Site icon BnBoi.Com

স্বর্গখেলনা – বিমল কর

স্বর্গখেলনা – বিমল কর

১. ছেলেমেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে

০১.

বাসটা ছেলেমেয়ে কুড়িয়ে নিয়ে বেলা নটা নাগাদ এখানে হাজির হয়, আসার কথা আটটায়, আসতে আসতে ওই সময়টুকু যায়। পথ মাইল পাঁচেক অবশ্য, কিন্তু পথের হিসেবে কিছু আসে যায় না। ছেলেমেয়েগুলোকে শুধু কুড়িয়ে আনা তো নয়, গুছিয়ে আনাও। ঘুরে-ফিরে এর-ওর দরজায় দাঁড়াও, প্যাঁক-প্যাঁক হর্ন দাও, সজোরে কড়া নাড়ো, কোনও ছেলের ঘুম ভাঙিয়ে ইজের পরাও, কোনও মেয়ের বাসি-চুলে একটু আলগা চিরুনি বুলিয়ে নাও, তারপর বাচ্চাগুলোকে গাড়িতে তোলো। এই রকম করে আসা। রোজ, নিত্য। সময় বয়ে যাবে তাতে আশ্চর্য কী! পাঁচ মাইলের পথ যদি আট-দশ মাইলের পেট্রল খায়, তাতেও অবাক হবার কিছু নেই। তবু তো বাসটা নিয়মিত আসে।

কী করে আসে সেটাই এক আশ্চর্য। আসার কথা নয়, যে কোনওদিন যে কোনও জায়গায় ওটা দমবন্ধ নিশ্চল-অসাড় হয়ে পড়ে থাকতে পারে। বিন্দুমাত্র ভরসা নেই, মাঝেই-মধ্যেই নাড়ি হারায়, তবুও ওই গাড়িকেই ভরসা। নুটু মিস্ত্রি, যে এই অদ্ভুত মজার গাড়ি তৈরি করেছিল, তার হাতে গড়াপেটা বলেই নয় শুধু, তারই হাতে লালিত-পালিত হচ্ছে বলেই সবাইয়ের যেটুকু ভর ভরসা।

নুটু মিস্ত্রির এই গাড়ির গায়ে মিস্ত্রি নিজেই সাদা রং আর ব্রাশ দিয়ে নাম লিখেছে ইংরেজিতে। মিস্ত্রির যে ইংরেজি বর্ণ-জ্ঞান আছে তা মনে করার হেতু নেই। গত বছর বাঘা দাদাকে দিয়ে খড়িতে করে বাসের গায়ে হরফগুলো লিখিয়েছিল, তারপর নিজে সাদা রং দাগে দাগে বুলিয়ে গেছে। ফলে ইংরেজিতে এই বাসের নাম মেজর গাড়ি–অর্থাৎ বাংলায় যা হবে মজার গাড়ি। নামটা বাচ্চাগুলোই দিয়েছিল, লিখেছিল অবশ্য বাঘা। লেখার দোষ বাঘার নয়। তার বয়স ছিল মাত্র দশ, মিস্ত্রির কাঁধে বসে ঘাড়ের পাশ দিয়ে পা দুটো গলিয়ে তাকে লিখতে হয়েছিল। একটা করে অক্ষর শেষ হয় আর মিস্ত্রি এক পা করে সরে যায় পাশে।

বাঘা আর নেই, গত শীতে তার বাবা বদলি হয়ে গেলে বাঘা চলে গেছে, তার লেখাটা থেকে গেছে। নুটু মিস্ত্রির খুবই ইচ্ছে ছিল বাসের অন্য পাশে সে বাংলাতেও নামটা লিখে নেবে। বাঘাদাদা চলে যাওয়ায় হয়নি, না কি অপেক্ষা করছে জ্যোতিবাবু কবে নিজে থেকেই গোটা গোটা করে নামটা লিখে দেন। জ্যোতিবাবু ছবি আঁকান ছেলেমেয়েদের, পড়ান, তাঁর হাতে লেখা খাসা হবে।

নুটুর কথা, নুটুর গাড়ির কথা তাকে জিজ্ঞেস করলে সে সাত কাহন বলবে। কবে কোথায় কোন উইলিসাহেবের সোফার হয়ে দশ বছর কাটিয়েছে, কেমন করে সেই বিশ্বকর্মা সাহেবের হাতে তার গাড়ির কাজের যাবতীয় যা কিছু শিক্ষা, তারপর উইলিসাহেব মরে গেলে পাটনায় আগরওয়ালার মোটর কারখানায় টানা কবছর হরেক রকম গাড়ির মেরামতি করেছে, কোন বিশারদ নুটুকে সার্টিফিকেট দিয়েছিল এই বলে যে, নুটু নেভার সেজ নো–এসব কথা প্রত্যেকটি মনে আছে নুটুর। বলতে পারলে নুটু খুশি হয়। কিন্তু সব গল্পের পর নুটুর শেষ গল্পটা বড় কষ্টের। সেটা সে বলতে চায় না।

সেই গল্পেরই পরিণতি এই মজার গাড়ি, নুটু যার জন্মদাতা। একটা ফোর্ড গাড়ির ইঞ্জিনই শুধু সে পেয়েছিল। পুরনো বনেদি বংশ বলে জঞ্জালের মধ্যেও নুটু ইঞ্জিনটার চরিত্র বিষয়ে নিঃসন্দেহ হল। লোহার দরেই ওটা সে কেনাল সাহেবদাদুকে দিয়ে। তারপর দিনের পর দিন মাসের পর মাস সে মেতে থাকল। শহরের সারাইখানা, কামারবাড়ি আর কাঠমিস্ত্রিদের সঙ্গে সমানে গতর দিয়ে লড়ে এই গাড়ি সে তৈরি করেছে। নুটুই গাড়ির সব, ড্রাইভার ক্লিনার মেকানিক সব কিছু।

এই গাড়ি না হওয়া পর্যন্ত শহর থেকে বাচ্চাদের আনা যেত না। মধুবাবুর ঘোড়ার গাড়ি চেপে পাঁচ-সাত জন যা আসত, বাকিরা এখানে থাকত। বাকি বলতে জনা তিরিশ ছাত্র। এখন আরও বিশ-পঁচিশ বেড়েছে, দু-দশ জন মাইল দেড়-দুই দূর থেকে হেঁটেও আসে।

মজার গাড়ির সবটাই মজা। তার হাত-পা গুটোনো, কচ্ছপের মতন একটা খোলা আছে পিঠে, ভেতরে তিনটে সরু লং বেঞ্চ, জানলার ফুটোয় ক্যাম্বিসের পরদা গুটোনো থাকে। গাড়িটা ফট ফট শব্দ করে, ধোঁয়া ছাড়ে চিমনির মতন, তার সারা গা নড়ে, বিচিত্র স্বর আওড়ায় সর্বদা, চলতে গেলেই বাঁয়ে হেলে পড়ে, ডাইনে দোল খায়–তবু গাড়িটা চলে।

এই গাড়ি নিয়ে নুটু ভোরের কাক ডাকতেই ছেলেমেয়ে আনতে যাত্রা করে দেয়। পনেরো মিনিটের পথ, হাতে আরও বাড়তি একঘণ্টা সময় নিয়ে বেরোয়। বাধা-বিপত্তি তো থাকবেই। যত রকম কলকবজা যন্ত্রপাতি যাবতীয় গাড়ির মধ্যে সিটের নীচে মজুত নুটুর।

শহরে ঢুকে–ঢাকার ঠিক মুখেই শান্তি কুটিরের সামনে গিয়ে গাড়িটাকে প্রথমে দাঁড় করিয়ে দেয় নুটু।

জানলা দিয়ে গলা বাড়ায় তুষার দিদিমণি। কোনওদিন সবে ঘুম ভেঙে উঠেছে, ফোলা-ফোলা চোখ, এলোমেলো চুল। মুখ বাড়িয়ে সকালের প্রথম মিষ্টি হাসিটুকু হেসে হাত নেড়ে বারান্দায় এসে বসতে বলেছে তুষার দিদিমণি, তারপরই জানলা ফাঁকা।

নুটু গাড়ি থেকে নেমে শান্তি কুটিরের কাঠের ফটক খুলে বাগানে ঢুকেছে। বাগানে কয়েকটি গাছ, কিছু দেশি ফুল, যখন যা ফোটে। নুটু জানে বলেই বেছে বেছে কয়েকটি ফুল তুলে নেয়। তারপর বারান্দার ছোট সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সূর্য-ওঠা-সকাল দেখে। একটু পরেই একগ্লাস চা আসে ভেতর থেকে, কামিনীঝি দিয়ে যায়। নুটুর এটা বাঁধা।

যেদিন তুষার দিদিমণি তৈরি থাকেন, সে দিনও নুটুকে নীচে নেমে এসে প্রাপ্য চা-টুকু এবং দিদিমণির সকালের প্রথম মিষ্টি হাসিটুকু সূর্য-ওঠা-আলোর মতন সকৃতজ্ঞ চিত্তে গ্রহণ করতে হয়।

তুষার দিদিমণি একটা হালকা বেতের টুকরি নিয়ে গাড়িতে নুটুর পাশে এসে বসলেন। নুটুর গাড়ি ছাড়ল।

আজ কেমন একটু শীত, নুটু। তুষারদিদি বললেন হয়তো।

বাদলার ঠাণ্ডা দিদি?

না। এমনি; শিশির বা হিমের হবে।

বাদলার বড় ভয় নুটুর। বাদলার রাস্তা গাড়িটাকে বড় ভোগায়। শিশির কি হিমের ঠাণ্ডা শুনে নুটু নিশ্চিন্ত হয়। অল্প এগিয়ে বলে, বুলুটার গায়ে তবে একটা মোটা কিছু পরিয়ে নেবেন দিদি।

বুলু পাঁচ বছরের মেয়ে, রোগা-রোগা দেখতে, হয়তো কদিন সর্দিকাশিতে ভুগেছে।

তুষারদিদি এক পাশে ঘাড় হেলিয়ে হাসি-স্বচ্ছ চোখে নুটুকে দেখেন, যেন ঠাট্টা করে বলেন, তাই নাকি।

গাড়িটা শহরের চারপাশে টহল মারে তারপর। তুষারদিদিকে প্রায় সব বাড়িতে নামতে হয়, ঢুকতে হয়।

কাঞ্চন মুখ ধুচ্ছে সবে। চটপট তাকে তুষারদিদি নিজেই তৈরি করে নেন। কাঞ্চনের মা রাগ করে বলেন, এই ছেলেকে তুই বাপু নিয়ে গিয়ে রাখ তুষার, আমি আর পারি না। কখন থেকে ঠেলছি, বিছানা ছেড়ে কিছুতেই উঠবে না। ওইটুকু একফোঁটা ছেলের কী আয়েস।

রায়বাহাদুরের নাতি তো। তুষার হেসে বলে, একটু হবে। বলতে বলতে শার্টের সামনেটা কাঞ্চনের প্যান্টে গুঁজে দিয়ে আস্তে করে ঠেলে দেয় তুষার কাঞ্চনকে, চল চল…ছুট দে। কাঞ্চনের বই-খাতার ব্যাগটা নিজেই অনিলার হাত থেকে নিয়ে সদরের দিকে এগোয়।

আর এক বাড়িতে মন্টুকে হয়তো ঘুম থেকেই টেনে তুলতে হয়। মন্টুর মাথার পাশে বসে তুষার ডাকে, এই মন্টু, ওঠ। উঠবি না? আজ লেবুপাতার গল্পটা হবে তোদের।

বিনুর আর সব তৈরি–শুধু চুল আঁচড়ানো হয়নি। রিবনটা বিনুর হাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়ে তুষার তাকে টেনে এনে গাড়িতে তোলে।

পুটুর দুধদাঁত পড়েছে, পুটু ঘুম থেকে উঠে সেই দাঁত পেয়েছে বিছানায়। ইঁদুরের গর্ত খুঁজছে, গর্তে দাঁত না দিয়ে সে যাবে না স্কুলে। তুষার হয় গর্ত খুঁজতে বসল, না হয় পুটুকে বলল, পাগলা ছেলে, এখানে ইঁদুর কই, মাঠে কত ইঁদুরের গর্ত, বড় ইঁদুরচল সেই গর্তে দিয়ে দেব। পুটু সানন্দে মাথা নাড়ল মাঠের ইঁদুর তার যেন বেশি পছন্দ।

এমনি করেই ছেলেমেয়েগুলোকে টেনে-টুনে তুলে আনতে হয়। পথের মধ্যেও তুষারের শত কাজ। নিজের জায়গা ছেড়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বসে কারও মুখ মুছিয়ে দেয়, কোনও মেয়ের চুল আঁচড়ে রিবন বাঁধে, কারও বা জামায় বোতাম বসায়।

তুষারের বেতের টুকরিতে সব থাকে। নিজের একটা শাড়ি, জামা, চিরুনি, ছোট্ট পাউডারের কৌটো, চুঁচ-সূতোটুকটাক আরও অনেক কিছু।

গাড়িটা শহরের এলাকা পেরিয়ে একটা বাঁক নেয় ডান দিকে থাকে রেল লাইন বাঁ দিকে ক্ষেত আর মাঠ। রেল লাইনের পাশে পাশে খানিকটা ছুটে এসে হঠাৎ পথ গোলমাল হয়ে যায়, টিলার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে লাইন পুবের জঙ্গলে অদৃশ্য, তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাথর কাঁকর আর মোরম রঙের মাটি মেশানো সড়ক ধরে নুটুর বাস তেঁতুল-ঝোঁপের মধ্যে এসে দাঁড়ায়, ঝোঁপ পেরোলেই দূরে চাঁদমাড়ি পাহাড়। রাস্তাটা এখানে ঢালু। দুপাশে ফাঁকা মাঠ, অল্প-স্বল্প গাছ, টেলিগ্রাফের একটা লাইন রাস্তার গায়ে গায়ে চলে গেছে।

রেলগাড়ির সঙ্গে মজার গাড়ির কোনও কোনওদিন দেখা হয়ে যায়। সাড়ে সাতটার প্যাসেঞ্জার গাড়ি। যতক্ষণ একসঙ্গে ছুটছে ছেলেমেয়েগুলো ভীষণ উত্তেজনা বোধ করে। রেলগাড়িকে হারাবার জন্যে বাচ্চাগুলো একসঙ্গে চেঁচায়: নুটুদা, হারিয়ে দাও, রেলকে হারিয়ে দাও। নুটুও গিয়ার বদলায়, যেন দেখাতে চায় তার গাড়ির শক্তিও কিছু কম নয়। হ্যাঁন্ডিকাপ পেলে নুটু রেলকে হারায়, অবশ্য দেড়শো গজ দৌড়ে নুটু যদি পঞ্চাশ গজ হ্যাঁন্ডিকাপ পায়। রেল হারলে ছেলেগুলোর খুব ফুর্তি। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে একসঙ্গে সব কজন কলা দেখাবে আর দুয়ো দেবে রেলকে। রেলের ইঞ্জিনের কাটা-দরজায় দাঁড়িয়ে মাথায় পট্টি বাঁধা ফায়ারম্যান দুয়ো পেয়ে হাত তুলে নাড়ে যতক্ষণ দেখা যায় গাড়িটাকে।

পথটা কিন্তু ভাল। ফাঁকা, শান্ত, স্তব্ধ। রোদ উথলে পড়ছে চারপাশে, মাঠগুলো বেশির ভাগই পতিত, কোনও কোনওটায় ডাল বোনা হয়েছে বা সরষে, মাঠের কোথাও কোথাও কুল অর্জুন আর অশ্বত্থ গাছ। পাখি উড়ে যায়, বাতাসে সরু শিসের ডাক ভাসে একটুক্ষণ, কোথাও বা রাখাল গোরু-মোষ চরাচ্ছে। পথে বয়েল গাড়ির সাক্ষাৎ পাওয়া যাবে, সকাল বেলা জঙ্গলে চলেছে কাঠ কাটতে, বয়েলের গলায় বাঁধা ঘণ্টা বাজছে, ফাঁকা জায়গায় ঘণ্টার সেই শব্দ চমৎকার শোনায়।

মাইল আড়াই এই ভাবে এগিয়ে আসার পর চোখে পড়বে ছোট্ট একটি গ্রাম। গাড়িটা এখানে থামে অল্প সময়। কুচকুচে কালো চেহারা, ছোট ছোট চুল, বড় বড় চোখ, নাক একটু খাঁদা একটি ছেলে, তারই হাত ধরে গোলগাল মোটা নাদুসনুদুস একটি বাচ্চা মেয়ে এসে উঠবে গাড়িতে। ছেলেটার নাম টুসু, মেয়েটির নাম বেলা।

টুসু একটা ফুল পায় তুষারের কাছ থেকে। কোনওদিন বা বেলাও। তুষারের নিয়ম, ডাকাডাকি না করতেই যে তৈরি হয়ে থাকবে গাড়ির জন্যে, সে একটা ফুল পাবে। অবশ্য তুষারের এই ফুল শেষাবধি আর থাকে নাকাড়াকাড়ি করে ওরা নিয়ে নেয়।

টুসুদের তুলে নিয়ে মজার গাড়ি যখন নিস্তব্ধ ফাঁকা রোদভেজা মাঠ-ঘাট দুপাশে রেখে বিচিত্র দেহভঙ্গি ও শব্দ করতে করতে চলেছে, তখন সমস্বরে ছেলেমেয়েগুলো মজার গাড়ির ছড়া গায়। ছড়াটাও মজার। তুষারকেও মাঝে মাঝে গাইতে হয়। সেই কলকণ্ঠের গীত ছড়ায় অলস মাঠ ঘাট যেন প্রফুল মুখে হেসে ওঠে।

.

০২.

পাহাড়ের মাটি আর কাঁকর ছড়ানো রাস্তা দিয়ে গাড়িটা শেষ পর্যন্ত যেখানে এসে থামে সেখানে ছোট বড় কয়েকটা কটেজ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে আদিগন্ত ফাঁকা মাঠের মধ্যে পাহাড়তলিতে কয়েকটা ছোট ছোট কুঁড়েঘর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আসলে এটাই সাহেবদাদুর শিশুতীর্থ।

অনেকটা দূরে পাহাড়ের তরঙ্গ, আকাশ এবং মেঘের মাথা ছুঁয়ে ছুঁয়ে কালচে-সবুজ একটি রেখা উত্তর পশ্চিম দিকটা ঢেকে রেখেছে। দিনের আলোয় সবুজ বনানী কার্পেটে তোলা সুতোর কাজের মতন দেখায়, বৃক্ষলতায় ঘন, অস্পষ্ট অবয়ব। বনের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঢালু জমি, যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে যে ঢেউ ভেঙে পড়েছিল-তার ভাঙন বন এবং বনের পর ঢালু মাটিতে গড়াতে গড়াতে এখানে এসে থেমে গেছে। এখানটা মোটামুটি সমতল। কিছু বৃক্ষ, কিছু পাথর! সাহেবদাদুর শিশুতীর্থ এই সমতলে পাহাড়তলির নির্জন লোকালয়ের ছবির মতন দাঁড়িয়ে।

ছ-সাতটি কুটির, কটেজের মতন চেহারা; কোনওটা ইটের, পাথর মাটি মিশিয়ে তৈরি; কারও মাথায় খাপরা, কারও মাথায় খড়ের ছাড়ি। ঘন মেটুলি রঙের গা। শালের চারা কেটে কেটে এলাকাটার বেড়া দেওয়া হয়েছে। সামনের দিকের বেড়া বোধ হয় সামান্য বেশি মজবুত, কারুকর্ম কিছু কিছু চোখে পড়বে। শিশুতীর্থরৈ এটা সামনের দিক বলেই হয়তো বেড়ার পাশে পাশে কোথাও জাফরি, কোথাও আকাশ-জালি, ফুল লতা-পাতার বাগান। জাফরি বেয়ে বুনো লতা উঠেছে, আকাশ-জালিতে ছিটফুলের চুমকি, চন্দনের ফোঁটার মতন এক রকমের লতানো ফুল। মাটিতে বিবিধ পাতা গাছ, কোথাও গাঁদা কোথাও কলাফুল কোথাও বা মোরগঝুঁটি–ঋতুর পথ চেয়ে ফোটে, পালা ফুরালে মরে যায়।

শিশুতীর্থর সদর ফটক আছে একটা। কাঠের ফটক। ফটকের মাথায় মালতী লতার টোপর, দুপাশে ঝাউ ঝাউয়ের কুঞ্জ। গায়ে গায়ে জবা গাছ, অপরাজিতার ঝোঁপ। ফটকের মাথায় কাঠের তক্তায় শিশুতীর্থ নামটা ঝুলছে।

কাঁকরে মাটির রাস্তা ফটকের কাছ থেকে আদরে যেন ডেকে নিয়ে এই তীর্থের খানিকটা পৌঁছে দেবে, তারপর আর বাঁধাধরা রাস্তা কোথাও চোখে পড়বে না। হয় মাটি, না হয় ঘাসভরা মাঠ, গাছের ছায়া, এদিক ওদিক মুখ করে আলো-ছায়ায় কুটিরগুলো দাঁড়িয়ে আছে তফাত-তফাত।

এই এই রকম চার পাঁচটি কটেজ এ পাশে, সামনের দিকটায়। পিছনে অনেকটা সবুজ মাঠের ওধারে আরও তিনটি বাড়ি, একই ধরনের অনেকটা, দুটো খুব গায় গায়–অন্যটা গজ পঞ্চাশ তফাতে। সাহেবদাদুর বাড়ি ওরই কাছাকাছি। পুবমুখো টালি ছাওয়া বাড়িটাই সাহেবদাদুর। ছোটখাটো বাসা, সামনে পিছনে বাগান।

ঘরগুলোর পরিচয় দেওয়া দরকার। সামনে দিকের বাড়িগুলো ক্লাসরুম। লম্বা লম্বা চেহারা, উঁচু উঁচু মাথা, দেওয়ালের গায়ে বড় বড় জানলা। জানলায় খড়খড়ি। রোদ বাতাস খেলা করে ঘরে, জানলা দিয়ে গাছের ডাল-পালা দেখা যায়, আকাশ চোখে পড়ে।

এক মাঠ তফাতে পিছন দিকের তিনটে বাড়ির দুটোতে থাকে কিছু ছেলে, দুজন শিক্ষক। সাহেবদাদুর বাড়ির কাছাকাছি লম্বা বাড়িটায় আশাদি আর রেবা। ঝি-চাকররা ওই বাড়িরই একপাশে ঘর পেয়েছে, রান্নাঘরটাও বাড়ির গা লাগানো, ছেলেদের খাবার ঘর ওখানে।

সাহেবদাদুর কথা সামান্য বলতে হয়। গায়ের রং এবং মুখের গড়ন অনেকটা সাহেবদের মতন বলে ছেলেমেয়েরা এই ডাক শুরু করে দিয়েছিল কবে সেই থেকে উনি সাহেবদাদু। সাহেবদাদুর বয়স হয়েছে, এখন বোধ করি প্রায় সত্তর। বার্ধক্য-হেতু চলাফেরা করেন খুব কম। চাকা গাড়িতে বসে মাঝেমাঝে তাঁর শিশুতীর্থের চারপাশ দেখে বেড়ান। অসুস্থ থাকলে বাড়ির বারান্দায় শুয়ে থাকেন, শুয়ে শুয়ে শিশুতীর্থের মেলা দেখেন।

সাহেবদাদুর পূর্ব পরিচয় ছিল, সে-পরিচয় তিনি কাউকে জানানো প্রয়োজন মনে করেন না। একদা কেমন করে যেন এসে পড়েছিলেন এদিকে। জায়গাটা ভাল লেগে গিয়েছিল। বছর কয়েক পরে আবার এলেন, সঙ্গে মাত্র একটি ভৃত্য। ছোটখাটো একটি মাথা গোঁজার জায়গা করে ঈশ্বর উপাসনায় মন দিতে চেয়েছিলেন; মন বসেনি। হঠাৎ কিছুদিনের জন্যে কোথায় চলে গেলেন, ফিরে এলেন মাসান্তে। সঙ্গে একটি শিশু। এই শিশুই তাঁর শেষ জীবনের মায়া মোহের শিকড় হয়ে তাঁকে এখানে বেঁধে রাখল, শান্তির স্বাদ জাগাল।

কোনও কোনও মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে শিউলি ফুলের তুলনা করা চলে। এরা অবেলায় ফোটে, যখন আর দিনালোক নেই, সন্ধ্যা নেমেছে তখন ফুটে ওঠে, অন্ধকারে সৌরভ বিলোয়, তারপর সকালে ঝরে যায়। সাহেবদাদুর জীবনের দিকে তাকালে মনে হবে, দিনান্তে তিনি যেন তাঁর হৃদয়ের আকুলতা অনুভব করে এই শিশুতীর্থ গড়তে চেয়েছেন, এখন সেই পুষ্প বিকশিত। উষাকালের মুখ চেয়ে বসে আছেন এবার তিনি। এই তীর্থের মাটিতে ঝরে যাবেন।

আমি ছিলাম ভবঘুরে সাহেবদাদু একদিন আশালতাকে বলেছিলেন মৃদু আচ্ছন্ন গলায়, কে জানত বল, তোদের এই পাথুরে মাটিতে আমার পা এমনি করে গেঁথে যাবে! ১৬

আশালতা পাথুরে মাটি শব্দটার অর্থ বুঝেছিল। তার মনে হয়েছিল, সাহেবদাদু সংসার থেকে পালাতে গিয়েও ফিরে এসেছেন বলে মাঝে মাঝে যেন স্নেহবশে এই সংসারকে তিরস্কার করেন।

আশালতা কোনও জবাব দিতে পারে না। ইচ্ছেও করে না কিছু বলতে। মন কেমন বিষণ্ণ অথচ গভীর মমতায় সিক্ত হয়ে আসে। নীরবে সে দাঁড়িয়ে থাকে।

সাহেবদাদু যে শিশুটিকে এনেছিলেন, একদিন সে সাহেবদাদুকে প্রায় ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। ঘটনাটা ঘটেছিল এইভাবে:

তখন চৈত্র মাস। চাকরটার তাপ-জ্বর; সে বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। রোদের তাত সামান্য পড়ে আসতেই সাহেবদাদু তাঁর টমটম হাঁকিয়ে শহরে ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলেন। শেষ বেলায় আচমকা ঝড় উঠল। ভয়ঙ্কর কালবৈশাখী। আকাশ কালো করা সেই দৈত্যকায় ঝড় এত ভীষণ চেহারা নিয়ে দেখা দিল যে, শিশুটি ভয়ে দিশেহারা হয়ে সঙ্গী খুঁজছিল। তার কোনও সঙ্গী ছিল না, বুড়ো চাকরটা জ্বরে বেঘোর। এই জনহীন প্রান্তর ঝড়ের গর্জনে ভরে গেছে, চারপাশ নিকষ কালো, গাছপালা গা মাথা লুটিয়ে মাটিতে আঁচড়াচ্ছিল, বাতাসের বেগ শাখা-প্রশাখা ভাঙছিল। ভীত শিশু তার একমাত্র সঙ্গী চাকরটার কাছে গিয়ে গা আঁকড়ে বসেছিল। কিন্তু জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ মানুষটা কোনও কথা বলতে পারেনি, কোনও সাহস সান্ত্বনা দিতে পারেনি, এমনকী চোখের পাতা খুলে তাকিয়ে থাকাও তার সাধ্যাতীত ছিল।

সাহেবদাদু যখন ফিরে এলেন তখন ঝড় থেমেছে, চাকরের ঘরে শিশুটি মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে আছে বিছানার পাশে। ওকে মৃত দেখাচ্ছিল; মনে হচ্ছিল বীভৎস এবং ভয়ংকর কিছুর সংস্পর্শে এসে সে অসহায়ের মতন কোনও অবলম্বন খুঁজেছিল, পায়নি; না পেয়ে শেষাবধি এই ভাবে কোণঠাসা হয়ে মরেছে।

ওর নাম ইতি। ওর আট বছরের জীবনে সেদিন ছেদ পড়তে পারত। পড়েনি। সাহেবদাদু ডাক্তার ডাকতে গিয়েছিলেন বলেই সঙ্গে তাঁর প্রয়োজনীয় মানুষটি ছিল। ইতি সে-যাত্রা বেঁচে গেল। কিন্তু মেয়েটার মনে সেদিনের আচমকা ভয় কোথায় যেন একটা অসাড়ত্ব এনে দিল। সে একা থাকতে চাইত না, একা শুতে পারত না, ফাঁকায় তার গা ছমছম করত।

সাহেবদাদু বুঝেছিলেন, মেয়েটার সঙ্গী দরকার। তাঁর বা বিষ্ণুর সঙ্গ যথেষ্ট নয়।

তোর মাসির কাছে যাবি? সাহেবদাদু ইতির মনের ভাব বোঝবার চেষ্টা করলেন।

না।

মাসিকে তোর মনে আছে?

নেই।

তবে?

কিচ্ছু না।

ইতির কথা–ইতির সঙ্গীর কথা চিন্তা করতে করতেই একদিন সাহেবদাদুর খেয়াল হল, কয়েকটা বাচ্চাকাচ্চা জুটিয়ে এনে এখানে একটা পাঠশালার মতন খুললে কেমন হয়। সাহেবদাদুর কোনও অভিজ্ঞতা ছিল না, কিন্তু মানুষ নতুন কোনও খেলা শিখলে যেমন নেশায় জড়িয়ে যায়, উনি অনেকটা সেই ভাবে জড়ালেন।

ছ বছর আগে একটি মাটির ঘরে শিশুতীর্থের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। পাঁচ-ছটি ছাত্র। চারটি ছাত্র তিনি জোগাড় করেছিলেন মাইল দেড়েক দূরের গ্রাম থেকে, তারা আদিবাসী, ক্রিশ্চান। আর দুটি আসত শহরের কাঠ কারখানার মালিকের বাড়ি থেকে, মটর বাইকের সাইডকারে। কাঠ কারখানার মালিক সাহেবদাদুর প্রতি শ্রদ্ধাবান এবং অনুরক্ত ছিলেন বলেই যেন সাহায্য করেছিলেন নিজের ছেলেমেয়ে দুটিকে শিশুতীর্থে পাঠিয়ে।

একথা বোঝাই যায়, অজায়গায় এমনি একটি কোমল লতা রোপণ করেছিলেন সাহেবদাদু যা রক্ষা করা ও বর্ধিত করা খুবই কষ্টকর। যে কোনও সময় শুকিয়ে যেতে পারত সে সম্ভাবনা সর্বদাই ছিল। কিন্তু সাহেবদাদুর প্রাণান্ত চেষ্টায় কয়েকজনের সাহায্যে লতাটি শুকোয়নি, বেঁচে গেছে। ছ বছরে তার যেটুকু বৃদ্ধি ও বিস্তার তা নিতান্ত কম নয়।

সামান্য আর কয়েকটি কথাও বলতে হয়। যে বয়সে সাহেবদাদু তাঁর জীবন এই দুরূহ কর্মে উৎসর্গ করেছিলেন, সে বয়স উদ্যমের নয়। অবশিষ্ট শক্তিটুকু ছিল আয়ুকে কোনও রকমে রক্ষা করার জন্যে। উনি সেই শক্তিকে কর্মের জন্যে ব্যয় করে খুব দ্রুত আয়ুকে ফুরিয়ে আনলেন। এখন এই মানুষটির কাছে সেসব কল্পনা, যে কল্পনা জাফরি কাটা জানলার রৌদ্র ছায়ার মতন অস্পষ্ট ও মেদুর, তেমন কল্পনা অবলম্বন করে পড়ে আছেন। হয়তো তিনি দেখতে পান, শিশুতীর্থে খুব বড় একটা মেলা বসেছে, মুখর হয়ে উঠেছে সর্বত্র, কলরবে এ নির্জনতা পূর্ণ, শত শিশুর চরণের ধুলোয় ধুলোয় গাছের পাতা ধূসর হয়ে গেছে, ঘাসের ডগাগুলো দলিত, দূর থেকে একজোড়া ছেলে-মেয়ে ছুটে আসছে, রোদের খর আলোয় মুখগুলো দেখা যাচ্ছে না ঠিকমতো, ছুটতে ছুটতে তারা পলাশ গাছটার তলা দিয়ে সামনে চলে এল, সাহেবদাদুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, ওদের হাতে মুঠো ভরা ফুল…

দৃশ্যটা হঠাৎ যেন রোদের ছটায় ফিকে হয়ে মিলিয়ে যায়। সাহেবদাদু চোখের পাতা বুজে বসে থাকেন।

.

০৩.

আজ সকালেও কালকের রাত্রের প্রকাণ্ড মেঘটার কিছু অবশেষ ছিল। যেমন ঘুম ভাঙার পরও ঘুমের রেশ, তেমনি রেশ ছিল বাদলার। অল্প পরেই টুটে গেল। ঝকঝকে রোদ ছড়াল মাটিতে। আকাশ বোয়া মোছা উঠোনের মতন নিকানো।

মাসটা আশ্বিন। এই সবে আশ্বিন পড়েছে। বৃষ্টি-বাদলের পালা ফুরোচ্ছে। একটু-আধটু শরতের বর্ষণ থাকবে কিছুদিন। নুটুর মনে তেমন আর উদ্বিগ্নতা নেই। এইমাত্র তার গাড়ি এসে থামল শিশুতীর্থর ফটকে।

তুষার নীচে নেমে দাঁড়াল। ছেলেমেয়েগুলো নামছিল হুড়োহুড়ি করে, কাউকে কাউকে হাত ধরে নামিয়ে দিচ্ছিল তুষার। কলকণ্ঠে ভরে উঠল জায়গাটা। যেন এক ঝাঁক পাখি হঠাৎ উড়ে এসে এখানের মাঠে নেমেছে।

ওরা নেমে গেলে বাস ফাঁকা। এই ফাঁকার দিকে তাকালে তুষারের একটা কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ছেলেবেলায় সে দেখত, একটা প্যাসেঞ্জার গাড়ির কামরা তাদের স্টেশনে কেটে রেখে বাকি গাড়িটা চলে যেত। বাবার অফিসে গিয়ে তুষার কিছুক্ষণ জ্বালাতন করত বাবাকে, তারপর প্ল্যাটফর্ম ধরে হেঁটে হেঁটে অনেকটা চলে আসত শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। কামরাটা দাঁড়িয়ে আছে লাইনে, কোনও কোনও দরজা খোলা, ভেতরটা একেবারে ফাঁকা, কেউ নেই, কিছু নেই। মাঝে মাঝে এই ফাঁকা কামরার মধ্যে উঠে পড়ত তুষার। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকত। কেমন যেন লাগত তার। ভাল লাগত না।

ফাঁকা বাসটার মধ্যে তাকিয়ে কয়েক পলক যেন তুষার ছেলেবেলার সেই দৃশ্য মনে করে নেয়। তারপর মাথা নিচু করে কোমর নুইয়ে তাকে আবার উঠতে হয় বাসে। তিনটে সরু সরু লম্বা বেঞ্চির কোথাও না কোথাও, বেঞ্চের নীচে কিছু কিছু জিনিস রোজই পড়ে থাকে, ওরা ফেলে যায়।

তুষার চারপাশে একবার তাকিয়ে নিল। কে তার বই ফেলে গেছে একটা, এক কোণে ধ্রুবর নতুন লাট্ট পড়ে আছে, তপুর পিসি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব দেখে ভাইপোর গায়ে কোট পরিয়ে দিয়েছিল–তপু সেটা খুলে ফেলে কুঁকড়ে-মুকড়ে একপাশে ফেলে রেখেছে, বিনুর বা চন্দ্রার কানের দুল, বেঞ্চির তলায় এক পাটি জুতো। জুতোটা অশোকের। এক পাটি এখানে ফেলেছে, আর-একপাটি এতক্ষণে মাঠের কোথাও ফেলে রেখে পালিয়েছে।

একে একে তুষার সব কুড়িয়ে নিল। কুড়িয়ে বুকের কাছে জড়ো করে নীচে নামল। নুটু ততক্ষণে নীচে নেমে তার গাড়ির মুখের ঢাকা খুলে দিয়ে হাওয়া খাওয়াচ্ছে। তুষারকে নামতে দেখে নুটু নিজের জায়গায় ফিরে এসে তুষারের বেতের টুকরিটা তুলে নিয়ে এগিয়ে দিল তুষারকে। এক হাত বুকের কাছে আড় করে, বাচ্চাগুলোর ফেলে যাওয়া জিনিসপত্র আগলে, অন্য হাতে নিজের বেতের টুকরিটা ঝুলিয়ে তুষার ফটকের দিকে এগিয়ে চলল।

ছেলেমেয়েগুলো কেউ আর এখানে নেই। নামা মাত্রই সব কটা দৌড় দেয়। ১৮

তুষার ফটক পেরিয়ে রাস্তা ধরল।

আশাদির ঘরে গান হচ্ছে। একেবারে কচিগুলো গান গাইছে। আশাদি নিজেও ভাল গাইতে পারে। সামান্য দূরে ডান দিকের ঘর থেকে আষো আধো কচি কচি গলার গান ভেসে আসছিল। তুষার হাঁটতে হাঁটতে সামনের দিকে তাকাল একবার। চমৎকার রোদ হয়েছে আজ, সোনার মতো চকচক করছে। তুষার একটু মুখ উঁচু করে আকাশ দেখে নিল, নীলের রং লেগেছে, আশে পাশে পুঞ্জ পুঞ্জ সাদা মেঘ।

গাছে গাছে পাখি ডাকছিল। কোথায় যেন অনেকগুলো চড়ুই ঝগড়া বাধিয়েছে। একটা কাককে তাড়া করে লোমের ঝালর ঝোলানো ক্ষুদে কুকুরটা ছুটতে ছুটতে তুষারের পায়ের কাছে পড়ল।

অভ্যর্থনা। ওর নাম তুলল। সাদা লোমের পুঁটলি বলে কুকুরটার ওই নাম হয়েছে। তুলো তুষারের পায়ের ওপর লাফিয়ে, শাড়ির প্রান্ত কয়েকবার দাঁত দিয়ে টেনে, লাফাতে লাফাতে আবার ছুটল।

তুষারের ঘর ও-দিকটায়; ওই যে কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে! তুষার তার ঘর দেখতে পেল। খোলা জানলা; পশ্চিম দিকের দেওয়াল ঘেঁষে ছায়ার চওড়া পাড় বসানো যেন। দোপাটির বাগান শুকিয়ে গেছে, কয়েকটা কলাফুলের গাছ ঘরের সিঁড়ির পাশে রোদে স্নান করছে। করবীর ঝোঁপ একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে।

সামান্য এগিয়ে আসতেই আড়াল পড়া দূরের ঘরটাও চোখে পড়ল। ওটা জ্যোতিবাবুর ঘর। জ্যোতিবাবুর ঘরের সামনে আমতলায় তাঁর ছেলেমেয়েরা শুয়ে বসে কী যেন শুনছে, আর জ্যোতিবাবু একটা বেতের মোড়ায় বসে কী বলছেন।

মাঠের ঘাস মাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে আরও অল্প এগিয়ে আসতেই তুষারের চোখে পড়ল শিরিষ গাছের ডালে বাঁধা দোলনার ওপর আদিত্যবাবু বসে আছেন। তুষার যেতে যেতে মুহূর্তের জন্যে থামল, দেখল। কেমন অস্বস্তি বোধ করল।

আশাদির ঘর থেকে গানের সুর ভেসে ভেসে আসছে, জ্যোতিবাবুর ছেলেমেয়েরা একসাথে কী যেন একটা বলছে, সেই সমবেত স্বর কানে বাতাসের স্রোতের মতন এসে লাগল, তুষার সামান্য দ্রুত পায়ে তার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

শিরিষ গাছের কাছে আসতেই আদিত্য দোলনার পিড়ি একটু দুলিয়ে সামান্য যেন ঝুঁকে এল।

মুখ তুলল তুষার। চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে যেমন মিষ্টি হাসি আসে মুখে তেমন হাসিমুখ করল।

আদিত্য শিষ্টাচার প্রকাশ করল না, যেন ওসবের কোনও প্রয়োজন নেই। চোখের তারা স্থির, কয়েক মুহূর্ত দেখল তুষারকে, তারপর ঘরের দিকটায় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত করে দেখাল।

তুষার বুঝল। কিছু বলল না। ও চলে যাচ্ছিল, আদিত্য কথা বলল। আপনার ভেড়ার পালকে কী রকম ঠাণ্ডা করে রেখেছি দেখেছেন। গলার স্বরে, বলার ভঙ্গিতে ব্যঙ্গ ছিল স্পষ্ট। আদিত্যর ঠোঁটের কোণায়, গালে বিদ্রুপের হাসিও দেখতে পেল তুষার।

পা বাড়াতে গিয়েও তুষার একটু দাঁড়াল। তাকাল, তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। আসার পথেই বুঝতে পেরেছিলাম।

আদিত্য দোলনা থেকে উঠে দাঁড়াল। আমায় দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন?

বোঝা যায়।

কী বোঝা যায়, আমি রয়েছি।

হ্যাঁ। তুষার মাথা নাড়ল। নয়তো আমার ঘরে এত শান্তশিষ্ট হয়ে সব থাকবে কেন।

আদিত্যর হাতে একটা ঢিল ছিল, ঢিলটা সে দূরে একটা ময়নার দিকে ছুঁড়ে মারল। তুষার দেখল।

আপনাদের এই..কী যেন শিশুতীর্থ না বোগাস কী যেন এই আখড়া–এই আখড়ার নিয়মকানুন কে তৈরি করেছে? আদিত্য বিরক্ত মুখে বলল।

তুষার চোখে চোখে তাকাল আদিত্যর। কেন?

অল স্টুপিড।

তুষার বিরক্ত বোধ করল, প্রকাশ করল না। এখানের কোনও নিয়ম নেই।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি, যার যা মরজি চালিয়ে যাচ্ছে।

দায়িত্ব আছে।

কী? …কী বললেন কথাটা? আদিত্য সমস্ত মুখ বিরূপ করে যেন ধমকে উঠল।

বললাম দায়িত্ব আছে। তুষার শান্ত গলায় জবাব দিল।

খবরদার–আদিত্য মাথা নেড়ে নেড়ে ব্যঙ্গ এবং রঙ্গের ভঙ্গিতে বলল, কাউকে যেন ভুল করেও কথাটা বলবেন না। বলে আদিত্য হেসে উঠল, নিয়ম নেই, দায়িত্ব আছে। হাউ স্টুপিড।

তুষার ভেবেছিল জবাব দেবে না। সে শান্ত থাকতে চেয়েছিল, পারল না। বলল, নিয়ম মানুষ তৈরি করে, দায়িত্ব অনুভব করতে হয়।

আদিত্য কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশের মতন চোখ বড় এবং স্থির করল। মানে কী কথাটার?

তুষার মানে বলল না। ঠোঁটের আগায় হাসল একটু। বলল, আপনার জন্যে এখানকার নিয়ম দায়িত্ব কোনওটাই নেই, ওকথা তুলে কী লাভ।

লাভ। আদিত্য অপ্রসন্ন উত্তেজিত স্বরে বলল, মুখে তো বললেন দিব্যি আমার জন্যে কিছু নেই, কিন্তু কাল কী হয়েছিল জানেন?

তুষার তাকাল।

কাল সন্ধেবেলায় আমি ওই কুয়াতলার দিকে–আদিত্য হাত বাড়িয়ে দূরে একটা জায়গা দেখাল, একটা বুনো বক মারার চেষ্টা করছিলাম।

বুনো বক?

খোঁড়া বক। কী ভাবে চলে এসেছিল যেন। ভাল মাংস হত। ওই মেয়েটা কী যেন নাম ইতি না কি, আপনাদের খোদ কর্তার বাড়ির মেয়েটা, সে এসে আমাকে ধমকে দিল।

তুষার ভেতরে ভেতরে অশান্তি বোধ করছিল, ওপরে কিছু প্রকাশ করল না, বরং কত যেন অন্যায় কাজ করা হয়ে গেছে এমন গলা করে বলল, না কি? আমাদের ইতি–

আকাশ থেকে পড়বেন না। আপনাদের ইতি-ফিতি আমি বুঝি না, বুঝতে চাই না। গাছের পাখি, বনের বক মারব তার আবার এখান-ওখান কী আছে! মেয়েটা এসে আমার মুখের ওপর শাসিয়ে বলে গেল, মারবেন না, দাদুর বারণ, রাগ করবেন।

আদিত্য যেন কালকের অপমান এবং আক্রোশ নতুন করে অনুভব করছিল, আমি একটা বক মারব তাতে তার দাদু রাগ করবে কেন? কী আমার এল গেল তার দাদুর রাগে। আরও একদিন ও আমায় দাদুর কথা বলে শাসিয়েছিল, আমি এখানে বেড়াতে বেড়াতে সিগারেট খাচ্ছিলাম।

তুষার বিব্রত বোধ করছিল। চলে যেতে পারলে সে বাঁচে। বলল, এখানে এই চৌহদ্দির মধ্যে কতক জিনিস আছে যা করা অনুচিত।

যেমন–?

নিষ্ঠুর কিছু কাজ, অভব্য কোনও আচরণ।

মাংস খাওয়াটা নিষ্ঠুরতা, সিগারেট খাওয়া অভব্যতা–এসব আমায় শিখতে হবে?

সব জায়গায় সবকিছু করা যায় না।

না করার জন্যে আপনাদের নিয়ম আছে দেখছি। আদিত্য উপহাস করে বলল, ফন্দি-ফিকিরগুলো ভাল। সোজাসুজি বললেই পারেন, পয়সা নেই মাছ-মাংস খাওয়াবার তাই কাঁচকলার ঝাল খাওয়াই, ওসব বাজে কথা বলার কী দরকার।

তুষার কোনও জবাব দিল না। নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। আদিত্য পিছন থেকে জোরে জোরে বলল, মানুষ ছাগল নয়। আপনারা একটা খোঁয়াড় তৈরি করে রেখেছেন। অল স্টুপিড।

তুষার পিছন ফিরে তাকাল না, সিঁড়ির অল্প কয়েকটি ধাপ ভেঙে বারান্দায় উঠল।

আদিত্য তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল। তুষারের হাঁটা দেখতে তার ভাল লাগে। স্কুল, মাংস, সিগারেট–কোনও কিছু আর মনে পড়ছিল না আদিত্যর। তুষারের শরীর তার ইন্দ্রিয়কে কেমন কাতর করছে। তুষার সুন্দর। তুষার…

তুষারের নীরব ঘর থেকে আচমকা একটা কলরব ভেসে এল, যেন জানলা খোলা পেয়ে একঝাঁক পায়রা বদ্ধ ঘর থেকে একসঙ্গে ডানা ঝাঁপটে বাইরে বেরিয়ে এল। আদিত্যের অন্যমনস্কতা নষ্ট হল শব্দে, ঘরটার দিকে ঘৃণা এবং বিরক্তির চোখে তাকিয়ে আদিত্য দাঁতে দাঁত ঘষে অস্পষ্ট গলায় কী যেন বলল একটা। তারপর মাঠ দিয়ে অন্য দিকে চলে গেল।

.

নিজের ঘরে ঢুকে তুষার একটা হাস্যকর অবস্থা দেখল। তার ঘরের ছেলেমেয়েরা আসন হয়ে বসে, মুখের কাছে খোলা বই নিয়ে চুপ করে বসে আছে। বীরুর চোখ বন্ধ, সে সমানে বই হাতে করে দুলছে, কানু দু-হাতে দুকান ধরে বসে আছে। মালা বইয়ের আড়াল দিয়ে আমসত্ত্বের টুকরো চুষছে।

তুষার নিজের জায়গায় গিয়ে জিনিসপত্র নামিয়ে রাখল। রোদের তাতে তার কপালে গলায় সামান্য ঘাম হয়েছে। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে তুষার আবার একবার ওদের দেখল।

ততক্ষণে ছেলেমেয়েরা সব যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে। পিছু ফিরে একবার দেখে নিল নতুন লোকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে কি না! নেই, কেউ নেই। সঙ্গে সঙ্গে বীরুর দুলুনি থেমে গেল, চোখের পাতা স্প্রিঙের মতন খুলে গেল, এক লাফে বীরু দাঁড়িয়ে উঠল। কানু কান ছেড়ে মালার হাত থেকে আমসত্ত্ব কেড়ে মুখে পুরে দিল টপ করে। মালা কানুর জামা খামচে ধরল।

তোরা সকলে এত লক্ষ্মী হয়ে বসে! তুষার বলল, বলে এক পা এগিয়ে এল।

লক্ষ্মীরা নিমেষে যে কতবড় লক্ষ্মীছাড়া হতে পারে তার প্রমাণ দিতেই একজন কোথা থেকে একটা এয়ারগান বের করে ফট করে শব্দ করল, একটা ছেলে প্যান্টের পকেট থেকে বেলুন বাঁশি বের করে ফুঁ দিয়ে ছেড়ে দিল, বাঁশি বাজতে লাগল, অন্যগুলো কোলাহল করে উঠল, কেউ তুষারের কাছে ছুটে গেল, কেউ বা বসে বসেই অন্যের সঙ্গে খুনসুটি শুরু করল।

যে-ঘর এতক্ষণ ফাঁকা নির্জীব নিষ্প্রাণ মনে হচ্ছিল–তুষার আসার পর সেই ঘর যেন জীবন্ত মুখর হয়ে উঠল। এই ঘরের এটাই রীতি, এ-রকমই স্বাভাবিক।

তুষারের ঘরের একটু বর্ণনা দিতে হয়। ঘরটা খুব বড় নয়, লম্বা ছাঁদের দেখতে। মাথার ওপর খাপরার ছাউনি, চটের সিলিং দেওয়া। সিলিঙের ওপর ঘন চুনকাম। দেওয়ালগুলোতে প্লাস্টার নেই, ইটের গাঁথনির গায়েই চুনকাম পড়ে পড়ে সাদা হয়ে আছে। দুপাশেই বড় বড় জানলা গোটা চারেক।

ঘরের মেঝে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো। প্রায় সমস্ত ঘর জুড়ে পাতলা চট ছড়ানো, তার ওপর বড় বড় শতরঞ্জি পাতা। বাচ্চাগুলো মাটিতে বসে, ছোট ছোট ডেস্ক পড়ে আছে–একটা বেঞ্চিও। ঘরের দেওয়ালে কাগজের ফুল সাজানো, দুচারখানা ছবিও। তুষারের বসবার দিকটা বারো রকম জিনিসে ভরা, কিছু ছবির বই-পত্ৰ, গ্লোব, ব্ল্যাকবোর্ড, ন্যাকড়ার খেলনা, মাটির মূর্তি, আরও কিছু কিছু জিনিস এই রকমের।

তুষারের বসবার একটা চেয়ার আছে অবশ্য কিন্তু সেটা একপাশে সরিয়ে রাখা, টেবিলটাও। বেতের মোড়াটা টেনে নিয়েই বেশির ভাগ সময় বসে তুষার, কখনও কখনও সরাসরি শতরঞ্জির ওপর আসন হয়ে, কিংবা হাঁটু ভেঙে।

তুষারের বসবার দিকটার এক কোণে ছোট একটা দরজা খুললে কুঠরি মতন এক ফালি ঘর চোখে পড়বে। ঘরটা নানা কাজ অকাজের খুচরো জিনিসে ভরা, তবু, ওই ঘরেই নিচু ছোট জানলার পাশে একটা ক্যাম্বিসের হেলানো চেয়ার দেখলেই বোঝা যায় এটা তার বিশ্রামের নিভৃত স্থান।

তুষারের ঘরে এই রকম একটা কুঠরি থাকলেও সকলের ঘরে নেই। আশাদির ঘরে নেই, মলিনার ঘরেও নয়। জ্যোতিবাবুর ঘরে আছে, যদিও জ্যোতিবাবু সেটা ব্যবহার করেন বলে মনে হয় না।

তুষারকে যারা ঘিরে ধরেছিল তাদের একজনের গালে কালির দাগ। তুষার বুঝতে পারল না, এতখানি কালি কী করে ও মুখে মাখল।

ইস! তুষার ছেলেমানুষের মতন গলা করে বলল, বলে জিভ বের করল, যেন কত বড় একটা অঘটন ঘটিয়েছে ছেলেটা। মুখে কালি মাখালি কী করে রে, শানু?

কালি মেখে শানুর কোনও অনুশোচনা হয়েছে বলে মনে হল না। বরং সে গাল দুটো আরও ফোলাল, ফুলিয়ে চোখ বড় বড় করল।

ও বহুরূপী সাজছিল দিদি…অশোক বলল।

বহুরূপী? তুষার অবাক!

আমি কাল একটা বহুরূপী দেখেছি। শানু চোখ ঘুরিয়ে বলল। শানুর ওপর পাটির তিনটে দাঁতই পড়ে গেছে, নতুন দাঁত এখনও ওঠেনি। মাথার চুল খোঁচা খোঁচা।

ততক্ষণে যমুনা তুষারের বই খাতা কাগজপত্র এটা সেটা রাখার টেবিল থেকে কালির শিশিটা এনে দিয়েছে তুষারের হাতে। তুষার শিশি দেখেই বুঝতে পারল। কাল একটা লেখার কাজ করছিল তুষার, কালির শিশি বাইরে বের করেছিল, তুলে রাখতে ভুলে গেছে।

শানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তুষার কোলের কাছে টেনে নিল; হাসল, কেমন বহুরূপী দেখেছিস রে, শানু?

শানু সঙ্গে সঙ্গে তুষারের কোলের কাছ থেকে ছিটকে দুহাত সরে এল। সরে এসেই দু হাত তুলে চোখ জ্বলজ্বল করে বহুরূপীর বিবরণ দিতে লাগল। এত্ত বড়! …রাজা হয়েছিল। লাল জামা গায়ে, হাতে ধনুক ছিল। সেই বহুরূপীটাকে ছোট মামা একটা টাকা দিল।

রাজা বহুরূপী? তুষার ছেলেমানুষ হয়ে শানুর গল্প শুনতে লাগল।

হ্যাঁ-শানু মাথা নাড়ল। তারপরেই হেসে ফেলল কেমন, বলল, রাজাটার না দিদি, রাজাটার তরোয়ালই নেই। শানুর হাসি এবং কথা থেকে মনে হবে যে-রাজার তরোয়াল নেই সে আবার কেমন রাজা!

তুষার তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। ঘরের অন্যদিকে রুনু আর নন্তুতে ডিগবাজি খাওয়া, খেলা খেলছে; হাবুল মাটিতে মাথা আর দেওয়ালে পা তুলে দিয়ে ক্রমশ ঠেলে ওঠার চেষ্টার করছে কতদূর পা তুলতে পারে তারই পরীক্ষা, পড়ে যাচ্ছে পা, আবার চেষ্টা করছে। ঘরের মধ্যে অনর্গল কথা, চিৎকার, হাসি।

তুষার মাটিতে হাঁটু ভেঙে বসে বলল, রাজাটা বোধ হয় ভুল করে তরোয়াল বাড়িতে রেখে গিয়েছিল, শানু।

শানু তাকাল। কথাটা তার মনে লাগল। হতেও পারে, হয়তো সত্যি সত্যি তরোয়াল তার ছিল, বাড়িতে ফেলে গিয়েছে। শানুর চোখ-মুখ দেখে মনে হল, সে ভাবছে। তার দুঃখই হচ্ছে, আহা তরোয়ালটা থাকলে কেমন ভাল দেখাত রাজাকে।

যমুনা হাঁটু ভেঙে তুষারের পিঠের কাছে বসে। তুষারের খোঁপার ওপর একটা কুটো পড়েছিল কীসের। যমুনা কুটোটা তুলে নিয়ে ফেলে দিল। বলল, বহুরূপীরা আগের জন্মে গিরগিটি ছিল।

তুষার হাসল না। তাকে নিত্য এরকম অদ্ভুত মজার মজার কথা শুনতে হয়। যমুনার দিকে মুখ ফিরিয়ে তুষার বলল, কে বলল রে?

পিসিমা।

ও! …তুই বহুরূপী দেখেছিস?

হু, ক–ত দেখেছি।

কী কী সাজতে দেখেছিস?

অনেক, হনুমান, রাক্ষস..যমুনা ভেবে ভেবে বলল, ধোপা, শিব, দুর্গা, অর্জুন..

অর্জুন সাজতেও দেখেছিস?

যমুনা মাথা কাত করে হেলাল।

তুষার একটু কী যেন ভেবে নিল। অর্জুনের গল্প জানিস তোরা?

একটু আধটু জানত সবাই; কিন্তু কেউ আর কিছু বলল না। ওরা জানে, তুষারদিদি অর্জুনের গল্পটা নিজেই বলবে। সবাই একটু ঘেঁষে গুছিয়ে বসল।

তুষার হাতে তালি দিয়ে সকলকে চুপ করতে বলল। এত সহজে সবাই শান্ত হবে এমন কথা ভাবা ভুল। রুনু, নন্তু কিংবা হাবুলের কানে তুষারের তালির শব্দ পৌঁছেছে বলেও মনে হল না। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুটি মেয়ে হাতে তালি দিয়ে বিকুইক খেলছে।

তুষার এবার নাম ধরে ধরে ডাকল প্রত্যেককে। যমুনা ঘোষণা করে দিল, দিদি অর্জুনের গল্প বলবেন। দেখা গেল, গল্পের নামে সবাই কাছ ঘেঁষল পলকে। তুষারকে ঘিরে বসল ওরা।

গল্প শুরু করার আগে তুষার তার বেতের টুকরিটা আনিয়ে নিল। তারপর গল্প শুরু করল।

গল্পের মধ্যে তুষার কোনও ছেলের জামায় সেফটিপিন আটকে দিল, কারও চুল আঁচড়ে দিল, মেয়েদের বিনুনি বেঁধে দিল। পরিবেশটা স্কুলের নয়, ঘরের; মনে হবে বাড়িতে দালানে বসে যেন কোনও দিদি মাসি পিসি তার স্নেহের পাত্রদের সাজিয়ে-গুছিয়ে কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে।

অর্জুনের গল্প শেষ হতে কতক্ষণ লাগবে কেউ জানে না। কিন্তু আর একটু বেলায় এদের সকলের খাওয়ার ছুটি। তুষার ওদের নিয়ে খাওয়ার ঘরে চলে যাবে। হাত-মুখ ধুইয়ে খাওয়াবে সকলকে। তারপর বিশ্রাম। ওরা এই ঘরে এসে শুয়ে পড়বে। অবশ্য কেউ বড় একটা শোয় না। খেলা করে, দুরন্তপনা করে।

তুষার গল্প বলতে বলতে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। রোদ গাঢ় হয়ে উঠেছে। পাখিদের কিচকিচ শব্দ ভেসে আসছে। হাত-ঘড়ি দেখল তুষার, দশটা বেজে গেছে।

গল্প মাঝপথে, শিশুতীর্থর পেটা ঘড়িতে ঘণ্টা বাজল। দূর থেকে শব্দটা কেঁপে-কেঁপে ভেসে এল। খাওয়ার ছুটি।

গল্পের আকর্ষণে কেউ উঠল না। তুষার হাসল। বলল, চল। বাকিটা পরে হবে।

দুপুরে? শানু শুধোল।

কাল।

না, না, আজ। তুষারকে কয়েকজনে মিলে জাপটে ধরল।

আজ দুপুরে ওই গানটা হবে যে, পুশি ক্যাট পুশি ক্যাট হোয়ার হ্যাড ইউ বিন..

ওটা গান নয়, ইংরেজি ছড়া। সবাই জানত কথাটা। এ-ঘরেও গান হয়, তুষারদির সঙ্গে তারা সবাই গায়। সেগুলো বাংলা গান। ইংরেজি ছড়ায় গানের মজা নেই, কিন্তু তুষারদি ছড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলা খেলান। খেলাটা খুব মজার।

আমি আজ ক্যাট হব। টুটুল বলল।

শানু টুটুলকে কাঁচকলা দেখাল। ফলে টুটুল শানুর ওপর লাফিয়ে পড়বে এটা স্বাভাবিক। শানু দু-হাত মুঠো করে পাকিয়ে শুন্যে ঘোরাতে ঘোরাতে মাথা ঝাঁকিয়ে বলছিল, আমি টাইগার। ক্যাটকে খেয়ে ফেলব।

তুষার উঠল। বেতের টুকরি হাতে করেই উঠে দাঁড়াল। ছেলেমেয়েরাও তৈরি। বলল, চল তোরা।

হুড়মুড় করে ছেলেমেয়েগুলো ঘর থেকে দৌড় দিল।

তুষার চলে যাচ্ছিল। যেতে গিয়ে তার জুতোর কথা মনে পড়ল, অন্যান্য জিনিসগুলোও নিল তুষার। জামাটা নিল না। জামাটা যার তাকে নিজের ঘরেই পাওয়া যাবে। অন্য বাচ্চাদের জিনিস এবার দিয়ে দেবে তুষার।

বাইরে এসে তুষার দেখল, তার ঘরের ছেলেমেয়েরা ছুটে অনেকটা দূরে চলে গেছে।

.

০৪.

শিশুতীর্থর সব ব্যবস্থাই একটু অন্য রকম। এখানে স্কুলের মতন করে ক্লাস হয় না, পড়াশোনা করানোর রীতি নেই। সাহেব দাদু যখন শিক্ষা নিয়ে রীতিমতো মাথা ঘামাতে বসলেন তখন তাঁর মনে হয়েছিল, কচি বয়সের এই ছেলেমেয়েগুলোকে ক্লাসরুমে পুরে খোঁয়াড়ের মতন আটকে রেখে কোনও লাভ নেই। পড়াশোনাকে জীবনের আর সমস্ত থেকে আলাদা করে দেখা আমাদের স্বভাব। এটা ভাল না।

সাহেবদাদু এমন একটা ব্যবস্থা খুঁজছিলেন যাতে এই কচি বয়সের ছেলেমেয়েগুলোর জীবনযাপন এবং শিক্ষাকে অঙ্গীভুত করা যায়, যেন, স্বতঃস্ফুর্ত ভাবেই এরা যেটুকু শেখবার শেখে, বাকিটুকু ফেলে দেয়।

কিছু কিছু বিদেশি বই আনিয়ে বিভিন্ন শিক্ষার ধারা বোঝবার চেষ্টা করেছিলেন তিনি, কোনও কোনওটা মনঃপূত হলেও তাঁর সামর্থ্য যা তাতে বড় কিছু একটা করার উপায় ছিল না। ফলে ইচ্ছে থাকলেও সে-সব বৃহত্তর ব্যাপারে তিনি যাননি। এমন সময় হল্যান্ড না কোন দেশের গ্রাম্য বিদ্যালয়ের একটা পদ্ধতির বিবরণ তাঁর চোখে পড়ে। ব্যবস্থাটা তাঁর ভাল লাগে, ভরসা হয় এখানে এই রীতি তিনি চালু করতে পারবেন।

অন্যের পরিকল্পনা নিজের মনের মতন করে, সম্ভব-অসম্ভব খতিয়ে দেখে তাঁকে সেই ব্যবস্থাটা এখানের মতন করে গড়ে নিতে হয়েছে। সেই নিয়মেই শিশুতীর্থ চালানো হয়।

এখানে গুটি পাঁচেক শিক্ষক শিক্ষয়িত্রী। ছাত্র সংখ্যা ষাট-পঁয়ষট্টি। ছাত্রদের ভাগ করা হয়েছে বয়স দেখে, কখনও কখনও তাদের স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি দেখে। এদের এক একটি দলকে এক একজন শিক্ষকের হাতে সম্পূর্ণ ভাবে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন তুষারের হাতে যারা আছে তারা একান্ত ভাবেই তুষারের হাতে মানুষ হচ্ছে। তুষারের ঘর কথাটার অর্থ তুষারের ক্লাস। তুষারের ছাত্রদের যাবতীয় যা কিছু তুষারই শেখাবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় মাস্টার বদলাবে, একজন এসে ইংরেজি শেখাবে, অন্যজনে অঙ্ক–এসব ব্যবস্থা এখানে নেই। সাহেবদাদুর ধারণা ভাগের মা গঙ্গা পায় না যেমন, তেমনি পাঁচ হাতে শিক্ষা হয় না। শিক্ষা এক হাতে একের অধীনে হওয়া দরকার। তাতে মানুষের মনে যে পারিবারিক বোধ আছে তার বিকাশ হয়, যারা শেখে তারা শিক্ষকের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে, আত্মীয়তা বোধ করে, আর যে শেখায় তার সুখ এই, সে নিজের মনের মতন করে, নিজের কল্পনা মতন ছাত্রদের শেখাতে পারে। এই স্বাধীনতা না থাকলে, সাহেবদাদু বলেন, টিচার আর কী শেখাতে পারে! আমরা মাস্টার ভাড়া করি, তাঁদের হাতে ভার তুলে দিই না। পিতা-মাতার যেমন সন্তান ছাত্র এবং শিক্ষকের সম্পর্কটা সেই রকম পারবারিক ও অন্তরঙ্গ করতে হবে, দায়-দায়িত্ব সব থাকবে তাঁরই ওপর, যেমন ছেলেমেয়ের দায় শিক্ষা সবই তার বাবা-মার।

সাহেবদাদুর এই নীতি যে কার্যক্ষেত্রে সফল হয়েছে, শিশুতীর্থ দেখলে সেটা বোঝা যায়। বোঝা যায়–তুষার, আশাদি, জ্যোতিবাবুকে দেখলে। আর দুজন আছে এখানে, প্রফুল্লবাবু আর মলিনা, এরা দুজনেই নতুন। প্রফুল্ল কেন যেন এখনও ঠিক তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। মলিনা তৈরি হয়ে উঠতে পারবে কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।

খাবার ঘরে ছেলেমেয়েগুলোর খাওয়া-দাওয়া শেষ হল। তুষারের ঘর আর মলিনার ঘরের বাচ্চাগুলোর পর বাকি তিন ঘরের ছেলেমেয়েরা এসে খাবে। জ্যোতিবাবু আর খাবার ঘরে আসেন না, প্রফুল্লবাবুও নন। আশাদি একাই সব কজনকে সামলে খাইয়ে দেয়। ঠাকুর আছে, ঝি আছে। অসুবিধে বড় একটা হয় না।

খাওয়ার ব্যাপারটা এখানে খুবই সাধারণ। ভাত, ডাল, তরিতরকারি, মাছের টুকরো পাতে থাকে কোনওদিন, কোনওদিন থাকে না। বাচ্চাদের দুধ দেবার খুবই সাধ ছিল সাহেবদাদুর–সংগ্রহ করা মুশকিল বলে পেরে ওঠেন না। বেলা দুটো নাগাদ এদের জলখাবার দেওয়া হয়। কোনদিন রুটি-তরকারি, কোনওদিন ফলমূল, কোনওদিন বা আর কিছু।

তিনটেয় ছুটি। নুটুর বাস শহরের ছেলেমেয়ে নিয়ে ফিরে যায়। এখানে যারা থাকে তারা ছোটে সাহেবদাদুর বাড়িতে।

.

বাচ্চাদের খাওয়া শেষ হলে তুষার কারও কারও হাত-মুখ ধুয়ে দিল, মুছিয়ে দিল। ছেলেমেয়েগুলো ছুটতে ছুটতে খেলতে খেলতে চলে গেল মাঠের দিকে।

মলিনা বাইরে জলের ড্রামটার কাছে দাঁড়িয়েছিল। পাশে দুটো কলাগাছ, একটা পেঁপে গাছ; হাত পনেরো দুরে রান্নাঘর। এঁটো পাতায় ডাঁই এনে মতি-ঝি আঁস্তাকুড় রাখা চৌবাচ্চাটায় ফেলল।

এখানে শরৎ আর হেমন্তর তফাতটা যেন ভাল করে বোঝা যায় না। আজ বোঝা যাচ্ছিল আকাশের দিকে তাকিয়ে রোদ লক্ষ করে। সারা আকাশ খুব হালকা নীল, যেন সেই নীল থেকে কুলোয় করে কেউ ঝকঝকে রোদ ঝেড়ে ঝেড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে। ফড়িংয়ের মতন কয়েকটা সবুজ পোকা উড়ছিল। পেঁপেগাছের চিকরিকাটা পাতার ডগা দুলছে থেকে থেকে, কলাগাছের তলায় দুটো বেড়াল বাচ্চা খেলা করছে।

মলিনা রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলল, তুমি আমাদের পাড়ায় গিয়েছিলে তুষারদি?

তুষার হাত ধুয়ে ড্রামের কাছ থেকে সরে এল। না, যাইনি!

তুমি ওদিকে যাও না?

খুব কম। আমি বাড়ি থেকে বড় একটা বেরোতে পারি না।

মলিনা শাড়ির আঁচলের পাক গলায় জড়াল একবার, আবার খুলল। মুখচোখ খুব বিরস। তুষারের দিকে তাকাল না, অনেকটা আপন মনে কথা বলার মতন করে বলল, বাড়িতে থেকেও তুমি বেরুতে পার না, আর আমরা–? কথাটা মলিনা শেষ করল না।

তুষার লক্ষ করল মলিনাকে। মলিনা এই রকম। তার কথা কখনও পুরোপুরি বোঝা যায় না।

তোমাদের কী হয়েছে? তুষার শুধোল।

মলিনা জবাব দিল না। তার মুখের হতাশ বিরক্ত অসুখী ভাব থেকে যা বোঝার বুঝতে হবে। মলিনার মুখে কখনও হাসি থাকে না। ও কখনও খুশি নয়। মলিনার মনে যে সুখ নেই, সর্বক্ষণ যেন সে সেটা প্রকাশ করতে চায়!

তুষারের হাতে বেশি সময় নেই। আশাদির কোয়ার্টারে গিয়ে তাকে স্নান করে নিতে হবে। সকালে তুষার স্নান করে আসতে পারে না। এখানে এসে এই খাওয়ার ছুটিতে সে স্নান করে নেয়। স্নান করে, খাওয়া-দাওয়া সারে। ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় সে নেয় না। কেই বা নেয় এখানে! আশাদি অবশ্য মাঝে মাঝে বলে, দেখ তুষার, আমার বড় আলসেমি বাড়ছে, খাওয়ার পর একটু শুয়ে আসতে ইচ্ছে করে। কেন বল তো?

সকাল থেকেই যে তোমার খাটুনি।

সে তো তোরও।

তোমার মতন নয়।

কথাটা অবশ্য ঠিক। এই এতগুলো ছেলেমেয়ে তারা পাঁচ-সাত জন–সকলের রান্না বান্না খাওয়া-দাওয়ার ভার আশাদির ঘাড়ে। জ্যোতিবাবু বাজার আর ভাঁড়ারের দায় মাথায় নিয়েছেন, বাকি সব দায় আশাদির। খুব সকালে উঠে আশাদি ঠাকুর-চাকরদের এদিকের ব্যবস্থা বুঝিয়ে এবং গুছিয়ে দিয়ে তবে অন্য কাজে হাত দিতে পারে।

তুষার সময় নষ্ট করতে পারছিল না। খাবার ঘর পরিষ্কার করে অন্য দলের পাতা পড়ছে। মলিনার কোনও তাড়া নেই। তুষার বলল, তোমার কোনও দরকার আছে? কাজ থাকে তো বলো, আমি বরং সময় করে একবার তোমাদের ওদিকে যাব।

দরকার। …মলিনা তুষারকে অন্যমনস্ক চোখে দেখল। না, দরকার নেই কিছু৷দু মুহূর্ত থেমে চাপা গলায়, যেন অনুচিত কোনও অনুরোধ করেছে এমন সুরে বলল, আমি পাঁচটা টাকা দেব তোমার হাতে। বাড়িতে যদি পৌঁছে দাও। বাবা একটা ধুতি কিনতে টাকা চেয়েছিল। মলিনার মুখ অপ্রসন্ন, তিক্ত।

তুষারের ভাল লাগছিল না। মলিনার বাড়ির কথা উঠলে তার অস্বস্তি হয়, ভাল লাগে না। তুষার বলল, বেশ তত দিয়ো। আমি পাঠিয়ে দেব।

তুষার আর অপেক্ষা করল না। আশাদির ছেলেমেয়েগুলো আসছে, তাদের গলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। তুষার বারান্দার মতন ঢাকা জায়গায় উঠে দেওয়ালের পেরেকে ঝুলোনো বেতের টুকরিটা নিয়ে চলে গেল।

সামনেই আশাদির কোয়ার্টার, গা লাগানো। এই কোয়ার্টারে আশাদি আর মলিনা থাকে। দুজনের দুটো ছোট ছোট ঘর, এক ফালি বারান্দা। কাঠের জাফরি দিয়ে বারান্দাটাও অনেকখানি ঘেরা। কোয়ার্টারের পেছন দিকে উঠোন, কলঘর।

আশাদির ঘর খোলাই থাকে। তুষার ঘরে এসে বেতের টুকরিটা রাখল।

ঘরের জানলাগুলো খোলা। রোদ এসে বিছানায় পড়েছে আশাদির। ঘরটা ছোট, খুব সাধারণ ভাবে সাজানো, বিছানার তক্তপোশ ছাড়া আসবাবের মধ্যে একটা ছোট টেবিল-খান দুয়েক বেতের মোড়া; এক কোণে আশাদির সেলাই কল, বাক্স, স্যুটকেস। জানলায় পরদা নেই। দেওয়ালে আশাদির মার ফটো। এক ক্যালেন্ডার ঝুলছে পশ্চিমের দেওয়ালে। ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

একটা মোড়া টেনে তুষার একটু বসল। এলো খোঁপাটা খুলে নিল। কাল মাথায় জল দিতে পারেনি; আজ জল না দিলে বিকেলে আর মাথা তোলা যাবে না। বেতের টুকরি থেকে শাড়ি জামা বের করে পাশে রাখল তুষার–বিছানার ওপর, চিরুনি বের করে চুলের গোড়ার জট ছাড়িয়ে নিল। তুষার তেল আনতে ভুলে গেছে আজ। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। কলঘরে আশাদির মাথায় মাখা তেল আছে– নারকেল তেল। তুষার কোনওদিনই মাথায় একরাশ তেল মাখতে পারে না, অথচ একটু তেল জল না পড়লে তার বড় মাথা ধরে।

রান্নাঘর থেকে বাচ্চাদের খাওয়া-দাওয়ার শব্দ প্রায় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ভেসে আসছে। ওরা এই রকম, খেতে বসেও শান্ত নয়। জ্যোতিবাবু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তদারক করেন, আশাদি ভেতরে পাতের কাছে ঘুরে ঘুরে দেখছেন, তবু যেন মনে হবে একটা ছোট হাট বসে গেছে।

চুল ছাড়িয়ে শাড়ি জামা হাতে নিয়ে তুষার উঠে পড়ল। পিছনের দরজার ছিটকিনি খুললেই উঠোন, উঠোনের একপাশে কলঘর। উঠোনের দুধারে দুই খুঁটি, তার বাঁধা। আশাদি আর মলিনার সকালের শাড়ি জামা শুকোচ্ছে। রোদ উঠোন মাড়িয়ে ডালিম গাছটার দিকে সরে গেছে অল্প। কয়েকটা চড়ুই ফর ফর করে উড়ছিল।

তুষার তাড়াতাড়ি স্নান করতে কলঘরে ঢুকে গেল। ড্রামে আজ জল কম। আশাদি বোধহয় সকালে স্নান সেরে রেখেছে। জল সাবান গোলা। তুষার তার গা-মোছা গামছাটা খুঁজে পেল না। কলঘরের একপাশে দড়িতে তার গামছা থাকে। কোথায় গেল গামছাটা? আবার কলঘর থেকে বাইরে আসতে হল তুষারকে। বাইরে কোথাও তার গামছা নেই। তুষার মনে মনে ঈষৎ বিরক্ত হল।

সাবান গোলা জলে স্নান করতে করতে তুষার মলিনার কথা ভাবল। মলিনা এই রকম। তার সব কাজই অপরিষ্কার। এই জলে সে সাবান দিয়ে ঘোলা করেছে, ওই যে কয়েকটা নোংরা পড়ে আছে এক পাশে–ভেতর-জামা, সায়া, ওগুলোও মলিনার। নিজের হাতে তোলার অবসর পায়নি, ফেলে রেখেছে, ঝিকে দিয়ে কাচিয়ে নেবে। তুষারের মনে হল, গামছাটাও বোধহয় মলিনা ব্যবহার করে ঘরে নিয়ে গিয়ে কোথাও ফেলে রেখেছে।

স্নান সেরে ধোওয়া কাপড় জামা গায়ে জড়িয়ে তুষার বেরিয়ে এল। তার ধোওয়া শাড়ি জামা নিংড়ে রোদে মেলে দিতে দিতে আকাশের তলায় দুটো চিলকে সাঁতার কাটতে দেখে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকল তুষার। তার ভাল লাগছিল।

রোদে মেলা ভিজে শাড়িতে একবার করে মাথা মোছে তুষার আবার একবার করে চুল ঝাড়ে। খাবার ঘর শান্ত। কতক কাক কা কা করছে।

আশাদির পায়ের শব্দ শুনতে পেল তুষার। আশাদি ঘরে এসেছে।

অগোছালো শাড়ি পরে তুষার ঘরে এল।

আশাদি বিছানায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছে।

চান হল?

হল। …আমার গামছাটা পেলাম না। তুষার তার চিরুনি তুলে আগে চুল আঁচড়ে নিতে লাগল।

পেলি না?

না।

সে কী? আশাদি অবাক। কোথায় গেল?

আমি কী করে জানব। তুষার বলল, বলেই ছেলেমানুষের মতন গলা করে বলল, মাথা মুছতে পেলাম না ভাল করে, দেখো তো কি জল থেকে গেল। সারাদিন ভিজে থাকলে এমন গন্ধ হয় মাথায়।

আমার গামছাটা নিলে পারতিস।

না, তুমি যা ফিটফাট, তোমার গামছায় মাথা মুছে রাখলে গালাগাল খাবে কে!

আশাদি নিজেই উঠল। বাইরে রোদ থেকে গামছা এনে তুষারের মাথা মুছিয়ে দিল। বলল, তোর চুল যেন আরও বাড়ছে, তুষার।

আরও খুকি হচ্ছি যে। তুষার শব্দ করে হেসে উঠল। হেসে মুখ ফিরিয়ে আশাদিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরল।

ছাড়। আশাদি নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। নিজের তো সব হয়ে গেল, আমার আজ চান হয়নি।

তুষার আশাদির মাথার দিকে লক্ষ করল। তুমি চান করোনি?

না। সময় করে উঠতে পারলাম না।

কিন্তু জল কই, যেটুকু ছিল আমি শেষ করে এলাম। তাও আবার সাবান গোলা জল।

আশাদি গায়ের আঁচল আলগা করল। মুখে কপালে ঘাম। গালে কীসের একটা আঁচড় লেগে লাল হয়ে আছে। তুষার দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে গায়ে জড়ানো শাড়িটা ভাল করে পরতে লাগল।

আশাদি বলল, সকালে ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। শরীর খারাপ। দেরি হয়ে গেল।

কী হয়েছে ওঁর? তুষার বাড়তি আঁচল হাতে গুটিয়ে নিয়ে নিমেষে আশাদির দিকে ঘুরে দাঁড়াল। তার মুখে উৎকণ্ঠা।

একটু জ্বর জ্বর মতন হয়েছে।

সাহেবদাদুর শরীর ইদানীং আর ভাল যাচ্ছে না। প্রায় কোনও না কোনও উপসর্গ লেগে থাকে। ওঁর জ্বর হয়েছে শুনে তুষার উদ্বিগ্ন হল।

বলল, ঠাণ্ডা–?

হতে পারে। জানি না ঠিক।

ডাক্তারবাবুকে খবর দিয়েছ?

উনি দিতে বারণ করলেন। গাড়িটাও তখন তোদের আনতে বেরিয়ে গেছে।

তুষার আঁচল গায়ে তুলল। জ্যোতিবাবুকে বললে না কেন, সাইকেল নিয়ে চলে যেতেন?

আশাদি কোনও জবাব দিল না। মনে হল ভাবছে যেন কিছু।

তুষার বলল, আমি বিকেলে দেখা করে যাব।

আশাদি স্নানের জন্যে ঘর ছেড়ে চলে যেতে যেতে বলল, যাস। …ও শোনদরজার কাছেই আশাদি ঘুরে দাঁড়াল, আমায় উনি ওই আদিত্যবাবুর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। আমি কিছু বলতে পারলাম না। ওই ভদ্রলোকও কেমন। আমার ভাল লাগে না।

আশাদি চলে গেল, তুষার দাঁড়িয়ে থাকল।

.

০৫.

এখন দুপুর। বাইরে রোদ প্রখর। ভাদ্রের শেষ বলে রোদে হলকা আছে। গাছ এবং গাছের পাতায় অনেকটা তাপ শুষে যাচ্ছিল বলে গরমের আঁচ গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছিল না। তা ছাড়া বর্ষা হয়ে গেছে, কালও দু-চার পশলা ছিল, কাজেই বাতাস তেমন গরম নয়। তবু ঘাম হচ্ছিল। তুষার তার বেতের মোড়ায় চুপ করে বসে। তার ঘরের ছেলেমেয়েগুলো এখন খুব শান্ত। ওরা হাতের লেখা করছে। হাতের লেখা শেষ হলে, তুষার ভেবে রেখেছে আজ স্বাস্থ্য পড়াবে। স্বাস্থ্য পড়ানোর একটা মোটামুটি ছক সে ঠিক করে রেখেছে।

হাতের লেখা লেখবার সময় বাচ্চারা যেমন এক শব্দ বা কথা উচ্চারণ করে টেনে টেনে-সেই রকম শব্দ হচ্ছিল। বিভিন্ন ছেলে মেয়ের গলায় বিভিন্ন শব্দে সেই ধ্বনি অদ্ভুত শোনাচ্ছিল।

বাইরে ঘুঘু ডাকছে। গাছের ছায়ায় বসে রোজ দুপুরবেলা এমনি করে ঘুঘু ডাকে এখানে। মাঝে মাঝে কোকিলও। আজ কোকিলটা আশে পাশে কোথাও নেই, কোন ঘরের সামনে গিয়ে বসেছে জানে।

তুষার কপাল মুছে নিল। একটা হাতপাখা অবশ্য আছে ওদিকে। কোনও দরকার নেই পাখার। এখুনি জানলা দিয়ে দমকা হাওয়া বয়ে গেলে ঘর আবার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগবে। আজকের বাতাস তেমন গরম নয়। বরং দুরে কোথাও বৃষ্টির জলে ভিজে ঠাণ্ডা হয়ে মাঝে মাঝে এপাশে এসে লুটিয়ে পড়ছে।

বসে থাকতে থাকতে তুষার সাহেবদাদুর কথা ভাবছিল। আজ যাবার আগে নিশ্চয় একবার দেখা করে যেতে হবে। গত দুদিন তুষার তাঁর কাছে যেতে পারেনি। সাহেবদাদুর শরীরটা এই একবছরে যেন বড় তাড়াতাড়ি ভেঙে পড়ল। সেই যে টমটম করে কোথায় যেতে গিয়ে গাড়ি উলটে পড়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটালেন, তারপর থেকেই ওঁর শরীর ভাঙার দিকে। অবশ্য বয়স হয়েছে, শরীর ভাঙবে, অথর্ব হয়ে পড়বেন ক্রমশই–এটা কিছু আশ্চর্যের নয়। কিন্তু বছরখানেক আগেকার সাহেবদাদুর সঙ্গে আজকের সাহেবদাদুর তুলনা করলে মনে হবে, এক বছরে এত স্বাভাবিক নয়।

উনি নানা দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায় আছেন। একটা দুটো দুর্ভাবনার কথা তুষার জানে, আশাদিও জানে। জ্যোতিবাবুও যে না জানেন এমন মনে হয় না।

সেই সব দুর্ভাবনার একটা হল, অর্থচিন্তা। এই শিশুতীর্থের জন্যে উনি ওঁর যথাসর্বস্ব দিয়েছেন। মোটামুটি ধনী লোক না হলে বা অর্থের ব্যবস্থা না থাকলে এই প্রতিষ্ঠান এতকাল কষ্টেসৃষ্টে চালানোও সম্ভব ছিল না। এত কিছুঘরবাড়ি জিনিস-পত্র–যত দীন ভাবেই হোক উনি একার সামর্থেই করেছেন। এখন ভাণ্ডার বোধ হয় প্রায় শূন্য। সর্বক্ষণই দুশ্চিন্তা, কেমন করে শিশুতীর্থ চলবে।

সাহেবদাদুর এক বন্ধু কোনও মিশনারি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের যেন হর্তাকর্তা ব্যক্তি। তুষার আশাদির কাছে শুনেছিল সাহেবদাদু সেই বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে বাৎসরিক কিছু সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। তুষার ঠিক জানে না সাহায্যটা এত দিনে পাওয়া গেছে কি না। এ ছাড়া সামান্য আর যা সাহায্য অন্যান্য সূত্র থেকে আসে–সাহেবদাদুর অবর্তমানে তা পাওয়া যাবে কি না কে জানে!

সাহেবদাদুর অন্য দুর্ভাবনা ইতি। দেখতে রোগা মতন মেয়েটা তার অবোধ মুখ নিয়ে কেমন বড় হয়ে উঠল। তুষার নিজের চোখেই গত দুবছর ধরে ওকে দেখছে। কেমন শীর্ণ শ্যামলা ছিল, সেই মেয়ে যেন বাড়ন্ত হবার সময়ে এসে হু হু করে বেড়ে উঠল। মেয়েদের এই এক আশ্চর্য ব্যাপার। ঝড় এলে যেন বানের মতন আসে। পনেরো বছরের ইতিকে চট করে দেখলে কে আজ বলবে যে বছরখানেক আগেও অমন রোগা ছিপছিপে চঞ্চল মেয়ে ছিল। আজ ইতি রীতিমতো তুষারের মাথায় মাথায় হয়ে উঠেছে। শরীর বড় সুন্দর হয়ে বেড়েছে, নতুন ফোঁটা ফুলের মতন দেখায়। গায়ের সেই শ্যামলা রং যে কী উজ্জ্বল মিষ্টি হয়ে উঠেছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

ইতির সবই ভাল। মন্দ এই যে, মেয়েটা কেমন করে যেন এই বয়সেই অনেকখানি গম্ভীর, চুপচাপ। এত শান্তশিষ্ট হওয়া ওকে–ওই বয়সের মেয়ের পক্ষে-মানায় না। মাঝে মাঝে মেয়েটাকে, তুষার লক্ষ করে দেখেছে, বড় একা নিঃসম্পর্ক নিষ্প্রাণ দেখায়। যেন একটা বৈরাগ্যের ছবি।

সাহেবদাদু ইতির সম্পর্কে সব সময় দুশ্চিন্তা করেন। তাঁর অবর্তমানে মেয়েটার কী হবে, এই শিশু-তীর্থ সম্বল করে সে কি জীবন কাটাতে পারবে? শিশুতীর্থের ভবিষ্যতই যেখানে স্পষ্ট করে দেখা যায় না, সেখানে ইতিকে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত করে নিশ্চিন্ত হওয়া কিংবা ভরসা পাওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া ইতির কাছে, কে বলতে পারে, এই শিশুতীর্থের মূল্য সত্যি সত্যি কতটা!

ঘুঘুর ডাকে তুষারের মনোযোগ ছিল না। জানলার বাইরে থেকে একটা হলুদ ছিটঅলা পাখি ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। ফর ফর করে উড়ে আবার অন্য জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। তুষারের অন্যমনস্কতা ফিকে হয়ে এল, ঘুঘুর ডাক আবার শুনতে পেল তুষার। দু-এক দমক হাওয়া এসেছে। বাইরের রোদ এত ঘন যেন আলোর সর পড়ে জমে আছে।

ছেলে-মেয়েদের দিকে চোখ বুলিয়ে তুষার জানলার বাইরে তাকাল। মনে পড়ল, সাহেবদাদুর সঙ্গে দেখা করতে গেলে উনি আদিত্যবাবুর কথা জিজ্ঞেস করবেন। আশাদি বলেছে। সাহেবদাদু জিজ্ঞেস করলে তুষার যে কী জবাব দেবে বুঝতে পারল না।

এত লোক থাকতে তুষারকেই বা কেন যে আদিত্যবাবুর সম্পর্কে প্রশ্ন করার যোগ্য পাত্র মনে হল এও এক অদ্ভুত ব্যাপার। খুব সম্ভব আশাদি বিদঘুঁটে ব্যাপারটা তার ঘাড়ে চাপিয়ে নিস্তার পেয়েছে।

তুষার কিছু জানে না। সামান্য অসহিষ্ণু হয়ে বিরক্ত হয়েই তুষার মনে মনে বলল, আমি কিছু জানি না। আদিত্যবাবু এখানে কী করছেন, কেমন দেখছেন শিশুতীর্থ, কী বলছেন–আমি জানতে চাই না, জানি না।

ব্যাপারটা অস্বস্তিকর বলেই তুষার তার দায় এড়াতে আদিত্য সম্পর্কে নিস্পৃহ থাকতে চাইল। কিন্তু পারল না। কারণ এখানে–এই শিশুতীর্থে তুষার ছাড়া অন্য কেউ আদিত্যর ওপর প্রসন্ন নয়। আশাদি খুবই বিরক্ত, মুখে কিছু বলেন না। জ্যোতিবাবু হয়তো বিরক্ত নন, কিন্তু আদিত্য তাঁকে এড়িয়ে চলে। মলিনা আর প্রফুল্লবাবুকে আদিত্য গ্রাহ্য করে না।

ভদ্রলোক এখানে কেন এসেছেন তুষার বুঝতে পারে না। অযথা সময় নষ্ট করছেন এখানে বসে। শিশুতীর্থ তাঁকে কিছু শেখাচ্ছে না, বা তিনি এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর খোরাক কিছুই জোগাড় করতে পারছেন না। তবু বসে আছেন। বসে বসে নিজের এবং অন্যদের সহিষ্ণুতার মাত্রা নষ্ট করছেন।

সংসারে কত রকমের অদ্ভুত মানুষই না থাকে, আদিত্য সেই রকম। সত্যিই মানুষটা বিচিত্র, তুষার এই রকম লোক দেখেনি। যার উচিত ছিল পুলিশের কোনও চাকরি নেওয়া সে এসেছে শিশুশিক্ষার তদারকি করতে। স্বভাবে চরিত্রে মনে এই মানুষ শিশুরাজ্যে, শিক্ষার রাজ্যে একেবারে বেমানান। দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ বলে কথা আছে একটা–যদি প্রহ্লাদকুলে দৈত্য বলে কিছু থাকত তবে আদিত্যকে সেখানে বসানো চলত। ফুলের বনে মত্তহস্তী। ও কেন এল? সংসারে ওর কি অন্য জায়গা ছিল না?

আদিত্য নিজেই বলে, আমি মিসফিট। এসব শিশুশিক্ষা-টিক্ষায় আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।

নেই?

একেবারেই না। আদিত্য বিতৃষ্ণার সঙ্গে মাথা নেড়েছিল।

আশ্চর্য! তুষার বলেছিল।

আশ্চর্যের কিছু না। এই রকমই হয়ে থাকে।

যে যা পছন্দ করে না তাকে তাই হতে হয়?

হ্যাঁ। আজকাল জগৎ অন্য রকম হয়ে গেছে। যার পাকা চোর হওয়া উচিত সে সাধু হয়।

কথা শুনে তুষার হেসে ফেলেছিল। এই রকমই কথা বলে লোকটা। কী বলছে ভেবে দেখে না।

আপনি তো শিশুশিক্ষার বিষয় নিয়ে চর্চা করেছেন শুনেছি। তুষার বোঝাবার মতন গলা করে বলেছিল একদিন।

না, মোটেই না।

সে কি! আমরা যে শুনেছিলাম–

শোনানোর মতন পরিচয় আমার ছিল বলে শুনেছেন। তবে সেটা মিথ্যে পরিচয়। পেটের জন্যে রাখতে হয়েছে।

মানে?

জীবিকা। আমায় মাস গেলে চাইল্ড এডুকেশন সোসাইটি অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার থেকে তিনশো টাকা মাইনে দেয়।

তুষার বিন্দুমাত্র খুশি হয়নি কথা শুনে। একটু রূঢ় ভাবেই বলেছিল, তা হলে আপনি ওদের ঠকাচ্ছেন?

একরকম তাই। ঠকানো ছাড়া উপায় কী। আমরা সব সময় হয় নিজেকে না হয় অন্যকে ঠকাই।

হ্যাঁ, যদি ঠগ হই। তুষার ক্ষুব্ধ স্বরে বলেছিল।

আদিত্য গ্রাহ্য করেনি; হেসেছিল।

এই পরিচয় ওর। শিশুশিক্ষা, শিশুর মন, শিক্ষার তত্ত্ব কোনও কিছুর প্রতিই আদিত্যর আকর্ষণ নেই, অথচ এই লোক, তুষার জেনেছে, এই লোকই মনস্তত্ত্বের ডিগ্রি নিয়েছে, শিশুশিক্ষার ডিপ্লোমা পেয়েছে, সরকারি পয়সায় দেড় দুবছর বিদেশ ঘুরে এসেছে শিশুশিক্ষা পদ্ধতির নতুন রীতি-নীতিতে শিক্ষিত হয়ে আসতে। এখানে এসে বাঁধা চাকরি পেয়েছে, চাকরির শর্ত অনুযায়ী নানা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে অভিজ্ঞতা ও গবেষণা করছে।

তুষারের ঘৃণা হয়েছিল। আদিত্যকে সে ঘৃণাই করেছিল তখন। লোকটা শুধু অযোগ্য নয়, প্রবঞ্চকও।

তবু এই মানুষই তুষারকে কেমন একটা সৌজন্যমূলক দুর্বলতার মধ্যে ফেলেছে। যদি সাহেবদাদু ওর কথা জিজ্ঞেস করেন তুষার কি বলতে পারবে, এখানে ওঁকে থাকতে দেওয়া নিরর্থক। শিশুতীর্থের আদর্শ ও শান্তির পক্ষে ভদ্রলোক বিঘ্ন।

তুষার ভেবে দেখল, সে কিছু বলবে না। আদিত্যবাবুর বিপক্ষে নয়, স্বপক্ষেও নয়। বিপক্ষে বলা ভাল দেখায় না, কারণ মানুষটা এখানের অতিথি, মাসখানেকের বেশি হল এসেছে, আরও হয়তো মাসখানেক থেকে চলে যাবে। ওর সঙ্গে শিশুতীর্থের যখন কোনও যোগাযোগ নেই, তখন কেন অনর্থক একজনের অপযশ গাওয়া।

আদিত্যর প্রতি তুষার করুণাই অনুভব করল। নিতান্ত চাকরির জন্যে যে লোক শিশু কল্যাণের ব্রত নিয়েছে তার সম্পর্কে তুষারের কিছু বলার নেই। আদিত্যকে অত্যন্ত দীন এবং হীন বলে মনে হচ্ছিল তুষারের।

শানুর অঙ্ক হয়ে গেছে। শানু তুষারকে ডাকল দিদি।

তুষারের চমক ভাঙল। চমক ভাঙার পরই তুষার অনুভব করতে পারল তার কপাল গলা ঘাড় ঘামে ভিজে উঠেছে।

২. বিকেলের শেষ মলিন-আলোয়

০৬.

সেদিন বিকেলের শেষ মলিন-আলোয় তুষার অবাক হয়ে দেখল আদিত্য তার বাড়ির গেটের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

আপনি? তুষার বাগানে জল দিয়ে ঝারি হাতে দাঁড়িয়েছিল। শুকনো মাটিতে সদ্য জল পড়ে সোঁদা গন্ধ উঠছে। পাশে কয়েকটা কলকে ফুল বাতাসে দুলছিল।

গেটের মধ্যে সাইকেল ঢুকিয়ে আদিত্য বাগানের সদরে পা দিল। খোঁজ নিতে এলামআদিত্য বলল অক্লেশে। গেটটা বন্ধ করল না।

তুষার মাটিতে ঝারি নামিয়ে রাখল। তার পরনে সাদামাটা শাড়ি, গায়ের জামাটা বাসন্তী রঙের। এখনও চুল বাঁধেনি তুষার। পিঠময় চুল ছড়িয়ে আছে।

আসুন। তুষার নিজেকে সামলে নিয়ে বলল। সে বুঝতে পারছিল না, খোঁজ নিতে এলাম কথাটার অর্থ কী।

আদিত্য সাইকেল ঠেলে সিঁড়ির কাছে এগিয়ে গেল। তার ভঙ্গিতে কোনও আড়ষ্টতা নেই। যেন এইভাবে সে রোজই এখানে আসে।

গেটটা তুষার বন্ধ করে দিল। বিকেলের আলো আর নেই। শুন্যের রং ময়লা। গাছের মাথায় পাখিরা কলরব করছে। গেট বন্ধ করে ফেরার সময় শিউলি ফুলের ঈষৎ গন্ধ পেল তুষার।

সাইকেলটা একপাশে ফেলে রেখে সিঁড়ির ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আদিত্য সিগারেট খাচ্ছে। এই মাত্র ধরিয়েছে। তুষার লক্ষ করল, আদিত্য আজ প্যান্ট আর হাতকাটা শার্ট পরে এসেছে। এই পোশাকটা সেদিনও পরে এসেছিল আদিত্য যেদিন শহরে আচমকা দেখা হয়ে গেল তুষারের সঙ্গে। তুষার বাজারের দিকে মণিদির বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছিল–ফেরার পথে আদিত্যকে বান্ধব চা কেবিনের পাশে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল। তুষার একটু অবাক হয়েছিল। পরিচিত লোককে পথে দেখলে মানুষ হন হন করে চলে যেতে পারে না। তুষারও পারেনি। আদিত্য সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল।

আদিত্য তার শহরে আসার কৈফিয়ত দিতে চায়নি। কিন্তু কথায় কথায় বলেছিল, কিছু জিনিসপত্র কিনতে সে শহরে এসেছে। তুষার পথে-ঘাটে বাজারে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, আর এই সদর বাজারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা তার স্বভাবের বাইরে। তুষার হাঁটতে আদিত্যও পাশে পাশে আসতে লাগল। কথা বলছিল অনর্গল। তুষার একান্ত সৌজন্যবশেই সেদিন ওকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছিল। আমন্ত্রণ না জানালে ব্যাপারটা খুবই দৃষ্টিকটু হত।

আজ আবার আদিত্য এসেছে। নিজেই।

তুষার সিঁড়ির কাছে আসতে আসতে গায়ের আঁচল আরও সামান্য ঘন করে জড়িয়ে নিল।

বাজারে এসেছিলেন? তুষার মুখ তুলে ভদ্র আলাপে বলল।

না। আদিত্য মাথা নাড়ল। আঙুল দিয়ে সিগারেটের মুখের ছাই পরিষ্কার করল। এক বিন্দু রক্তের মতন আগুনের ঢিপ জ্বলতে লাগল।

সিঁড়িতে পা দিল তুষার। দুধাপ উঠে কী ভেবে একটু দাঁড়াল, সাইকেলটা দেখল। জ্যোতিবাবুর সাইকেল? কথাটা এমন স্বরে বলল তুষার যেন মনে হয়, পরের সাইকেল আরও একটু যত্ন করে রাখতে হয়।

আদিত্য বোধ হয় কথাটা শুনল না। শুনলেও কিছু বুঝল না। বলল, আপনি গাছে জল দেন?

প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে না পেরে তুষার তাকাল চোখ তুলে। আদিত্যর মুখে হাসি, হাসিটা পরিহাসের না উপহাসের বোঝা মুশকিল।

তুষার ভাবল এক মুহূর্ত। বলল, ছুটির দিন ছাড়া বড় একটা সময় হয় না। এই দুদিন সামান্য যত্ন করি।

এবার একটা তপোবন করে ফেলুন। আদিত্য উপহাসের হাসি হাসল।

তুষার কিছু বুঝল না, অথচ আড়ষ্ট বোধ করল হাসির শব্দে।

বৃক্ষলতা, হরিণ শাবক…, আপনি তো প্রায় শকুন্তলা হয়ে উঠেছেন। আদিত্য হাসছিল, হাসতে হাসতে সিগারেটটা ছুঁড়ে দিল বাগানে।

তুষার বুঝল। বুঝে কেমন লজ্জা পেল। বলল, হরিণ কোথায় দেখলেন?

দেখিনি। কিন্তু চতুষ্পদ জন্তু ছাড়াও তো জন্তু আছে, তাদেরও শাবক থাকে। আপনার দ্বিপদ শাবক তো কয়েক গণ্ডা।

তুষার রাগ করল না। আদিত্যর কথা বলার ধরন সে জানে। এমন নয়, সব কথা আদিত্য বুঝে বলে, বিবেচনা করে বলে। ঠোঁটের গোড়ায় কথাকে ও-মানুষটা লাগাম পরাতে পারে না।

আপনি গাছপালাও পছন্দ করেন না? তুষার স্নিগ্ধ স্বরে বলল।

না।

ওরা তো জন্তু নয়। তুষার জন্তু শব্দটার ওপর জোর দিল। আদিত্য শিশুতীর্থের ছেলেমেয়েদের জন্তু বলে গণ্য করে।

জন্তুর সমান। আদিত্য জবাব দিল।

তুষার বারান্দায় উঠে এসেছিল। এক পাশে বেতের একটা চেয়ার সব সময় পড়ে থাকে বারান্দায়। আজ চেয়ারটা ছিল না। মেরামত করার জন্যে শিশির পাঠিয়ে দিয়েছে। ইতস্তত করে তুষার বলল, বসার কিছু এনে দি, আপনি বসুন।

আদিত্য বাধা দিল সঙ্গে সঙ্গে। বসার কিছু দরকার নেই আমার। আমি বেশ দাঁড়িয়ে আছি। দাঁড়াতে আমার কষ্ট হয় না।

তুষার কান দিল না কথায়। ভেতরে চলে গেল চেয়ার আনতে।

সামান্য পরেই ফিরে এল তুষার। কাঠের চেয়ার বয়ে এনে রাখল। আদিত্য পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাড় মুখ মুছছিল।

আমি সিঁড়ির ওপর বসতে পারতাম। আদিত্য বলল।

সিঁড়ির ওপর বসবেন কেন ময়লায়। চেয়ার দেখাল ইঙ্গিতে তুষার, বসুন।

আপনি?

আমি দাঁড়িয়ে আছি। আপনি বসুন।

উঁহু-আপনিই বসুন, আমি এই সিঁড়িতে বসছি।

না, না–সে কি! ছি! তুষার বিব্রত কণ্ঠে বলল।

আদিত্য হাসল। পদপ্রান্তে বসাই কি ভাল না?

তুষার কথাটা শুনতে না শুনতেই ফুরিয়ে গেল। যেন লহমার জন্যে একটি শিখা তাকে স্পর্শ করে অদৃশ্য হল। বিমূঢ় বোধ করল তুষার। অর্থটা বুঝল কি বুঝল না স্পষ্ট করে, কেমন শিহরিত ও সঙ্কুচিত হল। নতচোখে বারান্দার অন্ধকার দেখছিল।

আদিত্য কথা বলল। আমায় বসতে দিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে থাকলে আতিথ্য পালন করা হয় বটে, কিন্তু উদ্দেশ্যটাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

উদ্দেশ্য?

হ্যাঁ। অর্থাৎ অতিথিকে বিদায় করতে চান বলেই একতরফা ব্যবস্থা।

কই না, আমি তেমন কিছু ভাবিনি। তুষার সবিস্ময় কুণ্ঠায় বলল।

সব কিছু বলতে হয় না। ব্যবহার অনেক কিছু প্রকাশ করে।

আপনি বসুন, আমি একটু কাজ সেরে আসছি।

অপেক্ষা করব?

তুষার জবাব দিল না। পাশের দরজা দিয়ে ঘরে চলে গেল।

ঘরে এসে তুষার হাঁপ ছাড়তে পারল। এ-রকম মানুষ সে আর দেখেনি। সন্দেহ হয়, লোকটা সভ্য সমাজে মিশেছে কি না। অভদ্র… তুষার কথাটা বলতে গিয়েও পারল না, আটকাল। কেন আটকাল? সৌজন্য জ্ঞানহীন ওই অদ্ভুত মানুষটাকে আর কী বলা যায়? অসভ্য, ইতর..?

না। তুষার বিরক্ত হয়েছে বলেই একজনকে অত সহজে অভদ্র বা ইতর বলতে পারে না। তুষারের স্বভাবই সে-রকম নয়। সে কখনও জোরে, রাগ করে কিংবা জ্ঞান হারিয়ে কিছু করে না, করতে পারে না। আদিত্যর কথাবার্তা আচরণে অস্বস্তি এবং সঙ্কোচ বোধ করেছিল তুষার, কিন্তু রাগ করেনি।

নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে তুষার টেবিলের বাতিটা দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে দিল। ঘরগুলো অন্ধকার হয়ে গেছে। বাইরে উঠোন ও দালানে সন্ধ্যা নেমে গেছে। গঙ্গাকে দেখতে পাচ্ছে না তুষার। গঙ্গা কি এখনও কুয়াতলায়?

শিশিরের ঘরে কোনও সাড়াশব্দ নেই। তুষার বাইরে বারান্দায় এসে নিচু গলায় গঙ্গাকে ডাকল– গঙ্গা, এই গঙ্গা। দালানের ওদিকে পিছন কুয়াতলায় গঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে।

ডাক শুনে গঙ্গা তাকাল, হন হন করে এগিয়ে এল।

বাতি জ্বালবি না? তুষার বলল।

জ্বালব। গঙ্গা মাথা নাড়ল।

আর কখন জ্বালবি? রাত হয়ে গেলে?

গঙ্গা উঠোন বারান্দা ঘরের দিকে তাকিয়ে যেন অন্ধকার পরীক্ষা করে নিল। যেন দেখে নিল, এই অন্ধকার বাতি জ্বালার উপযুক্ত অন্ধকার কি না। তারপর বাতি জ্বালতে চলে গেল।

শিশির অন্ধকারে শুয়ে ছিল। সে এই ভাবে শুয়ে থাকে। সে বিকলাঙ্গ। পায়ের দিকটা আজও চেয়ারের পায়ার মতন সরু, বেঁকানো বেতের মতন বেঁকা। ছেলেবেলায় পোলিও হয়েছিল। চিকিৎসা করেছিলেন বাবা সাধ্য মতন, দুবার অপারেশন করা হয়েছিল, দেড় বছর ছিল হাসপাতালে কিছু হয়নি। ডাক্তারে বলেছিল আরও সাতবার অপারেশন করতে হবে। বাবা রাজি হননি। প্রাণটা তবু তো আছে ছেলেটার, সেটুকুই থাক।

এই বাড়ি, সামান্য কিছু জমিজমা–সবই বাবা ছেলের মুখ চেয়ে করেছিলেন। তুষারের জন্যে তাঁর ভাবনা ছিল না। তিনি জানতেন, মেয়ে তাঁর জীবনের ঢেউয়ের তলায় ডুবে যাবে না, প্রয়োজন হলে একটা ব্যবস্থা সে করে নিতে পারবে। কিন্তু শিশির…?

শিশিরের কথা ভেবেই যা কিছু ব্যবস্থা, কিন্তু তুষার সেই ব্যবস্থার শরিক তো নিশ্চয়, এমনকী এর দায়-দায়িত্বও তুষারের ঘাড়ে চাপানো। তুষার না থাকলে বাবা বোধ হয় পাগল হয়ে যেতেন।

ভাইয়ের ঘরে ঢুকে তুষার অন্ধকারে বিছানার দিকে তাকাল। জানলার কাছে বিছানা। বালিশ সাজিয়ে শিশির নিত্য দিনের মতন বসে আছে।

শিশির

উঁ—

সন্ধে হয়ে গেল রে! দাঁড়া বাতি জ্বালি। তুষার অন্ধকারে ঘরের মধ্যে দেশলাই খুঁজতে লাগল।

কে এল রে দিদি, তখন?

সেই ভদ্রলোক। তুষার কেন যেন বিব্রত বোধ করল সামান্য।

শিশির সাইকেলের শব্দ শুনতে পেয়েছিল। এখান থেকে তাকালে বাইরের বাগান রাস্তা দেখা যায় বটে, কিন্তু গেটের দিকটা ঠিক মতন চোখে পড়ে না। সাইকেলের শব্দে শিশির গেটের দিকে তাকিয়ে আগন্তুককে দেখতে পায়নি। গঙ্গা বাতি দুলিয়ে আসতেই তুষারের খেয়াল হল, সে বোকার মতন দেশলাই খুঁজছিল। এ-ঘরের বাতিটা পরিষ্কার করার জন্যে গঙ্গা বিকেলেই বাইরে নিয়ে গিয়েছিল।

তুষার বাতি নিল গঙ্গার হাত থেকে। সব ঘরে বাতি দিয়েছিস?

মাথা নাড়ল গঙ্গা, দিয়েছে।

একটু জল ছিটিয়ে দে লক্ষ্মী, চৌকাটে। তুষার বলল, বলেই আবার যোগ করল, তোর উনুন ধরিয়েছিস?

চুলায় অনেক আগ৷ গঙ্গা জবাব জিল। গঙ্গা হিন্দুস্থানি ঝি–এদেশের লোক, অনেক কাল এ বাড়িতে কাজ করছে, বাংলা বলে হিন্দি মিশিয়ে মিশিয়ে।

মুহূর্তের জন্যে ভাবল তুষার। আদিত্যকে চা দিতে হয়। আতিথ্য। চায়ের সঙ্গে আর কী দেবে? কুচো নিমকি না পাঁপড় ভাজা? ডিম ভেজে দিলে কেমন হয়? ঘরে অন্য কিছু আছে বলে মনে হল না।

ডিম আছে রে? তুষার শুধোল গঙ্গাকে।

আছে। গঙ্গা মাথা দুলিয়ে জানাল, আছে। তুষার চায়ের জল চড়াতে বলল। তুই বাইরে একটা বাতি দিয়ে চায়ের জল চাপিয়ে দে, আমি আসছি।

গঙ্গা চলে গেল। তুষার ভাইয়ের দিকে তাকাল।

সদ্য আলো পেয়ে অন্ধকার ঝাপসা ঘরটা অনেকখানি দৃশ্যময় হয়ে উঠেছে। শিশিরের বিছানার পায়ের দিকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শিশিরকেও দেখা যাচ্ছিল। তুষার ভাইয়ের বিছানার কাছে সরে এল। শিশিরের মুখ চোখ বিশেষ করে চোখ দুটি বড় সুন্দর দেখতে। ভাই-বোনের মুখের আদলে মিল আছে। তবে তুষার আরও ফরসা, আরও লাবণ্যময়। শিশিরের চোখ তুষারের চেয়ে সুন্দর। কেন সুন্দর বলা মুশকিল। হয়তো ঘন কালির মতন কালো পুরু জোড়া ভুরুর জন্যে চোখ দুটি অমন সুন্দর দেখায়, হয়তো শিশিরের চোখের দৃষ্টিতে যে অসহায় বেদনা মেঘলার মতন মাখানো–তার জন্যেই করুণাবশত ওর চোখ অনেক সুন্দর মনে হয়।

আজ একটুও বাইরে বসলি না রে? তুষার ভাইয়ের বিছানার পাশ ঘেঁষে এসে বসল।

শিশির কোনও জবাব দিল না কথার। বালিশের পাশে একটা বই উপুড় করা ছিল। শিশির বইটা । মুড়ে রাখল। আমাকেও আর এক পেয়ালা চা দিস, দিদি।

দেব। আর কী খাবি?

কিছু করবি তুই?

যা খেতে চাস বল, করব।

কর যা হয় একটা। শিশির হাই তুলল। ভদ্রলোককে বাইরে বসিয়ে রেখে তুই দিব্যি ঘরে ঢুকে পড়লি। শিশির কৌতুকের মুখে হাসল।

তুষার গলার হারের আংটটা নখ দিয়ে টিপছিল। চোখ তুলে তাকাল। বলল, কী বিপদে পড়লাম দেখ তো। এখনও আমার চুলটা পর্যন্ত বাঁধা হয়নি, সন্ধে উতরে গেল। বাইরে লোক এসে বসে।

তুই রাত বারোটায় যদি চুল বাঁধিস, লোকের কী দোষ!

তুষার পিঠের পাশ থেকে এলো চুল মুঠো করে সামনে টেনে নিল। আজ একটা নাগাদ মাথা ঘষেছি, চুলই শুকোয় না।

নিয়ে আয় তোর ফিতে চিরুনি–আমি বেঁধে দিচ্ছি। শিশির হাসিমুখে বলল।

থাক। তুষার ডান হাত তুলে ক্ষান্ত করার ভঙ্গি করল।

থাক কেন, দে, আমি বেঁধে দি।

মাথা নাড়ল তুষার। না। তুই এখনও গোড়া বাঁধতে পারিস না। এমন শক্ত করে দিস যে মাথা ধরে যায়।

তুষার কথা বলতে বলতে ঘরের ডান দিকের পরদা সরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। পাশের ঘরে পায়ের শব্দ শোনা যেতে লাগল।

শিশির দিদির চলাফেরার শব্দ শুনছিল। সে মাঝে মাঝে দিদির চুল বেঁধে দেয়। এই তাদের ভাই-বোনের এক অদ্ভুত প্রীতি-সান্নিধ্য। কেমন করে যেন ছেলেবেলা থেকেই শিশিরের দিদির চুলের ওপর ঝোঁক। ছেলেবেলায় এই চুল সে দু হাতে মুঠো করে ধরে ছিড়ত, বয়স বাড়লে পছন্দটা কেমন পালটে গেল। এক সময় যা রাগ করে ছিড়ত, পরে তা ভালবেসে বেঁধে দেয়। তুষারের কাছ থেকে কত কষ্ট করে তবে এই চুল বাঁধা শিখতে হয়েছে।

তুষার নিজের ঘর থেকে চিরুনি আর কাঁটা নিয়ে এসেছে। ভাইয়ের বিছানায় বসল। বলল, আজ আর চুল বাঁধব না, এলোখোঁপা করে জড়িয়ে নি। বলে দ্রুত হাতে চুল আঁচড়াতে লাগল।

শিশির দিদিকে দেখছিল। কেরাসিনের আলোয় দিদিকে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। কী ভাবছে দিদি? বাইরে লোক বসিয়ে রেখে এসেছে বলে অস্বস্তি বোধ করছে?

দিদি, ভদ্রলোককে তুই ঘরে এনে বসাতে পারতিস।

ঘরে এনে?

বাইরে একা বসে থেকে চলে না যায়।

তাই বলে ঘরে এনে বসাব। যাঃ।

শিশির বুঝল না যাঃ কেন। তার বন্ধুরা সকাল বিকেল কি তার ঘরে এসে বসে না? অন্য লোকজন এলেও তো কত সময় ঘরে এসে বসে। বাইরে চুপচাপ একটা লোককে বসিয়ে রাখার চেয়ে ঘরে এনে বসালে ভাল দেখায় বইকি।

তোর যে কী জ্ঞানবুদ্ধি বাড়ছে, দিদি-কে জানে। শিশির অভিভাবকের গলায় বলল।

থাম। তুষার হাসিমুখে ভাইকে ধমকে দিল, আমার বুদ্ধি বাড়ছে না, বাড়ছে তোর। তাও যদি না চার বছরের ছোট হতিস।

শিশির হাত তুলে হতাশার ভঙ্গি করল। এবং খুব গম্ভীর গলায় বলল, দিন দিন তোর হিসেব বেড়েই যাচ্ছে। আগে বলতিস আড়াই তিন বছরের বড়, তারপর সাড়ে তিন বলতে লাগলি, এখন চারে দাঁড়িয়েছে। …যেন তোর বয়সটা এগিয়ে যাচ্ছে, আমারটা পিছিয়ে যাচ্ছে।

তুষার প্রায় চঞ্চল হাঁসের মতন হঠাৎ হাসির দমকে ভাইয়ের কোলের কাছে বালিশে ঝাঁপিয়ে এসে লুটিয়ে পড়ল। খিল খিল হাসি তুষারের নরম চিকণ গলায় তরঙ্গ তুলে ঘরে আবহাওয়াকে কেমন অবিচ্ছিন্ন গাঢ় সুখী ও তৃপ্ত করে তুলল।

শিশিরও হাসছিল।

.

আদিত্য বাইরে ছটফট করছিল। ধৈর্য ধরে জগন্নাথের মতন এক জায়গায় বসে থাকা তার স্বভাবে নেই। গোটাকয়েক সিগারেট টানল, বাগানে পায়চারি করল খানিক, কয়েকবার সাইকেলের ঘন্টি বাজিয়ে যেন ভেতরে তার অধৈর্যের সংবাদ পাঠাল, শেষে প্রায় চিৎকার করে ডাকতেই যাচ্ছিল তুষারকে–এমন সময় তুষার এল।

শাড়ি পালটায়নি তুষার, তেমনি ভাবেই ঘরোয়া করে পরা, জামাও বদলায়নি; চুলই যা এলো খোঁপা। করে বেঁধে নিয়েছে। তুষারের হাতে ডিম ভাজা আর চা।

আদিত্য খুব রেগেছিল। বলল, চমৎকার ব্যবহার আপনার।

তুষার ডিমের প্লেট এগিয়ে দিল। ধরুন।

ফেলে দিন। আদিত্য বুকের কাছে দুহাত গুটিয়ে নিল।

ফেলে দেব–তুষার চোখের পাতা কৌতুকে বড় করল, আদিত্যের ছেলেমানুষি রাগ দেখে তার মজা লাগছিল। নিন।

আমি খেতে আসিনি। আদিত্যের আত্মসম্মান আহত হয়েছে, যেন সে তারই প্রতিশোধ নিচ্ছে এমন এক গলা করে জবাব দিল।

তুষার অনুভব করতে পারছিল, ভদ্রতা এবং সৌজন্যের দিক থেকে তার ব্যবহার কিছুটা দৃষ্টিকটু .. হয়েছে। এতটা দেরি তুষার না করলেও পারত। রান্নাঘরে বসে চা খাবার করার সময়ও তুষারের মনে হয়েছে সে যেন একটু বাড়াবাড়ি করছে। আদিত্যকে এভাবে অপেক্ষা করানো অনুচিত, ভদ্রতা বিরুদ্ধ। আদিত্য আহত হতে পারে। অথচ তুষার কেমন জোর করে এই অনুচিত বোধকে তরল করে দেখছিল। …আদিত্যর আহত স্বরে তুষার সামান্য অনুশোচনা বোধ করল। মানুষ যেমন সাধারণ ছোটখাটো কোনও অন্যায় করে ফেললে ব্যাপারটা মুছে ফেলতে চায়, তুষার সেইভাবে মালিন্য মুছে ফেলার চেষ্টা করল। সলজ্জ সঙ্কুচিত হাসি এবং ত্রুটি স্বীকারের মুখ করে বলল, বা, আমি রান্নাঘরে বসে বসে করে আনলাম…। চা না দিলে আপনিই কি খুব খুশি হতেন—

আদিত্য তাকিয়ে থাকল কয়েক পলক। হাত বাড়াল বলল, আমি বোধহয় টাটকা তোলা পাতার চা খাচ্ছি।

খোঁচাটা তুষার হাসিমুখেই সহ্য করল।

আদিত্য যে রাগ করেছিল বা অপমানিত বোধ করছিল কয়েক মুহূর্ত পরে আর তা বোঝার উপায় থাকল না। ও এমন করে খেতে লাগল যেন কত ক্ষুধার্ত, মুখের এমন ভঙ্গি করে খাচ্ছিল যেন কী উপাদেয় বস্তু খাচ্ছে। তুষার আড়চোখে লক্ষ করছিল। মজা লাগছিল, হাসি পাচ্ছিল, আবার ভালও লাগছিল।

আপনার চা?

আনি।

হ্যাঁ, আনুন। আদিত্য বলল, আসবার সময় এক গ্লাস জল নিয়ে আসবেন।

তুষার চলে যাচ্ছিল। আদিত্য মনে করিয়ে দিল, দেখবেন আবার যেন বাতাস হয়ে যাবেন না। আমি তা হলে ঘন্টি বাজাতে শুরু করব।

হেসে ফেলেছিল তুষার। চলে গেল।

.

ক্রমে রাত হয়েছে। বাইরের ঘেরা ছোট বারান্দায় একপাশে টিমটিমে লণ্ঠনটা জ্বলছে। এ আলোয় অন্ধকারকে চেনানো যায়। বাগানে শিউলি ফুলের গন্ধ এসেছে, বাতাসে আচমকা একবার সেই গন্ধ ভেসে আসছে। আদিত্য চেয়ারে বসে। তুষার বেতের মোড়ায়। চায়ের কাপ ডিমের প্লেট অন্ধকারে একপাশে পড়ে আছে কখন থেকে। ওরা কথা বলতে বলতে এক সময় হঠাৎ দুজনেই চুপ করে গেছে কখন। অনেকক্ষণ নীরবে কেটে যাবার পর আদিত্য পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল।

এই ভেড়ার পাল চরিয়ে আপনি কী সুখ পান আমি জানি না। তামাকের ধোঁয়া ছেড়ে আদিত্য বলল।

সকলের সুখ এক রকম নয়। তুষার জবাব দিল।

হ্যাঁ– আদিত্য সামনের দিকে তাকিয়ে যেন স্বগতোক্তির মতন বলল, তা ঠিক। তবে অনেকে নিজের সুখ কীসে তাও জানে না।

ওদের কথাবার্তার ধরন থেকে বোঝা যাচ্ছিল অনেকটা সময় কথা বলতে বলতে ওরা দুজনেই এক ধরনের আলাপী অন্তরঙ্গতা বোধ করছিল। তুষার এখন আড়ষ্ট বা সঙ্কুচিত নয়; স্বল্প পরিচয়ের বা তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলার যে অস্বাচ্ছন্দ্য, আপাতত তুষারের মধ্যে সেই অস্বাচ্ছন্দ্য এত কমে গেছে। যে ওকে সহজ বলেই মনে হয়। আদিত্য যেন সহজ ভাসা ভাসা কথার জগৎ থেকে ক্রমশ কোনও আন্তরিক জগতে প্রবেশ করবার চেষ্টা করছে, পারছে না।

আমি অত বুঝি না। তুষার মন দিয়ে আদিত্যের কথা শুনছিল, মৃদু গলায় জবাব দিল, এই বাচ্চাকাচ্চা আর শিশুতীর্থ নিয়ে আমি তো বেশ সুখেই আছি।

দেখছি তা। আপনার সুখ অন্যের ফরমাসে গড়া।

মানে! তুষার বিস্মিত হল।

অন্যে বলে এতে সুখ আছে, আপনিও সে কথা বিশ্বাস করেন।

না, আমায় কেউ বলেনি। আমি নিজেই বেছে নিয়েছি।

আদর্শ?

জানি না।

ডেডিকেশান। ..য়ুরোপে অনেক ক্রিশ্চান মেয়ে এইভাবে নিজেদের সমর্পণ করে ধর্মের কাছে। নান। আপনি জানেন?

শুনেছি।

আমাদের দেশে রামকৃষ্ণ আশ্রমের সাধুরা আছে, সন্ন্যাসিনীরাও।

ভালই তো।

কে বললে ভাল? অন্ধকারেও আদিত্যকে অসহিষ্ণু উগ্র দেখাল। এরা নিজেদের ঠকায়। বঞ্চনা করে।

তা কেন। আপনি আপনার দিক থেকে ভাবছেন বলেই ও-রকম মনে হচ্ছে। তুষার আস্তে আস্তে নরম গলায় বলল, ভাল না লাগলে, সুখ-শান্তি না পেলে মানুষ কেন নিজেকে সেখানে জড়িয়ে রাখবে।

আদিত্য সিগারেটের মুখের ফুলকি জোর করল, ধোঁয়া ছাড়ল, বলল, মানুষের স্বভাব নিজেকে ঠকানো৷

কেন? লাভ কী ঠকিয়ে?

বড় রকম লোকসানের দুঃখ থেকে সান্ত্বনা পাওয়া। আদিত্য যেন অন্তর থেকে নিজের বিশ্বাসের কথা বলছিল। আপনি বাচ্চাদের মন হাতড়াতে মশগুল, যাদের বাচ্চা সেই মা-বাপের–মানে মানুষের মন নিয়ে ভেবেছেন, কখনও। জানা উচিত, এলিমেন্টারি স্কুলের আগে এলিমেন্টাল ম্যানের কথা জানা দরকার।

পরে জানব। তুষার অন্যমনস্ক গলায় বলল।

কেন, পরে কেন? এখন জানতে দোষ কী? আদিত্য যেন তুষারকে তার তর্কের বা যুক্তির নাগালে পেয়ে গেছে এমন নিঃসন্দেহ গলায় বলল, খুব সোজা একটা কথা ভেবে দেখুন না, যারা কোনও না কোনও কারণে দুঃখী, অসুখী, অতৃপ্ত, তারাই আশ্রমে ঢোকে, মন্ত্র নেয়, বৈরাগ্য ধরে।

তুষার কথা বলল না। তার হঠাৎ প্রতিভাদির কথা মনে হল। প্রতিভাদি বিয়ের বছরখানেকের মধ্যে বিধবা হয়েছিল। পরে কোথায় যেন দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসিনী হয়ে যায়। তুষার ছেলেবেলায় প্রতিভাদিকে দেখেছিল, তার কথা শুনেছিল। আজ আর তার মুখ মনে পড়ে না।

আমি যা বলছি এর মধ্যে কোনও ভেজাল নেই। আদিত্য বলল, বিছানা যাদের জোটে না, তারা মাদুরের ওপর শুয়ে ভাবে সাত্ত্বিক ধর্ম পালন করলাম।

ভাল লাগছিল না তুষারের। আদিত্যর কথায় সে চঞ্চলতা বা দুর্বলতা অনুভব করছিল এমন নয়, কিন্তু এই আলোচনা তার খুব পছন্দ হচ্ছিল না। আদিত্য কেন যে ভাবছে, তুষার সুখী নয়–তাও তুষার বুঝতে পারছিল না। আর সে সুখী কিনা সেটা তার নিজের ব্যাপার, অন্য লোক এসে সেটা বুঝিয়ে দেবে কেন! না, আদিত্যর এই মাথা গলানো কি জবরদস্তির জন্যে সে ঠিক রাগ করতেও পারে না। রাগের মতন কথা তো হচ্ছে না।

যার যা ভাল লাগে তাই করাই ভাল। তুষার ছোট করে তার সাধারণ মতামত বলল। যেন এসব কথা এখানেই শেষ করে দিতে চাইল।

আদিত্য থামল না। তাকে কথায় পেয়েছে, সে ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত। বলল, যার যা ভাল লাগে সে যদি তাই করতে পারবে তবে জগৎটা স্বর্গ হয়ে যেত। আমার রাস্তা পুব দিকে, সংসার আমাকে পশ্চিমের পথে ঠেলে দিল। এই সংসারের এটাই মজা।

আপনার পক্ষে অবশ্য তাই। তুষার আলগা ভাবে বলল। বলার সময় তার ওই কথাটা মনে হচ্ছিল, এর পথ ছিল অন্য কোথাও, জোর করে শিশুশিক্ষার রাজ্যে ঢুকে পড়েছে।

আমার বেলায় কেন, সকলের বেলাতেই। আদিত্য বলল, আমি প্রকাশ করি–ঠকতে চাই না, সাত্বনাও পেতে চাই না। তবে সব লোক আমার মতন নয়। আমার বাবার মতন লোকও আছে।

বাবার কথায় তুষার তাকাল আদিত্যের দিকে। আদিত্যের রং ঠিক ময়লা নয়, আধ-ফরসা। বেশ লম্বা শক্ত চেহারা। মুখ পুরু। চোখ নাক শক্ত। মাথার চুল কোঁকড়ানো। সুপুরুষ চেহারা হলেও আদিত্যর চোখের দৃষ্টিতে গালের ভাঁজে কেমন একটা চাঞ্চল্য এবং অস্থিরতার ভাব আছে যাতে ওকে এখনও নাবালক মনে হয়। তুষার মৃদু আলো এবং অধিক অন্ধকারে আদিত্যের মুখের দিকে তাকিয়ে ওর অসহিষ্ণুতা অনুভব করতে পারল। আপনার বাবা

জোচ্চোর ছিল। আদিত্য অক্লেশে বলল। শুধু বলল না, মনে হল যেন রাগে ক্ষোভে ক্ষেপে গিয়ে চিৎকার করে উঠল।

চমকে উঠে তুষার অপলক চেয়ে থাকল।

আমার বাবা বড় রকমের জালিয়াত ছিল। ব্যাঙ্কে চাকরি করত। নানা জোচ্চুরি জালিয়াতি করে জেলে গেল হাজত খাটতে। মা আমায় নিয়ে মামার বাড়িতে এসে উঠল। একটা লোকবাবার কোনও বন্ধু–এ লোফার–আমাদের টাকাপত্র দিতে আসত মাঝে মাঝে, বলত বাবা গচ্ছিত রেখে গেছে। একদিন সেই লোফারকে মামা গালাগাল দিল, মাকে ধমকাল। কিছুদিন পরে মা আফিং খেয়ে মারা গেল। আমি তখন তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলে। আন্দাজ করতে পেরেছিলাম কিছুটা। মা অযথা অকারণে আত্মহত্যা করেছিল। সত্যি সত্যিই বাবা চোরাই টাকা কিছু তার বন্ধুর কাছে গচ্ছিত রেখেছিল, লোকটা আমাদের সেই টাকা দিতে আসত, কিন্তু চেহারাটা ছিল লোফারদের মতন। মামার হাতে টাকা দিলে গণ্ডগোলটা হত না। আদিত্য যেন এক নিশ্বাসে এতগুলো কথা বলে হাঁফ ছাড়ল। কয়েক মুহূর্ত পরে আবার বলল, জেল থেকে ফিরে এসে আমার বাবা মার দুঃখে হাউ-মাউ করে কাঁদল। তারপর দেড় বিঘে বেনামি কলকাতার জমি বেচে টাকাটা আশ্রমে দিয়ে সাধু হয়ে গেল। সাধুরাও মরে, আমার বাবা বছরখানেকের মধ্যে পরপারে চলে গেল। আমি যেমন ভিখিরি তেমন ভিখিরি থেকে গেলাম। আমার বাবা স্বভাবে ছিল জোচ্চোর, হঠাৎ যে কেন সাধু হতে গেল বুঝলাম না। আমার মা ছিল অভিমানী অহংকারী, মা অভিমান করে মরল।

তুষার আড়ষ্ট। নিশ্বাসের শব্দ করতেও তার কুণ্ঠা হচ্ছিল। আদিত্যের বাবার চেহারা অন্ধকারে পশুর মতো ছায়া নিয়ে কল্পনায় দেখা দিল, মা-র মূর্তি পাথরের মতন শক্ত হয়ে বাবার পাশে দুলছিল। তুষার ঠোঁট খুলে মুখে নিশ্বাস নিচ্ছিল, বুক ধক ধক করছিল।

নীরব। সমস্ত নীরব। ঘরে শব্দ নেই, বাইরেও না। তুষার ঘামছে। আদিত্য হঠাৎ চেয়ারের হাতলে ঘুষি মেরে বিড় বিড় করে কী বলল, বলে উঠে দাঁড়াল।

তুষার সচেতন হল। আদিত্য সিঁড়ি দিয়ে দুধাপ নেমেছে। সাইকেলটা উঠিয়ে নেবে। তুষার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

আপনার আলো আছে তো? তুষার শুধোল।

না। আদিত্য তাচ্ছিল্যের গলায় বলল।

সে কী! এতটা রাস্তা অন্ধকারে যাবেন কী করে? তুষার উদ্বিগ্ন। দাঁড়ান, আমাদের টর্চটা এনে দি।

তুষার টর্চ আনতে ঘরে গেল তাড়াতাড়ি।

টর্চ খুঁজে ফিরে আসার সময়ই তুষার আদিত্যের গলা পেল। বেল বাজিয়ে গেট খুলে রাস্তায় সাইকেলে উঠতে উঠতে আদিত্য তার মোটা গলায় কী বলল। তুষার বারান্দায়। প্রায় পলকেই অন্ধকারে আদিত্য উধাও। খানিক দূর থেকে তার ভারী গলার ক্ষিপ্ত গান শোনা গেল।

তুষার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

সেদিন আরও ঘণ্টাখানেক পরে পাতলা একটু চাঁদ উঠেছিল।

.

০৭.

আদিত্যের চরিত্র তুষার ক্রমে ক্রমে বুঝে ফেলেছিল। যাদের একগুঁয়েমি, জেদ, নির্লজ্জতা দেখলে ভাবনা হবার কথা, আদিত্য তেমন নয়। তুষার যত তার সংস্পর্শে আসতে লাগল, ততই বুঝতে পারছিল আদিত্যের চরিত্রে দুটি জিনিস প্রবল, উচ্ছ্বাস আর উম্মা। নিজেকে সংযত শালীন করতে আদিত্য শেখেনি; আদিত্যের উচ্ছ্বাস বালকের মতন, সহজে সে উত্তেজিত হয়, অকারণে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। বুদ্ধি আছে আদিত্যের, কিন্তু সেই বুদ্ধি নিজের জন্যে খরচা করা তার স্বভাব নয়। ভীষণ আবেগ তার, আবেগই তাকে যেন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

শিশুতীর্থের কয়েকটা ঘটনা পর পর এমন ঘটতে লাগল যার ফলে আদিত্যের চরিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। বাড়িতেও মাঝে মাঝে হানা দিচ্ছিল আদিত্য। এর মধ্যে শিশুতীর্থের গুটি দুয়েক এবং বাড়ির একটা ঘটনা তুষার কিছুতেই ভুলতে পারবে না।

শিশুতীর্থে একদিন ছুটির বেলায় এক কাণ্ড হয়ে গেল। বাবলু আর কমল কাঠচাঁপার গাছ বেয়ে উঠে নীচের ডালে বসে বসে পা দোলাচ্ছিল। কমল একটু দুষ্টু গোছের ছেলে, নানান ফন্দি তার মাথায়। বাবলুর সঙ্গে খুনসুটি করে ঝগড়া বাঁধিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে দিল ডাল থেকে। বাবলু পড়ে গেল নীচেমুখ থুবড়ে, কমল নির্বিকার বসে থাকল। …তখন ছুটির বেলা, ছেলেমেয়েরা চারপাশে ছুটোছুটি করছে, তুষাররা যে যার নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। হঠাৎ দেখা গেল কোনও আড়াল থেকে আদিত্য বেরিয়ে এসে দ্রুত পায়ে বাবলুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বাবলু উঠে বসেছে ততক্ষণে কিন্তু কাঁদছে। তুষার আর আশাদি এগিয়ে যাচ্ছিল, জ্যোতিবাবুও আসছিলেন তার আগেই আদিত্য পকেট থেকে রুমাল বের করে বাবলুর ডান হাতের কবজির ওপরটা জোর করে বেঁধে ফেলেছে।

জ্যোতিবাবু পাশে, তুষাররা কয়েক পা দূরে। আদিত্য জ্যোতিবাবুকে বলল, একে আস্তে করে তুলে নিয়ে যান, হাতটা সামলে ধরবেন। হাত ভেঙেছে।

হাত ভেঙেছে! জ্যোতিবাবু তাড়াতাড়ি হাঁটু গেড়ে বসে বাবলুকে ধরলেন।

আদিত্য চোখ তুলে গাছের ডালের দিকে তাকাল। কমল বসে আছে। ছেলেটা বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। কী যেন হল আদিত্যের কাঠচাঁপার একটা পলকা ডাল পট করে ভেঙে ফেলল, তারপর প্রায় এক হেঁচকা টানে কমলকে নীচের ডাল থেকে মাটিতে টেনে নামিয়ে পাগলের মতন কয়েক ঘা পিটিয়ে দিল। আরও মারত, তুষাররা হতচকিত হয়ে গিয়েছিল, জ্যোতিবাবুই চিৎকার করে কী যেন বললেন। ততক্ষণে আশাদির সংবিত ফিরেছে। তুষারও যেন বোধ ফিরে পেয়েছে। ওরা বাধা দিল ছুটে এসে। আদিত্যের হাতের পলকা ডাল ভেঙে গিয়েছিল। তার চোখ নিষ্ঠুর পশুর মতন, মুখ কেমন রাগে নীলচে হয়ে গেছে, যেন শরীরের সমস্ত রক্ত মুখে এসে জমে গেছে।

তখনকার মতন সব শান্ত হয়ে গেলেও ব্যাপারটা পরের দিন অন্য দিকে গড়াল। বিকেলে ছুটির পর সাহেবদাদুর কাছে তুষারের ডাক পড়ল। সাহেবদাদুর ঘরে তখন আশাদি, আদিত্য জানলার দিকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে, জ্যোতিবাবু বসে ছিলেন একপাশে, হাতে একটা চিঠি।

তুষার ঘরে ঢুকে দাঁড়াল। সাহেবদাদুর শান্তভাবে তাঁর ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে বসে।

গতকালের কথাটা উঠল। কমলের বাবা চিঠি দিয়েছে সাহেবদাদুকে। জ্যোতিবাবুর হাতে সেই চিঠি।

সাহেবদাদু বললেন, কাজটা কি অন্যায় হয়নি?

না। আদিত্য মাথা নাড়ল।

আশাদি জ্যোতিবাবু এবং তুষার তিনজনেই আদিত্যের দিকে তাকাল।

সাহেবদাদু বললেন শান্ত গলায়, এখানে কারও গায়ে হাত তোলা হয় না। মারধোর খেয়ে যদি ছোট ছেলেরা ভালমন্দ শিখতে পারত তবে আমরা এখানে হাজত তৈরি করতাম, মাস্টারের বদলে কনস্টেবল রাখতাম।

আদিত্য শুনল কথাগুলো। সকলকে এক পলক দেখে নিল তাকিয়ে। বলল, উত্তর চান, না কৈফিয়ত শুনতে চান? আদিত্য ইংরেজিতেই বলেছিল কথাটা।

না, উত্তর। সাহেবদাদু সৌজন্য এবং ভদ্রতা রেখে বললেন, বাংলাতেই।

আদিত্য সাহেবদাদুর দিকে চেয়ে থাকল সামান্য, তারপর জবাব দিল। কিছু কিছু ছেলেমেয়ে আছে তারা অন্যদের নিরীহদের ওপর অত্যাচার করে আনন্দ পায়। যে ছেলেটা কাল গাছ থেকে আর একটাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল সে ওই রকম। আমি নিজে দেখেছি, সে ধাক্কা মেরে বাচ্চাটাকে ফেলে দিচ্ছে।

কমল একটু দুষ্টু স্বভাবের। আশাদি বললেন।

দুষ্টু নয়, বদমাশ স্বভাবের। আদিত্য কঠিন গলায় বলল। আমি লক্ষ করে দেখেছি ও রোজ একে মারে, ওর চোখ খামচায়, অন্যের বইয়ের পাতা ছিঁড়ে দেয়–এমনকী আরও দু একটা কাজ যা করে তা শুনলে আপনাদের গা কাঁটা দেবে।

সকলে চুপ। আবহাওয়া কেমন থমথমে। ..সাহেবদাদুই কথা বললেন মৃদু গলায়, আপনি কি ভাবেন রাগ করে মেরে ধরে ওকে শোধরানো যাবে?

আদিত্য অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ সে জানলা থেকে সরে এসে সাহেবদাদুর পায়ের তলায় বসে পড়ল। বলল, শিশুতীর্থের যে সব পদ্ধতি তাতেও ওই ছেলে বিন্দুমাত্র শোধরায়নি। শুধরেছে কি? এমনকী ছেলেটা দুষ্টু এই বাজে কথা বলে আপনার এখানে ওকে আরও বদমাইশি করার প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। বলেই আদিত্য হাত বাড়িয়ে সাহেবদাদুর হাঁটু স্পর্শ করল। একটা কথা আমায় আপনি বলুন, আপনি নিশ্চয় সত্যি কথাই বলবেন। ছেলেবেলায় আপনি কি বাবা মা কারও শাসন পাননি, কেউ কি আপনার গায়ে হাত তোলেনি কখনও?

সাহেবদাদু ভীষণ অবাক হয়েছিলেন। কেমন হতভম্ব হয়ে সোজা হয়ে বসতে গেলেন। খানিক পরে বললেন, তা দু-চার দিন কি আর মার খাইনি। খেয়েছি।

বোধহয় সেই মার খেয়ে আপনি অমানুষ হয়ে যাননি। যদি দু-চার ঘা মার দিলে মনে হয় শিশুহত্যা করা হচ্ছে তবে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু এসব জিনিসকে কায়দা করে শিক্ষা পদ্ধতির উন্নতি বলা বাজে কথা। শাসনের হাত তো একটা নয়, অনেক। যে ছেলেমেয়েকে আপনারা মারেন না–সে যে বাড়ি গিয়ে বা খেলা করতে গিয়ে অন্য কোথাও মারধোর খায় না–কে বলল। …তা ছাড়া

কী?

জীবনভোর অনেক বড় মার খেতে হবে এদের। এই হাতের দু-চার ঘা কিছু নয়। নাথিং।

আবার নীরবতা। কেউ কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। সাহেবদাদু অবশেষে বললেন, আপনি যা বলছেন তার হয়তো অনেক কিছুই সত্য। কিন্তু আমাদের এখানে শাস্তি দেওয়া বারণ।

আমি শাস্তি দিইনি।

শাস্তি দেননি? আশাদি অস্ফুট গলায় বলল।

না। আমি আমার শান্তি পাবার চেষ্টা করছিলাম। আই হেট। একটা শয়তান বদমাশ স্বাস্থ্যঅলা ছেলে নিরীহ গোবেচারি একটা ছেলেকে ঠেলে ফেলে দেবে গাছের ডাল থেকে, আই হেট ইট। কোনও বড় মানুষ এরকম কোনও কাজ করলে আমি তাকে মারতাম। আই অ্যাম নট গোয়িং টু টলারেট এনি ব্লুটালিটি।

সাহেবদাদু নির্বাক। তুষাররাও। তুষারের হঠাৎ চোখ পড়ে গেল, দেখল আদিত্যর চোখে যেন জলের ঝাপসা আড়াল।

আদিত্য উঠে পড়ল। আপনাদের অপছন্দ হয়ে থাকলে আমার করার কিছু নেই। আমি চলে যেতে পারি। কাল কি পরশু চলে যাব।

আদিত্য চলে গেল ঘর ছেড়ে।

তুষাররা নীরবে বসে থাকল। ঘরের আবহাওয়া কেমন ভারী এবং বিষাদে ভরে উঠেছিল। সাহেবদাদু অনেকক্ষণ পরে বললেন, ছেলেটি অদ্ভুত।

.

আর একদিনের ঘটনা তুষার ভুলবে না। এই ঘটনা ঘটেছিল বাড়িতে।

সেদিন সন্ধের মুখে আদিত্য হাঁটতে হাঁটতে এসে হাজির। তুষার শিশিরের সঙ্গে বসে বসে তাস খেলছিল। সময় কাটানো আর কি। তাস খেলতে খেলতে গল্প হচ্ছিল দুই ভাই বোনে।

আদিত্য এসে ডাকল। ডাকার ভঙ্গি বড় অদ্ভুত। মানুষ মানুষকে নাম ধরে ডাকে, কিংবা দরজায় ধাক্কা দেয়, কড়া নাড়ে–আদিত্য ও-সবের ধার দিয়ে গেল না।

বারান্দায় উঠতে উঠতে তার সেই মোটা গলায় গান ধরল: পথভোলা এক পথিক এসেছি।

হাতের তাস নিয়ে তুষার প্রায় চমকে উঠল। বুঝতে পারেনি প্রথমে, চেনা গলার স্বর কানে একটু থিতিয়ে আসতেই জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। শিশিরও অবাক। হঠাৎ কেমন আড়ষ্ট সঙ্কুচিত হয়ে হাতের তাস ফেলে দিয়ে তুষার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাল।

কী রে দিদি?

সেই ভদ্রলোক। আদিত্যবাবু। কী যে বিরক্ত করে…। বলতে বলতে তুষার উঠে দাঁড়াল, ভাইয়ের মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না, বলল, দাঁড়া, বিদায় করে দিয়ে আসি। নয়তো ও যা লোক চেঁচিয়েই যাবে।

শিশির ঠোঁট উঁচু করে ঠাট্টার হাসি হাসল। বেশ তো গাইছে, গাইতে দে। তুই বোস।

বেশ গাইছে! তুষার চোখ বড় করল।

পুরুষমানুষের মতন! কেমন গম্ভীর গলা।

বাজে বকিস নাতুষার ছটফট করে উঠল, গানের তুই কী বুঝিস?

বুঝি। সব তুই একা বুঝবি বুঝি। …জানিস, আমি কবিতা লিখি।

রাখ তোর বোঝা। লোকটাকে আমি থামাব।

অযথা গানটা বন্ধ করে দিবি? গাক না ও, তুই বোস।

তুষার বসবে না। শিশির বুঝবে কোথা থেকে এভাবে আদিত্য এসে ওকে কি বিশ্রী লজ্জার এবং অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে।

কিন্তু শিশির বোধহয় বুঝেছিল। তুষার চলে যাচ্ছে দেখে হেসে বলল, তাস গুটিয়ে রাখছি রে, দিদি।

তুষার বাইরে এল। আদিত্য বেপরোয়া গলায় গান গাইছে। যেন ও জানে এই পরিহাস আনন্দেরই, এতে কোনও গ্লানি নেই লজ্জা নেই। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকিয়েই আদিত্য গান গাইছিল। তুষারকে দেখে থামল।

তুষার এক পলক দেখে নিল আদিত্যকে। হঠাৎ এদিকে?

এলাম। আজ খুব ভাল লাগছিল।

দেখছি তাই, নয়তো আর গান হবে কেন।

আমি রাস্তায় আসতে আসতে ভাবলাম কোন গানটা উপযুক্ত হবে, মানে স্যুটেবল। এইটেই মনে এল।

মনের খুব বাহাদুরি রয়েছে। তুষার গম্ভীর হয়ে বলতে চাইল।

গানটা কিন্তু খুব স্যুটেবল হয়েছে, বলুন ঠিক কি না। আদিত্য হাসল জোরে জোরে, রবীন্দ্রনাথ এই একটা কাজ করে গেছেন, অনেক সময় মানুষ যা বলতে চায় একটু হাতড়ালেই দেখতে পাবে বুড়ো একটা গান বেঁধে গেছেন।

তুষার কৌতুক বোধ করল। উনি কি জানতেন আপনার মতন লোক তাঁর গান গেয়ে গলা সাধবে।

মানে। হোয়াট ডু ইউ মিন? আমি বাজে গাই?

কে বলছে! চমৎকার গান।

আদিত্য আবার হাসল। সিগারেট বের করতে করতে বলল, আমি গোটা পঁচিশেক গান সত্যি সত্যি জানি। এ ভেরি পুয়োর স্টক ইনডিড। কিন্তু বেশ লাগে।

তুষার কিছু বলল না। কথাটা কিন্তু খুব মিথ্যে নয়। সব বাঙালি ছেলের মতন আদিত্যও কয়েকটা জানে। হয়তো সুর কোথাও ভুল হয়ে যায়, শব্দ শুদ্ধ হয় না, কিন্তু এখানে সেটা বড় কথা নয়। তুষারও কিছু গান জানে। হয়তো তার সুরও কোনও জায়গায় ভুল, শব্দ অশুদ্ধ। আদিত্যর গলা সত্যিই গম্ভীর ভারী। মন্দ শোনায় না, তুষার যতই ঠাট্টা করুক শিশিরের কাছে।

সিগারেট ধরিয়ে আদিত্য বলল, কী করছিলেন?

ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছিলাম।

ও! আদিত্য ধোঁয়া ছেড়ে কী যেন ভাবল সামান্য। বলল, আমি আপনার ভাইয়ের কথা শুনেছি।

তুষার তাকাল। আদিত্য অন্য দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। বাগানের দিকে। চাঁদের আলো বাগানে।

তা হলে থাক। আমি চলি। আদিত্য চাপা গলায় বলল।

তুষার বুঝতে পারল। যে দুঃখ নিশ্বাসের মতন স্বাভাবিক ভাবে বয় বলে তুষার সচেতন থাকে না, সেই দুঃখকে আদিত্য চেতনায় আনল। মানুষ যদি প্রতিটি নিশ্বাস-প্রশ্বাস সম্পর্কে হঠাৎ সচেতন হতে চায়, দু মুহূর্ত পরেই কেমন অস্বস্তি বোধ করবে। তুষার সেই রকম অস্বস্তি বোধ করছিল। শিশিরের কথা সে কাউকে বলতে চায় না। পছন্দ করে না। শিশিরও নয়। ওরা ভাইবোনে তাদের দুঃখ হাটে টেনে এনে না অনুকম্পা না করুণা চায়।

নিজেকে সামলে নিতে নিতে তুষার বলল, যাবেন কেন, বসুন। কথাটা বলে তুষার সিঁড়ির দিকে তাকাল। খেয়াল হল, আদিত্য সাইকেল আনেনি, মনে পড়ল, ও হেঁটে আসার কথা বলছিল। আলোচনা অন্য দিকে নিয়ে যাবার মতন সুযোগ পেল তুষার। সাইকেল কোথায়?

সাইকেল নিইনি, হেঁটে বেরিয়েছি।

হেঁটে–তুষার অস্ফুট বিস্ময় জানাল।

ভাল লাগছিল হাঁটতে। আজ আমার খুব ভাল লাগছে। এক একটা দিন মাঝে মাঝে মানুষের অসম্ভব ভাল লেগে যায়। আপনার লাগে না?

তুষার সামান্য অন্যমনস্ক চোখে আদিত্যর দিকে তাকাল। মাথা নাড়ল, অথচ এই জবাব–এই হ্যাঁ জানানো সে বাস্তবিক ভেবে বলল না।

রাস্তায় আসতে আসতে আমি ভাবছিলাম আজ এখানে এসে আপনাকে নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাব। আদিত্য অকৃত্রিম আবেগে বলল।

বেড়াতে! তুষার যেন খুব অবাক।

চলুন। আমার যে কী ভাল লাগছে আজ! আদিত্য ছেলেমানুষের মতন তার বিহ্বলতা জানাল। তুষার অনুভব করতে পারছিল, ভদ্রলোক আজ খুশিতে টলমল করছে। ওর খুশির ভাগ গলার স্বরে উপচে উঠছিল।

এখন কি আমার বেড়ানোর সময়! তুষার নরম করে হেসে বলতে গেল।

এখন নয়তো কখন! সবে সন্ধে। মস্ত বড় একটা চাঁদ রয়েছে আকাশে, পুরো শরতের বাতাস। চলুন।

তুষার কী করে বলবে, শিশির একা বসে রয়েছে; কী করে বোঝাবে, এ-ভাবে বেড়াতে বেরোলে শিশির কী মনে করবে! তা ছাড়া তুষার কখনও কি একজন পরিচিত পুরুষের সঙ্গে এই শহরের কোথাও বেড়াতে বেরিয়েছে। আদিত্যকে সরাসরি না বলতে তার বাধছিল। অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে তুষার। আদিত্যও তেমন, তার জোর জবরদস্তি অনুরোধ বিন্দুমাত্র শিথিল হচ্ছে না।

বিখ্যাত লেখকের এক বিখ্যাত কথা আছে জানেন না–আদিত্য বলল, দিনের মধ্যেই আমরা বাঁচি, কিন্তু কোনও কোনও দিনই আমাদের সত্যিকারের বাঁচায়।

তুষারকে বাধ্য হয়ে যেতে হল। আদিত্য কিছুতেই ছাড়বে না। আর আদিত্য যখন ঝোঁক ধরে সে-ঝোঁক ঠেকাবার সাধ্য মানুষের থাকে না। তুষার চেষ্টা করেও ওই অবুঝ জেদি মানুষটাকে ঠেকাতে পারল না।

রাস্তায় পা দিয়ে তুষার দক্ষিণ মুখে এগুতে লাগল। শহরের দিকে সে যাবে না। খানিকটা আড়ষ্ট, মনে কেমন অস্বস্তি, ভাল লাগছে না, অথচ খারাপ লাগার যথার্থ কোনও কারণও খুঁজে পাচ্ছে না তুষার। …পথে হাঁটতে হাঁটতে তুষার দক্ষিণের দিকে অন্যমনস্ক ভাবেই এগিয়ে গেল।

আদিত্য প্রায় সমানে কথা বলে যাচ্ছে। নানান কথা। তার উচ্ছ্বাস এবং আনন্দের প্রাবল্য অনুভব করা যাচ্ছিল সর্বসময়, সে সেই ভাবে হাঁটছে, কথা বলছে, হাসছে।

এক সময় তুষার অবাক হয়ে লক্ষ করল, পায়ে ধুলো মেখে মেখে তারা মেঠো পথ, ঘাস এবং তারপর রুক্ষ কাঁকর পেরিয়ে সেই টিলাটার কাছে চলে এসেছে। টিলার ওপাশে শহরটাকে দূরে দেখা যায়–অনেকটা ঢালুতে দাঁড়িয়ে আছে, ছায়ার মতন, আলোর বিন্দু কিছু। এ পাশে টিলার এদিকটা নির্জন নির্বাস প্রান্তর, মাঠ আর জংলা ভূমি, দূরে সেই ছোট নদীর সাঁকো।

টিলার ওপরে উঠে আসতেই তুষার অনুমানে ট্রেন লাইন দেখতে পেল। কিছুটা তফাত দিয়ে চলে গেছে, গাছের আড়াল দিয়ে দেখা যাচ্ছে না।

আজ পরিষ্কার জ্যোৎস্না। গত কাল পূর্ণিমা গেছে। মাথার ওপর নীলচে আলো লেপা আকাশ, চাঁদ প্রায় রুপোর থালার মতন গোল।

আদিত্য বসল। তুষারও এক টুকরো পাথরের ওপর আলগা হয়ে বসল। জায়গাটা ঝিম ঝিম করছে। কোনও সাড়াশব্দ নেই। বাতাসের চাঞ্চল্য এবং বেগ অনুভব করা যাচ্ছিল। এই ফাঁকায় তুষারের হঠাৎ কেমন মনে হল, সে অনর্থক যেন কীসের ভয় পাচ্ছে।

আপাতত আদিত্যও আচমকা নীরব হয়ে গেছে। জ্যোৎস্নধৌত ভূভাগের দিকে তাকিয়ে সে প্রায় সম্মোহিতের মতন বসে ছিল। তুষার নির্বাক। প্রত্যহের জীবন থেকে পরিবেশ থেকে কে যেন আলাদা করে এই সময়টুকু ওদের কাছে এনে দিয়েছে। তুষার ভাবছিল, আদিত্য ঠিক বলেছে, রোজই আমরা বেঁচে থাকি কিন্তু প্রত্যহের সেই বাঁচা আর একটা টুকরো সময়ের মধ্যে নিবিড় হয়ে, মগ্ন হয়ে বেঁচে থাকা আলাদা। তুষার অনুভব করতে পারছিল, তার মন এখানে এই স্তব্ধতা জ্যোৎস্না বাতাস এবং নির্জনতার মধ্যে এক ধরনের চাপা বিষাদ ও প্রশান্তি অনুভব করতে পারছে।

আদিত্য কাঠি জ্বালাল। সিগারেট ধরিয়ে নিল। আলোর একটি পিপীলিকা যেন পাখা পেয়ে হঠাৎ উড়ে এসেছিল আবার হারিয়ে গেল।

আমার একটা কথা মনে পড়ছে।

তুষার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল।

বিদেশে থাকার সময় আমার একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, সুইডিস মেয়ে, গ্রামার স্কুলে চাকরি করত, একদিন আমায় একটা গল্প বলেছিল, তাদের দেশের রূপকথার গল্প। সুন্দর গল্প। চাঁদের বিয়ে, দুই রাজকন্যাই তাকে বিয়ে করতে চায়, একজন প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে এলবাজনা বাজিয়ে দাস দাসী নিয়ে; চাঁদ কিছু বলল না। পরের দিন আর এক রাজকন্যা এল, একা–তার সঙ্গে কেউ নেই, না আলো বাজনানা দাস দাসী। চাঁদ বলল, তুমি একা? আমার জন্যে কিছু আনননি? রাজকন্যা জবাব দিল, এনেছি। দি সাইলেন্স… চাঁদ তৃপ্ত হয়ে হাসল। বলল, তুমিই জিতলে। আদিত্য গল্প শেষ করল। করে অভিভূত গলায় বলল, গল্পটা ভাল নয়?

তুষার মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। মাথা হেলিয়ে সায় দিল।

আদিত্য অনেকক্ষণ পরে বলল, মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যারা অন্ধ, যারা বোবা–এই সংসারে তারাই সুখী।

কেন? তুষার অস্ফুট গলায় প্রশ্ন করল।

কিছু দেখতে হয় না, কোনও কথা বলা যায় না। …আমরা দেখি বলে পুড়ি, কথা বলতে পারি বলে না বলার দুঃখে বুক জ্বলে যায়।

আদিত্যের কথার মর্ম তুষার বুঝতে পারল না।

সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে খানিক বসে থাকল আদিত্য, মাথা ওঠাল, ছটফট করল, তারপর বলল, আমার যা বলতে ইচ্ছে করছে তা বলতে পারছি না।

তুষার তার অন্তরের ভয় এবার স্পষ্ট করে অনুভব করতে পারল। কিন্তু প্রকাশ করল না। উঠে দাঁড়াল হঠাৎ। বলল, চলুন, ফিরি এবার।

আদিত্য বোধহয় প্রত্যাশা করেনি, তুষার সমস্ত মোহ মায়া তুচ্ছ করে এমন করে উঠে পড়বে। অবাক হয়ে ঘাড় তুলে তাকিয়ে থাকল আদিত্য। তারপর ক্ষুণ্ণ হল। এভাবে উঠে পড়লেন যে!

বা, বাড়ি ফিরতে হবে না। রাত হয়ে যাচ্ছে। তুষার সহজ সরল গলা করে বলল, যেন যা করা উচিত তুষার তা করেছে। কথাটা বলে তুষার টিলার ঢালুর দিকে এগিয়ে গেল।

আদিত্য উঠল না। তুষারকে দেখছিল। তুষার দশ বিশ পা এগিয়ে গেলে আদিত্য উঠে পড়ল। আহত ক্ষুব্ধ মানুষ যে ভাবে দ্রুত পায়ে ছুটে আসে আদিত্য সেই ভাবে যেন হেঁটে এল। এভাবে আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? ভয়?

ভয়! তুষার হাসিমুখে চোখ তুলল। ভয়ের কী আছে। তুষারের গলা এবং হাসি দেখলে মনে হবে যেন কীসের ভয় কেন ভয় সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

আদিত্য পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। তুষারকে লক্ষ করছিল।

আমি বাঘ সিংহনই। আদিত্য অশান্ত।

কে বলেছে।

আপনার ব্যবহার দেখে তাই মনে হয়।

নাকি?

আমাকে কি আপনি ছেলেমানুষ মনে করেন।

ছেলেমানুষ! তুষার টিলার ঢালু দিয়ে খানিকটা নেমে এসে সমতল পেয়ে হাঁটতে লাগল, আদিত্যের দিকে তাকাল, মুখভরা শান্ত হাসি, বলল, সত্যিই আপনি ছেলেমানুষ।

আদিত্য আচমকা তুষারের হাত ধরে ফেলল। তার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল যেন পাগলামি করছে। আমার বয়েস আটাশ। আমায় বোকা ভাববেন না।

তুষার হাত ছাড়াবার জন্যে ব্যগ্রতা দেখাল না। বলল, এমন কি বয়েস আপনার, আমার বয়েস বাইশ। …মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে সব সময় বেশি বুদ্ধিমান হয়। তুষার জোর করল না, ছটফট করল না, কেমন অক্লেশে স্নিগ্ধ স্বরে কথা বলতে বলতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল। জানেন না, মেয়েদের বয়স এক বছরে যা, ছেলেদের তাতেই দুবছর। …ওই দেখুন–তুষার হাত বাড়িয়ে দিল সামনের দিকে। শুনতে পাচ্ছেন?

গাড়ির শব্দ?

হ্যাঁ। সাড়ে আটটার মেল ট্রেন। কতটা রাত হয়ে গেছে দেখেছেন।

তাই তো।

শিশির একা বসে আছে। আপনারও না অতটা রাস্তা যাবার আছে, তাও আবার সাইকেল আনেননি। কী করে যাবেন?

যাব না আজ।

যাবেন না?

আদিত্য মাথা নাড়ল। ট্রেনের শব্দ ফাঁকায় প্রতিধ্বনিত।

কী সর্বনাশ! যাবেন না তো কী করবেন? মাঠে মাঠে ঘুরবেন? তুষার হালকা কৌতুকের গলায় বলল।

আদিত্য জবাব দিল না। খানিকটা পথ চুপচাপ। তারপর আদিত্য বলল, আপনি এমন সুন্দর রাতটা নষ্ট করে দিলেন।

আমি?

কী ভাল লেগেছিল আজ, এখন মনে হচ্ছে আপনাকে জোর করে টেনে এনেছি। কেন তখন বললেন না, আপনার আসতে ইচ্ছে নেই। আদিত্যর গলায় বিষাদ, মনস্তাপ।

তুষার শাড়ির আঁচল টেনে নিতে গিয়ে আদিত্যর হাতে স্পর্শ দিল। মধুর প্রশান্ত হাসি তার মুখে। বলল, ইচ্ছে না থাকলে কেউ কি আসে। …কিন্তু চাঁদের আলোই তো সব নয়; আমার ঘর বাড়ি ভাই আছে–আপনারও…

আমার কিছুই নেই। আদিত্য তুষারের কথা টেনে নিয়ে বলল। সে যেন ভীষণ অধৈর্য, আহত, বিক্ষুব্ধ।

তুষার চোখের দৃষ্টি বাঁকা করে দেখে নিল আদিত্যকে। কিছু নেই বলবেন না।

কেন বলব না?

বলতে নেই। …শুনতেও ভাল লাগে না।

রাস্তায় এসে পড়েছিল তুষার। বাড়ি দেখা যাচ্ছে। তুষারের কোনও উদ্বেগ নেই; এই উদ্বেগ টিলার আসন ছেড়ে উঠে পড়ার পর থেকেই ক্রমে কেমন মিলিয়ে গেছে। এতটুকু আড়ষ্টও আর বোধ হচ্ছে না। আদিত্যকে তার সত্যিই ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে। বোধ বুদ্ধি-সাংসারিক বোধ বুদ্ধি ওর নেই। তুষার মায়া এবং মমতা বোধ করছিল আদিত্যের জন্যে।

আমাকে আরও পৌঁছে দিয়ে কী লাভ? এতটুকু যেতে আমার অসুবিধে হবে না। আপনি বরং ফিরুন, অনেকটা রাত হয়েছে।

আদিত্য কথার জবাব দিল না। হাঁটতে লাগল।

কী হল, যাবেন না?

না।

না কি! কোথায় থাকবেন সারারাত। তুষার বিপদে পড়ল।

যে কোনও জায়গায়।

পাগলামি করবেন না। তুষার যেন ভর্ৎসনা করল মৃদু গলায়। সারারাত রাস্তায় রাস্তায় কেউ ঘোরে নাকি?

আমি ঘুরি। …আমি অনেক ঘুরেছি এ-ভাবে। আদিত্য উপেক্ষার গলায় বলল, একদিন না ঘুমোল মানুষ মরে না।

বাড়ির গেটের কাছে এসে পড়েছে তুষার। দাঁড়াল। আদিত্যকে চোখ ভরে দেখল। কী রকম মানুষ

যে আপনি। তুষার ভেবে পাচ্ছিল না কী বলবে। সামান্য চুপ করে থেকে বলল, আমায় কেন দুর্ভাবনায় ফেলছেন?

আদিত্যের মাথায় বোধহয় কোনও বুদ্ধি এসেছিল। বলল, কিছু না। আপনি যান। আমি স্টেশনে চললাম।

স্টেশন? তুষার আকাশ থেকে পড়ল।

স্টেশনের ওয়েটিং রুমে খাবারের দোকান আছে, লম্বা লম্বা বেঞ্চি আছে…

এই…। তুষার প্রায় আঁতকে উঠে বলল, স্টেশনের ওয়েটিং রুমে…, না, ছি, সে কি…।

আদিত্য তুষারের গেট খুলে দিয়ে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াল। তুষার বিমূঢ়। আপনি বরং এখানে খাওয়া-দাওয়া

স্টেশনে রাত কাটাতে আমার ভাল লাগে। আদিত্য পা বাড়াল।

প্ল্যাটফর্মে বসে থাকব, ঘুমন্ত স্টেশন, একটা দুটো গাড়ি চলে যাবে…

আদিত্য দু-চার পা এগিয়ে মুখ ফেরাল হঠাৎ, আপনার কথা ভাবব। যদি ইচ্ছে হয় চলে আসব। আপনি তখন ঘুমোবেন।

না, না–তুষার শিউরে উঠে বাধা দিল। হাত নাড়ল। ছি ছি। না, ওসব করবেন না।

করা কি আমার হাতে। মন যদি করায়–আদিত্য কী এক আনন্দ যেন মুঠোয় পেয়েছে। হাসতে হাসতে পা বাড়াল।

তুষার গলা উঁচুতে তুলে শেষ বারের মতন বলল, না, আপনি দয়া করে আসবেন না।

আদিত্য তাকাল না। মনেই হল না, তুষারের কথায় সে কর্ণপাত করেছে। তুষার স্তব্ধ কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

তুষারের কী দুশ্চিন্তা সেদিন। ভীষণ ভয়। যদি আদিত্য আসে। ওকে বিশ্বাস নেই, ওর মতিগতি তুষার বুঝতে পারে না। হয়তো আসবে সত্যিই, হয়তো চাঁদের আলোয় বাগানের পাশ দিয়ে তার ঘরের জানলার সামনে এসে ডাকবে–তুষার, তুষার।

তুষারের মনে হচ্ছিল আদিত্য যেন সব চেনে, তার ঘর–তার জানলা, তার বিছানার শিয়রের বাতায়ন–সবই যেন আদিত্যের পরিচিত। এমনকী তুষারের ভয়ও।

আদিত্য আসবে এই ভয়ে তুষার ঘুমোতে পারল না, শিশিরের ঘরের দিকে দরজাটা আস্তে করে ভেজিয়ে দিল পুরোপুরি, বাতি নিভিয়ে দিল, আর উৎকণ্ঠা সম্বল করে বসে থাকল বিছানায়।

বাগানে চাঁদের আলো ফুট ফুট করছে, বাতাস বয়ে যাচ্ছে, পাতার শব্দ উঠছিল মাঝে মাঝে, তুষার চমকে উঠছিল। সব নিস্তব্ধ, চরাচর নিদ্রিত, তুষার বিছানায় শুয়ে থাকল আড়ষ্ট হয়ে।

এক সময় বাগানে ছায়া দীর্ঘ হয়ে এল, বাতাস শিশিরার্জ হল, নিশীথের নিদ্রা আরও যেন গম্ভীর হয়ে সমস্ত অসাড় নিশ্চেতন করে ফেলল। তুষার জেগে থাকল।

আদিত্য এল না?

এল। তুষার তখন বুঝি ঘুমে অচেতন। আদিত্য জানলার কাছে এসে মৃদু সুরে ডাকল, তুষার তুষার।

তুষার চোখ মেলতে পারল না। ঘুম তার সর্ব ইন্দ্রিয় প্রাণহীন করে ফেলেছে।

তুষার। আমি এসেছি।

তুষার স্বপ্নের ঘোরে যেন অস্ফুট শব্দ করল।

তুষার এই যে আমি। তোমার জানলায়।

তুষার উঠল। আদিত্য জানলার কাছে। ঘুমে আলস্যে তন্দ্রাজড়িমায় তুষার যেন আদিত্যকে ভাল করে চিনতে পারল না। জ্যোতিবাবুর মুখের মতন মনে হল। তুষার চমকে উঠল। পরে চিনতে পারল আদিত্য।

আপনি?

আমি। বাইরে এসো তুষার।

না।

একটিবার। লক্ষ্মীটি এসো।

না।

এখানে কত আলো, তোমায় এই আলো ধুইয়ে দেবে। এখানের বাতাস শিশিরে ভিজেছে, তোমার কী ভাল যে লাগবে।

না আমি যাব না। তুমি যাও। তুষার জানালা বন্ধ করে দিল শব্দ করে।

ঘুম বেঙে তুষার নুটুর গাড়ির শব্দ পেল। মাথার দিকের জানলা সত্যিই বন্ধ। তুষার জানলা খুলে তাকাল। নুটু গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখে নীচে নেমেছে।

আজ তুষার স্নিগ্ধ হাসতে পারল না। তার প্রতিদিনের হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করতে ভুলে গেল। রোদ উঠছে। বাগানে সকালের ফরসা। পাখিদের কাকলি। তুষার লক্ষ করে দেখল। আদিত্য কি এসেছিল? তুষার বুঝতে পারল না।

এই প্রথম তুষার বড় ক্লান্ত অনুভব করল নিজেকে। তার ইচ্ছে হল ছুটি নেয়। নুটুকে বলে, আজ আমি যাব না নুটু, তুমি যাও।

বলতে পারল না তুষার। তাকে যেতে হবে। শিশুতীর্থ তার পথ চেয়ে বসে আছে।

জানলার কাছ থেকে সরে আসার সময় তুষারের চোখে জল এল।

এই প্রথম, চোখের জল দিয়ে তুষারের ভোর শুরু হল।

.

০৮.

নুটুর গাড়ি নিত্যকার মতন তুষারকে শিশুতীর্থে এনে পৌঁছে দিল। তুষার নেমে দাঁড়াল; ছেলেমেয়েগুলো হুড়োহুড়ি করে নামল, ঠেলাঠেলি, কলরোল, দেখতে দেখতে কয়েকজন মিলে দৌড় দিল। তুষার দাঁড়িয়ে।

সোনার জল দিয়ে যেন রং করা এই রোদ, কী উজ্জ্বল শরতের নীল আকাশের তলায় শান্ত নদীর মতন পড়ে আছে, তুষার রোদ দেখল না। বাচ্চাগুলো ছুটতে ছুটতে ঘাস মাটি গাছতলা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, তুষার সেদিকেও তাকিয়ে নেই। একটা বেগুনি রঙের বড় প্রজাপতি তুষারের পায়ের তলায় ঘাসের ডগায় বসে পাখা গুটোচ্ছে, আবার মেলছে, তুষার তা লক্ষ করল না।

শিশুতীর্থ যেন ফাঁকা, নিস্তব্ধ। যেন তুষার হঠাৎ আজ সকালে কোনও অপরিচিত জায়গায় চলে এসেছে তার পরিচিত কেউ কোথাও নেই। অন্যমনস্ক, স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকল তুষার।

নুটু প্রত্যহের অভ্যেস মতন তুষারের বেতের টুকরি সিট থেকে নামিয়ে নিয়েছে। তুষারদিদিমণিকে আজ কেমন যেন লাগছে নুটুর। সারাটা পথ দিদিমণি আজ চুপচাপ এসেছে। বরাবর রাস্তার দিকে তাকিয়ে, কথা বলেনি একরকম, বাচ্চাদের সঙ্গেও না কথা না আর কিছু। নুটুর মনে হল, তুষারদিদিমণির শরীর খারাপ।

নুটুর সাড়া পেয়ে তুষার সচেতন হল।

অন্যদিন তুষার নিজেই গাড়িতে ওঠে, কোন ছেলেমেয়ে কী ফেলে গেছে কুড়িয়ে নেয় যত্ন করে। আজ তুষার আর গাড়িতে উঠল না। নুটুর কাছ থেকে নিজের টুকরিটা হাতে নিয়ে মৃদু গলায় বলল, ভেতরটা একবার দেখে এসো, নুটু।

নুটু গাড়িতে উঠল।

তুষার চারপাশে তাকাল। সব ফাঁকা। মাঠ সবুজ, রোদে নরম। গাছের পাতা বাতাসে কাঁপছে মৃদু। জঙ্গলের দিকে বুঝি একটা গরুর গাড়ি চলেছে, ঘণ্টা বাজছে, গরুর গলায় বাঁধা ঘণ্টা।

নুটু একটা ব্যাগ, একটা চকোলেটের বাক্স, কার যেন পেনসিল কুড়িয়ে এনে তুষারের হাতে দিল।

আর ঠিক এ-সময় তুষার অবাক হয়ে দেখল, অনেকটা দূরে ফাঁকা মাঠে একটা ঘোড়া। ঘোড়াটা চরছিল, চরতে চরতে ডেকে উঠল।

নুটু–তুষার ঘোড়র দিকে চোখ রাখল, ঘোড়া কোথা থেকে এল?

নুটু মাঠের দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসল একটু। বলল, ধনীরামের ঘোড়া, দিদি।

কার?

ধনীরাম। জঙ্গলের গাছ কাটায় ধনীরাম।

তুষার চলে যাচ্ছিল। নুটু বলল আবার, নতুন যে বাবু এসেছেন, সেই বাবু একটা ঘোড়ার কথা বলছিলেন। সাহেবদাদুর টমটমে জুতে চড়বেন। ধনীরামবাবুকে বলেছিলাম। কাল বিকেলে এনেছি। বড় বদমাশ ঘোড়া ওটা।

তুষার থমকে দাঁড়াল। আদিত্য ঘোড়া আনিয়েছে! সাহেবদাদুর সেই পুরনো গাড়িটায় ঘোড়া জুতে চড়বে! তুষার গভীর বিস্ময় বোধ করছিল।

নুটু নিজের গাড়ির মুখ খুলতে এগিয়ে গেল। কেমন একটা গন্ধ বেরোচ্ছে, তেল না কোনও কিছু পোড়ার কে জানে।

তুষার ফটকের দিকে এগিয়ে গেল।

মালতী লতার টোপর পরানো ফটকের তলায় এসে তুষারের পা কেমন অবশ হয়ে এল একটু। পাশে ঝাউয়ের কুঞ্জ থেকে একটা পাখি ডাকছে। জবা আর অপরাজিতার ঝোঁপ রোদ গায়ে দাঁড়িয়ে, অনেকগুলো ঘাস ফড়িং ঝোঁপের চারপাশে উড়ে উড়ে নাচছে। তুষার এসব চোখ চেয়ে ভাল করে দেখল না, চোখে পড়ল। চোখে পড়ল, সামনের মাঠে ক্ষুদে কুকুরটা চড়ুইয়ের সঙ্গে যেন কুমির কুমির খেলা খেলতে গিয়ে তুষারকে দেখেছে, ছুটে আসছে।

আরও দূরে জ্যোতিবাবু। আমতলায় বেতের মোড়া পেতে বসে জ্যোতিবাবু। তাঁর ছেলেমেয়েরা সবাই তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে।

তুষার হাঁটছিল। কুকুরটা গায়ের কাছে এসে লাফিয়ে উঠল। শাড়ির পাড় মুখে করে টানতে টানতে ক পা গেল, তারপর একটা পাখির বাচ্চা দেখে ছুটে আবার অন্য দিকে পালাল।

আশাদির ঘর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে না। আজ কি তবে অনেকটা দেরি হয়ে গেল তুষারের!

আদিত্যকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তুষার পথ চলতে চলতে চারপাশে তাকাল, গাছগাছালির আড়ালে কোথাও যদি লুকিয়ে থাকে আদিত্য তবে সেকথা আলাদা, কিন্তু কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।

তুষার বিরক্ত বোধ করল। আদিত্যের ব্যবহার আজ তার কাছে বিরক্তিকর মনে হল। এতক্ষণ, সেই সকাল থেকে এ-পর্যন্ত, গাড়িতে আসতে আসতে তুষার এই বিরক্তি অনুভব করেনি। কালকের সেই মাঠ টিলা চাঁদের আলো, আদিত্যের অবুঝ ছেলেমানুষি, তার আসব বলে ভয় দেখানো, এবং স্বপ্ন সব যেন মিলেমিশে কেমন সম্মোহিত করে রেখেছিল তাকে। তুষার কী ভাবছিল ভাল করে মনে করতে পারল না।

হয়তো তুষার কখনও ভেবেছে পুরোটাই স্বপ্ন, কখনও মনে করেছে আদিত্য বাস্তবিকই অবুঝ ছেলেমানুষ, আবার কখনও কিছু ভাবেনি, শুধু কালকের নির্জন দৃশ্যগুলি টুকরো টুকরো ভাবে ছবির মতো দেখেছে।

সারাটা পথই–তুষার যাই ভাবুক, মনে মনে নিজেকে আজ খুব শুন্য মনে করছিল। তার মন ভার হয়ে ছিল। এ অনেকটা সেই রকম, সকালে ঘুম থেকে চোখ মেলেই মেঘলা দেখা, যে-মেঘলা সর্বত্র যার শেষ নেই, মনকে যা অকারণে বিষণ্ণ অপ্রসন্ন করে তোলে।

শিশুতীর্থে পা দিয়ে অকস্মাৎ তুষার এই বিশ্রী সম্মোহন থেকে যেন মুক্তি পেয়ে প্রথমেই বিরক্ত ও অপ্রসন্ন বোধ করল। তার উচিত অনুচিত বোধ, তার ভালমন্দ জ্ঞান, এবং অভ্যস্ত জীবনের নীতি তাকে ধিক্কার দিল। ছি ছি, তুমি কী বলে ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে একা ফাঁকায় বেড়াতে গেলে? তুমি কী করে ওর হাত ধরা হয়ে থাকলে কোন দুঃসাহসে ও তোমার কাছে ওই সব আবদার জানায়-আপনার কথা ভাবব। যদি ইচ্ছে হয় চলে আসব। আপনি তখন ঘুমোবেন। …

আদিত্য কাল কী করে এসব কথা বলতে পারল, তার সাহস জোগাল কেমন করে, তুষার ভাবছিল। ক্রমশ মাঠ ধরে গাছতলা দিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে আসছিল তুষার। জ্যোতিবাবুর দিকে তার চোখ পড়ল। জ্যোতিবাবু আকাশের দিকে হাত তুলে তাঁর ছেলেমেয়েদের কিছু বোঝাচ্ছেন।

আদিত্যের অত সাহসের জন্যে তুষার হঠাৎ নিজেকেই দায়ি করল। ভাবল, তার প্রশ্রয় না পেলে আদিত্য কখনওই অত কথা বলতে পারত না। তুষার লোকটাকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে ফেলেছে। আর প্রশ্রয় পেয়েই লোকটা মাথায় উঠেছে; কী বলা উচিত, কী বলা উচিত না সে-জ্ঞান লোপ হয়েছে ওর। আশ্চর্য, কোনও ভদ্রলোক কোনও মেয়েকে কী করে বলে, রাত্রে ঘুমের বেলায় সে তার বাড়ি আসবে।

তুষার এখন যত ভাবছিল, যত ঘুরে ঘুরে কালকের সেই বিদায় মনে করছিল ততই অসন্তুষ্ট হচ্ছিল। আদিত্যের ওপর তার রাগ হচ্ছিল। নিজের অক্ষমতার কোনও সঙ্গত কারণ খুঁজে না পেয়ে নিজের ওপরই ক্রুদ্ধ হচ্ছিল।

তুষারের ঘরে নিত্যকার মতন কোলাহল। ছেলেমেয়েরা খেলা করছে, ছড়া পড়ছে সমস্বরে, গান গাইছে, ডিগবাজি খাচ্ছে। তুষার ঘরে ঢুকল। সবাই দেখল, মনে হল না তাতে তাদের কোনও ব্যাঘাত ঘটেছে।

.

যমুনা আর বেবি বি কুইক খেলছে। দুজনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, দুজনেরই দুটো করে হাত বুকের কাছে তালি দেবার মতন করে ধরা, তিনবার করে তুড়ি দিচ্ছে, বার দুই করে তালি মারছে নিজেদের হাতে, তারপর পরস্পরের হাতে তালি দিয়ে যমুনা বলছে ব্ল্যাক বোর্ড…বি কুইক…বেবি পালটা তুড়ি দিয়ে, তালি মেরে যমুনার হাতে হাত ঠুকে বলছে, দিদিমণি…বি কুইক…।

ওরা দুজনেই একেবারে তুষারের বসার জায়গাটিতে দাঁড়িয়ে। তুষারকে দেখেও হৃক্ষেপ করল না। কারণ যমুনা একটা শক্ত কথা বলে ফেলেছে, বেবি কিছুতেই আর শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না–তার পুঁজি ফুরিয়ে গেছে, সে হেরে যাচ্ছে।

তুষার তার বসার জায়গায় মেয়েদের দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেলা করতে দেখে হঠাৎ কেমন রেগে গেল। আর কখনও যা করে না, করেনি এ-যাবৎ, যমুনার কাঁধে হাত দিয়ে ঠেলে দেবার মতন করে মৃদু ধাক্কা দিল। নিজের জায়গায় যাও। নিজের জায়গায়। অসভ্য মেয়ে।

যমুনা এবং বেবি দুজনেই হাত নামাল। দুজনেই অবাক। ছোট ছোট দুটি মেয়ে নির্বোধ বিস্মিত চোখ তুলে তাদের তুষারদিদিকে দেখছিল।

কথা শুনতে পেলে না? তুষার গম্ভীর গলায় বলল, তার চোখে মুখে বিরক্তি।

যমুনা মাথা নাড়ল, কথা শুনতে পেয়েছে।

তবে এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

বেবি আগে, পরে যমুনা চলে গেল।

ঘরে তখনও হট্টরোল চলছে।

তুষার ব্ল্যাকবোর্ডের কাছ থেকে ডাস্টার তুলে নিয়ে টেবিলে ঠুকল, ঠুকে আওয়াজ করল; দু এক জন সেই শব্দে তুষারের দিকে চোখ ফেরালেও অন্যেরা খেলা এবং মজা ছাড়ল না। তুষার গলা তুলে বলল, চুপ করো। তোমরা চুপ করো সবাই। …এই শানু নিজের জায়গায় যাও। অশোক–এই অশোক, তোমায় আমি থামতে বলছি না, কানে কথা ঢুকছে না? বলতে বলতে তুষার ঘরের মধ্যে গিয়ে একে ছাড়াল ওকে বসাল, তাকে ঠেলে সরিয়ে দিল।

ছেলেমেয়েগুলো থতমত থেকে শান্ত হয়ে আসছিল। তুষার তাদের তিরস্কার করছে: সারাক্ষণ খেলা…! অবাধ্য অশান্ত সব ছেলেমেয়ে। তোমাদের কানে কথা যায় না, না? আমি চেঁচিয়ে যাচ্ছি, তোমরা নিজের মনে খেলা করে যাচ্ছ। এই অশোক, তুমি জানলার কাছে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো। শানু, বোর্ডে গিয়ে তেরোর ঘরের নাম লেখো। …ছি ছি ছি। এই ঘরটা কী? মেলা নাকি? কেউ ঘরে ঢুকলে কী বলবে তোমাদের? ছি ছি…?

ঘর শান্ত স্তব্ধ। যে-ঘর সামান্য আগে শিশুকোলাহলে মুখর ও জীবন্ত হয়ে ছিল, সেই ঘর চুপ হয়ে গেল। এত চুপ যে মনে হবে, এ-ঘরের সমস্ত ছেলে ছুটির পর চলে গেলে ঘর যেমন নিঃসাড় নীরব হয়ে থাকে, তেমনি। কেউ আর কথা বলছিল না, ঠোঁট পর্যন্ত খুলছিল না। সকলেই বুঝতে পারছিল তুষারদিদিমণি খুব রেগেছে। ওরা কখনও, বা এত কম–এক আধবার তুষারদিদিকে গম্ভীর হতে, রাগ করতে দেখেছে যে, আজকের রাগ সবাই অবাক হয়ে দেখছিল। তুষারদিদি অনেকদিন আগে একবার মন্টুকে কান ধরার শাস্তি দিয়েছিল, আজ অশোককে। অশোক জানলার কাছে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

শানু বোর্ডে তেরোর ঘরের নাম লিখছিল। সাত তেরোং একানব্বই পর্যন্ত লিখে আট তেরোংয়ের হিসেবটা মনে মনে ভাবছিল।

এই যমুনা, এদিকে এসো। তুষার ডাকল।

যমুনা জায়গা ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে তুষারের কাছে এল।

গ্লোবের কাছে যাও।

যমুনা গ্লোবের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। গ্লোবের দক্ষিণ দিক কোনটা?

যমুনা যেন ঝপ করে পুকুরে পড়ে গেল। গ্লোবের দক্ষিণ দিক। সেটা কী? যমুনা গ্লোব থেকে মাত্র দুটো জিনিস বার করতে পারে ভারতবর্ষ আর উত্তরমেরু। তবু, শুকনো মুখে, বড় মানুষের মতন জিব দিয়ে ঠোঁট চাটতে চাটতে যমুনা গ্লোবে হাত রাখল। হাত দিলেই গ্লোব ঘুরে যায়। উত্তর মেরু উত্তরে এটা মনে মনে ঠাওর করলেও যে-গ্লোব ক্রমাগত হাত দিলেই ঘুরে যাচ্ছে, তার দিকনির্ণয় তার অসাধ্য। সে কি ছাই উত্তর দক্ষিণ জানে!

তুষার তার বেতের টুকরিটা এতক্ষণ মোড়ার ওপর নামিয়ে রেখেছিল। এবার তুলে নিল। বলল, হই হই, হট্টগোল করতে তো কষ্ট হয় না, নামতা লিখতে বললেই আর পারো না; দক্ষিণ দিক কোনটা তাও জান না। …আমি আর আসব না তোমাদের ঘরে। অন্য ঘরে চলে যাব। বলতে বলতে তুষার শানুর হাত থেকে খড়ি নিয়ে তেরোর নামতা পুরো লিখে দিল। যমুনাকে দক্ষিণ দিক দেখিয়ে চোখের দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা করল, করে ছোট দরজা দিয়ে তার কুঠরি-ঘরে চলে গেল।

ঘরটা শান্ত স্তব্ধ, কেমন যেন আকস্মিক ঝড়ে নিয়মিত আবহাওয়া থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য রকম হয়ে থাকল। ছেলেমেয়েগুলো নীরব। সবাই মুখ শুকনো করে বসে। তুষারের ভর্ৎসনায় যেন আহত, ক্ষুব্ধ।

কুঠরি-ঘরে তুষার অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকল। এ-ঘরে এক চিলতে জানলা। জানলার দিকে মুখ করে ক্যাম্বিসের চেয়ারটা পাতা থাকে, আরও পাশে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোর আর পড়াশোনার কিছু জিনিসপত্র। ওরই মধ্যে তুলো আর কাপড় দিয়ে তৈরি মস্ত একটা হাঁস। ধুলোয় তার গা ময়লা হয়ে আছে।

জানলা দিয়ে তাকালেই দুরে জ্যোতিবাবুকে চোখে পড়ছিল। জ্যোতিবাবু তাঁর ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন। ঘরে চোখ ফিরিয়ে নিলে হাঁসটা চোখে পড়ছিল। এই হাঁসটাও জ্যোতিবাবুর তৈরি।

তুষার কখনও বাইরে তাকাচ্ছিল কখনও ঘরে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল। বাইরে শরতের বেলা বেড়ে উঠছে। কাঁচের গায়ে রোদ পড়লে যেমন আলো ঠিকরে ওঠে, এখন রোদ তেমনি ঠিকরে আসছে; সবুজ ঘাসে যেন পালিশ তুলে দিয়েছে কেউ, বাতাসে গাছগুলোর ডাল পাতা মাঝে মাঝে কাঁপাচ্ছিল, আর পাখিরা ডাকছিল।

অনেকটা সময় চুপচাপ বসে তুষার নিজের বিরক্তি রাগ সামলে নেবার চেষ্টা করল। সে যে কেন রাগল, কেন অসন্তুষ্ট হল–তার যথার্থ কারণ খোঁজা কঠিন নয়। আদিত্যর ওপর মনে মনে যতটা রেগেছে তুষার, যেরকম অসন্তুষ্ট হয়েছে, তারই খানিকটা অযথা বাচ্চাগুলোর ওপর যেন ফলিয়ে এসেছে।

খারাপ লাগছিল তুষারের, অনুতাপ হচ্ছিল। নিজের এই অকারণ মানসিক চাঞ্চল্যের জন্যে গ্লানি বোধ করছিল।

পরে অশোক শানু যমুনার জন্যে তুষারের কেমন কষ্টও হল। ওদের দোষ নেই, ওরা কি জানত রোজ ওরা যা করে যেভাবে সময় কাটায়, আজ তুষারদিদি তাতে হঠাৎ রাগ করে বসবে!

তুষার উঠল। মনে মনে ঠিক করল আজ অশোক শানু যমুনাকে দিয়ে অন্য রকম ভাবে ইতিহাসের একটা গল্প পড়াবে।

.

দুপুরের খাওয়ার ছুটিতে আদিত্যকে দেখা গেল। তুষার ছেলেমেয়েদের নিয়ে খাবার ঘরের দিকে যাচ্ছে, আদিত্য গাছতলায় দাঁড়িয়েছিল।

ছেলেমেয়েরা চলে গেছে অনেক, তুষার যাচ্ছে, আদিত্য গাছতলা থেকে ডাকল।

তুষার দাঁড়াল। দাঁড়িয়েই ভাবল, তার চলে যাওয়া উচিত ছিল।

আদিত্য কয়েক পা এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়াল। মুখে চোখে প্রবল হাসি মাখানো। কী খবর?

তুষার মুখ তুলল না। মানুষটার গলার স্বর থেকেই সে আদিত্যর উৎফুল্লভাব অনুমান করতে পারছিল। এত আনন্দের কী আছে! তুষার বিরক্ত হয়ে ভাবল, এত খুশি হবার মতন কী পেয়েছে ও?

কাল আপনার জন্যে যা ভুগলাম। আদিত্য দুর্ভোগের মাত্রা জানাবার জন্যে তার কথার স্বর ও শব্দে ঝোঁক দিল।

তুষার কথা বলল না। কে ভুগেছে কাল? যে-লোক শাসায়, না, যে-লোক সর্বক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে? আদিত্যর এই নির্লজ্জ উক্তিতে যেন তুষারের আরও রাগ হচ্ছিল।

কাল দেখলাম, মানুষ কত অভদ্র হয়। আদিত্য বলল।

তুষার মুখ তুলল, দেখল আদিত্যকে। লোকটা তাকে অভদ্র বলছে! তুষারের কপালের কাছটায় জ্বালা করে উঠল। কী দুঃসাহস, কতখানি ঔদ্ধত্য তার! কে অভদ্র?

আপনাদের স্টেশন-স্টাফ।

তুষার রুক্ষ চোখে দেখছিল আদিত্যকে। কথা পালটে নিয়েছে আদিত্য, তুষার সন্দেহ করল, বে-ফসকা কথাটা বলে এখন সামলাবার চেষ্টা করছে।

আমি মাঝরাতে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে একটু শোব ভেবে ছিলাম। তালা বন্ধ ঘর, বললাম– মশাই একটু খুলে দিন। দিল না; বলল, আপনি তো প্যাসেঞ্জার নন। আদিত্য নিজের মনেই বলে চলল, লোকগুলো একেবারে অ্যানিমাল…।

যে-সে এসে থাকতে চাইলেই ঘর খুলে দেবে–তুষারের মুখ থেকে কথাটা বেরিয়ে গেল। সে স্টেশনের প্রসঙ্গে কথাটা বললেও আসলে এই কথার অর্থ ছিল, ভিন্ন ইঙ্গিত। আদিত্য তাকে ইঙ্গিত করেছে আগে, কাজেই তুষার সেই ইঙ্গিতের প্রত্যুত্তর দিল। আর কিছু বেশি হয়তো দিল, আদিত্যকে ভদ্রতা এবং ভদ্র বোধ সম্পর্কে কিছু জ্ঞান।

যে সে–! যে সে মানে কী! …ওয়েটিং রুম কারও ভাড়া করা বাড়ি নয়।

আপনিও প্যাসেঞ্জার নন।

আদিত্য হাসল। বলল, আঃ-হা, তা একটা লোক যখন বিপদে পড়েছে তখন অত নিয়ম কী। নেসেসেটি…।

সবাই নিয়ম ভাঙতে চায় না। তুষার অন্য অর্থে বলল।

সে যারা ভিতু, বা…নিতান্ত প্রেজুডিস…

আপনি তা মনে করতে পারেন। তুষার বলল, বলে হাঁটতে শুরু করল।

পাশে পাশে হাঁটছিল আদিত্য। হাঁটতে হাঁটতে বলল, আপনি কাল যদি কিছু খাইয়ে দিতেন তা হলেও বাঁচতাম। রাত্রে খিদে পেয়ে গেল খুব। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখি মাত্র পাঁচ আনা পয়সা। খেয়াল ছিল না, টাকা পয়সা নেই।

অনাহার এবং অনিদ্রা, তুষার ভাবল, কাল এই মানুষটার অনাহারে এবং অনিদ্রায় রাত কেটেছে, কাটুক, তুষার তার কী করতে পারে!

তারপর ওই খালি পেটে ভোর হতে না হতেই হাঁটতে শুরু করেছি। হেঁটে হেঁটে এতটা পথ। আদিত্য হাসল কেমন করে যেন, হাসি থামলে বলল, খুব শিক্ষা দিলেন।

তুষার ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। শিক্ষা পেয়েছে না কি লোকটা? পেয়েছে যদি তবে হাসছে কেন?

পাওয়া উচিত। তুষার বলল, জোর দিয়েই বলল।

উচিত?

নয় তো কি ভাবছেন আপনার কোনও জ্ঞান হত।

আমার জ্ঞান কি আপনার চেয়ে কম?

আপনার কোনও জ্ঞানই নেই।

আদিত্য উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তুষারের কথা বলার গাম্ভীর্য এবং রাগের ভাবে যেন সে অসাধারণ কোনও মজা পাচ্ছিল।

অপ্রত্যাশিত এই হাসি তুষারকে কেমন বিব্রত করল। মনে হল, তার সমস্ত কাঠিন্য, বিরক্তি যেন অর্থহীন হয়ে গেছে; আদিত্যকে কিছু স্পর্শ করতে পারছে না। কিছুই সে গ্রাহ্য করছে না।

তাড়িয়ে দিয়েও অত বড় বড় কথা শোনাচ্ছেন কেন? আদিত্য হাসি মুখে বলল।

তুষার নীরব। খাবার ঘরের কাছাকাছি তারা পৌঁছে গেছে।

কাল আপনি আমায় যেভাবে তাড়ালেন, মনে হল যেন কোনও ডাকাত কিংবা চোর-ফোরকে বাড়ির ত্রিসীমানা থেকে সরালেন!

মনে মনে তুষার স্বীকার করল, হ্যাঁ। হ্যাঁ সে এই মানুষটাকে ভয় পেয়েছিল। লোকটা তার বাড়িতে অবাঞ্ছিত ছিল। এমন মানুষকে কেউ আশ্রয় দেয় না। দেওয়া উচিত না।

খিদের মুখে আমার যা রাগ হচ্ছিল আপনার ওপর…! দুটো খেতে দিয়েই না হয় বাড়ি থেকে। তাড়াতেন!

তুষার বলব কি বলব না করে শেষ পর্যন্ত বলল, আপনিই কি আমায় খুব স্বস্তি দিয়েছেন?

আই ডিড নাথিং।

না, কিছুই করেননি। …খালি শাসিয়ে গেলেন, যখন খুশি চলে আসতে পারেন।

কিন্তু আমি আসিনি।

কী যেন বলতে যাচ্ছিল তুষার, অকস্মাৎ অনুভব করল, আদিত্য আসেনি বলেই কি তুষার এত বিরক্ত অপ্রসন্ন শূন্য বোধ করছে। আজকের এই ক্ষোভ দুঃখ রাগ মনমরা ভাব কি আদিত্যর না আসার জন্যে?

স্বপ্নের কথা মনে পড়ল তুষারের। আর সহসা সে নিজেকে ধিক্কার দিয়ে উঠল, ছি ছি, এই সব বিশ্রী চিন্তা তার মনে আসছে কেন? কে আদিত্য, তার সঙ্গে তুষারের কীসের সম্পর্ক? কেন তার আসা না আসার ওপর তুষারের মন বিরক্ত বা অপ্রসন্ন হবে, কেন তার স্বপ্ন দেখে তুষার চোখের জল দিয়ে ভোর শুরু করবে।

তুষার কোনও কথা বলল না, দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল।

.

০৯.

দিদি?

কী?

তুই কোথায় গিয়েছিলি? বাইরে?

না। বাগানে ছিলাম। বসে ছিলাম। তুষার অন্যমনস্ক গলায় বলল।

শিশির দিদিকে দেখছিল। লণ্ঠনের মেটে আলোয় তুষারকে নিষ্প্রভ দেখাচ্ছিল, আলোটাও জানলার দিকে, তুষার দেরাজের কাছে দাঁড়িয়ে। শিশির দিদিকে লক্ষ করছিল। আজ এখন পর্যন্ত দিদি তার সঙ্গে তেমন কোনও কথা বলেনি। স্কুল থেকে ফিরে, অবেলায় অনেকক্ষণ নিজের ঘরে শুয়েছিল, সন্ধের পর উঠে চা খেয়ে, কাপড় ছেড়ে একবার এ-ঘরে এসেছিল, দু একটা কথা বলে চলে গেছিল। তারপর অনেকক্ষণ পরে হয়তো ঘণ্টা খানেকেরও বেশি বাইরে থাকার পর, এই ফিরল।

দিদিকে ভাল দেখাচ্ছে না। অবেলায় শোয়ার জন্যেই হোক, কিংবা দিদির কোনও কারণে শরীর খারাপ হয়েছে হয়তো, তাই কেমন ম্লান মনমরা শুকনো দেখাচ্ছে দিদিকে।

বাগানে ছিলি এতক্ষণ? কী করছিলি একলা একলা? শিশির বলল।

বসে ছিলাম।

তুই আবার একা বসে থাকতে পারিস নাকি? শিশির যেন বিশ্বাস করল না, কিংবা দিদির স্বভাবকে নিন্দেই করল। সে আমি, একা থেকে থেকে অন্য অভ্যেসই হয়ে গেছে।

বাইরেটা ভাল লাগছিল। তুষার দেরাজ থেকে থেকে পুরনো ওষুধের শিশি সরিয়ে কী যেন খুঁজছিল।

আমায় ডাকলি না কেন? শিশির বলল।

তুষার কথার জবাব দিল না। সে একা ছিল। একা থাকার সময় ভাইকে ডাকা যায় না। ডাকতে ইচ্ছে করে না।

হ্যাঁরে, এখানে না একটা অ্যাসপিরিনের শিশি ছিল? তুষার ভাইয়ের দিকে তাকাল।

দেখ, আছে ওখানেই। …তুই অ্যাসপিরিন খাবি?

মাথা ধরেছে বড়।

অবেলায় ঘুমোলি যে।

না। ঘুমোইনি। শুয়েছিলাম। তুষার অ্যাসপিরিনের শিশি খুঁজে পেল। সকালের দিকে ঠাণ্ডা লেগেছে বোধ হয়। তুষার কথা বলতে বলতে দেওয়ালের দিকে গেল। কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকাল, বলল, কটা খাব রে? দুটো? চারটে?

না না, চারটে নয়, বুক ধড়ফড় করে মরবি। দুটো খা।

তুষার অ্যাসপিরিন মুখে দিয়ে জল খেল। অনেকটা জল। তারপর শিশি জায়গা মতন রেখে ভাইয়ের বিছানায় এসে বসল।

ভাই বোন মুখোমুখি। তুষার বিছানায় পা গুটিয়ে বসল। তাস খেলবি?

না, মাথা নাড়ল শিশির। তোর তো এমনিতেই মাথা ধরে আছে।

তা হোক; তাস আনি। তুষার নেমে পড়ছিল।

না রে দিদি, তাস না। ভাল লাগছে না। বরং দুটো গল্প করি।

তুষার আবার পা গুটিয়ে নিল। ভাইয়ের মুখ দেখল কপলক। শিশিরের মুখ বেশ সুন্দর। নরম পাতলা টিকলো নাক, শান্ত চোখ, কপাল বেশ লম্বা। তুষারের মুখের সঙ্গে নীচের মুখের মিল আছে ওপর মুখের নেই। ভাইয়ের মুখ মাঝে মাঝে তুষারকে কেমন বেদনা দেয়। কারণ এমন সুন্দর নরম মুখের পুরুষ মানুষটি কোনওদিন জীবনের সব তৃপ্তি পাবে না। ভগবানের নিষ্ঠুর অভিশাপ তাকে কী ভীষণ অক্ষম করে রেখেছে।

হ্যাঁরে দিদি, আমাদের বাগানে শিউলি ফুটেছে?

ফুটেছে। এখন অল্প।

আমি কালও গন্ধ পেয়েছি যেন। শিশির জানলার দিকে তাকাল, গাছটাকে এবছরে এমন নষ্ট করে দিল।

তার জন্যেই তো! তুষার বলল।

শিশির চুপ করে থাকল। শিউলি গাছটাকে এক বন্ধুর কথা শুনে লোক ডেকে ডাল পালা ছাঁটিয়ে দিয়েছিল শিশির। নতুন ডালপালা, নতুন অজস্র পাতার স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু গাছটাকে আগামুড়ো অমন করে কুপিয়ে কেটে দিলে এক বর্ষার জল আর কত তার গা ভরতে পারে।

আমায় কাল কিছু ফুল এনে দিস তো৷ শিশির বলল।

তুষার মাথা নাড়ল। দেবে। তারপর কী ভেবে আচমকা একটু ঠাট্টা করল। ফুল দেখে কবিতা লিখবি?

লিখলেই বা৷ শিশির জবাব দিল। দিদির চোখে চোখে চেয়ে হঠাৎ তার মাথায় কোনও দুষ্টুবুদ্ধি এল, বলল, আমরা ফুল দেখলে কবিতা লিখি, তোরা হলে মালা গাঁথতিস।

গাঁথতাম, অন্যায়টা কী হত।

কিছু না। মেয়েদের সবটাই তো কাজে লাগে এমন কিছু করা, প্র্যাকটিক্যাল পারপাস ছাড়া…

থাম, তুই আবার ছেলে মেয়ে কী বুঝিস? এক ফোঁটা তো ছেলে।

বুঝি না?

ডিম বুঝিস।

আচ্ছা, তা হলে, তোকে..ধর তোকে নিয়েই একটা গল্প লিখি।

গল্প?

লিখি না একটা। …আগে দু তিনটে লিখেছি। …আজকাল গল্প লিখতেও ইচ্ছে করে, দিদি। শিশিরের গলায় কোনও এক রকম বিষাদ। যেন বলতে চাইছে, সারাদিন সারাটা দিন একা একা আর পারি না রে, বড় অসহ্য লাগে। এই অসহ্য একঘেয়ে সময় কাটানোর জন্যে আর কী করা যায়, এক বসে বসে গল্প লেখা ছাড়া! আমি পারি, এই অফুরন্ত সময় নিয়ে বসে বসে, খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমি এক মনে একটা একটা করে গল্প লিখতে পারি।

তুষার নীরব থাকল। ভাইকে আর দেখছিল না। শিশির কি কিছু বলতে চায়, শিশির কি কোনও কিছু বুঝতে পারে! তুষারের মনে হল, এই গল্প লেখার কথাটা একেবারে অকারণে নয়; তার সন্দেহ হল, শিশির কিছু ভাবে, হয়তো ভেবেছে।

ভাই বোন দুজনেই অল্প সময় নীরব থাকল। বাইরে শরতকাশের চাঁদ স্নিগ্ধ পূর্ণ জ্যোৎস্না ঢেলেছে, জানলার গা দিয়ে সেই জ্যোৎস্না ঘরে আসার অপেক্ষা করছে। শীতল মৃদু বাতাস আসছিল। রাস্তা দিয়ে কখনও কখনও সাইকেল যাচ্ছে। সাইকেলের ঘন্টি শোনা যাচ্ছে অস্পষ্ট ভাবে। তুষার ঘন্টির সঙ্গে অন্যমনস্ক এবং ভীত হচ্ছিল।

শিশির–তুষার কিছু ভাবতে ভাবতে বলল, এবারে পুজোর সময় কান্তিমামাদের ওখানে যাবি?

কান্তিমামা! শিশির বোধ হয় অবাক হয়েছিল।

চল না। অনেকবার তো বলেছে।

তুই পাগল। শিশির বলল।

পাগল! –কেন?

এই ঘর বাড়ি ফেলে যাওয়া! …তা ছাড়া আমাদের সঙ্গে তার কিই বা আত্মীয়তা?

আমাদের কার সঙ্গেই বা আত্মীয়তা! তুষার বলল, ওসব আত্মীয়তার কথা ধরলে তোর আমার যাবার জায়গা কোথাও নেই। এখানেই সারা জন্ম থাকতে হয়।

রয়েছি তাই। শিশির দিদির চোখে চোখে তাকিয়ে বলল।

তুষার কেমন যেন বাধা পেল। কয়েক পলক ভাইকে দেখল, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল, মৃদু গলায় বলল, একবার না দুবার আমরা বাইরে গেছি, বাবা বেঁচে থাকতে। তারপর সেই যে এখানে পড়ে আছি, কোথাও যাইনি। আর ভাল লাগে না রে!

দিদির গলার স্বর শিশির মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। দিদির কথায় হতাশা ক্লান্তি, দিদির মন তার গলার স্বরে ধরা পড়ছিল। শিশির স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, দিদির যেন আজ কদিন কিছু আর ভাল লাগছে না।

অল্প সময় শিশির নিজমনে কিছু ভাবল। ভেবে নিশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, ও সব তোর খেয়ালের কথা ছাড়। এখান থেকে তুই কোথাও গিয়ে থাকতে পারবি না, যেতেও পারবি না। কেন বাজে কথা বলছিস, দিদি।

তুষার বুঝতে পারল না, বাস্তবিক এই অসম্ভব অকারণ কথা কেন সে বলতে গেল। এখান ছেড়ে এবাড়ি ছেড়ে কোথাও কি কখনও গিয়েছে তুষার? যাবার কথা কি ভেবেছে?

অথচ যখন তুষার কথাটা বলেছিল, তখন মনে হয়েছিল, সত্যিই এখানের একঘেয়েমি এবং ক্লান্তি সে অনুভব করছে; অন্য কোথাও যেতে পারলে হয়তো বাঁচে।

শিশির হাত বাড়িয়ে একটা বালিশ টেনে নিল, কোলের ওপর রাখল। জ্যোতিদার খবর কী রে?

তুষার যেন শুনতে পায়নি। মুখ সামান্য বেঁকা করে বসেছিল। জানলার দিকে সরাসরি মুখ নয়, কিন্তু জানলা দেখা যাচ্ছিল। জ্যোৎস্না এসেছে, জানলার শিক গলে, শিকের ছায়া ফেলে আলো এসে গেছে।

জ্যোতিদার সঙ্গে তোর দেখা হয় না? শিশির আবার বলল।

কথাটা এতক্ষণে তুষার শুনতে পেয়েছে। জ্যোতিদা…! শিশিরের মুখের দিকে তাকাল তুষার। জ্যোতিবাবুর কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিল তুষার এমন চোখ করে তাকিয়ে থাকল। বলল, দেখা হয়।

একদিন আসতে বলিস না। অনেক দিন আসেননি।

তুষার শুনল। কোনও জবাব দিল না। মনে মনে জ্যোতিবাবুর কথা ভাবছিল।

এ-রকম মানুষ আমি দেখিনি। শিশির বলল, স্কুল নিয়ে মাতল তো মাতলই, আর এ-মুখো হল না।

অনেক কাজকর্ম নিয়েছেন যে। তুষার অন্যমনস্ক গলায় জবাব দিল। সামান্য চুপ করে থেকে আরও বলল, সারাদিনই একটা না একটা ঝাট থাকে।

বাড়িতেও আসে না। শিশির বালিশের ওপর কনুই রেখে সামান্য কুঁজো হল। তোকে বলিনি। সেদিন জয়ন্তীদি এসেছিল।

এখানে?

হ্যাঁ। শিশির মাথা নাড়ল। বলল, দুপুরবেলায় কী কাজে বেরিয়ে এখানে এসেছিল, অনেকক্ষণ ছিল। গল্প করল অনেক।

কী বলল? তুষার আগ্রহ বোধ করছিল।

সে অনেক কথা শিশির পিঠ সোজা করল। জ্যোতিদা বাড়ি আসে না, ছেলেমেয়ে নিয়ে জয়ন্তীদি একলা। বড় ছেলেটা হাত ভেঙেছে। মেয়েটার জ্বর। তার ওপর এমন দুই ভাড়াটে জ্যোতিদাদের, রোজই ঝগড়া মারপিট করছে, একজন আবার থানায় গিয়ে ডায়রি করেছে।

তুষার মন দিয়ে শুনছিল। বলল, জ্যোতিবাবুকে বলব।

বলিস!

সামান্য ইতস্তত করে শিশির বলল, আরও একটা কথা, দিদি।

কী?

তোকে বলব? শিশিরের মুখে সামান্য দ্বিধা।

আমায় বলবি না! কী কথা?

তোদের সেই মলিনার বাবা একদিন জ্যোতিদাদের বাড়ি গিয়ে যা তা করেছে।

যা তা–! অস্ফুট বিস্মিত স্বর বেরুল তুষারের গলা দিয়ে। তুষার অপলকে তাকিয়েছিল। শিশির সসঙ্কোচে মৃদু গলায় বলল, একদিন মদ ফদ খেয়ে হাজির হয়েছিল জ্যোতিদাদের বাড়িতে। জয়ন্তীদিকে যা তা বলে গেছে। জ্যোতিদা নাকি তার মেয়েকে ভুলিয়ে স্কুলে নিয়ে গেছে! শিশির আর কিছু বলল না।

তুষার স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল।

.

১০.

জ্যোতিবাবু এই শহরের লোক। তুষাররা যত দিনের তার চেয়ে অবশ্য কম। তবু পুরনো বাসিন্দেই বলা যায়। জ্যোতির বাবা ছিলেন পুলিশ দারোগা। চাকরির শেষ পর্বে এখানে এসে ছিলেন, তারপর অবসর নিয়ে আর অন্য কোথাও যাননি, পুরনো হাটের দিকে অনেকটা জায়গা কিনে বাড়ি তুলেছিলেন। বাংলো ছাঁদের বাড়ি, একতলা। বাড়ির মাথায় টালির ছাউনি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন এখানে বসেই। সেই মেয়ে পাঁচ বছরের মধ্যেই বিধবা হয়ে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি ফিরে এল! জ্যোতির মা তার আগেই মারা গেছেন।

বিধবা মেয়ে ও নাতি নাতনিদের নিয়ে কয়েকটা বছর হরসুন্দর দারোগার কেটে যায়, তিনি বজ্রাঘাতে মারা যান। লোকে বলত পাপের জীবন এমনি করেই শেষ হয়। হরসুন্দর দারোগার কোথায় পাপ কেউ জানত না, তিনি এ-শহরে এসে এমন কিছু করেননি যাতে পাপের কথা মুখে আসে, তবু লোকে বলত। প্রথমে স্ত্রী, তারপর জামাতা হারালেন। শেষে নিজে ভগবানের পায়ে ঠাঁই নিলেন। সবই যে তাঁর পাপের ফল এ-ধারণা এখানের বহু লোকেরই ছিল, হয়তো আজও আছে।

বাবা মারা যাবার সময় জ্যোতি সবে মাত্র কলেজের পড়া শেষ করেছে। বছর বাইশ তেইশ বয়স। এই ছেলে ছিল আলাদা প্রকৃতির। শহরে তার কোথাও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। বাল্যাবধিই বাইরের স্কুল কলেজে পড়েছে, হোটেল-বোর্ডিংয়ে থেকেছে। ছুটিতে বাবার কাছে এসেছে, কিন্তু সে-থাকা এত নিভৃত নিঃসম্পর্ক যে শহরের তার সমবয়সীরাও তার নাগাল পায়নি।

সংসারটা, বাবার মৃত্যুর পর, জ্যোতির ঘাড়ে পড়ল। দিদি আর ভাগ্নে ভাগ্নি সংসারে, সবে কলেজ ছেড়ে এসেছে ও। কী করবে ভেবে পায়নি। প্রথম প্রথম দু এক জায়গায় কাজ করেছে, ভাল লাগেনি বোধহয়, ছেড়ে দিয়েছে। বাস কোম্পানির এজেন্টগিরি করেছে কিছুদিন, তাও ছেড়ে দিয়েছে পরে। শেষে একটা মনিহারি দোকান খুলেছিল। বছর দুয়েক পরে সে-দোকানও উঠিয়ে দিল।

শেষে শিশুতীর্থ। শিশুতীর্থে জ্যোতিই সব চেয়ে পুরনো, তারপর আশাদি, তারপর তুষার। তুষারকেও জ্যোতিই শিশুতীর্থে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

ঘটনাটা এই রকম। জ্যোতি এই শহরের যে দু পাঁচজনের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পরিচিত হয়েছিল, বা যাদের সঙ্গে মোটামুটি তার একটা সৌহার্দ্যর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে শিশির একজন। শিশিরের কোনও বন্ধুর সঙ্গে জ্যোতি একদিন এ বাড়ি এসেছিল। শিশিরকে দেখে কেমন গভীর সহানুভূতি বোধ করেছিল, আর সেই সহানুভূতির দরুন মাঝে মাঝে আসত এ বাড়িতে! তুষারের সঙ্গে পরিচয় সেইসূত্রে।

সাহেবদাদুর শিশুতীর্থে জ্যোতি নিজের জায়গা করে নেবার পর তুষারকেও নিয়ে গেল। কথাটা অন্যভাবেও বলা যায়, বরং সেটাই বলা উচিত। …শিশুতীর্থের তখনও নামকরণ হয়নি, সবে সাহেবদাদু কয়েকটা আদিবাসী ছেলে জোগাড় করে একটা পাঠশালার মতন চালাচ্ছেন, এবং আরও দু পাঁচজন ছেলে জোগাড়ের চেষ্টা করছেন আশপাশ থেকে। এসময় একদিন জ্যোতি বেড়াতে গিয়ে ছিল ওদিক পানে। সাহেবদাদুর সঙ্গে তার চোখের পরিচয় ছিল, বেড়াতে গিয়ে সেই পরিচয় পাকা হল। তারপর সাহেবদাদুর কাছে যাওয়া আসা করে জ্যোতি সাহেবদাদুর কল্পনার কথা শোনে, এবং ক্রমশ ওদিকে জড়িয়ে পড়তে থাকে। সাহেবদাদুই জ্যোতিকে ডেকেছিলেন: তুমি এলে আরও একটু ভরসা পাই জ্যোতি, নতুন করে কিছু কাজও করা যায়।

জ্যোতি শিশুতীর্থের প্রয়োজনে নিজেকে উৎসর্গ করল। তারপর শিশুতীর্থ একটু একটু করে বেড়েছে, আর জ্যোতি একে একে তাদের নিয়ে গেছে, তুষারকে মলিনাকে। আশাদিকে সাহেবদাদু নিজেই খুঁজে বের করেছিলেন। প্রফুল্ল গিয়েছে আশাদির ডাকে।

তুষারকে যেদিন শিশুতীর্থের কথা বলেছিল জ্যোতি, তুষার অবাক হয়েছিল। তার ধারণায় আসেনি কেমন করে কী গুণে তুষার শিশুতীর্থে জায়গা পেতে পারে।

আমি! তুষার সবিস্ময়ে বলেছিল।

জ্যোতি নীরব। শিশির পাশে বসে আছে। জ্যোতি শিশিরের দিকে তাকিয়ে, যেন কথাটা সে শিশিরকেই বলেছে।

আমাদের লোকের বড় অভাব। জ্যোতি বলেছিল, ছেলে মেয়ে কিছু হয়েছে, তোক পাচ্ছি না।

তা বলে আমি! তুষার তখনও বিশ্বাস করতে পারছিল না। শিশুতীর্থের কাজ সে নিতে পারে, সে যোগ্যতা তার আছে।

তুমি বেশ ভাল পারবে। জ্যোতি বলল। (জ্যোতি তুষারকে তুমি বলত। ) বলে তুষারের চোখে চোখে তাকিয়ে অনুরোধের মতন করে স্মিত হাসল যেন, তোমার স্বভাব শান্ত।

কথাটা শুনে তুষার হেসে ফেলেছিল, শিশিরের দিকে তাকিয়ে আরও যেন মজা পেল, বলল, শিশির বলেছে বুঝি?

শিশির কেন বলবে, আমি দেখেছি। জ্যোতি মৃদু গলায় জবাব দিল, তুমি আমাদের শিশুতীর্থ দেখেছ? দেখোনি। দেখলেই বুঝতে পারবে–এ অন্য ধরনের কাজ। স্বভাব মন ইচ্ছা থাকলেই আমাদের কাজ হয়।

আমি নিজেই কিছু জানি না, অন্যদের কী পড়াব?

না পড়ালে। তোমার যা জানা আছে তাই শেখাবে ওদের। জ্যোতি যেন নিঃসন্দেহ, তুষার পিরবে; নিঃসন্দেহ বলেই আর কথা বাড়াতে চাইল না।

মনে মনে তুষার ঈষৎ রোমাঞ্চিত হলেও ভরসা পাচ্ছিল না। তা ছাড়া শিশির আছে; শিশিরকে একা বাড়িতে ফেলে রেখে সে কী করে সারাদিনের মতন বাইরে যেতে পারে। নুটুর গাড়ি তখনও আসত না। তাকে কে নিয়ে যাবে, কী ভাবে সে যাবে! সমস্যা অনেক। আমায় দিয়ে হবে না।

হবে। না হলে শিখিয়ে নেব। জ্যোতি শান্ত করে হাসল, বলল, কাজটাকে কাজ মনে কোরো না। তোমায় আমরা টাকা পয়সা দিতে পারব না। যদি মন ভরে, ভাল লাগে তুমি নিজেই সব পারবে।

তুষার নীরব ছিল। তার ভাল লাগবে কি!

শিশির হঠাৎ কথা বলল। বলল, সারাদিন বাড়িতে বসে থাকিস তুই। একবার এ-ঘর, একবার ও-ঘর করিস। এ তোর ভাল লাগবে দিদি। সময়টা কাটবে।

তুষার আর আপত্তি করেনি।

কিন্তু শিশুতীর্থ তুষারকে সামান্য দিনেই মোহের মতন টানল। তুষার ভাবেনি, তার সাধ্য আছে; তুষারের সন্দেহ ছিল–এই কাচ্চাবাচ্ছাদের নিয়ে তার দিন কাটবে কিনা; এবং তুষার ভেবে ছিল, জ্যোতিবাবু তাকে দায়ে পড়ে বেশি রকম বিশ্বাস করে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে সে উপযুক্ত পাত্র নয় এটা প্রমাণিত হয়ে যাবে।

আশ্চর্য, তুষার শিশুতীর্থের মধ্যে খাপ খেয়ে গেল। সাহেবদাদু তাকে যাদু করল; সে কী এক পবিত্র গন্ধ পেল এখানে, কীসের আনন্দ, দিন ব্যয়ের সুখ, আত্ম নিবেদনের শান্তি যে তুষার শিশুতীর্থকে তার প্রত্যহের অস্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলল। সুখ বা শান্তি হয়তো এই রকমই। যে ভেবে নেয় পেলাম সে পায়। কোন গল্পে আছে না, মাটিকে সোনা ভেবে এক ফকির পুঁটলি ভরে মাটি বয়ে গ্রামে ফিরেছিল দীর্ঘকাল পরে। লোকে বলল, হায় বোকা–এ তো মাটি, এতদিন পরে এই মাটি তুমি সোনা ভেবে বয়ে এনেছ! ফকির হাসল, বলল, এই সোনা যে মাটি নয় সেটা বুঝতেই এতকাল বাইরে ছিলাম।

সুখ শান্তিও তেমনি। তুষার ক্রমে ক্রমে ভেবে নিল এই শিশুতীর্থের মধ্যেই সুখ আনন্দ তার। সুখ আনন্দ পেল। তুষার ভেবে নিল, নিজেকে ব্যয় করার এই পথটিই তার মনকে তৃপ্তি দিচ্ছে সুতরাং তুষারের মন ভরে থাকল।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে তুষার অনেকদিন পরে পুরনো কথাগুলো আজ ভাবল। জ্যোতিবাবুকে সে কখনও গভীর করে খুব কাছাকাছি এনে ভাবেনি। কারণ জ্যোতিবাবু তেমন মানুষ যাকে কাছে আনার বা কোনও নিকট সম্পর্কে এনে ভাবার সুযোগ পাওয়া যায় না। তুষারের সঙ্গে জ্যোতিবাবুর পরিচয় পুরনো, অথচ তুষার কখনও এই শান্ত নম্র ধীর স্থির মানুষটিকে অকারণে মনে করতে পারেনি। অপ্রয়োজনে তার সামনে যেতে বা কথা বলতে পারেনি। তার ফলে পরিচয় সত্ত্বেও, জ্যোতিবাবু তাকে শিশুতীর্থের মায়ায় জড়িয়ে দেওয়ার কারণ হলেও, তুষার ওঁকে দূরে দূরে রেখেছে, তুষার ওঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করেছে। জ্যোতিবাবুকে দেখলে তুষারের মনে যে ভাব হয়েছে তাকে ঠিক কী ভাবে বর্ণনা করা যায় তুষার জানে না। তবু যদি বর্ণনা করতেই হয়, তুষার বলবে, বুঝলি শিশির, তোদের জ্যোতিদাকে মিশনের সাধু-টাধু মনে হয়।

প্রকৃতপক্ষে জ্যোতিবাবুকে তেমন করে কেউ দেখে না। জ্যোতিবাবু কোনও উঁচু জায়গায় চড়ে নেই। খুব সাধারণ সরল কাজের মানুষ। অথচ এই মানুষটিকে কখনও অন্তরঙ্গ ভাবা যায় না, উপায় নেই ভাববার। কেন?

বোধ হয়, তুষার ভাবল, বোধ হয় জগতে এই রকম কিছু মানুষ থাকে, যারা আত্মীয়তা ও প্রীতি সম্পর্কের নাগালের মধ্যে থাকলেও শ্রদ্ধা-সম্মানের পাত্র হলেও, কোনও আশ্চর্য কারণে ঘনিষ্ঠ হতে পারে না।

আদিত্য এবং জ্যোতির তুলনা তুষারের এই মুহূর্তে মনে পড়ল। আকস্মিক ভাবেই।

এদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। তুষার মনে মনে ভাবল, দুই মূর্তিকে দুপাশে দাঁড় করিয়ে যেন দেখল অল্পক্ষণ, তারপর অপ্রসন্ন বোধ করল।

দিদি শিশির কথা বলল।

তুষার তখনও ভাবছিল। অন্যমনস্ক চোখে শিশিরের দিকে তাকাল। শিশিরকে এখন কেমন ছায়ার সঙ্গে জ্যোৎস্না মেশানো ছবির মতন দেখাচ্ছে। চাঁদের আলো যে কখন জানলা দিয়ে আরও এগিয়ে বিছানায় এসেছে, কখন যে শিশির সেই আলোর দিকে সরে বসেছে তুষার জানে না। সে খুব অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। এখন খেয়াল হল।

তোদের পুজোর ছুটি কবে হচ্ছে রে? শিশির শুধোল।

জানি না। তুষার জবাব দিল। কেন?

জিজ্ঞেস করছি।

হবে শীঘ্রি। পুজোর তো আর দেরি নেই।

ছুটি একটু আগে আগে হলে ভাল হয়। বাড়িটায় এবার চুনকাম করা দরকার। দেখছিস না দেওয়াল-টেওয়ালগুলো কেমন হলদে হয় যাচ্ছে।

তুষার দেওয়ালের দিকে তাকাল। লণ্ঠনের অপ্রচুর আলোয় চারপাশটাই আবছা হয়ে আছে, অন্ধকারই বেশি, দেওয়ালগুলো কালো ছায়ার মতন দেখাচ্ছে।

তোর ছুটি না থাকলে হবে না! শিশির বলল।

গলার হারটায় তুষার অযথা আঙুল দিয়ে ঘষছিল। শিশিরের পায়ের কাছে চাঁদের আলো সাদা লোমঅলা পোষা বেড়ালের মতন যেন ঘুমিয়ে আছে। তুষার অকস্মাৎ অনুভব করল, তার চারপাশে কেমন বেদনার নীরবতা। নিরানন্দের একটি জগতে তারা দুই ভাইবোনে বসে আছে। তারা দেওয়ালে চুনকামের কথা ভাবছে। তারা তাদের গৃহবাসকে হলুদ মলিন বিবর্ণ হয়ে আসছে দেখে উজ্জ্বল করে তোলার প্রয়োজন অনুভব করছে। কিন্তু তা কি সম্ভব?

সহসা বাইরে সাইকেলের ঘন্টি বাজল। চমকে উঠল তুষার। কান পেতে থাকল। তার বুকের শব্দ ঈষৎ দ্রুত, নিশ্বাস অনিয়মিত। কপালে সামান্য উষ্ণতা অনুভব করছিল।

তুষার মনে মনে স্থির করল, আদিত্যকে সে আজ বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেবে না। রূঢ় এবং নিস্পৃহ। আচরণ দেখাবে। মানুষটা সহজ সৌজন্যের সুযোগে অনেক বেশি মাথায় উঠেছে। না, তুষার আর ওই লোকটিকে ছেলেমানুষ ভেবে, কৌতুক অনুভব করে, অকারণে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ দেবে না।

বিছানা ছেড়ে ওঠার জন্যে যেন তুষার অপেক্ষা করতে লাগল। আদিত্যকে স্পষ্ট করে তুষার আজ বলে দেবে, সন্ধেবেলায় আমার কাজ থাকে, গল্প করার সময় আমার কই। আপনি বরং অন্য কোথাও…

বাগানে কোনও শব্দ হল না। সাইকেলের ঘন্টি আরও দূরে বার কয়েক বেজে বেজে আর বাজল না। তুষার বুঝতে পারল, আদিত্য নয়। রাস্তা দিয়ে কেউ চলে গেল।

তুষারের উচিত ছিল স্বস্তি অনুভব করা, কিন্তু তুষার স্বস্তি পাচ্ছিল না।

৩. তুষার কাপড় বদলাচ্ছিল

১১.

আশাদির ঘরে তুষার কাপড় বদলাচ্ছিল। বাইরের দরজা ভেজানো, ঘরের ভেতর দিকের দরজা খোলা। আশাদি স্নানের ঘরে স্নান করছে, জলের শব্দ ভেসে আসছিল। খোলা জানলার পরদা দিয়ে মধ্যাহ্নের উজ্জ্বল রোদ অনুভব করা যায়। বাইরে একটা ঘুঘু অনবরত ডেকে যাচ্ছে। এই ঘর নিস্তব্ধ। তুষার আঁচলটা গায়ে টেনে নিয়ে বেতের মোড়া টেনে বসল, চুল ঠিক করে নেবে। চিরুনি হাতে উঠিয়ে, আশাদির ছোট আয়নায় নিজের মুখ দেখে তুষার একটুক্ষণ চেয়ে থাকল। তার চোখের সাদা জমির কোণে যেন লালের ছিট লেগেছে। বেশি জল ঘাঁটার জন্যে, নাকি সাবানের ফেনায়, অথবা রোদ লেগে এই লালটুকু হয়েছে, তুষার বুঝতে পারল না। আজ সে খুব জল ঘেঁটেছে, অনেকক্ষণ ধরে স্নান করেছে। মাথাটা কেমন ভাব ধরা-ধরা হয়েছিল সকাল থেকেই, রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি। যেন ঘুমের মোটা সর কোনও কারণে দুধের সরের মতন ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল। সকালে বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে করছিল না, বাসের হর্ন শুনে উঠেছে। আজ তার তৈরি হয়ে বেরোতে বেশ দেরি হয়ে গেছে।

চিরুনি বসিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে তুষার অনুভব করল, তার চুল মাথা এখন খুব ঠাণ্ডা। ভাত খাবার পর সমস্ত গা ঘুমের আলস্যে জড়িয়ে ধরবে। ঘুম পাবে খুব।

খাওয়া-দাওয়ার পর ছেলেমেয়েগুলোর খানিকক্ষণ শুয়ে থাকার কথা। যা দস্যি সব, শোয় না, ঘুমোয় না–চুপ করেও থাকে না। কেউ লুডো খেলে, কেউ স্নেক ল্যাডার; নয়তো মাঠে ছুটবে, টেনিস বল নিয়ে ফুটবল খেলবে। আজ ওদের শান্ত করতে পারলে তুষার নিজের ছোট ফালি-ঘরে গিয়ে ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে নেবে একটু।

টেনে টেনে চুল আঁচড়াচ্ছিল তুষার। এলো চুলই থাকবে। একটা গিট দিয়ে নেবে দুপাশের দুগুচ্ছ চুল এনে। রোজই তাই করে। সারা দুপুর বিকেলে চুল শুকোয়, বাড়ি ফিরে তবে বিনুনি বা খোঁপা বেঁধে নেয়।

পুজোর ছুটির জন্যে আজ সকাল থেকেই তুষার কেমন ছেলেমানুষদের মতন কাতর হচ্ছিল, আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। পুজো খুব কাছে। আর বুঝি বিশ বাইশটা দিন। এখানে আকাশ যেন অপরাজিতা ফুলের পাপড়ির আগার মতন বেগুনেনীল; কী নির্মল নয়ন জোড়ানো, হালকা তুলোর মেঘ কোথাও কোথাও রোদে গা ভাসিয়ে শুয়ে আছে, রোদের রং সোনার মতন, বর্ষার শেষে গাছপালা মাঠ সবুজ, সবুজে রোদ পড়ে সর্বত্র একটি আভা ঠিকরে উঠেছে। আর এই বাতাস বার বার শরতের সেই সুগন্ধ এনে দিচ্ছে।

তুষার আজ শিশুতীর্থ আসার পথে বাইরে প্রকৃতি দেখতে দেখতে অনুভব করল, তার মন এখন সব দায় দায়িত্ব ভুলে গিয়ে নিভৃত বিরাম চাইছে। প্রত্যহের এই পুনরাবৃত্তি থেকে কিঞ্চিত বিরাম।

আশাদি বারান্দায়, তার গলার আওয়াজ শোনা গেল। মনে মনে কথা বলে আশাদি, অথচ সে কথা উচ্চস্বর হয়ে ওঠে। তুষার শুনল শুনল না,তার কানে ভাসা ভাসা ভাব একটা কথা গেল শুধু, মলিনা…।

সামান্য পরেই আশাদি ঘরে এল। আলগা অগুছালো শাড়িতে আশাদিকে বউ বউ দেখাচ্ছে। আয়নার এক পাশে চোখ করে তুষার আশাদিকে দেখল। তার হাসি পাচ্ছিল, মজা লাগছিল দেখতে।

তোর চুল আঁচড়ানো হল? আশাদি বললেন।

হ্যাঁ। হয়েছে। বলে তুষার আয়না থেকে মুখ সরিয়ে ঘাড় ফেরাল।

গা থেকে শাড়ির আঁচল আলগা করে আশাদি সেমিজের ওপর জামা পরছিল।

আশাদি?

বল।

তুমি রঙিন শাড়ি পরে বাইরে যাও না কেন? তুষার শুধোল।

হাত গলিয়ে জামা গায়ে পরে নিয়ে আশাদি তুষারের দিকে না তাকিয়ে বলল, সেফটিপিন দে তো৷।

তুষার উঠে নিজের বেতের টুকরি থেকে চাবির গোছা বের করল। চাবির রিঙে দু একটা সেফটিপিন থাকে।

আশাদির হাতে সেফটিপিন দিয়ে তুষার আবার বলল, রঙিন শাড়িতে তোমায় বেশ দেখায়, আশাদি।

জামায় সেফটিপিন আটকে আশাদি মুখ তুলে তুষারকে দু পলক দেখল। চোখের তলায় সকৌতুক হাসি সামান্য। আয়নার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, আমাদের কি রঙিন শাড়ি পরার বয়েস আছে রে! বুড়ি হয়ে গেলাম। নিজের চিরুনি খুঁজে নিয়ে আশাদি চুল আঁচড়াতে বসল।

তার চিরুনিটা পরিষ্কার করে জানলা দিয়ে ওঠা-চুলের গুচ্ছটা ফেলে দিচ্ছিল তুষার। আদিত্যকে দেখতে পেল। রান্নাঘরের দিকে গাছতলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে মলিনার সঙ্গে। যেমন করে মানুষ রেল স্টেশনের গাড়ি দেখে, সরল কৌতূহলে, তুষার সেই ভাবে আদিত্যদের দেখল। দেখে জানলা থেকে সরে এল।

তোমার যা কথা– তুষার আশাদির বিছানার পায়ের কাছে বসল, সত্যি তুমি রঙিন শাড়ি মাঝে মাঝে পরো, আশাদি। বেশ দেখায়।

কেমন দেখায় শুনি।

আ-হা। কেমন আর? ভাল। তুষার হাসল। বাড়িতে যেমন বউদি-টউদিদের দেখায়।

খুব। আশাদি মোড়া ঘুরিয়ে তুষারের মুখোমুখি বসল, চুল আঁচড়াতে লাগল, তোর দেখি খুব। সাধ।

ওমা, সাধ কীসের। তুষার বোধ হয় সামান্য অপ্রস্তুত, দেখতে ভাল লাগে তাই বললাম।

চুলের প্রান্ত বুকের কাছে এনে জটের বাধা ছাড়াতে ছাড়াতে আশাদি বলল, ভাল লাগলেই কি সব করা যায়! বলে দু মুহূর্ত থামল, আবার বলল, রঙিন পরতে আমার বড় লজ্জা করে রে। পরি না তো। এই ঘরে কাপড়-চোপড় ছাড়তে বা বিকেলে পরতে হয়। ঘরে চলে। বাইরে নয়।

তুষার বুঝে পাচ্ছিল না, ঘরে যদি পরা যায় বাইরে নয় কেন? কীসের বাধা?

আশাদি কী ভেবে বলল, এই শাড়িটাও কি সাধে পরেছি। …কাল বিকেলে মলিনা একটা শাড়ি চাইল। দিলাম বাক্স খুলে। তখনই এটায় চোখ পড়ল। কবেকার কেনা জানিস, দু বছর আগে। বাংলা দেশ ছাড়া এশাড়ি তুই পাবি না। পরতে ইচ্ছে হল খুব। হাজার হোক মেয়েমানুষ তো রে…আশাদি হেসে উঠল, শাড়ির লোভ বড় লোভ। কাল সন্ধেবেলায় পরেছিলাম।

তুষার শুনছিল। মলিনার কথায় আবার তার আদিত্যের কথা মনে পড়ল। এখনও কি ওরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছে গাছতলায়? তুষারের ইচ্ছে হল, একবার উঠে গিয়ে দেখে। দেখল না।

চুল আঁচড়ানো শেষ করে আশাদি মুখ মুছে নিল। এখন খেতে যেতে হবে। শাড়িটা বদলে নিলেও চলত, কিন্তু তুষারের জন্যেই যেন, বদলাল না আশাদি; খেয়ে এসে বদলালেই চলবে।

তুষার?

বলো।

একটা কথা বলি তোকে। আশাদি এলো-আঁচলের প্রান্ত কাঁধে উঠিয়ে নিল। জ্যোতিবাবুর আস্কারায় মলিনা যা করছে আজকাল; চোখে লাগে বাপু আমাদের।

কী করছে মলিনা? তুষার তাকাল, তাকিয়ে থাকল অপলকে।

কাল সন্ধের গোড়ায় মলিনা ওই আদিত্যের সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে গেল–ফিরল যখন তখন আমরা খেতে বসেছি। কী বিচ্ছিরি লাগে দেখতে বল তো! আশাদি অনুযোগের গলায় বলল।

তুষার যেন কেমন হতবুদ্ধি,হল। কথাটা বুঝেও না-বোঝার মতন করে বসে থাকল। এখানে এসব ছিল না। …আমি বলছি না এতে কিছু মন্দ আছে, তুষার। কিন্তু মানুষের চোখ বলে একটা জিনিস আছে। দৃষ্টিকটু লাগে। লাগত না, যদি ওরা এখানে আশেপাশে কোথাও ঘুরে বেড়াত অত রাত না করত। আশাদি যে বেশ অসন্তুষ্ট, ব্যাপারটা পছন্দ করেনি বোঝা যাচ্ছিল।

খুবই আচমকা তুষার কেমন বিরক্তি অনুভব করল, রাগ হয়তো। বলল, এতে জ্যোতিবাবুর দোষ কোথায়?

দোষ দিচ্ছি না আমি, বলছি। জ্যোতিবাবু মলিনাকে প্রশ্রয় দেন যথেষ্ট। নয়তো এরকম সাহস মলিনার হত না।

মলিনার নিজেরই বোঝা উচিত। তুষার বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল।

কে বুঝবে! কোনও জ্ঞান-গম্যি আছে তার। আশাদি এবার রাগের গলায় বলল, এখানে ওকে দিয়ে কাজ চলে না। সে স্বভাব মন ওর নয়। জ্যোতিবাবু ভাবেন, ওকে তৈরি করে নেবেন। তৈরি হবার মতন মেয়ে ও নয়। সে যোগ্যতা মলিনার নেই। আশাদিও উঠে পড়ল।

চল খেয়ে আসি। বাইরে বেরিয়ে দরজাটা টেনে ভেজিয়ে দিতে দিতে নিচু গলায় আশাদি বলল, আর ওই এক এসে জুড়ে বসেছে। যাবার নাম করে না। …তুই জানিস তুষার, একটা ঘোড়া কোথা থেকে এনে সাহেবদাদুর পুরনো গাড়িটায় জুড়ে গাড়ি হাঁকাবার চেষ্টা করছে। কাল ওই করতে গিয়ে মরত। যত বিদঘুঁটে কাণ্ড!

তুষার নীরব। আশাদির বাড়ির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মলিনার ঘরের দিকে তাকাল একবার, দরজা বন্ধ। মলিনা সকালেই স্নান করে নেয়, দুপুরে সে বড় একটা ঘরে আসে না। প্রয়োজন হয় না তার।

বাড়ির নীচে দু পাঁচ পা এগিয়ে একটা গাছ। বেশ বড়, লম্বা লম্বা পাতা। ওরা কেউ নাম জানে না গাছটার। বুনো কোনও বৃক্ষ। …ঘুঘুটা তখনও ডাকছিল। তুষার খাবার ঘরের দিকে তাকাল। ছেলেমেয়েরা খেয়ে-দেয়ে চলে গেছে–ঝি এঁটো ফেলছে। এক খণ্ড দুধের মতন সাদা মেঘ চোখে পড়ল তুষারের। তার এখন আর কিছু ভাল লাগছিল না। অল্প আগে এই শরতের স্পর্শ মনকে হালকা আলস্য লোভী করেছিল। এখন সব বিরস লাগছে। ভাল লাগছে না। রোদের তাত মুখে লাগার মতন গাল কপাল তপ্ত লাগছে। তুষার খাবার ঘরের দিকে হেঁটে চলল।

.

খাবার ঘরে একপাশে মেয়েরা–আশাদি তুষার মলিনা; অন্য দিকে জ্যোতিবাবু প্রফুল্ল আর আদিত্য। মাটিতে বসে খেতে হয়। হাট থেকে কিনে আনা শালপাতার অভাব পড়ে না, পড়ে এনামেলের থালা বাটির। বাচ্চাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শালপাতা পেতে দিলে তারা খুব খুশি হয়। তুষারদের অবশ্য কাঁসার থালা কিন্তু বাটি গ্লাস এনামেলের।

ওরা পুরুষরা একদিকে মেয়েরা অন্যদিকে বসে খাচ্ছিল। খাবার ঘরের জানলাগুলো হাট করে খোলা, ডালিম গাছটা চোখে পড়ে। সিমেন্ট করা মেঝেতে রোদের আভা আর নেই, ছায়া ছড়িয়ে আছে। ঘরটা নিরিবিলি; একটা কালো ভ্রমর এসে সমস্ত ঘরে গুঞ্জন তুলেছে; কখনও কখনও বাইরে থেকে দাসদাসীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে।

খাবার সময় সচরাচর মেয়েদের তরফে বড় একটা কথা হয় না; বা হলেও কোন খাবারটা কেমন হয়েছে তার জন্যে আশাদিকে হয়তো পুরুষপক্ষ থেকে কিছু বলা হয়। পুরুষদের দিকে মোটামুটি একটা কথাবার্তা থেকে যায়। মেয়েরা হয়তো খেতে খেতে সে কথায় কান দেয় কখনও, কখনও বা দেয় না।

আজ পুরুষদের দিকে আদিত্য অন্য দিনের চেয়েও বেশি কথা বলছিল। তার বলার বিষয়ের অভাব নেই, এবং ঈশ্বর তাকে লজ্জা সঙ্কোচ দেননি। খেতে খেতে আদিত্য ঘোড়ার কথা বলছিল। বলছিল, এ দেশে ঘোড়ার আদর ছিল রাজপুতদের কাছে, মিডাইভাল যুগে। কারণ, সমস্ত রাজপুতনা আর তার আশেপাশেও যে প্রকৃতি–সে-প্রকৃতি রুক্ষ নির্মম। সে মানুষকে বিশ্বাস করেনি, মানুষকে তার মাটিতে বসাতে চায়নি। চিরকাল সে বিমুখ ছিল–বিমুখতাই তার স্বভাব…।

কথাগুলো জোরে জোরে বলছিল আদিত্য, বলতে বলতে তুষারের দিকে তাকাচ্ছিল। আদিত্যর কথা শুনতে ভাল লাগে। তার কথায় সব সময় হৃদয়ের আবেগ থাকে, সে ভাষায় অলঙ্কার দিয়ে কথা বলে, কিন্তু একথা মনে হয় না, এসব বেখাপ্পা, এসব নাটুকে। ফলে আদিত্যের কথা সবাই শোনে। আজও শুনছিল।

রাজপুতরা কেমন করে তাদের প্রতি বিমুখ প্রকৃতিকে জয় করার জন্যে ঘোড়ার ভক্ত হয়েছিল, ঘোড়াকে খাতির যত্ন করতে শিখেছিল, আদিত্য তার এক বিবরণ দিল। বিবরণ দেওয়া শেষ হলে সে রাজপুত রাণাদের ইতিহাস প্রসিদ্ধ ঘোড়ার নামগুলো একে একে বলে গেল। তারপর থামল, থেমে হাসল হাহা করে বলল, আমি এখানকার সব বিমুখতাকে জয় করব। বুঝলেন, জ্যোতি-স্যার, সেই জন্যে একটা ঘোড়া আনিয়েছি।

জ্যোতি-স্যার কথাটা ঠাট্টা করে বলা। এই রকম ঠাট্টা আদিত্য করে থাকে। জ্যোতিবাবু রাগ করে কি? তুষার জানে না। মনে হয় না রাগ করে, রাগ করার মানুষই নয়।

আদিত্যর কথায় প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল বোধ হয়। ইঙ্গিত বলে মনে হওয়ার আরও কারণ, আদিত্য কথা বলতে বলতে প্রায়ই চোখ তুলে তুষারকে দেখছিল। তুষার লক্ষ করেছে।

খাওয়ার পর্ব তাড়াতাড়ি সারতে চাইছিল তুষার। তার ভাল লাগছিল না। আশাদির সঙ্গে কয়েকবার চোখাচুখি হল। মনে হল আশাদি বলছেন, বড্ড কথা বলে ভদ্রলোক; এত বাজে কথা মানুষ বলতেও পারে! তুষার মলিনাকে দেখল নজর করে, মলিনা যেন মুগ্ধ চিত্তে আদিত্যর বক্তৃতা শুনছে। কী বিশ্রী!

আদিত্য ঘোড়ার গল্প শেষ করে বলল, জ্যোতি-স্যার কি কখনও ঘোড়দৌড়ের মাঠে গেছেন?

জ্যোতি মাথা নাড়ল। না।

রেস-এ বাজি ধরেন কখনও?

না। জ্যোতি হাসি মুখে বলল।

দ্যাটস অ্যান এনজয়মেন্ট! ..খুব থ্রিলিং। আদিত্য বলল, আমি বার দুই তিন গিয়েছি। একবার প্রায় টাকা চল্লিশেক জিতেছিলাম।

চল্লিশ টাকা। মেয়েদের দিক থেকে মলিনা বলল। এমন আচমকা বলল যে, পুরুষরা সকলেই তাকাল। আশাদি এবং তুষার পরস্পরের মুখের দিকে তাকাল। তুষারের মনে হল, মলিনা যেন তাদের এই তরফের আভিজাত্য সম্মান রুচি সব নষ্ট করে দিল।

চল্লিশ টাকা জেতা কিছু নয়… আদিত্য ও-তরফ থেকে বলল, যার লাক ফেবার করে সে চার হাজারও একদিনে জিততে পারে চোখের পলকে। ইট ইজ এ কোশ্চেন অফ লাক!

জুয়া খেলা ভাল না–প্রফুল্ল মিনমিনে গলায় বলল, মানুষে শুনেছি হারে বেশি, জেতে কম।

আদিত্য হেসে উঠল। উচ্চস্বর সেই হাসির কোনও মাথা মুণ্ডু খুঁজে পেল না তুষার। খাবার ঘরটা কি জুয়ার গল্পের আড্ডা হয়ে উঠল! বিরক্ত হয়ে তুষার হাত গুটিয়ে নিল। আশাদিও অসন্তুষ্ট।

মলিনাকেই যা উৎসাহিত দেখা গেল, এই সব গল্প যেন তার খুব ভালই লাগছে।

হাসি থামলে আদিত্য প্রফুল্লকে উপলক্ষ করে সকলকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, আপনি মশাই শিশুশিক্ষার বই-টই লিখুন, বেণীর গল্প গোপালের গল্প-টল্প, বিদ্যাসাগর মশাই মার খেয়ে যাবেন। …যা বললেন একটা কথা, জুয়া খেলা ভাল না, মানুষ হারে বেশি–জেতে কম! …আরে মশাই, সব খেলাতেই হারের আশংকা বেশি, আপনার কথাটাই ভেবে দেখুন না–উইন করছেন নাকি, বেধড়ক হেরে যাচ্ছেন। তবু তো পড়ে আছেন মাটি কামড়ে। জীবনে জেতাটাও ভাগ্য! লেট আস হোপ ফর দি বেস্ট–বলতে বলতে আদিত্য চোখ তুলে তুষারের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকল।

তুষার মাথা তুলতেই সেই চোখ দেখতে পেল। তার অস্বস্তি হল, ঘৃণা হল। কী করে একটা লোক বার বার এভাবে মেয়েদের দিকে তাকায়! তুষার এবার স্পষ্ট গলায় আশাদিকে বলল, আমি উঠছি, আশাদি। অপেক্ষা করল না আর তুষার, এঁটো কুড়িয়ে নিয়ে উঠল পড়ল। জ্যোতিবাবু যে তার দিকে তাকাল, তুষার দাঁড়িয়ে ওঠার পর তা লক্ষ করল।

.

দুপুরের আলস্য গভীর করে জড়িয়ে ধরেছে তুষারকে। নিজের ক্লাস-ঘরের কুঠরিতে ক্যাম্বিসের চেয়ারে সে শুয়ে আছে। সামনে ফালি জানলা। শরতকালের এই দুপুর এখানে কী জারকে যেন জরে যাচ্ছে। সামনের মাঠটুকুতে ছায়ার কাপড় যেন শুকোতে দেওয়া হয়েছে, এক ছায়া থেকে অন্য ছায়ার মধ্যে রোদ, দুপুরের রোদ বলেই প্রখর, মৃদুমন্দ বাতাস বইছে, আর সম্মিলিত পক্ষীকুলের বিচিত্র শব্দ কখনওঁ নিকটে কখনও দুরান্ত থেকে ভেসে আসছে। পড়ার ঘরে ছেলেমেয়েগুলো খেলছে হয়তো, খেলা শেষ হলে আজ পাঁচটা ধাঁধাঁ করবে। ধাঁধাঁগুলো তুষার ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিয়ে এসেছে। এই ধাঁধার মধ্যে একটা বানান সংক্রান্ত, একটা মহাভারতের, একটা ভূগোলের, আর বাকি দুটো অঙ্কের। ছেলেমেয়েরা খুব ভালবাসে এই ধাঁধা। তুষার জানে ধাঁধার খেলা নিয়ে এক দেড় ঘণ্টা ওরা অনায়াসে কাটিয়ে দেবে। গোলমাল করবে না, বাইরে পালিয়ে যাবে না।

ক্যাম্বিসের চেয়ারে শুয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তুষার চোখের পাতা ক্রমে ছোট করে আনছিল, যেন কপালের কোথাও আলস্যজাত ঘুমের কাজল আছে, চোখের পাতায় ছুঁইয়ে নিতে পারলেই চোখ জুড়ে যাবে। ভাল লাগছিল ওর, শরীরের প্রতি অণু এই মধ্যদিনের পুঞ্জিত বিশ্রামের মধ্যে শিথিল হয়ে আসছিল।

তুষার ছুটির কথা ভাবছিল। পুজোর ছুটি যেন এখন থেকেই নেশার মতন টানছে। যত তাড়াতাড়ি ছুটি হয়, ততই ভাল। তুষার জানে না, সেই ছুটি কেন তার এত কাম্য। তবু মনে হচ্ছে ছুটিটায় সে বিশ্রাম নেবে, এই প্রাত্যহিক কর্ম থেকে বিরতি, একটানা কাজ থেকে খানিক ছুটি।

নিজেকে তুষার বাস্তবিক আজ কদিন ক্লান্ত অনুভব করছে। তার এমন চিন্তা–এই ক্লান্তি অনুভব আগে কখনও আসেনি। শরীর হয়তো ক্লান্ত লেগেছে, সে ক্লান্তি পরিশ্রমের, আসা যাওয়ার, দায় দায়িত্ব পালনের। আজকাল যে ক্লান্তি অনুভব করছে তুষার–তা শরীরের, ঠিক শরীরজাত নয়, পরিশ্রমের জন্যেও নয়। মনের কোথাও যেন একটা ভাল না লাগার ভাব। উদাস ও অবসন্ন হওয়ার শূন্যতা বোধ করছে। কেন? এরকম কেন লাগছে তুষারের? তার শরীর কি ভাল যাচ্ছে না!

তন্দ্রায় চোখ জড়িয়ে তুষার ঘুমিয়ে পড়ছিল। আচমকা গলা শুনে চোখ খুলল তুষার। তার জড়তার মধ্যে আদিত্যকে দেখল। দেখেও যেন মনে করতে পারল না, ওই লোকটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ঘুমের চোখে তাকাল, আবার পাতা বুজল।

বাঃ, দিব্যি ঘুমোচ্চন তো! আদিত্য বলল।

তুষার ঘুমের বোজা চোখে ঠোঁটে যেন হাসল, ফিক করে। সে দেখছিল না।

মেয়েরা দুপুর বেলায় খানিক গা গড়িয়ে নেয় তা হলে–সে যেই হোন। আবার বলল আদিত্য।

চোখ মেলল তুষার। ফালি জানলার ওপাশে আদিত্য দাঁড়িয়ে আছে। ডান হাতের আঙুলে চোখের পাতা বুলিয়ে তুষার আবার দেখল। আদিত্য। তা হলে তন্দ্রায় বা ঘুমের জড়তায় নয়, সত্যিই আদিত্যকে সামনে দেখছে তুষার। সঙ্গে সঙ্গে গায়ের কাপড় ঠিক করে ক্যাম্বিসের চেয়ারের ওপর সোজা হয়ে, পিঠ উঁচু করে নিয়ে বসল তুষার। পায়ের দিকের কাপড় গুছিয়ে টেনে নিল। চোখের দৃষ্টিতে বিরক্তি ফুটল।

আপনি! তুষার গলা তুলতে পারল না।

দেখতে এলাম আপনাকে। আদিত্য বলল, মুখে সেই হাসি, তুষার যে-হাসি অপছন্দ করে।

কথাটা কানে কটু শোনাল তুষারের। অভদ্র!

আপনি কী মনে করেন? তুষার খুব অপ্রসন্ন হলেও রাগ যথাসম্ভব সংযত করে বলল। বলে তিরস্কারের চোখে চেয়ে থাকল।

আদিত্য জানলার কাছে আরও সরে এল দু পা-খাঁচায় বন্দি কোনও প্রাণীকে কৌতূহলে সকৌতুকে দেখছে–এমন চোখ করে দেখল সামান্য সময়। বলল, আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। আপনি বড় অদ্ভুত পদার্থ!

অদ্ভুত!

রাগ করে খাওয়ার ঘর থেকে উঠে এলেন কেন? আদিত্য স্পষ্ট গলায় জানতে চায়।

তুষার দু মুহূর্ত দেখল আদিত্যকে, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, রাগ! কীসের রাগ?

কী করে জানব। তবে আপনার মুখ দেখে মনে হল না আমার ওপর যথেষ্ট অনুরাগ দেখিয়ে উঠে এলেন।

তুষারের কানে শব্দটা ভাল শোনাল না। মনের মধ্যে যেন কাঁকর পড়েছে–অনুরাগ শব্দটা সেই ভাবে অস্বস্তি জাগাল। বিরক্তস্বরে ও বলল, আমার খাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

বাজে কথা বলছেন কেন!

বাজে কথা!

আমার ওপর আপনার এত বিতৃষ্ণা কেন বলুন তো তুষার দিদিমণি–আদিত্য হাস্যকর গলা করে বলল, যেন সত্যিই সে একটা কথা সরাসরি জানতে চাইছে।

তুষার জানলা দিয়ে তাকাল। আদিত্য প্রায় সবটুকু জানলাই জুড়ে নিয়েছে। ওপাশের মাঠ বা গাছ আর দেখা যাচ্ছে না। দেখা যাচ্ছে না জ্যোতিবাবুর ঘরের বাইরের অংশ। কে কোথায় রয়েছে এখন, কে দেখছে, যদি তুষারের ঘরের সামনে আদিত্যকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কী ভাববে ইত্যাদি চিন্তায় তুষার অস্বস্তি বোধ করল, বিব্রত হল।

বিতৃষ্ণা সতৃষ্ণার কথা নয়–তুষার চোখ নামিয়ে বলল, এখন বিশ্রামের সময়, আমি বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবেন না দয়া করে…, এটা–তুষার কথা শেষ করতে পারল না।

আদিত্য গ্রাহ্য করল না। বরং আরও যেন দৃষ্টিকটু কাণ্ড করল, জানলার কাণা ধরে দাঁড়াল। সদা সত্য কথা বলিবে। কাহাকেও প্রবঞ্চনা করিবে না। …আপনি সাদামাটা সত্যি কথাটা বলে ফেলুন না, ঝঞ্ঝাট চুকে যায়।

কী বিরক্তিকর! মানুষটা কি কানে তুলো গুঁজে গায়ে গণ্ডারের চামড়া দিয়ে থাকে। কেন তুষারকে ও বার বার এমন করে অপ্রসন্ন বিরক্ত করে তুলতে চায়। ভাল লাগে না তুষারের সহ্য হয় না। বিশ্রী লাগে তুষারের, গায়ে যেন জ্বালা করে, মনে ঘৃণা আসে। তুষারকে কি ও তার পরিহাসের পাত্রী পেয়েছে?

আপনি এখান থেকে যান। তুষার শক্ত গলায় বলল। এটা গল্পগাছা করার জায়গা নয়।

কেউ দেখবে এই ভয় বোধ হয় আপনার!

দেখতে পারে।

দেখলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

আমি পছন্দ করি না।

আমায় যে কেন আপনার এত অপছন্দ আমি বুঝে উঠতে পারি না। আমি আপনার কোনও ক্ষতি করিনি। …হোয়াই শুড ইউ হেট মি? হোয়াই? অ্যাম আই এ লোফার? …কী, ব্যাপারটা কী? সরাসরি মন খুলে বলে দিন।

আদিত্য এমন ভাবে জানলার মধ্যে ঝুঁকে পড়ল যে, তুষারের মনে হল ও বোধ হয় গলে আসবে ফোকর দিয়ে। আসা কিছু অসম্ভব নয়, জানলাটায় গরাদ নেই, দু পাট খড়খড়ি শুধু। আর আদিত্যর পক্ষে সব সম্ভব। তুষার আরও বুঝল আদিত্য সত্যিই আহত হয়েছে, রেগেছে।

কী বলবে ভেবে পেল না তুষার। মাথায় কোনও আপাতবুদ্ধি আসছিল না। সঙ্কুচিত আড়ষ্ট ভাব নিয়ে তুষার শরীরটাকে চেয়ারের পিছু দিকে টেনে নিল। বলল, ছেলেমানুষি করবেন না। …আমায় এবার উঠতে হবে।

উঠেই দেখুন, একটা কেলেঙ্কারি করব।

মানে?

চেঁচাব।

চেঁচাবেন–

চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সুর করে কবিতা আওড়াব। আপনার ঘরের সব ছেলেমেয়েকে যদি বাইরে বের করে আনতে না পারি তো কি! জাস্ট লাইক দি পাইপপাইপার অফ হ্যাঁমেলিন। আমি বাঁশি বাজাতে বাজাতে যাব, আপনার ছেলেমেয়েরা নেংটি ইঁদুরের মতন নাচতে নাচতে আমার সঙ্গে যাবে। …দেখতে চান? আমি পারি।

আদিত্য এমন ভাবে তাকিয়ে থাকল যেন সে তুষারের সঙ্গে এই নিয়ে একটা বাজি ধরতে চাইছে। তাকে খুব নিঃসন্দেহ দেখাচ্ছিল।

না, থাক। তুষার বিশ্বাস করল না এই পাগলকে। হয়তো পারবে না, হয়তো পারবে। পারুক না পারুক একটা দৃষ্টিকটু ব্যাপার ঘটবে যে তাতে তুষার নিঃসন্দেহ।

আদিত্য বিজয়ীর মতো হাসল। বলল, তবে বসুন। এমন কিছু দেরি হয়ে যায় নি। এখন মাত্র দেড়টা। হাতের ঘড়ি দেখল আদিত্য, দেখাল।

তুষার ভিজে চুলের গোছাটা পিঠে সরিয়ে দিল। কী বিপদেই পড়া গেল! এ মানুষ কেমন, তাড়ালে যায় না, বিরক্তি দেখালে গ্রাহ্য করে না, অপমান করলে মাখে না। আচ্ছা, ওকে কি সত্যি রূঢ়ভাবে অপমান করে দেখবে একবার তুষার, কী হয়! ও গায়ে মাখে কি মাখে না। তুষার চোখ তুলল, দেখল আদিত্যকে, কিছু বলতে পারল না। বলতে ইচ্ছে করল না।

দেখুন দিদিমণি আদিত্য পরিহাস করে বলল, আমি স্ট্রেট ব্যাপারটা পছন্দ করি। যা করব পরিষ্কার। লুকোচুরি, মুখ আড়াল করে কথা বলা, আই হেট ইট। …সরাসরি বলে ফেলুন তো, আপনার চক্ষুশূল হবার মতন কারণটা কী ঘটিয়েছি?

তুষার এই বিপদ থেকে আপাতত মুক্তি পেতে চায়। চায় বলেই কথা বাড়াবে না, মানুষটাকে শাসাবে, বরং কেমন যেন আপোস করার ভাবই ভাল দেখাবে। তুষার অপ্রসন্নতা মুছে নেবার চেষ্টা করে বলল, কী যা তা বলছেন আপনি! কীসের চক্ষুশূল!

তবে?

কী তবে!

আমার সঙ্গে এরকম দুর্ব্যবহার কেন?

আমি কোনও দুর্ব্যব্যহার করিনি। কেনই বা করব! ..এখানে আপনিও যা আমিও তাই।

পাগল। আদিত্য ঘোরতর প্রতিবাদের ভান করল, আমি আউটসাইডার। আপনি ভেতরের লোক। আমার কাজ ভাঙার, লণ্ডভণ্ড করার আপনার কাজ…কী বলে যেন…আপনার কাজ রক্ষণের, লালনের পালনের-আদিত্য টেনে টেনে বলল, পরিহাসের গলায়।

আপনি কি নিজেকে কালাপাহাড় ভেবে খুশি হন। তুষারের গলার স্বর তার অজান্তে নরম কোমল ও সরস হয়ে এসেছিল।

না। আমি নিজেকে কালাপাহাড় ভাবতে চাই না। লোকে আমায় ভেবে নেয়।

অন্যায় করে?

বোধ হয়। আদিত্য অন্য দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বলল। চুপ করে থাকল দু মুহূর্ত, আবার বলল, আমার চরিত্রে অনেক দোষ আছে, না কি বলুন?

তুষার আবার অস্বস্তি বোধ করল! হ্যাঁ, আছে। কিন্তু তুষার কি তাই বলবে না কি! পাগল! কেউ কি বলে তা! কথাটা এড়িয়ে যাবার জন্যে তুষার বলল, ওসব কথা থাক। এখানে–

বলা যায় না বলছেন? বেশ তা হলে বাড়িতে যাব।

বাড়ি! তুষার অস্ফুট গলায় বলে ফেলল।

বারণ করছেন যেতে?

না, না। সে কী…! তুষার তীর ছাত্রীদের মতন বিপর্যস্ত বোধ করে ঢোঁক গিলল।

তা হলে কাল যাব। …আদিত্যর গলা সরল, আজ একবার ঘোড়াটাকে গাড়িতে জুতে ট্রায়াল দিতে হবে। সাংঘাতিক বদমাস ঘোড়া! বাট, আই উইল মেক দ্যাট অ্যানিমাল বিহেভ প্রপারলি।

বলতে বলতে আদিত্য বোধ হয় ঘোড়ার চিন্তায় অন্যমনস্ক হয়ে জানলা থেকে সরে গেল। চলে গেল লম্বা লম্বা পা ফেলে।

জানলাটা এতক্ষণ আদিত্যর শরীরে আড়াল হয়ে ছিল। ও চলে গেলে আবার মাঠ ঘাস গাছ দেখা গেল। দ্বিপ্রহরের রৌদ্র চোখে পড়ল। চোখে পড়ল একটা হরিয়াল পাখিও।

তুষার জানলা দিয়ে তাকিয়ে অনুভব করল, সে অনেকক্ষণ যেন নিশ্বাস বন্ধ করে ছিল। বুক ভারী লাগছে। দীর্ঘ করে নিশ্বাস ফেলল।

.

১২.

বাড়ির বারান্দার কাছাকাছি আসতেই চমকে উঠল তুষার। আতাগাছটার পাশে সাইকেল। হেলান দিয়ে রাখা সাইকেলটার দিকে তাকিয়ে তুষার আর পা বাড়াতে পারল না। আদিত্য তা হলে এখনও অপেক্ষা করছে।

ভয় হল তুষারের। বাড়ির বাগানটা ছোট, গাছপালা প্রচুর নয়; চারদিকে সতর্ক চোখে তাকিয়ে আদিত্যকে খোঁজার চেষ্টা করল। তার ভয় হচ্ছিল; মনে হচ্ছিল, কোনও গাছপালার আড়াল থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে আদিত্য তার সামনে দাঁড়াবে, বলবে–এই রকম অভদ্রতা কেন, আমায় আসতে বলে বাড়ি থেকে পালানো?

বাগানে কোথাও নেই আদিত্য, বারান্দাতেও নেই। তবে কোথায় গেল? চলে গেছে! চলে যাবে যদি তবে সাইকেল পড়ে থাকবে কেন? তা হলে কি তুষারকে না পেয়ে সাইকেল রেখে অন্য কোথাও ঘুরে আসতে গেছে? বোধ হয় তাই। আবার আসবে আদিত্য।

সামান্য সময় লেবুগাছের কাছে দাঁড়িয়ে থেকে তুষার পা পা করে বারান্দার দিকে এগিয়ে চলল। আদিত্য আসবে জেনেও সে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। তুষার আশা করেছিল, বাড়ি এসে তাকে না পেয়ে আদিত্য ফিরে যাবে। ক্ষুণ্ণ হবে, রাগ করবে। তা হোক ক্ষুণ্ণ, তুষারের কিছু আসে যায় না। পরে দেখা হলে বলবে, আমায় একটা জরুরি কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল, কিছু মনে করবেন না।

প্রকৃতপক্ষে তুষার চায়নি, আদিত্য তার বাড়ি এসে আবার জ্বালাতন করুক। ওর উৎপাত সহ্য করা উচিত না; প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। এই ধরনের মানুষকে একটু প্রশ্রয় দিলেই তারা মাথায় ওঠে। বাস্তবিক, আদিত্যকে ছেলেমানুষ বা পাগল ভেবে নিতান্ত ভদ্রতা করে যেটুকু সহানুভূতি দেখিয়েছে তুষার তার পরিণাম এখন বিশ্রী হয়ে উঠেছে! সামলাতে পারছে না তুষার। আদিত্য যেন পেয়ে বসেছে।

ইচ্ছে করে, জোর করে, আদিত্যকে দূরে সরাবার মতন কারণ তৈরি করার অন্যতম উপায় হিসাবে আজ তুষার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সে জানত, আসব যখন বলেছে তখন আদিত্য আসবেই আর এলে সহজে মুক্তি দেবে না, লক্ষটা কথা বলবে জ্ঞানহীনের মতন। এমন অদ্ভুত কোনও অনুরোধ করে বসবে যা করা অশোভন, অযথা অনর্থক তুষারকে ক্রমাগত বিরক্তিকর অবস্থার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে। …

যারা অন্যের সহ্য অসহ্য বোঝে না বুঝতে চায় না, যারা জানে না অন্যেরও ভালমন্দ লাগা আছে, ছোঁয়া পেলে আঠার মতন জড়িয়ে থাকতে চায়, ফুটে যাওয়া কাঁটার মতন যন্ত্রণা দেয় তাদের কাছ থেকে রেহাই পেতে হলে এ ছাড়া আর কী পথ আছে ওই এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া, দূরে দূরে সরে থাকা বই?

কিন্তু, মানুষটা গেল কোথায়? তুষার বারান্দার সিঁড়িতে গিয়ে দাঁড়াল। চারপাশে তাকাল আবার, ভাল করে দেখল।

এমন তো নয়, তুষার ভাবল, আদিত্য চলেই গেছে, শুধু তুষারকে বিব্রত করতে ভয় দেখাতে সাইকেলটা রেখে গেছে? হতে পারে; কিছুই আশ্চর্য নয়। বরং, তুষারের মনে হল, বরং আদিত্যর যা স্বভাব তাতে এই রকম বিশ্রী কিছু করাই তাকে মানায়। সে তোমায় উদ্বেগে রাখবে, দুশ্চিন্তা যাতে জিইয়ে থাকে তার চেষ্টা করবে, তোমায় ভীত ব্যস্ত পীডিত করবে, ওতেই ওর আনন্দ।

কয়েক দিন আগে সেই রাত্রে আসব বলে শাসিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে তুষার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঘরের মধ্যে পা বাড়াল।

ঘর থেকে বারান্দা। রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে। গঙ্গা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। বারান্দার একপাশে মিটমিটে বাতি। অন্ধকারে ডুবোনো দাওয়ায় দড়ির ওপর তুষারের ভিজে শাড়ি বাতাসে দুলছে। তুষার দু মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল, উঁচু মুখে আকাশ দেখল, তারার প্রশ্ন চিহ্নটা একেবারে চোখের সামনা সামনি।

গঙ্গাকে ডাকবে ভেবেছিল তুষার। না ডেকে শিশিরের ঘরের দিকে পা বাড়াল। শিশির বলতে পারবে, ওই মানুষটা কখন এসে ছিল? বাইরে থেকে চিৎকার করে কিছু বলে গেছে কিনা!

শিশিরের ঘরে পা দিয়ে তুষার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। না এগুতে না পিছিয়ে আসতে পারল। চোখের পাতা স্থির, অপরিসীম এক বিস্ময় তাকে বিমূঢ় করেছে। শিশিরের বিছানার ওপর দাবার ছক বিছানো, লণ্ঠনটা জানলার ওপর, দুজনে, গালে হাত দিয়ে দাবার চাল ভাবছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ভুলে। আদিত্যর পিঠ দরজার দিকে।

তুষার এতটা প্রত্যাশা করেনি, কল্পনাও করেনি। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় শিশিরকে তার পালাবার কারণ পর্যন্ত না, বলেছিল আমি সুষমা বউদিদের বাড়ি যাচ্ছি রে, দরকার আছে! ফিরতে দেরি হবে।

দেরি হওয়ার কথাটা বলেছিল এই জন্যে যে, যদি আদিত্য খোঁজ নেয়, জানতে পারবে তুষারের ফেরার দেরি আছে, অপেক্ষা করবে না। অথচ তুষারের সমস্ত অভিসন্ধি আদিত্য ব্যর্থ করল।

এই বা কী রকম? আলাপ পরিচয় নেই শিশিরের সঙ্গে, তবু একটা বাইরের লোক সদর থেকে অন্দরে ঢুকে দিব্যি দাবা খেলছে বসে বসে। কোনও গা নেই, গ্রাহ্য নেই, সঙ্কোচ নেই। শিশিরই বা ওকে কেন ঘরে আসতে দিল!

তুষার একবার ভাবল, যেমন নিঃশব্দে সে এসেছে তেমনি নিঃশব্দে সে চলে যায়। আবার বাইরে, বাড়ি ছেড়ে কাছাকাছি কারও বাড়ি গিয়ে বসে থাকে। যদি রাত দশটা বাজে বাজুক, এগারোটা বেজে যায় তাতেও ক্ষতি নেই, আদিত্যকে দেখা না দিয়ে সে ফিরিয়ে দেবে। কতক্ষণ বসে থাকবে আদিত্য, কত সময় সে অপেক্ষা করতে পারবে।

এখন কটা? আটটা বেজে গেছে বোধ হয়। তুষারের মনে হল, সে নিজেই বোকামি করেছে। তার আরও বেশিক্ষণ বাইরে থাকা উচিত ছিল। অথচ, বাইরে কেমন যেন সময় দীর্ঘ ও গত মনে হল, মনে হল রাত হয়ে গেছে, বাড়ি ফেরার ইচ্ছে ক্রমাগত তাকে অন্যমনস্ক করতে লাগল, সে ফিরে এল।

তুষার দুপা এগিয়ে এল। পালিয়ে গিয়ে লাভ নেই। আদিত্য, বলা যায় না সারারাতই বসে থাকতে পারে।

গলায় শব্দ করল তুষার। শিশির নৌকো চালতে ব্যস্ত, চোখ তুলল। দিদি। বলল ওই যা, আবার চাল দিতে চোখ নামাল।

আদিত্য যেমন বসেছিল তেমনি, মুখ ঘাড় ফেরাল না। তুষার অবাক হল।

তুষারের আবির্ভাব ওদের দুজনকে বিচলিত বা অব্যবস্থচিত্ত করতে পেরেছে এমন লক্ষ্মণ কোথাও দেখা গেল না। পায়ের মাপ আরও একটু বাড়াল তুষার, জানলার পাশে চায়ের কাপ পড়ে আছে, বোঝ দায়-দাবা–দাবা খেলার শুরুতে বা মধ্যে শিশির অতিথি আপ্যায়ন করেছে। তবে কি শিশিরই অতিথি বৎসল হয়ে আদিত্যকে ডাকিয়ে এনে ঘরে বসিয়েছে? শিশিরের ওপর রাগ হচ্ছিল তুষারের। সে যাকে এড়িয়ে যেতে চায় শিশির তাকে আদর করে ঘরে ঢোকায়। বাঁদর কোথাকার! কী বিশ্রী কাণ্ডটা বাঁধাল শিশির!

আদিত্য বিড় বিড় করে কী বলল আপন মনে, একটা চাল দিল, দিয়ে মাথা চুলকোল। এবং পরের চাল ভাববার জন্যেই সিগারেট ধরাল।

রাগ হচ্ছিল তুষারের। কেন হচ্ছিল সে জানে না। দাবা খেলার জন্যে, নাকি তার দিকে কারও ক্ষেপ নেই দেখে! আদিত্য কি এখনও খেয়াল করতে পারছে না, তুষার ঘরে এসেছে?

ইচ্ছে করেই, যেন আদিত্যকে তার দাবার নেশা থেকে অন্যমনস্ক করে দেবার জন্যেই তুষার বিছানার মাথার দিকে–শিশিরের পাশে এগিয়ে গেল। কখন এলেন?

আদিত্য ঘাড় ফিরিয়ে দেখল তুষারকে। এই যে! এসেছেন তা হলে!

তুষার এমন ভাবে তাকাল, যার অর্থ সে বলতে চাইছে, মানে–তা হলে এসেছেন মানে কী?

শিশির আদিত্যর রাজা বেঁধে ফেলেছে। বলল, এবার সামলান।

আদিত্য দাবার ছকের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকল কয়েক দণ্ড। বলল, হেরে গেলাম, ভাই। বলে হাত বাড়িয়ে শিশিরের হাতে চাপ দিল।

হাসল শিশির। বলল, আপনার দুটো চাল আমার মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল। অনেক কষ্টে সামলেছি।

আমি সেই কবে খেলেছি, চাল-ফাল ভুলে গেছি। তা ছাড়া ওই কনসেনট্রেসন–ওটা আর হয় না।

তা হলেও পাকা খেলোয়াড়ের মতন খেলেছেন।

আদিত্য অট্টহাস্যে হাসল।

শিশির দিদিকে বসতে দিচ্ছে এমন ভাব করে সামান্য সরে গেল। তুষার বসল না।

আদিত্য এবার তুষারকে ভাল করে দেখল। তারপর হাতঘড়ি দেখে বলল, সাড়ে ছটায় এসেছি, এখন আটটা কুড়ি৷ খুব লোক আপনি।

তুষার চোখে চোখে তাকাল আদিত্যর, লহমার জন্যে চোখ ফিরিয়ে শিশিরের দিকে রাখল। এক জায়গায় যেতে হল, দরকারি কাজ ছিল একটা। …বলে তুষার সামান্য থামল, শিশিরের সামনে সমস্ত ব্যাপারটাকে সে শালীন স্বাভাবিক করতে চাইল, অনেকক্ষণ বসে আছেন তা হলে–অপরাধ মার্জনা করুন গোছের ফিকে একটু হাসি টানল মুখে। সময় ভালই কাটছিল দেখলাম!

ভালই। আদিত্য জবাব দিল। আমায় কখনও বড় একটা জলে পড়তে হয় না। কথা শেষ করে আদিত্য চোখের তারা এবং পাতায় যে ভাব দেখাল তাতে মনে হল, আদিত্য যেন বলছে, আমি এসব গ্রাহ্য করি না।

হয়তো আদিত্য তার ইচ্ছাকৃত অনুপস্থিতি বুঝতে পেরেছে, তুষার ভাবল। ভাবল, যদি বুঝে থাকে তবে বসে ছিল কেন? কেন ও ক্ষুব্ধ হচ্ছে না? অপমান বোধ করছে না?

আপনার ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প হল। আদিত্য বলল, শিশিরের দিকে সস্নেহের চোখে তাকাল, আমায় গান গাইতে বলছিল।

গান! অস্ফুটে বলল তুষার, প্রথমে আদিত্য পরে শিশিরের দিকে তাকাল।

সেই যে– শিশির হেসে দিদিকে সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করল, আমি পথ ভোলা এক পথিক… আমি বলছিলাম, আপনার গান শুনেছি সেদিন, আপনাকে দেখিনি; আজ দেখলাম। বললাম একটা গান করুন, গলা ছেড়ে; গাইলেন না। শিশির হাসছিল।

তুষার এই হাসি, এই জলের মতো সাধাসিধে অন্তরঙ্গতা পছন্দ করছিল না। শিশিরের কাণ্ডজ্ঞান বড় কম। আদিত্যর কোনও কাণ্ডজ্ঞানই নেই। কী ভেবেছে লোকটা? শিশুতীর্থ থেকে বাড়ি, বাড়ি থেকে অন্দরমহল, ও কি ভেবেছে পা বাড়ালেই সব দরজা খুলে যাবে! না। দরজা খুলবে না।

মনে মনে ছটফট করলেও কিছু বলতে পারছিল না তুষার। শিশিরের কাছে দৃষ্টিকটু হয় এমন কিছু করা, শ্রুতিকটু হয়–এমন কিছু বলা যায় না। বিছানার মাথার দিকে অকারণে ঝুঁকে চাদরটা ঠিক করে হাতে হাতে ঝেড়ে দিল।

একদিন তোমায় একটা ইংরিজি গান শোনাব। আদিত্য হেসে বলল শিশিরকে লক্ষ করে।

ইংরিজি?

খুব ভাল গান। …আই ওয়াক অ্যালোন…অ্যালোন, মাই ওয়ে ইজ…কথাটা শেষ না করেই আদিত্য তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল, ও হো, আপনাকে বলিনি খবরটা। কাল ঘোড়া জুতে গাড়িটা চালিয়েছি।

কার গাড়ি! শিশির অবাক হয়ে শুধোল।

ওঁদের সাহেবদাদুর। ভাঙা জঙ্গলের মধ্যে পড়েছিল, গাড়িটা ঠিক করলাম ঘোড়া জোগাড় করলাম–তারপর কাল ট্রায়েল দিলাম। …এখনও বেশ রাফ রয়েছে ঘোড়াটা, আরও°ট্রেইন করতে হবে। …এক দিন তোমায় বেড়াতে নিয়ে যাব। টমটমে চড়ে বেড়ানো একটা প্লেজার। আদিত্য উঠল। শিশিরের হাতে হাত দিয়ে বলল, চলি ভাই। আবার দেখা হবে।

আদিত্য আগে পিছু পিছু তুষার ঘরে ছেড়ে চেলে গেল।

বাইরে এসে আদিত্য বলল, আমার ভয়ে আপনি পালিয়ে গিয়ে বসেছিলেন।

তুষার বারান্দার সিঁড়িতে, আদিত্য শেষ ধাপে নেমে দাঁড়িয়েছে। দেখল না তুষার, চোখ মুখ তুলে তাকাতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল। নিচু গলায় বলতে গিয়ে কথাটা ঠিক মুখে আনতে পারল না।

আদিত্য বাগানে নামল। তার পায়ের চাপে কাঁকরে শব্দ উঠিল। এ ধরনের লুকোচুরি খেলা আমার ভাল লাগে না।

লুকোচুরি! তুষারের স্বর অস্পষ্ট।

আমাকে আপনি সহ্য করতে পারেন না।

কই, না! তুষার এমন একটা অবস্থার মধ্যে পড়বে জানলে বাড়ি ফিরত না, আরও রাত করত; অনেক রাত।

ন্যাকামি করছেন কেন! আদিত্য ক্ষুব্ধ, সামান্য উত্তেজিত। তুষার বুঝতে পারছিল। আদিত্যর সন্দেহ নেই, তুষার আর পাঁচটা মেয়ের মতন ন্যাকামি করছে। তুষারের দিকে তাকিয়ে তিক্ত গলায় আদিত্য বলল, আপনার অত ভয় কীসের! সত্যি কথা বলতে আটকাচ্ছে কেন?

তুষার অসন্তুষ্ট। তার রাগ হচ্ছিল। এই মানুষটা কী ভাবে তাকে? ভদ্রতাকে সে ভয় ভাবে, শিষ্টতাকে ন্যাকামি? তুমি কে, কী তোমার ব্যক্তিত্ব যে তুষার তোমায় ভয় পাবে!

আজ একটা পরিষ্কার বোঝাপড়া হয়ে যাওয়া ভাল। রোজ ওর গায়ে পড়া ঘনিষ্ঠতা তুষারের ভাল লাগে না, ভাল লাগে না জোর জবরদস্তি, ইচ্ছাকৃত অবিবেচনা।

মানুষকে বিরক্ত করা, উত্যক্ত করা আপনার স্বভাব। তুষার চাপা রাগে বলল।

আপনাকে আমি উত্যক্ত করি?

করেন কি না করেন আপনি জানেন।

না। আমি জানি, আপনাকে আমার ভাল লাগে।

রাগে তুষারের কপালের শিরা টাটিয়ে উঠল। কেমন করে কথা বলছে ও? তুষার কি তার…

আমাকে, আপনি সহ্য করতে পারেন না, কিন্তু আপনাকে আমার খুব ভাল লাগে। আদিত্য আবার বলল। কোনও সংকোচ নেই, স্বরে একটু সুরও নেই।

কী লাগে না লাগে আমার শুনে লাভ নই। আপনি যদি ঠিক মতন কথা বলতে না পারেন কথা বলবেন না। তুষারের গলায় যেন কেউ শান দিয়ে মরচে তুলে ক্রমশ ধার ফুটিয়ে আনছে।

আপনি অত অসহিষ্ণু কেন?

সহিষ্ণু হবার কোনও দরকার নেই আমার।

তা হলে এবার স্পষ্ট করেই বললেন–আদিত্য মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তুষারের দিকে তাকাল। ইউ হেট মি…ঘেন্না করেন!

তুষার নীরব। তার ইচ্ছে হচ্ছিল, সোজা ঘরে চলে যায়। যাচ্ছিল না, যদি এখানে আজ একটা নিষ্পত্তি ঘটে যায়–যাক। প্রত্যহ এই পীড়ন তার ভাল লাগে না।

সামান্য অপেক্ষা করে আদিত্য দু পা এগিয়ে এল। সিঁড়ির প্রথম ধাপে তার একটা পা রাখল। আমাকে আপনি কী ভাবেন? বাঁদর না হনুমান?

তুষার নীরব। কথা বলতেও ইচ্ছে করছিল না।

আপনাকে উত্ত্যক্ত করা আমার চাকরি নয়। …ভাল লাগত বলে আসতাম। দু মুহূর্ত থেকে আদিত্য হাত দুলিয়ে কেমন এমন একটা ভঙ্গি করল, বলল, ন্যাকাবোকা ছেলেদের মতন আমি মেয়েদের কাছে আসতে শিখিনি। …দূরে দূরে থাকলে, আপনার ছায়ার দিকে তাকিয়ে হু হা করলে আপনি ভাবতেন আহা, বড় ভালবাসে আমায় ও। আদিত্য পাগলের মতন বলছিল, বলার সময় ওর গলার স্বর প্রচণ্ড লাগছিল এবং মনে হচ্ছিল সে এক একটা শব্দকে বিকৃত করে ঠাট্টা করে আরও হাস্যকর করে তুলছে। আমি ওই ধরনের সাবুবার্লি খাওয়া প্রেম করতে দেখেছি। আই হেট ইট…। আমার কিছু আসে যায় না। হ্যাঁ, আপনার মতন আমারও কিছু যায় আসে না। …আপনি ভাবছেন, আমায় খুব ঠোক্কর দিলেন! খুব শিক্ষা দিলেন আমায়! আমি গ্রাহ্য করি না। পরোয়া করি না। বুঝলেন তুষারদিদিমণি, আমার চরিত্র আলাদা। ভালবাসা না পেলে আমি মরে যাই না৷বলতে বলতে আদিত্য সিঁড়ির ওপর তুষারের গায়ের কাছে এসে পড়ল। এবং পরক্ষণেই হাত ধরে ফেলল, তুষার বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে, আদিত্য বলল, আমার ভালবাসা ওয়েল ড্রেসড নয়, সিভিলাইজড নয়, কিন্তু সেটা বাঁদর হনুমানের মতনও নয়। আপনি যেমন দেখলে আহ্লাদিত হতেন–বিহ্বল হয়ে পড়তেন তেমন করে আসতে পারিনি। …কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাকে আমার ভাল লাগে।

তুষার জোর করে হাত টেনে নিল। সর্বাঙ্গ তার জ্বালা করছে। রাগ ক্ষোভ লজ্জা ঘৃণায় তুষারের মনে হচ্ছিল, লোকটার গালে ঠাস করে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলে, চলে যান এখান থেকে। অভদ্র ইতর কোথাকার!

আদিত্যর কী হয়েছিল কে জানে, তুষার হাত টেনে নিলে সে হাসল, হো হো করে হাসতে লাগল, অপ্রকৃতিস্থের মতন। হাসি থামলে দেখল তুষার দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ বলল বাড়ির ভেতর চিরকাল থাকতে পারবেন না দিদিমণি, একদিন বাইরে আসতে হবে। তখন দেখবেন আমি নেই।

তুষার কথাগুলো শুনল কি শুনল না–বোঝা গেল না। ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ করল।

আদিত্য দাঁড়িয়ে থাকল অল্পক্ষণ। সিঁড়ি থেকে নামল, ওপাশে আতাগাছের কাছে গিয়ে সাইকেলটা নিল। তারপর সাইকেল ঠেলে বাগান পেরিয়ে যেতে যেতে তার দীর্ঘশ্বাস সে নিজের কানে শুনল। দাঁড়াল। আবার দীর্ঘ করে শ্বাস ফেলল। আবার কান পেতে শুনল। আপন মনে বলল, সো সিলি এ হার্ট, নেভার নোজ লাভ, লাভ দ্যাট ইজ অ্যান আর্ট।

.

১৩.

আদিত্যর স্বভাব দেখে তুষার কয়েক দিন পরে আবার মনে মনে হাসল। নিতান্ত অবোধ হলে কি এই রকম হয়! যখন রাগল তখন সে রাগ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল, কোনও মাত্রা মানল না, এলোমেলো বাতাস পাওয়া শিখা ওঠা আগুনের হলকার মতন তার ক্রোধের হলকা চারপাশে যা পারল তার গায়ে ছোবল দিল, তারপর কখন সব আবার শান্ত হয়ে গেল। আঁচ বা আগুন আছে তাও মনে হবে না। অবোধে এই ভাবে রাগ করে, দপ করে জ্বলে ওঠে, খানিক পরেই আবারই নিভে যায়।

ছেলেমানুষের। রাগ। তার জ্বলতে যতক্ষণ নিবতেও ততক্ষণ। তুষার ভেবেছিল, আদিত্যর শিক্ষা হয়ে গেছে, মানুষটা আহত ক্ষুব্ধ অপমানিত হয়ে আক্রোশে রাগে যা বলার সব বলেছে, এবার নিজেকে সরিয়ে ফেলবে, তুষারকে আর উত্ত্যক্ত করতে আসবে না।

দু তিনটে দিন ওই রকম হয়েছিল। শিশুতীর্থে ওরা সামনাসামনি পড়ে গেছে, প্রায়ই, খাবার ঘরে নিয়মিত মুখোমুখি বসে দু দলকেই খেতে হয়েছে, আদিত্য কোনও রকম অশোভনতা করেনি। বরং তুষার লক্ষ করেছে, তার মনে চাপা রাগও যে আছে আদিত্য তাও প্রকাশ করত না। মুখ বুজে থাকার পাত্র আদিত্য নয়, মুখ বুজে থাকেনি, তবু তার অতিরিক্ত চঞ্চলতাও যেন এ কদিন কোনও অসুখে ভুগছিল, তেমন করে প্রকট হত না।

এরই মধ্যে তুষার কখনও দেখেছে আদিত্য আর মলিনা গল্প করছে গাছতলায় দাঁড়িয়ে, কখনও দেখেছে জ্যোতিবাবু একা কোথাও বসে আছেন, কখনও বা তুষার কান পেতে শুনে নিয়েছে, মলিনা আদিত্যর কাছ থেকে গান শিখে দুপুরে স্নান করতে এসে নিজের ঘরে চুল খুলতে খুলতে সেই গান গাইছে। মলিনার ওই গানের গলায় আমি পথভোলা এক পথিক এসেছি,–শুনে তুষারের হাসি পেয়েছে। ভেবেছে, যেমন মাস্টার তেমনি ছাত্রী। কিন্তু এও ঠিক, তুষার আদিত্যর গলায় আচমকা যতটুকু শুনেছিল গানটা, তাতে মনে হয়নি আদিত্যর গলার সুর খারাপ। মলিনার গলায় কিন্তু সত্যিই বিশ্রী শুনিয়েছিল, অত্যন্ত বিশ্রী।

এমনি করে কয়েকটা দিন কাটল। শরতের যাওয়া পথে মেঘ আবার দল জুটিয়ে দুটো দিন তুমুল বর্ষা নামাল। শিশুতীর্থ বন্ধ থাকল, নুটুর গাড়ি পাঁচ মাইল পথ এই আসা যাওয়ার ধকল সইতে পারল না। তারপর আবার রোদ উঠল, মেঘের সমস্ত ময়লা যেন কেউ আকাশ থেকে ঝাঁট দিয়ে নিয়ে গেছে, তকতকে পরিষ্কার আকাশটা আর নীল, রোদের আভায় অপরূপ উজ্জ্বল।

পরশু মহালয়া। শিশুতীর্থ এখন শিশু-স্বর্গ। ছেলেমেয়েগুলো বই খাতা পত্র আর ছোঁবে না, ঘরেও ঢুকবে না। সমস্ত মাঠ ভরে শুধু তাদের কলরব আর ছোটাছুটি, খেলা আর চাঞ্চল্য।

প্রতিবার মহালয়ার দিন এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কাছাকাছি একটা জায়গায় গিয়ে চড়ুইভাতি করতে হয়। এখন একটা আর শীতে আর একটা।

জ্যোতিবাবু আর আশাদি চড়ুইভাতির ব্যবস্থা করতে মত্ত। সাহেবদাদুর শরীর আজ কদিন সামান্য ভাল যাচ্ছে বলে তিনি ইতির হাত ধরে বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ছেলেমেয়েদের ডেকে নিজেই এক একটা অবাক খেলার নিয়ম শিখিয়ে দিচ্ছেন, ওপাশেই যেন বাচ্চাকাচ্চাদের ভিড় বেশি, প্রফুল্ল নুটুর গাড়ি নিয়ে বাজার হাট করতে ছুটছে শহরে, আর মলিনা আদিত্যর ছায়ায় ছায়ায় ঘুরছে।

তুষারের কিছু অন্য কাজ ছিল। একাজ খানিকটা অফিসের কাজও। মাসখানেকেরও বেশি বন্ধ থাকবে শিশুতীর্থ। এই বন্ধের মধ্যে ক্লাস ঘরগুলোর তদারকির ব্যবস্থা, জিনিসপত্র রাখার ব্যবস্থা টাকা পত্র দেওয়া থোওয়া, কয়েকটা ছোটখাটো হিসেব–এই রকম আরও কিছু।

কাগজপত্র নিয়ে কাজ করতে বসে তুষার দেখল, আদিত্য তার দু মাসের পাওয়া সরকারি মাইনের প্রায় সবটাই এখানে জমা রেখে দিয়েছে। টাকাটা তার আজকালের মধ্যে নিয়ে নেওয়া উচিত, মহালয়ার পরও অবশ্য দু-চার দিনের মধ্যে নিতে পারে, না নিলে এই হিসেবপত্রের খাতা বন্ধ হয়ে যাবে, ছুটির মধ্যে কে আবার হাঙ্গামা করবে!

তুষার আরও দেখল, জ্যোতিবাবুর সই করা চিট-এ মলিনা তার মাইনের অতিরিক্ত শ দেড়েক টাকা আগাম নিয়েছে। দেখল, আদিত্যর নামে-আসা একটা চিঠি, তার জবাবও। আদিত্য পুজোর ছুটির আগে চলে যাচ্ছে, তার এখানের কাজ শেষ।

একটানা ঘন্টা দুই কাজ করে তুষার উঠে পড়ল। বেলা হয়েছে। এগারোটা বাজে প্রায়।

সাহেবদাদু বারান্দায় বসে বিশ্রাম করছেন। স্নান করতে যাবেন। ইতি কাঠের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার বুঝি স্নান সারা হয়ে গেছে, মাথার চুল এলো। ঘন বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে ইতি। কেমন বড় বড় লাগছিল দেখতে। তুষার আসতে গিয়ে কী ভেবে সাহেবদাদুর দিকে এগিয়ে গেল।

বারান্দায় উঠতে গিয়ে ইতির সঙ্গে চোখাচুখি। তুষার হাসল। কী রে! তোকে বড্ড বড় দেখাচ্ছে।

ইতি লজ্জায় হাসল। রংটা ভাল, না তুষারদি?

খুব সুন্দর।

তোমার মতন ফরসা রং হলে আরও মানাত।

তুই কি কালো নাকি?

শাড়িটা আমায় আশাদি কিনে দিয়েছে। ইতি বলল, পুজোর জন্যে।

তুষারের খেয়াল হল, ইতির জন্য তাকেও একটা শাড়ি কিনতে হবে। আগে আগে তুষার জামা করে দিত, আজকাল ইতি বেশির ভাগ শাড়ি পরে, শাড়িই কিনতে হবে এবার।

ইতিকে ওরা সবাই দেয়, জ্যোতিবাবু, আশাদি, তুষার, প্রফুল্ল। মলিনা নয়। মলিনাটা যেন কী! কাণ্ডজ্ঞান নেই।

বারান্দায় উঠে সাহেবদাদুর মুখোমুখি দাঁড়াল তুষার।

কী খবর? কাজ হল? সাহেবদাদু প্রশান্ত মুখে তাকালেন।

হ্যাঁ, অনেকটা। তুষার সাহেবদাদুর চোখে চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। দু মুহূর্ত নীরব থাকল, সাহেবদাদুর কপালে ঘাম ফুটে আছে, তুষার বিনীত গলায় বলল, ওই টাকাটার কী হবে?

কোন টাকা?

আদিত্যবাবুর! উনি তুলে না নিলে হিসেব গোলমাল হবে।

নেয়নি টাকাটা? আমি তো আগেও বলেছি ওকে। সাহেবদাদু যেন সামান্য চিন্তিত হলেন, কী ভাবলেন অল্প সময়, বললেন, টাকাটা সরাসরি ওকে পাঠালেই পারে, আমাদের হাত দিয়ে ঘুরে যাবার যে কী দরকার আমি জানি না। …টাকাটা ওকে ডেকে দিয়ে দাও।

তুষার ঘাড় কাত করল। দিয়ে দেবে।

তুষার

আজ্ঞে

আমার চিঠিপত্রের মধ্যে একটা ড্রাফট পাবে। ব্যাঙ্ক ড্রাফট। জ্যোতিকে বলো ছুটির আগেই যাতে ভাঙিয়ে আনে। তোমাদের হাতে এখন কিছু না দিলে আমার খারাপ লাগবে।

মলিন করে হাসল তুষার। আমায় দিতে হবে না।

কেন? তোমার কি জমিদারি আছে? সাহেবদাদু তাকিয়ে থাকলেন।

আমার দরকার হলে আমি নিই।

এবারে না হয় এমনিই নাও। …সবাই মিলে তোমরা নাও, ওই ছেলেটিকেও দিয়ো। …

তুষার কোনও কথা বলল না। বলার প্রয়োজন ছিল না। সাহেবদাদু এমনি মানুষ। পুজোর আগে সবাইকে কিছু কিছু টাকা দিতে না পারলে তাঁর শান্তি নেই। এই টাকা হয়তো কর্জ করে এনেছেন, হয়তো তাঁর কোনও পুরনো সম্পত্তি বেচেছেন কী করেছেন কেউ কোনওদিন জানতে পারবে না। তবু তিনি দেবেন, না দিয়ে স্বস্তি পাবেন না।

তুষার চলে আসার জন্যে ফিরে দাঁড়াল। ইতি নেমে রোদে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সাহেবদাদু আচমকা বললেন, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করব, তুষার। কদিনই ভাবছি। তুষার দাঁড়াল।

ইশারায় তুষারকে আরও একটু কাছে ডাকলেন সাহেবদাদু, তুষার পাশে এসে দাঁড়াল। খানিকটা সময় পরিপূর্ণ নীরব থাকলেন সাহেবদাদু, খুব যেন আত্মমগ্ন। শেষে মৃদুস্বরে বললেন, আমার আয়ু আর বেশি দিন নয়; আজকাল প্রায়ই রাত্রের দিকে বুকের মধ্যে কেমন করে। এমনিতেও বুঝতে পারছি, যাওয়ার দিন এল।

এমন শারদ দিনে, এই পুঞ্জিত রৌদ্র আর উদ্ভাসিত পূর্ব মধ্যাহ্নে সাহেবদাদুর শান্ত অথচ বিষণ্ণ আলাপ তুষারের ভাল লাগছিল না। তুষার বিষণ্ণ বোধ করল। সাহেবদাদুর চোখের দিকে তাকাতে পারল না। মনে হল, হয়তো সেই আসন্ন দুঃখকে সাহেবদাদুর মুখে ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে।

অস্বস্তি বোধ করে তুষার বলল, আপনি যত অমঙ্গল ভাবেন।

অমঙ্গল ভাবি! যা সত্যি তাই ভাবা কি অমঙ্গল? সুন্দর একটু হাসি সাহেবদাদুর ঠোঁটে, যেন এই হাসি তুষারকে বলছে, ওরে এমনি করেই তো যেতে হয়।

তুষার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাক টানল, গায়ের আঁচল অকারণে নাড়ল, তারপর কয়েক পলকের জন্যে সাহেবদাদুর মুখ দেখল।

আমার ভাবনা ইতিকে নিয়ে। সাহেবদাদু বললেন নিশ্বাস ফেলে, ও আর ওর মাসির কাছে যাবে না। এই শিশুতীর্থর বাইরে ওকে পাঠানো মুশকিল। আমি বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছি, তুষার। ওর একটা ব্যবস্থা করে যেতে পারলে শান্তি পেতাম।

আর একটু বড় হোক, আমাদের সঙ্গে কাজ করবে। তুষার সহজ সাধারণভাবে বলল, সরল পথ দেখিয়ে দিল।

তোমরা কি চিরটা কাল এখানে কাটাবে, তুষার–! সাহেবদাদু চোখ স্থির রেখে তাকিয়ে থাকলেন, মুহূর্ত কয় পরে বললেন, আমি তোমাদের জীবনের সব নিতে পারি না। জ্যোতি হয়তো পারবে, আশাও পারতে পারে কিন্তু তোমরা পারবে না। …তোমাদের নিজেদেরও একটা জীবন আছে, শুধু শিশুতীর্থে পড়ে থাকলে চলবে কেন!

আমরা তো ভালই আছি। তুষার আড়ষ্ট গলায় বলল। সাহেবদাদুর কথা সে বুঝতে পেরেছে।

মেয়েদের ভাল সব দিক তাকিয়ে ভাবতে হয়–সাহেবদাদু বললেন, জ্যোতির কথা ধরো; সে পুরুষমানুষ। এই শিশুতীর্থর দায় নিয়ে তার আজীবন কেটে যেতে পারে। তার যদি সংসার করতে ইচ্ছে হয়, আটকাবে না কোথাও; কাজের সঙ্গে সংসারের বিরোধ হবে না। কিন্তু মেয়ে হলে কি পারত?

আশাদির কথা তুষারের মনে হল। ইচ্ছে হল জিজ্ঞেস করে আশাদি তো মেয়ে, সেও কি পারবে না! কথাটা তুষার বলল না; সাহেবদাদু আশাদিকে বোধ হয় সংসারের সাধারণ পথ থেকে পাশে সরিয়ে রেখেছেন। কেন? আশাদির একটু বয়স হয়ে গেছে বলে! বয়স হয়ে গেলে কি মেয়েরা বিধবার মতন হয়ে যায়। মেয়েদের বয়সও কি এক ধরনের বৈধব্য। তুষারের চোখে আশাদির রঙিন শাড়ি পরা সেদিনের চেহারাটা ভাসছিল। দুঃখ হচ্ছিল তুষারের। দুঃখ হচ্ছিল, আশাদি নিজেকে বুড়ি সাজিয়ে রেখেছে বলে।

সাহেবদাদু বললেন, ইতির জন্যে আমার বড় ভাবনা, তুষার। তোমাদের ভরসা ছাড়া ওকে আর কোথায় বা রাখব অথচ তোমাদের ঘাড়ে এই দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে যেতেও ইচ্ছে করে না।

তুষার নীরব থাকল। সাহেবদাদুর দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনা সে অগ্রাহ্য করতে পারল না। সাহেবদাদুর অবর্তমানে ইতির দায় দায়িত্ব কে নেবে? জ্যোতিবাবু? জ্যোতিবাবু কি পারবেন? আশাদিও কি ওই মেয়ের সব ভালমন্দের ভার আজীবন বইতে পারবে? …তুষারের কেমন আচমকা মনে হল, মেয়েদের দায় বয়ে নিয়ে যাওয়া বড় কঠিন। অকূল নদীতে যাত্রী চাপিয়ে নৌকা বয়ে যাওয়ার মতন। কোনও স্থিরতা নেই, নির্দিষ্ট চিহ্ন নেই যে ততটুকু পৌঁছে দেবে। এই সমস্যা তুষারকে এখন কেমন বিহ্বল করল।

একটি অল্পবয়সী ভাল ছেলে পেলে আমি ইতির বিয়ে দিয়ে দিতাম। সাহেবদাদু বললেন হঠাৎ।

তুষার চমকে উঠল। এত অল্প বয়সে!

ষোলো বছর। খুব কম আর কোথায়! সাহেবদাদু চিন্তিত মুখে বললেন, পারলে এটাই ভাল হত, তুষার। …যাক তোমায় বলা থাকল। তেমন কোনও খবর পেলে আমায় একটু জানিয়ে।

বেলা বাড়ছে। তুষার অল্প সময় দাঁড়িয়ে থেকে মাঠে নামল। ইতি তখনও রোদে। মাথার চুল শুকিয়ে নিচ্ছে। তুষার দাঁড়িয়ে ভাল করে আরও একবার দেখল ইতিকে। বেশ বাড়ন্ত দেখায়। তবু মুখের আদলে সেই কচি ভাবটা রয়ে গেছে ইতির। ওকে বিয়ে দিলে কেমন দেখাবে, ভাবতে তুষারের সকৌতুক হাসি পেল।

তুষারদি–ইতি কাছে এসে দাঁড়াল তুষারকে দেখতে পেয়ে।

তুষার স্নেহের চোখে দেখছিল। ইতির গায়ের রং যেমনই হোক, মুখ বড় মিষ্টি। নাক লম্বা পাতলা, ভুরু সরু, ঠোঁট পাতলা। এক মাথা চুল। তুষারের বড় ভাল লাগছিল দেখতে।

আজ তুমি যখন বাড়ি যাবে আমি একটু কাপড় দিয়ে দেব। ইতি বলল।

কীসের কাপড়?

জামার। তুমি কেটে এনে দিয়ো, আমি সেলাই করে নেব।

আমি সেলাই করতে পারি না? তুষার হাসিমুখে বলল।

তুমি তো কত ভাল পার! ..না, অত কাজের মধ্যে আর সেলাই করে দিতে হবে না তোমায়। আমি হাতে সেলাই করে নেব।

কাপড়টা তা হলে যাবার সময় দিয়ে দিস।

মাথা নাড়ল ইতি, দিয়ে দেবে কাপড়টা।

তুষার আশাদির বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।

সাহেবদাদুর কথা ভাবছিল তুষার। ভেবে অবাক হচ্ছিল যে-লোক পাণ্ডব বর্জিত জায়গায় এসে, কোন পাহাড়ের কোলে, বুড়ো বয়সে একটা স্কুল খুলে বসতে সাহস পেলেন, তিনি আজ একফোঁটা মেয়ের জন্যে কোনও ভরসা খুঁজে পাচ্ছেন না। ইতির বিয়ে দেওয়ার জন্যে সাহেবদাদুর এত দুশ্চিন্তা কেন! শিশুতীর্থ যতকাল আছে ততদিন ইতির আশ্রয় আছে, ভালমন্দ দেখার লোকও আছে। তবু সাহেবদাদু কেন এত ভাবছেন?

শিশুগাছের ছায়ায় তুষার একটু দাঁড়াল। অনেকটা দূরে আদিত্য। তুষার আদিত্যর টাকাটার কথা ভাবল। আজ আদিত্যকে বলতে হবে, টাকাটা আপনি তুলে নিন, আমার হিসেব রাখতে গোলমাল হচ্ছে।

আঁচলের আগায় গলা কপাল আলতো করে মুছে তুষার হাঁটতে লাগল।

ইতির জন্য সাহেবদাদুর ভাবনা যেন বেশি বেশি। এই বয়সে একটা বিয়ে দিয়ে দিলেই কি সব সমস্যা ঘুচে যাবে। সাহেবদাদুর মনের অন্য দিকের জানালাগুলো যতই খোলা থাক–এ দিকে, তুষারের মনে হল, এদিকের জানলাটা কিন্তু বন্ধ। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়াকেই তিনি নিরাপদ বলে ভেবে নিয়েছেন। একটি পুরুষের হাতে একটি মেয়েকে সমর্পণ করলেই কি মেয়ের জীবনের সব সমস্যা মিটে যায়! তুষার স্বীকার করল, এতে মেয়েদের একটা আশ্রয় জোটে, বল-ভরসাও, কিন্তু সংসারে কি ইতির মাত্র সেইটুকুই প্রয়োজন? যদি তাই হয়, তবে ইতির আশ্রয়ের অভাব তো শিশুতীর্থে নেই, ইতির সুখ দুঃখের ভাবনা ভাববার লোক তো রয়েছে শিশুতীর্থে–জ্যোতিবাবু, আশাদি, তুষার নিজেই। …তবে?

এসব ভাঙা যুক্তি, সাধারণ কথাবার্তা তুষারের পছন্দ হল না। সাহেবদাদু অত সামান্য বুদ্ধির মানুষ নন। ইতির মাথায় যে ছাদ থাকবে, ইতির দেখাশোনা করার লোক যে আছে–তিনি নিশ্চয় জানেন। তবু বিয়ের কথা ভাবেন যে, তার কারণ আছে। কারণটা তুষার অস্পষ্টভাবে অনুমান করতে পারছিল।

তুষার ভাবছিল, যাকে সোজা কথায় আশ্রয় বলা হয়–যাকে দায় দায়িত্ব ভার বলা হয়, তেমন আশ্রয় বা দায় দায়িত্ব বয়ে বেড়ানোর লোক মেয়েদের জীবনে অন্য ভাবেও জুটতে পারে; কিন্তু কোনও মেয়ের জীবন হয়তো এতে সম্পূর্ণভাবে আশ্রিত বা নিরাপদ, নিশ্চিন্ত অথবা নিরুদ্বিগ্ন থাকে না। ঘরবাড়ি খাওয়া পরার ভাবনা আপদ বিপদে দেখার লোক–এসব সাংসারিক প্রয়োজনের পরও নিশ্চয় মেয়েদের জীবনে অন্য প্রয়োজনও আছে। সেটা কী?

সেটা কী, তুষার ভাল করে ভাবতে পারছিল না। তবে অনুভব করতে পারছিল, ইতির যদি আজ বিয়ে হয়ে যায়, ইতি শুধু তার স্বামীর বাড়িতে থাকার, স্বামীর ছায়ায় নিশ্চিন্ত হবার, আহার বিহারের সুযোগ পাবে না–তার বেশি–অনেক কিছু বেশি হয়তো সেই জিনিসই পাবে, যাকে আমরা নিজের সুখ বলি। বা, তুষার ভাবল, হয়তো এই পাওয়াতে মেয়েদের এমন কোনও প্রাপ্তি আছে যা গভীর, যা পূর্ণ। হয়তো ইতিকে সাহেবদাদু এমন কোনও মানুষের হাতে দিয়ে যেতে চান–যার চেয়ে ঘনিষ্ঠ, যার চেয়ে অধিক আত্মীয়, যার চেয়ে ইতির সমস্ত মন প্রাণ সুখ দুঃখ, আশা আকাঙ্ক্ষার বেশি অন্য কেউ হতে পারবে না। সমস্ত জীবনের মতন ইতি তাকে পাবে, পাবে মৃত্যু পর্যন্ত।

ভাবনাটা তুষারের অনুভূতিকে কেমন রোমাঞ্চিত করল। যেন এই ভাবনার অজ্ঞেয় তাপ হৃদয়কে উষ্ণ ও কামনার্ত করল।

তুষার থমকে দাঁড়াল। সামনে আদিত্য। চোখ তুলে আদিত্যকে দেখল তুষার। এ কদিন তুষার আদিত্যর পাশ কাটিয়েছে। আদিত্যও তাকে উত্ত্যক্ত করতে আসেনি। আজ তুষার কী মনে করে সৌজন্যোচিত হাসি আনল মুখে।

আদিত্য হাসল না। তাকিয়ে থাকল।

আপনার টাকাটা নিয়ে নেবেন আজ। তুষার বলল।

টাকা! কীসের টাকা?

খেয়ালও নেই আপনার! তুষার চোখ ভরে আদিত্যকে দেখল, আপনার মাইনের টাকা। আমাদের কাছে পড়ে আছে।

কত টাকা?

আপনার হিসেব নেই?

না। কিছু টাকা আমি নিয়েছিলাম।

চারশো প্রায়।

শ খানেক আমায় দিয়ে দেবেন। মানে!

তুষার বিস্মিত হয়ে চোখ তুলল। সবটাই তো আপনার টাকা। জানি।

আমার শ খানেক হলেই চলবে। পুজোর পর রাঁচির দিকে একটা স্কুলে যাব। মিশনারি স্কুল। কোনও খরচা নেই। আদিত্য ধাঁধার মতন বলছিল, আমায় একশোটা টাকা দিয়ে দেবেন।

তুষার কিছু বুঝতে পারছিল না। মানুষটা পাগলামি করছে! বাকি টাকা কি ওর জন্যে জমা করে নিয়ে বসে থাকবে তুষার। বাকি টাকা? তুষার প্রশ্ন করল।

দান করে দিলাম। অবহেলার গলায় বলল আদিত্য।

দান!

ডোনেশান। …দু তিনটে গোরু কিনে নেবেন টাকাটায়।

গোরু! তুষার বিস্মিত।

গোরু ভাল জিনিস। একটা গোয়ালঘর করে রেখে দেবেন। দুধ-টুধ হবে বাচ্চাদের খাওয়াবেন। আদিত্য ঠাট্টা করছিল না, নাকি বিদ্রূপ, অথবা সত্যিই সে গরু কেনার প্রস্তাব দিচ্ছিল, তুষার কিছু বুঝতে পারল না। আদিত্য আবার বলল, মিলক ইজ গুড ফর হেলথ। বলে হাসতে লাগল।

তুষার বুঝতে পারল সমস্তটাই বিদ্রূপ। রাগ হল তুষারের। বলল, এখানে কী ব্যবস্থা করা হবে তার ভাবনা আমরা ভাবব।

আদিত্য কথাটা শুনল, গ্রাহ্য করল না। বলল, টাকাটা সত্যিই আমি আপনাদের ফান্ডে দিলাম। আমার এখন প্রয়োজন নেই। …গোর না কিনতে চান কিনবেন না, যা খুশি করবেন।

আদিত্য দু হাত মাথার ওপর তুলে আলস্য ভাঙল। হাই তুলল। কাল একেবারে ঘুম হয়নি। আজ দুপুরে একটু ঘুমোতে হবে। চলি।

চলে গেল আদিত্য। তুষার দাঁড়িয়ে থাকল। লোকটা কি সত্যিই তিনশো টাকা দান করে দিল। খেয়াল নাকি? তোক দেখানো দম্ভ। দম্ভ হলে এতদিন কেন টাকাটা দেয়নি!

তুষার আবার আশাদির বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে মনে হল, মানুষটা বোধ হয় কিছুটা ছেলেমানুষ, কিছুটা খেয়ালি। না, ওর কোনও দম্ভ নেই। অথচ দম্ভ দেখালে বেমানান হত না। যতই তুমি অপছন্দ করো, তবু একথা স্বীকার না করে উপায় নেই, ও বিদেশ ঘুরেছে এই শিক্ষাপদ্ধতি দেখে বেড়াতে, ও না জানে এমন বিষয় বোধ হয় শিশুশিক্ষার মধ্যে নেই। লোকটাকে অশিক্ষিত বলা চলে না।

কয়েক পা এগিয়ে এসে তুষারের হঠাৎ মনে হল আচ্ছা–আদিত্য, সাহেবদাদু যদি আদিত্যের সঙ্গে ইতির বিয়ে দেন, কেমন হয়! বয়সে একটু বেমানান, কিন্তু স্বভাবে কি খুব বেমানান হবে! দুজনেই ছেলেমানুষ।

কথাটা ভাবতে তুষারের কেমন ভীষণ হাসি পেল। আদিত্য ইতির স্বামী, ইতি আদিত্যের স্ত্রী। আর তখন, আদিত্য শিশুতীর্থ-য় সর্বেসর্বা। তার ধমকে তার কথা মতন তুষারদের চলতে হবে।

আদিত্য তখন নিশ্চয় তুষারকে আর কাজ করতে দেবে না। তাড়িয়ে দেবে। তুষারের ওপর গায়ের জ্বালা কি তখন না মিটিয়ে পারবে আদিত্য।

এই কাল্পনিক অকারণ চিন্তা তুষারকে কেমন ম্রিয়মাণ করল। তার ভাল লাগল না ভাবতে। আদিত্যকে ইতির স্বামী হিসেবে যেন তুষার পছন্দ করতে পারল না।

.

১৪.

শিশুতীর্থ বন্ধ হয়েছে। পুজোর ছুটির বন্ধ। জ্যোতিবাবু আর আশাদির এখনও ছুটি হয়নি। যে ছেলেগুলো শিশুতীর্থর মধ্যে থাকে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছে ওরা। কাছাকাছি। জায়গার ছেলে ওরা–বিশ পঁচিশ মাইলের মধ্যে বাড়ি; এক একটা দল করে ট্রেনে বোডবাসে পৌঁছে দিতে হচ্ছে কচিগুলোকে। দুতিনদিনের মধ্যে শিশুতীর্থ খালি হয়ে যাবে, থাকার মধ্যে সাহেবদাদু, ইতি, আশাদি আর দু একজন ঝি চাকর আর নুটু।

ছুটি শুরু হবার পর চারটে দিন দেখতে দেখতে কেটে গেল। এবার আশ্বিন শেষ করে পুজো। অর্থাৎ এই পুজো কেটে গেলেই কার্তিকের গোড়ায় হেমন্তকাল শীতের ছোঁয়া দিতে আসবে।

তুষার কটা দিন ঘরবাড়ি পরিষ্কার করল। পুজোর আগে প্রতিবার তার এই এক খাটুনি। সমস্ত বাড়ি, প্রতিটি জিনিস নিজের হাতে পরিচ্ছন্ন করবে। শিশির বলছিল বলে, এই ঘরদোর ধোওয়া মোছর সঙ্গে অন্য খাটুনিও জুটল চুনকাম করানোর হাঙ্গামা।

বাড়ি ঘর তকতকে করিয়ে তুষার যখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, তখন বোধনের বাজানা বেজে উঠেছে।

সকালে চা খেতে খেতে শিশির বলল, তুই না তোদের শিশুতীর্থতে যাবি বলছিলি একবার।

হ্যাঁ রে, একবার যেতে হবে। আজ ষষ্ঠী হয়ে গেল। ইতিকে কাপড়টা দিয়ে আসতে হবে পুজোর।

যাবি কী করে? শিশির শুধোল।

তাই তো ভাবছি।

কালও নুটু এসেছিল, ওর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই পারতিস।

নুটু এত দিন তার গাড়ি নিয়ে রোজই এসেছে। জ্যোতিবাবু আর আশাদি ছেলেদের পৌঁছতে যাচ্ছে, ফিরছে; নুটুর গাড়িও তাই যাচ্ছে আসছে। কাল শেষবারের মতন এসে গেছে নুটুর গাড়ি; আজ আসবে কি না কে জানে। তুষারের খেয়াল ছিল কালকেও, কিন্তু নুটুর হাত দিয়ে ইতিকে পুজোর শাড়ি পাঠাতে তার মন চায়নি। তা ছাড়া তুষার সাহেবদাদুর জন্যে একজোড়া কার্পেটের চটি বুনেছে অনেকদিন থেকে, ইচ্ছে ছিল এবারে নিজে গিয়ে সাহেবদাদুকে দিয়ে আসবে।

নুটুর গাড়ি অবশ্য শহরে আবার আসবে। ইতিকে আশাদিকে নুটু শহরের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে আসবে। কিন্তু সে কি আর আজ আসবে? এলেও তখন ইতিকে কিছু দেওয়া ভাল দেখাবে না।

কবে কিনেছি–তুষার আপন মনে বলল, নিয়ে যাব যাব করে ভুলে গেলাম।

শিশির হাসল। বলল, তোর দেওয়ার ইচ্ছে নেই বলেই অত ভুল।

বাজে কথা বলিস না।

বাজে কথা কেন! শাড়ি তোরও খুব পছন্দ ছিল রে। শিশির হাসছিল।

তাতে কি, পছন্দ হতেই পারে। তা বলে ইতির নাম করে কিনে আমি নিজে নেব।

আমি তার কী জানি! তুই-ই বলেছিলি।

হ্যাঁ বলছিলাম। তোর মুণ্ডু।

কথাটা খুব অসত্য নয়। মেতিপাতা বাটলে যেমন রং হয়, তেমনই লাল রঙের লম্বা ডুরে দেওয়া একটা শাড়ি ইতির জন্যে কিনেছিল তুষার। কিন্তু শাড়িটা তার নিজেরই পছন্দ ছিল। শিশিরকে দেখাবার সময় বলেছিল, শাড়িটা আমায় কেমন মানাবে বল তো! শিশির রং দেখে মুগ্ধ হয়েছিল, দিদির গায়ের রঙের সঙ্গে যে চমৎকার মানাবে তাতে তার বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না; শিশির বলেছিল, তোকে ওয়ান্ডারফুল মানাবে।

তুষারের মন দীন নয়, তবু আশ্চর্য যে, তুষার সহসা যেন এই সুন্দর শাড়িটা নিজের জন্য রাখার লোভ করেছিল। বলেছিল, ইতির জন্যে তবে অন্য একটা আনতে হয়।

মনে মনে তুষার কি এই দ্বিধাবশত শাড়িটা ইতির জন্যে নিয়ে যেতে ভুলে যাচ্ছিল! তুষার কি অকস্মাৎ কোনও কারণে নিজের সৌন্দর্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়েছে? না। তুষার পরে মাথা নেড়েছে, এবং তার এই ছেলেমানুষি লোভ ও চিত্ত দীনতাকে শাসন করে নিয়েছে।

একটা উপায় বল তো তুষার ভাইয়ের কাছে পরামর্শ চাইল।

শিশির ভাবল। বলল, তুই না ছেলেবেলায় একবার সাইকেল চড়া শিখেছিলি।

ইয়ার্কি করিস না–তুষার রাগ করে বলল।

তবে হেঁটে যা।

খুব বললি!

শিশির নীরব হল। তার মাথায় এমন কোনও বুদ্ধি এল না, যাতে দিদিকে নিশ্চিত করতে পারে।

তুষার ভাইয়ের ঘাড়ে যেন সব দোষটা চাপাবার চেষ্টা করে বলল, তোর জন্যেই এরকম হল।

আমার জন্যে!

না তো কী! এ কদিন শুধু ঘর দোর পরিষ্কার, চুনকাম করানো–এসব দেখতে গিয়ে আর সময় পেলাম কই। নয়তো নুটুর সঙ্গে গিয়ে কাজটা সেরে আসতাম। তুষার কিছুটা ক্ষুণ্ণ যেন।

শিশির বলল, দেখ দিদি, তুই এক কাজ কর। পোস্ট অফিসের কাছে যতীনের বাড়ি। যতীনকে গিয়ে বল, ব্যবস্থা করে দেবে।

তুষার যতীনকে চেনে। শিশিরের বন্ধু যতীন। কাঠগোলার মালিকের ছেলে। মাঝে মাঝে তাদের জিপগাড়ি বন জঙ্গলে যায় কাঠ কাটা তদারক করতে। তুষার বললে যতীন যে একটা ব্যবস্থা করে দেবে তাতে সন্দেহ নেই। সামান্য নিশ্চিন্ত হল তুষার।

.

আরও একটু বেলায় তুষার যতীনদের কাঠগোলায় গেল। যতীন নেই কাজে বেরিয়েছে, ফিরতে দুপুর হবে। তুষার ফিরে এল।

নুটুর গাড়ি আজ আসবে না। যদি আসার হত সকালেই আসত। বিকেলে কি আর আসবে। জ্যোতিবাবু বাড়ি আসবেন আজ বিকেলেই হয়তো, কিন্তু তিনি সাইকেল নিয়ে আসবেন, গাড়ি নিয়ে নিশ্চয় নয়। তুষার ভেবে দেখল, তার পক্ষে অপেক্ষা করা ছাড়া পথ নেই। যদি কোনও কাজে কর্মে নুটু এসে পড়ে গাড়িটা নিয়ে ভাল, নয়তো কাল যখন ইতি আর আশাদিকে নিয়ে নুটু ঠাকুর দেখাতে আসবে তখনই যাবে তুষার। উপায় কী!

আজ দুপুরটা অজস্র সময় আর কর্মহীন অবসর নিয়ে এসেছিল। তুষার অনুভব করল তার চারপাশে অফুরন্ত আলস্য দীঘির মতন বিরাজ করছে। এখানে শরৎ কাল বাংলা দেশের মতন নয়, কিন্তু এই শরৎ আরও শুষ্ক, যেন শীতের মিশেল দেওয়া। রোদ ঠিকরে আছে, আকাশ সুনীল, বাতাস মৃদু ও শীতল। বাগানে কয়েকটা প্রজাপতি আপন মনে উড়ছে।

বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে অনেকক্ষণ তুষার এই দুপুরকে অনুভব করল। আজ অনেকটা বেলায় সে মাথা ঘষেছে, চুলগুলো এখনও সামান্য ভিজে। রোদে দাঁড়িয়ে তুষার চুল শুকিয়েছে যতটা পেরেছে, তারপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি, রোদটা কপালে লাগছিল। তা ছাড়া, আরও কিছু যেন লাগছিল।

তুষার দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে কেমন বিষণ্ণ মনে করেছিল। কোনও কারণ নেই, তবু শান্ত নিবিড় দুপুরে, যখন আকাশের তলায় কয়েকটা চিল ডানা মেলে উড়ছে, পাকা হরীতকীর মতন রং ধরা শূন্যতা চারপাশে, অলস কাক কোথাও বসে ভাবছে এবং শিউলি গাছটার তলা থেকে কদাচিত বাতাসে গন্ধ ভেসে আসছে–তখন তুষার অনুভব করল তার কোথাও যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুষার সাহেবদাদু, ইতি, আশাদি জ্যোতিবাবুর কথা ভাবল। মলিনার কথাও। কিন্তু এদের ভাবনার মধ্যে তুষার নিজের মনকে ডুবিয়ে রাখতে পারল না। আদিত্যর কথা তার বার বার মনে পড়ছিল।

আদিত্য এখনও যায়নি। তার যাবার কথা তুষার শুনেছে। গতকালই তার চলে যাওয়া উচিত ছিল। যায়নি। গেলে দেখা হত, আদিত্য দেখা করত। কেননা নুটুর গাড়ি ছাড়া উপায় নেই যাবার। আর নুটুর গাড়ি কালও এসেছে তুষারের বাড়িতে। আদিত্যর যাওয়ার কথা কেউ বলেনি।

আদিত্যর কথা ভাবতে ভাবতেই তুষার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। শিশিরটা ঘুমোচ্ছে। বিছানায় শুয়ে তুষারেরও ঘুমোতে ইচ্ছে করল। কিন্তু সাহস হল না। অতক্ষণ মাথা ঘষার পর দুপুরে ঘুমোতে ভরসা পাচ্ছিল না, বিকেলে মাথা ভার হবে, সর্দিও হয়ে যেতে পারে। তুষার না ঘুমিয়ে শিশিরের ঘর থেকে একটা মাসিক পত্রিকা এনে শুয়ে পড়ল।

একটা গল্প পড়ল তুষার। ভাল লাগল না। পাতা ওলটাল এ-লেখা সে-লেখায়, মন বসল না। পাতা উলটে উলটে বিজ্ঞাপন দেখল। তারপর পত্রিকাটা রেখে দিল।

অবশেষে জানলা দিয়ে মরে আসা দুপুর দেখতে লাগল। দুপুর ফুরিয়ে আসছে দেখলে কেমন মায়া হয়; মনে হয় যে সকালটি সুশোভিত হয়ে দেখা দিয়েছিল, তার যাবার বেলা হয়ে এল। আর এসব কথা মনে পড়লেই কেন যেন অলস মন যত অদ্ভুত চিন্তা করে। চিন্তা করে যে, সব জিনিসই ফুরিয়ে আসে, সব জিনিসেরই পরিণাম আছে। যেমন করে সকাল ফুরোল, এমনি করেই শরৎ ফুরিয়ে আসছে, শীত আসবে তাও ফুরোবে। তুষারও ফুরিয়ে আসছে। আশাদির মতন।

সব শুরুই কেমন সুখের, সব ফুরিয়ে যাওয়াও কেমন দুঃখের। তুষার সাহেবদাদুর কথা ভাবল। সাহেবদাদু একেবারে শেষ বেলায় এসে পড়েছেন। এবার ডুবে যাবেন। কী হবে তখন শিশুতীর্থের? জ্যোতিবাবু কর্তা হবেন। জ্যোতিবাবু দায় দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়ে সাহেবদাদুর অত সাধের শিশুতীর্থকে চালাবেন। পারবেন কি? হয়তো পারবেন। জ্যোতিবাবুর না পারার কারণ নেই। তিনি জীবনে অন্য কিছু কামনা করেন না। আর করলেও সেই কামনা বড় কিছু নয়। হয়তো মলিনাকে বিয়ে করলে সে কামনাও মিটবে।

আশাদি কথাটা বলেছে তুষারকে। বলেছে, মলিনার ওপর জ্যোতিবাবুর যেমন টান তুষার, তাতে মনে হয় মেয়েটাকে জ্যোতিবাবুই বিয়ে থা করবেন।

কথাটা তুষার বিশ্বাস করতে চায় না। আবার পুরোপুরি অবিশ্বাসও নয়। মলিনাই বা কেমন? আদিত্যর সঙ্গে তার মেশামিশিতে আটকায় না, আবার জ্যোতিবাবুর মায়া মমতাটুকুও সুযোগ বুঝে নেওয়া চাই। ওই মেয়েটাকে তুষারের কোনও দিনই ভাল লাগে না। নামই মলিনা নয়, ওর মনও বড় মলিন।

ভাবতে ভাবতে তুষারের চোখে তন্দ্রা জমেছিল। কয়েকবার চোখের পাতা খুলে সে দুপুরের দিকে চেয়ে থাকল, সতর্ক হল, ঘুমোতে চাইল না। তবু কখন তন্দ্রা এসে তার চোখের পাতা জুড়ে দিল। তুষার বালিশের কোলে মাথা মুখ চেপে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

ঘুম ভাঙল বিকেলে। রোদ পালিয়েছে। বিকেলের রং ঘন হয়েছে, বাগানের চেহারা নিরুজ্জ্বল। রোদের কিরণ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ছায়ার আঙুলগুলো যেন ঘরের জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এবার ঘরে ঢুকবে। তুষার ধড়মড় করে উঠে বসল। শিশিরের ঘরে কার যেন গলার শব্দ।

বাইরে এসে তুষার কলঘরে গেল। বেরিয়ে এসে আকাশ দেখল, রোদের ঈষৎ আভা আকাশের তলায় লেগে আছে। একটা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ নিচু দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। চোখ মুখের জল আঁচলে মুছতে মুছতে রান্নাঘরের দিকে তাকাল তুষার। বাইরে কুয়োতলার কাছে ঝিয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। অবেলার ঘুমের জন্যে হাই উঠছিল তুষারের। ইস সেই ঘুমিয়ে পড়েছিল তুষার। মাথাটা অবশ্য এখনও ভার লাগছে না।

শিশিরের ঘরের কাছে দু দণ্ড দাঁড়িয়ে শেষে তুষার ঘরে ঢুকল। যতীন।

তুষারকে দেখে যতীন বলল, এই যে দিদি, আপনি গিয়েছিলেন শুনলাম। আমি দুটোর পর ফিরেছি। স্নান খাওয়া করে এলাম। বলে যতীন একটু লজ্জার হাসি হাসল, বলল, শিশিরের কাছে শুনলাম। আমার জিপ অচল। কাল সকালে আপনাকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দেব।

কাল।

খুব সকালেই পাবেন। জিপটার ব্রেক ধরছে না ঠিক মতন। সারতে লাগিয়ে দিয়েছি।

তবে তাই। সকালেই পাঠিয়ে দিয়ে। আমার বেশি দেরি হবে না। তুষার হাসল।

যতক্ষণ খুশি আপনি আটকে রাখবেন। কাল থেকে আমার চার পাঁচটা দিন নো-ওয়ার্ক। যতীন হাসল।

যতীনের বয়স বেশি নয়। চেহারাও ভাল। কাঠগোলার ব্যবসায় দু পয়সা মন্দ করছে না। ছেলেটি ভাল, ভদ্র, বিনীত। তুষারের হঠাৎ ইতির কথা মনে পড়ল। যতীনের কথা সাহেবদাদুকে বললে হয়।

চা খেয়েছ? তুষার শুধোল।

খেয়েছি।

কী ঘুম ঘুমোলি তুই। শিশির বলল তুষারের দিকে তাকিয়ে, এই রেটে গোটা ছুটি ঘুমোলে মোটা হয়ে যাবি।

তুষার ভাইকে দেখল। শিশির তাকে ডেকে দিতে পারত। ডাকেনি। দিদির ওপর কত মায়া! হাই আসছিল তুষারের আবার, মুখে হাত আড়াল দিয়ে তুষার হাই তুলল, বলল, সারা বছর কাজ করি, ছুটিতে একটু ঘুমোব না? ..যাক গে, চা খাবে আর একটু যতীন?

খাবে। তুই তৈরি করে নিয়ে আয় তো! শিশিরই জবাব দিল।

রান্নাঘরে চলে গেল তুষার। স্টোভ ধরিয়ে চা করল। অবেলার ঘুম বড় আলসামি মাখিয়ে দেয় সারা গায়ে। তুষারের সর্বাঙ্গে সেই আলস্য, যেন তুলোর মতন কোমল, মনে হয় আবার গিয়ে বিছানায় চুপ করে শুয়ে থাকি। শুয়ে থেকে থেকে সন্ধ্যাকে দেখি, দেখি রাত কেমন করে আসে, কেমন করে সেই রাতের মধ্যে ডুবে যাই।

শিশিরদের চা দিয়ে, নিজে চা খেয়ে তুষার যখন রুক্ষ চুল নিয়ে বসেছে, তখন সন্ধে হয়ে আসছিল। আর ঠিক সন্ধের মুখে আদিত্য এল। ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে।

তুষার অবাক। মানুষটা এ-ভাবে এসেছে কেন? সে কি আজও যাবে না? ব্যাপার কী?

শিশিরের ঘরেই বসেছিল আদিত্য। কথা হচ্ছিল শিশিরের সঙ্গে। তুষার বলল, আমি ভেবেছিলাম আপনি চলে গেছেন।

কাল যাব। ..আদিত্য বলল, আজ একবার লাস্ট ভিজিট সেরে নিচ্ছি।

শহরে আর কার সঙ্গে দেখা করতে আসবে আদিত্য। তুষারের ইচ্ছে হল পরিহাস করে বলে, মলিনার সঙ্গে দেখা হল? অথচ মনে মনে কোনও সাড়া পেল না তুষার। বলল না। মলিনাকে শেষ দেখা করার লোক বলে ভাবতেও পারল না।

কথাটা শিশিরই পাড়ল হঠাৎ। বলল, দিদি, তুই তো সঙ্গী পেয়ে গেলি।

সঙ্গী! তুষার ভাইয়ের দিকে তাকাল অবাক চোখে। আদিত্যবাবু তাঁর রথ নিয়ে এসেছেন। শিশির হাসিমুখে ব্যাখ্যা করল। আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, দিদি শিশুতীর্থে যাবার জন্যে সকাল থেকে জ্বালাচ্ছে। আপনিই নিয়ে যেতে পারেন।

তুষারের ইচ্ছে হল শিশিরের মুখের কথা কেড়ে নেয়, থামিয়ে দেয়। কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই না কি ওর! অত দরদ দেখাবার কী দরকার পড়ল শিশিরের! তুষার বিরক্ত বোধ করে শিশিরের দিকে ভর্ৎসনার চোখে তাকাল। তুষার পাগল হয়নি। ওই মানুষের সঙ্গে পথে বেরিয়ে কি সে আরেক জ্বালার মধ্যে পড়বে না কি! না। শিশিরের কথার পর-পরই তুষার আপত্তি জানাতে গেল, না না, এখন নয়। সকালে যাবার দরকার হয়েছিল একটু!

আদিত্য, তুষারের দিকে প্রত্যাশার চোখে তাকাল। আমি ঘোড়ার গাড়িটা এনেছি চলুন।

না-না। তুষার মাথা নাড়ল।

না কেন–! শিশির বলল, চলে যা না। তোর অসুবিধে কী! জিনিসগুলো দিয়ে আসবি, বেড়ানোও হয়ে যাবে।

শিশিরের মূর্খতায় তুষার রাগ না করে পারল না। কে তোকে বলেছে ঘরের কথা ঢাক পিটিয়ে বাইরের লোকের কাছে বলতে? তোর অত মাথা ব্যথার দরকার কী? যা করার তুষার করবে। এমন অসভ্য আর মোড়ল হয়েছে শিশির! তুষার ভাইয়ের ওপর বিরূপ বিরক্ত হল।

আদিত্য কি এই অপ্রত্যাশিত সুযোগই খুঁজছিল! তুষার দেখল আদিত্য যেন উৎসাহের আবেগে প্রদীপ্ত। আতিশয্য প্রকাশ করে বলল, না কেন, চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে যাব আবার।

এখন থাক; এমন কিছু জরুরি ব্যাপার নয়।

নাই বা হল। এমনি বেড়িয়ে আসবেন। …ঘোড়াটা ভাল ছুটছে, খুব মজা পাবেন। ইউ উইল এনজয় দি রাইড।

তুষার মাথা নাড়ল। না, এখন সে যাবে না।

আদিত্য অনুমান করতে পারল তুষারের আপত্তি কোথায়, কেন তুষার যেতে চাইছে না। আহত এবং ক্ষুব্ধ দেখাল তাকে। মুখ ম্লান। আদিত্যের দৃষ্টি যেন বলছিল, আমায় অতটা অবুঝ ভাবার কী আছে? আমি কি তোমার কোনও ক্ষতি করব?

শিশির দিদির এই হেঁয়ালি বুঝতে পারছিল না। যাবার দরকার যখন তখন ঘুরে আসুক না কেন। কালকের অপেক্ষায় বসে থেকে কী লাভ! যতীনের গাড়ি যদি ঠিক না হয়! যন্ত্রের কথা কে বলতে পারে! শিশির বলল, কাল সকালে যতীনের গাড়ি ঠিক না হলে আবার সেই গজ গজ করবি। হাতের সুযোগ পায়ে ঠেলে ফেলছিস তখন জলে পড়বি।

আদিত্য তুষারকে যেন ভাল করে লক্ষ করে নিল। গলায় সামান্য জ্বালা, বলল, বেশি বুদ্ধিমানরাও মাঝে মাঝে বোকামি করে।

আবহাওয়া কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠেছিল। তুষার বুঝতে পারল, ব্যাপারটা দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছে। আদিত্য স্পষ্ট বুঝতে পারছে, তুষার তাকে এড়িয়ে যেতে চাইছে, তার সঙ্গে পথে বেরোতে রাজি হচ্ছেনা। স্বভাবতই নিজেকে অপমানিত বোধ করছে আদিত্য, ব্যথিত এবং ক্ষুব্ধ হচ্ছে। শিশিরই বা কী ভাবছে কে জানে। দিদির এই হঠাৎ আপত্তির কারণও কি সে অনুমান করতে পারছে। তুষারের মনে হল, শিশির বরাবরই যেন এই জিনিসটা লক্ষ করছে, আদিত্যের সম্পর্কে তুষারের কেমন যেন একটা সঙ্কোচ, এড়িয়ে থাকার চেষ্টা। কেন? শিশির কি এই কেন-র দিকে তাকিয়ে কিছু ভাববার চেষ্টাও করছে! বলা যায় না। সেদিন, আদিত্যর আসার কথা শুনে তুষার যে পালিয়ে গিয়ে বসেছিল শিশির পরে তা বেশ বুঝতে পেরেছে। বুঝে বলেছিল, ভদ্রলোককে তুই অত ভয় পাস কেন। কেন ভয় পায় শিশির কেমন করে জানবে।

তুষার অস্বস্তি বোধ করছিল। হঠাৎ বলল, এখন সন্ধে হয়ে গেছে, এসময় লাভ কী গিয়ে।

ওর এই কারণ দেখানো এখন যেন খুব জলল, ছেলেমানুষির মতন শোনাল। মনে হল, নিতান্ত একটা ছুতো দেখাবার জন্যেই কথাটা বলল তুষার। শিশির আদিত্যর চোখে চোখে তাকাল, তারপর দিদিকে দেখল। যাবি তো চার পাঁচ মাইল রাস্তা, তাও গাড়িতে তার আবার সন্ধে।

আদিত্য হাসল, হাসিটা ব্যঙ্গের। সন্ধে হয়ে গেলে পথে বোধ হয় ভূত বেরোয়।

তুষার বিদ্রূপ গায়ে মাখল না। মাখলে অন্য জালে জড়িয়ে পড়তে হবে। বরং সাধারণ ভাবে হেসে বলল, আপনার ভরসায় বেরিয়ে তারপর গাড়ি উলটে মরি।

কেন? আদিত্য তাকাল।

আপনাকে ভরসা কী! যদি লাগাম সামলাতে না পারেন, তবেই মরেছি।

কথাটার কি কোনও সূক্ষ্ম অর্থ ছিল। হয়তো, হয়তো নয়। আদিত্য দু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, লাগাম ধরতে পারি কি পারি না একবার ট্রায়াল দিয়েই দেখুন। …অত সহজে মানুষ মরে না–গাড়ি উলটে গেলেও নয়।

তুষার তবু হাসল। যেন হাসিতেই তার শেষ বক্তব্য লুকোনো আছে। হাত পা ভাঙে তো!

হাত পা ভাঙা এমন কিছু নয়। আবার জুড়ে যায়।

শিশির অসহিষ্ণু হয়ে বলল, তোর খালি কথা। যাবি তো যা, না হয় যাস না। অত হ্যাঁ না করার কী আছে।

আদিত্য পকেট থেকে সিগারেট বার করল। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, সাহস না পেলেই কিন্তু থাকে। কী বলুন!

তুষার যেন কী ভাবছিল। হঠাৎ বলল, বেশ চলুন। আমি কিন্তু তাড়াতাড়ি ফিরব।

আদিত্যর মুখ দেখে মনে হল সে সন্তুষ্ট হয়েছে। এক মুখ ধোঁয়া জানলার দিকে উড়িয়ে দিয়ে ও বলল, তা হলে তাড়াতাড়ি বেরুতে হয়।

তুষার দ্বিতীয় কোনও কথা বলল না। বাইরে চলে গেল। ত্বরিতেই সে তৈরি হয়ে নেবে। চুল আর বাঁধবে না, রুক্ষ্ম চুল জড়িয়ে এলো খোঁপা করে নেবে, আর গায়ের শাড়িটা পালটে নেবে। কতক্ষণ আর লাগবে তার। সামান্যক্ষণ। ততক্ষণে সন্ধে আরও ঘন হয়ে আসবে। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে তুষার আকাশের দিকে তাকাল। তারা ফুটেছে।

.

১৫.

আকাশের তলায় অন্ধকার। যেন কালো মোম দিয়ে সমস্ত আকাশটা কেউ ঘষে দিয়েছে। তারাগুলো সেই অন্ধকারে খচিত হয়ে আছে। এখন অনেকটা রাত। কত রাত কেউ জানে না। প্রসারিত অরণ্য ওদের চক্ষু থেকে সমস্ত সংসার আবৃত করে রেখেছে। তুষার একটা বড় পাথরের ওপর বসে, আদিত্য পাশের ছোট পাথরটার ওপর দাঁড়িয়ে। ঘোড়ার গাড়িটা সামান্য তফাতে। তার গায়ে টিমটিমে দুটো বাতি জ্বলছে। মাঝে মাঝে ঘোড়াটা পা ঠুকছিল, কদাচিত ঊর্ধ্বে মুখ তুলে অরণ্যকে তার সম্ভাষণ জানাচ্ছিল।

তুষার নীরব। শিশুতীর্থ সে অনেকক্ষণ আগে ফেলে এসেছে। ফেলে আসাই। এখন সেই রকম মনে হচ্ছে। যেন কোন সন্ধ্যাকালে একবার সেখানে গিয়েছিল, সাহেবদাদুর পায়ে পশমের চটিটা পরিয়ে প্রণাম করেছে, ইতিকে দিয়ে দিয়েছে তুষারের সেই ভাল-লেগে-যাওয়া শাড়িটা, আশাদির সঙ্গে দেখা করেনি আর, আদিত্যর গাড়িতে চেপে বসেছে আবার। আর আদিত্য তাকে কেমন অদ্ভুত যাদুমন্ত্র বলে যেন নিয়ে এসেছে এই পাহাড় সন্নিকট অরণ্যে।

সেও যেন কতক্ষণ, মনে হয় সময়ের হিসেব পাওয়া যাবে না। প্রতিটি মুহূর্ত যেখানে মাসান্ত বলে মনে হয় সেখানে এই দীর্ঘ সময় একটি যুগও মনে হতে পারে। কিন্তু তা নয়। কেননা ওই আকাশের এই অন্ধকার অচিরে হালকা হয়ে আসবে, আর তারপর একটি শীর্ণ চাঁদ দেখা দেবে, ষষ্ঠীর চাঁদ।

আদিত্যকে দেখা যাচ্ছে না। বৃক্ষছায়ার মতন অন্ধকারে সে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে।

তুষার হাঁটু ভেঙে বসেছিল। হাঁটুর ওপর চিবুক। তার দৃষ্টি আকাশ অথবা নক্ষত্রের শোভা দেখছে না। সামনের কয়েকটা পাথর, দু একটি বন্য চারা আর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে সে বসেছিল। প্রত্যহের স্বাভাবিক চেতনা থেকে সে ছিন্ন। যেন এই প্রকাশ্য চেতনা তার মনের অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে, তুষার তাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। তার যেন সে আগ্রহও ছিল না। হয়তো এই পরিত্যক্ত নির্জন নিস্তব্ধ জগতের মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করে সে তৃপ্ত। হয়তো এই নিভৃতি এবং অন্তরাল তাকে মোহাচ্ছন্ন করেছে।

আদিত্য আজ সত্যই তুষারকে মোহাচ্ছন্ন করেছে। তুষার নিজের বোধ ও জ্ঞান ওই মানুষটির কাছে কেমন করে বিসর্জন দিতে পারল সে জানে না। অথচ আদিত্য যে ক্রমশ এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তুষারের স্বাভাবিক চেতনাকে অপহরণ করেছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

সামান্য আগে কোনও বাক্যালাপ উভয়কে অকস্মাৎ এমন এক বেদনা দিয়েছিল যারপর স্তব্ধতা ভিন্ন উপায় ছিল না। আদিত্য তুষারের কাছ থেকে উঠে গিয়েছিল, তুষার অর্ধ-আনত চোখে সামনের অন্ধকার দেখছিল।

অবশেষে তুষার নিশ্বাস ফেলল। নিশ্বাস ফেলে মুখ তুলল। সন্নিকট অরণ্যের অন্ধকার যবনিকার মতন দাঁড়িয়ে আছে। সেই যবনিকার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে তুষারের মনে হল, জীবনের এই অপ্রকাশ্য রূপটি কেন স্থায়ী নয়। কেন? কেন এই রাত্রি, এই বিচ্ছিন্নতা, এমন মুক্তি সম্ভব হয় না?

আদিত্য আবার সামনে এল। কাছে। তুষারের পাশে নিচু পাথরটায় বসে পড়ল।

সমস্যার শেষ হয় না। আদিত্য বলল আচমকা, যেন তার ভাবনার একটি অসম্পূর্ণ অংশ ব্যক্ত করল। আমরা বড় মূর্খ, সব সময় সমস্যাটাকে বড় করে দেখি।

তুষার কোনও জবাব দিল না। বাতাস তার কপালের রুক্ষ চুলের গুচ্ছ চোখে ফেলছিল। কপাল থেকে চুল সরাল নিঃশব্দে।

আমি হিসেব করতে শিখিনি। আদিত্য বলল।

আদিত্যর মুখ দেখল তুষার। দেখা যায় না। অন্ধকারে ছায়ার মতন হয়ে আছে।

ছেলেবেলায় একটি মেয়ের সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। আদিত্য কী ভেবে বলল, সে খুব হিসেবি ছিল। আমায় হিসেব করে দেখিয়েছিল আমার বয়স যখন বাইশ হবে, তার আঠারো–তখন আমাদের কোথাও কোনও বাধা থাকবে না। … হিসেবটা ভুল হবার কথা নয়; তবু তার ষোলো বছরে বিয়ে হয়ে গেল এক জুয়েলারের সঙ্গে।

আদিত্যর বাল্য-প্রণয় তুষারকে উৎসাহী করল না। সেই মেয়েটি যে বয়সে হিসেব শিখেছিল, হয়তো সেবয়সে ভাল করে কিছু শেখা যায় না।

আমরা কি নিজের গড়া জগতে বাস করি? আদিত্য আগের প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করল কথাটা।

করি না? তুষার মুখ ফেরাল আবার।

না, করি না।

তবে?

জানি না। আমার কোনও ইচ্ছে নেই জানার। আমি এই বাঁচাটুকু বিশ্বাস করি। যা আমার চোখের সামনে আমার হাতের কাছে, আমার প্রার্থনা সেখানে। এর বেশি জেনে আমার কী লাভ!

কী জানি! তুষার দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।

অল্প সময় আবার নীরবতা। আদিত্য যেন আরও ঘন হয়ে এল তুষারের কাছে। কোনও মুহূর্তে প্রেমিকের মিনতির মতন তুষারের একটি হাত তুলে নিল। তুষার বাধা দিল না।

তুষার।

তুষার কথা বলল না। তার হৃদয় যেন আবার কেমন আশ্চর্য কুহকে আচ্ছন্ন হচ্ছিল।

আমার সমস্ত কিছুই ছেলেমানুষি নয়। আদিত্য তুষারের হাঁটুর এত কাছে মুখ এনেছিল যে, তুষার উষ্ণ নিশ্বাস পাচ্ছিল। তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারো।

কে অবিশ্বাস করেছে।

তুমি।

না।

তা হলে?

তা হলে কী? কেন তুষার স্বীকার করছে না, আদিত্যর ভালবাসা সে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করছে। আমি তোমার এই প্রেম আমার প্রাণকে নিতে দিয়েছি আদিত্য, আমার কোনও কুণ্ঠা নেই, আমি সুখী। তুষার যদি অবিশ্বাস না করবে তবে আদিত্যর প্রেমকে উদ্দেশ্য করে অনুচ্চারিত ভাবে এই কথাগুলো বলতে পারত। পারা উচিত ছিল। তুষার তা পারছে না। এই প্রেম তার কাছে মধুর, এর স্বাদ তাকে বহুক্ষণ পূর্ব থেকেই রোমাঞ্চিত করছিল, আদিত্যর হাতের তালুর মধ্যে কিছুক্ষণ আগে সে আরও একবার এখনকার মতন নিজেকে সমর্পণ করে বসেছিল। তখন যেন তুষার এই মুহূর্তেরও অধিক আনন্দ পেয়েছিল। এখন যেন সেই আনন্দ ঈষৎ হ্রাস পেয়েছে।

রাত হয়েছে অনেক। তুষার বলল।

আদিত্য তুষারের হাত নরম করে নিজের দিকে আকর্ষণ করল, মুখের পাশে রাখল। তুষার তার সমস্ত মমতা হাতে নির্ভর করতে চাইল। তার বুকের তলায় এখন যেন একটি তুলোর হৃদয় সমস্ত অনুভূতিকে স্নিগ্ধ কোমল করতে চাইছিল।

তুষারের নরম হাত নিজের মুখ গাল কপাল এবং চোখে রাখছিল আদিত্য। বুলিয়ে নিচ্ছিল। আহত কাতর ব্যক্তি যেমন করে স্বস্তি ও শান্তির স্পর্শ পেতে চায়, আদিত্য সেই ভাবে তুষারের করতল নিজের উষ্ণ মুখে রাখছিল।

তুষারের অঙ্গে শিহরণ ছিল। কিন্তু ক্রমশ তার স্নায়ু শিহরণকে সহনশীল করে তুলেছে।

ফিরতে হবে। তুষার বলল চাপা গলায়।

না। আদিত্য ছেলেমানুষের গলায় জবাব দিল।

না ফিরে তারপর?

কিছু না। আমরা বসে থাকব।

পাগলামি। তুষার বিষণ্ণ মধুর করে হাসল।

আদিত্য তুষারের আঙুল নিজের ঠোঁটে রাখল! ফুলের পাপড়ির মতন আলগা করে বুলোতে লাগল।

তুমি ওই গানটা কেন গাইলে, তুষার। আদিত্য কাতর ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল, যেন অভিমানের পর এখন সে আঘাত প্রকাশ করছে। এই মণিহার তোমায় কেন সাজবে না?

তুষার আজ ওই গানটা গেয়েছিল। আদিত্য তাকে দিয়ে গাইয়েছিল। তুষার জানত না কী গান গাইবে। গাইতে শুরু করে তার কণ্ঠ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ওই গানের কলিটা এসে গিয়েছিল। কেন এসেছিল তুষার জানে না।

তুমি ভিতু। আদিত্য বলল, তোমার মনে সাহস নেই।

নেই।

কেন নেই?

কী করে জানব।

তুমি সমস্ত জান। তুমি জান একে ছেঁড়া কষ্টের।

একে পরাও যায় না, কষ্ট হয়।

ওটা তো গানের কথা।

আমার কথাও।

তুষার-আদিত্য পাগলের মতন মাথা নাড়ল। না, না; গানের কথাকে তুমি তোমার কথা বোলোনা । আদিত্য তুষারের করতল চুম্বন করল, তুষারের হাত দিয়ে নিজের চোখ ঢাকল। মনে হচ্ছিল এই প্রত্যাখ্যান আদিত্য স্বীকার করবে না। তুষার তুমি আমার কষ্ট দেখছ না।

কষ্ট।

আমি তোমায় কী করে বোঝাব…

আমি বুঝি। তুষার আবার হাত টেনে নিল। বলল, আর দেরি করা যায় না। ফিরতে হয়।

আদিত্য উঠল না। তার স্বাভাবিক উত্তেজনাও এত প্রখর নয়। এখন সে আরও ব্যাকুল, উদভ্রান্ত, অস্থিরচিত্ত। জ্ঞানহীনের মতন আদিত্য তুষারের পায়ে–জানুর ওপর মুখ রাখল। ফিরে গেলে তুমি আবার বদলে যাবে।

শিশির ভাবছে। অনেক রাত হয়ে গেল। তুষার আদিত্যর মাথা সরাতে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত তার চুলে হাত রাখল। কষ্ট হচ্ছিল তুষারের। এই স্পর্শ আর কোনওদিন অনুভব করবে না তুষার।

আদিত্য শিশুর মতন তুষারের জানুতে মুখ রেখে যেন কাঁদছিল। তুষার নিঃসাড় হয়ে বসে। ঘোড়াটা অধৈর্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠল। তার পা ঠুকছিল। এই নিস্তব্ধ আবহাওয়ায় পশুটার কর্কশ ডাক বন্যজন্তুর কান্নার মৃতন শোনাল।

ওঠো! তুষার নিবিড় করে ডাকল, আদিত্যর মাথা সরিয়ে দিল কোমল করে, আর রাত করা উচিত না।

আদিত্য উঠল। ঘোড়াটা বড় অস্থির হয়ে পড়েছে। একেবারে বুনো ঘোড়া। এত অন্ধকার আর রাত্রে ওই ঘোড়াটাকে সামলে নিয়ে যাওয়া খুব মুশকিল।

.

আদিত্য উঠে দাঁড়িয়েছে দেখে তুষারও উঠে দাঁড়াল। পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে থাকার দরুন তুষার নিজেকে আদিত্যর চেয়ে অনেক দীর্ঘ মনে করল। তার মনে হল, এই উচ্চতা তাকে রক্ষা করেছে।

সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে দুটি মানুষ গাড়িতে এসে বসল। আদিত্য সামনে, তুষার পিছনে। গাড়িটা ছোট। পিছনের দিক নিচু হয়ে আছে। পাদানে পা রেখে তুষার সামনের কাঠে হাত রেখে হেলে বসল। আদিত্য ঘোড়ার লাগাম ধরে। ঘোড়াটার মুখ ঘুরিয়ে নিল আদিত্য।

জঙ্গলের পথ; গাড়িটা উঁচু নিচু রুক্ষ অসমতল পথ দিয়ে যাবার সময় লাফিয়ে উঠছিল, কাত হয়ে যাচ্ছিল। তুষার সেই ঝাঁকুনিতে গড়িয়ে যেতে যেতে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল।

এই রাস্তাটা তুমি জানো? আদিত্য বলল।

না।

কখনও আসোনি আগে?

কই আর এসেছি

ডান দিকে গেলে আমরা পাহাড়ে গিয়ে পড়ব।

আমরা তো বাঁ দিকে যাচ্ছি।

তোমার শিশুতীর্থের দিকে।

সামান্য সময় আর কথা হল না। ঘোড়াটা বোধ হয় তার চেনা পথের গন্ধ পেয়েছে বলে এখন খানিকটা শান্ত হয়ে পথ চলছিল। বাতির আলো এত অনুজ্জ্বল যে পথ ভাল করে দেখা যায় না। আদিত্য হাত বাড়িয়ে গাড়ির গায়ে ঝুলোনো বাতির শিখা আরও উজ্জ্বল করে দিল।

আমার ভাগ্য খুব খারাপ, তুষার। আদিত্য বলল। আমার মার ভাগ্য নিয়ে আমি জন্মেছি।

উনি না আত্মহত্যা করেছিলেন?

সম্মানে লেগেছিল বলে।

আত্মহত্যায় কোনও লাভ নেই।

আমি বোকা নয়। মরব না।

আমার কেমন মনে হয়–

কী?

তুমি পাহাড়ের খারাপ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছ। ভয় করে।

আমি ইচ্ছে করলে অন্ধকারে ঝাঁপ দিতে পারি। কিন্তু দেব না।

এত বেপরোয়া, অবুঝ হলে চলে না। সংসার কেবল খরচ করার জায়গা নয়। তুমি কেন নিজেকে খরচ করে ফুরিয়ে যাচ্ছ?

আমি ফুরিয়ে যাচ্ছি কিনা জানি না। একটা কিছু হয়ে ওঠার জন্যে আমি পাগল। আমার কিছু হচ্ছে না।

হবে। আরও পরে। তোমার এই অস্থির স্বভাব একদিন শান্ত হয়ে এলে তুমি নিজেকে বুঝতে পারবে।

আদিত্য কথা বলল না। ঘোড়ার খুরের শব্দ এবার কানে যাচ্ছিল, সামনের পথ অনেকটা সমতল। তুষার আদিত্যর শক্ত কালো পিঠের দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে থাকল।

খানিকটা পথ শেষ হল। এবার রাস্তা পাওয়া যাবে। আদিত্য ঘোড়াটার লাগাম আলগা করে দিল।

আমি তোমার কথা ভুলব না। আদিত্য বলল।

জোর করে কিছু বলা ঠিক না। তুষার মৃদু গলায় বলল।

আদিত্য কথাটা শুনল কিনা বোঝা গেল না। ঘোড়ার পিঠে আলগা করে চাবুক কষাল।

এই শিশুতীর্থ তোমায় কতকাল ধরে রাখবে, আমার জানতে সাধ হয়। একদিন তোমার কাছে এর দাম থাকবে না। আদিত্য মুখ ফেরাল না, সামনের দিকে তাকিয়েই বলল।

আমি জানি।

জান! আগে তো বলোনি?

আগে জানতাম না, এখন জানতে পেরেছি। তুষার নিজের মনের সঙ্গে কথা বলার মতন করে বলল। আমার ভাগ্যও খুব সুখের নয়, আমার চারপাশের দায় দায়িত্বও কম নয়।

তুমি খুব সাবধানী।

কে জানে! ..

ঘোড়াটা রাস্তা পেয়ে গেছে। আদিত্য অনুভব করল তার হাতের লাগামটা আলগা, ঘোড়াটা কদমের জোর বাড়িয়েছে।

তুষার কপাল থেকে চুলের গুচ্ছ সরাল। ভাল করে গুছিয়ে বসল। গাড়িটা আর তাকে অস্বস্তি দিচ্ছে না। অন্ধকারের মোম ঘষা পৃথিবী কেমন নরম হয়ে এসেছে।

এবার চাঁদ উঠবে। আদিত্য বলল।

আজ ষষ্ঠী, এতক্ষণে ওঠা উচিত। তুষার আকাশের দিকে তাকাল।

চাঁদ ওঠেনি এখনও, উঠবে বলে আকাশের একদিকে অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে।

তোমাদের শিশুতীর্থ–আদিত্য হাত বাড়িয়ে অদুরের দু একটি মৃদু আলো দেখল।

তুষার বুঝতে পারল, সাহেবদাদুর ঘরে বাতি জ্বলছে, বাতি জ্বলছে আশাদির ঘরে, আরও কোথাও কোথাও। জোনাকির আলোর মতন বিন্দু বিন্দু আলোগুলো দেখে তুষার অনুভব করল, সে আর-এক জগত পেরিয়ে নিজের জগতে এসে পড়েছে।

ঘোড়াটা ছুটতে ছুটতে হঠাৎ ডেকে উঠল। আর তখনি তুষার দেখল, আকাশে চাঁদ উঠেছে, শীর্ণ চাঁদ।

শিশুতীর্থ পেরিয়ে এল গাড়িটা। চাঁদ ম্লান আলো এনে ওদের গাড়িকে পথ দেখাল এতক্ষণে। আদিত্য ঘোড়ার পিঠে আবার চাবুক মারল। ঘোড়াটা একবার পিছু দিকে লাফিয়ে উঠে হঠাৎ দ্রুততা আনল তার ছোটার বেগে।

তুষার অবলম্বনটা আঁকড়ে ধরল।

তোমার দুঃখ হচ্ছে না, তুষার? আদিত্য শুধোল।

হচ্ছে। মাথা হেলিয়ে তুষার বলল।

কীসের দুঃখ?

কীসের দুঃখ তুষার কেমন করে বোঝাবে। হয়তো সে নিজের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করেই এই দুঃখ লাভ করল। সুখ পাবার লোভে সে গিয়েছিল, সুখ পেয়ে আবার সেই সুখকে হারিয়ে এল, কেননা এই দুঃখ তাকে প্রলুব্ধ করেছিল।

বললে না! আদিত্য আবার শুধোল।

তুষার অস্বস্তি বোধ করল। সে কিছু বলতে চায়, পারছে না। আদিত্যকে নিজের হিসেবটা দেখাতে বিব্রত বোধ করছিল তুষার।

গাড়ি আরও এগিয়ে এল। তুষার নিচু গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।

তুমি কিছুই বুঝতে পার না।

সত্যিই তুষার কিছু বুঝতে পারে না। সে বুঝতে পারছে না, কেন সে আদিত্যর সঙ্গে এই অভিসারে এসেছিল। সে জানত, তার অভিসার সত্য নয়, সে আদিত্যকে গ্রহণ করতে পারবে না, সে এই ছেলেমানুষির খেলায় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে পারবে না, তবু সে এসেছিল। কেন?

হয়তো তুষার তার মহিমা দেখতে চেয়েছিল, হয়তো তুষার জানতে চেয়েছিল, সে মলিনার ঊর্ধ্বে কি না, হয়তো তার ইচ্ছা হয়েছিল এই খেলায় সুখ কেমন তা অনুভব করবে।

আদিত্য পথে আলো পেয়ে ঘোড়াটাকে চাবুক কষাচ্ছিল। পর পর। আর বন্য ঘোড়াটা দুরন্ত হয়ে উঠেছিল, সে যেন হিংস্র উন্মত্ত। তার গতিতে কোনও সংযম ছিল না, সাবধানতা ছিল না।

ঘোড়াটা বড় খারাপ ছুটছে। তুষার বললে শঙ্কিত গলায়।

আর সামান্য পথ। আদিত্য জবাব দিল।

এই ভয়ে কি তুষার এতক্ষণ পরে নিজের চেতনাকে আবিষ্কার করল! অকস্মাৎ তুষারের কাছে এই রাত্রির রহস্য মরে গেল।

যে জগত তুষারকে মোহাচ্ছন্ন আবৃত ও পৃথক করেছিল, এখন সেই জগত স্বপ্নের জগতের মতন দূরে পড়ে থাকল। খেলার জগৎ থেকে ফিরে এল তুষার, ফিরে এসে দেখল, পথের ধুলোয় চাঁদের আলো মেটে রং ধরে আছে, মাঠ-ঘাট তার চেনা, দেখল, ট্রেন লাইনটা সামনে।

নিজের প্রাত্যহিক জগতের দিকে তাকিয়ে তুষারের মনে হল যে জগত থেকে সে ফিরে এল তার সবটাই সোনার ছিল, স্বর্গের। তার খেলনাগুলো কেবল দ্যুতি ঠিকরে দেয়, তারা চোখকে বিস্মিত ও মুগ্ধ করে, সেই মণিমাণিক্য বিহ্বল হয়ে দেখার মতন, কিন্তু তাকে ব্যবহার করা যায় না।

তুষার এমন খেলনা নিয়ে কিছু করতে পারত না। তার ব্যবহারযোগ্য জিনিস ওটা নয়।

গাড়িটাকে আদিত্য আরও বেপরোয়া ভাবে ছোটাচ্ছিল। যেন তার কোনও দিকে গ্রাহ্য নেই, মমতা নেই। দুরন্ত কোনও নেশা তাকে ছোটাচ্ছে, কিসের আক্রোশ তাকে উন্মত্ত করে রেখেছে।

ধাবমান গাড়িতে বসে তুষার অনুভব করতে পারল, আদিত্যর প্রেম এই রকম, অসাবধান অসতর্ক, দুঃসাহসী ও দুরন্ত; অতি দ্রুততায় তার সমস্ত উত্তজনা প্রখর পৌরুষের মতন দেখায়, অথচ এমন অনিশ্চয় যে, যেকোনও সময় তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে পারে।

তুষার স্বীকার করল, জীবনকে এমন করে সে অনিশ্চয়ের মধ্যে ফেলে দিতে পারত না। হয়তো স্তিমিত শান্ত সুস্থির কোনও ভালবাসা সে কামনা করেছিল। হয়তো মলিনা তা পাবে। পাক। তুষার জ্যোতিবাবুর জন্যে আন্তরিক কষ্ট পেল। অনুভব করল, তার হৃদয়ে শূন্যতা বিচরণ করছে।

রেল লাইনের লোহায় অশ্বখুরের স্ফুলিঙ্গ তুলে গাড়িটা লাফ মেরে অন্য পারে চলে গেল।

ভীত কণ্ঠে তুষার বলল, আমায় নামিয়ে দিন।

আদিত্য তুষারকে নামাল না।

.

বাড়ির কাছে এসে আদিত্য গাড়ি থামাল। তুষার নামল। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল। এই ভ্রমণ যে কী ভয়ঙ্কর তুষার যেন এখন তা সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারছিল।

Exit mobile version