Site icon BnBoi.Com

ঝড় – কাজী নজরুল ইসলাম

ঝড় - কাজী নজরুল ইসলাম

অপরূপ সে দুরন্ত

ভাব-বিলাসী অপরূপ সে দুরন্ত,
বাঁধন-হারা মন সদা তার উড়ন্ত!
সে ঘুরে বেড়ায় নীল আকাশে।
চাঁদের সাথে মুচকি হাসে,
গুঞ্জরে সে মউ-মক্ষীর গুঞ্জনে,
সে ফুলের সাথে ফোটে, ঝরে পরাগ হয়ে অঙ্গনে।
তার চোখের পলক ভোরের তারায় ঝলে,
ধুমকেতু তার ফুলঝুরি, সে উল্কা হয়ে চলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।

সে প্রথম-ফোটা গোলাপ-কুঁড়ির সনে–
হিঙুল হয়ে ওঠে লাজে হঠাৎ অকারণে।
ধরা তারে ধরতে নারে ঘরের প্রদীপ দিয়ে,
সে শিশির হয়ে কাঁদে, খেলে পাখির পালক নিয়ে।
সে ঝড়ের সাথে হাসে
সে সাগর-স্রোতে ভাসে,
সে উদাস মনে বসে থাকে জংলা পথের পাশে
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!

সে বৃষ্টিধারার সাথে পড়ে গলে,
অস্ত-রবির আড়াল টেনে লুকায় গগন-তলে।
দীপ্ত রবির মুকুরে সে আপন ছায়া দেখে,
সে পথে যেতে যায় যেন কি মায়ার মোহ এঁকে।
ঝরা তারার তির হানে সে নিশুত রাতের নভে,
ঘুমন্তরে জাগিয়ে সে দেয় বিপুল বজ্র-রবে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!

সে রঙিন প্রজাপতি
কভু ফুলের দিকে মতি
কভু ভুলের দিকে গতি
তার রুধির-ধারা নদীর স্রোতের মতো
দেহের কূলে বদ্ধ তবু মুক্ত অবিরত।
রূপকে বলে সঙ্গিনী সে, প্রেমকে বলে প্রিয়া,
রূপ ঘুমালে ঊর্ধ্বে ওঠে আত্মাতে প্রেম নিয়া।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত।

মরণকে সে ভয় করে না, জ্ঞানীর সভায় ভয়,–
ভাবের সাথে ভাব করে সে অভাব করে জয়।
তার তরল হাসি সরল ভাবে মুগ্ধ সবার মন,
মন ভরে না জ্ঞানীর, করে অর্থ অন্বেষণ।
চোখ আছে যার, তারই চোখের পাতা টিপে ধরে,
হাতিশালায় যায় না, যায় ফুল ফোটে যে-ঘরে।
তার পথের পথিক সাথি,
তার বন্ধু নীরব রাতি,
খ্যাতির খাতায় চায় না চাঁদা, চাঁদের সাথে খেলে,
সে কথা কহে, মুক্ত-পাখা পাখির দেখা পেলে।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!

তারে জ্ঞান-বিলাসী ডাকে না, তায় গাঁয়ের চাষি ডাকে,
তৃষার জলের পাত্র-সম জড়িয়ে ধরে তাকে।
সে রয় না আন্দোলনে,
যেথা আনন্দ হয় আন্দোলিত যায় সে গোপন বনে।
সে চাঁদের আলো, বর্ষা-মেঘের জল,
আপনার খুশিতে ঝরে আপনি সে চঞ্চল।
সে চায় না ফুলের মালা, সে ফুলের মধু চায়,
সে চায় না তাহার নাম,
দান দিয়ে সে পালিয়ে বেড়ায়
চায় না তাহার দাম।
অপরূপ সে দুরন্ত,
মন সদা তার উড়ন্ত!

কেউ যদি তায় ভালো বলে, আলোর বুকে হয় সে লয়,
বলে, ‘ওগো সুন্দর মোর, তোমায় বলে, আমায় নয়!’
ছন্দ তাহার স্বচ্ছন্দ, দ্বন্দ্ব মাঝে রয় না সে,
যে বড়ো তাঁর সুনাম নিয়ে ক্ষুদ্র কথা কয় না সে।
তার মন্দ শোনার নাইকো সময়,
রসের সাথে নিত্য প্রলয়,
তারে নিন্দা দিলে চন্দন দেয়
সে নন্দন-জাদুকর,
সুন্দর সে, তাই দেখে না কাহারেও সে অসুন্দর।
তারে লোভ দেখিয়ে যায় না ধরা,
আপনাকে যে দিতে চায়–
প্রেম-ভিক্ষু দুরন্ত সে লুটিয়ে পড়ে তাহার পায়।
পূর্ণের সে প্রতিচ্ছায়া, অপরূপ সে দুরন্ত,
মন কাঁদে মোর তারই তরে, মন সদা যার উড়ন্ত!

আঁধারে

অমানিশায় আসে আঁধার তেপান্তরের মাঠে;
স্তব্ধ ভয়ে পথিক ভাবে,– কেমনে রাত কাটে!
ওই যে ডাকে হুতোম-পেঁচা, বাতাস করে শাঁ শাঁ!
মেঘে ঢাকা অচিন মুলুক; কোথায় রে কার বাসা?
গা ছুঁয়ে যায় কালিয়ে শীতে শূন্য পথের জু জু–
আঁধার ঘোরে জীবন-খেলার নূতন পালা রুজু।

আগা মুরগি লে কে ভাগা

[সুর : ‘একদা তুমি প্রিয়ে আমারই এ তরুমূলে’]

একদা তুমি আগা দৌড়ে কে ভাগা মুরগি লেকে।
তোমারে ফেলনু চিনে ওই আননে জমকালো চাপ দাড়ি দেখে॥
কালো জাম খাচ্ছিলে যে সেইদিন সেই গাছে চড়ে
কালো জাম মনে করে ফেললে খেয়ে ভোমরা ধরে।
‘চুঁ করো আওর চাঁ করো ছোড়ে গা নেই,
সব কুছ কালা কালা খা জায়ে গা’ – বললে হেঁকে॥
ভুলো আর টেমি জিমি চেনে যে ওই ঝাঁকড় চুলে,
তোমারে দেখলে পরে তারস্বরে আসে তেড়ে ল্যাজুড় তুলে।

ও-পাড়ার হীরু তোমায় দেখেই পালায় পগার-পারে,
‘রুপিয়া লে আও,’ বলে ধরলে তাহার ছাগলটারে।
দেখিয়াই মটরু মিয়াঁর মুরগি লুকায় ঝোপের আড়ে,
তাই কি ছেলেমেয়ে মুরগি-চোরা বলে ডাকে॥

উঠিয়াছে ঝড়

উঠিয়াছে ঝড়, কড় কড় কড় ঈশানে নাকাড়া বাজিছে তার,
ওরে ভীরু, ওঠ, এখনই টুটিবে ধমকে তাহার রুদ্ধ দ্বার!
কৃষ্ণ মেঘের নিশান তাহার দোলে পশ্চিম-তোরণে ওই,
ভ্রুকুটি- ভঙ্গে কোটি তরঙ্গে নাচে নদনদী তাথই থই।
তরবারি তার হানিছে ঝিলিক সর্পিল বিদ্যুল্লেখায়,
হানিবে আঘাত তোর স্বপ্নের শিশমহলের দরোয়াজায় ;
কাঁদিবে পূর্ব পুবালি হাওয়ায়, ফোটাবে কদম জুঁই কুসুম ;
বৃষ্টিধারায় ঝরিবে অশ্রু, ঘনালে প্রলয় রবে নিঝুম?

যে দেশে সূর্য ডোবে – সেই দেশে হইল নবীন সূর্যোদয়,
উদয়-অচলে টলমল করে অস্ত-রবির আঁধার ভয়!
যুগ যুগ ধরি, তপস্যা দিয়ে করেছি মহিরে মহামহান,
ফুটায়েছি ফুল কর্ষিয়া মরু, ধূলির ঊর্ধ্বে গেয়েছি গান।
আজি সেই ফুলে-ফসল-মেলায় অধিকার নাই আমাদেরই,
আমাদের ধ্যান-সুন্দর ধরা আমাদের নয় আজি হেরি!
গীত-শেষে নীড়ে ফিরিবার বেলা হেরি নীড়ে বাসা বাঁধে শকুন,
মাংস-লোলুপ ফিরিতেছে ব্যাধ স্কন্ধে রক্ত-ধনুর্গুণ!
নীড়ে ফিরিবার পথ নাই তোর, নিম্নে নিষাদ, ঊর্ধ্বে বাজ,
তোর সে অতীত মহিমা আজিকে তোরে সব চেয়ে হানিছে লাজ!

উঠিয়াছে ঝড় – ঝড় উঠিয়াছে প্রলয়-রণের আমন্ত্রণ,
‘আদাওতি’র এ দাওতে কে যাবি মৃত্যুতে প্রাণ করিয়া পণ?
ঝড়ে যা উড়িবে, পুড়িবে আগুনে, উড়ুক পুড়ুক সে সম্বল,
মৃত্যু যেখানে ধ্রুব তোর সেথা মৃত্যুরে হেসে বরিবি চল!
অপরিমাণ এ জীবনে করিবি জীবিতের মতো ব্যয় যদি,
ঊর্ধ্বে থাকুক ঝড়ের আশিস, চরণে মরণ-অম্বুধি!

বিধাতার দান এই পবিত্র দেহের করিবি অসম্মান?
শকুন-শিবার খাদ্য হইবি, ফিরায়ে দিবি না খোদার দান?
এ-জীবন ফুল-অঞ্জলি সম নজরানা দিবি মৃত্যুরে, –
জীবিতের মতো ভুঞ্জি জীবন ব্যয় করে যা তা প্রাণ পুরে!
চরণে দলেছি বিপুলা পৃথ্বী কোটি গ্রহ তারা ধরি শিরে,
মোদের তীর্থ লাগি রবি শশী নিশিদিন আসে ফিরে ফিরে।
নিঃসীম নভ ছত্র ধরিয়া, বন্দনা-গান গাহে বিহগ,
বর্ষায় ঝরে রহমত-পানি-প্রতীক্ষমাণ সাত স্বরগ।
অপরিমাণ এ দানেরে কেমনে করিবি, রে ভীরু অস্বীকার?
মৃত্যুর মারফতে শোধ দিব বিধির এ মহাদানের ধার।
রোগ-পাণ্ডুর দেহ নয় – দিব সুন্দর তনু কোরবানি,
রোগ ও জরারে দিব না এ দেহ, জীবন-ফুলের ফুলদানি।
তাজা এ স্বাস্থ্য সুন্দর দেহ মৃত্যুরে দিবি অর্ঘ্যদান,
অতিথিরে দিবি কীটে-খাওয়া ফুল? লতা ছিঁড়ে তাজা কুসুম আন!

আসিয়াছে ঝড়, ঘরের ভিতর তাজিম করিয়া অতিথে ডাক,
বন্ধুর পথে এসেছে বন্ধু, হাসিয়া দস্তে দস্ত রাখ।
যৌবন-মদ পূর্ণ করিয়া জীবনের মৃৎপাত্র ভর,
তাই নিয়ে সব বেহুঁশ হইয়া ঝঞ্ঝার সাথে পাঞ্জা ধর।

ঝঞ্ঝার বেগ রুধিতে নারিবে পড়-পড় ওই গৃহ রে তোর,
খুঁটি ধরে তার কেন বৃথা আর থাকিস বসিয়া, ভাঙ এ দোর!
রবির চুল্লি নিভিয়া গিয়াছে, ধূম্রায়মান নীল গগন,
ঝঞ্ঝা এসেছে ঝাপটিয়া পাখা, ধেয়ে আয় তুই ক্ষীণ পবন!

কর্থ্যভাষা

কর্থ্যভাষা কইতে নারি শুর্দ্ধ কথা ভিন্ন।
নেড়ায় আমি নিম্ন বলি (কারণ) ছেঁড়ায় বলি ছিন্ন॥
গোঁসাইকে কই গোস্বামী, তাই মশাইকে মোর্স্বামী।
বানকে বলি বন্যা, আর কানকে কন্যা কই আমি॥
চাষায় আমি চশ্‌শ বলি, আশায় বলি অশ্ব।
কোটকে বলি কোষ্ঠ, আর নাসায় বলি নস্য॥
শশারে কই শিষ্য আমি, ভাষারে কই ভীষ্ম।
পিসিরে কই পিষ্টক আর মাসিরে মাহিষ্য॥
পুকুরকে কই প্রুষ্করিণী, কুকুরকে কই ক্রুক্কু।
বদনকে কই বদনা, আর গাড়ুকে গুড়ুক্কু॥
চাঁড়ালকে কই চণ্ডাল, তাই আড়ালকে অণ্ডাল।
শালারে কই শলাকা, আর কালায় বলি কঙ্কাল॥
শ্বশুরকে কই শ্মশ্রু, আর দাদাকে কই দদ্রু।
বামারে কই বম্বু, আর কাদারে কই কদ্রু॥
আরও অনেক বাত্রা জানি, বুঝলে ভায়া মিন্টু।
ভেবেছ সব শিখে নেবে, বলছিনে আর কিন্তু॥

গান

আমার বিফল পূজাঞ্জলি
অশ্রু-স্রোতে যায় যে ভেসে।
তোমার আরাধিকার পূজা
হে বিরহী, লও হে এসে।
খোঁজে তোমায় চন্দ্র তপন,
পূজে তোমায় বিশ্বভুবন,
আমার যে নাথ ক্ষণিক জীবন
মিটবে কি সাধ ভালোবেসে॥
না-দেখা মোর বন্ধু ওগো,
কোথায় বাঁশি বাজাও একা,
প্রাণ বোঝে তা অনুভবে
নয়ন কেন পায় না দেখা!

সিন্ধু যেমন বিপুল টানে
তটিনীরে টেনে আনে,
তেমনি করে তোমার পানে
আমায় ডাকো নিরুদ্দেশে॥

ঘোষণা

হাতে হাত দিয়ে আগে চলো, হাতে
নাই থাক হাতিয়ার!
জমায়েত হও, আপনি আসিবে
শক্তি জুলফিকার॥

আনো আলির শৌর্য, হোসেনের ত্যাগ,
ওমরের মতো কর্মানুরাগ,
খালেদের মতো সব অসাম্য
ভেঙে করো একাকার॥

ইসলামে নাই ছোটো বড়ো আর
আশরাফ আতরাফ;
এই ভেদ-জ্ঞান নিষ্ঠুর হাতে
করো মিসমার সাফ!

চাকর সৃজিতে চাকরি করিতে
ইসলাম আসে নাই পৃথিবীতে;
মরিবে ক্ষুধায় কেহ নিরন্ন,
কারো ঘরে রবে অঢেল অন্ন,
এ-জুলুম সহেনিকো ইসলাম –
সহিবে না আজও আর॥

বন্ধন

অনন্তকাল এ-অনন্তলোকে
মন-ভোলানোরে তার খুঁজে ফিরে মন।
দক্ষিণা-বায় চায় ফুল-কোরকে ;
পাখি চায় শাখী, লতা-পাতা-ঘেরা বন।
বিশ্বের কামনা এ – এক হবে দুই ;
নূতনে নূতনতর দেখিবে নিতুই॥
তোমারে গাওয়াত গান যার বিরহ
এড়িয়ে চলার ছলে যাচিয়াছ যায়,
এল সেই সুদূরের মদির-মোহ
এল সেই বন্ধন জড়াতে গলায়।
মালা যে পরিতে জানে, কন্ঠে তাহার
হয় না গলার ফাঁসি চারু-ফুলহার॥
জলময়, নদী তবু নহে জলাশয়,
কূলে কূলে বন্ধন তবু গাহে গান ;
বুকে তরণির বোঝা কিছু যেন নয়–
সিন্ধুর সন্ধানী চঞ্চল-প্রাণ।
দুই পাশে থাক তব বন্ধন-পাশ,
সমুখে জাগিয়া থাক সাগর-বিলাস॥
বিরহের চখাচখি রচে তারা নীড়,
প্রাতে শোনে নির্মল বিমানের ডাক ;
সেই ডাকে ভোলে নীড়, ভোলে নদীতীর,
সন্ধ্যায় গাহে : ‘এই বন্ধন থাক’!
আকাশের তারা থাক কল্পলোকে,
মাটির প্রদীপ থাক জাগর-চোখে॥

সালাম অস্ত-‘রবি’

কাব্য-গীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা, দ্রষ্টা, ঋষি ও ধ্যানী
মহাকবি রবি অস্ত গিয়াছে! বীণা, বেণুকা ও বাণী
নীরব হইল। ধূলির ধরণি জানি না সে কত দিন
রস-যমুনার পরশ পাবে না। প্রকৃতি বাণীহীন
মৌন বিষাদে কাঁদিবে ভুবনে ভবনে ও বনে একা ;
রেখায় রেখায় রূপ দিবে আর কাহার ছন্দ-লেখা?
অপ্রাকৃত মদনে মাধবী চাঁদের জ্যোৎস্না দিয়া
রূপায়িত রসায়িত করিবে কে লেখনী, তুলিকা নিয়া?

ব্যাস, বাল্মীকি, কালিদাস, খৈয়াম, হাফিজ ও রুমি
আরবের ইমরুল-কায়েস যে ছিলে এক সাথে তুমি!
সকল দেশের সকল কালের সকল কবিরে ভাঙি
তাঁহাদের রূপে রসে রাঙাইয়া, বুঝি কত যুগ জাগি
তোমারে রচিল রসিক বিধাতা, অপরূপ সে বিলাস,
তব রূপে গুণে ছিল যে পরম সুন্দরের আভাস!

এক সে রবির আলোকে তিমির-ভীত এ ভারতবাসী
ভুলেছিল পরাধীনতা-পীড়ন দুঃখ-দৈন্যরাশি।
যেন ঊর্ধ্বের বরাভয় তুমি আল্লার রহমত,
নিত্য দিয়াছ মৃত এ জাতিরে অমৃত শরবত।
সকল দেশের সকল জাতির সকল লোকের তুমি
অর্ঘ্য আনিয়া ধন্য করিলে ভারত-বঙ্গভুমি॥

তোমার মরুতে তোমার আলোকে ছায়া-তরু ফুল-লতা
জন্মিয়া চির-স্নিগ্ধ করিয়া রেখেছিল শত ব্যথা।
অন্তরে আর পাই না যে আলো মানস-গগন-কবি,
বাহিরের রবি হেরিয়া জাগে যে অন্তরে তব ছবি।
গোলাপ ঝরেছে, গোলাবি আতর কাঁদিয়া ফিরিছে, হায়!
আতরে কাতর করে আরও প্রাণ ফলেরে দেখিতে চায়।
ফুলের, পাখির, চাঁদ-সুরুজের নাহিকো যেমন জাতি,
সকলে তাদেরে ভালোবাসে, ছিল তেমনি তোমার খ্যাতি।
রস-লোক হতে রস দেয় যারা বৃষ্টিধারার প্রায়
তাদের নাহিকো ধর্ম ও জাতি, সকলের ঘরে যায়।
অবারিত দ্বার রস-শিল্পীর, হেরেমেও অনায়াসে
যায় তার সুর কবিতা ও ছবি আনন্দে অবকাশে।

ছিল যে তোমার অবারিত দ্বার সকল জাতির গেহে,
তোমারে ভাবিত আকাশের চাঁদ, চাহিত গভীর স্নেহে!
ফুল হারাইয়া আঁচলে রুমালে তোমার সুরভি মাখে
বক্ষে নয়নে বুলায়ে আতর, কেঁদে ঝরাফুল ডাকে।

আপন জীবন নিঙাড়ি যে জন তৃষাতুর জনগণে
দেয় প্রেম-রস, অভয়-শক্তি বসি দূর নির্জনে,
মানুষ তাহারই তরে কাঁদে, কাঁদে তারই তরে আল্লাহ্‌,
বেহেশ্‌ত হতে ফেরেশতা কহে তাহারেই বাদশাহ!

শত রূপে রঙে লীলা-নিকেতন আল্লার দুনিয়াকে
রাঙায় যাহারা, আল্লার কৃপা সদা তাঁরে ঘিরে থাকে।
তুমি যেন সেই খোদার রহম এসেছিলে রূপ ধরে,
আরশের ছায়া দেখাইয়া ছিলে রূপের আরশি ভরে।

কালাম ঝরেছে তোমার কলমে, সালাম লইয়া যাও!
ঊর্ধ্বে থাকি এ পাষাণ জাতিরে রসে গলাইয়া দাও॥

হিন্দি গান

আজ বন-উপবন-মে
চঞ্চল মেরে মন-মে
মোহন মুরলীধারী কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম।
সুনো মোহন নূপুর গুঁজত হ্যায়,
বাজে মুরলী বোলে রাধা নাম॥
কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম॥
বোলে বাঁশরি আও শ্যাম-পিয়ারি–
ঢুঁড়ত হ্যায় শ্যাম-বিহারী,
বনবালা সব চঞ্চল
ওড়াওয়ে অঞ্চল
কোয়েল সখী গাওয়ে সাথ গুণধাম॥
কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম॥

ফুলকলি ভোলে ঘুংঘট খোলে
পিয়াকি মিলনকি প্রেমকি বোলি বোলে,
পবন পিয়া লেকে সুন্দর সৌরভ
হাঁসত যমুনা সখী দিবস-যাম॥
কুঞ্জ কুঞ্জ ফিরে শ্যাম॥

॥ ২॥
খেলত বায়ু ফুল-বনমে আও প্রাণ-পিয়া।
আও মনমে প্রেম-সাথি আজ রজনি
গাও প্রাণ-প্রিয়া॥
মন-বনমে প্রেম মিলি
ভোলত হ্যায় ফুল-কলি,
বোলত হ্যায় পিয়া পিয়া।
বাজে মুরলিয়া॥

মন্দিরমে রাজত হ্যায় পিয়া তব মুরতি,
প্রেম-পূজা লেও পিয়া, আও প্রেম-সাথি,
চাঁদ হাসে তারা সাথে
আও পিয়া প্রেম-রাথে,
সুন্দর হ্যায় প্রেম-রাতি, আও মোহনিয়া।
আও প্রাণ-পিয়া॥

॥ ৩॥
চক্র সুদর্শন ছোড়কে মোহন
তুম ব্যনে বনওয়ারি।
ছিন লিয়ে হ্যায় গদা পদম সব
মিল করকে ব্রজনারী॥
চার ভুজা আব দো বানায়ে,
ছোড়কে বৈকুন্ঠ ব্রিজ-মে আয়ে,
রাস রচায়ে ব্রিজ-কে মোহন
ব্যন গয়ে মুরলীধারী॥

সত্যভামা-কো ছোড়কে আয়ে,
রাধা-প্যারি সাথ-মে লায়ে,
বৈতরণি-কো ছোড়কে ব্যন গয়ে
যমুনাকে তটচারী॥

॥ ৪॥
তুম প্রেমকে ঘনশ্যাম
ম্যায় প্রেম কি শ্যাম প্যারি।
প্রেম কা গান তুমহরে দান
ম্যায় হুঁ প্রেম-ভিখারি॥
হৃদয় বিচমে যমুনা-তীর
তুমহরি মুরলী বাজে ধীর,
নয়ন-নীর কী বহত যমুনা
প্রেমকে মাতোয়ারি॥
যুগ যুগ হোয়ে তুমহরি লীলা মেরে হৃদয়-বনমে।
তুমহরে মোহন মন্দির পিয়া মোহত মেরে মনমে।

প্রেম-নদী-নীর নিত বহি যায়,
তুমহরে চরণ কো কাঁহু না পায়,
রোয়ে শ্যাম-প্যারি সাথে ব্রজনারী
আও মুরলীধারী॥

॥ ৫॥
ঝুলন ঝুলায়ে ঝাউ ঝক ঝোরে,
দেখো সখী চম্পা লচকে।
বাদরা গরজে দামিনী দমকে॥

আও ব্রজ-কি কুঙারি ওঢ়ে নীল শাড়ি,
নীল কমল-কলিকে পহনে ঝুমকে॥
হাররে ধান কি লও মে হো বালি,
ওড়নি রাঙাও শতরঙ্গি আলি,
ঝুলা ঝুলো ডালি ডালি,
আও প্রেম-কুঙারি মন ভাও,
প্যারে প্যারে সুর-মে শাওনি সুনাও!

রিমঝিম রিমঝিম পড়ত কোয়ারে,
সুন পিয়া পিয়া কহে মুরলী পুকারে,
ওহি বোলি-সে হিরদয় খটকে॥

॥ ৬॥
ঝুলে কদমকে ডারকে ঝুলনা মে কিশোরী কিশোর।
দেখে দোউ এক এক-কে মুখকো চন্দ্রমা-চকোর–
য্যায়সা চন্দ্রমা চকোর হোকে প্রেম-নেশা বিভোর॥

মেঘ-মৃদং বাজে ওহি ঝুলনাকে ছন্দ্-মে,
রিমঝিম বাদর বরষে আনন্দ্-মে,
দেখনে যুগল শ্রীমুখ-চন্দ-কো
গগন ঘেরি আয়ে ঘনঘটা-ঘোর॥

নব নীর বরষণে কো চাতকী চায়,
ওয়সে গোপী ঘনশ্যাম দেখ তৃষ্ণা মিটায়;
সব দেবদেবী বন্দনা-গীত গায়–
ঝরে বরষা-মে ত্রিভুবন-কি আনন্দাশ্রু-লোর॥

॥ ৭॥
প্রেমনগর-কা ঠিকানা কর-লে
প্রেমনগর-কা ঠিকানা।
ছোড় কারিয়ে দো-দিন-কা ঘর
ওহি রাহ-মে জানা॥
দুনিয়া দওলত হ্যায় সব মায়া,
সুখ-দুখ হ্যায় দো জগৎ কা কায়া,
দুখ-কো তু গলে লাগা লে–
আগে না পসতানা॥

আতি হ্যায় যব রাত আঁধারি–
ছোড় তুম মায়া বন্ধন ভারি,
প্রেম-নগর কি কর তৈয়ারি
আয়া হ্যায় পরোয়ানা॥

॥ ৮॥
সোওত জগত আঁঠু জান রাহত প্রভু
মন-মে তুমহারে ধ্যান।
রাত-আঁধেরি-সে চাঁদ সমান প্রভু
উজ্জ্বল কর মেরা প্রাণ॥

এক সুর বোলে ঝিওর সারে রাত–
এ্যায়সে হি জপ তুহু তেরা নাম, হে নাথ!
রুম রুম মে রম রহো মেরে
এক তুমহারা গান॥
গয়ি বন্ধু কুটুম স্বজন–
ত্যজ দিনু ম্যায় তুমহারে কারণ,
তুম হো মেরে প্রাণ-আধারণ–
দাসী তুমহারি জ্ঞান॥

Exit mobile version