Site icon BnBoi.Com

ওঙ্কার – আহমদ ছফা

ওঙ্কার - আহমদ ছফা

১. আমাদের কিছু জমিজমা ছিল

ওঙ্কার – উপন্যাস – আহমদ ছফা

বইটি সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত

এ গ্রন্থটি পাঠ করলে যে কোনো সহৃদয় পাঠকই মোহিত হবেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচণ্ড আবেগ এবং অনুভূতি নিয়ে এর চাইতে উৎকৃষ্ট কিছু কোথাও লিখিত হয়েছে এমন আমার জানা নেই।

-আবুল ফজল

শেষে জানাই তাঁর (আহমদ ছফার) লেখা পড়ে আমি আনন্দ পেয়েছি এবং সকল পাঠক আমারই মত তাঁর গ্রন্থ পাঠে সে আনন্দের শরীক হতে পারবেন বলে আমার ধারণা।

-দৈনিক পূর্বদেশ

হিন্দু পুরাণ মতে ‘ওঙ্কার’ হচ্ছে আদি ধ্বনি, সকল ধ্বনির মূল। লেখক বলতে চেয়েছেন, বাহ্য কান দিয়ে আমরা ধরতে পারি না পারি, সকল চেতনে, সকল হৃদয়ে সেই আদ্য ধ্বনি বিরাজিত। এই ধ্বনি, এই হৃদয় এই চেতনা যে বোবা মেয়েতে ছিল, সে তার প্রাণ দিয়ে তা প্রমাণ করেছে। একটি সমুচ্চ বক্তব্যকে তীক্ষ্ণ ও তীব্রভাবে প্রকাশের চেষ্টা করেছেন লেখক। তার এই প্রচেষ্টা কিছুটা অভিনব। আহমদ ছফার ছোট গল্প পড়তে গিয়ে দেখেছি তিনি দুঃসাহসী পুরুষ।

-দৈনিক ইত্তেফাক

আহমদ ছফার বর্ণনা কৌশল চরিত্র চিত্রণ রীতি এবং অনুভুতি স্নিগ্ধ ও হৃদয়গ্রাহ্য ভাষাই মনকে গ্রাস করে। এই রচনার অন্তর্গত সংবেদনশীলতাই বক্তব্যের গভীরে টেনে নেয়। … মনে হয়, একটি মহাকাব্যের বিষয়কে যেন সনেটে বেঁধে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে এই গ্রন্থে।

-দৈনিক বাংলা

সত্যি বলতে কি আজকাল গল্পের বাজার বড় মন্দা। প্রথম পাঠে আন্দোলিত বা বিহ্বল হবার মত গ্রুপ অধুনা তেমন চোখে পড়ে না। আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’ সেদিক থেকে এক বিরল ব্যতিক্রম।

-সাপ্তাহিক বিচিত্রা

একজন প্রাবন্ধিক হিসেবেই আহমদ ছফাঁকে জানতাম। কিন্তু সম্প্রতি ‘বিচিত্রায় প্রকাশিত তাঁর গল্প ‘ওঙ্কার’ পড়ে তার মধ্যে একজন নিপুণ গল্পকারকে দেখতে পেয়েছি। সত্যিই ভাষায় সাবলীল সৌন্দর্যে বিদগ্ধ বর্ণনায়, তাঁর গল্পটি হয়ে উঠেছে সজীব প্রাণময়। গল্পের বিষয়বস্তুটিও নতুনতর।

-বিচিত্রায় জনৈক পাঠকের পত্রাংশ

সমগ্র উপন্যাসটি বড় গল্প না গদ্য কবিতা? আমাকে একটি বিদেশী উপন্যাসের কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, যদিও তার সঙ্গে বিষয়বস্তুর দিক থেকে কোনই মিল নেই। শ্রী বিষ্ণুদে অনূদিত ভের করস (ফরাসী) সমুদ্রের মৌন’ উপন্যাসটি আপনি পড়েছেন? ফ্রান্সে নাজি অবরোধের সময় লেখা।…

ক্ষয়িষ্ণু সমাজের প্রতিনিধি বোবা বাংলা মার মুখে ভাষা ফোঁটাতে পারবে না, যে কাজ একমাত্র শক্তিমান সচেতন মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই সম্ভব। এই কথা কটি যে কতখানি সত্য তা আমরা এখানে (পশ্চিম বাংলায়) সবচেয়ে ভাল এখন বুঝতে পারছি।

-সিদ্ধার্থ ঘোষ

সাহিত্য ধারা। ৪ / ২, মহেন্দ্র রোড, কোলকাতা, ২৫ (জনৈক কোলকাতার পাঠকের পত্রাংশ)।

.

০১.

আমাদের কিছু জমিজমা ছিল। আমার বাবা নিজে করেননি। তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সম্পত্তির সঙ্গে একখানা মেজাজও তাঁকে পূর্বপুরুষেরা দিয়ে গিয়েছিল। তাঁর তেজ বিশেষ ছিল না, তবে ঝাঁঝটা ছিল খুব কড়া রকমের।

সময়টা বাবার জন্য যথেষ্ট ভালো ছিল না। শহর বন্দর অফিস আদালত কলেকারখানায় ব্যক্তির আত্মসত্তা গরিমায় নিজের শোণিত উষ্ণ রাখতে চেষ্টা করতেন। ঈষদুষ্ণ নয়, কিছুদিন রীতিমতো উষ্ণই রাখতে পেরেছিলেন। তার কারণ, বাবা পিতৃপুরুষদের কাছ থেকে রক্তের মতো বিত্তও উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেছিলেন। সেজন্য পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত বিত্তে আত্মশোণিতের হিমোগ্লোবিন কণা উজ্জ্বল রাখতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু, হায়রে! কবে কেটে গেছে সে কালিদাসের কাল!

আমার বাবা যেভাবে দিনাতিপাত করতেন, তাকে কিছুতেই একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারণ বলা যাবে না। তাঁর স্বপ্ন কল্পনা চিন্তা বাসনার বাগানে পিতৃপুরুষদের প্রেতাত্মারা দলে দলে হানা দিত। এই প্রেতাত্মাই তাঁকে জাগরণে নেশাগ্রস্ত করত। তিনি একজন নেশাগ্রস্ত মানুষের মতোই জীবনযাপন করতেন।

বলতে ভুলে গেছি। আচারে ব্যবহারে তিনি উগ্র রকমের পরহেজগার মানুষ ছিলেন। তাঁর বিশেষ সংস্কার নিয়ে ঠাট্টা করব অন্তত তেমন কুসন্তান আমি নই। বাবা ধর্মপরায়ণ মানুষ ছিলেন। শরীয়তের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। চূড়ান্ত দুঃখের দিনেও আল্লাহর ওপর ভরসা করে নির্বিকার থাকতে পারতেন।

অতি ছোট বয়সে তাঁকে হাতীর দাঁতে খোদাই করা ব্যক্তিত্বের অনুপম স্তম্ভ মনে করতাম। এখন বুদ্ধি বিচেনা পেকেছে। দুনিয়াদারীর যাবতীয় বস্তু বিবসনা করে ভেতরের ব্যাপার জানার মতো দুঃসাহসী হয়ে উঠেছে চেতনা। জনকের কাঠিন্যমণ্ডিত বয়েসী ছবিটি স্মরণে এলেই কেন বলতে পারব না, শরীরের আঁকে বাঁকে ঢেউ খেলে একটা ধ্বনি চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রাণময় হয়ে ওঠে। পশু-পবিত্র পশু। হাঁ তিনি পবিত্র পশুই ছিলেন। আর তার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন যথার্থ পশু। এক সময়ে মদে মেয়েমানুষে আমাদের সে তল্লাট উজাগর রেখেছিলেন। তার ক্ষীণ প্রতিধ্বনি অতীত যুগের পরিধি পেরিয়ে আমার কানে বহু দূরাগত বাদ্যের আওয়াজের মতো রণিত হয়নি গুঞ্জন। ক্ষুধার্ত মানুষের কর্কশ আর্তচিৎকার শুনেছি। অতীতরূপী মুজিয়মে সঞ্চিত চিত্রমালার আভা, ধ্বনিপুঞ্জের লাবণী, রক্তের খরতেজ আমাকে স্পর্শই করতে পারে নি।

এখন স্পষ্ট বুঝতে পারি এর সব কটিই বাবার চিন্তাচেতনার পরতে পরতে অপরূপ কুহক রচনা করেছিল। বাবাকে তাই পবিত্র পশু বলেছি। আবার এই সময়ের মধ্যেই জগতের আমাদের অংশে নতুন ছাদের পশুদের উদ্ভব হতে শুরু করেছে।

কখনো কখনো ভারি বিব্রত লক্ষ্য করতাম তাঁকে। বার্ধক্যজীর্ণ মুখাবয়বে একটা অসহায় ভঙ্গি বড় করুণভাবে ঝুলে থাকত। তখন বুঝিনি। বয়সে বুদ্ধি ছিল না। এখন উপলব্ধির স্তরে স্তরে জনকের অদৃশ্য অশ্রুপাত জোয়ারের জলের মতো ফুলে ফুলে সারা মনপ্রাণ ভিজিয়ে দিয়ে যায়।

অনেক বার বাবাকে আমাদের পিশাচের দাঁতের মতো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত লাল ইট বের হওয়া দালানের নামাজের বিছানায় বসে হতাশভঙ্গিতে রেলের লাইন, ট্রাক বাসের গতায়ত, এক চোখ কানা আবুনসর মোক্তার সাহেবের ধবধবে সাদা নতুন বাড়ির পানে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। চিড়িয়াখানার খাঁচায় আবদ্ধ সিংহ যেমন সম্পূর্ণ অনাত্মীয় দৃষ্টিতে লোহার খাঁচা নিরিখ করে, তেমনি দৃষ্টি দিয়ে আমার বাবা আমার কালের পৃথিবীর দিকে তাকাতেন। গাছপালা দেখলে অন্তরীণ সিংহশিশুর চোখে যেমন গহন বন, নিবিড় অরণ্যানী আর নিষ্ঠুরতার স্বপ্ন নামে, তেমনি আবেশে ঘনিয়ে আসত দৃষ্টি, যখন তিনি ফার্সি হরফে লেখা তুলোট কাগজের ‘সজরা অথবা বংশপঞ্জির বুকে সস্নেহে আঙ্গুল বুলোতেন। যুগ-যুগান্তরের পুরনো কীটদষ্ট পাংশুটে তুলোট কাগজ। ডানদিক থেকে জের জবর সম্বলিত বাঁকা-বাঁকা টানা হাতের লেখা খয়েরী রঙের হরফগুলো অখণ্ড প্রতাপ অফুরন্ত মহিমার প্রতাঁকের মতো তাঁর চোখে অদৃশ্য শিখায় জ্বলজ্বল করত। নামোক্ত এসব মহাপুরুষদের স্মৃতিতে জীয়ন্ত করে বাবা তাঁদের সঙ্গে হৃদয়ের ভাব বিনিময় করতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন একটানা। সেই সময় বাবার চারপাশে চেতনে নিশ্চেতনে মিশে একটা নিশ্চল তন্ময় পরিবেশের সৃষ্টি হতো। তন্ময়তা কেটে গেলে তাঁর দু-চোখে একটা অচেনা আলো ফুটে বের হতো। তার অর্থ করলে এরকম দাঁড়াতো- এই দুনিয়াদারী, ঘরবাড়ি, মানুষজন এসবের কিছুই আমি চিনিনে, কিছুই বুঝিনে। তাঁর দৃষ্টিতে বন্দী বিহঙ্গের কাতরতা ফুটে থাকত। সামনে যে যুগ থাবা প্রসারিত করে এগিয়ে আসছিল তার নখরাঘাত তিনি অনুভব করতেন। এই যুগে তিনি যে একজন ফালতুর বেশি নন তা নিজেই ভালো করে উপলব্ধি করতেন।

তাঁর চিন্তা কল্পনা সবই অতীতের মাপে তৈরী। কিছু বর্তমানের সঙ্গে খাপ খায় না। সেজন্যেই বোধহয়, সৃষ্টিকর্তার ওপর তার আস্থাটাও নোঙরের মতো অমন স্থির অনড় ছিল । সহায়হীন মাতাল রাতের অন্ধকারে ঘরের বৌয়ের গঞ্জনা সইতে না পেরে যেমন শুড়িখানায় সান্ত্বনার সন্ধানে যায়, তেমনি চারপাশের পরাক্রান্ত পৃথিবী প্রবল তিরস্কারে বাবাকে তাঁর সৃষ্টিকর্তার কাছে পাঠাতো। হয়তো তিনি জানতেন, হয়তো জানতেন না। তাঁর চোখেমুখে কি রকম বিষণ্ণ যন্ত্রণার ফুল ফুটে থাকত। তার যন্ত্রণার মধ্যে সমস্ত বিশ্বেসী মানুষের যন্ত্রণা আমি প্রত্যক্ষ করেছি।

যেহেতু আমি বাবাকে পবিত্র পশু বলেছি সেজন্য কেউ যেন আমাকে পিতৃপুরুষের প্রতি শ্রদ্ধাহীন মনে না করেন। পশুদেরও তো রক্তধারা বংশপরম্পরা সামনের দিকে ধাবিত হয়। আমি নিজে যে মমতাহীন নই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ নিজের মুখে সে কাহিনী চূড়ান্ত বিশ্বস্ততাসহকারে আপনাদের কাছে বলে যাচ্ছি।

পুরনো মডেলের গাড়ি যেমন শহরের নতুন রাস্তায় ঠিকমতো চলতে পারে না, ঝাট লাগায়, দুর্ঘটনা বাঁধায়, ধোঁয়া ছড়ায়, তেমনি আমার বাবা আমার কালের পৃথিবীতে বসবাসের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি কেবল দুর্ঘটনার জন্ম দিয়েই যাচ্ছিলেন। সৃষ্টির বোঁটা ধরে নাড়া দিয়ে একটা লণ্ডভণ্ড কাণ্ড বাঁধাবার মতো শক্তি কিংবা শিক্ষা কোনোটিই তার ছিল না। তিনি আঘাত করতে গিয়ে আহতই হচ্ছিলেন।

বলেছি, সামান্য কিছু জমিজিরেত তিনি তাঁর বাবার কাছ থেকে পেয়েছিলেন। তাই নিয়ে খোঁচাখুঁচি করে বিক্রম প্রকাশ করতেন। তাই করে রক্তের হিংস্রতার দংশন কিছুটা লাঘব করতেন। আমাদের মানুষজন বিশেষ ছিল না। খুনজখম বাঁধিয়ে একটা রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটানো তাও সাধ্যের বাইরে ছিল। বাবা মামলা মোকদ্দমা করেই মনের ঝাল মেটাতেন। তখন দুনিয়ার আমাদের অংশ আবুনসর মোক্তার সাহেবদের দখলে চলে যেতে বসেছে।

২. পূর্বপুরুষের একটা তালুক

পূর্বপুরুষের একটা তালুকের সাড়ে তিন আনা অংশের মালিক ছিলেন আমার বাবা। সে গর্বে তিনি সর্বক্ষণ স্ফীত হয়ে থাকতেন। কেউ টু শব্দটি করলে সহ্য করতে পারতেন না। গ্রামের মানুষ এইরকম একটা ফুটো তালুকদারের কর্তালী মেনে নেবে তারা তেমন বোকা ছিল না। সুতরাং তারা শব্দ করত, হল্লা করত, গান করত এবং চিৎকার করত। গ্রামবাসীর সম্মিলিত জীবনধারা থেকে খসে পড়া শব্দমালা আমার জনকের গায়ে বিছুটির জ্বালা ধরিয়ে দিত। সে জ্বালা মিটাতে যখন-তখন তিনি আদালতে ছুটতেন। বেছে-বেছে ফৌজদারী মামলা রুজু করতেন। একধারা দুধারা থেকে আরম্ভ করে ক্রিমিনাল অ্যাক্টের সাতশ সাতাশি ধারা পর্যন্ত গরীব প্রতিবেশীর নামে ঠুকে দিতেন।

এ ব্যাপারে আবুনসর মোক্তার সাহেব ছিলেন বাবার ডান বাম দুই হাত এবং সে সঙ্গে শলা-পরামর্শ বুদ্ধি-বিবেচনার একখানি নির্ভরযোগ্য আড়ত। একেকটি মোকদ্দমার দিন এলে আমাদের বাড়িতে উৎসবের ধুম লেগে যেত। মুরগীর পোলাও হতো, খাসী জবাই হতো, সাবেক কালের বড় বড় চীনামাটির বাটিতে ঝোলে-ঝালে রাধা রুই-কাতলার মস্তক হা-করে তাকিয়ে থাকত। সাক্ষীরা লুঙ্গির গিট খুলে দিয়ে চিবিয়ে চুষে খেত। বাটাভরা পান থেকে কিছু মুখে পুরত এবং কিছু লুঙ্গির গিটে ঔজত। তারপর সাড়ে সাত টাকা নগদ গুণে ভোর সাড়ে আটটায় ট্রেনে আল্লাহর নামে হলপ করে মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে আদালতে ছুটত। মোকদ্দমা কোর্টে ওঠার আগে বাবা সাক্ষীসাবুদসহ আবদুল ফাত্তাহ লেনে মুক্তার সাহেবের বাসায় এসে হাজির হতেন। মোক্তার সাহেব সাক্ষীদের মিথ্যে কথার প্যাঁচগুলো একটু একটু কষে দিতেন।

আমাদের বাড়িতে পাঁচ সাত জন মোল্লা সারাক্ষণ মুখে ফেনা ছুটিয়ে কোরআন পাঠ করত। মা সারাদিন রোজা রেখে আসমানের আল্লাহর মন জোগাতে চেষ্টা করত। মোকদ্দমার দিন এলে ভারি খুশী হয়ে উঠতাম আমরা সব কটি ভাইবোন। মানুষজনের নিপ্রাণ স্তব্ধতায় ক্ষণস্থায়ী হলেও একটা চাঞ্চল্য জেগে উঠত। তা আমাদের বুকের গভীরে আনন্দের ঘূর্ণিস্রোত বইয়ে দিত। মোকদ্দমার দিন যাতে ঘন ঘন আসে সেজন্য শিশুমনের সবটুকু আবেগ ঢেলে খোদার কাছে আবেদন পাঠাতাম। তাড়াতাড়ি মোকদ্দমার দিন এলে বাবা ভীষণ নেতিয়ে পড়তেন। তিনি অনেক সময় নামাজের বিছানায় ঘুমিয়ে যেতেন। মুখের রেখাগুলো আরো গভীর দেখাতো। এ সময় মাকে বড় কাতর দেখতাম।

সেবার একটা ব্যাপার ঘটে গেল। বাবা তাঁর প্রতিভার জোরে একটা আধা খুনের মামলায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। বাস্তবে কিন্তু লোকটিকে খুন করার সঙ্গে তাঁর কোনো যোগ ছিল না। তবে তিনি দীর্ঘদিন থেকে প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছিলেন, ওই হারামজাদা পাজীটাকে বাগে পেলে খুন না করে ছাড়বেন না। বলাবাহুল্য, কারো সঙ্গে ঝগড়া বচসা ইত্যাদি হলে তিনি খুন করার সংকল্প সাড়ম্বরে ঘোষণা করতে পারলেই খুব প্রীত হতেন। শেষ পর্যন্ত সে ঘোষিত মানুষটাই মঙ্গলবার হাট থেকে ফেরার পথে ভয়ংকরভাবে জখম হলো।

গাঁয়ের লোকদের কেউ বাবার নামে অপবাদ দিল, আবার কেউ তার প্রথম পক্ষের বড় ছেলেকে দুষল। ঐ ছেলেটার সঙ্গে তার তৃতীয় পক্ষের স্ত্রীর একটা বিশ্রী ব্যাপার নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি হচ্ছিল। সে যাক্। লোকটা কিন্তু বাবাকে এক নম্বর আসামী করে মামলা লটকে দিল। সে ছিল গাঁয়ের খুব জবরদস্ত মানুষ। তার বিরুদ্ধে আমাদের পক্ষে কেউ সাক্ষ্য দেবে তা ছিল কল্পনারও অতীত। মোক্তার সাহেব বাবাকে একজন প্রখ্যাত মিথ্যেবিশারদ সাক্ষী জুটিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু এই মহাপুরুষের সাক্ষ্য দেয়ার গুণে কত খুনের আসামী বেকসুর খালাস গেছে, কত তালুকদারী জমিদারী লাটে উঠেছে, কত সম্পন্ন গেরস্তের বাস্তুতে ঘুঘু চরেছে- রঙ চড়িয়ে বর্ণনা করেছিলেন। বাবা এই ফলাও বর্ণনা শুনে খুবই আশ্বস্ত হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই সাক্ষীকে দেবার জন্য মোক্তার সাহেবের হাতে নগদ একশ টাকা প্রদান করেছিলেন। সেও নিতান্ত কাচুমাচু হয়ে। তাঁর ভাবখানা এরকম ছিল যে এই মহান মিথ্যের শিল্পীর প্রকৃত সমাদর করার ক্ষমতা আপাতত তার নেই। সেই সময়ে আমাদের সংসারে টাকা পয়সার খুবই টানাটানি। জমি বন্ধক রেখেও কোথাও টাকা সংগ্রহ করার উপায় ছিল না। কারণ বন্ধকীযোগ্য জমিগুলো বহু আগেই মহাজনের দখলে গিয়েছিল।

অবশেষে একদিন আমরা মিথ্যে বলার বীরপুরুষটিকে দেখতে পেলাম। কালো কুচকুচে বেঁটে চেহারার গুছি দাড়িঅলা আস্তে আস্তে কথা বলে মানুষটিকে ভীতি মিশ্রিত কৌতূহলসহকারে খুটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। যতক্ষণ এই রহস্যময় মানুষটি আমাদের বাড়িতে ছিল, আমি একবারও অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাইনি। ভাবে ভঙ্গিতে আমাদের মনে হয়েছিল মস্তবড় একজন বীর পুরুষ বাক্যের মন্ত্রশক্তিতে পৃথিবীর যাবতীয় নয়কে হয় এবং হয়কে নয় করার ক্ষমতা তিনি রাখেন বটে।

আদালতে হাকিমের সামনে হাজির হওয়ার পরেই লোকটা তার আসল প্রতিভার পরিচয় দিল। প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আরো কিছু বাড়তি টাকা কোমরের খুতিতে খুঁজে আদালতগৃহে শপথ করে বলল যে সে নিজের কানে বাবাকে বলতে শুনেছে যে আহাদ আলীকে খুন না করে তিনি ছাড়বেন না এবং আহাদ আলী যে আল্লাহর অপরিসীম অনুগ্রহে প্রাণে বাঁচতে পেরেছে, সেজন্য হাকিমের সামনেই আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালো! এমন পাকা সাক্ষীর কথা অবিশ্বেস কোন্ হাকিম করতে পারে? মামলায় আমাদের হার হলো। বাবা একটুর জন্য জেল থেকে বাঁচলেন। লোকজনকে বলাবলি করতে শুনলাম মাথার শুভ্রকেশের দিকে তাকিয়ে আদালতের হাকিম বাবার ওপর করুণা করেছেন। আমাদের নগদ আড়াই হাজার টাকা জরিমানা দিতে হলো। সারা বছরের খোরাকীর জন্য আমাদের যে জমিগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো, তার একাংশ জলের দামে বেচে আদালতের প্রাপ্য শোধ করতে হলো।

সময় বয়ে যাচ্ছিল। এরই ফাঁকে ফাঁকে বোনেরা সেয়ানা হয়ে উঠল। বিয়ে হয়ে গেল সকলের ঝটঝট করে। এ ব্যাপারে বাবার ধর্মপ্রীতি খুবই সাহায্য করল। তিনি মনে করতেন যুবতী মেয়ে ঘরে পুষে রাখাটা মস্ত গুনাহর কাজ। তাই বোনেরা একটু সেয়ানা হয়ে উঠতে না উঠতেই হাতের কাছে যাকে পেলেন কোনোরকম বাছবিচার না করে ধরে ধরে গছিয়ে দিলেন।

বাকি রয়ে গেলাম আমি। সবে বি. এ. ক্লাশে ভর্তি হয়েছি। আমার পড়াশোনা সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে বাবাকে কোনোদিন উচ্চবাচ্য করতে শুনিনি। তিনি কিন্তু মনে মনে এই স্কুলে কলেজে পড়াশোনার কাজটাকে পছন্দ করতেন না। তবে মুখ ফুটে কোনোদিন প্রতিবাদও করেননি। কতেক বিষয়ে তিনি আমার মায়ের ওপরে জবরদস্তি করতে সাহস পেতেন না। আমার পড়াশোনা তার একটি।

আমার মায়ের অত ঠাট ঠমক ছিল না। মা সাদাসিদে গেরোস্তর ঘরের মেয়ে। কোনোদিন তাকে কারো বিরুদ্ধে নালিশ করতে শুনিনি। অপ্রাপনীয় বস্তুর প্রতি লোভ কিংবা আগ্রহ মা জীবনে দেখায়নি। মায়ের উৎসাহ, আগ্রহ এবং চোখের জলই আমার তাবৎ কর্ম-প্রেরণার উৎস।

আমার বাবাও যে এক সময়ে প্রকৃত পশু হতে চেষ্টা করেছিলেন তার প্রমাণ আমার এই মা। বাবা যৌবনকালে এক গেরস্ত ঘরের মেয়েকে রূপ দেখে জোর করে বের করে নিয়ে এসেছিলেন। মোল্লা মৌলবী ডেকে যে বিয়ে পড়ানোর একটা ব্যাপার আছে তাও প্রথমে করেননি। পরে চাপে পড়ে কিছু কিছু সামাজিকতা পালন করতে হয়েছিল! বাবাকে বাঁকা লাঠি হাতে মসজিদ থেকে বেরুতে দেখলে পাড়ার বর্ষীয়সী নারীরা স্মৃতির ভাণ্ড নাড়া দিয়ে সেসব কথা যখন বলাবলি করত লজ্জা শরমে আমার দুকান লাল হয়ে যেত।

আড়াই হাজার টাকা জরিমানা দিয়ে বাবার মাথা ভয়ংকর বিগড়ে গিয়েছিল । গ্রামে আমাদের খুবই অখ্যাতি রটেছিল। বাবা দশজনের সামনে মুখ দেখাতে পারছিলেন না। হাটে বাজারে যাওয়া-আসা করাও তাঁর পক্ষে একরকম অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। তিনি আমাদের দহলিজে বসে দিনরাত চাপা রাগে ফুলতে লাগলেন। অপমানে হতাশায় অন্ধ হয়ে এককালীন হিতৈষী সুহৃদ আবুনসর মোক্তার সাহেবের সঙ্গে এক ধারা দুধারা থেকে শুরু করে আইনের সর্বোচ্চ নম্বরে মামলা জুড়ে দিলেন।

আবুনসর মোক্তার সাহেব এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা যে জটিল প্যাঁচ কষে দুনিয়ার আমাদের অংশ নিজেদের অধিকারে নিয়ে আসছিলেন, সে একই সূক্ষ্ম প্যাঁচ অতীতজীবী উদভ্রান্ত বাসনার অসহায় শিকার আমার বাবার ওপর ঠাণ্ডা মাথায় অথচ পরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে প্রয়োগ করে রক্তের গাঁজলা বের করে দিচ্ছিলেন। মামলায় আমাদের হার হচ্ছিল। বাবা যতই হারছিলেন ততই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন। এক সময়ে অবশ্য তাঁর বুঝতে বাকি রইল না, কানা মোক্তার তাঁকে সম্পূর্ণ ধরাশায়ী না করে ছাড়বেন না।

৩. সেই সময়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার

সেই সময়ে যুক্তফ্রন্ট সরকার পূর্বপাকিস্তানের ক্ষমতায় আসে। তারা জমিদারী প্রথা উঠিয়ে দিল এবং জমিদারীর পেছন পেছন তালুকদারী প্রথা আপনা থেকেই উঠে গেল। বাবা খবরটা কাগজে পড়ে প্রথম দুতিন দিন- যে ভিখিরীর ছেলেরা ক্ষমতা হাতে পেয়ে পুরনো মানী লোকদের বেইজ্জত করতে লেগেছে, তাদের উদ্দেশে সুশ্রাব্য নয় এমন শব্দরাজি একটানা বর্ষণ করে গেলেন।

তারপরে একেবারে অন্য মানুষ বনে গেলেন। বসলে উঠবার কথা ভুলে যেতেন। ভাতের থালা নিয়ে ঠায় বসে থাকতেন। গ্রাস মুখে তুলতে গিয়ে কি ভেবে শিউরে উঠতেন, হাতের গ্রাস মাটিতে পড়ে যেত। অথচ কিছুদিন আগেও তিনি মোক্তার সাহেবের সঙ্গে কি প্রচণ্ড বিক্রমে লড়েছিলেন। তাঁর প্রাণশক্তি কি করে এমন থিতিয়ে এল বুঝতে পারলাম না।

তালুকদারী গেছে আমাদের কাছে সুসংবাদ বৈ এমন কিছু নয়। কিন্তু বাবার বুকে আঘাতটা বজ্ৰশেলের মতো বাজল। একটা শরিকী তালুকের সাড়ে তিন আনা অংশের মালিক ছিলেন আমার বাবা। বছরে একশ তিন টাকা বারো আনা সাত পাই খাজনা আমাদের পাওনার কথা। কিন্তু আমার বয়েসকালে কোনোদিন টাকাটা বিনা ঝাটে পেয়েছি একটুও মনে পড়ে না। বরঞ্চ কোনো কোনো বছর আদালতে তার দশগুণ ব্যয় করতে হয়েছে।

বাবার একটা প্রাণপ্রিয় স্বভাব- যাদের কাছে তিনি খাজনা পেতেন, তাদের উঠতে বসতে ছোটলোক ছাড়া ডাকতেন না। আর সেই ছোটলোকেরাই লেখাপড়া বিত্ত-বৈভবে আমাদের চাইতে অনেক বেশি সম্পন্ন ছিল। নতুন কোনো মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলেই হাতের বাঁকা লাঠিটা প্রসারিত করে গোটা গ্রামখানি দেখিয়ে বলতেন, এই যে দেখছেন চারপাশের ঘরবাড়ি এরা সবাই আমাদের সাতপুরুষের প্রজা। সাত পুরুষের প্রজারাও তাই আদালতে তালুকদার সাহেবকে না তুলে খাজনাটা কখনো হাতে হাতে পরিশোধ করত না। বাবাকে আদালতে নালিশ করতে হতো, ওরা পাল্টা জবাব দিত। এভাবে উকিল মোক্তার সাক্ষী সাবুদ পেশকার পেয়াদার পেছনে নির্ঘাত হাজারখানেক টাকা বেরিয়ে যেত। সেই তালুকদারী যাওয়াতে একটু ব্যথা পেলেও মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক মামলা মোকদ্দমা হ্যাঙ্গাম হুজ্জত পোহাতে হবে না।

বাবার শরীর দিনে দিনে ভয়ংকর রকম দুর্বল হয়ে আসছিল। তিনি ক্লোরোফর্ম করা রোগীর মতো অসাড় হয়ে পড়ে থাকতেন। যখন-তখন সে তুলোট কাগজের বংশপঞ্জিটা খুলে বসতেন। খয়েরী হয়ে আসা হরফগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতেন। বিড়বিড় করে বংশপঞ্জিটি আমাদের পরিবারের উত্তরণ ধারার রেখাচিত্র। কালের জল আমাদের মেদ মাংস পচিয়ে ফেলেছে একথা সত্যি, তবু কিন্তু অস্থির আড়ালে মজ্জার সঙ্গে শয়ান এক রকমের হীরকের মতো কঠিন অথচ জ্যোতিন অহংকার আমরা লালন করতাম। যতই দরিদ্র হই, সেই শিলা-দৃঢ় অহংকার ভাইবোন কেউ ভুলতে পারিনি।

এই বাঙাল মুলুকে আমাদের স্থিতি হয়েছিল সেই কবে মোগল আমলে। মোগল আমল, নবাবী আমল, ইংরেজ আমল কত কাল এল গেল । কত রাজ্য কত রাজা এসেছে আর গিয়েছে। কত যুদ্ধ-বিগ্রহ, ধ্বংস-সৃষ্টি, বিপ্লব-উপবিপ্লব সবকিছুর আঘাত সহ্য করেও সগৌরবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল আমাদের পরিবার। কোনো আকস্মিক বিপদ-আপদই আমাদের পরিবারকে স্পর্শ করতে পারেনি। অখণ্ড প্রতাপ খণ্ড-খণ্ড হয়ে পড়েছে, বিশাল জমিদারী কোথায় বিলীন হয়েছে। তারপরও এক পুরুষের পর এক পুরুষ এসেছে। হৃদয়লালিত অহংকারে ভরিয়ে দিয়ে গেছে উত্তরপুরুষের বুক। বংশপঞ্জিতে তাদের আশ্চর্য সব নাম পাঠ করে আর ততধিক আশ্চর্য কীর্তি কাহিনী শ্রবণ করে আমি নিজেও তো কতবার রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছি। এই সম্মোহনের মধুর স্বাদ কি করে কাটাই।

বাবার অবস্থা ভয়াবহ। এই তালুকদার শব্দটার ব্যঞ্জনায় তিনি সর্বক্ষণ মোহিত হয়ে থাকতেন। ভুলে যেতে পারতেন চারপাশের বাস্তবের রূঢ় পরিবেশ। এই পাঁচটি অক্ষরে উচ্চারিত বিশেষ ধ্বনিটির মাধ্যমে তিনি পূর্বপুরুষের নৈকট্য অনুভব করতেন। সেই তালুকদার নামটাই আইনের খড়গে কাটা পড়ে গেল। তিনি অনুভব করলেন, বংশপঞ্জিতে তার নাম থাকার আর কোনো সার্থকতা নেই। চোখ কান খুঁচিয়ে উপলব্ধি করলেন- ঘুমের ভেতর স্বপ্নের যোগানদার, জাগরণে নেশাগ্রস্ত করার মহাজনদের হাট থেকে তিনি একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। বৈরী বিশ্বে দাঁড়িয়ে অস্তিত্বের অর্থহীনতা গভীর মর্মবেদনায় প্রথমবারের মতো অনুভব করলেন। অচেতন রোগী সংজ্ঞা ফিরে পাওয়ার পর একটা হাত কিংবা পা কাটা দেখে যে রকম রিক্ততা অনুভব করে তেমনি এক ধরনের রিক্ততার ভেতর ডুবে গেলেন বাবা। তাঁকে বাতে ধরে জখম করে দিয়ে গেল। তিনি উত্থান শক্তি হারালেন।

আমার বি. এ পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। এমন সময়ে চূড়ান্ত দুঃসংবাদ শুনলাম। বাবা হাইকোর্টের মামলায় গরু হারা হেরেছেন। আবুনসর মোক্তার সাহেব মামলার খরচ ডিগ্রি পেয়েছেন। যেহেতু আমাদের ঋণ পরিশোধ করার মতো টাকা নেই, তাই মোক্তার সাহেব আদালতে জীর্ণ বাড়ি, হাজা পুকুর, জমা দিঘি সব নিজের নামে নিলাম করিয়ে নিয়েছেন। খবর শুনে মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। পাগলের মতো ছুটে বাড়ি এলাম। গাঁয়ের মানুষ নানারকমের গুজব ছড়াচ্ছিল। কেউ বলছিল পুলিশ এনে আমাদের বাড়ির বের করে দেয়া হবে, কেউ বলছিল আমাদের জীর্ণ বাড়ি ভেঙে বেগুন চাষ করে মোক্তার সাহেব গায়ের ঝাল মেটাবেন। আমি, আমি কি করব। অসুস্থ জনক, বৃদ্ধা জননী এবং ছোট বোনটার হাত ধরে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব। চিন্তা-ভাবনা করার শক্তি বিলকুল হারিয়ে ফেলেছিলাম। প্রতিবেশীদের কেউ কেউ সমবেদনার কথা বলতে আসত। তখন, ঠিক তখনই আমার চোখ ফেটে ঝরঝর করে জল বেরিয়ে আসতে চাইত।

এ অকূলেও কূল পেয়ে গেলাম। পথ বাৎলে দিলেন স্বয়ং আবুনসর মোক্তার সাহেব। বাবার এই সাংঘাতিক অসুখের সময় তিনি এক সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে এলেন। আগের দিনে এলে যেমন করতেন, তেমনি অত্যন্ত প্রসন্নভঙ্গিতে কথাবার্তা কইলেন। আগে কেন তাঁকে খবর দেয়া হয়নি সেজন্য মৃদু স্বরে আমাদের বকলেন। বাবার কপালে হাত দিয়ে তাপ পরীক্ষা করলেন। চুক-চুক আফসোস করলেন। কথাবার্তার ভঙ্গিটি এরকম যেন কোনোদিন তার সঙ্গে আমাদের টু শব্দটি হয়নি। মনে হল, মার সঙ্গে তিনি আগের চাইতেও সমীহ করে কথাবার্তা বলছেন। তাঁর আগমন আমাদের বাড়িতে এতই অভাবিত যে আমরা পান তামাকটা দেয়ার কথাও ভুলে গেছি। এরই মধ্যে অর্থস্বার্থ বুদ্ধি পরামর্শের জোরে মোক্তার সাহেব একজন দেশের কেউকাটা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি যে এমনভাবে আমাদের বাড়িতে আসতে পারেন, স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। অনেকক্ষণ বসে নানা সুখ-দুঃখের কথা কইলেন।

যাওয়ার সময় মাকে উঠোনে ডেকে নিলেন। নারকেল গাছের হেলানো ছায়াটির নিচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ চুপি চুপি কি সব কথাবার্তা কইলেন। তারপর গমিত হলেন। সন্ধ্যেটা গাঢ় হয়ে এসেছে। আমাদের জীর্ণ বাড়িতে ঝিঁঝির চিৎকার ঘনায়মান অন্ধকারকে আরো ভুতুড়ে করে তুলেছে। মা ঘরে এসে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল। মোক্তার সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে চুপি চুপি কি বলে গেলেন আমি জানতে চাইলাম না। মা তেমনি চুপ করেই রইল। ফের জিজ্ঞেস করলাম, কি বলে গেল? মা দুবার ঢোক গিলল। একবার আমার দিকে, একবার রুগ্‌ণ বাবার দিকে বড় করুণভাবে তাকালো। বুঝতে অসুবিধা হলো না, কথাটা বলতে মার কেমন জানি কষ্ট হচ্ছে। যাহোক কথাটা বাবার গায়ের ওপর ভালো করে টেনে দিয়ে আস্তে আস্তে মা বলল : আমাদের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে হবে না, পুকুর দিঘি সব আগের মতো আমাদের দখলে থাকবে। মোক্তার সাহেব নিজ ব্যয়েই বাড়িঘরের সংস্কার করিয়ে দেবেন। বাবাকে শহরে রেখে বিলেতফেরত ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাবেন। এটুকু বলে একটু থেমে মা বাবার মুখমণ্ডল আরেকবার ভালো করে দেখে নিল। আসল কথাটা বলবে কি না তখনো দ্বিধা করছিল।

কথাটা বাবা শীর্ণ হাতে মুখ থেকে সরিয়ে ক্ষীণ কিন্তু তীক্ষ্ম কণ্ঠে বলল : তারপর… তারপর কি বলল? এইবার মা বলে ফেলল। বিনিময়ে আমাকে শুধু তার বোবা মেয়েটিকে বিয়ে করতে হবে। বাবা একটিমাত্র ধ্বনি উচ্চারণ করলেন : কি? কেরোসিনের বাতিতে ঐ স্বল্পালোকিত ঘরে ঐ ছোট্ট ধ্বনিটি অনেকক্ষণ পর্যন্ত যেন জ্বলতে থাকল। মা আর আমি পাশাপাশি বসে। বাবার মুখ দিয়ে সেই ছুঁছুঁলো ধ্বনিটি আবার তীরের মতো বেরিয়ে এল কি? তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে পাশ ফিরে ঘুমালেন। তার বুকের গভীরে ফোঁসকা পড়ছে আর ভাঙছে।

মা কোনো বিষয়ে কোনোদিন মতামত দেয়নি। বাবা নিঃসাড়। সব জেনে সব বুঝেও হ্যাঁ বললাম আমি। কেন রাজী হয়ে গেলাম বলতে পারব না। লোভের বশীভূত করার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে। অতএব শ্রাবণ মাসের এক গুমোট দিনে আবুনসর মোক্তার সাহেবের বোবা মেয়েটির সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বাবার অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হয়ে আসছিল। মা কেমন ঝিম মেরে গেল। মোক্তার সাহেব কথামতো বাবাকে হাসপাতালে রাখলেন। বড় ডাক্তার দেখালেন। ডাক্তার দেখলেন এবং ঘাড় ফেরালেন। তিনি হাসপাতালেই মারা গেলেন। বাবার পেছনে পেছনে গেলেন মা।

৪. আবুনসর মোক্তার সাহেব

আবুনসর মোক্তার সাহেব আমাকে শুধু মেয়ে দিলেন না। হতাশা লাঞ্ছিত পূর্বপুরুষের জীর্ণ অট্টালিকা থেকে টেনে আলো-ঝলমল-করা শহরে এনে বসালেন। রাজধানী শহরে আমার চাকরি হলো। চাকরির সঙ্গে সঙ্গে আস্ত একখানা বাড়িও শ্বশুর সাহেব মোক্তারী বুদ্ধি খরচ করে জুটিয়ে দিলেন। আগে থাকত এক নিরীহ ব্রাহ্মণ। যে প্যাঁচে শ্বশুর সাহেব তার বেয়াইকে অন্তত দশ বছর আগে স্বর্গে পাঠিয়েছিলেন একই প্যাঁচে নিরীহ ব্রাহ্মণকে গ্রাম এবং শহরের সমস্ত মূল থেকে উপড়ে তুলে সীমান্তের ওধারে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।

মোক্তার সাহেবকে এখন থেকে শ্বশুরই বলব। শুরু থেকে কেন সম্মানসূচক বাক্য ব্যবহার করে আসছি, আশা করি এখন তা বুঝতে পারছেন।

দেশে ত্বরিত গতিতে সময় পাল্টাচ্ছিল। পৃথিবীর গভীর গভীরতরো অসুখের খবর সংবাদপত্রের পাতায় কালো ফুলের মতো ফুটে থাকে। দেশে আইয়ুব খান সাহেব সৈন্য-সামন্ত নিয়ে গেড়ে বসেছেন। সংবাদপত্রের ব্যানারে খান সাহেবের একজোড়া গোঁফ হুংকার দিয়ে জেগে থাকে। দেখতে না দেখতেই দেশের জীবন প্রবাহের মধ্যে খান সাহেবের অপ্রতিহত প্রভাব প্রবল সামুদ্রিক তিমির মতো ছুটাছুটি করছিল। এই সুযোগে আমার শ্বশুরের মতো মানুষেরা অন্ধকার থেকে সূর্যালোক ফাঁকি দিয়ে শহরের ফ্ল্যাশ ক্যামেরার সামনে উঠে আসতে লেগেছেন। আগেই তিনি মোক্তারী ছেড়ে দিয়েছিলেন। মরা গরুর খালের নাহান আদালতের ময়লা বেটপ শামলা গা থেকে গাছের পুরনো বাকলের মতো ঝরে পড়েছে সে কবে। এখন তিনি আদ্দির গিলে করা ফিনফিনে পাঞ্জাবী পরেন। সোনার বোতাম ঝিলিক দেয়। হাতে হীরার আংটি ঝকমক করে। তিনি আইয়ুব রাজত্বের শক্ত একটা খুটি না হলেও ঠেকনা জাতীয় কিছু একটা তো বটেই। বসনে-ভূষণে অনেক সম্ভ্রান্ত হয়ে উঠেছেন। একটা ব্যক্তিত্বও না জানি কোত্থেকে উড়ে এসে শরীরে আশ্রয় করেছে। একটু বয়স হলে যেমন মেয়েদের বুকে স্তনের বাঁকা রেখা আভাসিত হয়, তেমন টাকা পয়সা এবং দাপট এলেই শেয়ালের মতো চেহারায়ও সিংহের আকৃতি জাগি জাগি করে।

আমার শ্বশুরের চারদিকে জয়জয়কার। শালা-সম্বন্ধীরা ব্যবসায়ে রীতিমতো লাল হয়ে যেতে থাকল। লোকে বলাবলি করত আমার শ্বশুর ভাগ্যবান। নিজেকেও আমি কম ভাগ্যবান মনে করতাম না। এমন একজন লোকের মেয়ে বিয়ে করেছি, সে কি চাট্টিখানি কথা! নাইবা রইল একখানা হাত কিংবা পা। শ্বশুরের সৌভাগ্যের ছিটেফোঁটা আমিও পেতে থাকলাম।

ব্রাহ্মণের ভাঙা বাড়িটা নতুন করে বানিয়েছি। ঝোপেঝাপে ঢাকা কম্পাউণ্ডে একটা কুয়োর মতো ছিল। চারপাড় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দিয়েছি। পুরনো ঘাট ঝালাই করেছি। আমাকে লোকে যাই বলুক শ্বশুরের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। তিনি আমার প্রকৃতি ধরতে পেরেছিলেন, তাই আমার জন্য যা যা করেছিলেন এমনভাবে করেছিলেন যেন প্রবৃত্তি এবং প্রকৃতির সঙ্গে একেবারে খাপ খেয়ে যায়। কোনো কোনো গাছ আছে কড়া আলোতে বাঁচে না, কোনো কোনো মানুষ ভিড় এবং ঠেলাঠেলি সইতে পারে না। সেদিকে লক্ষ্য রেখে শ্বশুর সাহেব আমার চাকরি ঠিক করেছেন, বাসা নির্বাচন করেছেন আর যা যা করেছেন গায়ের লাগসই পোশাকের মতো একেবারে নিখুঁতভাবে মানিয়ে গেছে।

এসব ব্যবস্থাপনার মধ্যে একখানা শিল্পী মনের দরদ খুঁজে পাই। এসব তিনি করেছেন বোবা মেয়েটির জন্যই তো। মেয়েকে তিনি ভারি ভালবাসতেন। তাঁর আরো মেয়ে আছে। কিন্তু আমার স্ত্রীর প্রতি পক্ষপাতটা কম্পাসের মতো হেলে থাকত। যখন আমার স্ত্রীর সাথে কথা বলতেন, মুখে কথা বলতেন না, আরেকজন বোবার মতো আভাসে ইঙ্গিতে কথা কইতেন। আসল বোবা আর নকল বোবার এই যে মাখামাখি তা আমার চোখে অত্যন্ত সুন্দর এবং পবিত্র মনে হতো। এই জন্য আমার শ্বশুরকে আমি ভালবাসি। কেননা তাঁর একখানা দরদী মন ছিল। তিনি আপনার জনদের ভালবাসতে জানতেন।

কিন্তু মানুষ তাঁকে ভাল বলত না। তাঁকে দিয়ে যাদের সর্বনাশ হয়েছে তারা তাঁকে অভিসম্পাত দিত। আমাকেও লোক মন্দ বলত। কারণ আমি তার বোবা মেয়ে বিয়ে করে অল্প-স্বল্প সৌভাগ্যের মুখ দেখেছি। তার জন্য আমি কিছুই মনে করিনে। লোকে তো কত কথাই বলে। তাছাড়া আমি নির্বিরোধ মানুষ। ঝগড়াঝাটি পরনিন্দে এড়িয়ে চলাই স্বভাব।

বাড়িতে খাই দাই এবং ঘুমাই। নিয়মিত অফিসে যাই অফিস থেকে আসি। দিন কেটে যাচ্ছে একরকম দিনের মতো। আনন্দ নেই- নিরানন্দ তাও নেই। বন্ধুরা সকলে তাদের বৌয়ের গল্প করে। তাদের নিয়ে বাজারে যায়, সিনেমা দেখে, অবসর মুহূর্তগুলো মৌচাকের মধুর মতো কথাবার্তার রসে ভরিয়ে রাখে। কোনো কোনো বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে তাদের বৌদের সঙ্গে গল্প করেছি, গান শুনেছি। মনের মধ্যে একটা কাঁটার তীক্ষ্ণ দংশন অনুভব করেছি। আমার বুকের ভেতরে একটা দুঃখ পাশ ফিরে ঘুমিয়েছে। জীবনে কি সব পাওয়া যায়। সকলে কি সমান ভাগ্যবান! মনকে। প্রবোধ দিতে চেষ্টা করতাম। কখনো প্রবোধ মানত কখনো মানত না। বাতাসের মতো চঞ্চল মন।

আমাদের অফিসে নৃপেন নামে এক এল-ডি ক্লার্ক আছে। সে আমার পাশের কামরায় বসে। ফাঁকিবাজ ছোঁকড়া। প্রতিদিন আড্ডা ইয়ার্কি করে দশটা থেকে পাঁচটা কাবার করে। কাজ পড়ে থাকে। চাকরি যাই যাই করেও কি কারণে জানি যায়নি।

কিছুদিন আগে সে ছোঁড়ার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকে নৃপেন এক নতুন উৎপাত শুরু করেছে। নতুন বৌ কি বলল, কিভাবে বলল- একটা কথা একশবার করে বলত। হেসে কথা বললে কি রকম দেখায়, রেগে বললে কি রকম মুখের ডৌল হয়, স্বরতরঙ্গের খাঁজগুলো উঁচুগ্রাম থেকে নিচুগ্রামে ওঠানামা করে যখন, গলাতে যে সুন্দর ভাঁজ পড়ে কি অপরূপ দেখায়- এসব কথা বয়ান করত। শুনে চাপা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলতাম কেউ শুনতে না পায় মতো। কিন্তু নৃপেন প্রসঙ্গ পাল্টায় না। বলুক না বলুক নতুন বৌয়ের নাম করে নৃপেন কিছু একটা বানিয়ে হলেও বলবে। এটা তার একটা স্থায়ী মুদ্রাদোষে দাঁড়িয়ে গেছে।

আমার ধারণা হলো আমি বোবা মেয়ে বিয়ে করেছি বলে এবং তার কর্তা বলেই আমাকে এসব কথা শুনিয়ে শুনিয়ে বলে। তখন থেকেই আমি নৃপেনকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করলাম, মনে করতে লাগলাম, নৃপেন একটা বাজারের খানকী বিয়ে করেছে। একমাত্র খানকীরাই অত বেশি হাসে, কথা বলে এবং বিশ্রী ভঙ্গি করে। প্রতিশোধ নেবার তীব্র ইচ্ছে মনের ভেতর ফণা ধরে জেগে উঠত। কিন্তু আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের কতটুকু দাম! প্রেম কিংবা ঘৃণার পক্ষে বিপক্ষে কিছু করার ক্ষমতা আমার ছিল না। যে আইয়ুব খান অঘটনঘটনপটিয়সী ক্ষমতার প্রভাবে আমার শ্বশুরের মতো

হেজী-পেজী মোক্তারকেও গণ্যমান্য সম্ভ্রান্ত মানুষে রূপান্তরিত করেছে, সম্ভব হলে সেই আইয়ুব খানকে ডেকে বলতাম : হে প্রবল প্রতাপান্বিত আইয়ুব খান, তোমার লোহার ডাণ্ডাটি নিয়ে দয়া করে একটি বার এসো। নৃপেনকে মারধর করতে যদি তোমার মতো ফিল্ড মার্শালের পৌরুষে বাধে, অন্তত চাকরিটি খেয়ে তাকে কলকাতা পাঠিয়ে দাও।

হায়রে! এসব ছিল অক্ষমের কল্পনা মাত্র। বাস্তবে আমার শ্বশুর যেখানে বসিয়ে দিয়েছিলেন, তার বাইরে এক চুল হেলবার সাধ্যিও আমার ছিল না।

কয়েকদিন থেকে দেখছি নৃপেনের ভিন্ন অবস্থা। অপরিমিত যৌন সম্ভোগের ক্লান্তিতে সে একেবারে মিইয়ে গেছে। যখন-তখন নতুন বৌয়ের নাম করে আর জ্বালাতন করে না। ফাইলপত্তরের সামনে বসে বড় বড় হাই তোলে। আর সকাল বিকেল রেসের গল্প করে।

নৃপেন একটা স্কাউণ্ডেল। আমার নিস্তরঙ্গ নিথর জীবনযাত্রার মধ্যে একটা জীবন্ত অতৃপ্তি ঢুকিয়ে দিয়েছে সে। এখন স্ত্রীকে আমি দু-চোখে দেখতে পারিনে। মাঝে মাঝে পাকা জুয়োড়ীর মতো মনোভাব জাগে। ইচ্ছে হয় শ্বশুর সাহেবের কাছে গিয়ে বলি, আপনি যা দিয়েছেন ঘর বাড়ি চাকরি সব নিন। বিনিময়ে কেবল আমাকে আপনার বোবা মেয়ে রত্নটির দায় থেকে রক্ষা করুন। আমি সমগ্র জীবনের সমস্ত কিছুর বিনিময়ে এমন একজন মেয়ে মানুষকে কাছে পেতে চাই- যে কালো হোক, কুৎসিত হোক, না থাকুক তার গুণপনা সে শুধু কথা বলবে, অনবরত কথা বলবে। তার মুখ থেকে নানা রকমের শব্দমালা শরতের বিবাগী বাতাসে শিউলী ফুলের মতো ঝরে পড়বে। কল্পনায় কত মেয়েমানুষ সৃজন করি তাদের সঙ্গে কত কাল্পনিক কথোপকথন চালাই। বুকের গভীর থেকে শব্দরাজি থরে-বিথরে নীলকান্ত মণির মতো জেগে ওঠে। গানের মতো সুরের ছোঁয়া লাগা, প্রাণের লাবণীভরা কথা ঝর্নাধারার বেগে উছলে ওঠে। জীবনে নারীর সঙ্গে কথা বলার এমন তীব্র আকুতি কোনোদিন বোধ করিনি। নৃপেনের খোঁচা খেয়ে আমার ভেতরে আরো একটা আমির উদ্ভব হয়েছে। এই যে নিষ্ঠুর নির্মম ক্ষুধাবোধ এতদিন কোনো গর্ভগুহায় লুকিয়ে ছিল জানতে পারিনি।

আগেই তো বলেছি, ইচ্ছেশক্তি বলতে কোনো কিছু নেই। তাই বলে আমি যে কিছু চাইনে একথা সত্যি নয়। নানা জায়গায় আমার যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু চরণ সামনে চলতে রাজী হয় না। অনেক কিছু করার সাধ জাগে কিন্তু অবশ হাত উঠতে চায় না। নানা আনন্দ-বেদনার ধ্বনি আমার জিভের ডগায় পুঁটিমাছের মতো নাচলেও একটুকুর জন্য ঝরে পড়তে পারে না। এমন নিষ্ক্রিয় পুরুষ মানুষ আমি।

একটি সবাক সজাগ নারীর সঙ্গে কথা বলার কামনা বুকের তলায় রক্তবর্ণ বুদবুদের মতো জাগে আর ভাঙ্গে। অফিস থেকে আসা যাওয়ার পথে রিকশা বাস, পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জটলা পাকানো তরুণীদের দিকে বাক্যের ক্ষুধা নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকি। নারীকণ্ঠ নিঃসৃত কলকাকলী শোনার জন্য সন্তর্পণে কানজোড়া পেতে রাখি। দমকা বাতাসে চারাগাছ যেমন কাঁপে তেমনি নারীর সুন্দর হাসির লহরী আমার বুকের স্তরে স্তরে কি আবেগেই না সমীরিত হয়! সে কথা কেমন করে বোঝাই।

প্রতিদিন অফিস শেষ করে বাসায় আসি। বোবা স্ত্রী আমাকে দোরগোড়ায় দেখলেই অপরিসীম আগ্রহ নিয়ে ছুটে আসে। সে যেন সারাদিন আমার বাড়ি আসার ক্ষণটির অপেক্ষায় দোরগোড়ায় তৈরী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জুতো মোজা খুলতে সাহায্য করে, জামা-কাপড় ছাড়তে হাত লাগায়। বাথরুমে ঢুকে হাতের কাছে সাবান তোয়ালে এগিয়ে ধরে। হাউমাউ করে চাকরানী মেয়েটিকে ঈশারায় দুধ গরম করতে বলে। হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলে নাস্তার প্লেট এবং ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এসব আদিখ্যেতা দেখে আমার বিরক্তি ধরে যায়। লাথি মারতে ইচ্ছে করে… পারিনে অভ্যেস নেই বলে। চা-টা শেষ করে অন্যদিকে মুখ ফেরাই। সে বুঝতে পারে আমার মন খারাপ। বোবাদের ঘ্রাণশক্তি বড় তীক্ষ্ম । কথা যে বলতে পারে না এ বিষয়ে পুরো সজাগ। তাই সেবা দিয়ে কথার অভাব ভরাট করতে চায়। পুরুষ মানুষের সেবায় কতদিন চলে। আমার দরকার অন্য কিছুর। আমি মনের সাধ মিটিয়ে কথা বলতে চাই। তাজা উষ্ণ, রূপরাঙা, রসরাঙা কথা আমার মনের বৃন্তে বৃন্তে বসন্তের পল্লবের মতো মুকুলিত হয়। মুকুলিত হয় আর ঝরে যায়। সমস্ত হৃদয় মনের আকুতি দুখানি কালো চোখের তারায় থরোথরো নাচে। বিশাল কালো চোখে চোখ পড়ে কখনো বা মনটা আপনা থেকেই ধক করে কেঁপে যায়।

গম্ভীর হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকি। ভেতরের তাপে চাপে ওপরের আবরণ খান-খান হয়ে ভেঙে পড়তে চায়। দুর্বলতার টুটি চেপে ক্ষেপে উঠতে চেষ্টা করি। পারিনে। এ ধরনের মানসম্মান বোধহীন মেয়েমানুষের সঙ্গে রাগ কেমন করে করতে হয়, তাও আমি জানিনে। হাবাগোবা মোমের পুতুলের মতো এমন পুরুষ মানুষ আমি। আমাকে দিয়ে জীবনের কোনো দিকের সীমা অতিক্রম হলো না। জ্বলব, পুড়ব, ব্যথা পাব অথচ কিছুই করতে পারব না, কিছুই বলতে পারব না, কোথাও যেতে পারব না।

আমার এদিকে বুকটা ভয়ে ঢিপঢিপ করে। কি জানি শ্বশুর সাহেব যদি টের পেয়ে যান তাঁর মেয়েটিকে আমি অবহেলা করছি। চাকরিটি খেয়ে মেয়েটা ফিরিয়ে নিয়ে যদি বলেন, এখন বনটির হাত ধরে যেখানে ইচ্ছে চলে যাও, তখন কোথায় কোন্ বৃক্ষের ছায়ায় দাঁড়াব?

আমি আইয়ুব খান সাহেবকে কাজে খাটাতে পারিনে। তিনি শ্বশুর সাহেবের হাতে যে পরিমাণ ক্ষমতা গচ্ছিত রেখেছেন, আমি তো তিতপুঁটি, তাই দিয়ে অনেক রুই-কাতলাও ঘায়েল করা যায়। আমার মনটা বড় সন্দেহপ্রবণ। দুর্বল কিনা। দুর্বলেরা ভারি সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়। এইরকম মানসিক সন্ত্রস্ততার মধ্যে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে দিলাম। সে সময়ে আমার অর্ধেক চুল পেকে গেছে। ওজন আট পাউণ্ড কমেছিল। এখন মনে হয় নরকবাস করছিলাম।

আমার বোনটা ছোটবেলা থেকেই আমাকে ভয়ানক ভয় করে। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে আরো দূরে সরে গেছে। আগে এক-আধটু কাছে ঘেঁষত। এখন তাও না। নিজের মনে সব সময়ে একা থাকে। স্কুলে যায় আসে, মৃদুস্বরে পড়া মুখস্থ করে। ছোট্ট তক্তপোষখানিতে একা একা ঘুমোয়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একজন পুরুষ ছেলের কথা ভাবে কিনা আমি বলতে পারব না।

মা-মরা মেয়েটির এই নিঃসঙ্গ জীবনযাত্রা দেখে কতবার আমার মনটা হু হু করে নিঃশব্দে কেঁদেছে। অনেকবার ভেবেছি তাকে একটু আদর করব, মাথায় হাত বুলিয়ে দেব, একটা সুন্দর জামা, দুগজ চুলের ফিতা কিনে দেব। একদিন সিনেমায় নিয়ে যাব। কিন্তু অনভ্যেশবশত এসবের কিছুই করতে পারিনে। তাই বোনটি যেমন আছে তেমনি রয়েছে। চোখের কোণায়, মুখাবয়বে ভয় পাওয়ার সে প্রাচীন গ্রামীণ চিহ্নটি এখনো অক্ষয় হয়ে জেগে আছে।

মানস যন্ত্রণার এই সময়ে আমি বড় অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। ধারে কাছে কেউ নেই যে একটু গভীর কথা বলে বুকের ব্যথা লাঘব করি। ব্যথা মনে পাষাণের মতো চেপে থাকে। কি করি, কোথায় যাই। কার কাছে গিয়ে মনের এই অদ্ভুত বেদনার কথা প্রকাশ করি। মনের ভেতর যে ক্ষিপ্র স্রোতোবেগ জাগছে কোথায় আছে এমন পরম বান্ধব যার কাছে গিয়ে সব অকপটে প্রকাশ করি। এই পৃথিবীতে আমার তো আপনার জন বলতে কেউ নেই।

এই সময়ে ছোট বোনটির সঙ্গে একটু একটু করে কথা কইতে থাকি। পয়লা তো সে আমার কাছেই ঘেঁষত না। একটা কিছু জিজ্ঞেস করলে জবাব দেবার সময় পাঁচবার তোতলাতো। তিনবার মুখের দিকে করুণভাবে তাকাতো। মনে মনে আশা করতাম বোনটি এইবার কথা বলুক। ভাইজান বলে ডাকুক। অসীম উৎকণ্ঠায় প্রতিদিন প্রতীক্ষা করি। কিন্তু বোনের কণ্ঠে সে আকাঙ্ক্ষিত ধ্বনিটি শুনিনে। অনাদরে অবহেলায় তার মধ্যে যে নির্বাকতার সৃষ্টি করেছি, কিছুতেই সে দেয়াল ভাঙল না। অগত্যা নিজেই উদ্যোগী হয়ে তার সঙ্গে এটা সেটা নানা কথা কইতে থাকি। এই কথাবার্তার প্রভাবেই আমি অনুভব করলাম আমার মানসিক স্থিতিশীলতা ফিরে। আসছে।

এভাবে কিছুদিন যাবার পর আমরা অত্যন্ত সহজভাবে পরস্পরের সঙ্গে কথা কইতে থাকি। তারপর থেকে আমরা দুভাইবোনে কথা বলতাম। গ্রামের বাড়ির কথা, বাবা-মার কথা, অদ্ভুতকর্মা পূর্বপুরুষদের কথা। আমাদের পরিবারের ঘুমন্ত ইতিহাস ভাইবোনের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে চমকে চমকে জেগে উঠত। অবলীলায় কথা বলতে শুরু করার পর থেকে আমি উপলব্ধি করি যে আগের সে ভীত-সন্ত্রস্ত ভাবটি কেটে গেছে। মানসিক অভাববোধ আমাকে আর ক্ষ্যাপার মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় না। একদিন এক বন্ধুর বৌয়ের গলায় গান শুনে চট করে ধারণা করে ফেললাম বৌটিকে গান শেখাব। তাকে দিয়ে নিপ্রাণ জড় এবং শুষ্ক শব্দ সমষ্টিতে প্রাণের গতি দান করব। এলোমেলো ধ্বনিপুঞ্জ ধরে সুন্দর সুর সৃষ্টি করার সুকুমার কলা কৌশল শেখাব। এটা আমার বোবা মেয়ে বিয়ে করার প্রতিক্রিয়া কি না বলতে পারব না। অনেক খোঁজ-খবর করার পর ভাল এবং বুড়ো দেখে একজন গানের মাস্টার ঠিক করে দিলাম।

 ৫. মানসিকতার শেকড়

এখন আমার মানসিকতার শেকড়ে শেকড়ে নতুন রসের রসায়নের লীলাখেলা চলছে। তার কার্যকারণসূত্রের সমস্ত রহস্যটা আমার কাছেও সুস্পষ্ট নয়। তবু বলি, বোনটি গান-বাজনায় বেশ সুন্দর উন্নতি করছে। এটা যে কেমন করে সম্ভব হলো তা আমি নিজেও বলতে পারব না। আমাদের পরিবারে কোনোকালে গান-বাজনার চর্চা ছিল না। হয়তো এমন হবে আমার বাবার রক্তের যে বাসনা, যে কামনা পাথরের ভেতর কীটের মতো বন্দী হয়ে ছিল, তাই-ই আমার বোনের কণ্ঠস্বরে রঙিন কুয়াশার মতো মুক্তিলাভ করছে। আমি যে কত খুশী হয়েছিলাম।

যাক আসল কথায় আসি। এই সময় থেকেই স্ত্রীকে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিতে দেখতে আরম্ভ করলাম। একটা ছোট্ট ঘটনাই তার কারণ। তাই সেটা বিবৃত করি। একদিন সন্ধ্যেবেলা আমি অফিস থেকে ফিরেছি। কি কারণে মনে পড়ছে না, সেদিন ফিরতে একটু দেরী করে ফেলেছিলাম। আমি তো বোবা স্ত্রীর স্বামী। তাই অফিস থেকে ফিরে অযথা কাউকে ডাকাডাকি করে বিড়ম্বনা বাড়াইনে। সেদিনও চুপি চুপি গেট খুলে ঘরে ঢুকি। আমার বোন তার থাকার ঘরটিতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গানের প্র্যাকটিস করছে। গলার স্বর উঁচু পর্দা থেকে নিচু পর্দায় নামছে। নিচু থেকে উঁচুতে চড়ছে। স্বরতরঙ্গের এই লাস্যময় উত্তরণ অবতরণ ধারায় প্রাণের যে মাধুরী রক্ত সন্ধ্যেয় ব্যক্ত হচ্ছে তা ঘরের বাতাস পর্যন্ত মধুময় করে তুলেছে। আমার বোন নিজের মনে গান-বাজনা করছে। আর আমার বোবা স্ত্রী বদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তার গলা দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ নামছে। বাতির আলোতে একফালি কপাল দেখতে পাচ্ছি। দ্বিতীয়ার চাঁদের মতো সুন্দর। চোখ থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় জল গড়িয়ে পড়ছে। সারা শরীর থর-থর করে কাঁপছে। কোনো অসুখ-বিসুখ নয়ত! হাতে পায়ে বিশ্রী রকম খিল ধরার অবস্থা। সচরাচর সে তো এমন করে না। কাউকে ডেকে রহস্যটা উদ্ঘাটন করার সংকল্প নেই। বেশ খানিকক্ষণ লাগল বুঝতে।

আমার বোন গান গাইছে আর বোবা স্ত্রী সকলের অলক্ষ্যে প্রাণপণ প্রচেষ্টায় বোনের সুরেলা কণ্ঠের সঙ্গে নিজের নির্বাক কণ্ঠটি মেলাবার চেষ্টা করছে। চমৎকার অনুসরণ প্রক্রিয়া। কিন্তু পারছে না। সে তো বোবা। তার বাক-যন্ত্রটি কাজ করছে না। কিন্তু শরীরের অণুপরমাণু এই অক্ষমতা মেনে নিতে রাজী নয়। তাতে করে হিষ্টিরিয়া রোগীর মতো খিল ধরছে। সমস্ত শরীর থেকে যে প্রচণ্ড প্রয়াস স্কুরিত হচ্ছে তারই তোড়ে গলা দিয়ে গোল গোল নুড়ি পাথরের খণ্ড-খণ্ড শব্দাংশ ঝরে পড়ছে। সেটা ভাষা নয়। গাড়ি স্টার্ট দেয়ার পূর্বে যে ধরনের আওয়াজ দেয় তেমনি ধরনের একটা কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় ।

সেদিন থেকে স্ত্রীর প্রতি আমার মনোভাবটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। বুঝতে বাকি থাকল না, তার মনের ভেতর কথা বলার আকাঙ্ক্ষা কি রকম জলপ্রপাতের ধারার মতো ফুলে ফুলে উঠছে। তার কণ্ঠও সুন্দর ধ্বনির প্রসূতি হতে তীক্ষ্মভাবে আগ্রহী। একজন মানুষ কথা বলতে পারে না, এটা কত দুঃখের!

যেটা আমাকে সবচে বেশি নাড়া দিয়েছে আমার স্ত্রী বাকশক্তিহীন দশাটিকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়নি। তার শরীরের প্রতিটি কণা, প্রতিটি অণু-পরমাণু এই বোবাত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বিক্ষোভে ফেটে পড়তে চায়। আমি নিজের চোখে তো দেখলাম। তারও মনের গভীরে ফুলের স্তবকের মতো কথা স্তরে স্তরে সাজানো রয়েছে। তার মনের ভেতর সুখ-দুঃখের আকারে যা ঘটছে এবং বাইরের পৃথিবীতে সুন্দর কুৎসিত যা বিরাজমান রয়েছে, প্রতি মুহূর্তেই পরিবর্তিত হচ্ছে- সব কিছুরই একটি নাম আছে। এই নামটিকেই সে প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু পারে না। বাক যন্ত্রটি খারাপ এবং অকেজো বলে।

এই কদিন আগে আমিও তো মনের খনিজ তিমিরে মধুর গুঞ্জরণশীল পাখনাযুক্ত শব্দ ভাণ্ডার পরম দুঃখে আবিষ্কার করেছি। শুধু মেয়েমানুষের সঙ্গে কথা বলার জন্য কেমন উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলাম। আমার বৌটির অবস্থা তার চাইতে ঢের ঢের করুণ। তার আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি গভীর। দাবী অনেক বেশি বাস্তব এবং জোরালো। স্ত্রীর প্রতি দরদ এবং মমতায় সমস্ত অন্তর মথিত হয়ে উঠল। সে রাতে তাকে অত্যন্ত কোমলভাবে আদর করলাম। স্বামী হিসেবে জীবনে যে-সব করিনি সব করলাম। হঠাৎ আদরের ঘটা দেখে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল । স্ত্রী জীবনে কোনোদিন আদর মমতার মুখ দেখেনি। খুবই ছোট্ট বয়সে মাকে হারিয়েছে। সত্মার সংসারে মানুষ। আমি তো একজন নিষ্ক্রিয় পুরুষ। হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তার বাইরে কিছু আছে বা থাকতে পারে একথা মনে একবারও উদয় হয়নি। আসলে আমার শ্বশুর সাহেব মোক্তারী বুদ্ধি দিয়ে যা সম্ভাবিত করেছিলেন তাই নিয়েই আমি সন্তুষ্ট ছিলাম।

গুণী বাজিয়ের হাতে পড়লে বেহালার তারের তড়িত যেমন অপরূপ শিখায় জ্বলে ওঠে তেমনি তার সমগ্র সত্তা আমার প্রতি স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। চোখে ঘুম নামছিল। আধোঘুমের মধ্যে অনুভব করলাম আমার বৌটি কাঁদছে… আহা কাঁদুক।

মাঝরাতে উঠে বাথরুমে যাবার জন্য বাতি জ্বাললে দেখি সে একাকী জানলার পাশে হাতের ওপর মুখ রেখে বসে রয়েছে। খুব দূরে শিরিশ পাতার জালের ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে একখণ্ড কৃষ্ণ পক্ষের স্নান চাঁদ উঠে আসছে। তার মুখমণ্ডলে দেবীর মতো বিকশিত মহিমা। হাত ধরলে পায়ে পায়ে বিছানায় চলে এল। সারারাত একতাল কাঁদার মতো আমার শরীরের সঙ্গে লেগে রইল।

৬. শরীর খারাপের নাম

০৬.

দুচারদিন পর শরীর খারাপের নাম করে একটানা দুই মাসের ছুটির দরখাস্ত দিলাম। আমাকে ছুটি নিতে দেখে অফিসের সমস্ত মানুষ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। চোখের ওপর দিয়ে প্রতি বছর শীত বসন্ত গড়িয়ে গেছে, গ্রীষ্ম বর্ষা অতীত হয়েছে। শরৎ হেমন্তে দেখেছি কখনো বা অফিসের নুলো পিয়নটিও যথারীতি ছুটি ভোগ করে অপরিমিত প্রাণোচ্ছ্বাস নিয়ে গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে এসেছে। আমার যে কি করে চলত, কি করে যে আমি এই ছোট্ট অফিস কামরার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখতাম, তা বলতে পারব না।

সে যাক দুমাসের ছুটি নিলাম। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক একরকম চুকিয়ে দিয়ে বাসায় এসে ডেরা পাতলাম। এ দুটি মাসই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। সকাল সন্ধ্যে ঘরে থাকি। খুঁটিনাটি কাজে মন দেই। আমরা স্বামী-স্ত্রী বিয়ে হওয়ার বহু বছর পর আবার নব বিবাহিত দম্পতির মতো জীবন শুরু করলাম। প্রতিটি দিনকেই যেন আমরা দুজনে অস্তিত্বের ভেতর থেকেই সৃষ্টি করে নিচ্ছিলাম। প্রতিটি উষা রাঙা নিমন্ত্রণলিপি মেলে ধরে। দিনগুলো ঝকঝকে নতুন প্রাণবন্ত। অফুরন্ত স্বাদ-গন্ধে সারা মন প্রাণ ভরিয়ে দিয়ে যায়। রাতগুলো বিধাতার আশীর্বাদের মতো সন্ধ্যের স্বর্ণতেরণ দিয়ে কেমন কান্তিমান ভঙ্গিতে নেমে আসে।

আমি আজকাল ফুর্তিবাজ হয়ে উঠেছি। স্ত্রীটিও বেশ সুন্দরী হয়ে উঠেছে। জীবনের জল তার সারা শরীরে ঝলকাতে লেগেছে।

অঙ্গে লাবণ্যের স্রোত নতুন গাঙের মতো ঢলঢল করে। আজকাল সাজ পোশাকের দিকে তার নজর বহুগুণে বেড়ে গেছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে । মাথা ভর্তি কালো চুল ছেড়ে দিলে পিঠ ঝেপে যায়। ইচ্ছে হলে গোল করে খোঁপা বাঁধে। ইদানীং দুয়েকটা ফুল খুঁজতেও শিখেছে। মৌসুমী ফুলের চারা লাগিয়েছি কটি। পরনের শাড়ি শক্ত করে কোমরে পেঁচিয়ে সকাল দুপুর জল ঢালে। তরু শিশুদের পুত্র-কন্যার স্নেহে লালন করে তখন তাকে ঠিক আশ্রম কন্যার মতো মনে হয়। সমস্ত শরীরে সরল সৌন্দর্য ফুলের গর্বে ফুটে থাকে।

বোনের গানের রেয়াজ করার সময়টিতে ইচ্ছে করে আমি ঘরে থাকিনে। স্ত্রী স্বরগ্রাম অনুকরণ করার প্রয়াসটি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখি। হাত-পায়ের খিল ধরা অবস্থাটিকে এখন আকার পাওয়া সুন্দর সুমিত একটি পিপাসার মতো লাগে। এমনি করেই বুঝি প্রাচীনকালে সাধনাকে অপ্সরারা মুণি ঋষির ধ্যান ভাঙাতো। তার এই নীরব একমুখী সাধনাকে মনে মনে প্রকৃতির হলাদিনী শক্তির সঙ্গে তুলনা করে কৌতুক বোধ করতাম। আমার বোনের গানের চেয়ে মধুর, পৃথিবীর সেরা নর্তকীর নাচের মুদ্রার চাইতে দৃষ্টিহারী অনুপম তুলনাবিহীন। বোধহয় এই সুন্দরের সাধনার বলেই দিনে দিনে সে সুন্দরী হয়ে উঠছে। আমার চোখে তার বোবাত্ব ঘুচে গেছে । প্রতিটি ভঙ্গিই এখন আমার মনে শ্রেষ্ঠ কবিতার আমেজ জাগিয়ে তোলে। তার এই প্রচেষ্টা ফাল্গুনের ফুল ফোঁটাবার জন্য শীতে সাধনার মতো গোপন এবং কঠিন। যখন-তখন তাকে আমি চুমো খাই। তার মুখমণ্ডলে একটা অসহায় ভাব জলছবির মতো আপনাআপনি ভেসে উঠে- দেখলে মনের ভেতর কি যে দুঃখস্রোত বয়ে যায়। মানুষ কেন বোবা হয়ে জন্মায়? বোবারও বা কথা বলার অত সাধ জাগে কেন?

একদিন মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে দেখি সে বিছানায় নেই। বাথরুমে খুঁজলাম, বারান্দা খুঁজলাম। এঘর ওঘর তালাশ করে, বোনের গানের প্র্যাকটিস করার ঘরে দেখি হারমোনিয়ামটাকে বাচ্চা শিশুর মতো কোলে নিয়ে বসে। খুব সন্তর্পণে একেকটা রীড টিপছে। একবার টিপে একবার ওদিক তাকায়। বড় ভয়, পাছে কেউ দেখে ফেলে। হারমোনিয়াম থেকে মিহি স্থূল আওয়াজ বের হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখে রঙের বদল ঘটছে। জানালার পাশ ধরে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ এ দৃশ্য দেখলাম। শেষে ঘরে ঢুকি। তার চোখে মুখে একটা অপরাধীর ভাব । হাত ধরতেই সে সঙ্গে সঙ্গে ঘরে চলে এল। এই আগুনের মতো প্রয়াসের বিফলতার কথা চিন্তা করে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বুকের ভেতর জমিয়ে ফেললাম।

আরো একদিন এমন হলো। আধারাতে উঠে দেখি সে বিছানায় নেই। বোনের ঘর, হেঁশেল, বাথরুম সবখানে তন্ন-তন্ন করে দেখি। আচমকা একটা সন্দেহের ছায়া মনের ভেতর দুলে উঠে। তবে কি- । কোথায় গেল সে?

নিঃশব্দে দরজা খুলে পেছনের পুকুরের দিকে যাই। দেখি সে ঘাটলার ওপর বসে। গলা দিয়ে বিনা প্রযত্নেই গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। তা’হলে প্রক্রিয়াটি এই অল্প সময়ের মধ্যে সে আত্মস্থ করে ফেলেছে। আকাশে থালার মতো একখানা চাঁদ জেগে। কুয়োতে গাছের বাকা নারকেল গাছের চিরল পাতাগুলো কাঁপছে। রাতের শিশিরে সিক্ত পাতাগুলো চাঁদের আলোর স্পর্শে চিকচিক জ্বলছে। এক ঝাঁক নক্ষত্র ফুলের মতো ফুটে আছে। প্রস্ফুটিত নক্ষত্রের ভারে প্রণত হয়ে পড়েছে আকাশ। শহর নীরব। মাঝে মাঝে মৃদু অতি মৃদু শব্দ শোনা যায়। মনে হয় গভীর ঘুমে চন্দ্রালোকিত নিশিরাতে পাশ ফিরে নিশ্বাস নিচ্ছে। এরই মধ্যে বাক্যপ্রার্থিনী রমণীর গলায় গোঁ গোঁ আওয়াজ রাতের ছন্দিত হৃৎপিণ্ডের মতো একটানা শব্দ করে যাচ্ছে। গোটা শহর মৃত-ঘুমন্ত । আমি গিয়ে সামনে হাজির হলাম। সে নজরও দিল না। আমিও যেন সারবন্দী নারকেল গাছের একটি। আপন মনে তার কাজ করে যায়। কি করে বুঝে গেছে তার এ কাজ আমি অপছন্দ করছিনে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে এই স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটার পাশে গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। এক সময় আওয়াজ আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে এল। মনে হলো প্রবল বেগে চলার পর একটি পাম্পিং মেশিন থামল। ঘাটলার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে অনেকক্ষণ কালা মাছের মতো শ্বাস টানল। আরো কিছুক্ষণ পর নিজেই আমার হাত ধরে ঘরে নিয়ে এল। আমার বড় ভাল লাগল। এমনি করে বিস্ময় পরিস্ফুরিত দৃষ্টিতে প্রতিদিন স্ত্রীকে দেখছিলাম। প্রতিদিনই মনে হয় নতুন। যতই দেখি আশ মেটে না। ইচ্ছে হয় আরো দেখি- আরো ।

একদিন ছোট বোনটি স্কুল থেকে এসে বলল, জানো দাদা এক ব্যাপার হয়ে গেছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিরে? পয়লা সে মুখ টিপে হাসল। তারপর বলল, স্কুল থেকে ফিরে দেখি ভাবী হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাইছে। তারপর মুখে আঁচল দিয়ে হাসি চাপতে অদৃশ্য হয়ে গেল। বোনটিকে সেদিন বড় ফাজিল এবং নিষ্ঠুর মনে হল। কয়েকদিন পরই বাজারে রাষ্ট্র হয়ে গেল আমার বোবা বৌ হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গায়। দাসী চাকরদেরও এ কথা বলাবলি করতে শুনলাম। লজ্জা শরমে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলাম। সে তো নিজে কথা বলে না, তাই লোকের কথায়ও তার কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমি তো কথা বলা সামাজিক জীব। লোকমুখের রটনা আমি অগ্রাহ্য করব কেমন করে! অথচ মুখ ফুটে কিছু বলব তার উপায় নেই। স্ত্রীর এই প্রচেষ্টাটি ছিল আমাদের দুজনেরই গোপন কঠিন সাধনা। সেটি প্রচার হয়ে গেছে। তাকে উলঙ্গ করে রাস্তায় ছেড়ে দিলেও বোধহয় এ রকম ব্যথা পেতাম না।

৭. দেশের পরিস্থিতি

দেশের পরিস্থিতি দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল। যেখানে দেশের গভীর ব্যথা, মার্শাল সাহেবের গোমড়ামুখো সৈন্যেরা সেখানেই কাঁটা বসানো বুট জুতোর লাথি মারে। প্রথম প্রথম গোটা দেশ আঘাতের বেদনায় গুঙিয়ে উঠত। ক্ষত থেকে রক্ত বের হতো। আওয়াজে যন্ত্রণা ফুটে থাকত। প্রায় এক যুগ ধরে লাথি খেয়ে ব্যথা-জর্জর অংশ আঁটো হয়ে উঠেছে। এখন প্রতিবাদ করার জন্য মুখিয়ে উঠছে। যন্ত্রণা, বেদনা এবং দুঃখের কারখানা থেকেই প্রতিরোধের শাসানো আওয়াজ ফেটে ফেটে পড়ছে। তার ধার যেমন তীক্ষ্ণ, ভারও তেমনি প্রচণ্ড। সারাদেশে স্লোগানের ঢল নেমেছে। পথে-ঘাটে মানুষ- কেবল মানুষ। চন্দ্রকোটলের জোয়ারের জলের মতো বইছে মানুষ। বাংলাদেশের রাস্তাগুলো নদী হয়ে গেছে। তাদের চোখে আগুন, বুকে জ্বালা, কণ্ঠে আওয়াজ, হাতে লাঠি। রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে স্লোগানের ধ্বনি বাংলাদেশের আকাশমণ্ডলের কোটি কোটি বর্শাফলার মতো ঝিকিমিকি খেলা করে।

শেখ মুজিব জেলে। আগরতলা মামলার বিচার চলছে। এখানে ওখানে বোমা ফুটছে, মিটিং চলছে। ঝাঁকে-ঝাঁকে মিছিল বেরিয়ে আসে। গুলি চলে। লাল তাজা খুনে শহরের রাজপথ রঞ্জিত হয়। সরকারী পত্রিকার অফিসগুলোতে হুতাশনের মতো প্রলয়করী অগ্নিশিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠে। প্রতিটি সকালেই খবরের কাগজের পাতা উল্টোলেই টের পাওয়া যায় ভয়ংকর কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। গতিকটি সুবিধের নয় বলে মনে হলো। আইয়ুব খানের সিংহাসন ঝড়ে পাওয়া নায়ের মতো টলছে। শক্ত মানুষ ফিল্ড মার্শালের জন্য চিন্তিত হলাম। মার্শাল যদি যান আমার শ্বশুরও তো চিৎপটাং হবেন। যাদের করুণার বদৌলতে আমি পাড়া-গাঁয়ের ধূলিশয্যা থেকে এই বড় কর্তার আসনে উঠে এসেছি, তাঁরা সকলে যাবেন অথচ আমি একা থাকব সে কেমন করে হয়। শ্বশুরের জন্যে চিন্তিত হলাম। কথাটি পুরোপুরি সত্যি নয়। আসলে আমার মনেই দুশ্চিন্তা শত শত হুল ফোঁটাচ্ছিল।

যুগের হাওয়ার প্রচণ্ড একটা অস্থিরতা। কোথাও শান্তি নেই। বাতাসে বাতাসে মোচড় খেয়ে ঘূর্ণি হাওয়া যেমন বেগ সঞ্চয় করে, তেমনি মানুষের ক্ষোভ রুদ্ধ আক্রোশে ফুলে ফুলে একটা সৃষ্টিনাশা ঝড়ের আকার ধারণ করছিল। যেখানেই যাই- দেখি তোলপাড় লণ্ডভণ্ড অবস্থা। বিপদ ঘনিয়ে এলেই আমি কোনো বিষয়ে স্থিরভাবে চিন্তা করতে পারিনে। বলির পাঁঠার মতো নির্বিকার দাঁড়িয়ে সর্বনাশের প্রতীক্ষা করি। বাইরের দিক থেকে আমার মানসিক অবস্থা অনুমান করার উপায় নেই। আমার চিন্তা চাঞ্চল্যহীন নির্বিকারত্বকেই লোকে ক্লাসিক স্থিরতা বলে মনে করে। এত বেশি শুনেছি যে কথাটা নিজেও প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম।

চুপচাপ বসে থাকি। অফিসে যাওয়া আসার পথে পারতপক্ষে ডাইনে বাঁয়ে তাকাইনে। রাতের অন্ধকারে বেবাক রাস্তায় কারা সব ভয়ংকর পোস্টার সেঁটে রাখে। পোস্টারের বুকে সর্বনাশের লাল সংকেত জ্বলজ্বল করে। তাই ভাবুকের মতো আকাশের দিকে তাকাই। সেখানেও মাঝে মাঝে দেখতে পাই, মেঘে মেঘে ঘষা লেগে বিজলীর বাঁকা ছুরি ঝলসে উঠে। বজ্র ফেটে পড়ে। প্রকৃতির রাজ্যের নিটোল শান্তি ভাঙ্গার অপরাধে আকাশের দেবতাকে অভিযুক্ত করি। পত্রিকা পড়া ছেড়ে দিয়েছি। পত্রিকাঅলাদের আমি বিশ্বাস করিনে। কি করে করব। আমার শ্বশুর সাহেব যে পত্রিকাটিকে তার প্রভাব খাঁটিয়ে ব্যাংক থেকে লোন পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, দেখলাম সে ব্যাটাই আমার শ্বশুরের দলের বিরুদ্ধে তেজালো লেখা লিখছে। বাজারের কসবীকে বিশ্বেস করা যায়, কিন্তু পত্রিকাঅলাদের নয়।

আগে অল্পস্বল্প এটাসেটা পড়াশোনা করতাম। এখন সব ছেড়ে দিয়েছি। উসকোখুসকো লাগলে নবযুগ ডাইরেকটরী পঞ্জিকার পাতা উল্টাই। রাশি বর্ষ ফল দেখি। মেহ-প্রমেহ ইত্যাদি যৌন রোগের বিজ্ঞাপনে চোখ বুলোই। তাছাড়া আর কি। করার ছিল আমার। দেখতে পাচ্ছিলাম চারিদিকে সব দুমড়েমুচড়ে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আমার মনের গহনে তখনো একটা নিশ্চিন্তি বোধ নোঙরের মতো অটুট ছিল।

আমি জানতাম আমার একটা বৌ আছে। ছায়াময় উদ্যানকুঞ্জের মতো সে বৌয়ের একখানা স্নেহপ্রবণ মন আছে। এই বিশ্বসংসারে একমাত্র আমিই সে মনের খবর জানি। সে তো বোবা। মানুষের জয়-পরাজয় উত্থান-পতনে তার কিছু যায় আসে না। সুতরাং মানুষও সে মনের কোনো খবর জানত না। সময়ে অসময়ে জাগতিক অশান্তি অস্থিরতা আমাতে ভর করলে, মরুভূমির পথিক যেমন পান্থপাদপের ছায়ায় এসে দাঁড়ায়, তেমনি ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াব ভেবেছিলাম। আমার সুখ-দুঃখ সব কিছুর ওপর তার মনের অনাবিল শান্তি প্রসন্ন মাধুর্যে ভরিয়ে দেবে। কল্পনা করে সুখ, আমিও কল্পনা করেছিলাম।

৮. স্লোগানের আওয়াজ

বহুরূপী – কিশোর উপন্যাস – শাহরিয়ার কবির

০১. শিংটোলার ছআনি দশআনি

শিংটোলার জমিদারদের নিকুঞ্জ-কুটিরের মতো বড় আর পুরোনো বাড়ি গোটা তল্লাটে দ্বিতীয়টি নেই। সেই কোম্পানির আমলের বানানো। বংশের আদিপুরুষ নিকুঞ্জ নারায়ণ রায়ের নামে এ-বাড়ি বানিয়েছিলেন তার অধস্তন চতুর্থ পুরুষ কালী নারায়ণ রায়। জয়পুর থেকে মার্বেল আনানো হয়েছিলো, কড়ি-বরগা আর দরজা-জানালার কাঠ এসেছিলো বার্মা থেকে, ঝাড়লণ্ঠন এসেছিলো ভেনিস থেকে–সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড।

পাড়ার লোকেরা অবশ্য অনেক আজেবাজে কথা বলতো। নাকি নিকুঞ্জ নারায়ণ রায়ের বংশে ফাঁসুড়ের রক্ত আছে। যদিও কালী নারায়ণ বলতেন ইদ্রাকপুরে তাদের জমিদারি কেনা হয়েছিলো স্বপ্নে পাওয়া গুপ্তধনের টাকায়, অনেকে সেসব কথা বিশ্বাসও করতো, তবে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা কোনোকালেই কম ছিলো না।

অত জাঁকজমক করে বাড়ি বানানো, লক্ষ্ণৌ থেকে বাইজি আর গানের ওস্তাদ আনিয়ে নবাবদের সঙ্গে টক্কর দেয়া–সবকিছু তিন পুরুষেই কপুরের মতো উবে গেলো। কালী নারায়ণের চতুর্থ পুরুষে এসে শরিকদের ভেতর সম্পত্তি ভাগ হলো। দেনার দায়ে বসতবাড়ি ছাড়া বাকি সবই নিলামে উঠলো। নিকুঞ্জ কুটিরের দশাও একরকম না থাকার মতোই। কোথায় গেলো ভেনিসের ঝাড়বাতি, দরজা-জানালার বর্মী-নক্সা আর দেয়ালের চকমিলান কারুকাজ! সিংহদরজার থামের ওপর বসানো সিংহ দুটোর দশাও তেমনি। একটার লেজ উড়ে গেলো কবে কেউ টেরও পেলো না, আরেকটার সামনের এক ঠ্যাং ভাঙা–দুটোরই আস্তর খসে ভেতরের সুরকি বেরিয়ে গেছে।

ইংরেজদের রাজত্ব শেষ হওয়ার পর ইতুর বড়দাদু ঠিক করলেন কলকাতা থেকে ঢাকা চলে আসবেন। ওঁদের ওয়েলেসলি স্ট্রিটের বাড়িটা প্রথমে বিক্রি করার জন্য দালাল ধরলেন। সে-সময় বাড়ি কেনার গরজ নেই কারো। উল্টোপাল্টা দাম বলার জন্য তিন তিনটে দালাল ইতুর বড়দাদুর লাঠিপেটা খেয়ে পালালো। ওঁর সঙ্গে স্কুলে পড়তেন ঢাকার নিকুঞ্জ কুটিরের ছআনি শরিকদের এক ছেলে। পরে বাপ মরার পর নিজেই মালিক হয়েছেন, তবে ঢাকার বাড়ির খোঁজখবর সামান্যই রাখতেন। এক বিটকেল নায়েব ছিলো, বাড়িতে সে ভাড়াটে বসিয়েছিলো। বছরে একবার এসে কিছু টাকা দিয়ে যেতো, বারো মাসের ভাড়া যা হওয়ার কথা তার অর্ধেকেরও কম। বলে নিকুঞ্জ কুটির নাকি ভুতুড়ে বাড়ি, বেশিদিন কোনো ভাড়াটে থাকে না, ন্যায্য ভাড়াও পাওয়া যায় না।

বাড়ি বিক্রির খবর শুনে ছআনি শরিক একদিন নিজে এলেন ইতুর বড়দাদুর সঙ্গে দেখা করতে। ভূতের কথা গোপন করে বন্ধুকে বললেন, যখন ঢাকা যাবে। ঠিক করেছো, তখন আমার বাড়িটা গিয়ে একদিন দেখে এসো। তোমার পছন্দ হলে আমি ওটার সঙ্গে তোমার এ বাড়ি বদল করতে পারি।

কথাটা ইতুর বড়দাদুর মনে ধরলো। শিংটোলার নিকুঞ্জ কুটিরের ছআনি অংশ দেখে তাঁর পছন্দও হলো। বাড়ি অনেক পুরোনো বটে, তিরিশ-চল্লিশ বছরে কোনো মিস্তিরির হাত লাগে নি, রঙও কেউ করে নি, তবে জায়গা অনেকখানি। পেছনের জমিতে আম, কাঁঠাল, নারকেল আর লিচুর গাছ আছে বেশ কয়েকটা। দেরি করলে যদি হাতছাড়া হয়ে যায়–কলকাতায় এসেই কাগজপত্র সব পাকা করে ফেললেন। ছআনি শরিকও ভূতুড়ে বাড়ির হিল্লে করতে পেরে ভারি খুশি।

শিংটোলার বাড়িতে আসার অনেক পরে ইতুদের জন্ম হয়েছে। বড়দাদু এ-বাড়িতে এসেই রঙ মেরামত সব করেছিলেন, তবু পুরোনো চেহারাটা রয়েই গেছে। পাড়ার লোকদের কাছে নিকুঞ্জ নারায়ণের বংশের সব কীর্তি-কাহিনী ইতুরা জন্মের পর থেকেই শুনছে। ইতুর দিদা ভীষণ কড়া মানুষ। বলেন, ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি তো, তাই এ-বাড়ি সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলে। আসার পর থেকে বছরে কটা মিলাদ পড়াই হিসেব করেছিস? আমি তো চোখ বুজলেই দেখতে পাই সারা বাড়িতে ফেরেশতারা গিজগিজ করছে।

ইতুরা চোখ বুঝে কখনো ফেরেশতা দেখে নি ঠিক, তবে খারাপ কিছুও দেখে নি। দিদার কথা শুনে একদিন মিতু বললো, বাড়িতে তো আমরাই গিজগিজ করি দিদা। তুমি আমাদের কথা বলছো?

বড়রা সবাই দিদাকে আজরাইলের মতো ভয় পেলেও ছোটরা সবসময় ওঁর আহ্লাদ পেয়ে এসেছে। মিতুর কথায় দিদা এতটুকু রাগলেন না। মুখ টিপে হেসে বললেন, তোরা সব ইবলিশের ঝাড়। বাচ্চা থাকতে সবাই ফেরেশতা থাকে, তোরাও ছিলি একসময় এখন সব আস্ত শয়তান হয়েছিস।

ইতুর তিন দাদুর ছেলেমেয়ে–ওদের বাবা, কাকা, জ্যাঠা আর ফুপিরা মিলে আঠারো ভাইবোন। সবাই অবশ্য এ-বাড়িতে থাকে না। বড় দাদুর এক ছেলে রাঙা জেঠু অনেক আগে–সেই ইংরেজ আমলে ভূপালে গিয়ে আস্তানা গেড়েছেন, দেশে ফেরার কথা মুখেও আনেন না। বিয়ে করেছেন সেখানকার এক নামী বংশে। রাঙা জেঠিমার কথা ইতুরা কেবল বড়দের মুখে শুনেছে, চোখে দেখে নি। ওঁদের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করতে গিয়েছিলো কেউ বিলেতে, কেউ আমেরিকায়। পড়ার পাট শেষ করে কেউ দেশে ফেরে নি। ভূপালে রাঙা জেঠু আর জেঠিমা বাড়িতে একগাদা কুকুর আর বেড়াল পুষ্যি নিয়ে দিব্বি আরামে দিন কাটাচ্ছেন। ইতুদের আরেক কাকা থাকেন রেঙ্গুনে। তিনিও সেখানে বর্মী বিয়ে করে থিতু হয়ে বসেছেন। এ-বাড়িতে ইতুরা কাকাতো, জ্যাঠাতো ভাইবোন মিলে ডজনখানেকের মতো। ক্লাস সিক্স-এ পড়া ইতুরই বয়সী এক গণ্ডা ভাই রয়েছে।

নিকুঞ্জ কুটিরের দশআনি শরিক ইংরেজ আমলেই কলকাতায় থাকতেন। তবে ছআনির মতো সুবিধের মক্কেল না পাওয়াতে তার অংশটুকু বহুদিন খালি পড়েছিল। ইতুরা সেখানে লুকোচুরি খেলতো। বুড়ো পাহারাওয়ালা বনমালী ওদের কিছুই বলতো না। তবে গত একমাস ধরে ও-বাড়িতে ঘষামাজার কাজ শুরু হয়েছে। সেই থেকে ওদেরও সেদিকে যাওয়া বন্ধ। কারা নাকি কিনেছে ও বাড়ি।

রোববার সকালে ইতুদের বাড়ির বাসি কাপড় নিতে এসে গিরিবালা ধোপানি দিদাকে বললো, আইজকা একটু কম দিয়েন বড়মা। আইজ ম্যালা কাপড় ঘোয়ন লাগবো।

গিরিবালার কথা শুনে ভারি অবাক হলেন ইতুর দিদা। প্রতি রোববার কাপড় নিতে এসে সবসময় ও বলে, বড়বাড়ির কাপড় বেশি না ওইলে মাইনষে কি কয় বড়মা! আঠারো খানই দিলেন? কুড়ি পুরাইয়া দ্যান না গো বড় মা! কাপড় যাই দেয়া হোক গিরিবালা সবসময় বেশি ধুতে চায়। নাকি তার পোষায় না।

ইতুর দিদা জানতে চাইলেন, আজ যে বড় কম নিতে চাইছিস গিরি! আর কোন রইসের কাপড় ধুচ্ছিস শুনি?

দোক্তাওয়ালা বড় একখিলি পান মুখে দিয়ে বুড়ি গিরিবালা বললো, আপনেরা অখনও হোনেন নাই বড়মা? দশআনি বাড়িত নতুন ভাড়াইটা আইছে। ক্যামন মানুষ আইলো দ্যাখতে গেছিলাম কাইল রাইতে। পয়লা দিনই দশআনি গিন্নিমা পঞ্চাশখানা ধরায়া দিছে।

ওমা কখন এল, দেখি নি তো! ইতুর মেজো জেঠিমা শুনে অবাক হলেন–কারা এসেছে গো গিরিবালা?

দিদা গম্ভীর হয়ে মেজো জেঠিকে বললেন, আমার কথার মাঝখানে কথা বলো কেন? আফসারউদ্দিনের ওঠার সময় হয়ে গেছে। যাও, ওর চা দিয়ে এসো।

মেজো জেঠিমা জিভ কামড়ে সরে গেলেন সামনে থেকে। দিদা বললেন, ওদের কর্তা কী করে শুনেছিস?

গিরিবালা ঢক করে পানের পিক গিলে বললো, তা কইবার পারুম না। তয় গিন্নিমা যে কী সোন্দর দেখতে! এত বয়স হইছে–মুখখানা দুম্না পিতিমার মতোন। বাড়ির বউ-ঝিরাও পরির মতোন। পোলারাও কম সোন্দর না বড়মা।

দিদার ভারি দুঃখ এ-বাড়িতে তাঁর মতো দুধে আলতায় গায়ের রঙ আর কারো নয়। মেয়েগুলো বেশিরভাগই শ্যামলা, বড় নাতনীটি যা কিছুটা ফর্শা। আর ছেলেগুলোকে কালোই বলতে হয়। দশআনির নতুন ভাড়াটেদের মেয়েরা পরির মতো শুনে তিনি খুশি হলেন না। তাঁর সাবালক নাতি রয়েছে গোটা চারেক, দুই নাতনীর বিয়ের বয়স হয়েছে। বড়টির জন্য ঘটকও লাগিয়েছেন। অপ্রসন্ন গলায় দিদা গিরিবালাকে বললেন, ও-বাড়ির কাপড় ধুয়ে যদি তোর সময় না থাকে তাহলে থাক, আমি হরিমতিকে খবর দিই। আজকাল তোর থোয়াও ঠিক হয় না।

গিরিবালা বললো, এইটা কেমুন কতা বড়মা! আপনেগো কাপড় ধুইবার পারুম না–এ-কতা কইলে আমার মুখে বিলাই মুতবো না! আপনে আমার কম উস্কার করছেন বড়মা! দরকার ওইলে ওই বাড়ির কাপড় আর ধুমু না।

গিরিবালা চলে যাওয়ার মিনিট কুড়ি পরে ছআনি শরিকের চিলেকোঠার ঘরে দেখা গেল এ-বাড়ির ইতু, মিতু, রন্টু, ঝন্টু আর ছোটনকে। পাড়ার সবাই ওদেরকে পঞ্চপাণ্ডব বলে। দিদার কাছে মহাভারতের গল্প শুনে নিজেরা সাইজমতো নাম মিলিয়ে নিয়েছে। সবার বড় মিটমিটে পাজি ছোটন হল যুধিষ্ঠির। গায়ে-গতরে বড়সড় মিতু হল ভীম, সবচেয়ে বুদ্ধিমান ইতু বলেছে সে নাকি অর্জুন আর সেজকাকার জমজ পাজি দুটো হল নকল সহদেব।

গিরিবালার অস্পষ্ট খবরের জন্য বসে থাকে নি পঞ্চ পাণ।ডব। মিতুকে নিয়ে নিজেদের কাঁচাপাকা কুল পাড়ার সুবাদে দশআনি শরিক থেকে সকালেই ঘুরে এসেছে ছোটন। ছআনির ঝাকড়া নারকেলি কুলগাছের অর্ধেক পড়েছে দশআনির বাগানে। পাড়তে হলে ওদিক থেকেই সুবিধে। পাঁচিলের উপর দাঁড়িয়ে মিতু তুমুল জোরে ডাল ঝাঁকাচ্ছিলো আর ছোটন টপাটপ করে ঝরেপড়া কুল কুড়োচ্ছিলো, তখনই দেখলো ওদের কাছাকাছি বয়সী ফ্ৰকপরা দুটি মেয়ে সদ্য চুনকাম করা দশআনি বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। বয়সে অল্প ঘোট মেয়েটা দুপাশে দুটো বেণী ঝোলানো, কাছে এসে রিনরিনে গলায় বললো, তোমরা আমাদের গাছের বরই পাড়ছ কেন? এক্ষুণি চলে যাও এখান থেকে।

সাদা রিবন দিয়ে পনিটেল চুল বাঁধা মেয়েটা ওকে চাপা গলায় বলল, এই সিমকি কী অসভ্যতা হচ্ছে, ওটা আমাদের গাছ নাকি! ওদের গাছেরটা ওরা

পাড়ছে, তুই চেঁচাচ্ছিস কেন?

সিমকি অবাক হয়ে বলল, বারে ছোটপা, তুই-ই তো বললি ওদের সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য এভাবে ধমক দিতে! এখন যে বড় অসভ্যতা বলছিস?

সিমকি এসে যেভাবে ওকে ধমক দিয়ে কথা বলছিলো, ছোটন ভেবেছিলো শক্ত একটা জবাব দেবে। ওর পরের কথা শুনে হাসি চেপে আবার কুল কুড়োতে লাগলো। এক ফাঁকে আড়চোখে দেখলো সিমকির কথা শুনে পনিটেল-এর ফর্শা মুখ লাল হয়ে গেছে। আরো চাপা গলায় ও সিমকিকে বললো, তুই একটা হদ্দ বোকা মেয়ে সিমকি, ওদের চলে যেতে বলছিস কেন?

সিমকি বুঝে উঠতে পারলো না ও কী বলবে। অবাক হয়ে নিজের বোনকে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর কাছে এসে ছোটনকে বললো, এই তোমরা আমাদের সঙ্গে ভাব করবে?

ছোটন হাসি চেপে গম্ভীর হওয়ার ভান করে বলল, তোমরা কারা?

বারে, দেখ নি বুঝি, আমরা যে কাল সন্ধ্যায় এলাম! এটা তো আমাদের বাড়ি। তোমার নাম কী?

আমাদের দুটো নাম আছে, কোটা বলবো?

তোমার যেটা খুশি বলো।

আমার নাম যুধিষ্ঠির আর ওর নাম ভীম।

নাম শুনে দুই বোন হেসে গড়িয়ে পড়লো। হাসতে হাসতে পনিটেল বললো, আমাদের আগের বাড়িতে যে গোয়ালাটা দুধ দিতো ওর নাম ছিলো যুধিষ্ঠির আর

ভীম আমাদের জুতো মেরামত করতো।

মিতু রেগে গিয়ে বললো, মহাভারত পড়লে এমন অসভ্য কথা বলতে না। লোকে আমাদের পঞ্চপাণ্ডব বলে, সেজন্যে ওসব নাম বলা। আমার ডাক নাম। মিতু, ওর নাম ছোটন।

সিমকি বললো, আমার নাম–

জানি, সিমকি। বাধা দিয়ে মিতু বললো, তোমার ছোটপার নাম কী নিমকি?

সিমকি হেসে বললো, না, ওর নাম রিমকি। আমার একটা ছোট ভাই আছে। ওর নাম নিমকি!

খেতে কেমন? গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করলো ছোটন।

কাছে যেও। হাসতে হাসতে রিমকি বললো, কামড়ে দাঁত বসিয়ে দেবে। নতুন চারটে দাঁত গজিয়েছে। যা পায় তাই কামড়ায়।

মিতু বললো, ভাব করতে হলে আমাদের আরো তিনজন আছে। সবার সঙ্গে করতে হবে।

ঠিক আছে। সিমকি বললো, আমাদেরও দুটো মামাতো ভাই আছে–রাঙা আর পিটু। তোমরা দল ভারি করতে চাইলে আমরাও করতে পারি। জানো না তো রাঙার গায়ে কী জোর! রোজ দুবেলা জিমনাসিয়ামে গিয়ে ব্যায়াম করে।

মিতু কাষ্ঠ হেসে বললো, দেখা যাবে, পাঞ্জায় কে জেতে!

ছোটন জানতে চাইলো, এখানে আসার আগে তোমরা কোথায় ছিলে?

রিমকি বললো, নবরায় লেন-এ। এর চেয়ে বড় বাড়ি ছিল ওটা।

সিমকি বললো, ওটা ভাড়া বাড়ি ছিলো। এটা আমাদের নিজেদের।

রিমকি বললো ওরা কোন্ স্কুলে পড়ে, ছুটির দিনে কত মজা করে–এইসব। একটু পরে বাড়ির ভেতর থেকে ইতুদের কাজের ঝি দুখির মার মতো একজন কার মা এসে রিমকি-সিমকিকে ডেকে নিয়ে গেল।

ছোটন আর মিতু উত্তেজিত হয়ে ঘরে ফিরে সবাইকে কুল-পাড়া অভিযানের ঘটনা জানালো। ইতু সব শুনে গম্ভীর হয়ে বললো, গায়ে পড়ে ভাব জমাতে চাইছে–ভেবে দেখতে হবে অন্য কোনো মতলব আছে কিনা।

রন্টু বললো, তুই সব কিছুতেই সন্দ করিস। দুটো মেয়ে ভাব জমাতে চেয়েছে, এতে মতলবের কী হল?

ঝন্টু বললো, মেয়ে দুটো দেখতে কেমন রে!

মিতু উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো, একেবারে পরির মতো!

আহ্ আস্তে বল্! চাপা গলায় ধমক দিল ছোটন। সিঁড়িতে শব্দ শুনছিস? নির্ঘাত ছোড়দি আসছে।

ক্লাস টেন-এ উঠেই ছোড়দি নিজেকে বড়দি-মেজদির মতো বড় ভাবতে শুরু করেছে। সুযোগ পেলেই ছোট ভাইগুলোর ওপর পণ্ডিতি ফলায়। ছোটন ঠিকই ভেবেছিলো। ছোড়দি এসে বললো, স্কুল ছুটি বলে লেখাপড়া সব শিকেয় তুলে এখানে বসে আড্ডা মারা হচ্ছে বুঝি!

ছোটন বিরক্ত হয়ে বললো, তোর সামনে পরীক্ষা বলে এখনই আবোল-তাবোল বকা শুরু করেছিস! ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে জানিস না বুঝি! নতুন ক্লাসে না-ওঠা পর্যন্ত কিসের পড়া শুনি?

গাছ থেকে পড়া হতে পারে। বলল মিতু।

না আকাশ থেকে পড়া। ছোড়দির কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়েছি। ফোড়ন কাটলো ইতু।

রেজাল্ট বেরোবার পর পিঠে যখন বড় জেঠুর বেতের বাড়ি পড়বে তখন বুঝবে পড়া কাকে বলে। পাকামো না করে নিচে যাও। দিদা ছোটনকে বাজার করতে ডেকেছেন।

বাজার করতে ছোটনের আপত্তি নেই। দুআনা চারআনা যা বাঁচে সেটা ওর। তবে চারআনার বেশি বাঁচলে দিদা পুরোটাই নিয়ে নেন। সেজন্যে যা-ই বাজার করুক ছোটন হুঁশিয়ার হয়ে গেছে। এখন ও চারআনার বেশি বাঁচায় না।

দিদা ক্লাস নাইনের ছোটনের হাতে বাজারের ফর্দ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, চার আনা বাঁচাবার জন্য সেদিনের মতো আবার পচা বেগুন আনিস না!

ছোড়দি ফোড়ন কাটলো, চারআনা না আটআনা বাঁচায় তুমি কি বাজারে গিয়ে দেখেছো দিদা!

বেআক্কেলে কথা বলবে না হোসেনেআরা। আমি কোন্ আহ্লাদে বাজারে গিয়ে দেখতে যাবো?

বড়দের সবাইকে দিদা পোষাকি নামে ডাকেন। যখন থেকে তিনি কাউকে পোষাকি নামে ডাকা শুরু করবেন, তখন থেকে বুঝতে হবে তারা বড় হয়ে গেছে, কথা বলতে হবে হিসেব করে। অল্প কদিন ধরে ছোড়দিকে দিদা পোষাকি নামে ডাকা আরম্ভ করেছেন।

বাজারে যাওয়ার সময় ছোটন মিতুকে সঙ্গে নিয়ে যায় ব্যাগ বয়ে আনার জন্য। এর জন্য ওকে দুপয়সার পেয়ারা নয়তো অন্যকিছু কিনে দিতে হয়। ছোটরা বাজারে যাওয়ার পর ঝন্টু ইতুকে বললো, যাবি নাকি নারকেলি পাড়তে?

ইতু ভুরু কুঁচকে বললো, ও-বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ভাব জমানোর জন্য বুঝি তর সইছে না!

তোর সবকিছুতে বাড়াবাড়ি! এই বলে নিরীহ রন্টুকে সঙ্গে নিয়ে ঝন্টু দশআনি বাড়িতে গেল কুল পাড়তে।

ইতু রহস্যলহরী সিরিজের নতুন বইটা নিয়ে চিলেকোঠার ঘরে পড়তে বসলো। ওদের ক্লাসের বিজনের কাছ থেকে এনেছে, অর্ধেকের বেশি পড়াও হয়ে গেছে; পরশু ফেরত দিতে হবে। কয়েক পাতা পড়ে ওর মনে হল ঝন্টুর সঙ্গে যাওয়া উচিত ছিলো। আরো দুপাতা পর নায়ক যখন পাহাড়ের চূড়ায় ভিলেনের সঙ্গে লড়তে গিয়ে হঠাৎ ছিটকে পড়েছে কিনারে, কোনোরকমে একহাত দিয়ে পাথরের কার্নিশ ধরে ঝুলছে ছহাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে, তখন ইতুর মনে হলো ঝন্টুরা কী করছে দেখা দরকার। বই রেখে সে উঠে পড়লো।

ছাদের ওপর থেকে দশআনি বাড়ির বাগান পুরোটা দেখা যায়। ইতু তাকিয়ে দেখলো কুলগাছের পাশে ঘরের ওপর বসে মেয়ে দুটোর সঙ্গে জমিয়ে গল্প করছে ঝন্টুরা। হাঁদারাম রন্টুটা অসভ্যের মতো হাসছেও। রাগে ইতুর গা জ্বলে গেলো।

.

০২. দশআনির ওপর দিদার রাগ

ছোটন আর মিতু বাজারে যাওয়ার জন্য সদর দরজা দিয়ে বেরোতেই সামনে পড়ল দশআনির রিমকিদের বড়ভাই। ছোটনদের মেজদার বয়সী হবে, চব্বিশ-পঁচিশের কাছাকাছি, দেখতে মেজদার চেয়ে অনেক সুন্দর, দেব সাহিত্য কুটিরের বইয়ের ছবিতে যেমন দেখা যায়। চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা থাকাতে একটু বেশি ভারিক্কি মনে হচ্ছিলো, পায়জামা-পাঞ্জাবিপরা, হাতে বাজারের থলে।

ছোটনদের দেখে অমায়িক হেসে মার্জিত গলায় যুবকটি বললো, তোমরা বুঝি এ-বাড়িতে থাকো! আমরা কাল এসেছি তোমাদের যমজ বাড়িতে।

গম্ভীর হয়ে ছোটন বললো, জানি। সকালে রিমকিদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। আপনি তখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন।

তাই বুঝি! কই তখন তো আমার সঙ্গে পরিচয় করতে এলে না? মিতু ফিক করে হেসে বললো, পাড়ায় যারা নতুন আসে তারাই আগে এসে পুরোনোদের সঙ্গে পরিচয় করে!

বাব্বা, এতোও জানো! ঠিক আছে, পরিচয় দিচ্ছি। আমার নাম সাইফ হায়দার চৌধুরী। দুবছর ধরে মেডিকেল কলেজে পড়াই। তিন ভাই চার বোনের ভেতর আমি সবার বড়! এই বলে রিমকির ভাই ছোটনদের দিকে হাত বাড়ালো।

ছোটনরা ওর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিজেদের পরিচয় দিলো। বললো, আপনাকে আমরা সাইফ ভাই বলবো।

সাইফ মৃদু হেসে বললো, তোমাদের খুশি। বাজারে যাচ্ছ নিশ্চয়? চলো একসঙ্গে যাই।

ছোটন বললো, আপনি কি সত্যি সত্যি ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ান?

হ্যাঁ।

আমাদের বড়দি মেডিকেলে পড়ে।

তাই নাকি! কোন্ ইয়ারে?

ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। রেজাল্ট এখনো দেয় নি।

কী নাম বলতো?

জাহানারা তরফদার।

জাহানারা তোমাদের বড়দি? খুব ভালো করেই চিনি। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে।

সাইফের কথা শুনে ছোটন আর মিতু একে অপরের দিকে তাকালো। বাড়িতে বড়দির ধমকের ভয়ে ওরা পালিয়ে বাঁচে না, আর তার টিচার বলছে লক্ষ্মী মেয়ে!

কথাটা বলেই ফেললো মিতু–বড়দি কিন্তু খুব রাগী।

তাই নাকি! সাইফ হেসে বললো, জাহানারাকে কিন্তু কখনো আমার রাগী মনে হয় নি। লেখাপড়ার ব্যাপারে ও খুব সিরিয়াস।

বড়দি রোজ ছ-সাত ঘণ্টা পড়ে। লেখাপড়ার ব্যাপারে সিরিয়াস–এটাও মিথ্যে নয়, তবে লক্ষ্মী মেয়ে কথাটা ওকে মানায় না।

সাইফ ওদের বাড়ির কথা আরো জানতে চাইলো। কে কী করে, আগে কোথায় ছিলো, বড় হয়ে ওরা কে কী হবে এসব মামুলি কথা। সাইফের সঙ্গে বাজার করতে গিয়ে ছোটনদের ভালো-ভালো জিনিস কিনতে হলো। চারআনা বাঁচাবার কথা আর মনে থাকলো না। বাজারে চমৎকার ভঁসা পেয়ারা উঠেছিলো। মিতু কেনার কথা বলতে ভুলে গেলো। সাইফের সঙ্গে কথা বলে ওরা দুজন অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ওর মহাভক্ত হয়ে গেলো।

বাড়ি ফেরার পর বাজার দেখে দিদা ভারি খুশি। বললেন, বাজারে আজ এত ভালো তরকারি উঠেছে কেন রে ছোঁড়ারা? নিশ্চয় কোনো রহস্য আছে?

মিতু বলল, আজ যে সাইফ ভাই আমাদের সঙ্গে বাজার করেছেন!

সাইফ ভাই আবার কে? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন দিদা।

দশআনিতে কাল যারা এসেছে। জানো দিদা, সাইফ ভাই বড়দিকে ভালো করে চেনে! বড়দিদের কলেজে পড়ায়।

দিদা ধমক দিয়ে বললেন, কলেজে পড়ায় বলতে হয় না, পড়ান বলবে। আদব-কায়দা সব কি শিকেয় উঠেছে?

ভালো বাজার করার পরও মিতুর জন্য দিদার ধমক খেয়ে ছোটনের মন খারাপ হয়ে গেলো। দিদারও রাগের কারণ ছিলো। সকালে গিরিবালা ধোপানি ও-বাড়ির লোকদের সম্পর্কে যে-সব কথা বলেছে, শোনার পর থেকে দিদার মন ভালো নয়।

ছোটন আর মিতু ওপরে ওদের চিলেকোঠার ঘরে এসে দেখে ইতু একা খাটে শুয়ে আছে। পাশে অযত্নে খোলা পড়ে আছে রহস্যলহরী সিরিজের বই। ছোটন জানতে চাইলো, রন্টু ঝন্টু কোথায় গেছে?

ইতু মুখ ভার করে বললো, তোমাদের নতুন পাওয়া বান্ধবীদের সঙ্গে বসে গল্প করছে।

ওরা কি ডেকেছিলো?

ডাকলে তো কথা ছিলো না। বেহায়ার মতো নিজেরা গেছে কথা বলতে! মেয়ে দুটো ভাববে আমরা কী হ্যাংলা গায়ে পড়ে আলাপ করতে চাচ্ছি।

তা কেন ভাববে? মিতু বুঝিয়ে বললো, ওরা কখনো আমাদের হ্যাংলা ভাববে না। বন্ধুত্বের জন্য ওরা আমাদের সব শর্ত মেনে নিয়েছে। তুই যাস নি কেন?

গায়ে পড়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না।

জানিস, বাজারে যাওয়ার পথে এক কাণ্ড হয়েছে। এই বলে সাইফের সঙ্গে পরিচয়ের কথা ইতুকে সব জানালো ছোটন। বয়সে একবছরের ছোট হলেও ইতুর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় ও বুঝি স্কুল পেরিয়ে গেছে।

সাইফের কথা শুনে ইতু উঠে বসলো। বললো, বড়দিকে বলবি না?

মিতু বললো, ধমক খাবে কে, তুই?

আমার মনে হয় না বড়দি ধমক দেবে। বিজ্ঞের মতো বলল ইতু।

ছোটন বলল, চল তাহলে। আমার তো মনে হয় বড়দির ধমক থেকে বাঁচার একটা ব্যবস্থা আমরা করতে যাচ্ছি। বড়দি উল্টোপাল্টা কিছু বললে সাইফ ভাইকে বলে দেব না!

ইতুদের বড়দি ওর ঘরে বসে পেল্লাই আকারের গ্রের এ্যানাটমির বই খুলে কী যেন দেখছিলো। ছোটন নিরীহ গলায় বললো, বড়দি তুমি সাইফ ভাইকে চেনো?

ঘাড় বাঁকিয়ে বড়দি ওর দিকে তাকালো। ভুরু কুঁচকে রাগী গলায় বললো, সাইফ ভাই কে?

ডাঃ সাইফ হায়দার চৌধুরী। তোমাদের কলেজে নাকি পড়ান?

বড়দির কোঁচকানো ভুরু স্বাভাবিক হলো। গলা থেকে সমস্ত রাগ কর্পূরের মতো উবে গেলো–চিনবো না কেন? সপ্তাহে আমাদের দুটো ক্লাস নিতেন তিনি। তোরা জানিস কীভাবে?

পরিচয়ের বৃত্তান্ত শুনে বড়দির চেহারা কোমল হয়ে এলো। বলল, তিনি সত্যি সত্যি বলেছেন আমি লক্ষ্মী মেয়ে?

সত্যি বলছি বড়দি। তোমার অনেক প্রশংসা করেছেন।

আর কী বলেছে? বড়দির কান লাল হলো।

বলেছে, পড়াশোনার ব্যাপারে তুমি নাকি খুব সিরিয়াস।

মৃদু হেসে বড়দি বললো, তিনি নিজেও লেখাপড়ার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস।

মিতু বললো, সাইফ ভাইর ছোটবোন দুটোও খুব ভালো। আজ সকালে নিজে থেকে ওরা আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চেয়েছে।

ভালোই তো। নরম হেসে বড়দি বলল, সাইফ ভাইর বোন যখন নিশ্চয় খুব সুন্দর দেখতে!

একেবারে পরির মতো। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো মিতু।

বড়দির হাবভাব দেখে ইতু খুব অবাক হলো। অনেক চেষ্টা করেও ও মনে করতে পারলো না, বড়দি কারো সঙ্গে হেসে কথা বলেছে।

বিকেলে ওরা রোয়াকে বসে এ নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বললো। সবশেষে ইতু উপসংহার টানলো, এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সাইফ ভাইর নামের একটা আলাদা জাদু আছে।

ছোটন বলল, জীবনেও আমি বড়দিকে হাসতে দেখি নি।

ওদের ভেতর বুদ্ধিশুদ্ধি একটু কম হলো রন্টুর। বলল, বড়দির সঙ্গে সাইফ ভাইর বিয়ে হলে দারুণ মানাবে।

ইতু ধমক দিয়ে বললো, অসভ্যের মতো কথা বলিস না রন্টু। দিদার কানে গেলে সবার পিঠের চামড়া তুলবেন।

মুখ কালো করে রন্টু বললো, আমাদের নিজেদের সব কথা দিদাকে বলতে হবে কেন? আমি–

রন্টুর কথা শেষ হলো না। সিং দরজার দিকে মুখ করে বসেছিলো মিতু। বললো, আরে, রিমকিরা আসছে যে!

সবাই ঘুরে তাকালো। রিমকি-সিমকির সঙ্গে দিদার বয়সী এক মহিলা। এত বয়স হয়েছে তবু কী সুন্দর দেখতে! রিমকি এগিয়ে এসে বললো, আমাদের নানি তোমাদের দিদার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছেন।

সবার পেছনে ছিল রিমকিদের কাজের বুয়া বেদানার মা। হাতে মিষ্টির দুটো হড়ি। ইতুরা উঠে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে বললো, স্লামালেকুম!

রিমকির নানি মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। বেদানার মা একগাল হেসে বললো, ওয়ালাইকুম সালাম। কী লক্ষ্মী সব পোলাপাইন। তোমাগো দাদিআম্মা কই গো?

ওরা রিমকিদের ভেতরে নিয়ে গেলো। যেতে যেতে রিমকি ইতুকে বললো, তুমি বুঝি অর্জুন?

ইতু গম্ভীর হয়ে বলল, আমার নাম ইখতিয়ারউদ্দিন খান তরফদার।

জানি। মুখ টিপে হেসে রিমকি বললো, সারাক্ষণ তুমি বই নিয়ে পড়ে থাকো, আর ক্লাসে সবসময় ফার্স্ট হও। তোমার সব কথা আমি শুনেছি।

রিমকির কথা শুনে ইতুর মনটা নরম হলো। যতটা ভেবেছিলো এরা ততটা খারাপ নয়। খারাপ কেন ভালোই বলতে হবে। এত মিষ্টি নিয়ে পাড়ার কেউ কখনো ওদের বাড়িতে দেখা করতে আসে নি। ইতুর ফার্স্ট হওয়ার খবরও জেনে গেছে। বললো, ফার্স্ট হওয়া এমন কী কঠিন কাজ!

তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কে ফার্স্ট হতে যাবে বলো। শোনার পর থেকে ভাবছি তোমার ইংরেজি নোটের খাতাটা দেখবো। ইংরেজিতে আমার নম্বর কখনো পঞ্চাশের ওপর ওঠে না।

ঠিক আছে, কাল এসো–দেখাব।

দিদা ওঁর ঘরে ছিলেন। রিমকির নানি অমায়িক হেসে বললেন, আপনাদের নতুন প্রতিবেশী আমরা। পরিচয় করতে এলাম।

রিমকি, সিমকি এসে দিদাকে সালাম করলো। মিষ্টির হাড়ি দুটো টেবিলের ওপর রেখে বেদানার মাও রিমকিদের মতো দিদার পা ধরে সালাম করলো। দিদা কাষ্ঠ হেসে একবার বললেন, থাক বাছা থাক। আরেকবার বললেন, এত মিষ্টি আনবার কি দরকার ছিলো?

নানি বললেন, মিষ্টি মুখে দিয়ে পরিচয় করলে সারা বছর মিষ্টি কথা শুনবো।

নানিকে দিদার ঘরে রেখে ইতুরা রিমকিদের নিয়ে চিলেকোঠায় এল। বাড়ি ভাগের সময় উঁচু পাঁচিল দিয়ে ছাদও দুভাগ করা হয়েছে। ছাদে ওঠার সিঁড়ি আর চিলেকোঠা ইতুদের ভাগে পড়েছে। এত বড় ছাদ দেখে রিমকিরা বেজায় খুশি। সিমকি তো ছাদে উঠেই প্রজাপতির মতো ডানায় ভর করে এক পাক উড়ে এলো। রিমকি বললো, আহা ছাদটা যদি আমাদের হত।

ইতু বলল, রোজ এসে খেললেই হয়।

রিমকি বললো, ছোটনদের সঙ্গে বড়দার আলাপ হয়েছে বুঝি! তোমাদের বড়দিকে দেখতে হবে একবার।

ইতু বললো, বড়দি খুব রাগী মেয়ে।

রিমকি মুখ টিপে হাসলো–আমাদের দেখলে তিনি মোটেই রাগবেন না।

পৌষ মাস না আসতেই বেশ শীত পড়ে গেছে। ডিসেম্বর মাস পুরোটাই স্কুল বন্ধ। ছোটন রিমকিকে বললো, শীতে কি তোমরা পিকনিক করো?

নবরায় লেন-এর বাড়ির ভেতরে করতাম। জবাব দিলো রিমকি।

বাড়ির ভেতরে বুঝি পিকনিক করে? মুখ টিপে হাসলো মিতু। শহরের বাইরে না গেলে কিসের পিকনিক?

আমাদের ওই বাড়ির পেছনে বড় একটা আমবাগান আছে। ওখানে নিজেরা রান্নাবাড়ি করতাম।

আমরা প্রত্যেক বছর পিকনিকে যাই। ভঁট দেখিয়ে বললো মিতু তেজগাঁয়ে আমাদের একটা বাগানবাড়ি আছে। ঘোড়ার গাড়িতে যেতে দুঘণ্টা লাগে।

এ বছর যাও নি?

যাবো, এত তাড়া কিসের? ছোটন বললো, শীতটা আরো পড়ুক।

সিমকি বললো, আমাদের সঙ্গে নেবে? পিকনিকে আমরাও চাঁদা দেব।

সিমকির কথা শুনে রিমকি আর ছোটনরা একটু বিব্রত বোধ করলো। রিমকি ভাবলো বাড়িতে কারো সঙ্গে কথা না বলে হুট করে এভাবে যেতে চাওয়া ঠিক হচ্ছে না। ছোটনরা ভাবলো, দিদাকে না জানিয়ে রাজি হলে শেষে যদি দিদা বেঁকে বসেন। আমতা আমতা করে ইতু বললো, একসঙ্গে পিকনিক করলে ভালোই হবে। তবে সবকিছু ঠিক করেন দিদা আর বড় জেঠু। ওঁদের আগে বলতে হবে।

রিমকি কাষ্ঠ হেসে বললো, সিমকি এমনি বলেছে। নানি আমাদের যেতে দিলে তো!

দুখির মা এসে বললো, ম্যামানগো দাদিআম্মায় মিষ্টি খাওনের লাইগা বোলায়! চলেন গো সোন্দর মাইনষের সোন্দর মাইয়ারা।

রিমকি-সিমকি দুখির মার সঙ্গে চলে গেলো। রন্টু বললো, সবাই মিলে একসঙ্গে পিকনিকে গেলে কী মজাই না হবে!

ঝন্টু বললো, মনে হয় না দিদা রাজি হবেন।

ছোটন বললো, দিদাকে রাজি করানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

কীভাবে দিদাকে রাজি করানো যেতে পারে এ-নিয়ে ওরা অনেক জল্পনা-কল্পনা করলো। শেষে ঠিক হলো সাইফ ভাইকে দিয়ে কথাটা প্রথম বড়দিকে বলতে হবে। বড়দি সেটা দিদার কাছে পাড়বে। বড়দের ভেতর লেখাপড়ায় ভালো বলে বড়দিকে দিদা একটু বেশি পছন্দ করেন। কিন্তু কখনো সেটা কাউকে বুঝতে দেন না। তবে ছোটরা অনেক কিছুই লক্ষ করে, যা বড়দের চোখে পড়ে না।

একটু পরে ছুটতে ছুটতে রিমকি-সিমকি এসে বললো, আমরা এখন যাচ্ছি। কাল সকালে বাগানে এসো।

রিমকিরা চলে যাওয়ার পর ছোটনরাও নিচে নামলো। শুধু ইতু ওর শেষ না-করা বইটা নিয়ে বসলো।

সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নামলে প্রথমে পড়ে ঢাকা-বারান্দা। বারান্দার পাশে আগে বসার ঘর, তার পর দিদার আর অন্যসব ঘর। ছোটরা ভেবেছিলো দিদার ঘরের পাশ দিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে যাবে। সন্ধে হতে চলেছে, এ-সময় বাইরে যাওয়া বারণ। অথচ পিকনিকের কথাটা সাইফ ভাইকে না বললেই নয়। ছোটদের স্কুল বন্ধ থাকলেও মেডিকেল কলেজে ক্লাস হচ্ছিলো। সাইফ ভাই কালই পিকনিকের কথাটা বড়দিকে বলতে পারে। বড়দিদের ক্লাস না থাকলেও ও রোজ কলেজে যায়। নাকি যে-কোনো দিন ফল বেরোবো।

দিদা কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। ওঁর একটা কথা ছোটনদের কানে যেতেই ওরা থমকে দাঁড়ালো। দিদা বলছিলেন, ওসব হচ্ছে বড়লোকি ঢং। নাকি কুমিল্লা থেকে রসমালাই এনেছেন! কে খাবে ওসব! দিও ওই ছেঁড়াগুলোকে, আহ্লাদ করে দোতালায় নিয়ে এসেছে। নিচের বসার ঘরে বসালেই হত!

বড় ফুপি বললেন, আমার তো ভদ্রমহিলাকে ভালোই মনে হলো। বেথুন থেকে বি এ পাশ করেছেন, এতটুকু অহংকার নেই।

পড়ার নেই তো কী হয়েছে! রূপের অহংকার তো ষোলআনাই আছে। শুনলে না, হাসতে হাসতে দিব্যি বললো, আমাদের বংশে কালো কেউ নেই!

না থাকলেও কি আছে বলবে আম্মা? দেখলেনই তো নানি-নাতনি সবাই কী সুন্দর!

তোমার কি আর কোনোকালেই বুদ্ধিসুদ্ধি হবে না আকিকুননেসা? নেই তো নেই, সেটা বড় গলায় বলাটা মোটেই ভালো শোনায় না। তোমাকে আরো বলি বাছা, কিটকিটে ফর্শা হলেই যে মানুষ সুন্দর হয় যারা এমন মনে করে, তাদের সবাই বোকার হদ্দ বলে। যাক, এসব নিয়ে আলোচনা না করে রান্নাঘরে গিয়ে তোমার ছোট চাচার জন্য কখানা রুটি বানিয়ে দাও গে। ওর তো আবার তোমার রুটি ছাড়া মুখে রোচে না।

বড়ফুপি ঘর থেকে বেরোবার আগেই ছোটনরা ঝুলবারান্দায় চলে গেলো। রিমকির নানির ওপর ভীষণ রেগে আছেন দিদা–এ-কথাটা ভাবতেই ওদের পিকনিকে যাওয়ার উৎসাহ থিতিয়ে গেলো। বড় ফুপির সঙ্গে ওঁর কথা থেকে এটুকু শুধু পরিষ্কার হয়েছে ও-বাড়ির সবাই ফর্শা বলে দিদার যত রাগ। কারণ এ-বাড়িতে দিদা ছাড়া আর কেউ ও-বাড়ির ছেলেমেয়েদের মতো ফর্শা নয়।

বড় ফুপির পেছন-পেছন দিদাও যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন ছোটনরা টের পায় নি। বারান্দায় ওদের দেখে দিদার মনে হলো এগুলোকে এখন থেকে সাবধান করে দিতে হবে। কাছে গিয়ে শান্ত গলায় বললেন, শুনলাম আজ সকালে নাকি তোমরা দশআনি বাড়িতে গিয়েছিলে? মতলব কী শুনি!

ছোটদের যখন দিদা তুমি বলেন তখন বুঝতে হবে তিনি রেগে আছেন। বেশি রেগে গেলে আপনি বলেন। দিদার কথা শুনে কাষ্ঠ হেসে ছোটন বললো, কুল পাড়তে গিয়েছিলাম।

কুল পাড়তে গিয়ে ও-বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে অত গল্প কিসের বাছা! এই বেলা সাবধান করে দিচ্ছি–যখন-তখন ও-বাড়ি যাওয়া চলবে না।

কেন দিদা? বোকার মতো প্রশ্ন করলো সাদাসিধে রন্টু।

তোমরা এখন বড় হচ্ছো! শান্ত গলায় দিদা বললেন, আমি চাই না তোমরা এমন কিছু করো, যাতে এ-বাড়ির লোকদের কারো কাছে ছোট হতে হয়!

ছোটন বললো, ওরা চাইলে তখন কথা না-বলাটাও তো অভদ্রতা হবে।

সেটা তোমরা জানো। আমি এসব পছন্দ করি না, শুধু এইটুকু মনে রাখলেই চলবে। এই বলে দিদা নিচে নেমে গেলেন।

Exit mobile version