Site icon BnBoi.Com

চল্লিশের দিনগুলি – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

চল্লিশের দিনগুলি - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

 অন্তিম শ্রাবণসন্ধ্যা

বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে জলের গন্ধ রয়েছে এখনও।
আকাশের ভাবগতিক দেখে মনে হয়,
খানিকটা জিরিয়ে নিয়ে সে আবার কাজে লেগে যাবে।
পাখিরা তা জানে, তাই কোনো
উৎসাহ তাদেরও নেই এই মুহূর্তে ডানা ছড়াবার।
দিকচিহ্নহীন
যে-বিশ্বে রঙের স্পর্শ এতক্ষণ কোথাও ছিল না,
মেঘের আড়াল থেকে সূর্যদেব বিদায়ের ক্ষণে
সেখানে সামান্য রঙ ছড়িয়ে দিলেন।
জানালায় বসে দেখি শেষ হল আরও একটি দিন
অন্তিম শ্রাবণে।

 নদীর কিনারে

প্রতীক্ষার শেষ নেই, ওরা তাই নদীর কিনারে
বসে আছে উদয়াস্ত। ওরা
কয়েকটি বৃদ্ধ ও যুবা, বৃদ্ধা ও যুবতী।
দু’তিনটি শিশুও ছিল। তারা কালীমন্দিরের ধারে
কাঠের জিরাফ, হাতি, ঘোড়া,
ছাঁচের মাটির দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী
দেখে নিয়ে মন্দির-চত্বরে গেছে প্রসাদ ভিক্ষায়।

শুধু ওরা নদীর কিনারে প্রতীক্ষায়
স্থিত বসে আছে।
দূরে গিয়েছিল নদী, জোয়ারে এসেছে ফিরে কাছে।
ঝিঁ ঝিঁ ডাকে, অনেকজনের-মধ্যে-একা
কয়েকটি মানুষকে ঘিরে জমে ওঠে গাঢ় অন্ধকার।

নির্বাক তবুও ওরা বসে আছে, অথচ নৌকার
নেই দেখা।

 নিশির ডাক

নিশির ডাক শুনে
মাঝরাত্তিরে যারা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল,
এখন আবার
খুব শান্ত আর খুব সুন্দর এই সকালবেলায়
একে-একে সেই ছেলেগুলো যে যার
ঘরে ফিরে আসছে।

ওদের ছেঁড়া জামাকাপড়, ওদের
রক্তাক্ত হাত-পা, আর সেইসঙ্গে ওদের
ভাষাহীন চাউনি দেখেই
বোঝা যায় যে, যা পাবে বলে ওরা
রাস্তায় গিয়ে নেমেছিল,
তা ওরা পায়নি।

মাথা নিচু করে ওরা এখন ফিরে আসছে।
অথচ, রাত্তিরের অন্ধকারে
অনেক-অনেক কাঁটাঝোপ ওরা পেরিয়ে গিয়েছিল,
অনেক-অনেক পথ।

বৃষ্টির পর

কিছুটা আলো কালো মেঘের
রেলিঙে ছিল ঝুঁকে।
কিছুটা ছিল আড়ালে, আর
কিছুটা সম্মুখে।
ছবিটা তবু পূর্ণ নয়,
খানিক ছিল বাকি,
পৃথিবী থেকে আকাশে তাই
উড়াল দেয় পাখি।

সারাটা দিন বৃষ্টি আর
বাতাসি আস্ফোটে
ছিল না যার চেতনা, যেন
ধীরে সে জেগে ওঠে।
দিনাবসানে মাঠকোঠার
দরজা ধরে ঠায়
দ্যাখো সে ওই দাঁড়িয়ে আছে
শ্রাবণ-সন্ধ্যায়।

যা কিছু দ্যাখে তাতেই যেন
ভারী অবাক মানে,
বোঝে না ছিল কোথায়, আর
এল সে কোনখানে।
এ যদি সেই পোড়া শহর
তা হলে বলো হেন
অঙ্গে তার এত বাহার
ঝলমলায় কেন।

পৃথিবী যেন পৃথিবী নয়,
আলোর সরোবর;
আলোয় ভাসে বৃক্ষলতা
সমূহ বাড়িঘর।
অবাক হয়ে আকাশে চেয়ে
দাঁড়িয়ে আছে একা,
বোঝে না কেন এমন ছবি
হঠাৎ দিল দেখা।

আকাশে আলো ছড়িয়ে যায়,
বাতাস মধুময়।
নিরুচ্চার কে যেন বলে
চলছে : জয়, জয়!
যেখানে যায়, যেদিকে চায়,
আলোয় মাখামাখি।
সাঁজবেলায় আলোর জলে
সাঁতার কাটে পাখি।

 স্বপ্ন যখন

আমরা আগাপাস্তলা সব বুঝতে পারি
ভক্তেরা সামান্য পারে।
কিন্তু তারা আদ্যোপান্ত দীন-ভিখারি,
যা কও, তাতেই মাথা নাড়ে।
নাড়ুক, ভক্তিভাবের জোয়ার
কাটলে তারা থাকবে না আর;
কেউ বা যাবে বিন-টিকিটে ঝালুকবাড়ি,
কেউ জশিডি-কর্মাটারে।

ছু-মন্তরের ম্যাজিক তুমি অনেক জানো,
জলের পাত্রে অগ্নিশিখা
জ্বালিয়ে লোভী লোকগুলোকে জুটিয়ে আনো
প্রসাদ দিয়ে এক-কণিকা।
কিন্তু আমরা তোমায় চিনি,
এমন স্বপ্ন তাই দেখিনি
তুলব ধুধু মাঠের মধ্যে চক-মিলানো
ময়দানের অট্টালিকা।

স্বপ্ন আছে আর-এক রকম। আমরা মাখি
তার সুগন্ধ জীবন জুড়ে।
অন্ধকারের বুকেও স্বপ্ন লুকিয়ে রাখি
নৈশ ভয়ের ভিত্তি খুঁড়ে।
ধ্বস্ত বাড়ির বিশাল কামরা
যখন খোলে, তখন আমরা
স্বপ্ন আঁকি, তার ভিতরেও স্বপ্ন আঁকি
পায়রা-ডাকা ভরদুপুরে।

Exit mobile version