পাঁচ
অষ্টাদশ শতাব্দীর সমাজব্যবস্থায় পরিবার গঠিত হত যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারের ভিত্তিতে। এই পরিবারের মধ্যে বাস করত। স্বয়ং ও তার স্ত্রী, স্বয়ং-এর বাবা-মা, খুড়োখুড়ি, জেঠ-জেঠাই, তাদের সকলের ছেলে-মেয়েরা, স্বয়ং-এর ভাইয়েরা ও তাদের স্ত্রীরা ও ছেলেমেয়েরা এবং নিজের ছেলেমেয়েরা। অনেক সময় পরিবারভুক্ত হয়ে থাকতো কোন বিধবা পিসি বা বোন বা অন্য কোন দুঃস্থ আত্মীয় ও আত্মীয়া। এরূপ পরিবারে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিই হতেন ‘কর্তা’ এবং পরিবারস্থ সকলেই তাঁর অধীনে থাকত।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে পরিবারস্থ মেয়েদের বিবাহ আট দশ বছর বয়সেই হয়ে যেত। এরূপ বিবাহকে গৌরীদান বলা হত। মেয়েকে গৌরী দান করাই সকলের লক্ষ্য থাকত। আট পার হয়ে গেলে ন’ বছর বয়সে যে বিবাহ হত, তাকে রোহিনী দান বলা হত, আর দশ বছর বয়সে বিবাহকে বলা হত কন্যাদান। দশ পার হয়ে গেলে (কুলীনকন্যা ছাড়া), মেয়ের ব্যাপকে একঘরে করা হত। সেজন্য সকলেই দশের মধ্যে মেয়ের বিবাহ দিত। বিয়ে সাধারণতঃ ঘটক বা ভাটের মাধ্যমে হত।
ছয়
অষ্টাদশ শতাব্দীর লোকের জীবনচৰ্যার ওপর দৈব ও অপদেবতার প্রভাব ছিল খুব বেশী। দৈনন্দিন জীবনে আধিব্যাধির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ঝাড়ফুক, মাদুলি, জলপাড়া, গ্রহশান্তি ইত্যাদির আশ্রয় নিত।
তা ছাড়া, জ্যোতিযোিরও প্রভাব ছিল প্ৰচণ্ড। এবং যেহেতু সামাজিক জীবনে বিবাহই ছিল সবচেয়ে বড় আনুষ্ঠানিক সংস্কার সেজন্য বাঙালী পাত্ৰ-পাত্রী নির্বাচনের সময় কোঠি-ঠিকুজিতে সপ্তম ঘরে কোন গ্ৰহ বা সপ্তমধিপতি কোন ঘরে আছে, তার বিচার করত। যদি সপ্তম ঘরে কোন পাপগ্ৰহ থাকত, তবে সে বিবাহ বর্জন করত। তারপর গণের মিল ও অমিলও দেখত।
বিবাহের পর আসত দ্বিরাগমন। তারপর মেয়েদের জীবনে পর পর ঘটত গর্ভাধান বা প্ৰথম রজোদর্শন, পুংসবন, পঞ্চামৃত, সাধ, সীমান্তোয়ন ইত্যাদি। এগুলো সবই ছিল আনন্দময় সামাজিক উৎসব, এবং এসব উৎসবই বাঙালীর লৌকিক জীবনকে সুখময় করে তুলত।
সন্তান প্রসবের পর শুরু হত স্বামী-স্ত্রীর ধর্মীয় জীবন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই কুলগুরুর কাছ থেকে ‘মন্তর’ নিত। কেননা, মেয়েদের বিশ্বাস ছিল যে ‘মন্তর’ না নিলে দেহ পবিত্র হয় না। যারা ‘মন্তর’ নিত, তাদের প্রতিদিনই ইষ্টমন্ত্র জপ করতে হত। যাদের ‘মন্তর’ হত না, তাদের ঠাকুরঘরে যেতে দেওয়া হত না। এমন কি শ্বশুর-শাশুড়ীও তাদের হাতের জল শুদ্ধ বলে মনে করত না।
মেয়ের সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই পঞ্চকন্যার নাম স্মরণ করত। পঞ্চকন্যা হচ্ছে অহল্যা, দ্ৰৌপদী, কুন্তী, তারা ও মন্দোদরী। তারপর সদর দরজা থেকে শুরু করে বাড়ীর অন্দরমহল পর্যন্ত সর্বত্র গোবর স্কুলের ছিটা দিত। এ ছাড়া, প্ৰতি বাড়ীতেই তুলসী, মঞ্চ থাকত এবং সন্ধ্যাবেলা তুলসীমঞ্চে প্ৰদীপ জ্বেল শিশুকাল থেকে নানারকম ব্ৰত পালনের ভিতর দিয়েই মেয়েদের ধর্মীয় জীবন গড়ে উঠত। পাঁচ থেকে আট বছরের মেয়েরা নানারকম ব্রত করত। যেমন বৈশাখ মাসে শিবপূজা, পুণ্যিপুকুর ও গোকুল, কার্তিক মাসে কুলকুলতি, পৌষমাসে সোদর, মাঘ মাসে মাঘমণ্ডল ইত্যাদি। আর সধবা মেয়েদের তো ব্ৰতের অন্ত ছিল না। সারা বছর ধরে দু-এক দিন অন্তর একটা না একটা ব্ৰত লেগেই থাকত। যেমন সাবিত্রী ব্ৰত, ফলহারিণী ব্ৰত, জয়মঙ্গলবারের ব্ৰত, বিপত্তারিণী ব্ৰত, নাগপঞ্চমী, ইতু পূজা, নীলের উপবাস, লুণ্ঠন ষষ্ঠী, চৰ্পট যষ্ঠ, রাধা অষ্টমী, তাল নবমী, অনন্ত চতুর্দশী, কাত্যায়নী ব্ৰত, শীতল ষষ্ঠী, অশোক যষ্ঠ, অরণ্য ষষ্ঠী ইত্যাদি। এ ছাড়া, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন কলসী উৎসর্গ করত। বৈশাখ মাসে তুলসী মঞ্চে তুলসী গাছের ওপর জলের ‘ঝারা বাধত। কার্তিক মাসে ‘আকাশ প্ৰদীপ’ দিত। পৌষ সংক্রান্তিতে ‘বাউনি’ বঁাধত। ভাদ্র মাসের সংক্ৰাস্তিতে ঘটা করে ‘অরন্ধন’ করত। পৌষ মাসের সংক্রাস্তিতে ‘পৌষপার্বণ’ ও ফান্তন মাসের সংক্রাস্তিতে ঘণ্টাকর্ণ পূজা করত। নূতন শস্য উঠলে ‘নবান্ন’ করত। শীতল যষ্ঠীর দিন আগের দিনে সিদ্ধকরা কড়াই সিদ্ধ খেত। চৈত্র সংক্রান্তিতে যবের ছাতু খেত। ডান্দ্র মাস, পৌষ মাস ও চৈত্র মাসে লক্ষ্মীপূজা করত। অনেকে শিবের গাজন উপলক্ষে চৈত্র মাসে সন্ন্যাস গ্ৰহণ করত।
আঠারো শতকে বাঙালীর অসংখ্য পরব ছিল। অনেক পরবের নাম আজ লুপ্ত হয়ে গেছে। ১১৯৪ বঙ্গাব্দের (১৭৮৭ খ্রীস্টাব্দের) ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির এক বিজ্ঞপ্তি থেকে আমরা জানতে পারি যে নিম্নলিখিত পর্বের দিনসমূহে সরকারী কাৰ্যালয়সমূহ বন্ধ থাকত–অক্ষয় তৃতীয়া ১দিন, নৃসিংহ চতুর্দশী ২দিন, জ্যৈষ্ঠ মাসের দশমী-একাদশী ২দিন, স্নানযাত্রা ১দিন, রথযাত্রা ১দিন, পূর্ণধাত্রা ১দিন, জন্মাষ্টমী ২দিন, শয়ন একাদশী ১দিন, রাখীপূর্ণিমা ১দিন, উত্থান একাদশী ২দিন, অরন্ধন ১দিন, দূৰ্গাপূজা ৮দিন, তিলওয়া সংক্রান্তি ১দিন, বসন্ত পঞ্চমী ১দিন, গণেশ পূজা ১দিন, অনন্ত ব্ৰত ১দিন, বুধনবমী ১দিন, নবরাত্রি ১দিন, লক্ষ্মীপূজা ১দিন, অন্নকুট ১দিন, কার্তিক পূজা ১দিন, জগদ্ধাত্রী পূজা ১দিন, রাসযাত্ৰা ১দিন, অগ্রহায়ণ নবমী ১দিন, রটন্তী অমাবস্যা ২দিন, মৌনী সপ্তমী ১দিন, ভীমাষ্টমী ১দিন, বাসন্তী পূজা ৪দিন, শিবরাত্রি ২দিন, দোলযাত্রা ৫দিন, বারুণী ১দিন, চড়কপূজা ১দিন, ও রামনবমী ১দিন। এছাড়া গ্রহণাদির দিনও ছুটি থাকত। গ্রহণের দিন লোক হাঁড়ি ফেলে দিত। রান্নার জন্য আবার নূতন হাড়ি ব্যবহার করত। তা ছাড়া গ্ৰহণের পর সাতদিন অযাত্রা বলে গণ্য হত। এই সকল পূজাপার্বণ উপলক্ষে বাঙালী মেয়োরা সুযোগ পেত, তাদের শিল্পমননকে ক্রীয়াশীল করত নানারকম বিচিত্র আলপনা অঙ্কনে। বিবাহ উপলক্ষে বরকনের পিঁড়ের ওপর অঙ্কিত আলপনাগুলোও দেখবার মত হত।