Site icon BnBoi.Com

অনুবাদ কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনুবাদ কবিতা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অদৃষ্টের হাতে লেখা

অদৃষ্টের হাতে লেখা সূক্ষ্ম এক রেখা,
সেই পথ বয়ে সবে হয় অগ্রসর।
কত শত ভাগ্যহীন ঘুরে মরে সারাদিন
প্রেম পাইবার আগে মৃত্যু দেয় দেখা,
এত দূরে আছে তার প্রাণের দোসর!
কখন বা তার চেয়ে ভাগ্য নিরদয়,
প্রণয়ী মিলিল যদি–অতি অসময়!
“হৃদয়টি?’ “দিয়াছি তা!’ কান্দিয়া সে কহে,
“হাতখানি প্রিয়তম?’ “নহে, নহে, নহে!’

Matthew Arnold

আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি

আঁখি পানে যবে আঁখি তুলি
দুখ জ্বালা সব যাই ভুলি।
অধরে অধরে পরশিয়া
প্রাণমন উঠে হরষিয়া।
মাথা রাখি যবে ওই বুকে
ডুবে যাই আমি মহা সুখে।
যবে বল তুমি, “ভালবাসি’,
শুনে শুধু আঁখিজলে ভাসি।

Heinrich Hein

আবার আবার কেন রে আমার

আবার আবার কেন রে আমার
সেই ছেলেবেলা আসে নি ফিরে,
হরষে কেমন আবার তা হলে,
সাঁতারিয়ে ভাসি সাগরের জলে,
খেলিয়ে বেড়াই শিখরী শিরে!
স্বাধীন হৃদয়ে ভালো নাহি লাগে,
ঘোরঘটাময় সমাজধারা,
না, না, আমি রে যাব সেই স্থানে,
ভীষণ ভূধর বিরাজে যেখানে,
তরঙ্গ মাতিছে পাগল পারা!
অয়ি লক্ষ্মী, তুমি লহো লহো ফিরে,
ধন ধান্য তুমি যাদেছ মোরে,
জাঁকালো উপাধি নাহি আমি চাই,
ক্রীতদাসে মম কোনো সুখ নাই,
সেবকের দল যাক-না সোরে!
তুলে দাও মোরে সেই শৈল-‘পরে,
গরজি ওঠে যা সাগর-নাদে,
অন্য সাধ নাই, এই মাত্র চাই,
ভ্রমিব সেথায় স্বাধীন হৃদে!
অধিক বয়স হয় নে তো মম,
এখনি বুঝিতে পেরেছি হায়,
এ ধরা নহে তো আমার কারণে,
আর মম সুখ নাহি এ জীবনে,
কবে রে এড়াব এ দেহ দায়!
একদা স্বপনে হেরেছিনু আমি,
সুবিমল এক সুখের স্থান,
কেন রে আমার সে ঘুম ভাঙিল
কেন রে আমার নয়ন মেলিল,
দেখিতে নীরস এ ধরা খান!
এক কালে আমি বেসেছিনু ভালো,
ভালোবাসা-ধন কোথায় এবে,
বাল্যসখা সব কোথায় এখন–
হায় কী বিষাদে ডুবেছে এ মন,
আশারও আলোক গিয়েছে নিবে!
অমোদ-আসরে আমোদ-সাথীরা,
মাতায় ক্ষণেক আমোদ রসে,
কিন্তু এ হৃদয়, আমোদের নয়,
বিরলে কাঁদি যে একেলা বসে!
উঃ কী কঠোর, বিষম কঠোর,
সেই সকলের আমোদ-রব,
শত্রু কিম্বা সখা নহে যারা মনে,
অথচ পদ বা বিভব কারণে,
দাও ফিরে মোরে সেই সখাগুলি,
বয়সে হৃদয়ে সমান যারা,
এখনি যে আমি ত্যেজিব তা হলে,
গভীর নিশীথ-আমোদীর দলে,
হৃদয়ের ধার কি ধারে তারা!
সর্বস্ব রতন, প্রিয়তমা ওরে,
তোরেও সুধাই একটি কথা,
বল দেখি কিসে আর মম সুখ,
হেরিয়েও যবে তোর হাসি-মুখ,
কমে না হৃদয়ে একটি ব্যথা!
যাক তবে সব, দুঃখ নাহি তায়,
শোকের সমাজ নাহিকো চাই,
গভীর বিজনে মনের বিরাগে,
স্বাধীন হৃদয়ে ভালো যাহা লাগে,
সুখে উপভোগ করিব তাই!
মানব-মন্ডলী ছেড়ে যাব যাব,
বিরাগে কেবল, ঘৃণাতে নয়,
অন্ধকারময় নিবিড় কাননে,
থাকিব তবুও নিশ্চিন্ত মনে,
আমারও হৃদয় আঁধারময়!
কেন রে কেন রে হল না আমার,
কপোতের মতো বায়ুর পাখা,
তা হলে ত্যেজিয়ে মানব-সমাজ,
গগনের ছাদ ভেদ করি আজ,
থাকিতাম সুখে জলদে ঢাকা!

George Gordon Byron

ভারতী, আষাঢ়, ১২৮৫

কষ্টের জীবন (মানুষ কাঁদিয়া হাসে)

মানুষ কাঁদিয়া হাসে,
পুনরায় কাঁদে গো হাসিয়া।
পাদপ শুকায়ে গেলে,
তবুও সে না হয় পতিত,
তরণী ভাঙিয়া গেলে
তবু ধীরে যায় সে ভাসিয়া,
ছাদ যদি পড়ে যায়,
দাঁড়াইয়া রহে তবু ভিত।
বন্দী চলে যায় বটে,
তবুও তো রহে কারাগার,
মেঘে ঢাকিলেও সূর্য
কোনোমতে দিন অস্ত হয়,
তেমনি হৃদয় যদি
ভেঙেচুরে হয় চুরমার,
কোনোক্রমে বেঁচে থাকে
তবুও সে ভগন হৃদয়।
ভগন দর্পণ যথা,
ক্রমশ যতই ভগ্ন হয়,
ততই সে শত শত,
প্রতিবিম্ব করয়ে ধারণ,
তেমনি হৃদয় হতে,
কিছুই গো যাইবার নয়।
হোক না শীতল স্তব্ধ,
শত খন্ডে ভগ্ন চূর্ণ মন,
হউক-না রক্তহীন,
হীনতেজ তবুও তাহারে,
বিনিদ্র জ্বলন্ত জ্বালা,
ক্রমাগত করিবে দাহন,
শুকায়ে শুকায়ে যাবে,
অন্তর বিষম শোকভারে,
অথচ বাহিরে তার,
চিহ্নমাত্র না পাবে দর্শন।

George Gordon Byron

কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা

“কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে!
এতই যাতনা দুখিনী আমারে
দিতেছ কেমন করে?
গাঁথিয়া রেখেছি পরাতে মালিকা
তোমার গলার-‘পরে,
কোরো না ছলনা, কোরো না ছলনা,
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে!
এতই যাতনা দুখিনী-বালারে
দিতেছ কেমন করে?
যে শপথ তুমি বলেছ আমারে
মনে করে দেখো তবে,
মনে করো সেই কুঞ্জ যেথায়
কহিলে আমারি হবে।
কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে,
এতই যাতনা দুখিনী-বালারে
দিতেছ কেমন করে?’
এত বলি এক কাঁদিছে ললনা
ভাসিছে লোচন-লোরে
“কোরো না ছলনা– কোরো না ছলনা
যেয়ো না ফেলিয়া মোরে।
এতই যাতনা দুখিনী-বালারে
দিতেছ কেমন করে?’

William Chappel

গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে


গভীর গভীরতম হৃদয়প্রদেশে,
নিভৃত নিরালা ঠাঁই, লেশমাত্র আলো নাই,
লুকানো এ প্রেমসাধ গোপনে নিবসে,
শুদ্ধ যবে ভালোবাসা নয়নে তোমার,
ঈষৎ প্রদীপ্ত হয়, উচ্ছ্বসয়ে এ-হৃদয়,
ভয়ে ভয়ে জড়সড় তখনি আবার।

শূন্য এই মরমের সমাধি-গহ্বরে,
জ্বলিছে এ প্রেমশিখা চিরকাল-তরে,
কেহ না দেখিতে পায়, থেকেও না থাকা প্রায়,
নিভিবারও নাম নাই নিরাশার ঘোরে।

যা হবার হইয়াছে– কিন্তু প্রাণনাথ!
নিতান্ত হইবে যবে এ শরীরপাত,
আমার সমাধি-স্থানে কোরো নাথ কোরো মনে,
রয়েছে এ এক দুঃখিনী হয়ে ধরাসাৎ।

যত যাতনা আছে দলুক আমায়,
সহজে সহিতে নাথ সব পারা যায়,
কিন্তু হে তুমি-যে মোরে, ভুলে যাবে একেবারে
সে কথা করিতে মনে হৃদি ফেটে যায়।

রেখো তবে এই মাত্র কথাটি আমার,
এই কথা শেষ কথা, কথা নাহি আর,
(এ দেহ হইলে পাত, যদি তুমি প্রাণনাথ,
প্রকাশো আমার তরে তিলমাত্র শোক,
ধর্মত হবে না দোষী দোষিবে না লোক–
কাতরে বিনয়ে তাই, এই মাত্র ভিক্ষা চাই,
কখনো চাহি নে আরো কোনো ভিক্ষা আর)
যবে আমি যাব ম’রে, চির এ দুঃখিনী তরে,
বিন্দুমাত্র অশ্রুজল ফেলো একবার–
আজন্ম এত যে ভালোবেসেছি তোমায়,
সে প্রেমের প্রতিদান একমাত্র প্রতিদান,
তা বই কিছুই আর দিয়ো না আমায়।

George Gordon Byron

গানগুলি মোর বিষে ঢালা

গানগুলি মোর বিষে ঢালা
কী হবে আর তাহা বই?
ফুটন্ত এ প্রাণের মাঝে
বিষ ঢেলেছে বিষময়ী!
গানগুলি মোর বিষেঢালা,
কী হবে আর তাহা বই?
বুকের মধ্যে সর্প আছে,
তুমিও সেথা আছে অয়ি!

Heinrich Hein

গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয়

গিয়াছে যে দিন, সে দিন হৃদয়
রূপের মোহনে আছিল মাতি,
প্রাণের স্বপন আছিল যখন
প্রেম প্রেম শুধু দিবস রাতি!
শান্ত আশা এ হৃদয়ে আমার
এখন ফুটিতে পারে,
সুবিমলতর দিবস আমার
এখন উঠিতে পারে।
বালক কালের প্রেমের স্বপন–
মধুর যেমন উজল যেমন
তেমন কিছুই আসিবে না,
তেমন কিছুই আসিবে না!
সে দেবীপ্রতিমা নারিব ভুলিতে
প্রথম প্রণয় আঁকিল যাহা,
স্মৃতি-মরু মোর উজল করিয়া
এখনো হৃদয়ে বিরাজে তাহা!
সে প্রতিমা সেই পরিমল সম
পলকে যা লয় পায়,
প্রভাতকালের স্বপন যেমন
পলকে মিশায়ে যায়।
অলস প্রবাহ জীবনে আমার
সে কিরণ কভু ভাসিবে না আর
সে কিরণ কভু ভাসিবে না,
সে কিরণ কভু ভাসিবে না!

Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies

 চপলারে আমি অনেক ভাবিয়া

চপলারে আমি অনেক ভাবিয়া
দূরেতে রাখিয়া এলেম তারে,
রূপ-ফাঁদ হতে পালাইতে তার,
প্রণয়ে ডুবাতে মদিরা-ধারে।
এত দূরে এসে বুঝিনু এখন
এখনো ঘুচে নি প্রণয়-ঘোর,
মাথায় যদিও চড়েছে মদিরা
প্রণয় রয়েছে হৃদয়ে মোর।
যুবতীর শেষে লইনু শরণ
মাগিনু সহায় তার,
অনেক ভাবি সে কহিল তখন
“চপলা নারীর সার।’
আমি কহিলাম “সে কথা তোমার
কহিতে হবে না মোরে–
দোষ যদি কিছু বলিবারে পারো
শুনি প্রণিধান করে।’
যুবতী কহিল “তাও কভু হয়?
যদি বলি দোষ আছে–
নামের আমার কুযশ হইবে
কহিনু তোমার কাছে।’
এখন তো আর নাই কোনো আশা
হইয়াছি অসহায়–
চপলা আমার মরমে মরমে
বাণ বিঁধিতেছে, হায়!
দলে মিশি তার ইন্দ্রিয় আমার
বিরোধী হয়েছে মোর,
যুবতী আমার–বলিছে আমারে
রূপের অধীন ঘোর!

Lord Cantalupe

জাগি রহে চাঁদ (জাগি রহে চাঁদ আকাশে যখন)

বেহাগ

জাগি রহে চাঁদ আকাশে যখন
সারাটি রজনী!
শ্রান্ত জগত ঘুমে অচেতন
সারাটি রজনী!
অতি ধীরে ধীরে হৃদে কী লাগিয়া
মধুময় ভাব উঠে গো জাগিয়া
সারাটি রজনী!
ঘুমায়ে তোমারি দেখি গো স্বপন
সারাটি রজনী!
জাগিয়া তোমারি দেখি গো বদন
সারাটি রজনী!
ত্যজিবে যখন দেহ ধূলিময়
তখনি কি সখি তোমার হৃদয়,
আমার ঘুমের শয়ন-‘পরে
ভ্রমিয়া বেড়াবে প্রণয়-ভরে।
সারাটি রজনী!

জীবন উৎসর্গ (এসো এসো এই বুকে নিবাসে তোমার)

এসো এসো এই বুকে নিবাসে তোমার,
যূথভ্রষ্ট বাণবিদ্ধ হরিণী আমার,
এইখানে বিরাজিছে সেই চির হাসি,
আঁধারিতে পারিবে না তাহা মেঘরাশি।
এই হস্ত এ হৃদয় চিরকাল মতো
তোমার, তোমারি কাজে রহিবে গো রত!
কিসের সে চিরস্থায়ী ভালোবাসা তবে,
গৌরবে কলঙ্কে যাহা সমান না রবে?
জানি না, জানিতে আমি চাহি না, চাহি না,
ও হৃদয়ে এক তিল দোষ আছে কিনা,
ভালোবাসি তোমারেই এই শুধু জানি,
তাই হলে হল, আর কিছু নাহি মানি।
দেবতা সুখের দিনে বলেছ আমায়,
বিপদে দেবতা সম রক্ষিব তোমায়,
অগ্নিময় পথ দিয়া যাব তব সাথে,
রক্ষিব, মরিব কিংবা তোমারি পশ্চাতে।

Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies

জীবন মরণ (ওরা যায়, এরা করে বাস)

ওরা যায়, এরা করে বাস;
অন্ধকার উত্তর বাতাস
বহিয়া কত-না হা-হুতাশ
ধূলি আর মানুষের প্রাণ
উড়াইয়া করিছে প্রয়াণ।
আঁধারেতে রয়েছি বসিয়া;
একই বায়ু যেতেছে শ্বসিয়া
মানুষের মাথার উপরে,
অরণ্যের পল্লবের স্তরে।
যে থাকে সে গেলদের কয়,
“অভাগা, কোথায় পেলি লয়।
আর না শুনিবি তুই কথা,
আর হেরিবি তরুলতা,
চলেছিস মাটিতে মিশিতে,
ঘুমাইতে আঁধার নিশীথে।’
যে যায় সে এই বলে যায়,
“তোদের কিছুই নাই হায়,
অশ্রুজল সাক্ষী আছে তায়।
সুখ যশ হেথা কোথা আছে
সত্য যা তা মৃতদেরি কাছে।
জীব, তোরা ছায়া, তোরা মৃত,
আমরাই জীবন্ত প্রকৃত।’

Victor Hugo

‘আলোচনা’ পত্রিকা, কার্তিক, ১২৯১

 তুমি একটি ফুলের মতো মণি

তুমি একটি ফুলের মতো মণি
এম্‌নি মিষ্টি, এম্‌নি সুন্দর!
মুখের পানে তাকাই যখনি
ব্যথায় কেন কাঁদায় অন্তর!
শিরে তোমার হস্ত দুটি রাখি
পড়ি এই আশীষ মন্তর,
বিধি তোরে রাখুন চিরকাল
এমনি মিষ্টি, এম্‌নি সুন্দর!

Heinrich Hein

দামিনীর আঁখি কিবা

দামিনীর আঁখি কিবা
ধরে জ্বল’ জ্বল’ বিভা
কার তরে জ্বলিতেছে কেবা তাহা জানিবে?
চারি দিকে খর ধার
বাণ ছুটিতেছে তার
কার-‘পরে লক্ষ্য তার কেবা অনুমানিবে?
তার চেয়ে নলিনীর আঁখিপানে চাহিতে
কত ভালো লাগে তাহা কে পারিবে কহিতে?
সদা তার আঁখি দুটি
নিচু পাতে আছে ফুটি,
সে আঁখি দেখে নি কেহ উঁচু পানে তুলিতে!
যদি বা সে ভুলে কভু চায় কারো আননে,
সহসা লাগিয়া জ্যোতি
সে-জন বিস্ময়ে অতি
চমকিয়া উঠে যেন স্বরগের কিরণে!
ও আমার নলিনী লো, লাজমাখা নলিনী,
অনেকেরি আঁখি-‘পরে
সৌন্দর্য বিরাজ করে,
তোর আঁখি-‘পরে প্রেম নলিনী লো নলিনী!
দামিনীর দেহে রয়
বসন কনকময়
সে বসন অপসরী সৃজিয়াছে যতনে,
যে গঠন যেই স্থান
প্রকৃতি করেছে দান
সে-সকল ফেলিয়াছে ঢাকিয়া সে বসনে।
নলিনী বসন পানে দেখ দেখি চাহিয়া
তার চেয়ে কত ভালো কে পারিবে কহিয়া?
শিথিল অঞ্চল তার
ওই দেখো চারি ধার
স্বাধীন বায়ুর মতো উড়িতেছে বিমানে,
যেথা যে গঠন আছে
পূর্ণ ভাবে বিকাশিছে
যেখানে যা উঁচু নিচু প্রকৃতির বিধানে!
ও আমার নলিনী লো, সুকোমলা নলিনী
মধুর রূপের ভাস
তাই প্রকৃতির বাস,
সেই বাস তোর দেহে নলিনী লো নলিনী!
দামিনীর মুখ-আগে
সদা রসিকতা জাগে,
চারি ধারে জ্বলিতেছে খরধার বাণ সে,
কিন্তু কে বলিতে পারে
শুধু সে কি ধাঁধিবারে,
নহে তা কি খর ধারে বিঁধিবারি মানসে?
কিন্তু নলিনীর মনে
মাথা রাখি সঙ্গোপনে
ঘুমায়ে রয়েছে কিবা প্রণয়ের দেবতা।
সুকোমল সে শয্যার
অতি যা কঠিন ধার
দলিত গোলাপ তাও আর কিছু নহে তা!
ও আমার নলিনী লো, বিনয়িনী নলিনী
রসিকতা তীব্র অতি
নাই তার এত জ্যোতি
তোমার নয়নে যত নলিনী লো নলিনী।

Thomas Moore

ভারতী, আষাঢ়, ১২৮৮

দিন রাত্রি নাহি মানি

দিন রাত্রি নাহি মানি, আয় তোরা আয় রে,
চির সুখ-রসে রত আমরা হেথায় রে।
বসন্তে মলয় বায় একটি মিলায়ে যায়,
আরেকটি আসে পুনঃ মধুময় তেমনি,
প্রেমের স্বপন হায়
একটি যেমনি যায়
আরেকটি সুস্বপন জাগি উঠে অমনি।
নন্দন কানন যদি এ মরতে চাই রে
তবে তা ইহাই রে!
তবে তা ইহাই রে।
প্রেমের নিশ্বাস হেথা ফেলিতেছি বালিকা,
সুরভি নিশ্বাস যথা ফেলে ফুল-কলিকা,
তাহাদের আঁখিজল
এমন সে সুবিমল
এমন সে সমুজল মুকুতার পারা রে,
তাদের চুম্বন হাসি
দিবে কত সুধারাশি
যাদের মধুর এত নয়নের ধারা রে।
নন্দনকানন যদি এ মরতে চাই রে
তবে তা ইহাই রে।
তবে তা ইহাই রে!
থাকুক ও-সব সুখ চাই না, গো চাই না,
যে সুখ-ভিখারী আমি তাহা যে গো পাই না।
দুই হৃদি এক ঠাঁই
প্রণয়ে মিলিতে চাই
সুখে দুখে যে প্রেমের নাহি হবে শেষ রে।
প্রেমে উদাসীন হৃদি
শত যুগে যাপে যদি,
তার চেয়ে কত ভালো এ সুখ নিমেষ রে!
নন্দনকানন যদি এ মরতে চাই রে
তবে তা ইহাই রে
তবে তা ইহাই রে।

Thomas Moore

নলিনী (লীলাময়ী নলিনী)

লীলাময়ী নলিনী,
চপলিনী নলিনী,
শুধালে আদর করে
ভালো সে কি বাসে মোরে,
কচি দুটি হাত দিয়ে
ধরে গলা জড়াইয়ে,
হেসে হেসে একেবারে
ঢলে পড়ে পাগলিনী!
ভালো বাসে কি না, তবু
বলিতে চাহে না কভু
নিরদয়া নলিনী!
যবে হৃদি তার কাছে,
প্রেমের নিশ্বাস যাচে
চায় সে এমন করে
বিপাকে ফেলিতে মোরে,
হাসে কত, কথা তবু কয় না!
এমন নির্দোষ ধূর্ত
চতুর সরল,
ঘোমটা তুলিয়া চায়
চাহনি চপল
উজল অসিত-তারা-নয়না!
অমনি চকিত এক হাসির ছটায়
ললিত কপোলে তার গোলাপ ফুটায়,
তখনি পলায় আর রয় না!

Alfred Tennyson

ভারতী, কার্তিক, ১২৮৬

নীল বায়লেট নয়ন দুটি করিতেছে ঢলঢল

নীল বায়লেট নয়ন দুটি করিতেছে ঢলঢল
রাঙা গোলাপ গাল দুখানি, সুধায় মাখা সুকোমল।
শুভ্র বিমল করকমল ফুটে আছে চিরদিন!
হৃদয়টুকু শুষ্ক শুধু পাষাণসম সুকঠিন!

Heinrich Hein

পাতায় পাতায় দুলিছে শিশির

পূরবী

পাতায় পাতায় দুলিছে শিশির
গাহিছে বিহগগণ,
ফুলবন হতে সুরভি হরিয়া
বহিতেছে সমীরণ
সাঁঝের আকাশ মাঝারে এখনো
মৃদুল কিরণ জ্বলে।
নলিনীর সাথে বসিয়া তখন
কত-না হরষে কাটাইনু ক্ষণ,
কে জানিত তবে বালিকা নিদয়
রেখেছিল ঢাকি কপট-হৃদয়
সরল হাসির তলে!
এই তো সেথায় ভ্রমি, গো, যেথায়
থাকিত সে মোর কাছে,
প্রকৃতি জানে না পরিবরতন
সকলি তেমনি আছে!
তেমনি গোলাপ রূপ-হাসি-ময়
জ্বলিছে শিশির-ভরে,
যে হাসি-কিরণে আছিল প্রকৃতি
দ্বিগুণ দ্বিগুণ মধুর আকৃতি,
সে হাসি নাইকো আর!

Irish Song

প্রথমে আশাহত হয়েছিনু

প্রথমে আশাহত হয়েছিনু
ভেবেছিনু সবে না এ বেদনা;
তবু তো কোনোমতে সয়েছিনু,
কী করে যে সে কথা শুধায়ো না।

Heinrich Hein

প্রেমতত্ত্ব (নিঝর মিশেছে তটিনীর সাথে)

নিঝর মিশেছে তটিনীর সাথে
তটিনী মিশেছে সাগর-‘পরে,
পবনের সাথে মিশিছে পবন
চির-সুমধুর প্রণয়-ভরে!
জগতে কেহই নাইকো একেলা,
সকলি বিধির নিয়ম-গুণে,
একের সহিত মিশিছে অপরে
আমি বা কেন না তোমার সনে?
দেখো, গিরি ওই চুমিছে আকাশে,
ঢেউ-‘পরে ঢেউ পড়িছে ঢলি,
সে কুলবালারে কে বা না দোষিবে,
ভাইটিরে যদি যায় সে ভুলি!
রবি-কর দেখো চুমিছে ধরণী,
শশি-কর চুমে সাগর জল,
তুমি যদি মোরে না চুম’, ললনা,
এ-সব চুম্বনে কী তবে ফল?

P. B. Shelley

বলো গো বালা, আমারি তুমি

পিলু

বলো গো বালা, আমারি তুমি
হইবে চিরকাল!
অনিয়া দিব চরণতলে
যা-কিছু আছে সাগরজলে
পৃথিবী-‘পরে আকাশতলে
অমূল মণি জাল!
শুনি আশার মোহন-রব
যা-কিছু ভালো লাগিবে তব
আনিয়া দিব, হও গো, যদি
আমারি চিরকাল!
যেথায় মোরা বেড়াব দুটি,
কুসুমগুলি উঠিবে ফুটি,
নদীর জলে শুনিতে পাব
দেবতাদের বাণী।
তারকাগুলি দেখাবে যেন
প্রেমিকদেরি জগতহেন,
মধুর এক স্বপন সম
দেখাবে ধরাখানি!
আকাশ-ভেদী শিখর হতে
পতনশীল নিঝর-স্রোতে
নাহিয়া যথা কানন-ভূমি
হরিত-বাসে সাজে,
চির-প্রবাহী সুখের ধারে
দোঁহার হৃদি হাসিবে হারে–
যেই সুখের মূল লুকানো
কলপনার মাঝে!
প্রেম দেবের কুহক জালে
হৃদয়ে যার অমৃত ঢালে,
সেই সে জনে করেন প্রেম
কত না সুখ-দান।
ভবন তাঁর স্বরগ-‘পরে,
যেথায় তাঁর চরণ পড়ে
ধরার মাঝে স্বরগ শোভা
ধরে, গো, সেইখান!

Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies

বারেক ভালোবেসে যে জন মজে

বারেক ভালোবেসে যে জন মজে
দেবতাসম সেই ধন্য,
দ্বিতীয়বার পুন প্রেমে যে পড়ে
মূর্খের অগ্রগণ্য।
আমিও সে দলের মূর্খরাজ
দুবার প্রেমপাশে পড়ি;
তপন শশী তারা হাসিয়া মরে,
আমিও হাসি– আর মরি।

Heinrich Hein

বিচ্ছেদ (প্রতিকূল বায়ুভরে, ঊর্মিময় সিন্ধু-‘পরে)

প্রতিকূল বায়ুভরে, ঊর্মিময় সিন্ধু-‘পরে
তরীখানি যেতেছিল ধীরি,
কম্পমান কেতু তার, চেয়েছিল কতবার
সে দ্বীপের পানে ফিরি ফিরি।
যারে আহা ভালোবাসি, তারে যবে ছেড়ে আসি
যত যাই দূর দেশে চলি,
সেইদিক পানে হায়, হৃদয় ফিরিয়া চায়
যেখানে এসেছি তারে ফেলি।
বিদেশেতে দেখি যদি, উপত্যকা, দ্বীপ, নদী,
অতিশয় মনোহর ঠাঁই,
সুরভি কুসুমে যার, শোভিত সকল ধার
শুধু হৃদয়ের ধন নাই,
বড়ো সাধ হয় প্রাণে, থাকিতাম এইখানে,
হেথা যদি কাটিত জীবন,
রয়েছে যে দূরবাসে, সে যদি থাকিত পাশে
কী যে সুখ হইত তখন।
পূর্বদিক সন্ধ্যাকালে, গ্রাসে অন্ধকার জালে
ভীত পান্থ চায় ফিরে ফিরে,
দেখিতে সে শেষজ্যোতি, সুষ্ঠুতর হয়ে অতি
এখনো যা জ্বলিতেছে ধীরে,
তেমনি সুখের কাল, গ্রাসে গো আঁধার-জাল
অদৃষ্টের সায়াহ্নে যখন,
ফিরে চাই বারে বারে, শেষবার দেখিবারে
সুখের সে মুমূর্ষু কিরণ।

Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies

 বিদায় (যাও তবে প্রিয়তম সুদূর প্রবাসে)

যাও তবে প্রিয়তম সুদূর প্রবাসে
নব বন্ধু নব হর্ষ নব সুখ আশে।
সুন্দরী রমণী কত, দেখিবে গো শত শত
ফেলে গেলে যারে তারে পড়িবে কি মনে?
তব প্রেম প্রিয়তম, অদৃষ্টে নাইকো মম
সে-সব দুরাশা সখা করি না স্বপনে
কাতর হৃদয় শুধু এই ভিক্ষা চায়
ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়।
স্মরিলে এ অভাগীর যাতনার কথা,
যদিও হৃদয়ে লাগে তিলমাত্র ব্যথা,
মরমের আশা এই, থাক্‌ রুদ্ধ মরমেই
কাজ নাই দুখিনীরে মনে করে আর।
কিন্তু দুঃখ যদি সখা, কখনো গো দেয় দেখা
মরমে জনমে যদি যাতনার ভার,
ও হৃদয় সান্ত্বনার বন্ধু যদি চায়
ভুলো না আমায় সখা ভুলো না আমায়।

Mrs. Amelia Opie

বিদায়-চুম্বন (একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার)

একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার
জনমের মতো দেখা হবে না কো আর।
মর্মভেদী অশ্রু দিয়ে, পূজিব তোমারে প্রিয়ে
দুখের নিশ্বাস আমি দিব উপহার।
সে তো তবু আছে ভালো, একটু আশার আলো
জ্বলিতেছে অদৃষ্টের আকাশে যাহার।
কিন্তু মোর আশা নাই, যে দিকে ফিরিয়া চাই
সেই দিকে নিরাশার দারুণ আঁধার!
ভালো যে বেসেছি তারে দোষ কী আমার?
উপায় কী আছে বলো উপায় কী তার?
দেখামাত্র সেই জনে, ভালোবাসা আসে মনে
ভালো বাসিলেই ভুলা নাহি যায় আর!
নাহি বাসিতাম যদি এত ভালো তারে
অন্ধ হয়ে প্রেমে তার মজিতাম না রে
যদি নাহি দেখিতাম, বিচ্ছেদ না জানিতাম
তা হলে হৃদয় ভেঙে যেত না আমার!
আমারে বিদায় দাও যাই গো সুন্দরী,
যাই তবে হৃদয়ের প্রিয় অধীশ্বরী,
থাকো তুমি থাকো সুখে, বিমল শান্তির বুকে
সুখ, প্রেম, যশ, আশা থাকুক তোমার
একটি চুম্বন দাও প্রমদা আমার।

Robert Burns

বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা

বিশ্বামিত্র, বিচিত্র এ লীলা!
দিবেরাত্রি আহার নিদ্রে ছেড়ে,
তপিস্যে আর লড়াই করে শেষে
বশিষ্টের গাইটি নিলে কেড়ে।
বিশ্বামিত্র তোমার মতো গোরু
দুটি এমন দেখি নি বিশ্বে!
নইলে একটি গাভী পাবার তরে
এত যুদ্ধ এত তপিস্যে!

Heinrich Hein

সাধনা, বৈশাখ, ১২৯৯

বৃদ্ধ কবি (মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে)

মন হতে প্রেম যেতেছে শুকায়ে
জীবন হতেছে শেষ,
শিথিল কপোল মলিন নয়ন
তুষার-ধবল কেশ!
পাশেতে আমার নীরবে পড়িয়া
অযতনে বীণাখানি,
বাজাবার বল নাইকো এ হাতে
জড়িমা জড়িত বাণী!
গীতিময়ী মোর সহচরী বীণা!
হইল বিদায় নিতে;
আর কি পারিবি ঢালিবারে তুই
অমৃত আমার চিতে?
তবু একবার আর-একবার
ত্যজিবার আগে প্রাণ,
মরিতে মরিতে গাহিয়া লইব
সাধের সে-সব গান!
দুলিবে আমার সমাধি-উপরে
তরুগণ শাখা তুলি,
বনদেবতারা গাইবে তখন
মরণের গানগুলি!

ভারতী, কার্তিক, ১২৮৬

ভালোবাসে যারে তার চিতাভস্ম-পানে

ভালোবাসে যারে তার চিতাভস্ম-পানে
প্রেমিক যেমন চায় কাতর নয়ানে
তেমনি যে তোমা-পানে নাহি চায় গ্রীস্‌
তাহার হৃদয় মন পাষাণ কুলিশ
ইংরাজেরা ভাঙিয়াছে প্রাচীর তোমার
দেবতাপ্রতিমা লয়ে গেছে [সিন্ধুপার]
এ দেখে কার না হবে হবে ॥।
[ধূম]কেতু সম তারা কী কুক্ষণে হায়
[ছা]ড়িয়া সে ক্ষুদ্র দ্বীপ আইল হেথায়
[অ]সহায় বক্ষ তব রক্তময় করি
দেবতা প্রতিমাগুলি লয়ে গেল হরি।

George Gordon Byron

মালতী পুঁথি

ভুজ-পাশ-বদ্ধ অ্যান্টনি (এই তো আমরা দোঁহে বসে আছি কাছে কাছে)

এই তো আমরা দোঁহে বসে আছি কাছে কাছে!
একটি ভুজঙ্গ-ভুজে আমারে জড়ায়ে আছে;
আরেকটি শ্যাম-বাহু, শতেক মুকুতা ঝুলে,
সোনার মদিরা পাত্র আকাশে রয়েছে তুলে।
অলকের মেঘ মাঝে জ্বলিতেছে মুখখানি,
রূপের মদিরা পিয়া
আবেশে অবশ হিয়া,
পড়েছে মাতাল হয়ে, কখন্‌ কিছু না জানি!
রাখিয়া বক্ষের পরে অবশ চিবুক মোর,
হাসিতেছি তার পানে, হৃদয়ে আঁধার ঘোর!
বাতায়ন-যবনিকা, বাতাস, সরায়ে ধীরে
বীজন করিছে আসি এ মোর তাপিত শিরে।
সম্মুখেতে দেখা যায়
পীতবর্ণ বালুকায়
অস্তগামী রবিকর আদূর “নীলের’ তীরে।
চেয়ে আছি, দেখিতেছি, নদীর সুদূর পারে,
(কী জানি কিসের দুখ!)
পশ্চিম দিকের মুখ
বিষণ্ণ হইয়া আসে সন্ধ্যার আঁধার ভারে।
প্রদোষ তারার মুখে হাসি আসি উঁকি মারে!
রোমীয় স্বপন এক জাগিছে সম্মুখে মোর,
ঘুরিছে মাথার মাঝে, মাথায় লেগেছে ঘোর।
রোমীয় সমর-অস্ত্র ঝঞ্ঝনিয়া উঠে বাজি,
বিস্ফারিত নাসা চাহে রণ-ধূম পিতে আজি।
কিন্তু হায়! অমনি সে মুখ্‌ পানে হেসে চায়,
কী জানি কী হয় মতি,
হীন প্রমোদের প্রতি।
বীরের ভ্রূকুটিগুলি তখনি মিলায়ে যায়!
গরবিত, শূন্য হিয়া, জর্জর আবেশ-বাণে,
যে প্রমোদ ঘৃণা করি হেসে চাই তারি পানে।
অনাহূত হর্ষ এক জাগ্রতে স্বপনে আসি,
শৌর্যের সমাধি-পরে ঢালে রবি-কর রাশি!
কতবার ঘৃণি তারে! রমণী সে অবহেলে
পৌরুষ নিতেছে কাড়ি বিলাসের জালে ফেলে!
কিন্তু সে অধর হতে
অমনি অজস্র স্রোতে
ঝরে পড়ে মৃদু হাসি, চুম্বন অমৃত-মাখা
আমারে করিয়া তুলে, ভাঙাঘর ফুলে ঢাকা।
বীরত্বের মুখ খানি একবার মনে আনি,
তার পরে ওই মুখে ফিরাই নয়ন মম,
ওই মুখ! একখানি উজ্জ্বল কলঙ্ক সম!
ওই তার শ্যাম বাহু আমারে ধরেছে হায়!
অঙ্গুলির মৃদু স্পর্শে বল মোর চলে যায়!
মুখ ফিরাইয়া লই– রমণী যেমনি ধীরি
মৃদু কণ্ঠে মৃদু কহে, অমনি আবার ফিরি।
রোমের আঁধার মেঘ দেখে যেই মুখ-‘পরে,
অমনি দু বাহু দিয়ে কণ্ঠ জড়াইয়া ধরে,
বরষে নয়নবারি আমার বুকের মাঝ,
চুমিয়া সে অশ্রুবারি শুকানো বীরের কাজ।
তার পরে ত্যজি মোরে চরণ পড়িছে টলে,
থর থর কেঁপে বলে–“যাও, যাও, যাও চলে!’
ঢুলু ঢুলু আঁখিপাতা পুরে অশ্রু-মুকুতায়,
শ্যামল সৌন্দর্য তার হিম-শ্বেত হয়ে যায়!
জীবনের লক্ষ্য, আশা, ইচ্ছা, হারাইয়া ফেলি,
চেয়ে দেখি তার পানে কাতর নয়ন মেলি।
আবার ফিরাই মুখ, কটাক্ষেতে চেয়ে রই,
কল&ড়বঁ;ঙ্ক প্রমোদে মাতি তাহারে টানিয়া লই!
আরেকটি বার রোম, হইব সন্তান তোর
একটি বাসনা এই বন্দী এ হৃদয়ে মোর।
গৌরবে সম্মানে মরি এই এক আছে আশ,
চাহি না করিতে ব্যয় চুম্বনে অন্তিম শ্বাস!
বুঝি হায় সে আশাও পুরিবে না কোনো কালে
রোমীয় মৃত্যুও বুঝি ঘটিবে না এ কপালে!
রোমীয় সমাধি চাই
তাও বুঝি ভাগ্যে নাই,
ওই বুকে মরে যাব, বুঝি মরণের কালে!

Robert Buchanan

ভারতী, আশ্বিন-কার্তিক, ১২৮৮

 ম্যাক্‌বেথ্‌ (ঝড় বাদলে আবার কখন)

(ডাকিনী । ম্যাক্‌বেথ্‌)
দৃশ্য : বিজন প্রান্তর । বজ্র বিদ্যুৎ । তিনজন ডাকিনী।
১ম ডা — ঝড় বাদলে আবার কখন
মিল্‌ব মোরা তিনটি জনে।
২য় ডা — ঝগড়া ঝাঁটি থামবে যখন,
হার জিত সব মিট্‌বে রণে।
৩য় ডা — সাঁঝের আগেই হবে সে ত;
১ম ডা — মিল্‌ব কোথায় বোলে দে ত।
২য় ডা — কাঁটা খোঁচা মাঠের মাঝ।
৩য় ডা — ম্যাক্কেথ সেথা আস্‌চে আজ।
১ম ডা — কটা বেড়াল! যাচ্ছি ওরে!
২য় ডা — ঐ বুঝি ব্যাং ডাক্‌চে মোরে!
৩য় ডা — চল্‌ তবে চল্‌ ত্বরা কোরে!
সকলে — মোদের কাছে ভালই মন্দ,
মন্দ যাহা ভাল যে তাই,
অন্ধকারে কোয়াশাতে
ঘুরে ঘুরে ঘুরে বেড়াই!

প্রস্থান।
দৃশ্য : এক প্রান্তর। বজ্র। তিনজন ডাকিনী।
১ম ডা — এতক্ষণ বোন কোথায় ছিলি?
২য় ডা — মারতে ছিলুম শুয়োরগুলি।
৩য় ডা — তুই ছিলি বোন, কোথায় গিয়ে?
১ম ডা — দেখ্‌, একটা মাঝির মেয়ে
গোটাকতক বাদাম নিয়ে
খাচ্ছিল সে কচ্‌মচিয়ে
কচ্‌মচিয়ে
কচ্‌মচিয়ে–
চাইলুম তার কাছে গিয়ে,
পোড়ারমুখী বোল্লে রেগে
“ডাইনি মাগী যা তুই ভেগে।’
আলাপোয় তার স্বামী গেছে,
আমি যাব পাছে পাছে।
বেঁড়ে একটা ইঁদুর হোয়ে
চালুনীতে যাব বোয়ে–
যা বোলেছি কোর্‌ব আমি
কোর্‌ব আমি–
নইক আমি এমন মেয়ে!
২য় ডা — আমি দেব বাতাস একটি।
১ম ডা — তুমি ভাই বেশ লোকটি!
৩য় ডা — একটি পাবি আমার কাছে।
১ম ডা — বাকি সব আমারি আছে।
* * *
খড়ের মত একেবারে
শুকিয়ে আমি ফেল্‌ব তারে।
কিবা দিনে কিবা রাতে
ঘুম রবে না চোকের পাতে।
মিশ্‌বে না কেউ তাহার সাথে।
একাশি বার সাত দিন
শুকিয়ে শুকিয়ে হবে ক্ষীণ।
জাহাজ যদি না যায় মারা
ঝড়ের মুখে সবে সারা।
বল্‌ দেখি বোন্‌, এইটে কি!
২য় ডা — কই, কই, কই, দেখি, দেখি।
১ম ডা — একটা মাঝির বুড় আঙুল
রোয়েচে লো বোন, আমার কাছে,
বাড়িমুখো জাহাজ তাহার
পথের মধ্যে মারা গেছে।
৩য় ডা — ঐ শোন্‌ শোন্‌ বাজ্‌ল ভেরী
আসে ম্যাক্কেথ, নাইক দেরী!
দৃশ্য : গুহা। মধ্যে ফুটন্ত কটাহ। বজ্র। তিনজন ডাকিনী।
১ম ডা — কালো বেড়াল তিনবার
করেছিল চীৎকার।
২য় ডা — তিনবার আর একবার
সজারুটা ডেকেছিল।
৩য় ডা — হার্পি বলে আকাশ তলে
“সময় হোল’ “সময় হোল!’
১ম ডা — আয় রে কড়া ঘিরে ঘিরে
বেড়াই মোরা ফিরে ফিরে
বিষমাখা ওই নাড়ি ভুঁড়ি
কড়ার মধ্যে ফেল্‌ রে ছুঁড়ি।
ব্যাং একটা ঠান্ডা ভুঁয়ে
একত্রিশ দিন ছিল শুয়ে,
কড়ার মধ্যে ফেল্‌ব মোরা।
সকলে — দ্বিগুণ দ্বিগুণ দ্বিগুণ খেটে
কাজ সাধি আয় সবাই জুটে।
দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বল্‌রে আগুন
ওঠরে কড়া দ্বিগুণ ফুটে।
২য় ডা — জলার সাপের মাংস নিয়ে
সিদ্ধ কর কড়ায় দিয়ে।
গির্গিটি-চোক ব্যাঙ্গের পা,
টিকটিকি-ঠ্যাং পেঁচার ছা।
কুত্তোর জিব, বাদুড় রোঁয়া,
সাপের জিব আর শুওর শোঁয়া।
শক্ত ওষুধ কোরতে হবে
টগ্‌বগিয়ে ফোটাই তবে।
সকলে — দ্বিগুণ দ্বিগুণ দ্বিগুণ খেটে
কাজ সাধি আয় সবাই জুটে।
দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বলরে আগুন
ওঠ্‌রে কড়া দ্বিগুণ ফুটে।
৩য় ডা — মকরের আঁশ, বাঘের দাঁত,
ডাইনি-মড়া, হাঙ্গর ব্যাঁৎ,
ইষের শিকড় তুলেছি রাতে,
নেড়ের পিলে মেশাই তাতে,
পাঁঠার পিত্তি, শেওড়া ডাল
গেরণ-কালে কেটেছি কাল,
তাতারের ঠোঁট, তুর্কি নাক,
তাহার সাথে মিশিয়ে রাখ।
আন্‌গে রে সেই ভ্রূণ-মরা,
খানায় ফেলে খুন-করা,
তারি একটি আঙুল নিয়ে
সিদ্ধ কর কড়ায় দিয়ে।
বাঘের নাড়ি ফেলে তাতে
ঘন কর আগুন-তাতে।
সকলে — দ্বিগুণ দ্বিগুণ দ্বিগুণ খেটে
কাজ সাধি আয় সবাই জুটে।
দ্বিগুণ দ্বিগুণ জ্বল্‌রে আগুন
ওঠরে কড়া দ্বিগুণ ফুটে।
২য় ডা — বাঁদর ছানার রক্তে তবে
ওষুধ ঠান্ডা কোরতে হবে–
তবেই ওষুধ শক্ত হবে।

ভারতী, আশ্বিন, ১২৮৭

 যাও তবে প্রিয়তম সুদূর সেথায়


যাও তবে প্রিয়তম সুদূর সেথায়,
লভিবে সুযশ কীর্তি গৌরব যেথায়,
কিন্তু গো একটি কথা, কহিতেও লাগে ব্যথা,
উঠিবে যশের যবে সমুচ্চ সীমায়,
তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমায়–
সুখ্যাতি অমৃত রবে, উৎফুল্ল হইবে যবে,
তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমায়।

কত যে মমতা-মাখা, আলিঙ্গন পাবে সখা,
পাবে প্রিয় বান্ধবের প্রণয় যতন,
এ হতে গভীরতর, কতই উল্লাসকর,
কতই আমোদে দিন করিবে যাপন,
কিন্তু গো অভাগী আজি এই ভিক্ষা চায়,
যখন বান্ধব-সাথ, আমোদে মাতিবে নাথ,
তখন অভাগী বলে স্মরিয়ো আমায়।

সুচারু সায়াহ্নে যবে ভ্রমিতে ভ্রমিতে,
তোমার সে মনোহরা, সুদীপ্ত সাঁজের তারা,
সেখানে সখা গো তুমি পাইবে দেখিতে–
মনে কি পড়িবে নাথ, এক দিন আমা সাথ,
বনভ্রমি ফিরে যবে আসিতে ভবনে–
ওই সেই সন্ধ্যাতারা, দুজনে দেখেছি মোরা,
আরো যেন জ্বল জ্বল জ্বলিত গগনে।

নিদাঘের শেষাশেষি, মলিনা গোলাপরাশি,
নিরখি বা কত সুখী হইতে অন্তরে,
দেখি কি স্মরিবে তায়, সেই অভাগিনী হায়
গাঁথিত যতনে তার মালা তোমা তরে!
যে-হস্ত গ্রথিত বলে তোমার নয়নে
হত তা সৌন্দর্য-মাখা, ক্রমেতে শিখিলে সখা
গোলাপে বাসিত ভালো যাহারি কারণে–
তখন সে দুঃখিনীকে কোরো নাথ মনে।

বিষণ্ণ হেমন্তে যবে, বৃক্ষের পল্লব সবে
শুকায়ে পড়িবে খসে খসে চারি ধারে,
তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমারে।
নিদারুণ শীত কালে, সুখদ আগুন জ্বেলে,
নিশীথে বসিবে যবে অনলের ধারে,
তখন স্মরিয়ো নাথ স্মরিয়ো আমারে।
সেই সে কল্পনাময়ী সুখের নিশায়,
বিমল সংগীত তান, তোমার হৃদয় প্রাণ।
নীরবে সুধীরে ধীরে যদি গো জাগায়–
আলোড়ি হৃদয়-তল, এক বিন্দু অশ্রুজল,
যদি আঁখি হতে পড়ে সে তান শুনিলে,
তখন করিয়ো মনে, এক দিন তোমা সনে,
যে যে গান গাহিয়াছি হৃদি প্রাণ খুলে,
তখন স্মরিয়ো হায় অভাগিনী বলে।

Thomas Moore, Moore’s Irish Melodies

 রানী, তোর ঠোঁট দুটি মিঠি

রানী, তোর ঠোঁট দুটি মিঠি
রানী, তোর মধুখানা দিঠি
রানী, তুই মণি তুই ধন,
তোর কথা ভাবি সারাক্ষণ।
দীর্ঘ সন্ধ্যা কাটে কী করিয়া?
সাধ যায় তোর কাছে গিয়া
চুপিচাপি বসি এক ভিতে
ছোটোছোটো সেই ঘরটিতে।
ছোটো হাতখানি হাতে করে
অধরেতে রেখে দিই ধরে।
ভিজাই ফেলিয়া আঁখিজল
ছোট সে কোমল করতল।

Heinrich Hein

রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার

রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার
যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই,
রূপসী আমার যাইবি কি তুই,
ভ্রমিবারে গিরি-কাননে?
পাদপের ছায়া মাথার ‘পরে,
পাখিরা গাইছে মধুর স্বরে
অথবা উড়িছে পাখা বিছায়ে
হরষে সে গিরি-কাননে!
রূপসী আমার প্রেয়সী আমার
যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই,
রূপসী আমার, যাইবি কি তুই
ভ্রমিবারে গিরি-কাননে?
শিখর উঠেছে আকাশ-‘পরি,
ফেনময় স্রোত পড়িছে মরি,
সুরভি-কুঞ্জ ছায়া বিছায়ে
শোভিছে সে গিরি-কাননে!
রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার
যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই,
রূপসী আমার, যাইবি কি তুই
ভ্রমিবারে গিরি-কাননে?
ধবল শিখর কুসুমে ভরা
সরসে ঝরিছে নিঝর-ধারা
উছসে উঠিয়া সলিল-কণা
শীতলিছে গিরি-কাননে!
রূপসী আমার, প্রেয়সী আমার
যাইবি কি তুই যাইবি কি তুই,
রূপসী আমার, যাইবি কি তুই
ভ্রমিবারে গিরি-কাননে?
সুখ দুখ যাহা দিলেন, বিধি,
কিছুই মানিতে চায় না হৃদি,
তোমারে ও প্রেমে লইয়া পাশে
ভ্রমি যদি গিরি-কাননে!

Robert Burns

ললিত-নলিনী (হা নলিনী গেছে আহা কী সুখের দিন)

(কৃষকের প্রেমালাপ।)
ললিত
হা নলিনী গেছে আহা কী সুখের দিন,
দোঁহে যবে এক সাথে, বেড়াতেম হাতে হাতে
নবীন হৃদয় চুরি করিলি নলিন!
হা নলিনী কত সুখে গেছে সেই দিন।
নলিনী
কত ভালোবাসি সেই বনেরে ললিত,
প্রথমে বলিনু যেথা, মনের লুকানো কথা,
স্বর্গ-সাক্ষী করি যেথা হয়ে হরষিত
বলিলে, আমারি তুমি হইবে ললিত।
ললিত
বসন্ত-বিহগ যথা সুললিত ভাষী,
যত শুনি তত তার, ভালো লাগে গীতধার,
যত দিন যায় তত তোরে ভালোবাসি,
যত দিন যায় তব বাড়ে রূপরাশি।
নলিনী
কোমল গোলাপকলি থাকে যথা গাছে,
দিন দিন ফুটে যত, পরিমল বাড়ে তত,
এ হৃদয় ভালোবাসা আলো করি আছে
সঁপেছি সে ভালোবাসা তোমারি গো কাছে।
ললিত
মৃদুতর রবিকর সুনীল আকাশ
হেরিলে শস্যের আশে, হৃদয় হরষে ভাসে
তার চেয়ে এ হৃদয়ে বাড়ে গো উল্লাস
হেরিলে নলিনী তোর মৃদু মধু হাস।
নলিনী
মধু আগমন বার্তা করিতে কুজিত
কোকিল যখন ডাকে, হৃদয় নাচিতে থাকে
কিন্তু তার চেয়ে হৃদি হয় উথলিত,
মিলিলে তোমার সাথে প্রাণের ললিত।
ললিত
কুসুমের মধুময় অধর যখন
ভ্রমর প্রনয়ভরে, হরষে চুম্বন করে
সে কি এত সুখ পায় আমার মতন
যবে ও অধরখানি করি গো চুম্বন?
নলিনী
শিশিরাক্ত পত্রকোলে মল্লিকা হসিত,
বিজন সন্ধ্যার ছায়ে, ফুটে সে মলয়বায়ে,
সে অমন নহে মিষ্ট নহে সুবাসিত
তোমার চুম্বন আহা যেমন ললিত।
ললিত
ঘুরুক অদৃষ্টচক্র সুখ দুখ দিয়া
কভু দিক্‌ রসাতলে, কভু বা স্বরগে তুলে
রহিবে একটি চিন্তা হৃদয়ে জাগিয়া
সে চিন্তা তোমারি তরে জানি ওগো প্রিয়া।
নলিনী
ধন রত্ন কনকের নাহি ধার ধারি
পদতলে বিলাসীর, নত করিব না শির
প্রণয়ধনের আমি দরিদ্র ভিখারি,
সে প্রণয়, ললিত গো তোমারি তোমারি।

Robert Burns

সংগীত (কেমন সুন্দর আহা ঘুমায়ে রয়েছে)

কেমন সুন্দর আহা ঘুমায়ে রয়েছে
চাঁদের জোছনা এই সমুদ্রবেলায়!
এসো প্রিয়ে এইখানে বসি কিছুকাল;
গীতস্বর মৃদু মৃদু পশুক শ্রবণে!
সুকুমার নিস্তব্ধতা আর নিশীথিনী–
সাজে ভালো মর্ম-ছোঁয়া সুধা-সংগীতেরে।
বইস জেসিকা, দেখো, গগন-প্রাঙ্গণ
জলৎ কাঞ্চন-পাতে খচিত কেমন!
এমন একটি নাই তারকামণ্ডল
দিব্য গীত যে না গায় প্রতি পদক্ষেপে!
অমর আত্মাতে হয় এমনি সংগীত।
কিন্তু ধূলিময় এই মর্ত্য-আবরণ
যতদিন রাখে তারে আচ্ছন্ন করিয়া
ততদিন সে সংগীত পাই না শুনিতে।

William Shakespeare

সুখী প্রাণ (জান না তো নির্ঝরিণী, আসিয়াছ কোথা হতে)

জান না তো নির্ঝরিণী, আসিয়াছ কোথা হতে,
কোথায় যে করিছ প্রয়াণ,
মাতিয়া চলেছ তবু আপন আনন্দে পূর্ণ,
আনন্দ করিছ সবে দান।
বিজন-অরণ্য-ভূমি দেখিছে তোমার খেলা
জুড়াইছে তাহার নয়ান।
মেষ-শাবকের মতো তরুদের ছায়ে ছায়ে
রচিয়াছ খেলিবার স্থান।
গভীর ভাবনা কিছু আসে না তোমার কাছে,
দিনরাত্রি গাও শুধু গান।
বুঝি নরনারী মাঝে এমনি বিমল হিয়া
আছে কেহ তোমারি সমান।
চাহে না চাহে না তারা ধরণীর আড়ম্বর,
সন্তোষে কাটাতে চায় প্রাণ,
নিজের আনন্দ হতে আনন্দ বিতরে তারা
গায় তারা বিশ্বের কল্যাণ।

Robert Buchanan

আলোচনা’ পত্রিকা, ভাদ্র, ১২৯১

সুশীলা আমার, জানালার ‘পরে

সুশীলা আমার, জানালার ‘পরে
দাঁড়াও একটিবার!
একবার আমি দেখিয়া লইব
মধুর হাসি তোমার!
কত দুখ-জ্বালা সহি অকাতরে
ভ্রমি, গো, দূর প্রবাসে
যদি লভি মোর হৃদয়-রতন–
সুশীলারে মোর পাশে!
কালিকে যখন নাচ গান কত
হতেছিল সভা-‘পরে,
কিছুই শুনি নি, আছিনু মগন
তোমারি ভাবনা-ভরে
আছিল কত-না বালিকা, রমণী,
রূপসী প্রমোদ-হিয়া,
বিষাদে কহিনু, “তোমরা তো নহ
সুশীলা, আমার প্রিয়া!’
সুশীলে, কেমনে ভাঙ তার মন
হরষে মরিতে পারে যেই জন
তোমারি তোমারি তরে!
সুশীলে, কেমনে ভাঙ হিয়া তার
কিছু যে করি নি, এক দোষ যার
ভালোবাসে শুধু তোরে!
প্রণয়ে প্রণয় না যদি মিশাও
দয়া কোরো মোর প্রতি,
সুশীলার মন নহে তো কখনো
নিরদয় এক রতি!

Robert Burns

স্বপ্ন দেখেছিনু প্রেমাগ্নিজ্বালার

স্বপ্ন দেখেছিনু প্রেমাগ্নিজ্বালার
সুন্দর চুলের, সুগন্ধি মালার,
তিক্ত বচনের, মিষ্ট অধরের,
বিমুগ্ধ গানের, বিষণ্ণ স্বরের।
সে-সব মিলায়ে গেছে বহুদিন,
সে স্বপ্নপ্রতিমা কোথায় বিলীন।
শুধু সে অনন্ত জ্বলন্ত হুতাশ
ছন্দে বন্ধ হয়ে করিতেছে বাস।
তুমিও গো যাও, হে অনাথ গান,
সে স্বপ্নছবিরে করগে সন্ধান।
দিলাম পাঠায়ে, করিতে মেলানী,
ছায়া-প্রতিমারে বায়ুময়ী বাণী।

Heinrich Heine

Exit mobile version