অত্যাচার বাড়তে লাগল। দেশকে অত্যাচার ও অরাজকতার হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য সন্ন্যাসীরা রুখে দাঁড়াল। সাধারণ গৃহীরাও সন্ন্যাসীর দলে যোগ দিল। সন্ন্যাসীদের সেই কর্মযজ্ঞ অবলম্বন করেই রচিত হয়েছিল আনন্দমঠ ও দেবী চৌধুরাণী।
সীতারামের পটভূমিকা আরও ষাট-সত্তর বছর আগেকার। মুরশিদকুলি খাঁ তখন বাঙলার মসনদে অধিষ্ঠিত। তার আমলে বাঙলার সর্বত্র হিন্দুর ওপর নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচার চলেছিল। মুরশিদকুলি শুনলেন বাঙলার সর্বত্র হিন্দু ধুলায় লুষ্ঠিত, কেবল ভৌমিক সীতারামের রাজ্যেই তাদের বড় প্রশ্ৰয়। তখন তিনি ফৌজদার তোরাব খাঁর প্রতি আদেশ পাঠালেন- ‘সীতারামকে বিনাশ কর’। সেই পরিস্থিতিতেই সীতারাম রচিত।
বঙ্কিমের তিনখানি উপন্যাসই ঐতিহাসিক মহাকাব্য। কিন্তু উপন্যাসগুলি ঘটনাপ্রবাহের নিছক অনুবৃত্তি নয়। জনশ্রুতির এলোমেলো নৃত্যকে বঙ্কিম তার অসামান্য সংহতি প্ৰতিভার সাহায্যে ছন্দোবদ্ধ করে এক মূৰ্তিমতী কল্পলোকের সৃষ্টি করেছিলেন। সেকল্পলোকের মানুষরা হিন্দুরাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখেছিল। স্বপ্নটা সম্পূর্ণ বঙ্কিমের নিজস্ব। অনুশীলনতত্ত্বের উন্মাদন তখন বঙ্কিমকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। সেই কুহেলিকাময় আচ্ছন্নতার মুকুৱেই বঙ্কিম হিন্দুরাজ্য স্থাপনের স্বপ্নবিলাসে মত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাস বাঙলায় এরূপ হিন্দুরাজ্য প্রতিষ্ঠা প্রয়াসের কথা লেখে না।
পথের দাবী ও চার অধ্যায়ের পটভূমিকা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। উদ্দেশ্যও পৃথক। প্রথম মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে দেশের মধ্যে যে সন্ত্রাসবাদ প্ৰকাশ পেয়েছিল, তারই পটভূমিকায় পথের দাবী ব্ৰহ্মদেশের কলকারখানার মজুরদের সঙ্ঘবদ্ধ করবার প্রয়াসের ইতিহাস।
চার অধ্যায় রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ত্ৰিশের দশকে। দেশের তরুণ-তরুণীরা যখন স্বাদেশিকতার মাদকতায় মত্ত হয়ে দেশকে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্ত করবার জন্য আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছিল, এখানি তারই এক বান্ময় ব্যঞ্জনা।
বঙ্কিম ও রবীন্দ্ৰনাথ, এই উভয়েরই মননশীলতায় অন্তঃসলিলার মতো প্ৰবাহিত হয়েছিল গীতার শিক্ষা ও আদর্শ। শান্তি সত্যানন্দকে বলছে‘অৰ্জ্জুন যখন যাদবী সেনার সহিত অন্তরীক্ষ হইতে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, কে তাঁহার রথ চালিয়েছিল? দ্ৰৌপদী সঙ্গে না থাকিলে, পাণ্ডব কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুঝিত?’ আবার চার অধ্যায়ে রবীন্দ্রনাথ ইন্দ্রনাথের মুখ দিয়ে এলাকে বলিয়েছেন—‘শ্ৰীকৃষ্ণ অৰ্জ্জুনকে এই কথাটাই বুঝিয়েছিলেন। নির্দয় হবে না, কিন্তু কৰ্তব্যের বেলা নির্মম হবে।‘
বিপ্লবের অভিধানিক অর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন। সেদিক থেকে পাঁচখানা উপন্যাসের ফলশ্রুতি একই। বর্ণিত বিপ্লবসমূহের ফল ছিল নেতিবাচক। বঙ্কিমের তিনখানা উপন্যাসেই বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুরাজ্য স্থাপন করা। ইতিহাস বলে যে এরূপ কিছু ঘটেনি। তিন উপন্যাসের উপসংহােরও তাই বলে। শান্তি ও প্ৰফুল্ল ফিরে এসেছিল ব্ৰহ্মচারিণীরূপে নিজ নিজ গৃহে। শ্ৰী-ও ফিরে আসতে চেয়েছিল সীতারামের সঙ্গিনীরূপে, কিন্তু বিপরীত স্রোতে পড়ে সে সন্ন্যাসিনীই থেকে গিয়েছিল। এদিক থেকে এই তিন নায়িকার মধ্যে একটা মিল আছে। শরৎচন্দ্রের পথের দাবীর উদ্দেশ্য ছিল ব্ৰহ্মদেশের কলকারখানার মজুরদের সঙ্ঘবদ্ধ করে তাদের ন্যায্য অধিকার অর্জনের জন্য বিপ্লব ঘটানো। যে কাহিনী শরৎচন্দ্ৰ বিবৃত করেছেন, সে কাহিনী অনুযায়ী এ-বিষয়ে বিপ্লবীদের উদ্দেশ্য বিফল হয়েছিল। সুমিত্ৰা ফিরে গিয়েছিল ঐশ্বৰ্য ভোগ করবার জন্য।
এ চারখানা উপন্যাসের মধ্যে অনেক অসঙ্গতি ও অবাস্তবতাও আছে। কিন্তু তা বিবৰ্ণ করেনি মূল কাহিনীকে। সত্য ও কল্পনা আলোছায়ার মতো পরস্পরকে জড়িয়ে থেকে আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরেছে বিশাল মহাকাব্যিক ঘটনাধারার চমকপ্রদ চালচিত্র। অবাস্তবতার দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়।‘ অনেকটা মুক্ত। কল্পনার চেয়ে সত্যকেই সেখানে দেওয়া হয়েছে শ্রেষ্ঠ আসন। তরুণ-তরুণীরা কোন উদ্দেশ্যসাধনের জন্য যখন দলবদ্ধ হয় ও পরস্পরের সান্নিধ্যে আসে, তখন যা ঘটে, রবীন্দ্রনাথ সেই বাস্তব ও জৈবসত্যের বাসরঘরে শেষচুম্বন দিয়েই তাঁর কাহিনীর সমাপ্তি ঘটিয়েছেন।
***
শাস্তিকে আমরা পাই ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পদচিহ্নে উদ্ভূত সন্ন্যাসীবিদ্রোহের মধ্যে। শান্তি চরিত্র বঙ্কিমের এক অনুপম সৃজন। শান্তির পিতা অধ্যাপক ব্ৰাহ্মণ। অতি শৈশবেই শান্তির মাতৃবিয়োগ হয়েছিল। সেজন্য গৃহে আর কোন লোক ছিল না। বঙ্কিম লিখেছেন-’যে সকল উপাদানে শান্তির চরিত্র গঠিত, ইহা তাহার মধ্যে প্রধান’। পিত যখন টোলে ছাত্রদের পড়াতেন, শান্তি তখন তাঁর কাছে বসে থাকত। টোলের ছাত্ররা শান্তিকে আদর করত। শান্তি তাদের সঙ্গেই খেলা করত, তাদের কোলে-পিঠে চড়ত। এভাবে নিয়ত পুরুষ-সাহচর্যের ফলে, শান্তি মেয়ের মতো কাপড় পরতে শিখল না। ছেলের মতো কেঁচা করে কাপড় পরত। টোলের ছাত্ররা খোপা বঁধে না, সুতরাং শান্তিও খোঁপা বাঁধত না। বড় হলে টোলের ছাত্ররা যা পড়ত, শান্তিও শুনে শুনে তা শিখত। এভাবে শান্তি ভট্ট, রঘু, কুমার, নৈষধাদির শ্লোক ব্যাখ্যা সমেত মুখস্থ করতে লাগল। এইসব দেখেশুনে শান্তির পিতা শান্তিকে মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ ও দু-একখানা সাহিত্যও পড়ালেন। তারপর শান্তির পিতৃবিয়োগ হল। টোল উঠে গেল। শান্তি নিরাশ্রয় হল। একজন ছাত্র তাকে সঙ্গে করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেল। সে-ই পরে সন্তান সম্প্রদায়ে প্রবেশ করে জীবানন্দ নাম গ্ৰহণ করেছিল। জীবানন্দের পিতামাত শাস্তির সঙ্গে জীবানন্দের বিবাহ দিল। কিন্তু বিবাহের পর সকলেই অনুতাপ করতে লাগিল। কেননা, শান্তি মেয়েদের মতো কাপড় পারল না, চুল বঁধিল না, পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলা করতে লাগল। নিকটস্থ জঙ্গলে গিয়ে কোথায় ময়ুর, কোথায় হরিণ, কোথায় দুর্লভ ফুল এইসব খুঁজে বেড়াতে লাগল। শ্বশুর-শাশুড়ী প্ৰথমে নিষেধ, পরে ভর্ৎসনা, শেষে প্ৰহার ক’রে, শিকল দিয়ে শান্তিকে বেঁধে রাখল। একদিন খোলা পেয়ে, কাউকে কিছু না বলে শান্তি বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল।