Site icon BnBoi.Com

গভীর রাতের ট্রাঙ্ককল – পূর্ণেন্দু পত্রী

গভীর রাতের ট্রাঙ্ককল - পূর্ণেন্দু পত্রী

আগুনের ভেতর দিয়ে বাস-রুট

গনগনে আগুনের ভিতর দিয়ে
আমাদের বাস-রুট।

পিকাসোর ছবির মতো
ক্ষতবিক্ষত ভাঙচুরে
পরস্পরের সঙ্গে জুড়ে গেছি আমরা।
ফাটাচায়ের পেয়ালা থেকে লাফিয়ে উঠে
যে-সব নীরব শোক
আত্মঘাতী হওয়ার জন্যে ছুটে যায়
ঘুরন্ত চাকার দিকে
তাদের পিঠে হাত রেখে আমরা বলি
এসো।
আশবাঁটিতে মাছ-কাটার মতো ফিনকি দেওয়া
যাদের আর্তনাদে
সূর্যোদয়ের আকাশ
ভাঙা আশির মতো ঝাঁঝরা,
তাদের হাতে গন্তব্যের টিকিট দিয়ে বলি
এসো।
বিকট অন্ধকার আর নক্ষত্র লন্ঠনে মাঝখানে
কোনো বসার জায়গা না পেয়ে
যেন বন্যার্ত
এইভাবে গায়ে গা এঁটে যায় আমাদের।
বাতাস যেন
ডালপালাময় কোনো ফলন্ত গাছ
এইভাবেই বাতাসকে বিশ্বস্ত ভঙ্গিতে জড়িয়ে থাকে
আমাদের হাত-পা
নিশ্বাস
বিশ্বাস
আর গনগণে আগুনের ভিতর দিয়ে
আমাদের বাস-রুট।

খালি চোখে
রাহুতে খাওয়া সূর্যের দিকে
তাকিয়েছিল যারা
খরার খেতে আলোর বীজ-বপনের ব্যগ্রতায়,
তাদের রক্তাক্ত শহীদবেদী ছুয়ে ছুয়েই
স্টপেজ।
যে-কোনো মহৎ ভাবনার শরীর
যখনই হয়ে ওঠে
আঠারো বছরের কুমারীর মতো স্বাস্থ্যময়
গোপন সুড়ঙ্গ থেকে
ঝাঁপিয়ে পড়ে বলাৎকার
সেই সব ফুপিয়ে কান্নার গা ঘেঁষেই
স্টপেজ।
উলঙ্গ ষাঁড়েরা ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছে
তিনমাথা চারমাথার
মোড়ে মোড়ে।
খুনখারাপির দাঁত
থকথকে পানের পিক ছিটিয়ে চলেছে
বাঁকে বাঁকে
আর গনগনে আগুনের ভিতর দিয়ে
আমাদের বাস-রুট।

আকাশের ছেঁড়া-কাঁথায়
চিকেন-পকসের কাতরতা নিয়ে
শুয়ে আছে মেঘ।
গত দশ বছর
বজ্রের গলায় আল্‌সার।
বিস্তীর্ণ ভূখন্ডে শ্যামল চাষাবাদের জন্যে
প্রস্তুত বৃষ্টিরা
হারিয়ে ফেলেছে তাদের নৈশ অভিযানের
মানচিত্র।
জল নেই
অথচ থকথকে কাদা
আর গর্ত
গহ্বর
নিম্নগামী আদিম খাদ।
গন্তব্য ক্রমাগতই রয়ে যায়
দূরত্বে
অথবা ভূল রুটে বাজতে থাকে
বিপন্ন হর্ন।

গনগনে আগুনের ভিতর দিয়েই
আমাদের বাস-রুট।

আমরা কথা বলি

আমরা কথা বলি
ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত।

আমরা বলি
শাক সবজির মতো সরল সাদামাঠা কথাবার্তা।
যে-সব রাজবাড়ি ভেঙে পড়ছে
তার ইটগুলো কারা কিনবে,
পুরনো বন্ধুরা মারা যাওয়ার আগে
কে স্বপ্ন দেখেছিল কেমন,
কাঁকড়া বিছে এবং মাকড়শার মধ্যে
কে বেশি বিষাক্ত,
পৃথিবীর সমস্ত বসন্তকালকেই
শীত ঠেলে ঠেলে আসতে হয় কেন
এইরকম সব পাতলা ঝিরঝিরে
ঝাউপাতার মতো কথাবার্তা।

আমরা কথা বলি
ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত।
যে কবিতা ভালোবাসে
সে মনের মেঘ-বৃষ্টি নিয়ে কথা বলে।
যে হাসপাতাল ভালোবাসে
সে মৃত্যুর দক্ষিণ দিকের জানলা নিয়ে কথা বলে।
যে ্লেক-লুডো ভালোবাসে
সে নানারকম সন্ত্রাসের কথা।
কথার মধ্যে জেগে ওঠে আমাদের হারানো ছেলেবেলা
গোল আয়নার মতো ঝকঝকে যার চিবুক,
আর সেইসব পুরনো ঘন্টার ধ্বনি
যার শব্দে নুয়ে পড়ে মহানিমের ডাল,
আর সেইসব ময়লা ফটোগ্রাফের মতো ভালোবাসা
যার গল্প শুনতে
এখনো সমুদ্রের জল ছুটে আসে তটরেখায়।

আমরা কথা বলি
ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত।

কথার মধ্যে
রঙিন মলাটে ঝলসে ওঠে
আমাদের সমস্ত না ছাপা বই
কথার মধ্যে
আমরা রিপু করে নিই
গত বছরের জামা পাজামার ফাটল।
কথার মধ্যে
ভুলে যাই আমাদের ছেড়া জুতোর পেরেক
শোবার ঘরের ভাঙা বালব।
আর কথার মধ্যেই
পৌছে যাই এমন সব জঙ্গলে
গত রাত্রেও নরবলি হয়েছে যেখানে।
আমরা কথা বলি
ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত।

একটা চিয়ারে তিনজন
এক চিলতে ঘরে একশো হয়ে যাই আমরা
কথা বলতে বলতে।
তখন আমাদের তোবড়ানো গালের খোঁদলগুলো
ভরে যায় জলোচ্ছ্বাসে, জ্যোৎস্নায়।
নক্ষত্র ফোটাতে ফোটাতে মরচে-পড়া আকাশ
এক গাল হাসি নিয়ে
নেমে আসে জানলার কাছে।
তখন আমাদের মাথা উসকো খুসকো চুলগুলো
এমন সব শিকড়
জল হাওয়া পেলে এখুনি হয়ে উঠবে
হিজলের ঝাঁকড়া বন।
আমরা কথা বলি
ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত।

আমরা কথা বলছি
আর গর্ভকেশরগুরো ফেটে পড়ছে বনে বনে
হাওয়ার ভিতরে পাখির মতো ওড়াউড়ি করছে
নতুন নতুন বীজকোষ।

আমরা কথা বলছি
আর ঘা পড়ছে সমস্ত ভেজানো সিংদরোজায়
সাত শতাব্দীর অন্ধকার ঝিনুকের ডালা
একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে
ইস্পাতের চাড়ে।

আমরা কথা বলছি
খুবই আসে-, ধীরে, মোমবাতির মতো জ্বলে,
গাছপাতার মতো সংযমে।
অথচ পাহাড় থেকে পাহাড়ে
আকাশের এপার ওপার ছুয়ে,
আদিম কোনো দৈববানীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে তারা,
মর্মানি-ক আর প্রতিধ্বনিময়।

আমরা কথা বলি
ভিতরে ঢুকে পড়ে কার যেন ঠাণ্ডা হাত।

পল এলুয়ার

কাল সারা রাত ভোর করে দিলে তুমি।
মনে হচ্ছিল শিকড় নামছে সারা গায়ে, যেন ক্রমশ গভীর মাটি
টানছে আদরে, ওদিকে উপরে আকাশেরও মুখে জননীর মতো হাসি।
হাওয়া বিলোচ্ছে পাতায় পাতায় শিরমিরে সুখ, ফলে-ফুলে ভরে গেছি।
গাছ থেকে গাছ, প্রতি মূহুর্তে জন্ম এবং পূর্নতা আর বিসতৃত হতে থাকা
গাছ থেকে গাছ, হাজার গাছের বনরাজি যেন শোভাযাত্রায় হাঁটে
একটি যুবক হয়ে গেল যুব-উৎসব কাল কাঁপলো এমন ঝড়ে।

অক্ষর থেকে অদৃশ্য এক নারীর শরীর উঠে এল যেন কাছে।
আঙুর গুচ্ছে ভরেগেল হাত, বিছানা, বেদনা, সকল শূন্যস্থান।
যে-সব সুখের জন্যে মানুষ ছিড়েছ নিজের চামড়া, রক্ত-নাড়ী
সেই সুখ নিয়ে বন্দরে এল সাতশো জাহাজ গর্বিত হাসি হেসে।
যে সব ক্ষতের রক্ত কখনো শুকোবার নয় এমনই মর্মঘাতী
তাও মুছে গেল অবিশ্রান্ত ঝরনার সাদা জলে।
গায়ের যা কিছু পুরনো ময়লা নরম তোয়ালে ঘষে ঘষে তুলে দিল,
শব্দে বাজাল সোনার চুড়ির নিক্কণ সেই অক্ষরজাত নারী।

হঠাৎ ঘুরে যায় দৃশ্যপট
হঠাৎ বনে বাজে নদীর শাঁক
প্রেমিক হয়ে ওঠো তপস্বী
শোনাও স্বাধীনতা মন্ত্র পাঠ।

প্রেয়সী, যার চুলে আকাশ পাও
প্রেয়সী, যার চোখে তিন ভুবন
তাকেও ফেলে রেখে দূরত্বে
এগিয়ে চলে এলে প্রান্তরে।

তখন তুমি যেন অন্য লোক
বিষাদ আর গাঢ় প্রতিজ্ঞায়
দৃপ্ত দেহখানা দীর্ঘকায়
বৃষ্টিভারাতুর উচ্চারণ।

শিশুর জন্যে নরম তুলোর বিছানা
যদি কেঁদে ওঠে দুগালে চাঁদের চুমো,
নারীর জন্যে দীপাবলী জ্বালা রজনী
ঘরকন্নায় কম ছায়া বেশি আলো।
পুরুষ, যাদের কর্মঠ কাঁধ, সকলে
বৃক্ষের মতো ভরপুর হবে ফসলে।
সংক্ষেপে ছিল প্রতিশ্রুতিরা এইসব।
শত্রু ছুড়েছ কামান ও কালো ঁেধায়া।
যেখানে যা-কিছু আলোর শিল্পসজ্জা
যেখানেই খাঁকি সৈন্যের লাফালাফিতে
ঘনান্ধকার পিশাচের মতো হেসেছে।
প্রস্তুত হও, সকলে এবং তুমিও
প্রেয়সী আমার চুম্বনগুলো তোলা থাক
ধ্বংস পেরোনো নীল রাত্রির জন্যে।
কাল সারারাত এইভাবে ভোর হয়ে গেল তোমার সঙ্গে।
উৎপীড়ন এবং উজ্জীবনের মাঝামাঝি
প্রচণ্ড প্রেম এবং প্রবল ঘৃণার মাঝামাঝি
দূর নেপথ্য এভং নিকটবর্তী প্রত্যক্ষের মাঝামাঝি
সজ্জিত মঞ্চের সিড়ি ভেঙে ভেঙে ক্রমশ উপরে ওঠা।
ঝাউবনের সঙ্গে যে-ভাষায় কথা বলাবলি
বিপন্ন নৌকার সঙ্গে যে-ভাষায় জোয়ার জলের আলাপ-আলোচনা
সেই ভাষায়, মঞ্চের উপর থেকে, ুতমি বাড়িয়ে দিলে বন্ধুত্ব।
কীভাবে স্পন্দিত হতে হবে এখন আমি জেনে গেছি।

এখন আমার হাতে যে-কেউ একটা মরা পাখি তুলে দিক।
আমি প্রথমেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবো বন্দনায়
দ্যাখো, দ্যাখো, প্রাচীন গ্রীওসর যাবতীয় সৌন্দর্য এর পালকে।
তার পরেই আমার গলায় ঝনঝন করে উঠবে আক্রমণ
হত্যাকারী! তুমি দেওয়ালের দিকে মুখ রেখে দাঁড়াও।।

Exit mobile version