কবিতা চিরকাল এক থাকে না। ভাষা ও ব্যক্তিগত মানবিক বোধের উৎকৃষ্ট সমন্বয়ই কবিতা; আর যুগে যুগে ভাষা ও মানবিক বোধের বিভিন্ন প্রান্তের ওপর পড়ে জোর, এবং কবিতা হয়ে ওঠে। ভিন্ন। পশ্চিমের আধুনিক কবিরা, যাদের প্রভাব খুবই ব্যাপক আধুনিক বাঙলা কবিতার ওপর, কবিতা সম্পর্কে পেশ করেছেন বহু ব্যক্তিগত তত্ত্ব; সেগুলোর মধ্যে সাড়াজাগানো একটি হচ্ছে কবিতার নৈর্ব্যক্তিকতা ও বিজ্ঞানধর্মিতা, কিন্তু খুব বেশি কবি তা মেনে চলতে পারেন নি। বিজ্ঞান এক শতকেরও বেশি সময় ধ’রে প্রলুব্ধ করে আসছে সাহিত্যকে, ওই প্রলোভনে প্রথম ধরা দিয়েছিলেন প্রাকৃতবাদী ঔপন্যাসিকেরা। জেলা উপন্যাসকে ক’রে তুলতে চেয়েছিলেন বিজ্ঞান, কিন্তু শেষে দেখা গেছে বিজ্ঞানের থেকে মানবিক উপাদানের জন্যেই তার, ও প্রাকৃতবাদীদের, উপন্যাস গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কবিদের অনেকেই বিজ্ঞানকে ঈর্ষা করেছেন, ভুলভাবে কবিতাকে সম্রান্ত ক’রে তুলতে চেয়েছেন; কবিতায় আয়ত্ত করতে চেয়েছেন বিজ্ঞানের অবথা, চেয়েছেন কবিতার নৈর্ব্যক্তিকীকরণ। এর প্রধান প্ৰবক্তা টি এস এলিঅট। তার মতে শিল্পীর অগ্রগতি হচ্ছে ধারাবাহিক আত্মবিসর্জন, ধারাবাহিক ব্যক্তিত্ব নির্বাপণ। তার মতে এ-নৈর্ব্যক্তিকীকরণ প্রক্রিয়াই শিল্পকলা অর্জন করে বিজ্ঞানের অবস্থা। সৃষ্টির এ-প্রক্রিয়াকে তিনি তুলনা করেছেন গবেষণাগারের একটি নিরীক্ষাপ্রক্রিয়ার সাথে, কবির মন তার কাছে হয়ে উঠেছে প্ল্যাটিনাম টুকরোর মতো অনুঘটক। রোম্যান্টিকের কাছে কবির মনই ছিলো বিধাতা, মন যা সৃষ্টি করে তা-ই শুধু সত্য; আর তার কাছে মন হয়ে ওঠে অনুঘটকমাত্র, যার কাজ নিজে অপরিবর্তিত থেকে বিভিন্ন আবেগের বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করা। এলিঅট নিজে খুব বিজ্ঞানপ্রবণ ছিলেন না, বরং ধর্মের মতো অপবিশ্বাসের প্রতিই ঝোঁক ছিলো তার বেশি; আর এখানে তিনি যে-বিজ্ঞানটুকু চর্চা করেছেন, তাও খুব উচ্চতর রসায়ন নয়, একেবারেই প্রাথমিক রসায়নশাস্ত্র। মন প্র্যাটিনামের মতো নিস্ক্রিয় পদাৰ্থ নয়। এলিঅট পরে অবশ্য এমন কথা বলেছেন, যাতে বাতিল হয়ে যায়। তাঁর নৈর্ব্যক্তিকীকরণতত্ত্ব। তিনি বলেছেন যাদের রয়েছে ব্যক্তিত্ব ও আবেগ, শুধু তারাই জানেন ওই ব্যক্তিত্ব ও আবেগ থেকে মুক্তির কী অর্থ। তবে নৈর্ব্যক্তিক কবিতাও কবিতা, তা লিখেছেন অনেকেই, এলিআটও; তার অসাধারণ রূপও অসাধারণ, কিন্তু কবিতাকে নৈর্ব্যক্তিক হ’তেই হবে, তা নয়। তাঁর একটি উক্তি-ভালো কবিতা বোঝার অনেক আগেই ংক্রামিত হয়—একসময় খুবই গৃহীত ছিলো; কিন্তু এখন সন্দেহ দেখা দিয়েছে ওটি সম্পর্কে। সত্যিই কি ভালো কবিতা বোঝার অনেক আগেই ভেতরে ঢোকে, মনে বা হৃদয়ে? অনেক বাজে জিনিশও কি ঢুকে যায় না। আমাদের মনে, এবং অনেক ভালো জিনিশাও কি বুঝতে অনেক সময় লাগে না আমাদের, বা কখনোই বুঝে উঠি না। আমরা? ভালোর থেকে খারাপই তো মানুষের মনে বেশি ঢোকে; আমরা কি দেখতে পাই না উৎকৃষ্ট কবি ও কবিতা উপেক্ষিত আর নন্দিত নিকৃষ্ট কবি ও কবিতা? সুধীন্দ্রনাথের যযাতি’ বাঙলার অনেক কবিরও মনে এখনো ঢোকে নি, অনেকের মনে কখনোই ঢুকবে না; কিন্তু বিজ্ঞাপনের বা হিন্দি গানের বহু নিকৃষ্ট ধ্বনিপুঞ্জ ঢুকেছে তাদের মনে। আমরা কি মনে করবো যযাতি’র থেকে ওগুলো উৎকৃষ্ট কবিতা?
ইয়েট্স্ যখন কবি, এমনকি অপবিশ্বাসী কবি, তখন তিনি অসাধারণ; তবে অপবিশ্বাস ব্যাখ্যা করার সময় তিনি হাস্যকর; কিন্তু যখন কবিতা লেখার কথা বলেন, তখন বলেন কবিতা লেখারই কথা। অডেন চমৎকার কথা বলেছেন যে আজকাল সব ধরনের যোগ্যতাহীন হ’লেই তরুণতরুণীরা মনে করে তাদের রয়েছে কবিপ্রতিভা। কিন্তু তরুণতরুণীদের যোগ্য বা প্রতিভাবান ক’রে তোলার জন্যে তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন কবি হওয়ার যে-পাঠক্রম, তা কোনোক্রমেই কাউকে কবি হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। কবি যে অশিক্ষিত হবেন, বা অশিক্ষিত হ’লেই কেউ কবি হবেন, তা নয়; কবি অবশ্যই শিক্ষিত হবেন, তবে শিক্ষা কাউকে কবি হওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। অডেনের পাঠক্রম সুচারুরূপে সম্পন্ন করার পর ভালো প্রশংসাপত্ৰ পাবে অনেকেই, কিন্তু তাদের অনেকেরই কবি না হওয়ার সম্ভাবনা বিপুল। সম্পূর্ণ বাজে কথা হয়েও কোনো লেখা হ’তে পারে, হাউজম্যানের ভাষায়, ‘র্যাভিশিং পোয়েটি’; কবিতার জন্যে শিক্ষা দরকারী নয়; কিন্তু আধুনিক কালে শিক্ষা কবিতার সঙ্গে শত্ৰুতা না ক’রে মিত্ৰতাই করেছে বেশি। শিক্ষা ছাড়া জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথকে পেতাম না। আমরা, পেতাম। এমন অনেককে যেমন পেয়েছি অনেককে। অডেনের পাঠক্রম হাস্যকর, কিন্তু আমি অশিক্ষিত কবি চাই না; কবিতা চাই, কবি শিক্ষিত বা অশিক্ষিত যা-ই হোক। তবে একালে অশিক্ষিত কবি হওয়ার বিপদ খুবই বেশি, বাঙলায় তা এখন বেশ চোখে পড়ে। অশিক্ষিত হওয়ার একটি সুবিধা হচ্ছে তাতে প্ৰলাপ বিকা বা মাতলামো বা ফাজলামো করা যায় দ্বিধাহীনভাবে, এবং তাকে কবিতা ব’লে মনে করতে লজ্জা তো লাগেই না, বরং তাতেই অশিক্ষিতারা গৌরব বোধ করে।
পশ্চিমের কয়েকজন আধুনিক কবি কবিতা সম্পর্কে কী বলেন, তা দেখতে পারি। কয়েকজনের কবিতা সম্পর্কে কথা এমন :
ডব্লিউ বি ইএটস
কবি সব সময় লেখেন তার ব্যক্তিগত জীবন থেকে, জীবনের ট্র্যাজেডি থেকে জন্ম নিতে পারে তার উৎকৃষ্টতম রচনা, তা যা-ই হোক, অনুশোচনা, ব্যর্থ প্রেম, বা নিতান্ত নিঃসঙ্গত; যেমন হয় প্রাতঃরাশ টেবিলে তেমন সরাসরি কারো সাথে তিনি কথা বলেন না, সব সময়ই থাকে এক অলীক ছায়ামূর্তিপরম্পরা। দান্তে ও মিল্টনের ছিলো পুরাণ, শেক্সপিয়রের ছিলো ইংরেজি ইতিহাস বা প্রথাগত রোমান্সের চরিত্র; এমনকি যখন কবি বেশিরভাগই প্রতিভাত হন নিজে, যখন তিনি রেলি এবং ক্ষমতাবানদের দেন। মিথ্যা, অথবা শেলি ‘এমন স্নায়ু যার ওপর লতিয়ে চলে অননুভূত পার্থিব পীড়ন, অথবা বায়রন যখন আত্মা ক্ষয় করে বক্ষকে যেমন তলোয়ার ক্ষয় করে তার খাপকে, তিনি কখনোই সে-আকস্মিকতা ও অসামঞ্জস্যের সমষ্টি নন যা বসে প্রাতঃরাশের জন্যে; তিনি পুনর্জন্ম নিয়েছেন এমন এক ভাবরূপে, যা অভিপ্রেত, সম্পূর্ণ।
শৈলি প্রায় সবখানিই অসচেতন। আমি যা করতে চেয়েছি তা আমি জানি, আমি যা করেছি তাসমান্যই জানি।… আমি পরিকল্পনা নিই ছোটো ছোটো লিরিক বা কাব্যনাটক লেখার যাতে প্রতিটি উক্তি হবে সংক্ষিপ্ত ও সংহত, বোনা হবে নাট্যিক উদ্বেগো, এবং আমি তা করেছি। অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের সাথে কেননা তখনকার তরুণ ইংরেজ কবিরা সংকটমুহূর্তে লিখছিলেন আবেগে, যদিও তাদের ধীর-অগ্রসর ধ্যান ফিরে আসতো অনতিবিলম্বে। তখন, এবং এ-ইংরেজি কবিতা আমার নেতৃত্বই মেনে নিয়েছে, আমি ইংরেজি কবি তার ভাষা, ও সংরক্ত স্বাভাবিক উক্তির ভাষাকে অভিন্ন ক’রে তোলার চেষ্টা করেছি। স্বগতভাস্কণের সময় যে-ভাষা সবচেয়ে স্বাভাবিকভাবে আসে। আমি তাতেই লেখার চেষ্টা করেছি, যেমন আমি প্রাত্যহিক জীবনে সারাদিন ক’রে থাকি. বছর বিশেক আগে আমি আবিষ্কার করি যে আমাকে খুঁজতে হবে, ওয়ার্ডসওঅৰ্থ যেমন মনে করেছিলেন, প্রাত্যহিক ব্যবহৃত শব্দ, তা নয়; আমাকে খুঁজতে হবে একটি শক্তিশালী ও সংরক্ত বাক্যসংগঠন, এবং যতি ও স্তবকের মধ্যে সম্পর্ণ অভিন্নতা। যেহেতু সংরক্ত বিষয়বস্তুর জন্যে আমার দরকার সংরক্ত বাক্যসংগঠন, তাই আমি নিজেকে বাধ্য করেছি। প্রথাগত ছন্দোরীতি গ্রহণ করতে যা বিকশিত হয়েছে ইংরেজি ভাষার সাথে। এজরা পাউন্ড, টার্নার, লরেন্স প্রশংসনীয় মুক্তছন্দ লিখেছেন, আমি পারি নি।