Site icon BnBoi.Com

কাব্যগ্রন্থ – অমিয় চক্রবর্তী

কাব্যগ্রন্থ - অমিয় চক্রবর্তী

এই বৃষ্টি

চিন্তার সমস্ত রং ধুয়ে গেছে শাদা হ’য়ে
মনের প্রহরী ভিজছে ছাতি হাতে নিঃকুম প্ৰহরে,
কুপকূপ বৃষ্টির গলিতে
বাসনার আলোগুলো বিমিয়ে ঝাপসা জলে পাশে ।
হে বিরতি
ঘন রাত্রে কোনখানে এক স্তব্ধ চেয়ে আছে :
মেঘে-মেঘে ভয়ংকর আসন্নতা,
বোবা বুক চিরে ঝলে বর্ষার বিজলি শঙ্কাহারা,
শুধু মেনে নেওয়া বেলা, প্রবাসে যেমন ৷।

বসন্তের মাঝামাঝি এই বর্ষাকাল,
প্ৰস্তুত ছিলো না, তবু এলো যেই, ব্যস্ত মন
রাজি হ’লো ঘোরাফেরা চেনার কল্পনা ফুল ভুলে,
ফেলে গিয়ে ঘরে-ফেরা সুদূর কাহিনী,
শুধু ভিজতে, খানিকক্ষণ ধারাবাহী মগ্ন অবকাশে ।
মাটির প্রতীক্ষা আর ঘাসের শ্যামতা সঞ্চারিত
নির্মান নতুন পাওয়া
অস্ফুট স্বদেশী ছাপ রেলিঙের ধারে৷।

এপারে

দেখলাম দু-চক্ষু ভ’রে, হে প্ৰভু ঈশ্বর মহাশয়
চৈতন্যে প্ৰসন্ন সূৰ্য,
খচিত রাত্রির দেয়া গান
রেডিয়ো নক্ষত্রে বাজিলো এই দেহে ঝিমঝিম দূরে
শিরায় জড়ানো নহবৎ ।
ইন্দ্ৰিয়ের চুর্ণ সুরে
জেগেছে সংসার প্রান্তে আদিম গায়িত্ৰীমন্ত্রময়
ভুভূবঃ স্বঃ।
হোক না স্বেচ্ছায় বন্দী প্ৰাণ
হঠাৎ মুক্তি সে পেল।
( কিছু বন্দীদশা ইচ্ছাতীত,
সে তর্কে নামবো না। আজ । )
মহাশয়, পার্থিবের দেশে
স্বীকার্য, অনেক হ’লো : সভ্যতা যতই পাপ কাজে
যুদ্ধে হানে জ্যোতিবুদ্ধি, রক্তবহ যন্ত্রণ সমাজে
গঙ্গোত্রীর ধারা নেমে বার-বার অলক্ষ্য রঙ্গিত
ধুয়ে মুছে দিয়ে গেলো মুহুর্তে অক্ষয় লোকালয়
কোটি মৃত্যু কান্না ছোয়া সমুদ্রের নীল নিরুদ্দেশে ।
শুধু আজ্ঞা দাও, যেন বুঝি
আয়ুকাব্য মহাময়
অধ্যায়ে-অধ্যায়ে খোলা অভাব্যের এই পরিচয়
গ্ৰন্থিবাধা তারি মধ্যে এসে আমি জন্মমৃত্যুপারে
আজো কোন খুজি বাসা,
এদিকে পঞ্চাশ হ’লো, দিন
এ যাত্ৰা সন্ধ্যায় ক্রমে সন্ধিক্ষণে হ’য়ে আসে। ক্ষীণ
পালা-বদলের বেলা,
মেলাবে কি যোগ অন্ধকারে
সৌর ধুলো তৈরি দেহ রাখি যবে, ঘরে-ফেরা বাঁশি–
বহু পথ এসেছি তো বস্টনে বাঙালি দূরবাসী ৷

এম্পান্যোল্‌

বঙ্কিম ভঙ্গিতে কাঁপা খেয়ালি পথের বেহালায়
দূর সমুদ্রের পথ চিনে
কেন এ ইস্পানি গান গাও এই কঠিন মার্কিনে ;
মধু তাল উত্তাল নৃত্যনীল সুরে মাতা’
রোদ্দুরে বিদ্যুতে গাঁথা
বাজাও স্পন্দিত ধ্বনি ক্যাস্টানেটে ।
হালকা খুশির ভান
অশ্রুতে করে আনচান
মেদ্রিদের অলিন্দের একাকী উৎসুক বুক ফেটে ;
ভিড়ে ছুঁলো সে লাবণী অনির্দেশ মেঘের ভাসান ।
এই গানে অলিভের ছায়া দোলে,
আঙুরের মিষ্টিতে সোনা মদরস ভ’রে তোলে,
আঙুলে মুদ্রার ভাষা, পায়ের নাচের তাল খোলে
এ-গানের যা-ই নাম দাও
এই গান
এই প্ৰেম, এই প্ৰাণ
কভু বাস্ক্‌, ক্যাটালনিয়ান্‌
পাহাড়ের নীল-কাটা আভা দৃষ্টি তাও
চেনা চেয়ে বেশি,
শুধু নয় মন্ত্র অন্যদেশী–
এর টুইটাং ঘণ্টা শাদা ধুলো রাস্তা বেয়ে
চঞ্চল চলন্ত কত জীবনীর ছায়া ছেয়ে
দাঁড়ায় মিনার তলে, পান্থশালা রঙিন বাজারে
প্ৰাচীন ইস্পানি খচা ভারি দরজা তারি ধারে ;
আজ আনে দু-দিনের রক্তে কোন আঁকাবাঁকা
যুগান্ত পৌঁছনো প্ৰাণ, বিস্মরণী ছাঁকনিতে ছাঁকা ।
হয়তো পেরিয়ে পিরেনিসে
বিদ্রোহীর ধ্যানে মিশে
কাসাল্‌স্‌ চেলোয় তাঁর নির্বাসিত বেদনার স্পেন
অগণ্যের ঘরে জাগা
নতুন প্ৰাণনী লাগা
শৈলাভ গ্রামের বুকে এ-গান নিলেন ৷।

ওক্লাহোমা

সাক্ষাত্ সন্ধান পেয়েছ কি ৩-টে ২৫-শে?
বিকেলের উইলো বনে রেড্ এরো ট্রেনের হুইসিল
শব্ দ শেষ ছুঁয়ে গাঁথে দূর শূণ্যে দ্রুত ধোঁয়া নীল ;
মার্কিন ডাঙার বুকে ঝোড়ো অবসান গেলো মিশে ||
অবসান গেল মিশে ||
মাথা নাড়ে ‘জানি’ ‘জানি’ ক্যাথলিক গির্জাচুড়া স্থির,
পুরোনো রোদ্দুরে ওড়া কাকের কাকলি পাখা ভিড় ;
অন্যমনস্ক মস্ত শহরে হঠাত্ কুয়াশায়
ইস্পাতি রেলের ধারে হুহু শীত-হাওয়া ট’লে যায়||
শীত হাওয়া ট’লে যায় ||
হৃত্পিণ্ডে রক্তের ধ্বনিযেখানে মনের শিরা ছিঁড়ে
যাত্রী চ’লে গেল পথে কোটি ওক্লাহোমা পারে লীন,
রক্ত ক্রুশে বিদ্ধ ক্ষণে গির্জে জ্বলে রাঙা সে-তিমিরে—
বিচ্ছেদের কল্পান্তরে প্রশ্ন ফিরে আসে চিরদিন ||
ফিরে আসে চির দিন ||

কোথায় চলছে পৃথিবী

তোমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া।
সমস্ত সংসার
হাওয়া
উঠছে নীল ধূলোয় সবুজ অদ্ভূত;
দিনের অগ্নিদূত
আবার কালো চক্ষে বর্ষার নামে ধার।
কৈলাস মানস সরোবর
অচেনা কলকাতা শহর—
হাঁটি ধারে ধারে
ফিরি মাটিতে মিলিয়ে
গাছ বীজ হাড় স্বপ্ন আশ্চর্য জানা
এবং তোমার আঙ্কিক অমোঘ অবেদন
আবর্তন
নিয়ে
কোথায় চলছে পৃথিবী।
আমারও নেই ঘর
আছে ঘরের দিকে যাওয়া।।

চার্লস নদীর ধারে

স্মরণাতীতের রৌদ্রভূমি
সেখানে এনেছো তুমি,
স্পষ্ট লেখা
নিবিড় ঘাসের গূঢ় রেখা
কচি নাচে
অঙ্গের আসঙ্গে ডুবে আছে
শ্যামতির মাঠে ;
মেঘোৰ্ত্তীর্ণ শূন্যের ললাটে
এক জোড়া পানকৌড়ি তীর বেগে দূরে যায়
মধ্যাহ্নে বার্নিশ করা আকাশের গায়,
মনোপারে তীর পায় ;
কানের অচেনা পটে ভাষার বুনুনি
ঝুমঝুমি আদি কথা শুনি
মানে যার অশব্দ কাকলি,–
যেটুকুতে কাজ চলে শুনি আর বলি।
যে-কোনো দু-জনে গল্পে চলে রাস্তা দিয়ে
ছলছল বুকে যায় আত্মীয় বুলিয়ে,–
ভাবি ডেকে প্রশ্ন করি অন্য কোন দিনের কুশল
কত কাল ভুলে যাওয়া জন্মফল ;
পাড়ার প্রত্যেক বাড়ি বিস্ময় আঙুল তুলে বলে :
অন্য সংসারের চিমনি তলে
কোন এ শীতের লগ্নে উৎসবের বেলা এলো ফের,–
ধোঁয়া ওঠে কুণ্ডলী প্রশ্নের ॥

পিঁপড়ে

আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক
কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা —
স্তব্ ধ শুধু চলায় কথা বলা —
আলোয় গন্ধে ছুঁয়ে তার ঐ ভুবন ভ’রে রাখুক,
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক ||
ভয় করে তাই আজ সরিয়ে দিতে
কাউকে, ওকে চাইনে দুঃখ দিতে |
কে জানে প্রাণ আনলো কেন ওর পরিচয় কিছু,
গাছের তলায় হাওয়ার ভোরে কোথায় চলে নিচু —
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে সেই অতলে ডাকুক |
মাটির বুকে যারাই আছি এই দুদিনের ঘরে
তার স্মরণে সবাইকে আজ ঘিরেছে আদরে ||

বিনিময়

তার বদলে পেলে—
সমস্ত ঐ স্তব্ ধ পুকুর
নীল-বাঁধানো স্বচ্ছ মুকুর
আলোয় ভরা জল—
ফুলে নোয়ানো ছায়া-ডালটা
বেগনি মেঘের ওড়া পালটা
ভরলো হৃদয়তল—
একলা বুকে সবই মেলে ||তার বদলে পেলে—
শাদা ভাবনা কিছুই-না-এর
খোলা রাস্তা ধুলো-পায়ের
কান্না-হারা হাওয়া—
চেনা কণ্ঠে ডাকলো দূরে
সব-হারানো এই দুপুরে
ফিরে কেউ-না-চাওয়া |
এও কি রেখে গেলে ||

বৃষ্টি

কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।
ফাল্গুন বিকেলে বৃষ্টি নামে।
শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার।
লুটোয় পাথরে জল, হাওয়া তমস্বিনী;
আকাশে বিদ্যুৎজ্বলা বর্শা হানে
ইন্দ্রমেঘ;
কালো দিন গলির রাস্তায়।
কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলধারে।
নিবিষ্ট ক্রান্তির স্বর ঝরঝর বুকে
অবারিত।
চকিত গলির প্রান্তে লাল আভা দুরন্ত সিঁদুরে
পরায় মূহুর্ত টিপ,
নিভে যায় চোখে
কম্পিত নগরশীর্ষে বাড়ির জটিল বোবা রেখা।
বিরাম স্তম্ভিত লগ্ন ভেঙে
আবার ঘনায় জল।
বলে নাম, বলে নাম, অবিশ্রাম ঘুরে-ঘুরে হাওয়া
খুঁজেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।
আদিম বর্ষণ জল, হাওয়া, পৃথিবীর।
মত্ত দিন, মুগ্ধ ক্ষণ, প্রথম ঝঙ্কার
অবিরহ,
সেই সৃষ্টিক্ষণ
স্রোত:স্বনা
মৃত্তিকার সত্তা স্মৃতিহীনা
প্রশস্ত প্রচীর নামে নিবিড় সন্ধ্যায়,
এক আর্দ্র চৈতন্যের স্তব্ধ তটে।
ভেসে মুছে ধুয়ে ঢাকা সৃষ্টির আকাশে দৃষ্টিলোক।
কী বিহ্বল মাটি গাছ, দাঁড়ানো মানুষ দরজায়
গুহার আঁধারে চিত্র , ঝড়ে উতরোল
বারে-বারে পাওয়া, হাওয়া, হারানো নিরন্ত ফিরে-ফিরে-
ঘনমেঘলীন
কেঁদেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।

বে-স্টেট রোডে

ঠিক তাই ; ধারে-আসা। একটি কথার প্রতি ধাপে
শব্দ যেই স্তব্ধ হ’য়ে ভাবনা আভার নীলে ঠেকে
সেখানে সিঁড়িতে বসা, পাশে দেখা পশ্চিমী পাতার
লাল তামা আসন্নত নবেম্বরে, রঙা অশ্রুভার
অন্যতার প্রান্ত-নিঃশ্বসিত ; ট্রাফিকের ভিড় থেকে
কেম্ব্রিজের ব্রিজে শোনা সমস্ত নগর দূরে কাঁপে
একটি গুঞ্জন জনতার ; বারে-বারে শীর্ষে থামা,
ঊর্ধ্বে জ্বলে বৌদ্ধতারা, বহুরাত্রিপারে দৃষ্টিনাম ॥

ঘরে ফিরে শুভলক্ষ্মী রেকর্ডের শুভ্ৰাত ভজন
মুহুর্তের কণ্ঠে আনে দ্বাদশ দেউল জাগা তীর,
প্রবাস-সমুদ্রহীন, অকল্প চাওয়ার বুকে স্থির ;
কত দিন হ’য়ে গেলো খুঁজেছি সে পথের লগন ।
নীল আঁকা চীনে হাঁস ফুলপাত্রে উড়েছে মিং যুগে
ডেস্কে তারি কাছে আসা ; শূন্য শান্ত ; বেঁচেছি দৈবাৎ
—ককটেল আতিথ্যে কারো ধূম্রতা বিলাসী কক্ষে ভুগে—
কার্পেটে তুরানী নক্সা, নিয়ে তারি ঐন্দ্রিক দৃক্‌পাত ৷।

চিত্ৰ-আসি, তীর্থ-আসি : শিরায় মনের দুঃখে ঝড়ে
জমা-মেঘ-সন্তর্পিত ব্যবধান চূৰ্ণ-করা দিনে
পাতঞ্জলি সূত্ৰ পড়ি, কোচে শুয়ে ভাবি, বই খোলা
প্ৰাঞ্জল আয়ুকে কেন প্রত্যহ ধুলোর ধর্মে ভ’রে
অব্যবহিত-হারা আবিস্মিত ইট গেঁথে তোলা ।
আখ্‌রোটের কাঠে-খোদা কাশ্মীর ভূস্বৰ্গ স্বপ্ন চিনে
চুমকি-বসানো হ্রদ— মনে আছে ? –ধরি বুকে তাই ;
স্বামীজি অখিলানন্দ তাঁর কাছে মধ্যে-মধ্যে যাই ৷।

বড়োবাবুর কাছে নিবেদন

তালিকা প্রস্তুত
কী কী কেড়ে নিতে পারবে না-
হই না নির্বাসিত-কেরানি।
বাস্তুভিটে পৃথিবীটার সাধারণ অস্তিত্ব।
যার এক খন্ড এই ক্ষুদ্র চাকরের আমিত্ব।
যতদিন বাঁচি, ভোরের আকাশে চোখ জাগানো,
হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো।
কুয়োর ঠান্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি
গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি।
আপন জনকে ভালোবাসা,
বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা।
তাড়াও সংসার, রাখলাম,
বুকে ঢাকলাম
জন্মজন্মান্তরের তৃপ্তি যার যোগ প্রাচীন গাছের ছায়ায়
তুলসী-মন্ডপে, নদীর পোড়ো দেউলে, আপন ভাষার কন্ঠের মায়ায়।
থার্ডক্লাসের ট্রেনে যেতে জানলায় চাওয়া,
ধানের মাড়াই, কলা গাছ, কুকুর, খিড়কি-পথ ঘাসে ছাওয়া।
মেঘ করেছে, দু-পাশে ডোবা, সবুজ পানার ডোবা,
সুন্দরফুল কচুরিপানার শঙ্কিত শোভা,
গঙ্গার ভরা জল; ছোটো নদী; গাঁয়ের নিমছায়াতীর-
হায়, এও তো ফেরা-ট্রেনের কথা।
শত শতাব্দীর
তরু বনশ্রী
নির্জন মনশ্রী :
তোমায় শোনাই, উপস্থিত ফর্দে আরো আছে-
দূর-সংসারে এলো কাছে
বাঁচবার সার্থকতা।।

মিল

মিশোতে কি পারবে ঠিক ক’রে
মৃত্যুকেই এ মুক্তি-জীবনে
রোজ-রোজ ;
যেমন নীলের ধূলি পৃথিবী মাটিতে গাঁথা অবলীন
প্ৰাণবায়ু প্ৰাণভূমি প্রাণশূন্য।
কান্নাবিন্দু অলক্ষ্য মুক্তোয় ঝরা
এই যে আলোয় মিশ্র আপনি বাংলার আশীৰ্বাণী
আনে দূরে ঘোর-দেয়া এপারের ঘরে নিত্য সুধা,
সে কি এই শেষ দৃষ্টিভরা।
মনে হয় ফিরে-পাওয়া মৃন্ময়ী বাসায়
গোলক চাপার তলে ব’সে আছি,
খোয়াই-পেরোনো স্থির সম্পূর্ণ স্বীকৃতি
শান্তিনিকেতনে,
অথচ সবই সে কোন পূর্বজীবনের সন্ধিমাখা,
বিদেশের ক্ষণোজ্জল সায়াহ্নে এখানে শুধু বাঁশি

যা-কিছু প্ৰত্যক্ষ তারি জরি
সূৰ্যসুতোর জালে আয়ুময় আন্দোলিত
মুহুর্ত মন্দিরে ঝলমল,
পর্দা সেও : তুলে তাকে
একেবারে দেখবো কি ডুবে-যাওয়া পান্থজীবনের
অবিচল ধারণায়—
প্ৰবাসে সর্বস্বহারা দিনে উদ্ভাসিত ;
পারবে কি, চৈতন্যময় মন,
পারবে কি ক্ষুধায় কাঁদা বুক ৷।

রাত্রি

অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাত্ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোত্স্না,
দেখি তুমি নেই ||

সংলাপ

(১৯৫৫)

“সরু সামাজিক পথে চ’লে
একটু-আধটু কঁচা জায়গা তবুও মনের মধ্যে রাখা :
আগাছায় ছায়া-দেয়া আদিমতা ।
শোনো, বন্ধু, অলিগলি আঁকাবাঁকা তাতে ঘুরি।
চমক পাথরে মোড়া উজল মনন সভ্যতায়
অতিথি, তবুও ফিরে গিয়ে
ব’সে থাকি ভাঙা ঘাটে, সেই শিবতলা পুলে
গঙ্গার ওপারে, দেখি, কিছু নয়, মাছটা, পাখিটা,
কানাই ঘোরায় লাঠি, ছোটো ছেলেমেয়ে ভিড় করে,
হাঁ ক’রে তখুনি মানে জাদুবিদ্যে, ভেঁপু কেনে।
দামী রাজ্যে স্বনির্বাসী গরিব বাঙালি
তারি যে নিতান্ত সার্থী, ছেড়া চটি প’রে চলে যাই
আত্মীয় যুগের মধ্যগ্রামে,
একেবারে প্রাথমিক প্ৰণতির ।
আহা, ঐ বোষ্টমী ভিখারি
কিছু না জেনেও গায় কত সে পুরোনো ধ্বনিভরা
গান,
ছন্দ তার যেন নান্দী পাঠ, একতারা বাজা
ভাঙা ব্যাকরণে মেশা পার্থিব যোগের সংসারতা
হাটের বাটের, ছোঁয়া রাধা-কৃষ্ণ প্ৰেমধ্যানে,
শিব-পার্বতীর কথা, শৈল স্নিগ্ধ নীল হিমাচল
হাওয়ায় পুজোর ঠাণ্ডা আনে কলকাতায়,
বাংলা ঘরে-ঘরে ;
এ সব বলবারই নয়, হয়তো, কী জানি
প্রামাণ্যই নয়, তবু এতেও সূক্ষ্ম ধন
নরহরি বার্তা আছে তোমাদেরও ।
আশ্বিনে সানাই বাজে শোনো দূর শ্রুতি।
আজ আমার বুক ভরা, সবাইকে শ্ৰদ্ধা ক’রে বলি
সুন্দর স্বাগত দিলে, দেখো ছুটি অর্জেছি
দুই তীরে,
আন্তর্জাতিক মন শিকড়ে মাটিকে আঁকড়ে থাকে
যে-মাটি এ-বুকে আজো বাংলা পার্থিব,
যদি ফোটে মেঠো ফুল, তাই নাও সেই মাটি থেকে
যাত্রী-অৰ্ঘ্য নব বৎসরের ॥”

সমাবর্ত

নিরবধি কালের সকাল । নীল ইস্পাতী রেলে জ্ব’লে ওঠে
কালো দ্যুতি, দুটো-পঁচিশের ট্ৰেন এলো ব’লে, প্রশ্নচক্ষু স্থির
সিগ্‌নলের— হঠাৎ সবুজ দৃষ্টি— ঝোড়ো এক্সপ্রেস ছোটে
সময়ের অন্য দূরে দূরে ; থেমে যায় আন্দোলিত ভিড়

কম্পিত পরিধি প্ৰান্তে ; পাশে অসংলগ্ন জলে গম্ভীর বকের
এক-পা বাড়ানো ধ্যান : মনে একটি মাছ ; উঁচু টেলিগ্ৰাফ তারে
কোটি বার্তা চলে তা কে জানে, তাতে ব’সে দোলায় সখের
পুচ্ছ বুনো পাখি, ভিন্ন লোকে ; মাঠে লাল ট্র্যাক্টর অন্যধারে।

মধ্য-মার্কিনে আছি মিসিসিপি পারে, চলেছি যে-ঘড়ি হাতে
টিকটিক আয়ু তার আনে ছিন্ন এটা-ওটা : খুজি নিঃসময়
কোন ঘটনার ছবি–বাংলা ভাষায় গাঁথা–চিরক্ষণে যাতে
শাদা বক, ব্যস্ত ট্রেন, বুকে ধরে এই সকালের পরিচয়৷।

 সাবেকি

গেলো
গুরুচরণ কামার, দোকানটা তার মামার,
হাতুড়ি আর হাপর ধারের ( জানা ছিল আমার )
দেহটা নিজস্ব |
রাম নাম সত্ হ্যায়
গৌর বসাকের প’ড়ে রইল ভরন্ত খেত খামার|
রাম নাম সত্ হ্যায় ||
দু-চার পিপে জমিয়ে নস্য হঠাত্ ভোরে হ’লো অদৃশ্য—
ধরনটা তার খ্যাপারই—
হরেকৃষ্ণ ব্যাপারি |
রাম নাম সত্ হ্যায়
ছাই মেখে চোখ শূণ্যে থুয়ে, পেরেকের খাট তাতে শুয়ে
পলাতক সেই বিধুর স্বামী
আরো অপার্থিবের গামী
রাম নাম সত্ হ্যায়
রান্না রেঁধেকান্না কেঁদে, সকলেরপ্রাণে প্রাণে বেঁধে
দিদি ঠাকরুন গেলেন চ’লে—
খিড়কি দুয়োর শূণ্যে খোলে!
রাম নাম সত্ হ্যায়
আমরা কাজে রই নিযুক্ত, কেউ কেরানি কেউ অভুক্ত,
লাঙল চালাই কলম ঠেলি, যখন তখন শুনে ফেলি
রাম নাম সত্ হ্যায়
শুনবো না আর যখন কানে বাজবে তবু এই এখানে
রাম নাম সত্ হ্যায় ||

 ১৩৫০

 

হাত থেকে তার পড়ে যায় খসে
অবশ্য আধলা ধুলোয়।
চোখ ঠেলে খোলা অসাড় শূন্যে।
প্রাণ, তুমি আজো আছ ঐ দেহে,
আছ মুমূর্ষু দেশে।
কঙ্কাল গাছ ভাদ্রশেষের ভিখারী ডালটা নাড়ে,
কড়া রোদ্দুর প্রখর দুপুরে ফাটে।
হাতের আঙুলে স্নেহ দিয়েছিলে
চোখে চেনা জাদু আপন ঘরের বুকে –
বাঙলার মেয়ে, এসে ছিল তার জীবনের দাবি নিয়ে,
দুদিনের দাবি ফলন্ত মাঠে, চলন্ত সংসারে;
কতটুকু ঘেরে কত দান ফিরে দিতে।
সামান্য কাজে আশ্চর্য খুশি ভরা।
আজ শহরের পথপাশে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েকোথা
সভ্যতা ছোটে তেরোশো পঞ্চাশিকে।।

Exit mobile version