Site icon BnBoi.Com

নতুন চাঁদ – কাজী নজরুল ইসলাম

নতুন চাঁদ - কাজী নজরুল ইসলাম

অভেদম্

দেখিয়াছ সেই রূপের কুমারে, গড়িছে যে এই রূপ?
রূপে রূপে হয় রূপায়িত যিনি নিশ্চল নিশ্চুপ!
কেবলই রূপের আবরণে যিনি ঢাকিছেন নিজ কায়া
লুকাতে আপন মাধুরী যে জন কেবলই রচিছে মায়া!
সেই বহুরূপী পরম একাকী এই সৃষ্টির মাঝে
নিষ্কাম হয়ে কীরূপে সতত রত অনন্ত কাজে।
পরম নিত্য হয়ে অনিত্য রূপ নিয়ে এই খেলা
বালুকার ঘর গড়িছে ভাঙিছে সকাল-সন্ধ্যা বেলা।
আমরা সকলে খেলি তারই সাথে, তারই সাথে হাসি কাঁদি
তারই ইঙ্গিতে ‘পরম-আমি’রে শত বন্ধনে বাঁধি।
মোরে ‘আমি’ ভেবে তারে স্বামী বলি দিবাযামী নামি উঠি,
কভু দেখি – আমি তুমি যে অভেদ, কভু প্রভু বলে ছুটি।

একাকী হইয়া একা-একা খেলি, চুপ করে বসে থাকি।
ভালো নাহি লাগে, কেন সাধ জাগে খেলুড়িরে কাছে ডাকি!
সৃষ্টির ঘুড়ি উড়াই শূন্যে, আনন্দে প্রাণ নাচে,
দেখি সে লাটাই লুটায়ে পড়েছে কখন পায়ের কাছে।
বীজ রূপে রই – নিজ রূপ কই? খুঁজিতে সহসা দেখি
সেই বীজ-আমি মহাতরু হয়ে ছড়ায়ে পড়েছি – এ কী!
শাখাপ্রশাখায় পল্লবে-ফুলে ফলে-মূলে কত রূপে
কখন আমারে বিকশিত করি খেলিতেছি চুপে চুপে!
কত সে বিহগ-বিহগী আসিয়া বেঁধেছে আমাতে নীড়,
ঊর্ধ্বে নিম্নে কত অনন্ত আলো আঁধারের ভিড়।
অনন্ত দিকে অনন্ত শাখা, অনন্ত রূপ ধরি
উদ্ভিদ জড় জীব হয়ে আমি ফিরিতেছি সঞ্চরি।

চির-আনমনা উদাসীন, তাই নিজ সৃষ্টিরই মাঝে
হেরি কত শত ছন্দপতন অপূর্ণতা বিরাজে।
চমকি উঠিয়া সংহার করি আপনার সেই ভুল,
সেই ভুল দিয়া নতুন করিয়া ফুটাই সৃষ্টি-ফুল।
মৃত্যু কেমন লাগে মোর কাছে, শোনো সে বাণী অভয়,
আঁখির পলক পড়িলে যেমন ক্ষণিক সৃষ্টি-লয়,
একটি পলক আঁধারে হেরিয়া আবার সৃষ্টি হেরি,
মৃত্যুর পরে জীবন আসিতে ততটুকু হয় দেরি!
মৃত্যুর ভয় ভীত যারা, হয় তাদেরই নরকভোগ,
অমৃতে সেই ডুবে আছে, যার নিত্য আত্ম-যোগ!
মোরই আনন্দ সৃষ্টি করিছে স্ত্রী ও পুত্র আদি,
কেবলই মিলন লাগে নাকো ভালো, বিরহ রচিয়া কাঁদি।

কেবল শান্তি শ্রান্তি আনিলে নিজে অশান্তি আনি,
ভুলিয়া স্বরূপ ঠুলি পরে টানি শত কর্মের ঘানি।
রুদ্রের রূপে সংহার করি, প্রেমময় রূপে কাঁদি,
যারে ‘তুমি’ বল, সেই ‘আমি’ খুঁজি নিজের অন্ত আদি।
সংসারে আসি সং সেজে আমি – শত প্রিয়জন লয়ে,
আপনারে ভোগ করিতে জন্মি বিপুল তৃষ্ণা হয়ে।
যত ভোগ করি তত আপনার তৃষ্ণা বাড়িয়া যায়
অমৃত-মধু মদ হয়ে উঠে তৃষ্ণায় পিয়ালায়!
বন্ধু! কেমনে মিটিবে তৃষ্ণা পূর্ণেরে নাহি পেলে,
আমি যে নিজেই অপূর্ণরূপে এসেছি পূর্ণে ফেলে!
সৃষ্টি-স্থিতি-সংহার – এই তিন রূপই যাঁর লীলা,
সেই সাগরের আমি যে ঊর্মি, বিরহিণী ঊর্মিলা!

দুখ শোক ব্যাধি নিজে লই সাধি, – কখনও অত্যাচারী-
অসুর সাজিয়া কেড়ে খাই – পুন দেবতা সাজিয়া মারি!
বিদ্বেষ নাই, আসক্তিহীন শুধু সে খেলার ঝোঁকে
অসাম্য করি সৃজন – আবার সংহার করি ওকে।
খেলিতে খেলিতে সহসা চকিতে দেখি আপনারই কায়া
শ্রী ও সামঞ্জস্যবিহীন এ কী কুৎসিত ছায়া!
সেই কুৎসিত শ্রীহীন অসুরে তখনই বধিতে চাই,
মোর বিদ্রোহ সাম্য-সৃষ্টি – নাই সেথা ভেদ নাই।
নাই সেথা যশ তৃষ্ণার লোভ, নাই বিরোধের ক্লেদ,
নাই সেথা মোর হিংসার ভয়, নাই সেথা কোনো ভেদ,
নাই অহিংসা-হিংসা, সেখানে কেবল পরম সাম,
রাজনীতি নাই, কোনো ভীতি নাই, ‘অভেদম্’ তার নাম।

অভয়-সুন্দর

কুৎসিত যাহা, অসাম্য যাহা সুন্দর ধরণিতে –
হে পরম সুন্দরের পূজারি! হবে তাহা বিনাশিতে।
তব প্রোজ্জ্বল প্রাণের বহ্নিশিখায় দহিতে তারে
যৌবন ঐশ্বর্য-শক্তি লয়ে আসে বারে বারে।
যৌবনের এ ধর্ম বন্ধু, সংহার করি জরা
অজর অমর করিয়া রাখে এ প্রাচীনা বসুন্ধরা।
যৌবনের সে ধর্ম হারায়ে বিধর্মী তরুণেরা –
হেরিতেছি আজ ভারতে – রয়েছে জরার শকুনে ঘেরা।

যুগে যুগে জরাগ্রস্ত যযাতি তারই পুত্রের কাছে
আপন বিলাস ভোগের লাগিয়া যৌবন তার যাচে।
যৌবনে করি বাহন তাহার জরা চলে রাজপথে
হাসিছে বৃদ্ধ যুবক সাজিয়া যৌব-শক্তি-রথে।
জ্ঞান-বৃদ্ধের দন্তবিহীন বৈদান্তিক হাসি
দেখিছ তোমরা পরমানন্দে – আমি আঁখিজলে ভাসি
মহাশক্তির প্রসাদ পাইয়া চিনিলে না হায় তারে
শিবের স্কন্ধে শব চড়াইয়া ফিরিতেছ দ্বারে দ্বারে।

এই কি তরুণ? অরুণে ঢাকিবে বৃদ্ধের ছেঁড়া কাঁথা
এই তরুণের বুকে কি পরম-শক্তি-আসন পাতা?
ধূর্ত বুদ্ধিজীবীর কাছে কি শক্তি মানিবে হার?
ক্ষুদ্র রুধিবে ভোলানাথ শিব মহারুদ্রের দ্বার?
ঐরাবতেরে চালায় মাহুত শুধু বুদ্ধির ছলে –
হে তরুণ, তুমি জান কি হস্তী-মূর্খ কাহারে বলে?
অপরিমাণ শক্তি লইয়া ভাবিছ শক্তিহীন –
জরারে সেবিয়া লভিতেছ জরা, হইতেছ আয়ুক্ষীণ।

পেয়ে ভগবদ্-শক্তি যাহারা চিনিতে পারে না তারে
তাহাদের গতি চিরদিন ওই তমসার কারাগারে।
কোন লোভে, কোন মোহে তোমাদের এই নিম্নগ গতি?
চাকুরির মায়া হরিল কি তব এই ভগবদ্-জ্যোতি?
সংসারে আজও প্রবেশ করনি, তবু সংসার – মায়া
গ্রাস করিয়াছে তোমার শক্তি তোমার বিপুল কায়া।
শক্তি ভিক্ষা করিবে যাহারা ভোট-ভিক্ষুক তারা!
চেন কি – সূর্য-জ্যোতিরে লইয়া উনুন করেছে যারা?

চাকুরি করিয়া পিতামাতাদের সুখী করিতে কি চাহ?
তাই হইয়াছে নুড়ো-মুখ যত বুড়োর তলপিবাহ?
চাকর হইয়া বংশের তুমি করিবে মুখোজ্জ্বল?
অন্তরে পেয়ে অমৃত, অন্ধ, মাগিতেছ হলাহল!
হউক সে জজ, ম্যাজিস্ট্রেট কি মন্ত্রী কমিশনার –
স্বর্ণের গলাবন্ধ পরুক – সারমেয় নাম তার!
দাস হইবার সাধনা যাহার নহে সে তরুণ নহে –
যৌবন শুধু খোলস তাহার – ভিতরে জরারে বহে।

নাকের বদলে নরুন-চাওয়া এ তরুণেরে নাহি চাই –
আজাদ-মুক্ত-স্বাধীনচিত্ত যুবাদের গান গাই।
হোক সে পথের ভিখারি, সুবিধা-শিকারি নহে যে যুবা
তারই জয়গাথা গেয়ে যায় চিরদিন মোর দিলরুবা।
তাহারই চরণধূলিরে পরম প্রসাদ বলিয়া মানি
শক্তিসাধক তাহারেই আমি বন্দি যুক্ত-পাণি।
মহা-ভিক্ষু তাহাদেরই লাগি তপস্যা করি আজও
তাহাদেরই লাগি হাঁকি নিশিদিন – ‘বাজো রে শিঙ্গা বাজো!’

সমাধির গিরিগহ্বরে বসি তাহাদেরই পথ চাহি –
তাহাদেরই আভাস পেলে মনে হয় পাইলাম বাদশাহি!
মোর সমাধির পাশে এলে কেউ, ঢেউ ওঠে মোর বুকে –
‘মোর চির-চাওয়া বন্ধু এলে কি’ বলে চাহি তার মুখে।
জ্যোতি আছে হায় গতি নাই হেরি তার মুখ পানে চেয়ে –
কবরে ‘সবর’ করিয়া আমার দিন যায় গান গেয়ে!
কারে চাই আমি কী যে চাই হায় বুঝে না উহারা কেহ।
দেহ দিতে চায় দেশের লাগিয়া, মন টানে তার গেহ।

কোথা গৃহহারা, স্নেহহারা ওরে ছন্নছাড়ার দল –
যাদের কাঁদনে খোদার আরশ কেঁপে ওঠে টলমল।
পিছনে চাওয়ার নাহি যার কেউ, নাই পিতামাতা জ্ঞাতি
তারা তো আসে না জ্বালাইতে মোর আঁধার কবরে বাতি!
আঁধারে থাকিয়া, বন্ধু, দিব্যদৃষ্টি গিয়াছে খুলে
আমি দেখিয়াছি তোমাদের বুকে ভয়ের যে ছায়া দুলে।
তোমরা ভাবিছ – আমি বাহিরিলে তোমরা ছুটিবে পিছে –
আপনাতে নাই বিশ্বাস যার – তাহার ভরসা মিছে!

আমি যদি মরি সমুখ-সমরে – তবু যারা টলিবে না –
যুঝিবে আত্মশক্তির বলে তারাই অমর সেনা।
সেই সেনাদল সৃষ্টি যেদিন হইবে – সেদিন ভোরে
মোমের প্রদীপ নহে গো – অরুণ সূর্য দেখিব গোরে!
প্রতীক্ষারত শান্ত অটল ধৈর্য লইয়া আমি
সেই যে পরম ক্ষণের লাগিয়া জেগে আছি দিবা-যামী।
ভয়কে যাহারা ভুলিয়াছে – সেই অভয় তরুণ দল
আসিবে যেদিন – হাঁকিব সেদিন – ‘সময় হয়েছে, চল!’

আমি গেলে যারা আমার পতাকা ধরিবে বিপুল বলে –
সেই সে অগ্রপথিকের দল এসো এসো পথতলে!
সেদিন মৌন সমাধিমগ্ন ইসরাফিলের বাঁশি
বাজিয়া উঠিবে – টুটিবে দেশের তমসা সর্বনাশী!

অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি

চরণারবিন্দে লহো অশ্রু-পুষ্পাঞ্জলি,
হে রবীন্দ্র, তব দীন ভক্ত এ কবির।
অশীতি-বার্ষিকী তব জনম-উৎসবে
আসিয়াছি নিবেদিতে নীরব প্রণাম।
হে কবিসম্রাট, ওগো সৃষ্টির বিস্ময়,
হয়তো হইনি আজও করুণাবঞ্চিত!
সঞ্চিত যে আছে আজও স্মৃতির দেউলে
তব স্নেহ করুণা তোমার, মহাকবি!
ধ্যান-শান্ত মৌন তব কাব্য-রবিলোকে
সহসা আসিনু আমি ধূমকেতুসম
রুদ্রের দুরন্ত দূত, ছিন্ন হর-জটা,
কক্ষচ্যুত উপগ্রহ! বক্ষে ধরি তুমি
ললাট চুমিয়া মোর দানিলে আশিস!
দেখেছিল যারা শুধু মোর উগ্ররূপ,
অশান্ত রোদন সেথা দেখেছিলে তুমি!
হে সুন্দর, বহ্নিদগ্ধ মোর বুকে তাই
দিয়াছিলে ‘বসন্তের’ পুষ্পিত মালিকা!
একা তুমি জানিতে হে, কবি মহাঋষি,
তোমারই বিচ্যুত-ছটা আমি ধূমকেতু!
আগুনের ফুলকি হল ফাগুনের ফুল,
অগ্নি-বীণা হল ব্রজকিশোরের বেণু।
শিব-শিরে শশিলেখা হল ধূমকেতু,
দাহ তার ঝরিলো গো অশ্রু-গঙ্গা হয়ে।

বিশ্ব-কাব্যলোকে কবি, তব মহাদান
কত যে বিপুল, কত যে অপরিমাণ
বিচার করিতে আমি যাব না তাহার,
মৃৎভাণ্ড মাপিবে কি সাগরের জল?
যতদিন রবে রবি, রবে সৌরলোক,
হে সুন্দর, ততদিন তব রশ্মিলেখা
দিব্যজ্যোতিঃ পুষ্প গ্রহ-তারকার মতো
অসীম গগনে রবে নিত্য সমুজ্জ্বল!
ছন্দায়িত হবে ছন্দে সৃষ্টি যতদিন,
ছন্দ-ভারতীর পায়ে বাণীর নূপুর
ঝংকারিবে যতদিন বৃষ্টিধারাসম
ততদিন মধুচ্ছন্দা করি, ছন্দ তব
লীলায়িত হবে মধুমতী-স্রোত সম।
বিহগের কন্ঠে গীত রবে যতদিন,
যতদিন রবে সুর দখিনা পবনে,
হিল্লোলিত সিন্ধুজলে ঝরনা-তটিনীতে,
বহিবে বিরহী-বুকে রোদন-প্রবাহ –
ততদিন তব গান তব সুর কবি
মর্মরিবে মরমির মরমে মরমে!
মৌনা যদি কোনোদিন হয় বীণাপাণি
তব বীণা কবি কভু হবে না নীরব।
যেমন ছড়ান রশ্মি সূর্য-নারায়ণ
সেই রশ্মি রূপ নেয় শত শত রঙে
পল্লবে ও ফুলে ফলে জলে স্থলে ব্যোমে,
তেমনই দেখেছি আমি বিমুগ্ধ নয়নে
অপরূপ রাগ-রেখা তোমার লেখায়, –
মুরছিত হইয়াছে আবেশে এ তনু।

দেখেছি তোমারে যবে হইয়াছে মনে
তুমি চিরসুন্দরের পরম বিলাস!
মানুষ এ পৃথিবীতে অন্তরে বাহিরে
কত সে উদার কত নির্মল মধুর
কত প্রিয়-ঘন প্রেমরসসিক্ত তনু
কত সে সুন্দর হতে পারে সর্বরূপে
তাই প্রকাশের তরে পরম সুন্দর
বিগ্রহ তোমার গড়েছিল ওগো কবি!
যখনই কবিতা তব পড়িয়াছি আমি
তার আস্বাদনে যেন হয়ে গেছি লয়,
রস পান করে আমি হয়ে গেছি রস,
বলিতে পারি না তাই সে রস কেমন।
তোমারে দেখিতে গিয়া দেখিয়াছি আমি
বক্ষে তব চির-রূপ-রসবিলাসীরে!
হারায়ে ফেলেছি সেথা সত্তা আপনার
কাঁদিয়াছি রূপমুগ্ধা রাধিকার মতো।
হে কবি, আজিও শুনি সে চির-কিশোর
তোমার বেণুতে গাহে যৌবনের গান।
সেথা তুমি কবি নও, ঋষি নহ তুমি,
সেথা তুমি মোর প্রিয় পরম সুন্দর!

শুনি আজও কত শত পাথরের ঢেলা
তোমারে নিষ্ঠুর বলে, বলে – প্রেম নাই।
মেঘের হুংকার শুধু শুনিল তাহারা,
দেখিল না রসধারা, দেখিল বিদ্যুৎ!
এ বিশ্বে অনন্ত রস ঝরে অনুক্ষণ
কত জন পাইয়াছে সে রসের স্বাদ?
সেই রসে তরুলতা হয় ফুলময়,
পাথরের নুড়ি বলে, পৃথিবী নীরস।

হে প্রেম-সুন্দর মম, আমি নাহি জানি
কে কত পেয়েছে তব প্রেম-রসধারা।
আমি জানি, তব প্রেম আমার আগুন
নিভায়ে, দিয়াছে সেথা কান্তি অপরূপ।
মনে পড়ে? বলেছিলে হেসে একদিন,
‘তরবারি দিয়ে তুমি চাঁছিতেছ দাড়ি!
যে জ্যোতি করিতে পারে জ্যোতির্ময় ধরা
সে জ্যোতিরে অগ্নি করি হলে পুচ্ছ-কেতু?’
হাসিয়া কহিলে পরে, ‘এই যশ-খ্যাতি
মাতালের নিত্য সান্ধ্য নেশার মতন।
এ মজা না পেলে মন ম্যাজম্যাজ করে
মধুর ভৃঙ্গারে কেন কর মদ্যপান?’

যে বহ্নিতরঙ্গ উঠেছিল মোর মাঝে
তোমার পরশে তাহা হল চন্দ্র-জ্যোতি।
মনে হল তুমি সেই নওলকিশোর
ঐশ্বর্য কাড়িয়া যিনি দেন শুধু রস।
যাঁহার বেণুর সুরে আঁখির পলকে
প্রেমে বিগলিত হয় স্বর্ণ-বৃন্দাবন!

হে রসশেখর কবি, তব জন্মদিনে
আমি কয়ে যাব মোর নব জন্মকথা!
আনন্দসুন্দর তব মধুর পরশে
অগ্নিগিরি গিরি-মল্লিকার ফুলে ফুলে
ছেয়ে গেছে! জুড়ায়েছে সব দাহজ্বালা!
আমার হাতের সেই খর তরবারি
হইয়াছে খরতর যমুনার বারি!
দ্রষ্টা তুমি দেখিতেছ আমাতে যে জ্যোতি
সে জ্যোতি হয়েছে লীন কৃষ্ণঘনরূপে!
অভিনন্দনের মদ চন্দনিত মধু
হইয়াছে, হে সুন্দর, তব আশীর্বাদে!

আজ আমি ভুলে গেছি আমি ছিনু কবি,
ফুটেছি কমল হয়ে তব করে রবি!
প্রস্ফুটিত সে কমল তব জন্মদিনে
সমর্পিনু শ্রীচরণে, লহো কৃপা করি
জানি না জীবনে মোর এই শুভদিন
আবার আসিবে ফিরে কবে কোন লোকে!
আমি জানি মোর আগে রবি নিভিবে না
তার আগে ঝরে যেন যাই শতদল!

আজাদ

কোথা সে আজাদ? কোথা সে পূর্ণ-মুক্ত মুসলমান?
আল্লাহ্ ছাড়া করে না কারেও ভয়, কোথা সেই প্রাণ?
কোথা সে ‘আরিফ’ , কোথা সে ইমাম, কোথা সে শক্তিধর?
মুক্ত যাহার বাণী শুনি কাঁদে ত্রিভুবন থরথর!
কে পিয়েছে সে তৌহিদ-সুধা পরমামৃত হায়?
যাহারে হেরিয়া পরান পরম শান্তিতে ডুবে যায়।
আছে সে কোরান-মজিদ আজিও পরম শক্তিভরা,
ওরে দুর্ভাগা, এক কণা তার পেয়েছিস কেউ তোরা?
সেই যে নামাজ রোজা আছে আজও, আজও সে কলমা আছে,
আজও উথলায় আব-জমজম কাবা শরিফের কাছে।
নামাজ পড়িয়া, রোজা রেখে আর কলমা পড়িয়া সবে
কেন হতেছিস দলে দলে তোরা কতলগাহেতে জবেহ?
সব আছে, তবু শবের মতন ভাগাড়ে পড়িয়া কেন?
ভেবেছ কি কেউ কৌমের পির, নেতা; কেন হয় হেন?
আজিও তেমনই জামায়েত হয় ঈদ্গাহে মসজিদে,
ইমাম পড়েন খোৎবা, শ্রোতার আঁখি ঢুলে আসে নিদে!
যেন দলে দলে কলের পুতুল, শক্তি শৌর্যহীন,
নাহিকো ইমাম, বলিতে হইবে – ইহারা মুসলেমিন!
পরম পূর্ণ শক্তি-উৎস হইতে জনম লয়ে
কেমন করিয়া শক্তি হারাল এ জাতি? কোন সে ভয়ে
তিলে তিলে মরে, মানুষের মতো মরিতে পারে না তবু?
আল্লাহ্ যার প্রভু ছিল, আজ শয়তান তার প্রভু!
খুঁজিয়া দেখিনু, মুসলিম নাই, কেবল কাফেরে ভরা,-
কাফের তারেই বলি, যারে ঢেকে আছে শত ভীতিজরা।
অজ্ঞান-অন্ধকার যাহারে রেখেছে আবৃত করি,
নিত্য সূর্য জ্বলে, তবু যার পোহাল না বিভাবরী!
আল্লাহ্ আর তাহার মাঝারে কোনো আবরণ নাই,
এই দুনিয়ায় মুসলিম সেই – দেখেছ তাহারে ভাই?
আল্লার সাথে নিত্য-যুক্ত পরম শক্তিধর,
এই মুসলিম-কবরস্তানে পেয়েছ তার খবর?
চায় নাকো যশ, চায় নাকো মান, নিত্য নিরভিমান,
নিরহংকার আসক্তিহীন – সত্য যাহার প্রাণ;
জমায় না যে বিত্ত নিত্য মুসাফির গৃহহীন,
আশমান যার ছত্র ধরেছে, পাদুকা যার জমিন;
দিনে আর রাতে চেরাগ যাহার চন্দ্র সূর্য তারা,
আহার যাহার আল্লার নাম – প্রেমের অশ্রুধারা?

যার পানে চায় – সেই যেন পায় তখনই অমৃত বারি,
যাহারে ডাকে – সে অমনি তাহার সাথে চলে সব ছাড়ি?
অনন্ত জনগণ মাঝে পারে শক্তি সঞ্চারিতে,
যারে স্পর্শ করে সে অমনি ভরে ওঠে অমৃতে।
সেই সে পূর্ণ মুসলমান, সে পূর্ণ শক্তিধর,
‘উম্মি’ হয়েও জয় করিতে সে পারে এই চরাচর!
যে দিকে তাকাই দেখি যে কেবলই অন্ধ বদ্ধ জীব,
ভোগোন্মত্ত, পঙ্গু, খঞ্জ, আতুর, বদ-নসিব।
কাগজে লিখিয়া, সভায় কাঁদিয়া গুম্ফ শ্মশ্রু ছিঁড়ে,
আছে কেউ নেতা, লবে ইহাদের অমৃত-সাগরতীরে
আসে অনন্ত শক্তি নিয়ত যে মূল-শক্তি হতে
সেখান হইতে শক্তি আনিয়া ভাসাতে শক্তি-স্রোতে–
কোন তপস্বী করিছে সাধনা? বন্ধু, বৃথা এ শ্রম,
নিজে যার ভ্রম ভাঙেনি সেই কি ভাঙাবে জাতির ভ্রম?
দোজখের পথে, ধ্বংসের পথে চলিয়াছে সারা জাতি,
শূন্য দু-হাত, ‘পাইয়াছি’ বলে তবু করে মাতামাতি!

সেদিন এমনই মাতালের সাথে পথে মোর হল দেখা,
শুধানু, ‘কী পেলে?’ সে বলে, দেখো না, কপালে রয়েছে লেখা?
কপালের পানে চাহিয়া আমার নয়নে আসিল বারি,
বাদশাহ হতে পারিত যে হায়, পেয়েছে সে জমাদারি!
দলে দলে আসে, কারও বুকে, কারও পেটে, কারও হাতে লেখা,
আজাদির চিন্ – অর্থাৎ কিনা চাকুরির মসিলেখা!
কাঁদিয়া কহিনু, – ওরে বে-নসিব, হতভাগ্যের দল,
মুসলিম হয়ে জনম লভিয়া এই কি লভিলি ফল?
অন্যেরে দাস করিতে, কিংবা নিজে দাস হতে, ওরে
আসেনিকো দুনিয়ায় মুসলিম, ভুলিলি কেমন করে?
ভাঙিতে সকল কারাগার, সব বন্ধন ভয় লাজ
এল যে কোরান, এলেন যে নবি, ভুলিলি সে সব আজ?
হায় গণ-নেতা ভোটের ভিখারি নিজের স্বার্থ তরে
জাতির যাহারা ভাবী আশা, তারে নিতেছ খরিদ করে।
সারা জাতি সারারাতি জেগে আছে যাহাদের পানে চেয়ে,
যে তরুণ দল আসিছে বাহিরে জ্ঞানের মানিক পেয়ে –
তাহাদের ধরে গোলাম করিয়া ভরিতেছ কার ঝুলি?
চা-বাগানের আড়কাঠি যেন চালান করিছ কুলি!
উহারা তরুণ, জানে না উহারা, কেন লভিল এ জ্ঞান,
তপস্যা করি জাগাবে উহারা ভারত-গোরস্তান!
ওদের আলোকে আলোকিত হবে অন্ধকার এ দেশ,
ওদেরই শৌর্যে ত্যাগে মহিমায় ঘুচিবে দীনের ক্লেশ।

তুমি চাকরির কশাইখানায় ঘুরিছ তাদেরে লয়ে,
তুমি কি জান না, ওখানে যে যায় – সে যায় জবেহ্ হয়ে?
দেখিতেছ না কি শিক্ষিত এই বাঙালির দুর্দশা,
মানুষ যে হত, চাকরি করিয়া হয়েছে সে আজ মশা।
ভিক্ষা করিয়া মরুক উহারা, ক্ষুধা তৃষ্ণায় জ্বলে –
সমবেত হোক ধ্বংস-নেশায় মুক্ত আকাশতলে।
আগুন যে বুকে আছে – তাতে আরও দুখ-ঘৃতাহুতি দাও,
বিপুল শক্তি লয়ে ওরা হোক জালিম-পানে উধাও
যে ইস্পাতে তরবারি হয়, আঁশ-বটি করো তারে!
অন্ধ, খঞ্জ, জরাগ্রস্ত নিজেরা অন্ধকারে
ঘুরিয়া মরিছ, তাই কি চাহিছ সবাই অন্ধ হোক?
কৌম জাতির প্রাণ বেচে তুমি হইতেছ বড়োলোক।…

আজাদ-আত্মা! আজাদ-আত্মা! সাড়া দাও, দাও সাড়া!
এই গোলামির জিঞ্জির ধরে ভীম বেগে দাও নাড়া!
হে চির-অরুণ তরুণ, তুমি কি বুঝিতে পারনি আজও?
ইঙ্গিতে তুমি বৃদ্ধ সিন্ধবাদের বাহন সাজ!
জরারে পৃষ্ঠে বহিয়া বহিয়া জীবন যাবে কি তব,
জীবন ভরিয়া রোজা রাখি ঈদ আনিবে না অভিনব?
ঘরে ঘরে তব লাঞ্ছিতামাতা ভগ্নীরা চেয়ে আছে,
ওদের লজ্জা-বারণ শক্তি আছে তোমাদেরই কাছে।
ঘরে ঘরে মরে কচি ছেলেমেয়ে দুধ নাহি পেয়ে হায়,
তোমরা তাদেরে বাঁচাবে না আজ বিলাইয়া আপনায়?
আজ মুখ ফুটে দল বেঁধে বলো, বলো ধনীদের কাছে,
ওদের বিত্তে এই দরিদ্র দীনের হিস্‌সা আছে!
ক্ষুধার অন্নে নাই অধিকার ; সঞ্চিত যার রয়,
সেই সম্পদে ক্ষুধিতের অধিকার আছে নিশ্চয়।
মানুষেরে দিতে তাহার ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার
ইসলাম এসেছিল দুনিয়ায়, যারা কোরবান তার –
তাহাদেরই আজ আসিয়াছে ডাক – বেহেশ্‌ত-পার হতে,
আনন্দ লুট হবে দুনিয়ায় মহা-ধ্বংসের পথে –
প্রস্তুত হও – আসিছেন তিনি অভয় শক্তি লয়ে –
আল্লাহ্‌ থেকে আবে-কওসর নবীন বার্তা বয়ে।
অন্তরে আর বাহিরে নিত্য আজাদমুক্ত যারা,–
নব-জেহাদের নির্ভীক দুর্বার সেনা হবে তারা,
আমাদেরই আনা নিয়ামত পেয়ে খাবে আর দেবে গালি,
জেহাদের রণে নওশা সাজিয়া মোরা দিব হাততালি!
বলিব বন্ধু, মিটেছে কি ক্ষুধা, পেয়েছ কি কওসর?
বেহেশ্‌তে হবে তকবির ধ্বনি, আল্লাহু আকবর!
জিন্নাৎ হতে দেখিব মোদের গোরস্তানের পর
প্রেমে আনন্দে পূর্ণ সেথায় উঠেছে নূতন ঘর।

আমার কবিতা তুমি

প্রিয়া-রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,
আঁখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি!
জুড়াল গো তার শত জনমের রৌদ্রদগ্ধ-কায়া–
এতদিনে পেল তার স্বপনের স্নিগ্ধ মেঘের ছায়া!
চেয়ে দেখো প্রিয়া, তোমার পরশ পেয়ে
গোলাপ দ্রাক্ষাকুঞ্জে মরুর বক্ষ গিয়াছে ছেয়ে!

গভীর নিশীথে, হে মোর মানসী, আমার কল্পলোকে
কবিতার রূপে চুপে চুপে তুমি বিরহ-করুণ চোখে
চাহিয়া থাকিতে মোর মুখ পানে ; আসিয়া হিয়ার মাঝে
বলিতে যেন গো – ‘হে মোর বিরহী, কোথায় বেদনা বাজে?’
আমি ভাবিতাম, আকাশের চাঁদ বুকে বুঝি এল নেমে
মোর বেদনায় বুকে বুক রাখি কাঁদিতে গভীর প্রেমে!
তব চাঁদ-মুখপানে চেয়ে আজ চমকিয়া উঠি আমি,
আমি চিনিয়াছি, সে চাঁদ এসেছে প্রিয়া-রূপ ধরে নামি!

যত রস-ধারা নেমেছে আমার কবিতার সুরে গানে
তাহার উৎস কোথায়, হে প্রিয়া, তব শ্রীঅঙ্গ জানে।
তাই আজ তব যে অঙ্গে যবে আমার নয়ন পড়ে,
থির হয়ে যায় দৃষ্টি সেথাই, আঁখি-পাতা নাহি নড়ে!
তোমার তনুর অণু-পরমাণু চির-চেনা মোর, রানি!
তুমি চেন নাকো ওরা চেনে বলে, ‘বন্ধু তোমারে জানি।’
অনন্ত শ্রীকান্তি লাবণি রূপ পড়ে ঝরে ঝরে
তোমার অঙ্গ বাহি, প্রিয়তমা, বিশ্ব ভুবন-পরে!
মন্ত্র-মুগ্ধ সাপের মতন তোমার অঙ্গ পানে
তাই চেয়ে থাকি অপলক-আঁখি, লজ্জারে নাহি মানে!

তুমি যবে চল, যবে কথা বল, মুখ পানে চাও হেসে
মূর্তি ধরিয়া ওঠে যেন সেথা আমার ছন্দ ভেসে।
মনে মনে বলি, তুমি যে আমার ছন্দ-সরস্বতী,
ওগো চঞ্চলা, আমার জীবনে তুমি দুরন্ত গতি!
আমার রুদ্র নৃত্যে জেগেছে কঙ্কালে নব প্রাণ,
ছন্দিতা ওগো, আমি জানি, তাহা তব অঙ্গের দান!
নাচ যবে তুমি আমার বক্ষে, রুধির নাচিয়া ওঠে
সেই নাচ মোর কবিতায় গানে ছন্দ হইয়া ফোটে।
মনে পড়ে যবে তোমার ডাগর সজল-কাজল আঁখি,
সে চোখের চাওয়া আমার গানের সুর দিয়ে বেঁধে রাখি।
প্রেম-ঢলঢল তোমার বিরহ-ছলছল মুখ হেরি
ভাবের ইন্দ্রধনু ওঠে মোর সপ্ত আকাশ ঘেরি।
আমার লেখার রেখায় রেখায় ইন্দ্রধনুর মায়া,
উহারা জানে না, এই রং তব তনুর প্রতিচ্ছায়া!
আমার লেখায় কী যেন গভীর রহস্য খোঁজে সবে
ভাবে, এ কবির প্রিয়তমা বুঝি আকাশ-কুসুম হবে!
উহারা জানে না, তুমি অসহায় কাঁদ পৃথিবীর পথে,
উহারা জানে না রহস্যময়ী তুমি মোর লেখা হতে।

আমিই ধরিতে পারি না তোমারে, উহারা ধরিতে চায়,
সাগরের স্মৃতি খুঁজে ওরা মরুভূর বালুকায়!
তোমার অধরে আঁখি পড়ে যবে, অধীর তৃষ্ণা জাগে,
মোর কবিতায় রস হয়ে সেই তৃষ্ণার রং লাগে।
জাগে মদালস-অনুরাগ-ঘন নব যৌবন-নেশা
এই পৃথিবীরে মনে হয় যেন শিরাজি আঙুর-পেশা!
সুর হয়ে ওঠে সুরা যেন, আমি মদিরা-মত্ত হয়ে
যৌবন-বেগে তরুণেরে ডাকি খর তরবারি লয়ে।
জরাগ্রস্ত জাতিরে শুনাই নব জীবনের গান,
সেই যৌবন-উন্মদ বেগ, হে প্রিয়া তোমার দান।
হে চির-কিশোরী, চির-যৌবনা! তোমার রূপের ধ্যানে
জাগে সুন্দর রূপের তৃষ্ণা নিত্য আমার প্রাণে।
আপনার রূপে আপনি মুগ্ধা দেখিতে পাও না তুমি
কত ফুল ফুটে ওঠে গো তোমার চরণ-মাধুরী চুমি!
কুড়ায়ে সে ফুল গাঁথি আমি মালা কাব্যে-ছন্দে-গানে,
মালা দেখে সবে, জানে না মালার ফুল ফোটে কোনখানে!

হে প্রিয়া, তোমার চির-সুন্দর রূপ বারে বারে মোরে
অসুন্দরের পথ হতে টানি আনিয়াছে হাত ধরে।
ভিড় করে যবে ঘিরিত আমারে অসুন্দরের দল,
সহসা ঊর্ধ্বে ফুটিয়া উঠিত তব মুখ-শতদল।
মনে হত, যেন তুমি অনন্ত শ্বেত শতদল-মাঝে,
মোর প্রতীক্ষা করিতেছ প্রিয়া চির-বিরহিণী সাজে।
সেই মুখখানি খুঁজিয়া ফিরেছি পৃথিবীর দেশে দেশে,
শ্রান্ত স্বপনে হৃদয়ে-গগনে ও মুখ উঠিত ভেসে!
যেই ধরিয়াছি মনে হত হায়, অমনই ভাঙিত ঘুম,
স্মৃতি রেখে যেত আমার আকাশে তব রূপ-কুঙ্কুম!
দেখি নাই, তবু কহিতাম গানে ‘সাড়া দাও, সাড়া দাও,
যারা আসে পথে, তারা তুমি নহ, ওদের সরায়ে নাও!’
ভেবেছিনু, বুঝি পৃথিবীতে আর তব দেখা মিলিল না,
তুমি থাক বুঝি সুদূর গগনে হয়ে কবি-কল্পনা।
সহসা একদা প্রভাতে যখন পাখিরা ছেড়েছে নীড়,
হারানো প্রিয়ারে খুঁজেছি আকাশে অরুণ-চন্দ্রাপীড়,
আমি পৃথিবীতে খুঁজিতেছিনু গো আমার প্রিয়ারে গানে,
থমকি দাঁড়ানু, চমকি উঠিনু কাহার বীণার তানে!
বেণু আর বীণা এক সাথে বাজে কাহার কন্ঠ-তটে,
কার ছবি যেন কাঁদিয়া উঠিল লুকানো হৃদয়-পটে।
হেরিনু আকাশে তরুণ সূর্য থির হয়ে যেন আছে,
কে যেন কী কথা কয়ে গেল হেসে আমার কানের কাছে।
আমার বুকের জমাট তুষার-সাগর সহসা গলে
আছাড়িয়া যেন পড়িতে চাহিল তোমার চরণ-তলে।
ওগো মেঘ-মায়া, বুঝিয়াছিলে কি তুমি?
দারুণ তৃষায় তব পানে ছিল চেয়ে কোনো মরুভূমি?
তুমি চলে গেলে ছায়ার মতন, আমি ভাবিলাম মায়া,
কল্প-লোকের প্রিয়া আসে না গো ধরণিতে ধরি কায়া!

ভেবেছিনু, আর জীবনে হবে না দেখা –
সহসা শ্রাবণ-মেঘ এল যেন হইয়া ব্রজের কেকা!
যমুনার তীরে বাজিয়া উঠিল আবার বিরহী বেণু,
আঁধার কদম-কুঞ্জে হেরিনু রাধার চরণ-রেণু।
যোগ-সমাধিতে মগ্ন আছিনু, ভগ্ন হইল ধ্যান,
আমার শূন্য আকাশে আসিল স্বর্ণ-জ্যোতির বান।
চির-চেনা তব মুখখানি সেই জ্যোতিতে উঠিল ভাসি
ইঙ্গিতে যেন কহিলে, ‘বিরহী প্রিয়তম, ভালোবাসি!’
আমি ডাকিলাম, ‘এসো এসো তবে কাছে।’
কাঁদিয়া কহিলে, ‘হেরো গ্রহ তারা এখনও জাগিয়া আছে,
উহারা নিভুক, ঘুমাক পৃথিবী, ঘুমাক রবি ও শশী,
সেদিন আমারে পাবে গো, লাজের গুন্ঠন যাবে খসি।
কেবল দুজন করিব কূজন, রহিবে না কোনো ভয়,
মোদের ভুবনে রহিবে কেবল প্রেম আর প্রেমময়।’

‘আমি কী করিব?’ কহিলাম আঁখি-নীরে
কহিলে ‘কাঁদিবে মোর নাম লয়ে বিরহ-যমুনাতীরে!
যমুনা শুকায়ে গিয়াছে প্রেমের গোকুলে এ ধরাতলে,
আবার সৃজন করো সে যমুনা তোমার অশ্রুজলে।
তোমার আমার কাঁদন গলিয়া হইবে যমুনা জল
সেই যমুনায় সিনান করিতে আসিবে গোপিনীদল,
ওরা প্রেম পাবে, পাইবে শান্তি, পাবে তৃষ্ণার মধু,
তোমারে দিলাম চির-উপবাস, পরম বিরহ, বঁধু!’
‘এ কী অভিশাপ দিলে তুমি’ বলে যেমনই উঠি গো কাঁদি,
হেরি কাঁদিতেছ পাগলিনি মোর হাত দুটি বুকে বাঁধি!
আজ মোর গানে কবিতায়, সুরে তুমি ছাড়া নাই কেউ,
সেই অভিশাপ যমুনায় বুঝি তুলেছে বিপুল ঢেউ!
সবার তৃষ্ণা মিটাইতে আমি যমুনা হইয়া ঝরি,
জানে না পৃথিবী, কোন নিদারুণ তৃষ্ণা লইয়া মরি!
বড়ো জ্বালা বুকে, বলো বলো প্রিয়া – না-ই পাইলাম কাছে,
এই বিরহের পারে তব প্রেম আছে আজও জেগে আছে!
যদি অভিমান জাগে মোর বুকে না বুঝে তোমার খেলা,
দূরে থাক বলে ভাবি যদি তারে অনাদর অবহেলা –
কেঁদে কেঁদে রাতে যদি মোর হাতে লেখনী যায় গো থামি,
বিরহ হইয়া বুকে এসে মোর কহিয়ো – ‘এই তো আমি।’

আর কতদিন?

আমার দিলের নিদ-মহলায় আর কতদিন, সাকি,
শারাব পিয়ায়ে, জাগায়ে রাখিবে, প্রীতম আসিবে নাকি?
অপলক চোখে চাহি আকাশের ফিরোজা পর্দা-পানে,
গ্রহতারা মোর সেহেলিরা নিশি জাগে তার সন্ধানে।
চাঁদের চেরাগ ক্ষয় হয়ে এল ভোরের দর-দালানে,
পাতার জাফরি খুলিয়া গোলাপ চাহিছে গুলিস্তানে।
রবাবের সুরে অভাব তাহার বৃথাই ভুলিতে চাই,
মন যত বলে আশা নাই, হৃদে তত জাগে ‘আশনাই’।
শিরাজি পিয়ায়ে শিরায় শিরায় কেবলই জাগাও নেশা,
নেশা যত লাগে অনুরাগে, বুকে তত জাগে আন্দেশা।

আমি ছিনু পথ – ভিখারিনি, তুমি কেন পথ ভুলাইলে,
মুসাফিরখানা ভুলায়ে আনিলে কোন এই মঞ্জিলে?
মঞ্জিলে এনে দেখাইলে কার অপরূপ তসবির,
‘তসবি’তে জপি যত তাঁর নাম তত ঝরে আঁখি-নীর!
‘তশবিহি’ রূপ এই যদি তাঁর, ‘তনজিহি’ কীবা হয়,
নামে যাঁর এত মধু ঝরে, তাঁর রূপ কত মধুময়।
কোটি তারকার কীলক-রুদ্ধ অম্বর-দ্বার খুলে
মনে হয় তার স্বর্ণ-জ্যোতি দুলে উঠে কুতুহলে।
ঘুম-নাহি-আসা নিঝঝুম নিশি-পবনের নিশ্বাসে
ফিরদৌস-আলা হতে যেন লাল ফুলের সুরভি আসে।
চামেলি জুঁই-এর পাখায় কে যেন শিয়রে বাতাস করে,
শ্রান্তি ভুলাতে কী যেন পিয়ায় চম্পা-পেয়ালা ভরে।

শিস দেয় দধিয়াল বুলবুলি, চমকিয়া উঠি আমি,
ইঙ্গিতে বুঝি কামিনী-কুঞ্জে ডাকিলেন মোর স্বামী।
নহরের পানি লোনা হয়ে যায় আমার অশ্রুজলে,
তসবির তাঁর জড়াইয়া ধরি বক্ষের অঞ্চলে!
সাকি গো! শারাব দাও, যদি মোর খারাব করিলে দীন,
‘আল-ওদুদের’ পিয়ালার দৌর চলুক বিরাম-হীন।
গেল জাতি কুল শরম ভরম যদি এসে এই পথে
চালাও শিরাজি, যেন নাহি জাগি আর এ বে-খুদী হতে
দূর গিরি হতে কে ডাকে, ওকি মোর কোহ-ই-তুর-ধারী?
আমারই মতো কি ওরই ডাকে মুসা হল মরু-পথচারী?
উহারই পরম রূপ দেখে ইশা হল না কি সংসারী?
মদিনা-মোহন আহমদ ওরই লাগি কি চির-ভিখারি?
লাখো আউলিয়া দেউলিয়া হল যাহার কাবা দেউলে,
কত রূপবতী যুবতি যাহার লাগি কালি দিল কুলে,
কেন সেই বহু-বিলাসীর প্রেমে, সাকি, মোরে মজাইলি,
প্রেম-নহরের কওসর বলে আমারে জহর দিলি?

জান সাকি, কাল মাটির পৃথিবী এসেছিল মোর কাছে,
আমি শুধালাম, মোর প্রিয়তম, সে কি পৃথিবীতে আছে?
‘খাক’ বলিল, না, জানি না তো আমি,‘আব’ বুঝি তাহা জানে
জলেরে পুছিনু, তুমি কি দেখেছ মোর বঁধু কোনখানে?
আমার বুকের তসবির দেখে জল করে টলমল,
জল বলে, আমি এরই লাগি কাঁদি গলিয়া হয়েছি জল।
আগুন হয়তো তেজ দিয়া এরে বক্ষে রেখেছে ঘিরে,
সূর্যের ঘরে প্রবেশিনু আমি তেজ-আবরণ ছিঁড়ে।
হেরিনু সূর্য সাত-ঘোড়া নিয়ে সাত আশমানে ছুটে,
সহসা বঁধুর তসবির হেরে আমার বক্ষ-পুটে।
বলিল, কোথায় দেখেছ ইহারে, হইয়াছে পরিচয়?
ইহারই প্রেমের আগুনে জ্বলিয়া তনু হল মোর ক্ষয়।
যুগযুগান্ত গেল কত তবু মিটিল না এই জ্বালা।
ইহারই প্রেমের জ্বালা মোর বুকে জ্বলে হয়ে তেজোমালা।

যেতে যেতে পথে দেখিনু বাতাস দীরঘ নিশাস ফেলি
খুঁজিতেছে কারে আকাশ জুড়িয়া নীল অঞ্চল মেলি।
মোর বুকে দেখে তসবির এল ছুটিয়া ঝড়ের বেগে,
বলে – অনন্ত কাল ছুটে ফিরি দিকে দিকে এরই লেগে।
খুঁজিয়া স্থূল ও সূক্ষ্ম জগতে পাইনি ইহার দিশা,
তুমি কোথা পেলে আমার প্রিয়ের এই তসবির-শিশা?
হাসিয়া উঠিনু ব্যোম-পথে, সেথা কেবল শব্দ ওঠে
অলখ-বাণীর পারাবারে যেন শত শতদল ফোটে।
আমি কহিলাম, দেখেছ ইহারে হে অলক্ষ্য বাণী?
বাণীর সাগর কত অনন্ত হল যেন কানাকানি!
‘নাহি জানি নাহি জানি’ বলে ওঠে অনন্ত ক্রন্দন,
বলে, হে বন্ধু, জানিলে টুটিত বাণীর এ বন্ধন।–
জ্যোতির মোতির মালা গলে দিয়া সহসা স্বর্ণরথে
কে যেন হাসিয়া ছুঁইয়া আমারে পলাল অলখ-পথে।

‘ও কি জৈতুনি রওগন, ওরই পারে জলপাই-বনে
আমার পরম-একাকী বন্ধু খেলে কি গো নিরজনে?’
শুধানু তাহারে ; নিষ্ঠুর মোর দিল নাকো উত্তর?
জাগিয়া দেখিনু, অঙ্গ আবেশে কাঁপিতেছে থরথর!…

জোহরা-সেতারা উঠেছে কি পুবে? জেগে উঠেছে কি পাখি?
সুরার সুরাহি ভেঙে ফেলো সাকি, আর নিশি নাই বাকি।
আসিবে এবার আমার পরম বন্ধুর বোররাক
ওই শোনো পুব-তোরণে তাহার রঙিন নীরব ডাক!

ঈদের চাঁদ

সিঁড়ি-ওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ
চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা;
মোদের হিস্‌সা আদায় করিতে ঈদে
দিল হুকুম আল্লাতালা!
দ্বার খোলো সাততলা-বাড়িওয়ালা, দেখো কারা দান চাহে,
মোদের প্রাপ্য নাহি দিলে যেতে নাহি দেব ঈদ্গাহে!
আনিয়াছে নবযুগের বারতা নতুন ঈদের চাঁদ,
শুনেছি খোদার হুকুম, ভাঙিয়া গিয়াছে ভয়ের বাঁধ।
মৃত্যু মোদের ইমাম সারথি, নাই মরণের ভয়;
মৃত্যুর সাথে দোস্তি হয়েছে – অভিনব পরিচয়।
যে ইসরাফিল প্রলয়-শিঙ্গা বাজাবেন কেয়ামতে–
তাঁরই ললাটের চাঁদ আসিয়াছে, আলো দেখাইতে পথে।
মৃত্যু মোদের অগ্রনায়ক, এসেছে নতুন ঈদ,
ফিরদৌসের দরজা খুলিব আমরা হয়ে শহিদ।
আমাদের ঘিরে চলে বাংলার সেনারা নৌজোয়ান,
জানি না, তাহারা হিন্দু কি ক্রিশ্চান কি মুসলমান।
নির্যাতিতের জাতি নাই, জানি মোরা মজলুম ভাই –
জুলুমের জিন্দানে জনগণে আজাদ করিতে চাই!
এক আল্লার সৃষ্ট সবাই, এক সেই বিচারক,
তাঁর সে লীলার বিচার করিবে কোন ধার্মিক বক?
বকিতে দিব না বকাসুরে আর, ঠাসিয়া ধরিব টুঁটি
এই ভেদ-জ্ঞানে হারায়েছি মোরা ক্ষুধার অন্ন রুটি।
মোরা শুধু জানি, যার ঘরে ধনরত্ন জমানো আছে,
ঈদ আসিয়াছে, জাকাত আদায় করিব তাদের কাছে।
এসেছি ডাকাত জাকাত লইতে, পেয়েছি তাঁর হুকুম,
কেন মোরা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মরিব, সহিব এই জুলুম?
যক্ষের মতো লক্ষ লক্ষ টাকা জমাইয়া যারা
খোদার সৃষ্ট কাঙালে জাকাত দেয় না, মরিবে তারা।
ইহা আমাদের ক্রোধ নহে, ইহা আল্লার অভিশাপ,
অর্থের নামে জমেছে তোমার ব্যাঙ্কে বিপুল পাপ।
তাঁরই ইচ্ছায় – ব্যাঙ্কের দিকে চেয়ো না – ঊর্ধ্বে চাহো,
ধরার ললাটে ঘনায় ঘোলাটে প্রলয়ের বারিবাহ!
আল্লার ঋণ শোধ করো, যদি বাঁচিবার থাকে সাধ ;
আমাদের বাঁকা ছুরি আঁকা দেখো আকাশে ঈদের চাঁদ!
তোমারে নাশিতে চাষার কাস্তে কী রূপ ধরেছে, দেখো,
চাঁদ নয়, ও যে তোমার গলার ফাঁদ! দেখে মনে রেখো!
প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে, আজীবন উপবাসী,
তাহাদেরই তরে এই রহমত , ঈদের চাঁদের হাসি।
শুধু প্রজাদের জমায়েত হবে আজিকার ঈদ্গাহে,
কাহার সাধ্য, কোন ভোগী রাক্ষস সেথা যেতে চাহে?
ভেবো না ভিক্ষা চাহি মোরা, নহে শিক্ষা এ আল্লার,
মোরা প্রতিষ্ঠা করিতে এসেছি আল্লার অধিকার!
এসেছে ঈদের চাঁদ বরাভয় দিতে আমাদের ভয়ে,
আবার খালেদ এসেছে আকাশে বাঁকা তলোয়ার লয়ে!
কঙ্কালে আজ ঝলকে বজ্র, পাষাণের জাগরণ,
লাশে উল্লাস জেগেছে রুদ্র উদ্ধত যৌবন!
দারিদ্র্য-কারবালা-প্রান্তরে মরিয়াছি নিরবধি,
একটুকু কৃপা করনি, লইয়া টাকার ফোরাত নদী।
কত আসগর মরিয়াছে, জান, এই বাপ মা-র বুকে?
সকিনা মরেছে, তোমরা দখিনা বাতাস খেয়েছ সুখে!
শহিদ হয়েছে হোসেন, কাসেম, আসগর, আব্বাস,
মানুষ হইয়া আসিয়াছি মোরা তাঁদের দীর্ঘশ্বাস!
তোমরাও ফিরে এসেছ এজিদ সাথে লয়ে প্রেত-সেনা,
সেবারে ফিরিয়া গিয়াছিলে, জেনো, আজ আর ফিরিবে না।
এক আল্লার সৃষ্টিতে আর রহিবে না কোনো ভেদ,
তাঁর দান কৃপা কল্যাণে কেহ হবে না না-উম্মেদ !
ডাকাত এসেছে জাকাত লইতে, খোলো বাক্‌সের চাবি!
আমাদের নহে, আল্লার দেওয়া ইহা মানুষের দাবি!
বাঁচিবে না আর বেশিদিন রাক্ষস লোভী বর্বর,
টলেছে খোদার আসন টলেছে, আল্লাহু-আকবর!
সাত আশমান বিদারি আসিছে তাঁহার পূর্ণ ক্রোধ।
জালিমে মারিয়া করিবেন মজলুমের প্রাপ্য শোধ।

ওঠ রে চাষি

চাষি রে! তোর মুখে হাসি কই?

তোর গো-রাখা রাখালের হাতে বাঁশের বাঁশি কই?

তোর খালের ঘাটে পাট পচে ভাই পাহাড়-প্রমাণ হয়ে,

তোর মাঠের ধানে সোনা রং-এর বান যেন যায় বয়ে,

সে পাট ওঠে কোন লাটে?

সে ধান ওঠে কোন হাটে?

উঠানে তোর শূন্য মরাই মরার মতন পড়ে–

স্বামীহারা কন্যা যেন কাঁদছে বাপের ঘরে।

তোর গাঁয়ের মাঠে রবি-ফসলছবির মতন লাগে,

তোর ছাওয়াল কেন খাওয়ার বেলা নুন লঙ্কা মাগে?

তোর

তরকারিতেও সরকারি কোন ট্যাক্স বুঝি বসে!

তোর ইক্ষু এত মিষ্টি কি হয় চক্ষুজলের রসে?

তোর গাইগুলোকে নিঙড়ে কারা দুধ খেয়েছে ভাই?

তোর দুধের ভাঁড়ে ভাতের মাড়ের ফেন – হায়, তাও নাই!

 

তোর ছোটো খোকার জুড়িয়েছে জ্বর ঘুমিয়ে গোরস্তানে,

সে দিদির আঁচল ধরে বুঝি গোরের পানে টানে।

বিকার-ঘোরে দিদি তাহার ডাকছে ছোটো ভায়ে,

দুধের বদল ঝিনুক দিয়ে আমানি দেয় মায়ে।

কবর দিয়ে সবর করে লাঙল নিয়ে কাঁধে,

মাঠের কাদাপথে যেতে আব্বা তাহার কাঁদে।

চারদিকে তার মাঠ-ভরা ধান আকাশ-ভরা খুশি,

লাল হয়েছে দিগন্ত আজ চাষার রক্ত শুষি!

মাঠে মাঠে ধান থই থই, পণ্যে ভরা হাট,

ঘাটে ঘাটে নৌকা-বোঝাই তারই মাঠের পাট।

 

কে খায় এই মাঠের ফসল, কোন সে পঙ্গপাল?

আনন্দের এই হাটে কেন তাহার হাড়ির হাল?

কেন তাহার ঘরের খোকা গোরের বুকে যায়?

গোঠে গোঠে চরে ধেনু, দুধ নাহি সে পায়!

ওরে চাষা! বাঁচার আশা গেছে অনেক আগে

গোরের পাশের ঘরে কাঁদা আজও ভালো লাগে?

জাগে না কি শুকনো হাড়ে বজ্র-জ্বালা তোর?

চোখ বুজে তুই দেখবি রে আর, করবে চুরি চোর?

বাঁশের লাঠি পাঁচনি তোর, তাও কি হাতে নাই?

না থাক তোর দেহে রক্ত, হাড় কটা তোর চাই।

তোর হাঁড়ির ভাতে দিনে রাতে যে দস্যু দেয় হাত,

তোর রক্ত শুষে হল বণিক, হল ধনীর জাত

তাদের হাড়ে ঘুণ ধরাবে তোদেরই এই হাড়

তোর পাঁজরার ওই হাড় হবে ভাই যুদ্ধের তলোয়ার।

তোরই মাঠে পানি দিতে আল্লাজি দেন মেঘ,

তোরই গাছে ফুল ফোটাতে দেন বাতাসের বেগ,

তোরই ফসল ফলাতে ভাই চন্দ্র সূর্য উঠে,

আল্লার সেই দান আজি কি দানব খাবে লুটে?

তেমনি আকাশ ফর্সা আছে, ভরসা শুধু নাই,

তেমনি খোদার রহম ঝরে, আমরা নাহি পাই।

হাত তুলে তুই চা দেখি ভাই, অমনি পাবি বল,

তোর ধানে তোর ভরবে খামার নড়বে খোদার কল!

কিশোর রবি

হে চিরকিশোর কবি রবীন্দ্র, কোন রসলোক হতে
আনন্দ-বেণু হাতে লয়ে এলে খেলিতে ধূলির পথে?
কোন সে রাখাল রাজার লক্ষ ধেনু তুমি চুরি করে
বিলাইয়া দিলে রস-তৃষাতুরা পৃথিবীর ঘরে ঘরে।
কত যে কথায় কাহিনিতে গানে সুরে কবিতায় তব
সেই আনন্দ-গোলোকের ধেনু রূপ নিল অভিনব।
ভুলাইলে জরা, ভুলালে মৃত্যু, অসুন্দরের ভয়
শিখালে পরম সুন্দর চিরকিশোর সে প্রেমময়।
নিত্য কিশোর আত্মার তুমি অন্ধ বিবর হতে
হে অভয়দাতা টানিয়া আনিলে দিব্য আলোর পথে।

তোমার এ রস পান করিবার অধিকার পেল যারা
তারাই কিশোর, তোমাতে দেখেছে নিত্য কিশোরে তারা
ওগো ও পরম কিশোরের সখা, জানি তুমি দিতে পার
নিত্য অভয়, অনন্ত শ্রী, দিব্য শক্তি আরও।
কোথা সে কৃপণ বিধাতার মধু-রসভাণ্ডার আছে
তুমি জান তাহা, তাহার গোপন চাবি আছে তব কাছে।
ওগো ও পরম শক্তিমানের জ্যোতির্দীপ্ত রবি
সেই বিধাতার ভাণ্ডার লুটে দিয়ে যাও হেথা সবই।
যারা জড়, যারা নুড়ির মতন নিত্য রসপ্রবাহে
ডুবিয়া থেকেও পাইল না রস, তারা তব কৃপা চাহে।
এই ক্ষুধাতুর, উপবাসী চির-নিপীড়িত জনগণে
ক্লৈব্য-ভীতির গুহা হতে আনো আনন্দ-নন্দনে।
ঊর্ধ্বের যারা তাহারা পাইল তোমার পরম দান
নিম্নের যারা, তাদের এবার করো গো পরিত্রাণ।
মরে আছে যারা তারা আজ তব অমৃত নাহি পায়
তোমার রুদ্র আঘাতে এদের ঘুম যেন টুটে যায়।
শুধু বেণু আর বীণা লয়ে তুমি আস নাই ধরা পরে
দেখেছি শঙ্খ চক্র বিষাণ বজ্র তোমার করে।

ওগো ও পরম রুদ্র কিশোর! তোমার যাবার আগে
নির্জিত নিদ্রিত এ ভারত যেন গো বহ্নিরাগে
রঞ্জিত হয়ে ওঠে! অসুরের ভীতি যেন চলে যায়।
ওগো সংহার-সুন্দর, পরো প্রলয়-নূপুর পায়!
তোমার যে মহাশক্তি কেবল জ্ঞান-বিলাসীর ঘরে
অনন্ত রূপে রসে আনন্দে নিত্য পড়িছে ঝরে,
গৃহহীন অগণন ভিক্ষুক ক্ষুধাতুর তব দ্বারে
ভিক্ষা চাহিছে, দয়া করো দয়া করো বলি বারে বারে।
বিলাসীর তরে দিয়াছ অনেক, হে কিশোর-সুন্দর,
এবার পঙ্গু-অঙ্গে পরশ করুক তোমার কর।
জানি জানি তব দক্ষিণ করে অনন্ত শ্রী আছে,
দক্ষিণা দাও বলে তাই ওরা এসেছে তোমার কাছে।

হে রবি, তোমারে নারায়ণরূপে এ ভারত পূজা করে,
যাইবার আগে, জাগাইয়া তুমি যাও সেই রূপ ধরে।
দৈত্য-মুক্ত ব্রজের রাখাল কিশোরেরা ভয়হীন,
খেলুক সর্ব-অভাবমুক্ত হয়ে ব্রজে নিশিদিন।
হউক শান্তিনিকেতন এই অশান্তিময় ধরা,
চিরতরে দূর হোক তব বরে নিরাশা-ক্লৈব্য-জরা।

কৃষকের ঈদ

বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিমে আশমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!
হেরো ঈদ্গাহে চলিছে কৃষক যেন প্রেত-কঙ্কাল
কশাইখানায় যাইতে দেখেছ শীর্ণ গোরুর পাল?
রোজা এফতার করেছে কৃষক অশ্রু-সলিলে হায়,
বেলাল! তোমার কন্ঠে বুঝি গো আজান থামিয়া যায়!
থালা ঘটি বাটি বাঁধা দিয়ে হেরো চলিয়াছে ঈদ্গাহে,
তির-খাওয়া বুক, ঋণে-বাঁধা-শির, লুটাতে খোদার রাহে।

জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
একটি বিন্দু দুধ নাহি পেয়ে যে খোকা মরিল তার
উঠেছে ঈদের চাঁদ হয়ে কি সে শিশু-পাঁজরের হাড়?
আশমান-জোড়া কাল কাফনের আবরণ যেন টুটে
এক ফালি চাঁদ ফুটে আছে, মৃত শিশুর অধর-পুটে।
কৃষকের ঈদ! ঈদ্গাহে চলে জানাজা পড়িতে তার,
যত তকবির শোনে, বুকে তার তত উঠে হাহাকার!
মরিয়াছে খোকা, কন্যা মরিছে, মৃত্যু-বন্যা আসে
এজিদের সেনা ঘুরিছে মক্কা-মসজিদে আশেপাশে।
কোথায় ইমাম? কোন সে খোৎবা পড়িবে আজিকে ঈদে?
চারিদিকে তব মুর্দার লাশ, তারই মাঝে চোখে বিঁধে
জরির পোশাকে শরীর ঢাকিয়া ধনীরা এসেছে সেথা,
এই ঈদ্গাহে তুমি কি ইমাম, তুমি কি এদেরই নেতা?
নিঙাড়ি কোরান হাদিস ও ফেকা, এই মৃতদের মুখে
অমৃত কখনও দিয়াছ কি তুমি? হাত দিয়ে বলো বুকে।
নামাজ পড়েছ, পড়েছ কোরান, রোজাও রেখেছ জানি,
হায় তোতাপাখি! শক্তি দিতে কি পেরেছ একটুখানি?
ফল বহিয়াছ, পাওনিকো রস, হায় রে ফলের ঝুড়ি,
লক্ষ বছর ঝরনায় ডুবে রস পায় নাকো নুড়ি!

আল্লা-তত্ত্ব জেনেছ কি, যিনি সর্বশক্তিমান?
শক্তি পেল না জীবনে যে জন, সে নহে মুসলমান!
ইমান! ইমান! বলো রাতদিন, ইমান কি এত সোজা?
ইমানদার হইয়া কি কেহ বহে শয়তানি বোঝা?
শোনো মিথ্যুক! এই দুনিয়ায় পূর্ণ যার ইমান,
শক্তিধর সে টলাইতে পারে ইঙ্গিতে আশমান!
আল্লার নাম লইয়াছ শুধু, বোঝোনিকো আল্লারে।
নিজ যে অন্ধ সে কি অন্যেরে আলোকে লইতে পারে?
নিজে যে স্বাধীন হইল না সে স্বাধীনতা দেবে কাকে?
মধু দেবে সে কি মানুষ, যাহার মধু নাই মৌচাকে?

কোথা সে শক্তি-সিদ্ধ ইমাম, প্রতি পদাঘাতে যার
আবে-জমজম শক্তি-উৎস বাহিরায় অনিবার?
আপনি শক্তি লভেনি যে জন, হায় সে শক্তিহীন
হয়েছে ইমাম, তাহারই খোৎবা শুনিতেছি নিশিদিন!
দীন কাঙালের ঘরে ঘরে আজ দেবে যে নব তাকিদ
কোথা সে মহান শক্তি-সাধক আনিবে যে পুন ঈদ?
ছিনিয়া আনিবে আশমান থেকে ঈদের চাঁদের হাসি
ফুরাবে না কভু যে হাসি জীবনে, কখনও হবে না বাসি!
সমাধির মাঝে গণিতেছি দিন, আসিবেন তিনি কবে?
রোজা এফতার করিব সকলে, সেই দিন ঈদ হবে।

কেন জাগাইলি তোরা

কেন ডাক দিলি আমারে অকালে কেন জাগাইলি তোরা?
এখনও অরুণ হয়নি উদয়, তিমিররাত্রি ঘোরা!
কেন জাগাইলি তোরা?
যে আশ্বাসের বাণী শুনাইয়া পড়েছিনু ঘুমাইয়া
বনস্পতি হইয়া সে বীজ পড়েনি কি ছড়াইয়া–
দিগদিগন্তে প্রসারিয়া শাখা? বাঁধেনি সেথায় নীড়,
প্রাণ-চঞ্চল বিহগের দল করেনি সেথায় ভিড়?
যেখানে ছিল রে যত বন্ধন যত বাধা ভয় ভীতি
সেখানে তোদেরে লইয়া যে আমি আঘাত হেনেছি নিতি।
ভাঙিতে পারিনি, খুলিতে পারিনি দুয়ার, তবুও জানি–
সেই জড়ত্ব-ভরা কারাগারে ভীষণ আঘাত হানি–
ভিত্তি তাহার টলায়ে দিয়েছি, – আশা ছিল মোর মনে
অনাগত তোরা ভাঙিবি তাহারে সে কোন শুভক্ষণে॥

মহা সমাধির দিকহারা লোকে জানি না কোথায় ছিনু
আমারে খুঁজিতে সহসা সে কোন শক্তিরে পরশিনু –
সেই সে পরম শক্তিরে লয়ে আসিবার ছিল সাধ –
যে শক্তি লভি এল দুনিয়ায় প্রথম ঈদের চাঁদ –
তারই মাঝে কেন ঢাক-ঢোল লয়ে এলি সমাধির পাশে
ভাঙাইলি ঘুম? চাঁদ যে এখনও ওঠেনি নীল আকাশে।
ওরে তোরা থাম! শক্তি কাহারও নহে রে ইচ্ছাধীন –
রাত না পোহাতে চিৎকার করি আনিবি কি তোরা দিন?
এতদিন মার খেয়েছিস তোরা – তবুও আছিস বেঁচে,
মারের যাতনা ভুলিবি কি তায় ঢাক-ঢোল নিয়ে নেচে?

সূর্য-উদয় দেখেছিস কেউ – শান্ত প্রভাত বেলা?
উদার নীরব উদয় তাহার – নাই মাতামাতি খেলা;
তত শান্ত সে – যত সে তাহার বিপুল অভ্যুদয়,
তত সে পরম মৌনী যত সে পেয়েছে পরম অভয়!
দিকহারা ওই আকাশের পানে দেখ দেখ তোরা চেয়ে,
কেমন শান্ত ধ্রুব হয়ে আছে কোটি গ্রহ তারা পেয়ে।
ওই আকাশের প্রসাদে যে তোরা পাস বৃষ্টির জল
ওই আকাশেই ওঠে ধ্রুবতারা ভাস্কর নির্মল।
ওই আকাশেই ঝড় ওঠে – তবু শান্ত সে চিরদিন–
ওই আকাশের বুক চিরে আসে – বজ্র কুন্ঠাহীন!
ওই আকাশেই তকবির ওঠে – মহা আজানের ধ্বনি
ওই আকাশের পারে বাজে চির অভয়ের খঞ্জনি।
জানি ওরে মোর প্রিয়তম সখা বন্ধু তরুণ দল
তোদেরই ডাকে যে আসন আমার টলিতেছে টলমল!
তোদেরই ডাকে যে নামিছে পরম শক্তি, পরম জ্যোতি,
পরমামৃতে পূর্ণ হইবে মহাশূন্যের ক্ষতি।
‘মাহে রমজান’ এসেছে যখন, আসিবে ‘শবে কদর’,
নামিবে তাঁহার রহমত এই ধূলির ধরার পর।
এই উপবাসী আত্মা – এই যে উপবাসী জনগণ,
চিরকাল রোজা রাখিবে না – আসে শুভ ‘এফতার’ ক্ষণ!

আমি দেখিয়াছি – আসিছে তোদের উৎসব-ঈদ-চাঁদ, –
ওরে উপবাসী ডাক তাঁরে ডাক, তাঁর নাম লয়ে কাঁদ।
আমি নয় ওরে আমি নয় – ‘তিনি’ যদি চান ওরে তবে
সূর্য উঠিবে, আমার সহিত সবার প্রভাত হবে।

চাঁদিনি রাতে

কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে,
হাবুডুবু খায় তারা-বুদ্‌বুদ, জোছনা সোনায় রাঙে।
তৃতীয়া চাঁদের ‘সাম্পানে’ চড়ি চলিছে আকাশ-প্রিয়া,
আকাশ-দরিয়া উতলা হল গো পুতলায় বুকে নিয়া।
নীলিম-প্রিয়ার নীলা গুল-রুখ নাজুক নেকাবে ঢাকা
দেখা যায় ওই নতুন চাঁদের কালোতে আবছা আঁকা।
সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রানি,
‘লায়লা’-সেহেলি দিয়ে গেছে চুপে কুহেলি-মশারি টানি।
নীহার-নেটের ঝাপসা মশারি, যেন ‘বর্ডার’ তারই
দিক্‌-চক্রের ছায়া-ঘন ওই সবুজ তরুর সারি।

সাতাশ-তারার ফুল-তোড় হাতে আকাশে নিশুতি রাতে
গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে।
‘উঁহু উঁহু’ করি কাঁচা ঘুম হতে জেগে ওঠে নীলা হুরি,
লুকায়ে দেখে তা ‘চোখ গেল’ বলে হাসিছে পাপিয়া ছুঁড়ি।
‘মঙ্গল’ তারা মঙ্গল-দীপ জ্বালিয়া প্র্রহর জাগে,
ঝিকিমিকি করে মাঝে মাঝে, বুঝি বধূর নিশাস লাগে।

উল্কা-জ্বালার সন্ধানী আলো লইয়া আকাশ-দ্বারী
‘কাল-পুরুষ’ সে জাগি বিনিদ্র করে ফেরে পায়চারি।
সেহেলিরা রাতে পালায়ে এসেছে উপবনে কোন আশে,
‘হেথা হোথা ছোটে, পিকের কন্ঠে ফিক ফিক করে হাসে।
আবেগে সোহাগে আকাশ-প্রিয়ার চিবুক বাহিয়া ও কি
শিশিরের রূপে ঘর্মবিন্দু ঝরে ঝরে পড়ে, সখী!
নবমী চাঁদের ‘সংসারে’ ও কে গো চাঁদিনি-শিরাজি ঢালি
বধূর অধরে ধরিয়া কহিছে, ‘তহুরা পিয়ো লো আলি!’
কার কথা ভেবে তারা-মজলিসে দূরে একাকিনী সাকি
চাঁদের সংসারে কলঙ্ক-ফুল আনমনে যায় আঁকি!

মস্তানা শ্যামা দধিয়াল টানে বায়ু-বেয়ালায় মিড়,
ফর্‌হাদ-শিরী লায়লি-মজনু মগজে করেছে ভিড়!
ছুটিতেছে গাড়ি, ছায়াবাজি-সম কত কথা ওঠে মনে,
দিশাহারা-সম ছোটে খ্যাপা মন জলে থলে নভে বনে!
এলোকেশে মোর জড়ায়ে চরণ কোন বিরহিণী কাঁদে,
যত প্রিয়-হারা আমারে কেন গো বাহু-বন্ধনে বাঁধে!
নিখিল বিরহী ফরিয়াদ করে আমার বুকের মাঝে,
আকাশে-বাতাসে তাদেরই মিলন তাদেরই বিরহ বাজে।

আনমনা সাকি, শূন্য আমার হৃদয়-পেয়ালা কোণে
কলঙ্ক-ফুল আনমনে সখী লিখো মুছো ক্ষণে ক্ষণে।

চির-জনমের প্রিয়া

আরও কতদিন বাকি?
বক্ষে পাওয়ার আগে বুঝি, হায়, নিভে যায় মোর আঁখি!
অনন্তলোকে অনন্তরূপে কেঁদেছি তোমার লাগি
সেই আঁখিগুলি তারা হয়ে আজও আকাশে রয়েছে জাগি।
চির-জনমের প্রিয়া মোর! চেয়ে দেখো নীলাকাশে
ভ্রমরের মতো ঝাঁক বেঁধে কোটি গ্রহ-তারা ছুটে আসে
তোমার শ্রীমুখ-কমলের পানে! ওরা যে ভুলিতে নারে
আজিও খুঁজিয়া ফিরিছে তোমায় অসীম অন্ধকারে!
বারে বারে মোর জীবন-প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে, প্রিয়া।
নেভেনি আমার নয়ন, তোমারে দেখিবার আশা নিয়া।
আমি মরিয়াছি, মরেনি নয়ন ; দেখো প্রিয়তমা চাহি
তব নাম লয়ে ওরা কাঁদে আজও – ওদের নিদ্রা নাহি।
ওরা তারা নয়, অভিশপ্ত এ বিরহীর ওরা আঁখি,
মহাব্যোম জুড়ে উড়িয়া বেড়ায় আশ্রয়হারা পাখি!
আঁখির আমার ভাগ্য ভালো গো, পেয়েছিল আঁখি-জল,
তাই আজও তারা অমর হইয়া ভরে আছে নভোতল!
বাহু দিয়া মোর কন্ঠ যদি গো জড়াইতে কোনদিন,
আঁখির মতন এই দেহ মোর হইত মৃত্যুহীন!
তোমার অধর নিঙাড়িয়া মধু পান করিতাম যদি,
আমার কাব্যে, সংগীতে, সুরে বহিত অমৃত-নদী!

* * *
ফুল কেন এত ভালো লাগে তব, কারণ জান কি তার?
ওরা যে আমার কোটি জনমের ছিন্ন অশ্রুহার!
যত লোকে আমি তোমার বিরহে ফেলেছি অশ্রুজল,
ফুল হয়ে সেই অশ্রু – ছুঁইতে চাহে তব পদতল!
অশ্রুতে মোর গভীর গোপন অভিমান ছিল হায়,
তাই অভিমানে তোমারে ছুঁইয়া ফুল শুকাইয়া যায়!
ঝরা ফুল লয়ে বক্ষে জড়ায়ে ধরেছ কি কোনোদিন?
এত সুন্দর, তবু কেন ফুল এমন ব্যথা-মলিন?
তব মুখ পানে চেয়ে থাকে ফুল মোর অশ্রুর মতো;
তোমারে হেরিয়া উহাদের গত জনমের স্মৃতি যত
জেগে ওঠে প্রাণে! তাই অভিমানে ঝরে সে সন্ধ্যাবেলা,
ভুলিতে পারে না, যুগে যুগে তুমি হানিয়াছ যত হেলা!

* * *
পূর্ণিমা চাঁদ দেখেছ? দেখেছ তার বুকে কালো দাগ!
ওর বুকে ক্ষত-চিহ্ন এঁকেছে, জান, কার অনুরাগ?
কোটি জনমের অপূর্ণ মোর সাধ-আশা জমে জমে
চাঁদ হয়ে হায় ভাসিয়া বেড়ায় নিরাশার মহাব্যোমে!
কলঙ্ক হয়ে বুকে দোলে তার তোমার স্মৃতির ছায়া,
এত জ্যোৎস্নায় ঢাকিতে পারেনি তোমার মধু মায়া!
কোন সে অতীতে মহাসিন্ধুর মন্থন শেষে, প্রিয়া,
বেদনা-সাগরে চাঁদ হয়ে উঠে তোমারে বক্ষে নিয়া!
পালাইতে ছিনু সুদূর শূন্যে! নিঠুর বিধাতা পথে
তোমারে ছিনিয়া লয়ে গেল হায় আমার বক্ষ হতে!
তুমি চলে গেলে, বুকে রয়ে গেল তব অঙ্গের ছাপ,
শূন্য বক্ষে শূন্যে ঘুরি গো, চাঁদ নয় অভিশাপ!

* * *
প্রাণহীন দেহ আকাশে ফেলিয়া ধরণিতে আসি ফিরে,
তোমারে খুঁজিয়া বেড়াই গোমতী পদ্মা যমুনা তীরে!
চিনি যবে হায় গোধূলিবেলায় শুভ লগ্নের ক্ষণে,
বাঁশি না বাজিতে লগ্ন ফুরায়, আঁধার ঘনায় বনে!
তুমি চলো যাও ভবনের বধূ, আমি যাই বনপথে,
মোর জীবনের মরা ফুল তুলে দিই মরণের রথে!

* * *
শ্রাবণ-নিশীথে ঝড়ের কাঁদন শুনেছ কি কোনোদিন?
কার অশান্ত অসহ রোদন আজও শ্রান্তহীন
দিগ্‌দিগন্তে দস্যুর মতো হানা দিয়ে ফেরে হায়!
ভবনে ভবনে কার বুক থেকে কাহারে ছিনিতে চায়? –
এমনই সেদিন উঠেছিল ঝড় মহাপ্রলয়ের বেশে
যেদিন আমারে পথে ফেলে গেলে চলিয়া নিরুদ্দেশে!
প্রবল হস্তে নাড়া দিয়া আমি অসীম শূন্য নভে
কৃষ্ণ মেঘের ঢেউ তুলেছিনু ; গর্জিয়া ভীম রবে
বিশ্বের ঘুম ভেঙে দিয়েছিনু! যেখানে যে ছিল সুখে
যেখানে প্রিয় ও প্রিয়া ছিল – সেথা বজ্র হেনেছি বুকে!
ঝড়ের বাতাসে আমার নিশাসে নড়িল না মহাকাল,
মোর ধূমায়িত অশ্রু-বাষ্প রচিল জলদ-জাল।
অঝোর ধারায় ঝরিনু ধরায় খুঁজিলাম বনভূমি
ফুরাইল আয়ু, থির হল বায়ু, সাড়া দিলে নাকো তুমি!
আমার ক্ষুধিত সেই প্রেম আজও বিজলি-প্রদীপ জ্বেলে
অন্ধ আকাশ হাতড়িয়া ফেরে ঝঞ্ঝার পাখা মেলে!
তুমি বেঁচে গেছ, অতীতের স্মৃতি ভুলিয়াছ একেবারে,
নইলে ভুলিয়া ভয় – ছুটে যেতে মরণের অভিসারে!

* * *
শান্ত হইনু প্রলয়ের ঝড়, মলয়-সমীর রূপে
যেখানে দেখেছি ফুল সেইখানে ছুটে গেছি চুপে চুপে।
পৃথিবীতে যত ফুটিয়াছে ফুল সকল ফুলের মুখে
তব মুখখানি খুঁজিয়া ফিরেছি – না পেয়ে উগ্র দুখে
ঝরায়েছি ফুল ধরার ধুলায়! জরা ফুল-রেণু মেখে
উদাসীন হাওয়া ফিরিয়াছি পথে তব প্রিয় নাম ডেকে!
সদ্য-স্নাতা এল কুন্তল শুকাইতে যবে তুমি
সেই এলোকেশ বক্ষে জড়ায়ে গোপনে যেতাম চুমি!
তোমার কেশের সুরভি লইয়া দিয়াছি ফুলের বুকে
আঁচল ছুঁইয়া মূর্ছিত হয়ে পড়েছি পরম সুখে!
তোমার মুখের মদির সুরভি পিইয়া নেশায় মাতি
মহুয়া বকুল বনে কাটায়েছি চৈতি চাঁদিনি রাতি।
তব হাত দুটি লতায়ে রহিত পুষ্পিতা লতা সম
কত সাধ যেত যদি গো জড়াত ও লতা কন্ঠে মম!
তব কঙ্কণ চুড়ি লয়ে আমি খেলেছি, দেখনি তুমি,
চলিতে মাথার কাঁটা পড়ে যেত, আমি তুলিতাম চুমি!
চোরের মতন চুরি করিয়াছি তব কবরীর ফুল!–
সে সব অতীত জনমের কথা – আজ মনে হয় ভুল!

* * *
আজ মুখপানে চেয়ে দেখি, তব মুখে সেই মধু আছে,
আজও বিরহের ছায়া দোলে তব চোখের কোলের কাছে!
ডাগর নয়নে আজও পড়ে সেই সাগর জলের ছায়া,
তনুর অণুতে অণুতে আজিও সেই অপরূপ মায়া!
আজও মোর পানে চাহ যবে, বুকে ঘন শিহরন জাগে,
আমার হৃদয়ে কোটি শতদল ফুটে ওঠে অনুরাগে
আজও যবে চাও, আমার ভুবনে ওঠে রোদনের বাণী,
কানাকানি করে চাঁদে ও তারাতে –‘জানি গো তোমারে জানি!’
রুধিরে আমার নূপুর বাজে গো, কহে – ‘প্রিয়া, চিনি, চিনি’!
একদিন ছিলে প্রেমের গোলোকে মোর প্রেম-গরবিনি।
ছিল একদিন – আমার সোহাগে গলিয়া যমুনা হতে
নিবেদিত নীল পদ্মের মতো ভাসিতে প্রেমের স্রোতে!
ভাসিতে ভাসিতে আসিয়াছ আজ এই পৃথিবীর ঘাটে,
আমি পুষ্প-বিহীন শূন্যবৃন্ত কাঁটা লয়ে দিন কাটে!

* * *
মনে করো, যেন সে কোন জনমে বিদায় সন্ধ্যাবেলা।
তুমি রয়ে গেলে এপারে, ভাসিল ওপারে আমার ভেলা!
সেই নদীজলে পড়ে গেলে তুমি ফুলের মতন ঝরে,
কেঁদে বলেছিলে যাবার বেলায় – ‘মনে কি পড়িবে মোরে,
জনমিবে যবে আর কি আঁকিবে হৃদয়ে আমার ছবি।’
আমি বলেছিনু, ‘উত্তর দেবে আর জনমের কবি!’
সেই বিরহীর প্রতিশ্রুতি গো আসিয়াছি কবি হয়ে,
ছবি আঁকি তব আমার বুকের রক্ত ও আয়ু লয়ে!
ঝাঁকে ঝাঁকে মোর কথার কপোত দিকে দিকে যায় ছুটে
হংস-দূতীর মতো মোর লিপি ধরিয়া চঞ্চুপুটে!
হারায়ে গিয়াছে শূন্যে তাহারা ফিরিয়া আসেনি আর,
তাই সুরে সুরে বিধূনিত করি অসীম অন্ধকার!
ভবনে ভবনে সেই সুর প্রতি কন্ঠ জড়ায়ে কহে–
‘যাহারে খুঁজিয়া কাঁদি নিশিদিন, জান সে কোথায় রহে?’
তারা মরে, ফুল ঝরে সেই সুরে, তুমি শুধু কাঁদিলে না
আমার সুরের পালক কুড়ায়ে কবরীতে বাঁধিলে না!
আমার সুরের ইন্দ্রাণী ওগো! ব্যথার সাগর-তলে–
দেখেছি কি কত না-বলা কথার মুক্তা মানিক জ্বলে?
তোমার কন্ঠে মালা হয়ে তারা মুক্তি লভিতে চায়
গত জনমের অস্থি আমার নিদারুণ বেদনায়
মুক্তা হয়েছে; অঞ্জলি দিতে তাই গাঁথি গানে গানে
চরণে দলিয়া ফেলে দিয়ো পথে যদি তা বেদনা হানে।
মনে করো, দুঃস্বপ্নের মতো আমি এসেছিনু রাতে
বহুবার গেছ ভুলিয়া এবারও ভুলিয়া যাইয়ো প্রাতে
কহিলাম যত কথা প্রিয়তমা মনে কোরো সব মায়া,
সাহারা মরুর বুকে পড়ে না গো শীতল মেঘের ছায়া!
মরুভূর তৃষা মিটাইবে তুমি কোথা পাবে এত জল?
বাঁচিয়া থাকুক আমার রৌদ্রদগ্ধ আকাশতল!

দুর্বার যৌবন

ওরে অশান্ত দুর্বার যৌবন!
পরাল কে তোরে জ্ঞানের মুখোশ সংযম-আবরণ?
ভিতরের ভীতি ঢাকিতে রে যত নীতি-বিলাসীরা ছলে
উদ্ধত যৌবন-শক্তিরে সংযত হতে বলে।
ভাবে, ভাঙনের গদা লয়ে যদি যৌবন মাতে রণে,
গুড়ুক টানিতে পারিবে না বসে সোনার সিংহাসনে!
ওরে দুরন্ত! উড়ন্ত তোর পাখা কে বাঁধিল বল?
দীপ্ত জ্যোতির্শিখায় ঢাকিল শীর্ণ জরাঞ্চল?
ওরে নির্ভীক! ভিখ-মাগা যত পঙ্গুর দলে ভিড়ে –
আঁধার নিঙাড়ি আলো আনিত যে – সে রহিল বাঁধা নীড়ে!
যাহাদের মেরুদণ্ডে লেগেছে মেরুর হিমেল হাওয়া,
যাহাদের প্রাণ শক্তিবিহীন কঠিন তুহিনে ছাওয়া
তাদের হুকুমে প্রাণের বিপুল বন্যা রাখিলি রুখে?
মরুর সিংহ মার খায় সার্কাসি পিঞ্জরে ঢুকে।

সৃষ্টির কথা ভাবে যারা আগে সংহারে করে ভয়,
যুগে যুগে সংহারের আঘাতে তাদের হয়েছে লয়।
কাঠ না পুড়ায়ে আগুন জ্বালাবে বলে কোন অজ্ঞান?
বনস্পতির ছায়া পাবে বীজ নাহি দিলে তার প্রাণ!
তলোয়ার রেখে খাপে এরা, ঘোড়া রাখিয়া আস্তাবলে
রণজয়ী হবে দম্ভবিহীন বৈদান্তিকী ছলে!
প্রাণ-প্রবাহের প্রবল-বন্যা বেগে খরস্রোতা নদী
ভেঙেছে দু-কূল, সাথে সাথে ফুল ফুটায়েছে নিরবধি।
জলধির মহা-তৃষ্ণা জাগিছে যে বিপুল নদীস্রোতে,
সে কি দেখে, তার স্রোতে কি ডুবিল, কে মরিল তার পথে?
মানে না বারণ, ভরা যৌবন-শক্তিপ্রবাহ ধায়
আনন্দ তার মরণ-ছন্দে কূলে কূলে উথলায়।
জানে না সে ঘর আত্মীয় পর, চলাই ধর্ম তার
দেখে না তাহার প্রাণতরঙ্গে ডুবিল তরণি কার।
বণিকের দুটো জাহাজ ডুবিবে, তা বলে সিন্ধু-ঢেউ
শান্ত হইয়া ঘুমায়ে রহিবে – শুনিয়াছ কভু কেউ।
ঐরাবত কি চলিবে না, পথে পিপীলিকা মরে বলে?
ঘর পোড়ে বলে প্রবল বহ্নিশিখা উঠিবে না জ্বলে?

অঙ্ক কষে না, হিসাব করে না, বেহিসাবি যৌবন,
ভাঙা চাল দেখে নামিবে না কি রে শ্রাবণের বর্ষণ?
যৌবন কেনা-বেচা হবে কি রে বানিয়ার নিক্তিতে?
মুক্ত-আত্মা আজাদে ভোলাবে প্যাক্টের চুক্তিতে?
তরু ভেঙে পড়ে তাই বলে ঝড় আসবে না বৈশাখী!
ভীরু মেষ-শিশু ভয় পায় বলে রবে না ঈগল পাখি?

জ্ঞান ও শান্তি সংযম – বহু ঊর্ধ্বের কথা দাদা,
কহে নির্মল শান্তির কথা যার সারা গায়ে কাদা!
যে মহাশান্তি উদার-মুক্ত আকাশের তলে রহে,
কাম-ক্রোধ-লোভ-মত্ত জীবেরা আজ তারই কথা কহে।
অনন্ত দিক আকাশ যাহার সীমা খুঁজে নাহি পায়
এমন মুক্ত মানব দেখিলে শান্ত কহিয়ো তায়;
ওঠে তরঙ্গ অতি প্রবল যে বিরাট সাগরজলে
সেই উদ্‌বেল শক্তিরে তার অসংযমী কে বলে?
ডোবায় খানায় কূপে ঢেউ নাই, শান্ত তারাই বুঝি?
সংযমী বলে প্রতারক মোরা শুধু জড়তারে পূজি।

জাগো দুর্মদ যৌবন! এসো, তুফান যেমন আসে,
সুমুখে যা পাবে দলে চলে যাবে অকারণ উল্লাসে।
আনো অনন্ত-বিস্তৃত প্রাণ, বিপুল প্রবাহ, গতি,
কূলের আবর্জনা ভেসে গেলে হবে না কাহারও ক্ষতি।
বুক ফুলাইয়া দুখেরে জড়াও, হাসো প্রাণখোলা হাসি,
স্বাধীনতা পরে হবে – আগে গাও ‘তাজা ব-তাজা’র বাঁশি।
বসিয়াছে যৌবন-রাজপাটে শ্রীহীন অকাল জরা,
মৃত্যুর বহু পূর্বে এ-জাতি হয়ে আছে যেন মরা!
খোলো অর্গল পাষাণের, খুশি বহুক অনর্গল,
ঝাঁক বেঁধে নীল আকাশে যেমন ওড়ে পারাবত দল।
সাগরে ঝাঁপায়ে পড়ো অকারণে, ওঠো দূর গিরিচূড়ে
বন্ধু বলিয়া কন্ঠে জড়াও পথে পেলে মৃত্যুরে!
ভোলো বাহিরের ভিতরের যত বদ্ধ সংস্কার
মরিচা ধরিয়া পড়ে আছ সব আলির জুলফিকার!
জাগো উন্মদ আনন্দে দুর্মদ তরুণেরা সবে,
নাই-বা স্বাধীন হল দেশ, মানবাত্মা মুক্ত হবে।

নতুন চাঁদ

দেখেছি তৃতীয় আশমানে চিদাকাশে
চির-পথ-চাওয়া মোর নতুন চাঁদ হাসে।
দেহ ও মনের রোজা আমার
‘এফতার’ করে গেরেফতার
করিব, তৃষিত বক্ষে মোর ওই চাঁদে,
সহিতে পারি না বিরহ ওর, মন কাঁদে!
জুড়াব এবার জুড়াব গো,
খুশির পায়রা উড়াব গো
নামিবে ও চাঁদ মোর হৃদয়-আশমানে,
মত্ত হইব আনন্দের রসপানে।
বদলাবে তকদির আমার,
ঘুচিবে সর্ব অন্ধকার,
পরিব ললাটে, চুমু দেব, বাঁধব তায়
আল্লাহ্ নামের রজ্জুতে দিল্‌-কোঠায়।
সাম্যের রাহে আল্লাহের
মুয়াজ্জিনেরা ডাকিবে ফের,
পরমোৎসব হবে সেদিন ময়দানে
সাত আশমান দোল খাবে জয়-গানে
এক আল্লার জয়-গানে,
মহামিলনের জয়-গানে
‘শান্তি’ ‘শান্তি’ জয়-গানে!
একঘরে হেথা দশ প্রাচীর,
হিংসা-ক্লৈব্য-বদ্ধ নীড়
ভেঙে যাবে, মন রেঙে যাবে এক রঙে।
এক আকাশের তলে রব এক সঙে।
চাঁদ আসিছে রে, নতুন চাঁদ!
অপরূপ প্রেম-রসের ফাঁদ
বাঁধিবে সকলে এক সাথে গলে গলে
মিলিয়া চলিব তাঁর পথে দলে দলে।
রবে না ধর্ম জাতির ভেদ
রবে না আত্ম-কলহ-ক্লেদ,
রবে না লোভ, রবে না ক্ষোভ অহংকার,
প্রলয়-পয়োধি এক নায়ে হইব পার।
একের লীলা এ, দু-জন নাই
তাঁহারই সৃষ্টি সবাই ভাই,
কত নামে ডাকি – সর্বনাম এক তিনি,
তাঁরে চিনি নাকো, নিজেরে তাই নাহি চিনি।
আলো ও বৃষ্টি তাঁহার দান
সব ঘরে ঝরে এক সমান
সকলের মাঠে শস্য দেয় ফুল ফোটায়,
সকল মানুষ তাঁর ক্ষমা করুণা পায়।
প্রলয়ের রূপ ধরে যবে
তাঁর ক্রোধ নেমে আসে ভবে,
সব ধর্মের সব মানব মরে তখন,
থাকে না হিন্দু-মুসলমানের আস্ফালন!
এককে মানিলে রহে না দুই,
এসো সবে সেই এককে ছুঁই,
এক সে স্রষ্টা সব কিছুর সব জাতির।
আসিছে তাহারই চন্দ্রালোক এক বাতির!
মরিছে যাহারা – তাহারা নয়,
আসিছে – যাহারা বাঁচিয়া রয়,
নিত্য অভেদ উদার-প্রাণ নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
আশমানে চাঁদ দেয় আজান নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
মৃত্যুকে তারা করে না ভয় নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
তাহারা বুদ্ধি-বদ্ধ নয় নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
কাপুরুষ তার্কিক যারা
কেবল বিচার করে তারা,
অগ্রে চলে না ক্লীব ভীরু, ভয় দেখায়,
যারা আগে চলে, পিছে তাদের টানিতে চায়!
প্রাণ-প্রবাহের শত্রু সব,
ধূর্ত যুক্তি-শৃগাল-রব
দুই কূলে করে, তবু চলে নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
মহাবন্যার তরঙ্গসম সম্মুখে দলে দলে
তবু চলে নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
জাগাবে জোয়ার নতুন চাঁদ
এদেরই বক্ষে ; ভাঙিবে বাঁধ
জরায় জীর্ণ মড়া ঘাটের বিলাসীদের
মানিবে না এরা হট্টগোল মণ্ডূকের
সত্য বলিতে নিত্য ভয়
যুক্তি-গর্তে লুকায়ে রয়
ইহারা তাদের দলের নয় – নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
এরা জীবন্ত মুক্ত-ভয় নৌজোয়ান!
ভীরু ইঁদুরের কিচি-মিচি
শোনে নাকো এরা মিছামিছি,
এরা শুধু বলে, ‘চল্‌ আগে নৌজোয়ান!’
অসম্ভবের অভিযানে এরা চলে,
না চলেই ভীরু ভয়ে লুকায় অঞ্চলে!
এরা অকারণ দুর্নিবার প্রাণের ঢেউ,
তবু ছুটে চলে যদিও দেখেনি সাগর কেউ।

জানে পারাবার, জানে অসীম,
এরাই শক্তি মহামহিম,
এরা উদ্দাম যৌবন-বেগ দুরন্ত
মুক্তপক্ষ নির্ভয় এরা উড়ন্ত।
নাই ইহাদের অবিশ্বাস
যা আনে জগতে সর্বনাশ।
প্রতি নিশ্বাসে এরা কহে – ‘মোরা অমর!’
তনুমনে নাই সন্দেহের বিসর্গ অনুস্বর।
হাতের লাট্টু এদের প্রাণ
গুলতির গুলি এদের প্রাণ
বেপরোয়া ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারে দিকে দিকে,
এদের বুদ্ধি চিকমিকায় না ঘেরা চিকে!
তিন্তিড়ি গাছে জোনাকি-দল
চাঁদের নিন্দা করে কেবল,
পুচ্ছের আলো উচ্ছের ঝোপে জ্বালায়ে কয় –
‘মোরা আলো দেব, চন্দ্রের দেশে ভীষণ ভয়!’
পাহাড়ে চড়িয়া নীচে পড়ে – নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
অজগর খোঁজে গহ্বরে – নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
চড়িয়া সিংহে ধরে কেশর – নৌজোয়ান!
বাহন তাহার তুফান ঝড় – নৌজোয়ান!
শির পেতে বলে – ‘বজ্র আয়!’
দৈত্য-চর্ম-পাদুকা পায়,
অগ্নি-গিরিরে ধরে নাড়ায় – নৌজোয়ান!
দলে দলে তারা খুঁজে বেড়ায়
ভূকম্পের ঘর কোথায় –
নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!
বিলাস এদের দারিদ্র্য,
গতি ইহাদের বিচিত্র,
দেখেনিকো জ্ঞান-বিলাসীরা এদের পথ,
শুনিলেও কাঁপে বলি-যূপের ছাগের বৎ!
এরাই দেখিবে নতুন চাঁদ জ্যোতিষ্মান,
ইহাদের নাই দেহ ও মন, কেবল প্রাণ!
নৌজোয়ান, নৌজোয়ান!

এদেরেই পথ দেখাতে ওই
নতুন চাঁদের জ্যোৎস্না-খই
আকাশ-খোলায় ফুটিছে! ভীরুরা যাসনে কেউ,
যাদের পিছনে লেগেছে বুদ্ধি ভয়ের ফেউ!
মৃত্যুর ভয় প্রতি পদে ওই পথে
লঙ্ঘিতে হবে কত সমুদ্র পর্বতে।
বিলাসীরা থাকো চুপ করে
রূপ দেখে খেয়ো টুপ করে
যাত্রী অরুণ-তীর্থের পথে নৌজোয়ান!
পথ দেখায় যে, সে শুধু কয় – ‘জীবন দান
জীবন দান, নৌজোয়ান!’
জীবনে না করে নিষ্ঠীবন,
মৃত্যুর বুকে সঞ্চরণ
করে যারা, তারা নবযুগের নৌজোয়ান!
তাহাদের পথে এসো না কেউ ভীরু, আল্লার না-ফরমান।
ওরা দুর্জয় ভয়-হারা
ওদের ভ্রান্ত কয় কারা?
এই মর্ত্যের ভোগের গর্তে যারা মরে?
অমৃত আনিতে যায় – তারে অনাদর করে?
এক আল্লার সৃষ্টিতে
এক আল্লার দৃষ্টিতে
দেখিবে সবারে দুনিয়াতে নৌজোয়ান!
তলোয়ার তার বক্ষে লুকানো
নববধূ সম শয্যাতে –
নৌজোয়ান!
নৌজোয়ান!

 নিরুক্ত

আর কতদিন রবে নিরুক্ত তোমার মনের কথা?

কথা কও প্রিয়া, সহিতে নারি এ নিদারুণ নীরবতা।

কেবলই আড়াল টানিতে চাহ গো তোমার আমার মাঝে

সে কি লজ্জায়? তবে কেন তাহা অবহেলা সম বাজে?

হেরো গো আমার তৃষিত আকাশ তব অধরের কাছে

যে কথা শোনার তরে শত যুগ আনত হইয়া আছে,

বলো বলো প্রিয়া, সে কথা বলিবে কবে?

সে কথা শুনিয়া মাতিয়া উঠিবে আকাশ মহোৎসবে!

যে কথা কারেও বলনি জীবনে আমারেও নাহি বল,

যে কথার ভারে অসহ ব্যথায় টলিতেছে টলমল,

তোমার অধর-পল্লব ফাঁকে সেই নিরুক্ত বাণী –

ফুলের মতন ফুটিয়া উঠিবে কোন শুভক্ষণে, রানি?

না-বলা তোমার সে কথা শোনার লাগি

শত সে জনম কত গ্রহ তারা আড়ি পেতে আছে জাগি!

সে কথা না শুনে তিথি গুনে গুনে চাঁদ হয়ে যায় ক্ষয়,

শুনিবে আশায় লয় হয়ে চাঁদ আবার জনম লয়!

আমার মনের আঁধার বনের মৌনা শকুন্তলা,

কোন লজ্জায় কোন শঙ্কায়, যায় না সে কথা বলা?

তুমি না কহিলে কথা

মনে হয়, তুমি পুষ্পবিহীন কুন্ঠিতা বনলতা!

সে কথা কহিতে পার না বলিয়া বেদনায় অনুরাগে

তব অঙ্গের প্রতি পল্লবে ঘন শিহরন জাগে।

তোমার তনুর শিরায় শিরায় সে কথা কাঁদিয়ে ফিরে,

না-বলা সে কথা ঝরে ঝরে পড়ে তোমার অশ্রু-নীরে!

হে আমার চির-লজ্জিত বধূ, হেরো গো বাসরঘরে

প্রতীক্ষারত নিশি জেগে আছি সে কথা শোনার তরে।

হাত ধরে মোর রাত কেটে যায়, চরণ ধরিয়া সাধি,

অভিমানে কভু চলে যাই দূরে, কভু কাছে এসে কাঁদি।

তোমার বুকের পিঞ্জরে কাঁদে যে কথার কুহু-কেকা,

অধর-দুয়ার খুলিয়া কি তারা বাহিরে দেবে না দেখা?

আমার ভুবনে যত ফুল ফোটে রেখে তব রাঙা পায়

ফাগুনের হাওয়া উত্তর নাহি পেয়ে কেঁদে চলে যায়।

হে প্রিয় মোর নয়নের জ্যোতি নিষ্প্রভ হয়ে আসে,

ঘুম আসে না গো, বসে থাকি রাতে নিরুদ্ধ নিশ্বাসে।

বুঝি বলিতে পার না লাজে

মোর ভালোবাসা ভালো লাগে নাকো বেদনার মতো বাজে!
কহো সেই কথা কহো,

কেন বেদনার বোঝা বহ তুমি কেন আপনারে দহ?

আমি জানি মোর নিয়তির লেখা, – তবু সেই কথা বলো

‘ভিখারি, ভিক্ষা পেয়েছ, তোমার যাবার সময় হল!’

মুষ্টি-ভিক্ষা চাহিয়া ভিখারি দৃষ্টি-প্রসাদ পায়,

উৎপাত-সম তবু আসে, তারে ক্ষমা করো করুণায়!

কেন অপমান সহি নেমে আসি বিরহ যমুনাতীরে।

– রাগ করিয়ো না, হয়তো চিনিতে পারনি এ ভিখারিরে!

কী চেয়েছিনু, হয়তো বুঝিতে পারনিকো তুমি হায়,

তোমারে চাহিতে আসিনি, আমারে দিতে এসেছিনু পায়!

আমি বলেছিনু, ‘আমারে ভিক্ষা লইয়া বাঁচাও মোরে,

তুমি তা জান না, কত কাল আছি ভিক্ষা-পাত্র ধরে।’

আমি বলেছিনু, ‘ধরায় যখন চলিবে যে পথ দিয়া,

চরণ রেখো গো, সেই পথে আমি বুক পেতে দেব প্রিয়া!

তোমার চরণে দেখেছি যে বেদ-গানের নূপুর-পরা,

কত কাঁটা কত ধূলি ও পঙ্কে পৃথিবীর পথ ভরা

তাই শিবসম, হে শক্তি মম, তব পথে পড়ে থাকি,

তাই সাধ যায় গঙ্গার মতো জটায় লুকায়ে রাখি!’

চির-পবিত্রা অমৃতময়ী, বলো কোন অভিমানে

তোমার পরম-সুন্দরে ফেলি যাও শ্মশানের পানে?

আপন মায়ায় পরম শ্রীমতী চেন নাকো আপনারে,

কহিলে না কথা, নামায়ে আমার প্রেম-যমুনার পারে।

আমি যা জানি না, তুমি তাহা জান ভালো,

তুমি না কহিলে কথা, নিভে যায় বৃন্দাবনের আলো!

বক্ষ হইতে চরণ টানিয়া লইলে, ভিক্ষু শিব

মহারুদ্রের রূপে সংহার করিবে এ ত্রিদিব।

রহিবে না আর প্রিয়-ঘন মোর নওলকিশোর রূপ,

মহাভারতের কুরুক্ষত্রে দেখিবে শ্মশান-স্তূপ!

হে নিরুক্তা, সেদিন হয়তো শূন্য পরম ব্যোমে

শুনাতে চাহিবে তোমার না-বলা কথা তব প্রিয়তমে।

আসিবে কি তুমি বেণুকা হইয়া সেদিন অধরে মম?

এই বিরহের প্রলয়ের পারে

কোন অনাগত আরেক দ্বাপরে

লজ্জা ভুলিয়া কন্ঠ জড়ায়ে কহিবে কি – ‘প্রিয়তম!’

 মোবারকবাদ

মোরা ফোটা ফুল, তোমরা মুকুল এসো গুল-মজলিশে
ঝরিবার আগে হেসে চলে যাব – তোমাদের সাথে মিশে।
মোরা কীটে-খাওয়া ফুলদল, তবু সাধ ছিল মনে কত–
সাজাইতে ওই মাটির দুনিয়া ফিরদৌসের মতো।
আমাদের সেই অপূর্ণ সাধ কিশোর-কিশোরী মিলে
পূর্ণ করিয়ো, বেহেশ্‌ত এনো দুনিয়ার মহফিলে।
মুসলিম হয়ে আল্লারে মোরা করিনিকো বিশ্বাস,
ইমান মোদের নষ্ট করেছে শয়তানি নিশ্বাস!
ভায়ে ভায়ে হানাহানি করিয়াছি, করিনি কিছুই ত্যাগ,
জীবনে মোদের জাগেনি কখনও বৃহতের অনুরাগ!

শহিদি-দর্জা চাহিনি আমরা, চাহিনি বীরের অসি,
চেয়েছি গোলামি, জাবর কেটেছি গোলামখানায় বসি।
তোমরা মুকুল, এই প্রার্থনা করো ফুটিবার আগে,
তোমাদের গায়ে যেন গোলামের ছোঁয়া জীবনে না লাগে।
গোলামের চেয়ে শহিদি-দর্জা অনেক ঊর্ধ্বে জেনো;
চাপরাশির ওই তকমার চেয়ে তলোয়ারে বড়ো মেনো!
আল্লার কাছে কখনও চেয়ো না ক্ষুদ্র জিনিস কিছু,
আল্লাহ্ ছাড়া কারও কাছে কভু শির করিয়ো না নিচু!
এক আল্লাহ্ ছাড়া কাহারও বান্দা হবে না, বলো,
দেখিবে তোমার প্রতাপে পৃথিবী করিতেছে টলমল!
আল্লারে বলো, ‘দুনিয়ায় যারা বড়ো, তার মতো করো,
কাহাকেও হাত ধরিতে দিয়ো না, তুমি শুধু হাত ধরো।’
এক আল্লারে ছাড়া পৃথিবীতে কোরো না কারেও ভয়
দেখিবে – অমনি প্রেমময় খোদা, ভয়ংকর সে নয়!
আল্লারে ভালোবাসিলে তিনিও ভালোবাসিবেন, দেখো!
দেখিবে সবাই তোমারে চাহিছে আল্লারে ধরে থেকো!

খোদার বাগিচা এই দুনিয়াতে তোমরা নব মুকুল,
একমাত্র সে আল্লাহ্ এই বাগিচার বুলবুল!
গোলামের ফুলদানিতে যদি এ মুকুলের ঠাঁই হয়,
আল্লার কৃপা-বঞ্চিত হব, পাব মোরা পরাজয়!
যে ছেলেমেয়ে এই দুনিয়ায় আজাদমুক্ত রহে,
তাহাদেরই শুধু এক আল্লার বান্দা ও বাঁদি কহে!
তারাই আনিবে জগতে আবার নতুন ঈদের চাঁদ,
তারাই ঘুচাবে দুনিয়ার যত দ্বন্দ্ব ও অবসাদ!
শুধু আরশের আতরদানিতে যাহাদের হয় ঠাঁই,
তোমাদের এই মহফিলে আমি সেই মুকুলেরে চাই!

সেই মুকুলেরা এসো মহফিলে, বসাও ফুলের হাট,
এই বাংলায় তোমরা আনিয়ো মুক্তির আরফাত।

 শিখা

যৌবনের রাগ-রক্ত লেলিহান শিখা
জ্বলিয়া উঠিবে কবে ভারতে আবার
জড়তার ধূমপুঞ্জ বিদারণ করি
উদ্ভাসিয়া তমসার তিমির-শর্বরী?
কোথা সে অনাগত সাগ্নিক পুরোধা
নির্বাপিত-প্রায় এই যজ্ঞ হোমানলে
উচ্চারিয়া বেদমন্ত্র দানিবে আহুতি,
নব নব প্রাণের সমিধ কে জোগাবে সেথা?

হায় রে ভারত, হায় যৌবন তাহার
দাসত্ব করিতেছে অতীত জরার!
জরাগ্রস্ত বুদ্ধিজীবী বৃদ্ধ জরদ্গব
দেখায়ে গলিত-মাংস চাকুরির মোহ
যৌবনের টিকা-পরা তরুণের দলে
আনিয়াছে একেবারে ভাগাড়ে শ্মশানে।
যৌবনে বাহন করি পঙ্গু জরা আজি
হইয়াছে ভারতে জনগণপতি!

যে হাতে পাইত শোভা খর তরবারি
সেই তরুণের হাতে ভোট-ভিক্ষা-ঝুলি
বাঁধিয়া দিয়াছে হায়! – রাজনীতি ইহা!
পলায়ে এসেছি আমি লজ্জায় দু-হাতে
নয়ন ঢাকিয়া! যৌবনের এ লাঞ্ছনা
দেখিবার আগে কেন মৃত্যু হইল না?

যৌবনের আবরণে ভারতে কি তবে
ফিরিতেছে দলে দলে বৃদ্ধ-প্রাণ জরা?
নহিলে এ সিন্ধবাদ কেমন করিয়া
ফিরিতেছে যৌবনের স্কন্ধে চড়ি আজও?

অতীতের অর্থ ভূত, সেই অদ-ভুত
অতীত কি বর্তমানে এখনও শাসিবে?
এই ভূতগ্রস্ত জাতি জানি না কেমনে
স্বাধীন হইবে কভু, পাইবে স্বরাজ!

রে তরুণ, তোমারে হেরিয়া আমি কাঁদি!
অসম্ভবের পথে অভিযান যার
সুদূর ভবিষ্যতে দুর্মদ দুর্বার
সে আজি অতীতে পানে মেলিয়া নয়ন
কেবলই পিছনে চলে, নেতার আদেশে।
তলোয়ার হইয়াছে লাঙলের ফলা!

তোমাদেরই মাঝে আছে নেতা তোমাদের,
তোমাদেরই বুকে জাগে নিত্য ভগবান,
ভয়হীন, দ্বিধাহীন, মৃত্যুহীন তিনি!
তোমারে আধার করি সেই মহাশক্তি
প্রকাশিতে চান নিত্য, চাহো আঁখি খুলি
আপনার মাঝে দেখো আপন স্বরূপ!

অতীতের দাসত্ব ভোলো! বৃদ্ধ সাবধানী
হইতে পারে না কভু তোমাদের নেতা।
তোমাদেরই মাঝে আছে বীর সব্যসাচী
আমি শুনিয়াছি বন্ধু সেই ঐশীবাণী
ঊর্ধ্ব হতে রুদ্র মোর নিত্য কহে হাঁকি,
শোনাতে এ কথা, এই তাঁহার আদেশ।

তোমাদের প্রাণের এ অনির্বাণ-শিখা
যৌবনের হোমকুণ্ড-পাশে বৃদ্ধ বসি,
আগুন পোহাবে, বন্ধু, এ দৃশ্য দেখিতে
যেন নাহি বাঁচি আর। সমাধি হইতে
আর যেন নাহি উঠি প্রলয়ের আগে!

 সে যে আমি

ওগো দুরন্ত সুন্দর মোর! কার পরে রাগ করি
তারার মুক্তা-মালিকা ছিঁড়িয়া ছড়ালে গগন ভরি?
কারে তুমি ভালোবাস প্রিয়তম? কার নাহি পেয়ে দেখা
চাঁদের কপোলে মাখাইয়া দিলে কালো কলঙ্ক-লেখা?
কার অনুরাগ নাহি পেয়ে তুমি লাল হয়ে ওঠ রাগে?
প্রভাত-সূর্যে, সৃষ্টিতে সেই রাগের বহ্নি লাগে।
কাহার বিরহ-জ্বালায় জ্বালাও বিশ্ব, পরম স্বামী?
সে কি আমি? সে কি আমি?

বনে উপবনে কুঞ্জে ফোটাও চামেলি চম্পা হেনা,
ওগো সুন্দর, ফুল ফুটাইয়া মালা কেন গাঁথিলে না?
শ্রাবণ-গগনে মেঘরূপে ওঠে তব রোদনের ঢেউ,
ঝুরিয়া ঝুরিয়া ক্ষীণ হল তনু, ভালোবাসিল না কেউ?
ওগো অভিমানী! বলো, কেন কোন নির্দয় অভিমানে
সৃষ্টিতে দিয়া জীবন, আবার টানিছ মৃত্যু-টানে?
গড়িয়া নিমেষে ভেঙে ফেল রূপ, যেন ভালো নাহি লাগে
রূপের এ খেলা। কোন অপরূপা স্মৃতিতে তোমার জাগে।
তাহারই লাগিয়া জাগিয়া রয়েছ উদাসীন দিবাযামী,
সে কি আমি? সে কি আমি?
ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোমে বসালে ভূতের মেলা,
ভূত নিয়ে এ কী অদ্ভুত খেলা, কে হানিয়াছে হেলা?
মাধবীলতার কাঁকন পরায়ে সহকার-তরুশাখে
রুদ্র ঝড়ের রূপে এসে তুমি কেন ছিঁড়ে ফেল তাকে?
তোমার প্রেমের রাখি কে নিল না, কে সেই গরবিনি?
আজও সৃষ্টির পিত্রালয়ে কি কাঁদে সেই বিরহিণী?
তাই কি যেখানে মিলন, সেখানে নিত্য বিরহ আনো?
আপন প্রিয়ারে পেলে না বলিয়া সবার প্রিয়ারে টানো?
কার কামনার সৃষ্টিতে তব রূপ চঞ্চলকামী?
সে কি আমি? সে কি আমি?

কাহারে ভুলাতে ঝর অনন্ত পরম-শ্রীর রূপে,
তোমারই গুণের কথা কি ভ্রমর ফুলে কয় চুপে চুপে?
মুহু মুহু উহু উহু করে ওঠ কুহুর কন্ঠস্বরে
তোমারই কাছে কি শিখিয়া পাপিয়া পিয়া পিয়া রব করে?
পদ্মপাতার থালায় তোমার নিবেদিত ফুলগুলি
ঝরে ঝরে পড়ে অশ্রুসায়রে, কহ লইল না তুলি!
যাহার লাগিয়া ফুলের বক্ষে সঞ্চিত কর মধু,
সকলে সে মধু লইল, নিল না তোমারই মালিনীবধূ?
যে অপরূপারে খোঁজ অনন্তকাল রূপে রূপে নামি –
সে কি আমি? সে কি আমি?

সংহারে খোঁজ, সৃষ্টিতে খোঁজ, খোঁজ নিত্য স্থিতিতে,
যাহারে খুঁজিছ পরম বিরহে, খুঁজিছ পরম প্রীতিতে,
যে অপরূপা পূর্ণা হইয়া আজিও এল না বাহিরে
পাইয়া যাহারে বলিছ, এ নয়, হেথা নয় সে তো নাহি রে।
সেই কুন্ঠিতা গুন্ঠিতা তব চির-সঙ্গিনী বালিকা
অনন্ত প্রেমরূপে অনন্ত ভুবনে গাঁথিছে মালিকা।
ভীরু সে কিশোরী তব অন্তরে অন্তরতম কোণে
হারাবার ভয়ে তোমারে, লুকায়ে রহে সদা নিরজনে।
সকলেরে দেখ, আপনারে শুধু দেখ না পরম উদাসীন,
দেখিলে, দেখিতে যেখানে তুমি, সেইখানে সে যে আছে লীন!
যত কাঁদে, তত বুকে বাঁধে তোমারেই অন্তর্যামী!
সে কি আমি? সে কি আমি?

ওগো প্রিয়তম! যত ধরি আমি দু-হাতে তোমারে জড়ায়ে
আমারে খুঁজিতে আমারেই তত সৃষ্টিতে দাও ছড়ায়ে।
আমারে যতই প্রকাশিতে চাহ বাহিরে ভুবনে আনিয়া,
তত লুকাইতে চাহি ; আজিও যে আমি অপূর্ণা জানিয়া।
হে মোর পরম মনোহর ! তব প্রিয়া বলে দিতে পরিচয়,
ক্ষমা করো, যদি অপূর্ণা এই বালিকার মনে জাগে ভয়!
আমার কলহ মান-অভিমান তোমার সহিত গোপনে,
জাগ্রত দিনে আজও লাজ লাগে, তাই মিলি আমি স্বপনে।
ওগো ও পরম নিলাজ, পরম নিরাবরণ, হে চঞ্চল,
আমারে ধরিতে, টানিয়া চলেছ সৃষ্টিতে মোর অঞ্চল।
আমারে কাঁদাতে সকলের সাথে দেখাও মিলন-অভিনয়,
বাহিরে এনো না, কাঁদিব বক্ষে, রেখো এ মিনতি প্রেমময়।
যদি ভালো তুমি বাস অপরেরে, হে পর-পুরুষ সুন্দর,
আমি আছি, আমি রব চিরকাল জুড়িয়া তোমার অন্তর।
আমি যে তোমার শক্তি হে প্রিয়, প্রকাশ বহির্জগতে,
আমারে না পেয়ে দুঃখের রূপে কাঁদিছে স্বর্গে-মরতে।
কলঙ্ক দিয়া আমার ধর্মে কলঙ্কী নাম নিলে হে,
দুই হয়ে তব রটে অপযশ, একাকী তো বেশ ছিলে হে।
তব সুন্দর-ছায়া মায়া রচে, মায়াতীত হয়ে তাহাতে–
কেন আসক্ত হলে তুমি, তারে জড়ায়ে ধরিলে বাঁ হাতে?
রূপ নাই, তবু রূপের তৃষ্ণা কেন তব বুকে জাগে,
এত রূপ রসে ঝরিয়া পড়িছ বলো কার অনুরাগে?
খেলা-শেষে মহাপ্রলয়ের বেলা আমার দুয়ারে থামি
জানাবে পরম-পতি আমারে কি –
আমি, প্রিয়, সে যে আমি!

Exit mobile version