Site icon BnBoi.Com

প্রথম পয়ার – মহাদেব সাহা

প্রথম পয়ার - মহাদেব সাহা

আমি ও যুদ্ধোত্তর মধ্যরাত্রি

বড়ো ত্রাস, সদর দরোজা ভেঙে
যেন হুহু করে মধ্যরাতে ঢুকে পড়ে সন্ত্রাসের ট্রাক
অকস্মাৎ ভেঙে দেয় নিসর্গের রম্য খেলা
জ্যোৎস্নাময় এ-রাত্রি, কাঁঠালীচাঁপার বন,
বনচারী পাখিদের শান্ত ঘুম, অবকাশ
ত্রাস, শুধু ত্রাস
ত্রাস, শুধু কি আমার
এখন এ-মধ্যযামে নিদ্রামগ্ন রয়েছেন পিতা
অগ্রজ ঘুমান, কে নেবে তল্লাস কার
গৃহের কুকুর সেও গভীর নিদ্রায়,
নিদ্রিত সমস্ত বাড়ি অন্ধকারে কেঁপে কেঁপে ওঠে
এই কোলাহলহীন রাত্রি চোখে নিয়ে
আমি শুধু জেগে আছি, পিতা।
এ বাড়িতে, এই জনশূন্য মধ্যরাত্রিত্রাসিত বাড়িতে
আমার পিতার আগে
আর কোনোদিন কেউ বংশধর ছিলো,
আমাদের আগে এ শহরে ছিলো কোনো
সপ্রতিভ নারী ও পুরুষ অধিবাসী?
এই যুদ্ধোত্তর নগরের মধ্যরাত্রে আর কেউ
অধিবাসী নেই, নগরকোটাল গেছে ফিরে,
একে একে দিবসের দীপ্ত প্রদর্শনী শেষ
জনসমাগমহীন ধূসর চৌরাস্তা,
গোরস্থানে নেই শববাহী কেউ, এমনকি
রাত্রি পতনের শব্দে পালিয়েছে নগরের ঝানু গুণ্ডা,
মাতাল লম্পট,
নাগরিক নরনারী, এই ভয়াবহ মধ্যরাত্রে আমি শুধু
জেগে আছি তোমাদের সর্বশেষ প্রতিনিধি।
যেখানে আমার পিতা একদিন দাঁড়াতেন
হাতে মৌনতার মালা গেঁথে
এ বাড়ির সেই ছাদ ভগ্ন, বোমাবিদ্ধ কঠিন কার্নিশ,
আমার রোমাঞ্চকর শৈশবের সঙ্গীজন
দেখি তার সবুজ কবর
শহরের উচ্চতম টাওয়ার ছুঁয়ে যুদ্ধ তার রেখে গেছে
ভয়ঙ্কর মজ্জাগত প্রেম
এ-রাত্রিতে, এই মধ্যরাত্রে শহরের প্রধান দরোজা ভেঙে
যুদ্ধের পোশাকধারী কারা ছুটে আসে
ত্রাস, যুদ্ধের সন্ত্রাস?
এই মধ্যরাত্রে নিদ্রামগ্ন পিতা, আশ্রিত আলয় কম্পমান,
নিদ্রিত শহর
যুদ্ধোত্তর রাত্রির সন্ত্রাস বুকে
এই রাত্রে, এই ভয়াবহ মধ্যরাত্রে আমি শুধু
জেগে আছি তোমাদের সর্বশেষ প্রতিনিধি।

আলিঙ্গন

তোমার মাটিতে আঁকা
আমার শরীর
চুলের অরণ্যে ছায়া,
রৌদ্র তোমার আমি দেহের সীমায়।
তুমি চোখ খোলো
তোমার চোখের কালো জলে
দেখো আমি খেলা করি মাছ
কোথায় ভাসাবে তুমি
কোথায় খুঁড়বে কালো গোর
সমগ্র মাটিতে দেখো
ছেয়ে যাবে আমার শরীর;
যা চাও আমাকে তুমি
পাখি বলো পাখি
মেঘ বলো মেঘ
তুমি যদি মেলে ধরো তোমার শরীর
আমরা দুজনে হই
পাথর খোদাই।

তোমাকে ডাকার স্বাধীনতা

আজ এ-বৎসরের শেষ রবিবারে
সমস্ত শহর করে তোলপাড়
গ্রীসীয় যুবার মতো ভুঁড়ে দেবো শব্দের মাতাল নিনাদ
আমার প্রেমিকা, প্রিয়তমা নারী
উদ্দেশে তোমার;
তোমাকে ডাকবো আমি নির্লজ্জ গেঁয়োর মতো
সমবেত অগ্রজের মুখোমুখি বসে-
দীর্ঘদিন বলি না প্রেমিকা,
বলি না গোলাপ
কতোদিন আনি না মুখে প্রেয়সী নারীর নাম
যেন উচ্চারণে অস্পষ্ট শিশুর মতো
কতিপয় শব্দ ছিলো সীমাহীন দূরত্বে আমার,
আজ বর্ষণের রাতে আমি বুঝি প্রথম কৃষাণ
শতাব্দীর অকর্ষিত মাটি ভেদ করি
কতোদিন তোমাকে আনি না মুখে প্রেম,
প্রিয় স্বাধীনতা, রম্য গোলাপ
যুদ্ধক্ষেত্রে গ্রেনেডের শব্দে, মাইনের মুখর সঙ্গীতে
শত্রুর রণদামামায় শুনতাম কবিতার পরিচিত পঙ্‌ক্তি,
একঝাঁক রাইফেলের শব্দে ঝরে পড়ে অসংখ্য খুলির মালা
যেন প্রিয়ার হাতে রডোডেনড্রনগুচ্ছ
আজ এ-বৎসরের শেষ রবিবারে, যুদ্ধ শেষে
তোমাকে ডাকার স্বাধীনতা
প্রিয়তমা প্রেমিকা আমার!

তোমার প্রেমিক

এখানে প্রেমিক নেই আমি ছাড়া
সর্বক্ষণ উদ্যত পুরুষ
হাতে যার যুদ্ধজয়ী পিতার কৃপাণ
হুলস্তুল মধ্যরাতে
যখন পাল্টে যায় সবুজ দেয়াল
ছত্রখান হয়ে ভেঙে পড়ে অট্টালিকা, চাঁদ
কে পারে বদলে দিতে সে রাত্রিকে ফের
দিনের সমান
সে তোমার গোপন প্রেমিক;
তুমি তাকে চেনো না তেমন ভালোভাবে
তাকে তুমি দেখো নাই ক্রোধে কম্পমান
দীর্ঘতর হতে,
যে পারে আমূল এনে তোমাকে বসাতে
মধ্যস্তলে, জ্বেলে দিয়ে হাজার প্রদীপ
সে তোমার গোপন প্রেমিক;
তাকে তুমি দেখো নাই জ্যোৎ্লাহীন
খোলা মাঠে, অন্ধকারে দুরন্ত গেরিলা
দেখো নাই তাকে তুমি সুতীক্ষ্ণ ব্যারেল খুলে
লক্ষ্যভেদী অব্যর্থ অর্জুন
সে তোমার ভীষণ প্রেমিক;
কে পারে রক্তাক্ত করোটি থেকে
পুনরায় জন্ম দিতে সভ্যতার মাটি
ইতিহাস সম্ভাবনাময় পথে
নেমে আসে কার ডাকে খোলে স্তব্ধ
শতাব্দীর নিরেট কপাট
আর কেউ নয়
সে তোমার জেদী উদ্ধত প্রেমিক;
সে জানে আদিম সত্য
ভালোবেসে পরাজয় নেই,
চষা ক্ষেতে উলঙ্গ কৃষাণ যেন কৃষাণীকে
করে তোলে শস্যময় অগাধ সবুজ
সে তোমার অবাধ্য প্রেমিক;
তাকে তুমি চোখ তুলে দেখো
সে এসেছে যদ্ধজয়ী যুবরাজ
আর কেউ নয়, এই আমি
সে তোমার গোপন প্রেমিক।

স্মৃতি

সে আসে আমার কাছে ঘুরে ঘুরে যেন এক
স্রোতস্বিনী নদীর সুবাস, ভালোবাসা সে যেন হৃদয়ে শুধু
ঘুরে ঘুরে কথা কয়, চোখের ভিতর হতে সুগভীর চোখের
ভিতরে, সে আসে প্রতিদিন জানালায় ভোরের রোদের মতো
বাহুলগ্ন আমার প্রেমিকা;

সে আসে প্রত্যহ এই আলোকিত উজ্জ্বল শহরে, ইতিহাস
আরো সব কিংবদন্তী কথা কয় আমার স্মৃতিতে, সে আসে
দূর থেকে মনে হয় শ্যামল ছায়ায় ভরা যেন এক
হরিণীর চোখ, অথবা রোদের সুরভিমাখা হেমন্তের শিশির সকাল
সে আসে আমার কাছে নুয়ে পড়ে আমলকী বন;
সে আসে আমার কাছে ভরে ওঠে বছরের শূন্য খামার
নদীতে সহসা ওড়ে মাছরঙ নায়ের বাদাম
ক্ষেতের দরাজ দেহ সিক্ত করে মেঘের মৈথুন,
সে আসে আমার কাছে
ফুটে ওঠে নিসর্গের নিবিড় কদম
সে আসে আমার কাছে ঘুরে ঘুরে নদীর স্রোতের মতো
জলে-ভাসা ভেলা।

Exit mobile version