আমি তাকে খুঁজে পেয়েছি। তবে এখনো আপনার কোনো খবর তাকে দেওয়া হয় নি। আপনি চাইলেই দেওয়া হবে। পাখিবিষয়ক আরেকটি গ্রন্থ আপনাকে পাঠালাম-Mysteries of Migratory Birds. আমি বইটি পড়ে আনন্দ পেয়েছি-আপনিও পাবেন বলেই আমার ধারণা।
বিনীত
ম. রহমান
মিসির আলি পরপর তিনবার চিঠি পড়লেন। সব দীর্ঘ চিঠিতেই অপ্রকাশ্য কিছু কথা থাকে। যে কথা পত্ৰলেখকের মনে আছে, কিন্তু তা তিনি জানাতে চান না। সেই অপ্ৰকাশ্য কথা পত্ৰলেখকের অজান্তে ধরা পড়ে। এখানেও কি ধরা পড়েছে? না, পড়ে নি। এই চিঠি খুব সাবধানে লেখা হয়েছে।
পাখির ওপর লেখা বইটিতে মিসির আলিকে উদ্দেশ্য করে দুটা লাইন লেখা :
দ্রুত সেরে উঠুন। এই শুভ কামনা।
তন্ময়।
একটি বিষয় লক্ষণীয়-সে দুটি নাম ব্যবহার করেছে। এর থেকে কি কিছু দাঁড় করানো যায়? না, যায় না। এত সহজে কিছু দাঁড় করানো সম্ভব নয়। তথ্যের পাহাড় যোগাড় করতে হয়। সেই অসংখ্য তথ্যের ভেতর থেকে বেছে বেছে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো নিয়ে ঘর বানাতে হয়। একটা নয়–বেশ কয়েকটা তার থেকে বেছে নিতে হয় মূল প্রাসাদ…কঠিন কাজ।
নার্স মেয়েটি গামলা ভর্তি গরম পানি এবং একটা তোয়ালে নিয়ে এসেছে। পা স্পঞ্জ করবে। মিসির আলি বললেন, আমি কি আরেক পেয়ালা চা খেতে পারি?
জি না স্যার। চা, একটা উত্তেজক পানীয়। ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস না করে। আপনাকে দেওয়া যাবে না।
আপনার নাম কী?
আমার নাম জাহেদা।
শুনুন জাহেদা, আপনি যদি আমাকে খুব গরম এক কাপ চা না খাওয়ান তা হলে আমি আপনাকে গা স্পঞ্জ করতে দেব না।
জাহেদা চলে গেল। মিসির আলি খুশি মনে অপেক্ষা করছেন। মেয়েটির মোরালিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। যখন ফিরে আসবে তখন তাকে বলা হবে-শুনুন জাহেদা, আপনি আমাকে একটা সিগারেট এনে দিন। আমাকে একটা সিগারেট না খাওয়ালে আমি ওষুধ খাব না। গোপনে এনে দিন। আমি বাথরুমে বসে খেয়ে নেব। কেউ কিছুই বুঝতে পারবে না।
জাহেদা ফিরে এল। কঠিন পলায় বলল, ডাক্তার সাহেবকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি নিষেধ করেছেন। কাজেই চা হবে না। আপনি শার্ট খুলুন।
মিসির আলি লক্ষ করলেন, তার নিজের মোরালিটিই ভেঙে যাচ্ছে। শার্ট খুলে ফেলাই ভালো।
মিসির আলি ভেবেছিলেন তিনি পুরোপুরি সেরে গেছেন। দুপুরে শুয়ে শুয়ে পাখিবিষয়ক বইটি পড়তে পড়তেই তার মাথা ধরল। সন্ধ্যাবেলা আবার জ্বর এল। দেখতে দেখতে জ্বর বেড়ে গেল। পুরো রাত কাটল জুরের ঘোরে। সকালে আবার ভালো। ডাক্তার যখন দেখতে এলেন তখন পায়ে জ্বর নেই। শরীর ঝরঝরে লাগছে। পরপর তিনদিন একই ব্যাপার। মিসির আলি ডাক্তারকে বললেন, কী ব্যাপার ডাক্তার সাহেব? আমার হয়েছে কী?
ডাক্তার সাহেব বললেন, এখনো বলতে পারছি না। টেস্ট করা হচ্ছে।
কদিন থাকতে হবে?
তাও বলা যাচ্ছে না।
মিসির আলি শঙ্কিত বোধ করছেন। হাসপাতালের আকাশছোঁয়া বিল অন্য একজন দিয়ে দেবে তা হয় না। পুরো বিল তিনিই দেবেন। কিছু টাকা তিনি আলাদা করে রেখেছিলেন-ভয়াবহ দুঃসময়ের জন্যে। সেই টাকায় হাত দিতে হবে। রাজকীয় চিকিৎসা তার জন্যে না। সরকারি হাসপাতালে যাওয়া দরকার। এই হাসপাতাল ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। প্রতিদিন ভোরকেলা অনেকখানি রোদ এসে তার পায়ে পড়ে। এই দৃশ্যটি তাঁর অসাধারণ লাগে। অন্য কোনো হাসপাতালে এরকম হবে না। রোদে পা মেলে দিয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকার এই আনন্দ থেকে তিনি নিজেকে বঞ্চিত করতে চান না। একজন মানুষের জীবন হচ্ছে ক্ষুদ্র আনন্দের সঞ্চয়। একেক জন মানুষের আনন্দ একেক রকম। তাঁরটা হয়তোবা কিছুটা অদ্ভুত।
তিনি আজো রোদে পা মেলে শুয়ে আছেন। চোখ বন্ধ। হাসপাতালের নার্স ভঁাকে জানিয়েছে-আজ তাকে বাড়তি এক কাপ চা দেওয়া হবে। শুধু তাই না, সিগারেটও দেওয়া হবে। তবে সিগারেট খেতে পারবেন না। হাতে নিয়ে বসে থাকবেন। তাই-বা কম কী। তামাকের গন্ধ নেওয়া হবে।
কেমন আছেন স্যার?
মিসির আলি চোখ না মেলেই বললেন, ভালো।
আমাকে চিনতে পেরেছেন?
পেরেছি। আপনি মুশফেকুর রহমান। বসুন।
চেয়ার টানার শব্দ হল। মিসির আলি ফুলের গন্ধ পেলেন। মুশফেকুর রহমান তাঁর জন্যে ফুল নিয়ে এসেছে। টেবিলে ভারী কিছু রাখার শব্দ হল। ফুল নয়-অন্যকিছু। ফল হতে পারে। কী ফল?
কমলা হবে না। কমলার ঘ্রাণ তীব্র। তিনি গন্ধ পাচ্ছেন না। সম্ভবত আপেল এবং কলা। না, কলা হবে না। আপেল এবং কলা এক ঠোঙায় আনা হবে না। তিনি একটি ঠোঙা রাখার শব্দ শুনেছেন। হয়তো আপেল। না, আপেলও হবে না। তিনি যে শব্দ শুনেছেন তাতে মনে হয়েছে শক্ত কিছু রাখা হয়েছে, যেমন ডাব। তবে ডাব হবে না। ডাব কেউ টেবিলে রাখবে না। মেঝেতে রাখবে–তা হলে কী?
মিসির আলি চোখ মেললেন, তবে টেবিলের দিকে তাকালেন না। তাকালেন। মুশফেকুর রহমানের দিকে। তিনি এক ধরনের বিস্ময়বোধে আক্রান্ত হলেন। কোলের উপর হাত রেখে শািন্ত, ভদ্র ও বিনয়ী একটা ছেলে বসে আছে।
তিনি মুশফেকুর রহমানকে দিনের আলোয় কখনো দেখেন নি। একজন মানুষকে দিনের আলোয় এক রকম দেখাবে, রাতে অন্য রকম তা তো হয় না। ছেলেটির মধ্যে মেয়েলি ভাব অত্যন্ত প্রবল। এ ব্যাপারটি তিনি আগে কেন লক্ষ করেন নি? ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ। লাল ঠোঁট, বেশ লাল, চোখের মণি ঘন কালো এবং ছলোছালো। ইংরেজি উপন্যাসে চোখের বর্ণনায় পাওয়া যায়-Liquid eyes, এরও তাই। চোখের পল্লবও মেয়েদের চোখের মতো দীর্ঘ। বয়সও খুব বেশি নয়। পঁচিশ থেকে পঁয়ত্ৰিশের মতো হবে। তাঁর ধারণা ছিল মুশফেকুর রহমানের বয়স চল্লিশের বেশি।