Site icon BnBoi.Com

বুলবুল (দ্বিতীয় খণ্ড)- কাজী নজরুল ইসলাম

বুলবুল - কাজী নজরুল ইসলাম

অনেক ছিল বলার যদি সেদিন ভালোবাসতে

অনেক ছিল বলার, যদি
সেদিন ভালোবাসতে।
পথ ছিল গো চলার, যদি
দু-দিন আগে আসতে॥
আজকে মহাসাগর-স্রোতে
চলেছি দূর পারের পথে
ঝরা পাতা হারায় যথা
‍ সে আঁধারে ভাসতে॥
গহন রাতি ডাকে আমায়
এলে তুমি আজকে
কাঁদিয়ে গেলে হায় গো আমার
বিদায় বেলার সাঁঝকে।
আসতে যদি হে অতিথি
ছিল যখন শুক্লা তিথি
ফুটত চাঁপা, সেদিন যদি
চৈতালি চাঁদ হাসতে॥

আজও ফাল্গুনে বকুল কিংশুকের বনে

মঞ্জুভাষিণী

আজও ফাল্গুনে বকুল কিংশুকের বনে
কহে কোন কথা হৃদয় স্বপ্নে আনমনে
মৃদু মর্মরে পথের পল্লবের সাথে
গাহে কোন গীতি নিশীথে পানসে জ্যোৎস্নাতে
খোঁজে কার স্মৃতি নীরস শুভ্র চন্দনে॥
গ্রহে চন্দ্রে কয়, সে কি গো মৃত্যুদ্বার খুলে
হয়ে সৃষ্টি পার গিয়াছে অমৃতের কূলে
কাঁদে কোন লোকে পরম সুন্দরের সনে॥

আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়

আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়, চাঁদ নেহারিয়া প্রিয়
মোরে যদি মনে পড়ে, বাতায়ন বন্ধ করিয়া দিয়ো॥
সুরের ডুরিতে জপমালা সম
তব নাম গাঁথা ছিল প্রিয়তম
দুয়ারে ভিখারি গাহিলে সে গান তুমি ফিরে না চাহিয়ো॥
অভিশাপ দিয়ো, বকুল-কুঞ্জে যদি কুহু গেয়ে ওঠে,
চরণে দলিয়ো সেই জুঁই গাছে আর যদি ফুল ফোটে।
মোর স্মৃতি আছে যা কিছু যেথায়
যেন তাহা চির-তরে মুছে যায়,
(মোর) যে ছবি ভাঙিয়া ফেলেছ ধুলায়
আর তুলে নাহি নিয়ো।
(তারে) তুলে নাহি নিয়ো॥

আনো গোলাপ-পানি, আনো আতরদানি গুলবাগে

আনো গোলাপ-পানি, আনো আতরদানি গুলবাগে
সেহেলি গো কিছু ভালো নাহি লাগে॥
বেদুইন ছেলের বাঁশি কারে ডাকে
কেঁদে কেঁদে অনুরাগে॥
মরুযাত্রীদের উটের সারি যেমন চাহে তৃষার বারি
তেমনই মম পিয়াসি পরান যেন কার
প্রেম-অমৃত বারি মাগে॥
চাঁদের পিয়ালাতে জোছনা-শিরাজি ঝরে যায়
আমারই হৃদয় কেন গো সে মধু নাহি পায়।
হায়, হায়, বাদাম গাছের আঁধার বনে
নিশ্বাস ওঠে যেন বুলবুলির শিসের সনে,
বিরহী মোর কোথায় কাঁদে কোন মদিনাতে–
ফোরাত নদীর রোদন সম বুকে ঢেউ জাগে॥

আমার ভুবন কান পেতে রয় প্রিয়তম তব লাগিয়া

আমার ভুবন কান পেতে রয় প্রিয়তম তব লাগিয়া।
দীপ নিভে যায়, সকলে ঘুমায়, মোর আঁখি রহে জাগিয়া
প্রিয়তম তব লাগিয়া॥
তারারে শুধাই, ‘কত দেরি আর?
কখন আসিবে বিরহী আমার?’
ওরা বলে, ‘হেরো পথ চেয়ে তার নয়ন উঠেছে রাঙিয়া’।
প্রিয়তম তব লাগিয়া॥
‘আসিতেছে সে কি মোর অভিসারে’ কাঁদিয়া শুধাই চাঁদে,
মোর মুখপানে চেয়ে চেয়ে চাঁদ নীরবে শুধু কাঁদে।
ফাগুন-বাতাস করে হায় হায়
(বলে) ‘বিরহিণী তোর নিশি যে পোহায়।
ফুল বলে, ‘আর জাগিতে নারি গো,
ঘুমে আঁখি আসে ভাঙিয়া॥’
প্রিয়তম তব লাগিয়া॥

আমায় নহে গো ভালোবাস শুধু ভালোবাস মোর গান

আমায় নহে গো, ভালোবাস শুধু ভালোবাস মোর গান।
বনের পাখিরে কে চিনে রাখে গান হলে অবসান।
চাঁদেরে কে চায়, জোছনা সবাই যাচে
গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধূলি মাঝে;
তুমি বুঝিবে না, আলো দিতে পোড়ে কত প্রদীপের প্রাণ।
যে কাঁটা-লতার আঁখি-জল, হায়, ফুল হয়ে ওঠে ফুটে,
ফুল নিয়ে তায় – দিয়েছ কি কিছু শূন্য পত্রপুটে!
সবাই তৃষ্ণা মিটায় নদীর জলে,
কী তৃষা জাগে সে নদীর হিয়া-তলে
বেদনার মহাসাগরের কাছে করো তার সন্ধান॥

 আমি আছি বলে দুখ পাও তুমি

আমি আছি বলে দুখ পাও তুমি, তাই আমি যাব চলে।
এবার ঘুমাও প্রদীপের কাজ শেষ হয়ে গেছে জ্বলে॥
আর আসিবে না কোনো অশান্তি,
আর আসিবে না ভয়ের ভ্রান্তি,
আর ভাঙিবে না ঘুম নিশীথে গো, ‘জাগো প্রিয়া জাগো’ বলে॥
হয়তো আবার সুদূর শূন্যে আকাশে বাজিবে বাঁশি,
গোপী-চন্দন-গন্ধ আসিবে বাতায়ন-পথে ভাসি।
চম্পার ডালে বিরহী পাপিয়া
‘পিয়া পিয়া’ বলে উঠিবে ডাকিয়া,
বৃন্দাবন কি ভাসিবে আবার
সেদিন রোদন-যমুনা-জলে॥

আমি চাঁদ নহি, চাঁদ নহি অভিশাপ

আমি চাঁদ নহি, চাঁদ নহি অভিশাপ।
শূন্য গগনে আজও নিরাশায় আকাশে করি বিলাপ॥
শত জনমের অপূর্ণ সাধ লয়ে –
(আমি) গগনে কাঁদি গো ভুবনের চাঁদ হয়ে,
জোছনা হইয়া ঝরে গো আমার অশ্রু বিরহ-তাপ॥
কলঙ্ক হয়ে বুকে দোলে মোর তোমার স্মৃতির ছায়া,
এত জোছনায় ঢাকিতে পারি নি তোমার মধুর মায়া
কোন সে সাগর-মন্থন শেষে মোরে
জড়াইয়া যেন উঠেছিলে প্রেমভরে,
(হায়) তুমি গেছ চলে, বুকে তবু দোলে তব অঙ্গের ছাপ॥

আমি চিরতরে দূরে চলে যাব

আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে।
(আমি) বাতাস হইয়া জড়াইব কেশ, বেণি যাবে যবে খুলিতে॥
তোমার সুরের নেশায় যখন
ঝিমাবে আকাশ কাঁদিবে পবন
রোদন হইয়া আসিব তখন তোমার বক্ষে ঝুরিতে॥
আসিবে তোমার পরমোৎসব কত প্রিয়জন কে জানে
মনে পড়ে যাবে – কোন সে ভিখারি পায়নি ভিক্ষা এখানে।
তোমার কুঞ্জ পথে যেতে হায়
চমকি থামিয়া যাবে বেদনায়
দেখিবে, কে যেন মরে মিশে আছে তোমার পথের ধূলিতে।

আমি জানি তব মন আমি বুঝি তব ভাষা

আমি জানি তব মন আমি বুঝি তব ভাষা।
তব কঠিন হিয়ার তলে জাগে
কী গভীর ভালবাসা॥
ওগো উদাসীন! আমি জানি তব ব্যথা,
আহত পাখির বুকে বাণ বিঁধে কোথা,
কোন অভিমানে ভুলিয়াছ তুমি
ভালবাসিবার আশা॥
তুমি কেন হানো অবহেলা অকারণে আপনাকে,
প্রিয়া, যে হৃদয়ে বিষ থাকে – সেই হৃদয়েই অমৃত থাকে।
তব যে-বুকে জাগে প্রলয়-ঝড়ের জ্বালা
আমি দেখেছি যে সেথা সজল মেঘের মালা
ওগো ক্ষুধাতুর আমারে আহুতি দিলে
মিটিবে কি তব পরানের পিপাসা॥

আমি নহি বিদেশিনি

আমি নহি বিদেশিনি।
(ওই) ঝিলের ঝিনুক, বিলের শালুক
ছিল মোর সঙ্গিনী॥
ওই বাঁধা-ঘাট, ওই বালুচর,
মাটির প্রদীপ, ওই মেটে ঘর
চেনে মোরে ওই তুলসীতলার নববধূ ননদিনি॥
‘বউ কথা কও’ পাখি–
বাদলা নিশীথে মনের নিভৃতে আজও যায় মোরে ডাকি।
এত কালো চোখ এলোকেশ-ভার
এত শ্যাম-মেঘ আছে কোথা আর
(ওই) পদ্ম-পুকুরে মোরে স্মরি ঝুরে সখি মোর
কমলিনী॥

আমি পুরব দেশের পুরনারী

আমি পুরব দেশের পুরনারী
গাগরি ভরিয়া এনেছি গো অমৃত-বারি।
পদ্মাকূলের আমি পদ্মিনী বঁধু গো,
এনেছি শাপলা পদ্মের মধু গো
ঘন বনছায়ার শ্যামলী মায়ায়
শান্তি আনিয়াছি ভরি হেমঝারি॥
আমি শঙ্খনগর হতে আনিয়াছি শাঁখা, অভয়শঙ্খ
ঝিল ছেনে এনেছি সুনীল কাজল গো
বিল ছেনে এনেছি চন্দনপঙ্ক।
এনেছি শত ব্রত পার্বণ উৎসব
এনেছি সারস হংসের কলরব
এনেছি, নব আশা উষার সিন্দূর
মেঘ-ডম্বরু সাথে মেঘডুমুর শাড়ি॥

আমি সন্ধ্যামালতী বনছায়া অঞ্চলে

আমি সন্ধ্যামালতী বনছায়া অঞ্চলে
লুকাইয়া রই ঘন পল্লব-তলে॥
বিহগের গীতি ভ্রমরের গুঞ্জন
নীরব হয় যখন
আমি চাঁদেরে তখন পূজা করি আঁখিজলে॥
আমি লুকাইয়া কাঁদি বনের শকুন্তলা,
মনের কথা এ জীবনে হল না বলা।
গভীর নিশীথে বন-ঝিল্লির সুরে
ডাকি দূর বন্ধুরে
আমি ঝরে পড়ি যবে প্রভাতে সবার
হৃদয়-মুকুল খোলে॥

আর অনুনয় করিবে না কেউ কথা কহিবার তরে

আর অনুনয় করিবে না কেউ কথা কহিবার তরে।
আর দেখিবে না স্বপন রাতে গো
কেহ কাঁদে হাত ধরে।
তব মুখ ঘিরে আর মোর দু-নয়ন
ভ্রমরের মতো করিবে না জ্বালাতন
তব পথ আর পিছল হবে না আমার অশ্রু ঝরে॥
তোমার ভুবনে পড়িবে না আর কোনোদিন ছায়া মম
তোমার পূর্ণচাঁদের তিথিতে আসিব না রাহু-সম।
আর শুনিবে না করুণ কাতর
এই ক্ষুধাতুর ভিখারির স্বর,
শুনিবে না আর কাহারও রোদন
রাতের আকাশ ভরে॥

উজান বাওয়ার গান গো এবার

উজান বাওয়ার গান গো এবার, গাসনে ভাটিয়ালি,
আর গাসনে ভাটিয়ালি।
নতুন আশার চাঁদ উঠেছে কুমড়ো জালির ফালি
যেন কুমড়ো জালির ফালি॥
‍বান এসেছে, বাঁধ ভেঙেছে, নায়ে দোলা লাগে ;
আড় বাঁশিতে তান ছেড়ে তুই দাঁড় বেয়ে চল আগে ;
দেখ জোয়ার-জলে ডুবে গেছে চরের চোরাবালি॥
কালো বউ-এর চোখ যেন, দেখ
মউরলা মাছ ভাসে,
গাঙচিল আর জল-পায়রা উড়ছে
মুখের পাশে,
শোন ‘বউ কথা কও’ পাখি মোদের করছে দূতিয়ালি॥
জল নিয়ে বউ দাঁড়িয়ে আছে, গাছে কচি ডাব,
লোকসানেরই হিসাব দেখিস, লাভের কথা ভাব!
সাজ রে তামাক, নামুক দেয়া, দুঃখু তো ইজমালি॥

এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে এই তো নদীর খেলা

এ কূল ভাঙে ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা
(রে ভাই) এই তো বিধির খেলা।
সকাল বেলার আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা॥
সেই নদীর ধারে কোন ভরসায়
(ওরে বেভুল) বাঁধলি বাসা সুখের আশায়,
যখন ধরল ভাঙন পেলিনে তুই
পারে যাবার ভেলা॥
এই দেহ ভেঙে হয় রে মাটি, মাটিতে হয় দেহ,
যে কুমোর গড়ে সেই দেহ – তার খোঁজ নিল না কেহ।
রাতে রাজা সাজে নাট-মহলে
দিনে ভিক্ষা মেগে পথে চলে
শেষে শ্মশান-ঘাটে গিয়ে দেখে
সবই মাটির ঢেলা।
এই তো বিধির খেলা রে ভাই
ভব-নদীর খেলা॥

 এই বিশ্বে আমার সবাই চেনা

এই বিশ্বে আমার সবাই চেনা, কেউ অচেনা নাই
যারে দেখি হয় মনে সেই বন্ধু প্রিয় ভাই
কেউ অচেনা নাই॥
কোন সে লোকে, নাই তা মনে
চেনা ছিল সবার সনে
দেখে এদের প্রাণ জুড়িয়ে যায় রে আমার তাই।
কেউ অচেনা নাই॥
চোখ যারে কয় ‘চিনতে নারি’ প্রাণ কেন রে কাঁদে
(তারেই) জড়িয়ে ধরতে চায় এই বুক (যে) শত্রু হয়ে বাঁধে।
সব মানুষের প্রাণের কাছে
আমার চেনা লুকিয়ে আছে
(তাই) অচেনা কেউ চেনা হলে এত আনন্দ পাই
কেউ অচেনা নাই॥

এবার যখন উঠিবে সন্ধ্যাতারা – সাঁঝ আকাশে

এবার যখন উঠিবে সন্ধ্যাতারা – সাঁঝ আকাশে
দেখতে পাবে দুটি নতুন তারা – তাহার পাশে॥
চেয়ে দেখো ভালো করে
কার দুটি চোখ যেন মরে
তারা হয়ে ধরার পানে চাহে
তোমার আঁখি দেখার আশে॥
যে দুটি চোখ নিত্য লোকের মাঝে
তোমায় দিত লাজ
পড়বে মনে গো –
সেই দুটি চোখ চিরতরে এই পৃথিবী হতে –
হারিয়ে গেছে আজ।
পায়নি গো, তাই অভিমানে
চলে গেছে দূর বিমানে
(দেখো) সেদিন যেন আজের মতো চাইতে ওদের পানে
দ্বিধা নাহি আসে॥

 ওগো সুন্দর তুমি আসিবে বলিয়া বনপথে পড়ে ঝরি

ওগো সুন্দর তুমি আসিবে বলিয়া বনপথে পড়ে ঝরি
রাঙা অশোকের মঞ্জরী
হাসে বনদেবী বেণিতে জড়ায়ে মালতীর বল্লরি, নব কিশলয় পরি।
কুমুদি কালিকা ঈষৎ হেলিয়া, চাঁদেরে নেহারি হাসে মুচকিয়া
মহুয়ার বনে ভ্রমর ভ্রমরী ফিরিতেছে গুঞ্জরি॥
যাহা কিছু হেরি ভালো লাগে আজ লুকাইতে নারি হাসি,
কাজ করি আর শুনি যেন কানে মিঠে পাহাড়িয়া বাঁশি।
এক শাড়ি খুলে পরি আর শাড়ি
বারে বারে মুখ মুকুরে নেহারি
দুরু দুরু হিয়া ওঠে চমকিয়া, অকারণে লাজে মরি॥

ওগো প্রিয়, তব গান

ওগো প্রিয়, তব গান!
আকাশ গাঙের জোয়ারে উজান বহিয়া যায়।
মোর কথাগুলি বুকের দুয়ারে
–পথ খুঁজে নাহি পায়।
ওগো দখিনা পবন, ফুলের সুরভি বহো
ওরই সাথে মোর না-বলা বাণী লহো,
ওগো মেঘ, তুমি মোর হয়ে গিয়ে কহো,
বন্দিনী গিরি ঝরনা পাষাণ-তলে
যে কথা কহিতে চায়॥
ওরে ও সুরমা, পদ্মা, কর্ণফুলি, তোদের ভাটির স্রোতে
নিয়ে যা আমার না-বলা বাণীগুলি ধুয়ে মোর বুক হতে।
(ওরে) ‘চোখ গেল’ ‘বউ কথা কও’ পাখি,
তোদের কন্ঠে মোর সুর যাই রাখি কি?
(ওরে) মাঠের-মুরলী কহিয়ো তাহারে ডাকি,
আমার এ কলির না-ফোটা বুলি,
ঝরে গেল নিরাশায়।

ওরে ডেকে দে দে লো, মহুয়া-বনে ফুল ফোটাত

ওরে ডেকে দে দে লো, মহুয়া-বনে ফুল ফোটাত
বাজিয়ে বাঁশি কে।
বনের হরিণ নাচাত, পাখিকে গান গাওয়াতো,
ঢেউ ওঠাতো ঝরনাজলে – পা্হাড়তলিতে॥
তারগানের কথা জানিয়ে দিত ফুলের মধুকে,(তার)সুরের নেশা করত ব্যাকুল মনের বঁধুকে
গো মনের বঁধুকে
বুকের মাঝে বাজত নূপুর চপল হাসিতে
লো তার চপল হাসিতে॥
আঁধার রাতে ফোটাত সে হলুদ গাঁদার ফুল,
সে বন কাঁদাতো, মন কাঁদাতো, কাজ করাতো ভুল
লো কাজ করাত ভুল।
আর সে বাঁশি শুনি না
ধোঁয়ার ছলে কাঁদি না,
আর রাঙা শাড়ি পরি না, নোটন খোঁপা বাঁধি না,
আমিরইতে নারি না হেরে সেই বন-উদাসীকে লো
বন-উদাসীকে॥

কত দূরে তুমি ওগো আঁধারের সাথি

কত দূরে তুমি, ওগো আঁধারের সাথি।
হাত ধরো মোর নিভিয়া গিয়াছে বাতি॥
চলিতে চলিতে তোমার তীর্থপথে
হারায়ে গিয়াছি অন্ধকারের স্রোতে
এসে তুলে লও তোমার সোনার রথে
(লহো) প্রভাতের তীরে, শেষ হয় যেথা রাতি॥
যে ধ্রুবতারার পথ দেখাইয়া নীরবে চলেছ তুমি
সে পথ ভুলিয়া আসিলাম মায়াতৃষ্ণার মরুভূমি।
সাড়া নাহি পাই আজ আর ডেকে ডেকে
কাঁদিছ কি তুমি মোরে সাথে নাহি দেখে?
হয়তো ফিরিবে অমৃতের তীর থেকে
সেই আশে আছি পথ পানে আঁখি পাতি॥

 কত ফুল তুমি পথে ফেলে দাও

কত ফুল তুমি পথে ফেলে দাও, মালা গাঁথ অকারণে।
আমি চেয়েছিনু একটি কুসুম, সেই কথা পড়ে মনে॥
তব ফুল-বনে কত ছায়া দোলে
জুড়াইতে চেয়েছিনু তারই তলে
চাহিলে না ফিরে, চলে গেলে ধীরে
ছায়া-ঢাকা অঙ্গনে।
সেই কথা পড়ে মনে॥
অঞ্জলি পাতি চেয়েছিনু, তব ভরা ঘটে ছিল বারি,
শুষ্ক কন্ঠে ফিরিয়া আসিনু পিপাসিত পথচারী।
বহু দিন পরে দাঁড়াইনু এসে
তোমার দুয়ারে উদাসীন বেশে,
শুকানো মালিকা কেন দিলে তুমি
তব ভিক্ষার সনে?
ভাবি বসি আনমনে॥

কাবেরী নদী-জলে কে গো বালিকা

কাবেরী নদী-জলে কে গো বালিকা
আনমনে ভাসাও চম্পা শেফালিকা
প্রভাত-সিনানে আসি আলসে
কঙ্কণ-তাল হানো কলসে,
খেলে সমীরণ লয়ে কবরীর মালিকা॥
দিগন্তে অনুরাগে নবারুণ জাগে
তব জল ঢলঢল করুণা মাগে।
ঝিলম রেবা নদী তীরে
মেঘদূত বুঝি খুঁজে ফিরে
তোমারই তন্বী শ্যামা কর্ণাটিকা॥

 কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া

কুহু কুহু কুহু কোয়েলিয়া
কুহরিল মহুয়া-বনে।
চমক জাগিনু নিশীথ শয়নে॥
শূন্য ভবনে মৃদুল সমীরে
প্রদীপের শিখা কাঁপে ধীরে ধীরে,
চরণ-চিহ্ন রাখি দলিত কুসুমে
চলিয়া গেছ তুমি দূর-বিজনে॥
বাহিরে ঝরে ফুল আমি ঝুরি ঘরে
বেণু-বনে সমীরণ হাহাকার করে,
বলে যাও কেন গেলে এমন করে
কিছু নাহি বলে সহসা গোপনে॥

কেন মেঘের ছায়া আজি চাঁদের চোখে

কেন মেঘের ছায়া আজি চাঁদের চোখে
মোর বুকে মুখ রাখি ঝড়ের পাখি-সম কাঁদে ও কে
গভীর নিশীথে কন্ঠ জড়ায়ে
শ্রান্ত কেশভার গগনে ছড়ায়ে
হারানো প্রিয়া মোর এল কি লুকায়ে
আমার একা-ঘরে ম্লান আলোকে॥
গঙ্গায় তারই চিতা নিভেছে কবে,
মোর বুকে সেই চিতা আজও জ্বলে নীরবে।
স্মৃতির চিতা তার
নিভিবে না বুঝি আর
কোন সে জনমে কোন সে লোকে॥

কেমনে হইব পার

কেমনে হইব পার
হে প্রিয়, তোমার আমার মাঝে এ বিরহের পারাবার
নিশীথের চখাচখির মতন
দুই কূলে থাকি কাঁদি দুইজন
আসিল না দিন মোদের জীবনে
অন্তহীন আঁধার।
কেমনে হইব পার॥
সেধেছিনু বুঝি বাদ
কাহার মিলনে সে কোন জনমে, তাই মিটিল না সাধ।
স্মৃতি তব ঝরা পালকের প্রায়
লুটায় মনের বালুচরে হায়
সে কোন প্রভাতে কোন নবলোকে
মিলিব মোরা আবার।

কোন সে সুদূর অশোক-কাননে বন্দিনী তুমি সীতা

কোন সে সুদূর অশোক-কাননে বন্দিনী তুমি সীতা
আর কতকাল জ্বলিবে আমার বুকে বিরহের চিতা
সীতা – সীতা।
বিরহে তোমার অরণ্যচারী
কাঁদে রঘুবীর বল্কলধারী,
ঝরা চামেলির অশ্রু ঝরায়ে
ঝুরিছে বন-দুহিতা।
সীতা – সীতা!
তোমার আমার এই অনন্ত অসীম বিরহ নিয়া
কত আদি কবি কত রামায়ণ রচিবে কে জানে প্রিয়া।
বেদনার সুর-সাগর তীরে
দয়িতা আমার এসো এসো ফিরে
আবার আঁধার হৃদি-অযোধ্যা
হইবে দীপান্বিতা॥
সীতা – সীতা।

গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়

গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়, কে যেন আমারে ডাকে –
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
কার স্মৃতি বুকে পাষাণের মতো ভার হয়ে যেন থাকে –
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
কাহার ক্ষুধিত প্রেম যেন, হায়!
ভিক্ষা চাহিয়া কাঁদিয়া বেড়ায়,
কার সকরুণ আঁখি দুটি যেন রাতের তারার মতো
মুখ পানে চেয়ে থাকে –
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
নিশির বাতাস কাহার হুতাশ দীর্ঘ নিশাস সম
ঝড় তোলে এসে অন্তর মোরে; ওগো দুরন্ত মম!
সে কি তুমি, সে কি তুমি?
মহাসাগরের ঢেউ-এর মতন
বুকে বাজে এসে কাহার রোদন?
পিয়া পিয়া নাম ডাকে অবিরাম বনের পাপিয়া পাখি
আমার চম্পা-শাখে –
সে কি তুমি, সে কি তুমি?

গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে

গভীর রাতে জাগি খুঁজি তোমারে
দূর গগনে প্রিয়া তিমির পারে॥
জেগে যবে দেখি হায় তুমি নাই কাছে
আঙিনায় ফুটে ফুল ঝরে পড়ে আছে
বাণ-বেঁধা পাখি সম আহত এ প্রাণ মম
লুটায়ে লুটায়ে কাঁদে অন্ধকারে॥
মৌনা নিঝুম ধরা, ঘুমায়েছে সবে।
এসো প্রিয়, এই বেলা বক্ষে নীরবে।
কত কথা কাঁটা হয়ে বুকে আছে বিঁধে,
কত অভিমান কত জ্বালা এই হৃদে
দেখিবে এসো প্রিয় কত সাধ ঝরে গেল কত আশা
মরে গেল হাহাকারে॥

 গাঙে জোয়ার এল ফিরে তুমি এলে কই

গাঙে জোয়ার এল ফিরে তুমি এলে কই।
খিড়কি দুয়ার খুলে পথ-পানে চেয়ে রই॥
কালোজামের ডালের ফাঁকে
আমায় দেখে কোকিল ডাকে,
আজও কেন যায় না দেখা তোমার নায়ের ছই॥
চুল বেঁধে আর সেজে গুজে পিদিম জ্বালাই সাঁঝে,
ঠাকুরঝিরা মুচকি হাসে, আমি মরি লাজে।
বাদলা রাতে বৃষ্টি ঝরে
মন যে আমার কেমন করে
আমার চোখের জলে বন্ধু মাঠ করে থই-থই॥

গান ভুলে যাই মুখ পানে চাই

গান ভুলে যাই মুখ পানে চাই, সুন্দর হে
(সুন্দর মোর!)
তব নয়ন পানে চাহি কন্ঠের সুর কাঁপে থরথর হে
(সুন্দর মোর!)
তোমার অনুরাগে, ওগো বুলবুল!
মোর গানের লতায় ফোটে কথার ফুল,
অশ্রু হয়ে সেই ফুল তব পায়ে ঝরিতে চায় ঝরঝর হে
(সুন্দর মোর!)
এ নহে গান প্রিয়, কান্না এ যে তব বিরহে,
অন্তর-শিলাতলে রোদনের সুরধুনী সুর হয়ে বহে।
প্রিয়, এ নহে গানের ছন্দ,
এ যে আনন্দে বিষাদে মনের দ্বন্দ্ব,
(এ যে) রাগিণীর তলে তব অনুরাগিণীর
– মর্মের ক্রন্দন বিলাপ-মর্মর হে
(সুন্দর মোর!)

ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে

ঘুমাইতে দাও শ্রান্ত রবিরে, জাগায়ো না জাগায়ো না।
সারা জীবন যে আলো দিল, ডেকে তার ঘুম ভাঙায়ো না॥
(যে) সহস্র করে রূপ-রস দিয়া
জননীর কোলে পড়িল ঢলিয়া,
তাঁহারে শান্তি-চন্দন দাও, ক্রন্দনে রাঙায়ো না॥
যে তেজ শৌর্য-শক্তি দিলেন আপনারে করি ক্ষয়
তাই হাত পেতে নাও।
বিদেহ রবি ও ইন্দ্র মোদের নিত্য দেবেন জয়
কবিরে ঘুমাতে দাও।
অন্তরে হেরো হারানো রবির জ্যোতি
সেইখানে তাঁরে নিত্য করো প্রণতি
(আর) কেঁদে তাঁরে কাঁদায়ো না॥

চোখ গেল চোখ গেল কেন ডাকিস রে

‘চোখ গেল’ ‘চোখ গেল’ কেন ডাকিস রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে!
তোরও চোখে কাহার চোখ পড়েছে নাকি রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে!
তোর চোখের বালির জ্বালা জানে সবাই রে–
জানে সবাই
চোখে যার চোখ পড়ে তার ওষুধ নাই রে–
তার ওষুধ নাই ;
কেঁদে কেঁদে অন্ধ হয় কাহার আঁখি রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে॥
তোর চোখের জ্বালা বুঝি নিশিরাতে বুকে লাগে
‘চোখ গেল’ ভুলে রে ‘পিউ কাঁহা’ ‘পিউ কাঁহা’ বলে
তাই ডাকিস অনুরাগে রে।
ওরে বন-পাপিয়া, কাহার গোপন প্রিয়া ছিলি–
আর-জনমে
আজও ভুলতে নারিস আজও ঝুরে হিয়া
ওরে পাপিয়া বল, যে হারায় তাহারে কি
পাওয়া যায় ডাকি রে–
‘চোখ গেল’ পাখি রে।
‘চোখ গেল’ পাখি॥

 ছড়ায়ে বৃষ্টির বেলফুল

ছড়ায়ে বৃষ্টির বেলফুল
দুলায়ে মেঘলা চাঁচর চুল
চপল চোখে কাজল মেঘে আসিল কে॥
বাজায়ে কে মেঘের মাদল
ভাঙালে ঘুম ছিটিয়ে জল,
একা-ঘরে বিজলিতে এমন হাসি হাসিল কে॥
এলে কি দুরন্ত মোর ঝোড়ো হাওয়া,
চির-নিঠুর প্রিয়-মধুর পথ চাওয়া।
হৃদয়ে মোর দোলা লাগে,
ঝুলনেরই আবেশ জাগে,
ফেলে-যাওয়া বাসি মালায়–
আবার ভালোবাসিলে কে॥

জানি জানি প্রিয় এ জীবনে মিটিবে না সাধ

জানি, জানি প্রিয়, এ জীবনে মিটিবে না সাধ।
আমি জলের কুমুদিনী ঝরিব জলে
তুমি দূর গগনে থাকি কাঁদিবে চাঁদ॥
আমাদের মাঝে বঁধু বিরহ-বাতাস
চিরদিন ফেলে যাবে দীরঘ শ্বাস,
কভু পায় না বুকে, তবু মুখে মুখে
চাঁদ কুমুদীর নামে রটে অপবাদ॥
তুমি কত দূরে বঁধু, তবু বুকে এত মধু কেন উথলায়?
হাতের কাছে রহ রাতের চাঁদ মোর, ধরা নাহি যায়
তবু ছোঁয়া নাহি যায়।
মরুতৃষা লয়ে কাঁদে শূন্য হিয়া
(তবু) সকলে বলে, আমি তোমারই প্রিয়া।
সেই কলঙ্ক-গৌরব সৌরভ দিল গো,
মধুর হল মোর বিরহ-বিষাদ॥

জুঁই-কুঞ্জে বন-ভোমরা গুঞ্জে গুনগুন

জুঁই-কুঞ্জে বন-ভোমরা গুঞ্জে গুনগুন!
প্রেম-ঝরনার মধু-মঞ্জীর বাজে বক্ষে রুনুঝুন॥
মন-গোলাপের পাঁপড়ি কাঁপে কেন গো
স্বপন দেখে পালিয়ে যাওয়া বুলবুলি যেন গো
চুড়ি কঙ্কণে কোন আনমনা পেয়ালা বাজায়
রিনিঠিনি ঠুনঠুন॥
ছলছল চোখে চাঁদ আশমানে জলসায়
সঙ্গিনী তারাদের ভুলে ধরার কুমুদীর পানে কেন চায়,
হৃদয়ের এই নির্দয় খেলা দেখে
হাসনুহানা হেসে খুন॥

ঝুম ঝুম ঝুমরা নাচ নেচে কে এল গো

ঝুম ঝুম ঝুমরা নাচ নেচে কে এল গো, সই লো দেখে আয়।
বঁইচি বনের বিরহে বাউরি বাতাস বহে এলোমেলো গো,
(সে) আড়বাঁশি বাজায় আড় চোখে তাকায়
–তির হানার ভঙ্গিতে ধনুক বাঁকায়
নন্দন পাহাড়ে তাহারে দেখে চাঁদ আঁউরে গেল গো।
ঝাঁকড়া চুলের পাশে টুলটুলে চোখ হাসে কতই ছলে,
মউরলা মাছ যেন খেলে বেড়ায় গো কালো জলে,
মউটুসির মউ ফেলে ভোমরা রয় তাকিয়ে
গুরুজনের মতো বটের তরু দাঁড়িয়ে জট পাকিয়ে
আমলকী গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখি
সে দেখতে কি তা পেল গো॥

তব চলার পথে আমার গানের ফুল ছড়িয়ে যাই গো

তব চলার পথে আমার গানের ফুল ছড়িয়ে যাই গো
ফুল ছড়িয়ে যাই।
তারা ধূলায় পড়ে কাঁদে, বলে, ‘তোমার পরশ হতে চাই গো
আলতা হতে চাই!’
ওরা রাঙা হয়ে অনুরাগের রসে
তোমার চরণ-তলে পড়ে খসে,
ওদের দলে যেয়ো না যদি হয় বক্ষে তোমার
ঠাঁই গো॥
ওরা বুক পেতে দেয় পায়ের কাছে, অশ্রু-টলমল
বলে, ‘ধূলির পথে চলো না গো, ফুলের পথে চলো!’
(তুমি) চরণ ফেলে কেন ভয়ে ভয়ে
বিরহ মোর ফুটেছে ফুল হয়ে,
কাঁটা আছে আমার বুকে, ফুলে কাঁটা নাই গো॥

তব মুখখানি খুঁজিয়া ফিরি গো সকল ফুলের মুখে

তব মুখখানি খুঁজিয়া ফিরি গো সকল ফুলের মুখে,
ফুল ঝরে যায় তব স্মৃতি জাগে কাঁটার মতন বুকে।
তব প্রিয়নাম ধরে ডাকি
ফুল সাড়া দেয় মেলি আঁখি
তোমার নয়ন ফুটিল না হায় ফুলের মতন সুখে।
আকাশে বাতাসে তব নাম লয়ে* ওঠে রোদনের বাণী
কানাকানি করে চাঁদ ও তারায় জানি গো তোমারে জানি।
খুঁজি বিজলি প্রদীপ জ্বেলে
কাঁদি ঝঞ্ঝার পাখা মেলে
অন্ধ গগনে আঁধার মেঘের ঢেউ ওঠে মোর দুখে।

 তুমি আমার সকাল বেলার সুর

তুমি আমার সকাল বেলার সুর
হৃদয় অলস-উদাস-করা অশ্রু-ভারাতুর॥
ভোরের তারার মতো তোমার সজল চাওয়ায়
ভালোবাসার চেয়ে সে যে কান্না পাওয়ায়
রাত্রি-শেষের চাঁদ তুমি গো
বিদায়-বিধুর॥
তুমি আমার ভোরের ঝরাফুল
শিশির-নাওয়া শুভ্র শুচি
পূজারিনির তুল।
অরুণ তুমি, তরুণ তুমি, করুণ তারও চেয়ে,
হাসির দেশে তুমি যেন বিষাদ-লোকের মেয়ে,
তুমি ইন্দ্র-সভায় মৌনবীণা, নীরব নূপুর॥

 তুমি প্রভাতের সকরুণ ভৈরবী

তুমি প্রভাতের সকরুণ ভৈরবী,
শিশির-সজল ভোরের আকাশে ভাসে
তোমারই উদাস ছবি॥
বিষাদ গভীর কার কল্পনা
রূপ ধরে তুমি ফের আনমনা।
তোমারই মুরতি ধেয়ায় স্বপনে
বিরহী সুরের কবি
তুমি ধরা দিতে যেন আস নাই ধরণিতে
একা-একা খেলা খেল সারাবেলা
সাথিহীন তরণিতে।
আঘাত হানিয়া সে কোন নিঠুর
জাগাবে তোমাতে আশাবরি সুর
পাষাণ টুটিয়া গলিয়া পড়িবে অশ্রুর জাহ্নবী॥

তুমি শুনিতে চেয়ো না আমার মনের কথা

(তুমি) শুনিতে চেয়ো না আমার মনের কথা।
দখিনা বাতাস ইঙ্গিতে বোঝে –
কহে যাহা বনলতা॥
চুপ করে চাঁদ সুদূর গগনে
মহাসাগরের ক্রন্দন শোনে
ভ্রমর কাঁদিয়া ভাঙিতে পারে না
কুসুমের নীরবতা॥
মনের কথা কি মুখে সব বলা যায়?
রাতের আঁধারে যত তারা ফোটে
আঁখি কি দেখিতে পায়?
পাখায় পাখায় বাঁধা যবে রয়
বিহগ-মিথুন কথা নাহি কয়
মধুকর যবে ফুলে মধু পায়
রহে না চঞ্চলতা॥

তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয় সে কি মোর অপরাধ

তুমি সুন্দর, তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সে কি মোর অপরাধ?
চাঁদের হেরিয়া কাঁদে চকোরিণী, বলে না তো কিছু চাঁদ॥
চেয়ে চেয়ে দেখি ফোটে যবে ফুল
ফুল বলে না তো সে আমার ভুল
মেঘ হেরি ঝুরে চাতকিনি, মেঘ করে না তো প্রতিবাদ॥
জানে সূর্যেরে পাবে না, তবুও অবুঝ সূর্যমুখী
চেয়ে চেয়ে দেখে তার দেবতাকে, দেখিয়াই সে যে সুখী॥
হেরিতে তোমার রূপ মনোহর
পেয়েছি এ আঁখি, ওগো সুন্দর
মিটিতে দাও হে প্রিয়তম মোর
নয়নের সেই সাধ॥

 তেমনই চাহিয়া আছে নিশীথের তারাগুলি

তেমনই চাহিয়া আছে নিশীথের তারাগুলি,
লতা-নিকুঞ্জে কাঁদে আজও বন-বুলবুলি।
ফিরে এসো, ফিরে এসো প্রিয়তম॥
ঘুমায়ে পড়েছে সবে মোর ঘুম নাহি আসে
তুমি যে ঘুমায়েছিলে সেদিনও আমার পাশে
সাজানো সে গৃহ তব ঢেকেছে পথের ধূলি।
ফিরে এসো, ফিরে এসো প্রিয়তম॥
আমার চোখের জলে মুছে যায় পথ-রেখা
রোহিণী গিয়াছে চলি চাঁদ কাঁদে একা একা
কোন দূর তারালোকে কেমনে রয়েছ ভুলি।
ফিরে এসো, ফিরে এসো প্রিয়তম॥

দোলন-চাঁপা বনে দোলে দোল-পূর্ণিমা রাতে

(দোলন-চম্পা)

দোলন-চাঁপা বনে দোলে, দোল-পূর্ণিমা রাতে
চাঁদের সাথে।
(শ্যাম) পল্লব-কোলে যেন দোলে রাধা
লতার দোলনাতে॥
(যেন) দেব-কুমারীর শুভ্র হাসি
ফুল হয়ে দোলে ধরায় আসি,
আরতির মৃদুজ্যোতি প্রদীপ-কলি–
দোলে যেন দেউল আঙিনাতে॥
বন-দেবীর ও কি রুপালি ঝুমকা চৈতি সমীরণে দোলে।
রাতের সলাজ আঁখি-তারা যেন তিমির আঁচলে।
ও যেন মুঠি-ভরা চন্দন-গন্ধ
দোলে রে গোপিনীর গোপন আনন্দ,
ও কি রে চুরি-করা শ্যামের নূপুর
চন্দ্রা-যামিনীর মোহন হাতে॥

 ধর্মের পথে শহিদ যাঁহারা আমরা সেই সে জাতি

ধর্মের পথে শহিদ যাঁহারা আমরা সেই সে জাতি
সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি
আমরা সেই সে জাতি॥
পাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যাঁরা
মরুর তপ্ত বক্ষ নিঙাড়ি শীতল শান্তিধারা
উচ্চ-নীচের ভেদ ভাঙি দিল সবারে বক্ষ পাতি।
আমরা সেই সে জাতি॥
কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনিকো ইসলাম
সত্যে যে চায় আল্লায় মানে মুসলিম তারই নাম।
আমির-ফকিরে ভেদ নাই সবে ভাই সব এক সাথি
আমরা সেই সে জাতি॥
নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নরসম অধিকার
মানুষের গড়া প্রাচীর ভাঙিয়া করিয়াছি একাকার
আঁধার রাতির বোরখা উতারি এনেছি আবার ভাতি
আমরা সেই সে জাতি॥

নদীর স্রোতে মালার কুসুম

নদীর স্রোতে মালার কুসুম
ভাসিয়ে দিলাম প্রিয়
আমায় তুমি নিলে না,
মোর ফুলের পূজা নিয়ো।
পথ-চাওয়া মোর দিনগুলিরে
রেখে গেলাম নদীর তীরে,
আবার যদি আস ফিরে–
তুলে গলায় দিয়ো॥
নিভে এল পরান-প্রদীপ
পাষাণ-বেদির তলে
জ্বালিয়ে তারে রাখব কত
শুধু চোখের জলে।
তারা হয়ে দূর আকাশে
রইব জেগে তোমার আশে,
চাঁদের পানে চেয়ে চেয়ে
আমারে স্মরিয়ো॥

নন্দন বন হতে কে গো ডাক

নন্দন বন হতে কে গো ডাক মোরে আধো-নিশীথে,
ক্ষণে ক্ষণে ঘুম হারা পাখি কেঁদে ওঠে করুণ গীতে॥
ভেঙে যায় ঘুম চেয়ে থাকি,
চাহে চাঁদ ছলছল আঁখি,
ঝরা চম্পার ফুল যেন কে
ফেলে চলে যায় চকিতে॥
সহিতে না তিলেক বিরহ ছিলে যবে জীবনের সাথি
বলে যাও আজ কোন অমরায় কেমনে কাটাও দিবারাতি।
জীবনে ভুলিলে তুমি যারে
(তারে) ভুলে যাও মরণের ওপারে
আঁধার ভুবনে মোরে একাকী
দাও ওগো দাও ঝুরিতে॥

নিরজন ফুলবন এসো পিয়া

নিরজন ফুলবন, এসো পিয়া
রহি রহি বোলে কোয়েলিয়া।
পথ পানে চাহি
নাহি নিঁদ নাহি,
ঝরা ফুল জড়ায়ে ঝুরে হিয়া॥

নিশি পবন নিশি পবন ফুলের দেশে যাও

নিশি পবন! নিশি পবন! ফুলের দেশে যাও
ফুলের বনে ঘুমায় কন্যা তাহারে জাগাও॥
মউ টুসটুস মুখখানি তার
ঢেউ খেলানো চুল
ভোমরার ঝাঁক ঘেরা যেন ভোরের পদ্ম ফুল।
হাসিতে যার মাঠের সরল বাঁশির আভাস পাও॥
চাঁপা ফুলের পুতলি-ঘেরা চাঁপা রঙের শাড়ি,
তারেই দেখতে আকাশ গাঙে চাঁদ দেয় রে পাড়ি।
(তার) একটু খানি চোখের আদল বাদল-মেঘে পাও।
ধীরে ধীরে জাগাইয়ো তায়
ঝরা কুসুম ফেলিয়া গায়
জাগলে কন্যা যেন রে মোর পত্রখানি দাও॥

নিশিরাতে রিম ঝিম ঝিম বাদল-নুপুর

নিশিরাতে রিম ঝিম ঝিম বাদল-নুপুর
বাজিল ঘুমের মাঝে সজল মধুর॥
দেয়া গরজে বিজলি চমকে
জাগাইল ঘুমন্ত প্রিয়তমকে
আধো-ঘুমঘোরে চিনিতে নারি ওরে
‘কে এল কে এল’ বলে ডাকিছে ময়ূর॥
দ্বার খুলি পড়শি কৃষ্ণা মেয়ে মেঘের পানে আছে চেয়ে
কারে দেখি আমি কারে দেখি
মেঘলা আকাশ না ওই মেঘলা মেয়ে।
ধায় নদীজল মহাসাগর পানে
বাহিরে ঝড় কেন আমায় টানে
জমাট হয়ে আছে বুকের কাছে
নিশীথ-আকাশ যেন মেঘ-ভারাতুর॥

নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়

নীলাম্বরী শাড়ি পরি নীল যমুনায়
কে যায়, কে যায় কে যায়।
যেন জলে চলে থল-কমলিনী
ভ্রমর নূপুর হয়ে বোলে পায় পায়॥
কলসে কঙ্কণে রিনিঠিনি ঝনকে
চমকায় উন্মন চম্পা বনকে
দলিত অঞ্জন নয়নে ঝলকে
পলকে খঞ্জন হরিণী লুকায়॥
অঙ্গের ছন্দে পলাশ-মাধবী অশোক ফোটে,
নূপুর শুনি বন-তুলসীর মঞ্জরী উলসিয়া উঠে।
মেঘ বিজড়িত রাঙা গোধূলি
নামিয়া এল বুঝি পথ ভুলি;
তাহার অঙ্গ-তরঙ্গ বিভঙ্গে
কূলে কূলে নদীজল উথলায়॥

 নূরজাহান! নূরজাহান!

নূরজাহান! নূরজাহান!
সিন্ধুনদীতে ভেসে, এলে মেঘলামতীর দেশে
ইরানি গুলিস্তান॥
নার্গিস লালা গোলাপ আঙুরলতা
শিরিঁ-ফরহাদ সিরাজের উপকথা
এনেছিলে তুমি তনুর পিয়ালা ভরি
বুলবুলি দিলরুবা রবাবের গান॥
তব প্রেমে উন্মাদ ভুলিল সেলিম সে যে রাজাধিরাজ,
চন্দন-সম মাখিল অঙ্গে কলঙ্ক লোক-লাজ।
যে কলঙ্ক লয়ে হাসে চাঁদ নীলাকাশে
(যাহা) লেখা থাকে শুধু প্রেমিকের ইতিহাসে
দিবে চিরদিন নন্দন-লোকবাসী
(তব) সেই কলঙ্ক সে প্রেমের সম্মান॥

নয়নভরা জল গো তোমার আঁচল-ভরা ফুল

নয়নভরা জল গো তোমার আঁচল-ভরা ফুল।
ফুল নেব, না অশ্রু নেব ভেবে হই আকুল।
ফুল যদি নিই তোমার হাতে
জল রবে গো নয়ন-পাতে,
অশ্রু নিলে ফুটবে না আর প্রেমের মুকুল॥
মালা যখন গাঁথ তখন পাওয়ার সাধ যে জাগে
মোর বিরহে কাঁদ যখন আরও ভালো লাগে।
পেয়ে তোমায় যদি হারাই
দূরে দূরে থাকি গো তাই
(তাই) ফুল ফুটিয়ে যাই গো চলে চঞ্চল বুলবুল॥

পঞ্চ প্রাণের প্রদীপ-শিখায়

পঞ্চ প্রাণের প্রদীপ-শিখায়
লহো আমার শেষ আরতি।
ওগো আমার পরম-গতি
ওগো আমার পরম পতি॥
বহু সে কাল বাহির-দ্বারে
দাঁড়িয়ে আছি অন্ধকারে,
এবার দেহের দেউল ভেঙে
দেখব নিঠুর, তোমার জ্যোতি॥
আমি তোমায় চেয়েছিলাম, শুধু সেই সে অপরাধে
ধ্যান ভেঙেছ আমার, ফেলে নিত্য নূতন মায়ার ফাঁদে।
আজ মায়ার ঘরে আগুন জ্বেলে
পালিয়ে গেলাম পাখা মেলে,
জীবন যাহার মিথ্যা স্বপন
মরণ তার নাইকো ক্ষতি॥
কেটে দিলাম নিঠুর হাতে যে বাঁধনে বেঁধেছিলে,
রইল না আর আমার বলে কোনো স্মৃতি এ-নিখিলে।
আবার যদি তোমার মায়ায়
রূপ নিতে হয় নূতন কায়ায়,
তোমার প্রকাশ রুদ্ধ যেথায়
সেথায় যেন না হয় গতি॥

পদ্মার ঢেউ রে– ও মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যারে

পদ্মার ঢেউ রে–
ও মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যারে।
এই পদ্মে ছিল রে যার রাঙা পা
আমি হারায়েছি তারে॥
মোর পরান – বঁধু নাই,
পদ্মে তাই মধু নাই নাই রে–
বাতাস কাঁদে বাইরে–
সে সুগন্ধ নাই রে–
মোর রূপের সরসীতে আনন্দ-মৌমাছি নাহি ঝংকারে।
ও পদ্মারে, ঢেউয়ে তোর ঢেউ ওঠায় যেমন চাঁদের আলো
মোর বঁধুয়ার রূপ তেমনই ঝিলমিল করে কৃষ্ণ কালো।
সে প্রেমের ঘাটে ঘাটে বাঁশি বাজায়
যদি দেখিস তারে, দিস এই পদ্ম তার পায়
বলিস কেন বুকে আশার দেয়ালি জ্বালিয়ে
ফেলে গেল চির-অন্ধকারে॥

প্রদীপ নিভায়ে দাও, উঠিয়াছে চাঁদ

প্রদীপ নিভায়ে দাও, উঠিয়াছে চাঁদ।
বাহুর ডোর আছে, মালায় কী সাধ?
ফুল আনিয়ো না ভবনে
কেশের সুবাস তব ঘনাক মনে,
হৃদয়ের লাগি মোর হৃদয় কাঁদে
চন্দন লাগে বিস্বাদ॥
খোলো গুন্ঠন, ফেলে দাও আভরণ,
হাতে রাখো হাত, তোলো আনত নয়ন।
বাহিরে বহুক বাতাস
বক্ষে লাগুক মোর তব ঘন শ্বাস
চম্পার ডালে বসে মোদেরে দেখে
কুহু আর পাপিয়ায় করুক বিবাদ॥

 ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি

ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি?
ভোরের হাওয়ায় কান্না পাওয়ায় তব ম্লান ছবি।
যে বীণা তোমার পায়ের কাছে
বুকভরা সুর লয়ে জাগিয়া আছে,
তোমার পরশে ছড়াক হরষে
আকাশে-বাতাসে তার সুরের সুরভি।
তোমার যে প্রিয়া
গেল বিদায় নিয়া
অভিমানে রাতে
গোলাপ হয়ে কাঁদে তাহারই কামনা
উদাস প্রাতে।
ফিরে যে আসিবে না ভোলো তাহারে,
চাহো তাহার পানে দাঁড়ায়ে যে দ্বারে,
অস্ত-চাঁদের বাসনা ভোলাতে অরুণ অনুরাগে
উদিল রবি॥

বঁধু তোমার আমার এই যে বিরহ

বঁধু তোমার আমার এই যে বিরহ
এক জনমের নহে।
তাই যত কাছে পাই তত এ হিয়ায়
কী যেন অভাব রহে॥
বারে বারে মোরা কত সে ভুবনে আসি
দেখিয়া নিমেষে দুইজনে ভালোবাসি
দলিয়া সহসা মিলনের সেই মালা
(কেন) চলিয়া গিয়াছি দোঁহে॥
আমরা বুঝি গো বাঁধিব না ঘর, অভিশাপ বিধাতার
শুধু চেয়ে থাকি, কেঁদে কেঁদে ডাকি, চাঁদ আর পারাবার।
মোদের জীবন-মঞ্জরী দুটি হায়
কতবার ফোটে, কতবার ঝরে যায়
(বঁধু) আমি কাঁদি ব্রজে, তুমি কাঁদ মথুরায়,
(মাঝে) অপার যমুনা বহে॥

বন-বিহঙ্গ যাও রে উড়ে

বন-বিহঙ্গ! যাও রে উড়ে
মেঘনা নদীর পারে।
দেখা হলে আমার কথা
কইয়ো গিয়া তারে॥
কোকিল ডাকে বকুল-ডালে
যে মালঞ্চে সাঁঝ-সকালে
আমার বন্ধু কাঁদে সেথায়
গাঙেরই কিনারে॥
গিয়া তারে দিয়া আইস আমার শাপলা-মালা
আমার তরে লইয়া আইস তাহার বুকের জ্বালা।
সে যেন রে বিয়া করে
সোনার কন্যা আনে ঘরে
আমার পাটের জোড় পাঠাইয়া দিব সে কন্যারে॥

বন্ধু আজও মনে যে পড়ে আম-কুড়ানো খেলা

বন্ধু আজও মনে যে পড়ে আম-কুড়ানো খেলা।
আম কুড়াইবারে যাইতাম দুইজন নিশি ভোরের বেলা॥
জোষ্ঠিমাসের গুমোট রে বন্ধু আসত নাকো নিঁদ,
রাত্রে আসত নাকো নিঁদ,
আম-তলার এক চোর আইস্যা কাটত প্রাণের সিঁদ;
(আর) নিদ্রা গেলে ফেলত সে চোর আঙিনাতে ঢেলা॥
আমরা দুজন আম কুড়াইতাম, ডাকত কোকিল গাছে,
ভোলো যদি – বিহান বেলার সুর্যি সাক্ষী আছে।
(তুমি) পায়ের কাছে আম ফেইল্যা গায়ে দিতে ঠেলা॥
আমার বুকের আঁচল থাইক্যা কাইড়া নিতে আম
বন্ধু, আজও পায় নাই দাসী সেই না আমের দাম।
(আজ) দাম চাইবার গিয়া দেখি তুমি দিছ মেলা॥
নিশি জাইগ্যা বইস্যা আছি, জোষ্ঠি মাসের ঝড়ে
সেই না গাছের তলায় বন্ধু, এখনও আম পড়ে;
(আজ) তুমি কোথায় আমি কোথায়, দুইজনে একেলা॥

 বন্ধু দেখলে তোমায় বুকের মাঝে

বন্ধু! দেখলে তোমায় বুকের মাঝে
জোয়ার ভাটা খেলে।
আমি একলা ঘাটে কুলবধু, কেন তুমি এলে
বন্ধু, কেন তুমি এলে॥
আমার অঙ্গে কাঁটা দিয়ে ওঠে, বাজাও যখন বাঁশি ;
খিড়কি-দুয়ার দিয়ে বন্ধু জল ভরিতে আসি,
ভেসে নয়ন জলে ঘরে ফিরি, ঘাটে কলস ফেলে॥
আমার পাড়ায়, বন্ধু, তোমার নাম যদি লয় কেউ
বুকে আমার দুলে ওঠে পদ্মা নদীর ঢেউ।
ওগো ও চাঁদ, এনো না আর
দু-কূল-ভাঙা এমন জোয়ার ;
কত ছল করে জল লুকাই চোখের,
কাঁচা কাঠে আগুন জ্বেলে।

 বলেছিলে, তুমি তীর্থে আসিবে আমার তনুর তীরে

বলেছিলে, তুমি তীর্থে আসিবে আমার তনুর তীরে।
হায়! তুমি আসিলে না, আশার সূর্য ডুবিল সাগর-নীরে॥
চলে যাই যদি, চিরদিন মনে
তোমার সে কথা রহিবে স্মরণে
শুধু সেই কথা শোনার লাগিয়া হয়তো আসিব ফিরে॥
শুধু সেই আশে হয়তো এ তনু মরমে হবে না লীন,
পথ চেয়ে চেয়ে, তব নাম গেয়ে বাজাব বিরহ-বীণ।
হেরো গো, আমার যাবার সময় হল,
তোমার সে কথা মিথ্যা হবে না বলো,
কোন শুভক্ষণে নিমেষের তরে জড়াবে কন্ঠ ঘিরে॥

বসন্ত মুখর আজি

বসন্ত মুখর আজি
দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে
বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি॥
অকারণ ভাষা তার ঝরঝর ঝরে
মুহু মুহু কুহু কুহু পিয়া পিয়া স্বরে।
পলাশ বকুলে অশোক শিমূলে
সাজানো তাহার কল-কথার সাজি॥
দোয়েল মধুপ বন-কপোত কূজনে
ঘুম ভেঙে দেয় ভোরে বাসর-শয়নে।
মৌনী আকাশ সেই বাণী-বিলাসে
অস্ত চাঁদের মুখে মৃদু মৃদু হাসে
বিরহ-শীর্ণা গিরি-ঝরনার তীরে
পাহাড়ি বেণু হাতে ফেরে সুর ভাঁজি॥

বাজো বাঁশরি বাজো বাঁশরি বাজো বাঁশরি

বাজো বাঁশরি বাজো বাঁশরি বাজো বাঁশরি
সেই চির-চেনা সুরে।
যে সুরে বিরহী প্রাণ আজও ঝরে॥
যে সুরে হৃদয়ে হোরির রং লাগে
ভুলে যাওয়া যৌবন-স্মৃতি মনে জাগে,
আকাশ কাঁদে যে সকরুণ রাগে
যে সুর ঘুমায়ে আছে প্রিয়ার নূপুরে॥
যে সুর শুনি আজও পল্লির প্রান্তে
মল্লিকা-কুঞ্জে শ্রান্ত দিনান্তে
বিরহ বিধুর দূর হারানো দিনের
ছায়া ফেলে যে সুর মনের মুকুরে॥

বিদায়ের বেলা মোর ঘনায়ে আসে

পুরবি – তেতালা

বিদায়ের বেলা মোর ঘনায়ে আসে
দিনের চিতা জ্বলে অস্ত আকাশে।
দিনশেষে শুভদিন এল বুঝি মম,
মরণের রূপে এলে মোর প্রিয়তম,
গোধুলির রঙে তাই দশদিশি হাসে॥
দিন গুনে নিরাশার পথ-চাওয়া ফুরাল,
শ্রান্ত এ জীবনের জ্বালা আজ জুড়াল।
ওপার হতে সে এল তরি বাহি।
হেরিলাম সুন্দরে, আর ভয় নাহি।
আঁধারের পারে তার চাঁদমুখ ভাসে॥

বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে

নৌরোচ্‌কা – তেতালা

বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে
ঝরা বন-গোলাপের বিলাপ শোনে॥
শিরাজের নওরোজে ফাল্গুন মাসে
যেন তার প্রিয়ার সমাধি পাশে
তরুণ ইরান-কবি কাঁদে নিরজনে॥
উদাসীন আকাশ থির হয়ে আছে
জল-ভরা মেঘ লয়ে বুকের কাছে।
সাকির শারাবের পিয়ালার পরে
সকরুণ অশ্রুর বেলফুল ঝরে
চেয়ে আছে ভাঙা চাঁদ
মলিন আননে॥

বেদিয়া বেদিনি ছুটে আয় আয় আয় আয়

বেদিয়া বেদিনি ছুটে আয় আয় আয় আয়।
ধাতিনা ধাতিনা তিনা ঢোলক মাদল বাজে
বাঁশিতে পরান মাতায়॥
দলে দলে নেচে নেচে আয় চলে
আকাশের শামিয়ানা তলে
বর্শা তির ধনুক ফেলে আয় আয় রে
হাড়ের নূপুর পরে পায়॥
বাঘ-ছাল পরে আয় হৃদয়-বনের শিকারি
ঘাঘরা পরে, পরে পলার মালা
আয় বেদের নারী।
মহুয়ার মউ নিয়ে ধুতুরা ফুলের পিয়ালায়
আয় আয় আয়॥

ভোরে ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে কে

ভোরে ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে কে
কে ভ্রমর-কুন্তলা কিশোরী
ফুল দেখে বেভুল সিনান ‘বিসরি’
একী নতুন লীলা আঁখিতে দেখি ভুল
কমল ফুল যেন তোলে কমল ফুল
ভাসায়ে আকাশ-গাঙে অরুণ-গাগরি॥
ঝিলের নিথর জলে আবেশে ঢলঢল
গলে পড়ে শত সে তরঙ্গে
শারদ আকাশে দলে দলে আসে
মেঘ-বলাকার খেলিতে সঙ্গে॥
আলোক-মঞ্জরী প্রভাতবেলা
বিকশি জলে কি গো করিছে খেলা
বুকের আঁচলে ফুল উঠিছে শিহরি॥

 মনে পড়ে আজও সেই নারিকেল কুঞ্জ

মনে পড়ে আজও সেই নারিকেল কুঞ্জ গুবাক তরুর ঘন-কেয়ারি
বালুচর, বেত বন, দেখা হত দুইজন, মন হত উনমন দোঁহারি॥
গাছ থেকে টুপটাপ ঝরিত কালো জাম
জাম খেয়ে চুপচাপ মেঘ পানে চাহিতাম,
গাব নিয়ে কাড়াকাড়ি, ভাব হত, হত আড়ি দুজনে,
আমি ছিনু ধনিকের ছেলে গো
ছিলে ভুঁইমালিদের তুমি ঝিয়ারি॥
ভুঁইমালিদের ঘরে ভুঁইচম্পার কলি ডুমা-পরা উমা-সম খেলিতে
আমার দালান ঘরে – দোতালায় কেন গো উতলা মনে ছায়া ফেলিতে
সহসা হেরিনু তব বধূরূপ, ভাঙা চালা হাতে তব চালুনি
পার্শ্বে দামাল ছেলে কাঁদিছে হেরিয়া পান্তভাত আলুনি
ঘোমটা টানিয়া দিলে আমারে হেরিয়া
উদাস চোখে এল কালো মেঘ ঘেরিয়া,
তারে চিনিতে কি পেরেছিলে প্রণাম যে করেছিল
কল্যাণী রূপ তব নেহারি॥

 মেঘ-মেদুর বরষার কোথা তুমি

মেঘ-মেদুর বরষার কোথা তুমি
ফুল ছড়ায়ে কাঁদে বনভূমি।
ঝুরে বারিধারা,
ফিরে এসো পথহারা,
কাঁদে নদীতট চুমি॥

মেঘলা নিশি-ভোরে মন যে কেমন করে

মেঘলা নিশি-ভোরে
মন যে কেমন করে,
তারই তরে গো, মেঘবরন যার কেশ।
বুঝি তাহারই লাগি
হয়েছে বৈরাগী
গেরুয়া-রাঙা গিরিমাটির দেশ॥
মৌরি ফুলের খেতে, মৌমাছি ওঠে মেতে,
এলিয়েছিল কেশ কি গো তার এই পথে সে যেতে।
তার ডাগর চোখের ঝিলিক লেগে রাত হয়েছে শেষ (গো)॥
শিরীষ পাতায় ঝিরিঝিরি, বাজে নূপুর তারই,
সোনার ডালে দোলে তাহার কামরাঙা-রং শাড়ি।
হয়েছে মন ভিখারি–
মন শিকারি আমি
উঠি পাহাড় চূড়ায়–
ঝরনা-জলে নামি,
কালো পাথর দেখে জাগে কার চোখের আবেশ (গো)॥

মোমতাজ মোমতাজ তোমার তাজমহল

মোমতাজ! মোমতাজ! তোমার তাজমহল
(যেন) বৃন্দাবনের একমুঠো প্রেম, ফিরদৌসের একমুঠো প্রেম
আজও করে ঝলমল॥
কত সম্ম্রাট হল ধূলি স্মৃতির গোরস্থানে
পৃথিবী ভুলিতে নারে প্রেমিক শাজাহানে।
শ্বেত মর্মরে সেই বিরহীর ক্রন্দন-মর্মর
গুঞ্জরে অবিরল॥
কেমনে জানিল শাজাহান, প্রেম পৃথিবীতে মরে যায়!
(তাই) পাষাণ প্রেমের স্মৃতি রেখে গেল পাষাণে লিখিয়া হায়!
(যেন) তাজের পাষাণ অঞ্জলি লয়ে নিঠুর বিধাতা পানে
অতৃপ্ত প্রেম বিরহী-আত্মা আজও অভিযোগ হানে,
(বুঝি) সেই লাজে বালুকায় মুখ লুকাইতে চায়
শীর্ণা যমুনা-জল॥

মোর গানের কথা যেন আলোকলতা

মোর গানের কথা যেন আলোকলতা
যেন স্বর্ণলতা।
মূল নাই ফুল নাই আছে শুধু
বর্ণের বিহ্বলতা॥
আকাশ-বনস্পতি জড়ায়ে
ধরনির বুকে পড়ে গড়ায়ে
কখন কি আবেশে কার কথা ভাবে সে
কে জানে কেন অযথা॥
রহে কারও বক্ষে, রহে কারও চক্ষে বিরহের অশ্রুজলে
কন্ঠলগ্না কারও রহে সে গীত-কলি মুঞ্জরে অধরতলে।
রাখি হয়ে কারও হাত বাঁধে সে
কাহারও চরণতলে কাঁদে সে
সুরে সুরে গুঞ্জিত ও যেন পুঞ্জিত
অকারণ মৌন ব্যথা॥

 মোর প্রিয়া হবে এসো রানি

মোর প্রিয়া হবে, এসো রানি,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির
চৈতি চাঁদের দুল॥
কন্ঠে তোমার পরাব বালিকা
হংস-সারির দুলানো মালিকা
বিজলি-জরিন ফিতায় বাঁধিব
মেঘ-রং এলোচুল॥
জ্যোৎস্নার সাথে চন্দন দিয়ে
মাখাব তোমার গায়,
রামধনু হতে লাল রং ছানি
আলতা পরাব পায়।
আমার গানের সাত সুর দিয়া
তোমার বাসর রচিব প্রিয়া,
তোমারে ঘিরিয়া গাহিবে আমার
কবিতার বুলবুল॥

মোর ভুলিবার সাধনায় কেন সাধো বাদ

মোর ভুলিবার সাধনায় কেন সাধো বাদ?
কেন নিরাশা-আঁধারে জ্বালো আশার চাঁদ॥
যে প্রেম লভিয়াছে সমাধি
কী হবে সেথায় আর কাঁদি
বাঁচিবে না নয়নের জলে সে
পুড়ে ছাই হয়ে গেছে যার সুখ-সাধ॥
যে তরুর কাটিয়াছে মূল, কেন ফুল সেথা চাও
নির্জন অরণ্যে বিরহ-তাপে তারে শুকাইতে দাও।
শুভ লগ্নের ক্ষণ ভুবনে
একবার আসে শুধু জীবনে
বয়ে গেছে সেই শুভদৃষ্টির শুভক্ষণ
আর পাইব না তব আঁখির প্রসাদ॥

মোর স্বপনে যেন বাজিয়েছিলে করুণ রাগিণী

মোর স্বপনে যেন বাজিয়েছিলে করুণ রাগিণী।
হে রূপকুমার! ঘুমিয়েছিলাম
সেদিন জাগিনি॥
যেন আধোঘুমের ঘোরে
দেখেছিলাম চুরি করে–
চাইতে গিয়ে চোখের জলে
চাইতে পারিনি॥
তন্দ্রা আমার টুটল তবু শরম ভরে
(হে) চির-চাওয়া! পারিনিকো ডাকতে আদরে।
চেয়ে চেয়ে আমার পানে
চলে গেলে অভিমানে,
(তোমার) পথের ধূলি হইনি কেন
হতভাগিনি॥

মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম নদীর চরে

মোরা আর জনমে হংস-মিথুন ছিলাম নদীর চরে
যুগলরূপে এসেছি গো আবার মাটির ঘরে॥
তমালতরু চাঁপালতার মতো
জড়িয়ে কত জনম হল গত,
সেই বাঁধনের চিহ্ন আজও জাগে
জাগে হিয়ার থরে থরে॥
বাহুর ডোরে বেঁধে আজও ঘুমের ঘোরে যেন
ঝড়ের বন-লতার মতো লুকিয়ে কাঁদ কেন?
বনের কপোত, কপোতাক্ষীর তীরে
পাখায় পাখায় বাঁধা ছিলাম নীড়ে
চিরতরে হল ছাড়াছাড়ি
(কোন) নিঠুর ব্যাধের শরে॥

যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে

যখন আমার গান ফুরাবে তখন এসো ফিরে।
ভাঙবে সভা, বসব একা রেবা-নদীর তীরে–
তখন এসো ফিরে॥
গীত শেষে গগন-তলে
শ্রান্ত তনু পড়বে ঢলে
ভালো যখন লাগবে না আর সুরের সারেঙ্গিরে
তখন এসো ফিরে॥
মোর কন্ঠের জয়ের মালা তোমার গলায় নিয়ো
ক্লান্তি আমার ভুলিয়ে দিয়ো, প্রিয় হে মোর প্রিয়।
ঘুমাই যদি কাছে ডেকো
হাতখানি মোর হাতে রেখো
জেগে যখন খুঁজব তোমায় আকুল অশ্রুনীরে–
তখন এসো ফিরে॥

যবে ভোরের কুন্দ-কলি মেলিবে আঁখি

যবে ভোরের কুন্দ-কলি মেলিবে আঁখি
ঘুম ভাঙায়ে হাতে বাঁধিয়ো রাখি॥
রাতের বিরহ যবে প্রভাতে নিবিড় হবে
অকরুণ কলরবে গাহিবে পাখি।
ঘুম ভাঙায়ে হাতে বাঁধিয়ো রাখি॥
যেন অরুণ দেখিতে গিয়া তরুণ কিশোর
তোমারে প্রথম হেরি ঘুম ভাঙে মোর,
করবীর মঞ্জরী আঙিনায় রবে ঝরি
সেই ফুল পায়ে দলি এসো একাকী,
ঘুম ভাঙায়ে হাতে বাঁধিয়ো রাখি॥

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে।
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে॥
আমি গান গাহি আপনার দুখে
তুমি কেন আসি দাঁড়াও সুমুখে
আলেয়ার মত ডাকিয়ো না আর
নিশীথ অন্ধকারে॥
দয়া করো, দয়া করো, আর আমারে লইয়া
খেলো না নিঠুর খেলা;
শত কাঁদিলেও ফিরিবে না
সেই শুভলগনের বেলা॥
আমি ফিরি পথে, তাহে কার ক্ষতি
তব চোখে কেন সজল মিনতি
আমি কি ভুলেও কোনোদিন এসে
দাঁড়ায়েছি তব দ্বারে॥
ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে॥

রাঙা মাটির পথে লো মাদল বাজে

রাঙা মাটির পথে লো মাদল বাজে
বাজে বাঁশের বাঁশি।
বাঁশি বাজে বুকের মাঝে লো, মন লাগে না কাজে লো,
রইতে নারি ঘরে ওলো প্রাণ হল উদাসী লো।
মাদলিয়ার তালে তালে অঙ্গ ওঠে দুলে,
দোল লাগে শাল-পিয়াল বনে নোটন খোঁপার ফুলে।
মহুয়া বনে লুটিয়ে পড়ে মাতাল চাঁদের হাসি লো॥
চোখে ভালো লাগে যাকে–
তাকে দেখব পথের বাঁকে,
তার চাঁচর কেশে পরিয়ে দেব ঝুমকো জবার ফুল,
তার গলার মালার কুসুম কেড়ে করব কানের দুল।
তারে নাচের তালে ইশারাতে বলব ভালোবাসি লো॥

রিম ঝিম রিম ঝিম ঝিম ঘন দেয়া বরষে

রিম ঝিম রিম ঝিম ঝিম ঘন দেয়া বরষে
কাজরি নাচিয়া চল পুরনারী হরষে॥
কদম তমাল ডালে দোলনা দোলে
–কুহু পাপিয়া ময়ূর বোলে।
মনের বনের মুকুল খোলে, নটশ্যাম সুন্দর–
মেঘ পরশে॥
হৃদয়-যমুনা আজ কূল জানে না গো
মনের রাধা আজ বাধা মানে না গো
ডাকিছে ঘর-ছাড়া ঝড়ের বাঁশি,
অশনি আঘাত হানে দুয়ারে আসি
গজরাক গুরুজন ভবনবাসী
আমরা বাহিরে যাব ঘনশ্যাম দরশে॥

রুম ঝুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম ঝুম

রুম ঝুম ঝুম ঝুম রুম ঝুম ঝুম
খেজুর পাতার নূপুর বাজায়ে কে যায়।
ওড়না তাহার ঘূর্ণি হাওয়ায় দোলে
কুসুম ছড়ায় পথের বালুকায়॥
তার ভুরুর ধনুক বেঁকে ওঠে
তনুর তলোয়ার,
সে যেতে যেতে ছড়ায় পথে
পাথরকুচির হার।
তার ডালিম-ফুলের ডালি
গোলাপ-গালের লালি
(যেন) ঈদের চাঁদও চায়॥
আরবি ঘোড়ার সওয়ার হয়ে, বাদশাজাদা বুঝি
সাহারাতে ফেরে কোন মরীচিকায় খুঁজি।
কত তরুণ মুসাফির পথ হারাল হায়,
কত বনের হরিণ মরে তারই রূপ-তৃষায়॥

 রূপের দীপালি-উৎসব আমি দেখেছি তোমার অঙ্গে

রূপের দীপালি-উৎসব আমি দেখেছি তোমার অঙ্গে।
শত ফুলশর মুরছায় প্রিয়া, তোমার নয়নভঙ্গে॥
যে আঁখি পরম সুন্দরে দেখিয়াছে
সেই আঁখি কাঁদে তোমার পায়ের কাছে,
দেখেছে সে আঁখি, বিশ্ব দুলিছে তোমার রূপ-তরঙ্গে॥
তোমারে দেখিতে আমার আকাশ আনত হইয়া কাঁদে,
(তব) মণিহার হতে বিবাদ করে গো কোটি গ্রহ-তারা চাঁদে।
তুমি দেখিতে যদি গো আপন রূপের আলো
আমারে ভুলিয়া নিজেরে বাসিতে ভালো,
তোমারে আড়াল করিয়া গো তাই ছায়া-সম ফিরি সঙ্গে॥

রেশমি রুমালে কবরী বাঁধি

রেশমি রুমালে কবরী বাঁধি
নাচিছে আরবি নটিনি বাঁদি॥
বেদুইন সুরে বাঁশি বাজে
রহিয়া রহিয়া তাঁবু-মাঝে সুদুরে
সে সুরে চাহে বোরখা তুলিয়া শাহাজাদি॥
যৌবন-সুন্দর নোটন কবুতর
নাচিছে মরু-নটী
গাল যেন গোলাপ, কেশ যেন খেজুর-কাঁদি॥
চায় হেসে হেসে চায় মদির চাওয়ায়,
দেহের দোলায় রং ঝরে যায়, ঝরঝর
ছন্দে দুলে ওঠে মরু মাঝে আঁখি॥

শাওন আসিল ফিরে সে ফিরে এল না

শাওন আসিল ফিরে, সে ফিরে এল না
বরষা ফুরায়ে গেল, আশা তবু গেল না॥
ধানির-রং ঘাঘরি, মেঘ-রং ওড়না
পরিতে আমারে মা গো অনুরোধ কোরো না
কাজরির কাজলা মেঘ পথ পেল খুঁজিয়া
সে কি ফেরার পথ পেল না মা, পেল না॥
আমার বিদেশিরে চিনিতে অনুক্ষণ
বুনো হাঁসের পাখার মতো উড়ু উড়ু করে মন।
অথৈ জলে মা গো মাঠ ঘাট থই থই,
আমার হিয়ার আগুন নিভিল কই,
কদম-কেশর বলে, ‘কোথা তোর কিশোর’,
চম্পা ডালে দোলে শূন্য দোলনা।

শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে

শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে
বাহিরে ঝড় বহে, নয়নে বারি ঝরে॥
ভুলিয়ো স্মৃতি মম, নিশীথ-স্বপন-সম
আঁচলের গাঁথা মালা ফেলিয়ো পথ পরে॥
ঝুরিবে পুবালি বায় গহন দূর বনে
রহিবে চাহি তুমি একেলা বাতায়নে।
বিরহী কুহু-কেকা গাহিবে নীপ-শাখে
যমুনা-নদীপারে শুনিবে কে যেন ডাকে।
বিজলি দীপ-শিখা খুঁজিবে তোমায় প্রিয়া
দু-হাতে ঢেকো আঁখি যদি গো জলে ভরে॥

শুকনো পাতার নুপুর বাজে

শুকনো পাতার নুপুর বাজে
দখিন বায়ে!
কে এলে গো কে এলে গো চপল পায়ে॥
ছায়া-ঢাকা আমের ডালে চপল আঁখি
উঠল ডাকি বনের পাখি উঠল ডাকি
নতুন চাঁদের জ্যোৎস্না মাখি
সোনার শাখায় দোল দুলায়ে॥
সুনীল তোমার ডাগর চোখের দৃষ্টি পিয়ে
সাগর দোলে আকাশ ওঠে ঝিলমিলিয়ে।
পিয়াল বনে উঠল বাজি তোমার বেণু,
ছড়ায় পথে কৃষ্ণচূড়া পরাগ-রেণু
ময়ূর-পাখা বুলিয়ে চোখে কে গো দিল ঘুম ভাঙায়ে।

শোক দিয়েছ তুমি হে নাথ

শোক দিয়েছ তুমি হে নাথ, তুমি এ প্রাণে শান্তি দাও!
দুখ দিয়ে কাঁদালে যদি তুমি হে নাথ সে দুখ ভোলাও!
যে হাত দিয়ে হানলে আঘাত
(তুমি) অশ্রু মোছাও সেই হাতে নাথ,
বুকের মানিক হরলে যার–
তারে তোমার শীতল বক্ষে নাও॥
তোমার যে চরণ প্রলয় ঘটায়
সেই চরণ কমল ফোটায়।
শূন্য করলে তুমি যে বুক
সেথা তুমি এসে বুক জুড়াও॥

 সন্ধ্যা নেমেছে আমার বিজন ঘরে

সন্ধ্যা নেমেছে আমার বিজন ঘরে, তব গৃহে জ্বলে বাতি
ফুরায় তোমার উৎসব নিশি সুখে, পোহায় না মোর রাতি,
প্রিয়া পোহায় না মোর রাতি॥
আমার আশার ঝরাফুল দিয়া
তোমার বাসর-শয্যা রচিছ প্রিয়া
তোমার ভবনে আলোর দীপালি জ্বলে,–
আঁধার আমার সাথি।
প্রিয়া পোহায় না মোর রাতি॥
ঘুমায়ে পড়েছে আমার কাননে কুহু, নীরব হয়েছে গান,
তোমার কুঞ্জে গানের পাখিরা বুঝি তুলিয়াছে কলতান।
পৃথিবীর আলো মোর চোখে নিভে আসে
বাজিয়ে বাঁশরি তোমার মিলন-রাসে
ওপারের বাঁশি আমারে ডাকিবে কবে
আছি তাই কান পাতি।
প্রিয়া পোহায় না মোর রাতি॥

সবার কথা কইলে কবি, নিজের কথা কহো

সবার কথা কইলে কবি, নিজের কথা কহো।
(কেন) নিখিল ভুবন অভিমানের আগুন দিয়ে দহ।
নিজের কথা কহো॥
কে তোমারে হানল হেলা, কবি?
সুরে সুরে আঁক কি গো সেই বেদনার ছবি
কার বিরহ রক্ত ঝরায় বক্ষে অহরহ–
নিজের কথা কহো॥
(কোন) ছন্দোময়ীর ছন্দ দোলে তোমার গানে গানে
তোমার সুরের স্রোত বয়ে যায় কাহার প্রেমের টানে গো
কাহার চরণ পানে?
কাহার গলায় ঠাঁই পেল না বলে
(তব) কথার মালা ব্যথার মতো প্রতি হিয়ায় দোলে।
(তোমার) হাসিতে যে বাঁশি বাজে, সে তো তুমি নহ
নিজের কথা কহো॥

সাপুড়িয়া রে বাজাও বাজাও

সাপুড়িয়া রে ! বাজাও বাজাও
সাপ খেলানোর বাঁশি
কালিদহে ঘোর উঠিল তরঙ্গ
কালনাগিনি নাচে বাহিরে আসি॥
ফণি-মনসার কাঁটা কুঞ্জতলে,
গোখরো কেউটে এল দলে দলে রে,
সুর শুনে ছুটে এল পাতাল-তলের
বিষধর, বিষধরী রাশি রাশি॥
শন শন শন শন পূব হাওয়াতে
তোমার বাঁশি বাজে বাদলা রাতে,
মেঘের ডমরু বাজাও গুরু গুরু বাঁশির সাথে।
অঙ্গ জরজর বিষে,
বাঁচাও বিষহরি এসে,
একী বাঁশি বাজালে কালা
সর্বনাশী॥

 সেই মিঠে সুরে মাঠের বাঁশরি বাজে

সেই মিঠে সুরে মাঠের বাঁশরি বাজে।
নিঝুম নিশীথে ব্যথিত বুকের মাঝে॥
মনে পড়ে যায় সহসা কখন
জল-ভরা দুটি ডাগর নয়ন
পিঠ-ভরা চুল সেই চাঁপা ফুল
ফেলে ছুটে যাওয়া লাজে॥
হারানো সে দিন পাব না গো আর ফিরে
দেখিতে পাব না আর সেই কিশোরীরে।
তবু মাঝে মাঝে আশা জাগে কেন
আমি ভুলিয়াছি ভোলেনি সে যেন,
গোমতীর তীরে পাতার কুটিরে
আজও পথ চাহে সাঁঝে।
(সে) আজও পথ চাহে সাঁঝে॥

সেদিন ছিল কি গোধূলি-লগন

সেদিন ছিল কি গোধূলি-লগন
শুভদৃষ্টির ক্ষণ?
চেয়েছিল মোর নয়নের পানে যেদিন তব নয়ন॥
সেদিন বকুল শাখে কি গো আঙিনাতে
ডেকে উঠেছিল কুহু-কেকা এক সাথে,
অধীর নেশায় দুলে উঠেছিল মনের মহুয়া বন॥
হে প্রিয়, সেদিন আকাশ হতে কি তারা পড়েছিল ঝরে,
যেদিন প্রথম ডেকেছিলে তুমি মোর ডাকনাম ধরে?
(প্রিয়) যেদিন প্রথম ছুঁয়েছিলে ভালোবেসে
আকাশে কি বাঁকা চাঁদ উঠেছিল হেসে?
শঙ্খ সেদিন বাজায়েছিল কি পাষাণের নারায়ণ॥

স্বপ্নে দেখি একটি নতুন ঘর

স্বপ্নে দেখি একটি নতুন ঘর!
তুমি আমি দু-জন প্রিয়, তুমি আমি দু-জন।
বাহিরে বকুল-বনে কুহু পাপিয়ায়
করে কুজন।
আবেশে ঢুলি ফুল-শয্যায় শুই
মুখ টিপে হাসে মল্লিকা জুঁই,
কানে কানে গানে গানে কহে, ‘চিনেছি উতল সমীরণ॥’
পূর্ণিমা চাঁদ কয়, গান আর সুর চঞ্চল, ওরা দুজন!
প্রেম জ্যোতি আনন্দ অবিরল ছলছল ওরা দুজন!
মৌমাছি কয় গুনগুন গান গাই
মুখোমুখি দুজনে সেইখানে যাই,
শারদীয়া শেফালি গায়ে পড়ে কয়–
‘ব্রজের মধুবন এই তো ব্রজের মধুবন।’

হে অশান্তি মোর এসো এসো

হে অশান্তি মোর এসো এসো!
(তব) প্রবল প্রেমের লাগি ভবন হতে, বৈরাগিনী বেশে
এসেছি বাহির পথে।
কুণ্ঠা ভুলায়ে দাও, খোলো গুন্ঠন,
দস্যু-সম মোরে করো লুন্ঠন,
তৃণ-সম মোরে ভাসাইয়া লয়ে যাও
কূল-ভাঙা বিপুল বন্যা-স্রোতে॥
নদী যেমন করে টানে পারাবার,
তেমনি মরণ-টানে আমারে টানো, হে বন্ধু আমার!
প্রলয়-মেঘের বুকে বিজলি-সম
তোমারে জড়ায়ে রব হে প্রিয়তম!
হবে শুভদৃষ্টি তোমায় আমায়
মরণ-হানা অশনির-আলোতে॥

Exit mobile version