Site icon BnBoi.Com

বিষের বাঁশি – কাজী নজরুল ইসলাম

বিষের বাঁশি - কাজী নজরুল ইসলাম

অভিশাপ

আমি বিধির বিধান ভাঙিয়াছি, আমি এমনি শক্তিমান!
মম চরণের তলে, মরণের মার খেয়ে মরে ভগবান।

আদি ও অন্তহীন
আজ মনে পড়ে সেই দিন –
প্রথম যেদিন আপনার মাঝে আপনি জাগিনু আমি,
আর চিৎকার করি কাঁদিয়া উঠিল তোদের জগৎ-স্বামী।
ভয়ে কালো হয়ে গেল আলো-মুখ তার।
ফরিয়াদ করি গুমরি উঠিল মহা-হাহাকার –
ছিন্ন-কণ্ঠে আর্ত কণ্ঠে তোমাদের ওই ভীরু বিধাতার –
আর্তনাদের মহা-হাহাকার –
যে, ‘বাঁচাও আমারে বাঁচাও হে মোর মহান, বিপুল আমি!
হে মোর সৃষ্টি! অভিশাপ মোর!
আজি হতে প্রভু তুমি হও মম স্বামী!’ –
শুনি খলখলখল অট্ট হাসিনু, আজিও সে হাসি বাজে
ওই অগ্ন্যুদ্‌গার-উল্লাসে আর নিদাঘ-দগ্ধ
বিনা-মেঘের ওই শুষ্ক বজ্র-মাঝে!
স্রষ্টার বুকে আমি সেই দিন প্রথম জাগানু ভীতি, –
সেই দিন হতে বাজিছে নিখিলে ব্যথা-ক্রন্দন গীতি!
জাপটি ধরিয়া বিধাতারে আজও পিষে মারি পলে পলে,
এই কালসাপ আমি, লোকে ভুল করে মোরে অভিশাপ বলে।

 অভয়-মন্ত্র

বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়!
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়!
কোরাস : বল, হউক গান্ধি বন্দি, মোদের সত্য বন্দি নয়।
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ পুরুষোত্তম জয়।
তুই নির্ভর কর আপনার পর,
আপন পতাকা কাঁধে তুলে ধর!
ওরে যে যায় যাক সে, তুই শুধু বল, ‘আমার হয়নি লয়’!
বল, ‘আমি আছি’, আমি পুরুষোত্তম, আমি চির-দুর্জয়।
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …

তুই চেয়ে দেখ ভাই আপনার মাঝে,
সেথা জাগ্রত ভগবান রাজে,
নিজ বিধাতারে মান, আকাশ গলিয়া ক্ষরিবে রে বরাভয়!
তোর বিধাতার ধাতা বিধাতা, বিধাতা কারারুদ্ধ কি হয়?
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …

আজ বক্ষের তোর ক্ষীরোদ-সাগরে
অচেতন নারায়ণ ঘুম-ঘোরে
শুধু লক্ষ্মীর ভোগ লক্ষ্য তাঁহার, নয় কিছুতেই নয়!
তোর অচেতন চিতে জাগারে চেতনা নারায়ণ চিন্ময়।
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …

ওই নির্যাতকের বন্দি-কারায়
সত্য কি কভু শক্তি হারায়?
ক্ষীণ দুর্বল বলে খণ্ড ‘আমি’র হয় যদি পরাজয়,
ওরে অখণ্ড আমি চির-মুক্ত সে, অবিনাশী অক্ষয়!
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …

ওরে সত্য যে চির-স্বয়ম্ প্রকাশ,
রোধিবে কি তারে কারাগার-ফাঁস?
ওই অত্যাচারীর সত্য পীড়ন? আছে তার আছে ক্ষয়!
সেই সত্য মোদের ভাগ্য-বিধাতা, যাঁর হাতে শুধু রয়।
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …

যে গেল সে নিজেরে নিঃশেষ করি
তাদের পাত্র দিয়া গেল ভরি!
ওই বন্ধু মৃত্যু পারেনিকো তাঁরে পারেনি করিতে লয়!
তাই আমাদের মাঝে নিজেরে বিলায়ে সে আজ শান্তিময়!
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …

ওরে রুদ্র তখনই ক্ষুদ্রেরে গ্রাসে
আগেই যবে সে মরে থাকে ত্রাসে,
ওরে আপনার মাঝে বিধাতা জাগিলে বিশ্বে সে নির্ভয়!
ওই শূদ্র-কারায় কভু কি ভয়াল ভৈরব বাঁধা রয়?
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …

ওই টুটে-ফেটে-পড়া লোহার শিকল,
ভগবানে বেঁধে করিবে বিকল?
ওই কারা ওই বেড়ি কভু কি বিপুল বিধাতার ভার সয়?
ওরে যে হয় বন্দি হতে দে, শক্তি আত্মার আছে জয়।
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়। …

ওরে আত্ম-অবিশ্বাসী, ভয়-ভীত!
কেন হেন ঘন অবসাদচিত?
বল পর-বিশ্বাসে পর-মুখপানে চেয়ে কি স্বাধীন হয়?
তুই আত্মাকে চিন, বল ‘আমি আছি’, ‘সত্য আমার জয়’!
বল, নাহি ভয়, নাহি ভয়,
বল, মাভৈঃ মাভৈঃ, জয় সত্যের জয়।
বল, হউক গান্ধি বন্দি, মোদের সত্য বন্দি নয়!

আত্মশক্তি

এসো বিদ্রোহী মিথ্যা-সূদন আত্মশক্তি বুদ্ধ বীর!
আনো উলঙ্গ সত্যকৃপাণ, বিজলি-ঝলক ন্যায়-অসির।

তূরীয়ানন্দে ঘোষো সে আজ
‘আমি আছি’– বাণী বিশ্ব-মাঝ,
পুরুষ-রাজ!
সেই স্বরাজ!

জাগ্রত করো নারায়ণ-নর নিদ্রিত বুকে মর-বাসীর;
আত্ম-ভীতু এ অচেতন-চিতে জাগো ‘আমি-স্বামী নাঙ্গা-শির’…

এসো প্রবুদ্ধ, এসো মহান
শিশু-ভগবান জ্যোতিষ্মান।
আত্মজ্ঞান-
দৃপ্ত-প্রাণ!

জানাও জানাও, ক্ষুদ্রেরও মাঝে রাজিছে রুদ্র তেজ রবির !!
উদয়-তোরণে উড়ুক আত্ম-চেতন-কেতন ‘আমি-আছি’-র

করহ শক্তি-সুপ্ত-মন
রুদ্র বেদনে উদ্‌বোধন,
হীন রোদন –
খিন্ন-জন

দেখুক আত্মা-সবিতার তেজ বক্ষে বিপুলা ক্রন্দসীর!
বলো, নাস্তিক হউক আপন মহিমা নেহারি শুদ্ধ ধীর!

কে করে কাহারে নির্যাতন
আত্ম-চেতন স্থির যখন?
ঈর্ষা-রণ
ভীম-মাতন
পদাঘাত হানে পঞ্জরে শুধু আত্ম-বল-অবিশ্বাসীর,
মহাপাপী সেই, সত্য যাহার পর-পদানত আনত শির।

জাগাও আদিম স্বাধীন প্রাণ,
আত্মা জাগিলে বিধাতা চান।
কে ভগবান? –
আত্ম-জ্ঞান!

গাহে উদ্‌গাতা ঋত্বিক গান অগ্নি-মন্ত্র শক্তি-শ্রীর।
না জাগিলে প্রাণে সত্য চেতনা, মানি না আদেশ কারও বাণীর !

এসো বিদ্রোহী তরুণ তাপস আত্মশক্তিবুদ্ধ বীর,
আনো উলঙ্গ সত্য-কৃপাণ বিজলি-ঝলক ন্যায়-অসির॥

আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ!

আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ!
গাইবি আবার কণ্ঠছেঁড়া বিষ-অভিশাপ-সিক্ত গান।
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

আয় রে আমার বাঁধন-ভাঙার তীব্র সুখ
জড়িয়ে হাতে কালকেউটে গোখরো নাগের
পীত চাবুক!
হাতের সুখে জ্বালিয়ে দে তোর সুখের বাসা ফুল-বাগান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

বুঝিসনি কি কাঁদায় তোরে তোরই প্রাণের সন্ন্যাসী!
তোর অভিমান হল শেষে তোরই গলার নীল ফাঁসি!
(তোর) হাসির বাঁশি আনলে বুকে যক্ষ্মা-রুগির রক্ত-বান,
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

ফানুস-ফাঁপা মানুষ দেখে, হায় অবোধ
ছুটে এলি ছায়ার আশায়,
মাথায় তেমনি জ্বলছে রোদ।
ফাঁকির ফানুস ছাই হল তোর,
খুঁজিস এখন রোদ-শ্মশান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

তুই যে আগুন, জল-ধারা চাস কার কাছে?
বাষ্প হয়ে যায় উড়ে জল সাগর-শোষা তোর আঁচে।
ফুলের মালার হুলের জ্বালায় জ্বলবি কত অগ্নি-ম্লান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

অগ্নি-ফণী! বিষ-রসানো জিহ্বা দিয়ে দিস চুমা,
পাহাড়-ভাঙা জাপটানি তোর – ভাবিস সোহাগ-সুখ-ছোঁওয়া!
মৃত্যুও যে সইতে নারে তোর সোহাগের মৃত্যু টান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

সুখের লালস শেষ করে দে, স্বার্থপর!
কাল-শ্মশানের প্রেত-আলেয়া! তুই কোথা বল
বাঁধবি ঘর?
ঘর-পোড়ানো ত্রাস-হানা তুই সর্বনাশের লাল-নিশান!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

তোর তরে নয় শীতল ছায়া,
পান্থ-তরুর প্রেম-আসার,
তুই যে ঘরের শান্তি-শত্রু,
রুদ্র শিবের চণ্ড মার।
প্রেম-স্নেহ তোর হারাম যে রে
কসাই-কঠিন তুই পাষাণ!
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

সাপ ধরে তুই চাপবি বুকে
সইবে না তোর ফুলের ঘা,
মারতে তোকে বাজ পাবে লাজ
চুমুর সোহাগ সইবে না!
ডাক-নামে ডাক তোর তরে নয়,
আহ্বান তোর ভীম কামান।
আয় রে চির-তিক্ত প্রাণ!

ফণীমনসার কাঁটার পুরে
আয় ফিরে তুই কালফণী,
বিষের বাঁশি বাজিয়ে ডাকে নাগমাতা –
‘আয় নীলমণি!’
ক্ষুদ্র প্রেমের শূদ্রামি ছাড়,
ধর খ্যাপা তোর অগ্নি-বাণ!
আয় রে আবার আমার চির-তিক্ত প্রাণ!

উদ্‌বোধন

বাজাও প্রভু বাজাও ঘন বাজাও
ভীম বজ্র-বিষাণে
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!

অগ্নি-তূর্য কাঁপাক সূর্য
বাজুক রুদ্রতালে ভৈরব –
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!

নট-মল্লার দীপক-রাগে
জ্বলুক তাড়িত-বহ্নি আগে
ভেরির রন্ধ্রে মেঘমন্দ্রে জাগাও বাণী জাগ্রত নব।
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!

দাসত্বের এ ঘৃণ্য তৃপ্তি
ভিক্ষুকের এ লজ্জা-বৃত্তি,
বিনাশো জাতির দারুণ এ লাজ, দাও তেজ দাও মুক্তি-গরব।
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!

খুন দাও নিশ্চল এ হস্তে
শক্তি-বজ্র দাও নিরস্ত্রে;
শীর্ষ তুলিয়া বিশ্বে মোদেরও দাঁড়াবার পুন দাও গৌরব –
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!

ঘুচাতে ভীরুর নীচতা দৈন্য
প্রেরো হে তোমার ন্যায়ের সৈন্য
শৃঙ্খলিতের টুটাতে বাঁধন আনো আঘাত প্রচণ্ড আহব।
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!

নির্বীর্য এ তেজঃ-সূর্যে
দীপ্ত করো হে বহ্নি-বীর্যে,
শৌর্য ধৈর্য মহাপ্রাণ দাও, দাও স্বাধীনতা সত্য বিভব!
দুর্জয় মহা-আহ্বান তব, বাজাও!

 উৎসর্গ (বিষের বাঁশি)

বাংলার অগ্নি-নাগিনি মেয়ে মুসলিম-মহিলা-কুল-গৌরব
আমার জগজ্জননী-স্বরূপা মা
মিসেস এম. রহমান সাহেবার
পবিত্র চরণারবিন্দে –

এমনই প্লাবন-দুন্দুভি-বাজা ব্যাকুল শ্রাবণ মাস –
সর্বনাশের ঝান্ডা দুলায়ে বিদ্রোহ-রাঙা-বাস
ছুটিতে আছিনু মাভৈঃ-মন্ত্র ঘোষি অভয়কর,
রণ-বিপ্লব-রক্ত-অশ্ব কশাঘাত-জর্জর!
সহসা থমকি দাঁড়ানু আমার সর্পিল-পথ-বাঁকে,
ওগো নাগমাতা, বিষ-জর্জর তব গরজন-ডাকে!
কোথা সে অন্ধ অতল পাতাল-বন্ধ গুহার তলে,
নির্জিত তব ফণা-নিঙড়ানো গরলের ধারা গলে;
পাতাল-প্রাচীর চিরিয়া তোমার জ্বালা-ক্রন্দন-চূর
আলোর জগতে এসে বাজে যেন বিষ-মদ-চিক্কুর!
আঁধার-পীড়িত রোষ-দোদুল সে তব ফণা-ছায়া-দোল
হানিছে গৃহীরে অশুভ শঙ্কা, কাঁপে ভয়ে সুখ-কোল।
ধূমকেতু-ধ্বজ বিপ্লব-রথ সম্ভ্রমে অচপল,
নোয়াইল শির শ্রদ্ধা-প্রণত রথের অশ্বদল!
ধূমকেতু-ধূম-গহ্বরে যত সাগ্নিক শিশু-ফণী
উল্লাসে ‘জয় জয় নাগমাতা’ হাঁকিল জয়-ধ্বনি!
বন্দিল, উর নাগ-নন্দিনী ভেদিয়া পাতাল-তল!
দুলিল গগনে অশুভ-অগ্নি পতাকা জ্বালা-উজল!
তারপর মা গো কোথা গেলে তুমি, আমি কোথা হনু হারা,
জাগিয়া দেখিনু, আমারে গ্রাসিয়া রাহু রাক্ষস-কারা!
শৃঙ্খলিতা সে জননীর ব্যথা বাজিয়া এ ক্ষীণ বুকে
অগ্নি হয়ে মা জ্বলেছিল খুন, বিষ উঠেছিল মুখে,
শৃঙ্খল-হানা অত্যাচারীর বুকে বাজপাখি সম
পড়িয়া তাহারে ছিঁড়িতে চেয়েছি হিংসা-নখরে মম, –
সে আক্রমণ ব্যর্থ কখন করেছে কারার ফাঁদ,
বন্দিনী দেশ-জননীর সাথে বেঁধেছে আমারে বাঁধ।
হাতে পায়ে কটি-গর্দানে মোর বাজে শত শৃঙ্খল,
অনাহারে তনু ক্ষুধা-বিশীর্ণ, তৃষায় মেলে না জল,
কত যুগ যেন এক অঞ্জলি পাইনিকো আলো বায়ু,
তারই মাঝে আসি রক্ষী-দানব বিদ্যুতে বেঁধে স্নায়ু –
এত যন্ত্রণা তবু সব যেন বুকে ক্ষীর হয়ে ওঠে,
শত্রুর হানা কণ্টক-ক্ষত প্রাণে ফুল হয়ে ফোটে!–
এরই মাঝে তুমি এলে নাগমাতা পাতাল-বন্ধ টুটি
অচেতন মম ক্ষত তনু পড়ে তব ফণা-তলে লুটি!
তোমার মমতা-মানিক-আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা,
তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্বজননী! তোমার আঁচল পাতা
নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে; বিষ শুধু তোমা দহে
ফণা তব মা গো পীড়িত নিখিল ধরণির ভার বহে ! –
আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে,
সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে,
নহে তার তরে, – সব সন্তানে তুমি যে বেসেছ ভালো,
তোমার মানিক সকলের মুখে দেয় যে সমান আলো,
শুধু মাতা নহ, জগন্মাতার আসনে বসেছ তুমি, –
সেই গৌরবে জননী আমার, তোমার চরণ চুমি!

তোমার নাগ-শিশু
নজরুল ইসলাম
হুগলি
১৬ শ্রাবণ, ১৩৩১

কৈফিয়ত (বিষের বাঁশি)

‘অগ্নিবীণা’ দ্বিতীয় খণ্ড নাম দিয়ে তাতে যেসব কবিতা ও গান দেব বলে এতকাল ধরে বিজ্ঞাপন দিচ্ছিলাম, সেইসব কবিতা ও গান দিয়ে এই ‘বিষের বাঁশি’ প্রকাশ করলাম। নানা কারণে ‘অগ্নিবীণা’ দ্বিতীয় খণ্ড নাম বদলে ‘বিষের বাঁশি’ নামকরণ করলাম। বিশেষ কারণে কয়েকটি কবিতা ও গান বাদ দিতে বাধ্য হলাম। কারণ ‘আইন’-রূপ ‘আয়ান ঘোষ’ যতক্ষণ তার বাঁশ উঁচিয়ে আছে, ততক্ষণ বাঁশিতে তথাকথিত ‘বিদ্রোহ’-রাধার নাম না নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ওই ঘোষের পো-র বাঁশ বাঁশির চেয়ে অনেক শক্ত। বাঁশে ও বাঁশিতে বাঁশাবাঁশি লাগলে বাঁশিরই ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কেননা, বাঁশি হচ্ছে সুরের, আর বাঁশ হচ্ছে অসুরের।

এই বাঁশি তৈরির জন্য আমার অনেক বন্ধু নিঃস্বার্থভাবে অনেক সাহায্য করেছেন। তাঁরা সাহায্য না করলে এ বাঁশির গান আমার মনের বেণুবনেই গুমরে মরত। এঁরা সকলেই নিঃস্বার্থ নিষ্কলুষ প্রাণ-সুন্দর আনন্দ-পুরুষ। আমার নিখরচা কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ পাওয়ার লোভে এঁরা সাহায্য করেননি। এঁরা সকলেই জানেন, ওসব বিষয়ে আমি একেবারে অমানুষ বা পাষাণ। এঁরা যা করেছেন তা স্রেফ আনন্দের প্রেরণায় ও আমায় ভালোবেসে। সুতরাং আমি ভিক্ষাপ্রাপ্ত ভিক্ষুকের মতো তাঁদের কাছে চিরচলিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তাঁদের আনন্দকে খর্ব ও ভালোবাসাকে অস্বীকার করব না। এঁরা যদি সাহায্য হিসাবে আমায় সাহায্য করতে আসতেন তাহলে আমি এঁদের কারুর সাহায্য নিতাম না। যাঁরা সাহায্য করে মনে মনে প্রতিদানের দাবি পোষণ করে আমায় দায়ী করে রাখেন, তাঁদের সাহায্য নিয়ে আমি নিজেকে অবমানিত করতে নারাজ। এতটুকু শ্রদ্ধা আমার নিজের উপর আছে। স্রেফ তাঁদের নাম ও কে কোন মালমশলা জুগিয়েছেন তাই জানাচ্ছি – নিজেকে হালকা করার আত্মপ্রসাদের লোভে।

এ ‘বিষের বাঁশি’র বিষ জুগিয়েছেন আমার নিপীড়িতা দেশমাতা, আর আমার ওপর বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার।

বাঁশ জুগিয়েছেন সুলেখক ঔপন্যাসিক বন্ধু সনৎকুমার সেন। এ-বাঁশকে বাঁশি করে তুলেছেন – ‘বাণী’ যন্ত্র দিয়ে ওই যন্ত্রাধিকারী বিখ্যাত স্বদেশ-সেবক আমার অগ্রজ-প্রতিম পরম শ্রদ্ধাস্পদ ললিতদা ও পাঁচুদা। তাঁদের যন্ত্রের সাহায্য না পেলে এ-বাঁশি শুধু বাঁশই রয়ে যেত। এই বাঁশি গায়ের অদ্ভুত বিচিত্র নকশাটি কেটে দিয়েছেন প্রথিত-যশা কবি-শিল্পী – আমার ঝড়ের রাতের বন্ধু – ‘কল্লোল’-সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ। এই সবের তত্ত্বাবধানের ভার নিয়েছিলেন দেশের-কাজে-উৎসর্গ-প্রাণ আমার পরম শ্রদ্ধার বন্ধু মৌলবি মঈনউদ্দিন হোসেন সাহেব বি. এ. (নূর লাইব্রেরি)। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, ডি. এম. লাইব্রেরির গোপালদা এই গান শোনাবার জন্য ঢোল শোহরৎ দেওয়ার ভার নিয়েছেন।

এত বন্ধুর এত চেষ্টা সত্ত্বেও অনেক দোষত্রুটি রয়ে গেল আমার অবকাশ-হীনতা ও অভিমন্যুর মতো সপ্তরথী-পরিবেষ্টিত ক্ষতবিক্ষত অবস্থার জন্য। যাঁরা আমায় জানেন, তাঁরা জানেন, আমার বিনা কাজের হট্টমন্দিরে অবকাশের কীরকম অভাব এবং জীবনের কতখানি শক্তি ব্যয় করতে হয় দশ দিকের দশ আক্রমণ ব্যর্থ করবার জন্য। যদি অবকাশ ও শান্তি পাই, তাহলে দ্বিতীয় সংস্করণে এর দোষত্রুটি নিরাকরণের চেষ্টা করব। ইতি –

নজরুল ইসলাম
হুগলি
১৬ শ্রাবণ, ১৩৩১

চরকার গান

ঘোর –
ঘোর রে ঘোর ঘোর রে আমার সাধের চরকা ঘোর
ওই স্বরাজ-রথের আগমনি শুনি চাকার শব্দে তোর॥


তোর ঘোরার শব্দে ভাই
সদাই শুনতে যেন পাই
ওই খুলল স্বরাজ-সিংহদুয়ার, আর বিলম্ব নাই।
ঘুরে আসল ভারত-ভাগ্য-রবি, কাটল দুখের রাত্রি ঘোর॥


ঘর ঘর তুই ঘোর রে জোরে
ঘর্ঘরঘর ঘূর্ণিতে তোর
ঘুচুক ঘুমের ঘোর
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
তোর ঘুর-চাকাতে বল-দর্পীর তোপ কামানের টুটুক জোর॥


তুই ভারত-বিধির দান,
এই কাঙাল দেশের প্রাণ,
আবার ঘরের লক্ষ্মী আসবে ঘরে শুনে তোর ওই গান।
আর লুটতে নারবে সিন্ধু-ডাকাত বৎসরে পঁয়ষট্টি ক্রোড়॥


হিন্দু-মুসলিম দুই সোদর,
তাদের মিলন-সূত্র-ডোর রে
রচলি চক্রে তোর,
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
আবার তোর মহিমায় বুঝল দু-ভাই মধুর কেমন মায়ের ক্রোড়॥


ভারত বস্ত্রহীন যখন
কেঁদে ডাকল – নারায়ণ!
তুমি লজ্জা-হারী করলে এসে লজ্জা নিবারণ,
তাই দেশ-দ্রৌপদীর বস্ত্র হরতে পারল না দুঃশাসন-চোর॥

এই সুদর্শন-চক্রে তোর
অত্যাচারীর টুটল জোর রে ছুটল সব গুমোর
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
তুই জোর জুলুমের দশম গ্রহ, বিষ্ণু-চক্র ভীম কঠোর॥


হয়ে অন্নবস্ত্রহীন
আর ধর্মে কর্মে ক্ষীণ
দেশ ডুবছিল ঘোর পাপের ভারে যখন দিনকে দিন,
তখন আনলে অন্ন পুণ্য-সুধা, খুললে স্বর্গ মুক্তি-দোর॥


শাসতে জুলুম নাশতে জোর
খদ্দর-বাস বর্ম তোর রে অস্ত্র সত্যডোর,
তুই ঘোর ঘোর ঘোর।
মোরা ঘুমিয়ে ছিলাম, জেগে দেখি চলছে চরকা, রাত্রি ভোর॥


তুই সাত রাজারই ধন,
দেশ- মা-র পরশ-রতন,
তোর স্পর্শে মেলে স্বর্গ অর্থ কাম মোক্ষ ধন।
তুই মায়ের আশিস, মাথার মানিক, চোখ ছেপে বয় অশ্রু-লোর॥

 জাগৃহি

জাগৃহি
[তোটক ছন্দ]

‘হর হর হর শংকর হর হর ব্যোম’ –
একী ঘন রণ-রোল ছায়া চরাচর ব্যোম!
হানে ক্ষিপ্ত মহেশ্বর রুদ্র পিনাক,
ঘন প্রণব-নিনাদ হাঁকে ভৈরব-হাঁক
ধু ধু দাউ দাউ জ্বলে কোটি নর-মেধ-যাগ,
হানে কাল-বিষ বিশ্বে রে মহাকাল-নাগ!
আজ ধূর্জটি ব্যোমকেশ নৃত্য-পাগল,
ওই ভাঙল আগল ওরে ভাঙল আগল!
বোলে অম্বুদ-ডম্বুর কম্বু বিষাণ,
নাচে থই-তাতা থই-তাতা পাগলা ঈশান!
দোলে হিন্দোলে ভীম-তালে সৃষ্টি ধাতার,
বুকে বিশ্বপাতার বহে রক্ত-পাথার!
ঘোর মার’ দৈত্য, অসুর,
প্রেত, রক্ত-পিশাচ, রণ-দুর্মদ সুর।
করে ক্রন্দসী-ক্রন্দন অম্বর রোধ –
ত্রাহি ত্রাহি মহেশ হে সম্বরো ক্রোধ!
সুত মৃত্যু-কাতর, হাহা অট্টহাসি
হাসে চণ্ডী চামুণ্ডা মা সর্বনাশী।
কাল- বৈশাখী ঝঞ্ঝারে সঙ্গে করি –
রণ- উন্মাদিনী নাচে রঙ্গে মরি!
উর- হার দোলে নরমুণ্ড-মালা,
করে খড়্গ ভয়াল, আঁখে বহ্নি-জ্বালা!
নিয়া রক্তপানের কী অগস্ত্য-তৃষা
নাচে ছিন্ন সে মস্তা মা, নাইকো দিশা!
‘দে রে রক্ত দে রক্ত দে’ রণে ক্রন্দন,
বুঝি থেমে যায় সৃষ্টির হৃৎ-স্পন্দন!
জ্বলে বৈশ্বানরের ধু ধু লক্ষ শিখা,
আজ বিষ্ণু-ভালে লাল রক্ত-টিকা!
শুধু অগ্নি-শিখা ধু ধু অগ্নি-শিখা,
শোভে করুণার ভালে লাল রক্ত-টিকা!
রণ- শ্রান্ত অসুর-সুর-যোদ্ধৃ-সেনা,
শুধু রক্ত-পাথার, শুধু রক্ত-ফেনা!
একী বিশ্ব-বিধ্বংস নৃশংস খেলা,
কিছু নাই কিছু নাই প্রেত-পিশাচে মেলা।
আজ ঘরে ঘরে জ্বলে ধু ধু শ্মশান মশান –
হোক রোষ অবসান, ত্রাহি ত্রাহি ভগবান!
আজি বন্ধ সবার পূতি-গন্ধে নিশাস,
বিষে বিশ্ব-নিসাড়, বহে জোর নাভিশ্বাস!
দেহো ক্ষান্ত রণে, ফেলো রঙ্গিণী বেশ,
খোলো রক্তাম্বর মাতা সম্বরো কেশ!
এ তো নয় মাতা রক্তোন্মত্তা ভীমা!
আজ জাগৃহি মা, আজ জাগৃহি মা।
তব চরণাবলুণ্ঠিত মহিষ-অসুর,
হল ধ্বংস অসুর, লীন শক্তি পশুর।
তবে সম্বরো রণ, হোক ক্ষান্ত রোদন–
হোক সত্য-বোধন আজ মুক্তি-বোধন!
এসো শুদ্ধা মাতা এই কাল-শ্মশানে
আজ প্রলয়-শেষে এই রণাবসানে!
জাগো জাগো মানব-মাতা দেবী নারী!
আনো হৈম ঝারি, আনো শান্তি-বারি!
এসো কৈলাস হতে মা গো মানস-সরে,
নীল উৎপল-দলে রাঙা আঁচল-ভরে।
এসো কন্যা উমা, এসো গৌরী রূপে,–
বাজো শঙ্খ শুভ, জ্বালো গন্ধ ধূপে!
আজ মুক্ত-বেণি মেয়ে একাকী চলে,
ওই শেফালি-তলে হেরো শেফালি-তলে।
ওড়ে এলোমেলো অঞ্চল আশ্বিন-বায়,
হানে চঞ্চল নীল চাওয়া আকাশের গায়!
ঘোষে হিমালয় তার মহা হর্ষ-বাণী, –
এল হৈমবতী, এল গৌরী রানি।
বাজো মঙ্গল শাঁখ, হোক শুভ-আরতি,
এল লক্ষ্মী-কমলা, এল বাণী-ভারতী।
এল সুন্দর সৈনিক সুর কার্তিক,
এল সিদ্ধি-দাতা, হেরো হাসে চারিদিক!
ভরা ফুল-খুকি ফুল-হাসি শিউলির তল,
আজ চোখে আসে জল, শুধু চোখে আসে জল!
নিয়া মাতৃ-হিয়া নিয়া কল্যাণী-রূপ
এল শক্তি স্বাহা, বাজো শাঁখ, জ্বালো ধূপ!
ভাঁজো মোহিনী সানাই, বাজো আগমনি-সুর,
বড়ো কেঁদে ওঠে আজ হিয়া মাতৃ-বিধুর।
ওঠে কণ্ঠ ছাপি বাণী সত্য পরম –
বন্- দে মাতরম্। বন্‌দে মাতরম্!

জাতের বজ্জাতি

জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত-জালিয়াত খেলছে জুয়া
ছুঁলেই তোর জাত যাবে? জাত ছেলের হাতের নয় তো মোয়া॥
হুঁকোর জল আর ভাতের হাঁড়ি, ভাবলি এতেই জাতির জান,
তাই তো বেকুব, করলি তোরা এক জাতিকে একশো-খান!
এখন দেখিস ভারত-জোড়া
পচে আছিস বাসি মড়া,
মানুষ নাই আজ, আছে শুধু জাত-শেয়ালের হুক্কাহুয়া॥
জানিস না কি ধর্ম সে যে বর্মসম সহনশীল,
তাকে কি ভাই ভাঙতে পারে ছোঁয়া-ছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল।
যে জাত-ধর্ম ঠুনকো এত,
আজ নয় কাল ভাঙবে সে তো,
যাক না সে জাত জাহান্নামে, রইবে মানুষ, নাই পরোয়া॥
দিন-কানা সব দেখতে পাসনে দণ্ডে দণ্ডে পলে পলে
কেমন করে পিষছে তোদের পিশাচ জাতের জাঁতাকলে।
(তোরা) জাতের চাপে মারলি জাতি,
সূর্য ত্যজি নিলি বাতি,
তোদের জাত-ভগীরথ এনেছে জল জাত-বিজাতের জুতো-ধোয়া॥
মনু ঋষি অণুসমান বিপুল বিশ্বে যে বিধির,
বুঝলি না সেই বিধির বিধি, মনুর পায়েই নোয়াস শির।
ওরে মূর্খ ওরে জড়,
শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়ো,
(তোরা) চিনলিনে তা চিনির বলদ, সার হল তাই শাস্ত্র বওয়া॥
সকল জাতই সৃষ্টি যে তাঁর, এই বিশ্ব মায়ের বিশ্ব-ঘর,
মায়ের ছেলে সবাই সমান, তাঁর কাছে নাই আত্ম-পর।
(তোরা) সৃষ্টিকে তাঁর ঘৃণা করে
স্রষ্টায় পূজিস জীবন ভরে
ভস্মে ঘৃত ঢালা সে যে বাছুর মেরে গাভি দোওয়া॥
বলতে পারিস বিশ্বপিতা ভগবানের কোন সে জাত?
কোন ছেলের তাঁর লাগলে ছোঁয়া অশুচি হন জগন্নাথ?
নারায়ণের জাত যদি নাই,
তোদের কেন জাতের বালাই?
(তোরা) ছেলের মুখে থুথু দিয়ে মার মুখে দিস ধূপের ধোঁয়া॥
ভগবানের ফৌজদারি-কোর্ট নাই সেখানে জাতবিচার,
(তোর) পইতে টিকি টুপি টোপর সব সেথা ভাই একাক্কার।
জাত সে শিকেয় তোলা রবে,
কর্ম নিয়ে বিচার হবে,
(তা-পর) বামুন চাঁড়াল এক গোয়ালে, নরক কিংবা স্বর্গে থোয়া॥
(এই) আচার-বিচার বড়ো করে প্রাণ দেবতায় ক্ষুদ্র ভাবা,
(বাবা) এই পাপেই আজ উঠতে বসতে সিঙ্গি-মামার খাচ্ছ থাবা।
তাই নাইকো অন্ন নাইকো বস্ত্র,
নাইকো সম্মান, নাইকো অস্ত্র,
(এই) জাত-জুয়াড়ির ভাগ্যে আছে আরও অশেষ দুঃখ-সওয়া॥

ঝড়

ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় –
শন – শন – শনশন শন –ক্কড়ক্কড় ক্কড় –
কাঁদে মোর আগমনি আকাশ বাতাস বনানীতে।
জন্ম মোর পশ্চিমের অস্তগিরি-শিরে,
যাত্রা মোর জন্মি আচম্বিতে
প্রাচী-র অলক্ষ্য পথ-পানে
মায়াবী দৈত্যশিশু আমি
ছুটে চলি অনির্দেশ অনর্থ-সন্ধানে!
জন্মিয়াই হেরিনু, মোরে ঘিরি ক্ষতির অক্ষৌহিণী সেনা
প্রণমি বন্দিল – ‘প্রভু! তব সাথে আমাদের যুগে যুগে চেনা,
মোরা তব আজ্ঞাবহ দাস –
প্রলয় তুফান বন্যা, মড়ক দুর্ভিক্ষ মহামারি সর্বনাশ!’

বাজিল আকাশ-ঘণ্টা, বসুধা-কাঁসর;
মার্তণ্ডের ধূপদানি – মেঘ-বাষ্প-ধূমে-ধূমে ভরাল অম্বর!
উল্কার হাউই ছোটে, গ্রহ উপগ্রহ হতে ঘোষিল মঙ্গল;
মহাসিন্ধু-শঙ্খে বাজে অভিশাপ-আগমনি কলকল কল কলকল কল কলকল কল!
‘জয় হে ভয়ংকর, জয় প্রলংকর’ নির্ঘোষি ভয়াল
বন্দিল ত্রিকাল-ঋষি।
ধ্যান-ভগ্ন রক্ত-আঁখি আশিস দানিল মহাকাল।
উল্লম্ফিয়া উঠিলাম আকাশের পানে তুলি বাহু,
আমি নব রাহু!
হেরিলাম সেবারতা মহীয়সী মহালক্ষ্মী প্রকৃতির রূপ,
সহসা সে ভুলিয়াছে সেবা, আগমন-ভয়ে মোর
প্রস্তর-শিখার সম নিশ্চল নিশ্চুপ!
অনুমানি যেন কোনো সর্বনাশা অমঙ্গল ভয়
জাগি আছে শিশুর শিয়র-পাশে ধ্যানমগ্না মাতা, শ্বাস নাহি বয়।
মনে হল ওই বুঝি হারা-মাতা মোর! মৌনা ওই জননীর
শুভ্র শান্ত কোলে
– প্রহ্লাদকুলের আমি কাল-দৈত্য-শিশু –
ঝাঁপাইয়া পড়িলাম ‘মা আমার’ বলে।
নাহি জানি কোন্ ফণিমনসার হলাহল-লোকে –
কোন্ বিষ-দীপ-জ্বালা সবুজ আলোকে –
নাগমাতা কদ্রু-গর্ভে জন্মেছি সহস্রফণা নাগ
ভীষণ তক্ষকশিশু! কোথা হয় নাগনাশী জন্মেজয়-যাগ –
উচ্চারিছে আকর্ষণ-মন্ত্র কোন্ গুণী –
জন্মান্তর-পার হতে ছুটে চলি আমি সেই মৃত্যু-ডাক শুনি!
মন্ত্র-তেজে পাংশু হয়ে ওঠে মোর হিংসা-বিষ-ক্রোধ-কৃষ্ণ প্রাণ,
আমার তুরীয় গতি – সে যে ওই অনাদি উদয় হতে
হিংসাসর্প-যজ্ঞমন্ত্র-টান!
ছুটে চলি অনন্ত তক্ষক ঝড় –
শন – শন – শনশন শন
সহসা কে তুমি এলে হে মর্ত্য-ইন্দ্রাণী মাতা,
তব ওই ধূলি-আস্তরণ
বিছায়ে আমার তরে জাতকের জন্মান্তর হতে?
লুকানু ও-অঞ্চল-আড়ালে, দাঁড়ালে আড়াল হয়ে মোর মৃত্যু-পথে!
ব্যর্থ হল অঞ্চল-আড়াল; বহ্নি-আকর্ষণ
মন্ত্র-তেজে ব্যাকুল ভীষণ
রক্তে রক্তে বাজে মোর – শনশন শন –
শন – শন – ওই শুন দূর –
দূরান্তর হতে মাগো, ডাকে মোরে অগ্নি-ঋষি বিষহরি সুর!

জননী গো চলিলাম অনন্ত চঞ্চল,
বিষে তব নীল হল দেহ, বৃথা মা গো দাব-দাহে পুড়ালে অঞ্চল!
ছুটে চলি মহা-নাগ, রক্তে মোর শুনি আকর্ষণী,
মমতা-জননী
দাহে মোর পড়িল মুরছি;
আমি চলি প্রলয়-পথিক – দিকে দিকে মারী-মরু রচি।

ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় –
শন – শন – শনশন শন –ক্কড়ক্কড় ক্কড় –
কোলাহল-কল্লোলের হিল্লোল-হিন্দোল –
দুরন্ত দোলায় চড়ি – ‘দে দোল দে দোল’
উল্লাসে হাঁকিয়া বলি, তালি দিয়া মেঘে
উন্মদ উন্মাদ ঘোর তুফানিয়া বেগে!
ছুটে চলি ঝড় – গৃহ-হারা শান্তি-হারা বন্ধ-হারা ঝড় –
স্বেচ্ছাচার-ছন্দে নাচি ! ক্কড়ক্কড় ক্কড়
কণ্ঠে মোর লুণ্ঠে ঘোর বজ্র-গিটকিরি,
মেঘ-বৃন্দাবনে মুহু ছুটে মোর বিজুরির জ্বালা-পিচকিরি!
উড়ে সুখ-নীড়, পড়ে ছায়া-তরু, নড়ে ভিত্তি রাজ-প্রাসাদের,
তুফান-তুরগ মোর উরগেন্দ্র-বেগে ধায়।
আমি ছুটি অশান্ত-লোকের
প্রশান্ত-সাগর-শোষা উষ্ণশ্বাস টানি।
লোকে লোকে পড়ে যায় প্রলয়ের ত্রস্ত কানাকানি!

ঝড় – ঝড় – উড়ে চলি ঝড় মহাবায়-পঙ্খিরাজে চড়ি,
পড়-পড় আকাশের ঝোলা শামিয়ানা
মম ধূলিধ্বজা সনে করে জড়াজড়ি!
প্রমত্ত সাগর-বারি – অশ্ব মম তুফানির খর ক্ষুর-বেগে
আন্দোলি আন্দোলি ওঠে। ফেনা ওঠে জেগে
ঝটিকার কশা খেয়ে অনন্ত তরঙ্গ-মুখে তার !
আমি যেন সাপুড়িয়া মারি মন্ত্র-মার–
ঢেউ-এর মোচড়ে তাই মহাসিন্ধু-মুখে
জল-নাগ-নাগিনিরা আছাড়ি পিছাড়ি মরে ধুঁকে!
প্রিয়া মোর ঘূর্ণিবায়ু বেদুইন-বালা
চূর্ণি চলে ঝঞ্ঝা-চুর মম আগে আগে।
ঝরনা-ঝোরা তটিনীর নটিনি-নাচন-সুখ লাগে
শুষ্ক খড়কুটো ধূলি শীত-শীর্ণ বিদায়-পাতায়
ফাল্গুনী-পরশে তার। – আমার ধমকে নুয়ে যায়
বনস্পতির মহা মহিরুহ, শাল্মলি, পুন্নাগ, দেওদার,
ধরি যবে তার
জাপটি পল্লব-ঝুঁটি, শাখা-শির ধরে দিই নাড়া;
গুমরি কাঁদিয়া ওঠে প্রণতা বনানী,
চচ্চড় করে ওঠে পাহাড়ের খাড়া শির-দাঁড়া!

প্রিয়া মোর এলোমেলো গেয়ে গান আগে আগে চলে;
পাগলিনি কেশে ধূলি চোখে তার মায়া-মণি ঝলে।
ঘাগরির ঘূর্ণা তার ঘূর্ণি-ধাঁধা লাগায় নয়নালোকে মোর।
ঘূর্ণিবালা হাসির হররা হানি বলে – ‘মনোচোর।
ধরো তো আমারে দেখি’ –
ত্রস্ত-বাস হাওয়া-পরি, বেণি তার দুলে ওঠে সুকঠিন মম ভালে ঠেকি।
পাগলিনি মুঠি মুঠি ছুঁড়ে মারে রাঙা পথধূলি,
হানে গায় ঝরনা-কুলুকুচু, পদ্ম-বনে আলুথালু খোঁপা পড়ে খুলি!
আমি ধাই পিছে তার দুরন্ত উল্লাসে;
লুকায় আলোর বিশ্ব চন্দ্র সূর্য তারা পদভর-ত্রাসে!
দীর্ঘ রাজপথ-অজগর সংকুচিয়া ওঠে ক্ষণে ক্ষণে,
ধরণি-কূর্মপৃষ্ঠ দীর্ণ জীর্ণ হয়ে ওঠে মত্ত মোর প্রমত্ত ঘর্ষণে।
পশ্চাতে ছুটিয়া আসে মেঘ ঐরাবত-সেনাদল
গজগতি-দোলা-ছন্দে; স্বরগে বাজে বাদল-মাদল!
সপ্ত সাগর শোষি শুণ্ডে শুণ্ডে তারা–
উপুড় ধরণি-পৃষ্ঠে উগারে নিযুত লক্ষ বারি-তীর-ধারা।
বয়ে যায় ধরা-ক্ষত-রসে
সহস্র পঙ্কিল স্রোত-ধার।
চণ্ডবৃষ্টি-প্রপাত-ধারা-ফুলে
বরষার বুকে ঝলে জল-মালা-হার।
আমি ঝড়, হুল্লোড়ের সেনাপতি; খেলি মৃত্যু-খেলা
ঘূর্ণনীয়া প্রিয়া-সাথে। দুর্যোগের হুলাহুলি মেলা
ধায় মম অশ্রান্ত পশ্চাতে!
মম প্রাণরঙ্গে মাতি নিখিলের শিখী-প্রাণ মুহু-মুহু মাতে!
শ্যাম স্বর্ণ পত্রে পুষ্পে কাঁপে তার অনন্ত কলাপ। –
দারুণ দাপটে মম জেগে ওঠে অগ্নিস্রাব-জ্বলন্ত-প্রলাপ
ভূমিকম্প-জরজর থরথর ধরিত্রীর মুখে!
বাসুকি-মন্দার সম মন্থনে মম সিন্ধুতট ভরে ফেনা-থুকে।
জেগে ওঠে মম সেই সৃষ্টি-সিন্ধু-মন্থন-ব্যথায়
রবি শশী তারকার অনন্ত বুদবুদ! – উঠে ভেঙে যায়
কত সৃষ্টি কত বিশ্ব আমার আনন্দ-গতিপথে।
শিবের সুন্দর ধ্রুব-আঁখি
যমের আরক্ত ঘোর মশাল-নয়ন-দীপ মম রথে।
জয়ধ্বনি বাজে মোর স্বর্গদূত ‘মিকাইলের’ আতশি-পাখায়।
অনন্ত-বন্ধন-নাগ-শিরস্ত্রাণ শোভে শিরে! শিখী-চূড়ায় তায়
শনির অশনি ওই ধূমকেতু-শিখা,
পশ্চাতে দুলিছে মোর অনন্ত আঁধার চিররাত্রি-যবনিকা!
জটা মোর নীহারিকাপুঞ্জ-ধূম পাটল পিঙ্গাস,
বহে তাহে রক্ত-গঙ্গা নিপীড়িত নিখিলের লোহিত নিষ্কাশ।

ঝড় – ঝড় – ঝড় আমি – আমি ঝড় –
ক্কড়ক্কড় ক্কড় –
বজ্র-বায়ু দন্তে-দন্তে ঘর্ষি চলি ক্রোধে!
ধূলি-রক্ত বাহু মম বিন্ধ্যাচল সম রবিরশ্মি-পথ রোধে।
ঝঞ্ঝনা-ঝাপটে মম
ভীত কূর্ম সম
সহসা সৃষ্টির খোলে নিয়তি লুকায়।
আমি ঝড়, জুলুমের জিঞ্জির-মঞ্জীর বাজে ত্রস্ত মম পায়!
ধাক্কার ধমকে মম খান খান নিষিদ্ধের নিরুদ্ধ দুয়ার,
সাগরে বাড়ব লাগে, মড়ক দুয়ার্কি ধরে আমার ধুয়ার!
কৈলাসে উল্লাস ঘোষে ডম্বরু ডিণ্ডিম
দ্রিম দ্রিম দ্রিম!
অম্বর-ডঙ্কার ডামাডোল
সৃজনের বুকে আনে অশ্রু-বন্যা ব্যথা-উতরোল।
ভাণ্ডারে সঞ্চিত মম দুর্বাসার হিংসা ক্রোধ শাপ।
ভীমা উগ্রচণ্ডা ফেলে উল্কারূপী অগ্নি-অশ্রু, সহিতে না পারি মম তাপ!
আমি ঝড়, পদতলে ‘আতঙ্ক’-কুঞ্জর, হস্তে মোর ‘মাভৈঃ’-অঙ্কুশ।
আমি বলি, ছুটে চলো প্রলয়ের লাল ঝাণ্ডা হাতে, –
হে নবীন পরুষ পুরুষ!
স্কন্ধে তোলো উদ্ধত বিদ্রোহ-ধ্বজা; কণ্টক-অশঙ্ক রে নির্ভীক!
পুরুষ ক্রন্দন-জয়ী, – দুঃখ দেখে দুঃখ পায় – ধিক তারে ধিক
আমি বলি, বিশ্ব-গোলা নিয়ে খেলো লুফোলুফি খেলা!
বীর নিক বিপ্লবের লাল-ঘোড়া,
ভীরু নিক পারে-ধাওয়া পলায়ন-ভেলা!
আমি বলি, প্রাণানন্দে পিয়ে নে রে বীর,
জীবন-রসনা দিয়া প্রাণ ভরে মৃত্যু-ঘন ক্ষীর!
আমি বলি, নরকের ‘নার’ মেখে নেয়ে আয় জ্বালা-কুণ্ড সূর্যের হাম্মামে।
রৌদ্রের-চন্দন-শুচি, উঠে বসো গগনের বিপুল তাঞ্জামে!
আমি ঝড় মহাশত্রু স্বস্তি-শান্তি-শ্রীর,
আমি বলি, শ্মশান-সুষুপ্তি শান্তি –
জয়নাদ আমি অশান্তির।

পশ্চিম হইতে পূর্বে ঝঞ্ঝনা-ঝাঁঝর
ঝঞ্ঝা-জগঝম্প ঘোর – বাজায়ে চলেছি ঝড় –
ঝনাৎ ঝনাৎ ঝন
ঝমরঝমরঝন ঝননঝননশন
শনশনশন
হুহু হুহু হুহু –
সহসা কম্পিত-কণ্ঠ-ক্রন্দন শুনি কার – ‘উহু! উহু উহু উহু!’
সজল কাজল-পক্ষ্ম কে সিক্তবসনা একা ভিজে –
বিরহিণী কপোতিনী, এলোকেশ কালোমেঘে পিঁজে।
নয়ন-গগনে তার নেমেছে বাদল, ভিজিয়াছে চোখের কাজল,
মলিন করেছে তার কালো আঁখি-তারা
বায়ে-ওড়া কেতকীর পীত পরিমল!
এ কোন্ শ্যামলী পরি পুবের পরিস্থানে কেঁদে কেঁদে যায় –
নবোদ্ভিন্ন কুঁড়ি-কদম্বের ঘন যৌবন-ব্যথায়!
জেগেছে বালার বুকে এক বুক ব্যথা আর কথা,
কথা শুধু প্রাণে কাঁদে,
ব্যথা শুধু বুকে বেঁধে, মুখে ফোটে শুধু আকুলতা!
কদম্ব তমাল তাল পিয়াল-তলায়
দূর্বাদল-মখমলে শ্যামলী-আলতা তার মুছে মুছে যায়!
বাঁধে বেণি কেয়া-কাঁটা বনে।
বিদেশিনি দেয়াশিনি একমনে দেয়া-ডাক শোনে!
দাদুরির আদুরি কাজরি
শোনে আর আঁখি-মেঘ-কাজল গড়ায়ে
দুখ-বারি পড়ে ঝরঝরি।
ঝিমঝিম রিমঝিম – রিমিরিমি রিম ঝিম
বাজে পাঁইজোর –
কে তুমি পুরবি বালা? আর যেন নাহি পাই জোর
চলা-পায়ে মোর, ও-বাজা আমারও বুকে বাজে।
ঝিল্লির ঝিমানি-ঝিনিঝিনি
শুনি যেন মোর প্রতি রক্ত-বিন্দু-মাঝে!

আমি ঝড়? ঝড় আমি? – না, না, আমি বাদলের বায়!
বন্ধু! ঝড় নাই কোথায়?
ঝড় কোথা? কই? –
বিপ্লবের লাল-ঘোড়া ওই ডাকে ওই –
ওই শোনো, শোনো তার হ্রেষার চিক্কুর,
ওই তার ক্ষুর-হানা মেঘে! –
না, না, আজ যাই আমি, আবার আসিব ফিরে,
হে বিদ্রোহী বন্ধু মোর! তুমি থেকো জেগে!
তুমি রক্ষী এ রক্ত-অশ্বের,
হে বিদ্রোহী অন্তর্দেবতা! – শুনো শুনো মায়াবিনী ওই ডাকে ফের –
পুবের হাওয়ায় –
যায় – যায় – সব ভেসে যায়
পুবের হাওয়ায় –
হায়! –

তূর্য-নিনাদ

কোরাস : (আজ) ভারত-ভাগ্য-বিধাতার বুকে গুরু-লাঞ্ছনা-পাষাণ-ভার,
আর্ত-নিনাদে হাঁকিছে নকিব, – কে করে মুশকিল আসান তার?
মন্দির আজি বন্দির ঘানি,
নির্জিত ভীত সত্য, বদ্ধ রুদ্ধ স্বাধীন আত্মার বাণী,
সন্ধি-মহলে ফন্দির ফাঁদ, গভীর আন্ধি-অন্ধকার!
হাঁকিছে নকিব – হে মহারুদ্র চূর্ণ করো এ ভণ্ডাগার॥
রক্তে-মদের বিষ পান করি
আর্ত মানব; স্রষ্টা কাতর সৃষ্টির তাঁর নির্বাণ স্মরি!
ক্রন্দন-ঘন বিশ্বে স্বনিছে প্রলয়-ঘটার হুহুংকার, –
হাঁকিছে নকিব – অভয়-দেবতা, এ মহাপাথার করহ পার॥
কোলাহল-ঘাঁটা হলাহল-রাশি
কে নীলকণ্ঠ গ্রাসিবে রে আজ দেবতার মাঝে দেবতা সে আসি?
উরিবে কখন ইন্দিরা, ক্রোড়ে শান্তির ঝারি সুধার ভাঁড়?
হাঁকিছে নকিব – আনো ব্যথা-ক্লেশ-মন্থন-ধন অমৃত-ধার॥
কণ্ঠ ক্লিষ্ট ক্রন্দন-ঘাতে,
অমৃত-অধিপ নর-নারায়ণ দারুময় ঘন মনোবেদনাতে।
দশভুজে গলে শৃঙ্খল-ভার দশপ্রহরণধারিণী মার –
হাঁকিছে নকিব – ‘আবিরাবির্ম এধি’ হে নব যুগাবতার!
মৃত্যু-আহত মৃত্যুঞ্জয়,
কে শোনাবে তাঁরে চেতন-মন্ত্র? কে গাহিবে জয় জীবনের জয়?
নয়নের নীরে কে ডুবাবে বলো বলদর্পীর অহংকার? –
হাঁকিছে নকিব – সে দিন বিশ্বে খুলিবে আরেক তোরণ-দ্বার॥

পাগল পথিক

এ কোন্‌ পাগল পথিক ছুটে এল বন্দিনী মা-র আঙিনায়।
ত্রিশ কোটি ভাই মরণ-হরণ গান গেয়ে তাঁর সঙ্গে যায়॥
অধীন দেশের বাঁধন-বেদন
কে এল রে করতে ছেদন?
শিকল-দেবীর বেদির বুকে মুক্তি-শঙ্খ কে বাজায়॥
মরা মায়ের লাশ কাঁধে ওই অভিমানী ভায়ে ভায়ে
বুক-ভরা আজ কাঁদন কেঁদে আনল মরণ-পারের মায়ে।
পণ করেছে এবার সবাই,
পর-দ্বারে আর যাব না ভাই!
মুক্তি সে তো নিজের প্রাণে, নাই ভিখারির প্রার্থনায়॥
শাশ্বত যে সত্য তারই ভুবন ভরে বাজল ভেরি,
অসত্য আজ নিজের বিষেই মরল ও তার নাইকো দেরি।
হিংসুকে নয়, মানুষ হয়ে
আয় রে, সময় যায় যে বয়ে!
মরার মতন মরতে, ওরে মরণভীতু! ক-জন পায়!
ইসরাফিলের শিঙা বাজে আজকে ঈশান-বিষাণ সাথে,
প্রলয়-রাগে নয় রে এবার ভৈরবীতে দেশ জাগাতে।
পথের বাধা স্নেহের মায়ায়
পায় দলে আয় পায় দলে আয়!
রোদন কীসের ? – আজ যে বোধন!
বাজিয়ে বিষাণ উড়িয়ে নিশান আয় রে আয়॥

ফাতেহা-ই-দোয়াজ্-দহম্ [আবির্ভাব]


নাই তা জ
তাই লা জ?
ওরে মুসলিম, খর্জুর-শিষে তোরা সাজ!
করে তসলিম হর কুর্নিশে শোর আওয়াজ
শোন কোন মুজ্‌দা সে উচ্চারে হেরা আজ
ধরা-মাঝ!

উরজ-য়্যামেন নজ্‌দ হেজাজ তাহামা ইরাক শাম
মেশের ওমান তিহারান স্মরি কাহার বিরাট নাম।
পড়ে ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্‌লাম।
চলে আঞ্জাম
দোলে তাঞ্জাম
খোলে হুর-পরি মরি ফিরদৌসের হাম্মাম !
টলে কাঁখের কলসে কওসর ভর , হাতে আব-জমজম জাম ।
শোন দামাম কামান তামাম সামান নির্ঘোষি কার নাম
পড়ে ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্লানম।’


মস্ তান !
ব্যস থাম্!
দেখ মশ্‌গুল আজি শিস্তান-বোস্তান ,
তেগ গর্দানে ধরি দারোয়ান রোস্তাম ।
বাজে কাহারবা বাজা, গুলজার গুলশানগুলশান : পুষ্প-বাটিকা।
গুলফাম !

দক্ষিণে দোলে আরবি দরিয়া খুশিতে সে বাগে-বাগ ,
পশ্চিমে নীলা‘লোহিতে’র খুন-জোশিতে রে লাগে আগ,
মরু সাহারা গোবিতে সব্‌জার জাগে দাগ!
নূরে কুর্শির
পুরে ‘তূর’ -শির,
দূরে ঘূর্ণির তালে সুর বুনে হুরি ফুর্তির,
ঝুরে সুর্খির ঘন লালি উষ্ণীষে ইরানিদূরানি তুর্কির!
আজ বেদুইন তার ছেড়ে দিয়ে ঘোড়া ছুড়ে ফেলে বল্লম
পড়ে ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাললাম।’


‘সাবে ঈন’
তাবে ঈন
হয়ে চিল্লায় জোর ‘ওই ওই নাবে দীন !
ভয়ে ভূমি চুমে ‘লাত্ মানাত’ -এর ওয়ারেশিন ।
রোয়ে ওয্‌যা-হোবলইবলিসখারেজিন , –
কাঁপে জীন্ !
জেদ্দার পূবে মক্কা মদিনা চৌদিকে পর্বত,
তারই মাঝে ‘কাবা’ আল্লার ঘর দুলে আজ হর ওক্ত্ ,
ঘন উথলে অদূরে ‘জম-জম’ শরবৎ!
পানি কওসর,
মণি জওহর
আনি ‘জিবরাইল’ আজ হরদম দানে গওহর ,
টানি মালিক-উল-মৌতজিঞ্জির – বাঁধে মৃত্যুর দ্বার লৌহর।
হানি বরষা সহসা ‘মিকাইল’ করে ঊষর আরবে ভিঙা ,
বাজে নব সৃষ্টির উল্লাসে ঘন ‘ইসরাফিল’ -এর শিঙা!


জন্ জাল
কঙ্ কাল
ভেদি, ঘন জাল মেকি গণ্ডির পঞ্জার
ছেদি, মরুভূতে একী শক্তির সঞ্চার!
বেদি পঞ্জরে রণে সত্যের ডঙ্কার
ওংকার!
শঙ্কারে করি লঙ্কার পার কার ধনু-টংকার
হুংকারে ওরে সাচ্চা-সরোদে শাশ্বত ঝংকার?
ভূমা- নন্দে রে সব টুটেছে অহংকার!

মর- মর্মরে
নর- ধর্ম রে
বড়ো কর্মরে দিল ইমানের জোর বর্ম রে,
ভর্ দিল্ জান্ – পেয়ে শান্তি নিখিল ফিরদৌসের হর্ম্য রে!
রণে তাই তো বিশ্ব-বয়তুল্লাতে মন্ত্র ও জয়নাদ –
‘ওয়ে মার্‌হাবা ওয়ে মার্‌হাবা এয়্ সর্‌ওয়ারে কায়েনাত !’


শর- ওয়ান
দর্- ওয়ান
আজি বান্দা যে ফেরউন শাদ্দাদ নমরুদ মারোয়ান ;
তাজি বোর্‌রাক্ হাঁকে আশমানে পর্‌ওয়ান, –
ও যে বিশ্বের চির সাচ্‌চারই বোর্‌হান –
‘কোর-আন’!

‘কোন্ জাদুমণি এলি ওরে’ – বলি রোয়ে মাতা আমিনায়
খোদার হবিবে বুকে চাপি, আহা, বেঁচে আজ স্বামী নাই!
দূরে আব্‌দুল্লার রুহ্ কাঁদে, “ওরে আমিনারে গমি নাই –

দেখো সতী তব কোলে কোন্ চাঁদ, সব ভর-পুর ‘কমি’ নাই।’
‘এয়্ ফর্ জন্দ’ –
হায় হর্‌দম্
ধায় দাদা মোত্‌লেব কাঁদি, – গায়ে ধুলা কর্দম!
‘ভাই। কোথা তুই?’ বলি বাচ্চারে কোলে কাঁদিছে হাম্‌জা দুর্দম!
ওই দিক্‌হারা দিক্‌পার হতে জোর-শোর আসে, ভাসে ‘কালাম’ –
‘এয় ‘শাম্‌সোজ্জোহা বদরোদ্দোজা কামারোজ্জমাঁ’ সালাম!’

ফাতেহা-ই-দোয়াজ্-দহম্ [তিরোভাব]

এ কী বিস্ময়! আজরাইলেরও জলে ভর-ভর চোখ!
বে-দরদ দিল্ কাঁপে থর-থর যেন জ্বর-জ্বর শোক।
জান-মরা তার পাষাণ-পাঞ্জা বিলকুল ঢিলা আজ,
কব্‌জা নিসাড়, কলিজা সুরাখ , খাক চুমে নীলা তাজ ।
জিব্‌রাইলের আতশি পাখা সে ভেঙে যেন খান খান,
দুনিয়ার দেনা মিটে যায় আজ তবু জান আন্-চান!
মিকাইল অবিরল
লোনা দরিয়ার সবই জল
ঢালে কুল মুল্লুকে , ভীম বাতে খায় অবিরল ঝাউ দোল।
এ কি দ্বাদশীর চাঁদ আজ সেই? সেই রবিয়ল আউওল ?

ঈশানে কাঁপিছে কৃষ্ণ নিশান, ইস্‌রাফিলের ও প্রলয়-বিষাণ আজ
কাতরায় শুধু! গুমরিয়া কাঁদে কলিজা-পিষানো বাজ!
রসুলের দ্বারে দাঁড়ায়ে কেন রে আজাজিল শয়তান?
তারও বুক বেয়ে আঁশু ঝরে, ভাসে মদিনার ময়দান!
জমিন্-আশমান জোড়া শির পাঁও তুলি তাজি বোর্‌রাক্ ,
চিখ্ মেরে কাঁদে ‘আরশে’ র পানে চেয়ে, মারে জোর হাঁক!
হুরপরি শোকে হায়
জল- ছলছল চোখে চায়।
আজ জাহান্নমের বহ্নি-সিন্ধু নিবে গেছে ক্ষরি জল,
যত ফিরদৌসের নার্গিস-লালা ফেলে আঁশু-পরিমল।

মৃত্তিকা-মাতা কেঁদে মাটি হল বুকে চেপে মরা লাশ,
বেটার জানাজা কাঁদে যেন – তাই বহে ঘন নাভি-শ্বাস!
পাতাল-গহ্বরে কাঁদে জিন, পুন মলো কি রে সোলেমান ?
বাচ্চারে মৃগী দুধ নাহি দেয়, বিহগীরা ভোলে গান!
ফুল পাতা যত খসে পড়ে, বহে উত্তর-চিরা বায়ু,
ধরণির আজ শেষ যেন আয়ু, ছিঁড়ে গেছে শিরা স্নায়ু!
মক্কা ও মদিনায়
আজ শোকের অবধি নাই!
যেন রোজ-হাশরের ময়দান, সব উন্মাদসম ছুটে।
কাঁপে ঘন ঘন কাবা , গেল গেল বুঝি সৃষ্টির দম টুটে।

নকিবের তূরী ফুৎকারি আজ বারোয়াঁর সুরে কাঁদে,
কার তরবারি খান খান করে চোট মারে দূরে চাঁদে?
আবুবকরের দর দর আঁশু দরিয়ার পারা ঝরে,
মাতা আয়েষার কাঁদনে মুরছে আশমানে তারা ডরে!
শোকে উন্মাদ ঘুরায় উমর ঘূর্ণির বেগে ছোরা,
বলে ‘আল্লার আজ ছাল তুলে নেব মেরে তেগ্ , দেগে কোঁড়া ।’
হাঁকে ঘন ঘন বীর –
‘হবে, জুদা তার তন শির,
আজ যে বলিবে নাই বেঁচে হজরত – যে নেবে রে তাঁরে গোরে।’
আজ দারাজ দস্তে তেজ হাতিয়ার বোঁও বোঁও করে ঘোরে!

গুম্বজে কে রে গুমরিয়া কাঁদে মসজিদে মস্‌জিদে?
মুয়াজ্জিনের হোশ্ নাই, নাই জোশ চিতে, শোষ হৃদে!
বেলালেরও আজ কণ্ঠে আজান ভেঙে যায় কেঁপে কেঁপে,
নাড়ি-ছেঁড়া এ কী জানাজার ডাক হেঁকে চলে ব্যেপে ব্যেপে!
উস্‌মানের আর হুঁশ নাই কেঁদে কেঁদে ফেনা উঠে মুখে,
আলি হাইদর ঘায়েল আজি রে বেদনার চোটে ধুঁকে!
আজ ভোঁতা সে দুধারি ধার
ওই আলির জুলফিকার !
আহা রসুল-দুলালি আদরিণী মেয়ে মা ফাতেমা ওই কাঁদে,
‘কোথা বাবাজান।’ বলি মাথা কুটে কুটে এলোকেশ নাহি বাঁধে!

হাসান-হুসেন তড়পায় যেন জবে-করা কবুতর,
‘নানাজান কই!’ বলি খুঁজে ফেরে কভু বার কভু ঘর।
নিবে গেছে আজ দিনের দীপালি, খসেছে চন্দ্র-তারা,
আঁধিয়ারা হয়ে গেছে দশ দিশি, ঝরে মুখে খুন-ঝারা!
সাগর-সলিল ফোঁপায়ে উঠে সে আকাশ ডুবাতে চায়,
শুধু লোনা জল তার আঁশু ছাড়া কিছু রাখিবে না দুনিয়ায়।
খোদ খোদা সে নির্বিকার,
আজ টুটেছে আসনও তাঁর!
আজ সখা মহ্‍বুবে বুকে পেতে দুখে কেন যেন কাঁটা বেঁধে,
তারে ছিনিবে কেমনে যার তরে মরে নিখিল সৃষ্টি কেঁদে!

বেহেশ্‌ত সব আরাস্তা আজ, সেথা মহা ধুম-ধাম,
গাহে হুরপরি যত, ‘সাল্লালাহু আলায়হি সাল্‌লাম।’
কাতারে কাতারে করজোড়ে সবে দাঁড়ায়ে গাহিছে জয়, –
ধরিতে না পেরে ধরা-মা-র চোখে দর দর ধারা বয়।
এসেছে আমিনা আবদুল্লা কি, এসেছে খদিজা সতী?
আজ জননীর মুখে হারামণি-পাওয়া-হাসা হাসে জগপতি!
‘খোদা, একী তব অবিচার!’
বলে কাঁদে সুত ধরা-মা-র।
আজ অমরার আলো আরও ঝলমল, সেথা ফোটে আরও হাসি,
শুধু মাটির মায়ের দীপ নিভে গেল, নেমে এল অমা-রাশি

* * * * *

আজ স্বরগের হাসি ধরার অশ্রু ছাপায়ে অবিশ্রাম
ওঠে একী ঘন রোল – ‘সাল্লাল্লাহু আলায়হি সাল্‌লাম।’

বন্দনা-গান

কোরাস : শিকলে যাদের উঠেছে বাজিয়া বীরের মুক্তি-তরবারি,
আমরা তাদেরই ত্রিশ কোটি ভাই, গাহি বন্দনা-গীতি তারই॥

তাদেরই উষ্ণ শোণিত বহিছে আমাদেরও এই শিরা-মাঝে,
তাদেরই সত্য-জয়-ঢাক আজি মোদেরই কণ্ঠে ঘন বাজে।
সম্মান নহে তাহাদের তরে ক্রন্দন-রোল দীর্ঘশ্বাস,
তাহাদেরই পথে চলিয়া মোরাও বরিব ভাই ওই বন্দি-বাস॥
শিকলে যাদের …

মুক্ত বিশ্বে কে কার অধীন? স্বাধীন সবাই আমরা ভাই।
ভাঙিতে নিখিল অধীনতা-পাশ মেলে যদি কারা, বরিব তাই।
জাগেন সত্য ভগবান যে রে আমাদেরই এই বক্ষ-মাঝ,
আল্লার গলে কে দেবে শিকল, দেখে নেব মোরা তাহাই আজ॥
শিকলে যাদের …

কাঁদিব না মোরা, যাও কারা-মাঝে যাও তবে বীর-সংঘ হে,
ওই শৃঙ্খলই করিবে মোদের ত্রিশ কোটি ভ্রাতৃ-অঙ্গ হে।
মুক্তির লাগি মিলনের লাগি আহুতি যাহারা দিয়াছে প্রাণ
হিন্দু-মুসলিম চলেছি আমরা গাহিয়া তাদেরই বিজয়-গান
শিকলে যাদের …

বন্দি-বন্দনা

আজি রক্ত-নিশি-ভোরে
একী এ শুনি ওরে,
মুক্তি-কোলাহল বন্দি-শৃঙ্খলে,
ওই কাহারা কারাবাসে
মুক্তি-হাসি হাসে,
টুটেছে ভয়-বাধা স্বাধীন হিয়া-তলে॥
ললাটে লাঞ্ছনা-রক্ত-চন্দন,
বক্ষে গুরু শিলা, হস্তে বন্ধন,
নয়নে ভাস্বর সত্য-জ্যোতি-শিখা,
স্বাধীন দেশ-বাণী কণ্ঠে ঘন বোলে,
সে ধ্বনি ওঠে রণি ত্রিংশ কোটি ওই
মানব-কল্লোলে॥
ওরা দু-পায়ে দলে গেল মরণ-শঙ্কারে,
সবারে ডেকে গেল শিকল-ঝংকারে,
বাজিল নভ-তলে স্বাধীন ডঙ্কারে,
বিজয়-সংগীত বন্দি গেয়ে চলে,
বন্দিশালা মাঝে ঝঞ্ঝা পশেছে রে
উতল কলরোলে॥
আজি কারার সারা দেহে মুক্তি-ক্রন্দন,
ধ্বনিছে হাহা স্বরে ছিঁড়িতে বন্ধন,
নিখিল গেহ যথা বন্দি-কারা, সেথা
কেন রে কারা-ত্রাসে মরিবে বীর-দলে।
‘জয় হে বন্ধন’ গাহিল তাই তারা
মুক্ত নভ-তলে॥
আজি ধ্বনিছে দিগ্‌বধূ শঙ্খ দিকে দিকে,
আজি গগনে কারা যেন চাহিয়া অনিমিখে,
ধু ধু ধু হোম-শিখা জ্বলিল ভারতে রে,
ললাটে জয়টিকা, প্রসূন-হার-গলে
চলে রে বীর চলে;
সে নহে নহে কারা, যেখানে ভৈরব-
রুদ্র-শিখা জ্বলে॥
কোরাস : জয় হে বন্ধন-মৃত্যু-ভয়-হর! মুক্তিকামী জয়।
স্বাধীন-চিত জয়। জয় হে
জয় হে! জয় হে! জয় হে!

বিজয়-গান

ওই অভ্র-ভেদী তোমার ধ্বজা
উড়ল আকাশ-পথে।
মা গো, তোমার রথ-আনা ওই
রক্ত-সেনার রথে॥
ললাট-ভরা জয়ের টিকা,
অঙ্গে নাচে অগ্নিশিখা,
রক্তে জ্বলে বহ্নিলিখা – মা!
ওই বাজে তোর বিজয়-ভেরি,
নাই দেরি আর নাই মা দেরি,
মুক্ত তোমার হতে॥
আনো তোমার বরণডালা, আনো তোমার শঙ্খ, নারী!
ওই দ্বারে মা-র মুক্তি সেনা, বিজয়-বাজা উঠছে তারই।

ওরে ভীরু! ওরে মরা!
মরার ভয়ে যাসনি তোরা;
তোদেরও আজ ডাকছি মোরা ভাই!
ওই খোলে রে মুক্তি-তোরণ,
আজ একাকার জীবন-মরণ
মুক্ত এ ভারতে॥

বিদ্রোহীর বাণী

দোহাই তোদের! এবার তোরা সত্যি করে সত্য বল্!
ঢের দেখালি ঢাক ঢাক আর গুড় গুড়, ঢের মিথ্যা ছল।
এবার তোরা সত্য বল॥
পেটে এক আর মুখে আর এক – এই যে তোদের ভণ্ডামি,
এতেই তোরা লোক হাসালি, বিশ্বে হলি কম-দামি।
নিজের কাছেও ক্ষুদ্র হলি আপন ফাঁকির আপশোশে,
বাইরে ফাঁকা পাঁইতারা তাই, নাই তলোয়ার খাপ-কোশে।
তাই হলি সব সেরেফ আজ
কাপুরুষ আর ফেরেব-বাজ,
সত্য কথা বলতে ডরাস, তোরা আবার করবি কাজ!
ফোঁপরা ঢেঁকির নেইকো লাজ!
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি দেখেই ঘর ছুটিস সব রামছাগল!
যুক্তি তোদের খুব বুঝেছি, দুধকে দুধ আর জলকে জল!
এবার তোরা সত্য বল॥

বুকের ভিতর ছ-পাই ন-পাই, মুখে বলিস স্বরাজ চাই,
স্বরাজ কথার মানে তোদের ক্রমেই হচ্চে দরাজ তাই!
‘ভারত হবে ভারতবাসীর’ – এই কথাটাও বলতে ভয়!
সেই বুড়োদের বলিস নেতা – তাদের কথায় চলতে হয়!

বল রে তোরা বল নবীন –
চাইনে এসব জ্ঞান-প্রবীণ!
স্ব-স্বরূপে দেশকে ক্লীব করছে এরা দিনকে দিন,
চায় না এরা – হই স্বাধীন!
কর্তা হবার শখ সবারই, স্বরাজ-ফরাজ ছল কেবল!
ফাঁকা প্রেমের ফুসমন্তর, মুখ সরল আর মন গরল!
এবার তোরা সত্য বল॥

মহান-চেতা নেতার দলে তোল রে তরুণ তোদের নায়,
ওঁরা মোদের দেবতা, সবাই করব প্রণাম ওঁদের পায়।
জানিস তো ভাই শেষ বয়সে স্বতই সবার মরতে ভয়,
ঝড়-তুফানে তাঁদের দিয়ে নয় তরি পার করতে নয়।

জোয়ানরা হাল ধরবে তার
করবে তরি তুফান পার!
জয় মা বলে মাল্লা তরুণ ওই তুফানে লাখ হাজার
প্রাণ দিয়ে ত্রাণ করবে মার!
সেদিন করিস এই নেতাদের ধ্বংস-শেষের সৃষ্টি কল।
ভয়-ভীরুতা থাকতে দেশের প্রেম ফলাবে ঘণ্টা ফল!
এবার তোরা সত্য বল॥

ধর্ম-কথা প্রেমের বাণী জানি মহান উচ্চ খুব,
কিন্তু সাপের দাঁত না ভেঙে মন্ত্র ঝাড়ে যে বেকুব!
‘ব্যাঘ্র সাহেব, হিংসে ছাড়ো, পড়বে এসো বেদান্ত!’
কয় যদি ছাগ, লাফ দিয়ে বাঘ অমনি হবে কৃতান্ত!
থাকতে বাঘের দন্ত-নখ
বিফল ভাই ওই প্রেম-সেবক!
চোখের জলে ডুবলে গর্ব শার্দুলও হয় বেদ-পাঠক,
প্রেম মানে না খুন-খাদক।
ধর্মগুরু ধর্ম শোনান, পুরুষ ছেলে যুদ্ধে চল।
সেও ভি আচ্ছা, মরব পিয়ে মৃত্যু-শোণিত-অ্যালকোহল!
এবার তোরা সত্য বল॥

প্রেমিক ঠাকুর মন্দিরে যান, গাড়ুন সেথায় আস্তানা!
শবে শিবায় শিব কেশবের – তৌবা – তাঁদের রাস্তা না!
মৃতের সামিল এখন ওঁরা, পূজা ওঁদের জোরসে হোক,
ধর্মগুরু গোর-সমাধি পূজে যেমন নিত্য লোক!

তরুণ চাহে যুদ্ধ-ভূম!
মুক্তি-সেনা চায় হুকুম!
চাই না ‘নেতা’, চাই ‘জেনারেল’, প্রাণ-মাতনের ছুটুক ধূম!
মানব-মেধের যজ্ঞধূম।
প্রাণ-আঙুরের নিঙরানো রস – সেই আমাদের শান্তি-জল।
সোনা-মানিক ভাইরা আমার ! আয় যাবি কে তরতে চল।
এবার তোরা সত্য বল॥

যেথায় মিথ্যা ভণ্ডামি ভাই করব সেথায় বিদ্রোহ!
ধামা-ধরা! জামা-ধরা! মরণ-ভীতু! চুপ রহো!
আমরা জানি সোজা কথা, পূর্ণ স্বাধীন করব দেশ!
এই দুলালুম বিজয়-নিশান, মরতে আছি – মরব শেষ!
নরম গরম পচে গেছে, আমরা নবীন চরম দল!
ডুবেছি না ডুবতে আছি, স্বর্গ কিংবা পাতাল-তল!

বোধন

দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥
কেঁদো না, দমো না, বেদনা-দীর্ণ এ প্রাণে আবার আসিবে শক্তি,
দুলিবে শুষ্ক শীর্ষে তোমারও সবুজ প্রাণের অভিব্যক্তি।
জীবন-ফাগুন যদি মালঞ্চ-ময়ূর তখতে আবার বিরাজে,
শোভিবেই ভাই, ওই তো সেদিন, শোভিবে এ শিরও পুষ্প-তাজে॥

হোয়ো না নিরাশ, অজানা যখন ভবিষ্যতের সব রহস্য,
যবনিকা-আড়ে প্রহেলিকা-মধু, – বীজেই সুপ্ত স্বর্ণ শস্য!
অত্যাচার আর উৎপীড়নে সে আজিকে আমার পর্যুদস্ত,
ভয় নাই ভাই! ওই যে খোদার মঙ্গলময় বিপুল হস্ত!
দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥

দুদিনের তরে গ্রহ-ফেরে ভাই সব আশা যদি না হয় পূর্ণ,
নিকট সেদিন, রবে না এদিন, হবে জালিমের গর্ব চূর্ণ!
পুণ্য-পিয়াসী যাবে যারা ভাই মক্কার পূত তীর্থ লভ্যে;
কণ্টক-ভয়ে ফিরবে বা তারা বরং পথেই জীবন সঁপবে।
দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥

অস্তিত্বের ভিত্তি মোদের বিনাশেও যদি ধ্বংস-বন্যা,
সত্য মোদের কাণ্ডারি ভাই, তুফানে আমরা পরোয়া করি না।
যদিও এ পথ ভীতি-সংকুল, লক্ষ্যস্থলও কোথায় দূরে,
বুকে বাঁধো বল, ধ্রুব-অলক্ষ্য আসিবে নামিয়া অভয় তূরে।
দুঃখ কী ভাই, হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥

অত্যাচার আর উৎপীড়নে সে আজিকে আমরা পর্যুদস্ত,
ভয় নাই ভাই! রয়েছে খোদার মঙ্গলময় বিপুল হস্ত!
কী ভয় বন্দি, নিঃস্ব যদিও, অমার আঁধারে পরিত্যক্ত,
যদি রয় তব সত্য-সাধনা স্বাধীন জীবন হবেই ব্যক্ত!
দুঃখ কী ভাই হারানো সুদিন ভারতে আবার আসিবে ফিরে,
দলিত শুষ্ক এ মরুভূ পুন হয়ে গুলিস্তাঁ হাসিবে ধীরে॥

ভূত-ভাগানোর গান


ওই তেত্রিশ কোটি দেবতাকে তোর তেত্রিশ কোটি ভূতে
আজ নাচ বুড্‌ঢি নাচায় বাবা উঠতে বসতে শুতে!
ও ভূত যেই দেখেছে মন্দির তোর
নাই দেবতা নাচছে ইতর,
আর মন্ত্র শুধু দন্ত-বিকাশ, অমনি ভূতের পুতে,
তোর ভগবানকে ভূত বানালে ঘানি-চক্রে জুতে॥


ও ভূত যেই জেনেছে তোদের ওঝা
আজ নকলের বইছে বোঝা,
ওরে অমনি সোজা তোদের কাঁধে খুঁটো তাদের পুঁতে,
আজ ভূত-ভাগানোর মজা দেখায় বোম-ভোলা বম্বুতে!

ও ভূত সর্ষে-পড়া অনেক ধুনো
দেখে শুনে হল ঝুনো,
তাই তুলো-ধুনো করছে ততই যতই মরিস কুঁথে,
ও ভূত নাচছে রে তোর নাকের ডগায় পারিসনে তুই ছুঁতে!

আগে বোঝেনিকো তোদের ওঝা
তোরা গোঁজামিলের মন্ত্র-ভজা।
(শিখলি শুধু চক্ষু-বোঁজা)
শিখলি শুধু কানার বোঝা কুঁজোর ঘাড়ে থুতে,
তাই আপনাকে তুই হেলা করে ডাকিস স্বর্গদূতে॥

ওরে জীবন-হারা, ভূতে-খাওয়া!
ভূতের হাতে মুক্তি পাওয়া
সে কি সোজা? – ভূত কি ভাগে ফুসমন্তর ফুঁতে?
তোরা ফাঁকির ‘কিন্তু’ এড়িয়ে – পড়বি কূলহারা ‘কিন্তু’তে!

ওরে ভূত তো ভূত – ওই মারের চোটে
ভূতের বাবাও উধাও ছোটে!
ভূতের বাপ ওই ভয়টাকে মার, ভূত যাবে তোর ছুটে।
তখন ভূতে-পাওয়া এই দেশই ফের ভরবে দেবতা দূতে॥

মরণ-বরণ

এসো এসো এসো ওগো মরণ!
এই মরণ-ভীতু মানুষ-মেষের ভয় করো তো হরণ॥
না বেরিয়েই পথে যারা পথের ভয়ে ঘরে
বন্ধ-করা অন্ধকারে মরার আগেই মরে,
তাতা থইথই তাতা থইথই তাদের বুকের পরে
ভীম রুদ্রতালে নাচুক তোমার ভাঙন-ভরা চরণ॥
দীপক রাগে বাজাও জীবন-বাঁশি,
মড়ার মুখেও আগুন উঠুক হাসি।
কাঁধে পিঠে কাঁদে যেথা শিকল জুতোর-ছাপ,
নাই সেখানে মানুষ সেথা বাঁচা-ও মহাপাপ।
সে দেশের বুকে শ্মশান-মশান জ্বালুক তোমার শাপ,
সেথা জাগুক নবীন সৃষ্টি আবার হোক নব নামকরণ॥
হাতের তোমার দণ্ড উঠুক কেঁপে
এবার দাসের ভুবন ভবন ব্যেপে,
মেষগুলোকে শেষ করে দেশ-চিতার বুকে নাচো!
শব করে আজ শয়ন, হে শিব জানাও তুমি আছ।
মরায়-ভরা ধরায়, মরণ! তুমিই শুধু বাঁচো –
এই শেষের মাঝেই অশেষ তুমি, করছি তোমায় বরণ॥
জ্ঞান-বুড়ো ওই বলছে জীবন মায়া,
নাশ করো ওই ভীরুর কায়া ছায়া!
মুক্তিদাতা মরণ! এসো কালবোশেখির বেশে;
মরার আগেই মরল যারা, নাও তাদেরে এসে।
জীবন তুমি সৃষ্টি তুমি জরা-মরার দেশে,
তাই শিকল-বিকল মাগছে তোমার মরণ-হরণ শরণ॥

 মুক্ত-পিঞ্জর

ভেদি দৈত্য-কারা
উদিলাম পুন আমি কারা-ত্রাস চির-মুক্ত বাধাবন্ধ-হারা
উদ্দামের জ্যোতি-মুখরিত মহা-গগন-অঙ্গনে –
হেরিনু, অনন্তলোক দাঁড়াল প্রণতি করি মুক্ত-বন্ধ আমার চরণে।
থেমে গেল ক্ষণেকের তরে বিশ্ব-প্রণব-ওংকার,
শুনিল কোথায় বাজে ছিন্ন শৃঙ্খলে কার আহত ঝংকার!

কালের করাতে কার ক্ষয় হল অক্ষয় শিকল,
শুনি আজি তারই আর্ত জয়ধ্বনি ঘোষিল গগন পবন জল স্থল।
কোথা কার আঁখি হতে সরিল পাষাণ-যবনিকা,
তারই আঁখি-দীপ্তি-শিখা রক্ত-রবি-রূপে হেরি ভরিল উদয়-ললাটিকা।

পড়িল গগন-ঢাকে কাঠি,
জ্যোতির্লোক হতে ঝরা করুণা-ধারায় – ডুবে গেল ধরা-মা-র স্নেহ-শুষ্ক মাটি,
পাষাণ-পিঞ্জর ভেদি, ছেদি নভ-নীল –

বাহিরিল কোন্ বার্তা নিয়া পুন মুক্তপক্ষ অগ্নি-জিব্রাইল!
দৈত্যাগার দ্বারে দ্বারে ব্যর্থ রোষে হাঁকিল প্রহরী!
কাঁদিল পাষাণে পড়ি
সদ্য-ছিন্ন চরণ-শৃঙ্খল!

মুক্তি মার খেয়ে কাঁদে পাষাণ-প্রাসাদ-দ্বারে আহত অর্গল!
শুনিলাম – মম পিছে পিছে যেন তরঙ্গিছে
নিখিল বন্দির ব্যথা-শ্বাস –
মুক্তি-মাগা ক্রন্দন-আভাস।

ছুটে এসে লুটায়ে লুটায়ে যেন পড়ে মম পায়ে;
বলে – ‘ওগো ঘরে-ফেরা মুক্তি-দূত!
একটুকু ঠাঁই কিগো হবে না ও ঘরে-নেওয়া নায়ে?’
নয়ন নিঙাড়ি এল জল,
মুখে বলিলাম তবু – ‘বন্ধু! আর দেরি নাই, যাবে রসাতল
পাষাণ-প্রাচীর-ঘেরা ওই দৈত্যাগার,
আসে কাল রক্ত-অশ্বে চড়ি, হেরো দুরন্ত দুর্বার!’ –
বাহিরিনু মুক্ত-পিঞ্জর বুনো পাখি
ক্লান্ত কণ্ঠে জয় চির-মুক্তি ধ্বনি হাঁকি –
উড়িবারে চাই যত জ্যোতির্দীপ্ত মুক্ত নভ-পানে,
অবসাদ-ভগ্ন ডানা ততই আমারে যেন মাটি পানে টানে।
মা আমার! মা আমার! এ কী হল হায়!

কে আমারে টানে মা গো উচ্চ হতে ধরার ধূলায়?
মরেছে মা বন্ধহারা বহ্নিগর্ভ তোমার চঞ্চল,
চরণ-শিকল কেটে পরেছে সে নয়ন-শিকল।
মা! তোমার হরিণ-শিশুরে
বিষাক্ত সাপিনি কোন টানিছে নয়ন-টানে কোথা কোন্ দূরে!
আজ তব নীলকণ্ঠ পাখি গীতহারা
হাসি তার ব্যথা-ম্লান, গতি তার ছন্দহীন, বদ্ধ তার ঝরনাপ্রাণধারা!
বুঝি নাই রক্ষীঘেরা রাক্ষস-দেউলে
এল কবে মরু-মায়াবিনী
সিংহাসন পাতিল সে কবে মোর মর্ম-হর্ম্যমূলে!
চরণ-শৃঙ্খল মম যখন কাটিতেছিল কাল –
কোন্ চপলার কেশ-জাল
কখন জড়াতেছিল গতিমত্ত আমার চরণে,
লৌহবেড়ি যত যায় খুলে, তত বাঁধা পড়ি কার কঙ্কণবন্ধনে!
আজ যবে পলে পলে দিন-গণা পথ-চাওয়া পথ
বলে – ‘বন্ধু, এই মোর বুক পাতা, আনো তব রক্ত-পথ-রথ –’
শুনে শুধু চোখে আসে জল,
কেমনে বলিব, ‘বন্ধু! আজও মোর ছিঁড়েনি শিকল!
হারায়ে এসেছি সখা শত্রুর শিবিরে
প্রাণ-স্পর্শমণি মোর,
রিক্ত-কর আসিয়াছি ফিরে!’…
যখন আছিনু বদ্ধ রুদ্ধ দুয়ার কারাবাসে
কত না আহ্বান-বাণী শুনিতাম লতা-পুষ্প-ঘাসে!
জ্যোতির্লোক মহাসভা গগন-অঙ্গন
জানাত কিরণ-সুরে নিত্য নব নব নিমন্ত্রণ!
নাম-নাহি-জানা কত পাখি
বাহিরের আনন্দ-সভায় – সুরে সুরে যেত মোরে ডাকি।
শুনি তাহা চোখ ফেটে উছলাত জল –
ভাবিতাম, কবে মোর টুটিবে শৃঙ্খল,
কবে আমি ওই পাখি-সনে
গাব গান, শুনিব ফুলের ভাষা
অলি হয়ে চাঁপা-ফুলবনে।
পথে যেত অচেনা পথিক,
রুদ্ধ গবাক্ষ হতে রহিতাম মেলি আমি তৃষ্ণাতুর আঁখি নির্নিমিখ!
তাহাদের ওই পথ-চলা
আমার পরানে যেন ঢালিত কী অভিনব সুর-সুধাগলা!
পথ-চলা পথিকের পায়ে পায়ে লুটাত এ মন,
মনে হত, চিৎকারিয়া কেঁদে কই –
‘হে পথিক, মোরে দাও ওই তব বাধামুক্ত অলস চরণ!
দাও তব পথচলা পা-র মুক্তি-ছোঁয়া,
গলে যাক এ পাষাণ, টুটে যাক ও-পরশে এ কঠিন লোহা!’
সন্ধ্যাবেলা দূরে বাতায়নে,
জ্বলিত অচেনা দীপখানি,
ছায়া তার পড়িত এ বন্ধন-কাতর দু-নয়নে!

ডাকিতাম, ‘কে তুমি অচেনা বধূ কার গৃহ-আলো?
কারে ডাক দীপ-ইশারায়?
কার আশে নিতি নিতি এত দীপ জ্বাল?
ওগো, তব ওই দীপ সনে
ভেসে আসে দুটি আঁখি-দীপ কার এ রুদ্ধ প্রাঙ্গণে!’ –
এমনই সে কত মধু-কথা
ভরিত আমার বদ্ধ বিজন ঘরের নীরবতা।

ওগো, বাহিরিয়া আমি হায় এ কী হেরি –
ভাঙা-কারা বাহু মেলি আছে মোর সারা বিশ্ব ঘেরি!
পরাধীনা অনাথিনি জননী আমার –
খুলিল না দ্বার তাঁর,
বুকে তাঁর তেমনই পাষাণ,
পথতরুছায় কেহ ‘আয় আয় জাদু’ বলি জুড়াল না প্রাণ!

ভেবেছিনু ভাঙিলাম রাক্ষস-দেউল
আজ দেখি সে দেউল জুড়ে আছে সারা মর্মমূল!
ওগো, আমি চির-বন্দি আজ,
মুক্তি নাই, মুক্তি নাই,
মম মুক্তি নতশির আজ নতলাজ!
আজ আমি অশ্রুহারা পাষাণ-প্রাণের কূলে কাঁদি –
কখন জাগাবে এসে সাথি মোর ঘূর্ণি-হাওয়া রক্ত-অশ্ব উচ্ছৃঙ্খল আঁধি!
বন্ধু! আজ সকলের কাছে ক্ষমা চাই –
শত্রুপুরীমুক্ত আমি আপন পাষাণপুরে আজি বন্দি ভাই!

মুক্ত-বন্দি

বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দিবীর,
লঙ্ঘিলে আজি ভয়দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।
বন্দি তোমায় বন্দিবীর
জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!
অগ্রে তোমার নিনাদে শঙ্খ, পশ্চাতে কাঁদে ছয়-বছর,
অম্বরে শোনো ডম্বরু বাজে–‘অগ্রসর হও, অগ্রসর!’
কারাগার ভেদি নিশ্বাস ওঠে বন্দিনী কোন্ ক্রন্দসীর,
ডান-আঁখে আজ ঝলকে অগ্নি, বাম-আঁখে ঝরে অশ্রু-নীর।
বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডি-মুক্ত বন্দি-বীর,
লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।
বন্দি তোমায় বন্দিবীর
জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!

পথতরুছায় ডাকে ‘আয় আয়’ তব জননীর আর্ত স্বর,
এ আগুন-ঘরে কাঁপিল সহসা ‘সপ্তদশ সে বৈশ্বানর’।
আগমনি তব রণদুন্দুভি বাজিছে বিজয়-ভৈরবীর,
জয় অবিনাশী উল্কা-পথিক চিরসৈনিক উচ্চশির।
বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দিবীর,
লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।
বন্দি তোমায় বন্দিবীর
জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!

রুদ্ধ-প্রতাপ হে যুদ্ধবীর, আজি প্রবুদ্ধ নব বলে।
ভুলো না বন্ধু, দলেছ দানব যুগে যুগে তব পদতলে!
এ নহে বিদায়, পুন হবে দেখা অমর-সমর-সিন্ধুতীর,
এসো বীর এসো, ললাটে এঁকে দি অশ্রুতপ্ত লাল রুধির।
বন্দি তোমায় ফন্দি-কারার গণ্ডিমুক্ত বন্দি-বীর,
লঙ্ঘিলে আজি ভয়-দানবের ছয় বছরের জয়প্রাচীর।
বন্দি তোমায় বন্দিবীর
জয় জয়স্তু বন্দিবীর!!

মুক্তি-সেবকের গান

ও ভাই মুক্তিসেবক দল!
তোদের কোন্ ভায়ের আজ বিদায়-ব্যথায় নয়ান ছল-ছল?
ওই কারা-ঘর তো নয় হারা-ঘর,
হোথাই মেলে মা-র-দেওয়া বর রে!
ওরে হোথাই মেলে বন্দিনী মা-র বুক-জড়ানো কোল!
তবে কীসের রোদনরোল?
তোরা মোছ রে আঁখির জল।
ও ভাই মুক্তিসেবক দল!।

আজ কারায় যারা, তাদের তরে।
গৌরবে বুক উঠুক ভরে রে!
মোরা ওদের মতোই বেদনা ব্যথা মৃত্যু আঘাত হেসে
বরণ যেন করতে পারি মাকে ভালোবেসে।
ওরে স্বাধীনকে কে বাঁধতে পারে বল?
ও ভাই মুক্তিসেবক দল!

ও ভাই প্রাণে যদি সত্য থাকে তোর
মরবে নিজেই মিথ্যা, ভীরু চোর।
মোরা কাঁদব না আজ যতই ব্যথায় পিষুক কলজে-তল।
মুক্তকে কি রুখতে পারে অসুর পশুর দল?
মোরা কাঁদব যেদিন আসবে তারা আবার ফিরে রে,
কাঙালিনি মায়ের আমার এই আঙিনা-তল।
ও ভাই মুক্তিসেবক দল॥

যুগান্তরের গান

বলো ভাই মাভৈঃ মাভৈঃ
নবযুগ ওই এল ওই
এল ওই রক্ত-যুগান্তর রে।
বলো জয় সত্যের জয়
আসে ভৈরব-বরাভয়
শোনো অভয় ওই রথ-ঘর্ঘর রে॥
রে বধির! শোন পেতে কান
ওঠে ওই কোন্ মহা-গান
হাঁকছে বিষাণ ডাকছে ভগবান রে।
জগতে জাগল সাড়া
জেগে ওঠ উঠে দাঁড়া
ভাঙ পাহারা মায়ার কারা-ঘর রে।
যা আছে যাক না চুলায়
নেমে পড় পথের ধুলায়
নিশান দুলায় ওই প্রলয়ের ঝড় রে।
সে ঝড়ের ঝাপটা লেগে
ভীম আবেগে উঠনু জেগে
পাষাণ ভেঙে প্রাণ-ঝরা নির্ঝর রে।
ভুলেছি পর ও আপন
ছিঁড়েছি ঘরের বাঁধন
স্বদেশ স্বজন স্বদেশ মোদের ঘর রে।
যারা ভাই বদ্ধ কুয়ায়
খেয়ে মার জীবন গোঁয়ায়
তাদের শোনাই প্রাণ-জাগা মন্তর রে।
ঝড়ের ঝাঁটার ঝাণ্ডার নেড়ে
মাভৈঃ-বাণীর ডঙ্কা মেরে
শঙ্কা ছেড়ে হাঁক প্রলয়ংকর রে।
তোদের ওই চরণ-চাপে
যেন ভাই মরণ কাঁপে,
মিথ্যা পাপের কণ্ঠ চেপে ধর রে।
শোনা তোর বুক-ভরা গান,
জাগা ফের দেশ-জোড়া প্রাণ,
যে বলিদান প্রাণ ও আত্মপর রে॥
মোরা ভাই বাউল চারণ,
মানি না শাসন বারণ
জীবন মরণ মোদের অনুচর রে।
দেখে ওই ভয়ের ফাঁসি
হাসি জোর জয়ের হাসি,
অ-বিনাশী নাইকো মোদের ডর রে!
গেয়ে যাই গান গেয়ে যাই,
মরা-প্রাণ উটকে দেখাই
ছাই-চাপা ভাই অগ্নি ভয়ংকর রে॥
খুঁড়ব কবর তুড়ব শ্মশান
মড়ার হাড়ে নাচাব প্রাণ
আনব বিধান নিদান কালের বর রে।
শুধু এই ভরসা রাখিস
মরিসনি ভিরমি গেছিস
ওই শুনেছিস ভারত-বিধির স্বর রে।
ধর হাত ওঠ রে আবার
দুর্যোগের রাত্রি কাবার,
ওই হাসে মা-র মূর্তি মনোহর রে॥

শিকল-পরার গান

এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল-পরা ছল।
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করব রে বিকল॥

তোদের বন্ধ কারায় আসা মোদের বন্দি হতে নয়,
ওরে ক্ষয় করতে আসা মোদের সবার বাঁধন-ভয়।
এই বাঁধন পরেই বাঁধন-ভয়কে করব মোরা জয়,
এই শিকলবাঁধা পা নয় এ শিকলভাঙা কল॥
তোমার বন্ধ ঘরের বন্ধনীতে করছ বিশ্ব গ্রাস,
আর ত্রাস দেখিয়েই করবে ভাবছ বিধির শক্তি হ্রাস।
সেই ভয়-দেখানো ভূতের মোরা করব সর্বনাশ,
এবার আনব মাভৈঃ-বিজয়মন্ত্র বলহীনের বল॥

তোমরা ভয় দেখিয়ে করছ শাসন, জয় দেখিয়ে নয়;
সেই ভয়ের টুঁটিই ধরব টিপে, করব তারে লয়।
মোরা আপনি মরে মরার দেশে আনব বরাভয়,
মোরা ফাঁসি পরে আনব হাসি মৃত্যু-জয়ের ফল॥

ওরে ক্রন্দন নয়, বন্ধন এই শিকল-ঝঞ্ঝনা,
এ যে মুক্তি-পথের অগ্রদূতের চরণ-বন্দনা।
এই লাঞ্ছিতেরাই অত্যাচারকে হানছে লাঞ্ছনা,
মোদের অস্থি দিয়েই জ্বলবে দেশে আবার বজ্রানল॥

সত্য-মন্ত্র

পুথির বিধান যাক পুড়ে তোর,
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!
(এই) খোদার উপর খোদকারি তোর
মানবে না আর সর্বলোক!
মানবে না আর সর্বলোক!!

(তোর) ঘরের প্রদীপ নিবেই যদি,
নিবুক না রে, কীসের ভয়?
আঁধারকে তোর কীসের ভয়?
(ওই) ভুবন জুড়ে জ্বলছে আলো,
ভবনটাই সে সত্য নয়।
ঘরটাই তোর সত্য নয়।
(ওই) বাইরে জ্বলছে চন্দ্র সূর্য
নিত্যকালের তাঁর আলোক।
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!

লোক-সমাজের শাসক রাজা,
(আর) রাজার শাসক মালিক যেই,
বিরাট যাঁহার সৃষ্টি এই,
তাঁর শাসনকে অগ্রে মান
তার বড়ো আর শাস্ত্র নেই,
তার বড়ো আর সত্য নেই!
সেই খোদা খোদ সহায় তোর,
ভয় কী? নিখিল মন্দ ক’ক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!

বিধির বিধি মানতে গিয়ে
নিষেধ যদি দেয় আগল
বিশ্ব যদি কয় পাগল,
আছেন সত্য মাথার পর, –
বেপরোয়া তুই সত্য বল।
বুক ঠুকে তুই সত্য বল!

(তখন) তোর পথেরই মশাল হয়ে
জ্বলবে বিধির রুদ্র-চোখ!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!

মনুর শাস্ত্র রাজার অস্ত্র
আজ আছে কাল নাইকো আশ,
কাল তারে কাল করবে গ্রাস।
হাতের খেলা সৃষ্টি যাঁর
তাঁর শুধু ভাই নাই বিনাশ,
স্রষ্টার সেই নাই বিনাশ!
সেই বিধাতায় মাথায় করে
বিপুল গর্বে বক্ষ ঠোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
সত্যতে নাই ধানাই পানাই
সত্য যাহা সহজ তাই,
সত্য যাহা সহজ তাই;
আপনি তাতে বিশ্বাস আসে,
আপনি তাতে শক্তি পায়
সত্যের জোর-জুলুম নাই
সেই সে মহান সত্যকে মান –
রইবে না আর দুঃখ-শোক।
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!

নানান মুনির নানান মত যে,
মানবি বল সে কার শাসন?
কয় জনার বা রাখবি মন?
এক সমাজকে মানলে করবে
আরেক সমাজ নির্বাসন,
চারিদিকে শৃঙ্খল বাঁধন!
সকল পথের লক্ষ্য যিনি
চোখ পুরে নে তাঁর আলোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!

সত্য যদি হয় ধ্রুব তোর,
কর্মে যদি না রয় ছল,
ধর্ম-দুগ্ধে না রয় জল,
সত্যের জয় হবেই হবে,
আজ নয় কাল মিলবে ফল,
আজ নয় কাল মিলবে ফল।
(আর)প্রাণের ভিতর পাপ যদি রয়
চুষবে রক্ত মিথ্যা-জোঁক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!

জাতের চেয়ে মানুষ সত্য,
অধিক সত্য প্রাণের টান,
প্রাণ-ঘরে সব এক সমান।
বিশ্বপিতার সিংহ-আসন
প্রাণবেদিতেই অধিষ্ঠান,
আত্মার আসন তাইতো প্রাণ।
জাত-সমাজের নাই সেথা ঠাঁই
জগন্নাথের সাম্য-লোক
জগন্নাথের তীর্থ-লোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!

চিনেছিলেন খ্রিস্ট বুদ্ধ
কৃষ্ণ মোহম্মদ ও রাম –
মানুষ কী আর কী তার দাম।
(তাই) মানুষ যাদের করত ঘৃণা,
তাদের বুকে দিলেন স্থান
গান্ধি আবার গান সে গান।
(তোরা) মানব-শত্রু তোদেরই হায়
ফুটল না সেই জ্ঞানের চোখ।
বিধির বিধান সত্য হোক!
বিধির বিধান সত্য হোক!!

সেবক

সত্যকে হায় হত্যা করে অত্যাচারীর খাঁড়ায়,
নেই কি রে কেউ সত্যসাধক বুক খুলে আজ দাঁড়ায়?
শিকলগুলো বিকল করে পায়ের তলায় মাড়ায়, –
বজ্র-হাতে জিন্দানের ওই ভিত্তিটাকে নাড়ায়?
নাজাত -পথের আজাদ মানব নেই কি রে কেউ বাঁচা,
ভাঙতে পারে ত্রিশ কোটি এই মানুষ-মেষের খাঁচা?
ঝুটার পায়ে শির লুটাবে, এতই ভীরু সাঁচা? –

ফন্দি-কারায় কাঁদছিল হায় বন্দি যত ছেলে,
এমন দিনে ব্যথায় করুণ অরুণ আঁখি মেলে,
পাবক-শিখা হস্তে ধরি কে তুমি ভাই এলে?
‘সেবক আমি’ – হাঁকল তরুণ কারার দুয়ার ঠেলে।

দিন-দুনিয়ায় আজ খুনিয়ার রোজ-হাশরের মেলা,
করছে অসুর হক-কে না-হক, হক-তায়ালায় হেলা!
রক্ষ-সেনার লক্ষ আঘাত বক্ষে বড়োই বেঁধে,
রক্ষা করো, রক্ষা করো, উঠতেছে দেশ কেঁদে।
নেই কি রে কেউ মুক্তি-সেবক শহিদ হবে মরে,
চরণ-তলে দলবে মরণ ভয়কে হরণ করে,
ওরে জয়কে বরণ করে –
নেই কি এমন সত্য-পুরুষ মাতৃ-সেবক ওরে?
কাঁপল সে স্বর মৃত্যু-কাতর আকাশ-বাতাস ছিঁড়ে,
বাজ পড়েছে, বাজ পড়েছে ভারতমাতার নীড়ে!

দানব দলে শাস্তি আনে নাই কি এমন ছেলে?
একী দেখি গান গেয়ে ওই অরুণ আঁখি মেলে
পাবক-শিখা হস্তে ধরে কে বাছা মোর এলে?
‘মা গো আমি সেবক তোমার! জয় হোক মা-র।’
হাঁকল তরুণ কারার-দুয়ার ঠেলে!

বিশ্বগ্রাসীর ত্রাস নাশি আজ আসবে কে বীর এসো
ঝুট শাসনে করতে শাসন, শ্বাস যদি হয় শেষও।
– কে আজ বীর এসো।
‘বন্দি থাকা হীন অপমান!’ হাঁকবে যে বীর তরুণ, –
শির-দাঁড়া যার শক্ত তাজা, রক্ত যাহার অরুণ,
সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের,
খোদার রাহায় জান দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের।
দেশের পায়ে প্রাণ দিতে আজ ডাক পড়েছে তাদের,
সত্য-মুক্তি স্বাধীন জীবন লক্ষ্য শুধু যাদের।
হঠাৎ দেখি আসছে বিশাল মশাল হাতে ও কে?
‘জয় সত্যম্’ মন্ত্র-শিখা জ্বলছে উজল চোখে।
রাত্রি-শেষে এমন বেশে কে তুমি ভাই এলে?
‘সেবক তোদের, ভাইরা আমার! – জয় হোক মা-র!’
হাঁকল তরুণ কারার দুয়ার ঠেলে!

Exit mobile version