Site icon BnBoi.Com

অন্ধকার বারান্দা – নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

অন্ধকার বারান্দা - নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

অমলকান্তি

অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে ক্লাসে আসতো, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকতো যে,
দেখে ভারী কষ্ট হত আমাদের।

আমরা কেউ মাষ্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল!
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প-একটু হাসির মতন লেগে থাকে।

আমরা কেউ মাষ্টার হয়েছি, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে;
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে, “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।

আমাদের মধ্যে যে এখন মাষ্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত,
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছেপূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সেই অমলকান্তি–রোদ্দুরের কথা ভাবতে-ভাবতে
ভাবতে-ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।

১৮ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৯৫

অল্প-একটু আকাশ

অতঃপর সে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।
জুঁইয়ের গন্ধে বাতাস যেখানে মন্থর হয়ে আছে;
এবং রেলিংয়ে ভর দিয়ে,
সেখান থেকে অল্প-একটু আকাশ দেখা যায়।

আকাশ!
এতক্ষণে তার মনে পড়ল,
সারাটা সকাল, সারাটা বিকেল আর সন্ধ্যা
কাজের পাথরে মাথা ঠুকতে-ঠুকতে, মাথা ঠুকতে-ঠুকতে
মাথা ঠোকাই তার সার হয়েছে।
কোনো-কিছুই সে শুনতে পায়নি;
না একটা গান, না একটু হাসি।
এখন শুনবে।

কোনো-কিছুই সে দেখতে পায়নি;
আন একটা ফুল, না একটু আকাশ।
এখন দেখবে।

রুগ্‌ণ স্ত্রীকে মেজার-গ্লাসো-মাপা ওষুধ খাইয়ে,
কুঁচকে-যাওয়া বালিশটাকে গুছিয়ে রেখে,
ঘুমন্ত ছেলের ইজেরের দড়িটাকে আর-একটু আলগা করে দিয়ে,
সে তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল।

আংটিটা

আংটিটা ফিরিয়ে দিও ভানুমতী, সমস্ত সকাল
দুপুর বিকেল তুমি হাতে পেয়েছিলে।
যদি মনে হয়ে থাকে, আকাশের বৃষ্টিধোয়া নীলে
দুঃখের শুশ্রূষা নেই, যদি
উন্মত্ত হাওয়ার মাঠে কিংশুকের লাল
পাপড়িও না পেরে থাকে রুগ্‌ণ বুকে সাহস জাগাতে,
অথবা সান্ত্বনা দিতে বৈকালের নদী,–
আংটিটা ফিরিয়ে দিও সন্ধ্যার সহিষ্ণু শান্ত হাতে।

আংটিটা ফিরিয়ে দিও, এ-আংটি যেহেতু তারই হাতে
মানায়, যে পায় খুঁজে পত্রালির ভিড়ে
ফুলের সুন্দর মুঘ, ঘনকৃষ্ণ মেঘের শরীরে
রৌদ্রের আলপনা। কোনো ক্ষতি
ফেরাতে পারে না তাকে তীব্রতম দুঃখের আঘাতে।

আংটিটা ফিরিয়ে দিও, তাতে দুঃখ নেই, ভানুমতী।

আবহমান

যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল
সন্ধ্যার বাতাসে।

কে এইখানে এসেছিল অনেক বছর আগে,
কেউ এইখানে ঘর বেঁধেছে নিবিড় অনুরাগে।
কে এইখানে হারিয়ে গিয়েও আবার ফিরে আসে,
এই মাটিকে এই হাওয়াকে আবার ভালবাসে।
ফুরয় না্‌ তার কিছুই ফুরয় না,
নটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না!

যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল,
সন্ধ্যার বাতাসে।

ফুরয় না তার যাওয়া এবং ফুরয় না তার আসা,
ফুরয় না সেই একগুঁয়েটার দুরন্ত পিপাসা।
সারাটা দিন আপনে মনে ঘাসের গন্ধ মাখে,
সারাটা রাত তারায়-তারায় স্বপ্ন এঁকে রাখে।
ফুরয় না, তার কিছুই ফুরয় না,
নাটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না।

যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল,
সন্ধ্যার বাতাসে।

নেভে না তার যন্ত্রণা যে, দুঃখ হয় না বাসী,
হারায় না তার বাগান থেকে কুন্দফুলের হাসি
তেমনি করেই সূর্য ওঠে, তেমনি করেই ছায়া
নামলে আবার ছুটে আসে সান্ধ্য নদীর হাওয়া
ফুরয় না, তার কিছুই ফুরয় না,
নাটেগাছটা বুড়িয়ে ওঠে, কিন্তু মুড়য় না।

যা গিয়ে ওই উঠানে তোর দাঁড়া,
লাউমাচাটার পাশে।
ছোট্ট একটা ফুল দুলছে, ফুল দুলছে, ফুল,
সন্ধ্যার বাতাসে।

উপলচারণ

না, আমাকে তুমি শুধু আনন্দ দিয়ো না,
বরং দুঃখ দাও।
না, আমাকে সুখশয্যায় টেনে নিয়ো না,
পথের রুক্ষতাও
সইতে পারব, যদি আশা দাও দু-হাতে।

ভেবেছিল, এই দুঃখ আমার ভোলাবে
আনন্দ দিয়ে; হায়,
প্রেম শত জ্বালা, সহস্র কাঁটা গোলাপে,
কে তাতে দুঃখ পায়,
যদি আশা জ্বলে মনের গোপন গুহাতে।

যে আমাকে চায় তন্দ্রার থেকে জাগাতে,
মোহ যে ভাঙাতে চায়
প্রবল পুরুষ আশার বিপুল আঘাতে,
কঠিন যন্ত্রণায়,
আমি তারই, তুমি দিয়ো না মমতা, গৃহ না!

হয়তো বুঝিনি, হয়তো বোঝাতে পারিনি,
তবে শুধু মনে হয়,
প্রেমের প্রকৃতি হয়তো উপচারিণী,
যদিচ অসংশয়।
না, আমাকে তুমি করুণা দিয়ো না, দিয়ো না।

চলন্ত ট্রেনের থেকে

চলন্ত ট্রেনের থেকে ধুধু মাঠ, ঘরবাড়ি এবং
গাছপালা, পুকুর, পাখি, করবীর ফুলন্ত শাখায়
প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখে যতটুকু তৃপ্তি পাওয়া যায়,
সেইটুকুই পাওয়া। তার অতিরিক্ত কে দেবে তোমাকে।

দুই চক্ষু ভরে তবে দ্যাখো ওই সূর্যাস্তের রঙ
পশ্চিম আকাশে; দ্যাখো পুঞ্জিত মেঘের গাঢ় লাল
রক্ত-সমারোহ; দ্যাখো উম্মত্ত উল্লাসে ঝাঁকে-ঝাঁকে
সবুজ ভুট্টার খেতে উড্ডীন অসংখ্য হরিয়াল।

চলন্ত ট্রেনের থেকে ধুধু মাঠ, ঘরবাড়ি অথবা
ঘরোয়া স্টেশনে আঁকা চিত্রপটে করবীর ঝাড়,
গাছপালা, পুকুর, পাখি, গৃহস্থের সচ্ছল সংসার,
কর্মের আনন্দ দুঃখ দেখে নাও; আকাশের গায়ে
লগ্ন হয়ে আছে দ্যাখো প্রাণের প্রকাণ্ড লাল জবা।

সমস্ত পৃথিবী এসে দাঁড়িয়েছে ট্রেনের জানলায়।

জলের কল্লোলে

জলের কল্লোলে যেন কারও কান্না শোনা গেল,
অরণ্যের মর্মরে কারও দীর্ঘনিশ্বাস।
চকিত হয়ে ফিরে তাকাতেই দেখা গেল
নির্বান্ধব সেই বাবলা গাছটাকে।
আর আর তাকে গাছ বলে মনে হল না;
মনে হল,
সংসারের সমস্ত রহস্য জেনে নিয়ে
কেউ যেন জলের ধারে এসে দাঁড়িয়েছে।

ফলত, যা হয়,
অত্যন্ত বিব্রত বোধ করল সেই মানুষটি।
কেননা, জীবনের কাছে মার খেয়ে
প্রকৃতির কাছে সে তার দুঃখ জানাতে এসেছিল।
প্রকৃতি নিজেরই এত দুঃখ
সে তা জানত না।
জলের কল্লোলে যে কারও কান্না ধ্বনিত হতে পারে,
অরণ্যের মর্মরে কারও নিশ্বাস,
সে তা বোঝেনি।
এবং ভাবেনি যে নদীর ধারের বাবলা গাছটাকে আজ
বিষণ্ণ একটা মানুষের মত দেখাবে।

নদীকে সে তার দুঃখ জানাতে এসেছিল;
জানাল না।
সন্ধ্যার আগেই সে তার ঘরে ফিরে এল।

জুনের দুপুর

উপর থেকে নীচে তাকাও, দ্যাখো,
ছায়াছবির মতোই হঠাৎ
চোখের সামনে থেকে
এরোড্রমটা দৌড়ে পালায়
পৃথিবী যায় বেঁকে।
রইল পড়ে দশটা-পাঁচটা,
ঝাঁকড়া-মাথা মেপ্‌ল গাছটা,
চওড়া-ফিতে রাস্তাটা আর
নদীর নীলচে শাড়ি,
ফুলের বাগান, গির্জে, খামার,
ছক-কাটা ঘরবাড়ি।

উপর থেকে নীচে তাকাও, দ্যাখো,
লক্ষ লক্ষ টুকরো দৃশ্য
নতুন করে ভেঁজে
একটি অসীম রিক্ততাকে
তৈরি করল কে যে।
নোত্‌রদামের গির্জেটা আর
হোটেল, কাফে, মস্ত টাওয়ার
মিলিয়ে দিচ্ছে মেঘের শান্ত
হাল্কা নীলের তুলি।
মিলায় মিলায় পারির প্রান্ত-
রেখার দৃশ্যগুলি।

উপর থেকে নীচে তাকাও, দ্যাখো,
দৃশ্যহারা দীর্ঘ দুপুর
সমস্ত দিক ধুধু,
জুনের আকাশ আপন মনে
রৌদ্র পোহায় শুধু।

কোথায় ফাটছে আগুন-বোমা,
কোথায় কাইরো, কোথায় রোমা!
শূন্য মোছায় দেখার ভ্রান্তি
নিত্যদিনের চোখে।
বিশ্ববিহীনতার শান্তি অসীম ঊর্ধ্বলোকে।

তোমাকে বলেছিলাম

তোমাকে বলেছিলাম, যত দেরীই হোক,
আবার আমি ফিরে আসব।
ফিরে আসব তল-আঁধারি অশথগাছটাকে বাঁয়ে রেখে,
ঝালোডাঙার বিল পেরিয়ে,
হলুদ-ফুলের মাঠের উপর দিয়ে
আবার আমি ফিরে আসব।
আমি তোমাকে বলেছিলাম।

আমি তোমাকে বলেছিলাম, এই যাওয়াটা কিছু নয়,
আবার আমি ফিরে আসব।
ডগডগে লালের নেশায় আকাশটাকে মাতিয়ে দিয়ে
সূর্য যখন ডুবে যাবে,
নৌকার গলুইয়ে মাথা রেখে
নদীর ছল্‌ছল্‌ জলের শব্দ শুনতে-শুনতে
আবার আমি ফিরে আসব।
আমি তোমাকে বলেছিলাম।

আজও আমার ফেরা হয়নি।
রক্তের সেই আবেগ এখন স্তিমিত হয়ে এসেছে।
তবু যেন আবছা-আবছা মনে পড়ে,
আমি তোমাকে বলেছিলাম।

দৃশ্যের বাহিরে

সিতাংশু, আমাকে তুই যতো কিছু বলতে চাস, বল।
যতো কথা বলতে চাস, বল।
অথবা একটাও কথা বলিসনে, তুই
বলতে দে আমাকে তোর কথা।
সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।

কী বলবি আমাকে তুই, সিতাংশু ? বলবি যে,
ঘরের ভিতরে তোর শান্তি নেই, তোর
শান্তি নেই, তোর
ঘরের ভিতরে বড়ো অন্ধকার, বড়ো
অন্ধকার, বড়ো
বেশি অন্ধকার তোর ঘরের ভিতরে।
(সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।)

কী বলবি আমাকে তুই, সিতাংশু ? বলবি যে,
দৃশ্যের সংসার থেকে তুই
(সংসারের যাবতীয় অস্থির দৃশ্যের থেকে তুই)
স্থিরতর কোনো-এক দৃশ্যে যেতে গিয়ে
গিয়েছিস স্থির এক দৃশ্যহীনতায়।
অনন্ত রাত্রির ঠাণ্ডা নিদারুণ দৃশ্যহীনতায়।
দৃশ্যের বাহিরে তোর ঘরে।

জানিরে, সিতাংশু, তোর ঘরের চরিত্র আমি জানি।
ওখানে অনেক কষ্টে শোয়া চলে, কোনোক্রমে দাঁড়ানো চলে না।
ও-ঘরে জানালা নেই, আর
ও-ঘরে জানালা নেই, আর
মাথার দু’ইঞ্চি মাত্র উর্ধ্বে ছাত। মেঝে
স্যাঁতস্যাঁতে। দরোজা নেই। একটাও দরোজা নেই। তোর
চারদিকে কাঠের দেয়াল।
এবং দেয়ালে নেই ঈশ্বরের ছবি।
এবং দেয়ালে নেই শয়তানের ছবি।
(তা যদি থাকত, তবে ঈশ্বরের ছবির অভাব
ভুলে যাওয়া যেত।) নেই, তা-ও নেই তোর
নির্বিকার ঘরের ভিতরে।

না, আমি যাব না তোর ঘরের ভিতরে।
যাব না, সিতাংশু, আমি কিছুতে যাব না।
যেখানে ঈশ্বর নেই, যেখানে শয়তান নেই, কোনো-কিছু নেই,
প্রেম নেই, ঘৃণা নেই, সেখানে যাবো না।
যাব না, যেহেতু আমি মূর্তিহীন ঈশ্বরের থেকে
দৃশ্যমান শয়তানের মুখশ্রী এখনো ভালোবাসি।
না, আমি যাব না তোর ঘরের ভিতরে।

সিতাংশু, তুই-ই বা কেন গেলি ?
অস্থির দৃশ্যের থেকে কেন গেলি তুই
স্থির নির্বিকার ওই দৃশ্যহীনতায় ?
সিতাংশু, আমি যে তোর সমস্ত কথাই জেনে গেছি।
আমি জেনে গেছি।
দৃশ্যের ভিতর থেকে দৃশ্যের বাহিরে
প্রেম-ঘৃণা-রক্ত থেকে প্রেম-ঘৃণা-রক্তের বাহিরে
গিয়ে তোর শান্তি নেই, তোর
শান্তি নেই, তোর
ঘরের ভিতরে বড়ো অন্ধকার, বড়ো
অন্ধকার, বড়ো
বেশি অন্ধকার তোর ঘরের ভিতরে।

দেয়াল

চেনা আলোর বিন্দুগুলি
হারিয়ে গেল হঠাৎ–
এখন আমি অন্ধকারে, একা।
যতই রাত্রি দীর্ণ করি দারুণ আর্তরবে,
এই নীরন্ধ্র নিকষ কালোর কঠিন অবয়বে
যতই করি আঘাত,
মিলবে না আর, মিলবে না আর,
মিলবে না তার দেখা।

হারিয়ে গেল হঠাৎ আমার
আলোকলতা-মন,–
নেই, এখানে নেই;
হারিয়ে গেল প্রথম আলোর হঠাৎ-শিহরণ,–
নেই।
চার-দেয়ালে বন্ধ হয়ে চার দেয়ালের গাতে
যতই হানি আঘাত, আমার আর্ত আকাঙ্ক্ষায়
যতই মুক্তিলাভের চেষ্টা করি,
ততই কঠিন পরিহাসের রাত্রি নামে, আর
ততই ভয়ের উজান ঠেলে মরি।

চেনা আলোর বিন্দুগুলি
হারিয়ে গেল হঠাৎ–
এখন আমি অন্ধকারে, একা।
চারদিকে চার-দেয়াল, চোখের দৃষ্টি নিবে আসে,
শিউরে উঠি অন্ধকারের কঠিন পরিহাসে;
এই নীরন্ধ্র অন্ধকারে যতই হানি আঘাত,
আসবে না আর, আসবে না কেউ,
মিলবে না তার দেখা।

ভাঙো আমার দেয়াল, আমার দেয়াল।

নিজের বাড়ি

ভাবতে ভাল লেগেছিল, এই ঘর, ওই শান্ত উঠোন,
এই খেত, ওই মস্ত খামার–
সবই আমার।
এবং আমি ইচ্ছে হলেই পারি
ইচ্ছেমতন জানলা-দরজা খুলতে।
ইচ্ছেমতন সাজিয়ে তুলতে
শান্ত সুখী একান্ত এই বাড়ি।

ভাবতে ভাল লেগেছিল, চেয়ার টেবিল,
আলমারিতে সাজানো বই, ঘোমটা-টানা নরম আলো,
ফুলদানে ফুল, রঙের বাটি,
আলনা জুড়ে কাপড়-জামার
সুবিন্যস্ত সমারোহ, সবই আমার।
এবং আমি ইচ্ছে হলেই পারি
দেয়ালে লাল হলুদ রঙের কাড়াকাড়ি
মুছে ফেলতে সাদার শান্ত টানে।
এই যে বাড়ি, এই তো আমার বাড়ি।

ভাবতে ভাল লেগেছিল, এই ঘর, ওই ঠাণ্ডা উঠোন,
এই খেত, ওই মস্ত খামার,
আলমারিতে সাজানো বই,
ফুলদানে ফুল, রঙের বাটি,
টবের গোলাপ, নরম আলো,
আলনা জুড়ে কাপড়-জামার
শৃঙ্খলিত সমারোহ, সবই আমার, সব-ই আমার।

ভাবতে ভাল লেগেছিল, কাউকে কিছু না জানিয়ে
হঠাৎ কোথাও চলে যাব।
ফিরে এসে আবার যেন দেখতে পারি,
যে-নদী বয় অন্ধকারে, তারই বুকের কাছে
বাড়িটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
ওই যে বাড়ি, ওই তো আমার বাড়ি।

নিতান্ত কাঙাল

নিতান্তই ক্লান্ত লোকটা শুধু
ছোট্ট একটা ঘরের কাঙাল।
দক্ষিণের জানলা দিয়ে ধুধু
অফুরন্ত মাঠ দেখবে। আর
পশ্চিমের জানলা দিয়ে লাল
সূর্য-ডোবা সন্ধ্যার বাহার।
নিতান্তই ক্লান্ত লোকটা। শুধু
ছোট্ট একটা ঘরের কাঙাল!

নিতান্তই ক্লান্ত লোকটা। তাই
মিষ্টি একটা মেয়ের কাঙ্গাল।
যে তাকে খুনসুটি করে প্রায়ই
রাত জাগাবে। বলবে, ‘কোন দিশি
লোক তুমি তা বোঝা শক্ত। কাল
আনতে হবে আলতা এক শিশি।’
নিতান্তই শান্ত লোকটা। তাই
মিষ্টি একটা মেয়ের কাঙ্গাল।

নিতান্তই ভ্রান্ত লোকটা। হায়,
অল্প-একটু সুখের কাঙাল।
রৌদ্রে, জলে, উদ্দাম হাওয়ায়
ঢের ঘুরেছে। বুঝল না এখনও
ইচ্ছার আগুনে খেয়ে জ্বাল
একটু-সুখে তৃপ্তি নেই কোনো!
নিতান্তই ভ্রান্ত লোকটা। হায়,
অল্প-একটু সুখের কাঙাল।

প্রিয়তমাসু

তুমি বলেছিলে ক্ষমা নেই, ক্ষমা নেই।
অথচ ক্ষমাই আছে।
প্রসন্ন হাতে কে ঢালে জীবন শীতের শীর্ণ গাছে।
অন্তরে তার কোনো ক্ষোভ জমা নেই।

তুমি বলেছিলে, তমিস্রা জয়ী হবে।
তমিস্রা জয়ী হলো না।
দিনের দেবতা ছিন্ন করেছে অমারাত্রির ছলনা;
ভরেছে হৃদয় শিশিরের সৌরভে।

তুমি বলেছিলে, বিচ্ছেদই শেষ কথা।
শেষ কথা কেউ জানে?
কথা যে ছড়িয়ে আছে হৃদয়ের সব গানে, সবখানে;
তারও পরে আছে বাঙময় নীরবতা।

এবং তুষার মৌলি পাহাড়ে কুয়াশা গিয়েছে টুটে,
এবং নীলাভ রৌদ্রকিরণে ঝরে প্রশান্ত ক্ষমা,
এবং পৃথিবী রৌদ্রকে ধরে প্রসন্ন করপুটে।
দ্যাখো, কোনোখানে কো্নো বিচ্ছেদ নেই।
আছে অনন্ত মিলনে অমেয় আনন্দ, প্রিয়তমা।

ফলতায় রবিবার

কেউ কি শহরে যাবে? কেউ যাবে? কেউই যাব না।
বরং ঘনিষ্ঠ এই সন্ধ্যার সুন্দর হাওয়া খাব,
বরং লুণ্ঠিত এই ঘাসে-ঘাসে আকণ্ঠ বেড়াব
আমি, অমিতাভ আর সিতাংশু।
সিতাংশু, এই ভাল,
শহরে ফিরব না। দ্যাখো, অমিতাভ, কতখানি সোনা
ডুবে গেল নদীর শরীরে। দ্যাখো, তরঙ্গের গায়ে
নৌকার লণ্ঠন থেকে আলো পড়ে, আলো কাঁপে, আলো
ভেঙে-ভেঙে যায়।

কেউ কি শহরে যাবে? কেউ যাবে? কেউই যাব না।
শহরে প্রচণ্ড ভিড়, অকারণ তুমিল চিৎকার,
লগ্ন নিয়নের বাতি। শহরে ফিরব না কেউ আর।
বরং চুপ করে দেখি, অন্ধকারে নদী কত কালো
হতে পারে, অপচয়ী সূর্য তার সবটুকু সোনা
কী করে ওড়ায়; দেখি মৃদুকণ্ঠ তরঙ্গমালায়
নৌকার লণ্ঠন থেকে আলো পড়ে, আলো কাঁপে, আলো
ভেঙে-ভেঙে যায়।

বারান্দা

‘এ-কন্যা উচ্ছিষ্ট, কোনো লোলচর্ম বৃদ্ধ লালসার
দ্বাবিংশ সন্ধ্যার প্রণয়িনী।
ধিক্‌, এরে ধিক্‌!’
বলে সেই সত্যসন্ধ নিষ্পাপ প্রেমিক
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন।
সেখানে টগর জুঁই হাস্নুহানা রজনীগন্ধার
সহৃদয় সান্নিধ্যে এবং
সন্ধ্যার হাওয়ায় তাঁর ক্লিষ্ট স্নায়ুমন
শান্ত হয়ে এলে ফের অরিন্দম সেন
দু-দণ্ড তন্ময় বসে থেকে
পুনরায় নেই একই চিন্তার হাঁটুতে মাথা রেখে
নবতর সিদ্ধান্তে এলেন :
তা বলে কি প্রেম নেই? প্রেমে শান্তি নেই? আছে, আছে।
বিবৃতজঘনা এই কন্যাদের কাছে
সে-প্রেম যাবে না পাওয়া। কিংবা পাওয়া গেলেও বিস্তর
মূল্য দিতে হবে। আমি ততটা শাঁসালো
প্রেমিক যখন নেই, অনিবার্য এই পরাজয়ে
শোকার্ত হব না। অতঃপর
আমার আশ্রয় নেওয়া ভাল
মেঘ-নদী-বৃক্ষলতাপাতার প্রণয়ে।’

অপিচ পরম রঙ্গে টবের গোলাপে
মগ্ন হয়ে দেখা যায়, সে এক আশ্চর্য প্রণয়িনী!
ঘনিষ্ট, তবুও শান্ত। এবং পাপড়িতে তার কাঁপে
সেই একই অপার্থিব অমর্ত্য পিপাসা,
যাকে বলি প্রেম।

তাই সমস্ত প্রগল্‌ভ ছিনিমিনি
শেষ হয়ে গেলে সেই প্রেমিক আবারও বুঝি পারে
হৃদয়ে জ্বালিয়ে নিতে আর-এক প্রসন্ন ভালবাসা
বারান্দার এই মৌন বসন্তবাহারে।

বৃদ্ধের স্বভাবে

“এককালে আমিও খুব মাংস খেতে পারতুম, জানো হে;
দাঁত ছিল, মাংসে তাই আনন্দ পেতুম।
তোমার ঠানদিদি রোজ কব্জি-ডোবা বাটিতে, জানো হে,
না না, শুধু মাংস নয়, মাংস মাছ ইত্যাদি আমায়
(রান্নাঘর নিরামিষ, তাই রান্নাঘরের দাওয়ায়)
সাজিয়ে দিতেন। আমি চেটেপুটে নিত্যই খেতুম।
সে-সব দিনকাল ছিল আলাদা, জানো হে,
হজমের শক্তি ছিল, রাত্তিরে সুন্দর হত ঘুম।”

মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি, রোগা ঢ্যাঙা বৃদ্ধ এক তার
পাতের উপরে দিব্য জমিয়েছে মাংসের পাহাড়।
যদিও খাচ্ছে না। শুধু মাংসল স্মৃতির তীব্র মোহে
ক্রমাগত বলে যাচ্ছে–‘জানো হে, জানো হে’!

মাটির হাতে

এ কোন্ যন্ত্রণা দিবসে, আর
এ কোন্ যন্ত্রণা রাতে;
আকাশী স্বপ্ন সে ছুঁয়েছে তার
মাটিতে গড়া দুই হাতে।

বোঝেনি, রাত্রির ঝোড়ো হাওয়ায়
যখন চলে মাতামাতি,
জ্বলতে নেই কোনো আকাঙ্ক্ষায়
জ্বালাতে নেই মোমবাতি।

ভেবেছে, সবখানে খোলা দুয়ার
দ্যাখেনি দেয়ালের লেখা;
এবং বোঝেনি যে বারান্দার
ধারেই তার সীমারেখা।

তবু সে গিয়েছিল বারান্দায়,
কাঁপেনি তবু তার বুক;
তবু সে মোমবাতি জ্বেলেছে, হায়,
দেখেছে আকাশের মুখ।

এখন যন্ত্রণা দিবসে, আর
এখন যন্ত্রণা রাতে।
আকাশী স্বপ্ন সে ছুঁয়েছে তার
মাটিতে গড়া দুই হাতে।

মাঠের সন্ধ্যা

অন্যমনে যেতে যেতে হঠাৎ যদি
মাঠের মধ্যে দাঁড়াই,
হঠাৎ যদি তাকাই পিছন দিকে,
হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে বিকেলবেলার নদীটিকে।

ও নদী, ও রহস্যময় নদী,
অন্ধকারে হারিয়ে যাসনে, একটু দাঁড়া;
এই যে একটু-একটু আলো, এই যে ছায়া ফিকে-ফিকে,
এরই মধ্যে দেখে নেব সন্ধ্যাবেলার প্রথম তারাটিকে।

ও তারা, ও রহস্যময় তারা,
একটু আলো জ্বালিয়ে ধর, দেখে রাখি
আকাশী কোন্‌ বিষণ্ণতা ছড়িয়ে যায় দিকে-দিকে,
দেখে রাখি অন্ধকারে উড়ন্ত ওই ক্লান্ত পাখিটিকে।

ও পাখি, ও রহস্যময় পাখি।
হারিয়ে গেল আকাশ-মাটি, কান্না পাওয়া
এ কী করুণ সন্ধ্যা! এ কোন্‌ হাওয়া লেগে
অন্ধকারে অদৃশ্য ওই নদীর দুঃখ হঠাৎ উঠল জেগে।
ও হাওয়া, ও রহস্যময় হাওয়া!

 মৃত্যুর পরে

দু’ দণ্ড দাঁড়াই ঘাটে। এই স্থির শান্ত জলে তার
আয়াত দৃষ্টির মৌন রহস্য বিম্বিত হয় যদি।
দু’ দণ্ড দাঁড়াই এই আদি অন্ধকারে। বলি, ‘নদী,
কে তার ব্যর্থতাগুলি ক্ষিপ্ত হাতে নিয়েছে কুড়িয়ে
সন্ধ্যার আকাশ, অস্ত-সূর্য আর নিঃসঙ্গ হাওয়ার
বিষণ্ণ মর্মর থেকে, শীতের সন্ন্যাসী বনভূমি
থেকে? তুমি নাকি? তার আকাঙ্ক্ষার ক্লান্ত পথ দিয়ে
কে ফিরে এসেছে এই অপরূপ অন্ধকারে,–তুমি?’

দু’ দণ্ড দাঁড়াই ঘাটে। তরঙ্গের অস্ফুট কল্লোলে
কান পাতি। যদি তার কণ্ঠের আভাস পাওয়া যায়।
যদি এই মধ্যরাতে শীত-শীত সুন্দর হাওয়ায়
নদীর গভীরে তার কান্না জেগে ওঠে। হাত রাখি
জলের শরীরে। বলি, ‘নদী, তোর নয়নের কোলে
এত অন্ধকার কেন, তুই তার অশ্রুজল নাকি?’

মৌলিক নিষাদ

পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর নদীর ঠিক পাশে
দাঁড়িয়ে রয়েছি। পিতামহ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি, আর চেয়ে দেখছি রাত্রির আকাশে
ওঠেনি একটিও তারা আজ।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে তাকাই–শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার।
পিতামহ, আমি এক নিষ্ঠুর সময়ে বেঁচে আছি।

এই এক আশ্চর্য সময়।
যখন আশ্চর্য বলে কোনো কিছু নেই।
যখন নদীতে জল আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
যখন পাহাড়ে মেঘ আছে কি না-আছে
কেউ তা জানে না।
পিতামহ, আমি এক আশ্চর্য সময়ে বেঁচে আছি।
যখন আকাশে আলো নেই,
যখন মাটিতে আলো নেই,
যখন সন্দেহ জাগে, যাবতীয় আলোকিত ইচ্ছার উপরে
রেখেছে নিষ্ঠুর হাত পৃথিবীর মৌলিক নিষাদ–ভয়।

পিতামহ, তোমার আকাশ
নীল–কতখানি নীল ছিল?
আমার আকাশ নীল নয়।
পিতামহ, তোমার হৃদয়
নীল–করখানি নীল ছিল?
আমার হৃদয় নীল নয়।
আকাশের, হৃদয়ের যাবতীয় বিখ্যাত নীলিমা
আপাতত কোনো-এক স্থির অন্ধকারে শুয়ে আছে।

পিতামহ, আমি সেই ভয়ের দরুণ অন্ধকারে
দাঁড়িয়ে রয়েছি! পিতামহ,
দাঁড়িয়ে রয়েছি, আর চেয়ে দেখেছি, রাত্রির আকাশে
ওঠেনি একটাও তারা আজ।
মনে হয়, আমি এক অমোঘ মৃত্যুর কাছাকাছি
নিয়েছি আশ্রয়। আমি ভিতরে বাহিরে
যেদিকে তাকাই, আমি স্বদেশে বিদেশে
যেখানে তাকাই–শুধু অন্ধকার, শুধু অন্ধকার
অন্ধকারে জেগে আছে মৌলিক নিষাদ–এই ভয়।

যেহেতু

আশা ছিল শান্তিতে থাকার,
আহা, ব্যর্থ হল সেই আশা,
যেহেতু মস্তিষ্কে ছিল তার
মস্ত একটা ভিমরুলের বাসা।

এবং সাদা যে কালো নয়,
কালো নয় নীল কিংবা লাল,
যেহেতু সে তাতেও সংশয়
লালন করেছে চিরকাল…

বন্ধুদের পরামর্শ শুনে
মীমাংসার বারিবিন্দুগুলি
অবিলম্বে চিন্তার আগুনে
ছিটোটে পারলেই তার খুলি
ঠাণ্ডা হয়ে আসত। সে যেহেতু
সাধ্য আর সাধনার সেতু
বেঁধে নিতে চায়নি, বারবার
পরাস্ত হয়েও প্রাণপণে
নৌকা খুলে দিয়েছিল তার
অনির্দিষ্ট লক্ষ্যের পিছনে…

এবং যেহেতু তার মনে
ইথে কোনো সন্দেহ ছিল না,
যা-কিছু ঝলসায় ক্ষণে-ক্ষণে,
সমস্তই নয় তার সোনা…

সুতরাং শান্তিতে থাকার,
আহা, ব্যর্থ হল সব আশা
মস্তিষ্কে অবশ্য ছিল তার
মস্ত একটা ভিমরুলের বাসা।

শিল্পীর ভূমিকা

আপনি তো জানেন, শুধু আপনিই জানেন, কী আনন্দে
এখনও মূর্খের শূন্য অট্টহাসি, নিন্দুকের ক্ষিপ্র
জিহ্বাকে সে তুচ্ছ করে নিতান্তই অনায়াসে; তীব্র
দুঃখের মুহূর্তে আজও কী পরম প্রত্যয়ের শান্তি
শিল্পীকে বাঁচিয়ে রাখে; সন্ধ্যামালতীর মৃদু গন্ধে
কেন তার স্বপ্ন হয়ে সমুদ্রের মতো নীলকান্তি;
উপরে যন্ত্রণা যার, অন্তরালে সুধা অতলান্ত।

আপনি তো জানেন, শুধু আপনিই জানেন, মায়ামঞ্চে
কেউ বা সম্রাট হয়, কেউ মন্ত্রী, কেউ মহামাত্য;
শিল্পীর ভূমিকা তার, সাময়িক সমস্ত দৌরাত্ম্য
দেখার ভূমিকা। তাতে দুঃখ নেই। কেননা, অনন্ত
কালের মৃদঙ্গ ওই বাজে তার মনের মালঞ্চে।
ত্রিকালী আনন্দ তার; নেই তার আদি, নেই অন্ত।

সহোদরা

না, সে নয়, অন্য কেউ এসেছিল; ঘুমো, তুই ঘুমো।
এখনো রয়েছে রাত্রি, রোদ্দুরে চুমো
লাগেনি শিশিরে। ওরে বোকা,
আকাশে ফোটেনি আলো, দরজায় এখনো তার টোকা
পড়েনি! টগর-বেল-গন্ধরাজ-জুঁই
সবাই ঘুমিয়ে আছে, তুই
জাগিসনে আর! তোর বরণডালার মালাগাছি
দে আমাকে, আমি জেগে আছি।
না রে মেয়ে, নারে বোকা মেয়ে,
আমি ঘুমোবো না। আমি নির্জন পথের দিকে চেয়ে
এমন জেগেছি কত রাত।
এমন অনেক ব্যথা-আকাঙ্ক্ষার দাঁত
ছিঁড়েছে আমাকে! তুই ঘুমো দেখি, শান্ত হ’য়ে ঘুমো।
শিশিরে লাগেনি তার চুমো,
বাতাসে ওঠেনি তার গান। ওরে বোকা,
এখনও রয়েছে রাত্রি, দরজায় পড়েনি তার টোকা ।

সান্ধ্য তামাশা

হা-রে হা-রে হা-রে, দ্যাখো, হা-রে,
কী জমাট সান্ধ্য তামাশায়
আকাশের পশ্চিম দুয়ারে
সূর্য তার ডুগডুগি বাজায়।

টকটকে আগুনে জ্বেলে দিয়ে
আকাশের শান্ত রাজধানী
শূন্যে ও কে দিয়েছে উড়িয়ে
রক্তরং সতরঞ্জখানি।

দ্যাখো রে পুঞ্জিত মেঘে-মেঘে
চিত্রিত অলিন্দে ঝরোকায়
রঙের সংহত ছোঁয়া লেগে
সারি বেঁধে ও কারা দাঁড়ায়।

হা-রে হা-রে হা-রে, দ্যাখো, হা-রে,
কী জমাট সান্ধ্য তামাশায়…

ও কারা কৌতুকে ঠোঁট চেওএ
সায়াহ্নের সংবৃত আবাগে
দ্যাখে ভেল্কিবাজের চাতুরি;
কী করে সে শূন্যে জাল বেয়ে
নিখিল সন্ধ্যায় করে চুরি
নানাবর্ণ মাছের সম্ভার।
দর্শকেরা রয়েছে তাকিয়ে,
তবু কিছু লজ্জা নেই তার।

অন্তিম তামাশা ছিল বাকি।
অকস্মাৎ চক্ষের নিমেষে
নিঃসঙ্গ বিহ্বল এক পাখি
বিদ্যুত-গতিতে ছুটে এসে
যেন মায়ামন্ত্রবলে প্রায়
ডুবেছে অথই লাল জলে।
গেল, গেল!–মেঘেরা দৌড়ায়
নিঃশব্দ ভীষণ কোলাহলে।

হা-রে হা-রে হা-রে, দ্যাখো, হা-রে,
কী জমাট সান্ধ্য তামাশায়
আকাশের পশ্চিম দুয়ারে
সূর্য তার ডুগডুগি বাজায়।

সোনালি বৃত্তে

একটুখানি কাছে এসেই দূরে যায়
নোয়ানো এই ডালের ‘পরে
একটু বসেই উড়ে যায়।
এই তো আমার বিকেলবেলার পাখি।
সোনালি এই আলোর বৃত্তে
থেমে থাকি,
অশথ গাছের কচি পাতায় হাওয়ার নৃত্যে
দৃষ্টি রাখি।
একটু থামি, একটু দাঁড়াই,
একটু ঘুরে আসি আবার।
কখন যে সেই দূরে যাবার
সময় হবে, জানি না তা।
রৌদ্রে ওড়ে পাখি, কাঁপে অশথগাছের কচি পাতা।

দুপুরবেলার দৃশ্য নদী হারিয়ে যায় বারে বারে
সন্ধ্যাবেলার অন্ধকারে।
তবু আবার
সময় আসে নদীর স্বপ্নে ফিরে যাবার।
নদীও যে পাখির মতোই, কাছের থেকে দূরে যায়,
মনের কাছে বাঁক নিয়ে সে ঘুরে যায়।
একটুখানি এগিয়ে তাই আলোর বৃত্তে
থেমে থাকি,
অশথখানি কচি পাতায় হাওয়ার নৃত্যে
দৃষ্টি রাখি।

হঠাৎ হাওয়া

হঠাৎ হাওয়া উঠেছে এই দুপুরে
আকাশী নীল শান্তি বুঝি ছিনিয়ে নিতে চায়।
মালোঠিগাঁও বিমূঢ়, হতবাক্‌।
মেঘের ক্রোধ গর্জে ওঠে ঝড়ের ডঙ্কায়।
এখনই এল ডাক।
মন্দাকিনী মিলায় তাল তরঙ্গের নূপুরে।

এ যেন হরধনুর টান ছিলাতে
হেনেছে কেউ প্রবল টংকার।
চিনের চোখ মীলিত। কার ভীষণ জটাজাল
আকাশে পড়ে ছড়িয়ে, শোনো বাতাসে বাজে তার
সঘন করতাল।
ত্রিলোক কোটিকণ্ঠে চায় গানের গলা মিলাতে।

এ যেন কোন্‌ শিল্পী তার খেয়ালে
উপুড় করে দিয়েছে কালো রঙ
আকাশময়। পাখিরা ত্রাসে কুলায়ে ফিরে যায়।
কে যেন তার ক্রোধের কশা দারুণ নির্মম
হানে হাওয়ার গায়ে।
অট্টহাসি ধ্বনিত তার গিরিগুহার দেয়ালে।

এবং, দ্যাখো, নিমেষে যেন কী করে
মিলিয়ে যায় খামার-ঘরবাড়ি,
মিলিয়ে যায় নিকট-দূর পর্বতের চূড়া।
খেতের কাজ গুছিয়ে মাঠ-চটিতে দেয় পাড়ি
ত্রস্ত গাঁওবুড়া।
বিদ্যুতের নাগিনী ধায় মেঘের কালো শিখরে।

হঠাৎ হাওয়া উঠেছে এই দুপুরে,
আকাশী নীল শান্তি যেন ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
মালোঠিগাঁও বিমূঢ়, হতবাক্‌।
মেঘের ক্রোধ গর্জে ওঠে ঝড়ের ডঙ্কায়।
এসেছে তার ডাক।
মন্দাকিনী মিলায় তাল তরঙ্গের নূপুরে।

 হলুদ আলোর কবিতা

দুয়ারে হলুদ পর্দা। পর্দার বাহিরে ধুধু মাঠ
আকাশে গৈরিক আলো জ্বলে।
পৃথিবী কাঞ্চনপ্রভ রৌদ্রের অনলে
শুদ্ধ হয়।
কারা যেন সংসারের মায়াবী কপাট
খুলে দিয়ে ঘাস, লতা, পাখির স্বভাবে
সানন্দ সুস্থির চিত্তে মিশে গেছে। শান্ত দশ দিক।
দুয়ারে হলুদ পর্দা। আকাশে গৈরিক
আলো কাঁপে। সারাদিন কাঁপে।

আকাশে গৈরিক আলো। হেমন্ত-দিনের মৃদু হাওয়া
কৌতুকে আঙুল রাখে ঘরের কপাটে,
জানালায়। পশ্চিমের মাঠে
মানুষের স্নিগ্ধ কণ্ঠ। কে জানে মানুষ আজও মেঘ
হতে গিয়ে স্বর্ণাভ মেঘের স্থির ছায়া
হয়ে যায় কি না। তার সমস্ত আবেগ
হয়তো সংহত হয় রোদ্দুরের হলুদ উত্তাপে।

আলো কাঁপে। সারাদিন কাঁপে।

হাতে ভীরু দীপ

হাতে ভীরু দীপ, পথে উন্মাদ হাওয়া,
ভ্রুকুটিকুটিল সহস্র ভয় মনে।
কেন ভয়? কেন এমন সঙ্গোপনে
পথে নেমে তোর বারে-বারে ফিরে চাওয়া?
এ কী ভয় তোর সকল সত্তা কাঁপায়?
আমি যে এসেছি, সে যেন জানতে না পায়।

দূরে হেলঙের পাহাড়, পাহাড়তলি
ছাড়িয়ে পিপলকোঠির চড়াই, আর
তারপর সাঁকো। বাঁয়ে গেলে গঙ্গার
ধারে সেই গ্রাম, অমৌঠি রঙ্কোলি।

সেইখানে যাব। সামনের শীতে যদি
পাওয়া যায় জমি ঢালু সিয়াসাঙে, তাই
চলেছি। এ ছাড়া, জানেন গঙ্গামাঈ,
কোনো আশা নেই। বরফের তাড়া খেয়ে
নির্জন পাকদণ্ডির পথ বেয়ে
নীচে নেমে যাই। কী ভয়ে আমাকে কাঁপায়–
জানে মানাগাঁও, জানে পাহাড়িয়া নদী।
আমি যে এসেছি, সে যেন জানতে না পায়।

হেলং

এ যেন আরণ্য প্রেত-রাত্রির শিয়রে এক মুঠো
জ্যোৎস্নার অভয়।
অন্তত তখন তা-ই মনে হয়েছিল
সুন্দরী হেলং, সেই পাহাড়িয়া বৃষ্টির তিমিরে।
সকাল থেকেই সূর্য নিখোঁজ। দক্ষিণে
স্পর্ধিত পাহাড়। বাঁয়ে অতল গড়খাই
উন্মাদ হাওয়ার মাতামাতি
শীর্ণ গিরিপথে।
যেন কোনো রূপকথার হৃতমণি অন্ধ অজগর
প্রচণ্ড আক্রোশে তার গুহা থেকে আথালি-পাথালি
ছুটে আসে; শত্রু তার পলাতক জেনে
নিজেকে দংশন হানে, আর
মৃত্যুর পাখসাট খায় পাথরে-পাথরে।

উপরে চক্রান্ত চলে ক্রূর দেবতার। ত্রস্ত পায়ে
নীচে নেমে আর-এক বিস্ময়।
এ কেমন অলৌকিক নিয়মে নিষ্ঠুর
ঝঞ্চা প্রতিহত, হাওয়া নিশ্চুপ এখানে।
নিত্যকার মতোই দোকানি
সাজায় পসরা, চাষি মাঠে যায়, গৃহস্থ-বাড়ির
দেয়ালে চিত্রিত পট, শান্ত গাঁওবুড়া
গল্প বলে চায়ের মসলিসে।
দুঃখের নেপথ্যে স্থির, আনন্দের পরম আশ্রয়
প্রাণের গভীরে মগ্ন, ক্ষমায় সহাস্য গিরিদরি–
সুন্দরী হেলং।

অন্তত তখন তা-ই মনে হয়েছিল
তোমাকে, হেলং, সেই পাহাড়িয়া বৃষ্টির তিমিরে।
এবং এখনও মনে হয়,
তীব্রতম যন্ত্রণার গভীরে কোথাও
নিত্য প্রবাহিত হয় সেই আনন্দের স্রোতস্বিনী
যে জাগায় দারুণ ভয়ের
মর্মকষে শান্ত বরাভয়।।
মনে হয়, রক্তরং এই রঙ্গমঞ্চের আড়ালে
রয়েছে কোথাও
নেপথ্য-নাটকে স্থির নির্বিকার নায়ক-নায়িকা,
দাঁড়ে টিয়াপাখি, শান্তি টবের অর্কিডে।

Exit mobile version