অতসীও স্তব্ধ রাত্রে জনশূন্য রাস্তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবে, সীতু অকৃতজ্ঞ সীতুর মা-ই বা অকৃতজ্ঞতায় কী কম যায়! নইলে শ্যামলীর কাছ থেকেও নিজেকে লুপ্ত করে নিল কি করে? শ্যামলী হরসুন্দরীর বাড়ি জানত, এ বাড়ির সন্ধান পাবার কোন উপায় তার নেই।
কিন্তু চিঠি লিখে ঠিকানা জানাবে অতসী কোন পরিচয় বহন করে?
শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ির রাঁধুনী?
.
কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি।
আকাশে নক্ষত্রের সভা। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকলে কেমন একটা ভয় ভয় আর মন ঝিমঝিম করা অনুভূতি আসে। তেমনি অনুভূতিতে অনেকক্ষণ নিথর হয়ে থেকে অতসী ভাবে, এমন করে হারিয়ে গিয়ে আবার কোনদিন কি তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোনা যাবে?
ছেলেকে তো দৃঢ়চিত্তে শাসন করেছিল সে সেদিন, মরে যাব কেন? মরে গেলেই তো হেরে যাওয়া হল। তোমাকে মানুষ হতে হবে, মানুষের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর উপযুক্ত হতে হবে।
কিন্তু কবে সেই উপযুক্ততা আসবে সীতুর? আর যখন আসবে, তখন কি তারা অবিকল থাকবে, যাদের সামনে উঁচু মাথা নিয়ে গিয়ে দাঁড়ানোর মূল্য?
যদি তা না হয়, যদি এই হারিয়ে যাওয়া দিন থেকে কূলে উঠে দেখে অতসী, যাদের দেখাবার জন্যে এই কাঁটাবনের সংগ্রাম, তারাই গেছে হারিয়ে? আর সেই পুতুলটা
অসম্ভব একটা যন্ত্রণায় মাথাটা দেওয়ালে ঠুকতে ইচ্ছে করে অতসীর। ইচ্ছে করে খুকু খুকু করে চীৎকার করে কাঁদে। কিছুই করতে পারে না, শুধু স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে ঊর্ধ্বলোকের নক্ষত্রসভায়।
মৃগাঙ্ক কি কোনদিন রাত্রে জেগে থাকেন? তাকিয়ে থাকেন আকাশের দিকে?
কিন্তু যদিই থাকেন? সে খবর জানবার দরকার কি–শিবনাথ গাঙ্গুলীর বাড়ির রাঁধুনীর?
.
বর্ষা যায় শরৎ আসে, গাঙ্গুলীদের মেয়ের মতন রাঁধুনীর দিন কাটে মৃদু মন্থরে। ভারাক্রান্ত, ক্লান্ত ছন্দ, রাঁধার পরে খাওয়া আর খাওয়ার পরে রাঁধার একটানা একঘেয়ে পুনরাবৃত্তি।
কাজের চাপ বেশি থাকলেও বুঝি ছিল ভাল, তাতে তাল উঠত দ্রুত। কিন্তু এঁদের সংসার ছোট, চাহিদা কম, পুরনো চাকর আছে, সে প্রায় সবই করে, অতসীর অনেক অবসর।
কিন্তু সে অবসরকে কাজে লাগাবার সুবিধে কোথায়? অতসী ভাবে, আমি কি আবার লেখাপড়া করব? আমি কি চেষ্টা করে কোথাও সেলাই শিখব? আমি কি আমার আয়ত্তাধীন বিদ্যে পশম বোনাটাকে কাজে লাগিয়ে উপার্জনের চেষ্টা করব? একটা কিছু না করে কি করে কাটাব আমি? আর কতদিন বহন করব এই রাঁধুনীর পরিচয়?
ভাবে, ভেবে ভেবে উত্তাল হয়ে ওঠে তার দিনের অবসর, বিনিদ্র রাত্রি মর্মরিত হয়ে ওঠে সে ভাবনার দীর্ঘশ্বাসে। কিন্তু কিছুই করে উঠতে পারে না। ভয়ঙ্কর এক ভয় গ্রাস করে থাকে তাকে, পথে পা বাড়াতে দেয় না।
এ তো হরসুন্দরীর পাড়ার সর্পিল গলি নয়, এটা বড় রাস্তা। আর জীবনের সম্ভ্রম খুঁজে নিতে পা বাড়াতে হলে তো বড় রাস্তার পথ ধরেই চলতে হবে।
কিন্তু বড় রাস্তায় পা ফেলতে যে সেই দুর্দমনীয় ভয়। যদি কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়!
দেখা হয়ে গেলে কী হয়? অনেক দিন ভেবেছে অতসী, আর ভাবতে ভাবতে খেই হারিয়ে ফেলেছে। কী হয়, সেটা আর সম্পূর্ণ একটা ছবিতে পরিণত করতে পারে নি।
খেই হারাতে হারাতে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে তার অতীত জীবন। শ্লেট পাথরের মত একটা বিবর্ণ ভারী ভারী অনুভূতি ছাড়া সবই যেন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ভুলে যাচ্ছে এ বাড়ির রাঁধুনী ছাড়া আর কোন পরিচয় অতসীর ছিল।
তা এমন অতীত হারানো বিস্মৃতির কুয়াশা অনেক মেয়ের জীবনেই তো ক্রমশ পাকা বনেদ নিয়ে বসে। বিদেশে বাসায় রাজার হালে কাটাতে কাটাতে হঠাৎ ওঠে কালবৈশাখীর ঝড়, তচনচ করে উড়িয়ে নিয়ে যায় পাখীর বাসাটুকু, ভাগ্যহতের পরিচয় সর্বাঙ্গে বহন করে এসে আশ্রয় নিতে হয় তাদের কাছে, যারা এযাবৎ তার সুখসৌভাগ্যে আনন্দের থেকে ঈর্ষা অনুভব করেছে বেশি। সেখানে গৃহকর্মের সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে সেই মেয়েকে টিকে থাকতে হয় সংসার নামক বৃক্ষের শাখায়। যদি তাকে টিকে থাকাই বলা হয়।
তখন সেই দাস্যবৃত্তির অন্তরালে কোনও দিন কি কখনো মনে পড়ে তার একদা অনেক সুখ তার হাতের মুঠোয় ছিল?
ভুলে যায়! অতসীও ক্রমশ ভুলছে। ভুলছে বললে ঠিক বলা হয় না, মনে আনার চেষ্টাই। করছে না। কেন করবে, অতসীকে তো তার ভাগ্য প্রত্যক্ষ আঘাত হানে নি। আপাতদৃষ্টিতে তো দেখলে মনে হয় অতসী নিজেই হাতের মুঠো আলগা করে ছড়িয়ে ফেলে দিয়েছে তার সুখ, তার জীবন।
তাই অতসীর অনেক ভয়। ভয়, যদি পথে বেরিয়ে হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে যেতে হয় সেই অনেক সুখের অতীত জীবনের সঙ্গে?
কিন্তু অতসী কি বুঝতে পারে সীতুও আজকাল ওই এক রোগে ভুগছে। ওই ভয় রোগে। যদি কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। এই আতঙ্কে সীতু স্কুলে যায় আসে প্রায় চোখ বুজে।
না, অতসী জানে না।
সে দিনের সে কথা সীতু অতসীকে বলে নি। তা কবে আর কোনও কথা মার কাছে বলে সীতু? তাই সেদিন বলবে পথে কী ভয়ানক ঘটনা ঘটেছিল? সেদিন সীতু শুধু আরক্ত মুখ আর ভয়ঙ্কর ওঠা পড়া বুক নিয়ে ছুটে এসেছিল। আর অতসীর ব্যাকুল প্রশ্নে বলেছিল রাস্তায় পড়ে গেছি।
অতসী কি করে জানবে সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে মোড় পার হবার মুহূর্তে সীতুর পাশ দিয়ে ধাঁ করে বেরিয়ে গিয়েছিল একখানা ভয়ঙ্কর পরিচিত মোটরগাড়ি। আর তার চালকের আসনে যে বসেছিল সে সীতুর দিকে চোখ ফেলে নি বলেই এ যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল সীতু।