নেলি লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। কুকুর দুটোও লাফাচ্ছে। নেলির চুল উড়ল উত্তুরে হাওয়ায়। কাপড় উড়ল। এখানে সেখানে ঝোপ, ঝাড়, জঙ্গল। এখানে সেখানে উঁচুনিচু মাটি। নেলি লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে।
কতবার ঘুরে গেছে এ—অঞ্চলে নেলি। কতবার লখি এল, টুনুয়া এল। গেরু, গঙ্গা, যমুনা এল। কতবার সে একা এসেছে। কুকুর দুটো ওকে পাহারা দিয়েছে। জলকলের সেই অদ্ভুত শব্দটা সে কতবার শুনল। কতবার শুনেছে। আজও নেলি কান পেতে শুনল। মাটি এখানে কুমিরের পিঠের মতো অমসৃণ। ঝোপ—ঝাপ সবুজ কাঁটার জঙ্গল দুধারে, দু মানুষ সমান উঁচু বনফুলের ঝোপ। দু—একটা গিরগিটি লাফিয়ে পড়ল ওদের উপর। দু—একজন মানুষ শহর থেকে ফিরছে। আকাশে চিল উড়ছে—দূরে দূরে আসশ্যাওড়ার জঙ্গল। সোনা—ব্যাঙের ঢিবি মাঝে মাঝে। দুটো একটা খরগোশের গর্ত—গঙ্গা যমুনা নাক দিয়ে গর্তগুলো শুঁকছে।
নেলি পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল। সে জানে বুড়ো মানুষের বেটারা ওই পথে গঙ্গায় নেমে আসবে। হাতে ওদের নতুন মালসা থাকবে। মালসায় আতপ চালের ভাতগুলো ডেলা ডেলা থাকবে। বুনো ঘাস থাকবে উপরে। নেলি এখানে দাঁড়িয়ে ঝোপ—জঙ্গল অতিক্রম করে দূরে পুরোনো বড় বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে—বুড়ো মানুষটা গত রাতে এ—বাড়ি থেকেই ঘাটে গেছে। যমুনাকে দিয়ে বুড়োর খাটো কাপড়টা সে রাতে চুরি করিয়েছে। দুখিয়া বলছে, নেলি চোর। বলেছে, নেলি বেইমানি কিয়া। হাম জরুর সালিসি মানে,—তু বলিছে, হাম শুন লিছে। চামার! চামার!
নেলি এই পথের ওপর দাঁড়িয়ে দুখিয়াকে গাল দিতে থাকল। ….ঘাটের ডাক লিয়েছিস বুলে মাথা কিনে লিয়েছিস! একটা খাটো কাপড় লিয়েছি, ওয়ার লাগি জান গেছে। হাম সালিসি মানে! সালিসি! কে শুনে লিবে রে তুর সালিসি। কোন শুনে লিবে। হামি বলবে না কিছু তু ভেবে লিছিস। নেমকহারাম! বেইমান! নেলি এখন সেই কাপড়টাই পরে আছে বলে ওর যেন যন্ত্রণা হতে থাকল এবং গলায় গরল উঠতে থাকল।
কুকুর দুটো ওর পায়ে পায়ে ঘুরছে। সে এ—সময় কুকুর দুটোকে সালিস দিল—শুনে লে দুধিয়া কী বাত বুলছে। হামি চোর, তু চোর—এ বাত বুলছে। তুরা হামার সালিসি থাকল।
নেলি এবার কুকুর দুটোকে হাত জড়িয়ে আদর করল। জলের নিচে দেখা গেরুর শরীরটা ওর মনে পড়ল। —গেরু, তু বহুত আচ্ছা আছে। তু একদফে বড় হয়ে ঘাটের ডাক লিবি। ঘাটের কাঁথা—তোষক সব লিবি। দুখিয়ার মাথায় লাঠি ভাঙবি। হামি বহুত খুশি হবে। তু আওর হামি, হামি আওর তু। নেলি এই নিঃসঙ্গ পথে দাঁড়িয়ে অভুক্ত শরীরে স্বপ্ন দেখল। এখন চিলের ছায়াটা জলের ওপর ভাসছে। জলের ওপর নিজের ছায়া দেখল, গেরুর ছায়া এবং বুঝল নেলি এখন বড় হয়েছে। হঠাৎ এই ভরদুপুরে শরীরটার দিকে চেয়ে ওর কেমন ভয় করল। ও ছুটতে থাকল। ও ছুটছে ফের। হঠাৎ কী এক রহস্যকে ধরতে পেরে নেলি ভয়ে ভয়ে চটানে উঠে এল। চটানে উঠেই শুনল শিবমন্দিরের পথে হরিধ্বনি দিচ্ছে। ঘাটে মড়া নামানো হচ্ছে।
নেলি বুঝতে পারছে মড়াটা বড়ঘরের। বাবু মানুষদের কাঁধে খাটুলী। নেলি এই বাবু মানুষদের গঙ্গার পারে কতদিন দেখেছে। কতদিন দেখেছে। কতদিন সে দিদিমণিদের আলগা হয়ে পথ করে দিয়েছে। কতদিন এই সব বাবুভাইদের ধমক খেয়ে চটানে ফিরে এসেছে! ওরা এখন সিঁড়ি ধরে নেমে ঘাটের দিকে যাচ্ছে। দুখিয়া ছুটছে চটান থেকে। —আহারে মরদ হামার। ছুটছে ত ছুটছেই। তুর বৌটা কুথারে? বৌটাকে সাথে লিয়ে লে! একা ছুটলে আছাড় পড়বি। নেলি রসিকতা করতে চাইল দুখিয়াকে।
এখন চটানের মাগি মরদরা অফিসের বারান্দায় সব জমা হয়েছে। ওরা এখন কাঠ বইবে ঘাটে। ঘাটোয়ারিবাবু কাউন্টারে বসে পত্রিকা পড়ছেন। চোখ তুলছেন না অথচ বুঝতে পারছেন কোথায় কী হচ্ছে। তিনি জানেন দুখিয়া ঘাটে ছুটে গেছে। মড়ার কাঁথা—কাপড় আগলাচ্ছে। মড়ার নাকে কানে গহনা আছে কিনা দেখছে। তিনি জানেন হরীতকী আজ কাঠ বইতে আসবে না, সোনাচাঁদ আসবে না। কৈলাস আসবে না। গোমানি চটানে থাকলে আসত। নেলি আসবে, গেরু, লখি, টুনুয়া, ঝাড়ো ডোমের সব বেটারা, পারলে বৌটা পর্যন্ত। মণ পিছু দু আনা পাবে—চার মণে আট আনা। আনা আনা ভাগ বসাবে—না পেলে মারধোর করবে। চাটনে নাচন—কোঁদন শুরু হবে ফের।
এ—ছাড়া তিনি কাউন্টারে মুখ না তুলেই বুঝতেই পারেন কে সেখানে দাঁড়াল। কার ছায়া পড়ল। তিনি সব বুঝতে পারেন।
তিনি প্রশ্ন করলেন, কোত্থেকে মড়া এল? কার মড়া?
মড়া সেনবাবুদের।
কী হয়ে মরল?
দু দিনের জ্বরে।
বেশ, বেশ। কী নাম? মেয়েছেলে না বেটাছেলে?
ঘাটোয়ারিবাবু এবার মুখ তোলেন। রেজিস্ট্রিখাতা বের করে লাল কালিতে প্রথমে নখে নিব ঘষলেন। রেজিস্ট্রিখাতা থেকে কয়েকটা নাম উচ্চারণ করলেন। ওটা ওঁর স্বভাব। তিনি বললেন, কৃষ্ণপক্ষে যশোদানন্দন গেল, আহা যশোদানন্দন! তুমি তবে মরেছ। বেশ করেছ। কাজের কাজ করেছ। হীরামতি গেল নিতাই পাঠক গেল—এবারের নামটি কী যেন বললেন?
সুচিত্রা গুপ্তা।
বেশ, বেশ সুচিত্রা গুপ্তা। বয়স?
আঠারো।
কাঁচা গেল দেখছি। কী হয়ে মরল যেন?
দু দিনের জ্বরে।
তা হলে দু দিনের জ্বরে লোক এখনও মরছে। বেশ, বেশ। হরি ওঁ। ঘাটোয়ারিবাবু রসিদ লেখার আগে বললেন, হাসপাতাল থেকে এল?
না।