Site icon BnBoi.Com

ধূলোমাটির মানুষ – মহাদেব সাহা

ধূলোমাটির মানুষ - মহাদেব সাহা

অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প

অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প, আমি তাকে
দুঃখভরা নকশীকাঁথার মতো আমার শরীরে
করেছি সেলাই,
বড়োই যাতনাময় তবু তার নিবিড় সান্নিধ্যে থেকে আমি
বুঝেছি কেমন এই প্রবাহিত তোমাদের অটুট জীবন
চারধারে, কেমন সুস্থতা
তার মাঝে ক্রমাগত অন্তঃসারশূন্যতার কী গভীর ধস ও ফাটল!
অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প তার কাছে থেকেই তো আমি
প্রথম শিখেছি তোমার মুখের সাথে গোলাপের কোথায় অমিল
কিংবা এই চলচ্ছক্তিহীনতার মধ্যে কী প্রখর অন্তহীন ধাবমান আমি
আর সিরিঞ্জের রক্তিম ওষুধই কখনো কখনো
কীভাবে তোমার সূক্ষ্ম অনুভূতি হয়;
অসুস্থতা আমাকে দিয়েছো গাঢ় অবিমিশ্র এ কোন চেতনা
যতোই তাকাই চোখ মেলে মনে হয়
ওষুধের একেকটি মৃদু ফোঁটা স্মৃতির ভিতরে রাত্রিদিন
ঝরে কোন বিরল শিশির
শুভ্র নার্স যাকে আমি চিরকাল ভেবেছি শুশ্রূষা
মানুষের ক্ষত ও আহত দেহময় উদ্বেলিত কোমল বর্ষণ
বলে চিনি,
অসুস্থতা তাই তারও কণ্ঠে আমি শুনেছি কোরাস
আমার সকল ঘরময় কখনো দেখেছি তাকে অপেরার মতন
উদ্দাম
এলায়িত ভঙ্গি আর নৃত্যপরায়ণ-
না হলে তাকেই বুকে নিয়ে
কীভাবে এমন আছি দীর্ঘ রাত্রি মগ্ন ও মোহিত
কখনো কখনো এই অসুস্থতাকে মনে হয় প্রিয়তমা প্রেমিকার
চেয়ে আরো বেশি
মনে হয় অনুরক্ত বুঝি কোনো লাজুক তরুণী সে যে
খুব সন্তর্পণে শান্তধীর কিংবা দ্বিধায় আমার শরীরে
তার অলৌকিক স্পর্শ রেখে যায়
এই অসুস্থতা আমাকে দিয়েছে তার নগ্নদেহ, নগ্ন শিহরন
আর তার ব্যাকুলতাময় ঊরু, জঙ্ঘা, স্তন ও শোণিত।
তার দিকে চেয়ে দেখি আমার সম্মুখে
বয়ে যায় কল্লোলিত জীবনদেবতা
আমার সামান্য এই ছিটেফোটা পরমায়ুটুকু কেবল তারই তো দেখি
করুণাধারায় সিক্ত
আমি এই অসুস্থতা তোমাকে পেয়েই কতো যে না-পাওয়াগুলি সহজে ভুলেছি!

তোমার ট্রান্সপেরেন্ট উদার চক্ষুদ্বয়ে দেখা যায়
প্রজ্জ্বলিত ঐশ্বরিক মেধা
তোমার মুখের দিকে চেয়ে আমি তাই মনে মনে ভাবি
তুমি কি মৃত্যুর কাছ থেকে এই সূর্যাস্তের ছায়া, মুগ্ধ টিপ
আর এই সূক্ষ্ম শিল্পের কাজ-করা বিদায়খচিত সুবর্ণপদক
এনেছো আমার জন্য?
যার একদিকে উদাত্ত আহ্বান আর
অন্যদিকে গাঢ় বিস্মরণ!
অসুস্থতা আমার নির্জন শিল্প আমি জানি
তোমার একটি তুচ্ছ ব্রণের দাগও এতো বেশি চেনা
আমার আত্মাকে যতো শুদ্ধ হতে বলি, বলি বীজন জড়তামুক্ত হও
তার মুখ ততো নৈঃশব্দ্যের দিকে ঘুরে যায়
আর সেই অস্পষ্ট বিলীয়মান কন্ঠস্বরে যেন মনে হয় শুনি
আমার এ রুগ্নতার ভিতর দিয়েই সভ্যতা ও ইতিহাসই
চায় আজ মৌলিক শুশ্রূষা!

আমার সমুদ্র দেখা, আমার পাহাড় দেখা

আমার কোনোদিন সমুদ্রদর্শন হয়নি, পাহাড় দেখাও না
কেন যে সমুদ্র বা পাহাড় আমাকে এন বিমুখ করেছে
সমুদ্র আমাকে দর্শন দেননি কখনো
পাহাড় আমাকে সান্নিধ্য,
বাল্টিকের তীরে দাঁড়িয়ে আমি যেমন ধু-ধু জলরাশি ছাড়া
কোনো সমুদ্রই দেখতে পাইনি আর
তেমনি ময়নামতির পাহাড়েও প্রস্তরীভুত নিস্তব্ধতা,
এই আমার পাহাড় কিংবা সমুদ্রদর্শন!
হয়তো সমুদ্র দেখতে গিয়েই আমার তখনই
মনে পড়ে যায় একটি নিঃসঙ্গ চড়ুই কিংবা কাকের করুণ মৃত্যু
কিংবা মাতিসের কোনো নীল চোখের দিকে তাকিয়েই মনে হয়
সমুদ্র
কখনো কপালকুণ্ডলার আখ্যান জুড়েই উচ্ছল হয়ে ওঠে
নীলফেনিল তরঙ্গমালা!
কিন্তু আমি তো সমুদ্রই দেখতে চেয়েছিলাম তবুও সমুদ্রের কাছে গিয়ে
আমার কখনো সমুদ্র দেখা হয়নি
যেমন পাহাড়ের কাছে গিয়ে দেখা হয়নি কোনো নিবিড় পাহাড়কে,
আমি সেখানে উচ্চতা ছাড়া পাহাড় বলতে কিছুই দেখিনি!
এই সমুদ্র আমাকে চিরদিন বিমুখ করেছে
সমুদ্রের গায়ে হাত রেখে তাই তাকে
কেমন আছে বলে কুশল প্রশ্ন করতে পারিনি কখনো,
যতোবারই তাকিয়েছি ততোবারই মনে হয়েছে ব্যর্থতা
এক অর্থে এই ব্যর্থতার নামই সমুদ্র কিংবা পাহাড়;
পাহাড় আর সমুদ্রের মধ্যে ঈশ্বর জানেন কোথায় যেন কি
মিল আছে
হযতো তাই পাহাড়কে কখনো আমার মনে হয়েছে তরঙ্গময়
সমুদ্রকে শিলাশোভিত;
আমি হয়তো সমুদ্রের মধ্যে আরো কোনো পৃথক সমুদ্র সন্ধান
করেছিলাম কি না কে জানে
পাহাড় কিংবা আকাশের দিকে তাকিয়েও ঠিক তেমনি
অন্য কোনো স্বপ্ন-কোনো আভাস
তাই এখন কেবল মনে পড়ছে বাল্টিক কিংবা আরব সাগরের কূলে
আমি একটিও ঝিনুক কিংবা শঙ্খ কুড়াইনি কখনো
ক্যামেরায় সমুদ্রের ছবি তোলার দুঃসাহস করবো কীভাবে
সমুদ্রের কাছ থেকে আমি উপহার পেয়েছিলাম সামান্য যা টাকাকড়ি
তার নাম ব্যর্থতা;
চিরকাল পাহাড় ও সমুদ্রদর্শন করতে গিয়ে
আমার লাভের মধ্যে এই কিছু পবিত্র বিষাদ অর্জন!
তাই সমুদ্র দেখতে গিয়ে আমার সমুদ্রদর্শন হয়নি
পাহাড় দেখতে গিয়ে পাহাড় দেখা,
না দেখেছি পাহাড় না দেখেছি সমুদ্র
অথচ কী যে দেখতে দেখতে কী যে দেখতে দেখতে
আমার কতোবার দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে
হয়তো আমি কিছুই দেখিনি সেই না-দেগখাটাই ছিলো আমার
সমুদ্রদর্শন, আমার পাহাড়-প্রবেশ।
সমুদ্রের নীল জলরাশির দিকে তাকিয়ে কখন েমনে পড়েছে
আমার মায়ের অশ্রুভেজা দুটি চোখ
সমুদ্রকে তার সেই সিক্ত ও সজল চোখের চেয়ে বিসতৃত মনে
হয়নি আমার,
যে চোখ এতো অশ্রু ও মমতা ধারণ করে আছে তার দিকে তাকিয়েই
আমি বলেছি এই তো সমুদ্র!
হতে পারে সমুদ্রকে এভাবেই আমি ভিন্ন ও পৃথক রূপে দেখে
ভীত ও শিহরিত হয়েছিলাম।
আবার আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতেই আমার কখন যে
বাংলাদেশের একজন ক্ষুধার্ত কিশোরীর মলিন ছেঁড়া শাড়ির কথা
মনে পড়ে যায়, বলতে পারবো না
আকাশের চেয়ে তার দারিদ্র্যকেই বেশি বড়ো মনে হয় আমার
আমি কি করবো, সমুদ্র দর্শনের ঠিক একাগ্রতাই হয়তো আমার নেই
কিংবা আকাশ কি পাহাড় দেখার সঠিক মনোযোগ,
তাই সমুদ্র দেখতে দেখতে আমার মধ্যে জেগে ওঠে সামান্য একটি
চড়ুইয়ের মৃত্যুদৃশ্য
আকাশ দেখতে দেখতে আমার মনে হয় আমি বুঝি
সারা বাংলাদেশ জুড়ে কেবল বাসন্তীর ছেঁড়া শাড়ি টানানো দেখছি,
পাহাড় দেখতে গিয়ে কতোবার যে আমি এমনি আহত হয়ে
ফিরে এসেছি
সকলে সুদৃশ্য পাহাড় দেখলেও আমি সেসবের কিছুই দেখিনি।
তাই এসব অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করতে বললে
তখনই কেবল চোখের সামনে পাহাড় ও অকূল সমুদ্র
ভেসে ওঠে
চোখের জলই আমার মনে হয় সমুদ্র
অটল মৌনতাই আমার কাছে পাহাড়;
কিন্তু সমুদ্রের সেই পৃথক সুন্দর রূপ আমি স্পষ্ট দেখতে পারিনি কখনো
তাই সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বারবার আমি দেখেছি জলের দম্ভ
অনেকটা মরুভূমির মতোই শূন্য ও ধূসর সে, এখানেই তো
বালিরও উদ্ভব
পরক্ষনেই সমুদ্রে জাহাজগুলোকে ভাসতে দেখে
আমার মনে হয়েছে অনন্তের মধ্যে সাঁতার কাটছে তোমার রাজহাঁস,
মাছগুলো এই সমুদ্রের রহস্যের মতোই লাল ও উদাসীন
সূর্যাস্ত আর গোধূলিও যেন এই সুমদ্রের মধ্যেই শুয়ে আছে!
কখনো এই সমুদ্রের মধ্যেই আমি দেখেছি জ্বলজ্বল করছে
অসংখ্য তারা, চাঁদ ভাসচে সমুদ্রে
হঠাৎ সমুদ্রের মধ্যে এই নীলাকাশ দেখে
আমি কেমন বিহ্বল ও অনুতপ্ত হয়ে পড়ি;
আর আমার সমুদ্র দেখা হয় না, সমুদ্রের কলতান
আমার কাছে মনে হতে থাকে তোমার ব্যাকুল আহ্বান যেস,
তাই কেউ যখন পাহাড়ের উচ্চতা মাপতে যায়
আমি তখন মৌনতা বিষয়ে ভাবতে থাকি।
আমি হয়তো সমুদ্রে ঠিক সমুদ্র দেখতে পাই না
পাহাড়ে ঠিক পাহাড়,
হয়তো সমুদ্রের চেয়েও কিছু বেশি পাহাড়ের চেয়েও কিছু অধিক
আমি সেই সমুদ্র ও পাহাড়কেই হয়তো নাম দিতে চাই কবির তন্ময়তা।

এই ব্যর্থ আ-কার এ-কার

এই তো আমার কাজ আ-কার এ-কারগুলো খুঁটে খুঁটে দেখি যদি হয়,
যদি কিছু হয়
যদি একটি পাখিরও মৃদু ঠোঁট হয়ে ওঠে নিরুপায় শিথিল
অক্ষরে
চোখের অধীর অশ্রু যদি কাঁপে এ-কারের ক্ষীণ কণ্ঠস্বে
আমি তা জানি না; আমি শুধু অবিচল মুদ্রাকরের মতন
কালিঝুলি-মাখা এই কেসের ভিতরে সারাক্ষণ চালাই
আঙুল।
এই তো আমার কাজ আ-কার এ-কারগুলো জড়ো করি
আর ভেঙে ফেলি
কখনো ঘনায় মেঘ কখনোবা রঙিন সূর্যাস্ত নেমে আসে
টাইপের এই জীর্ণ কেসের গহ্বরে
কখনো একটি ভাঙা আ-কার খুঁজতে গিয়ে দেঝি তার গায়ে কতো রহস্যের
রাঙা স্পর্শ লেগে আছে, এ-কার কখনো দেখি তন্ময়ের
তীরে একা-একা,
আমি তবু ভাঙি আর জড়ো করি এই ব্যর্থ বর্ণের ব্যঞ্জনা।
মাঝে মাঝে আমিও কখনো হয়ে উঠি রোমাঞ্চিত যদি দেখি
একটিও সফল আ-কার কোনোখানে বসিয়েছি ঠিক,
আর তাই তো কখনো আমি পড়তে দিইনি ধুলো এই কালো
এ-কারে আ-কারে
তারা যেন ক্ষেতের সোনালি পাকা ধান, থোকা থোকা
পড়ে থাকা জুঁই!
আমি এই অসহায় চিহ্নগুলোকে নিয়েই হয়তো বানাতে
চাই ব্যাকুল বাগান
হয়তো ফোটাতে চাই তারই ডালে প্রত্যাশার গাঢ় স্বর্ণচাঁপা
এমনও হয়তো আমি তারই মাঝে ফুটিয়ে তুলতে চাই
জ্যোৎ্লার নিবিড় জড়োয়া!
এই তো আমার তুচ্ছ কাজ আ-কার এ-কারগুলো তুলি আর
তুলি ভেঙে ফেলি
দেখি যদি হয়, যদি কিছু হয়
কোনো মুখ, কোনো নাম, কোনো প্রিয় স্মৃতির রুমাল
যদি হয়, যদি কিছু হয় একটি আ-কার জুড়ে দিলে
সেই বিস্ফারিত চোখ, জলাশয়, চিত্রিত হরিণ
কিংবা পর্যটনের পাখিটি;
তাই তো এমন মনোযোগে
এতো রাশি রাশি অক্ষরের ফাঁকে বসিয়েছি এই ভালোবাসার
এ-কার
আ-কার তখনো বাকি আমি ভাবি বুঝি আ-কার এ-কার
জুড়ে দিলে
অনায়াসে হয়ে যাবে তোমার প্রকৃতি
তাই তো মেখেছি এতো কালিঝুলি এই হাতে, এই দুটি
হাতে!
যদি হয় এই ব্যর্থ আ-কার এ-কারগুলো তুলে কোনো মগ্ন
মাটির বারান্দা
পাতার ছাউনি আর গ্রিলের লতানো নিশ্চয়তা যদি হয়
একখানি ঘরোয়া ইমেজ;
সেই ভেবে রেফ আর অনুস্বরগুলো প্রায় ছুঁইনি আঙুলে
কেবল পরেছি এই আহত কপালে আমি অকারণ বিস্ময়ের ফোঁটা
আর মাঝে মাঝে প্রশ্নের দরোজাখানি খুলে ডেকেছি তোমাকে
যদি হয়, যদি কিছু হয এই আ-কার এ-কারগুলো থেকে
রঞ্জিত বা গূঢ় উচ্চাতি!

কোথাও পাই না দেখা

কেবল তোমারই দেখা পাই না কোথায। যেন তুমি
অদৃশ্য অলীক কিছু; স্বপ্নও জানে না কোনো খোঁজ
তারও রুপালি পর্দায় কখনো ওঠে না ভেসে তোমার ইমেজ
তুমি আছো এতোদূরে স্পর্শগন্ধহীন স্বপ্নেরাও সূক্ষ্ম অগোচরে
কেবল তোমারই দেখা পাই না এখন। জনারণ্যে এভেন্যুর
উদ্দীপনাময় ভিড়ে কোথাও তোমার দেখা নাই। তুমিই
কি সেই অদৃশ্য স্বপ্নের পাখি কিংবা মায়াবী হরিণ
চিলে, আর কোনোখানে নেই, তুমি কি সেই গ্রীক
পুরাণকাহিনী?
না হলে পাই না কেন কোথাও তোমার দেখা? যদিও
প্রত্যহ এ শহর
জনসংখ্যার চাপেই অস্থির তার বাহুতে গ্রীবায় গণ্ডে
কেবল চলেছে বেয়ে অবিরাম মানুষের ধারা; ফুটপাত, রাজপথ
কিংবা বিপণি সিক্ত ও ব্যাকুল এই লোকের বন্যায়
তবু তোমার একটি মুখ এ শহরে একান্ত দুর্লভ
এমনকি কোনো মনোরম চিত্রশালা কিংবা মিউজিয়াম ঘুরেও
কখনো তোমার একটি মুখ হয়নি তো নয়নগোচর
শাগালের সুসমৃদ্ধ ঐশ্বর্যশালীন প্রদর্শনী জুড়ে
সবার অজান্তে আমি খুঁজেছি তোমার মুখ; তোমারই
দুটি চোখ পিকাসোর চিত্রময় অ্যালবাম ব্যেপে করেছি
প্রত্যাশা
যামিনী কি জয়নুল-কামরুলেও তন্নতন্ন খুঁজেছি তোমায়
কি জানি হয়তো তুমি লোকচক্ষুর আড়ালে হয়ে আছো
এ-রকমই কোনো মুগ্ধ শিল্পের ব্যঞ্জনা;
আমারই ব্যর্থ চোখ দেখতে অক্ষম।
হয়তোবা আর সকলেই অতি সহজেই তোমাকে দেখতে পায়
কারো ঘরে অনিবার্যভাবে তুমি সন্ধ্যাদীপের মহিমা তাও জানি
কিংবা কারো কাতানের কাতর প্রশংসা এমনকি
হয়তোবা ফুটে আছো এইরূপই কোনো সংসারের পাশে
লোকায়ত টবে,
কেবল আমার জানা বা চেনা চাই কি স্বপ্নেরও অন্তরালে!
কিছুই দেখতে চাই না তবু সবকিছু দেখি আর
কেবল তোমারই পাই না দেখা। কেন যে আমার কাছে
তুমি হলে
এ-রকমই রূপহীন, বর্ণহনি, এই অবয়বহীন!
হঠাৎ পথের মোড়ে দুপুরে কি পড়ন্ত সন্ধ্যায়
এই অসংখ্য মুখে একটি মুখও কি রূপান্তরিত হয়ে যেতে
পারে না তোমার মুখে
অজস্র চোখের একটি চোখও কি অকস্মাৎ আমার সম্মুখে
তোমার দুসপ্রাপ্য চোখ হয়ে উঠতে পারে না তেমন?
বলো একটি গোলাপও কি রূপান্তরিত হয়ে যেতে
পারে না তোমার মৃদু ঠোঁটে?
কিংবা মেঘও কি তোমার মূর্তি পেতে পারে না সহসা
সব চিত্রশালা আর ভাস্কার্যের মেলা মুহূর্তে কি তোমার দিব্যদেহ নিয়ে একবারও জানাতে পারে না
সম্ভাষন?
জলাশয়ে বিচরণরত একটি মরাল
তোমার গ্রীবার ভঙ্গি আমাকে কি পারে না দেখাতে? তার অর্থ
তুমি কি বরতে চাও তোমার সাক্ষাৎলাভ স্বপ্নেও সম্ভব
নয় আর!
কিন্তু আমি তো ভালোই জানি তুমি যে মিশেই আচো
এ-দেশেরই চিরন্তর শিল্পের ঐতিহ্যে, স্থাপত্য ও দেশজ কলায়
তাই না দেখেও হয়তো প্রত্যহ আমি তোমাকেই প্রিয়তমা মানি।

কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই

তোমার দুঃখের সাতমহল বাড়ির পুরনো বাসিন্দা বলেই
আমি হৈচৈ শামিয়ানার নিচে যাই না,
ভালোবাসার জন্য ব্যাকুলতা আছে বলেই তো
রঙিন কুয়াশা কুড়াতে যাই না কোথাও-
ঝরা বকুলের জন্য ব্যাকুল হয়েছি বহুবার কিন্তু বিদেশী
খেলনার দিকে ছুটিনি
নক্ষত্রপুঞ্জকে ডলার ভেবেছি বলেই আমি বসে আছি এমন
তোমার পথ চেয়ে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো বিমান
ধরার তাড়া নেই আমার,
তবু তোমার চোখ যদি একবার অশ্রুসজল হয়!
কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই আমার,
কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই
আমি আরো বহুদিন তোমার দুঃখের সাতমহলা
পাহাড়া দিতে পারবো
তুমি যতো অপেক্ষা করতে বলো
আমি তার চেয়েও বেশি প্রস্তত
আমি শুধু দেখতে চাই তোমার চোখ থেকে
একফোঁটা অশ্রু গড়াতে গড়াতে
কীভাবে সোনার খনি গড়ে ওঠে-
আর কোনো তাড়া নেই আমার,
কোথাও যাওয়ার তাড়া নেই!

 কোনো তরুণ প্রেমিকের প্রতি

তরুণ প্রেমিক তুমি তো জানো না তোমার উতল আলুথালূ প্রেম
একদিন ছিলো আমারই আকাশে উদাসীন মেঘ, মাতাল নৌকা-
সারারাত বেয়ে জ্যোৎস্নার খেয়া ভোরবেলা হাতে ব্যর্থ কুয়াশা
তুমি তো জানো না এসব কাহিনী ঝরে গেছে কতো যামিনীর চাঁদ,
তবু যে প্রেমিক আজো খুঁজে পাও কোথাও স্বপ্ন, কোথাও গন্ধ
কোথাও স্মৃতির স্নিগ্ধ বকুল কুড়াও এখনো তেমনি বিভোর
তুমি তো জানো না তুমি তো জানো না বকুলগুলি যে কার ব্যর্থতা!
তরুণ প্রেমিক আমি ঠিকই জানি তুমি তাকালেই খুলবে পাপড়ি
মেঘ জমা হবে আবেগে তোমার; কিংবা নদীর দূর মোহনায়
ভাসবে আবার তোমাদেরই নামে অনাদি কলস!
তরুণ প্রেমিক তুমি তো জানো না তোমার উতল আলুথারূ প্রেম
একদিন ছিলো আমার এ-বুকে বিয়াত্রিচের ব্যথিত তৃষ্ণা তাই ঘুরে মরি
অন্ধ নরকে ভীষণ একাকী আহত দান্তে তুমি তো জানো না
তুমি তো জানো না অর্ফিয়ুসের কর্তিত মাথা তবু করি এই পুরাতন গান
যে-গান এখনো তোমার শোণিতে লেখে চিরায়ত করুণ কাব্র
তোমার মতোই তরুণ প্রেমিক আমি কি ধরিনি বেদনার হাত
ছুঁইনি কি তার অধীর ওষ্ঠ তোমার মতোই আমি একদিন?
সুন্দর বলে ভুল করে আমি সেই বেদনাকে নিয়েছি বক্ষে
তরুণ প্রেমিক তুমি তো জানো না তোমাদের আগে এখানে ঝরেছি!

তরুন প্রেমিক তুমি তো জানো না তোমার উতল আলুথালু প্রেম
একদিন ছিলো আমারই চোখের অতৃপ্ত নেশা, চিরজাগরণ
তোমার মতোই মেঘে মেঘে আমি খুঁজেছি হরিণ, অশোকগুচ্ছ
কিংবা খুঁজেছি দূর নভে কোনো গাঢ় ম্যানসন পাইনি তবুও
বাড়িয়েছি হাত তোমার মতোই কেবল শূন্যে
ভেবেছি হয়তো সেখানেই আছে হাড়ের গায়ে কোমল ঝর্ণা
কুলুকুলূ নদী আর তার পাশে ফুটে আছে বুঝি আমার কাম্য
তোমার মতোই তরুন প্রেমিক আমিও একদা খুঁজেছি অলীক!

তরুণ প্রেমিক তুমি যে ভাসাও স্বপ্ন বোঝাই এই সাম্পান
তুমি তো জানো না ভিড়বে কিনা সে তোমার সবুজ নির্জন দ্বীপে
তবু যে প্রেমিক আজো করো তুমি আকাশকুসুম তেমনি চয়ন
তেমনি আজো যে নগ্ন দুহাতে তুলে নাও তুমি রঙিন গোধূলি
তোমার মতোই আমিও একদা রাতের শিশিরে ভরেছি পকেট!
তরুন প্রেমকি তুমি তো জানো না তোপমার উতল আলুথালূ প্রেম
আমার বুকের কোথায় লালিত, কতোদিন তাকে দিয়েছি আহার
তরুণ প্রেমিক তোমাদের হাসি, তোমার কুজন
তুমি তো জানো না আমারই বুকের ঝরাপাতাদের গান!

চৈত্রের চিঠি

চৈত্রের এই শেষ রজনীতে
তোমাকে পাঠাই বিব্রত খাম,
লিখেছি কি তাতে ঠিক মনে নেই
তবু এই চিঠি, এই উপহার!
তোমার খামে কি আদৌ লিখেছি
স্বপ্নের মতো স্মরণীয় নাম?
তাও মনে নেই; আমি শুধু জানি
তবু এই চিঠি তোমারই জন্যে।
যদি কোনোদিনও মলিন চিঠিটি
পৌছবে না গিয়ে সেই ঠিকানায়
বছর এমনি আসবে ও যাবে,
ভাসবে না তবু যুগল কলস!
আমি বসে আছি, তুমিও কি পারে
তাহলেই থামে কালের যাত্রা
এই চিঠিখানি অনন্তকাল
তাহলেই পারে সাহসে উড়তে।
তাহলেই শুধু ক্ষীণ ভরসায়
সময়কে বলি, একটু দাঁড়াও!

জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই অধিক সুন্দর

যে-কোনো বিষয় নিয়েই হয়তো এই কবিতাটি লেখা যেতো
পিকনিক, মর্নিং স্কুলের মিসট্রেস
কিংবা স্বর্নচাঁপার কাহিনী; হয়তো পাখির প্রসঙ্গ
গত কয়েকদিন ধরে টেলিফোনে তোমার কথা না শুনতে
পেয়ে জমে থাকা মেঘ,
মন ভালো নেই তাই নিয়েও ভরে উঠতে পারতো এই
পঙ্‌ক্তিগুলো
অর্কিড কিংবা উইপিঙ উইলোও হয়ে উঠতে পারতো
স্বচ্ছন্দে এই কবিতাটির বিষয়;
কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রমত দেশের একজন কবির
মনু মিয়ার হাঁড়ির খবর ভুললে চলে না,
আমি তাই চোয়াল ভাঙা হারু শেখের দিকে তাকিয়ে
আন্তর্জাতিক শোষণের কথাই ভাবি,
পেটে খিদে এখন বুঝি কবিতার জন্য কি অপরিহার্য
জুঁইফুলের চেয়ে কবিতার বিষয় হেশেবে আমার কাছে
তাই
শাদা ভাতই অধিক জীবন্ত- আর এই ধুলোমাটির মানুষ;
এই কবিতাটি তাই হেঁটে যায় অন্ধ গলির নোংরা বস্তিতে
হোটেলের নাচঘরের দিকে তার কোনো আকর্ষণ নেই,
তাকে দেখি ভূমিহীন কৃষকের কুঁড়েঘরে বসে আছে
একটি নগ্ন শিশুর ধুলোমাখা গালে অনবরত চুমো খাচ্ছে
আমার কবিতা,
এই কবিতাটি কখনো একা-একাই চলে যায় অনাহারী
কৃষকের সঙ্গে
জরুরী আলাপ করার জন্য,
তার সঙ্গে কী তার এমন কথা হয় জানি না
পর মুহূর্তেই দেখি সেই ক্ষধার্ত কৃষক
শোষকের শস্যের গোলা লুট করতে জোট বেঁধে দাঁড়িয়েছে;
এই কবিতাটির যদি কোনো সাফল্য থাকে তা এখানেই।
তাই এই কবিতার অক্ষরগুলো লাল, সঙ্গত কারণেই লাল
আর কোনো রঙ তার হতেই পারে না-
অন্য কোনো বিষয়ও নয়
তাই আর কতোবার বলবো জুঁইফুলের চেয়ে শাদা ভাতই
অধিক সুন্দর।

তোমার দূরত্ব

তোমার ভালোবাসার দূরত্বের চেয়ে এমন আর কি
দূরত্ব আছে আমার, এমন আর কি
মাইল মাইল দূরত্ব সে তো একখানি মাত্র টিকিটের ব্যবধান
তারপরই উষ্ণ অভর্থ্যনা, তোমার আঁচলে ঘাম মুছে ফেলা।
সে-কথা জানি বলেই তো তোমার ভালোবাসার দূরত্বকেই
কেবল বলি বিচ্ছেদ।
না হলে যতো দূরেই বলো যেতে পারি মাইল মাইল নীলিমা,
মাইল মাইল সমুদ্র-
তার আগে শুধু সঙ্গে নিতে চাই তোমার ভালোবাসা;
এই মূলধনটুকু পেলে আমিও বাণিজ্যে যেতে পারি
বলো তো দেশভ্রমণে বের হয়ে যেতে পারি এইমাত্র
কিন্তু তার আগে আমার ছাড়পত্রে তোমার ভালোবাসার
স্বচ্ছ সীলমোহর আঁকা থাকা চাই-
বিদেশ মানেই তো আর দূরত্‌ নয়, দূরত্ব তোমার ভালোবাসার
কয়েক হাত ব্যবধান,
তোমার ভালোবাসা থেকে দুই পা সরে দাঁড়ানো
তার চেয়ে কোনো দূরত্ব আমার জানা নেই,
আমার জানা নেই।
আমি যাকে দূরত্ব বলি তা একই কার্নিশের নিচে দাঁড়ানো
বিচ্ছেদ
কিংবা একই কার্পেটের উপর দাঁড়ানো তীব্র শীত
আমাদের মাঝে প্রবাহিত এই হিমবাহকেই আমি বলি
বিদেশ, আমি বলি দূরত্ব।
না হলে সব দূরত্বই তো তোমার চোখের পলকমাত্র
তুমি ফিরে তাকাতেই আমি দেখতে পাবো ঢাকা এয়ারপোর্টে
চক্কর দিচ্ছে আমার বিমান
হ্যালো বাংলাদেশ! আমার চিরসবুজ বাংলাদেশ!

 তোমার বর্ণনা

তোমাকে বিশদ ব্যাখ্যা করবো কি বর্ণনায়ই বুঝেছি অক্ষম
নাই সে কিঞ্চিৎ ভাষাজ্ঞান, মাত্রাবোধ এমনকি শব্দেরও
শৃঙ্খলা
সে-বিদ্যা আয়ত্তে নাই অনায়াসে পাঠ করি তোমার চিবুক
কিংবা ধরো প্রসিদ্ধ নগর দেখে দেয় কেউ যে-রকম গাঢ়
বিবরণ,
দর্শনীয় বস্তু আর সুপ্রাচীন স্থানের তালিকা, সে-রকম
তোমার বিশদ ব্যাখ্যা জানি আমি পারবো না কখনো।
তোমাকে বিশদ ব্যাখ্রা করবো কি এখনো তো হয়নি অক্ষর-
জ্ঞানই কিছু
শব্দার্থ হয়নি জানা কি তোমার ঠোঁট কিংবা চোখের আভাস
এমন যোগ্যতা নাই তোমার সামান্য অংশ অনুবাদ করি
কিংবা একটি উদ্ধৃতি দিই যে-কোনো বিশেষ অংশ থেকে
এখনো হয়নি পড়া তোমার যুগল ভুরু, সূক্ষ্ম তিল
একগুচ্ছ চুলের বানান। হয়নি মুখস্ত জানি একটি আঙুল
তোমাকে বিশদ ব্যাখ্যা করবো কি এখনো তো হয় নাই
বর্ণমালা চেনা,
কি তোমার অনুভূতি কি তোমার বিশুদ্ধ আবেগ, সেসবের
জানার তো প্রশ্নই ওঠে না, এখনো মিখিনি উচ্চারণ।
তোমাকে বিশদ ব্যাখ্যা করবো কি এখনো তো খুলি নাই
পুঁথি
পাঠাভ্যাসই হয় নাই কীভা েকরবো বলো নিখুঁত তুলনা
কীভাবে দেখানো মিল, অনুপ্রাস, শব্দের ব্যঞ্জনা
তোমার দেহের কাছে মূখ্য ছাড়া আর কিছু নই!
তেমন যোগ্যতা নাই তোমাকে সামান্যতম মর্মোদ্ধার করি
এখনো হয়নি পড়া কাদামাটি, পাঁচটি আঙুল
রহস্যের কথা থাক তোমার সরল অর্থ তাই খুঁজে পাইনি
কোথাও,
এখনো হয়নি শেখা বাস্তবিকই মূর্তি নয় পোড়ামাটি কিংবা অঙ্গার
তোমাকে বিশদ ব্যাখ্যা করবো কি আদিঅন্ত নিয়ত আঁধার।

বেশিদিন থাকবো না আর

বেশিদিন থাকবো না আর চলে যাবো গোলাপের
গাঢ় গিঁট খুলে
চলে যাবো পিঁড়ির গহন স্নেহ ভেঙে, চলে যাবে,
অনেক বসেছি
বেশি তো থাকবো না আর চলে যাবো মেঘ রেখে,
মমতাও রেখে
মন্ময় কাঁথাটি রেখে চরে যাবো বেশি দেরি নেই!
কুশন ও কার্পেটের নিবিড় গোধূলি ফেলে চলে যাবো
চাই কি ফুলের শুশ্রূষা আর ফুলদানিরও আদর,
চলে যাবো এখাবে বসার সুক ফেলে, চলে যাবে
বেত, বাঁশ, বস্তুকে মাড়িয়ে,
বেশি দেরি নেই চলে যাবো জমাট মঞ্চেরও মোহ ভেঙে
মেধাকেও পরাবো বিরহ, আত্মাকেও অনন্ত বিচ্ছেদ।
বেশিদিন থাকবো না চলে যাবো এই তীব্র টান
ভেদ করে, ফেলে রেখে এই আন্তরিকতার জামা,
হাতের সেলাই
অধিক থাকবো না আর অনেক জড়িয়ে গেছি চলে যাবো
আসর ভাঙার আগে, আচ্ছন্নতা উন্মেষেরও আগে
চলে যাবো চোখের জলেরও আগে না হলে পারবো না।

ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই

ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো
আমার ভিতরে কোথঅয় নেমেছে ধস,
কোথায় নেমেছে ঘোর কালো!
দেখো আমার ভেতরে এখন প্রবল গ্রীষ্মকাল
খরা আর খাদ্যের অভাব; ভালো করে চেয়ে দেখো
আমার ভিতরে সমস্ত কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন, ভগ্ন ও ব্যথিত
ঠিক যে আঁধার তাও নয় মনে হয় মধ্যাহ্নে অকালসন্ধ্যা
অস্তমিত সকল আলোর উৎস;
ভালো আছি বলি কিন্তু ভিতরে যে লেগেছে হতাশা
লেগেছে কোথাও জং আর এই মরচে-পড়া লোহার নিঃশ্বাস
গোলাপ ফুটতে গিয়ে তাই দেখো হয়েছে ক্রন্দন,
হয়েছে কুয়াশা!
আমি কি অনন্তকাল বসে আছি, কেন তাও তো জানি না
চোখে মুখে উদ্বেগের কালি, থেকে থেকে ধূলিঝড়
আতঙ্কের অন্তহীন থাবা; ভিতরে ভীষণ গোলযোগ
ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো
ভিতরে কেমন কোলাহল উদ্যত মিছিল
ঘন ঘন বিক্ষুব্ধ শ্লোগান, ডাক-তার-ব্যাঙ্ক ধর্মঘট
হরতালপ্লাবিত দেখো আমার ভিতরে এই এভেন্যু ও পাড়া,
হঠাৎ থমকে আছে ব্যস্ত পথচারী যেন কারফিউতাড়িত
আমার ভিতরে এই ভাঙাচোরা, দ্বন্দ্ব ও দুর্যোগ;
দেখো অনাহারপীড়িত শিশু
দেখো দলে দলে দুর্ভিক্ষের মুখ
ভালো আছিবলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো
ভিতরে কী অস্থির উন্মাদ, ভিতরে কী নগ্ন ছেঁড়া ফাড়া!

 ভালোবাসা

ভালোবাসা তুমি এমনি সুদূর
স্বপ্নের চে’ও দূরে,
সুনীল সাগরে তোমাকে পাবে না
আকাশে ক্লান্ত উড়ে!
ভালোবাসা তুমি এমনি উধাও
এমনি কি অগোচর
তোমার ঠিকানা মানচিত্রের
উড়ন্ত ডাকঘর
সেও কি জানে না? এমনি নিখোঁজ
এমনি নিরুদ্দেশ
পাবে না তোমাকে মেধা ও মনন
কিংবা অভিনিবেশ?
তুমি কি তাহলে অদৃশ্য এতো
এতোই লোকোত্তর,
সব প্রশ্নের সম্মুখে তুমি
স্তবির এবং জড়?
ভালোবাসা তবে এমনি সুদূর
এমনি অলীক তুমি
এমনি স্বপ্ন? ছোঁওনি কি কভু
বাস্তবতার ভূমি?
তাই বা কীভাবে ভালোবাসা আমি
দেখেছি পরস্পর
দুলো ও মাটিতে বেঁধেছো তোমার
নশ্বরতার ঘর!
ভালোবাসা, বলো, দেখিনি তোমাকে
সলজ্জ চঞ্চল,
মুগ্ধ মেঘের মতোই কখনো
কারো তৃষ্ণার জল।

ভালোবাসা আমি তোমার জন্য

ভালোবাসা আমি তোমাকে নিয়েই
সবচেয়ে বেশি বিব্রত আজ
তেমাকে নিয়েই এমন আহত
এতো অপরাধী, এতো অসহায়!
তোমাকে নিয়েই পালিয়ে বেড়াই
তোমাকে নিয়েই ব্যাকুল ফেরারী।
ভালোবাসা তুমি ফুল হলে তার
ফুলদানি পেতে অভাব ছিলো না,
মেঘ হলে তুমি সুদূর নীলিমা
তোমাকে দিতার উড়ে বেড়াবার;
জল হলে তুমি সমুদ্র ছিলো
তোমারই জন্য অসীম পাত্র-
প্রসাধনী হলে তোমাকে রাখার
ছিলো উজ্জ্বল অশেষ শো-কেস,
এমনকি তুমি শিশির হলেও
বক্ষে রাখার তৃণ ছিলো, আর
সবুজ পাতাও তোমার জন্য
হয়তোবা হতো স্মৃতির রুমাল।
ভালোবাসা তুমি পাকি হতে যদি
তোমাকে রাখার ভাবনা কি ছিলো
এই নীলকাশ তোমারই জন্য
অনায়াসে হতো অনুপম খাঁচা!
কিন্তু তুমি তো ফুল নও কোনো
মেঘ নও কোনো দূর আকাশের,
ভালোবাসা তুমি টিপ নও কোনো
তোমাকে কারো বা কপালে পরাবো;
ঘর সাজাবার মেহগনি হলে
ভালোবাসা তুমি কথঅ তো ছিলো না
তুমি তো জানোই ভালোবাসা তুমি
চেয়েছো মাত্র উষ্ণ হৃদয়!
খোঁপায় তোমাকে পরালেই যদি
ভালোবাসা তুমি ফুটতে বকুল,
কারো চোখে যদি রাখলেই তুমি
হতে ভালোবাসা স্নিগ্ধ গোধূলি-
তাহলে আমার তোমাকে নিয়ে কি
বলো ভালোবাসা এমন দৈন্য,
আমি তো জানিই তোমার জন্য
পাইনি যা সে তো একটি হৃদয়
সামান্যতম সিক্ত কোমল,
স্পর্শকাতর অনুভূতিশীল!

 ভূদৃশ্যের বর্ণনা

ভূদৃশ্য এমন হয় চতুর্দিকে অদম্য পাহাড়, বাবলার ঝোপ
পাশে মানুষের খেয়ালি বসতি, কাদামাটি ধুলোর বিস্তার
কেউ করে গান, কেউ অশ্রু ফেলে, নিমজ্জিত ঘর আর বাড়ি,
ভূদৃশ্য এমন হয় মাঝে নদী মাথায় আকাশ, উঁকি দেয়
ছেঁড়া চাঁদ, গাঢ় পাতা, হাস্যহীন কলরোলহীন তবু পাড়া-
মানুষ ফেলেছে তাঁবু বহুদূর বনের পশ্চাতে কিন্তু চিতাবাঘ
আর প্রফুল্ল হরিণ জল খায় ঘোরে ফেরে বাৎসল্যে দ্বিধায়
হঠাৎ আক্রান্ত কেউ মৃত্যু এসে নিয়ে যায় তাকে, এই খেলাধুলা
ভূদৃশ্য এমন হয় চারদিকে উড়ন্ত পাহাড় পাশে সামাজিক নদী
মানুষের ব্যবহার মেঘ ধরে মেঘ বন্দী করে তার ক্ষেতে ও টিলায়!

মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস

কেউ জানে না একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস
নিয়ে বেড়ায়-
কোনো বিষণ্ন ক্যাসেটেও এতো বেদনার সংগ্রহ নেই আর,
এই বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস যেন একখানি
অন্তহীন প্রগাঢ় এপিক!
পাতায় পাতায় চোখের জল সেখানে লিপিবদ্ধ
আর মনোবেদনা সেই এপিকের ট্রাজিক মলাট;
মানুষের বুকে এতো দীর্ঘশ্বাস, এতো দীর্ঘশ্বাস, কে জানতো!

দীর্ঘশ্বাসভরা এই বুকের চেয়ে শীতপ্রধান বিপন্ন অঞ্চল
আর কোথাও নেই,
এমন হলুদ, ধূসর ও তুষারাবৃত!
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
হঠাৎ একসঙ্গে অসংখ্য দুঃখ যদি কখনো কেঁদে ওঠে
কিংবা যদি
প্রাচীন শিলালিপি থেকে সব শোকের গান সশব্দে বেজে যায়,
তাহলে যেমন মধ্যাহ্নের আকাশ সহসা দুঃখে ম্লান হয়ে যাবে
গোলাপ হবে কৃষ্ণবর্ণ, তার চেয়েও বিষণ্নতা নেমে আসবে
মানুষের বুক থেকে এই দীর্ঘশ্বাস যদি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে।

তেমন সম্ভাবনা আছে বলেই মানুষ বুকের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস
চেপে রাখে
তার চোখে নিয়তই জল ঝরে তবু দেখা যায় না;

মানুষের বুকের ভেতর কতো যে দীর্ঘশ্বাস, জমাট বেঁধে আছে
কতো যে ক্রন্দন, পাতা ঝরার শব্দ, মৃত্যুসংবাদ
মানুষের বুকের মধ্যে ব্যথিত ব্যাকুল ইতিহাস
আর আহত সভ্যতা
মেঘের মতো ঘনীভূত হতে হতে একেকটি মর্মানি-ক
দীর্ঘশ্বাস হয়ে আছে
মানুস তাকে বয়ে বয়ে দগ্ধ বেঁচে থাকে;
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ বুকের মধ্যে কী গভীর দীর্ঘশ্বাস বয়ে
বেড়ায়, কেউ জানে না
একেকটি মানুষ নিজের মধ্যে কীভাবে নিজেই মরে যায়,
হায়, কেউ জানে না!

 সব তো আমারই স্বপ্ন

সব তো আমারই স্বপ্ন মাথার উপরে এই যে কখনো
উঠে আসে মরমী আকাশ কিংবা স্মৃতি ভারাতুর চাঁদ
মেলে ধরে রূপকাহিনীর গাঢ় পাতা। কোনো এক
কিশোর রাখাল কী করে একদা দেখা পেয়ে গেলো
সেই রাজকুমারীর আর পরস্পর ভাসালো গন্ডোলা।
সেও তো আমারই স্বপ্ন রূপময় এই যে ভেনিস
কী যে সিক্ত বাষ্পাকুল ছিলো একদিন রঙিন বর্ষণে
শিল্পের গৌরবে তার মুখচ্ছবি উদ্ভাসিত আর তেকে থেকে
জ্যোৎ্লাখচিত সারা দেহে খেলে যেতো চিত্রের মহিমা!
এসব তো আমার স্বপ্নের মৃত শিশু এই যে কখনো
দেখি শৈশবের মতো এক স্মৃতির সূর্যাস্ত, অনুভূতিশীল মেঘ
যেন রাত্রি নামে নক্ষত্রের নিবিড় কার্পেটে
বুঝি যামিনী রায়ের কোনো সাতিশয় লোকজ মডেল।
সব তো আমারই স্বপ্ন তবে, মাঝে মাঝে উদ্যান, এভন্যু,
লোকালয় মনে হয় অভ্রভেদী অব্যক্ত ব্যাকুল
এই গাছগুলি কেমন মিষ্টিক আর প্রকৃতি পরেছে
সেই বাউল বর্ণের উত্তরীয়! এও তো আমারই স্বপ্ন
আঙিনায় একঝাঁক মনোহর মেঘ
আর উন্মুক্ত কার্নিশে দোলে নীলিমা, নীলিমা! কিংবা
টবে যে ব্যাপক চারাগুলি তাতে ফুটে ওঠে মানবিকতার
রাঙা ফুল; এখনো যে কোনো কোনো অনুতপ্ত খুনী
রক্তাক্ত নিজের হাত দেখে ভীষণ শিউরে ওঠে ভয়ে
আর প্রবল ঘৃণায় নিজেই নিজের হাত ছিঁড়ে ফেলে
সেখানে লাগাতে চায় স্নিগ্ধ গোলাপের ডালপালা।
সেও তো আমারই স্বপ্ন এই যে চিঠিতে দেখি
ভালোবাসারই তো মাত্র স্বচ্ছ অনুবাদ কিংবা
একটি কিশোরী এখনো যে বকুলতলায় তার
জমা রাখে মৃদু অভিমান; এখনো যে তার গণ্ডদেশ
পেকে ওঠে পুঞ্জীভূত মাংসের আপেল। এসব তো
আমার স্বপ্নের মৃত শিশু, বিকলাঙ্গ, মর্মে মর্মে
খঞ্জ একেবারে! যেন আমি বহুকাল-পোষা
একটি পাখির মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে আঝি।
আমি জানি সবই তো আমার স্বপ্ন নীলিমায়
তারার বাসর আর এভেন্যুতে গূঢ় উদ্দপিনা-
এইগুলি সব তো আমারই স্বপ্ন, সব তো আমারই স্বপ্ন।

Exit mobile version