Site icon BnBoi.Com

গাছের পাতা নীল – আশাপূর্ণা দেবী

গাছের পাতা নীল - আশাপূর্ণা দেবী

 ১. অধ্যাপক মৈত্র

গাছের পাতা নীল – উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী

কোনও দিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন অধ্যাপক মৈত্র। যেমন মাথা নিচু করে চলে যায় সাহায্যপ্রার্থী গরিব তার ধনী আত্মীয়ের দরজা থেকে অবহেলার দান কুড়িয়ে নিয়ে।

অবহেলাই। অবহেলা করেই ছেড়ে দিল ওরা শেষটায় ওদের আসামিকে। বোধ করি বা একটু করুণাও হয়েছিল ওদের কারও কারও, অধ্যাপকের গম্ভীর হতাশা-আঁকা অসহায় মুখ দেখে। বলল,  যাক গে, চলে যান।

অবিশ্যি গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দলের মধ্যে থেকে দু-একটা শেয়াল ডাক উঠল বইকী, ওদের এতদিনকার প্রিয় আর সম্মাননীয় অধ্যাপকের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা লক্ষ করে। উঠল দু-একটা তীব্র অসভ্য সিটি। কিন্তু সে তো হবেই। ওইটুকুর ওপর দিয়েই যে গেছে, প্রৌঢ় লোকটাকে যে হাসপাতালে পাঠায়নি ওরা এই ঢের। ইচ্ছে করলেই নাকি ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দিতে পারত, অথবা মুখে ঘুসি মেরে দাঁত খসিয়ে নিতে পারত। তা করেনি ওরা।

অতএব বলতেই হবে রীতিমত ভদ্রই ওরা। ওরা শুধু সিটি মেরে দয়া দেখিয়ে ছেড়ে দিয়েছে, আর পিছনে হুক্কা হুয়া ডেকেছে।

হুক্কা হুক্কা, হুক্কা হুয়া।

শুনতে শুনতে এগিয়ে গেলেন অধ্যাপক।

না, কানে হাত চাপা দিলেন না, অথবা ওদের সম্পর্কে কোনও অভিশাপবাণীও উচ্চারণ করলেন না। অনুভূতির যন্ত্রটা কেমন অসাড় অসাড় লাগছে, শুধু বুকের মধ্যে কীসের যেন একটা পাষাণভার। এ কি হৃদ্যন্ত্রে কোনও কঠিন ব্যাধি আক্রমণের পূর্বলক্ষণ? না শুধু ভয়ংকর একটা উত্তেজনার ভার?

এই ভারটা প্রথম অনুভব করেছিলেন অধ্যাপক যখন তাঁর ক্লাসে লেকচারের সময় ছেলেরা রাজনীতি নিয়ে তুমুল তর্ক তুলেছিল এবং বেশ কয়েকবার নিষেধ করা সত্ত্বেও তর্ক তো থামায়ইনি, বরং বলে উঠেছিল, এই আছেন এক পেঁতি বুর্জোয়া, সত্যিকথা শোনবার সাহসটুকুও নেই।

তখন। হঠাৎ ওই ভারটা অনুভব করেছিলেন অধ্যাপক মৈত্র। আর সঙ্গে সঙ্গেই যেন মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন।

চেঁচিয়ে উঠে বলেছিলেন, গেট আউট। যারা গোলমাল করছ, বেরিয়ে যাও আমার ক্লাস থেকে।

অধ্যাপক মৈত্রের দীর্ঘ অধ্যাপনার ইতিহাসে এমন ঘটনা বোধ করি এই প্রথম। তাঁর স্বরনালী থেকে এমন রূঢ়স্বর বেরোনো সম্ভব একথা আর কেউ দূরে থাক, তিনি নিজেও বুঝি কখনও জানতেন না।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও–এমন কথা জীবনে কখনও মনে মনেও বলেছেন কি মৈত্র? বোধ করি বলেননি। কারণ অতীতে এমন পরিস্থিতি আসেওনি। পড়ানোর গুণে তিনি সকলের প্রিয়, চরিত্রের গুণে সকলের শ্রদ্ধেয়।

তবে তিরস্কার কি আর করতে হয় না কখনও? কলেজের কিছু ছাত্র তো সর্বদাই থাকে যারা ছাত্র নামের অযোগ্য, যারা অসভ্য অভব্য দুর্বিনীত।

করতে হয় তিরস্কার, কিন্তু অধ্যাপক মৈত্র বরাবরই সেটা করেছেন তাঁর নিজস্ব মৃদু অথচ দৃঢ়ভঙ্গিতে। যেটা অনেক সময় ধমকের চেয়ে কার্যকরী। যার সামনে অবিনয় অভব্যতা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে।

কিন্তু আজ অন্য ঘটনা ঘটে গেল। যার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে অধ্যাপক মৈত্রেরই মাথা হেঁট করে প্রস্থান।

মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই সুদীর্ঘ সাধনা-অর্জিত সম্মানের আসনটি হারালেন অধ্যাপক মৈত্র।

মুহূর্তের মধ্যে যেন কী হয়ে গেল।

রূপান্তর ঘটে গেল অধ্যাপক মৈত্রের সামনের ওই ভদ্র চেহারার আর সভ্য পোশাকের ছেলেগুলোর। হঠাৎ দেখতে পেলেন অধ্যাপক, তিনি একদল গুণ্ডার দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেছেন।

হ্যাঁ, তাই দেখলেন অধ্যাপক সরোজাক্ষ মৈত্র। মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগেকার এমনি এক অবস্থার কথা– কোনও এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়ির নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বেশি রাত্রে ফিরছিলেন। ট্রাম রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয় সে বাড়ি থেকে। রাস্তার লোকসমাগম কমে গেছে। কিন্তু সরোজাক্ষ সেটাকে বিপজ্জনক মনে না করে বরং শান্তির কারণ মনে করে নানা কথা ভাবতে ভাবতে আসছিলেন। ভাবছিলেন নসুমামা এমন কিছু বড়লোক নন, অথচ মেয়ের বিয়েতে যা দানসামগ্রী দিয়েছেন, তা বড়লোকের মতো। কষ্ট করেই দিয়েছেন। তবে না দিলে নাকি বিয়েটা ঘটত না। এমন ভাল জামাইটি হাতছাড়া হয়ে যেত। তাই বহু টাকা ঋণ করে নসুমামা ভাল জামাইয়ের উপযুক্ত দক্ষিণা সংগ্রহ করেছেন।

ভাল জামাই!

ভালর সংজ্ঞাটা কী?

ভাবতে ভাবতে আসছিলেন সরোজাক্ষ, হঠাৎ যেন মাটি খুঁড়ে পাঁচ-সাতটা লোক উঠে দাঁড়িয়ে ঘিরে ধরল সরোজাক্ষকে। আর কবলিত শত্রুকে ব্যঙ্গ করার ভঙ্গিতে ঠাণ্ডা গলায় বলে উঠল, সঙ্গে যা আছে চটপট বার করে দাও তো জাদু!

ঠিক যে ভঙ্গিতে একটু আগেই সরোজাক্ষর ছাত্ররা বলে উঠেছিল, তাঅ্যাপলজিটা একবার চেয়েই নিন না স্যার চটপট।

হ্যাঁ, ওটাই দাবি ছিল ওদের। এই দাবিতেই ঘেরাও করেছিল তাঁকে। ক্ষমা চাইতে হবে অধ্যাপককে তাঁর উদ্ধত বচনের জন্যে।

.

সেদিনের সেই গুণ্ডাগুলোর দাবি এক কথাতেই মিটিয়ে দিয়েছিলেন সরোজাক্ষ। টাকা-পয়সা বেশি ছিল না সঙ্গে, কিন্তু দামি ঘড়িটা হাতে ছিল, ছিল সোনার আংটি সোনার বোতাম। নিজের বিয়েটা তখনও খুব পুরনো হয়ে যায়নি তাই বিবাহলব্ধ ওই জিনিসগুলো ছিল। সরোজাক্ষর শ্বশুর অবস্থাপন্ন ছিলেন, জামাইকে দামি দামি জিনিসই দিয়েছিলেন।

কিন্তু পরিস্থিতির চেহারা দেখে দামি জিনিসগুলি সামলাবার চেষ্টা করেননি সরোজাক্ষ, বিনা বাক্যে খুলে দিয়েছিলেন ঘড়ি আংটি বোতাম, গায়ের শাল। পকেট থেকে পার্স। মাত্র সাতটি পয়সা চেয়ে নিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে মৃদু হেসে, বলেছিলেন, এত রাত্রে পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে যেতে বড় বেশি কষ্ট হবে।

কিন্তু আজ বিনা বাক্যে এককথায় ওদের দাবি মেনে নিতে পারেননি। ঘড়ি আংটির থেকে অনেক বেশি দামি একটা জিনিস রক্ষা করতে চেষ্টা করেছিলেন প্রথমটায়। ওরা যখন ঠাণ্ডা গলায় বলেছিল ক্ষমা চাইতে হবে স্যার, মাপ চেয়ে কথা ফিরিয়ে নিতে হবে–তখন তিনিও ঠাণ্ডা গলায় বলেছিলেন, অন্যায় কিছু বলে থাকলে নিজেই ফেরত নিতাম, নিজেই ক্ষমা চাইতাম।

একটা ছেলে, হয়তো অধ্যাপকের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিশীল, সে এসে গলা নামিয়ে বলেছিল– তা শ্রদ্ধাশীল সহানুভূতিশীল ছেলে যে একেবারেই ছিল না তা নয়, ছিল। অনেক ছিল। হয়তো তারাই সংখ্যায় বেশি, কিন্তু তাদের সাহস ছিল না সহপাঠীদের এই অসভ্যতার প্রতিবাদ করবার। কারণ তারা দলের শিকার। তারা জানে তারা যে মুহূর্তে প্রতিবাদ করবে, সেই মুহূর্তে বন্দুকের মুখ ঘুরে যাবে। তাই তারা বিপন্নমুখে একে ওকে মৃদু অনুযোগ করছিল, না না, এটা ঠিক হচ্ছে না। এতটা করার কোনও মানে হয় না।

কিন্তু তাদের আবেদন ধোপে টেকেনি, কারণ তারা সংখ্যাগুরু হলেও দলের কাছে তাদের হার। স্বাধীন চিন্তার স্বাধীন মত স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করবার সাহস বা শক্তি তাদের নেই। ব্যক্তিস্বাধীনতার রাংতায় মোড়া একটা অমোঘ দাসত্বের যূপকাষ্ঠের বলি তারা।

তাই তাদের একজন গলা নামিয়ে পরামর্শের সুরে বলেছিল, যা হোক করে দুটো কথা বলে ওদের শান্ত করে ফেলুন স্যার, বড় ভয়ংকর ছেলে ওরা। ছুরি বার করতেও পিছপা হয় না।

তবু তখনও সরোজাক্ষ হিসেব করতে পেরে উঠছিলেন না কোনটাকে বেশি দামি বলে ধরবেন, নিরাপত্তা না আত্মসম্মান?

তাই তখন বলেছিলেন, দেখা যাক কতদূর করতে পারে।

বলেছিলেন। কারণ তখনও ভেবেছিলেন কদিন ঘেরাও করে রাখতে পারে রাখুক। দেখি কদিন চলে এই নাটক। আমাকে আমি সে নাটকের দর্শক ছাড়া আর কিছু ভাবব না।

ওঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছেলেটি বলেছিল, সামান্যর জন্যে ভয়ানক মুশকিলে পড়ে যাবেন স্যার।

সরোজাক্ষ যেমন ছিলেন সেই ভাবেই বলেছিলেন, সামান্য কিনা তাই হিসেব করছি।

.

কিন্তু শেষ পর্যন্ত অঙ্কটা কষা হল না।

সংখ্যাগুলো যেন ছড়িয়ে ছত্রখান হয়ে গেল। বেশ কয়েক ঘণ্টা বসে থাকার পর ক্লাস-রুমের ধারের হল-এর ফোনটা বেজে উঠল, আর সঙ্গে সঙ্গে একটা ছেলে সেটাকে তুলে নিয়ে বলতে শুরু করল,ওঃ, স্যারের বাড়ি থেকে বলছেন? দেখুন ফিরতে তাঁর একটু দেরি হবে, বিশেষ একটা ব্যাপারে আটকা পড়ে গেছেন।…কখন মিটবে? তা বলতে পারছি না, সেটা ওঁর নিজের হাতে।…না, মাপ করবেন, ওঁকে এখন ডেকে দেওয়া যাবে না

টেলিফোনটাকেও ঘেরাও করে রেখেছিল ওরা, কাজেই কারও পক্ষেই সম্ভব হচ্ছে না সেটা ব্যবহার করা। না অন্য প্রফেসরদের, না শুভবুদ্ধি চাকর দারোয়ান কেরানিদের। অথচ সবাই একবার করে পুলিশের কথা ভেবেছে।

অধ্যাপক মৈত্র যেন এতক্ষণ কোনও একটা ঔষধের প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে বসে ছিলেন। ওদের ঠাণ্ডা গলা ক্রমশই উত্তপ্ত হচ্ছিল, নিজেদের মধ্যেই তর্কাতর্কির মাধ্যমে চেঁচিয়ে উঠছিল–কিছুতেই না। অ্যাপলজি না চাইলে একটি পা নড়তে দেওয়া হবে না। জাদু ঘুঘুই দেখেছেন, এবার ফাঁদ দেখুন।…পুলিশ? কে ডাকবে? প্রিন্সিপাল? ডাকুক। দেখি কত মুরোদ..

সরোজাক্ষ যেন অবাক হয়ে শুনছিলেন কথাগুলো।

এরা পড়ত তাঁর কাছে?

বসে থাকত সভ্য চেহারা নিয়ে?

ক্রমশই যেন সেই আচ্ছন্নতা বাড়ছিল।

এই ফোন-এর ব্যাপারটার পর হঠাৎ যেন চমক ভাঙল। চিন্তার পরদায় আস্তে আস্তে ভেসে উঠল, বাড়ির লোকের ব্যস্ততা…লোক জানাজানি কাণ্ড, পুলিশের সাহায্য ভিক্ষা নিয়ে উদ্ধার…নিরাপত্তার আশ্বাসবাহী সুরক্ষিত ভ্যান-এ চড়ে পলায়ন…পরদিনের সংবাদপত্রের হেডলাইন, বন্ধু আত্মীয় হিতৈষিবর্গের বিস্ময় প্রশ্ন ও দার্শনিক মন্তব্য, তার সঙ্গে সহানুভূতি বারি।…কী লজ্জা কী লজ্জা!

তারপরে খেয়ালে এল দরজায় কিছু কিছু চেনা মুখ দেখেছিলেন যেন, হতাশ বিপন্ন উদ্বিগ্ন নিরুপায়।

হয়তো সেই মুখেরা কিছু বলতেও চেষ্টা করেছিল এই উন্মত্তগুলোকে লক্ষ্য করে, তারপর আস্তে সরে গিয়েছিল। তার মধ্যে কি অধ্যক্ষের মুখও ছিল? মনে করতে পারছেন না। হয়তো ছিল। হয়তো ঈষৎ বিরক্তিও ছিল তাতে।

যেন সে বিরক্তিতে অভিযোগের ছায়া, কী আবার ঘটালে বাপু? নাও এখন বোঝে। জানো তো বিষধর সর্প নিয়ে বাস আমাদের, কেন আবার তাদের ল্যাজে পা দিতে যাওয়া।

অর্থাৎ ওঁরা দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসবেন না।

সংকল্পে ভাঙন ধরল।

কেলেঙ্কারির দৃশ্যগুলো মাথা তুলে দাঁড়াল। আপস করতে হল। ওদের সঙ্গে নয়। নিজেরই সঙ্গে। ভবিষ্যতের কর্মপন্থা ভবিষ্যতে স্থির হবে, এখন এই অবস্থার অবসান দরকার। নচেৎ আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো তাঁর বড় ছেলে সরেজমিনে তদন্ত করতে আসবে কোন জটিল কর্মর্জালে আটকা পড়ে আছে তার বাবা। গোঁয়ার প্রকৃতির ছেলে, হয়তো থানা-পুলিশ কাণ্ড করে পরিস্থিতি নরক করে তুলবে।

সংকল্পচ্যুত হলেন।

ক্ষমা চাইলেন।

উঠে দাঁড়িয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, তোমরা আমাকে ক্ষমা চাইতে বলেছ, এতক্ষণ ধরে আমি বিচার করে দেখছিলাম সেটা চাইবার মতো কাজ আমি করেছি কিনা।

ভিড়ের মধ্যে বেশ একটু গুঞ্জন উঠল।

অর্থাৎ হুঁ বাবা, পথে এসো।

অধ্যাপক মৈত্র কথা শেষ করলেন, দেখলাম ক্ষমা চাওয়াই উচিত। একা আমি নয়,সমস্ত প্রতিষ্ঠানটারই ক্ষমা চাওয়া উচিত। কারণ দিনের পর দিন তোমাদের আমরা ঠকিয়েছি। তোমাদের আমরা শিক্ষা সংস্কৃতি সভ্যতা শোভনতা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাশি রাশি টাকা নিয়ে চলেছি, কিন্তু দিতে পারিনি সে জিনিস। দিতে পারছি কি না তাকিয়েও দেখিনি। এই প্রতারণার জন্যে ক্ষমা চাইছি ।

আরও কিছু বলতেন হয়তো, ঘেরাও দলের পিছন থেকে মোরগ ডাক উঠল। তারপর অনেকগুলো গলার ছ্যাবলা হাসি-সেন্টিমেন্টে ঘা দিয়ে কথা বলছে রে! ওসবে আর কিছু হবে না চাঁদ, সে দিন চলে গেছে।

সরোজাক্ষর যেন মনে হল কাছে কোথায় ফার্নেস জ্বলছে, তার হলকা আসছে কানে মাথায় মুখে। তবু কষ্টে বললেন, তা বটে। তবে এটা সাজানো কথা নয়। এই মুহূর্তে সত্যিই অনুভব করছি, তোমাদের আমরা ঠকিয়ে চলেছি। তোমাদের গার্জেনদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অর্থের সুযোগ নিচ্ছি, অথচ তাঁদের বিশ্বাসের মূল্য রাখছি না। বিবেকের কাছেই জবাব দেবার কিছু খুঁজে পাচ্ছি না, তোমাদের আর কী বলব। তবে মনে হচ্ছে হঠাৎ একদিন শাসন করতে বসাটা অন্যায় হয়েছে আমার। তার জন্যে ক্ষমা চাওয়া দরকার।

গুঞ্জনটা প্রবল হল।

অধ্যাপকের ক্ষমা চাওয়ার সুরের মধ্যে যেন অন্য অর্থ নিহিত রয়েছে। তথাপি অন্যায় স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়াটাও রয়েছে স্পষ্ট ভাষায়। কী তবে করা যায়? ছেড়ে দে বাবা, ছেড়ে দে। বলল একটা অশ্লীল গলা।

তারপর কারা যেন কাদের মিনতি করল, অনুরোধ উপরোধ শোনা গেল কিছু কিছু ধরে নে বাবা প্রথম অপরাধ–এই নিয়ে আর গণ্ডগোলে কাজ নেই। ক্ষমা চাওয়াটা তো পষ্ট প্রত্যক্ষ, সেই–সেইটাই রেকর্ড থাকবে–

অতঃপর ওরা ঘেরাওয়ের প্রাচীর ভেঙে ঈষৎ সরে গিয়ে যেন করুণার গলায় বলে উঠল,ঠিক আছে, চলে যান।

সরোজাক্ষ কোনওদিকে না তাকিয়ে মাথা নিচু করে যেন কোনও অপরাধের নাটকের ধরা পড়া নায়কের মতো আস্তে আস্তে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন।

প্রাচীরের ভাঙা ইটের এক একটা খণ্ড বলে উঠল, এইটুকু তো আগে করলেই হত জাদু! মিথ্যে ভোগালেন।

তারপর শব্দ উঠল হুক্কা হুয়া। শব্দটা যেন অধ্যাপক মৈত্রকে তাড়া করে পিছু পিছু ছুটে আসতে লাগল।

আমি হার মানলাম।

মনের গভীরে নিঃশব্দ নিশ্বাসে উচ্চারণ করলেন সরোজা-ভাবিনি এরকমটা কখনও হবে। হয়তো আমারই ভুল হয়েছিল। ওরা ছাত্র, ওরা রাজনীতি নিয়ে উত্তেজিত হবে এটা স্বাভাবিক। আমরাও হয়েছি

সরোজাক্ষ একবার চিন্তাকে থামালেন–আমরাও হয়েছি কিন্তু সে কি এইরকম অসভ্য নির্লজ্জতায়? আমরাও উত্তেজিত হয়েছি, কিন্তু তার জন্যে কি ভাষার শালীনতা হারিয়েছি? তার জন্যে কি..না, কোনও একটা অদৃশ্য শক্তির ক্রীড়নক হয়ে ইচ্ছে করে মতলব করে কখনও উত্তেজিত হইনি আমরা। পরাধীনতার অপমানে উত্তেজিত হয়েছি। উত্তেজিত হয়েছি শাসকদের অনাচার দেখে, অত্যাচার দেখে, দেশের জনগণের নিশ্চেষ্ট ঔদাসীন্য দেখে। উত্তেজিত হয়েছি, বিচলিত হয়েছি।

কিন্তু এদের রাজনীতি আলাদা।

এদের উত্তেজনা উন্মাদনার উৎস অন্য। এরা মূঢ় অন্ধ, এরা একটা মতলবের শিকার মাত্র। তাই এরা

উত্তেজিত হয়ে ওঠে না, ইচ্ছে করে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এরা ছাত্র সেজে এসেছে, সত্যি ছাত্রদের ঘর পোড়াতে। তাই এই অগ্নিনাটকের সৃষ্টি।

সরোজাক্ষ এদের কথা জানেন না তা নয়। তবু সরোজাক্ষ কোনওদিন দুঃস্বপ্নেও ধারণা করতে পারেননি, তাঁরই দুগজ দুরে বসে এরা এমন করে বারুদ তৈরি করছিল, আর সে বারুদের প্রথম বলি হবেন সরোজাক্ষ নিজেই। অবশ্যই এর পর অধ্যয়ন অধ্যাপনার শান্তছন্দে ঝড় উঠবে, কল্যাণের বুলি আওড়াতে আওড়াতে অকল্যাণ এসে ঢুকবে চোরা দরজা দিয়ে। শান্তির ছদ্মবেশে আসবে অশান্তি। সর্বনাশা অশুভ বুদ্ধির মদে মাতাল একটা শক্তি তছনছ করতে থাকবে চিরায়ত মূল্যবোধগুলি। তছনছ করতে থাকবে শ্রদ্ধা সম্মান আশ্বাস বিশ্বাস ভালবাসা।

সরোজাক্ষ এখন কী করবেন?

পদত্যাগ? না আবার মাথা হেঁট করে ফিরে গিয়ে বিনম্র দাসত্ব?

হ্যাঁ, পদত্যাগের প্রশ্নও আসছে।

এ শুধু কয়েকটা বাজে ছেলের ঔদ্ধত্যই নয়, এর পিছনে যেন রয়েছে সরোজাক্ষদের অসহায়তার ছবি। এ যেন দিন ফুরোনোর নোটিশ। যেন অদৃশ্য দেয়ালে দেয়াল-লিপি লেখা হচ্ছে, নীতি রত্নমালার মালা পরিয়ে পরিয়ে আমাদের সাজিয়ে রেখে এযাবৎকাল অনেক সুবিধে নিয়েছ তোমরা, বিনা দাবিতে দখল করে বসে আছ শ্রদ্ধা সম্মানের আসন, আর চলবে না ওসব কৌশল। আমরা শুধু পৃথিবীতে তোমাদের চেয়ে কিছুদিন পরে এসেছি বলেই তোমাদের চরণ পুজো করে চলব, এমন বোকামির দিন শেষ হয়েছে। তোমাদের গড়া ওই মিথ্যে ভব্যতার খোলস খুলে ফেলে আমরা বন্য হব, বর্বর হব, আদিম মানবের সন্তানের রূপে ফিরে যাব। যেটা নির্ভেজাল, যেটা সত্য।

ওদের এই শেয়াল ডাকের মধ্যে, মোরগ ডাকের মধ্যে, সিটি দিয়ে ওঠার মধ্যে যেন সেই সংকল্পের আভাস রয়েছে। আর সে সংকল্পের পিছনে রয়েছে একটা প্রবল যুথশক্তি।

.

ঠিক এইভাবেই হয়তো ভাবছিলেন না সরোজাক্ষ, ভাবতে পারছিলেন না, শুধু যেন এক একটা ঢেউ উঠছিল চিন্তার সমুদ্রে।

এ যুগের এই সংকল্পের আভাস কি শুধু আজই দেখতে পেলেন সরোজাক্ষ তাঁর ক্লাসের কতকগুলো ছেলের চোখে? আপন সংসারের গণ্ডিতে দেখেননি? মাঝে মাঝে হঠাৎ কোনও একটি ঘটনার স্ফুলিঙ্গ দেখেননি তাঁর পরিচিত জগতের পরিধিতে?

তবে আজই হঠাৎ এমন বিচলিত হয়ে পড়লেন কেন? কেন তখন হঠাৎ করে মনে হল কোনও লুকোনো কার্নিসের খাঁজ থেকে বেরিয়ে এসে একঝাঁক চামচিকে তাঁর মুখের উপর দিয়ে উড়ে গেল? কেন মনে হল একটা কালো বাদুড় ডানা ঝাঁপটে চলে গেল তাঁর চোখের সামনে দিয়ে?

সরোজাক্ষ ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করছিলেন, কিন্তু সরোজাক্ষর ক্ষমা চাওয়াই উচিত হয়েছে। এত অল্পে বিচলিত হবেন কেন তিনি? তিনি কি আগামীকালের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন না? তিনি কি তার জন্যে নিজেকে একবিন্দুও প্রস্তুত করেননি? যদি না করে থাকেন সেটাই ভুল।

.

আস্তে আস্তে গাড়িটা চালাচ্ছিলেন সরোজাক্ষ, আস্তে আস্তে চিন্তার ভাঁজ খুলে খুলে যাচ্ছিল। আমি কি শুধু আজকেই হার মেনেছি? আমরা কি হঠাৎই কোনও একদিন পরাজিত হই? জন্মের শুরু থেকেই কি আমরা হার মানতে চলছি না?

জীবনের যে স্ফুলিঙ্গকণাটুকু নিয়ে আমাদের এত আস্ফালন, সেটা আমাদের সম্পূর্ণ হাতের বাইরের জিনিস। অনন্তকাল ধরে এই একটা আক্ষেপে মাথা খুঁড়ছে মানুষ

কোথায় ছিলাম কেনই বা এলাম
এই কথাটা জানতে চাই,
আসার কালে ইচ্ছাটা মোর।
কেউ তো কেমন শুধায় নাই।

তা হলে? তা হলে হচ্ছে এই–

আমার জন্ম আমার ইচ্ছাধীন নয়, আমার জীবনের পরিবেশ আমার ইচ্ছাধীন নয়। তবে এই পৃথিবীর লীলাটা আমার ইচ্ছাধীন হবে এমন বায়না করি কেন? আর বায়না করলেও যে কোনও লাভ নেই– সেও তো প্রতিপদে অনুভব করতে করতে এই প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পা দিয়েছি, তবু হঠাৎ বিচলিত হলাম, তবু সেই বায়নাটা করে মেজাজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললাম।

গ্লানি জমে উঠছে মনে।

যে রকম মৃদু গতিতে গাড়ি চালান, গতি তার চাইতেও মৃদু হয়ে যাচ্ছে, যেন ভুলে ভুলে যাচ্ছেন কোথায় যাবেন।

হ্যাঁ, গাড়িটা চালান সরোজা হাস্যকর রকমেরই মৃদুগতিতে।

সরোজাক্ষর বড় ছেলে বলে, বাবার মোচার খোলা গাড়ি, গোরুর গাড়ির স্পিড।

.

কিন্তু গাড়িটা কি সরোজাক্ষ নিজে কিনেছেন?

নাঃ, অধ্যাপক মানুষ, আর শান্ত স্তিমিত মানুষ, গাড়ি কিনবার সাধ তাঁর কোনওদিনই হয়নি, সাধ্যও না। বরং গাড়ি চড়ে কলেজ যেতে লজ্জাই পান, অনেকটা দূরে রেখে, পায়ে হেঁটে গিয়ে ঢোকেন। তবু এই গাড়িটা তাঁকে চড়তে হয়, চড়ে কলেজে যাওয়া-আসা করতেও হয়। সেও তো এক হার মানারই ব্যাপার।

স্নেহের আবদারের কাছে হার মানা।

নিঃসন্তান ছোট কাকার ভারী প্রিয়পাত্র ছিলেন সরোজা, কাকিরও। তাঁদের মনের জগতে ছেলের জায়গাটুকুতেই যেন সরোজাক্ষর স্থান ছিল।

বছর দুই আগে কাকা মারা গেলেন আর তখনই এল এই হার মানার পরিস্থিতি। কাকিমা বললেন, উনি বলে গেছেন গাড়িটা তোমায় দিতে।

সরোজাক্ষ বিচলিত গলায় বললেন,আমায় দিতে মানে? আমি গাড়ি নিয়ে কী করব?

চড়বে। কলেজ যাওয়া-আসা করবে। বড় শখের জিনিস ছিল ওঁর এটি, তাই যখন তখন বলতেন, আমি মরে গেলে তুমি যেন কে চালাবে ভেবে গাড়িখানা বেচে দিও না, গাড়িটা সরোজকে দিও।

সরোজাক্ষ অবশ্য এইটুকুতেই রাজি হননি, এ প্রস্তাবের প্রতিবাদের দিকে অনেক যুক্তি খাড়া করেছিলেন–লোকে হাসবে, ড্রাইভার রাখার পয়সা কোথা? নিজের অভ্যাস নেই।

কাকি উড়িয়ে দিয়েছেন সেকথা।

বলেছেন, চালাতে তো তুমি জানো একটু একটু, তা ছাড়া শিখে নেবে। তোমার কাকাও তো যখন গাড়ি কিনলেন, কিছুই জানতেন না, শিখে নিলেন। বলতেন, ব্যাপারটা কিছুই শক্ত নয়, একটু চোখ কান খোলা রেখে ঠাণ্ডা মাথা নিয়ে চাকাটা ধরতে পারলেই হল। কাকি একটু চুপ করে থেকে আবার বলেছিলেন,তুমি ওটা ভোগ করলে তিনি পরলোকে থেকেও তৃপ্তি পাবেন। তুমি ওতে চড়ে কলেজ যাবে আসবে।

আর কি করবেন সরোজাক্ষ?

কাকির চোখে জল!

কাকার পরলোকগত আত্মার পরিতৃপ্তির দায়িত্ব।

অতএব গাঢ় মেরুন রঙের ছোট ছিমছাম ওই গাড়িটি গ্রহণ করতে হল সরোজাক্ষকে নিশ্চয় ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কাকি বারবার সেই কথাই বললেন, কাউকে কিন্তু দিয়েটিয়ে দিও না বাপু, তুমি ব্যবহার করলেই তিনি পরিতৃপ্ত হবেন।

বিগত আত্মার পরিতৃপ্তি লাভের ক্ষমতা আছে কি না, অথবা প্রয়োজন আছে কি না, আর সত্যিই এই তুচ্ছ পার্থিব বস্তুর উপরে সে পরিতৃপ্তি নির্ভরশীল কি না, এ সব কুট প্রশ্ন তোলবার মতো প্রকৃতি নয় সরোজাক্ষর, তিনি তাঁর এই প্রায়-সমবয়সী অথচ স্নেহে শ্রদ্ধায় মাতৃস্থানীয়া মহিলার অনুরোধ ঠেলতে পারলেন না।

তদবধি ব্যবহার করছেন ওটা।

আস্তে আস্তে চালান, সযত্নে রক্ষা করেন। যেন কার গচ্ছিত ধন, যেন সে ফিরে এসে আবার ফেরত নেবে।

তা এই গাড়ি লাভের পর থেকেই যেন সহকর্মীদের আর ওঁর প্রতি তেমন সহানুভূতি নেই। যেন সরোজাক্ষ ওদের টেক্কা দিয়ে কোনও উচ্চস্তরে ওঠার চেষ্টায় হাত লাগিয়েছেন।

হয়তো সরোজাক্ষর আজকের দুর্দশায় তাই কেউ তেমন কাতর হয়নি। হয়তো ভেবেছে-কমুক, অহংকারটা একটু কমুক।

গাড়িটার জন্যে বাড়িতেও কি কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে থাকতে হয় না সরোজাক্ষকে? সরোজাক্ষর স্ত্রী বিজয়া কি বলেন না, অমন গাড়ির গলায় দড়ি! দুটো বই তিনটে মানুষের বসবার জায়গা হয় না, তাকে আবার গাড়ি বলে! ও গাড়ি ওই বাঁজা মানুষদেরই ভাল। ছেলেপুলের ঘরে গেরস্তপোষা গাড়ি নইলে মানায়? ছিঃ।

যেন মানানোর প্রশ্ন বিস্মরণ হয়ে নিজেই গাড়িটা আহরণ করেছেন সরোজাক্ষ। তবু মন্তব্যের ভঙ্গি এমনি তীব্র আর নিরাবরণ বিজয়ার।

হয়তো বিজয়ার গাড়িটার প্রতি এই সপত্নীর ঈর্ষা হত না, যদি সরোজাক্ষ তাঁকে ওই গাড়ি চড়িয়ে কালীঘাট গঙ্গার ঘাট করিয়ে বেড়াতেন, কিন্তু আশ্চর্য, কোনওদিন সে প্রস্তাব করেন না সরোজা। একদিনও করেননি।

বিজয়া কি নিজে মান খুইয়ে বলতে যাবেন?

তবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কানে কি আর তোলেন না কথাটা? কোনও কাউকে মাধ্যম করে সরোজাক্ষর কানের কাছে কি উচ্চারণ করেন না, কালী গঙ্গা? ঠাকুর মন্দির? হুঁ, পারতাম ছোটখুড়ির মতো বুড়ো বয়েস অবধি পিঠে আঁচল ফেলে শাড়ি আর টাইট ব্লাউজ পরে সন্ধ্যাবেলা গঙ্গার ধারে হাওয়া খেতে যেতে, তা হলে হয়তো ভাগ্যি ফিরত। দেখেছি তো খুড়িকে এ-যাবৎ। কে বলবে আমার থেকে আটন বছরের বড়। ছুকরিটি সেজে বরের পাশে বসে সিনেমা যাচ্ছেন, নিউ মার্কেটে যাচ্ছেন। বলি, শেষরক্ষা কি হল?

সরোজাক্ষ শুনতে পান।

কিন্তু সরোজাক্ষর চিরকালের পরম সাধনা, কানে তুলো দেওয়ার সাধনা। তাই বিজয়ার সব কথাই শূন্যে গদা ছোঁড়া। হয়তো এই ব্যর্থতার জ্বালা থেকেই বিজয়ার ভাষা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, জিভ আরও শাণিত হয়, কিন্তু সমোজাক্ষ আপন সাধনায় অবিচল থাকেন। সরোজাক্ষ কোনওদিনই বলে ওঠেন না, তোমার তা হলে শেষরক্ষার গ্যারান্টি আছে তো? শাড়ির বদলে গামছা সার করে, আর গোবর গঙ্গাজলের পারানি সঞ্চয় করে?

না, বলেন না, নীরবই থাকেন।

শুধু আজই হঠাৎ সরোজাক্ষ চিরদিনের সাধনা বিস্মৃত হয়েছিলেন।

সরোজাক্ষ ভাবতে চেষ্টা করলেন, পদত্যাগের প্রতিক্রিয়াটা কী হতে পারে? ঘরেবাইরে? অবশ্যই বাইরে সহস্র প্রশ্ন, আর বাড়িতে সহস্র শরাঘাত। পুরুষমানুষ রাগ করে উপার্জন ত্যাগ করতে চাইলে সংসার কবে তাকে ক্ষমা করে? কবে বলে থাকে–ঠিক করেছ। সত্যিই তো এমন অপমানের মধ্যে কখনও টেকা যায়? এ তো একদিনের ব্যাপার নয়, আবার হেঁট মাথায় ফিরে গেলে, রোজই করবে। তার চেয়ে এই ভাল।

বলে না।

বলতে পারে না। সমস্ত সম্পর্কই স্বার্থের শৃঙ্খলে বাঁধা। সেখানে এতটুকু টান পড়লেই কর্কশ শব্দ বেজে উঠবে।

অতএব ধরেই নিতে হবে, এ সংকল্প প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই খুব একটা অশান্তির মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে সরোজাক্ষকে।

কলেজেও হয়তো সহজে গৃহীত হবে না সেই পদত্যাগপত্র। কর্তৃপক্ষ সম্ভ্রম-সম্মানের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব নিতে না পারলেও অনুরোধ-উপরোধ আসবে সেখান থেকে। কারণ সেটা স্বার্থের ব্যাপার। প্রফেসর মৈত্রর পড়ানোর সুনাম আছে। কথাটা ভেবে পরক্ষণেই লজ্জিত হলেন সরোজাক্ষ। শুধুই কি স্বার্থ? সরোজাক্ষকে সকলেই কি ভালবাসেন না? অন্যান্য অধ্যাপকেরা, স্বয়ং অধ্যক্ষ? দায়িত্ব তাঁদের নেবার ক্ষমতা নেই তাই। যে-কোনও মুহূর্তে তাঁরাও এইভাবেই লাঞ্ছিত অপমানিত হতে পারেন। এ আশঙ্কা আছে তাঁদের।

হঠাৎ একটু কৌতুক বোধ করলেন সরোজাক্ষ–আমরা কি তবে সেই দেশে বাস করছি, যে দেশের ব্যবহার বিধিতে বেড়ালরা পালায় নেংটি ইঁদুরদের দেখে!

তাই, তা ছাড়া আর কি।

ঘরে বাইরে কর্মক্ষেত্রে-মর্মক্ষেত্রে ওই মজার দেশেরই লীলা আজ।

.

পদত্যাগপত্রের বিষয়ে পরামর্শের কেউ নেই। নিজেকেই চিন্তা করতে হবে।

বিজয়া কোনওদিনই তাঁর মর্মভাগিনী নয়, বিজয়ার সঙ্গে তাঁর দুর গ্রহের ব্যবধান। বিজয়া কোনওদিনই সরোজাক্ষর রুচিকে, চিন্তাকে, ভাবধারাকে বুঝতে চেষ্টা করেননি। বিজয়া আপন স্থূলবস্তুর জগতে বিচরণশীল। যদিও বিজয়া ওই ব্যবধানটা অনুভব করতে পারেন। সরোজাক্ষর সৌজন্য ভদ্রতা আর শান্ত ব্যবহারের আবরণ তাঁকে সশ্রদ্ধ করতে পারে না। সেই অনুভূতিটা অতএব আক্রোশপরায়ণ করে বিজয়াকে।

বিজয়া তাই যেন ইচ্ছে করেই অধিকতর স্কুল হন, অধিকতর কর্কশ।

কিন্তু শুধুই কি ইচ্ছে করে?

বিজয়ার উপাদানে আর কী-ই বা আছে? আর কী-ই বা ছিল?

অথচ সরোজাক্ষর সমস্ত কল্পনার সমস্ত ভাবনার একটি শরীরিণী মূর্তি একদা চোখে পড়েছিল সরোজাক্ষর। সরোজাক্ষর মনে হয়েছিল মানসী শব্দটার প্রকৃত অর্থ জানতে পারলাম আজ।

কিন্তু সেটা এ যুগের ব্যাপার নয়।

সরোজাক্ষ তখন তরুণ যুবক, সদ্য এম-এসসি পাশ করে বেরিয়েছেন। মেয়েটি বি-এ পাশ করে এম-এ পড়বার জন্যে বায়না ধরেছে তার অধ্যাপক পিতার কাছে।

সরোজাক্ষরই অধ্যাপক তিনি।

সরোজাক্ষ তখনও রুজি-রোজগারে স্থিতিশীল হননি, তবু লজ্জার মাথা খেয়ে করে বসেছিলেন প্রস্তাব।

হয়তো সেই সঞ্চারিণী পল্লবিনী শ্যামাঙ্গীর কৃষ্ণকালো চোখ দুটির মধ্যে সে প্রস্তাবের প্রশ্রয় ছিল।

কিন্তু সরোজাক্ষর লজ্জার মাথাটা খাওয়াই সার হল। সরোজাক্ষর বাবা নলিনাক্ষ বলে উঠলেন, ওরা তো গাঙ্গুলি। তার মানে রাঢ়ী? তা হলে?

তা হলে যে কি, তার অজস্র উত্তর ছিল সরোজাক্ষর মনের মধ্যে, তবু সরোজাক্ষ সেই কুঞ্চিত জ্বর নীচে মাথা তুলতে পারলেন না।

সরোজাক্ষর মা বললেন, বি-এ এমএ পাশ মেয়ে, বউ হয়ে আসবে? তার মানে তুই বিয়ে করেই আলাদা হতে চাস?

মার সামনে একটু কথা বলেছিলেন সরোজা। বলেছিলেন,কেন, আলাদা হবার কথাই বা আসছে কেন? পাশকরা মেয়েরা কি বাঘ না ভালুক?

মা সতেজে বলেছিলেন,আমাদের কাছে তাই।

কেন? আমিও তো এম-এ পাশ।

সেকথা রাখ। ছেলে আর মেয়ে সমান নাকি?

হ্যাঁ, তখনও একথা বীরদর্পে চলত।

ছেলে আর মেয়ে সমান নাকি?

মার কাছে যুক্তি ছিল না। শুধু রায় ছিল। কারণ রায় মানবার লোক ছিল।

তাই সরোজাক্ষ মানসীকে অপ্রাপ্য বস্তু বলে আশার জগৎ থেকে বিদায় দিলেন। আর যখন বউদি তার ঘোট বোন উত্ত্যক্ত করতে লাগল বাবাঃ, এক কেলে শুঁটকির বিরহে যে তুমি নিজে কালিবর্ণ হয়ে গেলে,তখন কিছুদিনের জন্যে এলাহাবাদে পিসির বাড়িতে চলে গিয়েছিলেন।

ওইখানেই ইতি। আবার ফিরলেন ম্লান গম্ভীর মুখ নিয়ে। যদিও

সরোজাক্ষ জানতেন প্রেমও নয় বিরহও নয়, এ শুধু একটা আশাভঙ্গের বেদনা। অধ্যাপকের মেয়ের সঙ্গে তাঁর হয়তো আঙুল গোনা কয়েকটি দিনের দেখা। তবুও–বেজেছিল বেদনা। তার কী হয়েছিল তার খবর পাননি কোনওদিন।

কিন্তু সরোজাক্ষ পাগলও নয়, বুন্ধুও নয় যে, সেই বেদনাকে সম্বল করে জীবন কাটিয়ে দেবার পণ করবেন।

সরোজা শুধু দৃঢ়স্বরে জানিয়েছিলেন, রোজগার না করে বিয়ে করব না।

নলিনাক্ষ ক্ষুব্ধ প্রশ্ন করেছিলেন, আমার একমাত্র পুত্রবধূকে একমুঠো ভাত জোগানোর ক্ষমতা আমার নেই?

সরোজাক্ষ বলেছিলেন, তা নয়, ওটা আমার একটা খেয়ালই ধরুন।

হয়তো খেয়াল, হয়তো নীতি, হয়তো বা কিছুটা সময়ক্ষেপ। তবে বাপ-মা আর বেশি ব্যস্ত করেননি। তাঁরাও হয়তো ভেবেছিলেন বড় মাছকে টেনে তুলতে হলে প্রথমে সুতো কিছুটা ছাড়াই দরকার, হঠাৎ টান মারলে ছিঁড়ে যাবে।

তাঁরা শুধু তলে তলে পরমাসুন্দরী খুঁজছিলেন, বিত্তবানের কন্যা হওয়াও আবশ্যক। হাঘরের মেয়ে তাঁদের পছন্দ নয়। তা সরোজাক্ষর মা বাবা তাঁদের মানসকন্যাকে আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছিলেন। পিতা বিত্তবান, কন্যা অ-বিদুষী। আর রূপ? হ্যাঁ, এখন শুনলে অবিশ্বাস্য হলেও একদা বিজয়া রূপসী ছিলেন। রূপসী, স্বাস্থ্যবতী, নবযৌবনা সেই কন্যাকে ছেলের কাছে ধরে এনে দিয়ে মা বাপ আড়ালে মুখ টিপে হেসেছিলেন।

এক সময় পথ শেষ হয়।

গোরুর গাড়িও পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট জায়গায়।

নিতান্ত অন্যমনস্ক হয়ে চললেও অভ্যস্ত হাত যথাপথেই চালিয়ে নিয়ে যায়।

পকেট থেকে চাবি বার করে বাড়ির পাশের ছাড়া জমিটুকুতে চালা তুলে নেওয়া গ্যারেজটা খুলে ফেলে গাড়িটা ঢুকিয়ে দেন সরোজা, আবার তালাবন্ধ করেন, ধীরে ধীরে বাড়ির মধ্যে ঢুকে আসেন।

সরোজাক্ষর বড় ছেলে নীলাক্ষ যে গাড়িটাকে মোচার খোলা বলে ব্যঙ্গ করে, হয়তো এটাও তার একটা কারণ। সরোজাক্ষর ওই স্বার্থপরের মতো কেবলমাত্র নিজের ব্যবহারের শেষে গাড়িটা তুলে ফেলা। কাউকে অফার না করা। নীলাক্ষর কি হাত নিসপিস করে না? ওই গাড়িটার ওপর হাত পাকিয়ে নিতে ইচ্ছে করে না? কিন্তু মান খোয়াতে কে চায়?

অথচ এই এক অদ্ভুত মনোভাব সরোজাক্ষর। তোমরা যখন আমার সেন্টিমেন্টের মূল্য বোঝো না, গাড়িটাকে যে আমি ছোটকাকার ভালবাসার মূর্তি হিসেবে দেখি তা বোঝো না, ছোট বলে ব্যঙ্গ করো, দাতব্যের মাল বলে কৌতুক করো, তখন ঠিক আছে–চড়ো না কেউ।

বাড়ির মধ্যে ঢুকে এলেন সরোজা।

বাপের আমলের বাড়ি, সেকেলে ধরনের গড়ন। মাঝখানে উঠোন, চারপাশে ঘর। চারের একদিকে দুখানা বৈঠকখানা, একদিকে রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর খাবারঘর, একদিকে বাজে বাড়তি ঘর আর স্নানের ঘর, আর বাকি দিকটায় সিঁড়ি উঠে গেছে দালানের মধ্য থেকে।

কোথাও কারও সাড়া নেই, কারণ বিজয়ার এখনও ঠাকুরঘর থেকে নামার সময় হয়নি। নামলেই কুরুক্ষেত্র বাধবে। ঠাকুর-চাকরের এতক্ষণকার গাফিলি, বউমার অনুপস্থিতি, ছেলের বে-আক্কেল, আর সরোজাক্ষর ঔদাসীন্য, সব নিয়ে চেঁচাতে শুরু করবেন। স-পুরী একগাড়ে করে ছাড়বেন।

কিন্তু এখন বাড়িটা যেন থমথম করছে। সরোজা অনুমান করতে পারলেন, নীলাক্ষ সেই একবার টেলিফোন করে নিশ্চিন্ত হয়ে বেড়াতে বেরিয়ে গেছে। বিজয়ার নিশ্চিন্ত অনিশ্চিন্ততার প্রশ্ন নেই। তিনি যদি সত্যিই চিন্তিত হয়ে থাকেন সরোজাক্ষর দেরি দেখে, হয়তো কিছু হরির লুট মেনে বসেছেন।

আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন সরোজাক্ষ।

সিঁড়িটা নীচের তলার দালান থেকে উঠতে উঠতে একবার দোতলার দালানের মুখে ক্ষণিক বিশ্রাম নিয়েই আবার একটা মোচড় খেয়ে বাঁক নিয়ে উঠে গেছে তিনতলার ইশারা বহন করে। কিন্তু ওর সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলে দেখা যাবে ইশারাটা মিথ্যা, তিনতলার ভরাটি দেহ কোথাও নেই। সিঁড়ির শেষটা খাঁ-খাঁ করা ন্যাড়া ছাদের মাঝখানে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

ছাদটায় বর্ষায় বৃষ্টি পড়ে পড়ে শ্যাওলা জমে, আবার বর্ষার শেষে রোদের দাপটে সে শ্যাওলা শুকিয়ে উঠে কলাই ডালের খোসার মতো গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে কোণে কোণে জমা হয়। তার খাঁজে খাঁজে খুদে খুদে আগাছার চারা জন্মায়। আবার দৈবাৎ কোনও একদিন সম্মার্জনীর মার খেয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় তারা।

কারণ ছাদের সীমানায় সিঁড়ির ঘরটা বিজয়ার ঠাকুরঘর। কাজে কাজেই বিজয়া আদৌ পছন্দ করেন না ঝি-চাকররা যখন তখন হুট করে ঝাঁটা নিয়ে উঠে এসে আশ্রমপীড়া ঘটায়। তা ছাড়া দরকারই বা কি? ছাদে আসছেই বা কে? দেখছেই বা কে?

নিতান্তই যখন দেখা যায় জঞ্জালের ছিপিতে ছাদের রে ওয়াটার পাইপের মুখ বন্ধ হয়ে উঠেছে, তখনই বিজয়ার আদেশপত্র গিয়ে পৌঁছয় নীচের তলায়। কোনও একজন ঝাঁটাধারী সাবধানে এসে সাফ করে দিয়ে যায় বিজয়ার কড়া পাহারার শাসনতলে।

নচেৎ বারো মাসই বিজয়া ওই ধুলো জঞ্জাল ভরা খাঁ-খাঁ করা ন্যাড়া ছাদটাকে সামনে নিয়ে নিজের সেই ছোট্ট এল শেপ কুঠুরিটিতে বসে থাকেন, কে জানে ধ্যানমগ্ন হয়ে কিংবা জপের মালার হিসেব নিয়ে।

দোতলাটা ভরা ভর্তি।

দোতলায় অনেক ঘর।

সিঁড়িতে উঠেই বড় দালান, দালানের দুপাশে ঘরের সারি। দক্ষিণের সারিতে প্রথমেই সরোজাক্ষর নিজের ঘর, তার পাশে অবিবাহিত পুত্র কমলাক্ষর ঘর, আপাতত সে এখন খঙ্গপুরে পড়তে গেছে, তাই ঘরটা ফাঁকা। কমলাক্ষর ঘরের পাশে সরোজাক্ষর দুই মেয়ের ঘর, যার মধ্যে একজন বিবাহসূত্রে ঘরের দখল ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে, অপরজনও যাই-যাই করছে। তবে এখনও সে এ ঘরে সবলে প্রতিষ্ঠিত। নিজের জিনিসপত্র ব্যতীত কারও একখানা রুমালকেও প্রবেশাধিকার দিতে নারাজ সে। হয়তো ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই তার দাবির ভাষা এত জোরালো। জোরের যেখানে ভিত নেই, সেখানেই তো মুখের আস্ফালন।

শুধু দিদি এলে মীনাক্ষী ঘরের দখল ছেড়ে মায়ের ঘরে শুতে যায়। কারণ দিদি অর্থেই তো জামাইবাবু।

কমলাক্ষর ঘরটায় কেউ শুতে রাজি হয় না। ঘরটার একটা বিরাট দোষ সরোজাক্ষর ঘরের সঙ্গে তার যে ব্যবধান প্রাচীর, সেটা একটা কাঠের পার্টিশন মাত্র। কথা বললে শোনা যায়। গুনগুনিয়ে গান গাইলে শোনা যায়, রাত জেগে গল্পের বই পড়লে আলো দেখা যায়।

সরোজাক্ষর ছেলেমেয়েরা ইচ্ছাসাপেক্ষে বাবার জ্ঞানগোচরে আসতে রাজি নয়।

মীনাক্ষীর ঘরের পরে, সামনে খোলা বারান্দাওলা সবচেয়ে বড় ঘরখানা সরোজাক্ষর বড় ছেলে নীলাক্ষর। সস্ত্রীক সপুত্র তার সেখানে বসতি। মীনাক্ষীর ঘরের মধ্যে দিয়ে মাঝখানে যে দরজাটা আছে, সে-দরজার ওপর একটা আলমারি চাপিয়ে রেখে নীলাক্ষ নিজের জন্যে একটা অন্য ভুবন গড়ে নিয়েছে। ওর ঘরে কেউ কদাচিৎ ঢোকে।

উত্তরধারে খানিকটা অংশ বারান্দা বাবদ খরচ হয়ে যাওয়ায়, ঘর দক্ষিণের মতো চারখানা না হয়ে তিনখানা। এই তিনখানা ঘরের দুখানা ঘর গৃহিণীর অধিকৃত। একখানায় তিনি মাত্র রাত্রিটুকুতে দেহরক্ষা করেন (আর সময় কোথা তাঁর?), বাকিখানায় সুরক্ষিত রাখেন তাঁর সাংসারিক মালপত্রের বোঝা। সে ঘরে নেই এমন জিনিস নেই। বাসনের সিন্দুক থেকে শুরু করে ভাঙা লোহা পর্যন্ত, বাড়তি বিছানা থেকে শুরু করে তোশক ঘেঁড়া টিকিন পর্যন্ত, সব জমানো আছে বিজয়ার সেই ঘরে। আছে ঘি-তেলের খালি টিন, কাঠি ফুরনো দেশলাই বাক্স, মশলা বাঁধা দড়ি, বাসি খবরের কাগজ, পরিত্যক্ত ঠোঙা। আরও কত কীই আছে। স্রেফ হরেকরকমবার ব্যাপার।

এগুলিতে সংসারের কারও হাত দেবার অধিকার নেই, কারণ এ ঘরের প্রত্যেকটি জিনিসই নাকি বিজয়ার একান্ত প্রয়োজনীয় এবং নিতান্ত বিশুদ্ধ। পাছে কেউ কোনও প্রয়োজনে বিজয়ার ধ্যানমগ্নতার অবকাশে ওগুলির বিশুদ্ধতা কলঙ্কিত করে বসে, তাই ঘরটাকে বিজয়া চাবিবন্ধ করে রাখেন।

আগে আগে সরোজাক্ষ বলতেন, বসবাস করা বাড়িতে চোখের সামনে একটা দরজায় তালা ঝুলছে এটা দেখতে বিশ্রি–এখন আর বলেন না।

কারণ বিজয়া তার জবাবে বলেছেন, তোমার সংসারে আমিও তো একটা বেমানান বিশি, তবু তো আছি চোখের সামনে দৃষ্টিশূল হয়ে।

বিজয়ার কথা বলার ধরনই এইরকম।

তা বিজয়ার ছেলেমেয়েদেরও কথায় কিছু ধরনআছে। ঘরটাকে কমলাক্ষ বলে মার মিউজিয়াম। ময়ূরাক্ষী বলে, মার বৈরাগ্যের নিদর্শন; আর মীনাক্ষী বলে সাড়ে বত্রিশ ভাজার খিলি।

নীলাক্ষ ঠিক এ ধরনের কথা বলে না, সে চাপা রাগের গলায় বলে, এটা হচ্ছে স্রেফ নির্লজ্জ দখলের নমুনা। আমি কেবলমাত্র একটা ঘরে কত অসুবিধেয় পড়ে আছি, অথচ উনি আস্ত একটা ঘরে শুধু জঞ্জাল ভরে রেখে

আরও একটা বরবাদি ঘর নিয়েও চাপা সমালোচনার ঝড় বয়, কিন্তু সরোজাক্ষর মুখোমুখি এসে পৌঁছয় না ঝড়টা। ওই জায়গাটায় যে সরোজাক্ষর মনোভাব অনমনীয়, সেটা সকলেরই জানা। সে ঘরটা ঠিক সিঁড়িতে উঠেই বাঁ হাতি, অর্থাৎ সরোজাক্ষর ঘরের সামনাসামনি। ঘরটার দরজায় একটা ছিটের পরদা আছে বটে, কিন্তু সেটা ঝোলানো থাকে কদাচিৎ, ওলটানোই থাকে সব সময়, কাজেই ঘরের অধিকর্তাকে সর্বদাই দেখতে পাওয়া যায়।

নীলাক্ষর মতে সেটাও একটা কুদৃশ্য, কিন্তু ওর আর প্রতিকার নেই। লোকটা নীলাক্ষর ঠাকুর্দার জামাই, আর এ-সংসারে আছে সেই ঠাকুর্দার আমল থেকেই। মগজে ছিটওয়ালা বেকার জামাইটিকে ভদ্রলোক দিব্যি জামাই আদরেই প্রতিষ্ঠিত করে রেখেছিলেন। সরোজাক্ষও সেই আসন থেকে টেনে নামাননি তাকে। বোন কবে মরে ভূত হয়ে গেছে, ভগ্নীপতি রয়ে গেছে। এখনও তার জন্য যখন তখন রাবড়ি আসে, রাজভোগ আসে, বড় গলদা চিংড়ি, রুইমাছের মুড়ো আসে। তার বাসনা হলেই আসে। এই বিরাট দৃষ্টিশূল জিনিসটাও সয়ে যেতে হয় সরোজাক্ষর সংসারকে।

কারণ ওটা সরোজাক্ষর স্পেশ্যাল খরচ।

ছেলেমেয়েদের পক্ষে এই আতিশয্যে এই অপচয়ে বিরক্ত হওয়াই স্বাভাবিক, অপর আত্মীয়রা অথবা অনাত্মীয়রাও শুনে বলে অনাসৃষ্টি। কিন্তু সইতে হচ্ছেই।

ছেলেবেলায় অবশ্য পিসিবর্জিত পিসেমশাই ছেলেমেয়েদের কাছে রীতিমত আকর্ষণের বস্তু ছিল। কারণ ছেলে ভোলানোর বহুবিধ কৌশল ছিল তার আয়ত্ত। বলতে কি, নিজেই সে শিশু বনে যেতে পারত, সমবয়সী হয়ে যেতে পারত ওদের।

কিন্তু ওরা তো আর কেউ চিরশিশু নয়। ওদের শৈশব যথাসময়েই গত হল এবং সেই অতিক্রান্ত শৈশববিজ্ঞেরা তাদের সদ্যলব্ধ জ্ঞানচক্ষুর দ্বারা বুঝে ফেলল কী ঘোরতর একটা অপচয়ের ধারা অনাহত স্রোতে বয়ে চলেছে সংসারে।

অথচ–

হ্যাঁ, অথচ সরোজাক্ষ কর্মক্লান্ত শরীরে সিঁড়ি উঠে এসে প্রথম সম্বোধন করেন তাঁর ওই দীর্ঘকালের বিপত্নীক ভগ্নীপতিটিকেই। উঠেই বাঁ দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন, কী সারদা, কী হচ্ছে? নতুন কোনও আবিষ্কার হল নাকি আজ?

সারদাপ্রসাদ সামনে পিছনে পাশে কোলে নতুন পুরনো ছেঁড়া ময়লা বই কাগজের বস্তা নিয়ে বসে থাকে চৌকিতে, সাড়া পেয়ে চোখ তোলে, অথবা চোখ না তুলেই বলে, আবিষ্কার কি দাদা, এ তো পড়েই আছে। চন্দ্ৰসূর্যের মতো সত্যি। আমরাই কেবল চোখ থাকতে অন্ধ। আমি শুধু সেই দৃষ্টিটা খুলে দিতে চাইছি–

লোকের জ্ঞানদৃষ্টি খুলে দিতে চাইছে সারদাপ্রসাদ; অর্থাৎ বিরাট এক গবেষণা পুস্তক লিখছে সে।

সারদাপ্রসাদের গবেষণার বিষয়বস্তু হল–আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রাচীন যোগশক্তি। আধুনিক বিজ্ঞান যা দিয়েছে, অথবা নিত্য নতুন চেহারায় দিয়ে চলেছে, সেসব যে প্রাচীনকালের যোগী-ঋষিদের কাছে ছেলেখেলা মাত্র ছিল, হাজার হাজার বছর আগে এই ভারতবর্ষই যে বিজ্ঞানের শেষ কথা বলে গেছে, এই সত্যটি প্রমাণ করবার জন্যে জীবন পাত করে চলেছে সারদাপ্রসাদ। সারাজীবন ধরে এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে সে, তত্ত্ব অনুধাবন করছে এবং তুলনা ও উদাহরণ লিপিবদ্ধ করছে। সব গোছানো হয়ে গেলেই থিসিসটি লিখে ফেলার কাজে হাত দেবে।

সরোজাক্ষ মাঝে মাঝে খোঁজ নেন, কী সারদা, তোমার থিসিসের কতদূর?

সারদাপ্রসাদ মহোৎসাহে বলে, এই তো দাদা, এইবার আরম্ভ করব। এদিক ওদিক আর সামান্য একটু গোছানো বাকি।

সরোজাক্ষ হয়তো কোনও সময় মৃদু হেসে চলে যান, হয়তো কোনও সময় মৃদু হেসে বলেন, আরম্ভটা করেই ফেলল। হাত না দিলে এগোবে না।

না দাদা, সারদাপ্রসাদ আত্মস্থের গলায় বলে, সবদিক থেকে গুছিয়ে না নিয়ে হাত দেওয়াটা ঠিক নয়। গোছটা হয়ে গেলেই হেসে ওঠে সারদাপ্রসাদ, ধরব, আর মারব।

সারদাপ্রসাদের পৈতৃক সম্পত্তির নিজ অংশ থেকে মাসে মাসে কিছু ভাড়া পায়, জ্ঞাতি ভাইপোরা করুণাপরবশ হয়েই হোক, বা চক্ষুলজ্জার বশেই হোক, পাঠিয়েই দেয়, মেরে নেয় না। সেই টাকায় সারদাপ্রসাদ রাজ্যের পুরনো পুরনো বই কেনে, আর দিস্তে দিস্তে কাগজ কেনে। সে সব কাগজের পারিপাট্য কম নয়, আলাদা আলাদা অধ্যায় হিসেবে পাঞ্চকরে, দড়ি বেঁধে, মলাট লাগিয়ে, দস্তুরমতো ব্যবস্থা করে রাখে সে। এমনকী পর পর পৃষ্ঠাসংখ্যা পর্যন্ত লিখে রাখে, যাতে পরে না এলোমেলো হয়ে যায়। এখন শুধু ধরা আর মারাটাই বাকি।

বিজয়া এক-আধ সময় তীক্ষ্ণ হুল ফোঁটানো গলায় বলেন, সময়কালে ওই ধরা আর মারার অভাবেই আমরা আজ পড়ে মার খাচ্ছি।

কমলাক্ষ যখন ছুটিতে আসে, মাঝে মাঝেই বলে, পিসেমশাইয়ের ওই ধরা আর মারাটা যদি আমাদের জীবকালে হত, তা হলে দেখে যেতে পারতাম।

ময়ূরাক্ষী কদাচ আসে।

তবু কড়া হুল বিঁধিয়ে বলে,আরে বাবা, আমি যা বলছি সারকথা, ওই থিসিসটি একটি আবরণমাত্র। বউ নেই, অথচ শ্বশুরবাড়িতে শেকড় গেড়ে বসে আছি–এই লজ্জাটি ঢাকবার ছল। মনে হচ্ছে থিসিস উনি কোনওকালেই লিখবেন না। দেখে নিও তোমরা। আমি বলছি–পাগলও নয় ছাগলও নয়, স্রেফ ফন্দিবাজ ধূর্ত।

আগে ময়ূরাক্ষী এত আক্রোশের গলা তুলত না, এখন তোলে। ওর বর ওর বাপ-ভাইকে বোকা বুদ্ধ বলে বড় ঠাট্টা করে বলে লজ্জায় অপমানে আক্রোশ জন্মে গেছে। নইলে পিসেমশাই যে ওদের সংসারে বাড়তি মাল, অনাবশ্যক জঞ্জাল, পরগাছা, এসব কথা ওর মাথায় আসত না। এখন আসে। বরের ভাবেই ভাবিত ময়ুরাক্ষী, বরের চোখেই জগৎ দেখে।

মীনাক্ষীর অবশ্য সে প্রশ্ন নেই, কারণ মীনাক্ষীর এখনও বর হয়নি। কিন্তু নিজেই সে দুনিয়া দেখতে শিখে ফেলেছে; তাই তার চোখেও পিসেমশাইয়ের এই নিশ্চিন্ত জীবনটি অসহ্য। তাই মীনাক্ষী বলে, মরে মনিষ্যি হব, ঘরজামাই হয়ে জন্ম নেব! বাবাঃ কার জামাই কে পুষছে।

বলে, তবে সরোজাক্ষর সামনে নয়।

সরোজাক্ষ যে বকেন তা নয়, সরোজাক্ষ কেমন অদ্ভুত একটা ধিক্কার দেন। এ ধরনের কথার আভাসমাত্র শুনলেই একবার চোখ তুলে বলেন, এসব ছোট কথা তোমাদের মাথায় আসছে কী করে। বলো তো?

অতএব বাবার সামনে নয়।

অতএব সরোজাক্ষ সিঁড়িতে উঠেই প্রথম সম্বোধন করেন তাঁর বাড়ির সেই অবান্তর লোকটাকেই। কী সারদা, কাগজপত্র আছে তো? কী সারদা, বিকেলে একবার বেরোও না? শরীর ভাল থাকবে কী করে?–সারদা, একটা বাংলা টাইপরাইটার থাকলে তোমার বেশ সুবিধে হত, তাই না?

ওরা শুনতে পেলে ঘরে বসে দাঁতে দাঁত পিষে বলে, তা দাও না, তুমিই একটা কিনে দাও। এত যখন ভালবাসা!বলে, শরীর ভাল থাকার সুরও তো কিছু দেখি না। আহারটি যা দেখা যায়… বলে, ওঃ কাগজের খোঁজ নেওয়া হচ্ছে, তার মানে এসে যাবে দু-চার দিস্তে।

তবে যাকে প্রশ্ন করা হয়, সে বোঝে এগুলো প্রশ্নের জন্যে নয় কথার জন্যে। কথা বলবার একটা উপলক্ষ। তাই সে আত্মস্থর গলায় বলে, আপনিও যেমন দাদা, আবার টাইপ মেশিন! ভগবান পাঁচ-পাঁচটা আঙুল তবে দিয়েছে কেন?..বলে, শরীর? এ শরীর হচ্ছে দধীচির হাড়ে তৈরি বুঝলেন? বজ্র, বজ্র!.বলে, কাগজ থাকবে না? ফুরুতে দিই নাকি? কমতে নামতেই এনে মজুত করি না?

ব্যস ওই পর্যন্তই।

সরোজাক্ষ হয়তো ততক্ষণে নিজের ঘরে ঢুকে পড়েছেন।

আজ কিন্তু সরোজাক্ষ কথা বলতে ভুলে গেলেন, সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে নিঃশব্দে নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। ভয়ানক একটা ক্লান্তি অনুভব করছেন, তাই কখনও যা না করেছেন তাই করলেন। হাতমুখ না ধুয়ে পোশাক না ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। সরোজাক্ষর পক্ষে এটা একটা লক্ষণীয় অনিয়ম।

শুয়ে থাকতে থাকতে সরোজাক্ষ শুনতে পেলেন তিনতলায় সিঁড়ি থেকে বিজয়া সশব্দে স্বগতোক্তি করছেন, পোড়ারমুখো কলেজে কি রোজই মিটিং? এই এতখানি রাত হল, এখনও মিটিং চলছে? ধন্যবাদ, ধন্যবাদ!

ধন্যবাদটা কাকে দিচ্ছেন বিজয়া তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না। সরোজাক্ষকে, না কলেজ কর্তৃপক্ষকে, কে জানে!

সরোজাক্ষ তবু উঠে পড়ে সাড়া দিলেন না, যেমন পড়ে ছিলেন, পড়ে রইলেন। কিন্তু একটু পরেই ঘরের মধ্যে পদশব্দ। তার সঙ্গে একটা উদ্বিগ্ন প্রশ্ন, দাদা, এসে শুয়ে পড়লেন যে? শরীর খারাপ হয়নি তো?

বন্ধ চোখটা খুললেন সরোজাক্ষ, আর কেন কে জানে হঠাৎ চোখ দুটো তাঁর জ্বালা করে উঠল।

উঠে বসলেন।

সহজ গলায় বললেন, না না, শরীর ঠিক আছে।

অনেক দেরি হল। মিটিং ছিল বুঝি?

সরোজাক্ষ একবার ওর দিকে তাকালেন, কেমন একটু হেসে বললেন, না, ওরা আমায় আটক করেছিল।

আটক! ওরা! কারা?

সারদাপ্রসাদ অবাক গলায় তাকায়।

সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, ছেলেরা! আমার ছাত্ররা। ঘেরাও করেছিল, ক্ষমা চাইয়ে তবে ছেড়ে দিল।

সারদাও হেসে বলে, ধ্যাৎ কী যে বলেন! ঠাট্টা করছেন।

ঠাট্টা নয় হে, সত্যিই!

সারদা বলে, সত্যি! আপনি ক্ষমা চাইলেন, এই কথা বিশ্বাস করব আমি?

সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, আধুনিক জগতে অবিশ্বাস্য বলে কোনও কথা নেই সারদা! ওটা সেকেলে হয়ে গেছে।

সারদা হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে, ওটা সেকেলে হয়ে গেছে? ভারী বড়াই আধুনিক যুগের। বলি কীসের বড়াই? চাঁদে গুতো দিতে যাচ্ছে বলে? বলি প্রাচীনকালের পুরাণ, উপপুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, এসব খুলে দেখেছে আধুনিক যুগ? দেখেনি, দেখে না। দেখলে বুঝতে পারত চাঁদ তো তুচ্ছ কথা, ইন্দ্রলোক বরুণলোক বায়ুলোক,–এমনকী গোলোক পর্যন্ত ফটফটিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ। অবশ্য হরে নরে যদু মধুরা কি আর? তারা একাল সেকাল চারকালেই এক। বেড়াতেন যোগসিদ্ধরা। যোগসিদ্ধ বলতে কী বোঝায়? বিজ্ঞানসিদ্ধ। স্রেফ নামের পার্থক্য। একাল বলে বিজ্ঞান, সেকাল বলত যোগ। যোগটাই উপযুক্ত নাম। যোগঅর্থাৎ মনঃসংযোগ। তাই মনঃসংযোগের ফলেই বস্তুতে বস্তুতে রাসায়নিক যোগ, দুরের সঙ্গে নিকটের যোগ।

এসব কথা অবশ্য সরোজাক্ষর শতবার শোনা, তবু ওই উৎসাহ-প্রদীপ্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, তাই তো, এটা তো সত্যি ।

বলতেই হবে সত্যি– উদ্দীপ্ত মুখ আরও উদ্দীপ্ত হয়, তবেই বলুন, বড়াইটা তোরা করছিস কী নিয়ে? বিজ্ঞান দেখাচ্ছে। আরে বাবা, এ যুগ তো বিজ্ঞানের অ আ ক খ শিখছে, আর সেকালের যোগীঋষিরা? তার অনুস্বর বিসর্গ চন্দ্রবিন্দু সব শেষ করে ফেলেছিল। নারদ ঋষি ঢেঁকি চড়ে ত্রিভুবন পয়লট্ট করে বেড়াত। সেই চেঁকিটি কী?

সারদাপ্রসাদ রহস্যব্যঞ্জক হাসি হেসে বলে, লিখব সেকথা! ঢেঁকিটি আর কিছুই নয়, একটি পাওয়ারফুল হেলিকপ্টার। সেইটিতে চেপে শূন্যে ঘুরত, নীচে থেকে চাষা-ভুষোরা বলাবলি করত ঠিক যেন ভেঁকি। সেই থেকে ওইটাই চলিত হয়ে গেছে।-মনোরথ মানে কী? ওই বস্তু।–উঃ ভাবতে গেলে মাথা খারাপ হয়ে যায় দাদা–সারদা যেন ছটফটিয়ে ওঠে,আধুনিক বিজ্ঞান এক একটা রকেট ছুঁড়ে মনে করছে কী বাহাদুরিই করলাম! আর সেকালে? গ্রহে গ্রহে যাতায়াত, আদানপ্রদান, এসব কিছুই নয়। ধরুন, বৃহস্পতি গ্রহের একটা ছেলে শুক্র গ্রহে এসে লেখাপড়া করল, প্রেম করল, কত কীর্তিই দেখাল। বিজ্ঞানের কতখানি উন্নতি হলে তবে এসব সম্ভব বলুন? এ যুগের তোরা তো বড় বড় মারণাস্ত্র আবিষ্কার করে মনে করছিস কী কাণ্ডই করলাম, আর সেকালে? মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী অমর হওয়ার মন্ত্র!

সারদা পায়চারি করে বেড়ায়, মাথার চুলটা মুঠো করে চেপে ধরে, ভাবলে জ্ঞান থাকে? বলুন?

সরোজাক্ষ খুব ক্লান্তি অনুভব করছিলেন, তবু মৃদু হাসলেন, না না, জ্ঞানটা রাখা দরকার। ওটা হারানো ঠিক নয়।

দরকার তো বুঝলাম, কিন্তু থাকে কই? যখনই চিন্তা করি, মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে। এই আমরা ভারতবর্ষের লোক আজ যেন ভিখিরি। আমাদের কিছু ছিল না, কিছু নেই। আমরা মূর্খ, অজ্ঞ, হা-দেখলে! অথচ আমাদের সবই ছিল।

সরোজাক্ষ বিষণ্ণ গলায় বলেন, কী ছিল তা জানি না সারদা, তবে এখন যে কিছু নেই তা জানছি।

সারদা দৃঢ় গলায় বলে,শুধু সেটা জানলেই তো চলবে না, তার প্রতিকার করতে হবে। জগৎ সমক্ষে এইসব প্রমাণপত্র নিয়ে গিয়ে গিয়ে দাখিল করে তাদের তাজ্জব করে দিতে হবে। কী করে রাষ্ট্রদূতেরা? দেশের পয়সা খরচ করে বিদেশে বসে থেকে? শুধু বিলাসিতা, শুধু দেশের নাম ডোবানো, এই তো? কেন, দেশের মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে নিয়ে যেতে পারে না এইসবনজির? বলতে পারে না ভারী তোরা আজ বিমান যুদ্ধের বড়াই দেখাস, মেঘনাদের নাম শুনেছিস? জানিস রাবণ সীতাকে হরণ করে নিয়ে গিয়েছিল কীসে চেপে? পুষ্পকরথ শব্দটার অর্থ কী? না, তা বলবে না, শুধু বিদেশে গিয়ে এই গরিব দেশের পয়সায় লঞ্চপানি করবে, মদ খেয়ে বেহেড হবে।

সরোজাক্ষর মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল, সরোজাক্ষর আর কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, তবু বললেন, এক কাজ করো সারদা, এই নিয়ে নতুন একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলল।

আপনি বলবেন তবে লিখব? সারদা হাসে, এ সবই তো তৈরি! নেহাত কাটাকুটি তাই আপনাকে পড়তে দিতে পারছি না, নচেৎ দেখিয়ে দিতাম কীভাবে হেনস্থা করেছি ওদের। মানে ওই আমাদের দেশের কেষ্ট-বিষ্ণুদের। কালোবাজারিদের দুষি আমরা। কিন্তু আমি বলব ওই আমাদের দেশের মাথারা, রাষ্ট্রদূতেরা, তার থেকে অনেক বেশি অনিষ্টকারী! কালোবাজারিরা যা করছে, তার পিছনে তবু একটা যুক্তি আছে। ব্যবসা করতে নেমেছে, দু পয়সা লুঠতে চেষ্টা করছে। আর তোরা? শিক্ষিত সভ্য নামধারী অসভ্য অশিক্ষিতরা? একহাতে ভিক্ষের ঝুলি বয়ে বেড়াচ্ছিস, আর অন্য হাতে পয়সার হরির লুঠ দিচ্ছিস। ওদের দেশের ছেঁড়া কাঁথা কুড়িয়ে এনে গায়ে জড়িয়ে বলছিস–দেখ দেখ, আমরা কেমন সেজেছি। আর বলছিস কাকে?না, ওদের কাছেই। বুঝিসনা কত হাস্যাস্পদ হচ্ছিস। অথচ নিজের ঘরে লক্ষ্মীর ঝাঁপি, নিজের ঘরে শাল দোশালা।

শুনে শুনে সরোজাক্ষর এসব মুখস্থ হয়ে গেছে, কারণ সারদাপ্রদাদের যখনই মাথার মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে, তখনই সারদার মুখ থেকে এইসব জ্বালাময়ী বাণী বেরোতে থাকে। এ-জ্বালা নিরোধের একমাত্র ওষুধ নতুন একটা চ্যাপ্টার লিখে ফেলার অনুরোধ।

সরোজা আবার সে অনুরোধ করেন।

সারদা গম্ভীরভাবে বলে, এই চললাম দাদা, টাকা-টাটকি লিখে ফেলাই ভাল।

সেই ভাল।

বলে আবার শুয়ে পড়েন সরোজা।

সারদা ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েও আবার ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, বই আমাকে দুটো লিখতে হবে দাদা! একটা হচ্ছে আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রাচীন যোগশাস্ত্রের তুলনামূলক ব্যাখ্যা, আরআর একটা হচ্ছে আজকের এই অধঃপতিত ভারতবর্ষের

সারদার আবেগে বাধা পড়ল, ওপর সিঁড়ি থেকে বিজয়ার গলা শোনা গেল, এত আড্ডা হচ্ছে কার সঙ্গে ঠাকুরজামাই? শালাবাবু বুঝি এসেছেন?

সেরেছে! বউদি!বলে সারদা ছেলেমানুষের মতো দৌড় দেয়।

বিজয়া দরজায় এসে দাঁড়ান।

সশব্দ স্বগতোক্তি করেন, ছুটে পালানো দেখো। যেন চোর-ছ্যাঁচোড়। তারপর কণ্ঠস্বর ঈষৎ তোলেন, আমার এখনও পুজোপাঠ শেষ হয়নি।

সরোজাক্ষ ইঙ্গিতটা বোঝেন, নিঃশব্দে উঠে দরজার পরদাটা সরিয়ে দিয়ে এসে বসেন। না, শুয়ে পড়েন না আর, বসে থাকেন ঋজু হয়ে।

বিজয়া এক পা রথে, এক পা পথের ভঙ্গিতে দরজায় দাঁড়িয়ে তিক্ত গলায় বলে ওঠেন, রোজ রোজ কীসের এত মিটিং?

সরোজাক্ষ ওই তিক্ত কণ্ঠের উৎসের দিকে একবার তাকান। দেখেন শরীরটা এত অকথ্য অযত্নেও অমলিন। হলুদরঙা কপালটার উপর মস্ত বড় সিঁদুর টিপটা নিত্য দিনের মতোই জ্বলজ্বল করছে। নিত্যদিনের মতোই জ্বলজ্বল করছে গরদ শাড়ির চওড়া লালপাড়টা। গায়ে জামা শেমিজের বালাই না থাকায় ডানদিকের অনাবৃত কাঁধটা দেখা যাচ্ছে, সেই অংশটুকুও সমান জ্বলজ্বলে। শুধু মাংসভারহীন।

ওই জ্বলজ্বলে দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে দেখে হঠাৎ একটা হিংস্র কল্পনা মনে এল শান্তস্বভাব সরোজাক্ষর। সরোজাক্ষ ভাবতে চেষ্টা করলেন বিধবা হলে ওকে কেমন দেখাবে।

মনে মনে ওঁর সর্বাঙ্গ থেকে লাল রং মুছে নিলেন সরোজা, শাড়ির পাড়ের লাল, সিঁদুরের লাল, হাতের শাঁখার লাল। তারপর মনে মনে বললেন, একটা হলদে কাঠের পুতুল দেখাবে, স্রেফ একটা হলদে কাঠের পুতুল। মনে মনে ওঁর রংটা মুছে ফেলতে থাকেন সরোজা।

বিজয়া এই অবকাশে অসহিষ্ণু হলেন, আবার বললেন, ইস্কুল কলেজের মিটিং রাতদুপুর অবধি চলে?

সরোজাক্ষ নির্লিপ্ত গলায় বললেন, মিটিং ছিল না।

মিটিং ছিল না? বিজয়ার তেতো গলা সন্দেহে তীক্ষ্ণ শোনায়, তবে যে নীলু বলল, টেলিফোনে বলেছে মিটিং হচ্ছে।

তা হবে।

তা হবে? চমৎকার! কী নিশ্চিন্দি! বাড়ির লোকের যে দুশ্চিন্তা বলে কিছু থাকতে পারে সেটা বোধ হয় স্মরণে থাকে না?

দুশ্চিন্তা!

সরোজাক্ষ আর একবার ওই লাল প্রহরীদের দিকে তাকালেন। ভাবলেন যমের কি সাধ্য হবে তোমার ওই প্রহরীদের অতিক্রম করে বৈধব্য ঘটাতে পারবে তোমার?

মুখে বললেন, দুশ্চিন্তার কী আছে?

তা তো বটে। বিজয়ার সর্বপ্রকার বাহুল্য মাংসবর্জিত মুখের নিখুঁত কাঠামোখানা আরও কাঠ দেখাল। বিজয়ার কটুকণ্ঠ ধ্বনিত হল, বলাই ভুল হয়েছিল আমার।

সরোজাক্ষ এতক্ষণে উঠে গায়ের জামাটা খুলে আলনায় টাঙিয়ে রাখতে রাখতে বলেন, নীলু বাড়ি আছে?

নীলু? বিজয়া উলটোনো ঠোঁটে অবজ্ঞার ভঙ্গি ফোঁটান, কেন? বাপের বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে বলে? দুশ্চিন্তায়?

সরোজাক্ষ একটু ব্যঙ্গের গলায় বলেন, আশ্চর্য কি! এই তো শুনেছিলাম বাড়ির লোক দুশ্চিন্তায় কাতর।

হুঃ! তা হলে তো তরেই যেতাম! ছেলে টেলিফোনে একবার বাপের খবর নিয়ে কর্তব্য সেরে বেরিয়ে গেলেন, বউও তার সঙ্গে নাচতে নাচতে চলে গেলেন, ব্যস আর কি চাই? সাজের কী ঘটা। পেটকাটা পিঠকাটা একবিঘৎ জামা, হাওয়ার শাড়ি, ঠোঁটে নখে রং, দেখলে মাথা কাটা যায়। ছিলেন তো একখানা ঘরের ভাড়াটের মেয়ে, নম্রতা ভব্যতা সভ্যতার ভেকও ছিল, এখন নিজ মূর্তি ধরেছেন!

বিজয়া মুখ বাঁকালেন।

সরোজাক্ষ ভাবলেন, অন্যায় কথা বলব না, শুধু এই নীতিই কি সভ্য মানুষের শেষ নীতি? অন্যায় কথার প্রতিবাদ না করাটাও কি অন্যায় করারই নামান্তর নয়? অথচ সরোজাক্ষ ওই না বলার নীতিতেই প্রতিষ্ঠিত থেকে নিজেকে সভ্য শিক্ষিত ভেবে স্বস্তিতে থাকেন।

এই দুর্বল নীতিই কি তাঁকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে? প্রথম থেকে কঠোর শাসনের নীতিতে বিশ্বাসী হলে আজকের ইতিহাস অন্য হত? ঘরে এবং বাইরে?–

কিন্তু সরোজাক্ষ কোনওদিন শাসনের পথ ধরেননি, প্রতিবাদেরও নয়। নির্লিপ্ত থাকবার সাধনাটাই অভ্যাস করেছেন।

ভুল করেছেন কি ঠিক করেছেন, সে হিসেব করতে না বসে হঠাৎ অভ্যস্ত সাধনা থেকে চ্যুত হয়ে বলে ওঠেন, মূর্তিটা তিনি নিজে ধরেননি, তাঁর গুণবান স্বামীই তাঁকে নতুন মূর্তিতে গড়ে তুলেছেন।

কথাটা সত্যি।

নীলাক্ষর স্ত্রী সুনন্দা ছিল নেহাতই গেরস্থালি ঘরের মেয়ে। সুনন্দা বাল্যে তার গরিব বাবার সেই একখানা ঘরের সংসারেরও একটি কোণে বসে শিবপুজো করেছে, পুণ্যিপুকুর করেছে। সুনন্দা তরুণী হয়ে উঠেও বারব্রত করতে ভালবাসত। সুনন্দা গুরুজন দেখলে মাথায় কাপড় দিত, আর মাথা হেঁট করত। সুনন্দা পায়ে আলতা পরত, সুনন্দা স্নান করে উঠে সিঁদুর না পরে জল খেত না। সেই সুনন্দাকে ভেঙে গড়েছে নীলাক্ষ।

কিন্তু ভাঙাটা কি খুব সহজে হয়েছিল? নীলাক্ষকে কি তার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে নিষ্ঠুর হতে হয়নি? যথেষ্ট পরিমাণে কৌশলী? একদিনে তো ভাঙেনি, তিলে তিলে দিনে দিনে। অনেক অনিচ্ছা, অশ্রুপাত, প্রতিবাদ, প্রতিরোধকে উপেক্ষা করে সেই সাধারণীকে ভেঙে নিশ্চিহ্ন করল নীলাক্ষ। তারপর?

তারপর এই নতুন মূর্তি।

যা দেখে নীলাক্ষও এখন মাঝে মাঝে ভয় পায়, বিস্মিত হয়।

এখন আর সুনন্দা শুধু নীলাক্ষর প্রয়োজনেই পেটকাটা বুককাটা ব্লাউজ পরে অতি আধুনিকার মার্কা মেরে পার্টিতে যায় না। এখন সে নিজের সংগৃহীত নিমন্ত্রণপত্রে পার্টিতে পার্টিতে ঘুরে বেড়ায়, হি-হি করে হাসে, মিহি করে কথা বলে, আর এমন ভাব দেখায় যেন চিরকালই সে এই জীবনে অভ্যস্ত।

নীলাক্ষ যেখানে বউকে ওর ডিলারদের সঙ্গে শুধু হেসে কথা বলতে বলে, সুনন্দা সেখানে তাদের গা ঘেঁষে বসে উদ্দাম হাসিতে নিজেকে ছেড়ে দেয় তাদের গায়ে।

নীলাক্ষ তার বউকে টোপ করে গভীর জলের রুই কাতলাকে খেলিয়ে তুলতে চেয়েছিল,নীলাক্ষর বউ তার স্বামীকে সে রকম দু-দশটা রুই কাতলা ধরে দিয়ে নিজেই কোন ফাঁকে গভীর জলের মাছ হয়ে গেছে।

ওদের একটা ছেলে আছে, যার ভাল নাম উজ্জ্বলাক্ষ, আর ডাকনাম বিচ্ছু। ছেলেটা আগে প্রাণ ছিল সুনন্দার, এখন যেন অসুবিধের বোঝ। অন্তত তার কথাবার্তায় আর ব্যবহারে তাই যেন মনে হয়। যখন তখনই বলে আর একটা বছর গেলেই বোর্ডিঙে দিয়ে দেব ওটাকে।আর বলে বেশ সরবেই।

সরোজাক্ষ শুনতে পান, কিন্তু ডেকে হেঁকে কোনওদিন সে সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করেন না। সমর্থনে কি অসমর্থনে কোনওদিকেইনা। তবু তাঁর যেন মাঝে মাঝে মনে হয় বুঝি সেটাও ভাল। অন্তত ছেলেটা তার বোধের দরজা খোলার পর যেন টের না পায় সে তার মা-বাপের একটা অসুবিধে! সে তার মা বাপের স্বচ্ছন্দ জীবনযাত্রার পথে বাধা-স্বরূপ।

কিন্তু কথাটা বিজয়ার কানে পৌঁছলেই তিনি মন্তব্য করে বসেন। বলেন, তা দেবে বইকী বোর্ডিঙে। নইলে বাবা-মার সাহেব হওয়াটা হবে কী করে? একটা মাত্তর ছেলে, সে ছেলেটাকে পাঁচ বছর পার হতে না হতে বাড়িছাড়া করে দেবার কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না? মায়া-দয়া বলে বস্তুটা কি ভগবান তোমাদের শরীরে দেননি?

সুনন্দা, যে সুনন্দা নাকি বিয়ের পর বেশ কয়েকটা বছর শাশুড়ির সঙ্গে মুখ তুলে কথা বলতে পারত, সে এখন তার খাটো চুলের গুচ্ছ নাচিয়ে অমায়িক গলায় বলে, তা বোধ হয় দেনই নি। তা আপনার যদি মন কেমন করে, আপনিই নিন না ভার। আমার সময় কম, দেখাশোনা করতে পারি না বলেই

বিজয়ার রাগ আছে, তেজ নেই। অহংকার আছে, আত্মসম্মানবোধ নেই। তাই বিজয়া বলেন, হ্যাঁ, আমার তো আর অন্য কাজ নেই। আমি আমার পুজোপাঠ শিকেয় তুলে ওই বিচ্ছু বদমাইশের ভার ঘাড়ে নেব।

তবে আর কী করা! সুনন্দা চোখ নাচিয়ে বলে, তবে ওর কপালে বোর্ডিংই। মা বাপ নিষ্ঠুর। ঠাকুমা বিজি, পিসি উদাসীন, অতএব?

বলে যেন কেটে কেটে, যেন টুকরো বসিয়ে বসিয়ে।

আর বোধ করি দিন গোনে কবে ছেলেটাকে বাড়িছাড়া করবার বয়সে পৌঁছতে পারবে। সুনন্দাকে তার স্বামী নিজে হাতে ধরে যে জীবনে পৌঁছে দিয়েছে, সে জীবনে ওই দুরন্ত শিশুটা নিতান্তই অবান্তর।

আপাতত এখনও বাড়িছাড়া করতে পারেনি, তাই নিজেরা যখন বেরোয়, ছেলেটাকে তার মামার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়। আর ফেরার সময় ঘুমে অচৈতন্য ছেলেটাকে উঠিয়ে টানতে টানতে নিয়ে আসে।

দিদিমা খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে–নাতিরমতো করে নয়, গচ্ছিত রাজপুত্রের মতো করে। কারণ জামাইয়ের ভঙ্গিটা স্রেফ রাজোচিত। এই দীনের কুটিরে নিতান্ত দীন শয্যায় যে তার ছেলেকে রেখে যায় সে, সেটা যেন কুটিরবাসীদের প্রতি বিশেষ কৃপা।

তবুও ভদ্রমহিলা মাঝে মাঝে বলেন, আহা, ঘুমিয়ে পড়েছে, থাকুক না হয়, সকালে ওর দাদু দিয়ে আসবেন।

কিন্তু এ অনুরোধের মূল্য দেয় না ওরা। মহিলার নিজের মেয়েই ঝংকার দিয়ে বলে ওঠে, না বাবা, একদিন ওই আহ্লাদেপনার স্বাদটি পেলে আর রক্ষে আছে? রোজ বলবে–মামার বাড়িতেই ঘুমিয়ে থাকি। তার মানেই স্কুলের বারোটা বেজে যাওয়া।

কথাটা অবশ্য সত্যি।

চার বছরের বিচ্ছু আজ প্রায় বছর দুই হল স্কুলে যাচ্ছে। ভোরের স্কুল, তাকে পিটিয়ে পাটিয়ে স্কুলে পাঠানোর জন্যে শেষ রাত থেকে তুমুল শোরগোল শুরু হয়ে যায় বাড়িতে, ঘুম-ঘুম চোখ ছেলেটাও ওই যাওয়াটাকে পণ্ড করবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করে। অতএব লড়াই চলে এক পর্ব।

প্রথমে দু-একদিন বলেছিলেন সরোজাক্ষ, এত অল্প বয়স থেকে স্কুলে যাবে? অতটুকু বাচ্চা সবটা ঘুমুতে না পেলে, সকালের খেলাটা খেলতে না পেলে, স্বাস্থ্যটা ঠিক থাকবে? মেজাজও বিগড়ে যায় ওতে।

নীলাক্ষ বলেছিল,নিয়মে স্বাস্থ্য ভাল থাকে।

আর কিছু বলেননি সরোজা।

ওইটুকুতেই তাঁর মনে হয়েছিল নিজের গণ্ডি অতিক্রম করে ফেলেছেন। ওদের ছেলে, ওরা অবশ্যই তার ভাল-মন্দ বুঝবে। তিনি কি আর বোঝতে বসবেন, নিয়মটা শুধু কোনও একটা সময়ে করলেই হয় না, চব্বিশটা ঘণ্টাকেই তা হলে নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধতে হয়।

একটা দুবছরের শিশুকে ভোরবেলা স্কুলে পাঠাতে হলে, তাকে অন্তত রাত আটটার মধ্যে বিছানায় পাঠাতে হয়। কিন্তু সেদিকে তোমরা চোখ বুজে থাকবে। তোমাদের স্বেচ্ছাবিহারের তালে ওর জীবনটা নিয়ন্ত্রিত। ও সারা সন্ধ্যা ওর দিদিমার কাছে যথেচ্ছ উপদ্রব করবে, যথেচ্ছ আবদার করবে আর যথেচ্ছ সময়ে খেয়ে হয়তো অনেক রাত পর্যন্ত জেগে যখন নিতান্তই ঘুমে ঢুলে পড়বে, তখন তোমরা ওকে কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ায় নিয়ে আসবে টানতে টানতে, আর ঘণ্টা কয়েক পরেই ওকে নিয়মের শিক্ষা দেখাতে বসবে। ওতে নিয়মও হয় না, স্বাস্থ্যও গড়ে না।

না, ছেলেকে এসব বোঝতে বসেন না সরোজা। তিনি অন্যমনস্ক বটে, তবে অবোধ নন। এ ধরনের কথা বললে ওরা যদি বলে বসে, বেশ তো, মা রাখুন ওকে। ঠিক সময় খাওয়া শোয়া হবে।

বলতেই পারে। বলবেই নিশ্চয়। সুযোগ পেলেই ছোবল বসাবে। এই মনোভাব নিয়েই থাকে ওরা। কেন থাকে, তা জানেন না। তবে থাকে এটা জানেন। আর এও জানেন, বিজয়া কোনওদিনই স্বামীর কথার মান রাখতে বসবেন না।

বিজয়ার সময় কোথায় নাতি দেখবার?

বিজয়ার নিজের ঘরে ডজনখানেক পোষ্য নেই? বিজয়াকে তাদের খাওয়াতে হয় না? শোয়াতে হয় না? চামর ব্যজন করতে হয় না? তাদের সেই সেবাপর্বের জন্যে সর্বদা বিশুদ্ধবাসা হয়ে থাকতে হয় না? সরোজাক্ষ তো জানেন পৃথিবীর কোনও মহাশক্তিই ওঁকে ওঁর আসন থেকে টলাতে পারবে না। অন্য সর্ববিধ শোভনতা অশোভনতা ওঁর কাছে তুচ্ছ। সরোজাক্ষ অবশ্য বোঝাতে যাবেন না, তবু যদি বোঝাতে চেষ্টা করেন নিশ্চয়ই জানেন বিজয়া পরিষ্কার প্রাঞ্জল ভাষায় বলবেন, রোজ দিদিমার ঘাড়ে চাপানোটা দৃষ্টিকটু তা বুঝি। তবে তারও চেয়ে দৃষ্টিকটু ওই বাচ্চা ছেলেটাকে ভাসিয়ে দিয়ে নিত্য সন্ধেয় মা বাপের ধেই ধেই করে বেড়াতে যাওয়া। তবে? ওরা ওদের ছাগল ল্যাজে কাটবে, আমার কি!

হ্যাঁ, এইরকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হক কথা অধ্যাপক গৃহিণীর।

আগে আগে সরোজাক্ষ স্ত্রীর এই নিরাবরণ হক কথার নিরাবরণতায় মরমে মরে যেতেন। মরমে মরে যেতেন ওঁর গ্রাম্যতায়। ক্রমশ সয়ে গেছে, অথবা সয়ে যায়নি। সয়ে যাবার নয়। শুধু চুপ করে গেছেন।

আগে চেষ্টা করতেন। বিয়ের পর প্রথম প্রথম, সেই অতীতকালে। নববধূর আচার-আচরণ, ভাষা-ভঙ্গি সবকিছুর ওপরই সংস্কারের মার্জনা চালাতে ব্ৰতী হয়েছিলেন। বিজয়া ওঁর সে চেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে। পঞ্চদশী বিজয়া স্বচ্ছন্দে তার অতি মার্জিত অতি সুকুমার রুচি নতুন বিয়ের বরের সামনে খসখস করে গা চুলকোতে চুলকোতে বলেছে, নমস্কার করি বাবা তোমাদের বালিগঞ্জের পায়ে। মশার কামড়ে একেবারে ডুমো ডুমো করে ছাড়ল। এমন ডাঁশ ডাঁশ মশা নিয়ে ঘর করো কী করে তোমরা? গায়ে গণ্ডারের চামড়া নাকি?

সরোজ মরমে মরেছেন।

সরোজাক্ষ বলেছেন, ওভাবে কথা বলছ কেন? ভালভাবে কথা বলতে পারো না?

বিজয়া তার সুন্দর মুখে খিলখিল করে হেসে বলেছে, কথায় আবার ভালমন্দ কি? আমি তো মশাদের গালমন্দ করছি না? রক্তগুলো সব চুষে নিল, বলব না সেটা?

কিন্তু খারাপ গালমন্দই কি মুখে আটকায় বিজয়ার? না আটকাত? তবু তখন মাঝে মাঝেই সব বিরক্তি ছাপিয়ে সুন্দর মুখেরই জয় হত।

হত। কারণ তখন সরোজক্ষর বয়েস পঁচিশের নীচে। সেই বয়েসটার কাছে হার মানতেই হত মাঝে মাঝে। হার মানতে হত বিজয়ার নিখুঁত মুখ আর অনবদ্য গঠনভঙ্গির কাছে। হার মানতে হত তার চাঁপা রঙের দেহবল্লীর কাছে। আর হার মানার পরমুহূর্তেই আসত ধিক্কার। নিজেকে মারতে ইচ্ছে করত। আরও করত, যখন দেখতেন বিজয়া সেই অসহায় আত্মসমর্পণটুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে।

ষোড়শী বিজয়া সরোজাক্ষকে শুনিয়ে শুনিয়ে তার সমবয়সী ননদকে বলত, বেটাছেলে জাতটা হচ্ছে একটা নচ্ছার জাত বুঝলি? বিয়ে হলে টের পাবি। মুখে দেখায় যেন কতই উদাসীন সাধুপুরুষ, বুঝি মেয়েমানুষ জাতটাকেই ঘেন্না…হি হি হি, রাত্তিরের অন্ধকারে বুঝলি? বুঝবি, বিয়ে হলে টের পাবি।

সরোজাক্ষর কান বাঁচিয়ে তো নয়ই, বরং কান লক্ষ্য করেই এ আলোচনা চলত। খেয়াল করত না আলোচনার সঙ্গিনী সরোজাক্ষরই ছোট বোন। দাদা বলে যার সমীহর শেষ নেই। মুখ তুলে কথা বলতে পারে না।

শুনে অপমানে ধিক্কারে কান গরম হয়ে উঠত সরোজাক্ষর, প্রতিজ্ঞা করতেন ইহজীবনে আর নয়। কিন্তু রক্ষা হত না সে প্রতিজ্ঞা। ওই বেহায়া মেয়েটাই আবার গায়ে পড়ে কাছে এসে, অথবা কেঁদেকেটে ফিট করে–

কিন্তু যাক, সে কথা।

সে-জীবনে ইতি পড়ে গেছে।

বিজয়া এই মর্ত্যলোকের মালিন্য থেকে ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন। সরোজাক্ষ নীচের তলায় নিজের কাজে। সরোজাক্ষ ওই ঊর্ধ্বগতির কারণ নির্ণয় করতে অক্ষম নন, কিন্তু সরোজাক্ষর তার প্রতিকারের ক্ষমতা নেই।

সরোজাক্ষ তাই ওই পট্টবস্ত্র পরিহিতার সংস্রব থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকতেই চেষ্টা করেন। যতটা সম্ভব কম কথা কইতে।

তবু আজ একটু কথা কইলেন।

কিন্তু বিজয়া কি চুপ করে যাবেন?

বিজয়া কি জীবনে কখনও চুপ করে যেতে রাজি হন? হন না। এখনও তা হলেন না। বললেন, হু। স্বামী! মেয়েমানুষ নিজে শক্ত হলে স্বামীর সাধ্যি আছে তাকে বদলাবার?

সরোজাক্ষ ভাবলেন, তা নেই বটে।

কিন্তু সরোজাক্ষ আর কথা বললেন না। সরোজা তোয়ালেটা পেড়ে নিয়ে বাথরুমে চলে গেলেন। আর ভাবতে লাগলেন, কাল সকালে কোনও খবরের কাগজের পৃষ্ঠায় সরোজাক্ষর লাঞ্ছনার কাহিনী ঘোষিত হবে না তো?

সরোজাক্ষ দেখতে পেলেন না একজোড়া জ্বলন্ত চোখ নিষ্ফল আক্রোশে তাকিয়ে থেকে থেকে আগুন ছড়িয়ে আবার চলে গেল তার সেই নাসেরে আসা পুজোপাঠের উদ্দেশ্যে।

.

রাস্তার মোড়ে ছাড়াছাড়ি হতে হয়, বাড়ির সামনে পর্যন্ত একসঙ্গে আসার সাহস হয় না। কী জানি কে দেখে ফেলে। এই নিয়ে দিবাকর ব্যঙ্গ হাসি হাসে। বলে, বাস্তবিক কী অদ্ভুত তোমাদের বাড়িটি! বিশ্বাস হয় না তোমরা একটা উচ্চশিক্ষিত পরিবার, তোমার বাবা একজন অধ্যাপক, মেয়েদের কলেজে পড়বার পারমিশান দিয়েছেন, আর এই কলকাতা শহরের আধুনিক সমাজে বাস করছ তোমরা!

এ ব্যঙ্গে মীনাক্ষী ক্ষুব্ধ নিশ্বাসে তপ্ত হয়। বলে, কেন বিশ্বাস হবে না? আমার শ্রীযুক্ত দাদার আচার-আচরণ দেখলে খুব বিশ্বাস হবে। রাত দুপুরে বউ নিয়ে পার্টি থেকে ফিরবেন। চোখ লালচে, পা বেঠিক, ইংরেজি ছাড়া বোলচাল নেই মুখে, মার সামনে বউদির কাঁধ ধরছেন পিঠ ঠুকছেন, কে বলবে তবে আমরা অনগ্রসর।

দিবাকর দাসের বাড়ি গণ্ডগ্রামে, ওর বউদিরা এখনও একগলা ঘোমটা দেয়, আর ওর ছোট বোনের শ্বশুরবাড়িতে এখনও দিনের বেলায় বর বউয়ের দেখাসাক্ষাৎটা গর্হিত কর্মের মধ্যে পড়ে, তাই বোধহয় দিবাকরের সমাজচিন্তা এত প্রগতিশীল। তাই সে কথায় কথায় মীনাক্ষীকে সেকেলে বলে নিন্দে করে, ভীরু কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে ব্যঙ্গ করে। বলে,শুধু তোমার গার্জেনদের দোষ দিলে কী হবে, তুমি নিজেও কম কনজারভেটিভ নও। নইলে এতদিনেও একবারের জন্যে একটু সুযোগ জোগাড়ে রাজি করাতে পারলাম না।

মীনাক্ষী আরক্তিম হয়, মীনাক্ষী ঝংকার দেয়,আঃ যতসব অসভ্যতা।

দিবাকর দাস বলে, ওই ওইটিই হচ্ছে বদ্ধমূল কুসংস্কার। যা চিরন্তন সত্য, যা অপরিহার্য অনস্বীকার্য তাকে অস্বীকার করা, তাকে চোখ বুজে এড়িয়ে যাওয়া, তার ওপর অকারণ একটা পাপ মার্কা দেওয়া, এর কোনও মানে হয়?

দিবাকরের ঈষৎ বিস্ফারিত চোখ দুটো যেন আগুনের ঢেলার মতো জ্বলে।

মীনাক্ষীর বুক কাঁপে, মীনাক্ষীর পায়ের নীচের মাটিটা যেন সরে যেতে চায়, মীনাক্ষী তাই কথা পালটায়। বলে,উঃ বাংলা ভাষায় কী দখল! তুমি ইকনমিকসে অনার্স নিতে গেলে কেন, বাংলায় নেওয়া উচিত ছিল।

কথা পালটাচ্ছ? তার মানে ভয় পাচ্ছ!

দিবাকরের মোটা মোটা ঠোঁট দুটো ব্যঙ্গে ঝুলে পড়ে, আশ্চর্য! আশ্চর্য এই মিথ্যে ভয় পাওয়া আর তার জন্যে অনর্থক লোকসান খাওয়া। জীবনের সবচেয়ে দামি দিনগুলো তুমি লোকসান দিচ্ছ।

মীনাক্ষী তবু কথা হালকা করতে চায়, মীনাক্ষী দিবাকর দাসের ধধ করে জ্বলে ওঠা চোখের দিকে তাকায় না, অন্যদিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের গলায় বলে, যতসব বাজে কথা! লোকসান আবার কি? তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে আবার লাভ লোকসানের হিসেব!

দিবাকর উত্তেজিত হয়, দিবাকর রূঢ় গলায় বলে,তুচ্ছ? তুচ্ছ যে মোটেই নয় তা কোটি কোটি বছরের পৃথিবীর ইতিহাসই সাক্ষ্য দেবে। লোকান মনে হচ্ছে কিনা তার উত্তর নিজের মধ্যেই পাবে, যদি নিজের দিকে স্পষ্ট করে তাকাবার সাহস থাকে। নেই, সে সাহস নেই! তোমরা মেয়েরা হচ্ছ উটপাখির দল! বালিতে মাথা গুঁজে বসে আছ।

দিবাকর দাসের গায়ের রং কালো, গড়ন বেঁটে আর বলিষ্ঠ ধরনের, ঠোঁট পুরু, নাক মোটা, চওড়া কাঁধ। দিবাকরের মাথার চুল কুচি কুচি করে ছাঁটা, পরনে একটা সাদা ট্রাউজার আর কোমরে চওড়া ইলাস্টিক দেওয়া হাতপুরো ঢিলে ব্লাউজ ধরনের গাঢ় খাকি রঙের কোট। এককথায় সবটা মিলিয়ে কেমন একটা কর্কশ বন্য বন্য ভাব। অন্তত মীনাক্ষীর বাবা, সরোজাক্ষ দেখলে দিবাকর দাসকে একটা বর্বর ছাড়া আর কিছু বলতেন না। কিন্তু মীনাক্ষীর দুরন্ত আকর্ষণ ওই বন্যতার উপর, ওই বর্বরতার প্রতি। পুরুষের কোমল স্নিগ্ধ সৌম্য চেহারা তার পছন্দ নয়। তাই দিদির বরকে দেখলে তার হাসি পায়। অবজ্ঞা আসে। এবং দিদিকে সে কথা বলতেও ছাড়ে না। ঠোঁট উলটে হেসে হেসে বলে, যাই বলিস দিদি, পুরুষ মানুষকে অমন মোলায়েম ভদ্র চেহারা মোটেই মানায় না। একটু বুনো বুনো গোঁয়ার গোঁয়ার না হলে পুরুষ মানুষ অচল।

দিদির ভিতরে কী আছে কে জানে, তবে তর্কে হারতে রাজি হয় না সে। তাই বলে,ঠিক আছে, তোকে একটি নিগ্রো যুবকের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হবে।

মীনাক্ষী হেসে ওঠে।

মীনাক্ষী ঠিক দিবাকরের মতো কাঁধ ঝাঁকায় আর ঠোঁট ওলটায়, বিয়ে দেওয়া হবে? সেই অপেক্ষায় বসে থাকব নাকি তোর মতো?

নিজেই করবি?

নিশ্চয়।

মীনাক্ষীর দিদি যেন ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায় তার অবিবাহিতা ছোট বোনের দিকে। ওর দৃষ্টি দেখলে মনে হয় যেন ওকে ওর প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে মীনাক্ষী সেটা ভোগ করতে চাইছে। তাই হঠাৎ কৌতুকের গলা ছেড়ে কড়া গলায় বলে, তলে তলে চালানো হচ্ছে বুঝি কিছু?

মীনাক্ষী সামলে নেয়, হেসে দিদির গলা ধরে। বলে, রাগলে তোকে কী সাংঘাতিক সুন্দরী দেখায় দিদি।

দিদিকে ওর ভাল লাগে না, সর্বদাই ওর মনে হয়, ছেলেবেলা থেকেই মনে হত, দিদি যেন ওকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখছে। তবু যখন তখন দিদির বাসায় বেড়াতে যেতে হয় মীনাক্ষীকে, না হলে কলেজ শেষে এবং বাড়ি ফেরার সময়ের দীর্ঘ ব্যবধানটাকে মাঝে মাঝে ম্যানেজ করে নেওয়া শক্ত হয়ে ওঠে।

মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, মীনাক্ষী এ ভয়টুকু করে চলে। ভয় করে বাবার সামনে পড়ে যাবার, তাই মোড়ের কাছ থেকেই ছাড়াছাড়ি করতে হয় দিবাকরের সঙ্গে।…আর দিবাকর দাস চওড়া কাঁধটা ঝাঁকিয়ে ব্যঙ্গ হাসি হেসে চলে যায়। দিবাকর দাসেদের পরিবারে সেই প্রথম ছেলে যে বি-এ পড়ছে, তাই দিবাকর দাসের মধ্যে যেন একটা বিশ্ব নস্যাৎ ভাব জন্ম নিয়েছে। দিবাকর দাস মনেপ্রাণে আচারে আচরণে অতি প্রগতিশীল হতে চায়, তাই দিবাকর মীনাক্ষীকে চমকে দেবার মতো কথা বলে। বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করে।

দিবাকর তার বন্য বর্বর চেহারাটার জন্যে লজ্জিত তো হয়ই না, বরং সাজসজ্জায় সে চেহারাকে আরও কর্কশ করে তুলতে পছন্দ করে। আর মীনাক্ষীর আকর্ষণও সেই বস্তুটার উপরই। মীনাক্ষী ওই কর্কশ কুৎসিত লোকটার আকর্ষণেই সম্মোহিত।

দিবাকর যদি ওকে লুঠ করে নিয়ে যেতে পারত, হয়তো মীনাক্ষী লুঠ হয়ে যেতে দ্বিধা করত না। কিন্তু দিবাকরের চোখেই শুধু আগুন জ্বলে, দিবাকরের মোটা মোটা ঠোঁট দুটোতেই শুধু একটা সর্বগ্রাসী। ক্ষুধা জেগে ওঠে, কার্যক্ষেত্রে দিবাকর সেই মোড়ের কাছ থেকেই ছাড়াছাড়ি হয়। আর অন্তত একদিন একটা সুযোগ আহরণ করাবার জন্যে মীনাক্ষীকেই পীড়াপীড়ি করে।

মীনাক্ষীর বুক ধকধক করে, মীনাক্ষীর পায়ের নীচের মাটি সরে সরে যায়, মীনাক্ষী শুধু বলে, সবুর করো না বাপু, আর কিছুদিন সবুর করো।

সেই সবুর করাটাকে মীনাক্ষী ভবিষ্যতের কোনও একটা শুভলগ্নের তারিখ পর্যন্ত ঠেকিয়ে রাখতে চায়।

যে নাকি পিছিয়ে পড়ে থাকবার ভয়ে অনেকখানি এগিয়ে গিয়ে গলা বাড়ায়, ধর্মসতীত্ব সততা সভ্যতা সবকিছুকেই কুসংস্কার আর প্রথামাত্র বলে অবজ্ঞার চোখে দেখার ভান করে, তার কথা মীনাক্ষী জানে না। মীনাক্ষী লজ্জিত হয়।

লজ্জিত হয় নিজের সভ্যতা সততা ধর্মবোধ আর সতীত্ববোধের জন্যে। কিন্তু ওগুলো যে তার মজ্জায় মজ্জায়, তাই ত্যাগ করে উঠতে পারে না। মীনাক্ষী অতএব পতঙ্গের ভূমিকা নিয়ে আগুনের পাশে পাশে ঘুরে মরে।

সরোজাক্ষ তাঁর আত্মহারা কন্যার এই বিহ্বলতার সংবাদ জানেন না, তিনি তাঁর মেধাবিনী কন্যার পরীক্ষার রেজাল্টটাই জানেন। সেখানে মীনাক্ষী কোনওদিন বাবাকে হতাশ করেনি। অতএব মেয়ে সম্পর্কে আর কোনও কিছু জানবার চেষ্টা করেন না সরোজাক্ষ।

তবে ইদানীং বিনা চেষ্টায় আরও কিছু কিছু জানতে পেরে যাচ্ছেন, যেমন মীনাক্ষীর নাকি ক্রমশই বন্ধুসংখ্যা খুব বাড়ছে, আর মীনাক্ষী প্রায় প্রত্যেকদিনই কারও না কারও বাড়ি বেড়াতে গিয়ে দেরি করে বাড়ি ফেরে।

সরোজাক্ষ অবশ্য তাঁর মেয়ের এই দেরি করাটা মোটেই পছন্দ করেন না, কিন্তু অপছন্দর প্রকাশ তো তাঁর শুধু মুখটা একটু কোঁচকানো, এ ছাড়া আর কি? আর কি করবার ক্ষমতা তাঁর আছে?

তথাপি ওইটুকুতেই ভয়।

ওইটুকুতেই মীনাক্ষী সন্ত্রস্ত হয়, ওইটুকুর জন্যেই তার বন্ধুর সঙ্গে রাস্তার মোড়ের কাছ থেকেই ছাড়াছাড়ি, ওইটুকুর জন্যেই বন্ধুকে একবারও বাড়িতে আমন্ত্রণ না করা, ওইটুকুর জন্যেই সহস্র মিথ্যার জাল ফেলা।

এর প্রভাব কাটিয়ে উঠবার শক্তি অর্জন করতে পারে না মীনাক্ষী।

মোড়ের কাছ থেকে সরে এসে দ্রুত পায়ে বাড়ি পর্যন্ত চলে এল মীনাক্ষী। একটু থমকে তার ঠাকুর্দার আমলের এই পুরনো ধরনের বাড়িখানার দিকে চোখ তুলে তাকাল।

দেখল দোতলায় বাবার ঘরে আলো জ্বলছে, খোলা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে সে আলো। ঠোঁটটা একটা কামড়াল। এটা দিবাকরের কাছ থেকে শেখা নয়, এটা মীনাক্ষীর নিজস্ব। ছেলেবেলা থেকেই কোনও কিছু অপছন্দ হলে ঠোঁটটা কামড়াত। এখনও রয়ে গেছে অভ্যাসটা।

ঠোঁট কামড়ে ভাবল, আশ্চর্য, একজন পুরুষ মানুষ সারাদিনের কাজের শেষে সন্ধ্যায় একটু খেলাধুলো আমোদ-প্রমোদের ধার ধারে না। একটু বেড়াতে যায় না। স্রেফ বাড়ি বসে থাকে! অথচ দিবাকর

উঠতে বসতে যে কোনও ব্যাপারে দিবাকরের সঙ্গে তুলনা করাই যেন নেশা হয়ে গিয়েছে মীনাক্ষীর। বোধ করি অতুলনীয় দিবাকরকেই তার পুরুষের আদর্শ বলে মনে হয়। তাই দিবাকরের বেপরোয়া রাত এগারোটা বারোটা পর্যন্ত ঘুরে বেড়ানোর গল্প মনে পড়ে যায় তার বাবাকে সন্ধ্যাবেলা বাড়ি বসে থাকা দেখে।

নিজের বেপরোয়াপনার অনেক গল্পই করে দিবাকর। বলতে গেলে ওইটিই তার গল্পের উপজীব্য। আমি!আমিকে কেন্দ্র করেই তার যত কথা।

থাকে দিবাকর তার এক বিজনেসম্যান বিরাট বড়লোক মামার বাড়িতে, কারণ নিজেদের বাড়ি তো তাদের দেশের জমিদারিতে। তা মামা নাকি দিবাকরকে শাসন করার কথা কল্পনাও করতে পারেন না। শাসন করতে এলে দিবাকর মামাকে হাসির তোড়ে উড়িয়ে দেয়। যুগটা যে আর তার মামার আমলে আটকে নেই, সেই পরম সত্য তথ্যটি শুনিয়ে দিয়ে মামাকে ঠাণ্ডা করে দেয়।

বেড়িয়ে বাড়ি ফেরবার সময় একটু রাত হয়ে গেলে যখন ভয়ে বুকটা ছমছম করে, তখন মীনাক্ষীর দিবাকরের সেই নির্ভীক উক্তিগুলো মনে পড়ে গিয়ে নিশ্বাস পড়ে।

যুগটা পালটেছে সে কথা কি মীনাক্ষীই সগর্বে ঘোষণা করে না তার মায়ের কাছে? করে, মায়ের কাছে করে। যথেষ্টই করে। বলে, তুমি তোমার ওই মান্ধাতার আমলের ঠাকুর ঘরেই আবদ্ধ থেকো গে মা, আমাদের চালচলনের মানে আর তোমার বুঝে কাজ নেই।বলে, পৃথিবী গিয়ে চাঁদে উঠছে, আর তোমরা তোমাদের সেই পুরনো খোঁটায় বাঁধা পড়ে থেকে পুরনো কালের জাবর কাটছ।

এমন আরও অনেক কিছুই বলে মীনাক্ষী।

কিন্তু মাকে বলে আর লাভ কি? বাবাকে দেখলেই তো অস্বস্তিতে মন ভরে ওঠে, সিঁড়ির নীচে চটি খুলে রেখে পা টিপে টিপে দোতলায় উঠতে হয়।

এতে যেন নিজের কাছেই নিজে হেয় হয়ে যায় মীনাক্ষী। যেন বাপের মুখের উপর সশব্দ প্রতিবাদে ফেটে পড়তে পারলেই তার অহমিকা পরিতৃপ্ত হতে পারে।

কিন্তু সরোজাক্ষ তাকে সে সুযোগ দেন কই?

সরোজাক্ষ কি কোনওদিন ধমকে উঠে বলেন, এত রাত করে ফিরলে কেন?

বলেন না।

শুধু সরোজাক্ষ, মেয়ে যখন তাঁর দরজার সামনে দিয়ে পার হয়, একবার তাকিয়ে দেখেন। মীনাক্ষী অবশ্য সেই তাকানোর দিকে তাকিয়ে দেখে না, কিন্তু মীনাক্ষী অনুভব করে সেই তাকানোর চোখ দুটোয় অসন্তোষের গভীর কালো ছাপ, সেই চোখ দুটোর উপরকার হৃ দুটো কুঁচকে গিয়ে কাছাকাছি সরে এসেছে।

ওই অনুভবটাই মনের মধ্যে অপমানের জ্বালা ধরায় মীনাক্ষীর। তাই নিজের ঘরে ঢুকে গিয়ে অকারণের যেন কী এক আক্রোশে ফুলতে থাকে সে, আর একা-একাই নিজের স্বপক্ষে বহুবিধ যুক্তি খাড়া করে বাবাকেই আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।

নীলাক্ষর আচরণটা তখন তার যুক্তির মালমশলা হয়। ছেলের বেলায় যে দিব্যি অম্লান বদনে মেনে নেন সরোজাক্ষ, আর মেয়ের বেলায় ভুরু কোঁচকান, এইটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মনে করে জবাব তৈরি করতে থাকে সে।

যাক, সেসব জবাব তৈরি তো পরের ব্যাপার। এখন সিঁড়ির তলায় চটি খুলে রেখে খালি পায়ে নিঃশব্দে ওঠার কৌশলে চলে যাবে সোজা তিনতলার মার ঠাকুরঘরের সামনে। ফিরেছে, সেটা যত তাড়াতাড়ি মাকে জানানো যায়।

বিজয়া যেই বলেন, এই এখন ফিরলি তুই? সঙ্গে সঙ্গে মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠতে পারে মীনাক্ষী, কেন, খুব রাত হয়ে গেছে? খাওয়া-দাওয়ার সময় হয়ে গেছে তোমাদের?না কি ঘুমের? তোমার ছেলে বউ ফিরেছে তো?

দিবাকরের কাছে হেয় হয়ে আসার শোধটা তোলে মায়ের ওপর।

বিজয়া হয়তো বলেন, দাদার দৃষ্টান্তটাই খুব ভাল কেমন? হয়তো বা বলেন, আমাকে শুনিয়ে কী হবে, আমি তোমাদের সংসারের কে? আমি তো এ সংসারের একটা আবর্জনা জঞ্জাল! আমার কাছে আসাই বা কেন? ফিরেছ বেশ করেছ, আমার বাবার মাথা কিনেছ, যাও এখন খাটে শুয়ে পা নাচাও গো

এইরকমই কথা বিজয়ার।

কিন্তু আজ বিজয়া অন্য সুরে কথা বললেন। মেয়ে গিয়ে ঠাকুরঘরের দরজায় দাঁড়াতেই চাপা গলায় বললেন, সোজা উঠে আসছিস, না বাপের সঙ্গে দেখা হয়েছে?

সোজাই উঠে এসেছি।

ঠিক আছে। দেরি দেখে কিছু বললে, বলবি অনেকক্ষণ এসেছি, মার কাছে ছিলাম।

মীনাক্ষী এখন সাহসীর ভূমিকা নেয়। বলে কেন, খামোকা বাজে কথা বলতে যাব কেন?

বললে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবেনা।বিজয়া মুখভঙ্গি করেন, বাজে কথা তো বলোনা একটুও!

সেটা আবার তুমি কখন শুনলে?

বিজয়া মেয়ের চোখে চোখে তাকান। চাপা কঠোর গলায় বলেন,দেখ মীনা, তুই আমার পেটে জন্মেছিস বই আমি তোর পেটে জন্মাইনি। কোনটা সত্যি কথা আর কোনটা বাজে কথা, তা আমি চোখের চাউনিতেই টের পাই। এই আটটা সাড়ে আটটা রাত পর্যন্ত তুমি যে তোমার কোন বান্ধবীর বাড়ি বেড়াতে যাও, আর কোন লাইব্রেরিতে পড়তে যাও, তা আর আমার বুঝতে বাকি নেই। যা বলছি তোমার ভালর জন্যেই বলছি।

মীনাক্ষী মার চোখের থেকে চোখ নামিয়ে নেয়, তবু গলার স্বর সতেজ রাখে। বলে, আমার সবচেয়ে ভাল করা হয় মা, যদি একটা লোহার খাঁচা বানিয়ে তাতে ভরে রাখতে পারো আমায়।

খাঁচা? তোমরা খাঁচায় আছ? এ যুগের মেয়েরা? বিজয়া উত্তেজিত গলায় বলেন, উঃ কী বেইমান তোরা, কী বেইমান! হয়তো এরপর তোর বউদিও বলবে, আমি খাঁচায় বন্দিনী হয়ে আছি।

বউদির সঙ্গে আমার তুলনা কোরো না, মীনাক্ষী ক্রুদ্ধ গলায় বলে, দেখো তোমার ওই বউও একদিন মদ খেয়ে টলমল করতে করতে ফিরবে।

সেকথা কি তুই আমায় বোঝাতে আসবি? আমি তো চোখের ওপর দেখতে পাচ্ছি সে দৃশ্য।

হু! যত দোষ মেয়ের বেলায়।

মেয়েকে যে পরের বাড়িতে চালান করতে হবে।

দরকার নেই। মীনাক্ষী ভারী গলায় বলে, আমার জন্যে মাথা ঘামাতে হবে না তোমাদের।

তা জানি! বিজয়া কটুগলায় বলেন,তোমার ভাবনায় যে তুমিই মাথা ঘামাচ্ছ তা আমি খুব টের পাচ্ছি। এখন যাও কিছু খাওগে। রাতদুপুর অবধি যেখানে আড্ডা দাও তারা তো আর খিদের সময় খেতে দেয় না।

আমার খিদে পায়নি– মীনাক্ষী সর্বশরীরে একটা মোচড় দিয়ে বলে, আমি যাচ্ছি বাবার কাছে। জিজ্ঞেস করব বাবার পিসিদের কালটা এখনও আছে কি না। জিজ্ঞেস করছি, কলকাতা শহরের রাস্তাটা এখনই এই সন্ধেবেলাতেই মহিলাশূন্য হয়ে গেছে কি না।

কেন, ইচ্ছে করে কেঁচো খোঁড়বার কী দরকার?

অকারণ ভয়ে কাঁটা হওয়ার দরকারটা কী, তাও জানি না। মীনাক্ষী ভাবে, হঠাৎ উদ্ধতের ভূমিকা নিয়ে বলেই ফেলি আজ আমার কথা দিবাকরের কথা। হয়ে যাক–একটা হেস্তনেস্ত।

কিন্তু হঠাৎ যেন সাহসটা ফুরিয়ে যায়। তাই মীনাক্ষী আর না এগিয়ে বলে ওঠে, যাক, আমার কথা আর তোমাদের শুনে কাজ নেই। তুমি থাকো তোমার স্বর্গলোকে। বাবা থাকুন তাঁর উচ্চচিন্তার গজদন্ত মিনারে। দাদার স্বর্গ তো দাদা নিজেই রচনা করছে। আমার ভাবনা আমি ভাবব।

বলে পাক খেয়ে তরতর করে নেমে এসে বাবার ঘরের দিকে একটা কটাক্ষপাত করে ঢুকে পড়ে বাঁ দিকে সারদাপ্রসাদের ঘরে। আর আশ্চর্য কৌশলে মুখে একটা হালকা হাসির প্রলেপ মাখিয়ে নিয়ে সহাস্যে বলে, কী পিসেমশাই! নতুন কী আবিষ্কার করলেন?

.

পিসেমশাইকে নিয়ে মজা করবার উদ্দেশ্যে মাঝে মাঝেই এ-ঘরে এসে ঢোকে মীনাক্ষী। প্রশ্ন তোলে, নতুন কী আবিষ্কার করলেন পিসেমশাই?

মজা করা ছাড়াও আরও একটা উদ্দেশ্যও অন্তর্নিহিত আছে। কোথায় কোন অদৃশ্য কালির লেখায় যেন পড়ে নিয়েছে মীনাক্ষী, পিসেমশাইকে আত্মীয়ের পদমর্যাদা দিলে বাবাকে কিঞ্চিৎ সন্তুষ্ট করা যায়। আর–ডেকে কথা কওয়া মানেই তো আত্মীয়ের মর্যাদা দেওয়া।

কই, দিদি কি দেয় সেটুকু মর্যাদা?

বেড়াতে আসে, দু-চার ঘণ্টা কাটিয়ে যায়। একবার পিসেমশাইবলে উঁকিও মারে না। মীনাক্ষী উঁকি মারে। বিশেষ করে যেদিন দিবাকরের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আসতে একটু বেশি দেরি হয়ে যায়, যেদিন সেই মুক্ত হয়ে চলে আসবার সময় অনবরতই ভয় ভয় করে, মনে হয় পায়ের তলার মাটিটা যেন সরে সরে যাচ্ছে একটা অতল গহ্বরের সংকেত জানিয়ে জানিয়ে।

সেদিন মায়ের সামনে এসে দাঁড়াতে অস্বস্তি হয়। মনে হয় মায়ের চোখ দুটো সার্চলাইট হয়ে মীনাক্ষীর ভিতরটা সমস্ত দেখে ফেলছে। দেখে ফেলছে ওই গহ্বরের সংকেতটাও। হয়তো মা হঠাৎ ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলে উঠবে, কী গো তোমরা একালিনীরা, আমাদের সন্দেহ বাতিক নিয়ে বড় যে ধিক্কার দাও, এখন কী হচ্ছে? ঘি আর আগুনের প্রবাদটা খেটে যাচ্ছে না?

কিন্তু কে আগুন, কে ঘি?

মীনাক্ষীই তো গলে গলে যাচ্ছে, মীনাক্ষীই তো আগুনের আঁচে পাখা পোড়াতে ছুটছে।

কী তীব্র আকর্ষণ সেই বন্য বর্বরতার, কী সৌন্দর্য সেই পুরু পুরু ঠোঁটজোড়ার, সেই জ্বলন্ত আগুনের ঢেলার মতো দুটো চোখের!

কিন্তু আকর্ষণের অন্তরালেই তো ভয়ের বাসা।

অতএব বাবার সামনে এসে দাঁড়াতেই পারা যায় না দিবাকরের সান্নিধ্য থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে। নিজেকে কেমন যেন অশুচি অশুচি লাগে, মনে হয় বাবার দৃষ্টিতে দেখতে পাবে ঘৃণা আর হতাশা। যেন সে দৃষ্টি অনুক্ত হলেও তীব্র প্রশ্ন করে উঠবে,ছি ছি মীনাক্ষী, তুমি এই! এই তোমার রুচি!

অতএব প্রথম নম্বর এই পাগলের ঘরটায় ঢুকে পড়া শ্রেয়।

এই আত্মনিমগ্ন খ্যাপা লোকটা তাকিয়ে দেখবে না। দেখবে না মীনাক্ষীর কোথায় কোথায় লেগে রয়েছে একটা বন্যসুখের স্বাদ।

সারদার আবিষ্কার সম্পর্কে প্রশ্ন করলেই সারদা উল্লসিত হয়, উত্তেজিত হয়। আজও হল। বলে উঠল, আবিষ্কার কিছুই নয়, সবই রয়েছে জাজ্বল্যমান, শুধু তাকিয়ে দেখার ওয়াস্তা। শুধু পূর্বপুরুষের বুদ্ধির প্রতি একটু শ্রদ্ধা রেখে বিচারটা করা। তা নয়–গোড়া থেকেই তোমরা ধরে বসে আছ, তোমাদের জেনারেশনের আগে পর্যন্ত সবাই বুদ্ধ ছিল। হচ্ছিল সেই কথা দাদার সঙ্গে। একটা তুচ্ছ কথাই ধরো না–এই যে খাদ্যাখাদ্য বিচার, এই যে বার তারিখ তিথিনক্ষত্র ধরে ধরে খাদ্যগুণের হিসেব কষা, যা নাকি করে গিয়েছেন আগেকার পণ্ডিতরা, তার সম্পর্কে শ্রদ্ধা নিয়ে চিন্তা করে দেখেছ কোনওদিন তোমরা? দেখোনি। স্রেফ উপহাসের হাসি হেসে রায় দিয়ে রেখেছ সেকালের লোকগুলোর কোনও কাজকর্ম ছিল না, তাই বসে বসে লিখে রেখেছে তেরোদশীতে বেগুন খেলে মহাপাতক, প্রতিপদে কুম্মাণ্ড খেলে জাতিপাত।

আরে বাবা, ব্যাপারটা যে সম্পূর্ণ হাইজিনিক তা তলিয়ে দেখেছ? তা দেখবে কেন? সেটা যে তোমাদের মতে বুন্ধুরা করে গেছে। এখন তোমাদের স্বর্গভূমি ওদেশ থেকে ফতোয়া আসুক ফেব্রুয়ারিতে মুলো খেলে ক্যানসার হয়, আর নভেম্বরে ওল খেলে কুষ্ঠ, তা হলে ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে–উঃ বিজ্ঞানের কী উন্নতিই করেছে ওরা! এইসব বুঝে ফেলেছে।

সারদা একটা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করে বলে, অথচ এদেশ? কোন জন্মে উদ্ভিদ জগতের সব রহস্য জেনে বুঝে ফাঁস করে বসে আছে।

মীনাক্ষীর কাছে এসব কথা নতুন নয়, তবে উত্তেজিত সারদাপ্রসাদ সব সময় নতুনের মতো করেই বলে, কাজেই মীনাক্ষীও নতুন শোনার সুরেই বলে, তা বেশ তো পিসেমশাই, না হয় তাঁরা সব জেনে ফেলে বলে-টলে গেছেন, কিন্তু ওইসব ধর্মের ভয় দেখিয়ে কেন?

কেন? সারদাপ্রসাদের মুখে একটি অলৌকিক হাসি ফুটে ওঠে, কেন, বুঝতে পারছ না? মানুষ জাতটা যে আত্মঘাতী জাত! হিতাহিত জ্ঞানের বালাই মাত্র নেই। বিশেষ করে জনসাধারণ, মানে তোমাদের ওই গণদেবতারা। যাতে ক্ষতি, যাতে সর্বনাশ, সেইদিকেই ঝোঁক। অন্য প্রাণিজগতে কোনও বেনিয়ম আছে? কদাচ না। নিজেদের অনিষ্টকর কিছু করছে তারা? মোটেই না। কিন্তু মানুষ? নিজের অনিষ্ট নিজে ডেকে আনাই তার পেশা।

মীনাক্ষী সহসা কেঁপে ওঠে।

মীনাক্ষীর মনে হয় সারদাপ্রসাদ বুঝি তাকে উদ্দেশ করেই বলছে কথাটা। ৩৪

কিন্তু সারদার অভিযোগ কোনও ব্যক্তিবিশেষের প্রতি নয়, নিতান্তই সমষ্টিগত ব্যাপার। তাই সে দুই হাত উলটে বলে–কাজে কাজেই তাদের হিত করতে, পাপ, পুণ্য, ধর্ম, অধর্ম, ভাল হওয়া, মন্দ হওয়া, অনেক কিছুর কোটিং মাখিয়ে ওষুধের বড়ি দিতে হয়। যাঁরা চিন্তাশীল, যাঁরা সমাজকল্যাণকামী, তাঁরা তাই সেই বুদ্ধির বশেই সবকিছুতেই ওই করতে নেই আর করতে হয়-এর ছাপ দিয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু মানুষ তো আর চিরদিন অজ্ঞ থাকে না? থাকতে রাজি হয় না।

কথা কয়ে নিজেকে হালকা করে নিচ্ছে মীনাক্ষী, করে নিচ্ছে সহজ।

তবে মীনাক্ষীর এ প্রশ্নে সারদা কৌতুক হাসি হেসে ওঠে, অজ্ঞ থাকে না? থাকতে রাজি হয় না? বলি ওহে একালের বিজ্ঞ মেয়ে, ডাক্তার যখন প্রেসক্রিপশন দেয়, তুমি তার সব উপাদান জেনে, তার উপকারিতা বুঝে তবে খাও? তা তো খাও না? জানো লোকটা একটা বিদ্যে শিখেছে, সেই বিদ্যেটা প্রয়োগ করছে, তুমি তা থেকে লাভবান হচ্ছ। এও তাই। ডাক্তার যদি বোঝতে বসে কীসের মধ্যে কী আছে, তুমি তখন আর গ্রাহ্য করে খাবেনা,বুঝলে? সেকালের ডাক্তাররাও তাই ওই ধর্ম দেখিয়ে হিত করত লোকের। ওই পাপপুণ্য দেখিয়েই দিত স্বাস্থ্যশিক্ষা, সমাজশিক্ষা, শৃঙ্খলারক্ষার শিক্ষা। বলতে পারা যায় শাস্ত্র মানে লবুক!…কিন্তু তোমরা সেই লকে অবজ্ঞা করে স্বেচ্ছাচারিতাটি বেছে নিয়েছ। তাতে কী হচ্ছে? বলল কতটা লাভবান হচ্ছ তাতে? কচু। কচুপোড়া! সমস্ত সমাজটাই ফ্রাস্টেশানে ভুগছে।

মীনাক্ষী এই পাগলের কথা উড়িয়ে দিতে পারত। দেয়ও তাই, কিন্তু আজ যেন মীনাক্ষী এই হাস্যকর তর্কের মধ্যে থেকেই আপন যুক্তির শক্তি সংগ্রহ করতে চাইছে। তাই সে দৃঢ়গলায় বলে, অবোধের শান্তির চাইতে এই ফ্রাস্টেশানও ভাল পিসেমশাই।

ভাল? সারদাপ্রসাদ বিরক্ত গলায় বলে, তারপর? পরিণামটা? হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে সারদাপ্রসাদ, পরিণামটা কী জানো? ওই ফ্রাস্টেশান ব্যাধিগ্রস্ত জগৎ কাজ ছেড়ে দেবে, চেষ্টা ছেড়ে দেবে, বেঁচে থাকবার জন্যে যেসব আয়োজন, তাতে পরাত্মখ হবে। হয়ে ক্রমশ কাপড় পরা ছেড়ে, কাঁচা মাংস ধরে, কোটি কোটি বছরের সাধনা মুছে ফেলে সাবেককালের গুহ্য-জীবনে ফিরে যাবে।

উত্তেজনায় হাঁপাতে থাকে সারদাপ্রসাদ।

এই উত্তেজিত মূর্তির দিকে তাকিয়ে হাসিটা আর চেপে রাখতে পারে না মীনাক্ষী। হেসে উঠে বলে, সেটা আপনার আমার জীবদ্দশায় হবে না আশা করছি

সারদাপ্রসাদ এই ব্যঙ্গে হঠাৎ স্থির হয়ে যায়। তারপর কড়াগলায় বলে, তোমাদের মতো ফাজিল ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলাই ঝকমারি। যাও, নিজের কাজে যাও।

অর্থাৎ ঘর থেকে বিদায় হও। অপমানে মীনাক্ষীর মুখটা লাল হয়ে ওঠে। সেও পাথুরে গলায় বলে, যাচ্ছি।

সারদাপ্রসাদ আপন অধিকারের সীমা সম্পর্কে চিন্তা করে না। বলে, হ্যাঁ যাও। আমার কাজ আছে। প্রায় ওকে ঠেলে ঘরের বাইরে বার করে দিয়ে সশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দেয় সারদাপ্রসাদ।

হ্যাঁ, এরকম রেগে ওঠে সে।

কিন্তু সে রাগ শরতের মেঘ। ভুলে যায়। হয়তো কালই আবার মীনাক্ষীকে ডেকে বলবে,ওহে আধুনিকা, শোনো শোনো–আজকের এই হতভাগ্য ভারতবর্ষের প্রাচীনকালে কী ছিল শোনন–

মীনাক্ষীও পাগল ছাগল বলে ক্ষ্যামা ঘেন্না করে থাকে পিসেমশাইকে, দাদা বা দিদির মতো তীব্র একটা আক্রোশ নেই লোকটার উপর। কিন্তু আজ সে বড় ক্রুদ্ধ হয়েছে। আর এই ক্রোধটা হয়তো নানা কারণ সঞ্জাত।

হয়তো বিজয়া যা বলেছেন সেটাও একটা কারণ, আড্ডায় আড়াই হয়, খাওয়াটা হয় না।একেবারে হয় না তা নয় অবশ্য, হয়। হয়তো বা এক পেয়ালা কফি, হয়তো বা চা আর অমলেট। বেশি খাওয়ার রেস্ত কোথায়? দুজনেই তো পড়ুয়া। দিবাকর অবশ্য তাদের দেশের জমিদারি আর বিজনেসম্যান বিরাট মামার গল্প অনেক করে, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই দেখা যায় ও পার্সটা ভুলে এসেছে, কিংবা পার্সটা ভরে আনতে খেয়াল করেনি। তাছাড়া আর এক ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত দিবাকর তুচ্ছ ক্ষুধাতৃষ্ণার ধারই ধরতে চায় না যেন। সেই প্রথম পরিচয়কালের মতো কফি হাউসে এক ঘণ্টা অথবা গঙ্গার ধারে পঁয়তাল্লিশ মিনিট-এর মনোরম স্বাদ প্রায় ভুলেই গেছে মীনাক্ষী। এখন ভূমিকাটা অনেকটা অভিযুক্ত ও অভিযোক্তার। মীনাক্ষী আছে কাঠগড়ায় যেন অন্ধ কুসংস্কারের জ্বলন্ত নিদর্শন হয়ে, আর দিবাকর। প্রতিপক্ষের উকিলের ভূমিকায়। দিবাকরের প্রত্যেকটি অভিব্যক্তিতেই তাই শাণিত বিদ্রূপ আর তীক্ষ্ণ সমালোচনা। দিবাকর তাই সর্বদাই উগ্ৰ অসহিষ্ণু।

ভালবাসার মধুর স্বাদটা যে কী, তা জানে না মীনাক্ষী। জানে না তার স্নিগ্ধতা, সরসতা, পূর্ণতার স্বাদ। মীনাক্ষীর প্রেমাস্পদ ওকে দেয় শুধু একটা তীব্র জ্বালার অনুভূতি। প্রতিক্ষণই তাই মনে হয় মীনাক্ষীর, আপন জীবনে সে নিরুপায়, সে বন্দিনী, সে একটা কঠোর শাসনের তলায় নিষ্পেষিত। যে শাসনটা অন্যায়।

সব কিছু মিলিয়ে মীনাক্ষীও যেন ভারসাম্য হারাচ্ছে।

তাই আজ মীনাক্ষী, যা হয়তো সে ঘণ্টাখানেক পূর্বেও কল্পনা করতে পারেনি, তাই করে বসে। সারদাপ্রসাদের ঘর থেকে বেরিয়ে তীব্র বেগে বাবার ঘরের পরদাটা সরিয়ে ঢুকে পড়ে বিনা ভূমিকায়। বলে ওঠে, বাবা, আপনার কি মনে হয়, পৃথিবীতে কিছুদিন আগে এসে পড়ার অধিকারে যাকে যা খুশি অপমান করা যায়?

২. ঘুমন্ত ছেলেটা

সুনন্দা দোতলায় উঠে ঘুমন্ত ছেলেটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেছে। নীলাক্ষ ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে ধীরে ধীরে অসমান পায়ে দোতলায় উঠে এসে জড়িত গলায় প্রশ্ন করে, কী ব্যাপার! ডাক্তারকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম মনে হল।

প্রশ্নটা শূন্য দালানকে, তাই উত্তর মিলল না।

নীলাক্ষ অতএব বাবার ঘরের পরদা সরিয়ে আর একবার উচ্চারণ করল প্রশ্নটা।

মীনাক্ষী বিছানার ধারে একটা চেয়ারে বসে ছিল, খাটের উপর সরোজাক্ষ শুয়ে। চোখ বোজা। জেগে আছেন কি ঘুমিয়ে আছেন বোঝা যাচ্ছে না।

মীনাক্ষীও শূন্য দালানের ভূমিকাতেই স্থির থাকল। শুধু একবার চোখটা তুলে তাকাল। সে চোখে ঘৃণার ছায়া।

একটা নেশায় টলমল মানুষকে দেখে ঘৃণা ছাড়া আর কোন ভাবেরই বা উদয় হবে!

ওঃ অসুখটা তা হলে বাবার!

নীলাক্ষ তেমনি জড়িত গলাতেই বলে, হওয়াই স্বাভাবিক! কলেজে তো আজ বেশ একখানি নাটক হয়ে গেছে। ঘেরাও নাটক! আরে বাবা, কলেজটা বাড়ি নয় যে, যাকে যা খুশি বলে পার পাবে! ও হল গিয়ে কেউটের বাচ্চার আচ্ছা। সেখানে তুমি গিয়েছ তাদের ল্যাজে পা দিতে।

মীনাক্ষী এই রোগীর ঘরে বাঁচালতার বিরুদ্ধে হয়তো রুক্ষভঙ্গি নিত, কিন্তু নীলার মন্তব্যটা অভাবিত বিস্ময়কর, তাই নিষেধ করতে ভুলে গিয়ে তাকিয়ে থাকে।

নীলাক্ষ স্ফুর্তির সঙ্গে বলে চলে, হঁ বাবা, এ হচ্ছে ঘেরাওয়ের যুগ, কথাটি কয়েছ কি ঘেরাও। নাও এখন বুঝলে তো ঠ্যালা। হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে তবে

সরোজাক্ষকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে, সেই ওষুধের ক্রিয়ায় এখনও আচ্ছন্নই আছেন হয়তো, তবু যেন মনে হল মীনাক্ষীর, শয্যাগতের কপালটা একটু কুঁচকে উঠল। হয়তো সত্যি নয়। হয়তো তার মনের ভ্ৰম, তবু সে নিচু অথচ দৃঢ়গলায় বলে, ও ঘরে গিয়ে কথা বলল।

ও ঘরে গিয়ে? ওঃ! অসুখটা কী?…মনোভঙ্গ? ব্লাডপ্রেসার? স্ট্রোক?

অসমান পায়ে চলে যায় নিজের ঘরে।

মীনাক্ষী সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। মীনাক্ষীর চোখের সেই ছায়াটা আরও নিবিড় হয়।

সে ঘৃণা গিয়ে পড়ে আর এক অন্তরালবর্তিনীর উপর।

বউ এসে গটগটিয়ে ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। খোঁজও করলেন না ডাক্তার এসেছিল কোন প্রয়োজনে। বোধ করি তাঁরও পায়ের ঠিক নেই, আর সেটা ঢাকতেই তাড়াতাড়ি

অথচ ওই বউ আগে কী ভিজে বেড়ালটিই ছিল!

মীনাক্ষীর চিন্তা বর্তমানের সব কিছু থেকে সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নীলাক্ষর বউ সুনন্দার সদ্যবধূজীবনের অধ্যায়খানার সামনে।…ভিজে বেড়াল, স্রেফ ভিজে বেড়াল, আস্তে আস্তে কথা, কথায় কথায় মাথায় ঘোমটা টানা, শাশুড়ি ননদের মনোরঞ্জনের চেষ্টায় তাদের পায়ে পায়ে ঘোরা! কত ভেক্!…আর মেয়েই বা কী ঘরের! মীনাক্ষী অজ্ঞাতসারেই নাকটা কোঁচকায়, সেই তো নেহাত গরিব গেরস্ত ঘর, মা এখনও কয়লাগুঁড়োয় গুল দেয়, ক্ষার কাঁচে। বাবারই বা কী ছিরি! গাঁইয়া বুড়ো, চটের থলি হাতে ঝুলিয়ে বাজার যাচ্ছেন, রেশন আনছেন। মায়ের অঙ্গে শেমিজ ব্লাউজ কদাচ ওঠে (মীনাক্ষীর মায়ের অঙ্গে যে সেই কদাচটিও ওঠে না, তা মনে পড়ে না মীনাক্ষীর। সুনন্দার মার চেহারাই মনে পড়ে তার)। রাতদিন লক্ষ্মী-ষষ্ঠী-ইতু-মনসা-ঘেঁটু-ভাদু নিয়ে পড়ে আছেন!..বউদিই বা কী? মীনাক্ষী ভাবে, সেও তো যখন এল, তখন কত কী ব্রতট্রত করত। বলেছিল, ধরা ব্রত চার বছর করতেই হয়, আর উদ্যাপনও করতে হয়, নইলে পতিত হয়।

সুনন্দার ওই বোকা বোকা সেকেলে সেকেলে কথা শুনে মীনাক্ষীরা দুই বোন হেসে কুটিকুটি হত। আর বলত, একটু বর্তমান হও বাবা, একেবারে অতীত যুগ হয়ে থেকো না।

তবু সুনন্দা এক বছর ধরে এয়ো সংক্রান্তি করেছিল। মাস শেষ হলেই যত এয়ো ধরে ধরে তাদের পা পুজো করতে বসত। কী সাজ তখন মহিলার! সোজাসুজি বাঙালি করে শাড়ি পরা, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর, তেল জবজবে চুলে ইয়া এক খোঁপা বাঁধা, গলায় আবার বড় বড় মটর দানার মালা! এককথায় যেন গাঁইয়া নম্বর ওয়ান! দাদা যদি কোথাও বেড়াতে নিয়ে যেতে চাইত, কি সিনেমা যেতে চাইত, ভয়ে লজ্জায় একেবারে দিশেহারা। বলা হত, একলা যাব কি? ঠাকুরঝিরাও চলুক না।

ঠাকুরঝি!ননদদের ঠাকুরঝি বলত সুনন্দা। মীনাক্ষীরাই হেসে ঠাট্টা করে সে ডাক ছাড়িয়েছে। দিদি বলেছে, দাদার সঙ্গে একা যেতে তোমার ভয়? কেন? পরপুরুষ নাকি? সেই মেয়ের পেটে পেটে এত ছিল। উঃ!

দিদিই তো বলতে গেলে ওকে সাজসজ্জায় মানুষ নামের যোগ্য করে তুলেছিল। আর এখন? এখন বেহেড দিদিটাও ওর সজ্জা দেখলে লজ্জা পায়। নেহাত পুলিশে ধরবার ভয়েই বোধ হয় বিবসনা হয়ে বেড়ায় না, সে ভয় না থাকলে তাও বেড়াত! আর কথাবার্তাই বা কী এখন! ইংরিজি বুকনি, মিহি গলা, বেপরোয়া বোলচাল!..আগে দাদা বউকে একটু ফ্যাসানি করবার জন্যে মাথা খুঁড়েছে, এখন বোধহয় বউয়ের কায়দাকানুন দেখে মাথা খুঁড়ছে। এঁয়োপোকা থেকে যে প্রজাপতি হতে পারে, বউদিই তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ! তার মানে ভিতরে ভিতরে ছিল সব, ওপরে দেখাত ওই ধড়িবাজি। শুনতে পাই দাদার ব্যবসার উন্নতির কারণই নাকি সুন্দরী স্ত্রী। কে জানে স্বভাব চরিত্রই বা—

এখানে থামে মীনাক্ষী। অর্থাৎ ভাবনাটাকে থামায়। ভাবে, যাকগে আমার কি? দাদাই বুঝবে। তবে ভোলটা ফিরিয়েছে বটে এ বাড়ির বউ। এত যে তটস্থ থাকত বাবা বাবা করে, এখন তো সে বাবার ছায়াও মাড়ায় না। আর শাশুড়ি-ননদদের সঙ্গে যদি কথা কইল তো ব্যঙ্গের সুরে ভিন্ন নয়। এ সংসারের সবাই যেন উপহাসের পাত্র।

মানুষ কত বদলাতেই পারে। বিশেষ করে মেয়েমানুষ! মীনাক্ষী নড়েচড়ে বসে। ভাবে, অবশ্য সব মেয়েমানুষ নয়। যাদের মধ্যে বস্তু নেই তারাই পারে দেবী থেকে দানবী হতে, শুয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হতে। এটা ঠিক, দাদাই দিয়েছে আশকারা। দাদাই করেছে এটি, কিন্তু করলেই তাই করবি তুই?

নিজের একটা সত্তা নেই? এবাড়ির প্রজাপতি হয়ে ওঠা বউয়ের বিরুদ্ধে চিন্তা করতে করতে নিজের কথা ভুলে যায় মীনাক্ষী। ভুলে যায় দিবাকর নামের একটা দাঁতাল প্রাণী তার সত্তাকে কীভাবে নিঃশেষে গ্রাস করতে বসেছে।

.

বাইরের সাজসজ্জা খুলে ফেলে, শুধু একটা টাইটবডি আর পেটিকোট পরে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সুনন্দা। চুলটাকে রাতের উপযুক্ত করে টেনেটুনে একটা বেণী বাঁধছিল, ঘষে ঘষে ক্রিম মাখছিল সর্বাঙ্গে। নীলাক্ষ ভোম্বলের মতো পড়ে ছিল বিছানায়।

দরজার বাইরে একটা মৃদুকণ্ঠের আওয়াজ শোনা গেল, সুনন্দা গালে ক্রিম ঘষতে ঘষতেই পরদাটা সরিয়ে বলল,আমরা আজ আর খাব না, খেয়ে এসেছি।

বলে ফিরে এল আবার। ক্রিমের শিশিটার গহ্বর প্রায় শূন্য করে বাহুমূলে লাগাল মোটা আঙুলের পোঁচড়ায়, শিশির ঢাকনি বন্ধ করল, আবার ডলবে ভাল করে।

নীলাক্ষ উঠে বসে ভুরু কুঁচকে বলল,কে কথা বলল?

সুনন্দা তাচ্ছিল্যের গলায় বলল,নিতাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিল, এখন খাব কি না। বলে দিলাম খাব না।

নীলাক্ষ বিরক্তির গলায় বলে ওঠে, তুমি এভাবে বেরোলে তার সামনে?

সুনন্দা অবিচলিত ভঙ্গিতে বলে, ইস তাই তো! ভারী অন্যায় হয়ে গিয়েছে তো। ঘোমটা দেওয়া উচিত ছিল।

ঘোমটার কথা হচ্ছে না–নীলাক্ষ বিরক্তির গলায় বলে, চাকরবাকরদের সামনে একটা প্রেস্টিজ রাখা উচিত।

উচিত বুঝি? সুনন্দা ঘাড়ে গলায় মুঠো মুঠো পাউডার মাখতে মাখতে বলে, তোমার পা দুটোর গতিবিধি যেমনই হোক ব্রেনটা কিন্তু ঠিক জায়গায় আছে বলতে হবে। একেবারে কারেক্ট চলছে।

তার মানে?

মানে অতি প্রাঞ্জল। একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে।

নীলাক্ষর বিরক্ত গলায় বলে, সভ্যতা শালীনতা বলে একটা জিনিস আছে।

সভ্যতা! শালীনতা! ওরে বাবা, এ যে ভাল ভাল বাংলা সাহিত্য-টাহিত্য করছ নাকি আজকাল?

আমাকে ডাউন করতে পেলে তো আর কিছু চাও না। কিন্তু আমার শালীনতার মাপকাঠিতে তোমার ব্যাপারটা মাপা চলে না?

সুনন্দা পাউডার ঘষা স্থগিত রেখে রাজহংসীর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, চলে না কেন।

চলে না বলেই চলে না। নীলাক্ষ দুর্বল গলায় বলে, আমি যদি মদ খেয়ে খানায় পড়ে গড়াগড়ি দিই, লোকে বড়জোর হাসবে, কিন্তু

আমার ব্যাপারেও ওই একই কথা। সুনন্দা তার একটা পা খাটের উপর তুলে সুগঠিত সুন্দর গোছটায় ক্রিম ঘষতে ঘষতে বলে, তা ছাড়া আর কিছুনয়। লোক হাসবে, আর কি? কিন্তু হাসার কথাই বা উঠছে কেন? সুনন্দা পা বদলায়, তেমন দৃশ্য দেখলে লোকে বরং ধন্যি ধন্যি করবে।…বলবে, কী চমৎকার কুসংস্কারমুক্ত। কী প্রগতিশীল।

এতক্ষণে আলনা থেকে একটা শাড়ি টেনে নিয়ে জড়ায় সুনন্দা।

নীলাক্ষ বিরস গলায় বলে, তোমার কথাবার্তাগুলো ক্রমশই এত কটু হয়ে উঠছে

সুনন্দা হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে। যে হাসিটা ও কিছুকাল ধরে রপ্ত করে করে শিখেছে। আর সেই হাসির গলাতেই বলে, তাইনাকি? কবে থেকে গো?কবে থেকে আমার কথা কটু লাগতে শুরু করল? মিসেস সিনহার সঙ্গে আলাপ হয়ে পর্যন্ত বুঝি?

মিসেস সিনহা। মিসেস সিনহা মানে? নীলা ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে বলে, এর মধ্যে আবার থার্ড পার্টির কথা আসছে কোথা থেকে?

তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাবেই তো দুজনের মাঝখানে কটু তিক্ত লবণাক্ত স্বাদের সৃষ্টি হয়।

পাখার রেগুলেটারটা শেষ পয়েন্ট অবধি ঠেলে দিয়ে সুনন্দা এবার বিছানার পাশে রাখা সোফাটায় হাত পা ছড়িয়ে বসে।

নীলাক্ষ আবার উঠে বসে, ক্রুদ্ধ গলায় বলে, তা বললে তো অনেক আগেই সেটা সৃষ্টি হতে পারত। মিস্টার মেহেরার সঙ্গে যেভাবে গা গড়িয়ে মেলামেশা করো তুমি, তাতে

কথা শেষ করতে পারে না নীলা, একখানা শার্সি ভেঙে পড়ে যেন। হ্যাঁ, সুনন্দা ওই কাভাঙা সুরের হাসিটা রীতিমত রপ্ত করেছে। সেই হাসির ঝাঁপটায় কথার শেষটা আর এগোয় না। হাসিটাই কথা হয়ে এগোয়, তাতে যে-কোনও স্বামীরই রক্ত টগবগিয়ে ফুটে উঠত, তাই না? তবে নেহাত না কি এক্ষেত্রে রক্তের বদলে বরফ জল, তাই আর ফুটে ওঠে না।

এই কটু তিক্ত লবণাক্তর উত্তরে কী বলত নীলাক্ষ কে জানে, কিন্তু উত্তর দেওয়া হল না। পরদার ওপিঠে বিজয়ার চাঁচা-ছোলা ধারালো গলাটি বেজে উঠল, ছ ঘণ্টা বউ নিয়ে বেড়িয়ে এসেও আবার ঘরে বসে বউয়ের সঙ্গে হাসি-মশকরা করছিস নীলে? গায়ে কি মানুষের চামড়া নেই তোর? এদিকে বাপ মরতে পড়েছে।

সুনন্দা সাড়া দেয় না, সুনন্দা শুধু উঠে বসে। সুনন্দার কপালটা একটু কুঁচকে যায়।

নীলাক্ষ দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। নীলাক্ষর বোধ করি নেশা ছুটে এসেছিল, তাই ঈষৎ অপ্রস্তুত গলায় বলে, এসেই তো বললাম ডাক্তার এসেছিল কেন? তা কা কস্য পরিবেদনা! কেউ জবাবই দিল না।

বাপ অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছে দেখতে পাসনি বুঝি? বিজয়ার কণ্ঠে জগতের ধিক্কার।

আড়ালে নীলাক্ষ অনেক কিছুই করে, এই সনাতন বাড়ির ছেলে হয়েও নীলাক্ষ মদ ধরেছে, বউকে নিয়ে বাইরে নাচাচ্ছে, তবু মায়ের তীব্রতার সামনে মুখোমুখি দাঁড়ালেই নীলাক্ষ যেন কেমন অসহায়তা বোধ করে।

আর তীব্র তো বিজয়া সব সময়।

আত্মসম্মান বোধের মাপকাঠি বিজয়ার সরোজাক্ষর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর মতে এ-যুগ ভালমানুষীর যুগ নয়, ভদ্রতার যুগ নয়। তোমার ভদ্রতায় অন্যে ভদ্র হবে, এ আশা বাতুলের আশা। বরং সেই ভদ্রতার সুযোগটা নেবে সে আঠারো আনা। তবে ভদ্রতায় লাভ?

লাভের জন্যে ভদ্রতা নয়, ভদ্রতার জন্যেই ভদ্রতা–সরোজাক্ষর এ মতবাদে বিশ্বাসী নন বিজয়া। তিনি বলেন, আর কিছু না হোক, দুকথা শুনিয়ে নেবার সুখটাই বা ছাড়ি কেন? যাচ্ছেতাই করে শুনিয়ে আমি দেবই সবাইকে। মেয়ে জামাই ছেলে বউ আত্মীয় বন্ধু কাউকে ছেড়ে কথা কইব না। হক কথা কইব, ভয়টা কাকে?

বিজয়ার শুনিয়ে দেবার বদলে অপর পক্ষও শুনিয়ে দিলে, আরও গলা তুলবেন তিনি, আর শেষ অবধি বিজয়িনীর গৌরব নিয়েই ফিরবেন।

নীলাক্ষ বলে, দেখতে পাব না কেন? তা তোমার ছোট কন্যে তো কথাই কইল না, বুঝব কেমন করে কী হয়েছে?

হয়েছে ব্লাডপ্রেসার বৃদ্ধি। বিজয়া কেমন নিষ্ঠুর গলায় বলেন, স্ট্রোক হতে হতে হয়নি এই আর কি! তবে ধরনটা তাই।

নীলাক্ষর কণ্ঠস্বরে নেশার আভাস বিদ্যমান, তবে কথার মধ্যে যুক্তির অভাব নেই। মার কথার উত্তরে বলে, হলেও আশ্চর্য হবার কিছু ছিল না। কলেজেই স্ট্রোক হতে পারত। বাবার মতন লোককে দিয়ে অ্যাপো-ইয়ে, ক্ষমা চাইয়ে নিয়েছে, সোজা কথা!

বিজয়া ভুরু কুঁচকে তাকান, কী চাইয়ে নিয়েছে?

ক্ষমা! স্রেফ হাতজোড় করিয়ে

কে? বিজয়া অবাক হন, কে চাইয়ে নিয়েছে?

কেন, বাবার সাধের ছাত্ররা। ঘেরাও করে ধরেছিল। ক্ষমাটি না চাইলে ওইখানেই গুম করে রেখে দিত।

বিজয়া এবার স্থির গলায় বলেন, এসব কথা কখন হল, কই উনি তো

আরে বাবা, নিজে মুখে কি আর বলবেন উনি?না, বলেন কিছু কখনও?–শুনলাম আমার শালার মুখে। তার শালীর ছেলে পড়ে ওখানে, সে এসে গল্প করে গেছে। করবেই তো, এমন একটা মজাদার গল্প! তবে কী আশ্চর্য যে সুমতি হয়েছিল, ক্ষমা চেয়েছিলেন, জেদ করলে ব্যাপার গুরুতর হয়ে উঠত।

বিজয়া ক্রুদ্ধগলায় বলেন, তা কারণটা কী ঘটল? খামোকা

কারণ আর কি!নীলাক্ষ অলস গলায় বলে, মধ্যযুগীয় জমিদারের মনোভাব। মনে করছেন ছাত্ররা সবাই ওঁর প্রজা, তাই মেজাজ দেখিয়ে বসেছেন। আরে বাবা, মেজাজ দেখাবার যুগ যে আর নেই, সেটা খেয়াল করবে তো?

যুগ থাকবেনা কেন, খুব আছে। বিজয়া ঝংকার দিয়ে বলে ওঠেন, যুগ-মাহাত্ম্যে মেজাজ দেখাবার অধিকারটা রাজা থেকে প্রজায় বর্তেছে এই যা! তা নইলে ঘরের বউ সন্ধে না হতেই ধেই ধেই করে বেরিয়ে যাচ্ছেন, রাত দুপুরে বাড়ি ফিরছেন, ফিরে এসে পালঙ্কে অঙ্গ ঢেলে দাস-দাসীকে হুকুম করছেন, আর বুড়ো শাশুড়ি সংসার নিয়ে মরছে? যুগমাহাত্ম্যর গুণেই তরে যাচ্ছে এসব। বলতে গেলেই। মেজাজ

এবার দরজার কাছে আর একটি মূর্তির ছায়া পড়ে, এবং খুব শান্তগলার একটু কথা শোনা যায়। সংসারের জ্বালা কি সিঁড়ি ভেঙে তিনতলা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে মা?

বিজয়া ছটফটিয়ে ওঠেন এই শান্তকণ্ঠের দাহে। যদি গলা তুলে ঝগড়া করতে আসত তাঁর সঙ্গে, তা হলে যেন মর্যাদা বজায় থাকত তাঁর, তিনিও তার উপর গলা তুলে বিজয়িনী হতে পারতেন। কিন্তু এই শান্তভাষার যুদ্ধ যেন হাতিয়ার কেড়ে নেওয়া যুদ্ধ।

তাই যুদ্ধের অন্য পথ ধরলেন তিনি, কড়াগলায় বলে উঠলেন, হচ্ছিল মায়ে-ছেলেয় কথা। তুমি তার মধ্যে নাক গলাতে এলে কেন শুনি?

শুধু মায়ে-ছেলেয় কথা হলে অবশ্যই আসতাম না। ঘরের বউয়ের আচরণের কথা উঠল কি না—

বিজয়া হইচই করে তেড়ে ওঠেন, উঠবেই তো, একশোবার উঠবে। পাঁচঘণ্টা বেড়িয়ে এসে ঘরে ঢুকে অঙ্গ ঢাললে, শ্বশুর যে মরতে পড়েছে তা একবার তাকিয়েও দেখলে না। মুখ নেড়ে কথা বলতে লজ্জা করছে না তোমার?

শ্বশুরকে সুনন্দা ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে, অসুস্থতার সংবাদে উদ্বিগ্ন হয়নি তা নয়। কিন্তু উদ্বেগ · প্রকাশের ধৃষ্টতা তার নেই, ধৃষ্টতা নেই শ্বশুরের শিয়রে গিয়ে বসবার। সরোজাক্ষর সামনে সাধ্যপক্ষে বেরোয় না আর সে। অর্থাৎ যতদিন থেকে মূর্তি বদলেছে তার।

কিন্তু এই মহিলাটিকে বরদাস্ত করা কঠিন। মানুষের মধ্যেকার কোমল বৃত্তিটুকুকে টেনে বার করে পায়ে দলে পিষে শেষ করে দেওয়াতেই আনন্দ ওঁর।

অতএব ওঁকে সুনন্দা ছেড়ে কথা কয় না। শুধু ভঙ্গিটা শান্ত আত্মস্থ। বাবার অসুখটা যে এত গুরুতর তা কী করে বোঝা যাবে বলুন? ভাবলাম তেমন হলে আপনি নিশ্চয় পুজো পাঠ ফেলে এসে কাছে বসতেন।

পুজো পাঠ ফেলে? কাছে এসে বসতাম? বিজয়া চেঁচিয়ে ওঠেন,তোমাদের কালের মতন শিক্ষা আমরা পাইনি বউমা! চব্বিশ ঘণ্টা স্বামীর অঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষিরও অভ্যেস নেই, রোগ হলে ডাক্তার ডাকতে হয় তাই জানি, ঠাকুর-দেবতার কাছে কেঁদে পড়তে হয় তাই জানি, শিয়রে গিয়ে না বসলে যে কর্তব্য হয় না তা জানি না। তবে তুমি ছেলের বউ হয়ে—

ও-ঘর থেকে উঠে আসে মীনাক্ষী, চাপা রাগের গলায় বলে, মা, তোমরা ভেবেছ কী? চিৎকারের চোটে যে ঘুমের ওষুধ খাওয়া ঘুমও ভেঙে যাচ্ছে। আশ্চর্য!

চলে যায় মীনাক্ষী বিরক্তি ছড়িয়ে।

বিজয়াও তিরতিরিয়ে সরে যান। সরোজাক্ষর জন্যে তিনি এই ফাঁকে অনেক মানত-টানত করে নিয়েছেন, আর ভয় নেই।

আর ভয়টা তো কমেও গেল নীলাক্ষর কথায়। রোগটা আকস্মিক আর অকারণ নয়। কারণ আছে। মানী মানুষ, অপমানটা বুকে বেজেছে। তাই বে-এক্তার হয়ে গেছেন হঠাৎ।

কিন্তু বিজয়া এতে যেন রীতিমত একটা উল্লাস অনুভব করছেন। অদৃশ্য প্রতিপক্ষকে দাঁড় করিয়ে বলে চলেছেন তিনি। দেখে বোঝো, অপমান জিনিসটার জ্বালা কত! জীবনভর এই একটা মেয়েমানুষকে অপমানই করে গেলে, তাকিয়ে দেখলে না তার কতটা লাগে।

তার শান্তি একটু পেতে হবে বইকী, ভগবান কি নেই?

খুব যে বলা হত, মানটা বজায় রাখা নিজের হাতে, রাখতে জানলে কারও সাধ্য নেই সেটা কেড়ে নেয়। এখন?

এখন বোঝো? অদৃশ্য সেই প্রতিপক্ষ উত্তর করে না। তবু বলেই চলেন বিজয়া মনে মনে।

মীনাক্ষী আবার বাবার ঘরে গিয়ে বসে। ৪০

আর ভাবতে থাকে বাবার এই অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণ কি শুধুই বাবার ছাত্রদের ঔদ্ধত্য, অসভ্যতা, দুর্বিনয়?

বাবার সন্তানদের ব্যবহার একেবারে নম্র সভ্য বিনীত? এবং বাবা স্ত্রীরও তাই?

মীনাক্ষীর চিন্তা যেন একটা ঘড়ির পেণ্ডুলামে বাঁধা পড়েছে, তাই সে একবার দক্ষিণে হেলে, একবার বামে। দক্ষিণের দাক্ষিণ্য নিয়ে ভাবে বাবার মতো চরিত্রের লোকের পক্ষে এ চাপটা বাস্তবিকই দুঃসহ। ঘরে বাইরে এই অসভ্য অস্ত্র উদ্ধত ব্যবহারের ভার বহন করতে করতে বাবার স্নায়ুরা সহনক্ষমতা হারিয়ে বসেছে।

আবার ক্ষণপরেই বাপের বিরূপতা নিয়ে ভাবতে বসে। কিন্তু ওঁরা কেন এই যুগকে স্পষ্ট প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে দেখবেন না? কেন এখনও বালির গাদায় মুখ গুঁজে বসে অতীত যুগের স্বপ্ন দেখবেন? কেন ওঁদের এখনও এত প্রত্যাশা, এত ভাবপ্রবণতা?

ভাবে, তবু মাথার মধ্যে একটা আর্তস্বর অনবরত ধাক্কা দিতে থাকে, বাইরে আজ হাতজোড় করে ক্ষমা চেয়ে এসেছি, এবার তোমাদের কাছেও তাই চাইছি, দয়া করে তুমি এ-ঘর থেকে যাও।

অর্থাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যাও।

ধাক্কাটা তখন অনুভবে আসেনি।

তখন মীনাক্ষীর মনের সঙ্গে শরীরটাও শক্ত হয়ে গিয়েছিল। সেই শক্ত হয়ে যাওয়া শরীরটায় একটা। মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসছিল মীনাক্ষী, কিন্তু বেরিয়ে আসা হয়নি।

তার আগেই সরোজাক্ষর মাথাটা অসহায়ভাবে বুকের উপর ঝুঁকে পড়েছিল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তে ভেবেছিল মীনাক্ষী,–অথচ আমি দিবাকরের কথা তুলিনি। কিন্তু তুলব বলেই ঘরে ঢুকেছিলাম।

সারদার বয়েসটা যে নেহাত কম তা নয়, কিন্তু আকৃতি এবং প্রকৃতি দুজনেই যেন ওকে মাঝপথে কোনও একখানে বসিয়ে রেখে কোথায় সরে পড়েছে।

সারদাকে দেখলে তাই মনে হয় যেন একটি চটপটে ছটফটে খটখটে যুবক, আর সারদার কথা শুনলে মনে হয়, কৈশোর এখনও অতিক্রম করেনি।

ওষুধ নিয়ে যখন ফিরছিল সারদা, তখন তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হতে পারত দৌড়ের রেস দিচ্ছে। কিন্তু বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ানক শান্ত হয়ে গেল। সন্তর্পণে সিঁড়িতে উঠতে লাগল জুতো খুলে পা টিপে টিপে।

নিতাই খাবার কথা জিজ্ঞেস করে ধমক খেয়েছে। বাড়ির কর্তা মুখের খাবার ফেলে বিছানা নিয়েছে, আর বাড়ির অন্য সদস্যরা খাবে, এর চাইতে নির্লজ্জতা আর কী হতে পারে জানা নেই সারদার। সেই নির্লজ্জতার প্রশ্ন নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে ছিল নিতাই। অতএব ধমক খাবে, এটা স্বাভাবিক।

তবে ধমকটা উচ্চারিত হল খুব চাপা গলায়। খাওয়া? খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করছ? লজ্জা করল না? সব রান্না টান মেরে ফেলে দাও গে–।

এই বলে আবার উঠে যায় নিঃশব্দে, হাতের ওষুধগুলো নামিয়ে রাখে টেবিলে। যার সামনে বসে মীনাক্ষী নিদ্রায় গভীর, আর যেন অপরিচিত একটা মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছিল, অথচ আমি দিবাকরের কথা তুলিনি।…

ভেবেছিলাম আজ একটা হেস্তনেস্ত করে ফেলব। হল না। সরোজাক্ষ হঠাৎ শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললেন বলেই কি বলা হল না?

সরোজাক্ষ সুস্থ সবল হয়ে বসে শুনলেই কি বলা হত?

হত না।

অনুভব করল মীনাক্ষী। আর মনে মনে বলল, দিবাকর ঠিকই বলে, আমি ভীরু আমি ভীরু। কিন্তু আমাকে সাহসী হতে হবে।

.

কমনরুমে জোর আড্ডা চলছিল।

নাঃ ঠিক আড্ডা নয়, বরং বললে ঠিক হবে বিতর্ক। বিষয়বস্তু প্রফেসর মৈত্র।

গতকালকার ঘেরাও ঘটনা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং উত্তেজনার ঝড় বইছে। ঘটনাটার প্রস্তুতিপর্বেই ছাত্রদের মধ্যে দুটো দল হয়ে গিয়েছিল, কাজেই এখন চলছে দুই শিবিরের বাকযুদ্ধ।

অবশ্য ছাত্রদের এই দলবিভেদটা যে কেবলমাত্র তাদের অধ্যাপকের লাঞ্ছনাকে ঘিরেই ঘটেছে তা নয়, এমনিতেই রাজনৈতিক মতবাদের পার্থক্যে তারা বহু শিবিরে বিভক্ত।

বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী, বাম-দক্ষিণ পন্থী, দক্ষিণ বাম পন্থী এবং বাম-উগ্র বাম, দক্ষিণ-উগ্র দক্ষিণ, বামেতর দক্ষিণ বা দক্ষিণেতর বাম ইত্যাদি নানা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শাখায় বিচরণ তাদের।

তারা কেউ কারও সঙ্গে পানভোজন করে না, কেউ কারও সঙ্গে খেলাধুলা করে না এবং একে অপরের শুধু অস্পৃশ্যই নয়, ব্যঙ্গের পাত্র, করুণার পাত্র, অবজ্ঞার পাত্র।

আবার ওরই মধ্যে যারা বেশি বলবান গোষ্ঠী, তারা দুর্বল পক্ষকে ভয় দেখিয়ে দলভুক্ত করবার চেষ্টাতেও দ্বিধা করে না।

স্বাভাবিকই।

আমার মতবাদে যে আস্থাশীল নয়, সে আবার মানুষ নামের যোগ্য নাকি? এই তো মনোভাব মানুষের। অতএব হয় তাকে স্বমতে এনে মনুষ্য পদবাচ্য করে তুলব,নয় তাকে ঘৃণা করব, অবজ্ঞা করব, করুণা করব।

বন্ধুত্ব?

কদাচ না।

আমার দলে না ভিড়লে আবার বন্ধুত্ব কীসের? বন্ধুত্ব করব তুমি একটি সুন্দর হৃদয় ঐশ্বর্যের ঐশ্বর্যবান বলে? ধুত্তোরি রাবিশ! হৃদয় আবার একটা বস্তু নাকি? হৃদয়ে হৃদয়ে বন্ধুত্ব, ওসব হেঁদো কথায় আর বিশ্বাস করে না এ যুগ।

এ যুগ জানে বন্ধুত্ব সম্ভব কেবলমাত্র মতবাদে মতবাদে। বন্ধুত্ব সম্ভব শুধু একই শিবিরের ছায়ায়। সেখানে হৃদয় বস্তুটা হাস্যকর।

তা এরা সেই এক শিবিরেরই লোক–অসিত, দিলীপ, অনিল, কুমারেশ, বিমল, শিবেন্দু, অবনীশ, ইন্দ্রজিৎ, পরাশর এবং আরও অনেকে। সম্প্রতি প্রফেসর মৈত্রকে কেন্দ্র করে ওদের মধ্যেও দলবিভেদ ঘটে গেছে। আবার আর একটি শিবির বেড়ে গেছে।

এদের এক পক্ষ গতকালকার ঘটনায় লজ্জিত দুঃখিত মর্মাহত, অপর পক্ষ উল্লসিত, উচ্ছ্বসিত, বীরত্বে গর্বিত।

ছেলেবেলায় স্কুলে থাকাকালীন অবস্থাতে এ পদ্ধতি ছিল তাদের। কোনও এক ছেলের সঙ্গে কোনও এক ছেলের ঝগড়া হলেই চটপট দুটো দল গড়ে উঠত, যার নাম গ্যাঙ। একটা গ্যাঙ একটা ছেলেকে সমর্থন করত, অপর গ্যাঙ অপর ছেলেকে। বলা বাহুল্য কলহ অনলকে অতএব জইয়ে রাখত তারা নিজ নিজ দুষ্টুমির ইন্ধনে। যাদের মধ্যে বিবাদ, তারা পরস্পরে অনুতপ্ত হলেও, ঝগড়া মিটিয়ে নেবার উপায়টি আর থাকত না তাদের নিজের হাতে।

এখন এরা নিজেদেরকে আর গ্যাঙ নামে অভিহিত করে না বটে, তবে মনোভাবটার পরিবর্তন ঘটেনি।

পরিবেশ অন্য, সহপাঠীরা অন্য, কারণও অন্য, কিন্তু মনোভাব অপরিবর্তিত। তাই এক পক্ষ যখন বলে, কালকের কাজটা ভাল হয়নি, অপর পক্ষ তখন বলে, আরে রেখে দিন মশাই আপনাদের মেয়েলিপনা। ঠিক কাজ হয়েছে। মুখের মতো জুতো হয়েছে, কুকুরের উপযুক্ত মুগুর।… শা-কে যা টাইট দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে আর ট্যাঁ-ফোঁকরতে হবেনা। শা–ঘুঘু দেখেছে ফাঁদ দেখেনি। এবার বুঝবেন বাছাধন, সাপের ল্যাজে পা দেওয়ার ফলটা কী!

অতঃপর তর্ক উদ্দাম।

এভাবে কথা বলা নিজেদেরই সভ্যতা নষ্ট করা।

ও হো হো তাই নাকি? চুক চুক। এটা বাইবেলের কোন অধ্যায় ব্রাদার?

সে আপনারা যাই বলুন, আমি বলব, প্রফেসর মৈত্র সত্যিকার ভাল লোক।

ভাল লোক!ভাল শব্দটার ধাতুরূপ কী মাইরি? লোকটা একটা পেঁতি বুর্জোয়া, বুঝলেন? স্রেফ একটা পেঁতি বুর্জোয়া। আবার গাড়ি চড়ে কলেজে আসা হয়। মাইনে তো টুটু কোম্পানি, তাতে সংসার চালিয়ে গাড়ি চালানো যায়? হুঁ! অন্য আয় আছে বুঝলেন?

সেটা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু নিশ্চয় বলব পড়ানোর ব্যাপারে ওঁর তুল্য আর একজনও নেই। সবাই তো ফাঁকিবাজের রাজা। তাদের মুখ্য বিজনেস খাতা দেখা আর টিউশানি করা। ক্লাস নেওয়াটা গৌণ। সাইড বিজনেস।

কিন্তু প্রফেসর মৈত্রের

আরে বাবা ক্যাপাসিটি থাকলে তো? ওই পড়ানোটুকু পর্যন্তই ক্ষমতার সীমা।

তা আমাদের সেটাই দরকার।

হতে পারে। তবে একটু ভাল পড়ায় বলে ধরাকে সরা দেখবে? হাতে মাথা কাটবে? গেট আউট বলবে? অত কীসের? ব্যস, দিয়ে দেওয়া গেল একটু টাইট। আর বলতে হবে না কিছু। মাথাটি হেঁট করে এসো, মাথাটি হেঁট করে চলে যাও, ব্যস! ওসব মধ্যযুগীয় জমিদারের মনোভাব নিয়ে বাঘের বাচ্চা চরাতে আসা চলবে না বাছাধন। স্টুডেন্টরা তোমার খাস তালুকের প্রজা নয়।

অপর পক্ষে প্রতিবাদ ওঠে, এটা আপনাদের বাড়াবাড়ি হচ্ছে। উনি মোটেই ও ধরনের নন।

কী হল মশাই? মৈত্র কি আপনাদের উকিল রেখেছে? উনি কী ধরনের, আপনার থেকে আমি ভাল জানি। একদিন ও এই শিবেন্দুর হাত থেকে একটা বই নিয়ে ছিঁড়ে ফেলেছিল তা জানেন?

ছিড়ে ফেলেছিলেন? বই? কী বই?

নামটা ঘোড়ার ডিমের মনে নেই। একটু ইয়ের ব্যাপার আর কি সাদা বাংলায় বলি মশাই একখানি কড়া সেক্সের বই। বহু চেষ্টায় জোগাড় করেছিল বেচারা

তা সেখানি ক্লাসে এনে প্রফেসরের নাকের সামনে না পড়লে চলত না?

হঠাৎ ও পক্ষ থেকে সমবেত একটি হাস্যধ্বনি ওঠে। হাস্যরোলই।

সদাচার সমিতিতে নাম লেখান গে মশাই, সেটাই আপনাদের উপযুক্ত জায়গা

ঠাট্টা করুন। তবু বলব এভাবে শিক্ষককে অপমান করার মধ্যে নিজেদেরও কোনও মর্যাদা নেই। আমরা যদি আমাদের মা বাপকে অপমান করতে বসি, সেটা আমাদেরই অসম্মানকর।

কথাটা সম্পূর্ণ শেষ হয় না-হয়, একটা হুক্কাহুয়া ধ্বনিতে চাপা পড়ে যায়। এরা তুলছে ওই শেয়ালডাক। এরা হেসে টেবিল চাপড়ে বলছে-আহা হা চুকচুক, দেশে কোথাও ধর্মযাজকের পোস্ট খালি নেই? চলে যান, চলে যান। সেটাই উপযুক্ত ক্ষেত্র আপনাদের।

তারপর নিজেদের বাহাদুরিতে উল্লসিত দল নানা জানোয়ারের ডাক ডাকতে শুরু করে, প্রতিপক্ষ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তা ছাড়া আর কী করতে পারে? চিরদিনই বর্বরতার দাপটে সভ্যতা চাপা পড়ে যায়, চিৎকারের নীচে মৃদুতা।

ওদের চলে যাওয়া দেখে এরা আরও খানিক হইহই করে উঠল, তারপর আবার শুরু করল, আজ আর কলেজে আসেনি! হ্যাঁ, হ্যাঁ বোধহয় অপমানের জ্বালায় বাসায় গিয়ে মরে আছে। কদিন না এসে থাকবে জাদু? এখানেই যে ভাত জল।…বলে কিনা কাজটা ভাল হয়নি। ইঃ, খাশা হয়েছে। বেশ হয়েছে। উত্তম হয়েছে। ওই একজনের টাইটে আরও সবাই সায়েস্তা হয়ে যাবে।…হুঁ হুঁ, এ হচ্ছে বাবা সায়েস্তা খাঁর আমল।

আরও কিছু অর্থহীন অভব্য উক্তির প্রতিযোগিতা চালাতে থাকে ওরা। যেন যে যত নোংরা আর অমার্জিত কথা বলতে পারবে সে তত বাহাদুর। তার সঙ্গে অনুপান অশ্লীল হাসি।

অথচ এরা একটি বিশিষ্ট কলেজের ছাত্র, লেখাপড়ায় খারাপও নয় হয়তো, যখন শিল্প, সাহিত্য, সমাজনীতি বা রাজনীতি নিয়ে কথা বলে, মনে করা যেতে পারে বুদ্ধিমান চিন্তাশীল সর্বজ্ঞ।

কিন্তু কোনও একটা উপলক্ষে যদি একবার খুলে পড়ে উপরের খোলস, ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে আদিম বর্বরতা। যে বর্বরতা শ্রদ্ধা সম্ভ্রম স্নেহ ভালবাসা রুচি আচরণ, সব কিছুকে নস্যাৎ করে দিয়ে একটা বন্য সুখে উল্লসিত হয়।

কে জানে, সত্যিই এদের ভিতরটা এইরকম অশালীন অপালিশ,না এটা শুধু যুগের ফ্যাশান। কোনও কিছুকে মূল্য দেব না এই ফ্যাশান নিয়ে এরা নিজেদেরকে নিরাবরণ করে উন্মত্ত নৃত্য করে।

ওরা ভাবছে ওরা খুব বাহাদুর, জানে না যুগ একথায় হাসে। জানে না ওরাই এ যুগের প্রধান বলি। যুগ ওদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, ওদের মধ্যে যা কিছু সুন্দর, যা কিছু শুভ তা নিঃশেষে নিষ্কাশিত করে দিয়ে ওদের সেই শুকনো চামড়াখানায় জয়ঢাক বাজাতে চাইছে।

যুগ ওদের দিয়ে নোংরা কথা বলাচ্ছে, নোংরা চিন্তা করাচ্ছে, ওদের চোখ থেকে সব রং কেড়ে নিচ্ছে, মন থেকে সব রস।

তাই ওরা নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা, এইসব শব্দগুলোকে ওল্ড মডেল বলে হেসে ওঠে। প্রেম ভালবাসা এই শব্দগুলোকে ধিক্কার দেয়। গুরু এবং গুরুজনকে টাইট দিতে পারাটাকেই ওরা চরম আধুনিকতা ভাবে। ভাবে মানুষ নামের জীবটার যুগ-যুগান্তরের রুচির সভ্যতার আর সংস্কৃতির সাধনাকে মুছে ফেলে, তার কেবলমাত্র জৈবিক সত্তাটাকেই শেষকথা বলে ফতোয়া জারি করাটাই হচ্ছে আধুনিকতা।

চিরাচরিতকে উড়িয়ে দেবার চেষ্টায় এরা চিরন্তন আচার আচারণকে উড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, আর ভাবে সেটাই আধুনিকতা। ওদের কাছে আধুনিকতার সংজ্ঞা এই। সাহস আর উদ্ধৃঙ্খলতা যে এক জিনিস নয়, সেটা ভেবে দেখে না।

অধ্যাপক প্রসঙ্গ স্তিমিত হয়ে গেলে ওরা হয়তো মডার্ন কবিতা বা মডার্ন আর্ট নিয়ে বিতর্ক সভা বসাবে এবং বোলচাল শুনে মনে হবে প্রত্যেকেই এরা এই মডার্ন রহস্যে ওয়াকিবহাল। ওদের চলনে বলনে সেই মাতব্বরি, ওদের ভাষার ছটায় সেই তীব্রতা।

কিন্তু এরাই কি সব?

নাঃ, এরাই সর নয়।

হয়তো এরা নিতান্তই সংখ্যালঘু।

তবু এরাই যেন আজ যুবসমাজের প্রতিনিধির ভূমিকা নিয়ে আসরে নেমেছে, এদের কণ্ঠ সোচ্চার। সেই উচ্চ চিৎকারে সংস্কৃতির ক্ষীণকণ্ঠ চাপা পড়ে যাচ্ছে। আশঙ্কা হচ্ছে ক্রমশ এরাই বুঝি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠবে।

কারণ তীব্রতার একটা আকর্ষণ আছে, বলমত্ততার একটা প্রভাব আছে। আর–ভাল ছেলে নামের ধিক্কার বাণীটা বড় ভয়ংকর। তাতে ভাল ছেলেদের লজ্জায় দিশেহারা করে কোথায় না কোথায় নিয়ে যেতে পারে।

.

দিবাকর ভাল ছেলে নয়, দিবাকর বরং বন্যতার প্রতিমূর্তি। তাই দিবাকরের প্রেম, ভালবাসা, আসক্তি উগ্ৰ অসহিষ্ণু। তার মধ্যে স্নেহের স্বাদ নেই। তাই মীনাক্ষী নিজের বাড়ির দরজার মধ্যে ঢুকে গেলে। দিবাকর খানিকক্ষণ হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। যেন মীনাক্ষীর ওই নিশ্চিন্ত আশ্রয়টুকু, ওই আরাম-আয়েস সুখ-স্বস্তিভরা গৃহকোণের অধিকারটুকু ছিঁড়েকুটে তছনছ করে দিতে পারলে ওর জ্বালা মেটে।

কারণ দিবাকরের ওসব নেই।

দিবাকর জানে এখান থেকে মোচড় খেয়ে ঠিকরে গিয়ে একটা বাসে চেপে পড়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে যে দরজায় গিয়ে দাঁড়াবে ও, সেখানে ওর ভূমিকা দরজায় দাঁড়ানোরই। যে ঘরে গিয়ে ঢুকবে সেখানে দিবাকরের কোনও অধিকার নেই।

নিতান্তই গ্রাম-সম্পর্কের এক মামার অবহেলার আশ্রয়ে বাস দিবাকরের। দিবাকর জানে এখন গিয়ে সেই প্রাসাদতুল্য বাড়িটার নীচতলায় একখানা অন্ধকার-অন্ধকার ছোট্ট ঘরে গিয়ে ঢুকতে হবে তাকে। যে ঘরটার অর্ধাংশ দখল করে থাকে বাড়ির ঝাড়মোছকরা চাকর নবীন।

ঘরটা রান্নাঘর ভাঁড়ারঘর আর খুঁটে কয়লার ঘরের মাঝামাঝি কোনও একখানে। বাইরের আলো-হাওয়ার প্রবেশপথ বলতে একটিমাত্র সংকীর্ণ জানলা আছে গলিপথের দিকে। নবীনের শোয়ার চৌকিটা সেই জানলার নীচে। অতএব দিবাকরের ঠাঁই গুমোট দেয়ালের দিকে।

দিবাকরের সেই চৌকির গা ঘেঁষেই দেয়ালের গায়ে টানা লম্বা একটা দড়ি টাঙানো, যেমন ও দেয়ালে নবীনের। নবীনের দড়িতে নবীনের জামা পায়জামা ধুতি শার্ট গেঞ্জি গামছা, দিবাকরের দড়িতে দিবাকরের প্যান্ট বুশশার্ট লুঙ্গি তোয়ালে গেঞ্জি।

নবীনের মাথার কাছের দেয়াল-আলমারিতে নবীনের গোলাপ ফুল আঁকা টিনের সুটকেস, ক্যালেন্ডার থেকে সংগৃহীত নানা দেবদেবী ও সিনেমা স্টারের ছবি, বড় সাইজের একখানি আরশি, প্লাস্টিকের চিরুনি, কুন্তল বাহার তেলের শিশি, মলয় সাবান, রেণু পাউডার, আর গোছভর্তি দাঁতন কাঠি।

দিবাকরের মাথার কাছের দেয়াল-আলমারিতে দিবাকরের সস্তা ধরনের ঢাউশমার্কা নকল চামড়ার সুটকেসটা ধরে না বলে, সুটকেসটা ওর চৌকির নীচে ঢোকানো আছে। দিবাকর সেটাকে সর্বদা তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখে এবং যখন-তখন তালা খুলে উলটেপালটে সন্দিগ্ধদৃষ্টিতে হিসেব মিলোতে বসে সব ঠিক আছে না চুরি গেছে।

আলমারির তাকে দিবাকরের নবীনের থেকেও সস্তামাকা আরশি চিরুনি তেল সাবান মাজন শেভিংসেট। আর আছে পাঠ্যপুস্তক ও খাতা কলম, পার্থক্য শুধু এই।

দিবাকর এখন গিয়ে পরনের শার্ট ট্রাউজার সাবধানে ভাঁজ করে দড়ির আলনায় তুলে রেখে লুঙ্গিটা জড়িয়ে বেজার মুখে নিজের চিরশ্যা পাতা চৌকিটায় গিয়ে বসে কিছুক্ষণ হাতপাখা চালিয়ে গায়ের ঘাম শুকিয়ে নিয়ে তারপর উঠোনের ধারের চৌবাচ্চাটার কাছে গিয়ে উঁকি মারবে। যদি দেখে কিছু কিঞ্চিৎ জল আছে, মুখের পেশিগুলো তার একটু ছড়িয়ে পড়বে। উলটোটা হলে সেই পেশিগুলো আরও গুটিয়ে যাবে, মুখটা ঝামা ইটের চেহারা নেবে–মগ ঠুকে ঠুকে কোনওরকমে একটু স্নান সেরে যখন ঘরে এসে কুচি কুচি করে ছাঁটা চুলগুলো ঝেড়ে আঁচড়াবে দিবাকর, তখনও সেই চেহারাটাই বজায় থেকে যাবে। ঝামা ইটের চেহারা।

বরং আরও বেড়েই যাবে মুখের সেই ঝামাত্ব, দোতলা তিনতলার আলো-ঝলমলে ঘর-বারান্দাগুলোর চেহারা স্মরণ করে।

ওই ওপরতলাগুলোকে চোখে দেখবার সুযোগ তার মাঝে মাঝে হয়, মামি কখনও কখনও কোনও কূট ফরমাশে ডাকেন। বলেন, নবীনের দ্বারা এসব তো হবে না, বিষ্ণুটাও তেমনি বুন্ধু। তুমি এটা করো দিকি।

কদাচ তুমি ছাড়া তুই বলেন না মামি, নিকটতম স্নেহ সম্বোধনে আত্মীয় সম্পর্কটাকে প্রতিষ্ঠিত করবার ইচ্ছে তাঁর নেই বলেই মনে হয়।

দিবাকর মামির ঘরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে, মামি হয়তো কিছু কেনবার জন্যে টাকা দেন, হয়তো কোনও একটা ঠিকানা আর বাসভাড়া। কোনও খবর আনতে হবে, কি কোনও খবর পৌঁছতে হবে।

হয়তো তেমন আদেশ দিবাকরের পরীক্ষার দিনও আসতে পারে। দিবাকরের সাহস হয় না সে কথা উল্লেখ করবার। কারণ এখানেই ওই নবীনের ঘরের অর্ধাংশের আশ্রয়টুকু ও দুবেলার নিশ্চিত অন্নের নিশ্চিন্ততাটুকু এই মামিরই বদান্যতায়।

প্রথম যখন দিবাকর দেশ থেকে এসে দূরতম মামা সম্পর্কের ভরসাটুকু সম্বল করে এই বড় বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়েছিল, মামা প্রকাশ মণ্ডল তো প্রায় সেই দরজা থেকেই বিতাড়িত করেছিলেন, এখানে জায়গা কোথায় বলে।

মামিই দয়ার গলায় বলেছিলেন, তা ও তো তোমার, ওপরতলায় ওঠবার বায়না করছে না গো, নবীনের ঘরের একপাশে একখানা চৌকি পেতে পড়ে থাকবে। থাকার অভাবে গরিবের ছেলের নেকাপড়াটা হবে না!

প্রকাশ মণ্ডল বেজার গলায় বলেছিলেন,আত্মীয় সম্পর্কটা হচ্ছে বিষধর সর্পের মতো বুঝলে? দুধকলা দিয়ে পুষেছ কি মরেছ।

মামি আরও দয়ার গলায় বলেছিলেন,দুধকলার বায়না আবার কে করছে গো? সাপ্টা হেঁসেলের দুটো ডালভাত গুড়-রুটি খাবে, নিজের দিন কিনে নেবে, হয়ে গেল ব্যস। না না, তুমি অমত কোরো না, তোমার ঘরে মা-লক্ষ্মী হেলাফেলা। একটা পেট বই তো নয়।

সেদিন সেই বহু আড়ম্বরপূর্ণ ঘরে পালঙ্কোপবিষ্টা অষ্টালঙ্কারভূষিতা এই মহিলাটিকে দেবীসদৃশ মনে হয়েছিল দিবাকরের, কারণ দিবাকর তখন ভয়ংকর একটা উচ্চাশা নিয়ে দেশ থেকে চলে এসেছিল সদ্য স্কুল ফাইনাল পাশ করে। হোস্টেলে থেকে পড়বে এমন সামর্থ্য নেই। দাদারা বিরক্তচিত্তে মাত্র পড়ার খরচাটা পাঠাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।

তা মামির করুণায় বাকিটা হয়ে গেল, কোথা থেকে যেন একটা পায়া নড়বড়ে চৌকি এসে গেল নবীনের ঘরে, মামির খাস ঝি অবলা এসে দাঁড়িয়ে ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল কোন দিকে নবীনের জিনিসপত্র থাকবে, কোন দিকে দিবাকরের।

উনি নেকাপড়া করবে, জাঁল্লার দিকটা ওনার থাক- এ বিবেচনা প্রকাশ করেছিল অবলা। কিন্তু নবীনের কাঠকবুল প্রতিজ্ঞা জানলার ধারের অধিকার ছাড়বে না। কাজেই দেয়ালের দিকেই দিবাকর কায়েম হল।

বরাদ্দ হল সাপ্টা হেঁসেলের ডালভাত গুড়টি। যে হেঁসেলটার অধীনস্থ প্রজা হচ্ছে প্রকাশ মণ্ডলের দোকানের কর্মচারীকুলনবীন, বিষ্ণু প্রমুখ। অবলা খাস ঝি। অবলা এদের দলে নয়। কর্তা-গিন্নির হেঁসেলের তলানিতেই তার ভাল ব্যবস্থা হয়ে যায়।

তখন মামার একটা বছর চোদ্দর মেয়ে ছিল, যার নাম ব্রজবালা। মেয়েটা সম্পর্ক সূত্র শুনে দিবাকরকে দাদা বলতে শুরু করেছিল এবং বিশেষ একটু নেজরের বশে লুকিয়ে চুরিয়ে দিবাকরকে দুধটা মিষ্টিটা মাছটা ডিমটা সাপ্লাই করতে শুরু করেছিল, কিন্তু নবীনের বিশ্বাসঘাতকতায় লুকোচুরিটা প্রকাশ পেয়ে গেল। ঘরের ভাগ দিতে বাধ্য হওয়া পর্যন্ত নবীন দিবাকরের দিকে আক্রোশের দৃষ্টি ব্যতীত কদাচ সমীহর দৃষ্টিতে তাকায় না, এহেন সুবর্ণ সুযোগটা ছাড়ল না।

ফলস্বরূপ ব্রজবালার নীচে নামা বন্ধ হল, দিবাকরের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হল। মরুভূমির ওয়েসিসটুকু শুকোল।

তারপর তো ব্রজবালার বিয়েই হয়ে গেল।

এখন ব্রজবালা শ্বশুরবাড়ি থেকে আসে যায় সোনার ঝলক দিয়ে, কারণ তার শ্বশুর গুড়ের কারবারে অনেক লক্ষপতি। সেই সোনার ঝলসানিতে ব্রজবালারও বোধ করি মনে থাকে না দিবাকর নামে কেউ একটা থাকে এ বাড়িতে। দিবাকর রাগে ফোঁসে।

তবু মাথার উপর ছাদ।

কোলের গোড়ায় বাড়া ভাতের থালা।

তাই দিবাকর এখানেই পড়ে আছে।

পড়ে থাকার আর একটা সুবিধে, বাইরে থেকে এসে ঢোকে তো মস্ত দেউড়িটা ঠেলে। সাবান কেচে ইস্ত্রি করে বহু কষ্টে ফিটফাট করা পোশাকটি পরে যখন বেরোয় কলেজের বই খাতা নিয়ে, তখন তো বেরোয় সেই দেউড়িটা খুলে।

লোককে তো বলা যায় বিরাট মামার আদুরে ভাগ্নে। সেটাই কি কম পাওয়া। সেই আদরের চেহারাটা তো বন্ধুসমাজ দেখতে আসে না।

বাড়িতে কাউকে ডাকতে পারে না দিবাকর, কারণ মামা ছাত্রজীবনে আড্ডা দেওয়া পছন্দ করেন না।

এই বালির দুর্গে বাস দিবাকরের।

তাই ভিতরে তার এত দাহ।

তাই তার প্রেয়সী যখন নিজের পাথরের দুর্গে গিয়ে ঢোকে, আক্রোশের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সে।

সকালবেলা ছেড়ে রেখে যাওয়া লুঙ্গিটা পরে হাতপাখা নাড়তে নাড়তে আর এক আক্রোশের মনোভাব নিয়ে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখছিল দিবাকর।

চকমিলানো ছাঁচের বাড়ি, নীচতলা থেকে ওপরতলার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা যায়। থাকলে দেখতে পাওয়া যায় চড়া পাওয়ারের আলো জ্বালা, দেয়ালে রং করা, কেমন শনশন করে বিদ্যুৎ পাখা ঘুরে ঘুরে বাতাসের দাক্ষিণ্য বিতরণ করছে।

দোতলায়, তিনতলায়।

দোতলাটা মামা-মামির মন্দির, তিনতলাটা মামির ভাই-ভাজের। সমান রাজকীয়। অথচ ওরাও আশ্রিত–ভাবল দিবাকর। অনেক বাড়তি জায়গা আছে উপরতলায়। ওদের ঘরের একাংশে গিয়ে বসলে আলাদা করে বিদ্যুৎ খরচ হবে এমন নয়।

তবু দিবাকরকে চাকরের ঘরের কোণে বসে ভাঙা হাতপাখায় বাতাস খেতে হয়!

দিবাকর তবে অন্নদাতা আর আশ্রয়দাতা বলে কী করে কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হবে ওই প্রকাশ মণ্ডলের প্রতি?

দিবাকর কেন সর্বদা চিন্তা করবে না কী করে লোকটার অনিষ্ট সাধন করা যায়?

চিন্তা করে, কিন্তু সুযোগ নেই।

নির্বোধ ব্রজবালাটার ওপর দিয়ে সে আক্রোশ মিটিয়ে নেবার বাসনা ছিল, কিন্তু হয়ে ওঠেনি। ওই শয়তান নবীন, সর্বদা শ্যেনদৃষ্টি মেলে বসে থেকেছে, সুযোগের সুযোগ আসেনি।

তারপর তো ব্রজবালা ব্রজধামে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হল।

আজ নাকি এসেছে বরের সঙ্গে। প্রকাণ্ড গাড়ি চড়ে।

গাড়িটাই গেট থেকে সংবাদ বহন করছে। দেখলে বিষ ওঠে।

জামাইটা নাকি একটা পাশ করা। সেই গৌরবে গরবিনী মামি এমন ভাব করেন যেন জামাতা না দেবতা!

এই পৃথিবীতে থাকতে হয় দিবাকরকে।

বামুন ঠাকুর একটা পিতলের রেকাবি করে জলখাবার রেখে গেল। রুটি, একটুকরো বেগুন ভাজা, খানিকটা গুড়।

নবীনের সঙ্গে এইটুকু পার্থক্য দিবাকরের, নবীনের থেকে এইটুকু খাতির, জলখাবারটা ঘরে দিয়ে যায়। রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে আবেদন করতে হয় না।

তবু ওই থালাটা দেখলেই যেন গা জ্বালা করে। কিন্তু ফেলে দেওয়ার সামর্থ্যও নেই। খিদের সময় অযাচিত পেয়ে যাওয়া গরম রুটির মূল্যই কি কম?

দেশের বাড়িতে এই বস্তুটাও তো দুর্লভ ছিল। খাবে খাও, মুড়ি চিড়ে খাও।

এখন আর দেশের বাড়িতে গিয়েও ভাল লাগে না দিবাকরের! এই কলকাতার মোহমদ নেশাচ্ছন্ন করে রেখেছে তাকে। থাক দৈন্য, হোক অপমানের ভাত, তবু তো জুটছে এই মদ।

কলকাতার আকাশে বাতাসে, প্রতিটি ধূলিকণায় মদিরাস্বাদ।

তাই যারা বছরের পর বছর ফুটপাথে পড়ে থাকে, স্টেশনের প্লাটফর্মে জন্ম মৃত্যু বিয়ের লীলায় লীলায়িত হয়ে জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, যারা মানুষের চেহারা নিয়ে জানোয়ারের জীবনে নিমজ্জিত থাকতে বাধ্য হয়, তারাও পারে না কলকাতাকে ছেড়ে যেতে।

কলকাতা তার অক্টোপাশের বাহুতে বেঁধে রেখেছে সবাইকে।

দিবাকরও সেই বন্ধনে বাঁধা পড়ে গেছে।

দিবাকরের দাদারা বলেছিল, একটা পাশ করেছ, আর দুটো পাশ করে এসে গাঁয়ের ইস্কুলে মাস্টারি করো, নিজেরও ভাল গাঁয়েরও ভাল।

কিন্তু দিবাকর জানে গ্রামের জীবনে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব নয় তার।

দিবাকর এই চার বছরেই কলকাতার রসে জারিত হয়ে গেছে। দিবাকর কলকাত্তাইদের সঙ্গে তাল দেবার চেষ্টায় এত জোরে দৌড় দিয়েছে যে, তাদের ছাড়িয়ে গেছে।

দিবাকর তাই তার নিগ্রো নিগ্রো চেহারা নিয়েও অধ্যাপকের মেয়ের চোখে হিরো।

.

চেহারাটার ওই বিশেষণ স্পষ্ট করে কানে এল।

খাওয়ার শেষে বেগুন ভাজার খোসাটাও মুখে পুরে তাড়াতাড়ি উঠোনের কলে জল খেতে যাচ্ছিল দিবাকর, (না, জলের গ্লাস দিয়ে যায় না ঠাকুর) দেখল সিঁড়ি দিয়ে জামাই নামছে। পিছু পিছু ব্রজবালা।

ব্রজবালার ধরন দেখে মনে হচ্ছে না সেও চলে যাবে। মনে হচ্ছে এবার থাকতে এসেছে। অতএব বরকে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। বিদুষী নয় বলে কি আপ-টু-ডেট হতে পারে না?

গদগদ হাসিতে বিগলিত হয়ে নামছে সিঁড়ি দিয়ে।

জল খাওয়া হল না, চট করে গলির দিকের প্যাসেজে ঢুকে পড়ল দিবাকর। আর সেই সময় পিছনে পটকা ফাটল।

কাফ্রি কাফ্রি দেখতে ওই ছোকরাটি তোমাদের কে বলল তো?

কাফ্রি কাফ্রি? ব্রজবালা ভুরু কুঁচকে বলে, দিবুদার কথা বলছ নাকি? ও মাগো, জানো তোমার ডবল বিদ্বান উনি।

তাই নাকি? আহা!

গুড়ের কারবারের ভবিষ্যৎ মালিক কণ্ঠে গুড়ের প্রলেপ বুলিয়ে বলে, তবে তো তোমার বাবার উচিত নয় ওঁকে চাকরের ঘরে থাকতে দেওয়া! যথাযোগ্য সম্মানে–

বাকি কথা শোনা গেল না। উঠোন পার হয়ে বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল কম্পাউন্ডে। যেখানে গুড়ের কারবারির প্রকাণ্ড গাড়িখানা অপেক্ষা করছে।

জ্বলতে জ্বলতে ঘরে ফিরে এল দিবাকর জল খেতে ভুলে। আর সেই মুহূর্তে তার আগুনের ঢেলার মতো চোখ দুটোয় জ্বলে উঠল একটা রূঢ় সংকল্পের শিখা।

একটা নির্বোধ মেয়েকে নষ্ট করতে কত কাঠখড় পোড়াতে হয়?

কিছু না কিছু না।

বিবাহিতা?

পতিব্রতা সতী?

ফোঃ

ওসব কথাগুলোর কোনও মূল্য আছে নাকি?

বরং বিবাহিতাদের সাহস বেশি। দিবাকরের সে অভিজ্ঞতা আছে। স্কুলের পড়া সাঙ্গ করে আসবার আগেই সে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছে দিবাকর। রাঙাপিসির মেয়ে চামেলিদির কাছ থেকে। অবশ্য বয়েসটা তার তখন নিতান্ত স্কুল-জনোচিত ছিল না।

চামেলিদির শ্বশুরবাড়িতে জ্বালা, তাই চামেলিদি বাপের বাড়িতে বসে থাকে। বর আসে সপ্তাহে সপ্তাহে।

কিন্তু চামেলিদির ওই মুষ্টিভিক্ষায় পেট ভরে না। তাই চামেলিদি উঞ্ছবৃত্তি করে বেড়ায়। আর হেসে হেসে বলে, বিধবা নই, আইবুড়ো নই, ভয়টা কী?

অতএব বুঝতে বাকি থাকেনি দিবাকরের, ভয়ের বাসাটা আসলে কোথায়?

দিবাকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।

দিবাকর তার সেই চামেলিদিকে দিয়ে সব মেয়েকে বিচার করছে।

দিবাকর ফিরতি মুখে পথ আগলায়, বড়লোকের বাড়ি বিয়ে হয়ে ব্রজবালা যে আর গরিবদের দেখতেই পাও না!

ব্রজবালা হঠাৎ এই আক্রমণে থতমত খায়, অপ্রস্তুত গলায় বলে, বাঃ, দেখতে পাব না কেন?

কই আর পাও? আসো যাও, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, তুমি তো ফিরেও চাও না।

আমি তো বেড়িয়েই চলে যাই, এসে থাকতে পাই না। এবারেই কিছুদিন

ব্রজবালা একটু রহস্যময় কটাক্ষ করে।

অর্থাৎ এবারে ব্যাপার আলাদা। এবারে কিছুদিন থাকবার অধিকার নিয়ে এসেছে।

দিবাকর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, নবীন নেই ধারেকাছে, কেউই নেই। চট করে ব্রজবালার গালটায় একটা টোকা দিয়ে নিচু গলায় বলে ওঠে,তাই নাকি? নতুন খবর?

ব্রজবালা রেগে ওঠে না।

ব্রজবালা লাল লাল মুখে বলে, আঃ অসভ্য!

দিবাকর একটা বেপরোয়া হাসি হেসে বলে, এইটুকুতেই অসভ্য? উঃ কী শুচিবাই! ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে যা চালাই দেখলে কী যে বলতে তুমি!

ব্রজবালা মাটির সঙ্গে আটকে যায়। ব্রজবালা বিস্ফারিত চোখে বলে, তোমাদের কেলাসে মেয়েমানুষও আছে নাকি?

তা নেই?

তাদের সঙ্গে তুমি এইসব ইয়ার্কি করো?

এইসব? দিবাকর তাচ্ছিল্যের গলায় বলে,আরও কত সব।

ধ্যেৎ।

ধ্যেৎ তো ধ্যেৎ।

এই দিবুদা সত্যি?

সত্যি না তো কি মিথ্যে বলছি? বিশ্বাস করো না করো তোমার ইচ্ছে। ব্র

জবালা হঠাৎ সতেজে বলে, ওইজন্যেই ও বলে লেখাপড়া শিখলে মেয়েমানুষ জাহান্নমে যায়।

ও মানে তোমার বর?

তবে না তো কী।

বলবেই তো৷ নিজে তো সে আস্বাদ পেল না কখনও।

আহা, ও কক্ষনও ওরকম নয়।

ভাল। না হলেই ভাল। তুমি যখন অত শুচিবাই। তবে আমি তো কিছু দোষ দেখি না।

দোষ দেখো না?

ব্রজবালা যেন হঠাৎ ভয় পায়, বলে ওঠে, যতসব বাজে কথা। শুনতে চাই না। বলে দুড়দুড় করে পালায়।

দিবাকর একটা পরিতৃপ্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে।

ভয় পেয়েছে।

পাক। সেটাই দরকার।

ভয়ের কাছেই আকর্ষণ।

দিবাকর অপমানের শোধ নেবে।

দিবাকর নিশ্চিত জানে ব্রজবালা ওই ভয়-ভয় করা ভয়ংকর কথার লোভে সুযোগ সৃষ্টি করবে। নবীনকে ছুতো করে ভাগাবে।

গা ছমছমে নির্জনতায় এসে বসে বলবে, বলো তো শুনি তোমার কেলাসের মেয়েদের কথা। আমার তো বাপু বিশ্বাস হয় না, তোমার নিশ্চয় সব বানানো।

দিবাকর অবশ্যই বানাবে।

ব্রজবালা সেই বানানো গল্প গোগ্রাসে গিলবে, গোগ্রাসে বিশ্বাস করবে, আর আস্তে আস্তে জালে পড়বে। মাকড়সার জালে বন্দিনী পোকার মতো ছটফট করবে। কিন্তু বেরোতে পারবেনা। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে আত্মসমর্পণ করবে।

আর হয়তো ভাববে, আমার আবার ভয়টা কী? বিধবা নই, কুমারী নই–

.

কিন্তু মীনাক্ষী?

তাকে কবে সম্পূর্ণ কবলিত করে ফেলতে পারবে দিবাকর?

সেটার প্রয়োজন আছে।

দিবাকর তার নিজ গণ্ডি থেকে উর্ধ্বে উঠতে চায়। প্রফেসর মৈত্রের মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে সেই চাওয়াটা রূপ পেতে পারে। আর ওই বিয়েটার জন্যেই কবলিত করার দরকার।

মেয়েগুলো ভারী বোকা হয়।

একটু এদিক ওদিকেই ভাবে আমার সব গেল, গেল আমার শুচিতা, আমার পবিত্রতা, আমার সততা।

অতএব বিয়ে ভিন্ন আর গতি নেই আমার। বিশেষ করে মীনাক্ষীর মতো ভীরু মেয়ে। ও যেই ভাববে আমার সব গেছে, তখনই ও ওর সেই আদর্শবাদী অধ্যাপক বাবার কাছে গিয়ে আছড়ে পড়ে বিয়ের জন্যে আর্জি করবে। দিবাকরকে কিছু করতে হবে না।

দিবাকর সেই ভরসাতেই আছে।

দিবাকর তাই কড়া কড়া বিদেশি নভেল পড়ে বোলচাল মুখস্থ করে রাখে যাতে মীনাক্ষীকে বিধ্বস্ত করে ফেলা যায়।

ঘরে এসে দিবাকর আবার চৌকিতে বসল, দেখল বালিশের তলায় একটা পোস্টকার্ড গোঁজা।

তার মানে এসেছে কোনও সময়, নবীনবাবু অনুগ্রহ করে রেখে দিয়েছেন।

দিবাকরের তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়, হয়তো তার অনুপস্থিতিতে আসা চিঠিগুলো ফেলে দেয় নবীন। অবশ্য চিঠি কোথা থেকে আসবে সেটা জানা নেই দিবাকরের।

ভাল চিঠি। প্রত্যাশার চিঠি!

মাঝে মাঝে যা আসে সে তো ওই কদর্য অক্ষরে রচিত পোস্টকার্ড মাত্র। ওটাকে যত্ন করে রেখে না দিলেও ক্ষতি ছিল না। ওতে যে কী লেখা আছে দিবাকরের জানাই আছে। চিঠি দিবাকরের দাদার লেখা–

কল্যাণবরেষু
দিবাকর, পরে সবিশেষ জানাই বাটিস্থ সব কুশল। তবে মাতাঠাকুরাণী বাতের বেদনায় বিশেষ কাতর এবং মধু ও গোপাল পেটের রোগে ভুগিতেছে, তৎসহ জ্বর। প্রভাকরও কয়েকদিন যাবৎ আমাশায় কষ্ট পাইতেছে। তা ছাড়া তোমার বড় বউঠাকরুণও কার্বঞ্চল হইয়া প্রায় শয্যাগত। এইসব কারণে আমারও শরীর ভাল যাইতেছে না।
বাটিস্থ সব কুশল-এর পর এতগুলি ফিরিস্তি দাখিল করে দাদা অতঃপর শুরু করবে ঝড়ে একটি আমগাছ পড়িয়া গিয়াছে। বুধির একটি বকনা বাছুর নষ্ট হইয়া গিয়াছে। বাঁশবাগান হইতে কে বা কাহারা বাঁশ কাটিয়া লইয়াছে ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাপর শেষ কথা তোমার কবে একজামিন শেষ হইবে? তোমার আসার আশায় দিন গুনিতেছি, তুমি আসিয়া পড়িলেই সব সুসার হইবে শ্রীভগবানের নিকট এই প্রার্থনা। ইতি–
নিত্য আঃ—-
তোমার বড়দাদা

এই চিঠি।

পর পর সাতখানা চিঠি সাজিয়ে রাখলে মনে হবে একই চিঠির কার্বন কপি। শুধুমাত্র কখনও আমগাছের বদলে জামগাছ, কখনও বুধির বদলে মঙ্গলা, অথবা বকনার বদলে এঁড়ে।

তা ছাড়া সব এক।

প্রবৃত্তি হয় না হাত বাড়িয়ে হাতে নিতে। প্রবৃত্তি হয় না পড়তে। তাই দিবাকর ঘৃণায় মুখ বাঁকিয়ে একবার তাকিয়ে দেখে মাত্র।

আশ্চর্য, দিবাকর সম্বন্ধে কী ধারণা ওদের! দিবাকর লেখাপড়া শেষ করে বাড়ি গিয়ে দাঁড়ালেই ওদের ছেলের পেটের অসুখ, মায়ের বাত, ভাজের ফোঁড়া ইত্যাদি সব সেরে যাবে, আর হবে না। পড়শিরা বাঁশ কেটে নেবে না। ঝড়ে আর গাছ পড়বে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।

থাকো ভুয়ো এই আশা নিয়ে।

দিবাকর আর যাচ্ছে না। দিবাকর তোমাদের আত্মীয় বলতে লজ্জা পায়।

.

সরোজাক্ষ তাঁর সংসারের মাথায় এক ঘা লাঠি বসিয়ে দিলেন। সরোজাক্ষ তাঁর চাকরিতে ইস্তফা দিলেন।

প্রথম জীবনে যখন সরোজাক্ষ তাঁর জীবিকা বেছে নিয়েছিলেন, তখন কেন যেন তাঁর মনে হয়েছিল এটা ঠিক চাকরি নয়। এই অবাস্তব ভুল ধারণাটি অবশ্যই সরোজাক্ষর নিজস্ব মানসিক গঠনের ফসল, তবে সেই ভুল ধারণাটি সমূলে উৎপাটিত হবার তেমন কোনও কারণ ঘটেনি। অতএব সেই ভুলের রসটাই কোন অলক্ষ্যে থেকে সরোজাক্ষকে সঞ্জীবিত রেখেছিল।

কিন্তু সরোজাক্ষর এই বিপ্লবাত্মক কর্মই ভুলটা সমূলে উৎপাটন করল। সরোজাক্ষর কানের কাছে এখন অবিরত এই ধ্বনি, চাকরি ছেড়ে দিলে?চাকরিটা ছেড়ে দিলেন?–আজকালকার দিনে যদি এত তুচ্ছ ব্যাপারে চাকরি ছাড়তে হয়, তা হলে তো

যারা হিতৈষী, তারা এ প্রশ্নও করল–এই বয়েসে কোথায় তুমি কমপিটিশনে নামতে যাবে, ইয়ং গ্রুপের সঙ্গে? কথায় কথায় এখন মেয়েছেলেরা ডি ফিল, ডি এসপি, পি-আর এস হচ্ছে।

বিস্ময় বিরক্তি, লাঞ্ছনা গঞ্জনা, উপদেশ আক্ষেপ বহুবিধ আক্রমণের মুখে পড়তে হচ্ছে সরোজাকে। সব আক্রমণের সার কথা–চাকরিটা ছাড়া উচিত হয়নি। অতএব এখন সরোজাক্ষর মনের মধ্যে আর সেই পুরনো ভুলটা বসে নেই। সরোজা জেনে নিয়েছেন তিনি চাকরি করছিলেন, চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।

কেন?

মেজাজের দোষে।

মেজাজ দেখিয়েছিলেন সেখানে, অতএব শিক্ষা দিয়ে দিয়েছে তারা, সরোজাক্ষ সে জায়গায় সমঝে না গিয়ে আরও মেজাজ দেখিয়ে চাকরিটাই ছেড়ে দিলেন।

কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য এককথায় সরোজাক্ষর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি, সরোজাক্ষকে ভাবতে সময় দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সরোজাক্ষ সে সময় নেননি। সবিনয়ে বলে এসেছেন, নতুন করে আর কী ভাবব? ভেবেই তো দিয়েছি

তার মানে সরোজাক্ষ কেবলমাত্র নিজের মান-অপমানের কথাই ভেবেছেন, আর কিছু ভাবেননি। ভাবেননি–তাঁর স্ত্রী আছে, নাবালক পুত্র আছে, অবিবাহিতা কন্যা আছে এবং সারদাপ্রসাদ নামে একটা অর্থহীন অবান্তর পোষ্য আছে। ভাবেননি, তাঁর উপার্জনশীল সাবালক ছেলেটা একটা অমানুষ এবং নিজে তিনি এ যাবৎকাল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন।

তবে?

তবে তোমায় কে সহানুভূতির চক্ষে দেখবে?

সংসারী মানুষ তুমি, একটা সংসারের (কর্তা বলে কেউ না মানলেও দায়িত্বের আইনে) কর্তা, তুমি অমনি কোথায় একটু মানের কানা খসে গেল বলে দুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিলে? কর্তব্য নেই তোমার? দায়িত্ব নেই? মায়া মমতা বিবেচনা কিছু নেই।

তা এ সবই যদি না থাকে, শুনতেই হবে কটুকথা। যাদের সঙ্গে তোমার এই ব্যাপারের কোনও লাভ লোকসানের প্রশ্ন নেই, তারাও শুনিয়ে যাবে দুটো ধিক্কারের কথা। আর যাদের সঙ্গে ঘোরর সম্পর্ক, তারা তো

হ্যাঁ, একা বিজয়াই নয়, বাড়ির লোকে জনে জনে লাঞ্ছিত করেছে সরোজাক্ষকে (যদি সেই লাঞ্ছনায় মতি ফেরে), তবে বিজয়াই অগ্রণী। বিজয়া তাঁর কাঁচা কাপড়ের দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর ভেঙে এ-ঘরে বিছানার ধারে এসে বসে পড়ে বলেছেন, ব্যাঙ্কে তোমার কত টাকা আছে?

সরোজাক্ষ চোখ তুলে তাকিয়েছেন বোধ হয় একটু অবাক-অবাক দৃষ্টিতে। কারণ তখনও সরোজাক্ষ ভেবেছিলেন, বিজয়া খামোক একটা বোকার মতো প্রশ্ন করল কেন।

কিন্তু বিজয়া সব ক্ষেত্রে বোকা নয়।

বিজয়া সেই সদ্য-বিবাহের কাল থেকেই ক্ষেত্রবিশেষে চালাক। বিজয়া যখন নেহাত নতুন বউ, তখনই সরোজাক্ষর অনুপস্থিতিতে সরোজাক্ষর আলমারি দেরাজ বুকশেলফ এমনকী মোটা মোেটা বইয়ের পাতাগুলি পর্যন্ত উলটে উলটে চতুর দৃষ্টিনিক্ষেপ করে দেখত। কোনওখান থেকে কোনও দলিল সংগ্রহ করে ফেলতে পারে কি না সরোজাক্ষর, কোনও দুর্বলতার সাক্ষ্য জোগাড় করে ফেলতে পারে কিনা।

আছে অপরাধ, আছে দুর্বলতা, এ বিষয়ে সেই সদ্য কৈশোরপার তরুণীটি নিঃসন্দেহ ছিল। নইলে বিজয়ার মতো অমন একটা লোভনীয় বস্তুকে হাতের মুঠোয় পেয়েও লোকটা দিনে রাত্রে সকালে সন্ধ্যায় তার সদ্ব্যবহার করে না? তাকে কী নিধি পেলাম বলে সর্বদা গলায় ঝুলিয়ে রাখে না?

করে না। রাখে না।

অতএব নির্ঘাত অন্য ব্যাপার।

অন্য ব্যাপার না থাকলে, এক্ষেত্রে রক্তমাংসের শরীরওলা যুবক বর স্রেফ হ্যাংলা বনে যেত।

সেই প্রত্যাশিত হ্যাংলামি তো করেই না বিজয়ার বর, বরং নেহাতই রক্তমাংসের দাবি মেটাতে একটু দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেললেই যেন মরমে মরে যায়। যেন ঘৃণায় লজ্জায় মুষড়ে পড়ে। তাকিয়ে দেখে না, তার সেই রূপবতী এবং স্বাস্থ্যবতী যুবতী বউ তাতে কী পরিমাণ অপমান বোধ করে।

করত অপমান বোধ বিজয়া।

আর সেই অপমান বোধ থেকেই আক্রোশ উঠত ধুইয়ে। সেই আক্রোশে অধিকতর আকর্ষণময়ী হবার জন্যে লজ্জা শরমের বালাই রাখত না এবং সরোজাক্ষকে একদিন কাঠগড়াতে দাঁড় করাবার জন্যে খুঁজে খুঁজে বেড়াত তার অপরাধের দলিল।

হয়তো ঠিক এ পথে চিন্তাকে প্রবাহিত না করলে বিজয়া সরোজাক্ষর চিত্তজগতে স্থান করে নিতে পারত। দেহকে সম্বল করেও মনের দরজায় টোকা দিতে পারত। কিন্তু বিজয়া নিজের ভুল চিন্তাতেই নিমজ্জিত থেকেছিল, বিজয়া তার স্বামীর মনটাকে হাত ফসকে পালিয়ে যেতে দিয়েছিল। ভালবাসার বদলে ঘৃণা সংগ্রহ করেছিল।

সেই ঘৃণাটা প্রথম উপচে উঠেছিল সেই একদিন দুপুরে। যে দুপুরে সরোজাক্ষ হঠাৎ জ্বর হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন।

এসে দেখলেন সরোজাক্ষর তিনতলার ঘরটা একেবারে তছনছ। দেরাজ খোলা, ট্রাঙ্ক খোলা, আলমারি খোলা, বিছানা ওলটানো, র‍্যাকের বইগুলো ছড়ানো, যেন পুলিশে খানাতল্লাশি করে গেছে। আর দেখলেন কাকার দেওয়া সেই চন্দনকাঠের বাক্সটাকে নিয়ে বিজয়া

হ্যাঁ, সারা ঘর তছনছ করেও বিজয়া সেই পাতলা গড়নের ছোট চন্দনকাঠের বাক্সটার চাবি সংগ্রহ করতে পারেনি। বিজয়া স্থিরনিশ্চিত ছিল, ওই চাবিটা খুলে ফেলতে পারলেই সরোজাক্ষর সেই গোপন ঘরটা খুলে পড়বে, যে ঘরে লুকোনো আছে সরোজাক্ষর অপরাধের প্রমাণপত্র অবৈধ প্রেমপত্র। প্রেম বস্তুটাকে অবৈধই ভাবত বিজয়া।

ওই বাক্সটাকে দেখেছে বিজয়া ইতিপূর্বে, নেড়েছে চেড়েছে, আর ভেবেছে অবসরমতো এটাকে নিয়ে পড়তে হবে। আজকে পড়েছিল তাই। ভেবেছিল চিঠি তো পাবই, ফটো-টটোও কোনও না পাব। কিন্তু নেই, কোথাও নেই চাবি।

তার মানে এমন কোনও গোপন জায়গায় রেখে দেয়, যা বিজয়ার চোখকেও ফাঁকি দিতে পারে। তার মানে দেখতে যেমন আলাভোলা বরটি তার, ভিতরে তেমন নয়। কে জানে ঘরের সিলিঙে কড়ি-বরগার মধ্যেই কোথাও খাঁজ কেটে রেখেছে কিনা।

সে বাড়িটা বিজয়া যে বাড়িটায় বিয়ে হয়ে এসেছিল, সেটা ছিল ভাড়াটে বাড়ি। পুরনো ধরনের বাড়িটা, তিনতলাটা পুরো ছাদ। ঘর মাত্র একখানাই।

বিয়ের আগে থেকেই ঘরটার অধীশ্বর ছিল সরোজা নামের সেই পড়ুয়া ছেলেটা। বিজয়া এল তারপর। অধীশ্বরী হয়ে বসল।

কিন্তু শুধু ঘরের অধীশ্বরী হয়ে কী লাভ বিজয়ার?

চাবি সংগ্রহে হতাশ হয়ে নিজের চাবির রিংটা নিয়ে যে কটা চাবি দিয়ে চেষ্টা করা সম্ভব, তা করে বিফল হয়ে মরিয়া বিজয়া করে বসল–এক কাণ্ড। বাক্সটার ডালার খাঁজে একটা ছুরি ঢুকিয়ে চাড় দিতে বসল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সরোজা এসে ঢুকলেন জ্বরে টলতে টলতে।

ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন এবং দেখতে পেলেন, সুন্দর কারুকাজ করা সেই মহীশূরী চন্দনকাঠের বাক্সর ডালার খানিকটা অংশ উপড়ে বেরিয়ে এল ছুরির সঙ্গে, ডালাটা খুলে গেল চাবির কজা আলগা হয়ে।

সরোজাক্ষ খাটের উপর বসে পড়ে ঘরটাকে দেখে নিলেন, দেখে নিলেন বিজয়াকে। রুক্ষ গলায় বললেন, এসব কী?

এতখানি ভয়ংকর মুহূর্তে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে সাহস করল না বিজয়া, তাই খুব তাড়াতাড়ি বলে উঠল,ও মা তুমি এমন অসময়ে যে? ঘরটর সব এলোমেলো করে ঝাড়াঝুড়ি করছিলাম—

সরোজাক্ষর মাথা ছিঁড়ে পড়ছিল, সরোজাক্ষ তবু শুয়ে পড়েননি, আরও রুক্ষ গলায় বলেছিলেন, ওই বাক্সটার ভিতরের ঝুল ঝাড়ছিলে?

বাক্সটা!

এর কী জবাব দেওয়া যায় ভেবে না পেয়ে বিজয়া চুপ করে গিয়েছিল। আর বোধ করি মনে মনে শক্তি সংগ্রহ করছিল। সরোজাক্ষ খাট থেকে নেমে বাক্সটাকে হাতে নিয়ে তার দুর্দশা দেখলেন, তারপর তার ভিতর থেকে একগোছা কাগজপত্র বার করে বাড়িয়ে ধরে ঘৃণা আর ব্যঙ্গে তিক্ত গলায় বলে উঠলেন, প্রেমপত্র খুঁজছিলে? নাও! পড়ে দেখো। যদি অবশ্য পড়বার ক্ষমতা থাকে।

কাগজপত্রগুলো সরোজাক্ষর ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট, চশমার প্রেসক্রিপশন, ক্যামেরার গ্যারান্টিপত্র ইত্যাদি। হয়তো উপহার পাওয়া শৌখিন আধারটায় ওই সার্টিফিকেটগুলোই রাখতে ইচ্ছে হয়েছিল সরোজাক্ষর, তারপর এটা ওটা ঢুকে পড়েছে। চাবিটা পাছে হারিয়ে যায় বলে মায়ের কাছে রেখে দিয়েছিলেন সরোজাক্ষ।

বিজয়ার হৃতশক্তি ফিরে আসছিল, যে শক্তিটা নাকি ধৃষ্টতার গর্ভজাত। ধৃষ্টের গলাতেই বলে উঠেছিল বিজয়া, বাব্বা। এইসব জিনিস আবার মানুষে এত বাহারি করে রাখে তা কী করে জানব?

সরোজাক্ষ আর কথা বলেননি।

শুধু সরোজাক্ষর চোখমুখ দিয়ে ঘৃণা উপচে উঠেছিল। ঘৃণার সেই প্রথম প্রকাশ। তারপর সারাজীবনই প্রতিনিয়ত ধরা পড়ে যায় সেই ঘৃণা, সেই ব্যঙ্গ।

সরোজাক্ষর বাবা মারা যেতে বিজয়া যখন ডুকরে-ডুকরে কেঁদেছিল, ওগো আমার রাজা শ্বশুর ছিল যে গো! ওগো–আমি যে রাজকন্যের আদরে ছিলাম গো–ইত্যাদি আখর দিয়ে দিয়ে, সরোজাক্ষ মৃতের বিছানা থেকে উঠে এসে বলেছিলেন, তোমার এই শোকটা যদি চালাতেই হয়, তো তিনতলায় নিজের ঘরে যাও।

সরোজাক্ষর মা মারা গিয়েছিলেন তার আগে। বিজয়া তখন সধবা শাশুড়ির হাতের লোহা আর পায়ের আলতার প্রসাদ নেবার জন্যে কাড়াকাড়ি করেছিল। সরোজাক্ষ তীব্র গলায় বলেছিলেন, তোমার এই ভক্তি নাটকটা বড় বেশি ওভার অ্যাকটিং হয়ে যাচ্ছে বিজয়া, অসহ্য লাগছে।

এমন অনেক উদাহরণ আছে বিজয়ার দাম্পত্যজীবনে, যা নাকি অপরের চোখেও ধরিয়ে দিয়েছে সেই জীবনের ফাঁকি। সেই আক্রোশ বিজয়াকে উগ্র করেছে, নির্লজ্জ করেছে। এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়াই বিজয়িনী হয়েছে।

বিজয়িনী তো হবেই।

মোক্ষম হাতিয়ার যে এসে গেছে তখন তার হাতে। ঝুপঝাঁপ করে চার চারটে ছেলেমেয়ে এসে গেছে।

হয়তো সবগুলোই সরোজাক্ষর দুর্বলতার সাক্ষী নয়, বিজয়ার বেহায়ামির কারণ, কিন্তু সে ইতিহাসের তো সাক্ষী নেই। সরোজাক্ষ তো বিজয়ার মতো অপরের কান বাঁচাবার চেষ্টামাত্র না করে সরবে প্রশ্ন করবেন না, তখন মনে পড়েনি? সরোজাক্ষ তো ঘোষণা করবেন না, বড় যে ঘেন্না আমার ওপর, বলি এগুলো এল কোথা থেকে? রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনেছি? সরোজাক্ষ তো হেসে হেসে বলবেন না, এদিকে তো তেজে মটমট, বলি সে তেজ থাকে? তেজ ভেঙে মাথা মুড়োতে আসতে হয় না? মনে ভাবো সাক্ষী থাকে না, কেমন? বলি আগুন কি ছাইচাপা থাকে?

হ্যাঁ, বিজয়া এসব কথা অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারত, আর সরোজাক্ষর নিরুপায়তায় মনে মনে হাসত। আবার সেই বিজয়াই কোনও এক সাক্ষীহীন শান্ত অন্ধকারকে নখে আঁচড়ে আঁচড়ে কেঁদে কেঁদে বলত, না হয় রাগের মাথায় একটা অন্যায় কথা বলেই ফেলেছি, তাই বলে তুমি আমায় ত্যাগ করবে? তা হলে খানিকটা বিষ এনে দাও আমায়, খেয়ে মরি। বেহায়া উদ্ধত, আর আত্মসম্মানজ্ঞানহীন স্ত্রীর কাছে স্বামী নামক জীবটা যে কত অহায় সেকথা হয়তো কেবলমাত্র তার সৃষ্টিকর্তাই জানেন।

.

অবশ্য এখন নাটক অন্য দৃশ্যে পৌঁছেছে। এখন বিজয়া আত্মস্থ গলায় বলতে পারছেন, ব্যাঙ্কে তোমার কত টাকা আছে?

হঠাৎ কথাটা সরোজাক্ষর অবান্তর বলে মনে হয়েছিল।

তারপর ভাবলেন, বিজয়া কোনও মোটা খরচের ধাক্কায় ফেলতে চাইছেন তাঁকে। হয়তো কোনও ব্যয়সাপেক্ষ ব্রত, হয়তো কোনও সুদূর তীর্থযাত্রার সংকল্প।

কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যেই।

বিজয়ার বিদ্রূপ কুঞ্চিত মুখে বিজয়ার প্রশ্নের আসল মানেটি লেখা ছিল। অতএব সরোজাক্ষ উত্তর দিলেন না, অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন।

বিজয়া আবার চিমটিকাটা স্বর ব্যবহার করলেন, কই, জবাব দিলে না?

সরোজাক্ষ গম্ভীর গলায় বললেন, অনেক টাকা।

বিজয়া সহজের রাস্তা ধরলেন।

বললেন, হ্যাঁ, সেকথা তো আমার অবিদিত নেই। তবে বলি ভাঁড়ে যখন মা ভবানী, তখন এত তেজ দেখাবার কী দরকার ছিল?

সরোজাক্ষর উত্তর দিতে ইচ্ছে হয় না, তবু সরোজা জানেন, কোনও একটা উত্তর না নিয়ে ছাড়বেন না বিজয়া। তাই তেমনি গম্ভীর কণ্ঠেই বলেন, যদি বলি ছিল দরকার?

বিজয়া তাঁর সেই কাঠ কাঠ হলুদরঙা মুখটা বাঁকিয়ে কুদর্শন করে বলে ওঠেন, তা তুমি আর বলবে না কেন? নিজের কাজকে কি আর অদরকারি বলবে? তা সেই দরকারটা বোধ হয় স্ত্রী-পুত্রের পেটের ভাতের থেকেও বড়?

সরোজাক্ষ অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলেন। সরোজাক্ষ অন্যমনস্কর মতো বলে ফেললেন, হয়তো বড়।

কিন্তু বিজয়া কি রাগ করে উঠে যাবেন? বিজয়া বলে উঠবেন না, তা তোমার কাছে তাই হতে পারে, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ত্রিজগৎ তা বলবে না। আমি বলছি ওসব তেজ-মান রেখে আবার জয়েন করতে হবে তোমায়।

তা হয় না।

হয় না তো, যেমন করে পারো রোজগার করে আনন। আর নয়তো আমায় অনুমতি দাও, ঝুলি হাতে করে ভিক্ষেয় বেরোই।

সরোজাক্ষ হঠাৎ হাতজোড় করে বলে ওঠেন, তুমি একটু এ ঘর থেকে যাবে?

এই, এইটিই অস্ত্র সরোজাক্ষর।

এরপর আর থাকেন না বিজয়া।

চোখে আগুন ঝরিয়ে চলে যান। কিন্তু সেদিন চলে যাননি। সেদিন তীক্ষ্ণ ধারালো গলায় চিৎকার করে করে বলেছিলেন, তাড়িয়ে দিয়ে পার পাবে ভেবেছ? সে আর এখন হয় না। মাস মাস যতটি টাকা সংসারে লাগে, তা যে করে থোক আমায় এনে দেবে, এ দিব্যি গালো, তবে আমি নড়ছি।

সে চিৎকারে সারদাপ্রসাদ ছুটে এসেছিলেন, বলেছিলেন, কী হচ্ছে কি বউদি? মানুষটা এই সেদিন মরণ বাঁচন রোগ থেকে উঠেছে, আবার এইসবে যদি একটা স্ট্রোক-টো হয়ে যায়? যান, যান, আপনার পুজোর ঘরে চলে যান।

বিজয়া এ সুযোগ ছাড়েননি।

বিজয়া হাত-মুখ নেড়ে বলে উঠেছিলেন, মুখে হিতৈষী হতে সবাই পারে গো ঠাকুরজামাই। বলি এতগুলি লোকের পেট তাতে মানবে?

সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল। যে সারদাপ্রসাদ ব্যঙ্গবিক্রপ কাকে বলে জীবনে জানে না, সে হঠাৎ সেই গলায় বলে উঠেছিল, কেন, আপনার ঠাকুর কী করছেন? শুধু নিজে বসে বসে ছানা-মাখনের ভোগ লাগাবেন? তিনি পারবেন না এই পেটগুলোর ভার নিতে?

বিজয়া সহসা একথার উত্তর দিয়ে উঠতে পারেননি। তাই ন্যাকামি বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সিঁড়িতেই উঠে গিয়েছিলেন।

সারদাপ্রসাদ সুউচ্চ কণ্ঠে বলেছিল, হ্যাঁ, তাই যান। তাঁকেই জ্বালাতন করুন গে। চিরটাকাল তাঁকে নিয়েই পড়ে থাকলেন, এখন বিপদকালে মানুষের ভরসা কেন?

এত ঝামেলার মধ্যেও হঠাৎ সরোজাক্ষর মুখে একটু কৌতুকের হাসি ফুটে উঠেছিল যেন। বলেছিলেন,তোমার তো আজকাল খুব সাহস বেড়েছে দেখছি।

সারদাপ্রসাদ লজ্জিত গলায় বলেছিল, কী করব দাদা, হঠাৎ রাগটা কেমন চড়ে গেল! বুনো গোঁয়ার তো।

তারপর নিজেই বলেছিল, তারপর? এখন কী ঠিক করছেন? কিছু তো একটা করতেই হবে?

তা তো হবে।

সারদা ক্ষুণ্ণ গলায় বলেছিল, আমার বইটা শেষ হয়ে গেলে, এত ভাবতাম না। কী করব, হয়ে তো ওঠেনি। তবে গোটা কয়েক দিন চালিয়ে নিন, ও বই ছাপা হলে–একেবারে হট কেক হবে। অথচ এদিকে দামটা ভাল হবে। টাকা কুড়ির কম তো নয়ই। ধরুন যদি ফার্স্ট এডিশানে দু হাজারও ছাপায়–এসব গবেষণার বইটই অবশ্য তা ছাপে না। একেবারে চার-পাঁচ হাজার ছাপে। যাক আমি না হয় দুহাজারই ধরছি। তা হলেও–আপনার গিয়ে চল্লিশটি হাজার ঘরে আসছে। পরের পার্টটাও তো লেখা হতে থাকবে ততদিনে।

সারদাপ্রসাদের মুখটা আহ্লাদে ভরে ওঠে। সারদাপ্রসাদ সেই ভাবনাশূন্য দিনটির কল্পনায় বিভোর হয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করতে যায় তার লেখা।

সরোজাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে থাকেন। একটি শ্রদ্ধামিশ্রিত স্নেহের সঙ্গে।

তা সরোজাক্ষর অনেক কিছুই উলটোপালটা বইকী! নইলে সারদাপ্রসাদের জন্যে শ্রদ্ধা! স্নেহ করুণা কৃপা দয়া মায়া এগুলো না হয় ক্ষ্যামাঘেন্নার ব্যাপার। কিন্তু শ্ৰদ্ধা? সরোজাক্ষর ছেলেমেয়েরা শুনলে হেসে কুটিকুটি হত।

এখন অবশ্য সরোজাক্ষর ছেলেমেয়েদের হাসবার মুড ছিল না। বাবার ওই চাকরি ছাড়ার গোঁয়ার্তুমিতে সকলেই আহত।

বড় ছেলে বলে গেছে, যা করেছেন নিজের দায়িত্বেই করেছেন, আমার কিছু বলার নেই। তবে আমার কাছে সংসার যেন কিছু প্রত্যাশা না করে, এই হচ্ছে আমার সাফ কথা। তবে হ্যাঁ। বলতে পারেন, আমার ফ্যামিলির দায়িত্বটা আমারই। বেশ বলে দিন স্পষ্ট করে, চলে যাব নিজের ফ্যামিলি নিয়ে।

এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকল একটুক্ষণ, যেন অর্ডারটা পেলেই চলে যায়। নেহাত যখন কোনও শব্দ উঠল না ঘরে, নীলাক্ষ শরীরে একটা মোচড় খেয়ে বলে চলে গেল,ঠিক আছে। যখনই অসুবিধে বোধ করবেন, বলে দেবেন।

ময়ূরাক্ষী এল বিকেলে।

বউদিকে টেক্কা দেওয়া সাজ সেজে। এসেই পাখার স্পিডটা বাড়াল। তারপর বলল, আপনি হঠাৎ এমন একটা তিলকে তাল করা কাণ্ড করবেন বাবা, এটা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। আশ্চর্য! ঘেরাও আজকাল কে না হচ্ছে? প্রাইম মিনিস্টার থেকে হাইকোর্টের জজ পর্যন্ত বাকি আছে কেউ? সবাই কাজকর্ম ছেড়ে দিচ্ছে?

সরোজাক্ষ একটু হেসে বললেন, তুমি আমায় হিতোপদেশ দিতে এসেছ, না কৈফিয়ত তলব করতে এসেছ?

হিতোপদেশ! বরের সামনে এহেন অপমানে লাল হয়ে গিয়ে ময়ুরাক্ষী বলল, আপনাকে হিতোপদেশ দিতে আসব, এমন মুখ আমি নই বাবা। আর–কৈফিয়তই বা কীসের? আপনার চাকরি ছাড়ায় তো আমার সংসার অচল হয়ে যাবে না। এমনি কথার কথাই বলছিলাম। আপনি আমাদের সন্তানের মর্যাদা না দিলেও আমরা তো সম্পর্কটা ভুলতে পারি না।

বড় মেয়ের বাক্যের হুলে সরোজাক্ষ বিব্রত হয়েছিলেন। বিপন্ন গলায় বলেছিলেন, এ সব কথা বলছ কেন? চাকরি ছাড়াটা হয়তো সংসারের পক্ষে অসুবিধেকর, কিন্তু আমার বিবেকে বাধছে। মনে হচ্ছে এতকাল ওদের ঠকিয়ে মাইনে নিয়ে এসেছি। ওদের শিক্ষা দেবার ভান করেছি, অথচ দিইনি শিক্ষা। পিটুলি গোলা খাইয়ে দুধ খাওয়াচ্ছি বলে মিথ্যে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছি। তারপর–মেজাজের ওজন হারিয়ে বসেছি ওরা শিক্ষিতহয়নি দেখে। এতদিন খেয়ালে আসেনি বলেই চালিয়ে আসছিলাম। এখন আর

সরোজাক্ষর জামাই শ্বশুরের সামনে মুখ খোলে কম। যা কিছু মন্তব্য করে, আড়ালেই করে। আজ কিন্তু মুখ খুলল। একটু চোরা-হাসি হেসে বলল, ছাত্ররাই তা হলে আপনার জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছে বলুন?

সরোজাক্ষ একবার ওই আহ্লাদে আহ্লাদে মুখটার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বলেন, তাই দিয়েছে বলতে হবে।

ময়ূরাক্ষীর নিজের মতবাদ যাই হোক, বরের কথার প্রতিবাদ করবেই। ওই প্রতিবাদটাই হয়তো ওর আসল মতবাদ।

ও তাই নিজের কথাই খণ্ডন করে বলে, তুমি থামো তো! এ যুগের ছেলেগুলো হচ্ছে পাজি নম্বর ওয়ান! সভ্যতা নেই ভব্যতা নেই, কোনও কিছুতেই শ্রদ্ধা নেই

হয়তো ওদের সামনে–সরোজাক্ষ একটু থেমে বলেন,ওদের শ্রদ্ধার যোগ্য কিছু নেই।

ঠিক বলেছেন। সরোজাক্ষর জামাই উৎসাহিত গলায় বলে, নেই কিছু। দেখছে তো চারদিক তাকিয়ে। বুদ্ধি তো হয়েছে। দেখছে–যেমন অপদার্থ দেশের সরকার, তেমনি অপদার্থ কর্পোরেশন, তেমনি অপদার্থ ইউনিভার্সিটিগুলো, আর–

থাক জয়ন্ত, বৃথা কষ্ট কোরো না, সরোজাক্ষ আস্তে বলেন, এ দেশের অপদার্থতার লিস্ট করতে বসলে কাগজে কুলোবে না। তোমরা বরং চা-টা খাও গে…

খাও গে!

অর্থাৎ অন্যত্র সরে পড়ো গে।

জয়ন্ত মুচকি হেসে বলে, তাই ভাল। কী বলো মক্ষী? বাবাকে অনর্থক ডিস্টার্ব করার কোনও মানে হয় না।

না না– ডিস্টার্ব কেন? সরোজাক্ষ কুণ্ঠিত গলায় বলেন, অনেকক্ষণ এসেছ, চা-টা খাবে তো একটু?

ময়ূরাক্ষীর বাবাকে হিতকথা শোনানোর প্রচেষ্টা ওই চা খাওয়াতেই ইতি হল। তার ভাগ্যক্রমে সেদিন তখনও নীলাক্ষ বাড়ি ছিল, ছিল সুনন্দা।

সুনন্দাই নিজের ঘরের শৌখিন সরঞ্জাম বার করে চা খাওয়াল, খুব প্রশংসার গলায় বলল, মক্ষী তো খুব চমৎকার সেজেছ? শাড়িটা নতুন কিনেছ তাই না?

ওই নিরীহ প্রশ্নটার মধ্যে ময়ূরাক্ষী যে অপমানের কী পেল! ক্রুদ্ধ হল সে। আজেবাজে করে বলতে লাগল, নতুন শাড়ি দেখাবার জন্যেই সে এসেছে, এমন নিচু কথা সুনন্দা ভাবতে পারল কী করে। নেহাত নাকি বাবার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে কিনা দেখতে-বলল, হয় এরকম। হঠাৎ হঠাৎ অপমানে মানী লোকেদের ব্রেনের মধ্যে এদিক ওদিক হয়ে যায়।

সুনন্দা এতক্ষণ এদের কথায় যোগ দেয়নি। সুনন্দা লীলায়িত ভঙ্গিতে চা বিস্কুট কাজু সরবরাহ করছিল, এখন একটু হেসে বলল, হঠাৎ বুঝি?

ময়ূরাক্ষী ভুরু কোঁচকাল, কী বলছ?

কিছু না। অপমানটা হঠাৎ হলে, একটা এদিক ওদিক হয়ে যায় বলছিলে কিনা, তাই জিজ্ঞেস করছিলাম হঠাৎ কি না।

ময়ূরাক্ষী লাল লাল মুখে বলে, তা সে অপমান তোমরাই করে চলেছ। মেয়েদের থেকে বাবা কোনও আঘাতই পাননি।

কোথা থেকে কী সে কথা তো বলিনি ভাই মক্ষী, চটে উঠছ কেন?সুনন্দা হাতের প্লেটটা বাড়িয়ে ধরে বলে,আর দুটো কাজু খাও।

নীলাক্ষ বলে ওঠে, এটা হচ্ছে আমার প্রতি শ্লেষ, বুঝলি মক্ষী? শ্রীমতী সুনন্দার ধারণা আমার বাবাকে উনি আমার থেকে বেশি ভালবাসেন।

ভালবাসা!

সুনন্দা হঠাৎ বেয়াড়া ভঙ্গিতে হেসে ওঠে, সে আবার কী বস্তু? ভালবাসা! হি হি হি! তোমাদের দাদা বেশ মজার মজার কথা বলেন মক্ষী! কী জয়ন্তবাবু, শুনে আপনার মজা লাগছে না?

মীনাক্ষী বাবাকে দোষারোপ করেনি, শুধু বলেছিল, কলেজটা ছাড়া যখন আপনার পক্ষে অনিবার্যই হল বাবা, তখন আমায় একটু কিছু করবার অনুমতি দিন, যাতে নিজের দরকারটাও অন্তত

সরোজাক্ষ একটা অপ্রত্যাশিত কথা বললেন। বললেন,আমি তো তোমাকে কোনও কিছু করতে কোনওদিন নিষেধ করিনি, হঠাৎ এখন অনুমতির কথা কেন?

মীনাক্ষী একথা আশা করেনি। মীনাক্ষী ভেবেছিল বাবা আহত হবেন, ক্ষুব্ধ হবেন। তাই ঈষৎ বিচলিত হল মীনাক্ষী। বলল,এতদিন এদিকটা ভেবে দেখিনি। বেশ, আপনার যখন অমত নেই–

মীনাক্ষীকে থামতে হল।

মীনাক্ষীর বাবা তাঁর চোখের থেকে চশমাটা খুলে মুছতে মুছতে সেই চশমাহীন গভীর ছাপপড়া। চোখ দুটো মেয়ের চোখে ফেলে বললেন, আমার অমত, আমার অনুমতি, এগুলোর সত্যিই কোনও প্রয়োজন আছে তোমাদের জীবনে?

মীনাক্ষী চমকে উঠল।

মীনাক্ষী কেঁপে উঠল।

মীনাক্ষীর মনে হল, সব প্রকাশ হয়ে পড়েছে। বাবার কাছে আর কিছুই অবিদিত নেই। তবু মীনাক্ষী ভাবল–এই সুযোগ। এখনই তার নিজের কথা বলে ফেললে ভাল হত।

কিন্তু মীনাক্ষীর স্বরযন্ত্রটাকে কে যেন আটকে ধরল।

মীনাক্ষী আজও অন্যদিনের মতোই ব্যর্থ হল।

মীনাক্ষীর মাথা নিচু করে বলল, এ কথা কেন বলছেন?

বলছি–একটা উত্তর পেতে চাই বলে। এটা আমার জিজ্ঞাসা।

মীনাক্ষী ঘাড় নিচু করে বসে রইল।

সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বললেন, প্রশ্নপত্রটা বড় শক্ত হয়ে গেছে, তাই না? এত তাড়াতাড়ি উত্তরপত্র তৈরি করা সম্ভব নয়। আচ্ছা থাক।

মীনাক্ষী বোকার মতো একটুক্ষণ বসে থেকে উঠে গেল। মীনাক্ষী তারপর নিজের ঘরে এসে চিঠি লিখতে বসল।

.

আজই দেখা হয়েছে।

তাতে কী?

আবার এখুনই তো কত কথা জমে উঠেছে। প্রেমের কথা না হোক, প্রয়োজনের কথা।

দিবাকর আজ বলেছিল, তোমার বাবার যা মতবাদ দেখছি, তাতে ওঁর প্রতি আর আস্থা নেই। এখনও এ যুগেও তিনি এতটুকু মান-অপমানে বিচলিত হন। এখনও আশা করেন ছেলেগুলি সুশীল সুবোধ হবে। এরপর আর কী করে তবে ভাবা যেতে পারে তিনি তাঁর মেয়ের এই স্বয়ংবরা হওয়াটা সুচক্ষে দেখবেন! নাঃ, আশা নেই।

আশা তো করছি না।

তবে আর আমায় ঝুলিয়ে রাখা কেন বাবা? ছেড়ে দাও, বাবার বাধ্য কন্যা হয়ে পিড়িতে বসো গে৷

মীনাক্ষী আজ ক্ষুব্ধ ছিল।

মীনাক্ষী উদ্ধত গলায় বলেছিল, বেশ, দরকার নেই বাবার প্রসন্ন অনুমতির, তোমাকেও আর ঝুলিয়ে রাখতে চাই নে। কালই চলো নোটিশ দিতে। এখন বলো, বিয়ে করে আমায় কোথায় নিয়ে গিয়ে তুলবে।

দিবাকর হো হো করে হেসে উঠল। একেই বলে মেয়ে! যে-কোনও বয়েসেই তোমরা ঘোরতর বিষয়ী!

বিষয়ী না হতে পারলে, কোনও বিষয়েই এগোনো যায় না দিবা! ডাঙার মাটি না দেখেই নৌকো থেকে পা তুলে নেওয়া নির্বুদ্ধিতা মাত্র।

উঃ, একেবারে টাকা-আনা-পাইয়ের হিসেব।

মীনাক্ষী বিরক্ত মুখে বসে ছিল, উত্তর দেয়নি।

দিবাকর তখন এক গল্প ফেঁদেছিল। বলেছিল, মেয়েরা যে কত হিসেবি হয় তা হলে বলি

তারপর দিবাকর তার মামার মেয়ে ব্রজবালার নাম দিয়ে সেই তার দেশের দিদির গল্পটা শুনিয়ে দিয়েছিল।

মীনাক্ষী রুদ্ধকণ্ঠে বলেছিল, এই কথা বলল সে তোমায়?

বলল তো! দিব্যি স্বচ্ছন্দেই বলল।

দিবাকর দিব্যি বানিয়ে বানিয়ে বলেছিল, দোতলায় ঠিক ওর ঘরের পাশেই হচ্ছে আমার ঘর, এ ঘরে চলে এসে হাসতে হাসতে বলল, তোমাদের ভগ্নীপতি আজ দশদিন হল আসছে না। তাই আজ্ঞা দিতে এলাম তোমার ঘরে।

আমি তো বিব্রত বিপন্ন।

বললাম, কিন্তু এত রাত্রে?

ও অনায়াসে ধূর্ত হাসি হেসে বলল,তাতে কী? বিধবা নই, কুমারী নই, ভয়টা কী? বাবা মা থিয়েটার দেখতে গেছে কিন্তু সাবধান করে দিচ্ছি দিবুদা, আমার সেই হতভাগা বরটা যখন আসবে, যেন দেখে না তোমার সঙ্গে আমার চেনা আছে। তুমি বাবার ভাগ্নে, এই পর্যন্ত।

বোঝো তা হলে? সাধে বলছি মেয়েরা হচ্ছে এক নম্বর হিসেবি। তারা সব সময় দু নৌকোয় পা রাখে, যাতে দুটোই দখলে থাকে। তারা মাটিতে পা না রাখা পর্যন্ত নৌকো ছাড়ে না। যেমন তুমি।

মীনাক্ষী রুদ্ধ গলায় বলেছিল, ছেলেরা আর আমাদের অবস্থা কী বুঝবে!

হুঁ, সেই চিরকেলে মেয়েলি প্যানপ্যানানি। এ দেশের আর উন্নতি হয়েছে।

মেয়েরা খুব বেপরোয়া হলেই বুঝি দেশের খুব উন্নতির চান্স?

বেপরোয়া মানেই সাহসী! দিবাকর বলেছিল, সাহসের অভাবই আমাদের দেশকে শেষ করেছে।

দিবাকরের সেই ঘোর কালো রঙের আঁটি সাঁটি ধরনের মুখটা যেন ঘৃণায় বেঁকে গিয়েছিল, এ দেশের সাহসের অভাবের কথা স্মরণ করে।

মীনাক্ষীর মুখে আর কথা জোগায়নি। কিন্তু বলবার কথা অনেক ছিল।

— সেই কথা লিখতেই কাগজ কলম নিয়ে বসল মীনাক্ষী। লিখল, তুমি কেবল আমার সাহসের অভাবই দেখছ, নিজের অভাবটা তোকই দেখছনা? এতবার বলছি তোমার মামার কাছে, তোমার মার কাছে আমাকে একবার নিয়ে চলো, কই যাচ্ছ না তো? তার মানে সাহস হচ্ছে না। ঠিক আছে, আমি একলাই যাব। দেখব কী তাঁরা বলেন আমায়।

.

মীনাক্ষী যখন তার হাতের কলমটা থামিয়ে ভাবনার গভীরে ডুবে গিয়ে ভাবছিল, আচ্ছা আমাদের দেশের সেই প্রথাটাই কি তবে ভাল ছিল? সুখের ছিল? বালিকা বয়েসেই বাপ-মা ধরে একজনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিত, ব্যস নিজের দায়িত্ব বলে কিছু থাকত না।–আর জ্ঞান হওয়া ইস্তক যাকে একমাত্র অবলম্বন বলে জানত, তাকেই ভালবেসে ফেলত–মীনাক্ষী ভাবনা থামিয়ে হাসল। ভাবল, আমার মা বাপের দাম্পত্য জীবনই তো আমার প্রশ্নের উত্তর।

মীনাক্ষীর তার নিতান্ত শৈশবের কথা অস্পষ্ট মনে পড়ল। মনে পড়ল তার মায়ের সেই একটা ভয়ংকর হিংস্র মূর্তি। তার বাবার সেই নিবিড় ঘৃণা আর অবজ্ঞার মূর্তি।

অথছ ওঁরা একসঙ্গে কাটিয়েও এলেন এই দীর্ঘ জীবনটা। ওঁরা কোনওদিন বিবাহ-বিচ্ছেদের কথা চিন্তা করেননি, কোনওদিন পালিয়ে যাবার, আত্মহত্যা করবার, সমস্ত সংসারের কাছে নিজেদের এই ফাঁকির ঝুলিটা খুলে ধরবার সাহসও অর্জন করতে পারেননি।

মীনাক্ষীর বাবাও ঠিক সেই সময় সেই কথাই ভাবছিলেন।

অথচ এই জীবনের মধ্যে কাটিয়ে এলাম এতখানি বয়েস পর্যন্ত। কোনওদিন ভাবিনি, এই ফাঁকির জীবনটাকে ছিঁড়ে ছড়িয়ে ধুলোয় ফেলে দিয়ে, সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াই।

সরোজাক্ষ ভাবছিলেন–

আসলে আমি আমার এই পারিবারিক সত্তাটাকে গৌণ ভাবতে অভ্যস্ত হয়েছিলাম, আমার কাছে মুখ্য ছিল আমার কর্মময় সত্তাটি। তার উপরেই আমার আমিটাকে প্রতিষ্ঠিত রেখে চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সেখানেই ছিল আমার ভালবাসা, আমার আশ্রয়।

এখন সহসা ধরা পড়ে গেছে, সেই আমার একান্ত ভালবাসার, একান্ত আশ্রয়ের জায়গাটা আরও বিরাট একটা ফাঁকির শূন্যতা সৃষ্টি করে রেখে বাতাসে মিলিয়ে গেছে।

মনে হচ্ছে জীবনে বোধহয় আর কোনওদিন আমার এই অভ্যস্ত কাজে ফিরে যেতে পারব না। আমি বোধহয় পড়াতে ভুলে গেছি। ভুলে গেছি আমার অধীত বিদ্যাকে।

না, আমি এখন আর আমার ছাত্রদের ঔদ্ধত্যে মর্মাহত হচ্ছি না, বুঝতে পারছি এ ছাড়া আর কিছু করবার ক্ষমতা ছিল না তাদের। তাদের আমরা শুধু বিদ্যাই দিয়ে এসেছি, শিক্ষা দিতে পারিনি।

বিদ্যাটা তো একটা হাতিয়ার মাত্র। যেটা তাদের জীবনযাত্রার কাজে লাগবে, জীবন সাধনায় নয়।

ওদের সামনে অনেক আশার ছবি তুলে ধরছে জগৎ, তুলে ধরতে পারছেনা কোনও আদর্শের ছবি। চরিত্র বস্তুটা দেখতে পাচ্ছে না ওরা, চরিত্রবান হবে কোথা থেকে তবে? ওদের কাছে প্রত্যাশার পাত্র খালি পেতে ধরলে বিফল তো হবই।

না, আমার ছাত্রদের দোষ দিতে পারছি না আমি। আমার সন্তানদেরও নয়।

আমার অক্ষমতাই আমার সন্তানদের অসার করেছে, অবিনয়ী করেছে, অসভ্য করেছে। আমাদের প্রেমহীন বিকৃত দাম্পত্য জীবনের অসহায় বলি ওরা। ওদের জন্যে বেদনাবোধ করবার আছে। ওদের কাছে ক্ষমা চাইবার আছে।

৩. বিজনেসের গল্প

দিবাকর কোনওদিন মীনাক্ষীকে তার বাসস্থান দেখায়নি, তবু মীনাক্ষী সে বাড়ির দরজায় এসে হাজির হল।

মীনাক্ষী দিবাকরের মামার বিজনেসের গল্প শুনেছিল এবং শুনেছিল তাঁর দোকানের নাম। সেই সূত্র ধরে ঠিকানাটা জোগাড় করে নিয়েছিল এবং সাহসে ভর করে এসে দাঁড়িয়েছিল।

দাঁড়িয়েছিল। তবু সেই সেকেলে প্যাটার্নের টানা লম্বা জালটাকা বারান্দাওলা প্রচণ্ড তিনতলা বাড়িখানার গেট ঠেলে চট করে ঢুকে পড়তে বাধছিল, তাকিয়ে দেখতে লাগল।

তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবল, দিবাকর এত আধুনিক, কিন্তু ওর বাড়িটা একেবারে সেকেলে। এই নিরেট নিরেট বাড়িটার মধ্যে কি প্রগতির হাওয়া খেলে? কিন্তু ঢুকব কী করে?

এ সময় একটা ঘটনা ঘটল, মীনাক্ষীর পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠল, কাকে চান?

মীনাক্ষী তাকিয়ে দেখল।

দেখল বাড়ির চাকরটাকর কেউ।

হাতে মিঠে পানের খিলি।

পান কিনতে বেরিয়েছিল বোধহয়, ফিরে এসে দরজায় এমন একটি অপরিচিতা তরুণীকে দেখে একটু অবাক হচ্ছে।

এ বাড়িতে আত্মীয়স্বজন ছাড়া কারও যাতায়াত নেই। আর অনেকদিনের পুরনো চাকরের সেই আত্মীয়জনদের চিনতেও বাকি নেই।

নবীন সবাইকে চেনে।

নবীন সবাইয়ের সঙ্গেই মুরুব্বিয়ানা চালে কথা কয়ে থাকে।

কিন্তু আজকের অতিথিটি নবীনের অচেনা, তাই মুরুব্বিয়ানার সুরটা গলার মধ্যেই মজুত রেখে নবীন ঈষৎ সমীহর গলায় বলল, কাকে চান?

মীনাক্ষী জানত এ-সময় দিবাকর বাইরে, মীনাক্ষী সেটা ভাল করে জেনেই তবে এসেছিল। তবু হঠাৎ ভেবে পেল না কাকে চাই বলবে? তাই থতমত খেয়ে বলে ফেলল, দিবাকরবাবু আছেন?

দিবাকরবাবু!

নবীনের সমীহর গলা উপে গেল। বেরিয়ে এল তাচ্ছিল্যের গলা।

যে মেয়েছেলে দিবাকরকে খুঁজতে এসেছে, তাকে সমীহ করবার প্রয়োজন বোধ করল না।

তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, না, নেই। দরকার থাকে সকালের দিকে আসবেন।

পান নিয়ে গেট ঠেলে ঢুকে ঘুরে দাঁড়াল নবীন, যেন আগলানোর ভঙ্গিতে।

মীনাক্ষীর ওই ভঙ্গিটা দেখে একবার মনে হল, ধ্যেতারি চলে যাই। মনে হচ্ছে এ বাড়ির মধ্যে ঢুকে আমি সুবিধে করতে পারব না।

কিন্তু বিনা বাক্যব্যয়ে চলে আসবে শুধু একটু ভাল না লাগার কারণে? যে আসা কত আয়োজন করে।

মীনাক্ষী সাহসে ভর করে বলে,আমি তাঁর মার সঙ্গে দেখা করতে চাই।

মা!

নবীন আকাশ থেকে পড়ে।

মা! দিবাকর দাদাবাবুর মা আবার এখানে কোথা?

নেই? সে কী? কোথাও গেছেন বুঝি?

নবীন ব্যঙ্গের গলায় বলে, যাবে কোথায়? কোনওকালেও ছিল না। দেশে থাকে।

কী আশ্চর্য!

দিবাকর তা হলে কী করে যখন তখন বলে, মা এই বলল, এই বোঝাল, মাকে এই শুনিয়ে দিলাম।

দিনের পর দিন তা হলে বাজে কথা বলেছে দিবাকর?

ধ্যেৎ। তাই কি সম্ভব? মাকে নিয়ে এমন অদ্ভুত বাজে কথা বলবে কেন? কোথাও একটা ভুল হচ্ছে।

মীনাক্ষী তাই সন্দিগ্ধ গলায় প্রশ্ন করে, এটা দিবাকরবাবুর মামার বাড়ি তো?

নবীন ইত্যবসরে ট্যারা দৃষ্টিতে মীনাক্ষীকে যাকে বলে পুঙ্খানুপুঙ্খ সেইভাবে দেখে নিচ্ছিল। তার তীক্ষ্ণ প্রখর বুদ্ধিতে ধরা পড়তে দেরি হল না মেয়েটা দিবাকর দাদাবাবুর লভ-এর মেয়ে। সিনেমা দেখে দেখে লিভ-এর হাড়হ তার নখদর্পণে!

আর সিনেমাও তো দেখতে বাকি থাকে না কিছু। নিজের চাহিদায় যায়, গিন্নিমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেও যায়।

প্রকাশ মণ্ডলের এত সময় নেই যে গিন্নি নিয়ে সিনেমা যাবেন, গিন্নি কুসুমকামিনীর তাই একমাত্র গতি খাস চাকর নবীন। যান না অবশ্য একা, ব্রজবালা থাকলে ব্রজবালা যায়, ভাই বউ বীণা যায়, কিন্তু একটা বেটাছেলের ভরসা তো চাই?

দশটা মেয়েমানুষও একা, না ভ্যাকা! একটা বেটাছেলে হচ্ছে ভরসা। তা সে নাবালক হোক, অথবা গণ্ডমূর্খ চাকরই হোক।

অতএব নবীনের সিনেমা দেখাটা খুব ঘটে। সেই অভিজ্ঞতাতেই বুঝতে দেরি হয় না তার মেয়েটা কে!

তবু বুঝে ফেলেও উদাসীন গলায় বলে, হ্যাঁ, বাবুর ভাগ্নে বলেই তো জানি।

মীনাক্ষী চাকরটার কথার মধ্যে একটা স্পষ্ট অবজ্ঞা দেখতে পায়। মীনাক্ষীর রাগে হাড় জ্বলে যায়। বুঝতে বাকি থাকে না বড়লোকের আদুরে বেয়াদপ চাকর।

কিন্তু চোরের ওপর রাগ করে তো মাটিতে ভাত খেতে পারে না মীনাক্ষী? চাকরের ওপর রাগ করে দরজায় এসে ফিরে যেতে পারে না?

তবে কেমন যেন ধারণা হয়, ভিতরে ঢুকলেও অভ্যর্থনাটা সুবিধের হবে না। কিন্তু কী করা? এসেছে যখন ভিতরে ঢুকে দেখে যাবেই।

ঠিক আছে। মীনাক্ষী গম্ভীর স্বরে বলে, মামা বাড়ি আছেন?

না তো! এখন আবার তিনি কোথায়? গদিতে গেছে।

মামি আছেন তো? না কি তিনিও গদিতে গেছেন?

মীনাক্ষীর বিরক্তি গোপন থাকে না।

কিন্তু নবীন ঘুঘু ছেলে, সে ভয় খায় না, এতক্ষণে নিজে একটু সরে মীনাক্ষীকে প্রবেশ পথ দিয়ে বলে, গিন্নিমাকে চান তো, উপরে চলুন। তবে নীচের ঘরে একটু বসতে হবে, আগে জানানো দরকার।

মীনাক্ষী আশান্বিত হয়ে ঢোকে।

ধড়িবাজ নবীন অমায়িক মোলায়েম গলায় বলে, দিবাকর দাদাবাবুর ঘরে বসবেন?

দিবাকর দাদাবাবুর ঘর!

মীনাক্ষীর মনটা পুলকে ভরে ওঠে। যে মানুষকে সর্বদা দেখি, অথচ জীবনে তার ঘর দেখিনি, তার ঘরটা দেখতে আগ্রহ হয় বইকী!

কিন্তু মীনাক্ষী তো জানে–দিবাকর দোতলায় মামার মেয়ে ব্রজবালার ঠিক পাশের ঘরে থাকে। তাই বলে,থাক, এখন নীচেই বসছি।

নবীন কী ভাবল বা বুঝল কে জানে। বলল,ঠিক আছে বসবার ঘরেই বসুন।

মীনাক্ষী ওর পিছু পিছু বাড়ির মধ্যে ঢুকে আসে, সঙ্গে সঙ্গে তার কানের পরদা ফুটো করে একটা বিষবাণ এসে মাথার মধ্যে বিধে যায়।

হ্যাঁ নবনে, গেট-এ দাঁড়িয়ে এত কথা হচ্ছিল কার সঙ্গে? ছুঁড়িটা কে?

নবীন উপরে উঠে গিয়েছিল।

বোধ করি ছুঁড়িটা কে, এবং এত কথাটা কীসের তাই জানাতে। মীনাক্ষী একা বসে ঘামছিল আব ভাবছিল, ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়িনি তো!

এই বাড়ি দিবাকরের?

এই ভাষা দিবাকরের বাড়ির লোকের? যে দিবাকর মীনাক্ষীর বাড়ির সেকেলেপনা দেখে মুহূর্তে মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে যায়!

এটা কী সরল গ্রাম্যতা?

নাঃ! কণ্ঠস্বর কী কর্কশ!

ভঙ্গিতে কী অপরিচ্ছন্নতা!

না, না, এ বোধহয় ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়েছে মীনাক্ষী।

উঃ! চাকরটাও যে গেল তো গেলই।

নেমে এসে তাকে বলে চলে যেতে পারে, এখন আর ওই গিন্নি-টিন্নির সঙ্গে দেখা করার উৎসাহ নেই মীনাক্ষীর।

নবীন এল অনেকক্ষণ পরে।

খুব সম্ভব সব কিছু গিন্নির কর্ণগোচর করে।

এসে সহাস্যে বেশ মাইডিয়ারি ভঙ্গিতে বলে ওঠে, হয়ে গেছে কুইন ভিক্টোরিয়ার হুকুম! আসুন উপরে।

মীনাক্ষীর আপাদমস্তক জ্বলে যায়, মীনাক্ষীর ইচ্ছে হয়, বলে,থাক এখন, হঠাৎ মনে পড়ল অন্য কাজ আছে।

কিন্তু মীনাক্ষীকে কৌতূহলে টানল।

যে কৌতূহল মেয়েমানুষের স্বভাবধর্ম। দেখাই যাক না কী ব্যাপার। কিন্তু নিশ্চিত হবার উপায়টা কী?

যে লোকটার সঙ্গে কথা কইতে হাড় জ্বলছে, তাকেই বলে,আচ্ছা ইনি দিবাকর দাস তো?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

মামার নাম?

আজ্ঞে, শ্রী প্রকাশচন্দ্র মণ্ডল।

নামটা যেন এইরকমই মনে হচ্ছে মীনাক্ষীর। কারণ প্রথম শুনে মণ্ডল শব্দটা যে হঠাৎ কানে একটা ধাক্কা মেরেছিল, সেই স্মৃতিটা স্মরণে এল।

অতএব উপরে ওঠা।

বসবার ঘরটাকে আর একবার তাকিয়ে দেখল মীনাক্ষী। প্রকাণ্ড একটা গোলটেবিল, তার ধার ঘিরে খানকয়েক কাঠের চেয়ার, ভারী ভারী হাতল দেওয়া। দেয়ালে নানা দেবদেবীর ছবি, তার সঙ্গে একটি মেমমার্কা ক্যালেন্ডার। ক্যালেন্ডারখানা বাদে সবই কেমন মলিন বিবর্ণ ধূসর।

পয়সা আছে, রুচি নেই।

কেমন একটা বিতৃষ্ণা মেশানো কৌতূহল নিয়ে নবীনের পিছু পিছু উপরে উঠল মীনাক্ষী। আর সেই সময় জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

.

কুসুমকামিনীও সেই প্রশ্নই করেন, তোমার নাম কী?

কুসুমকামিনীর ঘরে বসবার জন্যে একটি সোফা আছে। ফুলপাতাসংবলিত সেকেলে গড়নের জোড়া পালঙ্কের পায়ের দিকে একধারে সেটি পাতা। সামনে ছোট টেবিল।

প্রকাণ্ড ঘর। জোড়া পালঙ্ক, সোফা টেবিল দেরাজ আলনা ইত্যাদি রেখেও জায়গা আছে।

কুসুমকামিনী অবশ্য সোফায় বসে নেই। তিনি সেই সোফা থেকে হাতখানেক উঁচু পালঙ্কে একটি তাকিয়া কোলে নিয়ে বসে আছেন। কাছে ডাবরে পান।

বয়সের তুলনায় চুল পাতলা, মুখে ভারিক্কি ছাপ। তাঁর পাশে ব্রজবালা গড়িয়ে শুয়ে ছিল, মীনাক্ষীকে দেখে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে উঠে বসল।

মীনাক্ষী অবশ্য আন্দাজে ভাবল এই বোধহয় ব্রজবালা। কিন্তু এ মেয়ের মুখে কোনও দুদে ধরনের ছাপ দেখতে পেল না মীনাক্ষী। বরং যেন নেহাতই নিরেট নিরেট। এই মেয়ে সেইকথা বলতে পারে?

সে যাক, এদের একবার যাচাই করে যেতে হবে মীনাক্ষীকে। যাতে দিবাকর সম্পর্কে সঠিক জানতে পারে।

ভয়ানক একটা জ্বালা অনুভব করছে; প্রতারিত হবার জ্বালা, ঘৃণার জ্বালা।

কুসুমকামিনীর পরনে একখানি কল্কাপাড় মিহি শান্তিপুরে শাড়ি, গায়ে জামা-শেমিজের বালাই নেই। গায়ে জামা-শেমিজের বালাই মীনাক্ষীর নিজের মারও থাকে না। কিন্তু সে যেন আর একরকম। তার মধ্যে কতকটা যেন কৃচ্ছসাধনের পবিত্রতা। তা ছাড়া সর্বদাই তো গরদ-তসর পরে বেড়ান বিজয়া, একটু পুজো-পুজো ভাব থাকে, খালি গা এত দৃষ্টিকটু লাগে না।

কিন্তু এঁর সবটাই যেন একটা অশ্লীল স্থূলতা।

ডাবর থেকে একটা পান তুলে নিয়ে তার নীচের কোণটুকু দাঁতে কেটে থু করে ফেলে দিয়ে, সেটিকে মুখে পুরে কুসুমকামিনী রাশভারী গলায় বলেন, বোসো৷

মীনাক্ষী বসে।

গৃহকর্ত্রীর থেকে হাতখানেক নিচুতে।

কুসুমকামিনী তার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে বলেন, নাম কী তোমার? মীনাক্ষী নাম বলে।

মীনাক্ষী? বেশ নতুন নামটা তো।কুসুমকামিনী তেমনি রাশভারী গলায় বলেন,দিবাকরকে খুঁজতে এসেছিলে?

মীনাক্ষী ইতস্তত করে বলে, খুঁজতে ঠিক নয়, মানে একটু দরকার ছিল। একটা বই দেবার কথা ছিল।

কার কাকে দেবার ছিল, তা অবশ্য বোঝা গেল না।

কুসুমকামিনী কিন্তু বুঝলেন। মুচকি হেসে বললেন, ও সে একই কথা, যার নাম ভাজা চাল তার নামই মুড়ি! খুঁজতে আসোনি, দরকার ছিল! তা ওর কলেজে পড়ো বুঝি?

হ্যাঁ।

কতদিন ভাব?

ভাব।

কতদিনের চেনা নয়, আলাপ নয়, পরিচয় নয়, ভাব।

মীনাক্ষীর মাথা থেকে পা অবধি একটা বিদ্যুৎপ্রবাহ বয়ে যায়। কিন্তু ভাব নেই–এ কথা তো বলা চলে না। কী করতে তবে এসেছে সে?

মীনাক্ষী রুক্ষ গলায় বলে, যতদিন একসঙ্গে পড়ছি।

অ। তা ভাল। তা কোনওদিন তো আসতে দেখিনি। আজ হঠাৎ

বললাম তো একটা বইয়ের দরকার ছিল।

তবে যে নবনে বলছিল, মামাকে চেয়েছ, মামিকে চেয়েছ—

বিপন্ন বোধ করে মীনাক্ষী, বুঝতে পারে, ফাঁদটা নিজেই পেতেছে। অতএব সোজা হতে হবে, শক্ত হতে হবে। ফাঁদে জড়িয়ে পড়া চলে না। অতএব মাথা তুলে বলে, আমার ধারণা ছিল ওঁর মাও এখানে থাকেন, মামার বাড়ি যখন। শুনলাম থাকেন না। কোথায় থাকেন, ঠিকানাটা কী, জানতে চাই।

কুসুমকামিনী এবার শিথিল ভঙ্গি ত্যাগ করে নড়েচড়ে বসেন। তীক্ষ্ণ গলায় বলেন,কেন বলো তো? হঠাৎ ওর মাকে কী দরকার?

আছে দরকার।

কেন? ছোঁড়া কোনও বিপদে-আপদে পড়েনি তো?

না, বিপদ হবে কেন?

তবে বুঝি বে?

ব্রজবালা মুচকি হেসে বলে ওঠে, ও মা, বোধহয় দিবুদার বের ঘটকালি করতে এসেছেন ইনি৷

কুসুমকামিনী নকল ধমকে বলেন, তুই থাম তো বেজো।

বেজো।

তার মানে ব্রজ।

তার মানে ব্রজবালা।

তার মানে ভুল বাড়ি নয়।

অতএব আশার ক্ষীণ শিখাটুকুও নিভে গেল।

মীনাক্ষী বলল, আচ্ছা আমি যাই।

ওমা সে কী! বাড়িতে এয়েছে ভদ্রলোকের মেয়ে, অমনি ছাড়ব? একটু চা-জলখাবার খেয়ে যেতে হবে।

কুসুমকামিনী যে বাস্তবিকই এত অতিথিবৎসলা তা নয়, তবে মেয়েটাকে এক্ষুনি উঠতে দিতে ইচ্ছে নেই। তাই ওই চা-জলখাবারের ফাঁদ।

মীনাক্ষী অবশ্য-এ ফাঁদে পা দেয় না।

নিজের পাতা ফাঁদ থেকে উদ্ধার পেতে পারলে বাঁচে এখন সে।

তাই বলে, না, এখন কাজ আছে। দিবাকরবাবু এলে বলবেন মীনাক্ষী মৈত্র এসেছিল।

আহা তা তো বলবই। তবে কী উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলে তা তো কই বললে না?

কতবার বলব? বললাম তো একটা বইয়ের জন্যে

অ! আমার আবার ভুলো মন, ভুলে যাই। তা দিবার মার কাছেও তা হলে ওই বইয়ের জন্যেই দরকার? মাগী আবার এত বিদ্যেবতী হল কবে লো? অ বেজো।

কুসুমকামিনী হি হি করে হাসতে থাকেন।

কুসুমকামিনী যদি অন্য কোথাও মীনাক্ষীর মতো মেয়েকে দেখতেন, অবশ্যই রীতিমত সমীহর দৃষ্টিতে দেখতেন। কলেজে পড়া মেয়েদের প্রতি ভয় সমীহ সবই আছে তাঁর। তবে এক্ষেত্রে আলাদা। এ হচ্ছে দিবাকরের লভ-এর মেয়ে। অতএব এর সম্পর্কে এর চাইতে সভ্য ব্যবহার করার প্রশ্ন ওঠে না। যে মেয়ে দিবাকরকে পুজি করতে পারে, তার আবার মান-সম্মান।

তার ওপর আবার জাতে বামুন।

বামুনের মেয়ে হয়ে সদগোপের ছেলেকে! ছি! অবিশ্যি যার সঙ্গে যার মজে মন–এ হচ্ছে শাস্ত্রের কথা। কিন্তু হাতের কাছে এমন একটা মজার বস্তু পেলে কে না মজা করে ছাড়ে?

মীনাক্ষী আরক্ত মুখে উঠে দাঁড়ায়, বলে, আমার ভুল হয়েছিল। আচ্ছা—

মীনাক্ষী বেরিয়ে আসে।

কিন্তু ব্রজবালা হঠাৎ খাট থেকে নেমে ওর পিছু পিছু আসে। যদিও ওই আসাটা মোটেই দৃষ্টিসুখকর হয় না। একেই তো শরীরটা তার ভারী হয়ে গেছে, তার উপর জামাকাপড় যেন এলিয়ে পড়া। যেন দেহটাকে না ঢেকে উপায় নেই, তাই কোনওরকমে ঢেকে রেখেছে।

তবু আসে তাড়াতাড়ি।

চুপি চুপি বলে, মায়ের কথাবার্তার ধরনই অমনি৷ ছিরিছাঁদ নেই। রাগ করবেন না। আপনার সঙ্গে বুঝি দিবুদার ভালবাসা আছে?

মীনাক্ষী ফিরে দাঁড়ায়।

মীনাক্ষী তীব্র গলায় বলে, হঠাৎ আপনাদের এমন একটা অদ্ভুত ধারণার হেতু কী? ভালবাসা ছাড়া কেউ কাউকে খোঁজে না? কারুর সঙ্গে কারুর দরকার থাকতে পারে না?

ব্রজবালা এই তীব্রতায় থতমত খায়।

ব্রজবালা ভেবেছিল, এ মেয়ে দিবুদা বর্ণিত সেইসব মেয়ের একজন। যে মেয়েরা নাকি নীতিধর্ম সতীধর্ম কোনও কিছুকেই কেয়ার করে না। যারা নাকি সহজেই এমন সব ভয়ংকর কাণ্ড করে বসে, যা শুনলে ব্রজবালার হৃদকম্প হয়।

কিন্তু সেসব মেয়ের কি কেবলমাত্র একটু ভালবাসার কথায় এমন প্রচণ্ড রাগ আসে? ব্রজবালা তাই মলিন গলায় বলে, না না, এমনি ভাবলাম–

ও রকম ভাবনা আর ভাববেন না।

রেগে আগুন হয়েই নামছিল, তবু সিঁড়ির পাশের ঘরটার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মীনাক্ষী। বলে, এই ঘরটা বুঝি দিবাকরবাবুর? দেখতাম বইটা যদি থাকে।

বানিয়েই বলল অবশ্য।

ঘরটা এ বাড়ির পক্ষে ছিমছাম এবং সরু খাট, ছোট টেবিল, হালকা বুক শেলফ ইত্যাদিতে একটি একক ছাত্রের উপস্থিতির ছাপ। দেখে মনটা তবু একটু নরম হল।

হয়তো এ বাড়ির এই পরিবেশটা দিবাকরকেও পীড়িত করে, তাই তার মধ্যে থেকেই নিজের মতো একটু ছিমছাম হয়ে থাকে।

কিন্তু সে নরমটা মুহূর্তেই কঠিন হয়ে উঠল।

ব্রজবালা অবাক গলায় উত্তর দিল,দিবুদার? না তো? এ ঘরে আমার মামার ছেলে থাকে। পড়ে কিনা? আট নটা ক্লাস পড়া হয়ে গেছে তার। তিনতলায় গোলমাল, তাই এখানে খুব ইয়ে ছেলে। বলে–অনেক পড়ব, বিলেত যাব।…দিবুদা ব্রজবালা একটু ঢোক গিলে বলে, দিবুদা নীচতলায় থাকে। নবীনকে দেখলেন তো? ওই ওর ঘরে। আমি বলেছিলাম, ও লেখাপড়া করে, ওর একটা ভাল জায়গা, তা মা বলে কি, ধান সম্পর্কে পোয়াল মাসি। কোন ডালপালার ভাগ্নে আমার, ওর জন্যে আমি রাজ আদর করতে বসব নাকি?… আমার ওই মা-টি না মোটেই সুবিধের নয় বুঝলেন? আর কেপ্পনের জাসু৷

কথা বলতে বলতে নেমে এসেছে দুজনেই।

মীনাক্ষী নীচের উঠোনে নেমে বলে, আচ্ছা নমস্কার! অনেক উপকার করলেন আমার, তার জন্যে ধন্যবাদ।

বেরিয়ে যায়।

এগোতে থাকে।

সমস্ত শরীর যেন শিথিল হয়ে ধসে পড়তে চায় তার।

পৃথিবীতে যেন বাতাস নেই। আকাশে যেন আলো নেই।

আর কোথাও কোনও আশ্বাস নেই।

দিবাকরকে খুব একটা মহৎ অবশ্য কোনওদিনই ভাবে না সে, তাই বলে এত জোচ্চোর দিবাকর?

এ কী আপনি?

রাস্তার মোড়ে যেন ভূত দেখল দিবাকর। এখানে মীনাক্ষী! তার মানে তাদের বাড়িতেই এসেছিল। তার মানে যা বলেছিল, তাই করে ছেড়েছে। বলেছিল,ঠিক আছে, নিয়ে না যাও, নিজেই যাব।

তা হলেও দিবাকর মীনাক্ষীর সেই সংকল্পটাকে আমল দেয়নি। ভাবেনি সত্যি আসবে।

কিন্তু এখানে ঠিক ওদের বাড়ির মোড়ে আর কোন মহৎ কাজে আসবে মীনাক্ষী?

রাগে সমস্ত শরীর জ্বালা করে ওঠে দিবাকরের। মেয়েমানুষের এত মর্দানি? উঃ! ঠিকানাই বা পেল কোথায়? আর এসে দেখলটা কী?

নির্ঘাত দিবাকরের থাকার জায়গাটা দেখিয়েছে কেউ। নির্ঘাত নবনে বদমাইশ অনেক কিছু গল্প করেছে।… নির্ঘাত মামি আর ব্রজবালা যা-তা প্রশ্ন করেছে।

তার মানে সর্বস্ব ঘুচিয়েছে দিবাকরের।

এখন কোন বালুকণায় এই সমুদ্র বাঁধবে দিবাকর? কোন ছুঁচে রিপু করবে এই প্রচণ্ড গহ্বর?

তা ছাড়া জানাও তো নেই, কতটা কী জেনেছে মীনাক্ষী।

দিবাকরের কতখানি উদঘাটিত হয়েছে।

তুমি এখানে?

এ প্রশ্নের মধ্যে বিস্ময়ের চেয়ে অনেক বেশি ফোটে বিপদে পড়ার সুর।

মীনাক্ষী সেই সুর ধরতে পারবে এটা আশ্চর্যের নয়। মীনাক্ষী তাই দাঁড়িয়ে পড়ে তীব্র ব্যঙ্গের গলায় বলে, বড্ড অসুবিধেয় ফেলে দিলাম, তাই না?

না না, আমার অসুবিধে কী? তোমারই

আমার কথা থাক।মীনাক্ষী ঠিকরে ওঠে,আমার কোনও অসুবিধেই নেই। অসুবিধেটা তোমারই। এতদিন ধরে এত কৌশল করে ধাপ্পার সুতো বুনে বুনে যে মিথ্যের জালটি রচনা করেছিলে, সেটি ছিঁড়ে গেল, তোমার স্বরূপ বেরিয়ে পড়ল, অসুবিধে নয়?

দিবাকর প্রথমটা জাল দিয়ে জল ধরতে যায়, নুন দিয়ে নদী বাঁধতে যায়, দিবাকর তার মিথ্যের জালে নতুন ধাপ্পার সুতো লাগায়, কী হল কী? ব্যাপারটি কী? কার সঙ্গে দেখা হল? বেজায় পাজি একটা চাকর আছে আমাদের বাড়িতে, ইয়ারের রাজা! সে বুঝি কিছু

দিবাকর! মিথ্যের জালে আর নতুন মিথ্যে জুড়ো না। বড় ঘৃণা হচ্ছে। শুধু তোমার উপরই নয়, নিজের উপর, পৃথিবীর উপর।

মীনাক্ষী চলে যেতে উদ্যত হয়।

কিন্তু দিবাকর পথ আগলায়।

দিবাকর কোনওমতে মুখে হাসি টেনে এনে বলে, কিন্তু কী হল সেটা তো বলবে? মামির প্রকৃতিটা অবশ্য ভাল নয়, দুর্বাসার মহিলা সংস্করণ। কিন্তু গালমন্দ খেয়ে এলে বুঝি?

দিবাকর, আর কষ্ট দিও না–মীনাক্ষীর চোখে জল আসছিল, সে জলকে আগুনে পরিণত করে মীনাক্ষী বলে, খড় দিয়ে আগুন ঢাকতে যেও না দিবাকর! হিমালয় পাহাড় ফুয়ে ওড়ানো যায় না। তুমি যে কী, তা ভালই জেনে গেছি আমি।

মীনাক্ষী!

হঠাৎ দিবাকরের মুখের চেহারার অদ্ভুত একটা পরিবর্তন ঘটে। দিবাকরের সেই কাঠ কাঠ আঁট-আঁট মুখটা যেন ঝুলে পড়ে। দিবাকরের পুরু পুরু ঠোঁট দুটো যেন নেতিয়ে পড়ে, দিবাকরের ছোট ছোট করে ছাঁটা চুলগুলোও এলিয়ে যায়।

দিবাকর কাঁপা কাঁপা থরথরে গলায় বলে, জানতাম! আমার এই তাসের অট্টালিকা টিকবে না। কিন্তু কী করব মীনাক্ষী, এ ছাড়া কোনও উপায় ছিল না আমার! জানি আমি ঠগ-জোচ্চোর, মিথ্যেবাদী, কিন্তু এসব কেন জানো মীনাক্ষী? আমি বড় গরিব! রাস্তার ভিখিরিরও অধম। আমার সেই দারিদ্র্যের লজ্জা তোমার কাছে উদঘাটন করতে পারিনি। আমার মনে হয়েছে, এ দিনকে একদিন না একদিন আমি জয় করবই, একদিন আমি মানুষ নামের যোগ্য হব, সেই কদিন শুধু এই পাতার ছাউনিতে মাথা ঢেকে–

মীনাক্ষীর ওই বেদনাকাতর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে, মীনাক্ষীর সেই লোহা হয়ে ওঠা মনটা ঈষৎ নরম হয়, মীনাক্ষী স্থির গলায় বলে, গরিব হওয়াটা অপরাধ নয় দিবাকর!

আমি মনে করি অপরাধ–দিবাকরের ঝুলেপড়া চেহারাটা আবার যেন একটু সতেজ হয়, যেন পায়ের নীচে আবার একটু মাটি পেয়েছে দিবাকর, যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আবার বড় বড় কথা বলতে পারবে। বলতে পারবে জোরালো গলায়, আমি মনে করি অপরাধ। কারণ অক্ষমতাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় অপরাধ মীনাক্ষী! আর দারিদ্র্য তো অক্ষমতারই সন্তান।

মীনাক্ষী তবু প্রতিবাদ করে ওঠে, তা হোক দিবাকর, মিথ্যের মতো অপরাধ আর কিছু নেই। আমি ভাবতে পারছি না যে, তুমি দিনের পর দিন এইভাবে মিথ্যের প্রাসাদ বানিয়ে বানিয়ে আমাকে ঠকিয়েছ। মামার বাড়ির চাকর নবীনের সঙ্গে এক ঘরে থাকো তুমি। তোমার মা জীবনে কলকাতায় আসেননি। আর তোমার আত্মীয়রা–

চুপ করে যায় মীনাক্ষী।

গলাটা বন্ধ হয়ে যায় বলেই চুপ করে যায়।

দিবাকরের চোখের তারায় অলক্ষ্যে আগুন জ্বলে। দিবাকরের মুখের পেশিতে যেন একটা মতলবের ভাঁজ পড়ে। কিন্তু দিবাকর রুদ্ধকণ্ঠে বলে, মীনাক্ষী, তুমি যদি একটা সুযোগ আমায় দাও, আমার সমস্ত কথা বলার জন্যে একটুখানি সময়

মীনাক্ষী আবার ক্রুদ্ধ ব্যঙ্গের গলায় বলে, সময়? যাতে আরও একবস্তা ধাপ্পা তৈরি করে ফেলতে পারো?

দিবাকরের মুখের চেহারা আবার দপ করে নিভে যায়। দিবাকর পাকা অভিনেতার মতো সেই নিভে যাওয়া মুখের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা বিষণ্ণ গলায় বলে, আচ্ছা ঠিক আছে, থাক, জানতাম আমার দারিদ্র্য প্রকাশ হয়ে পড়লেই তুমি আমায় পরিচিতের মর্যাদা দিতে অস্বীকার করবে–

থামো। নাটক রাখো- মীনাক্ষী রূঢ় গলায় বলে, যে দারিদ্রটা প্রকাশ হয়ে পড়েছে দিবাকর, সেটা তোমার চরিত্রের। অবস্থার দারিদ্র্য লজ্জার নয়, চরিত্রের দারিদ্রই লজ্জার।

অবস্থাই চরিত্রকে মুচড়ে দুমড়ে বিকৃত করে ফেলে মীনাক্ষী! ওই যে আমি মামার বাড়িতে থাকি, প্রতিক্ষণ কি মনে হয় না এই গ্লানি থেকে মুক্ত হই, কিন্তু কী করব? যতদিন কলেজে পড়তে হবে, ততদিন এইভাবে কুকুরের মতো পড়ে থাকতে হবে।

মীনাক্ষী মলিন হয়। বলে, বুঝতে পারছি তোমার দেশের জমিদারির গল্পও আরব্য উপন্যাসের গল্প। কিন্তু এ আমি কোনও যুক্তিতেই বরদাস্ত করতে পারি না দিবাকর! এরপর আর তোমার কোন কথাটা বিশ্বাস করতে পারব আমি?

দিবাকর মাথা হেঁট করে।

দিবাকর আস্তে বলে, তোমার সঙ্গে আমার সামাজিক অবস্থার আকাশ-পাতাল তফাত, অথচ তোমার কাছে পৌঁছবার দুর্দমনীয় বাসনা, তাই মিথ্যের সিঁড়ি দিয়ে আকাশে উঠতে চেয়েছিলাম। যাক, শিক্ষা হয়ে গেল। হয়তো জীবনে আর দেখা হবে না, এই শেষ। আচ্ছা চলি।

মীনাক্ষী ক্রুদ্ধ গলায় বলে, এই শেষ, জীবনে দেখা হবে না, এসব কথার মানে কী? বিষ খাবে? না গলায় দড়ি দেবে?

ভাবছি।

ন্যাকামি রাখো। তোমার ওই অদ্ভুত মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করো। জোচ্চুরি ধাপ্পাবাজি ছেড়ে মানুষের মতো মানুষ হবার সাধনা করো।

ততদিন কি তুমি আমার জন্যে বসে থাকবে মীনাক্ষী?

দিবাকরের স্বর করুণ।

এ যেন আর এক দিবাকর।

মীনাক্ষীর মমতা আসে উদ্বেল হয়ে।

মীনাক্ষীর বুকের মধ্যেকার সেই চিরন্তন নারী অপরাধীকে ক্ষমা করে বসে। মীনাক্ষী ওর ওই ম্লান কণ্ঠ, বিষণ্ণ মুখ, আর অপরাধী দৃষ্টিকে বিশ্বাস করে বসে। তাই বলে,আচ্ছা, সে দেখা যাবে। তুমি ওখানটা ছাড়বার চেষ্টা করো তো।

মীনাক্ষী ভাবে ওখানটা ছাড়লেই বুঝি দিবাকর সুন্দর হয়ে উঠবে, সত্যের মর্যাদা দিতে শিখবে।

মীনাক্ষী, তা হলে একবার তোমাকে আমার মার সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি আমার মাকে তোমায় দেখাব।

তোমার মা? তিনি তো দেশে থাকেন শুনলাম। অথচ তুমি দিনের পর দিন

আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি মীনাক্ষী, আমি কান মলছি—

থাক, থাক, রাস্তার মাঝখানে আর সিন করতে হবে না। তবে তোমার সঙ্গে দেখা হল তাই। দেখা না হলে হয়তো জীবনে আর তোমায় ক্ষমা করতে পারতাম না।

দিবাকরও সেটা বুঝতে পারে।

দিবাকর কিছুক্ষণ আগে যে দেখা হওয়াটায় আড়ষ্ট হচ্ছিল, এখন সেটাকে ভাগ্যের দান মনে করে। নিজের অভিনয় ক্ষমতার উপর ওর অগাধ আস্থা। যখন যেমন দরকার, চালিয়ে নিতে পারবে। এতদিন মীনাক্ষীকে ডাউনকরে এসেছে, এখন অবস্থা বুঝে সম্পূর্ণ উলটোপথ ধরছে।

এখন দেখছে ওকে আয়ত্ত করবার অন্য পথ আবিষ্কার করতে হবে। মোটকথা, একবার জব্দ করে ফেলতে পারলেই এইসব সতী প্যাটার্নের মেয়েদের কজায় আনা যায়।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ কথা চালিয়ে যাওয়া এ পাড়ায় দৃষ্টিকটু। এ দক্ষিণ কলকাতা নয় যে, বিকেল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত পথে শুধু যুগল মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। যাদের ভঙ্গিতে থাকে–এই দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলছি, এখুনি ছাড়াছাড়ি হবে। কিন্তু ঘণ্টা, দু ঘণ্টা সেই অবস্থাই চলতে থাকে।

এখানে পথচারীরা বারবার তাকাচ্ছিল।

তবু দিবাকর হেস্তনেস্তটা করে নিতে চায়। তার সেই দীনহীন গ্রামে, ততোধিক দীনহীন কুটিরে তার দীনদুঃখী মা-টিকে একবার দেখাতে চায় মীনাক্ষীকে।

মীনাক্ষী শুধু তার বড়লোক আত্মীয়দেরই দেখল, যাদের মধ্যে শুধু অহংকার, শুধু নীচতা। কিন্তু দিবাকরের সেই পর্ণকুটিরবাসিনী মা?

না, নিজমুখে তার কথা আর বলবে না দিবাকর।

বলেছে, অনেক বলেছে। মায়ের গল্প কেন করত তা বলেছে

কিন্তু কেন জানো মীনাক্ষী দিবাকর উদার উদাস স্বপ্নালু গলায় বলে, আমি যে মায়ের কাছ থেকে অনেক দূরে পড়ে আছি, আমার যে মনের কথা বলবার কেউ নেই, এটা ভাবতে ইচ্ছে করে না। তাই–দিবাকর চুপ করে যায়।

এবং শেষ পর্যন্ত মীনাক্ষীকে বাক্যদত্ত করিয়ে নেয়, কোনওমতে একটা দিনের জন্যে সুযোগ সৃষ্টি করে দিবাকরের সঙ্গে দিবাকরের গ্রামে যাবে।

বাংলাদেশের হতভাগ্য গ্রামকে একবার চোখে দেখাও দরকার মীনাক্ষী দিবাকর জোরালো গলায় বলে,দেখতে পাবে আসলে আমরা কী! আসলে আমরা কোথায় পড়ে আছি। যে শহরটাকে দেখে গর্বে পুলকিত হয়ে ভাবি আমরা কত এগিয়ে গেছি, সেই শহরটা এই বিরাট দেশের কতটুকু অংশ? বললে বিশ্বাস করবে, এখনও আমাদের গ্রাম এবং তার মতো হাজার গ্রাম মোটরগাড়ি কেমন তা চোখে দেখেনি? ইলেকট্রিক আলো তাদের কাছে রূপকথার গল্প। লক্ষ লক্ষ লোক রেলগাড়ি চড়ার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বুড়ো হয়ে মরে যায়। স্নানের জন্যে যে আলাদা একটা দরজা বন্ধ ঘর থাকতে পারে, এ তারা কেউ জানে না। জানে না–অসুখ করলেই তখুনি ডাক্তার পাওয়া যায়।…

দিবাকর একটু দম নেয়।

কিছুদিন আগে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শোনা কোনও এক সমাজসেবীর মেঠো বক্তৃতার খানিকটা ঝাড়া মুখস্থ বলে ফেলতে পেরে রীতিমত পুলকিত হয় দিবাকর।…এ ধরনের কথাগুলো যে তার পূর্বমতের বিরোধী তা খেয়াল করে না।

খেয়াল মীনাক্ষী করে।

ওর দম নেওয়ার অবসরে বলে, সেকথা তো আমিও বলি। তুমিও তো কেবল আমাদের সমাজের অন্ধতা আর কুসংস্কার নিয়ে সমালোচনা করো। আর ও-দেশ দেখাও। আমিই বলি ও-দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে আমাদের যতকিছু পুরনো সংস্কার ভেঙে ফেলার লড়াইয়ে যদি জিতেই যাও তোমরা, তোমাদের সেই প্রগতির রাজ্যটা ভোগ করবে কাদের নিয়ে? ওই তোমার লক্ষ লক্ষ অবোধ অজ্ঞান হতদরিদ্র দেশবাসীই তো তোমার সম্বল? সংস্কারমুক্তির সংগ্রাম নিয়ে কত মাথাব্যথা হবে তাদের, যাদের পেটের ভাতের সংস্থান নেই? তুমিই লম্বা লম্বা কথা বলে আমায় ডাউন করে ফেলতে চাও। তুমিই বলো সতীত্ব, পবিত্রতা এইসব শব্দগুলো পুরুষের অধিকার রক্ষার সুবিধেয় তৈরি। আসলে একেবারে মানেহীন। মেয়ে-পুরুষের সমান অধিকার থাকা উচিত। নিজের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অধিকার। কিন্তু নিজেই দেখাচ্ছ দেশের এই অন্ধকার ছবি। অধিকার শুধু দিলেই হয় না। অধিকার বোধটা জন্মাবার শিক্ষাও দিতে হয়। না হলে সেটা অস্ত্রশিক্ষা না দিয়ে অস্ত্রের অধিকার দেওয়ার মতোই হবে। কিন্তু থাক, রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেক লেকচার দেওয়া হল। তবে একটা কথা বলে যাচ্ছি, যেটা সব কথার শেষ কথা। ব্লাফ দিয়ে শেষরক্ষা হয় না।

দিবাকরের ভিতরটা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছিল।

দিবাকরের ইচ্ছে হচ্ছিল ওই নাক-উঁচু মেয়েটাকে ধরে একেবারে ছিঁড়েখুঁড়ে শেষ করে দেয়। মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের মতন থাক, তা নয়, নিজে তেড়ে এসেছেন বিয়ের ফয়সালা করতে! এতদিন ধরে এত কষ্ট করে নিজেকে লোকসমাজে চরে বেড়াবার মতো একটা পরিচয় বানিয়েছিলাম, উনি এসে তাকে তছনছ করে নিলেন। …উঃ! ভাবলে আমার জ্ঞান থাকছে না। আমার যে কী পোজিশান, তা সবাইকে বলে বেড়াবে নিশ্চয়। আমাকে বিয়ে করার বাসনাটা তো উপে গেল, বলে বেড়াতে আর আপত্তি কী?

…গরিব আমি চিরদিন থাকব না, তোদর মতো বড়লোকের নাকে ঝামা আমি ঘষব, এই আমার প্রতিজ্ঞা, তা সে যে কোনও পথেই হোক।… টাকা তো পৃথিবীর ধুলোয় পড়ে আছে, সেই ধুলো কুড়োতে পারলেই হল। শুধু একটু বিদ্যে করে নেওয়া দরকার। ভেক না হলে হয় না। তোদের ওই পণ্ডিত সমাজে, সভ্য সমাজে চরে বেড়াতে না পারলে তো প্রতিষ্ঠা নেই, তাই এমনি করে কুকুরের মতো পড়ে আছি প্রকাশ মণ্ডলের বেয়াদপ চাকরের ঘরে। গিন্নির আদুরে চাকর, তাই তার এত দাপট! সেই হতভাগাই বোধ হয় আমার নামে যা-তা বলেছে। আচ্ছা, এইসা দিন নেহি রহেঙ্গা।

মনের কথা কেউ টের পায় না, তাই মানুষের পৃথিবীটা আজও চালু আছে। নচেৎ কবেই ধ্বংস হয়ে যেত।

কিন্তু মন বস্তুটা বায়ুশূন্য কৌটোয় রক্ষিত, ওর থেকে আওয়াজ বেরিয়ে ছড়ায় না। তাই ওই কটুক্তিগুলোর মানসিক উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দিবাকর মুখে নভঙ্গিতে উচ্চারণ করে, মীনাক্ষী, আসবে তো আমাদের কুঁড়েঘরে?

মীনাক্ষী দ্বিধাগ্রস্ত হয়, কিন্তু গিয়ে কী হবে বলতে পারো?

দিবাকরের বিস্ফারিত ধরনের চোখদুটো মলিন হয়, কিছু না মীনাক্ষী, শুধু আমার মাকে একবার তোমায় দেখাব। আমার মতো হতভাগারও যে একটা ঐশ্বর্য থাকতে পারে শুধু সেইটুকুই

কিন্তু কী বলব বাড়িতে?

যা হোক। যা তোক একটা কিছু বোলো। একটা রাত, লোকে তো বন্ধু বান্ধবের বিয়েতেও বাইরে কাটাতে পারে।

রাত। মীনাক্ষীর চমকে ওঠাটা অস্পষ্ট থাকে না। রাত কেন?

তা ছাড়া তো সুবিধেমতো আর কোনও ট্রেন নেই।…মেদিনীপুর স্টেশনে নেমে তেরো মাইল গোরর গাড়িতে যেতে হয়। চলো মীনাক্ষী, শুধু আমার মাকেই নয়, এই বাংলাদেশটার সত্যিকার চেহারাও একবার দেখবে চলো।

দিবাকরের কণ্ঠে তার স্বভাববিরুদ্ধ আবেগ ফোটে।

আর সেই তার সর্বদা প্রজ্বলিত ভঙ্গির জায়গায় এই নম্র বিষণ্ণ আবেগকম্পিত ভঙ্গিটা নতুন একটা আকর্ষণ এনে দেয়।

মীনাক্ষী রাজি হয়।

মীনাক্ষী এবার এগিয়ে গিয়ে বাস-এ চড়ে। দেখতে পায় না পেছন থেকে দুটো জ্বলন্ত গোলক তাকে ভস্ম করবার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

.

যদি মীনাক্ষী আজ এই দুঃসাহসিক অভিযানে পা না বাড়াত, হয়তো মীনাক্ষীর জীবন সম্পূর্ণ অন্যরকম হত।

যদি আজ ফেরবার সময় তার জীবনের রাহুর সঙ্গে দেখা হয়ে না যেত, হয়তো মীনাক্ষীর জীবন অন্য মোড় নিত না। কিন্তু মীনাক্ষী দুঃসাহসের পথে পা বাড়িয়েছিল, মীনাক্ষী নির্বুদ্ধিতার ফাঁদে গলা দিতে রাজি হয়েছিল।

আর মীনাক্ষী চলতে চলতে পিছন ফিরে তাকাতে ভুলে গিয়েছিল।

তাকালে হয়তো ওই জ্বলন্ত গোলকদুটোই ওকে সাবধান করে দিত।

.

সরোজাক্ষর বেশি অসুখের সময় পর পর কদিন তাঁকে দেখতে এসেছিলেন কাকিমা হৈমবতী দেবী। কতদিন যেন পরে আজ আবার এলেন এবাড়িতে।

প্রায় সমবয়েসী এই ভাসুরপোটির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক একাধারে স্নেহের, শ্রদ্ধার, বন্ধুত্বের, তথাপি এ-বাড়িতে তিনি কদাচই আসেন।

হৈমবতী সুন্দরী নন, কিন্তু সুশ্রী।

এই শ্রী তাঁর সর্বাঙ্গে দীপ্যমান।

সুষমা শব্দটির যে অর্থ, সেটা নতুন করে উপলব্ধি হয় হৈমবতাঁকে দেখলে। এই প্রৌঢ় বয়েসেও তাঁর আপাদমস্তক একটি ছন্দোময় সুষমায় মন্ডিত। দেখলে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, দেখলে সম্ভ্রম জাগে।

হালকা-পাতলা ছোটখাটো চেহারা, কিন্তু তাতে তারল্য নেই, আছে একটি মার্জিত গাম্ভীর্য। অথচ ব্যবহারিক অর্থে গম্ভীর তিনি আদৌ নন। কথায় ধার আছে, কৌতুক আছে, সৌন্দর্য আছে।

হৈমবতী এসে বসলে, তাঁকে ঘিরে যেন আপনিই একটি উজ্জ্বল পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। হৈমবতী এসে বসলে মনে হয় একটি নির্মল পরিচ্ছন্নতা প্রতীক হয়ে দেখা দিল।

হৈমবতীর প্রতি এ বাড়ির সকলেই আকৃষ্ট, বাদে বিজয়া।

বিজয়া হৈমবতীর আচার-আচরণ সব কিছুকেই নিচু চোখে দেখেন।

হৈমবতী যে বিধবা হয়েও বডিস-ব্লাউজ পরেন, হৈমবতী যে বিধবা হবার পর চুল কেটে ফেলেও সেই চুলে স্যাম্পু করে মুখে তরুণীর শ্রী ফোঁটান, হৈমবতীর চশমা চটি ভ্যানিটি ব্যাগ সব কিছুতেই যে শৌখিন রুচির ছাপ, এটা বিজয়া একেবারে বরদাস্ত করতে পারেন না। আর সেই না-পারাটা চাপতেও চেষ্টা করেন না।

হয়তো সেইটাই হৈমবতীর এবাড়িতে বেশি না আসার কারণ। নচেৎ স্বামীর সম্পর্কের আত্মীয় তো তাঁর আর বেশি নেই। দূর-সম্পর্কিত একটি বেকার ভাগ্নে আছে, সেইটিই হৈমবতীর কর্ণধার।

কিন্তু সে যাক–আজ হৈমবতী তাঁর স্বামীর সম্পর্কিত আত্মীয়-ভবনে বেড়াতে এলেন।

সরোজাক্ষর ছেলেমেয়েরা কেউ হৈমবতাঁকে ঠাকুমা বলে না, বলে কাকি দিদা। এই অদ্ভুত ডাকটি সরোজাক্ষই তাঁর বড় ছেলের শৈশবকালে আমদানি করেছিলেন, পর পর আর নিজনও তাই শিখে গেছে।

বিজয়া এতেও ন্যাকামি দেখেন। ঠোঁট উলটে বলেন,আদিখ্যেতা!ছোট ঠাকুমা বলবে, ফুরিয়ে গেল ন্যাঠা! তা নয় সৃষ্টিছাড়া এক ডাক কাকি-দিদা! ঠাকুমা ডাকলে বুড়ি হয়ে যাবেন যে! চিরযুবতী থাকবেন উনি।

খুড়-শাশুড়ির উপর যেন তাঁর একটা জাতক্রোধ।

এখন না হয় বিধবা হয়েও বিধবার আচরণ সম্যক পালন করেন না বলে রাগ, কিন্তু যখন মহিলাটি সধবা ছিলেন? তখনও তো রাগের কমতি ছিল না।

কাকি- দিদা এসেছেন।

ঠাকুরঘরে গিয়ে জানিয়ে এল মীনাক্ষী।

বিজয়া মুখটা বাঁকিয়ে জোরে জোরে মালা ঘোরাতে লাগলেন।

মীনাক্ষী আবার বলল, শুনতে পেলে? কাকি-দিদা এসেছেন।

এসেছেন তো কী? নাচতে হবে?

বিজয়া নিমপাতা খাওয়া মুখে মালাটা কপালে ছোঁয়ালেন।

নাচবে কি কাঁদবে, তা তুমিই জানো মীনাক্ষী বলে, খবর না দিলেও তো বলবে, নীচে কত ঘটনা ঘটে যায়, কত লোক আসে যায়, আমি টেরও পাইনা। দাসীর মতন এক পাশে পড়ে আছি, ছো করে একটু খবরও দিতে আসে না। বলে গেলাম, এখন তোমার ফুরসত হয় নেমো, না হয় নেমো না।

চলে যায় মীনাক্ষী।

বিজয়া জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলেন, কথা দেখো মেয়ের! যেন মিলিটারি! মার সঙ্গে কথা বলছে, না বাড়ির ঝিয়ের সঙ্গে কথা বলছে বোঝবার জো নেই। আছে, কপালে তোমার অশেষ দুর্গতি আছে। একটা দজ্জাল শাশুড়ির হাতে পড়বে তুমি, এ আমি দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। তখন ওই খরখরানি বেরিয়ে যাবে। উঠতে বসতে কাঁদতে হবে।

বিজয়া এখনও দুই মেয়ের দজ্জাল শাশুড়ির হাতে পড়ে উঠতে বসতে কাঁদবার স্বপ্ন দেখেন। বিজয়ার এখনও মুখস্থ আছে–

হলুদ জব্দ শিলে,
চোর জব্দ কিলে,
দুষ্ট মেয়ে জব্দ হয়
শ্বশুরবাড়ি গেলে।

ওই প্রবাদের ছড়াটা যে সমাজ অনেকদিন হল ভুলে গেছে এটা খেয়াল করেন না বিজয়া। আর খেয়াল করেন না এই অভিশাপ বাণীটি যার উদ্দেশ্যে বর্ষিত হল সে তাঁরই সন্তান।

তা খেয়াল বস্তুটা সংসারে দুর্লভ বইকী! কজনেরই বা যথাযথ থাকে ওটা? খাম-খেয়ালেরই

সেই খামখেয়ালের একটি নমুনাসরোজাক্ষর চাকরি ছাড়ার সংকল্প, আর তার কারণ।

অপমান সয়ে থাকতে পারলাম না–এর পিছনে তবু একটা যুক্তি আছে। একটা বলিষ্ঠ পৌরুষের প্রকাশ আছে। কিন্তু সরোজাক্ষর ভাষ্যটা যে উদ্ভট!

ওই অপমানের ধাক্কায় হঠাৎ তিনি নাকি অনুভব করলেন, এতদিন ছাত্রদের ঠকিয়ে পয়সা নিয়ে এসেছেন! অতএব অনুভব করে ফেলে আর সেটা চালিয়ে যেতে বিবেকে বাধছে।

খাম-খেয়ালের নজির ছাড়া আর কী?

প্রকৃষ্ট নজির।

আরে বাবা, এ-যুগের ছেলেগুলি যে এক-একখানি বিষ্ণুর অবতার, সেটা দেখতে পাচ্ছ না? দেখতে পাচ্ছ না শুধু তোমার পাড়াটি নয়, তোমার দেশটি নয়, দেশে-বিদেশে, সমগ্র পৃথিবীতে ওই ছেলেগুলোই আগুন জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছে?

রাবণের অনাচারে খেপে উঠে লঙ্কা দহনের সংকল্পে ওরা ল্যাজে আগুন বেঁধেছে।

তাতে রাবণের লঙ্কা ধ্বংস হচ্ছে কিনা রাবণই জানে, তবে তাদের নিজেদের ল্যাজগুলো যে পুড়ছে তাতে সন্দেহ নেই, সেই পোড়া ল্যাজের দহনে মুখও পুড়ছে বাছাদের।

মুখ তারা নিজেদের তো পোড়াচ্ছেই, পোড়াচ্ছে আরও অনেক কিছুই। পোড়াচ্ছে সভ্যতা, সংযম, আদর্শ, চক্ষুলজ্জা, লোকলজ্জা, মায়া-মমতা, শালীনতা, সৌকুমার্য। কে জানে এই ধ্বংসস্তৃপের উপর কোন স্বর্গ রচনার স্বপ্ন দেখছে ওরা?

না কি স্বপ্ন-টপ্ন কিছু নেই ওদের। শুধু হঠাৎ হাওয়ার সুযোগ নিয়ে নিজেদের সমস্ত ক্রটি, নিজেদের সমস্ত দৈন্য ঢাকা দিতে চাইছে দাবির লড়াইয়ের ছদ্মবেশ দিয়ে।

তা নইলে ক্ষেত্ৰ-অক্ষেত্র মানছে না কেন ওরা? প্রয়োজন-অপ্রয়োজন মানছে না কেন? কারণে-অকারণে যেখানে-সেখানে আর যখন-তখন আগুন জ্বেলে তুলছে কেন? অর্থাৎ আসল লক্ষ্য ওই জ্বালাটাই।

নাঃ, লঙ্কা দহনে মন নেই বাপু ওদের, আপন আপন হৃদয়ের দাহ নিবৃত্ত করতেই ছটফটিয়ে বেড়াচ্ছে। যা-তা করছে।

তা নইলে সরোজাক্ষর মতো চিরশান্ত চিরসৌম্য অধ্যাপককে ঘেরাও করে বসে অপমান করে?

কিন্তু মহৎ প্রাণ সরোজা ওদের দোষ দেখছেন না, দোষ দেখছেন নিজের। তবে কেন বলা যাবে না জগৎ সংসারে খেয়ালের চেয়ে খাম-খেয়াল বেশি?

হৈমবতীও মৃদু হেসে বলেন, লোকে কিন্তু তোমাকে খামখেয়ালি বলে বদনাম দিচ্ছে।

হৈমবতী এ প্রসঙ্গ তুলতে আসেননি।

হৈমবতী এসেছিলেন সরোজাক্ষর কাছে কয়েকটা বই নিতে। তবু উঠে পড়ল প্রসঙ্গটা।

বলতে কী সরোজাক্ষই উঠিয়ে ফেললেন।

হৈমবতী এসে ঘরে ঢুকতেই সরোজাক্ষর মুখটা খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল, সেই খুশি-খুশি মুখেই হেসে বলে উঠলেন, কী, তুমিও কি এক-পালা উপদেশ বর্ষণ করতে এলে? কিন্তু দোহাই তোমার, আর যে করে করুক তুমি কোরো না।

হৈমবতী প্রথমটা বিস্মিত হলেন, কারণ হৈমবতীর স্মরণে ছিল না সরোজাক্ষর উপর একহাত নেওয়ার একটি সুযোগ এসেছে।

তবু একটু থতমত খেয়েই বুঝে নিলেন ব্যাপারটা। আর সঙ্গে সঙ্গে হেসে বললেন, কেন, আমি নয় কেন? আমি তোমার গুরুজন না? উপদেশ বর্ষণের রাইট অবশ্যই আছে আমার।

সব সময় সব রাইট প্রয়োগ করতে নেই।

বাঃ সুযোগ পেলে কে ছাড়ে? লোকে তোমায় খাম-খেয়ালি বলে বদনাম দিচ্ছে তা জানো?

লোকে দিচ্ছে! তুমি তো দিচ্ছ না? মৃদু হেসে বলেন সরোজাক্ষ।

বা রে, আমিই বা নয় কেন? আমি কি তোক ছাড়া?

খুব শান্ত গলাতেই বলেন, তবু হৈমবতীর মুখে একটি সরসতার উজ্জ্বল দীপ্তি ফুটে ওঠে।

সরোজাক্ষ হেসে বলেন, আমার তো তাই ধারণা।

ভুল ধারণা! আমি ওই লোকেদেরই দলে। আমিও তো বলছি এটা তোমার খাম-খেয়াল! আমি ওদের ঠকিয়ে খাচ্ছিলাম হঠাৎ এমন একটা দৃঢ় ধারণা করে বসবার মানে হয় না। তোমরাও একদা ছাত্র ছিলে এবং তোমাদের যাঁরা শিক্ষক ছিলেন তাঁরা সকলেই কিছু মহাপুরুষ ছিলেন না, খুঁজলে তাঁদের বিরুদ্ধেও অনেক তথ্য বেরোতে পারে, তবু তোমরা এখনও তাঁদের নামে সশ্রদ্ধ হও, এখনও কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে স্যার!বলে বিগলিত চিত্তে আভূমি প্রণিপাত করো। করো না কি?

আমরা হয়তো একটা নির্বিচার পূজার মন্ত্রেই দীক্ষিত ছিলাম তাই! এ-যুগ ওই নির্বিচার পূজায় বিশ্বাসী নয়। গুরুজন বলেই তিনি শ্রদ্ধাভাজন একথা এ-যুগ মানে না।

বিচার করতে বসলে বিচারের শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা আমাদের মতো মুখ মানুষের চেয়ে পণ্ডিত মানুষ তোমরাই ভাল বুঝবে। আর সেটা চিরকালই আছে। ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়–এটা নেহাত এ-যুগের কথা নয়। বুঝলাম নির্বিচারে মানবে না, কিন্তু বিচার করবারও একটা অধিকার থাকা দরকার নয় কি? বিচারবুদ্ধিটা না জন্মাতেই যদি বিচারকের ভূমিকা নিয়ে বসে

সরোজাক্ষ একটা নিশ্বাস ফেলেন।

কারণ সরোজাক্ষ নিজেও একথা বেশ কয়েকদিন ধরে ভেবেছেন। ভেবেছেন ওরা অর্বাচীন। ভেবেছেন ওরা উত্তপ্ত মস্তিষ্ক হিতাহিত জ্ঞানশূন্য। তবু বিবেক সুস্থির হতে দেয়নি। তবু মনে হয়েছে, এ সমস্তই আমাদের ত্রুটির ফল। আমাদের গলতি। আমাদের অক্ষমতার নিদর্শন।

অনেক ভেবে ভেবে তবেই না

সরোজাক্ষ নিশ্বাস ফেলে বলেন, নাঃ ছোট কাকি, তবু বলব এ-যুগের চোখ কান অনেক খোলা।

হৈমবতী তর্ক করেন না। প্রতিবাদও না।

হৈমবতীও একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন, কী জানি, খোলা, না অন্য এক মোহ-আবরণে ঢাকা। আমি তো দেখি মস্ত এক খেলার আড্ডায় ও বেচারিরা নেহাতই দাবার খুঁটি, রঙের তাস। ওদের নিয়ে চলছে বিরাট জুয়াখেলা। আর ওরা হতভাগারা ভাবছে–আমরাই হারছি জিতছি, দান পাচ্ছি! বেচারিরা জানেও না–নাইকো পাশার ইচ্ছা স্বাধীন যেই নিয়েছে খেলার ভার, ডাইনে বাঁয়ে ফেলছে তারে যখন যেমন ইচ্ছা তার। আর এও বোঝে না বাক্সবন্দি সব পুনরায় সাঙ্গ হলে খেলার জের। রাজা যুধিষ্ঠির খেলার নেশায় উন্মত্ত হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে শেষে আপন স্ত্রী-পুত্রকে বাজি ধরেছিলেন, এ-নেশা এমনই সর্বনেশে!–এ-যুগের দাবায় যুধিষ্ঠিররা মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎকে বাজি ধরছে।

সরোজাক্ষ একটু চুপ করে থেকে অন্যমনস্কের গলায় বলেন, কে জানে এ থেকে অন্য এক নতুন সভ্যতার জন্ম হবে কি না। যা নির্ভুল, যা নিখুঁত।

নির্ভুল! হৈমবতী মৃদু হাসেন। বলেন, প্রকৃতির সৃষ্টিতেই ভুলের শেষ নেই, খুঁতের শেষ নেই, আর মানুষের সৃষ্টি নির্ভুল হবে? হয়তো হবে একটা ভুলের বদলে আর একটা ভুল। হয়তো একটা খুঁতের বদলে আর একটা খুঁত!

প্রকৃতি তো অন্ধ।

মানুষই বুঝি চক্ষুম্মান?

মানুষের চিন্তাশক্তি আছে।

মানুষ তাই ভাবে বটে–হৈমবতী সহজ সুরে হেসে ওঠেন, সত্যি সে শক্তি থাকলে ভাবত না পৃথিবীতে শুধু একা আমিই থাকব, আর কেউ থাকবে না।

মানুষ সম্পর্কে অনেক ভাবো তো দেখছি

ভাবতে হবে কেন? চোখের উপর জাজ্বল্যমান তো। ওই ভাবনাতেই মানুষ প্রতিজ্ঞা করে বসে নিঃক্ষত্রিয় করিব পৃঙ্খী–ওই ভাবনাতেই যুগে যুগে কুরুক্ষেত্র কাণ্ড ঘটায়, ওই ভাবনাতেই সমস্ত কল্যাণবোধ বিসর্জন দিয়ে দাবার ছক পেতে বসে। কিন্তু থাক বাবা এসব দার্শনিক আলোচনা, এখনই তর্ক বেধে যাবে। আর পণ্ডিতেমূর্থে তর্ক বাধলে ব্যাপার সুবিধের হবে না। তার চাইতে যা বলতে এসেছি বলি–আমায় যে সেই বই দুটো দেবে বলেছিলে, কই দিলে না?

হৈমবতীর ডিগ্রী-টিগ্রীর বালাই নেই, তবু হৈমবতী সরোজাক্ষর পাঠোপযোগী শক্ত শক্ত ইংরিজি বইয়ের গাদা পার করেন। এটা একটা বিরক্তিকর ব্যাপার বইকী! অন্তত বিজয়ার কাছে তো বটেই।

বিজয়া অবশ্য ওই পার করাটায় তেমন বিশ্বাসী নয়। বলেন, পড়ে না, হাতি! তোমার কাছে কায়দা দেখায়।

সরোজাক্ষ এধরনের কথার উত্তর বড় দেন না, একদিন বলেছিলেন, তাতে ওঁর লাভ?

আহা, তুমি অবাক হবে, তুমি বাহবা দেবে, সেইটাই পরম লাভ।

সরোজাক্ষ আর কথা বলেননি! চুপ করে গিয়েছিলেন। আজও হৈমবতীর কাছে একটু চুপ করে গেলেন। তারপর আস্তে বললেন, ওটা কলেজ লাইব্রেরি থেকে এনে দেব ভেবেছিলাম। আচ্ছা আমি ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে এনে দেব।

আরে বাবা তাড়ার কিছু নেই– হৈমবতী লজ্জিত গলায় বলেন, বিদুষী নই যে বইয়ের জন্যে কাতর হব। বেকারের দিন,কাটতেই চায় না, তাই বই বই করে মরি। তবে আপাতত ব্যস্ততা নেই, নতুন করে আবার কালী সিংহীর মহাভারত পড়ছি—

এই সেরেছে! সরোজাক্ষ ঈষৎ কৌতুকে বলেন, সারদার কানে গেলে আর রক্ষে নেই–

হৈমবতী কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ ঘরের বাইরে সারদাপ্রসাদের উদাত্ত স্বর শোনা গেল, সারদার কথা কী হচ্ছে দাদা? আরে ছোট কাকি যে? কতক্ষণ? খুড়ি ভাশুরপোয় মিলে সারদাবাবুর নিন্দে হচ্ছে তো খুব? বলে হা-হা করে হেসে ওঠে। খুড় শাশুড়িকে অবশ্য প্রণাম করতে আসে না। হৈমবতী হেসে ফেলে বলেন,কেন বাপু, নিন্দে কেন? তুমি কি আমাদের নিন্দের ছেলে?

ঘরে চেয়ার থাকতেও বিছানার একপ্রান্তে বসে পড়ে সারদাপ্রসাদ কোঁচার খুটটা তুলে কপালের ঘাম মুছে বলে, সে আপনারা স্নেহ করে না বললেও, লোকে তো পাগল ছাগল ছাড়া কিছু ভাবে না।

সারদাপ্রসাদ যে বাইরে কোনওখান থেকে ঘুরে এসেছে, তা তার সাজসজ্জায় মালুম হচ্ছে। পরনে ধুতি আর শার্ট হলেও, জিনিস দুটো ধোপদুরস্ত। যেটা দৈবাতের ঘটনা।

সরোজাক্ষর চোখেও ধরা পড়ে দৃশ্যটা। সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন,কে আবার ওকথা বলতে গেল তোমায়?

আপনি বাদে সবাই বলে, সারদাপ্রসাদ বেশ উদাত্ত গলায় বলে, বলবে, এখন বলবে। দেশটি যে আমাদের চিতায় মঠ দেবার। এই তো গিয়েছিলাম এক পাবলিশার মহাপ্রভুর কাছে। এমন একটা ভ্যালুয়েবল ম্যানাস্ক্রিপট নিয়ে গেছি, একবার দেখলও না। যেন দেখলেও পয়সা খরচ হয়ে যাবে। সাবজেক্ট ম্যাটার বোঝাতে গেলাম, তা এমন উপহাস্যি করে কথা বলল, যেন একটা সত্যি পাগল গেছি আমি। বলে কী জানেন? আমরা মশাই ক্ষুদ্র প্রাণী, দুটো গল্প উপন্যাস বেচে খাই, আমাদের কী সাধ্য যে এই মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করি। আপনি বরং আপনার ওই মহার্ঘ পাণ্ডুলিপিটি রাশিয়ায় পাঠিয়ে দিন, ওরা দরের জিনিসের কদর বুঝবে। শুনুন! শুনলে কী মনে হয়? যত সব ভুষিমাল এসে বইয়ের ব্যবসা ফেঁদে বসেছে, ধান চাল লোহা-লক্কড়ের থেকে অধিক মূল্য দিতে জানে না। আমি বলব, বরং যখন ছাপাখানা ছিল না, তখন ছিল ভাল। দামি জিনিসের দাম ছিল। সারদার স্বর উত্তেজিত।

কিন্তু তুমিই তো বলো সারদা, ছাপাখানা ছিল না বলেই আমাদের অনেক কিছু চিরতরে খোয়া গেছে। সরোজাক্ষ বলেন, ছাপা জিনিসের একটা আধটা কপিও কোথাও পড়ে থাকে।

সারদা উত্তেজিত থেকে উত্তেজিততর হয়। বলে, বলেছিলাম, বলেও থাকি। কিন্তু এইসব অসভ্য লোকেদের ব্যবহারে মেজাজ খাপ্পা হয়ে যায়, বুঝলেন? বলে কিনা, বুঝলাম না একদা আমাদের এই মহান ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ হয়েছিল এবং আপনি তা প্রমাণ করেও ছেড়েছেন, কিন্তু সে প্রমাণে এখন কী ঘণ্টা হবে বলতে পারেন? এখন তো পরের দরজায় হাত পেতে বসে আছি, কতবড় মুখর মতো কথা বলুন? হাত পেতে বসে আছি বুদ্ধির দোষে আর কপাল-দোষে। তা বলে চির ভিখিরি যে ছিলাম না, সেটুকুও বোঝাতে হবে না পৃথিবীকে?

সরোজাক্ষ ওই উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত হন, তবু সে ভাব গোপন রেখে উৎসাহের গলায় বলেন, তা তোমার সেই থিসিস কি শেষ হয়ে গেছে নাকি?

শেষ!

সারদাপ্রসাদ যেন একটা অর্বাচীনের কথা শুনল, এইভাবে মুরুব্বির ভঙ্গিতে বলে ওঠে, শেষ কি দাদা? ওটা তো ফার্স্ট ভলম! এখনও ওইরকম নটা ভল্যুম হবে। অবশ্য হয়েই আছে একরকম। মানে খুচরো খুচরো কাগজে নোট করা আছে, সেগুলোই একবার গুছিয়ে

হৈমবতী সারদাপ্রসাদের গবেষণার বিষয়বস্তু জানেন। হৈমবতী এও বোঝেন, সরোজাক্ষর এখন ওই অবোধ লোকটার সঙ্গে মনের ভাব গোপন করে কথা চালাতে কষ্ট হচ্ছে, তাই হৈমবতীই হাল ধরেন, বলেন, তা একেবারে দশখণ্ডই শেষ করে ছাপালে হত না সারদাপ্রসাদ?না হলে এতে জিনিসটা সম্পর্কে ওদের ধারণা স্পষ্ট হবে না।

হ্যাঁ আমিও ভেবেছিলাম তাই সারদাপ্রসাদ হঠাৎ কেমন অন্যমনস্ক গলায় বলে, কিন্তু ভেবে দেখছি, এখন থেকেই চেষ্টা করা দরকার যাতে তখন চট করে মার্কেটটা ক্রিয়েট করা যায়। তা যাক–

সহসাই আবার সারদাপ্রসাদ নিজস্ব উত্তেজিত ভঙ্গিতে ফিরে আসে। বলে, ওর জন্যে ভাবি না। একবারেই হাল ছাড়বে এমন পাত্তর সারদাপ্রসাদ নয়। আমি বলে যেই মনে হল ঠিক লেখা হচ্ছে না, অমনি খাতাকে খাতা ছিঁড়ে কুচিকুচি করে আবার নতুন করে লিখতে বসি।সব পাবলিশারই কিছু আর গোলা লোক নয়, বিদ্বান বুদ্ধিমান কালচার্ড লোকও আছে এই লাইনে। যাব তাদের সন্ধান জেনে। তখন বুঝলেন কাকিমা, পড়তে পাবে না। বিষয়টা যে ভয়ানক দামি। মনে করুন না কেন– আজ আমরা ও-দেশে হৃদবদল-এর খবর শুনে উধ্ববাহু হয়ে নাচছি, অথচ ওটা ছিল আমাদের এই দেশে। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, উপপুরাণ দেখুন হাঁটকে, সব পাবেন। মৃতদেহে প্রাণসঞ্চার, একের দেহ থেকে অন্য দেহে প্রাণ ট্রান্সফার, ইচ্ছেমতো যে কোনও মানুষের বা যে কোনও প্রাণীর দেহ ধারণ, চির-যৌবন, অন্যের যৌবন আকর্ষণ করে নিজের শরীরে স্থাপন, কী নয়? বললে ফুরোবে না কাকিমা। এখানে এসে দুমাস থাকুন, একে একে নজির ধরে ধরে দেখিয়ে দেব।

দুমাস? হৈমবতী হেসে ফেলেন।

সারদাপ্রসাদ উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলে, দুমাস বলে আপনি ঘাবড়াচ্ছেন কাকিমা, ওটা তবু আমি কম করেই বললাম। দু মাসেও কুলোয় কিনা সন্দেহ। কত আছে, যা আপনার এ যুগের বিজ্ঞান এখনও স্বপ্নও দেখছে না। হৈমবতী হেসে বলেন, তা কবিকল্পনাও তো ছিল কিছু? যেমন সত্যযুগের মানুষ একুশ হাত লম্বা ছিল।

সারদাপ্রসাদ হঠাৎ যেন ধসে পড়ে! ছি ছি, আপনি এই কথা বললেন কাকিমা? অথচ আমি আপনাকে না–এটা আপনি বলবেন না। একুশ হাত মানুষ ছিল না কী বলছেন? তা হলে বলুন পৃথিবীতে অতিকায় হাতি, অতিকায় জিরাফ, অতিকায় কুমির কিছুই ছিল না? অবিশ্বাসের কী আছে বলুন। তাদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে থাকত। প্রকৃতির কাজই তো হচ্ছে অ্যাডজাস্ট করে চলা। পৃথিবীতে যখন দেদার জায়গা ছিল, তখন বৃহৎ প্রাণী ছিল, মানুষ তাই বৃহৎ ছিল। ক্রমশ পৃথিবীতে জায়গা কমতে শুরু করল, মানুষের সংখ্যা বেড়ে যেতে শুরু করল, ব্যস, প্রকৃতি অমনি মানুষের মাপ কমাতে শুরু করল। এখন আপনাদের সংখ্যাতত্ত্ববিদরা বলছেন–এরপর আর পৃথিবীতে মানুষ ধরবে না। দেখবেন ঠিকই ধরে যাবে। তখন মানুষ লিলিপুট বা বুড়ো আঙুল হয়ে যাবে। তা এখন থেকেই তার কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রথমে মন নিয়ে শুরু হয় কিনা। দিনের পর দিন তাই মানুষের মন ছোট হয়ে যাচ্ছে। আরও ছোট হয়ে যাবে, তারপর দেহগুলোই ছোট হতে থাকবে। তা হলেই বলুন একুশ হাতে অবিশ্বাস কীসের?

হৈমবতী এই অভিনব মতবাদের বহরে কষ্টে হাসি গোপন করে বলেন, তা হয়তো সত্যি। তবে গুজব বলেও তো একটা জিনিস আছে? মনে করো সেই সত্য থেকে কলি, এই চার যুগ ধরে সেই গুজবের বাড় বৃদ্ধি হয়ে চলেছে

সারাদাপ্রসাদ এবার গম্ভীর হয়।

বলে,আপনিও যদি একথা বলেন তো নাচার। তবে সাহেবরা যখন গবেষণা করে ওইসব দেখিয়ে দেবে, তখন আমরা বাহবা দিয়ে বলব। কী আশ্চয্যি। কি অদ্ভুত, কী মজা! তখন আর অবিশ্বাস করব না।

হৈমবতীর অবশ্য মুখে আসছিল, চোখে দেখলে আর অবিশ্বাস করা যায় কী করে? কিন্তু বললেন না। হৈমবতী অনুপ্তের ভূমিকা নিলেন। বললেন, তা যা বলেছ। ভেবে দেখলে তাই। একসময় যে এই প্রাচ্যভূমি জ্ঞানে-বিজ্ঞানে পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল, তার প্রমাণ নেই তাও নয়।

সেই তো, সেই কথাই তো বলে মরছি জীবনভর– সারদাপ্রসাদ হৃষ্টচিত্তে বলে, আপনি একটা কথাতেই বুঝলেন, স্বীকারও করলেন, কিন্তু আর কেউ কানই দিতে চায় না। অরণ্যে রোদন করে মরি বেনাবনে মুক্তো ছড়াই। অথচ তলিয়ে দেখতে পারলেই বোঝা যায়। এই যে, শ্রীকৃষ্ণ একমুঠো বেনাঘাস তুলে ছুঁড়ে মারলেন, আর সেগুলো লোহার মুষল হয়ে গিয়ে যদুবংশ ধ্বংস করল, কী এটা? আমি তো বলব স্রেফ আণবিক বোমার ব্যাপার, একবার নিক্ষেপেই বংশকে বংশ লোপাট।অথচ যেহেতু আমাদের নিজেদের দেশের ইতিহাসে রয়েছে সেই হেতুই ধরে নিতে হবে ওসব রূপক, গুজব, কবিকল্পনা।না না এটা ঠিক নয়।–এই যে সেদিন মীনাক্ষীকে বোঝাতে গেলাম, বল জিনিসটা আর কিছুই নয় বাপু, স্রেফ গাছের অংশ থেকে তৈরি আর্ট সিল্ক বা রেয়ন সিল্ক। তা শুনে মেয়ে একেবারে হেসেই অস্থির। একই জিনিসের নাম যেমন ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন কালেও অনেক সময় বিভিন্ন হয়ে যেতে পারে, একথা মানে না। যাক গে ওর জন্যে ভাবি না। সত্য কখনও চিরদিন আবৃত থাকে না, এই সারদাপ্রসাদের গবেষণার ফল একদিন ভারতকে পৃথিবীর দরবারে শ্রেষ্ঠ আসন দেবে কিনা দেখবেন। আধুনিক বিজ্ঞান যতই অগ্রসর হোক, তাকে মাথা হেঁট করে বলতেই হবে, প্রাচীন ভারতবর্ষের যোগবলের কাছে এখনও আমরা অ আ ক খর ছাত্র, আর ওই যোগবলটিই হচ্ছে বিজ্ঞানশক্তি।

হৈমবতী ওই অবোধ মানুষটার উত্তেজনায় লাল মুখটার দিকে তাকিয়ে কোমল অথচ ব্যস্ত গলায় বলেন, এসব কথা তোমার মতো এমন করে তলিয়ে তো দেখি না বাপুকখনও, শুনলে মনটা খুব চঞ্চল হয়, কিন্তু তুমি এখন সারাদিন ঘুরে এলে, স্নান করবে, খাবে

আমার স্নানাহার? এর জন্যে কিছু ভাববেন না সারদাপ্রসাদ অধিকতর উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং আরও বেশ কিছুক্ষণ প্রবল বিক্রমে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রাচীন যোগবল সম্পর্কে তুলনামূলক সমালোচনা করে হঠাৎই একসময় বলে ওঠে, নাঃ স্নানটাই সেরে আসি, মাথাটা কেমন ঝাঁ ঝাঁ করছে।

সারদাপ্রসাদ চলে গেলে হৈমবতী করুণার গলায় বলেন, সত্যি সরোজ, কোনওমতে ওর ওই লেখা ছাপিয়ে ফেলা যায় না?

সরোজাক্ষ মৃদু বিষণ্ণ হাসি হেসে বলেন, হাজার কয়েক টাকা খরচ করতে পারলে যায়।

আমার যদি অনেক টাকা থাকত, হৈমবতী বলেন, আমি একজন পাবলিশার হতাম।

সরোজা বলেন, কিন্তু তাতেই কি ওকে আঘাত থেকে বাঁচানো যেত ছোট কাকি? সে আরও বড় আঘাত। এ তো তবু বেচারা জানছে এতবড় একটা কাণ্ড আর কাজ ও কাউকে দেখাতে পাচ্ছে না। তাতে ব্যাকুলতা আছে, আকুলতা আছে, উত্তেজনা আছে, আশাও আছে। অগাধ আশা। যার জোরে ওর এত অ্যাকটিভিটি। কিন্তু তখন? তখন ওই আশাটাই যে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। যখন দেখবে ওর গবেষণাগ্রন্থ পড়ে পড়ে পোকার খাদ্য হচ্ছে, তখন ওর ভিতরটাও ঘুণ ধরে ঝরে পড়বে।

সত্যি, কী অবাস্তব একটা নেশার পিছনে ছুটে মানুষটা

সরোজাক্ষ মৃদু গলায় বলেন, পৃথিবীতে কোন্ নেশাটাই বা অবাস্তব নয় বলো? ক্ষমতার নেশা, জয়ের নেশা, একচ্ছত্র নায়কত্বের নেশা, স্বর্ণের নেশা, ধর্মের নেশা, সংসারের নেশাযা কিছুই ছুটিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে মানুষকে, তার কোন্টাই বা অবাস্তব আশার নয়? মানুষ থাকলেই অন্ধ নেশাও থাকবে। হয়তো ওটাই গতির শক্তি। যেদিন সে টের পায় এতদিন যা নিয়ে বিশ্বজগৎ ভুলে ছুটছিলাম, সেটা স্রেফ শূন্য, তখনই ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যায়।

হৈমবতী প্রতিবাদের সুরে বলেন, কিন্তু কখনও কি কারুর সাকসেস হয় না?

আমার তো মনে হয়, না। শ্রীরামচন্দ্র রামরাজ্য গড়েও সুখী হননি।

তবুও বেচারার ওই দুর্দান্ত আশা দেখে মনে হচ্ছিল, একটা বইও ওর অন্তত ছাপা হলে–

নাঃ। তার পরবর্তী যে ভয়ংকর বাস্তব, ও সেটা সহ্য করতে পারবে না।

হৈমবতী ঈষৎ অন্যমনা গলায় বলেন, কিন্তু এদের জন্যে বড্ড মায়া হয়।

সরোজাক্ষ একটু হেসে ফেলে বলেন, সকলের হয় না। যেমন এ বাড়ির গিন্নির!

হৈমবতী সচমকে বলেন, এই সেরেছে! এতক্ষণ যে কথাটা মনেই পড়েনি। কোথায় এ বাড়ির গিন্নি? ইস এতক্ষণ এসেছি, খোঁজ করিনি।

সেটা কোন পক্ষের করণীয় তাই ভাবছি

বাঃ, আমারই। আমি এলাম, যাই দেখি গে—

হৈমবতী উঠে দাঁড়ান।

আর সেই দাঁড়ানোয় বিজয়া বিপদগ্রস্ত হন। ঘরে ঢুকতে এসেও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি নিজস্ব নিয়মে। আড়ি পেতে অপরের কথা শোনা তাঁর একটি প্রিয় কাজ, কিন্তু সেটা প্রকাশ হয়ে পড়াটা বাঞ্ছনীয় নয়। তাই তিনি সহসা একটুকু সরে গিয়ে সিঁড়িতে গলা বাড়িয়ে অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ করে বলে ওঠেন,আচ্ছা আমি যাচ্ছি, তুমি ততক্ষণ ওটা সেরে ফেলল।

তারপর সাহস করে ঘরে এসে ঢোকেন।

আর যেন এইমাত্র জানলেন, এমন ভঙ্গিতে বলে ওঠেন,ছোট খুড়ি যে? কতক্ষণ?

বিজয়ার বাপের বাড়িতে কাকিকে খুড়ি বলা রেওয়াজ, তিনি সেটাই চালান।

হৈমবতী অপ্রতিভ গলায় বলেন, এই তো খানিকক্ষণ। তুমি বুঝি পুজো করছিলে?

পুজো? বিজয়া একটি উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলেন,পুজো আর কী, পুজো-পুজো খেলা। তবু এই জঞ্জালের জগৎ থেকে খানিকটা সরে যাওয়া।

একথার আর উত্তর কী?

হৈমবতী চুপ করে থাকেন।

বিজয়া নিজেই আবার পূর্বকথা ভুলে গিয়ে বলেন, এসেছ, তা জেনেছি অনেকক্ষণ। মীনা গিয়ে খবর দিয়ে এসেছে। তবে ভাবলাম, আমি আর সাততাড়াতাড়ি নেমে কী করব? বিদুষী খুড়ি, বিদ্বান ভাশুরপো, তাদের বড় বড় কথার মধ্যে আমি গিয়ে বসব, হংস মধ্যে বক! তার চেয়ে থাক। আগে তোমরা প্রাণভরে গপো করে নাও, তারপর যাব। বিজয়ার মুখে একটুকরো কুটিল হাসি।

হৈমবতীর কিছু অজানা নয়, বিজয়াকে তিনি যথেষ্ট চেনেন। তবু সরোজাক্ষ হৈমবতীর উপস্থিতিতে বিজয়ার স্বরূপের এই নির্লজ্জ উদঘাটনে একেবারে অবিচলিত থাকতে পারেন না।

সরোজাক্ষ বলে ওঠেন, বড় বড় কথা না জানলেই যে ছোট কথা কইতে হবে, এমন কোনও আইন আছে কি?

বিজয়া মূর্খ হলেও বোকা নয়। বিজয়া এ ধরনের কথার উত্তর জানেন, এবং তা প্রয়োগও করেন। বলেন, ছোট মনের মানুষ, ছোট কথা ছাড়া আর কোথায় কী পাব বলো? তা হলে বোবা হয়ে থাকতে হয়। তা তাই তো আছি। তোমাদের এই বড় মনের বাড়িতে বোবা হয়েই বসে আছি। ছেলে তার বউকে নিয়ে গিয়ে সভার মধ্যে বাইজি নাচ নাচাচ্ছে, বউ মদ খেয়ে বেহুঁশ হয়ে বাড়ি ফিরছে, মেয়ে একটা শূদুরের ছেলের সঙ্গে মাখামাখি করে আখের খোওয়াতে বসেছে, আর কর্তা বিজয়া গলার সব বিষটুকু নিঃশেষে ঢেলে বলেন, আর কর্তা ঘরে ভাঁড়ে মা ভবানী জেনেও, তেজ করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভোলানাথ হয়ে বসে থেকে বড় বড় কথার চাষ করছেন, বড় বড় বই পড়ছেন, আর এই ছোটলোক মেয়েমানুষটা টাকার কথা বলতে এলেই তাকে ঘেন্না করছেন। তবু তো কথাটি কইছি না–বোবা হয়ে বসে আছি!

স্বভাবগত দ্রুতভঙ্গিতে প্রায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাগুলো বলে নেন বিজয়া, মাঝখানে বাধা দেবার অবকাশ না রেখে।

কথার শেষে আর বাধা দেবার প্রবৃত্তি থাকে না সরোজাক্ষর।

সন্দেহ নেই, ইচ্ছে করেই এই কথাগুলো হৈমবতীর সামনে উচ্চারণ করে নিলেন বিজয়া, তাতে আর সন্দেহ নেই।

কারণ হৈমবতী ভদ্র সভ্য সুরুচিসম্পন্না। কারণ হৈমবতী সরোজাক্ষর শ্রদ্ধেয় প্রিয়জন। অতএব এই কুরুচিপূর্ণ কথাগুলো বিজয়ার মুখ থেকে হৈমবতীর সামনে উচ্চারিত হলে সরোজাক্ষ মরমে মরে যাবেন। বলে নিয়ে বিজয়া যেন বিজয়গর্বের উল্লাস অনুভব করেন।

নাও, এখন কোথায় মুখ লুকোবে লুকোও?

খুব যে দুজনে মুখোমুখি হয়ে বসে উচ্চাঙ্গের কথাবার্তা হচ্ছিল, ঘরের মধ্যে তোমার কোন উচ্চবস্তুর চাষ হচ্ছে দেখে যাক শৌখিন খুড়ি!

আজ বাদে কাল বাড়ি বাঁধা দিতে হবে, গয়না বেচতে হবে। এই তো সংসারের অবস্থা। উনি পুরুষ–পরম-পুরুষ সেজে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। চিরকাল নিজে মহৎ হলেন, সংসারকে তাকিয়ে দেখলেন না। তাই অমন গুণনিধি ছেলে, তাই অমন বেলেল্লা বউ। হচ্ছে–আরও একটি মুগুর তৈরি হচ্ছে তোমার জন্যে, ওই তোমার ছোট কন্যেটিই তোমার মান সম্ভ্রম চ্যাপটা করে দেবেন, দেখতে পাচ্ছি দিব্যচক্ষে। দি দি না, তাই চাই আমি। সমাজে তোমার মুখটা ভাল করে পড়ুক। উচ্চলোকে বসে নিম্নলোককে ঘেন্না করার ফল ফলুক। মেয়ে যখন হাড়ি-ডোমের গলায় মালা দেবে, তখন আমার নাম কেউ তুলতে আসবে না, তোমার নামেই টি-টি পড়বে।

চিন্তা বাতাসের চেয়েও দ্রুতগামী।

সরোজাক্ষর ওই মরমে মরে-যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে হিংস্রপুলকে মুহূর্তে এতগুলো কথা ভেবে নিলেন বিজয়া।

হয়তো এমনিই হয়। যে ঘরটা ভালবাসার বাসা হবার কথা, সে ঘরটা শূন্য পড়ে থাকে না। ঘরটা দখল করে নেয় ঘৃণা, দখল করে নেয় হিংস্র আক্রোশ। তাই ভাইয়ে-ভাইয়ে পিতা-পুত্রে স্বামী-স্ত্রীতে যদি ভালবাসার ঘাটতি ঘটে, তো বহিঃশত্রুর চাইতে অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে পরস্পরের হিংসা আক্রোশ ঘৃণা।

কিন্তু কথাগুলো মনে মনে বলেছেন বিজয়া, তাই তৎক্ষণাৎ মুখে বলে উঠতে পারেন, যাক ওসব কথা। ঘরের কেলেঙ্কারি বলবার নয়, তবে তুমিও ঘরেরই লোক তাই বললাম গো খুড়ি! যাক দেখো যেন পাঁচ কান না হয়।

পাঁচ কান!

হৈমবতী হেসে বলেন, নাঃ, সে ভয়টা অন্তত কোরো না।

সরোজাক্ষ আরও মরমে মরেন।

সরোজাক্ষ অনুভব করেন বিজয়া সেজেগুজে লড়াইয়ে নেমেছে, ওকে এখন বকে দমানো যাবে না। সরোজাক্ষ কিছু বলতে গেলে বিজয়া আরও অপদস্থ করে ছাড়বেন স্বামীকে। অনেক সময় জ্বালাতুনে ছোট ছেলেমেয়েদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় এই প্রবৃত্তি। বাইরের লোকের সামনে বাড়ির লোককে অপদস্থ করতে পারলে আর কিছু চায় না তারা।

কিন্তু বিজয়া কি ছোট বাচ্চা?

বিজয়ার হিংস্রতাটা কি কেবলমাত্র জ্বালাতন বলে স্নেহের কোপ দেখিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়?

হৈমবতী সরোজাক্ষর মনের ভাব পাঠ করতে পারেন। তাই সহাস্য-সপ্রতিভতায় বলে ওঠেন, তা কী হল বউমা; তোমার ঠাকুরের প্রসাদ-টসাদ কই? বার করো? আর একটু চা খাওয়াও। তর্ক করে গলা শুকিয়ে গেছে।

সরোজাক্ষ কৃতজ্ঞচিত্তে এই করুণাময়ীর দিকে তাকান, সরোজাক্ষর বুঝতে বাকি থাকে না বিজয়াকে অন্য কাজে অন্যমনস্ক করার তাল হৈমবতীর।

বিজয়া কিন্তু এ ফাঁদে পা দেন না। বিজয়া অম্লান গলায় বলেন,ঠাকুরের প্রসাদ? সে আর তোমার মতন মেম-শাশুড়ির জন্যে কি আর আনতে সাহস করি? চাকরকে দোকানে পাঠিয়েছি খাবার আনতে। তোমার তো আর বামুনের ঘরের বিধবার মতন অত শুচিবাই নেই, ওদের দিকের চা-ই করে দিতে বলেছি। এই আনল বলে।

হৈমবতী স্তব্ধ হয়ে যান

হৈমবতী স্বখাত সলিলের চেহারা দেখতে পান। এরপর আর তাঁর বলার উপায় রইল না, খাব না, খিদে নেই।

এরপর বসে বসে শুনতেই হবে, বেশ আছো বাবা ছোট খুড়ি, বিচার-আচারের বালাই নেই, চাকরবাকর যা দিল খেলে। আমার মতন মরণদশা নেই বাবা তোমাদের।

শুনতেই হচ্ছে, কারণ বিজয়া যেখানে উপস্থিত, সেখানে সকলেরই শ্রোতার ভূমিকা হতে বাধ্য। বিজয়া যেন অন্য সকলের সমস্ত সূক্ষ্ম কোণ আর মিহি ধার ভোঁতা পাথরে শান দিয়ে ক্ষইয়ে দিতে চান।

সরোজাক্ষ কি প্রার্থনা করছিলেন একটা দুর্বিপাকও ঘটুক, যাতে বিজয়ার কথা থামে? আর সরোজাক্ষর বিধাতা শুনতে পান সে প্রার্থনা এবং মঞ্জুরও করেন?

তাই কথার মাঝখানে দুগ্রহের আবির্ভাব ঘটে।

নীচতলায় কী যেন একটা হইচই ওঠে, তারপর সিঁড়িতে জুতোর শব্দ। সেই শব্দছন্দের শেষ যতিতে এসে দাঁড়ায় সরোজাক্ষর ছোট ছেলে।

হাতে ছোট সুটকেস।

কপালে চওড়া ব্যান্ডেজ।

.

গোলমাল শুনে সারদাপ্রসাদ তেল মাখতে মাখতে চলে এসেছেন। ব্যান্ডেজ দেখে সকলেই শিউরে ওঠে, তবে বিজয়ার মাতৃহৃদয়, তাই বিজয়া চেঁচিয়ে ওঠেন, এ কী কাণ্ড বাবা কমল? কোথায় কী সর্বনাশ ঘটিয়ে এলি?

কমলাক্ষ অগ্রাহ্যভরে উত্তর দেয়, কিছু না বাবা, কিছু না। এমন কিছু মহা মারাত্মক কাণ্ড ঘটেনি। গোটা চার-পাঁচ মাত্র স্টিচ দিতে হয়েছে।

স্টিচ দিতে হয়েছে! হৈমবতী কাছে এসে বলেন, তা হলে তো নেহাত কম লাগেনি। কী হল, পড়ে মাথা ফাটিয়েছ, না মারামারি করেছ?

নাতি সম্পর্কের কৌতুকের ভঙ্গিমাতেই বলেন।

কমলাক্ষও সেই সুরে বলে, কাকি-দিদাই ঠিক ধরেছেন। ওই শেষেরটা।

মারামারি? রাস্তার ছেলেদের মতন মারামারি করে কপাল ফাটালি তুই? বিজয়া ঘৃণা ধিক্কার আর ব্যঙ্গে গঠিত একটা সুরে পুনরায় চেঁচিয়ে ওঠেন, চমৎকার! এই একটা ছেলেই বাকি ছিল, সেও বাড়ির ধারা রাখছে। মহাপুরুষ বাপের মহৎ শিক্ষার ফল। বলি কী নিয়ে কার সঙ্গে করলি এসব?

বউদি, সারদাপ্রসাদ ধমকের গলায় বলে, সেই ইতিহাস একটু পরে শুনলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে যাবে না। এখন ছেলেটাকে দেখুন শুনুন!

বিজয়াকে ধমক দিয়ে কথা একমাত্র সারদাপ্রসাদই বলতে পারে।

বিজয়া একটু দমে যান।

বলেন, আমি আর কী দেখব! তোমরাই দেখো। ডাক্তারকে খবর দাও।

ডাক্তার!

কমলাক্ষ হইহই করে ওঠে, দরকার নেই বাবা, দরকার নেই। হসপিটালের ডাক্তার দেখেছে, বেঁধেছে, ঠিক হয়ে গেছে। ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গিতে বলে ওঠে কমলাক্ষ, বাড়ির আসল মানুষটাকে দেখছি না কেন? বিচ্ছুবাবু?

বিচ্ছু নামটা কমলাক্ষরই দেওয়া। এবং কাকুর সঙ্গেই তার ভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এখন রীতিনীতি পালটেছে।

কমলাক্ষ বাড়ি ছাড়া, নীলাক্ষ আর বউদি সুনন্দা ছেড়েছে তাদের পূর্ব নীতি। হয়তো বা সব কিছু নীতিই।

অথচ কীসের জন্যে কে কী ছাড়ছে বোঝা যাচ্ছে না।

বিজয়া কিন্তু এই অবকাশে সুযোগ ছাড়েন না। বিজয়া বলে ওঠেন, তোর জানা সংসারের ভোল এখন অনেক বদলে গেছে, বুঝলি? ভাইপোকে দেখতে ইচ্ছে হলে এখন হয় তার ইস্কুলে যেতে হবে, নয় তার মামার বাড়ি।

কমলাক্ষ অনেকদিন আসেনি, পর পর দুটো ছুটিতে ক্যাম্পে যেতে হয়েছিল তাদের, তাই ঈষৎ অবাক হয়ে বলে, হঠাৎ এ ব্যবস্থা?

দুদিন থাকলেই বুঝতে পারবি। তোর বউদি তো এখন ছেলেকে বাপের বাড়িতে রেখে পার্টিতে নাচতে যাচ্ছে।

বাঃ বাঃ, শুনে বড় আহ্লাদ হচ্ছে।

সরোজাক্ষ স্থিরদৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকান।

হৈমবতী অস্বস্তি বোধ করেন।

হৈমবতী বলেন, আমি এখন যাই সরোজ আর তারপরই বোধ করি এই হঠাৎ চলে যাওয়ার অস্বস্তি কাটাতে বলেন, কমল, তুই তো এখন আছিস? একটু ভাল হলে যাস একদিন। শুনব তোর বীরত্বের কাহিনী।

তার আগেই শুনবেন–কমলাক্ষ হেসে হেসে বলে, কাগজেই দেখতে পাবেন। এমন একখানা জোরালো ঘটনা কি আর কাগজে না বেরোবে? খড়গপুর টেলজিক্যাল স্কুলে ছাত্র-বিক্ষোভ। শিক্ষকগণ প্রহৃত, পুলিশ ও ছাত্রের মধ্যে সংঘর্ষ, উভয় পক্ষে আহতের সংখ্যা বাইশ, তিনজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।অবশ্য তার দুজনই পুলিশ। থান ইটের ব্যাপার তো!

দিব্য হেসে হেসে বলে কমলাক্ষ!

যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়।

যেন হাসিরই কথা, তাই হেসে হেসে বলছে।

অতএব বলতে পারা যায়, বাড়ি থেকে অনেক দূরে থেকেও এ বাড়ির আর-এক ছেলেরও ভোল পালটেছে। মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে এসে লজ্জা পাচ্ছে না সে। লজ্জা পাচ্ছেনা শিক্ষককে পিটিয়ে, পুলিশকে হটিয়ে।

হৈমবতী চলে গেলেন।

বিজয়া ব্যস্ত হয়ে বলতে গিয়েছিলেন, তোমার জন্যে চায়ের জল চড়িয়েছে, তোমার জন্যে খাবার আনতে গেছে

হৈমবতী হেসে কমলাক্ষর গায়ে একটু হাত বুলিয়ে বলে যান, আমার ভাগটা আমার নাতি খাবে।

বিজয়া পাশ কাটান।

হাসপাতালের ব্যান্ডেজ, অনায়াসে ছুঁয়ে চলে গেল বিধবা মানুষ।

মার চেয়ে দরদ!

বিজয়ার কি ইচ্ছে হচ্ছিল না, ছেলের গায়ে-মাথায় হাত বুলোতে? কিন্তু ব্যান্ডেজের জাতটা দেখতে হবে না?

চমৎকার দেশটি হল আমাদের! বলে সারদাপ্রসাদও আবার মাথায় তেল ঘষতে ঘষতে চলে যায়। সারদা আর হৈমবতী চলে যেতে সরোজা আস্তে বলেন, এগুলোর কি খুব দরকার ছিল?

কমলাক্ষ মাস্টার পিটিয়ে আর মাথা ফাটিয়ে এসে, হেসে ওড়াবার চেষ্টা করলেও, বাবার মুখোমুখি একটু আড়ষ্ট হয়। তবু সহজ গলায় বলতে চেষ্টা করে, পরিস্থিতি শুনলে আপনিই বুঝবেন দরকার ছিল কিনা।

সরোজাক্ষ ঈষৎ দৃঢ় গলায় বলেন, আমার পক্ষে হয়তো বোঝা শক্ত। কারণ আমাদের আমলে দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা ছিল। তবু জিজ্ঞেস করি কত খারাপ পরিস্থিতি হলে তুমি আমায় ধরে ঠেঙাতে পারো?

ও আবার কী কথার ছিরি! বিজয়া বিরক্ত গলায় বলেন, কমল, তুই চলে আয়। হাত-মুখ ধুবি, খাবি।

তুমি যাও, ও যাচ্ছে–সরোজা বলেন, আমার প্রশ্নের উত্তরটা তোমায় দিয়ে যেতে হবে কমল! আমি কতটা গর্হিত আচরণ করলে তুমি আমায় ধরে মারতে পারো?

কমলাক্ষর অবশ্য কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থটি বুঝতে দেরি হয় না, তবু সে পাশ কাটাতে বলে, হঠাৎ একথাটা বলছেন কেন?

কেন বলছি, সেটা বোঝবার মতো ক্ষমতা অবশ্যই তোমার হয়েছে। চিরদিন এই শিক্ষাই তো পেয়ে এসেছ শিক্ষক পিতার তুল্য!

কমলাক্ষ এবার উদ্ধত গলায় বলে, আপনাদের আমলের ওসব আদর্শ আর চলবে না বাবা! তখন ব্যাপারটা উভয় পক্ষেই ছিল। শিক্ষক শিক্ষকের মতো ব্যবহার করতেন।

সেই কথাই তো জানতে চাইছি, কতদুর গর্হিত কাজ করেছেন তাঁরা যে, ধরে মারতে হয়?

খুব চটপট বলল না অবশ্য কমলাক্ষ, তবে জেরার মুখে বেরোলো ঘটনার ইতিহাস।

এধরনের জেরা সরোজাক্ষ জীবনে করেন না ছেলে-মেয়েদের। যখন ওরা ছোট ছিল, ছোটখাট খুঁটিনাটি নিয়ে বিজয়া জেরা করতে বসতেন, সরোজাক্ষর কানে গেলে বিরক্ত হতেন। বলতেন,ওতে ওদের অসহিষ্ণু করে দেওয়া হয়, ভীরু করে দেওয়া হয়, মিথ্যে কথা শেখানো হয়। ছেড়ে দাও।

কিন্তু আজ হঠাৎ সরোজাক্ষ নিজেই ব্যাপারটাকে ছেড়ে দিলেন না। যেন কেমন এক কৌতূহল, আর জিজ্ঞাসু চিত্ত নিয়ে জানতে চাইলেন। যেন দেখতে চান এই জগতের আর কোথায় কী ঘটছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখবেন নিজের অবস্থা।

তাই জানতে চাইছেন, কতটা গহিত আচরণ করেছিলেন কমলাক্ষদের মাস্টার।

কমলাক্ষ তার উত্তর দিয়েছে। কমলাক্ষর মতে–

তোমরা যদি বলো গর্হিত নয় তো বলো। তোমরা তোমাদের পুরনো চশমা দিয়ে নতুন পৃথিবীকে দেখতে চাও তো দেখো। পৃথিবীর তাতে কিছু এসে যাবে না। লজ্জিত হয়ে বদলাতেও বসবে না সে নিজেকে।

এ-যুগ বলবে মাস্টার হয়েছ বলে মাথা কেনোনি। তুমি টাকার বিনিময়ে তোমার অধীত বিদ্যা বিক্রি করছ, আমি আমার টাকা দিয়ে সেই বিদ্যা কিনছি। এর মধ্যে এ-সম্পর্ক আসে কীসে যে আমাকে তুমি কিনে নেবে? আমায় তুমি সদাচার শেখাতে আসবে? কোনও ছেলে যদি হোস্টেলের বাইরে তার গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে বেড়ায়, তাতে তোমার নিষেধ করতে আসার কী রাইট আছে?

.

ব্যাপারটা ঘটেছিল এই।

কোন মাস্টার নাকি দেখেছিলেন, হোস্টেলের একটি ছেলে রাস্তায় তার এক গার্ল ফ্রেন্ড নিয়ে হি-হি হো-হো করে বেড়াচ্ছে।

ক্লাস কামাই করে না অবশ্য, ছুটির দিনে।

ব্যস, তিনি গেলেন নাক গলাতে। তিনি ছাত্র-জীবনের আদর্শ, হোস্টেলের ডিসিপ্লিন, এইসব নিয়ে এলেন লেকচার ঝাড়তে! তারপর তাঁকে বুঝতে হবে না, সাপের ল্যাজে পা দিলে কী হয়?

সব ছাত্র এককাট্টা হয়ে মাস্টারকে পেড়ে ফেলবে না?

তাও যদি হাতে-পায়ে পড়ত তো হত। তিনি গেলেন সুপারিন্টেন্ডেন্টকে জানাতে।

খেপবে না ছেলেরা?

ভাঙবে না কলেজের চেয়ার টেবিল যন্ত্রপাতি? যা নিয়ে কাজ করে নিজেরা। সেইসব জিনিসই ভেঙে তছনছ করে ছাড়ল।

সুপারিন্টেন্ডেন্টও তেমনি বুন্ধু, তুই না হয় মেটাবার চেষ্টা কর? তা নয় তিনি পুলিশ ডাকলেন।

ব্যস্ তার পরিণতি এই।

ছাত্ররাও অবশ্য আহত হয়েছে।

পুলিশের লাঠিতে হয়েছে।

কিন্তু পুলিশ আহত হয়েছে থান ইটে। আর মাস্টাররা আহত হয়েছেন চেয়ার-টেবিল থেকে।

কমলাক্ষ ছিল দল-নেতাদের একজন, তাই তার মাথায় একটা লাঠি না পড়ে যায়নি। কিন্তু তাতে সে কেয়ার করে না। সে বাবার কথায় সজোরে প্রতিবাদ করে,নিশ্চয়ই অন্যায় হয়েছে মাস্টারের। স্টুডেন্ট বলে কেউ নাবালক নয়। তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে তুমি মাথা গলাতে আসো কেন?

বোকামি করলে, তার প্রতিফল তো পেতেই হবে।

সরোজাক্ষ আস্তে বলেন, হোস্টেলের ছেলেদের নৈতিক চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষকদের কোনও দায়িত্ব নেই?

থাকবে না কেন? আছে। কোনও ছেলে যদি রাত দশটার পর হোস্টেলের বাইরে থাকে, সে সম্বন্ধে হোস্টেলের আইনের প্রশ্ন তুলে কথা বলার দায়িত্ব বা রাইট আছে। তা ছাড়া কখনওই নয়।

সম্পর্কটা কি শুধুই আইনের? ভাল-মন্দের দায়িত্ব বলে কিছু নেই? সরোজাক্ষ শিথিল গলায় বলেন, কোনও ছেলে যদি হোস্টেলের বাইরে গিয়ে মদ খায়, শিক্ষকের চোখে পড়লে কিছু বলতে পারে না?

হোস্টেলের বাইরে? কমলাক্ষর মুখে মৃদু একটু হাসির আভাস ফুটে ওঠে, কষ্ট করে বাইরে যাবে কেন? ভেতরেই তো যথেষ্ট চলছে।

সরোজাক্ষ অবোধ বইকী!

বিশুদ্ধ গলায় যাকে বলে ন্যাকা। তা নইলে সরোজাক্ষ একথায় এত মর্মাহত হন? তাই সরোজাক্ষ বিহ্বলদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন ছেলের দিকে। যেন বুঝতে পারছেন না ও কী বলছে।

কমলাক্ষ বাপের এই মর্মাহত অবস্থা কি বুঝতে পারে না? তবু সে যেন বাপের মোহভঙ্গ করতেই নির্মম হয়।

তাই বেপরোয়া গলায় বলে, অবাক হচ্ছেন? আপনারা নেহাত ভাল ছেলে ছিলেন, আর চিরকাল বাড়ির মধ্যে মানুষ হয়েছেন, তাই পৃথিবীটাকে দেখবার সুযোগ পাননি। নইলে মদ জিনিসটা কবে ছিল না? কবে না খেয়েছে মানুষ? স্টুডেন্টরাও ছেড়ে কথা কয়নি। পুরনো কালের হোস্টেলের সঠিক ইতিহাস দেখুন তো!

তবে হ্যাঁ, আগে লোকে অনেস্ট কম ছিল, লুকিয়ে খেত, এখন লোক অনেস্ট হয়েছে, অত লুকোচুরি করে না। হোস্টেলের অধিকাংশ ছেলেই তো মদ খায়। এবং চাকফির মতো প্রকাশ্যেই খায়।

সরোজাক্ষ ছেলের দিকে নির্নিমেষে তাকিয়ে বলেন, তুমিও বোধ হয় সেই অধিকাংশের মধ্যেই পড়ো?

আমি?

কমলাক্ষ ব্যান্ডেজ বাঁধা মাথাটাই ঝাঁকিয়ে বলে, যদি বলি পড়ি না, হয়তো আপনি বিশ্বাস করবেন না। তবে বিশ্বাস করলে বলব, পড়ি না। কারণটা নীতিগত কিছু নয়, ও আমার ভাল লাগে না। তবে যারা খায়, তাদেরও এমন কিছু মহাপাতকী মনে করি না। ওটা আজকাল এত সাধারণ ব্যাপার হয়ে গেছে। ছেলেরা তো দূরস্থান, বলে মেয়েরাই

এবার একটু চুপ করে যায় কমলাক্ষ।

বোধ হয় মনে করে, বাবার পক্ষে একটু ওভারডোজ হয়ে যাচ্ছে।

সরোজাক্ষর মাথাটা আবার ঝুঁকে পড়ছে কেন? রক্তচাপে? না অন্য একটা চাপে? তাঁর নিজেরই বাড়িতে অধিক রাত্রে কোন নাটক অভিনয় হবে, সেটা স্মরণ করে?

কমলাক্ষ তো দেখবে সেই নাটকের অভিনয়। কমলাক্ষ তো দেখেনি ইতিপূর্বে।

কিন্তু আশ্চর্য, সরোজাক্ষ তাঁর ওই বেহেড পুত্রবধূকে ঘৃণার চক্ষে দেখেন না। সরোজাক্ষ যেন তাকে মমতার চক্ষে দেখেন, দেখেন করুণার চক্ষে।

তবু সরোজাক্ষর মাথা ঝুঁকে পড়ল, হয়তো সরোজাক্ষ ভাবলেন, এ প্রসঙ্গ আমি তুললাম কোন মুখে?

কমলাক্ষ চলে গেল ভিতরে।

ফুর্তিবাজ ছেলে, ওর মনে কোনও ভার দাঁড়াতে পায় না।

ও মীনাক্ষীকে দেখতে না পেয়ে, তার খোঁজ করতে গেল।

কিন্তু মীনাক্ষী কোথায়?

মাকে কাকি-দিদার আগমনবার্তা জানিয়েই সে হাওয়া হয়ে গেছে।

 ৪. সংসারের ঘটনা

বিজয়াই ছেলেকে নিয়ে বসলেন।

সংসারের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানিয়ে আক্ষেপ করলেন। সরোজাক্ষ যে বিজয়ার উপর শত্রুতা সাধতেই চাকরি ছেড়ে সংসারটাকে ভাসাতে বসেছেন, সেকথাও বলতে ছাড়লেন না।

কমলাক্ষ অবশ্য ওটা মানল না।

বলল, এ-ধারণার কোনও মানে হয় না তোমার। বাবা তো চিরদিনই ওইরকম অদ্ভুত আদর্শবাদী। একটা অবাস্তব পৃথিবীতেই বাস করলেন বরাবর। আর তোমরা কেই বা নয়? তুমি আছো তোমার নিজের বানানো এক অলৌকিক স্বর্গে, বাবা আছেন তাঁর আদর্শের পৃথিবীতে। আর আমরা, তোমাদের অভাগা সন্তানরা, মোহমুক্ত চোখ নিয়ে তোমাদের করুণা করছি। তা যাক, শ্ৰীমতী মীনাক্ষী দেবী গেলেন কোথায়? এসে পর্যন্ত তো তাঁর টিকি দেখছি না।

মীনা?

বিজয়া ঠোঁট উলটে ছোট ছেলের কাছে তাঁর ছোট মেয়ের পাখা গজানোর বার্তা শোনান এবং শিগগিরি যে সে একটা অজাত-কুজাতকে বিয়ে করে বসবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেন।

কমলাক্ষ মার কথাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না বটে, কারণ বরাবরই জানে মার তিলকে তাল করা রোগ, তবে দাদা বউদির নতুন উন্নতির বিশদ খবরে চমকৃত না হয়ে পারে না। যা রটে তার কিছুও তো বটে।

আর দিদি? দিদির খবর কী?

দিদি!

বিজয়া ঠোঁটের সেই একই ভঙ্গি করেন, তিনিও সুবিধে পেলে বউদির দলেই যান, তবে কিপটে বলেই একটু রক্ষে। দুটিতেই তো সমান কিপটে! আসে যায়, এক পয়সার মিষ্টি কখনও হাতে করে আসে না।

মার এই একঘেয়ে কথা আর ভাল লাগছিল না কমলাক্ষর। তাই সে যাই, একটু ঘুরে আসি।বলে উঠে দাঁড়ায়।

এখন আবার কোথায় ঘুরতে যাবি মাথায় ফেট্টি নিয়ে?

মাথায় ফেট্টি? হু:, ওতে লজ্জা কী? ও তো বিজয়-গৌরবের স্বাক্ষর!

বলে হাসতে হাসতে চলে যায় কমলাক্ষ।

কিন্তু নীচতলায় সারদাপ্রসাদ ধরে।

তোমার আর কবছর বাকি?

আর এক বছর, কমলাক্ষ হেসে বলে, যদি অবশ্য ফেল না করি। কেন বলুন তো?

সারদাপ্রসাদ বলে, অ্যাঁ? ফেল করবে কেন?

পাশ করছি কেন এই ভেবেই তো অবাক হচ্ছি মাঝে মাঝে। সারা বছরই তো ফাঁকি দিই।

সারদা গম্ভীর হয়।

বলে, বাবার মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পয়সা। সে পয়সা এইভাবে অপচয় করো?

কমলাক্ষও সহসা গম্ভীর হয়।

বলে, হঠাৎ এ-প্রশ্নটা আপনার মাথায় উদয় হল যে?

হওয়ার কারণ রয়েছে। তোমার বাবা কলেজ ছেড়ে দিয়েছেন জানো না বোধহয় তুমি!

জানতাম না। মার কাছে জানলাম।

তা এখন তো সংসারের কথা সকলকেই ভাবতে হবে, সারদাপ্রসাদ তার মুখে বেমানান একটা গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, নীলু তো ঝেড়ে জবাব দিয়েছে।

কমলাক্ষ হালকা গলায় বলে, বাবাকে ওই পাগলামিটা ছাড়তে হবে। আবার গিয়ে জয়েন করতে হবে।

ছেড়ে দিয়ে আবার?

সারদাপ্রসাদ অবাক চোখে তাকায়।

কমলাক্ষ ওই অবাকটা বোঝে না। বলে, সেটা অসম্ভব নয়। বুঝিয়ে একটা চিঠি লিখলেই হবে। বললেই হবে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কাজটা করেছিলাম

তোমার বাবার কথা হচ্ছে কমল!

সারদার গলা শান্ত শোনায়।

কমলাক্ষ চঞ্চল হয়ে ওঠে। কমলাক্ষ অশান্ত গলায় বলে, বাবা তো চিরকালই একটা অবাস্তব বুদ্ধিতে চললেন। অন্য অন্য জায়গায় মাস্টাররা ঠেঙানি খেয়ে আবার হেঁট মুখে এসে কাজ করছে, আর বাবা একটু ঘেরাও হয়ে–আশ্চর্য! ঘেরাও আবার আজকাল কে না হচ্ছে? আচ্ছা আমি একটু বেরোচ্ছি।

কমলাক্ষ বেরিয়ে যায়।

পিছনের চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখে না।

দেখে না তাই ভাল। দেখলে চমকে যেত। সারদাপ্রসাদ নামের মানুষটার চোখে যে এমন আগুন জ্বলতে পারে সেটা তার ধারণার বাইরে।

.

আবার যে চোখ দুটো সর্বদাই প্রায় আগুনের ঢেলার মতো জ্বলত, সেই চোখ এমন মলিন নিষ্প্রভ নিভে যাওয়া কয়লার মতো দেখাতে পারে তেমন ধারণাও ছিল না একজনের।

কিন্তু দেখাচ্ছে তাই।

দিবাকরের চোখ দুটো যেন নিভে যাওয়া কয়লার মতো হয়ে গেছে।

কাল বিকেল চারটের গাড়িতে যেতে পারবে মীনাক্ষী?

মীনাক্ষী অস্বস্তির গলায় বলে,আচ্ছা ভোরবেলার কোনও গাড়ি ধরো না, যাতে সন্ধের গাড়িতে ফিরে আসা যায়।

তেমন কোনও গাড়ি নেই মীনাক্ষী! যেভাবেই যাও একটা রাত কাটাতে হবে।

তারপর দিবাকর বোঝতে বসে, শুধু দিনের আলোয় গিয়ে ঘুরে এলে, গ্রামের যথার্থ দৈন্য, যথার্থ চেহারা ধরা পড়বে না। তার জন্যেও অন্তত মীনাক্ষীর রাতটুকু থাকা উচিত-দেখবে–অন্ধকার মানে কী! দেখবে–অসহায়তা মানে কী! দেখবে কী আমাদের দেশ!

কিন্তু এতদিন দিবাকর তো অন্য কথাই বলেছে।

তা বলেছে বটে!

কিন্তু কেন বলেছে?

জ্বালায়।

ভেবেছে মনের মুক্তি এলেই বুঝি অবস্থারও মুক্তি আসবে। এখন বুঝছে সেটা ভুল।

অনেক কথা হয়!

অনেক কাঠ-খড় পোড়ে।

অবশেষে মীনাক্ষী রাজি হয়।

বাড়িতে কী বলবে?

বলুক না সাহসের সঙ্গে, একজন সহপাঠীর গ্রাম দেখতে যাচ্ছি। অনেকদিন ধরে বলছে।

.

কথা দিয়ে এল।

কিন্তু যেন মনের মধ্যে একটা পাষাণভার। আস্তে আস্তে বাড়ি ঢুকছিল, হঠাৎ কমলাক্ষকে দেখে যেন হাতে স্বর্গ পেল।

ছোড়দা তুই কখন এলি? হঠাৎ এখন? মাথায় কী হল?

একঝাঁক প্রশ্ন।

কমলাক্ষ যতটা সংক্ষিপ্ত করে সম্ভব উত্তরটা দিয়ে বলে ওঠে, তোমার কী ব্যাপার শ্রীমতী মীনাক্ষী দেবী, শুনলাম তোমার নাকি পাখা গজিয়েছে, তুমি নাকি উড়ছ, কোনদিন না হঠাৎ ফুড়ুৎ করে বনে পালাও।

শোনা হয়ে গেছে সব? মীনাক্ষী হালকা গলায় বলে, যাক বাঁচা গেছে, আমাকে আর খাটতে হল না।

তারপর মীনাক্ষী নিজের সমস্যার কথা পাড়ে।

কিন্তু কমলাক্ষ যেন এক ফুয়ে উড়িয়ে দেয় তার মনের পাথর।

এই ব্যাপার। এর জন্যে এত চিন্তা? নাঃ, তোদের এ যুগে জন্মানোই ভুল হয়েছে। ওই বিজয়া দেবীরই সমকালীন তুই। একদিনের জন্যে সহপাঠীর দেশে বেড়াতে যাবি, তাই নিয়ে এত দুশ্চিন্তা, এত ভাবনা!

আহা আমার নিজের জন্যে যেন–মীনাক্ষী ঝংকার দিয়ে ওঠে,আমাদের বাড়িটি কেমন, জানো না বুঝি? পারমিশন পেতে। এই কথাই বলে। বাধা তার নিজেরই মধ্যে, তা বলে না।

ওইখানেই ভুল। কমলাক্ষ বলে, ওটা পাবার চেষ্টামাত্র না করে নিজের মনে কাজ করে যাও, দেখবে সব সহজ হয়ে যাবে। এত কিছু নাবালিকা নও তুমি যে, একদিনের জন্যে কোথাও যেতে পাবে না। এটা কি ঊনবিংশ শতাব্দী নাকি?

মীনাক্ষী হয়তো একটু আশ্বস্ত হয়, কিন্তু মীনাক্ষী আশ্চর্য হয়। কতদিন আসেনি কমলাক্ষ! এর মধ্যে কী অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে তার।

কমলাক্ষই সর্বদা বলত,আরে বাবা, একটু বাধ্য বাধ্য ভাব, একটু মত নেওয়া নেওয়া খেলা, এগুলো করলেই যদি বুড়ো ভদ্রলোককে, আর পুণ্যশীলা মহিলাটিকে সন্তুষ্ট রাখা যায়, করলে ক্ষতি কী? সত্যি তো আর খোসামোদ করছ না? একটু ভোয়াজ দেখাচ্ছ, মিটে গেল সমস্যা।আসল কথা কাজ হাসিল। সেটা লাঠি মেরেও হয়, তোয়াজ করেও হয়। আমার মতে, তোয়াজটা অনেক সহজ। একটা যন্ত্র ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করলেও তেল দিতে হয়। আর এ তো মানুষ! দেখবি যথাসময়ে একটু তেল প্রয়োগে সব শান্ত।

কিন্তু এ কমলাক্ষ নতুন।

এর ভাষায় যেন দিবাকরের সুর।

পুরনো দিবাকরের।

এ বলতে চায়, সাবালক হয়েও নাবালকের ভূমিকা অভিনয় করে চোলো না। তুমি হচ্ছ তোমার। তুমি কারও ইচ্ছের পুতুল নও।

মা বাপ সম্মানের জিনিস, কিন্তু যতক্ষণ তাঁরা নিজেরা সম্মাননীয় রাখেন নিজেদের

একদা তাঁরা এই হতভাগ্যদের পৃথিবীতে এনেছিলেন বলেই তাদের কিনে রেখেছেন? কে তাঁদের আনতে মাথার দিব্যি দিয়েছিল?

কেউ না।

তাঁরা নিজেদের খেয়াল চরিতার্থ করতে যা করেছেন, আমরা তার অবাঞ্ছিত আকস্মিক ফলমাত্র।

.

কমলাক্ষর নতুন মতবাদে অবাক হয়ে যায় মীনাক্ষী। আর তারপরই সেই অবাক হওয়া মন আস্তে আস্তে সাহসী হয়ে ওঠে। সত্যিই বটে, কী তুচ্ছ একটা ব্যাপারকে কতটা উচ্চ মূল্য দিচ্ছে সে। ভারী তো কাণ্ড!

দিবাকরের সঙ্গে একটা ট্রেনে চেপে বসবে, নামবে, তার মার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। তারপর দারিদ্র্যের ঘরের আন্তরিকতার যত্ন সানন্দে গ্রহণ করে একটা রাত কাটিয়ে সকালে চলে আসা। এর জন্যে এত ভাবছে কেন?

তুই তো এখন আছিস?

তাই ভাবছি। অন্তত যতদিন না মাথাটা সারে।

ঠিক আছে। যদি গৃহকর্তা বা গৃহিণী বিশেষ আপত্তি শুরু করেন, তুই ম্যানেজ করে দিবি।

মীনাক্ষীর বুকের পাষাণভারটা নামে। মীনাক্ষী প্রস্তুত হয়।

.

সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফেরে নীলাক্ষ, সঙ্গে স্ত্রী। শ্বশুরবাড়ি থেকে তুলে এনেছে।

মাঝে-মাঝেই এ ব্যবস্থা হয়।

নীলাক্ষ অফিস যাবার সময় সুনন্দাকে তার বাপের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়, সুনন্দা সেখান থেকেই ছেলেকে স্কুল থেকে আনিয়ে নেয়। আবার এ-বেলা নীলাক্ষ শুধু স্ত্রীকে নিয়ে ফেরে, পুত্র থাকে। নিজেরা বেড়িয়ে ফিরে তাকে উদ্ধার করে আনে সেই রাত্রে।

বিজয়া যে ছোট ছেলেকে বলেছিলেন, ভাইপোকে দেখতে চাস তো তার মামার বাড়িতে যেতে হবে–কথাটা নেহাত অত্যুক্তি নয়।

ব্যবস্থাটা ক্রমশই এই খাতে গড়াচ্ছে।

আগে এত পিত্রালয়-প্রীতি ছিল না সুনন্দার, ক্রমশই বাড়ছে। আবার তার মায়েরও মাতৃস্নেহ বাড়ছে। একদিন মেয়েকে না দেখলেই নাকি তিনি চক্ষেহারা হন। অথচ আগে হতেন না।

কমলাক্ষকে দেখে অবশ্য খুশি হয় সুনন্দা, কিন্তু কমলাক্ষ হয় না। বিচ্ছুর অভাবটা তার বড় বেশি লাগে।

নিজে সে অনেক বদলেছে, তার হৃদয়যন্ত্রে সম্পূর্ণ নতুন সুর, অথবা অসুর। কিন্তু বাড়ির এই সুর বদল তার ভয়ংকর খারাপ লাগছে।

যেন যে জিনিসটা রেখে গিয়েছিল, সে জিনিসটা তার অনুপস্থিতিতে হারিয়ে গেছে।

হয়তো এইরকম হয়।

মানুষ নিজে প্রতিনিয়ত বদলায়, কিন্তু আশা করে, আমার পারিপার্শ্বিকতা অবিচল অবিকৃত থাকুক। নিজে সে তার মূল্য দিক বা না দিক, থাকাটা দরকার।

কমলাক্ষ তেমন করে কথা কইল না।

কমলাক্ষ তার নিজের ঘরে গিয়ে অসময়ে শুয়ে পড়ল।

কমলাক্ষ সর্বপ্রথম হাতজোড় করে বলেছিল, মাথার ব্যান্ডেজ প্রসঙ্গটা বাদে, অন্য প্রসঙ্গ।

তবু সুনন্দা বরকে বলল, আমার আজ বেরোতে ইচ্ছে করছে না।

কেন? কমলাক্ষবাবুর আপ্যায়নের জন্যে? নীলাক্ষ ব্যঙ্গের গলায় বলে, বাবু তো ভাল করে কথাই কইলেন না।

সুনন্দা ভুরু কোঁচকায়।

সুনন্দা ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, হঠাৎ এমন অদ্ভুত ধারণা হল কেন তোমার যে, আমি তোমার ছোট ভাইয়ের সেবাযত্নের জন্যে বাড়ি বসে থাকতে চাইছি?

তবে খামোকা বাড়ি বসে থাকবে কেন?

প্রত্যেকেরই ভাল লাগা, ভাল না-লাগা ব্যাপারটা আছে। আজ আমার ভাল লাগছে না।

নীলাক্ষ তবু কয়েকবার স্ত্রীকে অনুরোধ উপরোধ করল।

তারপর বিরক্ত হয়ে চলে গেল।

সুনন্দা এদিকের ছায়াও মাড়াল না। সুনন্দা অন্ধকার বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

সুনন্দার মনের মধ্যে যেন একটা ভাঙা গ্রামোফোন রেকর্ড বাজতে লাগল। যে রেকর্ডের কথাগুলো হচ্ছে এইরকম–এই বাড়িতে ওকেই সবচেয়ে ভালবাসতাম আমি। মানে যখন আমি সত্যিকার আমি ছিলাম। আর ও-ও আমার সবচেয়ে প্রীতির চক্ষে দেখত। এখন ও আমায় ঘৃণা করছে। করছে সেটা তো দেখতেই পেলাম।

শুধু ওরই নয়, এখন আমি আমার সমস্ত পুরনো পরিচিত জগতের কাছেই ঘৃণিত। কারণ আমার পুরনো আমিকে ভস্ম করে সেই ভস্মের টীকা পরে নৃত্য করছি।

তার বদলে আমি কী পেয়েছি?

পেয়েছি মেহেরা সাহেবের প্রেমমুগ্ধ দৃষ্টি। পেয়েছি শকুন্তলা রায়ের ঈর্ষা। আর পেয়েছি জগৎকে তুচ্ছ করবার ক্ষমতা।

এখন আমি আমার স্বামীকে অনায়াসে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারি। শ্রীমতী বিজয়া দেবীকে অবহেলার চরম দেখাতে পারি। পারি আরও অনেক কিছুই।

কারণ এই গৃহগণ্ডির বাইরে আমার যে একটা মূল্য আছে সেটা টের পেয়েছি আমি।

পাওয়ার খাতায় আরও জমা পড়েছে।

কিন্তু সুখ পেয়েছি কি?

নিদেন শান্তি?

অথবা আরও সস্তা জিনিস, স্বস্তি?

পাইনি।

ওর কোনওটাই পাইনি।

কারণ ওর বদলে ওই দামি দামি জিনিসগুলো আমি সত্যি চাইনি। আমি শুধু আমার স্বামীর ওপর আক্রোশ করে নিজেকে ধ্বংস করেছি।

এখন ও আমাকে ভয় পায়।

এটাকে যদি সুখ বলো তো সুখ।

অথচ কমল আমায় অগ্রাহ্য করে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল বলে আমার পৃথিবীটা বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে।

আমি চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেয়েছি। আমি ওর উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজের উপর প্রতিশোধ নিয়েছি।

আমার শ্বশুর আমায় শ্রদ্ধা করতেন, এখন আমি তাঁর সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারি না।

অথচ আমি ওঁর ঘরের সামনে দিয়ে মাতাল হয়ে টলতে টলতে আসি।

এই অদ্ভুত জীবনটার পরিসমাপ্তি কী, জানি না।

হয়তো যখন আমার ছেলে বড় হয়ে আমায় ঘৃণা করবে, তখন এর পরিসমাপ্তির চেহারা দেখতে পাব।

সুনন্দা নীচে রাস্তার দিকে তাকায়।

কতটুকু দুরত্ব?

হঠাৎ এখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে এখুনি সব প্রশ্নের উত্তর মিলে যেতে পারে কি?

এই মুহূর্তে সেইরকম একটা ইচ্ছে দুর্দম হয়ে উঠছে।

আশ্চর্য!

একটা খুদে ছেলে আমায় ঘৃণা করছে, তাই আমার কাছে সমস্ত পৃথিবীটা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে?

ছিঃ!

পেটে আজ আনন্দরস পড়েনি, তাই এমন দুরবস্থা।

শুনেছি মাতালদের মদ না খেলে অকারণ বিষাদ রোগ হয়।

আমারও তাই হয়েছে।

কী মজা! কী মজা! আমিও মাতাল। তার মানে আমি জাতে উঠেছি। আমি অভিজাত হয়েছি। আর আমায় গেরস্ত ঘরের বউ বলে চেনা যাবে না।

শকুন্তলা রায়ের পর্যায়ে উঠে গেলাম আমি।

কী মজা!

কিন্তু এত মজার মধ্যেও আমার কান্না পাচ্ছে কেন? আজ তো আমি নেশা করিনি। আমার শরীরের সব রক্তই কি তবে মদ হয়ে গেছে? নেশা না করেও নেশা হয়? তাই শুধু শুধু কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, শুধু শুধু হাততালি দিতে ইচ্ছে করছে।

ও-মা-গো, আমি কী করি?

.

ঝিকিমিকি বেলায় এই বাড়িটায় ওকে নিয়ে এসে ঢুকল দিবাকর। কিন্তু সেই ঝিকিমিকির পরমায়ু যে বেশি নয়, তা ধরা পড়ছে তার লালচে আভায়।

কিন্তু বাড়িটা কি গরিবের পাতার কুটির?

যে কুটিরে দিবাকরের মহীয়সী জননী তাঁর অগাধ স্নেহসাগর নিয়ে অপেক্ষা করে বসে থাকেন দিবাকরের আশায়?

না, সে বাড়ি এ নয়।

এ কোনও বিগতকালের ধনীর পরিত্যক্ত অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ।

যতক্ষণ স্টেশন থেকে হাঁটাপথে আসছিল মীনাক্ষী, ততক্ষণ বেশ ভালই লাগছিল তার। ঝোঁপঝাড় গাছপাতার মাথায় পড়ন্তবেলার আলোর লুকোচুরি, ছবিতে দেখা কুঁড়েঘরের মতো উঁচু উঁচু মাটির দাওয়া দেওয়া পাতার কুঁড়ে, পানাপুকুর, পায়েচলা পথ, ক্কচিৎ এক-আধটি গ্রামবধুর জল আনতে যাওয়ার দৃশ্য, মনের জগতে পাড়াগাঁয়ের যে ছবি আঁকা আছে, তার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে।

দিবাকর এইগুলোর পরিচয় দিতে অনর্গল কথা বলছিল, কিন্তু মীনাক্ষীর মনে হচ্ছিল এত কথার দরকার ছিল না। এর আর পরিচিতি দেবার কী আছে? আঁকা ছবিতে যা দেখেছে, সিনেমার ছবিতে যা দেখেছে, তারই জীবন্ত সংস্করণ বই তো নয়!

অনেকবার ভাবল বলে যে, দিবাকর তুমি একটু কম কথা বলো, শান্ত হও, ধীরে কথা কও, ওরে মন নত করো শির।কারণ সন্ধ্যা আসছে।

কিন্তু বলতে পারল না।

বলবার ফাঁক পেল না।

আবার কোনও এক সময় যখন ফাঁক পেল, তখন নিজেই কথার বীজ পুঁতে বসল। বলল,আচ্ছা, তোমাদের এখানে ইটের দেয়াল করতে নেই নাকি? সমস্তই তো দেখছি মাটির বাড়ি।

দিবাকর মৃদু হেসে বলে, মাটির মানুষদের দেশ যে।

তারপর পকেট থেকে রুমাল বার করে অকারণ তার সেই অগ্নি-গোলকের মতো চোখ দুটো মুছে নিয়ে বলে, এই মাটির দুখানা ঘর তুলতেই এদের যথাসর্বস্ব বাঁধা পড়ে, সারাজীবন ঋণ আর শোধ করে উঠতে পারে না।

মীনাক্ষী একটু ছেলেমানুষি গলায় বলে, বাঃ, তা কেন? মিস্ত্রিকে না দিয়ে নিজেরা করে নিলেই পারে? কী আর শক্ত?

দিবাকর উচ্চতরালে হেসে ওঠে। নির্জন পথে পথ চলতে দিবাকরের সেই হাসিটায় হঠাৎ যেন গা ছমছম করে ওঠে মীনাক্ষীর।

এতে এত হাসির কী আছে? ভয় ভাঙতেই বোধ করি তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে মীনাক্ষী, এতে এত হাসির কী আছে? যারা ঘর বানায় তারাও তো মানুষ? চাষা-টাষা মানুষরা যদি নিজেরা খেটেখুটে

নিজেরা খেটেখুটেই করে নেয় মীনাক্ষী, মিস্ত্রির স্বপ্ন দেখে না এরা। মেয়ে-পুরুষ, বালবাচ্চা সবাই মিলে খাটে। কিন্তু মাল-মশলা তো চাই?

মাল-মশলা? মীনাক্ষী অবাক হয়ে বলে, মাল-মশলা আবার কী? শুধু তো মাটি! চারদিকে এত মাঠ–।

নাঃ তোমাকে যতটুকু অবোধ ভেবে রেখেছিলাম, দেখছি তার দশগুণ অবোধ তুমি। মাঠ পড়ে আছে বলেই কি মাটি নেওয়া যায়? যার জমি সে আপত্তি করবে না? তা ছাড়া বাঁশ বাখারি, দড়ি পেরেক, এইসব চাই না?

বাঃ, ওর এত কী দাম!

অনেক দাম মীনাক্ষী, এদের কাছে ওই তুচ্ছ বস্তুগুলোই অনেক দামি।

দিবাকরের গলার স্বর ভারী হয়ে আসে। দিবাকর আস্তে মীনাক্ষীর কাঁধের উপর একটা হাত রেখে বলে, শহুরে নাট্যকাররা এদের দুঃখ দুর্দশায় বিগলিত চিত্তে জোরালো নাটক লিখে মঞ্চস্থ করে বাহবা লোটেন, কিন্তু জানো, এদের দুঃখের এক সহস্রাংশও তাতে প্রকাশ হয় না। এদের কথা ভাবো মীনাক্ষী! গভীর ভাবে ভাবো।

মীনাক্ষী চুপ করে গিয়েছিল।

মীনাক্ষীর মনটা ভারী ভারী হয়ে গিয়েছিল। মীনাক্ষীর মনে পড়েনি দিবাকরের হাতটা তার কাঁধের উপর রয়ে গেছে।

এক সময় দিবাকর আবার হালকা গলায় বলে, নাঃ, তোমার মনটা খারাপ করে দিলাম। কী জানো? দেশে এলেই–যাক গে, ওসব কথা থাক। হ্যাঁ, কী বলছিলে তখন? এখানে পাকাবাড়ি আছে কিনা। তা একেবারে নেই, তা নয়। অনেক হতভাগ্যের মধ্যে, এক-আধজন ভাগ্যবানও থাকে তো৷

দিবাকর, তুমি যে বলেছিলে স্টেশন থেকে খুব বেশি দূরে নয় তোমাদের বাড়ি, কিন্তু অনেকক্ষণ তো হাঁটছি।

গ্রামের হিসেবে এইই সামান্য মীনাক্ষী! তোমার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে?

না না, কষ্ট হতে যাবে কেন? এমনি বলছি।

আর একটু কষ্ট করতে হবে।বলেছিল দিবাকর।

তারপর বেলা যখন মরণোন্মুখ, তখন দিবাকর এই ধ্বংসগ্রস্ত পোড় অট্টালিকাটায় এসে ঢুকল মীনাক্ষীকে নিয়ে।

মীনাক্ষী অবাক হয়ে বলে, এখানে কী? এটা তোমার বাড়ি নাকি?

না। আমার কেন হবে? দিবাকর হঠাৎ যেন ব্যঙ্গের গলায় কথা কয়ে ওঠে,নিন্দে করছিলে এখানে কোঠাবাড়ি নেই বলে, তাই কোঠাবাড়ি দেখাতে নিয়ে এলাম।

ওর এই স্বরটা ভাল লাগল না মীনাক্ষীর। ভয়ানক অস্বস্তি হল কপাট উড়ে যাওয়া জানলা দরজার ফোকরগুলো দেখে। ভয় করে উঠল ভাঙা দেয়ালের গায়ে গায়ে গাছের শিকড় নামা দেখে।

মীনাক্ষী তাই রুক্ষ গলায় বলে উঠল, নিন্দে আবার কখন করলাম? শুধু জিজ্ঞেস করেছি। ঘাট হয়েছে বাবা! চলল চলল, সন্ধে হয়ে আসছে, কোথা থেকে হয়তো সাপ-খোপ বেরিয়ে পড়বে ।

দিবাকর একটা নির্লজ্জ হাসি হেসে বলে, এক্ষুনি চলে যাব মানে? এত কলাকৌশল করে এত তোড়জোড় করে আসা কি এক্ষুনি চলে যাবার জন্যে?

সহসা চারধারের ভাঙা দেয়ালগুলো ভূমিকম্পে দুলে ওঠে, ঝিকিমিকি আলোটা মুহূর্তে গাঢ় অন্ধকারের গহ্বরে ডুবে যায়, একটা দাঁতখিচনো দৈত্য ওই ফোকরে ফোকরে উঁকি দিয়ে দিয়ে বেড়ায়।

মীনাক্ষীর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

মীনাক্ষীর বুকের ভিতরে প্রকাণ্ড একটা পাথরের চাঁই এসে বসে।

তবু মীনাক্ষী চিৎকার করে ওঠে, ভাঙা ভাঙা গলায়।

একথার মানে কী দিবাকর?

দিবাকর বিচলিত হয় না।

দিবাকর তেমনি নির্লজ্জ হাসি হেসে বলে, মানে অতি প্রাঞ্জল। কলকাতার সমাজে কোনওখানে তো পাওয়া যাবে না তোমায়, তাই অনেকদিনের একটা বাসনা পূরণ করতে এত কাঠখড় পোড়ানো

দিবাকর!

মীনাক্ষী তীব্র তিরস্কারে চেঁচিয়ে ওঠে, এতবড় শয়তান তুমি?

দিবাকর রূঢ় গলায় বলে, গরিব যদি জগতের কোনও ভোগ্যবস্তুর দিকে হাত বাড়ায় তা হলেই সে শয়তান বলে গণ্য হয়। কিন্তু এছাড়া তোমায় আমি পেতাম কী করে?

পাওয়া!

মীনাক্ষী অন্ধকার হয়ে যাওয়া পটভূমিকায় তার একদার প্রেমাস্পদের মুখটা দেখবার চেষ্টা করে। সবটা মিলিয়ে শুধু একটা ছায়ামাত্র দেখতে পায়। তার উদ্দেশেই ক্ষুব্ধ গলায় বলে, একে তুমি পাওয়া বলো?

বলি। তাই বলি– দিবাকর নিষ্ঠুর গলায় বলে,এইমাত্র স্বর্গ থেকে পড়নি তুমি মীনাক্ষী, এই পৃথিবীটাকে দেখনি তা নয়। আমাদের মতো রক্তমাংসের মানুষের কাছে পাওয়ার আর কোন অর্থ আছে তুমিই বলো?

দিবাকর, এত নীচ হোয়য়া না, নিজেকে এত ছোট কোরো না। তোমার সভ্যতার কাছে, তোমার ভদ্রতার কাছে নিজেই তুমি এ প্রশ্নের উত্তর চাও।

সভ্যতা? ভদ্রতা? ওগুলো তো স্রেফ এক-একটা মেকি শব্দ। আমি ওর ধার ধারি না। আমি ঠিক করেছি

তুমি কী ঠিক করেছ, সেটা আমার না জানলেও চলবে–মীনাক্ষী ভিতরের ভয় চাপা দিয়ে সহজ ভাব দেখায়। যেন দিবাকর নামের ওই ছেলেটা একটা বাজে বিষয় নিয়ে তর্ক করছে এইভাবে জোরে জোরে বলে, তোমার বাড়ি দেখার সাধ আমার মিটেছে, এখন দয়া করে এখান থেকে বেরিয়ে চলো দিকি। স্টেশনের দিকে চলল। অদ্ভুত! যেন একটা হিন্দি সিনেমার ভিলেনের অভিনয় করতে বসেছ তুমি।

দিবাকর পকেট থেকে একটা টর্চ বার করে। এদিকে ওদিক দেখে নিয়ে আবার পকেটে পুরে ফেলে মীনাক্ষীর একটা হাত চেপে ধরে কাছে টানবার চেষ্টা করে বলে, ঠিকই বলেছ। তোমাদের তথাকথিত রোমান্টিক নায়ক হবার বাসনা আমার নেই। ভিলেনই হতে চাই আমি। অনেক চেষ্টা করে, অনেক মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে এ ব্যবস্থা করেছি, দয়া করবার ক্ষমতা আজ আমার নেই। এ বাড়ির ও-পাশের একটা অংশ বাসযোগ্য আছে, এবং বাস করেও একজন। আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে সে আজকে ঘরের অধিকার ছেড়ে চলে গেছে। একদা কোনও এক রাজা-মহারাজার বাগানবাড়ি ছিল এটা

দিবাকর! আমি তোমার এই বাড়ির ইতিহাস জানবার জন্যে ব্যগ্র নই। হাতটা ছাড়িয়ে নেয় মীনাক্ষী, খুব খারাপ লাগছে আমার।

কিন্তু হাতের তালুটা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল তার। ওই লোকটা যে একদা তার বন্ধু ছিল, এটা আর মনেও পড়ছে না। একটা হিংস্র জানোয়ারের সামনে পড়ার মতোই অবস্থা হচ্ছে তার। আর ছুটে পালাবার চিন্তাটাই পেয়ে বসে তাকে।

কিন্তু সূর্যালোকের শেষ কণিকাটুকুও যে মুছে গেল! মীনাক্ষী চারধারে গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। মীনাক্ষী তবু সেই অন্ধকারেই সেই ভাঙা অট্টালিকার দেউড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে। ছুটতে চেষ্টা করে।

কিন্তু কোথায় ছুটবে?

এই নীর অন্ধকারে কে জানে কোথায় আছে কাঁটা ঝোঁপ, কোথায় আছে ডোবা পুকুর। দিবাকর এগিয়ে আসে। বলে, মীনাক্ষী, বৃথা ছেলেমানুষি কোরো না। এটা লোকালয়ের থেকে অনেক দূরে, চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ শুনতে পাবে না। আর পৃথিবীর কেউ জানতেও পাবে না, তোমাকে আমি কয়েক ঘণ্টার জন্যে পৃথিবী থেকে চুরি করে এনে—-

মীনাক্ষী হঠাৎ নিচু হয়ে একখানা ভাঙা ইট কুড়িয়ে নেয়। ঘৃণার গলায় বলে, ইতর শয়তান, ছোটলোক! আর এক পা-ও যদি এগোও, তোমার প্রাণের চিন্তাও করব না আমি তা জেনো৷

করো, তবে খুনই করো আমায় দিবাকর যেন কৌতুকের গলায় বলে, ভেবেছিলাম একরাতের জন্যে স্বর্গের টিকিট কিনছি, তা যখন হবে না, তখন তোমার হাতে মরেই স্বর্গে যাই।

পাকা অভিনেতা দিবাকর দাস, তেমনি ভাবেই বলে, মনে একটা অহংকার ছিল, বুঝি গরিব চাষা হয়েও রাজকন্যার ভালবাসা পেয়েছি। দেখছি সে অহংকার মিথ্যে।

মীনাক্ষী একটু নরম হয়।

নরম গলাতেই বলে, সেটা বুঝতে পেরেছ তার জন্যে ধন্যবাদ। আশা করি বুঝে ফেলে আবার সেই মিথ্যেটাকে গায়ের জোরে সত্যি করে তোেলার চেষ্টা করতে যাবে না। নাও, টর্চটাকে বার করো দিকি, চলো–

হঠাৎ হেসে ওঠে দিবাকর, জোরে জোরে বলে, যার অন্য জোর নেই, তার গায়ের জোরই ভরসা। মিথ্যে আর ভুগিও না, হাতের ইটটা ফেলল। আশ্বাস দিচ্ছি, জগতের কেউ জানতে পারবে না। আবার তোমায় যথাযথ ফেরত নিয়ে যাব।

তোমার কৃপার কথা মনে থাকবে–মীনাক্ষী অন্ধকারেই ক্ষীণ নক্ষত্রলোককে ভরসা করে এগোতে এগোতে বলে, তবে দরকার হবে না, আমি নিজেই যেতে পারব।

মীনাক্ষী চেষ্টা করে করে অন্ধকারেই এগোতে থাকে।

কিন্তু মীনাক্ষীর নিয়তি বুঝি অলক্ষ্যে ক্রুর হাসি হাসে। ঠিক সেই সময় সহসা শূন্য প্রান্তরের দিকে দিকে তীব্র চিৎকারে আকাশ সচকিত করে তোলে স্বেচ্ছাবিহারী গ্রাম্য শেয়ালের দল।

মীনাক্ষী যে-শত্রুর ভয়ে পালাচ্ছিল সেই শত্রুকেই ডেকে ওঠে, দিবাকর টর্চটা ধরো। তোমার ধর্মের দোহাই।

কিন্তু দিবাকর কি ওকে আলো দেখাবার জন্যে, ওর ফিরে যাবার পথ সুগম করার জন্যে টর্চটা ধরে? দিবাকর কি ধর্মের ধার ধারে?

তা ধারে না, তা ধারে না।

দিবাকর সত্যি সত্যিই সস্তা নাটকের ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করে।

মীনাক্ষীর হাতের ইট কোনও কাজে লাগে না।

অন্ধকারে স্থানচ্যুত হয়ে কোথায় হারিয়ে যায়।

মীনাক্ষীও বুঝি হারিয়ে যায় একটা অতলস্পর্শী অন্ধকারের মধ্যে।

.

লে বাবা! আমি এলাম মাথা ফাটিয়ে, আবার তুই এলি জ্বর করে–কমলাক্ষ চেঁচিয়ে বলে, ও মা দেখে যাও তোমার ছোট মেয়ে ফিরেছেন। তবে শুধু হাতে নয়, গ্রাম থেকে বেশ একখানি উপহার নিয়ে।…ব্যাপার কী বল দিকি? পাড়াগাঁয়ের মাটিতে গিয়েই কি ডোবার জলে ডুব দিয়েছিলি নাকি?

হ্যাঁ দিয়েছিলাম! তাই দিয়েছিলাম। মীনাক্ষী ক্লান্ত গলায় বলে, এখন একটু শুতে দে দিকি।

শুতে চায় মীনাক্ষী।

নিজেকে ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়তে চায়। কোনও কিছু ভাববে না, কোনও ঘটনা বিশ্লেষণ করতে বসবে, কাউকে দোষ দিতে যাবে না, নিজেকে ধিক্কার দেবে না, শুধু একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে একটু ঘুমোবে।

কিন্তু কে তাকে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দেবে?

অনভিজ্ঞ ওই ছেলেটা জ্বরশব্দটাকে বিশ্বাস করে নিচ্ছে বলেই কি বিজয়ানামের ভয়ানক অভিজ্ঞ তীক্ষ্ণদৃষ্টি মহিলাটি তাই বিশ্বাস করবেন?

.

এ সংসারে একটিমাত্র মানুষ সুখী ছিল, প্রকৃত সুখী।

কিন্তু তারও সুখ গেছে।

তার সেই মনোরম গৃহকোটরটি ছেড়ে পৃথিবীর হাটে নেমে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে সে। ভাবছে–

আশ্চর্য! কী বুদ্ধিহীন এই পৃথিবী! এ পৃথিবী যেন তার জানা জগতের বাইরের আর কিছু জানতেই চায় না। শুধু তাই নয়, যেটা তার অজানা তাকে ব্যঙ্গ করে, বিদ্রূপ করে, হাস্যকর বলে স্রেফ উড়িয়ে দেয়। একবার কৌতূহলের বশেও উলটে দেখতে রাজি হয় না।

দীর্ঘদিনের সাধনার ফল, প্রাচীন ভারতের জ্ঞান ও আধুনিক জগতের বিজ্ঞানের পাণ্ডুলিপির বোঝা বয়ে পৃথিবীর দরজায় ঘুরে এই মূর্খ পৃথিবী সম্পর্কে হতাশ হয়ে এখন সারদাপ্রসাদ চাকরি খুঁজছে।

অথচ জগতের কোনও কাজই জানে না সে। তবু সে শুধু যাকে পায় তাকেই বলে বসে, দাদা, একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারেন?

তবে ঝোঁক তার প্রেসে কাজ করবার।

হয়তো ওই প্রেসের চাকরির ঝোঁকের অন্তরালে কোনও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আশা প্রচ্ছন্ন আছে। তার।

কিন্তু সবাই চায় পূর্ব অভিজ্ঞতা!

আগে কোথায় কাজ করেছেন? কোন প্রেসে?

করিনি কোথাও। এখানে করব বলে এসেছি।

ওঃ, তা হঠাৎ প্রেসে কাজ করতে ইচ্ছে হল যে? অন্য কোথায় কাজ করতেন? ছেড়ে এলেন কেন এ বয়েসে?

সারদাপ্রসাদ বিরক্ত হয়।

রেগে রেগে বলে,কেন, কী বিত্তান্ত, এত কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাব কেন মশাই? আপনার চাকরি খালি আছে কিনা তাই বলুন।

অপর পক্ষই কি তবে ছেড়ে কথা কইবে, মেজাজ দেখাবে না? নাই বা তাকে বহাল করা হচ্ছে, চাকরি যে চাইতে এসেছে, সে-ই চাকর। অতএব মনিবের গলাতেই বলে তারা, আছে খালি। কিন্তু আপনাকে দেব না। তবে এইটুকু জেনে যান, ওইসব কেন কী বিত্তান্ত না জেনে কেউ আপনাকে একখানা অফিসারের চেয়ারে বসিয়ে দিতে আসবে না। একটা বেয়ারার কাজ করতে এলেও শুধু আপনার কেন, আপনার সাত পুরুষের ঠিকুজি কুষ্ঠির বিত্তান্ত জানতে চাইবে।

কেন? কেন শুনি মশাই? দাগী আসামি নাকি?

ওরা হ্যা-হ্যা করে হেসে ওঠে।

বলে, ওঃ চিড় খাওয়া! তাই বলি।

চিড় খাওয়া ব্রেনের লোক স্বাভাবিক হয় না।

কিন্তু সরোজাক্ষর ব্রেনেও কি চিড় খেয়েছে? তাই তিনি বাড়ির চৌকাঠের বাইরে পা দেওয়াটাও ছেড়ে দিয়েছেন?

ডাক্তারের নিষেধকাল কবে পূর্ণ হয়ে গেছে, তবু মানুষটা ঘর ছেড়ে নড়ে না, এ কী কুদৃশ্য!

কমলাক্ষ মায়ের কাছে এসে বলে, ব্যাপারটা কী বলল তো মাদার? কর্তা আর রাস্তায় বেরোন না কেন? অসুখ তো কিছু দেখি না।

বিজয়ার মাথার মধ্যে এখন সর্বদাই আগুন জ্বলছে। বিজয়া তাঁর ছোট মেয়েকে উঠতে বসতে ভস্ম করছেন আর নিজের মৃত্যুকামনা করছেন।

তাই বিজয়া তাঁর অনেকদিন পরে বাড়ি আসা ছোট ছেলেটাকেও রেয়াত করে কথা বলেন না। কড়া গলায় উত্তর দেন, কেন বেরোন না তা আমায় জিজ্ঞেস করতে এসেছিস কেন? আমায় রাতদিন তার সঙ্গে গলাগলি করতে দেখছিস বুঝি? যা না, নিজে জিজ্ঞেস করছে না।

আমি? বাপস!

কমলাক্ষ ভয়ের ভান করে।

কেন, বাপস কেন? বিজয়া তিক্ত গলায় বলেন, নিজের বাপ বই পাড়ার লোক নয়, পাগল-ছাগল হয়ে যাচ্ছে কিনা তোরা দেখবি না তো দেখবে কে?

আমার দরকার নেই বাবা!

কমলাক্ষ বলে, আমি শিগগিরই চলে যাচ্ছি বাবা! বাড়ির যা অবস্থা দেখছি।বাড়ির কর্তাটি তোমার ভাষায় পাগল-ছাগল হয়ে যাচ্ছে, বাড়ির গিন্নি সর্বদাই সিংহবাহিনী, বাড়ির বড় ছেলে গোল্লার দোরে গিয়ে বসে আছেন, বাড়ির বড় মেয়ে একবার করে এসে ছটা বিকীর্ণ করে চলে যাচ্ছেন, বাড়ির ছোট মেয়ে মিছিমিছিজ্বর বলে রাতদিন শুয়ে আছেন, আর বাড়ির যে একটা মজার মানুষ ছিল, সে রাস্তায় চাকরি দেবে গো? চাকরি দেবে গো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিজয়ার মাথায় আগুন জ্বলছে, তবু বিজয়া থমকে ভুরু কোঁচকান। বিজয়া বলেন, চাকরি চাকরি করছে কে?

কেন, শ্রীযুক্ত পিসেমশাই!কমলাক্ষ হো হো করে হেসে ওঠে, বাবা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, তাই উনি সংসারের ভার নেবেন। সোজাসুজি বাবার চেয়ারটায় গিয়ে বসলেই পারেন।

বিজয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, চাকরি খুঁজছে? সংসারের জন্যে? তাই বুঝিয়েছে বুঝি তোকে? ওই একখানা লোক! কী ঘুঘু, কী ঘুঘু! তোদের সবাইকে ও এক হাটে বেচে অন্য হাটে কিনতে পারে। রাতদিন ঘুরে বেড়াচ্ছে ও কেন জানিস? ওর সেই মস্ত দামি মহাভারতখানি ছাপাবার তালে। সেই বই ছাপলেই নাকি পৃথিবী জুড়ে ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে। সব বদমাইশি। ওই ছল করে সারাজীবন শালার ঘাড় ভেঙে রাজার হালে কাটিয়ে এল, এখন দেখছে সেখানে মৌচাকের মধু শুকিয়ে এসেছে, তাই নিজের নেশার খরচটার জন্যে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে।

নেশা? আরে দূর! কমলাক্ষ বলে ওঠে,ও অপবাদটি অন্তত ও ভদ্রলোককে দিও না।

বলেই হঠাৎ চুপ করে যায়।

কমলাক্ষর মনে হয় জগতের কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না।

বিজয়া ছেলের এই ভাবান্তর দেখেন এবং তার কারণটাও অনুমান করতে পারেন।

তাই বিজয়া চাপা রোষের গলায় বলেন, সংসারসুদ্ধ সকলেরই তো ব্যাখ্যা করলি, বলি, বাড়ির বউয়ের কথাটা বুঝি বলতে সাহস হল না?

কমলাক্ষ একটু চুপ করে থাকে।

তারপর অস্তে বলে, সাহস হল না নয় মা, রুচি হল না।

আস্তেই বলে।

কারণ সুনন্দা এখন বাড়ি আছে।

কেন কে জানে সুনন্দা এখন প্রায়ই বাড়ি থাকছে।

সুনন্দা বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেছে।

সুনন্দা সন্ধ্যাবেলায় সেজেগুজে নীলাক্ষর সঙ্গে বেরোচ্ছে না।

কিন্তু কেন?

বিজয়া মনে-মনেই প্রশ্ন করেন, কেন? হঠাৎ এ পরিবর্তন কেন?

চোরের মন ভাঙা বেড়ায়, তাই বিজয়া নিজের ভাঙা বেড়াটার দিকেই তাকান। বিজয়ার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়, সুনন্দা মীনাক্ষীকে সন্দেহ করছে। সুনন্দা মীনাক্ষীকে লক্ষ করবার জন্যেই বাড়িতে থাকছে।

সন্দেহ করতেই পারে।

মেয়েমানুষের চোখ! ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। মীনাক্ষীর যে কোনও অসুখ করেনি, মীনাক্ষী যে শুধু মরমে মরে পড়ে আছে, একথা সুনন্দা বুঝতে পেরেছে।

বিজয়া ভাবেন, আমি কি একদিন ওই পাজি বউটার সঙ্গে কোনও উপলক্ষে ঝগড়া বাধিয়ে ওকে বাড়িছাড়া করব?

তা হলে হয়তো মীনাক্ষীর ব্যাপারটা লোক জানাজানি হয়ে যাবে না। তা হলে হয়তো মীনাক্ষী আস্তে আস্তে সামলে ওঠবার সময় পাবে। তারপরেই ধরে বেঁধে একটা বিয়ে দিয়ে দেবেন তার।

হয়তো সুনন্দার পরিবর্তনের মূলে অন্য কিছু।

হয়তো সুনন্দা তার ননদের দিকে তাকায়ওনি, তবু বিজয়া ওই কথাই ভাবছেন।

কিন্তু একদিন সত্যিই সুনন্দা তাকিয়ে দেখল।

সুনন্দা লক্ষ করল মীনাক্ষীর জন্যে কোনও ডাক্তার আসে না, মীনাক্ষী উঠে গিয়ে ভাতটাতও খায়, অথচ মীনাক্ষী কলেজ যায় না, রাতদিন ঘরের মধ্যে পড়ে থাকে।

সুনন্দা ভাবে, তবে কি মীনাক্ষী কোনও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি? তাই লজ্জায় এরকম করছে?

হয়েছে ভাল।

বাবা বাড়ি থেকে বেরোনো ছেড়েছেন, বাবার মেয়েও তাই করছে। আর বাবার পুত্রবধূও সুনন্দা মনে মনে যেন নিজের জন্যেই ব্যঙ্গ হাসি হাসে, বাবার পুত্রবধূও বাইরের পৃথিবী থেকে ডানা গুটিয়ে নিয়ে এসে ঘরে বসতে চাইছে। এবার কি তবে ব্রতকথার গল্পের মতো অতঃপর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ঘরকন্না করবে?

না কি এ শুধু কোনও একটা ঝড়ের আগের গুমোট?

সুনন্দাও নিজের ঘরেই থাকতে ভালবাসে।

যেন এটা একটা হোটেল।

একই রান্নাঘরে রান্না হয় এদের, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের লোক, ঘরে ঘরে বাস করে।

একদা যে এরা একই পরিবারভুক্ত ছিল, এরা একই জায়গায় বসে গল্প করত, খেত, পরস্পরের দিকে তাকালো, পরস্পরের কথা জানত, তা আর যেন এখন কারুর মনে পড়ে না।

অথচ ছিল সে অবস্থা।

সরোজকে কখনওই বেশি কথা বলতেন না, তবু তাঁর আশেপাশে এসে বসত সবাই।

সুনন্দা বলত, বাবা, এই বইটার এখানটা ঠিক বুঝতে পারছি না, বলুন তো লেখক এখানে কী বলতে চেয়েছেন?

মীনাক্ষী বলত, উঃ কী করে যে বউদি অত মোটা মোটা বইগুলো এক-একদিনে শেষ করে!

কমলাক্ষ তখন তো বাড়িতেই।

কমলাক্ষ চাপা গলায় বলত, মানুষ যে কেন পড়ার বইয়ের বোঝা টানার পরও আবার বই পড়তে বসে, এ আমার বুদ্ধির বাইরে। রেখে দাও বউদি, বই রেখে দাও, নইলে এ বাড়ির কর্তার হাওয়া গায়ে লাগবে। তার চেয়ে একহাত ক্যারাম হয়ে যাক।

নীলাক্ষ বলত, দ্যাখ কমল, লেখাপড়া শিখে ঢিকিয়ে টিকিয়ে চাকরি করে কিছু হয় না। যদি বড়লোক হতে চাস তো ব্যবসা করতে হবে। বিজনেস জিনিসটা কী, সেটাই শিখতে চেষ্টা কর এখন থেকে।

ময়ূরাক্ষীও তখন বাড়িতে।

ময়ূরাক্ষী তখন কুমারী।

ময়ূরাক্ষী বলত, থামো তুমি দাদা! বাঙালির মাথায় ওসব হয় না। যারা লোটা কম্বল সম্বল করে দুপয়সার ছোলাভাজা খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতে পারে, তারাই পারে ওসব। বাঙালির রুচি আলাদা।

আর হঠাৎ সেই আসরে পাগলা সারদাপ্রসাদ এসে পড়ে বলে উঠত, তোরা এইসব বাজে কাজে মত্ত হয়ে সময় নষ্ট করছিস, অথচ আমার সেই নতুন চ্যাপ্টারটা শুনতে বলছি, সময়ই হচ্ছে না তোদের! অথচ শুনলে বুঝতিসকী ইন্টারেস্টিং! রাবণ স্বর্গের সিঁড়ি গাঁথছিল, গাঁথতে গাঁথতে অসমাপ্ত রেখে মরে গেল। আসলে ব্যাপারটা কী? রাবণ দূরপাল্লার রকেটের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিল। আরও কিছুদিন সে পরীক্ষা চালিয়ে যেতে পারলে কাজটায় সফল হতে পারত, চাঁদে মঙ্গলে শুক্রে যেতে পারত। কিন্তু তার আগেই রাবণব্যাটা একটা পাপযুদ্ধে নেমে ধ্বংস হল। যেমন এখন ভিয়েতনামের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কিন্তু কে বলতে পারে রাবণের সেই ফরমুলাটাই কোনওরকমে এ যুগে কারও হস্তগত হয়েছে কিনা। সেকালে লোকে মন্ত্রগুপ্তি করতে ওইসব ফরমুলা তামার সিন্দুকে পুরে জলে ভাসিয়ে দিত।তা সেই রাবণের ফরমুলাই পাক, কিংবা নিজেরাই আবিষ্কার করুক, এ যুগ কিছু নতুন করছে না, সেটাই তোমাদের শোনাতাম।

.

কিন্তু সারদাপ্রসাদের কথা কেউই শুনতে চাইত না। পাশ কাটাত। কিন্তু তাকে অপমান করে নয়, কৌশল করে।

তারপর ওর আড়ালে হাসাহাসি করত।

সেই পারিবারিক আসরে অনুপস্থিত থাকতেন শুধু বিজয়া। বিজয়া তাঁর ঠাকুরঘরের দুর্গে বসে থাকতেন।

কিন্তু আজকাল বিজয়া আর অষ্টপ্রহর সেই দুর্গে বসে থাকতে পাচ্ছেন না।

বিজয়া যেন ছটফটিয়ে নেমে আসছেন।

বিজয়ার গলা যখন-তখনই দোতলায় একতলায় শোনা যাচ্ছে।

বিজয়ার কি হঠাৎ খেয়াল হয়েছে বাড়ির গিন্নি নিজেকে সংসার থেকে ভাসিয়ে রাখলে সংসারটা ভেসে যায়?

বিজয়ার কথা বিজয়াই জানেন, তবে সরোজাক্ষ মাঝে মাঝে বিস্মিত হন। সরোজাক্ষ জীবনে যা না করেছেন, তাই করেন এক এক সময়। বিজয়া কী বলছেন শুনতে চেষ্টা করেন।

বিজয়ার উচ্চ চিৎকার থেকেই সরোজাক্ষ একদিন টের পান, সারদাপ্রসাদ চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

অথবা বেড়াচ্ছেন না, ছল করে রাস্তায় ঘুরছেন।

সরোজাক্ষ স্তব্ধ হয়ে যান।

সরোজাক্ষ নিজের কর্তব্য নির্ণয় করতে বসেন।

কিন্তু একদিন বিজয়ার আশঙ্কা সত্য হয়।

সুনন্দা তার ননদের দিকে তাকায়।

সুনন্দা একদিন তার ঘরে ঢুকে পড়ে বলে, তোর কী হয়েছে বল তো মীনা?

জানলা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে ঘরের দেয়ালে পড়েছিল, মীনাক্ষী তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে জানলাটা বন্ধ করে দিল।

ওই পড়ন্ত বেলার ঝিকিমিকি আলোকে বড় ভয় মীনাক্ষীর। ওটা যেন একটা সর্বগ্রাসী কালো দৈত্যের সোনালি মুখোশ। মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে মুখোশটা, মুহূর্তে সেই কালো দৈত্যটা তার লোমশ থাবাটা বাড়িয়ে মীনাক্ষীকে চেপে ধরবে, সেই থাবার মধ্যে নিষ্পিষ্ট হয়ে যাবে মীনাক্ষী, মুছে যাবে মীনাক্ষী নামের মেয়েটা।

.

কিন্তু মীনাক্ষী নামের সেই মেয়েটা কি আছে এখনও? সেই ভীরু অথচ বিদ্রোহী, মৃদু অথচ সতেজ, এমনি উলটোপালটা উপাদানে গঠিত সেই মেয়েটা?

নিজে তো সে ভাবছে, সে শেষ হয়ে গেছে, মুছে গেছে, মরে গেছে। তাই পৃথিবীর দিকে পিঠ ফিরিয়ে চুপ করে বিছানায় পড়ে আছে সে।

এই পৃথিবীর দিকের একটি দরজা মাঝে মাঝে ঝড়ের ধাক্কায় খুলে যায়, আর সে ঝড় আছড়ে আছড়ে পড়ে মীনাক্ষীর উপর। রাতদিন শুয়ে থেকে থেকে আর কত মুখ পোড়াবে? বাড়ির লোক তো কানা নয়, তারা ভাবছে কী? জ্বর বলে শুয়ে থাকলেই তো আর লোকের সন্দেহের হাত এড়ানো যায় না? বলবে না তারা, এতদিন ধরে জ্বর যদি তো ডাক্তার আসে না কেন?

কিন্তু মীনাক্ষী সেই ঝড়ের মুখে বোবা কালা পাথর। মীনাক্ষী দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে।

কখনও কখনও সেই ঝড় আবার কাছে এসে ফিসফিস গলায় কথা কয়, মীনাক্ষীর গালে কপালে উত্তপ্ত নিশ্বাসের তাপ এসে লাগে। কেলেঙ্কারি তো করেই এসেছ বুঝতে পারছি, এখন চূড়ান্ত বিপদ কিছু ঘটেছে কিনা তাই বলো। তা হলে শতজন্মের নরক ভোগ স্বীকার করে নিয়েও তার ব্যবস্থা করতে হবে।

পাথরের কি অনুভূতি থাকে?

পাথরও কি ভয়ে বিস্ময়ে ঘৃণায় শিউরে উঠতে পারে?

বোঝা যায় না।

বোঝা গেলে হয়তো একটা তীব্র চিৎকার দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেত। ছি ছি! ছি ছি!

বলে উঠত–এই আমার পুণ্যবতী আর ধর্মশীলা মা।

আর্তনাদটা ওঠে না।

বোবা দেয়ালের দিকে মুখ করে পড়ে থাকে একটা বোবা পাথরের পুতুল।

ঝড়টা অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা ঘরে গিয়ে আছড়ে পড়ে। যে ঘরটা নাকি তার চিরশত্রুর ঘর।

মান-অপমানের মাথা খেয়ে তোমার কাছেই এসে পড়তে হল বউমা! তবে এও বলে রাখছি বাছা, এ কলঙ্ক শুধু একা আমারই নয়, তোমাদেরও। তোমার এই শ্বশুরকুলের কলঙ্কের কথা যদি রাষ্ট্র হয়, তো চুনকালি তোমাদের মুখেও পড়বে। আমি তো লক্ষ্মীছাড়া মেয়েকে জিজ্ঞেস করে করে হার মেনে গেছি, একটা বাক্যি বার করতে পারিনি মুখ থেকে। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো দিকি। আমার ভাগ্যিক্রমে আজকাল যখন বাড়িতে থাকচ্ছ।

সুনন্দা শুনল৷ সুনন্দাও প্রায় পাথরের পুতুলের মতোই ভাবশূন্য মুখে তার শাশুড়ির উত্তেজনা রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ওটাই এখন ওর প্রকৃতি।

যেন কিছু বুঝতে পারছি না।

তুমি সব বিশদ বোঝাবে, তবে আমি বুঝব।

অথচ সুনন্দা সবই টের পাচ্ছে।

কারণ সুনন্দা আজকাল প্রায়ই বাড়িতে থাকছে। আর মেয়েমানুষের প্রখর দৃষ্টিতে ঘটনার স্পষ্ট চেহারাটা ধরা পড়তে দেরি হচ্ছে না।

তবু সুনন্দা অবোধ সাজল।

তাকিয়ে রইল ভাবশূন্য চোখে।

দেখে অবশ্য হাড় জ্বলে গেল বিজয়ার, তবু বিজয়া মনের রাগ মনে চেপে আবার বললেন, লক্ষ্মীছাড়িকে বোঝাও গে একটু, এভাবে পড়ে থাকলে লোকলজ্জা বাড়বে বই কমবে না। আর এও জিজ্ঞেস করো গে একটা কিছু ঘটিয়ে বসেছে কিনা। ভগবান, এমন কপালও করে এসেছিলাম!

কপালের দুঃখ গাইতে পারেন বিজয়া, কারণ এই ভয়াবহ সংকটের সময় কিনা বড় মেয়ে কাছে নেই। সে গেছে বম্বে বেড়াতে। অজন্তা ইলোরা দেখে তবে ফিরবে।

মেয়ে থাকলে কি তিনি বউয়ের শরণাপন্ন হতেন? তা ছাড়া এখন যে আবার ঢঙিনী ঢং করে বাড়িতেই থাকছেন বেশি বেশি। বেশিরভাগ দিনই নীলু একা বেরিয়ে যাচ্ছে। কী কারণ কে জানে! বিজয়াকে পাহারা দিচ্ছে নাকি?

হ্যাঁ, এ কথাও ভাবতে দ্বিধা করেন না বিজয়া, হয়তো বিজয়ার উপর চোখ রাখতেই সুনন্দা বাড়ি বসে থাকছে। হয়তো দেখছে বিজয়া কী করেন।

যাক এখন একটি মোক্ষম চাল দেওয়া গেল, ভাবলেন বিজয়া, এ বাড়ির কলঙ্ককালিমা যে ওদের গালেও উঠবে সেটা বুঝিয়ে ছেড়েছি। এ কাহিনী আর বাপের বাড়ি গল্প করতে যাবে না। তা ছাড়া এ আস্থা আছে বউয়ের উপর, নিষেধ করলে বলবে না কাউকে। সে বরং নিজের বড় মেয়ের সম্পর্কে বিশ্বাস কম। তার পেটে কথা থাকে না।

বিজয়া তাই ভাবলেন, মান সম্মান খুইয়ে বউয়ের শরণ নিয়ে এখন উদ্ধার তো হই। তবু নিজ কপালকে ভর্ৎসনা করলেন।

বউ কিন্তু সেই দুঃখে সমবেদনা দেখাল না, শুধু অবাক গলায় বলল, আপনি যে কী সম্পর্কে কথা বলছেন, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।

বিজয়া একটু থতমত খেলেন, তারপরই এই হাড়ে বজ্জাত বউয়ের ন্যাকামিতে নিজের হাড়টাই জ্বলে গেল তাঁর। তবু সামলে বললেন, কী সম্পর্কে সেটা কি আর তোমার মতো বুদ্ধিমতাঁকে খুলে বলতে হবে বউমা? দেখছ তো ছোট ননদটাকে? আর ওর কী হয়েছে, তাও অবশ্যই অনুমান করতে পারছ?

অনুমান? আমি?

সুনন্দা আকাশ থেকে পড়ে।

আমি কী অনুমান করব? আমি কি ডাক্তার? স্লো ফিভার–মানে ঘুসঘুসে জ্বর কত কারণেই হয়।

জ্বর? জ্বরটা সত্যি ওর গায়ে নাকি বউমা? বিজয়া তীব্র চাপাগলায় বলেন,ও তো মনের জ্বর। সেই জ্বরে জর্জর হচ্ছে। সেই একদিন কোন চুলোয় রাত কাটিয়ে এসে কী সর্বনাশ যে ঘটাল কে জানে!

সুনন্দা অমায়িক গলায় বলে, পাড়াগাঁয়ে রাত কাটালে মশা থেকে ম্যালেরিয়া হতে পারে, জল থেকে বিকোলাই হতে পারে, ব্যাঙ থেকে—

থামো বউমা, তুমি আর ন্যাকামি কোরো না। বিজয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, মেয়েমানুষ হয়ে মেয়েমানুষের কী জ্বালা জানো না? তদবধি ও কেন ঘরের কোণে মুখ গুঁজে পড়ে আছে তা জানো?

শরীর খারাপ হলে তো থাকবেই।

তা সেই খারাপটাই কোন জাতের সেটাই দেখো। দেখে তার প্রতিকার করো। মশা ছারপোকা সাপ ব্যাঙ ছাড়াও শত্রু আছে মেয়েমানুষের। সেই শত্রুর নিপাত চেষ্টা করতে হবে।

এবার সুনন্দা ঘৃণা আর রাগের সংমিশ্রণে গঠিত একটা ভাব নিয়ে বলে, এসব কী বলছেন আপনি! মীনাক্ষী না আপনার নিজের মেয়ে?

বিজয়া ধিক্কারে বিচলিত হন না। বলেন, নিজের মেয়ে বলেই তো এত জ্বালা বউমা! পাড়ার মেয়ে হলে কি আর এইভাবে মরমে মরতাম? এখন দেখো গে যাও বাছা। তোমার উপর সব দায় ফেলে দিলাম! যা প্রতিকার করবার করো।

বললেন, অনায়াসেই বললেন এই মান-খোওয়ানো কথা।

কিন্তু সুনন্দা সেই ধুলোয়-পড়া সম্মানের দিকে না তাকিয়ে স্থির গলায় বলে, আপনি কিছু নিশ্চিত হয়েছেন?

তা নিশ্চিত ছাড়া আর কী? বিজয়া কপালে করাঘাত করেন, কী হাল হয়েছে মেয়েটার, তাকিয়ে দেখলে বুঝতে! লেখাপড়ায় এত মন ছিল, সে জিনিস ভাসিয়ে দিল। বই ছুঁচ্ছে না, কলেজ যাচ্ছে না।

বিজয়া হঠাৎ আঁচলে চোখ মোছেন।

সুনন্দা নির্নিমেষে একবার সেদিকে তাকিয়ে দেখে আরও স্থির ধাতব গলায় বলে, আপনি কী ধরনের প্রতিকারের কথা বলছেন?

বিজয়ার গায়ে বিষ ছড়ায়।

বিজয়ার গায়ে আগুন ছড়ায়।

তবু বিজয়া মেজাজ শান্ত রেখে ক্ষুব্ধ ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, সেকথা কি আমি তোমাকে শেখাতে যাব বউমা? তোমাদের একালে কত ব্যবস্থা হয়েছে, তোমরা আধুনিক মেয়েরা সেসবের কত জানো শোনো। প্রাণটা যাতে না যায়, সেভাবে

কথার মাঝখানে কথা বলে ওঠে সুনন্দা। হেসে উঠে বলে,আমাদের একাল তা হলে আপনাদেরও কিছু কিছু সুবিধে করে দিচ্ছে? আচ্ছা ঠিক আছে, দেখি কী করতে পারি।

.

এ ঘরে সুনন্দা দৈবাৎই আসে।

বলতে গেলে আসেই না।

আজ এল।

এসে মীনাক্ষীর পড়ার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়ে সহজ আন্তরিক গলায় বলল,কী রে মীনা, তুই নাকি পড়া ছেড়ে দিবি বলেছিস?

মীনাক্ষী এ আক্রমণে ভুরুটা একটু কোঁচকাল। বুঝতে পারল না, এটা আবার কী!

স্ব-ইচ্ছেয় এসেছে, না কারও প্রেরিত দূত হয়ে? কার হবে? ছোড়দাটাও তো চলে গেছে। মার প্রেরিত নিশ্চয়ই নয়। তবে কি বাবার? মীনাক্ষী নিজের মৃত্যুকে ডাকতে লাগল। আকস্মিক মৃত্যু।

সুনন্দা আবার বলল, মা বলছিলেন, তুই নাকি আর কলেজ-টলেজ যাস না, বই স না। অথচ জ্বরটর সব বাজে কথা।

সুনন্দার গলায় কোন বহু যুগের আগের ঘরোয়া সুর।

সুনন্দা কতকাল এ সুরে কথা বলেনি। মীনাক্ষীর কী হল কে জানে, সুনন্দার নিজের কানটাই যেন অনাস্বাদিত একটা স্নিগ্ধস্বাদে ভরে গেল। যেন এখনও এই সহজ ঘরোয়া কথা বলার শক্তিটা তার আছে। দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেছে সুনন্দা। কাটা-ছাঁটা গলায় মাপামাপা কথা বলতে বলতে সুনন্দা যেন যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল, সুনন্দা তাই এই আকস্মিক আবিষ্কার হয়ে যাওয়া শক্তিটার স্বাদ আর-এক গণ্ডুষ পান করতে চাইল।

সুনন্দা বলল, হল কি তোর? সারা বছর ফাঁকি দিয়ে, এখন বুঝি পরীক্ষার সময় ভয় ধরেছে?

ভয়। পরীক্ষার!

মীনাক্ষী হঠাৎ উঠে বসল।

মীনাক্ষীও বুঝি সুনন্দার এই নতুন রূপে অথবা পুরনোকালের রূপে বিচলিত হল। তাই মীনাক্ষী কথা বলল।

উদাস বিষণ্ণ গলায় বলল, আমি আর তোমাদের সেই মীনাক্ষী নেই বউদি।

সুনন্দা নির্লজ্জ বেশ করে পার্টিতে গিয়ে মদ খায়, সুনন্দা মেহেরা সাহেবের গায়ে ঢলে পড়ে হি-হি করে হেসে তার স্বামীর কর্মোন্নতির সহায়তা করে, সুনন্দা সর্বপ্রকার ভাবপ্রবণতাকে ব্যঙ্গ হাসি দিয়ে বিদীর্ণ করে, তবু মীনাক্ষীর ওই বিষণ্ণ মুখটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মায়ায় মন ভরে গেল তার। সুনন্দার মনে হল, হয়তো বা বিজয়ার সন্দেহটাই সত্যি।

কিন্তু সুনন্দা সেই জটিল সন্দেহটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না, হেসে উঠে বলল, নেই? তুই আর সে মীনাক্ষী নেই? কন্ধকাটা শাঁখচুন্নি হয়ে গেছিস?কই বুঝতে পারছি না তো? ঠিক তো আগের মতোই দুই হাত দুই পা দুই চোখ দুই কান ও একটি মাথাসমেত আস্ত একটা মানুষকেই দেখছি।

মীনাক্ষী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, বাইরে থেকে যা দেখা যায় সেটাই তো সব নয়।

সুনন্দা এক মুহূর্ত কী ভাবল, তারপর কৌতুকের গলায় বলে উঠল, সর্বনাশ! এ মেয়েটা কী বলে গো! ভিতরের অদৃশ্য কোটরে কিছু ঘটনা ঘটাচ্ছিস নাকি রে বাবা!

মীনাক্ষী চমকে ওঠে।

মীনাক্ষীর মনটা হঠাৎ বিমুখ হয়ে ওঠে।

ওঃ তাই!

বিদ্রূপ করতে আসা হয়েছে।

ওই মমতার কণ্ঠটুকু তা হলে ছল!

মীনাক্ষীর সেই বিষণ্ণ-বিধুর স্বরটুকুতে রূঢ়তার ছাপ পড়ে। মীনাক্ষী ঈষৎ সোজা হয়ে বসে বলে,ও, অনুসন্ধানে এসেছ?

সুনন্দা গম্ভীর হয়।

বলে, তোর অবশ্য সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। আমার প্রতি এর চাইতে উচ্চ ধারণা আর কীই বা হবে! কিন্তু এ ধারণা বদলালেও পারতিস! যদিও মার নির্দেশেই এসেছি আমি, তোকে সদুপদেশ দিয়ে প্রতিকারে প্ররোচিত করবার হুকুম নিয়ে। তবু থাক।সুনন্দা মুখ ফিরিয়ে বলে, ভেবে এক এক সময় হাসি পায় মীনা, অথচ একদা বাংলাদেশের লক্ষ্মী বউয়ের আদর্শটাই আমার আদর্শ ছিল।

মীনাক্ষী একটু চুপ করে থেকে বলে, হয়তো আদর্শ নামের লোকটা একদম ক্ষমতাহীন, ঘটনাচক্রই সমস্ত কিছুর নিয়ামক।

তা বটে! ঘটনাচক্রের কোপে পড়ে আমি তো একদিন তোদের মৈত্র পদবি ছেড়ে মিসেস মেহেরা হতে বসেছিলাম। শেষে আবার ওই ঘটনাচক্রই রক্ষে করল। একটা মদে চুরচুরে লোকের প্রেম নিবেদনের উপর আস্থা রাখা সমীচীন মনে হল না। এর জন্যে তোমার দাদা খুব ক্ষুব্ধ হলেন। ভেবেছিলেন ওই পদবি বদলের বদলে একটা বিরাট অঙ্কের চেক বাগাতে পারবেন। তা সে আশায় ছাই পড়ল। হতভাগাটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসে আবার তোমার দাদার স্কন্ধে ভর করলাম।

বউদি।

মীনাক্ষীর এই কদিনের নীরব হয়ে থাকা কণ্ঠে একটা তীব্র সুর ঝলসে ওঠে,দাদার মূর্তিটাকে এতটা নারকীয় করে বলবার দরকার ছিল না। তোমাকে তো কেউ কিছু বলতে যায়নি।

মীনাক্ষী ভেবেছিল, এ অপমানে সুনন্দা ঠিকরে উঠে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু তা গেল না সুনন্দা। ও সেই একই ভাবে চেয়ারের পিঠটায় দোলা দিতে দিতে বলে, তোকেও তো কেউ কিছু বলতে আসেনি। তবু তুই মৃত্যুশয্যার পণ নিয়ে পড়ে আছিস কেন? বিবেক না কী যেন সেই আছে না একটা? সেটাই হুকুম করে। সে যাক, মায়ের হুকুম হয়েছে তোমার যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তো, প্রতিকার অফিসে নিয়ে যেতে।

বউদি!

মীনাক্ষী তীব্র গলায় বলে ওঠে, মা বলেছেন এই কথা?

বললেন তো

কেমন একটা ঘৃণায় আর ধিক্কারে মীনাক্ষীর ঠোঁটটা যেন বেঁকে যায়। মীনাক্ষী তীব্রতর গলায় বলে, মা না রাতদিন ঠাকুর পুজো করেন? মা না মশা ছারপোকা পিঁপড়ে মারাকেও জীবহত্যা বলে ধরেন?

সুনন্দা হঠাৎ হেসে ওঠে।

সুনন্দা বলে, মানুষ নামের জীবটা এমনি সব উলটোপালটা জিনিস দিয়েই তৈরি রে মীনা! ওইজন্যেই বোধহয় বলে পঞ্চভূতের দেহ। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী বল?

মীনাক্ষী আবার শুয়ে পড়ে।

মীনাক্ষী দেয়ালমুখো হয়।

মীনাক্ষী যেন ধূসরকণ্ঠে বলে,পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। সেটা আরও একটা পাপ দিয়ে হয় না।

পাপ!

সুনন্দা যেন আকাশ থেকে পড়ে। সুনন্দার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে ওঠে। সুনন্দা ব্যঙ্গের গলায় বলে, কোন যুগে আছিস তুই যে, তাই এখনও পাপ পুণ্য, পাপের প্রায়শ্চিত্ত, এইসব পচা পুরনো শব্দগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস? রাবিশ!

কিন্তু এ ব্যঙ্গ কাকে করে সুনন্দা?

সত্যিই কি মীনাক্ষীকে?

মীনাক্ষীর দিক থেকে কোনও উত্তর আসে না। মীনাক্ষী যেন আবার পৃথিবীর দিকে পিঠ ফিরোয়।

সুনন্দা ওর ওই পৃথিবীর দিকে পিঠ ফিরোনো ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে,দেখ মীনা, অসতর্কে কাউকে যদি কুকুরে কামড়ায়, সে কি সেই কামড়ের বিষটাকে দূর করবার চেষ্টা না করে তাকে আঁকড়ে বসে বলে,বিষটা থাক! আমার অসাবধানতার প্রায়শ্চিত্ত করব।

মীনাক্ষী তথাপি নীরব।

সুনন্দা একটু অপেক্ষা করে ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, এ যুগের সভ্য সমাজকে তেমন করে দেখবার সুযোগ তোর আসেনি মীনা, তাই তুই এখনও তোর সেই প্রপিতামহীর সংস্কারের বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছিস। এভাবে অসুবিধে-মুক্ত হওয়াটা এখন এত বেশি স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, ও নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে, এটা শুনলেই লোকে হাসে।

বিউদি, আমার এসব কথা শুনতে কষ্ট হচ্ছে।

সুনন্দা একটু হেসে আস্তে কৌতুকের গলায় বলে, তার মানে অপরাধীটি নেহাত আততায়ী নয়? তোমার প্রেমপাত্র। তাই তার দেওয়া উপহার

বউদি! আমাকে নিজের ধরনে মরতে দাও।

সুনন্দা যেন একটা বাচ্চার অভিমান দেখছে, তাই সুনন্দা বলে ওঠে,এই তো নিজের ধরনে মরাটা তো হয়েই গেছে। এইবার আমাদের ধরনে বাঁচাবার চেষ্টা করব আমরা।

দোহাই তোমাদের বউদি! আমার জন্যে তোমরা একটু কম ভেবো। আমি নিজেই এত বেশি ভাবছি যে, যথেষ্টর অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে।

তবু তো বোকার মতো ডিসিশান নিচ্ছিস। আদি-অনন্তকাল ধরে যা চলে আসছে, হয়তো অনন্তকাল ধরেই চলবে, সেই সহজ পথটা ছেড়ে অন্য পথ ধরে চলতে চাইছিস। সেটা চাইলে সমাজে চলে না মীনা! যে প্রপিতামহীর সংস্কারের কথা বলছি, তাঁরও পিতামহী প্রপিতামহীদের আমল থেকেই সমাজের সমস্ত পবিত্রতা আর শুচিতার সংস্কারের অন্তরালে প্রবাহিত হয়ে চলেছে বিপন্মুক্তির অভিযান। পরিবারের সুনাম যাবে, বংশে কলঙ্ক পড়বে–এই ভয়ংকর ভয়ে জলজ্যান্ত মেয়েগুলোকেই রাতারাতি ভ্যানিশ করে দিয়েছে মানুষ–এ ইতিহাসও তো কম নেই? মোট কথা, পাপ পুণ্য ধর্ম বিবেক, ওগুলোর ধার ততক্ষণই ধারে মানুষ, যতক্ষণ অবস্থাটা থাকে বেশ পোেষা জন্তুর মতো শান্ত শিষ্ট বাধ্য। কিন্তু যে মুহূর্তে মানুষ দেখবে অবস্থা অসুবিধের হয়ে উঠেছে, সেই মুহূর্তেই তার পাপ পুণ্য ধর্ম বিবেক, এসবের সংস্কার মুছে যাবে। সেই অসুবিধেটা দূর করতে, করতে পারবে না এমন কাজ নেই। এই হচ্ছে সংস্কারের মূল্য, এই হচ্ছে চিরন্তন মূল্যবোধের মূল্য। পাপ পুণ্য ধর্ম অধর্মের একটা ফাটকাবাজার আছে বুঝলি? স্বার্থ আর সুবিধে এঁরাই হচ্ছেন সে বাজারের মালিক।

মীনাক্ষী ওদিকে পিঠ ফিরিয়ে থেকেই বলে, তোমার এই দামি-দামি কথাগুলো থাক বউদি, আমার ভাল লাগছে না।

সুনন্দা তবু যেন হাসির গলায় বলে, তা হলে বলছিস হেরে ফিরে যাব?

তোমার কোনটা হার কোনটা জিত জানি না বউদি, শুধু জানি আমিই বড় বেশি হেরে গেছি।

সুনন্দা তবু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, সুনন্দা তবু বোঝাতে চেষ্টা করে এ যুগ এই তুচ্ছ ব্যাপারটাকে নিয়ে চিন্তা করে না, এটাকে নিতান্তই অ্যাকসিডেন্ট বলে মনে করে। তারপর ফিরে যায়।

যাবার সময় শুধু আবারও বলে, বুঝলাম লোকটা তোর প্রেমাস্পদ, তাই পাপ প্রায়শ্চিত্ত এইসব শব্দগুলো বেছে নিয়ে মনকে চোখ ঠারছিস। কিন্তু তোর এই প্রায়শ্চিত্ত পদ্ধতিটা কোন মাটিতে বসে চালাবি তাই ভাবছি। যুগ যতই উদার আর প্রগতিশীল হোক, তুমি যে একটা গোত্র-পরিচয়হীন প্রাণীকে স্নেহের ছায়ায় আশ্রয় দিয়ে মানুষ করতে বসবে, সেটি চলবে না। কর্ণকে চিরদিনই কুন্তীর ক্রোড়চ্যুত হতেই হয়। হাজার হাজার বছরের পৃথিবীতে সমাজের কত পরিবর্তনই হল, কিন্তু কর্ণকুন্তী সংবাদটা অপরিবর্তিতই রয়ে গেল।

.

সুনন্দা হেরে ফিরে গেল।

কিন্তু বিজয়া কি হার মানবেন?

বিজয়া নিজের খুব শক্ত অসুখ বলে বড় মেয়েকে তারকরান। বিজয়ার এক ভক্ত গুরুভাইকে এই তারবার্তা প্রেরণের ভার দেন বিজয়া।

.

নীলাক্ষ বড় মুশকিলে পড়ে গেছে।

নীলাক্ষ বাইরের জগতে ঘুরছে যেন হালভাঙা নৌকোর মতো, হাতিয়ারহীন সৈনিকের মতো। অথচ কিছুতেই যেন সুনন্দাকে বশে আনতে পারছেনা। সুনন্দা প্রায় রোজই বলে-মাথা ধরেছে, বলে, জ্বর আসছে–বলে, মুড নেই।

আশ্চর্য!

এই যে মেহেরা সাহেব গাড়ি পাঠাতে চাইছে এবং সেইসঙ্গে এ ইশারাও জানাচ্ছে বেশি চালাকি চালালে নীলাক্ষ নামক মিথ্যে বাঘটাকে পুনর্মুষিক করে দেবে, এটা কি কম যন্ত্রণার?

তুই তুচ্ছ একটা মেয়েমানুষ, একটু উপকারে লাগিস বলেই না তোকে এত তোয়াজ করা, নইলে তোর কাছে হেঁট হতে আসি আমি? সেই সুযোগটুকু পেয়ে তুই আমাকে দেখাতে আসিস মুড?

অনবরত মনে মনে এই কথাগুলোই মনের মধ্যে ফুঁসতে থাকে নীলাক্ষর, কী দাম তোর? কী ছিলি আগে? সেই তো এক হাঁড়িঠেলা মা আর বাজারবওয়া বাপের বেটি। চেহারা তো ছিল তেল-জবজবে গাঁইয়া একটা মেয়ের মতো। সাতচড়ে রা বেরোতো না।কে তোকে এতখানি করে তুলল? ঘসে মেজে পিটিয়ে বুঝিয়ে, কে তোকে বাইরের পৃথিবীর যোগ্য করে তুলল? কে তোকে ওইসব লাখপতি কোটিপতিদের চোখের সামনে নিয়ে গিয়ে তুলে ধরল? এই আমি নয়? এখন আমায় তুই মুড দেখাতে আসিস? কারণ আমি তোকে মাথায় তুলেছি বলে, কেমন? সেই যে সেদিন? মেহেরা সাহেবটার সঙ্গে বলতে গেলে কেলেঙ্কারির তো কিছু বাকি ছিল না, তবু কিছু বলেছি আমি? দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করিনি? করেছিলাম কেন, না তুই আমার সাহায্যকারিণী সহধর্মিণী এই বিশ্বাসে। আর তোর বুদ্ধির উপর আস্থার বশে। বিশ্বাস রেখেছিলাম, আর একটু প্রশ্রয় দিয়ে তুই ওই মাতালটাকে কাত করে, তারপর সম্মানহানির ছুতো করে একটা মোটা খেসারত বাগাবি৷ তা নয়, তুই খালি হাতে ফিরে এসে স্বামীকে নস্যাৎ করতে কাটা কাটা বুলি ছাড়লি! একবার একটু এদিক ওদিকে সব সতীত্ব ধ্বংস হয়ে গেল তোমার!! ওটাও একটা শো বাবা, জানতে আর বাকি নেই। হয়তো কোনওদিন আমাকেই হুট আউট করে দিবি।

সারাক্ষণ মনের মধ্যে এই গজরানি নিয়ে কাটাচ্ছে নীলাক্ষ। অথচ সুনন্দাকে বাগ মানাতে পারছে না।

এমনকী বাপের বাড়িতেও তেমন বেশি বেশি যাচ্ছে না। সুনন্দার মা পর্যন্ত অনুযোগ করছেন, সুনু আর আসছে না কেন বাবা? বিচ্ছু বাবুকেও দেখতে পাচ্ছি না অনেকদিন

কিন্তু কেন সুনন্দার এই পরিবর্তন?

এ বাড়ির ছোট ছেলেটা, একদা নাকি যার বউদির প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ভালবাসা, সে অবজ্ঞা করেছে বলে?

আরে দূর দূর!

সুনন্দা কি পাগল? সেই ছেলেটা আবার একটা মনুষ্য পদবাচ্য নাকি? তাই তার একটু শ্রদ্ধা অশ্রদ্ধার প্রশ্নে সুনন্দা নামের দামি মানুষটা নিজেকে বদলাতে বসবে? তবে হয়তো তার ওই অবজ্ঞার আরশিতে হঠাৎ নিজের এই আত্মঘাতী মূর্তিটা দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে সুনন্দা। হয়তো ভাবছে, কার উপর আক্রোশ করে এই আত্মহনবনের যজ্ঞ করতে বসেছি আমি? যার উপর আক্রোশ, সে কি আক্রোশেরই যোগ্য?

গভীরে তলিয়ে গেলে হয়তো দেখা যায় আক্রোশের পাত্র নীলাক্ষ নামের ওই অর্থলোভী স্বার্থপর অন্তঃসারশূন্য লোকটাই নয়। হয়তো এ বাড়িতে যে আর একটি আত্মচিন্তা-কেন্দ্রিক পুরুষ নিজেকে সংসারের সমস্ত মালিন্য থেকে ভাসিয়ে নিয়ে উর্ধ্বে স্থাপন করে রেখেছেন, তিনি।

অভিমান বুঝি সুনন্দার তাঁরই উপর। যেন উনি রক্ষা করতে পারতেন, উনি সে কর্তব্য পালন করেননি। উনি কেবলমাত্র আপন অহমিকার পরিমণ্ডলে বাস করেছেন, আপন সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার দিকে সজাগ থেকেছেন। তার মানে উনি গৃহকর্তার কর্তব্য পালন করেননি। উনি ভেবেছেন পাছে কেউ ওঁর নির্দেশ না মানে!

কিন্তু সুনন্দার বাবা তো এমন নয়?

তিনি নিজের ওই সম্মানহানির ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন না কখনও। তিনি স্ত্রী পুত্র পরিবারকে বকেন, শাসন করেন, ভালবাসেন। অতএব তাঁর শাসিত প্রজাকুল সেটাকেই স্বাভাবিকনীতি ভেবে তটস্থ থাকে।

কিন্তু সরোজাক্ষ যদি হঠাৎ শাসন করতে নেমে আসেন? কেউ কি স্বাভাবিক ভাববে? শাসিতা নিজেদের অপমানিত ভাববে।

অথচ আমি সেইরকমই একটি সংসার চেয়েছিলাম– সুনন্দা ভাবে, সেই আমার ধারণাগত পারিবারিক আদর্শের ছাঁচে তৈরি সংসার। চেয়েছিলাম কল্যাণী বধু হতে, সেবাময়ী স্ত্রী হতে, স্নেহময়ী মা হতে। আমি তা হতে পেলাম না। আমার স্বামীর লোভের আগুনে ধ্বংস হয়ে গেলাম আমি।আমি নির্লজ্জ পোশাক পরাটাই বাহাদুরি বলে গণ্য করতে শিখলাম, লোকব্যবহারে আমি শালীনতা বর্জন করতে শিখলাম, আমি অকল্যাণের মশাল হাতে নিয়ে জীবনের সমস্ত মূল্যবোধগুলিকে পুড়িয়ে দিতে শিখলাম।

তার মানে আমি জগতের সেই চরমতম বোকামির নিদর্শন–চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার উদাহরণ হলাম। অথচ লোকে আমায় বুদ্ধিমতী বলত। আর আমিও বিশ্বাস করতাম সে কথা।

আপন জীবনটুকুকে যে নিজের মতো করে সাজাতে পারে না, ধুলোয় ছড়িয়ে ফেলে, তার আবার বুদ্ধির বড়াই!

.

কিন্তু শুধু সুনন্দাই নয়, আরও একজন ওই শব্দটা ব্যবহার করে প্রবল কণ্ঠে।

বুঝলেন কাকিমা, এ যুগের সবাই বুদ্ধির বড়াই করে। ভাব দেখায় যেন সব বোঝে। আমি বলব, কিছু বোঝে না।

বিরাট একবোঝা কাগজ হৈমবতীর টেবিলে বসানো, তার দুদিকে দুজন বসে। হৈমবতী আর সারদাপ্রসাদ।

হৈমবতী নাকি তাঁর কোনও এক বান্ধবীর কাছে শুনেছেন পুস্তক প্রকাশনের ব্যবসাটা খুব লাভজনক। টাকায় টাকা আয়। তাই তিনি একটি পাবলিশার হয়ে বসতে চান। এবং প্রথম বই হিসেবে সারদাপ্রসাদের ওই গবেষণা-পুস্তকটি গ্রহণ করতে চান।

ওই কাগজের বোঝা তাই নিয়ে এসেছেন সারদাপ্রসাদ।

সারদাপ্রসাদ উদাত্তকণ্ঠে বলেন, দাদার পরে এই প্রথম আর একজনকে দেখলাম যে-লোক ভারতবর্ষের ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল। অথচ চিরদিনই বউদির মুখ থেকে আপনার সমালোচনাই শুনে এসেছি, আপনি নাকি ফ্যাসানি, আপনি নাকি মেমসাহেব।

বলে ফেলে একথা সারদাপ্রসাদ। আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধির আশায় তোয়াজ করতেও নয়, আর বিজয়ার নিন্দে করতেও নয়। অথবা বিজয়ার নামে লাগিয়ে দিয়ে সুয়ো হতেও নয়। বলে নিতান্তই আবেগের বশে।

হৈমবতী নিজেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন, জানিয়েছেন সেই সেইদিন থেকে তাঁর মাথায় ওই বইটাকে কেন্দ্র করে একটা বিজনেস-চিন্তা ঘুরছে। তাই তিনি প্রেসের মালিক-টালিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বয়ে দেখেছেন, এইবার কাগজপত্র কিনে শুরু করবেন। এখন সারদাপ্রসাদ কতটা অ্যাডভান্স চান, সেইটাই হৈমবতীর জিজ্ঞাসা।

সারদাপ্রসাদ প্রথমে চমকে উঠেছিল। রক্তিম মুখে বলেছিল, আপনার কাছে অ্যাডভান্স নেব? বলেন কী?

কিন্তু হৈমবতী বুঝিয়েছেন, বিজনেসের ব্যাপারে সমস্ত কেতাকানুন মেনে শুরু করাই সঙ্গত; নইলে নিজের কাছে গুরুত্ব থাকে না, কেমন যেন এলেবেলে মনে হয়।

সারদাপ্রসাদ এ যুক্তিতে ভিজেছে। সারদাপ্রসাদ অতএব বলেছে, আপনি যা বলেন।

হৈমবতী বলেছেন, আমার তো বাপু এই প্রথম ব্যবসায় নামা। বেশি দিতে পারব না। প্রথমে হাজার তিনেক দিই, তারপর আরম্ভ হলে–

অঙ্কটা সারদাপ্রসাদের কাছে আশাতীত। আর সে কথাটা প্রকাশ করতে কুণ্ঠাও বোধ করেনি সে। কিন্তু হৈমবতী যে সব হিসেব-নিকেশ করে কাজে নামছেন। হৈমবতী তো জানছেন, যে তিনটি খণ্ডে বইটি সম্পূর্ণ, তার এক-একটা খণ্ডই অন্তত ত্রিশ টাকা করে হবে। দ্বিতীয়, তৃতীয় খণ্ডটা অবশ্য এখনও লেখা হয়নি, কিন্তু মালমশলা তো সবই মজুদ, লিখতে আর কতক্ষণ? প্রথম খণ্ড ছাপতে ছাপতেই হয়ে যাবে। তা সে যাক, যে বইয়ের দাম হবে তিরিশ টাকা, তার জন্যে অগ্রিম অন্তত ওই তিন হাজার না দিলে প্রকাশিকার সম্ভ্রম থাকবে কেন?

সারদাপ্রসাদ বলে, আশ্চর্য! আপনি একজন বিধবা মহিলা, আপনি সাহস করছেন, অথচ এই শহরের তাবড় তাবড় প্রকাশকমশাইরা বলেন, রিস্ক নিতে পারব না। তার মানে জিনিসটার প্রতি আস্থা নেই। তার মানে ভিতর থেকে কোনও প্রেরণা নেই। তার কারণ দেশ সম্পর্কে চিন্তা করেনি কোনওদিন। শুনলে অবাক হবেন, সেদিন একটি ছোকরাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা বলো তো এই যে আমাদের দেশে আকাশ-প্রদীপ দেওয়ার রীতি আছে, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? ছোকরা বাংলায় এম-এ, খুব নাকি ভাল ছাত্র, বলল কিনা, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলে কিছু নেই, সম্পূর্ণ কুসংস্কার। স্রেফ মরা গোরুর ঘাস খাওয়ার ব্যাপার! মরে-যাওয়া পিতৃপুরুষের প্রেতদের জন্য যমপুরীতে আলো দেওয়া হয়। বলে সে কী ব্যঙ্গ হাসি! অথচ একটু ভেবে দেখলেই তাৎপর্যটা দেখতে পেত। তখন ছোকরার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম,ওহে বাপু, ওটা হচ্ছে গোলা লোকদের জন্যে ব্যাখ্যা! মানুষ জাতটা তো এক নম্বরের অবাধ্য? ভাল কথা কিছু শুনবে না তো? তাই একটা রূপকের বহিরঙ্গ। আসলে শ্যামাপোকার উৎপাত থেকে আত্মরক্ষার উপায়। বাড়িতে উঁচুতে একটা করে আলো জ্বললে পোকাগুলো সেখানেই ভিড় করবে। তা ছোকরা কথাটা বিশ্বাস করল কিনা কে জানে! হেসে চলে গেল। দেওয়ালির আলো ও আতসবাজির তাৎপর্যটাও বুঝিয়ে দেব ভেবেছিলাম, সময়ই দিল না। তা যাক সেকথা, আপনি তা হলে মনস্থই করে ফেলেছেন?

হৈমবতী প্রায় হইচই করে ওঠেন, মনস্থ বলে মনস্থ। আমি তো দিন গুনছি। তবে কিন্তু ওই যা বলেছি, একটি শর্তে। কিছুতেই যেন –

হ্যাঁ, একটি শর্ত হৈমবতী করেছেন তাঁর জামাইয়ের সঙ্গে। হৈমবতী যে প্রকাশিকা হতে চলেছেন, এটা যেন এখন না প্রকাশ হয়ে পড়ে। সবাইকে তিনি তাক লাগিয়ে দিতে চান।

সারদাপ্রসাদ সেকথা বিশ্বাস করেছে বইকী! এবং তাতে আমোদই অনুভব করেছে।

সারদাপ্রসাদ ঘাড় হেলিয়ে বলে, তা আবার বলতে! এ শুধু আপনি জানবেন, আমি জানব, আর কম্পোজিটার জানবে। আচ্ছা তা হলে চলি। সময় অন্তর একটু দেখবেন উলটেপালটে।না কি একেবারে ছাপা হলেই?

হৈমবতী ঘাড় হেলিয়ে বলেন, তাই ভাল।

কিন্তু ওই যা বললাম কাকিমা, প্রুফটা আমার নিজের দেখা দরকার।

হ্যাঁ সে তো নিশ্চয়, হৈমবতী অমায়িক গলায় বলেন,তুমি নিজে না দেখলে তো যা তা কাণ্ড হয়ে যাবে।

সারদাপ্রসাদ উচ্ছ্বসিত হয়।

এই, এইজন্যেই আপনাকে এত পুজ্যি করি কাকিমা! বোঝেন সব জিনিসটা। একটা অক্ষরের এদিক ওদিকে যে জিনিসটা একেবারে মার্ডার কেস হয়ে যাবে, একথা কজন বোঝে?

সারদাপ্রসাদ শেষবারের মতো পরম স্নেহভরে কাগজের বোঝাগুলোর উপর হাত বুলিয়ে বলে, তা হলে রইল? দেখবেন যেন কিছু

না না, এ আমি এখুনি যত্ন করে তুলে রাখছি।

সারদাপ্রসাদ আবার একটু বসে।

একগ্লাস জল চায়।

জল খাওয়ার অবকাশে আরও বার দুই-তিন কাগজগুলো স্পর্শ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, যাক, আপনি আমায় বাঁচালেন। চাকরি খুঁজে খুঁজে বেড়ানোর দায় থেকে বাঁচালেন!

চাকরি?

হৈমবতী যেন আকাশ থেকে পড়েন। হৈমবতী যেন কোনওদিন শোনেননি, সারদাপ্রসাদ নামে অবোধ প্রাণীটা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছে।

তাই আকাশ থেকে পড়া গলায় বলেন, চাকরি?

সারদাপ্রসাদ হেসে ওঠে।

যেন সবটাই কৌতুকের বিষয়।

বলে,আর বলেন কেন? ওইসব গণ্ডমুখ পাবলিশারদের উপর চটেমটে গিয়ে খাতাপত্তর গুটিয়ে চাকরিই খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। করতে তো হবে একটা কিছু?

হৈমবতী ঈষৎ হেসে বলেন, তা তো সত্যি! সরোজও তো

না না সেজন্যে নয়, সেজন্যে নয়। দাদার কীসের অভাব? হাতির জন্যে মশা কী করবে? এ কেবল আমার নিজেরই জন্যে। মানে চুপ করে কি দিন কাটানো যায়?

সারদাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি পালায়।

হৈমবতী অনেকক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থাকেন। হৈমবতীর মুখে একটা বিচিত্র বিষণ্ণ হাসি ফুটে ওঠে।

 ৫. দশ টাকার নোটের তাড়া

চেক নয়, একশো টাকার নোটও নয়, স্রেফ দশ টাকার নোটের তাড়া। হয়তো হৈমবতী ওটাই সুবিধে বুঝেছিলেন।

সরোজাক্ষ সেই তিন তাড়া নোটের দিকে তাকিয়ে অবাক গলায় বলেন, কী এ?

সারদাপ্রসাদ যেন শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরতে যাচ্ছে।

সারদাপ্রসাদের ভঙ্গিতে অন্তত সেই ব্যস্ততা। নোটের তাড়া তিনটে সরোজাক্ষর সামনে ফেলে দিয়ে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে যেতে যেতে বলে যায়, কিছু না, কিছু না। একজন পাবলিশার প্রথম খণ্ডটা নিয়ে হাজার তিনেক টাকা অ্যাডভান্স দিল, তাই

সারদাপ্রসাদের কণ্ঠে অনায়াস তাচ্ছিল্যের সুর। যেন হাজার তিনেক টাকাটা কিছুই না, যেন সেটা খোলামকুচির সমগোত্র, তাকে পকেট থেকে বার করে যেখানে-সেখানে ফেলে দেবার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই।

পালিয়ে গিয়ে অবশ্য পরিষ্কার করে কিছু ভাবতেও সময় লাগে বেচারার।

বুকের ধড়ফড়ানি কমলে তবে ভাবে, নাঃ মিথ্যে কথাটা আর কী? পাবলিশার বলতে দোষ কোথায়? বাংলায় তবু প্রকাশিকা বলে একটা শব্দ আবিষ্কার করা হয়েছে, কিন্তু ইংরেজি ভাষায় ওই পাবলিশার শব্দটার নারী সংস্করণ কী হওয়া উচিত তা যখন সারদাপ্রসাদের জানা নেই, তখন পাবলিশার ছাড়া আর কী বলবে সে?

তবে হ্যাঁ, মনে মনে মাথাটা নাড়ে সারদাপ্রসাদ, ওই দিয়েছে শব্দটা উচ্চারণ করা গর্হিত হয়েছে। দিয়েছেন বলা উচিত ছিল। কিন্তু কেমন গোলমাল হয়ে গেল। যাক গে, ভবিষ্যতে যাতে না জিভটা অমন অসতর্ক হয়ে বসে, হুশ রাখতে হবে।

তা সারদাপ্রসাদ যাই ভাবুক, সরোজাক্ষ সেই নোটের তাড়াগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবেন, সারদা কি শেষটায় চুরি-ডাকাতি ধরল নাকি?

সারদার সঙ্গে ওই চুরি-ডাকাতি শব্দটা খাপ খাওয়ানো সহজ নয়, কিন্তু এটাই কি বিশ্বাস করা সহজ, সত্যি সত্যিই কোনও প্রকাশক ওকে তিন-তিন হাজার টাকা অগ্রিম দিয়ে বসেছে। কথায় ভুলে টাকা খসাবে, ব্যবসাদাররা এমন কাঁচা ছেলে নয়।

তবে আর কী?

ইদানীং যে সারদা উপার্জনের চেষ্টায় ঘুরছে সেটা সরোজাক্ষ বিজয়ার সুতীব্র এবং সশব্দ স্বগতোক্তির কল্যাণে নিজের এই আত্ম-নির্বাসন কক্ষে অবরুদ্ধ থেকেও টের পেয়েছেন, কিন্তু সেই চেষ্টার গাছে যে সহসা এতখানি ফল ধরে, সে ফল একেবারে পেকে উঠেছে, তাই বা বিশ্বাস করা যায় কী করে?

টাকাটা যে সারদাপ্রসাদ কোনও অলৌকিক পথে পেয়েছেন, তাতে সন্দেহ নাস্তি, কিন্তু অবোধ লোকটা কার খপ্পরে পড়ল সেইটাই তো চিন্তা।

তা ছাড়া সারদাপ্রসাদের এই আচরণটাও চিন্তার। এনে ফেলে দিয়েই ছুটে পালাবার হেতুটা কী?

লজ্জা?

হতে পারে।

কতকগুলো ব্যাপারে অহেতুক লজ্জা ওর আছে। কারও প্রতি মায়া-মমতা প্রকাশ করতে পারে না সে, ওটা খুব লজ্জার বিষয় ওর কাছে। তাই যে-কোনও ভাবে পাওয়া ওই টাকাটা অমন করে

কিন্তু সরোজাক্ষ?

সরোজাক্ষর কি লজ্জা নেই?

সরোজাক্ষ ওর সেই অব্যক্ত মায়া-মমতার শিকার হবেন?

না, তা হয় না।

সরোজাক্ষকে আপন নির্বাসন কক্ষ থেকে বেরোতে হল।

সরোজাকে ওই পলায়মান লোকটাকে ডেকে বলতে হয়, তা হয় না।

সারদাপ্রসাদ সেই তার অবোধ মুখটা নিয়ে বলে, হয় না? তার মানে?

মানে বুঝিয়ে দিতে হবে, এমন শক্ত কথা তো এটা নয় সারদা? ধরে নিচ্ছি তোমাকে তোমার কোনও পাবলিশার দিয়েছে টাকাটা। কিন্তু আমি সে টাকা নিতে যাব কেন? আর আমাকেই বা দিতে যাবে কেন তুমি?

আপনি নিতে যাবেন কেন? আপনাকে দিতে যাব কেন? সারদা হতভম্ব মুখে তাকিয়ে থেকে বলে, তবে কাকে দেব?

সরোজাক্ষ বলেন, দেবার কথা আসছে কোথা থেকে? তোমার টাকা তোমার নিজের কাছে রেখে দেবে। ব্যাঙ্কে জমা দেবে।

সারদাপ্রসাদের মুখটা আস্তে আস্তে লাল হয়ে ওঠে। তবু সারদাপ্রসাদ উত্তেজিত হয় না। শান্ত গলায় বলে, আমার টাকা আমি ব্যাঙ্কে জমা করে রাখব।

সদা উত্তেজিত সারদাপ্রসাদের মুখে এই শান্ত ভাবটা অদ্ভুত দেখতে লাগে। কিন্তু সরোজাক্ষর চোখে বোধহয় সেটা ধরা পড়ে না। কারণ সরোজাক্ষর চোখ দুটোই অন্যদিকে। সরোজাক্ষ আকাশে চোখ রেখে কথা বলছেন।

তাই সরোজাক্ষ আগের মতো সুরেই বলেন, হ্যাঁ, তাই তো রাখবে। সেটাই তো স্বাভাবিক। ভবিষ্যতে ওই টাকা থেকে তুমি অন্য খণ্ডগুলো ছাপাতে পারবে। সব সময় এ রকম পাবলিশার নাও পেতে পারো!

সারদাপ্রসাদও এবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলে,ওই টাকা দিয়ে ভবিষ্যতের সুবিধের কথা ভাবব? সেই ভবিষ্যতের জন্যে আমি দোরে দোরে ঘুরে

থেমে যায়।

হয়তো শেষটা আর বলা সঙ্গত নয় বলে বলে না। অথবা হয়তো শেষটা আর বলতে পারে না বলেই বলে না।

কিন্তু যতটুকু বলেছে, বোঝবার পক্ষে সেটাই যথেষ্ট।

সরোজাক্ষর মুখটা লালচে হয়ে ওঠে।

সরোজাক্ষ গম্ভীর মুখে বলেন, আমার জন্যে তুমি দোরে দোরে ঘুরে টাকার সন্ধান করে বেড়িয়েছ?

আহা হা! কী আশ্চর্য! ইয়ে মানে আমি কি তাই বলছি? মানে আমি বলতে চাইছি, আমি বাউণ্ডুলে মানুষ, টাকা-ফাঁকা নিয়ে করবটা কী? হয়তো কোথায় রাখতে কোথায় রেখে হারিয়েই ফেলব। এ বরং নিরাপদ থাকল।

তা হয় না।

জজের রায় দেবার ভঙ্গিতে ওই ছোট্ট কথাটুকু উচ্চারণ করেন সরোজাক্ষ।

কিন্তু ওইটুকুই তো যথেষ্ট।

সারদাপ্রসাদের কানদুটো ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। ওই টাকাটাকে ঘিরে ও মিষ্টি একটি স্বপ্ন দেখতে দেখতে আসছিল। আর কিছুই নয়। মিষ্টি একটু প্রসন্নতা, বইটা সম্পর্কে একজনও আগ্রহী হয়েছে শুনে এতটুকু আনন্দ। কিছুটা রিহার্সালও দিতে দিতে এসেছিল সারদাপ্রসাদ, প্রকাশকের নামধাম জিজ্ঞেস করলে কী বলবে।

সরোজাক্ষ সারদাপ্রসাদের সেই রঙিন কাঁচের ফুলদানিটা আছড়ে ভেঙে দিলেন!

তবু সারদাপ্রসাদ, হ্যাঁ, সেই গরম জলে ফেটে পড়া চোখটাকে কষ্টে সামলে সারদাপ্রসাদ ভাবল, আমারই ভুল হয়েছিল। আমার ভাবা উচিত ছিল দাদা এইরকমই একটা কিছু বলবেন। দাদাকে তো আমি জানি, এ টাকা বউদির হাতে দিলেই ঠিক হত। আমি দাদার একটু প্রসন্নতার আশায় এই বোকামিটা করে বসলাম।

তাই সারদাপ্রসাদ কষ্টে গলা পরিষ্কার করে বলে,ঠিক আছে। আপনাকে নিতে হবে না।

বলে ফের ঘরে ঢুকে নোটের তাড়া তিনটে কুড়িয়ে নিয়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে এগোয়।

সরোজাক্ষ অবোধ নন।

সরোজাক্ষ বুঝতে অক্ষম হন না, সারদাপ্রসাদের লক্ষ্যটা কী।

তাই সরোজা গম্ভীর গলায় ডাকেন, সারদা।

শুধু সারদা।

তার বেশি কিছু নয়।

তবু সেই কেবলমাত্র ওই ডাকটির মধ্যেই ভয়ংকর একটি প্রতিবাদ। যেন পায়ে লোহার শিকল পড়ল সারদাপ্রসাদের।

অগত্যা দাঁড়িয়ে পড়তে হল তাকে।

সেই দাঁড়িয়ে পড়ার মধ্যেও শক্তি সংগ্রহ করতে লাগল সে। বেশ তো, উনি না নিলেন তো বয়েই গেল, বউদি কখনওই

মনে করল শক্তি সঞ্চয় হয়ে গেছে।

তাই শান্ত গলায় বলল, কী বলছেন?

বলছি টাকাগুলো নিয়ে তুমি ছাতে যাচ্ছ কেন?

যাচ্ছি এমনি।

এমনি বলে কোনও কথা হয় না সারদা!

এমনি আবার কী। আমি বাড়ির গিন্নিকে দেব।

তা হয় না সারদা!

তাও হয় না?

সারদাপ্রসাদ ঘাড় ফিরিয়ে বলে, বাড়ির লোকেরা, বাড়ির ছেলেরা রোজগার করে এনে বাড়ির হেডের হাতে দেয় না?

সরোজাক্ষ একটু থেমে যান।

কিন্তু সরোজাক্ষ থেমে থাকেন না, আবার কথা বলে ওঠেন।

হয়তো সরোজাক্ষর শত্ৰুগ্রহই কথা বলায়। নইলে সরোজাক্ষ তত বাদ-প্রতিবাদের মানুষ নন। সরোজাক্ষ তো একটা বিষয় নিয়ে দুটো কথা বলতে ভালবাসেন না।

তবু আজ বললেন।

বললেন, ওটা তোমার রোজগারের টাকা হলে হয়তো আপত্তির ছিল না সারদা, কিন্তু তা তো নয়।

তা নয়?

সারদাপ্রসাদ কায়দা করে জামার কাঁধে মুখ নামিয়ে চোখটাকে কিঞ্চিৎ ভদ্রমতো করে নিয়ে বলে, তবে কি আমি চুরি করে এনেছি?

কী করেছ তা অবশ্য তুমিই জানো, কিন্তু হঠাৎ তুমি—

তা জানি৷ সারদা ক্ষুব্ধ আহত গলায় বলে, হঠাৎ আমাকে কেউ একটা অফিসারের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে সে কথা বলছিও না। পাবলিশার দিলে সেটাও রোজগারই।

পাবলিশার?

সরোজাক্ষর মুখে একটা সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে।

সে হাসি সারদাপ্রসাদের চোখ এড়ায় না। সারদাপ্রসাদের মনে হয় সিঁড়িটা দুলছে। সারদাপ্রসাদের মনে হয় চিরদিন যে মাটিটার উপর সে মাটি ভেবে নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে ছিল, হঠাৎ দেখা যাচ্ছে সেটা চোরাবালি।

সারদাপ্রসাদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা তরল আগুন ছুটোছুটি করে ওঠে। সারদাপ্রসাদ ধৈর্য হারায়, জীবনে কখনও যা না করেছে তাই করে, সরোজাক্ষর সামনে তীব্র গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, হাসলেন যে? হাসলেন কেন?

সরোজাক্ষ চমকে ওঠেন।

সরোজাক্ষর হঠাৎ মনে হয়, সারদাপ্রসাদের গলার স্বর জীবনে এই প্রথম শুনলেন।

এই অপরিচিত স্বরকে আর শুনতে সাহস হল না সরোজাক্ষর, বললেন, হাসব কেন?

বলে ঘরে ঢুকে এলেন।

হাসলেন তো–বলে সারদাপ্রসাদও পিছু পিছু আসে।

কিন্তু ততক্ষণে অন্য ঘটনা ঘটে গেছে। সারদাপ্রসাদের ওই বিকৃত কণ্ঠের চিৎকার সুনন্দাকে ঘর থেকে বার করেছে, বার করেছে মীনাক্ষীকেও, আর নামিয়ে এনেছে বিজয়াকেও।

ওরা সাহস করল না।

বিজয়া সাহস করলেন।

বিজয়া ঘরে ঢুকে এসে বলে উঠলেন, ব্যাপার কি ঠাকুরজামাই? হঠাৎ হাল্লা তুলেছ যে?

হাল্লা?

সারদাপ্রসাদের ভিতরের গুহার হঠাৎ-জেগে-ওঠা ঘুমন্ত বাঘটা আবার গর্জে ওঠে, আপনারা ভেবেছেন কী? আমি একটা মানুষ নই? আমার রোজগারের টাকা দাদা পা দিয়ে ছুঁলেন না, অবিশ্বাসের হাসি হাসলেন, আর আপনি

তোমার রোজগারের টাকা

বিজয়ার এতক্ষণে সারদাপ্রসাদের হাতের উপর চোখ পড়ে, বিজয়ার চোখে লোভের আগুন জ্বলে ওঠে। টাকা হচ্ছে টাকা, তার ইতিহাসটা যাই হোক।

আর মোটামুটি ইতিহাসটা বিজয়া অনুমান করেই নেন। যেভাবেই হোক ওই টাকাটা সারদাপ্রসাদ এনেছে এবং সরোজাক্ষকেই দিতে এসেছে, কিন্তু মহাপুরুষটি নিতে অস্বীকৃত হচ্ছেন।

বিজয়া বলে ওঠেন, তুমিও আচ্ছা বটে ঠাকুরজামাই, টাকা দিতে এসেছ পরমহংস ঠাকুরের কাছে? যাঁর কাছে টাকা মাটি, মাটি টাকা! আমরা বাবা সংসারী মানুষ, আমাদের কাছে টাকা টাকা! আমায় দাও

বিজয়া আপন পরিধেয়র শুচিতা ভুলে প্রায় ছোঁ মেরে টাকাটা নিয়ে নিতে যান।

কিন্তু সরোজাক্ষকে বুঝি আজ সর্বনাশের নেশায় পেয়েছে। তাই সরোজাক্ষ কঠিন গলায় বলেন, না। নেবে না। ও টাকা সারদা নিজের জমি-জমা বেচে নিয়ে এসেছে–

জমি-জমা!

আকাশ থেকে পড়ে সারদা।

আপনি সেই কথা ভাবছেন?

তবে কি সত্যিই ভাবব সারদা, তোমার ওই বই নিয়ে পাবলিশার—

ওই! আবার আপনি হাসছেন। সারদাপ্রসাদের মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, সারদাপ্রসাদ আবার চেঁচিয়ে ওঠে,নেহাত নাম বলা বারণ আছে তাই, নইলে আমি এক্ষুনিই আপনাকে নিয়ে গিয়ে ভজিয়ে দিতাম। দেখাতাম সত্যিই কেউ দিয়েছে কিনা।

নাম বলা বারণ! তবে আর কী করা–সরোজাক্ষ খাটের উপর বসে পড়ে বলেন, কিন্তু ওই অনামা অজানা টাকা তো তোমার বউদিকে নিতে দিতে পারি না সারদা।

নিতে দিতে পারেন না?

সারদাপ্রসাদও বুঝি বসে পড়ে।

তার মানে এ-সংসারের উপর আমার কোনও দাবি নেই! আমার টাকা আপনারা পা দিয়েও ছোঁবেন না? অথচ আমি চিরকাল নিজের বাড়ি ভেবে-সারদাপ্রসাদ ছটফটিয়ে পায়চারি করতে করতে বলে, বিনা দ্বিধায় খেয়েছি পরেছি, আবদার করেছি। তার মানে সেটা দয়ার ভাত খেয়েছি। তার মানে আপনি আমাকে বাড়ির একটা পোষা কুকুর-বেড়াল ছাড়া আর কিছু ভাবেননি।

আঃ। সরোজাক্ষ প্রায় ধমকে ওঠেন, কী বাজে বাজে কথা বলছ?

বাজে নয়, বাজে নয়, ঠিকই বলছি–সারদা সরোজাক্ষর সামনে এসে দাঁড়ায়, লাল লাল চোখে বলে, বুঝতে পারছি চিরদিনই আপনি আমার লেখাকে ব্যঙ্গের দৃষ্টিতে দেখেছেন। আজ সেই হাসি প্রকাশ পেয়ে গেছে। আমি মুখ, আমি গাধা, তাই বিশ্বাস করে এসেছি–সারদাপ্রসাদের চোখের জল এবার সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পরম শত্রুতা করে বসে। সারদা ভাঙা ভাঙা গলায় বলে ওঠে, কিন্তু জগতে একজনও খাঁটি লোক আছে–জিজ্ঞেস করুন গে আপনার খুড়িমাকে, টাকা সারদা কোথায় পেয়েছে–

আবেগে উত্তেজনায় নাম প্রকাশের নিষেধবাণী রক্ষা করা সম্ভব হয় না সারদাপ্রসাদের। বলে ফেলে জামার হাতাটা তুলে তুলে ঘন ঘন চোখের জলটা মুছতে থাকে সারদা।

পুরুষমানুষের চোখের জল একটা মর্মান্তিক দৃশ্য বইকী! বোধ করি জগতের প্রধানতম মর্মান্তিকের অন্যতম। সরোজাক্ষ অপ্রতিভ হচ্ছিলেন, কিন্তু খুড়িমা শব্দটা যেন সরোজাক্ষর মাথার মধ্যে হাতুড়ির ঘা বসিয়ে দিল। সেই আঘাতে সরোজাক্ষর সামনের অন্ধকারের পরদাটা ছিঁড়ে উড়ে গেল। সরোজাক্ষ আর ওই মর্মান্তিক দৃশ্যটার জন্যে অপ্রতিভ হতে পারলেন না।

সরোজাক্ষ কপালটা টিপে ধরে ধিক্কারের গলায় বলে উঠলেন, সারদা, সত্যিই তুমি মুখ অবোধ। তাই খুড়িমা তোমাকে মাধ্যম করে তোমার পাবলিশার সেজে খুড়িমা ও টাকা আমার সংসারকে ভিক্ষে দিয়েছেন সারদা! জানেন–তুমি সেটা বুঝতে পারবে না। তুমি সত্যিই বিশ্বাস করবে তোমার ওই ছেঁড়া কাগজের বোঝাগুলো

কথার মাঝখানে থেমে যান সরোজা। বোধ করি হঠাৎ হুঁশ হয়। কোথায় গিয়ে পড়ছিলেন।

কিন্তু এ হুঁশে কি আর কোনও উপকার হয়? যেখানে পৌঁছতে যাচ্ছি ভেবে থমকালেন, সেখানে তো পৌঁছে গেছেনই।

ওই আধখানা কথায় শান্ত হয়ে গেছে সারদাপ্রসাদ। তার চোখের জল শুকিয়ে গেছে।

সারদাপ্রসাদ সেই শুকনো চোখ আর শান্ত গলায় বলে, এখন বুঝতে পারছি সেটা! মূর্খের শতেক দোষ, একথাটা শাস্ত্রেই আছে, তবে অন্ধেরও চোখ ফোটে।

বলে টাকাগুলো আবার পকেটে পুরে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়।

সুনন্দা দেখে, মীনাক্ষী দেখে, ঘটনাটা কী ঠিক না বুঝলেও ওরা ভীত হয়। ওদের সাহস হয় না, ওই চিরসহজ মানুষটার কাছে এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করতে, যাচ্ছ কোথায়?

এমনকী বিজয়াও মূক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন।

আর সরোজাক্ষ?

তিনি তো চির মূক।

তিনি যেন অনুভব করেন, তাঁর হৃদপিণ্ডের একটুকরো অংশ তিনি নিজেই খামচে ছিঁড়ে বার করে ফেলে দিলেন। সেই খামচানো জায়গাটায় হয়তো চিরদিনই ক্ষত থেকে যাবে।

সরোজাক্ষ আর কোনওদিন ওই মূর্খ অবোধ লোকটার মুখের দিকে তাকাতে পারবেন না।

কিন্তু এ ছাড়া আর কী করতে পারতেন সরোজাক্ষ?

বিজয়ার মতো টাকাকে কেবলমাত্র টাকা ভাবতে পারার ক্ষমতা তাঁর কোথায়? তবে এবার সরোজাক্ষকে স্বীকার করতেই হবে, মানুষ পরিবেশের দাস! পরিবেশকে অস্বীকার করে নিজের ছাঁচে নিজেকে গড়ব বলে পণ করে বসে থাকলে সেটা ব্যর্থতার বোঝা হয়ে ওঠে মাত্র।

সরোজাক্ষ কালই আবার কলেজের দরজায় গিয়ে দাঁড়াবেন। ঘাড় হেঁট করে বলবেন, আমি ভুল করেছিলাম।

আমি ভুল করেছিলাম!

মনে-প্রাণে স্বীকার না করলেও, বলতেই হয় মানুষকে একথা।

আমি ভুল করেছিলাম।

না বললে এই সমাজের মধ্যে তোমার ঠাঁই হবে না। তুমি যদি তোমার কর্মস্থলে গিয়ে সাধু হয়ে থাকতে চাও, যদি ঘুষ নিতে না চাও, দুর্নীতির প্রশ্রয় দিতে না চাও, যদি দুর্নীতিকে উদঘাটিত করতে চাও, তোমার ভাগ্যে জুটবে উৎপীড়ন, অসুবিধে, লাঞ্ছনা, অপমান, জুটবে দারিদ্র, অসহায়তা, অনিশ্চয়তা।

তুমি দরজায় দরজায় ঘুরে পৃথিবীর চেহারাটা দেখতে পাবে, তখন তুমি ফিরে গিয়ে বলতে বাধ্য হবে, আমি ভুল করেছিলাম, সাধু থাকার পণ করে মস্ত একটা ভুল করেছিলাম।

তুমি পৃথিবীর মন্ত্রে দীক্ষা নেবে তখন।

পৃথিবীই দেবে সে দীক্ষা।

সরোজাকে কেউ দীক্ষা দিতে আসেনি, কিন্তু ভিক্ষা দিতে এসেছে। তার থেকে অসহায়তাই বা আর কী আছে?

সরোজাক্ষকে অতএব পুরনো দরজায় ফিরে গিয়ে বলতেই হবে, আমি ভুল করেছিলাম।

আর সেটা যদি বলতে না পারো, ভীরু কাপুরুষের মতো পৃথিবী থেকে বিদায় নাও।

সরোজাক্ষ কি সেই পথই বেছে নেবেন?

ছি ছি!

তার মধ্যেই বা সম্মান কোথায়? গৌরব কোথায়? নিজের মতো করে বাঁচা কোথায়? নিজের মতো করে মরাটাকে পৃথিবী ক্ষমা করে না।

বলে, ছি ছি! লোকটা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাল!

অথচ অতর্কিতে সহজ আর স্বাভাবিক মৃত্যু আসবে সেইসব মানুষের, যারা দীর্ঘদিন পৃথিবীটাকে আঁকড়ে ধরে থেকে অনেক শ্বাস-প্রশ্বাসের সংখ্যা গুনতে চায়।

সরোজাক্ষর দরজায় নাকি একদিন মৃত্যুর পদধ্বনি শোনা গিয়েছিল, দরজা থেকে ফিরে গেছে, ঘরে এসে ঢোকেনি। অতএব সরোজাক্ষকে জীবনের দরজায় গিয়ে হাত পাততে হবে।

কারণ পৃথিবী যদি কাউকে দীক্ষা দিতে না পারে, তোভিক্ষা দিতে আসে।

.

আচ্ছা তুমি আমার সঙ্গে এরকম শত্রুতা করছ কেন বলো তো?

নীলাক্ষ পরম আদরে স্ত্রীকে নিবিড় বাহুবন্ধনে বেঁধে বলে, সেই সেদিনের রাগটা বুঝি আর ভুলতে পারছ না?

সুনন্দা সুকৌশলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অবাক গলায় বলে, রাগই বা কীসের, শত্রুতাই বা কীসের?

নীলাক্ষ মনে মনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, হারামজাদি শয়তানি! ভদ্রঘরের বউ হতে এসেছিলে কেন তুমি? স্টেজে যাওনি কেন? পাবলিক থিয়েটারের স্টেজে? পয়লা নম্বরের একটি অভিনেত্রী হতে পারতে! অথচ আমার উপকারের জন্যে একটু প্রেমের অভিনয় করতে ক্ষয়ে যাও তুমি! তুতিয়ে পাতিয়ে খোশামোদ করে পাঠালে, তুমি শয়তানি আমাকে জব্দ করবার জন্যে এমন বাড়াবাড়ি করে বসো যে, পা থেকে মাথা অবধি জ্বলে যায়। বুঝতে পারি না সেটা সত্যি, না অভিনয়। যেমন মেহেরাটার সঙ্গে করছিলে। ব্যস, যেই সে একটু বেশি এগোতে গেল, অমনি তুমি পতিব্রতা হিন্দু কুলবধূ হয়ে ছিটকে পালিয়ে এসে ঘরের কোণে আশ্রয় নিলে! আর আমার অবস্থাটা কী হল? ভাবলে সেটা? ভাবছ একবারও? ব্যাটা বদমাশ যে এখন আমাকে জুতোর ঠোক্কর দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে, তার কি? তাকে আমি দোষ দিই না। এতখানি অপমানে পুরুষ বাচ্চা খেপে যাবে না? কিন্তু আমাকে যে সেই খ্যাপা কুকুরের কামড় খেতে হচ্ছে। পতিব্রতা! তাই যদি, পতির একটু উপকার করতে পারো না–এত অহংকার! আরে বাবা, তুই একটা বিবাহিতা মেয়ে, তোর আস্ত সুস্থ একটা স্বামী রয়েছে, তোর আবার এত ভয়টা কী?

কিন্তু মনের দাঁত মনের বাইরে মুখে আসে না। মুখের মধ্যেকার সাজানো দাঁতের পাটিটাই মুখের বাইরে উঁকি মারে।

তা রাগ ছাড়া আর কী! আমার সঙ্গে বেরোতেই চাও না। মেহেরা সাহেব কত দুঃখ করছিলেন। বলছিলেন, মদের ঝোঁকে কখন কী আবোল-তাবোল বলে ফেলেছিলাম, তার জন্যে মিসেস এত রেগে গেলেন যে–

বলেছেন বুঝি সাহেব? সুনন্দা মৃদু হেসে বলে, কোনটা কোন ঝোঁকে বলেছেন, সেটাই অবশ্য গোলমেলে রয়ে গেল। কিন্তু তোমার আজ ব্যাপার কী?চাঁচাছোলা কণ্ঠস্বর, পদক্ষেপ সঠিক, আজ বুঝি ড্রাই ডে?

নীলাক্ষ আর একবার মনের দাঁতটা কড়মড়িয়ে, মুখের দাঁতে হেসে ওঠে, তুমি কেবলই আমাকে মাতাল হতে দেখো। অথচ ক্লাবে আমায় সবাই বলে, এই মিস্টার মৈত্র হচ্ছেন একটি লোক, যাকে কোনওদিন টেনে তুলে নিয়ে যেতে হয় না, নিজের পায়ে বাড়ি ফেরেন।

সত্যি? সুনন্দা চোখে হাসির ঝিলিক মেরে বলে ওঠে, এ যে দেখছি দারুণ সার্টিফিকেট। বেশ! বেশ।

নীলাক্ষ ওই ঝিলিকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে, আমার জন্যে ওইটুকুর বাজে খরচা কেন? আমি কি ওতে কাত হব?

কিন্তু মুখে নীলাক্ষকে অভিমানী স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়, ভাবছি–আর বেশ থাকব না। বেহেড হব! রাস্তায় পড়ে গড়াগড়ি খাব–

বাঃ বাঃ, চমৎকার! সাধু সংকল্প! সুনন্দা হাততালি দিয়ে ওঠে,উঃ দি আইডিয়া!

তা তুমি যদি আমার সঙ্গ ত্যাগ করো, উচ্ছন্ন যাওয়া ছাড়া গতি কি আমার?

সুনন্দা মনের দৃষ্টিটাকে শ্যেন করে। ওর শেষ চাল! নিজে উচ্ছন্ন যাবার ভয় দেখিয়ে স্ত্রীকে সেই পথে ঠেলে দেবার সাধু চেষ্টা। কিন্তু প্রভু, তোমার ইচ্ছের পুতুল হয়ে আমার স্বর্গে নরকে কোথাও যাবার ইচ্ছে নেই। যাই যদি তো নিজের ইচ্ছেতেই যাব। নরকে হলে নরকেও।

কিন্তু সুনন্দাও মনের ছায়া বাইরে ফেলে না। সুনন্দা কৌতুকের গলায় বলে, তা সেটাই বা কম কী? উচ্ছন্ন নামক জায়গাটা তো পৃথিবীর সেরা জায়গা। যদি আমার কল্যাণে তুমি সেই সেরা জায়গার টিকিটটা সংগ্রহ করে ফেলতে পারো, নিজেকে আমি ক্রেডিট দেব।

আচ্ছা সেটা না হয় পরে দিও। আজ চলো না একটু আমার সঙ্গে।

(সুনন্দা মনে মনে) হুঁ বুঝেছি, নতুন কোনও রুই কাতলার সন্ধান পেয়েছ, খেলিয়ে তুলতে ভাল টোপ-এর দরকার। কিন্তু আমি আর তোমার টোপ হচ্ছি না। না, সতীধর্মের পরাকাষ্ঠা দেখাতে নয়, পবিত্রতার বিশুদ্ধতা রক্ষা করতেও নয়, স্রেফ তোমার উদ্দেশ্য-সিদ্ধির হাতিয়ার না হবার জন্যে। তুমি যে হরদম তোমার সুন্দরী স্ত্রীটিকে ভাঙিয়ে খাবে, তা আর হতে দিচ্ছি না। ভেবো না তোমার থেকে আমি বোকা।

মুখে—

আজ তো হতেই পারে না। আজ আমার বিশেষ একটু কাজ আছে।

কাজ! তোমার আবার কাজ কী?

কেন, আমার কোনও কাজ থাকতে পারে না?

আঃ পারবে না কেন? তবে আমি জানি না, অথচ বিশেষ কাজ–

তাতে চোখ কপালে তোলবার কী আছে? আমি জানি না, অথচ তোমার বিশেষ, এমন কাজ তো ঝাঁকে ঝাঁকে আছে তোমার।

তা অবশ্য আছে—

নীলাক্ষ গৌরবের গলায় বলে, পুরুষের একটা আলাদা কর্মজীবন থাকে—

মেয়েদেরও সেটা থাকতে পারে।

কী ব্যাপার, তলে তলে কিছু আয় উপায় করা হচ্ছে নাকি?

সুনন্দা এবার মুখের সেই ব্যঙ্গহাসির খোলসটা খুলে ফেলে বলে, যদি হয়, সেটা কি ভুল করা হবে? সংসারের অবস্থা তুমি জানো তো?

সংসারের?

নীলাক্ষ সহসা উদ্দীপ্ত গলায় বলে ওঠে, আমি সংসারের অবস্থা জানতে যাব কী জন্যে? সংসার আমার অবস্থা জানতে চেয়েছে কোনওদিন? আজই আমি দুপয়সা করে খাচ্ছি, কিন্তু এমন দিনও গেছে আমার যে, একটা সিগারেট কেনবার পয়সা জোটেনি, বন্ধুদের কাছে ধার করে করে বন্ধু হারিয়েছি। একটা ভিন্ন দুটো গরম স্যুট ছিল না। দেখেছে সেদিকে তাকিয়ে সংসার? না না, সংসার যেন আমার কাছে কিছু আশা করে না।

করছেও না।

সুনন্দা জানলার কাছে সরে গিয়ে বলে, করছেও না সে আশা।

কিন্তু তুমি? তুমি আমার স্ত্রী, তুমিই বা সে আশা দেখাতে যাবে কেন? বহুবার তোমায় বলেছি– আমরা এখান থেকে সরে পড়ি ।

অথচ আগে যখন আমি বলেছি ওকথা, তুমিই বলেছ, চলে গেলে বাড়ির ভাগ পাব না।

বলেছিলাম! মানছি সেকথা! কিন্তু কর্তার যা মতিগতি দেখা যাচ্ছে, তাতে আর এ বাড়ির একখানা ইটও উত্তরপুরুষদের জন্যে থাকবে বলে মনে হয় না। স্রেফ তো জরদগব হয়ে বসে আছেন। কোনওদিন শুনব বাড়ি মর্টগেজ আছে। হ্যাঁ, হঠাৎ কোনওদিন এ কথা শুনলে আশ্চর্য হব না। তারপর? বাড়ির কর্তাটির যদি হঠাৎ এদিক-ওদিক হয়ে যায়, তখন? ভেবেছ তখন গলায় কী কী পড়বে? বিধবা মা, আইবুড়ো বোন, অপোগণ্ড ভাই, ওই এক আগাছা, আর নিজের স্ত্রী-পুত্র তো আছেই। বুঝছ অবস্থা?

বুঝেছি বইকী! সুনন্দা বলে,আহা, ভেবে এখন থেকেই তোমার জন্যে করুণা হচ্ছে। এই বঙ্গভূমিতে কার কার ভাগ্যে এহেন গন্ধমাদন চেপেছে!

নীলাক্ষ ট্রাউজার ছেড়ে পায়ে একটা পায়জামা গলাতে গলাতে বলে, জানি তুমি ব্যঙ্গ করবে। জানি আমার জন্যে সহানুভূতির কানাকড়িও নেই। কেন যে এখনও ও আমার দু চক্ষের বিষ– বলে ডিভোর্স স্যুট আনছ না তাই ভাবি। আনছ না বোধ হয় তোমার এই সাধের শ্বশুরবাড়ি, পরম পূজনীয় শ্বশুরঠাকুর, আদরের ঠাকুরপো ঠাকুরঝিদের হারাতে হবে ভেবে।

সুনন্দা খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, এই সেরেছে, কারণটা ধরে ফেলেছ? সত্যি তুমি কী চালাক।

নীলাক্ষ একথার উত্তর দেয় না।

নীলাক্ষ হঠাৎ বলে ওঠে, আচ্ছা, মীনার কী হয়েছে বলতে পারো?

মীনার!

হ্যাঁ। রাতদিন দেখি ঘরে শুয়ে আছে, কলেজেফলেজেও যাচ্ছে না নাকি?

রাতদিন?

সুনন্দা আবার হি হি করে হাসতে থাকে। তুমি এত দেখার সময় পেলে কোথায় গো! তুমি যে আমায় চমকে দিলে! অ্যাাঁ, রাতদিন বাড়ির কে কী করছে, তার খবর রাখছ তুমি?

.

হৈমবতীও সরোজাক্ষর মতোই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, কী এ?

সারদাপ্রসাদ অনুত্তেজিত শান্ত গলায় বলল,আপনার সেই টাকাটা।

আমার টাকা! হৈমবতী প্রমাদ গোনেন। পাগলা খ্যাপা মানুষটা কী বুঝতে কী বুঝেছে। তাই আকাশ থেকে পড়া গলায় বলেন, কোন টাকা?

সারদাপ্রসাদ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দেয়ালের মতোই ভাবশূন্য গলায় বলে, বইয়ের ছুতো করে যেটা ভিক্ষে দিয়েছিলেন আমায়।

সদা-উত্তেজিত সারদাপ্রসাদের এই শান্ত মূর্তি আর ঠাণ্ডা স্বর হৈমবতাঁকে রীতিমত ভীত করে।

তা ছাড়া শুধুই কি কণ্ঠস্বর?

ভাষা নয়?

এই কি সারদাপ্রসাদের ভাষা?

চির সরল, চির শিশু সারদাপ্রসাদের?

হৈমবতী ভীত গলাতেই বলেন,আমি তো তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না সারদাপ্রসাদ!

সারদাপ্রসাদের ঘাড়টা আরও মোচড় খায়।

সারদাপ্রসাদ যেন সাদা দেয়ালের গায়ে অদৃশ্য কালিতে লেখা কোনও লিউপর পাঠোদ্ধার করছে।

হৈমবতী একটু অপেক্ষা করে আবার বলেন, কী হয়েছে বলে তো ঠিক করে। আমি তো সত্যিই বুঝতে পারছি না ।

সারদাপ্রসাদ তবু ঘাড় ফেরায় না।

সারদাপ্রসাদের সেই শান্ত স্বর আরও শান্ত, আরও দৃঢ় শোনায়, আমি বোকা–মুখ, নির্বোধ অন্ধ, আমার পক্ষে অনেক কিছুই বোঝা শক্ত, কিন্তু আপনার তো বুঝতে না পারার কিছু নেই খুড়িমা! তবে আপনাকে আমি বিশ্বাস করতাম। নির্বোধ পেয়ে আপনিও আমায় ঠকাবেন, এ ধারণা ছিল না। মূর্খের শিক্ষা বোধ হয় এইভাবেই আসে। যাক, কী বলতে কী বলছি, অপরাধ নেবেন না। আপনার টাকাটা কোনও কাজে লাগল না, তাই রেখে গেলাম। যে ছেঁড়া কাগজের টুকরোগুলোর ছুতো করে ওটা দিয়েছিলেন, সেগুলো রান্নার উনুনে ফেলে দেবেন।

চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে সারদাপ্রসাদ, কোনওদিকে না তাকিয়েই আস্তে আস্তে নেমে যায়।

হৈমবতী পাথরের পুতুলের মতো তাকিয়ে থাকেন সেই চলে যাবার দিকে।

ওই চলে যাবার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ থাকে না তাঁর, এ যাওয়া চিরদিনের জন্যে যাওয়া। ওই দীর্ঘ মাপের শিশু-মানুষটা আর কোনওদিন ফিরে আসবে না।

কিন্তু হৈমবতী ওকে আটকাবেন কোন উপায়ে?

হৈমবতী কি ছুটে গিয়ে ওর হাত ধরে বলবেন, পাগল ছেলে, চলে অমনি গেলেই হল? সব কথা না বলে কেমন তুমি চলে যাও দেখি?

না কি এখনও আবার পুরনো ভঙ্গিতে উৎসাহভরে বলবেন, কী আশ্চর্য! কী বলছ তুমি? আমি বলে আমার নতুন ব্যবসার প্রতিষ্ঠা নিয়ে কত স্বপ্ন দেখছি।

নাঃ এত নিষ্ঠুর হতে পারবেন না হৈমবতী, হতে পারবেন না অত খেলো।

তীক্ষ্ণবুদ্ধি হৈমবতীর পক্ষে অবস্থাটা অনুমান করা কঠিন হয় না, আর হঠাৎ নিজেকে ভারী ক্লেদাক্ত মনে হয় তাঁর।

মাথার মধ্যে সমস্ত কোষে কোষে একটা আহত কণ্ঠের তীব্র অভিযোগ যেন অবিরাম ধাক্কা দিয়ে চলে, নির্বোধ পেয়ে আপনিও আমায় ঠকাবেন, এ ধারণা ছিল না।

হ্যাঁ, অপরাধ করেছেন হৈমবতী।

নির্বোধ পেয়ে ঠকাতেই চেষ্টা করেছেন ওকে। একটা সরল বিশ্বাসী হৃদয়কে দুপায়ে মাড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ ভেবেছেন ওর ভাল করছি।

তার মানে ওকেই অন্ধ ভেবে নিশ্চিন্ত থেকেছি আমি, ভাবলেন হৈমবতী–নিজে যে কতটা অন্ধ সে খেয়াল করিনি। ও আমার দৃষ্টি খুলে দিয়ে গেল।

কিন্তু ওর দৃষ্টি খুলে দিল কে?

বিজয়া?

সরোজাক্ষ?

হায়, হৈমবতী কেন নিমিত্ত হলেন?

হৈমবতী টেবিলে পড়ে-থাকা টাকাগুলোর দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে বসে রইলেন।

.

অন্ধ যদি রুদ্র আলোর প্রহারে সহসা দৃষ্টিলাভ করে বসে, সে বুঝি চক্ষুষ্মনদের থেকেও সচেতন হয়ে ওঠে। তাই সারদাপ্রসাদ যাত্রাকালে বিদায় গ্রহণের পালা অভিনয় করে না। নিঃশব্দে কখন যেন চলে যায় চিরদিনের জন্যে।

তার এতদিনের অধিকৃত ঘরটায়, যে অধিকারটা সরোজা বাদে বাড়ির সকলেরই দৃষ্টিশূল ছিল, সেই ঘরটায় যেখানে যা ছিল সবই পড়ে থাকল অবিকল, অবিকৃত। শুধু তার বাকি ছেঁড়া কাগজের বস্তাগুলো, যেগুলো দ্বিতীয় খণ্ড, তৃতীয় খণ্ড রূপে প্রকাশিত হবার অপেক্ষায় দড়িবাঁধা পড়ে ছিল, সেইগুলোর জায়গাটাই শূন্য হয়ে গেল।

আর গেল সারদাপ্রসাদের জায়গাটা।

কিন্তু এ বাড়িতে তার কি কোথাও জায়গা ছিল, একমাত্র সরোজাক্ষর হৃদয়ে ছাড়া?

অথচ আশ্চর্য, সরোজাক্ষর নির্মমতাতেই বিদায় হয়ে গেল সে।

হয়তো এমনিই হয়।

সবচেয়ে প্রিয়জনের কাছ থেকেই সবথেকে বড় আঘাত আসে। তার ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়, অসতর্কতায়।

.

সারদাপ্রসাদ যে তার সমস্ত পদচিহ্ন মুছে নিয়ে চিরদিনের মতো চলে গেছে, এ সত্য ধরা পড়তে সময় লেগেছিল। কারণ ওটা কারও আশঙ্কার মধ্যে ছিল না। সারদাপ্রসাদ কখন বেরোয়, কখন ঢোকে, কতক্ষণ বাড়ি বসে থেকে জ্ঞানচর্চা করে, কে তার হিসেব রাখে? খোঁজ ছিল শুধু সরোজাক্ষর, কিন্তু সেটা ইদানীং নয়। ইদানীং তো দুজনেরই জীবন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। যখন সরোজাক্ষর জীবনটা ছিল আঁটসাঁট একটা কর্মের ছন্দে গাঁথা, আর সারদাপ্রসাদ ছিল ঘরকুনো, তখন সরোজাক্ষ প্রতিদিন সাড়া নিতেন কী খবর সারদা? নতুন কী আবিষ্কার করলে?

কিন্তু সে প্রশ্নের মধ্যে কি ব্যঙ্গ থাকত?

না, তা থাকত না, থাকত স্নেহ, সদয়তা।

অথচ সে কথা আর এখন বলা যাবে না। সারদাপ্রসাদও আর সেই মধুর মিথ্যার স্মৃতিকে মধুর ভাবতে পারবে না। সারাজীবনের সমস্ত স্নেহ প্রশ্নগুলোই ব্যঙ্গের শর হয়ে শরশয্যায় রেখে দেবে সারদাপ্রসাদকে।

চক্ষুষ্মান সারদাপ্রসাদ এখন প্রতিক্ষণ অনুভব করবে, কী অনধিকারের ভূমিতে দাবির অহংকারে স্ফীত হয়ে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে এসেছে সে।

এখন সারদাপ্রসাদ বুঝতে পারছে নীলাক্ষ নামের ঔদ্ধত্যটার চোখে কোন ছবি ছিল৷ ময়ূরাক্ষী নামের অসহিষ্ণুতাটার চোখে কোন বিষ। বিজয়া নামের অহমিকাটির চোখে কী অবজ্ঞা।

অনেক দূরে চলে না গেলে বুঝি ক্যামেরার লেন্সে এত স্পষ্ট মূর্তি ধরা পড়ে না।

একদা সরোজাক্ষই সারদার খবর নিতেন। এখন সরোজাক্ষ স্তব্ধ হয়ে গেছেন। তাই সারদার চলে যাবার খবরটা প্রথম টের সরোজা পাননি, পেলেন বিজয়া, সারদাপ্রসাদ সম্পর্কে যাঁর অবজ্ঞা এবং ঔদাসীন্য ছাড়া আর কিছু ছিল না।

কিন্তু কৌতূহল আর আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল সারদা সেই টাকাটা দিয়ে।

উদগ্র একটা কৌতূহল আর তীব্র একটা হায় হায় নিয়ে বিজয়া বারবার পুজোর ঘর থেকে নেমে এসে খোঁজ করেছেন ওই হতভাগ্য মানুষটার, কিন্তু দেখেছেন সে সবসময়ই অনুপস্থিত।

তা ছাড়া–যে দরজার পরদাটা সর্বদাই দরজার মাথার কাছে ডেলা পাকিয়ে গোটানো থাকত সেটা সর্বদাই ঝুলে রয়েছে যেন একটা বোবা নিষেধের ভঙ্গিতে।

বিজয়া না বুঝে শূন্য ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই হাঁক পেড়েছেন, কী গো ঠাকুরজামাই, তোমার আবার তোমার শালার মতন পরদা বাই হল কেন? ওলটাও দিকি। একটা কথা আছে।

পরদা তিনি নিজে সরাতে পারেন না, কারণ পুজো করতে করতে শুচিবস্ত্রে নীচে নেমেছেন।

অতএব কণ্ঠস্বরকেই পরদায় পরদায় তুলেছেন, কী ব্যাপার, এই ভরসন্ধেতেই ঘুমিয়ে কাদা হলে না কি গো? বলি ও মান্যমান মশাই, একটা অধম মানুষ যে এত ডাকছে, গ্রাহ্যি নেই?

একবার দুবার তিনবার।

অতঃপর বুঝেছেন, ঘরে নেই লোকটা।

কিন্তু সেই নোটের গোছর দৃশ্যটা যে মর্মে বিধে আছে। লোকটাকে না পেলে তার রহস্য উদ্ধার হবে কী করে? বারবার এসে এসে দেখেছেন বিজয়া, ঘরে আছে কিনা সারদাপ্রসাদ নামের মূর্খটা।

কিন্তু কোথায়? কোনও সময়ই নেই।

অবশেষে দিন তিন-চার পরে সন্দেহ হল। একতলায় নেমে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, ঠাকুর, পিসেমশাই খেয়ে বেরিয়ে গেছে?

ঠাকুর চোখ কপালে তুলে প্রতি-প্রশ্ন করল, পিসেমশাই?

হ্যাঁ হ্যাঁ, আকাশ থেকে পড়লে যে! বলছি এতখানি বেলা হয়ে গেল, এখনও ফেরেনি মানুষটা, জিজ্ঞেস করছি খেয়ে বেরিয়েছে তো?

ঠাকুর এবার কপাল থেকে চোখ নামিয়ে যা বলে, তার সারমর্ম হচ্ছে, পিসেমশাইয়ের কথা আজ নতুন করে হঠাৎ কেন? তিনি তো আজ চারদিন হল হাওয়া। কেন, মা সেকথা জানেন না? ঠাকুরকে তো বলে গেছেন তিনি, ঠাকুর, তুমি আর আমার জন্যে চাল নিও না, আমি চলে যাচ্ছি। ঠাকুর সৌজন্য করে বলেছিল, কবে ফিরবেন? বলে গেছেন, জানি না, ঠিক নেই।মা এসবের কিছু জানেন না?

বিজয়ার গৃহিণীগর্বে আঘাত লাগে।

বিজয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, জানব না কেন। ঢং করে যাই বলে যাক, কাল তো তার ফেরার কথা ছিল। ফেরেনি মানে?

ঠাকুর মনে মনে একটু মুচকি হাসে।

এই কালকে ফেরার কথাটা যে সম্পূর্ণ বাজে কথা তা বুঝতে দেরি হয় না তার। শুধু বুঝতে পারে না পিসেমশাই সম্পর্কে হঠাৎ মার এত দরদ উথলে ওঠবার হেতু কী! সে লোকটার খাওয়া সম্পর্কে মাকে তত বেজারই দেখেছে ঠাকুর বরাবর। বাবুই খোঁজ করেছেন, লক্ষ্য করেছেন, ভাল জিনিস আনিয়েছেন।

ইদানীং বাবুরও ছাড়া-ছাড়া ভাব, রান্নাঘরেও সমারোহ নেই, পিসেমশাইয়েরও আগের মতো সেই আরাম আয়েসে ভোজনপর্বটি নেই। কখন হঠাৎ বেরিয়ে যায়, কখন হঠাৎ ফেরে, কখনও ব্যস্ত হয়ে নেমে এসে নিজেই জল আর আসন নিয়ে রান্নাঘরেরই একপাশে বসে পড়ে বলে,ঠাকুর, ভাত হয়ে থাকে তো আমায় দুটি দিয়ে দাও তো। থাক, থাক, মাছ-তরকারি না হোক, ডাল হয়েছে তো? ওতেই হবে।

কোনওদিন বা বেলা দুটো-তিনটের সময় অস্নাত অভুক্ত পরিশ্রান্ত চেহারা নিয়ে এসে বলেছে, ঠাকুর, বড্ড বেলা হয়ে গেল! তুমি বেচারি এখনও বসে আছ কেন? ঢাকা দিয়ে রেখে চলে গেলেই পারতে।

অপ্রতিভ ভাবে মাথায় দুবালতি জল ঢেলে জলঝরা গায়েই এসে খেতে বসেছে।

লোকটার উপর ঠাকুরের কেমন একটা মমতা ছিল বলেই বসে থাকত হাঁড়ি নিয়ে। মা সে খবর রাখতেন না বলেই, রাখলে, নির্ঘাত হুকুম দিতেন, বসে থাকবার দরকার নেই, ভাত ঢেকে রেখে দাও।

সেই মা আজ হঠাৎ পিসেমশাইয়ের সম্বন্ধে এত ব্যস্ত! লোকটা যে আজ চারদিন আগে চলে গেছে, সে খবরও রাখেন না গিন্নি!

ঠাকুর তার কর্মদশায় সারদাপ্রসাদকে কোনওদিন চলে যেতে দেখেনি। তাই তারও যেন মনে হয়েছিল এই চলে যাওয়াটা একেবারেই চলে যাওয়া। ওই চাল নিতে বারণ করার সময় ভয়ানক একটা যন্ত্রণার মুখ দেখেছিল ঠাকুর।

কিন্তু সে রাঁধুনি মানুষ, কাকে কী জিজ্ঞেস করবে?

তা ছাড়া বাড়িটা কি আর আগের মতো আছে? যেন ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে গেছে। মা অবশ্য চিরদিন উপরতলাবাসিনী, কিন্তু বউদি, দাদাবাবুরা, দিদিমণিরা, পিসেমশাই, এরা তো মাতিয়ে রাখত বাড়িটা। কিন্তু ক্রমে ক্রমে কী হয়েই গেল। বড়দিদির বিয়ে হয়ে গেল, ছোড়দা বিদেশে চলে গেল। বড়দাদাবাবু মদ ধরল, বউদি তার সঙ্গে সুর ধরল, ছোড়দিও কেমন কেমন হয়ে গেল। তারপর তো চলছেই ভাঙন। বাবু কাজ ছেড়ে দিয়ে ডোম্বল হয়ে বসে আছে, ছোড়দি ঘর থেকে বেরোয় না, খায় না দায় না, বড়দা বেহেড় হয়ে বাড়ি ফেরে, আবার তো ছোট্ট ছেলেটাকে বোর্ডিঙে না কোথায় রেখে এসেছে। ছেলেটা সেইখানেই থাকে, ছুটি হলে মামার বাড়ি যায়।

শেষমেশ পিসেমশাইটা ছিল, তাও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। তবে আর বাড়িটাকে ভুতুড়ে ছাড়া কী বলবে ঠাকুর? পুরনো লোক, সব কিছুই দেখছে বসে বসে। পুরনো মানুষ!

বিজয়ার কুদ্ধ গলায় ভয় পায় না। অবজ্ঞার গলায় বলে, ফেরেননি তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। মানে আর আমি কী জানব? আমার তো মনে হল বরাবরের জন্যেই চলে গেলেন।

কেন কে জানে হঠাৎ বিজয়ার ভারী ভয় হয়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা বিদ্যুৎ শিহরণ অনুভব করেন বিজয়া। তবু ক্রুদ্ধ কণ্ঠটা বজায় রাখেন,ওঃ, তাই মনে হল তোমার? তা তাই যদি মনে হল, আমায় একবার বলতে পারলে না?

ঠাকুর সমান অবজ্ঞার গলায় বলে, আমি মাইনে করা লোক, আমি আপনাদের কী বলতে যাব? আর জানবই বা কেমন করে আপনারা জানেন না?

লোকটা বীরভূমের লোক, তেজী। রেখে-ঢেকে কথা বলে না।

.

বিজয়া উপরে এসে সরোজাকে ধরেন, ঠাকুরজামাই যে চলে গেল, সেটা আমায় একবার জানানো দরকার মনে হল না?

সরোজাক্ষ বিজয়ার কথায় কমই কর্ণপাত করেন, কিন্তু ওই চলে গেল শব্দটায় চমকে তাকালেন। তারপর প্রশ্ন করলেন, কোথায় চলে গেল?

সরোজাক্ষ আজ তিনদিন ধরে মনকে সংকল্পে স্থির করছেন, আবার ফিরে যাব কলেজে। মাথা হেঁট করে বলব, আমি ভুল করেছিলাম।

কিন্তু সংকল্পে স্থির হলে কী হবে, কোথায় গিয়ে বলবেন? কাকে বলবেন? কলেজে তো অনির্দিষ্ট কালের জন্যে ছাত্র-ধর্মঘট চলছে। সরোজাক্ষ সঠিক জানেন না কী তাদের দাবি। হয়তো পরীক্ষা পিছিয়ে দেবার দাবি, হয়তো প্রশ্নপত্র সহজ করার দাবি, হয়তো বা কোনও প্রফেসর বা স্বয়ং অধ্যক্ষকেই বরখাস্ত করা হোক দাবি। মোট কথা, কোনও একটা দাবিরই লড়াই এটা। এই লড়াইয়ের প্রথম সোপানস্বরূপ অধ্যক্ষকেও একদিন ঘেরাও করেছিল তারা, কিন্তু তাতে তেমন লাভ হয়নি। অতএব ধর্মঘট!

সরোজাক্ষ কোথায় গিয়ে পেশ করবেন তাঁর আবেদন?

সরোজাক্ষ কি তবে কলকাতার বাইরের কোনও শিক্ষায়তনে আবেদন করতে যাবেন? যেখানে বিজয়া যাবে না, যাবে না সরোজাক্ষর বাকি সংসার। সরোজাক্ষ একা থাকবেন ছোট একটি কোয়ার্টার্সে। হয়তো তেমনভাবে থাকতে পেলে, এখনও নিজেকে খুঁজে পাবেন সরোজাক্ষ। নিজেকে বুঝতে পারবেন।

সংসারের জন্যেও অবশ্য কর্তব্য আছে। সে কর্তব্য পালনের উপকরণ তো টাকা? সরোজাক্ষ নিতান্ত কৃচ্ছসাধন করে থেকে পাঠিয়ে দেবেন সেটা।

এই ধরনের একটা স্বপ্নজগতে বাস করছিলেন সরোজাক্ষ, সেখানে বিজয়ার প্রশ্নটা যেন পাথরের টুকরোর মতো এসে লাগল।

সারদাপ্রসাদের সেদিনের সেই মর্মাহত মুখটার ছবিটাকে সরোজাক্ষ যেন সভয় আতঙ্কে অনুভূতির ঘর থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন, সাহস করে একবারও খোঁজ করে দেখেননি সারদার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

যখনই ঘর থেকে বেরোচ্ছিলেন, একটা অপরিচিত দৃশ্য যেন সরোজাকে পাথর করে দিচ্ছিল। সারদাপ্রসাদের দরজায় পরিপাটি করে পরদা ঝোলানো। সারদাপ্রসাদ কি ওর লেখাগুলো সব নষ্ট করছে বসে বসে ওর অন্তরালে?

হাসলেন যে? হাসলেন কেন?

এ প্রশ্নটা কার?

কার এই রুক্ষ কঠিন কণ্ঠস্বর? যে-স্বর সরোজাক্ষকে অবিরত কাঁটার চাবুক মারছে? যে-স্বরের আওতা থেকে পালাতে চাইছেন সরোজাক্ষ?

কিন্তু একথা কি ভেবেছিলেন সরোজাক্ষ, সেই স্বরটাই তাঁর থেকে অনেক দূরে চলে যাবে? সরোজাক্ষকে মুক্তি দিয়ে যাবে?

সরোজাক্ষ তাই চমকে উঠে বললেন, কোথায় চলে গেছে?

ন্যাকা সাজছ কেন? তুমি জানো না?

না।

সেদিনের সেই টাকার ঘটনাটাই বা কী শুনি?

জানি না।

তোমাকেও কিছু বলে যায়নি, একথা বিশ্বাস করব আমি?

সরোজাক্ষ নীরব।

বিজয়া আবার বলেন, যাবার সময় তোমাকেও কিছু বলে যায়নি?

সরোজাক্ষ নিরুত্তর।

বিজয়া রুষ্ট ক্ষুব্ধ গলায় বলেন, যদি সত্যিই চলে গিয়ে থাকে, তো আমার দুর্ব্যবহারে যায়নি। গেলে তোমার দুর্ব্যবহারেই গেছে, সেটা মনে রেখো।

সরোজাক্ষ চোখ তুলে আস্তে বলেন, মনে রাখব। সারাজীবন মনে রাখব।

খোঁজ করবে না?

না।

বিজয়া ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।

সামনের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ান।

নাট্য-শেষের যবনিকার মতো সম্ভাবনাহীন ওই পরদাটা যেন বিজয়ার দিকে ব্যঙ্গদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন এখুনি বলে উঠবে, কেন? এখন মনটা এমন হু হু করে উঠছে কেন? এই তো চেয়েছিলে চিরকাল।

চেয়েছিলেন।

কিন্তু চাওয়াটা পাওয়ার চেহারা নিয়ে এসে ধরা দিলে যে এমন বীভৎস লাগে তা তো জানা ছিল না বিজয়ার।

সরোজাক্ষও আস্তে বেরিয়ে এলেন, চুপ করে তাকিয়ে রইলেন সামনের দিকে, যেখানে সারদাপ্রসাদের মতো একটা অবোধ অজ্ঞান মানুষ হঠাৎ বোধের ধাক্কায় ছিটকে চলে যাবার সময় চিরদিনের মতো একটা যবনিকা টেনে দিয়ে গেছে।

হ্যাঁ, সরোজাক্ষও টের পাচ্ছেন চিরদিনের মতো। কারণ সরোজাক্ষ বিষবাণ খাওয়া একটা হৃদয় দেখতে পাচ্ছেন, সরোজাক্ষ রুক্ষ বিদীর্ণ একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেন হাসলেন যে? হাসলেন কেন?

.

খবরটা নীলাক্ষ তার স্ত্রীর কাছে পায়নি, সংসারের যাবতীয় গুঢ় আর গোপন খবর যার কাছে পাবার কথা। স্ত্রী তো তাকে ব্যঙ্গ করেই উড়িয়ে দিল।

খবর দিল ময়ূরাক্ষী।

দেশ ভ্রমণ সেরে কলকাতায় ফিরেই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল ময়ূরাক্ষী আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে, গৌরবে ঝলসাতে ঝলসাতে। বিজয়া সেই গৌরব আহ্লাদের দিকে দৃষ্টিপাতমাত্র না করে নিভৃতে ডেকে নিয়ে গিয়ে তাকে মুহূর্তে পাথর করে দিলেন।

ধৈর্য ধরবার ক্ষমতা বিজয়ার নেই, সবুরে মেওয়া ফলে এ বিশ্বাসও নেই। তাই মেয়েটার উপর নিজের চিন্তাভারের খানিকটা চাপিয়ে দিয়ে যেন কিঞ্চিৎ হালকা হলেন।

ময়ূরাক্ষীও আবার হালকা হতে চাইল দাদার উপর চাপিয়ে।

নীলাক্ষ অবশ্য ওর মতো প্রত্যেকটি খবরকেই গুরুত্ব দিল না। বাবা কলকাতার কাজ ছেড়ে হুগলি কলেজের দ্বারস্থ হয়েছেন।

এটা কী আর এমন মন্দ?

বাড়ি বসে বসে ফসিল হচ্ছিলেন, যান না বাইরে।

সারদাপ্রসাদের চলে যাওয়া?

সেটাতেও আপাতত নিজের কাছে নিজেকে ঈষৎ অপ্রতিভ অপ্রতিভ লাগলেও, খবরটা সুখবরই, কিন্তু মীনাক্ষী?

সংসার সম্পর্কে দায়িত্ব এবং মমত্বলেশহীন নীলাক্ষও শুনে হঠাৎ আঘাত খেয়ে জেগে ওঠা বাঘের মতো গর্জে উঠে বলেছিল, অসম্ভব।

কিন্তু অসম্ভববলে হুঙ্কার দিলেই তো হল না? ময়ূরাক্ষী তো নিজের ঘর থেকে গল্পটা বানিয়ে এনে দাদাকে শোনাতে বসেনি? বিশ্বাস না হয় মাকে জিজ্ঞেস করুক সে।

মাকে জিজ্ঞেস না করে স্ত্রীকেই জিজ্ঞেস করল,জানতে তুমি?

সুনন্দা গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, হ্যাঁ।

আমায় বলোনি যে?

বললে কী করতে?

কী করতাম?

নীলাক্ষ গজরাতে গজরাতে বলে, সেই হতভাগা রাস্কেলটাকে ধরে এনে বিয়ে করতে বাধ্য করতাম।

ওঃ বাধ্য করতে? কিন্তু বাধ্য করে বিয়েয় যদি তোমার বোনের মন না থাকে?

মন না থাকে? মন না থাকে? ইয়ার্কি নাকি? মন কী করে করাতে হয় দেখাচ্ছি গিয়ে।

সুনন্দা দৃঢ়স্বরে বলে, পাগলামি কোরো না। তোমাদের হিসেবনিকেশের ধারায় চলবার মেয়ে ও নয়।

নীলাক্ষ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, শুধু ও কেন, জগতের কোন মেয়েমানুষটাই বা সহজে ন্যায্য হিসেবনিকেশের ধারায় চলতে চায়? এক নম্বরের পাজি জাত।

সুনন্দা উত্তর দেয় না, শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকায়। নীলাক্ষ তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে বলে ওঠে, বেশ তো, বিয়ে করতে রাজি না হয়, তার নাম-ঠিকানাটা বলুক, চাবকে ছাল ছাড়িয়ে দিয়ে আসি রাস্কেলটার।

তা হলে তো খুবই ভাল হয়–সুনন্দা ভালমানুষের গলায় বলে, ছুরিটা শানিয়ে ফেলো ততক্ষণ।

নীলাক্ষ ওর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে ওঠে, রাবিশ! তারপর মীনাক্ষীর ঘরে গটগটিয়ে ঢুকে এসে বিনা ভূমিকায় বলে ওঠে, এই মীনা, সেই রাস্কেলটার নাম-ঠিকানা কী?

.

মীনাক্ষী অনেকদিন পরে তার দাদাকে মুখোমুখি দেখল। মীনাক্ষী অনেকদিন পরে তার দাদার দিকে তাকাল। তারপর বলল, নাম-ঠিকানা জেনে তোমার কোনও লাভ হবে না দাদা!

লাভ-লোকসান আমি বুঝব,নীলাক্ষ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, নাম-ঠিকানাটা আমার জানা দরকার।

দরকার নেই দাদা!

দরকার নেই মানে? আমি তাকে ধরে এনে বিয়ে করতে বাধ্য করতে চাই।

মীনাক্ষী ওর দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে বলে, তোমার সঙ্গে এভাবে এমন স্পষ্ট করে কথা বলতে হবে ভাবিনি দাদা! ভয় ছিল হয়তো বাবার দরবারে-যা বলছিই যখন, তখন বলি, বাধ্য করানো বিয়েতে তোমার আস্থা আছে?

আস্থা? আস্থা মানে? কীসের আস্থা?

মানে সেটা সুখের হবে বলে তোমার ধারণা?

সুখের।

নীলার মুখে হঠাৎ একটা উদাস দার্শনিক হাসি ফুটে ওঠে, বাধ্য করে ছাড়া অন্য সব বিয়েই সুখের হয়, এই তোর ধারণা?

মীনাক্ষী স্থির গলায় বলে, তবু তার মধ্যে অন্তত সম্ভ্রম আছে।

সম্ভ্রম! ওঃ!

নীলাক্ষ আরও সূক্ষ্ম একটু হাসে, সম্ভ্রম কথাটার মানে তো দূরে থাক, বানানই জানা নেই মীনা! জানি না কাদের জানা আছে।

এটা তুমি কী বলছ দাদা।

ঠিকই বলছি মীনা। নীলাক্ষ অস্থিরভাবে পায়চারি করতে করতে বলে, সম্ভ্রম আমাদের কোথায়? সমবোধই বা কোথায়? সমাজের উঁচু চুড়োয় ওঠবার জন্যে আমরা নীচতার পাতালে নামতেও প্রস্তুত, সম্ভ্রমের সিংহাসনে বসবার টিকিট সংগ্রহ করতে অসম্ভ্রমের নরকে যেতেও পিছপা নই। সবাই সবাইয়ের আসল মুখের চেহারা জানে, তবু আমরা মুখোশ পরে ঘুরে বেড়াই, আর ভাবি আমি কী সম্ভ্রান্ত! এবং যদি কেউ সে মুখোশ খুলে নিজের সত্যি মুখ দেখাতে চায়, তাকে সবাই ছি ছি করে উঠি। কোনও ক্ষেত্রেই তো কেউ কাউকে সম্ভ্রমের চোখে দেখি না। তবে আর ও শব্দটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ?

মীনাক্ষী মৃদুগলায় বলে,অন্যের চোখে সম্ভ্রান্ত হওয়ার কথা বলিনি আমি দাদা, প্রশ্নটা আত্মসম্ভ্রমের।

নীলাক্ষ ওর ছোট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে। নীলাক্ষ যেন অবাক হয়ে যায়। ওর হঠাৎ মনে হয়, ছোটরা কোন ফাঁকে সহসা বড় হয়ে ওঠে। আমি ভাবছিলাম আমি ওর ভার নেব। ও নির্বোধ, ও অসহায়, ও আমার ছোট বোন, আমি ওর সহায় হব। দেখছি কখন ও বড় হয়ে গেছে। ওর আর কারও সাহায্যের দরকার নেই। ও নিজের ভুল নিজেই শোধরাতে চায়। এখানে তবে আমার আর কী করার আছে?

তবু নিজের পূর্ব চিন্তার জের টেনে বলল নীলাক্ষ, বেশ,–বিয়েতে তোর আপত্তি থাকে, ঠিকানা পেলে তাকে চাবকে আসতেও পারি।

তাতেই বা সম্মান কোথায় দাদা?

বেশ! চমৎকার! তুমি তোমার ওই এক ফস্ সম্মান আর সমবোধ নিয়ে ধুয়ে জল খাও, আর একটা বদমাইশ যা ইচ্ছে অন্যায় করে পার পেয়ে যাক, কেমন?

মীনার চোখটা এবার নেমে এসেছিল, মীনা আর দাদার মুখোমুখি তাকাতে পারছিল না, তবু আস্তে বলল, সব অন্যায়ের দায় অন্যের ঘাড়ে চাপানোর মধ্যে স্বস্তি থাকতে পারে দাদা, সত্য নেই। অন্যায় কি আমারই নেই? আমি দুঃসাহস করেছি, আমি যাকে বিশ্বাসের অযোগ্য বলে মনে করেছি, তাকেই বিশ্বাসের ভান করেছি, আমি মার অবাধ্য হয়েছি, আর–আর আমি আমার পারিবারিক মর্যাদার কথা না ভেবে লুকিয়ে একটা বাজে ছেলের সঙ্গে মিশেছি। প্রতিনিয়ত মনে হয়েছে আমি ভুল করছি–তবু মোহগ্রস্ত হয়ে ভেবেছি ওই মনে হওয়াটা কুসংস্কার, ওর প্রভাবমুক্ত হতে পারাটাই আধুনিকতা। তার একটা মাশুল দিতে হবে বইকী!

মীনাক্ষী যে তার দাদার সঙ্গে এমন খোলাখুলি কথা বলতে পারবে, একথা কবে ভেবেছিল মীনাক্ষী? অথচ পারল। মানুষ যখন কোনও একটা সংকল্পে স্থির হয়, তখন বোধ করি তার এমনি করেই সাহস আসে। আর তখন তার সেই সাহসকে অপরের সমীহ না করে উপায় থাকে না।

নীলাক্ষও করল সমীহ।

পায়চারি করতে করতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, তা হলে তুমি কী করবে ঠিক করছ?

অহরহ সেটাই ভাবছি।

নীলাক্ষ একটু ইতস্তত করে বলে ওঠে, ময়ূর বলছিল অথচ অতি সহজেই সমস্যার সমাধান হতে পারে।

মীনাক্ষী তার দাদার মুখের দিকে চেয়ে দেখে। সেখানে হিতৈষী বড়ভাইয়ের ব্যাকুলতা ছাড়া আর কিছু দেখতে পায় না। মীনাক্ষী অবাক হয়। দাদাকে মীনাক্ষী হৃদয়হীন বলেই জেনে এসেছে এতদিন। ভেবে এসেছে দাদা পারিবারিক বন্ধনহীন। অথচ দাদা তার ছোট বোনের জন্যে ভাবছে, ব্যাকুল হচ্ছে। তবে হয়তো ওর ওই বন্ধনহীনতার জন্যে এই পরিবারের পরিবেশই দায়ী। চিরদিন মা আছেন তাঁর কল্পিত স্বর্গের সিংহাসনে, বাবা তাঁর অহংকারের গজদন্তমিনারে, আমরা অবাঞ্ছিত, আমরা অবান্তর। তাই আমরাও স্বার্থপর হয়ে গড়ে উঠেছি। আমরা ভাইবোনে পরস্পরকে ভাল না বেসে সমালোচনা করতে শিখেছি। তবু তার মধ্যে থেকেও দাদা আমার জন্যে উদ্বিগ্ন হচ্ছে, ব্যথিত হচ্ছে।

মীনাক্ষীর চোখের কোণটা ভিজে এল, মীনাক্ষী মাথা নামিয়ে বলল,শুধু দিদি কেন, মা-ও সে সমাধানের নির্দেশ দিতে এসেছিলেন দাদা, কিন্তু একজনের কাছে যা সহজ, অন্যের কাছে তা সহজ নাও হতে পারে। অপরাধ করে তার দণ্ড ফাঁকি দেব, এ আমি ভাবতে পারছি না। তবু তোমাদের আর বেশিদিন বিপদে ফেলে রাখব না—

বিপদে ফেলে রাখবি না! নীলাক্ষ ভয় পাওয়া গলায় বলে ওঠে, কী করবি তবে? কী তোর মতলব? সুইসাইড করতে চাস বুঝি?

মীনাক্ষী মুখ তোলে।

মীনাক্ষী মৃদু হাসে।

বলে, না দাদা! সেও তো দণ্ড এড়িয়ে পালিয়ে যাওয়াই। আর তেমন মতি হলে এতদিন ধরে এত ভেবে মরবই বা কেন?

নীলাক্ষ আর একবার পায়চারি করে ঘরটা ঘুরে নেয়। তারপর মীনাক্ষীর খুব কাছে এসে তাড়াতাড়ি বলে,জানি না কী তুই ভেবে ঠিক করছিস। আমি তো ফরনাথিং এত কষ্ট পাবার কোনও মানেই খুঁজে পাচ্ছি না। তুচ্ছ একটা সেন্টিমেন্টের জন্যে জীবনটাকে জটিল করে তোলার মধ্যে কী যুক্তি আছে তোদের ভগবানই জানে। যাক–যাই ভাবিস, আর যাই ঠিক করিস, টাকা-ফাঁকার দরকার হলে বলতে লজ্জা পাস নে।

ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

মীনাক্ষী ওর চলে যাবার পথের দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। দাদার হৃদয়ে যে তার জন্যে এতটা স্নেহ ছিল তা কবে জেনেছে মীনাক্ষী?

কিন্তু ছিল সেকথা কি নীলাক্ষ নিজেই জানত? নীলাক্ষ সর্বদাই মনকেঠিক দিত, এ সংসারের কেউ আমার নয়, আমি কারও নই, ব্যস।

অথচ ও ওর ছোটবোনের জন্যে খুব একটা কষ্ট বোধ করছে। ও ওর ছোটবোনের হাতে নিজের চেক বই তুলে দিতে চাইছে।

.

হয়তো এমনিই হয়।

তাই বিজয়া সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে পরদা ঝোলানোনা একটা দরজার দিকে তাকাতে পারেন না। বিজয়ার অহরহ মনে পড়তে থাকে–একটা শিশুর মতো মানুষ শুধু খেতে থাকতে বলে বিজয়া তাকে বিষদৃষ্টিতে দেখতেন, বিজয়া তার উচ্ছেদ কামনায় পুজো মানত করতেন। ওই একটা ঘর বরবাদ হয়ে আছে বলে রাগের শেষ ছিল না তাঁর। কিন্তু কই, ঘরটায় ঢুকে পড়ে পুরনো চিহ্ন ধুয়ে মুছে ফেলে কাজে লাগাবার কথা ভাবতেও পারা যাচ্ছে না কেন?

.

সরোজাক্ষর ছেড়ে আসা কলেজ থেকে সহকর্মী ডক্টর মজুমদার এলেন একদিন সরোজাক্ষর বাড়ি খুঁজে।

তা বাড়ি খুঁজেই।

সরোজাক্ষ আর কবে তাঁর সহকর্মী বন্ধুদের বাড়িতে ডেকে বাড়ি চিনিয়েছেন?

কদাচ না।

ছেলেমেয়ের বিয়েতেও না।

নিজের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে কর্মজগতে তিনি একেবারে নীরব ছিলেন। কেউ কোনও প্রশ্ন করলেও যতটা সম্ভব সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে সারতেন।

অতএব সুজন মজুমদারকে বাড়ি খোঁজার কাজটাই করতে হল।

এলেন তিনি কলেজ কর্তৃপক্ষের দূত হয়ে। তাঁরা আবার ডাকছেন।

সরোজাক্ষ যখন পুনর্বার কাজে যোগ দিতে চেয়েছিলেন, বলেছিলেন, পদত্যাগ করে আমি ভুল করেছি ঠিক সেই মুহূর্তেই তাঁকে কেন নেওয়া সম্ভব হয়নি তার কারণ দর্শে এবং অনুতাপ প্রকাশ করে অনুরোধ জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষ, সরোজাক্ষ যেন আবার নিজ জায়গায় ফিরে আসেন।

সরোজাক্ষ এ সংবাদে উৎফুল্ল হলেন কি বিব্রত হলেন, কিছুই বোঝা গেল না। নির্লিপ্ত গলায় বললেন, রয়েছেন তো একজন?

মজুমদার হেসে বলেন, রয়েছেন, কিন্তু না থাকাতে কতক্ষণ? একযোগে সবাই মিলে একবার অনাস্থা প্রস্তাব তুললেই

সরোজাক্ষ প্রায় অবাক গলায় বলেন, কিন্তু কেন?

কেন আর? মজুমদার অনিবার্যের গলায় বলেন, ওঁর পড়ানো ছেলেদের ভাল লাগছে না।

আমার পড়ানো ভাল লাগত?

কী আশ্চর্য! এটা কি আর নতুন করে জিজ্ঞেস করবার কথা?

কিন্তু এটা বোধহয় আপনার ভুল ধারণা সুজনবাবু, সরোজাক্ষ বলেন, তা হলে একজন ছাত্রও কোনওদিন আমার কাছে এসে আক্ষেপ প্রকাশ করত।

এসে আক্ষেপ প্রকাশ করবে! মনের ভাব গোপনে অপটু সুজন মজুমদার ব্যঙ্গ হাসি হেসে ওঠেন, তা হলেই হয়েছে। ওদের কাছে আমাদের অত আশা করবার কিছু নেই সরোজবাবু! দয়া করে যার ক্লাসে শেয়াল ডাক ডাকবে না, ধরে নিতে হবে তাকে কিঞ্চিৎ পছন্দ করছে। কিছু ছেলে অবশ্য আছে যারা সভ্য ভদ্র বিনয়ী, কিন্তু ব্যঙ্গ বিদ্রুপের ভয়ে তারাও ক্রমশ মস্তান হয়ে ওঠে। আপনি বরাবরই সাতে-পাঁচে কম থাকেন তাই অতটা লক্ষ করেন না। ভদ্রঘরের ছেলেদের মুখের ভাষা কী হয়েছে যদি শোনেন! বন্ধুতে বন্ধুতে আড্ডা দিচ্ছে, আদরের সম্বোধন হল, শালা মাইরি! কানে এলে কান গরম হয়ে ওঠে। আমরা বরাবর জানতাম মশাই, ওসব হল ইতরের ভাষা। এখন শুনছি ওটাই নাকি বাহাদুরি। একটামাত্র তুচ্ছ নমুনাই শোনালাম আপনাকে, সব কথা আপনার নার্ভ বরদাস্ত করতে পারবে না, তাই বলছি না। মজুমদার একবার দম নিয়ে বলেন, বলা হয়–শিক্ষাই সুরুচির বাহন, তা দেশে শিক্ষার প্রসার যত বাড়ছে, রুচির বালাই তো ততই দুরে সরে যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষার আশ্রয় কলেজগুলোকেই তো মাপকাঠি বলে ধরতে হবে? তা দেখুন তাকিয়ে। সর্বত্রই দেখুন। স্টুডেন্ট মহলে এখন মদ না খাওয়াটা গাঁইয়ামি, মার্জিত ভাষায় কথা বলাটা বুড়োমি, আর দু-পাঁচটা করে গার্ল ফ্রেন্ড না থাকাটা বুষ্টুমি। এইসব ছেলেরাই ওই উচ্চশিক্ষার জোরে দেশের দপ্তরে দপ্তরে ছড়িয়ে পড়বে, উঁচু পোস্টে গিয়ে বসবে। আর আমরা নির্বোধের মতো ভাবতে বসব দেশের সমস্যা দূর হবে কোন পথে?

সরোজাক্ষ একটু সোজা হয়ে বসেন। বলেন, না, শুধু তাই ভাবতে বসব না, ভাবতে বসব কোন পদ্ধতিতে অর্থপুস্তক লিখতে পারলে অধিক অর্থ উপার্জন করতে পারব। আর ক্লাসের সময় ফাঁকি দিয়ে কীভাবে প্রাইভেট টিউশানির জন্যে সময় বার করব।

মজুমদার অবশ্যই এ আক্রমণের জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না, তাই উত্তেজিত গলায় বলেন, আপনি তা হলে ওদেরই সমর্থন করছেন?

ভুল করছেন সুজনবাবু, আমি কাউকেই সমর্থন করছি না, আমি শুধু যা ঘটে তাই বলছি।

সুজন মজুমদার কিছু অর্থপুস্তক লিখেছেন, এবং প্রাইভেট টিউশানিও করে থাকেন তিনি, তাই আক্রমণটা তাঁর গায়ে বাজে। বাড়ি খুঁজে বাড়ি বয়ে যার হিত করতে এসেছেন, তার এই ব্যবহার!

সুজন মজুমদার উত্তেজিত গলায় বলেন, শুধু যা ঘটে তাই বলবেন কেন, উদ্দেশ্য নিয়েই বলছেন। তবে ভুলবেন না আমি আপনার হিত চেষ্টাতেই এসেছিলাম।

সরোজাক্ষ আস্তে বলেন, আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন সুজনবাবু! কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখুন, আমাদের কি আজ আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন আসেনি? শুধু ছেলেদের ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্ত চিত্তে বসে তাদের সমালোচনা করাতেই কর্তব্য শেষ হবে আমাদের?

কথাগুলো শুনতে বেশ ভাল, বুঝলেন? সুজন মজুমদার উষ্ণভাবেই বলেন, সিনেমা থিয়েটারে কি গল্পে উপন্যাসে চেঁচিয়ে বলতে পারলে বাহবা পাওয়া যায়। কিন্তু চোখ খুলে দেখলেই বুঝতে পারবেন কী অবতারই হয়ে উঠেছে আমাদের ছেলেরা! কিছু না হোক, শুধু বারোয়ারি পুজোগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন। পুজোর স্রোত বইছে দেশে। সবাই একযোগে ভক্ত হনুমান হয়ে উঠেছেন, পুজো না করে প্রাণ বাঁচবে না। এর মধ্যেকার তত্ত্বটা কী আর তথ্যটা কী? ভেবে দেখেছেন? এই হাজার হাজার বারোয়ারি পুজোর রসদ আসছে কোথা থেকে? আসছে জুলুমবাজির মাধ্যমে। চোখ রাঙিয়ে চাঁদা আদায় করে পুজোর নামে বেপরোয়া ফুর্তি করব, এই হচ্ছে লক্ষ্য। এক-একটি পুজোর সময় দেশের চেহারা দেখলে বোঝা যাবে এ-দেশে দুঃখ আছে? দৈন্য আছে? অভাব আছে? সমস্যা আছে?

মজুমদারকে বোধ করি সম্প্রতি মোটা চাঁদার হাড়িকাঠে গলা দিতে হয়েছে, তাই এই প্রসঙ্গে আরও উদ্দীপ্ত হন। আবেগতপ্ত কণ্ঠে চালিয়েই যান, শুধু স্ফুর্তি, শুধু উল্লাস! হৃদয় বলে কিছু নেই, চিন্তা বলে কিছু নেই, মানবিকতা বলে কিছু নেই! নইলে বাংলাদেশের এক প্রান্ত যখন ক্ষয়ক্ষতি আর মৃত্যুতে শ্মশান হয়ে পড়ে আছে, অপর প্রান্তে তখন উল্লাসের উদ্দাম রোশনাই জ্বলছে।–এইসব ইয়ংদের মধ্যে সহানুভূতি থাকবে না? সমবেদনা থাকবে না? সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার প্রেরণা থাকবে না? প্রেরণা আসে কীসে? না লরি চড়ে তরুণ-তরুণী মিলে সমবেতকণ্ঠে গান গাইতে গাইতে শহর প্রদক্ষিণ করে সাহায্য সংগ্রহে। তারপর সেইসব জিনিসের গতিটা কী হল–হিসেব পাবেন না আপনি!

সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, সেটাও বলতে পারা যায়, যা দেখছে তাই শিখছে।

সুজন বলেন, ওঃ বুঝেছি, ঘেরাও হয়ে পর্যন্ত আপনি এখন ওদের ভয় করে চলতে শিখছেন। আমি সে দলে নই। আমি যদি শতবার ঘেরাও হই তো দুশতবার বলব আমাদের পরবর্তী জেনারেশান স্রেফ অপদার্থ হয়ে গেছে। ওদের হয়ে বলছেন বলেই বলছি–আপনি ভাবতে পারেন আপনার ছেলেবেলায় আপনার বাবা গুরুতর পীড়িত, অথচ আপনি বারোয়ারি তলায় বসে হল্লা করছেন? আমি অন্তত ভাবতেই পারি না। আমরা ছেলেবেলায় বাড়িতে কারও শক্ত অসুখ করলে কখনও জোরে হেসে উঠতে পারতাম না। আর এখন? প্রত্যক্ষ দেখা, ছেলেরা তো বটেই, মেয়েগুলো সুষ্ঠু-এই তো আমারই বাড়ির সামনে–এক ভদ্রলোকের সিরিয়াস অসুখ, ডাক্তারে বাড়ি ভর্তি, আর তাঁর এক চোদ্দ-পনেরো বছরের ধিঙ্গি মেয়ে পুজোপ্যাণ্ডেলে রাজ্যের মেয়ে-ছেলের সঙ্গে হি হি করছে।–জিজ্ঞেস করলাম, বাবা কেমন আছেন আজ?সঙ্গে সঙ্গে মুখের চেহারা করুণ করে ফেলে ন্যাকা ন্যাকা গলায় উত্তর দিল, আজ তো বাবার খুব বেশি বাড়াবাড়ি।বুঝুন এ জ্ঞান আছে খুব-বেশি-বাড়াবাড়ি। অথচ মনে এতটুকু মমতা নেই, ভয় নেই, এমনকী চক্ষুলজ্জার বালাই পর্যন্ত নেই। এই হচ্ছে এযুগের ছেলেমেয়ে, বুঝলেন? পারিবারিক বন্ধনের ধারই ধারে না।

সরোজাক্ষ যেন মনশ্চক্ষে কী দেখেন।

সে কি নিজেরই বাড়ির পারিবারিক ছবি?

কে জানে কী!

তবে উত্তর দেন, সেও আমাদেরই ত্রুটি সুজনবাবু! এই অবসরের ক মাস আমি কেবল বসে বসে ভেবেছি। অনেক ভেবেছি। আর ভেবে ভেবে দেখতে পাচ্ছি আমরা নিমের চাষ করে, আমের আশা করছি। যে কর্তব্যবুদ্ধি, যে মমতা, যে সমবেদনা ওদের কাছে আশা করছি, আমরা নিজেরা সে আদর্শ দেখাতে পারছি কই ওদের? আমরা ছেলেবেলায় কী ছিলাম ওরা সেটা দেখতে যাবে না। আমরা এখন কী হয়েছি? আমরা প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতিশীল? আমরা একে অন্যের কথা ভাবি? বেশি কথা কী, একই বাড়িতে একজন আর একজনকে বুঝি না, একজন অপরজনকে নিষ্ঠুর আঘাত হেনে বসি। তবে?

তবে আর কী? হাত পা ছেড়ে দিয়ে ভাসাই শ্রেয় হবে। বিদ্রুপের গলায় কথাটা বলে সুজন মজুমদার দাঁড়িয়ে উঠে বলেন,আচ্ছা, আপনার মতামত জানাবেন পরে।

পরে জানাবার কিছু নেই সুজনবাবু, সরোজা বলেন, আমি মনঃস্থির করে ফেলেছি হুগলি কলেজেই জয়েন করব। আপনার সহানুভূতির জন্যে ধন্যবাদ!

সুজন মজুমদার নমস্কার করে বেরিয়ে যেতে যেতে ভাবেন, চিন্তা করছ। হরদম চিন্তা করছ। তার মানে, তোমার হেড কোম্পানিতে গণ্ডগোল বেধেছে।

তাই তো ভাবে লোকে।

কাউকে তলিয়ে চিন্তা করতে দেখলে আর বিচার করতে বসতে দেখলে বলে, লোকটার মাথাখারাপ হয়ে গেছে। চিন্তাহীন বিচারহীন–শুধু অভ্যাসের স্রোতে ভেসে যাওয়াই স্বাভাবিকতা, সুস্থতা।

.

একবস্তা কাগজ তো হৈমবতীর কাছে পড়ে রইল, বাকি বস্তাটা ভেবেছিল গঙ্গায় ফেলে দেবে, দিতে গিয়ে দিতে পারল না। গঙ্গার ঘাটে কত লোক, হাওড়া ব্রিজে কত লোক। লোকের চোখকে বড় ভয় সারদাপ্রসাদের।

হয়তো সেইটা ভেবেই মনকে চোখ ঠারছে সে। হয়তো নিজের হাতে করে জলে ফেলে দিতে বুকে বেজেছে। তাই ভাবছে, কলকাতার গঙ্গায় নয়, অন্য কোথাও। নির্জন কোনও ঘাট থেকে। আস্তে আস্তে নেমে নামিয়ে দিয়ে বলব, গঙ্গা, সারাজীবনের বৃথা স্বপ্ন আর বৃথা পরিশ্রমের ভার তোমার কাছেই নামিয়ে রেখে গেলাম।

নামিয়ে রেখে গেলাম!

নামিয়ে রেখে গেলাম।

কিন্তু কোথায় গেলাম?

সারদাপ্রসাদ যেন অবাক হয়ে ভাবে, তারপর আমি কোথায় যাব? সেই আমার প্রায় অচেনা ভাইপোদের কাছে?

তারপর যে কথাটা জীবনে কখনও মনে পড়েনি সারদাপ্রসাদের, সেই কথাটা মনে পড়ল। হয়তো পড়ত না, যদি না সরোজাক্ষ সেদিন সেই অদ্ভুত সন্দেহের কথাটা উচ্চারণ করতেন। সরোজাক্ষ সেই নোটের তাড়াটা দেখে সন্দেহ করেছিলেন সারদাপ্রসাদ তার দেশের জমিজমা বিক্রি করেছে।

সারদাপ্রসাদের তাই হঠাৎ মনে পড়ল দেশে তার জমিজমা আছে। মনে পড়ল সে জমিজমা বেচা যায়। আর বেচলে তা থেকে টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু কত সেই টাকা? সে টাকায় সারদাপ্রসাদ কোনও একটা জায়গায় নিজের মতো করে থাকতে পারে?

কিন্তু নিজের মতোটাই বা কেমন?

স্পষ্ট কোনও ধারণা করতে পারল না সারদাপ্রসাদ সেই নিজের মতোটা সম্পর্কে। সারদাপ্রসাদ আছে, অথচ তার লেখার খাতা নেই। কেমন সেই জীবন? সকাল থেকে রাত অবধি কী তবে করবে সারদা?

সারদা তো ভেবেছিল চাকরি করবে।

সাধারণ মানুষে যা করে তাই করবে। চাকরি খুঁজে খুঁজেই তো বেড়াচ্ছিল। তবে আবার সেই খোঁজার চাকরিটাই ধরুক। তারপর যখন সত্যি চাকরি জুটবে

কিন্তু জুটলেই বা কী?

কী জন্যে সেটা করবে সারদাপ্রসাদ?

শুধু নিজে কোনও একটা জায়গায় থাকবে, আর কোনওরকমে দুবেলা খাবে, এই জন্যে? সেই থাকাটা আর খাওয়াটার জন্যে সারদাপ্রসাদকে বাঁধা নিয়মে ঘুম ভেঙে উঠতে হবে, সারদাপ্রসাদকে হয়তো বাজার করতে হবে। তারপর দাড়ি কামাতে হবে, চান করতে হবে, ফরসা কাপড় জামা পরে সেজেগুজে জনতার ভিড় ঠেলে কর্মস্থলে পৌঁছতে হবে, সারাদিন খাটতে হবে?

তারপর?

তারপর আবার কী?

বাড়ি ফিরে হয়তো আবারও দোকান বাজার যেতে হবে, যার উপর রান্নার ভার, সে রান্না ফেলে। সারদাপ্রসাদের টাকার ব্যাগটা নিয়ে সরে পড়েছে কিনা খোঁজ করতে হবে, আর সেটা না করে বেঁধে সামনে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে দেখলে কৃতজ্ঞচিত্তে ভগবানকে সাতসেলাম ঠুকে খেয়েদেয়ে সকালবেলা যাতে সহজে উঠতে পারা যায়, তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়তে হবে।

কিন্তু এসব কেন করতে হবে।

তার বিনিময়ে কী পাবে সারদাপ্রসাদ?

কী পায় লোকে?

কী আবার? ওই থাকা আর খাওয়া! ঘুরে ফিরে তো সেই একই জায়গায় এসে পৌঁছচ্ছে।

অথচ ভেবে খুব একটা হাসি পাচ্ছে সারদাপ্রসাদের। শুধু ওইটুকু পাবার জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ? কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত!

হয়তো নিজের কাছে নিজেকে ওই রকম আশ্চর্য আর অদ্ভুত লাগে বলেই মানুষ লোভ নামক রথের চাকায় বেঁধে ফেলে নিজেকে। অর্থলোভ, ক্ষমতার লোভ, নারীলোভ, উদ্দেশ্য সিদ্ধির লোভ, আত্মপ্রচারের লোভ। এই লোভের চাকায় নিজেকে বেঁধে ফেলে কাঁটাবনে ঘষটাতে ঘষটাতে যেতে যেতে তবে মানুষ আপন অকিঞ্চিৎকরতাটাকে ভুলে থাকতে পারে। অথবা ভুলে থাকতে চায়। নচেৎ শুধু খাওয়া শোয়ার জন্যে বেঁচে থাকাটা ভারী অর্থহীন লাগবে যে!

ওই অর্থহীন কাজটার উপর একটা ইতি টেনে দিলেই বা ক্ষতি কী?

ভাবল সারদাপ্রসাদ, গঙ্গায় তো জলের অপ্রাচুর্য নেই। আবার ভেবে লজ্জিত হল। ভাবল, ছি ছি! এ কী ভাবছি আমি! ভগবানের এই রাজ্যে মহৎ কাজের কোনও অভাব আছে?

.

মীনাক্ষী ভাবেনি, ভগবানের এই রাজ্যটা

মীনাক্ষী ভাবছিল, এত বড় পৃথিবীটায় এমন এতটুকু জায়গা নেই যে মীনাক্ষী সেখানে একটু বিশ্রাম নেয়। নিশ্চিত বিশ্রাম। যেখানে মাথা নিচু করে থাকতে হবে না। যেখানে মীনাক্ষী ভাবতে পারবে, এখানে আমি আমার মতো করে থাকব।

পৃথিবীর সেই দুর্লভ কোণটুকু ভেবে পায় না মীনাক্ষী। মীনাক্ষীর সব গোলমাল হয়ে যায়।

আমি কি তবে কাকি-ঠাকুমার আশ্রয়ে গিয়ে উঠব?

ভাবে মীনাক্ষী, অন্তত কিছুটা দিনের জন্যে?

উনি সংস্কারমুক্ত, উনি সংসারে একা, উনি লোকলজ্জার ধার ধারেন না।

কিন্তু উনি আর আসেন না।

পিসেমশাই থাকলে–তাঁকে দিয়ে বলে পাঠাতে পারতাম।

ভাবতে গেলেই চোখটা জ্বালা করে আসে মীনাক্ষীর। ভাবে পিসেমশাইকে যে আমি এত ভালবাসতাম তা তো কই কখনও বুঝতে পারিনি। পিসেমশাই দুঃখ পেয়ে চলে গেছেন ভাবলে কী ভয়ানক একটা যন্ত্রণা হয়। পিসেমশাইকে ইচ্ছে করে কত দুঃখ দিয়েছি, আঘাত করেছি, অবজ্ঞা করেছি, খুব একটা কৌতুকের জায়গা ভেবে মজা করেছি।

অথচ এখন ভেবে মাটিতে মিশিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কত ছোট হয়েছি তাঁর কাছে। কাউকে ছোট করতে গেলে নিজেই যে কত ছোট হয়ে যেতে হয়, সেটা বোঝা যায় সেই মানুষটা যদি বিদায় নেয়।

.

মেয়ে যখন আসত, তখন রোজ আসত, রোজ থাকত। আবার এখন আসে না তো আসেই না।

সুনন্দার মা উদ্বিগ্ন হন।

মেজাজি জামাই কোনও কারণে রেগে-টেগে যায়নি তো? অথবা মেয়ে?

মহিলাটি নেহাতই সাদাসিধে গেরস্তালি ধরনের। ক্ষুদ্র একটি পরিধির মধ্যে সারা জীবন কাটিয়ে এলেন, কিন্তু নিজেকে কোনওদিন ক্ষুদ্র ভেবে মরমে মরেননি, বিধাতাকে অভিশাপ দেননি। তিনি জানেন, তাঁর হাতে যেটুকু আছে সেইটুকুতেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়, সেইটুকু দিয়েই স্বর্গের সাধনা করতে

মেয়েটিকে ভাল ঘরে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ কেমন করেই যে বদলে গেল সেই মেয়ে!

সেই বদলের চেহারাটা সুনন্দার মার কল্পনার বাইরে ছিল।

সুনন্দার মা মেয়ের সেই বদলে যাওয়ার রূপ দেখে ভীত হতেন, লজ্জিত হতেন, ব্যথিত হতেন, কখনও কখনও ঘৃণায় স্তব্ধ হয়ে যেতেন, তবু সাহস করে তার ব্যবহারের সমালোচনা করতে পারতেন না। পারতেন না, পাছে সেই সমালোচনার ফলে সে আর না আসে।

মাতৃহৃদয় যে সেইখানেই অসহায়।

পাছে আমার কাছে আর না আসে। পাছে আমাকে আর মা বলে না ডাকে।

এই এক ভয়ংকর ভয়ে মাতৃহৃদয় জেনেবুঝেও অন্যায়ের প্রশ্রয় দিয়ে দোষীর কাছে দোষী সাজে।

সেই দোষী মূর্তিতেই সুনন্দরা মা স্বামীর কাছে প্রায় কেঁদে পড়লেন। কতদিন আসেনি ওরা, তুমি একবার আসতে বলবে না?

সুনন্দার বাবা গম্ভীরভাবে বলেন, যখন ওদের আসার ইচ্ছে হত, আসত। বরং অতিরিক্তই আসত। এখন ইচ্ছে হয় না আসে না, আসতে বলতে যাবার দরকারটা কী?

পিতৃহৃদয় মাতৃহৃদয় থেকে অনেক বেশি যুক্তিবাদী এবং বাস্তববাদী।

সুনন্দার বাবা মেয়ে-জামাইয়ের তখনকার সেই বেয়াড়া আবদারের বোঝা মুখ বুজে সহ্য করে। গেলেও মনে মনে রীতিমত অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন, এখন যে আর তাদের সেই প্রত্যহ আসার হুল্লোড়টা নেই, তাতে যেন খুশিই আছেন ভদ্রলোক।

মেয়ে-জামাইয়ের নিত্য আগমনে তিনি তো প্রায় সংসারে অবান্তর হয়ে পড়েছিলেন। খাওয়ার অনিয়ম, শোয়ার অনিয়ম, বিশ্রামের অনিয়ম। তারপর দুরন্ত একটা বাচ্চা ছেড়ে রেখে দিয়ে নিত্যই তাদের কেটে পড়া। গৃহিণী অতএব কর্তাকে গৃহকর্তার বদলে, গৃহভৃত্যের পোস্টটা দিয়ে রেখেছিলেন।

জামাইয়ের জন্যে খাবার আনতে ছোটো, মাংস আনতে ছোটো, নাতি কাঁদলে তাকে সামলাতে পাতালে নামো, আকাশে ওঠো। আর পকেটে পয়সা না থাকলে পয়সা বার করো।

মহিলারা যদি সবদিকেও বুঝমান হন, দু-একটা দিকে ভীষণ অবুঝ। বাপের বাড়ি, আর জামাইবাড়ি।

সুনন্দার বাবা ভেবে নিশ্চিন্ত ছিলেন, সংসারটা একটু সমে এসেছে। হঠাৎ গৃহিণীর কণ্ঠস্বরে সেই অবুঝের আভাস পেলেন। অতএব তিনি চকিত হলেন। শক্ত হলেন।

আর সেই শক্তপোক্ত গলাতেই বললেন,আমি তো কোনওদিন তাদের যেতে বলিনি যে তাই আসতে বলতে যাব?

বাঃ তা যাবে না? রোজ আসত হঠাৎ আর একেবারেই কেন?

সুনন্দার বাবা বেজার গলায় বলেন, পকেটে টাকার ঘাটতি হয়েছে বোধহয় ফুর্তিটা কম হচ্ছে। তা ছাড়া ছেলেকে বোর্ডিঙে রেখে দিয়েছে, আর তোমায় দরকার কী?

তুমি তো চিরদিনই ওই রকম নির্মায়িকের মতো কথা কয়ে এলে। বলি–কোনও কারণে রাগ অভিমানও হতে পারে!

রাগ অভিমান? সুনন্দার বাবা তপ্ত গলায় বলেন, রাগ অভিমান কীসের? তুমি তো ফুল চন্দন হাতে করে বসে থাকো, আর আমিও কোনওদিন বলতে যাইনি এ বাড়ির মেয়ে হয়ে তুই মদ খেয়ে টলছিস? কোন লজ্জায় মুখ দেখাচ্ছিস? বলিনি, একদিনের জন্যেও বলিনি। জামাইকে যখন ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছে, তখন তার জন্যে রাবড়ি রাজভোগ আনতে দোকানে ছুটেছি। তবুও যদি তাঁদের রাগ অভিমান হয়, নাচার।

সুনন্দার মা অভিমানের গলায় বলেন, তুমি যে জামাইকে বিষদৃষ্টিতে দেখো তা আর আমার জানতে বাকি নেই।

বাকি নেই? তবু আমাকে দিয়ে তাকে নেমন্তন্ন করতে পাঠাতে চাইছ? বাঃ।

সুনন্দার মা ক্ষুব্ধ স্বরে বলেন, তবে কি আমি যাব?

যেতেই হবে কেন, সেটাই আমার প্রশ্ন।

সে প্রশ্ন তুমি করতে পারো, তোমার কাঠ প্রাণ। সুনন্দার মা কেঁদে ফেলেন, তারা যদি আর না আসে, তোমার তো মনেও পড়বে না কোনও দিন।

ওই তো ওইটিতেই চিরদিন জিতে এলে।

সুনন্দার মধ্যবিত্ত বাপ, তাঁর মধ্যচিত্ততারও নমুনা হন। তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, বলো তো যাই, তাঁদের পায়ে ধরে নেমন্তন্ন করে আসি। মেয়ে কি আর তোমার সেই মেয়ে আছে? পেটকাটা জামা পরে পার্টিতে যাচ্ছে, মদ খেয়ে টলছে, শাশুড়ির ওপর আক্রোশ দেখাতে আর টেক্কা দিতে তোমাকে মা বলে ডেকে এসেছে। এখন হয়তো দরকার ফুরিয়েছে।

সুনন্দরা মা কাঁদো কাঁদো গলায় বলেন, তা হলে তুমি ওদের আসতে বলবে না?

না, সে কথা আর বলতে পারছি কই? তবে বেয়াইবাড়ি ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। বেয়াই একটার বেশি দুটো কথা কন না, বেয়ান উৰ্ব্বলোক থেকে নামেনই না,কথা যা কই তো সেই পিসেমশাই, তা সেও তো শুনছি বিদায় নিয়েছে।

সুনন্দা তো আছে? না কি সেও গেলে কথা কইবে না?

কইতেও পারে, না কইতেও পারে। তবে যেতে যখন বলছ যেতেই হবে।

এই হচ্ছে সুনন্দার মা বাপ।

অতি সাধারণ।

তারা পরস্পরের মধ্যে কোনও দিন প্রেমের কথার আমদানি করেনি, তারা জীবনের ব্যর্থতা সার্থকতা নিয়ে মাথা ঘামায়নি, তারা তাদের জীবনকে কখনও বোঝাস্বরূপ মনে করেনি।

তারা বাজার করে রান্না করে, তুচ্ছ বিষয়বস্তু নিয়ে গল্প করে রাগ করে ঝগড়া করে, আবার বলে, বলেছ যখন, তখন না করে উপায় কী?

দাম্পত্য জীবনের এই ছবিই দেখেছে সুনন্দা তার কুমারী জীবনে।

দেখেছে কখনও মা বাবাকে ভয় করে, কখনও বাবা মাকে ভয় করে। কখনও মা কোনও কাজ করে মেয়ের কাছে চুপিচুপি বলেছে, এই, দেখিস যেন তোর বাপ না জানতে পারে। যা রাগী মানুষ, টের পেলে আর রক্ষে রাখবে না।

কখনও বাবা কোনও কাজ করে মেয়েকে বলেছে, দেখিস বাবা তোর মা যেন না টের পায়, পেলে কেঁদে-কেটে অনর্থ করবে। যা ছিচকাঁদুনে মানুষ!

সুনন্দা বড় মেয়ে, তাই সুনন্দার সঙ্গেই পরামর্শ।

কিন্তু কীই বা সেই কাজগুলো? ভাবলে এখন হাসি পায় সুনন্দার। হয়তো মা একটি ছিট কাপড়-ফেরিওয়ালা ডেকে দুগজ ছিট কিনেছে, নয়তো বা একটা বাসনওলা ডেকে পুরনো বাসন বদলে দুটো বাটি কিনেছে। আর বাবা হয়তো সুনন্দার জন্যে জুতো কিনতে এসে পাঁচ টাকার জুতো কিনে নিয়ে গিয়ে অম্লান বদনে বলেছে, এইটুকুন জুতো আট টাকা দাম নিল, বাজার দেখেছ? হয়তো সুনন্দার মার ফরমাশি কিছু কিনতে এসে দাম দেখে পিছিয়ে গিয়ে দরাজ গলায়ে বলেছে, কোথাও পেলাম না বুঝলে? পাঁচ সাতটা দোকান ঘুরলাম, বলে ওটা আজকাল আর পাওয়া যায় না।

ষড়যন্ত্রের অংশীদার সুনন্দা দোকান বাজারে বাপের সঙ্গে থেকেছে, তাই সেও সোৎসাহে বলেছে, উঃ হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা হয়ে গেছে।

আর বাবা যদি কখনও প্রশ্ন করেছে, এই তোর মা দুপুরবেলা ফেরিওলাটোলা ডাকে না তো?

সুনন্দা অপার্থিব মুখ করেছে, না তো বাবা!

এই! এমনিই সব ঘটনা নিয়ে তাদের মান অভিমান, ভয়, লুকোচুরি! প্রায় ছেলেমানুষের মতো। এই জানত সুনন্দা।

আক্রোশ নয়, হিংস্রতা নয়, একজন অপরজনকে হেয় করবার চেষ্টায় উন্মুখ হয়ে থাকা নয়, হৃদয়ের বন্ধনহীন একটা প্রতিপক্ষের ভাব নিয়ে এক ছাদের তলায় থাকার নির্লজ্জতা নয়।

এরা কি তুচ্ছ? ক্ষুদ্র? অসম্ভ্রান্ত?

এ বাড়িতে এসে সুনন্দা দাম্পত্য জীবনের তার সেই পরিচিত ছবি দেখতে পায়নি। তারপর নিজের জীবনে ।

সুনন্দা জানে নীলাক্ষ তার অতি সাধারণ শ্বশুর-শাশুড়িকে কৃপার চক্ষে দেখে। প্রয়োজনের খাতিরে তাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা করলেও কখনও সমীহের দৃষ্টিতে তাকায় না।

অভাবের মধ্যে থেকেও যারা সুখে থাকতে পারে, তাদের প্রতি বড় অবজ্ঞা নীলাক্ষর।

নীলাক্ষ টাকার অভাবটাকেই একমাত্র অভাব বলে জানে। সেই অভাবটাই উঠেপড়ে লেগে ঘোচাতে চেষ্টা করেছিল নীলাক্ষ সুখ পাবার আশায়।

আর সেই চেষ্টায় মূলধন করেছিল সুনন্দাকে। তাই যখন সুনন্দা হাসিতে কটাক্ষে নাচে গানে তার ডিলারদের মুগ্ধ করে বড় বড় একটা কাজ গুছিয়ে দিয়েছে, তখন নীলাক্ষ সুনন্দাকে আদরে ডুবিয়ে বলেছে, তুমি আমার একটি সোনার খনি!

সুনন্দা বলত,আমাকে ভাঙিয়ে তুমি বড়লোক হতে চাইছ?

নীলাক্ষ অম্লানবদনে বলত, তা ভাঙাবার মতো আর কী সম্পত্তি আমার আছে বলো?

এ বাড়িতে এসে নিজের জীবনে এই দাম্পত্য সম্পর্ক দেখতে পেল সুনন্দা। তবু সুনন্দা এবাড়িতেই রয়ে গেছে।

আশ্চর্য!

তবে কি ওই লোকটার জন্যেও ভালবাসা রয়েছে সুনন্দার? সুনন্দা তাই ভাবতে চেষ্টা করেছে, আর কিছু নয় ও নির্বোধ, বড় বেশি নির্বোধ, তাই বুঝতে পারছে না কীসের বদলে কী কিনছে।

কিন্তু ভালই যদি বাসে, ওকে তবে সব সময় বিধতে ইচ্ছে করে কেন সুনন্দার?

ব্যঙ্গ হাসির ছুরি দিয়ে, ধারালো কথার তীর দিয়ে দিয়ে?

জানে না, কেন।

তবু নীলাক্ষ যখন তার বোনের কাছ থেকে ফিরে এসে হতাশ গলায় বলে, রাস্কেলটার ঠিকানা দিলে না? তখন সুনন্দা সেই তীর মারে। বলে, অত বিচলিতই বা হচ্ছ কেন গো? তুমি তো এমন কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিলে না? মেয়েদের জীবনে এ তো একটা অ্যাকসিডেন্ট মাত্র। পবিত্রতা সতীত্ব এসব তো তোমার কাছে স্রেফ কুসংস্কার।

নীলাক্ষ ক্রুদ্ধ গলায় বলে, সতীত্ব মানে? ওর কি বিয়ে হয়েছে?

ও হো হো তাই তো বটে! সুনন্দা হি হি করে হাসে, কী বোকা আমি। হি হি হি। পতি না হলে আর সতী? সত্যি, আমি এমন বোকা কেন বলো তো?

আচ্ছা, অস্বাভাবিকের ভান করতে করতে সুনন্দা কি শেষ পর্যন্ত অস্বাভাবিক হয়ে যাবে?

.

গ্যারেজের চাবি খুলে ঢুকে গাড়িটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখলেন সরোজাক্ষ। ধুলো জমেছে বিস্তর, সরোজাক্ষর সেই অসুখ হয়ে পড়ার পর থেকেই তো চাবিবন্ধ পড়ে আছে।

নীলাক্ষ গ্যারেজের সামনে দাঁড়িয়ে তীব্রদৃষ্টিতে দেখে দেখে ফুটপাথে নেমে ট্যাক্সি ডাকে।

কমলাক্ষ যখন এসেছিল কদিনের জন্যে, সেও বলেছিল, বসে থেকে থেকে তো জং ধরে গেল ওটায়, চাবিটা বাগিয়ে আনো না মা, একবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

বিজয়া প্রথমে বলেছিলেন, হ্যাঁ, মারামারি করে মাথা ফাটিয়ে এসেছ, এবার গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করে হাত-পা ভাঙো। চালাতে শিখলি কবে যে গ্যারেজের চাবিটা পেলেই চালাবি?

তারপর বলেছিলেন, চাবি উনি দিলে তো? ওই গাড়িটা তো তোদের বাপের কাছে গাড়ি নয়, ওঁর মরে যাওয়া কাকা!

সরোজাক্ষ অবশ্য শুনতে পাননি সে কথা। শুনলে হয়তো অবাক হয়ে ভাবতেন, বিজয়া কবে আমায় এমন নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ে ফেলল?

বাস্তবিকই বুঝি সরোজাক্ষর হৃদয়ে গাড়িটা সম্পর্কে ওই রকমই একটি ভাবপ্রবণতা আছে। ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে যেন কোনও প্রিয় স্মৃতির গা থেকে বিস্মৃতির ধুলো ঝাড়লেন।

কিন্তু একে এখন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না, এতদিনের অবহেলার মাশুল দিতে হবে। আবার চাবিবন্ধ করলেন গ্যারেজের, রাস্তায় নামলেন, বাসস্টপের দিকে এগোলেন।

রোদে বেরোনো ডাক্তারের নিষেধ ছিল সরোজাক্ষর, ভিড়ের মধ্যে ট্রামে বাসে চড়া নিষেধ ছিল, সে নিষেধ এতদিন মেনেছিলেন সরোজাক্ষ। ডাক্তারের আদেশের প্রতি নিষ্ঠাবশতই যে মেনেছিলেন তা নয়, যেন নিষ্ক্রিয়তার একটা কফিনের মধ্যে নিজেকে পুরে ফেলে এই একখানা ঘরের মধ্যে কবরিত করে ফেলেছিলেন নিজেকে।

কেন?

সে কথা সরোজাক্ষ নিজেও বোধ করি জানেন না। হয়তো সহসা একটা বড় আঘাতে অসাড় হয়ে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, হয়তো বা অসাড় চিত্ত সহসা একটা বড় আঘাত পেয়ে বহু চিন্তায় সচেতন হয়ে উঠেছিল বলে চিন্তার দুর্গে বন্দি করে ফেলেছিলেন নিজেকে।

আজ আবার সহসাই যেন সব নিষ্ক্রিয়তার খোলস খুলে বার করে আনলেন নিজেকে সমর্পণ করলেন জনারণ্যের মধ্যে।

কিন্তু কেন?

কেন হঠাৎ আবার আজ আপন সৃষ্ট দুর্গ থেকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে হল সরোজাক্ষর? আর বাড়ির কাউকে না জানিয়েই বেরিয়ে পড়লেন কেন?

সরোজাক্ষ কি তবে হঠাৎ তাঁর সংসারের ক্লেদাক্ত ঘটনা শুনে ফেলেছেন, তাই বিচলিত হয়ে বেরিয়ে পড়েছেন সেই সংসারের গণ্ডি থেকে?

কিন্তু কই? তা তো নয়।

বিজয়া তো সেই কলঙ্কিত কথা এ পর্যন্ত সযত্নে স্বামীর কাছ থেকে গোপন করেই আসছে। জানেন কেউ কাছে গিয়ে না বললে, টের পাবার ক্ষমতা নেই সরোজাক্ষর। বিজয়া এখনও পর্যন্ত আশা করছিলেন, হয়তো শেষ অবধি মীনাক্ষীর সুমতি হবে, হয়তো গোপনটা গোপনই থেকে যাবে।

স্বামীকে বিজয়া কোনও ব্যাপারেই ভয় করেন না, স্বামীর পছন্দ-অপছন্দকে তোয়াক্কাই করেন না। কিন্তু এবারে একটু বে-পোটে পড়ে গেছেন। এবারে ভয় জন্মেছে।

অথচ এ ভয় করবার কথা ছিল না।

অন্তত বিজয়ার প্রকৃতিতে ছিল না।

বিজয়ার প্রকৃতিতে তো স্বাভাবিক ছিল স্বামীর কাছে এসে ফেটে পড়ে মেয়েকে যথেচ্ছ বিচরণের সুযোগ দেওয়ার অপরাধে তাঁকেই বাক্যবাণে বিদ্ধ করে জর্জরিত করা এবং মেয়েকে বিজয়ার ইচ্ছে অনুযায়ী মানুষ করতে দিলে যে আজ এমন কেলেঙ্কারি ঘটতে পারত না, সেটাও সগৌরবে ঘোষণায় বুঝিয়ে ছাড়া।

কিন্তু বিজয়া তা করেননি।

বিজয়া ভয় পেয়েছেন, ওই ধিক্কারটা তাঁর নিজের উপরই আসবে ওই আশঙ্কায়। বিজয়া ভেবেছিলেন, সরোজাক্ষ নিঃশব্দে শুধু তাকিয়ে থেকেই বিজয়াকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারেন। সরোজাক্ষ একটিমাত্র ঘৃণার বাণী উচ্চারণ করে মা আর মেয়েকে বিদীর্ণ করে ফেলতে পারেন।

বিজয়া বুঝতে পেরেছিলেন, সেই নিঃশব্দ ধিক্কারের, সেই একটি ঘৃণার বাক্যের সামনে বিজয়া মুখ খুলতে পারবেন না। মর্যাদাজ্ঞানহীন বিজয়া স্বামীর হৃদয়-দুর্গে প্রবেশের পথ না পেয়ে চিরকাল সেই দুর্গদ্বারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করেছেন, আর ভেবেছেন, এটাই বুঝি বিজয়, কিন্তু হঠাৎ যেন সেই পদ্ধতির মধ্যে কোনও ভরসা খুঁজে পাচ্ছেন না। মীনাক্ষী নামের ওই মেয়েটা যেন বিজয়াকে শক্তিহীন করে ফেলেছে। বিজয়া অনুভব করছেন মিথ্যা মর্যাদার প্রাসাদটাকে আর বুঝি রক্ষা করা যাবে না।

নিজের স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করতে অনেক চেষ্টা করেছেন বিজয়া, ভেবেছেন–মেয়েদের যথেচ্ছাচার করবার সুযোগ দেবে তোমরা এ যুগে, দেবে যথেচ্ছ বিচরণের স্বাধীনতা, অথচ সেই মেয়েরা যদি নির্বোধের মতো আগুনে পা ফেলে তখন দোষ হবে মায়ের? সকলে সকলরবে বলবে, মায়ের শিক্ষা শাসন থাকলে এমন হতে পারে না, মায়ের দায়িত্বজ্ঞান ঠিক থাকলে মেয়ের সাধ্য কী? মা বেহুঁশ, তাই এমন বেয়াড়া কাণ্ড ঘটে বসেছে।

হ্যাঁ, এই কথাই বলবে লোকে।

বিজয়া যেন সেই লোক-মুখগুলোকে দেখতে পাচ্ছেন, তাই বিজয়া ক্রমশই সাহস হারাচ্ছেন। আর তাই বিজয়া মেয়েকে তিরস্কার করার পালা শেষ করে এখন তাকে তোয়াজের পালা ধরেছেন। মীনাক্ষী যদি এতটুকু সদয় হয় মায়ের উপর। মীনাক্ষী যদি একবার মায়ের মুখের দিকে তাকায়, তা হলেই সব সমস্যা মিটে যায়। মীনাক্ষী কঠিন হয়ে বসে আছে, তবু বিজয়া সেই কাঠিন্য গলাবার চেষ্টা করে চলেছেন।

তাই বিজয়া এখনও স্বামীর আছে উদঘাটিত করে বসেননি তাঁর এই চারখানা দেয়ালের মধ্যে কোন দুরপনেয় কলঙ্কের ইতিহাস রচিত হচ্ছে।

অতএব সরোজাক্ষর এই হঠাৎ কাউকে না বলেকয়ে বেরিয়ে পড়ার মধ্যে বিজয়া-ঘটিত কোনও ঘটনা নেই। সরোজাক্ষ এমনিই বেরিয়েছেন। হয়তো বাইরের পৃথিবীটাকে ভুলে যাচ্ছি ভেবে বিচলিত হয়েছেন।

ডাক্তারের নিষেধ, তবু সরোজাক্ষ একটা ভিড়ের বাসেই উঠে পড়লেন। কিন্তু ভিড়ের ছাড়া হালকা বাস পাচ্ছেন কোথায়? এই ভরা দুপুরেও তো রড ধরে ঝুলছে লোকে।

আশ্চর্য, কত লোক পৃথিবীতে! কত লোক এই শহরটায়!

মাটির নীচেই যে অন্ন জল লুকোনো আছে, শুধু খুঁড়ে বার করার ওয়াস্তা, এ কথা যেন ভুলেই যাচ্ছে। মানুষ। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সবাই শুধু লোহালক্কড়ের কাছে ছুটে আসছে। আসছে পাথরের প্রাসাদের দরজায়। যেন সব অন্ন শুধু সেখানেই জমা আছে।

অথচ এখনও মাথার উপরের আকাশ ফুরিয়ে যায়নি। ফুরিয়ে যায়নি মাটির রস।

শুধু আমরাই ফুরিয়ে যাচ্ছি।

লোভের তাড়নায় একটা শূন্যতার গহুর লক্ষ্য করে ছুটতে ছুটতে, হারিয়ে ফেলছি আমাদের সত্তাকে। অতএব লক্ষ্যে পৌঁছবার পরিতৃপ্তি নেই, সাফল্যের আনন্দ নেই, আছে শুধু শেষ অবধি হুমড়ি খেয়ে সেই শূন্যতায় আছড়ে পড়া।

মানুষ যদি সভ্যতার শৃঙ্খলে বাঁধা না পড়ত? মানুষ যদি অনেক না চাইত? সরোজাক্ষ যেন নিজের প্রশ্নে নিজেই কৌতুক অনুভব করে নিজেকে একটি সরস উত্তর দিলেন।

তা হলে বাসে এত ভিড় হত না।

দাদু কি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছেন নাকি?

থমকে তাকালেন সরোজাক্ষ।

কে কাকে বলল কথাটা! এমন ভোলা ধারালো গলায়! আমাকেই নয় তো? অবহিত হয়ে তাকালেন, ওই প্রশ্নের লক্ষ্যের প্রতি লক্ষ করবার চেষ্টা করলেন।

প্রশ্নকর্তাকে দেখতে পেলেন না।

অতএব লক্ষ্যটা সরোজাক্ষ নয়।

সরোজাক্ষ এবার উত্তর শুনতে পেলেন, তাই দেখতে পেলেন লক্ষ্যটিকে। শীর্ণকায় এক বৃদ্ধ, পরনে অর্ধমলিন ধুতি এবং হাওয়াই নয়, পুরনো আমলের একটা জিনের কোট। কোটের উপর আবার গলায় পাক দিয়ে একখানা র‍্যাপার জড়ানো। র‍্যাপার গায়ে দেবার মতো শীত আর অবশিষ্ট নেই, তা ছাড়া দুপুর রোদ। অথচ রোদটা যে প্রখরতা লাভ করেছে সে খেয়াল ভদ্রলোকের নেই তা নয়, দেখা যাচ্ছে রোদের প্রতিষেধক ছাতাটি রয়েছে বগলে।

সরোজাক্ষর মনে হয়, এ এবং এদের মতো লোকেরা হয়তো এই শহরের বাসিন্দা নয়, হয়তো মাথার উপর যে আকাশ আছে, সেটা এরা সন্ধ্যাতারার স্নিগ্ধ আলোকে টের পায়, তবু এই দুপুরের রোদে ঠেলাঠেলি করতে এই শহরে আসে ভিড় বাড়াতে।

আসে, কারণ এরা ভুলে গেছে এদের পিতামহ প্রপিতামহ জানত মাটির নীচে অন্নজল সঞ্চিত থাকে।

বুড়ো ভদ্রলোক উত্তর দিলেন,আমায় বলছ?

একটা রোগা সিঁড়িঙ্গে ছেলে, যে ধরনের চেহারা এবং সাজসজ্জা রকের আড্ডায়, রাস্তায় ইট পেতে ক্রিকেট খেলায়, সর্বজনীন প্রতিমা ভাসানোর লরিতে টুইস্ট নাচে অথবা দুপুর রোদে সিনেমার টিকিট কাটার লাইনে সর্বদা দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি ছেলে, মুখে একপোঁচ ব্যঙ্গের প্রলেপ মেখে উত্তর দেয়,আজ্ঞে হ্যাঁ দাদু, অনেকক্ষণ থেকে আপনার ছাতার খোঁচায় হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে কি না!

হয়তো ভদ্রলোকের মস্তিষ্কে ওই ভাষাটা চট করে প্রবেশ করল না, তাই তিনি অবাক অবাক গলায় বলেন, কী বলছ?

দাদু বুঝি কানে একটু কম শোনেন?

বাসের মধ্যে একটু মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠল। সন্দেহ নেই ছোকরার ওই ব্যঙ্গোক্তি সবাই বেশ উপভোগ করছে।

বেচারি বুড়ো ভদ্রলোকের শীর্ণমুখে একটা দীর্ণ হাসি ফুটে ওঠে, আমাদের মতো হতভাগ্যের কানে কম শোনাই ভাল ভাই।

তা অবিশ্যি–ছোকরা খুক খুক করে হেসে বলে,অন্যের পাঁজর বিদীর্ণ করে অকুতোভয়ে এগিয়ে যাবেন, সরুন মশাই বললে শুনতে পাবেন না। তা ছাতাটা দয়া করে একটু নামান দাদু!

ভদ্রলোক ছাতাটাকে টেনে হিঁচড়ে একটু নামিয়ে কাতর গলায় বলেন, আমাদের মতো শক্তিহীন লোকের আর এই বাসে-ট্রামে চড়া চলে না।

আহা আমিও তো তাই বলছি দাদু–ছোকরা জিভে একটু চুকচুক শব্দ করে বলে,কেন কষ্ট করে রোদে বেরিয়েছেন? দিব্যি শীতলপাটি বিছিয়ে, ঘরে বসে দিদিমার হাতের বেলের পানা খাবেন, আর তালপাখার হাওয়া খাবেন, তা নয়, এই আমাদের পাঁজরে ছাতার খোঁচা দিতে

এবার আর মৃদু গুঞ্জন নয়, সারা বাসে একটা স্পষ্ট হাসির ঢেউ খেলে যায়।

স্বাভাবিক।

কৌতুকের কথায় কৌতুক-হাসি হাসবে না লোকে?

বিশেষ করে যখন অনেকে একত্রে রয়েছে। অনেকজন যখন একত্র হয়, তখন তো আর তারা ব্যক্তি থাকে না, হয়ে যায় জনতা।

জনতা একটা আলাদা জাত।

যে জাতের সংক্রামতা প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই।

যে কোনও ব্যাধিই তাকে মুহূর্তে গ্রাস করতে পারে।

যে কোনও ঘটনাই তাকে মুহূর্তে অনুপ্রাণিত করতে পারে। যে কোনও সবল কণ্ঠই তাকে অনুবর্তী করে ফেলতে পারে।

তাই জনতার মধ্যে একজন যদি হঠাৎ সভ্যতার বেড়া ডিঙোয়, সঙ্গে সঙ্গে সবাই অসভ্য হয়ে ওঠে। একজন যদি গালাগালি করে তো, সবাই গালাগালি শুরু করে দেয়–কেন, কাকে, কী জন্যে, সে চিন্তা না করেই।

তা হাসিও একটা সংক্রামক ব্যাধি, যদি সেটা ব্যঙ্গ হাসি হয়। অতএব এ ব্যাধি জনতার মধ্যে সংক্রামিত হতে দেরি হয় না। আর হয় না বলেই, যারা তার পথিকৃৎ, তারা চেষ্টা করে করে আরও কৌতুক কথার আমদানি করে, যাতে লোকে আরও হাসে।

অনেক লোকেরই এ-প্রবণতা দেখা যায়, তোক হাসানো। এমনিতে হয়তো তারা সুরসিক বলে খ্যাত নয়, কিন্তু বিশজন লোককে একত্রে দেখলেই তাদের রসনা আপনিই সরস হয়ে ওঠে। ট্রামে বাসে রেলগাড়িতে উঠলেই এরা কথায় ফুলঝুরি ঝরাতে আরম্ভ করে, ও দাদা, দয়া করে শ্রীচরণটি একটু গোটান। নইলে–এ-অভাগা যে মারা যায়। না-না, মাদুর গোটানো করে গোটাতে বলছিনা, জাস্ট একটু মুড়ে বসা।

ও দাদু, কৃপা করে যদি বিছানাটা একটু তোলেন।–আহা, ইস্ ইস্ দাদুর বুঝি দিবানিদ্রার অভ্যাস, তাই দিনদুপুরেই বিছানা বিছিয়ে–..

মাসিমা বুঝি ট্রান্সফার হয়ে অন্য কোথাও সংসার পাতাতে যাচ্ছেন? মাল মোটের বহর দেখছি কি না

এক একটি কথার সঙ্গে সঙ্গেই সারা কামরায় হাসির ঢেউ ওঠে, তা সে কথা যতই পচা পুরনো সস্তা স্থূল হোক। এতএব রসিক ব্যক্তিটি উদ্বেলিত হয়ে উঠে নব নব রসে পরিবেশন শুরু করে দেন। জুড়োতে দিতে চান না। একে ঠাণ্ডা করতে পারে একমাত্র রাজনীতি। সেটাও–ভয়ংকর রকমের সংক্রামক ব্যাধি তো! আর–সেটা যে-কোনও রসের পিছনেই গুঁড়ি মেরে বসে থাকে, এবং সহসা উঁকি মেরে মুখটি বাড়িয়ে দেয়।

এই জীর্ণ বৃদ্ধকে নিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি হতে হতে হয়তো শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা রাজনীতিতে পৌঁছবে, কিন্তু সরোজাক্ষ তার আগেই নেমে পড়লেন।

সরোজাক্ষ বড় বেশি পীড়াবোধ করলেন, যখন দেখলেন, ওই শীতলপাটি আর বেলের পানাশব্দ দুটি একখানা শীর্ণ মুখের রেখায় রেখায় যেন অসহায়তার আর অপমানের গভীর বেদনা ফুটিয়ে তুলল, আর সারা গাড়িতে তুলল কৌতুকের হাসির ঢেউ।

যখন দেখলেন, ওই ঢেউ থেকে নব প্রেরণা লাভ করে নতুন উদ্যমে গলায় রঙিন রুমালবাঁধা ছোকরা আবার বলে উঠল, সত্যি, কেন ঝুটমুট আসেন দাদু? আমাদের দিদিমা বুঝি মানা করেন না? এবং জনতার হাসি আরও উদ্দাম হয়ে উঠল।

আশ্চর্য। এর মধ্যেকার নির্মমতা কি কারও চোখেই পড়ছে না? সরোজাক্ষ যেন অবাকই হলেন। সরোজাক্ষ চঞ্চল হলেন, সরোজা জানলার বাইরে মুখ রাখলেন।

বৃদ্ধ ভদ্রলোক এই হাস্যমুখর কামরার মধ্যে বোধ করি সহানুভূতির মুখ দেখতে না পেয়েই ক্ষুব্ধ গলায় বলে উঠলেন, এখুনি নেমে যাব ভাই, বেশিক্ষণ তোমাদের অসুবিধে ঘটাব না।

আহাহা, অসুবিধে কী? চুকচুক ছোকরা হাঁটুদুটোকে একবার টুইস্ট নাচের ভঙ্গিতে মোড় খাইয়ে বলে ওঠে, বরং বলুন উপকার। মাঝে মাঝে খোঁচাটা বিশেষ দরকার দাদু, তাতে বেচাল হবার ভয় থাকে না। এই তিন ভুবনে এত যে বেচাল দেখছেন, সবই তো ওই যথাসময়ে আর যথাস্থানে খোঁচাটুকুর অভাবে।

এবার হাসির বাঁধ ভাঙল।

সরোজাক্ষ সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নেমে পড়লেন বাস থেকে।

আশ্চর্য, মানুষ জাতটা কী নির্লজ্জ! কী নির্মম!

অথবা মানুষ জাতটা নয়, ওই জনতা নামক জাতটা।

 ৬. মাথার উপর চড়া রোদ

ধীরে ধীরে এগিয়ে চললেন সরোজা।

কোন দিক লক্ষ্য করে, তা বোঝা গেল না। হয়তো নিজেও তিনি জানেন না সেটা। অথচ মাথার উপর চড়া রোদ। গায়ে সেই আগুনের হলকা লাগছে।

রোদ শুরু হয়ে গেছে, আর সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেছে ডাবের লীলা। যেখানে সেখানে বসে গেছে ডাবের বেসাতি। গাছতলায়, ফুটপাথে, পানের দোকানে। দোকানি ক্ষিপ্রহাতে ডাবের মুখ কেটে এগিয়ে দিচ্ছে পিপাসার্তের মুখের কাছে।

কেউ এমনিই গলায় ঢালছে, কেউ কায়দা করে কাগজের খড় ডুবিয়ে খাচ্ছে।

সরোজাক্ষ ভাবলেন, সহজ হতে পারার হয়তো আলাদা একটা সুখ আছে। আমি ভাবতেই পারি না রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কোনও কিছু খাচ্ছি। অথচ এরা অনায়াসেই

শুধু ডাব কেন, বহুবিধ বস্তুই।

শহরের রাস্তা অজস্র লোভনীয় খাদ্য পানীয় সাজিয়ে নিয়ে বসে আছে, হাতছানি দিয়ে ডাকছে, পথচারীর ইচ্ছের ঘরের দরজায় টোকা দিচ্ছে, খাবে না তারা? খাবেই তো।

সরোজাক্ষ পারেন না, সেটা সরোজাক্ষর ত্রুটি। সবাই যেটা করছে, সেটা করতে না পারা একটা ত্রুটিই নিশ্চয়ই। যে ত্রুটিটা অন্যের কোনও অসুবিধে ঘটায় না, অসুবিধে ঘটায় নিজের।

স্যার, আপনি এ সময় এখানে?

একটি ছেলে নিচু হয়ে প্রণাম করতে এল।

থাক থাক! দুপা পিছিয়ে সরে এসে তাকালেন সরোজাক্ষ, কে?

স্যার আমি শিখরেন্দু। আমি শিখরেন্দু বলেই নিশ্চিত হল ছেলেটা। তার মানে ধরে নিল, ওইটুকুতেই সব বলা হয়েছে। স্যার নিশ্চয় বুঝে নেবেন, একে পড়িয়েছেন, এবং কবে পড়িয়েছেন।

কথাটা ভেবেই সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হলেন সরোজাক্ষ। ভাবলেন, কেন নয়? কেনই বা প্রত্যাশা থাকবে না এদের, যাঁর কাছে তিন চার বছর ধরে পড়েছি তিনি আমার মুখটি দেখে, অথবা নামটি শুনে চিনে ফেলবেন?

হয়তো এ আমার খুব প্রিয় ছাত্রই ছিল, হয়তো খুব মেধাবী ছিল, কিন্তু সেসবের কিছু মনে নেই আমার।

সরোজাক্ষ ভাবলেন, কিংবা এ হয়তো সেদিনের সেই ঘেরাওয়ের দলেই ছিল। এখন দলছাড়া। তাই এখন নিজের ভদ্রসত্তাকে ফিরে পেয়েছে। অথবা হয়তো প্রাক্তন ছাত্র।

সরোজাক্ষ তাই চেনা-অচেনার মাঝামাঝি একটুকরো সৌজন্যের হাসি হেসে বলেন, আমিও তোমায় সে প্রশ্ন করতে পারি।

যখন স্যার বলে পায়ের ধুলো নিতে এসেছে, তখন তুমি বলাই শোভন।

আমার কথা বলছেন? ছেলেটা যেন নিজেকে তাচ্ছিল্যের ধুলোয় আছড়ে ফেলে দিয়ে বলে, আমাদের কথা বাদ দিন। কাজের ধান্দায় সময় অসময় বলে কিছু নেই। সেই পঁয়ষট্টি সাল থেকে কী না করছি, কোথায় না ঘুরছি, কাকে না ধরছি, ঠিকমতো একটা কিছুই পাচ্ছি না।

পঁয়ষট্টি সাল!

তার মানে প্রাক্তন।

তার মানে ঘেরাওদের দলের নয়।

সরোজা ঈষৎ নিশ্চিন্ত চিত্তে বলেন, আছো কোথায় এখন?

আছি এখানেই। তালতলায় সেই পিসির বাড়িতেই আছি, একটা কিছু জোগাড় করে ফেলতে পারলেই একটু বাসাভাড়া করে মাকে দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসব। একা-একা থাকেন

নিজেকে তাচ্ছিল্যের ধুলিতে নিক্ষেপ করার ভঙ্গি করলেও, নিজের কথাই সাতকাহন ছেলেটার।

শেষ বয়েসেও যদি মাকে একটু শান্তি দিতে না পারলাম, তবে আর কী হল। কিন্তু বলব কি স্যার, চাকরির বাজার যা হয়েছে–ব্যাকিং না থাকলে কার সাধ্য কিছু জোটাতে পারে।

সরোজাক্ষ এই জোলো জোলো আক্ষেপ আর জোলো জোলো মাতৃভক্তির বুলি শুনে মৃদু হাসলেন। এই ধরনের ছেলে বলেই বোধ হয় গুরু-শিষ্য সম্পর্কটা বজায় রেখেছে মনের মধ্যে। ভাবলেন, মাকে শান্তি দিতে না পারার আক্ষেপের পিছনে আর একটি আক্ষেপও কাজ করছে বইকী! মনকে চোখ ঠারা, ভাবের ঘরে চুরি, মাকে শাস্তি দেওয়া!

ওই আত্মপ্রতারণার বশে যা হোক একটা চাকরি জুটলেই একটু বাসাভাড়া করে মাকে দেশ থেকে এনে ফেলে মার সেবিকা এনে হাজির করবে, তারপর আবার কিছুদিন পরেই মাকে শাস্তি দিতে ফের দেশের বাড়িতে রেখে আসবে। তফাতের মধ্যে এখন সপ্তাহে মাকে দেখতে যাওয়া, তখন সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন শুধু মনি অর্ডারের ফরমে মাতৃ-সম্বোধনযুক্ত চিঠি।

এদের দিয়েই দেশ ছাওয়া।

সরোজাক্ষর প্রশ্ন করতে হয় তাই করেন। তোমার আর ভাই নেই?

আছে স্যার। একটি ছোট ভাই আছে, ক্লাস টেন-এ উঠল এবার। ভাবছি ওকে আর হায়ার এডুকেশনে দেব না। কোনও টেকনিক্যাল লাইনে

সরোজাক্ষর ক্লান্তি আসছিল।

সরোজাক্ষর ভয় করছিল–এরপরই হয়তো বয়স্থা আইবুড়ো বোনের কথা তুলবে এবং বিয়ের বাজার নিয়ে দার্শনিক মন্তব্য করবে।

সরোজাক্ষ তাই বলেন, সেটাই ভাল। এখন যাচ্ছিলে কোথায়?

এই এখানে একজনের সঙ্গে দেখা করতে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের সঙ্গে নাকি ওঁর ভাইপোর বিশেষ চেনা-জানা আছে। দেখি যদি বলে কয়ে দেশের স্কুলে একটা মাস্টারি পেয়েছিলাম, মানে তারাই ধরাধরি করছিল, বুঝলেন? মারও খুব ইচ্ছে ছিল যাতে দেশেই থাকা হয়। মাইনে-টাইনেও আজকাল আগের মতো পুওর নয়, সবই ঠিক, কিন্তু কী জানেন স্যার, লাইনটা বড় ইয়ে। মানে মানসম্ভ্রম বলে কিছু থাকে না। স্কুল মাস্টার শব্দটাই যেন হতশ্রদ্ধার। নয় কি না বলুন?

উত্তরের আশায় সরোজাক্ষর মুখের দিকে তাকায় শিখরেন্দু।

কিন্তু কী উত্তর দেবেন সরোজাক্ষ?

নয়, এ কথা বলতে পারবেন?

সরোজাক্ষ অতএব বলেন, সর্বত্র নয়।

এবার ছেলেটি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে, নয় কি বলছেন স্যার? সর্বত্র। সর্বত্রই এক অবস্থা। এখন আর গুরুমশাই-এর বেতের ভয়ে ছাত্ররা তটস্থ নয়। ছাত্ৰমশাইদের বেতের ভয়ে গুরুমশাইরাই আশঙ্কিত। সেই যে ছেলেবেলায় পড়েছিলাম সেই দেশেতে বেড়াল পালায় নেংটি ইঁদুর দেখে মনে হচ্ছে সেই মজার দেশটাতেই বাস করছি আমরা। নচেৎ আপনার মতো মানুষের–ছেলেটার করুদ্ধ হয়ে আসে, শুনেছি তো ব্যাপার! কাগজে বেরিয়েছিল! আপনার মতো মানুষকে যে এভাবে

সরোজাক্ষ মৃদু দৃঢ় গলায় বলেন, যাক ও সব কথা। অনেক পুরনো হয়ে গেছে।

শিখরের কিন্তু এ ইশারায় চোখ ফোটে না, সে উদ্দীপ্ত গলায় বলে, আপনি স্যার মহানুভব মানুষ, অপমান গায়ে মাখেন না, কিন্তু শুনে আমাদের যা মনের অবস্থা হয়েছিল! আর কিছুই নয় স্যার, সবই পার্টি পলিটিক্স! ওই স্টুডেন্টদের মধ্যেই যা চাঁই এক-একখানি আছে স্যার! বছর বছর ইচ্ছে করে ফেল করে করে কলেজের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে থাকে, আর অন্য সব ছেলেকে বিষাক্ত করে তোলে।

সরোজাক্ষ মৃদু হেসে বলেন, ইচ্ছে করে ফেল করে?

হাসছেন স্যার? আছো কোথায় আপনি? যা অবস্থা হয়েছে আজকাল শিক্ষা বিভাগের। রন্ধ্রে রন্ধ্রে শনি। কোথাও বাদ নেই। শুধু ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিই নয়, সর্বত্র! আমার এক পিসতুতো দাদা–

সরোজাক্ষর বুঝতে দেরি হয় না। শিখরেন্দু নামের এই ছেলেটির কোনও কথাটাই নিজস্ব চেতনা থেকে উদ্ভূত নয়, সবই ওই পিসতুতো দাদা আর মাসতুতো জামাইবাবুর ব্যাপার। সব উত্তেজনাই ঠাণ্ডা হয়ে যাবে ওর যদি এখনি একটা মনের মতন চাকরি পায়। যে চাকরির আয় থেকে অন্তত শহরে একটু বাসা করা যায়, এবং একটি বিয়ে করে ফেলে সোনার সংসার রচনা করা যায়।

সময়ে উপার্জনআর সময়ে বিয়ে, এটাই বোধ করি যুগ-যন্ত্রণার ওষুধ। ওইটার অভাবেই ওরা আগুন জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছে।

পিসতুতো দাদার অভিজ্ঞতার কাহিনী শুনতে ইচ্ছে হল না সরোজাক্ষর, তাই বললেন, হ্যাঁ, চারদিকেই তো ওই পাটি-পলিটিক্স।

সেই কথাই তো বলছি স্যার শিখরেন্দু মহোৎসাহে বলে, আপনার সঙ্গে যে ব্যবহার করা হয়েছে, তার পিছনেও তাই। নইলে–

সরোজাক্ষ দৃঢ়স্বরে বলেন, না! ওর মধ্যে অন্য কিছু নেই। সম্পূর্ণ আমার নিজের দোষ। আমি ওদের প্রতি সম্মান রেখে ব্যবহার করিনি, ওরা শুধু তার পালটা জবাব দিয়েছে। আমার আরও ভদ্র হওয়া উচিত ছিল, আরও সহিষ্ণু হওয়া উচিত ছিল।

শিখরে এবার যেন একটু থতমত খায়।

আস্তে বলে, কাগজে কিন্তু

কাগজের কথা বাদ দাও। ওরা সব কিছুতেই লাগাতে ভালবাসে। আচ্ছা

সরোজাক্ষ বিদায়ের ইঙ্গিত করলেন।

নাছোড়বান্দা ছেলেটা তবু স্রিয়মাণ গলায় বলে, কিন্তু একটা কথা শুনে বড় দুঃখ পেলাম স্যার, আপনি কলেজ ছেড়ে দিয়েছেন–

কলেজ ছাড়িনি–সরোজাক্ষ স্থির গলায় বলেন, ওই কলেজটা ছেড়েছি।

সেই তো, সেই কথাই তো বলছি–ওখানে আপনি নেই, ভাবতেই পারা যায় না–

সরোজাক্ষ এবার হাসেন, তাতে তোমার আর আক্ষেপকীসের? তুমি তো আর আবার ওখানে ভর্তি হতে আসছ না?

শিখরেন্দুও এবার হাসে।

তা না হোক। তবু মানে এখনকার স্টুডেন্টদের জন্যেই

ওখানে ছাড়াও তো স্টুডেন্ট আছে। তাদের নিয়েই কাজ করা যাবে। কাজ করারই চেষ্টা করব এবার। এতদিনের ফাঁকির প্রায়শ্চিত্ত করতে চেষ্টা করব।

ফাঁকি! আপনি!

শিখরেন্দু প্রায় জিভটা বার করে জিভ কাটে।

আপনি দিয়েছেন ফাঁকি! সেই কথা বিশ্বাস করব? লোকে বুঝি এই কথা রটিয়ে বেড়াচ্ছে? ছি ছি! যুগে যুগে এই হয় স্যার! মহতের পিছনেই ষড়যন্ত্র চলে।

দুঃখে ভেঙে পড়ে শিখরেন্দু।

সরোজাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে দেখেন না। বলেন, আচ্ছা, আশা করছি শিগগিরই কাজ পেয়ে যাবে।

চলে যান আর না তাকিয়ে।

ভাবেন, ফাঁকি দিইনি তো কী?

তুমিও তো আমার হাত দিয়েই পার হয়েছ।

.

যে খবর সযত্নে গোপন করেছিলেন বিজয়া, সেই খবর নিয়েই এসে ফেটে পড়লেন, যখন শুনলেন সরোজাক্ষ সত্যিই চলে যাচ্ছেন এবং একেবারে একাই যাচ্ছেন।

শেষ পর্যন্ত আশা ছিল তাঁর, সরোজাক্ষর দ্বারা অতখানি হয়ে উঠবেনা। একা বাক্স-বিছানা নিয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবেন জীবিকার সন্ধানে, এ অসম্ভব। কিন্তু বিজয়ার আশাভঙ্গ হল, সরোজা ঘোষণা করেছেন, কাল নটার গাড়িতে বেরোতে হবে আমায়।

বিজয়া শুনলেন, বামুন ঠাকুরের মুখে।

তাঁকেই জানিয়েছেন সরোজাক্ষ, সকাল করে ভাত দেবার জন্যে।

বিজয়া এসে ঘরে ঢুকলেন।

দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালেন।

বিজয়ার চোখে আগুনের ঝলক।

বিজয়ার মুখে পাথরের কাঠিন্য।

সরোজাক্ষ তবুও হয়তো কিছুই বলতেন না যদি না বিজয়া অমন করে দরজা বন্ধ করে আটকে দাঁড়াতেন।

সরোজাক্ষর হঠাৎ মনে হল, যেন অনেক অনেকগুলো দিন আগের বিজয়াকে দেখছেন। সরোজাক্ষ প্রায় প্রায় তাঁর পড়ার ঘরেই রাত দুটো তিনটে পর্যন্ত কাটিয়ে ফেলতেন, পড়াশোনা করতে করতে, এবং একান্তভাবে প্রার্থনা করতেন বিজয়া যেন ঘুমিয়ে পড়ে, তিনি বাকি রাতটুকু এই সোফাটাতেই কাটিয়ে দিয়ে বাঁচেন।

কিন্তু প্রার্থনা পূর্ণ হত না।

একঘুম থেকে উঠে নীচের তলায় পড়ার ঘরে নেমে আসত বিজয়া, আর এইভাবে দরজাটা বন্ধ করে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াত। বিজয়ার চোখে আগুন জ্বলত, বিজয়ার নিশ্বাসে আগুন ঝরত। বিজয়াকে যেন একখানি সুন্দরী পিশাচীর মতো দেখতে লাগত।

বিজয়া দাঁতে দাঁত চেপে চাপ রূঢ় গলায় বলত, তুমি ভেবেছ কী?

সরোজাক্ষ এই মূর্তিকে ভয় করতেন। কারণ সরোজা জানতেন ওর ওপর কথা বলতে গেলে কেলেঙ্কারি করতে পিছপা হবে না ও।

তাই সরোজাক্ষ ফিকে গলায় বলতেন,তুমি ঘুমোওনি এখনও?

ঘুম! বিজয়া কটু গলায় বলতেন, ঘুমোব, একেবারে জন্মের শোধ ঘুমোব, তোমাকে চিরশান্তি দিয়ে যাব। সেই ঘুমের ওষুধটা এনে দিয়ে আমায়। কিন্তু যতক্ষণ না দিচ্ছ–

সরোজা খাতাপত্র গুছিয়ে তুলতে তুলতে তাড়াতাড়ি বলতেন, কী যে যা-তা বলল। এই পড়তে পড়তে কীরকম অন্যমনস্ক হয়ে গিয়ে

থাক থাক, রোজ রোজ আর একই কৈফিয়ত দিতে এসো না। তোমার বলতে ঘেন্না করে না, আমার শুনতে ঘেন্না করে। আর কত চুনকালি দেবে আমার গালে! বাড়ির ঝি-চাকরটা পর্যন্ত বুঝে ফেলেছে। আমার দাম কী।

নিশ্বাসের তালে তালে বুকটা এমন ওঠাপড়া করত যে, মনে হত ফেটে পড়বে।

বিজয়ার আজকের এই চেহারায় সেই অতীতের ছবি দেখতে পেলেন সরোজা।

শুনতে পেলেন সেই কণ্ঠস্বর।

সংসারের সব দায় আমার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে কেটে পড়তে চাও, কেমন?

সরোজাক্ষ শান্ত গলায় বলেন, সংসারের দায় তো কোনওদিনই আমি বহন করিনি।

তা জানি। চিরটাদিন গায়ে হাওয়া লাগিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছ। কিন্তু চিরদিন চলেছে বলেই যে চিরকাল চলবে, তার মানে নেই। ভেবেছিলাম বলব না, ভেবেছিলাম এত বড় সর্বনেশে কথাটা বলে হার্টের অসুখের রুগির হার্টটা ফেল করিয়ে বসব? কিন্তু তুমি যখন নিশ্চিন্ত হয়ে চলে যাচ্ছ, তখন তো আর না বলে পারছি না। আমি একলা মেয়েমানুষ কি আইবুড়ো মেয়ে নিয়ে নার্সিং হোমে ছুটব?

বিজয়ার বুকটা ওঠাপড়া করতে থাকে।

বিজয়ার কণ্ঠে আগুন ঝরে।

বিজয়া যে চাপা তীব্র গলায় আরও কত কথা কয়ে যাচ্ছেন তা শুনতে পান না। সরোজা যেন হঠাৎ একটা বিরাট গহ্বর দেখতে পেয়েছেন, যে গহ্বরটা তাঁর নিজে ত্রুটির, নিজের অক্ষমতার।

বিজয়া বলে চলেছেন, আমি পারি না, আমার দ্বারা হয় না বলে তোমরা দিব্যি গা বাঁচিয়ে চলতে পারো, যত দায় এই মেয়েমানুষের। কিন্তু কেন? বলতে পারো কেন? মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আসা ছেলেবউয়ের সঙ্গে ডেকে কথা বলতে হবে আমাকেই, আইবুড়ো মেয়ের কেলেঙ্কারি ঢেকে বেড়াতে হবে আমাকেই

সরোজাক্ষ হঠাৎ কঠিন স্বরে বললেন, চুপ করো।

চুপ করব?

হ্যাঁ, চুপ করবে। আর একটি কথা উচ্চারণ করবে না।

বিজয়া অনেক রকম কথা ভেবে এসেছিলেন, অনেক যুক্তিতর্কের ভাষা মনে মনে ঠিক করেছিলেন, কিন্তু এ পরিস্থিতির জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। বিজয়া হঠাৎ সমস্ত আত্মসম্মান বিজর্সন দিয়ে কেঁদে ফেলেন।

অপমানের কান্না, দুঃখের কান্না, অসহায়তার কান্না।

সেই উচ্ছ্বসিত কান্নার গলায় বলেন,বেশ, চুপ করছি। চিরকালের জন্যেই চুপ করব। শুধু বলে যাও, ওই মেয়েকে নিয়ে আমি কী করব?

আগুনের জায়গায় জল।

সরোজাক্ষ সেদিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর স্পষ্ট গলায় উচ্চারণ করলেন, ওকে আমি নিয়ে যাব।

ওকে আমি নিয়ে যাব।

ওকে আমি নিয়ে যাব।

এ কী অদ্ভুত ভাষা।

সরোজাক্ষ কি বিজয়ার সঙ্গে ব্যঙ্গের খেলায় নামলেন?

না কি না বুঝেসুঝে কী একটা বলে বসলেন?

অগাধ বিস্ময়ে বিজয়ার চোখের জল মুহূর্তে শুকিয়ে গেল।

বিজয়া যেন যন্ত্রের মতো উচ্চারণ করলেন,ওকে তুমি নিয়ে যাবে?

হ্যাঁ। ওকে প্রস্তুত করে রেখো।

সরোজাক্ষ তাঁর রায় উচ্চারণ করে থেমে গেলেন। বিজয়া জানেন, আর একটি কথাও বলবেন না উনি।

কিন্তু এ কী ঘোষণা?

এ কি বিজয়াকে শাস্তি দেওয়া?

বিজয়ার আবার কান্না উথলে ওঠে, কষ্টে কান্না থামিয়ে বলেন, তুমি ওকে নিয়ে গিয়ে করবে কী? রাখবে কোথায়? আমায় শান্তি দেবার জন্যে

বহুদিন পরে বিজয়ার নাম ধরে ডাকলেন সরোজাক্ষ।

বললেন, তোমাকে শাস্তি দেবার জন্যে নয় বিজয়া, শাস্তিই যদি বলল, তত বোধহয় নিজেকেই দেবার জন্যে।

বিজয়া কি ওই সম্বোধনে সম্মোহিত হলেন? তাই বিজয়া স্তব্ধ হয়ে গেলেন।

বিজয়া আস্তে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন।

প্রকৃতিবিরুদ্ধ নম্র রুদ্ধ গলায় বললেন, কিন্তু ওকে আমি এ কথা বলব কী করে? ও ভাববে বুঝি ওর প্রতি ঘেন্নায় রাগে তুমি নিজের উপর শোধ নিচ্ছ।

সরোজা বলেন,ঠিক আছে, তোমায় বলতে হবে না, আমিই বলব।

হ্যাঁ, সরোজাই বললেন।

.

কতকাল পরে, মনে হল যেন কত যুগ পরে মেয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন সরোজা।

কোনও ভূমিকা করলেন না, শান্তভাবে বললেন, মীনা, তুই তোর জামাকাপড় গুছিয়ে ঠিক করে রাখ, আমার সঙ্গে যাবি।

মীনাক্ষী জানত বাবা চলে যাচ্ছেন, তবু মীনাক্ষী দম আটকানো বুকে নিজের ঘরে চুপ করে বসে ছিল। মীনাক্ষীর নিশ্চিত ধারণা ছিল, বাবা সব জানেন, তাই বাবা ঘৃণায় চলে যাচ্ছেন। ধারণা ছিল বাবা তাকে একটি কথাও বলে যাবেন না।

যখন দেখল দরজায় বাবা, তখন ভাবল বাবা যে ঘৃণায় ধিক্কারে চলে যাচ্ছেন, সেই কথাটাই জানিয়ে যাবেন বলে এসে দাঁড়িয়েছেন। এস্তে উঠে পড়ে মনকে শক্ত করে বসে রইল। না, কিছুতেই ভেঙে পড়বে না সে। কিছুতেই কেঁদে ফেলবে না।

কিন্তু অচিন্তিত একটা কথা বললেন বাবা।

সহজ সাধারণ গলায়।

যেন মীনাক্ষী নামের সেই অনেকদিন আগের মেয়েটাই বেঁচে আছে। যেন অনেকদিন আগের সেই সরোজাক্ষ মেহগম্ভীর গলায় বলছেন, কাল এই পড়াটা তৈরি করে রেখো, আমি দেখব।

তবে কি বাবা জানেন না?

কিন্তু তা হলে বাবা হঠাৎ মীনাক্ষীকে নিয়ে যেতে চাইবেন কেন? মীনাক্ষী যে আর কলেজে যায় না, সে কথা কি জানেন সরোজাক্ষ?

তা নয়।

এ হচ্ছে মীনাক্ষীর প্রতি দণ্ডাদেশ।

বাবা!

সরোজাক্ষ চলে যাচ্ছিলেন, ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, কিছু বলবি?

বাবা! আমায় নিজের মতো করে মরতে দিন।

হ্যাঁ, এই মুহূর্তে ওই মরার কথাটাই মনে এল মীনাক্ষীর। এতদিন এত রকমের মধ্যেও যে কথাটা কোনওদিন মনে আনেনি, মুখে আসেনি।

আজ সরোজাক্ষর ওই স্বাভাবিক গলার ওই ভয়ংকর অদ্ভুত একটা নির্দেশে, যা মৃত্যুদণ্ডাদেশের মতোই লাগল মীনাক্ষীর, মীনাক্ষী মৃত্যুচিন্তা করল। মীনাক্ষী ভাবল, মরাই উচিত ছিল আমার। এখনও ফুরোয়নি সে সময়।

তাই মীনাক্ষী তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে বলে উঠল, বাবা! আমায় নিজের মতো করে মরতে দিন।

সরোজাক্ষ চলে যেতে গিয়ে ফিরে দাঁড়িয়েছিলেন, ঘরের মধ্যে ঢুকে এলেন। ঘরে এসে সামান্য হেসে বললেন, নিজের মতো করে কোনও কিছু করার অধিকার কারও নেই মীনা, বাঁচবারও না, মরবারও না।

মীনা তবু মাথা হেঁট করে কাতর গলায় বলে, আমায় যেতে আদেশ করবেন না বাবা

সরোজাক্ষ ওর ওই বিশীর্ণ পাণ্ডুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন। তারপর প্রায় অভ্যাস ছাড়া অন্তরঙ্গ গলায় বলেন, আদেশ বলছ কেন? কী মুশকিল। অনুরোধ করছি। আমি বাড়ি ছেড়ে বাইরে যাচ্ছি, আমায় কে দেখাশোনা করবে? একজনের তো গেলে ভাল হয়?

সরোজাক্ষ বলছেন,আমায় কে দেখাশোনা করবে? সরোজাক্ষ বলছেন তাঁর জন্যে একজনের গেলে ভাল হয়। সরোজাক্ষকে কি তবে কেউ ছাঁচে ঢালাই করে ফেলেছে?

মীনাক্ষী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার চলে যাওয়ার পথের দিকে।

.

ভেবেছিলেন কোথাও কোনও বন্ধন নেই, দেখছে সহস্র বন্ধন। সবচেয়ে বড় বন্ধন বুঝি এই বইয়ের পাহাড়।

এই পাহাড় নিয়ে যাবার কথাও ভাবা যায় না, রেখে যাবার কথাও ভাবা যায় না। সরোজা তবু বিশেষ দরকারি কয়েকটি বেছে আলাদা করছিলেন, খানিকক্ষণ বাছতে বাছতে সহসা চোখে পড়ল ওই বিশেষ দরকারিতেই ছোটখাট একটি পাহাড় হয়ে গেছে। এদের গুছিয়ে তুলে সুটকেসে ভরতে হবে ভেবে ভারী একটা ক্লান্তি বোধ হল, সব সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালেন, জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

কত রাত এখন?

দুটো? আড়াইটে? তিনটে?

কলকাতার রাস্তায় রাত বোঝা শক্ত, তবু গভীরত্বটা বোঝা যাচ্ছে। রাত্রিশেষের আভাসবাহী একটা হিম হিম হাওয়া আসছে জানলা দিয়ে।

সরোজাক্ষর মুখেচোখে এসে লাগছিল সেই হাওয়া।

সরোজাক্ষ ভাবছিলেন, নিয়তি বলে সত্যিই কেউ আছে কোথাও?

আজ সকালে কি আমি ভেবেছিলাম

পিছনে কীসের একটা শব্দ হল।

ফিরে তাকালেন।

বিজয়া এসে ঘরে ঢুকেছেন।

সরোজাক্ষ শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকালেন, আবার কী?

কিন্তু বিজয়া কী বলে তাঁর শুচিতার গৌরব ভুলে বিছানার উপর এসে বসলেন?

নিজের বিশুদ্ধ শয্যা ছাড়া অন্য কারুর বিছানা তো স্পর্শও করেন না বিজয়া। এত রাতে আবার কোন দরকারে? আরও কী সাংঘাতিক গোপন তথ্য আছে বিজয়ার ভাঁড়ারে? যার জন্যে বিজয়া এতখানি উলটোপালটা কাজ করে বসতে পারেন?

সরোজাক্ষ তাকিয়ে দেখেন।

কিন্তু এ কী গোপন তথ্য ভাঁড়ার থেকে বার করলেন বিজয়া?

অবচেতনের কোন অতলে তলিয়ে ছিল এই তথ্য? বিজয়া নিজেই কি জানতেন?

জানতেন কি, এমন করে অভিসারিকার মতো গভীর রাত্রির মৌন মহিমা বিদীর্ণ করে সরোজা নামের ওই পাষাণমূর্তিটার পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে বলতে আসতে হবে তাঁকে, আমায় ফেলে রেখে যেও না তুমি, আমায় নিয়ে চলল।

তুমি আমায় ফেলে রেখে যেও না।

এ কী অলঙঘ্য ভাষা!

বিজয়ার ওই রূঢ় রুক্ষ স্থূল সোচ্চার মনের কোন গভীরে লুকোনো ছিল এ ভাষা?

সরোজাক্ষ এখন কী করবেন?

সরোজাক্ষ একটা ভয়ংকর দুঃসাহসিক শপথে মীনাক্ষী নামের ওই দুরূহ বিপদকে স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নিচ্ছিলেন, কিন্তু সরোজাক্ষ এই আবেদনের বিপদের সামনে থতমত খেলেন। সরোজা বলতে পারলেন না, ঠিক আছে, চলো৷

সরোজাক্ষ যেন বোবা দেয়ালের কাছে উত্তরের আশ্রয় খুঁজলেন।

সরোজাক্ষ সে আশ্রয় পেলেন না।

সরোজাক্ষ ধূসর গলায় বললেন,তুমি! তুমি কেমন করে যাবে?

বিজয়া মুখ তুললেন।

নিশ্চিত গলায় বললেন, যেমন করে স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে যায়।

তবু সরোজাক্ষর কুণ্ঠিত ধূসর গলা আর একটা কথা উচ্চারণ না করে পারল না, কিন্তু তোমার ওই সব ঠাকুর-টাকুর

সে ভাবনা আমার।

সরোজাক্ষ দৃষ্টিকে প্রসারিত করলেন।

সরোজাক্ষ তাঁর ভবিষ্যতের ছবির দিকে তাকালেন। যেখানে বুঝি একটুকরো আলোর আয়োজন হচ্ছিল, সেখানে নিয়তির লোমশ কালো হাতের থাবা দেখতে পেলেন। যে থাবা চিরদিনের জন্যে কবলিত করে রেখেছে সরোজাক্ষকে। ওর থেকে মুক্তি নেই সরোজাক্ষর।

অতএব সরোজাক্ষকে এই চিরপরিচিত জায়গাটা ছেড়ে অজানা অপরিচিত কোনও এক পরিবেশে বিজয়াকে নিয়ে নতুন করে সংসার পাততে হবে।

বিজয়ার এই আবেগ, এই ব্যাকুলতা, এই আত্মনিবেদনের নম্রতা অবশ্যই চিরদিনের নয়, বিজয়া সেই নতুন পরিবেশে আবার সোচ্চার হবেন, বিজয়া হয়তো সেখানে মীনাক্ষীকে নিয়ে বহু মিথ্যার জাল রচনা করতে বসবেন।

সরোজাক্ষ যখন মীনাক্ষী নামের বিপদটাকে মাথায় তুলে নেবার সাহস করছিলেন, ভেবেছিলেন ডাক্তার আর টাকা এই দুটো জিনিস হাতে থাকলে পরিবেশের সঙ্গে যোগসূত্রহীন হয়েও যে কোনও অবস্থাকে আয়ত্তে আনা যায়।

কী ভাববে আশেপাশের লোক!

যা ইচ্ছে।

তবু কেউ এসে সরোজাক্ষর জীবনের জানলায় উঁকি দিতে সাহস করবে না। ভেবেছিলেন তাই। কিন্তু বিজয়া সেই নিশ্চিতার ছবিতে মোটা তুলির একটা কালির পোঁচ বসিয়ে দিলেন। বিজয়া গেলেই সে জানলার কপাট ভেঙে পড়বে, আর বিজয়া বানানো কথার জাল বুনে বুনে তাকে আবৃত করবার হাস্যকর চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।

এই মুহূর্তে

এত স্পষ্ট আর পরিষ্কার করে কিছু ভাববার ক্ষমতা হয়তো হয়নি সরোজাক্ষর, তবু নিয়তির সেই লোমশ থাবার পিছনে এমনি অনেক ছায়াছবির মিছিল যেন সরোজাকে ব্যঙ্গ কটাক্ষ করে গেল।

তবু সরোজাক্ষ সেই থাবার মধ্যেই আত্মসমর্পণ করলেন।

বললেন, বেশ চলো! তোমার যদি অসুবিধে না হয়—

অসুবিধে হবে কেন?

কিন্তু অসুবিধেই তো হবার কথা বিজয়ার। বিজয়া কি তাঁর ওই বিগ্রহের সংসারটিকে নিয়ে যেতে পারবেন তাঁর নতুন সংসারে?

যাঁদের গ্রীষ্ণকালে পাখার বাতাস করে ঘুম শুকিয়ে দিতে হয়, আর শীতকালে গায়ে গরম চাদর টেনে দিতে হয়, যাঁদের ভোরে ঘুম ভাঙাতে হয়, আর রাত্রে ঘুম পাড়াতে হয়, এবং ক্ষণে ক্ষণে ভোগ দিতে হয়, তাঁদের কী ব্যবস্থা হবে সেখানে?

না, সেখানে আর কী করে কী ব্যবস্থা হবে? ওই ঠাকুরের সংসারটিকে বিজয়া পুরোহিত বাড়িতে রেখে যাবেন।

বিবেকের দংশন?

না, তাতেই বা দংশিত হতে যাবেন কেন বিজয়া? উচিতমতো সেবার জন্যে মোটা প্রণামীর ব্যবস্থা করে যাবেন।

সরোজাক্ষ চলে গেলে বিজয়া ওই ছবি আর পুতুলগুলো নিয়ে করবেন কী? শত্রুপক্ষ বিদায় নিলে যুদ্ধের হাতিয়ার কোন কাজে লাগে?

.

গ্রামের নাম মৌটুংরি।

কে জানে কী তার অর্থ, অথবা সেটা কোন কথার অপভ্রংশ। কোন সূত্রে যে কোন নাম গড়ে ওঠে গ্রামের, শহরের, পল্লীর।

হয়তো বা ভাষাটা আদিবাসীর।

কারণ গ্রামটা একটা আদিবাসী পল্লীর গা ঘেঁষা।

গ্রামের কোল দিয়ে বয়ে যাওয়া অজানা নামের ঝিরিঝিরি একটা নদী আছে, ছোট ছোট ঢিবি ঢিবি পাহাড়ের মতো আছে একেবারে গ্রামের কিনারে।

বাংলার গ্রাম হলেও, মাঠে ঘাটে গাছে পালায় যেন বিহারের রুক্ষতার আদল।

এইখানে সারদাপ্রসাদের পিতৃভিটে।

কতদিন আগে ছেড়ে যাওয়া এই গ্রামটার পথে হঠাৎ একদিন সারদাপ্রসাদকে দেখা গেল। একে ওকে জিজ্ঞেস করছে, লাহিড়ী বাড়িটা কোনদিকে।

ঠিকানা অবশ্য জানা আছে সারদাপ্রসাদের। জ্ঞাতিরা মাঝে মাঝে তার ভাগের জমিজমার উপস্বত্বস্বরূপ কিছু পাঠিয়েছে এ যাবৎ।

বিবেকের তাড়নায় পাঠাত না অবশ্যই, পাঠাত বোধ করি পাছে সারদা হঠাৎ কোনদিন এসে হাজির হয়ে নিজের ভাগ বুঝে নিয়ে বেচে-টেচে দিতে আসে। সেটা বড় ঝামেলা। তার চাইতে মুষ্টিভিক্ষা একটু দিয়ে রাখা ভাল।

তা, তার জন্যে সারদাপ্রসাদের কখনওই কিছু এসে যায়নি। নমাসে ছমাসে যদি কিছু আসত, চট করে বেশ কিছু লেখার সরঞ্জাম কিনে ফেলত। কাগজকালি ব্লটিং পেপার আলপিন, এটা ওটা।

নিজের অন্য প্রয়োজনে?

সে কথা কোনওদিন ভেবে দেখেনি লোকটা।

জামা ছিঁড়ে গেলে অম্লানবদনে ছেঁড়া জামা গায়ে দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে গেছে, কাপড় সেপটিপিন দিয়ে আটকে রেখে পরতেও দ্বিধা করেনি। তবে আশ্চর্য, সরোজাক্ষর মতো অন্যমনস্ক প্রকৃতির মানুষেরও কেমন করে যেন ওই ঘাড়ছেঁড়া শার্ট, কিংবা সেপটিপিন আটকানো ধুতি চোখে পড়ে যেত। তবে তেমন অবস্থাটা সহজে হত না, সরোজাক্ষর জামা কাপড় তোয়ালে গেঞ্জির সঙ্গে সারদাপ্রসাদেরও আসবে এই নিয়মটাই সরোজাক্ষর বাবার আমল থেকে বলবৎ ছিল।

যা দেখে বিজয়ার বাপের বাড়ির লোকেরা গালে হাত দিতেন, মেয়ে মরে গেছে, তবু বুড়ো জামাই পুষছে। ধন্যি বাবা!

কিন্তু সে যাক! সে জীবনে তো ইতি পড়ে গেছে।

এ এক নতুন সারদাপ্রসাদ তার পিতৃভিটেয় ফিরে এসেছে, জীবনের আর একটা নতুন অধ্যায়ের পাতা ওলটাতে।

একে ওকে তাকে জিজ্ঞেস করতে করতে পথটা স্মৃতির পটে ফুটে উঠতে থাকে।

শহরের রাস্তা নিত্য পরিবর্তনশীল।

আজ যেখানে মাঠ, কাল সেখানে বৃহৎ ইমারত, আজ যেটা নিচু ছোট একতলা বাসা, কাল সেটা বিরাট তিনতলা প্রাসাদ। আজ যেখানটা শৌখিন ব্যক্তির বাড়ির সামনের পুষ্পেদ্যান, কাল সেখানটা সারি সারি দোকানঘর।

গ্রামের চেহারা এমন দ্রুত পরিবর্তনশীল নয়। সেখানে হয়তো বড়লোকের ভেঙে যাওয়া দালান কোঠাটা দশ-বিশ বছর ধরে ভাঙতে ভাঙতে ভূমিসাৎ হয়, হয়তো গ্রামদেবতার মন্দিরের মাথার হেলে যাওয়া চুড়োটা ধীরে ধীরে আর একটু হেলে, শানবাঁধানো চকচকে নাটমন্দিরটায় অলক্ষ্যে কখন ফাটল ধরতে থাকে, কাকচক্ষু পুকুরটা তিলে তিলে পানায় মজতে থাকে।

আর কী?

বড়জোর কেউ ভিটের সংস্কার সাধন করতে ইটবারকরা দেয়ালের গায়ে ব্যঙ্গহাসির মতো একটু চুন লেপে, হয়তো বা কেউ রান্নাঘরের পড়ে যাওয়া ছাদটার কড়ি বরগা রাবিশ ফেলে দিয়ে দুখানা নতুন করোগেট টিন বসায়। বহু ইতিহাসের সাক্ষী পুরনো বৃহৎ গাছগুলো ঝড়ে পড়ে যাওয়া ছাড়া নতুনত্বের কোনও ছাপ নেই এই মৌটুংরির মতো গণ্ডগ্রামে।

রেল স্টেশনের ধারেকাছে যে সব গ্রাম, তাদের অনেক উন্নতি হয়েছে।

সেখানে ছাইকেল রিকশার দেখা মেলে, সেখানে ঘরে ঘরে বাইসাইকেল। তরুণ সমাজের পরনের ধুতি অপসারিত, সেখানে প্যান্টের একাধিপত্য রাজত্ব। সেই প্যান্টের পকেট হাতড়ালে প্রায় প্রত্যেকের পকেটেই একটা করে টর্চ পাওয়া যাবে, মাঝে-মাঝেই কোনও অবস্থাপনের ছাওয়ালের পকেটে ট্রানজিস্টার।

রেল স্টেশনের ধারেকাছের গ্রাম থেকে চট করে দু-একটা স্টেশন পার হয়ে সিনেমা দেখতে যাওয়া যায়, মনের মতো জামা জুতো শাড়ি ব্লাউজ কিনতে যাওয়া যায়, হাই-ইস্কুল এবং সরকারি হাসপাতালের সুবিধেও মেলে।

মৌটুংরি রেল স্টেশন থেকে অনেক মাইল দূরে। এখানে সাইকেল রিকশার টুংটাং সুদুর স্বপ্নের ছায়া। নিজের পা আর গোরুর পা, এইমাত্র ভরসা এখানে। তবে মাল বোঝাই গোরুর গাড়ির ঘণ্টাধ্বনির কামাই নেই। কতখানি যেন দূর দিয়ে কোন প্রাপ্তসীমার পারের পথে মহাজনদের লরি গাড়ি যায় গ্রামের অন্ন লুঠ করে নিয়ে যেতে, ওই গোরুর গাড়ি কাজে লাগে সেই লুঠের মালগুলো পৌঁছে দিতে।

তেমনি একখানা মালবওয়া গাড়ির ফিরতি খেপের সুযোগ রেল স্টেশন থেকে গ্রামের মধ্যে ঢুকে এসেছে সারদাপ্রসাদ, গাড়োয়ানের সঙ্গে ভাব জমিয়ে।

ওই গাড়োয়ানরা বেশিরভাগই দেহাতি বিহারি, লাহিড়ী বাড়ির ঐতিহ্যের খবরের ধার ধারে না, কাজেই তাদের কাছে হদিস মেলেনি। গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়ে, জিজ্ঞেস করে করে আর চিনে চিনে এসে দাঁড়িয়েছে লাহিড়ী বাড়ির ভিটের উঠোনে।

তা ভিটেটা না হয় চিনে বার করা গেছে, কিন্তু পাতলা লম্বা শ্যামবর্ণ, আর সুকুমার মুখ এই আধাবয়েসী মানুষটাকে চিনবে কে? কার দায় আছে তাকে চিনে ফেলে দুহাত বাড়িয়ে অভ্যর্থনা করবার?

পরিচয় দিয়ে তবে চেনাতে হবে।

কিন্তু সেই পরিচয়টাই বা কাকে দিতে বলবে সারদাপ্রসাদ? নিজেই কি সে চেনে কাউকে? তা ছাড়া ধারেকাছে আছেই বা কে?

তবু মনিঅর্ডারের কুপনের স্বাক্ষর স্মরণ করে গলা ঝেড়ে ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে ডাক দেয়, শ্যামাপ্রসাদবাবু আছেন?

যদিও ওই উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি সম্পর্কে তার ভাইপো, তবু বাবুই বলে সারদাপ্রসাদ।

সারদাপ্রসাদ যদি কিছুদিন আগেও শুধু পিতৃভিটে দেখব বলে বেড়াতে আসত, সারদাপ্রসাদের কণ্ঠে অন্য সুর বাজত।

উল্লাসের সুর, প্রত্যাশার সুর, অকুণ্ঠিতের সুর।

কিন্তু সারদাপ্রসাদ একটা মারখাওয়া পশুর মতো ছুটে চলে এসেছে, আর কোনও জায়গার কথা মনে পড়েনি বলে। আর সারদা এই সামান্য কদিনেই অনেকখানি বয়েস বাড়িয়ে এসেছে। এসেছে পৃথিবী সম্পর্কে যেন অনেকখানি অভিজ্ঞতা নিয়ে।

আগে হলে সারদাপ্রসাদ নিশ্চয়ই ভাবত, এতদিন পরে এলাম আমি, আমায় দেখে আনন্দে দিশেহারা হবে এরা। ভাবত, কী জানি বাবা, ছাড়তে চাইবে কি না।

কিন্তু বয়েস বেড়ে যাওয়া সারদাপ্রসাদ তা ভাবছে না। বরং ভাবছে চিনতে চাইবে তো? জায়গা ছেড়ে দেবে তো?

ওই বাবু ডাকের মধ্যে সেই সংশয়ের দ্বিধা।

বারদুই ডাকের পর, সামনের দালানের একটা ভেজানো দরজা খুলে গেল, একটা ছিটের ইজের পরা ছোট ছেলে তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্ন করল, কে?

আমাকে তুমি চিনবে না–সারদাপ্রসাদ আর একটু এগিয়ে এল, তুমি শ্যামাপ্রসাদবাবুর ছেলে?

ছেলেটা সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাড়ির ভিতর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে উঠল, পিসি, দেখো কে এসেছে

এবার দেখা গেল এক মলিনবসনা বিধবা মহিলাকে। চেহারায় বয়েসের থেকে অনেক বেশি জীর্ণতার ছাপ। দরজাটাকে এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরে প্রায় রূঢ় গলায় প্রশ্ন করে, কাকে চান?

সারদাপ্রসাদের বয়েস বেড়েছে, তবু সারদাপ্রসাদ বুঝতে পারে না এই অকারণ রূঢ়তার অর্থ কী?

এরা যে অপরিচিতকে দেখলেই সন্দেহ করে, আর সন্দেহ করে বলেই প্রথম থেকেই শক্ত হয়, সেটা জানা ছিল না সারদাপ্রসাদের। তাই রূঢ়তায় আরও বিষ হল সে।

আস্তে বলল, শ্যামাপ্রসাদবাবু আছেন? মানে আমি তাঁর কাকা, সারদাপ্রসাদ। কলকাতা থেকে এসেছি।

বিধবা মহিলা এবার কিঞ্চিৎ সহজ কণ্ঠে বলেন, ও, বুঝেছি। নতুন ঠাকুরদার ছেলে! আমি শ্যামার দিদি! তা আপনি এখনই এলেন বুঝি?

কণ্ঠস্বর ততটা রুক্ষ না হলেও আনন্দে অধীর নয়। বরং অপ্রসন্নতার আভাস।

সারদাপ্রসাদ এ প্রশ্নে অবাক হয়।

এখনই এলেন, এমন একটা বাহুল্য প্রশ্নের হেতু কী? সারদাপ্রসাদের কি এখানে অন্য আস্তানা আছে যে, সেখানে নেমে ধীরে সুস্থে স্নানাহার সেরে জ্ঞাতি গোত্রের বাড়িতে দেখা করতে এসেছে?

সারদাপ্রসাদ সেই অবাক অবাক অসহিষ্ণু গলায় বলে, এখন নয় তোকখন? এই তো আসছি। বাবা, যা ধুলো, গলা শুকিয়ে গেছে। জল দেখি দিকি এক গ্লাস।

তুমি আপনি বাঁচিয়ে এই প্রার্থনা।

মহিলাটি কিন্তু ওই আবেদনেও বিশেষ ব্যস্ত হয়ে ওঠেন না, সেই ছেলেটার মতোই ভিতরের দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে কাকে যেন উদ্দেশ করে বলেন,এই এক গ্লাস জল আন তো।

মহিলাটির কণ্ঠে জেলার টান। সেই বিশেষ একটি টান সংবলিত ভঙ্গিতেই তিনি আবার প্রশ্ন করেন, এখনি এলেন তো সঙ্গে জিনিসপত্তর কই?

সারদাপ্রসাদ চকিত হয়।

ওঃ, তাই ওই বাহুল্য প্রশ্ন।

অন্যখান থেকে এলেই মানুষের সঙ্গে কিছু না কিছু থাকে। নিদেন একটা হাতব্যাগও।

সারদাপ্রসাদের সঙ্গে কিছু নেই।

সারদাপ্রসাদ তার সমস্ত অন্তরটার মতোই শূন্য দুখানা হাত নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

কিন্তু কেন?

সারদাপ্রসাদের হাত একেবারে শূন্য কেন? কিছু তো থাকবার কথা। সারদাপ্রসাদ তো তার বাকি খাতার বোঝা সরিয়ে নিয়েছিল বিজয়ার ঘর খালি করে দিতে।

সারদাপ্রসাদের সেই আজীবনের ফসল সোনার ধানের বোঝর খানিক অংশ না হয় হৈমবতীর কাছে পড়ে রইল, কিন্তু বাকিগুলো সারদাপ্রসাদ করল কী?

সেগুলো তো আনবে?

না সেগুলো আনেনি।

কিন্তু সেই বোঝা নিয়ে করবেই বা কী সারদাপ্রসাদ? প্রিয়জন যতই প্রাণপ্রিয় হোক, তার মৃতদেহটা কে বয়ে নিয়ে বেড়ায়? তার শেষ সমাপ্তি তো হয় আগুনে, নয় জলে।

সারদাপ্রসাদের ওই প্রাণপ্রিয় খাতাগুলোর তো এখন মৃত্যু ঘটেছে, অতএব তাদের ওই দুটোর কোনও একটায় ঠেলে দেওয়া ছাড়া আর কী করবে?

তারপর এই চির অবহেলিত পিতৃভিটেয় এসে দাঁড়িয়েছে একান্ত প্রিয়জনকে পুড়িয়ে আসা শ্মশানপ্রত্যাগতের মূর্তি নিয়ে।

কিন্তু তেমন মূর্তি কে পছন্দ করে?

ঝকঝকে সুটকেস হাতে মটমটে চেহারার শহুরে আত্মীয় হঠাৎ গ্রামে এসে দাঁড়ালে, জ্ঞাতিরা তাকে সমীহর দৃষ্টিতে দেখে, এমন সর্বস্বান্তের মূর্তিকে আদৌ নয়।

তাই শ্যামাপ্রসাদের দিদি জলের আদেশ দিলেও পিপাসার্তের জন্যে তটস্থ হলেন না। খাতির করে বসতেও বলেন না, বরং উত্তর না পেয়েও আবার প্রশ্নের গামছা ছাঁকা দিয়ে খবরের চুনোপুঁটি সংগ্রহের চেষ্টা করেন।

কখনও তো আসতে দেখি না, এতদিনে বুঝি দেশকে মনে পড়ল?

এই আর কি, আসা হয়ে ওঠেনা–সারদাপ্রসাদ অন্যমনস্কের মতো এদিক ওদিক তাকায় কোনও একটা বসবার আসনের প্রত্যাশায়। কোথাও কিছু নেই, শুধু ওই উঁচু দাওয়ায় ওঠবার ইটের কোণ ভাঙা বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে যাওয়া সিঁড়িগুলো ছাড়া।

তা সেও তো ধূলিধূসরিত।

সারদাপ্রসাদ ক্লান্ত গলায় বলে, শ্যামাপ্রসাদ কখন আসবে?

তার আসতে দেরি আছে। কই রে অটল জল আনলি নে?

এতক্ষণে অটল নামধারী একটা একটু বড় ছেলে ঝকঝকে করে মাজা একটা ঘটিতে একঘটি জল নিয়ে আসে, তার সঙ্গে অপর হাতে ঝুলিয়ে আনে একটা জলচৌকি।

শ্যামাপ্রসাদের দিদি অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে বলেন,তুই এই ভারীটা বয়ে আনলি? রাখাল কী করছে?

সে তো গোরু ছাড়তে গেছে।

দিনভর গোরু ছাড়ছে? মহিলা বেজার গলায় যেন অনুপস্থিত রাখালের ফাঁকি দেওয়ার সমস্ত দোষটা সারদাপ্রসাদের ঘাড়েই চাপিয়ে বলেন, নিন বসুন কাকা,শ্যামা বাড়িতে থাকতে এলে আপনাকে এত অসুবিধেয় পড়তে হত না।

না না, অসুবিধে কী?

সারদাপ্রসাদ দাওয়ায় উঠে জলচৌকিতে বসে ঘটির সব জলটুকু খেয়ে শেষ করে একটা নিশ্বাস ফেলে গলায় বুকে ছিটিয়ে পড়া জলের ধারা মুছতে থাকে কোঁচার কাপড় তুলে তুলে। ঘটিতে জল খাওয়ার অভ্যাস তো নেই।

শ্যামাপ্রসাদের দিদি মনে মনে বলেন, শহুরে ভূত! চুমুক দিয়ে ঘটিতে জল খাচ্ছে।

মুখে বলেন,তা আপনি হাতমুখ ধোবেন তো?

সারদাপ্রসাদ বোকার মতো গলায় বলে, হাতমুখ? কেন স্নানের সুবিধে হবে না?

ওমা শোনো কথা। চানের আবার অসুবিধে কী? পুকুরে কি জল নেই? তবে আপনার কাপড় গামছা তো দেখছি নে–

শ্যামাপ্রসাদের দিদি বেজারই থাকেন। অনেক মালপত্র নিয়ে এসে-পড়া আত্মীয়ও যেমন ভীতিকর বইকী! হয়তো তদপেক্ষাও। চান করতে উদ্যত হয়েই তো ও প্রথমে চাইবে তেল গামছা, তারপর চাইবে কাপড়।

এ আবার কী মুশকিল! সেই মুশকিলের চিহ্ন ফুটে ওঠে তার মুখে। সারদাপ্রসাদ চকিত হয়।

সারদাপ্রসাদ যেন তার কোনও এক প্রগতির গতির ভরসায় এসেছে।

তাই সারদাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি বলে, তবে থাক, তবে থাক, শ্যামাপ্রসাদ এলেই হবে এখন। জিনিসপত্তর আনা হয়নি–মানে হঠাৎ চলে এলাম কিনা–

শ্যামাপ্রসাদের দিদি এই হঠাৎ-এর কারণ নির্ণয় করতে পারেন না। সেই একই ভাবে বলেন, তবে বসুন। শ্যামা আসুক। তবে এভাবে একবস্ত্রে আসা আপনার উচিত হয়নি কাকা!

ভাইঝি আর একবার কাকাকে উপদেশ অমৃত দান করে বলেন, একটা বেলা থাকলেও, মানুষের একখানা ধুতি গামছা লাগে।

ভিতরে ঢুকে যান তিনি, দরজাটি বন্ধ করতে ভোলেন না।

সারদাপ্রসাদ একা বসে থাকেন সেই অদেখা, বা ভুলে যাওয়া ভাইপোর আশাপথ চেয়ে। যেন সেই শ্যামাপ্রসাদই বুঝবে তাকে।

হয়তো বুঝত শ্যামাপ্রসাদ।

যতই হোক রক্তের সম্পর্ক।

কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ তার থেকে অনেক বেশি বোঝে টাকা-পয়সা। সেটা নাকি গায়ের রক্তেরও অধিক।

তাই শ্যামাপ্রসাদ এসেও আহ্লাদে অধীর হয় না কাকাকে দেখে।

কী করেই বা হবে?

সারদাপ্রসাদের বাপের দিকের ভিটের অংশটা শ্যামাপ্রসাদের খামার বাড়ি হয়নি কী? নিজের রান্নাঘরটা পড়ে যাওয়া ইস্তক-সারদাপ্রসাদের দিকের ভাঁড়ার ঘরটায় রান্নার কাজ চালাচ্ছে না? আর শ্যামাপ্রসাদের নিজের পাতকুয়োয় বালি ওঠা ইস্তক, সারদাপ্রসাদের দিকের পাতকুয়োটাই ব্যবহার করছে না কি? তা ছাড়া বাগান পুকুর সবই তো। তবে?

এই মানসিক উদ্বেগের অবস্থায় কে পারে কাকা কাকা করে গড়িয়ে পড়তে? অন্তত শ্যামাপ্রসাদ পারবে না। এই রুক্ষ মাটির বক্ষ থেকে ক্ষুধার অন্ন আহরণ করতে হয় তাকে।

শ্যামাপ্রসাদ যদি একবার তার জ্ঞাতিকাকাকে তার নিজস্ব অধিকারের জায়গাগুলো চিনিয়ে দেয়, রক্ষে আছে?

তাই সারদাপ্রসাদ যখন নেহাতই স্মৃতির মন্থন করে জিজ্ঞেস করে,আচ্ছা কোনদিকে যেন আমরা থাকতাম? সেই বড় একটা টানা বৈঠকখানায় বাবা বসতেন, আরও সব কারা আসত, দাবা খেলত–

তখন শ্যামাপ্রসাদ একটি উচ্চাঙ্গের হাসি হেসে বলে, সেই টানা বৈঠকখানা? হায় অদৃষ্ট! সে তো কবে ভূমিসাৎ হয়ে গেছে। ভিটেবাড়ি না দেখলে যা হয়। তুমি তো শুনতে পাই এখেনে ইস্কুলের পড়া সাঙ্গ করেই কলকাতায় মামার বাড়িতে থেকে কলেজে পড়েছ, তারপর বড়লোকের বাড়ি বে করে ঘরজামাই থেকেছ, এযাবৎ আর এ মুখো হওনি। মানুষকে যেমন ভাত জল দিতে হয়, ভিটেবাড়িকেও তেমনি ভাত-জল দিতে হয়। তা সে কথা আর মানলে কবে? এখনও যে তোমার সেই বাড়ি-ঘরের চেহারা মনে আছে, এইটাই অবাক কথা!

সারদাপ্রসাদ তার প্রায় সমবয়েসী ভাইপোর এই অবাকে নিজের সেই মনে থাকার লজ্জায় মরমে মরে। বাস্তবিক তো, মনে থাকাটা উচিত হয়নি তার। প্রশ্ন করাটা আরও গর্হিত হয়েছে।

ব্যস্ত হয়ে বলে, না না, এমনি হঠাৎ স্মরণে এল। সত্যিই তো, থাকবে কেন? যাবেই তো পড়ে।

শ্যামাপ্রসাদের বুক থেকে পাহাড় নামে।

তারপর ভাবে, ভাগ্যিস খামারবাড়িটা পাঁচিল দিয়ে ঘিরে নিয়েছি। নচেৎ চোখে পড়ে যেত।

তবে পাড়ায় নয় নয় করেও কুটিল বুড়ো দু-চারটে আছে তো? তারা একা পেলেই ঠিক ওর কানে তুলবে। কে জানে কতদিন থাকবার মতলবে এসেছে? জিনিসপত্তর যখন কিছু আনেনি, বেশিদিন থাকবে না বলেই মনে হয়। কিন্তু একেবারে এত শূন্য হয়ে কি লোকে একবেলার জন্যেও আসে?

ভগবান জানে রাস্তায় বাক্স সুটকেস খোয়া গিয়েছে কিনা–মুখের চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। যাই হোক, চোখে চোখে রাখতে হবে।

পাড়ার লোকের সঙ্গে একবারও একা মিশতে দেওয়া হবে না। যে কদিন থাকে, একটু ইয়ে হয়ে থাকলেই তবে আদরযত্ন নয়। আদরযত্ন পেলে আর রক্ষে থাকবে না। এসো লক্ষ্মী, যাও বালাই। আমি তো বাবা এই সার বুঝি।

তা ক-অক্ষর গোমাংস গাঁইয়াটি এবং তার সংসার যা বুঝল তাই করল।

বাড়ির ভিতরের যে মহিলাটি ছেলের হাত দিয়ে জলের সঙ্গে জলচৌকি পাঠিয়ে দিয়েছিল, ভিতরে গিয়ে শ্যামাপ্রসাদ তাকে চাপা তর্জনে শাসিয়ে আসে, তোমায় অত সর্দারি করতে কে বলেছিল, অ্যাঁ, কে বলেছিল? খবরদার! বেশি লাই দিতে যেতে হবে না। মানে মানে বিদেয় করবার চেষ্টা করতে হবে।

তা সেই চেষ্টাটা কি করতে হয়েছিল সারদাপ্রসাদের জন্যে?

নাঃ।

সারদাপ্রসাদ নিজেই বিদায় নিয়েছে।

সারদাপ্রসাদ তার ভাইপোর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেছে, এসেছি যখন, তখন দুদিন থেকে যেতে বলছ? তা থাকতে পারলে তো আমারও ভাল লাগত, কিন্তু থাকার উপায় কোথা?

শ্যামাপ্রসাদের মুখ থেকে উদ্বেগের পাথর সরে গিয়েছিল। শ্যামাপ্রসাদ এরপর তার কাকার এতদিন পরে দেশে এসে দুটো দিন থাকতে না পারার জন্যে অনেকখানি বড় একটা নিশ্বাস ফেলে আক্ষেপ করেছিল।

সারদাপ্রসাদ চুপ করে তাকিয়ে থেকেছিল সামনের তেঁতুল গাছটার দিকে।

যেখানে ঝিরিঝিরি পাতার এক পরম সৌন্দর্যের খেলা চলেছে অবিরাম ভাবে।

প্রকৃতির ঘরে এমন কত ঐশ্বর্য, কত সৌন্দর্যের সঞ্চয়! যাদের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুধু চুপ করে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়।

অথচ সারদাপ্রসাদ কোনওদিন এই বিনামূল্যে বিকোনো অফুরন্ত ঐশ্বর্যের দিকে ফিরে তাকায়নি। সারদাপ্রসাদ দশ ফুট বাই বারো ফুট একখানা ঘরের মধ্যে নিজেকে কবরিত করে ফেলে–একটা মুর্শের স্বর্গের স্বপ্ন দেখেছে বসে বসে।

প্রকৃতির এই অফুরন্ত ঐশ্বর্যের রাজ্যে কোথাও একটুকরো জায়গা কি জুটবে না সারদাপ্রসাদের? শ্যামাপ্রসাদের উদ্বেগ হয়ে এই মৌটুংরি গ্রামে পড়ে থাকবে সে? নাঃ, থাকবার ইচ্ছে নেই সারদাপ্রসাদের।

আরও তো হাজার হাজার গ্রাম আছে বাংলাদেশে। সবই তো সারদাপ্রসাদের মাতৃভূমি।

তা সেদিন কি সারদাপ্রসাদ স্নান আহার কিছুই না করে বিদায় নিয়েছিল তার সাত পুরুষের ভিটে থেকে?

না না, তাই কি হয়?

শ্যামাপ্রসাদ তাই ছাড়ে কখনও?

স্নান না হোক, আহারটা হয়েছিল বইকী!

স্নানের জন্যেও প্রস্তাব দিয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ। বলেছিল, তোমার কাপড়জামাগুলো পরে স্নান করে এসে ওগুলো মেলে দিয়ে ততক্ষণ না হয় আমার একখানা ধুতিটুতি পরে খাওয়া দাওয়া করো, শুকিয়ে গেলে নিজেরটা পরে নিও। দেরি হবে না, রোদের জোর আছে।

রোদের জোর আছে!

রোদের যে জোর আছে, সে খবর টের পাচ্ছিল বইকী সারদাপ্রসাদ, শরীরে প্রত্যেকটি অণুপরমাণু থেকে টের পাচ্ছিল। দুদিন স্নান হয়নি। স্নানটাই একমাত্র বিলাস ছিল সারদাপ্রসাদের।

যার জন্যে বিজয়া রেগে রেগে বলতেন, জামাই নবাব চৌবাচ্চার সবটুকু জল নিজের গায়ে ঢালছেন, আর যেন কারুর কাজ নেই।

তা বিজয়ার কথা বাড়ির কেউই গায়ে মাখত না, সারদাপ্রসাদও না। কথা গায়ে মাখার অভ্যাসই ছিল না তার।

হঠাৎ কেমন করেই যেন তার অভ্যাসের জগৎটা আমূল পালটে গেল।

তাই সে ওই জোরালো রোদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, না থাক, এত বেলায় আর স্নান টান করব না।

অতএব হাতে মুখে জল দিয়েই খেতে বসেছিল সারদাপ্রসাদ। আর সেই সাজিয়ে দেওয়া অন্নব্যঞ্জনে কোনও এক অন্তরালবর্তিনীর শ্রদ্ধা-ভক্তির স্পর্শ পেয়েছিল যেন।

থাকবে না, চলে যাবে।

এতে এত প্রীত হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ যে, ভিতরে গিয়ে বলেছিল, পোস্তর বড়া-টড়া দুখানা করে দাও না। আর যদি ওবেলার জন্যে মাছ থাকে তো না হয় তার থেকে

শ্যামাপ্রসাদের বউ বলেছিল,থাক তোমার আর বুদ্ধি দিতে আসতে হবে না। বাড়ির মানুষ বাড়িতে এসেছেন, দুটো যত্নের ভাত পাবেন না? শ্বশুর যে কেমন বস্তু তা তো চক্ষে দেখিনি, কাকাকে দেখে ইচ্ছে হচ্ছে গিয়ে পায়ের ধুলো নিই।

থাক, ইচ্ছেময়ীর আর অত ইচ্ছেয় কাজ নেই। শ্যামাপ্রসাদ সন্দেহের গলায় বলেছিল,দেখলে কখন?

বাঃ, সামনেই তো বসে ছিলেন দালানে। এই জানলা থেকে দেখতে পাওয়া যায় না?

থাকবে না।

চলে যাবে।

এই মন্ত্রের জোরে এত সব প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়তে পেরেছিল শ্যামাপ্রসাদ। নচেৎ ওই জানলা দিয়ে দেখা নিয়েই লেগে যেত ধুন্ধুমার।

পড়ন্তবেলাতেই বিদায় নিল সারদাপ্রসাদ।

শ্যামাপ্রসাদের দিদি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে কাকাকে বিদায় দিতে গিয়ে অভিযোগ করল, এক বেলার জন্যে শুধু মায়া বাড়াতে এলে কাকা! এতকাল পরে সেই যখন এলেই, দুটো দিন অন্তত থাকলে হত। আত্মজন একটু খবরই পেল না। কারুর সঙ্গে দেখা হল না।

সারদাপ্রসাদ সেই তেঁতুলপাতার ঝিরিঝিরিনির দিকে চোখ রেখেই মৃদু হেসে বলল,দেখা হলেও যা, না হলেও তা। আমায় আর কে চেনে?

নাই বা চিনল। নতুন ঠাকুরদার নামেই চিনত।

সেকালের কেউ তো আর বেঁচে নেই।

আছে, কেউ কেউ আছে– শ্যামাপ্রসাদ সাবধানে বলে, নাম করলে চিনতে পারবার লোকও আছে কিছু কিছু।

সাবধানে না বললে?

আগ্রহের অভিনয়টা যদি বেশি জোরালো হয়ে যায় তো লোকটার মন ঘুরে যেতে পারে। তার থেকে ওই সাবধানতাটুকু ভাল।

আমি জানি না আমি কোথায় যাচ্ছি। সারদাপ্রসাদ মনে মনে বলে, তবু যেতে হবে। এইটাই হচ্ছে। আসল কথা।

এবেলা আর গোরুর গাড়ির সুবিধে নেই, দ্রুতপায়ে হেঁটেই যাচ্ছিল সারদাপ্রসাদ। যাচ্ছিল আদিবাসীদের গ্রামের দিকে। ওই ছোট ছোট মাটির কুটিরগুলি দূর থেকে বড় সুন্দর লাগছে।

ওখানে যেতে হবে।

হয়তো এখনও সরলতা নামের বস্তুটা ওখানেই পাওয়া যেতে পারে। হয়তো ওখানেই বাকি জীবনটা কেটে যেতে পারে, শুধু গাছের পাতার ঝিরঝিরির দিকে তাকিয়ে।

প্রকৃতির ওই সবুজের ভাণ্ডার বিষে নীল হয়ে যায়নি, সে তার চির সম্ভার নিয়ে চিরকাল অপেক্ষা করে আছে, থাকবে! বিষে নীল হয়ে যাওয়া মানুষ যদি কখনও আবার ফিরে তাকিয়ে দেখে।

অনেকটা পথ পার হয়ে আসার পর হঠাৎ পিছনে একটা শব্দ পেয়ে ফিরে তাকাল সারদাপ্রসাদ। দাদু! দাদু! বলে কে কাকে ডাকছে?

সকালের সেই জল এনে দেওয়া ছেলেটা। হাতে তার একটা কাঁচা শালপাতায় মোড়া খাবারের পুঁটলি। সাধ্যের অতিরিক্ত ছুটে ছুটে এসেছে বেচারা। তাই কথা বলতে দেরি লাগে। হাঁপাতে থাকে।

সারদাপ্রসাদ সস্নেহে বলে, কী রে?

ছেলেটা কথা বলার ক্ষমতা পেয়ে বলে, দাদু, মা বলল, তুমি তো রাত্তিরে থাকলে না, তোমার রাত্তিরের খাবার।

সারদাপ্রসাদ মুহূর্তখানেক স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর আস্তে বলে, আমি যে তো দাদু হই, এ কথা কে বললে রে?

মা! মা বলল, তোমার বাড়িঘর সব নিজে নিয়ে বাবা তোমায় তাড়িয়ে দিল, থাকতে দিল না।

সারদা মৃদু ভর্ৎসনার গলায় বলে,ছিঃ ও কথা বলতে নেই। আমি পাগলাছাগলা মানুষ, কোনওখানে কি স্থির হয়ে বসতে পারব? ঘুরে ঘুরে বেড়াব। ইস, কত ছুটে এসেছিস তুই।

আসব না, হি! মা বলল না? মা গুরুজন না?

তাই তো, সত্যিই তো।

সারদাপ্রসাদ আস্তে ওর মাথায় একটা হাত রাখে। বলে, বেঁচে থাকো দাদু, সুখে থাকো। কিন্তু এ কত খাবার ভাই, বিরাট ভারী মনে হচ্ছে। তুমি কিছু খাও।

ধ্যেৎ ছেলেটা হেসে ওঠে, তোমার জন্যে আনলাম।নাভু পরোটা আর ভোলাচচ্চড়ি আছে, খেয়ে কিন্তু। আর শোনো, মা বলেছে তোমায় পেন্নাম জানিয়েছে।

সারদাপ্রসাদ সহসা অন্যদিকে তাকায়। সারদাপ্রসাদের কোনওখানে একটু বসে পড়তে ইচ্ছে করে। সারদাপ্রসাদ একটুক্ষণ পরে রুদ্ধ কণ্ঠে বলে, তোমার মাকে আমার আশীর্বাদ দিলাম ভাই, বোলো। আর বোলো খাবারটা পেয়ে বেঁচে গেলাম। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল রাত্তিরটা উপোসেই কাটাতে হবে।

দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে সারদাপ্রসাদ। পিছন দিকে আর তাকায় না। তবু অনুভব করে, ছেলেটা পিছনে দাঁড়িয়ে আছে।

সারদপ্রসাদ অনুভব করে, একটি আধময়লা শাড়িপরা নেহাত সাধারণ গ্রামের মেয়ে ওর পিছনে কোথাও যেন খোলা দরজার কপাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। যার কোনও অন্যায়ের প্রতিকারের ক্ষমতা নেই, তবু সে ন্যায়-অন্যায় সত্য-অসত্যের অঙ্ক কষে বেদনা অনুভব করে।

সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সারদাপ্রসাদ।

.

যাত্রার আয়োজন সম্পূর্ণ ছিল। অমোঘ অলঙ্ঘ্য অনিবার্যকে স্বীকার করে নিয়ে সমস্ত ভবিষ্যৎ চিন্তাকে দূরে সরিয়ে রেখে, গভীর একটি ত্যাগের জন্য মনকে প্রস্তুত করে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন সরোজাক্ষ, কিন্তু সেই অমোঘ অনিবার্যই যেন নতুন এক নির্লজ্জ খেলায় ব্যঙ্গের হাসি হেসে সবকিছু ভূমিসাৎ করে দিয়ে গেল, মূল্যহীন করে দিয়ে গেল সরোজাক্ষর ত্যাগের গভীরতাকে, দুঃসাহসের শক্তিকে।

সেই নির্লজ্জ খেলাটা এল মৃত্যুর বেশে।

এল সেই রাত্রি শেষ হবার আগেই। যে সকালে যাবার কথা সরোজাক্ষর। কিন্তু সে মৃত্যু রাজার মতো পরম সমারোহে এল না, এল চোরের মতো চুপিচুপি-মৃত্যুর এই তস্করের রূপটা ঘৃণ্য কুৎসিত অশুচি। এই অশুচির সামনে শোকের পবিত্রতা মাথা হেঁট করে দাঁড়ায়, শোকের স্তব্ধতা আতঙ্কে বিদীর্ণ হয়।

এই তস্কর এসে উঁকি মারল সরোজাক্ষর সংসারে। চুরি করে নিয়ে গেল সংসারের এক পরম মূল্যবানকে, আর যেন সেই নিয়ে যাওয়ার সুত্রে ক্রুর হাসি হেসে বলে গেল, শুধু নিজেকে নিয়ে থাকলেই হয় না সরোজা, শুধু শান্তিপ্রিয় হলেই হয় না। সে শান্তিরক্ষার দায়িত্বও গ্রহণ করতে হয়। না হলে এই রকমই হয়। তোমার সংসারের সব সৌন্দর্যের সবুজ কোন ফাঁকে বিষে নীল হয়ে আছে, তুমি তাকিয়েও দেখোনি, তুমি শুধু নিজেকে ভদ্র আর সুন্দর করে রাখবার সাধনায় নিজেকে ঘিরে দুর্গ রচনা করে তার মধ্যে নিজেকে সুরক্ষিত রেখেছ।

তবে এখন দ্যাখো।

দ্যাখো তোমার দুর্গপ্রাচীরের ওপারে কত বিষ জমছিল। হয়তো তুমি ওই যন্ত্রণাকাতর আত্মাটাকে তোমার স্নেহের স্পর্শ দিয়ে কিছুটা স্নিগ্ধ করতে পারতে, হয়তো ওই নিরুপায় অভিমানকে তোমার ছত্রতলে আশ্রয় দিয়ে, তাকে একটু সুস্থ রাখতে পারতে। হয়তো তোমার আশ্বাস তাকে পায়ের তলায় মাটি দিতে পারত, কারণ সে তোমাকে শ্রদ্ধা করত, ভালবাসত, ভক্তি করত। কিন্তু তুমি মহিমায় উদাসীনতায় কোনও কিছুর দিকে তাকিয়ে দেখোনি।

দেখো এখন কী দুর্নিবার লজ্জা তোমার, কী দুঃসহ পরাজয়।

আর কেউ বলে যায়নি

ওই মৃত্যুনীল মুখটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে এ ভাবনাটা নিজেই ভাবছিলেন সরোজাক্ষ।

আমি ওকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম, স্নেহের সঙ্গে, সমাদরের সঙ্গে, তারপর আমি ওকে ভুলে গিয়েছিলাম। অন্তত ও তাই ভেবে গেল। ধিক্কার দিয়ে গেল আমার নির্মমতাকে, আমার নির্লিপ্ততাকে।

অথচ চিরদিন আত্মহত্যার সংকল্প ঘোষণা করে এসেছেন বিজয়া। যে কোনও ইচ্ছা-অনিচ্ছার ঠাণ্ডা লড়াইয়ে স্বামীকে ঠাণ্ডা করে দিয়েছেন গলায় দড়ি দেব বলে।

সেই ঘোষণায় অদ্ভুত এক নিরুপায়তার রজ্জুতে সরোজাক্ষরই দমবন্ধ হয়ে এসেছে, সরোজাক্ষ পরাভূত হয়েছেন।

কিন্তু সেই বিজয়া দীনভাবেই না পরাভব স্বীকার করে বসলেন!

বিজয়া সরোজাক্ষর কাছে আছড়ে এসে পড়ে বললেন, আমায় তোমার সঙ্গে নিয়ে চলো।

সেই ভয়ানক মুহূর্তে বিজয়ার তো তাঁর সেই হাতের মুঠোর অস্ত্রটার কথা মনে পড়ল না। সেটাকে কাজে লাগালেই তো জিতে যেতে পারতেন বিজয়া, জব্দ করে ফেলতে পারতেন তাঁর চিরদিনের প্রতিপক্ষকে।

কিন্তু তা করেননি বিজয়া।

বিজয়া হার মেনেছেন।

বিজয়া বলেছেন, আমায় ফেলে চলে যেও না।

মরবার বদলে হারলেন বিজয়া।

তা মরার কথা তো এ বাড়ির ছোট মেয়েটারও ছিল। মরাটাই তো ছিল ওর কাছে সবচেয়ে সহজ সমাধান। কিন্তু ও সেই সহজের পথে যায়নি।

ও সমস্যার জটিলতার জালে নিজেকে জড়িয়েছে, অপর সবাইকে জড়িয়েছে।

অথচ যার মরবার কোনও কথা ছিল না, যার নামের কাছাকাছি মৃত্যু শব্দটাকে কেউ কোনওদিন ভাবতেই পারেনি, সেই মানুষটা অম্লান বদনে একমুঠো ঘুমের বড়ি খেয়ে মরে গেল।

বিগত সন্ধ্যাতেও সুনন্দা জরির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে মুখে তুলির কারুকার্য করে, ওর বরের সঙ্গে কার যেন একটা দামি মোটরগাড়ি চেপে বেড়িয়ে এসেছে।

বেশ কিছুদিন অবশ্য যাচ্ছিল না ওই প্রমোদ ভ্রমণে, জরির শাড়ি গায়ে জড়াচ্ছিল না, খুব সাদাসিধে সাজ করে ঘরের মধ্যে পড়ে থেকে বই পড়ছিল, ছবি আঁকছিল।

কোনও কোনও দিন হয়তো একা চলে যাচ্ছিল মায়ের কাছে।

মায়ের রান্নাঘরের দরজায় ধুলোয় বসে পড়ে বলছিল,আচ্ছা মা, তোমার কখনও মনে হয় না এখান থেকে পালিয়ে যাই অনেক অনেক দূরে?

বলছিল,আচ্ছা মা, তোমার কখনও মনে হয় না বেঁচে থাকার মানেটা কী?

মা বলেছে, হয় না আবার? রাতদিনই তো মনে হচ্ছে কোথাও ছুটে পালাই–অহরহই মনে হচ্ছে। এমন দুর্গতি করে বেঁচে থাকার থেকে মরণ ভাল।

বলেছে আর সঙ্গে সঙ্গে খসখস করে বড়ির ডাল বেটেছে, মিহি মিহি করে মোচা কুটেছে, আমতেলে মশলার গুঁড়ো মেখেছে তরিবৎ করে।

সুনন্দা মৃদু হেসে উঠে এসেছে।

একদিন মা বলেছিল, একটা মাত্তর সন্তান, সেটাকে দিয়ে দিলি বোর্ডিঙে, মন হু হু করবে এ আর আশ্চয্যি কী?

সুনন্দা বলেছিল,তুমি ওকে নাও তো বোর্ডিং থেকে নিয়ে আসি, তোমায় দিয়ে যাই।

মা বলেছিল, বালাই ষাট! নিতে যাব কেন? তোর জিনিস তোর বুকভরা হয়ে থাক। তবে যদি আমার কাছে রাখতে চাস

সুনন্দা নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, নাঃ যেমন আছে থাক।

কিন্তু কাল সুনন্দা ওর মার বাড়ি যায়নি।

কাল জরির শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বরের সঙ্গে পার্টিতে নাচতে গিয়েছিল। যে নাচের দৌলতে ওর বরের দৌলত বেড়ে যাওয়ার কথা।

সেই মিনতিই করেছিল ওর বর, পায়ে হাতে ধরে বলেছিল, টাকা না থাকলে বেঁচে থাকবার কোনও মানেই নেই সুনন্দা!

নাচের পর সুনন্দা কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল, আর নীলাক্ষ একখানে বসে বসে গ্লাসের পর গ্লাস খালি করেছিল। দাঁড়াতে পারছিল না, টলছিল।

তারপর সুনন্দাও ফিরে এল প্রায় টলতে টলতে, আর খুব হাসতে হাসতে। কেমন করে যে এক রাঘববোয়ালকে ঘায়েল করে নীলাক্ষর বেঁচে থাকার মানে জোগাড় করবার প্রতিশ্রুতি আদায় করে ফেলেছে, রসিয়ে রসিয়ে তার গল্প করেছিল সারাক্ষণ গাড়িতে।

নীলাক্ষ মাতাল হলেও ইশারায় ড্রাইভারকে দেখিয়ে দিয়েছিল, সুনন্দা সে ইশারা গায়েই মাখেনি। হি হি করে হেসে উঠে বলেছিল, দূর দূর, ওরা কি শুনতে পায়? ওরা কালা বোবা অন্ধ।

নীলাক্ষ আর কিছু বলেনি, কারণ তখন নীলাক্ষ চটাতে চায়নি তার স্ত্রীকে।

বাড়ি ফিরেও তোয়াজই করেছে তাকে।

অথচ কোন ফাঁকে সুনন্দা একমুঠো ঘুমের বড়ি খেয়ে বসে থাকল।

নিঃশঙ্ক নীলাক্ষ লম্বা একটা ঘুমের পর জেগে উঠে হঠাৎ কী ভেবে অভিমানীকে একটু কাছে টানতে গিয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে উঠেছিল, লাফিয়ে পড়েছিল বিছানা থেকে। দরজা খুলে বেরিয়ে গিয়ে মায়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিয়েছিল, মা মা, শিগগির একবার এসো এ ঘরে।

হয়তো সরোজাক্ষর আর কোনওদিনই এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া হবে না, হয়তো এই শহরেই কোনও একখানে কর্মক্ষেত্র নির্বাচন করে নিয়ে আস্তে আস্তে ট্রাম ধরবেন, বাস ধরবেন, ছাতাটা সব সময় হাতে রাখবেন। আর বারেবারে পকেট থেকে রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছবেন।

শৈশব থেকে সরোজা শুধু একটি জিনিসই চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা তিনি পাননি। সুন্দরের বদলে অসুন্দরকেই পেয়ে এসেছেন সরোজা, কারণ সরোজাক্ষর মা বাপ জীবনের মানে খুঁজছিলেন রাঢ়ী বারেন্দ্র কুলশীল গোত্র পর্যায়ের মধ্যে। সরোজাক্ষর স্ত্রী জীবনের মানে খুঁজেছিল দেহগত প্রাপ্তির মধ্যে, আর সরোজাক্ষর পুত্র সেই মানেটা খুঁজতে গিয়েছিল ব্যাঙ্কের খাতার মধ্যে।

হয়তো একা সরোজাক্ষরই নয়, সকলেরই এমনি হয়। হয়তো সুন্দরকে চাওয়াটা খুব একটা অসম্ভব চাওয়া, কারণ মানুষরা বড় বেশি নির্বোধ। ওই সুন্দরটাকে তারা নিজে হাতে ধ্বংস করে।

মনে হয় ওরা বুঝি শয়তান, কিন্তু তা নয়। আসলে শুধু ওরা বোধহীন। তাই নিজের হাতে গড়া সভ্যতা নিজের হাতে ধ্বংস করে উল্লাসের হাসি হেসে চিৎকার করে, জিতেছি, জিতেছি!

সরোজাক্ষর ছাত্রদলও তাদের গুরুকে অবমাননা করে মহোল্লাসে ভেবেছিল, জিতেছি, জিতেছি।

দিবাকর নামের সেই মহামূর্খটাও তার স্বর্ণহংসীকে হত্যা করে উল্লাস করেছিল জিতেছি, জিতেছি।

হয়তো বিজয়া একদা যদি একটা হৃতসর্বস্ব রোগজীর্ণ মানুষের দেহটার সেবার অধিকার পায়, সেই দাবিতেই পুলকিত হয়ে ভাববে, জিতেছি, জিতেছি।

বিজয়ার বড় মেয়ে তার স্বামীর কালোবাজারি পয়সায় দামি শাড়ি পরে মোটরগাড়ি চড়ে বেড়াবে আর ভাববে, কী জেতাই জিতেছি।

হয়তো বিজয়ার ছোট ছেলে তার বিপক্ষ পার্টির নেতার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে ভাববে, জিতেছি।

শুধু হয়তো বিজয়ার বড় ছেলে কিছু ভাববে না, শুধু বসে বসে মদ খাবে, আর নেশার ঝোঁকে নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলবে।আর বিজয়ার ছোট মেয়ে একটা সস্তা স্কুলের মাস্টারি, আর একটা অবাঞ্ছিত শিশুর বোঝা টানতে টানতে ভাববে, জিতলাম না হারলাম?

রুক্ষ শুষ্ক সেই মানুষটা হয়তো ক্রমশ একটা তিক্ততার পুতুল হয়ে ঘুরে বেড়াবে। কারণ এরা জানত না কোনটা সুন্দর।

আর একদল বোধহীন আছে জগতে। জীবনেও যাদের জ্ঞানচক্ষু খোলে না। জীবনেও যারা লাভ-লোকসানের হিসেব বুঝে উঠতে পারে না। সারদাপ্রসাদ চিরদিনই তাদের দলে। তাই সারদাপ্রসাদ মৌটুংরি গ্রামের দোরে দোরে ঘুরে সহায় সংগ্রহ করে অন্যায় দখলকারী জ্ঞাতি ভাইপোর কবল থেকে নিজের পিতৃভিটে আর সাতপুরুষের বিষয়-আশয় উদ্ধার করবার চেষ্টা না করে চলেই গেল মৌটুংরি ছেড়ে।

অথচ সহায় খুঁজলে পেত।

নির্ঘাত পেত।

কিছু কমিশনের আশা থাকলে ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করতে প্রাণপণ করবার মতো লোকের অভাব ছিল না মৌটুংরি গ্রামে।

সারদাপ্রসাদ সেই সহায়ের পথ না ধরে সামনের পথ ধরল।

কিন্তু সারদাপ্রসাদের সেই পথ কি শেষ হয়েছে? খুঁজে পেয়েছে সে তেমন জায়গা, আজও যেখানে সারল্য আছে, সততা আছে, বিশ্বাস আছে?

তা কে জানে পেয়েছে কিনা খুঁজে, তবে পথচলা থামিয়ে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে বটে তাকে একটা জায়গায়। যার সামনে দিয়ে ঝিরিঝিরি একটা নাম-না-জানা নদী বয়ে যাচ্ছে, আর চোখ তুললে আকাশের কোলে কোলে ছোট্ট ছোট্ট টিবি টিবি পাহাড় দেখা যাচ্ছে।

সারদাপ্রসাদের বসবার জায়গাটা অবশ্য খুব একটা আদর্শ নয়। গাছতলাকে কে আর কবে আদর্শ আশ্রয় বলে? কিন্তু সারদাপ্রসাদই বা কবে লোকে কাকে কী বলে তার ধার ধেরেছে?

ওই গাছতলাটাই তো রাজসিংহাসন লাগছে তার। অন্তত তার মুখ দেখে সেইরকমই মনে হচ্ছে। চোখে তার উৎসাহের উদ্দীপনা, মুখে তার আনন্দের দ্যুতি। তার মসৃণ ললাটে নির্মল সুখের ছাপ। ওর সিংহাসনটা যে নিতান্তই ধূলি-ধূসরিত একটা গাছতলা, ওর পৃষ্ঠপটে যে নিতান্তই একটা মাটির কুটির, সেটা ওর মনেও পড়ছে না।

ওই মাটির ঘরটার গায়ে যে অদ্ভুত সুন্দর করে আলপনা আঁকা আছে, ওই গাছের গোড়াটা যে কাঁকর কাঁকর লালচে মাটির প্রলেপে অভিনব হয়ে উঠেছে, আর ওই কুঁড়েটার পাশ দিয়ে যে পায়েচলা পথটা ঘন চুলের মধ্যেকার সরু সিঁথির মতো যেতে যেতে কোনও একটা জঙ্গলে যেন হারিয়ে গিয়েছে, এইটাই ওর কাছে পরম সম্পদ।

কিন্তু মৌটুংরি গ্রামের ধারেকাছেই তো এ সব ছিল। দেহাতি প্রতিবেশিনীদের দেখাদেখি রান্নাঘরের মেটে দেয়ালে আলপনা আঁকত শ্যামাপ্রসাদের বউ। যা দেখে শ্যামাপ্রসাদের বিধবা দিদি বলত, সাঁওতাল হয়ে গেলি নাকি বউ? তোর ধরনধারণ পছন্দ-অপছন্দ সবই যেন সাঁওতালদের মতো।

তার মানে মৌটুংরি গ্রাম থেকে অধিক দূর যায়নি সারদাপ্রসাদ।

তার মানে যে জিনিসগুলোর সন্ধান করছিল সারদাপ্রসাদ, সেগুলো খুব তাড়াতাড়িই পেয়ে গেছে। অনেক পথ হাঁটতে হয়নি।

অথবা হয়তো ওই সারল্য, সততা, বিশ্বাস ইত্যাদি দুষ্প্রাপ্য দুষ্প্রাপ্য জিনিসগুলো নিজের কাছেই ছিল সারদাপ্রসাদের, ও মনে করল খুঁজে পেয়েছি।

যদিও একটা বড় হাতুড়ির ঘায়ে ওর ওই দুষ্প্রাপ্য জিনিসের সিন্দুকটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কে জানে কখন যেন সেই ভাঙা টুকরোগুলোই জোড়া লেগে লেগে আবার আস্ত হয়ে উঠেছে।

হয়তো তেঁতুল পাতার ঝিরিঝিরি, হয়তো ওই নাম-না-জানা নদীটায় বালি চিকচিকে ঝিরিঝিরি জল, হয়তো ওই শাল জঙ্গলের সোঁদা সোঁদা গন্ধ–এরা ভাঙা-জোড়ার কারিগর।

বারেবারে খালি হয়ে যাওয়া ভাঁড়ার বারেবারে পূর্ণ করে তোলার অনাহত লীলায় যে চিররহস্যময়ী, তার একান্ত সন্নিকটে এসে বসতে পারলে ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ আবার কোন ফাঁকে ভরাট হয়ে ওঠে।

অথবা সবাই হয়ে ওঠে না, শুধু সারদাপ্রসাদের মতো বোধহীন মানুষগুলোই। নিজে বোধহীন বলেই হয়তো সারদাপ্রসাদের সঙ্গীগুলোও ততোধিক বোধহীন।

ওরা তাই সারদাপ্রসাদের সঙ্গ ছাড়তে চায় না। সারদাপ্রসাদকে দেখলেই মহোল্লাসে চেঁচিয়ে ওঠে, পাগলা মাস্টারমশাই আসছে, পাগলা মাস্টারমশাই।

মাস্টারমশাই আখ্যা পেল কেন সারদাপ্রসাদ, তা সে নিজে জানে না।

ওই মালকোঁচা মেরে ছোট ছোট ধুতির টুকরো পরা খালি গা ছেলেগুলোকে তোত কোনওদিনই বই শেলেট নিয়ে পড়াতে বসায়নি সারদাপ্রসাদ। ওদের সঙ্গে যোগসূত্র শুধু গল্পবলায় আর শোনায়। সেটা অবশ্য শোনায় সারদা খুব সমাদরে।

যদিও ছেলেগুলো নিতান্তই বালক বলে শুধু খেয়ে খেলিয়ে বেড়াবার ছাড়পত্র পায় না, এদের মধ্যে অনেককেই ছোট ছোট টোকা মাথায় দিয়ে গোরু চরাতে হয়। বাপ-ঠাকুরদার সঙ্গে খেতবাড়িতে গিয়ে উঞ্ছবৃত্তির কাজগুলো করতে হয়, অথবা মজুরানী মায়েদের সঙ্গে সঙ্গে জোগাড়ের কাজে হাত পাকাতে হয়। তবু ফাঁকে ফাঁকে ছুটে আসে ওরা এই শাখা-প্রশাখা ছড়ানো প্রকাণ্ড ছাতিম গাছটার ছাতার মতো ছায়ার নীচে।

নতুন জগতের স্বাদ পাওয়া কৌতূহলী চোখ মেলে মহোৎসাহে বলে, তারপর?

ডাকতে অবশ্য পাগলা মাস্টার বলে না, ওটা উচ্ছ্বাসের ডাক।

সারদা মাঝে মাঝে সচেতন করিয়ে দেয়, মা বাপের কাছে বকুনি খাবি নে তো বাপ? যা বাবা যা, একবার গিয়ে দেখে আয় গোরুগুলো পালিয়ে গেল কিনা। যা বাবা দেখ গে, মা ডাকছে কিনা।

কেউ হয়তো অনিচ্ছা মন্থর গতিতে গুটি গুটি উঠে যায়, কেউ বা হয়তো অগ্রাহ্যভরে বলে, না, ডাকতেছে না, তুমি বলো।

সারদাপ্রসাদ বলতে শুরু করে।

অফুরন্ত গল্পের সঞ্চয় আছে সারদার ভাঁড়ারে, সারদা এইসব চির-পতিত জমিতে তার বীজ ছড়ায়।

গল্প বলে আর তারপর মহোৎসাহে বলে, তা হলে বুঝছিস, সাহেবরা কোনও কিছুই নতুন আনেনি। এই যে নলকূপ দেখতে পাস জঙ্গলে বাংলোর মাঠে, কী যেন বলিস তোরা ওকে? টিপকল তাই না? ওটা সেই হাজার হাজার বছর আগেও ছিল। ভীষ্ম ঠাকুর যখন শরশয্যায় শুয়ে ঠাণ্ডা জল চাইল, অর্জুন তীর মেরে মেরে মাটির ভিতর থেকে জল বার করল মানে কী? কিছু না। ওই টিপল।

আর উড়োজাহাজের গল্প তো বলেইছি সেদিন। এখন যে এতসব অস্তর-শস্তরের বড়াই করে, সব তো মানুষ মারবার কল। মরামানুষ বাঁচাতে পারে কেউ? পারে না। তবে চেষ্টা করছে। আর সেই তখন? হাজার হাজার বছর আগে? হাসতে হাসতে মরামানুষ বাঁচাতে পারত।

বলতে বলতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে সারদাপ্রসাদ, শ্রোতাদের গ্রহণের পাত্রটার মাপের হিসেব ভুলে যায়, জোরালো গলায় বলে, লক্ষটা মানুষ মেরে ফেলার থেকে একটা মানুষ বাঁচানো যে অনেক শক্ত তা ভাবে না। শুধু মারামারি। পৃথিবী জুড়ে শুধু মারামারি। ১৪৬

হয়তো এই উত্তেজনার উর্ধলোক থেকে তার শ্রোতাদেরই কেউ তাকে নামিয়ে এনে বলে, সেই অবধি আমরা আর মারামারি করেছি মাস্টারমশাই?

সারদাপ্রসাদ ঊর্ধ্বলোক থেকে নেমে আসে। বলে, না না, তোরা যে সব সোনার চাঁদ ছেলে।

সোনার চাঁদদের দু-একজন হয়তো পাশের ছেলেদের সঙ্গে চিমটি কাটাকাটি চালাচ্ছিল। তারা হাত ঝেড়ে সামনে এনে অলৌকিক শান্তমুখে বলে, সেই আঙুলকাটার গপপোটা আজ আবার বলো না মাস্টার মশা, ধনু শোনে নাই। ধনুর বাপ সেদিন ওকে হাটে নে গেছিল।

আঙুলকাটার গপপো! অর্থাৎ একলব্যের কাহিনী, উতঙ্কের কাহিনী, বরাক্ষসের কাহিনী, জতুগৃহদাহের কাহিনী, এগুলো ওদেরও প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। অর্থাৎ সারদা ওদের মগজে ঢুকিয়ে তবে ছেড়েছে।

বাড়িতে সন্ধ্যাবেলা ওরা ওদের মায়ের কাছে গল্প করে সেইসব কাহিনী হয়তো কতক ভুলে গিয়ে, কতক উদোর বোঝা বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে, তবু ওদের মা বাপেরা সারদাপ্রসাদকে ভক্তিশ্রদ্ধার চোখে দেখে।কথক ঠাকুরদের মতন সুর করে না হোক, সেইসব ঠাকুর দেবতাদের কথাই বলছে মাস্টারমশাই।

.

সারদাপ্রসাদের গল্পের আসরে মেয়ে শ্রোতার অভাব। মেয়েগুলো নিতান্ত শৈশব থেকেই মায়ের কাজে ভিড়ে যায়, পথেঘাটে বিশেষ ঘোরে না। তবু তারাও হঠাৎ কোনখানে টোকা মাথায় সারদাপ্রসাদকে দেখলেই চেঁচিয়ে ওঠে পাগলা মাস্টার লোমোস্কার।

সারদা হাসে, বলে, লোমোস্কার। তা তোরা কেন গপপো শুনতে আসিস না?

ওরা হি হি করে হেসে ছুটে পালায় আর চেঁচায়, পাগলা মাস্টার, পাগলা মাস্টার!

ব্যঙ্গ করে নয়, ভালবেসেই।

ওরা যে ওদের ভাইটারদের মতো প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না রাখতে পেলেও মনের মধ্যে যোগসূত্র রেখেছে, সেটাই প্রকাশ করে।

পাগলা মাস্টার ভাবতে ভাবতে পথ হাঁটে আজ কোন গল্প বলবে।হনুমানের ল্যাজের আগুনে লঙ্কা পোড়ানোর গল্প অথবা গন্ধমাদন পর্বত বয়ে আনার গল্প, কাঠবেড়ালির সমুদ্র বন্ধনের গল্প এইগুলোয় ওদের মহোৎসব, হেসে কুটিকুটি হয়, ঠেলাঠেলি করে মাটির চাপড়া মাথায় তুলে হনুমান সাজে, কিন্তু সারদাপ্রসাদ যেন মহাভারতের গল্প বলতেই বেশি উৎসাহী। সারদাপ্রসাদ সেকাল আর একালের তুলনা করে একালকে নস্যাৎ করে দিয়ে ওদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলন করে দিতে চায়।

মেয়েরা বিশেষ আসে না, শুধু

মাঝে মাঝে একটি মহিলা শ্রোতা এসে বসে, সারদাপ্রসাদ তটস্থ হয়, সারদাপ্রসাদ কোঁচার কাপড় দিয়ে গাছতলাটা ঝেড়ে ধুলো ওড়ায়।

যে আসে সে অবশ্য গল্প শোনার উদ্দেশ্যে আসে না, আসে সারদাপ্রসাদের জন্যে খাবার নিয়ে। হয়তো নিতান্তই তুচ্ছ সেই খাবার, তবু যে আনে তার হৃদয়ের স্পর্শে সেই তুচ্ছতেই পরমের স্বাদ লাগে।

ওই মলিনবসনা গ্রাম্য বিধবার মুখে রানির মহিমা দেখতে পায় সারদাপ্রসাদ।

যে আসে সে একা আসে না, সঙ্গে তার ছেলে দুটোও আসে। বড়টা কোনও কোনওদিন বলে, জানো দাদু, তোমার বলা রামচন্দরের গপপোটা আমাদের ইস্কুলের বইয়ে আছে।

সারদাপ্রসাদ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, সেই তিন মাইল রাস্তা ভেঙে ইস্কুল যেতে হয় ভাই, আবার কেন এই দু-কোশ রাস্তা ভেঙে এতদূর আসিস?

মায়ের সঙ্গে আসব না, হিঃ! ছেলেটা সারদার উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়ে বলে, বেটা ছেলের বুঝি হাঁটলে কষ্ট হতে আছে? মা?

মা ঘোমটার অন্তরাল থেকে মৃদু হেসে বলে, না।

সারদাপ্রসাদ বলে, তুমিই বা কেন প্রায় প্রায় এত কষ্ট করে আমো বউমা? আমিই বরং গিয়ে খেয়ে আসব।

অটল নামের ছেলেটা হেসে উঠে বলে, মা বুঝি নল চালিয়ে তোমায় বলে পাঠাবে আজ কলাবড়া করেছি, আজ সরুচাকলি করেছি! তুমি জানবে কী করে?

সারদাপ্রসাদ বলে, তা এতসব করতেই বা বসো কেন বউমা? তোমার শরীর খারাপ—

অটল বলে, মা বলে, সারাদিন কী করব?

হয়তো সত্যিই তাই, শ্যামাপ্রসাদের হঠাৎ মৃত্যু শ্যামাপ্রসাদের চিরবন্দিনী স্ত্রীকে ভয়ানক একটা মুক্তির শূন্যতা দিয়ে গেছে।

আর তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ স্বাধীনতা।

তাই সে কলার বড়া তালের পিঠের উপচার দিয়ে দুক্রোশ পথ ভেঙে আসে তার চিরদিনের অদেখা খুড়শ্বশুরের কাছে।

ননদ রেগে বলে, শ্যামা মরে তোমার বড্ড পাখা উঠেছে বউ! বলি সাতজন্মের অচেনা খুড়শ্বশুরের জন্যে এত ভক্তি উথলে উঠেছে কেন? বুড়ো নয় হাবড়া নয়, জোয়ান মদ্দ, তার কাছে তোমার যাওয়ার দরকার?

বউ না-রাম না-গঙ্গা কিছুই করে না, অথচ যায়।

ননদ বলে, মুখের ঘোমটাটা ফেলে গলগল করে গপপো হয় বোধ হয় শ্বশুরের সঙ্গে?

বউ বলে, কুচ্ছিত কথা বলে ভগবানের দেওয়া মুখটা নষ্ট কোরো না ঠাকুরঝি।

ঠাকুরঝি এই সদুপদেশ বাণীতে আরও জ্বলে ওঠে। বলে, শ্যামা মরে তোর পা-ই শুধু লম্বা হয়নি বউ, মুখও খুব লম্বা হয়েছে।…ওরে শ্যামা রে, ওপর থেকে দেখ তোর বউয়ের আসপদ্দা। সাতচড়ে যে রা কাড়ত না, সে এখন চোটপাট করছে।

চোটপাট আমি কিছুই করিনি ঠাকুরঝিবলে বউ দুটো ছেলের হাত ধরে বেরিয়ে পড়ে।

ননদের হাঁটুতে বাতের ব্যথা, তাই পিছু পিছু গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করতে পারে না, পিছনে দাঁড়িয়ে আঙুল মক্কায়। আর চেঁচিয়ে বলে, বলে যা, তবে তুই বলে যা, যাস কেন সেখানে? যাস কেন?

.

কেন যায় সে কথা ননদের কাছে বলে না শ্যামার বউ, বলে আসল জায়গায়। কিন্তু মুখের কাপড় ফেলে কথা তো আর বলে না সত্যি। ছেলেদের মাধ্যমে কথা।

অটল বলে, দাদু, মা বলছে, মৌটুংরিতে তোমার রাজ্যপাট পড়ে, তুমি কেন এখানে পাঁচজনের দয়ায় পড়ে থাকবে?

সারদাপ্রসাদ হেসে হেসে বলে, তোর মাকে বল ভাই, তোর দাদুর এখানেও রাজ্যপাট। রাজা আমি হবই ভাবলে কে তার রাজ্যপাট কাড়তে পারে?

মা বলছে তুমি ওখানে গিয়ে আমাদের দেখাশোনা করবে, আমাদের মানুষ করার ভার নেবে।

দূর দূর! সারদা হেসে ওঠে, তোদের দাদু নিজে তো একটা অমনিষ্যি, সে আবার মানুষ করবে কী! তোরা যে মা পেয়েছিস তাতে তোদের মানুষ হওয়া আটকায় কে?

মা বলছে তোমার বিষয়-আশয় তোমাকে ভোগ করতে না দিয়ে নিজেরা ভোগ করছি, মহাপাপ হচ্ছে আমাদের।

সারদা এ কথায় উষ্ণ হয়েছে।

অতএব সারদা মাধ্যম ছেড়েছে।

সরাসরিই বলেছে, এ কথাটি তো তোমার মতন কথা হল না বউমা! আমার বিষয়-আশয় আমার নাতিরা ভোগ করবে না তো কে করবে শুনি? আমি তো একটা বাউণ্ডুলে পাগল ছাগল, আমি ওসবের মর্ম বুঝি? এ আমি বেশ আছি, খুব ভাল আছি। পাঁচজনের ভালবাসায় খাওয়া থাকাটা চলে যাচ্ছে, এদের নিয়ে আনন্দে আছি।

ছেলেটা আবার মাতৃশিক্ষামতো বলে, মা বলছে, তোমার তো একটা মানসম্মান আছে, বরাবর অন্য লোকে তোমায় খাওয়াবে কেন?

খাওয়াবে কেন?

সারদাপ্রসাদ হা হা করে হেসে ওঠে। বলে, বলে কিনা খাওয়াবে কেন! আরে বাবা ঘরের ঠাকুরটিকে খাওয়ায় কেন লোকে? পোষা কুকুরটাকে খাওয়ায় কেন? না খাওয়ালে আর কে খাওয়াবে, এই ভেবেই খাওয়ায়। সে খাওয়ায় ঠাকুরও লজ্জা পায় না, কুকুরও লজ্জা পায় না। তবে? তা ছাড়া এই ছেলে, বুঝলে বউমা, ভারী বুদ্ধিমান। এককথায় বুঝে ফেলে। এটা ঠিক নয়, ওটা ভুল বলছ বলে খোঁচ তোলে না। বোঝেও সব। তা তোমার অটলও খুব বোঝে। সেদিন বলছিলাম, সেকালে এই ভারতবর্ষের মুনিঋষিরা শরীরকে সবরকম সওয়াবার জন্যে গ্রীষ্মকালে আগুন জ্বেলে, শীতকালে একগলা জলে ডুবে, আর বর্ষাকালে খোলা আকাশের নীচে বসে তপস্যা করতেন–ছেলেটা ফটু করে বলে উঠল,ওইসব শুনে শুনে সাহেবরা সব বিদ্যে শিখে নিয়েছে, না দাদু? আমাদের ইস্কুলের মাস্টার মশাই বলেছেন, সায়েবরা যাদের চাঁদে পাঠিয়েছিল তাদেরও ওই রকম করে ঠাণ্ডা গরম, না খেয়ে থাকে, সবকিছু সইয়ে নিয়েছিল।

শুনে তো আমি তাজ্জব বনে গেলাম। অতটুকু বাচ্চা, তার মাথায় এলোও তো প্রকৃত ঘটনাটা! ঠিক তাই বুঝলে বউমা, অবিকল তাই। ওই ভাবেই মুনিঋষিরা আকাশে উঠতেন, পাতালে ঢুকতেন। তবু তো এ যুগে মায়ের পেটের মধ্যেকার শিশুর সাধ্যি নেই বাইরের জগতের কিছু শোনে কি দেখে। কিন্তু প্রাচীনকালে?

সারদাপ্রসাদ একটু উচ্চাঙ্গের হাসি হাসে, প্রাচীনকালে ততদূর পর্যন্তও এগিয়েছে মানুষ। তোমার গিয়ে অভিমন্যুই তার সাক্ষী। কিন্তু সাহেবদের দেশে হোক দিকি এখন ওই ঘটনা? ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে। সবাই বলবে-বিজ্ঞানের কী শক্তি! অথচ এমন কপাল আমাদের, কেউ একবার নিজেদের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখবে না। মহাভারতখানা একবার সাহেবদের নাকের সামনে তুলে ধরে বলে উঠতে পারবে না, কীসের বড়াই করছ তোমরা জাদু, এই দেখো। বিদ্যে থাকে তো পড়ে দেখো। বুঝতে পারবে কিছুই নতুন করোনি তোমার।

বলতে বলতে কণ্ঠস্বর উদাত্ত হয়ে ওঠে সারদাপ্রসাদের, চোখ ঝকঝক করে। নিজের একহাতের তালুতে অপর হাতে একটা ঘুসি মেরে বলে, আসল কথা কী জানো বউমা, আমাদের দেশের কারও কোনও বিষয় খেয়াল নেই। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও চমকে ওঠে না, উলটে আবার হাসে। তবে এই আমি বলে রাখলাম, এ হাসি আমাদের ঘুচবে একদিন। ওই সাহেবরাই যখন একদিন স্বীকার করবে–আমাদের যা কিছু বিদ্যে সবই তোমাদের ভারতবর্ষ থেকে পাওয়া বাপু, সংস্কৃত শাস্ত্রের যত কিছু প্রাচীন পুঁথি সেগুলি আমাদের হাতেই এসে গিয়েছিল, তার থেকেই আমাদের এত লপচপানি, তখন আমাদের বাছাধনরা বলবেন, তাই তো, তাই তো, সত্যিই তো! এই যে দেখছি হুবহু সব মিলে যাচ্ছে।

মধ্যাহ্ন সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিমের দিকে ঢলে পড়ে। পড়ন্ত বিকেলের রং সোনালি আলো সমস্ত পরিবেশটাকেই যেন সোনালি করে দিয়ে যায়।

আধাপাগল একটা প্রৌঢ় ব্যক্তিকে ঘিরে বসে থাকে কতকগুলো অবোধ বালক আর একটা সংসার-অভিজ্ঞ মলিনবসনা বিধবা।

সারদাপ্রসাদের কথাগুলো তারা ঠিকমতো বুঝতে পারে কিনা কে জানে, কিন্তু সারদাপ্রসাদকে তারা বোঝে। সেই বোঝার মধ্যে এক অপরিসীম কৌতূহল।

এতকাল ধরে তো এই দৃষ্টিরই প্রতীক্ষা করে এসেছে সারদাপ্রসাদ।

এই ভয়ংকর বিস্ময়কর তথ্যটা জেনে ফেলে আবিষ্কারককে তারা মুগ্ধদৃষ্টির প্রদীপ জ্বেলে পুজো করবে না?

সারদাপ্রসাদের কণ্ঠ ক্রমশ গম্ভীর হয়ে আসে, সারদাপ্রসাদ একটির পর একটি কাহিনী বলে চলে, আর তার ব্যাখ্যা শোনায়।

ওর সেই রাশি রাশি কাগজের ভূপ নিজে হাতে বিসর্জন দিয়েছে ও, কিন্তু তাতে ক্ষতিটা কী হয়েছে? কোন কথাটা হারিয়ে গেছে?

সারদাপ্রসাদের মনের পৃষ্ঠায় আগাগোড়াই ছাপা হয়ে মুদ্রিত নেই?

ছাপাখানায় ছাপা হয়ে সারদাপ্রসাদের এই অমূল্য গবেষণা লোকলোচনে আসতে পেল না বলে আর আক্ষেপ নেই সারদাপ্রসাদের, নেই জগতের ওপর কোনও ক্ষোভ, অভিমান। এই প্রায়-অরণ্য প্রকৃতির কোলে, এই গাছতলায় বসে নিজেকে তার প্রাচীনকালের শিষ্য পরিবেষ্টিত মুনিঋষির মতো লাগে।

সারদাপ্রসাদ অতএব মুনিঋষির দিব্য জ্ঞানটাও পায় যেন। তাই সেই গভীর গম্ভীর গলায় বলে, এত জ্ঞান-বিজ্ঞান, এত যন্ত্র-শক্তি কী করে হারিয়ে ফেলল ভারতবর্ষ তা বুঝতে পারছ? শুধু শক্তির অহংকারে নিজেরা নিজেরা কাটাকাটি করে। লঙ্কাকাণ্ডের পর ত্রেতাযুগ ধ্বংস হল, কুরুক্ষেত্রের পর দ্বাপর। তবু এই অভাগা কলিযুগের চৈতন্য নেই। নিজেকে ধ্বংস করে, সব উন্নতি সমুদ্রের জলে খতম করে আবার গুহার মানুষ হয়ে গিয়ে তবেই যেন ওর ছুটি। হবে, হচ্ছে, এই হিপিরাই তার সূচনা।

শ্রোতাদের কথা বুঝি আর মনে থাকে না সারদাপ্রসাদের, যেন নিজের সঙ্গেই নিজে কথা কয়, তবে আর তোদর বড়াই কীসের? বিধাতার নিয়মেই চলছিস তোরা। যেমন দিনের পরে রাত, তেমনি আলোর পরেই অন্ধকার, নিজেদের সৃষ্টি নিজেরাই ধ্বংস করে ফের কাঠে কাঠে ঘষে আগুন জ্বালাবে মানুষ, এও তো সেই প্রাচীনকালের মুনিঋষিরা লিখে রেখেই গেছে।

Exit mobile version