Site icon BnBoi.Com

মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ৩য় খণ্ড

মতি নন্দী উপন্যাস সমগ্র ৩য় খণ্ড

০. ভালো লেখা, না তার ভান?

ষোল বছর আগে (১৯৭৮ সালে) ষাটের দশকে উঠে আসা বাইশজন লেখকের প্রতিনিধিত্বমূলক গল্প সংকলন গ্রন্থের আলোচনা করেছিলাম একটি লিটল ম্যাগাজিনে। ওই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত একজন লেখেন, তিনি ‘বিশ্বাস করেন পূর্বসূরি লেখকদের সঙ্গে ষাটের দশকের লেখকদের কোনোরকম বিষয় ও বোধগত মিল নেই।’

তখন আমি লিখেছিলাম কুড়ি বছর আগে (অর্থাৎ ১৯৫৭ নাগাদ, যে সময় থেকে আমি লেখা শুরু করি) বাংলা গল্পে যে বিষয় ও বোধসমূহ প্রকাশিত হয়েছে এই সংকলনের গল্পগুলিতে প্রায় সেই জিনিসই পাচ্ছি। লিখেছিলাম : ‘জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী বা বিমল করকে সরিয়ে রেখেই বলা যায়, দীপেন, সন্দীপন, দেবেশ, দিব্যেন্দু, সুনীল বা শ্যামল এমনকি তখনকার শীর্ষেন্দুও যে বিষয় ও বোধ নিয়ে গল্প লিখেছিল, তার থেকে ষাটের দশকের লেখকরা নতুন কোনো জমিতে পা দেননি, শুধুমাত্র চেহারার আদলে কিছু রকমফের হওয়া ছাড়া। নতুন সংজ্ঞা, ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধির নতুন প্রণালী বা রূপকের নতুন বিস্তার যে বাস্তবতার জমি থেকে উৎপন্ন হয় তা ‘পূর্বসূরিদের’ আমল থেকে এমন কিছু বদলায়নি যাতে ‘কোনোরকম’ শব্দটি গ্রাহ্য হতে পারে। ইতিহাসের যে চাপ গত দশ বছর (১৯৬৭—৭৭) এই রাজ্যটি সহ্য করেছে তার থেকেও শ্বাসরোধকারী উত্তপ্ত, দিশাহারা করে দেওয়ার মতো চাপ চল্লিশের দশকে সহ্য করেছে এই বাংলা। উপরিভাগে কিছু রূপান্তর ঘটলেও ষাটের দশকে যা প্রবাহিত হয়ে এসেছিল তা চল্লিশেরই জোয়ার থেকে। আমাদের সামাজিক বনিয়াদে মৌল কোনো রূপান্তর ঘটেনি। যেসব বহিঃশক্তির সমাবেশের প্রভাবে আমাদের জগৎকে ঘিরে বাস্তবতা ও ভাবাবেগ তৈরি হয় তাতে এমন কোনো বিস্ফোরণ ঘটেনি যাতে পূর্বসূরি ও ষাটের দশক, এই দুই আমলের মানসিকতার মধ্যে ফাটল ধরিয়েছে মনে করতে হবে। এখন ভারতে শতকরা ৮০ জন দিনযাপন করেন ভূমির ওপর নির্ভর করে। পূর্বসূরি লেখকদের মতো ষাটের দশকের এঁরাও কৃষিপ্রধান সামাজিক আবহাওয়াতেই লালিত। ঔপনিবেশিক মানসিকতার জের এখনও টেনে চলেছে এই সমাজ। এই সমাজের শৃঙ্খলারক্ষার প্রধান খুঁটি হলো ধর্ম ও বুর্জোয়া নীতিবোধ। ভবিতব্যে নির্ভরশীলতা, অনুসন্ধিৎসায় অনিচ্ছা, প্রথানুসরণের ইচ্ছা, অ্যাডভেঞ্চারে স্বতঃস্ফূর্ত তাগিদের অভাব এবং নির্লিপ্ত অর্থাৎ স্থাণু ও জড়চেতনার অনুকূল প্রতিটি উপাদান আমাদের ব্যক্তি ও সমাজজীবনে অটুট হয়ে রয়েছে। কংগ্রেসের বা নেহরুদের বিকল্প কিছুর চিন্তা সত্তর দশকের অর্ধেক অতিক্রান্ত হওয়ার পর তবেই আমাদের মাথায় এসেছে। শরৎচন্দ্র, যাত্রাপালা বা ক্রিকেট টেস্ট ম্যাচ প্রভৃতি কৃষিনির্ভর আবহাওয়ায় যে সব ব্যাপারের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ এখনও তা আমাদের উৎসবের কারণ।’

লেখাটির ষোল বছর পর উপরোক্ত পর্যবেক্ষণ থেকে এখনও আমি এক পা—ও পিছিয়ে আসতে রাজি নই। পশ্চিমবাংলার সমাজ—বাস্তব পঁয়ত্রিশ বছর আগে যেখানে ছিল এখন অবশ্য আর সেখানে নেই। এখন তার সঙ্গে বর্ধিত হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির পৃষ্ঠপোষকতা— স্থূল অনুভূতি, আগ্রাসী পেশিশক্তি, কাপট্য, ভান, নির্বুদ্ধিতা আর অন্ধ আক্রোশ। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে— ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান ও বিস্তার, জ্যোতিষীদের আংটি ও মাদুলির ফলাও কারবার, লটারির পুরস্কার মূল্য কোটি টাকায় পৌঁছে যাওয়া, সংবাদপত্রে প্রতিদিনের রাশিফল নামক ধাপ্পা আর বিনা পরিশ্রমে হাতিয়ে নেওয়ার জন্য সুযোগের ও উৎকোচের অন্বেষণ। এই সবই ইঙ্গিত দেয়, পশ্চিমবাংলা নিজেকে সঁপে দিয়েছে ভবিতব্যের হাতে, সে হারিয়েছে আত্মবিশ্বাস, কাজের ও চিন্তার ক্ষমতা। তার বদলে অর্জন করেছে ভীরুতা, আত্মপ্রবঞ্চনা, হতাশা আর আতঙ্কে দিনযাপনের গ্লানি। টেনেটুনে কোনোক্রমে নিজেকে টিকিয়ে রেখে জীবনযাপনের জন্য একটু জায়গা করে নেওয়ার অভ্যাসে এই রাজ্যের সাধারণ মানুষ রপ্ত হয়ে গেছে। দশ বছর আগেও বাসে যে আসনে পাঁচজনে বসতো এখন তাতে বসছে ছজন, লোকাল ট্রেনে তিনজনের আসনে বসছে চারজন। পশ্চিমবঙ্গ আত্মমর্যাদাবোধ তো হারিয়েছেই, ন্যায্য সুস্থতার জন্য দাবি জানাতেও ভয় পায়।

এমন অবস্থায় বাস্তব সচেতন গল্প, উপন্যাস, কবিতার লিখিয়েরা কী করতে পারেন? তা হলে একটা কথা সোজাসুজি প্রথমেই বলে নিই, গল্প বা কোনো কিছু লিখে দেশের বা দশের উন্নয়ন ঘটানো যায় না। পৃথিবীতে এমন ব্যাপার কোথাও ঘটেছে বলে জানি না। বহু বছর ধরে বহু লেখক বহু ভাবে গরিব সর্বহারাদের দুঃখ, বেদনা, প্রতিরোধ ও সংগ্রামের কাহিনি লিখেছেন, তাতে সর্বহারাদের বৈষয়িক ও আত্মিক দুর্দশা এক কাচ্চচাও লাঘব হয়নি। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ বাংলার তথাকথিত ‘প্রগতি’ সাহিত্য। গরিবদের কাহিনি যাঁদের নিয়ে লেখা হয়েছে এবং হচ্ছে তাঁরা কেউ সে সব কাহিনি পড়েননি এবং পড়ছেন না। তার কারণটা বুঝে নেওয়া খুব জটিল নয়। যাঁদের জন্য এই সব লেখা হয়েছে বা হচ্ছে তাঁরা একদমই পড়তে—লিখতে জানেন না। পড়েন শুধু টেবিল—চেয়ারে বসে কাজ করা কিছু লোক। এঁরা প্রধানতই শহুরে এবং মধ্যবিত্ত। ‘শিক্ষিত’ নামক জনসমষ্টির বিরাট একটা অংশ সাহিত্য পাঠের ধারই ধারেন না।

লেখক এই সব তথ্য জানেন এবং এটাও জানেন এঁরা তাঁর লেখাকে ভালো হয়েছে বললে তিনি প্রতিষ্ঠা অর্জনে সুবিধা পাবেন। তাই গরিব সর্বহারাদের নিয়ে গল্প লেখার সময় তাঁর মনে ভেসে থাকে এক মধ্যবিত্ত পাঠকের চেহারা যিনি সাহিত্য রসাস্বাদনে পটু, বোদ্ধা, হয়তো বা আলোচনা—প্রবন্ধও লিখে থাকেন। লেখক এই শিক্ষিত পাঠকের বোধ ও বুদ্ধির কাছে নিবেদন করেন তাঁর লেখাটিকে। তাঁর গল্পের মানুষরা যদিও দিনমজুর, ছোটচাষি, ভিক্ষুক, বেশ্যা, উপজাতি, বাচ্চচা শ্রমজীবী ইত্যাদি। লেখক কিন্তু কোনোদিনই এঁদের মতো জীবনযাপন করেননি, এঁদের সমস্যার ও ভাবনার ধারে কাছেও তিনি যেতে পারেন না এবং তিনি এঁদের ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ততটা দেখেন না যতটা দেখেন সামাজিক শ্রেণি হিসাবে। একটি প্রগতিশীল পত্রিকায় গত দশ বছরের গল্পকারদের নিয়ে একটি সমীক্ষা—প্রবন্ধে দেখলাম বলা হয়েছে, ‘এখানেই পূর্ববর্তী সময়ের গল্প থেকে এই সময়ের এ জাতীয় গল্পের মূল পার্থক্য।’ প্রবন্ধকারের মতে, গল্পকারদের দৃষ্টি সর্বহারাদের ওপর গিয়ে পড়েছে হয়তো বা নকশালবাড়ি আন্দোলনের ঝাঁকুনির ফলে।

আমাদের বাস্তবতাকে বিভিন্ন আমলের লেখকরা নানা ভঙ্গির চাহনি মেলে পর্যবেক্ষণ করতে চেয়েছেন। এই চাহনি বা রচনার কাজ করতেই লেখক নিজেকে সংস্কার করেন। সমাজবাস্তবতার বাইরের গড়ন আর তার ভিতরের টানাপোড়েন অর্থাৎ কোনটি প্রকৃত আর কোনটি প্রতিবিম্ব এটা চিনে নিয়ে আলাদা করা বেশ জটিল ব্যাপার। এই টানাপোড়েন, ঘাতপ্রতিঘাত থেকে তৈরি হয় লেখকের অনুভূতি। কিন্তু বাস্তবের মৌল শক্তিগুলির কি কোনো বদল এখন পর্যন্ত ঘটেছে? নকশাল আন্দোলন দেশের ও দেশের মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতার অভাব থেকে তৈরি ভঙ্গিসর্বস্ব এমন এক বিপ্লবীয়ানা, যা তৈরি করতে পারেনি নতুন কোনো বিপ্লবী পথ, গড়ে তুলতে পারেনি আদর্শের জন্য রাজনীতি করার উন্নত কোনো নৈতিকতা। এই আন্দোলন যেভাবে দপ করে উঠেই নিভে গেল, যেভাবে টুকরো গোষ্ঠীতে পরিণত হলো, সর্বোপরি এর নেতাদের মধ্যেই যেভাবে হতাশা ও অবসাদের ছাপ ফুটে উঠতে লাগল, তাই থেকেই বোঝা যায় শুধু এর বহির্বাস্তবতাকে অবলম্বন করে গল্প লিখলে তার পরিণতি ওই আন্দোলনের মতই ব্যর্থ হবে। এই আন্দোলনের ঝাঁকুনি থেকে উৎপন্ন গল্পগুলির কিছু কিছু পাঠকদের তারিফ অর্জন করেছে কিন্তু সেটা মূলতই সমাজের ও রাষ্ট্রের দৃশ্যমান বিশৃঙ্খলাটুকু লেখায় প্রতিফলিত হওয়ার জন্য। ৫৬ বছর আগে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রঙ্গপুর সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর ভাষণে বলেছেন : ‘সাহিত্যিক বাস্তব জগতের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে তার চিত্র আঁকবেন কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি যথেষ্ট পরিষ্কার হলে তিনি দেখবেন যে বাইরের জগতে যা ঘটে তার চেয়ে লেখকের মনের জগতে আর এক মহত্তর ব্যঞ্জনাময় বাস্তব আছে।’

মনের জগতের বাস্তবটিকে আবিষ্কারে আমাদের প্রগতিশীল লেখকরা খুব বেশি সফল হতে পারেননি। না পারার একটি বড় কারণ, মানুষকে সামাজিক শ্রেণির প্রতিভূরূপে দেখার তত্ত্ব মেনে লিখতে গিয়ে একটা ছাঁচের মধ্যে ঢুকে যাওয়া। স্বাধীনতা লাভের আগে সারা দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রীয় পরাধীনতা ঘোচাবার জন্য একটা একমুখী কর্মিষ্ঠ সদর্থক সমাজচেতনা গড়ে উঠেছিল। ‘মহত্তর ব্যঞ্জনায়’ ভূষিত মানবিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা তখন তৈরি হয়ে ওঠে, ফলে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা সমাজে দানা বাঁধে। এরই সঙ্গে যোগসূত্র রচিত হয়েছিল বহিঃস্তরের আন্দোলনের আর বাঙালি সাহিত্যিকদের কাছে সেইজন্য অন্তর্দৃষ্টিকে সাহায্য করতে সেটাই নোঙরের কাজ করে। ব্যক্তিমানুষকে সদর্থক সামাজিক পটভূমিতে রাখার সুযোগ তখন ছিল। সেই আমলের বহু লেখকের গল্প উপন্যাস আজও পাঠকদের আনন্দ দেয়।

মানুষের অভিজ্ঞতা বিষয়ে যে কোনো ধরনের সত্যে পৌঁছতে হলে শেষ পর্যন্ত শৃঙ্খলার দিকে আসতেই হবে। কিন্তু শৃঙ্খলা সম্পর্কে বিশেষ কোনো ধারণা আঁকড়ে বসে থাকা যায় না। এটা স্থাণু নয়, এটা বদলায়। যেমন বদলায় বিশৃঙ্খলার ধরন। বিশৃঙ্খলার ততটাই বরদাস্ত করি যতটা আমাদের বর্তমান মূল্যবোধগুলির সঙ্গে মানিয়ে যাচ্ছে। মানুষের প্রকৃতি এমনই, নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি বিশৃঙ্খলা সইতে পারে না। পরিমাণটা সহনীয় করতে তখন কল্পনার সাহায্য নেওয়া হয়। কল্পনা তখন শৃঙ্খলা সম্পর্কে মায়াবী পরিমণ্ডল তৈরি করে দেয়। এই পরিমণ্ডলই অন্যতর কোনো উপলব্ধির জন্য পাঠককে উত্তেজিত করায়। কিন্তু যে কল্পনার সাহায্য লেখকরা নেবেন তা কীসের উদ্দেশে ধাওয়া করবে, সেই লক্ষ্যটা স্থির করার জন্য চাই মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। গত দশ পনেরো বছরের মধ্যে যাঁরা গল্প লিখতে এসেছেন তাঁরা বিশৃঙ্খলার বহিঃস্তরের কিছুটা অল্প পরিসরের মধ্যে দেখতে পেয়েছেন। এটা কিন্তু সমগ্র বাস্তব নয়। পাঠককে অন্য কোনো উপলব্ধিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুধু ‘অন্তর্দৃষ্টি’ই যথেষ্ট নয়, তাদের কল্পনার বহনযোগ্যতার ক্ষমতাও থাকা চাই। এই দুটি ব্যাপারেই এখন বিরাট ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ কোনো তত্ত্ব দ্বারা সম্ভব নয়। সম্প্রতি এক বিদগ্ধ গ্রন্থসমালোচক আক্ষেপ করে লিখেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে বাংলা কথাসাহিত্যে যথার্থ শিল্পীর সংখ্যা দ্রুত কমে আসছে। এটা যদি বাংলা সাহিত্যের পক্ষে এবং বাংলা সাহিত্যের প্রাপ্তমনস্ক পাঠকের পক্ষে আক্ষেপের কথা হয়, তবে এর চেয়েও আক্ষেপের কথা, এই ঘটনাটি সম্বন্ধে আমরা যথেষ্ট মনোযোগী হতে পারছি না, অথবা এর প্রতি আমরা এক দায়িত্বজ্ঞানহীন ঔদাসীন্য দেখাচ্ছি।’ তিনি বলছেন, ‘মনে রাখবার মতো ছোট গল্পের সংখ্যা যে ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে, এটাও আমাদের আর যথেষ্ট দুঃখ দিতে পারে না।’

সামাজিক চেতনায় গত কুড়ি বছরে যদি কিছু বদল হয়ে থাকে তা হলে সেটা ওই ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন ঔদাসীন্য’টার বেড়ে যাওয়া। সোমনাথ হোর বলছেন : ‘পঞ্চাশের মন্বন্তরের যে ক্ষত, যুদ্ধের যে অমানবিকতা, ছেচল্লিশের দাঙ্গার বীভৎসতা—এগুলি আমার আঁকার পদ্ধতিতে খোদিত হয়ে যাচ্ছিল, আমার অজানিতে।… দুর্ভিক্ষের ছবির যে খড়ি হাতের আঙুল পেরিয়ে হৃদয়ে যে দাগ কেটেছিল, তার দাগ আর মিলাল না।’ জীবনকে ভালোবাসলে, অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা থাকলে হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়া দাগ সৎ ও খাঁটি শিল্পী কখনও মিলিয়ে যেতে দিতে পারেন না। উনি চল্লিশের দশকের পোড় খাওয়া মানুষ। দাগটা রেখে দেওয়ার দায় উনি বহন করে চলেছেন।

তারপরও অনেক দশক এসেছে ও চলে গেছে কিন্তু হৃদয়ে দাগ কেটে দেওয়ার মতো কোনো মন্বন্তর, কোনো যুদ্ধ বা কোনো বীভৎস দাঙ্গা, এমনকি ছিন্নমূল মানুষের বন্যা পশ্চিমবঙ্গ আর দেখেনি। গত চার দশক ধরে ক্রমান্বয়ে অপহৃত হয়ে চলেছে মানবিক মূল্যবোধগুলি, সমাজ চেতনায় ছড়িয়ে গেছে টেনশন, গা—ছাড়া হয়ে পড়েছে ব্যক্তির সঙ্গে তার জগতের সম্পর্ক। মানুষ পড়েছে অবিশ্বাসের শূন্যতার মধ্যে। আধুনিক সময়ের এই আঁচড়গুলো পড়ছে যে সমাজদেহের অঙ্গে সেটা কিন্তু রয়ে গেল চারদশক আগের। এই বাইরের আর ভিতরের মধ্যেকার আমলকে তারা সনাক্ত করতে চাইল। এই দুইয়ের সঙ্ঘাত থেকে উৎপন্ন বিদ্যুৎকে ভাষার মাধ্যমে গল্পে সঞ্চার করার জন্য মাঝে মাঝেই ঝাঁক বেঁধে আন্দোলনে নেমেছেন তরুণরা। সাহিত্যে বাসি হয়ে যাওয়া প্রথাগুলিকে ভেঙে নতুন চেতনার বাস্তবতায় তাঁরা বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন চমকপ্রদভাবে আধুনিক হওয়ার জন্য, বাস্তবকে মুচড়ে মনোমতো করে বানিয়ে, যুক্তির মাত্রা কমিয়ে চমকদার বাক্য সাজিয়ে যাওয়া ছাড়া কিন্তু তাদের কাছ থেকে আর কিছুই পাওয়া গেল না। আধুনিকপন্থীদের হামলার প্রধান লক্ষ্য হয় বুর্জোয়া সমাজ ও মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ। সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলে প্রথমে একটু পিছিয়ে আসতে হয়। তাই করতে গিয়ে সমাজ—বাস্তবতা থেকে আন্দোলনকারীদের কখন যেন বিযুক্তি ঘটে যায়। আধুনিক রূপে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পর তাঁরা বুর্জোয়া বিরোধিতার একই কথার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে থাকেন, তবে একটু অন্য গলায়। সাহিত্য থমকে থাকে একই জায়গায়। তখন আমরা বলি, মনে রাখবার মতো গল্প আর পাচ্ছি না। যশস্বী হওয়ার আগে বাঙালি লেখকরা যে পরিমাণ যত্ন ও পরিশ্রম লেখার জন্য দেন, দুঃখের কথা, পরে আর তা দেন না। আরও দুঃখের কথা, বহু নামী লেখকের দুর্বল রচনা সম্পাদকেরা ছাপিয়ে চলেছেন, যে রকম রচনা কোনো অনামী লেখক লিখলে অবশ্যই অমনোনীত হত। এবং আরও দুঃখের কথা, পাঠকরা দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে সত্যিই উদাসীন।

মতি নন্দী
২৩.১.৯৪

ভালো ছেলে

এক

অনন্তের ক্লাস নাইনের এবং অমরের ক্লাস এইটের এগারো দিন পর অফিস থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাসে উঠতে গিয়ে শক্তিপদ পিছলে চাকার তলায় চলে যায়। মৃত্যু সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে। হাতে ছিল তাঁর দু—ছেলে অনন্ত আর অমরের জন্য দু—জোড়া চটির বাক্স।

‘যদি ও—দুটো হাতে না থাকত তা হলে শক্তিদা হ্যান্ডেলটা ভালো করে ধরতে পারতেন।’

মাস ছয়েক পর এক সন্ধ্যায় শক্তিপদের অফিসের সহকর্মী অবিনাশ কথাটা বলেছিল তাদের ঘরে বসে। অনন্ত আর অমর পরস্পরের দিকে তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। ধীরে ধীরে পাংশু হয়ে যায় তাদের মুখ। মৃত্যুর তিন দিন আগে শক্তিপদ কয়েক আউন্স উল আর বোনার কাঁটা অনিমার জন্য আর এক বাক্স রং পেনসিল অলকার জন্য কিনে এনেছিলেন। ওরা ক্লাসে উঠেছে ফাইভে আর ফোরে।

শীলা বলেছিল, ‘মেয়েদের দিলে, আর ছেলেরা বুঝি ক্লাসে ওঠেনি?’

অনন্ত আর অমর চোখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল।

‘মাকে বল না আমাদের চটি নেই।’ অনন্ত বলেছিল। অমর একটু গোঁয়ার, মুখ আলগা। সে চেঁচিয়েই শীলাকে জানিয়ে দেয়, ‘আমার আর দাদার জন্য চটি চাই।’

সেই চটি কিনে বাসে উঠতে গিয়ে….অবিনাশ তাই বলেছিল, ‘বাক্সদুটো হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল, সামলাতে গিয়ে রড থেকে হাতটা পিছলে গেল।’

‘বাক্স দুটোর কী হল, আমরা তো চটি পাইনি!’ অমর ক্ষুণ্ণস্বরে বলেছিল।

অমরটা বোকা, ওর প্রথম চিন্তাই চটি। ভিড় আর উত্তেজনার মধ্যে নিশ্চয়ই কেউ তুলে নিয়েছিল রাস্তা থেকে। কিন্তু অনন্ত একটা কথাই তখন ভেবেছিল, ‘যদি ও—দুটো হাতে না থাকত’ তা হলে বোধহয় বাবার মৃত্যু হত না।

সেই সময় রেকাবিতে পরোটা আর বেগুন ভাজা নিয়ে অনিমা ঘরে ঢোকে। অবিনাশ আপত্তি জানাবার জন্য রান্নাঘরের উদ্দেশে চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘এলেই যদি এইরকম খাবার দেন বউদি তা হলে কিন্তু আর আসব না।’

‘এ আর কী এমন।’

শীলা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে জানায়।

অবিনাশ তখন প্রায় অভিভাবক হয়ে উঠেছিল। রোজই আসত। সংসারের খুঁটিনাটি ব্যাপারও তার পরামর্শ ছাড়া চলত না। পাঁচজনের পরিবার একসময় তার অনুগ্রহনির্ভর হয়ে চলেছিল।

শক্তিপদর মৃত্যুর দিন শীলার হাতে ছিল বত্রিশ টাকা। মাইনের টাকা শক্তিপদ নিজের কাছে স্টিল আলমারির লকারে রাখত, চাবিও থাকত তার কাছে।

চাবির রিংটা ছিল প্যান্টের পকেটে, হাসপাতালের কেরানি সেটা শীলাকে দিতে অস্বীকার করে। মৃত শক্তিপদর সঙ্গে পাওয়া জিনিসগুলো যেমন রুমাল, নস্যির ডিবে, চটির বিল, চশমার খাপ, মানিব্যাগ, পাঁচটি চাবিসহ রিং আর একটা ডাকঘরের খাম পুলিশের হাতে তুলে দেয়। খামটির এক ধার ছেঁড়া ভিতরে একটা চিঠি। পুলিশের এস আই বলেছিল পরদিন থানা থেকে মৃতের জিনিসগুলো প্রমাণ দিয়ে নিয়ে যেতে।

অবিনাশের এক আত্মীয় পুলিশের পদস্থ অফিসার। তাকে সে অনুরোধ করেছিল জিনিসগুলো বিনা ঝামেলায় ফেরত পাবার জন্য। পরদিন শক্তিপদকে দাহ করে ফেরার সময় অনন্তকে সঙ্গে নিয়ে অবিনাশ থানায় যেতেই জিনিসগুলো কিঞ্চিৎ খাতিরসহই ফেরত পায়। অনন্ত একটা খাতায় সই করে জিনিসগুলো নেয়। তখন সে জানত না খামের মধ্যে চিঠিটা কার লেখা এবং তাতে কী লেখা। বাড়ি ফিরে প্রথমেই টাকার জন্য আলমারি খোলা হয়। তারপর সে বাবার জিনিসগুলো ও খামটিও লকারে রেখে চাবি বন্ধ করে দিয়েছিল। এরপর নানা কাগজপত্র বার করার জন্য লকার খোলা হয়েছে কিন্তু এককোণে প্লাস্টিকের মোড়কে সুতো দিয়ে বেঁধে—রাখা ওই জিনিসগুলো বা খামটিতে হাত আর দেওয়া হয়নি।

সাকসেশন সার্টিফিকেট বার করা, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, এগারো দিন চাকুরির মাইনে, এ ছাড়াও জীবনবিমার তিন হাজার টাকা, সবই অবিনাশ সংগ্রহ করে দিয়েছিল। শীলাকে সঙ্গে নিয়ে কখনো—বা অনন্তকে নিয়ে সে ট্রামে, বাসে, ট্যাক্সিতে আদালতে এবং অফিসে অফিসে ঘুরেছে নিজের খরচে, ঘুস দেবার প্রয়োজন হলে নিজের পকেট থেকেই দিয়েছে।

‘আপনার ঋণ কীভাবে যে শোধ করব ঠাকুরপো…আমার ছেলেমেয়েদের উপর ভগবানের কী যে অসীম দয়া, না হলে এমন বিপদের দিনে কি আপনাকে পেতাম! তিনিই পাঠিয়ে দিয়েছেন আপনাকে।’

প্রভিডেন্ট ফান্ডের তেরো হাজার টাকার চেক নিয়ে নামার সময় শীলা যখন কথাগুলি বলছিল, প্রৌঢ় লিফটম্যানের মুখে তখন এক চিলতে হাসি দেখেছিল অনন্ত। জীবন সম্পর্কে নিশ্চিন্ত একটা ধারণায় পৌঁছবার পর মানুষ এমন বৈরাগীর মতো হাসতে পারে। অবিনাশের মুখেও একটা হাসি ফুটে উঠেছিল—কিছুটা আত্মসুখ, কিছুটা বিনয় ও উদবেগ মেশানো।

‘ও—সব পরে শুনব, আগে এই চারটে নাবালকের কথা তো ভাবতে হবে।’

এবার হাঁটতে হাঁটতে তারা সার্কুলার রোডে আসে।

‘চা খাবেন বউদি?’

‘আপনি খান, আমি দোকানের ছোঁয়াছুঁয়ি…’

বিধবা জীবনে শীলা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল কয়েক সপ্তাহেই।

অবিনাশ চায়ের বদলে কোকাকোলা খেয়েছিল দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে। অনন্ত জীবনে সেই প্রথম এই পানীয়ের আস্বাদ পায়। তার ভালো লেগেছিল এবং তিন ভাই—বোনের কথা মনে পড়ে বিষণ্ণ বোধ করে।

‘শক্তিদার তো আরও বেশি থাকার কথা।’

‘হবে, আমি তো এ—সব খবর রাখতুম না। সংসারের টাকা আমার হাতে কখনো দিতেন না। ঝিয়ের মাইনেটাও নিজে হাতে দিতেন। আমি বরং কখনো—সখনো…’

অনন্ত জানে মা কেন থেমে গেছল। বাবা পায়খানা গেলে মা তার পকেট হাতড়ে বা মানিব্যাগ থেকে দু—তিন টাকা সরাত। একদিন সে দেখে ফেলেছিল। কাউকে সে—কথা সে বলেনি। বাবার নিশ্চয় সন্দেহ হত। মানিব্যাগ খুলে একদিন বাবাকে ভ্রূ কোঁচকাতে দেখেছিল। অনন্ত ভয়ে ভয়ে থাকত, হয়তো বাবা তাকে জিজ্ঞাসা করবে, ব্যাগে টাকা কমে গেল কেন? কিন্তু করেনি।

টাকা নিয়ে মা কী করত। অনন্ত স্কুল থেকে ফিরে একদিন দেখেছিল রাস্তায় সদর দরজার সামনে তিন—চারটি লঙ্কা—নুন—মাখা শালপাতা। কেউ আলুকাবলি বা ফুচকা খেয়েছে। কে খেয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই মা থতমত খেত।

‘ওপরের মেজোবউ কি রত্না বোধহয়, প্রায়ই তো ডেকে ডেকে কিনে খায়।’

আর একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখল মা বাড়ি নেই। অমর তার আগে স্কুল থেকে পৌঁছে খেতে শুরু করে দিয়েছে।

‘মা কোথায় রে?’

‘অনু আর অলুকে নিয়ে সিনেমা গেছে।’

‘পয়সা পেল কোথায়? তুই জানলি কী করে?’

‘কে জানে কোথায় পেয়েছে, ওপরের জেঠিমা বলল।’

অলুর স্কুল সকালে, দশটার মধ্যেই সে বাড়ি ফিরে আসে।

‘অনু স্কুলে যায়নি?’

‘বোধহয় হাফ—ছুটি করে চলে এসেছে।’

‘তালা দিয়ে গেছল?’

‘ওপরে চাবি রেখে গেছে।’

ওপরে আছে বাড়িওয়ালার আত্মীয় এক পরিবার। বিশেষ মাখামাখি নেই। বাড়িওয়ালা থাকে শিলিগুড়ি। অনন্ত তাকে কখনো দেখেনি। ওপরের জ্যাঠামশাই আর তার ভাই বাড়িওয়ালার ভূমিকা নিয়েই বসবাস করে। তবে প্রতি মাসের পাঁচ তারিখে বাবা মানিঅর্ডারে ভাড়ার পঁয়ষট্টি টাকা শিলিগুড়িতে পাঠিয়ে দেয় জনৈক সুখরঞ্জন পোদ্দারের নামে। একবারের জন্যও পাঁচ তারিখের নড়চড় হয়নি। নামটা সে জেনেছে যেহেতু পোস্ট অফিসে গিয়ে মানিঅর্ডার করার ভার ছিল তার উপর। দু—বছর পর বাবা মারা যাবার তিন মাস আগে পঁয়ষট্টি হয়েছিল সত্তর।

বাবা পছন্দ করত না পাড়ার লোক বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মেলামেশা বা ঘনিষ্ঠতা। কলকাতায় বউবাজারে আর জামশেদপুরে থাকে দুই মামা, কিন্তু সম্পর্ক নেই। যাদবপুরে কাকার রেস্টুরেন্ট আছে, অবস্থা ভালো, তার সঙ্গেও বাবার মুখ দেখাদেখি নেই। ঠাকুমা আর ঠাকুরদা ছিল কাকার সঙ্গে। দু—জনেই মারা গেছে। ভাইয়ের সঙ্গে বাবার যে কেন ঝগড়া, অনন্ত তা জানে না।

মা সিনেমা দেখত বা এটাসেটা কিনে খেত এবং সেজন্য কোথা থেকে পয়সা পেত, শুধু অনন্ত নয় তার ভাইবোনেরাও তা বুঝে গেছল। শীলা হয়তো সেটা জানত কিংবা জানত না। সে প্রায় নিরক্ষর এবং সরল আর অসম্ভব পরিশ্রমী। কিন্তু ছেলেমেয়েরা বাবার কানে তোলেনি। তারা মাকে ভালোবাসে।

কোকাকোলা খাবার পর সেদিন ট্রামে উঠে ওরা লম্বা সিটে পাশাপাশি বসেছিল। মাঝখানে শীলা।

‘দু—মাস আগে চার হাজার টাকা পি এফ থেকে তুলেছিলেন, ওরা খাতা থেকে আমায় দেখাল। কীজন্য, কিছু জানেন কি?’

শীলা মাথা নাড়ল।

‘দু—বছর আগে তিন হাজার।’

শীলার বিভ্রান্তি অব্যাহত। সে তাকাল অনন্তর দিকে।

‘কিছু জানিস?’

অনন্ত মাথা নাড়ল। বাবা খুব খরচে লোক নয়। ছেলেমেয়েদের জন্য কেনাকাটার বা খাওয়া—দাওয়ার বা বেড়ানোর জন্য খরচ করত না। নিজের জন্যও নয়। একজোড়া প্যান্ট আর একজোড়া হাওয়াই শার্ট, সারাবছর অফিসের জন্য ওই পোশাক। ফিতেওলা জুতো তিন বছর তো চলতই। মোজা থেকে সব ক—টা আঙুল বেরিয়ে থাকত।

.

বাবার এত টাকা তোলার কেন দরকার হল? ধার—দেনা ছিল কি?

অনন্তের কাছে সেটা তখন রীতিমতো রহস্যময় মনে হয়েছিল এবং বাড়ি ফিরে চেকটা আলমারির লকারে রাখতে গিয়ে প্লাস্টিকের মোড়কটা দেখে হঠাৎ তার মনে হয়েছিল বাবার পকেটে খামের মধ্যে যে চিঠিটা ছিল সেটা আজও দেখা হয়নি।

মোড়ক থেকে খামটা বার করে পকেটে রাখার সময় সে পিছন ফিরে দেখে ঘরে কেউ তাকে লক্ষ করছে কি না। ঘরে তখন অনু আর অলু ছাড়া কেউ ছিল না।

কেন যে তার মনে হয়েছিল চিঠিটা সবার সামনে পড়া উচিত নয়, তা সে আজ একুশ বছর পরও জানে না। কিন্তু অদ্ভুত অন্যায় খবর পাওয়া যাবে যেটা কাউকে বলার নয়, এমন একটা ধারণা সেই মুহূর্তে হয়েছিল। অন্যের চিঠি পড়া উচিত নয় এই বোধটাও তখন কাজ করছিল প্রবলভাবে।

বাড়ির কোথাও বসে সবার চোখ এড়িয়ে পড়ার জায়গা নেই। সন্ধ্যার পর পার্কের মাঝে আলোর নীচে গিয়ে বসল চিঠিটা পড়ার জন্য। দুটি তাসের আসর গোল হয়ে। তাদের থেকে কিছু দূরে সে বসেছিল। খামের উপর ঠিকানা ইংরেজিতে, অক্ষরগুলো মেয়েলি ছাঁদের। শেষবারের মতো সে ইতস্তত করেছিল চিঠিটা বার করার আগে।

চার ভাঁজ করা ছোটো চিঠি।

‘শক্তি,

আজও তোমার অফিসের সামনে রাস্তার ওপারে ছুটির সময় অপেক্ষা করেছি। এই নিয়ে পরপর চারদিন। তুমি বেরোলে দেখলাম, নিজের মনে হেঁটে স্টপে গিয়ে বাসে উঠে বাড়ি চলে গেলে। একবার মুখ তুলে তাকালেও না কোনোদিকে। তা হলে দেখতে পেতে এক অভাগিনীকে। আমি কী দোষ করলাম যে গত এক মাসে একবারও এলে না। লক্ষ্মীটি এসো। যদি অপরাধ করে থাকি পায়ে ধরে মাপ চাইব। এসো এসো এসো। ভালোবাসা নিয়ো। প্রণাম নিয়ো

ইতি
মিনু (১১ ডিসেম্বর)

এক নিশ্বাসে চিঠিটা পড়ে ফ্যালফ্যাল করে অক্ষরগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকেছিল মিনিট দুই। তারপর প্রথমেই সে ভেবেছিল, কে এই মিনু? বাবার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?

চিঠিটা সে তিনবার পড়েছিল আর ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল এই পত্র—লেখিকার সঙ্গে তার বাবার কিছু একটা গোপন সম্পর্ক রয়েছে যার সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও তারা কিছু জানে না। ‘মিনু’ নামটি কখনো তাদের সংসারে উচ্চচারিত হতে সে শোনেনি। চিঠির বিষয় থেকে মনে হয় দু—জনের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক। এটা ভাবতেই সে মনে মনে অপরাধীর মতো কুণ্ঠায় জড়সড় হয়ে যায়। বাবার ব্যক্তিগত জীবনের একটা আড়াল করা দিক হঠাৎ পর্দা সরিয়ে দেখে ফেলার মতো লজ্জায় সে ভরে গেছল। আর সেই কুণ্ঠা এবং লজ্জার কারণ, চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলতে গিয়েও সে কিন্তু ছিঁড়তে পারেনি। সে ভাবতে পারছিল না তার মা ছাড়াও আর কোনো মেয়েলোক বাবার জীবনে থাকতে পারে। তার মনে হয়েছিল বাবার এটা জঘন্য কাজ।

চিঠিটা তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেছল। পার্কে বসে তাসুড়েদের চেঁচামেচির মধ্যে বাবাকে দুশ্চরিত্র ভাবতে তার বাধছিল অথচ মন থেকে সায়ও পাচ্ছিল না। তখন তার কৈশোর বয়স। সে বার বার বাবার আচরণ, কথাবার্তার মধ্য দিয়ে খুঁজতে চাইল কোনো অসংগতি, অযৌক্তিক কাজ কিংবা মা—র সঙ্গে ঝগড়া, মনোমালিন্য পাওয়া যায় কি না।

কিছুই পায়নি। মা—র সঙ্গে কোনোদিন উঁচুস্বরে বাবা কথা বলেছে বা বিরক্তি প্রকাশ করেছে বা অবহেলা দেখিয়েছে এমন কোনো উদাহরণ সে সংগ্রহ করতে পারল না। খুব রেগে উঠলে তার চোয়ালের পেশি দপদপ করত কিন্তু মা—র জন্য একবারও করেনি। অনন্ত কোনোদিন মৃদু বা গাঢ়স্বরে দু—জনকে কথা বলতে বা চোখে চোখ রাখতে দেখেনি অথচ পরস্পরের প্রতি আচরণে তাদের খুঁত নেই। যন্ত্রের মতো নিখুঁত ছিল সম্পর্ক।

রাত্রে আঁচাবার সময় অনন্ত মাকে উনুনের আঁচ শিক দিয়ে খুঁচিয়ে নামাতে দেখে সাধারণভাবেই জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘মিনু বলে কাউকে চেনো?’

শীলা একবার মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘না।’ কয়েক সেকেন্ড পর আবার বলেছিল, ‘কেন?’

অনন্ত জবাব দেয়নি।

একুশ বছর পর চল্লিশের দিকে ঢলে—পড়া বয়সে মধ্যরাত্রে বিছানায় শুয়ে সে সেদিনের মতো আবার নিশ্চিন্ত হল একটা ব্যাপারে। চটির বাক্স হাতে ছিল বলে বাবা বাসের হাতল ধরতে পারেনি এই যুক্তিটা ঠিক নয়। বাবার সম্পর্কে একটা রহস্য জেনে যাওয়ার পর সেই রাতে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে তার মনে হয়েছিল চিঠিটা সম্ভবত সেইদিনই বাবার হাতে এসেছিল যেদিন মারা যায়। হয়তো বাবা মিনুকে এড়াবার জন্যই চলন্ত বাসে ওঠার চেষ্টা করেছিল কিংবা চিঠিটা পড়ে এতই চঞ্চল বা অন্যমনস্ক হয়ে গেছল…আর যাই হোক চটির বাক্সে হাতজোড়া হয়ে থাকার কারণটা, যা অবিনাশকাকা প্রায়ই বলেন এবং প্রতিবার শুনে বুকের উপর সে পাষাণভার বোধ করে, সেটা ঠিক নয়।

সেই রাতে পাষাণভারটা মন থেকে নেমে তাকে হালকা করে দেয়। চিঠিটা পড়ার জন্য সে আর নিজেকে অপরাধী মনে করেনি এবং সেটা আজও সে নষ্ট করেনি।

বিছানা থেকে উঠে আলো জ্বেলে ঘরের কোণে জলচৌকির উপর থাক দিয়ে রাখা স্টিলের দুটো ট্রাঙ্কের উপরেরটা খুলল। ডালার খোপে গোঁজা কয়েকটি কাগজ থেকে সে চার—ভাঁজ করা একটি চিঠি বার করল।

চিঠিটি অনন্তের স্ত্রীর। বহুবার পড়েছে গত দু—দিনে। আবার সে পড়ার জন্য ভাঁজগুলো খুলতে লাগল।

দুই

অনন্তের স্ত্রীর নাম রেবতী। তার কথা ভাবতে ভাবতেই কিছুক্ষণের জন্য একুশ বছর পিছনের দিকে তাকিয়েছিল। যথেষ্ট উপরে উঠে পাখি—নজরে সে নিজের পিছন দিকে তাকাবে এমন ক্ষমতা তার নেই। জমির উপর দাঁড়িয়ে গিরিশ্রেণি দেখার মতো সে উঁচু—নীচু জীবনের কয়েকটা চূড়ামাত্র দেখতে পায়। তারই একটি, বাবাকে লেখা চিঠিটা।

এরপরের চূড়া ক্লাস টেন—এ তার ফেল হওয়া। এই নিয়ে স্কুল—জীবনে সে দ্বিতীয়বার পরীক্ষায় অকৃতকার্য হল। প্রথমবার ক্লাস ফোর—এ। অমর তৃতীয় হয়ে ক্লাস টেন—এ ওঠে। ও ভালো ছাত্র। সবাই বলে অমর কিছু একটা হবে। হয়েওছে। সে এখন দিল্লিতে থাকে। বড়ো একটা চামড়া—ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে সংযোগ রাখার দায়িত্বে আছে।

বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের তেরো হাজার টাকা, অবিনাশকাকার পরামর্শে পোস্ট অফিসের ক্যাশ সার্টিফিকেটে রাখা হয়েছিল অনু আর অলুর বিয়ের জন্য। ব্যাঙ্কে সাতশো এগারো টাকা আর অফিস থেকে সাহায্য বাবদ দু—হাজার টাকা। পুরো একটা বছর ঘর ভাড়া আর চারজনের স্কুল খরচ দিয়ে সাতাশশো টাকায় সংসার চলেছে, অনন্ত এখন তা ভাবতে পারে না। তখন দু—টাকা সের মাংস ছিল। টাকা ফুরিয়ে যাবার ভয়ে তারা একদিনও কেনেনি।

পরামর্শটা অবিনাশকাকার দেওয়া—অনন্ত কোনো কাজে ঢুকে যাক। সংসারে এবার টাকা রোজগারের লোক দরকার। ঘষতে ঘষতে বি এ, এম এ পাশ করে তো বড়োজোর কেরানি হবে, তার থেকে যেহেতু ওর মাথাটা অমরের মতো পরিষ্কার নয় তাই এখনই যেকোনো ধরনের কাজে অনন্ত লেগে পড়ুক। পঞ্চাশ—ষাট, যত টাকাই আনুক সেটা সাহায্য করবে। পাঁচ—পাঁচটা লোকের খাওয়া—পরা, সহজ কথা নয়।

শীলা আপত্তি করেনি। দিনযাপনের চিন্তায় ও অভাবে ধীরে ধীরে তার বাস্তববুদ্ধি বেড়েছে সেই সঙ্গে অবিনাশ—ঠাকুরপোর উপর নির্ভরতা। অনন্তকে কাজে ঢুকিয়ে দেবার কথায় শুধু একবারমাত্র সে বলেছিল, ‘এখন তো ওর খেলাধুলো করার বয়স।’

‘তা বললে তো হয় না, ওর বয়সি কত ছেলে দেখুন গে কত কাজ করছে। ট্রেনে জিনিস বেচছে, দোকানে কাজ করছে, মোট বইছে…ওর থেকেও কম বয়সি।’

অবিনাশকাকা মাথা নীচু করে বসে—থাকা অনন্তের পিঠে হাত রেখেছিলেন। কথাগুলো খুব স্বচ্ছন্দে বলতে চেষ্টা করেও পারছিলেন না। গলায় আটকে যাওয়ার জন্য মাঝে মাঝে খাঁকারি দিতে থামছিলেন।

‘বড়োছেলেরাই তো একসময় সংসারে বাবার জায়গা নেয়। স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলো, আড্ডা এসবের দরকার আছে কিন্তু ভাগ্য যদি অন্যরকম অবস্থায় ফেলে দেয়, তাহলে আর কী করার থাকতে পারে। মা—কে দেখা, ভাই—বোনেদের মানুষ করে তোলা, নিজেকে নিজে বড়ো করা এসব তো এবার তোকেই করতে হবে। জীবনে ত্যাগ করতে হয় নানাভাবে, সবাইকে করতে হয়।…কী আর করবি, ভাগ্য যার যেমন দেবে…।’

শুনতে শুনতে অনন্ত নিজেকে বাবার ভূমিকায় কল্পনা করে অভিভূত হয়ে গেছল। বাবা গ্র্যাজুয়েট, বয়সে তার থেকে অন্তত তিরিশ বছরের বড়ো, চাকরি করছিলেন প্রায় কুড়ি বছর, একটা সংসার তৈরি করেছেন, অনেক ঝাপটা সামলে তাদের নিয়ে এগোচ্ছিলেন, এমন একটা লোকের জায়গা সে নেবে কী করে?

অমর, অনু, মা সবার মুখের দিকে সে তখন তাকিয়েছিল। ওরা ঘরে ছড়িয়ে বসেছিল। চল্লিশ ওয়াটের বালবে ওদের ভয় ভাবনা দুঃখ আরও বেশি উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। ওরা মাঝে মাঝে মুখ নামাচ্ছে আর সন্তর্পণে তার দিকে তাকাচ্ছে। যেন বিচারসভায় বসে ওদের হত্যাকারীর প্রাণদণ্ডের আদেশ শুনছে এমন একটা ভাব চোখেমুখে।

নিজেকে বিরাট একটা মানুষ হিসেবে দেখার ইচ্ছা অথবা লোভ অনন্তের মাথার মধ্যে তখন ঢুকে যায়। সর্বস্ব ত্যাগ করে, আরাম বিশ্রাম সুখ উচ্চচাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে সে ভাই—বোনেদের বড়ো করে প্রতিষ্ঠিত করছে, নিজে যাপন করছে সামান্য জীবন। ভালো জামা—প্যান্ট পরে না, সিনেমা দেখে না, রেস্টুরেন্টে খায় না, ট্যাক্সি চাপে না, কারোর কাছে হাতও পাতে না। আত্মীয়স্বজন, পাড়া—প্রতিবেশী শ্রদ্ধাভরে তার দিকে তাকাচ্ছে, তার সম্পর্কে প্রশংসা করছে—কল্পনা করতে গিয়ে সে ঘরের সবক—টি মানুষের জন্য ভালোবাসা আর করুণাবোধ করছিল।

‘আমি সবাইকে দেখব।’

‘য়্যা!’ অমর হঠাৎ অবাক হয়ে শব্দ করে ফেলেছিল।

‘তোদের আমি দেখব।’

ওরা তিনজন কী বুঝল কে জানে, মা—র চোখ শুধু জলে ভরে উঠেছিল।

‘তুই সুখী হবি, দেখিস আমি বলছি,…জীবনে তুই কখনো কষ্ট পাবি না।’

রেবতীর চিঠিটা আবার ডালার খোপে রেখে অনন্ত হাসবার চেষ্টা করল। রেবতী গত পরশু তাকে ছেড়ে চলে গেছে, খবরটা কেউ এখনও জানে না।

মা—কে দেড় বছর আগে দিল্লি নিয়ে গেছে অমর। অনুর বিয়ে হয়েছে কটকে এক স্যাকরার সঙ্গে। তাকে সে সাত বছর দেখেনি। পাঁচটি ছেলেমেয়ে নিয়ে সে খুবই ব্যস্ত। অনুর বিয়েতে সবাই অমত করেছিল, কিন্তু সে জেদভরেই বোনের বিয়ে দেয়। শান্তনু পড়ত অলুর সঙ্গে কলেজে। বেকার ছিল। আজও প্রায় তাই। শান্তনু দু—বার চাকরি খুইয়েছে মাতলামো করে। এখন চাকরি খুঁজছে। অলু ফুড কর্পোরেশনে চাকরি করে। তাদের দুটি ছেলে।

কারোর সঙ্গেই অনন্তের দেখাসাক্ষাৎ নেই। দায়সারা বিজয়ার প্রণাম সে পায় বটে, সকলের ঠিকানায় জবাবও দেয় কিন্তু ওই পর্যন্তই। অলু কলকাতায় থাকে অথচ তার সঙ্গে তিন বছর দেখা হয়নি। অবিনাশকাকা রিটায়ার করে তাঁর দেশের বাড়িতে চলে যান, সেখানেই আছেন। ব্লাডপ্রেশারের রোগী, মাঝে মাঝে চিঠি দিয়ে শেষবারের মতো দেখে যেতে বলেন।

রেবতীর চলে যাওয়ার খবরটা জানাবার মতো লোক আছে শুধু মা। তার বিয়ের ব্যাপারে মা ছাড়া কেউ আর আগ্রহ দেখায়নি। অবশ্য ছেলেকে গৃহী দেখতে কোন মা না চায়!

আলো নিবিয়ে অনন্ত খাটে পা ঝুলিয়ে বসল।

অন্যরা শুনলে কী বলবে? বোনেদের না জানিয়েই সে বিয়ে করেছে। তবু কীভাবে যেন ওরা জেনে গেছল। অলু একদিন ঘণ্টাখানেকের জন্য এসেছিল রেবতীকে দেখতে। বাসে তুলে দিতে যাবার সময় অলু বলেছিল, ‘বউয়ের বয়স হয়েছে। পছন্দ করেই যখন বিয়ে করলে, কমবয়সি করলে পারতে।’

‘কত আর বয়স, তিরিশের নীচেই।’

আড়চোখে সে দেখেছিল, অলুর ঠোঁট মুচড়ে গেল।

‘তিরিশের নীচে! আমার থেকে অন্তত দু—তিন বছরের বড়ো বই কম নয়।’

অলুর জন্মসাল ধরে অনন্ত হিসেব করল।

‘তোর এখন একত্রিশ?’

‘হ্যাঁ। তিন মাস পর বত্রিশে পড়ব।’

‘আমারও তো ঊনচল্লিশে পড়ার কথা। বয়সের ফারাক খুব একটা কি?’

‘আর দু—দিন বাদেই তো বুড়ি হয়ে যাবে।’

‘হোক, শরীরই কি স্বামী—স্ত্রীর জীবনে সব? তা ছাড়া আমিও তো বুড়ো হয়ে যাব।’

তার কথার ভঙ্গিতে ও স্বরে গভীর শান্ততা এবং জীবনের উপর সহজ ভরসা প্রকাশ পেয়েছিল।

‘ভাগ্যে যা আছে তা হবেই।’

অলু চুপ করে থাকে।

‘তোর বোধহয় পছন্দ হয়নি বউদিকে।’

‘না না, পছন্দ হয়নি কে বলল? বেশ সুন্দরী, ফিগারটিও চমৎকার। আমি তো প্রথমে দেখে অবাকই হয়ে গেছলুম। তুমি এমন সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ভাব করলে কী করে? চিরকালই তো মেয়েদের দেখলে কুঁকড়ে সরে যেতে।’

অনন্ত অত্যন্ত খুশি হয়েছিল। অলুর দিকে তাকিয়ে গালভরা হাসি নিয়ে বলেছিল, ‘তোরা তো আমাকে বোকা ছাড়া আর কিছু ভাবিস না।’

‘মোটেই না। ছোড়দা আর অনু ভাবতে পারে আমি কোনোদিন ভাবিনি। …তুমি ওদের কোনো খবর পাও?’

‘না।’

‘ভাবছি একবার দিল্লি যাব। ছোড়দা যদি ওর একটা কাজকম্মের ব্যবস্থা করে দিতে পারে।’

‘শান্তনু এখন খায়টায়?’

‘ও জিনিস কি আর ছাড়া যায়!’

‘ওর স্বাস্থ্য এখন কেমন?’

‘ভালো না, রক্ত আমাশায় ভুগছে।’

‘খুব খারাপ রোগ।’

‘দাদা অনেকের জন্য তো অনেক করেছ, আর একটু করো না।’

‘আমি আবার কার জন্য কী করলুম! ভাগ্যে যা আছে তা—ই হয়েছে।’

‘শ পাঁচেক টাকা আমায় দেবে?’

‘পাঁ—চ—শো, কোথায় পাব!’

‘ওরা তোমায় কিছু দেয়নি।’

‘শ্বশুরবাড়ি? আরে দূর, দেবার মতো কেউ থাকলে তো দেবে। তিন বোন একটা ছোটো ভাই, আমাদের মতোই বাবা নেই।’

‘তোমার কাছে নেই?’

‘এখনই…খুবই দরকার? কবে চাই?’

‘আজ পেলে আজই।’

‘জোগাড় করতে হবে।’

অলুকে বাসে তুলে দিয়ে ফেরার সময়, ‘চিরকালই তো মেয়েদের দেখলে কুঁকড়ে সরে যেতে, কথাটি নিয়ে সে মনে মনে খুব হেসেছিল। কেউ জানে না, সতেরো—আঠারো বছর আগে সে একজনকে দারুণ ভালোবেসেছিল। গৌরী নাম। এখন সে কোথায় থাকে কে জানে!

বাড়ি ফিরতেই রেবতী বলেছিল, ‘কিছু বলল কি তোমার বোন?’

‘কী বলবে?’

‘আমার সম্পর্কে। নতুন মানুষ দেখলে মেয়েরা মন্তব্য না করে কি থাকতে পারে?’

‘তোমার ওকে পছন্দ হয়নি?’

‘যেভাবে হাঁড়ির খবর নিচ্ছিল…তোমার আর—এক বোনের নাকি অবস্থা খুব ভালো, কটকে থাকে?’

‘শুনেছি, আমি ঠিক জানি না।’

রেবতী ‘তোমার বোন’, ‘তোমার মা’, ‘তোমার ভাই’ এইভাবেই বলে। কখনো ‘মা’, ‘ঠাকুরঝি’, ‘বা ‘ঠাকুরপো’ ওর মুখ থেকে বেরোয়নি। অনন্ত একবার বলেছিল, ‘আমার মা এখন তোমারও মা।’

‘আগে তো দেখি তারপর মা ডাকব।’

রেবতীর শুকনো নিস্পৃহ স্বর বুঝিয়ে দিয়েছিল সে সহজে সম্পর্ক পাতাতে অনিচ্ছুক। অনন্ত কখনো জোর দেয়নি। সে নিঃসঙ্গতা থেকে রেহাই পেয়েছে, এতেই সে খুশি এবং সুখী।

এখন তার সুখ ধ্বংস হয়ে গেছে। জানাজানি হলে সে মুখ দেখাবে কী করে? যে শুনবে প্রথমেই সে বলবে, ‘কার সঙ্গে বেরিয়ে গেল?’ কিংবা ‘কোথায় গিয়ে উঠেছে?’

অনন্ত জানে কোথায় গেছে। চিঠিতে কিছু বলেনি বটে কিন্তু সে অনুমান করছে রেবতীর পিছনে আছে দিলীপ ভড় নামে সেই লোকটি যাকে বিয়ের আগে রেবতী পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল, ‘এই হচ্ছে দিলীপদা, অনেক উপকার করেছে আমাদের। দিলীপদা না থাকলে আমাদের পরিবারটা ভেসে যেত। …আর ইনি হচ্ছে সেই ভদ্রলোক কাগজে ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন।

‘ওহ আপনি!’

অনন্ত নমস্কার করেছিল, লোকটি না—দেখার ভান করে সিগারেটের বাক্সটা এগিয়ে দেয় তার দিকে। অনন্ত হাত জোড় করে বলে, ‘মাফ করবেন, খাই না।’

সিগারেট কেন সুপুরিও সে খায় না। অবিনাশকাকা বলেছিলেন, ‘এখন থেকে টাকা জমানো অভ্যেস কর। আজেবাজে সিনেমা দেখে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে, প্যান্ট—জামা—জুতোয় কী পান—সিগারেটে টাকা ওড়াসনি। মনে রাখিস তিনটে ভাইবোন, মা তোর জিম্মায়।’

অনন্তের বয়স তখন আঠারো। অবিনাশকাকা প্রথম দিন তাকে বই বাঁধাইয়ের দোকানটায় পৌঁছে দিয়ে মালিক প্রসাদ ঘোষের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর, কথাগুলো বলেন।

‘কিছুই তো কাজ জানে না, তবে শক্তিবাবুর ছেলে বলেই নিচ্ছি, এখন পঁয়ত্রিশ টাকা দোব, শিখুক, কাজ শিখলে তখন বাড়াব।’

‘পঁয়ত্রিশ, বড্ড কম। একটু বাড়ান, পঞ্চাশ করুন।’

অবিনাশকাকা আধ ঘণ্টা কষাকষি করে চল্লিশ টাকায় প্রসাদ ঘোষকে রাজি করান।

‘আপনার অফিস তো আর সেরকম কাজকম্ম দিচ্ছে না। সেই কবে ছ—মাস আগে একটা চার হাজার টাকার কাজ শেষ পেয়েছিলুম তারপর হাঁটাহাঁটিই সার হল। স্টোরকিপারকে তো ফাইভ পার্সেন্ট দিয়েছি, আরও একটা পার্সেন্ট বাড়াতে রাজি।’

‘আমি কালই কথা বলব সুনির্মলবাবুর সঙ্গে। শক্তিদার ছেলের উপকার হবে শুনলে নিশ্চয় কিছু কাজ করবে।’

চারদিনের মধ্যে দু—হাজার টাকার কাজ পেয়েছিল কমলা বাইন্ডার্স। সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত কাজ। প্রথম দিন অনন্ত মুশকিলে পড়েছিল দুপুরবেলায়। খিদেয় পেটে মোচড় দিচ্ছিল কিন্তু পকেটে পয়সা নেই। পাঁচজন দফতরিই বাড়ি থেকে রুটি ভাত এনে খায়। যেদিন আনে না কাছেই রাস্তার চায়ের দোকানে পাঁউরুটি আলুর দম খেয়ে নেয়।

অনন্তকে কাজ দেওয়া হয়েছিল পরেশ দাস নামে প্রৌঢ় কারিগরটির সঙ্গে। শীর্ণ, কুঁজো লোকটির বিরাট এক কোরণ্ড। মালকোঁচা দিয়ে ধুতিতে সেটি আঁট করে বাঁধা, পরনে ছেঁড়া গেঞ্জি। সে লক্ষ করেছিল অনন্ত বাড়ি থেকে খাবার আনেনি। দুটি রুটির উপর আলুছেঁচকি রেখে বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিল, ‘খাও। পেট ভরবে না জানি তবু সারাদিন খালি পেটে থাকা ভালো নয়।’

সে লজ্জায় পড়ে গেছল। নিতে রাজি হয়নি। পরেশ দাস দু—বার অনুরোধ করে নীরবে রুটি চিবিয়ে খায়।

‘মালিক কত দেবে বলেছে।’

‘চল্লিশ টাকা।’

‘বাড়িতে খেতে গেছে। এলে আট আনা পয়সা চেয়ে নিয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে খেয়ে নিয়ো। লজ্জা কোরো না, আগাম বলে চাইবে।’

প্রসাদ ঘোষ ফিরে এল আধ ঘণ্টা পর। কিন্তু সে আট আনা চাইতে পারেনি। সে ভেবে দেখেছে সকাল থেকে ঝাঁট দেওয়া, টিউবওয়েল থেকে কলসিতে জল ভরা ছাড়া শুধু কয়েকটা পুরোনো পাঠ্য বইয়ের মলাট খুলেছে আর কয়েকটা বোর্ডে লেই মাখিয়েছে। এই কাজের জন্য হয়তো আট আনা প্রাপ্য হয় কিন্তু এখুনি হাত পাতলে মালিক কী ভাববে তার সম্পর্কে তাদের পরিবার সম্পর্কে? হাঘরে ভিখিরি! আট আনাও পকেটে রাখার সামর্থ্য নেই!

সে আর চাইতে পারেনি। সারাদিন কয়েকবার জল খেয়েছিল। রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ফ্রকপরা একটি মেয়েকে সে চা তৈরি করতে দেখে। সর্বাগ্রে তার নজরে পড়ে আঁটো ফ্রকের ভিতর থেকে স্তনের দৃঢ়তা ফুটে রয়েছে। আবলুস রঙের চামড়া। ঘাড় পর্যন্ত চুল। মুখটি মিষ্টি। চাহনিতে চঞ্চলতা। দু—দিন পর দুপুরে বেঞ্চে বসে আলুর দম কিনে রুটি দিয়ে খেতে খেতে সে চাওয়ালাকে বলতে শুনল, ”গৌরী, উনুন কামাই যাচ্ছে, মটরগুলো সেদ্ধ কর।”

সেদিন মধ্যরাত পর্যন্ত সে ঘুমোতে পারেনি। শরীরে অদ্ভুত একটা অস্বস্তি চলাফেরা করেছিল।

অনন্ত আজ রাতেও আর এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করছে তবে শুধুই মাথার মধ্যে ইঞ্জিনের পিছনে মালগাড়ির মতো সার সার চিন্তা মাঝে মাঝেই লাইন বদলে অন্য লাইনে চলে যাচ্ছে। সে রেবতীর কথাই ভাবতে চায় কিন্তু তার কৈশোর আর প্রথম যৌবন বারবার তার চিন্তাকে থামিয়ে দিচ্ছে লাল সিগন্যালের মতো।

দিলীপ ভড় রেবতীদের ঘরের তক্তাপোশে পা ছড়িয়ে একটা বালিশ বগলে রেখে কাত হয়ে শুয়েছিল। সিগারেটের ছাই পড়ছিল মেঝেয়। রেবতীর ছোটোবোন শ্বাশ্বতী ওর পায়ের কাছে বসেছিল, একটা হাত দিলীপ ভড়ের পায়ের উপর আলতো করে রেখে অনন্তকে দেখছিল কৌতূহলে। অনন্ত তখন ভাবছিল এই লোকটা কে? নিকট আত্মীয়?

‘কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন কেন?’

‘তা ছাড়া উপায় ছিল না।’

‘সম্বন্ধ করে বিয়ে দেবার মতো কেউ নেই?’

‘না।’

অনন্ত হঠাৎ বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। কেউ নেই বলাটা ঠিক হল কি? দুটো বোন, একটা ভাই আর মা থাকা সত্ত্বেও তার কেউ নেই। সবাই দূরে দূরে। তাকে ফেলে মা যেতে চায়নি। কিন্তু থেকেও কোনো লাভ হত না। পেটের যন্ত্রণায় কাতরাত আর বিড়বিড় করত: ‘ভগবান, ভগবান, আর পারছি না গো। এবার নিয়ে যাও আমায়।’ দেখাশুনো করার লোক রাখারও সামর্থ্য নেই। রান্না, বাসনমাজা, কাচাকাচি সংসারের যাবতীয় কাজ অনন্ত নিজেই করত। মাঝেমধ্যে অলু এসে কিছুক্ষণ থেকে চলে যেত। পাড়ায় ছিল মেয়ে ডাক্তার মাধবী দত্ত। তিনি দেখে বলেছিলেন, ‘হাসপাতালে ভরতি করান, মনে হচ্ছে ক্যানসার।’

অনন্ত সেইদিনই অমরকে চিঠি দিয়েছিল। চারদিনের মাথায় অমর দিল্লি থেকে উড়ে এসে উঠল অফিসের গেস্ট হাউসে। মা—কে সে পরদিনই বড়ো ডাক্তার দেখিয়ে এক্স—রে করায়। ‘মা—কে নিয়ে যাব, ট্রিটমেন্ট দিল্লিতেই করাব।’

‘থাক না এখানে।’

‘অপারেশন করে একটা চেষ্টা করা যাক। এখানে থেকে লাভ কী? দেখার লোক নেই, তা ছাড়া খরচও অনেক।’

‘শুনেছি এ রোগে কেউ বাঁচে না।’

অমর জবাব দেয়নি। সন্ধ্যার সময় দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নীচুস্বরে কথা বলছিল। অমরের মুখ থেকে সে হালকা মদের গন্ধ পাচ্ছে। মা ভিতরে দালানে বসে রয়েছে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে।

‘মরবেই যদি তা হলে এখানেই মরুক না। আবার টেনে হিঁচড়ে অত দূরে নিয়ে গিয়ে কী লাভ!’

‘অপারেশন করলে আরও কিছুদিন কয়েক মাস কী একটা বছর টিকে যাবে। পারবে তুমি? ওষুধপত্তর ধরে কম করেও হাজার আষ্টেক টাকা, পারবে?

অনন্ত অসহায় বোধ করল। ব্যাঙ্কে তার সাড়ে সাত হাজারের মতো টাকা জমেছে। ক্যানসার রোগীর জন্য টাকা খরচ আর ভস্মে ঘি ঢালা একই ব্যাপার। কিন্তু বিনা চিকিৎসায় মা মারা যাবে? হতে পারে না। জীবনবিমা করেছে কুড়ি হাজার টাকার। তার মাইনে এখন কেটেকুটে ছ—শো একানব্বুই টাকা। অমর কত টাকা রোজগার করে তা সে জানে না। হয়তো সাত—আট হাজার মাইনে পায়। বার চারেক তো বিদেশ ঘুরে এসেছে।

‘চেষ্টা করে দেখি। অফিস কো—অপারেটিভ থেকে নয় লোন নেব।’

‘ভালো। পরশু সন্ধের ফ্লাইটে আমি চলে যাব।’

পরশু সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে সে দেখল দরজায় তালা ঝুলছে। তার পায়ের শব্দে দোতলা থেকে কাকিমা চেঁচাল, ‘কে?’

‘আমি অনন্ত।’

‘চাবিটা নিয়ে যাও।’

অনন্ত দোতলায় উঠে এল। জেঠিমা পুজোর ঘরে। কাকিমা, ঠিকে—ঝি আরতি, পাশের বাড়ির দু—জন গৃহিণী দালানে টিভি দেখছে।

‘ওই পেরেকে টাঙানো রয়েছে। বিকেলেই ওরা গেল। দিদি খুব কাঁদছিলেন, তোমার সঙ্গে আর দেখা হল না।’

শোবার ঘরে টেবলে চিরুনি চাপা দেওয়া একটুকরো কাগজ। তাতে বড়ো অক্ষরে লেখা : ‘দাদা, মা—কে নিয়ে যাচ্ছি, আমার কাছে শেষ ক—টা দিন থাকবে। রাগ কোরো না। ইতি—অমর।’

বারকয়েক পড়ে সে থম হয়ে বসে থাকে। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে যেতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে বাচ্চচাছেলের মতো কেঁদেছিল। দেড় বছর আগে লিখে রেখে যাওয়া অমরের চিঠিটা ট্রাঙ্কের মধ্যে এখনও রয়েছে। মা এখন জীবিত।

অনন্ত বিছানায় পাশ ফেরার সময় মুখে একটা শ্রান্তির শব্দ করল। সারাটা জীবন শুধু খাটুনি আর খাটুনি। এইবার সে একদমই একা। রেবতী পরশু চলে গেছে। কোনো ঝগড়া হয়নি, সামান্য তর্কাতর্কিও নয়। এমনিই চলে গেছে। পাঁচ মাস আগে তাদের বিয়ে হয়েছে।

কীভাবে সে পরিচিতদের কাছে মুখ দেখাবে! জেঠিমা আজ সকালে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘বউমা কোথায়, বাপের বাড়ি গেছে?’

‘হ্যাঁ।’

অমরের মতো ছোট্ট কাগজে অল্প কয়েকটা অক্ষর : ‘আমার আর ভালো লাগছে না। চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। রেবতী।’

মা বলেছিল, ‘তুই সুখী হবি, দেখিস…আমি বলছি। জীবনে তুই কখনো কষ্ট পাবি না।’

কবে বলেছিল, মা কবে বলেছিল কথাটা? ভাবতে ভাবতে অনন্ত ঘুমিয়ে পড়ল।

তিন

মাইনের দিন শক্তিপদ তারা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে কচুরি কিনে বাড়ি ফিরত। গোনাগুনতি মাথাপিছু চারটি অর্থাৎ চব্বিশটি। একবার সবাইকে ভাগ করে দিয়ে দেখা গেল একটি বেশি। পকেট থেকে খুচরো নোট ও পয়সা বার করে শক্তিপদ গুনে দেখল চব্বিশটির দামই সে দিয়েছে। দোকানি তা হলে ভুল করে একটি বেশি দিয়ে ফেলেছে। ‘ফেরত দিয়ে আসি।’ কচুরিটা কাগজে মুড়ে সে তখনই রওনা হয়ে গেছল। শীলা তখন বলেছিল, ‘পরে যেয়ো, আগে খেয়ে নাও।’ শক্তিপদ জবাব দেয়নি। অমর অস্ফুটে বলেছিল, ‘ফেরত দেবার দরকার কী? মিষ্টিওলাও তো কত লোককে ঠকায়।’

প্রথম মাইনে পেয়ে বাড়ি ফেরার সময় অনন্ত তারার দোকানের সামনে দাঁড়াল। দোকানের ভিতরে কয়েকজন খাচ্ছে। ক্ষীণ গন্ধ আসছে কচুরি ভাজার। ফুলকো গরম কচুরিতে আঙুলের টোকা দিয়ে গর্ত করছে একজন। কচুরি নিয়ে বাবা যখন বাড়ি পৌঁছত তখন ঠান্ডা হয়ে যেত। বেশিরভাগই চোপসানো। অনন্ত কানে কানে মা—কে বলত, ‘ফুলোগুলো কিন্তু আমার।’ আঙুল বসিয়ে গর্ত করে সে তারমধ্যে তরকারি ভরে দিত।

অনন্ত পায়ে পায়ে কাচের শো—কেসের সামনে এল। পকেটে চারটে দশ টাকার নোট মুঠোয় চেপে ধরে সে গলা থেকে স্বর বার করতে পারল না। দোকানি তার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী দোব?’

‘কচুরি।’

‘ক—টা?’

‘চব্বিশটা।’ আপনা থেকেই সংখ্যাটা তার মুখে এসে গেল।

‘দু—মিনিট দাঁড়াতে হবে, ভেজে আনছে।’

অনন্ত অপেক্ষা করতে করতে রোমাঞ্চ বোধ করল। ব্যাপারটা ঠিক বাবার মতোই হচ্ছে। বাড়িতে নিশ্চয় সবাই অবাক হয়ে যাবে। বাবাকে তখন সবার মনে পড়বে। ভাববে, সংসারের শূন্যস্থানটা এবার পূর্ণ হল। সবাই অন্যরকমভাবে তাকে দেখবে।

তার বুকের মধ্যে একটা উচ্ছ্বাস ঠেলে উঠছে। রাস্তার যানবাহন, লোকের চলাচল, কোলাহল, নানান শব্দ, ভঙ্গি, সব তখন অনন্তের ইন্দ্রিয়ের পরিধি থেকে সরে গেছে। সে শুধু দেখতে পাচ্ছে বাবাকে, একহাতে তরকারির ভাঁড় অন্যহাতে কচুরির ঠোঙা, ঈষৎ ঝুঁকে, শুধুমাত্র রাস্তার দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। সামনে মানুষ থাকলে একবার মুখটা তুলেই পাশ কাটিয়ে নিচ্ছে।

‘চব্বিশটা কচুরি।’

‘চব্বিশটা, ঠিক গুনেছেন তো?’

‘কম নেই।’

দশ টাকার নোট কাচের উপর রাখল। তার প্রথম উপার্জন, প্রথম খরচ। খুচরো নোটগুলো পকেটে রাখার সময় তার মনে হল সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো উচিত।

‘পাঁচটা কড়াপাক সন্দেশ দিন।’

‘আট আনার না এক টাকার?’

‘আট আনার।’

বাবা কোনোদিন সন্দেশ আনেনি। তা হলে কি নেওয়া ঠিক হবে? অনন্ত দ্বিধায় পড়ল। বাবাকে কি ছোটো করা হবে? তা তো সে চায় না। প্রথম চাকরির প্রথম মাইনে পেয়ে বাবা কি বাড়ির লোকেদের মিষ্টিমুখ করায়নি? জীবনে তো শুধু একবারই। এতে নিশ্চয় দোষ হবে না।

পকেটে সন্দেশের ঠোঙা, দু—হাতে কচুরি ও তরকারি নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একবার তার হাসি পেল। ইচ্ছে করেই অল্প কুঁজো হয়ে রাস্তার দিকে মুখ নামিয়ে সে কিছুটা হাঁটল। এখন তার পকেটে যে ক—টা টাকা, তার অন্তত কুড়িগুণ থাকত বাবার পকেটে। বাবার সমান হতে কি তার কুড়ি—বাইশ বছর লাগবে?

রাস্তার উপর চুন দিয়ে গোলাকার বৃত্ত আঁকা। রবারের বল খেলা হয়েছে বিকেলে। গোলকিপারের এলাকা চিহ্ন করে দাগ টানা। সে মাঝে মাঝে গোলকিপার হয়েছে। কোনো খেলাতেই তার দক্ষতা নেই। অমরকে সবাই দলে চায়। অন্য পাড়াও তাকে ফুটবল বা ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে নিয়ে যায়।

সদর দরজা ভেজানো। পা দিয়ে ঠেলে খুলতেই আবছা অন্ধকার উঠোনে দেখতে পেল পিছন ফিরে মা সাবান কাচছে। ডাকতে গিয়েও ডাকল না। পা টিপে সে মা—র পিছনে এল। ঝুঁকে ঘাড়ের কাছে মুখ নামাল।

‘হাল—লুম।’

‘বাবা গো!’

শীলা কেঁপে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখল অনন্ত ঠোঙা আর ভাঁড় তুলে হাসছে।

‘এরকম করে ভয় দেখায়!’

‘আমি তো হালুম করেছি। বাঘ এখানে আসবে, তাই ভেবেছ? এই দ্যাখো।’

শীলা ভ্রূ কুঁচকে অবাক হয়ে তাকিয়ে।

‘কী রে?’

‘বাবা যা আনত।’

‘আজ মাইনে দিল বুঝি! ঘরে রাখ আসছি। ঠাকুরপো তোর জন্য অনেকক্ষণ বসে রয়েছে।’

অনন্ত ঘরে ঢুকতেই সবাই তার হাতের জিনিস দুটোর দিকে চোখ রাখল। পাতলা হাসি ফুটে উঠল তার মুখে। ঠোঙা আর ভাঁড়টা কোথায় সে রাখবে ভেবে পাচ্ছে না। মেঝেয় বই নিয়ে অলু আর অমর। তক্তাপোশে অনু। অবিনাশ চেয়ারে বসে মন দিয়ে অমরের ভূগোল বইটা পড়ছে।

‘কাল অফিসে এসেছিল তোদের মালিক। আস্ত ঘুঘু…হাতে কী?’

‘কুচুরি।’

‘মাইনে দিয়েছে? মহা ধড়িবাজ, বলে কিনা আমার তো লোকের দরকার নেই, আপনি বললেন তাই ছেলেটাকে রাখলুম, খরচ বেড়ে গেল। আসলে মতলব এইসব বলে যদি আরও কিছু কাজ পাওয়া যায়। সুনির্মলবাবুকে বললুম সব। তিনি তো রেগে উঠে বললেন এখান থেকে যথেষ্ট কাজ পেয়েছে, শুধু শক্তিবাবুর ছেলের জন্যই ওকে কাজ দিয়েছি নইলে দিতুমই না। তোর সঙ্গে ব্যবহার করে কেমন?’

‘ভালো।’

‘কাজ শিখেছিস কিছু? এক মাস তো হল।’

‘অল্পস্বল্প, শক্ত কাজ তো নয়।’

ঘরে ঢুকল শীলা। তার চোখ ঝকঝক করছে। ঠোঙাটা তুলে নিয়ে বলল, ‘কী দরকার ছিল এসব আনার, আজেবাজে পয়সা নষ্ট।’

মায়ের আনন্দ কারোর কাছেই চাপা রইল না। শীলা একটা কাঁসার থালায় তরকারির বেশিরভাগ ঢেলে চার ভাগ করল, আর একটা প্লেটে বাকিটা তুলে অবিনাশের হাতে দিল। কচুরির ঠোঙাটা অনন্ত বাড়িয়ে দিল অমরের সামনে, ‘চারটে। সবার জন্য চারটে করে।’

ঠিক এইভাবেই তার বাবা বলত। ঠোঙা থেকে চারটে কচুরি তুলে সে অবিনাশের প্লেটে রাখল।

‘তোর কই?’

‘আমার আর মা—র আছে। আগে বরং একটু মিষ্টিমুখ হোক।’

ম্যাজিসিয়ানের মতো হাত নেড়ে অনন্ত পকেট থেকে এক ঝটকায় সন্দেশের ঠোঙা বার করল।

‘জীবনের প্রথম রোজগার। তবে এরপর আর এভাবে খরচ করা নয়।’

অবিনাশ স্মিত হেসে বললেও স্বরে কিছুটা ভর্ৎসনা ছিল।

‘হ্যাঁ, আর নয়।’ শীলা প্রতিধ্বনি করল। ‘তোরটা এখুনি খেয়ে নে, রেখে দিলে আর থাকবে না। যা সব…আমার ক—দিন ধরেই অম্বল হচ্ছে ভাজাটাজা আর খাব না।’

‘তা হলে আমায় দাও।’ অমর হাত বাড়াল। অনন্ত তার হাতে একটা কচুরি দিল, দুই বোনকেও। অবিনাশ হাতটা তুলে তাকে দিতে নিষেধ করল।

অনন্ত ভাই—বোনেদের মুখের দিকে তাকাল। এই মুহূর্তে সারা ঘর স্থির একটা নিশ্চিন্তিতে ডুবে গেছে। সবার মুখেই সুখের বুড়বুড়ি। অমর কচুরির সামান্য একটু ছিঁড়ে তরকারির ঝোলে বুলিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চিবোচ্ছে, মাঝে মাঝে দু—চোখ বুজে আসছে। অনু আঙুলের ডগায় ঝোল মাখিয়ে জিবে ঠেকাচ্ছে। অলুর চোখ দ্রুত চিবোনোর জন্য বড়ো হয়ে উঠেছে আর ঢোক গিলছে। বহুদিন পর তাদের ঘরে কিছুক্ষণের জন্য বাবা ফিরে এল। ‘বড়োছেলেরাই তো একসময় বাবার জায়গা নেয়’, আজ থেকে সে বড়ো হয়ে গেল। এখন তার আঠারো চলছে।

অনন্ত রাত্রে স্নান করে জলকাচা পাজামাটা উঠোনের তারে মেলে দিচ্ছিল। শীলা কাছে এসে নীচুস্বরে বলল, ‘ওরা আজ ভাড়া চেয়েছে, একসঙ্গে চার মাসেরই।’

অনন্ত চুপ করে রইল।

‘একগাছা চুড়ি বিক্রি করলে ভাড়াটা মেটানো যায়।’

‘অনু অলুর বিয়ের জন্য রাখবে বলেছিলে।’

‘ওদের বিয়ের বয়স হতে এখনও সাত—আট বছর বাকি। ততদিনে টাকা জোগাড় হয়ে যাবে। তেরো হাজার টাকা তো রয়েইছে।’

‘ততদিনে সোনার দামও তেরোগুণ হয়ে যাবে।’

‘তা হলে? উনি প্রতি মাসে ঠিক সময়ে ভাড়া পাঠিয়ে দিতেন, কোনোবার দেরি করেননি। এই প্রথম বাকি পড়ল, তাও চারমাসের।’

‘এরকম দু—চার মাস বাকি সব ভাড়াটেদেরই পড়ে।’

‘আমাদের কখনো পড়েনি।’

দু—জনে চুপ করে রইল। দোতালায় রেডিয়ো থেকে পল্লিগীতি ভেসে আসছে। নর্দমা থেকে একটা ছুঁচো উঠোনে লাফিয়ে উঠে শীলার পা ঘেঁষে ছুটে গেল। দূরে কোনো বাড়িতে ঝগড়া হচ্ছে।

‘একটা কথা বলব, রাগ করবি না?’

‘কী কথা?’

‘খোকার মা আজ বিকেলে বলল, বলাই মিত্তির লেনের দাসেদের বাড়িতে রান্নার লোক খুঁজছে।’

‘রাঁধুনি হবে!’

অনন্ত চাপা চিৎকার করে উঠল। তার হাতের আঙুলগুলো থরথর কাঁপছে।

‘তুমি চিন্তা করতে পারলে?…শেষকালে এমন একটা কাজের কথা…বাবা বেঁচে থাকলে তুমি এ—কথা বলতে পারতে?’

‘উনি তো আর নেই।’

‘আমাদের বংশ, মান—সম্মান?’

‘খেতে পরতে হবে, বাড়ি ভাড়া, এটা—ওটা, স্কুলের মাইনে…তুইও কি কখনো ভাবতে পেরেছিলিস পড়া ছেড়ে চল্লিশ টাকার কাজ নিবি?’

‘আমি ব্যাটাছেলে, আমার সব মানিয়ে যায়…না, তোমাকে রাঁধুনি হতে হবে না।’

অনন্ত প্রায় ছুটেই ঘরে এল। দেওয়াল ঘেঁষে অমর ঘুমোচ্ছে মেঝেতেই। তার পাশে বালিশটা ছুড়ে, আলো নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ল। কিছু পরে সে পাশের ঘর থেকে মা—র কণ্ঠস্বর পেল, ‘কী বিচ্ছিরি শোয়া বাপু…ওদিকে পা সরা।’

অনন্তের ঘুম আসছে না। অজস্র রকমের চিন্তা তার মাথায় যাওয়া—আসা করছে। প্রত্যেকটাই ভয়ের আর হতাশার। মা রাঁধুনি এ—কথা শুনলে পাড়ার লোকে কী বলবে, ওপরের লোকেরাও? অলু, অনু, অমরের স্কুলে যেভাবেই হোক অনেকেই জেনে যাবে। ঝি—চাকর—রাঁধুনি মোটামুটি তো একই পর্যায়ের। কেউ যদি ওদের আঙুল দেখিয়ে বলে রাঁধুনির ছেলে…রাঁধুনির মেয়ে’! ভাগ্য যাকে যেমন দেবে তা মেনে নিতেই হবে, কিন্তু তাই বলে মান—সম্মান ধুলোয় লুটিয়ে দিতে হবে নাকি?

গত এক মাসে সে বন্ধুদের বা পাড়ার লোকের সঙ্গে কথা বলেনি। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হলে ব্যস্ততার ভান করে হনহনিয়ে এড়িয়ে গেছে। স্কুলের অশোকবাবুর সঙ্গে একদিন রাস্তায় দেখা। এড়িয়ে যেতে গিয়েও পারেনি। জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘পড়া ছেড়ে দিলি? করছিস কী এখন?’

ইতস্তত করে সে বলেছিল, ‘অ্যাপ্রেন্টিস, কাজ শিখছি কারখানায়।’

‘কীসের কারখানা?’

অনন্ত তৈরি ছিল না প্রশ্নটার জন্য। সামনে নারায়ণ মেডিক্যাল হল—এর সাইনবোর্ডে চোখ পড়তেই বলেছিল, ‘ওষুধের কারখানা।’

‘কত দিচ্ছে?’

‘একশো চল্লিশ টাকা।’

‘অমরকে ভালো করে পড়াশুনো করতে বলিস, একটু খাটলেই ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে যাবে।’

‘আমি তো সারাক্ষণই বাইরে থাকি স্যার। আপনারা যদি ওকে বলেন…বাড়িতে তো বিশেষ পড়তে দেখি না।’

‘মাথা আছে ওর, একটু খাটলেই পেয়ে যাবে, আমার কোচিং—এ ওকে আসতে বলিস…না না টাকা লাগবে না।’

অমর ক—দিন ধরে সকালে স্যারের কোচিং—এ যাচ্ছে। অমর বোধহয় জানে না সে কত টাকা পায় কমলা বাইন্ডার্স থেকে। কিন্তু সে ওষুধের কারখানায় যে অ্যাপ্রেন্টিস নয় এটা অমর জানে। কথায় কথায় যদি অশোকবাবুকে বলে ফেলে দাদা কোথায় কাজ করে! খুঁটিয়ে বাড়ির খবর নেওয়ার অভ্যাস স্যারের আছে।

ঘুমের মধ্যে সে ছটফট করেছে। ঘুম ভেঙে যাবার পর বিশ্রী একটা অস্বস্তি নিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। অনু স্কুলে যাবে। মা বাসি রুটি আর তরকারি ওকে খেতে দিয়েছে। অমর এখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। উঠোনে বাসন রাখার শব্দ হল। কাল কচুরি আর সন্দেশ কেনার পর যে—টাকা ক—টা ছিল সে মাকে দিয়েছে। মা—র কাছ থেকে দুটো টাকা নিয়ে এবার সে বাজার যাবে। খুব সহজে এবং দ্রুত তার বাজার করা হয়ে যায়। আলু, ডাল আর একটা আনাজ। মাছের বাজারের দিকেই সে যায় না। মাছ তারা শেষ কবে খেয়েছে? মাসতিনেক আগে। হঠাৎ খুব ইলিশ ওঠে, পাঁচ টাকা কেজি পর্যন্ত দাম নেমেছিল। রাত্রে একটা আধ কেজি ইলিশ এনেছিলেন অবিনাশকাকা। পরদিনের জন্য গোনাগুনতি তুলে রাখা হয়েছিল। সকালে রাঁধতে গিয়ে মা একটা মাছ কম পায়। কেউই স্বীকার করেনি তবে সবাই সন্দেহ করেছিল এটা অমরেরই কাজ।

‘আর ঘুমোয় না, ওঠ এবার, বেলা হয়ে গেল।’ অনন্ত চোখ খুলে জানলা দিয়ে তাকাল। সামনের বাড়ির দোতলার বারান্দায় উৎপলের দাদু চেয়ারে বসে কাগজ পড়ছে। ওদের সদরের পাশেই আস্তাকুঁড় ছিল। দিন—সাতেক হল দাদু ঝিয়েদের সঙ্গে ঝগড়া করে জঞ্জাল ফেলা বন্ধ করেছে। রোজ সকালে দাদু বারান্দায় বসে লক্ষ রাখে কেউ ওখানে কিছু ফেলছে কি না। আরও তিনটে বাড়ি পেরিয়ে জঞ্জাল ফেলতে হওয়ায় ঝিয়েরা প্রথমে গজগজ করে এখন মেনে নিয়েছে। সকালে অনন্তদের জঞ্জাল ফেলে অনু। ওর স্কুল সাড়ে দশটা থেকে। ভাঙা—কলাইয়ের থালা হাতে দূরে গিয়ে ফেলতে অনু লজ্জা পায়। তাই ও ঘরের জানলা থেকে প্রথমে দেখে নেয় দাদু বারান্দায় আছে কি না। না থাকলে ছুটে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসে। পাতের এঁটো—কাঁটা কিছুই প্রায় থাকে না, আনাজ খোসাসমেতই রান্না হয়, শুধু উনুনের কিছু ছাই ছাড়া তাদের সংসারে প্রতিদিনের কোনো জঞ্জাল হয় না।

অনন্ত বাজারে বেরোবার আগেই অমর কোচিং—এ চলে গেছে। খোকার মা উঠোনে নীচু গলায় শীলার সঙ্গে কথা বলছিল। তাকে দেখে ওরা কাজ বন্ধ করল। অনন্ত না—দেখার ভান করে পেরেক থেকে থলিটা তুলে নিয়ে, চেঁচিয়ে বলল, ‘টাকা দাও।’

দুটো টাকা শীলার আঁচলে বাঁধা ছিল। খুলে দেবার সময় বলল, ‘খোকার মা—কে না বলে দিলুম। চাল শুধু এ—বেলার মতোই আছে।’

অনন্ত অসহায়ভাবে তাকাল। বাবা মারা যাবার পর এক বছর কেটে গেছে। যে—ক—টা টাকা ছিল তা—ও ফুরিয়েছে। এখন তার চল্লিশটা টাকাই সম্বল। সে ভেবে পাচ্ছে না তাদের পাঁচটা পেট কীভাবে ভরবে।

‘এবার থেকে দু—বেলা রুটি খেতে হবে।’

‘আটা কিনতেও তো পয়সা লাগবে। মেয়েদের জামা না কিনলেই নয়, সেলাই করে করে কত আর পরবে, অমরের জুতোটাও ফেলে দেওয়ার মতো হয়ে গেছে…’

‘তা আমি কী করব, শুধু আমায় বলছ কেন?’ অনন্ত হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল। শীলা অবাকচোখে তাকিয়ে। এভাবে কখনো ওকে চেঁচিয়ে উঠতে দেখেনি। দু—জনে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল। দু—জনেই জানে উত্তর দেবার কিছু নেই, উত্তর হয় না। অনন্ত চোখ নামিয়ে মাথা নীচু করে বেরিয়ে গেল।

বাজার থেকে ফেরার সময় সে অমরকে দেখল বইখাতা হাতে তিনটি ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। ওর পায়ের কাবলি জুতোটার গোড়ালির চামড়ার পটিটা উলটোনো, বকলেস নেই। জুতোর কালো রং ধুলো—কাদায় ফ্যাকাশে। ডান পাটির একধারের সেলাই ছিঁড়ে আঙুল বেরিয়ে গেছে। অমরের বুশ—শার্টটা ময়লা। ফুলপ্যান্টটা ঢলঢলে। দেখেই বোঝা যায় বহুদিন সাবানে কাচা হয়নি।

অনন্ত এবং অমর যে ফুলপ্যান্ট পরে আছে সে—দুটি তাদের বাবার। দুই ভাইয়ের মাপ একই। চার মাস আগে বাবার দু—জোড়া জামা—প্যান্ট দর্জিকে দিয়ে ছোটো করিয়ে নিয়েছিল। এখনও একটা প্যান্ট রয়েছে। সেটা ছোটো করিয়ে অমরকে দেবে। বাবার একজোড়া ধুতি আর একটা পাঞ্জাবি আলমারিতে পড়ে আছে। অনেকদিনই সে ভেবেছে প্যান্টগুলো অমরকে দিয়ে সে ধুতি পরবে। পাঞ্জাবি তার দরকার নেই। ওটা দিয়ে মায়ের ব্লাউজ হয়তো হতে পারে।

অমরের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওরা কথা বন্ধ করল। দু—জন তার মুখ চেনা, অমরের ক্লাসেই পড়ে। তৃতীয়জনকে সে চেনে না। মুখে আলতো হাসি ফুটিয়ে সে একবার শুধু তাকাল মাত্র, যেভাবে বয়স্করা ছোটোদের দিকে তাকায়।

যাতে উনুন কামাই না যায় সেজন্য অনন্ত বাজারে যাবার পর শীলা উনুনে আঁচ দেয়। উনুন ধরে উঠতে উঠতে বাজার এসে যায়। দু—বেলার রান্না সে সকালেই সেরে নেয় কয়লা খরচ কমাতে।

অনন্ত যখন ফিরল শীলা তখন হাঁড়িতে ফুটন্ত জলে চাল ঢালছে।

‘বাবার একটা ধুতি বার করে দাও তো।’

‘কী করবি?’

শীলা বাষ্প থেকে মুখ সরিয়ে তাকাল।

‘পরবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুই বার করে নে না।’

ধুতি—পাঞ্জাবি কাচিয়ে তোলা ছিল। পুরোনো হলেও ব্যবহার কম হয়েছে। অনন্ত পাট ভেঙে ধুতিদুটো তক্তাপোশের উপর ছড়িয়ে দিল। দু—তিন জায়গায় ফুটো, বোধহয় পোকায় কেটেছে।

অমর ঘরে ঢুকল। ধুতির দিকে একবার তাকিয়ে সে পিছন ফিরে তাক—এ বইখাতা গোছাতে লাগল। অনন্তের মনে হল সকলেরই জামা ফ্রক প্যান্ট থানকাপড় দরকার আর সে কিনা আস্ত দুটো ধুতি পেয়ে যাবে!

‘দুটো রয়েছে, তুই একটা নিবি নাকি?’

‘নাহ ধুতি আমার চলবে না তা ছাড়া কেমন যেন বুড়োটে দেখায়।

অনন্ত অপ্রতিভ বোধ করল। তাকে কি সত্যিই বুড়ো দেখাবে? তার বয়সি কেউ ধুতি পরে এমন কাউকে তার মনে পড়ছে না।

‘তোর জুতোটা একদম গেছে।’

অমর জবাব দিল না। চেয়ারে বসে সে একটা বইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল।

‘জুতো কেনার মতো টাকা তো হাতে নেই, আমি যা পাই তাতে একমাসের চালও কেনা যাবে না।’

অমর বই থেকে চোখ সরাল না। অনু ঘরে ঢুকল।

‘দাদা, আমার পেনসিলটা নিয়েছিস?’

‘হ্যাঁ, এই নে।’

অনু বেরিয়ে গেল। ওর ফ্রকের পিঠের বোতামগুলো নেই, একটিমাত্র সেফটিপিন দিয়ে আটকানো। অনন্ত পাট মিলিয়ে ধুতিদুটো ভাঁজ করতে লাগল।

ভাত খাবার সময় শীলা বলল, ‘চুড়িটা বিক্রি না করলে তো আর চালানো যাচ্ছে না, কয়লাওলা এসেছিল, দু—মাস ওকে কিছু দেওয়া হয়নি, বলে গেল আর কয়লা দেবে না।’

‘কত পাবে?’

‘সাড়ে আট টাকা।’

‘তোমার কাছে যা আছে তাই থেকে দিয়ে দাও।’

‘বাকি দিনগুলো যে কী করে…’

মালকোঁচা দিয়ে ধুতি তার উপর নীল শার্ট। অনন্ত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করল তাকে বুড়োটে দেখায় কি না। শীলার দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘কেমন যেন দেখাচ্ছে!’

‘কেন ঠিকই তো আছে।’

‘জামাটা ময়লা, ধুতির সঙ্গে মিলছে না।’

‘রাতে সাবান দিয়ে কেচে দোব।’

‘ওদের জন্য এবার কিছু কিছু কেনা দরকার…চুড়িটা থেকে কত পাবে?’

‘আটগাছা চুড়ি, হার, তোর বাবার আংটি, বোতাম নিয়ে চারভরি সোনা বিয়েতে দিয়েছিল। চুড়িগুলোয় আছে ছ—আনা করে।’

‘এতে কতদিন আর চলবে, অমর রোজগেরে হতে হতে এখনও পাঁচ—ছ—বছর তো লাগবেই।’

‘ভগবান ঠিক চালিয়ে দেবেন।’

বেরোবার সময় শীলা তাকে চার আনা আর কাগজে মোড়া চারখানা আটার রুটি দিল। ট্রামে—বাসে না চড়ে অনন্ত প্রায় একমাইল পথ হেঁটেই যাতায়াত করে। গলি দিয়ে যাবার সময় তার মনে হল সবাই যেন তার দিকে তাকাচ্ছে। পাড়ার কোনো লোকের সঙ্গে তার কথাবার্তা বলার মতো আলাপ নেই। সমবয়সিদের সঙ্গেও দরকার না হলে সে কখনো কথা বলে না। সবাই জানে সে কুনো, মুখচোরা, অমরের ঠিক উলটোটি।

দূর থেকে অনন্ত দেখল গৌরী সুলভ পুস্তক ভাণ্ডারের কাউন্টারে দু—গ্লাস চা রেখে ফিরে যাচ্ছে। তার বুকের মধ্যে হঠাৎ মোচড় দিয়ে উঠল। চায়ের দোকানের বেঞ্চে সেই ছোকরাটাও বসে রয়েছে যাকে সে সকাল—সন্ধ্যা যাতায়াতের সময় প্রায়ই দেখে। বছর পঁচিশ বয়স হবে। ডিগডিগে, লম্বা, ফরসা চেহারা। চোখা নাক। চুলে তেল নেই, সামনের দিকটায় ঢেউতোলা। ঘাড় কামানো। টেরিলিনের কালো প্যান্ট, ছুঁচলো জুতোটায় পিতলের বকলেস। গায়ে লাল গোলগলা ঝকমকে গেঞ্জি। কোনোদিন পরে সাদা ফুলশার্ট। একদিন তার কানে এসেছিল ছোকরাটি গৌরীর বাবাকে বলছে, ‘কাকাবাবু, একদিন খিদিরপুরে আমার সঙ্গে চলুন, মাল দেখুন…’

ছোকরা এখানে কেন বসে থাকে? গৌরীর জন্য? অনন্ত একটু দমে গেল। ছোকরার জামাপ্যান্ট জুতো ঝকঝকে দামি, পরিপাটি, দেখতেও ভালো, কথা বলে ঝরঝরে। অনন্ত নিজের সঙ্গে তুলনা করার কোনো চেষ্টাই করল না। চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় সে আড়চোখে দেখল ছোকরার দিকে তাকিয়ে গলার সবুজ পাথরের মালাটা বুড়ো আঙুল দিয়ে টেনে ধরে গৌরী হাসছে…’বাবা বাজার থেকে কিন্তু এখুনি এসে যাবে, খুলে রাখি?’

অনন্ত সামনের দিকে তাকিয়ে হেঁটে গেল। চাওয়ালার মেয়েকে নিয়ে আর সে মাথা ঘামাবে না। কিন্তু মনের মধ্যে একটা জ্বালা সে অনুভব করছে। কিছু একটা যেন সে চেয়েছিল অথচ সেটা তাকে দেওয়া হল না। কারোর কাছ থেকে কিছু পাওয়ার মতো দাবি বা অধিকার তার কোথাও নেই। গৌরী সম্ভবত ভালো করে কখনো তাকে লক্ষও করেনি। তার ভালো লেগেছে মানেই যে গৌরীরও ভালো লাগবে এমন কোনো কথা নেই।

দুপুরে আলুর দম নিয়ে সে মাথা নীচু করে রুটি দিয়ে খাচ্ছিল। বেঞ্চে তার পাশে মোটর গ্যারাজের দু—জন। তারা পাঁউরুটি কিনে এনেছে। এখন রাস্তায় লোক চলাচল কম। লোকদুটো কথা না বলে খেয়ে যাচ্ছে। বাঁশ দিয়ে খাড়া—করা ত্রিপলের ছায়ায় একটা টুলে গৌরী বসে। খেতে খেতে অনন্ত একবার মুখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হল। হাতায় আলুরদমের ঝোল নিয়ে গৌরী উঠে এসে তার প্লেটে ঢেলে দিল।

‘না না, আর দরকার নেই।’

‘দুটো রুটি খেতে খেতেই তো ঝোল ফুরিয়ে গেল, বাকি রুটিগুলো কি শুকনো চিবোবে?’

অনন্ত হাসবার চেষ্টা করল। ওর গলায় সবুজ মালাটা নেই দেখে তার ভালো লাগল। মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্বস্তি পাচ্ছে।

‘ওব্যেস নেই দুপুরে রুটি খাওয়ার।’

‘তা হলে ভাত নিয়ে আস না কেন? অনেকেই তো আনে টিফিন কেরিয়ারে।’

‘ভাত আমি খেয়েই আসি।’ অনন্ত কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার বলল, ‘আমাদের টিফিন কেরিয়ার নেই।’

‘দশরথের ভাতের হোটেলে তো খেতে পারো।’

অনন্ত চুপ করে খেয়ে যেতে লাগল। হোটেলে ভাত খাবার পয়সা নেই বলতে তার কুণ্ঠা হল। প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য সে বলল, ‘তোমার বাবা খেতে গেছে?’

‘আমি খেয়ে এলে বাবা খেতে যায়। বাবা ফিরে এলে আমি ঘরে যাব। আজ অবশ্য সিনেমায় যাব।’ গৌরী হাসল। অনন্তের মনের মধ্যে গুমোট জমে ভারী হয়ে উঠল। নিশ্চয় সেই ছোকরাটার সঙ্গেই যাবে। ওর বাবার কি এতে সায় আছে? থাকতে পারে। হয়তো ওর সঙ্গে গৌরীর বিয়েও দেবে।

‘একা যাবে?’

কথাটা বলেই অনন্ত লজ্জা পেল। সামান্য এইটুকু আলাপে এমন প্রশ্ন করা উচিত হয়নি। মুখ থেকে হঠাৎ—ই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু গৌরী এমন গায়েপড়া কৌতূহলে যেন খুশিই হল।

‘একা একা সিনেমা দেখতে আমার ভালো লাগে না।’

‘আমারও। অবশ্য সিনেমা আমি খুব কমই দেখি, যুদ্ধের বই দেখতেই ভালো লাগে।’

লোকদুটো দাম চুকিয়ে চলে গেল। দর্জির দোকান থেকে হাঁক শোনা গেল, ‘একটা চা দিয়ে যাস গৌরী।’

‘আমার ভালো লাগে রগড়ের বই দেখতে।’

‘চার্লি চ্যাপলিনের বই দেখেছ? আমাদের স্কুল থেকে একবার দেখাতে নিয়ে গেছল, দারুণ হাসির।’

‘স্কুলে পড়তে?’ গ্লাসে লিকার ঢালতে ঢালতে গৌরী বলল।

‘হ্যাঁ।’

‘পড়া ছাড়লে কেন?’

‘সংসার চালাতে হবে তো। বাবা হঠাৎ বাসচাপা পড়ে মারা গিয়ে…দুটো বোন একটা ভাই আর মা রয়েছে।’

গৌরী চামচ নাড়া বন্ধ রেখে ওর দিকে তাকাল। ও—চোখে সহানুভূতি, দরদ। অনন্তের গুমোট কেটে যাচ্ছে।

‘তুমিই বড়ো?’

‘হ্যাঁ। বড়োছেলেরাই তো বাবার জায়গা নেয়।’

ভারী গলায় কথাটিকে কেটে কেটে বলল। বলার সময় গৌরীর মুখের ভাব লক্ষ করছিল। কিছু বুঝতে পারল না।

দর্জির দোকানে চা দিয়ে ফিরে এসে গৌরী বলল, ‘বাবা টাকাকড়ি রেখে যায়নি?’

‘কিচ্ছু না শুধু তেরো হাজার টাকা পেয়েছি প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে, বোনেদের জন্য তোলা আছে, আর মায়ের ভরিচারেক গয়না।’

গৌরীর বাবাকে আসতে দেখে অনন্ত বেঞ্চ থেকে উঠল। পয়সা দেবার জন্য শার্টের পকেটে হাত ঢোকাতেই গৌরী চাপাস্বরে দ্রুত বলল, ‘দিতে হবে না।’

অনন্ত কয়েক সেকেন্ড বিভ্রান্তের মতো তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে কমলা বাইন্ডার্সের দিকে এগোল। বলতে গেলে গৌরীর সঙ্গে এই তার প্রথম পরিচয় অথচ এত কথা সে যে বলতে পারল, এটাই তাকে অবাক করছে। মেয়েটার চাহনিতে কী যেন একটা আছে যা তাকে সাহসী করে দিল। কিন্তু তাই বলে বিনি পয়সায় আর সে খাবে না, একবারই যথেষ্ট বরং কিছু একটা উপহার দিয়ে সে শোধ দেবে।

সন্ধ্যায় অনন্ত বাড়ি ফেরার সময় হাতিবাগানে একটা রেস্টুরেন্টে গৌরী আর সেই ছোকরাকে দেখতে পেল। টেবলে পাশাপাশি ওরা। ছোকরা প্লেটের দিকে মুখ নামিয়ে কাঁটা চামচে মাংখখণ্ড গাঁথায় ব্যস্ত। রাস্তার দিকে একবার যেন তাকাল। অনন্তকে বোধ হয় দেখতে পায়নি কিন্তু সে ওর গলায় সবুজ মালাটা দেখতে পেয়েছে। গৌরীর পরনে হলুদ রঙের শাড়ি।

ক্লান্ত, মন্থর পায়ে যখন সে বাড়ি পৌঁছোল তখন নিজেকে তার মনে হচ্ছিল বুড়ো হয়ে গেছে।

কে বা কারা যেন বলেছি, ‘অনন্ত খুব ভালো ছেলে।’ তখন তার বয়স কত ছিল? সাত, আট, হয়তো নয়। তখন তার চারপাশের জগৎ ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠছিল; তখন মানুষজন সম্পর্কে সচেতনতা শুরু হচ্ছিল, তাদের সে আলাদা আলাদা করে বুঝে প্রত্যেককে নিজস্ব ছকের মধ্যে দেখতে পাচ্ছিল। এখন থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের ঘটনা মনে করতে গিয়ে তার মনে হচ্ছে স্মৃতি যেন তার সঙ্গে চালাকি করছে। বহু মানুষ, বহু ঘটনা ধূসর হয়ে গেছে, কিছু কিছু মানুষ চেতনায় রয়েছে আলোকিত কুয়াশার মতো।

একা নির্জন অন্ধকার ঘরে অনন্ত তার অতীতের দিকে দৃষ্টি রাখতে গিয়ে মানুষ, ঘটনা, দৃশ্য, শব্দ, রং এখন আর আলাদা করতে পারছে না। রেবতীর চলে যাওয়াটা তাকে যতটা নাড়া দিয়েছে একদা গৌরীর জন্য তার হৃদয় কি এইভাবেই মুচড়ে উঠেছিল? অমর যেদিন বলল, ‘আমি আর এখানে থাকব না’ সেদিনও কি এমন করে অসাড় হয়ে গেছল তার অনুভব ক্ষমতা।

অমরকে সে চড় মেরেছিল। কারণটা আজও তার মনে আছে। স্কুল ফাইনালে প্রথম পঁচিশজনের মধ্যে অমর স্থান পেয়েছিল। অবিনাশকাকা এক বাক্স সন্দেশ কিনে এনেছিল। শীলা উপরে জেঠিমাদের কয়েকটা দিয়ে আসে, সামনে উৎপলদের বাড়িতেও অনন্ত নিজে গিয়ে পাঁচটা সন্দেশ দেয়। উৎপলের দাদু অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তিনটে লেটার পেয়েছে, বলিস কী!’

তার এক সপ্তাহ পরেই দাদু মারা যায়। হাই ব্লাডপ্রেশার ছিল, হৃৎপিণ্ডও বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে গেছল। বিকেলে বারান্দায় চেয়ারেই চলে পড়ে। দামি খাটে, প্রচুর ফুলে সাজিয়ে, সংকীর্তন করে ওকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। অমরও সঙ্গে গেছল। শ্রাদ্ধে অনন্তদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করে গেছল উৎপল। পরিবেশনকারীদের অন্যতম ছিল অমর। প্রায় আটশো লোক নিমন্ত্রিত হয়েছিল। কাপড় দিয়ে রাস্তার অর্ধেকটা ঘিরে টেবলে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। সেদিন অনু মায়ের পুরোনো সিল্কের শাড়ি পরেছিল। অলু উপর থেকে ইস্ত্রি এনে বাড়িতে কাচা ফ্রকটাকে মোটামুটি কাজের বাড়িতে যাওয়ার যোগ্য করে তুলেছিল। অনন্ত নিজেদের সদরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, খাওয়া শেষ করে একদল বেরিয়ে এলে নতুন পাত পড়ামাত্র গিয়ে বসে পড়বে। তখন অমর তার পাশ দিয়েই বাড়িতে ঢোকে। সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কী রে, চলে এলি যে?’ অমর অস্পষ্ট স্বরে কী যেন বলেছিল।

নিমন্ত্রণ খেয়ে বাড়ি ফিরে সে মায়ের কাছে কীভাবে তার সামনের লোকটি বাজি ধরে চল্লিশটা রসগোল্লা টপটপ খেয়ে গেল সেই গল্প করছিল, ‘ভাবতে পারবে না, লোকটা এই টিংটিঙে। বাজি ছিল তিরিশটা, দশটা বেশি খেল!’

অনু বলল, ‘কী বাজি ছিল?’

‘এক টাকা!’

‘মা—ত্ত—র!’

তখন মা হঠাৎ বলে ফেলে, ‘অমর অনেকগুলো সন্দেশ এনেছে।’

সে প্রথমে বুঝতে পারেনি। তারপরই খটকা লাগতে জিজ্ঞাসা করে, ‘কীভাবে আনল? ওরা কি অমরকে দিয়েছে?’

‘দেবে কেন। এমনিই এনেছে।’

‘এমনি, এমনি মানে? নিশ্চয় লুকিয়ে এনেছে…চুরি করে এনেছে।’

মা—কে চুপ করে থাকতে দেখে অনন্ত রাগে দাউদাউ করে উঠেছিল।

‘চোর! আমার ভাই চোর! সামান্য ক—টা সন্দেশের লোভ আর সামলাতে পারল না?’

সে লাফিয়ে উঠেছিল। ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে বাসন ছুড়ে ছুড়ে খুঁজছিল।

‘নিশ্চয় কেউ—না—কেউ ওকে সন্দেশ সরাতে দেখেছে।…আমাদের সবাইকে চোর ভাবছে…চোরের ফ্যামিলি…’

‘তুই অমন কচ্ছিস কেন…পাগল হলি নাকি?’

শোবার ঘরের তাকে কাগজে মুড়ে রাখা ছিল প্রায় গোটা কুড়ি সন্দেশ। চাপ খেয়ে দলা পাকানো। মা সেটা অনন্তের হাতে তুলে দিতেই সে ছুটে বেরিয়ে যায় উৎপলদের বাড়িতে।

‘কাকাবাবু এগুলো নিন, অমর বাড়িতে নিয়ে গেছল।’

উৎপলের বাবা অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘কী ব্যাপার?’

‘অমর এগুলো বাড়িতে নিয়ে গেছল।’

‘চুরি’ শব্দটা বলতে গিয়েও বেধে গেল গলায়। কাঁধে হাত রেখে উৎপলের বাবা মৃদুহেসে বলেছিল, ‘আরে দূর, ছেলেপুলেরা এরকম একটু—আধটু করে থাকেই, ফেরত দেবার কী দরকার। ও তুমি নিয়ে যাও।’

‘না, আমরা নিতে পারব না।’

টেবলে তখন কাগজ বিছানো হচ্ছে, অমর কলাপাতা হাতে অপেক্ষা করছিল। অনন্ত ছুটে গিয়ে সন্দেশমোড়া কাগজটা টেবলে রাখল। দলাপাকানো কাগজটার ফাঁক থেকে সন্দেশ দেখা যাচ্ছে। সেইদিকে তাকিয়েই অমরের মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। সে ফ্যালফ্যাল করে তার আশেপাশের কৌতূহলী মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে হাতের কলাপাতাগুলো টেবলে নামিয়ে দিল।

‘ছেলেটা সত্যিই ভালো।’

কে যেন তখন বলছিল। অনন্ত কোনোদিকে আর তাকায়নি। বাড়িতে এসে গুম হয়ে দালানে বসে থাকে। একটু পরেই অমর আসে।

‘ভালো ছেলে সার্টিফিকেট নেবার জন্য আমাকে এভাবে ডোবালে কেন? আমি পাড়ায় মুখ দেখাব কী করে?’

অনন্ত উঠে দাঁড়াল। কয়েক সেকেন্ড পর বিরাজমান নৈঃশব্দের মধ্যে চড়ের শব্দটা তীক্ষ্ন হয়ে উঠল। অমর কোনো কথা না বলে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। একটু পরে অনন্ত ওর পাশে গিয়ে শোয়।

অমর দু—দিন ঘর থেকে বেরোয়নি। তৃতীয় দিন দুপুরে কোথায় যেন যায়, ফিরে আসে অনেক রাতে যখন পাড়া নিশুতি হয়ে গেছে। মা শুধু বলেছিল, ‘ভাত তোলা আছে, খাবি?’

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই অনন্ত শুনতে পায় দালানে কথা বলছে মা আর অমর।

‘আমি এখানে আর থাকব না, চলে যাচ্ছি।’

‘কোথায় যাবি?’

‘ব্যবস্থা করে এসেছি।’

‘ব্যবস্থা?’

‘এন্টালিতে একজনের বাড়িতে থাকব, তার দুটো বাচ্চচা ছেলেকে পড়ানো, দেখাশোনার কাজ করতে হবে।’

‘তোর নিজের পড়াশুনো?’

‘করব।’

অনন্ত শুনতে শুনতে অসাড় হয়ে গেল। তার মনে হল অমর আর কোনোদিনই এই সংসারে ফিরে আসবে না, চিরকালের মতো বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কেন? বরাবরই ও আলগাভাবে ছিল এই সংসারের সঙ্গে। কিছুটা স্বার্থপর, কিছুটা উদাসীন। সবাই বলে ট্যালেন্টেড। ওকে বই নিয়ে পড়তে বিশেষ কেউ দেখেনি, অথচ ভালো রেজাল্ট করেছে। অনন্তের আশা ছিল, অমর ভালো চাকরি করে সচ্ছলতা আনবে, অন্তত বাবার থেকে বেশি রোজগার করবে।

সন্দেশগুলো ফিরিয়ে না দিলে অমর থেকেই যেত। সে কি অন্যায় কাজ করেছে? অনন্ত দু—দিন ধরে উত্তর খুঁজেছে। অমরের ধারণা ভালো ছেলে সাজার জন্য সে কাজটা করেছে। ভগবান জানে, মোটেই তা নয়। এইরকম কিছু দেখলে তার ভিতরে অসহ্য একটা চাপ তৈরি হয়, অস্থিরতা জাগে। সেটা বার করে না দিলে তার মনে হয় দম ফেটে মরে যাবে।

তার তখন দশ—এগারো বছর বয়স। পাড়ার সর্বজনীন দুর্গাপুজোয় তারা কয়েকজন সমবয়সি ভলান্টিয়ার হয়েছিল। প্যান্ডেলের একধারে সাবিত্রী—সত্যবানের মূর্তি রাখা ছিল। প্রতিমা দেখার পর মেয়েরা সরায় রাখা সিঁদুর সাবিত্রীর মাথায় ছুঁইয়ে নিজেদের সিঁথিতে দিত। সামনে রাখা থালায় পয়সা ফেলত। নানান আকারের রেজগিতে থালাটা ভরে উঠত দু—তিন ঘণ্টাতেই। দশ পয়সা থেকে সিকি—আধুলি, দু—টাকা, এক টাকার নোটও থালায় পড়ত। যুগলদা থালাটা তুলে নিয়ে নতুন একটা থালা রেখে যেত।

নবমীর দুপুরে অরবিন্দই বলেছিল, ‘পার্কে নাগরদোলা বসিয়েছে, চাপবি?’

‘পয়সা নেই।’

অরবিন্দের মামাতো ভাই পুজোয় বেড়াতে এসেছিল পাটনা থেকে। নাম ছিল নন্দন। তার কাছে ছিল একটা সিকি।

‘দশ পয়সা এক—এক বারে। আরও তো পয়সা চাই।’

অরবিন্দ আর নন্দন নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে অনন্তকে বলল, ‘তুই এইদিকটা আড়াল করে দাঁড়া।’

‘কেন?’

‘যা বলছি শোন।’

তিনদিক ত্রিপল দিয়ে ঢাকা ছোট্ট একটা ঘরে দু—হাত লম্বা সাবিত্রী হাতজোড় হাঁটু গেড়ে ভগবানকে ডাকছে, তার পাশে শোয়ানো সত্যবান। সামনে বাঁশের বেড়া। দুপুরে ভিড় প্রায় নেই—ই। চৌকিতে রাখা ক্যাশবাক্সে মাথা রেখে অন্যদিকে মুখ করে কোষাধ্যক্ষ যুগলদা আধশোয়া। দুটি ছেলে রেকর্ড বাজাচ্ছে।

‘পিছন ফিরে বাঁশে হেলান দিয়ে এদিকে মুখ করে দাঁড়া।’

অনন্ত ওর কথা—অনুযায়ী দাঁড়িয়েছিল। নন্দন তার পাশে দাঁড়াল। অরবিন্দ বাঁশের উপর ঝুঁকে খুব মন দিয়ে সাবিত্রীর দিকে তাকিয়ে। ওর হাতে একটা রুমাল। অনন্ত দেখল, রুমালটা হাত থেকে হঠাৎ থালার উপর পড়ল। অরবিন্দ দু—পাশে তাকিয়ে নীচু হয়ে এক লহমায় রুমালটা মুঠো করে তুলে প্যান্টের পকেটে রাখল।

অরবিন্দ মন্থরভাবে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় কর্পোরেশনের খাবার জলের ট্যাঙ্কের পাশে দাঁড়িয়ে হাতছানি দিয়ে তাদের দু—জনকে ডাকল।

‘চল।’

‘না, যাব না।’

‘নাগরদোলায় চাপবি না?’

‘না। আমি দেখেছি অরবিন্দ রুমালের সঙ্গে পয়সাও তুলল।’

‘আমরা ওমলেটও খাব। তাড়াতাড়ি আয়।’

অনন্ত যায়নি। ওরা দু—জন দূর থেকে বার বার হাতছানি দিয়ে ডেকে তার জন্য অপেক্ষা করেছিল। সে মাথা নেড়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকে। তখন তার ভয় করছিল। যদি কেউ দেখে থাকে? সারা পাড়ার লোক জেনে যাবে, রাস্তায় বেরোলেই লোকেরা আঙুল দিয়ে দেখাবে, কীরকম চোখে যেন তাকাবে। তার থেকেও বড়ো কথা বাবা, মা লজ্জায় পড়বে।

প্যান্ডেলের সামনের বাড়ির ঝি দোতলার জানালা থেকে দেখেছিল। সে বলে দেয় যুগলদাকে।

‘পয়সা সরিয়েছে ওরা?’

‘কী জানি, আমি দেখিনি।’

‘তুই তো ওদের সঙ্গেই দাঁড়িয়েছিলি।’

‘হ্যাঁ, তবে আমি দেখিনি।’

পুজো কমিটির তিন—চারজন তখন হাজির ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে আলোচনা করছিল। একবার তার কানে এল—’না না এ—ছেলেটা ভালো…দলে নেই।’

পরদিন অরবিন্দ আর তার মামাতো ভাইকে ডাকিয়ে এনে প্যান্ডেলে কান ধরে ওঠ—বস করানো হয়। তার দু—দিন পর ওরা দু—জন অনন্তকে সন্ধ্যার সময় ধরেছিল গলির মুখে।

‘তুই বলে দিলি কেন?’

‘না বলিনি।’

‘বলিসনি?’

অরবিন্দ তার পেটে এক ঘুসি মারল। সে পেট চেপে ধরে কুঁজো হতেই, ওরা দু—জনে এলোপাতাড়ি ঘুসি চালাল তার বুকে—পিঠে—মাথায়। সে দু—হাত তুলে যতটা সম্ভব আটকাতে চেষ্টা করে। একবারও পালটা আঘাত করার চেষ্টা করেনি বা পালাতে চায়নি।

‘ভালো ছেলে সাজা হচ্ছে? বলিসনি…তুই বলিসনি?’

‘না, আমি বলিনি।’

ওরা আবার ঘুসি চালিয়েছিল। সেইসময় পাড়ারই একজন দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে ধমক দেয়। ওরা দু—জন সরে যাবার সময় শাসায়, ‘আচ্ছা, পরে আবার ধরব, যাবি কোথায়?’

অরবিন্দ আর তাকে কিছু বলেনি। তার ঠোঁটের কোণের রক্ত দেখে মা ব্যস্ত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে কারণটা বলেনি।

‘হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছি।’

‘দেখে চলবি তো?’

অনন্ত তখন হেসেছিল। মানসিক আনন্দের প্রতিচ্ছায়ার মতো এমনই অস্পষ্ট যে লক্ষই করা যায় না হাসিটা। সেইদিন থেকে তার হৃদয়ের অন্তস্থলে দ্রুত একটা কী যেন পরিবর্তন ঘটে গেছল। পাড়ার বা স্কুলের ছেলেদের সঙ্গে সে আর মিশত না। স্কুল থেকে ছেলেরা ছোটো ছোটো দলে বাড়ি ফিরত। সে ফিরত একা। যা তার চোখে পড়ত, বাসে ঝুলন্ত মানুষ, বৃষ্টি, বারান্দায় ঝোলানো খাঁচায় পাখি, নর্দমার নোংরা জল সব দেখত।

‘ভালো ছেলে’। সেদিন পুজো প্যান্ডেলে কে যেন বলেছিল। কিন্তু সে ‘ভালো ছেলে’ কেন? অরবিন্দের মতো সে পয়সা চুরি করতে পারেনি। সততার জন্য জন্য নয়, আসলে তার ইচ্ছা হয়নি কিংবা সাহসে কুলোয়নি বলেই।

অরবিন্দই স্কুলে তার সম্পর্কে চাউর করে দেয়—ভালো ছেলে। তার মতো আরও অনেকে তখন বলতে শুরু করে। সে শুধু হাসত আর সেখান থেকে সরে যেত।

‘অনন্ত সাধু হয়ে যাবে। বাজি ধরে বলছি।’

ক্লাসে একদিন ছেলেরা তার পিছনে লেগেছিল। সে মুখে হাসি ফুটিয়ে শুধু শুনে গেছল। হয়তো তার হাসিটা খাঁটি ছিল না কিন্তু শান্ত নিরাসক্ত একটা ভাব তাতে ছিল।

‘ওকে চড় মেরে দেখ, কিছছু বলবে না।’

একজন তার গালে আলতো করে চড় মারে। সে তখনও হাসছিল।

অমরও তাকে ‘ভালো ছেলে’ বলল, কিন্তু সত্যিই কি সে তাই? সে ভিতু আর মুখচোরা বলেই কি সবার আগে নিরাপদ হবার জন্য ভালো ছেলে সাজে?

ঘর থেকে বেরিয়ে সে দেখল মা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে একদৃষ্টে উঠানের দিকে তাকিয়ে।

অনন্ত অপরাধীর মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কলতলায় গেল মুখ ধুতে। ফিরে এসে দেখল মা একইভাবে বসে।

‘আমি কি অন্যায় করেছি?’

মা একবার মুখ তুলে তাকাল। অনন্তের মনে হল সেই চাহনিতে যেন বলা হয়েছে—ন্যায়—অন্যায় বিচার করে কী লাভ?

‘ও চলেই যেত, আজ নয়তো কাল।’

কয়েক ঘণ্টা পর অনন্ত চায়ের দোকানটার সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখল সেই ছোকরা, পরে জেনেছে ওর নাম রমেন, বেঞ্চে বসে সিগারেট খাচ্ছে, হাতে চায়ের গ্লাস ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তমুখে লোক—চলাচল দেখছে। দোকানে গৌরী নেই। এই নিয়ে গত এগারো দিন গৌরী অনুপস্থিত।

দুপুরে একটা ছোটো ছেলেকে সে দোকানে দেখল। মুখের আদল আর গায়ের রং থেকে তার মনে হল বোধ হয় গৌরীর ভাই। তবু নিশ্চিত হবার জন্য সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাকে আগে দেখিনি তো, তোমাদের দোকান?’

‘হ্যাঁ।’

‘গৌরী কে হয়?’

‘দিদি।’

‘ও আজ এল না যে?’

‘দিদির বিয়ে।’

অনন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কবে?’

অপরিচিতের সঙ্গে ছেলেটি যেন এই বিষয়ে কথা বলায় অনিচ্ছুক। অনন্ত আর কৌতূহল দেখাল না। তার মনে হল, রমেনের সঙ্গে নয়, অন্য কোথাও গৌরীর বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে। তা যদি হয় তা হলে ভালোই। রমেনকে তার ধাপ্পাবাজ ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি। তবে সে বিষণ্ণবোধ করল, গৌরীকে আর দেখতে পাবে না। এইরকম বিষণ্ণতা অমর সম্পর্কে তার হয়নি। এটি তার একান্ত ব্যক্তিগত অন্যটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বার্থ। অমর রোজগার করে তার বোঝা হালকা করে দেবে এ ছাড়া আর কোনো প্রত্যাশা ওর কাছে নেই।

চার

দু—দিন পর বৃষ্টি হচ্ছিল সন্ধ্যাবেলায়। অনন্ত আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটা গাড়ি বারান্দার নীচে দাঁড়িয়েছিল ভিড়ের একধারে। রাস্তার কিনারে জল জমে গেছে। বৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে জলে ফুটপাথ, রাস্তা এবার ডুবে যাবে। মাঝে মাঝে দমকা বাতাস বৃষ্টির ছাট আসছে আর মানুষগুলো পিছিয়ে এসে জমাট হচ্ছে। রাস্তায় আলো কম, গাড়িও কম, লোকজন নেই বললেই চলে। স্টপে বাস এসে দাঁড়ালে এখান ওখান থেকে ছুটে এসে লোক উঠছে।

সেই সময় গৌরীকে ছুটে গাড়ি বারান্দার নীচে আসতে দেখে তার বুকটা ধক করে উঠল। বোধ হয় বাস থেকে নামল। অনন্তকে দেখতে পায়নি। ওর কপাল, গাল, বাহু, থুতনি বেয়ে জল ঝরছে। আঙুল দিয়ে টেনে কপাল থেকে জল মুছে গৌরী পিছনে তাকাল।

‘আরে!’

অনন্ত হাসল। সামান্য ইতস্তত করে গৌরীর পাশে এল। চোখে পড়ল গলার সবুজ মালাটা। গলা থেকে কোমর পর্যন্ত ফ্রকটা লেপটে রয়েছে। স্তনের ডৌল এমনকী বোঁটাও ব্রেসিয়ারের মধ্য দিয়ে এত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে অনন্তের মনে হল ওর সর্বাঙ্গে যেন কোনো আবরণ নেই।

অনুও বড়ো হয়ে উঠেছে। তেরো বছরের হল। গৌরীর মতো এমন ভাপিয়ে ওঠা শরীর নয় তবু ওর বুক চোখে পড়ে। কয়েকদিন আগে সে ঘরের মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল। অনুর পরনে তখন শুধুমাত্র সায়া, একটা হাত সবে ব্লাউজের মধ্যে গলিয়েছে। তাকে দেখেই কুঁকড়ে তাড়াতাড়ি পিছনে ফিরে যায়। ছি ছি কী ভাবল। অপ্রতিভ হয়ে সে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দরজায় এসে মা—র সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে।

‘এখানকার কাজটা ছেড়ে দেব ভাবছি।’

‘কেন!’

‘দূর, এসব কাজ শিখে কি উন্নতি করা যায়! পঁচিশ—তিরিশ বছর কাজ করছে এক—একজন আর মাইনে কিনা দুশো—আড়াইশো।’

‘তা হলে কী করবি?’ ভয়ে ভয়ে মা বলেছিল। ‘তবু কয়েকটা টাকা তো আসছে।’

‘চল্লিশ আবার টাকা নাকি? গয়নাগুলোর কিছুই তো আর রইল না, এরপর…’

‘পোস্টাপিসের কাগজ না ভাঙালে আর তো কোনো উপায় নেই। দাসেদের বাড়িতে কাজটা নিলে তবু…এখন আর অত মানসম্মান দিয়ে কী লাভ? ভগবান যখন যে—অবস্থা দেবেন সেইভাবেই তখন চলতে হবে।’

‘টাকাটা অনু—অলুর বিয়ের জন্য।’

‘বারবার তুই ওই বলিস। খেতে—পরতে পাচ্ছি না আর বিয়ের জন্য টাকা রেখে দেওয়া। রাখোতো ওসব কথা। যেমন ভাগ্য করে এসেছে তেমনি বিয়ে হবে। কবে তুই আয় করবি, অমর করবে, তার জন্য অপেক্ষা করে কি সংসার চলবে? অনুকে স্কুল ছাড়িয়ে দেব, মিছিমিছি টাকা নষ্ট করা। ও নিজেও আর পড়তে চাইছে না।’

‘সে কী, ছেড়ে দেবে পড়া?’

অনন্ত মর্মাহত হয়েছিল। অনু তখন শাড়ি পরে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘আর পড়বি না?’

‘না।’

অনুর স্বরে জেদ ছিল। সংসারকে সাহায্য করতে চায়। কিন্তু ক—টা টাকাই বা তাতে বাঁচবে? ভালো ঘর—বর পাবার কোনো যোগ্যতাই ওর নেই। সাদামাটা, স্বাস্থ্য নেই, চটক নেই, লেখাপড়াও ক্লাস সিক্স। শুধু অনু নয়, অলুরও বিয়ে দিতে হবে কিন্তু কীভাবে যে পারবে তা সে জানে না। অমর নাকি দুটো টিউশনি করছে। ষাট—সত্তর টাকা নিশ্চয় হয়। কাউকে কিছু বলেনি, কিছু চায়ও না। কলেজের মাইনে, বইপত্র, বা জামাপ্যান্ট কেনার জন্য হাত পাতে না। কিন্তু তাতেও কি কোনো সাশ্রয় হচ্ছে। শুধু আধ—পেটা খেয়ে থাকতেই তো কম করে মাসে দেড়শো—দুশো টাকা দরকার। সার্টিফিকেটগুলো না ভাঙালে উপোস দিয়ে মরতে হবে।

দমকা বাতাস গাড়ি বারান্দার নীচে দাঁড়ানো লোকগুলোকে বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিল। গৌরী সরে এল তার গা ঘেঁষে।

‘তুমি এখানে কোথা থেকে?’

‘একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলুম, পেলুম না।’

‘মনে হল তুমি বাস থেকে নামলে।’

‘না তো, এতক্ষণ ওধারে মুদি দোকানের সামনে একটা ছোট্ট বারান্দার নীচে দাঁড়িয়েছিলুম। দেখছ কীরকম ভিজে ঢোল হয়ে গেছি!’

‘জ্বর হতে পারে।’

‘আমার অভ্যেস আছে ভেজার।’

অনন্ত আড়চোখে দেখল কয়েকজনের নজর গৌরীর বুকের উপর গেঁথে রয়েছে। সে একটু সরে গৌরীকে আড়াল করল।

‘তোমাকে আর দোকানে দেখি না যে?’

‘ভালো লাগে না তাই যাই না।’

‘তোমার নাকি বিয়ে?’

‘কে বলল?’

‘তোমার ভাই।’

‘অ।’

দু—জনেই চুপ করে রইল। রাস্তার আলোয় বৃষ্টিকণা বরফের মতো ঝলসে উঠছে। অনন্তের গায়ে কাঁটা দিল ঠান্ডা বাতাসে। গৌরী লেপটানো ফ্রক দেহ থেকে ছাড়ানোয় ব্যস্ত। রাস্তার মাঝে গোছ ডুবে যাওয়ার মতো জল জমে গেছে। গাড়ি চলে যাওয়ামাত্র ঢেউ এসে ফুটপাথের উপর ভাসিয়ে দিচ্ছে। ওরা পিছিয়ে বাড়ির দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াল।

‘জোর করে বিয়ের ব্যবস্থা করেছে।’

‘এত তাড়াতাড়ি?’

‘আমিও তো তাই বলেছি। বাবা—ই শুনছে না…বোধ হয় আঁচ পেয়েছে।’

‘কীসের?’

‘রমেনদার সঙ্গে আমার ব্যাপারটা।’

‘কী ব্যাপার?’

‘থাক, আর ন্যাকামোয় দরকার নেই। ব্যাপার কাকে বলে যেন উনি জানেন না!’

অনন্ত কথা বলল না। গৌরীর ভিজে চুল থেকে সে নারকেল তেলের গন্ধ পাচ্ছে। তার কনুইয়ের সঙ্গে দু—বার ছোঁয়া লাগল গৌরীর বাহুর। মা বা বোনেদের ছাড়া আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ের এত কাছে সে দাঁড়ায়নি। অদ্ভুত ধরনের একটা প্রফুল্লতা আর সাহস তার ভিতরে তৈরি হয়ে যাচ্ছে অথচ সে জানে গৌরীর মনে তার জন্য আলাদা কোনো জায়গা নেই। নেহাতই রোজ দেখা হতে হতে যতটুকু আলাপ। তাদের বয়সটা কাছাকাছি। গৌরী স্বভাবে খোলামেলা, কথা বলতে ভালোবাসে। বোধহয় লেখাপড়া একদম করেনি।

বৃষ্টি ধরে আসছে। অনেকেই হাত বাড়িয়ে দেখে নিচ্ছে কতটা কমেছে। কয়েকজন গাড়িবারান্দা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। জায়গাটা ফাঁকা হয়ে আসছে দেখে অনন্ত অস্বস্তিবোধ করে বললে, ‘তুমি তো এবার বাড়ি যাবে?’

‘হ্যাঁ যাব, তুমিও তো যাবে।’

‘আমার খুব একটা তাড়া নেই। আমি এ—রাস্তা ও—রাস্তা করে বাড়ি যাই।’

‘বাড়িতে কে কে আছে?’

‘মা আর দুই বোন। একটা ভাই ছিল সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। তোমায় তো বলেইছি আমার বাবা নেই…বাস চাপা পড়ে মারা গেছে।’

‘আহ।’

অনন্তের মনে হল গৌরীর মুখ থেকে শব্দটা স্বাভাবিকভাবেই বেরিয়ে এসেছে।

‘চলো এবার হাঁটি, তুমি তো এখন সোজা শ্রদ্ধানন্দ পার্কের দিকে যাবে, আমি যাব একেবারে উলটোদিকে, বিবেকানন্দ রোড হয়ে, হেদোর পাশ দিয়ে।’

‘আগে একটু গরম চা খেয়ে নিলে বেশ হত, খাবে?’

‘আমি দিনে দু—কাপের বেশি খাই না।’

‘আমার জন্য নয় আজ এক কাপ বেশিই খাবে। চলো, একটু এগোলেই ঘোষ কেবিন।’

‘তুমি দেখছি এখানকার সব চেনো, আস বুঝি?’

গৌরী হাসল। ওরা ফুটপাথ দিয়ে জল ভেঙে চলতে শুরু করল। দু—জনেই হাতে চটি তুলে নিয়েছে। বৃষ্টি এখন গুঁড়ি গুঁড়ি। ফুটপাথ কোথায় শেষ হয়ে রাস্তা শুরু হয়েছে সেটা জলে ডুবে থাকায় বোঝা যাচ্ছে না।

‘দাঁড়াও আমি আগে রাস্তায় নামি।’

অনন্ত পা টিপে টিপে ফুটপাথের কিনারে এসে সন্তর্পণে রাস্তায় নেমে হাত বাড়িয়ে দিল : ‘হাতটা ধরে নামো।’

গৌরী তার হাত ধরে নামার সময় গর্তে পা দিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল। সে দু—হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়েই হাত সরিয়ে নিতে গেল। গৌরী আঁকড়ে ধরে রেখেছে তার হাত।

‘ধরে থাকো, আবার কোন গত্তে যে পড়ব কে জানে।’

অনন্তের মনে হচ্ছে হাতটা তার দেহের অংশ নয়। বুকের মধ্যে ধকধকানিটা এবার কানে তালা লাগিয়ে দেবে। লোমকূপগুলো এক—একটা আগ্নেয়গিরি হয়ে উঠেছে। এই প্রথম নারীদেহের কোমলতা সে অনুভব করল। নিজের অজান্তে সে গৌরীর কবজি অস্বাভাবিক জোরে চেপে ধরতেই মুখ তুলে গৌরী তাকাল, চোখে বিস্ময়। অনন্তের চোখ জ্বালা করছে, সে পরিচ্ছন্নভাবে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।

‘হাতটা ছাড়ো।’

সে দ্রুত হাতটা টেনে নিয়ে নিজের দেহের সঙ্গে চেপে ধরল।

‘আমি চা খাব না, আমার কাছে একটা পয়সাও নেই।’

‘আমার কাছে আছে।’

ঘোষ কেবিনে পাশাপাশি ওরা বসল। দু—জনেই ভিজে সপসপে। গৌরী ইশারায় দোকানের ছেলেটাকে ডাকল।

‘দুটো ডবল হাপ।’

‘আর কিছু দোব, ওমলেট, মটন চপ, মটন কাটলেট, মটন দোপেঁয়াজি, ফিশ ফ্রাই?’

গৌরী তাকাল অনন্তের দিকে। সে মাথা নাড়ল।

‘দুটো ফিশ ফ্রাই।’

ছেলেটি সরে যেতেই ফিসফিস করে অনন্ত বলল, ‘আমার কাছে সত্যিই পয়সা নেই।’

‘বললুম তো আমার কাছে আছে।’

‘তুমি পেলে কোথায়?’

‘যেখান থেকেই পাই না।’

‘কেউ দিয়েছে তোমায়?’

গৌরী চুপ করে রইল।

‘তোমার রমেনদা?’

এক চিলতে হাসি ওর মুখে ফুটে উঠল। সাদা পাথরের টেবলে আঙুলের টোকা দিতে দিতে মুখটা ঘুরিয়ে রাস্তার দিকে তাকাল।

‘মালাটাও ওর দেওয়া।’

‘দেখতে ভালো নয়?’

‘বাবা তো বিয়ে ঠিক করেছে, তা হলে কী করবে?’

‘করুক না ঠিক, আমি আমার ব্যবস্থা করব।’

‘কী ব্যবস্থা?’

‘সে এখন বলব না।’

‘তোমার রমেন এখানেই কোথায় যেন থাকে।’

‘হ্যাঁ আর একটু এগিয়ে বাঁ দিকের গলিটায়। ওদের বাসাতেই এসেছিলুম, বেরিয়ে গেছে কোথায়।’

‘তুমি প্রায়ই আস?’

‘হ্যাঁ।’

‘লোক কেমন, কী করে?’

‘ফরেন মাল খিদিরপুর থেকে এনে বিক্রি করে, আমাকে একটা আমেরিকান জর্জেট দিয়েছে, দারুণ শাড়িটা।’

‘তুমি আমার কাছে একটা আলুর দমের দাম নাওনি, মনে আছে? আবার আজকেও খাওয়াচ্ছ। তোমার কাছে আমার দেনা রয়ে গেল।’

‘শোধ দেবে বুঝি!’

‘হ্যাঁ, তবে এখন নয়। আগে হাতে টাকা আসুক।’

‘এরা কত দেয়?’

‘চল্লিশ টাকা।’

‘য়্যা, মোটে চল্লিশ।’

গৌরীর মুখে অবিশ্বাসের ছাপ দেখে অনন্ত লজ্জা পেল। মুখ নীচু করে আঙুল দিয়ে টেবলে আঁকিবুকি কাটতে লাগল। ছেলেটা টেবলে প্লেট নামিয়ে রাখতেই সে মুখ তুলল। আড়ষ্ট হাতে ছুরি দিয়ে ফ্রাইটা খণ্ড করতে করতে বলল, ‘যা জুটে গেল তাই করছি, চাকরির যা বাজার। শুধু শুধু বসে থাকার চাইতে তবু তো…তবে চেষ্টা করে দেখছি।’

ফ্রাইয়ের একটা খণ্ড মুখে দিয়ে আরামে সে চিবোতে লাগল। স্বাদটা বড়ো ভালো, খিদেও পেয়েছে খুব। গৌরীর ছুরি—কাঁটা ধরা দেখে সে বুঝতে পারছে তার মতো আনাড়ি নয়। হঠাৎ তার মনে পড়ল অনু—অলুকে। সে আজ বাজার থেকে যা এনেছে তাই রান্না হয়েছে। সকাল থেকে ভাত আর আলু—ঝিঙে—পোস্ত ছাড়া এখনও পর্যন্ত কিছু ওদের পেটে পড়েনি। মা পেট ভরে কখনোই খেতে পায় না। ছেলেমেয়েদের খাইয়ে কিছুই তো প্রায় থাকে না।

ফ্রাইটা আর তত স্বাদু মনে হচ্ছে না। পর পর মুখগুলো ভেসে উঠছে। ওরা যখন জানবে রেস্টুরেন্টে খেয়ে এসেছে তখন মনে মনে কিছু একটা নিশ্চয় ভাববে। যদি ভাবে সংসারের টাকা থেকে সরিয়ে সে খেয়েছে! গৌরী নামে একটা মেয়ে যে তাকে খাইয়েছে, এ—কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে?

তার বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিয়ে উঠল। একটু আগেও তার মনে হচ্ছিল আজকের দিনটা জীবনে মনে রাখার মতো একটা দিন। যতদিন বাঁচবে সে গৌরীর প্রত্যেকটি কথা, দেহের যাবতীয় নড়াচড়া, ওর চুলের গন্ধ, ওর চাহনি, হাসি, বিস্ময় সব স্মৃতিতে বাঁচিয়ে রেখে দেবে। তাই সে উদগ্রভাবে প্রতিটি মুহূর্তকে শুষে নিয়ে জমা করে রাখছিল তার চেতনার প্রতিটি কোষে। কিন্তু হঠাৎ কোষগুলোকে ফাটিয়ে দিল কতকগুলো শুকনো অবসন্ন মুখ।

‘আচ্ছা, এই যে খাচ্ছি। মুখে গন্ধ হবে?’

‘হবেই তো। পেঁয়াজ, রাই সর্ষে…গন্ধ হবে না?’

অনন্ত দমে গেল। সে ঠিক করল মশলা দেওয়া পান খাওয়াবার জন্য গৌরীকে বলবে।

‘তুমি ধুতি পরো কেন? এখনকার ছেলেরা তো প্যান্টই পরে।’

‘এটা বাবার ধুতি।’

‘মরা মানুষের জিনিস ব্যবহার করতে নেই।’

‘করলে কী হয়?’

‘কিছুই হয় না, তবে লোকটার কথা মনে পড়ে যায়। তোমার মনে পড়ে না বাবাকে?’

‘কই না তো! বাবা আমাদের সঙ্গে খুব কমই কথা বলত, আমরাও কাছে ঘেঁষতুম না।’

‘এক—একজন লোক ওইরকম হয়, ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারে না; আমার বাবাও ওইরকম।’

অনন্তের খাওয়া হয়ে গেছে। প্লেটে পড়ে আছে শুধু স্যালাড। খুঁটে খুঁটে সে বিট আর গাজরের কুচি মুখে দিতে লাগল পেঁয়াজ বাদ দিয়ে। গৌরী দু—আঙুল তুলে ছেলেটাকে বলল ‘চা।’

অন্য টেবলগুলো ভরে আছে। তাদের টেবলেও মুখোমুখি অফিসফেরত দু—জন দু—কাপ চা নিয়ে বসে। তারা বৃষ্টি, রাস্তায় জমা জল নিয়ে কথা বলছে আর মাঝে মাঝে নিরাসক্তচোখে, গৌরীর দিকে তাকাচ্ছে।

‘আমার ছাদটা ফাটা, শোবার ঘর বোধ হয় ভেসে গেছে।’

লোকটিকে উদবিগ্ন মনে হলেও ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছে না বাড়ি যাবার জন্য। মনে হয় রোজই এই সময় এখানে এসে চা খায়।

অনন্ত গরম চায়ে চুমুক দিয়েই চমকে কাপ সরিয়ে নিল।

‘জিব পুড়ল তো?’

‘এত গরম বুঝতে পারিনি।’

সে প্লেটে চা ঢেলে ফুঁ আ দিয়ে জুড়িয়ে নিআয়ে খেল। গৌরী তাই দেখে শুধু হাসল।

দরজার কাছের টেবলে দোকানের মালিক বসে। গৌরী ফ্রকের গলা দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ব্রেসিয়ারের ভিতর থেকে ছোটো একটা চামড়ার ব্যাগ বার করল।

‘তিন টাকা চল্লিশ।’

অনন্ত কৌতূহল সামলাতে না পেরে আড়চোখে দেখল ব্যাগটার মধ্যে ভাঁজ করা কয়েকটা দু—টাকার নোট। পাঁচ টাকার নোটের রংও দেখতে পেল। দুটো দু—টাকার নোট গৌরী টেবলে রাখল। মৌরি রাখা প্লেটে মালিক একটা আধুলি আর দশ পয়সা রাখল। ছেলেটা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। গৌরী আধুলিটার সঙ্গে খানিকটা মৌরিও তুলে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। ইতস্তত করে অনন্তও দু—আঙুলের চিমটেয় মৌরি তুলল।

‘দশ পয়সাটা নিলে না যে, বকশিশ?’

‘হ্যাঁ।’

‘সেলাম করল না তো!’

‘দশ পয়সায় আবার সেলাম দেবে কী!’

রাস্তায় জল, ফুটপাথেও পায়ের গোছ ডুবে যাচ্ছে। জলের মধ্যে পা টেনে টেনে সাবধানে গর্ত খুঁজে খুঁজে লোকেরা হাঁটছে। বৃষ্টি—ধোওয়া গাছের পাতাগুলো ছাড়া আর সব কিছুই ম্লান। ঘোষ কেবিনের নিওন আলোয় গৌরীর গায়ের চামড়া ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ভিজে চুল মাথায় বসা। ফ্রকটা ন্যাতার মতো শরীরে ঝুলছে।

‘কোনদিকে যাবে, বাড়ি?’

‘হ্যাঁ। তুমিও?’

‘চলো তোমার সঙ্গে খানিকটা যাই।’

অনন্ত একবার ভাবল, চটি হাতে তুলে নেবে কি না। সাত মাস আগে চার টাকা দিয়ে ফুটপাথের দোকান থেকে কেনা। স্ট্র্যাপ ঢিলে হয়ে গেছে জল ঠেলে যেতে যেতে যদি খুলে যায়! গৌরীর পায়েও চটি কিন্তু হাতে তুলে নেয়নি। সে আর চটির কথা ভাবল না। ধুতিটা হাঁটু পর্যন্ত গুটিয়ে গৌরীর পাশাপাশি হেঁটে চলল।

‘তোমার সঙ্গে বোধহয় কারোর ভাব নেই।’

অনন্ত বুঝতে পারল না গৌরী কী বলতে চায়। সে মাথা নেড়ে বলল, ‘না, আমি ছেলেদের সঙ্গে বড়ো একটা মিশি না।’

‘ছেলে নয় মেয়ে। কারোর সঙ্গে তোমার ভাব নেই?’

অপ্রতিভ হল অনন্ত। ভাব থাকাটা ভালো না মন্দ, উচিত কি অনুচিত, সে বুঝতে পারছে না।

‘নাহ, ওসব আমার নেই।’

‘কী নেই?’

গৌরী মুখ ফিরিয়ে তাকাল। ওর চোখে হাসি। একটা বাচ্চচা ছেলে ছুটে আসছে জল ছিটিয়ে। তাদের সামনে যে—লোকটি যাচ্ছে সে ধমক দিয়ে উঠল। বোধহয় ছেলেটা শুনতে পেল না বা অগ্রাহ্য করল। গৌরী কাছে সরে এল। অনন্ত থমকে হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে ধরতে গিয়ে পারল না।

‘তুমি খুব ভালো ছেলে।’

‘কী করে বুঝলে!’

‘সে বুঝতে পারি। তুমি একদমই চ্যাংড়া নও!’

‘আমার ঘাড়ের উপর একটা সংসার। তাদের দেখতে হবে তো।’

ওরা কিছুক্ষণ কথা বলল না। যত এগোচ্ছে ফুটপাথের জল ক্রমশই কমে আসছে। ট্রাম বন্ধ। স্টপে এক—একটা বাস থামছে আর ঝাঁপিয়ে পড়ছে মানুষ। গাড়ি আর পথচলতি লোকে রাস্তাটা বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। দু—ধারে জল জমে থাকায় রাস্তার মাঝখান দিয়ে রিকশা আর লোক চলছে। বাস, ট্যাক্সি বা বাড়ির মোটরের গতি মন্থর স্রোতের মতো মানুষ হেঁটে চলেছে শিয়ালদার দিকে।

দু—জনে ফুটপাথের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রাস্তাটার জটপাকানো অবস্থা দেখছিল।

‘তোমাকে একটা কথা বলব, কাউকে এ—পর্যন্ত কিন্তু বলিনি।’

‘কী কথা?’

গৌরী কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, ‘রমেনদার সঙ্গে আমি চলে যাব।…দমদমায় ঘর দেখে এসেছে।’

‘সে কী!’

‘কেন, মেয়েরা কি ভালোবেসে ঘর ছাড়ে না?’

‘তোমার বয়স কত?’

‘বয়স দিয়ে কী এসে যায়?’

‘তোমার বাবা রেগে যাবে।’

‘যাবে তো যাবে, আমার তাতে বয়েই গেল।’

‘তোমার বিয়ে ঠিক করেছে।’

‘কে করতে বলেছে? হাওড়ায় কোন এক গ্রামের ছেলে চাষা না কুলি কে জানে… রমেনদাকে বাবা কেন যে দেখতে পারে না জানি না।’

‘যদি পুলিশে খবর দেয়?’

‘দিক না, খুঁজে পেলে তো! তুমি কিন্তু কাউকে বোলো না।’

‘না।’

অনন্ত নিজের সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল। গৌরী তাকে বিশ্বাস করেছে। নিশ্চয় কিছু একটা তার মধ্যে পেয়েছে বলেই। এইরকম আস্থা তার উপর এখন পর্যন্ত কেউ তো রাখেনি। কিন্তু রমেন লোকটাকে তার ভালো লাগেনি। গৌরীর উচিত হবে না ওর সঙ্গে চলে যাওয়া। তার মনে হল কথাটা বোধহয় এখন বলা ঠিক হবে না। সাহস করে ঘর ছাড়ছে, অমরও তাই করেছে।

মা কালকেও অমরের কথা বলেছে : ‘ছেলেটা কোথায় গেল একটু খোঁজ কর।’ সে বলেছিল, ‘কচি—খোকা নয়, ঠিকই আছে কোথাও, এখানের থেকে হয়তো ভালোই আছে।’

গৌরীর বাড়িতেও এইভাবে কথা হবে নিশ্চয়।

‘তোমার মা কষ্ট পাবে।’

‘তা পাবে। আমি চিঠি লিখে যাব।’

‘কবে যাবে?’

‘এখনও দিনটিন ঠিক করিনি, টাকাপয়সা ব্যবস্থা করার ব্যাপার আছে তো, সংসার পেতে বসার জন্য সবই তো কিনতে হবে।…তোমায় যাবার আগে বলব। এখন যাই, আর আসতে হবে না।’

‘আমায় বলবে কী করে?’

‘ভাইয়ের হাতে চিঠি দোব, যখন খেতে আসবে তোমায় দেবে…চলি।’

গৌরী রাস্তা পার হয়ে চলে যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্য দিয়ে তার নিতম্বের দোলা, আর ফ্রকের গাঢ় নীল ফুলছাপ আর ভিজেচুল যতক্ষণ দেখা যায় অনন্ত দেখার চেষ্টা করল। আশা করেছিল একবার অন্তত পিছন ফিরে তাকাবে, কিন্তু গৌরী তাকায়নি। এতক্ষণ যে মৃদু আঁচ তার মনকে তাজা ঝরঝরে করে রেখেছিল গৌরী চলে যাওয়ামাত্র সেটা নিবে আসছে। ওর চলে যাওয়ার মধ্যে কেমন একটা নিষ্ঠুর ভঙ্গি রয়েছে যাকে বলা যায় কাঠিন্য। তবে ওর মায়া—মমতাও আছে। একবার আলুর দমের দাম নেয়নি, আজও ফ্রাই খাওয়াল। অথচ কী এমন তার সঙ্গে পরিচয়? পাঁচ মাস ধরে দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য দেখা হওয়া আর কয়েকটা সাধারণ কথাবার্তা! কত সহজভাবে তার সঙ্গে কথা বলল আজ। কত তাড়াতাড়ি তাকে বিশ্বাস করেছে, নয়তো বাড়ি থেকে পালাবার কথা কি বলত?

একটা গুপ্ত খবর জেনে যাওয়ার এবং সেটাকে কোনোমতেই প্রকাশ না করার সংকল্প থেকে তৈরি হওয়া চাপ তার মধ্যে উত্তেজনা এনে দিয়েছে। বাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে হাঁটতে অনন্তের মনে পড়ল পান খাওয়াবার জন্য গৌরীকে আর বলা হল না। মুখে কি গন্ধ হয়েছে? নিজের মুখের গন্ধ টের পাওয়া যায় না। হাতের চেটোয় ভাপ দিয়ে সে শুঁকল, কিছু বুঝতে পারল না। তাইতে অস্বস্তিবোধ করতে লাগল। সে ঠিক করল আজ সবার সঙ্গে দূর থেকে কথা বলবে। মুখটা অন্যদিকে ঘোরাবে মা যখন ঝুঁকে থালায় কিছু দিতে থাকবে।

কিংবা বলেই দেবে গৌরী তাকে খাইয়েছে। কে গৌরী? চাওয়ালার মেয়ে, রোজ ওর সামনে বেঞ্চে বসে আলুর দম দিয়ে রুটি খাই, তখন কথাবার্তা বলি। নানান রকমের কথা, সিনেমা, জামাকাপড়, হাঁটার স্টাইল, পুরুষদের কতরকমভাবে মেয়েদের দিকে তাকানো, বাড়িওয়ালাদের বদমাইশি, আরও অনেক রকম কথা। খুব ভালো মেয়ে, একদমই গায়েপড়া নয়। বয়স? প্রায় সমানই কিংবা দু—এক বছরের ছোটো।

মা কীভাবে নেবে? খারাপ কিছু ভাববে কি? সন্দেহ করার মতো মন মায়ের নয়। তা যদি হত তা হলে নিশ্চয় জেনে যেত মিনু নামে একজনের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক ছিল।

অনন্ত যখন বাড়ি পৌঁছল শীলা তখন অবিনাশের সঙ্গে কথা বলছে। অনু ঘরে নেই, বোধহয় পাশের বাড়িতে কিংবা দোতলায় আর অলু তক্তাপোশের এককোণে কাত হয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ছে। ভিজে শার্ট আর ধুতি উঠোনের তারে মেলে দিয়ে অনন্ত ঘরে আসতেই অবিনাশ বলল, ‘রাস্তার জল কমেছে?’

‘এদিকে বিশেষ জল জমেনি। আমাদের ওদিকটায় খুব জমেছে!’

‘ঠাকুরপো অনেকক্ষণ এসেছেন, অফিসে নাকি লোক নেবে, তাই বলছিলেন…

‘কিন্তু ও তো স্কুল ফাইনালটাও পাশ করেনি, টাইপও জানে না।…তাই বলছিলুম প্রাইভেটে পরীক্ষাটা দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে আর সেইসঙ্গে টাইপটাও শিখে নিলে ভালো। এমপ্লয়ির ছেলে, ধরাধরি করলে হয়ে যাবে। ইউনিয়নও এসব ক্ষেত্রে বাগড়া দেবে না, আমি কথা বলেছি। তুই সামনের বছরই পরীক্ষা দেবার জন্য তৈরি হ। এখানে না হোক অন্য কোথাও চেষ্টা করা যাবে। কোয়ালিফিকেশন না থাকলে তো কোথাও কিছু পাবি না। দপ্তরির কাজ করে কত টাকা আর পাবি, নিজে কারবার খুলেও যে কিছু করবি তা—ও সম্ভব নয়।’

‘না, আমি দপ্তরিখানা ছেড়ে দেব, এখানে আমার ভবিষ্যৎ নেই।’

অনন্ত ভারী গলায় বিজ্ঞের মতো তার সিদ্ধান্ত জানাল। শীলা চকিতে একবার অলুর দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘মেয়েদের বিয়ের টাকা ভাঙিয়ে খাচ্ছি। তা—ও তো একদিন শেষ হয়ে যাবে, তারপর?’

অবিনাশ মেঝের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর হল। অনন্ত একদৃষ্টে দেওয়ালে চোখ রাখে, কোলের উপর হাতদুটি। শীলা এই নীরবতাকে ভাঙার চেষ্টা করল না।

‘অমরকে যেতে দেওয়া ঠিক হয়নি।’

দু—জনে অবিনাশের মুখে জিজ্ঞাসু চোখ রাখল।

‘ওকে ওইভাবে অপদস্থ করা অনন্তর উচিত হয়নি…জীবনে এসব জিনিস বহু ঘটে, সামান্য ব্যাপার, তাই নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি…ছেলেটার মনে খুবই লেগেছে।’

অনন্ত মাথা নামাল। তারও একসময় মনে হয়েছিল, সে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। অনুতপ্ত বোধ করে ভেবেছিল অমরের খোঁজ নেবে পাড়ায় ওর বন্ধুদের কাছে অথবা কলেজে। কিন্তু কিছু সে করেনি।

‘কোথায় গেছে?’

‘জানি না!’

‘ও থাকলে, চার—পাঁচ বছরের মধ্যেই সংসারটাকে মোটামুটি নিশ্চিন্ত করে দিতে পারত।’

অনন্তের মনে হল, আর একটা বোঝা তার ঘাড়ে এসে পড়ল। সংসারের নিশ্চিন্ত হওয়ার একটা পথ ছিল কিন্তু তার জন্যই সেই পথ হারিয়ে গেল। এখন তার উপরই দায়িত্ব পড়ল আবার পথ বার করে নিশ্চিন্তি এনে দেওয়ার। নিশ্চিন্তি মানে টাকা রোজগার করতে হবে কিন্তু কীভাবে করবে?

‘আমাকে তা হলে স্কুল ফাইনাল পাশ করতে হবে?…কিন্তু আমি তো সব ভুলে গেছি।’

তার করুণ স্বর অবিনাশের গম্ভীর মুখে হাসি ফোটাল। অলু একবার বই থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল।

‘বই জোগাড় কর। পারিস তো একটা কোচিংয়ে ভরতি হয়ে যা। রোজ যদি ঘণ্টাচারেক করেও বই নিয়ে বসিস তা হলে ছ—মাসেই তৈরি হয়ে যাবি, পারবি না?’

অনন্ত শুধু তাকিয়ে রইল। ঠিক এইভাবে এই ঘরেই সে একদিন শুনেছিল, ‘ভাগ্য যদি অন্যরকম অবস্থায় ফেলে দেয় তা হলে আর কী করার থাকতে পারে। মা—কে দেখা, ভাইবোনদের মানুষ করে তোলা, নিজেকে নিজে বড়ো করা…’

সে মুখ নামিয়ে বুকের মধ্যে আটকে রাখা বাতাস নাক দিয়ে বার করার সময় বলল, ‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? তোর মতো ভালো ছেলের না পারার তো কথা নয়!’

‘পারবে না কেন, খুব পারবে।’

শীলা এমন এক সরল প্রত্যয় নিয়ে বলল যে ভয় পেয়ে অনন্ত রেগে উঠল। তীক্ষ্ন—চোখে সে তাকাল।

‘আমার পড়াশুনোর ব্রেন নেই, থাকলে কি ফেল করতুম?’

‘তোকে তো ফার্স্ট—সেকেন্ড হতে হবে না, শুধু পাশটা করতে হবে চাকরি পাবার জন্য। খাটলেই পাশ করা যায়।’

অনন্ত আবার মুখ নামিয়ে ফেলল। তাকে আবার বই নিয়ে বসতে হবে। আবার অঙ্ক, গ্রামার, এসে, সংস্কৃত, লেটার রাইটিং, মুখস্থ আর মুখস্থ। ভালো ছেলেরা পারে, পারতেই হয়, তাদের বড়ো হতে হয়, সবাইকে দেখতে হয়।

ক্লান্তচোখে সে তার ভবিষ্যৎ জীবনের দিকে তাকিয়েই যেন বলল, ‘ঠিক আছে।’

পাঁচ

ছ—মাসে নয়, অনন্ত প্রথমবার ফেল করে পরের বার কোনোক্রমে পাশ করেছিল। কিন্তু তারই মধ্যে জীবন একটা বাঁক নিয়ে কিঞ্চিৎ স্বস্তি এনে দেয় তাদের সংসারে। সে আড়াইশো টাকার একটা চাকরি পেয়ে যায়।

সেদিন অশোকবাবুর কোচিং থেকে ফিরতে তার রাত হয়ে গেছল। তাকে আটকে রেখেছিলেন একটা প্যাসেজ ইংরেজিতে নির্ভুল অনুবাদ করাবার জন্য। একসময় বিরক্ত হয়ে তিনি বলে ওঠেন, ‘বাড়ি যা, তোর দ্বারা এসব হবে না। তোর ভাইয়ের পেছনে এর ওয়ান—টেন্থও খাটতে হয়নি অথচ কী রেজাল্ট করল, আর তুই…’

অনন্ত বিষণ্ণমনে বাড়ি ফেরার সময় ঠিক করে ফেলে প্রত্যেকদিন ভোরবেলায় সে একপাতা করে গ্রামারও মুখস্থ করবে।

বাড়িতে পা দেওয়ামাত্র শীলা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘উৎপলদের চাকরটা তোকে ডাকতে এসেছিল, ওর বাবার কী যেন দরকার তোকে। এলেই যেতে বলেছে, কীজন্য তা আর বলল না।’

অনন্ত অবাক হয়ে বলল, ‘আমাকে! ব্যাপার কী? আমার সঙ্গে তো ওনার জীবনে কখনো কথা হয়নি।’

তারপরই মনে পড়ল সন্দেশগুলো সে ওঁকেই ফেরত দিয়েছিল, তখনই প্রথম দু—চারটে কথা বলেছিলেন। উৎপলের বাবা সাধন বিশ্বাস পেশায় অ্যাটর্নি। কাঁচাপাকা চুল, কখনো ইস্ত্রিবিহীন পাঞ্জাবি বা পাজামা পরেন না। গালদুটি সর্বদা মসৃণ, পায়ে চটি। একটা ভক্সহল মোটরে অফিসে বেরোন। সন্ধ্যার পর একতলার ঘরে ওঁকে দেখা যায়। চামড়ামোড়া গদির চেয়ারে বসে লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে। ঘরের এককোণে পিছন ফিরে একটা লোক টাইপ করে যায় রামকৃষ্ণদেবের ছবিটার নীচে চেয়ারে বসে।

‘গিয়ে দেখ না একবার, ঘরে তো আলো জ্বলছে।’

শীলার মতো অনু—অলুও উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে। সে নিজেও কৌতূহলী হয়ে উঠেছে ওদের মতো।

সাধন বিশ্বাসের ঘরের দরজা থেকে সে সন্তর্পণে উঁকি দিল। টাইপিস্ট তার কাজে ব্যস্ত। সাধন বিশ্বাস চেয়ারে হেলান দিয়ে মনোযোগে কী একটা পড়ছেন। সে বুঝে উঠতে পারছে না এখন তার কী করা উচিত।

উনি মুখ তুললেন এবং দ্রুত আড়ালে সরে—যাওয়া অনন্তের উদ্দেশে বলে উঠলেন, ‘কে ওখানে?’ সাড়া না পেয়ে আবার বললেন, ‘ওখানে কে?’

‘আমি সামনের বাড়ির অনন্ত।’

চেনার জন্য কয়েক সেকেন্ড মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘ও, এসো।’

অনন্ত পা টিপে ঘরে ঢুকল। মোজাইকের ঝকঝকে মেঝেয় ফুলের নকশা, মাড়াতে অস্বস্তি হয়। চেয়ারের পিঠ ধরে সে দাঁড়াল।

সাধন বিশ্বাসের ঠোঁটে হাসি দেখে সে বিভ্রান্ত হল, কোনো ধারণায় আসতে পারছে না কেন তাকে ডেকেছেন!

‘দেরি করলে যে?’

‘কোচিং থেকে ফিরতে ফিরতে…’

‘কী পড়তে যাও?’

‘প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল দোব…দেবার ইচ্ছে আছে।’

‘সারাদিন কী করো?’

‘একটা দপ্তরিখানায় কাজ শিখতে যাই।’

‘অ্যাপ্রেন্টিস?…কত পাও?’

অনন্তর চোখে ভেসে উঠল গৌরীর মুখটা আর সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেল, ‘য়্যাঁ, মোটে চল্লিশ!’ টাকার পরিমাণটা অসম্মানজনক, যে—কেউ শুনলেই তার সম্পর্কে ধারণা নীচে নামিয়ে দেবে।

‘কমই দেয়…একশো চল্লিশ।’

একবার মুখের দিকে তাকিয়ে সাধন বিশ্বাস কলমটা টেবলে ঠুকতে শুরু করলেন। অনন্ত ভয় পেল, মিথ্যাটা কি ধরে ফেলেছেন? হয়তো কোনোভাবে শুনেছেন কত পায়।

‘একটা চাকরি আছে সৎ আর বিশ্বাসী লোক দরকার, তোমার কথা মনে পড়ল। করবে?’

‘কী কাজ?’ অনন্তের শ্বাসকষ্ট শুরু হল।

‘আমার বন্ধু আবার ক্লায়েন্টও, কলকাতায় অনেক বিষয়সম্পত্তি আছে, বস্তি আছে একটা, বাড়ি আছে গোটাচারেক, নতুন একটা ফ্ল্যাটবাড়িও তৈরি করছে পার্ক সার্কাসে, শিবপুরে পেট্রল পাম্প, দেশে জমিজমা সিনেমা হল আছে, তা ছাড়া কয়লার ব্যবসা ওষুধের দোকান…নিজে কিছুই দেখে না, বনেদি বড়োলোক হলে যা হয়, কর্মচারীরাই সব দেখে আর দু—হাতে চুরি করে…সে থাক গে, ওর এস্টেটে একটা চাকরি খালি আছে, করবে?’

‘কী চাকরি?’

‘ভাড়া আদায় করার। এতকাল যে করত তাকে সরিয়ে ওষুধের দোকানে বসাচ্ছে, বাবার আমলের লোক তাই আর ছাড়ায়নি। কাজটা টাকাপয়সা নিয়ে। ভাড়া কালেকশন করতে টেনান্টদের ঘরে ঘরে যাওয়া, ভাড়াটেদের দেখাশোনা, বাড়ির মেরামতি, ট্যাক্স দেওয়া, আদায়ের হিসাবপত্তর রাখা, টাকা জমা দেওয়া, এই হল কাজ। কিন্তু চুরির সুযোগ আছে তাই একজন সৎ বিশ্বাসী লোক এখুনি চাই। আজই কথা হচ্ছিল, আমি বলেছি আমার জানা একটি ভালো ছেলে আছে, সামনের বাড়িতেই থাকে।…করবে?’

উনি কী করে জানলেন আমি ভালো ছেলে? অনন্ত অবাক হল। বোধহয় সন্দেশ ফিরিয়ে দেওয়ার ঘটনা থেকেই ওঁর ধারণা হয়েছে। বহুদিন সে মনে মনে আক্ষেপ করেছে, অমরকে ভাবে চোর প্রতিপন্ন না করালেও হত, হাজার হোক ভাই তো কিন্তু এখন তার মনে হল শাপে বরই হয়েছে।

‘হ্যাঁ করব।’ কোনোক্রমে কথাটা সে বলতে পারল। হাঁটুদুটো মাখনের মতো লাগছে হয়তো সে দুমড়ে পড়ে যাবে। চেয়ার আঁকড়ে থাকা আঙুলগুলোর গাঁট টনটন করে উঠল।

‘এখন যা পাচ্ছ তার থেকে বেশিই যাতে পাও দেখব। বোসো, একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, কালই কি যেতে পারবে? সকাল দশটার পর…তার আগে ঘুম থেকে ওঠে না।’

অনন্ত মাথা হেলাল কিন্তু চেয়ারে বসল না। সাধন বিশ্বাস কলমদানি থেকে লাল কলমটা তুলে তাঁর নাম ছাপা প্যাডে যতক্ষণ ধরে চিঠি লেখায় ব্যস্ত রইলেন ততক্ষণ নিজের হৃৎপিণ্ডের ধকধকানি ছাড়া আর কিছু শুনতে পেল না, চোখে একটা ঝাপসা পর্দা নেমে এসেছে যার ওধারে সাধন বিশ্বাসকে ছায়ার মতো লাগছে।

চিঠিটা চার ভাঁজ করে এগিয়ে দিলেন।

‘দেরি কোরো না কালই যাও।’

টেবলটা দ্রুত ঘুরে গিয়ে অনন্ত নীচু হল প্রণাম করতে। হরিণের চামড়ার চটির মাথায় পা ঢোকানো। গোড়ালিদুটো যেন শ্বেতপাথরের। চামড়ার উপর আঙুল বোলানোর সময় শিরশির করে উঠল তার মেরুদণ্ড।

‘থাক থাক…ভালো করে কাজ কোরো।’

‘কোথায় যেতে হবে?’

‘খুব বেশি দূরে নয়, রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে পরেশনাথ মন্দিরের কাছেই, ঠিকানা লিখে দিয়েছি…সমীরেন্দ্র বসুমল্লিক, ফটকে লেখা আছে অঘোর এস্টেট…ওর ঠাকুরদার নাম।

সদর দরজায় অনু দাঁড়িয়ে, তার পাশে শীলা। তার জন্যই অপেক্ষা করছে। সাধন বিশ্বাসের ঘরটার আধখানা এখান থেকে দেখা যায়।

‘দাদা, তোকে কী লিখে দিল রে?’

অনন্ত দু—জনের মুখের দিকে বিহ্বলচোখে তাকিয়ে শুধু বলল, ‘ভগবান আছে।’

তিনজনে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। চেয়ারে হেলান দিয়ে সে প্রত্যেকের মুখের দমবন্ধ কৌতূহল তারিয়ে তারিয়ে চাখল।

‘বললেন একটা চাকরি আছে, করবে?’

‘কী বললি?’

‘করব বললুম।’

‘কোথায়, কীসের চাকরি, কত দেবে?’

সেদিন রাতে অনন্ত ঘুমের মধ্যে বার বার ছটফট করল। সকালে ঘুম ভেঙে যেতেই সে পাশের ঘরে কথাবার্তার শব্দ পেল।

‘ইস্ত্রি না করলে এই পরে যাবে নাকি? চেয়ে আন ইস্ত্রিটা। চটি জোড়ায় কালি দিয়ে দে।’

রাতে উঠোনে ধুতি আর শার্ট নিয়ে মা সাবান দিতে বসে। দোতলা থেকে তখন জেঠিমা চেঁচিয়ে বলেছিল, ‘এত রাতে কাচাকুচি করছ যে?’

‘অনন্ত কাল নতুন চাকরিতে জয়েন করবে।’

চিত হয়ে অন্ধকার ঘরে সে হেসেছিল। চাকরিই হল না আর কিনা জয়েন?

‘কোথায় গো?’

‘এক জমিদারের আপিসে।’

অঘোর—এস্টেট খুঁজে নিতে অনন্তর অসুবিধা হয়নি। লোহার ফটক থেকে মাটির পথ অর্ধবৃত্তাকারে ঘুরে বারান্দার নীচে পৌঁছেছে। টানা তিন ধাপ সিঁড়ি, ডান দিকে বেলেপাথরের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে, বাঁদিকে পরপর কয়েকটা ঘর, সামনে পাথরের উঠোন আর ঠাকুর দালান।

সিঁড়ির পাশে একটা বেঞ্চে দুটি লোক বসে। চাহনি আর বসার ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় বাইরের লোক, কোনো কাজের জন্য এসেছে। বাঁদিকের ঘরগুলো থেকে লোকজনের গলা পাওয়া যাচ্ছে। অনন্ত উঁকি দিয়ে দেখল প্রথম ঘরটার অর্ধেক জুড়ে নীচু তক্তাপোশ, তাতে শতরঞ্চি পাতা। জানলার কাছে বাবু হয়ে বসে এক প্রৌঢ়, কোলের কাছে রাখা ডেস্কে ঝুঁকে একটা কাগজ থেকে দেখে দেখে খাতায় লিখছে। ঘরের কড়িকাঠ থেকে লোহার শিকে আটকানো দু—সারি কাঠের তাক ঝুলছে, মোটা মোটা ধুলো লাগা খাতা আর কাগজপত্রে সেগুলো ঠাসা। পাশের ঘরটায় কয়েকটা টেবল—চেয়ার। নানানরকমের কাগজে আর খাতায় টেবলগুলো ভরা। দেখে মনে হয় না ওগুলো কখনো নাড়াচাড়া করা হয়েছে। দুটো স্টিলের আলমারি ছাড়াও কাঠের র‌্যাক তিনদিকের দেওয়াল ঢেকে ফেলেছে। এখানেও খাতা আর কাগজ। পুরোনো একটা পাখা কিচকিচ শব্দ করে ঘুরছে। পিছন ফিরে একটি লোক চেয়ারে বসে।

অনন্ত বুঝতে পারছে না সমীরেন্দ্র বসুমল্লিকের সঙ্গে সে কীভাবে দেখা করবে। কোনো চাকর বা দারোয়ানকে দেখতে পাচ্ছে না। এত বড়োলোক এত বিষয়সম্পত্তি, সে ভেবেছিল দেখবে ঝকঝকে সাজানো অফিস, লোকজন গিজগিজ করছে। তার বদলে এমন নির্জন পুরোনো একটা বাড়ি, যার মেঝেয় সিমেন্টের চটা ওটা, দেওয়ালে নোনা, জানলা দরজার কাঠ ময়লা, শার্সির কাচ ভাঙা—দেখে সে দমে গেল।

‘কী চাই?’

অনন্ত ঘরে ঢুকল। প্রৌঢ় চশমাটা আঙুল দিয়ে ঠেলে নাকের উপরে তুলে তার দিকে তাকিয়ে।

‘সমীরেন্দ্র বসুমল্লিকের সঙ্গে দেখা করব।’

‘কী দরকার?’

‘একটা চিঠি এনেছি।’

‘কার কাছ থেকে?’

‘সাধন বিশ্বাস, অ্যাটর্নি।’

প্রৌঢ় হাত বাড়াল।

‘দেখি।’

অনন্ত চিঠিটা দিতে চটি খুলে তক্তাপোশে উঠল। চিঠিটা ইংরেজিতে। তাতে অল্প কথায় লেখা, যে—ছেলেটির কথা বলেছি তাকে পাঠালাম। অনেকক্ষণ ধরে পড়ার পর প্রৌঢ় তার আপাদমস্তক দেখে হাঁক দিল, ‘যুগল’। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই শুধু দোতলা থেকে কুকুরের ডাক শোনা গেল। প্রৌঢ় এবার গলা চড়িয়ে ডাকল।

‘কী বলছেন?’

দরজায় দাঁড়িয়ে ধুতি—গেঞ্জি পরা একটি লোক, প্রৌঢ়রই বয়সি। বোঝা যায় পুরোনো চাকর।

‘দেখা করতে এসেছে, অ্যাটর্নিবাবু চিঠি দিয়ে পাঠিয়েছেন।’

যুগল চিঠিটা নিয়ে দোতলায় উঠে গেল। মিনিট দুয়েক পর নেমে এসে বলল, ‘যান।’

সিঁড়িটা বাঁক নিতেই সামনের দেওয়ালে মানুষ প্রমাণ একটা আয়না। কাচের বহু জায়গায় কালো ছোপ পড়েছে। সোনালি চওড়া ফ্রেমটা বিবর্ণ। অনন্ত নিজের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে পেল। এই প্রথম সে জানতে পারল নিজের পুরো চেহারাটা কেমন।

সিঁড়িটা পৌঁছেছে লম্বা একটা দালান ঘরের প্রান্তে যার অপর প্রান্তে কয়েকটা সোফা এবং গদি আঁটা পুরোনো চেয়ার ও নীচু টেবল। পাঞ্জাবি ও লুঙ্গি পরা গৌরবর্ণ, সুদর্শন একটি লোক সোফায় হেলান দিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন, পায়ের উপর পা তোলা। একটা অ্যালসেশিয়ান কার্পেটের উপর দেহ ছড়িয়ে দু—পায়ের মধ্যে মুখ গুঁজে, অনন্তকে সে চোখ তুলে একবার দেখল মাত্র।

টেবলে সাধন বিশ্বাসের চিঠিটা একটা অ্যাশট্রে দিয়ে চাপা। অনন্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। একসময় কাগজটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে তাকালেন, চোখের মণিদুটো বিষণ্ণ, গভীর ও বড়ো। ঘুমের রেশ তখনও জড়িয়ে রয়েছে।

অনন্ত ঠিক করে রেখেছিল প্রণাম করবে। করতে পারল না। কী যেন একটা নিস্পৃহ দূরত্ব মানুষটির অচঞ্চল ভঙ্গি থেকে তৈরি হয়ে রয়েছে, যা ভেদ করে এই ঘর, আসবাব, এমনকী বাইরের পৃথিবীও লোকটির কাছাকাছি যেতে অক্ষম। সে বুকের কাছে দুই মুঠি ধরে দাঁড়িয়ে রইল। এই লোকটির ইচ্ছা—অনিচ্ছার উপর তার জীবনের ধারা বদলাবে।

‘বয়স কত…কুড়ি?’

অনন্তের ভরসা হল না কথা বলতে। শুধু হাসল।

চিঠিটা তুলে চোখ বোলালেন, একবার তাকালেন অনন্তের দিকে। কয়েক সেকেন্ড কী ভাবলেন।

‘নীচে গিয়ে বোসো, আর অজয়বাবুকে পাঠিয়ে দাও।’

কে অজয়বাবু সে জানে না, নীচের ঘরের প্রৌঢ়ই সম্ভবত। সিঁড়িতে সে মুখ ফিরিয়ে আয়নায় আবার নিজেকে দেখল। এই কয়েক মিনিটে তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন ঘটেছে বলে মনে হল না। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছে তার মনে পড়ল নমস্কার করে আসা হয়নি।

প্রৌঢ়ই অজয়বাবু। পরে জেনেছে ওর পুরো নাম অজয় হালদার। দোতলায় উঠে গিয়েই তাকে প্রায় তখুনি নেমে আসতে দেখে অনন্তের বুক কেঁপে উঠল। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল, তার মানে, বিদায় করে দাও! বেঞ্চে বসা লোকদুটিকে ইশারায় উপরে যেতে বলে অজয়বাবু গম্ভীরমুখে নিজের জায়গায় বসে বলল, ‘তোমার নাম কী?’

‘অনন্তকুমার দাস।’

‘বাবার নাম?’

‘ঈশ্বর শক্তিপদ দাস।’

‘বড়োছেলে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘কে কে আছে?’

‘মা, এক ভাই, দুই বোন। আমি বড়ো।’

‘কদ্দুর লেখাপড়া?’

‘স্কুল ফাইনাল দোব, প্রাইভেটে…রাতে কোচিং—এ পড়ি। বাবা হঠাৎ বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন, তাই স্কুল…টাকাপয়সা কিছু রেখে যাননি।’

‘ঘটি না বাঙাল?’

‘ঘটি।’

‘এখানে বসে কাজ করার মতো ব্যাপার খুব কম। যখন জমিদারি ছিল তখন এখানে কাজ ছিল, অনেক লোকও ছিল। এখন যা—কিছু ব্যবসার কাজটাজ ধর্মতলা স্ট্রিটের অফিস থেকে হয়। বুলুবাবু ওখানেই বসেন।’

অজয়বাবু চশমায় ঠেলা দিয়ে জানলার বাইরে তাকাল। অনন্ত মনে মনে অধৈর্য হয়ে উঠেছে। ধান ভানতে শিবের গীত গাইছে, কাজটা হবে কি হবে না সেটা আগে বলুক। প্রৌঢ় জানলা থেকে চোখ ঘরের মধ্যে এনে তাকের উপর দিয়ে বিষণ্ণ চাহনি বুলিয়ে অনন্তের মুখে বসাল।

‘তুমি কাল থেকে কাজে এসো। যা করার সব কাল বুঝিয়ে দেব।’

‘এই সময়ে আসব?’

‘তাই এসো। আসল কাজ বাইরে, ভাড়াটেদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়। অনেক টাকা মার গেছে, বছরের পর বছর ভাড়া বাকি, আদায় হয়েছে জমা পড়েনি…ভাড়াটে আছে কিন্তু আমাদের খাতায় নাম নেই অথচ তার কাছ থেকে ভাড়া আদায় হচ্ছে…এইসব। ভালো ভাড়াটেও আছে। রাজাবাজারের বস্তিটা গণিকে লিজ দেওয়া, গণির ভাড়ার টাকা মাসে মাসে ঠিক এসে যায়। এন্টালি আর আহিরিটোলার বাড়ি দুটোতেই যত ঝামেলা। সব পুরোনো ভাড়াটে, চল্লিশ—পঞ্চাশ বছর ধরে এক—একজন বাস করছে। আর দুটো বাড়ি টেরিটি বাজারে, সবই অফিস, ঠিক সময়ে দিয়ে দেয়।’

অজয়বাবু নীচু স্বরে ধীরে ধীরে যা বললেন তার বেশিরভাগই অনন্তের কানে পৌঁছল না। সে বুঝে গেছে কাজটা সে পেয়েছে, সত্যিকারের একটা চাকরি। সংসারের মাথার উপর এবার একটা চালা বসল।

ধীরে ধীরে তার চোখ জলে ভরে এল। কার কাছে সে কৃতজ্ঞতা জানাবে? সমীরেন্দ্র বসুমল্লিক…অজয়বাবু…সাধন বিশ্বাস নাকি অমর?

‘এস্টেটের নিয়ম হয়েছে ধর্মতলা অফিসের মতো এখানেও একই স্কেলে মাইনে দেওয়া হবে।…প্রথম ছ—মাস প্রোবেশনার, থোক আড়াইশো পাবে।’

‘কত?’

অজয়বাবু আবার বলল, অনন্তের কানে এল মা যেন বলছে, ‘আর একটু ভাত নে।’

‘কাঁদছ কেন?’

‘রাতে আমার ঘুম হত না। কী করে সংসারটা চালাব ভেবে পেতাম না। সবাই আমার মুখ চেয়ে আছে, বড়োছেলেই তো বাবার জায়গা নেয়।’

‘ছ—মাস পর যদি পাকা হও তখন হাতে তিনশো টাকার মতো পাবে।’

ছয়

রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেদিন চারপাশের বাড়ি, মানুষ, যানবাহন, দোকান, ফেরিওয়ালা এমনকী রাস্তার জঞ্জালও তার কাছে নতুন এবং বিস্ময়কর মনে হচ্ছিল। অসহায়ভাবে সে বুঝতে পারছিল না তার পৃথিবীটা হঠাৎ বদলে যাচ্ছে কেন! তার বোধের আয়ত্তে থাকছে না কেন? সে কোথাও কোনো ত্রুটি দেখতে পাচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে মানুষ এবং বাড়িগুলো একটু ছোটো হয়ে গেছে, অথচ সবই রয়েছে পুরোনো শৃঙ্খলা মেনে।

সেদিন হাঁটতে গিয়ে তার পদক্ষেপ বার বার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। লোকে কি মাতাল ভাববে? সে আপনমনে হেসে ইচ্ছে করে আরও এলোমেলো পা ফেলছিল। জামার হাতায় চোখের জল মুছেছিল। কী অদ্ভুতভাবে একটা নতুন রাস্তা তার সামনে এসে গেল। এই রাস্তা ধরে তাকে সাবধানে এগোতে হবে, সংসারটাকে সঙ্গে নিয়ে।

ছ—মাস না হলে চাকরিটা পাকা হবে না। ছ—মাস সে খুব ভালো কাজ দেখাবে, খাটবে আর কোনো প্রলোভনেই টলবে না। এই কাজে নাকি চুরির সুযোগ আছে, নিশ্চয় তার উপর লক্ষ রাখা হবে। রাখুক।

অনন্ত নানান অজানা রাস্তায় সেই দুপুরে হেঁটেছিল, বহুক্ষণ। সে জানে হারিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। প্রত্যেকটা গলি তাকে একসময় চেনা রাস্তায় পৌঁছে দেবেই। একসময় সে পৌঁছেও গেছল বাড়িতে। মা তখন মেঝেয় ঘুমোচ্ছিল। নিঃশব্দে জামা খুলে আলনায় রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল মা—র চোখ খোলা, চাহনিতে ভয়। ফিসফিস করে বলল:

‘কী হল রে?’

‘হয়েছে।’

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল শীলা। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘ভগবানকে সকাল থেকে ডাকছিলুম, মন বলছিল হয়ে যাবে। কত টাকা দেবে?’

বিকেলে অনন্ত রকে বসে বহুদিন পর ছেলেদের রবারের বল খেলা দেখল। নিজেকে তার হালকা লাগছে। কী বিরাট চাপে এতদিন কুঁকড়ে ছিল আজ সে বুঝতে পারছে। পাড়ার লোকেদের মুখোমুখি হতে এবার তার আর সংকোচ নেই। এখন সে মোটামুটি রোজগেরে—জীবনের সঙ্গে জড়ানো কিছু কিছু পরিস্থিতির সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা তার হয়েছে। তবে এটুকু জানে, প্রথম মাসের মাইনে না পাওয়া পর্যন্ত তাকে আগের মতোই টেনেটুনে চলতে হবে।

প্রসাদ ঘোষকে তার জানিয়ে আসা উচিত ছিল, আর সে কমলা বাইন্ডার্সে যাবে না। অঘোর এস্টেট থেকে বেরিয়ে প্রথমে ওখানেই যাওয়া দরকার ছিল অথচ তখন তার একদমই মনে পড়ল না! আঠারো দিনের কাজের টাকা পাওনা হয়েছে। কাল ন—টার মধ্যে গিয়ে জানিয়ে আসবে। টাকা নিশ্চয় তখুনি দেবে না, ঘোরাবে। কোনো পাওনাদারকেই একবারে টাকা দেয় না।

তা ছাড়া, গৌরীর কাছেও খবরটা পৌঁছনো দরকার। আড়াইশো টাকার চাকরি পাবার যোগ্যতা যে তার আছে এটা ও জেনে যাক। ওর অবাক হওয়া মুখটা কেমন দেখাবে কে জানে! কিন্তু ও তো আর দোকানে আসে না, ভাইকে বলে দিলেই হবে। গৌরী বলেছিল, ভাইয়ের হাত দিয়ে চিঠি দেবে। সে চিঠি আর পাওয়া হবে না, হয়তো আর কোনোদিন তাদের দেখাই হবে না।

সে বিমর্ষ হয়ে থেকেছিল কিছুক্ষণের জন্য। গৌরীর সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুত্বই, এমন আলাপ যে—কোনো ছেলের সঙ্গেও হতে পারত। অনন্ত মন থেকে গৌরীকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চেয়েছিল। জীবনের এই সময়টায় কোনো মেয়ের কথা ভাবলে তার চলবে না, তাকে উন্নতি করতে হবে। তা ছাড়া, গৌরী তো ভালোবাসে আর একজনকে। দরকার কী ওকে নিয়ে আজেবাজে ভাবনায়।

অনন্ত তার পরবর্তী সতেরো বছরে সংসার আর চাকরি ছাড়া, আর কিছু ভাবেনি। কিছু কিছু ঘটনা ঘটেছে, সে নাড়া খেয়েছে, বিভ্রান্ত হয়েছে, দুঃখ পেয়েছে। কিন্তু তার জীবনধারায় কোনোটিই বাঁক ফেরাতে পারেনি কিংবা হয়তো সে বাঁক নিতে চায়নি। তার নিজস্ব জগতের বাইরে যেতে সে ভয় পায়। একটা নির্দিষ্ট খাতের মধ্যে সে জীবনকে ঢেলে দিয়েছিল এবং বছরের পর বছর খাতটাকে শুধু গভীরই করেছে, কখনো উপচে পড়ার বা বদলাবার চেষ্টা করেনি। সে শুধু ভালো ছেলে হয়ে থাকার চেষ্টা করেছে।

এন্টালিতে অঘোর ভবনের ভাড়া আদায় করতে গিয়ে প্রথম দিনে তার বুকের মধ্যে কাঁপন ধরেছিল। প্রত্যেকেই তাকে দেখে অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। এ আবার কে? অনন্ত জানত প্রথমটা এরকমটা হবেই।

‘পরিমলবাবু কোথায়? আপনি কে?’

‘আমি পরিমলবাবুর জায়গায় কাজ করছি, তাকে এখন অন্য কাজে দেওয়া হয়েছে।’

রাস্তার উপর কাচ ও আয়নার দোকানের মালিক নারায়ণ দত্ত যেন ভাবনায় পড়ে গেল এমনভাবে মাথা চুলকে অনন্তর দিকে তাকাল।

‘পরে আসবেন।’

‘কখন?’

‘এই তো দোকান খুললুম, অন্য একসময় আসুন, এখনও ক্যাশে কিছু জমা পড়েনি।’

‘অন্য এক সময় মানে কখন?’

অনন্ত নাছোড়বান্দা। যত বিরক্তই হোক সে লেগে থাকবে। নারায়ণ দত্ত অবশ্য ভাড়া ফেলে রাখে না। ভাড়াটেদের ভাড়া দেওয়ার তারিখ খাতা থেকে দেখে সে বুঝে নিয়েছে কার কাছে কবে যেতে হবে।

‘পরশু বিকেলে আসুন।’

ভাড়ার বিলবই তার সঙ্গেই আছে। ন্যাশনাল গ্লাস স্টোরের বিলের পিছনে সে তাগিদায় আসার তারিখটা লিখে রাখল। পাশেই হিন্দ মোটর পার্টসের দোকান। মালিক এক পাঞ্জাবি। এখানেও প্রায় একই কথা, পরের হপ্তায় দেব।

অঘোর ভবনের ফটকের লাগোয়া একটা পান—সিগারেটের দোকান। দেওয়ালে কাঠের পাটা লাগিয়ে ফুটপাথের দিকে দেড় হাত বেরিয়ে থাকা জায়গাটুকুতে বাবু হয়ে বসে, পরিষ্কার ধুতি গেঞ্জি পরা, কপালে সিঁদুর ফোঁটা, পাকানো গোঁফ, টেরিকাটা, হৃষ্টপুষ্ট লোকটির বা দোকানের নামে বিল লিখেছে বলে অনন্তর মনে পড়ল না। খাতায় নাম থাকলে নিশ্চয়ই বিল লেখা হয়েছে! সে তন্নতন্ন করে বিলবইটার প্রত্যেক পাতা দেখল। অঘোর ভবনের দেওয়ালেই যখন দোকান, তা হলে অবশ্যই তাদের ভাড়াটে। কিন্তু পান—সিগারেট দোকানের নামে একটিও বিল নেই!

অস্বস্তিভরে সে দোকানের সামনে দাঁড়াল। লোকটাকে শক্তধাতের মনে হচ্ছে। পান সাজছে যন্ত্রের মতো হাত চালিয়ে। চুন, খয়ের, সুপুরি, জর্দা, দশ সেকেন্ডের মধ্যে পান তৈরি! সার সার নানা ব্র্যান্ডের সিগারেট প্যাকেট। বলা মাত্রই আঙুলের ডগা দিয়ে প্যাকেট টেনে নিয়ে সিগারেট বার করে দিচ্ছে।

অনন্ত অপেক্ষা করল খদ্দেরদের বিদায় হওয়ার জন্য। একসময় লোকটি ভ্রূ তুলে তাকাল, ‘কী দেবে?’

‘আপনার দোকান?’

‘হ্যাঁ।’

সন্দিগ্ধ এবং বিস্মিত চোখে তাকে দেখছে। অনন্ত এগিয়ে এসে গলা নামিয়ে বলল, ‘আপনি ভাড়া দেন?’

‘নিশ্চয়।’

‘আমি ভাড়া আদায় করতে এসেছি।’

‘কী নাম আপনার, কে পাঠিয়েছে?’

‘এস্টেট থেকে আসছি, আমার নাম অনন্ত দাস।’

বিল বইটা সে দেখাল। লোকটার কথায় সামান্য বিহারি টান না থাকলে বাঙালিই মনে হত।

‘আপনি যে বাড়িওয়ালার লোক তা বুঝব কী করে? বিল তো ছাপাখানা থেকে যে— কেউই ছাপিয়ে আনতে পারে।’

অনন্ত ফাঁপরে পড়ল। একটা চিঠি বা ছবিওলা আইডেন্টিটি কার্ড থাকলে ভালো হত। এমন প্রশ্ন যে উঠতে পারে তা একবার ভেবেওছিল। অজয় হালদার বলেছিল : ‘ও—সব লাগবে না, সবাই একবার চিনে গেলে আর কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে না।’ অনন্ত দ্বিতীয়বার আর বলেনি। নিজেকে চিনিয়ে নিতে না পারাটা হয়তো তাকে অযোগ্যতার পর্যায়ে ফেলে দেবে।

‘আমার ভাড়া পরিমলবাবু নিয়ে যেত।’

‘তিনি আর নেই।’

‘জানি। আমাকে বলে গেছে। এস্টেটের পেট্রল পাম্পে কাজ করছে।’

‘তা হলে ম্যানেজারবাবুকে বলব ভাড়ার জন্য আপনাকে চিঠি দিতে।’

‘চিঠিমিঠি কেন দেবেন’…লোকটা বিব্রত হয়ে বলল। ‘আপনাকেই ভাড়া দেব। পরিমলবাবু তো বিলটিল দিত না, আপনিও দেবেন না।’

‘সে কী! বিল দেব না?’

খদ্দের এসে পান চাওয়ায় লোকটা ব্যস্ত হল। অনন্ত এইবার বুঝতে পারছে ভাড়াটেদের লিস্টে কেন এর নাম নেই। এস্টেটকে গোপন করে দোকান বসানো হয়েছে, ভাড়াটাও গোপন রাখা হয়েছে। পরিমল চাটুজ্জেই একমাত্র লোক আদায়ের দায়িত্বে ছিল। সে যা জমা দিত তাই জমা করা হত। খাতাপত্র সেই লিখত, হিসেবও রাখত। কেউই ভাড়াটে সম্পর্কে খোঁজখবর নিত না। এভাবে কত টাকা যে পরিমল চাটুজ্জে পকেটে পুরেছে কে জানে!

‘তিন হাজার টাকা সেলামি দিয়েছি, মাসে সত্তর টাকা ভাড়া। আজ দু—বছর হল দোকান করেছি।’

লোকটা হাসছে। হাসিটা খুব স্বচ্ছ নয়।

‘আগের লোক কামিয়েছে, আপনিও কামান। ভাড়ার টাকা তো আমি দেবই। টাকা কে নিচ্ছে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। এ—বাড়িতে অনেকভাবে টাকা কামাতে পারবেন।’

‘অনেক ভাবে?’

‘হ্যাঁ অনেকভাবে। আপনাকে পরে বলব।’

‘এখনই বলুন না।’

‘বাড়ির উঠোনটা তো দেখেছেন, কত রকমের লোহালক্কড়, বস্তা, বাক্স, পেটি পড়ে আছে, ওমনি ওমনি কি আছে? ভাড়া দিচ্ছে। বিলটিলের ধার ধারে না।’

‘কারা দিচ্ছে?’

‘কাচের দোকানের মাল থাকে, মোটর পার্টসের দোকানেরও থাকে, বাইরের প্লাইউড দোকানের বড়ো বড়ো বোর্ড, রাতে রেডিমেড জামাকাপড়ওয়ালার চৌকি বাক্সও থাকে। জলের পাম্প খারাপ বলে, নতুন পাম্প পরিমলবাবু কিনল, পাম্পটা কিন্তু ভালোই ছিল, সেটা বিক্রি করে দিল, টাকা কি জমা দিয়েছে? দেখুন আমি সব জানি, বুঝতে পারি। এখানকার দারোয়ান নিতাই ওরই লোক…বাঙালি। একে আগে তাড়ান, চোট্টা আছে। রাতে এসে দেখবেন কত লোক ঘুমোয়, সকালে স্নান করে, পায়খানা সারে, সবার কাছ থেকেই পয়সা নেয় নিতাই। আমি আপনাকে ভালো লোক দিব, আমার ভাইয়ের ছেলে।’

লোকটা এতক্ষণ ঝুঁকে চাপা স্বরে দ্রুত কথা বলছিল। খদ্দের আসতেই সোজা হয়ে বসল। অনন্ত উত্তেজিত বোধ করছে। এতভাবে বাড়িটা থেকে টাকা ওঠে অথচ এক পয়সাও জমা পড়েনি। আজই সে গিয়ে ম্যানেজার অজয়বাবুকে বলবে। রাতে সাধন বিশ্বাসকে তো জানাবেই। প্রথম দিনেই এই সব খবর পেয়ে যাওয়া, তার কল্পনার অতীত।

‘ওকে আসতে বলি?’

‘কাকে?’

‘আমার ভাইয়ের ছেলেকে।’

‘আগে ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে কথা বলব। লোক রাখা না—রাখার মালিক তো আমি নই। এখন আপনার ভাড়াটা দিন।’

‘কাল পাবেন, দোকানে তো টাকা রাখি না, ঘর থেকে আনতে হবে। আপনি ম্যানেজারবাবুকে বলুন…এখানে যা চলছে তাতে এস্টেটেরই লোকসান হচ্ছে। ভালো লোক রাখা চাই। আমার ভাইয়ের ছেলেকে রাখলে চোরা কারবার বন্ধ হয়ে যাবে। আপনাকে সব তো বললুম, এবার আপনি ম্যানেজারবাবুকে বলুন।’

‘বলব। আপনার নামটা কী?’

‘নন্দকিশোর তেওয়ারি। আর যদি বলেন, আপনারও যাতে দু—চার টাকা আসে তা—ও ব্যবস্থা করতে পারি।’

‘আমি চোর নই।’

‘আহহা, আমি কি চুরির কথা বলছি! আপনাকে দেখেই বুঝেছি ভালো লোক আছেন। উপরি রোজগার তো ভালো—মন্দ সব মানুষই করে। টাকার কি দরকার নেই? সবার দরকার।’

‘আমার দরকার নেই। আমি কাল তা হলে আসছি।’

ফটক দিয়ে ঢুকে ডান দিকে সিমেন্ট বাঁধানো বড়ো চৌকো উঠোন আর সিঁড়ির পাশ দিয়ে ঢাকা লম্বা একটা পথ। নন্দকিশোর যা বলেছিল সেই রকমই, প্রায় গুদামের মতো হয়ে আছে জায়গাটা। একধারে স্তূপ হয়ে আছে কাঠের ভাঙা বাক্স। তার পাশে বস্তায় ভরা কাপড়ের ছাঁট, মোটর গাড়ির স্প্রিং পিনিয়ন, শরবতের ঠেলা গাড়ি, মোবিলের ড্রাম, দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ির পাশে বান্ডিল করে রাখা চটের বস্তা।

সে নিতাইকে খুঁজল। একতলায় একটা ঘরে থাকে, এইটুকুমাত্র সে জানে। ওকে সে একবারমাত্র অঘোর এস্টেটে দেখেছে। অজয় হালদার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল: ‘দারোয়ান কাম কেয়ারটেকার। বছর দশেক কাজ করছে।’ চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। কালো, রোগা, একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। নিতাইয়ের বিনীত কৃতার্থ ভঙ্গি তার ভালো লাগেনি।

ঢাকা পথটায় সে উঁকি দিল। পথের শেষে তালা দেওয়া কলঘর, তার পাশে পায়খানা ও পাম্পঘর। বাঁ দিকে তিনটে ঘর, বসবাসের জন্য নয়। মাত্র একটি জানালা প্রতি ঘরে, সম্ভবত মালপত্র রাখার জন্যই ঘরগুলো। একটা ঘরের জানালা এবং দরজায় গেরুয়া রঙের পর্দা। অনন্ত এগিয়ে এসে পর্দা সরিয়ে দেখল, দরজায় তালা দেওয়া। এখানেই কি নিতাই থাকে? সে কি জানালা—দরজায় পর্দা টাঙানোর মতো লোক?

অনন্ত ফিরে আসার সময় সিঁড়ির কাছে তাকে পাশ কাটিয়ে পথটার দিকে চলে গেল একজন মহিলা। যাবার সময় কৌতূহলে তার দিকে একবার তাকিয়েছিল। ডান গালে আঁচিল, হাতে ছাতা আর ব্যাগ, ছোটোখাটো ফরসা চেহারা। কালো ফ্রেমের চশমা। দ্রুত ছোটো পদক্ষেপ, পরনে কালো সরু পাড় সাদা মিলের শাড়ি। তার মনে হল, ইনিই বোধ হয় ঘরটায় থাকেন। ভাড়াটে? কিন্তু একতলায় দোকান ছাড়া আর তো কোনো ভাড়াটে নেই।

কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে অনন্ত ঘরটার কাছে ফিরে এল। আলো পাওয়ার জন্য জানলার পর্দা অল্প সরানো, দরজার পর্দাও। কিন্তু তাতেও ঘরের ভিতরটা আবছা। অনন্ত কিছুই দেখতে পেল না। বাসন নাড়ানোর শব্দ এল।

মহিলা প্লাস্টিকের একটি বালতি হাতে হঠাৎ বেরিয়ে আসতেই অনন্ত এক পা সরে গেল। মহিলা তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাউকে খুঁজছেন কি?’

‘হ্যাঁ, মানে আমি ভাড়া তুলতে এসেছি, নতুন, আজই প্রথম। আপনি কি টেনান্ট?’

‘টেনান্ট বললে টেনান্ট, নয়তো নয়।’

‘তার মানে!’

‘আপনি একটু দাঁড়ান, আমি জলটা ধরে নি। ছাদের ট্যাঙ্কে মাঝে মাঝে জল থাকে না, খুব অসুবিধায় পড়তে হয়…আপনি বরং ঘরে বসুন।’

‘না না এই তো বেশ আছি। আবার কেন…।’

কথা না বাড়িয়ে উনি কলঘরের দিকে গেলেন। চাবি দিয়ে কলঘরের তালা খুললেন। দরজা ভেজিয়ে দিলেন ভিতরে ঢুকে। অনন্তের মনে হল, এটাও পরিমল চাটুজ্জের আর একটা রোজগারের ব্যবস্থা। লোকটাকে তার দেখার ইচ্ছা হচ্ছে। শুনেছে বাগুইহাটিতে জমি কিনে একতলা বাড়ি তৈরি করেছে।

জলভরা বালতি নিয়ে উনি ফিরতেই অনন্ত জিজ্ঞাসা করল, ‘চাবি কি আপনার কাছেই থাকে?’

‘এটা ডুপ্লিকেট। দোকানের ওদের কাছেও একটা করে আছে।’

পর্দা সরিয়ে উনি ঘরে ঢুকে ভিতর থেকেই বললেন, ‘আপনি ভেতরে এসে বসুন।’

অনন্ত সামান্য দ্বিধা করে ঘরে ঢুকল। ঘরটা বেশ বড়োই। দড়িতে পর্দার কাপড় ঝুলিয়ে ঘরটা দু—ভাগ করা। উনি পর্দার ওধারে গেছেন হয়তো বাইরের কাপড় বদলাতে।

পর্দার এধারে অর্থাৎ দরজার কাছাকাছি খুবই পুরোনো একটি কাঠের গোলাকার টেবল আর দুটি হাতলবিহীন চেয়ার। টেবলে কয়েকটি পুরোনো বাংলা খবরের কাগজ সযত্নে ভাঁজ করে রাখা। শুধুই তারিখ দেওয়া একটা ক্যালেন্ডার দেওয়ালে। ঘরের কোণে এইমাত্র ছেড়ে রাখা জুতোর পাশে হাওয়াই চটি। ছোটো একটা জলচৌকিতে কুঁজো আর কাচের গ্লাস। জানলার কাছে নীচু একটা জালের আলমারি, তার উপরে কেরোসিন স্টোভ। জলের বালতিটা ওখানেই রাখা। আলমারিটাই বোধ হয় ভাঁড়ার এবং রান্নাঘরের কাজ করে। পর্দার ওধারে কী আছে অনন্ত তা জানে না। কিন্তু এধারে এত কম আসবাব এবং সেগুলি এত পরিচ্ছন্ন, গোছানো যে তাই থেকে এর মালিকের মানসিক গঠনটা যেন আঁচ করা যায়…নির্বিরোধী এবং কল্পনাপ্রবণ। অনন্তের মনে হল এই মহিলার সঙ্গে ঘরের চেহারাটার খুবই মিল আছে।

‘বসুন। বলুন কী বলছিলেন?’

একটা চেয়ারে উনি বসলেন অনন্তের মুখোমুখি। পর্দার ওধারে হালকা একটা ধোঁয়ার শিষ লতিয়ে উঠেছে। ধূপ জ্বালিয়েছেন। শাড়ি বদলে একটা সাদা থান পরেছেন। চশমার কাচ কাপড়ে মুছতে মুছতে হাসি মুখে তাকিয়ে। চোখের কোলে কালো ছোপ। বয়স বোধ হয় চল্লিশের এধার ওধারে।

‘আপনি কদ্দিন আছেন!’

‘তিন বছর।’

‘ভাড়া কত?’

‘সস্তাই, চল্লিশ টাকা।’

‘আপনার নাম কিন্তু আমাদের খাতায় নেই।’

সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলেন। ভ্রূ কুঁচকে সন্দিহান গলায় বললেন, ‘নাম নেই…কেন?’

‘কাকে ভাড়া দিতেন?’

‘পরিমলবাবুকে, তিনিই তো মালিকের লোক!’

‘হ্যাঁ। বিল দিতেন?’

‘নিশ্চয়, দাঁড়ান আপনাকে দেখাই।’

উনি উঠে গেলেন। দড়িতে কড়া লাগানো পর্দাটা সরিয়ে ভিতর মহলে যাবার সময় অনন্ত ওঁর দিকে তাকিয়েছিল। তাই সে সরানো পর্দার ফাঁকা জায়গা দিয়ে দেখতে পেল দেওয়ালে প্রায় এক হাত চতুষ্কোণ, সাদা ফ্রেমে বাঁধানো একটা ফোটো। একটি পুরুষের মুখ, গলা ও কাঁধ দেখা যাচ্ছে। ফোটোর নীচে কাঠের ব্র্যাকেট, সেখানে ধূপদানিতে তিন—চারটি জ্বলন্ত ধূপ।

ধীরে ধীরে অনন্তের ঘাড় থেকে শিরদাঁড়া বেয়ে চলন্ত পোকার মতো একটা বিস্ময় নেমে গেল কোমর পর্যন্ত। বাবা! কোনো সন্দেহ নেই। ডান দিকের রগের কাছে কাটা দাগটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ওটা নাকি স্কুলে পড়ার সময় কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের লাঠিতে হয়েছে। বাবা এর বেশি তাদের কিছু বলেনি।

এখানে এমন অকস্মাৎ বাবার ছবি দেখতে পেয়ে অনন্ত প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেল। তার বোধ ও যুক্তির শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার মতো দশায়। টেবলে রাখা আঙুলগুলো থরথর করছে, গলা শুকিয়ে এল। মাথায় একটা চিন্তাও স্থির থাকছে না।

ইনি তা হলে কে? বাবার ছবি এত যত্নে টাঙানো, ধূপ জ্বালানো…কে হন? মনের মধ্যে হঠাৎ ঝলসে উঠল বাবাকে লেখা কে এক মিনুর চিঠিটা।

‘এই যে পাঁচ মাস আগের একটা বিল।’

অনন্ত অসাড় হাতটা বাড়িয়ে বিলটা নিল। হুবহু তার কাছে যে বিল রয়েছে সেই রকমই। এস্টেটের স্ট্যাম্পটা আসলই কিন্তু সইটা কেমন জড়ানো, কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

মিনতি করের নামে বিল। ডাকনাম মিনু হওয়াই সংগত।

‘মিনতি কর আপনার নাম?’

‘হ্যাঁ।’

‘পরিমলবাবুর সই?’

‘বলতে পারব না, উনি লিখেই আনতেন, শুধু তারিখটা বসাতেন ভাড়া নেবার সময়।’

ছবিটা কবে তোলা? সতেজ যুবকের মতো দেখাচ্ছে। চাহনিটা জ্বলজ্বলে, তীক্ষ্ন অথচ হালকা হাসিতে ছাওয়া। বাবার এমন মুখ সে কখনো দেখেনি। ঘন থাক থাক চুল কপাল থেকে পিছনে ওলটানো। চুল উঠে কপালটা চওড়া হয়ে গেছল শেষ দিকে। চোয়ালে চর্বি জমেছিল কিন্তু এই ছবিতে গালদুটো মসৃণ, সমান। বাবার বয়স তখন কত, পঁচিশ—আঠাশ? ছবিটা কি বিয়ের আগে তোলা? অনন্ত কখনো তার বাবার এই ছবি দেখেনি।

সে কথা বলছে না। উনি অবাক হয়ে অনন্তের দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন। ছবিটার দিকে সারাক্ষণ চোখ স্থির হয়ে রইল।

‘এটা তো পাঁচ মাস আগের, তারপর আর ভাড়া দেননি?’

পাংশু হয়ে গেল ওর মুখ। শিশুর মতো মাথা নাড়তে লাগলেন।

‘চার মাস দেননি, এইটে নিয়ে পাঁচ মাস।’

‘হ্যাঁ। আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়নি, এখনও সম্ভব নয়। অ্যাঞ্জেল কেমিক্যালসে কাজ করতুম, আজ ছ—মাস সেখানে লক আউট চলছে। জানি না অফিস আর কখনো খুলবে কি না।… আমাকে কি তুলে দেবেন?’

অনন্তের বড়ো করুণ লাগল ওর শেষের কথাটি। কিন্তু বাবার সঙ্গে এর কোথায় পরিচয়, কেমন করে পরিচয়? এই রকম একটা ছবি তাদের সংসারে নেই কেন? গত ছ—মাসের মধ্যে একবারও কি কেউ বাবার সম্পর্কে কোনো কথা বলেছে…অনু, অলু, মা? সে নিজে?

প্রশ্নগুলো একসঙ্গে তার মাথাটাকে কামড়ে ধরছে আর যন্ত্রণাটা বুকের দিকে এগোচ্ছে।

সে কি নিজের পরিচয়টা এবার দেবে? ওঁর সঙ্গে বাবার সম্পর্কটা আগে জানা দরকার। ধূপ কি রোজ জ্বালেন? বাবার কোনো ছবি সে আজ পর্যন্ত দেখেনি। তাদের ঘরে মানুষের কোনো ছবি নেই।

‘তুলে দেওয়ার মালিক তো আমি নই। তবে আপনি বেআইনিভাবে রয়েছেন।’

‘আমি তো ভাড়া দিয়ে গেছি। ভাড়া বাকি তো পড়তেই পারে।’

‘কিন্তু আমাদের খাতায় আপনার নাম নেই, আপনার ভাড়াও জমা পড়েনি। সবই পরিমলবাবু নিজে গাপ করেছেন।’

‘সে কী! আমি তা হলে ভাড়াটে নই? পরিমলবাবু এইরকম লোক তা তো বুঝতে পারিনি। আমাদের অফিসে ওর ভাই কাজ করেন তার মারফত ওর সঙ্গে পরিচয়। খুব দরকার শুনে ঘরটা আমাকে দিলেন। ওঁকে ছাড়া আর কাউকে চিনিই না।’

অনন্ত মাথা নাড়ল।

‘বাইরে পানওলারও একই ব্যাপার।’

‘আমাকে আপনারা তা হলে রাস্তায় বার করে দিতে পারেন?’

‘আপনি অত ভাবছেন কেন? আর কোথাও কি থাকার জায়গা আছে?’

‘আমার কোথাও কেউ নেই।’

আর্তনাদের মতো অনন্তের কানে ঠেকল। অবিনাশকাকা বলেছিল বাবা প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে দু—বারে সাত হাজার টাকা তুলেছে, সে কি এনারই জন্য? কীভাবে খরচ হল?

চিঠিটায় একটা লাইন ছিল : ‘গত এক মাসে একবারও এলে না।’ এখানে কি বাবা আসত! কিন্তু মিনতি কর তিন বছর এই ঘরে, তার মানে বাবা মারা যাওয়ার পর এসেছেন। আগে তা হলে কোথায় থাকতেন?

‘আপনার আত্মীয়স্বজন, ছেলেমেয়ে…!’

‘নেই।’

‘আপনি অবিবাহিতা?’

প্রশ্নটা করেই শ্বাসবন্ধ করে উত্তরের অপেক্ষায় রইল। জিজ্ঞাসা করাটা বোধহয় গর্হিত হয়ে গেল।

মিনতি করের চাহনিটা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে এল নিবিয়ে দেওয়া সলতের আগুনের মতো। চোখের মণিদুটো গাঢ় হয়ে উঠল। মাথাটা একটু নুয়ে পড়ল।

অনন্ত আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না। উত্তেজনার আধিক্যে সে বলে ফেলল, ‘ওই ছবিটা কার, আপনার স্বামীর?’

প্রশ্ন করেই মায়ের মুখটা একবার তার চোখে ভেসে উঠল। বাবার গোপন জীবনের মধ্যে সে ঢুকতে যাচ্ছে। উচিত কি অনুচিত, বুঝতে পারছে না। সে অঘোর এস্টেটের কর্মচারী, ভাড়া আদায় করতে এসেছে। তার সামনে এমন একজন যিনি আইনত ভাড়াটে নন। সেইভাবেই তার আচরণ, কথাবার্তা হওয়া উচিত নয় কি? কারোর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার তার নেই।

তবে ওঁকে অঘোর এস্টেটের একজন কর্মচারী এমনভাবে ঠকিয়েছে যেটা ধরা ওঁর পক্ষে সম্ভব নয়। দোষটা ওঁর নয়। অনন্ত তার অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও বুঝতে পারছে তার তরফ থেকে বলার কিছু নেই।

কিন্তু সে বাবার জীবনেরই একটা অংশ। ওই ছবিটায় তারও এক ধরনের অধিকার আছে। সুতরাং সে জিজ্ঞাসা করতে পারবে না কেন?

‘উনি আমার কেউ না অথচ সব।’

মৃদু স্বরের কথাগুলো চন্দনের গন্ধের সঙ্গে ভেসে অনন্তের রোমকূপগুলোয় ধীরে ধীরে থিতিয়ে বসল। অযথা একটা ভার তার শরীরকে ক্লান্ত করতে শুরু করল। সে চুপ করে থাকল।

‘জীবনটা একসময় বড়ো ছোটো মনে হত, সময় কীভাবে যেন হু হু করে চলে যেত।’

মিনতি কর আবার মুখ ফিরিয়ে ছবিটার দিকে চেয়ে রইলেন। অনন্ত, ওঁর ডান চোখের কিনারা বাষ্পে চকচক করছে, দেখল।

‘পাশের বাড়িতে ওঁরা থাকতেন, ছোটো থেকে আলাপ। আমাদের বিয়ে হবে ঠিক ছিল, হয়নি।’

‘কেন?’

‘আমার নামে অনেক কিছু রটনা করেছিল ওঁর ভাই, উনি তা বিশ্বাস করেছিলেন। তখন আমার উপর রেগে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলেন।…পরে অবশ্য ভুল বুঝতে পারেন।’

‘আপনি বিয়ে করেননি?’

মিনতি কর ধীরে মাথা নাড়লেন।

‘মেয়েরা একজনকেই ভালোবাসে।’

‘ওঁর বউকে দেখেছেন।’

‘না।’

অনন্ত ইতস্তত করে বলল, ‘ওর পরিবার সম্পর্কে কিছু জানেন না?’

‘খুব বেশি নয়। দুটি ছেলে দুটি মেয়ে জানি, তারা স্কুলে পড়ে। বড়োটি হয়তো এখন কলেজে।’

‘তারা কি আপনার কথা জানে?’

‘বোধ হয় না।’

মিনতি কর উঠে ছবিটার কাছে গেলেন। দু—তিনটে ধূপ নিবে গেছে, দেশলাই জ্বেলে ধরালেন।

‘এখন ধূপগুলো যা হয়েছে, একটা গোটা দেশলাই খরচ হয়ে যায়।’

‘রোজ জ্বালেন?’

‘প্রতি শুক্কুরবার জ্বালি, এই বারেই উনি মারা গেছেন।’

বাবার মৃত্যুর তারিখটা তার মনে আছে কিন্তু বার কী ছিল মনে নেই। তারিখটা এলে বাবাকে মনে পড়ে। ছড়ানো এলোমেলো কিছু ছবি, কিছু ভঙ্গি,…থালায় ভাত মাখার, জুতোয় ফিতে বাঁধার, রাস্তা দিয়ে হাঁটার। কিছু কথার… ‘পায়ের আঙুলে ময়লা কেন?’; পেনসিলটা দু—আধখানা করে দু—জনে নাও’; ‘রান্নাঘরটা এত নোংরা থাকে কেন?’ সেদিন অন্যদের কীভাবে বাবাকে মনে পড়ে তা জানে না, কেউ বাবার প্রসঙ্গ তোলে না। তাদের জীবনে আর যেন মানুষটির কোনো দরকার নেই। মা—ও কখনো কিছু বলে না।

অথচ এই ঘরে বাবাকে মনে রাখা হয়েছে। কিছু একটা দিয়েছেন যা মিনতি করের জীবনে গভীরভাবে শিকড় ছড়িয়েছে। কী সেটা? ভালোবাসা! বাবাও নিশ্চয় ওঁর কাছ থেকে পেয়েছেন। ব্যাপারটা সে ঠিকমতো বুঝতে পারছে না। আর কিছু জিজ্ঞাসা করাটাও উচিত হবে না।

‘চাকরি নেই তা হলে ভাড়া দেবেন কী করে, এখন চালাচ্ছেন কীভাবে?’

‘টিউশানি করছি, সকাল বিকেল রাত, খাওয়াটা চলে যায়।’

‘কিন্তু ভাড়া?’

‘আমি জানি না…কীভাবে যে দোব! উনি থাকলে আজ এসব চিন্তা করতে হত না।’

অনন্ত উঠে দাঁড়াল।

‘যাচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ। আমাকে আর আপনি করে বলবেন না, লজ্জা পাব।’

‘আমাকে তুলে দেওয়া হবে কি? আমি তো জানতাম না পরিমলবাবু এভাবে ঠকাবেন!’

‘দেখি কী করা যায়।’

ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিতাইকে সে খুঁজে পেল না। নন্দকিশোর তাকে দেখে চেঁচিয়ে বলল, ‘দেখবেন বাবু, আমার ভাইয়ের ছেলের কথাটা মনে রাখবেন।’

অঘোর এস্টেটে ফিরে এসে অনন্তকে অপেক্ষা করতে হল। ম্যানেজার অজয় হালদার ব্লাডপ্রেশারের রুগি, দুপুরে ঘণ্টা দুই ঘুমোন। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে অনন্ত জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে সময় কাটাল। তখন সে গোপন একটা ব্যাপার জেনে ফেলার ধাক্কা সামলে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে যায়। সে ঠিক করে ফেলে মিনতি করের কথা বাড়িতে কাউকে বলবে না।

তার আজকের অভিজ্ঞতার কথা সে অজয় হালদারকে বলল। তিনি চোখের ইশারায় দোতলার বৈঠকখানাকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ওনাকে জানাতে হবে। নিতাইকে সরিয়ে অন্য কাউকে রাখা না—রাখার মালিক উনি। তবে এরকম যে চলছে সেটা আঁচ করে ঠারে ঠোরে ওনাকে বলেওছি কয়েকবার। যাই হোক পরিমলকে শেষ পর্যন্ত অ্যাটর্নিবাবুর পরামর্শে সরানো হল। এটা এমনি এক চাকরি প্রলোভন পদে পদে। সৎ মানুষকে অসৎ করে দেয়, দশ বছরে তিনজনকে সরানো হল। তুমি যেসব কথা খুলে জানালে এটাই দরকার। সৎ থাকবে তা হলে জীবনে উন্নতি করতে পারবে।’

কথাগুলো শুনতে শুনতে অনন্তের বুকের মধ্যে কাঁপন লাগল। সেসব কথাই বলেছে শুধু একটি ঘরের কথা বলেনি যেখানে বাস করে এমন একজন যে তার বাবাকে ভালোবাসত, আজও ভালোবাসে।

সে বিমর্ষ হয়ে বাড়ি ফিরল। জেনেশুনে এই প্রথম সে অসাধু হল। কেউ জানতে পারলে তাকে আর ভালো বলবে না। কাউকে বোঝাতেও পারবে না কেন সে মিনতি কর নামটা খাতাপত্রের বাইরে রাখতে চায়।

রাত্রে সাধন বিশ্বাসকে সে এন্টালির বাড়ির কথা বলল। তিনি যে ঠিক লোককেই কাজটার জন্য সুপারিশ করেছেন, লোক চেনার সেই বিরল ক্ষমতার গর্ব তার চোখেমুখে প্রতিফলিত হল। এবারও একতলার ঘরের কথাটা সে বলতে পারল না।

রাতে খাওয়ার পর হঠাৎই সে মাকে বলল, ‘বাবার কোনো ছবি নেই?’

‘আছে তো।’

‘কই দেখি?’

শীলা ট্রাঙ্ক খুলে কাপড় ঘাঁটাঘাঁটি করে ছবি বার করে আনল।

অনন্ত অবাক হয়ে দেখল সেই ছবিটাই যা আজ সকালে সে দেখেছে, তবে এটা আকারে অনেক ছোটো পোস্টকার্ড মাপের।

‘কবেকার তোলা?’

‘বিয়ের পর।’

‘রেখে দাও।’

সে দ্বিতীয়বার আর ছবিটার দিকে তাকায়নি।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে সে মনের মধ্যে একটা খচখচানি অনুভব করেছিল। সে তখন জানত না আজীবন এটা তাকে অস্বস্তি দেবে।

.

সাত

পরের মাসেই অনন্তের চাকরি পাকা হয়ে গেল। যে উদবেগ সে এবং তাদের সংসার কাঁটা হয়ে থাকত, সেটা আর নেই। এখন তারা নিরাপদ, এই বোধ তাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছে পরিচিতের সঙ্গে মেলামেশায়।

অজয় হালদারের অবসর নেবার সময় হয়ে এসেছে, ব্লাডপ্রেশারের জন্য প্রায়ই কামাই করে। বাবার আমলের লোক, সমীরেন্দ্র তাই ওকে বসিয়েই মাইনে দেন। ওর কাজগুলো একে একে অনন্তের উপর এসে পড়তে লাগল। এতে সে খুশিই। অবসর সময় কীভাবে কাটাবে সেই সমস্যা অনেকটা মিটিয়ে দেয় বাড়তি কাজগুলো।

কর্মস্থল থেকে সে সোজা বাড়ি ফিরে আসে। সে সিনেমা দেখে না, আড্ডাও দেয় না যেহেতু তার বন্ধু নেই। মায়ের সঙ্গে সাংসারিক কথাবার্তা ছাড়া আর তার অবসর কাটাবার কিছু নেই।

ধুতি—শার্টের মতোই অঘোর এস্টেট থেকে বাড়ি প্রায় দেড়মাইল রাস্তা হেঁটে যাতায়াতের অভ্যাসটা সে ছাড়েনি।

আহিরিটোলার বাড়ির ভাড়া আদায়ে বা কর্পোরেশন অফিসে ট্যাক্স, ইলেকট্রিক অফিসে বিল জমা দিতেও সে হেঁটে যায়। হাঁটা তার কাছে নেশার মতো।

‘শরীর ফিট থাকে।’

‘তাই বলে রোজ রোজ এত হাঁটবি? এখন তো আর ট্রাম বাসের খরচ বাঁচাবার মতো অবস্থা নয়।’

‘না হলেই বা, খরচ না করলে যখন চলে তখন করব কেন, এ তো আর চাল নুন তেল নয়? হিসেব করে দেখেছি হাঁটলে আঠারো থেকে কুড়ি টাকার মতো সেভ হয়, বাড়িভাড়ার প্রায় ওয়ান—ফোরথ।’

শীলা দালানে রুটি সেঁকছিল। অনন্ত খালিগায়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। তার পাশে থালায় গরম রুটি আর বেগুনভাজা।

‘সেদিন ওপরে গেছলুম, বড়োগিন্নি এ—কথা সে—কথার পর বলল, এবার কিছু বাড়াও, অনেকদিন ধরেই সত্তর রয়েছে…গোটা একতলা, এখন এর ভাড়া কম করে আড়াইশো, সেলামিও হাজার চারেক হবে। অনন্ত তো রোজগার করছে…’

‘ভাড়া বাড়াও বললেই যেন বাড়াতে হবে। আমাদের আহিরিটোলার বাড়িতে তিনখানা ঘর, ছাদ, আলাদা কল—পায়খানা নিয়ে রয়েছে, ভাড়া দেয় কত জানো? উনচল্লিশ টাকা বারোআনা। রেন্ট কন্ট্রোলে এই মাসেই সাধনবাবু ভাড়া বাড়ানোর জন্য মামলা তুলবেন। এন্টালির বাড়িতে এক—একটা ফ্ল্যাট, কেউ দেয় পঁয়তাল্লিশ, কেউ দেয় পঞ্চান্ন, সব পঞ্চাশ—ষাট বছরের ভাড়াটে।…উঠে যাক, এখুনি ছ—শো টাকার ভাড়া হয়ে যাবে। এদের বলে দিয়ো একআধলাও বাড়াব না।’

অনন্ত ক্রমশই হিসেবি হয়েছে, সেই সঙ্গে প্রখর হয়েছে বাস্তববুদ্ধি। সে এখন থেকেই ভাবতে শুরু করেছে অনুর বিয়ের কথা। অনু বড়ো হয়েছে। ওর শরীরের দিকে আগের মতো আর অসংকোচে তাকানো যায় না।

কয়েকদিন ধরেই তার চোখে পড়ছে উঠতি বয়সি কিছু ছেলে, তাদের জানলার উলটোদিকে উৎপলদের রকে বসে একটু বেশি জোরে কথা বলছে, নিজেদের পরাক্রম সম্পর্কে জোরালো দাবি রাখছে, ঘনঘন তাদের জানলার দিকে তাকায়। ওদের বেশিরভাগই তার থেকে মাত্র তিন—চার বছরের ছোটো কিন্তু তাকে দেখলেই গলা নামিয়ে কথা বলে। এটা তাকে অদ্ভুতভাবে তৃপ্ত করে। সে অভিভাবক, সংসারের কর্তা এবং মানী। বাবা বেঁচে থাকলে এমনভাবেই লোকে তাঁর সঙ্গে ব্যবহার করত! অথচ তখন তার বয়স পঁচিশও নয়।

খবরের কাগজে পাত্র—পাত্রীর বিজ্ঞাপন থেকে সে অনুর জন্য সম্বন্ধ খুঁজতে শুরু করে। তিন—চার জায়গায় চিঠিও দেয়। উত্তরও আসে।

‘সবাই টাকা চায়।’

‘এই তো আঠারোয় পড়ল আর দুটো বছর থাক না।’

‘না না, ছোটোতেই বিয়ে দেওয়া ভালো। তুমি বোঝো না, অল্পবয়সি কাঁচা মন সহজে অ্যাডজাস্ট করে নিতে পারে তাতে সুখীই হয়। আগেকার দিনে সাত—আট বছরেই বিয়ে দেওয়া হত, খুব ভালো নিয়ম ছিল।’

‘যা ভালো বুঝিস কর। গয়নাগুলো থাকলে ভাবনা ছিল না…দু—চার ভরি তো দিতেই হবে, একেবারে খালি গলা—হাতে কি মেয়ে দেওয়া যায়!’

‘ব্যাঙ্কে তো হাজার ছয়েক রয়েছে এখনও, তাই থেকে…’

‘অলুর জন্য লাগবে না?’

‘অর্ধেক টাকা ওর জন্য থাকবে।’

‘বিয়ের খরচ তো আছে…কিছু কেনাকাটা, লোক খাওয়ানো, নমস্কারি, ফুলশয্যার তত্ত্ব, দানের বাসন নমোনমো করে দিলেও তো হাজার দু—তিন, তার ওপর গয়না, অর্ধেক টাকায় এত সব হবে?’

অনন্ত চুপ করে থাকে। একটা প্রবল বিরক্তির মধ্যে তাকে হাত—পা বেঁধে যেন জোর করে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে। হাত—পা ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেই বাঁধনগুলোয় টনটন করে ওঠে। এসব দায় বাবার।

কিন্তু এখন সে বাবার জায়গায়, সে বড়োছেলে। অনেক টাকার দায় তার ঘাড়ে, অনেক বছর এটা থাকবে। তাকে টাকা রোজগার করে যেতে হবে শুধু এদের জন্য। অমর থাকলে সাহায্য করত কি?

এন্টালি থেকে মৌলালির দিকে হেঁটে যাবার সময় দু—তিনদিন সে একটা চায়ের দোকানে সকালে অমরকে দেখেছিল খবরের কাগজ পড়ছে। সামনের প্লেটে টোস্ট। পরনে লুঙ্গি আর হলুদ পাঞ্জাবি। কাছাকাছিই কোথাও থাকে। দেখা করে কথা বলতে ইচ্ছে করলেও সে জড়তা কাটাতে পারেনি। কী ব্যবহার করবে?

অবশেষে দোকানটার সামনেই একদিন সকালে তারা মুখোমুখি হয়ে গেছল। ন—টার মধ্যে সেদিন এক ভাড়াটের সঙ্গে দেখা করার কথা। অনন্ত ব্যস্ত হয়ে হাঁটছিল, অমরকে সে দেখতে পায়নি।

‘এদিকে কোথায় যাও?’

অনন্ত চমকে উঠেছিল। অমরের দিকে প্রথমে সে অবিশ্বাসীর মতো তাকিয়ে হঠাৎ ডান হাতটা ওর কাঁধে রেখে বলেছিল, ‘তুই তো বেশ মোটা হয়েছিস।’

অমরের ভ্রূটা কুঁচকে উঠল। কথাটায় আমল না দিয়ে বলল, ‘বাড়ির সবাই ভালো আছে?’

‘হ্যাঁ, মা তোর কথা বলে।’

‘অ।’

ওদের দু—পাশ দিয়ে মানুষ চলাচল করছে। ফুটপাথের মাঝখানে পথজুড়ে থাকার জন্য কেউ কেউ বিরক্তিভরে তাকিয়ে গেল।

‘চা খাবে…এসো তা হলে।’

অনুরোধ নয়, প্রশ্ন নয় যেন নির্দেশ। উত্তরের জন্য পরোয়া না করে অমর চায়ের দোকানের দিকে এগোল। ওর সঙ্গে অনন্তও ঢুকল। মুখোমুখি বসল। জীবনে এই দ্বিতীয়বার সে রেস্টুরেন্টে বসল। প্রথমবার গৌরীর সঙ্গে। ছোটো দোকান, চারটে মাত্র টেবল। দরজাবিহীন রান্নাঘর থেকে ডিম আর সেঁকারুটির গন্ধ আসছে।

‘ওমলেট খাবে?…অ্যাই এদিকে আয়।’

যতক্ষণ না ওমলেট এবং মাখন লাগানো টোস্ট এল, অমর খবরের কাগজের পাতা উলটে দ্রুত উপর—নীচের হেডিংগুলোয় চোখ বোলাল। দু—তিনবার ঝুঁকে পড়ল।

ততক্ষণ অনন্ত ওকে দেখছিল। মসৃণভাবে কামানো গালদুটো ভরন্ত। গায়ের রং একটু তামাটে হয়েছে। পাঞ্জাবির বোতাম খোলা, বুকের লোম ঘন, দু—হাতেও রোম, বাঁ—হাতে কালো ডায়ালের ঘড়ি। চুল এলোমেলো, কিছুটা যেন লম্বাও হয়েছে। গলার স্বর আগের থেকে ভারী। অমর একটা পুরুষমানুষ হয়ে উঠেছে। ওকে দেখে অনন্তের ভালো লাগল।

কাগজ নামিয়ে অমর চায়ে চুমুক দিয়ে একটা টোস্ট তুলে নিল।

‘সবাই তা হলে ভালো আছে।’

‘মা তোর কথা প্রায়ই বলে, গিয়ে দেখা করলেই তো পারিস।’

অমর কাগজ পড়ায় মন দিল। টোস্টে কামড় দিয়ে চিবোতেই মড়মড় শব্দে অপ্রতিভ হয়ে অনন্ত চিবোনো বন্ধ রেখে টুকরোটা মুখের মধ্যে রেখে দিল ভেজাবার জন্য। অমর তার অস্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে যাচ্ছে। কিছুই ভোলেনি তা হলে।

‘তুই এখন কী কচ্ছিস, থাকিস কোথায়?’

‘একটা ফার্মে আছি, রাত্তিরে পড়ি।’

‘বি এ—টা পাশ করেছিস?’

‘হ্যাঁ। তুমি কি এখনও বই বাঁধানোর কাছে আছ?’

‘না অনেকদিন ছেড়ে দিয়েছি। এই কাজটা…।’

অনন্ত থেমে গেল। ওকে বলা যাবে না। অমর জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে।

‘…বছর চারেক করছি। একটা এস্টেটে, এখন আর জমিদারি নেই, ওদের কলকাতার বাড়িগুলোর দেখাশোনা ভাড়া আদায় এই সব করি।’

‘অনু—অলুর কোন ক্লাস হল, পড়ছে ওরা?’

‘অনু ছেড়ে দিয়েছে পড়া, অলুর এবার প্রি—ইউ।’

‘ছাড়ল কেন, পড়া কি ছাড়তে আছে! এবার তা হলে বিয়ে দিয়ে দাও।’

নিজের বোন নয়, যেন দূরসম্পর্কের কোনো আত্মীয় সম্পর্কে পরামর্শ দিচ্ছে এমন ভঙ্গিতে অমর বলল। অনন্তের ভিতরটা ক্রমশই বসে যাচ্ছিল। ফিকে হেসে ওমলেটের শেষ টুকরোটা চামচেয় তোলার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘তাই ভাবছি। টাকাপয়সা তো নেই হাতে…।’

অনন্তের আশা জাগল, অমর এবার বলবে সে সাহায্য করবে। কিন্তু তার বদলে সে ওমলেটের টুকরোটাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘ওভাবে উঠবে না, হাত দিয়ে তুলে নাও।’

অপ্রতিভ হয়ে অনন্ত তাই করল। অমর টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না এটা সে বুঝে গেছে। কিংবা হয়তো চাইছে হাতজোড় করে দাদা তার কাছে টাকা চাক।

কিন্তু সে চাইবে না। ক—টা বছর একাই সংসার চালিয়ে গেল, একাই সে বোনেদের বিয়ে দেবে। যেমন ভাগ্য করে এসেছে তেমন পাত্রই পাবে।

‘উঠব এবার।’

অমর ইশারায় ছেলেটাকে ডেকে বুকপকেট থেকে পাঁচ টাকার নোট বার করে দিল।

‘তুই তা হলে আর আসবি না।’

‘না।’

‘খোঁজখবরও করবি না?’

‘এই তো খোঁজ নিলুম, এইভাবেই নেব…দূরে থাকাই তো ভালো।’

‘তুই কি আমার ওপর রেগে আছিস এখনও?’

অমর হাসল। স্বচ্ছ উদার। তাতে একছিটেও মালিন্য নেই।

‘একদমই না। হ্যাঁ, তখন রেগে ছিলুম তো বটেই। এখন বুঝতে পারছি ভালোই করেছি। সবাই মিলে ওভাবে একসঙ্গে, কোনোক্রমে আধপেটা খেয়ে বেঁচেবর্তে শুধু দিন কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই হত না। জড়াজড়ি করে এখন আর কিছু করা যায় না। বড়োজোর ভেসে থাকা যায় কিন্তু সাঁতার কাটা যায় না।’

‘সবাইকে দেখা, ভরণপোষণ…দায়িত্ব আছে সেটা তো পালন করা উচিত বিশেষ করে যাদের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। নয়তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করতে হবে। …মা দাসেদের বাড়ি রাঁধুনির কাজ নেবে বলেছিল আমি নিতে দিইনি…না খেয়ে থাকব সে—ও ভালো তবু মানসম্মান খোয়াব না।’

অনন্ত জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে রইল। অমরের মুখে বিরক্তিটা প্রকট হয়ে উঠেছে। খুচরো পয়সাগুলো পকেটে রেখে বাঁ হাতের তালুতে মৌরি তুলে নিল।

‘মানসম্মান বাঁচিয়ে রেখে কী পেয়েছ? চার বছর আগে যা ছিলে এখনও তো তাই আছ…ভবিষ্যতেও তাই থাকবে…লোকে বলবে তোমরা মানী, সৎ, ভালো…তাই দিয়ে কি অনুর বিয়ে দেওয়া যাবে?’

‘সেটা আলাদা কথা, যা চলে আসছে, যা নিয়ম সেইভাবেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। সম্মান একটা আলাদা ব্যাপার।’

‘কীসে আলাদা?’

অনন্ত এই মুহূর্তে কোনো জবাব খুঁজে পেল না। সে উঠে দাঁড়াল।

‘তুই তা হলে আমাদের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক রাখবি না?’

‘রাখারাখির কী আছে! তোমাদের কি কোনো অসুবিধা হয়েছে আমি না থাকায়?

‘না।’

অস্বাভাবিক জোর দিয়ে সে ‘না’ বলল। অমরের যে আদৌ কোনো গুরুত্ব নেই তাদের সংসারে এটাই সে বোঝাতে চাইল।

‘তাহলে? কী দরকার সম্পর্কের ডালপালা ছড়িয়ে?’

‘তাতে সাঁতার কাটায় সুবিধা হয়।’

‘ঠিক।’

অমরের সঙ্গে এরপরও কয়েকবার দেখা হয়েছে রাস্তায়, এই চায়ের দোকানের সামনে। ‘ভালো আছিস?’ ‘বাড়ির সবাই ভালো?’ ‘মা তোর কথা বলছিল, দেখতে চায়।’ ‘যাব একদিন।’ এইভাবেই হাঁটা থামিয়ে তারা কথা বলেছে। অমর কোথায় থাকে, কোথায় কাজ করে কিছুই বলেনি, অনন্তও জানাতে চায়নি। প্রথমদিন দেখা হওয়ার কথাটা সে মা—কে বলেছিল, তারপর আর বলেনি। মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অমর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছিল তার কাছে।

অনুর বিয়ের জন্য অর্থ ও পাত্র জোগাড় করার ভাবনা মাঝে মাঝেই তাকে বিব্রত করত। মাঝে মাঝে মনে হত অমর ঠিকই বলেছে, জড়াজড়ি করে সাঁতার কাটা যায় না। কীভাবে সাঁতার কাটতে হয় সেটাও শেখেনি। অমর বেরিয়ে গিয়ে শিখেছে। হয়তো পাড়ে উঠতে পারবে।

বিজ্ঞাপন দেখে নিয়মিত চিঠি দিয়ে যাচ্ছিল অনন্ত। কটক থেকে একটি জবাব তাকে আশান্বিত করল। মাকে চিঠি দেখাল। ছোটো চিঠি, পাত্রপক্ষ একপয়সাও নগদ নেবে না, একরতি সোনাও চায় না। মেয়ে পছন্দ হলে তারাই বিয়ের খরচ দিয়ে মেয়ে নিয়ে যাবে।

শীলা অবাক হয়ে বলল, ‘শুনেছি এরকম অনেক বিয়ে হয়েছে, বরপক্ষই খরচ দিয়ে মেয়ে নিয়ে গেছে। সে—সব পরমাসুন্দরী মেয়ে…অনু তো দেখতে পাঁচপাঁচি!’

‘বলি না মেয়ে দেখে যেতে।’

‘অতদূরে, খোঁজখবর নেওয়া তো সোজা নয়। কেমন ঘর, কেমন লোক, ঠগ কি না কিছুই তো জানি না। ঠাকুরপোকে বল না একবার। ওর তো চেনাশোনা কেউ কটকে থাকতে পারে, খোঁজখবর নিয়ে জানাবে।’

অবিনাশের চেনালোক ছিল ভুবনেশ্বরে। সে প্রায় রোজই কটকে যায় ব্যবসা সূত্রে। তাকে দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনপুরুষ তারা কটকের বাসিন্দা, সম্পন্ন একান্নবর্তী বিরাট পরিবার। দুটি দোকান আছে গহনার। পাত্রের বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ, বিয়ে হয়েছিল, বউ মারা গেছে একটি এক বছরের ছেলে আছে। পাত্র ক্লাস সেভেন—এইট পর্যন্ত পড়েছে।

ওরা তিনজন বিভ্রান্ত বিষণ্ণ হয়ে সন্ধ্যায় দালানে বসে ছিল। অবিনাশকে লক্ষ করে অনন্ত বলে, ‘কাকা কী করব বলুন? পরে সবাই আমাকে বলবে, হাত—পা বেঁধে মেয়েটাকে দাদা জলে ফেলে দিল, তা হতে দেব না।’

‘এমন ঘর, জল ভাবছিস কেন?’

‘বয়সের পার্থক্যটা? অনুর প্রায় দ্বিগুণ!’

‘এমন পার্থক্যে কি বিয়ে হয় না? আমার মা আর বাবার মধ্যে পার্থক্য তো একুশ বছরের, কোনো অসুবিধা হয়নি…বাহান্ন বছর দিব্যি কাটিয়ে গেছে একসঙ্গে।’

‘সে আমলে ওসব হত এখন কি আর হয়?’

শীলা অস্ফুটে বলল, ‘গিয়েই ছেলে ধরতে হবে। লেখাপড়ার কথা নয় ধরছি না, পুরুষমানুষের রোজগারই আসল গুণ।’

অনন্ত বুঝতে পারছে না সে রাজি হবে কি হবে না। শীলার খুঁতখুঁতনি বিপত্নীক হওয়ার জন্য। অবিনাশের মত আছে।

‘আমার মনে হয় অনুকেই জিজ্ঞাসা করা উচিত…ওর মতামতটাই আসল। ও যদি রাজি থাকে তা হলেই আমরা এগোব।’

অনু ঘরে ছিল। সব কথাই তার কানে গেছে। অনন্তর কথাগুলো শেষ হওয়ার কয়েক সেকেন্ড পরই ঘর থেকে তার গলা শোনা গেল।

‘আমার অমত নেই, তোমরা যেখানে বিয়ে দেবে সেখানেই বিয়ে করব।’

ওরা স্বস্তিবোধ করেছিল। কিন্তু অনন্তের বুকের মধ্যে শুরু হয়ে যায় নতুন একটা খচখচানি। সে মুখ নামিয়ে বসে থাকে।

তখন অবিনাশ মৃদুকণ্ঠে বলেন, ‘যার যেখানে অন্ন বাঁধা সেখানেই পাত পাততে হবে।’

এক মাসের মধ্যেই অনুর বিয়ে হয়ে গেল। পাত্রের দাদা ও সম্পর্কিত মামা এসে মেয়ে দেখে পছন্দ করে যায়। অনু বলেছিল, তার কোনো বন্ধুকে সে নিমন্ত্রণ করবে না। প্রায় নিঃসাড়েই বিয়ে হল। সদরে বাড়তি একটি বালব ছাড়া বিয়েবাড়ির কোনো চিহ্ন ছিল না। বরের সঙ্গে এসেছিল চারজন। উঠোনে উনুন পেতে রান্না হয়, খাওয়া হয় দালানে। পাড়ায় কাউকেই তারা বলেনি, শুধু সাধন বিশ্বাস আর তার ছেলে উৎপলকে নিমন্ত্রণ করেছিল। তিনি আসেননি শরীর ভালো না থাকায়, উৎপল এসে একটা তাঁতের শাড়ি দিয়ে গেছে। দোতলার জ্যাঠামশাই বাদে আর সবাই খেয়ে গেছে। দু—তিনজন কাঙালি সদরের সামনে অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে চলে যায়।

পরদিন বর—বউ বাড়ি থেকেই হাওড়া স্টেশনে যায়। ওদের ট্রেনে তুলে দিতে সঙ্গে গেছল অনন্ত। অনু ট্যাক্সিতে ওঠার সময় কাঁদেনি। ট্রেন ছাড়ার মুহূর্তে কেঁদে উঠবে এমন একটা ব্যাপারের জন্য সে তৈরি ছিল। ট্রেন ছেড়ে দিল। অনন্ত দেখল হাজার বছরের পুরোনো কাঠের মতো শুকনো মুখ নিয়ে তার বোন একদৃষ্টে সামনে তাকিয়ে বসে। মুখটাকে চিরকালের মতো অনন্তের বুকে খোদাই করে দিয়ে ট্রেনটা চলে গেল।

আট

অনন্ত ঠিক করেছিল অলুর বিয়ে এমনভাবে দেবে যাতে ওর মনে কোনো খেদ না থাকে।

বি এ পাশ করার দু—বছর পর অলু ফুড কর্পোরেশনে চাকরি পায়। নিজের চেষ্টাতেই জোগাড় করেছে। অনন্ত শুনে থ হয়ে গেছিল। তাদের বাড়ির মেয়ে চাকরি করবে দশটা—পাঁচটা! বিস্ময়টা ক্রমশ ভয়ে রূপান্তরিত হয়ে তাকে কিছুদিন নানান অশুভ ভাবনায় ডুবিয়ে দিয়েছিল। প্রায়ই তার মনে হত, অলু বাবার মতো বাস চাপা পড়ে মরে যাবে। এই পরিবারের মধ্যে অলু একটু আলাদা ধরনের। অমরের সঙ্গে ওর মিল আছে। কলেজে পড়ার সময় কিছু ছেলেমেয়ে ওর সঙ্গে দুপুরে বা বিকেলে আসত। বাড়ি ফিরে অনন্ত সে খবর পেত শীলার কাছে।

‘অলুর বন্ধুরা বেশ মিশুকে। মুড়ি খেতে চাইল, আমি বললুম দোকানে যাবার লোক নেই, ওদেরই একজন মুড়ি, বেগুনি কিনে আনল। চা করে দিলুম। ছেলেগুলো বেশ।’

‘ছেলে?’

‘ওর সঙ্গেই পড়ে।’

অলু কলেজ ইউনিয়নের সহ—সম্পাদিকা হয়েছিল। অনেকদিনই সে সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরত। অনন্তের সেটা ভালো লাগত না।

‘ওকে বলে দিয়ো বিকেল থাকতে থাকতেই যেন বাড়িতে ঢোকে। এ—বাড়ির মেয়েরা সূর্য ডুবলে বাড়ির বাইরে থাকে না।’

‘বিকেলে টিউশানিতে যায়, হয়তো কোনো কারণে দেরি হয়েছে।’

একদিন শীলা একটি পাতলা পত্রিকা অনন্তকে দেখাল। ‘অলু কেমন পদ্য লিখেছে দেখ।’

অনন্ত অবাক হয়ে পত্রিকার পাতাটার দিকে তাকিয়ে থেকেছিল। ছাপার অক্ষরে তাদের কারোর নাম সে জীবনে এই দ্বিতীয়বার দেখল। বাবার বাসচাপা যাওয়ার খবরটার সঙ্গে ‘শক্তিপদ দাস’ নামটা খবরের কাগজে বেরিয়েছিল।

ষোলো লাইনের পদ্যটা তিন—চারবার সে পড়ে। একদমই মাথামুণ্ডু বুঝতে পারেনি। কিন্তু ‘স্তন’ আর ‘চুম্বন’ শব্দদুটি তাকে রীতিমতো ভয় পাইয়ে দেয়। অলুর হাত দিয়ে এইসব নোংরা জিনিস বেরোয় কী করে? একটা মেয়ে! তাদের বাড়ির মেয়ে এইসব অসভ্য চিন্তা করছে আর পাঁচজনকে তা জানাচ্ছে, লোকে কী ভাববে! তারই বোন, তার সম্পর্কে কী ধারণা হবে? পাড়ার কেউ পড়েছে কি না কে জানে।

অলুর পদ্যটা কয়েকদিনের জন্য তাকে সন্ত্রস্ত রেখেছিল। সে আবার ভয় পায় যখন শীলা বলল, ‘অলু দু—দিনের জন্য বন্ধুদের সঙ্গে দিঘায় বেড়াতে যাবে।’

‘কী দরকার যাবার?’

‘মানুষ বেড়াতে যায় না? এই তো ওপরের ওরা পুরী—টুরি ঘুরে এল।’

‘ঘুরুক গে, পয়সা আছে তাই গেছে।’

‘তোরও তো পয়সা আছে, সেদিন তো বললি এখন সাড়ে ছ—শো টাকা মাইনে। আমায় নিয়ে চল না, কাশীটা একবার দেখে আসি।’

‘শুনতেই ওই সাড়ে ছ—শো। হাতে আর একটু জমুক। জিনিসপত্রের দাম কত বেড়েছে জানো? একজোড়া কাঁচকলা চল্লিশ পয়সা, শুনেছ কখনো?’

অলু দিঘা ঘুরে এল। তাদের বাড়ির মেয়ে দুটো দিন বাইরে কাটাচ্ছে, এটা সে ভাবতেই পারে না। অলু যখন তখন বাড়ি থেকে বেরোয়, ফেরারও ঠিক নেই, এটাও সে মানতে পারে না। সেজন্য মা—র কাছে বিরক্তি প্রকাশ করে, রাগও। কিন্তু অলু তা গ্রাহ্য করে না।

প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে অলু শীলার হাতে দু—শো টাকা দেয়। অনন্ত তখন ঘরে। ওদের কথা তার কানে যাচ্ছিল।

‘আমাকে দিচ্ছিস কেন, দাদার হাতে দে।’

‘তুমিই দাও।’

‘আমি না, তুই দিলেই ভালো দেখায়। সংসারের সব খরচ—খরচা তো ওই করে।’

অলুর মুখটা খুশিতে, লজ্জায় আর উত্তেজনায় টসটস করছিল। দেখতে সুশ্রীই, আলগা চটক সারা অবয়বে। কথাবার্তায় চোখা, অনুর মতো কুনো ভোঁতা নয়। এই বোনটিকে নিয়ে অনন্তর যত দুর্ভাবনা ততই নিশ্চিন্তি।

‘দাদা।’

অলুর বাড়ানো হাতে কড়কড়ে দুটো একশো টাকার নোট। অনন্ত ভেবেছিল পুরো মাইনেটাই তার হাতে দেবে। তাই তো উচিত। এতকাল যেমন টাকা চেয়ে নিয়েছে, সেইভাবেই চাইবে। অবশ্য টিউশনি শুরু করার পর অলু আর টাকা চায়নি।

‘আমায় দিচ্ছিস কেন, জমা, ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোল।’

‘অ্যাকাউন্ট আছে, এটা সংসারের খরচের জন্য।’

অ্যাকাউন্ট আছে শুনে অনন্ত ধাক্কা খেল। তার পরামর্শ না নিয়েই অলু ব্যাঙ্কে টাকা জমাতে শুরু করে দিয়েছে। নিজেই হিসেব করে দু—শো টাকা দিচ্ছে সংসারের জন্য। অথচ এমন দিনও গেছে টিপেটিপে ষাট টাকায় মাস চলেছে। তার মনে হল, সংসার থেকে অমরের মতো অলুও বিচ্ছিন্ন হতে চলেছে। তাকে আর ধর্তব্যের মধ্যে রাখছে না।

অনন্ত টাকাটা হাতে নেয়নি। অলুকে বলেছিল টেবলে রাখতে। আর বলেছিল পরের বার থেকে মা—র হাতেই যেন দেয়।

একদিন অলু তার মাকে জানাল সে বিয়ে করবে। ছেলেটির নাম শান্তনু। কলেজে তার দু—বছরের সিনিয়র ছিল। আধুনিক গান লেখে, রেডিয়োয় আর অ্যামেচার থিয়েটার দলে অভিনয় করে, খবরের কাগজে এটা—ওটা লেখে, ভবানীপুরে নিজেদের বাড়ি, অবস্থা ভালো। তবে চাকরি করে না।

রাত্রে অনন্ত খেতে বসলে শীলা ফিসফিস করে জানাল,

‘অলু বিয়ে করবে, ছেলে চাকরিবাকরি করে না।’

‘কী করে তা হলে?’

‘তুই ওকেই জিজ্ঞেস করিস। বেকারকে বিয়ে করবে, ওর কি মাথা খারাপ হয়েছে?’

‘পরে চাকরি পাবে।’

‘যখন পাবে তখনই বিয়ে করবে। তুই বারণ কর।’

‘আমাকে তো অলু বলেনি কিছু, যেচে বলাটা ঠিক হবে না। তা ছাড়া ছেলেকে তুমিও দ্যাখোনি আমি দেখিনি।’

পরদিন অফিস যাবার আগে অলু তাকে বলেছিল। অনন্ত চুপ করে শুনে যায়।

‘রেজিস্ট্রি করব। গাদাগুচ্ছের খরচ করার মতো টাকা আমার নেই।’

আমার নেই মানে? অলু কি নিজের বিয়ের খরচ নিজেই করবে? অনন্ত আর একটা ধাক্কা খেল। নিজের দায় নিজেই বইবে, ভালো। তাকে যদি অগ্রাহ্য করতে চায় করুক।

‘তুই ভেবেচিন্তে দেখেছিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমাদের বংশে কেউ রেজিস্ট্রি বিয়ে করেনি।’

‘করেনি, এবার হবে।’

অনন্ত একবার শুধু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আলনা থেকে শার্টটা তুলে নিয়ে বলল, ‘আমরা কেউ কিন্তু দায়ী থাকব না যদি কিছু ঘটে।’

‘কী ঘটবে?’

‘ভালোবাসার বিয়ে তো…দেখলুম না তো কাউকে সুখী হতে।’

‘তুমি আবার দেখলে কবে?’

অলু তীক্ষ্ন স্বরে ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল। ‘তুমি তো লোকজনের সঙ্গে কোনোদিন মেলামেশাই করোনি। কোনোদিন তোমার একটা বন্ধু দেখলাম না, একটা বই পড়তে দেখলাম না…সিনেমা, গান, নাটক, বেড়ানো কিছুই না। শুধু কাজে যাওয়া আর ঘরে বসে থাকা…তুমি ভালোবাসার বিয়ের কী বোঝ আর কী জানো, শুধু তো ভালো ছেলে হয়েই জীবন কাটিয়েছ।’

অনন্ত হতভম্ব হয়ে, শার্টের মধ্যে দু—হাত গলানো অবস্থায়, তাকিয়ে থেকেছিল। দরজার কাছে শীলা দাঁড়িয়ে।

‘অলু কাকে কী বলছিস তুই! তোর দাদা সতেরো বছর বয়স থেকে সংসারের হাল ধরেছে, তোদের মানুষ করেছে, আর তুই কিনা চাকরি পেয়ে সব ভুলে গেলি?’

অলুকে বিচলিত দেখাল কিন্তু রাগ পড়েনি।

‘ভালোবাসার বিয়ে নিয়ে দাদা বাজে মন্তব্য করল কেন? আমি অসুখী হব এমন ইঙ্গিত দেওয়ার কী দরকার ছিল? আমি তো অনু নই যে সবাই মিলে যেমন—তেমন একটা বিয়ে দেবে আর মেনে নেব।’

‘যেমন—তেমন? ওকে জিজ্ঞেস করে মত নিয়ে তবেই বিয়ের কথা বলেছি।’

‘মতামত দেবার মতো বুদ্ধি তখন ওর হয়নি, হলে বিয়ে করত না। তোমরা ওর জীবনটা নষ্ট করেছ।’

অলু দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। ওর জুতোর শব্দ সদরে না পৌঁছোনো পর্যন্ত কেউ কথা বলেনি।

‘অনুর জীবন কি নষ্ট হয়েছে, মা?’

‘পাঁচটা ছেলেমেয়ে পেটে ধরেছে, সতীনের ছেলেকে নিজের পেটের ছেলের থেকে আলাদা করে দেখে না, অনু আমার কত ভালো মেয়ে। ও সুখী হবে না তো কে হবে! জামাই বাড়ি করবে বলে জমি কিনেছে…’

অনন্ত আর শোনেনি। সে কাজে বেরিয়ে গেছল। সারাদিন তার মাথার মধ্যে ঘুরেছে অলুর কথাগুলো। সত্যিই সে মেলামেশা করেনি। সত্যিই তার কোনো বন্ধু নেই। ভালোবাসার কিছুই সে জানে না। অলুর প্রত্যেকটা কথাই সত্যি, ভালো ছেলে হয়েই তার দিনগুলো কেটে গেল।

রাত্রে অনন্তের ঘুম এল না। এন্টালির বাড়িতে ফাটা ছাদ দিয়ে জল পড়ছে, রাজমিস্ত্রি নিয়ে আজ গেছল কাজ বুঝিয়ে দিতে। ফেরার সময়, প্রতিবারের মতো, মিনতি করের ঘরে যায়।

‘রোজই অপেক্ষা করি এই বুঝি দারোয়ান এসে জিনিসপত্র ছুড়ে ছুড়ে ফেলে আমায় বার করে দেবে। রাতে ঘুম হয় না।’

‘আপনাকে তো বলেছি, এসব চিন্তা করবেন না। যদি তুলেই দিত, তা হলে দশ—বারো বছর আগেই দিত। আমি যতদিন আছি আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।’

‘পেটের ছেলেও এত করে না, তুমি যা করছ আমার জন্য।’

ঘরের মধ্যে লম্বা পর্দাটা আর নেই। অনন্ত যখনই আসে দরজার কাছে চেয়ারটায় বসে। ছবিটা একই জায়গায়, একই রকম উজ্জ্বল। শুধু ফ্রেমের রংটা ধূসর হয়েছে।

‘এখনও আপনি আগের মতোই ভালোবাসেন?’

চোখ পিট পিট করলেন মিনতি কর। আরও শীর্ণ, চোয়ালের চামড়া শিথিল, চোখের কোণে ভাঁজ, পিঠটা একটু বাঁকা কিন্তু হাসিটা বাচ্চচা মেয়ের মতো।

‘এই নিয়ে কতবার জিজ্ঞাসা করলে বলো তো?’

‘চারশো তিয়াত্তরবার।’

‘ঠাট্টা নয়, ঠাট্টা নয়…তোমার ভীষণ কৌতূহল ছবিটা সম্পর্কে,…নেবে ওটা?’

অনন্তর বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠেছিল। আচমকা তার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল কথাটা, ‘নেব।’

‘আমি মরে গেলে, তার আগে নয়।’

মিনতি কর চা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রসঙ্গটা বন্ধ হয়ে যায়।

ভোররাতে অনন্তের চোখে ঘুম নেমে আসে।

তিনদিন পর সন্ধ্যায় অলুর সঙ্গে একটি যুবক এল। উঠোনে দাঁড়িয়ে অনন্ত তখন খালি গায়ে ভিজে গামছা রগড়াচ্ছিল। যুবকটিকে দেখামাত্র তার মনে পড়ল রমেনকে। দাঁড়ানো, তাকানো ছাড়াও অসম্ভব মিল রয়েছে শরীরের গড়নে। আপনা থেকেই তার দৃষ্টি অলুর গলায় পড়ল। গৌরীর স্মৃতি অস্পষ্ট হয়ে এলেও সবুজ পাথরের মালাটা জ্বলজ্বলে রয়েছে। এত বছরে একবারও ওর সঙ্গে দেখা হল না।

‘শান্তনু…এই হচ্ছে আমার দাদা।’

হাত তুলে নমস্কার করল শান্তনু। অনন্ত কোনোরকমে হাতের মুঠি দুটো বুকের কাছে তুলল। কোনো কথা বলল না।

‘তোমার সঙ্গে কথা বলবে বলে এসেছে।’

‘কী কথা।’

নিজের গম্ভীর, নিস্পৃহ স্বরে অনন্ত অবাক। তার যে কোনো আগ্রহ নেই সেটা ওরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে।

‘বিয়ের কথা বলতে এসেছি।’

‘মা—র সঙ্গে।’

শান্তনুকে নিয়ে অলু মা—র ঘরে ঢুকল। একটু পরেই অনন্ত নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। পার্কে একটা রাজনৈতিক সভা চলছিল, সভার পিছনে বসে বক্তৃতা শুনতে শুনতে তার মনে হল পনেরো বছর আগে সে ঠিক এই কথাগুলিই শুনেছে এই পার্কে। লোকগুলোর বক্তৃতার স্বর এবং ভঙ্গি একটুও বদলায়নি। শ্রোতারাও পনেরো বছর আগের মতোই হাততালি দিল।

অলু বিয়েতে সাক্ষী হবার জন্য অনন্তকে বলেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে রাজি হয়ে যায়। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করছে কারোর মতামতকে গ্রাহ্য না করে। সুতরাং ভবিষ্যতে অলুর কিছু বলার মুখ থাকবে না।

শীলার কাছ থেকে অনন্ত শুনল, বিয়ের পর অলু শ্বশুরবাড়ি যাবে না। শান্তনুর মা, বউদি আর দাদার আপত্তি আছে এই বিয়েতে।

‘নগদ, গয়না, আলমারি, খাট এইসব আশা করেছিল।’

‘ছেলের তো কোনো রোজগারই নেই।’

‘তা হলেই বা বড়ো বংশ, নিজেদের বাড়ি, বড়ো বড়ো নামি আত্মীয়স্বজন…ওরা ঠিক করেছে ঘর ভাড়া নিয়ে আলাদা থাকবে।’

‘তার মানে অলুকেই সব খরচ টানতে হবে। এরকম বিয়ের কী যে দরকার…যাক গে ওরা যা ভালো বোঝে করুক।’

‘তুই সেদিন আর শার্ট পরিস না, পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে যাস।’

অনন্ত পাঞ্জাবি পরেই রেজিস্ট্রারের অফিসে হাজির হয়েছিল অলুর সঙ্গে। সে বাসে ওঠার কথা বলেছিল, অলু হাত তুলে ট্যাক্সি থামিয়ে বলেছিল ‘আজ আর বাসে নয়।’ ট্যাক্সি থেকে নামার পরই তার মনে পড়ে জীবনে এই দ্বিতীয়বার সে ট্যাক্সিতে উঠল! খুব আশ্চর্য হয়ে সে মুখ ফিরিয়ে গাড়িটাকে বারবার দেখে চিনে রাখার চেষ্টা করে। প্রভিডেন্ড ফান্ড তোলার জন্য প্রথম ট্যাক্সি করে গেছল।

শান্তনু আর তার দুই বন্ধু তখনও আসেনি। অলু অধৈর্য হয়ে কয়েকবার তার হাতঘড়ি দেখল।

‘ক—টায় আসবে বলেছে?’

‘একটায়।’

দেওয়াল ঘড়িতে তখন একটা—দশ। রেজিস্ট্রারের বন্ধ ঘরের মধ্যে দু—জন নারী—পুরুষ। তারা বিয়ের ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছে।

‘বোধহয় ট্র্যাফিক জ্যামে পড়েছে।’

আরও দশ মিনিট পর শান্তনু এল। ঝোলা কাঁধে চাপদাড়িওলা সঙ্গে একজন। অলুকে দেখে পরিচিতের হাসি হাসল।

‘আরে প্রশান্তর জন্য বারোটা থেকে অপেক্ষা করে করে…দাদা ভালো আছেন…শেষকালে আর দাঁড়ালাম না। অরুণ ইনি অলুর দাদা, আর এ হচ্ছে আমার বাল্যবন্ধু অরুণ সেন।’

আধ ঘণ্টার মধ্যেই বিয়ে শেষ করে, রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে ওরা বেরিয়ে পড়েছিল। অলুর হাতে গোলাপের স্তবক, অরুণের দেওয়া। বুকের কাছে রেখে মাথা নামিয়ে মাঝেমাঝে গন্ধ শুঁকছিল। শীলা একটা সিঁদুরের কৌটো অনন্তকে দিয়ে বলেছিল, ‘বিয়ের পর অলুর সিঁথিতে শান্তনু যেন দেয়।’

অনন্ত ভুলে গেছল। রেজিস্ট্রারই বললেন, ‘সিঁদুর এনেছেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই যে।’

অনন্ত পকেট থেকে বার করে কৌটোটা। শান্তনু নস্যির টিপের মতো সিঁদুর তুলে অলুর সিঁথিতে মাখিয়ে দেয়। অলুর চোখদুটো মুদে এল, চামড়া ভেদ করে আলতো একটা আভা মুখের উপর ছড়িয়ে পড়ল। নতুন সিল্কের শাড়ি পরেছে, হালকা গোলাপি জমিতে, রজনীগন্ধার ঝাড় উঠেছে পায়ের কাছ থেকে হাঁটু পর্যন্ত। আজ পরবে বলেই কিনেছে।

অনন্ত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ভাবল, অলুর যে এত রূপ তা তো কখনো জানতুম না।

অরুণ হঠাৎ উলু দিয়ে উঠল। অনন্ত সভয়ে তাকাল রেজিস্ট্রারের দিকে, তিনি হাসছেন।

‘এ আর কী, টেপরেকর্ডার এনে সানাইও বাজায়।’

অলু প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই অনন্ত তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ছলছল করছে ওর চোখ।

‘অনেক কথা বলেছি, মাপ করে দিয়ো।’

‘আরে ও কিছু নয়, কিছু নয়।…ওরকম হয়ই…ভালো করে সংসার কর, সুখে থাক…’

অনন্তর গলা ধরে গেল। সে বোকার মতো হাসল সকলের দিকে তাকিয়ে। শান্তনু প্রণাম করল।

ঝোলা থেকে সন্দেশের বাক্স বার করে অরুণ এগিয়ে ধরল।

‘এবার মিষ্টি মুখ…এই নিয়ে এগারোটা বিয়ের সাক্ষী হলুম, এখানেই দু—বার হল। দেখছি প্রফেশনাল উইটনেস হয়ে যাচ্ছি…এবার থেকে ফী নিতে হবে।’

পরিবেশটা হালকা হয়ে গেল। কিন্তু অলু কখন যে তার হাত ব্যাগ থেকে টাকা বার করে রেজিস্ট্রারের টেবলে রেখেছে, অনন্ত বুঝতে পারেনি। তার পকেটে তিরিশ টাকার বেশি নেই। বেরোবার সময়ও সে ভাবেনি রেজিস্ট্রারকে টাকা দিতে হবে। অন্যরা নিশ্চয় লক্ষ করেছে মেয়ের দাদা টাকা বার করল না। অলু কি আশা করেছিল, এই খরচটা দাদা দেবে?

সে অপ্রতিভ বোধ করল অন্তত এই টাকাটা তারই দেওয়া উচিত ছিল। কিছুই তো সে অলুকে দেয়নি, শাড়ি পর্যন্ত নয়। বিয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে অলুই খরচ করেছে। জেদি মেয়ে।

অনন্ত বিমর্ষ বোধ করেছিল রাস্তায় বেরিয়ে। তার মনে হচ্ছে কী যেন একটা সে হারাচ্ছে। একসময় বাবা, মা, সে, তিন ভাইবোনে পরিবারটা ভরা ছিল। একে একে লোক কমে যাচ্ছে। এখন তো সে আর মা। যখন প্রচণ্ড অর্থাভাব তখন এতটা নিঃসঙ্গ বোধ হয়নি। কী করে পরের দিনটায় খাওয়া জুটবে সেই ভাবনাটা তাকে ব্যস্ত রাখত। ধীরে ধীরে ভাবনাটা মেঘগর্জনের মতো আকাশে গড়িয়ে গড়িয়ে দূরে মিলিয়ে গেছে। এখন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য।

‘আমি যাই এখন।’

‘সে কী, আমরা যে এখন কোথাও বসে খাব ঠিক করেছি, আপনিও থাকবেন আমাদের সঙ্গে।’

‘না ভাই,’ শান্তনুর কাঁধে হাত রাখল অনন্ত। ‘অলু জানে আমি ভাত খেয়েই এসেছি। তা ছাড়া অম্বলটা আবার একটু বেড়েছে, বাইরের খাবার খাব না।’

‘কিন্তু আমরা যে…’

‘তাতে কী হয়েছে। অলু এদের নেমন্তন্ন কর, রোববার আসতে বল।’

অলু দু—জনের উদ্দেশে বলল, শুনলে তো অরুণ, রোববার নিশ্চয় আসবে!’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়, খাওয়ার ব্যাপারে ফেল করি না।’

অলু জানিয়ে রাখল সে অফিসের দু—তিনজনকেও বলবে।

বাসে রড ধরে দাঁড়িয়ে আসার সময় অনন্তের মনে হল, বোধহয় এরা সুখীই হবে। ভালোবাসার কিছুই তো সে জানে না। অলু এখন বাপের বাড়িতেই থাকবে যতদিন না কোথাও ঘর পায়।

বাপের বাড়ি। অনন্ত অবাক হয়ে ভাবল, অলুর বা অলুদের বাড়ি আর নয়, আজ থেকে তাদের বাড়ি ওর বাপের বাড়ি। মেয়েটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এই সংসার থেকে। অবশ্য হতই।

অসম্ভব শ্রান্তি নিয়ে অনন্ত বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়ল। আজ সে কাজেই যাবে না। এই বছরের প্রথম কামাই, গত বছরে একদিনও নেই, তার আগের বছর ইনফ্লুয়েঞ্জায় দশ দিন।

শীলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে যাচ্ছে তক্তাপোশের পাশে দাঁড়িয়ে। অনন্ত কপালের উপর হাত রেখে চোখ বুজে।

‘শুধু একজন, বন্ধু!’

‘আবার ক—জন আসবে? একি টোপর পরে বিয়ে যে সঙ্গে পঞ্চাশ—একশো বরযাত্রী আসবে।’

‘দুটো মালা কিনে নিয়ে গেলি না কেন?’

অনন্ত উত্তর দিল না।

‘মন্তর পড়েছিল?’

‘না।’

‘তা হলে! এসব বিয়ে কি শুদ্ধ?’

অনন্ত চুপ।

‘ও কখন ফিরবে কিছু বলেছে?’

কোনো উত্তর নেই।

‘অলু কী করল, শুধু সই?’

‘হ্যাঁ।’

‘সিঁদুরটা শান্তনুই দিল তো?’

জবাব না পেয়ে শীলা আধ মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কপাল থেকে হাত নামিয়ে অনন্ত তীব্র চাহনিতে তাকাল।

‘এবার শুধু আমরা দু—জন এই সংসারে।’

শীলা অপ্রত্যাশিত এই কথাটার কোনো তাৎপর্য খুঁজে পেল না। শুধু বলল, ‘ফাঁকা ফাঁকা লাগবে এরপর।’ কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে যোগ করল, ‘এবার তুই বিয়ে কর।’

‘কেন?’

‘ছেলেপুলে না থাকলে কি ঘর মানায়! বংশরক্ষা করতে হবে তো।’

‘অমর আছে।’

‘থাকলেই বা, পুরুষমানুষের বিয়ে না করলে কি চলে? এবার আমি মেয়ে দেখব।’

‘না।’

‘তুই নিজে পছন্দ করে বিয়ে করবি।’

‘না।’

‘তা হলে?’

অনন্ত চোখ বন্ধ করে হাতটা আবার কপালে রাখল।

‘আর টানতে পারব না, আর ভালো লাগে না, আমি এবার জিরোব।’

‘তা জিরো, এত বছর ধরে কম পরিশ্রম করেছিস, তাই তো সবাই বলে…’

ছিলেছেঁড়া ধনুকের মতো অনন্তের দুটো হাত ছিটকে গেল দু—ধারে। চিত হয়ে শোয়া শরীরটা এক ঝাঁকুনিতে উঠে বসল। মুঠো করা দুই হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, ‘সবাই বলে আমি ভালো ছেলে, ভালো ছেলে, ভালো ছেলে…সবাই খুশি তো? কথা দিচ্ছি আমি ভালো ছেলেই থাকব।’

ধীরে ধীরে সে আবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকা তার দুই চোখের কোল বেয়ে কয়েক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল।

নয়

পাঁচ বছর পর অনন্ত বিয়ে করল।

শীলার ক্যানসার ধরা পড়া, দিল্লি থেকে অমরের আসা এবং শীলাকে নিয়ে যাওয়ার ছ—মাস পরেই সে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। বয়ানটা কেমন হবে তাই নিয়ে সে দিন চারেক চিন্তার মধ্যে কাটায়। পাত্রী চাই কলমের থেকে শব্দ বাছাই করে প্রথমে সে বিজ্ঞাপনের খসড়া করেছিল: দঃ রাঢ়ী কায়স্থ (৩৫), স্বাস্থ্যবান, একা, মাঃ আয় ১০০০। গৃহকর্মনিপুণা রুচিশীল নম্র পাত্রী চাই। অন্য জাত বা বিধবাতেও আপত্তি নাই।

দুটো মিথ্যা কথা সে লেখে। বয়সটা প্রায় চারবছর কমিয়েছে, মাসিক আয় বাড়িয়েছে প্রায় দেড়শো টাকা। তারপর আয়নার সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে বহুক্ষণ নিজেকে খুঁটিয়ে দেখেছিল। পঁয়ত্রিশ বছরের মতো তাকে মনে হয় কি?

আয়নার খুব কাছে মুখটা এনেও সে বয়স বুঝতে পারছিল না। সামনের চুল উঠে গিয়ে কপালটাকে চওড়া করে দিয়েছে। সেখানে দুটো রেখা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভুরুতে কয়েকটা চুল খোঁচা হয়ে উঠে রয়েছে। কানদুটো ছোটো, পাশে ছড়ানো; কিছু চুল খুব ভালোভাবেই কানের গর্ত থেকে উঁকি দিচ্ছে; চোখদুটো গোল, ভিতরে বসা; নীচের ঠোঁটটা পুরু, কাঁধটা সরু, বুকের খাঁচাটা ছোটো, পেটটা ঝুলে থলথলে। মোটা কোমরের দু—ধারে চর্বির ভাঁজ। বাহুদুটি শীর্ণ, মেয়েদের মতো নরম।

অনন্ত একটি একটি করে নিজের দেহের ত্রুটি বার করে খসড়া থেকে প্রথমে স্বাস্থ্যবান কথাটা বাদ দিয়েছিল। তবে পঁয়ত্রিশ বছরটা এমনই, শোনামাত্র মনে হয় পরিণত যুবক, বয়সটা যেন ত্রিশের থেকে একটু বেশি অথচ চল্লিশের কাছাকাছি নয়। কিন্তু সে সাহস পায়নি নিজেকে ত্রিশের দিকে নিয়ে যেতে।

তবু নিশ্চিত হবার জন্য তার কাছাকাছি বয়সিদের সে লক্ষ করে গেছে দু—দিন ধরে। রাস্তায়, বাজারে, বাসে সর্বত্রই তার চোখ ছুঁকছুঁক করেছে। যাকেই মনে হয়েছে মধ্য—তিরিশ তন্নতন্ন করে তার গড়ন, হাবভাব, চলনের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, আর মনে হয়েছে পঁয়ত্রিশে যা হওয়া উচিত তার সেই রকম শরীর নয়। সে উনচল্লিশই লেখে।

খসড়ায় হাজার টাকা আয় বসাবার সময় সে দ্বিধায় পড়েছিল। হাজার কথাটা শুনতে ভালো, মনেও গাঁথে। তা ছাড়া সে তো মাইনের টাকা গুনেগুনে বউয়ের হাতে তুলে দেবে না।

তবে পাত্রীদের তরফ থেকে খোঁজখবর নিশ্চয়ই করবে। নিশ্চয় অঘোর এস্টেটে কেউ যাবে, কে কত মাইনে পায় সেটা বার করে নেওয়া মোটেই শক্ত নয়। তারা জেনে যাবেই সে একটা মিথ্যাবাদী। হাজার টাকাটা সে কেটে দেয়। বিজ্ঞাপনের ফর্ম ভরতি করে, টাকা দিয়ে দুপুরে খবরের কাগজের অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পরই অদ্ভুত একটা উত্তেজনা তাকে গ্রাস করে। সারাদিন তার শরীরের তাপ এমন অবস্থায় থাকে যে রাত্রে হোটেলে ভাত মুখে দিতে পারে না। দু—গ্রাস কোনোরকমে চিবিয়েই উঠে পড়ে।

‘কী হল অনন্তবাবু, রান্নায় কিছু…’

মালিক অবনী দত্তর উদবিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ‘শরীরটা ভালো নেই।’

‘তাই বলুন। এতদিন খাচ্ছেন, এমন তো কখনো দেখিনি। অম্বলটা বোধহয় বেড়েছে।’

‘হ্যাঁ।’

রাতে ঘুম এল না। সারা একতলায় সে একা। বিজ্ঞাপনেও ‘একা’ শব্দটা বসিয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটা সে দিল কেন? তার কি বিয়ে করার বা কোনো স্ত্রীলোককে ঘনিষ্ঠভাবে পাওয়ার খুবই দরকার! এতটা বছর তা হলে কাটল কী করে!

ঘর পেয়ে অলু চলে যাবার পর, যখন সে আর মা একই কথা, একই অভ্যাস, একই গণ্ডির মধ্যে দিন, হপ্তা, মাস, বছর কাটিয়ে গেছে তখন সে কিছু বোধ করেছিল কি?

কীভাবে তার দিন কেটেছে? অনন্ত গত পাঁচ বছরের এমন কোনো স্পষ্ট ছবি দেখতে পেল না যা দিয়ে সে কোনো তারিখ, কোনো ঋতু, কোনো মানুষকে শনাক্ত করতে পারে। তার ইন্দ্রিয়গুলো এমন কোনো আবেগ ধরে রেখে দেয়নি যা তাকে ভালো কোনো স্মৃতি দিতে পেরেছে। দেখাশোনার সব কিছুই তার কাছে অর্থপূর্ণ আবার অর্থহীন মনে হয়েছে।

একঘেঁয়ে দিন, ভ্যাপসা অথবা ভিজে। ছোটোবেলা থেকে সে একই গন্ধ পেয়ে আসছে বিছানা, আলমারি, বাসন, কলঘর সবকিছু থেকেই। বাজার যাওয়া, অঘোর এস্টেটে যাওয়া…খাতা, বিল—বই, তাগিদ, মামলা, ভাড়াটেদের হাজার অভিযোগ। আর হাঁটা, যেটা তার একমাত্র বিলাস।

গৌরীদের চায়ের দোকানটা উঠে গেছে, কমলা বাইন্ডার্সের প্রসাদ ঘোষ মরে গেছে, তার ছেলে এখন বসছে। পুরোনো লোকদের মধ্যে আছে শুধু ল্যাংড়া গুরু দাস। অন্য কোথাও কাজ জোটাতে পারেনি।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে, একটা ছেলে কিছুদিন কাজ করেছিল…সে তো বহু বছর আগে, পরেশদা তারপরই কোরণ্ডটা অপারেশন করাতে গিয়ে মরে গেল।’

একদিন সে সিনেমা দেখতে টিকিট কেটে হলে ঢুকেছিল। হিন্দি ছবি, কিছুক্ষণ পরই বিরক্ত বোধ করতে থাকে। বিরতির সময় বেরিয়ে আসে। এতগুলো লোক টানটান হয়ে চেয়ারে বসে দেখছে অথচ তার ভালো লাগল না।

সন্ধ্যায় গঙ্গার ধারে গেছে। কিছুক্ষণ বসে থেকে বাড়ি ফিরে এসেছে। পার্কে বসে তাস খেলা দেখেছে। মা চুপ করেই থাকে, ইদানীং আর বেশি কথা বলত না। সাধন বিশ্বাস একরাতে থ্রম্বসিসে মারা গেলেন। সে শ্মশানে গেছল। উৎপল এখন বাবার চেয়ারটায় বসে। পাড়ার দুর্গোৎসব কমিটির সভাপতি ছিল গত বছর।

অনু বছর সাতেক আগে কটক থেকে এসেছিল ওর স্বামীর গলব্লাডার অপারেশন করাতে। সঙ্গে আসে শুধু ভাসুরপো। সারাদিন খুব চিন্তায় থাকত। এখন সে নতুন বাড়িতে থাকে, বার বার যেতে বলেছে। চিকিৎসায় হাজার দশেক টাকা খরচ করে গেছে।

অলুর সঙ্গে দেখা নেই সাড়ে তিন বছর। বেহালায় থাকে। মা দিল্লি যাবার দিন দশ আগে বিকেলে এসেছিল, তার সঙ্গে দেখা হয়নি। শান্তনুকে এক সন্ধ্যায় নীলরতন হাসপাতালের গেটের কাছে দেখেছিল কথা বলছে একজনের সঙ্গে। শান্তনু টলছিল। লোকটিকে বারবার জড়িয়ে ধরছিল। সে দূর দিয়ে চলে যায়।

মাসে দু—তিনবার যখন সে এন্টালির বাড়িতে যায় মিনতি করের সঙ্গে তখন দেখা করে কিন্তু আর ভালো লাগে না কথা বলতে। আর ভালো লাগে না ছবিটার দিকে তাকাতে। নন্দকিশোরের ভাইপো একতলায় ওর ঘরের সামনে লম্বা প্যাসেজটায় সন্ধ্যার পর চোলাই মদের কারবার ফেঁদে বসে। এলাকায় এখন সে নামকরা মস্তান। অনন্ত সাহস পায় না কিছু বলতে। নন্দকিশোর পানের দোকান একজনকে ইজারা দিয়ে কসবায় চলে গেছে। সে মাসে মাসে পাঁচশো টাকা পায় দোকান থেকে। নন্দকিশোর চারটে গোরু কিনে কসবায় খাটাল করেছে, রেশন দোকানও দিয়েছে। মাসে একবার দু—বার আসে। চোলাইয়ের কথা বলতেই, ম্লান মুখে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলে, ‘সবই এই। দিনকাল কীরকম করে যে বদলে গেল। কত ভালো ছেলে ছিল। আমার কথায় ওকে কাজ দিলেন…আমার লজ্জা করে।’

মিনতি কর এখন আর উচ্ছেদের ভয় দেখেন না। ওষুধ কোম্পানিটা উঠে গেছে। সেখান থেকে চব্বিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। ভাড়া দিতে চেয়েছিলেন। অনন্ত বলেছে দরকার কী, যেমন চলছে চলুক।

‘সন্ধের পর বড্ড ভয় করে। ঘর থেকে বেরোতে পারি না, কলঘরেও যেতে পারি না…আর কী বিশ্রী গন্ধ। দরজা জানলা বন্ধ করে রাখি, হাঁপিয়ে যাই।’

অনন্ত চুপ করে শোনে। বৃদ্ধা হয়ে গেছেন কিন্তু যথেষ্ট সমর্থ। টিউশনি করে যাচ্ছেন, দোকান, বাজার, রান্না, জল তোলা নিজেই করেন। কিন্তু কতদিন করবেন? সে বিষণ্ণ হয়ে যায়। ওর ভালোবাসা এখনও কুড়ি—পঁচিশ বছর আগের মতো তীব্র আছে কি? ছবি আগলে থাকতে থাকতে ব্যাপারটা কি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়নি? এখন তার মনে হয় বাড়াবাড়ি, দেখানেপনা।

সন্ধ্যায় অনন্ত বাড়িতে ফিরে নিজের ঘরে শুয়ে থাকে। একটা ট্রানজিস্টর কিনেছে। মাঝে মাঝে শোনে। গান, বাজনা, কথিকা শোনার কোনো বাছবিচার নেই। নাটক হলে মা দরজার কাছে এসে বসে। দোতলায় টিভি এসেছে। সে এখনও টিভিতে কোনো অনুষ্ঠান দেখেনি।

পাত্রীর জন্য বিজ্ঞাপনটা কেন দিল তার কোনো কারণ অনন্ত খুঁজে পায়নি। অমর হঠাৎ মাকে নিয়ে চলে যাবার পর আচমকা নিঃসঙ্গতার যে গর্তে সে পড়ে গেছে তাই থেকে উঠে আসার জন্যই কি একজন সঙ্গী চাইছে? কিন্তু সে ছোটোবেলা থেকেই তো নিঃসঙ্গ।

তিরিশ হাজার টাকার কাছাকাছি ব্যাঙ্কে জমেছে। ভাবলে তার অবাক লাগে। কী করবে টাকাগুলো! কোনো শখ, কোনো বাবুয়ানি নেই ফলে তার কোনো খরচ নেই। মিনতি করের মতোই কি দিন কাটাতে হবে? যদি কঠিন অসুখ করে, সেবা—শুশ্রূষার দরকার হয়, কে তাকে দেখবে!

রাত্রে অনন্তর ঘুম হল না। তার মনে হল, স্ত্রীর থেকেও তার বেশি দরকার একটা মানুষ, যে কিছু একটা করবে তার নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে।

রবিবারের কাগজে তার বিজ্ঞাপনটা বেরোবার সাতদিন পর সে খবরের কাগজের অফিস থেকে এগারোটি চিঠি আনল। রাত্রে চিঠিগুলো মন দিয়ে পড়ল। সবগুলোই কলকাতার এবং স্বয়ং পাত্রীদেরই লেখা। তিনটি চিঠি বেছে নিয়ে সে স্থির করল উত্তর দেবার আগে লুকিয়ে এদের একবার দেখে নেবে।

ঊর্মিলা দেব স্কুল—শিক্ষিকা। তার চিঠিতে দেওয়া ঠিকানা মতো সে স্কুলে বেরোবার সময় আন্দাজ করে জীর্ণ একটা বাড়ির দিকে চোখ রেখে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে রইল। অবশেষে সেই বাড়ি থেকে একজনকে বেরোতে দেখল যাকে তার মনে হল স্কুল—শিক্ষিকা। সামনে দিয়ে যাবার সময় একবার অনন্তের দিকে চাইল। তাদের চোখাচোখি হল। অনন্তের মনে হল বিনা অনুমতিতে তার দিকে তাকানোর জন্য যেন কৈফিয়ত চাইল চাহনি মারফত। এসব মেয়েমানুষ খাণ্ডারনি হয়। সে নাকচ করে দিল ঊর্মিলা দেবকে।

তার দ্বিতীয় অভিযান সত্তরের—বি রাধিকাপ্রসন্ন মিত্র লেনে। একতলা টিনের চালের বাড়ি। রাস্তার দিকে সামনের ঘরে দুটি জানালা। পিছনে একটা বটগাছ। চাকুরে নয় সুতরাং বাড়ি থেকে বেরোবার নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। দু—দিন বাড়িটার সামনে দিয়ে সে হেঁটে গেল। জানলায় একটা মুখও দেখতে পেল না, দরজাটাও বন্ধ।

তৃতীয় দিন বিকেলে সে কড়া নাড়ল। মিনিট দুয়েক পর ভিতর থেকে নারীর কণ্ঠে প্রশ্ন এল, ‘কে?’

‘আমি, একবার কথা বলতে চাই।’

দরজা খুলে আটপৌরে ঢিলেঢালা বেশে, ঘুম—ভাঙা ফুলো চোখে যে দাঁড়াল তার নাম রেবতী সেনগুপ্ত। মাজা গায়ের রং, দীর্ঘাঙ্গী, ভ্রূ—র চুল তুলে চোখদুটি সাজানো, চোখা নাক, ডিম্বাকৃতি মুখ এবং মুখ বিস্ময়।

‘কাকে চাই!’

‘এখানে কি রেবতী সেনগুপ্ত থাকেন?’

‘আমিই।’

‘আপনি কি কাগজের একটা পাত্রী চাই বিজ্ঞাপনের কোনো জবাব দিয়েছেন?’

রেবতী বিব্রত হল। শাড়ির আঁচলটা কাঁধে তুলে দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, দিয়েছি…আপনি?’

‘বিজ্ঞাপনটা আমি দিয়েছি, আমার জন্যই।’

রেবতী তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, ‘একটু দাঁড়ান’।

দরজা ভেজিয়ে ভিতরে চলে গেল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই একটি তরুণী দরজা খুলে তাকে ভিতরে আসতে বলল। মুখের আদল থেকে মনে হল রেবতীর বোন।

দরজার পাশেই ঘর। তক্তাপোশে লোটানো তোশক আর বালিশ একটা রঙিন নকশাদার বেডকভারে ঢাকা। অনন্তের মনে হল, এখুনি ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ঘরের দরজায় এক প্রৌঢ়া বিধবা দাঁড়িয়ে।

‘রেবতী আমার বড়োমেয়ে। আমার তিন মেয়ে, তারপর এক ছেলে। ওদের বাবা সাত বছর আগে মারা গেছেন। বিজ্ঞাপনটা রেবতীই প্রথম দেখে।’

‘আমার নাম অনন্ত দাস। চিঠির জবাব না দিয়ে নিজেই চলে এলুম। বিজ্ঞাপন বা চিঠি থেকে সবকিছু বোঝা যায় না তো। চক্ষু—কর্ণের বিবাদ ভঞ্জন হয়ে যাওয়াই ভালো, আমারও বাবা নেই, বছর কুড়ি হল মারা গেছেন।’

সেই প্রথম তার রেবতীদের বাড়িতে যাওয়া। এরপর বাকি চিঠিগুলো নিয়ে তাকে আর মাথা ঘামাতে হয়নি।

সেদিন ঘণ্টাখানেক সে ছিল। রেবতী তাকে চুম্বকের মতো টেনেছে, তাকে উত্তেজিত করেছে, রাত্রে ঘুম হয়নি।

এরপরও তিনবার সে গেছে। পরিবারের সকলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তার নিজের কথা, ভাই বোন মায়ের কথা, কষ্ট করে সংসার চালানো, অঘোর এস্টেটে অপ্রত্যাশিত চাকরি পাওয়া, বোনেদের বিয়ে, অমরের চলে যাওয়া, মা—র ক্যানসার—সবই সে বলেছে।

ওদের নিজেদের বাড়ি, দু—খানি ঘর। তিনদিনের মধ্যে দু—দিনই সন্ধ্যার সময় রেবতী বাড়ি ছিল না।

‘এইমাত্র বেরোল এক বন্ধুর সঙ্গে, কখন আসবে ঠিক নেই। আপনি কি বসবেন?’

অনন্ত কিছুক্ষণ বসে থাকে। দু—একটা কথাও বলে। চা খায়, সঙ্গে দুটি সন্দেশ।

তৃতীয় দিনে রেবতী বেশিরভাগ সময়ই অন্য ঘরে ছিল। অনন্ত ছটফট করছে ওকে দেখার জন্য। পাশের ঘর থেকে রেবতীর কণ্ঠস্বর পেয়ে সে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারছে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটছে।

রেবতীর মা বিয়ের কথা তুললেন। ‘রেবতীর বাবা মারা গেলেন তখন ও বিএ পড়ছিল, আর পড়া হয়নি। আমরা কিন্তু কিছুই দিতে—থুতে পারব না শাঁখা সিঁদুর ছাড়া।’

অনন্তের মনে পড়ল অনুর বিয়ের কথা। সে বলল, ‘দিলেও আমি কিছু নোব না। আপনারা আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। আমি কোথায় থাকি, ঘরদোর কেমন সেটাও তো একবার দেখবেন।’

ঠিক হয় রেবতীকে নিয়ে গিয়ে অনন্ত তার একার সংসার দেখিয়ে আসবে। সন্ধ্যা নাগাদ সে রেবতীদের বাড়ি যায়। তখন ঘরের তক্তাপোশে বালিশ বগলে রেখে কাত হয়ে শুয়ে একটি লোক সিগারেট খাচ্ছিল। রেবতীর বোন শাশ্বতী আদুরে ভঙ্গিতে লোকটির পায়ের ওপর হাত রেখে বসে। রেবতী জানলার ধাপে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।

অনন্ত ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল। ওকে দেখেই ঘরের সবাই চুপ করে তাকিয়ে রইল। অবশেষে শাশ্বতী বলল, ‘আসুন।’

‘আজ দেখতে যাবার কথা ছিল।’

রেবতীর পায়ের দিকে তাকিয়ে অনন্ত বলল।

‘আজকেই, কিন্তু আজ যে…’

অনন্তর বুক কেঁপে উঠল। রেবতী কি যাবে না? সকালে সে ঘর—দালান জল দিয়ে ধুয়েছে, কাচানো ওয়াড় বালিশে পরিয়েছে, ঝুল ঝেড়েছে, তাকের জিনিসপত্র গুছিয়েছে, স্টোভে কেরোসিন ভরে রেখেছে, যদি চা খেতে চায়! ভেবে রেখেছে ট্যাক্সিতে রেবতীকে আনবে এবং পৌঁছে দেবে।

‘যাও না, কতক্ষণ আর সময় লাগবে।’ লোকটি অনুমতি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল।

‘আপনি বসুন, আমি কাপড়টা বদলে আসি…ওহ পরিচয় করিয়ে দিই, এই হচ্ছে দিলীপদা, অনেক উপকার করেছে আমাদের, দিলীপদা না থাকলে আমাদের পরিবারটা ভেসে যেত…আর ইনি হচ্ছেন সেই ভদ্রলোক কাগজে পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন।’

‘ওহ আপনি।’

অনন্ত নমস্কার করল, লোকটি প্রতি নমস্কার না করে সিগারেটের প্যাকেটটা তার দিকে এগিয়ে ধরে।

‘মাফ করবেন, খাই না।’

তক্তাপোশের নীচ থেকে একটা মোড়া বার করে দিল শাশ্বতী। অনন্ত দেওয়াল ঘেঁষে বসল। তার ভিতরে অস্বস্তি। কয়েকবারই সে দিলীপদা নামটা ওদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় উচ্চচারিত হতে শুনেছে। আজ সে চোখে দেখল। মাঝারি আকৃতি, ফরসা, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, বুশশার্ট ও প্যান্টটা দামি কাপড়ের। এদের আত্মীয় নয়, তাহলে কে? উপকারী বন্ধু। কী উপকার করেছে যাতে ভেসে যাওয়া বন্ধ হয়!

‘কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন কেন?’

‘তা ছাড়া উপায় ছিল না।’

‘সম্বন্ধ করে বিয়ে দেবার মতো কেউ নেই?’

‘না।’

‘কোথায় চাকরি করেন?’

‘জমিদারের এস্টেটে, সম্পত্তি দেখাশোনার কাজ।’

‘অ।’

দিলীপদা নিস্পৃহ হয়ে শাশ্বতীর দিকে মনোযোগ দিল।

‘মাসিমা কোথায় রে?’

‘ও ঘরে শুয়ে আছে, মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে। ডাকব?’

‘থাক। তাঁতিকে পাঠিয়ে দেব তা হলে, কখন আসবে?’

‘দুপুরে পাঠিয়ো।’

‘ভাস্বতী এই শনিবার আসবে?’

‘মেজদির কোনো কথার ঠিক নেই। আসতেও পারে।’

দিলীপদা উঠে বসল রেবতী ঘরে ঢুকতেই। হালকা টিয়া পাখি রঙের সিল্কের শাড়িটা ওর শরীরের উঁচু—নীচু জায়গাগুলোর উপর আলতো করে বিছানো। লিপস্টিকের আভাস পাওয়া যাচ্ছে, হাতকাটা ব্লাউজে বাহুর ডৌল বড়ো সুন্দর দেখাচ্ছে। কিন্তু অনন্ত চোখ নামিয়ে নিল।

‘আমার সঙ্গেই চলো, ওদিকে একটা কাজ আছে সেরে নেব।’

বাদামি অ্যাম্বাসাডারটা অনন্ত গলিতে ঢোকার সময় দেখেছিল। সেটা যে এই লোকটিরই বুঝতে পারল যখন চাবি দিয়ে দরজা খুলে ড্রাইভারের সিটে বসল। রেবতী পিছনের দরজা খুলে দাঁড়াল।

‘উঠুন।’

‘আপনি উঠুন।’

‘উঠব।’

অনন্ত গাড়িতে ঢুকতেই দরজা বন্ধ করে রেবতী সামনের দরজা খুলে দিলীপের পাশে বসল। অনন্ত আশা করেছিল অন্যরকম।

তাদের গলির মধ্যে গাড়ি ঢুকিয়ে বার করা কঠিন। তাই অনন্ত ঢোকাতে বারণ করল।

‘আমি এখানেই থাকছি, তুমি দেখে এসো।’

দিলীপদা সিগারেট ধরাল। রেবতীকে নিয়ে গলি দিয়ে হেঁটে আসার সময় সে সন্তর্পণে জিজ্ঞাসা করল, ‘উনি কে হন?’

‘দিলীপদা? উনি ফ্যামিলি ফ্রেন্ড, ওর নাম দিলীপ ভড়। বিরাট বিল্ডিং কন্ট্রাক্টর।’

আর প্রশ্ন না করে অনন্ত বাড়িতে ঢুকল, তালা খুলে রেবতীর দিকে তাকাল। কিছু বুঝতে পারল না। দালানের আলো জ্বালল।

চোখ ঘুরিয়ে মুখ তুলে রেবতী দেওয়াল, মেঝে, কড়িকাঠ দেখছে। অনন্ত প্রাণপণে বুঝতে চেষ্টা করছে ওর প্রতিক্রিয়া।

‘রান্নাঘরটা দেখুন।’

প্রায় ছুটে গিয়ে সে রান্নাঘরের দরজা খুলল।

‘মা এই জায়গাটা বসে রাঁধত।’

রেবতী দূর থেকে দেখে ফিকে হাসল।

‘দুটো ঘর।’

অনন্ত দরজা খুলে আলো জ্বালল। রেবতী দরজার কাছ থেকে উঁকি দিল।

‘চলি এবার।’

‘চা খাবেন?’

‘না, না, চা নয়।’

রেবতী সদরের দিকে এগোচ্ছে, অনন্ত পিছু নিল।

‘খুব পুরোনো বাড়ি।’

‘হ্যাঁ, শুনেছি আশি—নব্বুই বছরের। পাড়াটা খুব বনেদি।’

‘ভ্যাপসা একটা গন্ধ রয়েছে। জানলাগুলো ঠিকমতো বন্ধ হয়?’

‘হয়। মেঝেটা নতুন করে করাব ভাবছি, দেওয়ালের পলেস্তরাও…এসব করবার দরকার এতকাল হয়নি তো।’

কথাটা রেবতীর কানে গেল কি না সে বুঝল না। রাস্তার লোকেরা ওর দিকে তাকাচ্ছে। রকে যারা বসে ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে। বারান্দা থেকে ঝুঁকে আছে কয়েকটা মুখ।

দিলীপ ভড় রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। ‘দেখা হল?’

‘হ্যাঁ।’

কোনো কথা না বলে ওরা গাড়িতে উঠল। স্টার্ট দিয়ে মাথা নীচু করে দিলীপ ভড় তাকাল।

‘চলি তা হলে, আবার দেখা হবে।’

ফিরে এসে অনন্ত গুম হয়ে বসে রইল। রেবতী কিছুই বলল না। ঘর নিশ্চয়ই পছন্দ হয়নি। ওর মতো ঝকঝকে মেয়ের পক্ষে এটা বসবাসের উপযুক্ত জায়গা নয়।

এই প্রথম সে তার বাসস্থানকে ঘৃণা করল। প্রত্যেকটা পরিচিত বস্তু, যেগুলোকে সে কখনো লক্ষই করত না, তার চোখে কুৎসিত হয়ে দেখা দিচ্ছে।

অনন্ত ফাঁপরে পড়েছিল বিয়ের ব্যাপারে। সে একা, বিয়ের কাজকর্ম দেখার, করার কেউ নেই। উপরের জেঠিমা, কাকিমাদের বলা যায়, কিন্তু সে রাজি নয়। অলুকে জানানোর ইচ্ছে নেই, অনু হয়তো আসতে পারবে না, মা—র পক্ষেও আসা সম্ভব নয়।

‘এই নিয়ে এত চিন্তার কী আছে, আমার ওখান থেকে হবে…আমার ক্যামাক স্ট্রিটের ফ্ল্যাটটা তো খালিই পড়ে আছে। ওখান থেকেই বর যাবে, কনে নিয়ে ফিরেও আসবে।’

দিলীপ ভড় নিমেষে সমস্যাটার সমাধান করে দেয়। অনন্ত রাজি হয়। বিয়ের দিন সকালে ক্যামাক স্ট্রিটে ‘মধুবন’ বাড়ির সাততলায় অনন্তের পৌঁছনোর কথা। দালানের দরজায় তালা দিয়ে বিয়ের জন্যে কেনা জুতো, পাঞ্জাবি, ধুতিতে ভরা নতুন সুটকেসটা হাতে নিয়ে বেরোবার সময় তার মনে হল দোতলায় খবরটা দেওয়া উচিত। জন্ম থেকে ওরা তাকে দেখছে।

কাকিমা রান্নাঘরে ছিলেন, অনন্তকে দেখে কৌতূহলে বেরিয়ে এলেন খুন্তি হাতেই।

‘কাকিমা আজ আমার বিয়ে।’

‘য়্যাঁ…ওম্মা, কোথায় বিয়ে হচ্ছে? জোগাড়যন্তর কই, ও দিদি শুনে যাও অনন্তের আজ বিয়ে।…এ বাড়ি থেকে হচ্ছে না?…আজকেই!’

জেঠিমা বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। অনন্তকে লাজুক দেখাচ্ছে।

‘হঠাৎই ঠিক হয়ে গেল জেঠিমা। আপনাদের জানাবার পর্যন্ত সময় পাইনি…এক বন্ধুর বাড়ি থেকে বিয়েটা হচ্ছে। এখানে কে করবে—টরবে, তাই বন্ধুর বাড়ি থেকে।’

‘কেন রে আমরাই করতুম।’

‘আবার কেন আপনাদের ঝামেলায় ফেলব।’

‘বিয়ের কাজ কি ঝামেলার কাজ বাবা? আমাদের তুই পর ভাবলি!’

‘না না সে কী কথা। আপনাদের সাহায্য ছাড়া কি আমাদের চলত।’

‘খুব ভালো করেছিস। এই সেদিনই বলাবলি করছিলুম অনন্তর এবার বিয়ে করা উচিত। রোজগেরে ছেলে, এভাবে বাউণ্ডুলের মতো থাকবে কেন, রেঁধে দেবারও কেউ নেই।’

‘দিদি তো বলছিল জোর করে তোর বিয়ে দিয়ে দেবে। মেয়ের বাড়ি কোথায়…কে কে আছে মেয়ের, অবস্থা কেমন, বল সব।’

‘আমার মতো অবস্থা, বাবা নেই। দুই বোন এক ভাই আর মা।’

‘চাকরি করে?’

‘মেজোবোন স্কুলে পড়ায় বাইরে থাকে। এরা থাকে সিমলেয়। কাউকে নেমন্তন্ন করিনি, বউভাতে করব।’

‘আগে যদি বলতিস, আমরাই সব ব্যবস্থা করে দিতুম।’

দু—জনকে প্রণাম করে সে বেরিয়ে পড়ল। ট্যাক্সি থেকে নেমে, মধুবনের সাততলায় পৌঁছে যখন সে কলিংবেল টিপল তখন বেলা প্রায় এগারোটা। পাজামা শার্ট পরা এক ছোকরা দরজা খুলে হেসে তাকে ভিতরে আসতে বলল।

‘আপনার নামই তো অনন্ত দাস?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাবু সকালে টেলিফোনে বলে দিলেন, আপনার গায়ে হলুদ ছুঁইয়ে মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে। ড্রাইভার হলুদ দিয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি জামা খুলুন।’

বড়ো দালানের মতো বসার জায়গায় মোটা কার্পেটে মেঝে ঢাকা, সাদা দেয়াল, এককোণে দুটো বড়ো সোফা তার বাঁ দিকে বারান্দা। দেয়ালের ধারে একটা শূন্য টেবল ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। তিনটে বন্ধ দরজা সে দেখতে পাচ্ছে, বোধহয় শোবার ঘরের। অনন্ত কিছুটা এলোমেলো হয়ে গেল। এমন একটা নির্জন পরিবেশ সে আশা করেনি। সুটকেস টেবলে রেখে সে জামা খুলল। ছোকরা তার শরীরের যত্রতত্র হলুদ ছুঁইয়ে পেতলের রেকাবিটা নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, ‘আপনি কি উপোস দিচ্ছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘কিচেনে বিস্কুট আছে, বাদাম আছে, খেতে ইচ্ছে করলে খাবেন। বেডরুম খোলা আছে। আমি গায়ে হলুদ পৌঁছে দিয়ে টোপর, মালাটালা কিনে নাপিত, পুরুত সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসব।’

অনন্ত সোফায় বসে রইল অনেকক্ষণ। একবার বারান্দায় গিয়ে নীচের রাস্তা দেখল। তিনটে দরজার একটা রান্নাঘরের। জলতেষ্টা পেয়ে যাচ্ছে। বেসিনের কল থেকে গ্লাসে জল নিয়ে খেল। মেঝেয় একধারে চারটে মদের খালি বোতল। ফ্রিজের পাল্লা খুলে দেখল একদমই ফাঁকা।

সে শোবার ঘরে এল। দেওয়াল ঘেঁষে চওড়া খাট। ছোটো নীচু টেবলের উপর টেলিফোন। দেওয়াল আলমারি ছাড়াও রয়েছে ছোটো একটা স্টিল আলমারি, ছোটো দুটি চেয়ার, মেঝেয় কার্পেট, লাগোয়া বাথরুমের দরজা। বিপরীত দেওয়ালে মদের রঙিন ক্যালেন্ডারে আলস্য ভাঙছে আড়মোড়া দিচ্ছে এক নগ্ন বিদেশিনী। ছবিটা দেখেই ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল তার দুটো কান। পেটের মধ্যে যাবতীয় বস্তু কুঁকড়ে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে সে টানটান হয়ে সোফায় শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল। স্বপ্নের মধ্যে কাটাতে কাটাতে অনন্ত বিয়ের রাত পেরিয়ে এল। সকালেও তার মনে হল অবাস্তব এক জগতের মধ্যে সে বাস করছে। সন্ধ্যার সময় বর—বউ দিলীপ ভড়ের মোটরেই মধুবনের ফ্ল্যাটে এসে উঠল। রাতটা সে কাটাল সোফায়, রেবতী ঘরে শুয়েছিল দরজায় চাবি দিয়ে।

দশ

অদ্ভুত সময়, অদ্ভুত জীবনের মধ্যে অনন্ত নেমে যাচ্ছে যেভাবে মানুষ চোরাবালিতে নামে। শেষবারের মতো দুটো হাত বার বার মুঠো করে একটা শক্ত অবলম্বন পাবার জন্য যেমন আঁকুপাঁকু করে, রেবতীকে আঁকড়ে অনন্ত তেমনি চেষ্টা শুরু করল। সে জানে তার দেরি হয়ে গেছে, তার গলা মুখ চোখ ডুবে গেছে, বাকি আছে উঁচু করে তোলা হাতদুটো। সে জানে জীবনকে শুষে নিতে যত বেশি ব্যগ্র হবে তত দ্রুত তলিয়ে যাবে। রেবতীকে তাই সে সমীহ করে।

তারা একই শয্যায় শোয় কিন্তু অনন্তের মনে হয় রেবতী বহু মাইল দূরে, তারা কথা বলে কিন্তু পরস্পরকে যেন বোঝাতে পারে না। বিয়ের এগারো দিন পর অন্য দিনের থেকে একটু আগেই বিকেলে বাড়ি ফিরে অনন্ত দেখল দরজায় তালা দেওয়া। সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। আলুর দম—রুটি খেয়ে খবরের কাগজ নিয়ে সময় কাটাতে লাগল।

রেবতীকে দূর থেকে সে দেখতে পেল দ্রুত হেঁটে আসছে। ওর মেরুন—সবুজ তাঁতের শাড়িটা তারই কেনা। হাতে চামড়ার ছোটো ব্যাগটা। কিন্তু একটা কালো অ্যাম্বাসাডার থেকে যে রেবতী নামল সেটা তার চোখ এড়ায়নি। সে চেষ্টা করল দেখতে মোটরে কে আছে, কিন্তু দেখতে পেল না। গাড়িটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল।

আশেপাশে না তাকিয়ে রেবতী হাঁটে। ও ঠিকই জানে বহু চোখ তাকে দেখছে। গ্রাহ্যের মধ্যে আনে না, চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে সে চলে গেল। তখন বাড়িমুখো চা—পিপাসু এক অফিস ফেরত অশ্লীল শব্দ করে হাই তুলল। অনন্ত মাথাটা নামিয়ে দিল কাগজে।

হাতঘড়িতে সে দেখল পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেছে রেবতী চলে যাওয়ার পর। ঘড়িটা সে বিয়ের দু—দিন পর কিনেছে। বাবার কেনা ওয়াল ক্লকটা আজও নিখুঁত সময় দিয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে সময় জানতে তার অসুবিধা নেই, বাইরে প্রায় প্রত্যেকের হাতেই ঘড়ি। দরকার হলে সে জিজ্ঞাসা করে নেয়। তাই ঘড়ি কেনার জন্য ‘বাজে খরচের’ দরকার তার হয়নি। এখনও দরকার হয় না, তবু কিনেছে। উপরের কাকিমা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘শ্বশুরবাড়ি থেকে কী কী দিল?’

প্রথমেই সে বলে ফেলেছিল, ঘড়ি। তাই সে ঘড়িটা কিনে ফেলল। রেবতীর ঘড়ি আছে। তবু তিনশো টাকায় তাকে একটা কিনে দেয়।

অনন্ত যখন ফিরল রেবতী তখন চা করছে। শার্টটা খোলার পর গেঞ্জিটা খুলতে গিয়েও খুলল না। বাড়িতেও গেঞ্জি পরে থাকা সে শুরু করেছে বিয়ের পর।

‘চা আমাকেও একটু দিয়ো।’

‘এই ফিরলে?’

‘হ্যাঁ।’

কেন যে মিথ্যা কথাটা বলল তা সে জানে না। আপনা থেকেই মুখে এসে গেল।

‘কী করলে সারা দুপুর?’

রেবতী উত্তর দেবার আগে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। চাউনিটা তুরপুনের মতো, ঘুরতে ঘুরতে তার মনের মধ্যে গর্ত করে যাচ্ছে, যার মধ্য দিয়ে প্রশ্নের পিছনের উদ্দেশ্যটা দেখা যাবে। অনন্ত তার মুখটাকে নির্বিকারে করে রেখে দিল, হাতে চায়ের কাপ নেবার সময়।

‘কিছুই তো করবার নেই। তাই একবার বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম। মা—র মাথার যন্ত্রণাটা খুব বেড়েছে, ডাক্তার দেখাতে হবে মনে হচ্ছে।’

‘স্পেশালিস্ট দেখানোই ভালো।’

‘অনেক টাকার ধাক্কা।’

‘টাকার জন্য ভাবতে হবে না।’

রেবতী তাকাল এবং মিষ্টি করে হাসল। অনন্ত উত্তেজনা বোধ করে অথবা বহুদিন পর সাংসারিক দায়িত্বের স্বাদ পেয়ে, যেটাই হোক, বলল, ‘মাথার ব্যথার কখনো অবহেলা করতে নেই। স্পেশালিস্ট কত আর নেবে…পঞ্চাশ, একশো, দু—শো? অবহেলা যদি না করা হত তা হলে আমার মায়ের ক্যানসার গোড়াতেই ধরা পড়ত। কালই আমি খোঁজ নেব। আমাদের মালিক সমীরেন্দ্র বসুমল্লিককে যে ট্রিটমেন্ট করেছিল তার কাছেই বরং যাব।’

‘এত তাড়াহুড়োর দরকার কী…একটু বাজারে যাবে, ঘি, গরম মশলা ফুরিয়েছে। কপিটা আজই রেঁধে ফেলি।’

রাতে অন্যদিনের মতো রেবতী আজ বাঁ দিকে না ফিরে অনন্তের দিকে কাত হয়ে শুল। কিছুক্ষণ পর তার বাঁ হাত অনন্তের বুকের উপর পড়ল। সে নিশ্বাস চেপে শক্ত হয়ে শুয়ে রইল। এই প্রথম রেবতী তাকে স্বেচ্ছায় স্পর্শ করল, এটা কীসের আভাস দিচ্ছে?

সে প্রায় চুপিসারে তার ডান হাত বিছানা থেকে এমনভাবে বুকের দিকে আনতে লাগল যেন রেবতীর হাতটা একটা পাখি, সামান্য নড়াচড়া টের পেলেই উড়ে যাবে।

ধীরে ধীরে সে তা রাখল রেবতীর আঙুলের ওপর। মুঠিতে চাপ দিল এবং হাতটায় টান দিয়ে কাছে আসার জন্য ইঙ্গিত করল।

বাহুতে ভর দিয়ে মাথাটা সামান্য তুলে রেবতী ঝুঁকে পড়ল এবং অনন্তের ঠোঁটের উপর আলতো চুমু দিল।

অনন্ত সংবিৎ হারানোর আগে বুকের মধ্যে প্রচণ্ড চিৎকার শুনতে পেল। একটা অস্থিরতা তার শরীরটায় দাপিয়ে যাচ্ছে। একটা দুর্লভ চূড়ায় সে উঠবে। সেখান থেকে তার জীবনের পিছন দিকে একবার মাত্র সে তাকাবে।

রেবতী মাথাটা সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। অনন্ত দু—হাতে তাকে জাপটে ধরল।

‘নাহ।’

‘হ্যাঁ।’

রেবতী চেষ্টা করল অনন্তর মুঠি আলগা করতে। অনন্ত হুড়মুড় করে তার বুকের উপর ভেঙে পড়ল, এলোপাথাড়ি চুমু দিতে লাগল ওর গালে, গলায়, বুকে।

‘না আ আহ, কী ছোটোলোকমি হচ্ছে!’

রেবতীর নখ বসে গেছে অনন্তের ঘাড়ে। সে কিছুই বোধ করছে না শুধু একটা অন্ধ রাগ ফুঁসে উঠছে তার মাথার মধ্যে।

‘আমি তোমার স্বামী।’

‘তাতে কী হয়েছে!’

‘তা হলে বিয়ে করলে কেন?’

‘শুধু এইজন্যই বিয়ে করা?’

‘এটাও একটা কারণ।’

‘একটা নয়, তোমার কাছে এটাই একমাত্র কারণ।’

রেবতীর স্বরে তাচ্ছিল্যের ছোঁয়া রয়েছে। অনন্তের ইচ্ছা করছে ঘুসি মেরে মেরে ওর মুখটাকে থেঁতলে দিতে।

‘তোমার একটা মেয়েমানুষের শরীর দরকার, যে—কোনো, যেমন—তেমন, মেয়েমানুষ।’

অন্ধকারে মূঠো করা অনন্তের হাতটা উঠেছিল, সেটা দেখতে পেলে রেবতী হয়তো কথাগুলো বলত না। কয়েক সেকেন্ড পর হাতটা মন্থরভাবে নেমে গেল।

মাত্র এগারো দিন তাদের বিয়ে হয়েছে। অনন্তের মনে হচ্ছে, তারা আর মিলতে পারবে না। বোকার মতো সে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। চল্লিশটা বছর কেটেছে যেভাবে বাকি জীবন সেইভাবেই নয় কেটে যেত।

জীবনকে সে কিছু কি দিয়েছে যে আজ প্রতিদান আশা করছে? ভাই বোন মা সবাই একে একে সরে গেছে। তাদের জন্য সে সতেরো বছর বয়সে বাবার জায়গা নেওয়ার দম্ভে বলেছিল, ‘আমি সবাইকে দেখব।’ মা বলেছিল, ‘তুই সুখী হবি।’

সুখ।

রেবতী ওপাশ ফিরে দেওয়াল ঘেঁষে শুয়ে।

পরদিন যথারীতি সে বাজারে গেল, স্নান করল, ভাত খেল এবং বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। অন্যদিনের মতো সন্ধ্যার সময় ফিরল।

অন্ধকার ঘরে রেবতী শুয়েছিল। আলো জ্বালতেই চোখ বন্ধ করল।

‘শুয়ে যে! শরীর খারাপ নাকি?’

‘না…ভালো লাগছে না তাই।’

‘রান্না করবে না?’

‘যাচ্ছি।’

অলু একদিন এসেছিল ঘণ্টাখানেকের জন্য। তাকে বলেছিল: ‘এমন সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ভাব করলে কী করে?’ আর পাঁচশো টাকা চেয়েছিল। দু—দিন পর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে মানিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

একদিন সন্ধ্যায় দোতলার কাকিমার সঙ্গে রাস্তায় মুখোমুখি হতেই তিনি এ—কথা সে—কথার পর গলা নামিয়ে বলেন, ‘তোকে তো ন্যাংটো বয়স থেকে দেখছি, তুই তো আমার ঘরের ছেলে, বল তো প্রায়ই গাড়ি নিয়ে একটা লোক তুই বেরিয়ে যাবার পরই আসে আর বউমা সেজেগুজে তার সঙ্গে বেরিয়ে যায়…কে লোকটা?’

‘গাড়ি নিয়ে!’

‘ওই মোড়ে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করে, আমি অবিশ্যি দেখিনি, রেডিয়োয় গান গায় প্রফেসরের বউ সঙ্ঘমিত্রা—ওদের ঝি দেখেছে। তোর কাকাবাবুও দু—দিন দেখেছেন। দুপুরে পার্ক স্ট্রিট দিয়ে দু—জনকে গাড়ি করে যেতে।’

শুনতে শুনতে অনন্তের বুকটা খালি হয়ে যেতে লাগল। একটা নোংরা সন্দেহ পাড়ায় ছড়িয়েছে। তার নিজেরও ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। তা ছাড়া একবারের জন্যও রেবতী তাকে বলেনি সে দিলীপ ভড়ের সঙ্গে বেরিয়েছিল। গোপন করা কেন? মাকে স্পেশালিস্ট দেখাবার জন্য আর তো একবারও বলল না। মা—র কাছে সেদিন সত্যিই গেছল কি!

‘ওহো, দিলীপদা, উনি তো রেবতীর মাসতুতো দাদা।’

কাকিমার মুখের ভাবের বিশেষ কোনো বদল ঘটল না। রেবতীকে দোতলার কেউ পছন্দ করে না। সে ওদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না।

‘হোক দাদা, লোকে তো পাঁচকথা বলে, তুই একটু বারণ করিস।’

রাত্রে পাশাপাশি শুয়ে অনন্ত একসময় জিজ্ঞেস করল, ‘দিলীপদা আসে?’

সে টের পেল পাশের শরীরটা টানটান হয়ে শক্ত হল।

‘পাড়ায় অনেকে খারাপ ভাবে নিয়েছে।’

‘কী নিয়েছে?’

‘ওর সঙ্গে তোমার বেরোনোটা।’

হঠাৎ অনন্তের চোখে ভেসে উঠল মধুবনের খালি ফ্ল্যাট আর শোবার ঘরের দেওয়ালের ক্যালেন্ডারের ছবিটা। বুকটা তার দুরদুর করে উঠল। একটা বাজে সন্দেহ তার মনে ঝিলিক দিল।

‘আমি কার সঙ্গে বেরোই না বেরোই তাতে পাড়ার লোকের কী?’

‘তাদের কিছুই নয়, কিন্তু আমার কিছু।’

‘তোমার।’

‘কেন বেরোও?’

এত কঠিনস্বরে অনন্ত কখনো কথা বলেনি।

‘বেরোলেই বা, কিছুক্ষণ মোটরে ঘুরলে কী হয়েছে?’

অনন্ত বলতে যাচ্ছিল, বেরিয়ে কোথায় যাও? জিবের ডগা থেকে সে কথাটা প্রত্যাহার করল।

‘বিয়ে করাটা উচিত হয়নি।’

‘কার, তোমার?’

‘তোমার…কোনো দরকার ছিল কি?’

‘ছিল।’

‘ছিল?’

‘বলা যাবে না। ওর কাছে আমরা অনেক কৃতজ্ঞ, অনেক ঋণী।’

‘তার জন্য আমাকে বলি হতে হবে।’

তাদের মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। রেবতী হাত বাড়িয়ে অনন্তর বাহু স্পর্শ করল। সে কোনো উত্তেজনা অনুভব করল না।

শান্তভাবে কয়েকটা দিন কেটে যাবার পর, বাড়ি ফিরে অনন্ত দেখল দরজায় শিকল তোলা, তালা ঝুলছে না। ঘরে যাওয়ামাত্র টেবলে রাখা চিরকুটটা তার চোখে পড়ে।—’আমার আর ভালো লাগছে না। চলে যাচ্ছি। আর ফিরব না। রেবতী।’

রান্নাঘরে রাতের খাবার ঢাকা দেওয়া। তার দেওয়া কোনো কিছুই নিয়ে যায়নি। ঘড়িটা টেবলে রাখা।

খাটে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে থাকতে অসম্ভব একটা শ্রান্তির শব্দ তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। আবার সে একা। পাঁচ মাসের জন্য সে অন্য একটা জগতে ঘুরে প্রত্যাবর্তন করল।

একদিন পর জেঠিমা বলল, ‘বউমাকে দেখছি না যে! বাপের বাড়ি গেছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘কদ্দিনের জন্য?’

‘মাসখানেক থাকবে।’

এক মাস সময় পেল। এর মধ্যে কেউ কৌতূহল দেখাবে না। কিন্তু তারপর? জানাজানি হবেই। মুখ দেখাবে কী করে? যে শুনবে প্রথমেই বলবে—কার সঙ্গে বেরিয়ে গেল? কিংবা—কোথায় গিয়ে উঠেছে?

খবরটা রেবতীর বাড়ির লোকেরা কেমন ভাবে নেবে? তারা কি ওকেই সমর্থন করবে?.. কোথায় গিয়ে উঠেছে? বাড়িতে না মধুবনের ফ্ল্যাটে!

নানান অনুমান, প্রশ্ন এবং দ্বিধা কাটিয়ে চারদিন পর রাত্রিবেলায় সে রেবতীদের বাড়িতে হাজির হল। তাকে দেখে প্রত্যেকের মুখে অস্বস্তি ফুটে উঠল। সে বুঝল, এরা তা হলে জানে।

‘রেবতী কি এখানে?’

ওর মা ইতস্তত করে বলল, ‘বিকেলেও তো ছিল…বলে যায়নি কোথায় গেছে।’

‘তা হলে আমি একটু ঘুরে আসি।’

‘একটু কিছু মুখে দিয়ে যাও বাবা।’

অনন্ত ওখান থেকে বেরিয়ে এল মধুবনের সাততলায়। দরজা খুলল দিলীপ ভড়ই।

‘আসুন।’

যেন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। অনন্ত সোফায় বসল। সামনের সোফায় দিলীপ ভড়। হাতে আধভরতি মদের গ্লাস। ছোটো করে চুমুক দিল।

‘রেবতী এখানে নেই। এসেছিল। আমি ফিরে যেতে বলি, ও রাজি হয়নি। ওকে তাই পাঠিয়েছি আমাদের দেশের বাড়িতে।’

‘ফিরে যেতে…কোথায় ফিরে যেতে?’

‘আপনার কাছে।’

‘আমি তো ওকে গ্রহণ নাও করতে পারি, তখন যাবে কোথায়?’

দিলীপ ভড় বড়ো করে হাসলেন। গ্লাসটা শেষ হয়ে গেছে।

‘আমার কাছে।’

‘আপনি ওকে ভালোবাসেন?’

‘নিশ্চয়।’

‘তা হলে বিয়ে দিলেন কেন? আমারও তো একটা জীবন আছে।’

‘সেই জন্যই ওকে ফিরে যেতে বলি। ঠিক এই কথাটাই ওকে বলেছি। ও শুনল না।’

‘পরিচিতদের কাছে এবার মুখ দেখাব কী করে!’

‘বলে দিন বাস চাপা পড়ে মারা গেছে, কিংবা কলেরায়।’

‘তা হয় না, পরে ওকে কেউ দেখে ফেললে আরও জানাজানি হবে।…অবশ্য আমার এতে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই…বউ যদি দুশ্চরিত্রা হয়, স্বামী কী করতে পারে?’

‘আপনাকে কেউ দোষ দেবে না?’

‘না, সবাই জানে আমি ভালো ছেলে।’

কথাটা বলেই অনন্তের বুকের মধ্যে একটা যন্ত্রণা শুরু হল। ধীরে ধীরে ফ্যাকাশে হয়ে এল তার মুখ। ফ্যালফ্যাল করে সে দিলীপ ভড়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটে বলল, ‘কিন্তু সত্যিই কি আমি তাই!’

এগারো

প্রায় তিন ঘণ্টা হয়ে গেল অনন্ত এলোমেলো হাঁটছে। রাস্তায় ট্র্যাফিক কমে গেছে। একটা ট্রামের সামনে লাল বোর্ডে ‘লাস্ট কার’ লেখাটা চোখে পড়েছে। পথচারীরা প্রায় নেই। দু—একটা আধ ভেজানো দোকান, ভিতরে আলো জ্বলছে। বগলে চট নিয়ে দু—তিনজন শোবার জায়গা খুঁজছে ফুটপাথে। অনন্ত আলোজ্বলা গির্জার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তারপর নিজের হাতঘড়ি দেখল। বন্ধ হয়ে আছে।

‘ইসস একদম ভুলে গেছি।’

ঘড়িতে দম দিতে দিতে সে আরও জোরে হাঁটা শুরু করল। হাঁটুর কাছে টান ধরেছে। কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে গিয়ে হাঁটুর পিছনে শিরাটার হাত বুলোল, কিন্তু সে গতি কমাল না। জলতেষ্টা পাচ্ছে অসম্ভব। থুতু ফেলতে গিয়ে শুকনো জিবটা টাগরায় আটকে গেল।

দরজায় আস্তে টোকা দিল। জায়গাটায় আলো নেই, তখনও চোলাইয়ের গন্ধ ভাসছে। আবার সে টোকা দিল।

‘কে?’

‘আমি।’

দরজা খুলে একটা ছায়া দুই পাল্লার ফাঁকে ভেসে উঠল। তখন সে কাতর অনুনয়ে বলল, ‘আমি শক্তিপদর ছেলে, আমার এবার ভালোবাসা দরকার…দেবে?’

 ছায়াসরণীতে রোহিণী

এক

লালবাজার মোড় থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার পুবে বউবাজার স্ট্রিটে ট্রামের তার ছিঁড়ে পাঁচ—ছটা ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়েছে। তাদের দু—পাশ দিয়ে বাস, মিনিবাস এবং অন্যান্য গাড়ি ফুড়ুত করে বেরিয়ে যেতে গিয়ে সামনে থেকে আসা ট্র্যাফিকের মুখোমুখি হয়ে রাস্তাটা এখন অচল করে ফেলায় গাড়ির পিছনে গাড়ি জমতে জমতে লালবাজার মোড় পর্যন্ত জ্যামের জের পৌঁছে গেছে। জনা চারেক ট্র্যাফিক কনস্টেবল ও একজন সার্জেন্ট ছুটে এসে কলকাতার এই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাটাকে চালু করার জন্য হিমসিম খাচ্ছে। কে জানে, পুলিশের কোন বড়োকর্তা বা কোন মন্ত্রী জ্যামে আটকে পড়ল কিনা!

অপেক্ষা থেকে নিস্তার পাবার জন্য কিছু গাড়ি পাশের গলিগুলোয় ঢুকে পড়ছে। তাড়া আছে এমন মানুষেরা গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেছে। পরনে হালকা নীলের উপর সাদা নকশা সুতির শাড়ি, গায়ে ফিকে গোলাপি কার্ডিগান এবং কাঁধে মোটা কাপড়ের একটি রঙিন ঝুলি নিয়ে এক রমণী ট্যাক্সির ভাড়া চুকিয়ে নামল। ফুটপাথ ধরে সে দ্রুতপায়ে বিবাদী বাগের দিকে এগোবার চেষ্টা করল ভিড়ের মধ্য দিয়ে।

যদিও জানুয়ারির শেষ, কিন্তু কলকাতায় এবার শীত তেমনভাবে আসেনি। এখন দুপুর আড়াইটে, রোদ ঝলমল করছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ। বিকেলে ফুরফুরে হাওয়া বইলে ভালোই লাগে। বোধহয় বসন্ত এবার দু—দিন সপ্তাহ এগিয়ে আসবে। অবশ্য লালদিঘিতে যে ক—টা গাছ রয়েছে তাদের ভাবগতিক দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই। ক্যালেন্ডারি মতে বসন্ত না এলে তারা যেন শীতবস্ত্র পা থেকে নামাবেই না। কিন্তু এই দুপুরে কর্মব্যস্ত অফিস পাড়ায় শীত—বসন্ত নিয়ে কেউই মাথা ঘামাচ্ছে না। ট্র্যাফিক অচল হওয়ায় সবাই বিরক্ত। এরই মধ্যে হালকা নীল ছাপা শাড়ির রমণী যেন একটুকরো বসন্ত। তার দিকে যারই চোখ পড়ছে, দ্বিতীয়বার তাকাতে হচ্ছে।

রমণীর দ্রুত গমন—চেষ্টা পদে পদেই ব্যাহত হচ্ছে। কলকাতার যেকোনো ফুটপাথের মতো এটিও টেলিফোন, ইলেকট্রিক, কর্পোরেশন, সিএমডিএ প্রভৃতি জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানের দ্বারা ধর্ষিত। গর্ত, ঢিপি, ইট, কাদা প্রভৃতির জন্য পদক্ষেপে সতর্ক থাকায় বাধ্য হয়েই চলার বেগ মন্থর করতে হয়েছে। ফলে তার গমন ভঙ্গিতে কবুতরীর আদল এসেছে। তার উপর রমণীর দেহ পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চচ, যেটা বাঙালি মেয়েদের গড়পড়তা উচ্চচতার থেকে বেশি। ঈশ্বরের এবং সেই সঙ্গে নিজের চেষ্টায় দেহ—কাঠামোটি যেভাবে ভরাট হয়ে রয়েছে, তাতে মনে হয় দুর্বলচিত্তের পুরুষদের সঙ্গে নির্মম রসিকতা করার জন্যই যেন এই দেহটি নির্মিত। বস্তুত এই ট্র্যাফিকের জট—সমস্যা সমাধানে যে সময় লাগবে, তার থেকেও দশ বা পনেরো সেকেন্ড সময় বেশিই লাগবে এবং সেজন্য কর্তব্যে ব্যস্ত সার্জেন্টটিকে দোষারোপ না করে এই রমণীর রচনাকারকেই দায়ী করা উচিত। সার্জেন্টের অনুসরণে মিনিবাসের ড্রাইভার অ্যাক্সিলেটরে পায়ের চাপে আন্দাজের গোলমাল ঘটিয়ে সামনের স্টেটবাসের পিছনে যে ঢুঁ মারল, বলাবাহুল্য সেজন্য একজনই দায়ী।

রমণীর কিন্তু ভ্রূক্ষেপ নেই। যেন সে জানেই, তার উপস্থিতি পুরুষ—চিত্তের কাজকর্মে কী ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে। মুখে হালকা প্রসাধন, কিন্তু সদ্য অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা রোগীর মতোই যেন তার দুগ্ধহীন কফি রঙের মুখের ত্বক দুর্ভাবনায় শুকনো। ভালো করে লক্ষ করলে দুটি চোখের ঘন কালো মণিতে ত্রাসের ছায়া দেখা যাবে। দূর থেকে যা বিনিদ্র রাতের ক্লান্তি বলে মনে হচ্ছে।

রবীন্দ্র সরণির মোড় পার হয়ে লালবাজারের পুলিশী সদর দফতর অতিক্রম করে সে রাধাবাজার যাওয়ার গলিতে ঢুকল এবং চলার গতি দ্রুত করল। কাঁধ পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত কালো রেশমের মতো কেশ ঈষৎ আন্দোলিত হচ্ছে অথচ মহাদেবের ডমরু সদৃশ দেহটির গড়নে দ্রুত গমনজনিত কোনো বেতালা অসংগতি ফুটে উঠছে না। নিতম্বের উচ্ছ্বাস নিয়মিত ছন্দেই উত্থিত হয়ে স্তিমিত হয়ে চলেছে। নাভির নীচে শাড়ির ভাঁজগুলি প্রশস্ত সানুদেশের উপর বিছানো। তার দেহের দৈর্ঘ্যের সঙ্গে বিস্তারের কোনো বিবাদ নেই এবং অচঞ্চল ভঙ্গিতে গ্রীবা ও চিবুক তুলে সে হেঁটে চলেছে। পদক্ষেপের দৃঢ়তাই জানান দিচ্ছে তার পায়ের পেশি বলিষ্ঠ।

এই গলিতে নানাবিধ ঘড়ির দোকান দু—ধারে। মনোহারি দেওয়াল ঘড়িতে দোকানগুলি যেভাবে শোভিত, তা বহু লোকই গতি মন্থর করে দেখতে দেখতে যাচ্ছে। রমণী দোকানে ঢুকল। বিক্রয়কারিণী সিড়িঙ্গে চেহারার ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বালিকা। রাগী সিংহের মতো তার চুলগুলি ফাঁপানো। রমণী পরিচ্ছন্ন ইংরেজিতে তাকে বলল, ‘ছ—দিন আগে পুরুষদের একটি রিস্টওয়াচ সারাতে দিয়েছিলাম, আজ সেটি দেবার তারিখ।’ এই বলে সে ঝুলি থেকে একটি ছোটো চামড়ার পার্স বার করে তার থেকে বিল বার করল।

নম্বর দেখে শো—কেস থেকে একটি চৌকো স্বর্ণাভ দামি ঘড়ি তুলে নিয়ে বিক্রয়কারিণী সুন্দর করে হাসল। তার দাঁতগুলি শ্বেত প্লাস্টিকের মতো এবং সাজানো। সম্ভবত তার চাকুরি দাঁতের জন্যই। দাম চুকিয়ে রমণী দোকান থেকে বেরিয়ে দু—ধারে সন্তর্পণে তাকাল। তারপর আবার দ্রুতগতিতে ব্রেবোর্ন রোডে পৌঁছে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করল।

বড়ো বড়ো কয়েকটি অফিস—বাড়ি এবং দুটি রাস্তা অতিক্রম করে সে সাততলা একটি বাড়িতে ঢুকল। দশ—বারোটি অফিস এই বাড়িতে, কিন্তু লিফট মাত্র একটি। লিফটের দরজায় লাইন দিয়ে জনা দশেক অপেক্ষমাণ। রমণী তাদের দিকে একনজর তাকিয়ে পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল।

লোকগুলি নেহাতই ষড়রিপুর দাস। তাই চোরাদৃষ্টিতে রমণীর সিঁড়িভাঙা দেখতে গিয়ে শ্বাস রোধ করে রইল এবং তাদের দ্রষ্টব্য বস্তুটি চোদ্দো ধাপ অতিক্রম করে সিঁড়ির বাঁকে অন্তর্হিত হওয়ার পর নিশ্বাস ফেলে হাঁপ ছাড়ল।

‘এতবড়ো বাড়িতে দুটো লিফট থাকা উচিত।’ এক মধ্যবয়সি মন্তব্য করল। ‘জরুরি কাজ রয়েছে অথচ—’

‘লিফটম্যানটা বরাবরই এইরকম, উঠলে আর নামতে চায় না, রিপোর্ট করা উচিত।’ যুবকটি এই বলে বন্ধ কোলাপসিবল দরজার কাছে এসে মাথা বাঁকিয়ে উপর দিকে তাকাল। ‘নাহ, পাত্তাই নেই…হেঁটেই উঠি।’ এই বলে যে লাইন ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে লাফাতে লাফাতে উঠে আড়াই তলা বরাবর পৌঁছে রমণীকে দেখতে পেয়েই লাফানোর বেগ কমাল। ধুতি—শার্ট পরা এক শীর্ণকায় লোক উপর থেকে নেমে আসছে, তাকে দেখে রমণী থেমে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল ‘সাহেব আছেন?’

‘আছেন,’ লোকটি মাথা কাত করল ঈষৎ সম্ভ্রমভরে।

রমণী তিনতলায় পৌঁছে বাঁদিকের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। দরজার পাশে একটা কাঠের চৌকো টুকরোয় সাদা বড়ো অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা: ইস্টার্ন ম্যাগাজিনস প্রাইভেট লিমিটেড। তার নীচে আর একটি কাঠে ইংরেজিতে লেখা: বরুণা প্রিন্টার্স। তার পাশের কাঠে উপর থেকে নীচে ইংরেজিতেই তিনটি ম্যাগাজিনের নাম: চিত্ররেখা। মহারানি। শৈশব। নামগুলি তিনরকম রঙে, হলুদ, গোলাপি ও গাঢ় কমলায় লেখা।

এই অফিস ইস্টার্ন ম্যাগাজিনসের বৃহৎ দেহকাণ্ডের শুধু মুখটুক। এখানে সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক তিনটি ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় দফতর ছাড়াও আছে সার্কুলেশন, অ্যাকাউন্টস ও বিজ্ঞাপন বিভাগ। এ ছাড়া বাঁধাই ও ছাপার এবং কম্পোজিং ও প্রসেসিংয়ের কাজকর্ম হয় বেলেঘাটায়। ফোটো বিভাগটিও সেখানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে প্রায় এক বিঘে নিজস্ব জমিতে প্রেসবাড়ি, গুদাম ও গ্যারাজ। সম্প্রতি আর্ট বিভাগটিও সেখানে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ব্রেবোর্ন রোডের অফিস থেকে। বাচ্চচাদের জন্য শৈশব নামে একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ হচ্ছে। দফতর করতে জায়গা চাই, তাই এই স্থানান্তর। প্রয়োজন হলে আর্ট ডিরেক্টর শম্ভু দত্তকে বেলেঘাটা থেকে ডেকে পাঠানো হয়।

বিরাট একটা ঘর, যার আয়তন দেড়খানা ভলিবল কোর্টের সমান। তিনতলার অর্ধেক নিয়ে ইস্টার্ন ম্যাগাজিনস। ঘরের দেওয়াল সংলগ্ন কাঠের পার্টিশান দেওয়া কামরাগুলিতে তিনটি ম্যাগাজিনের দফতর। মাঝখানটিও গলা—সমান উঁচু কাঠের দেওয়ালে ঘেরা। সেখানে মোটামোটা লেজার বই, স্টিলের চারটি আলমারি, লোহার র‌্যাক, আর নানান আকারের খাতা, ফাইল, চিঠিপত্র, ভাউচার ইত্যাদি নিয়ে ব্যবসায়িক কাজ চলে ছোটোবড়ো সাতটি টেবিলে।

ইস্টার্নের মালিক, কর্ণধার এবং ব্যবসাটিকে বিরাট করে তোলার জন্য সব কৃতিত্বের অধিকারী গঙ্গাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কামরা ব্রেবোর্ন রোডের দিকে উত্তর—পশ্চিম কোণে। নীল কাপের্ট, এয়ারকুলার, দেয়ালে ফেল্টের বোর্ড, তাতে ম্যাগাজিনের মলাট পিন দিয়ে আঁটা ও মোটা কাচে ঢাকা টেবিল, যাতে ছয়জন বসে খেতে পারে। কাঠের গ্লাসে কলম, তাতে নানা রঙের ও ধরনের পেনসিল। লাল ও জলপাই রঙের দুটি টেলিফোন, টেবল ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি এবং স্লিপের প্যাড, এই ক—টিই টেবিলের স্থায়ী জিনিস, অবশ্য সকাল ন—টায় গঙ্গাপ্রসাদ চামড়ামোড়া ঘূর্ণি চেয়ারে বসার পর থেকেই টেবল ভরে উঠতে শুরু করে নানান ধরনের দরকারি কাগজে। তিনটি চেয়ার ছাড়াও দেওয়াল ঘেঁসে আছে অতিথিদের বসার জন্য দামি কাপড়ে মোড়া পুরু ফোমের গদি আঁটা জলচৌকির মতো আসন ও ঠেস দেওয়ার বালিশ।

গঙ্গাপ্রসাদ সাদাসিধে ধরনের। যতটুকু না হলেই নয়, শুধু ততটুকুরই পক্ষপাতী। প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চচ বলেই নিজের কামরাটিকে মূল্যবান, সুদৃশ্য জিনিস দিয়ে সাজাতে হবে এমন চিন্তা তিনি করেন না। যতটুকু সজ্জা বা আসবাব, সেটা তাঁর স্ত্রী বরুণার নির্দেশে হয়েছে। স্ত্রীকে তাঁর ভয় পাওয়ার ও ভালোবাসার কথা অফিসের বেয়ারাও জানে। বরুণার জন্যই তাঁকে টাই পরে বাড়ি থেকে বেরোতে হয় এবং অফিসে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামার আগে সেটি খুলে তিনি পকেটে রেখে দেন। একবার টুপি পরার প্রস্তাব বরুণা দিয়েছিল এবং গঙ্গাপ্রসাদ ঢোঁক গিলে বলেছিলেন, ‘গরমের দেশে ওসব মাথায় দিলে চুল উঠে টাক পড়ে।’ বরুণা সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে।

আটানব্বুই কিলোগ্রামের সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চচতার শরীরের ভার চেয়ারের পিঠে এলিয়ে দিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ এখন প্রকাশিতব্য বাচ্চচাদের ম্যাগাজিন ‘শৈশব’—এর প্রথম সংখ্যার জন্য নির্ধারিত মলাটের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে। টেবলে ছড়ানো আরও দুটি ওই একই মলাট, তবে রঙের ভিন্ন সমন্বয়ে। কোন রঙেরটি দিয়ে শৈশব শুরু হবে, তার চূড়ান্ত নির্বাচনে তিনি ব্যস্ত বা চিন্তায় মগ্ন।

আর্ট ডিরেক্টর শম্ভু দত্ত দশ মিনিট ঠায় বসে। মাঝে দু—বার কথা বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদের ভ্রূকুটি দেখেই গভীরভাবে মলাট অধ্যয়নে নিজেকে নিযুক্ত করে টেবলের অপর দিকের চিন্তাস্রোত কোন খাতে বইছে, সেটা আড়চোখে বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

গঙ্গাপ্রসাদের ভ্রূ যতটা উঠেছে, ঠিক ততটাই ঝুলে রয়েছে দুই স্তরে চর্বির চিবুক। গোলাকার বিরাট মুখটিতে ঘামের বিন্দু ফুটেছে। আনমনে গঙ্গাপ্রসাদ বন্ধ এয়ারকুলারের দিকে তাকাতেই শশব্যস্ত শম্ভু দত্ত বলল, ‘চালিয়ে দেব?’

‘না। কিন্তু তুমি যে কেন এই কালো রঙের ত্যারচা দুটো স্ট্রিপ কোণে রাখতে চাইছ বুঝছি না।’ গঙ্গাপ্রসাদ হাতের মলাটটি টেবলে ছুড়ে ফেলে বললেন। ড্রয়ার টানলেন রুমাল বার করার জন্য। সাত—আটটি রুমাল সেখানে।

‘তাহলে কি তুলে দেব?’ শম্ভু দত্ত ক্ষীণস্বরে জানতে চাইল। গঙ্গাপ্রসাদ ছয় বছর আগে প্রথম যখন চিত্ররেখা প্রকাশ করে ম্যাগাজিন ব্যবসায়ে নামেন, শম্ভু দত্ত তখন থেকেই রয়েছে। সে জানে, তর্ক করে লাভ নেই।

‘কালো রঙটার বদলে মেরুন দাও। আর এই বাচ্চচাটার জাঙিয়াটা…।’ গঙ্গাপ্রসাদ আবার ভ্রূ কোঁচকালেন, ‘খুলে দিলে কেমন হয়, পেছন ফিরেই তো রয়েছে।’

শম্ভু দত্ত চোখ সরু করে মলাটে দৃষ্টি রাখল। জাঙিয়াপরা আদুড় গা, একটি শিশু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার জন্য প্রথম ধাপে পা রেখেছে। কয়েক ধাপ উপরে দুটি কিশোর—কিশোরী সিঁড়ি দিয়ে উঠে যেতে যেতে পিছনে হাসিমুখে শিশুটির দিকে তাকিয়ে। পরিকল্পনাটা গঙ্গাপ্রসাদেরই, অর্থাৎ বরুণার। শৈশব ধরতে চায় কৈশোরকে।

‘বুবুনের ছোটোবেলার এইরকম একটা ছবি আছে।’ ‘গঙ্গাপ্রসাদের স্বর কোমল ও গাঢ় শোনাল। ‘ওর মায়ের তোলা। কলকাতায় চৌব্বাচার পাড়ে রাখা বালতি ধরার জন্য যেই দু হাত তুলেছে আর তখনই পিছন থেকে স্ন্যাপ নিয়েছিল। আমরা তখন দর্জিপাড়ার বাড়িতে থাকি। আজও যখন ছবিটা দেখি, ইচ্ছে করে কোলে নিয়ে খুব একচোট ধামসাই। যা নাদুসনুদুস ছিল। অথচ সেই বুবুন এখন জার্মানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। দেখ শম্ভু, ম্যাগাজিন তো আর বাচ্চচারা পকেট থেকে পয়সা বার করে কিনবে না, কিনবে তাদের বাবা—মা। ফিগারটা ভালোই হয়েছে, তুমি বরং জাঙিয়াটা খুলে দাও, বাৎসল্য রসকে ইনভাইট কর। দেখলেই কোলে তুলে নিতে ইচ্ছে করবে এমনভাবে বাচ্চচাটাকে প্লেস কর, পাছা দুটো নরম নরম করে দাও।’

মলাটটা আবার তুলে নিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। সেই সময় দরজা খুলে সন্তর্পণে মুখ বাড়াল সেই রমণী, যাকে কিছুক্ষণ আগে হেঁটে আসতে দেখা গেছে।

‘আসব?’

গঙ্গাপ্রসাদ মুখ তুলে দেখেই চেয়ারে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে বললেন, ‘আরে রোহিণী, তোমার কথাই ভাবছিলুম। এসো এসো একটু পরামর্শ দাও তো।’

রোহিণী কাঁধ থেকে ঝুলিটি নামিয়ে শম্ভু দত্তর পাশের চেয়ারটিতে বসামাত্র গঙ্গাপ্রসাদ মলাটটি তার সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই বাচ্চচাটাকে তোমার কেমন লাগছে? টেন্ডার, সুইট, সফট নয় কি?’

রোহিণী একঝলক তাকিয়ে স্মিত হেসে মাথা নাড়ল।

‘জাঙিয়াটা খুলে দিলে কেমন হয়। এইটুকু বাচ্চচার কি সেক্স থাকে।’

‘না না ওটা থাক।’ রোহিণী ব্যস্ততা দেখাল না বটে তবে কণ্ঠে দৃঢ়তা ফুটে উঠল।

গঙ্গাপ্রসাদ অপ্রতিভ হয়ে শম্ভু দত্তর ভাবলেশহীন মুখের দিকে বার কয়েক আড়ে তাকিয়ে অস্ফুট বললেন, ‘কিন্তু আমার কেমন যেন একটা আদর করার ইচ্ছে …বুবুনের ছবিটা মনে পড়ার জন্যই বোধহয়…।’

শম্ভু দত্ত ইতিমধ্যে রোহিণীর সমর্থন পেয়ে সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছে। সে গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘পয়সা দিয়ে যারা পাঁচ টাকার ম্যাগাজিন কিনবে, তারা মোটামুটি সচ্ছল, শিক্ষিতও। নিশ্চয় রুচিও আছে। তারা কি বাড়িতে বাচ্চচাদের ন্যাংটো রাখে বা এইভাবে দেখতে চায়? সাধারণত বস্তিটস্তি বা গ্রামট্রামে গরিবঘরের ছেলেপুলে ন্যাংটো থাকে।’

‘আমি ঠিক সেদিক থেকে ভেবে ‘না’ বলিনি।’ রোহিণী মুখ ঘুরিয়ে শম্ভু দত্তর দিকে তাকিয়ে বলল। ‘বাচ্চচাটা জাঙিয়া পরেছে বলেই দেখতে ভালো লাগছে, আর এটাই তো প্রধান বিবেচ্য বিষয়—ভালো লাগা, তাই তো?’

‘নিশ…চয়।’ গঙ্গাপ্রসাদ টেবলে চাপড় মারলেন। ‘ঠিক আছে শম্ভু তাহলে আর ওটা খোলার দরকার নেই।’

মলাটগুলো গুছিয়ে নিয়ে শম্ভু দত্ত দ্রুত বেরিয়ে গেল।

‘তোমার এবারের মহারানির লেখাটার টাইটেল একটু বদলে দিয়েছি, দেখেছ?’

‘হ্যাঁ ভালোই হয়েছে।’

‘একটু বেশি কাব্য কাব্য হয়ে গেছিল। লেখার বিষয় বা বক্তব্যটা আঁচ করতে অসুবিধে হচ্ছিল। সোজা সহজ আর ক্যাচি হওয়া দরকার, চোখ পড়লেই কৌতূহল জাগবে এমন টাইটেল চাই। চা খাবে?’

‘না।’

‘লিম্বু পানি? পাতিলেবুর রস, গোলমরিচ, সন্ধব নুন আর চিনি দিয়ে?’

‘চিনিটা বাদ।’

টেবিলের নীচে হাত ঢুকিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ কলিং বেলের বোতাম টিপলেন। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই ঘরে ঢুকল সেই ধুতি—শার্ট পরা শীর্ণকায় লোকটি, সিঁড়িতে রোহিণীর সঙ্গে যার দেখা হয়েছিল।

‘কমল দু—গ্লাস লিম্বু পানি, একটা চিনিছাড়া।’

কমল বেরিয়ে যেতেই গঙ্গাপ্রসাদ জানতে চাইলেন, ‘মীনা চ্যাটার্জির সঙ্গে আজ তোমার ইন্টারভিউ না?’

‘সাতটায়। টিভি সিরিয়ালেও নামছে, তাই নিয়ে নাকি ব্যস্ত।’

‘বড়ো পর্দা থেকে ছোটো পর্দায়! বোধহয় ফিল্মে আর তেমন সুবিধে হচ্ছে না। এরপর কি যাত্রায়?’

রোহিণী ফিকে হাসল। মীনা চ্যাটার্জিকে নিয়ে চিত্ররেখায় ফোটো ফিচারের প্রস্তাব গঙ্গাপ্রসাদেরই দেওয়া। সকালে বিছানা ছেড়ে ওঠা, যোগব্যায়াম থেকে শুরু করে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে ড্রেসিং টেবলে বসে মুখ, গলা, হাতের চামড়ায় এটা সেটা মাখা, মোটামুটি শরীরটাকে নানান ভঙ্গিতে দেখাতে হলে যা যা করা দরকার, মীনা চ্যাটার্জির সেই সব করার ছবির এবং একটি সাক্ষাৎকারের জন্য চিত্ররেখা চার পাতা বরাদ্দ করেছে। ওটা পাঁচ বা ছয় পাতাও হয়ে যেতে পারে, যদি ম্যাটার কম পড়ে।

‘টিভি—র জন্য আলাদা একটা বিভাগ চিত্ররেখায় করব ভাবছি। হাজার হাজার পরিবারের মগজে টিভি জায়গা করে ফেলেছে। ভেবেছি, তোমাকেই এটার দায়িত্ব দেব। তুমি টিভি দেখ তো?’

‘আমার টিভি সেট নেই। উপরের চারতলায় আছে, কিন্তু গিয়ে দেখার আর ইচ্ছে হয় না। পরিবারের কথাটি একটু জালাতনে…।’

‘মানে?’

রোহিণী ঠোঁট চাপল। গালের পেশি একটু শক্ত হল এবং প্রসঙ্গ এড়াবার জন্য বলল, ‘আপনি কি টিভি দেখেন?’

‘ধুর! সময় কোথায়। ছুটির দিনে ওয়ান ডে ক্রিকেট ম্যাচ কয়েকটা দেখেছি, দারুণ একসাইটিং। আর একবার রাতে ঢাকার একটা নাটক দেখেছিলাম। বরুণা তো ঢাকারই প্রোগ্রাম দেখে, কলকাতার থেকে নাকি ফার বেটার। তবে নাটকটায় একটা জিনিস আমাকে স্ট্রাইক করল। ক্যারেক্টাররা সবই মিডলক্লাস শিক্ষিত মুসলমান অথচ ‘বাবা—মা’ বলল, এমনকী পানি না বলে জলও বলল। পায়ে হাতে দিয়ে হিন্দুদের মতো প্রণাম করল। উচ্চচারণে বাঙালে টানটোন নেই। মনে হচ্ছিল, কলকাতারই কোনো হিন্দু পরিবার। তোমাকে একটা পোর্টেবল সেট কিনে দেব, দেখো আর চিত্ররেখায় শুরু করে দাও।

ট্রে—তে দুটি গ্লাস নিয়ে কমল ঢুকল। ওরা গ্লাস দুটো হাতে তুলে নিল। প্রথম চুমুক দিয়েই গঙ্গাপ্রসাদ ‘আহ হ’ বলে ওঠার পর এবং কমল বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেই রোহিণী ঝুলি থেকে ভাঁজ করা বাংলা একটা খবরের কাগজ বার করে এগিয়ে ধরল।

‘আজকের কাগজ। তিনের পাতায়, ফোর্থ কলামের একেবারে তলায় ছোট্ট খবরটা পড়ুন।’

গঙ্গাপ্রসাদ কাগজটা খুলে উপর দিকের হেডিংগুলোয় চোখ বোলাতে বোলাতে বললেন, ‘ভেতরের পাতাগুলো সকালে পড়ার আর সময় হয়ে ওঠে না। রাত্তিরে গিয়ে…।’ থেমে গেলেন। তাঁর বিরাট বপু হঠাৎ সামান্য ঝুঁকে পড়ল। কপালে ভাঁজ উঠল। তিনি তীক্ষ্ন চোখে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোনো নাম তো দেয়নি।’

‘হ্যাঁ, নাম নেই। কিন্তু…’ ইতস্তত করে রোহিণী চুপ করে গেল।

‘পুলিশ সূত্রে পাওয়া খবরে জানা গেছে, বহরমপুর জেল থেকে যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ড পাওয়া এক আসামী পালিয়ে গেছে। তাকে ধরার জন্য জোর তল্লাস চলছে। খবরটা নিজস্ব সংবাদদাতার। এইরকম খবরের কোনো মানে হয়? কীসের আসামি, কী তার নাম, কবে জেল ভেঙে পালিয়েছে, সে সব কিছুই নেই। এটা কি একটা রিপোর্ট হল!’ গঙ্গাপ্রসাদ কাগজটা বিরক্তিভাবে ছুড়েই প্রায় টেবিলে রাখলেন।

দু—হাতের তালুতে গাল চেপে ধরে গোঁজ হয়ে তাকিয়ে রইলেন দেওয়ালের ডিসপ্লে বোর্ডের দিকে।

‘পড়েই বুকটা কীরকম ছ্যাঁত করে উঠল।’ রোহিণী প্রায় ফিসফিস করে বলল। ‘ওকে তো বহরমপুরেই রাখা হয়েছে।’

‘কেউ পালালে যে সেটা শোভনেশই হবে, তার কি কোনো কারণ আছে?’

গঙ্গাপ্রসাদ ড্রয়ার খুলে একটা ছোটো চামড়া বাঁধানো ডায়েরি বার করে, পাতা উলটে লাল ফোনে রিসিভারটা তুলে নিলেন। ডায়াল করতে করতে বললেন, ‘রাইটার্সে আইজি প্রিজনস—এর কাছ থেকে খবর পাই কিনা দেখি।’

রোহিণী সিধে হয়ে বসল। হাতের মুঠিতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরল ঝুলিটা। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে রইল গঙ্গাপ্রসাদের মুখের দিকে।

‘হ্যালো আই জি প্রিজনস—এর অফিস? …হ্যালো, আমি ইস্টার্ন ম্যাগাজিন থেকে বলছি। আইজি আছেন? …নেই? দেখুন আমি একটা খবর জানতে চাই। আজ কাগজে একটা খবর বেরিয়েছে; বহরমপুর জেল থেকে একজন যাবজ্জীবনের আসামি পালিয়েছে, ওর নামটা কি আপনারা বলতে পারেন? ….হ্যাঁ ধরছি।’

রোহিণী ঝুঁকে পড়ল টেবলে। টেলিফোনে ওধার থেকে কী খবর দেয়, সেটা যেন সে নিজেই শুনে নিতে চায়।

ফোনের মাউথপিস হাত দিয়ে চেপে গঙ্গাপ্রসাদ চাপাস্বরে বললেন, ‘দেখছি বলল।’ তারপরই ‘হ্যাঁ হ্যাঁ কী বললেন? এখনও কিছু জানেন না! খবরটা আপনারাও দেখেছেন! হ্যাঁ হ্যাঁ…তাহলে কালই খবর নেব। আচ্ছা, ধন্যবাদ, নমস্কার। ‘ গঙ্গাপ্রসাদ রিসিভার রাখলেন।

‘কী বলল, জানে না?’ রোহিণী শ্বাস বন্ধ করে বলল।

‘হ্যাঁ। কাল খোঁজ নেব।’ অনুত্তেজিত, শান্ত স্বরে কথাগুলো বলে গঙ্গাপ্রসাদ হাসলেন। ‘মনে হচ্ছে আপসেট হয়ে পড়েছ, ভয় পাচ্ছ?’

রোহিণী শুধু তাকিয়ে রইল তার সামনে গোলাকার, স্মিত হাসিতে ভরা, অভয় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকা মুখটির দিকে।

‘কত বছর হল!’

‘ছ—বছর।’

‘কোনোরকম যোগাযোগ কি তুমি রেখেছ?’

‘না। একবারও নয়। আমার কোনো দরকার নেই যোগাযোগের, মনে হয় কোনোদিন দরকার হবেও না। আর ওর তরফ থেকেও সম্ভবত এই একই বক্তব্য।’

‘তোমার মনোভাব দেখছি এখনও একই রয়ে গেছে।’

‘বদলাবার মতো কোনো কারণ তো ঘটেনি।’ রোহিণী খবরের কাগজটা তুলে চোখের সামনে ধরল। তার মুখের পেশি কঠিন দেখাচ্ছে।

‘তুমি কীভাবে আছ, কোথায় আছ, শোভনেশ জানে না?’

‘না, জানার কথা নয়।’

‘তাহলে তো তোমার ভয় পাওয়ার কথা নয়। এই তিরিশ—চল্লিশ লাখ লোকের শহরে একজনকে খুঁজে বার করা কি সহজ ব্যাপার? তা ছাড়া ওরও তো ধরা পড়ার ভয় থাকবে, অবশ্যই এই পলাতক আসামি যদি শোভনেশই হয়।’

‘গঙ্গাদা, আপনি আপনার বন্ধুটিকে ভালোই চেনেন, আমার থেকেও ভালো চেনেন। আপনাদের মধ্যে আলাপ কলেজ—জীবন থেকে, তার মানে আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। আমি চিনি মাত্র বিয়ের আগে চার মাস আর তারপরে ছ—মাস।’

একষট্টি বছর বয়সি লোকটি অস্বস্তি ভরে নড়ে উঠে, গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘শোভনেশ একটু অন্য ধরনের, অদ্ভুত চরিত্রেরই। কতগুলো ব্যাপারে, বিশেষ করে নিজের পেশা ছবি আঁকার ব্যাপারে বড়ো কঠিন আর নির্মম ছিল।’

‘দানব ছিল বলুন।’

গঙ্গাপ্রসাদ আড় চোখে ঘৃণায় দোমড়ানো রোহিণীর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে হালকা স্বরে বলে উঠলেন, ‘অতীতটা অতীতেই থাক, এবার বর্তমানের খবর বল। তারপর তোমাদের কদ্দূর, মানে দ্বিতীয়বার আমার উইটনেস হবার চান্সের কদ্দূর?’

শোভনেশের সঙ্গে রোহিণীর রেজিস্ট্রি বিয়েতে গঙ্গাপ্রসাদ সাক্ষী ছিলেন।

‘এখনও আমার ডিভোর্স হয়নি। এখনও আমি মিসেস সেনগুপ্ত।’

‘যার স্বামী খুনের দায়ে যাবজ্জীবন পেয়েছে, সে তো চাওয়ামাত্রই ডিভোর্স পাবে। কিন্তু তোমরা এগিয়েছ কতটা?’

‘আমি এবার হুঁশিয়ার হতে চাই গঙ্গাদা। দশ বছর আগে যে—চোখে পৃথিবীকে দেখতাম, যেসব ধারণা মানুষ সম্পর্কে করতাম, তার অর্ধেকটাই বদলে গেছে। নিজের সম্পর্কেও এখন আমি অন্যরকম ভাবি। এটা তো ঠিক, এক—একটা মেয়েকে সম্মান মর্যাদা নিয়ে শুধুমাত্র খেয়ে পরে যদি টিকে থাকতে হয়, তাহলে তাকে চালাক হতেই হবে। স্নেহ, মমতা, প্রেম, বন্ধুত্ব, সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে দেখতে হবে। ঝোঁকের মাথায় কিছু করে ফেলার বয়স তো আর নেই।’

‘তুমি আমার সম্পর্কেও এখন তাহলে সন্দিহান?’

‘এই একটা জায়গায় আমি সবথেকে নিরাপদ।’ রোহিণী আজ এই প্রথম সহজভাবে হাসল। দেখা গেল বাঁদিকের গজদাঁতটি। দেহ শিথিল করে চেয়ারে হেলান দিল।

‘সত্যিকারের দাদা।’

‘আমি তোমার থেকে কত বছরের বড়ো? ছাব্বিশ, সাতাশ?’

‘সব্বোনাশ, তাহলে তো বাবার বয়সি প্রায়!’ রোহিণী আঁতকে ওঠার ভান করল। ‘তাহলে যে গঙ্গাকাকা—টাকা বলতে হয়।’

‘শোভনেশের সঙ্গে তোমার বয়সের ডিফারেন্স কত?’

‘ঠিক পঁচিশ বছরের।’

‘ও আমার থেকে দু—বছরের ছোটো। আর রাজেনের সঙ্গে তোমার?’

‘আমার থেকে ও চার বছরের ছোটো, রাজেনের এখন তিরিশ।’

‘তোমার তাহলে এখন…।’ টেলিফোন বেজে উঠল। বাক্যটি অসম্পূর্ণ রেখে গঙ্গাপ্রসাদ লাল রিসিভার তুললেন।

‘ব্যানার্জি। …ওহ বরুণা…হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ঠিক সাড়ে পাঁচটায় বাড়ি পৌঁছব। গোছগাছ এর মধ্যেই করে ফেলেছ? এখন তো মাত্র…।’ হাতঘড়ি দেখলেন গঙ্গাপ্রসাদ ‘পৌনে চারটে। আচ্ছা বাবা আচ্ছা, এখনি যাচ্ছি। …ঘরে কে রয়েছে? রোহিণী….দিচ্ছি।’

গঙ্গাপ্রসাদ রিসিভারটা বাড়িয়ে ধরলেন। কে ফোন করছে বলার দরকার হল না।

‘হ্যালো।’ হালকা গলায় রোহিণী শুরু করল। সে জানে, ওধার থেকে যিনি কথা বলছেন, তাঁকে একাই কথা বলতে দিতে হবে। তার কাজ শুনে যাওয়া।

‘বউদি আমি…’

‘রোহিণী, আমরা বিকেলে বাসুদেবপুর যাচ্ছি, গাড়িতে, তিন দিন থাকব, রবিবার রাতে ফিরব, তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে, তোমার দাদা অবশ্য কালই ফিরবে কিন্তু আমার সঙ্গে রবিবার ফিরবে, একা একা থাকতে ভালো লাগবে না, মোটরে খুব বেশি হলে ঘণ্টা দুই। তুমি তো গ্রামট্রাম দ্যাখোনি কখনো মানে ট্রেন থেকে দেখেছ, তাই তো? কিন্তু থেকেছ কখনো? অসম্ভব ভালো লাগবে বিশেষ করে মাঘ মাসেই এই সময়টায়। ভোরবেলা মাঠে কুয়াশা, ঘাসে শিশির, খালিপায়ে হাঁটতে যা লাগবে! হ্যাঁ, খেজুর রসও পাবে, আমাদের প্রায় দশটা খেজুর গাছ, না না এগারোটা; আর তোমায় মৌরলা মাছ খাওয়াব। আমাদের পুকুরের। ভাজা, চচ্চচড়ি, টক, আমিই রাঁধব; তুমি কি ভাবছ আমি রাঁধতে জানি না?’

‘বউদি…’

‘অ্যাঁ? মৌরলা কি তোমার পছন্দ নয়? চিংড়ি? গলদা যদি ওঠে, তাহলে নারকোল কুরে…তুমি কুচো চিংড়ি দিয়ে মোচার ঘণ্ট খেয়েছ? হ্যালো, হ্যালো,…তাহলে আসছ তো? শাড়িটাড়ি সব পাবে ওখানে, সব রাখা আছে, আমি তো ম্যাক্সি পরেই থাকি। অবশ্য আমার ব্লাউজ তোমার গায়ে হবে না, তাতে কিছু আসে যায় না, তুমি খালি গায়েই থেকো, ওখানে পুরুষমানুষ বলে কেউ নেই, তোমার দাদা তো কালই চলে আসবে। আর থাকলেই বা কি, ও মোটেই পুরুষমানুষ নয়, আমি জানি। ভালো কথা, তুমি কি সাঁতার জান? হ্যালো, হ্যালো, রোহিণী?’

‘বউদি আমার হার্টের ট্রাবলটা সকাল থেকে বেড়েছে, এখুনি ডাক্তারের কাছে যাব। কীরকম যেন বুকের মধ্যে হচ্ছে…ব্লাড প্রেশারটাও মনে হচ্ছে…’ বলতে বলতে রোহিণী তাকাল গঙ্গাপ্রসাদের দিকে। ঘরে ঢুকল অ্যাকাউন্ট্যান্ট ক্ষিতীশবাবু। হাতে কয়েকটা চিঠি। সেগুলো হাত বাড়িয়ে নিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ অনুমোদনের ভঙ্গিতে রোহিণীর দিকে মাথা নাড়লেন।

‘হ্যালো রোহিণী, হার্টের অসুখ তো অফিসে এসেছ কেন?’

‘মীনা চ্যাটার্জি আজ বিকেলে ইন্টারভিউয়ের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ডেট দিয়েছে।’

‘দিলেই যেতে হবে? এখুনি তুমি বাড়ি গিয়ে শুয়ে থাক।’

‘ডাক্তারের কাছে যাব না?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ ডাক্তার দেখিয়েই…নিশ্চয় গুচ্ছের ক্যাপসুল লিখে দেবে, ওগুলো কিনেই বাড়ি গিয়ে খাবে। তুমি কিছু ভেব না, এই বয়সে মেয়েদের হার্টের অসুখ আবার হয় নাকি? বরং তোমায় দেখলেই পুরুষদের…’

‘ওহ, বউদি আবার…।’

‘রোহিণী’ ওধার থেকে হঠাৎ স্বরটা ফিসফিসে হয়ে গেল। ‘তোমার দাদা কি টাই পরে আছে?’

‘অ্যাঁ, কি বললেন?’ গলা চড়িয়ে চিঠিতে মগ্ন গঙ্গাপ্রসাদকে শুনিয়ে রোহিণী বলল, ‘দাদা টাই পরে আছেন কিনা?’

চমকে গঙ্গাপ্রসাদ মুখ তুললেন এবং নিমেষে কোটের পকেট থেকে টাইটা বার করে হাতে ঝুলিয়ে রোহিণীকে দেখালেন।

‘দাদা তো পরেই রয়েছেন।’

‘কী রঙের? ওধারের স্বরে সন্দেহ।

‘মেরুন জমিতে সোনালি আর কালো স্ট্রাইপ।’

‘আচ্ছা, এখন তুমি তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে চলে যাও, দেরি করো না। পরের বার যখন বাসুদেবপুর যাব তোমাকে নিয়ে যাব, ওখানে ভালো রেস্ট পাবে।’

রিসিভার রেখে রোহিণী বড়ো করে শ্বাস ফেলল। ক্ষিতীশবাবু বেরিয়ে যেতেই গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, ‘বরুণা খুব সরল, ভালো মনের।’

রোহিণী শুধু হাসল। এতক্ষণ যত কথা সে বলেছে আর শুনেছে, তার মধ্যে অস্বস্তিটা চাপা পড়ে ছিল। ঘরটা হঠাৎ নীরব হয়ে যেতেই সে আবার আগের অবস্থায় ফিরে গেল।

‘লোকটা যদি শোভনেশ হয়…’

‘তাতে কি হয়েছে? তোমার ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই।’

‘প্রথমে আমারই খোঁজ করবে।’

‘কোথায় পাবে তোমায়?’

‘এই অফিসটা ও চেনে।’

‘আমার কাছে আসবে? আসুক। আমি বলব, রোহিণী কোথায় আছে আমি জানি না। ফেরারিকে আশ্রয় দেবার প্রশ্নই ওঠে না। পুলিশকে ডেকে ধরিয়ে দেব না, তবে পুলিশের ভয়টা দেখাব। কিন্তু তার আগে জানতে হবে ফেরারি লোকটা কে?’

‘আপনি কাল সকালে ফিরছেন। আমি অফিসে ফোন করে জেনে নেব।’

‘অত ঘাবড়াচ্ছ কেন বল তো? তুমি এখন একটু অন্য কোনো ঘরে বসো, দু—জন ভিজিটার আসবে।’

‘আমি মহারানির ঘরে থাকব। তারপর ইডেনে যাব। রাজেনের নেট প্র্যাকটিস আছে, পরশু জয়পুর যাবে।’

‘আমি তো বাড়ি যাব। ভালোই হল, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব।’

দুই

বি সি রায় ক্লাব হাউসের সামনে রোহিণীকে নামিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, ‘টিভি—র জন্য নতুন বিভাগটার কথা মাথায় রেখো। একটা সেট তোমার ওখানে পাঠিয়ে দেব।’

গাড়িটা সোজা বাবুঘাটের দিকে চলে গেল। গঙ্গার ধার দিয়ে দক্ষিণে যাবে। গঙ্গাপ্রসাদের বাড়ি ডায়মন্ডহারবার রোডে, মোমিনপুরে।

রাস্তা পার হবার জন্য রোহিণীকে অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। বাস বা মোটর এখানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছোটে, রাস্তাটাও চওড়া। পার হতে হলে, ফাঁক পেয়েই ছুটতে হবে। ততক্ষণ সে দু—ধারে তাকিয়ে সন্তর্পণে একবার পিছনেও তাকাল। কাস্টমস ও পুলিশ মাঠে ক্রিকেট খেলা এইমাত্র বোধহয় শেষ হয়েছে। মালি স্টাম্পগুলো তুলে তাঁবুতে ফিরে যাচ্ছে। দূরের এবং কাছের মানুষদের ওপর দিয়ে সে চোখ বোলাল। ছয় ফুটের উপর লম্বা, শীর্ণ, ধুতি—পাঞ্জাবিপরা একটি লোকের দিকে কয়েক সেকেন্ড দৃষ্টি ধরে রেখে সে মনে মনে অপ্রতিভ হল। জেল থেকে ধুতিপাঞ্জাবি পরে পালানো শক্ত ব্যাপার। তা ছাড়া লোকটার চুল কুচকুচে কালো, একটু কুঁজোও। নয়তো গলা, কাঁধ, মুখের গড়নে অনেকটা মিল আছে।

শোভনেশের চুল কাঁচাপাকা মেশানো, ঝাঁকড়া, ফাঁপানো। ক্যালেন্ডারের মৃত সতী—কাঁধে দক্ষযজ্ঞের শিবের চুলের মতো। জুলপিটা পুরু, গালের অর্ধেক পর্যন্ত। ছিপছিপে, আঙুল থেকে কনুই পর্যন্ত দড়ির মতো শিরায় পুরোবাহু যেন বেঁধে রাখা। কবজি চওড়া। বুকটা চাপা। কোটরে ঢোকা চোখ জ্বলজ্বলে। ঘনভুরুর চুলও ধূসর। এমন চেহারার একটি লোকও রোহিণীর এখন চোখে পড়ল না।

শেষ পর্যন্ত ছুটেই রাস্তা পার হতে হল। ঝুলিটার মুখ ফাঁক করে ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে সে ক্লাব হাউসের লোহার ফটক দিয়ে ভিতরে ঢুকল। দুটি যুবক বেরিয়ে আসছে। রোহিণীকে দেখে তারা পরিচিতের হাসি হাসল।

‘আছে?’ সে জিজ্ঞাসা করল।

‘মাঠে পাবেন।’ ওদের একজন বলল।

এদের সঙ্গে রাজেনই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। দু—জনেই বাংলা দলে বছর চারেক খেলছে। ভদ্র, বিনয়ী। তার সঙ্গে রাজেনের সম্পর্কটা ওরা জানে। একতলায় সদর দিয়ে ঢুকেই বাঁদিকে উপরে ওঠার সিঁড়ি। ডানদিকে করিডোর ধরে সোজা গিয়ে ফুলবাগানের কিনারে সিমেন্টের সরু পথ দিয়ে ফেন্সিংয়ে পৌঁছল রোহিণী। মাঠে ঢোকা উচিত নয় ভেবে সে দাঁড়িয়ে রইল।

নেট প্র্যাকটিস শেষ হয়ে গেছে। এখন চলেছে ক্যাচিং প্র্যাকটিস। একজন বল তুলে ব্যাট দিয়ে সজোরে মারছে। দূরে ছড়ানো পাঁচ—ছ’জন ফিল্ডার আকাশছোঁয়া বল লুফছে। বাউন্ডারি ধরে ধীরে ছুটছে দু—জন। নেটের পিছনে চেয়ারে, মাটিতে বসে আছে আরও চারজন। তাদের পাছে ছড়ানো কিছু সরঞ্জাম। রোহিণী খাঁ খাঁ কংক্রিট স্ট্যান্ডের উপর দিয়ে চাহনি ঘুরিয়ে মাঠের উপর রাখল। সমানভাবে ছাঁটা মসৃণ তকতকে ঘাস।

‘এই হল ঐতিহাসিক ইডেন গার্ডেনস’, রাজেন প্রথম দিন তাকে মাঠে এনে বলেছিল, পৃথিবীর সবথেকে পুরোনো ক্রিকেট ক্লাব হল ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব, অবশ্য ইংল্যান্ডের কথা ছেড়ে। প্রায় দুশো বছর বয়স এই ক্লাবের। এই মাঠে উনিশশো পঞ্চাশ সাল পর্যন্ত তাদেরই ছিল। ‘আর মাঠটার বয়স?’ রোহিণী কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়। সে এইটুকু জানত, গভর্নর জেনারেল অকল্যান্ডের দুই বোন, যাদের পদবি ছিল ইডেন, তারাই বাগান করেছিল। তাদের নামেই ইডেন উদ্যান। ‘কিন্তু এই মাঠটা তখন সেই বাগানের মধ্যে ছিল না।’

স্ট্র্যান্ড ধরে আউট্রাম ঘাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সেদিন রাজেন প্রায় ক্লাস—লেকচার দেবার ঢঙে বসেছিল, ‘মোহনবাগান মাঠের কাছ থেকে একটা রাস্তা ইডেনের মধ্য দিয়ে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম পর্যন্ত সোজা চলে গেছিল বাগান আর মাঠটাকে আলাদা করে। সেই রাস্তায় লোকজন, গাড়িঘোড়া চলত। রাস্তাটা শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়ে ক্রিকেট মাঠটাকে বাগানের অন্তর্গত করা হয়। ক্যালকাটা ক্লাব এই মাঠটায় প্রথম কবে খেলে, সঠিক বছরটা জানা যায়নি, তবে আঠারশো পঁয়ষট্টি নাগাদই হবে আর কাঠের প্যাভিলিয়ন তৈরি করে আঠারশো একাত্তরে। তারপর সেই প্যাভিলিয়নও ছেড়ে দিয়ে এখনকার এই বি সি রায় ক্লাব হাউসে উঠে আসে ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল। এখন যে হাজার হাজার টন কংক্রিট দেখছ মাঠটাকে ঘিরে রয়েছে, সে সব কিছুই ছিল না যখন আমরা স্বাধীন হই। মাঠ ঘিরে ছিল শুধু দেবদারু গাছ। বলের আর গাছের রঙ একাকার হয়ে উঁচু ক্যাচ নিতে নাকি খুব অসুবিধে হত। বড়ো বড়ো ম্যাচের সময় ফুটবল মাঠ থেকে কাঠের গ্যালারি এনে বসানো হত। জ্যাঠামশাই ইডেনে খেলা দেখছেন ছত্রিশ সাল থেকে। ঊনচল্লিশের ফেব্রুয়ারিতে বাংলা এই মাঠে রঞ্জি ট্রফি ফাইনাল খেলেছিল। সে গল্প জ্যাঠামশাই এখনও করেন। আট আনা আর এক টাকা দু—আনার টিকিট। খেলা শুরু হত এগারোটায়, শেষ হত সওয়া পাঁচটায়। ভাবতে পার, সওয়া পাঁচটা পর্যন্ত ইডেনে খেলা হচ্ছে? তখন এত উঁচু কংক্রিটের স্ট্যান্ড ছিল না। খোলা মাঠ, অনেকক্ষণ পর্যন্ত মাঠে রোদ থাকত, গঙ্গার হাওয়া আসত। বাংলা সেবারই প্রথম ট্রফি জিতেছিল।’

ক্রিকেট খেলা দেখতে রোহিণীর মোটামুটি খারাপ লাগে না। বোম্বাইয়ে থাকতে টেস্ট ম্যাচ দেখেছে পাকিস্তানের সঙ্গে। আর ইংল্যান্ডের সঙ্গে কলকাতাতে। তবে পাঁচদিন দেখার ধৈর্য বা আগ্রহ তার নেই। হাজার হাজার লোকের সঙ্গে বসা, নানান রকমের কথাবার্তা, মন্তব্য, পোশাক—আশাক আর জনতার মেজাজ বদলে যাওয়া, এই সবই তার ভালো লাগে। মাঠের মধ্যের ব্যাপার—স্যাপার তাকে টানে না, যেহেতু খেলার অনেক কিছুই সে বুঝতে পারে না, খবরাখবরও রাখে না। রাজেন যখন বলল, বাংলা ঊনচল্লিশে প্রথম রঞ্জি ট্রফি জিতেছে, তখন সে বলেছিল, ‘দ্বিতীয়বার কবে জেতে?’ রাজেন ঘুরে দাঁড়িয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে বলেছিল, ‘ঠাট্টা হচ্ছে?’ রোহিণী বুঝতে পারে, বোকার মতো কিছু সে বলেছে। সামলাবার জন্য সে বলে, ‘আমি কি ক্রিকেটের রেকর্ড রাখি যে, বলে দিতে পারব কোন বছর দ্বিতীয়বার জিতেছে?’ রাজেন যেন আশ্বস্ত হল। হালকা সুরে বলেছিল, ‘এখনও পর্যন্ত দ্বিতীয়বারটা আসেনি।’ এইবার রোহিণী দাঁড়িয়ে পড়ে চোখ পিটপিটানিটা নকল করে বলে ‘ঠাট্টা হচ্ছে?’ রাজেন মাথা নেড়ে তারপর জানায়, কথাটা সত্যিই, বাংলা আর কখনো রঞ্জি ট্রফি জিততে পারেনি।

.

শুনে রোহিণী অবাক হয়ে গেছিল। তার মনে হয়েছিল, হাজার হাজার লোকের টেস্ট ম্যাচ দেখার জন্য পাগল হয়ে ওঠা, এই ঐতিহাসিক মাঠ, এতবড়ো সাজানো তকতকে বাড়ি আর প্রায় লক্ষ লোকের খেলা দেখার ব্যবস্থা, সবই যেন কীরকম অর্থহীন, হাস্যকর। অনেকটা তার নিজের জীবনের মতোই।

ফেন্সিংয়ে দু—হাত রেখে রোহিণী মাঠের মধ্যে রাজেনকে দেখতে পাচ্ছে। উঁচু করে মারা বলটা লোফার জন্য দৌড়তে দৌড়তে ঝাঁপ দিল দু—হাত বাড়িয়ে। বল হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই মাঠের কয়েকজন তারিফ জানাতে চেঁচিয়ে উঠল। রাজেন কনুই তুলে দেখছে ছড়ে গেছে কিনা। সাটিনের মতো এমন মোলায়েম ঘাস, রোহিণীর ইচ্ছে করছে জুতো খুলে রেখে মাঠের মধ্যে গিয়ে হেঁটে বেড়াতে।

‘বেশ তো হাঁটুন না।’

চমকে সে পিছনে তাকাল। কেউ নেই। খাকি শার্ট আর ধুতি—পরা একজন মালির সঙ্গে একটি লোক কথা বলছে, তাও পনেরো—ষোলো মিটার দূরে। ক্লাব হাউসের কমপ্লিমেন্টারি আসনগুলির চালার উপরে দুটি পায়রা ছাড়া আর কোনো প্রাণী সে দেখতে পেল না।

রোহিণী অপ্রতিভ হল। কথাটা তার চেতনায় বরাবরের জন্য যেন ছাপ দিয়ে গেছে। কিছুতেই সে যেন ভুলতে পারে না—’বেশ তো হাঁটুন না।’ গভীর গমগমে স্বরে শোভনেশ তাকে অযাচিতই বলেছিল পিছনে দাঁড়িয়ে। চমকে পিছন ফিরে তাকিয়েছিল সে আর সাত বছরের ভাগনি মেধা। দীর্ঘদেহী, টকটকে গায়ের রং, কাঁচাপাকা আলুথালু চুল, লম্বা মোটা জুলপি, সামান্য চাপা নাক আর সরু চোখ দেখলেই মণিপুরী বা নাগা বলে মনে হয়। ঘন নীল সুতির টি শার্টের বুকের কাছে এমব্রয়ডারি করা সাদা দুটি অলিভ পাতা।

অ্যাকাডেমি আর ফাইন আর্টসের পশ্চিমের গ্যালারিতে ছবির সেই প্রদর্শনীতে তখন জনা দশেক দর্শক ছিল। দিদি সোহিনী যোগলেকর আর মেয়ে মেধার সঙ্গে রোহিণীও গেছিল ছবি দেখতে। প্রদর্শনীর স্পনসর ছিল রং তৈরির কোম্পানি, হিমালয়ান পেইন্টস। সোহিনীর স্বামী রঞ্জন যোগলেকর, যার ডাকনাম বাপু, হিমালয়ানের মার্কেটিং ডিভিশনের কন্ট্রোলার। অফিসের কাজে বাপুর সঙ্গে বোম্বাই থেকে এসে ওরা ছিল ওল্ড বালিগঞ্জে কোম্পানির গেস্ট হাউসে। ছবি দেখতে বাপু আসেনি। অফিসে তার কাজ ছিল, তা ছাড়া আঁকা ছবি দেখতে তার ভালোও লাগে না।

প্রদর্শনী—ঘরে ঢুকে ছবিগুলোর উপর একনজর তাকিয়েই দিদির চোখে বিরক্তি আর ভয় দেখতে পেয়েছিল রোহিণী। বাঁদিকের দেওয়ালে ছ—সাতটা তেলরঙের ছবি ছিল, অদ্ভুত ভঙ্গিতে শোয়া, বসা, দাঁড়ানো নগ্ন নারীর। অত্যন্ত বাস্তব চিত্রণ। শুধু পেশি বা ভাঁজগুলিই নয়, দেহের কোনো কোনো জায়গায় কেশও নিখুঁত। মনে হয় একজন নারীকেই নানান ভাবে ও ভঙ্গিতে রেখে পাটে পাটে মেলে দেওয়া হয়েছে—আর ঘাড়, কাঁধ, ঊরু তলপেট, হাঁটু, গোড়ালি, আঙুল, নিতম্বের কমনীয় গড়নকে। সোহিনী বারকয়েক অস্বস্তিভরে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রোহিণীকে বলেছিল, ‘মেধাকে নিয়ে তুই ওইদিকের ছবি দ্যাখ।’

দেখতে দেখতে একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে রোহিণী বলেছিল, ‘দেখেছিস কী সুন্দর মাঠ, ইচ্ছে করছে ছবিটায় ঢুকে খালি পায়ে হাঁটি।’

আর ঠিক তখনই পিছন থেকে ‘বেশ তো হাঁটুন না।’

শোভনেশ হাসছিল। গালের পেশিতে ও চোয়ালে শক্ত সবল ভাঁজ, ঠোঁটের ঢাকনা খোলা সরল দু—পাটি দাঁত, চোখ দুটি আরও সরু হয়ে গেছে হাসির কুঞ্চনে। রোহিণীর বুকের মধ্যে ছমছম করে উঠেছিল। শোভনেশ আঙুল দিয়ে ছবিটাকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘ওই যে দূরে একটা বেড়া আর তার পাশের চালাটা দেখা যাচ্ছে, তার ওধারে একটা গ্রাম আছে, আদিবাসীদের। নাম টুংলাপুট। হাঁটতে হাঁটতে ওখানেও চলে যেতে পারেন।’ রোহিণী ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ঘাসের সবুজ প্রান্তরের চড়াই, দূরে একটা টিলা, ছোপ ছোপ জঙ্গলের আভাস, আকাশের রং দেখে মনে হয় সূর্য অস্তে নামছে। সারা প্রকৃতি জুড়ে শান্ত নীরবতা। ঠিক এই সময়েই শাঁখ বেজে ওঠার কথা। শোভনেশ হুক থেকে ছবিটা খুলে রোহিণীর দিকে এগিয়ে দিল। ফ্রেমের কোণে আঁটা কাগজে দাম লেখা আড়াই হাজার টাকা। রোহিণীর হাত কেঁপে যায়। আড়াই ফুট বাই আড়াই ফুট জলরঙের ছবিটা হাতে নিয়েও সে ধরে রাখতে পারেনি। কাচ ভাঙার শব্দে যে ক—জন দর্শক ছিল ফিরে তাকাল। তাড়াতাড়ি উবু হয়ে বসে রোহিণী কাচ কুড়োতে যেতেই দুটি কাঁধ ধরে শোভনেশ তাকে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, ‘দোষটা আমারই, আপনি কুড়োবেন কেন?’

.

রোহিণী কুড়োবে কী কুড়োবে না ভেবে পেল না। রাজেন ইচ্ছে করেই বলটা তার দিকে গড়িয়ে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। ফেন্সের দরজা দিয়ে আনমনে কখন যে সে মাঠে ঢুকে খালি পায়ে দাঁড়িয়েছে, মনে নেই।

প্র্যাকটিস শেষ হয়ে গেছে। জয়পুর রওনা হবার আগে এটাই শেষবার। রাজস্থানের সঙ্গে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলা। রাজেনের ধারণা, ম্যাচটা তারা জিতবে। কেন জিতবে তাই নিয়ে পরশু দিনই আধ ঘণ্টা ধরে একটা লেকচার দিয়েছে।

‘পাঁচ মিনিট।’ রাজেন কাছে এসে বলল। ‘এক সেকেন্ডও বেশি নেব না। তুমি ততক্ষণ বরং এই চেয়ারটায় বোস। আমি চান সেরে জামা—প্যান্ট চেঞ্জ করেই আসছি।’

রাজেন ছুটে চলে গেল। সাদা ট্রাউজার্স ও হাফহাতা স্পোর্টস শার্ট—পরা ছিপছিপে শরীর। রোহিণীর থেকে দু—ইঞ্চি লম্বা, বেলেমাটির মতো গায়ের রং, কোঁকড়া চুল আর নাকটি চোখা। বাঁ চোয়ালের নীচে আঁচিল। বাঁ হাতে ব্যাট করে, ডান হাতে লেগব্রেক বল। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে সে হাত নেড়ে, ড্রেসিং রুমে ঢুকল। ফেন্সের ধারে একটা স্টিলের চেয়ার। রোহিণী বসল। সূর্য অস্তে নেমেছে, মাঠে ছায়া। চড়াইয়ের মতোই দুটো কালো পাখি উড়ছে—বসছে আর খুঁটে খুঁটে কী খাচ্ছে। বিরাট স্কোর বোর্ডটার দিকে সে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আগের খেলার কয়েকটা নাম আর স্কোর রয়ে গেছে। দূর থেকে লঞ্চের ভোঁ ভেসে এল। তার মনে হচ্ছে, একটা গামলার মধ্যে যেন বসে রয়েছে। বাইরে কী ঘটছে কিছুই বোঝার উপায় নেই। সে জানে না জেল পালানো লোকটা কে, এখন সে কোথায়!

‘পাঁচ মিনিট হয়েছে কিনা দ্যাখো!’

হেঁটে আসতে আসতে রাজেন চেঁচিয়ে বলল। রোহিণী ঘড়ি দেখার বদলে কাঁধের ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দোকান থেকে নেওয়া ঘড়িটা বার করল।

‘সারাতে কত নিল?’

‘তা দিয়ে তোমার দরকার কী?’

রাজেনের বাঁ হাতটা টেনে নিয়ে রোহিণী ঘড়িটা পরিয়ে স্টিলের ব্যান্ডটা টিপল।

‘আমি ডান হাতে পরি।’

‘না, বাঁ হাতে পরবে।’ ভ্রূ কুঁচকে রোহিণী বিরক্তি জানাল। ‘আর এই হাবিজাবি লেখা শার্ট পরা কেন? সাধারণ জামা তো পরতে পার। ম্যানুফ্যাকচারের ব্র্যান্ডনেম বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে কীজন্য, তুমি কি ডিসপ্লে বোর্ড? এসব জামা তারাই পরে, যাদের পার্সোনালিটি কম।’

রাজেন প্রতিবাদ জানাবার চেষ্টা করতে গিয়ে দু—হাত তুলে বলল, ‘সারেন্ডার করছি। এবার তাহলে চলা যাক।’

দু—জনে ক্লাব হাউস থেকে বেরিয়ে পশ্চিম দিকে হাঁটতে শুরু করল। বোঝা যায়, ওরা গঙ্গার ধারে বেড়াতে অভ্যস্ত।

‘গাড়ি আছে।’ রাজেন বলল।

‘থাক, বেশি দূর যাব না। ইডেনের ভেতরে গিয়ে বরং একটু বসি। মীনা চ্যাটার্জির সঙ্গে ইন্টারভিউ সাতটায়, পাংচুয়াল হতে চাই।’

‘কে মীনা চ্যাটার্জি?’

‘বাংলা সিনেমা দ্যাখো?’

‘না। ও হোও…নাম শুনেছি। এই তো রাস্তায় পোস্টার দেখলাম, কী একটা ছবির নায়িকা। বেশ ভালোই দেখতে। আমাদের উইকেটকিপার ছোটকা মীনা চ্যাটার্জির অন্ধ ভক্ত। ফিল্ম রিলিজ হলে প্রথম দিনে দেখবেই। কী যে অদ্ভুত মানসিকতা। ওর নাকি পাড়ার মেয়ে, ছোটোবেলায় একসঙ্গে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছে।’

‘তোমাদের ছোটকার পাড়া কোথায়?’

‘জোড়াবাগানে। তবে মীনা চ্যাটার্জিরা বোধহয় অল্প দিনই ছিল, তারপর পাড়া ছেড়ে কোথায় চলে যায়। গত বছর জামশেদপুরে যাবার সময় ট্রেনে কথায় কথায় ছোটকা কাকে যেন বলছিল, আমি আর ওতে কান দিইনি।’

রোহিণী বসার জায়গা খুঁজে এধার—ওধার তাকাচ্ছে। খোয়া, গর্ত, ধুলো এবং পুলিশী ঘোড়ার অসভ্যতার চিহ্ন ইতস্তত ছড়ানো। বিরক্ত হয়ে সে বলল, ‘আদিখ্যেতা করে যে কেন নন্দন কানন বলা হয়!’

‘টেস্ট ম্যাচের সময় যদি আসো, তাহলে দেখতে জায়গাটার কী অবস্থা হয়। চলো, জলের ধারটায় বসি।’

শীত যতটা থাকার কথা, নেই। তাই সন্ধ্যা আসন্ন সত্ত্বেও ভিড় রয়ে গেছে। বাচ্চচাদের ছুটোছুটি, মায়েদের ত্রস্ত ডাকাডাকি, বৃদ্ধবৃদ্ধার শান্ত পদক্ষেপ, ফেরিওয়ালাদের সুরেলা হ্রস্ব ডাক, পাখিদের কিচিরমিচির, সব মিলিয়ে রোহিণীকে খানিকটা জুড়িয়ে আনল।

‘না এখানে নয়, বাঁদিকে তাকিয়ে দ্যাখো।’

রাজেন তাকিয়ে দেখল। প্রায় তিরিশ হাত দূরে, বড়ো গাছের গুঁড়ির আড়ালে বসা একটি কিশোরীকে বাঁহাতে জড়িয়ে মুখের কাছে মুখ এনে এক ছোকরা কিছু বলছে। ঝোপঝাড় আর মোটা মোটা গাছে আর ঘন পাতায় এই দিনটা এখন আবছা হয়ে এসেছে। নজরটা একটু সরাতেই সে আবার অমন একটা ঘনিষ্ঠতার নমুনা পেল মেয়েটির কোলে মাথা রেখে শুয়ে একজন।

‘প্রকাশ্যে এইভাবে, এমন রুচিহীন অসভ্য…।’

রোহিণী বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করল।

রাজেন বলল, ‘দুপুরে এলে দেখতে, রাস্তা দিয়ে চলতে চলতেই রেলিং দিয়ে দেখা যায়…কী অল্পবয়সি সব ছেলেমেয়ে, মনে হয় স্কুলে পড়ে, এমন কম্প্রোমাইজিং ভঙ্গিতে গাছতলায় বসে থাকে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে লোকজন দাঁড়িয়ে দেখে, হাসাহাসি করে, ওরা তাতে ভ্রূক্ষেপও করে না, বরং যেন মজাই পায়। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানেও ভরদুপুরে এরকম ছেলেমেয়েদের দেখেছি।’

‘ডেফিনিটলি এরা কলকাতার নয়, সাবার্ব থেকে আসে। কলকাতার গেরস্ত, ভদ্র পরিবারের হলে চেনা কেউ দেখে ফেলার ভয়টা থাকত, অন্তত মেয়েদের থাকত।…এখানটায় বসি।’

ফাঁকা জায়গায়, তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে বসে থাকা মধ্যবয়সি এক দম্পতির কাছাকাছি ওরা বসল।

‘ভয়টা কি শুধু মেয়েদেরই থাকে?’

‘তবে না তো কী, ছেলেদের থাকে?’

‘যেমন? একটা উদাহরণ দাও।’

রোহিণী বলতে যাচ্ছিল, যেমন আমি। এই মুহূর্তে আমার থেকে ভীত পৃথিবীতে আর কেউ নেই। একটা খুনি জেল থেকে বেরিয়ে পড়েছে, সেটাই আমার কাছে ভয়ের ব্যাপার। আমাকে পেলে সে গলা টিপে মেরেও ফেলতে পারে। একটা অনিশ্চিত আতঙ্কে পড়ে গেছি।

‘কী ব্যাপার তুমি অমন চোখ কুঁচকে মুখে বিশ্রী ভাঁজ ফেলে কী ভাবছ? উদাহরণ খুঁজছ?’

‘দ্যাখো রাজেন’, রোহিণীর স্বর হঠাৎ তীব্র হয়ে উঠল। ‘আগেও তুমি কয়েকবার বলেছ আমার মুখে ভাঁজ পড়ে, হাসলে গলা বসে যায়, চোখের কোণের চামড়া কুঁচকোনো, জানি তুমি একথা কেন বল।’

রাজেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল। এইরকম আবেগের বিস্ফোরণ, সাধারণত রোহিণীর মধ্যে ঘটে না।

‘কবে আবার বলেছি?’

কথাটা কানে না তুলে রোহিণী একই তীব্রতায় বলল, ‘বয়স হয়েছে, এখন চোখের কোণে ঠোঁটের কোণে যদি ভাঁজ পড়ে, কী করতে পারি বল? তুমি বরং…।’ রোহিণী থেমে গেল।

‘বরং?’

‘বরং, ভুল শোধরাবার যথেষ্ট সময় রয়েছে। রাজেন তুমি আমার থেকে চার বছরের ছোটো।’

‘ওহ এই ব্যাপার।’ রাজেন হাঁফ ছাড়ার ভান করল শব্দ করে শ্বাস ফেলে। ‘আমি ভাবলুম, না জানি কী দোষের কথা বলে ফেলেছি। এই নিয়ে কতবার মনে করালে তুমি চার বছরের বড়ো। গত দু—বছরে, যদি মাসে একবার করেও হয় তাহলে চব্বিশবার। তার মানে চব্বিশবার আমাকে টর্চার করেছ, প্রতিবারে এজন্য যন্ত্রণা পেয়েছি বারো ঘণ্টা করে, মিনিমাম। তাহলে চব্বিশ ইনটু বারো, কত হয়?’

‘এটা রসিকতা করার ব্যাপার নয়।’

‘দুশো অষ্টাশি। কতটা ইনহিউম্যান হলে একজন মহিলা দুশো অষ্টাশি ঘণ্টা ধরে একজন পুরুষকে দগ্ধে দগ্ধে রোস্ট বানাতে পারে, তার হিসেব দিতে পার? এই নিষ্ঠুরতা গিনেস বুক অব…।’

‘রাজেন।’ রোহিণী তার হাঁটুতে রাখা, রাজেনের হাতটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। ‘বিহেভ। ওই গাছতলার মতো সীন আমি অপছন্দ করি।’

রাজেন আবার হাত রাখল। রোহিণী সরিয়ে দিল। রাজেন আবার রাখল, রোহিণী সরিয়ে দিয়ে সামান্য পিছিয়ে বসল। হাঁটু অন্যদিকে ঘুরিয়ে।

‘আহহ, এইটাই চেয়েছিলাম, দারুণ পোজ, তোমাকে সবথেকে সেক্সি দেখায় এইভাবে বসলে।’

‘দেখাক।’ বলেই রোহিণীর মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ ছুঁয়ে গেল। শোভনেশের ভারী গলার হুকুমের স্বর ধাক্কা দিয়ে উঠল, ‘এইভাবে, ঠিক এইভাবে, নড়বে না। তোমাকে ভারী সফট দেখায় এই পোজে।’ রেগে রোহিণী বলেছিল, ‘দেখাক, আমি পারব না। এসব আমার দ্বারা হবে না।’

প্রায় একইভাবে রাজেনও বলল, তবে একদমই অন্য প্রসঙ্গে, অন্য স্বরে। শোভনেশ বলেছিল, সফট দেখায়, রাজেন বলল সেক্সি। দুটোই শুনতে ভালো লাগে। যেকোনো মেয়েরই লাগবে।

‘কিছু হয়েছে বোধহয়, মেজাজ এত খাট্টা কেন?’

‘কিছু হয়নি।’

‘পরশু রওনা হব। ক্রিকেট এখন আর খেলা নয়, যুদ্ধ। যুদ্ধযাত্রার আগে পুরুষদের রণসাজ পরিয়ে, কপালে তিলকটিলক দিয়ে, দেবতার ফুল মাথায় ঠেকিয়ে, আরতিটারতি করে রমণীরা যুদ্ধে পাঠাত। কী দারুণ একটা সময়ই না ভারতে ছিল। পুরুষরাও তাই জেতার জন্য জান লড়িয়ে দিত। জেতার ইচ্ছাটা তৈরি হত মেয়েদের ভালোবাসা প্রেম পাবার জন্য। আর এখন?’ রাজেন অর্থপূর্ণ নীরবতা তৈরি করল নাটকীয়তা আনতে। ‘রণসাজ, তিলক, আরতি নয় শুধু একটু করুণাঘন দৃষ্টিপাত, একটি সাজানো হাসি তাও বরাদ্দ হয় না। এইজন্যই তো বাংলার ক্রিকেটের এই অবস্থা। বাঙালি মেয়েরা—’

‘তোমার বাজে বকা কি বন্ধ করবে?’ রোহিণীর স্বরের ঝাঁঝ যে পড়ে গেছে, রাজেন সেটা বুঝতে পেরে দ্বিগুণ উৎসাহে শুরু করল। ‘ওখানে গিয়ে খেলব কি? প্রথম বলেই তো আমি ফিরে আসব। স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি, কৈলাশ মাট্টুর প্রথম ওভারের প্রথম বল। অফ স্টাম্পের এক হাত বাইরে; ছেড়ে দেবার জন্য ব্যাট তুলেছি; পিচ পড়েই সিম করে ছিটকে ঢুকে এল। ব্যাট নামাবার সময়ই পেলাম না; অফ স্টাম্পের বেলটা উইকেটকিপারের কাছে উড়ে গেল। আমি বোকার মতো মুখ করে ফিরে আসছি।…উফফ কী লজ্জা। কেউ তো আর জানে না, জানার কথাও নয় কেন আমার কনসেনট্রেশন ভেঙেচুরে তালগোল পাকিয়ে গেছল। সবাই সান্ত্বনা দেবে, ‘ব্যাড লাক রাজেন…বলটা অসম্ভব ভালো ছিল…এমন বলে গাওস্করও আউট হত।’ আমার শুধু একটাই অপরাধ, হাঁটুতে হাত রেখেছিলাম।’

রোহিণী হেসে ফেলেই গম্ভীর হয়ে উঠল। ‘আমার খুব অস্বস্তি লাগে যখন ভাবি আমি তোমার থেকে বয়সে বড়ো, আমি বিবাহিতও। ধরে নিচ্ছি আমার কিছু ফিজিক্যাল অ্যাসেট আছে, কিন্তু কতদিন আর সেটা থাকবে? পদ্মপাতার জলের মতোই তো মেয়েদের যৌবন!’

‘রোহিণী, এসব কথা বহুবার তুমি বলেছ। আমিও প্রত্যেকবার যা বলেছি, সেটাই রিপিট করব। সেই পুরুষগুলো অত্যন্ত নির্বোধ, যারা রমণীকে বিচার করে শুধুই তার রূপ আর যৌবন দিয়ে। এই দুটো নিশ্চয়ই পুরুষদের কাছে বাঞ্ছিত। সুন্দরী বউয়ের মালিক হয়ে কে না গর্ববোধ করে? কিন্তু হৃদয়, আবেগ, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, সহমর্মিতা, শেষ পর্যন্ত এগুলোই কিন্তু অ্যাসেট হয়ে ওঠে।’

মুখ নীচু করে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে রোহিণী শুনে যাচ্ছিল। এখন তার মনে হচ্ছে, নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে উঠতে হলে তার একজন পুরুষমানুষ দরকার, যার উপর সে নির্ভর করতে পারবে। আর, যদি শোভনেশই সেই ফেরারি হয়, যদি খুঁজে খুঁজে তার কাছে এসে হাজির হয়, তাহলে আত্মরক্ষার জন্য দুর্গের মতো শক্তিশালী একটা আড়াল তার দরকার। রাজেন শরীর ও মনের দিক থেকে একটুও দুর্বল নয়। লড়াই করতে পিছোবে না। গঙ্গাদা তাকে ফ্ল্যাট দিয়ে, চাকরি দিয়ে যথেষ্ট সাহায্য করেছে, করবেও। তবু মনের গভীরে একটা নিরাপদ আশ্রয়, আশ্বাস, নির্ভরতা তার খুব দরকার। রাজেন কখনো কোনো সময়ই তার কাছ থেকে নোংরা সুযোগ নেবার চেষ্টা করেনি, যদিও ফাজলামিতে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।

রাজেন নতমুখ রোহিণীর দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে আছে। কথা বলার ঝোঁকে মুখটা উদ্ভাসিত, চোখ জ্বলজ্বলে। রোহিণীকে আনমনা দেখে সে বলল, ‘আমাদের দেশে মেয়েদের মুখটাই সব। মুখ সুন্দর হলেই সে সুন্দরী। তার গোটা শরীরটা যদি প্যাঁকাটির মতো কিংবা জালার মতো হয়ও, কোথাও যদি গড়নে ব্যালান্স, সামঞ্জস্য নাও থাকে, তবু সে রূপসি। আমাদের রুচি, সৌন্দর্যবোধ এভাবেই তৈরি হয়ে আছে। আমরা একদমই ফিজিক্যাল নই। দেখছ না, খেলায় আমরা কত পিছিয়ে।’

খাপছাড়াভাবে হঠাৎ রোহিণী বলল, ‘আমার ডিভোর্সটা করে ফেলা দরকার।’

‘উকিলের সঙ্গে কথা বলতে হবে। জয়পুর থেকে ফিরে এসেই যাব।’

‘তোমার বাড়িতে কি বলেছ কিছু আমার সম্পর্কে? বাবা, মা, দাদারা বউদিরা কি জানে?’

‘মা—কে বলেছি, তবে সব কিছু নয়। তোমাকে একবার দেখতে চেয়েছে।’

রাজেনের বলার ঢঙে কিন্তু ভাব দেখে রোহিণী উৎকণ্ঠিত হল। ‘সব কিছু বলোনি মানে? না, কোনোকিছুই চেপে যাওয়া চলবে না। তুমি ফিরে এসো, আমি যাব মায়ের কাছে। দরকার হলে আমার কথা আমিই তাঁকে বলব।’

রাজেনের মধ্যে উৎসাহ দেখা গেল না। অস্বস্তি কাটাতেই যেন সে এধার—ওধার তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘ঝালমুড়িওয়ালাটা তো এখানেই ছিল।’

বাগানের আলো জ্বলে উঠেছে। বহু মানুষ যেমন বেরিয়ে যাচ্ছে, আসছেও তেমনি নতুনরা। সর্বত্র আলো পড়েনি। পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার আর ছায়া ছড়িয়ে আছে। অনেক নরনারী সেদিকে যাচ্ছে।

রাজেন হঠাৎ বলে উঠল, ‘এই ঠিক হয়ে বসো, একটা লোক অনেকক্ষণ ধরে তোমায় দেখছে।’

রোহিণী প্রায় লাফিয়েই রাজেনের পাশে এসে আর্ত গলায় বলল, ‘কে? কোথায়?’

রাজেন হেসে উঠে বলল, ‘ওই দ্যাখো, কিন্তু এত ভয় পাওয়ার কী আছে?’

সত্যিই একটা লোক ওদের থেকে কুড়ি—পঁচিশ হাত দূরে তাদের দিকে মুখ করেই বসে।

‘এরা এক ধরনের মানসিক রুগি। সারা ময়দানে এদের দেখতে পাবে। যেখানেই মেয়ে আর পুরুষ একটু ঘনিষ্ঠভাবে বসবে, এরাও সেখানে গিয়ে কিছু ভালোবাসার ব্যাপার ঘটবে এই আশায়, সেটা দেখার জন্য বসে থাকবে।’

রোহিণী অবশ্য পাঞ্জাবি পরা, বেঁটে মোটা লোকটিকে দেখে হাঁফ ছাড়ল।

‘কিন্তু আমরা তো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসিনি।’

‘বসতে তো পারি।’

‘বটে।’

‘কিন্তু তোমার মীনা চ্যাটার্জির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময় হয়ে এসেছে।’

হাতঘড়িতে সময় দেখেই রোহিণী দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘আর একটা কথাও নয়। দশ মিনিটে পৌঁছে দিতে পারবে? গাড়িটা রেখেছ কোথায়?’

‘ক্লাব হাউসের পাশে।’

রোহিণীর সঙ্গে রাজেনকেও হনহনিয়ে যেতে হল গাড়ি পর্যন্ত।

.

রাজভবনের কাছে রেলিং—ঘেরা গোলাকার দ্বীপটি ঘুরে গাড়ি দক্ষিণমুখো হবার পর রোহিণী বলল, ‘আচ্ছা, বহরমপুর থেকে কলকাতায় পৌঁছতে কতক্ষণ সময় লাগে।’

রাজেন গাড়ির গতি বাড়াতে পারছে না ট্র্যাফিকের জন্য। সেজন্য বিব্রত হচ্ছে। সংক্ষেপে বলল, ‘অনেকভাবে আসা যায়, কীসে আসতে চাও? ট্রেন, মোটর, ট্রাক, বাস, নৌকো, সাইকেল, হণ্টন কীভাবে?’

রোহিণী ভেবে পাচ্ছে না একজন পলাতক আসামির পক্ষে এর কোনটা ব্যবহার করে কলকাতায় আসা উচিত।

‘যেভাবেই আসুক, মোট কথা একটা লোক ইচ্ছে করলে বাই রোড, জঘন্য রাস্তা আর ট্র্যাফিক জ্যাম ধরে নিয়েও পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টার মধ্যে আসতে পারবে। কারোর আসার কথা আছে নাকি?’

‘না।’

ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়ি থামল ব্রেক কষার জন্য। রাজেন তার ওভারটেক করার কৃতিত্বে বাধা পেয়ে দাঁত চেপে ‘হারামজাদা’ বলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়াল।

‘রাজেন, দু—চার মিনিট দেরি হলে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। পুলিশের নোট বইয়ে নম্বর তোলা বা হাসপাতালে যাওয়াটাও এখন খুব জরুরি নয়। তোমার একটা বড়ো ম্যাচ রয়েছে সামনেই।’

রোহিণী ডান হাতের তালু রাখল রাজেনের ঊরুতে। রাজেন আড়চোখে একবার তাকাল। পার্ক স্ট্রিটে ঢুকেই গাড়ির গতি মন্থর হয়ে গেল, প্রায় রিকশার মতোই।

‘কী ব্যাপার?’

‘চারদিন পরই খেলা, ইনজুরি টিনজুরি যাতে না হয়…’

‘মতলবটা কী?’

‘দু—ধারে কত খাবার দোকান, দেখতে দেখতে যাওয়াতেও কত সুখ বিশেষত প্রচণ্ড খিদের মুখে।’

‘আজ থাক দেরি হয়ে যাবে।’

‘রোহিণী, তোমার সম্পর্কে কত কিছু জানি, আবার অনেক কিছুই জানি না।’ রাজেনের মুখ ও স্বর গম্ভীর।

কাঠ হয়ে গেল রোহিণীর আলগাভাবে বসার ভঙ্গি। কী জানতে চায়? সবই তো সে বলেছে।

‘তুমি রাঁধতে জান কি?’

কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল ধাতস্থ হতে, তারপরই সে রাজেনের হাঁটুর কাছে বিশাল একটা চিমটি কাটল।

‘তুমি একটা মিটমিটে, কী বলব, মিচকে শয়তান। ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলে। গাড়িটা এবার জোরে চালাও। সার্কুলার রোডটা ক্রশ করে আর একটু গিয়েই ডান দিকে।’

রাজেন গাড়ির গতি বাড়িয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু এখনও জানি না রাঁধতে জান কি না। এটা জানার উপর, বলতে পার, আমাদের সম্পর্কটা কী হবে সেটা নির্ভর করছে।’

‘জানি।’

‘প্রমাণ চাই।’

‘ডান দিকে, ডান দিকে রাখো, এই তো আঠারো নম্বর।’

অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি। রাস্তার দিকে প্রত্যেক অ্যাপার্টমেন্টেরই একটি করে ছোট্ট ঝুলবারান্দা। একতলায় গাড়ি রাখার পাকা আঙিনা। ফটকে ডর্দি—পরা দারোয়ান। লিফট রয়েছে করিডরের দু—ধারে।

‘তুমি ফিরবে কীভাবে। অপেক্ষা করব?’

‘না, না, থাকতে হবে না। ঘণ্টাখানেক তো বটেই, তার বেশিও লাগতে পারে। আমি মিনিবাসে চলে যাব।’ দু—পা গিয়েই রোহিণী থেমে গেল। ফিরে এসে ঝুঁকে মুখ নামিয়ে বলল, ‘রাঁধতে পারি কি পারি না সেটা একদিন প্রমাণ করে দেব।’

‘কালকেই দাও। তা হলে প্রথম বলেই আউট হব না, এই গ্যার্যান্টি দেব।’

‘দুপুরে মহারানির ঘরে থাকব, টেলিফোন কোরো।’ বলেই দ্রুতপায়ে রোহিণী আঠারো নম্বর বাড়ির ফটকে ঢুকে গেল। গাড়িতে বসে রাজেন তাকিয়ে রইল যতক্ষণ না বোতাম টিপে রোহিণী লিফট চালু করল।

তিন

পালিশ করা সেগুন কাঠের একপাল্লার দরজায় পিতলের পাতের উপর ইংরেজিতে লেখা: মীনা চ্যাটার্জি। কলিং বেলের বোতাম টিপতেই ভিতরে পিয়ানোর টুং টাং বেজে উঠল। দরজায় নজরদারি কাচ লাগানো ছোটো গর্তটার দিকে রোহিণী তাকিয়ে ছিল। দরজা খোলার আগে ওটা দিয়ে তাকাবেই। তাকিয়ে যেন ভালো করে দেখতে পায়। গুন্ডা—টুন্ডা নয়, একটা মেয়ে।

দরজা ফাঁক করে পরিচ্ছন্ন শাড়ি ব্লাউজ পরা এক কিশোরী সম্ভবত কাজের মেয়ে, জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘আমার আসার কথা ছিল, মিস চ্যাটার্জি কি আছেন?’

‘আপনি বসুন, দিদি এখনও ফেরেনি।’

ঢুকেই কাশ্মিরী কাজ—করা মাথাসমান উঁচু কাঠের পার্টিশন। তার লতাপাতার জাফরির ফাঁক দিয়ে ঘরটা ভালো দেখা যায় না। রোহিণী ইতস্তত করল বসার আগে। ঘরের একদিকে আধ হাত পুরু, টকটকে লাল কাপড়ে মোড়া রাবার ফোমের সোফা। চারজন অনায়াসে বসতে পারে। তার উলটোদিকে গদি—পাতা নীচু চৌকি, যার পায়াগুলিতে পিতলের কুলপি লাগানো। ছড়িয়ে আছে কয়েকটি গেরুয়া ওয়াড় পরানো তাকিয়া। এ ছাড়াও আছে দুটি গদির চেয়ার। ঘরের মাঝে কাপের্ট এবং নীচু আখরোট কাঠের গোল টেবল, তাতে কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি রঙিন ম্যাগাজিন। হালকা পাতিলেবু রঙের দেওয়াল। আসমানি রঙের মোটা কাপড়ের পর্দা, যাতে খয়েরি ডোরা। কাঠের কয়েকটি ব্র্যাকেট বিচিত্র জ্যামিতিক কোণ রচনা করেছে দেয়ালে। তাতে রয়েছে কাঠের, পিতলের ও পাথরের মূর্তি ও পুতুল। এর মধ্যে একটি, তিন বছর আগে পাওয়া সেরা চলচ্চিচত্র অভিনেত্রীর অ্যাওয়ার্ড, বাকিগুলি উপহার পাওয়া। সারা ঘরে একটিই ছবি, সদর দরজার মাথায় দেড় ফুট লম্বা রামকৃষ্ণদেবের হাসিমুখ। মুখের নীচে সাদা ডায়ালে সোনালি কাঁটার ডিম্বাকৃতি ইলেকট্রনিক দেওয়াল ঘড়ি। টেবিলে ফুলগুলি প্লাস্টিকের নয়। সোফার দু—পাশে কাপ ডিশ রাখার জন্য কাঠের ছোটো টেবিলে ছাইদানিগুলি পরিষ্কার। বাইরের কোনো শব্দ ঘরে আসছে না। অন্দরে যাবার দুটি দরজা। তাতে পর্দা ঝুলছে। ভিতর থেকেও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। অসম্ভব নীরবতা ঘরে বিরাজমান।

মেয়েটা পাখা খুলে দেবার জন্য সুইচ বোর্ডের কাছে গিয়ে ফিরে তাকাল। খোলার দরকার আছে কি না জানতে চায়। রোহিণী বলল, ‘আস্তে, এক পয়েন্টে চালিয়ে দাও। আজ বেশ গরমই।’

সে সোফায় বসাই স্থির করল। সারা ঘরটা এবং অন্দরে যাবার একটি দরজা তার নজরের আওতায় থাকবে। মাথাটা ডানদিকে ঘোরালে অন্য দরজাটাও নজরে আসবে।

‘আপনাকে চা কি কফি দেব?’

‘না।’

‘কোল্ড ড্রিঙ্কস?’

‘না। উনি কখন আসবেন, কিছু বলছেন কি?’ ভিতরে কোথাও ফোন বেজে উঠল।

‘বলেছেন ফিরতে যদি দেরি হয়, তা হলে একটু যেন অপেক্ষা করেন।’

তৃতীয়বার বাজার মুখে রিং বন্ধ হয়ে গেল। কেউ রিসিভার তুলেছে। তার মানে কেউ ভিতরে রয়েছে। রোহিণী শুনেছে, মীনা চ্যাটার্জি একাই থাকে, অবিবাহিতা। বছর চারেক আগে এক গুজরাটি ব্যবসায়ী শিয়ালদা কোর্টে মামলা তুলে মীনাকে তার স্ত্রী অভিহিত করে ষাট হাজার টাকা গহনা অপহরণের দায়ে অভিযুক্ত করেছিল। সেই মামলার ফল খবরের কাগজে আর বেরোয়নি।

পর্দা সরিয়ে মেয়েটি ভিতরে চলে গেল। রোহিণী লক্ষ করল, ভিতরে যাবার পর সে দরজাটা আধখোলাই রেখে দিল। মহারানির সম্পাদক প্রশান্ত হালদারের কাছ থেকে মীনা সম্পর্কে কিছু আগাম তথ্য লিখে নিয়েছিল সে। রোহিণী ঝুলি থেকে ডায়েরি বইটা বার করে, ঝালিয়ে নেবার জন্য সেটা খুলল।

অফিসিয়াল বয়স ছাব্বিশ। তার মানে কি ত্রিশ? ছবিতে যা দেখেছে বা ফিল্মে, তাতে কিছু বোঝা যায় না। মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসেছে, এমন রোলেও গত বছর ওর ছবি রিলিজ করেছে। মোটামুটি মানিয়েই গেছে। মীনা এখন বয়সের এমন একটা অঞ্চলের মধ্যে, যেখানে বয়স নিরলস ও কঠিন যত্ন পেলে থমকে থাকে।

রোহিণী নিজের কথা ভাবল। বোধ হয় সেও এখন এই অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু কতদিন থাকবে? রাজেন বলেছে শরীরটাই সব নয়। ও আবেগপ্রবণ। শোভনেশ বলেছিল, শরীর ছাড়া মেয়েদের আর আছে কী? সেও মাঝে মাঝে আবেগের বশবর্তী হত, কিন্তু রাজেনের মতো এত কোমলতা সহাকারে নয়। শোভনেশের রূঢ়তার একটা আকর্ষণ ছিল, ওর নির্যাতনের ধরনে আদিম একটা—

রোহিণীর মনে হল, কেউ যেন তাকে লক্ষ করছে। আড়ষ্ট হয়ে উঠল তার পিঠ আর বুকের পেশি। মাথার মধ্যে শীতল হয়ে রক্তস্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এল। সে আড়চোখে তার ডান দিকের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল। পাল্লা ইঞ্চি দুয়েক ফাঁক। কাটা পর্দা একবার নড়ে উঠল। কেউ ফাঁক করে দেখছিল বোধ হয়। অথচ যখন সে ঘরে ঢোকে, দরজাটা তখন কিন্তু বন্ধই দেখেছিল।

কে? শোভনেশ?

ভয় পেয়ে মাথাটা খারাপ হল নাকি? রোহিণী নিজেকে ধমকাল। এখানে শোভনেশ আসবে কী করে? এটা তো মীনা চ্যাটার্জির ফ্ল্যাট। ওর সঙ্গে শোভনেশের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে কি? ছ—বছর আগেও, যখন মীনা অ্যামেচার নাটক দলের সামান্য অভিনেত্রী ছিল, তখন কোনো সম্পর্ক যদি থাকত, তা হলে সে জানতে পারত। আসলে এই নিস্তব্ধ ঘরে একাকী বসে থাকার আর মনে মনে শোভনেশের কথা ভাবার জন্য বোধ হয় সামান্য ব্যাপারেই তার ভয় লাগছে। দরজাটা হয়তো হাওয়ায় খুলে গেছে। পর্দাটা হয়তো পাখার হাওয়ায় নড়েছে।

রোহিণী আবার পর্দার দিকে তাকাল, নড়ছে না। এক পয়েন্টে পাখা ঘুরলে অত ভারী কাপড়ের পর্দা নড়বে কেন? ঠিক তেমনি, শোভনেশই বা এখানে হাজির হবে কেন? বহরমপুর থেকে পাঁচ—সাত ঘণ্টায় আসা গেলেও এবং মীনার সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় থাকলেও গত ছ—টা বছর তো জেলের বাইরের পৃথিবীর ঘটনার কিছুই ওর জানার কথা নয়। কত কী বদলে গেছে, সে কোথায় চলে গেছে, কী করছে সে সব জানবে কী করে? মীনা তো দু—বছর হল এখানে বাস করছে। শোভনেশ কী তা জানবে? তা হলে সে এখানে এসে উঠবে কী করে? তা হলে সে সল্টলেকে তার ফ্ল্যাটের খবরও তো জানে না।

রোহিণী যুক্তিগুলোকে আঁকড়ে ধরে কিছুটা হাঁফ ছাড়ল। সকালে খবরটা পড়ার পর থেকেই কী যে এই শোভনেশ—আতঙ্ক তাকে পেয়ে বসেছে! মানে হয়? সে নিজেকে সহজ করার জন্য উঠে পড়ল। ব্র্যাকেটে রাখা অ্যাওয়ার্ড আর সুভেনিরগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে তার চোখ ডান দিকের দরজার দিকে সরে গেল। হঠাৎই একটা অন্যায় কৌতূহল তাকে পেয়ে বসল। ঘরে কে রয়েছে?

হাতখানেক সরে গিয়ে হাত বাড়িয়ে পর্দাটা ফাঁক করল। এমনভাবে সে দাঁড়াল, যেন কেউ হঠাৎ এসে পড়লে সে হাতটা চট করে নামিয়ে জিনিসগুলোকে দেখার ভান করতে পারে।

দরজাটা ইঞ্চি তিনেক ফাঁক হয়ে রয়েছে। জমকালো নকশাদার বেডকভারে মোড়া একটা খাটের কিছুটা, ড্রেসিং টেবল আর এয়ারকুলারের কিছুটা আর যেটির আধখানা সে দেওয়ালে দেখতে পেল তাতে তার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। এবং কৌতূহল অবশেষে ভব্যতার শেষ সীমা ছাড়িয়ে গেল।

কাচ বাঁধানো ছবিটার আধখানা সে দেখতে পাচ্ছে। পায়ের পাতা, হাঁটু আর হাঁটুতে রাখা একটা মুখ, যেটা ঝাপসা। শোভনেশের আঁকা ন্যুড একনজরেই চেনা যাবে শুধু মুখটা দেখলেই। কুয়াশার মতো ঝাপসা সাদা ছায়ার পিছনে মুখের রহস্যময় ভৌতিক একটা আভাস পাওয়া যাবে। শোভনেশের সই থাকে ছবির নীচের বাঁ কোণে।

ছবিটার বাকি আধখানটায় রয়েছে শরীরের বাকি অংশ। রোহিণী সেটা দেখার লোভ আর সম্বরণ করতে পারল না। দরজার পাল্লাটা সে আঙুলের ডগা দিয়ে ঠেলল।

‘কে?’

বিদ্যুৎ ছোঁয়া লাগার মতো একটা ঝাঁকি খেয়ে সে পিছিয়ে গিয়ে দ্রুত আবার সোফায় এসে বসল। ঘরের লোকটা পুরুষ। বুঝতে পেরেছে কি দরজাটা সে ঠেলেছে? যদি জিজ্ঞাসা করে, তা হলে কী বলবে? লোকের বাড়িতে এসে দরজা ঠেলে শোবার ঘর চুপি চুপি দেখা শুরু রুচিহীনতাই নয়, একটা অপরাধও। না, বলা যাবে না। এই লজ্জাকর কাজ কিছুতেই স্বীকার করা যায় না, সে করবেও না।

সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলে রোহিণী কাঠ হয়ে বসে রইল। ছবিটার কিছুই প্রায় দেখার সময় পায়নি। চোখটা কতক্ষণের জন্য ছিল? পি টি উষা যতটুকু সময়ের জন্য ওলিম্পিক ব্রোঞ্জ হারিয়েছে ততটাই বোধ হয়।

ঘোর কালো পটভূমিতে ক্রমশ মিলিয়ে যাওয়া কালো রংটায় সামান্য ম্যাজেন্টার আভাস। দাবার মতো সাদা—কালো বরফি আঁকা পাথরের মেঝেয় বসা নগ্ন একটা নারী। দুই হাঁটু মুড়ে উঁচু করা, সামনে ঝুঁকে দুই হাতে হাঁটু জড়ানো এবং মুখটি জোড়া হাঁটুর উপর। স্তন দুটি ঊরুতে চেপে বসানো। ছবিটি আঁকা পাশ থেকে। মাথা থেকে মেঝেয়—রাখা নিতম্বের তলদেশ পর্যন্ত অর্ধ—জ্যা টানা ধনুকের মতো তুলির রেখা—রোহিণী এই রেখার সঙ্গে পরিচিত। বরফি কাটা পাথরের মেঝেটার সঙ্গেও তার পরিচয় আছে।

‘আপনি মহারানি থেকে এসেছেন?’

রোহিণী এই নিয়ে আজ কতবার যে চমকে উঠল! কোলে রাখা থলিটা আঁকড়ে সে মুখ তুলে তাকাল। লোকটি সাড়ে ছয় বা সাত ফুট লম্বা। তার মনে হল, কোথায় যেন একে দেখেছে!

‘হ্যাঁ।’

‘আপনার নাম?’

শীর্ণ, পাটকাঠির মতো। গলাটা লম্বা এবং সামনের দিকে বাড়ানো, কাঁধ দুটি অল্প ঝুঁকে থাকায়, এই ধবধবে ফরসা, বছর পঁয়তাল্লিশের লোকটিকে কুঁজো দেখাচ্ছে। পরনে ধুতি আর হাতাওয়ালা পাঞ্জাবি, আজকেই পাট ভাঙা হয়েছে। মুখটা যেন তার চেনা মনে হচ্ছে, কিন্তু কোথায় যে দেখেছে ঠাহর হচ্ছে না।

‘রোহিণী সেনগুপ্ত।’

‘সেনগুপ্ত!’ লোকটির স্বরে কেমন যেন একটা কর্কশ আবরণ সেনগুপ্ত শব্দটিকে ঘিরে ফুটে উঠল।

‘আমি মীনার ম্যানেজার, পিআরও, এমনকী গার্জেনও বলতে পারেন।’ চেয়ারে বসার পর লোকটি নিজের পরিচয় দিল। ‘আমার নাম সুভাষ গায়েন’ তারপর রোহিণীর মুখে বিস্ময় লক্ষ করে বলল, ‘পাশাপাশি বাড়িতে আমরা থাকতাম। ওকে ছোটোবেলা থেকেই চিনি।’

‘কোথায়?’

‘জোড়াবাগানে।’

‘এখনও কী—’

‘না। মীনারা ভাড়া থাকত। ওর বাবা ছিল নিমতলার কাঠের দালাল। যখন ওর বছর দশেক বয়েস, বাবা মারা যায়। খুব কষ্টের মধ্যে পড়ে। ওরা উঠে যায় পাড়া থেকে।’

‘কোথায়?’

‘যেখানেই যাক, আপনার লেখার জন্য তার দরকার হবে না নিশ্চয়।’ শিষ্ট স্বরে বললেও রূঢ়তার চাপা ঝাঁঝ চাপতে পারেনি। রোহিণীর মাথার মধ্যে উত্তাপ জমে উঠল। কথা বলা শেখেনি, অথচ নাকি অভিনেত্রীর পিআরও! ভেবেছে মহারানি ধন্য হয়ে যাবে মীনাকে ফিচার করে? ইডিয়টটাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, পাবলিসিটি ছাড়া মীনার মতো থার্ড গ্রেডের অ্যাকট্রেসের লাইনে টিকে থাকা অসম্ভব, যতই অ্যাওয়ার্ড পাক না কেন।

রোহিণীর মুখভাব লক্ষ করছিল সুভাষ গায়েন। মৃদু স্বরে বলল, ‘জীবনের সব কথাই কি প্রকাশ করা যায়?’ লোকে ওর অভিনয় জীবনের, বর্তমান জীবনের সম্পর্কেই ইন্টারেস্টেড, তাই তো? আপনি এর উপরই লিখুন, এটাই আমরা চাই। অতীতে তা অনেকের অনেক কিছুই ঘটেছে, সে সব ভুলেও গেছে বা ভুলে যাবার চেষ্টা করেছে। আপনিই বলুন, আপনি কি অতীতের সব ব্যাপার লোককে বলতে রাজি আছেন?’

রীতিমতো অভব্য! কী করে একজন অপরিচিতা মহিলাকে এভাবে ইঙ্গিত দিতে পারে যে, গোপন করার মতো ব্যাপার তার জীবনে আছে? রোহিণী তার বিরক্তি ও আপত্তি মুখভাবে ও কণ্ঠস্বরে সচেতনভাবে জাহির করল।

‘আপনার সঙ্গে কয়েক মিনিটের পরিচয়, এর মধ্যেই বুঝে ফেললেন আমার অতীত কেমন ছিল? আপনি কী মুখ দেখেই অতীত পড়ে ফেলতে পারেন?’

‘না, তবে কারোর কারোর পারি।’

একটা জবাব ঠোঁটে এসে গেছল রোহিণীর। কিন্তু কীরকম একটা খটকা লাগছে তার। এখানে শোভনেশের আঁকা ছবি ঘরে টাঙানো। কেন, কীভাবে এল? কোথাও থেকে কিনে এনে টাঙিয়েছে কি? পয়সা দিয়ে কেনা ছবি এই ধরনের লোকেরা পাঁচজনকে দেখাবার জন্য বাইরে রাখে, শোবার ঘরে রাখবে না। কেউ উপহার দিয়ে থাকলেও বাইরেই রাখবে। শ্লীল—অশ্লীল নৈতিক প্রশ্নেই কি লোকচক্ষুর আড়ালে রেখেছে? তা হতে পারে না। নীতিবাগীশরা ন্যুড ছবি শোবার ঘরে তো দূরের কথা, ঘুঁটে রাখার জায়গাতেও রাখবে না। তা হলে? কীভাবে এল ছবিটা?

লোকটা এত সাহস পেলে কোথা থেকে? শোভনেশের সঙ্গে কি কখনো পরিচয় ছিল? ও কি জানে শোভনেশ তার স্বামী, যে একটি স্ত্রীলোককে খুন করেছে, যাবজ্জীবন সাজা পেয়েছে। তাই কি এমন কায়দা করে, ঘুরিয়ে সেটা জানিয়ে দিল?

‘আমার অতীত বলতে পারেন?’ প্রায় চ্যালেঞ্জের সুরে রোহিণী বলল।

তার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সুভাষ গায়েন। রোহিণী লক্ষ করল লোকটির চোখের মণি সামান্য ধূসর। নাকের ডগা নীচের দিকে বাঁকানো। ঠোঁটের কোণ মুচড়ে রাখা। মুখটাই যেন একটা মুখোস।

সুভাষ গায়েন ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। রোহিণীর তার একবার মনে হল, কোথায় যেন একে সে দেখেছে। কোথায়, কোথায়? ওর নিজের উপর রাগ ধরতে শুরু করল। এত কম তার স্মৃতি!

‘আমায় কোথায় যেন দেখেছেন, কিন্তু মনে পড়ছে না, তাই তো? মৃদু স্বরে বলল সুভাষ গায়েন।

রোহিণীর মুখ জ্বালা করে উঠল। অপ্রতিভ বোধ করেও সে বলল, ‘হ্যাঁ।’

সুভাষ গায়েন হাসল। কিন্তু হঠাৎ প্রসঙ্গ বদল করে বলল, ‘মীনার ফিরতে দেরি হবে, কত দেরি হবে বলা শক্ত। আপনি কি অপেক্ষা করবেন, না অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আর একদিন আসবেন?’

‘সেটা এতক্ষণ বলেননি কেন!’ রোহিণী তার বিরক্তি জানিয়ে দিল এবং ক্ষোভও। ‘মিছিমিছি বসে থেকে সময় নষ্ট করলাম।’

তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে সুভাষ গায়েনও উঠল।

‘সময় নষ্ট হবে কেন, আপনি তো একটা জিনিস আবিষ্কার করেছেন। লাভই হয়েছে বলুন!’

প্রায় বিদ্রূপই শোনাল। রোহিণী টান টান সোজা হয়ে থুতনি তুলে বলল, ‘কথাটা ঠিক বোধগম্য হল না।’

খাপছাড়াভাবে সুভাষ গায়েন বলল, ‘আপনার ফিগারটা চমৎকার। আর্টিস্টরা মডেল হিসেবে এইরকমই চায়।’

কথাটাকে অগ্রাহ্য করে রোহিণী বলল, ‘কী জিনিস আবিষ্কার করেছি, বলুন সেটা?’

সুভাষ গানেয় দু—কদম পিছিয়ে ঘরের পর্দাটা তুলে ধরে দরজার পাল্লাটা ঠেলে খুলে দিল। তারপর তীব্র চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ছবিটা শোভনেশ সেনগুপ্তরই আঁকা। আমি জানি, সে আপনার স্বামী, এখন জেলে।’

‘আপনি ওকে চেনেন!’ বিস্ময়ের ধাক্কায় রোহিণী নিজের ব্যক্তিত্বের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল। তার মনের কাজকর্মের তাল কেটে গেছে। বিভ্রান্তিতে সে আচ্ছন্ন, বিমূঢ়।

সুভাষ গায়েন মাথা নাড়ল। দৃষ্টির তীব্রতা স্তিমিত হয়ে এসেছে। মুখ পাশে ফিরিয়ে বলল, ‘চিনি না। তবে চেনা থাকলে ও জেলে যেত না।’

‘কেন?’

সুভাষ গায়েন চুপ করে রইল। রোহিণী অধৈর্য হয়ে প্রায় চেঁচিয়েই বলল, ‘এ কথা বললেন কেন? বলুন? বলুন? আপনাকে বলতেই হবে!’

‘তাহলে আমিই জেলে যেতাম—ওকে খুন করে।’

‘সে কি!’

‘যাকে ও খুন করেছে, সে মীনার দিদি বীণা। তাকে আমি ভালোবাসতাম, বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শোভনেশ যে তাকে নষ্ট করেছে, পচিয়ে দিয়েছে, সেটা আগে আমি জানতে পারিনি। যদি জানতে পারতাম, তা হলে—’

‘বীণা তো মডেলের কাজ করত।’

‘অভাবের সংসার, লুকিয়ে লুকিয়ে সে দু—তিনজন আর্টিস্টের কাছে কাজ করত। শেষকালে শোভনেশের এক্সক্লুসিভ ছিল, আর তখনই ওদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যে ছবিটা দেখলেন, ওটা বীণার। শোভনেশের উপহার, কিন্তু বাড়িতে ছবিটা আনতে লজ্জা পায়। এক বন্ধুর কাছে রেখে দিয়েছিল। বছর দুয়েক আগে সে মীনাকে ওটা ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা বড়ো হচ্ছে তো।’

‘আমি এসব জানতাম না।’

‘কেন আপনি তো কোর্টে ট্রায়ালের সময় সাক্ষী ছিলেন। সেখানে বহু অজানা কথাই তো জানা গেছে।’

এতক্ষণে রোহিণী ধরতে পারল, কোথায় ওকে দেখেছে। কোর্টঘরে পিছনের দিকে একটা বেঞ্চে বসে কখনো আনমনে বিষণ্ণ চোখে, কখনো উদগ্রীব হয়ে সামনে ঝুঁকে ও সাক্ষীদের জেরা শুনত। বহু লোকই খুনের বিচার শুনতে যায়, রোহিণী ধরে নিয়েছিল, লোকটি তাদেরই মতো কেউ।

‘বিয়ের আগে আর পরেও বীণার সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না।’

‘শোভনেশ যদি আপনাকে বিয়ে না করত, তা হলে বোধ হয় বীণা বেঁচে থাকত।’

‘তার মানে? ওর মৃত্যুর কারণ আমি? এসব কী বলছেন?’

সুভাষ গায়েন মুখ ঘুরিয়ে একবার রোহিণীর দিকে তাকিয়েই শোবার ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। দরজাটা যেরকম শব্দ করে বন্ধ হল, তার একটাই অর্থ। আর সে বেরোবে না।

কাজের মেয়েটি ভিতর থেকে বেরিয়ে এল অন্য দরজা দিয়ে। ‘আপনি কি বসবেন?’

‘না।’

চার

ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে লিফটের জন্য বোতাম টিপে রোহিণীর মনে হল, সুভাষ গায়েনকে একটা খবর দেওয়া হল না। বহরমপুর জেল থেকে যাবজ্জীবন দণ্ড পাওয়া একজন পালিয়েছে। শোভনেশ ওখানেই ছিল। হয়তো জেল ভাঙা কয়েদি সে—ই।

লিফট এসে গেছে। রোহিণী লিফটে ঢুকে ‘জি’ লেখা বোতামটা টিপে ভাবল, কিছু কিছু খবর যদি কেউ কেউ জানতে না পারে তাতে অনেক সময় শান্তি রক্ষায় সাহায্যই হয়।

মিনিবাসে ভিড় ছিল। শেয়ালদার প্রাচী সিনেমার স্টপে পৌঁছে রোহিণী বসার জায়গা পেল। অবশ্য তার আগে ব্রিফকেস কোলে নিয়ে বসা টাই—পরা এক সুদর্শন পুরুষ তাকে আসন ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। সে রাজি হয়নি। ভাঙাচোরা কলকাতার রাস্তায় বাসে দাঁড়িয়ে যাওয়া বসে যাওয়ার থেকে, অনেক আরামের যদি না জানোয়ার—ঠাসা ভিড় থাকে।

বাসে উঠেই সে সব যাত্রীদের মুখগুলো একবার দেখে নেয়। ভয় পাওয়ার মুখটি নেই। যতবার বাস থেকে লোক ওঠানামা করেছে সে দরজার দিকে তাকিয়েছে। একটা নতুন অভ্যাসের মধ্যে সে যে ঢুকে যাচ্ছে, এটা রোহিণী বুঝতে পারছে। কিন্তু সে নিরুপায়।

শোভনেশের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে সুভাষ গায়েন নামে এক অস্বস্তি। লোকটার একটা কথা তাকে কামড়াচ্ছে এবং আজীবন তাড়া করে যাবে—’শোভনেশ যদি আপনাকে বিয়ে না করত, তা হলে বোধ হয় বীণা বেঁচে থাকত।’ কথাটার অর্থ সুভাষ গায়েন আর খুলে বলেনি। কী হতে পারে?

অর্থটা হয়তো এই, শোভনেশ যদি বীণাকে বিয়ে করত, তা হলে বীণা মরত না। কিন্তু ব্যাখ্যাটা রোহিণীর কাছে খুব সোজা, অগভীর এবং যুক্তিকর মনে হল না। তা হলে এইরকমও হতে পারে, পাছে বর্তমান স্ত্রী রোহিণী পূর্ব প্রণয়ের কথা জেনে ফেলে, তাই শোভনেশ শেষ করে দেয় বীণাকে। কিংবা বীণা তার প্রণয়ীর বিশ্বাসঘাতকতায় ক্ষেপে গিয়ে এমন একটা কিছু করবে বলে হুমকি দিয়েছিল বা করতে যাচ্ছিল, যা বন্ধ করার জন্য শেষ উপায় হিসাবে শোভনেশ এই কাজ করতে বাধ্য হয়।

বিচারের সময় শোভনেশ একদমই মুখ খোলেনি। উদ্দেশ্যটা কী, কেন সে খুন করল সে সম্পর্কে একটা কথাও তার মুখ থেকে পুলিশ বা উকিল জেরা করে বার করতে পারেনি। শুধু সে বলেছে, ‘আমি খুনি কি না প্রমাণ করার জন্য এত সময়, পরিশ্রম, অর্থ ব্যয় করার কী দরকার, যা শাস্তি দেবার দিয়ে দিন।’ কিন্তু যতক্ষণ না সাক্ষ্য—প্রমাণ পেয়ে আদালত নিশ্চিত হচ্ছে, ততক্ষণ তো আর সাজা দেওয়া যায় না। ‘হ্যাঁ, আমি বীণাকে খুন করেছি’, শুধু এই কথার উপরই কি প্রকৃত অপরাধী সাব্যস্ত হয়?

মে দিবসের ছুটির দিন, ঘটনার সময় রোহিণী ছিল মোমিনপুরে গঙ্গাপ্রসাদের বাড়িতে। দুপুরে নিমন্ত্রণ ছিল তাদের দু—জনের। শোভনেশ বলেছিল, গোয়াবাগানে তার একটা জরুরি কাজ আছে, সেখান থেকে সে একটার মধ্যে মোমিনপুর পৌঁছে যাবে। রোহিণী একাই ট্যাক্সি নিয়ে দশটা নাগাদ মোমিনপুর রওনা হয়ে যায়, বউবাজারে শোভনেশদের পঁচানব্বুই বছর—বয়সি বিরাট বাড়িটা থেকে। দুপুর একটার মধ্যে শোভনেশ না যাওয়ায় গঙ্গাপ্রসাদ ফোন করেন। ওধার থেকে কেউ রিসিভার তোলেনি। এরপর আরও চারবার ফোন করে হতাশ হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘পাগলের বংশ তো, দেখো হয়তো গোয়াবাগান থেকে মোমিনপুর পর্যন্ত বোশেখ মাসে হেঁটে আসতে কেমন লাগে বোঝার জন্যই হয়তো—ও অপেক্ষা করে লাভ নেই, আমরা খেতে বসে যাই।’

খাওয়া শব্দটা মাথায় বুদবুদ কাটতেই হঠাৎ রোহিণীর মনে পড়ে গেল, কাল সে রাজেনকে রেঁধে খাওয়াবে বলেছে। দুপুরে ওকে ফোন করতে বলেছে মহারানির অফিসে। কীরকম একটা আবেগের ঢেউ তখন, রাজেনের ছেলেমানুষি কথাবার্তার ধাক্কায় তাকে এমনই দুলিয়ে দিল যে, সে তখন ঠিক করে ফেলে, রাতে ওকে খেতে বলবে। কিন্তু খাওয়াবেই যে, এমন কোনো কথা দেয়নি। দুপুরে ফোন করলে বলে দেওয়া যায়, ম্যাচ জিতে ফিরতে পারলে রেঁধে খাওয়াব কিংবা চলো, সন্ধ্যাবেলায় অ্যামবারে গিয়ে শুধুই তন্দুরি চিকেন গোটা দুই খাই।

রাত্রে নিমন্ত্রণ করে রাজেনকে ফ্ল্যাটে আসতে বলাটা কতটা উচিত হবে, এখনও সে তা বুঝতে পারছে না। শোভনেশের মতো রাজেন অ্যাগ্রেসিভ নয়। ভদ্র, মার্জিত ধরনের বিশেষণগুলো ওকে মানায়। একবার, মাত্র একবার হালকাভাবে জড়িয়ে ধরা, গালে গাল ঘসা, ঘাড়ে, গলায়, থুতনিতে মিষ্টি কামড়, বুকে মুখ চেপে ধরা আর দু—তিন সেকেন্ডের জন্য ঠোঁটের উপর ঠোঁট রাখা ছাড়া রাজেন কোনোরকম বাড়াবাড়ির চেষ্টা করেনি। একটু ফাজিল, হিউমার বোধটা প্রচুর পরিমাণে আছে, যেজন্য রোহিণীর ওর সান্নিধ্য ভালো লাগে। রাজেন ছটফটে, ছেলেমানুষ অথচ দরকারের সময় প্রবীণ হতে পারে। ওকে বাইরে থেকে কুনো স্বভাবের মনে হয়।

রোহিণী মাঝে মাঝে বিস্মিত হয়ে ভেবেছে, এখন ছেলে ক্রিকেট খেলে কী করে? খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে ক্রিকেটারদের যে ধননের কর্কশ কথাবার্তা, বন্য উদ্দাম আচরণের খবর পড়েছে, তাদের সঙ্গে রাজেনের তো কোনো মিলই নেই! অবশ্য তারা টেস্ট খেলে। রাজেন অতদূর পর্যন্ত যায়নি, যেতে পারবেও না। ‘পাগল, আমি টেস্টম্যাচ খেলব? বয়স কত হল জান?’ রাজেন একদিন বলেছিল, ‘তোমার সঙ্গে যখন প্রথম আলাপ হল, তখনই ঠিক করে ফেলি: গাওস্কার কি বিশ্বনাথের রাস্তা ধরে নক্ষত্র হওয়ার থেকে রোহিণী নক্ষত্রের আলোয় বরং পথ চিনে—না না, সেটা যে খুব সহজ আমি মোটেই তা বলছি না, রোহিণীর আলোয় পথ চিনে বরং তার কাছে পৌঁছে যাওয়ার সাধনায় লেগে থাকলে একশো টেস্ট খেলার সুখ আর যন্ত্রণা হয়তো একদিন পেলেও পেতে পারি।’

কথাগুলো মনে পড়ায় রোহিণী হেসে ফেলল। জানালা থেকে চোখ বাসের মধ্যে আনতেই দেখল, রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকা দুটি অল্পবয়সি ছেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। ছেলে দুটিকে সল্টলেকে তার পাড়াতেই দেখেছে। কার্ডিগানের বোতাম খোলা রয়েছে। সে সন্তর্পণে কোলে রাখা ঝোলাটার মুখ খুলে ভিতরে কিছু দেখার ছল করে কার্ডিগানে টান দিল। ছেলেদের এই বয়সে যেসব কৌতূহল চিমটি কেটে যন্ত্রণা দেয়, রোহিণী সেই চিমটি থেকে ওদের রক্ষা করতে চায়।

‘কোথায় এলাম রে?’ একজন বলল। অন্যজন ঝুঁকে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। রোহিণী হাসল, তবে মনে মনে। রাজেনের মতোই এ দুটো। বাস থেকে নেমে মিনিট দু—তিন হাঁটতে হবে। রাস্তাটা নির্জন। দু—ধারে ফাঁকা প্লট আর ঝোপ। আলোগুলো টিমটিমে। অনেকগুলো তো জ্বলেই না। বাড়িগুলোর দরজা জানলা বন্ধ। বাইরে কিছু ঘটলে কেউ বেরোবে না।

‘কাঁকুড়গাছির কাছাকাছি এসেছি।’

‘এই যে রাস্তাটা দিয়ে বাসটা যাচ্ছে, এর নাম জানিস?’

‘সিআইটি রোড।’

‘হল না।’

‘ভিআইপি রোড।’

‘দূর, সে তো দমদম এয়ারপোর্ট থেকে উলটোডিঙির মোড় পর্যন্ত।

‘তাহলে কী?’

‘তুই বল।’

‘বললুম তো দুটো নাম, আচ্ছা তাহলে নজরুল ইসলাম সরণি।’

‘তাও নয়। ওটা তো ভিআইপি রোডেরই অফিসিয়াল নাম।’

রোহিণী ওদের কথা শুনছিল, ধীরে ধীরে কৌতূহলী হয়ে উঠল। রোজই এই রাস্তা দিয়ে সে যাতায়াত করে, কলকাতার এটাই বোধ হয় সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পথ, কেননা দমদমে প্লেন থেকে নেমে প্রধানমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী, নানান দেশের প্রেসিডেন্ট বা রাজা—রানিকে কলকাতায় যেতে হলে এই পথ দিয়ে যেতেই হবে।

‘তোকে ক্লু দিচ্ছি। রাস্তাটা একজন বাঙালির নামে, বিশ্ববিখ্যাত তাঁর নিজের ক্ষেত্রে।’

‘তুই তো কুইজ ছাড়লি।’

রোহিণী লক্ষ করল, তার মতো বাসের অনেকেই ছেলে দুটির কথোপকথন শুনছে আর মনে মনে উত্তর হাতড়াচ্ছে এবং সেই সঙ্গে টের পেল তার মধ্যে যে টেনশনটা স্নায়ুগুলোকে টেনে রেখেছিল, ওই কৌতূহলই তা ঢিলে করে দিচ্ছে।

‘রবীন্দ্রনাথ?’

‘ওঁর নামে তো রাস্তা রয়েছেই। আমি যাঁর কথা বলছি, তাঁর নামে আর কোনো রাস্তা নেই।’

সারা বাস ভাবতে শুরু করল এবং রোহিণীও। হঠাৎ সে বলে ফেলল, ‘কতদূর পর্যন্ত রাস্তাটা?’

এতগুলি লোকের চোখ টানতে পারায় ছেলেটি ঈষৎ ফেঁপে উঠেছিল, এবার ফুলে উঠল রোহিণীর মনোযোগের কারণ হয়ে উঠতে পেরে।

‘বেলেঘাটায় ফুলবাগানের মোড় থেকে এই সামনে উলটোডিঙির মোড়, এক মাইল কী তার বেশিও হতে পারে, এতবড়ো রাস্তাটা!’

‘বলো কি ভাই। এতখানি রাস্তার নাম কেউ জানে না?’ এক মাঝবয়সি বিস্ময় এবং সন্দেহ প্রকাশ করলেন, ‘এই রাস্তার চারপাশে কত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, পলিটিসিয়ান, মিনিস্টার থাকে, তারা কেউ জানে না?’

পিছনের সিট থেকে একজন ফোড়ন কাটল, ‘দাদা, বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি, এটা মানেন তো? এই যে পলিটিসিয়ান মন্ত্রীদের কথা বললেন, ভোটের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয় সেগুলো ভুলতে কতক্ষণ সময় নেয় বলুন তো?’

এবার কথাবার্তা অন্যদিকে মোড় নেবে। তাই রোহিণী ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘যার নামেই রাস্তা হোক, সেটা কেউ জানে না আর আপনি জানলেন কী করে?’

আপনি সম্বোধনে ছেলেটির ব্যক্তিত্ব অবশ্যই বেড়ে গেল, যেটা রোহিণীর অভিপ্রেত ছিল। বাস থেকে নেমে ওদের রক্ষণাধীনে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছনোর চিন্তাটা তার মাথায় এসে গেছে।

‘ফুলবাগানে শেতলা মন্দিরটার সামনে আর উলটোডাঙায় হাড়কো কমপ্লেক্সের গায়ে দুটো পাথর লাগানো আছে ছোট্ট দেওয়ালে, কলকাতার পুরমন্ত্রী বসিয়েছে। তাতে এই রাস্তার নাম বলা আছে—আচার্য সত্যেন বোস সরণি।’

‘অ্যাঁ!’ আত্মবিস্মৃত জাতির একজন কেউ আকাশ থেকে পড়লেন। ‘নামটা বলা উচিত ছিল, একদম মনেই পড়ল না।’

‘পুরমন্ত্রী যখন বসিয়েছে, তখন তো অফিসিয়াল নামই।’

‘অথচ কেউ তা জানে না। ভাই তুমি ঠিক বলছ?’ মাঝবয়সি লোকটি তার সন্দেহ স্পষ্টভাবেই প্রকাশ করলেন।

বাসটা বিধান শিশু উদ্যান স্টপ থেকে ছেড়েছে। ছেলেটি ভ্রূ কুঁচকে আহত স্বরে বলল, ‘সামনের স্টপই উলটোডাঙার মোড়। নামুন, আপনাকে দেখিয়ে দেব।’

ছেলেটি যেন এটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে। রোহিণীর দিকে আর দৃকপাত না করে সে দরজার দিকে এগোল, সঙ্গে অন্য ছেলেটিও। মাঝবয়সির গন্তব্য বোধহয় এখানেই, নামার জন্য তিনিও প্রস্তুত হলেন। রোহিণী দমে গেল। বাস থেকে নেমে সম্ভবত একাই তাকে হাঁটতে হবে। এই অল্পবয়সিরা সব ব্যাপারেই কেন যে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, এটা সে বুঝতে পারে না। কিন্তু বয়সটা বছর পনেরো কম হলে সেও কি এখন বাস থেকে নেমে পড়ত? উত্তরের জন্য সে অবশ্য মাথা ঘামাল না। তার মাথায় এখন অনেক কিছু রয়েছে ভাবার জন্য।

রোহিণীর সঙ্গে একজনই শুধু নামল এবং নেমেই লোকটি বাঁদিকে হাঁটতে শুরু করল। প্রতিদিনই সে সিডি ব্লকে সেকেন্ড অ্যাভিনুয়ের এই চক্করটায় মিনি বাস থেকে নামে। তার গন্তব্য ডানদিকে। ফাঁকা রাস্তার দিকে তাকিয়েই তার মনে হল, ছেলে দুটি থাকলে ভালো হত। অন্ধকারটা ঝাপসা, তারই মধ্যে খামচা খামচা রাস্তার আলো।

কোন এক বাড়ির টিভি থেকে খবর পড়া শুরুর আগের জিঙ্গল বাজছে। খিদে তো পেয়েছেই, তাছাড়া চঞ্চলা নামে বছর বারোর যে মেয়েটাকে কাল গৌরীর মা কাজের জন্য এনে দিয়েছে, সে যে কী করছে এতক্ষণ কে জানে! ওকে দোকান থেকে কয়েকটা জিনিস আনতে দিয়েছে আর দশটা ডিম। কী করে গ্যাস বার্নার জ্বালাতে—নেভাতে হয়, কাল ও আজ তা শিখিয়ে বলে রেখেছে রুটি করে রাখতে। মেয়েটা যথেষ্ট চালাক আর কৌতূহলী। এই বাড়িতে তিনটি ফ্ল্যাটে গৌরীর মা ঠিকে কাজ করে। বাসন মাজা, ঘর মোছা আর কাপড় কাচার জন্য রোহিণী তাকে আশি টাকা দেয়। যেহেতু দুপুরের পর সে থাকে না তাই কাজটা একবেলার। তবে দোকান—বাজার থেকে কিছু আনতে হলে গৌরীর মাকে সে টাকা দিয়ে রাখে, পরের দিন সকালে কাজে আসার সময় কিনে নিয়ে আসে। দুষ্প্রাপ্য কেরোসিনও কালোবাজার থেকে এনে দেয়। রেফ্রিজারেটর থাকটা খুবই দরকার। তাহলে গ্যাস খরচ কমবে, একসঙ্গে তিনদিনের বাজার করে রেখে নিতে পারবে, দু—দিনের রান্নাও। গঙ্গাদার কাছে হাজার পাঁচেক টাকা ধার চাইবে ভেবেও চাইতে পারেনি। বিনা ভাড়ায় ফ্ল্যাটে থাকতে দিয়েছেন, চাকরি দিয়েছেন, এরপরও কিছু চাইতে তার লজ্জা করে।

বাড়ির সামনে নীচু পাঁচিল নীচু লোহার ফটক। সোজা সিমেন্ট বাঁধানো পথ বাড়ির শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঘুরে গেছে পিছন দিকে। এই পথটায় রাত্রে গাড়ি রাখা হয়। তিনটি মোটর থাকে। পিছন দিকেই দারোয়ানের এবং জলের পাম্পের ঘর। চৌকো, সাদামাটা এই হালকা গোলাপি ও মাখন রং লাগানো বাড়িতে দুটি সিঁড়ি ষোলোটি ফ্ল্যাটের জন্য। রোহিণীর সিঁড়িটি ‘বি’ ব্লকে। তিনতলায় তিনশো ছয় নম্বর ফ্ল্যাট। পুব ও দক্ষিণ বন্ধই প্রায়। উত্তরের ঘরের জানলা খুললে দেখা যায় মাঠ, যেখানে এখনও বাড়ি ওঠেনি।

গেটের আলো পাঁচ দিন ধরে জ্বলছে না। আজও তাই। মোটর রয়েছে দুটি। একটি এখনও ফেরেনি। একতলার কোলপসিবল দরজার উপরে কম পাওয়ারের আলোটা জ্বলছে। ইলেকট্রিক মিটার বোর্ডগুলোর উলটোদিকে আটটি লেটার বক্স। রোহিণী অভ্যাসমতো বাক্সের কাচ দিয়ে দেখল, কোনো চিঠি নেই। দিদি অনেকদিন চিঠি দেয়নি।

সিঁড়ির দোতলার ল্যান্ডিংয়ের আলো জ্বলছে না। তিনতলারটাও নেভানো মনে হচ্ছে। যদি জ্বলত, তাহলে দোতলায় আলোর ছিটে পড়ত। রোহিণী থমকে দাঁড়াল। হৃদস্পন্দন সামান্য বাড়ল। আলো তো কালও জ্বলছিল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। মনে হল একটা খসখসানি যেন সে শুনতে পেল। কাঠের মতো সে দাঁড়িয়ে থাকল। কোনো মানুষ কী? দারোয়ানের থাকার কথা গেটের কাছে। কিন্তু নেই। সিঁড়ির দরজা রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে। বাইরের যে—কেউই উপরে উঠে যেতে পারে। কাছাকাছি কোনো বাড়িতে কিছুদিন আগে ডাকাতি হয়ে গেছে। কলিংবেল টিপে দরজা খুলিয়ে জনাচারেক ফ্ল্যাটে ঢোকে। ছোরা দেখিয়ে বেঁধে রেখে গহনা, নগদ টাকা, ঘড়ি, টেপ রেকর্ডার এমনকী দামি ছ—টা শাড়ি পর্যন্তও নিয়ে গেছে। আলমারি খুলে শাড়ি ও গহনা বার করার সময় বাধা দিতে গিয়ে গিন্নি ছোরার খোঁচা খেয়েছে ঘাড়ে আর পেটে। নগদে ও জিনিসে সত্তর হাজার টাকা ডাকাতরা নিয়েছে।

রোহিণী প্রথমেই নিশ্চিন্ত হল, ডাকাতরা তার ফ্ল্যাটে আসবে না। ওরা খোঁজখবর করেই আসে। আর নিশ্চয় এটা জানবে যে, একটা খুদে ট্রানজিস্টর, দুটো সুটকেস কয়েকটা শাড়ি, যার মধ্যে সর্বোচ্চচ দামেরটি সাড়ে ছশো টাকার, একটা সিলিং ফ্যান, টেবল ল্যাম্প ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না। নগদ প্রায় সাতশো টাকা আছে ডিক্সনারির মধ্যে, খুঁজে বের করা খুবই শক্ত। শোভনেশের দেওয়া হিরের আংটি, কানের মুক্তোর টপ, এগুলোর কোনোটাই সে পরে না। আছে সুটকেশে একটা খামের মধ্যে। এর জন্য ফন্দিফিকির করে ডাকাতরা এলে তাদের মজুরি পোষাবে না।

আবার খসখস হল। রোহিণী কয়েক ধাপ নেমে এসে একতলার ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়াল। ডাক্তারবাবুর ফ্ল্যাটের কলিংবেলে আঙুল রাখল। দরকার মনে করলেই টিপবে। উনি বৃদ্ধ, কিন্তু ওর চাকরটা বেশ বলিষ্ঠ। অন্যদিকের ফ্ল্যাটে এক মাড়োয়ারি পরিবার। প্রত্যেকের আনফিট শরীর, তা ছাড়া নিরীহ গোবেচারা ধরনের। ডাকাত শুনলে হয়তো চেঁচামেচি করবে, কিন্তু দরজা এঁটে।

লোডশেডিং হলে চলাফেরায় খুব অসুবিধে হয় শুনে গঙ্গাদা বলেছিলেন, একটা পেনসিল টর্চ ব্যাগে রেখে দিয়ো। টর্চ কিনেওছে। কিন্তু ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ায় সেটা টেবলে রেখে দেয়। ভুলে গেছে নতুন ব্যাটারি লাগাতে। একটা কাজ অবশ্য করা যেতে পারে, দারোয়ান বা তার বউকে ডেকে সঙ্গে করে উপরে ওঠা।

কিন্তু আর খসখস হচ্ছে না। চোর—ডাকাত হলে এতক্ষণ অপেক্ষা করত না। নেমে এসে তার পাশ দিয়ে ভালোমানুষের মতো বেরিয়ে যেত। রোহিণী আবার সিঁড়ি দিয়ে এক পা এক পা করে উঠতে শুরু করল। আর তখনই বাইরে মোটর থামার শব্দ হল।

সাহস পেয়ে সে দোতলা পর্যন্ত উঠল। তিনতলার সিঁড়িতে ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখ সইয়ে নিয়ে আবার উঠতে শুরু করল দেওয়ালে হাতে রেখে। ঠিক কোন ধাপটায় ল্যান্ডিং, সেটা বুঝতে পারছে না। একবার হোঁচটও খেল। ডান পা—টা সন্তর্পণে তুলে উপরের ধাপে ফেলতে গিয়ে সে আর সিঁড়ি পেল না ফলে সামনে ঝুঁকে পড়ে। ভারসাম্য রাখতে এক পা এগিয়ে দিতেই জুতোর ঠোক্কর লাগে নরম একটা জিনিসে।

রোহিণী এবং কুকুরটি একই সঙ্গে আর্তনাদ করে উঠল। তবে দু—জনের মুখ থেকে দু—রকম আওয়াজ বেরোয়। রোহিণী থরথর করে কাঁপতে থাকে আর কুকুরটি, বাইরের ফটকে যার আস্তানা, চোরের মতোই নীচে নেমে গেল।

একতলায় সুইচের শব্দ এবং সিঁড়ির সবকটি আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চচাদের কণ্ঠস্বর ও দুমদাম পা ফেলার আওয়াজ ভেসে এল। চারতলার তুষার দত্ত সপরিবারে ফিরলেন।

.

রোহিণীকে ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রথমে ছেলে দুটি তারপর বড়ো মেয়ে নন্দা—যার বয়স ষোলো, তারপর একদা বডি বিল্ডার ও বেঁটেখাটো তুষার দত্ত—যিনি কলপ দিয়ে যৌবনকে চিরস্থায়ী করে রাখতে চাইছেন, এবং সবশেষে সিঁথিতে সিঁদুর লেপা ও চশমা পরা, আরতি নামে একটি চর্বির বস্তা, অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওদের কারোর সঙ্গেই রোহিণীর ভালো পরিচয় নেই। শুধু দু—তিনবার ওদের ফ্ল্যাটে গেছে জরুরি ফোন ধরার জন্য।

‘সিঁড়িটা অন্ধকার ছিল, বেকায়দায় পা—টা এমন মচকে গেল।’

রোহিণী কৈফিয়ত দেবার মতো স্বরে তাড়াতাড়ি কথাগুলো বলেই বুঝতে পারল, সত্যিই সে ভয় পেয়ে গেছিল। মুখে করুণ ভাব ফুটিয়ে সে হাসারও চেষ্টা করল।

‘পা ফেলতে পারছি না, তাই দাঁড়িয়ে পড়েছি।’

রোহিণী যদি জানত, কী সর্বনাশকে সে এই একটি বাক্যদ্বারা ডেকে আনছে, তাহলে মুখে চাবি দিয়ে রাখত।

‘হাড় টাড় ভাঙল নাকি? দেখি দেখি, কোন পা?’ তুষার দত্ত হাত বাড়িয়ে প্রায় হুমড়ি খেলেন রোহিণীর পায়ের গোড়ায়।

‘না না ভাঙেনি।’ রোহিণী দু—হাত মেলে ধরে ঝুঁকে পড়ল।

‘কী করে জানলেন ভাঙেনি?’ তুষার দত্তের হাত পৌঁছে গেল রোহিণীর ডান পায়ের পাতায়। ‘এই পায়ে?’

রোহিণী সিঁটিয়ে গিয়ে বলল, ‘বাঁ পায়ে।’

সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাতের আঙুলগুলো বাঁ পায়ের পাতাটা জুতো সমেতই আঁকড়ে ধরল। তারপর পাতা থেকে গোছ পর্যন্ত তুষার দত্তর অর্থপেডিক পরীক্ষা শুরু হল। জুতোটা আগেই খুলে নিয়েছিল, সায়াটা কিঞ্চিৎ তোলার চেষ্টা করতেই রোহিণী মরিয়া হয়ে বলল, ‘দেখুন তো, আপনি গুরুজন পায়ে হাত দিচ্ছেন, আমার কী যে লজ্জা করছে!’

.

‘তাই বলে পা—টা ভেঙেছে কিনা দেখব না।’

রেহাই পাবার জন্য রোহিণী সাহায্যের আশায় অসহায় মুখে ওর ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীর দিকে তাকাল। তারাও বিভ্রান্ত।

‘মনে হচ্ছে স্প্রেন হয়েছে, সম্পূর্ণ রেস্ট দরকার। পায়ে চাপ দিয়ে ওঠা তো উচিত নয়।’

‘পারব, পারব, এই ক—টা তো সিঁড়ি।’

রোহিণী ব্যগ্র স্বরে তিনতলার ল্যান্ডিংয়ের দিকে তাকাল। ‘বারোটা মাত্র, পারব।’

‘পারবেন তো নিশ্চয়, কিন্তু দুটো সিঁড়ি ভাঙাও এখন উচিত হবে না। আপনি বরং—’

তুষার দত্ত তার পরামর্শকে বাস্তবায়িত করার আগেই রোহিণী হাত বাড়িয়ে নন্দাকে তার বাঁদিকে টেনে আনল।

‘এই তো নন্দা, ওর কাঁধে ভর দিয়ে উঠে যাব।’

সকাল থেকে কী যে ঝামেলা! রোহিণী দাঁতে দাঁত ঘষল। এভাবে ভয় পাওয়ার কোনো মানে হয়? বাইরে, মনের ভেতরে সবখানেই তো অন্ধকার। আনাচে কানাচে কুকুর তো আছেই, তার উপর এইসব উপকারী জীবেরা। এখন ঘরে পৌঁছনো তো খোঁড়ার অভিনয় করে যেতে হবে।

‘ওর একার পক্ষে কি সম্ভব? দু—জনেই পড়ে যাবেন, আমি বরং—’

তুষার দত্ত বোকামি করে আর সময়ক্ষেপ করল না। রোহিণীর প্রতিরক্ষা তৈরি হবার আগেই তার অরক্ষিত ডান বাহু জড়িয়ে ধরল বগলের তলা দিয়ে বাঁ হাত ঢুকিয়ে।

আরতি চুপ করে ব্যাপারটা দেখে যাচ্ছেন। ঠান্ডা গোবেচারা মানুষ। নীচুস্বরে কথা বলেন আর সংসারের কাজ করেন অবিরাম। রোহিণী অস্বস্তিভরে তার দিকে তাকাল। নন্দা তার বাবার এই কাজটা অনুমোদন করতে না পেরে বলল, ‘বাবা তোমায় আর ধরতে হবে না, আমার গায়ে যথেষ্ট জোর আছে।’

.

তুষার কটমটিয়ে একবার শুধু মেয়ের দিকে তাকাল। ‘এইবার আস্তে আস্তে পা ফেলুন। হ্যাঁ, হ্যাঁ, আহহ অত তাড়া কীসের।’

রোহিণীর ইচ্ছে করছে ছুটে তিনতলায় উঠে যেতে, কেননা তুষার দত্তর বাম বাহু তার পাঁজরের যে জায়গায় চাপ দিচ্ছে তাতে বিপন্নকে সাহায্য দেবার রীতিটা রক্ষিত হচ্ছে না। নন্দা তার অস্বস্তির কারণটা বুঝেই ডান বাহু ছেড়ে পিঠের উপর দিয়ে হাতটা বাড়িয়ে বাম বগলের নীচে ঢোকাতে গেল। কিন্তু তুষার দত্তর বাইসেপ দুর্ভেদ্য করে রেখেছে অঞ্চলটা। নন্দা একটু ফাঁক খুঁজছে হাতটা গলাবার জন্য, তুষার দত্ত আরও চেপে ধরেছে রোহিণীর পাঁজর। আরতি ওদের পিছনে, সামনে ছেলে দুটি।

রোহিণী ঠিক করল, আর নয় এবার কিছু করা দরকার। নন্দা বাবার ব্যাপারটায় লজ্জা পাচ্ছে এবং নিজের হাত রেখে একটা আড়াল তৈরি করতে চাইছে, এতে রোহিণী নিজেও কুঁকড়ে যাচ্ছে। এইটুকু মেয়ে, কী ভাবছে তার সম্পর্কে! বিরক্তিতে রাগে সে বাকি দুটি সিঁড়ি একলাফে পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়াল।

‘আমার কিছুই হয়নি, মিছিমিছি আপনাদের কষ্ট দিলাম।’ রোহিণী নিজের দরজার কলিং বেলের বোতামে চাপ দিল।

‘এটা কোনো কষ্টের ব্যাপারই নয়।’ তুষার দত্ত এখন বিনীত ও ভদ্রলোক। ‘বরফ দেওয়া দরকার। আমি এক্ষুনি আইসব্যাগ আর বরফ আনছি।’

লোকটি পড়িমরি চারতলায় উঠে গেল, তা সঙ্গে ছেলে দুটিও। নন্দার মুখে লজ্জার কালো ছাপ। আরতি কিছুই বোঝেননি। উৎকণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘বরফ দেওয়া ভালো। তাহলে আর ব্যথা হবে না।’

রোহিণী যথাসাধ্য হাসল এবং আবার বোতাম টিপল। তখন নন্দা ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আন্টি, আপনার কাজের মেয়েটা বিকেলে চলে গেছে। আমি গেটে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন ও চলে যাচ্ছে। আমায় বলল, একা থাকতে ভয় করছে, আর আসবে না।’

‘সে কি! ভয় করছে? আশ্চর্য তো!’

‘তাই তো বলল। আমি বললুম, তিনতলায় আবার ভয় কীসের? নতুন বাড়ি, ভূতটুত এখনও বাসা বাঁধেনি, তা ছাড়া এত লোক রয়েছে। তা আমার কথায় আর কিছু না বলেই হাঁটতে শুরু করে দিল। মেয়েটার মাথায় বোধ হয় ছিট আছে।’

রোহিণী দমে গেল খবরটা শুনে। যাও বা একটা কাজের মেয়ে পাওয়া গেল, একদিনেই ভেগে পড়ল।

‘সঙ্গে করে কিছু নিয়ে যেতে দেখলে?’

‘না, খালি হাতেই তো গেল। তবে লুকিয়ে কিছু নিয়েছে কিনা জানি না।’

থলি থেকে চাবি বার করে রোহিণী দরজা খুলল। ‘আচ্ছা।’

মুখের হাসি মিলিয়ে যাবার আগেই সে দরজার পাল্লা বন্ধ করে দিল।

অন্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে রোহিণী চোখ বন্ধ করল। সারা দিন নয়, যেন সারা জীবন ঘুরে এসে এখন সে চটপট হিসেব—নিকেশ করে ফেলার কাজে ব্যস্ত। অনেকগুলো বছর পিছিয়ে না গেলে এখনকার এই অবস্থাটা কেন হল, তার ফর্দ তৈরি করা যাবে না। তবে একটা জিনিস এখনও তার অটুট আছে, তার মূলধন, তার দেহ। এটা পাঁচ মিনিট আগেও পরীক্ষিত হয়েছে। কিন্তু এই দেহই তাকে এখন এই অন্ধকার জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখল।

চোখ সরে যেতে সে মেঝেয় ঘষে পা বাড়াল। ডাইনিং স্পেস, ডান দিকে খাওয়ার টেবল। সোজা গেলে শোয়ার ঘর, বাঁ দিকেও একটা ঘর, যেটা ফাঁকাই পড়ে আছে। টেবলটার পাশে রান্নাঘর আর কলঘর। অনাবশ্যক আসবাব একটিও নেই। রোহিণী হোঁচট না খেয়ে সুইচ বোর্ডের কাছে পৌঁছল।

উত্তরের জানলাটা খোলা। অন্ধকারের ফ্রেমের মধ্যে চৌকো একখণ্ড সাদা ক্যানভাসের আভা। অনেকটা কুয়াশার মতো, যা ভোরবেলায় মাঠের দু—হাত উপরে জমাট হয়ে থাকে। ঝাপসা সাদা ছায়ার পিছনে ছমছম করা রহস্য স্থির হয়ে রয়েছে। ক্যানভাসটায় রয়েছে একটা কৃষ্ণচূড়া, যে নিষ্পত্র ডালগুলো দিয়ে লজ্জা ঢাকার কাজে ব্যর্থ হয়ে রাস্তার ইলেকট্রিক বাতির সামনে অপ্রতিভ অবস্থায়। রোহিণী আচ্ছন্নের মতো জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল। অনেক কিছুই তার মনে পড়ে যাচ্ছে।

কলিং বেল বেজে উঠল। সুইচ টিপে ডাইনিংয়ের আলো জ্বালিয়ে সে একনজর জায়গাটায় তাকাল। চারটে ঠোঙা আর কিছু রেজগি টেবলে রয়েছে, যা সকালে ছিল না। চঞ্চলা তাহলে জিনিস কিনে দিয়েই কাজ ছেড়েছে। মেয়েটা বিশ্বাসী আর খাটিয়ে ছিল। চলে গিয়ে লোকসানই হল।

আবার বেল বাজল। লোকটা যে নাছোড়বান্দা টাইপের, এটা সে বহুদিন আগেই বুঝে গেছে। এখন বরফ এনেছে আর সেই বরফ পায়ে ঘষে দেবার জন্য বায়না জুড়বে। ব্যাটার বড্ড নোলা, এবার শাস্তি দিতে হবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে রোহিণী ঊর্ধ্বাঙ্গ মুচড়ে কার্ডিগানটা থেকে নিজেকে বার করতে করতে এবং অন্যমনস্কতার জন্য শাড়ি যাতে বিস্রস্ত হয়ে কিছুটা বেআব্রু করে দেয় সেদিকে লক্ষ রেখে, সে দরজার আই হোলে চোখ রাখল।

যা ভেবেছিল তাই—ই, কিন্তু পেছনে গম্ভীর মুখে মেয়েও দাঁড়িয়ে। হাঁফ ছেড়ে কার্ডিগান আবার শরীরে সেঁটে নিয়ে রোহিণী দরজার অর্ধেকটা খুলল। তুষার দত্ত কিছু বলার আগেই সে তার হাত থেকে আইসব্যাগটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওহ এনেছেন; দিন। ভালোই হল। ধন্যবাদ।’

সে দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছে তখন তুষার দত্ত ব্যস্ত হয়ে, ‘দাঁড়ান দাঁড়ান’ বলে মেয়ের দিকে তাকালেন।

‘আন্টি, আপনার তো আজ রান্না হয়নি।’

‘দেখতে হবে মেয়েটা কিছু রেঁধে রেখেছে কিনা।’

‘মা বলল, আপনার যদি অসুবিধা না হয় তো আমাদের সঙ্গে খাবেন।’

‘মানে আমিই বললুম যে, ওনার কাজের মেয়েটা তো চলে গেছে—’

বাপ আর মেয়ের মধ্যে চাহনির একটা জ্বলন্ত সংঘর্ষ ঘটে গেল। তার স্ফুলিঙ্গ নিভে যাবার আগেই রোহিণী বলল, ‘আচ্ছা, আমি আগে দেখি নিই রেঁধে রেখেছে কিনা।’

দরজা খুলে রেখেই সে রান্নাঘরে এসে আলো জ্বালল। সকালে মাজা বাসনগুলো গ্যাসবার্নারের পাশে উপুড় করে রাখা, রান্না হয়েছে এমন প্রমাণ কোথাও নেই। রুটিও করে রেখে যায়নি। ফিরে আসতে আসতে দেখল, ওরা দু—জন ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকে দেখছে।

‘আরে, রেঁধে রেখেছে দেখছি!’ বিস্ময়টা একটু বেশি মাত্রায়ই হয়ে গেল, কিন্তু রোহিণী সেটা কমাবার চেষ্টা করল না। ‘ডিমের ঝুরি করতে বলেছিলাম, সেদ্ধ করে রেখেছে! ভালোই হল, ভাজাভুজি যত কম খাওয়া যায়—।’

দু—জনের মুখে হতাশা ফুটে উঠল। কিন্তু রোহিণীর এতে কিছু করার নেই। খিদেয় পেটের মধ্যে নাড়িভুঁড়ি কচলাচ্ছে, তবুও সে উপরের ফ্ল্যাটে যেতে ইচ্ছুক নয়। ওরা লোক ভালো, কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, একটু বেশি ভালো।

‘ডিম সেদ্দটা কী একটা খাওয়ার জিনিস হল। আপনাকে ধোঁকা আর মাছের ডিমের চাটনি খাওয়াব। চলুন চলুন।’ তুষার দত্ত হাত ধরে টানবার মতো ভঙ্গি করলেন। রোহিণী এক পা পিছিয়ে গেল।

‘না, রাত্তিরে আমি বেশি খাই না।’

‘ফিগার রাখার জন্য?’ তুষার দত্ত কোনোরকম রাক ঢাক না রেখেই রোহিণীর গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত চাহনির বুরুশ চালালেন। নন্দার চোখে যে সেটা এড়াল না, রোহিণী তা লক্ষ করে বলল, ‘ফিগার রাখাটা কী খুব দোষের বা অস্বাভাবিক কিছু?’

‘না না না, তা বলছি না—’

‘আপনার খিদে পায়নি তুষারবাবু?’ কোমল স্বরে রোহিণী জানতে চাইল।

‘নিশ্চয় পেয়েছে।’ প্রায় সগর্বে তুষার দত্ত ঘোষণা করলেন।

‘তাহলে খেতে যান।’

গম্ভীর মুখে রোহিণী দরজা বন্ধ করে দিল। উপরে গিয়ে টেলিফোন ধরা বা করার পথটাও এবার বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু ঘাড়েপড়া একটা ঝঞ্ঝাটে জড়ানোর থেকে দূরে থাকতে এটা করতেই হল। লোকটা যা মাথামোটা, তার প্রত্যাখ্যানটা বুঝতে পারল কিনা কে জানে! তবে নন্দা বুঝতে পেরেছে।

এবার কিছু একটা রান্না করে খেতে হবে। চঞ্চলা ডিম, পেঁয়াজ, মুসুর ডাল, আর সকালের জন্য বিস্কুট কিনে রেখে গেছে। কাল গৌরীর মা না আসা পর্যন্ত জানা যাবে না, মেয়েটা কেন পালাল। ডিমের ওমলেট না শুধুই সেদ্ধ, কোনটা তাড়াতাড়ি করা যাবে? সেকেন্ড পাঁচেক ভেবে নিয়ে রোহিণী বাটিতে জল দিয়ে তিনটে ডিম সেদ্ধ করতে বসাল। সকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট ক্যালোরি এর থেকে পাওয়া যাবে।

কিবা শীত, কিবা গ্রীষ্ম, রাতে শোয়ার আগে রোহিণীর স্নান করার অভ্যাস। ডিম সেদ্ধ হবার আগেই সে শরীরকে যাবতীয় আবরণ থেকে রেহাই দিয়ে অন্ধকার শোবার ঘরে ম্যাক্সিটা খুঁজতে শুরু করল। চঞ্চলা কোথাও তুলে রেখেছে। ঘরে না পেয়ে নগ্ন অবস্থাতেই সে ডাইনিংয়ে এল। বন্ধ জানলাটার দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল। শোবার ঘরে উত্তরের খোলা জানলা দিয়ে শুধু মাঠ আর কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা যাচ্ছে। ওদিক থেকেও সে নিশ্চিন্ত। একা একটা ফ্ল্যাটে থাকার জন্যই তার দেহ সম্পর্কিত জড়তা ভেঙে গেছে। নগ্ন হয়েই বহুরাতে সে ঘুমিয়েছে, ঘুম ভেঙে ভোরে কলঘরে গেছে, ব্যায়াম করেছে এবং গৌরীর মা আসার আগে সায়া—শাড়ি পরেছে। একটা হালকা স্বাচ্ছন্দ্য আর অনাস্বাদিত মুক্তির আনন্দ সে পায়, যতক্ষণ নিরাবরণ হয়ে একা থাকে।

তন্ন তন্ন করে সে সারা ফ্ল্যাট খুঁজল। দুশো টাকা দিয়ে কিনে বোম্বাই থেকে দিদি চার মাস আগে ম্যাক্সিটা পাঠিয়ে দিয়েছিল। এটা পরে সে নীচের কল থেকে বালতিতে জল তুলে এনেছে, যখন পাওয়ার কাটের জন্য পাম্প না চলায় ট্যাঙ্কে জল ছিল না। উপরে উঠে ফোনও ধরেছে এবং নন্দা ফিসফিস করে তখন অনুরোধ জানায় তার জন্যও একটা আনিয়ে দিতে। জিনিসটা তার খুব প্রিয়, খুঁজে না পেয়ে তার বিরক্তি চরমে উঠল। খাটে বসে সে হতাশ হয়ে ডাইনিং থেকে আসা আলোয় ঘরের মধ্যে যতটা সম্ভব দেখার জন্য এধার—ওধার তাকিয়ে আয়নায় নিজের আবছা মূর্তিটা দেখে চমকে গেল।

ঠিক এইভাবেই! দোতলার খড়খড়ির জানলাটা খোলা ছিল। নিমগাছটার উপর দুপুরের রোদ ঝরছিল। পাতাগুলো গনগনে তাত শুষে নিয়ে কোমল হালকা আলো পাঠিয়ে দিচ্ছিল ঘরে। সেকেলে বিরাট ঘরের ভারী কড়িবরগার উঁচু ছাদ আর সাদা—কালো বরফি কাটা মার্বেলের মেঝের মধ্যবর্তী শূন্যতায় সেই আলো স্তরে স্তরে ভাগ হয়ে। ‘এই আলোটা আমার পছন্দ।’ শোভনেশ বলেছিল। জানলার কাছে কালো চামড়া—মোড়া পুরনো ভারী ডিভানে বসেছিল রোহিণী। ‘এইবার কাপড়চোপড়গুলো খুলে ফ্যালো।’ বিষাক্ত সাপ দেখে ভয় পাওয়ার মতো সে দাঁড়িয়ে উঠেছিল। ‘সে কী?’ বিশ্বাস করতে পারছিল না শোভনেশের কথা। ‘তাতে কী হয়েছে! এখানে শুধু তুমি আর আমি, বাইরের কেউ তো দেখতে পাবে না। তাড়াতাড়ি করো।’ শেষ দিকে কঠিন হয়ে গেছল শোভনেশের স্বর, প্রায় আদেশের মতো। রোহিণী জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। নিমগাছটা বাড়ির বাগানের মাঝামাঝি, তার দু—পাশে বাড়ির দুটো অংশ, যেখানে অন্য শরিকরা থাকে এবং গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যার প্রায় কিছুই দেখা যায় না। তিনতলায় জানালার সবগুলোই বন্ধ, তবে খড়খড়ির একটি দুটি পাখি খসে গেছে। এই জানালাগুলো কখনো সে খোলা দেখেনি। ছাদে লোক নেই। কেউ দেখতে পারে না ঠিকই কিন্তু সেজন্য নয়, রোহিণী কখনো কোনোদিন কারোর সামনে বিবসনা হয়নি। তার মন কিছুতেই সায় দেয়নি এই প্রস্তাবে। হোক না সেটা স্বামীর বা খ্যাতনামা কোনো আর্টিস্টের। ‘কী হল, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’ শোভনেশ অধৈর্য, বিরক্ত হয়ে গলা চড়ায়। ‘না আমি পারব না, ন্যুড হয়ে মডেল সাজা আমার দ্বারা হবে না।’ রোহিণী বন্ধ দরজার দিকে এগোয়। ড্রইং বোর্ডে সাঁটা কাগজের সামনে পেনসিল হাতে শোভনেশ দাঁড়িয়ে ছিল। প্রায় দশ কদম ছুটে এসে সে রোহিণীর দুটো কাঁধ সাঁড়াশির মতো আঙুলে চেপে ধরে ঠান্ডা গলায় বলে, ‘তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন?’ রোহিণী বলে, ‘শুধুই আমি করেছি? বিয়ে তো দু—জনে করেছি। কিন্তু তা কী এইভাবে মডেল হবার জন্য? এসব আমার দ্বারা সম্ভব নয়। যে তোমার সামনে কাপড় খুলত, তাকে ডেকে আন।’ এরপর শোভনেশ যা করল, রোহিণী তা কল্পনাতেও আনতে পারবে না। দু—হাতে ব্লাউজের গলা ধরে পড়পড় করে ছিঁড়ে দিয়ে শোভনেশ তাকে ঠেলতে ঠেলতে ডিভানের কাছে এসে ধাক্কা দেয়। রোহিণী চিত হয়ে পড়তেই সে শাড়ি ধরে টান দিয়ে খুলতে শুরু করে। আকস্মিকতার ধাক্কা কাটিয়ে রোহিণী পা ছোঁড়ে, সেটা শোভনেশের হাঁটুতে লাগে। সেই ফাঁকে ধড়মড়িয়ে উঠে সে দৌড়ে গিয়ে দরজার খিল খুলে তিনতলায় ছুটে আসে নিজের ঘরে। বিছানায় বসে হাঁফাতে হাঁফাতে পাশে তাকাতে চোখ পড়ে আয়নায়।

ঠিক এইভাবেই সেদিন সে বসেছিল।

কলিং বেল একবার টুং করে বেজেই থেমে গেল। রোহিণী অবাক হল এবং অস্বস্তি বোধ করল। আবার! এত রাতে? কে হতে পারে? অপেক্ষায় রইল আবার বেজে ওঠার। একটা কিছু গায়ে চাপাতে হবে। ছেড়ে রাখা শাড়িটাই টেনে নিল।

ডিম অনেকক্ষণ সিদ্ধ হচ্ছে। বেশি শক্ত হলে খেতে বিশ্রী লাগবে। শাড়িটা জড়িয়ে রান্নাঘরে এসে বার্নার নিভিয়ে সে বেল বাজার জন্য আবার অপেক্ষায় রইল।

আর বাজছে না। এবার সে কৌতূহলী হয়ে পড়ল। এত রাতে তুষার দত্ত বাঁদরামো করবে না। তাহলে কে? পায়ে পায়ে দরজায় এসে আই হোলে চোখ রাখল। ফাঁকা সিঁড়ি, দেওয়াল। একটা লোকও নেই।

দরজা খুলে উঁকি দিল। তারপর নীচের দিকে চোখ পড়তেই হতভম্ব হয়ে বলে উঠল, ‘একি!’

তার খুঁজে না—পাওয়া ম্যাক্সিটা পাট করা অবস্থায় দরজার গোড়ায়। হৃৎপিণ্ডের ধড়ফড়ানিটা কমল, একটা বড়ো শ্বাস বেরিয়ে এল এবং ঠোঁট মুচড়ে হাসি ফুটল। এ কাজ অবশ্যই নন্দার। বেচারা লোভ সামলাতে পারেনি, বিবেকটাও। এখানকার সব ফ্ল্যাটেরই সদর দরজার লকটা এমনই ঝঞ্ঝাটের যে, বন্ধ করলে শুধু ভিতর থেকেই নব ঘুরিয়ে খোলা যায়। বাইরে থেকে দরজা খুলতে হলে চাবি চাই—ই। যদি ভিতরে কেউ না থাকে এবং চাবি সঙ্গে না নিয়ে তখন কেউ বাইরে আসে এবং দরজাটি যদি তখন বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সমূহ বিপদ। হয় দরজা ভেঙে ঢুকতে হবে কিংবা পাইপ বা কার্নিস বেয়ে বারান্দা দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা খুলতে হবে নয়তো চাবিওয়ালা ডেকে চাবি বানিয়ে দরজা খুলতে হবে। এর প্রত্যেকটাই সময়সাপেক্ষ এবং ঝঞ্ঝাটের।

রোহিণী এখানে আসার পর একবার এইরকম ঘটনা ঘটেছিল। তার সামনের ফ্ল্যাটে বাসকারী এক তামিল দম্পতি, শ্রীনিবাসনরা চাবি সঙ্গে নিতে ভুলে গিয়ে সন্ধ্যায় বেরিয়েছিল। ভিতরে কেউ ছিল না। রাত্রে ফিরে বিপদে পড়ে। বিপদে রোহিণীও পড়ে, রাতের মতো তার ফ্ল্যাটে ওদের অতিথি হয়ে থাকতে বলে। একটিমাত্র বিছানা এবং মশারিও একটি। শ্রীনিবাসনরা শান্ত, ভদ্র, উচ্চচশিক্ষিত। রোহিণীর অসুবিধে বুঝে তারা রাতের মতো বেলেঘাটায় বন্ধুর বাড়িতে চলে যেতে চেয়েছিল। তাদের নিরস্ত করে সে উপরে যায়।

শোনামাত্র তুষার দত্ত খুশিতে টগবগিয়ে ওঠে।

‘দরজাটা ভেঙে দিলেই তো হয়, কিছু ভাববেন না, আমি ভেঙে দিচ্ছি।’

‘সে কী। দরজা ভাঙবেন?’

‘কেন আমি কি পারি না ভেবেছেন?’ খুবই উত্ত্যক্ত দেখাচ্ছিল তুষার দত্তকে। ‘শাল কাঠের তক্তা মাথা দিয়ে ভেঙেছি, লোহার পাটি দাঁতে চেপে দু—হাতে পাকিয়ে পাকিয়ে বিড়ে বানিয়েছি আর এ তো প্লাইউডের একপাল্লার দরজা! কাঁধ দিয়ে একটা ছোটো পুশ করব দেখবেন মড়াত করে একটা আওয়াজ হবে শুধু।’

‘দরজাটা রিপ্লেস করার টাকা দেবে কে?’

তুষার দত্ত গোলমালে পড়ে যায় রোহিণীর কথার টানে বাস্তব ভূমিতে নেমে এসে। চার—পাঁচ শো টাকা তো কম করে লাগবেই। তার পেশির বর্ম দুর্ভেদ্য হতে পারে কিন্তু টাকাপয়সা হিসাবের মল্লযুদ্ধে তুষার দত্ত সহজেই কুপোকাত হয়।

‘জানি, আপনি মড়াত কেন, পটাস করে দরজা ভাঙতে পারবেন কিন্তু আপনাকে এত রাতে আর কষ্ট করতে হবে না।’ রোহিণী প্রায় আবেদনই জানিয়েছিল। ‘মিসেস শ্রীনিবাসন আমার সঙ্গে থাকবেন, আপনি যদি মিস্টার শ্রীনিবাসনের একটু শোয়ার ব্যবস্থা করেন এখানে।’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়, এতবড়ো সোফাটা তাহলে আছে কীজন্য। মশারি না টাঙালেও চলবে, মশা মারার ধূপ জ্বালিয়ে দিচ্ছি।’

ইংরেজির মতো বেশ ভালোই বাংলা বলতে পারে রজনী শ্রীনিবাসন। রাতে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে রোহিণী এই শীর্ণকায়া তামিল বউটির সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারে সে বি—কম, স্বামীর অফিসেই স্টেনোগ্রাফার আর সেই মাল্টি ন্যাশনাল সংস্থায় অ্যাকাউন্টসের একটা বিভাগের কর্তা কৃষ্ণমাচারি শ্রীনিবাসন। ফ্ল্যাট ভাড়ার এগারোশো টাকা দেয় অফিসই। ‘চাকরি না করলেও চলে, কিন্তু করবে না কেন, যদি আয় বাড়িয়ে কমফর্ট আর সিকিউরিটি বাড়াতে পারি। এখন ছেলেমেয়ে নেই, কিন্তু হবে তো। মেয়ের বিয়ের জন্য, আমাদের ব্রাহ্মণদের, অনেক টাকা লাগে।’ কোয়েম্বাটোরের মাঝারি সরকারি অফিসার রজনীর বাবা দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে জামাই সংগ্রহ করেছেন। ‘খুব সস্তাতেই বলতে হবে।’ রজনী আপ্লুত হয়ে বলেছিল। তখন রোহিণী মনে মনে ভেবেছিল, এই ফ্ল্যাট ভাড়া দিলে গঙ্গাদা এগারোশো টাকা মাসে মাসে পেতেন। তার জন্যই পাচ্ছেন না। সে কৃতজ্ঞ থাকল।

পরদিন সকালেই তুষার দত্ত চাবিওয়ালা ডেকে আনে। তখন একটা পরামর্শ সে রোহিণীকে দেয়: ‘দুটো চাবির একটা ফ্ল্যাটের বাইরে কোথাও রাখুন, তাহলে এইরকম দুর্ভোগে পড়তে হবে না।’

‘কোথায় রাখব?’

‘আমার কাছে রাখতে পারেন, অবশ্য যদি বিশ্বাস করেন।’

‘না না অবিশ্বাসের কী আছে। আমার চুরি করার মতো দামি জিনিস কিছুই নেই।’

.

একটা চাবি সে তুষার দত্তর বউয়ের হাতে দিয়ে এসেছিল। কিন্তু তারপর থেকে তার মনের গভীরে একটা অস্বস্তি মাঝে মাঝে খচখচ করে। সে কোথায় যেন অনাবৃত, অনিরাপদ হয়ে রয়েছে। যেকোনো সময় তার জীবনের ঢিলেঢালা গোপনীয়তা আক্রান্ত হতে পারে, ব্যক্তিগত অংশের অনেকটাই যেন হারিয়ে গেল। তার ব্যক্তিত্ব যেন এখন থেকে অন্যের হাতে কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে।

সেদ্ধ ডিম খেতে খেতে রোহিণী ভাবল, চাবিটা উপর থেকে চেয়ে এনে রজনীর কাছে রাখলে কেমন হয়! ওরা দু—জনে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসে। দিনের বেলায় তো চাবির দরকার পড়বে না। নন্দার ভীষণ কৌতূহল আন্টির ব্যক্তিগত জীবন জানার জন্য। হয়তো ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে ফ্ল্যাটে ঢোকে। এটা ওটা ঘাঁটে।

আইসব্যাগ থেকে কিউবগুলো বার করে বাটিতে রেখেছিল। কিছুটা গলেছে। বাটি তুলে চুমুক দিয়ে জলটুকু খেয়ে সে স্নান করতে গেল। পশ্চিমে ছোটো বারান্দা, শোবার ঘর দিয়ে সেখানে যেতে হয়। অন্তর্বাসগুলো জলকাচা করে বারান্দার রেলিংয়ে মেলে দিয়ে সে রোজ যা করে না, বারান্দার দরজাটা আজ বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াবার সময় ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে তার মনে হল, মেয়েদের বসবাসের জায়গা যতটা ছিমছাম পরিচ্ছন্ন হওয়া উচিত, ঘরটা মোটেই সেরকম অবস্থায় নয়। এতটা অগোছালো হয় না যদি দিন—রাতের জন্য কাজের লোক থাকত। একটু গুছিয়ে নিলে ভালো হয়। কিন্তু এখন আর শরীর বইছে না। চঞ্চলা মেয়েটা ঠিক কেন যে পালাল, কাল গৌরীর মা—র কাছ থেকে সেটা জেনে নিতে হবে।

কালকের জন্য আর কী কী করণীয় কাজ রইল? চিরুনি থেকে কয়েকটা চুল টেনে বার করে রোহিণী জানালায় গেল। ফুঁ দিয়ে আঙুল থেকে চুল উড়িয়ে জানলার পাল্লা বন্ধ করল। বিছানায় মাথার কাছেই জানালাটা, শীতকালে খুলে রাখলে ঠান্ডা লেগে যাবে। কিন্তু সব ঋতুতেই ঘরের জানালা খুলে সে বাইরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

বাবাকে মনে পড়লেই ছোটোবেলার অনেক কথা, ঘটনা তার স্মৃতিতে জেগে ওঠে। মেয়েদের ইংরাজি বলা—কওয়া শেখানোর জন্য তাঁর চিন্তার আর শেষ ছিল না। রেডিয়োয় রাত ন—টার ইংরেজি খবর শোনা বাধ্যতামূলক ছিল। দুই বোনকে পুজোর অঞ্জলি দেবার ভঙ্গিতে রেডিয়োর সামনে বসতে হত, শুধু ইংরেজি উচ্চচারণ শেখার জন্যই নয়, পৃথিবীতে রোজ কত ঘটনা ঘটছে ওয়াকিবহাল থাকার জন্য। ‘শিক্ষিত লোকেদের সঙ্গে তা না হলে কথা বলবে কী করে? হাঁদা গ্র্যাজুয়েট হয়ে লাভ কী?’ খবর শেষ হলে বাবা ইংরেজিতে প্রশ্ন করতেন, ইংরেজিতেই উত্তর দিতে হত। অর্ধেক শব্দের মানেই বুঝত না রোহিণী, কিন্তু সোহিনী চমৎকার গুছিয়ে মেমসাহেবদের মতো উচ্চচারণে বলে দিত। বাবার চোখমুখ তখন জ্বলজ্বল করে উঠত গর্বে। ‘আমার এই মেয়েটারই হবে।’ কী হবে সেটা অবশ্য আর বলতেন না।

ইংরেজি খবরের পর, সাড়ে ন—টার মধ্যে শোওয়া আর ঠিক পাঁচটায় ঘুম থেকে ওঠা। তারপর পার্কে গিয়ে দৌড়ানো। বাবা হাঁটতেন জোরে জোরে, ডায়াবিটিস ছিল। ক্লাস এইটে পড়ার সময় স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য রোহিণী প্রথম গল্প লিখে বাবাকে দেখায়, একটা ভিখারি মেয়ের ধনীগৃহে ভিক্ষা চাইতে গিয়ে তার লাঞ্ছনা ও অপমান ছিল বিষয়। বাবা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার এই মেয়েটার ট্যালেন্ট আছে।’

মশা যেন আজ কমই মনে হচ্ছে। ঘরের আলো নিভিয়ে সে টেবল—ল্যাম্প জ্বালাল বেড সুইচ টিপে। খবরের কাগজটা নিয়ে বেডকভার সরিয়ে বিছানায় শুলো। মশারিটা আর টাঙাতে ইচ্ছে করছে না। বেডকভার দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢেকে সে কাগজটা খুলে আবার সেই ছোটো খবরটায় চোখ রাখল।

গঙ্গাদা কাল সকালে বাসুদেবপুর থেকে ফিরে খোঁজ নেবেন। হয়তো রাইটার্সে যাবেন। যদি জেলভাঙা লোকটা সত্যিই শোভনেশ হয়, তাহলে? তিরিশ—চল্লিশ লাখ লোকের শহরে একজনকে খুঁজে বার করা সহজ নয় ঠিকই, কিন্তু গঙ্গাদাকে খুঁজে বার করতে তো ওর এক মিনিটও সময় লাগবে না। বাড়ি চেনে, অফিসও চেনে। গঙ্গাদা বলেছেন, তিনি কোনোরকম হদিশ দেবেন না, বরং পুলিশে ধরিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু অফিসের অনেকেই তার এই ফ্ল্যাটের ঠিকানা জানে। তাদের কারোর কাছ থেকে তো জেনে নিতে পারবে। শোভনেশ তার সন্ধান পাবে অথবা পাবে না, এই উৎকণ্ঠাটাই সবথেকে ভয়ংকর। সারাক্ষণ কুরবে, মুহূর্তের জন্যও তাকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।

‘যদি আপনি জানতেন, ওর মডেল মৃত বীণা চ্যাটার্জির সঙ্গে ওর দৈহিক সম্পর্ক আছে, তাহলে কী আপনি শোভনেশ সেনগুপ্তকে বিয়ে করতেন?’

‘না।’

এক সেকেন্ডও ভাববার জন্য সময় নেয়নি রোহিণী। উকিলের নয়, শোভনেশের মুখের দিকে চোখ রেখে সে জবাব দিয়েছিল কঠিন স্বরে।

‘কেন বিয়ে করতেন না? উনি তো ভারতখ্যাত আর্টিস্ট, ওনার ছবি তো বহু টাকায় বিক্রি হয়।’

‘হতে পারে, কিন্তু চরিত্রহীন লোকেদের আমি ঘৃণা করি।’ রোহিণী তখন দেখেছিল, তার কথা শুনেই দপ করে জ্বলে ওঠে শোভনেশের চোখ। হাত মুঠো করে বীভৎস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করতে থাকে। সে ভয় পেয়েছিল। মনে হয়েছিল, কোর্ট ঘরটা যদি জনশূন্য হত শোভনেশ তাহলে ছুটে এসে তার গলা টিপে ধরত। ত্রাসের চাপেই সে একসময় জেরার মুখে বলে, ‘হ্যাঁ, আমার মনে হত, উনি আমাকেও গলা টিপে মারতে পারেন—একবার চেষ্টাও করেছিলেন।’

‘কেন করেছিলেন?’

কোর্টকে তা জানাবার আগে রোহিণী দেখেছিল, শোভনেশ দু—হাতের ফাঁদে আঙুলগুলো একটা অদৃশ্য গলায় জড়িয়ে, পিষে, ক্রমশই কঠিন করে ঝাঁকাচ্ছে।

মাথার মধ্যে উত্তাপ জমে উঠলে যা হয়, রোহিণীর চোখ থেকে ঘুম ছুটে পালাল। সে জানে, এখন আর ঘুমকে তাড়া করে ধরা যাবে না। সে জানে, কেননা এমন অশান্ত, উত্তেজক রাত সে বহুবার যাপন করেছে, এখন স্মৃতির দরজা খুলে তাকে ঢুকতে হবে একটা সুড়ঙ্গে। দু—ধারে সার দেওয়া ঘর। হাঁটতে হাঁটতে সে ঠিক করবে কোন ঘরটায় ঢুকবে। ঘরে ঘরে আলাদা আলাদা ঘটনা। আজও তো ঘটেছে অনেক কিছু। সেগুলোও নিশ্চয় কোনো ঘরে জমা হয়েছে, ভবিষ্যতে কোনো এক রাতে সেখানে সে ঢুকবে।

রোহিণী খবরের কাগজটা মেঝেয় ফেলে দিল। বেড সুইচ টিপে আলো নেভাল। জানলা দিয়ে বাইরের আলো এসে আবছা করেছে সিলিং।

ছ—বছর আগের একটা ঘরের সামনে থমকে গিয়ে সে ভিতরে ঢুকল।

.

ওল্ড বালিগঞ্জে হিমালয়ান পেইন্টসের গেস্ট হাউসের বিশাল অ্যাপার্টমেন্টে জামাইবাবু ককটেলে ডেকেছিল জনা চল্লিশ গণ্যমান্যকে। দোতলায় নীচু পাঁচিলঘেরা ছাদে সবাই জমায়েত। একদিকের দেওয়ালে ছ—সাতটা চীনা লণ্ঠনের টিমটিমে আলো ছাদটাকে আধো—অন্ধকার করে রেখেছে। টবের গাছে জোনাকির মতো হলুদ, নীল, টুনি জ্বলছে। উর্দিপরা বেয়ারারা কাবাব, চিজ, মাংসের শিঙাড়া, কাজুবাদাম আর সোডা, বরফ, রাম ও স্কচ হুইস্কির গ্লাস সাজানো ট্রে হাতে ঘুরছিল। হিমালয়ান পেইন্টসের কলকাতা অফিসের নানান স্তরের কর্তারা ছাড়াও ছিল সাংবাদিক, কবি, ছবির সমালোচক, ফিল্ম পরিচালক, ছবি আঁকিয়ে, ব্যবসায়ী এবং আরও কিছু লোক।

শোভনেশের ছবির প্রদর্শনীর সফল সমাপ্তির জন্য তার স্পনসরের দেওয়া পার্টি।

রঞ্জন আর সোহিনী অতিথিদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে, যাদের কাউকেই প্রায় তারা চেনে না, হেসে হেসে, বহুকালের পরিচিত এমন মুখ করে আলাপ করে যাচ্ছিল। একদিকের পাঁচিলের ধারে আলো কম, ছায়া ছায়া একটা কোণে রোহিণী একা দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে ছিল টোম্যাটো জ্যুসের গ্লাস।

সকালেই মেধাকে শান্তিনিকেতন দেখার জন্য দিদি সেখানে তার এক বন্ধুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। দুদিন থেকে আসবে। মদ—টদ খেয়ে অনেকেই বেসামাল হয়ে বিশ্রী পরিস্থিতি তৈরি করে। যদিও সেসব ঝঞ্ঝাট সামলানোর জন্য লোক মজুত থাকে, তবু দিদি একদমই চায় না ছোটো ছেলেমেয়েরা এই ধরনের পার্টিতে থাকুক।

‘একা কেন?’

সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল শোভনেশ। রোহিণী একটু অপ্রতিভ হয়। যার জন্য আজকের অনুষ্ঠান, সেই লোকটি একধারে একা—দাঁড়ানো—হোস্টের শালি ছাড়া পরিচয় দেবার মতো কিছুই নেই—এমন একজনকে আলাপ করার জন্য বেছে নেওয়ায় সে কৃতার্থ বোধ করে। প্রদর্শনীতে ছবিটা তার হাত থেকে পড়ে যাওয়ার ঘটনাটা মনে তখনও টাটকা।

‘কাউকেই চিনি না জানি না, এই বেশ আছি।’ রোহিণী দুর্বল স্বরে কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে বলে।

‘সে কী! বিখ্যাত বিখ্যাত লোক সব এরা। চলুন আলাপ করিয়ে দিই।’ এই বলে রোহিণীর বাম বাহু মুঠোয় ধরে আকর্ষণ করে শোভনেশ।

‘না না।’ রোহিণী আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘আমার দরকার নেই আলাপ করে। হোস্টের শালি এই পরিচয়ে এঁদের সঙ্গে কথা বলে খুব স্বস্তি পাব না।’

শোভনেশের আঙুলগুলো জড়িয়ে রয়েছে তার বাহু। হয়তো ইচ্ছে করেই, কিন্তু রোহিণীর মনে হল ইচ্ছে করে নয়। পার্টি এখন প্রাথমিক স্তর ছাড়িয়ে ওঠার পথে। ছোটো ছোটো জটলায় ভাগ হয়ে গেছে এক—এক ধরনের মানসিকতার গণ্ডি। শুরুতে মৃদু নম্র কণ্ঠে যারা কথা বলছিল এখন তাদের গলা চড়ছে। বিলম্ব করে যারা গ্লাস মুখে তুলছিল, এখন তারা একটু ব্যস্ত হয়ে ট্রে থেকে ভরা গ্লাস তুলে খালি গ্লাস রাখছে।

‘আপনার দেবার মতো পরিচয় নিশ্চয় আছে, আর সেটা মুখে বলার দরকার হয় না। আপনি আপাদমস্তক একটি মেয়ে, এটাই সেরা পরিচয়।’

জবাব না দিয়ে রোহিণী স্মিতমুখে চুমুক দিল রসে। ‘আপনি কী খাচ্ছেন?’ শোভনেশ জানতে চায়। ‘টোমাটোর রস বোধহয়! কোনো মানে হয়?’

রোহিণী বুঝে ওঠার আগেই শোভনেশ তার গ্লাস থেকে খানিকটা হুইস্কি রসের মধ্যে ঢেলে দিল।

‘আগে কখনো খাননি তো?’

‘না।’ বিমূঢ় হয়ে গেছিল রোহিণী।

‘তাহলে আমার অনুরোধে আজ খাবেন।’

শোভনেশের স্বরে খানিকটা আবদার, খানিকটা অনুরোধ, খানিকটা হুকুম, ঘনভুরুর ছাউনির নীচে জ্বলজ্বলে চোখ, সাদা অসম্মান দাঁত এবং দীর্ঘ দেহটিকে সামনে ঝুঁকিয়ে ঝোড়ো চুলের মাথাটা তার মুখের কাছে রাখা। রোহিণীর আপত্তি অসাড় হয়ে গেছিল। সে গ্লাস তুলে চুমুক দেয়। একটু তেতো স্বাদ ছাড়া সেই রসের আর কিছু বদলায়নি।

‘ভালো মেয়ে।’ শোভনেশ তারিফ জানায় আর রোহিণীর মাথায় আলতো টোকা মারে, বন্ধুর মতো। ‘এইবার চোঁ চোঁ করে শেষ করে দিন।’

রোহিণী তাই করেছিল বলামাত্র। ‘আর একটা আপনার জন্য আনি, ধরুন এটা।’ শোভনেশ তার গ্লাসটা রোহিণীর হাতে গচ্ছিত রেখে চলে গেল এবং ফিরে এল দুটো গ্লাস হাতে। টোম্যাটোর রস আর নিজের জন্য হুইস্কি।

‘দিন গ্লাসটা আর এটা ধরুন।’

হুইস্কির গ্লাস তার সামনে এগিয়ে ধরা। সভয়ে রোহিণী প্রথমেই ভিড়ের দিকে তাকিয়ে দিদিকে খুঁজল। একবার যদি দেখতে পায়, তাহলে এই বয়সেও তাকে চড় খেতে হবে। তার হাতে ধরা শোভনেশের আধ—খাওয়া গ্লাসটা ছাদের পাঁচিলে রেখে চাপা স্বরে সে বলল, ‘না, সরিয়ে নিন।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, এই দেখুন।’ গ্লাসে খানিকটা টম্যাটোর রস ঢেলে লাল করে দিয়ে শোভনেশ বলল, ‘ককটেল! কেউ আর বুঝতে পারবে না।’

‘না।’

কয়েক টন ওজনের দৃঢ়তা একটি শব্দের মধ্যে বোঝাই করে রোহিণী কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকে। দিদির ভয়ে নয়। কেউ তাকে বাধ্য করবে, তা যতই মজা করে বলুক না কেন, এটা সে মন থেকে মানতে পারে না। তার ব্যক্তিত্বকে অগ্রাহ্য করে কেউ যদি ধরে নেয়, যা বলব তাই সে মানবে, তাহলে ভুল করবে।

শোভনেশও তাকিয়ে থেকেছিল তার চোখের দিকে, অবাক হয়ে। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড এইভাবে ওরা ছিল। রোহিণী তার অপলক কাঠিন্য নরম করেনি। শোভনেশের চাহনিতে কিন্তু ক্রমশ প্রীতিভরা তারিফ ফুটে ওঠে। কথা না বলে সে প্রায় ছুটে গিয়ে আর একটা টোম্যাটো রস নিয়ে এসে এগিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে, ‘নাও।’

রোহিণীর গ্লাসধরা মুঠিটা শোভনেশ চেপে ধরে রেখেছিল কিছুক্ষণ। ‘নিন’ না বলে ‘নাও’, রোহিণীর কাছে সম্বোধনের এই বদলটা এড়াল না। ধীরে ধীরে তার চোখ নরম হয়ে আসে। ঠোঁটে হাসি ফোটে।

‘একটু ঢেলে দিন।’ সে গ্লাস এগিয়ে দেয়। শোভনেশ মাথা নাড়ে অসম্মতি জানিয়ে, বলে, ‘তোমার ছবি আমি আঁকব!’

শোভনেশ পিঠে হাত রাখল। রোহিণীর তখন মনে হয় নাতিগরম সেঁকের মতো হালকা চাঞ্চল্যকর একটা অনুভব তার শরীর স্পর্শ করেছে। হাতটা পিঠ থেকে নীচে নামছে তার দেহের কোমল বর্তুলতা জরিপ করতে করতে। শোভনেশের লম্বা হাত যতদূর নীচে নামতে পারে ততটাই পৌঁছে নিতম্বের উপর সফর করে আবার একইভাবে ঘাড় পর্যন্ত উঠে এল।

রোহিণী প্রথমে এত অবাক হয়ে পড়ে যে, হাতটা ঠেলে সরিয়ে দেবে, বা নিজেকে সরিয়ে নেবে, দুটোর কোনোটাই করতে পারল না। বাবা মারা যাবার পর তার দেহে এমন নিশ্চিন্তে কোনো পুরুষ হাত দেয়নি। বিক্ষুব্ধ কোনো প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে ঘটল না। মেয়েদের প্রকৃতিদত্ত বোধ থেকেই সে বুঝেছে হাতটা নোংরা নয়। তার দেহকে এই হাত অসম্মান করছে না।

‘অ্যাভারেজ বাঙালি মেয়ের তুলনায় তুমি অনেক লম্বা। কত হাইট?’

‘পাঁচ—আট।’

‘মাই গড! ওজন?’

‘মাস ছয়েক নিইনি। আটান্ন থেকে ষাট কেজির মধ্যে বোধ হয়।’

‘ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স নিয়ে কৌতূহল যদিও খুব প্রবল, তবু প্রশ্ন করব না। অনুমান করে নিয়েছি।’

‘এবার কিন্তু আমার হাত থেকে গ্লাস পড়ে যাবে।’

‘গ্লাস তো ছবি নয়!’

‘দুটোতেই কাচ আছে, দুটোই ভঙ্গুর।’

‘কিন্তু ভঙ্গুরতার মধ্যেই তো আনন্দ রয়েছে। হুইস্কি বা টোম্যাটোর রস বা নিসর্গচিত্র কোনোটাই অদরকারি নয়। তুমি কোনটা বেছে নেবে?’

‘ছবিটাকে মানে নিসর্গচিত্রকে, আপনি কোনটা বাছবেন?’

‘তোমাকে।’

‘আপনি বোধ হয় একটু বেশি খেয়ে ফেলেছেন।’

ঠিক এই সময়ই বেঁটে এবং ভীষণ মোটা একটি লোক, রোহিণী যাকে ছবির প্রদর্শনীতে একটা চেয়ারে বসে থাকতে দেখেছিল, তাদের দিকে এগিয়ে এল। বরং বলা যায়, গড়িয়ে এল। পরনে খয়েরি স্যুট, হাতে গ্লাস।

‘ওরে ব্যাটা, তুই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ফুসুর ফুসুর চালাচ্ছিস আর—।’ লোকটি থেমে গেল। ফ্যালফ্যাল চোখে রোহিণীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এ তো আমার থেকেও লম্বা!’

‘আমার কলেজ—দিনের বন্ধু গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি, প্রেস আছে, দু—তিনটে ম্যাগাজিন আছে। গঙ্গা কী নাম রে সেগুলোর?’

গঙ্গাপ্রসাদ স্থিরভাবে দাঁড়াতে পারছিল না। জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেছে। চোখ বিস্ফারিত।

‘নাম দিয়ে কী হবে য়্যা, যে নামেই ডাক না কেন গোলাপকে—এই তো ইনি, এনার নাম কী আমি জানতে চেয়েছি?’

‘আমার নাম রোহিণী।’

‘গঙ্গা, আমি এর ছবি আঁকব।’

‘সে কী রে শোভু। তোর যে একজন কে আছে, যাকে ন্যাংটো করে শুইয়ে বসিয়ে ছবি আঁকিস, আবার এঁকে কেন?’

রোহিণী এই প্রথম শোভনেশকে বিব্রত এবং বিরক্ত হতে দেখল। কথার বিষয়টা এড়াবার জন্য তাড়াতাড়ি শোভনেশ বলল, ‘বেশি খেয়ে ফেলেছিস গঙ্গা, এবার বাড়ি যা। বরুণা আজ ঝাঁটার শক্তিপরীক্ষা করবে তোর পিঠে।’

‘সেইজন্যই তো তোর কাছে এলুম। বাড়ি পৌঁছে দিবি চল, নীচে গাড়ি রয়েছে। বরুণাকে তুই ফেস করবি। যা যা বানিয়ে বলার বলবি। এনার সঙ্গে…হ্যাঁ ভাই, কী যেন নাম বললে?’

‘রোহিণী।’

‘রোহিণী—নক্ষত্র, চন্দ্রপত্নী তাই তো? আপনার সঙ্গে—তোমার সঙ্গে, অনেক ছোটো তো, তুমিই বলি—পরে আলাপ করব, এই নাও আমার কার্ড, ঠিকানা ফোন নম্বর সব পাবে।’

কোটের পকেট হাতড়ে গঙ্গাপ্রসাদ কার্ড বার করে রোহিণীকে দিল। ওকে স্থিরভাবে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য শোভনেশ ওর দুটো কাঁধ শক্ত করে ধরল।

‘লাগছে লাগছে ছাড়, ওরে বাবা আমি ঠিক আছি। আমার বডি, সোল, মেমারি, ইন্টালিজেন্স সব ঠিক আছে। এই রোহিণীর হাত থেকেই তো সেদিন ছবিটা পড়ে ভাঙল। কী, ঠিক বলেছি? মেমারি। তুই বললি ছবিটা ওকে প্রেজেন্ট করবি, আজও করিসনি। কী, ঠিক আছে মেমারি?’

অপ্রতিভ শোভনেশ তখন গঙ্গাপ্রসাদকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘চল এবার, অনেক হয়েছে। গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি।’

‘অনেক মোটেই হয়নি। ছবিটা ওকে কবে দিবি বল? আমি গিয়ে দিয়ে আসব। রোহিণী তোমার বাড়ির ঠিকানাটা দাও, আমি গিয়ে দিয়ে আসব।’

‘আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? রোহিণী বিব্রত অথচ হাসিমুখ করে বলে। গঙ্গাপ্রসাদকে তার মজার লোক মনে হচ্ছে।

‘ব্যস্ত হব না? অ্যাঁ, ব্যস্ত হব না? শোভু বলল, হোয়াট আ বডি! ছবিটাকে কত গভীরভাবে দেখছে দ্যাখ। বাহ্যজ্ঞান রহিত একেই বলে। ছবি এদের হাতেই তুলে দিতে ইচ্ছে করে, আমি বললুম, দিয়ে দে প্রেজেন্ট করে। মনে থাকে যেন, আমি বললুম। ও বলল, কিছু মনে করবে না তো? বললুম, হ্যাঁ রে কী বললুম বল তো?’ গঙ্গাপ্রসাদ তেরচা চাহনিতে তাকাল শোভনেশের দিকে।

‘আপনার মেমারি বোধ হয়—’। রোহিণী হাসি চেপে মুখে উদবেগ ফুটিয়ে কথাটা বলতেই গঙ্গাপ্রসাদ আড়ষ্ট হয়ে গেল। দুলুনি বন্ধ করল। মনে হল, খোলসের মতো শরীর থেকে অপ্রকৃতিস্থ ভাবটা খসিয়ে দিচ্ছে। তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে সে বলল, ‘রোহিণী তুমি কী কোথাও চাকরি করো? বিয়ে হয়েছে?’

‘বিয়ে হয়নি আর একটা প্রাইভেট ফার্মে রিসেপশনিস্ট রয়েছি।’

‘কোথায়?’

‘এই কলকাতাতেই।’

‘বলবে না? ঠিক আছে। জেনে রাখো, ঠিকানা বার করে তোমার বাড়িতে গিয়ে ওই ছবি দিয়ে আসব।’

‘পারবেন বাড়ির ঠিকানা বার করতে?’

‘আমার নাম গঙ্গা ব্যানার্জি। এই চল্লিশ লাখের শহরে একটা আলপিন হারিয়ে গেলে খুঁজে বার করে দিতে পারব, আর এ তো একটা আস্ত মানুষ। রিসেপশনিস্টকে খুঁজে বার করা কী খুব শক্ত, এইরকম ফিগার যার? ছোটোখাটো ফার্মে নিশ্চয় তুমি নেই?’

রোহিণী শুধু স্মিত হাসিতে প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছিল। গঙ্গাপ্রসাদকে তারপর শোভনেশ টেনে নীচে নিয়ে যায়।

দিন দশেক পর রবিবার সকালে মা জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘রুনু, দ্যাখ তো গাড়ি করে কারা এল?’

রোহিণী জানলায় এসে দেখে, মোটর থেকে গঙ্গাপ্রসাদ নামছে, হাতে কাগজে মোড়া জিনিসটি বোধ হয় সেই ছবিটাই, গাড়ির মধ্যে বসে আছে শোভনেশ।

দরজা খুলে সত্যি সত্যিই বিস্মিত চোখে সে গঙ্গাপ্রসাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘কী বলেছিলুম? কলকাতা শহরে তোমাকে খুঁজে বার করব ঠিক করলে, সেটা কারোর পক্ষেই এমন কিছু শক্ত কাজ হবে না।’

খাটে দুই হাঁটুতে মাথা রেখে অন্ধকারে রোহিণী বসে। স্মৃতির ঘর থেকে বেরিয়ে সে সুড়ঙ্গটায় এখন দাঁড়িয়ে। পা টিপে টিপে ছ—বছর আগের অতীত থেকে সে বেরিয়ে আসছে।

.

গঙ্গাদা আজ সকালে বললেন, ‘তাহলে তো ভয় পাওয়ার কথা নয়। এই তিরিশ চল্লিশ লাখ লোকের শহরে একজনকে খুঁজে বার করা কী সহজ ব্যাপার?’

আসলে বেশিরভাগ সাফল্যই হয়ে যাওয়ার ব্যাপার! সেদিন গঙ্গাদা তাদের বাড়িতে এসেছিলেন অনেকটা এইভাবেই। ঠিকানাটা পেয়ে গেছিলেন। হিমালয়ান পেইন্টসের কলকাতা অফিসে খোঁজ নিয়েছিলেন, রঞ্জন যোগলেকরের শ্বশুরবাড়িটা কোথায়? তার শালি কোথায় চাকরি করে? খুব সহজেই শুধু একটা টেলিফোনেই কাজটা হয়ে যায়। সুভাষ গায়েনের সঙ্গে দেখা, এটাও সেই হয়ে যাওয়ারই ব্যাপার। এমনকী, সিআইটি রোডটার নাম যে আচার্য সত্যেন বোস সরণি—এটা জানাও তো ওইভাবেই।

এখন ইচ্ছে করলে যে—কেউই তার ঠিকানা বার করে ফেলতে পারে। তাহলে তার নিরাপত্তাটা কোথায়?

রোহিণী অন্ধকার ঘরে পায়চারি শুরু করল। তার পায়ের শব্দে নীচের ফ্ল্যাটের লোকেরা, যদি ঘুমিয়ে না পড়ে থাকে, কী ভাববে? যা খুশি ভাবুক, তাতে তার কিছু আসে যায় না।

নিরাপত্তার কথা এবার ভাবতেই হবে, কিন্তু সেটা শোভনেশের ভয়ে নয়। বয়স, মেয়েদের যেটা সবথেকে বড়ো ঘাতক, একদিন তো দেখা দেবেই। ইদানীং মাঝে মাঝেই তার মনে হয়েছে, কতকাল সে একা এইভাবে চলতে পারবে? বয়স ক্রমশ বাড়বে। ধীরে ধীরে প্রৌঢ়ত্ব আসবে, তারপর বার্ধক্য, সে বুড়ি হবে। রোহিণী অবাক হতে হতেও ভয় পেল। তখন কে তাকে খাওয়াবে? এই ফ্ল্যাটে কতকাল আর গঙ্গাদা তাকে থাকতে দেবেন? কত বছর আর সে চাকরি করতে পারবে? ভাবতে ভাবতে রোহিণীর বুকের মধ্যে কনকনে একটা যন্ত্রণা উঠল। সে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল।

তাহলে আর রাজেনকে অপেক্ষায় রাখা ঠিক হবে না। এই শরীর সজীব তীক্ষ্ন সটান থাকতে থাকতেই নিরাপদ জায়গায় একে সরিয়ে রাখতে হবে। আজ ইডেনে বসে রাজেনকে সে যখন বলেছিল, ‘ধরে নিচ্ছি আমার কিছু ফিজিক্যাল অ্যাসেট আছে, কিন্তু কতদিন আর সেটা থাকবে? পদ্মপাতায় জলের মতোই তো মেয়েদের যৌবন।’ তখন সে দু—জনের মধ্যে বয়সের ব্যবধানটার কথা ভেবেই বলেছিল। পুরুষের লোভ তো মেয়েদের যৌবনের দিকেই। বউয়ের যৌবন ধসে পড়লে স্বামীরা ওপরের তুষার দত্তর মতো হয়ে যায়। রাজেনও হতে পারে, এইরকম আভাসই সে ওকে দিয়েছে।

কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে, বয়সটাকে বাধ্য হিসাবে দেখার কোনো যুক্তি নেই। তার থেকে কমবয়সি লক্ষ লক্ষ বাঙালি মেয়ের থেকেও সে বেশিদিন যৌবন ধরে রাখতে পারবে, এই প্রত্যয় তার আছে। রাজেনকে তার ভালো লাগে বললে কম বলা হবে, ওর সান্নিধ্য সে প্রার্থনা করে। রাজেনের ক্ষমতা আছে মন প্রসন্ন করে তোলার। স্ত্রী হিসাবে নিজেকে ভাবলে, ওর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার চিন্তায় তার মনে আড়ষ্টতা আসে না, যেটা শোভনেশের সঙ্গে আসত।

রাজেনের শরীরে জোর আছে, পুরুষালি দেখতে, ভালো মাইনের চাকরি, শিক্ষিত তো বটেই। বনেদি বাড়ির ছেলে, সেটা চালচলনে বোঝা যায়। সবথেকে বড়ো কথা, সব কিছু জেনেই সে বিয়ে করতে চেয়েছে। কাল কি ওকে বলব রাতে খাবার জন্য? অনেক দিন সে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে, তিনতলায় উঠে দরজা পর্যন্তও এসেছে, কিন্তু ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢোকেনি। রোহিণী তাকে একটু বসতে, এক কাপ চা খেয়ে যেতে অনুরোধ করেছে। রাজেন রাজি হয়নি। অদ্ভুত সংযমী প্রেমিক! ‘যতদিন না তুমি বউ হতে রাজি হচ্ছ, আমি ভেতরে যাব না।’ ছেলেমানুষের মতো অভিমান দেখিয়েছে। অথচ আমার হাতের রান্না খেতে চায়!

রোহিণী বালিশে মুখ চেপে হেসে ফেলল। রান্না খেতে গেলে যে ফ্ল্যাটে ঢুকতে হবে, বলার সময় সেই খেয়াল ওর ছিল না। কাল দুপুরে টেলিফোন করবে অফিসে। প্রথমেই ওকে এটা মনে করিয়ে দিতে হবে।

কাজের মেয়েটা পালিয়েছে, নিজেকেই কাল দোকান আর বাজার বয়ে আনতে হবে। কী রাঁধবে? নুডলসের কিছু? ভাতের কী ময়দার সঙ্গে খাওয়া যায় মাছের কী চিকেনের কোনো প্রিপারেশন? মহারানিতে ‘খাবার—দাবার’ বিভাগটা দেখে উৎপল। মেয়েদের নাম দিয়ে ও নাকি নিজেই লেখে। উৎপলের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

তার ঘুম আসছে এবার। শরীর আলগা হচ্ছে, চোখের পাতা ভারী হচ্ছে। উপরের ফ্ল্যাটে ঘড়ির কুক্কুটা দু—বার ডেকে উঠল। রোহিণী ঘুমিয়ে পড়ার আগে আগামীকালের জন্য করণীয় কাজগুলো পর পর মনে করতে চাইল। বাজার যাওয়া, অফিসে গঙ্গাদার কাছ থেকে জেনে নেওয়া, উনি পুলিশের কাছ থেকে যা জেনেছেন। রাজেনকে আর অপেক্ষা করানো নয়। এবং সব শেষে নিজেকে বলল, রোহিণী, ভয় পাচ্ছ কেন? এমন কিছু অসাধারণ নও যে, জীবন নিয়ে তোমাকে গোলমালে পড়তে হবে। লক্ষ লক্ষের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দাও, তাহলে কেউ আর তোমায় খুঁজে পাবে না।

পাঁচ

কলিং বেল বাজছে।

রোহিণী চোখ খুলল। হাত বাড়িয়ে টেবল থেকে হাতঘড়িটা তুলে চোখের কাছে আনল। ছ—টা দশ! প্রায় লাফ দিয়ে খাট থেকে সে নামল। এত বেলা পর্যন্ত বিছানায় থাকা জীবনে পাঁচ—ছ—বারের বেশি ঘটেনি। নিজের দিকে ঘাড় হেঁট করে তাকিয়ে সে গায়ের ম্যাক্সিটা নাড়িয়ে নিল। ভিতরে কিছু পরা নেই।

আবার বেল।

দরজার দিকে যেতে অপাঙ্গে আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে রোহিণী চুল ঠিক করতে করতে আই—হোলে চোখ রাখল। কী আশ্চর্য, অফিসের বেয়ারা কমল, অর্থাৎ কমলদা! এত সকালে? ছ্যাঁত করে উঠল তার বুকের মধ্যে! কারোর কিছু হয়নি তো? ম্যাক্সির গলার কাছটা টেনেটুনে যতটা সম্ভব খোলা জায়গাটা ঢেকে সে লক ঘুরিয়ে দরজা খুলল।

‘আরে কমলদা, আপনি?’

রোহিণী আর কিছু বলার আগেই কমল মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘দিদি, কাল একটা ভুল হয়ে গেছে। ঠিক ভুল নয়, গলদই বলতে পারেন। আপনাকে দেবার জন্য প্রশান্তবাবু একটা চিঠি দিয়েছিলেন, খুব জরুরি চিঠি। রাত্রেই আপনার কাছে পৌঁছে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি আসতে পারিনি।’ খামটা সে রোহিণীর হাতে দিল।

‘ভেতরে আসুন।’

রোহিণীর পিছনে কমল ভিতরে এল। দু—জনে ডাইনিং টেবলে বসল। চিঠিটা পড়তে পড়তে তার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। কমল সেটা লক্ষ করে বলল, ‘লেখাটা যে কী করে হারাল, কেউ বলতে পারল না। অথচ পরশু আমার হাতেই দুপুরে দিয়ে গেল, আমিও সেটা উৎপলবাবুর টেবিলে রাখলাম। কাল প্রেসে পাঠাতে গিয়ে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। সারা অফিস তন্ন তন্ন করে সন্ধে পর্যন্ত খোঁজা হল। আজ সকাল এগারোটার মধ্যে প্রেসে পৌঁছে দিতেই হবে। প্রশান্তবাবু চিঠি লিখে আমাকে বললেন, তুমি তো মানিকতলার দিকে চালতাবাগানে থাক, তোমার অসুবিধে হবে না যেতে। সোজা আগে সল্টলেকে গিয়ে এখুনি এটা রোহিণী দিদিকে দিয়ে তারপর বাড়ি যেয়ো। উনি যেন রাতেই লিখে রেখে দেন। তুমি সকালে ওর কাছ থেকে লেখাটা নিয়ে বেলেঘাটায় প্রেসে দিয়ে আসবে। কিন্তু আমি কাল আর আসতে পারিনি।’

করুণ মুখে কমল তাকিয়ে রইল। রোহিণী আবার চিঠিটা পড়ল। বিব্রত কণ্ঠে এবং চাপা বিরক্তি নিয়ে সে বলল, ‘কিন্তু আমি গ্রহ নক্ষত্র রাশিফলের কী জানি? আমাকে এসব লিখতে বলা কেন? আমার তো সকালে কাজ রয়েছে। রাতে একজনকে খেতে বলেছি, এখন আমি বাজার যাব।’

‘প্রশান্তবাবুকে উৎপলবাবুই বললেন, রোহিণী রাশিফল রেগুলার পড়ে না, মাথাও ঘামায় না, ওকেই লিখে দিতে বলুন। মহারানির পুরোনো তিন—চারটে সংখ্যা আর ইংরিজি বাংলা ম্যাগাজিনের থেকে এটা ওটা নিয়ে আধ ঘণ্টাতেই নামিয়ে দিতে পারবে।’

‘উৎপলবাবু নিজেই তো অফিসে বসে করে দিতে পারতেন, ‘খাবার—দাবার’ তো উনি এইভাবেই লেখেন।’ রোহিণী একটু ঝাঁঝের সঙ্গেই বলল। সে শুনেছে, উৎপল প্রায়ই ক্ষোভ জানায় এই বলে যে, রোহিণীকে দিয়ে কোনো কাজই করানো হয় না, শুধু গ্ল্যামারাস কভারেজ ছাড়া। ‘গঙ্গাবাবুর স্নেহের ধারাটা শুধু একদিকেই প্রবাহিত হয়।’ কথাটা প্রথম শুনে রোহিণীর মাথা গরম হয়ে গেছিল। গঙ্গাদাকে সে কিছু বলেনি, তবে নিজের থেকেই সে সম্পাদক প্রশান্ত হালদারের কাছে কাজ চেয়ে নেয়। ‘বসিয়ে মাইনে দেওয়া হচ্ছে’, এই ধারণাটা অফিসে চাউর হয়ে গেছে। বোধ হয় উৎপলেরই কাজ।

‘দিদি, কাল আমার মেজোছেলে ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় বাসের ধাক্কা লাগে। মেডিকেল কলেজে ভরতি হয়েছে। ওকে দেখতে গিয়েছিলাম, বড্ড রাত হয়ে গেল তাই আর আসতে পারিনি।’

‘সে কী! কখন হল? ছেলের বয়স কত?’ রোহিণী চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। হাত—পা শক্ত হয়ে গেছে।

‘এই তো চব্বিশে পড়ল গত পৌষে। ইংরিজিতে এম এ পড়ছে। অফিস থেকে বেরোচ্ছি, তখন হন্তদন্ত হয়ে মেয়ে এসে খবরটা দিল। দুপুরেই হয়েছে। খুব সিরিয়াস নয়, তিনটে পাঁজর ভেঙেছে। অপারেশন হয়েছে, ভালোই আছে। আপনি লিখে ফেলুন, ততক্ষণে আমি আপনার বাজার করে আনি।’

‘না না, সে কী কথা। আমি লিখে ফেলছি। আপনি বসুন, চা করি।’

কমল নাছোড়বান্দা। বার বার বলতে লাগল, ‘ছেলে ভালো আছে, তার জন্য কোনো দুশ্চিন্তা এখন আর নেই। থলেটা দিন আর কী কী আনতে হবে বলুন, বাসে করে মানিকতলা গিয়ে বাজার করে এনে দিচ্ছি। বড়োজোর এক ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব।’

মায়া হল রোহিণীর। রোগা, দুবলা, কাঁচাপাকা দাড়ি ভরা মুখ। আধ ময়লা ধুতি আর ফিকে নীল হাফ শার্ট। অফিসের জরুরি কাজটা করতে না পারার জন্য যেন মরমে মরে আছে। তার জন্যই রোহিণীদির বাজার করা হবে না, এটা যেন আরও বেশি ওকে অপরাধী করে তুলেছে। এখন যেন হালকা হবে দিদির জন্য কিছু একটা উপকার করে দিতে পারলে।

‘আচ্ছা, থলি দিচ্ছি।’

রোহিণী ডিক্সনারির মধ্য থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে কয়েক মুহূর্ত ভাবল। চর্ব্য—চোষ্য রাঁধার সময় নেই, সময় থাকলেও উপায় নেই, উপায় থাকলেও চীনে বা মোগলাই তিন—চারটের বেশি সে জানে না। ছিমছাম হলেই হবে। রাজেন তো ভোজ খেতে চায়নি, শুধু তার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে।

‘কমলদা, মাছ আনবেন। ভাজা খাওয়া যায় এমন, ভেটকি, বাগদা কী পার্শে কী তপসে। ফাইন সরু চাল এক কিলো, কড়াপাকের সন্দেশ দশ টাকার, দই আড়াই শো। একজনকে খেতে বলেছি, খুব হালকা রান্না করব। বুঝতেই পারছেন এক হাতে বেশি তো করে উঠতে পারব না।’

কমল থলি নিয়ে যাবার সময় বলে গেল, ‘পৌনে আটটার মধ্যেই আসছি।’

রোহিণী চিঠিটা চোখের সামনে ধরে দ্রুত ভেবে নিল। উৎপল তাকে মুশকিলে ফেলার জন্য রাশিফল তৈরি করার ঝামেলাটা ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে। ঠিক আছে, দেখিয়ে দেব ঝঞ্ঝাটে কাজ পারি কিনা। মহারানির পুরোনো সংখ্যা দেখে লাভ নেই। ধরা নাও পড়তে পারে, কিন্তু উৎপল যে বেনামা চিঠি সম্পাদককে লিখে তাকে অপদার্থ প্রমাণ করবে না তারও গ্যারান্টি নেই। ভালো করে টুকতেও জানে না, ভাষাটাসা বদলে, এটা ওখানে সেটা এখানে করে লেখা দাঁড় করাতেও শেখেনি—এই সব কথা যেন না শুনতে হয়।

সবথেকে ভালো হয় ইংরিজি ম্যাগাজিন থেকে টুকলে। মহারানি যারা পড়ে, তারা ইংরিজি অতশত বোঝে না, পড়ে না। কিন্তু তার কাছে যেসব ম্যাগাজিন আছে, তাতে তো রাশিফল থাকে না। তাহলে? আগে বাথরুম আর দাঁত মাজাটা তো সেরে নিই। ব্যায়াম করার জন্য আজ আর সময় দেওয়া যাবে না। দু—হাত তুলে শরীরটা টেনে, দু—পাশে বাঁকিয়ে আর হাঁটুতে নাক ঠেকিয়ে নমো নমো করে কাজটা সে সেরে নিল।

চায়ের জল বার্নারে চড়িয়ে রোহিণী দাঁত মাজতে মাজতে দরজা খুলে বারান্দায় এল। শুকিয়ে গেছে সায়া, ব্রা। এবার এ দুটো পরা দরকার। মুখ ধুয়ে চা বানিয়ে খেতে খেতে সে মনে করার চেষ্টা করল এই বাড়িতে, চটুল ধরনের কিন্তু গাম্ভীর্যের মুখোস— পরানো ইংরিজি ম্যাগাজিন কারা রাখতে পারে? সাতটি ফ্ল্যাটের থেকে ছাঁটাই করতে করতে অবশেষে দোতলার প্রৌঢ়া বিধবার ফ্ল্যাটটিকে সে অনুমানে প্রথম স্থান দিল।

বিধবার জন্য নয়, তাঁর যুবক বোনপো আর তার বউয়ের হাবভাবের, পোশাক—আশাকের কথা ভেবেই। টেপ ডেক আছে, প্রায় রাতেই পপ গান বাজায়। ঘরের মধ্যে হয়তো নাচে টাচেও। একটা সাদা মারুতি আছে। ভোরে দু—জনে জগ করতে বেরোয়। বোধ হয় কোনো মাল্টি ন্যাশনালে রাজেনের মতোই ম্যানেজমেন্টের জুনিয়র স্তরের একজিকিউটিভ। রাজেন ঠাট্টা করে এদের সম্পর্কেই বলে, ‘আওয়ার হোম—গ্রৌন ইউপ্পিস, ইয়াং আরবান প্রফেশ্যনালস অর্থাৎ এককথায় আপস্টার্ট, সোজা বাংলায় উঠাই—গিরাই।’ আপাতত, রাশিফল আছে এমন ইংরিজি ম্যাগাজিন যদি রাখে, তাহলে ওরা ইউপ্পি, উড়িপি, যা খুশি হোক, তাতে তার কিছু আসে যায় না।

ম্যাক্সি থেকে শাড়ি, চুলে ঝমাঝম চিরুনি, তারপর তিন মিনিটের মধ্যেই রোহিণী দোতলায় পিতলের পাতে ‘দত্তরায়’ লেখা দরজায় কলিং বেলের বোতামে আঙুল রাখল।

দরজা খুলল বউটিই। বয়স বাইশ—তেইশ, শীর্ণ দেহটি সোয়েট স্যুটে মোড়া। বোধ হয় জগিং সেরে কিছুক্ষণ হল ফিরেছে। কোমর পর্যন্ত খোলা চুল, লম্বাটে মুখ, গালে ব্রণর দাগ, সিঁথেয় অস্পষ্ট সিঁদুর, লম্বা নখে রং এবং চোখে প্রাথমিক বিস্ময় কাটিয়ে বিগলিত হাসি ফুটল। মেয়েটির মুখ তাতে মিষ্টি দেখাল।

রোহিণীর দ্বিতীয় একটা গলার স্বর আছে। খসখসে, চাপা, অনেকটা সর্দিধরা স্বরের মতো। শুনলে গা সিরসির করে। এই স্বরটা সে লোক বুঝে, খুব আধুনিক, উচ্চচ মহলে বিতরণ করে, সফিস্টিকেটেড, ইংরেজিতে কথা বলে গদগদ হয় এমন মানুষদের সঙ্গে কথা বলার সময় ব্যবহার করে। রাজেনের সঙ্গে প্রথম আলাপের সময় ব্যবহার করেছিল, পরে আর করেনি। ঠাট্টা করে রাজেন অনেক দিন বলেছে, ‘তোমার সেকেন্ড ভয়েসটা একটু বার করো তো, দারুণ সেক্সি লাগে।’

রাজেন যত ঠাট্টাই করুক, রোহিণী দেখেছে, শতকরা পঁচানব্বই ভাগ ক্ষেত্রে এই গলাটা কাজ দিয়েছে। যেমন এখন সে দ্বিতীয় গলায় বলল, ‘ভাই খুব মুশকিলে পড়ে গেছি, তোমাদের কাছে এমন কোনো ইংলিশ ম্যাগ আছে, যাতে স্টারস অ্যান্ড প্ল্যানেটসের পোজিশ্যনকে বেস করে ফোরকাস্ট, মানে…ইয়ে কী বলব…।’

‘রাশিফল?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, আছে?’

‘আমি তো অত লক্ষ করি না, আপনি ভিতরে আসুন, আমি দেখছি।’

রোহিণী ভিতরে ঢুকল। এই বাড়ির সব ফ্ল্যাটের নক্সাই একরকম। ঘরের মাঝে নীচু টেবলটার নীচে তাক থেকে বউটি কতকগুলো ম্যাগাজিন বার করে রোহিণীর সামনে রাখল। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল সে ওগুলোর উপর। সূচিপত্র দেখল, পাতা ওলটাল, কিন্তু বাঞ্ছিত জিনিসটি পেল না।

‘আচ্ছা, আমি ওকে জিজ্ঞাসা করে দেখি, বাথরুমে রয়েছে। ওর এসবে কিওরোসিটি আছে।’

অতঃপর একটা ম্যাগাজিনের পাতা ধীরে ধীরে ওলটাতে ওলটাতে রোহিণী কান খাড়া করে রইল। বাথরুমের দরজা দেখা যাচ্ছে না কিন্তু সে জানে ওটা কোথায়।

খট খট শব্দ এবং ‘এই শুনছ।’

বাথরুমের ভিতর থেকে হুসস ধরনের একটা শব্দ উঠল। তারপর চাপা স্বরে, ‘ওপরের সেই ভদ্রমহিলা এসেছেন।’ এবার সংক্ষিপ্ত একটা খ্যাক ধরনের শব্দ বেরিয়ে এল। ‘আরে সেই তিনতলার, যার হিপ সোফিয়া লোরেনের মতো সুইং করে বলেছিলে, সেই। …না না বেরোতে হবে না। উনি এসেছেন একটা জিনিসের খোঁজে, তুমি কী বলতে পারো…’

রোহিণীর কান ততক্ষণে বন্ধ হয়ে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে। হাতের ম্যাগাজিনটার খোলা পাতায় তার দৃষ্টি আটকে।

একটা প্রবন্ধ, যার শিরোনাম অনুবাদ করলে দাঁড়ায়: ‘লালসার আগুনে ভস্মীভূত শিল্পীরা।’ লেখক সিধারথ সিনহা। কয়েকটা ছবি, তার মধ্যে একটা শোভনেশের আঁকা নগ্ন নারীর। ভারতের চারজন নামি নাট্যকার—পরিচালক, ফিল্ম অভিনেতা, ক্ল্যাসিকাল গায়ক আর শোভনেশকে নিয়ে লেখাটা। বোধ হয় উদাহরণ দেওয়ার জন্য এদের রাখা হয়েছে। তিনজনের ছবি রয়েছে শুধু শোভনেশেরই নেই। নিশ্চয় পায়নি, তাই নেই। বদলে ওরই আঁকা একটা ছবি ছেপেছে।

কী লিখেছে শোভনেশ সম্পর্কে, সেটা দেখার জন্য যখন রোহিণীর দৃষ্টি প্রবন্ধের উপর দিয়ে ওঠানামা করছে, তখন বউটি ঘরে ঢুকল। এক কোণে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে ইংরেজি খবরের কাগজ। তার থেকে ঘেঁটে একটা খুদে আকারের আট পাতার ট্যাবলয়েড বার করে আনল।

‘এই যে আপনি যা চাইছিলেন।’ বউটির মুখ সাফল্যের গর্বে উদ্ভাসিত। ‘দারুণ মেমারি ওর, ঠিক বলে দিল।’

‘আচ্ছা, আমি যদি এটা পড়ার জন্য নিয়ে যাই, তোমাদের কি অসুবিধে হবে?’ রোহিণী ম্যাগাজিনটা দেখিয়ে গড়গড়িয়ে এবং তার নিজস্ব গলায় বলল। তার মানসিক স্থৈর্য আর পরিপাটি নেই।

‘না না, আপনি নয়ে যেতে পারেন। আমাদের তো দেখা হয়ে গেছে।’

রোহিণী দুটি পত্রিকাই হাতে নিয়ে বেরোবার সময় নিজেকে গুছিয়ে ফেলে আবার তার মন্থর দ্বিতীয় গলার স্বরে ফিরে গেল। ‘তুমি অনেক ছোটো তাই আর আপনি—টাপনি বললাম না। কত দিন বিয়ে হয়েছে?’

‘সাত মাস।’

‘তাহলে তো এখন অনেকদিন ছুটিতে থাকবে।’ রোহিণীর অর্থপূর্ণ হাসির ইঙ্গিতের প্রতিবিম্ব অন্যদিকেও ফুটল।

‘নাম কী তোমার?’

‘কুন্তী।’

‘আহহ হোয়াট আ বিউটিফুল নেইম! পঞ্চপাণ্ডব পাব তো? আচ্ছা চলি ভাই।’

ভাই বললে ওর দিদি না বলে উপায় নেই। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে রোহিণী আন্দাজে টের পেল, কুন্তী দরজা বন্ধ না করে তাকিয়ে রয়েছে। নিশ্চয় সোফিয়া লোরেনকে দেখছে।

নিজের ফ্ল্যাটে এসে, ম্যাগাজিনটা পড়ার প্রচণ্ড ইচ্ছাটা দমন করে রোহিণী কাগজ—কলম নিয়ে ডাইনিং টেবলে বসল। লেখালেখির কাজ সে এখানে বসেই করে। ভস্মীভূত শিল্পীরা অপেক্ষা করতে পারবে কিন্তু গ্রহ—নক্ষত্রদের এক্ষুনি প্রেসে পাঠাতে হবে। কমলের ফিরে আসার সময় হয়ে এল।

এয়ারঈজ, টর্যাস, জেমিনি, ক্যানসার, লিও…রোহিণী পর পর বারোটি রাশির বাংলা নাম মেষ, বৃষ, মিথুন, কর্কট, সিংহ ইত্যাদি লিখে সে কাগজটার তারিখ দেখল। মাস দেড়েক আগের এক রবিবার। অদলবদল না করে হুবহু বাংলা করে দিলেও কেউ ধরতে পারবে না। মহারানিতে রাশি পিছু গড়ে পাঁচ—ছ লাইন করে বেরোয়। ইংরেজি কাগজটাতেও তাই রয়েছে।

শোভনেশের আগ্রহ ছিল জ্যোতিষে। বিয়ের আগে একবার সে রোহিণীর কররেখা দেখেছিল। মিনিট পাঁচেক নীরবে গভীর মনোযোগে দেখার পর বলেছিল, ‘খুব জটিল নও। আবেগটা কম, অল্পে সন্তুষ্ট হও, বুদ্ধিচর্চার দিকেই ঝোঁক…’ তাকে থামিয়ে রোহিণী বলেছিল, ‘এসব বলার জন্য জ্যোতিষ জানার দরকার হয় না। আমিও বলে দিতে পারি হাত না দেখেই।’ শোভনেশ বলেছিল, ‘তাহলে কী জানতে চাও?’ রোহিণী হালকা স্বরে বলে, ‘মেয়েরা যা জানতে চায়। বিয়ে থা’, ছেলেপুলে, স্বামীর ভালোবাসা, গাড়ি, বাড়ি, গয়না।’ শোভনেশের মুঠোয় ধরা ছিল আঙুলগুলো। রোহিণীর করতল খুলে সে আবার তাকায়। ‘বিয়ে খুব শিগগিরই হবে। আর সেটা হবে আর্টের সঙ্গে যুক্ত কোনো লোকের সঙ্গে, সুখীও হবে।’

রোহিণী তখন হেসেছিল। বাড়ি ফিরে মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আমার কোনো কোষ্ঠীঠিকুজি আছে কি?’ মা জানিয়েছিল, নেই। বাবা এসবে বিশ্বাস করতেন না, তাই করানো হয়নি। শোভনেশের কোষ্ঠী ছিল। ওর ছিল বৃষ রাশি।

ট্যাবলয়েডে চোখ রাখল রোহিণী। দেড় মাস আছে শোভনেশের রাশি কী বলেছিল? ‘খরচ বাড়বে। বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ আসবে এবং তা গ্রহণ করলে লাভই হবে। বন্ধুদের সাহায্যে যশবৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। প্রণয়ের ক্ষেত্রে সফল হবেন, তবে সতর্ক থাকা দরকার। সন্তানের স্বাস্থ্য সম্পর্কে যত্নবান হতে হবে। কর্মক্ষেত্রে প্রভাব বৃদ্ধি পাবে।’

জেলে বসে শোভনেশের এই রাশিফল দেখার সুযোগ ছিল কি? সুযোগ থাকলে হো হো করে হেসে উঠে নিশ্চয় বলত, ‘যশবৃদ্ধি? প্রণয়? সন্তান? উরি ব্বাবা, তার ওপর বিদেশ ভ্রমণ, কর্মক্ষেত্রও! এতসব এখন সামলাব কী করে?’ কয়েদিদের কি খবরের কাগজ পড়তে দেওয়া হয়? কিন্তু রোহিণীর এখন এই নিয়ে মাথা ঘামাবার অবকাশ নেই। খসখস করে সে লিখে চলল। মাঝে একবার সে লেখা থামিয়ে অন্যমনস্ক চোখে টেবলে রাখা ম্যাগাজিনটার দিকে তাকিয়েছিল। কী লিখেছে শোভনেশ সম্পর্কে? হাত বাড়িয়ে ম্যাগাজিনটার মলাটে প্রকাশের তারিখ দেখল। ১ ডিসেম্বর। মাত্র দু—মাস আগের।

আটটা পঞ্চাশে কমল এল। তার সঙ্গেই পাউরুটি আর মাদার ডেয়ারির দুধের পাউচ হাতে গৌরীর মা—ও ঢুকল।

‘দিদি আপনার কথা রাখতে পারিনি। ইচ্ছে করেই রাখিনি। বাগদা, গলদা, পার্শে, তোপসে সবই ছিল কিন্তু কিনিনি।’

রোহিণীর জিজ্ঞাসু চোখের দিকে কমল তাকিয়ে অসাধ্য এক কাজ করে ফেলার মতো দাবি নিয়ে থলিটা তুলে বলল, ‘ইলিশ।’

‘অ্যাঁ’, এই অফ সিজনে?’

‘সেইজন্যই তো আপনার কথা অগ্রাহ্য করলুম। বাংলাদেশের চালানি মানে চোরা চালানি, আজ হঠাৎ এসে গেছে। একজনই নিয়ে বসেছিল, পঁয়ত্রিশ টাকা কিলো, সস্তাই বলতে হবে। সবথেকে ছোটোটা বারোশো গ্রাম, ওটাই আনলুম।’

‘খুব ভালো করেছেন, দেখি মাছটা!’

খুশিতে ঝকমক করে উঠল রোহিণীর চোখ। কমল কিন্তু কিন্তু করে বলল, ‘আমি যে কাটিয়ে আনলুম। আপনি কাটতে পারবেন কী না—।’

‘কী বলছেন কমলদা, বাঙালি মেয়ে আর ইলিশ কাটতে পারব না। ইসস আস্ত গোটা ইলিশ দেখতে যে কী টেরিফিক! কতদিন যে দেখিনি।’ থলিটা হাতে নিয়ে রোহিণী ফাঁক করে দেখল। মুখ নীচু করে ঘ্রাণ নিল। রাজেনকে শুধুই ভাত আর ইলিশ খাওয়াবে। তেল আর ভাজা আর ঝালসর্ষে দিয়ে ভাতে। ও ভীষণ ঝালের ভক্ত। কমলদাকে রীতিমতো খাদ্যরসিকই বলতে হবে।

‘আচ্ছা, আর একদিন আপনার জন্য আস্ত একটা আনব। …দিদি, লেখাটা?’

‘হয়ে গেছে। আর দু—মিনিট, কুম্ভ আর মীনটা বাকি। আপনাকে তো দশটার মধ্যে দিয়ে আসতে হবে। বরং ততক্ষণে দুটো ভাজা খেয়ে যান।’

রান্নাঘরের কলে গৌরীর মা বাসন মাজছিল। রোহিণী মাছ ভাজতে ভাজতে আবদারের গলায় বলল, ‘একটু সর্ষে, কাঁচালঙ্কা বেটে দেবে?’ তারপরই অনুযোগ করল, ‘তোমার ওই মেয়েটা বাপু না বলে—কয়ে কাল চলে গেছে। কেমন লোক দিলে তুমি?’

‘সে কী! চলে গেছে! আজকাল দিদি এইরকমই হয়েছে। কাজের লোক পাওয়া যে…তুমি বার করে রাখ, আমি নীচের ঘরের কাজ সেরে এসে কেটে দোব। তবে মেয়েটা ভালো, হাত—টান—ফান নেই। আমার সঙ্গে কাল আর দেখা হয়নি, আজই গিয়ে ওর মাকে জিজ্ঞেস করব, কেন কাজ ছাড়ল? চঞ্চলার মা—ইই তো আমাকে বলেছিল কাজ দেখে দেবার জন্য। ছ—টা ছেলেমেয়ে, মরুক গে। হ্যাঁ, দিদি, লোকটা কি তোমার আপিসের?’

‘হ্যাঁ!’ রোহিণী কড়া নামিয়ে বার্নার নিবিয়ে বলল, ‘গৌরীর মা, মাছগুলো তো সন্ধে পর্যন্ত তুলে রাখা যাবে না। কী করি বল তো।’

‘ওই জন্য বলেছিলুম একটা ফিজ কেনো। এ বাড়ির সবার ঘরে আছে, শুধু তোমার ঘরেই ফিজ, টিভি নেই।’ এমন ঘরে কাজ করাটা যে অগৌরবজনক, গৌরীর মা—র স্বর সেটাই জানিয়ে দিল।

‘কারোর ঘরে একবেলার জন্য যদি রাখা যায়! তুমি একটু দেখবে? সামনের মাদ্রাজিরা তো নিরামিষ, নন্দাদের ঘরেও রাখতে চাই না, ওদের সামনের ঘরের সঙ্গে আলাপ নেই। তুমি তো ওদের কাজ করো, একটু বলে দেখবে? আমি তো বলতে গেলে ওদের চোখেও দেখিনি আজ পর্যন্ত।’

‘কত্তা গিন্নি দু—জনেই খুব ভালো লোক। তুমি নিজে গিয়েই বরং বলো, সেটাই ভালো দেখাবে।’

দু—টুকরো মাছ ভাজা নিয়ে রোহিণী রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখল, কমল ম্যাগাজিনটা খুলে ঝুঁকে রয়েছে শোভনেশের আঁকা ছবিটার উপর। হঠাৎই ঝনঝন করে উঠল তার মাথার মধ্যে। প্রায় হুমড়ি খেয়ে রোহিণী টেবলের অপর প্রান্ত থেকে হাত বাড়িয়ে ম্যাগাজিনটা ছিনিয়ে নিল হতভম্ব কমলের হাত থেকে।

‘এসব আপনাকে দেখতে হবে না।’ কর্কশ স্বরে সে বলল এবং ম্যাগাজিনটা শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় ছুড়ে রেখে রোহিণী চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকল।

বিশ্রী রকমের অভব্যতা হল। কিন্তু মাথাটা কীরকম যে করে উঠল। কী মনে করছে কমলদা! ওইরকম ছবিওলা ম্যাগাজিন, ছোঁ মেরে সরিয়ে নিল। নিশ্চয় নোংরা অশ্লীল কিছু আছে যেটা লোককে দেখতে দিতে চায় না। বাজে মেয়ে, চরিত্র ভালো নয়, এইরকম ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক। রোহিণী লজ্জায় মুষড়ে পড়ল।

কমল অন্যমনস্কের মতো মাছের কাঁটা বেছে খাচ্ছিল। ম্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে রোহিণীকে আসতে দেখে মুখ তুলে হাসল।

‘লেখাটা শেষ করে ফেলি।’

কাগজ—কলম নিয়ে রোহিণী কুম্ভ রাশিটা শুরু করল। মনে মনে সে কুঁকড়ে আছে।

‘দিদি, মনটা খুব উতলা হয়ে রয়েছে ছেলের জন্য…আমি ইংরিজি পড়তেও পারি না। ছবিটা ভালো লাগছিল দেখতে, তাই—’

রোহিণী অবাক হয়ে কমলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভালো লাগছিল?’ তারপরই সম্বিত ফিরিয়ে এনে বলল, ‘কমলদা, আমি সেজন্য কিছু মনে করিনি। আমারও মনটা একটা ব্যাপারে উতলা হয়ে রয়েছে। এই ম্যাগাজিনটায় একটা লেখা বেরিয়েছে আমার স্বামীর সম্বন্ধে। এখনও পড়া হয়ে ওঠেনি। আপনি কী জানেন, আমার স্বামী একজন আর্টিস্ট ছিল, সে এখন জেলে?’

কমল তার দুশ্চিন্তা—জর্জরিত স্তিমিত চাহনি রোহিণীর সন্ত্রস্ত এবং ব্যগ্র চোখে রেখে বলল, ‘লেখাটা তাড়াতাড়ি শেষ করে নিন।’

মাথা নামিয়ে রোহিণী লেখায় মন দিল। গৌরীর মা—র ঝাঁট দেবার শব্দ ছাড়া ফ্ল্যাট নিঝুম। দালানের এক ধারে বেসিনের কলে হাত ধুয়ে এসে কমল কাগজগুলো নিয়ে ভাঁজ করে পকেটে রেখে বলল, ‘মাছটায় স্বাদ আছে।’

গৌরীর মা ঝাঁট দেওয়া শেষ করেছে। রান্নাঘর থেকে বলল, ‘দিদি তোমার টোস করে রাখছি, পরে এসে ঘর মুছে দোব’খন।’

‘কমলদা, আপনার ছেলের জন্য আমিও দুশ্চিন্তায় থাকব। নিশ্চয় হসপিটালে একবার যাবেন। দুপুরে অফিসে অবশ্যই বলবেন, কেমন আছে।’

‘বলব।’ তারপর ইতস্তত করে কমল বলল, ‘অফিসে আপনার সম্পর্কে অনেকে অনেক কথাই বলে, কিন্তু আমি তাতে কান দিই না। স্বামী যদি অন্য কোনো মেয়েকে খুন করে, সেটা তো স্ত্রীর দোষ নয়। কিন্তু অনেকের ধারণা, স্ত্রীরই দোষ।’

‘কী দোষ?’ রোহিণী বিভ্রান্ত, উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল। ‘আমি তো খুন করতে বলিনি, প্ররোচিতও করিনি।’

কমল হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ‘আমি ওদের বুঝি না। এরা এইরকমই, পরচর্চা, পরনিন্দা ছাড়া আর কিছু বোঝে না। যার স্বামী যাবজ্জীবনের জন্য জেলে, সে যদি কোনো পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা করে তাতে দোষটা কোথায়? কিন্তু অনেকের কাছে সেটাই দোষের। যাবজ্জীবন মানে তো তার বউ বিধবাই। বিধবার কী বিয়ে হয় না আমাদের দেশে? আমিই তো করেছি।’

কমলের শীর্ণ চোপসানো মুখ, কাঁচাপাকা দাড়িসমেত উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘গরিব বামুনের মেয়ে, এক সময় পরিচয় ছিল। আমার নীচু জাত, তাই ওরা বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। তাড়াতাড়ি এক জায়গায় বিয়ে দিয়ে দেয়। বিয়ের এক বছর পরই বিধবা হয়, এসব ছাব্বিশ বছর আগের কথা।’

কমল চলে যাবার পর রোহিণী কিছুক্ষণ বসে প্রৌঢ় লোকটির কথা ভাবল। ঠান্ডা প্রকৃতির নিরীহ স্বল্পবাক। পঁচিশ বছর ইস্টার্ন ম্যাগাজিনসে রয়েছে। ধুতি—শার্ট আর চটি ছাড়া অন্য পোশাকে কেউ ওকে দেখেনি। উচ্চচাকাঙ্ক্ষী, ভদ্র ডিসিপ্লিনড জীবন। ছেলে ইংরাজিতে এম এ পড়ছে। রোহিণীর মনে হল, এই সব লোকের সঙ্গে আলাপ করলে জীবনের জ্বালা—যন্ত্রণাগুলো নিবিয়ে ফেলতে সাহায্য পাওয়া যায়। এখন সে শান্ত বোধ করছে।

টোস্ট আর দুধ খাবার টেবলে রেখে দিয়ে, গৌরীর মা আর এক ঘরের কাজ সারতে চলে গেছে। যাবার আগে ভাত চড়িয়ে দিয়ে গেছে। ম্যাগাজিনটা নাড়াচাড়া করতে করতে রোহিণী ভাবল, মাছের টুকরোগুলো অপরিচিত জনের কাছে নিয়ে গিয়ে ফ্রিজে রাখার অনুরোধ জানানোটা কতটা সংগত হবে? তার আগে বাথরুম যাওয়া, স্নান করা, তারও আগে ভাতটা নামানো। এইসব ভাবতে ভাবতে সে পাতা খুলে ‘লালসার আগুনে ভস্মীভূত’ প্রবন্ধে খুঁজতে শুরু করল।

শেষের দিকে শোভনেশের কথা। প্যারাগ্রাফের প্রথম বাক্যটি পড়েই সে চমকে উঠল।

.

‘শোভনেশ সেনগুপ্তর বংশে অদ্ভুত একটা ধারা আছে। উন্মাদ হওয়ার। তার পিতামহের পিতামহ শ্যামাচরণ, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিধবা মায়ের সঙ্গে হুগলির এক গ্রাম থেকে উত্তর কলকাতায় মামার বাড়িতে আসেন ছয় বছর বয়সে। প্রাথমিক শিক্ষা হেয়ার স্কুলে। খুব অল্প বয়সে মামাদের কাগজের ব্যবসায়ে শিক্ষানবিশি শুরু করে পরে পাটের দালালিতে নামে। প্রচুর বিত্ত তিনি সঞ্চয় করেছিলেন। মধ্য কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে এক বিঘা এলাকা নিয়ে তৈরি বিশাল জরাজীর্ণ বাড়িটি এখনও তাঁর সমৃদ্ধির সাক্ষ্য বহন করছে। শ্যামাচরণ সন্দেহ ও ঈর্ষার বশে গলা টিপে হত্যা করেন তাঁর রক্ষিতাকে। কিন্তু বিচারের সময় দেখা যায়, তিনি সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে গেছেন।

‘শ্যামাচরণের তিন পুত্র। জ্যেষ্ঠ দ্বারিকনাথ বাবার ব্যবসা ছাড়াও স্টিমার কিনে পরিবহন ব্যবসায়ে নেমে পৈতৃক সম্পদ আরও বাড়ান। মেজোছলে ইংল্যান্ড যান এবং এক ইংরেজ রমণীকে বিবাহ করেন। শ্যামাচরণ তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন। ছোটোছেলে অল্প বয়সে ধনুষ্টংকারে মারা যান। দ্বারিকনাথ একবার ক্রোধের বশে তাঁর এক কর্মচারীকে এমন প্রহার করেন যে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। এর দু—বছর পর তিনি স্ত্রীকে হাত—পা বেঁধে ছাদের এক কুঠুরিতে সাতদিন বন্ধ করে রাখেন। জলটুকুও খেতে দেননি। অবশেষে বাড়ির এক ঝি পুলিশে খবর দেয়। তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় ঘর থেকে উদ্ধার করা হয়। দ্বারিকনাথ তখন খুলনায় গিয়েছিলেন। পুলিশ তাঁকে সেখানে গ্রেফতার করতে গেলে তিনি স্টিমার থেকে নদীতে ঝাঁপিয়ে ডুবে মারা যান।

‘দ্বারিকনাথের তিন কন্যা ও এক পুত্র। বিবাহের তিন বছর পর বড়ো মেয়ে তরলাবালা উন্মাদ হয়ে যান। বাষট্টি বছর বয়সে তাঁর মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি বাপের বাড়িতে একটি বদ্ধ ঘরে নিঃসঙ্গ জীবন কাটান। কিন্তু পুত্র রামচন্দ্র বা অন্য দুই মেয়ে স্বাভাবিক জীবনই যাপন করে পরিণত বয়সে মারা যান। বস্তুত এই সময় থেকেই সেনগুপ্তদের পাগলের বংশ, এমন একটা ধারণা কলকাতায় চাউর হয়ে যায়। বৈবাহিক সম্বন্ধ গড়ার প্রস্তাব পরপর প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় বহু অর্থব্যয়ে দ্বারিকনাথ তাঁর বাকি দুই মেয়ের বিয়ে দেন বরিশাল ও রানাঘাটে, ছেলের জন্য কন্যা সংগ্রহ করেন হাওড়ার এক গ্রামের দরিদ্র পরিবার থেকে।

‘পৈতৃক ব্যবসায়ে রামচন্দ্র একেবারেই মনোযোগী হননি। তাঁর ঝোঁক ছিল শিল্পের দিকে। তিনি দক্ষ অভিনেতা ছিলেন। থিয়েটারে অর্থ বিনিয়োগ করে নাট্য কোম্পানি তৈরি করেন। রামচন্দ্রের আমলেই সেনগুপ্তদের বিত্ত ও বৈভবের দ্রুত পতন ঘটে। একের পর এক বিপর্যয় ঘটে। যাত্রীসহ একটি স্টিমার ডুবে যাওয়ায় বিশাল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। পাটের ব্যবসায় তদারকির অভাবে ও কর্মচারীদের চুরি ও শোষণে ছিবড়েতে পরিণত হয়। থিয়েটার ব্যবসাও দু—বছরের মধ্যে বন্ধ করতে হয় প্রভূত গুনাগার দিয়ে। বস্তুত যাবতীয় স্থাবর সম্পত্তি রামচন্দ্রই বিক্রি করে ফেলেন, শুধু বাড়িটি ছাড়া।

‘রামচন্দ্রর দুই ছেলে দুই মেয়ে। দ্বিতীয় ছেলে রমেশচন্দ্রই শোভনেশের বাবা। বড়ো ছেলে উমেশচন্দ্র নিঃসন্তান ছিলেন তাই শোভনেশের ছোটোভাই রমেশকে তিনি দত্তক নেন। উমেশ—রমেশের ছোটোবোন সুষমার বারো বছর বয়সেই মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ দেখা দেয়। যে—ঘরে তরলাবালা উন্মাদ জীবন কাটান, সুষমাকে সেই ঘরেই রাখা হয়।

‘বংশে প্রতি পুরুষেই একজন করে পাগল হয়েছে, এটা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল উমেশচন্দ্রকে। প্রথমে তিনি বিয়ে করতে রাজি হননি ছোটোবোনকে ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যেতে দেখে। কিন্তু ভীরু ও অলস প্রকৃতির উমেশচন্দ্র বাবার হুমকি, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবার শাসানি ও মায়ের অলঙ্কারাদি পাওয়ার লোভ সামলাতে পারেননি। তবে বিয়ের আগে গোপনে তিনি নিজেকে নপুংশক করিয়ে নেন এক চিকিৎসক বন্ধু দ্বারা।’

কলিংবেল বাজল। পড়া থামিয়ে রোহিণী উঠে গিয়ে দরজা খুলল। গৌরীর মা বাকি কাজ সারতে এসেছে। রান্নাঘরে ঢুকেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এ কি, ভাত নামাওনি। পোড়া গন্ধও কি পাচ্ছ না?’

রোহিণী ‘তাই তো’ বলে ব্যস্ত হয়ে ছুটে গেল। আবার চাল সেদ্ধ করতে বসিয়ে সে দুধ আর ঠান্ডা টোস্ট দাঁতে ছিঁড়ে চিবোতে চিবোতে রান্নাঘর থেকে বাটনা বাটার শব্দের মধ্যে ডুবে গিয়ে ভাবল, শোভনেশদের পারিবারিক এত কথা সিধারথ সিনহা নামের লোকটি জানল কী করে! প্রায় একশো পঁচিশ বছরের, পাঁচ পুরুষের ইতিহাস তো অবাঙালি কারোর পক্ষে সংগ্রহ করা সহজসাধ্য নয়!

পুরো লেখাটার আকার অনুযায়ী শোভনেশের সম্পর্কেই বেশি জায়গা খরচ হয়েছে, তুলনায় বাকি তিন ভস্মীভূত শিল্পীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে কমই। নানা কাগজে ম্যাগাজিনে প্রকাশিত সংবাদ থেকে তথ্য নিয়ে যতটুকু লেখা সম্ভব, উপর উপর শুধু ছুঁয়ে যাওয়া, তাইই। কিন্তু শোভনেশের ব্যাপারটা, খেটেখুটে খবর জোগাড় করে লেখা। ম্যাগাজিনটা বোম্বাই থেকে বেরোয়। সেখানে বসে এটা লেখা নয়, সেখান থেকে এসে এত পুরোনো সব কথা জোগাড় করা সোজা কাজ নয়।

তার মনে হচ্ছে, সম্ভবত লেখকের নাম সিদ্ধার্থ সিংহ। দেশের পাঠকদের বড়ো অংশের কাছে গ্রহণীয় হবার জন্য বাঙালিয়ানা খসিয়ে সিধারথ সিনহা হয়েছেন। যেমন হিন্দি ফিল্মে পদবি উড়িয়ে দিয়ে মিস্টার রাজেশ, মিস মিতা বলা হয়। ভারতের কোন জায়গার লোক বোঝে কার সাধ্য। আরও মনে হচ্ছে, এই সিদ্ধার্থ শুধু বাঙালিই নন, কলকাতারই বাঙালি। এঁকে খুঁজে বার করতে পারলে নিশ্চয় শোভনেশের পারিবারিক অনেক খবর পাওয়া যেতে পারে। অন্তত উনি কোথা থেকে এসব কথা জেনেছেন, ওঁর সোর্সটা কী, তা জানতে পারলেও হবে। বোম্বাইয়ে ম্যাগাজিনটার সম্পাদকীয় অফিসে চিঠি দিয়ে সিদ্ধার্থ সিংহর ঠিকানাটা আনতে পারলে লোকটির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়।

লেখাটায় যা সব বলা হয়েছে, তার বিন্দুবিসর্গ আজ সকাল পর্যন্তও সে জানত না। শোভনেশ তার পারিবারিক অতীত সম্পর্কে কোনোদিন একটি কথাও বলেনি। শুধু বলেছিল, ‘আমি একা। বাবা—মা নেই। একটা ভাই, সে আলাদা থাকে, তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। অল্প বয়সে বাবার চাপে পড়ে বিয়ে করেছিলাম, বউ মারা গেছে।’

‘বিয়ে হয়েছিল! কত বছর বয়সে?’

‘কুড়ি—একুশে।’

‘কী করে মারা গেল?’

‘ম্যালিগন্যান্ট টাইফয়েডে।’

‘দেখতে কেমন ছিল? ছবিটবি আছে?’

‘ছবি রাখা আমি পছন্দ করি না। আর এত বছর আগের চেহারা, মুখ এখন চেষ্টা করলেও মনে করতে পারব না।’

গৌরীর মা দালান মুছছে। চেয়ারে সে বাবু হয়ে বসে। চঞ্চলা কাল বিস্কুট কিনে এনেছিল, রোহিণী ঠোঙাটা রাতে বাটি চাপা দিয়ে রাখে। এখন বাটি তুলে সেটা দেখে সে একটা বিস্কুট মুখে পুরল। খবরের কাগজটার পাতা আর একবার উলটে দেখে নিল। একটা লাইনও বহরমপুরের খবর নেই।

তাকে অন্যমনস্ক দেখে গৌরীর মা বলল, ‘মাছ নিয়ে আমার সঙ্গে ওপরে চলো, আলাপ করিয়ে দোব। মাসিমা একদিন দুখ্যু করে বলল, বুড়োবুড়ি বলে কেউ গপ্পোটপ্পো করতেও আসে না। বসে বসে শুধু টিভি দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। ছেলে, ছেলের বউ কোচিন না মোচিন কোথায় যেন থাকে, মেয়ে জামাই বিলেতে। নাও ওঠো, চুলটা একটু আঁচড়ে নাও, বুড়ি একটু সেকেলে, সিঁদুর আছে? আচ্ছা থাক আজকাল অফিসের মেয়েরা অত সিঁদুরমিদুর দেয় না। বরং একটা লাল টিপ পরে নাও, আছে তো?’

‘খুঁজতে হবে।’

গৌরীর মা নিজের কপাল থেকে টিপটা খুলে রোহিণীর কপালে সেঁটে দিয়ে বলল, ‘সাজগোজের দিকে তোমার একদম নজর নেই। স্বামী নিরুদ্দেশ হলেও, সধবা তো! হ্যাঁ দিদি, খোঁজটোজ চালাচ্ছ তো?’

‘কোথায় আর খোঁজ চালাব, বলো। আশি—পঁচাশি কোটি লোকের দেশ, সহজ তো নয়!’

‘তারকেশ্বরে হত্যে দাও একবার।’

‘হ্যাঁ তাই দোব ভাবছি। চলো এবার।’

দু—জনে পলিথিন ব্যাগে মোড়া মাছ নিয়ে উপর তলায় উঠে বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করছে। রোহিণী পিছনে মুখ ফিরিয়ে তুষার দত্তর ফ্ল্যাটের খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে তাকাল। দেওয়ালে কাচের পাল্লা দেওয়া আলমারিতে ডিনার সেট, সাজিয়ে রাখা। বিয়েতে পাওয়া। আঠারো বছরে একবারও ব্যবহারের সুযোগ আসেনি। স্টিলের থালা বাটি গ্লাসও সাজানো হয়েছে। আর একটা তাকে কয়েকটা রাজস্থানি মেয়ে পুঁতুলের সঙ্গে প্লাস্টিকের পুতুলও। আর এক তাকে তুষার দত্তর পেশি ফোলানোর ফসল কয়েকটা কাপ মেডেল। দেওয়ালেও জাঙ্গিয়া পরা তুষার দত্তর চার রকম ভঙ্গির ছবি, বহিরাগতদের যেন অস্বস্তির উপাদান জোগাতেই টাঙানো। হঠাৎ প্রেশার কুকারের বাষ্প নিঃসরণের তীক্ষ্ন আওয়াজ হল। ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে নন্দা খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই থমকে গেল আড়ষ্ট হয়ে। রোহিণী হাতছানিতে তাকে ডাকল।

‘আমার পরিচিত একজন জয়পুর যাচ্ছে, তাকে বলব তোমার জন্য…একটা আনতে। ওখানে দারুণ দারুণ প্রিন্টের পাওয়া যায়, কাচ বসানো।’

‘একটা’ কী জিনিস যে আনতে বলবে, সেটা আর বলার দরকার হল না। নন্দার মুখ উজ্জ্বল হয়েই ফ্যাকাসে হল।

‘বাবা ওসব পরা পছন্দ করে না। আমি দুপুরে আপনার ঘরে গিয়ে পরেছিলাম। চঞ্চলা তখন ছিল, ওকে বারণ করেছিলুম আপনাকে যেন না বলে।’

‘ঠিক আছে, আমি কিছু মনে করছি না।’

ইতস্তত করে নন্দা কী একটা বলতে যাচ্ছে, সেই সময় ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল। এক ছোটোখাটো চেহারার, স্নিগ্ধ মুখ, গৌরবর্ণা মহিলা ওদের দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে। বয়স ষাট—পঁয়ষট্টির মধ্যে।

‘মাসিমা, এই যে দিদি এসেছে।’

‘ওহ, এসো ভেতরে এসো। মাছ রাখবে তো? তোমার নাম তো রোহিণী।’

‘হ্যাঁ। আগে আমি কখনো এমন ঝামেলায় তো পড়িনি।’ রোহিণী কুণ্ঠিত স্বরে বলল। মাছ আনলাম, রেঁধে খেয়েও ফেললাম। তুলেটুলে রাখার মধ্যে আমি নেই। রাতে খাই নিরামিষ। কিন্তু আজই—’

‘শুনেছি, গৌরীর মা—ই বলেছে। বসো। ‘তুমি’ বলছি বলে—’

‘না না, নিশ্চয় বলবেন, মায়ের বয়সি আপনি।’ রোহিণী বসার জন্য ব্যস্ত হল না।

‘তা ছাড়া দিদি আপনাদেরই স্বজাত বদ্যি। ছোয়াছুঁয়ির আর কথাই উঠবে না।’

‘বদ্যি নাকি! তবে আমি অত জাতটাতের বাছবিচার করি না। তুমি নিজেই রেখে দাও।’

দালানের প্রান্তে রাখা ফ্রিজের কাছে গিয়ে পাল্লা খুলে মহিলা ডিপ ফ্রিজের ডালাটা টেনে বললেন, ‘এর মধ্যেই রাখ।’

রাখার সময় রোহিণী দেখল, প্লাস্টিকের সাত—আটটা কুলপি ভেতরে রয়েছে। নীচের তাকে কয়েকটা ঢাকা বাটিতে রান্না করা খাদ্য, জলের আর সিরাপের বোতল, মাখনের কৌটো। রোহিণীর চোখের দিকে নজর রেখেছিলেন মহিলা। বললেন, ‘একটা মালাই চেখে দেখবে নাকি?’

‘না না, আমি এই সকালে ঠান্ডা খাব না।’

‘কাল গুরুভাই এসেছিলেন। আমরা তো বারাসাতের বিনোদানন্দ ব্রহ্মচারীর শিষ্য। একটাই মালাই তখন পড়ে ছিল, তাই দিলাম। খেয়ে খুব ভালো লেগেছে বলায় বললাম, আজ আসুন, বেশি করে খাওয়াব।’

‘আমাকে অন্য আর একদিন করে খাওয়াবেন মাসিমা। আমারও খুব ভালো লাগে।’ রোহিণী ক্ষীণভাবে স্বরটা আবদেরে করল। খুশিতে টসটস করে উঠল ওঁর মুখ। প্রীত কণ্ঠে বললেন, ‘খেলে বুঝতে পারবে, দোকানের থেকে আমার মালাইয়ের পার্থক্যটা কত।’

‘হ্যাঁ দিদি, মাসিমার হাতের রান্না খুব ভালো, সেদিন জিরে—গোলমরিচ দিয়ে যা কচুর মুখি রেঁধেছিলেন না!’

গৌরীর মা—র তারিফটা উপভোগ করে উনি বললেন, ‘তোমার শ্বশুরবাড়ি কোথায়?’

রোহিণী ধরেই রেখেছে, গৌরীর মা তার সম্পর্কে যতটুকু জানে, সবিস্তারে নিশ্চয় এঁর কাছে তা বলেছে। তবে এটা জানে না, তার শ্বশুরবাড়ি কোথায়। কাউকে সে জানাতে চায়ও না। যদি হঠাৎ চেনাশোনা বেরিয়ে যায় তাহলে আবার এক ধরনের ফিসফিসে কৌতূহলের পাত্রী হয়ে পড়তে হবে।

‘মাসিমা, আমি এখন আসি, দিদি চললুম, এখনও কাজ পড়ে আছে।’ ব্যস্ত গৌরীর মা আর এক ফ্ল্যাটের কাজ শেষ করতে গেল।

‘সেন্ট্রাল ক্যালকাটায়, বউবাজারের দিকে।’

‘ওমা! আমরাও তো একসময় বউবাজারেই থাকতাম। পঁচিশ নম্বর দিগম্বর বর্ধন লেনে।’

শোনা মাত্রই রোহিণী মাথা ঘুরে প্রায় পড়ে যাবার মতো আঘাত পেল তার স্নায়ুকেন্দ্রে। ওটা তার শ্বশুরবাড়িরই ঠিকানা। ডাইনিং টেবলের একটা চেয়ার টেনে ধীরে ধীরে সে বসে পড়ল।

‘কবে ছিলেন?’ দমবন্ধ অবস্থায় রোহিণী জানতে চাইল।

‘আমার বিয়ের ঠিক পরেই। বছর চল্লিশ আগে তো বটেই। ওঁর অফিস ছিল মৌলালিতে, হেঁটেই যেতেন। তখন যুদ্ধের শেষের দিকে। আমরা ও বাড়িতে যাওয়ার কয়েক মাস পর ব্ল্যাক আউট উঠে গেল। আমার বড়োছেলে তখনই হয়।’

‘সে বাড়িতে কে কে ছিল?’

‘আমরা ছাড়াও, একতলায় আরও দু—ঘর ভাড়াটে ছিল। বাড়িওয়ালারা থাকত দোতলায়, পেল্লায় বাড়ি দু—ভাইয়ের, ওরাও বদ্যি, পার্টিশান করে পাঁচিল তুলে দু—ভাই আলাদা। এক সময় বিরাট ধনী ছিল, কিন্তু বসে বসে খেলে যা হয়। শেষে এমন অবস্থায় পড়ল যে, ভাড়াটে বসাতে হল। অনেকটা জমি ছিল বাড়ির সঙ্গে, গাছপালাও। আমরা দেখেছি কয়লার ডিপো আর রিকশার খাটাল হল সেই জমিতে, এক ডেকরেটার বাঁশ রাখত।’

‘বাড়িওয়ালার পরিবারে কে কে ছিল?’

‘ওরা তো দুই ভাই। বড়োভাইয়ের ছেলেপুলে হয়নি, তাই ছোটোভাইয়ের দুই ছেলের মধ্যে ছোটোটিকে পুষ্যি নেয়। এরা বাঁদিকের পোর্সানে থাকত, আর আমাদের বাড়িওয়ালা রমেশবাবুরা ডানদিকে। বড়োছেলে শোভনেশ, আর্ট কলেজে পড়ত, তখনই বাপ ওর বিয়ে দিয়ে দেয়।’

‘তখন ছাত্র তো, অত কম বয়সেই ছেলের বিয়ে দিয়ে দিল?’

‘ছেলে তো করতেই চায়নি, একদিন সে কী ঝগড়া বাপ আর ছেলেতে। আমি তখন ছাদ থেকে নামছি শুকনো কাপড় তুলে। শুনলাম—’ মহিলা কথা থামিয়ে মাথা নাড়তে লাগলেন। ‘সে—সব কথা মুখে আনা যায় না, তোমার মতো অল্পবয়সিদেরও বলা যায় না। আমরা ও—বাড়িতে যাওয়ার পর পাড়ার লোকের কাছে শুনি, সেনগুপ্তদের নাকি পাগলের বংশ। প্রতি পুরুষে হয় কোনো ছেলে নয় কোনো মেয়ে, একজন না একজন পাগল হয়েছেই। পাগল রাখার জন্য ওদের একটা ঘরই আছে। বুঝলে রোহিণী, ঘিঞ্জি এলাকায় বসবাসের অনেক অসুবিধে যেমন, তেমনি সুবিধেও অনেক আছে। এইরকম ফ্ল্যাটে দরজা বন্ধ করলেই একা, জানলা দিয়েও পাশের বা সামনের বাড়ি পাওয়া যায় না। ছাদ থেকেও গল্পসল্পর উপায় নেই। কিন্তু গলিতে বাড়ি হলে, সদর তো সবসময়ই খোলা জানলায় কী বারান্দায় দাঁড়াও, সবসময় কথা বলার লোক পাবেই। ভাড়াটে ভরতি বাড়ি হলে তো কথাই নেই, ঝগড়াঝাটি করেও সময় কেটে যায়। ও পাড়ায় প্রত্যেকের হাঁড়ির খবর প্রত্যেকে রাখত। আমাদের বাড়িওয়ালার সম্পর্কেও অনেক কথা শুনেছি। শুনে খুব ভয় ধরে গেছিল।’

‘কেন?’ রোহিণীর মস্তিষ্কের কোষগুলো সজাগতার তুঙ্গে পৌঁছল। এতক্ষণে আসল জায়গায় কৌতূহল তার জানার বিষয়টায় পা রেখেছে। ‘ভয় পাওয়ার মতো কী শুনেছেন?’

‘ভয় পাব না? কেউ—না—কেউ পাগল হয়ে আসছে পাঁচ পুরুষ ধরে, এই পুরুষে কেউ এখনও হয়নি, কিন্তু হবেই—কে হবে? পাড়ার লোকেরা তো এই নিয়ে রীতিমতো জল্পনাকল্পনা করত। পঞ্চাশ—ষাট বছর বয়সেও পাগল হয়েছে, আবার দশ—বারো বছর বয়সেও হয়েছে। কখন যে কে হবে, তার ঠিক নেই। বাপ—জ্যাঠার বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু তারাও তখন পাগল হতে পারে আবার শোভনেশ আর তার ভাই পরমেশও পাগল হয়ে যেতে পারে। সে যে কী এক যন্ত্রণাকর অবস্থা, ভাবলে তো সুস্থ মানুষও পাগল হয়ে যাবে।’

‘দারুণ ইন্টারেস্টিং তো মাসিমা, অদ্ভুত ব্যাপার! ওরাও কি এই নিয়ে ভাবত না?’

‘ভাবত না আবার! সিঁটিয়ে থাকত সবসময়। যাগযজ্ঞি শান্তি স্বস্ত্যয়ন তো লেগেই ছিল। তাবিজ তাগা, মাদুলি, আংটি, জ্যোতিষী, গণৎকার থেকে শুরু করে স্পেশালিস্ট ডাক্তার দেখানোও হয়েছে। কেউ একজন পাগল হলে ওরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, কিন্তু কেউই হচ্ছে না। এ যে কী সমস্যা, কী যন্ত্রণা ভাবলে এখন হাসি পায় বটে, কিন্তু যদি তুমি তখন ওই বাড়িতে থাকতে—তাহলে বুঝতে।’

মহিলা হাসলেন না। রোহিণীর হাতের আঙুলগুলো একবার কেঁপে উঠল। ওই বাড়িতে সে কয়েক মাস থেকেছে। কিন্তু কিছুই কি তখন তাকে অবাক করেনি? অমাবস্যা আর পূর্ণিমায় শোভনেশ বাড়ি থেকে বেরোত না। সারাদিন ছবি আঁকার ঘরে নিজেকে যেন বন্দি করে রাখত। একবার রোহিণী জুতো কিনতে যাবার জন্য তাকে সন্ধ্যায় বেরোতে বলেছিল। শোভনেশ রাজি হয়নি। ‘আজ অমাবস্যা, দিনটা ভালো নয়।’ অবাক হয়ে সে বলেছিল, ‘তুমি এসব মানো নাকি? এই ধরনের কুসংস্কার—’ তার কথা শেষ হবার আগেই অস্বাভাবিক চাহনিতে তীব্র স্বরে শোভনেশ বলে, ‘যা জানো না, তাই নিয়ে কথা বলো না। আমাদের বংশে এসব মানা হয়। দরকার থাকলে তুমি বেরোতে পার, তোমার শরীরে সেনগুপ্তদের রক্ত নেই।’

রোহিণী তখন কথাগুলোর অর্থ ধরতে পারেনি। তাই নিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহসও তখন ছিল না। কিন্তু এ ছাড়াও তাকে অবাক করার মতো আরও কিছুও তো ঘটেছিল।

‘শোভনেশ মাঝে মাঝে আমাদের ঘরে আসত। এসেই বলত ‘বউদি কিছু বুঝতে পারছেন?’ বুঝতে পারা মানে, পাগল হবার লক্ষণটক্ষণ দেখা যাচ্ছে কিনা সেটাই। আমি বরাবরের মতোই বলতাম, ‘তোমার দাদার মধ্যে যতটুকু দেখি, তোমার মধ্যেও ঠিক তাই দেখতে পাচ্ছি।’ শুনে খুশি হত। বিয়ের পর ওর ছটফটানি যেন বাড়ল। আমার স্বামীকে একদিন বলেছিল, ‘আমার সন্তান হওয়া কি উচিত? দাদা আপনি কী বলেন? বংশের এই ব্যাধিটা থামিয়ে দেওয়া দরকার। পরমেশকে বলেছি বিয়ে করিসনি, এমনকী তোর ঔরসেও যেন কারোর গর্ভে সন্তান না হয়, সেটা দেখিস। কিন্তু ও রাজি নয়। বউকে বলেছি, ‘আমাদের কোনো ছেলেপুলে হবে না। সেও রাজি নয়। ঠিক করেছি, আমি অপারেশন করিয়ে নেব। করলে কী অন্যায় হবে?’ উনি আর কী বলবেন, তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর, বলে এড়িয়ে গেলেন।’

‘বউ মারা গেল কীভাবে?’

মহিলা এবার অবাক হয়ে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ‘তুমি জানলে কী করে?’

হিম হয়ে গেল রোহিণীর বুক। হঠাৎই তার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে এসেছে। শোভনেশের বউয়ের মৃত্যু নিয়ে উনি তো এখনও একটা কথাও বলেননি। ব্যাপারটা সামলাবার জন্য সে হালকা স্বরে বলল, ‘এসব লোকের বউয়েরা সাধারণত বাঁচে না। আমার এরকম ঘটনা জানা আছে, স্বামীর বাতিকে উত্ত্যক্ত হয়ে একজনের বউ গলায় দড়ি দেয়, আর একজনের বউ অবশ্য পালিয়ে বেঁচেছিল। দু—জনেই ধনী, বনেদিবাড়ির বউ ছিল। তাই মনে হল—।’

‘শোভনেশের বউ যখন মারা যায়, আমরা তখন একটা বিয়ের নেমন্তন্নে টালিগঞ্জ গেছিলাম। দোতলার বড়ো ঘরটার জানলাগুলোয় গরাদ নেই। সেখান থেকে লাফিয়ে নাকি নীচে পড়ে, পেটে চার মাসের বাচ্চচা ছিল। আমাদের কিন্তু অন্যরকম মনে হয়েছিল।’

‘কী মনে হয়েছিল, খুন?’ রোহিণীর স্বর অস্ফুট হয়ে গেল, শ্বাসনালিতে উত্তেজনার চাপ পড়ায়।

‘হ্যাঁ। শুধু আমরা কেন পাড়ার লোকেও তাই মনে করে। কমলার মতো ঠান্ডা শান্ত মেয়ে, আঠারো—উনিশ বছর বয়সে কেন আত্মহত্যা করতে যাবে বলো, তার ওপর পেটে বাচ্চচা?’

‘কিন্তু ওর স্বামী তো অপারেশন করে নেবে বলেছিল, তাহলে আবার বউয়ের পেটে বাচ্চচা এল কী করে?’

‘করেছিল কী করেনি তা বাপু আমরা জানি না, আমাদের আর কিছু বলেওনি শোভনেশ। পরে আর তো আমাদের সঙ্গে কথাই বলত না।’

‘টর্চার করত?’

‘তেমন কিছু তো দেখিনি।’

‘তখন কি ছবি আঁকত?’

‘ঘরে বসে বসে আঁকত। আমি তো আঁকার ঘরে ঢুকিনি কখনো।’

‘এখন সেই শোভনেশ কোথায়, ওই বাড়িতেই আছে? আবার বিয়েটিয়ে করেছে?’

‘তা বলতে পারব না। কমলা মারা যাবার পর, ছাদের দরজায় তালা দিয়ে দিল। আর উপরে যেতে পারি না, তাই নিয়ে ঝগড়াও হল। ইতিমধ্যে উনি বদলি হলেন জলন্ধরে, সেন্ট্রাল গরমেন্টের চাকরি তো, তারপর থেকেই বাংলার বাইরে বাইরে ঘোরা। কলকাতার কোনো খবর পর্যন্ত রাখিনি। রিটায়ার করে এই চার বছর হল আমরা এসেছি। মাঝে মাঝে ভাবি একবার ঘুরে আসি দিগম্বর বর্ধন লেনে, তখনকার মানুষরা কে কেমন আছে দেখতে ইচ্ছে করে। বাড়িটার এখন কী দশা কে জানে।’

কলিং বেল বাজল। উনি গিয়ে দরজা খুললেন।

‘নীচের আন্টি আছেন?’ নন্দার গলা পেয়ে রোহিণী উঠল।

‘আন্টি, আপনার ফোন।’

একবার শুধু ভ্রূ কুঁচকেই রোহিণী বিরক্তি চেপে মুখে হাসি টেনে বলল, ‘আসি মাসিমা। খুব ভালো গল্প বলেন, আবার একদিন এসে শুনব। রাতে এসে মাছ নিয়ে যাব।’

দ্রুত পায়ে এসে টুলের উপর রাখা ফোনের রিসিভারটা তুলে সে চাপা স্বরে বলল: ‘হ্যালো।’

‘রান্না জানার প্রমাণ আজ দিচ্ছ তো?’

‘তোমাকে বলেছি না, খুব দরকার না পড়লে এখানে ফোন করবে না।’

‘খুব দরকারেই তো করছি। তোমার কি মনে হয়, প্রথম বলেই আউট হওয়াটা খুব মর্যাদাকর ব্যাপার হবে?’

‘আমার শরীর, মন আজ খুব ক্লান্ত, নানারকম চাপ…তুমি দুপুরে ফোন কোরো অফিসে।’

‘কীসের চাপ, ফোনে কী তা বলা যায়?’

‘দেখা হলে বলব। তোমাকে হয়তো আমার এবার দরকার হবে।’

‘খুব দরকার হলে আমি দেখা করব না, আর খুব খুব—’

‘রাজেন!’ রোহিণী গম্ভীর ধমক দিল। ‘তুমি যে প্রথম বলেই বোল্ড হবে, সেটা এখনি বুঝতে পারছি। সিরিয়াস হও। ইলিশ মাছ আনিয়েছি, আর একটি কথাও নয়।’

রিসিভার রেখে রোহিণী হাসল নন্দার দিকে তাকিয়ে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নন্দা ‘আন্টি’ বলে ডেকে, দ্রুত নেমে তার পাশে এল।

‘চঞ্চলা আর আসেনি?’

‘না তো, কেন?’

‘আন্টি, আমি কিন্তু ওকে ভয় দেখাইনি। ও বললেও তা বিশ্বাস করবেন না।’ নন্দার কাতর আবেদনভরা মুখটির দিকে তাকিয়ে রোহিণী অবাক হল।

‘ও হয়তো তাই বলবে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, লোকটাকে দেখে আমিও ভয় পেয়ে গেছিলাম।’

‘কে লোকটা? কীরকম দেখতে?’

‘খুব লম্বা, রোগা, আর ইয়া ঝাঁকড়া কাঁচাপাকা চুলদাড়ি, ভুরুটাও পাকা, ইয়া লম্বা জুলপি, সরু সরু চোখ দুটো দেখলে ভয় করে, যেন জ্বলছে!’

‘কোথায় লোকটা?’ রোহিণী প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। এ তো শোভনেশ!

‘জানি না। আমি ম্যাকসিটা পরে নীচে সংঘমিত্রাকে দেখাতে গেছিলাম। তখন ওদের জানলা দিয়ে দেখি, ওই লোকটা গেট দিয়ে ঢুকছে। ঢুকে এধার—ওধার কেমন যেন তাকাচ্ছে। কাঁধে একটা নানান কাপড়ের তাপ্পিমারা ঝোলা। তারপর উপরে গিয়ে আপনার কলিংবেল বাজালাম, কিন্তু দরজা আর খুলছে না। শেষে ধাক্কা দিয়ে ‘চঞ্চলা চঞ্চলা’ বলে নাম ধরে ডাকতে ও দরজা খুলল। দেখি, ভয়ে মুখ একদম ফ্যাকাসে।’

নন্দা যদি একটু ভালো করে নজর করত, তাহলে হয়তো বলত, আন্টি, ঠিক আপনার এখনকার মুখের মতো। কিন্তু বর্ণনাটা গুছিয়ে, শ্রোতার মনে দাগ কাটানোর চেষ্টায় তখন সে ব্যস্ত।

.

নন্দা ঢোঁক গিলে আবার শুরু করল, ‘প্রথমেই বলল, ছেলেধরা এসেছিল। আমি তো শুনে অবাক! জিজ্ঞাসা করলাম, কখন এসেছিল? বলল এইমাত্র। কলিংবেল টিপতেই দরজা খুললুম, দেখি, একটা ছেলেধরা কাঁধে ঝুলি নিয়ে দাঁড়িয়ে। লোকটা কটমট করে তাকিয়ে বলল, তুমি কে? এই বলে ভেতরে তাকিয়ে এধার—ওধার দেখতে লাগল। তারপর ঝুলি থেকে একটা কাগজ বার করে বিড়বিড় করে পড়ে বলল, ‘এটা কত নম্বর ফ্ল্যাট?’ চঞ্চলার তখন অজ্ঞান হয়ে যাবার মতো অবস্থা। কথা বলতে পারছিল না। লোকটা তখন বলল, ‘এখানে কে আছেন, তাঁকে ডাকো।’ চঞ্চলা বলল, ‘কেউ নেই এখন, মাসিমা বেরিয়ে গেছে। আমি একা আছি।’ এই বলেই ও দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর আমি ওপর থেকে নীচ খুঁজলাম, কিন্তু লোকটা যেন হাওয়া হয়ে গেছে, কোথাও দেখতে পেলাম না। চঞ্চলা বলল ‘আমি আর এখানে থাকব না।’ আমি কত ওকে বোঝালাম, ছেলেধরাটরা সব বাজে কথা, ওরা দুপুরে এভাবে এসে ধরে না, আর ধরলেও তোকে ধরবে না। কিন্তু কে শোনে আর সে কথা, গোঁ ধরে রইল—’আন্টি, আপনার কি পায়ের যন্ত্রণাটা আবার হচ্ছে?’

‘না না আমি ঠিক আছি। তুমি আইসব্যাগটা বরং নিয়ে যাও।’

রোহিণীর মনে হচ্ছে, তার দুই হাঁটুতে বাত হয়েছে। সে বৃদ্ধা হয়ে গেছে। হাঁটাচলার ক্ষমতা রহিত। নন্দা ব্যাগটা নিয়ে চলে যেতেই সে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কোনো সন্দেহ নেই লোকটা কে হতে পারে। কিন্তু কীভাবে জোগাড় করল তার এখানকার ঠিকানা?

যতই সে ভাবতে লাগল, তার ভয়টা ক্রমশ নিজের প্রতি রাগে রূপান্তরিত হতে শুরু করল। কেন সে এই লোকটিকে বিয়ে করতে গেল? বোম্বাইয়ে দিদিকে টেলিফোনে যখন সে বিয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানায় তখন দিদি বারণ করে বলেছিল, ‘রুনি, আর্টিস্টরা সাংঘাতিক লোক, এদের বিশ্বাস করিসনি। এরা অন্য প্রকৃতির হয়, এরা আলাদা জগতের লোক। সত্যিমিথ্যে দিয়ে বানিয়ে বানিয়ে মনগড়া জিনিসকে আসল বলে চালায়, তাইতে বোকারা কনফিউজড হয়। তোরও সেই দশা হয়েছে। তুই ভুল করিসনি। তোর জন্য অনেক অনেক ভালো পাত্র পাওয়া যাবে, আমি জোগাড় করে দেব এখানে।’

দিদির কথা শুনলে আজ এই অবস্থা তার হত না। মা তখন বেঁচে। শুধু বলেছিলেন, ‘তোমার মন যা চায় তাই করো, তুমি এখন সাবালিকা।’ বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়ে যাবার তিন দিন পরই দিদি বোম্বাই থেকে সকালের ফ্লাইটে এসে মাকে নিয়ে রাতের ফ্লাইটেই ফিরে যায়। বিশেষ কোনো কথাবার্তা হয়নি। যাবার সময় শুধু বলে যায়, ‘চাকরিটা ছেড়ো না, ভবিষ্যতে এটাই তো সম্বল করে বাঁচতে হবে।’ শোভনেশের মামলার রায় বেরোতেই দিদি টেলিফোন করে বলেছিল, ‘যা বলেছিলাম সেটা এখন মিলিয়ে নে। রঞ্জন বলেছে, আর তোকে কলকাতায় থাকতে হবে না। প্লেনের টিকিট পাঠাচ্ছি, দু—হপ্তার মধ্যে এখানে পৌঁছচ্ছিস এটাই আমি দেখতে চাই।’ চাকরি আর ভাড়া বাড়ি ছেড়ে, গঙ্গাদার আপত্তি সত্ত্বেও, সে দিদির কাছে চলে গেছিল।

এক ঘণ্টা পর, আরামদায়ক রৌদ্রের মধ্যে তিন নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে মিনিবাসের জন্য যখন সে দাঁড়াল, তখন তার কাঁধ ঝুলে পড়েছে, মাথা সামান্য ঝোঁকানো, ঝোলটার একটা কোণ শক্ত মুঠিতে ধরা আর চোখে শূন্য চাহনি।

.

‘তাহলে কাল সকালেই, দশটায়।’ টেলিফোন রেখে প্রশান্ত হালদার তাকালেন রোহিণীর মুখের দিকে। ‘অসুবিধে হবে না তো?’

‘না।’ ইতস্তত করে তারপর সে বলল, ‘কার সঙ্গে আপনি কথা বললেন?’

‘মীনার সেক্রেটারি কাম গার্জিয়ান সুভাষ গায়েন, যার সঙ্গে কাল তুমি কথা বলে এসেছ।’

‘আমার সম্পর্কে কিছু বলল?’

‘না তো? কেন, বলার মতো কিছু হয়েছে নাকি?’

‘না, লোকটাকে খুব রাফ মনে হচ্ছিল। আমিও একটু মাথা গরম করে ফেলেছিলাম, অবশ্য অন্য একটা ব্যাপারে।’ প্রশান্ত হালদার জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছেন দেখে রোহিণী যোগ করল, ‘ঘরে একটা ছবি টাঙানো ছিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম বলে লোকটা বিশ্রীভাবে জবাব দিয়েছিল।’

‘কী ছবি?’

‘একটা পেইন্টিং, ন্যুড মেয়ের।’

‘মীনার?’

‘না না অন্য কারোর।’

‘আহহ।’ প্রশান্ত হালদারের সিধে হয়ে যাওয়া শিরদাঁড়াটা আবার চেয়ারে, পিঠে নেতিয়ে পড়ল। ‘মীনার হলে ছবি তুলিয়ে এনে ছাপতুম।’

‘গঙ্গাদা কখন আসবেন বলেছেন কিছু?’

‘সময় তো হয়ে গেছে। খুবই ব্যস্ত এখন। আর একটা অফসেট ছাপার মেসিন কেনা হচ্ছে, বেলেঘাটার বাড়ি কমপ্লিট হলেই আসবে। তখন আমাদের সবাইকেই ওখানে চলে যেতে হবে। তা ছাড়া ম্যাগাজিনগুলোকে ট্রেন্ডি, ক্যাচি, আপবিট করারও তোড়জোড় হচ্ছে। নতুন ডিজাইনে মহারানি, চিত্ররেখা বেরোবে। অনেক ফিচার উঠে যাবে, নতুন নতুন ফিচার আসবে। গঙ্গাবাবু এজন্য বোম্বাইয়ের এক ডিজাইনিং কনসালট্যান্টের ওপর ভার দেবেন ঠিক করেছেন, কেন তুমি এসব শোননি?’

‘না তো! কবে ঠিক হল?’

‘গত হপ্তায় আমাকে বলেছেন।’

টেবিলের ওধারে একজোড়া বিস্মিত চোখ। রোহিণী অপ্রতিভ বোধ করল। সবাই জানে, সে গঙ্গাপ্রসাদের কাছের লোক, ভিতরের খবরাখবর জানে। কিন্তু গঙ্গাদা এইসব পরিকল্পনার কিছুই তাকে বলেননি। এটা গোপন রাখার মতো একটা ব্যাপার কী? হঠাৎ তার মনে হল; শোভনেশ সম্পর্কেও অনেক কথা উনি লুকিয়েছেন, যা বিয়ের আগেই জানালে আজ এই দশা তার হত না।

ফোন বেজে উঠল। রিসিভার কানে দিয়েই প্রশান্ত হালদার সেটা রোহিণীর দিকে বাড়িয়ে বললেন, ‘তোমার।’

‘হ্যালো।’

‘কখন বেরোবে?’

‘পাঁচটায়।’

‘মাছটা ততক্ষণে যদি বেড়াল—টেড়ালে খেয়ে ফেলে?’

‘খাবে না। ঠিক পাঁচটায়।’

‘যদি পৌনে ছ—টায় যাই?’

‘ঠিক পাঁচটায়।’ রোহিণী রিসিভার এগিয়ে দিল চিঠি পড়ায় মগ্ন প্রশান্ত হালদারের দিকে। তিনি হাত বাড়িয়ে সেটা নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘বিপ্লব আসেনি, বোম্বে থেকে যে কপি এসেছে সেগুলো দ্যাখো আর ছবির ক্যাপসন করে দাও।’

আধঘণ্টা পর গঙ্গাপ্রসাদ এলেন এবং প্রশান্ত হালদারকে ডেকে পাঠালেন। মিনিট পাঁচেক পর তিনি ফিরে এসে রোহিণীকে জানালেন, ‘তোমাকে ডেকেছেন।’

দুই তালুতে গাল চেপে একদৃষ্টে টেবলের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন গঙ্গাপ্রসাদ। রোহিণী চেয়ারে বসল উৎকণ্ঠা নিয়ে। রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে যে খবর নিয়ে এসেছেন, সেটাই বলার জন্য ডেকেছেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ভালো খবর নয়। আশঙ্কায় তার বুক ঢিপ ঢিপ করে উঠল।

‘বহরমপুরে আমার এক চেনা ব্যবসায়ী বন্ধু আছে। আজ সকালে বাসুদেবপুর থেকে ফিরেই তাকে ট্রাঙ্ককল করেছিলাম। ওখানে ভীষণ টেনশান এখন। কম্যুনাল ব্যাপার। কুড়ি—পঁচিশজন মারা গেছে, ই এফ আর, স্টেট আর্ম পুলিশ নেমেছে। লালগোলা, ভগবানগোলা, কাশিমবাজার, নসিপুর স্টেশনেও দাঙ্গা হয়েছে। পুলিশ এখন ভীষণ ব্যস্ত, কোনোদিকে তাদের নজর রাখার ফুরসতই নেই। ব্যাপারটা যেকোনো লেভেলে গেছে, কাগজ পড়ে তা বোঝা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে যদি কেউ জেল থেকে পালায়—খুবই সম্ভব পালানো। বলেছে, খোঁজ নিয়ে আমাকে বিকেলেই জানাবে। আমি ফোনের জন্য অপেক্ষা করছি।’

গঙ্গাপ্রসাদ ঘড়ি দেখলেন, ভ্রূ কোঁচকালেন। তারপর আবার বললেন, ‘রাইটার্সেও ব্যস্ত সবাই। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে এক আন্ডারট্রায়াল আসামি পালিয়েছে। দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে তো আটজন নকশাল পালিয়েছিল, তারপর এইসব ঘটনা। আবার এদিকে আলিপুর জেলের সুপারকে ঘেরাও করেছে কর্মচারীরা, তাই নিয়ে হই হই। জেল গেটে ডিউটি দেয় এক খুনের আসামি, সে নাকি বাইরে থেকে খবরাখবর চালান করে ভেতরে, তাকে সরাবার দাবি নিয়েই ঘেরাও। লালবাজার থেকে অ্যাডিশনাল ফোর্স গেছে। জেল মন্ত্রী, আই জি প্রিজন্স, হোম সেক্রেটারি আলোচনায় বসেছে, এর মধ্যে কে আর বহরমপুর জেল থেকে পালানোর খবর দেবে?’

গঙ্গাপ্রসাদ ও রোহিণী পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল। কারোরই আর কিছু যেন বলার নেই। অবশেষে দু—জনে চোখ সরিয়ে নিল।

ফোন বেজে উঠল। গঙ্গাপ্রসাদ ব্যস্ত হাতে রিসিভার তুললেন, রোহিণীর মুখটা চট করে দেখে নিয়ে।

‘হ্যালো, কে নির্মল?’ গঙ্গাপ্রসাদ ঘাড় নাড়লেন কাঠ হয়ে যাওয়া রোহিণীর দিকে তাকিয়ে।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ শোভনেশ সেনগুপ্ত…অ, অ, হ্যাঁ…হসপিটাল থেকে? সে কি নাম বলতে পারছে না? তাই কখনো হয়…দু—জন একসঙ্গে? পুলিশ পাহারা কি ছিল না?…কখন পালায়?…সন্ধেবেলা…কত তারিখে? য়্যাঁ সে তো পাঁচদিন আগে। তুমি কি আর একটু ডিটেইল খোঁজ নেবে? চেহারা, বয়স, নাম, কী অসুখ, কতদিন জেলে রয়েছে…কেউ মুখ খুলছে না? খুলবে খুলবে, সিলভার টনিক খাওয়াও…হ্যাঁ, খুব দরকার আমার, খুবই…হ্যাঁ বাড়িতে থাকব।…আচ্ছা, আচ্ছা, ও ও ও কে এ এ।’

রিসিভার রেখে দিয়ে তিনি শুধু তাকিয়ে রইলেন রোহিণীর দিকে। ভাবখানা, সবই তো শুনলে।

‘হসপিটাল আর দু—জন, তার মানে?’

‘দু—জন কয়েদিকে হসপিটালে ভরতি করা হয়েছিল। দু—জনেই লাইফার, দু—জনেই একসঙ্গে পালিয়েছে। খবরটা চেপে যেতে চাইছে বলে নাম জানাচ্ছে না, অস্বীকার করছে।’

‘পাঁচ দিন আগে পালিয়েছে?’

গঙ্গাপ্রসাদ সচকিত হলেন। সর্দিতে গলা বসে যাওয়া বা তীব্র চিৎকারের শেষ প্রান্তে এসে দম ফুরিয়ে যাওয়ার মতো ভেঙে পড়া কণ্ঠস্বর। মুখের স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য এই দু—তিন মিনিটের মধ্যেই বসে গেছে। তাঁকে তৃষ্ণার্ত, অভুক্ত এবং পরিশ্রান্ত লোকের মতো দেখাচ্ছে।

‘ও এখন কলকাতায়। কাল দুপুরে আমাকে খুঁজতে গেছিল।’

‘কে এখন কলকাতায়?’ গঙ্গাপ্রসাদের কৌতূহলী এবং চমকিত অভিব্যক্তি একই সঙ্গে প্রকাশ হল। ‘কে খুঁজতে গেছিল, শোভু?’

রোহিণী শুধু মাথাটা ঝোঁকাল।

‘সেকি!’ ভারী শরীরটা টেনে তুলে টেবলে ঝুঁকে পড়লেন। ‘তোমার ফ্ল্যাটে? তুমি ঠিক বলছ?’

রোহিণী চুপ করে রইল। ভাবহীন দৃষ্টি স্থির নিবদ্ধ গঙ্গাপ্রসাদের মুখে। নিজের মধ্যে ডুবে গিয়ে কী যেন আলোচনা সেরে নেওয়ায় মগ্ন।

‘তুমি তো তখন ছিলে না ফ্ল্যাটে!’

‘নতুন একটা কাজের মেয়ে রেখেছিলাম। সে ছিল।’

‘রেখেছিলাম মানে? এখন কি আর সে নেই?’

রোহিণী মাথা নাড়ল।

‘বরখাস্ত করেছ? কেন?’

রোহিণী চুপ। সে ঠিকই করে ফেলেছে, বেশি কথা আর বলবে না। নিজের সম্পর্কে কোনো খবর আর কাউকে জানাবে না। অন্যদের খবর এবার থেকে সে নেবে। সেজন্য মিথ্যা কথা বলতে হলেও বলবে।

‘সে কী বলল তোমায়? শোভু তাকে কী বলেছে?’

গঙ্গাপ্রসাদ টেবলে একটা চড় বসালেন, তাঁর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত, প্রায়—চিৎকারের মতো একটা আওয়াজ গলা থেকে বার করে। তাঁর চোখে রাগের ছায়া, নাক ফুলে উঠেছে।

‘শোভনেশ বলেছে আবার আসবে।’

‘কেন? তোমার সঙ্গে কী সম্পর্ক আর? তোমার কাছে এসে কী লাভ?’

‘তা আমি জানি না, তবে আসবে। হয়তো কোনো দরকার আছে।’

‘কী দরকার, তোমার সঙ্গে তার কী দরকার? টাকাপয়সা চাইবে? কিন্তু ওর তো কোনো টাকা নেই, সম্পত্তিও নেই। বাড়িটা একজনের কাছে মর্টগেজ ছিল, তোমাদের বিয়েরও আগে থেকে। খেতে পেত না, ছবিটবি কী আর এমন বিক্রি হত? তোমরা ভাব, আর্টিস্টরা লক্ষ লক্ষ টাকা ছবির বিক্রি থেকে পায়। আরে, সে তো এই ছ—সাত বছর হল পাচ্ছে। তাও ভারতে মাত্র কয়েকজনই টাকা করেছে। শোভুর ছবি সবেমাত্র বাজার পাচ্ছে আর তখনই ও কাণ্ডটা করল। তার আগে ইলেকট্রিক বিল, বাড়ির ট্যাক্স বহুবার আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গিয়ে দিয়েছে। পুরোনো আমলের সব ভাড়াটে, ভাড়াও ছিল সামান্য, আট—দশ মাস করে ভাড়া ফেলে রাখত, ঠিকমতো দিত না, তাই দিয়ে শুধু ভাতে ভাত খেয়ে চলত। ঝি—চাকর পর্যন্ত ছিল না। তিন পুরুষ ধরে গড়িয়ে গড়িয়ে কুঁজোর জল খেলে কিছু কী আর থাকে? একটা ফোঁটাও আর ছিল না। …আমাকে বলেছিল, ‘তোর ম্যাগাজিনের জন্য কিছু কাজ আমাকে দিয়ে করা। টাকার খুব দরকার।’ করিয়েছিলাম…অচল অচল, ম্যাগাজিনের পক্ষে অচল।’

‘ব্যাঙ্কে ওর টাকা ছিল।’

‘ছিল, হাজার সতেরো। কোর্টে দরখাস্ত করে আমি ম্যান্ডেট হোল্ডার হই ওরই অনুরোধে। ও তখন জুডিসিয়াল কাস্টডিতে। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে করাতে, তাইতে ও প্রচণ্ড আপত্তি জানিয়েছিল। কী বলেছিল জান?’

‘না।’

‘রোহিণীকে ভালো চিনি না, বুঝি না। ও বাইরের লোক, অল্পদিনের আলাপ। তুই আমার বহুকালের বন্ধু, বহুকালের চেনা। আমি তোর ওপরই নির্ভর করি। এই হচ্ছে শোভনেশ, তোমার স্বামী! ব্যাঙ্কের টাকা মামলার জন্য উকিলকে দিয়েছি, আমি নিজেও অনেক টাকা খরচ করেছি। পাইপয়সা হিসেব রেখে দিয়েছি। যখন ওর ট্রায়াল চলছে, তুমি তখন দিগম্বর বর্ধন লেনের বাড়িতেই। কী করে তোমার থাকা—খাওয়া চলত, তার খোঁজ কি কখনো নিয়েছে?’

.

‘আমার ধারণা ছিল, শোভনেশের ব্যাঙ্কের টাকা আর ছবি বিক্রির টাকা—।’ রোহিণী ইচ্ছে করেই বাক্য অসম্পূর্ণ রাখল। তার বদলে সে নজরটা তীক্ষ্ন করে গঙ্গাপ্রসাদের হাবভাব লক্ষ করার কাজ শুরু করল।

‘ছবি! ছবিগুলো?’ ঝুঁকে গঙ্গাপ্রসাদ টেবলে বুক ঠেকালেন। যেন হামাগুড়ি দিয়ে ওধারে যাবেন। ‘ছবি কোথায় দেখলে?’

‘অনেক ছবি তো স্তূপ হয়ে ওর স্টুডিয়োতে পড়েছিল দেখেছি। প্রায় চল্লিশ—পঞ্চাশটার মতো, নানান সাইজের। একদিন তো আপনি খানচারেক নিয়েও গেলেন, বললেন মামলার খরচ তোলার জন্য বিক্রির চেষ্টা করবেন।’ অত্যন্ত নিরীহ, অনুগত কণ্ঠে, যাতে গঙ্গাপ্রসাদ আহত না হন, এমন ভঙ্গিতে রোহিণী বলল।

কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদের মুখের ভাব নিমেষে বদলে থমথমে হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড রোহিণীর মুখের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘তুমি কি শোভনেশের বিষয়—আশয় নিয়ে দাবি জানাচ্ছ?’

‘না না গঙ্গাদা, আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমার কোনো লোভ নেই, আমি ওর একটা জিনিসও পেতে চাই না, ছুঁতেও চাই না।’

‘তাহলে আজ এসব কথা উঠছে কেন? ব্যাঙ্কের টাকা, ছবি বিক্রির টাকা, এসব কি তুমি এখন বলোনি?’

‘কথার পিঠে কথায় বলে ফেলেছি।’

‘যে ছবিগুলো স্তূপ হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছিলে, সেগুলির কী হাল হয়েছিল জান? পোকায় কেটে, ভাঙা জানলা দিয়ে বৃষ্টির জল এসে, তার একটারও আর টাঙাবার মতো অবস্থা ছিল না। পাঁচটা পয়সা দিয়েও কেউ তা কিনত না।’

ঘরে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা বিরাজ করল। রোহিণী মাথা নামিয়ে, গঙ্গাপ্রসাদ সিলিংয়ের দিকে মুখে তুলে।

‘শোভু আবার আসবে, হয়তো আশ্রয় কিংবা টাকা চাইবে। কী করবে তখন?’

‘গঙ্গাদা, এসব কিছুই হত না যদি বিয়ে না হত। আপনি যদি তখন আমাকে একবারও বলতেন—।’

‘কী বলতাম?’

‘ওদের পাগলের বংশ।’

‘তোমায় কে বলল?’

‘গত চার পুরুষ ধরে কেউ—না—কেউ পাগল হয়েছে ওদের বংশে।’

‘কে বলল তোমায়?’ গঙ্গাপ্রসাদ টেবলে চড় মেরে ধমকে উঠলেন। ‘এসব তো আমার কাছে নতুন কথা।’

রোহিণী বলতে যাচ্ছিল, সেদিন আপনার মুখ থেকেই কথাটা বেরিয়ে এসেছিল; ‘পাগলের বংশ তো, দেখো, হয়তো গোয়াবাগান থেকে মোমিনপুর পর্যন্ত বোশেখ মাসে হেঁটে আসতে কেমন লাগে বোঝার জন্য হয়তো—নাও অপেক্ষা করে লাভ নেই, আমরা খেতে বসে যাই।’ কিন্তু সে ঠিক করে ফেলেছে, বেশি কথা আর বলবে না। অন্যদের খবরই এবার থেকে নেবে নিজেকে আড়াল করে।

‘কথা বলছ না যে?’

‘আমার উপরের ফ্ল্যাটে একজন মহিলা থাকেন, যিনি একসময় দিগম্বর বর্ধন লেনের ওই বাড়ির একতলায় ভাড়া ছিলেন। তিনিই আজ আমায় বলেছেন।’

গঙ্গাপ্রসাদ চোখের চাহনি ত্যারচা করে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভেবে নিলেন।

‘বুঝেছি। ওদের একতলায় হাজব্যান্ড—ওয়াইফের একটা ফ্যামিলি ছিল। বউটি সুন্দরী, শোভুরই বয়সি। আশ্চর্য, তিনিই এখন কিনা তোমার উপরের ফ্ল্যাটে! কী অদ্ভুত ব্যাপার। কিন্তু ওরা বাড়ি ছেড়ে উঠে গেল কেন?’

‘ওঁর স্বামী বদলি হলেন, তাই বাসা ছেড়ে দেন।’

বিন্দু বিন্দু হাসি গঙ্গাপ্রসাদের ঠোঁটের কসে জমে উঠল। তারপর ঠোঁটটা চওড়া করে সারা মুখে ছড়িয়ে দিয়ে দু—হাতের আঙুলের মধ্যে আঙুল জড়িয়ে নিলেন।

‘তাই বলেছে বুঝি?’

রোহিণী একটু অবাক হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তাই তো বললেন।’

‘মিথ্যেবাদী।’ গঙ্গাপ্রসাদ একটা খুদে আগ্নেয়গিরির মতো হয়ে, জ্বালামুখ থেকে লাভাস্রোত বার করলেন। ‘সী ইজ এ লায়ার। চল্লিশ—বিয়াল্লিশ বছর পরও কিনা মিথ্যা কথা বলছে! শোভনেশের আজকের এই অবস্থার জন্য যদি কাউকে দায়ী করতে হয়, তাহলে ও—ই সেই লোক, যার থেকে এই মার্ডারের প্রথম সূত্রপাত।’

.

রোহিণীকে এখন যদি কেউ বলে, কাল থেকে কলকাতার ফুটপাথে একটিও হকার বসবে না, রাস্তাগুলোয় একটিও খানাখন্দ, ঢিপি থাকবে না, হাওড়া ও শেয়ালদা থেকে লোকাল ট্রেন কাঁটায় কাঁটায় সঠিক সময়ে ছাড়বে এবং পৌঁছবে, সে বিশ্বাস করতে রাজি। এমনকী যদি তাকে বলা হয়, গাওস্করের সব ব্যাটিং রেকর্ড রাজেন ভেঙে দেবে, তাও সে বিশ্বাস করবে। কিন্তু গঙ্গাপ্রসাদ যা বললেন, তার তো কোনো মাথামুণ্ডু সে হদিশ করতে পারছে না।

‘কী বলছেন গঙ্গাদা! কী শান্ত নিরীহ ভদ্রমহিলা, এই বয়সেও কী সুন্দরী, মার্জিত, পরিপাটি ব্যবহার, আর আপনি বলছেন মার্ডারের পিছনে এঁর হাত রয়েছে? কীভাবে সম্ভব?’

‘মেয়েদের শরীরের প্রতি শোভনেশের যে ঝোঁক, যে আগ্রহ, যে দুর্বলতা, যেটা ওকে ন্যুড স্টাডির দিকে টেনে নেয়, যেটা ওকে মেয়েদের দেহ সম্পর্কে বাতিকগ্রস্ত করে তোলে, আর তারই ফলে মডেলের সঙ্গে নানারকম মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, ইনভলভমেন্ট, সবশেষে যা কালমিনেট করে মার্ডারে, এর গোড়াপত্তন ওই তোমার উপরের মহিলাটি থেকেই। কী নাম ওঁর?’

‘জানি না। তবে ওরাও বদ্যি।’

‘ওঁর নাম সুজাতা গুপ্ত, ওঁর স্বামীর নাম হৃদয়রঞ্জন গুপ্ত। লোকটি স্ত্রীর মতোই ছোটোখাটো, বেঁটে, কিন্তু গায়ের রং স্ত্রীর বিপরীত, ঘোর কালো আর ডান পা—টা ছোটো একটু, খুঁড়িয়ে হাঁটেন।’

রোহিণীর শিরদাঁড়া বেয়ে সিরসিরানিটা চেয়ারে পৌঁছল। অবিশ্বাস্য বলে কোনো শব্দ যে এই গ্রহের কোনো অভিধানে আছে, আর সে তা মানতে পারছে না। এখন সে বিশ্বাস করতে রাজি, তুলে দেওয়া হকাররা আবার ফুটপাতে ফিরে আসবে না বা বিনা টিকিটে কেউ লোকাল ট্রেনে উঠবে না। গঙ্গাদা যা বললেন, ঠিক ওইরকমই মিশকালো, সামান্য খোঁড়া, নিরীহদর্শন এক বেঁটে লোককে সে কয়েকবার তাদের বাড়ির সিঁড়িতে দেখেছে।

‘এই পরিবারের সঙ্গে শোভুর খুবই হৃদ্যতা হয়, বিশেষ করে সুজাতার সঙ্গে। ভিজে কাপড় মেলা বা তোলার ছল করে উনি দিনে দু—তিনবার উপরে যেতেন। শোভুর আঁকার ঘরে, পরে যেটাকে ও স্টুডিয়ো বলত, সেখানে উনি গিয়ে গল্পটল্প করতেন। শোভুও ওদের ঘরে যেত। উনি প্রায়ই আবদার ধরতেন, ওঁর একটা ছবি এঁকে দেবার জন্য। ওঁর কয়েকটা পোর্ট্রেট স্কেচও করেছিল। সেগুলো অবশ্য ওঁকে দিয়ে দেয়। কিন্তু উনি চান ফুল ফিগারের ছবি, ক্যানভাসে। শোভু করছি করব বলে এড়িয়ে যাচ্ছিল। একদিন নীচে ওদের ঘরে গিয়ে সে সুজাতাকে—’

টেলিফোন বেজে উঠেছে।

‘হ্যাঁ বলছি, আচ্ছা ঠিক আছে, এখন আমি ব্যস্ত, পরে কথা বলব।’

রিসিভার রেখে গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, ‘অত বছর আগের কথা, শোভু আমায় যা বলেছিল, তাই বলছি। ও তো ভালো করে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না, খাপছাড়াভাবে বলেছিল। আমারও এখন সব মনে নেই।’

গঙ্গাপ্রসাদ কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে থেকে বললেন, ‘শোভুর তখন সবে বিয়ে হয়েছে, কিন্তু ছবিই তখন ধ্যানজ্ঞান। নামকরা মাস্টারদের ছবির অ্যালবাম এখান—ওখান থেকে চেয়ে এনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে স্টাডি করত, কপি করত। একটা কালেকশন এনেছিল, যাতে শুধুই মেয়েদের চান করার ছবি। নাম ছিল ‘বেদারস’। পৃথিবীর বিখ্যাত দশজনের আঁকা আঠারোটা ছবি। সবই ন্যুড, সেমি ন্যুড।

‘আর একটা অ্যালবাম ওর কাছে ছিল, নাম ‘রিক্লাইনিং উওম্যান’। বিছানায়, সোফায়, ডিভানে নানা ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে শোয়া ন্যুড মেয়েদের ছবি। অয়েলে পেনসিলে প্যাস্টেলে আঁকা। এতে ফ্রেঞ্চ আর্টিস্ট বালথাসের আঁকা একটা ছবি, নাম ‘দ্য রুম’ শোভুকে খুব আকর্ষণ করে। আমি ছবিটা দেখেছি। একটা ন্যুড মেয়ে ডিভানে চিত হয়ে হেলান দিয়ে, ডান পা মেঝেয় লম্বা করে ছড়ানো, হাঁটু মুড়ে বাঁ পা—টা ডিভানে উঁচু করে তোলা, ডান হাতটা আলগাভাবে ঝুলে রয়েছে, তার মাথাটা বোধ হয়…যতদূর মনে পড়ছে, পিছনদিকে করা, মুখটা সিলিংয়ের দিকে তোলা, কিংবা মুখটা সম্ভবত ডানদিকে ফেরানো…ঠিক মনে করতে পারছি না। ঘরের বিরাট উঁচু জানালার পর্দা সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বেঁটে বামনাকৃতির মেয়ে, মুখটা তেকোনা। প্রখর আলো জানলা দিয়ে এসে পড়েছে ন্যুড ফিগারটার উপর। ঘরের অন্ধকার কোণে টুলের উপর বসে আছে একটা কালো বেড়াল। ছবিটা অয়েলে আঁকা। ভীষণভাবে শোভুকে তখন ছেঁকে ধরেছিল চিন্তাটা, এইরকম একটা ছবি তাকে আঁকতেই হবে। আমায় বলেছিল, দিনরাত ছবিটা হন্ট করছে, রাতে ঘুমোতে পারি না। জিজ্ঞাসা করত, মেয়েটা ডেড না অ্যালাইভ, তোর কী মনে হয়? আমার কিন্তু মনে হয়েছিল…থাক তোমাকে তা আর বলা যায় না।’

‘না না বলুন।’ রোহিণী আগ্রহভরে বলল। তার উপরের ফ্ল্যাটের মহিলা সম্পর্কে জানার জন্য যে কৌতূহলটা চারাগাছের মতো গজিয়ে ছিল, সেটা এখন ডালপালা ছড়ানো একটা তদন্তের বিষয় হয়ে উঠেছে। গঙ্গাদা যা বলছেন, তাতে তো দু—জনের কথার মধ্যে অনেক অসংগতি দেখা যাচ্ছে! দু—জনেই ষাটের উপর, এই বয়সে ইচ্ছে করে তথ্য বিকৃতি কেউ করে না। কিন্তু একজন অবশ্যই করছে। কিন্তু কেন?

‘না থাক, ওটা খুব জরুরি কিছু বলার কথা নয়।’

‘সেক্সুয়াল কিছু কি?’

‘ওইরকমই। মুখটা আবছা অন্ধকার মাখানো, শরীরের ভঙ্গিতে মনে হয়েছিল রিল্যাক্সড অবস্থায় কিছু একটা যেন এনজয় করছে। যাকগে…আমাদের যা কথা হচ্ছিল, কী যেন বলছিলাম?’

‘শোভনেশ ছবির অ্যালবাম চেয়ে এনে স্ট্যাডি করত, কপি করত।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ…একদিন বেদারস নামের অ্যালবামটা খুঁজে পেল না। চেয়ে আনা পরের জিনিস, দুষ্প্রাপ্যও। খোঁজাখুঁজি করে অবশেষে নীচে এল। সুজাতা স্টুডিয়োতে আসে, হয়তো সেই নিয়ে গিয়ে থাকতে পারে, এই ভেবেই শোভু গিয়েছিল। ওদের ঘরে ঢুকেই সে থমকে দাঁড়ায়। বালথাসের ছবিটার মতোই ঘরটা আধো অন্ধকার, শুধু জানলাটা দিয়ে আলো এসে পড়েছে খাটে, আর সুজাতা ঠিক সেই ন্যুড মেয়েটার মতো বালিশে পিঠ দিয়ে আধবসা অবস্থায়, মাথা পিছনে হেলিয়ে ঘরের সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে। বাঁ হাতটা ঝুলছে খাট থেকে। ডান হাঁটুটা মুড়ে উঁচু করা। তবে সুজাতার শরীর একটা চাদরে ঢাকা ছিল।

নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে অন্তত মিনিট পাঁচেক ধরে সে তাকিয়েছিল। তখন মনের মধ্যে কিছু একটা ঘটে যায়।’

‘কী ঘটে?’

‘সেটা আর ব্যাখ্যা করে আমায় বলেনি। শুধু বলেছিল, ‘এই ঘরটাকেই যেন বালথাসের রুম মনে হল।’ অ্যালবামটার কথা জিজ্ঞাসা করতে সুজাতা বলল, ‘হ্যাঁ সে নিয়ে এসেছে। বালিশের নীচে রয়েছে, শোভু বার করে নিক। তার নিজের উঠে বার করে দেবার ক্ষমতা নেই। ক্ষমতা না থাকার কারণ, স্বামী এমন বেধড়ক পিটিয়েছে যে, নড়ে বসার জোরটুকুও আর নেই।’

রোহিণীর মুখ থেকে একটা শব্দ বেরোল আঁতকে ওঠার মতো। ‘বলেন কী। লোকটাকে যতটা দেখেছি, তাতে তো খুব শান্ত, ভীরু ভীরু মনে হয়েছে।’

‘এই ধরনের লোকেরা শান্তশিষ্ট মার্কাই হয়। জেলাসি থেকেই এই হিংস্রতা। পছন্দ করত না সুন্দরী বউ একটা সুদর্শন ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করুক বা কথা বলুক। অন্তত হৃদয়রঞ্জনের থেকে শোভু অনেক আকর্ষণীয় ছিল। অনেকবারই এই নিয়ে ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে, লোকটা চড়চাপড়ও মেরেছে, কিন্তু বউ জেদ ধরেই স্বামীকে অগ্রাহ্য করে ওপরে গেছে। এরপর ঘরে অ্যালবামটা দেখেই লোকটা ক্ষেপে যায়। ওইরকম সব ছবি যে—মেয়েছেলে দেখে, তার তো চরিত্র বলে কিছুই নেই, সে তো সন্ধেবেলায় মুখে রং মেখে বউবাজারের মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেটও খেতে পারে। শুরু হয় তর্কাতর্কি, তারপর লাঠি দিয়ে পেটানো।

‘সুজাতা গলা থেকে চাদর নামিয়ে শোভুকে দেখায়, তখন ওর ঊর্ধ্বাঙ্গে কোনো বস্ত্র ছিল না, মারের দাগড়া দাগড়া দাগ থেকে বোঝা যাচ্ছিল, কী ভয়ংকর বীভৎস রাগে লোকটা জ্বলছিল। দেখতে দেখতে শোভুর ব্রেইনে শর্ট সার্কিট হয়ে সে হঠাৎ সব অন্ধকার দেখতে থাকে।

‘আমাকে ও বলেছিল, ‘ইলেকট্রিক বালব ফিউজ হবার সময় যেরকম একটা শব্দ হয়, ঠিক সেইরকম যেন একটা শব্দ মাথার মধ্যে হল। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল, অবশেষে আমিই তাহলে পাগল হলাম।’ সেই অবস্থাতেই ও সুজাতাকে বলে, ‘ঠিক এইভাবে হেলান দিয়ে শোয়া তোমার ছবি আঁকব, পাগল হয়ে যাবার আগে।’

‘দিন সাতেক পর থেকে সুজাতা দোতলার স্টুডিয়োতে সিটিং দিতে শুরু করে।’ গঙ্গাপ্রসাদ কথা থামিয়ে রোহিণীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে যোগ করলেন, ‘ন্যুড হয়ে।’

দপ করে রোহিণীর চোখের উপর ভেসে উঠল ষাট বছরের এক মিষ্টি শান্ত মহিলার মুখ। আশ্চর্য। কে বলবে উনি চল্লিশ বছর আগে এমন দুঃসাহসিক কাজ করেছিলেন।

‘স্বামীকে উপেক্ষা জানাবার জন্যই বোধহয়।’

‘তার থেকেও বেশি, ঘৃণা প্রকাশের জন্য। শোভুর মনে একটা বিশ্বাস তারপর বদ্ধমূল হয়ে যায়। সে যে পাগল হল না তার কারণ, ন্যুড মেয়ের ছবি আঁকার জন্য। ওর মনে হল এটা একটা তুক। নিজেকে রক্ষা করার জন্য এটা তাকে করে যেতেই হবে।

‘ওরা পাগলের বংশ এ কথাটা ঠিক নয়। সুজাতাই বোধ হয় তোমাকে বলেছে। কিন্তু ওকে এই ধারণাটা সম্ভবত শোভুই দিয়েছিল এই বলে যে, সে পাগল হয়ে যাচ্ছিল শরীরে ওইরকম অত্যাচারের নমুনা দেখে। আমাকেও তাই বলেছে। একটা ইন্সট্যান্ট রিয়্যাকশন থেকেই ও বলে ফেলে আর সেটাকেই কল্পনায় ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সুজাতা গুপ্তর মনে হয়েছে পাগলের বংশ! ক্র্যাপ, ব্লাডি ট্র্যাশ, মিথ্যাবাদী।’

‘ওঁর ক—টা ছবি শোভনেশ এঁকেছিল?’

‘ওই একটাই, কেননা স্বামী জানতে পেরে যায়। একদিন সকালে লোকটি উপরে স্টুডিয়োয় এসে বউয়ের ওইরকম ছবি দেখে ক্যানভ্যাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফ্রেম ভেঙে ফেলে ছবিটাকে দু—পায়ে মাড়িয়ে শেষকালে শোভুকে অ্যাটাক করে। আমার বাড়িতে নিত্য নামে একজনকে তুমি বোধ হয় দেখেছ, মনে আছে কি?’

‘হ্যাঁ, খুব রোগা, টাক মাথা, কথা একটু বেশি বলে।’

‘এখন বাসুদেবপুরে থাকে। বাড়ি জমিজমা সব ওর জিম্মেতেই রয়েছে, চোর নয়। বাচ্চচা বয়স থেকে শোভুদের বাড়িতে চাকর ছিল। অবস্থা পড়ে যেতে ওরা ছাড়িয়ে দেয়, আমি নিয়ে আসি। বনেদি বাড়ির পুরোনো লোকজন এক রেয়ার অ্যান্টিক, সাজিয়ে রাখার জিনিস। তা সুজাতার স্বামী যখন পেপার ওয়েট দিয়ে শোভুকে মারতে যায় তখন নিত্য ওখানে ছিল, সে—ই হাতটা চেপে ধরে, ঠেলে ঘর থেকে বার করে দেয়। এর দু—মাসের মধ্যেই লোকটা অফিসের ট্রান্সফার নিয়ে কোথায় যেন বউ নিয়ে চলে যায়।’

‘জলন্ধরে, আমায় তাই বলেছেন। আচ্ছা, শোভনেশের তো তখন বিয়ে হয়ে গেছে। ওর বউয়ের কোনো রিয়্যাকশন হয়নি?’

‘হয়তো হয়েছিল। কমলা ভীরু, নিরীহ, কুনো ধরনের ছিল। চির রুগণ। সাত চড়ে রা কাড়ত না। ও বাড়িতে অতবার গেছি, একবারও চোখে দেখতে পাইনি। বাইরের ঘরেও আসত না।’

‘কীভাবে মারা গেল?’

‘প্রেগনান্ট ছিল। বাথরুমে পিছলে পড়ে গিয়ে প্রচণ্ড হেমারেজ হয়। ক্যাম্বেল হাসপাতালেই মারা যায়।’

রোহিণী আবার ধাক্কা খেল। কমলার মৃত্যুর তিন নম্বর কারণ। শোভনেশ বলেছিল ম্যালিগন্যান্ট টাইফয়েড, সুজাতা গুপ্ত বলেছেন দোতলা থেকে লাফিয়ে নীচে পড়ে এবং তাঁর সন্দেহ এটা নিছকই আত্মহত্যা নয়। আর গঙ্গাদা বলছেন অ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু সে তো ঠিক করেই ফেলেছে, কথা না বলে নিজেকে আড়ালে রাখবে। তাই বিস্ময় গোপন করে রইল। একটু আগেও সে বিস্ময় গোপন করেছে, যখন গঙ্গাদা বললেন, শোভনেশদের পাগলের বংশ নয়। অথচ সিধারথ সিনহা তালিকা দিয়ে উলটোটাই লিখেছে, সুজাতা গুপ্তও বলেছেন, পাগল হবার ভয়ে শোভনেশরা সিঁটিয়ে থাকত।

‘ভস্মীভূত শিল্পীদের’ বাকি অংশটুকু পড়া বাকি রয়েছে। রোহিণী এখনই পড়ে ফেলার ইচ্ছায় চনমন করে উঠল। আরও কত অজানা খবর লেখাটায় লুকিয়ে রয়েছে কে জানে! ঝুলির মধ্যে ম্যাগাজিনটা, হাত ঢুকিয়ে তবু সে জেনে নিল রয়েছে কিনা। গঙ্গাদা কি এটা পড়েছেন? কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কত রকমের কাঁড়ি কাঁড়ি ম্যাগাজিন যে এখন বেরোচ্ছে, সব কী কেউ পড়ে উঠতে পারে? ইস্টার্ন ম্যাগাজিন বহুরকম পিরিওডিক্যালই কেনে। এইটে,…আহ নামটা এখনও জানা হয়নি, মলাটটাই ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে, এইটে কেনা হয় না। হলে তার চোখে পড়তই।

রোহিণী যখন এই সব ভেবে চলেছে, গঙ্গাপ্রসাদ তখন কলম দিয়ে প্যাডে নিজের নাম সই করছেন আর ঘসে ঘসে সেটা কাটছেন অন্যমনস্ক হয়ে।

আবার ফোন বেজে উঠল। গঙ্গাপ্রসাদ রিসিভারটা কানে দিয়েই বাড়িয়ে ধরলেন, ‘তোমার।’

রোহিণী হাতে নেবার সময়ই বুঝে গেছে ওধারে কে।

‘বলছি। …একটু বসো, এখনি আসছি।’

‘তাহলে তুমি তো…আমায় তো ভাবনায় রাখলে। পাঁচদিন আগে হসপিটাল থেকে দু—জন পালিয়েছে। তাদের একজন যদি শোভু হয়, তাহলে ইতিমধ্যে কলকাতায় এসে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু চিনে তোমার ওখানে গেল কী করে? ঠিকানাটা পেল কোথা থেকে?’

গঙ্গাপ্রসাদের মতো রোহিণীও জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল। কারোর কাছেই উত্তর জানা নেই। রোহিণী ঝোলাটা কাঁধে চড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘আমি এখন আসি।’

‘তুমি আমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পার, কিংবা বাসুদেবপুরে। সাক্ষী দেবার সময় তুমি যেসব কথা বলেছিলে, আর তাইতে ও যেভাবে রিঅ্যাক্ট করে, সেটা আমিও লক্ষ করেছি। এখন তোমাকে সেফটির কথা ভাবতে হবে।

‘আমার উপরে একজন পালোয়ান থাকে। চিৎকার শুনলেই তিন লাফে হাজির হয়ে যাবে।’

‘ভোলা সাউকে কি তোমার সঙ্গে দেব আজ রাতের জন্য?’

‘না না ওসবের দরকার নেই। ওখানে দারোয়ানের একটা লোহার রড আছে দেখেছি, সেটা চেয়ে নেব। দরজা খোলার আগে দেখে নেব লোকটা কে! যদি ও হয়, তাহলে খুলবই না।’

রোহিণী বেরিয়ে যাচ্ছে ঘর থেকে, গঙ্গাপ্রসাদ ডাকলেন, ‘একটা কথা পরিষ্কার করে দেওয়া ভালো, শোভুর কোনো সম্পত্তি আর নেই। না বাড়ি, না ব্যাঙ্ক ব্যালান্স, না ছবিটবি।’

‘আমি তো বলেই দিয়েছি, ওর একটা কানাকড়িও আমি ছোঁব না। শুধু একটাই বলার ছিল, যদি বিয়ের আগে জানতাম’—রোহিণী বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। বন্ধ দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গঙ্গাপ্রসাদের মুখ বিকৃত হয়ে উঠল।

আলমারি ঘেরা অফিসের জায়গাটায় একটা চেয়ারে রাজেন বসে। রোহিণীকে দেখে উঠে পড়ল।

‘হয়ে গেছে, চলো। গাড়ি এনেছ?’

‘হ্যাঁ।’

ওরা বেরোচ্ছে, তখন কমলের সঙ্গে দেখা।

‘এখন কেমন আছে?’

‘ভালোই। কাল কী পরশু ছেড়ে দেবে।’

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে রোহিণী বলল, ‘বাসের ধাক্কা খেয়ে কাল ওঁর ছেলের পাঁজরের তিনটে হাড় ভেঙেছে। ছেলেটি ইংরেজিতে এম এ পড়ছে। উনি এখানকার বেয়ারা। ইলিশ মাছ উনিই বাজার থেকে সকালে এনে দিয়েছেন।’

রোহিণীর মন্থর স্বরে শ্রান্তির রেশ। রাজেন আড়চোখে মুখের দিকে তাকাল। কিছু একটা সিরিয়াস ধরনের ব্যাপার যে ঘটেছে, সেটা বুঝতে পারছে। সে কথা বলল না।

একটু দূরে গলির মধ্যে গাড়িটা রাখা। কালো শরীরের, একত্রিশ বছরের পুরোনো হিলম্যান। বহু জায়গায় রংচটা, সামনের একটা মাডগার্ড তোবড়ানো। পিছনের দরজার একটায় দড়ি বাঁধা। এঞ্জিন, চারটে চাকা, ব্রেক ও হর্ন ছাড়া হিলম্যানের বাকি অঙ্গ—প্রত্যঙ্গের উপর মালিকের নিয়ন্ত্রণের কোনো গ্যারান্টি নেই। রাজেন ছাড়া আর কেউ এই গাড়ি চালাতে ভরসা করে না।

গাড়ির পিছনের সিটে পলিথিন মোড়া কয়েকটা পুঁটলি। সামনের দরজা খুলে সিটে বসার সময় রোহিণী ওগুলো দেখে বলল, ‘কী কিনলে?’

‘ক—টা ছোটোখাটো জিনিস, একটা টি—শার্ট, তোয়ালে, ব্লেড।’

রাজেন স্টার্ট দেবার জন্য চাবি ঘোরাল। কয়েকবার কঁকিয়ে উঠে হিলম্যান জানিয়ে দিল। সে অসুস্থ। রোহিণী সারাদিনে এই প্রথম হাসতে শুরু করল। প্রথমে নিঃশব্দে তারপর চাপা খুকখুক করে।

‘নামবো?’

কেন?

‘ঠেলতে হবে তো?’

‘সারাদিনই ওবিডিয়েন্ট ছিল। যেই তুমি উঠলে—’ বলতে বলতে বিব্রত রাজেন নামল। ‘কার্বুরেটরটায়…’। এঞ্জিনের বনেট তুলে সে ঝুঁকে পড়ল। একটু পরেই বনেট নামিয়ে হাতে পেট্রলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে ফিরে এসে চাবি ঘোরাল। বারকয়েক কেশে নিয়ে হিলম্যান চলতে রাজি হল।

‘বুড়ো হয়ে গেছে, রিটায়ার করিয়ে দাও।’

‘এঞ্জিনটা ওভারহল করিয়ে, বডিটাকে রং করিয়ে নিলে দেখবে মারুতি ছোকরারাও আমার বুড়োর সঙ্গে পারবে না।’ রাজেনের গলায় চাপা অভিমান এবং ক্ষোভও।

‘করাচ্ছ না কেন?’

‘টাকা নেই।’

টিরেট্টা বাজার আর চিৎপুরের মোড়ে ট্রাফিকের জন্য গাড়ি দাঁড় করাতে হয়েছে। ওরা পুবদিকে এগিয়ে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন্যুতে পড়ে বাঁদিকে ঘুরল। গিরিশ পার্ক পর্যন্ত গিয়ে ডানদিকে বেঁকে তারপর বিবেকানন্দ রোড ধরে সোজা যাবে।

‘নেই কেন? হাজার তিনেক তো অফিস মাসে মাসে দিচ্ছে। কিপ্টেমিটা একটু শেখো, এটা শেখার জিনিস, একটা আর্টও বটে। বাড়িতে দাওটাও কিছু?’

‘মাকে হাজার দিই। বাকি দু—হাজার নিয়ে কিপ্টেমির আর্ট চর্চা করা যায় না। বড়দা তার অ্যাম্বাসাডার বেচে মারুতি কিনেছে। আমাকে বলল, তোমার মতোই বিদ্রূপ করে, এবার এটাকে রেহাই দে। টাকা দিচ্ছি, একটা নতুন কিছু কিনে নে। আমার ক্লার্কেরও যে এর থেকে ভালো গাড়ি রয়েছে। ব্যারিস্টার দাদা, কী আর বলব! একবার জজের সামনে দাঁড়ালেই আমার মাইনের টাকা মক্কেলের পকেট থেকে তুলে নেন।’

‘আমি বিদ্রূপ করিনি মোটেই। মায়া হচ্ছে বলেই বললাম।’

‘এখনকার চাকরিটা ছাড়ব ঠিক করেছি। খেলার জন্যই এতদিন ভালো ভালো অফার পেয়েও যাইনি। ওসব জায়গায় নাকে দড়ি দিয়ে খাটায়, খেলার জন্য ছুটিছাটা পাওয়া যাবে না। একটু আগে বুড়োকে রিটায়ার করাতে বললে, তাই মনে পড়ল। এবার নিজের কেরিয়ার দেখতে হবে। এবার খেলা ছাড়ব, এটাই শেষ সিজন। সম্ভব হলে ক্লাব ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু নয়। বিসিআই একটা খুব বড়ো কেবল তৈরির কোম্পানি।’

ট্রাফিক ছেড়ে দিয়েছে। মন্থর গতিতে সামনের গাড়িকে অনুসরণ করে রাজেন হুঁশিয়ারভাবে হিলম্যানকে নিয়ে এগোচ্ছে। এঞ্জিন চালু না থাকলে আবার কী মুশকিলে এই ভিড়ের মধ্যে ফেলে দেবে কে জানে!

‘কম্প্যুটারে, টেলি—কমিউনিকেশনে, পাওয়ার স্টেশনে, ডিফেন্সে, স্যাটেলাইট লাঞ্চিংয়ে, রেলওয়েজ, এইরকম বহু কাজে এদের তৈরি ওয়্যারস অ্যান্ড কেবলসের ব্যবহার হয়। এখন এক্সপ্যানশন প্রোগ্রাম নিয়েছে। পেট্রোলিয়াম জেলি ফিল্ড কেবলস আর কয়েল কর্ড তৈরির জন্য, এসব টেলিফোন ইন্সট্রুমেন্ট—এ লাগবে। ওদের প্রোডাকশন ডিভিশনে জয়েন করব সামনের এপ্রিলে। পাঁচ হাজার মাসে, প্লাস গাড়ি, প্লাস ফ্ল্যাট। যাদবপুর থেকে বি টেক করে বেরোবার পরই জোকায় যদি তখন এমবিএ করার জন্য অ্যাডমিশান নিতাম আর এই ক্রিকেটের নেশায় না পড়তাম, তাহলে এখন বছরে লাখ টাকা স্যালারি তো হতই।’

‘এইসব হা—হুতাশ কবে থেকে শুরু করেছ? আমাকে তো কখনো বলোনি?’

‘এসব কাউকে বলা যায় না। একদিন তো বিয়ে হবে, ফ্যামিলি হবে। ক্রিকেটে এত রান জমা হয়নি যে, তাই ভাঙিয়ে জীবন চলে যাবে।’

‘বিয়ে করছ? কাকে?’

‘নিশ্চয়ই একটা মেয়েকে। …ভালো কথা, তখন ফোনে বললে নানারকম চাপ, শরীর—মন ক্লান্ত, ব্যাপার কী?’

‘বলছি, রাস্তাটা পেরিয়ে নাও।’

মহাত্মা গান্ধী রোড পেরিয়ে আসার পর রোহিণী বলল, ‘কাল খবরের কাগজে একটা পাঁচ—ছ লাইনের খবর পড়ার পর থেকেই অদ্ভুতভাবে সময় কাটছে। অবাস্তব অথচ ভয়ের একটা জগতে আমি যেন ঢুকে পড়েছি। শোভনেশ বহরমপুর জেলে আছে, তোমায় তো বলেছি, ওই খবরে রয়েছে বহরমপুর জেল থেকে এক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি পালিয়েছে।’

‘তাই নাকি?’ রাজেন আদৌ চমকাল না। চোরবাগানের কাছাকাছি এসে গেছে। জায়গাটাকে কলকাতার রাজস্থান বলা যায়। এখানে ট্র্যাফিকের নিয়মকানুন রাজস্থানি মতে চলে। সে রিকশা, ঠেলা, টেম্পো ইত্যাদির ঔদাসীন্যের প্রতি সম্ভ্রম দেখতে এখন যত্নবান। রোহিণীর জন্য কান ছাড়া আর কিছু এখন পাতা সম্ভব নয়।

‘বেশ তো, পালাবার সুযোগ পেলে ছাড়বে কেন?’

‘কিন্তু সে শোভনেশ।’ রোহিণী অধৈর্য হয়ে গলা তীক্ষ্ন করল।

‘তুমি ঠিক জান?’

রোহিণী অপ্রতিভ হয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করেও আর বলল না।

‘নাম দিয়েছে?’

‘না।’

‘ডেসক্রিপশন? কীসের আসামি ছিল?’

‘না, সেসব কিছুই নেই। গঙ্গাদা বহরমপুরে একজনকে ট্রাঙ্ক কলে খোঁজ নিয়েছেন। সে বলল একজন নয়, দু—জন যাবজ্জীবনের আসামি পালিয়েছে, তাও হাসপাতাল থেকে।’

রাজেন শিস দিয়ে উঠল। ‘সাবাস, দু—জন তাহলে! তোমার ধারণা, এদের মধ্যে একজন অবশ্যই শোভনেশ?’

‘যাবজ্জীবন পাওয়া লোক কি গন্ডা গন্ডা পাওয়া যায়?’

‘কাগজ পড়? খুঁটিয়ে পড় কি? আইন আদালতের কলামে চোখ ফেললেই বুঝতে পারবে, জজ হাকিম বিচারপতিরা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় লিখতে লিখতে হাতে টেনিস—এলবো করে ফেলেছে। গাদা গাদা খুন, ধর্ষণ, বউ মারা!’

‘কিন্তু আমার মন বলছে শোভনেশই পালিয়েছে, আর সে এখন আমার কাছে আসার চেষ্টা করছে। কাল একটা লোক দুপুরে ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার খোঁজ করেছে। তার যা বর্ণনা শুনলাম, হুবহু শোভনেশ।’

এইবার রাজেন উদবিগ্ন হল। কাল ইডেনে সে রোহিণীকে ভীত—সন্ত্রস্ত হতে দেখেছিল। এখন তার কারণটা বুঝতে পারছে। হঠাৎই অকারণে রেগে উঠেছিল, আবেগভরে দু—চারটে কথা বলেছিল। মানসিক ভারসাম্য হারালে মানুষ যেমন আচরণ করে, তাই করেছিল। অথচ ও যথেষ্ট টাফ মেয়ে, সাহসীও।

গাড়ি গিরিশ পার্ক থেকে ঘুরে সিমলের কাছাকাছি। রাজেন স্টিয়ারিং ছেড়ে দু—হাত মাথায় ঠেকিয়ে কারও উদ্দেশে যেন প্রণাম জানাল রোহিণী অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকাল।

‘দু—জন বাঙালি প্রায় একই সময়ে জন্মেছিলেন, তাঁদের জন্মভিটের ঠিক মাঝামাঝি পয়েন্ট একই জায়গাটা, তাই একটা নমস্কারেই কাজ সারলাম।’ আড়চাখে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে রাজেন বলল, ‘এবার রবীন্দ্রনাথের এলাকা ছেড়ে বিবেকানন্দের এলাকায় ঢুকলাম।’

‘জানি। ছোটোবেলায় বাবা আমাদের দু—বোনকে এনে দেখিয়ে গেছলেন বাড়ি দুটো। এরপর দীনবন্ধু মিত্র, ডি এল রায়, রাজা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, সুকুমার রায়, সত্যজিৎ রায়, এরকম অনেকের বাড়ির অঞ্চল পড়বে রাজেন, তুমি বাপু কাজ সারতে আর স্টিয়ারিং ছেড়ো না।’

‘পুণ্য অর্জনেও বাধা!’ রাজেন স্বগতোক্তি করল রোহিণীকে শুনিয়ে। ‘ভেবেছিলাম মানিকতলায় মোড় পেরোবার সময় দূর থেকেই বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দিকে একটা—।’

বিধান সরণির মোড়। ট্র্যাফিকে হিলম্যান দাঁড়িয়ে গেল। রোহিণী নীচু স্বরে বলল, ‘রাজেন, অদ্ভুত ব্যাপারটা কী জান? একটা ভয়, ছমছমে একটা অনুভব সত্যিই হচ্ছে। কিন্তু তার থেকেও বেশি আমি বিভ্রান্ত। টোটালি কনফিউজড। উলটোপালটা কথা শুনছি একই ঘটনার।’

এই বলে সে সুভাষ গায়েন, উপরের সুজাতা গুপ্ত, গঙ্গাপ্রসাদ আর ‘লালসার আগুনে ভস্মীভূত শিল্পীরা’ থেকে যা শুনেছে এবং পড়েছে, সবই একে একে রাজেনকে বলল। এমনকী নন্দার কাছে শোনা ‘ছেলেধরার মতো’ লোকটার কথাও বলল। আর হিলম্যান ততক্ষণে মানিকতলা মোড় পেরিয়ে, খালের ব্রিজ, বাগমারি, ছাড়িয়ে কাঁকুড়গাছি মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরেছে।

‘এইবার বলো, এখন আমি কী করব?’

‘বলছি। আচ্ছা এই হাসপাতালটার পাশ দিয়ে সল্টলেকে যাবার রাস্তা আছে না?’

‘হ্যাঁ আছে।’

রাজেনের হিলম্যান আচার্য সত্যেন বোস সরণি থেকে ডানদিকে বেঁকে ট্রাম লাইন অতিক্রম করে মানিকতলা ইএসআই হাসপাতালের পাশের রাস্তা ধরল। সন্ধে হয়ে এসেছে, রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। বাঁদিকে দেবদারু গাছের বাগানওয়ালা গোলাপি রঙের বাড়ি, বোস ইন্সটিটিউট।

‘একটু দাঁড়াও তো এখানে।’

হিলম্যান থামল।

‘ওই বাগানের মধ্যে একজনের একটা কালো বাস্ট রয়েছে মুখটা নীচু করা, হাতে চারাগাছের দুটো পাতা। দারুণ মূর্তি। পুণ্যি করতে আর বাধা দেব না। ফার্স্ট বলে বোল্ড হয়ে এসে তারপর যে বলবে, আমার জন্যই—নাও কাজ সারো।’

‘কিন্তু কে?’ ভ্রূ তুলে, বড়ো বড়ো চোখ করে রাজেন তাকাল।

‘তার মানে! ভারতবর্ষে একটা মানুষের হাতেই তো গাছের পাতা থাকতে পারে!’

‘আমি বিভ্রান্ত। কনফিউজড।’ তারপরই ‘মাই গড’ বলে সে ধড়মড়িয়ে দরজা খুলে নেমে, ছুটে বাগানের রেলিংয়ের কাছে গেল। মিনিটখানেক পর ফিরে এসে স্টিয়ারিং ধরে ফিসফিস করে বলল, ‘গাছেরও প্রাণ আছে, মানুষের মতোই।’

‘মানুষও যদি গাছের মতো হত। মেঘ তৈরি করিয়ে, অক্সিজেন দিয়ে, ছায়া দিয়ে শীতল করে, ফল দিয়ে শুধু উপকার করা ছাড়া ওরা আর কিছু জানে না, পারে না। আর এই গাছকে আমরা—।’

‘মানুষের মতো নিষ্ঠুর জানোয়ার আর হয় না। বাঘ, সিংহীও অকারণে কখনো প্রাণীহত্যা করে না, শুধু খিদে পেলেই ওরা মারে। আর মানুষ?’

‘মানুষের সর্বনাশ করেছে তার ইমোশন। তাই থেকেই যত জটিলতা। নয়তো কী দরকার ছিল শোভনেশের এই খুনটা করার?’

বাঁদিকে বিধান শিশু উদ্যানের পাঁচিল, ডানদিকে বাগমারি কবরস্থানের ঝিল। তার মাঝের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গাড়ি পৌঁছাল ইস্টার্ন বাইপাসে।

রোহিণী নির্দেশ দিল, ‘ডানদিকে, তারপর একটু এগিয়েই বাঁদিকে সল্টলেকে ঢোকার পথ, আর সোজা মাইলখানেক চলে গেলে স্টেডিয়াম।’

‘ইমোশান আছে বলেই আমরা মানুষ। তোমার আমার আছে, তাহলে শোভনেশেরই বা থাকবে না কেন? কিন্তু কথাটা হল, কীভাবে কোনদিকে সেটা চালিত হচ্ছে। তাই তো? এই ধরো এখন আমার—।’

‘হ্যাঁ, তোমার? বলে ফ্যালো।’

‘থাক।’

‘আমি জানি, এখন তোমার কী ইচ্ছে করছে। এই নির্জন রাস্তা, তার উপর আলোগুলোও জ্বলছে না, এই পরিবেশ বিটলেমির ইমোশন ছাড়া তোমার মধ্যে আর কোনো ব্যাপার তৈরি করছে না।’

‘এক সেকেন্ড শুধু গাড়িটা থামাব।’

‘আধ সেকেন্ডও নয়। খবরদার, প্রথম বলে আউট হবার ভয় দেখাবে না।’ …হাত সরাও, অ্যাকসিডেন্ট করে বসবে।’

‘এই ফাঁকা রাস্তায় কীভাবে অ্যাকসিডেন্ট করব?’

‘যা হবার কথা নয়, সেটা হলে তাকে অ্যাকসিডেন্ট বলে।’

‘শোভনেশও তো অ্যাকসিডেন্টে মানুষ মারতে পারে।’

রোহিণী মুখ ঘুরিয়ে রাজেনের দিকে তাকাল। ‘তাই তো! এটা তো আমার মনে কখনো হয়নি!’

‘দিনে অন্তত পাঁচশো লোক এ দেশে গাড়ি চাপা পড়ে, তার একটাও কিন্তু গাড়িওয়ালার ইচ্ছাকৃত নয়। অথচ লোকে প্রথমেই তাদের পেটায় আর গাড়িতে আগুন ধরায়। আমরা ধরেই নিয়েছি, শোভনেশ খুন করেছে।’

‘পুলিশ ইনভেস্টিগেট করেছে, জজ সাক্ষ্য—প্রমাণ দেখেছেন, সবথেকে বড়ো কথা, আসামি নিজেই স্বীকার করেছে। এরপরও কোনো সন্দেহ থাকতে পারে কি?’

‘পারে। হয়তো পুলিশ ঠিকমতো তদন্ত করেনি আর শোভনেশ মানুষজনের কাছ থেকে সমাজ থেকে, নিজেকে সরিয়ে নেবার জন্যই নিশ্চয় প্রচণ্ড মেন্টাল প্রেশারে ছিল, হয়তো বাঁচার ইচ্ছেটা নষ্ট হয়ে গেছিল, তাই কনফেস করে।’

‘ও আমারও গলা টিপে ধরেছিল ন্যুড হয়ে সিটিং দিতে রাজি না হওয়ায়। বাড়িতে আমি পালিয়ে পালিয়ে থাকতাম। আমার ভয় করত, কখন আবার—’

গাড়ি থামাল রাজেন। তারা পৌঁছে গেছে। গেটের দু—ধারে আলো জ্বলছে। বাড়ির ভিতরে ড্রাইভওয়েতে তিনটে মোটর দাঁড়িয়ে, গাড়ি রাখার আর জায়গা নেই। গেটের কাছেই গাড়ি রেখে, পিছনের সিটে রাখা পলিথিন প্যাকেটের থেকে দুটো তুলে নিয়ে রাজেন বলল, ‘দুপুরে ভাত খাওয়ার পর এখনও পর্যন্ত পেটে কিছু পড়েনি।’

‘পথেই গাড়ি থামিয়ে কিছু খেয়ে নিলে পারতে।’

‘তাই তো চেয়েছিলাম, তুমিই তো খেতে দিলে না, উলটে অ্যাকসিডেন্টের ভয় দেখালে।’

‘হয়েছে। তোমার এই খাই খাই রোগটা সারাবার চিকিৎসা দরকার। ওপরে চলো।’

‘চিকিৎসার জন্য?’

রোহিণী কর্ণপাত না করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। তিনতলায় পৌঁছে সে বলল, ‘এই নাও চাবি, ঢুকতে হয় ঢোক, আর নয়তো এখানে দাঁড়াও। আমি উপর থেকে মাছটা নিয়ে আসি।’

এই বলে সে চারতলার সিঁড়ি ধরল। ঘোরার মুখে আড়চোখে দেখল, রাজেন দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সিঁড়িতে বসে পা ছড়িয়ে দিল।

দরজা খুললেন যিনি, তাঁকে রোহিণী চিনে নিল। গঙ্গাপ্রসাদের বর্ণনামতো ইনিই নিশ্চয় হৃদয়রঞ্জন। ভিতর থেকে দেখতে পেয়ে সুজাতা ডাকলেন, ‘এসো ভেতরে এসো, মাছটা নেবে তো?’

‘হ্যাঁ।’ বলেই ভিতরে ঢুকে রোহিণী কাঠ হয়ে গেল। খাওয়ার টেবিলে, পিছন ফিরে একজন বসে। দীর্ঘকায় রোগা, ঝাঁকড়া, কাঁচাপাকা চুল। টেবিলে একটা ছিটকাপড়ের তাপ্পি দেওয়া ঝোলা।

হৃদয়রঞ্জন দরজাটা বন্ধ করেছেন। রোহিণী সেটা আঁকড়ে ধরে কী একটা বলতে গেল। মুখ দিয়ে স্বর বেরোল না।

.

‘এসো ভেতরে এসো।’ সুজাতা আবার ডাকলেন।

চেয়ারে বসা লোকটি মুখ ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। হাতের চামচে মালাইয়ের ঢুকরো।

‘উনি আমাদের গুরুভাই। তোমায় বলেছিলাম না, কাল উনি এসেছিলেন।’

লোকটি দু—হাত জড়ো করে কপালে ঠেকাল আর তাই করতে গিয়ে চামচ থেকে মালাইয়ের টুকরোটা টেবিলের উপর পড়ল। রোহিণী তখনও ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। প্রতি—নমস্কার জানাবার বদলে সে ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু তাকিয়ে আছে। কোথায় শোভনেশ!

এই লোকটিকেই তা হলে চঞ্চলা আর নন্দা কাল দেখেছিল। কী নিশ্চিন্তি! আবার একটা ভয় থেকে সে বেরিয়ে এল। রোহিণী দু—হাত অনেক চেষ্টায় তুলল নমস্কার জানাতে। তার মনে হচ্ছে, সারা শরীরটাই একটা ঝরনাধারার মতো তিরতির করে নেমে যাচ্ছে। হাত পা মুখ গলে গলে নিশ্চিহ্ন হয়ে তাকে অদৃশ্য মানুষ বানিয়ে দিচ্ছে। সে দুটো অদৃশ্য হাত তুলে নমস্কার করল। এখন তো সে লোকটির পায়ের উপরও হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলতে রাজি, আপনি বাঁচলেন শোভনেশ না হয়ে।

‘কাল আপনি বোধ হয় নীচের তলায় একটা বাচ্চচা মেয়ের কাছে ফ্ল্যাটের নম্বর জানতে চেয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’ গুরুভাই বিব্রতভাবে বললেন। ‘চশমাটা পরশু ট্রেনে ভিড়ের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে দুটো কাচই ভেঙে গেছে। বনগাঁ লাইনের গাড়ি তো, লোকে বলে রাবণের গুষ্টির লাইন। তা ওটা দোকানে দিয়েছিলাম। কাল নিতে গেলাম, বলল হয়নি। চশমা বিনা ভালো দেখতে পাই না। ভুল করে তিনতলায় বেল বাজিয়ে ফেলি। লম্বা সেমিজ পরা একটি মেয়ে দরজা খুলল। তার পিছনে ছিল একটি ছেলে।’

‘অ্যাঁ!’ সঙ্গে সঙ্গে রোহিণী নিজেকে সংযত করে নিল। ‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মোটাসোটা, মুখটা গোল, গায়ের রং আমার মতোই কালো। পরনে ছিল গলা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত হলুদে খয়েরিতে ছোপ দেওয়া ম্যাক্সি।’ সে নন্দার বর্ণনাই দিল এবং তার ম্যাক্সির।

‘হ্যাঁ, ওইরকমই। মেয়েটি প্রথমে বোধ হয় আমাকে চোর—ডাকাত কিছু ভেবেছিল, খুব ভয় পেয়ে গেছিল। দরজাটা খুলেই বন্ধ করে দেয়, তারপর ছেলেটি দরজা খুলে আমার নাম ধাম জিজ্ঞেস করে বলে দেয়, ভুলে করেছেন, ওপরের ফ্ল্যাটে যান।’

নন্দাকে তো বোঝা গেল, কিন্তু ছেলেটা কে? রোহিণী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, ডুপ্লিকেট চাবিটা আজই সে চেয়ে নেবে। দুপুরে ফাঁকা ফ্ল্যাট খুবই বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ফেলে দিতে পারে তার মালিককে।

‘আমার দিদির ছেলেমেয়ে এসেছিল।’ সুজাতা ও হৃদয়রঞ্জন তাকিয়ে আছে দেখে রোহিণীকে কথাগুলো বলতে হল। একটা কনফিউশন, আবার একটা মিথ্যার জাল বোনার ঘটনা। তবে ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে। নন্দাকে হুঁশিয়ার করে দিতে হবে।

‘মাসিমা ওটা দিন।’

সুজাতা ডীপ ফ্রিজের পাল্লা খুলতেই সাজানো কুলপিগুলো রোহিণী দেখতে পেল।

‘এখনও দেখছি অনেকগুলো রয়েছে।’

‘বোসো, একটা খেয়ে যাও।’

তার বলাটা বৃথা গেল না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে রাজি হওয়াটা ভালো দেখাল না। রোহিণী একটু বেশিরকম আটপৌরে গলায় বলল, ‘না মাসিমা, যাকে নেমন্তন্ন করেছিলাম, সে নীচে অপেক্ষা করছে।’ তারপরই যোগ করল, ‘আচ্ছা আমি যদি নিয়ে যাই?’

‘নিতে পার।’ মাছের প্যাকেটের সঙ্গে জমানো মালাই ভরা প্লাস্টিকের দুটো কুলপি রোহিণীর হাতে দিয়ে বললেন, ‘একটা তোমার আর একটা তোমার অতিথির। খেয়ে বোলো কেমন লাগল।’

‘নিশ্চয় বলব।’ হালকা ফুরফুরে খুশি এখন রোহিণীর সর্বাঙ্গ জুড়ে। লোকটা শোভনেশ নয়। বহরমপুর হাসপাতাল থেকে যে দুটো লোক পালিয়েছে, তাদের একজন যে শোভনেশই, এমন প্রমাণ সত্যিই তো মেলেনি। মিছেই সে ভয়ে মরছিল।

বহু বছর পর, অন্তত কুড়ি বছর তো হবেই, রোহিণী চার ধাপ বাকি থাকতেই জোড় পায়ে লাফ দিয়ে সিঁড়ির বাঁকের ল্যান্ডিংয়ে নামল। টালটা সামান্য একটু ঝুঁকেই সে কৈশোর দিনের মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, তিনতলার ল্যান্ডিংয়ের দিকে তাকাল। ভয়ের বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে এসে এখন সে আনন্দে আর এক ধরনের দিশাহারা।

রাজেন এখনও দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পা ছড়িয়ে। তার ঝুলিটা কোলে, হাতে ফ্ল্যাটের দরজার চাবি। চোখ বন্ধ। যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। রোহিণী এবার আগের মতোই জোড় পায়ে ছ—টা সিঁড়ির উপর থেকে লাফ দিল এবং ধপ করে মেঝেয় পড়ে উবু হয়ে বসেই রইল, রাজেনের মুখোমুখি হয়ে।

রাজেন একটা চোখ খুলেই বন্ধ করল।

‘লাফটা ভালোই দিয়েছ।’ ঘুমের ঘোরে বলার মতো জড়িয়ে জড়িয়ে সে বলল, ‘কিন্তু এই বেরেদ্ধ বয়সে হাঁটুর জোর দেখানোটা কি উচিত হচ্ছে? ভেঙে—টেঙে তো যেতে পারে। তখন কে ঘরে বয়ে নিয়ে যাবে?’

‘তুমি।’

‘ওই বিশাল ওজন?’

‘মাত্র আটান্ন কেজি। কোনো যুবকের কাছে যদি এই সামান্য ওজনই বেশি হয়…দু—হাতে বউকে তোলার ক্ষমতা যদি না থাকে, তাহলে…।’

‘বউয়ের উচিত ওজনটাই কমিয়ে ফেলা।’ চোখ বন্ধ রেখেই রাজেন বলল।

‘তাহলে বিয়ে করার আগে তার বারবেল ভাঁজা উচিত।’

‘আমার তাহলে বিয়ে করা আর হল না। আমি বারবেল ভাঁজতে পারব না।’

‘তাহলে আমারও আর বিয়ে হল না।’

‘হবে। কথা দিচ্ছি আমি ভাঁজব।’

‘তাহলে প্রোপোজ করো।’

‘অনেকবার তো করেছি।’ রাজেন এখনও চোখ খোলেনি।

‘ভদ্রলোকের মতো করো, ইংলিশ নাইটরা যেভাবে—’ উঠে দাঁড়াল রোহিণী।

তার কথা শেষ হবার আগেই রাজেন তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। তারপর দুটি হাঁটু মুড়ে বসে, দু—হাত পাশে ছড়িয়ে, মাথাটা হেঁট করে নামিয়ে বলল, ‘মাই লেডি, উড য়্যু ম্যারি মী? প্রিয়ে তুমি কি আমায় স্বামিত্বে বরণ করবে?… রুনি এবার শকুন্তলার মতো ব্লাশ করো, ব্লাশ করো, মুখটা একটু আনত করো, আর চোখটা সামান্য পিটপিট, শ্বাস বন্ধ, নাকটা একটু স্ফীত—করছ?’

‘করছি। একটু কষ্ট হচ্ছে। তুমি এবার মাথা তোল।’

‘অ্যাকসেপ্ট করলে?’

জবাব না দিয়ে, ঝুঁকে রাজেনের চুলে রোহিণী মুখটা চেপে ধরল। আর রাজেনের মুখ চেপে বসল রোহিণীর বুকের মাঝে।

‘ইয়া হুউউ’। রাজেনের চিৎকারটা সিঁড়ি দিয়ে প্রতিধ্বনিত হতে হতে একতলায় নেমে গেল। চারতলাতেও পৌঁছল। তড়বড় করে সে সিঁড়ি দিয়ে দশটা ধাপ উঠে ঠিক রোহিণীর মতোই লাফ দিয়ে পড়ল পায়ের কাছে। দু—হাতে ঊরু দুটো জড়িয়ে ধরে সে রোহিণীকে তুলে ধরল।

‘এই হচ্ছে কি? হাত ব্যথা কোর না, দু—দিন পরই তো খেলা! ব্যাট তুলতে না পেরে বোল্ড হয়ে শেষে আবার ঘাড়ে দোষ চাপাবে।’

রোহিণীকে পাক দিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে রাজেন বলল, ‘আই উইল গেট আ সেঞ্চুরি ফর য়্যু, আই উইল স্কোর এ সেঞ্চুরি ফর য়্যু… আই অ্যাম আ ডন ব্র্যাডম্যান…।’

আর রোহিণী তখন উপরের ল্যান্ডিংয়ে নন্দার ছানাবড়া হওয়া চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, হায় আন্টি, আর তুমি কোন নৈতিক অধিকারে ওই কিশোরীকে জ্ঞান দেবে? হতচ্ছাড়া প্রেমই তোমাকে ডোবাল।

‘রাজেন, একজন দেখছে, নামাও।’ রোহিণী ফিসফিস করে বলল রাজেনের কানের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে।

‘কই?’ রাজেন ঘুরল। নন্দা ছুটে উপরে উঠে গেল।

‘তাই তো! এটা যদি এখন শোভনেশ দেখে ফেলত?’ রাজেন মজা করেই বলল রোহিণীকে নামিয়ে দিয়ে।

‘আমার হাত জোড়া, দরজা খোল।’

রাজেন দরজা খুলল। দু—জনে ভিতরে ঢুকল। খাবার টেবিলে বসল।

‘প্লিজ, ওই নামটা আর আমার কাছে কখনো উচ্চচারণ কোরো না।’ স্বাভাবিক অনুত্তেজিত রোহিণীর কণ্ঠ। ‘ওপারের মাসিমা দুটো মালাই দিয়েছেন, দুটোই তোমার।’

অপ্রতিভ রাজেন কুলপির ঢাকনা খুলে দেখল। গন্ধ শুঁকল। দুই তালুর মধ্যে কুলপি ঘসতে ঘসতে বলল, ‘দুটো প্লেট দাও, বার করে দিচ্ছি।’

এই ফ্ল্যাটে রাজেনের প্রথম আসা। কৌতূহলী চোখে সব কিছু সে দেখতে লাগল। কিছুক্ষণ পর চামচ দিয়ে মালাই খেতে খেতে সে বলল, ‘নামটা আমি না হয় উচ্চচারণ করলাম না, কিন্তু অন্যেরা তো করবে। এখনও তো সে তোমার স্বামীই। এখনও সে বেঁচে, এখনও তাকে নিয়ে অনেক কিছু ঘটতে পারে। হয়তো ওই দুই ফেরারিদের একজন…।’

সে নাম উচ্চচারণ না করে থেমে গেল। রোহিণী অনুনয় ভরা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আর আমাকে ভয়ের দিকে ঠেলে দিয়ো না। অন্তত আজকের দিনটায় নয়।’

‘তাহলে ওই মালাইটা ফেলে না রেখে খেয়ে নাও। দারুণ হয়েছে, বলে দিয়ো।’

‘আর আমি ওপরে যাব না। কেন জানি অস্বস্তি লাগছে ওপর সম্পর্কে।’

‘গঙ্গাদার কথা শুনে? কিন্তু কে সত্যি কে মিথ্যে সেটা তো এখনও সাব্যস্ত হয়নি।’

রোহিণী উত্তর দিল না। রাজেন পলিথিন প্যাকেট থেকে খাবারের বাক্স বার করল।

‘আবার কী?’

‘ধোকলা।’ বাক্স খুলে রাজেন এগিয়ে ধরল।’ খেয়ে দ্যাখো। ডালের জিনিস, নোনতা নোনতা, টক টক, সঙ্গে লঙ্কাও রয়েছে তবে ঝাল নেই।’

পুডিংয়ের মতো জমানো। ধনেপাতা ছড়ানো। রোহিণী একটা টুকরো মুখে দিয়ে, চাহনি মারফত তার পছন্দটা জানিয়ে দিল। উঠে গিয়ে সে সন্দেশের বাক্স আনল।

‘এটা বাঙালি খাবার।’

‘হুমম।’ রাজেনের মুখে তখন আস্ত একটা কড়াপাক। সে দ্বিতীয় পলিথিন প্যাকেটটার দিকে হাত বাড়াল।

‘কী আছে ওতে?’

‘চকোলেট কেক।’

‘থাক ওটা। মালাই, ধোকলা তারপর সন্দেশ! এই সবই যদি খাবে, তাহলে ভাত খাবে কে? খাওয়ানোর কথা তো আমারই। আর তুমি—দাও সরিয়ে রাখি, চোখের সামনে থাকলে—।’

রোহিণী প্যাকেটটা নিয়ে উঠে যেতেই রাজেন পাখা খুলে রেগুলেটর এক পয়েন্টে রাখল।

‘বেশ গরম আজ, ঘেমে গেছি।’

‘আমি তো রোজ মাথা না ভিজিয়ে রাতে চান করি।’ রোহিণী প্লেট তুলে রান্নাঘরে যাবার সময় বলল।

‘আমিও আজ চান করব।’

‘অভ্যেস নেই, ঠান্ডা লেগে যাবে। খেলা রয়েছে না?’

‘মাথায় জল দেব না।’ রাজেন কলঘরের দরজায় গিয়ে ভিতরে উঁকি দিল।

‘ভাতটা চড়িয়ে, মাছগুলোয় সর্ষে লঙ্কা বাটা মাখিয়ে, আমি আগে সেরে নিই।’

‘ততক্ষণে আমার গায়ে জল ঢালা হয়ে যাবে।’ রাজেন সোয়েটার খুলতে খুলতে বলল।

‘ভাত ফুটতে দু—মিনিট লাগবে।’ রোহিণী হাত বাড়িয়ে সোয়েটারটা নিল।

‘টস করব, কয়েন দাও।’

‘কয়েন? বেশ।’ ঝুলির মধ্যে রেজগির ছোট্ট ব্যাগটা। রোহিণী প্রথমে কার্ডিগানটা বার করল, তারপর ম্যাগাজিনটা, তারপর ব্যাগটা। একটা আধুলি সে রাজেনকে দিল।

‘বলো।’ আধুলিটা রাজেনের ডান তালুতে পড়তে বাঁ তালু দিয়ে চেপে ধরে সে বলল।

‘টেইল।’ রোহিণী চোখ বুজে আছে। হঠাৎই তার মনে হয়েছে,এই টস দিয়েই তার ভাগ্যেরও পরীক্ষা হবে। জিতলে তার জীবন সুখের হবে।

‘ইওর চয়েস, ব্যাটিং না ফিল্ডিং?’

‘মানে?’

‘জিতেছ। রান্নাঘরে, না কলঘরে, কোথায় যেতে চাও?’

আর একবার একটা আনন্দের প্লাবন রোহিণীকে ভাসাল। আবার সে দিশাহারা হয়ে যাচ্ছে। সুখী হবে সে! অতীতটা অতীতেই থাক। এখন থেকে সে ভবিষ্যতের দিকে তাকাবে। রাজেন ছাড়া ভবিষ্যৎকে আর ভাবা যায় না।

‘বাঙালি মেয়ে আগে কোনটা চয়েস করবে, সেটাও কি বলে দিতে হবে?’

‘তাহলে ফিল্ড করো। ভাতটা চাপাও, সর্ষে বাটা মাখাও। বেরিয়ে এসে আমি ফিল্ড করব। কিন্তু ফ্যানট্যান গালতে পারব না, আগেই বলে দিচ্ছি। শুধু ফার্স্ট স্লিপে দাঁড়াব।’

‘তার আগেই আমার হয়ে যাবে।’

কলঘরে জলের ঝারির নীচে রাজেন চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে। বন্ধ দরজা ভেদ করে গানের মিষ্টি সুর ভেসে আসছে রান্নাঘর থেকে। হঠাৎ সে চেঁচিয়ে বলল, ‘রুনি, ধারেকাছে ধোপাবাড়ি আছে কি?’

‘বোধ হয় নেই।’ চেঁচিয়েই জবাব দিয়ে রোহিণী কলঘরের দরজার কাছে এসে বলল, ‘আমার গলা কি এতই খারাপ?’

‘তোমার নয়, তোমার নয়।’ বলেই রাজেন বেসুরে গানটা ধরল, ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে।’

‘আস্তে রাজেন,আস্তে,ওপরে তুষারবাবুর মাসল খুব বদমেজাজি, উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে।’

শুনে রাজেন গলাটা আরও চড়াল। খুব তাড়াতাড়িই তার স্নান হয়ে গেল। বেরিয়ে এসে বলল, ‘দারুণ ফ্রেশ লাগছে।’

‘এবার একটু একা অপেক্ষা করো, আমি সেরে নিই, চিরুনি ঘরে রয়েছে, চুল আঁচড়ে নাও। আর রান্নাঘরে ঢুকে কোনো কিছুতে হাত দেবে না’। রোহিণী স্নানে যাবার আগে সদর দরজাটা বন্ধ আছে কিনা দেখে নিল।

কলঘর থেকে বেরিয়ে রোহিণী দেখল, একমনে রাজেন টেবিলে রাখা ম্যাগাজিনটা পড়ছে।

‘ওতেই লেখাটা রয়েছে। পড়ে ফ্যালো। আমার এখনও শেষ দিকটা পড়া হয়নি।’

‘ওটাই পড়ছি।’

রান্না শেষ হবার আগেই রাজেনের পড়া শেষ হয়ে গেল।

‘কী বুঝলে?’ টেবিলে মাছভাজার প্লেট আর তেলের বাটি রেখে রোহিণী জানতে উৎসুক হল।

‘এই সিধারথ সিনহাকে যেন চিনি চিনি মনে হচ্ছে। যাদবপুরে আমাদের সময় কম্পারেটিভ লিটারেচার পড়ত এক সিদ্ধার্থ সিংগী।

‘কীসের জন্য মনে হচ্ছে যে, এই লেখকই?’

‘অনেকটা এই ধরনের লেখা বছর দুয়েক আগে স্পোর্টস উইকলিতে লিখেছিল পৃথিবীর নামি কয়েকজন প্লেয়ারদের নিয়ে। লেখার আগে আমার কাছে এসে বিদেশি ক—জন ক্রিকেটারদের সম্পর্কে বই নিয়ে গেছিল। লেখাটা পড়েছিলাম, ইংরেজিটা ভালোই লেখে। অনেকটা এই ধাঁচেরই লেখা, বিষয়টা ছিল কতরকমভাবে বড়োবড়ো খেলোয়াড়দের পতন ঘটেছে। মনে হয় সিরিজ করছে,পরে বই করে বার করবে। তবে আগের লেখাটায় সিদ্ধার্থই ছিল, সিধারথ নয়।’

‘এর সঙ্গে আমি দেখা করব। ঠিকানা জান?’

‘নর্থে গ্রে স্ট্রিটে মানে অরবিন্দ সরণিতে কোথায় যেন বাড়ি, পড়াত আশুতোষে। খোঁজ নিয়ে তোমায় বলতে পারি।’

‘দেরি হয়ে যাবে। কাল সকালে যাব মীনা চ্যাটার্জির কাছে, ওখান থেকেই চলে যাব আশুতোষে।’

‘লেখাটার শেষ দিকটা খুব ইন্টারেস্টিং। তুমি বোধ হয় এখনও পড়োনি? … সিধারথ সিনহা বহরমপুরের জেলে দেখা করেছিল শোভনেশ সেনগুপ্তের সঙ্গে।’

‘সে কি!’ রোহিণী হাতায় করে ডেকচি থেকে প্লেটে গরম ভাত রাখছিল। থামিয়ে রেখে রাজেনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘জিগ্যেস করেছিল, মেয়েদের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী? শোভনেশ সেনগুপ্ত জবাব দেয়, ‘আমার কাছে মেয়েরা শুধু দু—রকমের, হয় মা ভগবতী, নয়তো পাপোশ। ভগবতীদের পা মোছার পাপোশে পরিণত করাতেই তো আনন্দ।’ অদ্ভুত কথা!’

‘আমাকেও এ কথাটা বার দুই বলেছিল। পরে জানতে পারি, কথাটা পিকাসোর। ওর খুব শখ পিকাসো হবার বা বলতে পারো, ওর বিশ্বাস পিকাসোর মতোই প্রতিভাবান। তাই নকলও করে। দেখছি, এত কিছুর পরও শোভনেশ আগের মতোই রয়েছে। পাগলামি সারেনি।’

‘আর একটা প্রশ্ন ছিল, মানুষের জীবনের মূল্য আপনার কাছে কতটুকু? শোভনেশ সেনগুপ্ত এর জবাবে যা বলে, তাতে কিন্তু লোকটি সম্পর্কে অন্যরকম ধারণা হয়। ভগবতীকে পাপোশ কোনো ভদ্রলোকে করে না, কিন্তু মানুষের জীবন সম্পর্কেও দরদ, ভালোবাসা রয়েছে। কী বলেছে জানো?… আরে ভাত দাও, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে যে।’

রোহিণীর হাতা আবার ব্যস্ত হয়ে উঠল। আর একটা প্লেটে নিজের জন্য ভাত নিয়ে সে রাজেনের মুখোমুখি বসল। একটা টিফিন বক্সে সর্ষে মাখানো মাছ গরম ভাতের ডেকচির মধ্যে বসানো। সেটা লক্ষ করে রাজেন বলল, ‘আমাদের বাড়িতে মাছের উপর—নীচে কলাপাতা রেখে তার ওপরে গরম ভাত ঢেলে দেওয়া হয়।’

‘বেশি ভাত হলে ওভাবে করা চলে, এখানে দু’জনের জন্য ওইটুকু ভাতের … তারপর কী বলল শোভনেশ?’

‘বিদেশের একটা ঘটনার কথা বলেছে। বছর আঠারো আগে এক বিখ্যাত আমেরিকান সিগারেট কোম্পানির রিসার্চ সায়েন্টিস্ট ডক্টর মোল্ড এমন একটা জিনিস আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে তৈরি করা সিগারেট স্মোকিংয়ে কোনো ক্ষতি হবে না অর্থাৎ ক্যানসার হবে না। এমন একটা আবিষ্কার পৃথিবীতে কেউ করতে পারেনি। কিন্তু সেই কোম্পানি এই সিগারেট তৈরি করে বাজারে ছাড়েনি। কারণ, তাদের উকিল জানায়, ক্যানসার হবে না বললে কোম্পানির তরফে এটাই মেনে নেওয়া হবে যে, তাদের আগের প্রোডাক্ট অনিরাপদ ছিল। সুতরাং ফুসফুসের ক্যানসারে মৃত্যুর জন্য তাদের দায়ী করা যাবে। আর তাহলে ক্ষতিপূরণের দাবিতে কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলাও করা যাবে। ক্ষতিপূরণের টাকা দেবার ভয়ে কোম্পানি সেই আবিষ্কারটা চেপে গিয়ে আগের মতোই সিগারেট তৈরি করে বিক্রি করে যেতে লাগল। এই পিশাচের মতো কাজের ফলে গত আঠারো বছর কত লোক ফুসফুসের ক্যানসারে মারা গেছে জানি না, কিন্তু টাকার জন্য সমাজকে দুর্দশায় ফেলে, মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে একটা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার চেপে যাওয়া স্রেফ কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার। ভাবলে মাথা ঠিক রাখা যায় না। এর তুলনায় একজনকে খুন করাটা গ্রাহ্যের মধ্যেই আনা চলে না। অথচ খবরের কাগজে সেটা নিয়েই ফলাও করা হয়। বেশি লোকের জীবন, তাদের বাঁচার অধিকারই শোভনেশ সেনগুপ্তর কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। লোকটার মধ্যে কনট্রাডিকসন রয়েছে—জটিল মন।’

‘কথা না বলে এবার খেয়ে নাও। মাছটার টেস্ট কেমন?’

‘মা—র কাছে একটা ছড়া শুনেছি—থোড় ডুমুর ইচলা মাছে খাইলে মুখের অরুচি ঘোচে। এই ইচলায় অরুচি ঘুচল, এতে তোমার ঠোঁটের স্বাদ রয়েছে।’

একঝলক রক্ত রোহিণীর মুখে সুখের আলতা ছড়িয়েই অন্তর্হিত হল। চোখ নামিয়ে নিল। তার জীবনে আজ একটা এমনই দিন, যার সঙ্গে আর কোনো দিনেরই তুলনা চলে না। পরিপূর্ণ তৃপ্তিতে সে ডুবে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ সে চুপ করে রইল।

‘তোমার মা—র কাছে কবে আমায় নিয়ে যাবে?’

রাজেনের প্লেটের ভাত শেষ হয়ে গেছে দেখে, রোহিণী ডেকচি থেকে টিফিন বক্সটা তুলে রাজেনের মুখের দিকে তাকাল। মুখটা গম্ভীর।

‘গিয়ে কোনো লাভ নেই। আমাদের ফ্যামিলি খুব কনজারভেটিভ, একথা তোমায় আগেও বলেছি। আমার দাদার বিয়ে হয়েছে ঘটকালি করে। খুঁজে খুঁজে, মধ্যবিত্ত ঘরের স্কুল ফাইনাল পাশ মেয়ে কিন্তু অপূর্ব সুন্দরী। ঘটকের আনা সম্বন্ধে বোনেদের বিয়ে হয়েছে। বড়োজামাই শ্বশুরের টাকায় এমআরসিপি করে আসে। মেজো এখন দাদার জুনিয়ার।’

‘তা হলে?’ রোহিণী অবুঝ দৃষ্টি মেলে রইল।

‘তা হলে আর কি! শরীর—মনে আমি সাবালক, অন্যের ইচ্ছা—অনিচ্ছায় আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ন্ত্রিত হবে, এটা মানতে রাজি নই।’

‘তুমি কি আমার সব কথা বলেছ?’

‘শোভনেশ সেনগুপ্ত প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে।’

‘বয়স?’

‘হ্যাঁ, এটাতেই—যাকগে এসব কথা। জয়পুর থেকে ফিরেই ডিভোর্সের কাজটা সেরে ফেলতে হবে। তারপর দেখা যাবে কতদূর কী হয়। মোটকথা শোভনেশ সেনগুপ্ত কোনো দিন এসে ‘আমার বউ’ বলে যাতে হাত না বাড়ায়, আগে সেই ব্যবস্থাটা তো করে ফেলি। তারপর তোমাকে একদিন নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনব।’

দু—জনে নীরবে খাওয়া শেষ করল। রোহিণীর মনে কাঁটার মতো খচখচ করছে একটা কথা, কিছু গোপন করা উচিত নয়, একদিন তো ওরা জানতে পারবেই।

রাজেন অনুমান করেছে, রোহিণীর চিন্তাধারা এখন কোন খাতে চলেছে। হালকা সুরে সে বলল, ‘রণে আর প্রেমে অন্যায় বলে কিছু নেই। বিষয়ের কথাটা চেপে গেলেই হবে। পরে যদি জানতে পারে তো পারবে।’

লোকটা জীবন থেকে সরে গিয়েও সরছে না। রোহিণী কেমন যেন অসহায় বোধ করল। শোভনেশের ছায়া কি তার জীবনপথে সবসময়ই এইভাবে পড়বে?

‘কাল ভোরে দিল্লির ফ্লাইট।’

‘আর দেরি কোরো না, তাড়াতাড়ি গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

‘আজ রাতে ঘুম আসবে না, জেগেই থাকব।’

‘জয়পুর থেকে একটা ম্যাক্সি বা কাচ—বসানো ঘাঘরা, যদি মনে থাকে, তাহলে এনো, উপরের মেয়েটিকে দেব।’

‘কোন মেয়েটি, যে তখন সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দেখছিল?’

‘সারাবাড়ি এখন চাউর হবে।’

‘ম্যাক্সিটা কি ঘুষ?’

‘তুমি যেখানে সেখানে যা—তা কাণ্ড বাধিয়ে এমন লজ্জায় ফেলে দাও!’

‘কাণ্ড! আমার তো তখন লঙ্কাকাণ্ড বাধাতে ইচ্ছে করছিল।’

‘ওটা জয়পুরের মাঠের জন্য এখন তোলা থাক। আর সেঞ্চুরি করব—টরব কখনো এসব বোলো না। যদি না পারো?’

‘পারব। বাজি?’

‘বাজি—টাজি নয়, তবে এটা হবে আমার জন্য লটারি। যদি সেঞ্চুরি করো তাহলে নিশ্চিত হয়ে যাব হাসপাতাল থেকে শোভনেশ পালায়নি, ওটা অন্য কেউ।’

দশ মিনিট পর, রাজেন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। পায়ের শব্দ ক্রমশ অস্পষ্ট হতে হতে মিলিয়ে গেল। রোহিণী দরজার খোলা পাল্লায় হেলান দিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে। সাত পাঁচ ভাবনা তাঁর মাথায় বুদবুদের মতো ফাটছে আর তৈরি হচ্ছে। তবে সব কিছুর গভীরে সুখবোধের একটা বেদি তৈরি হয়েছে। যার উপরে এইবার সে ভবিষ্যৎ—জীবনকে স্থাপন করবে।

‘আন্টি আপনার ফোন।’

চমকে উঠল সে। সিঁড়িতে নন্দা। এই সময় কে! কেন? রোহিণী সিঁড়ি দিয়ে উঠল। টিভি—তে হিন্দি সিরিয়াল চলছে। সপরিবার তুষার দত্ত দেখায় মগ্ন। রোহিণীকে দেখে সবাই মুখ ফেরাল।

‘হ্যালো।’

‘আমি গঙ্গাদা। বহরমপুর থেকে নির্মল এক্ষুনি ফোন করেছিল।’

‘কেন?’ রোহিণী যেন লটারির ফলের ঘোষণা শোনার জন্য তৈরি।

‘বলল, যে দু—জন পালিয়েছে তাদের একজন শোভুই। জেল—সুপারের কাছ থেকে জেনে এসেছে।’

রোহিণীর চোয়ালটা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল, রিসিভার ধরা মুঠিটাও। চোখের সামনে ভেসে উঠল তার নিজেরই জীবনের একটা মুহূর্ত—সিঁড়ির ছ—টা ধাপ উপর থেকে জোড় পায়ে সে লাফ দিয়ে পড়ছে ছেলেবেলার মতো। এই মুহূর্তটা সত্যি, তার কাছে ভীষণ গভীরভাবে সত্যি। এটাকে সে নষ্ট হতে দেবে না।

‘গঙ্গাদা, কাল শোভনেশ এসেছিল বলেছিলাম। কিন্তু একটু আগে জানলাম, সে শোভনেশ নয়, অন্য লোক। ও যদি আমার কাছে আসে তো আসুক, আমার ভয় পাবার কিছু নেই। এটা ঠিকই যে, আমি ভয়ের মধ্যে পড়েছিলাম কিন্তু এখন বেরিয়ে এসেছি। আপনি আমার জন্য চিন্তা করবেন না।’

ওধার থেকে আবার গঙ্গাপ্রসাদ কী যেন বলে গেলেন কিন্তু কিছুই তার কানে ঢুকল না। সে আর কিছু শুনতে চায় না। রিসিভার নামিয়ে রোহিণী ঘরের সবার দিকে একবার হাসিমুখে তাকিয়ে বেরিয়ে এল। সুজাতা গুপ্তর ফ্ল্যাটের দরজার সামনে একটু ইতস্তত করল। আজ থাক, পরেই কথা বলব, আগে সিদ্ধার্থ সিংহর লেখাটা পড়ে নিই, এই স্থির করে রোহিণী নিজের ঘরে ফিরে এল।

রাতে বিছানায় কাত হয়ে সে ‘ভস্মীভূত শিল্পীরা’ পড়ছিল। পড়তে পড়তে একসময় সে সোজা হয়ে বসে অস্ফুটে বলে উঠল, ‘আশ্চর্য, আমি এসব লক্ষই করিনি!’

ছয়

রোহিণী ঠিক দশটায় মীনা চ্যাটার্জির ফ্ল্যাটের কলিং বেলের বোতামে আঙুল রাখল।

দরজা খুলল সেই কিশোরী, যে সেদিন পাখা খুলে দিয়ে চা বা কোল্ড ড্রিঙ্কস দেবে কিনা জিজ্ঞাসা করেছিল।

‘মীনা চ্যাটার্জির সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।’

‘আসুন।’

ভিতরে পা দিয়েই রোহিণী দেখল, তিনটি পুরুষ একদিকের সোফায় বসে আর তাদের মুখোমুখি ঝালর দেওয়া বেড কভারে ঢাকা মোটা গদির ছোটো চৌকিতে মীনা। কোলে তাকিয়া নিয়ে ঈষৎ ঝুঁকে।

‘আসুন, আসুন।’ তাকিয়াটা পাশে রেখে মীনা সোজা হয়ে বসল। ম্যাগাজিনের লোকের জন্য তাঁর এইটুকু খাতিরই বরাদ্দ করা আছে। তবে রোহিণী যতটুকু মাথা নামাল নমস্কারের জন্য তার দ্বিগুণ মাথা নামিয়ে মীনা নমস্কারটা গ্রহণ করল। বিনয়ের প্রতিযোগিতায় সে টলিউড মেয়েদের মধ্যে গোল্ড মেডালিস্ট।

মীনার এক পলক চাহনি থেকেই রোহিণী বুঝে গেল, এইবার তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জরিপ করবে তার থেকে অফিসিয়ালি প্রায় আট বছরের ছোটো এই মেয়েটি। মীনার চোখে সে কৌতূহল এবং একটু অস্বস্তি দেখতে পেল।

‘আপনি তো দারুণ পাংচ্যুয়াল, দশটা মানে ঠিক দশটাই!’

‘কলকাতার ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে হলে সময়ের হিসেবটা খুব ভালো করে কষতে হয়। এখানে আসতে যে সময় লাগবে, সেটা হিসেব করে তার সঙ্গে আধ ঘণ্টা জুড়ে সেইমতো বাড়ি থেকে বেরিয়েছি।’

‘কারে এলেন?’

‘ট্যাক্সিতে।’ রোহিণীকে মিথ্যা কথাটা বলতেই হল। মিনিবাসে চড়ে এসেছি বললে তার গুরুত্বের পয়েন্ট কাটা যাবে।

.

মহারানির দপ্তর থেকে রোহিণী জেনে নিয়েছে, মীনাদের সংসারে এমন একটা সময় গেছে, যখন দু—বেলা হাঁড়ি চড়াই দায় হয়ে পড়েছিল। এখন সে সচ্ছল হয়েছে, টাকাওয়ালা লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা করছে। অতীত কোনোভাবেই তার এই জীবনে উঁকি দিক, এটা সে এখন চাইবে না। প্লেন, কার, বড়োজোর ট্যাক্সি পর্যন্ত সে নামতে পারে, কিন্তু ট্রাম বা বাস তার এই সাজিয়ে তোলা মানসিকতাতে যাতে না ঢুকে পড়ে এই ভয়ে সে তটস্থ থাকে। রোহিণী এই ধরনের রোগগ্রস্ত কিছু কিছু মন দেখেছে, যারা দারিদ্র্য থেকে মই বেয়ে উঠে এসেই মইটা ফেলে দেবার জন্য লাথি ছোড়ে। মীনা সম্ভবত কিছু লাথি ছুড়বে।

‘চা, কফি?’

‘না, এই সময় কিছুই খাই না বিশুদ্ধ জল ছাড়া।’

‘ওহহ মাইগড, কলকাতা কর্পোরেশন এলাকায় বিশুদ্ধ জল!’

রোহিণীর কানে খট করে লাগল মীনার উচ্চচারণের ভঙ্গিটা। ইম্প্রেস করাবার জন্য তার মতো মীনারও একটা দ্বিতীয় গলার স্বর আছে, কিন্তু তার মনে হল, কীসের যেন একটা ঘাটতি ওর বলার ভঙ্গিতে রয়েছে। সেটা বোধ হয় জন্মগত আভিজাত্যের, ব্যক্তিত্বের, মুক্ত চেতনার অভাবের জন্যই। রোহিণী তার এই ধারণাগুলো মনে মনে নোট করে নিল। লেখার জন্য দরকার হবে।

‘আপনি কি ফিল্টারড জল খান? আপনার হেলথ দেখে মনে হচ্ছে কখনো পেটের ট্রাবলে পড়েননি।’ রোহিণী সুতো ছাড়ল মীনাকে খেলাবার জন্য। প্রশংসার টোপ গিলে এইসব লোকেরা নিজেদের মন খুলে দেখিয়ে দেয়।

‘নেভার, নেভার, একদিনও নয়।’ মীনা খুকিদের মতো মাথা নাড়তে লাগল, ‘জানেন, আমি রোজ রাতে শোবার আগে এক গ্লাস চিরতার জল খাই। ইন্ডিয়ান হার্বাল মেডিসিন সম্পর্কে আমার অসীম শ্রদ্ধা, অগাধ আস্থা। লেখার মধ্যে এটা কিন্তু অবশ্যই রাখবেন… অসীম শ্রদ্ধা। আমাদের বাড়িতে কখনো অ্যালোপ্যাথি ওষুধ ঢোকেনি।’

‘কবিরাজি করাতেন না হোমিয়োপ্যাথি?’

‘কবিরাজি। আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান মানে কবিরাজ ছিলেন উমেশচন্দ্র সেনগুপ্ত।’

‘কী নাম বললেন?’ রোহিণীর ব্যগ্রতা প্রকাশ পেল হঠাৎ তার সিধে হয়ে বসায়।

‘উমেশচন্দ্র সেনগুপ্ত।’

‘কোথায় বাড়ি এনার?…এভাবে কৌতূহল দেখাচ্ছি বলে কিছু মনে করবেন না।’

‘না না, মনে করব কেন। আপনি ডিটেইলে সব জেনে তো নেবেনই। ওনার বাড়িতেই কবিরাজখানা ছিল বউবাজারে। মহামহোপাধ্যায় জ্যোতিষচন্দ্র সেনের সাক্ষাৎ ছাত্র, ওনার নাড়িজ্ঞান ছিল অদ্ভুত!’

রোহিণী আশ্চর্য হচ্ছে এই কারণে, সিধারথ সিনহার লেখাটায় সে কাল রাতেই জেনেছে, শোভনেশের জ্যাঠা নিঃসন্তান উমেশচন্দ্র কবিরাজ ছিলেন। পার্টিশান হওয়া বাড়ির অংশেই ছিল তাঁর কবিরাজখানা। পার্টিশনের পর উমেশচন্দ্রের সদর হয় বাড়ির পাশের দিকে তারক দত্ত লেনের উপর। সেদিক থেকেই ওরা রাস্তায় বেরোত। রোহিণী জানতই না যে উনি কবিরাজ ছিলেন। শোভনেশও তাকে বলেনি।

‘আপনি দেখেছেন ওনাকে?’

.

‘নিশ্চয়, উনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমি, দিদি, বাবা বহুবার গেছি ওঁর কবিরাজখানায়। গেলেই চামচে করে ভাস্কর লবণ হাতে দিতেন। ওই ভাস্কর লবণের লোভে আমি আর দিদি প্রায়ই যেতাম। উনি সাত—আট বছর আগে মারা গেছেন।’

‘এখন কে কবিরাজি করেন, ওঁর ছেলে?’

‘উনি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে কবিরাজখানাটা উঠে গেছে।’

রোহিণী তার নোটবই বার করল। মীনা তাই দেখে চুপচাপ বসে থাকা ঘরের অন্য তিনজন লোকেদের উদ্দেশে বলল, ‘তা হলে আপনাদের ডিসিশন পরশুর মধ্যেই জানিয়ে দেবেন।’

তিনজন উঠে দাঁড়াল।

‘কালই জানিয়ে দিতে পারব বোধ হয়।’ কথাটা বলে মাঝবয়সি হাওয়াই শার্ট পরা লোকটি চোখের ইশারায় মীনাকে দরজার কাছে যেতে বলল। মীনা উঠে গেল কাঠের পার্টিশনের ওধারে।

রোহিণী দু—একটা সংলাপ শুনতে পেল।

‘না না ওর কমে…’

‘লাইনে নতুন এসেছে, একটু বিবেচনা করো।’

‘করেছি। স্ক্রিপ্ট অতি বাজে, এ ছবিতে, আমার বদনামই হবে বাচ্চচুদা…’

ফিসফিস আরও কিছু কথা হবার পর মীনা ফিরে এল। ঘরের একধারে দেওয়াল ঘেঁসে একটা টেবল। তার ড্রয়ার থেকে জেরক্স করা তিন পাতা কাগজ বার করে এনে সে রোহিণীকে দিল।

‘এত লোক জিজ্ঞাসা করে যে, জবাব দিতে দিতে মুখে ব্যথা হয়ে গেছে। তাই টাইপ করে জেরক্স করিয়ে রেখেছি। বোম্বাইয়ের জেট সেট আর স্টারডাস্টকে এরই কপি দিয়েছি। আমার সম্পর্কে যা যা জানার কৌতূহল হতে পারে, বোধ হয় তার সবেরই উত্তর এতে আছে। তবু পড়ে নিন, এর বাইরে যদি কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে তো প্রশ্ন করুন। … একসকিউজ মী, আমি একটু ভিতর থেকে আসছি।’

রোহিণীর মনে হল, ভিতর থেকে কেউ ইশারা করে ওকে ডেকে নিল। সুভাষ গায়েন কোথায়? ভিতরে রয়েছে কি? ওকেই তো তার দরকার। আসলে ওর সঙ্গে কথা বলার জন্যই তো তার আসা।

জোড়াবাগান থেকে উঠে এসে মীনারা যে শোভনেশদের পাশের পাড়াতেই একসময় ছিল, এটা সে সিধারথ সিনহার লেখাতেই পেয়েছে। বীণার সঙ্গে শোভনেশের পরিচয় কবিরাজের কাছে যাতায়াতের সময়ই যে হয়েছিল, এই খবরও লেখায় আছে। তখন বীণার বয়স কতই বা ছিল, সতেরো, আঠারো! এই বয়সের মেয়েরা চট করে মুগ্ধ হয় গাইয়ে, গল্প লিখিয়ে, ছবি আঁকিয়েদের মতো লোকেদের সংস্পর্শে এলে। কিন্তু মৃত্যুর সময় বীণা অবিবাহিতা ছিল না, অন্তত সিধারথ সিনহার লেখাটায় তাই লেখা আছে। নিছকই অনুমানের ভিত্তিতে বলা। কিন্তু কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, সেটা বলতে পারেনি। কোর্টে বিচারের সময়ও প্রসঙ্গটা উঠেছিল। কিন্তু বীণার স্বামী যে কে ছিল, তার কোনো সাক্ষ্য—প্রমাণ দাখিল করা যায়নি। রোহিণীর অনুমান, সুভাষ গায়েনই সেই স্বামী।

লোকটা যদিও পরশু তাকে বলল, শোভনেশ যে বীণাকে নষ্ট করে পচিয়ে দিয়েছে, তা সে জানত না, জানলে শোভনেশকে খুন করে সে—ই নাকি জেলে যেত। কিন্তু এখন ‘ভস্মীভূত শিল্পীরা’ পড়ার পর অনেকের অনেক কথাই তার মিথ্যা মনে হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে বীণা ও শোভনেশের মধ্যে যে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, সুভাষ গায়েন তা জানত। খুব ভালো করেই জানত।

এইসব ভাবতে ভাবতে রোহিণী জেরক্স করা কাগজগুলোয় চোখ বোলাচ্ছিল। একজায়গায় দেখল, মীনার প্রিয় খাদ্য : মোয়া, পরিজ, পাবদা মাছ, লস্যি। প্রিয় লেখক : রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, গোর্কি, শার্লক হোমস। (অবশ্য নামটা কেটে কে যেন লাল কালিতে কোনান ডয়েল লিখেছে)। সংস্কার: প্রথমে বাঁ পায়ে জুতো পরা। ভয় : ভূত এবং ইন্টারভিউ দেওয়া। বাতিক : ভোরের সূর্য দেখা। ব্যায়াম : বুল ওয়ার্কার নিয়ে। প্রিয় খেলোয়াড় ম্যাকেনরো ও ভিভ রিচার্ডস। প্রিয় খেলা : স্কোয়াশ। পড়তে পড়তে রোহিণীর ঠোঁট মুচড়ে উঠল। নিশ্চয় কেউ লিখে দিয়েছে। বুল ওয়ার্কার! স্কোয়াশ! গোর্কি! ম্যাকেনরো! আবার মোয়াও! হঠাৎ তার চোখে পড়ল—প্রিয় ইচ্ছা : কৈশোর জীবনে ফিরে যাওয়া। কী আশ্চর্য, এতক্ষণ এটাই চোখে পড়েনি। মীনাকে তো এটা নিয়েই প্রশ্ন করা যায়।

মীনা ফিরে এল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই।

‘পড়লেন?’

‘সব নয়, খানিকটা। খুব উইটি উত্তরগুলো। এর মধ্য থেকেই আপনার চরিত্র অনেকটা ধরা যায়।’

‘কী ধরা যায়?’ মীনা উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল।

‘আপনার মধ্যে এমন একটা সূক্ষ্ম আর্টিস্টিক বোধ রয়েছে, যেটা ফাইন আর্টের শিল্পীদের মধ্যে পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে আপনি আর্টের ভক্ত। আর্ট মানে স্কালপচারস, পেইন্টিংস, এইসব আর কী।’

‘আপনি ঠিকই ধরেছেন।’ তাকিয়াটা কোলে নিয়ে মীনা কুঁজো হয়ে বলল, ‘কবিরাজ মশাইয়ের বাড়ির পিছনের অংশে ওনার ভাইপো থাকতেন, তিনি ছবি আঁকতেন। আমি আর দিদি গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম। দেখতে দেখতে আমার খুব ইচ্ছে হত আমিও শিল্পী হব, ছবি আঁকব, স্রষ্টা হব।’

রোহিণীর মনে হল, এইবার মীনার আবেগ আসবে। সৃষ্টির কাজকর্মে নেমে পড়লে আর ওকে থামানো যাবে না। এখনি একটা বাঁধ তুলে আবেগের স্রোত থামাতে হবে।

‘আমার মনের মধ্যে কী যে তখন হত, শিল্পীর তুলির ছাপ ক্যানভাসে তো নয়, যেন আমার মনের ক্যানভাসেই রং ধরাত।’

‘মিস চ্যাটার্জি, সেই শিল্পীর নাম কী?’

‘শোভনেশ সেনগুপ্ত।’

‘কোথায় তিনি আঁকতেন?’

‘ওঁদের দোতলায়। লম্বা একটা বড়ো ঘরে।’

‘বাড়িতে আর কেউ ছিল?’

‘বাবা ছিল। যতদূর মনে হয়, আর কাউকে দেখিনি। প্রায় বছর কুড়ি আগের কথা তো।’

‘আর্টিস্টের স্ত্রী বা অন্য কেউ? বন্ধুবান্ধব?’

‘স্ত্রী ছিল। শুনেছি, অসুখে না কীসে যেন মারা গেছে। আর বেঁটে মোটা একটা লোকেকে দু—একবার দেখেছি, বন্ধুই হবে।’

‘উনি আপনাদের সঙ্গে কথাটথা বলতেন?’

‘হ্যাঁ। ছবি বোঝাতেন। আঁকা কেমন করে হয়, মনের মধ্যে কীরকম অবস্থা থাকে আঁকার সময়—এইসব শুনতে শুনতেই বোধ হয় আমি আর্টিস্টিক সেন্সটা পেয়েছি।’

‘উনি কখনো আপনাদের ছবি আঁকেননি?’

‘নিশ্চয়।’ মীনার গলায় উঁকি দিল ঈষৎ গর্ব। ‘আমার মুখ এঁকেছিলেন।’

‘আর দিদির?’

মীনা উত্তর দিতে একটু সময় নিল। রোহিণীর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্কের মতো বলল, ‘হ্যাঁ, দিদিরও।’

‘আছে আপনার কাছে কোনো ছবি?’

‘না নেই।’ মীনার উত্তরটা এত দ্রুত এল যে, রোহিণীর পরের প্রশ্ন পিছু হটে গেল।

‘আচ্ছা ওনার সঙ্গে কোথায় দেখা করা যাবে, মানে কোথায় এখন আছেন? তা হলে জেনে নিতাম আপনার সম্পর্কে ওনার ইম্প্রেশনটা।’

মীনা হাসল। হাসিটার দশ—বারো রকমের অর্থ করা যায়। ‘ওঁকে পাওয়া শক্ত। তা হলে আপনাকে বহরমপুর জেলে যেতে হবে। ওখানে আছেন খুনের আসামি হয়ে।’

‘খুন করেছেন!’ রোহিণী আঁতকে ওঠার চেষ্টা করে দেখাল। ‘কাকে?’

‘একজনকে। নাম বললে আপনি চিনবেন না। একটি মেয়ে, যে ওঁর ছবির মডেল হত। ভেরি স্যাড, ভেরি স্যাড।’ হঠাৎ সামনে ঝুঁকে ফিসফিস করে মীনা এবার যা বলল, তা শোনার জন্য রোহিণী একদমই তৈরি ছিল না।

‘ভুল লোককে যাবজ্জীবন দিয়েছে। ইনোসেন্ট লোককে শাস্তি দিয়েছে। উনি খুন করে কোনো দোষ করেননি। শোভনেশ সেনগুপ্তকে মেয়েটি ঠকিয়েছে। চিট করেছে। শুধু ওঁকেই নয়, আর একটি লোককেও ঠকিয়েছে, স্বামীকে।’

‘ওহ বিবাহিতা ছিলেন?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু সেটা আমি ছাড়া আর কেউই জানত না। শোভনেশ সেনগুপ্তও জানতেন না। আবার স্বামীও জানত না শোভনেশের প্রেমিকা তার স্ত্রী। এই ধরনের মেয়েদের আমি ঘৃণা করি। করা উচিত নয় কি?’ মীনা দেখল, রোহিণী নোট বইয়ে দ্রুত লিখছে। সন্তুষ্ট গলায় সে আবার বলল, ‘আমার কোনো নিকট আত্মীয়াও যদি এমন কাজ করে, তা হলেও আমি ক্ষমা করব না।’

‘আপনি দেখছি অত্যন্ত নিরপেক্ষ। চিটারদের সম্পর্কে কোনো মোহ নেই, দুর্বলতা নেই।’

‘কারেক্ট। আপনি আমাকে ঠিকই বুঝেছেন। মানুষের মন নিয়ে যারা ঠকানোর কারবার করে, তারাই আসল খুনি।’

রোহিণীর মনে হল, মীনার কথাগুলোর মধ্যে আন্তরিকতা রয়েছে, মনে—প্রাণে বিশ্বাস করে। নিজের দিদিকে যখন ঘৃণা করছে, বুঝতে হবে ঘটনাটা তার মনের গভীরে দাগা দিয়েছে।

রোহিণী এবার সাহসভরে, শালীনতার গণ্ডি পেরিয়ে বলল, ‘যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে একটা প্রশ্ন করব?’

মীনা কৌতূহলভরে তাকিয়ে বলল, ‘করুন।’

‘আপনি বোধ হয় শোভনেশ সেনগুপ্তকে ভালোবেসেছিলেন? এখনও দুর্বলতা রয়েছে।’

যেন ভীষণ মজার কথা শুনল, এমনভাবে মীনা হেসে উঠল। ‘আমার তো তখন বারো বছর বয়স, যখন ওই বাড়িতে প্রথম ওঁকে দেখি।’

রোহিণী নিমেষে যোগটা করে ফেলল। কুড়ি আর বারো, তা হলে মীনার বয়স এখন বত্রিশ।

‘ভালোবাসাটাসার কিছুই তখন বুঝি না, তবে মানুষটাকে আমার ভালো লাগত। ছবি নিয়ে যেমন পরিশ্রম করতেন,তেমনি সিনসিয়ারও ছিলেন। বলতে পারেন, এই দুটো গুণ আমি ওঁর কাছ থেকেই পেয়েছি। এটা অবশ্যই উল্লেখ করবেন।’

‘ওঁর আঁকা কোনো ছবি যদি দেখতে পেতাম। আপনার কাছে যা শুনছি, তাতে ভীষণ ইচ্ছে করছে ওনার কোনো কাজ দেখতে।’

মীনা ইতস্তত করল।

যে ছবিটা শোভনেশ আর গঙ্গাপ্রসাদ রোহিণীকে তার বাড়িতে গিয়ে দিয়ে এসেছিল, সেটা বোম্বাইয়ে দিদির কাছে যাবার সময় সে গঙ্গাপ্রসাদকে দিয়ে দেয়। চমৎকার ছবিটা। চোখ পড়লে কিছুক্ষণ না তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ফেরানো যেত না। এই মুহূর্তে রোহিণীর আফশোস হল। না দিলেই হত।

‘আসুন আমার সঙ্গে। অনেক খুঁজে একটা ছবি সংগ্রহ করেছি।’

মীনা উঠে গিয়ে পর্দা সরিয়ে সেই দরজাটা খুলল, পরশু যেটা দিয়ে রোহিণী ঘরের দেওয়ালে বীণার ন্যুড ছবিটা দেখেছিল।

‘ভেতরে আসুন… আমার বেডরুম।’

ফিল্ম তারকার শয়নকক্ষে ঢোকার সুযোগ পেয়ে রোহিণী যতটা না রোমাঞ্চিত হল, তার থেকেও বেশি বিস্মিত হল, ছবিটা এখন আর দেওয়ালে নেই, রয়েছে একটা চেয়ারের উপর! চেয়ারটা রয়েছে ঘরের মাঝামাঝি। বিছানায় কাত হয়ে শুলে দৃষ্টির সমান্তরাল স্তরে ছবিটা দেখা যায়।

‘বরাবরই কি এইভাবে ছবিটা রাখা?’

‘হ্যাঁ। আমি রোজ ঘুমোবার আগে ছবিটাকে দেখি।’

মীনা কি মিথ্যা কথা বলল? পরশু সন্ধ্যায় সে ছবিটা দেওয়ালেই দেখেছিল। কিংবা রাত্রে নামায়, আবার কোনো এক সময় তুলে দেয় দেওয়ালে। রোহিণী একটি ব্যাপারে নিশ্চিত হল, সুভাষ গায়েন তার আসল পরিচয়টা মীনাকে জানায়নি। সে শোভনেশের স্ত্রী, এই কথাটা জানলে মীনার ব্যবহার অন্যরকম হত। এত কথাও বলত না, ঘরে ডেকে নিয়ে ছবিটাও দেখাত না।

‘দেখতে দেখতে জানেন, আমি এই জগৎ থেকে অন্য জগতে চলে যাই।’

‘আমারও সেইরকম লাগছে। কী অসাধারণভাবে বডি কার্ভসগুলো এসেছে। সো সফট, টেন্ডার অ্যান্ড রিয়্যাল। বিদেশি ক্লাসিক্যাল মাস্টার্সদের যেকোনো ভালো কাজের সঙ্গে তুলনীয়! দেখে ইচ্ছে করছে এইরকম আর্টিস্টের মডেল হতে… অবশ্য ওইরকম বডি আমার নেই।’

‘কে বলল নেই। আমার দিদির পর এই আপনাকে দেখেই মনে হয়েছে, আপনার স্কিন, আপনার ফ্লেশ,ভলিউম, স্ট্রাকচার, প্রোপোরশন, শোভনকাকা ঝাঁপিয়ে পড়তেন।’

পড়তেন নয়, পড়েছিলেন। রোহিণীর চোখে পলকের জন্য ঝলসে উঠল শোভনেশের উন্মাদের মতো চাহনি, সাঁড়াশির মতো আঙুলগুলো, দুটো কাঁধ চেপে ঠান্ডা গলার কথা, ‘তা হলে বিয়ে করেছিলে কেন?’ পড়পড় করে ব্লাউজ ছেঁড়ার শব্দ! ধাক্কা দিয়ে তাকে ডিভানে ফেলে দেওয়া।

‘আপনার দিদির পর বললেন কেন?’ রোহিণী কৌতূহলের মধ্যে প্রভূত সারল্য মিশিয়ে বলল।

‘আমার দিদিরও—’ মীনা ছবি দিকে ঝুঁকে তাকাল। ‘চমৎকার বডি ছিল। হিংসে করতাম দিদিকে। লোকে তাকিয়ে থাকত রাস্তা দিয়ে হাঁটলে।’

‘তিনি এখন কোথায়?’

মীনা ঝুঁকে ছবি নিরীক্ষণের ভান করছে, রোহিণীর প্রশ্নটা যেন শুনতে পায়নি এমন একটা ভাব করে।

‘আপনার দিদি এখন কী করেন?’ রোহিণী নাছোড়বান্দা। মীনা কীভাবে মিথ্যা কথাটা বলে সেটাতেই সে কৌতূহলী।

‘দিদি…’ যেন চটকা ভাঙল। ‘দিদি বিয়ে—থা করে সংসার করছে।’ মীনা শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল।

.

‘আপনি এখনও বিয়ে করেননি। কেন?’ কথার পিঠে কথায় প্রশ্নটা করার সুযোগ পেয়ে রোহিণী করেই ফেলল।

‘এমনি। করার মতো মানুষ পাইনি, পেলে নিশ্চয়ই করব।’ মীনা হালকা সুরে বলল। রোহিণী নোট বইয়ে কলমের আঁচড় দিল।

‘কী ধরনের মানুষ পেলে আপনি বিয়ের কথা ভাববেন?’ বাঁধা গৎ—এর প্রশ্ন। পৃথিবীর হাজার দশেক অভিনেত্রীকে এই প্রশ্নটা করা হয়ে গেছে, তিন হাজার খ্রিস্টাব্দেও করা হবে। পাঠকরা বা ভক্তরা নাকি এইসব খবর জানতে চায়। রোহিণীর মনে হল, মীনা যেন জানেই এইরকম প্রশ্ন তাকে করা হবে।

‘আমি লম্বা পুরুষমানুষ পছন্দ করি। ছিপছিপে গড়ন হবে। মাথায় প্রচুর কালো চুলের মধ্যে কিছু কিছু রুপোলি ঝিলিক দেবে। গায়ের রং তামাটে হবে। মুখে চোখা বুদ্ধির ছাপ থাকবে। আর হতে হবে সহৃদয়। আমার নিশ্চয় অনেক দোষ আছে, বোকামি আছে, অজ্ঞতা আছে, সেগুলো নিয়ে বিরক্ত হবে না, কারণগুলো দেখিয়ে শুধরে দেবে। মোট কথা আমাকে প্রভাবিত করবে তার ব্যক্তিত্ব, বিদ্যা, বুদ্ধি দিয়ে। মুগ্ধ করতে পারলে তো আরও ভালো।’

‘কীরকম পেশার লোক পছন্দ করেন? মালটি ন্যাশনাল কোম্পানির কোনো বড়োকর্তা? আইএএস? ব্যবসায়ী? পলিটিশিয়ান? বা এঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, ব্যারিস্টার? বা…’।

‘না না এসব নয়, এসব নয়। এমনকী অমিতাভ বচ্চচনও নয়, সুনীল গাওস্করও নয়। আমি বিরাট খ্যাতি, বিরাট বিত্ত নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাই না।’

রোহিণীর মনে এল, একটু আগেই মীনা যে কথা লোকগুলিকে বলল : ‘না না এর কমে…।’ টাকার ব্যাপারে মনে হয় মীনা একটু মীন টাইপেরই। বদনাম হতে পারে এমন ছবিতেও অভিনয়ে রাজি, যদি টাকা সেটা পুষিয়ে দেয়।

‘আমি সত্যিকারের একজন পুরুষ চাই, যার কাছে ক্রীতদাসী হয়েও সুখ পাব। আর এরকম লোক তো ক্রিয়েটিভ আর্টিস্টদের মধ্যেই পাওয়া সম্ভব, তাই না।’

ঘোড়ার ডিম সম্ভব। রোহিণী মনে মনে হেসে উঠলেও, গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ, পাওয়া নিশ্চয় সম্ভব।’ কী ধরনের আর্টিস্টদের কথা আপনি ভেবেছেন, আমির খাঁ, রবিশঙ্কর, সত্যজিৎ রায়? নাকি জীবনানন্দ,বিভূতিভূষণ… কিংবা রামকিঙ্কর কিংবা শম্ভু মিত্র কিংবা—।’

‘আপনি দেখছি ক্যাটলগ খুলে আউড়ে যাচ্ছেন। ওইসব তিমি মাছের পাশে আমি তো তেলাপিয়া!’

‘তা কেন, আপনিও বা কম কীসে?’

‘অনেক কম, কনেক কম। আমার লিমিটেশনস কিছু কিছু বুঝতে পারি। যেটা বেশিরভাগ লোকই পারে না। আমি একজনকে জানি, যে নিজের সীমাবদ্ধতা না বুঝে মনে মনে এক ছবি আঁকিয়েকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু সেই ভালোবাসা যখন প্রকাশ করল, তখন সেই লোকটি তাকে নিজের মেয়েকে বোঝাবার মতো বোঝাল, আদর করল, শাসন করল। বলল, ‘আমি তোমাকে অন্যভাবে পেতে চাই। সন্তানের মতো।’ মেয়েটির জীবন তিনি ঘুরিয়ে দিলেন।’

রোহিণী যেন মীনার চোখের কোণে জল দেখতে পেল। নিশ্চয় তার কথাই বলছে। এই প্রথম সে একজনকে পেল, যার চোখে জল শোভনেশের কথা বলতে গিয়ে।

‘এইজন্যই আমি সহৃদয় মানুষের কথা ভাবি। আচ্ছা, আমি এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করব, উত্তর দেবেন?’

‘দেব, যদি সাধ্যে কুলোয়।’

‘আপনি বিয়ে করেছেন?’

জীবনে এই প্রথম কেউ তাকে এমন প্রশ্ন করল। রোহিণী জবাবটা সহজেই দিতে পারত, যদি প্রশ্নটা মীনার কাছ থেকে না আসত। সিঁদুর বা শাঁখা থাকলে প্রশ্নটা উঠতই না। এখন ইতস্তত করলে একটা সন্দেহ মীনার মনে জাল বুনবে।

‘হ্যাঁ আমি বিবাহিতা। সিঁদুর পরি না বলে অনেকে বুঝতে পারে না।’

‘পরেন না কেন?’

‘শাস্ত্রে কোথাও লেখা নেই যে, শাঁখা—সিঁদুর পরতেই হবে। ভারতে বহু হিন্দু সমাজে এসব পরার রীতিই নেই।’

‘আপনার স্বামী চান না এসব পরুন?’

‘হ্যাঁ পছন্দ করতেন। তবে সেটা সৌন্দর্যের কারণে, ধর্মটর্ম বা রীতি মানার জন্য নয়। বলতেন কিছু কিছু মুখ আশ্চর্যভাবে রূপসি হয়ে যায় একটা টিপ বা একটা লাল রেখার জন্য।’

‘আপনি ‘করতেন’, ‘বলতেন’, এভাবে বলছেন কেন? আপনি কি বিধবা?’

‘ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে।’

‘ওহ। কী করেন উনি।’

এখন ঘানিটানি ঘোরান কী পাথর ভাঙেন। বা কলকাতায় ঘোরাঘুরি করছেন, হয়তো আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন—যদি এইরকম উত্তর দেয় তাহলে অনেকগুলো প্রশ্ন আবার আসবে। আর যদি বলেই দেয়, যে লোকটিকে আপনি ভালোবেসেছিলেন, এখনও যাকে মনে মনে পুজো করেন, রোজ যার আঁকা ছবি না দেখে ঘুমোতে পারেন না,তার সঙ্গেই আমার বিয়ে হয়েছিল, তিনিই আমার স্বামী! তাহলে মীনা চ্যাটার্জির মুখের অবস্থাটা এখন কেমন হবে?

রোহিণী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। প্রসঙ্গটা বোধহয় অস্বস্তিতে ফেলেছে, এই ভেবে মীনা বলল, ‘যাক। আর কী প্রশ্ন করার আছে, করুন।’

যাক কেন? হঠাৎ রোহিণীর মাথার মধ্যে একটা রাগ জমে উঠতে শুরু করল। তোমার কাছে গোপন করতে হবে, এমন কী গুপ্তকথা এটা? আর তুমিই বা কী এমন গুরুত্বপূর্ণ লোক যে, স্বামীর নাম বললে সর্বনাশ হয়ে যাবে? তোমার অনুগ্রহ নিয়ে তো আমার জীবন চলে না!

‘প্রশ্ন নয়, আপনার কথাটার উত্তর দেব কিনা তাই ভাবছি। কেননা, যা বলব সেটা আপনার কাছে পৃথিবীর নবম বা দশম আশ্চর্য বলে মনে হবে।’

‘কীরকম?’ মীনা আড়ষ্ট কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল।

‘শোভনেশ সেনগুপ্ত বিয়ে করেছিলেন জেলে যাবার ছ—মাস আগে, সেটা নিশ্চয় জানেন।’

‘হ্যাঁ।’

‘বউকে দেখেছেন?’

মীনা স্থির দৃষ্টিতে রোহিণীর মুখের উপর চোখ রাখল। চোখের মণির আকার, রং, যেন বদলাচ্ছে। রগের কাছে দপদপ করল। ঠোঁট দুটি খুলে যাচ্ছে। মুখের পাতলা চামড়ার নীচে পাণ্ডুর রং ফুটে উঠছে।

‘আমার দিদিকে আপনি দেখেছেন?’

‘না।’

‘মুখটুকু বাদ দিলে হুবহু আপনিই। এখন মনে হচ্ছে,শোভন কাকা কেন বিয়ে করেছিলেন।’

‘কিন্তু খুন করলেন কেন?’

‘সেটা আপনিই বলতে পারবেন। আপনি তখন ওই বাড়ির বাসিন্দা, ওঁর কাছের লোক। আমি কোনো কারণ বার করতে পারিনি।’

‘আমিও না।’

‘উনি কি বিয়ে করে সুখী হননি?’

‘আমার পক্ষে যা সম্ভব, তা করার চেষ্টা করেছি। যা অসম্ভব ছিল তা পারিনি।’

‘কী অসম্ভব ছিল?’

‘ওর ছবি আঁকার মডেল হওয়া, যেটা আপনার দিদি পেরেছিলেন।’

মীনার মুখটা ধীরে ধীরে ফিরল ছবিটার দিকে। নির্নিমেষ তাকিয়ে রইল। রোহিণীর কাছে এই মুহূর্তগুলো করুণ লাগছে। ওর মনের মধ্যে এখন কী ভাবনা চলছে, তা বোঝার উপায় নেই। বোধ হয় কিছুই ভাবছে না। শূন্যতায় ভরা।

‘একটা কথা আপনি জানেন না, জানা সম্ভবও নয়…।’

রোহিণী থেকে গিয়ে পরিস্থিতিটা নাটকীয় করে তুলল। মীনার চোখ থেকে শূন্যতা সরে গিয়ে ফিরে এল অনুভব ক্ষমতা।

‘কী জানি না?’

‘শোভনেশ কয়েক দিন আগে পালিয়েছে বহরমপুর থেকে। হাসপাতালে ছিল আর একজন কয়েদির সঙ্গে। দু—জনে একসঙ্গে সেখান থেকে পালিয়েছে।’

‘কোথায় এখন!’ মীনা দাঁড়িয়ে উঠল। উত্তেজনা যেন তার সর্বাঙ্গে হুল ফুটিয়েছে। ছটফট করে সে আবার বলল, ‘আপনার সঙ্গে কি দেখা হয়েছে?’

‘না।’

‘দেখা হবে?’

‘বলতে পারব না।’

‘আমার কথা বলবেন?’

‘নিশ্চয়, যদি দেখা হয়। কিন্তু আমি মোটেই দেখা হওয়ার জন্য ব্যস্ত নই। আমার জীবন থেকে তাকে মুছে ফেলেছি।’ রোহিণীর স্বর আপনা থেকে কর্কশ হয়ে উঠল।

‘আমার আর তাকে প্রয়োজন নেই।’

‘কিন্তু আমার আছে।’ মীনা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘ভোলা সম্ভব নয়।’

রোহিণী নীরবে তাকিয়ে। মীনা বসার জন্য পিছনে হাত নিয়ে গিয়ে বিছানাটা খুঁজছে। চোখ দুটি সুদূর অতীতে। ধীরে ধীরে নিজেকে সে বিছানায় নামিয়ে দিল।

‘আমি এবার যাই।’ নরম গলায় রোহিণী বলল।

মীনার কানে কথাটা ঢুকল না। সে একদৃষ্টে ছবির দিকে তাকিয়ে।

‘বছর চারেক আগে আমি দেখা করতে গেছিলাম। লুকিয়েই। বললেন, মুক্তি চাই, স্বাধীনতা চাই, প্রকৃতির ছবি আঁকতে চাই। এখান থেকে বেরোতে চাই। আর নারীদেহ নয়।’

‘আর কী বললেন?’ রোহিণীর আগ্রহ আবার ফিরে এল। শোভনেশের চরিত্রের আর একটা দিক খুলে যাচ্ছে।

‘ছবি আঁকার কিছু এখনও শেখা হয়নি। আবার অ—আ—ক—খ থেকে শুরু করতে চাই। যা এঁকেছি সব বাজে নষ্ট মনের কাজ। ওগুলো পুড়িয়ে ফেলা উচিত। লোকের চোখে যাতে না পড়ে, সেজন্য ধ্বংস করে ফেলা দরকার। আপনি কি জানেন, ওঁর আঁকা ছবিগুলো এখন কোথায়?’

‘আমি চল্লিশ—পঞ্চাশটার মতো ছবি দেখেছিলাম ওর স্টুডিয়োতে, গাদা করে একধারে রাখা ছিল। ওর বন্ধু গঙ্গাপ্রসাদ, যাকে আপনি ছোটোবেলায় দেখেছেন, এখন তিনি এই মহারানির মালিক, তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেই ছবিগুলোর কী হল? বললেন,পোকায় কেটে, বৃষ্টির জলে সব নষ্ট হয়ে গেছে।’

‘সে কি! আমি তো এই ছবিটাই তিন বছর আগে উপহার পেয়েছি একজন প্রোডিউসারের কাছ থেকে। তিনি তার মাত্র দু—হপ্তা আগে কিনেছিলেন সাত হাজার টাকায়। এই সেদিনও এক আর্ট ডিলার বললেন, শোভনেশ সেনগুপ্তর ছবি নাকি এখন বাজারে একটা দুটো করে আসছে। দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা দাম।’

‘আপনি উপহার পেয়েছেন, না আপনার দিদি তার এক বন্ধুর কাছে এটা রেখেছিল?’

‘তার মানে?’

‘এরকম ছবি বাড়ি নিয়ে যেতে লজ্জা হচ্ছিল বলে উনি বন্ধুকে দিয়ে দেন। এইরকমই তো শুনেছি।’

‘মিথ্যে কথা। কে বলেছে আপনাকে?’

‘আপনার সেক্রেটারি সুভাষ গায়েন। আগের দিন উনি আমাকে বলেছেন। আচ্ছা, এই ভদ্রলোকের সঙ্গে কি আপনার দিদির কোনো…।’ রোহিণী অসম্পূর্ণ রাখল বাক্যটি।

‘এর সঙ্গেই দিদির বিয়ে হয়েছিল। দিদিকে দিয়ে কয়েকটা ছবি সুভাষদা জোগাড় করে। পারভারটেড বহু পয়সাওয়ালা লোক আছে, যাদের কাছে পর্নোগ্রাফিক মূল্য ছাড়া ওই ছবির আর কোনো দাম নেই। তাদের কাছে বিক্রি করে বেশ কয়েক হাজার টাকা পায়। তাইতে ওর লোভ বেড়ে যায়। দিদিকে প্রেশার দিতে থাকে, আরও ছবি নিয়ে আসার জন্য। এমনকী, ভালগার অ্যাপিল তৈরি হয় এমন পোজে ছবি আঁকিয়ে নেবার জন্যও এমন সব কাণ্ড করেছিল, যেটা প্রায় অত্যাচারেরই মতো। এসব কথা দিদি আমাকে বলেছে। দিদিকে, বলতে গেলে এই সুভাষদাই নষ্ট করেছে।’

‘এমন লোককে আপনি রেখেছেন কেন?’

মীনার মুখে পাতলা হাসির মোচড় দেখা দিল। ধীর কণ্ঠে বলল, ‘এই লাইনে এক মেয়েছেলের জন্য পদে পদে বিপদ অপেক্ষা করে আছে। সুভাষদা অত্যন্ত বিশ্বাসী বুলগড। হুঁশিয়ার, চতুর, আমার ভালোর জন্য সব করতে পারে। টাকাকড়ির ব্যাপারেও বিশ্বস্ত। দিদির মৃত্যুর পর আমি ওকে ডেকে আনি। যদিও ওকে আমি ঘৃণা করি।’

‘যে প্রোডিউসার ছবিটা আপনাকে দিয়েছেন, তাঁর নাম কী? তিনি কার কাছ থেকে কিনেছিলেন, সেটা কি জানেন?’

‘জগন্নাথ ঘোষ, মাস ছয়েক আগে মারা গেছেন। ওঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তো অবশ্যই, কিন্তু তিনি জানিয়ে দেন, কিছুতেই বলা যাবে না কার কাছ থেকে কিনেছেন। তখন আমি বলি, এই আর্টিস্টের আরও ছবি থাকলে কিনব। দিন তিনেক পর তিনি বললেন, আর ছবি নেই।’

‘শোভনেশ আর কিছু কি আপনাকে বলেছিল?’ রোহিণী আবার শুরুতে ফিরে যাবার জন্য বলল। শোভনেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহটা ক্রমশই তার বাড়ছে। মীনা যে মিথ্যা বলছে না, এই বিশ্বাস তার এখন হচ্ছে। শুধু একটা ধাঁধা তৈরি হল, শোভনেশের ছবি কোনো এক জায়গা থেকে বিক্রির জন্য বাজারে আসছে আর ছবির দাম বেড়েছে। কেউ একজন টাকা করছে।

‘আমাকে বলেছিলেন আর যেন ওঁর সঙ্গে দেখা না করি। কোনোরকমভাবে যোগাযোগ না করি। অতীতকে একদমই ভুলে যেতে চান। নতুন মানুষ হতে চান। তা সত্ত্বেও আমি আবার গেছিলাম। দেখা করেননি।’

‘আপনার আমার মতোই পারফেক্ট। বুঝেছি আপনি কী বলতে চাইছেন, পাগল হয়েছেন কি না?’

রোহিণী কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ বোধ করল। সোজাসুজি কারোর উপর মস্তিষ্ক বিকৃতির দায় চাপিয়ে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত নয়। নিখুঁত মস্তিষ্ক কার আছে? সে নিজেও কি দাবি করতে পারে,তার কথা আর কাজ সবসময় স্বাভাবিক ও সংগত হয়? ছ—ধাপ সিঁড়ি থেকে লাফ মারা যে কেউই শুনলে পাগল বলবে। রাতে ঘুমোবার আগে রোজ একটা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকা, এটাও তো আর এক ধরনের পাগলামি!

সবই শোনা কথা। আমিও শুনেছি। শোভন কাকার আগের জেনারেশন পর্যন্ত সত্যিই এটা ঘটেছে। ওঁর এক পিসিকে একটুখানির জন্য জানলা দিয়ে দেখেছি, একটা বন্ধ ঘরে আটকে রাখা। থুরথুরে বুড়ি। আমায় দেখে মুরগির মতো চিঁ চিঁ করল। ভয়ে পালিয়ে আসি।’

‘শোভনেশ নাকি অপেক্ষা করছিল পাগল হয়ে যাবার জন্য?’

‘ওঁর জেনারেশনে দু—জন, উনি আর ওঁর ভাই যাকে কবিরাজমশাই দত্তক নিয়েছিলেন। তাকে কি আপনি দেখেছেন?’

রোহিণী দেখেছে পরমেশকে। দুই ভাইয়ের মধ্যে চেহারায় অদ্ভুত সাদৃশ্য। ছাদ দিয়ে বাড়ির দুই অংশে যাতায়াত করা যেত। পরমেশ চুপিসারে আসত একটি উদ্দেশ্যেই। যখন শোভনেশ আঁকত, তখন স্টুডিয়োর দরজা বন্ধ করে দিত। স্টুডিয়োর বাইরের জানলা ছাড়াও ভিতরের বারান্দার দিকেও খড়খড়ির জানলা আছে। তারই পাখি তুলে সে দেখত নগ্ন মডেল বীণাকে। রোহিণী এ খবর পেয়েছিল বাড়ির ঠিকে ঝিয়ের কাছ থেকে। সে একদিন পরমেশকে কুঁজো হয়ে পাখি তুলে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিল। কি জানত, দাদাবাবু এখন বীণা দিদির ছবি আঁকছে। ধরা পড়েই পরমেশ ছুটে সিঁড়ি দিয়ে পালায়। কি ব্যাপারটা শোভনেশকে বলে। সে গিয়ে পরমেশকে ধমকায়, মারধোরও নাকি করে। ছাদের দরজায় চাবি দিয়ে শোভনেশ তারপর ছবি আঁকত।

.

পরমেশকে রোহিণী পাশের ছাদ থেকে স্টুডিয়োর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছে। তিনতলায় একটা ঘরের জানলার ভাঙা পাল্লার ফাঁক থেকেও ওকে তাকাতে দেখেছে। রোহিণীর সঙ্গে চোখাচোখি হলেই চট করে সরে যেত। ব্যাপারটা বুঝতে তার বিন্দুমাত্রও মাথা ঘামাতে হয়নি। তারপর থেকে জানলার কাছে যাবার বা বাড়ি থেকে বেরোবার আগে সে আঁচল টেনে ঢেকে নিত নিজেকে। মীনার কথার উত্তরে সে বলল, ‘হ্যাঁ, পরমেশকে মাঝে মাঝে দেখেছি।’

‘একবার ওর খবর নিলে ভালো হয়। যদি রটনাটা সত্যিই হয়। তাহলে পরমেশের কিছু হয়েছে কিনা সেটা তো দেখা দরকার।’

‘আমার আর কোনো দরকার নেই। তবে পরমেশের মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার বোধ হয় আছে। যাকগে, এখন আমি চলি। জানি না, শোভনেশ এখন কোথায় কী করছে। পুলিশ নিশ্চয়ই খুঁজে বেড়াচ্ছে।’

‘আপনার কাছে আসতে পারেন।’

‘পারে, নাও পারে। ঠিকানা তো জানে না। তবে মহারানির অফিস ও চেনে। সেখান থেকে জোগাড় করা তো সহজই। ‘রোহিণী নিরাসক্ত স্বরে বলল।

‘যদি যান আপনার কাছে, কী করবেন?’ মীনা ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইল। ‘আপনি কি পুলিশ ডাকবেন?’

ফাঁপরে পড়ল রোহিণী। এমন অবস্থা হলে সত্যিই তো, সে ভেবে দেখেনি কী করবে! ফাঁকা ফ্ল্যাটে সে আর শোভনেশ! চিন্তা করা যায় না। থাকতে চায় যদি? যদি গলা—টলা টিপে ধরে? যদি বলে কিছু টাকা দাও চলে যাব, তাহলে যা আছে সব দিয়ে দেবে।

‘জানি না কী করব।’ অসহায়ভাবে রোহিণী বলল।

‘আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন?’ মীনা হাত চেপে ধরল রোহিণীর। ‘আমি ওঁকে লুকিয়ে রাখব। ওঁকে দিয়ে ছবি আঁকাব।’

রোহিণী যখন লিফটের জন্য অপেক্ষা করছে, তখন মীনা সম্পর্কে তার ধারণা বদলে গেছে। ‘আর্টিস্টিক সেন্স’ নিয়ে যে ব্যঙ্গটা তার মনে বুদবুদ কেটেছিল, সেটা আর নেই। মনে হল, মেয়েটির গভীরতা আছে।

বাড়িটা থেকে বেরিয়ে ফুটপাতে পা দিতেই প্লেনের আওয়াজে আকাশের দিকে মুখ তুলল। রাজেন এতক্ষণে দিল্লিতে পৌঁছে গেছে। বিকেলে জয়পুরের ফ্লাইট ধরবে। আর তাকে এখন আশুতোষ কলেজে গিয়ে সিধারথ সিনহার খোঁজ করতে হবে।

‘মীনার ইন্টারভিউ নেওয়া হল?’

রোহিণীর পিঠের কাছ থেকে বলে উঠল সুভাষ গায়েন।

.

সুভাষ গায়েনের লম্বা গলার পাটকাঠির মতো সরু দেহটি সামনে ঝোঁকানো, মনে হয় যেন বিনয়ের চাপে ধুঁকছে। ধুতি আর পাঞ্জাবি সেদিনের মতোই সদ্য পাটভাঙা। আবার সে বলল, ‘মীনার ইন্টারভিউ নেওয়া হল?’

‘হ্যাঁ।’ রোহিণী খুঁটিয়ে দেখতে লাগল সুভাষ গায়েনের মুখটি। মিথ্যাবাদীদের মুখে কী কী বৈশিষ্ট্য থাকে, সেটা এবার থেকে তাকে জানতে হবে। কিন্তু তাকে হতাশ হতে হল। এখন ওর মুখ আর প্রার্থনাসভায় রামধনু শ্রবণরত গান্ধীজির মুখ প্রায় একই রকম।

‘মীনা খুব ভালো ইন্টারভিউ দেয়। আমি থাকলে ও ভালো করে কথা বলতে পারে না, তাই ওই সময়টা থাকি না।’

‘কী করেন তখন?’

‘দেখতেই তো পাচ্ছেন, রাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে থাকি।’

‘মীনাকে আপনি আমার পরিচয়টা দেননি?’

‘নাহ, দিতে যাব কেন? আপনি একটা ম্যাগাজিন থেকে এসেছেন একটা কাজে, আপনার পরিচয় হল ইন্টারভিউয়ার, ব্যস।’

রোহিণী ঘড়ি দেখল। দু—ধারে তাকিয়ে বলল, ‘ভবানীপুর যাব, বাস বা মিনিবাস এখান থেকে পাওয়া যাবে কি?’

‘একটু হেঁটে যদি সার্কুলার রোডে যান, তাহলে পাবেন।’ সুভাষ গায়েন আঙুল তুলে দেখাল কোন রাস্তা ধরে হাঁটতে হবে। রোহিণী সেই আঙুলের ডগামত হাঁটার জন্য দু—পা গিয়েই ফিরে দাঁড়াল।

‘আমি কিন্তু ওকে বলেছি আমি শোভনেশের স্ত্রী।’

যা দেখার জন্য রোহিণী কথাটা বলল, ঠিক তাই দেখতে পেল। সুভাষ গায়েনের মুখে চমকানিটা গান্ধীজির প্রশান্তিকে খান খান করে একটা নাথুরাম গডসে হয়ে বেরিয়ে এল।

‘সে কি, বলতে গেলেন কেন? তা মীনা কী বলল?’

রোহিণী তখন হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে। প্রায় দৌড়েই সুভাষ গায়েন তার পাশে এসে সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে লাগল।

‘শুনে মীনা কী বলল?’

‘অনেক কথাই বলল।’

‘আমার সম্পর্কে কিছু?’

‘যৎসামান্য। তাতেই আপনাকে যা বোঝার বুঝে গেছি।’

‘কী বুঝেছেন?’

‘মিথ্যেবাদী আর…।’

দশ—বারো পা নীরব থেকে সুভাষ গায়েন বলল, ‘এই চায়ের দোকানটায় একটু বসবেন? তা হলে দুটো কথা বলব।’

রোহিণী ঠিক করল, লোকটাকে এবার দুড়ুম দাড়াম কয়েকটা কথা বলবে।

রেস্টুরেন্টে এই সময় লোক থাকায় কথা নয়। ফাঁকা টেবিলে ওরা বসল। দু—কাপ চায়ের বরাদ্দ দিয়ে সুভাষ গায়েন বলল, ‘চা খাবেন তো?’

‘হ্যাঁ। বলুন কী বলবেন?’

কী বলবে সেটা ইতিমধ্যে ঠিকই করে ফেলেছে সুভাষ গায়েন, ভনিতা না করেই শুরু করল। ‘আমার থেকেও অনেক বেশি মিথ্যেবাদী আপনি পাবেন। হ্যাঁ বীণা আমার বউ, রেজিস্ট্রি বিয়ে। ওর বাড়িতে আপত্তি ছিল জাত নিয়ে আর রোজগারপাতিও খুব ছিল না। ইউনিভার্সাল অপেরায় ছোটোখাটো পার্ট করতুম আর ম্যানেজমেন্টের এটা—ওটা কাজ…আমিই বীণাকে যাত্রায় নিয়ে যাই। তখন ইউনিভার্সাল খাবি খাচ্ছে, পরপর তিনটে পালা ফ্লপ করে। কিন্তু পরে বুঝতে পারি, বীণাকে নিয়ে গিয়ে ভুল করেছি। অ্যাক্টিংয়ের অ্যা—ও জানত না, আর কিছু বাজে লোকের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে। চতুর্থ পালাটা ফ্লপ করতেই ইউনিভার্সালের গদি ওলটায়। তখনই বিয়ে করি, মীনা তার একজন সাক্ষী ছিল।

‘হ্যাঁ, টাকা আমাদের দরকার ছিল, আর সেজন্য বীণার মডেলের কাজে আমি আপত্তি তো নয়ই বরং মনেপ্রাণেই চাইতাম। ওর একদমই ভালো লাগত না স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে, শুয়ে, বসে থাকতে। পঞ্চাশ টাকা পেত, মাসে কয়েকদিন, তাও অনেক সময় টাকা বাকি থাকত। তখন একটা ডীল করি শোভনেশ সেনগুপ্তর সঙ্গে। সরাসরি আমি নয়, বীণাকে দিয়েই বলাই, নগদের বদলে ছবি দিয়ে টাকা শোধ করতে। ওই ধরনের ছবি কেনার খদ্দের অনেক আছে। তবে বিশেষ ধরনের পোজের ছবি। এমনকী এও বীণাকে দিয়ে বলাই, যদি টাকা রোজগার করতে চান তা হলে বেশি করে এই ধরনের ছবি আঁকুন, বিক্রি করে দোব পঁচিশ পারসেন্ট কমিশন নিয়ে। তখন ওনার খুব টানাটানির অবস্থা, রাজি হয়ে যান।’

চা এল। দু—জনে চুমুক দিল। রোহিণীর এখন মীনাকে বলা শোভনেশের কথাগুলো মনে পড়ছে: ‘যা এঁকেছি, সব বাজে। নষ্ট মনের কাজ। ওগুলো পুড়িয়ে ফেলা উচিত। লোকের চোখে যাতে না পড়ে সেজন্য ধ্বংস করে ফেলা দরকার।’ সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘এমন ছবি কতগুলো এঁকেছিলেন?’

‘অনেক অনেক। বিক্রি করে অন্তত হাজার তিরিশ টাকা ওঁকে পাইয়ে দিয়েছি। আমি নিজেই পরে ছবির দালাল হয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতুম। তবে বীণার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ওঁকে জানাইনি। আর বীণাও আমার কাছে লুকিয়ে যাচ্ছিল একটা ব্যাপারে, শোভনেশ সেনগুপ্তকে ও ভালোবেসে ফেলেছে। অবশ্য এটা সব বিবাহিত মেয়েই স্বামীর কাছে লুকোবে, স্বাভাবিক।’ ‘আপনি জানতে পারলেন কবে, কীভাবে?’

সুভাষ গায়েন লম্বা চুমুকে চা শেষ করে বলল, ‘আর এক কাপ খাব, আপনি?’

রোহিণী মাথা নাড়ল। এই সময় সে এক চুমুকও চা খায় না। শুধু দোকানে বসার অজুহাত পাবার জন্য সে চা নিয়েছে, ঠোঁটে কাপ ঠেকিয়েছে মাত্র দু—বার।

‘একটা লোক আমাকে উড়ো চিঠি দিয়ে জানায়। চিঠিতে যেরকম খুঁটিনাটি কথা ছিল তাতে মনে হল, লোকটি শোভনেশের ঘনিষ্ঠ, অনেকদিন ধরেই পরিচয়। তার উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট, এই ধরনের ছবি এঁকে নিজের ট্যালেন্টকে অসম্মান করছে এই শিল্পী, তাতে সাহায্য করছে তার মডেল। আর এই মডেল এতে রাজি হয়েছে যেহেতু সে প্রেমে পড়েছে, শিল্পীর কাছে বেশিক্ষণ থাকার সুযোগ পাচ্ছে।’

‘চিঠি পেয়ে আপনি কী করলেন? বউয়ের মডেল হওয়া বন্ধ করে দিলেন?’ রোহিণী সরলভাবে প্রশ্ন করল। সুভাষ গায়েন সঙ্গে সঙ্গে জবাব না দিয়ে দ্বিতীয় কাপ চায়ে চুমুক দেওয়ায় ব্যস্ত হল। বোঝাই যাচ্ছে, উত্তরটা ভেবেচিন্তে দিতে চায়।

‘না, বীণাকে আমি বারণ করিনি। আজ স্বীকার করতে লজ্জা নেই, বীণা তো মরেই গেছে, টাকার জন্যই আমি ওকে চিঠির কথাটা বলিনি, ওর যাওয়াও বন্ধ করিনি। হ্যাঁ, ওকে ভাঙিয়ে টাকা রোজগারের এই পথটা আমি খোলা রাখতে চেয়েছিলুম।’

‘কিন্তু আপনার স্ত্রীর এটা ভালো লাগত না। তিনি আপত্তি করতেন।’

‘মীনা আপনাকে বলেছে?’ সুভাষ গায়েন তীক্ষ্ন কথাটা বলেই আবার ঝিমিয়ে পড়ল। ‘হ্যাঁ, বীণাকে মারধোরও কিছু করেছি। তবে কী জানেন, বীণা তো যেতে চাইত নিজেই। কিন্তু ওর মাথাতেও কী করে যেন ঢুকে যায় চিন্তাটা—একটা আর্টিস্ট এইসব ছবি এঁকে নিজেকে নষ্ট করছে। কিন্তু আপনিই বলুন, আর্টিস্টকে তো আগে বাঁচতে হবে, তার তো খাওয়া—পরা দরকার, তারপর তো আর্টের চর্চা। আমি তো ওঁর অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থাই করছিলুম। ওঁকে তো আর্টের ছবি আঁকতে আমি বারণ করিনি? তিনি যদি না আঁকেন, আমি কী করতে পারি?’

প্রসঙ্গটা এড়াতে রোহিণী বলল, ‘এসব তো তর্কের ব্যাপার। শিল্প সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই এ ধরনের কথা ওঠে। কিন্তু আপনাকে উড়ো চিঠিটা কে লিখল বলে মনে করেন?’

‘দুটো নাম মনে হয়েছিল। শোভনেশ সেনগুপ্তর বন্ধু আপনার ম্যাগাজিনের মালিক গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি আর মীনা, এই দু—জনের একজন।’

‘গঙ্গাদা!’

‘হ্যাঁ। এই দু—জনই বীণা—শোভনেশ সম্পর্কটা জানত। শোভনেশ তার বন্ধুকে আর বীণা তার বোনকে মনের কথা খুলে বলত। ওরা দু—জনে বীণাকে পরামর্শ দিয়েছিল, আমাকে ছাঁটাই করে দিতে।’ সুভাষ গায়েন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘শুধু ওর জীবন থেকেই নয়, পৃথিবী থেকেও।’

‘বলেন কি! … খুন!’

সুভাষ গায়েন মাথাটা হেলিয়ে দিল।

‘চেষ্টাও হয়েছিল। প্রথমে বিষ দিয়ে, তারপর গাড়ি চাপা দিয়ে। দুটোতেই দৈবক্রমে বেঁচে যাই।’

‘এসব কবে ঘটেছিল? মানে বীণা খুন হবার কত আগে?’

‘চারদিন আগে। রাত্রে টালা ব্রিজে ওঠার মুখে মোটর চাপা দেবার চেষ্টা হয়েছিল, তার চারদিন পরই বীণা ছাঁটাই হয়।’

‘মনে হচ্ছে, আপনি ওই দু—জনের কাউকে খুনি বলে ধরে নিয়েছেন, শোভনেশকে নয়।’

সুভাষ গায়েনের মুখটা মুহূর্তের জন্য কঠিন হয়েই মোলায়েম হয়ে পড়ল। আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে দোকানের ছেলেটাকে বলল, ‘তিনটে চায়ের দাম কত? তারপর রোহিণীকে লক্ষ করে, ‘আপনি ভবানীপুর যাবেন বলছিলেন না?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাবটা পেলাম না।’

‘প্রশ্ন আবার কী? কৌতূহল বলুন। এত বছর পর এসব বাসি জিনিস ঘাঁটলে দুর্গন্ধ বেরোবে। যেখানে যাচ্ছিলেন, যান।’

রোহিণীকে ফেলে রেখে সে হনহন করে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে রোহিণীও বেরিয়ে এল। লম্বা পায়ে, সাদা ধুতি পাঞ্জাবিতে মোড়া শীর্ণ দেহ নিয়ে সুভাষ গায়েন বকের মতোই হেঁটে চলে যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে আবার একটা ধোঁয়াটে যুক্তি ও অযুক্তির মধ্যে পড়ে গেল।

সুভাষ গায়েনকে খুন করার চেষ্টা কে করবে, কেন করবে? মিনিবাসে ভবানীপুর যাবার পথে রোহিণী ভেবে দেখার একটা চেষ্টা করল। যদি ধরা যায় মীনাই, তাহলে কারণটা এইভাবে হতে পারে—শোভনেশকে সে ভালোবাসে সুতরাং মীনা তার মঙ্গলই চায়। বীণাকে ইতিমধ্যে শোভনেশের নেশায় পেয়ে বসেছে, অতএব মীনা তার দিদিকে সূক্ষ্মভাবে ঈর্ষা করতে পারে, মনে মনে রাইভালও ভাবতে পারে। যদিও এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়িনীর জন্য কোনো ট্রফি নেই, আছে অহংকার রক্ষার জন্য এক ধরনের তৃপ্তি। অতএব মীনা চাইবে না দিদি সিটিং দিতে যাক। অবশ্য বীণাও নাকি আর চাইছিল না শুধু এই উদ্দেশ্যেই শোভনেশের কাছে যেতে। কিন্তু সুভাষ গায়েন অর্থাৎ স্বামী তাকে বাধ্য করত যাবার জন্য। কিন্তু যাকে ভালোবেসেছে, তার সান্নিধ্য তো সবাই কামনা করে। বীণার তো তা হলে শোভনেশের কাছে যাবার জন্য পা বাড়িয়েই থাকার কথা। অথচ বীণাকে নাকি সুভাষ গায়েন জোরজার করে পাঠাত। তাই কখনো হয়! রোহিণীর বিশ্বাস হচ্ছে না এই মারধোর করে পাঠাবার গল্পটা। বীণার গায়ে সুভাষ গায়েন হাত তুলত, কিন্তু সেটা বোধ হয় অন্য কোনো কারণে।

যাই হোক, রোহিণী ভেবে চলল, সম্ভবত মীনার এই বিশ্বাসটাই হয়ে যায় যে, শোভনেশ তার প্রতিভাকে নষ্ট করছে এইসব ছবি এঁকে, আর তাকে নষ্ট করাচ্ছে সুভাষ গায়েন তার বউকে পাঠিয়ে। সুতরাং প্রচণ্ড ঘৃণায় ক্ষেপে ওঠে মীনা চাইতেই পারে এই বদমাস লোকটা ধরাধাম থেকেই বিদায় হোক। কিন্তু চাওয়া আর সেটাকে কাজের মধ্য দিয়ে বাস্তব করে তোলা তো চাট্টিখানি কথা নয়। আরশোলা দেখলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলে এমন মেয়েও খুনের ব্যাপারে অসম্ভব সাহস দেখাতে পারে। মীনা শক্ত ধরনের মেয়ে, আরশোলা বা চামচিকে দেখলে চিৎকার না করে প্রথমেই সে ঝাঁটা খুঁজবে। অবশ্য গলায় ফাঁস দিয়ে বা বিষ খাইয়ে রক্তপাতহীন খুন করার যোগ্যতা মীনা রাখে। কিন্তু খুনটুন করা মানেই ঝুঁকি নেওয়া আর এই ঝুঁকি সে নেবে কেন?’

রোহিণীর কাছে সুভাষ গায়েনের এই খুনের অভিযোগটা মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। বরং সে যদি বলত, মীনা তার দিদিকে বিষ খাওয়াতে চেষ্টা করেছিল তাহলে নয় টেনেটুনে একটা মোটিভ খাড়া করা যেতে পারে। কিন্তু ওই লোকটাকে? … রোহিণী মাথা নেড়েই দেখল ভবানীপুর থানা থেকে এসে গেছে। নামার জন্য সে উঠে দাঁড়াল।

দশ মিনিট পর সে মুখোমুখি হল যে লোকটির, তার উচ্চচতা ফুট পাঁচেক হলেও ব্যক্তিত্বের দৈর্ঘ্য অন্তত পাঁচ মিটার। তবে রামছাগলে দাড়িটা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এখনও বিয়ে হয়নি, কেননা বউ থাকলে কিছুতেই সে এমন প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত চোখা এবং সরল মুখটাকে দাড়ি রেখে ভোঁতা হতে দিত না। রোহিণী এজন্য অতি মৃদু ধরনের আঘাত পেল বটে, কিন্তু ওর কৌতূহল ভরা ঝকঝকে চোখ এবং হাসিটা তাকে আঘাত কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করল।

‘আমি সিদ্ধার্থ সিংহ, আপনি?… দাঁড়ান দাঁড়ান, যদি না আমার স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে আপনি রোহিণী, ঠিক?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমাকে…’

‘কী করে চিনলাম? বলছি। তার আগে বলুন আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন, আমার এ হেন সৌভাগ্যের কারণটা কী?’

‘আপনার একটা লেখা পড়ে কয়েকটা কথা জানতে…।’ রোহিণী তার ঝোলা থেকে ম্যাগাজিনটা বার করল।

সিদ্ধার্থ একনজর দেখেই বলল, ‘আমার আজ আর ক্লাস নেই। মিনিট দু—তিন দেরি করে এলে আপনার সঙ্গে দেখা হত না। বাড়ি চলে যেতাম।’

‘তাহলে চলুন, বাইরে গিয়েই বলব।’

কলেজের ফটক থেকে বেরিয়েই রোহিণী কৌতূহলটা আর চেপে রাখতে পারল না। ব্যগ্র হয়েই বলল, ‘আমাকে আপনি চিনলেন কী করে?’

‘ওই লেখাটা তৈরি করার জন্য তিন—চারটে খবরের কাগজের পুরোনো ফাইল ওলটাতে হয়েছিল। দুটো কাগজে আপনার ছবি দেখেছিলাম, শুধুই মুখটুকু। বাকি অংশটুকু আর দেখা হয়ে ওঠেনি।’

ফিচেল। বিচ্চচু। দাড়িটা ধরে একটা টান মারলে কেমন হয়। রাজেনেরই বয়সি। ওরা একই সময়ে যাদবপুরের ছাত্র ছিল। বয়সে তার থেকে ছোটোই হবে। এটা ভেবেই রোহিণীর মেজাজ লঘু হয়ে এল। সিংহ মশাই আসলে কতটা কেশর ফোলাতে পারে দেখার জন্য সে বলল, ‘বাকি অংশটুকু দেখে কী ধারণা হল?’

‘শোভনেশ সেনগুপ্ত ভালো আর্টিস্ট ঠিকই, কিন্তু ভালো বুদ্ধির লোক ছিলেন না। চোদ্দ বছর নির্বাসনে যান যে লোক এইরকম ‘বাকি অংশটুকু’ ফেলে রেখে, তাঁকে আমি… আপনিই বলুন বোকা নন কি?’ সিদ্ধার্থ নকল গাম্ভীর্য ভরা মুখটা ফিরিয়ে তাকাল পাশে হেঁটে চলা রোহিণীর দিকে। রোহিণীর ভ্রূ দুটি কৌতুকে একবার ওঠানামা করল।

‘শোভনেশ সেনগুপ্ত কতটা লম্বা ছিল তা জানেন? ওর বুদ্ধিটাও ছিল ওর হাইটের সঙ্গে মানানসই। কিন্তু কোথায় যেন একটা গোলমাল হয়ে বুদ্ধিটা নেমে এসে, মানে আমার হাইটের থেকেও নেমে এসে বোকামি করত। জানেন, একবার তো দাড়িও রেখেছিল।’

রোহিণী ভেবেছিল, সিদ্ধার্থ এবার রেগে উঠবে। তার বদলে হাসতে শুরু করল। হাসিটা ওর সারা অঙ্গে ছড়িয়ে গিয়ে দমকা বাতাসে নুয়ে পড়া গাছের ডালের মতো ওর শরীরটাকে বাঁকিয়ে দিল আর ‘উ হু হু হু’ ধরনের একটা শব্দ মুখ থেকে বেরোতে লাগল। রাস্তার কিছু লোক ওর দিকে না তাকিয়ে থাকতে পারল না।

‘বলেছেন ভালো। সত্যিই আমি খুব শর্ট হাইটেড, এজন্যই আর ছাদনাতলায় দাঁড়ানোর সুযোগ হল না। উ হু হু হু… দাড়িটা…উ হু হু হু… এটা বোধ হয়।’

‘হ্যাঁ, ওটা কালই নির্মল করুন। দেখবেন, ছাদনাতলার রাস্তাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। সবাইকে কী সব জিনিস মানায়?’

‘আমার বউদিও ঠিক এই কথাই বলেছে, আর আপনার সঙ্গেই বউদি লেডি ব্রেবোর্নে পড়েছে। আপনার বাকি অংশের খবর তার কাছ থেকে আগেই পেয়েছি।’

‘বউদি আমার সঙ্গে পড়ত? কী নাম?’

‘শেফালি কর এখন সিংহ। আপাতত লস অ্যাঞ্জেলিসের ইউসিএলএ—তে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো স্বামীর রান্নাঘর সামলাচ্ছেন।’

‘ওম্মা! শেফালি আপনার বউদি? সেই কবে কত বছর আগে—।’ রোহিণী আর কথা বলতে পারল না।

‘চলুন মেট্রোয় উঠি। আপনি এখন কোনদিকে যাবেন?’

‘আমি কাজ করি মহারানি পত্রিকায়, থাকি সল্ট লেকে। দুটোই এখান থেকে উত্তরে। আপনি তো—।’ রোহিণী থেমে গেল। রাজেন বলেছিল, অরবিন্দ সরণিতে নাকি সিদ্ধার্থর বাড়ি। কিন্তু এখন রাজেনকে টেনে এনে সিদ্ধার্থর সামনে দাঁড় করানোর দরকার নেই।

‘আমিও উত্তরে। চলুন পাতালে প্রবেশ করা যাক।’

সিদ্ধার্থ টিকিট কাটল। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করার সময় সে বলল, বলুন কী জানতে চান। তবে তার আগে বলে রাখি, এই লেখাটা তৈরি করার জন্য আমি অনেকের কাছে গেছি। প্রশ্ন করেছি আপনাকে খুঁজতে মহারানি অফিসেও গেছিলাম। কিন্তু আমাকে ওখানে বলা হয়, আপনি দু—মাসের ছুটি নিয়ে বোম্বাইয়ে দিদির বাড়ি গেছেন।’

‘সে কী! কে বলল এ কথা? আমি তো আজ পর্যন্ত দু—সপ্তাহও ছুটি নিইনি। কবে বলেছেন?’

‘বলেছেন গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি, তা প্রায় সাত—আট মাস আগে। আমি তাঁকেও কিছু প্রশ্ন করেছিলাম শোভনেশ সেনগুপ্ত সম্পর্কে।’

‘কিন্তু গঙ্গাদা এমন মিথ্যা কথাটা বললেন কেন!’ রোহিণী বিস্ময়টা মুখ থেকে বার করে ফেলেই মনে মনে নিজেকে ধমকাল। আবার নিজেকে প্রকাশ করছ? বেশি কথা না বলে নিজেকে আড়ালে রেখে শুধু অন্যদের খবরই নেবার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার কী হল?

‘সেটা আমি কয়েকদিন পর বুঝতে পারি। তবে গঙ্গাপ্রসাদবাবু কিছু উলটোপালটা কথা আমায় বলেছিলেন, যা আমি লেখায় ব্যবহার করিনি। আমি অনুমান করছি, আপনি বোধ হয় জানতে চান, সেনগুপ্তদের ফ্যামিলি হিস্ট্রি আমি জানলাম কীভাবে, ঠিক?’

‘ঠিকই।’

‘ট্রেন আসছে। আগে উঠি, তারপর বলছি।’

এসপ্ল্যানেডগামী ট্রেনে এই সময় ভিড় থাকে না। ওরা বসার জায়গা পেল। ‘দরজা বন্ধ হচ্ছে’ কথাটা তিনটি ভাষায় ঘোষিত হবার পর দরজা বন্ধ হয়ে ট্রেন চলতে শুরু করলে সিদ্ধার্থ বলল, ‘আমার ঠাকুর্দার মেজোভাই সেনগুপ্তদের এস্টেটের ম্যানেজার ছিলেন। তাঁর একটু লেখালেখির বাতিক ছিল। ডায়েরিও রাখতেন। সেটা আমি পেয়ে যাই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি ধনী ব্যবসায়ীদের, জমিদারদের উত্থান আর পতন নিয়ে এখন অনেকেই কিছু একটা করার, অবশ্য সমাজবিজ্ঞান বা অর্থনীতির কিছুই তিনি জানতেন না। না জানলেও, একটা ফ্যামিলিকে ধরে তাদের কয়েক পুরুষের ওঠা আর পড়ার ঘটনাগুলো সাজিয়ে তিনি বাংলার, ওঁর মতে বাঙালি ধনীদের পিছু হটার কারণ দেখতে চেয়ে ডায়েরিতে কিছু কিছু কথা লিখে রাখেন, পরে কাজে লাগাবেন বলে। তাতে বেশিরভাগ তথ্য ছিল সেনগুপ্তদের সম্পর্কেই।

‘উনি কি বেঁচে আছেন?’

‘আমি যখন স্কুলে পড়ি তখনই মেজো ঠাকুরদা মারা যান, বছর পনেরো তো হলই।’

‘আপনি বউবাজারের বাড়িতে গিয়ে কখনো কি খোঁজ নিয়েছিলেন, ওদের এই জেনারেশনের কেউ পাগল হয়েছে কি না?’

‘না খোঁজ করিনি। আপনিও করেছেন?’

‘না। আমি তো আপনার লেখাটা পড়ার আগে পর্যন্ত এ সম্পর্কে কিছু জানতাম না।’

‘তবে আমি গঙ্গাপ্রসাদকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি প্রথমে তো সন্দেহের চক্ষে আমাকে দেখলেন। নানান প্রশ্ন করলেন লেখাটার উদ্দেশ্য নিয়ে। বললেন, পাগলামির লক্ষণ মাঝে মাঝে শোভনেশের মধ্যে দেখা দিত। তবে দ্বিতীয় বিয়ের পর স্পষ্ট হয়েই দেখা দেয়। ওঁর মতে এজন্য দায়ী শোভনেশের নতুন বউ রোহিণী।’

‘আমি! কীভাবে?’ রোহিণী তার আসনে টলে পড়ছিল। অবশ্য এসপ্ল্যানেড স্টেশনে ট্রেন ব্রেক কষে থামার জন্যই কি না, তা বলা শক্ত।

‘চলুন, কার্জন পার্কে বসে সেটা বলছি।’

.

মেট্রো রেল স্টেশন থেকে বেরিয়েই ওরা একটা মিছিল দেখতে পেল। দক্ষিণ দিক থেকে এসে ধর্মতলার মোড় ঘুরে বাঁদিকে সিধু—কানু ডহরে বেঁকছে। পুব দিক থেকেও লেনিন সরণি ধরে আর একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। ফলে ট্রাম বাস মোটর দাঁড়িয়ে ট্র্যাফিক বন্ধ।

‘মিছিল আর ট্র্যাফিক জ্যাম দেখতে আমার খুব ভালো লাগে, আপনার?’ সিদ্ধার্থ এগিয়ে যেতে যেতে বলল।

‘এটা কি একটা ভালো লাগার জিনিস?’ রোহিণী একটু অবাক বিভ্রান্ত হয়ে তার সঙ্গীর দিকে তাকাল। ‘কত লোকের কত অসুবিধে হয়, বলুন তো?’

‘নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলার মধ্যে একটা সৌন্দর্য আছে, ছন্দও আছে। আপনাকে সেটা খুঁজে বার করে নিতে হবে। একটা উচ্চচাঙ্গের মার্ডারের মধ্যেও কত যত্ন, কত মাথা খাটানো সূক্ষ্মতা থাকে… ভালো পেইন্টিং কি স্কালপচারেও আপনি সেটা পাবেন, ভালো খেয়াল বা ঠুংরিতেও পাবেন। এত লোকের অসুবিধে ঘটানো—এটা কি সহজ কাজ?’

এই সময় ধুতি পাঞ্জাবি পরা মাঝবয়সি একটি লোক মিছিল থেকে বেরিয়ে দ্রুত পায়ে ফুটপাতে উঠে মাটির জমিটুকু পার হয়ে লেনিনের মূর্তির প্রায় আট—দশ ফুট কাছে গিয়ে দু—পা ফাঁক করে ধুতির কোঁচা টেনে সরাল। সিদ্ধার্থ মুখ ফিরিয়ে খুব মন দিয়ে লোকটির কাজ দেখতে লাগল। ইতিমধ্যে বোধ হয় এই দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে, ব্রিফকেস হাতে প্যান্ট পরা এক যুবক মিছিলের সারি থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে মন্থর গতিতে এগোল মূর্তির দিকে, তারপর লেনিনের মূর্তির কাছাকাছি হয়ে চলনের গাম্ভীর্য খসিয়ে প্রায় ছুটেই ধুতি পরার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

‘বেচারা! কতক্ষণ আর প্রকৃতির ডাক প্রত্যাখ্যান করা যায়! নিশ্চয় বহুক্ষণ সংগ্রাম চালিয়ে আসছিল’, সিদ্ধার্থ সখেদে মাথা নাড়ল।

কী ভাবছে বলুন তো?’

‘কে, লেনিন? না, না, উনি মোটেই কিছু ভাবছেন না—বুদ্ধিমান লোক, এই ক—বছরে কল্লোলিনী তিলোত্তমা কলকাতাকে চিনে ফেলেছেন ঠিকই।’

‘আমি বলছিলাম, চারপাশের হাজার হাজার মানুষ, তারা দেখে কী ভাবছে?’

‘মানুষ!’ সিদ্ধার্থ অবাক চোখে এধার—ওধার তাকাল, ‘মানুষ কোথায়? হাজার হাজার ধ্যানমগ্ন নির্বিকার ঋষি বলুন। চলুন, এই তপোবন থেকে অচিরে এবার বিদায় নেওয়া যাক।’

‘জায়গাটা ঘিরে দেওয়া উচিত।’

‘একটা কোনো উপলক্ষ আসুক, দেখবেন তখন ঢাকঢোল পিটিয়ে, মঞ্চ বেঁধে বক্তৃতা করে লেনিনের পবিত্রতা রক্ষার ব্যবস্থা হবে।’

কার্জন পার্কের দিকে যেতে যেতে সিদ্ধার্থ আবার তিক্তস্বরে বলল, ‘ড্রাগের নেশায় নাকি আমাদের তরুণসমাজ ধ্বংসের পথে… কিন্তু মনে হয় নাকি গোটা কলকাতাটাই হেরোইন খেয়ে ঝিমোচ্ছে? সেলফ ডিগনিটি বোধটাও আর অবশিষ্ট নেই।’

দু—জনে পার্কের দক্ষিণ দিকে রানি রাসমণির মূর্তির কাছাকাছি বসল।

‘একজনের আসার কথা, এইখানেই। তবে মনে হচ্ছে, জ্যামের জন্য দেরি হবে।…হ্যাঁ এইবার কাজের কথায় আসি।’ সিদ্ধার্থ বাবু হয়ে মুখোমুখি। চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিল। ‘শোভনেশ সেনগুপ্তর মধ্যে পাগলামি দ্বিতীয় বিয়ের পর স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অন্তত গঙ্গাপ্রসাদের মতে, আর সেজন্য দায়ী আপনি।’

সিদ্ধার্থর কথার মধ্যে বিঘ্ন না ঘটাবার জন্য রোহিণী চুপ করে শুধু তাকিয়ে রইল।

‘আমি তখন কারণ জানতে চাইলাম। উনি বললেন, শোভনেশ তিন—চারবার তার কাছে অভিযোগ করে, বীণা চ্যাটার্জির স্বামী তাকে ব্ল্যাকমেইল করছে। বীণার যে স্বামী আছে, এটা সে আগে জানত না। এই স্বামীটি তাকে প্রায় বাধ্যই করছে আজেবাজে ছবি আঁকতে। যদি না আঁকে, তাহলে পরস্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারের মামলা করবে বলে শাসানিও দেয়। এতে শোভনেশ ভয় পেয়ে যায়। এতই সে মামলাকে ভয় করত যে, বীণার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে। বাড়িতে দরজা বন্ধ ঘরে বেশিরভাগ দিনই কাটাচ্ছিল। বীণা শোভনেশের নানারকম মানসিক বিকার দেখা দিতে শুরু করে। গঙ্গাপ্রসাদ এর পর পাঁচ মাস ছিল নির্বাসিতের মতো। সেখানে শোভনেশ অনবদ্য কিছু ল্যান্ডস্কেপ, গ্রামজীবনের কিছু ছবি আঁকে আর স্বাভাবিক হয়ে আসতে থাকে। তারপর ছবির প্রদর্শনী, সেখানে আপনার সঙ্গে দেখা, আর সেই দেখাতেই ওর মধ্যে আবার অস্থিরতা জেগে ওঠে। গঙ্গাপ্রসাদের ধারণা বিশেষ একটা ধাঁচের মেয়েদের শরীর ওকে উত্তেজিত করে। বীণার সেই ধাঁচের শরীর ছিল, আর আপনার রয়েছে। আবার ন্যুড আঁকার জন্য অশান্ত হয়ে ওঠার পরিণতিতেই এই বিয়ে। কিন্তু আপনি সিটিং দিতে রাজি না হওয়াতে উনি ক্ষেপে ওঠেন আর আবার বীণার কাছে ছুটে যান। কিন্তু বীণা এবার ওকে প্রত্যাখ্যান করে, ওর স্বামীও শোভনেশকে তাড়িয়ে দেয়। এর কারণটা কি জানেন?’

‘না।’

সিদ্ধার্থ মুখ ঘুরিয়ে এধার—ওধার তাকিয়ে কাউকে খোঁজার চেষ্টা করল, নিজের মনেই বলল:

‘নাহ জ্যামেই আটকা পড়েছে।’

‘ঝালমুড়ি খাবেন?’

রোহিণীর এখন ইচ্ছে করছে মুখরোচক কিছু চিবোতে চিবোতে শোভনেশের কাহিনি শোনার। অনেকগুলো প্রশ্ন তার করতে ইচ্ছে হয়েছিল, কিন্তু নিজেকে গুটিয়ে রাখার সিদ্ধান্তটাই বাদ সাধল। গঙ্গাদার চরিত্রটাও রীতিমতো ইন্টারেস্টিং, ক্রমশই কেমন যেন রহস্যময় হয়ে উঠছে। শোভনেশ পাগল হয়ে উঠছিল আর জন্য সেজন্য দায়ী কিনা আমি! অথচ এই সেদিন বললেন, ওদের বংশে পাগল হওয়াটা তার কাছে নাকি নতুন কথা! এইরকম উলটোপালটা কথা বলার উদ্দেশ্যটা কি? কিছুর থেকে যেন নিজেকে বাঁচাতে চাইছেন।

‘খাব। অনেকদিন খাইনি আর এভাবে অনেকদিন ঘাসের উপর বসিওনি। আপনি?’

রোহিণী বলতে যাচ্ছিল, এই তো সেদিন ইডেনে… কিন্তু রাজেন আবার এসে পড়বে কথার মধ্যে, এই ভেবে বলল, ‘আমিও অনেকদিন ঘাসে বসিনি।’

ঝালমুড়ি কিনে ঠোঙা থেকে মুখে কিছুটা ঢেলে সিদ্ধার্থ বলল, ‘বীণাদের গোয়াবাগানের বাড়িতে শোভনেশ সেনগুপ্ত গেছিল, এই পর্যন্ত বলে গঙ্গাপ্রসাদ বাঁড়ুজ্যে আর কিছু আমাকে জানাতে পারেননি বা জানাতে চাইলেন না। কেন জানি আমার মনে হল, এইখানে একটা ভাইটাল লিঙ্ক রয়েছে এই ঘটনা পরম্পরার। কিন্তু বাড়িটা যে ঠিক কোথায়, ঠিকানাই বা কি, তা আমি জানি না। বীণার স্বামীই বা এখন কোথায়, তাও জানি না।’

সিদ্ধার্থ ঠোঙা তুলল মুখে মুড়ি ঢালার জন্য। রোহিণী ভাবল,সুভাষ গায়েনের হদিশ যে আমি জানি, সেটা কি ওকে বলা উচিত হবে? বরং আরও কি বলে শোনা যাক। নিজেকে জাহির করার সময় এটা নয়।

.

‘আমার এক আত্মীয় থাকে গোয়াবাগানে। গেলাম তার কাছে। কত বছর আগে খুনটা হয়েছে, তখন ওখানে একটু চাঞ্চল্যও পড়েছিল, যদিও খুনটা হয় বউবাজারে। তাহলেও বীণার বাড়ি কিছুটা তো তখন বিখ্যাত হয়ে গেছিলই। আত্মীয়কে বলতেই সে বলল, এখুনি দেখিয়ে দিচ্ছি বাড়িটা, গোবরবাবুর আখড়ার খুব কাছেই। গিয়ে দেখলাম বাড়িটা। ওরা মাস কয়েক মাত্র ছিল। কারোর সঙ্গে মিশত না। একতলায় থাকত, দুটো বড়ো ঘর আর লম্বা দালান নিয়ে। এখন অবশ্য অন্য লোক থাকে। শুনলাম, বীণার স্বামীর নাম সুভাষ গায়েন। ছবির ব্যবসা করত। আরও শুনলাম, লোকটার ঘরে আর দালানেই ছবি আঁকা হত। পাঁচ—ছ’জন লোক বসে ছোটো—বড়ো নানান আকারের ছবি আঁকত। বাইরের কাউকে আঁকা দেখতে দেওয়া হত না। ওখানেই ছবির ফ্রেম তৈরি হত। বাঁধানো হত। মাঝে মাঝে লোকজন আসত, ছবি নিয়ে চলে যেত। বীণা মারা যাবার পরও তার স্বামী কয়েক মাস ওখানে ছিল। তারপর কোথায় যে চলে গেল, কেউ তা আর বলতে পারল না।’

‘ছবির বিষয় সম্পর্কে জানা গেলে হয়তো বলা যেত, আসলে ঠিক কি কারবার বীণার বাড়িতে ঘটছিল।’

‘হ্যাঁ। সেটা সুভাষ গায়েন বলতে পারে আর পারে সেই সব আর্টিস্টরা, যারা ওখানে বসে ছবি আঁকত। এই প্রসঙ্গে একটা খবর জানাই, কিছুদিন আগে কাগজে পড়লাম, বোম্বাইয়ে এক বাড়ি তৈরি করার ব্যবসায়ী, ছবি নকল করার এক কোম্পানি খুলেছে। ইউরোপিয়ান পেইন্টিংসের ওল্ড মাস্টার্সদের—দা ভিঞ্চি, দিউরার,কোরেগ্গিও, রেমব্রান্ট, রুবেনস, বোত্তিচেল্লি, টিশিয়ান, গোইয়া, কার নাম করব, সবারই কাজ নকল করার এক কারখানাই খুলে ফেলেছে জনা পঞ্চাশ বেকার ফ্রিলান্স পেইন্টারসকে কাজে লাগিয়ে। সবগুলোই যে অরিজিনাল সাইজের তা নয়, তবে স্কেল অনুসারে আসলের সঙ্গে মেপে ছোটো করা হয়। দাম কত জানেন? পনেরো হাজার থেকে শুরু তারপর কুড়ি, পঁচিশ, তিরিশ!’

‘এসব জিনিস লোকে কেনে!’

‘এদেশে দুধের বদলে পিটুলি গোলা খাবার লোকের অভাব আছে নাকি! লতা মঙ্গেশকর, কী রফি, কী কিশোরকুমারকে যদি পাড়ার ফাংশানে না আনা যায়, তাহলে কুছ পরোয়া নেই। লতাকণ্ঠী, রফিকণ্ঠ দিয়েই রমরম করে ফাংশন হবে। অ্যামপ্লিফায়ারে চিৎকার করে জানিয়ে দেওয়া হয় নকলরা, ভেজালরা গান গাইবে, আপনারা পয়সা খরচ করে তাদের গান শুনতে আসুন। দলে দলে ছেলে বুড়ো সেই গান গিলতে টিকিট কাটে না কি? যারা কলোনিয়াল স্টাইলে বাস করতে চায়, বাড়ি সাজাতে চায়, তারা যদি রিনেইসান্স পিরিয়াডের নকল ছবি কেনে, তাহলে দোষ দেবেন কেন? বড়োলোক, মধ্যবিত্ত আর গরিব সবাই তো পিটুলি গোলা পান করার ব্যাপারে একই সারিতে দাঁড়িয়ে।’

রোহিণী এতক্ষণে বুঝে গেছে, প্রসঙ্গান্তরে ছিটকে যাবার একটা প্রচণ্ড প্রবণতা সিদ্ধার্থর মধ্যে রয়েছে। কলেজ মাস্টারদের এই এক ব্যাধি, সামান্য চান্স পেলেই লেকচার দিতে শুরু করে। আর তাতে যদি ব্যঙ্গ—বিদ্রূপের মওকা থাকে তো কথাই নেই!

‘কিন্তু সুভাষ গায়েন কি এইরকম একটা ছবি নকলের ব্যবসা শুরু করেছিল বলে আপনার মনে হয়েছে?’

‘ভীষণভাবে মনে হয়েছে। আরও মনে হয়েছে, শোভনেশ সেনগুপ্ত এটা জেনে ফেলেছিল।’

‘তাহলে গঙ্গাদাও জেনেছিলেন।’

কথাটা বলেই রোহিণী জিভ কামড়াল। এটা তো সিদ্ধান্ত—বিরোধী কাজ হয়ে গেল। তার চিন্তাটা এভাবে আচমকা মুখ থেকে বেরিয়ে এল কেন? গঙ্গাপ্রসাদ সম্পর্কে কি তার অবচেতনে বাজে কোনো ধারণা তৈরি হয়ে গেছে?

সিদ্ধার্থ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবল। ‘হতে পারে, হতে পারে। গঙ্গাবাবুকে হয়তো শোভনেশ বলেছিল।’

তারপরই কি সুভাষ গায়েনকে খুন করার চেষ্টা হয়? লোকটা হয়তো মিথ্যে বলেনি। রোহিণী অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সন্দেহটা করে ফেলেই বলল, ‘শোভনেশের ছবি নাকি এখন বাজারে আসছে কোনো এক অজ্ঞাত জায়গা থেকে?’

‘তাই নাকি!’ সিদ্ধার্থ নড়েচড়ে বসল। ‘আমি অবশ্য ছবির বাজার সম্পর্কে খবর রাখি না।’

‘তাহলে এখন আরও বেশিই হবে। ফিদা হুসেইনের ছবিই পাঁচ লাখে বিক্রি হয়েছে। তাহলে শোভনেশ সেনগুপ্তর ছবি, যদিও হুসেইনের মতো পাবলিসিটি পাননি, হাজার পঞ্চাশ তো পেতে পারেই। কিন্তু ছবিগুলো কোথা থেকে বাজারে আসছে, ফেক না অরিজিনাল?’

‘বলতে পারব না, ছবির এসব আমি কিছুই বুঝি না।’ বলতে বলতে রোহিণীর চোখ পড়ল ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটি লোকের থমকে পড়ার দিকে। অফিসের উৎপল। অবাক হয়ে সে পার্কের রেলিংয়ের কাছে এসে চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনি এখানে বসে?’

রোহিণী গলা চড়িয়ে বলল, ‘এনার সঙ্গে একটু গল্প করছি।’

সিদ্ধার্থর দিকে তাকিয়ে উৎপল, ‘অ’। বলে আবার হাঁটতে শুরু করল।

‘ওই লোকটা মহারানির কাজ করে না? আমি প্রথমে এর কাছেই আপনার খোঁজ করেছিলাম। খুব বিরক্ত হয়ে বলেছিল, এডিটারকে জিজ্ঞেস করুন, আমি কিছু জানি না। এডিটার প্রশান্তবাবু তখন ছিলেন না।’

শুনে রোহিণী হাসল। বলল, ‘আপনার লোক এখনও এল না কিন্তু।’

‘চলুন ওঠা যাক, বাড়িতে গিয়ে একটা লেখায় বসতে হবে।’

দু—জনে উঠে পড়ল। বাস টার্মিনাসের দিকে যেতে যেতে রোহিণী বলল, ‘সব তো শোনা হল না, বাকি অংশটুকু পরে—’

সিদ্ধার্থ হঠাৎ দাঁড়িয়ে চোখ বিস্ফারিত করে বলল, ‘কার বাকি অংশটুকু?’

রোহিণী পুরুষ হলে অবশই হো হো করে হেসে উঠত। তার বদলে মুখে একরাশ নীরব হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘অবশ্যই শোভনেশের। ওর বাড়ির বিষয়ে আর কী আপনি জানেন সেটা একটু জানতে হবে।’

‘আর বিশেষ কিছু জানবার মত নেই।…ওহ ভালো কথা, বউবাজারের বাড়িটার এখন মালিক কে বলুন তো?’

‘জানি না, আমি কোনো খবর রাখি না ওর বিষয়—সম্পত্তির। যাতে আমার প্রয়োজন নেই, তা নিয়ে মাথাব্যথা করে লাভ কী?’

‘এ জিনিসটা যদি সবাই বুঝত, তাহলে পৃথিবী থেকে কত কোটি কোটি টন ব্যথা যে কমে যেত! আপনি কত নম্বরে উঠবেন? আমার বাসস্ট্যান্ড আর একটু ওধারে… বউদিকে জানাব আপনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে।’

‘জানাবেন। একটা কথা কিন্তু আপনাকে জানাতে ভুলে গেছি, শোভনেশ বহরমপুর হাসপাতালে ভরতি হয়েছিল, সেখান থেকে দিন কয়েক আগে পালিয়েছে।’

‘বলেন কি! এটা তো দারুণ খবর!’

‘নিদারুণ আমার পক্ষে। পুলিশের হাতে যদি ইতিমধ্যে ধরা পড়ে যায় তো ভালো, নইলে কোনোভাবে যদি আমার কাছে পৌঁছে যায়, তাহলে বিপদে পড়ে যাব।’

আমার মনে হয় না আপনার কাছে যাবে। গঙ্গাপ্রসাদবাবুর কাছে যা শুনেছি তাতে মনে হয়েছিল, আপনার ওপর শোভনেশ খুব চটা। আপনি যাতে বিষয়—সম্পত্তি কিছু না পান, সেজন্যই নাকি বাড়িটা বিক্রি করে দেন যখন মামলা চলছিল।’

‘বিক্রির টাকাটা কী হল?’

‘মামলার খরচে লেগেছে।’

অথচ গঙ্গাদা বলেছিলেন, বাড়িটা তাদের বিয়ের আগেই মর্টগেজ ছিল একজনের কাছে। ব্যাঙ্কে সতেরো হাজার টাকা ছিল, যা তিনি মামলার জন্য উকিলকে দিয়েছেন। রোহিণী ছোটো করে মাথা ঝাড়া দিল। ভিতরে ভনভন করে একটা সন্দেহের পোকা উড়ছে। সেটাকে বার করে দেবার চেষ্টায় সে বলল, ‘বন্ধুকে বাঁচাতে উনি নিজেও অনেক খরচ করেছেন।’

‘হ্যাঁ, তাও বলেছেন।’

রোহিণীর চোখে পড়ল সুজাতা আর হৃদয়রঞ্জন বাসের জন্য দাঁড়ানো যাত্রীদের লাইনের শেষ মাথা খুঁজছে।

‘আচ্ছা তাহলে এবার চলি, আমার বাস ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। স্টেট বাস, বুঝতেই পারছেন, এটা মিস করলে পরেরটার দেখা কখন যে পাব!’

‘আমার কার্ডটা রাখুন। যদি কখনো আবার দরকার পড়ে!’

সিদ্ধার্থর হাত থেকে কার্ড নিয়ে রোহিণী থলির মধ্যে সেটা রেখে যাত্রী—লাইনের শেষে দাঁড়ানো গুপ্ত দম্পতির দিকে এগিয়ে গেল।

.

‘মাসিমা! কোথায় গেছলেন?’ রোহিণী ভীষণভাবে অবাক হয়েই বুঝল অবাক হওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গেছে। তাই পরিমাণটা কমিয়ে আবার বলল, ‘এই একটু আগে আপনার কথা একজনকে বলছিলাম।’

সুজাতা এবং হৃদয়রঞ্জন একই সঙ্গে জিজ্ঞাসু চোখে রোহিণীকে ছেঁকে ধরলেন। রোহিণী ঠোঁট দুটো ইলাস্টিকের মতো টেনে হৃদয়রঞ্জনের দিকে আলাদাভাবে তাকিয়ে মাথাটা হেলাল।

‘আমার কথা! কেন, কাকে বলছিলে? আমি আবার কী অপরাধ করলাম?’ সুজাতাও তাঁর অবাক হবার ক্ষমতা দেখালেন, তবে তাঁর বিস্ময়টা যে কৃত্রিম সেটা বোঝাবার জন্য জুড়ে দিলেন, ‘বাব্বাঃ, আজ দেখছি সারপ্রাইজের মিছিলের মধ্যে পড়ে গেছি।’

‘আপনাকে তা হলে আরও সারপ্রাইজ দেব। আমার এক বন্ধুর দেওর, নাম সিদ্ধার্থ সিংহ, অ্যাবনরম্যাল সায়কোলজি নিয়ে রিসার্চ করছে। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে শোভনেশ সেনগুপ্তর কথাটা বললাম। আপনার কাছে যা যা শুনেছি ঠিক সেই সেই কথাগুলোই বললাম। পাগল হবার ভয়ে একটা লোক কীরকম উদ্ভট আচরণ করছে। তাই আমি ভাবলাম, এই ব্যাপারটা জানলে হয়তো ওর রিসার্চের কাজে লাগতে পারে। কিন্তু সব শুনে টুনে সিদ্ধার্থ কী বলল জানেন? বলল, শোভনেশ সেনগুপ্তদের বংশে কেউ কখনো পাগল হয়নি, তবে ছিটগ্রস্ত ছিল কেউ কেউ। আমি বললাম, তুমি জানলে কী করে? তুমি কি লোকটাকে চেনো? বলল, শুধু চিনিই নয়, ওর নাড়িনক্ষত্রেরও খবর জানি। একটু পারভার্ট ধরনের ছিল, মেয়েদের খারাপ খারাপ ছবি আঁকত।’

রোহিণী লক্ষ করল, হৃদয়রঞ্জন আড়চোখে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে একবার তাকিয়েই বউয়ের মুখের দিকে তাকালেন। কিন্তু সুজাতার মুখে কোনো ভাবান্তর ঘটল না। রোহিণী মনে মনে বলল, আজ আমি সারপ্রাইজের মিছিল দিয়ে ধুন্দুমার করে দেব। জ্যাম করব, কনফিউজড করব, টিয়ারগ্যাস, গুলি, অ্যারেস্ট, বোমা—পটকা, স্লোগান দিয়ে একটা বিপ্লব বাধিয়ে দেব। দেখি,কে আমায় আটকায়!

একটা বাস আসছে। ঢিলেঢালা সারি নড়াচড়া করে আঁট হয়ে উঠল। যাত্রীরা নেমে যেতেই কন্ডাক্টর বাসের পিছনের দরজার সামনে দাঁড়াল নতুন যাত্রীদের টিকিট কাটার জন্য। সারিটা এগোচ্ছে। রোহিণী থলি থেকে টাকার ব্যাগ বার করল। বসার জায়গা পাবে কিনা আঁচ করার জন্য দেখে নিল, সারিতে মেয়ে ক—জন রয়েছে। গোটা পনেরো সিট থাকে মেয়েদের জন্য। তার মনে হল, বসার জায়গা হয়তো পাওয়া যাবে, তবে বাসের সামনের দিকে মুখ করে বসার সিট হয়তো পাবে না।

‘টিকিট আমি কেটে নিয়েছি।’ হৃদয়রঞ্জন হাত তুলে রোহিণীকে দেখালেন।

বাসের মধ্যে পা দিয়েই ‘মেসোমশাই বসে পড়ুন, বসে পড়ুন।’ বলতে বলতে রোহিণী সামনের লেডিজ সিটের দিকে ছুটে গেল অনেকটা অপোনেন্ট ডিফেন্সের মধ্য দিয়ে চিমা ওকোরির মতো। পা মাড়িয়ে, পায়ের গোছে লাথি মেরে এবং কাঁধের ধাক্কায় একজনকে হুমড়ি খাইয়ে রোহিণী তার গোল পেয়ে গেল। তবে চিমার থেকে তার কৃতিত্বটা একটু বেশি। শুধু এই কারণেই, বাসের পিছন থেকে সামনে এক হাতে সুজাতাকে ধরে টানতে টানতে ডিফেন্স ভেঙে সে এগিয়েছে! সুজাতাকে ঠেলে সিটে বসিয়ে দিয়েই সে ঝপ করে পাশে বসে পড়ল, সেকেন্ডের ভগ্নাংশে তার আধাবয়সি এক সালোয়ার—কামিজকে ডজ করে। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সে এক প্লেট সন্দেশের মতো এগিয়ে দিল মিষ্টি হাসি।

‘কম করে পঁয়তাল্লিশ মিনিট তো থাকতে হবে।’ রোহিণী ফিসফিসিয়ে সুজাতার কানে বলল। তিনি মুচকি হেসে মাথা নাড়লেন।

‘তা হলে আপনি আমার প্যাকেটটা ধরুন।’ মেয়েটি ফিথে বাঁধা রঙিন কাগজের প্যাকেটটা এগিয়ে ধরতেই রোহিণী সেটা হাতে নিল।

‘কতদূর যাবে?’

‘বাগমারি।’

‘অনেকটা, প্রায় আধ ঘণ্টা।’

রোহিণী খুঁজল হৃদয়রঞ্জনকে। যা আশঙ্কা করেছিল, তাই হয়েছে। রড ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, বসার জায়গা পাননি।

‘মেসোমশাই বসতে পারেননি।’

‘উনি বাসটাসের ভিড়ে অনভ্যস্ত। চটপটেও নন।’

‘বরাবরই কি?’

‘বরাবরই। আমার বিয়ে হওয়া থেকেই দেখছি। ভীতু ধরনের। ঝগড়াঝাঁটি হবার সম্ভাবনা আছে দেখলে সেদিকে আর মাড়াবেন না।’

অথচ গঙ্গাদা বলেছিলেন, বেধড়ক এমন পিটিয়েছিলেন যে, সুজাতার নড়ে বসারও জোর শরীরে ছিল না। শোভনেশের সম্পর্কে জেলাসি থেকেই নাকি এই হিংস্রতা! তারপর শোভনেশের স্টুডিয়োতে গিয়ে ছবির ফ্রেম ভেঙেছেন, দু—পায়ে ছবি মাড়িয়েছেন, পেপারওয়েট দিয়ে শোভনেশকে মারতেও গেছিলেন। অথচ ইনি বলছেন, ওঁর স্বামী নাকি ভীতু, ঝগড়া—টগড়ার ধার দিয়েও হাঁটেন না।

তা হলে সত্যি কথাটা কে বলছে? কনফিউজড করবে ঠিক করে শেষে কিনা নিজেই সে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাচ্ছে!

যাত্রা শুরু করল বাস। অসম্ভব ভিড় আজ। রোহিণীর মনে হল ভিড়ের কারণটা বোধ হয় হাজিরা দিয়েই মিটিং থেকে অনেকে সটকে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। কিংবা আজ টিভি সিরিয়াল বুনিয়াদের তারিখ হয়তো। এটা তো মাঘ মাস, আজ বিয়েরও দিন থাকতে পারে। হাতের প্যাকেটটা দেখে মনে হচ্ছে, উপহারের কিছু এর মধ্যে আছে।

‘মাসিমা এখন কোথা থেকে ফিরছেন?’

‘গেছলাম পূর্ব পুটিয়ারিতে ছোটো ননদের বাড়িতে। ওর সেজোছেলের বিয়ে সামনের বুধবার। ছেলে একটা স্কুলে পড়ায় আর ছবি আঁকে। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা। মেয়েটিও পাশ করা আর্টিস্ট। ইরিগেশন ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে। একই সঙ্গে ওরা পাশ করেছে।’ সুজাতা হাসলেন, যার অর্থ হল বিয়েটায় অভিভাবকদের হাত নেই।

‘আর্টিস্টরা দেখছি আপনাকে কোনো—না—কোনোভাবে ছুঁয়ে আছেই।’

‘হ্যাঁ। ওরা বোধ হয় ছুঁয়ে থাকতে চায়, ভালোবাসতেও।’

ভালোবাসে বললেন কেন? রোহিণী সন্ধিগ্ধ হল। তা হলে কি শোভনেশকে ভালোবেসে ছিলেন? এখনও ভালোবাসেন? গঙ্গাদার থিওরি মানলে, স্বামীর ওপর ঘৃণা থেকে রিবাউন্ড করে শোভনেশের কাছে ন্যুড সিটিং দিয়েছেন। এটাকে ভালোবাসা বলা যায় না। এখন তো কেমন দিব্যিই স্বামী—স্ত্রী সুখেই রয়েছেন!

‘তোমার বন্ধুর দেওর বললেন, খারাপ খারাপ ছবি আঁকত? কিন্তু আমি যতটুকু দেখেছি, তাতে তো ওকে কখনো খারাপভাবে মেয়েদের দেহকে অপমান করে কিছু আঁকতে দেখিনি!’

‘সিদ্ধার্থ বলল, প্রচুর ভালগার ছবি এঁকেছেন।’

‘পরে এঁকেছে, পরে। আমি ওখানে থাকার সময় নয়। আজ আমিও শুনলাম অনুতোষের কাছে, আমার ননদের ছেলে, যার বিয়ে। ওরা তো সব খবরই রাখে বড়ো বড়ো আর্টিস্ট সম্পর্কে। ও—ই বলল, শোভনেশ খুন করে জেল খাটছে এখন।’

‘ওমা, তাই নাকি!’

সুজাতা মুখ ফিরিয়ে রোহিণীর মুখটা যেন মাইক্রোস্কোপে দেখলেন। তাইতে রোহিণী একটু ঘাবড়ে গেল। হাসি চেপে সুজাতা বললেন, ‘শোভনেশ আবার বিয়ে করেছিল।’

রোহিণীর বুকের মধ্যে নিশ্বাস জমে দম বন্ধ হবার উপক্রম হল। জ্যাম হওয়া বোধ হয় একেই বলে। সে ক্ষণেকের জন্যে ভুলে গেল, ভগবান নেই তার এই বিশ্বাসটাকে। মনে মনে কাতরে উঠে বলল, ভগবান আর আমি কখনো ইয়ার্কি করেও মিথ্যে কথা বলব না। এই বুড়ি কতদূর জেনেছে বুঝতে পারছি না, বুঝে কাজও নেই। তবে এখুনি যেন না বলে ফেলে, তুমিই তো সেই বউ, যে পরিচয় লুকিয়ে আমার পেট থেকে কথা বার করেছ! দোহাই ভগবান… এই ভিড় বাসের মধ্যে নয়।

‘তাই নাকি?’ রোহিণী ফ্যাকাসে মুখে বলল।

‘অনুতোষ বলল, এই দ্বিতীয় বউটা নাকি খুব মানসিক টর্চার করত। ওর ছবিটবি নিয়ে খোঁটা দিত, কখনোই ভালো বলত না। উৎসাহ দেওয়া, প্রেরণা দেওয়া এসবের ধারেকাছেও ছিল না। নিজেকে নিয়েই সবসময় ব্যস্ত থাকত। খুব খরচেও ছিল। খালি টাকা চাইত। আর সেই টাকা জোগাতে গিয়েই শোভনেশ অশ্লীল ছবি আঁকার কারবার শুরু করে।’

এবার রোহিণী টেলিস্কোপ দিয়ে সুজাতার মুখভাব লক্ষ করে যাচ্ছে। টিয়ার গ্যাস,বোমা পটকা তো তুচ্ছ জিনিস, উনি তো পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলি চালিয়েছেন। ছুটে পালাতেও দিচ্ছে না। হাত তোলারও উপায় নেই। কী সব কথা বলছেন! প্রত্যেকটাই ডাহা মিথ্যে, এত মিথ্যে যে, কলকাতার টেলিফোনের থেকেও কম বিশ্বাসযোগ্য, এমনকী লোকাল ট্রেনের টাইমটেবলের থেকেও!

‘শোভনেশের যে শেষে এই পরিণতি হবে, স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। শুনে মনটা যে কী খারাপ হয়ে গেল।’

সুজাতা বেদনায় অতঃপর স্তব্ধ হবার জন্য জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। রোহিণীও তাকাল। বউবাজারের মোড় ছাড়িয়ে বাস কলেজ স্ট্রিটে চাকা রাখছে।

‘আপনার ওই অনুতোষ এতসব ব্যক্তিগত খবর পেল কী করে? বউ খোঁটা দিত, টাকা চাইত, খরচে ছিল এসব তো বাইরের লোকের জানার কথা নয়?’

‘শুনেছে কোথাও থেকে।’

সুজাতা অতি নিরীহ স্বরে ফিসফিস করে তারপর যোগ করলেন, ‘আমার নামেও তো একসময় কত কথা লোকে বলত শোভনেশকে জড়িয়ে। উনি বলতেন, কান দিয়ো না। স্বার্থান্বেষীরা এইভাবে রটায়, চরিত্র হনন করে।’

‘ঠিক বলেছেন মাসিমা, আমাদের কাগজের মালিক, একসময় শোভনেশ সেনগুপ্তের বন্ধু ছিলেন, ওদের বাড়িতে অল্পবয়স থেকেই যাতায়াত ছিল। তা তিনি একবার কথায় কথায় বলেছিলেন,ওর একটা ছবির মডেলকে তার স্বামী এমন বেধড়ক পিটিয়েছিলেন যে, মডেল বেচারা বিছানা থেকে সাতদিন উঠতে পারেনি। তাই নয়, সেই স্বামী ছবিটার ফ্রেম ভেঙে, মাড়িয়ে একসা কাণ্ড করেন। পেপারওয়েট দিয়ে মারতেও যান শোভনেশকে। শুনে আমি বললাম, এত কথা জানলেন কী করে? বললেন, ওখানে নিত্য নামে যে চাকরটা তখন ছিল, তার কাছ থেকে শুনেছেন। বুঝুন মাসিমা, চাকরবাকরের কথা শুনে এইসব গুজব ওঁর মতো শিক্ষিত লোকও কিনা রটাচ্ছেন! কী যে দেশের অবস্থা!’

রোহিণীর টেলিস্কোপ ও সুজাতার মাইক্রোস্কোপ এখন মুখোমুখি। একজন দেখতে পেল, গ্রহ—নক্ষত্রমণ্ডলীতে বিশৃঙ্খলা শুরু হয়েছে, অন্যজন দেখলেন, নানাবিধ ভাইরাস কিলবিল করছে।

‘তোমার কাজের মালিকের নাম কী?’

‘গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি।’

শুনেই সুজাতার মুখের উপর দিয়ে কালো মেঘ ভেসে গেল। ঠোঁট টিপে ধরলেন, চোয়ালের পেশি শক্ত হল।

‘মনে হচ্ছে, লোকটাকে তখন দেখেছি। অনুতোষের কাছে শুনলাম, শোভনেশের ভালো ভালো বহু ছবি নাকি ওর কাছে আছে। চড়া দামে নাকি একটা দুটো বিক্রি করছে আর টাকাটা পকেটে পুরছে। আবার ছবি জাল করার ব্যবসাও নাকি আছে।’

‘কার, গঙ্গাপ্রসাদের?’

‘হ্যাঁ। এই গঙ্গাপ্রসাদ আর একটা লোক মিলে নাকি জাল করার ব্যবসাটা চালাচ্ছিল। অনুতোষ তখন বেকার। ও তখন কিছুদিন কাজ করেছিল।’

‘শোভনেশ সেনগুপ্ত কি জানত না, তার ছবি নিয়ে জালিয়াতি কারবার চলছে?’

‘হয়তো জানত, হয়তো জানত না। আমি সে কথা আর বলি কী করে! তবে বউয়ের গঞ্জনায়, টাকা রোজগারের জন্য হয়তো জেনেও টাকা খেয়ে চুপ করেছিল।’

‘অনুতোষ কোথায় গিয়ে কাজ করত?’

‘জায়গাটার কী একটা নাম যেন বলল…কী একটা বাগান দিয়ে নাম।’

‘চোরবাগান, মোহনবাগান, লাটবাগান, জোড়াবাগান, গোয়াবাগান, নাথেরবাগান…।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, গোয়াবাগান, হেদোর কাছে।’

‘বউটাই তা হলে আসল পাজি।’

রোহিণী জ্যাবজ্যাবে সারল্য মুখে লেপে, দৃঢ় সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দেখল ঠনঠনে স্টপে বাস হাজির।

তার হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিল যে মেয়েটি, সে কপালে ও বুকে দু—বার আঙুল ছুঁইয়ে কালীপ্রণাম সেরে নিল।

‘এইসব মেয়েরাই পুরুষদের নষ্ট করে। মাসিমা, এই ব্যাপারটা নিয়ে অমি একটা ফিচার লিখব মহারানিতে। আপনি আমায় মেটিরিয়াল দেবেন? নাম ঠিকানা কি জানেন এই বউটার? তা হলে একবার কথাও বলে নিতাম।’

আবার টেলিস্কোপ! সুজাতা কী একটা বলতে গিয়ে হাঁ করেও মুখ বন্ধ করলেন।

‘এসব কথা এখন থাক।’

রোহিণী ভেবে দেখল, ঠান্ডা যুদ্ধটা যখন শুরু হয়েই গেছে, তখন বার্লিন প্রাচীরের মতো একটা টেনশান দিয়ে সেটা মুলতুবি রাখলে কোনোদিনই এর মীমাংসা হবে না। সুজাতা জেনেছে সে কার বউ, আর সেও জানিয়ে দিয়েছে হৃদয়রঞ্জনের হাতে মার খেয়ে সুজাতা সাতদিন বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। কিন্তু ননদের ছেলে অনুতোষের নাম করে তার সম্পর্কে যেসব কথা বলল, সেটা তো হিরোসিমার উপর নামিয়ে দেওয়া অ্যাটম বোমাটার থেকেও ভয়ঙ্কর! সে কিনা শোভনেশকে মেন্টাল টর্চার করত? সে কিনা খুব খরচে ছিল? খালি টাকা চাইত? গঞ্জনা দিত? এইরকম মিথ্যে কথা তো গোয়েরিংয়ের জিভেও আটকে যাবে।

মাথার মধ্যে দাউ দাউ করে উঠল রোহিণীর। বুড়িটা নিশ্চয় কথাগুলো বানিয়ে বলল। আসলে তাকে টর্চার করে মজা পাবার জন্য এই বিটলেমিটা করল। ঠিক আছে, এর শোধ কীভাবে নিতে হয় তা দেখাব। রোহিণী মুখ ঘুরিয়ে দেখল হৃদয়রঞ্জন একই জায়গায় একইভাবে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নির্লিপ্ত গোবেচারা মুখ। ওটা ঘুমন্ত ভিসুভিয়াস বা ক্রাকাতোয়া কিনা, সেটা একবার খুঁচিয়ে দেখলে কেমন হয়। বউকে পিটিয়েছিল যে—জ্বলুনিতে, সেটার উৎপত্তি যদি ঈর্ষা থেকে হয় তাহলে ওর বুকের মধ্যে আগ্নেয়গিরিটা এখনও থাকারই কথা। ঈর্ষা কখনো নেভে না। নিশ্চয় শোভনেশ সম্পর্কে ওরও কিছু বলার কথা আছে।

এরপর রোহিণীর মাথার মধ্যে আগুনটা একটু একটু করে নিভে আসতে লাগল, যখন বিধান সরণি থেকে বাসটা বিবেকানন্দ রোড ঘুরল। তার সম্পর্কে কে কী বলল, কে কী ভাবল, তাই নিয়ে মাথা গরম করে লাভ নেই। যে জীবন ছেঁড়া কাপড়ের মতো ফেলে দিয়ে এসেছে, সেটাকে আবার কুড়িয়ে নিয়ে তার খুঁটে কিছু বাঁধা আছে কিনা দেখার ইচ্ছেটা আর নেই।

তবে গঙ্গাপ্রসাদ সম্পর্কে সুজাতা যা বলল, সেটা রোহিণীকে আশ্চর্য করল না। এইরকমই একটা সন্দেহ তার হচ্ছিল যে, শোভনেশের ছবিগুলো গঙ্গাদাই হাতিয়েছেন, হয়তো বাড়িটাও কবজা করেছেন, সিদ্ধার্থ বলল, মামলা চলার সময়ই বাড়িটা বিক্রি হয়েছে। কে কিনেছে? গঙ্গাদাই কি? ছেলের নামে কিংবা বউয়ের নামে।

ছবি জাল করার ব্যবসায় কি গঙ্গাদা নামবেন? আর একটা লোকের সঙ্গে মিলে এই ব্যবসাটা গঙ্গাদা চালাচ্ছিলেন। লোকটা তো অবশ্যই সুভাষ গায়েন। কিন্তু কথাটা কি বিশ্বাস করার মতো? এই দুটো লোক একসঙ্গে জুটল কী করে? জুটতে পারে। স্বার্থ যদি একই হয়, তখন সাপও ব্যাঙের গালে চুমু খায়। গঙ্গাদার কাছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, ছবি জালের কারবার, সুভাষ গায়নকে খুনের চেষ্টা, তাকে লেখা উড়ো চিঠি, এবং গায়েনের সন্দেহ—এইসব কথা পেড়ে দেখতে হবে কীভাবে রিয়্যাক্ট করেন।

কিন্তু এই যে বুড়ি, গঙ্গাপ্রসাদের নাম শোনামাত্র মুখ কালো করে দাঁতে দাঁত ঘষার মতো একটা মুখভাব করল, নিশ্চয় এও গঙ্গাদা সম্পর্কে কিছু জানে, ওর পেট থেকে আর কিছু বেরোয় কিনা সেটা দেখতে হবে। খুন হলেই নাকি মেয়েছেলে খোঁজা হয় পিছনের উদ্দেশ্য আবিষ্কারের জন্য। কিন্তু এক্ষেত্রে মনে হচ্ছে, টাকাই মূল মোটিভ। কিন্তু তাই বলে দ্বিতীয় বউয়ের ঘাড়ে দোষ চাপানো?

মানিকতলার মোড় পেরোনোর সময় বড়ো বড়ো গর্তে পড়ে বাসটা এমনই লাফালাফি করল যে, রোহিণীর গতিপথটাই বদলে গেল। হঠাৎ তার মনে হল, খুনটা যদি টাকার জন্যই হয়, তাহলে টাকা কামাবার জন্য শোভনেশ বাধ্য হয়েছিল, যেহেতু তার দ্বিতীয় বউটা তাকে অবিরাম টাকার জন্য খোঁচাত, গঞ্জনা দিত। এইরকম একটা ধারণা বাজারে ছড়িয়ে দিতে পারলে দোষটা রোহিণীর দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।

আর এই ছড়ানোর কাজটাই বোধ হয় নিয়েছে সুজাতা গুপ্ত। ওর ননদের ছেলে অনুতোষ তাকে এইসব বলেছে—একদম বাজে কথা। গঙ্গাদা যে সেদিন বললেন, ‘সী ইজ এ লায়ার’, বোধহয় ভুল বলেননি। অনুতোষের নাম করে নিজেই এসব বানিয়েছে। এখন নানান জায়গায় বলে বেড়াবে। নানান জায়গা বলতে তো কয়েকটা ফ্ল্যাট!

ওদের সামনে তুষার দত্তরা, রোহিণীর সামনের শ্রীনিবাসনরা, নীচের দোতলার দত্তরায়রা, কী যেন মেয়েটির নাম?রোহিণী অবাক হল! এর মধ্যেই নামটা ভুলে গেলাম। মাথাটা কী যে গণ্ডগোল করছে না! সে প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করতে লাগল। আর এই চেষ্টাটায় সফল হয়ে যখন সে আপন মনেই ‘কুন্তী, হাঁ কুন্তী,’ বলে উঠল, তখন সুজাতা গুপ্ত ঝুঁকে বললেন, ‘কিছু বলছ?’

‘না।’ রোহিণী বাধ্য হল বোকার মতো হাসতে। ‘একটা নাম মনে আসছিল না, এখন মনে এল।’

‘তুমি তো অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি বিড়বিড় করে কী যেন আপন মনে বকে যাচ্ছিলে, মাথা নাড়ছিলে। ভাবলাম পাগল—টাগল হয়ে গেলে নাকি?’

পাগল—টাগল বললেন কেন? রোহিণী টেলিস্কোপ তাক করল। সৌরমণ্ডলে কোনো বিশৃঙ্খলা দেখতে পাচ্ছে না। তাহলে কি ধরে নেবে, পাগল—টাগল বলার পিছনে কোনো উদ্দেশ্য নেই? পাগলের বংশে বিয়ে হওয়ার খোঁচা তাহলে বোধ হয় নয়! হতে পারে।

‘তোমার হাতে প্যাকেট রেখে মেয়েটা গেল কোথায়?’ সুজাতা ভিড়ের মধ্যে দৃষ্টি সেঁধোবার চেষ্টা করতে করতে বললেন ‘তাই তো। গেল কোথায়? আমরা এলাম কোথায়?’ রোহিণী সামনে দাঁড়ানো লোকটিকেই জিজ্ঞাসা করল। প্যাকেটটার গায়ে আঠা দিয়ে একটা কাগজ আঁটা। লতাপাতার নকশার মধ্যে তাতে লাল কালিতে সুন্দর হস্তাক্ষরে বড়ো বড়ো করে লেখা : ‘সুধীর সরকারের সঙ্গে রানি মণ্ডলের বিয়েতে প্রীতি উপহার—প্রণতা খুকু (সুচরিতা দত্ত, ক্লাস নাইন।)

কোথায় এসেছে সেটা জানালা দিয়ে দেখার জন্য লোকটি নীচু হল। রোহিণীর মুখের কাছে মুখ। মুখে ভালো জর্দার গন্ধ।

‘মাড়োয়ারিবাগান ছাড়িয়ে এখন কাঁকুড়গাছি যাচ্ছে।’

জায়গা চিনতে লোকটি একটু বেশিক্ষণই নীচু হয়ে রইল। কিছু করার নেই। কিন্তু মেয়েটি বলেছিল বাগমারিতে যাবে। তাহলে অন্তত তিনটে স্টপ আগে নেমে গেছে। ভিড় বাস থেকে নামার জন্য অনেক আগে থেকে একটা মানসিক অঙ্ক কষতে শুরু করতে হয়। তার উপর ধাক্কা, চাপ এবং ঝাঁকুনি সামলাতে দুটো হাতকেই কাজে নিযুক্ত রাখতে হয়। মন এবং হাত ব্যস্ত থাকলে হাতে রাখার জিনিসটা ভুলে যাওয়াই সম্ভব।

তাহলে কী করবে সে এখন?বেচারা নিশ্চয় বিয়েবাড়িতেই যাচ্ছিল উপহার নিয়ে। প্যাকেটটার ওজন খুব বেশি নয়। সামান্য দামের জিনিসই হবে।

‘কী করি মাসিমা?’ রোহিণী অসহায় স্বরে পরামর্শ চাইল।

‘কন্ডাক্টরকে দিয়ে দাও। ও জমা দিয়ে দেবে বাসের অফিসে। যার জিনিস সে নিশ্চয় একবার খোঁজ করবে, তখন পেয়ে যাবে।’

‘হ্যাঁ, তাই করা উচিত। কিন্তু এখন তো সে হাতে করে উপহারটা দিতে পারছে না। নিশ্চয়ই খুব লজ্জায় পড়ে যাবে। সবাই দিচ্ছে, অথচ সে খালি হাতে যেন শুধু খেতেই এসেছে। অবশ্য ও বলবেই যে, বাসে একজনকে ধরতে দিয়েছিল, কিন্তু তাড়াহুড়োয় নামতে গিয়ে ভুলে গেছে আর যার হাতে রাখতে দিয়েছিল, সেও বেমালুম চেপে গেছে। না, না, আমার খুব বিশ্রী লাগছে।’

‘এখন তো আর মেয়েটিকে খুঁজে বার করা সম্ভব নয় যে, তার হাতে দিয়ে আসবে।’

বাস কাঁকুড়গাছির মোড়ে। রোহিণী ধড়মড়িয়ে উঠে ধাক্কাধাক্কি করে সিঁড়িতে দাঁড়ানো লোকেদের পা মাড়িয়ে বাস থেকে নেমে পড়ল। খুঁজে বার করা সম্ভব নয়! দেখি তো।

সে বাগমারির দিকে হাঁটতে লাগল। একটা বাড়িতে সার সার লাল—নীল—হলুদ টুনি বালব ঝালরের মতো চারতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত জ্বলছে। ফটকে উজ্জ্বল আলো, অবশ্যই বিয়েবাড়ি। মেয়ে—পুরুষ, বাচ্চচাদের পোশাক, হাতে রাখা প্যাকেট, গহনা এমনকী আকণ্ঠ খাওয়ায় মুখের হাসফাঁসানি দূর থেকে দেখেই বোঝা যায়, কাছাকাছি বিয়ে কী বউভাত হচ্ছে। রোহিণীর ভরসা এখন, বেনারসী—পরা, খোঁপায় বেলফুলের মালা জড়ানো মেয়েরা। এদের ধরে ধরে জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয় বেরিয়ে পড়বে, রানি মণ্ডলের বিয়ের ছাদনাতলাটা।

‘আচ্ছা, আপনারা কি কোনো বিয়ে বা বউভাতে যাচ্ছেন?’

বউটি ভ্রু তুলে বলল, ‘বিয়েতে যাচ্ছি।’

‘কনের নাম কি রানি মণ্ডল?’

‘শুচিস্মিতা গাঙ্গুলি।’

‘মাপ করবেন, আমার ভুল হয়ে গেছে। আসলে ঠিকানাটা মনে করতে পারছি না… অফিস কলিগ, তাই এইভাবে জিজ্ঞেস করে করে…।’

রোহিণী ঠিক করল, প্রথমে বাসস্টপগুলো দেখবে। নিমন্ত্রণ খেয়ে ফেরা লোকেদের কেউ—না—কেউ নির্ঘাৎ বাস ধরতে এখানে থাকবেই। রেল ব্রিজের তলা দিয়ে এগিয়ে সে দু—ধারের বাড়িগুলোর একটাতেও বিয়েবাড়ির আলো দেখতে পেল না। ফুল সাজানো একটা মোটরও রাস্তায় দাঁড়িয়ে নেই, বরযাত্রীদের মিনিবাসও নয়। অ্যামপ্লিফায়ারে সানাই, হিন্দি গান এমনকী রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ডও বাজতে শুনল না। দু—দিকে গলি দেখলেই থমকে গিয়ে ভিতর দিকে চোখ পাঠিয়ে দিচ্ছে। বাসস্টপে চারজন। তাদের একজনের হাতে রংচটা একটি থলি, দু—জনের মুখে খিদে, অন্য জন এক শিখ।

হতাশ হল রোহিণী। মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে রইল বাসস্টপে, যদি ফুল, শাড়ির প্যাকেট হাতে ধুতি—গরদের পাঞ্জাবি বা ফাউন্ডেশন—ব্লাশার—কমপ্যাক্ট—গ্লো—গেটার লাঞ্ছিত মুখ একবারের জন্যও নজরে পড়ে।

একটা মিনিবাস থামল। তা থেকে পাঁচ জনের একটা পরিবার নামতেই রোহিণীর মুখে হাসি ফুটল। বিয়েবাড়ি যাওয়ার নিখুঁত প্রমাণ মহিলার শাড়িতে, গহনায়, বড়ো মেয়ের হাতে ধরা শাড়ির বাক্সে, কর্তার সাদা চটিতে।

‘কিছু মনে করবেন না, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব… আপনারা কি কোনো বিয়েতে যাচ্ছেন?’

মহিলা প্রথমে হকচকালেন, তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ যাচ্ছি, কেন?’

‘আচ্ছা, কনের নাম কি রানি মণ্ডল?’

‘তা তো বলতে পারব না। ওনার বন্ধুর ভাইয়ের বিয়ে। আমরা বরযাত্রী। হ্যাঁ গো, কনের নামটা কী?’

কর্তা বিব্রত হলেন। সেটা কাটাতেই একটু বিরক্তি দেখিয়ে বললেন, ‘কেন, তা দিয়ে কী হবে?’

‘আমি একটু মুশকিলে পড়ে গেছি। একটা বিয়েবাড়িতে যাব, কিন্তু ঠিকানাটা হারিয়ে ফেলেছি। শুধু বরকনের নামটাই—।’

‘খেতে যাবেন অথচ বাড়িটাই চেনেন না!’

‘আপনি কি কনের নামটা জানেন?’ রোহিণী গলার স্বর খরখরে করল।

‘বরের নাম জানি, অচ্যুত মুখার্জি। রাইটার্সে কাজ করে।’

‘নাহ। ধন্যবাদ!’

রোহিণী আর দাঁড়াল না। পরের স্টপের জন্য বাগমারির দিকে হাঁটা শুরু করল।

পেয়েছি। রজনীগন্ধার ছড়, প্রেশার কুকারের বাক্স নিয়ে সাত—আটজনের একটা দল। একজন বাদে সবারই পরনে প্যান্ট। তাদের সামনে দাঁড়িয়ে রোহিণী গতিরোধ করল এবং ‘আমি একটু মুশকিলে পড়ে গেছি’ দিয়ে শুরু করল।

‘কনের নাম? অ্যাই কার্ডটা দ্যাখ তো। মানে বিয়েটা আমাদের কলিগের বোনের।’

‘বরের নাম সুধীর সরকার কি?’

‘না তো’, একজন নিমন্ত্রণপত্র বার করে পড়ে বলল, ‘নীলোৎপল ঘোষ আর মানসী গুহ।’

‘সরি আপনাদের ট্রাবল দিলাম।’

‘না না, এ আর…’

রোহিণী পা বাড়াল। কানে এল চাপা মন্তব্য ‘খিদেটা মাইরি বেড়ে গেল।’ বাগমারি বাজারের স্টপে কিছু লোক। এইটাই তার শেষ চেষ্টার জায়গা। তিনটি কিশোরী। বিয়েবাড়িরই সাজগোজ। একটু নিশ্চিত হবার জন্য রোহিণী ওদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল, কথা শোনার জন্য।

ওরা কথা বন্ধ করে তাকে দেখতে লাগল। কানে কানে কিছু বলে মুখটিপে হাসলও। রোহিণী একটু বিব্রত হল। নিজের শাড়ি ঠিক আছে কিনা দেখল। রুমাল দিয়ে মুখ মুছে রুমালটা দেখল। কিছু লাগেনি মুখে। তাহলে হাসল কেন?

‘আচ্ছা, একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করব?’ তিনজনের একজন সপ্রতিভভাবে রোহিণীকে বলল।

‘বলো।’

‘আমাদের এক বন্ধু ঠিক আপনার মতো দেখতে একজনকে বাসে একটা জিনিস, আজকেই, এই আধ ঘণ্টাটাক আগে—’

‘আরে, আমি তো তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি। সেই কত দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি। যদি রাস্তায় দেখা হয়ে যায়, এই ভেবে আন্দাজেই আসছি। শুধু বলেছিল, বাগমারিতে নামব। তোমার বন্ধুর নাম কী?’

‘সুচরিতা।’

‘ব্যস, মিলে গেছে। এই নাও, তাকে গিয়ে দিয়ে দাও। বাব্বা হাঁফ ছাড়লাম।’

‘আপনি গিয়েই বরং ওকে দিন। এই তো খুব কাছেই এক মিনিটের পথ। ও চুপ করে বসে আছে। কাঁদছিল।’

‘আহা রে, চলো চলো। কার বিয়ে? স্কুলের ক—জন এসেছে?’

‘রানিদির বিয়ে। আমাদের ফিজিক্যাল সায়ান্সের টিচার। আমরা চারজন যারা ওঁর কাছে প্রাইভেটে পড়ি, তাদেরই শুধু বলেছেন।’

মিনিট দুই হাঁটতে হল। ছোটো একতলা বাড়ি। দরজায় একটা দুশো ওয়াটের বালব আর ভেলভেটের পর্দা। বাইরে কয়েকটা চেয়ারে বরযাত্রীরা বসে। ভিতরে মাটির উঠোনে সামিয়ানার এক ধারে খাওয়ার জায়গা, অন্য ধারে কাপড় ঘেরা জায়গায় বিয়ের ব্যবস্থা হয়েছে।

সুচরিতা খবর পেয়ে ছুটে এল। প্যাকেটটা ওর হাতে তুলে দিতেই, আবেগে দিশেহারা হয়ে সে রোহিণীকে প্রণাম করল। প্রণাম পাওয়া রোহিণীর মনে হল, জীবনে তার এটা দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রাপ্তি। সুচরিতার মাথায় হাত রেখে রোহিণী তৃপ্ত নয়নে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমার পরিশ্রমটা সার্থক হল।’

কথাটা বলেই দেখল, বিয়ের জায়গাটা থেকে বেরিয়ে আসছে সুভাষ গায়েন। রোহিণীকে দেখে সে অবাক হয়ে গিয়ে বলল, ‘আপনি এখানে? এটা তো আমার বোনের বাড়ি। রানি তো আমার ভাগনি।’

‘এটা আপনার বোনের বাড়ি!’

আজ দ্বিতীয়বার সুভাষ গায়েনের সঙ্গে তার দেখা হল। আর কী অদ্ভুত একটা জায়গায়। বিয়েবাড়িতে, যেখানে সে রবাহূত!

‘হ্যাঁ বোনের বাড়ি, কিন্তু আপনি? রানির সঙ্গে বোধহয় পরিচয় আছে।’

সুভাষ গায়েন ধরে নিয়েছে তার ভাগনি রানি মণ্ডল, যার আজ বিয়ে, রোহিণী বোধ হয় তার বান্ধবী বা ওইরকম কিছু। সুভাষের ভুলটা ভেঙে দিয়ে, এখানে তার আসার পিছনের কারণটা রোহিণী বলল।

‘তাজ্জব কথা! একটা উপহার ফেরত দেবার জন্য এত কাণ্ড করলেন?’

‘এর মধ্যে কাণ্ড দেখলেন? একটু বুদ্ধি আর একটু ইচ্ছা খরচ করে যদি একটা মেয়ের সেন্টিমেন্ট রক্ষা করা যায়, তাতে তাজ্জব হবার কী আছে? এর থেকেও তো কত বড়ো বড়ো কাণ্ড আপনিই করে ফেলেছেন, সেটা কি ভুলে গেলেন?’

‘আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।’ সুভাষ গায়েন প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ‘এসে যখন পড়েছেন, তখন খেয়ে যেতেই হবে।’

রোহিণী ‘আরে না না’, বলে শুরু করতে যাচ্ছিল, কিন্তু সুভাষ গায়েন ঝপ করে তার কবজি চেপে ধরে টানল ভিতরে নিয়ে যাবার জন্য। রোহিণী ওর মুখ দেখে বুঝল, অত্যন্ত খুশি এবং প্রীত হয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ আপনজনের মতোই তার হাতটা ধরেছে। হঠাৎই এমন এক অতিথি পেয়ে গিয়ে ওর মানসিক ভারসাম্যটা কয়েক ডিগ্রি পড়ে গেছে। রোহিণীর মনে হল সুভাষ গায়েন মোটেই কঠিন, ক্রুর, খল চরিত্রের লোক নয়।

‘না খাবার জন্য আপনি তেত্রিশটা কারণ দেখাবেন, আর আমি ছেষট্টিটা কারণ দাখিল করতে পারি। আচ্ছা শেষ কবে বিয়েবাড়িতে খেয়েছেন বলুন তো?’

রোহিণী ফাঁপরে পড়ল। সত্যিই সে মনে করতে পারছে না। বছর দশেকের মধ্যে তো নয়ই। বিয়ের পর শোভনেশের সঙ্গে কোথাও যাওয়া হয়নি। বোম্বাইয়ে দিদির কাছে থাকার সময় এক গুজরাতি বউভাতে দিদির সঙ্গে গেছিল। একটা সফট ড্রিঙ্ক খেয়েছিল। বাড়ি ফিরে দিদি বলেছিল, ‘এই ভালো। সর্ষের তেল আর বনস্পতি পেটে ঢুকিয়ে গ্যাসট্রিকটাকে বাড়িয়ে শরীরের স্বাচ্ছন্দ্য নষ্ট করার থেকে এইসব খাওয়ার পাট তুলে দেওয়াই ভালো।’ বোম্বাই থেকে ফিরে সে যেভাবে জীবন কাটাচ্ছে, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবহীন হয়ে, তাতে বিয়ের নিমন্ত্রণ কপালে জোটার কথা নয়।

‘অনেক দিন খাইনি, আর সেজন্যই আমার স্টমাক বিয়ের ভোজে অভ্যস্ত নয়। সুতরাং সুভাষবাবু, আমাকে মাফ করবেন।’

‘দই সন্দেশেও কি অভ্যস্ত নয়?’

‘একটা সন্দেশ ব্যস।’

‘তাহলে ভেতরে আসুন একবার।’

সংসার করার যাবতীয় জিনিসে ভরা একটি ছোটো ঘর। খাটের কোণে মেঝেয় বসে আছে কনে। তাকে ঘিরে রয়েছে নানা বয়সি স্ত্রীলোক। উপহারগুলো কনের পাশে জড়ো করে রাখা। একটি মেয়ের হাতে খাতা কলম। ঘরে পা ফেলার জায়গা নেই। বিয়ের লগ্ন দশটায় শুরু। বর এখনও আসেনি। প্রথম ব্যাচ খেয়ে উঠেছে। বিয়ে দেখে যাওয়ার সময় তাদের নেই। তাদের বাড়ি ফেরার বাস পাবে না। কলকাতায় সামাজিকতা নিয়ন্ত্রণ করে পরিবহন ব্যবস্থা। সমস্যাটা রোহিণীরও। অজ পাড়াগাঁর লোকেদের মতো রাত ন—টা বেজে গেলেই তারও উসখুশানি শুরু হয় সল্ট লেকের বাসের কথা ভেবে।

সুভাষ গায়েন তাকে পরিচয় করিয়ে দিল এই বলে, ‘বিখ্যাত আর্টিস্ট শোভনেশ সেনগুপ্তর স্ত্রী। কাজ করেন মহারানি ম্যাগাজিনে। আজ সকালে মীনার ইন্টারভিউ নিতে গেছিলেন, তখনই ওনাকে নেমন্তন্ন করছিলুম। অবশ্য আর একটা ব্যাপারও ঘটে গেছে এর মধ্যে। বাসে ওঁর হাতে একটি মেয়ে উপহারের প্যাকেট ধরতে দিয়ে ভুলে গিয়ে নেমে যায়। উনি সেটা ফিরিয়ে দেবার জন্য খুঁজে খুঁজে শেষকালে এইখানেই পৌঁছে গেছেন। একেই বলে ভগবানের হাত! কী অদ্ভুত যোগাযোগ!’

ঘরের দরজার কাছ থেকে রোহিণী নমস্কার জানাল। কনে স্কুল শিক্ষিকা, বয়স বছর ত্রিশ। রোহিণীর মজা লাগল ঘরের সকলের অবাক চাহনি দেখে। তার ক্ষীণভাবে ইচ্ছে হল, এদের সঙ্গে বসে গল্প করার। এরা সবাই মা, মাসি, পিসি—বোনঝি—ভাইঝি, প্রত্যেকেই কিছু—না—কিছু সামাজিক, পারিবারিক পরিচয়ে চিহ্নিত। তার পরিচয় শুধু কিনা আর্টিস্টের স্ত্রী, যে আর্টিস্ট এখন জেল ভেঙে কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে কেউ জানে না, আর সে নিজে কিনা কোন এক মহারানিতে কাজ করে! এটা কি কোনো মেয়ের পরিচয় হল? সে কারোর ননদ নয়, ভাজ নয়, বউদি নয়, কাকিমা নয়।

হঠাৎ রাজেনকে তার মনে পড়ল। এতক্ষণে জয়পুরে কোনো হোটেলে নিশ্চয় গা এলিয়ে খাটে শুয়ে। ফিরে এলেই বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। বাড়িতে রাজেন তার সম্পর্কে কী বলেছে সেটা ভালো করে ভেঙে বলছে না। নিশ্চয় কিছু কিছু ব্যাপার চেপে গিয়েই বলেছে। এটা উচিত নয়। সে নিজে গিয়ে রাজেনের মা—র সঙ্গে কথা বলে আসবে।

‘চলুন বাইরে চেয়ারে ততক্ষণ বসি।’

বাইরে এসে বসার সঙ্গে সঙ্গেই রোহিণী বলল, মিথ্যা কথাটা বললেন কেন? সকালে তো ঘুণাক্ষরেও বলেননি আজ আপনার ভাগনির বিয়ে, নেমন্তন্ন করা তো দূরের কথা!’

‘একটু আধটু রং চড়িয়ে বলা আমার অভ্যেস। এতে তো কারোর ক্ষতি হচ্ছে না।’

‘তাহলে এতদিনে যা যা বলেছেন, তাতেও রংটং চড়িয়েছেন?’

‘যেমন?’

‘গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জির সঙ্গে মিলে আপনি শোভনেশের ছবি নকল করার ব্যবসা খুলেছিলেন। আমার কাছে এই কথাটা চেপে গেছেন আর আপনাকে খুনের চেষ্টার কথাটা বলেছেন রঙ চড়িয়ে।’

সুভাষ গায়েনের মুখে অকৃত্রিম বিস্ময় ফুটে ওঠার বদলে থমথম করে উঠল রাগ। সেটা রোহিণীর জন্য নয়।

‘কিছু কিছু মিথ্যে কথা আপনাকে বলেছি ঠিকই, তবে সবটাই তা নয়। শোভনেশের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলি, বীণার বিশেষ বিশেষ পোজের ছবি আঁকার জন্য। টাকার জন্য উনি রাজি হন। এ কথার মধ্যে কোনো ভেজাল বা রংটং নেই। ওইরকম একটা ছবি গঙ্গাপ্রসাদ দেখে ফেলে শোভনেশের বাড়িতে। দেখার পর লোকটার মনে কী ঘটল কে জানে, সে শোভনেশকে সরিয়ে তার বাড়িতে মোমিনপুরে, তারপর সেখান থেকে গ্রামের বাড়ি বাসুদেবপুরে নিয়ে গিয়ে রাখে। আমি খোঁজ করে করে বাসুদেবপুরে গিয়ে হাজির হলুম। গিয়ে কী দেখলুম জানেন?’

‘কী করে জানব?’ রোহিণী মনে মনে মিলিয়ে নিচ্ছে সিদ্ধার্থর কাছ থেকে আজ বিকেলেই শোনা কথাগুলোকে।

‘শোভনেশ ছবি আঁকছে, হ্যাঁ বীণারই ছবি, তবে ন্যুড নয়। গলা টিপে ধরে, খাড়ার কোপ মেরে, গায়ে আগুন লাগিয়ে, জলে মুখ চেপে ধরে, বন্দুক দিয়ে গুলি করে—যত রকমে সম্ভব, তত রকমে একটা উলঙ্গ মেয়েকে খুন করছে একটা লোক—এই হচ্ছে শোভনেশের ছবির বিষয়, লাল আর কালো রঙে আঁকা বীভৎস সব ছবি!’

‘ওখানে আপনি ওকে গ্রাম আর প্রকৃতি নিয়ে ছবি আঁকতে দেখেননি?’

‘না। ঘরে শুধু ওই ছবিগুলোই দেখেছি।’

‘আপনাকে কিছু বলল?’

‘আমি ওকে একসময় ভয় দেখিয়েছিলুম, যেরকম ছবি ওকে আঁকতে বলেছি, যদি সেইরকম ছবি এঁকে না দেয়, তাহলে কোর্টে যাব, আমার বউয়ের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত এই অভিযোগ নিয়ে। তাইতে উনি ভয় পান আর আমার চাহিদা মতো ছবি আঁকেন। বাসদেবপুরে আমাকে দেখে তেড়ে এলেন। এই মারেন তো সেই মারেন। বললেন, আর আমাকে দিয়ে নোংরা ছবি আঁকাতে পারবে না। আমাকে তোমরা নষ্ট করেছ, আমিও তোমাদের খুন করব। ওকে দেখে মনে হল মাথার ঠিক নেই, কেমন যেন উন্মাদের মতো হাবভাব। আমি চলে এলাম।’

‘এসে তারপর জাল করার কারবার শুরু করলেন?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি একা নই। তার আগে আপনার গঙ্গাদা একদিন এসে হাজির আমার গোয়াবাগানের বাড়িতে। উনি শোভনেশের কাছ থেকে সব শুনেছিলেন আমার সম্পর্কে। এই বদবুদ্ধিটা ওনার মাথাতেই প্রথম খেলে। উনিই আমাকে প্রস্তাব দেন, এই সব ছবির যখন এত ভালো বাজার, এত ভালো দাম, তাহলে দু—জনে মিলে শুরু করা যাক। আমি রাজি হইনি। কেন হব? ব্যবসাটা তো আমি একাই শুরু করতে পারি, আবার পার্টনার নোব কেন? গঙ্গাপ্রসাদকে ফিরিয়ে দিয়ে আমি একাই নেমে পড়লাম।’

‘গঙ্গাদা নিশ্চয় তা জানতে পারেন।’

‘হ্যাঁ পারে। তার প্রমাণ আমাকে খুনের চেষ্টা। কোনো সন্দেহ নেই, গঙ্গাপ্রসাদই আমাকে মারতে চেয়েছিল। আমি যে বাসুদেবপুর গিয়েছিলুম,এটা জানতে পেরে উনি ক্রমাগতই বন্ধুকে ওসকাতেন আমার বিরুদ্ধে পুলিশে নালিশ করতে। কিন্তু শোভনেশ তাতে রাজি হয়নি। কেননা তাহলে বীণাকেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হত। এরপর ওই প্রস্তাব নিয়ে আমার কাছে গঙ্গাপ্রসাদের আসা আর আমার রাজি না হওয়া… থাক এখন এসব কথা, নিন ধরুন।’

একটি মেয়ে মাটির প্লেটে কলাপাতার উপর কয়েকটি রুই মাছের টুকরো, চারটি সন্দেশ, মাটির গ্লাসে দই নিয়ে রোহিণীর সামনে দাঁড়িয়ে। দেখেই আঁতকে উঠল সে।

‘আপনার যা স্বাস্থ্য, তাতে এগুলো ব্রেকফাস্ট হওয়া উচিত।’

‘হ্যাঁ উচিত, তবে এখন তো ব্রেকফাস্টের সময় নয়। তাই একটা সন্দেশ, কেমন?’

‘তাহলে কাল সকালেই খাবেন। ওরে এগুলো কলাপাতায় মুড়ে বেঁধে দে তো।’

‘তার মানে! ছাঁদা?’

‘উপহার। ছাঁদা কে বলল?’ সুভাষ গায়েন মৃদু ধমক দিল। ‘আপনার ওই ঝোলার মধ্যে দিব্যি চলে যাবে, শুধু দেখবেন বাসে, কেউ চাপটাপ না দেয়।’

‘কিন্তু এভাবে, না না।’

‘নিয়ে যান, এতে লজ্জার কিছু নেই। মীনাও বহু পার্টিতে না খেয়ে খাবারটা বাড়িতে নিয়ে আসে। আমিও তাতে ভাগ বসাই। আপনার বাড়িতে আরও তো লোক আছে?’

‘না, আমি একাই থাকি। একটা ঝি—চাকরও নেই।’

‘নিজেই রাঁধেন। বাহ তাহলে তো একটু বেশি করেই—’ বলতে বলতে সুভাষ গায়েন ভিতরে ঢুকে গেল।

অপ্রতিভ অপ্রস্তুত রোহিণী। এতক্ষণ যেসব কথা বলে সুভাষ গায়েন তাকে অস্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে রেখে দিয়েছিল, এখন তাকে দ্বিগুণ অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিল। শোভনেশ খুনের ছবি আঁকত বাসুদেবপুরে। গঙ্গাদা বলেছে, গ্রামজীবনের শান্ত স্নিগ্ধ ছবি আঁকব। গঙ্গাদাই তাহলে ছবি নকল করার মতলবটা সুভাষ গায়েনকে দেয়! সুভাষকে খুনের চেষ্টা—হ্যাঁ, গঙ্গাদার পক্ষে তা করার পিছনে যুক্তি আছে। অতঃপর মনে হল, ছাঁদাটা একটু বড়ো করে দেওয়ার পিছনেও যুক্তি আছে। বাড়ি গিয়ে তাকে তাহলে রান্নার উদ্যোগ করতে হবে না।

‘দেখি, দিন।’

রোহিণীর কাঁধ থেকে ঝোলাটা টেনে খুলে নিয়ে সুভাষ গায়েন তালের মতো একটা কাগজের পুঁটলি তার মধ্যে সাবধানে বসিয়ে দিল।

‘শীতকাল, মনে হয় না নষ্ট হবে। কাল দুপুরেও ভাতের সঙ্গে—অবশ্য আজ রাতেই যদি সব শেষ করে না দেন।’

‘আমাকে দেখে কি খুব খাইয়ে মনে হচ্ছে?’

‘বীণা খুব খেতে ভালোবাসত। চলুন, এগিয়ে দিয়ে আসি।’

বীণা ভালোবাসত বলে সেও খেতে ভালোবাসবে, এমন ধারণা লোকটার হল কী করে? হঠাৎ রোহিণীর মনে পড়ল সিদ্ধার্থকে বলা গঙ্গাদার কথা : বীণা আর তার শরীরের ধাঁচ নাকি একইরকম।

মিনিবাসে ওঠার আগে সুভাষ গায়েন বলল, ‘আরও অনেক কথা ছিল, পরে একদিন বলব’খন।’

বাস থেকে নেমে হেঁটে বাড়ি পৌঁছে রোহিণী ফ্ল্যাটের দরজা খোলার সময় উপরের সিঁড়ির দিকে তাকাল। সুজাতা বা হৃদয়রঞ্জন যে দাঁড়িয়ে থাকবেন না সিঁড়িতে, তা জানে। তবু এইরকমই হয় মনের মধ্যে। ওঁদের সঙ্গে পরিচয়ের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ হবার আগেই ভেঙে গেল।

পুঁটলি খুলে কলাপাতা সরিয়েই রোহিণী ‘ওরে বাবা’ বলে উঠল। দু—জনে দু—বেলা খাওয়া যায় এত জিনিস! লুচিতে বেগুন ভাজাটা রেখে, পাট করে মুখে সবে দিয়েছে, তখনই বেল বেজে উঠল। রোহিণীর বুকের মধ্যে কাঁপন লাগল।

আই হোল দিয়ে তাকিয়ে দেখল হৃদয়রঞ্জন শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে।

.

‘কী ব্যাপার! এত রাতে আপনি?’

রোহিণী সারাদিনে যত সঞ্চয় করেছে তা একসঙ্গে উদগিরণ করল গলা দিয়ে। এখন সে শোভনেশকে দেখলেও ততটা আশ্চর্য হত না, যতটা হল, যথেষ্ট আলাপ না হওয়া বার্ধক্যে পৌঁছানো তার এই প্রতিবেশীটিকে দেখে।

‘আপনার কাছে রক্ত বন্ধ হওয়ার কোনো ওষুধ আছে?’ ক্ষীণ মৃদুস্বরে কথাটা বলে হৃদয়রঞ্জন সকাতর নিবেদন করার মতো ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন।

‘রক্ত! কেন? কার?’ রোহিণীর বোধ—বুদ্ধি গুলিয়ে গেছে রক্ত শব্দটা শুনে। ‘আসুন আসুন, ভেতরে আসুন।’

‘আমার নয়। ফিস ফিস স্বরে হৃদয়রঞ্জন ভুল শুধরে দিলেন, ‘সুজাতা পড়ে গেছে মাথা ঘুরে। ডাইনিং টেবলের কোণটা গালে লেগেছে । টিংচার কী বেঞ্জিন কী মলম—টলম যদি থাকে?’

রোহিণী অসহায় বোধ করল। কোনোটাই নেই তার কাছে। ছোটোখাটো দুর্ঘটনার জন্য এইসব ওষুধপত্তর হাতের কাছে রাখা যে দরকার, এটা সে ছোটোবেলাতেই বাবার কাছে শুনে রেখেছে। কাটা, মচকানো বা সর্দি—জ্বরের মতো ব্যাপারের জন্য কিছু ওষুধ কিনে রাখার কথা ভেবেও কিনি কিনি করে আর কেনা হয়নি।

‘আমার কাছে তো কিছুই নেই, অন্য কারোর কাছে যদি—দাঁড়ান দাঁড়ান তুষারবাবুর কাছে বোধ হয়—’

কথা শেষ না করেই রোহিণী এক এক লাফে দুটো করে সিঁড়ি টপকে উপরে এসে তুষার দত্তর ফ্ল্যাটের বেল বাজাল। সেকেন্ড দশেকের মধ্যেই দরজা খুলে দাঁড়ালেন স্বয়ং তুষার দত্তই। তিনিও চমকিত এবং বিগলিতও।

‘তুষারবাবু, আপনার কাছে ধাক্কা লেগে কেটে যাওয়ার কোনো ওষুধ আছে?’

‘আপনার? কোথায় কোথায়?….কোথায় ধাক্কা লাগল, কোমরে?’

তুষার দত্তর বাড়ানো হাত থেকে রেহাই পেতে রোহিণী দু—হাত পিছোল।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ আছে। অ্যাই নন্দা, ফার্স্ট এড বাক্সটা দে, চটপট।…চলুন।’

সেই মুশকিলটা আবার ঘটেছে, যেটা ঘটেছিল শ্রীনিবাসনদের কপালে। হৃদয়রঞ্জন ব্যস্ততার জন্য সঙ্গে চাবি নিয়ে বেরোননি। দরজা বন্ধ হয়ে যেতেই তালা পড়ে গেছে। এখন ভিতর থেকে না খুলে দিলে দরজা খুলবে না। ভিতরে সুজাতা রয়েছে, কিন্তু তিনি তো গুরুতর আহত। রোহিণী ভাবল, হেঁটে এসে দরজা খুলে দিতে পারবেন কী? তবু সে আর একবার বেল বাজাল। দরজায় কান ঠেকিয়ে শোনার চেষ্টা করল সাড়াশব্দ পাওয়া যায় কিনা!

একেবারেই চুপচাপ। ভিতরে কোনো প্রাণী আছে বলে মনেই হচ্ছে না। হৃদয়রঞ্জন অসহায়ভাবে আই হোলের কাচের দিকে তাকিয়ে। তুষার দত্ত আর নন্দা তাকিয়ে রোহিণীর দিকে। নিজেদের দরজায় আরতিও দাঁড়িয়ে কৌতূহল নিয়ে। তুষার দত্ত আরও দু—তিনবার বেল বাজিয়ে বলল, ‘ভেঙে ফেলব দরজাটা?’

‘না না, আর একটু অপেক্ষা করা যাক। বুড়ো মানুষ, ইনজুরি নিয়ে দরজার কাছে হেঁটে আসবেন—’ রোহিণীর কথা শেষ হবার আগেই লক—এর হাতল ঘোরাবার শব্দ হল। ধীরে ধীরে দরজার পাল্লাটা খুলে গেল। সুজাতা দাঁড়িয়ে।

একটা ভিজে ন্যাকড়া বাম গালে চেপে ধরে রয়েছে। বাঁ চোখে কালসিটে। ফুলে উঠে চোখ প্রায় বন্ধ। অন্য চোখে প্রায় বিরক্তি। একটু শ্রান্ত স্বরে সুজাতা বললেন, ‘এত রাতে লোকজনকে বিরক্ত করার কী দরকার ছিল, ভেতরে এসো।’

হৃদয়রঞ্জন মাথা নীচু করে ভিতরে যেতেই সুজাতা বললেন, ‘উনি খুব নার্ভাস টাইপের, আমার তেমন কিছু হয়নি। বরফ লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা—।’

দরজা বন্ধ হতেই তুষার দত্ত হতাশ চোখে তাকাল রোহিণীর দিকে। আর তখনই রোহিণী বলে উঠল, ‘সর্বনাশ হয়েছে।’ সে প্রায় হুমড়ি খেতে খেতে নীচে নেমে এসে দেখল, সত্যিই তাই হয়েছে। তার নিজের ফ্ল্যাটের দরজাটা বন্ধ হয়ে রয়েছে। উপরে উঠে আসার ব্যস্ততায় ভুলেই গেছে চাবিটা সঙ্গে রাখতে।

তুষার দত্তও তার সঙ্গে সঙ্গে নেমে এসেছে তিন তলায়। রোহিণীর সমস্যাটা বুঝতে পেরেই তার মুখ থেকে হতাশা কেটে গিয়ে ঝলমল করে উঠল তৃপ্তি।

‘আর ‘না’ বলতে পারবেন না। এবার দরজাটা ভাঙতেই হবে। বেশি নয়, একটা ছোট্ট পুশ করব কাঁধ দিয়ে, আর মড়াত করে একটা আওয়াজ হবে।’

‘কিন্তু সেই আওয়াজ শোনার সৌভাগ্য তো আমার কপালে নেই।’ রোহিণী মুখটা বিষণ্ণতায় ভরিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়ানো নন্দার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ডুপ্লিকেট চাবিটা এনে দাও তো নন্দা।’

‘ওহ হো, তাই তো আপনার একটা চাবি তো আমাদের কাছেই রাখা আছে।’ তুষার দত্তকে মনমরা দেখাল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই উজ্জ্বল হয়ে উঠে বলল, ‘দেখুন, আমারই বুদ্ধিতে চাবিটা সেদিন করিয়েছিলেন বলেই আজ দরজা ভাঙার দরকার হল না।’

‘নিশ্চয়। আমি তো বরাবরই মনে করি, আপনার মতো বুদ্ধি, আপনার মতো গায়ের জোর এই কম্বিনেশনের লোক সাদা বাঘের মতোই খুব রেয়ার, পাওয়াই শক্ত।’ বলতে বলতে রোহিণী চাবিটা নন্দার হাত থেকে নিয়ে দরজায় লক—এ ঢোকাল। এখন তুষারের মুখটা কেমন দেখাচ্ছে, তা সে জানে। পাল্লা খুলে ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে সে বলল, ‘আচ্ছা, তুষারবাবু, ধন্যবাদ।’

দরজা বন্ধ করে রোহিণীর প্রথমেই সুজাতার মুখটা মনে পড়ল। চোখে ওইরকম কালসিটে টেবলের কোণা লেগে হয় না, মোটা ভারী ধরনের কিছুতে ধাক্কা লাগলে হয়। তা হলে কী! রোহিণী অবাক হয়ে ভাবল, হৃদয়রঞ্জনই কী ওই কালসিটের উদ্ভাবক? কিন্তু কেন? শোভনেশের সঙ্গে সুজাতার ব্যাপার তো কোন কালে চুকে বুকে গেছে! এত বছর পরেও কী ঈর্ষা বেঁচে থাকে বা একজনের স্মৃতি কী কেউ লালন করে বাঁচিয়ে রাখে!

রোহিণী গা ধুয়ে, সুভাষ গায়েনের ভাগ্নির বিয়ের খাবার থেকে মাছগুলো আর দুটো সন্দেশ খেয়ে, লুচি—বেগুনভাজা ঢাকা দিয়ে রেখে দিল গৌরীর মা—র জন্য। তারপর ঘরের আলো নিভিয়ে জানলাগুলো খুলে কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে সে তাকিয়ে রইল। আনমনা হয়ে সে সকাল থেকে এখন পর্যন্ত তার কাজকর্মের ধারা মনে করার চেষ্টা করল। মাথার মধ্যে জট পাকিয়ে যাচ্ছে, একটার সঙ্গে আর একটা জড়িয়ে গেছে, পরেরটার জায়গায় আগেরটা এসে পড়েছে। নিজের উপর বিরক্ত হয়ে সে টেবল—ল্যাম্প জ্বালিয়ে টেবিলে বসল কাগজ আর কলম নিয়ে।

সকাল দশটায় মীনা চ্যাটার্জি। কাগজের উপরে কথাটা লিখে তলায় লাইন টানল। রোহিণী মনে করতে চেষ্টা করল, তাদের কথাবার্তার মধ্যে তাৎপর্যময় বক্তব্য বা ঘটনা কোনটা যা শোভনেশের সম্পর্কে অজানা কিছু উদঘাটন করেছে? কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে সে ভাবতে শুরু করল।

মীনা বলেছে, স্বামী আর প্রেমিকদের যে ঠকায়, তাকে অর্থাৎ দিদিকে সে ঘৃণা করে। তাকে সে ক্ষমা করতে রাজি নয়। মানুষের মন নিয়ে যারা ঠকানোর কারবার করে, তারাই আসল খুনি। মীনার কোনো দুঃখ নেই বীণা খুন হওয়ায়। তার মতে ছবির ব্যাপারে শোভনেশ ছিল পরিশ্রমী আর সিনসিয়ার।

ভালো কথা। কিন্তু রোজ রাতে শোভনেশের আঁকা ছবির দিকে তাকিয়ে থাকা। মীনা বলেছে, তার দিদির চমৎকার বডি ছিল। দিদিকে হিংসে করত। এখনও বোধ হয় করে। তাই রোজ রাতে বীণাকে নিয়ে আঁকা ছবিটার দিকে তাকিয়ে থেকে সে—বোধ হয় সে—শোভনেশকেই অভিশাপ দেয়। কেন ‘অভিশাপ’ শব্দটা হঠাৎ তার মনে এল? রোহিণী যুক্তি খুঁজতে খুঁজতে ভাবল, হয়তো তাকে মডেল না করে দিদিকে পছন্দ করেছিল বলেই মীনা নিজেকে বঞ্চিতা মনে করে।

হতে পারে। মীনা তো তাকে বললই, আপনার স্কিন, ফ্লেশ, ভলিউম, স্ট্রাকচার, প্রোপোরশন দেখলে শোভনকাকা ঝাঁপিয়ে পড়তেন। কিন্তু মীনার জন্য ঝাঁপায়নি। শোভনেশ বিশেষ গড়নের শরীর পছন্দ করত, যে শরীর ওর নেই। মীনার হিংসা তার বারো বছর বয়স থেকে শুরু হয়, আর কুড়ি বছর ধরে সেটাকে ঘাড়ে নিয়ে আজও সে চলেছে। হয়তো মনে মনে বলে বীণার বদলে আমাকে যদি বাছতেন, তা হলে আজ এই পরিণতি হত না। হিংসা নয়, রোহিণী মাথা নাড়ল, করুণা। মীনা বোধ হয় করুণা দেখাতেই ছবিটার দিকে তাকায়।

মীনা নতুন কী জানাতে পারল শোভনেশ সম্পর্কে। রোহিণী কলমটা ঠুকতে লাগল কাগজের উপর । কালো কালো বিন্দু ফুটে উঠেছে সাদা কাগজে। মীনা বলেছে, সে তার লিমিটেশনস জানে, বুঝতে পারে। শোভনেশকে ভালোবাসা জানিয়ে মোলায়েমভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। বলার সময় তার চোখে জল দেখেছিল সে।

শোভনেশকে যতটা নিষ্ঠুর উন্মাদ বা নারীলোভী মনে হয়, মীনার এই চোখের জল থেকেই রোহিণী বুঝেছিল, ততটা নয় সে। ওটা অভিনেত্রীর অভিনয় ছিল না। মীনা এখনও মনে মনে পুজো করে শোভনেশকে।

কিন্তু বীণার খুনের কারণ মীনা বলতে পারেনি। পরিষ্কারই বলল,’কোনো কারণ বার করতে পারেনি।’ সত্যি কথা বলল কি?

কনফিউসড, বিভ্রান্তি, এলোমেলো, গুবলেট, আর কী কী হওয়া সম্ভব? রোহিণী কলমটা এবার কপালে ঠুকতে লাগল। পর পর খাতায় লিখে কোনো কিনারা পাওয়া যাবে না। ছবি জাল করে বিক্রির মতলবটা প্রথম গঙ্গাদার মাথাতেই খেলেছিল! একথা কী বিশ্বাস করা যায়? কিন্তু সুভাষ গায়েন আজ সত্যি কথা বলার মতো মেজাজেই ছিল। ভাগনির বিয়েতে আচমকা রোহিণীকে দেখে লোকটা যেন হঠাৎই স্নেহপরায়ণ হয়ে হৃদয়ের উপর জমা শ্যাওলা পরিষ্কার করতে শুরু করে দেয়।

মীনা চ্যাটার্জির কাছে কিছু কি আর জানার আছে? আপাতত নয়। গঙ্গাপ্রসাদ? অবশ্যই আরও অনেক কিছু।

কিন্তু কীভাবে সে কথা শুরু করবে? গঙ্গাদা নিশ্চয় চটবেন তার প্রশ্নে। চটলে তার চাকরি ‘নট’ করে দিতে পারেন, সঙ্গে সঙ্গে এই ফ্ল্যাটও তাকে ছাড়তে হবে। অবশ্য চাকরি সে জোগাড় করে নিতে পারবে। নিজের সম্পর্কে এই আস্থাটা তার আছে। কোনো পত্রিকায় বা বিজ্ঞাপন এজেন্সিতে বা প্রাইভেট ফার্মে। কিন্তু বলামাত্রই তো আর চাকরিটা তার ঝুলিতে কেউ ভরে দেবে না, কয়েকটা দিন তো সময় চাই। ততদিন সে থাকবে কোথায়? হাতে তো জমানো টাকা সামান্যই।

আহহ! রোহিণী চেয়ারের পিছনে মাথাটা হেলিয়ে সিলিংয়ের দিকে মুখ তুলে রইল। এই এক সমস্যা। এই সময় রাজেন যদি থাকত, তা হলে নিশ্চয় বলত—গো অ্যাহেড, আমি তো আছি। থাকা খাওয়ার ব্যাপারে দায়িত্বটা আমার। তুমি গঙ্গাদাকে যা প্রশ্ন করার, করো।

রোহিণী মাথা নাড়ল। রাজেন না ফেরা পর্যন্ত তাকে চুপচাপ থেকে চাকরি করে যেতে হবে। অবশ্য তার মধ্যে যদি—ভাবনাটা থমকে গেল রোহিণীর। সে নিজের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে লাগল, ভাবনাটাকে আর একটু টেনে নিয়ে গিয়ে এইরকম একটা আশা করবে কিনা—তার মধ্যে যদি শোভনেশ এসে পড়ে।

অবশেষে ক্লান্ত হয়ে সে নিজেকে বলল, আসুক। ও ছাড়া কার কাছ থেকেই বা সত্যি কথাটা জানব?

.

সকাল থেকে রোহিণী টেবিলে। মীনা চ্যাটার্জির সঙ্গে সাক্ষাৎকারটা লিখে ফেলে আজই প্রশান্তদাকে দিতে হবে। নোটবইটা মাঝে মাঝে দেখতে হচ্ছে মীনার কথাবার্তা উদ্ধৃত করার জন্য। দেখার পর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভেবে আবার ঝুঁকে পড়ছে লেখার জন্য। এইভাবেই চলছে গত দেড় ঘণ্টা ধরে। টেবিলে গ্লাসের দুধে সর পড়ে গেছে, টোস্টগুলো মিইয়ে ভিজে পেস্টবোর্ডের মতো। লিখতে লিখতে বাঁহাতে মুখে পুরে দেওয়া দুটো সিদ্ধ ডিম ছাড়া আর কিছু তার পেটে যায়নি। গৌরীর মা লুচি—বেগুনভাজা কাগজে মুড়ে রেখে কাজ সারতে গেছে উপরে, সুজাতাদের ফ্ল্যাটে।

চেয়ার থেকে উঠে রোহিণী পায়চারি শুরু করল। মীনার সঙ্গে শোভনেশের ব্যাপারটা তার লেখায় কতটা রাখবে, ঠিক বুঝতে পারছে না। ছোটোবেলায় একজন আর্টিস্টের সংস্পর্শে এসে মীনার মধ্যে একটা টান জেগেছিল শিল্প সম্পর্কে, একটা শিল্পবোধ গড়ে উঠেছিল। লেখাটাতে সে মীনাকে ওই দিক থেকে দেখিয়েছে। কিন্তু প্রশ্নটা হল, ভালোবেসে প্রেম নিবেদন করে শোভনেশের কাছে মোলায়েম প্রত্যাখান পাওয়া, আজও তার স্মৃতি ধরে রাখা, এইসব ডেলিকেট জিনিস তার লেখার মধ্যে রাখলে লেখাটা খুলবে ঠিকই, কিন্তু মীনা চ্যাটার্জির পক্ষে অস্বস্তির এমনকী হয়তো রাগেরও কারণ হয়ে উঠতে পারে। ভেরি ভেরি প্রাইভেট অ্যাফেয়ার এগুলো। তা ছাড়া কমার্শিয়ালও চোট পেতে পারে। মীনার যা ইমেজ—দাগ না পড়া, টোল না খাওয়া হৃদয়, রাজপুত্রের জন্য প্রতীক্ষারতা রাজকন্যে, অনাঘ্রাতা ফুলের মতো শরীর। এইগুলোই পাবলিসিটিতে প্রচ্ছন্নভাবে কাজে লাগানো হয়। ‘নির্মল, কোমল ত্বকের জন্য’ বলে মীনা সাবানের বিজ্ঞাপনে যে হাসিটা দেয়, তা নাকি দেবকন্যারা ছাড়া আর কারোর পক্ষে সম্ভব নয়। এহেন দেবকন্যা একদা কাউকে হৃদয় দিয়ে ফেলেছিল, এখনও সেই হৃদয় প্রত্যাহার করেনি, তা জানলে ফ্যানেরা আঘাত পাবে, তাদের সংখ্যা কমে যাবে। প্রোডিউসাররা এসবও নাকি কাউন্ট করে নায়িকা নির্বাচনের সময়।

রোহিণী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাসল। ঘাড় বেঁকিয়ে, মুখটা নামিয়ে, পাশে ফিরিয়ে পাঁচ—ছ রকম ভাবে হেসে শেষকালে মা—কালীর মতো জিভ বার করে মনে মনে বলল, ‘এইটেই হচ্ছে আসল হাসি।’

টেবিলে এসে কাগজগুলো তুলে সে কত শব্দ লেখা হয়েছে, তার একটা হিসাব কষল। এক হাজার শব্দ তো বটেই এগারোশোও হয়ে যেতে পারে। প্রশান্তদা বলেছেন, বারো—তেরোশোর বেশি কিছুতেই নয়। সঙ্গে তিনটে ছবিও যাবে।

দুধের গ্লাসটা তুলে এক চুমুকে শেষ করল। সাদা গোঁফটা কেমন তৈরি হল দেখার জন্য সে আবার আয়নার সামনে দাঁড়াল। একটা হালকা হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার মুখে। ছোটোবেলায় সে আর দিদি কম্পিটিশন করত দুধের গোঁফ বানাবার। কার গোঁফ চীনেম্যানের মতো হয়েছে, তার বিচার করতে হত বাবাকে। একবার বাবা বললেন, ‘সুনুরটা আজ ঠিক মাও সে তুংয়ের মতো’, অমনি দিদি দু—কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাংরা নাচ শুরু করে বলল, ‘আমি আজ মাও! আমি আজ মাও!’ বাবা তারপর সান্ত্বনা দেবার জন্য বললেন, ‘রুনিরটা একদম চিয়াং কাইশেক।’ ব্যস, শুনেই দিদির মুখ শুকিয়ে গেল। রাগে দুমদুম করে পা ফেলে বেরিয়ে সদরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বাবা গিয়ে ওকে বোঝালেন, ‘আরে বোকা মেয়ে, মাওয়ের কাছে তো যুদ্ধে চিয়াং হেরে গেছে, তাহলে রাগ করছিস কেন?’

রোহিণী জিভ দিয়ে ঠোঁটের উপর থেকে দুধের রেখা সবে চাটতে শুরু করেছে, তখনই বেল বেজে উঠল। গৌরীর মা নিশ্চয়, লুচি—বেগুনভাজা নিতে এসেছে। টোস্ট আর খেতে ইচ্ছে করছে না, ওগুলোও ওকে দিয়ে দেবে ঠিক করে সে দরজা খুলতে গেল।

‘আরে, কী ব্যাপার, এসো এসো।’ রোহিণী অবিশ্বাস্য বেগে প্রথম কণ্ঠস্বরকে পিছনে ঠেলে দিয়ে তার দু—নম্বরি স্বর বার করে আনল।

‘আপনাকে ডিসটার্ব করলাম না তো?’ কুন্তী একগাল হেসে বলল, ভিতরে না ঢুকে।

‘একটুও না, একটুও না। বরং এখনই ভীষণভাবে চাইছিলাম খুব মিষ্টি মুখের কোনো মেয়ে যদি গল্প করতে আসে, তাহলে খুব ভালো হয়। ভেতরে এসো।’

পুলকে উজ্জ্বল চোখ দুটি বার চারেক পিটপিট করে কুন্তী ভিতরে ঢুকল।

‘দ্যাখো, অত সাহেবি ফর্ম্যালিটি আমার সঙ্গে করতে হবে না। ডিস্টার্বড হলাম কী না হলাম, তাতে তোমার কী আসে যায় বাপু?’ রোহিণী স্নেহভরে নরম ধমক দিল। ‘দরজা খোলা পেলেই ঢুকে পড়বে। কাজ—টাজের কথা যদি থাকে বলে ফেলবে, তারপর যদি হাতে তোমার সময় থাকে, পরচর্চা শুরু করে দেবে। এটা আমি ভীষণ ভালোবাসি, তুমি?’

‘আমিও বাসি, তবে খুব বেশি নয়।’

‘বেশি নয় মানে! পরচর্চা আবার ডিগ্রি মেপে করা যায় নাকি? করবে যখন, প্রাণ খুলে চুটিয়ে করবে। তোমার কত্তা করে?’

‘করে, তবে শুধু অফিস কলিগদের নিয়েই। আচ্ছা, অচেনা লোকদের সম্পর্কে পরচর্চা করে কি সুখ হয়, বলুন? কালকেই ক্লাব থেকে ফিরে এসে বলল, বাণ্টু ঘোষের বউকে নাকি দেখা গেছে গড়িয়াহাটের এক কাপড়ের দোকানে হাফ প্রাইসে শাড়ি বিক্রি করছে। দু—মাস আগে বিয়ে হয়েছে, সত্তর—আশিটা শাড়ি পেয়েছে। অত শাড়ি দিয়ে কী আর হবে, তাই চুপি চুপি দোকানে গিয়ে কথাবার্তা বলে আদ্দেক দামেই নতুন নতুন শাড়িগুলো সেল করে দিয়েছে। আর সেটা দেখে ফেলেছে বাণ্টু ঘোষের অফিসেরই একজন।’

‘বাহহ, এটা তো ভালো সাবজেক্ট!’

‘কিন্তু বাণ্টু ঘোষকে আমি চোখেই দেখিনি, তার বউকে তো নয়ই। ওরা কীরকম কথাবার্তা বলে, কীভাবে থাকে, স্যালারি কত, পার্কস কীরকম পায়, ওদের টেস্ট কেমন, কানেকশনস কেমন, শ্বশুর কী করে, বউ কোন স্কুলে পড়েছে, সেসব কিছুই জানি না। মজার কথা কী জানেন পল্টুও তা জানে না।’

‘পল্টু কে?’

‘আমার কত্তা, ভালো নাম অলকেন্দু। ম্যাগনানি অ্যান্ড ফ্রেজিয়ারের হরিসাধন দত্ত ক্লাবে এটা গল্প করেছে। আর বাণ্টু ঘোষ থাপার গ্রুপ ছেড়ে সবে জয়েন করেছে ইলেকট্রনিকস ম্যানুফ্যাকচারিং ফার্ম মিলকমে। কে বাণ্টু, কে হরিসাধন কাউকেই জানি না, কী পরচর্চা করব বলুন তো?’

কুন্তী ঝরঝর করে হেসে উঠল। রোহিণীর মজা লাগল ওর কথা শুনে। বাস্তব থেকে কিছুটা দূরে, একটু আলাদা জগতে অন্যভাবে মানুষ হওয়া, সরল মেয়ে। সচ্ছলতা থেকে সচ্ছলতায় এসে পড়েছে।

‘ঠিকই বলেছ, একদম অপরিচিতদের নিয়ে হয় না। যদি আমার মতো প্রতিবেশীও হত, তাহলেও নয় করতে পারতে।’

‘না না রোহিণীদি, আপনাকে—’

‘রোহিণী নয় রুনি।’

‘হ্যাঁ, রুনিদি আপনাকে নিয়ে আমরা একটুও চর্চা করি না। সত্যি বলছি, মা কালীর দিব্যি!’

মা কালী তাহলে মুখ থেকে বেরিয়েছে! কুন্তী নামটা মহাভারত থেকে, সিঁথেয় সিঁদুরও দিতে হয়। নির্ঘাত মা বা ঠাকুমা কিংবা এখানে যার ফ্ল্যাটে রয়েছে সেই বিধবা মাসিমা রীতিনীতি মানা সম্পর্কে একটু জবরদস্ত প্রাচীনা।

‘ঠিক বলছ তো? আমাকে নিয়ে কোনো আলোচনা হয় না?’ রোহিণী হাসি চেপে বলল। ‘সোফিয়া লোরেনের মতো হিপ সুইং করে’ বলতে পারো যখন, আর কিছুও যে বল না, এটা কী বিশ্বাস করতে হবে?

বেল বেজে উঠল। গৌরীর মা।

‘কী গো, এত দেরি হচ্ছে দেখে আমি তো ঠিক করেই ফেলেছিলাম, লুচি বেগুনভাজা শেষ পর্যন্ত বোধ হয় আমার পেটেই যাবে।’

‘খাবে তো খাও না। বাসি নুচি খেতে যা লাগে না দিদি!’

গৌরীর মা চটপট কাগজ খুলে এগিয়ে দিল, কুন্তী উৎসুক চোখে তাকাল। রোহিণী ইতস্তত করে ‘আচ্ছা, তাহলে একটা—’ বলেই একটা লুচি আধখানা বেগুনভাজা মুখে দিয়ে চিবোতে চিবোতে চোখ বুজে বলল, ‘গ্রে এ এ ট!’

‘খুব দারুণ, না?’ কুন্তীর ঠোঁট সামান্য খুলে গেল। জুলজুল করে তাকিয়ে।

‘নাও না, তুমিও একটা নুচি খেয়ে দ্যাকো।’

কুন্তী চট করে একটা শক্ত মড়মড়ে লুচি তুলে নিয়েই কামড় বসাল।

‘বেগুনভাজা নিলে না!’ গৌরীর মা ব্যস্ত হল।

‘না, শুধুই খাব। সত্যি রুনিদি…উমমম…মনে হচ্ছে কার্ল লিউইসের চারটে ওলিম্পিক গোল্ড মেডেল চিবিয়ে খাচ্ছি…সিলভেস্টার স্ট্যালোনের হিরোইন মনে হচ্ছে, মাইকেল জ্যাকসনের সঙ্গে গান গাইছি, আর একটা খাব? কুন্তী প্রায় ভিক্ষা চাওয়ার মতো ভঙ্গিতে গৌরীর মাকে বলল।

‘খাও না। একটা কেন, অত রয়েছে, দুটো নাও।’

কুন্তী দুটো লুচি তুলে নিয়ে রোহিণীকে বলল, ‘জানেন, পল্টু আমায় তেল, ঘি, বাটার, সুগারের জিনিস একদম খেতে দেয় না, পার্টিতে সবসময় নজর রাখে আমার প্লেটের দিকে। খালি ক্যালোরি আর ক্যালোরি শুনে মাথা খারাপ হবার মতো অবস্থা। কারণ, মোটা হয়ে যাব। আচ্ছা আমার এই ফড়িংয়ের মতো চেহারা ছেলেদের ভালো লাগবে? আপনার মতো ফিগার না হলে—।’ কুন্তী থেমে গেল আচমকা। রোহিণী ওর চোখে ক্ষোভ আর হতাশা দেখতে পাচ্ছে, গৌরীর মা—ও বোধ হয়। বিদ্রোহীর মতোই কুন্তী কচমচ করে লুচি দুটো খেয়ে নিজেই গ্লাস নিয়ে বেসিনের কল থেকে ঢকঢক করে জল খেল।

রোহিণী ওর কষ্টটা বুঝেছে। মেয়েটা রোগাই। একটু ভরন্ত হলে খারাপ দেখাবে না। ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্যই সে বলল, ‘তোমার ফিগার তো খারাপ নয়, স্লিম, ছিপছিপে বেতের মতো—’

‘থাক, আপনাকে আর মিথ্যে কথা বলতে হবে না। আমি যে কী, সেটা আমি ভালোই জানি। পল্টু যেসব ম্যাগ কেনে, তাতে শুধু সেক্সি মেয়েদের ছবি। কেন? আমার ফিগার যদি অ্যাট্রাকটিভই হবে, তাহলে চুরি করে আপনার—’ কুন্তী আবার থেমে গেল। রোহিণী গম্ভীর হল। হঠাৎ তার মনে পড়ল, মীনা তার দিদিকে হিংসে করত এই শরীরের জন্যই।

‘গৌরীর মা, আমরা আর খাব না, এবার তুমি ওগুলো নিয়ে যাও।’ রোহিণী কথাগুলো বলল ওকে এখান থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। গৌরীর মা খুবই চালাক—চতুর এবং গোপ্পে। কুন্তীর কথাগুলো এই বাড়ির অন্যান্য ঝিয়েদের মুখ থেকে ছড়িয়ে পড়ুক এটা রোহিণী চায় না।

‘দিদি, তুমি একবার ওপরে গিয়ে মাসিমাকে দেখে এসো। কাল রাতে পড়ে গিয়ে চোখের যা অবস্থা হয়েছে না! মেসোমশাই তো সকাল থেকে বসে বসে কাঁদছে।’

রোহিণী অবাক হল। হৃদয়রঞ্জন কাঁদছেন কি অনুতাপে দগ্ধ হয়ে? এই বুড়ো বয়সেও এত ভালোবাসা?

‘হ্যাঁ যাব’খন দেখতে।’

‘মাসিমা তোমাকে যেতে বলেছেন।’ গৌরীর মা যাবার সময় বলে গেল।

রোহিণী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। কুন্তী দু—বার কী যেন বলল, সেটা তার মাথায় ঢুকল না। সুজাতা কেন যেতে বলেছেন, তার কারণ বার করার জন্য মাথাটা তার ব্যস্ত।

‘রুনিদি, আপনি কী অত ভাবছেন যে, আমার কথার জবাব দিচ্ছেন না?’

‘ওহঃ…হ্যাঁ, বলো, একটা কথা মনে পড়ে গেল, তাই।’

‘আমি লিখতে চাই।’

‘কোন ভাষায়, ইংরিজিতে?’

‘না না বাংলাতেই। আপনাদের ম্যাগাজিনে আপনি একটু চান্স করে দেবেন? এইটে বলতেই এসেছি।’

‘বেশ তো, খুব ভালো কথা। কী বিষয় নিয়ে লিখবে? আগে কি কোথাও লেখা বেরিয়েছে?’

‘কোথাও না। আমি কখনো লিখিইনি জীবনে। কিন্তু ঠিক করেছি এবার লিখব, ছাপাব, আর সবাইকে দেখাব।’

‘সবাই মানে তো, কত্তা?’

‘হ্যাঁ, পল্টুকে তো দেখাবই। ও ভীষণ জেলাস টাইপের, আমি লিখে ফেমাস হয়ে গেলে হিংসেয় মরে যাবে।’

‘ভালো কথা। তা কী নিয়ে লিখবে?’

‘সেটা আপনি বলে দিন।’

‘ওমমা, আমি বলে দেব, তারপর তুমি লিখবে। তাই কখনো হয়?’

‘হয়। আমি অনেক রকম জিনিস পড়ি, ভাবি, মনেও রাখি। যেমন সিনেমা, রক মিউজিক, স্পোর্টস, গোস্ট স্টোরিজ, ক্রাইম ডিটেকশন, ফিজিক্যাল ফিটনেস, ডেকরেশনস, গার্ডেনিং, আর ধরুন—’

‘ধরেছি। ক্রাইম ডিটেকশন পারবে? তাহলে তোমাকে একটা খুনের গল্প বলব, সেটা সলভ করার চেষ্টা করতে পারো।’

‘সলভ করলে ছাপাবেন?’

‘আমি ছাপাবার মালিক নাকি? তবে তোমার হয়ে সম্পাদককে যে খুবই ধরাধরি করব, এই কথাটা দিতে পারি।’

‘বেশ, বলুন কীরকম খুন? সত্যি তো?’

‘একদম সত্যি। কিন্তু ভাই এখন তো সময় নেই হাতে, একটা লেখা এখুনি শেষ করতে হবে। তুমি বরং এক কাজ করো, যে ম্যাগাজিনটা সেদিন তোমাদের কাছ থেকে এনেছিলাম, সেটায় সিধারথ সিনহা নামে একজনের একটা আর্টিকেল—’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়েছি। কী যেন নামটা, দ্য আর্টিস্টস হু ওয়্যার কনজিউমড….এই ধরনের একটা বিরাট নাম। পড়েছি, পড়েছি। একটা ন্যুড ছবি আছে, যেজন্য পল্টু ওটা কিনেছিল।’

‘কারেক্ট। আগে ওটা পড়ে ফ্যালো। শোভনেশ সেনগুপ্ত নামে একজনের কথা ওতে আছে, সেটা খুঁটিয়ে মন দিয়ে পড়ে তারপর এসো, তখন বলব কী কী ব্যাপার ডিটেক্ট করতে হবে, কেমন?’

কুন্তী ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। সময় কাটাবার জন্য কাজের মতো একটা কাজই শুধু পাওয়া নয়, লেখার সঙ্গে তার নামটাও বেরোবে। তার মানে পরিচিতি আর খ্যাতিও।

‘আপনি এখন ব্যস্ত, তার মানে ডিস্টার্ব করছি। এখন তাহলে আসি। কালকেই আপনাকে বলব কীভাবে, কী কারণে মার্ডার হয়েছে, আর কে করেছে।’ দরজা খোলার জন্য গোলাকার নবটায় হাত রেখে কুন্তী অবশেষে বলেই ফেলল, ‘আপনি বাড়িতে ব্রা পরেন না কেন?’

‘বাইরেও তো অনেক সময় না পরেই বেরোই।’

‘কেন? উইমেনস লিব সাপোর্ট করেন বলে? অবশ্য ব্রা না পরলেও আপনার চলে।’

‘মোটেই না। পুরুষদের মাঝে মাঝে একটু জ্বালাতন করার ইচ্ছে হলে পরি না।’

বলেই রোহিণী জোরে হেসে উঠে তারপর বলল, ‘তোমার আবার পুরুষদের মতো এইসব দিকে নজর কেন?’

‘আমি অত এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না পল্টু বলে, আমি শুনি।’

তার মানে কথা হয়েছে। রোহিণী মনে মনে বলল, সোফিয়া লরেন তো হয়েছি, তারপর কি লোলোব্রিজিদা, মনরো না অ্যানিটা একবার্গ? কিন্তু এদের জেনারেশন মনরো বা একবার্গকে কি দেখেছে? এখন বিগ গার্লসদের যুগ তো আর নেই!

‘শ্রীমান পল্টু যা বলে, শুনে যেয়ো। আর আমি যা বলছি সেটাও শুনে নাও, এখন দৌড়ে গিয়ে ম্যাগাজিনটা পড়তে শুরু করো আর কাল কী পরশু আমাকে বলে যেয়ো ওর মধ্যে থেকে কী কী মিস্ট্রি তুমি খুঁজে পেয়েছ। তারপর তোমাকে কয়েকটা ক্লু দেব। এখন কেটে পড়ো, আমার লেখা শেষ করতে হবে।’

দরজা বন্ধ করে রোহিণী একবার ভাবল, উপরে গিয়ে সুজাতাকে দেখে আসবে কী না। কিন্তু লেখাটা আগে শেষ করে ফেলা দরকার। রাতে গিয়ে দেখে এলেও, মারা তো আর যাচ্ছেন না।

একঘণ্টার মধ্যেই রোহিণী লেখা শেষ করে ফেলল। মীনার সঙ্গে শোভনেশ প্রসঙ্গ নিয়ে সে গভীরে যাবার কোনো চেষ্টাই করল না। টাইপ করা বায়োডাটা থেকে কিছু কিছু খবর তুলে যে মোটামুটি বোঝাবার চেষ্টা করল, এমন শিক্ষিতা মেধাবী, সুরুচিসম্পন্না ও সুরসিকা অভিনেত্রী বাংলায় কখনো জন্মায়নি। লেখাটা ভাঁজ করে ঝুলিতে রাখতে গিয়ে, কী ভেবে সে ভাঁজ খুলে তলার দিকে এক জায়গায় লিখল—বোধ হয় জন্মাবেও না। রোহিণী জানে, প্রশান্তদা কথাটা কেটে দেবেনই।

অফিসে লিফট থেকে বেরোতেই সে কমলের মুখোমুখি হল। রোহিণী জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, ছেলে এখন কেমন আছে? কিন্তু তার আগেই কমল বলল, ‘দু—বার আপনার খোঁজ করেছেন। গিয়ে এখুনি দেখা করুন।’

‘কে গঙ্গাদা?’

‘হ্যাঁ।’

লেখাটা প্রশান্ত হালদারের টেবিলে রেখে দিয়েই রোহিণী কামরা থেকে বেরিয়ে আসার সময় ভাবল, দু—বার খোঁজ করা কেন? শোভনেশ সম্পর্কে কিছু কি জানতে পেরেছেন? গঙ্গাপ্রসাদ প্লাস পাওয়ারের চশমা পরে টেবলে ঝুঁকে টাইপ করা কাগজ পড়ছিলেন। চশমাটা নাকের ডগার কাছে নামানো। ফ্রেমের উপর দিয়ে তিনি তাকিয়ে বললেন, ‘বোসো, এক মিনিট।’

এক মিনিট ফুরোবার আগেই পড়া বন্ধ করে তিনি বললেন, ‘টিভি—র জন্য একটা বিভাগ করব বলেছিলাম মনে আছে তো?’

রোহিণী মাথা নাড়ল।

‘তোমাকে একটা সেট কিনে দেব বলেছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই ওটা পৌঁছে দিয়ে আসবে, অ্যান্টেনাও লাগিয়ে দেবে। কখন লোকে গেলে তোমার সুবিধে হবে, সেটা প্রশান্তবাবুকে বলে দিয়ো।’

চেয়ারে হেলান দিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ ড্রয়ার খুলে রুমাল বার করে মুখ ঘাড় গলা মুছলেন। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী যেন খুঁজলেন। একটা লবঙ্গ বেরোল। সেটা মুখে পুরে গলাখাঁকারি দিয়ে অবশেষে রোহিণীর মুখের দিকে তাকালেন।

‘টিভি—র কথা বলার জন্য তোমাকে ডাকিনি।’

রোহিণী সেটা অনেকক্ষণ আগেই অনুমান করে নিয়েছে। গুরুতর কিছু বলার আগে গঙ্গাপ্রসাদ নিজেকে স্টেডি করার জন্য অযথা ব্যতিব্যস্ত হন।

‘শোভু ফোন করেছিল কাল রাতে। আমি তখন খেতে বসেছি। বুঝতে পারলাম না কোথা থেকে করছে, মনে হল কাছাকাছি রয়েছে। কয়েকটা কথা বলল, যা তোমাকে জানানো দরকার।’

রোহিণীর পিঠ শক্ত হয়ে উঠল। বগলের কাছে সিরসির করছে। ঘাড়ে রোঁয়া উঠল। তাহলে শেষ পর্যন্ত—। নাহ, সে ভয় পাচ্ছে না, পাবার মতো কিছুই তো বাকি নেই। এই ক—টা দিন ভয় পেতে পেতে সে ভয় পাওয়াটাতেই বিতৃষ্ণ হয়ে পড়েছে। সে তো এখন চাইছেই, জট পাকানো সত্যি—মিথ্যেগুলো ছড়িয়ে দেবার জন্য শোভনেশ ফিরে আসুক।

গঙ্গাপ্রসাদ স্থির চোখে তাকিয়ে রোহিণীর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছেন। কিন্তু রোহিণীরও স্থির সিদ্ধান্ত, কোনোরকম ভাব যেন মুখে ফুটে না ওঠে। মিনিটখানেকের একটা সংঘর্ষ নীরবে ঘটে গেল টেবিলের দু—ধার থেকে। রোহিণী আগ্রহ দেখাল না শোভনেশের বলা কথাগুলো শোনার জন্য। ভ্রূ কুঁচকে উঠল গঙ্গাপ্রসাদের।

‘প্রথমে ভাবলাম কেউ রসিকতা করছে, যখন ‘হ্যালো’ বলতেই শুনলাম, ‘কে গঙ্গা নাকি, আমি শোভু বলছি।’ শুনেই তো পাথর হয়ে গেলাম। গলা দিয়ে স্বর আর বেরোয় না। কোনোক্রমে বললাম, ‘হ্যাঁ’। কিন্তু শোভু কে?’ ‘বলল’, এর মধ্যে ভুলে গেলি? ছ—টা বছর তো মাত্র! আমি জেল থেকে পালিয়েছি গঙ্গা, কাগজে কি সে খবর বেরিয়েছে? আমি মিথ্যে করেই বললাম, ‘কই চোখে পড়েনি তো! শোভু মানে শোভনেশ সেনগুপ্ত কি?’ বলল, ‘এতক্ষণে সেটা বুঝতে পারলি! শোন, আমি তোর সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু পুলিশ নিশ্চয় আমার চেনাজানাদের ওপর নজর রাখবে। বউবাজারে যাওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কোথায় দেখা হতে পারে?’ আমি বললাম, ‘দেখা করার দরকারটা কী?’ ও বলল, ‘অনেক দরকার। আমার ছবিগুলো নিয়ে কথা বলব। প্রচুর জাল ছবি আমি দেখেই গেছিলাম, বাজারে তখনই বেরিয়ে গেছিল। মানুষ হিসাবে সমাজে আমার জায়গা হয়তো হবে অনেক নীচেই, কিন্তু শিল্পী হিসাবে এদেশে আমি প্রথম পাঁচ—সাত জনের মধ্যে তো পড়বই। আমার রেপুটেশন আজ অ্যান আর্টিস্ট ধ্বংস হচ্ছে এইসব জাল ছবির জন্য। এর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। এইজন্যই দেখা করতে চাই। এইজন্যই আমি পালিয়েছি।’ আমি বললাম, ‘তুই কোথায় আছিস বল, আমি গিয়ে দেখা করব।’ ও এড়িয়ে গেল, আমার প্রস্তাব। হঠাৎই বলল, ‘রোহিণী কোথায় আছে জানিস?’ কথাটা শুনেই আমি কীরকম ঘাবড়ে গেলাম।’

গঙ্গাপ্রসাদ থেমে গিয়ে নাটকীয় নীরবতা তৈরি করলেন। টানটান হয়ে উঠল রোহিণীর ঔৎসুক্য। কেন জানি তার মনে হল, গঙ্গাদা তাকে দূরবিন দিয়ে দেখছেন, কী কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কথাগুলো শুনে। তাই সে প্রাণপণে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে পায়ের উপর পা তুলে, ঊরুর উপর শাড়ির পাট ঠিক করতে করতে বলল, ‘হুঁ, তারপর?’

‘কোথায় আছ, সেটা বলব কী বলব না ভাবতে—ভাবতে বলেই ফেললাম, ‘রোহিণী কলকাতাতেই আছে, এক জায়গায় চাকরি করছে।’ শুনেই ওর মুখ থেকে একটা শব্দ বেরোল। অনেকটা যেন থুথু ফেলার মতো। বলল, ‘ঠিকানাটা কী জানিস, একবার ওকে দেখাব।’ মনে হল, থ্রেটনিং টোন যেন গলায় পেলাম। বললাম, ‘ঠিকানা জানি না।’ ও বলল, ‘আর বেশিক্ষণ কথা বলা সম্ভব নয়, তোকে আমি আবার ফোন করব।’ এই বলে রেখে দিল।’

‘এবার ফোন করলে বলবেন, ‘রোহিণী তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য দেখা করতে চায়।’

গঙ্গাপ্রসাদের চোখে পলকের জন্য বিভ্রান্তি ফুটে উঠেছিল, যা রোহিণীর নজর এড়াল না।

‘তুমি দেখা করবে! কেন? ওর মানসিক অবস্থা এখন কেমন, তা তুমি জান না। আমিও নয়। তোমার সম্পর্কে ওর মনোভাব যা দেখেছিলাম তাতে—।’

‘অর্থাৎ এই মার্ডারের জন্য আমিই দায়ী। আমিই সিটিং দিতে রাজি না হওয়ায় শোভনেশ ক্ষেপে উঠে বীণার কাছে ছুটে যায়। যদি না যেত, তাহলে মার্ডারটাও আর হত না।’

কথাটা বলেই রোহিণী ঠিক করে ফেলল, আর নয়। এবার নখ দাঁত বার করে অন্য মূর্তি ধরতে হবে। গঙ্গাপ্রসাদের মুখে রহস্যময় হাসি ফুটেছে দেখেও সে ঘাবড়াল না।

‘কাল তুমি কার্জন পার্কে বসেছিলে?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু একা নই। উৎপল কি সেটা বলেনি?’

‘বলেছে। সিদ্ধার্থ সিংহিকে অনেক কথাই বলেছিলাম, সব এখন মনে নেই। তবে যা বলেছি, তা ঠিকই। তোমার শরীর শোভুকে পাগল করেছিল। তোমাদের বিয়ে আমার ঘটকালিতেই হয়েছে। আমিই ওকে বুদ্ধিটা দিই, এমনি ন্যুড হতে বললে রাজি হবে না, কিন্তু স্বামীর কাছে আপত্তি করবে না। তুই মেয়েটাকে বিয়ে করে স্বামী হয়ে যা। কিন্তু আমি ভুল বলেছিলাম বা বুঝেছিলাম। এই মার্ডারের পিছনে আমিও তো অনেকটা দায়ী। বিয়েটা না ঘটালে এসব কিছুই হত না।’

গঙ্গাপ্রসাদের মৃদু শান্ত গলা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এল। টেবিলের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলেন। চিবুকের নীচে চর্বির ভাঁজ ফেলে মুখটা নীচু করা।

‘কিন্তু আমার তো মনে হয়, ছবি জাল করা নিয়েই এই খুন ঘটেছে। সিদ্ধার্থকে আপনি যা বলেছেন তাতে মনে হচ্ছে, বীণার স্বামী ব্ল্যাকমেইল করে ছবি আঁকিয়ে নিত।’

‘কারেক্ট। শোভু নিজে আমায় বলেছে।’

‘তখন মাঝে মাঝে ওর পাগলামি দেখা দিত।’

‘হ্যাঁ।’

‘কিন্তু আমাকে সেদিনই আপনি বলেছেন, ওদের বংশে কেউ কখনো পাগল হয়নি। সুজাতা গুপ্ত সম্পর্কে বললেন, শী ইজ এ লায়ার, বললেন সুজাতার থেকেই এই মার্ডারের সূত্রপাত। আবার সিদ্ধার্থকে বলেছেন আমিই মার্ডারের জন্য দায়ী, এখন আবার বলছেন, আপনি নিজেও অনেকটা দায়ী। গঙ্গাদা, আমার সব কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা বুঝতে। এত লোক দায়ী করলে তো শোভনেশকে আর মার্ডারার ভাবাই যায় না।’

‘একদিক থেকে দেখলে তাই। সব কাজের পিছনেই কিছু কারণ থাকে। সুজাতা, তুমি, আমি—আরও কেউ কেউ হয়তো এইসব কারণ জুগিয়ে গেছি।’

‘আরও কেউ কেউ মানে? ছবি জাল করার ব্যাপারে যারা জড়িত, তাদের কথা বলছেন কি?’

‘হ্যাঁ। সিদ্ধার্থ সিংহি নিশ্চয় নামটা তোমায় বলেছে।’

‘বলেছে। আমি তার সঙ্গে কথাও বলেছি।’

রোহিণীর চোখ ছুরির ফলার মতো ধারালো হল। গঙ্গাপ্রসাদ অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসলেন। বোধ হয় বুঝতে পেরেছেন, রোহিণী এবার কী বলবে।

‘কী বলল সুভাষ গায়েন? আমি তার কাছে গেছিলাম ছবি জাল করার ব্যবসা খুলব বলে?’

রোহিণীর হঠাৎ নিজেকে নিরস্ত্র, অসহায় মনে হল। তার মুখের কথা গঙ্গাদার মুখ থেকেই বেরিয়ে আসবে, এটা সে ভাবতে পারছে না। সবই উনি জানেন তাহলে।

‘কি ঠিক বলেছি?’ গঙ্গাপ্রসাদ চোখ পিট পিট করলেন।

‘হ্যাঁ’। অস্ফুটে রোহিণী বলল।

‘গায়েনও ঠিক বলেছে। হ্যাঁ, আমি গেছিলাম ওর কাছে। এর পিছনে একটা উদ্দেশ্য ছিল, আর সেটা হল শোভুকে ভয় দেখিয়ে ও যেসব ছবি আঁকিয়ে নিচ্ছিল, তা বন্ধ করা। গায়েনের অভিধানে শুধু একটাই শব্দ আছে—টাকা। ওকে যদি টাকা কামাবার অন্য একটা রাস্তা দেখিয়ে দিতে পারি, তা হলে হয়তো শোভুকে রেহাই দেবে। এই ভেবেই জাল করার পথটা ওকে চিনিয়ে দিয়ে আসি।’

‘তার আগেই আপনি শোভনেশকে কলকাতা থেকে সরিয়ে বাসুদেবপুরে নিয়ে গেছিলেন। সেখানে সে মোটেই গ্রামজীবন আর প্রকৃতি নিয়ে ছবি আঁকেনি। সেখানে উন্মাদের মতো শুধু লাল আর কালো রং দিয়ে একটা মেয়েকে খুনের বীভৎস ছবি আঁকত। খুন করত সে বীণাকে। সুভাষ গায়েন সেখানে গেছিল, তাকেও শোভনেশ খুন করবে বলেছিল। গঙ্গাদা, আপনি আমাকে বলেছিলেন, ওদের নাকি পাগলের বংশ নয়। মিথ্যা কথা বলেছিলেন। ওদের প্রত্যেক জেনারেশনে একজন করে পাগল হয়েছে। এই জেনারেশনে সেটা শোভনেশ। ন্যুড সিটিং দিতে চাইনি বলে ও আমার গলা টিপে ধরেছিল, যা কোনো প্রকৃতিস্থ লোক করবে না। আমার মনে হয়েছিল, আই রিয়্যালি ফেল্ট যে, আমাকে ও সেদিন মেরেই ফেলত যদি না—যদি না তখন পরমেশ এসে পড়ত।’

এক নিশ্বাসেই প্রায় জেট বিমানের টেক—অফের মতো রোহিণী তার ফুসফুসে চাপ দিয়ে মুখ থেকে কথা বার করাল। মুখে রক্ত ছুটে এসেছে। বুক ওঠানামা করছে।

‘পরমেশ? ওখানে?’ গঙ্গাপ্রসাদকে ঝুঁকিয়ে দিল তার বিস্ময়। ‘সে তো পাশের বাড়িতে থাকে। অবশ্য ছাদ দিয়ে আসতে পারে, যদি সিঁড়ির দরজা খোলা থাকে।’

‘হ্যাঁ, তাই এসেছিল। পরমেশের একটা বদ অভ্যাস ছিল। শোভনেশ যখন বীণাকে ন্যুড করিয়ে পোজ দেওয়াত, তখন পরমেশ চুপি চুপি এসে জানলার পাখি তুলে দেখত। আমার সম্পর্কেও এইরকম পারভারশন ওর ছিল। সেদিনও সে নিজেদের বাড়ির জানালা দিয়ে আমাকে স্টুডিয়োর ডিভানে বসে থাকতে দেখে ভেবে নেয় এবার বোধ হয় আমি ন্যুড হব, তাই সে তাড়াতাড়ি ছাদ দিয়ে চলে আসে। কিন্তু ততক্ষণে অন্য ব্যাপার ঘটে গেছে। আমি ছুটে তিন তলার ঘরে চলে এসেছি। পিছু পিছু শোভনেশও তাড়া করে আসছিল। কিন্তু সিঁড়িতেই তার সঙ্গে পরমেশের দেখা হয়ে যায়। সেটা পরে আমি ঝিয়ের মুখ থেকে শুনি।’

‘কী শোন?’ গঙ্গাপ্রসাদ কৌতূহল চাপতে পারলেন না। তাঁর মুখ ঈষৎ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। জল খাওয়া খালি গ্লাসটার দিকে একবার তাকালেন।

‘পরমেশ বলল, ‘কী রে, পেটে বাচ্চচা এসেছে নাকি? প্রথমটাকে তো নির্ঝঞ্ঝাটে পার করা গেছে, এটাকে কী অত সহজে পারবি?’ এই বলেই সে ছাদে উঠে যায়। শোভনেশ চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর নীচে নেমে আসে। …গঙ্গাদা আমাকে আপনি বলেছেন, শোভনেশের প্রথম বউ প্রেগনান্ট কমলা বাথরুমে পিছলে পড়ে মারা যায়। কিন্তু তা নয়। পরমেশের ওই ‘পার করা গেছে’—র সাপোর্ট আমি সুজাতা গুপ্তর কাছেও পেয়েছি। সেও মার্ডারড হয়েছে। আর একটা মিথ্যে কথা।’

রোহিণীর জ্বলজ্বলে উত্তেজিত চোখ থেকে গঙ্গাপ্রসাদ নিজের চোখ সরিয়ে নিলেন। বিড়বিড় করে কী যেন বললেনও। রোহিণীর মনে হল, সে বোধ হয় ঠিক জায়গাতেই ঘা দিয়েছে। এটা আর একটু দেওয়া দরকার।

‘সুভাষ গায়েনকে মার্ডার করার চেষ্টা হয়েছিল? আর সেটা হয় আপনার জালিয়াতি ব্যবসার প্রোপোজাল রিফিউজ করার পরই।’

‘হোয়াট ডু ইউ মীন?’ গঙ্গাপ্রসাদ উঠে দাঁড়ালেন তাঁর ওজনের পক্ষে অবিশ্বাস্য গতিতে। কী ইঙ্গিত করছ তুমি? আমি খুন করার চেষ্টা করেছি? তোমার সাহস সীমা ছাড়িয়ে গেছে দেখছি। আমাকে তুমি খুনি বানাতে চাও?’

‘আমি নয়, সুভাষ গায়েনই এইরকম মনে করে। আর মীনা চ্যাটার্জি মনে করে, শোভনেশের অরিজিন্যাল বহু ছবি কোথাও লুকোনো আছে, এখন একটা—দুটো করে বিক্রির জন্য বাজারে আসছে, দশ—পনেরো হাজার দাম ছিল তিন বছর আগে, এখন আরও বেশি। কেউ একজন মনে হয়, ছবি বিক্রি করে লাভ করছে।’

রোহিণী দেখল গঙ্গাপ্রসাদ রাগে থরথর করে কাঁপছেন। কথা বলার চেষ্টা করেও কিছু আওয়াজ ছাড়া বোধগম্য কোনো শব্দ মুখ থেকে বার করতে পারছেন না। রোহিণী অপেক্ষায় রইল ওঁর ব্লাডপ্রেশার নেমে আসার জন্য।

‘আর কী তুমি বলবে আমার সম্পর্কে?’ গঙ্গাপ্রসাদ অবশেষে আস্ত একটা বাক্য বলার মতো অবস্থায় ফিরে এলেন। ধীরে ধীরে আবার চেয়ারে বসলেন।

‘দিগম্বর বর্ধন লেনের বাড়িটা বিক্রি হয় মামলা চলার সময়ই… না, টাকার কথা তুলব না। বাড়িটা কে কিনল শুধু সেটাই জানতে চাই, আর কত দামে অমন পজিশনের বাড়িটা বিক্রি হল?’

‘তুমি তো অনেক খবরই জোগাড় করেছ, এটাও করে নিয়ো। শোভনেশ জানে কে কিনেছে, কত দামে কিনেছে।’

‘আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

‘কীভাবে করবে?’

‘আপনাকে ফোন করবে আবার। ওকে আমার ঠিকানা দিয়ে বলুন দেখা করতে।’

‘ও তোমাকে বিশ্বাস করে না। তুমি পুলিশে ধরিয়ে দিতে পারো।’

‘না, দেব না। আর যদি তাই মনে করে, তাহলে ফোনেই যোগাযোগ করুক। আমার উপর তলায় ফোন আছে, নম্বরটাও আপনি জানেন। থ্রি সেভেন টু ফাইভ…আচ্ছা, নয় আবার লিখেই দিচ্ছি।’

‘থাক, নম্বর আমার কাছে আছে। কিন্তু এটা তোমার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক হতে পারে। আমি চাই না, শোভু আবার একটা মার্ডারের আসামি হোক।’

‘হবে না। বীণা আর আমি এক জিনিস নই।’ বলার সঙ্গে রোহিণীর হাত আর মুঠি আপনা থেকেই শক্ত হয়ে গেল।

‘ব্রাভাডো দেখবার চেষ্টা করো না রোহিণী, যেমন জীবন চলছে তেমনিভাবেই চালাও। চাকরি করছ, প্রেম করছ, হয়তো বিয়েও করবে। এইসবই করো, কেন একটা বাসি জিনিস ঘেঁটে ঝামেলায় জড়াবে! তুমি বুদ্ধিমতী, সুতরাং বুঝতেই পারছ শেষ পর্যন্ত কোনো লাভ তোমার হবে না, ক্ষতি ছাড়া।’

‘লাভ—লোকসান না খতিয়েই তো জীবনের এতটা পথ পেরিয়ে এলাম। আমি মনে করি না, তাতে ঠকেছি। লোকসানকেও আমি কাজে লাগিয়ে লাভে পরিণত করে নিয়েছি।’

বলতে বলতে রোহিণী উঠে দাঁড়াল। ঝোলাটা কাঁধে গুছিয়ে, হাঁটু দিয়ে চেয়ারটা পিছনে ঠেলে সে আবার বলল, ‘বুঝতে পারছেন নিশ্চয়, আমার পক্ষে আপনার কাছে কাজ করা আর সম্ভব নয়, উচিতও নয়। দুটো লেখার কাজ হাতে রয়েছে, ও দুটো শেষ করে আর আমি এখানে আসব না, আপনার ফ্ল্যাটও ছেড়ে দেব, কিন্তু যতক্ষণ না শোভনেশের সঙ্গে কথা বলছি, ফ্ল্যাট থেকে ততক্ষণ নড়ব না।’

রোহিণী দরজার কাছে পৌঁছেছে, তখন গঙ্গাপ্রসাদ ডাকলেন।

‘কাজ তুমি ছেড়ো না, আমারও তো কাজের লোক দরকার। তবে তুমি বিপদে পড়বে, এইটুকু শুধু বলে দিলাম, মারাত্মক বিপদে পড়বে।’

রোহিণী জবাব দিল না। একটা অদ্ভুত হাসি তার মুখে ছড়িয়ে পড়ল। গঙ্গাপ্রসাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তার মনে হল, এখন তাকে অপেক্ষা করতে হবে দু—জনের জন্য। শোভনেশের আর রাজেনের জন্য।

অফিসে কারোর সঙ্গে কথা না বলে রোহিণী তিন তলা থেকে নেমে রাস্তায় এসে দাঁড়াল। এখন সে কী করবে? ঘড়ি দেখল। বিবাদী বাগের দিকে মন্থর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে সময় কাটাবার উপায় খুঁজতে লাগল। সিনেমায় যেতে পারে, কিন্তু ম্যাটিনি শোয়ে ছবি দেখার বয়স আর নেই। কারোর বাড়ি? দুপুরে ছোটোলোকরাই গল্প করতে লোকের বাড়ি যায়, তা ছাড়া কার বাড়িতেই বা সে যাবে? এখন জাদুঘরে কি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কি চিড়িয়াখানাই হচ্ছে সময় কাটানোর ভালো জায়গা। কিন্তু তার যাবার ইচ্ছে হল না।

মিনিবাস স্ট্যান্ডে দুটো সল্টলেকের বাস দাঁড়িয়ে। সে ফ্ল্যাটে ফিরে যাবার কথা ভাবল। অনেক দিন দুপুরে ঘুমোয়নি, আজ বরং ঘুমোবে। এই স্থির করে সে প্রথম বাসটায় উঠে একমাত্র খালি সিটটায় বসল, যেটায় জানালা পাওয়া যায়। খালি থাকার কারণ, পিছনের চাকার ঢাকাটা একটা চৌকো বাক্সর মতো উঁচু হয়ে আছে পা রাখার জায়গাটায়। বসলে হাঁটু দুটি প্রায় বুকের কাছে এসে যায়। এইরকম বাসও কলকাতা মেনে নিয়েছে, পয়সা দিয়েও মুখ বুজে অস্বাচ্ছন্দ্য সংগ্রহ করে। কী সহ্যশক্তি এই শহরটার! রোহিণী ভাবল, নাকি সিদ্ধার্থ যা বলেছিল সেটাই ঠিক, গোটা কলকাতাটাই ঝিমোচ্ছে! ভালো কথা, সিদ্ধার্থের সঙ্গে এখন একবার তো দেখা করা যায়!

কিন্তু কীজন্য? রোহিণী ভাবতে শুরু করল। দেখা করে কী—ই বা আর সে জানবে? সেই তো একঘেয়ে কয়েকটা কথা। আর তার ভালো লাগছে না এই শোভনেশ আর শোভনেশ। বরং ও সশরীরে আসুক বা ফোনেই কথা বলুক। ওকে সে বলবে, খুন একটা করে ফেলেছ, ভালোই করেছ, বেশ করেছ। প্রতিদিন কাগজ খুললেই গন্ডা গন্ডা খুন আর আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। এসব এখন জলভাত হয়ে গেছে। সুতরাং শোভনেশকে সে বলেই দেবে, তোমাকে নিয়ে কেউ মাথাব্যথা করছে না, পুলিশও বোধ হয় করছে না। যে যার নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। জেল ভেঙে পালিয়েছ, ভালো কাজই করেছ। এখন নিজেই নিজেকে সামলাও, আমি কোনো সাহায্য টাহায্য করতে পারব না। মীনার ঠিকানা দিচ্ছি, সেখানে চলে যাও। সে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ওখানে তোমার চেনা আর একটা লোককেও পাবে। যদি ইচ্ছে হয়, তাহলে সুভাষ গায়েনের চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকি দিয়ে বরং বলতে পারো—তুই ব্যাটা আমাকে দিয়ে আজেবাজে ছবি আঁকাতিস, সেজন্য আমি নষ্ট হয়ে গেছি। অবশ্য পয়সা পেতাম ঠিকই, কিন্তু তোর বউকে সিটিং দেবার জন্য আর তুই পাঠাতে রাজি হলি না কেন রে? জানিস না, ওকে আমি ভালোবাসতাম?

অবশেষে বাসটা ছাড়ল। লালদিঘি চক্কর দিয়ে লালবাজার পর্যন্ত পৌঁছতে এটা এবার যে সময় নেবে, তার মধ্যে একটা ট্র্যাফিক জ্যাম বা একটা লোডশেডিং ভরে দেওয়া যাবে! রোহিণীর কাঁধে রোদ লাগছে। আজ একটা সিরসিরে শুকনো বাতাস বইছে। রোদটা তাই জ্বালাচ্ছে না। শূন্য দৃষ্টিতে সে জি.পি.ও., রাইটার্স বিল্ডিংস, চার্চ, কলকাতা পুলিশের সদর ইত্যাদিতে চোখই শুধু রাখল, দেখল না কিছুই। ইতোমধ্যে সে আবার নিজের ভাবনায় ডুবে গেছে।

এইটুকু শুধু বলে দিলাম, মারাত্মক বিপদে পড়বে—কথাটা বলে গঙ্গাদা কী মিন করতে চাইলেন? দৈহিক বিপদ ছাড়া আর কি বিপদ ঘটা সম্ভব! দৈহিক মানে, খুন। মার্ডার! মৃত্যু! কীভাবে তাকে খুন করতে পারে? তার থেকেও বড়ো কথা—খুন কে করবে, এবং কেন করবে?

গঙ্গাদা? শোভনেশ? কিংবা ধরা যাক, সুভাষ গায়েন? এ ছাড়া আর কোনো নাম তো তার মনে আসছে না। ‘আমি চাই না, শোভু আর একটা মার্ডারের আসামি হোক’ অর্থাৎ গঙ্গাদার ধারণায় শোভনেশই কাজটা করবে। উনি তা আগাম জানলেন কী করে? সুভাষ গায়েনকে বিষ খাইয়ে বা গাড়ি চাপা দিয়ে খুনের চেষ্টা তো অন্য কেউ করেছিল, শোভনেশ নয়।

রোহিণী একটু ফাঁপরেই পড়ল। এইভাবে খুন একা করা সম্ভব নয়, লোক লাগিয়ে করতে হয়। সেজন্য টাকাকড়ির দরকার, পেশাদার খুনিদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকা দরকার। শোভনেশের পক্ষে তা কিছুতেই সম্ভব নয়। সে হুট করে রাগের মাথায় কিছু একটা করে ফেলতে পারে কিন্তু ঠান্ডা মাথায় প্লট ভেঁজে কিছু করা অসম্ভব। তাহলে গঙ্গাদাই কি—!

‘রাম মন্দির, গিরিশ পার্ক, মানিকতলা, কাঁকুড়গাছি…’ কন্ডাক্টরের হেল্পার এমন চিৎকার করে উঠল যে, রোহিণীর ভাবনাটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। সে দেখল, বউবাজার—চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনুর মোড়ে বাস থেমে রয়েছে। রাস্তার ওপরে পাতাল রেলের কাজ চলছে। বিরাট একটা ডাম্পার আঁজলা ভরে রাবিশ তুলে লরিতে ফেলছে, আর তাই দেখতে ছোটোখাটো ভিড় জমে গেছে। রোহিণীও দেখতে লাগল। এই সময়ই চোখে পড়ল কুন্তীকে। হেঁটে চলেছে পুবদিকে ট্রাম রাস্তা ধরে।

কুন্তী এখানে! এখন! কোথায় চলেছে? ওদিকে তো বউবাজার—কলেজ স্ট্রিট মোড়, তারপরই দু—ধারে গহনার দোকান। টাকা জমিয়ে টুকটাক গহনা কেনার অভ্যাস হয়তো আছে। নেমে গিয়ে ওর সঙ্গী হবে কি না ভাবতে ভাবতেই বাস ছেড়ে দিল।

যাক গে, রোহিণী ভাবল, সিদ্ধার্থর লেখাটা পড়ে মিস্ট্রি বার করার মতো ধৈর্য ওর নেই, মাথাও নেই। কিছুটা প্যাঁচালো বুদ্ধি না থাকলে ক্রাইম ডিটেক্ট করা সম্ভব নয়। মেয়েটা খুবই সরল, তাই—ই থাকুক বরং। স্বামী অফিসে গেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে টো টো কোম্পানি করে আবার বিকেলের মধ্যে ঘরে ফিরে যদি জীবনে একটু বৈচিত্র্য আনতে পারে তো আনুক।

রোহিণী তার চিন্তা সরিয়ে নিল কুন্তীর থেকে নিজের উপর। তাহলে গঙ্গাদাই কি টাকাকড়ি খরচ করে সুভাষ গায়েনকে মারার চেষ্টা করেছেন? সন্দেহটা প্রকাশ করে সে কি নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনল? তাই নয়, ছবি জাল করার কথাও কি তোলা উচিত হয়েছে? এতেও গঙ্গাদাকে খুব বিচলিত দেখাল, তার মানে জড়িত। খুনের থেকেও এটা তো কম অপরাধের কাজ নয়। শোভনেশের ছবি বাজারে আসছে কার কাছ থেকে? নিশ্চয় গঙ্গাদার কাছে প্রচুর ছবি লুকোনো আছে। সে নিজেও তো দিগম্বর বর্ধন লেনের বাড়িতে প্রায় চল্লিশ—পঞ্চাশটা ছবি স্তূপ করে রাখা দেখেছিল। গঙ্গাদা বলেছেন, ওগুলো পোকায় কেটে, বৃষ্টির জলে নষ্ট হয়ে গেছে! সব বাজে কথা। বাসদেবপুরে শোভনেশকে নিয়ে গিয়ে রেখেছিলেন, তখনকার আঁকা ছবিগুলোর কী হল? খুন, রক্তপাত যাই আঁকুন না, ছবি তো বটে! দাম তো আছে। গঙ্গাদা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, এইবার প্রশ্ন উঠবে : জাল নয়, আসল ছবিগুলো কোথায় কার কাছে? প্রশ্নটা যে তুলতে পারে, তাকে ধরাধাম থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কি হবে না?

রোহিণী ধীরে ধীরে অবশ হয়ে ঝুঁকে পড়ল। মৃত্যুর কথা মনে আনতে সে চায় না, তবুও মনে এসে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে শক্ত একটা কী যেন ক্রমশ ঢুকছে। একে বোধ হয় ভয় বলা হয়। অবস্থাটা কাটিয়ে ওঠার জন্য সে মনে মনে বলল, ‘আমি একটা ভোঁদা, আমার মাথায় গোবর, আমি মাথামোটা। কপালে হাত রেখে সে ভাবল, আমারই এখন কোথাও পালিয়ে যাওয়া উচিত, খুনিদের নাগাল এড়িয়ে। গঙ্গাদাকে মিথ্যাবাদী বলাটাও ঠিক কাজ হয়নি। সেনগুপ্তদের পাগলের বংশ নয়, এটা মেনে নিলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হত? তা নয়, শোভনেশ গলা টিপে ধরেছিল, তখন ওকে দেখাচ্ছিল পাগলের মতো, প্রত্যেক জেনারেশনে একজন পাগল হয় আর এই জেনারেশনে সেটা হয়েছে শোভনেশ—এইসব কথা বলে গঙ্গাদাকে মিথ্যাবাদী বানিয়ে দেওয়ার কী এমন দরকার ছিল? মাথা গরম হয়ে গেলে যাদের বুদ্ধিশুদ্ধি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়, তারা বিপদে পড়বে না তো আর কে পড়বে? এইভাবেই তো—হ্যাঁ, এই কাণ্ডজ্ঞান লোপের জন্যই আজ শোভনেশের এই দশা!

বাস থেকে নেমে ফ্ল্যাটে ঢোকা পর্যন্ত সময়ের মধ্যেই রোহিণী এই সিদ্ধান্তে পৌঁছল, কেউ যদি মারাত্মক বিপদে তাকে ফেলতে চেষ্টা করে, তাহলে যথাসাধ্য বাধা দেওয়া ছাড়া আর কিছু করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাতে মৃত্যু হয় যদি, হবে। কিন্তু এখন থেকে তাকে চোখ কান খুলে সাবধানে থাকতে হবে। কেন জানি তার মনে হচ্ছে, অশুভ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। রাজেন তাড়াতাড়ি ফিরে এলে সে মনে জোর পাবে। এখন এইটেই তার দরকার।

ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে সে ঝরঝরে তাজা বোধ করল। চা তৈরি করে খেয়ে উপরে গেল সুজাতার সঙ্গে দেখা করতে। দরজা খুললেন হৃদয়রঞ্জন।

‘কেমন আছেন মাসিমা?’

‘একটু ভালো।’ হৃদয়রঞ্জন সরে দাঁড়ালেন রোহিণীকে ভিতরে আসতে দেবার জন্য। খাটে শুয়ে সুজাতা। বাঁ চোখে তুলো আর স্টিকিং প্লাস্টার। হাত দিয়ে খাটের খালি জায়গাটা চাপড়ে বললেন, ‘বোসো।’

‘কী করে পড়লেন?’

‘মাথাটা কেমন যেন ঘুরে গেছিল।’ সুজাতা ধীর স্বরে বললেন। তাঁর ডান চোখটা স্থিরভাবে রোহিণীর মুখভাব লক্ষ করছে। যা দেখতে চেয়েছিলেন, সেটা দেখতে পেলেন বোধ হয়। তাই কোনোরকম ভনিতা না করেই বললেন, ‘তুমি মনে মনে যা ভেবেছ তাই।’

রোহিণী তাড়াতাড়ি তার অপ্রতিভতা কাটাতে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারল না। সুজাতা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলেন।

‘তোমাকে কাল বাসে কয়েকটা কথা বলেছি।’ সুজাতা এই বলে দাঁড়িয়ে থাকা হৃদয়রঞ্জনের দিকে তাকালেন। ‘রোহিণীকে একটু চা করে দাও। তুমি তো এখন অফিস থেকেই আসছ?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু মাসিমা—’ সে থেমে গেল সুজাতার হাতের বারণ দেখে। চা করতে বলাটা আসলে তাঁর স্বামীকে ঘর থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্যই, এটা বুঝতে রোহিণীর অসুবিধে হল না। হৃদয়রঞ্জন ব্যগ্র হয়ে বেরিয়ে গেলেন।

‘আমি দিগম্বর বর্ধন লেনে গেছলাম। অনেক স্মৃতি রয়ে গেছে ওই বাড়িটাকে নিয়ে।’ শান্ত অচঞ্চল, কোমল স্বরে সুজাতা বললেন চোখে হাসির ঝিলিক নিয়ে। ‘একাই গেছলাম। চুপিচুপি, কেউ জানে না। এত বছর পর, খুব অবাক লাগছিল। শোভনেশের অংশটা বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন মালিক মেরামত করে খালিই রেখেছে তালা দিয়ে। পাশে পরমেশদের অংশটা ভেঙেচুরে পড়ছে। বাড়ি সারাবার সামর্থ্য নেই। আর সারাবেই বা কে, পরমেশ তো পাগলের মতো অবস্থায়।’

‘অ্যাঁ!’ রোহিণীর মুখ থেকে বিস্ময়টা নির্গত হল স্বতঃস্ফূর্ত।

‘হ্যাঁ, কঙ্কালের মতো চেহারা হয়ে গেছে। মাথায় চুল নেই। ছেঁড়া ময়লা জামাকাপড়, গায়ে দুর্গন্ধ আর চুলকুনি। মনে হল, ভালো দেখতেও পায় না। আমার সঙ্গে ও কথা বলল, খুবই এলোমেলোভাবে। আমাকে চিনতে পারেনি, পারা অবশ্য শক্তই। কিছু কিছু পুরোনো কথা বললাম স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য, হুঁ হাঁ করল। ওকে দেখাশোনা করছে পুরোনো এক চাকর আর তার বউ।’

‘বিশ্বনাথ আর গীতা?’

‘হ্যাঁ, এই নামই বলল। পরমেশের একতলায় ওরা নাকি পনেরো বছর ধরে একটা ঘরে রয়েছে। আমাকে আর চিনবে কি! বিশ্বনাথ তখন ছিল না, গীতার সঙ্গেই কথা বললাম।’

সুজাতা থেমে রইলেন। মনের মধ্যে কী একটা দ্বন্দ্ব যেন শুরু হয়েছে, সেটা সামলাবার চেষ্টা করছেন। রোহিণী ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

‘জানো, গীতা একটা অদ্ভুত কথা বলল। এটা ওটা বলতে বলতে বীণার খুন হওয়ার কথাটা উঠেছিল। আমি বললাম, শোভনেশ যে এখন কাজ করবে, তা স্বপ্নেও ভাবা যায় না। গীতা হঠাৎ বলল, ‘উনি কেন খুন করতে যাবেন? দোতলা থেকে নেমে বড়দা উঠোন পেরিয়ে যখন গেটের কাছে, তখনই তো মেয়ে মানুষটা জানলা দিয়ে নীচে পড়ল। আওয়াজ পেয়ে বড়দা ছুটে গেল। আমি তো তখন উঠোনের একধারে কাপড় শুকোতে দিচ্ছিলুম।’ রোহিণী, ওর এই কথাটা শুনে আমি তো অবাক! বললাম গীতাকে, তুমি তাহলে এ কথাটা পুলিশকে তখন বললে না কেন? দ্যাখো তো, একটা লোক মিছিমিছি এখনও জেল খাটছে। ও বলল, ‘আমি তো ভয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে তখন কাঁপছি। অমন জিনিস দেখলে ভয় পাব না? কিছু পরে নারানের বাবা এল, তখুনি ওকে সব বললুম। ও শুনেই বলল, চুপ চুপ, মুখে চাবি দিয়ে রাখ। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, আর পুলিশে ছুঁলে আঠারো বছর কোর্টঘর থানা করিয়ে ছাড়বে। তুই বরং এখুনি বাপের বাড়ি চলে যা ছেলেকে নিয়ে, কাউকে মুখ ফসকে একটা কথা বলিসনি। ও বাড়ির ব্যাপারে আমাদের থাকার দরকার নেই। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নারানকে নিয়ে আমি তালতলায় বাপের বাড়ি চলে যাই। সাত দিন পরে ফিরে এসে শুনলাম, বড়দাকে পুলিশ ধরেছে। মনটা যে কী খারাপ হয়ে গেল সেই থেকে। বিশ্বাস করবে না রোহিণী, এই বলে সেই গরিব বউটা কাঁদতে শুরু করল।’

একটা ট্রে—তে দু—কাপ চা নিয়ে ঢুকলেন হৃদয়রঞ্জন। ওরা দু—জন কাপ তুলে নিল।

‘তুমি একবার দারোয়ানকে বলে এসো, কারেন্ট এলেই যেন আমাদের ট্যাঙ্কটায় আগে জল ভরে দেয়।’ সুজাতা নম্রস্বরে স্বামীকে বললেন, ঘরে তার উপস্থিতিটাকে সরিয়ে দেবার জন্য।’

‘একবার বলে এসেছি।’

‘আর একবার বলে এসো।’ সুজাতার কঠিন দৃঢ় স্বর দ্রুত ঘর থেকে বার করে দিল হৃদয়রঞ্জনকে। যেন এইভাবে আদেশ দেওয়াটা নিয়মিত ব্যাপার, এমনভাবে সুজাতা হাসলেন। রোহিণীর মনে হল, চোখের কালশিরাটা বোধ হয় স্বামীকে হুকুম দিয়েই উনি তৈরি করতে বাধ্য করিয়েছেন। নয়তো এমন মিনমিনে লোকের পক্ষে এত সাহস হয় কী করে? সঙ্গে সঙ্গেই আবার তার মনে হল, মাথা গরম হয়ে কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়ে মানুষ অনেক কিছু করে ফেলে।

‘কী বলছিলাম যেন?…হ্যাঁ, গীতা তো কাঁদতে শুরু করল। আমি ওকে বললাম, তুমি বড়দার নতুন বউকে গিয়ে চুপিচুপি বলে দিতে পারতে। গীতা বলল, ‘নারানের বাপ চোখেচোখে রাখত আমায়, খালি শাসাত, খবরদার ওবাড়ির দিকে এক পা বাড়িয়েছিস কি এ বাড়িতে আবার একটা খুন হয়ে যাবে। বড়ো ঘরের ব্যাপারস্যাপারে নাক গলিয়ে লাভ কী? তা ছাড়া নতুন বউও তো বাড়ি ছেলে চলে গেল, আমি আর বলব কাকে? বড়দার এক বন্ধু আসত, মোটা, বেঁটে মতন। সে এসে নারানের বাপের সঙ্গে কথা বলত, আর গাড়িতে করে ছবি নিয়ে চলে যেত।’

‘গঙ্গাদা!’ রোহিণী অস্ফুটে বলল।

‘হ্যাঁ, আমারও তাই মনে হয়েছে। এই ক—বছর গীতা কথাটা গোপন করে রাখার কষ্ট আর সহ্য করতে না পেরে আমার মতো এক বাইরের লোককে পেয়ে বলে ফেলে বুক হালকা করে। তারপর আমি চলে আসি।’

সুজাতা মুখ ফিরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। রোহিণীও অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল এলোমেলো ভাবনায়।

‘আমি বিশ্বাস করিনি। শোভনেশের পক্ষে একাজ কখনোই সম্ভব নয়। এখন দেখছি আমার বিশ্বাসে ভুল হয়নি।’

সুজাতা জানালার বাইরে চোখ রেখেই কথাগুলো বললেন। রোহিণী ফিসফিস স্বরে বলল, ‘এখন আর জেনে কোনো লাভ হবে না। ও তো পালিয়ে রয়েছে।’

‘থাকুক, কিন্তু ওর এই খুনি অপবাদটা মুছে দেওয়ার দরকার।’

‘তাহলে বীণা জানলা দিয়ে নীচে পড়ল কী করে?’

‘আত্মহত্যা করতে পারে! অন্য কেউ ওকে ঠেলে ফেলে দিতে পারে।’

‘অন্য কেউ!’ রোহিণী ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে থাকে, ‘অন্য আর কে আছে ওই বাড়িতে, যে ঠেলে ফেলে দেবে? একটা তো ঝি, তাও সেদিন সে সকালে ছুটি নিয়েছিল। সবথেকে বড়ো কথা, কোর্টে শোভনেশ নিজে স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছে, সে খুন করেছে। বলেছিল, যা শাস্তি দেবার, দিয়ে দিন।’

‘যা খুশি ও বলুক, খুন করেছি বললেই সে খুনি হয়ে যায় না। চাক্ষুষ প্রমাণ দেবার মতো লোক পাওয়া গেছে।’

সুজাতা উঠে বসে হঠাৎই রোহিণীর হাত দু—হাতে ধরে ব্যাকুল স্বরে বলে উঠলেন, ‘রোহিণী একবার চেষ্টা করে দ্যাখো না, পুলিশ আবার তদন্ত করে, নতুন করে মামলাটা তুলুক। যা খরচ হয়, আমি সাধ্যমতো দেব। তুমি ভালো একজন উকিল ঠিক করে তাকে সব কথা বলো। হাজার হোক, তোমার স্বামী তো! তুমি কি চাও না, ও ফিরে আসুক?’

রোহিণী প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল অভাবনীয় অপ্রত্যাশিত এই প্রস্তাবে। ফ্যালফ্যালে ভাবটা তার চোখ থেকে সরে যাবার পর কঠিন চাহনি ফুটে উঠল। নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল।

‘শোভনেশের সম্পর্কে তার প্রেমিকা মোহাচ্ছন্ন থাকতে পারে, কিন্তু স্ত্রীর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তাকে ফিরিয়ে আনার। মাফ করবেন, আমার জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে লোকটিকে আপনি কখনো দেখেননি। বহুদূর থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় অপরূপ দেখায়, কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কাছে গিয়ে দেখার চেষ্টা করুন, দেখবেন কী কর্কশ বিশ্রী পাথর দিয়ে সেটা তৈরি। আমি চললাম।’

রোহিণী ঘর থেকে বেরিয়ে সদর দরজার কাছে পৌঁছবার আগেই শুনতে পেল সুজাতার চিৎকার।

‘আমি যাব? উকিলের কাছে, পুলিশের কাছে। আমার দুটো চোখও যদি নষ্ট হয়, তবু কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না, পারবে না…।’

সুজাতার ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে রোহিণী সিঁড়িতেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বিশ্রী লাগছে তার নিজেকে। আজ দু—দুটো ঝগড়া সে করে ফেলল অল্প সময়ের মধ্যে। গঙ্গাদার সঙ্গে যা হল, সেটা অবশ্য ঠিক ঝগড়ার পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু কীসের পর্যায়ে যে পড়ে, সেটাও সে ঠিক করতে পারছে না। চরিত্র হনন করার মতো কয়েকটা অভিযোগ সে করেছে, তাকে ঝগড়া বলা যায় না। গঙ্গাদা কিছু কিছু উত্তর দিয়েছেন আর প্রচ্ছন্ন ভয় দেখিয়েছেন, ‘মারাত্মক বিপদে পড়বে।’ তাইতে সে হেসেছে। হাসিটা গঙ্গাদা দেখেছেন কী না, তা সে লক্ষ করেনি। চ্যালেঞ্জ নিলাম, এইরকম একটা ঔদ্ধত্য তখন রক্তে টগবগিয়ে উঠেছিল।

এই টগবগানি সবসময়, সর্বত্র দেখানোটা ভালো নয়। একটু ট্যাকটিকাল হওয়া ভালো। জীবন নিয়ে টানাটানির মতো ব্যাপারে খুব ঠান্ডা মাথায়, অগ্রপশ্চাৎ ভেবে পা ফেলতে হয়, কথা বলতে হয়। সিঁড়ি দিয়ে এক পা, এক পা করে নামতে নামতে রোহিণী ভাবল, গঙ্গাদাকে খোঁচানোটা উচিত হয়নি, অন্তত এই মুহূর্তে। শোভনেশ ওঁকে ফোন করেছিল শোনামাত্রই বীরত্ব দেখিয়ে, ‘রোহিণী তার সঙ্গে দেখা করতে চায়’ বলাটাও তার হাঁদামো হয়েছে।

চাবি দিয়ে দরজা খুলতে খুলতে পায়ের আওয়াজ পেল রোহিণী। তুষার দত্তর ছোটো ছেলে উঠে আসছে লাফাতে লাফাতে।

‘অ্যাই শোনো, আমার একটা ফোন আসার কথা আছে, এলেই ডেকে দিয়ো, কেমন?’

‘কখন আসবে?’

কী মুশকিল! এটা তো সে শোভনেশকে জানাবার জন্য গঙ্গাদাকে বলে দেয়নি! করে যদি, তাহলে নিশ্চয় লুকিয়ে—চুকিয়ে রাত্রিবেলাতেই করবে। গঙ্গাদা হয়তো তাই বলে দেবেন।

‘রাতের দিকে আসবে। এলেই কিন্তু—।’

ছেলেটি মাথা নেড়ে ব্যস্ত হয়ে উপরে উঠে গেল। সিঁড়িতে ধাপে ধাপে হৃদয়রঞ্জনের মাথাটা জেগে উঠছে। রোহিণী দাঁড়িয়ে থাকল।

‘আপনি একটু পরে যাবেন, মাসিমা এখন—’

‘কী হয়েছে?’ উদবিগ্ন হয়ে তাকালেন হৃদয়রঞ্জন।’ চোখে কী আবার কিছু হল নাকি?’

‘চোখে নয়।’ রোহিণী গলার স্বর খাদে নামিয়ে এনে বলল, ‘আমার সঙ্গে একটু মতান্তর ঘটেছে, তাইতে আপসেট হয়ে গেছেন।’

‘কেন?’

পলকের জন্য রোহিণীর চাহনি কঠিন হয়েই আবার মৃদু হল। ‘উনি যা চাইছেন, আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়। বোধ হয় কেউই তা করতে চাইবেন না। উনি চাইছেন—’

‘আমি জানি।’

হৃদয়রঞ্জন চশমার পুরু কাচের আড়ালেও তাঁর চোখের জ্বলে ওঠা ঝলকানি গোপন করতে পালেন না। দু—জনে দু—জনের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলেন। তারই মধ্যে রোহিণীর জানা হয়ে গেল পুরুষ ও নারীর মধ্যে লক্ষ বছরের টানাপোড়েনের বার্তা। হৃদয়রঞ্জন নিঃশব্দে নীচে নেমে গেলেন।

এখন বিকেল। এই সময় ঘরে থাকা রোহিণীর জীবনে খুব কমই ঘটেছে। কিন্তু সে যাবেই বা কোথায়, করবেই বা কী? মন এলোমেলো হয়ে গেছে, একটা ব্যাপারেও স্থিরভাবে নিবদ্ধ হতে পারছে না। তার ফলে এক ধরনের অনিশ্চয়তাবোধ ছায়ার মতো তার সঙ্গী হয়ে রয়েছে। অস্বস্তি আর অশান্তির কারণ হয়ে উঠেছে। সবার আগে এই ছায়াটার হাত থেকে রেহাই পাওয়া দরকার। ছড়িয়ে যাওয়া, অগোছাল, মনটাকে সংহত করে আনতে হবে একটা বিন্দুতে।

কী আশ্চর্য, রাজেন তো এই কথাগুলোই একদিন তাকে বলেছিল! একটা সিজন সে রানই পেল না। ক্লাব ক্রিকেটে একটার পর একটা ইনিংস ফেইল করেছে। তারপর রঞ্জি ট্রফির প্রথম খেলা অসমের সঙ্গে। অফ ফর্মে থাকা প্লেয়ারদের ফর্ম ফিরিয়ে দেওয়ার টিম হল অসম। কিন্তু রাজেনকে ব্যাটিং ফর্ম ফিরিয়ে দিতে পারল না। দু—ইনিংসে তার রান হল, তিন আর এগারো। এই সময় কে যেন রাজেনকে প্রোগ্রেসিভ রিল্যাকসেসন পদ্ধতির কথা বলেছিল।

‘সেটা আবার কী জিনিস?’ রোহিণী জিজ্ঞাসা করেছিল রাজেনকে। সন্ধ্যাবেলায় ওরা তখন বুড়ো হিলম্যানে চেপে বাবুঘাট থেকে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিল গঙ্গার ধার দিয়ে। ‘বলছি, আগে গাড়িটা পার্ক করার একটা জায়গা বার করি।’

গাড়ি রেখে দু—জনে, খোঁজাখুঁজি করে একটা বেঞ্চ পায়, যার কাছাকাছি লম্বা গাছ থাকায় জায়গাটা আলো—আঁধারি মধ্যে পড়ে গেছে। বেঞ্চে অল্পবয়সি দুটি ছেলেমেয়ে বসেছিল। রোহিণী বসল বেঞ্চের মাঝখানে, ছেলেটিকে ডাইনে আর রাজেনকে বাঁদিকে রেখে। ছেলেটি তখন অস্বস্তি ভরে আর একটু সরে গেল মেয়েটির দিকে। সরে গিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলা চালিয়ে যেতে থাকে। রাজেন কানের কাছে মুখে এনে বলে, ‘খবরদার কানটা যেন ওদিকে না যায়।’

‘কেন, অন্যের কথা শোনাই কি আমার অভ্যাস?’

‘তা নয়। ওদের দ্বারা প্রভাবিত হলে নিজের ওরিজিন্যালিটি নষ্ট হবে। আমি তো ওইজন্য ভয়ে বাংলা গল্প—উপন্যাস পড়িই না। প্রেমের ডায়লগগুলো এত ডাল, একঘেয়ে!’

‘আর সেইজন্যই বাংলা গল্প—উপন্যাসের এই দুর্দশা। ভালো করে প্রেম করবার মতো নায়কই আর খুঁজে পাচ্ছে না বাঙালি লেখকরা।’

‘তার জন্য কি আমি দায়ী নাকি?’

‘তোমার মতো রসকষহীন ওরিজিন্যাল লোকের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে, সুন্দর সুন্দর মিথ্যে কথাও আর এখন ছেলেরা বলতে পারে না। আমার পাশে এখন কী কথা চলছে, জান? রোহিণী ঝুঁকে রাজেনের কাঁধে মুখ ঠেকিয়ে বলেছিল।

‘আস্তে বলো, আস্তে, মুখটা আর একটু তোল, হ্যাঁ… কী কথা বলছে?’

‘এত কম স্যালারিতে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাচ্চচাকে পড়ানোর প্রেশার নিতে পারবে না। …রাজেন এটা পাবলিক প্লেস, মুখ সরাও…হ্যাঁ, তাহলে বোঝো কাণ্ড। বিয়েই হল না এখনও, আর কিনা তর্ক জুড়ে দিয়েছে। আরে বাবা, এখন গঙ্গার ধারে বসে বলবি তো—নিশ্চয় পড়াব, পুরো মাইনেটাই স্কুলে দেব। সাখাওয়াতে পড়াব, সাউথ পয়েন্টে পড়াব, প্র্যাট মেমোরিয়াল, ক্যালকাটা গার্লস, বয়েজ, শ্রী শিক্ষা, হিন্দি হাই, লা মার্ট, সেন্ট জেভিয়ার্স, দার্জিলিং যেখানে তোমার ইচ্ছে—বাচ্চচাকে সেখানেই পড়াব, বাচ্চচা গড়গড়িয়ে ইংরিজি না বলা পর্যন্ত আমাদের এই ভালোবাসা পূর্ণতাই পাবে না। এইসব এখন বলে যাবে। তা নয়, বলছে কিনা প্রেশার নিতে পারব না!’

‘প্রেশার! প্রেশারের কথা বলল?’ রাজেন নড়েচড়ে বসে। ‘আমার দশায় পড়েছে তাহলে। জানো, আমার এক সাইকোলজিস্ট বন্ধুর কাছে গত বছর গেছিলাম। একদমই তখন রান পাচ্ছিলাম না। লিগ ম্যাচে, একটা মাত্র ফিফটি, বাকি সব দশ, পনেরো, তিরিশ। ভয়, উদবেগ, অনিশ্চয়তা, কনফিডেন্সের অভাব, এইসব থেকে শরীরে আর মনে যে স্ট্রেস তৈরি হয়, তার খানিকটা দূর করার জন্য বন্ধুটি আমাকে প্রোগ্রেসিভ রিল্যাকসেসনের কথা বলল। ব্যাপারটা হল, প্রথমে একটা নির্জন শান্ত জায়গা বেছে নাও, যেখানে অন্তত পনেরো কুড়ি মিনিট কেউ আসবে না। ভালো হয় নিজের ঘরে দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে দাও। হাত, পা, ঘাড় একটু ছড়িয়ে নাও ব্যায়াম করে। তারপর বাবু হয়ে বসো কী চিৎ হয়ে শোও। চোখ বন্ধ করো। গভীরভাবে আস্তে আস্তে শ্বাস টানো আর ছাড়ো। রিল্যাকস। শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ভেবে যাও শরীর থেকে সব টেনশন, উদবেগ, দুশ্চিন্তা তুমি বার করে দিচ্ছ। এই সময় বিশেষ কোনো কিছু নিয়ে একদম চিন্তা করবে না। যা মনে আসছে আসুক আবার চলেও যাক, ভাবনাচিন্তা আঁকড়ে থাকবে না। এভাবে দশ—পনেরো মিনিট শরীরটা আগলা করে ছেড়ে দিয়ে, শরীর শক্ত করো, পাঁচ সেকেন্ড, টানটান করো। ব্যস। দিনে দু—বার, পারলে তিনবার এটা করা দরকার। এতে শরীর রিল্যাকসড হয়, টেনশন কমায়।’

‘এই করেই তুমি ফর্ম ফিরে পেলে? রোহিণীর কাছে ব্যাপারটা হেঁয়ালি মনে হয়। এক সহজেই কী স্ট্রেস কাটিয়ে রাজেন রানে ফিরে এল?

‘আরে না না, শুধু কী এই? নিজের সঙ্গে অনবরত কথা বলতে হয়েছে, অনবরত বলতে হয়েছে আমি রান পাব, পাবই; জিতব, জিতবই। এটা হল, পজিটিভ অ্যাফারমেশন। সজ্ঞানে ক্রমাগত অবচেতনে ইতিমূলক এইরকম ধারণা ঢুকিয়ে দিলে, আচরণে এর প্রভাব পড়বেই। সেজন্য অবচেতনকে এমনভাবে তৈরি করা, যাতে মোটিভেশনের আর কনসেনট্রেশনের জন্য হারার ভয়, নার্ভাসনেস, উদবেগ, ইনজুরির ভয়, নিজের উপর রেগে যাওয়া এইসব নেগেটিভ ব্যাপার দূর করতে এই পজিটিভ অ্যাফারমেশনকে দরকারের সময় কাজে লাগানো যায়। প্রোগ্রেসিভ রিল্যাকসেসনের সময় সাহস আর কনফিডেন্স তৈরি করার মতন কিছু কথা বার বার মন্ত্রের মতো আউড়ে অবচেতনে গেঁথে দিতে হয়।’

‘রাজেন, তোমার কথাগুলো খুবই উপকারী। কিন্তু এখন এইখানে বসে এগুলো মাথায় ঢোকানোর মতো অবস্থা আমার অবচেতনে নেই। তার কারণ কোনোরকম ভয়, উদবেগ, কনফিডেন্সের অভাব আমি আপাতত পাচ্ছি না।’

‘এত নিশ্চিতভাবে বলছ কী করে? ভয়টয় তো একদিন পেতেও পার। এই যে আমি ফর্ম হারিয়ে ছিলাম, সেটা এখন এক ভয় থেকেই যা আমি কল্পনাও করিনি কখনো।’

‘কি ভয় থেকে?’

‘রোহিণী নামে এক ভদ্রমহিলার হৃদয় জয় করতে পারব কী পারব না! ভাবতে ভাবতে ব্যাটিং কনসেনট্রেশন নষ্ট হল, টেনশন শুরু হল, ভয় ধরতে লাগল, ক্যাচ ফেলতে লাগলাম, রান আউট হলাম, রান আউট করালামও…’

‘হুমম। আর কী কী হল?’

‘সে বিরাট লিস্টি, সব এখন অবচেতন থেকে তুলে আনতে হবে, আমার অত সময় নেই।’

‘হাত ছাড়ো। পাশে লোক অসভ্যতা কোরো না।’

‘সাইকোলজিস্ট বলল, পজিটিভ অ্যাফারমেশন চাই। দিনরাত শুধু বলে যাও, রোহিণী, রোহিণী, আই মাস্ট উইন হার হার্ট, আই মাস্ট… আই মাস্ট…’

‘তা উইন হয়েছে কি?’

‘না। কারণ, হার হার্ট ইজ মাচ মাচ টাফার দ্যান গাওসকরস ডিফেন্সিভ ব্যাট, মাচ মাচ ক্রুয়েলার দ্যান ভিভ রিচার্ডসেস অ্যাগ্রেসিভ ব্যাট, মাচ মাচ…কী বলব…সোনিয়া গান্ধীর মুখেও হাসি দেখেছি কল্পনা করতে পারি, শাবানা আজমি পেটে বাচ্চচা নিয়ে শাড়ি পরে শুয়োর তাড়াতে তাড়াতে সাঁতরে গঙ্গা পার হচ্ছে দেখেও হাসি চাপতে পারি, কিন্তু এই ভদ্রমহিলার হৃদয় যে কী বস্তুতে গড়া, তা আজও বুঝতে পারলাম না।’

‘তার মানে পজিটিভ অ্যাফারমেশন তোমার ওপর কাজ করল না, তার মানে ফর্মও ফিরে পেলে না… তাহলে বেঙ্গল টিমে চান্স পাও কী করে?’

‘রান করে।’

‘রান পাচ্ছ তাহলে?’

‘পাচ্ছি, কিন্তু ওগুলো কি রান? ওকে কি রান বলা উচিত? একটা রানের পিছনে হৃদয় নেই, একটাও অন্তর দিয়ে পাওয়া নয়।’

‘রিল্যাক্স, রিল্যাক্স রাজেন…উত্তেজিত হয়ে পড়েছ, আর এক মিলিমিটার এগিয়েছ কী আমার পাশের দু—জন প্রতিবাদ জানাতে উঠে পড়বে, তখন কিন্তু বিপদ আসবে।’

‘কীভাবে আসবে।’

‘ওই জায়গায় দুটো খিটখিটে বুড়োবুড়ি এসে যদি বসে!’

রোহিণী হাসতে শুরু করল। রাজেনের কথা ভাবতে ভাবতে সে ভুলে গেছিল তার চারপাশের জগৎকে। ঘটে যাওয়া এতরকম ঘটনা, তাই থেকে বেরিয়ে আসা নানারকম উদবেগ, উৎকণ্ঠা, ভয়, সবগুলো জড়ো হয়ে মনের উপর একটা চাপ, যেটা ছায়ার মতো অনবরত তার সঙ্গী হয়ে ঘুরছে—সব সে ভুলে গেছিল কিছুক্ষণের জন্য রাজেনের পাশে বসে।

একথা ঠিক, রাজেন একবার সাইকোলজিস্টের কাছে গেছিল, যখন হঠাৎই ফর্ম হারিয়ে রান পাচ্ছিল না। রোহিণী ভেবে দেখল, এখন তার মানসিক অবস্থাটা ঠিক তখনকার রাজেনের মতো হয়ে উঠেছে, ভয় ধরছে, প্রত্যয় নেই নিজের উপর, কী হয় কী হয় একটা উদবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। মনের মধ্যে একটা আলোড়ন, রাজেন বলেছিল, একে নেগেটিভ ইমোশন বলে, এটা মন থেকে বার করে দিতে হয়। সেজন্য কারোর কাছে ভয়ের কথা, উদবেগের কথা স্বীকার করতে পারলে খুবই ভালো হয়। কিন্তু এখন সে কার কাছে মন খুলে কথা বলবে? তার একান্ত হিতার্থী, শুভার্থী, বন্ধু বলতে তো একজনও নেই, রাজেন ছাড়া!

নেগেটিভ ইমোশনের খর্পরটা আলগা করার জন্য রাজেন অবচেতনাকে তৈরি করত ইতিবাচক কথা অবিরত আউড়ে,আর তার নিজের সফল ব্যাটিংয়ের দৃশ্য চোখের সামনে ভাসিয়ে তুলে। রোহিণীকে সে বলেছিল, ‘চোখ বুজে দেখতাম, ইডেনে খেলা হচ্ছে ভারত বনাম বিশ্ব একাদশ। গাওস্কর আর আমি ভারতের হয়ে ওপেন করতে নেমেছি। বল করবে লিলি আর অ্যান্ডি রবার্টস। গাওস্কর রবার্টসের বল ফস্কাচ্ছে, প্যাডে লাগাচ্ছে, ক্যাচ তুলে বেঁচে যাচ্ছে। আঁকুপাকু করে কোনোরকমে টিকে রইল। আর আমি লিলিকে পরপর দুটো স্ট্রেট ড্রাইভ করে একটা হুক, একটা কাট করলাম। প্রথম ওভারেই ষোলো রান নিলাম। এইভাবে কল্পনায় হ্যাডলি, ইমরানকেও খেলতাম। সবাই তুচ্ছ আমার কাছে। তারপর মনে মনে বলতাম, সব বোলার আমার চাকর, পিটিয়ে সব বোলারের চামড়া তুলব। আমি ধীরে, স্থির শান্ত মনে ক্রিজে থাকব। কনসেনট্রেশনের আমার কোনো খুঁত নেই—।’

রোহিণী ঘরের মেঝেয় চিৎ হয়ে শুয়ে, সায়ার দড়ি খুলে দিয়ে চোখ বুজল। শরীর আলগা, শ্বাস—প্রশ্বাস গভীরভাবে ধীরে ধীরে। এই পর্যন্ত তার ঠিকই হয়েছে, এবার পজিটিভ করা অবচেতনে নামিয়ে গেঁথে দিতে হবে। কী বলবে সে? একটু নাভার্স হয়েই সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য ফিসফিস করে বলল: শোভনেশকে ভয় করি না। কে শোভনেশ?

গঙ্গাদাকে ভয় করি না। কে গঙ্গাদা?

সুভাষ গায়েন ফের মিথ্যা কথা বললে ধরে ফেলব। বোকা ভেবেছে নাকি?

শোভনেশ ফোন করলে কড়া জবাব দেব। বলব, আমার দুটো অ্যালসেশিয়ান, একটা ডোবারম্যান আছে, কামড়ে দিলে আমি কিন্তু দায়ী হব না।

কিন্তু অবচেতনে মিথ্যে কথা জমানোটা কি উচিত হবে? রোহিণী মনে মনে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে কুকুর বাতিল করল। রিভলভার আছে, ছোরা আছে, এসবও বলবে না ঠিক করল। তাহলে পজিটিভ স্টেটমেন্ট আর কী হতে পারে?

সে চোখ খুলল। অনুভব করল, মোটেই নিজেকে রিল্যাকসড মনে হচ্ছে না, মনের মধ্যে সাহস, ভরসা কিছুমাত্র জমেছে বলেও মনে হচ্ছে না। হঠাৎই এইভাবে নিজেকে বদলে নেওয়া যে যায় না, দিনের পর দিন অভ্যাসের মধ্যে থেকে অবচেতনকে গড়ে তুলতে হয়, রোহিণী তা বুঝতে পারল। এখন পুরো নগ্ন হয়ে আধ ঘণ্টা মেঝেয় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে হয়তো হালকা স্বচ্ছন্দ হতে পারবে।

যেমনই ভাবা, সঙ্গে সঙ্গে সে তাই করল। মেঝেয় শুয়ে সে ঘাড় থেকে গোড়ালি পর্যন্ত কঠিন শীতল স্পর্শটা সইয়ে নিয়ে দুই মুঠি বুকে জড়ো করে রাখল। এবার নেগেটিভ ইমোশনগুলো বার করে দিতে হবে।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঘরের আসবাব আবছা দেখাচ্ছে। হাতে লেখার কাজ রয়েছে, সেজন্য কিছু ভাবা, কয়েকটা মহারানির সংখ্যা দেখা আর দু—তিনজন লোকের সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু কিছুতেই এখন সে এসবে মন বসাতে পারবে না। একটা টেলিফোন কলের জন্য তাকে এই অন্ধকার ঘরে চুপচাপ অপেক্ষা করে থাকতে হবে।

শোভনেশ কেন তার সঙ্গে কথা বলতে চায়? রোহিণী চেষ্টা করল কারণটা খুঁজে বার করতে। তাদের দু—জনের মধ্যে সম্পর্কটা শেষদিকে এমনই বিষিয়ে উঠেছিল যে, শোভনেশ পুলিশ হাজতেও তার সঙ্গে দেখা করেনি। কাগজে কাগজে ফলাও করে তখন এই খুন নিয়ে সত্যি—মিথ্যে গল্প ছাপা হচ্ছিল। তাই পড়ে মরমে মরে যাচ্ছিল রোহিণী আর নিজের অদৃষ্টকে ধিক্কার দিচ্ছিল। যাই হোক, একসময় সেসবও ধুলোচাপা পড়ে গেল। ফিসফাস, কানাকানি বন্ধ হল, তারপর সেও বোম্বাই চলে গেল। সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে এসে ভালোই দিন কাটছিল, কিন্তু হঠাৎ আবার শোভনেশ রাহুর মতো তার জীবনে ফিরে এল কেন?

ভাবনার জাল বুনতে বুনতে রোহিণী অন্ধকার ঘরে কতক্ষণ সময় যে অতিবাহিত করল তা সে জানে না। দরজার বেল বেজে উঠতে তার জালবোনা থেমে গেল। ধুত্তোর ছাই! এইসব চিন্তা করে কি নেগেটিভ ইমোশন মন থেকে বার করা যায়? ধড়মড়িয়ে উঠে ম্যাক্সিটা মাথা দিয়ে গলাতে গলাতে সে ভাবল, কে এল এখন? হৃদয়রঞ্জন? সুজাতা? কুন্তী? শোভনেশ যে নয়, এটা সে ধরে নিতে পারে। আলো জ্বেলে সে দরজার আই হোল দিয়ে দেখল, তুষার দত্তর ছোটোছেলে।

‘আন্টি, আপনার ফোন।’

ধড়াস করে উঠল রোহিণীর বুক, শোভনেশের ফোন? কিন্তু এত তাড়াতাড়ি গঙ্গাদা ওকে খবর দিলেন কী করে? মাত্র তো আজ দুপুরেই সে বলেছে শোভনেশের সঙ্গে দেখা করতে চায়। ইতিমধ্যেই কি আবার গঙ্গাদাকে ফোন করে তার ফোন নাম্বারটা পেয়ে এখন তাকে ফোন করছে?

‘কে ফোন করছে? নাম বলল কি?’

‘না। শুধু বলল নীচের তলায় রোহিণী সেনগুপ্তকে দয়া করে একবার ডেকে দেবেন? খুব জরুরি দরকার।’

‘পুরুষ না মেয়ে?’

‘পুরুষ।’

‘আচ্ছা যাচ্ছি। কে কে আছে তোমাদের ঘরে?’

‘বাবা ছাড়া সবাই আছি।’

ছেলেটি ছুটে উপরে উঠে গেল। দরজার চাবিটা হাতে নিয়ে একপা একপা করে রোহিণী সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে নিজেকে বলল, ‘স্টেডি রোহিণী, স্টেডি…বী কাম, ভয় পেয়ো না। লোকটা অনেক দূরে, তোমায় সে দেখতে পাচ্ছে না, হাত বাড়িয়ে তোমার গলাও ধরতে পারবে না।… ঠান্ডা মাথায় কথা বলবে, আগে বুঝতে চেষ্টা করো ও কী করতে চায়, তারপর সেইমতো জবাব দেবে। দরকার হলে কঠিন হবে, কর্কশ গলায় নিজেকে প্রকাশ করবে, ভয়ও দেখাবে।

‘হ্যালো।’ রোহিণীর স্বর কেঁপে গেল এইটুকু শব্দ বার করতেই। ওধারে ঘরঘর শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন লং ডিস্টান্স কল। আবার সে বলল, ‘হ্যালো।’

হঠাৎ ঘরঘরানিটা থেমে গেল। ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠ পরিষ্কারভাবে ভেসে এল, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘আমি রোহিণী, আমি রোহিণী।’ রোহিণী ফোনটা কানে চেপে ঝুঁকে পড়ল। স্বরটা তার খুব চেনা।

‘আমি রাজেন।’ একটা ইঙ্গিতময় নীরবতা রিসিভারে বিরাজ করল। বক্তা যেন আশা করছে বিস্মিত অভিব্যক্তির ও উচ্ছ্বাসের একটা প্রকাশ।

‘গলা শুনেই আমি বুঝতে পেরেছি তুমি। ওহহ—কী ভীষণভাবে যে আমি চাইছিলাম একটা ফোন কল!’

‘কার কাছ থেকে?’ চিমটি কাটা প্রশ্ন এল।

‘তোমার কাছ থেকে। না না, অন্য কারোর কাছ থেকে।’ রোহিণী চিমটির জবাব দিল আর সঙ্গে সঙ্গে শোভনেশের মুখটা তার মনে পড়ল।

‘কে সেই পাপিষ্ঠ নরাধম ভাগ্যবান, যার কণ্ঠস্বর শোনার জন্য আকুল অপেক্ষায় ছিলে?’

‘রাজেন কালীঘাট কী দর্জিপাড়া থেকে নয়, জয়পুর থেকে বোধহয় ফোন করছ, তাই নয়?’

‘অবশ্যই। তোমার কী ধারণা, জয়পুর যাবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি জয়নগরে গিয়ে বসে বসে মোয়া খাচ্ছি?’

‘না, তা খাচ্ছ না। জয়পুরেই সম্ভবত গেছ। কিন্তু টেলিফোন চার্জ কত পড়বে, সেটা জেনে নিয়েছ কি? টাকাটা কি সিএবি দেবে, না নিজের পকেট থেকে দিতে হবে?’

‘এ প্রশ্ন কেন? টাকা তো আমিই দেব?’

‘তাহলে চটপট কাজের কথাট বলে নাও। আমাদের দেশে টেলিফোন ব্যবস্থাটা এমনই, যেকোনো সময় লাইন কেটে যেতে পারে। সুতরাং দরকারি কথাটা আগে সেরে নাও।’

‘রোহিণী…’। নীরবতা।

‘বলো।’

ওধার থেকে কোনো সাড়া এল না। রোহিণী রিসিভার কানে চেপে ব্যগ্র স্বরে বলল, ‘রাজেন, কী হল? বলো?’

‘তোমায় ভালোবাসি।’

রোহিণীর সারা দেহ অবশ হয়ে এল। বুকের মাঝখান থেকে তুবড়ির রঙিন ঝাড়ের মতো একটা আলোর উচ্ছ্বাস তার দেহের প্রতিটি কোষে আনন্দের খবর পৌঁছে দিচ্ছে। এখন সে কথা বলবে কী করে?

‘রোহিণী, কী হল? কথা বলো?’ উৎকণ্ঠিত স্বর ভেসে এল।

‘রাজেন, আবার বলো।’ আবেশ জড়ানো বিহ্বল গলায় উত্তর দিল।

‘তোমায় ভালোবাসি।’

‘বলার জন্যই তো সোজা মাঠ থেকে ছুটে এসেছি টেলিফোন অফিসে। আধ ঘণ্টার চেষ্টায় লাইন পেলাম। আজ প্রথম দিনে আমরা চার উইকেটে দুশো একাত্তর। তার মধ্যে আমার…’।

‘আহ থামলে কেন?’

টেলিফোন অপারেটর মেয়েটি গড়গড় করে কী যেন হিন্দুস্থানি ইংরিজিতে বলে উঠল। রাজেন তাকে ‘প্লিজ কন্টিনিউ’ বলল।

‘হ্যালো রাজেন…তোমার রান কত? এই এক বদ অভ্যেস তোমার, আসল কথাটা না বলে যত্ত সব আগডুম বাগডুম শুরু করবে।’

‘তোমাকে কি বলে এসেছিলাম?’

‘কী আবার বলেছ!…ওহ, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কৈলাস মাট্টুর প্রথম ওভারে প্রথম বলেই ব্যাট নামাবার আগেই…তারপর বোকা মতো মুখ করে ফিরে আসছ…তা ফিরে এসেছ তো? জানি আমি প্রথম বলেই তুমি… ফিরে আসার সময়কার মুখটা দেখতে পেলাম না এই আফশোসটা সারা জীবনের জন্য রয়ে গেল। সারাক্ষণ শুধু অসভ্যতা করার চিন্তা যারা করে, এক মুহূর্তের জন্য যারা সিরিয়াস হতে পারে না, তারা কনসেনট্রেট করবে কী করে? প্রোগ্রেসিভ রিল্যাকসেসন, পজিটিভ অ্যাফারমেশন—শুধু বড়ো বড়ো কথা। সাব কনসাসে ঢুকে আছে তো একটা জিনিসই, রোহিণীর সঙ্গে বাঁদরামো কী করে করব, তারই প্ল্যান।’

‘টেলিফোন চার্জ কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে।’

‘বাড়ুক আমি দিয়ে দেব। তা প্রথম বলেই না দ্বিতীয় বলে?’

‘শেষ বলে।’

‘ওহ, প্রথম পাঁচটা বল তাহলে মাট্টুকে করতে হয়েছে। একটা দুটো রান করেছ তো, নাকি গোল্লা?’

‘গোল্লা, দুটো গোল্লা।’

‘দুটো কেন? একটা তোমার আর একটা আমার জন্য?’

‘ঠিক একশো করলে, একের পর দুটো গোল্লাই তো বসে!’

‘তার মানে!’

‘মানে দিনের শেষ বলে মাট্টুকে স্কোয়ার লেগে ফ্লিক করে, ঠিক গাওস্কারের মতো, একটা রান নিয়ে নিরানব্বুই থেকে একশোয় পৌঁছে ড্রেসিং রুমে ফিরে এসে প্যাড খুলে, স্টেডিয়ামের অফিস থেকে ফোন করার চেষ্টা করে, লাইন না পেয়ে, এখানকার একজনকে সঙ্গে নিয়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে চলে এসেছি শুধু একটা কথাই কলকাতার একজনকে বোঝাতে: রুনি, আমি তোমায় ভালোবাসি।

‘ইউ গট আ সেঞ্চুরি! তুমি, তুমি…রাজেন, রাজেন!’

‘অ্যান্ড ইটস ফর ইউ। আমি বলছিলাম পারব, দ্যাখো পারলাম। ক্লিন অ্যান্ড অনেস্ট, আনব্লেমিশ, স্পটলেস… আমার ভালবাসার মতো। দুশো ছত্রিশ বল খেলে মাত্র তিনটে চার, বুঝতে পারছ কীভাবে নিজেকে অ্যাপ্লাই করেছি। বলেছিলাম, বাজি ধরো, আমি করবই। তুমি ভয় পেয়ে রাজি হলে না বাজি ধরতে, আমাকে তো বিশ্বাসই কর না… এ কি রুনি কাঁদছ, রুনি তুমি কাঁদছ!’

‘না কাঁদিনি। আমি ভীষ শক্ত মেয়ে রাজেন।’ চোখ থেকে নেমে আসা জলের ধারা বাঁ হাতে মুছে নিয়ে রোহিণী বলল। ‘সামান্য তো একটা সেঞ্চুরি, এতেই আমি কাঁদব নাকি? কত কঠিন পরিস্থিতি আমি ফেস করেছি, আমার জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে, যাচ্ছেও, এক ফোঁটা চোখের জলও আমার পড়েনি। আজই বা পড়বে কেন?’

‘তুমি কি সুখী হয়েছ? রুনি, শুধু এইটুকুই জানতে চাই। …কথা বলো, উত্তর দাও।’

গলা থেকে চিবুক হয়ে টপটপ ঝরে পড়ছে চোখের জল। কথা বলার মতো অবস্থা রোহিণীর আর নেই। দুটি কাঁধ আবেগ চাপার চেষ্টায় থরথর কাঁপছে।

‘সারা দিনে প্রথম কখন তোমাকে মনে পড়ল জান? শেষ রানটা কমপ্লিট করে স্কোরবোর্ডের দিকে তাকিয়েই দেখি ওখানে তোমার মুখ। তার আগে পর্যন্ত ডেলিবারেটলি তোমাকে মন থেকে মুছে ফেলে দিয়েছিলাম। শুধু একলব্যর মতো আমি কনসেনট্রেট করে গেছি আমার গোলের দিকে। ভাগ্যিস ওটা ছিল দিনের শেষ বল। আর একটা বল খেলতে হলেই আমি অবধারিত বোল্ড হতাম।’

‘কেন?’

‘তখন আর নিজেকে বেঁধে রাখতে পারতাম না। পাগল হয়ে যাব মনে হচ্ছিল, কমপ্লিট পাগল।’

‘না না।’ হঠাৎ রোহিণীর কান্না বন্ধ হয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এল আতঙ্কমাখা দুটো শব্দ।

‘একদম এসব কথা এখন আর ভাববে না। একদম আর ফোন করবে না। কথা দাও।’

‘সে কী! এখনই তো বেশি করে ফোন করব।’

‘না রাজেন, না। আমি আর পাগল নিয়ে ঘর করতে চাই না। ওই শব্দটা তুমি আমার কাছে আর উচ্চচারণ করবে না। ম্যাচ শেষ হলেই প্রথম যে ফ্লাইট পাবে, তাইতে চলে আসবে।’

‘কোথায় আসব?’

‘আমার কাছে।’

‘অসম্ভব, এখানে প্রচুর সুন্দরী মেয়ে খেলা দেখছে। গলিতে রাবারের বলের ম্যাচে হাফ সেঞ্চুরি করলেই মেয়েরা অটোগ্রাফ চায়, আর আমি তো ফুল সেঞ্চুরি করেছি, অটোগ্রাফ দেবার জন্য ভাবছি দুটো দিন থেকে যাব।’

‘এখানে এসে ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের রেজিস্ট্রি বুকে আগে অটোগ্রাফ দিয়ে তারপর পৃথিবীর যাবৎ সুন্দরীদের প্রাণভরে অটোগ্রাফ দিয়ো…কন্টিনিউ প্লিজ অপারেটর, কন্টিনিউ…দমদমে নেমেই সোজা আমার কাছে চলে আসবে। এখন ফ্ল্যাটেই সারাক্ষণ আছি, কেননা চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। কয়েক দিনের মধ্যে ফ্ল্যাটটাও ছাড়ব। তুমি এসো তখন সব বলব।’

‘চাকরি ছেড়েছ? মনে হচ্ছে গুরুতর কিছু ঘটেছে?’

রাজেনের কণ্ঠে উদবেগ ফুটে উঠেছে। রোহিণীর মনে হল, চাকরি ছাড়ার খবরটা রাজেনকে দিয়ে সে ভুল করল। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের মাঝখানে এটা শুনে, ওর পক্ষে মন লাগিয়ে খেলা আর সম্ভব হবে না। নিশ্চয় নানান রকম আজেবাজে অনুমান শুরু করে সেঞ্চুরি পাওয়ার আনন্দটা নষ্ট করবে। যা সিরিয়াস ছেলে!

‘রাজেন, এখনও চাকরিটা ঠিক ছাড়িনি, কিন্তু ছাড়ব ছাড়ব অবস্থায় এসেছি। ঠিক করেছি আর চাকরি নয়, বিজনেস করব। আমি আর কুন্তী…ওহহ কুন্তী হল নীচের সেই ইয়ুপ্পির বউ, খুব ভালো মেয়ে। প্রস্তাবটা কাল ওই দিল, সল্ট লেকে মেয়েদের জন্য একটা হেলথ ক্লাব খোলার।’

‘আমি কি সেখানে ইনস্ট্রাকটারের কাজটা পাব?’

‘না। মেয়েদের জন্য ক্লাব, সেখানে দারোয়ানের চাকরিও তুমি পাবে না।’

‘তাহলে নট ইন্টারেস্টেড ইন ইওর বিজনেস ভেঞ্চার।’

‘তা হবে কেন, তোমার ইন্টারেস্ট তো শুধু—’ কথার মাঝে থমকে কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে গলা নামিয়ে রোহিণী বলল, ‘রাজেন, আমি গভীর সুখে এখন আচ্ছন্ন, আজ আর ঝগড়া করতে ইচ্ছে করছে না। তুমি আমাকে আর উসকানি দিয়ো না।’

‘তুমি যে সত্যিই সুখী হয়েছ, এইবার সেটা বুঝতে পারলাম, আমাকে ধাতাবার এমন সুযোগ হাতে পেয়েও ছেড়ে দিচ্ছ দেখে।’

‘দিচ্ছি, তার কারণ তোমার মতো মনের উপর এমন কমান্ড, এত ভয়ংকর ইচ্ছাশক্তি আমার নেই। ঝগড়া করে এমন মানুষের সঙ্গে পারা যায় না।’

‘রুনি, আজ প্রত্যেকটা রান আমি হৃদয় দিয়ে কালেক্ট করেছি, প্রতিটি স্ট্রোক আমার অন্তর সুখে ভরিয়ে দিয়েছে, এসবই তোমাকে দেব বলে।’

‘ওই রানগুলো এনে আমার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দাও, আমি শরীরে মাখব।’

‘বেচারা শোভনেশ সেনগুপ্ত! তার ব্রাশ যা পেল না, আমার ব্যাট তা পাবে!’

গলাখাঁকারির শব্দে সচকিতে রোহিণী পিছনে তাকাল। তুষার দত্তের পুরো পরিবার তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। অপ্রতিভ হয়ে সে দ্রুত রিসিভারে বলল, ‘রাজেন আর নয়, ফোনটা অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি, এরপর কথা বলব কলকাতায় তুমি ফিরে এলে। রাখছি, অ্যাঁ, কী বললে?’

‘লোক রয়েছে তোমার পাশে?’

‘হ্যাঁ’।

‘কত দূরে? চুমুর আওয়াজ পৌঁছবে?’

‘হ্যাঁ… মানে, না পৌঁছবে না।’

আলতো বুজে এল রোহিণীর চোখের পাতা। সারা মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল উষ্ণ আবেশ। এক মিনিট পর ‘হয়েছে, আজ এই পর্যন্ত থাক।’ বলে রিসিভারটা ক্রেডলে রেখে দিয়ে সে লাজুক মুখে বোকার মতো হাসল।

‘আপনাদের অনেক অসুবিধে হচ্ছিল, কিন্তু কলটা জয়পুর থেকে এসেছে খুব দরকারি একটা ব্যাপারে, তাই একটু সময় লাগল।’

‘আমাদের কোনো অসুবিধে হয়নি তো।’ নন্দা কথাটা বলেই তার মায়ের দিকে তাকাল। আরতি মাথা নাড়ল। ‘বুবুল বলল, আন্টি ফোনে কথা বলতে বলতে কাঁদছেন। তাই ভাবলাম, কোনো খারাপ খবর হয়তো পেয়েছেন।’

‘উলটো, খুব ভালো খবরই পেয়েছি।’ রোহিণী আরও কৌতূহল মেটাবার দায় থেকে রেহাই পেতে দরজার দিকে এগোল। নন্দা তার সঙ্গ নিয়ে দরজার কাছে এসে গলা নামিয়ে বলল, ‘আঙ্কলকে বলেছেন সেইটে আনতে?’

‘ম্যাক্সি?…ঠিক আনবে, ও কথা দিলে কথা রাখবেই।’

‘আপনাদের হেলথ ক্লাবে আমি কিন্তু ভরতি হব।’

‘হয়ো।’

‘আঙ্কল কি পাগল হয়ে গেছলেন?’

‘হয়নি, তবে ফিরে এসে হবে।’

রোহিণী মিষ্টি করে হেসে নন্দার চুল আঙুল দিয়ে এলোমেলো করে, সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে গেল। নন্দা দরজা বন্ধ করার আগে কান খাড়া করে রইল। ‘ধপাস’ একটা লাফ দেবার শব্দ পেয়েই, তার মুখে হাসি খেলে গেল।

রাজেনের জয়পুর রওনা হবার আগে তার সঙ্গে যেসব কথা হয়েছিল, রোহিণী তার রোমন্থন করছিল ঘুমের আগে। কথার পর কথা সার দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ সারিটা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। কী আশ্চর্য, এটা তো আগেই তার মনে পড়ার কথা। রাজেন বলল ‘সেঞ্চুরি করতে পারব, বাজি! তাইতে বললাম, বাজি—টাজি নয়, তবে এটা হবে আমার জন্য লটারি। যদি সেঞ্চুরি করো, তাহলে নিশ্চিত হয়ে যাব, হাসপাতাল থেকে শোভনেশ পালায়নি, ওটা অন্য কেউ।’

লটারির ফল কী দাঁড়াল? রাজেন সেঞ্চুরি করেছে, তাহলে তো শোভনেশ পালায়নি। ওটা অন্য কেউ। এরকম কি হতে পারে? বহু সময় তো অদ্ভুত সব কাকতালীয় ঘটনা ঘটে। ভাগ্য সে মানে না, কোনোদিন লটারির টিকিট কেনেনি, জ্যোতিষীকে হাত দেখায়নি, কিন্তু আজব জিনিস তো ঘটতেই পারে। কিছু না ভেবেই সে কথাটা বলেছিল, কারণ অবচেতনে তার এটাই ধারণা ছিল: রাজেন সেঞ্চুরি করতে পারবে না আর হাসপাতাল থেকে পালানো লোকটা শোভনেশই।

অবিশ্বাসের বীজ রোহিণীর মনে পুঁতে দিয়েছে গত কয়েক দিনের ঘটনা। এখন অন্ধকার ঘরে ঘুম—না—আসা রাতে একমনে ভাবতে ভাবতে সেই বীজ থেকে অঙ্কুর বেরিয়ে এল। সেটা ক্রমশ বেড়ে উঠে চারায় পরিণত হল। যতই রাত গভীর হচ্ছে, ততই সে সন্দেহের সার, যুক্তির জল ঢেলে চারাটাকে বাড়িয়ে তুলল। তার মনে হতে লাগল, খবরের কাগজের ওই কয়েক লাইনের খবরটায় তার ভয় পাওয়া দেখেই গঙ্গাদা সেটাকে কাজে লাগাবার জন্য, ‘শোভনেশ আসবে’, ‘শোভনেশ আসছে, শোভনেশ এসে পড়ল’ আর এখন, ‘শোভনেশ এসে গেছে’ যেন বাচ্চচাদের কাছে জুজুর ভয় দেখাবার মতোই, মিথ্যেমিথ্যেই এইসব বলে তাকে আতঙ্কের মধ্যে রাখার চেষ্টা করেছেন? ভয়ের চাপে কোণঠাসা করে সম্পূর্ণতই তাকে গঙ্গাদা—নির্ভর করে তোলার একটা চেষ্টা যেন হয়ে আসছে।

কিন্তু যেই ওঁকে বললাম, শোভনেশ এখন কলকাতায়, কাল দুপুরে আমায় খুঁজতে ফ্লাটে গেছিল, অমনি গঙ্গাদা কেমন করে যেন চমকে উঠলেন। গঙ্গাদা প্রতিটি কথায় অদ্ভুতভাবে রিয়্যাক্ট করেছিলেন। মনে হয়েছিল, রোহিণীকে যেন তিনি টাইম বোমার মতো বিপজ্জনক জিনিস বলে ধরে নিয়েছেন। কখন কোথায় কীভাবে ফাটবে, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না।

শোভনেশ কলকাতায় এসে গেছে শোনার পরই গঙ্গাদাকে খুব চিন্তিত দেখিয়েছিল। বলেছিলেন, ‘এখন তোমার সেফটির কথা ভাবতে হবে।’ কেন বললেন? রোহিণী, তুমি একা থাকো, তুমি বিপন্ন, আনসেফ, অতএব আমার কবজার মধ্যে এসো? কোনো প্রশ্ন কোরো না শোভনেশের আঁকা ছবি, বাড়ি ইত্যাদি সম্পর্কে। টাকাকড়ি সংক্রান্ত ব্যাপারে খুব সেনসিটিভ মনে হয়েছিল। মাথায় যেন এই চিন্তাই ওঁর ঘুরছিল। চাকরি দিয়েছি করো, থাকার জায়গা দিয়েছি থাকো, বিয়ে করতে চাও করো, কিন্তু অন্যরকম কিছু ভাবতে বা করতে চাও যদি তাহলেই ওই শোভনেশ জুজুকে ধরিয়ে দেব। প্রাণের ভয় করে না, এমন মানুষ অবশ্যই আছে, গঙ্গাদা আমাকে তাদের মধ্যে রাখার যোগ্য মনে করেনি। রোহিণী মনে মনে ক্ষুণ্ণ হয়েও হেসে ফেলল। গঙ্গাদার ভুলটা ভেঙে দেওয়া দরকার। কিন্তু কীভাবে?

রোহিণী মাথা থেকে একটা বালিশ টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে কাত হয়ে শুলো। এখন এসব ভাবনা তোলা থাক। রাজেন তার জন্য সেঞ্চুরি করেছে, এটা মিথ্যে নয়। কাল সকালেই খবরের কাগজে ছাপা অক্ষরে প্রমাণটা সে পেয়ে যাবে। নিশ্চয় প্রথম পাতার খবর হবে না, তবে খেলার পাতায় কলকাতার কাগজগুলো নিশ্চয় ফার্স্ট লিড করবে। চব্বিশ পয়েন্ট টাইপটা রঞ্জি কোয়ার্টার ফাইনালের পক্ষে খুব ছোটোই হবে, অন্তত ছত্রিশ পয়েন্টে ডাবল কলাম…ডাবল কেন তিন কলামেই হওয়া উচিত! জিতলে তো বাংলা সেমিফাইনালে যাবে। ওখানে কি বছর বছর বাংলা উঠতে পারে? বাংলা কি বোম্বাই? রাজেনের ছবি তো নিশ্চয়ই থাকবে। বোকার মতো হাসা মুখওয়ালা ছবিটা হয়তো আবার ছাপবে। রোহিণী ভগবানকে ডাকল, রাজেনের অন্যরকম ছবি কালকের কাগজে দেখার আশায়। তার কাছে রাজেনের ভালো কোনো ছবি নেই। লাল নিউজপ্রিন্টে ছাপা হলে যাচ্ছেতাই দেখাবে রাজেনকে। কুন্তীরা ইংরিজি কাগজ রাখে, হোয়াইট প্রিন্টে ছাপা। কাগজটা চেয়ে আনতে হবে ওদের কাছ থেকে। ছবিটা কেটে নিলে ওরা বোধহয় কিছু মনে করবে না। কুন্তীর ক্রাইম ডিটেকশন কতদূর এগোল, সেটা ও জানায়নি এখনও। চটপটে, বুদ্ধিমতী আর উদ্যোগী মেয়ে। নিশ্চয় ভেবে ভেবে একটা কিছু সলভ করবে।

সকালে কাগজ পেয়েই রোহিণী খেলার পাতা খুলে খুশি হল। লাল নিউজপ্রিন্ট নয়, বোকার মতো হাসা ছবিটাও নয়, ছত্রিশ পয়েন্টের টাইপে তিন কলাম হেডিংয়েই খবরটা রয়েছে। রাজেনের ধৈর্যশীল ব্যাটিং বাংলার ইনিংসকে একদিক থেকে ধরে রেখে যে কী অসাধারণ উপকার করেছে, তারই ব্যাখ্যানে ভরা রয়েছে লেখাটা। রোহিণী চারবার সেটা পড়ে অন্য পাতায় নজর দিল।

প্রথম পাতায় রাজনীতির কোস্তাকুস্তি, নেতাদের ভাঁড়ামোর আর মিথ্যে কথার জঞ্জাল টপকে ভিতরের পাতায় চোখ বুলোতে বুলোতে হঠাৎ রোহিণী ‘একি!’ বলে সিধে হয়ে বসল। ডাবল কলাম হেডিংয়ে দুর্ঘটনার খবর : বাড়িওলা—ভাড়াটে সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু। খবরের তলায় ছোটো ছোটো সাব হেডিংয়ে তিন—চার লাইনে আরও চারটি দুর্ঘটনা আর মৃত্যুর খবর। তারই একটা—অ্যান্টেনা সারাতে গিয়ে মৃত্যু: পার্কসার্কাস অঞ্চলে বহুতল এক বাড়ির ছাদে টিভি অ্যান্টেনা ঠিক করার সময় সুভাষ গায়েন নামে (৪৯) এক ব্যক্তি পাঁচতলার ছাদ থেকে বাড়ির উঠোনে পড়ে যান। নীলরতন হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়।

.

আট

খবরের কাগজে সুভাষ গায়েনের মৃত্যুসংবাদ চোখে পড়ার দু—দিন পর রোহিণী মিনিবাস থেকে পার্কসার্কাসে যখন নামল, তখন আকাশ থেকে সূর্যালোকের অবশিষ্ট দাগটুকু মুখে নিয়েছে সন্ধ্যা।

এই দু—দিন সে ফ্ল্যাট থেকে বেরোয়নি। অপেক্ষা করেছে শোভনেশের কাছ থেকে টেলিফোনের জন্য। আসেনি। ভেবেছে, সুভাষ গায়েনের অপঘাত মৃত্যুটা নিছকই দুর্ঘটনা, নাকি আর কিছু? সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। তবে লোকটিকে যতদূর সে বুঝেছে, তাতে মনে হচ্ছে খুবই হুঁশিয়ার। অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কোনো কাজে হাত দেয় না। নিজেকে ও বাঁচিয়ে চলার কথাটা সবার আগে ভাবে। টিভি অ্যান্টেনা নিয়ে কাজ করতে হলে নিরাপদে দাঁড়িয়ে কাজটা করা যাবে কি না নিশ্চয় সেটা দেখে নিয়েছিল। অবশ্য হুঁশিয়ার লোকেরাও দুর্ঘটনায় পড়ে। কিন্তু এটা যদি দুর্ঘটনা না হয়, তাহলে দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি হল আত্মহত্যা।

রোহিণীর হাসি পেয়ে গেছিল সুভাষের আত্মহত্যার সম্ভাবনার কথাটা ভেবেই। যে লোক টাকার জন্য বউকে ঠেলে পাঠাত শোভনেশের কাছে নগ্ন হবার জন্য, ছবি জালিয়াতি করত, সে অন্যকে ঠান্ডা মাথায় খুন করতে পারে, কিন্তু নিজেকে নয়। এরা নিজের জীবন সম্পর্কে খুব ভীরু হয়, নিজেকে নিরাপদ করার জন্য টাকা সংগ্রহের কাজে নির্মম হয়। আত্মহত্যা করার মতো কোনো কারণ এরা জীবনেও খুঁজে পায় না, যুক্তি দিয়ে আত্মহত্যাকে অনিবার্য করে তোলার মতো মানসিক কাজেও এরা অপটু। সুতরাং দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিকেও রোহিণী বাতিল করেছে।

তাহলে যেটা বাকি থাকে, তাই নিয়েই সে দু—দিন খাপছাড়াভাবে ভেবেছে। খবরের কাগজে জয়পুরের খবর তাকে বিষণ্ণ করেছে কেননা বাংলার ক্রিকেটাররা তাদের চরিত্র বজায় রেখে প্রথম দিনের চার উইকেটে ২৭১—কে দ্বিতীয় দিন সকালে এক ঘণ্টার মধ্যেই দশ উইকেটে ৩২৩ করে ফেলে। রাজেন প্রথম ওভারেই বোল্ড হয় মাট্টুর বলে। রাজস্থান তারপর সাড়ে নয় ঘণ্টা খেলে তৃতীয় দিন চা—এর আধ ঘণ্টা পর নয় উইকেটে ৫৪০ রান তুলে প্রথম ইনিংস ছেড়ে দেয়। ২১৭ সানে পিছিয়ে পড়লে সেই ম্যাচ শেষ দিনে যে জেতা দুঃসাধ্য প্রায়, অন্তত বাংলার পক্ষে, সেটা রোহিণীর মতো ক্রিকেট—আনাড়িও বোঝে। খবরের কাগজটা তালগোল পাকিয়ে মেঝেয় ছুড়ে দিয়ে সে বিছানায় শুয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেছিল।

গৌরীর মা কাজ সেরে যাবার সময় ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘শরীর খারাপ?’

‘না।’

‘তবে শুয়ে আছ যে?’

‘মন খারাপ।’

রোহিণী উঠে বসল। আড়মোড়া ভেঙে চুলের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে চুল খামচে ধরে বলল, ‘খুব চেনা একজন লোক ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে।’

‘সে কি গো! ছাতে পাঁচিল ছিল না?’

রোহিণী জানে না পাঁচিল আছে কি না। মনে হয় আছে। এতবড়ো বাড়িতে কি লোকেরা ছাদে ওঠে না? ছাদে ওঠার ব্যবস্থা থাকলে পাঁচিলও নিশ্চয় থাকবে।

‘পাঁচিল আছে। পাঁচিলে উঠে টিভি—র অ্যান্টেনা ঠিক করছিল, তখন পড়ে যায়।’

‘আহা রে! দ্যাকো তো, কার মরণ যে কখন কীভাবে হয়, কেউ তা জানে না। আমাদের বস্তির একটা বউ নারকেলডাঙার কাছে রেল লাইনে কাটা পড়ে মরল রাত্তির বেলায়। সবাই বলল অ্যাকসিডেন্ট। তার স্বামী এক মাসের মধ্যে আবার বিয়ে করল। এই বউটাও রেলে কাটা পড়ল ওই একই জায়গায়। একই রকম অ্যাকসিডেন্ট কি দুবার হয়?’

‘স্বামীটা কেমন?’

‘স্বামী নয়, স্বামী নয় গো, ননদ আছে একটা, খাণ্ডারনী। ভাইয়ের বউদের সে সহ্য করতে পারে না। তুমি যা ভাবছ, আমরাও তাই ভেবেছিলুম। বোধ হয় স্বামীটাই এসব করেছে। একদিন ভাই—বোনে তুমুল ঝগড়া। আর ঝগড়ার মুখে ভাইটা চেঁচিয়ে বলে ফেলল, ‘তুই তো বউ—দুটোকে মেরেছিস ট্রেনের সামনে ঠেলে দিয়ে, আমি নিজের চক্ষে দেখেছি। পুলিশকে বললে তোর ফাঁসি হয়ে যাবে বলে আমি বলিনি।’ বোঝো কাণ্ড দিদি, বোনকে বাঁচাতে দাদা দু—দুটো বউয়ের খুনের কথা চেপে গেছে।’

‘থার্ড বিয়েটা কবে করল?’

‘জানি না বাপু। ওরা তারপরই বস্তি ছেড়ে কোথায় যে চলে গেল, সে আজ দু—বছর তো হয়ে গেছে।’

গৌরীর মা চলে যাবার পর রোহিণীর চিন্তা অন্য পথে চলতে শুরু করে। খুনের উদ্দেশ্য এবং কারণ যে কত বিচিত্র আর অদ্ভুত রকমের হতে পারে, মানুষের মন যে কত জটিল, তার খেই পাওয়া শক্ত। এই যে ওপরের সুজাতা গুপ্ত আর হৃদয়রঞ্জন, এরাও একটা জটিল ব্যাপার। গঙ্গাদাও একটা জট পাকানো কাণ্ড হয়ে রয়েছেন। মীনা চ্যাটার্জি তো রীতিমতো…রোহিণীর চিন্তা এইখানে এসেই থমকে দাঁড়াল।

সুভাষ গায়েন পড়েছে মীনা চ্যাটার্জির ফ্লাটের ছাদ থেকে। এর মধ্যে সন্দেহ করার কিছু কি থাকতে পারে? রোহিণী ভেবে দেখল, গঙ্গাদার পাঠানো লোক তাদের ছাদে অ্যান্টেনা লাগাতে এসে যদি নীচে পড়ে যায়, তাহলে কি সে তার জন্য দায়ী হবে? কেউ কি বলবে সে লোকটাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে? লাখখানেক গোয়েন্দা—কাহিনি পড়ে মাথা নষ্ট করা লোকও তা বলবে না। সুভাষ গায়েনের পড়াটা তো একটা স্বাভাবিক দুর্ঘটনাই।

এইরকম ভেবেও কিন্তু গৌরীর মা—র বলা একটা কথা তার মনে মাঝে মাঝেই ট্রেনের হুইশলের মতো বেজে উঠছিল: ‘ঝগড়ার মুখে ভাইটা বলে ফেলল, তুই তো বউ—দুটোকে মেরেছিস ট্রেনের সামনে ঠেলে দিয়ে।’ রোহিণীর চিন্তা একের পর এক লাইন বদল করে করে এমন একটা জংশনে এসে দাঁড়াল, যেখানে তাকে অপেক্ষা করতেই হবে। শোভনেশের টেলিফোন না পাওয়া পর্যন্ত সে লাইন—ক্লিয়ার সিগন্যাল পেয়ে এগোতে পারবে না। কিন্তু সেই টেলিফোন কি সত্যি সত্যিই বেজে উঠবে? অপেক্ষা করে করে টেনশান বাড়িয়ে তোলার থেকে বরং একটু ঘুরে আসা যাক—এই ভেবেই সন্ধ্যার মুখোমুখি সে ফ্ল্যাট থেকে বেরোয়।

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় কুন্তীদের দরজার সামনে সে দাঁড়াল। ইতস্তত করে বেল বাজাল।

দরজা খুলে দাঁড়ালেন প্রৌঢ়া এক বিধবা। কুন্তীর মাসশাশুড়ি, এই ফ্ল্যাটের মালিক।

‘মাসিমা, কুন্তী আছে নাকি?’

‘নেই। তিন—চারদিন ধরে সে সকাল নেই, দুপুর নেই বাড়ির বাইরে হুটহুট করে বেরোচ্ছে, যখন খুশি ফিরছে। পল্টু অফিসে কাজে গৌহাটি গেছে আর বউও এদিকে পল্টুর ক্যামেরা নিয়ে, টেপ রেকর্ডার নিয়ে… কী যে তার কাজ জানি না বাপু। কাঁধে একটা ঝোলা ঝুলিয়ে, এই তোমার মতো, হ্যাঁ গো এটা কী এখন ফ্যাশান হয়েছে নাকি?’

‘না না মাসিমা, এতে কাজের জিনিসপত্রই থাকে। কিন্তু হাতে নিয়ে এই ভিড় বাসে চলাফেরার এত অসুবিধে হয়, তাই এটা…।’

‘তুমি কি এখন বেরোচ্ছ, এই সন্ধেবেলায়?’ মাসিমার চোখেমুখে অনুমোদনের অভাবটা খুবই প্রকট। রোহিণীর মনে হল, তাকে বোধ হয় খুব একটা পছন্দ করছেন না।

‘আমার পিসিমা কাল কাশী থেকে ফিরেছেন। খবর পাঠিয়েছেন বিশ্বনাথের প্রসাদী ফুল এনেছেন, তাই মাথায় ঠেকাতে যাচ্ছি।’

প্রৌঢ়া ভ্রূ কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড রোহিণীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার বুকের মধ্যে গুরগুর করে উঠল। মিথ্যে কথাগুলো ছাপা অক্ষর হয়ে মুখে ভেসে ওঠে না তো। তারপরই সে হাঁফ ছাড়ল ওঁর স্মিত প্রসন্ন মুখ দেখে।

‘ঠাকুরদেবতায় ভক্তি থাকা ভালো। বাইরে দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে…।’

‘না না মাসিমা, দেরি হয়ে যাবে। সেই পার্কসার্কাসে যেতে হবে।’

হঠাৎই মুখ থেকে পার্কসার্কাস শব্দটা তখন বেরিয়ে এসেছিল, আর সেই মুহূর্তেই রোহিণী স্থির করে, সে মীনার সঙ্গে একবার দেখা করে সমবেদনা জানিয়ে আসবে।

মিনিবাস থেকে নেমে কয়েক গজ এগিয়ে সে রাস্তা পার হবার জন্য দাঁড়াল। এখান থেকে মীনাদের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটার সদর দেখা যায়। বাড়িটা থেকে এই সময় একটা সাদা অ্যামবাসাডার বেরোতে দেখে সে দৃষ্টি তীক্ষ্ন করল। গাড়িটা বেরিয়ে রাস্তায় পড়ে বাঁদিকে ঘুরল। সে যেখানে দাঁড়িয়ে, তার সামনে দিয়েই যাবে উত্তরে কিংবা চক্করটা ঘুরে আমির আলি অ্যাভিন্যু দিয়ে যাবে দক্ষিণে, কিংবা সোজা পুবেও যেতে পারে ইস্টার্ন বাইপাস ধরার জন্য।

দু—পা পিছিয়ে গিয়ে সারা শরীর শক্ত করে রোহিণী দাঁড়িয়ে রইল রাস্তার ধারের গাছটায় নিজেকে আড়াল করে। সাদা অ্যামবাসাডারটা দক্ষিণেই যাচ্ছে। চোখের নজরে যাবতীয় শক্তি প্রয়োগ করে প্রথমে সে গাড়ির নম্বরটা পড়ে নিয়েই পিছনের সিটে বসা লোকটিকে রাস্তার আলোয় যতটা বোঝা যায়, বোঝার চেষ্টা করে অস্ফুটে বলল, ‘আশ্চর্য। গঙ্গাদা ওই বাড়িতে?’

লিফটের দরজা বন্ধ। দরজার মাথায় লাল অক্ষরে ‘তিন’ সংখ্যাটা জ্বলছে। রোহিণী অপেক্ষা করতে লাগল। পুরু লেন্সের চশমা পরা এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়াল লিফটে ওঠার জন্য। চোখে প্রায় দেখতেই পায় না, হাতে একটা লাঠি। মুখ তুলে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে পরিচিত কেউ কিনা, সেটাই বোধ হয় চেনার চেষ্টা করল। দেখে রোহিণীর মায়া হল। সে হাসল বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে।

‘আমাকে একটু পৌঁছে দেবে, মা। সিঁড়িতে বালবটা ভেঙে গেছে, বড্ড অন্ধকার।’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়, ক—তলায় যাবেন?’

‘চারতলায়, থার্ড ফ্লোর। তুমি কোন ফ্লোরে?’

‘সেকেন্ড, তিনতলায়।’

‘অহহ, সেদিন যিনি মারা গেলেন, সেই ফ্লোর?’

‘হ্যাঁ। আমি ওঁরই ফ্ল্যাটে যাব।’

‘ওহহ। বড়ো দুঃখের ব্যাপার, স্যাড, ভেরি স্যাড।’ বৃদ্ধ মাথা নাড়ল। ‘বেশ ভালো লোক ছিলেন। কেন যে রাত্রে ছাদে গিয়ে অ্যান্টেনার লুজ তার ঠিক করতে গেলেন। আমি বললুম একটা রাত নয় একটু খারাপ পিকচারই দেখলেন, কাল সকালে বরং ঠিক করবেন। তা উনি শুনবেন না। বললেন, অসুবিধে হবে না, পারব, আগেও করেছি। তারপর খবরটা শুনে এত খারাপ লাগছে। যদি জোর করে আটকাতে পারতাম ওঁকে….’

রোহিণী সন্ত্রস্ত এবং গা ঝাড়া দিয়ে উঠল। তার হাতের রোঁয়া খাড়া হয়ে উঠেছে।

‘আপনার সঙ্গে ঘটনার আগে ওঁর দেখা হয়েছিল?’

লিফট নেমে এসেছে। দরজা খুলে গেল। বাচ্চচা কোলে একটা লোক বেরিয়ে এল। বৃদ্ধ লাঠি ঠুকঠুক করে লিফটে ঢুকল। রোহিণী ভিতরে ঢুকেই তিন নম্বর বোতামটা টিপল।

‘আপনি ওঁকে বারণ করেছিলেন?’

‘করবই তো। ওঁদের অ্যান্টেনার রড পাঁচিলের সঙ্গে লাগানো, আমাদেরটার পাশেই। তারটা যেখানে লাগানো, সেখানে হাত পৌঁছতে হলে একটা টুলের ওপর দাঁড়াতে হবে। উনি তো আর টুলফুল কিছু সঙ্গে নেননি, শুধুই যাচ্ছিলেন। তা হলে তার ঠিক করতে ওঁকে পাঁচিলে উঠতেই হবে। আর পাঁচিলেই উনি…’

লিফট চারতলায় থেমেছে। দরজা খুলল। বাইরে ল্যান্ডিংটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। রোহিণী হাত ধরে বৃদ্ধকে বাইরে আনল। দরজা বন্ধ করে লিফট নীচে নেমে গেল। এত অন্ধকার যে, চোখ সইয়ে নেবার জন্য রোহিণীকে কিছুক্ষণ দাঁড়াতে হল।

‘ডানদিকের ফ্ল্যাট। দরজায় ডানদিকে কলিং বেলের বাটন।’

বৃদ্ধের কথামতো রোহিণী হাতড়ে হাতড়ে কলিং বেলের বোতামটা পেয়ে টিপল।

‘তা হলে উনি পাঁচিলে উঠে তার আঁটছিলেন?’

‘বোধ হয়। আমি তো আর দেখিনি উনি উঠেছিলেন কিনা। এই ঠিক এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। কথা বলে আমি ভিতরে চলে যাই।’

‘তখন আলো ছিল এখানে?’

‘হ্যাঁ।’

ফ্ল্যাটের দরজা খুলল ফুটফুটে একটি পাঁচ—ছ বছর বয়সি মেয়ে। ভিতরের আলো এসে ল্যান্ডিংয়ে একটা চৌকো সাদা কাগজ পেতে দিয়েছে।

‘খুব তেষ্টা পেয়েছে, এক গ্লাস জল দেবেন?’ একটু শুকনো স্বরে রোহিণী বলল।

‘নিশ্চয়। ভেতরে আসুন।’

বলামাত্র রোহিণী ভিতরে ঢুকে এল। বৃদ্ধের কাছ থেকে আরও কিছু তথ্য সে জেনে নিতে চায়।

‘ঠান্ডা না গরম জল?’

‘গরম।’

‘মিঠু এক গ্লাস জল ফিলটার থেকে এনে দাও, তোমার ঠাকুমা কোথায়? টিভি দেখছে? আচ্ছা তুমি জল এনে দাও….পড়তে বসেছিলে তো? আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।’

রোহিণী ঘরের আসবাব দেখে বুঝল, বৃদ্ধের প্রথম জীবনে যা কেনা হয়েছে, তারপর আর বিশেষ কিছু সংযোজিত হয়নি। এই বাড়ির পুরোনো বাসিন্দা। বোধ হয় বড়ো সরকারি চাকুরে ছিল।

‘বাইরের বালবটা কখন কেটে গেছে?’

‘কাল, তখনই প্রায়।’

‘তখনই মানে?’

‘সুভাষবাবুর সঙ্গে কথা বলে আমি ভিতরে চলে এলাম, আর উনিও উপরে গেলেন। তারপর বোধ হয় দু—মিনিট হবে, আমার এই নাতনির প্রাইভেট টিউটর ওকে পড়িয়ে চলে গেলেন। ঠিক সাড়ে সাতটায় উনি ওঠেন। আমি দরজা বন্ধ করতে এসে দেখি ল্যান্ডিং অন্ধকার। রাতে ঝাপসাই দেখি, তার ওপর আলো নেই। দরজা বন্ধ করার সময় মনে হল, ছাদ থেকে কেউ খুব তাড়াতাড়ি নেমে চলে গেল নীচে। আমি ভাবলাম, বোধ হয় সুভাষবাবুই নেমে গেলেন।’

মিঠু জল এনে দিল। এক চুমুকে শেষ করে রোহিণী প্রমাণ দিল, সে সত্যিই তৃষ্ণার্ত ছিল।

‘ওঁর নীচে পড়ার আওয়াজ পাননি?’

‘না। পড়েছেন তো বাড়ির পিছন দিকের একটা খোলা জায়গায়। দারোয়ানদের কয়লা—টয়লা থাকে। ওদিকটা এমনিতেই অন্ধকার, কেউ যায়টায়ও না বিশেষ। অন্তত আধঘণ্টা পরে ওঁকে দেখতে পায় আমাদের দারোয়ানের বউ।’

‘তখন সুভাষবাবুর ফ্ল্যাটে কেউ ছিল না?’

‘মিস চ্যাটার্জি ছিলেন। কেননা দারোয়ান প্রথমে ওঁর ফ্ল্যাটেই ছুটে আসে, আর শোনামাত্র উনি চেঁচিয়ে উঠে নীচে নেমে যান।’

‘আধঘণ্টা একটা লোক ফিরছে না ছাদ থেকে, ততক্ষণ তো অ্যান্টেনার তার ঠিক করতে লাগে না।’

‘হ্যাঁ, তা লাগে না।’

‘তা হলে তো একবার খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল। তাই তো কী হল লোকটার?’

বৃদ্ধ বোধ হয় এতসব আগে ভাবেনি। রোহিণীর কথা শুনে যেন ধাঁধায় পড়ল।

‘বালবটার কী ফিলামেন্ট কেটে গেছে?’

‘না, না, একেবারে চুরমার হয়ে গেছে। আজও রিপ্লেস করেনি। আমরা পুরোনো ভাড়ায় আছি তো, তাই গ্রাহ্যই করে না বাড়িওয়ালা।’

‘পুলিশ তো এসেছিল, তা আপনাকে কী জিজ্ঞাসা করল?’

‘আমাকে?’ বৃদ্ধ আকাশ থেকে যেন পড়ল। ‘শুনেছি এসেছিল। ছাদে গেল, নীচে যেখানে পড়েছিল, সেখানে গেল। যাকে সামনে পেল জিজ্ঞাসা করল। মিস চ্যাটার্জির সঙ্গে বহুক্ষণ নাকি কথা বলল, তারপর চলে গেল। আমার সঙ্গে তাদের দেখাই হয়নি বা তারা কথা বলার কোনো আগ্রহ দেখায়নি।’

রোহিণী চেয়ার থেকে উঠল। মীনাকে এখন পাওয়া যাবে কিনা কে জানে। আর গঙ্গাদা এই বাড়ি থেকে গাড়িতে বেরোলেন, ব্যাপারটা যেন কেমন কেমন! কার কাছে এসেছিলেন? মীনার কাছে কী?

‘অনেকক্ষণ আপনাকে বকালাম। এইবার তা হলে আসি।’

রোহিণী নমস্কার করে বেরিয়ে আসার সময়ই ভিতর থেকে একটি তার বয়সি বউ বেরিয়ে এল। বোধ হয় বৃদ্ধের পুত্রবধূ। অবাক হয়ে সে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে রইল।

অন্ধকার সিঁড়িতে পা টিপে টিপে নামার সময় রোহিণীর মনে হল, বউটিকে কোথায় যেন সে দেখেছে। মহারানির অফিসে? নাকি ইডেন গার্ডেনসের ক্লাব হাউসে? ভাবতে ভাবতে তিনতলার ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছল। আলো জ্বলছে।

সে মীনার ফ্ল্যাটের কলিং বেলের বোতাম টিপল।

দরজা খুলতে একটু দেরিই হচ্ছে। হবারই কথা, কেননা, রোহিণী ধরেই নিল, প্রথমে আই হোল দিয়ে দেখে নিয়ে কাজের মেয়েটি ভিতরের ঘরে গিয়ে মীনাকে সেটা জানাবে। মীনা ভেবে দেখেবে, এখন তার সঙ্গে সে দেখা করবে, না দরজা থেকেই বিদায় হতে বলবে। তারপর তো মেয়েটি এসে দরজা খুলবে।

দরজা খুলল এবং মীনা দাঁড়িয়ে।

রোহিণীকে অবাক হবার অবকাশ না দিয়েই মীনা হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে তাকে ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়েই দরজা বন্ধ করে দিল।

‘কী ব্যাপার!’

‘কিছু না, এমনিই।’ মীনা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘কোনো লোককে দেখলেন?’

‘কোথায়?’

‘লিফটে, সিঁড়িতে, দরজার কাছাকাছি?’

‘না তো! কীরকম লোক?’

‘তাহলে দেখেননি।’ এক লহমা কী ভেবে নিয়ে মীনা হালকা স্বরে বলল, ‘যাকগে, এসব কথা, বসুন।’

রোহিণী সোফায় বসল। সে ভেবেছিল, মীনাকে মুহ্যমান, বিষণ্ণ বা ওইরকম ধরনের মুখ নিয়ে উদাস চোখে দেওয়াল বা মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখবে। অর্থাৎ শোকার্তের ভূমিকায় অভিনয়ের রিহার্সালে মগ্ন থাকবে। সুভাষ গায়েন আর প্রাইভেট সেক্রেটারিই তো শুধু নয়, দিদির স্বামীও। কিন্তু তার বদলে এইরকম ভীত, অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে কেন?

‘খবরটা কাগজে দেখেই মনটা বড়ো খারাপ হয়ে গেল।’ রোহিণী ধীর, বিষাদমাখা স্বরে শুরু করল। ‘কয়েক দিন আগে অনিমন্ত্রিত হয়েই অদ্ভুতভাবে এক বিয়েবাড়িতে গিয়ে পড়ি। দেখি, সেখানে উনি রয়েছেন। বললেন তার ভাগনির বিয়ে হচ্ছে। জোর করে আমার হাতে খাবার ধরিয়ে দিলেন, বাড়িতে নিয়ে গিয়ে খাবার জন্য। মানুষটার মধ্যে ভালোবাসা পাবার ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি হয়তো, কিন্তু স্নেহ দেবার জন্য ব্যগ্রতাটা ছিল। সেদিন ওঁকে খুব তৃপ্ত মনে হল, যখন আমি খাবারগুলো অ্যাকসেপ্ট করলাম।’

মীনা ভাবলেশহীন মুখে কথাগুলো শুনছিল। এইবার বলল, ‘আপনি বোধ হয় সমবেদনা বা ওইরকম কিছু জানাতে এসেছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তা শোনার মতো মানসিক অবস্থায় আমি নেই। আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার…মাই লাইফ ইজ ইন ডেঞ্জার…কে একজন আমায় থ্রেট করছে। মারবে, খুন করবে বলছে।’

‘কে?’ রোহিণী টানটান হয়ে ঝুঁকে পড়ল।

‘জানি না।’

‘কেন? কীজন্য?’

‘তাও জানি না।’

‘কীভাবে থ্রেট করছে, ফোনে? পারভারটেড, ডার্টি মাইন্ডেড লোকের তো অভাব নেই। ফোনে তারা অনেক কিছুই এভাবে বলে।’

‘ফোনে নয়, চিঠি দিয়েছি। কাল আর আজ দু—দুটো চিঠি দিয়েছে, দেখবেন?’

‘দেখি।’

মীনা উঠে শোবার ঘরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এল দুটো সাদা কাগজের টুকরো হাতে নিয়ে। রোহিণী হাত বাড়াল নেবার জন্য। তার হাতে দেবার আগে মীনা বলল, ‘দরজায় সেলোটেপ দিয়ে আটকে বেল বাজিয়েই পালিয়েছে। আমি দরজা খুলে পেয়েছি।’

‘আপনার কাজের মেয়েটিই তো দরজা খোলে।’

‘চারদিন আগে বাড়িতে একবেলার জন্য যাবে বলে সেই যে গেছে আজও আসেনি।’

মীনার কথাগুলো ভালোভাবে রোহিণীর কানে ঢুকল না কাগজের লেখার উপর মগ্ন থাকায়। একটা কাগজে লেখা : ‘সুভাষ গায়েনের যে দশা হল, তোমারও তাই হবে। সাবধান। অনেক পাপ জমে উঠেছে।’

অন্য কাগজে লেখা : ‘এই তো সবে শুরু। একে একে সবাই যাবে। তুমি আছ তালিকার তিন নম্বরে। অপেক্ষা করো, অপেক্ষা করো। আমি আসছি।’

হতভম্ব চোখ তুলে মীনার দিকে তাকানো ছাড়া রোহিণীর এখন আর কিছু করার নেই। সে আর একবার লেখার উপর চোখ রাখল। কাগজ দুটোই রুল—টানা। এক্সারসাইজ খাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া, বল পয়েন্ট রিফিল কলমের কালি। অক্ষরের ধাঁচ থেকে বোঝা যায়, খুব অশিক্ষিত নয় এবং মেয়েলি হাতের লেখা। শুরুতে কোনো সম্বোধন নেই, তলায় লেখকের নামও নেই।

‘কী বুঝছেন?’ মীনা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল।

মাথা নাড়ল রোহিণী। ‘আপনার উপর কেউ ভয়ঙ্কর রেগে আছে, যে মনে করে; অনেক পাপ জমার একটা কারণ আপনি।’

‘কী পাপ?’

‘বলা মুশকিল। পৃথিবীতে কোন কাজটা যে পাপমুক্ত, সেটা এখনও ভালোভাবে জানি না। এক্ষেত্রে আপনি নিজেই খুঁজে বার করুন জীবনে কখন, কোথায় কী কাজ করছেন, যেটা পাপ বলে গণ্য হতে পারে। তবে একটাই সান্ত্বনা, আপনি একা নন, আপনার আগে একজন আছে দু—নম্বর। আর এক—নম্বরটা ছিলেন বোধ হয় সুভাষবাবু। দু—নম্বর যাবে, তারপর তো তিন নম্বর! হাতে কিছু সময় পাচ্ছেনই। আপনি পুলিশের কাছে যাননি?’

‘না’।

‘সে কী? প্রথমেই তো সেখানে যাওয়া উচিত। এইরকম থ্রেটনিং লেটার পেয়ে—।’

‘গিয়ে কী লাভ!’ মীনার হালছাড়া, ভাঙা গলা অকূল হতাশায় ভেসে গেল। ‘এই তো সেদিন একটা বাচ্চচা মেয়েকে কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ পঞ্চাশ হাজার টাকা চেয়ে চিঠি দিল বাবাকে। বাবা লালবাজারে গিয়ে চিঠিটা দিল। ফাঁদটাদ পেতে কিডন্যাপারদের দু—জনকে ধরল বটে, কিন্তু মেয়েটাকে কী পুলিশ বাঁচাতে পারল। অন্যরা খবর পেয়েই মেয়েটাকে গলা টিপে মেরে ফেলে দিল। না, না, পুলিশে গেলে বিপদ আরও তাড়াতাড়ি এগিয়ে আসবে।’ চিঠি দুটো ভাঁজ করে সে সোফার একধারে রাখল।

‘আপনি কাকে সন্দেহ করছেন?’

‘কাকে যে করব।’ মীনা অসহায়ভাবে দু—হাত মুঠো করে কাঠ হয়ে বসে রইল।

‘নিশ্চয় কিছু কিছু লোকের মুখ মনে ভেসে উঠেছে। ধরুন, আমি যদি আজ এইরকম চিঠি পেতাম—’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ যদি পেতেন?’

‘প্রথমেই মনে হত ‘শোভনেশ’, আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে নাকচও করে দিতাম। কেননা এইভাবে চিটিফিটি লিখে ও মানুষ মারবে না।’

‘কে বলল, মারবে না? দিদিকে চিঠি লিখে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করেছিল। চিঠিটা আগের দিন দিদি আমাকে দেখিয়েছিল।’

‘খুন করবে বলেই চিঠি দিয়ে বাড়িতে ডেকে আনার কথাটা মামলার সময় কোর্টে উঠেছিল। এটা আমি জানি। কিন্তু এখন এই দুটো চিঠিতে আপনাকে ডাকা হয়নি।’

মীনা তর্কের দিকে আর গেল না। ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘প্রথমেই আপনার মনে হত শোভনেশ? তারপর কার মুখ?’

‘সুজাতা গুপ্তের। এঁকে আপনি দেখেছেন কিনা জানি না। বিবাহিত, একসময় শোভনেশের বাড়িতে নীচের তলায় ভাড়া থাকতেন আর ইনিই ওর প্রথম মডেল। পেশাদার নন, আর্টিস্টকে ভালোবেসে ন্যুড হয়ে পোজ দিয়েছিলেন। এখন বয়স ষাটের মতো, আমার উপর তলায় থাকেন, শোভনেশের স্মৃতি ভুলতে পারেননি, এখনও বিশ্বাস করেন, সে নির্দোষ, আর তার বউকে তিনি এখন ঘৃণা করেন। সুজাতা গুপ্ত আমাকে মুহুর্মুহু খুন করে যাচ্ছেন, যেজন্য চিঠি লেখার সময় করে ওঠা ওঁর পক্ষে খুবই শক্ত।’

‘এরপর কার মুখ মনে আসবে?’ মীনার প্রশ্নটায় এবার কৌতূহলীর সারল্য নেই। তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে যেন রোহিণীর মগজের কাজকর্ম দেখতে চাইছে। তাহলে দেখুক, মনে মনে রোহিণী এই সিদ্ধান্তটা নিল শুধু এটাই বোঝাতে, তার মগজে কিছু দুষ্টু বুদ্ধিও আছে।

‘তারপর তিন নম্বরে মনে ভেসে উঠবে আপনার মুখ।’

মুখটা সারল্যে ভরিয়ে রোহিণী কথাটা বলল। প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য চোখে আগ্রহ ফোটাল না। আসলে মনে মনে সে বিরক্ত হয়ে উঠছিল। মাত্র দু—দিন আগেই একটা লোক বিশ্রীভাবে মারা গেল, যে লোক বছরের পর বছর পাশাপাশি থেকেছে, যে লোক সম্পর্কে বলেছে, ‘আমার ভালোর জন্য সব করতে পারে। বিশ্বস্ত।’ সেই লোকটি তার আত্মীয় এবং অভিভাবকও বটে, অথচ সেই লোকের মৃত্যুতে চোখে জল নেই, কোনো শোক নেই, দুঃখও নেই। ভয় দেখানো চিঠি পেলে রোহিণীর মনে কী হতে পারে, তাই জানার জন্যই এখন ব্যস্ত। মীনা চ্যাটার্জি সম্পর্কে সে রূঢ় হয়ে পড়ছে অনেকটা নিজের অজান্তেই।

‘ভেসে ওঠার কারণটা জানতে পারি কি?’ অনুত্তেজিত স্বরে মীনা জানতে চাইল। মীনার এই শীতল সংযত ভাবটাই নিমেষে রোহিণীর মাথা গরম করে দিল।

‘এর কোনো কারণ নেই, এটা নিছকই ইনস্টিংক্ট। যেমন সুভাষবাবুর ছাদ থেকে পড়ে যাওয়াটাকেও আমার ইনস্টিংক্ট বলছে মোটেই দুর্ঘটনা নয়।’ কথাটা বলে সে চ্যালেঞ্জের চাহনি পাঠাল মীনার দিকে। দপ করে একবার শুধু জ্বলে উঠল মীনার চোখ। তারপরই শব্দ করে হেসে উঠল মীনা।

‘আপনাকে যতটা কাঠখোট্টা মনে হয়, ততটা কিন্তু নন, দেখছি সেন্স অফ হিউমার যথেষ্টই আছে। তিন নম্বরে কিনা আমাকেই বেছে নিলেন?’ মীনা আবার হেসে উঠল।

বিলো দ্য বেল্ট হিট করেছে। কাঠখোট্টা শব্দটা যখন অপমান করার জন্য বেছে নিয়েছে, তাহলে তাই হওয়া যাক। রোহিণী রাগটা চাপতে চাপতে বলল, ‘শোভনেশ কিন্তু যেচে বাড়ি বয়ে এসে এই কাঠখোট্টাকেই প্রেম নিবেদন করেছিল মিস চ্যাটার্জি। তার রুচির বা সৌন্দর্যবোধের অভাব ছিল, আপনি কি তাই মনে করেন?’

রাগে থমথমে হয়ে উঠল মীনার মুখ। রোহিণী শ্লথ ভঙ্গিতে বসে, হাতের নখের গড়ন পরীক্ষায় মগ্ন। দুনিয়ায় এখন যেন এইটেই তার কাছে সবথেকে বড়ো কাজ।

‘আপনি চার বা পাঁচ নম্বরের খোঁজ নেবেন না?’

‘তার দরকার নেই। আমার যা জানার, তা জেনে গেছি।’

‘কী জানলেন?’

‘আপনি এবার আসতে পারেন মিসেস সেনগুপ্ত।’

কিন্তু গাত্রোত্থানের কোনো লক্ষণ রোহিণীর মধ্যে ফুটল না। হাতের নখ দেখার কাজ সেরে সে ঘড়ির ব্যান্ডে নজর দিল।

‘আপনার কাছে একটু আগে কেউ এসেছিল?’

কথাটা শুনে মীনা চমকাল কিনা রোহিণী বুঝতে পারল না। চমকালেই সে আশ্বস্ত হত। তাহলে বুঝতে পারত মীনার মানসিক গড়ন দুর্বল।

‘এসেছিল, আর কে যে এসেছিল, মনে হয় সেটা জানেন। কেন এসেছিল, সেটা কিন্তু জানেন না।’

মাথা নেড়ে রোহিণী জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল। ভাবখানা, যদি ইচ্ছে হয় তো বলতে পারো, তবে জানার জন্যে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

‘খোঁজ নিতে এসেছিলেন গঙ্গাপ্রসাদবাবু।’

‘শোভনেশের? সে এখানে এসে লুকিয়ে আছে কিনা জানতে? সুভাষবাবুর ছাদ থেকে পড়ার পিছনে তাঁর কোনো হাত আছে কিনা, সেটা বুঝে নিতে?’

‘হ্যাঁ। আপনার অনুমানশক্তি তো দেখছি খুবই প্রখর।’

‘এতে শক্তি—টক্তির কোনো দরকার হয় না। ব্যাপারটা প্রথম থেকে যেভাবে চলে আসছে তাতে এই অনুমানে যে কেউই চলে আসবে, এমনকী আপনার কাজের মেয়েটিও এইরকম কনক্লুশনে পৌঁছবে যদি তার ঘটে এক ছটাকও বুদ্ধি থাকে।’

‘হঠাৎ ওকে কেন এর মধ্যে টানলেন?’

‘ওর বাড়ি চলে যাওয়ার টাইমিংটা একটু অদ্ভুত কিনা। ঠিক তারপরই ওই দুর্ঘটনাটা ঘটল, শোভনেশও টেলিফোন করেছে গঙ্গাদাকে। সে যে কোথা থেকে ফোন করছে, গঙ্গাদাকে তা বলেনি। আবার আপনি এইরকম দুটো চিঠিও পেলেন এরই মধ্যে সবই ঘটেছে মেয়েটি বাড়ি যাবার পর ফ্ল্যাটে যখন আপনি একা রয়েছেন।’

‘আমি একাই রয়েছি।’ মীনাকে এই প্রথম বিচলিত দেখাল। ‘আমি সত্যিই একা।’

‘সুভাষবাবু ছাদে যাওয়ার সময় চার তলার ল্যান্ডিংয়ে আলো জ্বলছিল। কিন্তু তারপরই কেউ বালবটা ভেঙে দেয়, আর অন্ধকারের মধ্যে কেউ ছাদ থেকে দ্রুত নেমে এসেছিল।’

‘এসবের কিছুই তো আমি জানি না। আপনি এত কথা জানলেন কী করে?’

‘ইচ্ছে থাকলে, চেষ্টা করলে অনেক কিছুই জানা যায় মিস চ্যাটার্জি। আবার কিছুটা ভাগ্যের সহায়তাও পাওয়া চাই। আপনি সেদিন খোঁজ করলেন না কেন সুভাষবাবুর ছাদ থেকে নামতে দেরি হচ্ছে দেখে?’

‘আপনি তো দেখছি পুলিশের মতো জেরা করতে শুরু করেছেন। আপনাকে কিন্তু আমি চলে যেতে বলেছিলাম। আমার আর একটুও ভালো লাগছে না আপনার সঙ্গে কথা বলতে।’

‘চিঠি দুটো সম্পর্কে কী করবেন? গঙ্গাদাকে এই বিষয়ে কিছু বলেছেন?’

‘হ্যা ওঁকে দেখিয়েছি। উনি বললেন, এটা শোভনেশের কাজ।’

‘শোভনেশ, যার বয়স এখন ষাট, সে চুপি চুপি তিনতলায় এসে আপনার দরজায় চিঠিটা এঁটে দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল বেল বাজিয়েই?’

‘অন্য কাউকে দিয়ে করাতে পারে।’

‘একজন ফেরারি আসামি, যার হাতে পয়সা নেই, বন্ধুদের কাছে যাবার উপায় নেই, যে লুকিয়ে থাকছে পুলিশের ভয়ে, সে লোক পাবে কোথায় এই কাজ করাবার জন্য?’

‘তাহলে কি শোভনকাকা নয়?’

‘গঙ্গাদাকে আপনি কতটা চেনেন?’

মীনা ইতস্তত করে বলল, ‘সামান্যই, তাই দিয়ে একটা লোকের চরিত্র বোঝা সম্ভব নয়। ওঁর আসাটা আমার কাছে অপ্রত্যাশিতই।’

‘সিঁড়ির বালবটা কি আপনিই ভেঙেছিলেন?’

‘এসব কী বলছেন?’

দু—জনে একই সঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠল। মুখোমুখি হয়ে পরস্পরের চোখে চোখ রেখে তারা কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল, কে আগে চোখ সরায়।

‘এই চিঠি দুটো কাকে দিয়ে আপনি লিখিয়েছেন?’

জবাব দেবার বদলে মীনা সজোরে রোহিণীর বাম গালে একটা চড় কষাল। থরথর করে তার শরীর কাঁপছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত । রোহিণীর মাথাটা ডানদিকে সামান্য ঘুরে গেছিল চড়ের ধাক্কায়, তবে দেহ একচুলও নড়েনি, গালে বুলোবার জন্য হাতও সে তোলেনি। বারকয়েক শুধু গালের পেশি কুঞ্চিত হল। শান্ত চোখে তাকিয়ে সে বলল, ‘এতটা কিন্তু আশা করিনি।’

‘গেট আউট। দু—হাত তুলে দরজা দেখিয়ে মীনা হিসহিসে গলায় আরও দু—বার বলল কথাটা।

‘কে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল সুভাষবাবুকে? মিস চ্যাটার্জি গায়ের জোর আর দেখাবেন না, প্লিজ…আমার এই সহজ, সরল প্রশ্নটায় আবার যদি রাগ দেখান, তাহলে কিন্তু কাঠখোট্টা শরীর তাতে ঘোরতর আপত্তি জানাবে। বলুন, কে সুভাষবাবুকে…’

মীনা ছুটে পর্দা সরিয়ে ভিতরে গিয়ে দু—তিন সেকেন্ডের মধ্যেই ফিরে এল ফুট—চারেক লম্বা একটি ছড়ি নিয়ে।

‘মেরে বার করব…বেরোবে কিনা বলো, নইলে…।’ মীনা ছড়িটা দু—হাতে ধরে মাথার উপর তুলল। রোহিণী এক পা পিছিয়ে এধার—ওধার তাকাল। চোখে পড়ল হাতের কাছেই দেওয়ালে কাঠের ব্রাকেটে রাখা পিতলের একটা বুদ্ধের মাথা। হাত বাড়িয়ে সেটা তুলে নিয়ে সে ছোড়ার জন্য তৈরি হল।

‘যদি আমার গায়ে ছড়ির একটু আঁচড়ও লাগে, তাহলে কিন্তু আপনার মুখ এই বুদ্ধের আশীর্বাদ পেয়ে ধন্য হবে। ফিল্ম কেরিয়ারও নির্বাণ লাভ করবে। জেনে রাখুন, আশীর্বাদের ওজন প্রায় এক কিলো হবে।’

মীনা ফ্যালফ্যাল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে ছড়িটা নামাল। মুখটা ফ্যাকাসে। দ্রুত শ্বাস পড়ছে। চোখে ভয়।

‘আপনার হাতটা নামান। এই দেখুন আমারটা ফেলে দিলাম।’ ‘মীনা সোফার উপর ছুড়ে দিল ছড়িটা। হাসি পাচ্ছে রোহিণীর। মুখ থেঁতলে গেলে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবার জন্য কেউ আর কনট্র্যাক্ট নিয়ে সই করাতে আসবে না। মুখসর্বস্ব অভিনেত্রীদের এটাই বোধ হয় জীবনের একমাত্র প্রধান সমস্যা—মুখ রক্ষা করা।

রোহিণী বুদ্ধের মাথাটা সেন্টার টেবলে নামিয়ে রাখল। এগিয়ে এসে মীনার দুই কাঁধ দুই হাতে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল। লটপট করে উঠল মীনার দেহ। অস্ফুটে তার মুখ থেকে যন্ত্রণায় ‘আহহ’—এর মতো একটা শব্দ বেরোল।

‘কাজের মেয়েটা মোটেই ছুটি নেয়নি, তাকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছেন, যাতে এই ফ্ল্যাটে আপনি ছাড়া আর কেউ না থাকে। কেন?’

‘বলব না।’

রোহিণীর দশ আঙুল বাঁকা হয়ে মীনার দুই কাঁধে কুঁকড়ে চেপে বসল। মীনা কাতরে উঠল।

কাঁধের হাড় দুটো আমি ভেঙে দেব যদি প্রশ্নের জবাব না পাই। কেন একা থাকতে চাইছেন?’

‘গঙ্গাপ্রসাদবাবু গত বুধবার টেলিফোন করে বললেন, শোভনকাকা এখন কলকাতায়। কোথা থেকে যেন তাঁকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন সুভাষদা এখন কোথায় আছেন? তখন গঙ্গাপ্রসাদবাবু আমার নাম করে বলেন, মীনার কাছে তার গার্জেনের মতো থাকেন। শুনে শোভনকাকা নাকি ওঁকে বলেন, সুভাষদার কাছে ওঁর অনেক নকল ছবি রয়ে গেছে। ওগুলো ডেস্ট্রয় করতে হবে, না করলে তাঁর আঁকা আসল ছবিগুলোকেও লোকে সন্দেহ করবে। ভবিষ্যৎ তাঁকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা তাহলে দেবে না। আমি গঙ্গাপ্রসাদবাবুকে বললাম, শোভনকাকাকে আমার কাছে আসতে বলুন। আমি ওঁকে লুকিয়ে রাখব, আমি ওঁর নকল ছবিগুলো যেভাবেই হোক উদ্ধার করে ওঁর সামনেই পোড়াব। আমি ওঁকে দিয়ে আবার ছবি আঁকাব, যেভাবে উনি আঁকতে চান…নতুন করে যেভাবে আবার শুরু করতে চান….চার বছর আগে বহরমপুর জেলে আমাকে যা বলেছিলেন, স্বাধীনতা চাই, মুক্তি চাই, প্রকৃতির ছবি আঁকতে চাই…।’

মীনা শেষ দিকে ফুঁপিয়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ হাউ হাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে অবশ হয়ে মেঝেয় লুটিয়ে পড়ছিল, রোহিণী দু—হাতে তাকে জড়িয়ে টেনে সোফায় এনে বসাল।

‘তারপর?’

‘গঙ্গাপ্রসাদবাবু বললেন, শোভনকাকা আমার এখানে কিছুতেই আসবেন না, এলেই তো সুভাষদা তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দেবেন। আমি বললাম সে ব্যবস্থা আমি করছি, আপনি শোভনকাকাকে আমার কাছে আসতে বলুন।’

‘সুভাষবাবুর সঙ্গে তারপর আপনি কথা বললেন?’

‘হ্যাঁ। নকল ছবির কথা তুললাম। সুভাষদা বললেন তাঁর কাছে একটাও নেই। দিদি মারা যাবার পরই তিনি এই ব্যবসা তুলে দেন। কিন্তু আমার মনে হল, কথাটা পুরো সত্যি নয়। ব্যবসাটা তুলে দেন ঠিকই, কিন্তু কিছু ছবি রয়েও যায় তাঁর হাতে, সেগুলো কোথায়? ওঁর সঙ্গে তর্কাতর্কি শেষে ঝগড়াও হল। আমি সুভাষদাকে ফ্ল্যাট ছেড়ে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে চলে যেতে বললাম। উনি জেদ ধরলেন, যাবেন না। তারপর…’

‘তারপর?’ রোহিণী দমচাপা স্বরে বলল। এতক্ষণে তার যাবতীয় আন্দাজ আর অন্ধকার হাতড়ানো বোধ হয় শেষ হতে চলেছে। ‘তারপর ওঁকে অ্যান্টেনার তার ঠিক করতে পাঠালেন?’

মীনা একদৃষ্টে বুদ্ধের মাথাটার দিকে তাকিয়ে তন্ময় হয়ে বসে রইল। চোখের পাতা পড়ছে না, শ্বাসপ্রশ্বাস চলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। যেন অন্য কোনো জগতে তার মন। রোহিণী অপেক্ষা করতে লাগল পারিপার্শ্বিকের প্রতি ওর সচেতনতা ফিরে আসার জন্য।

‘কিন্তু আপনি কি প্রমাণ করতে পারবেন, আমিই ওঁকে ঠেলে দিয়েছি? এটা তো দুর্ঘটনাই। পুলিশও ইনভেস্টিগেট করে তাই বলেছে। সুভাষদা এখন পঞ্চভূতে বিলীন, তাঁর পক্ষেও আর বলা সম্ভব নয় এটা দুর্ঘটনা না অন্য কিছু।’

পৃথিবীতে বহু খুন কাগজে কলমে আনসলভড থেকে গেছে। এটাই তাই হবে। খুনি কে জেনেও, রোহিণী কিছু করতে পারবে না। করার জন্য কোনোরকম উৎসাহ, ইচ্ছা বা তাগিদও আর তার মধ্যে নেই। সে নিজেকে আর এর মধ্যে জড়াতে রাজি নয়।

মীনা আবার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। আবেগের একটি ফোঁটাও আর কণ্ঠস্বর থেকে ঝরে পড়ল না। ধীরে ধীরে কুটিল ভাঁজ কপালের চামড়ায় জেগে উঠেছে। চাহনিতে আবার পুনর্বাসন পেয়েছে সতর্কতা। মেঝেয় পড়ে গেছিল চিঠি দুটো, মীনা নীচু হয়ে কুড়িয়ে নিল।

‘এই দুটো কার লেখা?’

‘আমার নয়।’

‘ঠিক বলছেন?’

মীনা ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল। ‘মিথ্যে কথা বলার কোনো দরকার আর আছে বলে মনে করি না।’

রোহিণী দরজার দিকে এগোল। এই ফ্ল্যাটে এক মিনিটও আর সে থাকতে চায় না। তার মনে হচ্ছে, আজকালের মধ্যেই সে একটা ফোন পাবে। না, রাজেন নয়। অন্য কেউ। কিন্তু কার কাছ থেকে।

ফ্ল্যাটের দরজাটা টেনে বন্ধ করার সময় রোহিণী ভিতরে একবার চোখ রাখল। মীনা বসে রয়েছে তার দিকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে। চিঠি হাতের মুঠোয় দলা পাকাচ্ছে। দরজাটা আবার খুলে রোহিণী ভিতরে একপা ঢুকে বলল, ‘শোভনেশ আমায় টেলিফোন করতে পারে। ওকে কি এখানে আপনার কাছে আসতে বলব?…না না, আমি পুলিশ—টুলিসে খবর দেব না।’

রোহিণী কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল উত্তর পাবার জন্য। আড়চোখে দেখল, চারতলা থেকে লিফটটা নীচে নেমে যাচ্ছে। যাক, সে সিঁড়ি ভেঙেই একতলায় নামবে। পায়ের ব্যায়ামটা তাতেই যতটুকু হবার হয়ে যাবে।

মীনা একইভাবে নির্নিমেষে তাকিয়ে।

‘বলুন? ওকে কি তা হলে—’

‘না। বলবেন না। …ওনাকে আসতে বলবেন না, তাহলে হয়তো উনি মাডারর্ড হতে পারেন।’

‘সে কী!’ রোহিণী দরজা বন্ধ করে পায়ে পায়ে মীনার সামনে এসে আবার বলল, ‘এ তো বড়ো অদ্ভুত কথা। শোভনেশ কেন খুন হতে যাবে? কে ওকে খুন করতে পারে? কী উদ্দেশ্য, কোন কারণে?’

মীনা মাথা নাড়ল, সে বলবে না।

‘আরে, কথা বলুন।’ রোহিণী অধৈর্য, বিরক্ত হয়ে উঠল। ‘আমার তো ধারণা, ও—ই খুন করতে চায়—আমাকে।’

‘উনি আপনার গায়ে আঁচড়টিও দেবেন না।’

‘আপনি জানলেন কী করে?’

মীনা চুপ রইল, অর্থাৎ উত্তর দেবে না।

‘ঠিক আছে, নয় নাই বললেন। কিন্তু আমি নিরাপদ নই কেন, সেটা তো বলতে পারেন?’

‘আপনি শুধু শরীরের দিক থেকেই নয়, মেজাজেও আমার দিদির মতো। তবে অনেক বেশি স্টার্ডি, স্ট্রং।’

‘এইটেই কারণ? একটা চড় মেরেই বুঝে গেলেন আমি স্ট্রং? ভালো। আমি যাচ্ছি।’

‘শুনুন।’

রোহিণী ফিরে দাঁড়াল। মীনা ইতস্তত করছে, যেন কথাটা বলা উচিত হবে কিনা ঠিক করতে পারছে না।

‘আপনি এবার নিঃশব্দে লোকের ভিড়ের মধ্যে মিলিয়ে যান। বিয়ে করুন, ঘর—সংসার করুন। ভুলে যান আপনার একটা বিয়ে হয়েছিল, কিছু ঘটনা ঘটেছিল। একটা ফ্রেশ জীবন শুরু করে দিন, এখনও তো তার বয়স আছে!’

শুনতে শুনতে রোহিণীর মনে হল, যেন গঙ্গাদার কণ্ঠই শুনছে।

দু—জনের কথার মধ্যে আশ্চর্য একটা মিল, যেন দু—জনে আলোচনা করে ঠিক করে নিয়েছে, রোহিণীকে সরে যেতে বলবে শোভনেশ সংক্রান্ত সব ব্যাপার থেকে। তাকে যেন এরা উটকো, অবাঞ্ছিত একটা উৎপাত বা পথের কাঁটা হিসাবে ভাবছে।

‘মিস চ্যাটার্জি, আপনার এই উপদেশটা খুবই উপকারী। শুধু আমার নয়, প্রত্যেক মেয়েকেই এটা প্রেসক্রাইব করা উচিত। আমি আপনার উপদেশ অনুযায়ীই চলব, চলতে চাইও। বিয়ে, ঘরসংসার, ছেলেপুলে—এসবে আমার লোভও খুব। তাই আপনাকে অনুরোধ, আমার হবু মার্ডারারকে একবার যদি বলে দেন, আমার একটুও ইচ্ছে নেই মরার।’

‘বিপদ নিয়ে রসিকতা করবেন না মিসেস সেনগুপ্ত।’

‘আবার মূল্যবান উপদেশ!’

‘ঠিক আছে, আপনি আসুন।’

রোহিণী দরজা খুলে ল্যান্ডিংয়ে বেরিয়েই দেখল লিফটটা আবার চারতলায় উঠে যাচ্ছে। এখুনি নেমে আসবে। তাহলে দাঁড়ানোই যাক। পায়ের ব্যায়াম নয় হেঁটেই করে নেবে। সে লিফটের বোতাম টিপল।

বিপদ আসছে। রোহিণী ভাবতে শুরু করল, কীভাবে কোথা দিয়ে আসতে পারে। সুভাষ গায়েন তো খারিজ হয়ে গেছে, তা হলে বাকি থাকল—গঙ্গাদা আর মীনা। এই দু—জন একই ধরনের কথা তাকে বলল, এটাই অবাক লাগছে।

মীনার পক্ষে কি সম্ভব সুভাষ গায়েনকে ঠেলে ফেলে দেওয়া? অত গায়ের জোর কি ওর আছে? কিন্তু পাঁচিলে দাঁড়ানো ভারী লোককেও হাঁটুর কাছে সামান্য ঠেলা দিলেই ব্যালান্স হারাবে আর সুভাষ গায়েন তো রোগাই ছিল। কেন জানি, এই মেয়েটিকে অবিশ্বাস করতে রোহিণীর মন সায় দিচ্ছে না। কোথায় যেন ওর একটা চারিত্রিক সত্যতা, গভীরতা আছে। নইলে এখনও পর্যন্ত শোভনেশের জন্য—। তার চিন্তার গতি বন্ধ হল নেমে আসা লিফট থেমে যাওয়ায়।

লিফটের ভিতরে সেই চারতলার বউটি, যাকে দেখে রোহিণীর মনে হয়েছিল, কোথায় যেন দেখেছি একে। আর এ—ও অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছিল। হয়তো ওরও ঠিক একইরকম মনে হচ্ছিল, কোথায় যেন দেখেছি।

লিফটের কোলাপসিবল দরজাটা বন্ধ করে রোহিণী বলল, ‘গ্রাউন্ড ফ্লোর?’

‘হ্যাঁ’।

দু—জনে পাশাপাশি চুপচাপ। দোতলা পার হল।

‘আপনাকে মনে হচ্ছে যেন চেনা চেনা!’

‘আমারও তাই লাগছে।’ রোহিণী মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল। লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে থেমেছে। দু—জনে বেরিয়ে এসে মুখোমুখি দাঁড়াল।

‘আমার নাম রোহিণী সেনগুপ্ত, আমি—।’

‘আ—আ—আ, এইবার মনে পড়েছে। আপনাদের বাড়িতে গেছিলাম একটা ছবি কেনার ব্যাপারে। সে প্রায় ছয় কী সাত বছর আগের কথা। দোতলার বড়ো ঘরটায় আমি, আমার স্বামী আর শোভনেশবাবু কথা বলছিলাম, তখন তিনতলা থেকে নেমে এসে আপনি কী একটা কথা জিজ্ঞাসা করে চেলে গেলেন।’

মনে পড়েছে রোহিণীর। স্বামী—স্ত্রী এসেছিল বটে ছবি দেখতে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে তাকিয়ে ওদের দেখেছিল। ছবি কিনেছিল কিনা সে জানে না। শোভনেশ তাকে কিছু বলেনি, সেও আর জিজ্ঞাসা করেনি।

‘ছবি কিনেছিলেন?’

‘হ্যাঁ, নিশ্চয়। ফটকের দিকে এগোতে এগোতে বউটি বলল, ‘আমাদের প্রথম ম্যারেজ অ্যানিভারসারি ছিল। উনি বললেন, তোমাকে ছবি প্রেজেন্ট করব। চলো, পছন্দ করবে। কম দামে বড়ো আর্টিস্টের ছবি কেনার একটা সুযোগ এসে গেছে, ছাড়া উচিত নয়। শোভনেশ সেনগুপ্ত থ্রো অ্যাওয়ে প্রাইসে ওঁর পেইন্টিংস বিক্রি করছেন খবর পেয়েছি।’

‘কোথা থেকে খবর পেয়েছেন?’

‘আমার ঠিক মনে নেই, উনি হয়তো বলতে পারবেন।’

‘আপনার স্বামীকে কোথায় পাওয়া যাবে?’

‘বাড়িতে। গড়িয়াহাট রোডে আমরা থাকি। এখানে আমার জ্যাঠামশাইরা থাকেন। আমার ছেলের অন্নপ্রাশন, তাই বলতে এসেছিলাম। এটি দ্বিতীয় পুত্র। ওহো, এখনও আমি আমার নামটাই বলিনি, আমার নাম পূর্বা ঘোষাল, স্বামীর ছোটোখাটো একটা লোহালক্কড়ের ব্যবসা আছে,ওঁর নাম চণ্ডীদাস। আপনি ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন? তা হলে চলুন না, গাড়ি রয়েছে।’

‘আমি থাকি সল্টলেকে। এত রাতে গড়িয়াহাট থেকে ফেরার ট্রান্সপোর্ট পাওয়া শক্ত। সল্টলেক যাব বললেই ট্যাক্সিওয়ালারা মাথা নেড়ে দেয়।’

‘ওসব আপনাকে ভাবতে হবে না, পৌঁছে দেবার ভার আমার।’

‘ছবিটা এখন কোথায়?’ রোহিণী জানতে চাই, চোখেমুখে কৌতূহল মাখিয়ে।

‘আমাদের বসার ঘরে। উনি তো বলেন, শোভনেশবাবুর মাস্টারপিসগুলোর মধ্যে এটা পড়ে।’

‘ন্যুড?’

‘হ্যাঁ।’

রোহিণী হঠাৎই স্মৃতিভারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। ২৫ দিগম্বর বর্ধন লেনের বাড়িটা চোখের সামনে পলকের জন্য ভেসে উঠল। তুলি হাতে ক্যানভাসের সামনে দাঁড়ানো, শোভনেশের চেহারাটাও মনে পড়ল। সেই ডিভানটা, চৌকো সাদা—কালো মার্বেল টালির মেঝে, গরাদহীন বিরাট বিরাট জানালা, নিমগাছ, ঘরের উঁচু সিলিং, কাঠের কড়িবরগা, পরপর সার বেঁধে চলে গেল চোখের সামনে দিয়ে।

‘ছবিটা দেখতে ইচ্ছে করছে।’

‘দেখে আসবেন চলুন।’ পূর্বা ঘোষাল হাত ধরে রোহিণীকে টানল।

পেভমেন্টের ধারে, একটা জলপাই রঙের মারুতি অপেক্ষা করছে। ড্রাইভার দরজা খুলে দাঁড়াল।

দশ মিনিটের মধ্যে গড়িয়াহাট রোড ছেড়ে বাঁদিকের একটা রাস্তায় ঢুকে, দু—তিনটে বাঁক নিয়ে ছোটো একটা দোতলা বাড়ির সামনে মারুতি থামল। একতলায় বসার ঘরে দু—জন লোক কথা বলছিল। তাদের একজনকে পূর্বা বলল, ‘দ্যাখো, কাকে ধরে এনেছি। মনে করতে পারবে কি? অবশ্য খুব অল্পক্ষণের জন্য, আধ মিনিট বড়ো জোর, দেখেছিলে।’

লোকটি অবাক মুখে, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ভ্রুদুটি একবারই শুধু ওঠানামা করল।

‘এনাকে তুমি পেলে কোথায়! মনে করতে পারব না মানে?’

লোকটির চোখ, রোহিণীর মুখ থেকে নীচের দিকে নামতে গিয়ে শালীনতার বেড়ায় আটকে গেল। রোহিণীর মনে হল, লোকটি বুদ্ধিমানই, বউয়ের সামনে কী কী কাজ করতে নেই, সেটা জানে। পরিচয় করিয়ে না দিলেও সে বুঝে গেছে ইনিই গৃহস্বামী চণ্ডীদাস, ছবিটার বর্তমান মালিক। বছর চল্লিশ বয়স, শ্যামবর্ণ, সুশ্রী, খাটিয়ে স্বাস্থ্য।

‘উনি ছবিটা দেখতে এসেছেন। জ্যাঠামশায়ের ওখানে, লিফটে আলাপ হল। আমরা ছবিটা কিনেছি শুনে বললেন, একবার দেখতে ইচ্ছে করছে।

‘ইচ্ছে হওয়াই স্বাভাবিক। ছবি যাঁরা বোঝেন, তাঁদের কাছে শোভনেশবাবুর এই ছবিটা বারবার দেখতে ইচ্ছে করবে।’ কথাটা বলে, চণ্ডীদাস চাপা গর্বে উদভাসিত মুখটা ফিরিয়ে, বাঁ হাতটা ঘরের একটা কোণের দিকে তুলল। আকারে ঘরটি চৌকো নয়, লম্বাটে। দু—ধারের দেওয়াল ঘেঁষে সোফা, মাঝে কার্পেট, কোনো টেবিল নেই। দেওয়ালে আলোর ব্রাকেট। রোহিণী ঘরে ঢুকে বাঁদিকটা লক্ষ করেনি। প্রায় তিরিশ ফুট দূরের কাঁঠালিচাঁপা রঙের দেওয়ালে, যে—একটা ছবি সাঁটা রয়েছে, আলোর ব্যবস্থার কারসাজিতে, সেটা এতক্ষণ তার নজরে আসেনি।

রোহিণী পায়ে—পায়ে এগিয়ে গেল ছবিটার দিকে। ওদিকটায় আলো কম। চণ্ডীদাস ব্যস্ত হয়ে সুইচ বোর্ডের দিকে প্রায় ছুটে গেল। সিলিং থেকে জোরালো স্পটলাইট পড়ল, ছবির উপর। রোহিণী থমকে গিয়ে স্তম্ভিত স্বরে বলে উঠল, ‘একি!’

সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে সম্বৃত করে, ছবির কাছে গিয়ে চোখ সরু করে খুঁটিয়ে দেখতে থাকল। তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে স্বামী—স্ত্রী। ঘরের অন্য লোকটি, সম্ভবত ব্যবসা সংক্রান্ত কাজেই এসেছিল, ইতিমধ্যে বিদায় নিয়ে চলে গেছে।

‘খুব সস্তায়, মাত্র দেড় হাজার টাকায় পেয়েছি। ভাবলে অবাক লাগে!’

রোহিণী পিছনে না তাকিয়েই বলল, ‘এটা কি আমাদের বাড়িতেই ছিল, নাকি অন্য কোথায়?’

‘আপনাদের বাড়িতে কিছু ছবি দেখিয়েছিলেন শোভনেশবাবু। তারপর বললেন, আরও যদি দেখতে চান, তা হলে অন্য জায়গায় রাখা আছে, সেখানে গিয়েও দেখতে পারেন।’

‘গোয়াবাগানে?’ রোহিণী অস্ফুটে বলল। তার প্রথমেই মনে এসেছে সুভাষ গায়েনের কথা।

জবাব না পেয়ে রোহিণী মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। স্বামী—স্ত্রী মুগ্ধ চোখে ছবির দিকে তাকিয়ে। দেখে তার মায়া হল। নিজেদের বিদগ্ধ, রুচিবান, শিল্পবোদ্ধা, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ইত্যাদি বোঝাবার জন্য নামি চিত্রকরের আঁকা ছবি কিনে এনে ঘরে রেখেছে। কিন্তু ছবিটা যে জাল, সেটা আর জানে না। রোহিণীও জানত না, যদি না সে ঠিক এই ছবিটাই কয়েকদিন আগে মীনা চ্যাটার্জির ঘরে দেখত।

ছবির আসল—নকল বোঝার মতো শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা তার নেই। কিন্তু সুভাষ গায়েন জানত কোনটে তার কারখানার প্রোডাক্ট আর কোনটে ওরিজিন্যাল। যেখানে বাস করছে, সেখানে কোনোমতেই সে লোককে দেখাবার জন্য জাল ছবি রাখবে না। অন্তত নিজের শালি, মীনার ঘরে তো নয়ই।

‘গোয়াবাগানে সুভাষ গায়েন নামে একটি লোকের কাছে ওঁর বহু ছবি ছিল। টাকাপয়সার ব্যাপারে তিনিই কথা বলতেন। কিন্তু এত কম দামে যে দিয়েছিলেন, এটা ভেবে আশ্চর্য লাগছে। সুভাষবাবু তো খদ্দেরদের গলা কাটতে ওস্তাদ ছিলেন।’

‘আমি তো গোয়াবাগানে গিয়ে ছবি কিনিনি।’

শুনেই ভ্রুকুটি করল রোহিণী। বলে কী! নকল ছবি সুভাষ গায়েন ছাড়া আর কার কাছ থেকে তাহলে কেনা সম্ভব। শোভনেশ এদের কোথায় তাহলে পাঠিয়েছিল?

‘তাহলে কার কাছ থেকে কিনেছিলেন?’ খুব স্বাভাবিক গলায় রোহিণী জানতে চাইল।

চণ্ডীদাস কিছু বলার আগেই পূর্বা বলল, ‘শোভনেশবাবু ওঁর এক বন্ধুর কাছে আমাদের যেতে বললেন। এই যে মহারানি নামে ম্যাগাজিনটা, তারই মালিক। আমরা ফোন করলাম তাঁকে। তিনি আমাদের যেতে বললেন সল্টলেকের একটা বাড়িতে, তিনতলার ফ্ল্যাটে।’

‘অ্যা!’ রোহিণী নিজের কানকে এমন অবিশ্বাস জীবনে কখনো করেনি, এবং এমন অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এভারেস্টচুম্বী বিস্ময়কে শহিদ মিনারের মাথায় নামিয়ে আনতে তার অসুবিধে হচ্ছে বইকী। ‘সল্টলেকে? সি ডি ব্লক? সেকেন্ড অ্যাভিনুয়ে? তিন নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে?’

‘বোধ হয়। এখন আর ঠিক মনে করতে পারছি না। আমরা তো ওঁর গাড়িতেই গেছিলাম। সেখানে প্রচুর ছবি ছিল। দুটো ঘরে।’

‘কোনো লোকজন ছিল না? মানে সেই ফ্ল্যাটে কেউ বাস করত না?’

‘বয়স্ক একজনকে দেখেছি, কেয়ারটেকারই হবে। বেল বাজাতে সে ভিতর থেকে দরজা খুলে দিয়েছিল।’ পূর্বা বলল।

হঠাৎই রোহিণীর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘কমলবাবু বোধ হয়।’

‘কমলবাবু। তাই কী?’ চণ্ডীদাস গভীর চিন্তায় ডুব দিল নামটা কুড়িয়ে আনতে। ‘হতে পারে।’

‘হতে পারে কি?’ পূর্বা তার স্বামীকে বিস্মৃতির তলদেশ থেকে টেনে তোলার জন্য বলল, ‘ওই নামেই তো উনি লোকটাকে ডেকে বললেন, ছবিগুলো দেওয়ালের গায়ে সাজিয়ে দাও, এঁরা দেখবেন। তোমার মনে পড়ছে না?’

কমলদা! রোহিণী ঢোঁক গিলল। আর কিনা গঙ্গাদার ওই ফ্ল্যাটেই জমা করা ছিল জাল ছবিগুলো! শোভনেশ নিশ্চয় তা জানত। এখন সে ছবিগুলো ধ্বংস করার জন্য এই ফ্ল্যাটে আসতে চাইবে। সে তো আর জানে না, গত ছ—বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। ছবিগুলোর বদলে এখন সেখানে বসবাস করছে কে, সে কথাটা ওকে গঙ্গাদা বলেছেন কি?

‘আপনি বসুন, চা না সফট ড্রিংকস?’

‘শুধু এক গ্লাস ঠান্ডা জল। মাথাটা কেমন যেন টিপটিপ করছে। শরীরটা ভালো লাগছে না। আমি কিন্তু এখনি যাব।’

রোহিণী এমন কাতর স্বরে বহু বছর কথা বলেনি। বহু বছর তার নিজের শরীরকে এত অপটু কখনো মনে হয়নি।

এই সরল, যথেষ্ট সচ্ছল, শিল্পপ্রেমী দম্পতিকে রোহিণীর বলতে ইচ্ছে করল না, যে—ছবিটা অত যত্নে, শ্রদ্ধায় শোভনেশের একটা মাস্টারপিস ভেবে ঘরে রেখেছেন, আসলে সেটা জাল। মূল ছবিটা রয়েছে মীনা চ্যাটার্জির ঘরে, যেটা সে রোজ রাতে চোখের সামনে রেখে ঘুমের দেশে পা বাড়ায়।

বড়ো শিল্পীর স্ত্রীকে বাড়িতে এনেছে, তাকে কীভাবে যে আপ্যায়িত করবে, ঠিক করতে পারছে না ঘোষালরা।

‘শুধু জল কী দেওয়া যায়’, পূর্বা ঘোষাল দ্রুত বসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রোহিণী বুঝতে পারছে তার ভাগ্যে এবার কী আসছে। প্লেট—ভরতি একগাদা মিষ্টি এবং সেই প্লেট সাফ করে তাকে অন্তত এক কিলো চর্বি সংগ্রহ করতে হবে। করতে হয় হোক, এখানে যদি পূর্বা ঘোষাল তাকে টেনে না আনত, তাহলে অনেক ব্যাপারেই সে অন্ধ থেকে যেত। চোখ খুলে যাওয়ার সাহায্য করার ঋণ শুধতে এক কিলো চর্বি বাড়িয়ে ফেলাটা কোনো ব্যাপারই নয়।

কিন্তু মাথাটা সত্যিই টিপটিপ করছে। সন্দেহ, শঠতা, ভয়, অবিশ্বাস, চমক ইত্যাদি ব্লাডপ্রেশার ও পালস রেট বাড়াবার যতরকম উপায় আছে, তার প্রত্যেকটা এখন রোহিণীর সহনক্ষমতা পরীক্ষায় নেমে পড়েছে।

সোফায় দু—হাতে কপাল চেপে ধরে রোহিণীকে বসে থাকতে দেখে চণ্ডীদাস বলল, ‘এতদিন পর ছবিটা হঠাৎ দেখার জন্যই বোধ হয়… একটা ইমপ্যাক্ট হয় তো!’

‘তাই হবে বোধ হয়।’

‘ওনার তো অনেকগুলো ছবিই তখন দেখেছিলাম, সবই কি বিক্রি হয়ে গেছে?’

‘বলতে পারব না। ছবির ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, খবরও রাখি না।’

‘সে কী! ছবির মালিক তো এখন আপনি।’

‘কিন্তু ছবিগুলো নাকি নষ্ট হয়ে গেছে। যার কাছ থেকে আপনি এই ছবিটা কিনেছেন তিনি ওঁর বন্ধু, নাম গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি। তিনি আমাকে বলেছেন, শোভনেশের সব ছবিই অযত্নে নষ্ট হয়ে গেছে।

‘ইসস, এখন তো কয়েক লক্ষ টাকা দাম হত।’

হঠাৎ রোহিণীর মনে হল, এই লোকটির কাছে তার মনের সন্দেহের কথা বোধহয় বলা যায়। বুদ্ধিমান, কর্মঠ এবং সহৃদয়, সবথেকে বড়ো কথা, শোভনেশের গুণগ্রাহী। একে কোনো কাজ করে দেবার জন্য অনুরোধ করলে সম্ভবত চেষ্টা করবে।

পূর্বা ঘরে ঢুকল, পিছনে ঝি—এর হাতে ট্রে।

‘না বলবেন না। খুব সামান্যই।’

রোহিণী প্লেটের দিকে তাকিয়েই বলল, ‘হ্যাঁ, আমি ‘না’ বলব না। তবে আমারও একটা অনুরোধ আছে, সেটা রাখতে হবে।’

স্বামী—স্ত্রী তাকিয়ে রইল। ক্রিকেট—বল সাইজের দুটো মোয়ার একটা প্লেট থেকে তুলে নিয়ে রোহিণী বলল, ‘শোভনেশের ছবিগুলো আমার মনে হয়, নষ্ট হয়নি। সেগুলো কোথাও, কারোর কাছে রয়েছে।’

‘বলেন কি?’

‘আপনি যেখানে গিয়ে ছবি কিনেছেন, সেই ফ্ল্যাটেই আমি এখন থাকি। আপনি তো অনেকগুলো ছবিই সেখানে দেখেছেন।’

‘নিশ্চয়ই।’ চণ্ডীদাস বলল।

‘আপনি কিন্তু খাচ্ছেন না।’ পূর্বা বলল।

রোহিণীর মুহূর্তের জন্য সুভাষ গায়েনকে মনে পড়ল। এদের বদলে ওই লোকটা এখন থাকলে স্বচ্ছন্দে সে বলতে পারত, একটা ঠোঙায় ভরে দিন, বাড়িতে গিয়ে সকালে খাব।

‘হ্যাঁ খাচ্ছি।’ রোহিণী কামড় বসাল। অনবদ্য, মনে মনে বলল, নলেন গুড় ব্যাপারটাই অন্যরকম।

‘আমার ছবি আনার কিছুদিন পরই ওই মিসহ্যাপটা ঘটল। তার মধ্যে কি আর উনি অতগুলি ছবি বিক্রি করতে পেরেছিলেন? মনে হয় না।’ চণ্ডীদাস কথাগুলো বলল ভেবেচিন্তে।

‘আমারও তাই ধারণা। তাহলে ছবিগুলো গেল কোথায়, সেটাই খুঁজে বার করতে হবে।’

‘ওই লোকটার কাছে থাকতে পারে।’ পূর্বা বলল। ‘তখনই আমার যেন কেমন কেমন মনে হয়েছিল।’

‘তোমার আবার কী মনে হয়েছিল? কই কিছু তো তখন আমায় বলোনি।’

‘বলার মতো মনে হয়নি বলেই বলিনি। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এত যে ছবি, এসবই কি ওঁর রিসেন্ট কাজ? তাইতে লোকটা বলল, প্রত্যেকটাই টাটকা। শোভনেশবাবুর ধারণা, তিনি নাকি শিগগিরই পাগল হয়ে যাবেন। তাই যা কিছু আঁকছেন, সবই তাঁর ওই বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। পাগল হয়ে গেলে খাবেন কী? সংসার চলবে কী করে? বন্ধুই তখন ছবি বিক্রি করে ওনার খরচ চালাবে। এইরকম ঘটবেই ভেবে নিয়ে নাকি সারাদিন ধরে উনি ছবি আঁকছেন আর সেগুলো জমা করে যাচ্ছেন। তার দরুনই এত ছবি জড়ো হয়েছে।’

‘এত কথা কখন তোমাদের মধ্যে হল?’ চণ্ডীদাস জানতে চাইল।

‘তুমি তখন অন্য ঘরে কমল বলে লোকটার সঙ্গে ছবি দেখছিলে। শোন না, তারপর আমি বললাম, শোভনেশবাবুর এমন ধারণা হল কেন যে, তিনি পাগল হয়ে যাবেন? তাইতে ওই মোটা লোকটা বলল, ওদের বংশে পাগল হয় প্রতি পুরুষে একজন করে। শোভনেশবাবুর মনে হয়েছে, তিনিও হবেন। অদ্ভুত!’

‘কথাটা হয়তো ঠিকই।’ চণ্ডীদাস ছবির দিকে মুখ ফিরিয়ে একটু আবেগ মাখিয়ে বলল, ‘পাগলামির ছোঁয়া না থাকলে জিনিয়াসদের ক্রিয়েটিভ প্রসেসটা… মানে সৃজনের, কী বলব…?

স্বামীকে অসহায়ভাবে কথা হাতড়াতে দেখে পূর্বা বলল, ‘পাগলরাই ভালো ছবি আঁকে।’

‘না, না, তা ঠিক বলছি না। পুরো পাগলরা আঁচড়ানো কামড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না। আমি বলছি জিনিয়াসরা এক ধরনের পাগলই হয়।’

‘চণ্ডীদাসবাবু’, আলোচনার মোড় ঘোরাবার জন্য রোহিণী দ্বিতীয় মোয়াটা তুলে নিল। তাই দেখে খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল পূর্বার চোখ। ‘শোভনেশের সেই বন্ধুটি খুব বাজে কথা বোধ হয় বলেনি। সত্যিই ওদের বংশে এইরকম একটা ব্যাপার আছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও, প্রতি পুরুষে একজন করে পাগল সত্যিই হয়েছে। কিন্তু আমাদের জানার বিষয়, ছবিগুলো এখন কোথায়, কার কাছে। আর সেটা খুঁজে বার করার জন্য আপনাদের একটু সাহায্য চাইব।’

‘আমাদের! কীরকম?’ চণ্ডীদাস বলল।

‘ভালো নয় মোয়াগুলো? জয়নগরে আমার বাপের বাড়ি থেকে আজ পাঠিয়ে দিয়েছে।’

‘দারুণ, বহু বছর পর এমন জিনিস খেলাম।… না, না, আর পারব না—একটা সূত্র তো পাওয়া গেছে, আপনারা গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জির কাছে প্রচুর ছবি জমা করা আছে দেখেছেন। আচ্ছা, আপনারা যদি ওঁকে বলেন, আবার ছবি কিনতে চান। তা হলে তো আপনাদের নিয়ে যাবেন ছবি দেখাতে?’

রোহিণী তাকিয়ে রইল দু—জনের মুখের দিকে। তার মনে হচ্ছে, ওদের কিছুটা উত্তেজিত করা গেছে।

‘আইডিয়াটা মন্দ নয়।’

‘যদি আবার কমসমে মাস্টারপিস পাওয়া যায়!’ পূর্বা সত্যিই উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। ‘তাহলে আর একটা এনে দিই?’

‘না না, একদম নয়। কী বড়ো বড়ো সাইজ! আবার খেলে রাতে আর কিছু খেতে পারব না।’ রোহিণী আঁতকে উঠল।

‘তাহলে রাতে আর আজ খেয়ে দরকার নেই।’ পূর্বা মোয়া আনতে চলে গেল। রোহিণী আশ্বস্ত হল। ফিরে গিয়ে আজ আর সেদ্ধ ডিম চিবোতে হবে না।

‘ফোন নাম্বারটা জানা থাকলে এখুনিই ওঁকে ফোন করতাম।’

রোহিণীর মুখস্থই আছে গঙ্গাপ্রসাদের বাড়ির নাম্বার। কিন্তু এঁর কাছে এখন সেটা মুখ থেকে বার করা মানেই বুঝিয়ে দেওয়া: গঙ্গাপ্রসাদকে সে খুব ভালো করেই চেনে, ফোন নাম্বারটা পর্যন্ত মনে করে রেখে দিয়েছে।

‘আচ্ছা, ফোন ডাইরেক্টরিতে তো পাব। এক মিনিট।’ চণ্ডীদাস ঘরের একধারে ব্র্যাকেটে রাখা টেলিফোনের কাছে গিয়ে তার তলার খোপ থেকে জাবদা বইটা বার করল।

‘আগে ‘বি’—টা দেখি তারপর ‘জি’ দেখব।’ পাতা ওলটাতে ওলটাতে চণ্ডীদাস নাম খোঁজায় মগ্ন হল। রোহিণী আর একবার ছবিটার দিকে তাকাল। সাদা কালো বরফি কাটা পাথরের মেঝেয় উবু হয়ে, দু—হাতে হাঁটু জড়িয়ে, স্তন দুটি ঊরুতে চেপে নগ্ন মডেলটি বসে রয়েছে। তার দেহের গড়ন নাকি হুবহু তার মতোই।

অবাক হয়ে রোহিণী তাকিয়ে থাকল। এই ছবি দেখা মানে তো তার নিজেকেই দেখা। আমি কি এইরকমই? রোহিণী নগ্ন নারীর প্রতিটি অংশে চোখ বোলাল। নট ব্যাড! মনে মনে তারিফ করল। মোয়া—টোয়া খেয়ে এমন একটা ফিগারকে নষ্ট করা একদমই উচিত নয়। তবে মোয়া গুড়ের তৈরি, চিনিতেই তো ওজন বাড়ায়।

চণ্ডীদাস ডায়াল করছে। নম্বর তাহলে পেয়েছে। রোহিণীর চোখ—কান সজাগ হল।

‘এটা কি গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জির বাড়ি?… আমার নাম চণ্ডীদাস ঘোষাল। উনি বাড়ি আছেন কি?… আচ্ছা আমি ধরছি।’ মাউথপিসে তালুচাপা দিয়ে চণ্ডীদাস নীচুগলায় রোহিণীকে বলল, ‘আছে। চাকর ধরেছিল, ডেকে দিচ্ছে।’

রোহিণী উঠে গিয়ে চণ্ডীদাসের পাশে দাঁড়াল। প্লেট হাতে পূর্বা ঢুকল। তাতে মাছ ভাজা।

‘আগে এগুলো খান, তারপর…’ চুপ করে গেল, রোহিণী তার ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ‘স স স স’ শব্দ করায়।

‘হ্যালো, নমস্কার, আমার নাম চণ্ডীদাস ঘোষাল,… আমাকে আপনার হয়তো মনে নেই, বছর সাতেক আগে আমি আর আমার স্ত্রী ছবি কিনতে গেছিলাম আপনার কাছে, শোভনেশ সেনগুপ্তর ছবি… অ্যাঁ আপনার মনে আছে? হ্যাঁ হ্যাঁ একটা ন্যুড কিনেছিলাম। তা, আমরা ওনার আর একটা ছবি রাখব ঠিক করেছি। হাজার চার—পাঁচের মধ্যে হলে পারব।’ চণ্ডীদাস আড়চোখে রোহিণীর দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করল। রোহিণীও মাথা নেড়ে অনুমোদন জানাল।

‘বলুন কবে যাব ছবি দেখতে?’

সারা ঘরে এখন হিচকক ফিল্মের ক্লাইম্যাক্স। পূর্বা আর রোহিণী টানটান হয়ে তাকিয়ে চণ্ডীদাসের মুখের দিকে। সেখানে অভিব্যক্তি বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও শ্বাসপ্রশ্বাস, রক্তচাপ বদলাচ্ছে।

‘তাহলে কী করা যায়?’ চণ্ডীদাস জানতে চাইছে।

ক্লাইম্যাক্সটা আর একটু উপরে উঠল।

‘পরশু আবার ফোন করব? বাড়িতে, এই সময়ে?…হ্যাঁ, হ্যাঁ, আচ্ছা, নমস্কার।’

ফোন রেখে চণ্ডীদাস হাসল এবং গম্ভীর হল।

‘কী করা যায় মানে? ছবি কি আর নেই?’ পূর্বা উদবেগ প্রকাশ করল।

‘কী করা যায় মানে হল, ছবিটবি আর ওনার কাছে নেই। শোভনেশবাবু সব ছবি নাকি দিয়ে গেছেন একজনকে। তার নাম উনি বলতে রাজি নন। তবে তাকে উনি জিজ্ঞাসা করবেন, ছবি বিক্রি করতে রাজি আছে কি না। আমাকে বললেন, পরশু ফোন করে জেনে নিতে।’

‘তার মানে ছবি তাহলে রয়েছে। কিন্তু কার কাছে, কোথায় রয়েছে, সেটা জানার জন্য পরশু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তাই তো?’ রোহিণী কথা বলতে বলতে পূর্বার হাত থেকে প্লেটটা নিল। বড়ো আকারের চারটে পার্শে মাছ ভাজা।

‘এ কিন্তু খুব অন্যায়, এতগুলো ভাজা কি খাওয়া যায়?’ মিষ্টির পর এই তেলে ভাজা মাছ। তেলও তো চর্বি তৈরি করে। কী যে মুশকিলে পড়া গেল। রোহিণী বিরক্ত হল নিজের উপর। এইসব খাবার জিনিস তার চোখের সামনে ধরে দেওয়া কেন! জিনিয়াসের স্ত্রীকে খাতির করা?

‘বসুন তো, আপনি বাচ্চচাও নন, বুড়িও নন। মোটে তো চারটে!’ পূর্বা হাত ধরে তাকে সোফায় বসিয়ে দিল।

‘যদি মিস্টার ব্যানার্জি বলেন, হ্যাঁ ছবি আছে বিক্রির জন্য, দেখতে আসুন, তাহলে?’

‘তাহলে দেখতে যাব, পছন্দ হলে কিনেও নেব। তুমি তো চার—পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম দিতে রাজি হলে।’

‘ওটা তো একটা টোপ দিলাম।’

‘সত্যি সত্যি নয়!’ পূর্বা ফ্যালফাল করে তাকিয়ে থেকে, ধীরে ধীরে গম্ভীর হয়ে উঠল। রোহিণী অস্বস্তি বোধ করে ভাবল, বিষম খেয়ে কাশতে শুরু করবে। পূর্বা তাহলে ব্যস্ত হয়ে জল আনতে ছুটবে। সে বার দুই খুক খুক করেছে মাত্র, তখনই চণ্ডীদাস বলল, ‘চার পাঁচ কী, দশ পর্যন্ত দেব যদি এইরকম পছন্দের একখানা পেয়ে যাই।’

পূর্বার মুখ দেখে রোহিণী বুঝল, আর তার বিষম খাবার দরকার নেই। চণ্ডীদাস সত্যিই বুদ্ধিমান লোক। পছন্দ হওয়া বা না হওয়া পর্যন্ত তার দশ হাজার টাকার অফারটাকে সে টিকিয়ে রেখে যাবে।

‘যদি ছবি দেখতে যেতে বলেন, তাহলে আপনারা অবশ্যই যাবেন। জায়গাটা কোথায় সেটা জেনে নেওয়া দরকার। তার থেকেও বড়ো কথা, ছবিগুলো এখন কার হেফাজতে রয়েছে?’ রোহিণী দ্বিতীয় ভাজাটা মুখের কাছে থামিয়ে, কথাটা বলেই, কামড় দিল।

‘আপনি কি মনে করেন ছবিগুলো কেউ চুরি করেছে?’

‘আমি কিছুই মনে করি না। তবে নানান ধরনের কথাবার্তা কানে আসছে, ঘটনাও কিছু ঘটছে। আপনারা তো জানেনই শোভনেশের কেন যাবজ্জীবন হয়েছে। ওর বহু ছবিই—’ রোহিণী থেমে গেল। জাল হয়েছে বলে ফেলেছিল আর কী! ‘কে যে নিয়ে গেল সেই সময়।’

আর খেতে ইচ্ছে করছে না। রোহিণী উঠে দাঁড়াল। ‘পারছি না আর। শরীরটা সত্যিই ভালো নেই। বেসিনটা কোথায়?’

‘না, না, ভালো না লাগলে দরকার নেই খাওয়ার। এদিকে বেসিনটা।’ চণ্ডীদাস ব্যস্ত হয়ে ঘরের পিছনের দরজায় এগিয়ে গেল।

গাড়িতে ওঠার সময় রোহিণী বলল, ‘আমি পরশু রাতে এই সময় ফোন করে জেনে নেব, মি. ব্যানার্জি আপনাকে কী জানালেন।’

‘হ্যাঁ, তাই করবেন।’ চণ্ডীদাসের সঙ্গে পূর্বাও নমস্কার জানাল।

পার্কসার্কাস থেকে ডান দিকে ঘুরে মোটর ইস্টার্ন বাইপাস ধরে যখন সল্টলেকের দিকে যাচ্ছিল, তখন রোহিণী চিন্তায় ডুবে যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিল। তার কাছে সবথেকে অবাক লাগছে, শোভনেশের ছবিগুলো কিনা এই ফ্ল্যাটেই ছিল আর সেখান থেকে বিক্রিও হত।

এরপর সে মীনা চ্যাটার্জির কথা ভাবল। বাঁ হাতটা আপনা থেকেই গালের দিকে উঠে গেল। বেশ জোরেই মেরেছে। বড়োই আচমকা চড়টা এল, একটু আগে আন্দাজ পেয়ে গালের মাসল শক্ত করে ফেললে এতটা লাগত না। রোহিণীর এখন মায়া হচ্ছে মীনার জন্য। ওকেই সুভাষ গায়েনের খুনি প্রতিপন্ন করার জন্য সে যা কিছু বলেছে, সবই তো আন্দাজে। আসলে ওকে চটিয়ে দিয়ে কিছু কথা বেরোয় কিনা সেটাই দেখতে চেয়েছিল। চিঠি দুটোর হাতের লেখা ওর কাজের মেয়েটির না—ও হতে পারে, সিঁড়ির বালবটা মীনা না—ও ভাঙতে পারে, সুভাষ গায়েনকে সে পাঁচিল থেকে না—ও ঠেলতে পারে—রোহিণী মাথা নাড়ল। আন্দাজগুলোকে সে টেনে লম্বা করার কাজটা একটু বেশিই করে ফেলেছিল, যেজন্য—সে গালে হাত বুলোল।

মীনার সন্দেহ, সুভাষ গায়েন ছবি জাল করার কারবার তুলে দিয়েছে বললেও, হাতে কিছু ছবি রেখে দিয়েছিল। সেই ছবিগুলো, এখন কোথায়? ওগুলোর খবর কি গঙ্গাদা জানেন না? হয়তো জানেন না, তাই হয়তো আজ মীনার কাছে এসেছিলেন খোঁজ করতে।

আর ওই চিঠি দুটো! কে এভাবে ভয় দেখাল মীরাকে? শোভনেশ নয়। যদিও বয়ান থেকে মনে হবে, সেই। মৃত্যু তালিকার তিন নম্বরে মীনা। এক নম্বর ছিল সুভাষ গায়েন। তাহলে দু নম্বরে কে? এভাবে চিঠিফিঠির কথা চিপ ডিটেকটিভ গল্পেই পাওয়া যায়। কিন্তু মীনাকে সত্যিই কেউ দিয়েছে। নইলে সে বলল কেন, কেউ ভয় দেখাতে চেয়েছে। ভালো। দেখাক। আমিও তা হলে দেখে নেব।

গাড়ি স্টেডিয়াম পেরিয়ে গেল। রোহিণী সোজা হয়ে বসল। এবার ড্রাইভারকে নির্দেশ দিয়ে নিয়ে যেতে হবে বাড়ি পর্যন্ত। রাস্তার আলোয় সে হাতঘড়িতে সময় দেখল, পৌনে দশটা।

বাড়ির গেটের সামনে তুষার দত্তর গাড়িটা দাঁড়িয়ে। তার পিছনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রোহিণী নামল। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল তুষার দত্ত, সঙ্গে এক বৃদ্ধ দম্পতি।

‘এখন ফিরছেন বুঝি! আমার কাকা আর কাকিমা, পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।’

‘অ।’

‘আপনার একটা ফোন এসেছিল।’

‘ফোন? কে করেছে?’

‘নাম বলব না। আপনি নেই শুনে বলল, পরে আবার করবে।’

‘পরে মানে আজকেই কি?’

‘তাও কিছু বলল না, ঝপাত করে রেখে দিল। এই লোকগুলোকে নিয়েই হয় মুশকিল, এমন আধাখ্যাচড়া করে রাখবে ব্যাপার, এখন আপনি বসে থাকুন ফোনের জন্য। তবে যত রাতেই আসুক, আমি আপনাকে ডেকে আনব।’

‘ওঁরা দাঁড়িয়ে আছেন।’

‘ওহ, হ্যাঁ… কাকা গাড়িতে উঠুন, দাঁড়িয়ে কেন?’

‘আপনিও উঠুন, নইলে চালাবে কে?’

‘হাঁ উঠছি। আপনার বাঁ গালে একটা লালচে ভাব দেখছি, ধাক্কা—টাক্কা লেগেছিল নাকি?’

‘হ্যাঁ, একটা লোকের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল। ইয়া চেহারা! কী শক্ত মাসল! বোধ হয় বডিবিল্ডার।’

‘আপনি সঙ্গে সঙ্গে চড় কষালেন তো?’

‘পাগল, তাহলে আমার হাতটা ভেঙে যেত।’

‘না, না, আপনার এটা ভুল ধারণা। আপনি আমাকে মেরে দেখুন। শরীরটা ফুলের মতো নরম করে চড়টা অ্যাবসার্ব করে নেব।’

‘আচ্ছা, পরে এটা করে দেখব। ওনারা গাড়িতে বসে আছেন।’

রোহিণী হাসি চেপে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে, তখন দোতলার অন্ধকার বারান্দা থেকে কুন্তী ডাকল, ‘রুনিদি।’

মুখ তুলে সে তাকাল। ‘খবর কী তোমার?’

‘একবার আসুন না।’

একসঙ্গে দুটো করে সিঁড়ি টপকে রোহিণী দোতলায় উঠে এল। বেল বাজাবার আগেই দরজা খুলল কুন্তী।

‘এই কদিন তোমার তো টিকিটিও দেখতে পেলাম না। করো কী সারাদিন? কর্তা নেই বলে—’

কুন্তী ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে চোখ বিস্ফারিত করল। ‘মাসিমার কাছে ঝাড় খেয়েছি, আবার আপনিও।’

‘বলবেনই তো। বাড়ির বউ, স্বামী এখন বাইরে, আর তুমিও সারাদিন বাইরে যদি ঘুরে বেড়াও তাহলে কি শাশুড়িরা বরণ ডালা নিয়ে অপেক্ষা করবে? এই সেদিন বাস থেকে দেখলাম তুমি বউবাজারের দিকে হেঁটে চলেছ। যাচ্ছিলে কোথায়, গহনা কিনতে?’

‘যাচ্ছিলাম মিস্ট্রি সলভ করতে দিগম্বর বর্ধন লেনে।’

‘অ্যাঁ!’ রোহিণী বোকার মতো তাকিয়ে রইল।

‘যা একখানা জিনিস আমায় গছিয়েছেন। ওসব কী বাড়িতে বসে ভেবে ভেবে সলভ করা সম্ভব? আপনার কাছে যতটুকু শুনেছি আর লেখাটা থেকে যতটুকু পেয়েছি, তাতে মনে হল ব্যাপারটা শুধুই মাথার নয়, গতরেরও। তাই চলে গেলাম বাড়িটা দেখতে।’

‘বলো কী! তুমি ওই বাড়িতে গ্যাছো?’

‘আস্তে, আস্তে।’ ভিতরের ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে কুন্তী বলল, ‘এখন টিভি দেখছেন। ওহ আপনার কী প্রশংসা আজ। ঠাকুর—দেবতায় ভক্তি তো দেশ থেকে উঠেই গেছে। তবু দু—একজনের মধ্যে এখনও আছে, তার মধ্যে আপনি একজন। প্রথমে আপনাকে দেখে যা ভেবেছিলেন, এখন দেখছেন মোটেই তা নন। বিশ্বনাথের প্রসাদী ফুল নিতে ছুটেছে, কত লক্ষ্মী মেয়ে! ব্যাপার কী রুনিদি? জপালেন কীসে?’

‘জপতপ পরে হবে, আগে বলো সেখানে কী হল? কী দেখলে?’

‘দেখলুম, শুনলুম, বুঝলুমও। আমি ছবি তুলেছি, টেপও করেছি। কিছু কিছু নোটস করে রেখেছি। সাজিয়ে লিখে আপনাকে দোব। ছাপিয়ে দেবেন তো?’

‘আগে দেখি তো লেখাটা, তারপর ছাপানোর কথা ভাবা যাবে। সেখানে কী শুনলে, দেখলে?’

‘এখন এখানে দাঁড়িয়ে অতসব তো বলা যাবে না। আপনাকে কাল গিয়ে বলব। তা ছাড়া আরও দু—একদিন যেতে হবে। আচ্ছা, গঙ্গাপ্রসাদ আর তার বউ তো মোমিনপুরে থাকে, তাই না? বাসুদেবপুর বলে একটা গ্রামে ওদের তো একটা বাড়িও আছে? সেখানে কখনো গেছেন?’

‘না।’

‘শোভনেশ সেনগুপ্ত ওখানে কিছুদিন ছিলেন, তাই না?’

‘হ্যাঁ, বিয়ের আগে।’

‘ওঁর ভাই পরমেশ থাকে বউবাজারের বাড়িতে। তাকে শেষ কবে দেখেছেন?’

‘বছর ছয়েক আগে।’

‘তারপর আর ওখানকার কোনো খবরটবর রাখেন না।’

‘একদমই নয়।’

‘দিন তিনেক আগে একজন সুন্দরী প্রৌঢ়া সন্ধেবেলা ঘোমটায় মুখ ঢেকে এসেছিল মোটরে, পরমেশের সঙ্গে কথা বলে গেছে। কে এসেছিল সেটা জানতে হবে।’

‘শুনেছি, পরমেশ নাকি এখন পাগল হবার মতো অবস্থায়। চোখে ভালো দেখতে পায় না, কঙ্কালের মতো চেহারা, মাথায় চুল নেই, গায়ে চুলকুনি।’

‘এই তো দেখছি খবর রাখেন।’

‘এটা কি রাখার মতো একটা খবর নাকি! কানে এল, তাই মনে আছে।’

‘কে আপনার কানে খবরটা দিল, জানতে পারি কী তার নাম?’

‘বললে কী চিনতে পারবে? তার নাম সুজাতা গুপ্ত।’

কুন্তী ঠোঁট কামড়ে সেকেন্ড পাঁচেক ভেবে বলল, ‘নাহ, চিনি না।’

খুব মেলামেশা না থাকলে এইরকম ফ্ল্যাট বাড়িতে প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধাদের নাম জানা সম্ভব নয়। মাসিমা কাকিমা হয়েই তারা রয়ে যান। রোহিণী নিজেও কী আগে জানত, ওনার নাম সুজাতা!

‘এর কথা তোমায় আগে বলিনি। তবে বলব। একটা সায়কোলজিক্যাল কেস, তেমনি মীনা চ্যাটার্জিও। ইনি ফিল্ম অ্যাকট্রেস। দুজনেই শোভনেশকে চেনে জানে। ওর জীবনের প্রথম ন্যুড মডেল সুজাতা। আর মীনা হল বীণার বোন।’

‘এদের কথা আগে আমায় বলেননি!’ কুন্তী আক্ষেপ করল। তাহলে দেখা করে কথা বলতাম। ওহহ ফিল্ম অ্যাকট্রেসের সঙ্গে আমার কথা বলার ইচ্ছে যে কতদিনের!

‘তুমি এই ক—দিন ধরে মিস্ট্রি সলভ করতে আদাজল খেয়ে সিরিয়াসলি নেমে পড়েছ, ভাবতেই পারছি না!’

‘আমাকে কী ভেবেছেন আপনি! অপদার্থ, অকর্মা, আদুরে, ছেলেমানুষ, বোকা…।’

‘থাক থাক তালিকাটা আর লম্বা কোরো না। তোমাকে আমি ওই কথাগুলোর ঠিক উলটোটাই ভাবি, তার সঙ্গে আরও একটা—পাগলি। রহস্য উদঘাটন যদি করতে পারো, প্রমিস করছি, তাহলে আমি তোমার দশ কেজি ওজন বাড়াবার ব্যবস্থা করবই। এখন চলি, কাল তাহলে আসছ, আমি সারাদিনই থাকব।’

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে রোহিণী ভাবল, কে আবার ফোন করল? গঙ্গাদা ছাড়া আর আছে রাজেন। জয়পুরে আজ খেলার শেষ দিন। সেখান থেকে ফোন করতে পারে, না—ও পারে।

নিজের ফ্ল্যাটের দরজার দিকে তাকিয়েই সে থমকে গেল। পাল্লার নীচের দিকে একটা সাদা কাগজ সেলোটেপ দিয়ে আটকানো।

কাগজ নয়, চারভাঁজ করা একটা চিঠি। টেপের আঠা থেকে চিঠিটা ছাড়িয়ে নিয়ে সে ভাঁজ খুলল। কোনো সম্বোধন নেই। শুধু লেখা: ‘এক নম্বর সুভাষ গায়েন, দু নম্বরে তুমি, তিন নম্বরে মীনা চ্যাটার্জি। তোমরা আবর্জনা। সব সাফ করব। আমি আসছি।’

ভ্রূ কুঁচকে রোহিণী চিঠিটা আবার ভাঁজ করে চাবি দিয়ে দরজা খুলল। আলো জ্বেলে ঘরের চারধারে চট করে চোখ বোলাল। একটু যে গা ছমছম করছে না, এটা সে অস্বীকার করবে না। যেকোনো সময় এমন একটা হুমকি পেলে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠবেই। অবশ্য প্রথম ধাক্কাটা মীনার ওখানেই লেগেছিল। তবে মীনার মতো কাগজটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলার ইচ্ছা তার হল না। হাতের লেখা দেখেই তো সে বুঝে গেছে, একই হাতে তাকে আর মীনাকে লেখা।

ঝোলার মধ্যে কাগজটা রেখে সে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ল পা ঝুলিয়ে। এখন মাথার মধ্যেটা একদম সাদা। অন্ধকার সিনেমা হলে ছবি শুরু হবার জন্য প্রতীক্ষারত উন্মুখ দর্শকদের মতো তার অবস্থা। কে একজন ফোন করেছে, কে একজন চিঠি দিয়েছে—কিছুই তার করার নেই। শুধু অপেক্ষায় থাকতে হবে। প্রোজেক্টর থেকে মাথার উপর দিয়ে তীব্র আলোক রশ্মি গিয়ে সাদা পর্দায় না ফেলা পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া তার মধ্যে জাগবে না।

বেল বাজল। রোহিণীর মনে হল, এইবার বোধ হয় শো শুরু হতে যাচ্ছে। দরজা খুলতেই বুবুল। হাতে একটা ফোন নম্বর লেখা চিরকুট।

‘এখান থেকে একটু আগে ফোন করেছিল। বলল, আপনি ফিরেই যেন এই নম্বরে ফোন করেন।’

নম্বরটা গঙ্গাদার বাড়ির ফোনের। রোহিণী ব্যস্ত হল না। চাবিটা হাতে নিয়ে সে মন্থর পায়ে উঠে এল।

গঙ্গাপ্রসাদের বাড়ির ফোন নম্বর ডায়াল করে দু—তিন সেকেন্ড পরই রোহিণীর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ‘হ্যালো’ বলে ফেলেছিল প্রায়! শব্দটা জিভের ডগা থেকে ফিরিয়ে এনে সে রিসিভারটা কানে চেপে ধরল। শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দও যেন শুনতে না পায়, এই ভেবে সে নিশ্বাসও বন্ধ করে রইল।

‘রোহিণী এসেছিল আমার কাছে।’

‘অ। তা কীজন্য? কী বলল?’

‘সুভাষদার জন্য শোক সমবেদনা জানাতে। ওর সন্দেহ : আমিই ছাদ থেকে সুভাষদাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছি।’

রোহিণী বন্ধ করে রাখা শ্বাস ফেলতে গিয়ে থমকে গেল। মীনা রিপোর্ট করছে গঙ্গাদাকে।

‘ভালো, এই ধারণাটাই করুক।’

তার মানে? রোহিণী বিভ্রান্ত হল। এই ধারণাটা করুক মানে কী? তাহলে মীনা নয়, অন্য কেউ ঠেলেছিল!

‘আপনাকে ও দেখেছে আমার কাছে আসতে।’

‘সে কী? কখন, কীভাবে দেখল?’

‘হয়তো আপনাকে এই বাড়িতে ঢুকতে বা বেরোতে দেখেছে। আপনি চলে যাবার পরপরই ও এল। ওর ধারণা, শোভনকাকা এখানে লুকিয়ে আছে কি না জানতেই আপনি এসেছিলেন।’

‘ভালো, এই ধারণাটাই যেন ওর থাকে। আর কিছু?’

আবার ওই ধারণা! রোহিণীর মনে হল, এদের দু—জনের মধ্যে যেন কোনো একটা চুক্তি হয়েছে কোনো এক ব্যাপারে। তার মনে ভুল ধারণা থাকুক এটা ওরা চায়।

‘ওকে চিঠি দুটো দেখালাম।’

‘কী বলল দেখে?’

‘ওর বিশ্বাস: চিঠি দুটো আমিই কাউকে দিয়ে… আমার কাজের মেয়েটাকেই সন্দেহ করছে, তাকে দিয়েই লিখিয়েছি ধরে নিয়েছে।’

‘আরও ভালো।’

রোহিণী বুঝল, চিঠিটা তাহলে অন্য কারোকে দিয়ে লেখানো। অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না। শুধু একটা জিনিস জানা গেল, মীনাকে জানিয়েই চিঠিটা তাকে দেওয়া হয়েছে। ওটা একেবারেই ভেজিটেবল মার্কা হুমকি!

‘আমি বলেছি, চিঠি দুটো আপনাকে দেখিয়েছি। দেখে আপনি বললেন, শোভনেশের কাজ।’

‘হুম।’

‘কিন্তু রোহিণী তা বিশ্বাস করেনি।’

‘করেনি?’ কিছুক্ষণ চিন্তাগর্ভ নীরবতা। ‘কেন? অবিশ্বাসের কারণ?’

‘শোভনকাকার পক্ষে এভাবে চিঠি লিখে দরজায় আটকে দিয়ে যাওয়াটা, ওর মতে অসম্ভব। এটা আমার নিজেরই কাজ বলে সন্দেহ করেছে।’

‘এখন আর তা করছে না। বাড়ি ফিরেই রোহিণী ইতিমধ্যে এইরকম একটা চিঠি পেয়ে গেছে।’

যাক, ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কাজটা তাহলে গঙ্গাদারই। রোহিণী মুখটা রিসিভার থেকে পাশে ঘুরিয়ে নিশ্বাস ছাড়ল। আমাকে ভয় পাওয়াতে চেয়ে এত কাণ্ড!

‘গঙ্গাবাবু, চারদিন ধরে আমি অপেক্ষা করছি। আপনি বললেন, সুভাষদা যেখানে আছে শোভনকাকা সেখানে আসবেন না। কিন্তু সুভাষদা তো আর…।’

‘আহহা এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন। শোভু আর তো ফোন করেনি, করলেই তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব। তোমার কাছে ওর আঁকা কতগুলো ছবি রয়েছে, সেটা কিন্তু আজও আমায় তুমি বললে না।’

‘বিশ্বাস করুন, একখানা ছবিও আমার কাছে নেই।’

মিথ্যে কথা। রোহিণী ভাবল, একখানা তো আমি নিজেই দেখেছি। যার নকলটা কিনেছে ঘোষালরা। মীনা দিব্যি মিথ্যে বলে দিল!

‘সুভাষের কাছে কিছু ছিল। তা ছাড়া তোমার নিজের কালেকশানেও নাকি একটা দুটো আছে বলে শুনেছি।’

‘আপনাকে তো তখন বললামই, সুভাষদার কাছে একখানাও জাল বা আসল থাকলে আমি ঠিক জানতে পারতাম। আমার কাছে কোনো ছবি আছে কী নেই, এটা কী করে যে আপনাকে বোঝাব—আপনার কথামতো তো আমি সব কাজই করেছি,…নরকেও আমার স্থান হবে না, শুধু একটা আশা নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে হাত মিলিয়েছি, কো—অপারেট করছি অথচ…।’

‘এইবার চুপ করো তো। শোভুর ‘উওম্যান ইন সলিচ্যুড’ নামের বিখ্যাত ছবিটা তোমার কাছে আছে, এই খোঁজ আমি পেয়েছি। ওটা আমার চাই।’

‘আমি তো আপনাকে বার বার বলেছি…’

‘আচ্ছা আচ্ছা, আমি খুঁজে নেব ছবিটা কোথায় আছে। এবার বলো, রোহিণী আর কী বলল?’

‘বলল, শোভনকাকা ওকে টেলিফোন করতে পারে।’

‘আর তাই শুনে তুমিও বললে, যেন সে তোমার শোভনকাকাকে তোমার কাছে আসতে বলে দেয়, কি ঠিক বলেছি?’

‘না না আমি এরকম কথা ওকে বলতে যাব কেন? বরং রোহিণীই বলল, আপনার কথা থেকে তার নাকি ধারণা হয়েছে, শোভনকাকা খুন করতে পারেন।’

আবার মিথ্যে কথা। রোহিণীর বলতে ইচ্ছে করছে, ওহে মীনা, তুমিই তো বাপু বললে, তোমার শোভনকাকা আমার গায়ে আঁচড়টিও দেবে না।

‘রোহিণীকে?’

‘হ্যাঁ।’ একটু ইতস্তত করে, ‘ওর মনে হচ্ছে শোভনকাকা নয়, অন্য কেউ একজন তাকে মার্ডার করতে পারে।’

বহুত আচ্ছা মীনা চ্যাটার্জি। রোহিণী মনে মনে বলল, চালিয়ে যাও। তোমার কথাগুলো আমার বলে চালাচ্ছ! আর আমিও যদি সুযোগ কখনো পাই তাহলে আমার কথাও তোমার বলে চালাব।

‘কে সেই অন্য কেউ? রোহিণী নাম বলল?’

‘না। আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জানতে চেয়েও ওর পেট থেকে নামটা বার করতে পারিনি। আর একটা কথাও রোহিণী বলল,… শোভনকাকাই সম্ভবত মার্ডারড হতে পারেন।’

সর্বনাশ! এটাও নাকি আমি বলেছি? রোহিণী বলল, টুক করে এবার সে তার গলাটা ঢুকিয়ে বলবে নাকি—গঙ্গাদা, এটা ও বলেছে, আমি নয়।

‘ননসেন্স! রোহিণী এসব কী রটাচ্ছে? শোভনেশ তো অলরেডি মরা মানুষই। ওকে কে মারতে যাবে? কেনই বা মারতে যাবে? শুধু পুলিশের হাতে তুলে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। তুমি কি ওকে বলেছ, বিয়ে—টিয়ে করে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে, এইসব ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে?’

‘হ্যাঁ বলেছি। মনে হল, ও যেন সেটাই চায়।’

‘ভালো, খুব ভালো। এটাই আমি শুনতে চেয়েছি। ধন্যবাদ, আমাকে এটা জানানোর জন্য।’

‘গঙ্গাবাবু, আমি কিন্তু শোভনকাকার জন্য অপেক্ষা করছি। আপনি বলেছিলেন…’

‘আঃ, আবার সেই এক কথা।’ প্রবল বিরক্তি আর ধমক মিশিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ বলে উঠলেন, ‘তুমিও কেন বিয়ে—থা করে ঘরসংসার সাজিয়ে বসলে না? টাকাওয়ালা লোক ধরে বেড়াব আবার শোভনকাকার জন্যও হেদিয়ে মরবে। এসব না করে…।’

‘গঙ্গাবাবু!’

রোহিণীর কান থেকে ফোনটা ইঞ্চি চারেক ছিটকে গেল। মেয়েদের মধ্যে গলা থেকে এমন শব্দ সিংহী বা বাঘিনিরাই বার করতে পারে।

‘আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কোনোরকম কমেন্টস আমি বরদাস্ত করব না। মনে রাখবেন, মীনা চ্যাটার্জিরও এই শহরে কিছু খারাপ লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে।’

সাব্বাস। রোহিণী তারিফ জানাল। এমন গলার স্বর অভিনয়ের সময় যদি মীনা বার করতে পারে, তাহলে বড়ো অভিনেত্রী অবশ্যই হতে পারবে।

‘আই অ্যাম সরি।’ বিনীত স্বর এবং ফোন রেখে দেবার শব্দ হল।

রোহিণীও রিসিভার রেখে দিয়ে মনে মনে ধন্যবাদ জানাল কলকাতার টেলিফোনকে। ভাগ্যিস ওরা যন্ত্রপাতিতে বাসা বাঁধা ভূতকে খোঁচাখুঁচি করে চটায় না!

নন্দ আর বুবুল খেতে বসেছে। আরতি পরিবেশনে ব্যস্ত। অতক্ষণ ধরে ফোন কানে লাগিয়ে আন্টি চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল কেন, সেটা জানার জন্য ভাইবোনকে খুবই কৌতূহলী মনে হচ্ছে। রোহিণী একটা চেয়ার টেনে টেবিলে বসল।

আরতি একটা প্লেট হাতে তুলে নিয়ে বলল, ‘একটু কিছু মুখে দেবেন নাকি?’

‘আরে না না।’ রোহিণী আঁতকে ওঠার ভান করল। ‘ইয়া বড়ো বড়ো দু—খানা জয়নগরের মোয়া, বুঝলে নন্দা, নারকেলের মতো সাইজ আর চারখানা পার্শে মাছ ভাজা খেয়ে এখন আমার পেটে আর একদানা ভাত রাখারও…ওটা কী রেঁধেছেন বলুন তো?’ রোহিণী টেবিলের প্রান্তে একটা বড়ো বাটির দিকে গলা উঁচিয়ে তাকাল।

‘কাকা আর কাকিমা এসেছিলেন। ছানার ডালনা খেতে কাকা খুব ভালোবাসেন, তাই করেছি।’

‘অ।’ রোহিণী দ্রুত ভেবে যাচ্ছে, মোয়া, পার্শে মাছের পর ছানাটা খাওয়া ঠিক হবে? ছেড়ে দেওয়াই ভালো। বড্ড ফ্যাট আজ শরীরে ঢুকেছে। কিন্তু ছানার ডালনা! গাওয়া ঘি আর গরম মশলার গন্ধটা যে জিভের অবস্থা এমন করে দেবে, কে জানত। সন্দেহ নেই, দারুণ রেঁধেছে। ভীমের মতো লোকের বউ, রন্ধনে দ্রৌপদী তো হবেই হবে। বহুদিন জিভে এমন জিনিস ঠেকাইনি। কিন্তু মুটিয়ে যাওয়া, আনফিট হওয়া, এসব ভয়ই কী এখন করা ঠিক হবে? নিজেকে সে বলল, রোহিণী অকুতোভয় হও। তোমার নাকি মার্ডার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? তাহলে জলে ভরে যাওয়া জিভ নিয়ে অন্তত মরো না।

‘দিন একটু চেপে দেখি। তবে খুব বেশি নয়, শুধু ওই বাটিটায়, যঅৎ সামান্য—’

ফোন বেজে উঠতেই, কথা শেষ না করে রোহিণী লাফিয়ে ছুটে গেল।

‘হ্যালো, কে গঙ্গাদা নাকি?’

‘হ্যাঁ। তোমাকে আগে ফোন করেছিলাম।’

‘আমিও ভাবছিলাম, তাই তো, কে আবার ফোন করছে! মীনা চ্যাটার্জির কাছে সন্ধ্যাবেলায় গেছিলাম। ভাবলাম, সেই আবার ফোন করল নাকি!’

‘ওহ মীনার কাছে গেছলে বুঝি? স্যাড, খুবই স্যাড ব্যাপারটা। সুভাষ গায়েন ওর ফ্রেন্ড, ফিলজফার অ্যান্ড গাইড বলতে যা বোঝায় তাই ছিল। খুব বুদ্ধিমান লোক। তুমি তো ওকে মিট করেছ।’

‘হ্যাঁ, বুদ্ধিমান ছিলেন।’

‘মীনা কী বলল তোমায়?’

‘কী আর বলবে, খুবই শোকাহত মনে হল।’ রোহিণী দু—সেকেন্ড থেমে, ভেবে, আবার বলল, ‘মনে হল মাথার ঠিক নেই, আবোল—তাবোল বকছে। কী বলল জানেন, আপনি নাকি ওকে মৃতুভয় দেখিয়ে দুটো চিঠি, মানে অনামা চিঠি দিয়েছেন। মনে হচ্ছে, মাথাটা ওর গেছে। বলল, সুভাষ গায়েনকে কে ঠেলে ফেলে দিয়েছে, সেটা নাকি আপনি জানেন। আচ্ছা বলুন তো, ওকে এবার রাঁচিতে না পাঠিয়ে আর উপায় আছে?’

রোহিণী থামল ওধার থেকে প্রতিক্রিয়া আসার জন্য। আলতো করে দুটো বোমা সে ঠেলে দিয়েছে। ফাটবে কীভাবে, সেটাই টেলিফোনে দেখতে চায় সে।

খিলখিল হাসি ভেসে এল। রোহিণীর মনে হল, বোমার ফিউজ পোড়ার মতো শব্দটা।

”বলো কী! মৃত্যুভয় দেখানো চিঠি, তারপর ঠেলে ফেলে দিয়েছে যে, তাকেও আমি জানি?’

‘আমাকে আবার বলল, এসব কথা যেন কাউকে না বলি, তাহলে আমাকেও নাকি ভয় দেখানো চিঠি দেবে। তা, আমি তো এখনও কোনো চিঠি পেলাম না। দু—তিনটে ফ্ল্যাটে খোঁজ নিলাম, কেউ বলতে পারল না আমার দরজায় কোনো চিঠি আঁটা দেখেছে কিনা। যাক গে এসব বাজে কথা, বলুন কেন ফোন করছেন।’

ওধারে চুপ। মনে হচ্ছে দ্রুত ভাবনাচিন্তা চলছে। গোলমালে পড়ারই কথা। নিশ্চয় ভাবছে, চিঠি সেঁটে যাবার কাজটা যাকে দিয়েছে, সে নিশ্চয়ই ফাঁকি মেরেছে।

‘হ্যালো, গঙ্গাদা?’

‘হ্যাঁ, শোভু ফোন করেছিল।’

আবার চুপ। রোহিণী বুঝল, এবার তার প্রতিক্রিয়া গঙ্গাদা শুনতে চায়।

‘প্লিজ গঙ্গাদা, আমার কিন্তু এখন যেন কেমন ভয় ভয় করছে। আমি ঠিক করেছি, বোম্বাইয়ে দিদির কাছে চলে যাব।’

‘আরে না না, ভয়ের কিছু নেই। চলে যাবে কেন? চাকরি ছেড়ে দিয়েছ তো কী হয়েছে। তোমার মতো মেয়ের জন্য অনেক চাকরি আছে, ইচ্ছে করলেই পাবে। শোভু বলল, একটা ছোটো জেলখানা থেকে এখন সে একটা বড়ো জেলখানায় এসে পড়েছে। এভাবে পলাতক, ফেরার জীবন অসহ্য লাগছে। সে ঠিক করেছে আবার বহরমপুরেই ফিরে যাবে, মানে জেলে যাবে। আমি বললাম, তা কেন করবি। তুই দূরে কোথাও চলে যা। টাকা আমি দোব। তোকে ধরার জন্য পুলিশের কোনো মাথাব্যথা নেই। তুই নকশাল নোস, স্মাগলার নোস, ফরেন এক্সচেঞ্জ রুলস ভেঙে বিদেশে টাকা জমাসনি। হঠাৎ একটা খুন করে ফেলেছিস, তাও একটা তুচ্ছ মেয়েমানুষকে। দেশের বা সমাজের তোকে নিয়ে ভয় পাওয়ার বা ক্ষতি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তুই দিব্যি বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়া। আমি বললাম, আমার বাসুদেবপুরের বাড়িতে গিয়ে থাক, ছবি আঁক। ওখানেই জীবনটা কাটিয়ে দে।’

‘কী বলল শুনে?’

‘রাজি আছে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলল, যাব।’

রোহিণী মাথাটা ঝাঁকিয়ে বুদ্ধির উপর জমে ওঠা সন্দেহের ধুলো ঝাড়ার চেষ্টা করল। নতুন কী চাল আবার চালতে চলেছে?

‘ভালোই হবে গঙ্গাদা। অতবড়ো একজন আর্টিস্ট তাকে আবার কাজের মধ্যে ফিরিয়ে আনা তো মহৎ ব্যাপার। এই সেদিন ওর একটা ছবি দেখে আমি তো থ’ হয়ে গেলাম। আগে আমি কখনো এটা দেখিনি। কী ড্রয়িং, কী কালার, কী রিয়্যাল যে মনে হচ্ছিল!’

‘কোথায় দেখলে?’

‘মীনা চ্যাটার্জির ভিতরের ঘরে। যেদিন ওকে ইন্টারভিউ করতে গেলাম, ও দেখাল একটা ন্যুড। মীনা বলল, ওটা বীণা।’

‘তুমি ঠিক বলছ?’ গম্ভীর থমথমে গঙ্গাপ্রসাদের স্বর। ‘নট ফেক, বাট রিয়্যাল।’

‘আসল কী নকল অত বুঝি না, তবে দারুণ লাগল। আপনি গিয়ে দেখে আসতে পারেন। মীনা বলল, ছবিটার নাম উওম্যান ইন সলিচ্যুড। এটা নাকি শোভনেশের সেরা কাজগুলোর একটা। অন্তত লাখ দুই টাকা এখন তো বটেই। গঙ্গাদা, এমন ছবি যে আঁকতে পারে, তাকে নষ্ট হতে দেওয়া উচিত নয়। ওকে আপনি বাসুদেবপুরেই ধরে রাখুন। না না, আমার সঙ্গে দেখাটেখা না হওয়াই ভালো। আমি কোনোদিনই ওর জীবনে আর ছায়া ফেলব না।’

‘তুমি কি একটাই ছবি দেখেছ, নাকি আরও আছে? আমার সন্দেহ হচ্ছে, আরও আছে আর আমি অলরেডি খোঁজ নেবার জন্য লোক পাঠিয়েও দিয়েছি, হয়তো পৌঁছেও গেছে।’

রোহিণীর মনে হল, এতক্ষণ যেসব কথা সে বলল, তার কিছুই গঙ্গাদার কানে ঢোকেনি। গঙ্গাদা এবার মুখোমুখি হবে মীনার। লক্ষ লক্ষ টাকার বেওয়ারিশ ছবির দখল নেবার লড়াইটা এবার ভালো করেই শুরু হয়ে যাক। মীনার আকুলতা ছবির থেকেও বেশি শোভনেশের জন্য। আর গঙ্গাদা নিশ্চয় সেটা বুঝতে পেরে, ‘শোভনেশকে তোমার কাছে এনে দেব’ এই টোপটা দিয়ে ওকে খেলাচ্ছে, যদি কিছু ছবি, মীনার কাছে থেকে থাকে সেগুলো হাতাবার জন্য।

”আরও ছবি আছে কিনা জানি না, আমি তো একটাই দেখেছি। গঙ্গাদা, হ্যালো, …আমার ওপরে থাকেন সেই সুজাতা গুপ্ত, তিনি একটা অদ্ভুত কথা কাল বললেন। আহ লাইনটা বড়ো ডিস্টার্ব করছে, হ্যালো, …উনি বললেন, শোভনেশ নাকি বীণাকে খুন করেনি। তার সাক্ষী নাকি একজন এখনও আছে দিগম্বর বর্ধন লেনের বাড়িতে। কী কাণ্ড দেখুনতো!’

‘কে সাক্ষী?’

‘সেটা উনি বলতে চাইলেন না।’ রোহিণী মনে মনে বলল, গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি, এইবার তোমাকে আমি খেলাব। কে সেই সাক্ষী জানার জন্য এইবার তুমি হন্যে হয়ে ওঠো।

‘কীভাবে উনি জানলেন? শোভনেশ নিজে কোর্টে কনফেস করেছে, সে নিজের হাতে খুন করেছে। আর এখন—’

‘আরে আমিও তো তাই বললাম। কিন্তু উনি রি—ট্রায়ালের জন্য এখন উকিলের কাছে যাবেন ঠিক করেছেন। নতুন করে কেসটা আবার ওপেন করালে, ভাবতে পারেন, আবার অনেককে কোর্টে দাঁড়াতে হবে। আমাকেও। উহফ, আমার আর এসব ভালো লাগছে না গঙ্গাদা। আবার কাগজে কাগজে কেচ্ছা বেরোবে ভাবলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। কী করে এটা বন্ধ করা যায় বলুন তো? পুলিশ তো তখন শোভনেশকে ধরার জন্য উঠে পড়ে লাগবে।’ রোহিণী উদবেগে উৎকণ্ঠায় ভেঙে পড়তে পড়তে ভাবল, মীনা চ্যাটার্জি কী আমার মতো অভিনয় করতে পারবে? ফুঃ।

‘রোহিণী, কালই তুমি আমার সঙ্গে অফিসে দেখা করো। সত্যিই এটা বিশ্রী ব্যাপার হবে যদি কেসটা আবার তোলা হয়। যেভাবেই হোক বন্ধ করা দরকার।’

গঙ্গাপ্রসাদের স্বরে কিছুটা যেন ভয়ের আভাস পেল রোহিণী। সে ঠিক করে ফেলল, সুজাতা গুপ্তকে উকিলের বাড়িতে পাঠাতেই হবে। শান্ত গলায় সে গঙ্গাপ্রসাদকে বলল, ‘হ্যাঁ, বন্ধ তো করতেই হবে।’

ফোন রেখে দিয়ে রোহিণী কঠিন চোখে রিসিভারটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল। চোয়াল শক্ত। কী যেন ভাবছে। রিসিভার তুলে আবার সে ডায়াল করতে শুরু করল।

‘হ্যালো, মিস চ্যাটার্জি?’

‘স্পিকিং।’

‘এইমাত্র গঙ্গাপ্রসাদবাবু ফোন করেছিলেন। উনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আপনার ঘরে শোভনেশের আঁকা যে ছবিটা রয়েছে, হ্যাঁ হ্যাঁ বেডরুমে যেটা রেখেছেন…।’

‘উনি জানলেন কী করে, আমার বেডরুমে ছবি রয়েছে?’ উত্তেজিত স্বর মীনার এবং বিব্রতও।

‘আমি তো আপনার সাক্ষাৎকারে ওটা মেনশ্যন করেছি। ওটা তো একটা প্লাস পয়েন্ট আপনার শিল্পবোধ, শিল্প চেতনা মানে আর্ট লাভার হিসেবে আপনি—’

‘চুলোয় যাক আর্ট লাভার। আপনি এসব লিখতে গেলেন কেন?’

‘আপনাকে উজ্জ্বল করতে আর আমার লেখাটাকে একটা পারসপেকটিভ থেকে—’ রোহিণী যেন দেখতে পেল মীনার শ্বদন্ত বেরিয়ে এল, হয়তো রিসিভারটাকেই কামড়ে ধরবে।’

‘ছবির কথা লিখেছি বলে কি আপনি বিরক্ত হলেন?’ কাঁচুমাচু স্বরে রোহিণী বলল, ‘আমি কালকেই প্রুফ আনিয়ে ওই অংশটা বাদ দিয়ে দেব।’

‘আর বাদ দেওয়া! যা ক্ষতি হবার তা তো হয়েই গেছে। গঙ্গাপ্রসাদবাবু আপনার কাছে কী জানতে চাইলেন?’

‘বললেন,’ রোহিণী ঢোঁক গিলল। তাই তো, কী বলা যায়! ‘বললেন, ছবিটা তো নকল। ওটাকে অত যত্ন করে রাখার কারণ কী?’

‘কে বলল ওটা নকল?’ মীনার স্বর তীব্র। ‘সুভাষদা আমায় দিয়েছিলেন।’

‘আপনি যে আমায় বললেন, কোন এক প্রোডিউসার ছবিটা আপনাকে উপহার দিয়েছেন?’

‘ভুল করে বলেছি। ছবিটা আসলই, এর নকলটা গঙ্গাপ্রসাদবাবু পেয়েছেন, বোধ হয় সুভাষদার কাছ থেকেই পেয়েছেন। আর পেয়ে সেটা কাকে যেন বিক্রিও করে দিয়েছেন।’

‘কী করে পেলেন?’

‘গঙ্গাপ্রসাদবাবু নকল ছবি বিক্রি করার জন্য সুভাষদার ব্যবসার পার্টনার হতে চান। কিন্তু সুভাষদা তাতে রাজি না হয়ে ওঁকে এজেন্ট করেছিলেন, একটা কমিশন দিতেন। মিসেস সেনগুপ্ত, আপনি কী জানেন, এই গঙ্গাপ্রসাদ লোকটির কাছে আপনার স্বামীর আঁকা কত লক্ষ টাকার ছবি জমা আছে? আসল ছবিগুলো কালেক্ট করার জন্য উনি এখন উঠে পড়ে লেগেছেন। ওগুলো জমিয়ে রাখছেন পরে বেশি দামে বিক্রি করবেন বলে। আর নকলগুলো এখন বিক্রি করছেন। লোক বুঝে বুঝে নকল ছবি বেচছেন। আপনি যে কীভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন, তা জানেন না।’

‘না, জানি না, জানতে চাইও না। আমি শুধু একটা পরিচ্ছন্ন, সভ্য জীবন চাই।’

‘গঙ্গাপ্রসাদবাবু আর কী বললেন?’

‘বললেন ওই ছবিটা ওনার চাই। শোভনেশ ওকে বলেছে, সব নকল ছবি ধ্বংস করে ফেলতে হবে। তাই যেখানে যত আছে, উনি খোঁজ পেলেই টাকা দিয়ে কিনে নেবেন ঠিক করেছেন।’

‘বাজারে নকলের ছড়াছড়ি থাকলে আসল কিনতেও খদ্দেররা ভরসা পাবে না বলেই ওনার এই ব্যস্ততা। কিন্তু জেনে রাখুন, আমার কাছে আসলটাই রয়েছে।’

রোহিণী ফোনের মধ্যে কলিং বেল বাজার শব্দ পেল। মীনার সঙ্গে কেউ দেখা করতে এসেছে।

‘এত রাতে কে আবার! এক মিনিট, কেউ নেই, আমাকেই দরজা খুলতে হবে, প্লিজ একটু ধরুন …আরও কিছু কথা আপনাকে বলব।’

রোহিণী রিসিভারটা শক্ত কোনো জায়গায় রেখে দেওয়ার শব্দ পেল। ফোনটা মীনার শোবার ঘরে। রোহিণী ফোন কানের কাছে ধরে পিছনে তাকাল। দত্ত পরিবার খাওয়ায় ব্যস্ত, কিন্তু কানগুলো নিশ্চয় তার কথাবার্তার দিকে। স্বাভাবিকই। খুন, মার্ডার ভয় ভয় করছে, বোম্বাইয়ে চলে যাব, কোর্ট, কনফেস, নতুন করে মামলা,—এইসব কানে গেলে, দাঁত দিয়ে খাবার চিবোনোর বদলে কান দিয়ে শব্দ গেলার কাজ বেড়ে যাবেই। বাটি ভরা ছানার ডালনা টেবিলে রাখা। কড়াইশুঁটির সবুজ দানাগুলোর দিকে তাকিয়ে রোহিণী ভাবল, মীনা বড্ড দেরি করছে।

হঠাৎ সে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে রিসিভারটা কানে চেপে ধরল। তার ঘাড়, বাহু শক্ত হয়ে উঠেছে! ক্ষীণভাবে হলেও স্পষ্টই কথাগুলো শোনা যাচ্ছে।

‘না, ঘরে ঢুকতে দেব না। বেরোও বলছি, নইলে চেঁচিয়ে লোক ডাকব।’

‘তা হলে জান খতম করে দেব। ওই তো ছবিটা, তুলে নে। চুপ করে থাক, নইলে—।’

‘না, না, আমি কিছুতেই—’ একটা ভারি কিছুতে ধাক্কার বা পড়ে যাবার মতো শব্দ রোহিণী পেল। মীনা বিপন্ন। ওর ঘরে একাধিক অবাঞ্ছিত লোক, তার ছবি নিতে এসেছে, মীনা বাধা দিচ্ছে। বোধহয় ওকে মারল।

‘ডাকাত, ডাকাত, বাঁচা—।’

কথাটা শেষ হবার আগেই থেমে গেল। রোহিণী থর থর কেঁপে উঠল। সর্বনাশ! ‘ওই তো ছবিটা’ বলল কেন? গঙ্গাদার লোক!

‘মুখটা বাঁধ। হাত আর পা দুটোও।’

ফোনের খুব কাছ থেকে লোকটা বলল। দ্রুত, তীক্ষ্ন, উত্তেজিত স্বর। উচ্চচারণ জড়ানো, অমার্জিত।

‘আর ছবি আছে? …সোনা দ্যাখ তো ভেতরের ঘরগুলো। …আরে গাধা, ফোটো নয় ফোটো নয়, হাতে আঁকা ছবি! এইরকম রং দিয়ে কাপড়ে আঁকা, দ্যাখ সব জায়গায়…বাথরুমটাও দেখবি।’

লোকগুলো জানে না, তাদের এই কীর্তিটা বহুদূর থেকে একজন জানতে পারছে। রিসিভারটা যে ক্রেডল থেকে নামিয়ে রাখা, চালু অবস্থায় রয়েছে এটা ওরা নজর করেনি। হুঁশিয়ার, পাকা গুন্ডা নয়। কিন্তু সে এই মুহূর্তে কী করতে পারে? রোহিণী অসহায়ভাবে মাথা নাড়ল। কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। শুধু শুনে যাওয়া ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। দুঃখিত মীনা চ্যাটার্জি, আমি দুঃখিত হওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারছি না।

‘আর নেই? ভালো করে দেখেছিস? ছবিটা আমি নিচ্ছি, তুই ওকে উপুড় করে খাটে শুইয়ে দে। …আরে ফোনটা যে নামিয়ে রাখা দেখছি…হ্যাল্লো।’

রোহিণী কিছু না ভেবেই বলল, ‘সব শুনেছি। কার হয়ে কীজন্য কাজ করছ, তাও জানি।’

খটাস। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভার রাখার শব্দ হল। রোহিণীর মনে হল, তার চুপ করে থাকাই উচিত ছিল। কথা বলে সে নিজের বিপদ ডেকে আনল না তো! গঙ্গাদাকে এটা ওরা সম্ভবত বলবে। যখন শুনবেন একটা মেয়ের গলায় বলল, ‘কার হয়ে কী জন্য কাজ করছ তাও জানি’, তখন প্রথমেই ওর মনে হবে, রোহিণী ছাড়া আর কেউ নয়। আর কোনো মেয়ে শোভনেশের ছবি সম্পর্কে গঙ্গাপ্রসাদের আগ্রহের কথা জানে না।

মীনাকে ওরা খুন করেনি। মনে হল, ধাক্কাটাই শুধু দিয়েছে। বড়ো ধরনের চোটও সম্ভবত পায়নি। তা হলেও একা একটা মেয়েকে পেয়ে এইভাবে হাত পা মুখ বেঁধে তার ঘর থেকে জিনিস চুরি করা—গঙ্গাদার এই কাজটা রোহিণীকে রাগিয়ে দিল এমনই যে, চোখ বন্ধ করে সে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।

মনে মনে সে নিজেকে বলল, কুল ডাউন রোহিণী, কুল ডাউন…ঠান্ডা হও। রেগে উঠছ কেন? মীনা চ্যাটার্জি তোমার কে? ওর ঘর থেকে যদি গুন্ডারা ছবি চুরিও করে, তাতে তোমার কী? মীনাও কম জাঁহাবাজ নয়। তাকে যদি গুন্ডারা দু—চারটে চড়চাপড় মারে, তাতেই বা তোমার কী? কয়েক ঘণ্টা আগেই তো তুমি ওর হাতের চড় খেয়েছ, মনে নেই?

কিন্তু একটা দুর্বল অসহায় মেয়ের ওপর এইভাবে গুন্ডা লেলিয়ে গঙ্গাদা যে—কাজটা করলেন, এটা ক্ষমার অযোগ্য নয় কী? রোহিণী নিজেকে ঠান্ডা করার বদলে আরও অশান্ত উত্তেজিত হয়ে উঠল। মীনা তার কেউ নয় ঠিকই, কিন্তু তার মতোই একটা মেয়ে তো। তার মতোই একা, তার মতোই বুদ্ধি আর গতর খাটিয়ে অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে।

রোহিণী থমথমে মুখে দরজার দিকে এগোল।

‘আন্টি, আপনার ছানার ডালনা।’

‘থাক, এখন খাবার ইচ্ছে নেই।’

মুখ না ফিরিয়েই কথাগুলো বলে সে দরজা বন্ধ করে দিল। সামনেই গুপ্তদের ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজা। সিঁড়িটা ফাঁকা। কোথাও কোনো শব্দ নেই। রোহিণীর মনে হল, মীনার মতো তার ফ্ল্যাটেও তো গঙ্গাদা খুনি পাঠাতে পারেন।

.

নয়

কলিং বেল বাজল।

রোহিণী আই—হোলে চোখ রেখেই দরজা খুলে দিল।

‘এসো।’

‘টেপটা আমি এনেছি। অবশ্য সব কথা এতে নেই। কী করব বলুন, পল্টু অর্ধেকটাই দখল করে রেখেছে ডি জি গিলেসপির জ্যাজ দিয়ে। রুনিদি, কী অসাধারণ যে গিলেসপি ট্রাম্পেট কী, বলব! সত্তর বছরের বুড়ো, কিন্তু বাজায় কী! …বাহ ডুডল ইবহা ডিবহা ডিডল বু ডাহ ডী বাহ ডিব বু …রুনিদি আমেরিকান জ্যাজ আপনার ভালো লাগে? আমার লাগে …গিলেসপির বিবপ স্টাইলের জ্যাজ যদি শোনেন …বিপ বপ বাহ ডীডী ডীডী ডাহ বাহ ডিডল বু ডি বো…’

‘কুন্তী, তোমার নাচ আর গান এবার থামাও।’

‘আপনি একটু শুনে দেখুন, পল্টু যা একখানা জোগাড় করেছে না!’

‘এখন তুমি আমায় আবদুল করিম খাঁ সাহেবের ‘যমুনা কী তীর’ শোনাতে চাইলেও শুনব না। আমার মেজাজ খুব খারাপ, সারারাত ঘুমোতে পারিনি।’

‘কেন?’

‘সে অনেক কথা, পরে বলব। তুমি দিগম্বর বর্ধন লেনে গিয়ে কী দেখলে শুনলে বুঝলে কী ছবি তুললে, টেপ করলে, নোটস নিলে সব আমাকে জানাবে বলেছিলে, এবার সেটা জানাও। তার আগে চায়ের জলটা চড়িয়ে আসি।’

রোহিণী রান্নাঘরে গেল। কুন্তী রেকর্ডারে ক্যাসেট ঢুকিয়ে শুরু করার জন্য টেপটা ঠিক জায়গায় রাখা আছে কী না পরখ করতে লাগল খাবার টেবিলে বসে। রোহিণী ফিরে এসে বলল, ‘আমি বরং প্রথমে তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করি।’ সুজাতা গুপ্ত চারদিন আগে তাকে যা বলেছিলেন, সেইগুলোই সে মনে মনে ঝালিয়ে নিল।

‘ওখানে পরমেশ সেনগুপ্ত যে অংশে থাকে, সেটা ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে, তাই তো?’

‘কারেক্ট।’

‘তার পাশে শোভনেশের অংশটা একজন কিনেছে। নতুন মালিক সারিয়ে মেরামত করে এখন খালি অবস্থায় তালা দিয়ে রেখেছে?’

‘রাইট। আমি ছবি তুলে এনেছি।’

‘পরমেশের একতলায় পুরোনো চাকর বিশ্বনাথ আর তার বউ গীতা থাকে।’

‘ওয়েট রুনিদি, ওয়েট। আমি ওখানে গিয়ে প্রথমে গীতার সঙ্গে কথা বলি। প্রথমে বললাম, আমি জন্মেছি এই বাড়িতে। শোভনেশ সেনগুপ্তর ঠাকুর্দার ভাইয়ের নাতির মেয়ে আমি। বুঝলে না, আমি কেন কৌতূহলী, সেটা তো আগে ওকে বোঝাতে হবে! তা গীতা তো খাতির করে ওর ঘরের সামনে রকটায় একটা টুলে বসতে দিল। নিজেই বলতে শুরু করল, ‘আর দিদিমণি, এখন আর কী দেখতে এয়েছেন। এখন তো ভূতের বাড়ি। এক ভাই ওপরে মাথা খারাপ অবস্থায়, আর এক ভাই জেলে।’ আমি বললাম, ‘জেলে কেন, চুরি করেছিল? গীতা ফিসফিস করে বলল, চুরি নয় গো…।’

কুন্তী টেপ—রেকর্ডারের রিড টিপল। রেকর্ডারটা সে রোহিণীর দিকে এগিয়ে দিল।

‘চুরি নয় গো, খুন করেছিল।’

‘খুউন! বলো কী, কাকে?’

‘একটা মেয়েমানুষকে। বড়দা তো ছবি আঁকত। ওই মেয়েমানুষটা, বীণা নাম, আসত। কাপড়—চোপড় খুলে শুয়ে বসে থাকত আর বড়দা তার ছবি আঁকত।’

‘এ ম্যাগো, ওইভাবে কেউ পুরুষ মানুষের সামনে—।’

‘টাকা পেত সেজন্য। কী করবে, গরিব মানুষকে পেটের জন্য অনেক কিছুই করতে হয়। তবে খারাপ কিছু ছিল না ওদের মধ্যে।’

‘তুমি জানলে কী করে? দেখেছ কী?’

‘না, না আমি দেখব কেন। লুকিয়ে লুকিয়ে তো দেখত ছোড়দা, ওই যার নাম পরমেশ, ওপরে থাকে। একদিন আমি দেখে ফেলেছিলুম, ছোড়দা খড়খড়ি তুলে দেখছে।’

‘তুমি একদিনও দ্যাখোনি?’

টেপ রেকর্ডারে শব্দ নেই। রোহিণী মুখ টিপে হাসল।

‘একদিন একটুখানি দেখেছি। ওই খড়খড়ি তুলে। বড়দা খুব রাগী মানুষ ছিল তো। জানতে পারলে বাড়ি থেকে বার করে দেবে।’

‘কেমন দেখলে বীণাকে?’

‘ওহ দিদিমণি, সে কী শরীর, কী গড়ন। দুগগা ঠাকুরকে কাপড় পরাবার আগে দেখেছ কখনো? কী কোমর! কী বুক! কী পাছা! হাত পায়ের গড়নই বা কী!

‘হবে না কেন? বড়দার বউ, যাকে বিয়ে করে আনল, তারও তো অমন শরীর ছিল!’

‘কী নাম তার?’

‘নামটাম বাপু অত জানি না। তবে হ্যাঁ, ওরও একটা দেখার মতো শরীর ছিল। যেমন লম্বা তেমনি মানানসই বুক পেট পাছা—’

চট করে রেকর্ডার বন্ধ করে রোহিণী বলল, ‘হাসছ কেন?’

কুন্তী নিঃশব্দে হাসতে হাসতে কুঁজো হয়ে গেছিল। সোজা হয়ে বলল, ‘ওহ রুনিদি, হাসব না? পল্টু যা বলে, গীতাও তাই বলল, আমিও তাই বলি। আপনার ফিগার যে একবার দেখেছে…এত…মানে কী বলব, প্রোভোকেটিভ যে…’

‘হয়েছে হয়েছে, এবার হাসি থামাও, বড়োদের নিয়ে ঠাট্টা করতে হবে না।’ রোহিণী দস্তুরমতো রাগ দেখাল।

‘ঠাট্টা! আপনি আমার কী ক্ষতি যে করেছেন পল্টুর সোফিয়া লোরেন হয়ে—’

‘আচ্ছা আচ্ছা, বলেছি তো, এইসব ঝামেলা চুকে যাক, তারপর তোমাকে নিয়ে পড়ব। হপ্তায় এক কেজি করে ওজন বাড়িয়ে দেব।’

‘ছাই করবেন।’ ঠোঁট ফুলিয়ে কথাটা বলেই কুন্তী রেকর্ডারের রিড টিপল।

‘দিদিমণি কী বলব, দু—জনের মধ্যে কিন্তু একদমই মনের মিল ছিল না। কেমন যেন ছাড়াছাড়া ভাব। হয়তো বয়সের পার্থক্যের জন্য।’

‘তা বড়দার বিয়ের পর সেই বীণা আর আসত?’

‘না। একদমই না। প্রথম এল সেইদিনই, যেদিন ওই জানালা দিয়ে নীচে পড়ে মরল।’

‘তোমার মনে আছে সেদিনের কথা?’

‘মনে থাকবে না? উঠোনে কাপড় শুকোতে দিচ্ছিলুম। দুপুরবেলা। দেখি বড়দা হনহনিয়ে বেরিয়ে গেটের দিকে যাচ্ছে। ওই পর্যন্ত, ওই যে ইটটা পড়ে রয়েছে, ওই পর্যন্ত গেছে, আর তখন দোতলার জানলা দিয়ে কে যেন চেঁচিয়ে কী বলল। মনে হল যে, দাঁড়াতে বলল। বড়দা দাঁড়াল না, আর তখনই ধপ করে শব্দ হল। আমি চমকে উঠে এগিয়ে গেলুম। বড়দাও ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে গেল। আমি দূর থেকে দেখলুম, বীণা হাত—পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছিল একটুও নড়ছে না। ভয়ে আমি একেবারে ঘরের মধ্যে ছুটে এসে বিছানায় উবুড় হয়ে শুয়ে পড়লুম। বাব্বা, এমন মিত্যু জীবনে কখনো দেখিনি।’

‘আমি তো শুনেছি, তোমার বড়দাই নাকি বীণাকে জানলা গলিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছিল।’

‘তাই কখনো সম্ভব নাকি? বড়দা তো তখন ঘরেই ছিল না।’

‘বীণা নিজেই ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল?’

টেপ রেকর্ডার থেকে কয়েক সেকেন্ড কথা বেরোল না।

‘রুনিদি, গীতা হেজিটেট করছে।’

‘না দিদিমণি, আমি নিজের চক্ষে যখন ঝাঁপ দিতে দেখিনি, তখন কী করে তা বলি। আমি তো পড়ার শব্দ শোনার পর তাকালুম।

‘বড়দা যে ফেলে দেয়নি, এটা তো তুমি জানো?’

‘হ্যাঁ বড়দা তখন তো গেটের কাছে।’

‘বড়দার বউ ছিল না তখন?

‘না। কোথায় একটা নেমন্তন্ন ছিল, সকালেই বেরিয়ে গেছিল।’

‘তারপর তুমি কী করলে?’

‘আমার সোয়ামি, নারানের বাপ, বলল: পুলিশ টুলিশ আসবে, তোকে আর এখন এখানে থাকতে হবে না, বাপের বাড়ি চলে যা। আমি তক্ষনি নারানকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলুম। সাতদিন পর ফিরলুম। বড়দাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, তার বউ একা রইল।’

‘কোনো আত্মীয়স্বজন কী বন্ধুবান্ধব তখন আসত না?’

‘কই কাউকে দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না। তবে বড়দার এক বন্ধু আসত।’

‘কী নাম?’

‘নাম জানি না, নারানের বাপ বলতে পারবে। ওর সঙ্গে বড়দার বন্ধুটার আলাপ হয়েছিল।’

‘কী কথা হত ওদের?’

‘আমাকে সেসব কিছু বলত না। শুধু একদিন বলেছিল লোকটার মতলব আছে, খুব চালাক। বড়দাকে জেলে ভরে রাখতে চায়। তা নারানের বাপও খুব স্যায়না। লোকটাকে বলল, মাসে মাসে দুশো করে টাকা দাও তাহলে আমার বউ মুখে চাবি দিয়ে থাকবে। লোকটা রাজি হল। কিন্তু যেই বড়দা জেলে ঢুকল, অমনি টাকা দেওয়া বন্ধ করে বলল, কাজ চুকে গেছে, আবার কীসের টাকা? কী নেমকহারাম খচ্চচর লোক দেখেছেন? নারানের বাপ আমাকে বলেছিল, তুই একদম কারোর কাছে মুখ খুলিস না, তা হলে পুলিশে ধরবে। আমিও বাপু কারোকে কিছু বলিনি। এই তোমাকেই …একটা বুড়ি এসেছিল, তার কাছেই, আর তোমার কাছেই শুধু অ্যাদ্দিন বাদে মুখ খুললুম।’

‘বুড়িটা কে?’

‘বলল তো এককালে নাকি এখানে ভাড়া থাকত।’

‘তোমার স্বামী কখন আসবে?’

‘এখন ক—টা বাজে? একটার সময় খেতে আসবে।’

‘ঠিক আছে, আমি তখন আবার আসব। ওর সঙ্গেও আলাপ করতে ইচ্ছে করছে। তোমরা সব পুরোনো লোক, কত পুরোনো পুরোনো গল্প জানো এই বাড়ি সম্পর্কে।’

‘আপনি ছোড়দার সঙ্গে দেখা করুন, তবে ভালো করে তো কথা বলতে পারে না। মাথার ঠিক নেই। বোধ হয় বেশিদিন আর বাঁচবে না। ওর কাছে পুরোনো কথা জানতে পারবেন।’

‘এখন গেলে দেখা হবে? ঘুমোচ্ছেন না তো?’

‘না না উনি দুপুরে ঘুমোন না।’

কুন্তী রেকর্ডার বন্ধ করল। রোহিণী এই কথাগুলো সুজাতা গুপ্তর কাছ থেকে আগেই শোনায়, খুব রোমাঞ্চিত হল না। শুধু বলল, ‘গঙ্গাদা সম্পর্কে গীতার স্বামী বিশ্বনাথ যে কথাগুলো বলেছে, সেটা খুব ইন্টারেস্টিং।’

‘হ্যাঁ, তাই আমি পরমেশ সেনগুপ্তর সঙ্গে কথা বলেই নীচে নেমে আসি বিশ্বনাথের সঙ্গে কথা বলতে। কিন্তু সেদিন ও খেতে আসেনি। তাই পরের দিন আবার যেতে হয়।’

‘পরমেশের সঙ্গে কী কথা হল?’

‘ওর সঙ্গে কথা বলা আর একটা চার বছরের বাচ্চচার সঙ্গে কথা বলা প্রায় একই ব্যাপার। আপনি এবার টেপটা শুনুন।’

কুন্তী টেপ রেকর্ডারের রিড টিপল। ‘রোহিণী! কে রোহিণী?’

পরমেশের ঘড়ঘড়ে সরু মেয়েলি গলা। তার কথা মাঝখান থেকে টেপে রেকর্ড করা হয়েছে। কুন্তী ফিসফিস করে বলল, ‘মিনিট কুড়ি এর আগে কথা বলেছি। টেপ করার মতো কিছু পাইনি।’

‘দাদার বউয়ের নাম ছিল রোহিণী। কিন্তু ওকে তো পাগল করে দিয়েছে!’

‘কে?’

‘আমার দাদা। দেয়নি?…তাহলে কে পাগল হল?’

‘কেউ হয়নি। আপনি ভুল করছেন, কেউ পাগল হয়নি।’

‘হ অ্যা অ্যা, বললেই হল। দাদা হয়নি? একদিন আমি নিজে দেখেছি, দাদা টেনে টেনে বউদির কাপড় ছিঁড়ছিল। বউদি দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে তিনতলায় গেল। আমি তখনই বুঝে গেছলুম, হা হা হা হা,…বুঝে গেছলুম আমি বেঁচে গেছি, বুঝলে আমি বেঁচে গেছি।’

‘কী বেঁচে গেছেন?’

‘আমি আর তাহলে পাগল হচ্ছি না। একজনের পাগল হওয়ার কথা তো! পাওয়া হয়ে গেছে সেই একজনকে । তুমি জেলে গিয়ে দেখে এসো শোভনেশ সেনগুপ্ত পাগল হয়ে রয়েছে। …বুঝলে, আমার এবার একটা বিয়ে করতে হবে। …কত লোককে বলেছি, আমার বিয়ে দিয়ে দাও, কেউ আমার কথা শুনল না।’

‘সে কী! আপনার মতো লোকের বিয়ে হবে না, তাই কখনো হয়! আমি আপনার বিয়ে দিয়ে দোব। কীরকম মেয়ে আপনার পছন্দ বলুন তো?’

‘হে হে হে, ঠিক বলছ তো, নাকি ধাপ্পা দিচ্ছ?’

‘কেন, কেউ কী আপনাকে ধাপ্পা দিয়েছে নাকি?’

‘দেয়নি আবার! ওই মোটা বেঁটে গঙ্গা হারামজাদা! আমায় বলল, মুখবন্ধ করে থাকো, কাউকে কিচ্ছু বলবে না, তাহলেই তোমার জন্য মেয়ে দেখে বিয়ে দোব। তা আমি দু—বছর মুখ বন্ধ করে বসে রইলুম। ফোক্কা…দাদার যাবজ্জীবন জেল হল, আর গঙ্গাব্যাটা আমায় কলা দেখাল। আর এলই না এ বাড়িতে!’

‘আপনি মুখ বন্ধ করেছিলেন? কিছু বলা বারণ ছিল কি?’

‘ছিল না? দাদা যখন সিগারেট কিনতে বাড়ি থেকে বেরুল, আমি তখন ফাঁক বুঝে ঘরে ঢুকে সে মাগিকে বললুম, ‘অ্যাই তোর পেটে বাচ্চচা আছে কিনা দেখব…দাদার বাচ্চচা,…পাগলের বাচ্চচা, ওটাও পাগল হবে। দেখি তোর পেটটা। সে মাগি যা ভয় পেল না। কী বলব! দাদার প্রথম বউটাও অমন ভয় পেয়ে জানলার দিকে ছুটে গেছিল চেঁচিয়ে লোক ডাকতে। এ মাগিও ঠিক তাই করল। সেবার যা করেছিলুম, এবারও তাই করলুম। দৌড়ে গিয়ে ঠ্যাং দুটো ধরে উলটে দিলুম আর টুক করে জানলা দিয়ে নীচে পড়ল। আর বাবা পাগলের ঝাড় বাড়তে পারবে না, কী বলো, ঠিক করেছি কিনা?’

‘বীণা তাহলে আপনিই ফেলে দিয়েছিলেন?’

‘তা না হলে পড়বে কেন? ও এলেই আমি লুকিয়ে লুকিয়ে ওর—।’

কুন্তী রিড টিপে টেপ বন্ধ করে, ফরোয়ার্ড লেখা রিডটা টিপল। খর খর শব্দে দ্রুত টেপ ঘুরে যেতে লাগল কিচির মিচির শব্দ করে। রোহিণী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল কুন্তীর দিকে।

‘এই জায়গাটা আর শুনতে হবে না। বুড়োটা বীণার অ্যানাটমি নিয়ে খুব ভালগার ফিলদি ওয়ার্ডস ইউজ করেছে।’ স্কুলের দিদিমণির মতো গম্ভীর স্বরে কুন্তী বলল।

‘আমার সম্পর্কেও বলেছে নাকি?’

‘না। বললে তো এই রেকর্ডারটা ওর মাথায় ভাঙতাম। আচ্ছা, এবার শুনুন।’

পরমেশের গলা আবার ফিরে এল টেপে।

‘দু—জনে খালি ঝগড়াই করে গেল, আমি বসে আছি কখন দাদা ছবি আঁকা শুরু করবে বলে। শুরুই আর হয় না। তারপর হঠাৎ বীণা চিৎকার করে উঠল।’

‘কী বলল?’

‘তোমায় তা বলব কেন?’

‘বলুন না।’

‘না বলব না। তুমি ধাপ্পা দিয়ে সব শুনে নিচ্ছ। ওই গঙ্গা ব্যাটাও আমার কাছ থেকে শুনেছিল। বলল আমার জন্য মেয়ে দেখবে…হুঁ হুঁ বাবা, আর আমি ভুলছি না। আগে মেয়ে দেখাও, তবে মুখ খুলব। এই মুখে চাবি দিলুম।’

কুন্তী টেপ বন্ধ করে হতাশ চোখে তাকাল।

‘বুড়ো আর মুখ খুলল না। কত করে বললুম, কিন্তু চাবি আর ঘোরাল না।’

‘মাথা খারাপ হয়েছে বটে, কিন্তু বদ্ধ উন্মাদ এখনও হয়নি। তবে মাঝে মাঝে হয়ে যায়। তখন দানবের আত্মা যেন ভর করে, অন্য সময় খুবই স্বাভাবিক। দুই ভাই পরস্পরকে খুব ভালোবাসত। পাগল হয়ে যাবার ভয়ে দু—জনেই সিঁটিয়ে থাকত। পরমেশকে বিয়ে করতে দেয়নি শোভনেশ, কারণ পাগলের বংশ সে এই জেনারেশনেই শেষ করে দিতে চেয়েছে।’

‘তাহলে উনি আপনাকে আবার বিয়ে করলেন কেন? আপনাদের মধ্যে কী—?’

রোহিণী কুন্তীর আড়ষ্ট কৌতূহল ভেঙে দেবার জন্যই বলল, ‘সেকসুয়াল সম্পর্ক? হ্যাঁ ছিল, আই টুক প্রিকশনস। আর এই বিষয়ে কথা নয়।’

‘রুনিদি চায়ের জল কিন্তু অনেকক্ষণ চড়িয়ে এসেছেন।’

‘ওমা, তাই তো!’ রোহিণী ধড়মড়িয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই কলিং বেল বেজে উঠল। দরজায় গিয়ে আই হোলে চোখ রেখেই সে প্রচণ্ড অবাক হল। গঙ্গাপ্রসাদ দাঁড়িয়ে। পিছন ফিরে হাত নেড়ে সে কুন্তীকে ইশারা করল, রেকর্ডারটা শোবার ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখার জন্য। কুন্তী বিস্মিত চোখে তাকিয়েই তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে গেল রেকর্ডারটা হাতে নিয়ে।

‘আরে গঙ্গাদা, আপনি?’ রোহিণী দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই বলল। ‘আসুন।’

‘গেছলুম লেকটাউনে একটা কাজে। ফেরার সময় মনে হল, যাই তোমাকে দেখে আসি।’

‘বসুন। চায়ের জল চড়িয়েছি।’

‘না না, চা—টা এখন খাব না।’ গঙ্গাপ্রসাদ ভিতরে এসে কুন্তী যে চেয়ারে বসেছিল, সেটিতেই বসলেন। কৌতূহলী চোখে চারধারে তাকাতে তাকাতে বললেন, ‘কত্ত বছর পর যে এলাম। চুনকাম করা দরকার। দরজাগুলোতেও রং করতে হবে।’ কথাটা বলেই খোলা দরজা দিয়ে রোহিণীর শোবার ঘরের ভিতরে তাকালেন। কুন্তীকে দেখা যাচ্ছে না।

‘আমি আগে চলে যাই, তারপর করাবেন।’

‘তুমি কি সত্যি সত্যিই মহারানিকে ছেড়ে দিলে?’ মৃদুস্বরে গঙ্গাপ্রসাদ জানতে চাইলেন।

‘সত্যি নয়তো কী? শোভনেশ সংক্রান্ত এইসব ব্যাপার—স্যাপার একদমই ভালো লাগছে না। ঠিক করেছি দিদির কাছেই চলে যাব।’

‘কিন্তু তুমি কাল যা বললে, তাতে তো আবার তোমাকে কোর্টে হাজির হওয়ার জন্য যে দরকার হবে। সুজাতা গুপ্ত যদি রি—ট্রায়ালের জন্য পিটিশ্যন করে, আর কোর্ট যদি তা অ্যাডমিট করে, তাহলে তো—’ কথা অসম্পূর্ণ রেখে তিনি উৎকণ্ঠা নিয়ে রোহিণীর মুখের দিকে তাকালেন।

‘করুক না পিটিশ্যন, তাতে আপনার কী?’

‘আমার কিছুই না, তবে শোভুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আমাকে আবার ডাকতে পারে। তাহলে বুঝতেই পারছ, এই নিয়ে খবরের কাগজগুলো কী শুরু করবে। আমার কথা ছেড়ে দাও, তোমার বিয়েরও তো একটা ব্যাপার আছে, সেটা ভেস্তে যেতে পারে।’

রোহিণীর মনে পড়ে গেল রাজেনের বাড়ির লোকেদের কথা। ওর মা দাদা বউদি, সবাই রক্ষণশীল। নিজেদের বনেদিয়ানা সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ। এইরকম কেলেঙ্কারির খুনের মামলার সঙ্গে জড়িয়ে গেলে রাজেনদের বাড়িতে বউ হয়ে ঢোকা বোধ হয় যাবে না।

‘গঙ্গাদা, আমি তো কালই আপনাকে বললাম, সুজাতা গুপ্তকে থামাতে হবে। ওর আর শোভনেশের মধ্যে যে সম্পর্কের কথা আপনার কাছে শুনেছি, তাতে উনিও একটা অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়বেন।’

‘পড়বেনই তো। উকিল জেরা শুরু করলে কতদূর পর্যন্ত যাবে, তার কি কোনো সীমা আছে?’

‘আপনি ওকে থামাবার ব্যবস্থা করুন।’ স্বর নামিয়ে চক্রান্তকারীর মতো একটা ভঙ্গি গলায় এনে রোহিণী বলল।

গঙ্গাপ্রসাদ তাকিয়ে রইলেন রোহিণীর মুখের দিকে। ধীরে ধীরে চোখ দুটো সরু হয়ে এল। কী যেন ভেবে দেখছেন। রোহিণী স্থির চোখে তাকিয়ে। ঠোঁটে ভেসে উঠল পাতলা হাসি।

‘কাল তুমি মীনাকে ফোন করেছিলে।’

‘হ্যাঁ। অচঞ্চল স্বরে রোহিণী বুঝিয়ে দিল, সে জানে গঙ্গাপ্রসাদ এখন কী ভাবছে।

‘কাল মীনার ফ্ল্যাটে কী ঘটেছে জান?

‘কাজটা করার কি খুব দরকার ছিল?’ রোহিণী লুকোচুরির বদলে মুখোমুখি হওয়াটাই শ্রেয় মনে করল। শোবার ঘর থেকে কুন্তীর উঁকি দেওয়া মুখ সে দেখতে পাচ্ছে।

‘হ্যাঁ দরকার ছিল। শোভনেশের ছবি আমার চাই।’

‘বিক্রি করে টাকাগুলো নেবার জন্য?’

‘হ্যাঁ।’

রোহিণী অবাক হয়ে দেখল, কীভাবে এক পলকের মধ্যেই একটা মুখ তার চরিত্র বদল করল। গঙ্গাপ্রসাদের স্তিমিত শান্ত চোখ দুটি কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মসৃণ সুডৌল গাল দুটি থেকে যেন চামড়া টেনে তুলে ফেলে, কর্কশ ভাঁজবহুল চামড়া লাগিয়ে দেওয়া হল। ঠোঁট দুটি থেকে মিষ্টি হাসিটা ভেঙে ভেঙে পড়ল।

‘হ্যাঁ, আমার টাকা চাই। আমি টাকা করতে ভালোবাসি।’

‘যেকোনো ভাবেই হোক?’

‘হ্যাঁ, যেকোনো ভাবেই হোক।’

‘চুরি, জাল, জোচ্চচুরি, খুন…”

‘হ্যাঁ তাই। টাকা করতে হলে এভাবেই করতে হয়।’

‘সততা, সাধুতা, বন্ধুত্ব এসবের তাহলে কোনো মূল্যই নেই?’

‘এইসব বস্তাপচা কথাগুলো আর আউড়ো না। আমি ওগুলো বাচ্চচা বয়স থেকেই জানি। শোনো রোহিণী, তুমি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে ফেলেছ। তাতে আমার সামান্য অসুবিধা হতে পারে।’

‘সামান্য?’

‘হ্যাঁ সামান্য। তুমি শুধু জেনেছ কিন্তু কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। শোভুর ছবিগুলো আমার কাছেই আছে। যদি পারো তো খুঁজে বার করো।’

‘আমার কোনো আগ্রহ নেই।’

‘নেই তো মীনা, সুভাষ গায়েন, সিদ্ধার্থ সিঙ্গি, সুজাতা গুপ্ত এদের সঙ্গে দেখা করেছ কেন?’

‘নিছকই কৌতূহল!’

‘খুব বিপজ্জনক দিকে তোমাকে নিয়ে গেছে এই কৌতূহলটা। এখন আমায় ভাবতে হচ্ছে, তোমাকে সচল রাখা আর উচিত হবে কিনা।’

‘অচল করে দেবেন! কীভাবে?’

‘যেভাবে সুভাষ গায়েন অচল হয়েছে।’

রোহিণীর সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গাপ্রসাদও উঠে দাঁড়ালেন। ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে নিজেকে শুনিয়েই যে, বললেন, ‘বাহাদুরিটা বোকারাই দেখাতে চায়, তার ফল যে কী হতে পারে—’

‘গঙ্গাদা!’ রোহিণীর গম্ভীর কঠিন গলার স্বরে গঙ্গাপ্রসাদের হাতটা দরজার হাতল থেকে নেমে হল।

‘আপনি আমাকে অচল করার ব্যবস্থাই করুন। বস্তাপচা কথা শুনে শুনেই আমি বাচ্চচা বয়স থেকে বড়ো হয়ে উঠেছি। এখনও বিশ্বাস করি, জীবন তো একটাই, তাই সেটা খুব দামি জিনিস। কোনোভাবেই অচল করা উচিত নয়, সেটাকে পরিপূর্ণভাবে ভোগ করাই উচিত। আর ভোগ করতে হলে একটা শক্ত মেরুদণ্ড থাকা দরকার। তাই না?’

গঙ্গাপ্রসাদ জবাব না দিয়ে ভ্রূ তুলে শুধু তাকিয়ে রইলেন। রোহিণী উত্তেজনায়, আবেগে এবং রাগে থরথর করে কাঁপছে।

‘আপনি জানেন কি না জানি না, আমার মেরুদণ্ডটা কিন্তু বেশ শক্তই। আর জীবনকে পরিপূর্ণভাবে পাওয়ার ইচ্ছাটাও প্রচুর। দোষেগুণেই মানুষ, আমি তার ব্যতিক্রম নই। আমার একটা বড়ো দোষ, আমি ভীতু নই। …এবার বেরিয়ে যান।’

রোহিণী তর্জনী তুলে দরজাটা দেখাল। গঙ্গাপ্রসাদ আঙুলটার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সারামুখে বিষাদ ছড়িয়ে বললেন, ‘হাততালিই দেওয়া উচিত, কিন্তু তোমার জন্য এত বেশি দুঃখ হচ্ছে যে—এই শরীর, এর ধ্বংস আমি চাই না। কিন্তু তুমি নিজেই তা ডেকে নিলে।’ মাথা নাড়লেন খেদ জানাতে। ‘সাহসী হওয়া তো ভালোই। তোমার সঙ্গে আর আমার দেখা হবে না, এটা ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। যাই হোক, সুখ দুঃখ নিয়েই তো মানুষের জীবন, তাই না?’

গঙ্গাপ্রসাদ দরজা খুলে বেরিয়ে সন্তর্পণে, শব্দ না করে তা বন্ধ করে দিলেন। রোহিণী রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাস নিভিয়ে ফুটে ফুটে জল উবে যাওয়া শুকনো কেটলিটা নামিয়ে রেখে ফিরে এল। কুন্তী শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তার চোখে মুখে দিশেহারা ভাব।

‘রুনিদি, লোকটা কে? এই কি সেই গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি?’

‘হ্যাঁ।’ রোহিণী ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে একদৃষ্টে টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘কী যেন বলছিল, অচল টচল করে দেবে! মানে কী কথাটার?’

‘খুব সোজাই মানেটা। হার্ট বিট বন্ধ করে দেবে…ডেথ!’

‘অ্যাঁ!’ কুন্তীর হাত আপনা থেকেই মুখে উঠে এল। ‘আর আপনি ওইভাবে জবাব দিলেন?’

রোহিণী মুখ তুলে কিছুক্ষণ কুন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ দিলাম। তুমি তো সবই শুনেছ, কী মনে হচ্ছে এখন আমাকে? বোকা?’

অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কুন্তীর মুখের ভাব তিন—চারবার বদলাল। আপন মনে সে বলল, ‘আমি কীরকম যেন কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি রুনিদি। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপনাকে। জীবন সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই।’

‘নেই তো কী হয়েছে, আস্তে আস্তে হবে।’ মৃদ নরম স্বরে রোহিণী বলল। ‘অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই জীবনকে বুঝতে পারা যায়। কখনো পালাবে না, ভয় যখন হাত বাড়াবে, তখন তেড়ে যাবে। হাতটা ধরে ভেঙে দেবে। আর যদি পালাও, তাহলে সারাজীবনই পালাতে হবে। সেই জীবনটা কি খুব কাম্য?’

কুন্তী চুপ করে রইল। রোহিণী উঠে দাঁড়িয়ে ওর পিঠে একটা থাবড়া কষিয়ে বলল, ‘ভাবনাচিন্তা পরে করবে, এখন আত্মরক্ষার ব্যবস্থার কথা ভাবতে হবে। আমার কাছে ঝাঁটা ছাড়া তো আর কোনো অস্ত্রই নেই। তোমাদের কাছে কিছু আছে কি? লাঠি, রড বা ওই ধরনের কিছু?’

‘লাঠি রড দিয়ে কী হবে?’

‘গুন্ডারা যদি আসে, তাহলে আটকাতে হবে।’

‘আপনি দরজা খুলবেন কেন? আগে তো আই হোল দিয়ে দেখে নেবেন, কে বেল বাজাল। যদি দেখেন অপরিচিত লোক, তাহলে একদমই খুলবেন না। ওরা তো আর দরজা ভেঙে ঢুকবে না।’

‘তা বটে।’

‘আর এখন একদমই বাড়ির বাইরে যাওয়া চলবে না।’

‘সে কী! না বেরোলে আমার চলবে কেন?’

‘বলছি বেরোনো বন্ধ। কুন্তী ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। রোহিণী অবাক হয়ে দেখতে থাকল ওর মুখটা, আর তার মনে হল হঠাৎ যেন কত বড়ো হয়ে গেছে এই মেয়েটা। সারা মুখে ছড়িয়ে আছে মায়ের উৎকণ্ঠা, উদবেগ আর স্নেহ।

‘কী দরকার আছে বেরোনোর? যা যা দরকার আমায় বলবেন, আমি এনে দেব। গল্পের বই দিয়ে যাচ্ছি, রেডিয়ো রয়েছে, আর খাটে শুয়ে জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়, ব্যস আবার কী চাই?’

‘কতদিনের জন্য?’

‘তখন কী একটা কথা শুনলাম, লোকটা যেন বলল, তোমার বিয়েরও ব্যাপার আছে…কী সেটা?’

‘কী আবার, বিয়ে মানে বিয়ে।’ রোহিণী মনে মনে অপ্রতিভ হতে লাগল। মেয়েটা তো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এবার কথা বার করতে শুরু করবে।

‘কার সঙ্গে?’

‘একটা পুরুষ মানুষের সঙ্গে।’

‘ন্যাচারালি। কিন্তু ডুবে ডুবে কতদিন জল খাওয়া হচ্ছে? তাই বলি, এমন একটা মেয়েকে কী কখনো পুরুষরা একা ফেলে রেখে দেবে। পল্টুর সঙ্গে বাজি ধরেছি, ও বলেছে ডেফিনিটলি লোকটা ডাক্তার, ফরেনে থাকে, চিঠিতে প্রেম চলছে। আমি বলেছি, এখানকার লোক, ফিল্ম ডিরেক্টর কী আই এ এস। ঠিক বলেছি?’

‘তোমরা তাহলে এতদূর পর্যন্ত গবেষণা করে ফেলেছ? কী বাজি ধরেছ?’

‘আমি জিতলে আইসক্রিম খাব, ও জিতলে চকোলেট।’

‘হায় ভগবান, আমাকে নিয়ে এত কম টাকার বাজি! মরে যেতে ইচ্ছে করছে কুন্তী, এত কম আমার মূল্য। নাহ আমি কলিং বেল বাজলেই, আই হোল দিয়ে না দেখেই দরজা খুলে দেব। তাতে যা হয় হোক।’

.

‘প্লিজ রুনিদি, ওটা করবেন না। আপনি যাকে বিয়ে করবেন তাকে খবর দিন। চটপট বিয়ে করে সেফ জায়গায় গিয়ে বসবাস করুন। ওই গঙ্গাপ্রসাদের কথাবার্তা, চাউনি—টাউনি আমার একদমই ভালো মনে হল না।’

‘তোমার টেপরেকর্ডারে আর কারোর জবানবন্দি রয়ে গেছে নাকি?’ কথা ঘোরাবার জন্য রোহিণী বলল।

‘না, শুধু গীতা আর পরমেশ সেনগুপ্তকেই টেপ করেছি। গীতার হাজব্যান্ড বিশ্বনাথের সঙ্গে দেখা হয়নি। ভাবছি, আজ কী কাল একবার যাব।’

‘আর যাওয়ার দরকার নেই। যা জানার ছিল, সেটা তো গঙ্গাদা নিজের মুখেই বলে দিলেন। আমি তো আর ডিটেকটিভ নই যে, সাক্ষ্য প্রমাণ জোগাড় করে কালপ্রিটকে পুলিশের হাতে তুলে দেব। যা ঘটে গেছে, তাকে আবার কবর থেকে তুলে ঘটনার কঙ্কাল নিয়ে খটখটানোর কোনো মানে হয় না। বহরমপুর জেল থেকে যাবজ্জীবন পাওয়া দু—জন কনভিক্ট পালিয়েছে, এই খবরটা কাগজে পড়েই কেন জানি মনে হয়েছিল, বোধহয় ওদের একজন শোভনেশ। আর কীরকম যেন একটা ভয় ধরল। সেই থেকে এই সাত—আট দিনে গড়াতে গড়াতে ভয়টা স্নো বল, হয়ে আজ এখানে পৌঁছেছে। এখন আর শোভনেশ নয়, গঙ্গাদাই হয়ে উঠেছেন ভয়ের কারণ।’

‘রুনিদি, হাতের কাছে কিছু জিনিস রাখা ভালো। যদি এসে পড়ে, তাহলে, বুঝলেন না ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে হয়তো দরজাটা নিঃশব্দে খুলে ঢুকে পড়ল, তখন কী করবেন?’

‘চেঁচাব।’

‘লোকজন এসে পড়ার আগে পর্যন্ত ফাইট করতে হবে তো! দাঁড়ান আমি আসছি।’

কুন্তী প্রায় ছুটেই বেরিয়ে গেল। রোহিণী খোলা দরজা দিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইল।

মানুষের জীবনে এক—একটা এমন সময় আসে, যখন তার মনে হয় পা থেকে মাথা, দেহটার মধ্যে বাতাস ছাড়া আর কিছুই নেই। শুধু রক্ত, মাংস, হাড়ই নয় কোনো ইন্দ্রিয়েরই অনুভব শক্তি নেই, চিন্তা করার ক্ষমতাও নেই। রোহিণীর জীবনে দু—তিনবার এইরকম সময় এসেছিল। এখন আবার সে ওই ধরনের একটা অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্য সে ধস্তাধস্তি শুরু করল। এখন কোনোভাবেই বোধ ও বুদ্ধি রহিত হয়ে ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া চলবে না।

গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি মোটেই সহজ লোক নন। মৃত সুভাষ গায়েনই তো তার প্রমাণ। মীনা চ্যাটার্জি তো বেঁচে আছে, আর একটা নজির হয়ে। এবার রোহিণীকেও এমন কিছু একটা করবেন, যাতে সে অচল হয়ে যায়। কী করতে পারেন গঙ্গাদা?

তার চোখ পড়ল খবরের কাগজে। আজ সকাল থেকে একবার উলটেপালটেও দেখা হয়নি। রোহিণী কাগজটা তুলে প্রথমেই পিছনের পাতা ওলটাল। কাল জয়পুরে রঞ্জি ট্রফির খেলা শেষ হয়েছে। যা ভেবেছিল, তার থেকেও বাজেভাবে খেলাটার ফল দাঁড়াল।

বাংলার ইনিংসে পরাজয়

মাট্টুর ৮ উইঃ ৪৭ রানে

কাগজটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে গিয়ে রোহিণী আবার তুলে ধরল। সরাসরি জেতার ইচ্ছায়, ঝড়ের গতিতে তিন ঘণ্টায় ২০২ রান তুলে বাংলার সবাই আউট। ইনিংস ও ১৫ রানে তো হারল। কিন্তু রাজেনের রান কত? পড়তে পড়তে তার মুখে হালকা হাসি ফুটল আর ক্রমশ তার মনে হতে লাগল, এখন যেন তার দেহের মধ্যে ভরাট হবার কাজ শুরু হচ্ছে। রক্ত, মাংস, হাড়, মেদ সব আবার ফিরে আসছে।

মাট্টুর প্রথম বলেই রাজেন বোল্ড হয়েছে।

সিঁড়িতে হালকা দ্রুত পায়ের শব্দ। রোহিণী সতর্ক হল। বোধ হয় সেই অফ স্টাম্পের বাইরের ইন সুইঙ্গারটা, ছেড়ে দেবার জন্য ব্যাট তুলে রাজেন ঠকে গেছে। হায় রে পজিটিভ অ্যাফারমেশন। সেঞ্চুরিটা পাওয়ার জন্য কী প্রচণ্ড টেনশ্যনের মধ্যে যে পড়েছিল, সেটা দ্বিতীয় ইনিংসে প্রথম বলেই আউট হওয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে। যে মুহূর্তে সেঞ্চুরি পাওয়া হল, জয়পুর থেকে কলকাতায় টেলিফোনে কথা বলল, তখনই টানটান হয়ে গুটিয়ে থাকা উত্তেজনা স্প্রিংয়ের মতো খুলে যাচ্ছিল। প্রেশার থেকে বেরিয়ে এসে রাজেন আর কনসেনট্রেট করতে পারেনি। রোহিণীর মনে হল, রাজেনের টেনশ্যনটা যে কত গভীর এবং যন্ত্রণাকর ছিল, এখন সে নিজে তা অনুভব করতে পারছে। আর সেটা বুঝতে শুরু করেই সে তার চারপাশের জগৎ সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। তার ভিতরের শূন্যতাবোধটা কেটে যাচ্ছে। রাজেনের শূন্য তাকে ভরাট করে দিল।

কুন্তী আসছে। দু—হাতে উপচে পড়ছে অস্ত্র।

‘রুনিদি, এইগুলোই পেলাম। হাসবেন না, হাসবেন না, খুব কাজে দেবে। পল্টু যখন রাতে ক্লাব থেকে টং হয়ে ফিরে এক একদিন গণ্ডগোল বাধাবার উপক্রম করে, তখন এগুলো…আপনাকেও হেল্প করবে, অন্তত কিছুক্ষণ তো গুন্ডাফুন্ডাদের আটকে রাখতে পারবেন।’

বলতে বলতে কুন্তী টেবিলের উপর জিনিসগুলো রাখল। প্লাস্টিকের দুটি খালি ওয়াটার বটল দেখিয়ে বলল, ‘এগুলো ছুড়ে মারার জন্য। জল ভরে দিচ্ছি, দেখুন এক—একটা কী ভারী হয়ে যাবে। আর যদি স্ট্র্যাপ ধরে বনবন করে ঘোরাতে পারেন, আচ্ছা আপনি টিভিতে ওলিম্পিক্সের হ্যামার থ্রো দেখেছেন?’ কুন্তী বেসিনের কল থেকে ওয়াটার বটলে জল ভরতে ভরতে প্রশ্ন করল।

‘দেখেছি মনে হচ্ছে।’ রোহিণী হাসবে না ঠিক করে ফেলেছে।

‘এই দেখুন এইভাবে হ্যামার ঘোরায়।’

কুন্তী কাঁধে ঝোলানোর ফিতের মতো স্ট্র্যাপটা দু—হাতে ধরে ওয়াটার বটলটা বৃত্তাকারে ঘোরাতে শুরু করল। ‘পল্টু আর এগোতে পারত না। অবশ্য বসে পড়লে মাথার ওপর দিয়ে বটলটা বেরিয়ে যাবে। এটা কিন্তু খেয়াল রাখবেন।’

‘পল্টু কি বসে পড়ত?’

‘চট করে বসেই, ডাইভ নিয়ে একদিন আমার পা দু—হাতে জড়িয়ে ধরে হ্যাঁচকা টানে ফেলে দিয়েছিল। য়ু মাস্ট বি কেয়ারফুল অ্যাবাউট দিজ গুন্ডাস।’

‘তোমাকে ফেলে দিয়েছিল, তাহলে শব্দও হয়েছিল, তাইতে মাসিমার ঘুমও ভেঙে গেছিল নিশ্চয়।’

‘নো নো রুনিদি, এই সময় আমরা দু—জনেই একদম সাইলেন্ট থাকি, একটা কথাও বলি না। পাশের ঘরেই তো মাসিমা। আর হ্যাঁচকা টানে মেঝেয় তো পড়িনি, খাটের ওপর পড়েছিলুম।’

‘সব্বোনাশ! শ্রীমান পল্টু তখন কী করল?’

‘পল্টু তখন…’ কুন্তীর ওয়াটার বটল ঘোরানো বন্ধ হয়ে গেল। ভ্রূ কুঁচকে, চোখ সরু করে সে সন্দেহজনক চাহনি রাখল রোহিণীর মুখে।

‘ওয়েল, পল্টু ইজ নট আ গুন্ডা। সুতরাং তখন একজন ভদ্রলোকের যা করা উচিত, সে তাই—ই করল। আর এই বিষয়ে কথা নয়। একটা কথাও নয়। আমরা এখন গুন্ডাদের ফেস করার জন্য প্রিপেয়ার্ড হচ্ছি, পল্টুকে সামলানোর জন্য নয়, সুতরাং ব্যাপারটাকে একভাবে দেখাটা ঠিক হবে না। পল্টু যেভাবে ডজ করেছিল, মনে রাখবেন ও একবছর জুনিয়র বেঙ্গল টিমে ফুটবল খেলেছে, গুন্ডারাও যে সেইভাবে ডজ করতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যদি ওয়াটার বটল ডিফেন্স ভেদ করে ওরা এগিয়ে আসে, তখন আপনি এইটে হাতে নেবেন।’ কুন্তী একটা তিন ব্যাটারির টর্চ এগিয়ে ধরল।

রোহিণী টর্চটা হাতে তুলে ওজন পরীক্ষা করল। নিজের মাথায় হালকাভাবে ঠুকে বলল, ‘বেশ ভারীই দেখছি। এটাকে কী কখনো পল্টুবাবুর ওপর প্রয়োগ করে দেখেছ?’

‘না, রুনিদি, আমাকে ও একটা চান্সও দেয়নি। বরং আমার মাথাতেই একদিন ঠকাস করে মেরে একটা আলু তৈরি করে দিয়েছিল।’

‘কিন্তু আমি কী আলুর চাষ করার জন্য ঠকাস করব, না নারকোল ভাঙার মতো করে মারব?’

‘আপনি নারকোল ভাঙারই চেষ্টা করবেন। কিন্তু মাথা যদি খুব শক্ত হয়, আপনি নিশ্চয় জানেন এক—একটা নারকোল খুব বেয়াড়া ধরনের হয়, এক ঘায়ে ভাঙে না, তা হলে কী করবেন?’

‘চেঁচাব।’

‘আহহা, সে তো করবেনই। কিন্তু অ্যাটাকটা তো কিছুক্ষণ সামলাতে হবে! নখ দেখি?’ রোহিণীর হাত তুলে ধরে আঙুল পরীক্ষা করে কুন্তী হতাশ হল। ‘বড্ড সেকেলে আপনি। নিজেকে ডিফেন্ড করার কোনো ব্যবস্থাই করেননি। নখগুলো সব কেটে রেখে দিয়েছেন?’

‘আমার দাঁত কিন্তু খুব স্ট্রং।’

‘না, না, কামড়াবেন না যাকে তাকে। খুব আনহাইজিনিক। পল্টুকে পর্যন্ত আমি কামড়াইনি কখনো। আপনি বরং চুলের এই কাঁটাটা রাখুন। কিন্তু রুনিদি, কাঁটা তো খোঁপায় গুঁজে রাখতে হবে, আর আপনি একেলে ফ্যাশনে চুল কেটে কী মুশকিল বাধিয়েছেন বলুন তো! কাঁটা গুঁজব কোথায়?’

কুন্তীর হাত থেকে রূপোর কাঁটাটা নিয়ে রোহিণী ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে মাথার ঠিক উপরের চুলের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে বলল, ‘এইভাবে রাখলেই হবে।’

‘মাসিমার দেওয়া, খুব সাবধান, হারায় না যেন। তবে নেহাতই যদি ব্যবহার করতে হয়, তাহলে চোখেই ঢুকিয়ে দেবেন। আর এটাও যদি ফেইল করে, তাহলে লাথি। কিন্তু রুনিদি আপনার ওই ফিনফিনে হালকা জুতোয় বা চটিতে তো কাজ হবে না।’

‘শুধু পায়েই লাথি মারব।’

‘ধ্যেৎ, তাতে কিস্সু হবে না। আমি বরং পল্টুর সরু মাথাওলা একজোড়া জুতো দিয়ে যাব। ওটা সবসময় পরে থাকবেন। অবশ্য একটু ঢিলে হবে, তা হোক। আর এই স্কিপিং রোপটাও রেখে দিন। টুল বক্সে তো বিশেষ কিছু পেলাম না, তবে এই স্ক্রু ড্রাইভারটা হয়তো কাজ দিতে পারে। আচ্ছা হ্যাক স্য কি দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে?’

‘না না, ওটা লাগবে না, তুমি নিয়ে যাও। করাত চালাবার সময় পাব না। যা দিয়েছ, এই যথেষ্ট।’

কুন্তীর মুখের উদবেগ কিন্তু কাটল না। ঠোঁট কামড়ে জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে খুবই চিন্তিত স্বরে সে বলল, ‘যথেষ্ট নয়, যথেষ্ট নয়। আপনি নিশ্চয় মনে মনে হাসছেন, কিন্তু এইসব ছোটোখাটো জিনিসই বিপদের সময় যা কাজ দেয়…রামচন্দ্র পর্যন্ত কাঠবেড়ালিদের হেল্প রিফিউজ করেননি।… অচল করে দেব বলে থ্রেট করে গেছে লোকটা, হালকাভাবে কথাটাকে কিন্তু নেবেন না। আমি অবশ্য সজাগ থাকব, জানালা দিয়ে গেটের দিকে নজরও রাখব। আপনার ফ্ল্যাটের বেল বাজলেই উঠে আসব।’

‘তা এসো, বেল না বাজলেও এসো। কিন্তু বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ হলে যে মরে যাব।’

‘তাহলে সেই ভদ্রলোককে এখানে আসতে বলুন। পাহারা দেবার জন্য একজন পুরুষমানুষ থাকলে ভালোই হবে। ঠিকানা দিন, আমি গিয়ে খবর দিয়ে আসছি।’

‘সে এসে কী করবে, আমার সঙ্গে থাকবে?’

‘নিশ্চয়’।

‘বিয়ের আগেই?’

‘নিশ্চয়। রুনিদি আপনি বড্ড সেকেলে। বিয়ের আগে কী—’ কুন্তী থেমে গেল। ঠিক কী ধরনের শব্দ ব্যবহার করা উচিত বুঝতে না পেরে সে অর্থহীন হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেলল। রোহিণী মনে মনে সিঁটিয়ে হাসিটার অর্থ বোঝার চেষ্টা করল। ভাগ্যিস রাজেন এখন জয়পুরে। সবেমাত্র তো কাল খেলা শেষ হয়েছে।

‘কুন্তী, সেই ভদ্রলোক আমার থেকেও সেকেলে, প্রচণ্ড কনজারভেটিভ, ভীষণ পিউরিটান। এখানে এসে আমাকে পাহারা দিতে বললে যে কী কাণ্ড বাধাবে…উরি বাবা, ভাবলেই শিউরে উঠছি।’

‘না না তাহলে দরকার নেই বলার। আপনি নির্ভয়ে থাকুন। আমি তো আছিই। পল্টুটা যদি এখন থাকত…আরও চারদিন লাগবে ওর ফিরতে। জানেন, পল্টু দেড়মাস ক্যারাটে শিখেছিল। একদিন আমাকে দেখাতে গিয়ে হাতটাকে কাটারির মতো করে ঘাড়ের এইখানে এমন একটা—।’

‘অ্যাঁ, মারল! তুমি নিশ্চয় পড়ে গেলে…খাটে?’

‘ঠাট্টা করছেন? আমি চললাম।’

কুন্তী সত্যিই চলে গেল। ও বেরিয়ে যাওয়া মাত্রই রোহিণীর মন থেকে হালকা স্বাচ্ছন্দ্যটা ঝরে গিয়ে থমথমে গুমোট একটা আবহাওয়া তৈরি হয়ে উঠল। এখন তার কিছুই করার নেই এবং যথেষ্টই করার মতো কাজ রয়েছে। কোনটা সে বেছে নেবে?

গঙ্গাদা অস্বস্তিতে পড়েছেন একটা ব্যাপারে আর সেইজন্যই এই সকালে মোমিনপুর থেকে সল্টলেকে ছুটে আসা। সুজাতা গুপ্ত যদি মামলাটা খুঁচিয়ে তোলেন, তাহলে গঙ্গাদা মুশকিলে পড়বেন। সুজাতা গুপ্তকে নিরস্ত করার ভার নেওয়ার জন্যই তাকে বলতে এসেছিলেন। কিন্তু কথাবার্তা যেভাবে এগোল তাতে গঙ্গাদা বুঝে গেছে, কোনো সাহায্যই তার কাছ থেকে পাবেন না, বরং পাবেন বিরুদ্ধতাই। এক্ষেত্রে গঙ্গাদা প্রথমে কী করবেন?

রোহিণী ভেবে দেখল, সুজাতা গুপ্ত বিপজ্জনক হয়েছেন দিগম্বর বর্ধন লেনে গিয়ে একটা খবর জেনে যাওয়ায়। গঙ্গাদা নিশ্চয় বুঝে গেছেন, কাজটা গীতা বা বিশ্বনাথের। ওই দু—জনকে অচল করে দিলে সুজাতার চেষ্টাটা ভস্মে ঘি ঢালার মতো ব্যাপারই হবে।

গঙ্গাদা অসম্ভব ধূর্ত লোক। কাল রাতে মীনার ঘরে যা ঘটেছে, টেলিফোনের মধ্য দিয়ে সেটা জেনে ফেলার ব্যাপারটা কেমন চট করে বুঝে নিলেন। তাহলে তো উনি প্রথমে টার্গেট করবেন গীতা, বিশ্বনাথ আর পরমেশকেও। কিন্তু তিনজনকে অচল করে দেওয়াটা তো ছোটোখাটো ব্যাপার নয়, হইচই পড়ে যাবে। এক্ষেত্রে গঙ্গাদার স্ট্র্যাটেজি কী হতে পারে?

রোহিণী পায়চারি শুরু করল। সাধারণ বুদ্ধিতে বলে : বিশ্বনাথ, গীতা, পরমেশরা এত বছর যখন চুপ করে ছিল, তখন চুপ করেই থাকবে। ওদের কোনো মাথাব্যথা নেই শোভনেশ সম্পর্কে। কোর্টঘর, পুলিশ, উকিল ব্যারিস্টার এসব ঝামেলায় জড়াতে হলে যথেষ্ট টাকাও তো চাই। ওরা কী দুঃখে এতে জড়াবে? তা ছাড়া নারানের বাপের হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দিলেই ওরা মুখে চাবি আঁটবে। সুজাতা গুপ্ত ওদের কথার ভিত্তিতেই মামলা তুলতে চান। তা এই বৃদ্ধাকে সরিয়ে দিলেই তো গঙ্গাদা ঝামেলামুক্ত হতে পারবেন।

পায়চারি থামিয়ে রোহিণী ভাবল, উপরে গিয়ে ব্যাপারটা সব খুলে বলে হুঁশিয়ার করে দেওয়া দরকার ‘সাবধানে থাকবেন মাসিমা। গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি কিন্তু আপনাকে অচল করে দেবার চেষ্টা করবেন।’

উপরে যাবার জন্য শাড়ি বদলাতে রোহিণী শোবার ঘরে এল। আয়নায় নিজেকে দেখে নিয়ে চিরুনি তুলে চুলে দিতেই রুপোর কাঁটাটা মেঝেয় পড়ে গেল। কাঁটাটা তোলার জন্য নীচু হতেই চোখে পড়ল, খাটে বালিশের পাশে কুন্তীর টেপ রেকর্ডারটা। নিয়ে যেতে ভুলে গেছে। তারপর তার মনে হল, এই টেপেই তো রয়েছে গীতা আর পরমেশের ভাইটাল কনফেশন! গঙ্গাদা টেপ করার কথাটা জানেন না। কিংবা ওদের কাছ থেকে পরে শুনতেও পারেন, সালোয়ার কামিজ পরা, একটা রোগা মেয়ে এসে তাদের কথা বলার সময় একটা ছোটো বাক্স সামনে রেখেছিল। ধূর্ত গঙ্গাদা বুঝে যাবেন বাক্সটা কী? খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা নেবেন মেয়েটার! ভাববার চেষ্টা করবেন, কে এই রোগা মেয়েটা? কুন্তীকে উনি দেখেননি।

গঙ্গাদা তাহলে আবার আসবেন। টেপ করার পিছনে আমার হাত আছে কিনা জানার চেষ্টা করবেন। যতক্ষণ না জানছেন, ততক্ষণ আমাকে অচল করার কাজে নামবেন না। টেপটা না হাতিয়ে উনি কোনোভাবেই নিজেকে নিরাপদ বোধ করবেন না।

রোহিণী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে খাটে বসে পড়ল, রেকর্ডারটা কোলে নিয়ে হাত বোলাতে বোলাতে ভাবল, এটাই এখন আমার সিকিউরিটি। গঙ্গাদা যত তাড়াতাড়ি এটার কথা জেনে যান, ততই নিরাপদ হওয়া যাবে। সুজাতা গুপ্তর কাছে কে মুখ খুলেছে, সেটা জানার জন্য গঙ্গাদা নিশ্চয় এখান থেকে সোজা দিগম্বর বর্ধন লেনে যাবেন। তার মানে এতক্ষণে হয়তো জেনে গেছেন, শোভনেশকে জেলে পাঠানোর জন্য তাঁর সাক্ষ্যলোপের ব্যবস্থার কথা কেউ একজন প্রমাণ করার উদ্যোগ নিতে পারবে। সুতরাং গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি…এবার তুমি পাগলের মতো টেপটা খুঁজে বেড়াও।

সন্ধ্যার সময় কুন্তী এসে তাকে ডেকে নিয়ে গেল ভিডিয়ো ফিল্ম দেখে সময় কাটাবার জন্য।

‘দুপুরে বেরিয়ে দোকান থেকে দুটো ক্যাসেট ভাড়া করে এনেছি, ক্যারাটে আর কুংফু ফিল্ম। আমার মনে হল, এখন আপনার এইরকম ছবিই দেখা দরকার। মনের জোর বাড়বে, তা ছাড়া কীভাবে অ্যাটাক আসে, কীভাবে সামলে পালটা অ্যাটাক করতে হয় সে সম্পর্কে একটা আইডিয়াও পেয়ে যাবেন।’

‘দুটো ফিল্ম দেখেই শিখে যাব? বলো কী। হাত—পা ছোড়াছুড়ি, ডিগবাজি খাওয়া, লাফ মারা, টেবিল চেয়ার ছোড়া, এসবের দরকার হবে না?’

‘হবে হবে, এত তাড়াহুড়োর কী আছে। আমি তো বলেছি, শুধু আইডিয়া পাওয়ার জন্য দেখা দরকার।’

ভিসিপি—তে ক্যাসেট গুঁজে দিয়ে, সুইচ টিপে কুন্তী বসল টিভি সেটের সামনে। গলা নামিয়ে রোহিণী বলল, ‘মাসিমা কোথায়?’

‘এই বেরোলেন, নীচের ফ্ল্যাটে বন্ধুর সঙ্গে পরচর্চা করতে।’

প্রথম ছবিটা শেষ হবার পর কুন্তী একটু উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘এবার বুঝতে পারলেন, কীভাবে আপনাকে পজিশ্যন নিয়ে দাঁড়াতে হবে! দরজাটা খুলেই চট করে কীরকম সরে যেতে হবে!’ বলতে বলতে সে ক্যাসেট বদল করে দ্বিতীয়টা ভরছিল। রোহিণী ‘উহহ’ বলে কাতরে উঠল।

‘কী হল রুনিদি?’

‘কলিক পেনের মতো একটা যন্ত্রণা…কালকেও হয়েছিল। আমি বরং এখন যাই, শুয়ে থাকলেই সেরে যাবে। তুমি বরং একটা গল্পের বই—টই দাও।’

‘তা দিচ্ছি। কিন্তু মাসিমাকে যে বলেছিলাম, রুনিদিকে রাতে খেতে বলেছি। আপনার জন্য উনি রান্না করেছেন। খেয়ে যেতে পারবেন না?’ কুন্তী উৎকণ্ঠিত চোখে তাকাল।

‘আবার কেন এসব করা।’ পেটে হাত রেখে রোহিণী বহু কষ্টে কথাগুলো বলল। তা কী রান্না করেছেন?’

‘এঁচোড়ের কী যেন, বোধ হয় কোপ্তা। কিন্তু এখন কী হেভি মশলা দেওয়া এসব আপনার—’

‘উচিত কুন্তী, উচিত। গুরুজনদের অসম্মান করা হবে, যদি আমি এখন না খাই। কত যত্ন করে রান্না করা!’

আধঘণ্টা পর শরৎ—সমগ্র হাতে নিয়ে কুন্তীদের ফ্ল্যাট থেকে রোহিণী যখন বেরোল, মাসিমা তখনও ফেরেননি। কুন্তী তাকে তিনতলায় পৌঁছে দিতে যাচ্ছিল। রোহিণী আপত্তি জানায়।

‘দোতলা থেকে তিনতলায় যাব, তাতেও ভয়?’

‘বুঝছেন না। সিঁড়িটা নির্জন। ফট করে যদি চারটে লোক ওপর থেকে নেমে আসে! ফিল্মে তাহলে কী দেখলেন?’

‘যদি নেমে আসেই, আমরা দুটো মেয়ে তাহলে কী করতে পারি?’

‘নাহ আপনাকে নিয়ে আর পারা যাবে না। ঠিক আছে যা ইচ্ছে হয় করুন।’ কুন্তী দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। বন্ধ দরজার দিকে স্নেহ ভরে তাকিয়ে রোহিণী মাথা নাড়ল আর মনে মনে বলল, পাগলামি করে তুমি যা তুলে এনেছ, সেটাই এখন আমার রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছে।

সিঁড়ির মাঝামাঝি রোহিণীর সঙ্গে দেখা হল হৃদয়রঞ্জনের। একটু উদবিগ্ন চোখে তার দিকে তাকিয়েই নেমে যাচ্ছিলেন। রোহিণী পিছন থেকে ডেকে বলল, ‘মাসিমা কেমন আছেন?’

‘ভালোই।’ তারপর ইতস্তত করে হৃদয়রঞ্জন বললেন, ‘বিকেলবেলায় বেরিয়েছে, এখনও ফিরল না।’

‘মাসিমা? কোথায় গেছেন?’

‘জানি না। কিছু বলেও যায়নি। একটা লোক এসে ওর সঙ্গে কথা বলে চলে গেল। কী যে কথা হল জানি না। তারপরই বলল, আমি একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, এখনি আসছি। শুধু এইটুকু বলে কাপড় বদলে বেরোল।’

‘দেখুন, এখনি হয়তো এসে পড়বেন। তবে বিকেলবেলায় এভাবে বেরোনো উচিত হয়নি। যে লোকটা এসেছিল, তাকে দেখতে কেমন?’

‘মাঝবয়সি, ধুতি শার্ট পরা, রোগা মতন।’

হৃদয়রঞ্জন যে বর্ণনা দিলেন, সেরকম লোক কলকাতা রাস্তায় অন্তত হাজার পঁচিশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। রোহিণী কয়েক সেকেন্ড হৃদয়রঞ্জনের চশমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?’

‘কোথাও না। গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখি।’ খোঁড়া পায়ের জন্য দুলে দুলে তিনি সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন। তখন রোহিণীর মনে হল, সকালবেলাতেই সে ভেবেছিল, সুজাতা গুপ্তও বিপদের মুখে এসে পড়েছেন। গঙ্গাদা ওঁকে অচল করবার চেষ্টা করবেন। তিনিই হয়তো কাউকে দিয়ে এই বৃদ্ধাকে ডাকিয়ে নিয়ে গেছেন।

বিষণ্ণ মনে রোহিণী ফ্ল্যাটে ফিরে এসে শরৎসমগ্র বইটা শোবার ঘরের খাটে রাখল। একমাস ধরে, দিনে দু—ঘণ্টা টানা পড়ে গেলেও বইটা শেষ করা যাবে না। ম্যাক্সিটা পরার জন্য সে নিরাবরণ হল। আড়চোখে একবার আয়নায় নিজেকে দেখে পেটে আর কোমরে হাত বোলাল। পিঠের দিকে হাত ঘুরিয়ে পেশি খামচে ধরল। অস্ফুটে বলল, এখনও জমেনি। তারপর মনে হল, শরৎচন্দ্রের পুরো কালেকশনটা যদি চিত হয়ে বুকে রেখে, দিনে একঘণ্টা পড়া যায়, তাহলে শরীরের কতকগুলো জায়গার ব্যায়ামের আর দরকার হবে না।

টেবল ল্যাম্প জ্বেলে চিত হয়েই সে বই পড়া শুরু করেছিল। মিনিট পনেরো পরই চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। ধীরে ধীরে পাতা বুজে আসছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো ঘুম ঝরে পড়ছে। সে শুনতে পাচ্ছে, কোথায় যেন ঘড়ি বাজছে। কিন্তু বাজার ছন্দটা একটু যেন অন্যরকম। থেমে গিয়ে আবার বাজল। কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবার বাজল। মস্তিষ্কের কোষের মধ্যে বিশৃঙ্খলা জাগছে। বিরক্তি ধরছে। রোহিণী চোখ খুলল।

কী আশ্চর্য, এ তো তার ফ্ল্যাটেরই কলিং বেল বাজছে! এত রাত্রে কে? ধড়মড়িয়ে উঠে বসল রোহিণী। বুক থেকে বইটা মেঝেয় পড়ে ধপ করে শব্দ হল। বইটা কুড়োবার সময় দেখল, পল্টুর একজোড়া সরু মুখ জুতো খাটের নীচে, সোজা হয়েই চোখে পড়ল টেবলে জলভরা ওয়াটার বটল, স্ক্রু ড্রাইভার, টর্চ, স্কিপিং রোপ। টেবল ল্যাম্পের পাশে চুলের কাঁটা। সে হাওয়াই চটি পায়ে গলিয়ে ঘরের আলো জ্বালল। দরজার দিকে এগোল বইটা হাতে নিয়েই।

রোহিণী আই হোলে চোখ রাখল। কী কাণ্ড! লোক কোথায়? মুখ তুলে কলিং বেল যন্ত্রটার দিকে তাকাল। এটাই কী বেজেছে, না অন্য কোনো ফ্ল্যাটে?

‘টিং টং।’

তাড়াতাড়ি সে আই হোলে চোখ রাখল। কেউ নেই। মাথা কাত করে আই হোল দিয়ে দু—পাশে যতটা দেখা যায়, দেখল। একটা আরশোলা পর্যন্ত নেই। বেলের সুইচটা ল্যান্ডিং—এ দরজার পাশে, ভিতর থেকে সেটা দেখা যায় না। কেউ একজন দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বেল টিপছে।

রোহিণীর গলা শুকিয়ে এল। বুকের মধ্যে স্পন্দনের শব্দ সে কানে শুনতে পাচ্ছে। দু—হাতে সমগ্র শরৎচন্দ্র আঁকড়ে সে বলে উঠল—কে? কিন্তু গলা দিয়ে একটু হাওয়া বেরোনোর শব্দ ছাড়া আর কিছু বেরোল না।

‘টিংটিং।’

আবার। ক—টা বাজে এখন? দশটা? বারোটা? যতটাই বাজুক, সারা বাড়ি, সারা এলাকা এখন নিঝুম এই সময় তার ফ্ল্যাটে ঘণ্টা বাজাবার মতো লোক পৃথিবীতে কে আর থাকতে পারে, একমাত্র গঙ্গাদার পাঠানো খুনিরা ছাড়া! কথাটা ভাবামাত্রই তার সারা দেহ শক্ত হয়ে উঠল। আর একটা শীতল অনুভব বুক থেকে তলপেটে নেমে এল।

‘কে?’ এবার গলা দিয়ে শব্দ বেরোল। মস্তিষ্ক কাজ করেছে। ‘কে এত রাতে?’

‘আঁমি ভূত।’ নাকিসুরে ভূতের গলা ভেসে এল দরজার পাশ থেকে। হাঁফ ছাড়ল রোহিণী। খুনিরা কলিং বেল টিপে আর যাই হোক ফাজলামি করবে না।

‘কে তুমি? মাঝরাতে লোকের বাড়িতে বেল টিপে ইয়ার্কি মারা হচ্ছে? মেরে মাথা ভেঙে দেব।’ রোহিণী একহাতে শরৎচন্দ্রকে শটপাট করার ভঙ্গিতে ঘাড়ের কাছে ধরে অন্য হাত দরজার হাতলে রাখল।

ধপ করে একটা শব্দ হল। ভারী কিছু একটা যেন মেঝেয় ফেলল।

‘আমি খুঁব বিঁপন্নঁ। আঁশ্রয় চাঁই রাঁতেঁর মঁতো। আঁমি আঁপনাঁর ঘাঁড় মঁটকাব নাঁ, আঁমি ভঁদ্দরলোঁক ভুঁত।

শব্দ না করে সন্তর্পণে রোহিণী দরজার হাতল ঘোরাল। পাল্লাটা এক সেন্টিমিটার মতো ফাঁক করে সে একচোখ দিয়ে তাকাল।

একটা লম্বা খয়েরি রঙের ক্যানভাস আর চামড়া মোড়া ব্যাগের একটা কোণ আর তাতে ঝোলানো ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের ব্যাগেজ টিকিট সে দেখতে পেল। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথার মধ্যে সাইক্লোন আর টর্নাডোর মিশ্রণে ওলটপালট করা তুমুল একটা বিপর্যয় ঘটে গিয়ে বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পাইয়ে দিল।

এক ঝটকায় দরজাটা খুলেই হাতের বইটা নীচের সিঁড়ির দিকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে রোহিণী লাফিয়ে ভূতের গলা জড়িয়ে ঝুলতে শুরু করল দুই হাঁটু পিছনে মুড়ে। আর রাজেন ভীত চোখে তাকিয়ে রইল সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা রোগা মেয়েটির দিকে, যার একহাতে ঝুলছে ওয়াটার বটল অন্য হাতে হ্যাক স্য।

‘এই ছাড়ো ছাড়ো, আমার গায়ে অত জোর নেই যে, গন্ধমাদন তুলতে—’

‘আঁমি শাঁকচুঁন্নি, এঁইবাঁর ঘাঁড় মঁটকাঁব।’ গলা জড়ানো দু—হাত দিয়ে টান দিল রোহিণী। রাজেনের মুখটা নীচু হতে হতে নাকের সঙ্গে নাক ঠেকে গেল। তারপর রোহিণীর হাঁ করা মুখের মধ্যে ঠোঁট দুটি ঢুকিয়ে নিশ্চিন্ত হল।

‘আমি ভালোবাসি।’

‘আমি তা জানি।’

‘কিন্তু এটা জান কী, সিঁড়িতে একজন দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছে?’

‘দেখুক। সারা পৃথিবী দেখুক। কিছু কিছু জিনিস দেখিয়ে বড়ো সুখ হয়।’

‘সেকেন্ড ইনিংসে জিরো করেছি।’

‘আমার সেকেন্ড ইনিংসে ব্র্যাডম্যান খেলবে।’

‘আমি আর খেলব না, রিটায়ার করব।’

‘খেলা কখনো ফুরোয় না, এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে সরে যায় শুধু।’

খুক খুক শব্দ হল।

‘রুনিদি, এখন রাত সওয়া এগারোটা।’ গম্ভীর স্বরে কুন্তীর চাপা ধমক শোনা গেল। রাজেনের গলা থেকে হাত ছেড়ে দিয়ে রোহিণী মেঝেয় পা রাখল। কাঁচুমাচু মুখে রাজেন তাকিয়ে রইল কুন্তীর দিকে।

‘ওয়ান্ট এনি হেল্প, রুনিদি?’

‘ইয়েস। তুমি যদি এবার লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঘুমোতে যাও, তাহলে—’

‘ইনি?’

‘আমার পাহারাদার।’

‘আপনি কি এখন সেফ হ্যান্ডে?’ কুন্তীর গলায় কিঞ্চিৎ উৎকণ্ঠা।

‘না।’

মেঝে থেকে রাজেনের ক্রিকেট গিয়ার্সের ভারী ব্যাগটা এক হাতে, সুটকেসটা অন্য হাতে তুলে নিয়ে রোহিণী পা দিয়ে দরজার পাল্লাটা খুলে ভিতরে যেতে যেতে বলল, ‘রাত্তিরে ভূতের হাতে সেফ থেকেছে পৃথিবীতে এমন মেয়ে দেখাতে পারবে?’

দরজা বন্ধ হল।

হাতে ধরা বইয়ের কোণা থ্যাঁতলানো মলাটের দিকে তাকিয়ে কুন্তী অনুযোগের সুরে বিড়বিড় করল, ‘শরৎচন্দ্রকে ছুড়ে এই দশা হল, মাসিমা দেখলে আমার যা হবে না!’

দু—হাতের মোট মেঝেয় নামিয়ে রেখে রোহিণী এবার গম্ভীরমুখে রাজেনের দিকে তাকাল। ওর চোখের ভাষাটা পড়ে নিয়ে রাজেন আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছে, তার আগেই তীক্ষ্ন প্রশ্ন হল: ‘এখন, এই সময়ে, কী ব্যাপার? জানো, আমি এখানে একা থাকি।’

‘একে একে উত্তর দিচ্ছি। প্রথমে, এখন কেন? কারণ চল্লিশ মিনিট আগে দিল্লির প্লেন দমদমে নেমেছে। সেখান থেকে মাল খালাস করে বেরিয়ে এক ডাক্তারের গাড়িতে লিফট পেয়ে এখানে এখন, এই সময়ে। দ্বিতীয়টা হল, কী ব্যাপার? কাল খেলা শেষ হবার পরই রাতের প্লেনে জয়পুর থেকে দিল্লি আসি। ভেবেছিলাম, ভোরের ফ্লাইটে কলকাতা চলে আসব। কিন্তু সেই ফ্লাইট ক্যানসেল হয়ে গেল। গ্রাউন্ড স্টাফের একজনকে সাসপেন্ড করায় অ্যাজিটেশন, কর্মবিরতি, তারপর অবধারিত পুলিশ, লাঠিচার্জ, ফলে প্লেন আর উড়ল না। অবশেষে আলোচনা, সাসপেনশন প্রত্যাহার করে প্লেন উড়ল বিকেলে। তাতে জায়গা পেলাম না। রাত সাড়ে আটটার ফ্লাইটে সিট পেলাম প্রায় হাতে—পায়ে ধরে। প্লেনে পাশের সিটেই এক ডাক্তার। ক্রিকেটের খবর রাখে। বাড়ি সল্টলেকে। দমদমে তাকে নিতে গাড়ি এসেছিল। আমাকে বলল, উলটোডাঙার মোড় পর্যন্ত লিফট দিতে পারি। ওখানে ট্যাক্সি পেয়ে যাবে। উলটোডাঙায় এসে মনে হল, তোমার এত কাছে এসে একবার দেখে যাব না?’

রাজেন চুপ করে শুধু তাকিয়ে রইল। রোহিণীর মন ভিজল কিনা সেটা না বুঝে আর এগোতে ভরসা পাচ্ছে না।

‘তৃতীয়টা?’

‘তুমি যে একা থাক, সেটা খেয়াল হল ডাক্তার এখানে নামিয়ে দিয়ে যাবার পর। কিন্তু আমি তো এখনি চলে যাব।’

‘কীভাবে? সল্টলেকে রাত সাড়ে এগারোটায় বাস, ট্যাক্সি, সাইকেল রিকশ, এমনকী ঠেলাগাড়িও পাবে না, শুধু মশা আর রাস্তার কুকুর ছাড়া।’

‘তাহলে হেঁটেই বাড়ি যাব। একরাতের জন্য এই দুটো জিনিস রাখতে নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না?’

‘এখান থেকে সাদার্ন অ্যাভিনু হেঁটে যাবে?’ এই মাঝরাতে? ভালো…তাই যাও।’

রাজেন কথা না বলে ধীরপায়ে এগিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল ফ্ল্যাট থেকে। দরজা বন্ধ হতেই রোহিণী বন্ধ পাল্লার কাছে দ্রুত এসে আই হোলে চোখ রাখল। রাজেন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। দরজাটা খুলে গলা বাড়িয়ে রোহিণী চাপাস্বরে বলল, ‘বীরত্ব? শিভালরি? খুব হয়েছে।’

কোনো জবাব এল না বা রাজেনের প্রত্যাবর্তনও ঘটল না। একতলার সিঁড়ি থেকে ড্রাইভওয়েতে বেরিয়ে এসে রাজেন গেটের দিকে যাচ্ছে, তখন দোতলার বারান্দা থেকে গলা ভেসে এল, ‘ও মশাই, এত রাতে বেরোচ্ছেন যে? আপনার না রুনিদিকে পাহারা দেওয়ার কথা?’

রাজেন থতমত হয়ে মুখ তুলে তাকাল। বাইরের দেওয়ালে জ্বলা ইলেকট্রিক আলোয় তার মনে হল, সেই মেয়েটিই, যে ওয়াটার বটল হাতে রোহিণীকে বলেছিল, ‘ওয়ান্ট এনি হেল্প?’

‘ও বলল পাহারার দরকার নেই।’

‘বললেই হল? আপনি ওপরে আসুন।’

রীতিমতো হুকুম। দোনামনা করে রাজেন দোতলায় উঠতেই দেখল সেই মেয়েটিই, তার ফ্ল্যাটের দরজা ভেজিয়ে ল্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে।

‘পাহারা লাগবে না মানে? আমি নিজের কানে শুনেছি, থ্রেট করে গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি আজ সকালেই ওকে বলল, অচল করে দেব। তার মানে মার্ডার করবে রুনিদিকে। এমন বিপদের মধ্যে একা রয়েছে আর আপনি ওকে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন?’

‘আমি তো এসবের কিছুই জানি না!’ রাজেন হতভম্ব। ‘আমাকে তো এসব কিছুই বলল না!’ তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে তার মাথার মধ্যে।

‘আশ্চর্য লোক বাপু! যান, শিগগিরি ওপরে যান।’

‘কিন্তু, ও একা…আমি কী করে…’

‘আপনিই তো সেই লোক, যিনি রুনিদিকে বিয়ে করবেন, রাইট?’

‘হ্যাঁ, না, মানে…ও আমাকে বিয়ে করবে।’

‘তাহলে রাতে থাকতে অসুবিধে কোথায়?’

‘আমার দিক থেকে তো…।’

‘আশ্চর্য লোক তো আপনি! দেখতে তো ম্যানলিই লাগছে, করেন কী?’

‘ক্রিকেট খেলি, এঞ্জিনিয়ারও।’

‘গেট ক্র্যাশিং কাকে বলে জানেন? দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ুন। আসুন…আস্তে কথা বলবেন, সবাই ঘুমোচ্ছে।’

‘ক্র্যাশিংয়ের শব্দে তো ঘুম ভেঙে যাবে!’

‘সেভাবে ক্র্যাশ নয়।’ সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কুন্তী পিছনে তাকিয়ে বলল, ‘রুনিদির কিছু এথিক্স আছে তো। পিউরিটান ধরনের মানুষ…আপনি এইখানে দাঁড়িয়ে থাকুন। ক্র্যাশ আমি করব।’

বেল টিপতে গিয়ে, কী ভেবে, কুন্তী দরজায় খুটখুট টোকা দিল। সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। রোহিণী প্রথমে কুন্তীর মুখে তারপর মুখের পাশ দিয়ে দৃষ্টিটা সিঁড়ির দিকে পাঠিয়ে খুঁজতে শুরু করল।

‘তুমি আবার যে? ঘুমোওনি?’

‘আমার জিনিসগুলো নিতে এসেছি।’ কুন্তী ভিতরে ঢুকে এল। ‘পল্টুর জুতোটা কোথায় রেখেছেন?’

‘শোবার ঘরে। কিন্তু কাল সকালেও তো নিতে পারতে?’

‘না এখনি দরকার। অপরিচিত একটা পুরুষমানুষ ফ্ল্যাটে রাতে থাকবে, পল্টুও নেই, লোকটা কেমন তাও জানি না! হাতের কাছে কিছু তো রাখা দরকার।’

‘কে থাকবে তোমার ফ্ল্যাটে? রাজেন!’

‘ওনার নাম রাজেন বুঝি?…ইসস ভদ্রলোক নীচে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে যেভাবে চোখ মুছছিলেন, দেখে বড়ো মায়া হল।’

‘রাজেন কাঁদছিল!’

‘আমি দৌড়ে নেমে গেলাম। উনি বললেন, রোহিণী আমায় তাড়িয়ে…।’

কুন্তীকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রোহিণী তির বেগে সিঁড়ির দিকে ছুটল। কুন্তী ছিটকে পড়েছিল দেওয়ালে। নিজেকে দাঁড় করিয়ে একগাল হেসে সে খোলা দরজা দিয়ে বাইরে তাকাল।

রাজেনকে টানতে টানতে ভিতরে আনল রোহিণী।

‘রুনিদি, আমি কী তাহলে—’

‘হ্যাঁ, দয়া করে এবার গিয়ে ঘুমোও। তোমাকে আর বারান্দায় বসে নজর রাখতে হবে না।’

‘কিন্তু এখনও তো আপনাদের—’ কুন্তী চিন্তিত মুখে থেমে গেল।

‘ওহহ কুন্তী! তুমি আর একটা কথা যদি বলেছ…রাজেন, এত হাসির কী আছে? একটু আগে তো গেটের কাছে দাঁড়িয়ে বাচ্চচাছেলের মতো কাঁদছিলে, লজ্জা করে না? …কুন্তী, মাসিমা যদি দেখেন তুমি মাঝরাতে ফ্ল্যাটের বাইরে, তাহলে কী কাণ্ডটা হবে ভেবে দেখেছ কী?’

‘মাসিমা দেখবেন কী করে? তিনি তো এতবড়ো একটা আফিংয়ের গুলি আর এক বাটি দুধ খেয়ে সেই যে বুঁদ হয়ে গেলেন, তারপর আমিই তো ওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। রুনিদি তাহলে কি উনি—’

‘হ্যাঁ, উনি আজ রাতটা আমাকে পাহারা দেবার জন্য এখানে থাকবেন…এটা কী খুব হাসির কথা যে হাসছ?’

‘আপনি সবার মুখে শুধু হাসিই দেখছেন। পল্টু না থাকলে আমার যে কী কান্না পায়, সেটা আর আপনি বুঝতে চাইছেন না, ওর কথা ভেবে আমার ঘুম আসে না বলেই বারান্দায় বসে মশার কামড় খাই। গঙ্গা ব্যানার্জির গুন্ডাদের উপর নজর রাখতে আমার বয়ে গেছে।’ কথাগুলো বলে থমথমে মুখে কুন্তী দরজার দিকে এগোল।

‘কুন্তী আমি খুব দুঃখিত। সত্যিই এটা আমার বোঝা উচিত ছিল।’ রোহিণী এগিয়ে এসে কুন্তীকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ‘এম্মা, বুড়ো মেয়ের চোখে জল!’ রোহিণী ওর মাথার উপর গাল চেপে ধরল। কপালে চুমু খেল।

ধাতস্থ হয়ে কুন্তী দরজা খুলে ফ্ল্যাট থেকে বেরোল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কী একটা মনে পড়ায় থেমে গিয়ে ফিরে তাকাল। খোলা দরজায় রোহিণী দাঁড়িয়ে স্নেহ ভরে তাকিয়ে। কুন্তী হালকা পায়ে উঠে এসে রোহিণীর ঘাড়ের উপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘ক্র্যাশ কাকে বলে এবার দেখলেন তো?’

‘এ তো ভিভ রিচার্ডসের ইনিংস!’

দরজা বন্ধ করার পর রোহিণী জিজ্ঞাসা করল, ‘ক্র্যাশটা কী জিনিস?’

‘কঠিন বাধা চুরমার করে দেওয়া! ইচ্ছে করছে, যে ম্যাক্সিটা এনেছি, সেটা ওকেই উপহার দিই।’

‘থাক থাক, তাহলে আড়াইটে কুন্তী লাগবে একটা নন্দার ম্যাক্সি ভরাতে। …খিদেটিদে পাচ্ছে কি, খেয়েছ কখন?’

‘পাচ্ছে। প্লেনে ডিনার নামে গালভরা যে জিনিস সার্ভ করে, তাতে মাত্র ঘণ্টা চারেক পেটটাকে চুপ করিয়ে রাখা যায়।’

‘তাহলে ডিম পাউরুটি দিয়ে মোগলাই টোস্ট…’

‘আহা হা হা, এখন আবার কষ্ট করে রান্নার দরকার কী! তৈরি খাবার যা আছে, তাতেই তো রাতটা চলে যাবে।’

‘তৈরি তো কিছুই নেই।’ বিব্রত স্বরে কথাটা বলে রোহিণী কুণ্ঠিত চোখে তাকাল এবং তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। হাত বাড়িয়ে সে টেবল থেকে টর্চটা তুলে নিয়ে বলল, ‘গুন্ডা দমনের জন্য কুন্তী এটা দিয়ে গেছে। ভালো ছেলের মতো যদি এই চেয়ারটায় বসে না থাক, তাহলে মাথায় আলুর খেত তৈরি হবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে টোস্ট হয়ে যাবে, পেঁয়াজটা কাটতে শুরু কর।’

‘কিন্তু রুনি, এক—একটা মিনিট এখন আমার কাছে এক—একটা বছর। পাঁচ মিনিট মানে পাঁচ বছর, এতদিন উপবাস করলে কেউ বাঁচে না। এটা বোঝার মতো হৃদয় কি ভগবান তোমায় দেননি?’

‘দিয়েছেন,’ রান্নাঘর থেকে জবাব ভেসে এল। ‘সেই সঙ্গে কিছু বুদ্ধিও। গঙ্গাদা এখন আমার বুদ্ধির পরীক্ষা নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।’

‘কুন্তী আমায় বলল, সে নিজের কানে শুনেছে, আজ সকালেই গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি নাকি তোমায় মার্ডার করবে বলে থ্রেট করেছে? সত্যি নাকি? আমি তো ভাবলুম, মেয়েটি তোমার বিপদের কথা বলে ভয় ধরিয়ে আমাকে আটকাবার জন্য কথাটা বানিয়ে বলল, তাই আর গুরুত্ব দিইনি। তুমিও তো এতক্ষণ এ সম্পর্কে কিছু বলোনি। আশ্চর্য লোক তো!’

রাজেন উঠে গিয়ে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল। তার চোখে উৎকণ্ঠা। হাতে কুচোনো পেঁয়াজ। মুখ গম্ভীর।

‘পাঁচ—ছ’দিন ছিলাম না। দেখে গেছিলাম, তুমি খুব ডিস্টার্বড ছিলে।’

‘হ্যাঁ ছিলাম, এখনও আছি। তারপর এই ক—দিনে অনেকগুলো ব্যাপার ঘটেছে, অনেক ব্যাপার জেনেছি, এমনকী একটা খুনও হয়েছে, একজনের ফ্ল্যাটে গুন্ডারা হামলা করে ছবিও চুরি করে নিয়ে গেছে। সবই তোমায় বলছি, আগে এটা করে নিই, তারপর খেতে খেতে শুনো।’

‘তার আগে গায়ে জল ঢালা দরকার। সারাদিনে স্নান হয়নি। তোমার কি রাতের স্নান হয়ে গেছে?’

প্রশ্নের উত্তর খুঁজে নেবার জন্যই যেন রোহিণীর সর্বাঙ্গে চোখ বোলাল রাজেন। কুঁকড়ে গেল রোহিণী। পাতলা, ঢিলে ম্যাকসিটার অন্তরালে কোনো অন্তর্বাস নেই; রাজেনের চোখ দেখে তার মনে হল, থাকার দরকার রয়েছে। সে ভ্রূ কুঁচকে পিছন ফিরল, মুখে বিরক্তি ফুটিয়ে।

রাজেন লক্ষ করেছে রোহিণীর মুখভাব। গম্ভীর স্বরে বলল, ‘নিশ্চিন্ত থাকতে পার, রেপ কেসের আসামি হবার ইচ্ছে আমার নেই।’

‘একটা আসামি নিয়ে হিমসিম খাচ্ছি, তারপর আর একটা কপালে জুটলে…। আচ্ছা, আমার এই শরীরটাকে ধ্বংস করে ফেললে হয় না? তাহলে আর কোনো ঝামেলার মধ্যে কাউকেই পড়তে হবে না।’

‘চমৎকার প্রস্তাব। গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি শুনলে খুবই পুলকিত হবে। আমি আর পেঁয়াজ—টেয়াজ কাটতে পারব না…বাথরুমে যাচ্ছি।’

‘এই এই শোনো।’ রোহিণী রান্নাঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে রাজেনের হাত ধরল, ওর চোখে চোখ রাখল। প্রায় এক মিনিট তারা এইভাবে তাকিয়ে রইল। ধীরে ধীরে স্তিমিত কোমল হয়ে এল রাজেনের ক্রুদ্ধ চাহনি। সে রোহিণীর মাথায় গালে, ঘাড়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ভয় থেকে আগে বেরিয়ে এসো, তা না হলে এই দেহ এই মন থেকে আমি নিজেকে পরিচ্ছন্ন করে নিতে পারব না।’

রোহিণীর মুখটা কিছুক্ষণ বুকে চেপে রেখে রাজেন স্নান করতে গেল।

রাত প্রায় চারটে। টেবিলে মুখোমুখি রোহিণী ও রাজেন। তৃতীয়বারের চা খাওয়া শেষ করে রাজেন বলল, ‘ব্যাপারটা তো আর হালকাভাবে নেওয়া যাচ্ছে না। তলায় তলায় যে এতটা গড়িয়েছে, তুমি কিছুই কি বুঝতে পারোনি?’

‘একদমই পারিনি। সবকিছু আনফোল্ড হতে লাগল তুমি চলে যাবার পর। আর কী অদ্ভুত দ্যাখো, ঘটনাগুলো ঘটতে লাগল আমার বিনা চেষ্টাতেই। মীনা চ্যাটার্জিকে ইন্টারভিউ করার জন্য আটদিন আগে তুমি আমাকে পৌঁছে দিলে, সেখানে ওর ফ্ল্যাটে একটা ছবি দেখে ফেললাম। ব্যস, সেই শুরু হল। সেখানেই সুভাষ গায়েনের সঙ্গে পরিচয়, তার কাছ থেকে অনেক কথাই জানতে পারলাম। আবার তোমাকে খাওয়াব বলে ইলিশ মাছ কিনে সেটা উপরের ফ্ল্যাটে ফ্রিজে রাখতে গিয়ে আলাপ হল সুজাতা গুপ্তর সঙ্গে, তার কাছেও আবার অনেক কথা জানতে পারলাম। মহারানির রাশিফল লেখার জন্য কুন্তীদের কাছ থেকে ইংরিজি ম্যাগাজিন আনলাম, তাতে শোভনেশ সম্পর্কে এমন একটা প্রবন্ধ দেখলাম, তুমিও সেটা পড়েছ, লেখাটা আমাকে এমনই চাগিয়ে তুলল যে, নিজেই উদ্যোগ নিয়ে খোঁজখবর করতে লাগলাম।’

‘না করলেই ভালো হত। তাহলে এইরকম অবস্থাটা তৈরি হত না। সুভাষ, মীনা, গঙ্গাপ্রসাদ বা সুজাতা গুপ্ত এরা তোমার কেউ নয়। যা কিছু বোঝাপড়া ওরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে করে নিত, তোমার কোনো দরকারই ছিল না এদের মধ্যে মাথা গলাবার। তা ছাড়া শোভনেশ সেনগুপ্তর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির উপরও তোমার যখন বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তখন এদের থেকে দূরে থাকাই ভালো ছিল।’

‘এখন তাই মনে হচ্ছে।’ মুখ নামিয়ে রোহিণী নখ দিয়ে টেবল থেকে মোমবাতির জমাট মোম তুলতে লাগল।

‘গঙ্গাপ্রসাদ কি কিছু করবে বলে মনে হচ্ছে?’

‘মীনাকে যা করেছে?’

‘না, সুভাষ গায়েনকে যা করেছে।’

‘মনে হয় না, অন্তত টেপের ক্যাসেটটা কার কাছে রয়েছে, সেটা না জানার আগে পর্যন্ত নয়।’ চিন্তিত স্বরে ধীরে ধীরে রোহিণী বলল। ‘একটা লোককে খুনি সাজিয়ে জেলে ঢোকাবার সুযোগ উনি নিয়েছেন। তার বহু টাকা দামের ছবি হাতিয়েছেন, বসত বাড়িটাও আমার মনে হয় বেনামে নিজেই কিনেছেন সামান্য টাকায়। তাই নয়, নিজের মুখেই বলে গেলেন, এসব করেছি টাকার জন্য, টাকা করতে ভালোবাসি, টাকা করতে হলে এভাবেই করতে হয়। ভাবতে পারো রাজেন, বেশ গর্বের সঙ্গেই কিছু না রেখে—ঢেকে একটা লোক পরিষ্কার দিনের আলোয় কিনা মুখের উপর বলল, কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না, আর শোভনেশের ছবিগুলো তো আমার কাছেই আছে!’

‘প্রমাণের কিছু না থাকলে, আমিও এইভাবে কথা বলতে পারি। শোভনেশ সেনগুপ্ত নিজের মুখে কোর্টে বলেছেন, তিনিই বীণাকে জানলা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন। তারই ভিত্তিতে কনভিক্টেড হয়েছেন। এরপর গঙ্গাপ্রসাদকে ফাঁসানো কি এত বছর পর সম্ভব হতে পারে? পুলিশে অবশ্য তুমি অভিযোগ করতে পারো, কিন্তু এমন জায়গায় এমনভাবে সেগুলো লুকোনো যে, খুঁজে বার করাই অসম্ভব হবে। ধরো, খোঁজ পাওয়া গেল, তখন দেখবে গঙ্গাপ্রসাদ এমন একটা দলিল বার করবে যাতে লেখা, শোভনেশ তার সব ছবিই ওঁকে বিক্রি করে দিয়ে গেছে। এখন তো আসল ছবিগুলোর সঙ্গে নকলগুলোও গঙ্গাপ্রসাদ বিক্রি করে যাবে, কিন্তু ধরা পড়বে না। ধরিয়ে দেবার লোক ছিল সুভাষ গায়েন, তাকে তো হাওয়া করে দিয়েছে।’

‘শুধু একটা লোকই এখন গঙ্গাদার মুখোশ খুলে দিতে পারে। কিন্তু সে লোকটা যে এই মুহূর্তে কোথায়, তা কেউই জানে না।’

‘শোভনেশ সেনগুপ্ত।’

রাজেন জলের গ্লাস নিয়ে উঠে বেসিনের কলে গেল। গ্লাসে জল ভরে ঢক ঢক করে খেয়ে, চোখে জলের ঝাপটা দিল।

‘শোভনেশ নাকি গঙ্গাদাকে ফোন করেছিল। আমার মনে হয়েছে এটা মিথ্যে কথা।’

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে। ব্লাফ দিয়ে তোমাকে বোধ হয় অসাড় করে দিতে চেয়েছিল।’ তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে হঠাৎ মোছা বন্ধ করে রাজেন বলল, ‘একবার বহরমপুর গিয়ে খোঁজ নিলে হত না? সেনগুপ্তর হাসপাতাল থেকে পালানোর খবরটাও ব্লাফ কিনা সেটা একবার ভেরিফাই করা কি উচিত নয়?’

‘কবে কী লাভ হবে? ধরো শোভনেশ পালায়নি।’ রোহিণী চেয়ারে বাবু হয়ে বসে মুখের সামনে তালু রেখে হাই তুলল। রাজেন কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।

‘ধরো শোভনেশ জেলেই আছে, তাতে এখনকার এইসব ব্যাপারের উপর তার কোনো প্রভাব পড়বে কি? গঙ্গাদার কেশাগ্রও স্পর্শ করা যাবে না। ওর শুধু একটাই অস্বস্তি, কেসটা রি—ওপেন হলে, ওনার সাক্ষ্যপ্রমাণ ধামাচাপা দেবার চেষ্টাটা ফাঁস হয়ে যাবে। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়তে পারে। …ওহহ দ্যাখো ভুলেই গেছি, ওপরের মাসিমা কাল বিকেলে বেরিয়ে রাত পর্যন্তও ফেরেননি।’

‘কে, সুজাতা গুপ্ত?’ রাজেন অবসাদ কাটাতে ক্যালিসথেনিকস শুরু করেছে। দু—পা ফাঁক করে কোমর থেকে ঊর্ধ্বাঙ্গ চক্রাকারে ঘোরাচ্ছিল। সেটা থামিয়ে বলল, ‘তোমায় কে বলল?’

‘মেসোমশাই। কাল রাতে সিঁড়িতে দেখা, তখন বললেন, খুবই আপসেট মনে হল।’

‘হওয়াটাই স্বাভাবিক। বুড়ো বয়সে বউ পালালে কী মুশকিল যে হয়!’

‘পালিয়েছেন ধরে নিচ্ছ কেন, হয়তো বিপদে পড়েছেন, অ্যাকসিডেন্টও হতে পারে। একবার উপরে গিয়ে খোঁজ নেওয়া উচিত।’

‘ওপরে গেলে ম্যাক্সিটা নিয়ে যেয়ো।’

‘ওরে বাবা, তুষার দত্ত ওটা দেখলে খাপ্পা হয়ে, ফড়াৎ করে হয়তো ছিঁড়ে ফেলে দেবে। আমি পরলে ঠিক আছে, কিন্তু নিজের মেয়ের গায়ে এইরকম অসভ্য ড্রেস উনি বরদাস্ত করবেন না। আমি বরং নন্দাকে ডেকে এনে দিয়ে দেব।’

রোহিণী চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে জানালা খুলল। বাইরে আবছা আলো। ভোর হচ্ছে। পাখিদের কিচির—মিচির ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

‘তোমার গৌরীর মা এসে পড়ার আগেই আমায় কেটে পড়তে হবে। ট্যাক্সি এখানে কখন পাওয়া যাবে? বাড়ি গিয়ে ঘুমোতে হবে।’

‘আটটা—নটার আগে পাচ্ছ না। তবে ভাগ্যে থাকলে তার আগেও পেয়ে যেতে পারো। ততক্ষণ তুমি বিছানায় গড়িয়ে নিতে পারো।’

‘এখন বিছানায় বডি ফেললে সাত—আট ঘণ্টার আগে সেটা তুলতে পারব না। অসম্ভব টায়ার্ড। বরং আর একবার চা হোক।’

চা করতে করতে রোহিণী বলল, ‘আজ একটা জরুরি কাজ আছে, ঘোষালদের ফোন করতে হবে। গঙ্গাদাকে আজই চণ্ডীদাস ঘোষাল ফোন করে জানবে, বিক্রির জন্য শোভনেশের ছবি পাওয়া যাবে কিনা। পাওয়া গেলে কোথায় ছবি দেখার জন্য ওদের যেতে হবে, সেটাই আমায় জানতে হবে।’

‘জেনে কী করবে?’ আঙুলে টুথ পেস্ট লাগিয়ে দাঁতে ঘষতে ঘষতে রাজেন বলল। ‘তুমিও কী ছবি দেখতে যাবে?’

‘যাব কিনা ভাবছি, তবে মীনা চ্যাটার্জিকে খবরটা নিশ্চয় দেব।’

.

দশ

চা খেতে খেতে রাজেন খবরের কাগজ পড়ছিল। রোহিণী চারতলায় গেছে হৃদয়রঞ্জনের কাছ থেকে সুজাতা গুপ্তর খোঁজখবর নিতে। তখন কলিংবেল বাজল।

দরজা খোলার জন্য রাজেন উঠে গিয়ে আই হোলে চোখ রেখেই সিঁটিয়ে গেল। একটি স্ত্রীলোক এবং হাতে পাউরুটি আর দুধের প্যাকেট দেখে মনে হচ্ছে কাজের লোক অর্থাৎ গৌরীর মা। রাজেন ভেবে পাচ্ছে না এখন তার কী করা উচিত। ফ্ল্যাটে রোহিণী নেই, দরজা খুলে দিলে তার পরিচয় জানার জন্য এই মহিলার ভ্রূ বেঁকে উঠবে আর সেটি কপালে উঠবে যথার্থ পরিচয় শুনলেই। অতএব দরজা না খোলাই উচিত। কিন্তু না খুললে ইনি তো বেল বাজিয়েই যাবেন।

গৌরীর মা আবার বেল বাজাল। মুখে বিরক্তি। তার পক্ষে জানা সম্ভব নয়; রোহিণী এখন চারতলায়। ‘যা হয় হবে’ এইরকম একটা বেপরোয়া ভাব নিয়ে রাজেন দরজা খুলল।

‘তুমি গৌরীর মা?’

‘হ্যাঁ।’ গৌরীর মা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে। তার মুখের উপর দিয়ে বিস্ময়, সন্দেহ, কৌতূহল পর পর ঢেউ খেলে গেল। ‘দিদি নেই?’

‘এইমাত্র ওপরে গেল মাসিমার খবর নিতে। দাঁড়িয়ে রইলে কেন, ভেতরে এসো।’ রাজেন খোলা দরজা থেকে এক পা পিছিয়ে গেল।

‘আপনি?’ প্রশ্নটা করার পরই গৌরীর মা—র মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘জামাইবাবু!’

রাজেন ভ্যাবচ্যাকা দশার মধ্যে পড়ল। এখনও হইনি তবে হবো, এই ধরনের একটা বাক্য সে মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিল, কিন্তু কাজটি সম্পূর্ণ করার আগেই গৌরীর মা—র মুখে ছড়ানো হাসি দেখে সে ঢোঁক গিলল।

‘আমার মন বলছিল, আপনি ফিরে আসবেনই। না এসে পারবেনই না…দিদির মতো অমন ভালো মেয়েকে কষ্ট দিয়ে কদ্দিন আর নিরুদ্দেশ হয়ে থাকতে পারবেন?’ গৌরীর মা ভিতরে এসে হাতের জিনিসগুলো টেবিলে রাখল। ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ করে রাজেন এবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

‘কতদিন আমি দিদিকে বলেছি, ওপরের মাসিমাকে, নীচের বউদিকেও বলেছি, জামাইবাবু ঠিক ফিরে আসবেনই আসবেন। আজ সকালেই তো আমার বাঁ চোখটা নাচল, তখন কেন জানি মনে হল, বাবা তারকনাথের দিব্যি, সন্তাোষী মা—র দিব্যি করে বলছি, মনে হল দিদির দুখ্যু আজ ঘুচবে, হ্যাঁ আজকেই। কেমন মিলে গেল তো? আমার মন যা বলবে, তা হবেই হবে। তা জামাইবাবু কতদিন আপনি নিরুদ্দেশ হয়ে ছিলেন?’

‘ছ—সাত বছর।’ মুখ ফসকেই রাজেনের অজান্তেই কথাটা বেরিয়ে এল।

‘য়্যাঃ! অত্তোদিন, এমন বউকে ফেলে? পারেন বটে আপনারা। আমার বর একবেলা আমায় না দেখে…তা দিদি এখন আবার উপরে গেল কেন, দাঁড়ান আমি ডেকে নিয়ে আসি। এখন কী…।’ শশব্যস্তে গৌরীর মা প্রায় জগ করেই বেরিয়ে গেল।

রাজেন বিমূঢ়ের মতো ধীরে ধীরে চেয়ারে বসে পড়ল। ঠিক সেই সময় চারতলায় হৃদয়রঞ্জনের ফ্ল্যাটেও রোহিণী উৎকণ্ঠিত স্বরে দ্বিতীয়বার বলল, ‘সে কি! মাসিমা রাতে ফেরেননি?’

হৃদয়রঞ্জন মাথা নাড়লেন।

‘তাহলে এবার পুলিশে খবর দিন। আর অপেক্ষা করার দরকার নেই। আমার মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে। মাসিমা দিগম্বর বর্ধন লেনে সেদিন না গেলেই ভালো করতেন।’

‘কেন?’ হৃদয়রঞ্জন তীক্ষ্ন তীব্র স্বরে, একটি শব্দেই বুঝিয়ে দিলেন, তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। ‘কেন পুলিশের কাছে যাব? যে স্বেচ্ছায় চলে গেছে তার জন্য সবাইকে উদবাস্তু করে লাভ কী?’

‘কিন্তু তিনি কোনো বিপদে পড়লেন কিনা…’

‘পড়ে পড়বেন। বহু বছর ধরে আমি যন্ত্রণা ভোগ করেছি। আমার সারাজীবন বিষিয়ে দিয়েছে…আমি খোঁড়া, আমি কুৎসিত, আমি শোভনেশ সেনগুপ্তর মতো লম্বা নই, ফর্সা নই, তাঁর মতো শিল্পী নই…কিন্তু আমারও তো সহ্যের সীমা আছে।’ বলতে বলতে হৃদয়রঞ্জন চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। পুরু কাচের ওধারে চোখ দুটোয় ধকধক করে ঘৃণা জ্বলছে। হাতের আঙুল কাঁপছে।

রোহিণী ভেবে পেল না, এখন কী বলে সে এই লোকটিকে সান্ত্বনা দেবে। লাঞ্ছিত, অপমানিত এক পুরুষ এতদিনে যেন শোধ নিতে নিজেকে জাগিয়ে তুলেছে।

‘এই একটা লোক আমার জীবন দুর্বিষহ করেছে। কলকাতা ছেড়ে দূরে চলে গিয়ে ভেবেছিলাম …কিন্তু এখন দেখছি সবই আগের মতনই রয়েছে, কিছুই মুছে যায়নি।’ হৃদয়রঞ্জনের স্বর হতাশায় অস্ফুট হয়ে এল।

যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে রোহিণী, ঠিক সেই সময়ই পড়িমরি ছুটে এল গৌরীর মা।

‘অ দিদি, অ্যাদ্দিন পর জামাইবাবু ফিরে এল, আর তুমি এখানে বসে বসে গপ্পো করচো! একদিন নয় এক বছর নয়, ছ—ছ’টা বছর পর নিরুদ্দেশ থেকে ফিরে এয়েচে! কোথায় তুমি তাঁর সেবা যত্ন করবে, তা না তুমি…ধন্যি বাবা। যাও যাও নীচে যাও।’

একটা পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটল অথচ একটা পিঁপড়েও মরল না, এমন একটা ব্যাপার যেন প্রত্যক্ষ করছে রোহিণী, সেইরকমভাবে গৌরীর মা—র দিকে তাকিয়ে রইল। হাত—পা অবশ হয়ে আসছে। মাথাটা টলে যেতেই সে চেয়ারে আবার বসে পড়ে বলল, ‘শোভনেশ ফিরে এসেছে?’

তখনই দরজার দিকে ছুটে যেতে গিয়ে টেবলের কোণায় ধাক্কা লেগে বেটাল হয়ে পড়তে পড়তে হৃদয়রঞ্জন চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমি খুন করব শয়তানটাকে, আজ আমি…।’ দেওয়ালে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আবার নিজেকে দাঁড় করিয়ে তিনি দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। রোহিণী চোখ বন্ধ করে ফেলল। গত সাত—আট দিন ধরে যে ভয়টাকে নিয়ে সে নাড়াচাড়া করেছে, অবশেষে সেটা বাস্তব রূপ নিল।

‘হ্যাঁ গো দিদি, ব্যাপার কী?’ গৌরীর মা কোনোক্রমে কথাটা বলতে পারল। ওদের আচরণ দেখে সে এইটুকু শুধু বুঝেছে, তার বলা কথাগুলো দক্ষের যজ্ঞে ক্ষ্যাপা শিবের মতো হাজির হয়েছে দু—জনের কাছে।

‘মেসোমশাই অমন করে ছুটলেন কাকে খুন করতে?’

সর্বনাশ, নীচে তো রয়েছে রাজেন। মনে পড়ামাত্র ছিটকে উঠেই রোহিণী দরজার দিকে ছুটল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে দেখল, তার ফ্ল্যাটের দরজা খোলা আর ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিনটি লোক, যাদের মধ্যে একজনকেই সে শুধু চেনে।

রোহিণী থমকে পড়ল মাঝ সিঁড়িতে। গঙ্গাদা আবার এসেছেন, কিন্তু সঙ্গে ওই দুটি লোক কারা? চেহারা সুবিধের মনে হচ্ছে না।

গঙ্গাপ্রসাদ দেখতে পেয়েছেন রোহিণীকে। ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে এসে বললেন, ‘কথা আছে। তার আগে বলো, ঘরে যে দু—জনকে দেখলাম, ওরা কারা?’

রোহিণী ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা লোক দুটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তার আগে বলুন আপনার সঙ্গের ওই লোক দুটি কারা?’

‘আমার লোক, আমার সঙ্গে এসেছে।’

‘ওদের বেরিয়ে আসতে বলুন। আমি পছন্দ করি না, আমার বিনা অনুমতিতে অপরিচিত কেউ আমার ফ্ল্যাটে ঢোকে।’

‘এ ফ্ল্যাট আমার, আমি এর মালিক।’

‘অবশ্যই। কিন্তু যতক্ষণ আমি এটায় রয়েছি, ততক্ষণ আমি মালিক।’

রোহিণী কণ্ঠস্বরকে যতটা ইস্পাত করল, ঠিক ততটা কঠিন চোখেই গঙ্গাপ্রসাদ তাকিয়ে রইলেন। সাত—আট সেকেন্ড পর মাথা নেড়ে ইশারা করলেন লোক দুটিকে বেরিয়ে আসার জন্য। ওরা বেরিয়ে আসতেই রোহিণী ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকল।

খাওয়ার টেবিলে চুপ করে বসে আছেন হৃদয়রঞ্জন, মাথা দু—হাতে ধরে, নীচু করে। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে রাজেন, একটু ঝুঁকে হাত নেড়ে কী যেন তাঁকে বলছে বোঝাবার মতো ভঙ্গিতে। রোহিণী হাঁফ ছাড়ল। খুনটুন ধরনের কিছু যে ঘটেনি, এটাই তাকে স্বস্তি দিল। অবশ্য বৃদ্ধ হৃদয়রঞ্জন, খালি হাতে কোনো ‘শয়তানকে’ যে সাবাড় করতে পারবেন, এমন সম্ভাবনাকে বহু চেষ্টাতেও সে স্বপ্নে জায়গা দিতে পারবে না। তাহলেও মানুষের সবথেকে সহজ কাজগুলোর মধ্যে, খুনই বোধ হয় সবথেকে সহজতম। আক্রমণ রুখতে গিয়ে রাজেনই হয়তো হৃদয়রঞ্জনকে মেরে ফেলতে পারে। যাই হোক, দু—জনকেই বেঁচে থাকতে দেখার পর রোহিণী ফিরে তাকাল দরজায় দাঁড়ানো গঙ্গাপ্রসাদের দিকে।

‘বলুন, কী কথা?’

‘একটু বাইরে এসো।’

রোহিণী পরিবেশটা বুঝে নিল। গঙ্গাদার লোক দুটোর অস্বস্তিকর রকমের চেহারা। বোধ হয় উনি ভেবেছিলেন, মীনা চ্যাটার্জিকে দেওয়া ওষুধেই কাজ সারতে পারবেন। কিন্তু ফ্ল্যাটে আরও দুটি লোক যে থাকবে, এটা জানতেন না। দশ ঘণ্টা আগে রোহিণীও জানত না। এখন আর ঝঞ্ঝাট বাধানোর কোনো ঝুঁকি ওরা নেবে না। রোহিণী সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে এসে দাঁড়াল।

কোনো ভনিতা না করেই গঙ্গাপ্রসাদ বললেন, ‘কুন্তী নামে কোনো মেয়েকে চেনো?’

‘কুন…তী!’ রোহিণী তার বিস্ময়কে দীর্ঘস্থায়ী করল চিন্তা করার সুযোগ নেবার জন্য। নামটা জেনে গেছে। কীভাবে? দিগম্বর বর্ধন লেনে গিয়ে তাহলে গীতা বা বিশ্বনাথের সঙ্গে গঙ্গাদা কথা বলেছেন। কুন্তী নিশ্চয় নিজের নামটা গীতার কাছে বলে ফেলেছিল। উনি এখন তাহলে টেপ রেকর্ডারের সন্ধানে বেরিয়েছেন।

‘মনে পড়ছে না এমন নামের কাউকে চিনি। কেন বলুন তো?’ সরল কৌতূহল রোহিণীর কণ্ঠে ও চোখে।

‘ভালো করে মনে করো…খুব রোগা, লম্বা চুল, বড়ো বড়ো চোখ, বয়স কুড়ি—বাইশ, সালোয়ার—কামিজ পরে…এমন কাউকে?’ গঙ্গাপ্রসাদ তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রোহিণীর মুখভাব লক্ষ করছেন। কিন্তু মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারছেন না।

রোহিণী মাথা নেড়ে বলল, ‘নাহ মনে পড়ছে না।’

‘অ।’ গঙ্গাপ্রসাদ একবার খোলা দরজা দিয়ে ফ্ল্যাটের ভিতরে তাকালেন, কী যেন ভাবলেন, তারপরই সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলেন। তাঁর পিছনে লোক দুটিও।

তখনই দেখা গেল সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে কুন্তী। তাকে দেখেই গঙ্গাপ্রসাদ থমকে দাঁড়ালেন। কুন্তীও থমকে পড়ল। গতকাল এই সময়ই সে রোহিণীর শোবার ঘর থেকে উঁকি দিয়ে গঙ্গাপ্রসাদকে দেখেছিল। মুখ তুলে কুন্তী একবার শুধু রোহিণীর দিকে তাকিয়েই কী যেন বুঝে নিল, তারপর গঙ্গাপ্রসাদকে বলল, ‘এক্সকিউজ মী, মিসেস রোহিণী সেনগুপ্তর ফ্ল্যাট কোনটে বলতে পারেন?’

‘আমি এখানে থাকি না।’

‘ওহহ।’ কুন্তী যখন পাশ কাটিয়ে উপরে উঠছে তখন রোহিণী বলল, ‘আমিই রোহিণী সেনগুপ্ত, আপনি?’

‘আমার নাম নন্দা দত্ত।’ কুন্তী চোখের পলক না ফেলে, অপরিচিতের মুখভাব বজায় রেখে বলল, ‘আমি আসছি পল্টু দত্তরায়ের কাছ থেকে।’

রোহিণীর মুখে হাসি ফুটল।

‘ওহো পল্টু! আসুন আসুন। কালকেই তো পল্টু ফোন করে বলল, আজ আসতে পারবে না, বউকে নিয়ে নার্সিং হোম যাবে…বাচ্চচা হবে কিনা। তা আপনাকে বুঝি পাঠাল?’

বাজারের থলি হাতে চারতলা থেকে তুষার দত্ত নামছে। সিঁড়িতে অতগুলো লোক দেখে সে মন্থর হয়ে গেল। রোহিণীর দিকে তাকিয়ে হেসে মাথা হেলিয়ে বলল, ‘বেরোচ্ছি, একটু বাজারের দিকে যাব। মেজো শালা এসেছে কানাডা থেকে, খুব বড়ো ডাক্তার, ওকে আজ খেতে বলেছি।’

‘তাই নাকি!’ এর বেশি আর কী সে বলতে পারে, রোহিণী তা ভেবে পেল না।

‘চেতলের পেটি খাওয়াব ভাবছি, চয়েসটা ঠিক করেছি কি না বলুন?’

‘অসাধারণ চয়েস। কিন্তু আপনি কি একটু দেরি করে ফেলেননি? বাজারে এসব জিনিস এত দেরি করে গেলে কি পাওয়া যায়?’

তুষার দত্ত, ‘তাই তো’ বলেই দ্রুত নেমে যেতে যেতে ভ্রূ কুঁচকে একবার গঙ্গাপ্রসাদ ও তার সঙ্গের লোক দুটির দিকে তাকাল। ফ্ল্যাটের ভিতর থেকে হৃদয়রঞ্জন ও রাজেন তখন বেরিয়ে এল।

‘চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।’ মৃদু কোমল স্বরে রাজেন বলল।

‘না না, আমি ঠিকই আছি, মাথাটা তখন কীরকম যেন—’

হৃদয়রঞ্জন এক পা এক পা করে সিঁড়ি ভেঙে উঠতে লাগলেন। রাজেন সিঁড়িতে লোকজন দেখে রোহিণীর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। কুন্তীর দিকে তাকিয়ে হেসে কী যেন বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রোহিণী ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘মেসোমশাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে যাও, দেখছ না ওনার মাথা ঘুরছে, পড়ে টড়ে যেতে পারেন।’

রাজেন লাফ দিয়ে হৃদয়রঞ্জনের কাছে পৌঁছল।

একদৃষ্টে গঙ্গাপ্রসাদ সব কিছু লক্ষ করছিলেন, এইবার রোহিণীকে লক্ষ করে বললেন, ‘নীচের ফ্ল্যাটে দত্তরায় লেখা একটা নেমপ্লেট দেখলাম। সেখান থেকেই কী উনি আসছেন।’

রোহিণীর বুক নিমেষের জন্য হিম হয়ে গেল। কিন্তু সামলে নিয়ে বলল, ‘দত্তরায় কী কলকাতা শহরে এই একজনই আছে?’

‘তা বটে।’ গঙ্গাপ্রসাদ শান্ত ভঙ্গিতে তাকালেন কুন্তীর পায়ের দিকে। শৌখিন ঘাসের চটি কুন্তীর পায়ে। ‘উনি তাহলে এ বাড়ির লোক নন, বাইরে থেকেই আসছেন। আচ্ছা চলি।’

গঙ্গাপ্রসাদরা নেমে যাওয়ামাত্র কুন্তীর হাত ধরে রোহিণী ফ্ল্যাটের মধ্যে তাকে টেনে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।

‘তুমি পল্টু দত্তরায় বলতে গেলে কেন?’

‘ওই নামটাই মুখে এসে গেল যে!’

‘নীচে গিয়েই খোঁজ নেবে গঙ্গাদা।’

‘নিক গে। আমার তাতে কিছু এসে যাবে না।’ কুন্তী অবহেলাভাবে কাঁধ ঝাঁকাল।

‘এসেছে কেন জান? তুমি যে টেপ করে এনেছ, সেই খবর পেয়ে গেছে। তোমার খোঁজেই এসেছে। সঙ্গের লোক দুটো গুন্ডা।’

‘ওহ রিয়ালি!’ কুন্তী খুশিতে চনমন করে উঠল। ‘আমার জন্য, গুন্ডা! রুনিদি, এ তো রিয়াল লাইফ থ্রিলার। আমি এটা লিখবই, কিন্তু ছাপিয়ে দিতে হবে।’

রোহিণী হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘ব্যাপারটার গুরুত্ব তুমি বুঝতে পারছ না এখনও।’

‘খুব বুঝতে পারছি, আমাকে অত হাঁদাভোঁদা ভাববেন না। আপনার ওই গঙ্গাদা এবার টেপের ক্যাসেটটা উদ্ধার করার জন্য আমাদের ফ্ল্যাট র‌্যানস্যাক করবে, আমাকে কিডন্যাপ করবে, টর্চার করবে আর পল্টু গিয়ে আমাকে ওদের ডেন থেকে রেসকিউ করবে। ভাবতে পারেন রুনিদি, ভাবতে পারেন?’ কুন্তী উত্তেজনায় জড়িয়ে ধরল রোহিণীকে।

কলিংবেল বাজল। রোহিণী দরজা খুলল।

‘কী কাণ্ড গো দিদি, য়্যাঁ উনি জামাইবাবু নন? আমাকে সে কথা বলবে তো?’

‘তুমি আমাকে সে কথা বলার সুযোগ অন্তত দেবে তো?’

‘ছিছিছি, এমন ভুল আমি করে বসলুম! সকালে বাঁ চোখটা নাচল, আমি ভাবলুম আজ তাহলে ভালো একটা কিছু ঘটবে। আর কিনা একটা বাইরের লোককে তোমার স্বামী বানিয়ে দিলুম! কী হবে এখন বলো তো? কী লজ্জায় যে এখন—’

‘কী আর করা যাবে, তোমার লজ্জা ঘোচাতে ওকেই এখন আমায় বিয়ে করতে হবে।’ ‘তোমার ভালো লোকটি করছেন কী উপরে?’ রোহিণী জানতে চাইল আর তখনই রাজেনকে ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখে গৌরীর মা ঘোমটা তুলে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

কুন্তী একগাল হেসে বলল, ‘আপনার খবর নিতেই এসেছি। কিন্তু এসেই ঘটে গেল গঙ্গাস্নান। এখন হিহি করে কাঁপছি। কী করা যায় বলুন তো?’

‘ভিজে কাপড়ে আর কিছুক্ষণ থাকলেই নিউমোনিয়া হবার খুবই সম্ভাবনা। গঙ্গাযাত্রা ঘটে যেতে পারে।’ রাজেন হালকা স্বরে বললেও তার মুখে ছড়ানো রয়েছে দুশ্চিন্তার ছায়া। সে জিজ্ঞাসু চোখে রোহিণীর দিকে তাকাল। দু—জনেই কোনো কথা বলছে না।

পরিবেশটা ক্রমশ গুমোট হয়ে উঠছে দেখে কুন্তী বলল, ‘টেপটার জন্যই তো দলবল নিয়ে ওর আসা, তা ওটা দিয়ে দিলেই তো হয়।’

‘সে কী! দিয়ে দেব?’ রোহিণী জীবনে এই প্রথম যেন একটা আজগুবি কথা শুনল! ‘এটাই তো এখন আমাদের হাতে রাখা দরকার।’

‘রুনিদি, দেব মানে এর একটা নকল দেব। আমার কাছে টেপ আছে, তাইতে ডুপ্লিকেট করে সেটাই ওকে দেব। গঙ্গারাম বুঝতেও পারবে না।’

রোহিণী আর রাজেন মুখ—চাওয়া চাওয়ি করল। সেটা লক্ষ করে কুন্তী বলল, ‘লোকটা যাতে আর ঝামেলা না করে, সেইজন্যই বললাম। তখন রুনিদি এমন একটা কথা ফট করে মুখ থেকে বার করলেন, শুনেই মনটা কীরকম যেন হয়ে গেল। এখন মনে হচ্ছে ধুমধাড়াক্কা, হুড়োহুড়ির থেকে শান্ত, আনন্দের জীবন অনেক সুন্দর।’ কুন্তীর কথাগুলো সকালের রোদের মতো সোনালি আভা হয়ে ঘরে ভেসে রইল।

অবাক স্বরে রোহিণী বলল, ‘কখন আমি কী বললাম?’

‘বললেন না, পল্টু নার্সিংহোমে বউকে নিয়ে গেছে কীসের জন্য যেন।’ কুন্তী মুখ ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। চোখে হালকা নরম স্বপ্নের ছায়া।

হেসে উঠতে গিয়ে রোহিণী হাসল না। রাজেন কথাগুলোর অর্থ বুঝতে না পেরে বিব্রত হয়ে বলল, ‘কারোর সিরিয়াস কিছু হয়েছে নাকি?’

‘হয়েছে। কুন্তীকে খুব সিরিয়াস রোগেই ধরেছে। কিন্তু পল্টুবাবু ছাড়া আর কারোর পক্ষে তো এর চিকিৎসা সম্ভব নয়। ফিরে আসুক গৌহাটি থেকে, তারপর কুন্তীর জন্য নার্সিংহোমের ব্যবস্থা করা যায় কিনা দেখব। কিন্তু তার আগে এই ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়াটা খুবই জরুরি। গঙ্গার ঢেউ কুন্তীর ঘরে ঢুকে বাচ্চচার দোলনা ভাসাক, এটা কোনোমতেই হতে দেওয়া যায় না। কুন্তী তোমার প্রস্তাবই শিরোধার্য করছি, এই টেপটার একটা কপি এখনি করে দাও।’

‘কপি করতে হলে আর একটা রেকর্ডার যে দরকার! জোগাড় করতে পারবেন?’ কুন্তী জানতে চাইল।

‘নন্দাদের একটা আছে। দাঁড়াও আমি দেখছি।’ রোহিণী ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে যাবার সময় রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘গৌরীর মা, নিরুদ্দেশ থেকে ফেরা তোমার জামাইবাবুটি সকাল থেকে অভুক্ত, টোস্ট করে অন্তত খাওয়াও।’

কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলল স্বয়ং নন্দা।

‘আঙ্কল তোমার জন্য জয়পুর থেকে ম্যাক্সি এনেছে, ওটা নিয়ে এসো, আর তোমাদের টেপরেকর্ডারটা কিছুক্ষণের জন্য দরকার, ওটা সঙ্গে করে নিয়ে যেয়ো। চটপট।’ দরজায় দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে কথাগুলো বলেই রোহিণী নেমে এল।

খাওয়ার টেবিলে টেপরেকর্ডারটা। কুন্তী ক্যাসেট রিওয়াইন্ড করায় ব্যস্ত। রাজেন গালে হাত দিয়ে বসে। গৌরীর মা লম্বা ঘোমটায় মুখ ঢেকে টোস্ট রেখে গেল টেবিলে।

‘নন্দা রেকর্ডার আনছে। কুন্তী তোমার কাছে স্পেয়ার ক্যাসেট আছে বললে, সেটা নিয়ে এসো। আমি ওটা বরং অফিসে গিয়ে গঙ্গাদার হাতেই দিয়ে আসব।’

দু—ঘণ্টার পর ট্যাক্সিতে মালপত্র তুলে রাজেন রওনা হল, সঙ্গে রোহিণীও। তাকে মহারানি অফিসে নামিয়ে দিয়ে সে বাড়ি যাবে। পথে হৃদয়রঞ্জনের প্রসঙ্গ উঠল। রাজেন বলল, ‘ভদ্রলোক একেবারে শ্যাটারড হয়ে গেছেন। আমিও খুব লজ্জায় পড়ে গেছলাম। আচমকা পিছন থেকে একজোড়া হাত যদি গলা টিপে ধরে, তাহলে আত্মরক্ষার জন্য ইনস্টিংকটিভলি যা করার তাই করেছি। বুড়ো মানুষ, গায়ে জোর নেই, আমি গলা থেকে হাতটা ছাড়িয়েই উঠে দাঁড়িয়ে একটা ঘুসি চালাই। ভাগ্য ভালো সেটা ওঁর মুখে লাগেনি। তাহলে এতক্ষণে হাসপাতাল আর পুলিশ করতে হত। তারপর আমি ওঁকে দেখে আর উনি সেনগুপ্তর বদলে আমাকে দেখে, দু—জনেই হতভম্ব হয়ে যাই। ওনার অবস্থাটাই মর্মান্তিক হয়ে পড়ে। বার বার এমনভাবে ক্ষমা চাইতে লাগলেন যে, দেখে আমার কষ্টই হচ্ছিল।’

‘ওঁর মনের ব্যাপারের কিছুটা বুঝতে পারি, কিন্তু কিছুই তো আমাদের করার নেই। ওঁর বউ যে এই বয়সে শোভনেশের জন্য এমন পাগলামো করবেন, এটা আমি ভাবতেও পারি না। ভদ্রমহিলা হঠাৎ যে কোথায় গেলেন!’

‘এইসব দেখে এখন তো বিয়ে করতেই ভয় করছে। কোনদিন বাড়ি ফিরে দেখব বউ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে।’

‘আমারও তো সেই একই দশা! একদিন হয়তো দেখব বরমশাই গেটে দাঁড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে আর রুমালে চোখ মুছছে।’

রোহিণী জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল। আর হো হো করে হেসে উঠল রাজেন।

‘কুন্তীর গেট ক্র্যাশিংয়ের কোনো জবাব নেই। ভাবছি, এবার থেকে গুরুতর কোনো সমস্যায় পড়লে ওরই দ্বারস্থ হব।’

‘হয়ো। তবে জেনে রেখো, আর আমায় বোকা বানাতে পারবে না। …আর হাতটা সরাও, এটা বিবাদী বাগ, রাস্তায় লাখখানেক লোক, তাদের অনেকেই ট্যাক্সির দিকে তাকাচ্ছেও।’

মহারানির অফিসের সামনে পেভমেন্ট ঘেঁষে ট্যাক্সি দাঁড়াল। নামার আগে নিশ্চিত হবার জন্য রোহিণী ঝোলা থেকে ক্যাসেটটা বার করে দেখে নিল।

‘ঠিক এক ঘণ্টা পর আমি এসে এখানে দাঁড়াচ্ছি।’ জানালায় মুখ বাড়িয়ে রাজেন বলল।

‘বাড়ি গিয়ে এখন তোমার একটা লম্বা ঘুম দেওয়া উচিত। কাল সারারাত তো জেগেই কাটালে।’

‘যতক্ষণ না জানছি গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জির কাছ থেকে কী অভ্যর্থনা পেলে, ততক্ষণ ঘুমটুম আর আসবে না। তাহলে এই কথাই রইল, এক ঘণ্টা পর এইখানে দাঁড়িয়ে থাকছি।’

ট্যাক্সিটা চলে যাবার পরও রোহিণী সেই দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। গঙ্গাদার এখন অফিসে থাকারই কথা। কীভাবে কথা শুরু করবে ভাবতে ভাবতে রোহিণী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েও ফিরে এসে লিফটের লাইনে দাঁড়াল।

সে দাঁড়াল ঠিক চণ্ডীদাস ঘোষালের পিছনেই। তাকে দেখে চণ্ডীদাস হেসে বলল, ‘সেই ছবি কেনার ব্যাপারে, মি. ব্যানার্জিকে সকালে ফোন করেছিলাম। উনি দেখা করতে বলেছেন। কোথায়, কখন ছবি দেখতে যাব সেটাই উনি এখন বলে দেবেন।’

.

চণ্ডীদাস ঘোষাল আর সে একসঙ্গে মহারানি অফিসে ঢুকলে সেটা কারোর চোখেই অস্বাভাবিক ঠেকবে না। তবে একটা ব্যাপারেই হুঁশিয়ার থাকা দরকার, রোহিণী সেটাই গলা নামিয়ে ঘোষালকে বলল, ‘আমরা কেউ কাউকে চিনি না, এটা খেয়াল রাখবেন।’

‘তা আর বলতে।’

লিফটে তারা তিন তলায় পৌঁছল। মহারানির অফিসে ঢুকল অপরিচিতের মতো। কমল বসেছিল তার বেঞ্চটায়। রোহিণীকে দেখে হেসে উঠে দাঁড়াল। কমলের দিকে তাকিয়েই চণ্ডীদাস ঘোষালের ভ্রূ দুটির কুঁচকে ওঠা রোহিণী লক্ষ করল। চিনতে পারার মতো একটা ভাব ঘোষালের চোখে ফুটে উঠল কেন, সেটা সে আন্দাজ করল। সল্টলেকের ফ্ল্যাটে ঘোষাল দম্পতিকে ছবি দেখিয়েছিল তাহলে কমলদাই।

‘দিদি, আপনি আসছেন না যে। ছুটি নিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, বরাবরের জন্য। গঙ্গাদার সঙ্গে দেখা করব, আছেন?’

ঘোষাল গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘মি. ব্যানার্জির সঙ্গে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।’ কার্ডটা সে কমলের দিকে এগিয়ে দিল।

‘আপনি কি ঘোষালবাবু?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে যেন চেনাচেনা মনে হচ্ছে। আচ্ছা, আপনিই তো সল্টলেকে দেখিয়ে ছিলেন শোভনেশ সেনগুপ্তর ছবি?’

‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন।’ কমল হঠাৎ শশব্যস্ত হয়ে চণ্ডীদাস ঘোষালকে থামিয়ে দিয়ে গঙ্গাপ্রসাদের কামরায় ঢুকে গেল। ঘোষাল আর রোহিণী দৃষ্টি বিনিময় করে হাসল।

সম্পাদকীয় দপ্তরের দরজা খুলে দুটি মহিলা বেরিয়ে গেলেন। দু—তিন সেকেন্ডের জন্য রোহিণী ভিতরটা দেখার সুযোগ পেল। তার চেয়ারটা খালিই রয়েছে দেখে একটু উন্মনা হল। গঙ্গাদা কি আশা করছেন রোহিণী আবার কাজ শুরু করবে! বৃথা আশা। গঙ্গাদার সঙ্গে সম্পর্ক রাখা আর কোনোভাবেই সম্ভব নয়। জীবনের এই অধ্যায়টা একেবারেই বন্ধ করে দিয়ে স্বস্তিতে বাকি জীবনটা কাটাবার চেষ্টা এবার সে করবে।

‘আপনি ভেতরে যান।’

কমল দরজার পাল্লা খুলে ধরে রেখেছে। ঘোষাল ভিতরে ঢুকে যাবার পর সে রোহিণীকে বলল, ‘আপনি এখানে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, অফিসে গিয়ে বসুন।’

‘আমি এই অফিস ছেড়ে দিয়েছি কমলদা, আর মায়া বাড়াব না। গঙ্গাদার সঙ্গে দরকারি একটা কাজ সেরেই চলে যাব।’ রোহিণী বেঞ্চে বসল, বলল, ‘বসুন আপনি। যতক্ষণ না ভদ্রলোক বেরোচ্ছেন, আপনার সঙ্গে কথা বলি।’

কমল বসল না। রোহিণীর অফিস ছেড়ে দেওয়ার কথা শুনে তাকে মর্মাহত দেখাচ্ছে।

‘আপনি আর কাজ করবেন না? কেন, কী হল? অন্য কোথাও ভালো কিছু পেয়েছেন নাকি?’

‘কিছুই পাইনি, আর হয়নিও কিছু। মাঝে মাঝে মানুষকে কুঁড়েমিতে ধরে, আমাকে এখন তাই ধরেছে। কতদিন ধরে থাকবে, কে জানে। যাকগে, আপনার ছেলে এখন কেমন আছে?’

‘ভালোই। ভয়ের আর কিছু নেই। কিন্তু দিদি, আপনি আর আসবেন না শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল।’

গঙ্গাপ্রসাদের কামরার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রোহিণী ম্লান হাসল। ঘোষালের বেরোতে এত দেরি হচ্ছে কেন! তিন—চারটে তো কথা বলবে। কোথায় যাব, কখন যাব, কী ধরনের ছবি আছে বা কেমন দামের ছবি আছে, এর বেশি আর কী কথা হতে পারে?

এরপরই রোহিণীর হুঁশ হল, গঙ্গাদা, আর ঘোষালের মধ্যে কী কথা হল সেটা সে জানবে কী করে? ঘোষালের বাড়িতে ফোন করে বা বাড়িতে গিয়ে? কিন্তু তার আগে এখানেই তো ঘোষালের কাছ থেকে জেনে নেওয়া যেতে পারে! কিন্তু কমলদার সামনে তো ঘোষালের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। তাহলেই গঙ্গাদার কানে তা পৌঁছে যাবে। আর যা ধূর্ত লোক, ঠিক বুঝে নেবে ঘোষালের ছবি কেনার পিছনে অন্য কোনো ব্যাপার আছে।

‘কমলদা, ভদ্রলোক তো এখন বেরোবেন বলে মনে হচ্ছে না, এদিকে নীচে একজনকে আমি দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি। আমি বরং নীচে গিয়ে তাকে বলে আসি, আপনি গঙ্গাদাকে বলে রাখুন আমি এসেছি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে।’

‘সে আমি জানিয়ে দিয়েছি। আর এই ভদ্রলোক এখনি চলে যাবেন, এসেছেন তো ছবি কেনার জন্য।’

‘কার ছবি?’ রোহিণী দ্রুত প্রশ্নটা করে বসল। থতমত হয়ে কমলের মুখে অস্বস্তি দেখা দিল।

‘কার ছবি? তাতো আমি বলতে পারব না।’

‘ভদ্রলোক তখন বললেন সল্টলেকে আপনিই তো শোভনেশ সেনগুপ্তর ছবি দেখিয়েছিলেন, কথাটার অর্থ ঠিক বুঝলাম না! ব্যাপারটা কী?’

‘ব্যাপার আবার কী। বহু বছর আগে শোভনেশবাবু তাঁর কয়েকটা ছবি বিক্রির জন্য সাহেবকে দিয়েছিলেন। এই ঘোষালবাবু তারই একটা কিনেছিলেন। আমি ওনাকে ছবিগুলো দেখাই।’

‘ক—টা ছবি দেখান?’

‘মনে নেই ঠিক…তিন—চারটে হবে।’

রোহিণী বুঝে গেল, কমল মিথ্যে কথা বলল। চণ্ডীদাস ঘোষাল আর তার বউ বলেছিল, দুটো ঘরভরা ছবি তারা দেখেছে।

‘বাকিগুলো কি বিক্রি হয়ে গেছে?’

‘বোধহয়।’

‘তাহলে এখন ঘোষালবাবু কার ছবি কিনতে এসেছেন?’

‘বলতে পারব না।’

রোহিণীর সপ্রশ্ন দৃষ্টি থেকে কমল চোখ সরিয়ে নিল। তার চোখমুখে গ্লানি। রোহিণী উঠে দাঁড়াল। ‘আমি নীচের থেকে আসছি।’

সিঁড়ি দিয়ে তর তর করে নীচে নেমে রোহিণী বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এসে চণ্ডীদাস ঘোষালের জলপাই রঙের মারুতিটাকে দেখতে পেল। গাড়ির কাছে অপেক্ষা করলেই ওকে ধরা যাবে। কিন্তু পেভমেন্টে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা মানেই কৌতূহল আকর্ষণ করা। নোংরা নজর পানের পিকের মতো গায়ের উপর এসে পড়বে।

পাশের বাড়ির গেটের ধারে মশলা—মুড়ির দোকান। রোহিণী সেদিকেই এগিয়ে গেল।

‘এক টাকার মুড়ি—নারকেল—বাদাম দাও তো।’ বলতে বলতে রোহিণী থলি থেকে পার্স বার করল।

ঠোঙাটা হাতে নিয়ে সবেমাত্র মুখে একগাল ঢেলেছে তখনই সে, চণ্ডীদাস ঘোষালকে দেখতে পেল, মারুতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মুখ ভরতি মুড়ি নিয়ে ডাকা সম্ভব হল না, তাই সে আধছোটা হয়ে ঘোষালের কাছে পৌঁছল।

‘আপনার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। কী কথা হল?’

চণ্ডীদাস বলল, ‘কাল বেলা বারোটায় মি. ব্যানার্জি দমদমে এয়ারপোর্টে হোটেলের সামনে গাড়িতে অপেক্ষা করবেন। আমরাও সেখানে তাকে মিট করব। তারপর একসঙ্গে যাব বাসুদেবপুর বলে একটা জায়গায়। সেখানে একটা বাড়িতে শোভনেশবাবুর পুরো কালেকশানটাই আছে।’

‘কাল বারোটায়, এয়ারপোর্ট হোটেলের সামনে?’

‘হ্যাঁ। আমি বললাম, বাসুদেবপুর জায়গাটা কোথায় বলুন। আমরা নিজেরাই চলে যাব। তা, উনি বলতে চাইলেন না। ‘ডিরেকশান দিলেও চিনে যেতে পারবেন না, ভিতরের দিকে একটা গ্রাম, এইসব বলে এড়িয়ে গেলেন।’

‘ঠিক আছে আপনি যান। আমি এখন গিয়ে একবার ওঁর সঙ্গে দেখা করব। দামটামের কথা জিজ্ঞাসা করলেন?’

‘করেছি। দশ—বারো হাজারের মধ্যে অল্পই আছে। পঁচিশের উপরেই বেশি। শিগগির নাকি বোম্বাই আর দিল্লিতে শোভনেশবাবুর একটা একজিবিশন করবেন। আমেরিকাতেও করার জন্য কথাবার্তা চালাচ্ছেন। ছবির দাম বাড়ানোর জন্যই এইসব কথা আমাকে শোনানো!’

‘আচ্ছা, আমি আসি। হয়তো কাল দেখা হতে পারে।’

রোহিণী দ্রুত পায়ে ফিরে গেল। দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছে, লিফটম্যান তাকে দেখে খুলে দিল। তিনতলায় থামতেই মুড়ির ঠোঙাটা সে লিফটম্যানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে এল।

গঙ্গাপ্রসাদের কামরার দরজায় টোকা দিয়ে ঠেলে খুলল। মুখ তুলে তাকে দেখে গঙ্গাপ্রসাদ একমুখ হাসি নিয়ে বললেন, ‘কে রোহিণী, এসো।’

চেয়ারটায় বসে, যেমন সে ভেবে রেখেছিল, কোনোরকম ভণিতা না করেই রোহিণী বলল, ‘আজ সকালে কুন্তীকে খুঁজতে গেছিলেন কেন? সঙ্গে আবার দুটো লোক নিয়ে?’

‘বিশ্বনাথের বউয়ের কিছু আবোল—তাবোল কথা মেয়েটি টেপ করে এনেছে। উপরে গিয়ে পরমেশের সঙ্গেও কথা বলেছে, টেপ করেছে। বিয়ের জন্য মেয়ে দেখে দেবে বলে কথা দিয়ে এসেছে। খুব ধড়িবাজ মেয়ে। যাই হোক, আমার মনে হল, ওকে দিয়ে এ কাজ করানো দু—জনের পক্ষেই সম্ভব—তুমি আর মীনা। কেননা, শোভনেশ সেনগুপ্ত সম্পর্কে আর কারোর তো মাথাব্যথা থাকার কথা নয়।’

‘সুজাতা গুপ্তও আছেন।’

গঙ্গাপ্রসাদের কপাল কুঁচকে উঠল। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওঁর কথাটা একদমই ভুলে গেছিলাম। তবে উনি কোনো ফ্যাক্টর নন। যাই হোক, আমি প্রথমে তোমার কাছেই যাই। আর গিয়েই কুন্তীকে পেয়ে গেলাম। টেপের ক্যাসেটটা আমার চাই। নিশ্চয় সেটা তোমাকেই ও দিয়েছে।’ ধীর শান্ত স্বরে কথাগুলো বলে তিনি রোহিণীর মুখে সার্চলাইট চাহনি ফেললেন।

‘হ্যাঁ দিয়েছে। এসব করার জন্য ওকে কিন্তু আমি বলিনি। নিজে থেকেই করে এনেছে। মিস্ট্রি, ক্রাইম থ্রিল এইসবের দিকেই মেয়েটির ঝোঁক। ওকে শুধু সিদ্ধার্থ সিনহার আর্টিকেলটা পড়তে দিয়েছিলাম। তারপর নিজের উদ্যোগেই খোঁজাখুঁজি করতে বেরোয়। মনে হচ্ছে ক্যাসেটটা পাওয়া আপনার খুবই দরকার।’

‘হ্যাঁ, দরকার।’

‘না পেলে আপনার লোকেরা সেইসব কাজ করবে, যা মীনা চ্যাটার্জিকে করেছে?’

‘তার থেকে বেশি কিছুও করতে পারে।’

‘আর যদি ক্যাসেটটা পেয়ে যান?’

গঙ্গাপ্রসাদের চোখ পিট পিট করে উঠল। হাসি মাখানো মুখে রুমাল ঘষলেন। রুমালের দিকে তাকিয়ে দেখলেন যেন, কতটা হাসি তাতে লেগে রয়েছে। হাতটা বাড়িয়ে বললেন, ‘বারগেন করতে চাও? মনে হচ্ছে, সঙ্গে করেই এনেছ। দাও। ক্যাসেটটা। কথা দিচ্ছি কখনো কোনো ঝামেলা হবে না।’

রোহিণী ঝুলি থেকে ক্যাসেটটা বার করে গঙ্গাপ্রসাদের হাতে দিল। তিনি চোখের কাছে তুলে ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেটা দেখে টেবিলের ওপর রাখলেন। ‘গীতা আর পরমেশ দু—জনেই এতে আছে?’

‘হ্যাঁ, যতটুকু পেয়েছে, তার সবই এতে রয়েছে।’

‘বাড়ি গিয়ে শুনব।’ চেয়ারে হেলান দিয়ে নিজেকে শিথিল করে গঙ্গাপ্রসাদ স্মিত হেসে বললেন, ‘এবার তুমি কী ঠিক করলে, বিয়ে?’

‘হ্যাঁ। শুধু একটা কথা এবার জিজ্ঞাসা করব, মনে হয় সত্যি কথাই বলবেন।’

‘মিথ্যে কথা বলার কোনো কারণ তো নেই।’

.

‘মিথ্যে আপনি অনেক বলেছেন, কাজও অনেক করেছেন। করেননি?’ রোহিণী ক্যাসেটটার দিকে তাকাল। গঙ্গাপ্রসাদ লক্ষ করলেন। তারপর চাপা হেসে বললেন :

‘শোভুর আর বেঁচে থাকার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করিনি। পাগলের বংশ, ও পাগল হয়ে যেতই। মাঝে মাঝেই ওর মধ্যে উন্মত্ত ব্যাপার—স্যাপার ফুটে উঠত। কুকুর পাগল হলে লোকে যা করে, আমি তাই করেছি। গুলি করে বা পিটিয়ে না মেরে, ওকে জেলের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করেছি। তাতে সবথেকে উপকার হয়েছে কার জান?’

গঙ্গাপ্রসাদ ঝুঁকে রোহিণীর মুখের দিকে তীব্র চোখে তাকালেন। অপলক দৃষ্টি রেখে রোহিণী বলল, ‘আমার?’

‘আমারও।’ গঙ্গাপ্রসাদ আবার হেলান দিয়ে হাসিটা ফিরিয়ে আনার জন্য সময় নিলেন। ‘আমার টাকার দরকার। ইস্টার্ন ম্যাগাজিনসের জন্য এক্সপ্যানশন প্রোগ্রাম নিয়েছি। শুধুই কয়েকটা পত্রিকা নিয়ে থাকলে তো চলবে না। আরও নানান ব্যবসা খোলা দরকার। বাড়াতে হবে, ক্রমশ নিজেকে বাড়াতে হবে।’ দু—হাত বিস্তার করে তিনি বোঝাতে চাইলেন।

‘সেজন্য আপনি ওর বাড়িটা আর ছবিগুলো হাতিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। নতুন কোম্পানি খুলছি। সেরামিক ফ্লোর টাইলস আর ওয়াটার হিটার তৈরির কারখানা শিগগিরই শুরু হবে উলুবেড়িয়ায়। আমার তখন খুব প্রয়োজন ছিল টাকার। তোমারও প্রয়োজন ছিল ওর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার, ঠিক বলছি কী?’

‘বোধ হয় ঠিক।’

‘এজন্য তোমাকে খেসারত দিতে হয়েছে শুধু তোমার স্বামীর যাবতীয় স্থাবর—অস্থাবর সম্পত্তি। আর সেজন্য তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হওনি। আগে যা ছিল তোমার, এখনও তাই রয়েছে। মাঝের থেকে পেয়েছ কিছু কঠিন অভিজ্ঞতা আর সম্ভবত প্রেম।’

গঙ্গাপ্রসাদ হাসতে লাগলেন। রোহিণী ভেবে পেল না, সে এই লোকটির ছাঁকা ছাঁকা কথাবার্তায় রেগে উঠবে কিনা।

‘কিন্তু আপনি একটি লোকের—সুভাষ গায়েনের মৃত্যু ঘটার জন্য দায়ী, আপনি আসল বলে জাল ছবি বিক্রি করে কিছু লোককে ঠকিয়েছেন এবং আরও ঠকাবেন।’

‘হ্যাঁ ঠিক কথাই, কিন্তু তাতে কী হয়েছে! একটা লোক মারা গেল তো বেশ গেলই।’ গঙ্গাপ্রসাদ তাচ্ছিল্য ভরে বললেন, ‘রোজ কত লোকই তো মারা যাচ্ছে, তাতে দেশের বা সমাজের কোনো ক্ষতি হচ্ছে কি? ও লোকটা নিজে সৎ কাজ কিছু করেছে জীবনে?’

‘মেরে ফেলার পক্ষে ওটাই কী আপনার যুক্তি?’

‘হ্যাঁ। এরা হল আগাছা। উপড়ে ফেলে দেওয়াটাই ভালো। আমাদের দেশে প্রাণের দাম এত সস্তা যে, খুন নিয়ে বাচ্চচা ছেলেরাও দু—দিন পর রাস্তায় খেলা করবে। কেউ ফিরেও তাকাবে না।’

‘আপনি তো একটা ভয়ংকর মানসিক অবস্থার মধ্যে চলে গেছেন। শোভনেশ কি বেশি পাগল ছিল আপনার থেকে?’ রোহিণী উঠে দাঁড়াল। ঝোলাটা কাঁধে তুলল।

‘এক মিনিট। ভয়ংকর মানসিক অবস্থার কথা বললে না?’ গঙ্গাপ্রসাদ মিষ্টি করে হাসলেন, ‘তাহলে একটা সাধারণ গরিব চাষার কথা বলি। উত্তরপ্রদেশের লোক, নাম গয়াসিরাম। ঝাঁসি জেলায় বাড়ি। জমিজমা সংক্রান্ত ঝগড়ায় সে নাকি একজনকে খুন করে। সেসন কোর্টে দু—বছর পর ফাঁসির হুকুম হয়, পাঁচ মাস পর এলাহাবাদ হাইকোর্ট তা বহাল রাখে, দু—বছর পর সুপ্রিম কোর্টেও তার আপিল অগ্রাহ্য হয়। ন—মাস পর ভারতের রাষ্ট্রপতির কাছে তার প্রাণভিক্ষা করে আবেদন জানায় গয়াসিরামের বউ। ফাঁসির হুকুম হয়েছিল দশ বছর আগে, প্রাণভিক্ষার জন্য আবেদন সাত বছর আগে!

‘রোহিণী, মানুষের প্রাণের দাম আমাদের দেশে কতটা? সেটাই জানতে চাও তো? গয়াসিরামের ব্যাপারটা নিষ্পত্তি করার জন্য গত চার বছরে উত্তরপ্রদেশ গর্ভমেন্ট ২১ বার রিমাইন্ডার পাঠিয়েছে ইউনিয়ন হোম মিনিস্ট্রিতে। কিস্সু হয়নি। ডিস্ট্রিক্ট জাজ জেলে গিয়ে গয়াসিরামকে দেখে এসে আইজি প্রিজন্সকে রিপোর্ট দেন, লোকটার মানসিক অবস্থা এখন এমনই, গরাদে মাথা ঠুকে নিজেকে হত্যা করবে যেকোনো দিন। সেই রিপোর্ট ইউনিয়ন হোম মিনিস্ট্রিতে পাঠানো হয় গত বছর, কিস্সু হয়নি।

‘গয়াসিরাম গত দশ বছর ধরে ঝাঁসির জেলে আছে কীভাবে জান? দশ বর্গফুটের একটা সেল—এ। তাতে পাথরের একটা ধাপ, সেটার উপর শোয়। মাত্র এক ঘণ্টার জন্য তাকে সেল থেকে বের করে হাঁটতে দেওয়া হয়। বাকি তেইশ ঘণ্টা সে থাকে দশ বর্গফুটের মধ্যে…দশ বছর ধরে এভাবেই সে রয়েছে, এখনও। কল্পনা করতে পারো রোহিণী? বাইরের কেউ গেলে গয়াসিরাম তাকে শুধু বলে; সাহিব কছু করো। হামারি ফাঁসি জলদি লাগওয়ায়ে দেও। লোকটার বয়স এখন ষাট।’

ভারী দেহটা নিয়ে গঙ্গাপ্রসাদ উত্তেজনায় হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলেন। টেবিলে ঝুঁকে, দাঁড়িয়ে থাকা রোহিণীর মুখের কাছে মুখ এনে বললেন, ‘এ দেশে মানুষের প্রাণের দাম? এ দেশে করুণা, মমতা, স্নেহ? কী জঘন্য অত্যাচার চলেছে এই লোকটির উপর, যেজন্য সে এখন শুধু মরতেই চায়। …আর আমিই হচ্ছি ভিলেন, বদমাস!’

শুনতে শুনতে রোহিণীর মাথাটা ঝন ঝন করে উঠেছিল। অস্ফুটে বলল, ‘গঙ্গাদা এখন আমি আসি।’

আনমনে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে ফটকের বাইরে এসে দাঁড়াল। এখন অফিসের সময়। কাতারে কাতারে লোক হেঁটে যাচ্ছে। বাস আর মোটর যেন ধাক্কাধাক্কি করছে রাস্তায়। জীবনের এক বিশাল স্রোত সশব্দে তীব্র গতিতে ব্রেবোর্ন রোড ধরে প্রবাহিত হচ্ছে। রোহিণী নিজেকে সুস্থির করার জন্য ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে রইল।

‘রুনি, আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছি’ রাজেন ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল ‘গাড়িটা ওধারে রেখেছি, চলো।’

.

‘একটু দাঁড়াও রাজেন, এক মিনিট।’

ব্রেবোর্ন রোডের পেভমেন্টে জনস্রোতের মাঝে দাঁড়িয়ে রোহিণী বাস্তব জগৎটাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করল। একটু আগে গঙ্গাপ্রসাদ মানুষের উপর মানুষের অত্যাচারের যে বীভৎস কাহিনিটা তাকে শোনালেন, তারপর অসুস্থ বোধ না করে উপায় নেই। দশ বছর ধরে একটা গরিব নিরক্ষর, বুড়ো চাষিকে দশ বর্গফুট ডেথ—সেলে আটকে রেখেছে, রাত দিনে এক ঘণ্টার জন্য মাত্র বাইরে বেরোতে পারে, সে এখন শুধুই মরতে চায়, বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছে! মানুষকে এই অবস্থায় নিয়ে গেছে মানুষই!

রোহিণী আপন মনেই বলল, ‘যেন মরেই যায়।’

‘হল কী তোমার? কার মরার কথা বলছ? গঙ্গা ব্যানার্জি কী বলল?’

‘বলছি সব। চলো।’

রাজেনের বুড়ো হিলম্যানটিকে দেখে কেন জানি রোহিণীর মায়া হল। সস্নেহে রংচটা তোবড়ানো দরজায় হাত বুলিয়ে সে বলল, ‘রাজেন, বুড়োকে এবার ছেড়ে দাও।’

‘সে কী, ছাড়ব মানে? এখনও ছোকরা মারুতিদের সঙ্গে সমানে টক্কর দেয়। গা—হাত—পা অবশ্য একটু কাঁপে, মাঝে মাঝে কাশেটাশেও—।’ বলতে বলতে রাজেন সেলফ স্টার্টারের চাবি ঘোরাল। হিলম্যান বার কয়েক কঁকিয়ে উঠে চুপ করে গেল।

‘অথচ বাড়ি থেকে বার করার সময় সঙ্গে সঙ্গেই স্টার্ট নিয়েছিল। তুমি চড়লেই ওর যত ভীমরতি ধরে।’ রাজেন হতাশ চোখে ড্যাশবোর্ডের মিটারগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল।

‘তাহলে আমি কি এখন নামব?’ রোহিণী দরজার হাতলে হাত রাখল। ‘কিন্তু বুড়ো কী তাতে আরও মনমরা হয়ে যাবে না?’

‘যেতে পারে।’ রাজেন এরপরই ধমকে উঠল, ‘আই বুড়ো, এবার যদি স্টার্ট না নাও, তাহলে মল্লিক বাজারের কসাইখানায় কিলোদরে বেচে দিয়ে আসব তোমায়! মনে থাকবে?…নাউ, অন ইওর মার্ক…সেট…গোওও।’

চাবি ঘোরানোমাত্র এঞ্জিন বারদুই খুক খুক করে ঝাঁঝিয়ে উঠল।

‘রেগে গেছে বোধ হয়।’ রোহিণী স্বস্তি বোধ করল।

‘ভয় পেয়েছে।’ রাজেন হুঁশিয়ার দৃষ্টিতে একটা মিনিবাসকে লক্ষ করতে করতে ক্লাচ ছাড়ল।

‘তোমার এখন কাজ কী?’

‘সিএবি—তে যাব। ওখানে জীবুদাকে নিয়ে যদি পাই, তাহলে ভালোই। ওর শালার বন্ধু ম্যারেজ রেজিস্ট্রার, জীবুদাকে তার বাড়িতে যাব। তারপর থাকার ব্যবস্থার খোঁজে যাব জহিরুলের বাড়ি, পার্ক সার্কাসে।’

‘আমি এখন পার্ক সার্কাসেই যাব, মীনা চ্যাটার্জির কাছে। তুমি ওখানেই নামিয়ে দাও আমায়।’

‘বেশ, ততক্ষণে বলো, গঙ্গা ব্যানার্জির সঙ্গে কী কথা হল। ক্যাসেটটা দিয়েছ?’

‘দিয়েছি। উনি জেনে গেছেন, কুন্তী ওই বাড়িতেই থাকে। ক্যাসেটটা পেলে উৎপাত করবেন না কথা দিতে আমি ওঁর হাতে দিলাম।’

‘কথা রাখবে তো?’

‘মনে হয় রাখবেন। গঙ্গাদা জাত—ভিলেন বলতে যা বোঝায়, সেরকম ঠিক নন। ওঁর অ্যাম্বিশন এখন ব্যবসা করে বড়ো হবার দিকে। ছ—সাত বছর আগে এক্সপ্যান্ড করার জন্য খুব বেশি ক্যাপিটাল ওঁর ছিল না। কয়েক লাখ টাকার জন্য তখন যে কাজ করেছিলেন, ওই পরিমাণ টাকার জন্য এখন হয়তো আর বন্ধুকে জেলে বা ফাঁসিতে পাঠাবার কথা ভাববেন না। অতীত কীর্তিকলাপ ফাঁস হয়ে গেলে বিপদে পড়তে পারেন ভেবেই গত কয়েকদিনে এইসব কাণ্ড করেছেন।’

‘ওর সম্পর্কে আমার রিডিংও তাই। শোভনেশ সেনগুপ্ত এখন ওর গলার কাঁটা, সেটা তুলে ফেলার জন্য একটা বক খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমার কী মনে হচ্ছে, জান?’

ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটে ট্রাম আর দোতলা বাসের মাঝে প্রায় পিষে যাবার মতো অবস্থায় হিলম্যান জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে। রাজেন শঙ্কিত চোখে বাঁদিকের বাসটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘গঙ্গা ব্যানার্জি এখন সেনগুপ্তকে পেলেই খুন করবে। ওঁকে সরিয়ে দিতে পারলেই ব্যানার্জির টিকি আর কেউ ছুঁতে পারবে না।’

বাঁদিকের বাসটা ঘোঁত ঘোঁত করে এগিয়ে গেল। রাজেন ডানদিকের ট্রামের থেকে এক হাত সরিয়ে আনল গাড়িকে।

‘আমারও রীডিং তাই।’ রোহিণীর মৃদু স্বরে বিষণ্ণতার ছোঁয়া লাগল। রাজেনের কানে তা ধরা পড়ল। ‘গঙ্গাদা বললেন, শোভনেশের আর বেঁচে থাকার দরকার আছে বলে তিনি মনে করেন না। ওঁর যুক্তিটা হল : পাগলের বংশ, একদিন—না—একদিন ও পাগল হয়ে যেতই। আচ্ছা রাজেন, তুমিও কি তাই মনে করো?’

‘না, মনে করি না।’ কথাটা বলেই রাজেন গাড়ি চালানোয় মন দিল।

মিনিট তিনেক পর রেড রোডের মুখ থেকে বাঁদিকে পার্ক স্ট্রিট যাবার রাস্তায় বেঁকে রাজেন মুখ খুলল, ‘কেন মনে করি না, জানতে চাও?’

রোহিণী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘শোভনেশ সেনগুপ্ত প্রতিভাবান। পাগল বলতে সাধারণত যা আমরা বুঝি, উনি সেই পর্যায়ে পড়েন না। ওঁকে আমাদের স্বাভাবিকত্বের মাপকাঠি দিয়ে মাপলে ভুল করা হবে। আমরা সাধারণ, ছাপোশা, মিডিওকার, ভীতু, নানান সংস্কারে বাঁধা কূপমণ্ডূক। পৃথিবীতে আমরাই সংখ্যায় বেশি। আমরা গাওস্কারকেই পছন্দ করি, হতে চাই ওইরকমই, কিন্তু দূর থেকে অ্যাডমায়ার করি গ্যারি সোবার্সকে। শোভনেশ সেনগুপ্তর মতো বাঁধনছেঁড়া নিয়মভাঙা লোককে আমরা ভয় পাই। এঁদের ছোঁয়া থেকে বাঁচার জন্য একটা পাঁচিল তুলে দিয়ে সেটাকে পাগল বলি। রুনি, তুমি এই পাঁচিলটা টপকাতে গিয়ে পড়ে গেছ।’

শুনতে শুনতে ক্রমশ গম্ভীর হয়ে গেল রোহিণী। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘হয়তো তাই। কিন্তু শোভনেশ পাগলই। অস্বাভাবিক। পাগলের ডেফিনিশন যাই হোক না কেন, একটা মেয়ের নিজস্ব কিছু সংজ্ঞা থাকে স্বামী সম্পর্কে। এই নিজস্ব ব্যাপারটা ঠিক বোঝানো যায় না। আমি ভুল নির্বাচন করেছিলাম।’

‘আবার সেই ভুল করতে যাচ্ছ না তো?’

রোহিণী মুখ ফিরিয়ে রাজেনের দিকে তাকাল। হাসি ছড়াল তার মুখে। ‘শোভনেশের হয়ে ওকালতি শুরু করলে কেন, কী ব্যাপার?’

‘আই অ্যাডমায়ার দ্যাট ম্যান।’

‘তাহলে বোধ হয় ভুল করতে যাচ্ছি।’

‘সর্বনাশ! তুমি কি আমাকে প্রতিভাবান ভাবলে নাকি? আরে আমার আইডল গাওস্কর!’

‘তাহলে ঠিক আছে। অবশ্য মাঝে মাঝে পাগলামির একটা স্ট্রেক তোমার মধ্যেও ঝলসায়। যাই হোক, সেটা আমি ম্যানেজ করে নেব।’

‘আমার মধ্যে পাগলামি? বলছ কী! তোমার মাথাটাও দেখছি বোধহয়—’

‘ওইভাবে জয়পুরে সেঞ্চুরি আর টেলিফোন, সুস্থ মাথায় করা যায় না।’

‘মাথাটা তো আর আমার হাতে এখন নেই।’

‘হয়েছে হয়েছে। এবার একটু দেখে চালাও তো। আর শোনো, কাল একটা ব্যাপার আছে। চণ্ডীদাস ঘোষাল নামে এক ভদ্রলোককে গঙ্গাদা কাল শোভনেশের ছবি দেখাতে নিয়ে যাবেন বাসুদেবপুরে। ওখানেই সব ছবিগুলো লুকিয়ে জমা করা আছে।’

‘তাহলে হদিশ পাওয়া গেছে!’ রাজেন সিধে হয়ে বসল।

‘কাল দুপুর বারোটায় মিট করবে এয়ারপোর্ট হোটেলের সামনে। সেখান থেকে রওনা হবে বনগাঁর দিকে। মছলন্দপুর আর গোবরডাঙার মাঝামাঝিই বোধ হয় গ্রামটা। ওদের পিছু নিয়ে কাল আমরা যাব।’

‘ব্যাপারটা থ্রিলিং হবে মনে হচ্ছে। কুন্তীকে কী—’

‘খবরদার। ওকে সঙ্গে নিলে সব গুবলেট করে দেবে। চণ্ডীদাস ঘোষালকে আমিই পাঠাচ্ছি ছবি কেনার ছলে জায়গাটা দেখে আসতে। উনিও শোভনেশের অ্যাডমায়ারার, তবে বউকে চটাতে চান না।’

‘আমিও চটাব না।’

‘হ্যাঁ, চটিয়ো না। এখন আমি মীনাকে ব্যাপারটা বলব, দেখি ও কী করে।’

হিলম্যান এসে থামল মীনা চ্যাটার্জির অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে রোহিণী আর একবার মনে করিয়ে দিল, ‘কাল এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে আমাকে তুলে নেবে। একটু আগে গিয়েই অপেক্ষা করব। বুড়োকে আজ বেশি খাটিয়ো না। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে ওকে ওষুধটসুধ দিয়ে, মালিশ করে চাঙ্গা করে রেখো।’

‘কিন্তু এখন যে জীবুদা আর জহিরুলের কাছে যেতে হবে। বুড়োকে একটু তো খাটাবই।’

‘আমি কী বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে আসব, নাকি—’

‘আমার হাতে এখন গোনাগুনতি টাকা, একস্ট্রা বাজার করার পয়সা নেই। দাও তো গোটাকতক টাকা।’

রোহিণী হাত পাতল। পার্সটা বাড়িয়ে দিল রাজেন। চোখ বুজে পার্সে আঙুল ঢুকিয়ে কয়েকটা নোট তুলে রোহিণী ঝুলিতে ফেলে দিয়ে বলল, ‘খেলা থেকে রিটায়ার করলে খাওয়া কমাতে হয়, নইলে চেহারা বেঢপ হয়ে যাবে, এটা খেয়াল রেখো।’

‘কিন্তু তুমি যে কাল বললে খেলা কখনো ফুরোয় না। শুধু এক মাঠ থেকে অন্য মাঠে সরে যায়। অন্য মাঠে খেললে কী খাওয়া বন্ধ করতে হবে? আমি তো ভাবছিলাম, চাকা চাকা করে মুলো কেটে টক আর বোয়াল মাছ, আলু, হিংয়ের বড়ি, বেগুন, সিম দিয়ে—।’

রোহিণী ততক্ষণে এগিয়ে গেছে বাড়ির ফটকের দিকে।

বেল বাজাতে মীনা চ্যাটার্জির ফ্ল্যাটের দরজা খুলে দাঁড়াল যে লোকটি, তাকে দেখেই রোহিণীর মনে পড়ল, সকালে গঙ্গাদার সঙ্গে আসা লোক দুটোর চেহারা। অনেকটা একই ধাঁচের। ত্রিশ—পঁয়ত্রিশের মধ্যে, ছিপছিপে, বুক খোলা কালো স্পোর্টস শার্ট, জীনস, বেল্ট, এলোমেলো চুল, চোখে অমার্জিত ধূর্ত চাহনি, হাতে লোহার বালা। ফিল্মের পোস্টারে অমিতাভ বচ্চচন বা মিঠুন চক্রবর্তীকে যেভাবে দেখা যায়, প্রায় সেই রকমেরই।

‘মিস চ্যাটার্জি আছেন?’

‘আপনার নাম? কী দরকার?’

লোকটির বাচনভঙ্গি ও উচ্চচারণ থেকেই রোহিণী বুঝে গেল, মীনা নিরাপদ থাকার জন্য ব্যবস্থা নিয়েছেন।

‘আমার নাম রোহিণী, ওর পরিচিতই আমি।’

লোকটি তার মুখের উপর চাহনি রাখল কিছুক্ষণ। ঝোলাটার দিকে তাকাল, এবং অবশ্যই গলা থেকে চটি পর্যন্ত বার দুই। রোহিণী ভেবে পেল না, তাকে বিদায় নিতে না অপেক্ষা করতে হবে!

এক মিনিট পরেই দরজা খুলল। ‘ভেতরে যান।’

লোকটির গা ঘেঁষেই রোহিণীকে ঢুকতে হল। ভিতরের ঘরের দরজার পর্দা তুলে মীনা দাঁড়িয়ে। কপালে স্টিকিং প্লাস্টার। রোহিণী বিস্ময় দেখাল ভ্রূ তুলে।

‘আসুন। এই ঘরেই বসি।’

শোবার ঘরে ঢুকেই রোহিণী খুঁজল ছবিটাকে। নেই।

‘কী হয়েছে আপনার কপালে?’ খাটের ধারে বসে বিস্মিত রোহিণীর প্রথম প্রশ্ন।

‘কপাল ফেটেছে। মিসেস সেনগুপ্ত, আমার কপালটাই এইরকম কিছুই আর আস্ত থাকে না। ফাটা কপাল নিয়েই আমাকে দিন কাটাতে হবে।’ মীনা নাটকের সংলাপ বলার ঢঙে কথাগুলো বলে এবং বলতে পারার কৃতিত্বে হাসল।

‘পড়ে গেছিলেন? বাথরুমে? আর একটু নীচে হলেই তো চোখটা যেত! রাবারের স্লিপার পরেছিলেন নাকি?’

মীনা মাথা নাড়ল। মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ালের দিকে তাকাল, যেখানে ছবিটা টাঙানো থাকত। রোহিণীকেও মুখ তুলে দেওয়ালের দিকে তাকাতে দেখে ম্লান হেসে মীনা বলল, ‘দেখেছেন, ছবিটা আর নেই। গঙ্গাপ্রসাদবাবুর লোকেরা এসে আমাকে মেরে ছবিটা নিয়ে চলে গেছে।’

‘সে কী!’ রোহিণী দাঁড়িয়ে উঠল। ‘এ কী বলছেন!…অসম্ভব, এ অসম্ভব, অবিশ্বাস্য!’

মীনা জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে। ঠোঁটে কষ মোচড়ান।

‘একটা ছবির জন্য কোনো মানুষ এমন কাজ করতে পারে?’ রোহিণী প্রশ্নটা করল মীনাকে কথা বলাবার জন্য।

‘পারে কি না পারে, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন। হ্যাঁ, একটা ছবির জন্যই। আপনাকে যখন ফোন করছিলাম, তখনই লোকগুলো এসেছিল।’

‘হ্যাঁ, হঠাৎ তখন লাইনটা কেটে গেল দেখে অবাক হয়ে গেছিলাম। তাহলে ব্যাপারটা তখনই ঘটেছিল!’

‘কিন্তু গঙ্গা ব্যানার্জিকে আমি সহজে ছাড়ব না। আমার ক্ষমতা কতটা, সেটা ওকে দেখাব। আমি সুযোগ পাই একবার—।’ দাঁতে দাঁত চেপে মীনা দু—হাত মুঠো করল। এভাবে অপমান করবে? কতকগুলো গুন্ডাকে পাঠাবে আমার গায়ে হাত তোলার জন্য, আর আমি সেটা মেনে নেব?’ হিস্টিরিয়াগ্রস্তের মতো সে কাঁপতে শুরু করল।

এখন কোনো কথা বললে ওঁর মাথায় ঢুকবে না। মীনাকে সুস্থির হবার জন্য সময় দিয়ে রোহিণী বলল, ‘ছবিটাই চলে গেল। একটা মাস্টারপিস! …পুলিশে জানিয়েছেন?’

‘দরকার নেই জানাবার। ওটা আমি খুঁজে বার করবই। জীবনের শেষ দিন খুঁজব, আমার শেষ কর্পদকও আমি খরচ করব। আর ওই লোকটাকে—।’

রোহিণীর মনে হল চকমকির ঘষা থেকে ছিটকে বেরোনো ফুলকির মতো কথাগুলো মীনার দাঁত থেকে বেরিয়ে এল। প্রতিশোধ নেবার বাসনায় ওঁর সুন্দর মুখটা দুমড়ে মুচড়ে বীভৎস দেখাচ্ছে।

‘ছবিটা কোথায় পাবেন বলে আপনার ধারণা?’

মীনা হতাশভাবে মাথা নাড়ল। ‘জানি না। তবে ওর অফিসে বা বেলেঘাটার প্রেসে নেই। আর বাড়িতে তো রাখবেই না।’

‘শুধু তো একটা ছবি নয়, আরও অনেক ছবিই রয়েছে শোভনেশের। সেগুলোই বা কোথায়?’ রোহিণী তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকাল প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।

মীনার বসার ভঙ্গিটা বদলাচ্ছে। চোখে চিন্তার ছায়া পড়ল। অস্ফুটে বলল, ‘সব ছবি পুড়িয়ে ফেলা দরকার।’

‘পুড়িয়ে ফেলা!’ রোহিণী হাঁ করে ফেলল কথাটা শুনে।

‘শোভনকাকা চার বছর আগে আমাকে তাই বলেছিলেন। উনি নতুন মানুষ হতে চান, বলেছিলেন, যা এঁকেছি সব বাজে, নষ্ট মনের কাজ। জানেন, সেদিনই আমি প্রতিজ্ঞা করি, ওঁর মনের ইচ্ছা আমি পূরণ করব। ওঁকে শান্তি দেব।’ মীনা টানা কথা বলে মুখ নামিয়ে রাখল।

‘আমার একজন পরিচিত লোক, শোভনেশের ছবি কেনার জন্য গঙ্গা ব্যানার্জির কাছে গেছিল। উনি বলেছেন, ছবিগুলো কলকাতায় নেই, বাইরে আছে।’

‘কোথায়, কোথায় আছে?’ বিদ্যুৎ ছুঁয়ে ফেলা প্রাণীর মতো মীনার মুখ ছিটকে উঠল।

‘কাল দুপুর বারোটায় এয়ারপোর্ট হোটেলের সামনে লোকটিকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। সেখানে ওঁরা মিট করবেন। তারপর রওনা হবেন বাসুদেবপুর বলে একটা গ্রামের দিকে। সেখানেই গঙ্গা ব্যানার্জির বাড়িতে ছবিগুলো আছে।’ রোহিণী ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল, যাতে মীনার বুঝতে অসুবিধা না হয়।

‘কী বললেন! কালকেই যাবে? বাসুদেবপুর? কোথায় সেটা?’

‘বনগাঁর দিকে। আমি আর কিছু জানি না।’

‘কাল বারোটায়, এয়ারপোর্ট হোটেলের সামনে?’

‘হ্যাঁ।’

মীনা প্রায় লাফিয়েই টেলিফোনের কাছে গেল। অধৈর্য হয়ে ডায়াল করতে গিয়ে দু—বার আঙুল পড়ল ভুল নাম্বারে। অবশেষে যথাযথ নাম্বারে যোগাযোগ ঘটল। উত্তেজনায় টসটস করছে তার মুখ।

‘হ্যালো, কে, শঙ্করবাবু?…আমি মীনা চ্যাটার্জি বলছি। বাচ্চচুদা আছে কি?…হ্যাঁ হ্যাঁ, ওকে একবার দিন।’

ফোন ধরে অপেক্ষা করতে করতে আঙুল দিয়ে কপালের উপর থেকে চুল সরাচ্ছে মীনা। রোহিণী তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। কী যে ভাবছে মীনা। চোখ দুটো সরু হয়ে কুটিল, আবার বিস্ফারিত হয়ে ক্রুদ্ধ, পরক্ষণেই চোখ বন্ধ করে আবেগ দমনে ব্যস্ত। ওর মনের মধ্যে কীসের ওঠাপড়া চলছে, রোহিণী তার খানিকটা আন্দাজ করতে পারছে।

‘হ্যালো, হ্যাঁ, বাচ্চচুদা? আমি মীনা, কী হল? সেদিন যে বললাম, পরশুর মধ্যে আপনাদের ডিসিশন জানিয়ে দেবেন…হ্যাঁ? আর বাড়াতে পারবে না? কিন্তু…হ্যাঁ হ্যাঁ তা তো বুঝলাম, কিন্তু স্টোরি এমনই হ্যাকনিড, বস্তাপচা যে, ধেই ধেই নেচে আর ভেউ ভেউ কেঁদেও তিনদিনের বেশি দর্শক, পারব না। হ্যাঁ, বলুন শুনছি…।’

রোহিণী লক্ষ করল মীনা কিছু শুনছে না, শুধু কানের কাছে ফোনটা ধরে আছে। প্রথম যখন মীনার সঙ্গে সে দেখা করে, তখন ঘরে তিনটি লোক বসেছিল, বোধ হয় কোনো ফিল্মে অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে। তাদের একজনকে, বাচ্চচুদা, বলে মীনা ডাকে। সম্ভবত তার সঙ্গেই মীনা কথা বলছে।

‘বেশ তাহলে রাজি। কিন্তু আমার একটা কাজ করে দিন! সামান্য কাজ, আর তা করে দেওয়ার জন্য আপনার হাতে সেরকম লোকও আছে, আমি জানি। …না না অত বিনয় করতে হবে না বাচ্চচুদা, খরচ যা করতে হয় আমিই করব, আপনি শুধু ব্যবস্থাটা করে দিন। ফোনে সব কথা তো বলতে পারব না, অসুবিধে আছে, হাতে সময়ও খুব কম, আপনি এখুনি চলে আসুন, এখুনি। …আভাস মানে এইটুকুই বলতে পারি, কলকাতার বাইরে গ্রামের দিকে কাল একটা ছোটো ব্যাপার, কী বলে অ্যাকশন, করে আসতে হবে। …একজনের বাড়িতে। …বাড়িটা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে আসতে হবে।’

রোহিণী দেখল, মীনার চোখমুখ হঠাৎ কীরকম বদলে গেল। শান্ত, পরিহাসের ভঙ্গিটা রূপান্তরিত হয়েছে তেল কমে যাওয়া প্রদীপের দপদপে শিখার মতো। রক্ত জমে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে মুখটা।

‘হ্যাঁ, বললাম তো, ওই টাকাতেই আমি রাজি, অবশ্য যদি আমার এই কাজটা…বেশ, এখুনি আসছেন?…আচ্ছা।’

ফোন রেখে মীনা হাসল রোহিণীর দিকে তাকিয়ে। সিরসির করে উঠল রোহিণীর সর্বাঙ্গ। মীনাকে এখন এক দানবী মনে হচ্ছে।

‘আমি এখন যাই।’

‘হ্যাঁ, আসুন। কাল যদি এমন সময় আসেন বা ফোন করেন, তাহলে ভালো একটা খবর আপনাকে দিতে পারব। গায়ে হাত দেওয়ার বদলা মীনা চ্যাটার্জি কীভাবে নেয়, সেটাই আপনাকে কাল জানাব।’ কথাটা বলেই মীনা দু—হাত বাড়িয়ে রোহিণীর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি নিয়ে, বলল, ‘ধন্যবাদ, অজস্র ধন্যবাদ, খবরটা আমায় দেওয়ার জন্য।’

মীনার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসার সময় রোহিণীর মনে হল, বাসুদেবপুরে ছবিগুলো আছে, এই খবরটা মীনাকে জানিয়ে বোধ হয় সে ভালো কাজ করেনি। কিন্তু টিউব টিপে পেস্ট বার করে ফেলে আর তা টিউবে ঢোকানো তো যায় না। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে থাকার সময় সে ভাবল, গঙ্গাদাকে ফোন করে যদি সে বলে দেয়, কাল একটা সর্বনাশ ঘনিয়ে আসবে বাসুদেবপুরে, তাহলে নিশ্চয় সেটা মানবিক কাজ হবে, কিন্তু—। এই কিন্তুটাকে নিয়ে সে সল্টলেক পর্যন্ত সারাটা পথ নিজেই নিজেকে নাস্তানাবুদ করল। তার বাস্তববোধ এত ভালো ড্রিবল করল কিন্তুটাকে নিয়ে যে, রোহিণীর মানবিকতার ডিফেন্স তছনছ হয়ে গেল।

যা হবার হোক, এইরকম একটা মানবিক অবস্থা নিয়ে সে কুন্তীদের ফ্ল্যাট পেরিয়ে তিনতলার সিঁড়িতে পা রেখেও ফিরে এসে বেল বাজাল।

দরজা খুললেন মাসিমা। রোহিণীকে দেখে একগাল হেসে বললেন, ‘এঁচোড়ের কোপ্তা তোমার নাকি খুব ভালো লেগেছিল? কই আমাকে একবারও তো সেকথা বললে না?’

‘আপনার হাতের রান্না ভালো হয়েছে, সেকথা আবার বলার অপেক্ষা রাখে নাকি! তাহলে তো রসগোল্লা খেয়েও বলতে হয়, আহা কী মিষ্টি লাগল!’

পুলকিত মাসিমা ঝটতি প্রতিশ্রুতি দিলেন, ‘আর একদিন করে খাওয়াব তোমায়।’

‘কুন্তী কোথায় মাসীমা?’

‘আর বোল না সে মেয়ের কথা, পল্টু তো গৌহাটি থেকে আজ দুপুরেই ফিরে এসেছে।’

‘আরও দু—দিন পরে ফেরার কথা না?’

‘আমি তো তাই জানি!’ মাসিমা দু—ধারে তাকিয়ে গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘থাকতে পারে না, বুঝলে, বউকে ছেড়ে দু—দিনের বেশি থাকতে পারে না! কাজকম্মো ফেলেই পালিয়ে এসেছে।’

‘কুন্তীও খুব ভালোবাসে।’

‘ছাই বাসে! পল্টু ফেরামাত্রই শুরু হয়ে গেল ঝগড়া। তারপর মারামারি। কী বলব তোমায় লজ্জার কথা, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পল্টুটা গাধার মতো মার খেল! ওর অপরাধ, কেন ওকে নার্সিংহোমে ভরতি করাচ্ছে না। আচ্ছা তুমি বলো, জ্বর নেই জারি নেই, থ্রম্বসিস হয়নি, অম্বল হয়নি, একটা ফোঁড়াও হয়নি, এমন একটা মানুষকে কী নার্সিংহোমে দেয় কেউ?’

‘মারামারিতে কী রেজাল্ট হল মাসিমা?’

‘কে জানে। দুটোতে মিলে তো বিকেলবেলায় বেরোলো, সিনেমা টিনেমায় হয়তো গেছে।’

‘কিংবা নার্সিংহোমের খোঁজে। আসি মাসিমা। কোপ্তা কিন্তু তাড়াতাড়ি চাই।’

তিনতলায় না থেমে রোহিণী চারতলায় উঠে এসে সুজাতা গুপ্তদের দরজার সামনে উদবিগ্ন হয়ে দাঁড়াল বেল বাজিয়ে।

একটু দেরি করে দরজা খুললেন হৃদয়রঞ্জন। টিভি থেকে নাটকের সংলাপ ভেসে আসছে।

‘মাসিমার খবর কী?’

‘ফোন করেছিল।’ ধীর আশ্বস্ত স্বর। ‘বহরমপুর থেকে।’

‘বহরমপুর!’ রোহিণীর চোখের উপর দিয়ে ঝলসে গেল শোভনেশের ভাঙাচোরা মুখ, কয়েকটা ন্যুড ছবি, বালিশে পিঠ দিয়ে আধবসা অবস্থায় মাথাটা পিছনে হেলিয়ে চাদর ঢাকা এক আবছা রমণী।

‘কেন বহরমপুরে কেন গেছেন?’

‘ওখানে ওর মাসতুতো এক দাদার বাড়ি, খাগড়ায়। টেলিফোন করেছিল তুষারবাবুদের ঘরে। আপনার সঙ্গেই কথা বলতে চাইছিল। কিন্তু আপনি তো বিকেলে তখন ছিলেন না, তাই ওরা আমাকেই ডেকে দেয়। বলল, কী একটা জরুরি কথা আপনাকে জানাতে চায়। আমি বললাম, আমাকে বলো, আমি জানিয়ে দেব। কিন্তু বলল, না, শুধু রোহিণীকেই বলব।’

‘আর কিছু বললেন?’ রোহিণী অস্বস্তি আর ভয় নিয়ে তাকিয়ে রইল অভিব্যক্তিহীন হৃদয়রঞ্জনের মুখের দিকে।

‘না। কালকেই ফিরে আসছে, শুধু এইটুকু বলেই ফোন রেখে দিল।’

‘কাল যখন? ট্রেনে না বাসে আসবেন?’

‘জানি না।’

রোহিণী ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল। না বলে—কয়ে হঠাৎ মাসতুতো দাদার বাড়ি বেড়াতে এই বয়সে যান না। নিশ্চয় শোভনেশকে দেখতেই গেছেন। কিন্তু কী উদ্দেশ্য? মামলা আবার শুরু করার জন্য কথাবার্তা বলতে? কিন্তু উনি তো জানেন, শোভনেশ বহরমপুর হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছে। তাহলে আবার ওখানে যাওয়া কেন? কাল ওনার ফিরে না আসা পর্যন্ত উত্তরটার জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হবে।

দরজায় চাবি ঢোকাতে গিয়ে গর্তটা দু—বারের চেষ্টায় সে খুঁজে পেল। হাতটা কাঁপছিল। রোহিণীর মনে পড়ল, মীনারও এমন হয়েছিল টেলিফোন ডায়াল করার সময়।

এগারো

রোহিণী স্বপ্ন দেখছিল।

ইংরেজি কথোপকথন শোনানোর জন্য দুই মেয়েকে বাবা মাঝে মাঝে ইংরেজি ফিল্ম দেখাতে নিয়ে যেতেন। টার্জান, চ্যাপলিন, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, লরেল হার্ডির পর রোহিণীর ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় হিচককে প্রোমোশন ঘটে। তখন ‘স্পেলবাউন্ড’ দেখেছিল। তাতে একটা উদ্ভট স্বপ্নের দৃশ্য ছিল, যার মাথামুণ্ডু সে একদম বোঝেনি। সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে সে স্বপ্নটা সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই বাবা বিব্রত হয়ে বলেন, ‘ওটা হল অবচেতনের ব্যাপার। মানুষের চেতনার তলদেশে অনেক কিছু জমা হয়ে থাকে। কখনো—সখনো সেগুলো অদ্ভুত চেহারা নিয়ে উপরে ভেসে ওঠে। এই দৃশ্যটার পরিকল্পনা করেছেন সালভাদোর দালি, খুব বড়ো একজন আর্টিস্ট। উনি এই ধরনের ছবি এঁকে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন। আরও বড়ো হও, তখন চেতন—অবচেতন সম্পর্কে আরও জানতে, বুঝতে পারবে।’

তারপর রোহিণী বড়ো হয়েছে বটে, কিন্তু অবচেতন নিয়ে কখনো জানা বা বোঝার জন্য মাথা ঘামায়নি। এই ধরনের স্বপ্নের বিবরণ গল্পে—উপন্যাসে পড়েছে। কিন্তু নিজের জীবনে সে এই প্রথম দেখল।

একটা চৌকো ঘর, ঘরের গরাদবিহীন জানালাগুলো বন্ধ, শুধু একদিকের একটার পাল্লা আধখোলা। ব্যাটারি ফুরনো টর্চের মতো ম্লান আলো বাইরে থেকে ঘরে এসে পড়েছে। তাইতে দেখা যাচ্ছে, চৌকো আকারের সাদা আর কালো মার্বেলের মেঝে। একটা খাট ঘরের দেওয়াল ঘেঁসে। তাতে বালিশে পিঠ দিয়ে আধবসা অবস্থায় একটা মূর্তি। তার মাথাটা পিছনে হেলানো, মুখটা সিলিংয়ের দিকে তোলা, বাঁ হাতটা ঝুলছে খাট থেকে, ডান হাঁটু মুড়ে উঁচু করা, শরীর একটা চাদরে ঢাকা। মূর্তিটা আবছা অন্ধকারে নিথর হয়ে রয়েছে। ঘরটায় গুমোট হয়ে জমে রয়েছে নৈঃশব্দ্য। ঘরে ঢুকল এক রমণী। অন্ধকারে সে দেহ থেকে বসন খুলতে লাগল। সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে, মেঝেয় যেখানে টর্চের মতো আলো, তার উপর গিয়ে দাঁড়াল। আলোটা ক্রমশ ম্যাজেন্টা রঙে পরিণত হল। রমণীর মুখ নেই। তার বদলে সেখানে সাদা রং করা একটা ক্যানভাসের টুকরো পিন দিয়ে আঁটা। রমণী মেঝেয় উবু হয়ে বসল। দুই হাঁটু জোড়া করে সামনে ঝুঁকে, দু—হাতে দুটি পা জড়িয়ে ধরল। মুখটি রাখল হাঁটুতে। স্তনদ্বয় ঊরুতে চেপে রাখা। টানা ধনুকের মতো বেঁকে রয়েছে মাথা থেকে নিতম্ব পর্যন্ত পৃষ্ঠদেশ। রমণী ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে পাথরের মতো কঠিন আকার নিল। এই সময় সেই ঘরে ঢুকল একটি কালো বিড়াল। একাধারে থাক দিয়ে রাখা তোরঙ্গের উপর বিড়ালটি লাফিয়ে উঠল। দুই থাবা সামনে রেখে সে সামনে তাকিয়ে বসে থাকল। ধীরে ধীরে সে জমাট হয়ে গেল। এবার ঘরে ঢুকল একটি দীর্ঘকায় পুরুষ। তার চুল কাঁচাপাকা, ঝাঁকড়া, ফাঁপানো। দক্ষযজ্ঞের শিবের মতো। পুরু জুলপিতে গালের অর্ধেক পর্যন্ত ঢাকা। সরু সরু আঙুল, চওড়া কবজি। চোখ দুটি কোটরে ঢোকানো জ্বলজ্বলে। ঘন ভুরুর চুলগুলিও ধূসর। লোকটির হাতে বলির খড়্গ। সে সোজা খাটের কাছে গিয়ে খড়্গ দিয়ে মূর্তিটির ঘাড়ে কোপ বসাল। মাথাটা ধড় থেকে ছিটকে মেঝেয় পড়ল। এরপর সে কোপ বসাল মেঝেয় বসা নগ্ন রমণীর ঘাড়ে। তার মাথাটা ছিটকে দেয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে ঘাড় থেকে। মেঝের সাদা কালো রং ক্রমশ লাল হয়ে গেল। লোকটি এবার উন্মত্তের মতো ধেয়ে গেল বিড়ালটার দিকে। প্রাণভয়ে বিড়ালটি লাফিয়ে মেঝেয় নামল। পালাবার জন্য দরজা খুঁজছে, কিন্তু রক্তাক্ত পাথরের মেঝেয় পিছলে যাচ্ছে তার থাবা। নখ দিয়ে হাঁচোড়—পাঁচোড় করছে এগোবার জন্য কিন্তু এগোতে পারছে না। তাকে ধরার জন্য লোকটি পা বাড়াতেই পিছলে পড়ল। তখন সে হামা দিয়ে এগোতে লাগল বিড়ালটির দিকে।

এই সময় স্বপ্ন দেখার মধ্যেই নড়েচড়ে উঠল রোহিণী। গলগল ঘামে তার বুক পিঠ ভিজে গেছে। মুখ দিয়ে ক্ষীণ একটা ভীত স্বর বেরোচ্ছে। অস্ফুটে সে কিছু যেন বলে উঠল। লোকটি তখন তার লাল পাঞ্জা বাড়িয়ে বেড়ালটিকে ধরল। মুঠিটা ক্রমশ ছোটো হতে লাগল গলায়। ধীরে ধীরে নিস্পন্দ হয়ে গেল বিড়ালটি। লোকটি তখন সেটিকে নামিয়ে রাখল মেঝেয়। কাটা মাথা দুটি কুড়িয়ে এনে রাখল মৃত বিড়ালটির পাশে। সারাক্ষণ ঘরে একটুও শব্দ হয়নি। কিন্তু স্বপ্নটি দেখতে দেখতে রোহিণী এবার ‘মাগো’ বলে চেঁচিয়ে, উঠে বসল। কাটা মাথা দুটির মুখ এবং বেড়ালটির মুখ, একজনেরই। রোহিণীর। তার নিজেরই।

নিজের ঘাড়ে হাত রেখে সে কুঁজো হয়ে বিছানায় বসে থাকল অনেকক্ষণ। জানালা দিয়ে ভোরের কমলা রোদ মেঝেয় এসে পড়েছে। সে মেঝের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল।

স্বপ্নটা তার মনকে বসিয়ে দিয়ে গেল অনিশ্চিত একটা জঙ্গলের মধ্যে। নানান কাঁটাঝোপ আর ঘন গুল্ম। এর মাঝে কোথাও একটা বাঘ লুকিয়ে আছে, এমন একটা সন্দেহ সারা সকাল ধরে মাঝে মাঝেই তার মনে উঁকি দিয়েছে। গৌরীর মা কাজে এল। খাঁটি পেশাদারের মতো সে দ্রুত হাতে কাজ করতে লাগল বাড়তি কোনো কথা না বলে। রোহিণী তাতে অবাক হল। সে আশা করেছিল, জামাইবাবু সম্পর্কে গতকালের অপ্রতিভতা কাটাতে, একঝুড়ি না হোক, একথলি কৌতূহল নিয়ে গৌরীর মা আজ আসবে। কিন্তু তার বদলে মুখ এত গম্ভীর কেন!

‘গৌরীর মা, আর একজন ভাত খাবে। তুমি দোকান থেকে—’।

রোহিণী কথা শেষ হবার আগেই গৌরীর মা উদাসীন স্বরে বলে উঠল, ‘আমার এখন দু—ঘরের কাজ বাকি রয়েছে। আমি যেতে পারব না।’

রোহিণী ঘড়ি দেখল। খবরের কাগজ খুলে খাবার টেবিলে বসে, পড়তে পড়তে আড়চোখে গৌরীর মা—কে মাঝে মাঝে লক্ষ করে গেল। বাঘটা বোধ হয় উঁকি দিচ্ছে। একটা অস্বস্তি মাথাচাড়া দিচ্ছে মনের মধ্যে। কাজ শেষ করে, ‘যাচ্ছি’ বলে যখন গৌরীর মা দরজার দিকে এগিয়েছে, তখন রোহিণী বলল, ‘হয়েছে কী তোমার, এত গম্ভীর কেন?’

থেমে ইতস্তত করে গৌরীর মা বলল, ‘দ্যাখো বাপু, আমি নয় বোকাসোকা মানুষ, ভুলটুল করতেই পারি। কিন্তু তোমরা তো বইটই পড়া, শিক্ষিত ভদ্দর নোক। বিয়ে না করে পুরুষমানুষের সঙ্গে রাত্তির কাটানো, এটা কেমন কথা? তোমাদের নয় বদনামের ভয় নেই, কিন্তু আমাদের তো আছে। সোয়ামি নিরুদ্দেশ, বেঁচে আছে কী মরে গেছে জানো না, এখনও সধবাই, আর কিনা এর মধ্যে এইসব কাণ্ড শুরু করে দিয়েছ? এমন ঘরে বাপু আর আমি কাজ কত্তে পারব না।’ প্রায় এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে সে দরজা খুলে বেরিয়ে, দড়াম করে পাল্লাটা বন্ধ করে দিল।

শব্দটা যেন ঠাস করে, রোহিণীর গালে চড় বসাল। গুম হয়ে সে তাকিয়ে থাকল খবরের কাগজের দিকে। একটা অক্ষরও তার মগজে ঢুকছে না। গৌরীর মা—র একটা কথা তার মাথায় দপদপ করে যাচ্ছে—এখনও সধবাই, আর কিনা এর মধ্যেই এইসব কাণ্ড শুরু করে দিয়েছ?

কিছুক্ষণ পর রোহিণী উঠল। ভেবে কোনো লাভ নেই। গৌরীর মা—র নৈতিক বোধ তারই থাক, সে কখনো আমার মতো অবস্থায় জীবন যাপন করেনি। পরিবেশ, পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলাই হচ্ছে জীবন। কে কী বলছে বা ভাবছে, তাই দিয়ে নিজেকে চালালে মানুষ কখনো কিছু করে উঠতে পারে না। আমার নিজস্ব একটা সত্তা আছে, রোহিণী বিড়বিড় করে নিজেকেই শুনিয়ে বলল, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছায় কারোরই হস্তক্ষেপ মানব না। আমার মর্যালিটি আমার কাছে, সেখানে আমি পরিষ্কার। ব্যস। রাজেন এলে ওকে ভাতে ভাতই খেতে হবে।

তাই খেতে হল রাজেনকে। সে সাড়ে দশটায় এসে হাজির হয়। এসেই প্রথম কথা, ‘কাল যা যা খাব বলেছিলাম—’

‘তার একটাও রাঁধা সম্ভব হয়নি। দোকান বাজার আমাকেই করতে হয়, এটা খেয়াল থাকে না কেন?’ রোহিণীর ধীর গম্ভীর স্বর রাজেনকে মিইয়ে দিল।

‘কেন? গৌরীর মা?’

‘সে আমার মতো দুশ্চরিত্রার কাজ আর করবে না। আজই বলে গেল, যার সোয়ামী বেঁচে আছে কী মরে গেছে তার ঠিক নেই, সে তো এখনও সধবাই। আর কিনা এইসব কাণ্ড, অর্থাৎ রাত্রে তুমি ছিলে—এটা যেভাবেই হোক ও জেনেছে। সুতরাং চরিত্র রক্ষার জন্য তিনি রিজাইন করবেন জানিয়ে গেছেন।’

‘কিন্তু আমরা তো কোনোরকম—’

‘আহ রাজেন,’ মাছি তাড়াবার মতো করে হাতটা মুখের সামনে নেড়ে রোহিণী বলল, ‘বাদ দাও তো এসব। কাল গেছিলে?’

‘ওহ, হ্যাঁ। জীবুদার কাছে গেছিলাম, নিয়ে গেলেন সেই ভদ্রলোকের কাছে। তিনি বললেন, আগে ডিভোর্সটা করিয়ে নিতে। বিয়ের রেজিস্ট্রির ব্যাপারটা একদিনেই হয়ে যাবে, বাড়িতে বসেই তিনি করে দেবেন। দু—তিনদিনের মধ্যেই ডিভোর্স স্যুট ফাইল করা হয়ে যাবে।’

‘আর বাড়ির ব্যাপারটা?’

‘জহিরুল নিয়ে গেল ওর পাড়াতেই একটা ফ্ল্যাট দেখাতে। একতলায়, একটু ভেতরের দিকে, দু—খানা ঘর। ডাইনিং, কিচেন যা যা থাকার ঠিকই আছে। টাইলসের মেঝে, জানালা দরজার রংও ভালো, পেলমেট আছে, দেওয়াল পেইন্ট করা, কনসিলড ইলেকট্রিক্যাল ওয়ারিং। মুশকিলটা হল, ভাড়া দু—হাজার, পনেরো হাজার সেলামি দিলে ওটা দেড় হাজার।’

‘নিয়ে নাও দু—হাজারেই।’ রোহিণী বলে উঠল রাজেনের কথা শেষ হওয়ামাত্রই। ‘এখন তো উঠে যাই। তারপর আরও কমে কোথাও খুঁজে নেব। এই ফ্ল্যাটে আর একমুহূর্তও থাকতে ইচ্ছে করছে না। গঙ্গাদার অনুগ্রহ যথেষ্ট নিয়েছি, আর নয়।’

রাজেন কয়েক সেকেন্ড রোহিণীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বাসুদেবপুর থেকে ফিরে আজই জহিরুলের কাছে যাব।’

ঠিক সওয়া এগারোটায় তারা তিনতলা থেকে নীচে নেমে এল। এখান থেকে এয়ারপোর্ট হোটেলের সামনে পৌঁছতে বুড়োর পক্ষে মিনিট কুড়ি হয়তো লাগবে। একটু আগে পৌঁছনোই ভালো। একটা জায়গা বেছে নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। চণ্ডীদাস ঘোষাল আসবে নিজের গাড়িতে, গঙ্গাপ্রসাদও তাই। ওরা কেউ বুড়োকে বা রাজেনকে আগে দেখেনি, সুতরাং চিনবে না।

একতলায় নেমেই রোহিণী মাথায় আঁচল তুলে, কালো চশমা পরল। রাজেন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল, ‘ছদ্মবেশ।’

‘ফিল্ম অ্যাকট্রেস ভেবে এতে আরও বেশি লোকে তাকাবে। আমার সান হ্যাটটা গাড়িতেই আছে। ওটা পরে সামনে একটু টেনে নামিয়ে নাও, মুখটা আড়াল হবে।’

কথা বলতে বলতে ওরা গেটের কাছে এসে দেখল, তুষার দত্ত কোমরে হাত রেখে খুব মন দিয়ে বুড়োকে নিরীক্ষণ করছে। রোহিণীকে দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘ঘোমটা! বিয়ে করেছেন নাকি?’

‘করতে যাচ্ছি।’

‘কাকে?’

গাড়ির দরজা খুলে রাজেন ভিতরে ঢুকছে। রোহিণী আঙুল দিয়ে তাকে দেখাতেই তুষার দত্ত গম্ভীর হয়ে গেল।

‘প্রেম করে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তলায় তলায় তাহলে এইসব চালিয়ে যাচ্ছিলেন?’

‘উপরে উপরে কী প্রেম চালিয়ে যাওয়া যায়?’

তুষার দত্তর মুখ কালো হয়ে গেল। ত্যারছা চোখে হিলম্যানটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শেষে এই একটা ওল্ড লঝঝড় গাড়ি জুটল। আমি তো ভেবেছিলুম, মার্সিডিজ নয়তো টয়োটো, নিদেন কন্টেসা চেপে বিয়ে করতে যাবেন।’

তুষার দত্তর গলায় কেমন যেন একটা জ্বালা রয়েছে, যেটা রোহিণীর কানে সহজেই ধরা পড়ল। কিন্তু রাজেনের গাড়িকে লঝঝড় বলাটা তার মনঃপূত হল না।

‘লঝঝড়ে বুড়োরা খুব ফেইথফুল হয়। কাজ নিয়ে কথা। ও তো আর মোটরশ্রী কনটেস্টে নামতে যাচ্ছে না!’ কথা বলে রোহিণী গাড়ির দরজা খুলে রাজেনের পাশের সিটে বসল।

হঠাৎই তুষার দত্তর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। একটু কুঁজো হয়ে রোহিণীর চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমার মেয়েকে নষ্ট করতে চাইছেন কেন? সকালে দেখলুম, একটা সেমিজ পরে রয়েছে। রাত্তিরে ওটা পরেই নাকি শুয়েছিল। আমায় দেখে লুকোতে যাচ্ছিল। ক্যাঁক করে ধরে, এমন অসভ্য জিনিস কোথা থেকে পেয়েছে জিজ্ঞেস করায়, প্রথমে বলতে চাইছিল না। দুটো থাপ্পড় কষাতে, বলল, আপনি নাকি দিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ দিয়েছি।’

‘ক্যানোওও।’ তুষার দত্ত চেঁচিয়ে উঠে গাড়ির চালে রোহিণীর ঠিক মাথার উপরে কিল বসাল। ‘নিজে পরেন বলে কি সবাইকে পরাতে হবে? অ্যারিস্টোক্র্যাট ফ্যামিলির মেয়েরা কি এসব পরে?’

রোহিণীর মনে হল, বাঘটা আবার উঁকি দিচ্ছে। মর্যালিস্টের পর এবার এই অ্যারিস্টোক্র্যাট। রাতের সেই বীভৎস স্বপ্ন কী যে অশুভ দিন বয়ে আনল, আর এর শেষ যে কীভাবে হবে! পাশে মুখ ফিরিয়ে মৃদুস্বরে সে বলল, ‘রাজেন আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

রাজেন স্টার্ট দিল। রোহিণীকে স্বস্তি দিয়ে বুড়ো কাশাকাশি না করেই গর্জন করে উঠল। তুষার দত্তর দিকে তাকিয়ে নড করে, রাজেন গাড়ি ছাড়ল।

‘এখানে থাকতে হলে ভদ্রভাবে থাকতে হবে, বুঝলেন?…’ তুষার দত্তর চিৎকার পিছনে ফেলে হিলম্যান সল্টলেক থেকে বেরিয়ে এল। রাজেন শুধু একবার বলেছিল, ‘অ্যাডভানটেজ নেবার চেষ্টা করেছিল?’

‘হ্যাঁ।’ রোহিণীর মুখে ফিকে একটা হাসি ফুটতে ফুটতেও মিলিয়ে গেল। ‘মেয়েটা আর বউয়ের জন্য কষ্ট হয়।’

‘এইরকম বাপ আর স্বামী হাজার হাজার আছে, সুতরাং কষ্টটা মন থেকে ঝেড়ে ফ্যালো।’

‘বলামাত্রই ঝেড়ে ফেলা যায় কি? গৌরীর মা, তুষার দত্ত, এরা ছারপোকার জাত। কামড়ালে চুলকোয়, পিষে মারলে আঙুলে গন্ধ লেগে থাকে। বার বার তোষক—গদি উলটেপালটে খুঁজতে হয়, কোথায় এরা লুকিয়ে আছে!’

‘তার থেকে অনেক নিশ্চিন্ত হতে পারবে, যদি পুরোনো তোষক—গদি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, মানে মন থেকে চিন্তা থেকে নির্মূল করে, একেবারে নতুন হয়ে উঠতে পারো। আর তা করতে হলে প্রথমেই তোমাকে এই বাসুদেবপুর যাওয়াটা বন্ধ করতে হবে।’

রাজেন গাড়ির গতি কমাল।

‘কেন বন্ধ করব! এতদূর পর্যন্ত এসে শেষ না দেখে ফেরা যায় না।’

‘যায়, জীবনকে খুব বাস্তব দিক থেকে দেখার চেষ্টা করলে, এই যাওয়ার কোনো পজিটিভ লাভ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ধরা যাক, শোভনেশ সেনগুপ্তর দামি দামি অনেক ছবি গঙ্গাপ্রসাদ বাঁড়ুজ্জে হাতিয়ে নিয়ে বাসুদেবপুরে রেখে দিয়েছে, সেগুলো বিক্রি করে সে বহু টাকা কামাচ্ছে বা কামাবে।’ রাজেন কয়েক সেকেন্ড কথা বন্ধ রেখে বলল, ‘তাতে তোমারই বা কী আর আমারই বা কী! তুমি কি ওই টাকার ভাগ চাও?’

‘মোটেই না। আমি তো বরাবরই বলে এসেছি—’ রাজেন বাঁ হাত তুলে রোহিণীকে থামিয়ে দিল।

‘তাহলে আমাদের কী দরকার, এই তথাকথিত একটা রহস্যর পিছু নিয়ে সময় নষ্ট করার আর গাড়ির তেল পোড়াবার? রুনি একটা কথা বলো, গত দশ—বারো দিনে তুমি এমন কী পেয়েছ—ভয়, অপমান আর মানসিক কষ্ট ছাড়া, যার মধ্যে নিজেকে পরিচ্ছন্ন, তাজা, আনন্দভরা মনে হয়েছে? বেঁচে থাকার একটা…কিছুই পাওনি। আজেবাজে লোকেদের নোংরামি আর স্বার্থপরতা দেখে আর ভেবে—।’

‘এবার থামো তো। গত দশদিনে আমি জীবনের শ্রেষ্ঠ জানাটা জেনেছি…বুড়োকে ঘোরাও।’

রোহিণীর গজদাঁতটা দেখা গেল ঠোঁটদুটো একটু বেশি ছড়িয়ে পড়ায়। রাজেন ব্রেক কষল। রোহিণী সান গ্লাস খুলে চোখ দুটি মেলে দেখাল তার অহঙ্কারের সুখাবেশ।

‘কী জেনেছ?’

‘জেনেছি, ভালোবাসার পরীক্ষা দেবার জন্য একটা লোক কী কঠোরভাবে নিজেকে ডিসিপ্লিনড করতে পারে, জেনেছি, আমি খুব সাধারণ তুচ্ছ নই, জেনেছি…।’ আবেগে রোহিণীর কথা বন্ধ হল।

‘বলে যাও, থেমো না।’ মৃদু স্বরে রাজেন বলল।

‘আর আমি জানি না। সব যেন কেমন এই মুহূর্তে গুলিয়ে যাচ্ছে…একটা দুর্দান্ত ফিলিংস রাজেন, যা সব মেয়েই জীবনে পেতে চায়, সর্বক্ষণ জমিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীতে গাদাগুচ্ছের সেঞ্চুরি হচ্ছে, তার মধ্যে একটা শুধু আমার জন্যই হবে, এটা জানিয়ে, প্রতিজ্ঞা নিয়ে একজন মাঠে নেমে সেটা করে নিয়ে এল। আমাকে সে মর্যাদা দিল, সম্মান দিল, আমি কী যে সে মেয়ে!’

মুখোমুখি দু—জনের দৃষ্টি একটি বিন্দুতে এসে স্থির হয়ে রইল অনেকক্ষণ। উভয়ের দৃষ্টিপথ বেয়ে প্রবাহিত হল গাঢ় অনুরাগ, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা।

‘ভীষণ খিদে পাচ্ছে।’ রাজেন বলল।

‘না না, রাস্তার মধ্যে ওসব নয়, বাড়ি ফিরে—’

‘আরে, সত্যিকারের খিদে পেয়েছে।’

‘তার মানে? তোমার তো একটাই খিদে!’

‘কখন আলু ভাতে ভাত খেয়ে বেরিয়েছি বলো তো? এটা পাকস্থলির বাস্তব খিদে।’

‘বাগুইআটি তো সামনেই, দই আর সন্দেশ কিনে খেয়ে নাও।’

‘উঁহু। এয়ারপোর্টে হোটেলেই আমরা যাব তবে অন্য উদ্দেশ্যে, লাঞ্চ করতে।’

‘সেই ভালো। আমারও বেশ খিদে পাচ্ছে।’

রাজেন গাড়ি ছাড়ল। বাগুইআটির মোড় পার হয়ে সে বলল, ‘মানুষ কতরকম ঝোঁকের মধ্যে যে জীবনকে টেনে নিয়ে যায়, তাই এইসব লোকগুলোকে দেখলে বোঝা যায়। টাকার ঝোঁক, প্রেমের ঝোঁক, প্রতিহিংসার ঝোঁক, উন্মাদ হয়ে যাবার ঝোঁক।’

‘আমিও কৌতূহলের ঝোঁকে পড়েছিলাম।’

‘এখন আর নেই?’

‘এখন শুধু ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর ঝোঁক।’ স্টিয়ারিং থেকে রাজেনের বাঁ হাতটা তুলে রোহিণী, তার ডান ঊরুর উপর রাখল, রাজেন হেসে ফেলল।

এয়ারপোর্ট হোটেলের সামনে কোনো গাড়ি দাঁড়িয়ে নেই। হোটেলের পার্কিং জোন—এ একটি অ্যাম্বাসাডর ও একটি জিপ। তাদের পাশেই রাজেন হিলম্যানকে রাখল।

হোটেলের রেস্টুরেন্টে ঢুকেই তাদের চোখ পড়ল ঘরের শেষপ্রান্তে এক কোণে টেবিলে মুখোমুখি বসে তিনটি লোক। তারা খাওয়ায় ব্যস্ত। টেবিলের ওপর চারটি বিয়ারের বোতল। চতুর্থ চেয়ারটি খালি কিন্তু প্লেটে আধ খাওয়া একটা তন্দুরী চিকেন রয়েছে। দরজার দিকে তাকিয়ে বসা লোক দু—জন রাজেন ও রোহিণীর দিকে তাকাল। রোহিণীর ভ্রূ কুঁচকে উঠল।

‘ওদিকে বসব না, এখানেই দেওয়ালের পাশে বসা যাক।’ রোহিণী চাপা স্বরে বলল।

‘কেন, আর একটু এগিয়ে—’

‘না।’ রোহিণী টেবিলে ঝোলাটা রেখে চেয়ার টেনে লোকগুলির দিকে পিছন ফিরে বসে বলল, ‘ওখানে বসা একটা লোকের মুখ কালই দেখেছি মীনা চ্যাটার্জির ফ্ল্যাটে, মীনাকে পাহারা দিচ্ছিল।’

রাজেন সামনে তাকিয়ে বলল, ‘ওরা তোমার দিকে তাকাচ্ছে আর নিজেদের মধ্যে তোমাকে নিয়েই কিছু যেন বলছে।’

‘বলুক গে। কিন্তু এই সময় ওরা এখানে কেন! বাসুদেবপুর যাবার তো এটাই রাস্তা। তাহলে কী—।’

রোহিণী কথা অসমাপ্ত রাখল রাজেনের চোখ দেখে। সে যে অপ্রত্যাশিত কিছু একটা দেখতে পেয়েছে।

‘মাই গড!’ রাজেন ফিসফিস করল। ‘এখানে মীনা চ্যাটার্জি! খালি চেয়ারটায় বসল, টয়লেট থেকে এসে। গ্লাসে বিয়ার ঢালছে। একটা লোক ওকে কী যেন বলল, বিয়ার ঢালা বন্ধ শুনছে, পিছনে তাকিয়ে দেখছে, তোমাকেই। চেয়ার থেকে উঠল, আমাদের দিকে আসছে, হাতে ভরতি গ্লাস, মুখে মস্ত হাসি, পায়ের স্টেপিং গোলমেলে, বোধ হয় অনেকক্ষণ বসে খাচ্ছে।’ রিলে করার মতো রাজেন বলে গেল রোহিণীর মুখের দিকে তাকিয়ে এবং কোনোরকম ভাবান্তর না ঘটিয়ে।

‘হ্যালো মিসেস সেনগুপ্ত।’ মীনা একটা হালকা থাপ্পড় কষাল রোহিণীর কাঁধে। রোহিণী এতটা উৎফুল্ল ঘনিষ্ঠতা আশা করেনি। একটু বেশি করেই চমকে উঠে রোহিণী বলল, ‘আরে আপনি এখানে?’

‘কেন আমি কি এখানে আসতে পারি না? শুধু কি আপনিই আসবেন?’ রোহিণীর পাশের চেয়ারে বসে মীনা হাসিমুখে রাজেনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ইনি?’

‘আমার বন্ধু।’

‘বাড়ি থেকে এতদূরে….বন্ধুর সঙ্গে।’ বলেই মীনা তার কথার তাৎপর্যটা বোঝাতে হাসল। তারপর চুমুক দিয়ে গ্লাসটা অর্ধেক করে টেবলে ঠকাস করে রাখল। ‘আমিও এসেছি বন্ধুদের নিয়ে, ভুল বললাম, বন্ধুদের রিসিভ করার জন্য। ওরা একটা মহৎ কাজে গেছিল।’ মীনা ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘কাজটা কী, জানেন মিসেস সেনগুপ্ত?’

রোহিণীর মনে হল একটা কেউটে ফণা তুলে তার মুখের কাছে দুলছে। তার শরীর সিরসির করে উঠল। মাথা নেড়ে শুকনো গলায় বলল, ‘না, জানি না।’

‘শোভনেশ সেনগুপ্তর আঁকা সব ছবি, ওঁর নষ্ট মনের কাজ আর লোকের চোখের সামনে আসবে না। সব ভস্মীভূত, পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।’

‘কোথায়, কবে, কখন পুড়ল?’ রোহিণী তীক্ষ্ন কণ্ঠে জানতে চাইল।

গ্লাসের বাকি বিয়ারটুকু শেষ করে মীনা চোখ বুজে বসে রইল। কী একটা আবেগ যেন দমন করার জন্য সে নিজের সঙ্গে ধস্তাধস্তি চালাচ্ছে। হঠাৎ চোখ খুলে বলল, ‘উনি যা চেয়েছিলেন আমি তাই করেছি, কোনো অন্যায় কোনো পাপ আমি করিনি…করেছি কি?’

‘ছবিগুলো তো বাসুদেবপুরে—’

গঙ্গাপ্রসাদের বাড়ি আজ ভোরেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মীনা চ্যাটার্জির সঙ্গে লাগতে এলে, তার কী ফল হতে পারে, ওই মোটা বেঁটে মর্কটটার এবার তা মালুম হবে। সুখবরের জন্য আমি দশটা থেকে এখানে অপেক্ষা করছিলাম। আধঘণ্টা আগে ওরা ফিরল। কাম ফতে।’ মীনা শেষ শব্দটা বলল টেবলে ঘুঁষি মেরে এবং উঠে দাঁড়াল।

‘কিন্তু ওইসব ছবির মধ্যে তো অনেকগুলো আসল কাজও ছিল, খুব ভালো কাজ।’

‘যাক আসল ছবি, যাক ভালো কাজ।’ মীনা হঠাৎ গলা চড়িয়ে দেহটা টানটান করে বলল, ‘ধ্বংস হয়ে যাক অতীত তার ভালো আর মন্দ নিয়ে, শোভনেশ সেনগুপ্ত আবার নতুন করে শুরু করবে, আবার সে রংতুলি নিয়ে দাঁড়াবে ক্যানভাসের সামনে।’ মীনার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছে, দেহ ঈষৎ টলে উঠল। ‘আমি ওকে দাঁড় করাব। বুঝলেন, আমি ওকে—’

মীনার চিৎকার শুনে ওর সঙ্গীরা মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে ছিল। তাদের মধ্য থেকে একজন উঠে দ্রুত মীনার কাছে এসে দু—হাতে ওর দু—কাঁধ ধরে বলল, ‘বি কোয়ায়েট মীনা, বি কোয়ায়েট…এবার আমরা যাব, চলো এখন। এটা পাবলিক প্লেস, এখানে ইনডিসেন্ট ব্যবহার করা উচিত নয়।’

লোকটিকে রোহিণী মীনার ফ্ল্যাটে প্রথম দিন দেখেছে। মীনা একে ‘বাচ্চচুদা’ বলে ডেকেছিল। তা ছাড়া টেলিফোনেও মীনা এর কাছেই সাহায্য চেয়েছিল।

‘মিস চ্যাটার্জি, কাগজের লোকজন সর্বত্রই আছে। ব্যাড পাবলিসিটি পেয়ে গেলে আপনার ক্ষতিই হবে।’ কথাগুলোকে বলে রোহিণী যা আশা করেছিল, তাই হতে দেখল। মীনার চোখমুখ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে এল, বাচ্চচুদার হাতদুটো কাঁধ থেকে নামিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘এক্সকিউজ মী, একটু উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম, হবার মতোই একটা ঘটনা, নয় কী?’

‘অবশ্যই’, রোহিণী ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘শোভনকাকাকে কলঙ্কমুক্ত করলেন, ভবিষ্যতে মানুষ আর তার খারাপ ছবিগুলো দেখতে পাবে না, এটা তো উত্তেজিত হবার মতোই ব্যাপার। এবার আপনি নিজের টেবিলে গিয়ে বসুন।’

রোহিণী তাকে ব্যঙ্গ করল কিনা, সেটা মীনা ঠাওর করার চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘আপনি কি খুব কষ্ট পেলেন?’

‘মোটেই না। কেননা আমিও আমার অতীত ধ্বংস করার জন্য উদগ্রীব, তাই শোভনেশ সেনগুপ্ত নামটাও আর শুনতে চাই না। মনে আছে, কী উপদেশ আমায় দিয়ে ছিলেন? সেটাই এবার পালন করব। সামনে যে লোকটি বসে, উনিই আমার ভবিষ্যৎ স্বামী,’ রোহিণী উঠে দাঁড়াল। মীনা হতভম্বের মতো তার মুখের দিকে তাকিয়ে। ‘রাজেন ওঠো, এখানে আর আমার ভালো লাগছে না, অন্য কোথাও খেয়ে নেব।’

ঝোলাটা কাঁধে তুলে নিয়ে রোহিণী কারোর মুখের দিকে না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রাজেন লাফিয়ে উঠে তার পিছু নিল।

হোটেলের গেট থেকে গাড়ি বেরোতেই রোহিণীর চোখে পড়ল, কুড়ি—পঁচিশ গজ দূরে জলপাই রঙের মারুতি। চণ্ডীদাস ঘোষাল অপেক্ষা করছে। কোনো লাভ নেই অপেক্ষা করে, গঙ্গাপ্রসাদ ব্যানার্জি আর আসবে না। এই কথাগুলো ওকে বলে দেবে কিনা, রোহিণী তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই গাড়ি অনেক দূরে চলে গেল। থাকগে, দাঁড়িয়ে আছে তো থাকুক। অনেক কিছুই তো জীবনে না—বলা থেকে যায়। বাড়িতে অত যত্নে শ্রদ্ধায় টাঙানো ছবিটা যে জাল, সে কথা তো চণ্ডীদাসকে বলা যায়নি। আসল ভেবে যদি পুজো করে তৃপ্ত হয়, তাহলে দরকার কী ভুলটা ভাঙিয়ে। এতে কারোরই তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না!

‘কী ভাবছ?’ রাজেন জানতে চাইল।

‘মনটা কীরকম হয়ে গেল। ছবিগুলোর জন্য তো বটেই, মীনা চ্যাটার্জির মানসিক অবস্থার কথা ভেবেও। প্যাথেটিক।’

‘আসলে হালভাঙা, পাল ছেঁড়া জীবনের এই অবস্থাই হয়। যখন যেরকম আবেগের ধাক্কা, পরিস্থিতির ধাক্কা লাগে, ওরা তখন সেইদিকেই ভেসে যায়। জীবন আর জগৎ সম্পর্কে একটা ধারণা, একটা দৃষ্টিভঙ্গি—অর্থাৎ কী চাই, কী করণীয়, করার জন্য একাগ্রভাবে লেগে থাক অচঞ্চল অটলভাবে ঝড়ঝাপটার বিরুদ্ধে সাহস নিয়ে দাঁড়ানো…এসবের জন্য চাই চরিত্র, সেটাই ওই মীনার মতো লোকদের নেই। তাই অত রোমান্টিক হয়, আজেবাজে কথা বলে, আচরণ করে।’ কথা বলতে বলতে রাজেন আড়চোখে দেখল, রোহিণী ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে টেপের ক্যাসেট বার করল, হাতটা তুলেছে সেটা জানলা দিয়ে ছুড়ে ফেলার জন্য। রাজেন সিলি পয়েন্টে ক্যাচ ধরার মতো বিদ্যুৎগতিতে বাঁ হাত বাড়িয়ে রোহিণীর হাত থেকে ক্যাসেটটা ছিনিয়ে নিল।

‘পাগল হয়েছ! কেউ কুড়িয়ে পেয়ে ওটা যদি বাজিয়ে শোনে, তাহলে?’

‘আমি আর ওটা রাখতে চাই না, ওটাও ধ্বংস হোক।’

‘ওতে আছে পরমেশের কনফেসন। পাগলের প্রলাপ বলে কোর্টে হয়তো উড়িয়ে দেওয়া যাবে, কিন্তু গীতার কথা সত্যি বলে ধরে নিলে শোভনেশ সেনগুপ্ত খুনি নন।’

‘তোমাকে আবার বলছি রাজেন, এসব নিয়ে আর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না। কে খুনি আর কে নয়, তাতে আমার আর কোনো কৌতূহল নেই। আমি ভুলে যেতে চাই, ভুলে যেতে চাই, ভুলে যেতে চাই।’ রোহিণী প্রায় মীনা চ্যাটার্জির মতোই চিৎকার করে দু—হাতের তালুতে মুখ ঢাকল।

সারা পথে একবার ছাড়া তার আর কথা বলেনি। পথে মিষ্টির দোকান দেখে রাজেন বলেছিল, ‘কিছু কী কিনব?’

‘খিদে নেই।’

সল্টলেকে ফ্ল্যাট বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নামার সময় রাজেন হালকা চালে বলল, ‘মীনা চ্যাটার্জি তখন চিৎকার করে বলল, ‘আমি ওকে দাঁড় করাব।’ কিন্তু যাকে দাঁড় করিয়ে ছবি আঁকাবে, সেই লোকটির তো পাত্তা নেই।’

‘গঙ্গাদার ওপর প্রতিশোধ নেবার আনন্দে বোধ হয় ওর এটা মনে ছিল না।’

‘তুমি ওপরে যাও, আমি আর একবার জহিরুলের কাছে ঘুরে আসি, ফ্ল্যাটের ব্যাপারটা আর একদিনও দেরি করা ঠিক হবে না। যা টাকা চাইছে, তাতেই রাজি হয়ে যাই।’

‘আজ থাক, বড়ো ক্লান্ত অবসন্ন লাগছে। বরং কাল যেয়ো। এখন একা থাকলে আমিই বোধ হয় পাগল হয়ে যাব।’

তিন তলায় উঠে এসে চাবি দিয়ে দরজা খুলে তারা ভিতরে ঢুকল। পাল্লাটা বন্ধ করার সময় রোহিণী বাইরের দিকে তাকিয়েই দেখল, চারতলার সিঁড়িতে সুজাতা গুপ্ত দাঁড়িয়ে। বিস্রস্ত মলিন সাদা শাড়ি, চুল বাঁধা নেই, মুখ শুকনো, চোখ বসা। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি, যার অর্থ বোঝা অসম্ভব।

‘মাসিমা! কখন এলেন?’ রোহিণী প্রাথমিক চমক কাটিয়ে, পাল্লাটায় হাত রেখে স্বস্তিভরে বলল।

হাসিটা মুখে রেখেই সুজাতা ধীর পদক্ষেপে নেমে এলেন।

‘বহরমপুর গেছিলাম। সেখান থেকে তোমার জন্য সুখবর এনেছি।’

রাজেন এসে দাঁড়াল রোহিণীর পাশে। সুজাতা তাকে দেখে বললেন, ‘ইনিই কী তোমার হবু স্বামী?’

‘হ্যাঁ।’

‘সুখে থাকো দুজনে।’ সুজাতার স্বরে শ্রান্তি, চোখ শান্ত।

‘কিন্তু সুখবরটা কী মাসিমা?’ রোহিণী ব্যগ্র হল।

‘শোভনেশ মারা গেছে। তুমি বিধবা হয়েছো।’

কথাটা বলেই সুজাতা ঘুরে সিঁড়িতে উঠতে যাচ্ছেন, তখন রোহিণীর আর্তনাদটা শুনলেন। ঘুরে দাঁড়ালেন।

‘আমি জেল সুপারের সঙ্গে কথা বলেছি। হাসপাতাল থেকে শোভনেশ আর তার সঙ্গে একজন পালিয়ে গেছিল ঠিকই। পালিয়ে গেছিল নসিপুর স্টেশনে, ট্রেনেও ওঠে। তখন ওখানে কম্যুনাল রায়ট চলছে। দাড়ি গোঁফ, লুঙ্গি, এইসবই ওর কাল হল। ট্রেন থেকে নামিয়ে বহু লোককে মারা হয়, তার মধ্যে শোভনেশ আর তার সঙ্গীও ছিল। শোভনেশের লাশ পুলিশ শনাক্ত করেছে। পুড়িয়েও দিয়েছে।’

সুজাতা গুপ্ত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন দেওয়াল ধরে ধরে। সিঁড়ি ঘোরার সময়ে আর একবার মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। রাজেনের বুকে মুখ চেপে রোহিণী তখন ফোঁপাচ্ছে। রাজেনের বাহু পিঠে বেড় দিয়ে শক্ত করে ধরে আছে ওর কাঁধ।

সুজাতা গুপ্ত দেখে শুধু মাথা নাড়লেন।

রাজেন দু—হাতে জড়িয়ে রোহিণীকে এনে ডাইনিংয়ের চেয়ারে বসাল। এখন কথা বলার সময় নয়। রোহিণী শুধু শূন্য দৃষ্টিতে রাজেনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রাজেন জানে, এই শূন্যতা প্রকৃতির নিয়মের মতোই বেশিক্ষণ থাকবে না? সে চায়ের জল চড়াতে গেল রান্নাঘরে।

বিজলিবালার মুক্তি

এক

দুদিন ধরে কখনো টিপটিপ কখনো ঝমঝম বৃষ্টি পড়ে চলেছে। উত্তর কলকাতার হাতিবাগানে চৌধুরিদের রাধাবল্লভ ঠাকুরবাড়িতে রথযাত্রার উৎসব। মাহেশের রথের মতো নয় চূড়া বিশিষ্ট দু—মানুষ উঁচু কাঠের রথ। ফুলে পাতায় ব্যাটারিতে জ্বলা টুনির আলোয় নানারঙের রাংতায় মুড়ে সাজিয়ে রাস্তা দিয়ে টেনে এলাকায় ঘোরানো হয়। রথের সামনে ইউনিফর্ম পরা বালক সংঘের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা কুচকাওয়াজ করে ড্রাম বাঁশি করতাল বাজাতে বাজাতে যায়। তার পিছনে সাইকেলের চাকা লাগানো ছোট্ট টেবিলের একটা ঠেলাগাড়ি তার উপর রাখা হারমোনিয়াম। বাদকের পাশে নানা বয়সি সাত—আটজন গায়ক। ব্যান্ড বাদকরা বাজনা বন্ধ করে দাঁড়ায় যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গায়করা জগন্নাথদেবকে নিয়ে রচিত গান সমবেত কণ্ঠে গেয়ে ওঠে। রথের দু—পাশে চামর হাতে শাড়িপরা দুটি কিশোরী হাঁটতে হাঁটতে যায়। কাঠের তৈরি প্রায় দেড় ফুট লম্বা জগন্নাথ সুভদ্রা বলরাম ত্রিতল রথের দ্বিতলে থাকেন ও চামরের বাতাস খান। প্রায় কুড়ি মিটার লম্বা শোভাযাত্রার সঙ্গে থাকে কার্বাইড গ্যাসের বাতি মাথায় চারটি মুটে।

উত্তর কলকাতায় চৌধুরিদের ঠাকুরবাড়ির রথযাত্রা চল্লিশ—পঞ্চাশ বছর আগে আরও জমকালো ছিল। বিজলিবালা হুগলি জেলার ভেনিয়াপুর গ্রাম থেকে তেতাল্লিশ বছর আগে যখন প্রথম জয় দত্ত স্ট্রিটের শ্বশুরবাড়িতে আসেন তখন থেকেই শাশুড়ির সঙ্গে দেখতে যেতেন চৌধুরিদের রথযাত্রা উৎসব। সবার সঙ্গে রথের রশি ধরে প্রথম টান দিতেন। বছরের পর বছর এটা করে তাঁর অভ্যাস বা নিয়মে পরিণত হয়ে যায়। শাশুড়ি মারা যাবার পর স্বামী কৃষ্ণকিশোর তাকে সঙ্গে নিয়ে রশি টানতে যেতেন; স্বামী মারা যাবার পর তিনি একাই যেতেন। গত সাত বছর হল সঙ্গে থাকছে পদ্মমণি।

বিকেলে হঠাৎ টিপটিপানি বৃষ্টিটা ঝমঝমিয়ে উঠতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিজলি বললেন, ‘পদ্ম এবার আর বোধহয় রথ টানতে যাওয়া হল না।’

‘কেন হবে না মাসিমা। এখুনি বৃষ্টি ধরে যাবে, কাল থেকে এই রকমই তো চলছে।’ পদ্ম কথা বলতে বলতে বারান্দায় দড়িতে ঝোলানো কাপড় হাত দিয়ে টিপে বলল, ‘কাল থেকে মেলা এখনও ভিজে রয়েছে। মাসিমা রথের দিনে পাঁপড় তেলেভাজা এবার খাবে না? সব বছরই তো খাও।’

‘ওই যাঃ, একদম ভুলে গেছি। ঘরে তো পাঁপড় নেই, তুই ছাতাটা নিয়ে সাধুখাঁর দোকান থেকে সন্ধেবেলাতেই কিনে আনবি। রথের দিনে পাঁপড় খাওয়ার ইচ্ছেটা ছোটোবেলায় বাবার সঙ্গে মাহেশের রথ দেখতে গিয়ে মনের মধ্যে সেই যে ঢুকে গেল তারপর এই পঞ্চাশ বছরে দু—তিনবার ছাড়া সব বছরই মেনেছি।’

পদ্ম অবাক হয়ে বলল, ‘পঞ্চাশ বছর ধরে!’

‘বললুম তো দু—তিন বছর বাদ দিয়ে। শ্বশুর মারা গেলেন রথযাত্রার আগের দিন। অশৌচ, তখন কি পাঁপড় ভেজে খাওয়া যায়? আর একবার শাশুড়ির অম্বলশূলের ব্যথা উঠল। ছটফটাচ্ছেন, উনি ডাক্তার আনলেন। তিনি দেখেটেখে ওষুধ দিয়ে বললেন, ‘অপারেশন না করালে আবার হবে। বেলগেছের কারমাইকেল কলেজে ভরতি করাল ওর ছেলে। ডাক্তার পঞ্চানন বাঁড়ুজ্জে, মস্ত বড়ো ডাক্তার, অপারেশন করলেন। আর সেইদিনই রথযাত্রা, তখন তো আমি হাসপাতালে শাশুড়ির বেডের পাশে। আর একবার কেন যে পাঁপড় খাওয়া হল না এখন আর মনে পড়ছে না।’

‘মাসিমা তুমি মাহেশের রথ দেখেছ? আমাকে একবার তোমার জামাই বলেছিল নিয়ে গিয়ে দেখাবে। বলেছিল লক্ষ লক্ষ লোক হয় আর রাস্তার দু—ধারে দোকান বসে। রথটাও পেল্লায় উঁচু। ইয়া মোটা লম্বা রশি। সবাই হুড়োহুড়ি করে রশি একবার ধরে টানার জন্য। টানলে নাকি মরার পর স্বগ্গে যায়, সত্যি?’

বিজলি ঘাড় কাত করে বললেন, ‘সত্যি। এখনকার ছেলেমেয়েরা তো এসব বিশ্বাসই করে না। আমি যেবার যাই সেবার একটা বুড়ি রথের চাকার নীচে পড়ে যায় ঠেলাঠেলির চোটে। ইয়া চারতলা বাড়ির মতো লোহার রথ তেমনি ভারী একশো বছরেরও আগে সাহেব কোম্পানির তৈরি; বড়ো বড়ো বারোটা লোহার চাকা; দুটো তামার তৈরি ঘোড়া একটার রং নীল অন্যটার সাদা; দুটো কাঠের রাজহাঁস, রথের সারথি মানুষের মাপের কাঠের তৈরি। আর রশিটা এখান থেকে শেতলের মিষ্টির দোকান পর্যন্ত, দু—হাতের মুঠোর মধ্যে আমি ধরতে পারিনি এত মোটা!’

পদ্ম বলল, ‘বুড়িটার কী হল মাসিমা?’

‘যা হবার তাই হল, তক্ষুনি মরে গেল। সবাই বলল, ‘ভাগ্যবতী, জগন্নাথদেব ওকে নিজের কাছে টেনে নিলেন’, শুনে আমার মনের ভেতরে তখন কীরকম যেন একটা হল।’

উৎসুক স্বরে পদ্ম বলল, ‘রথের চাকার নীচে পড়ে তোমার মরার ইচ্ছে হল? আচ্ছা মাসিমা চৌধুরিদের রথের চাকার নীচে পড়ে গিয়ে মরলে মানুষ স্বগ্গে যাবে?’

শুনেই ভ্রু কুঁচকে উঠল বিজলির। চোখ সরু করে বললেন, ‘কেন তোর কি মরার ইচ্ছে হয়েছে? জামাইয়ের খবরটবর রাখিস?’

‘শুনেছি আর একটা মেয়ে হয়েছে।’

‘তা হলে তো ভালোই আছে। তোকে কে বলল মেয়ে হয়েছে?’

‘আরতির বর শ্যামল শালকেতে তুলোর দোকানে কাজ করে, মাঝেমধ্যে ওর সঙ্গে দেখা হয়। ওই বলেছে এবারও মেয়ে হল! শ্যামলের কাছ থেকে শুনে আরতি আমায় বলেছে। থাকগে মাসিমা ওসব কথা বাদ দিন, যার যা কপালে লেখা আছে তাই হবে।’ পদ্ম বারান্দার বাইরে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘বৃষ্টি ধরেছে, চলো বেরিয়ে পড়ি। ফেরার সময় পাঁপড় কিনে নোবখন।’

দোতলার ঘরে আর সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়ে, দু—জনে একতলায় নামল। সিঁড়ির ডান দিকে টানা রক, সামনে ছোটো উঠোন। উঠোন পেরিয়ে সদর দরজা। রকের পাশে দুটো ঘর, শয়নের এবং রান্নার। ঘর ভাড়া নিয়ে আছে স্বামী স্ত্রী ও একবছরের একটি ছেলে। জ্যোতির্ময় হাবড়ায় একটি স্কুলের শিক্ষক, একহারা চেহারা, সুদর্শন যুবক, ঠান্ডা স্বভাব, কথাবার্তায় নম্র। হাসি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, স্বামীর বিপরীত স্বভাবের, দ্রুত কথা বলে, সর্বদাই হাসিখুশি, দেহের গড়ন কিঞ্চিৎ ভারী, দৈর্ঘ্যে সাধারণ বাঙালি মেয়ের থেকে খাটো। ভুটুর মুখখানি ও গায়ের রং মায়ের মতোই। স্বাস্থ্যবান শিশু। তার রান্না কালেভদ্রে শোনা যায়। হাসি চাকরি করে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে এক ট্রান্সপোর্ট এজেন্টের অফিসে।

একতলায় নেমে বিজলি বললেন, ‘দেখো তো পদ্ম হাসি ঘরের দরজায় ঠিকমতো তালাটা দিয়েছে কিনা, যা তড়বড়ে মেয়ে!’

পদ্ম দুটো ঘরের তালা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, ‘দিয়েছে। কোথায় গেছে হাসিদি? তোমায় বলে গেছে?’

‘বলেছিল তো ডাক্তারের কাছে যাবে। বুকের এইখানে কী একটা অনেকদিন ধরে খচখচ করছে।’ বিজলি ডান দিকের স্তনে হাত দিলেন। ‘ভুটুকে সঙ্গে নিয়েই গেছে অপিস থেকে ফিরে।’

‘ছেলেটা বেশ নাদুসনুদুস, কল্পনা বলছিল বেশিক্ষণ কোলে রাখতে কষ্ট হয়।’

‘ষাট ষাট, বচ্ছরকার এমন দিনে তুই ওর শরীরে নজর দিলি, বালাই ষাট। নে চল।’ বিজলির বিরক্ত স্বরে পদ্ম কুঁচকে গেল।

‘আমি আবার নজর দিলুম কোথায়! ভালো কথা বললে যে নজর দেওয়া হয় আমি জানতুম না বাপু।’

সদর দরজার ভিতরের কড়ায় তালা ঝুলছে। সেটা চাবি দিয়ে খুলে দু—জনে বাইরে বেরিয়ে এল। দরজার বাইরের কড়ায় তালা লাগাতে লাগাতে পদ্ম বলল, ‘চাবি হাসিদির না দাদার কাছে রয়েছে?’

‘হাসির কাছেই তো থাকে, অপিস থেকে তো আগে ফেরে। জ্যোতির তো ফিরতে ফিরতে রাত সাতটা—আটটা হয়ে যায়। হাবড়া কি কম দূর? তার ওপর বনগাঁ লাইন, ট্রেনের গন্ডগোল তো লেগেই আছে। ছাতাটা খোল।’

জয় দত্ত স্ট্রিট খুব সরু গলি নয়। মুখোমুখি হলে দুটি রিকশা পাশ কাটিয়ে যেতে পারে। ওরা দু—জন একটা বাঁক ঘুরে চওড়া রাস্তা হরি মিত্র লেনে পৌঁছেই থমকে দাঁড়াল। কর্পোরেশনের মিস্ত্রিরা রাস্তা খুঁড়ে জলের পাইপ সারিয়ে ইট আর মাটি দিয়ে গর্ত বুজিয়েছে। জায়গাটা হয়ে আছে কচ্ছপের পিঠের মতো। বৃষ্টির ফলে মাটি পিচ্ছিল, একটা—দুটো ইটের মাথা মাটির উপরে উঠে রয়েছে। ঢিপিটার পাশের দেওয়ালে রাস্তার টিউব লাইটের, টিউবটা আছে আলো নেই। দূর থেকে রাস্তার আলো আবছা হয়ে পড়ে ঢিপিটা চকচক করছে।

‘পদ্ম সাবধান। ওই ধার দিয়ে ঘুরে চল। ঢিপির ওপর উঠেছিস কি হড়কেছিস।’

ছাতা হাতে নিয়ে বিজলি পা টিপে টিপে ঢিপির পাশ দিয়ে এগোলেন, পিছনে পদ্ম। এবার হরি মিত্র লেন ধরে দু—জনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ছাতার নীচে থেকে চলল চৌধুরিদের রাধাবল্লভ ঠাকুরবাড়ির উদ্দেশে। জোরে বৃষ্টি নামল সঙ্গে দমকা হাওয়া, জলের ঝাপটা থেকে বাঁচতে পদ্ম ছাতাটা বিজলির হাত থেকে নিয়ে সামনে ঝুঁকিয়ে বলল, ‘মাসিমা এই বৃষ্টিতে রথ চালাবে কী করে? সব তো ভিজে ঢোল হয়ে যাবে।’

‘রথের দিনে বৃষ্টি না হলে রথযাত্রা আবার কীসের! ঠিক বেরোবে রথ।’

ট্রাম রাস্তায় পৌঁছে ফুটপাথ দিয়ে মিনিট পাঁচেক হেঁটে ওরা ঠাকুরবাড়ির লোহার ফটকে পৌঁছোল। ভিতরের ছোটো উঠোনে রথ অপেক্ষা করছে। বিজলি প্রথমে হাত জোড় করে রথকে প্রণাম জানিয়ে খুচরো রেজগি ও নোট রাখার চামড়ার ছোটো মানিব্যাগটা পদ্মর হাতে দিয়ে চটি খুলে মন্দিরের সিঁড়ি দিয়ে উঠলেন। রাধা কৃষ্ণ যুগ্ম বিগ্রহের সামনে দাঁড়িয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন। মিনিট দুই পর প্রণাম করলেন গড় হয়ে।

ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যেই, রথের রশিতে টান পড়ল। ছাতা বন্ধ করে পদ্ম দাঁড়াল বিজলির পাশে রশি ধরার জন্য। বৃষ্টির জন্যই এবার লোকজন কম। অন্যান্য বার ঠেলাঠেলি হয় রথ টানার জন্য। উঠোন থেকে ফুটপাত সমতল। বিজলি রশি ধরলেন পদ্মও ধরল।

‘তুই চাকার দিকে কেন, আমার বাঁদিকে আয়।’ বিজলির স্বরে সন্দিগ্ধ ধমক। চৌধুরিদের রথের নীচে পড়ে পদ্মর স্বগ্গে যাওয়া যায় কিনা প্রশ্নটা এখন মনে পড়ায় তাঁর এই ধমক। তিনি রথের চাকার দিকে তাকালেন। মাহেশের মতো অত বড়ো নয়। এ চাকার নীচে পড়লে পদ্মর মতো বছর তিরিশের মেয়ে মরবে না, বড়োজোর হাত—পা ভাঙবে। তাঁর মতো বুড়িটুড়ি হলে আলাদা কথা। বিজলি মোটামুটি আশ্বস্ত হলেও পদ্মর বুদ্ধিশুদ্ধিতে বিশেষ আস্থা নেই। বিয়ের ছ—মাস কাটতে—না—কাটতেই স্বামীর ঘর ছেড়ে তাকে উড়েপাড়ার বস্তিতে তার মা মকরবালার কাছে ফিরে আসতে হয়। ‘রোজ মদ খেয়ে এসে গোরু পেটানোর মতো কী পেটান যে পেটায় না!’ বলেছিল পদ্ম।

ওর শীর্ণ শরীরে মারের দাগ দেখে বিজলি মনে মনে আহত হয়েছিলেন। তখুনি বলেছিলেন, ‘মাকে বল আমার কাজ ছেড়ে দিতে, বুড়ি হয়েছে এবার ঘরে বসে থাকুক। তুই থাকবি আমার কাছে, আর তোকে স্বামীর ঘর করতে হবে না। মকর এত কষ্ট করে হাড়মাস কালি করে টাকা জমিয়ে শেষে এমন একটা পশুর সঙ্গে কিনা মেয়ের বিয়ে দিল! ছি ছি ছি, ভালো করে আগে একটু খোঁজখবরও নিল না! ব্লাউজটা পরে নে।’ মারের দাগ দেখাবার জন্য পদ্ম ব্লাউজ খুলে ছিল। টেপা বোতাম লাগাতে লাগাতে পদ্ম হঠাৎ হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে, ‘মাসিমা আমি কালো কুচ্ছিত রোগা, ওকে আমি খুশি করতে পারি না, আমার পাছা নেই বুক নেই। আমার কী দোষ মাসিমা?’ পদ্ম জানতে চেয়েছিল।

বিজলি ওর মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলেন। পদ্মর নাকের মাঝখানটা কেউ যেন নোড়া দিয়ে থেঁতলে বসিয়ে দিয়েছে। সেজন্য ওর ডাকনাম বুঁচি। বিজলি ওকে নাকের কথা মনে না করানোর জন্য প্রথম থেকেই ডাকেন ভালো নামে। কপাল নেই, ভুরুর একটু ওপর থেকে শুরু হয়েছে ঘন কোঁকড়া চুল। বড়ো গোল চোখের মণি কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। বিজলি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন পদ্ম কুরূপা।

‘মেয়েমানুষের বিচার হয় কি শুধু বাইরের রূপ যৌবন দিয়ে রে পদ্ম। গুণ বলে একটা জিনিস আছে। দয়া মায়া মমতা স্নেহ যার নেই রূপসি হয়েও সে সুন্দরী নয়। অন্তর সুন্দর না হলে সৌন্দর্য ফোটে না। তুই কষ্ট পাচ্ছিস কেন রে, অন্তরের মধ্যে তোর গুণের পদ্ম ফুটিয়ে তোল, দেখবি সবাই তোকে ভালোবাসবে। তাতেই তুই রূপসি হবি।’ পদ্মর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে স্নেহ মাখিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন বিজলি সাত বছর আগে। পরের মাস থেকেই পদ্ম দিনরাতের সঙ্গিনী হয়ে আছে বিজলির।

নামেই রথের রশি টানা। ওরা দু—জন ধরে একটু টান দিল মাত্র। আসলে টানল জনা পনেরো ছেলেবুড়ো। গড়গড়িয়ে রথ উঠোন থেকে ফুটপাতে। কাঠের পাটা পাতা ছিল তার উপর দিয়ে ফুটপাত থেকে ট্রাম রাস্তায় রথ নেমে গেল। বৃষ্টির মধ্যেই বালক সংঘের ব্যান্ড পার্টি বাজাতে শুরু করল। প্রতি বছরের মতোই হারমোনিয়াম, গ্যাসবাতি, টুনিবালব, চামর হাতে দুটি মেয়ে সঙ্গে নিয়ে শুরু হল জগন্নাথদেবের যাত্রা। বিজলি হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলেন। মিনিট তিনেক পর রথটি ডানদিকের রাস্তায় ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

‘পদ্ম একটা রিকশা ডাক আর হেঁটে যেতে পারব না, যা কাদা আর গর্ত!’

মন্দিরের ধারেই হুড আর পরদা ফেলে একটি রিকশায় উবু হয়ে বসে রিকশাওয়ালা। পদ্ম গিয়ে তার সঙ্গে হাত নেড়ে নেড়ে গন্তব্যস্থল বুঝিয়ে ফিরে এল বিজলির কাছে। ‘মাসিমা, বলল পনেরো টাকা নেবে।’

‘য়্যা, দু—মিনিটের রাস্তা পনেরো টাকা! বলিস কী?’

‘বিষ্টি পড়লে এই রেট, কী মেজাজ!’

‘চল তাই দোব, তবে বাড়ির দোরগোড়া পর্যন্ত পৌঁছে দিতে হবে কিন্তু।’

রিকশায় উঠে বিজলি ফিসফিস করে বললেন, ‘পদ্ম এতো হাড় জিরজিরে বুড়ো, টানতে পারবে তো?’

‘খুব পারবে, দ্যাখো না।’

মাথায় গামছা জড়ানো রবারের পাম্পশু পরা শীর্ণদেহী রিকশাওয়ালা প্রথমে লম্বা পায়ে তারপর জগিং করার মতো ছুটতে শুরু করল। বিজলি বললেন, ‘আগে রিকশাওয়ালা খালি পায়ে থাকত। গরমে পিচের রাস্তায় পা রাখা যায় না তখনও দেখেছি খালি পায়ে ওরা রিকশা টানত। ভালোই হয়েছে জুতো পরছে, কী বল?’

‘জুতো, হাওয়াই চটি পরছে বলেই তো ভাড়া বাড়িয়েছে।’ পদ্ম বিজ্ঞের মতো বলল।

‘যা বলেছিস। বিয়ের পর প্রথম সিনেমা গেলুম হাতিবাগানে, উত্তম—সুচিত্রার তখনও এত নাম হয়নি, মনে আছে বইটার নাম সাড়ে চুয়াত্তর, তোর মেসোমশাইয়ের সঙ্গে নাইট শো—এ গেছলুম। ফেরার সময় উনি বললেন চলো রিকশা করে যাই। কত ভাড়া নিল জানিস? বারো আনা!’

বিজলি অবাক চোখে পদ্মর দিকে তাকালেন, ‘ভাবতে পারিস?’

‘কী জানি আমি তো তখন জন্মাইনি।’

রিকশা হরি মিত্র লেন ধরে জয় দত্ত স্ট্রিটের কাছাকাছি হতেই পদ্ম ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘বাঁয়ে গলিমে ঢুকেগা।’ তারপর স্বগতোক্তি করল, ‘রাস্তার আলোটা এত কম, গলিটা চেনা যায় না।’

‘বৃষ্টি পড়লে রাস্তার আলো কম কম লাগে।’ বিজলির কথা শেষ হওয়ামাত্রই ঘটে গেল ব্যাপারটা।

রিকশার চাকা ঢিপিতে ঘটাং শব্দ করে ধাক্কা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রিকশাওয়ালার পা কর্দমাক্ত মাটিতে হড়কে গেল। সে মুখ থুবড়ে পড়ার সময় তার মুঠো থেকে টানার হাতল দুটি ছিটকে বেরিয়ে যাওয়ামাত্র রিকশাটা দুই সওয়ারির ভারে পিছন দিকে উলটে গিয়ে উলটানো ‘৯’কার বা ‘ৎ’—এর মতো হয়ে গেল। বিজলি ও পদ্ম বলাবাহুল্য উলটানো রিকশার তলায় চাপা পড়ে গেল।

‘বাবারে।’ বলে পদ্ম প্রথমেই আর্তনাদ করে উঠে চিৎকার করল ‘বাঁচাও বাঁচাও, মরে গেলুম।’

তালগোল পাকিয়ে পড়েছেন বিজলি, তার উপরে পদ্ম। তার চিৎকার শুনে পাশের দুটি বাড়ি থেকে কয়েকজন বেরিয়ে এল। পাড়ার নেতাজি তরুণদলের ঘরে কয়েকটি তরুণ ক্যারাম খেলছিল, তারা ছুটে এল চিৎকার শুনে। শীর্ণকায় রিকশাওয়ালা ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়ে দুটি হাতল ধরে রিকশাটাকে সোজা করে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে চলেছে। কাজটা করে দিল দুটি তরুণ হাতল দুটি ধরে টেনে নামিয়ে।

মাটির উপর জড়াজড়ি করে পড়েছিল ওরা দু—জন। পদ্ম নিজেই উঠে দাঁড়াল, তার ডান ভ্রুর উপরে কপাল থেকে রক্ত ঝরছে। বিজলি ওঠার চেষ্টা করে পারলেন না। তাঁর কাপড় হাঁটুর উপরে উঠে রয়েছে। পদ্ম দ্রুত নামিয়ে দিল কাপড়।

‘মাসিমা হাত ধরুন।’ বিজলির বাড়ানো হাত ধরে পদ্ম টেনে তোলার চেষ্টা করে পারল না। সে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের দিকে তাকাল।

‘সরো সরো, ঘণ্টু আয় তো দিদিমাকে তোল।’ পদ্মকে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে এল একটি যুবক, মাঝারি উচ্চচতা, বলিষ্ঠ গড়ন, তরুণদলের সচিব।

‘কে রে পলাশ! এই ডান পাটা বোধহয়—।’ বিজলি কথা শেষ করার আগেই দু—জন তাঁর বগল ধরে দাঁড় করাল। দাঁড়াতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। পলাশ তাঁকে পাঁজাকোলা করে তুলে পাশের রোয়াকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল। ইতিমধ্যে জমে গেছে ভিড়।

রিকশাওয়ালা তখন দুটো থাপ্পড় খেয়ে হাত জোড় করে বোঝাচ্ছে, ‘আমার কী কসুর আছে বাবু। এই দেখুন জমিনের হাল আউর আলো ভি কমতি আছে। আমি তো দেখতেই পাইনি, দেখলে কি রিকশা এর উপর চড়হাতাম?’

‘ঠিকই তো বলেছে।’ লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে চেঁচিয়ে বললেন এক মধ্যবয়সি ‘আলো তো মাসখানেক ধরে নেই। এই ঢিপিটা তো এক হপ্তা ধরে এমন হয়ে রয়েছে! রাস্তা খুঁড়ে সমান করে পিচ দেওয়ার দায়িত্ব তো কর্পোরেশনের। এসব দেখাশোনার দায় তো কাউন্সিলরের। তিনি যদি দায়িত্ব পালন না করেন তা হলে তো অ্যাকসিডেন্ট হবেই। পাড়ায় ঘুরে ঘুরে হাত জোড় করে ভোট চাইবেন, এই করে দোব তাই করে দোব বলবেন, যেই জিতলেন আর তার টিকিটি দেখা গেল না।’

‘চল পলাশ, শক্তি মুখুজ্জেকে ধরে এনে দেখাই। এইখানে দাঁড়িয়ে ওকে কথা দিতে হবে তিন দিনের মধ্যে রাস্তা আলো ঠিকঠাক করে দেবে—না দিলে রাস্তা অবরোধ হবে।’ বলল ট্রাউজার্স—হাওয়াই শার্ট পরা সিদ্ধার্থ ওরফে ঘণ্টু।

‘আমাদের বস্তির টিউবকলটাও ওইসঙ্গে ঠিক করে দিতে বোলো।’ ভিড়ের মধ্যে এক স্ত্রীকণ্ঠে শোনা গেল।

‘অবরোধ টবরোধ পরে হবে ঘণ্টু’ পলাশের গলা ভারী কর্তৃত্বব্যঞ্জক। ‘আগে দিদিমাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে চল, মনে হচ্ছে সিরিয়াস কিছু হয়েছে।’

রিকশাওয়ালা বুঝে গেছে এই দুর্ঘটনার পর ভাড়া চাওয়া উচিত হবে না। পনেরোটা টাকা মারা যাওয়ার দুঃখ চেপে সে রিকশা নিয়ে চলে যাচ্ছিল।

‘অ্যাই রিকশা যাতা কাঁহা? মাইজিকো তুলো। ডাক্তারখানামে লে চলো।’ পলাশ ধমকে উঠল। ‘অ্যাকসিডেন্ট তুম কিয়া অব ভাগ রাহে হ্যায়?’

রিকশাওয়ালা তটস্থ হয়ে ফিরে এল। বিজলি উঠে দাঁড়াতে পারল না। পদ্ম রিকশায় উঠে বসল। পলাশ আর ঘণ্টু ধরাধরি করে বিজলিকে রিকশায় তুলে বসিয়ে দিতে পদ্ম তাঁকে ধরে রাখল।

‘পদ্ম তোর মুখ তো রক্তে ভেসে যাচ্ছে রে, অ ঘণ্টু তোমার রুমাল টুমাল থাকে তো দাও না।’ রিকশার পাশে পাশে হাঁটছে চারটি ছেলে। বিজলির কথা শুনে একটি ছেলে খয়েরি রঙের একটা রুমাল দিল পদ্মর হাতে।

হরি মিত্র লেন যেখানে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে পড়েছে তার বাঁদিকের বাড়িতে সাধুখাঁর মুদির দোকান, শীতলার মিষ্টির দোকান আর সূর্য মেডিক্যাল হল, বড়ো ওষুধের দোকান। এখানে দু—বেলা চার জন ডাক্তার বসে পালা করে। ডানদিকে কাউন্টার ও কাচের শোকেস, বাঁদিকে প্লাইউডের দেওয়ালে ভাগ করা দুটো চেম্বার পরদা, ঝোলানো দরজা। চেম্বারের সামনে বেঞ্চে বসে জনা সাতেক চিকিৎসাপ্রার্থী নারী ও শিশু। তাদের সঙ্গের লোকেরা ফুটপাথে দাঁড়িয়ে।

প্রায় চ্যাংদোলা করে বিজলিকে নিয়ে এল তিনটি ছেলে।

‘উঠুন উঠুন দিদিমাকে বসতে দিন।’ পলাশ বলামাত্র দু—জন স্ত্রীলোক তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। ওরা বেঞ্চে বসিয়ে দিল বিজলিকে। পরদা সরিয়ে ডানদিকের চেম্বারে ঢুকল পলাশ।

‘ডাক্তারবাবু রিকশা উলটে পড়ে গেছে দিদিমা। বোধহয় পা ভেঙেছে, বাইরে বসিয়েছি, আপনি এসে একটু দেখুন।’

অল্পবয়সি সুদর্শন ডাক্তারের সামনে বসে দু—জন স্ত্রীলোক, কোলে বাচ্চচা। পলাশকে দেখে ডাক্তার যেভাবে তাকাল তাতে বোঝা যায় সে পলাশকে চেনে।

‘আপনার দিদিমা?’

‘হ্যাঁ।’

রুগি ফেলে ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উবু হয়ে বসে বিজলির ডান পা আলতো করে হাতে তুলে নিয়ে পরীক্ষা করতে লাগল। পলাশ তখন পদ্মকে দেখিয়ে দোকানের এক কর্মচারীকে বলল, ‘কপালটা পরিষ্কার করে ওষুধ টষুধ যা লাগে লাগিয়ে দিন।’

ডাক্তার জানালেন, ‘হাড় ভেঙেছে, অপারেশন করে জোড়া দিতে হবে, হাসপাতালে নিয়ে যান বা পাশের নার্সিংহোমেও যেতে পারেন। তবে পয়সা খরচের কথা যদি না ভাবেন তা হলে বলব হাসপাতালে না যাওয়াই ভালো।’

‘কী দিদিমা কোথায় যাবেন?’ পলাশ জিজ্ঞাসা করল হালকা সুরে। সন্ত্রস্ত হয়ে বিজলি বললেন, ‘না বাবা হাসপাতালে যাব না, যা সব শুনি! ওই নার্সিংহোমেই আমাকে নিয়ে চলো। বেশ যন্ত্রণা হচ্ছে।’

ডাক্তার যন্ত্রণার জন্য ট্যাবলেট লিখে দিল। দোকান থেকেই কিনে নিলেন বিজলি। পায়ে ব্যান্ডেজ করে ডাক্তার ঘড়ি দেখে বলল, ‘তাড়াতাড়ি নিয়ে যান, ওদের এক্সরে ইউনিট সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে।’

টাকার ব্যাগটা তখনও পদ্মর কাছে। ষাট টাকা নিয়ে বেরিয়ে ছিলেন বিজলি। ওষুধ আর ব্যান্ডেজের দাম মিটিয়ে দিয়ে পলাশের কাছে পদ্ম জানতে চাইল, ‘কত টাকা লাগবে দাদা নার্সিংহোমে?’

নিরস্ত করার ভঙ্গিতে হাত তুলে পলাশ বলল, ‘এখন ওসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না, পরে দিলেও চলবে।’ তারপর সে সঙ্গের ছেলেদের বলল, ‘দিদিমাকে নিয়ে তোরা লোটাস নার্সিংহোমের দোতলায় চলে যা। আমি গিয়ে কথাবার্তা বলে রাখছি।’

বিজলি হাতছানি দিয়ে পদ্মকে ডেকে ফিসফিস করে বললেন, ‘ঘরের চাবি তো তোর কাছে। আলমারির চাবি আছে শ্রীধরের সিংহাসনের তলায় বারকোশ ঢাকা খুঞ্চিপোশটার নীচে। সেটা নিয়ে আলমারি খুলে ওপরের তাকে গরম কাপড়ের পেছনে নীল কাপড়ের একটা থলি দেখবি। দু—হাজার টাকা আছে। নার্সিংহোম যেমন যেমন টাকা চাইবে দিয়ে দিবি।’

ওষুধের দোকান থেকে নার্সিংহোম তিরিশ মিটার দূরে। তিনটি ছেলে বিজলিকে বহন করে লোটাসের দোতলায় নিয়ে গেল, সঙ্গে পদ্ম। রিসেপশন কাউন্টারের মেয়েটির সঙ্গে তখন পলাশ কথা বলছিল। বিজলিকে চেয়ারে বসিয়ে রাখল, ‘দিদিমা আপনার ভাগ্যটা সত্যিই খারাপ। দশ মিনিট আগে এলে এক্সরে—টা করা যেত। যে করবে সে চলে গেছে।’

‘তা হলে বাড়ি ফিরে যেতে হবে, আবার কাল আসতে হবে!’ বিজলি হতাশ বিমূঢ় চোখে তাকিয়ে রইলেন।

‘আমিও তাই ভাবলুম, ফিরে যাওয়া আবার আসা? তার থেকে বরং রাতটা এখানেই থেকে যান, ভাঙা পায়ের ধকলটা আর তা হলে নিতে হবে না। সেটাই বললুম দিদিমণিকে। বেড একটা খালি আছে। একটা রাত তো, কোনোরকমে কাটিয়ে দিন, পারবেন না?’

বিজলি একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বললেন, ‘পারব। তোমরা আমার জন্য যা করলে বাবা চিরকাল মনে রাখব। আর তোমাদের কষ্ট দোব না। আর বসে থাকতে পারছি না, একটু শুইয়ে দেবে?’

পলাশ ব্যস্ত হয়ে রিসেপশনিস্টকে বলল, ‘বেডটা কোথায় দেখিয়ে দিন, ওঁকে শুইয়ে দিই।’

ভিতরে একটি বড়ো ঘর। আটটি বেড। ঘরের পাশে দুটি ছোটো ঘর। কেবিন। বেশি টাকা দিয়ে যারা আলাদা থাকতে চায় তাদের জন্য। একটি কেবিন আজ বিকেলেই খালি হয়েছে। বিজলিকে সেখানে খাটে শুইয়ে দিল ছেলেরা।

‘যন্ত্রণা হচ্ছে খুব?’ পলাশ জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ বাবা।’

নার্সকে ডেকে পলাশ বলল, ‘ঘুমের ওষুধ কিছু থাকলে দিন, ঘুমিয়ে থেকে অন্তত রাতটায় রেহাই পান।’ তারপর বিজলিকে বলল, ‘দিদিমা রাতে কিছু খাবেনটাবেন তো নাকি উপোস দেবেন?’

‘উপোসই ভালো, এরকম জায়গায় কিছু মুখে তুলতে পারব না।’

পদ্ম বলল, ‘দুধটা গরম করে এনে দোব মাসিমা, খই আর চিনি দিয়ে?’

‘দরকার নেই, রাতে উপোস দেওয়া আমার অভ্যেস আছে। পদ্ম, যাবার সময় পাঁপড় কিনে নিয়ে যাবি। এদের খাওয়াবি তুইও খাবি। পলাশ তোমরা ক্লাবের ঘরে এখন থাকবে তো, পদ্ম পাঁপড় ভেজে দিয়ে আসবে, রথের দিনে একটু মুখে দিয়ো। পাঁপড় হাসিকেও দিতে ভুলিসনি।’

ওরা কেবিন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, বিজলি ডাকলেন পদ্মকে। ‘অনেকগুলো ছেলে, বেশি করে পাঁপড় কিনিস। পয়সা না কুলোলে আলমারি থেকে টাকা বার করে নিস। আর শোন সত্যর চায়ের দোকানে বলে দিস ছেলেদের যেন চা দিয়ে আসে। হাসিকে বলিস ভুটুর মুখে যেন একটু পাঁপড় দেয়, জগন্নাথের প্রসাদ বলে। চটিজোড়া ভিজে আমসত্ত্ব হয়ে গেছে, বারান্দার একধারে রাখবি। সকালে জলখাবার খেয়ে তবে আসবি, এখন যা।’

দুই

পরের দিন দুপুর গড়াতেই বিজলি বাড়ি ফিরলেন, ডান পায়ের পাতার অর্ধেকটা থেকে গোড়ালি মুড়ে উপর দিকে পায়ের ডিম পর্যন্ত সাদা প্লাস্টারে মোড়া। চারটি ছেলে ধরাধরি করে রিকশায় তুলে পদ্মর পাশে বসিয়ে দেয়। রিকশা জয় দত্ত স্ট্রিটের মুখে আসতেই পদ্ম চেঁচিয়ে হুঁশিয়ারি দেয়, ‘দেখে চালাও বাপু, সব্বোনেশে জায়গা ওই ঢিবিটা।’

কাল রাত থেকেই বৃষ্টি ধরে গেছে। ঘোলাটে মেঘের ফাঁক দিয়ে নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে, রোদও এসে পড়েছে রাস্তায়, বাড়ির দেওয়ালে। বাড়ির দরজায় বিজলিকে রিকশা থেকে নামাল ছেলেরা। কড়া নাড়তে দরজা খুলল কল্পনা, কোলে ভুটু। ছেলেরাই দোতলায় তুলে নিয়ে গিয়ে বিজলিকে খাটে শুইয়ে দিল।

‘হ্যাঁ বাবা, কাল পাঁপড় খেয়েছিলে তো?’

ওরা একসঙ্গে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ দিদিমা। এক ঝুড়ি পাঁপড় দিয়ে গেছিল পদ্ম, তারপর সত্যদা চা পাঠিয়ে দেয়, আমরা এবার চললুম। পলাশদা বলেছে দরকার হলে ক্লাবে খবর দেবেন।’

‘দোব।’ বিজলির মুখে নিশ্চিন্তি। তৃপ্তির সঙ্গে স্নেহের হাসি ফুটে উঠল। তারপরই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘পদ্ম রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দেওয়া হয়নি, দৌড়ে যা।’

দুটো বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বিজলি। মাথার পিছনে পশ্চিমের জানলা, তার পাশে আশি বছরের পুরোনো বার্মা সেগুনের বড়ো আলমারি আর দাঁড়—করানো কাঠের আলনা, তার পাশে আবার জানলা। উত্তরের দেওয়াল ঘেঁষে দু—হাত উঁচু চার হাত লম্বা একটা কাঠের বাক্স। তার উপর পাশাপাশি দুটি স্টিলের তোরঙ্গ। তার পাশের জানলা আকারে অন্য তিনটির থেকে ছোটো। এই জানলার পরেই শ্রীধরের সিংহাসন। পুজোর সরঞ্জাম ও বাসনপত্র একটা জলচৌকিতে এবং তার পাশে পুবের দেওয়াল। এই দেওয়ালের পিছনের ঘরটি রান্নার, যার দরজা বারান্দায়। খাটে বসে বিজলি সোজা তাকিয়ে পুবদিকের দরজা দিয়ে বারান্দার ও—মাথা পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন। দেখলেন ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা নীচের থেকে উঠে এল, তার পিছনে পদ্মর সঙ্গে পাশের বাড়ির একতলার ভাড়াটে বউ অলকা।

‘ছেলেগুলো ছিল তাই, দশ টাকার কম নেবে না বলছিল। ওরা ধমকে বলল পাঁচ টাকা নিবি তো নয়তো রিকশার চাকা ভেঙে দোব। এইটুকু রাস্তা বলে কিনা দশ টাকা! পা ভাঙা লোক বেকায়দায় পড়েছে দেখেছে তো অমনি ভাড়া বাড়িয়ে দিল!’ পদ্মর গজগজানি থামিয়ে দিলেন বিজলি।

‘আমি হলে দশ টাকাই দিতুম। কাল রিকশায় চড়ে বৃষ্টির মধ্যে অতটা এলুম, তাকে কি ভাড়া দিয়েছিস? রিকশা উলটে গেছিল কি ওর দোষে? বেচারা শুধু শুধু মার খেল।’

‘জেঠিমা কালকেই শুনেছি রিকশা উলটে আপনার পা ভেঙেছে, লোটাস নার্সিংহোমে গেছেন। ভাবলাম গিয়ে দেখে আসি। রাত হয়ে গেছে বৃষ্টিও তখন আবার নামল। আর যাওয়া হল না।’ অলকার গলায় যেন কৈফিয়তের সুর। ‘সকালে জানেনই তো আমার স্কুল।’ অলকা দুই সন্তানের মা, হাওড়ার কদমতলায় এক প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। ভোরবেলায় তাকে বাড়ি থেকে বেরোতে হয়।

‘ও পদ্মদি, পদ্মদি ঠাকুমা ফিরে এসেছে?’

পাশের বাড়ি থেকে মেয়ে গলার ডাক শুনে পদ্ম জানলার কাছে গেল। সালোয়ার কামিজ পরা এক কিশোরী বারান্দায় ঝুঁকে রয়েছে। পদ্মকে দেখে বলল, ‘ঠাকুমা ফিরেছে বলল সিধুর মা, পা নাকি দু—টুকরো হয়ে গেছিল, অপারেশন করে জুড়ে দিয়েছে। এখন কেমন আছে?’

‘এখন লাফাচ্ছে।’

‘যাহহ, ঠাট্টা করছ।’

‘ঠাট্টা! রিকশা থেকে নেমে গট গট করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল। তুমি সিধুর মাকে জিজ্ঞেস করে দ্যাখো, ও নিজের চোখে দেখেছে। বিশ্বাস না হয় তো নিজে এসে দেখে যাও।’

বিজলি শুনে হাসছিলেন। দু—হাত বাড়িয়ে দিলেন ভুটুর দিকে, ‘ওকে দে আমার কাছে।’ ভুটুকে কোলে বসিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাল পাঁপড় খেয়েছ তো সোনা?’

‘মাসিমা কেউ খায়নি।’ কল্পনা বলল, ‘ডাক্তার দেখিয়ে ফিরে এসে বউদি তো শুয়ে পড়ল। দাদা ফিরতে দু—জনে কথা বলতে বলতে কীরকম যেন গম্ভীর হয়ে গেল। বউদি বলল কিছুই খাব না দাদাও বলল খিদে নেই পাঁপড়গুলো তুমি খেয়ে নাও। অত পাঁপড় আমি খাব কী করে! বাড়িতে নিয়ে গেলুম।’

বিজলি অবাক হয়ে বললেন, ‘কী এমন হল যে পাঁপড় খেল না?’

‘রাতেও কেউ খায়নি, খাবার যেমন ঢাকা দেওয়া ছিল তেমনই পড়ে ছিল সকালে। গরম করে দিলুম দাদা তাই খেয়ে বেরিয়েছে। বউদি অপিস যায়নি, খায়ওনি।’

‘হাসি কোথায়?’ বিজলি উদবিগ্ন স্বরে বললেন।

‘বিছানায়।’

‘যা ওকে বল আমি ডাকছি।’

কল্পনা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর অলকা ইতস্তত করে বলল, ‘জেঠিমা কী ব্যাপার বলুন তো! ডাক্তার দেখিয়ে এসেই হাসি অমন শুয়ে পড়ল, খেলোদেলোও না! অমন চনমনে উচ্ছল মেয়ে, যার মুখে সর্বদা হাসি লেগেই থাকে সে এমন করল কেন, সিরিয়াস কিছু হয়েছে বোধহয়।’

বিজলির গলার সরু সোনার চেনটা ধরে ভুটু টানাটানি করছে। চেনটা ওর মুঠো থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বিজলি বললেন, ‘আসুক, দেখি কী বলল ডাক্তার।’

হাসির বদলে এল অনুলেখা, পাশের বাড়ির কিশোরী। অলকার বাড়িওয়ালার মেয়ে।

‘ঠাকুমা তুমি নাকি লাফাচ্ছ?’ অনুলেখা আলতো করে আঙুল ছোঁয়াল বিজলির প্লাস্টারে, ‘ব্যথা লাগে?’

‘লাফিয়ে দেখাব তোকে?’

‘না না ওসব করতে যেয়ো না। যখন শুনলুম রিকশা উলটে ডিগবাজি খেয়ে পড়েছ তখন মনে হল ইসস এমন একটা সিন দেখা হল না। আমি বাবা আর জীবনে রিকশায় চড়ব না।’ বলেই অনুলেখা হেসে উঠল।

অলকা গম্ভীর স্বরে বলল, ‘অনু এটা হাসির ব্যাপার নয়। মনে রেখো একজন বুড়োমানুষ দুর্ঘটনায় পড়ে পা ভেঙেছেন আর তুমি বিশ্বাস করতে পারলে কী করে জেঠিমা লাফাচ্ছেন? হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছ কলেজে ভরতি হয়েছ, এখন একটু বুঝে শুনে কথা বলো।’

‘পদ্মদি ঠাট্টা করল তাই আমিও পালটা দিলুম। আর আহা উহু করে চোখের জল ফেললে কি ঠাকুমার পা ভালো হয়ে যাবে না ব্যথা দূর হবে? যদি হয় তা হলে এখুনি এক বালতি চোখের জল বার করে দেব।’ অনুলেখার গলায় ঝাঁঝ ফুটল।

‘হয়েছে হয়েছে, একবার উঠে দাঁড়াই তারপর দেখাব হনুমানের লাফ। আমার ছাদ থেকে অনুদের ছাদে লাফিয়ে পড়ব। তারপর ওকে নিয়ে রিকশায় চড়ে গঙ্গায় চান করতে যাব। যাবি তো?’

‘জেঠিমা কবে প্লাস্টার কাটবে?’ অলকা বলল পরিবেশটা বদলাবার জন্য।

‘বলেছে তো একমাস নড়াচড়া নয়। পায়ে কোনোরকম চাপ পড়ে এমন কিছু করা নয় তার মানে ডান পায়ে ভর দিয়ে কিছু করা চলবে না।’

‘তার মানে ঠাকুমার হাঁটা চলা বন্ধ। শুয়ে শুয়ে এবার কড়িকাঠ গোনো। আচ্ছা তুমি তো বারান্দায় চেয়ারে বসে রাস্তার লোকজন দেখতে পারো। বেস্ট হয় এবার যদি একটা টিভি কিনে ফ্যালো। এইভাবে পা ছড়িয়ে বসে হাতে রিমোট কন্ট্রোলটা নিয়ে পর পর শুধু হিন্দি বাংলা সিরিয়াল দেখে যাবে।’

‘রক্ষে কর, সিরিয়ালে আমার দরকার নেই, টিভি দেখতে হয় তোরা দ্যাখ। রাধুকে দেখতে গিয়ে একদিন ওর ঘরে বসে টিভি দেখলুম। হিন্দি একটা সিনেমা হচ্ছিল। সে কী বেলেল্লা নাচ একঝাঁক ছেলেমেয়ের। রাধুকে বললুম তুমি এই সব বসে বসে দ্যাখো? বলেই কিন্তু মনে হল, বেচারা আর করবেই বা কী? ও এমনভাবে তাকিয়ে রইল যে আমার বুকে মোচড় দিল।’

রাধু অর্থাৎ রাধাকিঙ্করী সামনের বাড়ির বউ, বিজলির থেকে বছর পনেরোর ছোটো। আট বছর আগে এক পাওয়ার কাট হওয়ার রাত্রে রাধাকিঙ্করী দোতলার সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে একতলায়। আশপাশের বাড়ির অনেকের ধারণা বা দৃঢ় বিশ্বাস শঙ্কর চাটুজ্যে বউকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। উদ্দেশ্য আবার বিয়ে করা। রাধাকিঙ্করী মরেনি তবে মরলেই ভালো হত। ওর শিরদাঁড়ার মাঝখানটা ভেঙে যায় এবং স্নায়ুকেন্দ্রে যে আঘাত লাগে তাতে তার নিম্নাঙ্গ সাড় হারায়, জিহ্বারও কথা বলার ক্ষমতা নষ্ট হয় প্রায় পঞ্চাশ ভাগ। তার জড়ানো অস্পষ্ট কথা শুধু বুঝতে পারে বাড়ির দু—তিনজন আর বিজলিবালা।

শঙ্কর চাটুজ্যে পঙ্গু বউয়ের পরিচর্যার জন্য দিনরাতের এক দাসী রেখেছে। মধ্য ত্রিশের বিধবা দুই সন্তানের মা অন্নপূর্ণা বা অন্ন দুর্ভাগ্যক্রমে প্রখর যৌবনা, বুদ্ধিমতী এবং সুশ্রী। অতএব আশপাশের বাড়ি দ্রুত এই সিদ্ধান্তে আসে অন্নপূর্ণা দিনে গৃহিণীর সেবায় নিয়োজিত থাকে রাত্রে গৃহস্বামীর। শঙ্কর চাটুজ্যে সফল ব্যবসায়ী, চার পুরুষ এই পাড়ায় বসবাস করছে। একটি মোটরগাড়ি এবং দুটি ঘরে এয়ারকুলার ও টিভি আছে। ব্যবসার কাজে ভারতের নানান শহরে যেতে হয়। একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন নিউ জার্সিতে কর্মরত সফটওয়্যার পারদর্শী বর্ধমানের ছেলের সঙ্গে। বিয়েতে তিনি জয় দত্ত স্ট্রিটের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে নিমন্ত্রণ করেন। মেয়ের বিয়ের পরের বছরই রাধাকিঙ্করী পঙ্গু হয়। গত আট বছর শুধু বিজলিবালাই তাঁর এই পঙ্গু বান্ধবীকে নিয়মিত দেখতে যান, যথাসাধ্য কথা বলার ও শোনার চেষ্টা করেন। রাধাকিঙ্করী হুইলচেয়ারে বসে থাকে, অন্নপূর্ণা টিভি চালিয়ে দেয়। সে বসে দেখে এবং শুধু চোখ মারফত বুঝিয়ে দেয় তার ভালো লাগা মন্দ লাগা।

‘ক—টা দিন তো পা ছড়িয়ে বসে থাকব তারপর আগের মতো যে কে সেই। রাধুর মতো পঙ্গু হলে নয় টিভি কেনার কথা ভাবব। এই দ্যাখো, কল্পনা সেই যে হাসিকে বলতে গেল তো গেলই। পদ্ম ভুটুকে দুটো এলাচদানা দে।’

শ্রীধরের কাঠের সিংহাসনের পাশে একটা দু—হাত উঁচু আলমারি তার মধ্যে শিশি বোতল ঠাকুরের বাসন বিছানা রাখা। পদ্ম হরলিকসের বোতল থেকে এলাচদানা বার করল। বিজলি কোল থেকে ভুটুকে মেঝেয় নামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা, মাসির কাছে যা।’

ভুটু টলতে টলতে দু—পা এগিয়েই সামনে ঝুঁকে পড়ল। দু—হাত মেঝেয় রেখে দ্রুত হামা দিয়ে এগোল।

‘ধর ধর পদ্ম, নারায়ণ শিলায় হাত দেবে। সেদিন ওকে কোলে নিয়ে শিবের মাথায় ফুল বেলপাতা দিচ্ছি নজরটা একটু সরিয়েছি, ওম্মা খপ করে নারায়ণকে তুলেই মুখে, শিলাটা ভাগ্যিস বড়ো নইলে মুখে ঢুকে গেলে কী কাণ্ডটাই যে হত!’ বিজলি শিউরে উঠলেন। ‘ব্যাটা বড়ো হয়ে পুরুত হবে, চক্রবর্তীর ব্যাটা তো!’

‘ঠাকুমা তোমার নারায়ণ শিলা ভুটু এঁটো করে দিল?’ অনুলেখা তির্যক স্বরে বলল। ‘আর আমি যদি হাত দিই অমনি হাঁ হাঁ করে উঠে বলবে, ছুঁয়ে দিলি নারায়ণকে?’

‘কে বলেছে তোকে আমি বলব?’ বিজলি বললেন তীক্ষ্ন স্বরে। ‘তুই তো কায়েতের মেয়ে, চামার মেথর নোস। আমাকে ভাবিস কী তুই?’

অনুর নাম ধরে পাশের বাড়ি থেকে চিৎকার ভেসে এল। ব্যস্ত হয়ে অনু বলল, যাই ঠাকুমা। মা—র চেল্লানি থামিয়ে আসি।’

অনুলেখা বেরিয়ে যাবার পর অলকা বলল, ‘মাস্টারমশাই পড়াতে এসেছেন। উঠতে বসতে গঞ্জনা দেয় ওকে, কেন সাতশোর ওপর নম্বর উঠল না! চার চার জন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়েও কেন তিনটের বেশি লেটার পেলি না বলে বাবা—মা শুধু মারতে বাকি রাখে। জেঠিমা, অনু দিনে ছ—সাত ঘণ্টা পড়ত, খাটিয়ে মেয়ে, কিন্তু শুধু খাটুনিতে কি দশ—কুড়ি জনের মধ্যে আসা যায়, মাথাটাও তো থাকা দরকার। ওর পড়ায় ব্যাঘাত হবে বলে টিভি পর্যন্ত কেনেনি। এই দেখুন না এখনও কলেজের ক্লাস শুরুই হয়নি, বাড়িতে মাস্টারের কাছে পড়া শুরু হয়ে গেছে।’

‘অনু কিন্তু বুদ্ধিমতী মেয়ে। ছোটো থেকে ঠিকমতো মানুষ করলে ও অনেক ভালো নম্বর করত।’ বিজলির স্বরে স্নেহ ও খেদ। মেয়েটার কথাবার্তা তাঁর ভালো লাগে, ওর চাপল্যে মজা পান।

‘ঠিকই বলেছেন জেঠিমা। বাবামা—ই যদি অশিক্ষিত হয়, উঠতে বসতে যদি বিধিনিষেধের বেড়ি পরিয়ে রাখে আর দিনরাত কানের কাছে যদি মন্ত্র জপে ‘রেজাল্ট চাই রেজাল্ট চাই, পড় পড়’ তা হলে যা হবার তাই হয়েছে অনুর। প্রায় সাতশো নম্বরেও ওরা খুশি নয়।’

‘বউমা অনুর বাবা মাকে অশিক্ষিত বলছ কী, ওরা দু—জনেই গ্র্যাজুয়েট!’

‘জানি জেঠিমা। কেন মেয়েকে লেখাপড়া শেখাচ্ছে সেটাই তো ওরা জানে না। একদিন কথায় কথায় ওর মা বলেছিল মেয়েকে কম্প্যুটার সায়ান্স পড়াবে, কুড়ি—পঁচিশ হাজার টাকার চাকরি বাঁধা। এটাই হল ওদের লেখাপড়া শেখাবার লক্ষ্য, একটা সম্পূর্ণ মানুষ গড়ে তোলার কথা ওরা ভাবে না, ওদের অশিক্ষিত বলব না তো কাকে বলব?’

বিজলি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তখনই হাসি এল। তার পোশাক দেখেই বোঝা যায় বাইরে কোথাও যাবে।

‘মাসিমা এসেছেন অথচ একতলা থেকে উঠে এসে একবার দেখা পর্যন্ত করতে এলুম না, নিজেকে কী যে অপরাধী লাগছে। আসলে কাল ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর থেকে মনটা এত খারাপ হয়ে গেছিল যে বিছানা ছেড়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল না।’ হাসি ক্ষীণ ভাবে হাসল। ‘বলুন এখন কেমন আছেন?’

হাসির প্রশ্নটা অগ্রাহ্য করে বিজলি শঙ্কিত গলায় বললেন, ‘ডাক্তার খারাপ কিছু বলেছেন নাকি?’

‘না না খারাপ কিছু নয়। বললেন এক্স রে করাতে, এখন সেটাই করাতে যাব।’ হাসির উত্তরটা প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার মতো। বিজলি বুঝলেন কিছু একটা চেপে যাচ্ছে হাসি। তিনি আর কিছু জিজ্ঞাসা না করে বললেন, ‘কাল বেস্পতিবার আমি তো নড়াচড়া করতে পারব না। তুমি সন্ধেবেলায়লক্ষ্মীপুজোটা করে দিতে পারবে? পুজো মানে পাঁচালিটা পড়া; আমার গরদের কাপড় রয়েছে পরে নেবে, শাঁখটা পদ্মই বাজাবে। আমি সব বলে বলে দেব। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।’

‘মাসিমা আমি কিন্তু কখনো পাঁচালি পড়িনি, আর কাউকে বলুন না।’ হাসি সংকুচিত হয়ে বলল।

‘এ বাড়িতে আর কে আছে বল যাকে দিয়ে পুজো করাতে পারি? তুমি বামুন, উঁচু জাত, পদ্মকে দিয়ে তো করাতে পারব না আর পাঁচালিও পড়তে পারবে না। দেখি আর কে সময় দিতে পারবে, কাউকে না পেলে পুজো বন্ধ রাখতে হবে।’ বিজলির চোখে হতাশা, কণ্ঠস্বরে বেদনা।

‘আমি কাল সন্ধেবেলায় আসব মাসিমা। এখন যাই।’ হাতঘড়ি দেখে হাসি উঠে দাঁড়াল, ভুটু দু—হাত বাড়াল মায়ের দিকে। ছেলেকে কোলে নিয়ে হাসি বলল, ‘এখন কিছুক্ষণ ঠাম্মার কাছে থাকো, আমি ফিরে এসে নিয়ে যাব। কল্পনা লক্ষ রাখিস কিছুতে হাতটাত যেন না দেয়।’ অলকার দিকে তাকিয়ে মাথা হেলিয়ে হেসে বেরিয়ে গেল হাসি।

ভুটু কান্না জুড়ল মা চলে যেতেই। বিজলি বললেন, ‘কল্পনা ওকে নিয়ে ছাদে যা। একটু ঘোরাঘুরি করে ভুলিয়ে রাখ।’

কল্পনা ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর অলকা বলল, ‘জেঠিমা বিছানায় একা একা এ ভাবে থাকতে হলে তো আপনিও বোর ফিল করবেন।’

‘তা একটু করব, ওই পদ্মর সঙ্গে কথা বলে যতটা পারি সময় কাটাব, ভুটু আছে, ওর মা হাসি আছে। ওর বাবা জ্যোতিকে অবশ্য চোখে দেখি না ছুটির দিন ছাড়া। স্কুলে বেরোয় আটটায়, উলটোডাঙা থেকে ট্রেন ধরে হাবড়ায় পৌঁছোয় পৌনে দশটায়, ছুটির পর ওখানেই একটা বাড়িতে গিয়ে পড়ায় হপ্তায় একদিন করে ছ—টা ছেলেমেয়েকে, সায়েন্সের মাস্টার, খুব যত্ন করে পড়ায় তাই টানাটানি ওকে নিয়ে। হাসির কিন্তু প্রচণ্ড আপত্তি। একেই জ্যোতির দুবলা শরীর, খাওয়াদাওয়া একদমই হয় না, সারা দিনে একফোঁটা বিশ্রাম নেই। সেই সকালে বাজার করে এসে নাকে মুখে দুটো গুঁজেই বেরিয়ে গিয়ে রাত ন—টা—সাড়ে ন—টায় বাড়ি ফেরা—এতে কি শরীর থাকে? হাসি একদিন বলছিল, একটা লোক ঘুম থেকে উঠে টানা চোদ্দো ঘণ্টা যদি বসে আর দাঁড়িয়ে কাটায় আধপেটা থাকে তা হলে সে তো যে—কোনো দিন কঠিন অসুখে পড়ে যাবে। হাসি বলে বলে ওর টিউশনি করা বন্ধ করেছিল, ভুটু হবার পর আবার ধরেছে। ছেলের খাওয়া পরা, ছেলেকে ধরার জন্য লোক রাখার খরচ মেটাতে নাকি টাকার দরকার!’

অলকা বলল, ‘হাসিও তো চাকরি করছে, তা হলে?’

‘মাইনে খুব কম, আড়াই হাজার টাকা মাত্র। ওইটুকু ছেলেকে ফেলে রেখে তোমার দরকার কী বাপু চাকরি করার, একথা বলতেই বলল, লেখাপড়া শিখে ঘরে বসে থাকব আর স্বামী মুখের রক্ত তুলে উদয়াস্ত খেটে সংসার চালাবার জন্য টাকা রোজগার করবে তাই কখনো হয়?’

অলকা বলল, ‘আমার পড়াতে যাওয়া নিয়ে শ্বশুর—শাশুড়ি দু—জনেরই আপত্তি ছিল তবে অন্য কারণে। ঘরের বউ চাকরি করবে এটা নাকি লজ্জার ব্যাপার, পরিবারের মাথা হেঁট হয়। উনি কিন্তু বাবামা—র আপত্তি গ্রাহ্য করেননি, আমাকে বলেন করো চাকরি। ক—টা মাস মন কষাকষি চললে তারপর ঠিক হয়ে যায়। জেঠিমা আমি কিন্তু ইচ্ছে করলেই টিউশানি করতে পারতাম, করিনি। ওই সময়টা, আমার মনে হল ক—টা টাকা পাওয়ার বদলে বাচ্চচু আর মিঠুকে দিলে অনেক বেশি লাভ করব।’

‘খুব ভালো করেছ বউমা, বাপমায়ের কাছে ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের থেকে বড়ো ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। হাসির কথা শুনেও মনে হয় হাসি চাকরি করে ঠিকই করেছে, স্বামীর ভালোমন্দও তো বউয়ের দেখা উচিত। এখন ভাবি আমার অল্পবয়সে তোমাদের মতন এমন করে চিন্তা করার কোনো সুযোগই ছিল না। থাকলে সেকেন্ড ক্লাস পর্যন্ত না পড়ে আরও পড়তুম।’

অলকা বলল, ‘আপনি তো সময় কাটাবার জন্য বইটই পড়তে পারেন।’

‘পারিই তো। একসময় খুব পড়তুম। উনি কিনে দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের বই। বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী। শরৎবাবুর লেখা কী ভালো যে লাগত। ‘দত্তা’ চার বার—পাঁচ বার পড়েছি। আবার পেলে আবার পড়ব। বছর দশেক আগে ঘরে উই লাগল। একশো বছরের পুরোনো বাড়ি তো, দেওয়ালে ড্যাম্প। সব বই উইয়ে খেয়ে ফেলল,’ বিজলি ফিকে হাসলেন। চোখ তুলে মোটা মোটা কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই দ্যাখো এখনও দাগ রয়েছে উইয়ের বাসার।’

অলকা মুখ তুলে কড়িকাঠ দেখে নিয়ে বলল, ‘আমার কাছে বিভূতিভূষণের বই আছে। আপনাকে দিয়ে যাব, পড়ে দেখুন ভালো লাগবে। জেঠিমা এখন চলি, যখন যা দরকার হবে বলবেন।’

‘আর দরকার।’ বিজলি দীর্ঘশ্বাসের মতো করে বললেন। ‘আমার আবার দরকার কী, বিছানায় এইভাবে যাকে কাটাতে হবে তার কিছুর কি আর দরকার হয়? পদ্মই এখন আমার চোখকান, হাত পা। ওর দয়া নিয়ে এখন আমায় বাঁচতে হবে।’ বলে মিটিমিটি হেসে পদ্মর দিকে বিজলি তাকালেন।

‘কী যে বলেন মাসিমা।’ লজ্জা ও পুলকে জর্জরিত পদ্ম আদুরে স্বরে ধমক দিল।

অলকা চলে যাবার পর পদ্ম বলল, ‘মাসিমা তখন বললেন পুজো করে দেবার জন্য হাসিদি ছাড়া আর বলার মতো কেউ নেই। কেন অলকা বউদিই তো রয়েছে, ওকে বললেই তো পারতেন। বউদি খুব ভালো লোক, আপনি বললে না করবেন না।’

বিজলি মাথা নেড়ে বললেন, ‘নারে পদ্ম ওকে পুজো করতে বলা যায় না, অলকারা ব্রাম্মো।’

পদ্ম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ‘বামুন তো! তবে?’

‘বামুন বামুন ব্রাহ্মণ নয়রে ব্রাম—হো। ওরা ঠাকুর দেবতা মানে না, পুজোআচ্চচা করে না, ওদের ধর্ম আমাদের মতো নয়। ওদের বিয়েতে হোম যজ্ঞটজ্ঞ হয় না, পিণ্ডি দেয় না শ্রাদ্ধে। এবার বুঝলি কেন ওকে বলিনি।’

‘বউদির কথাবার্তা চলনবলন তো আমাদের মতো!’ পদ্মর বিস্ময়ের ঘোর এখনও কাটেনি। ‘পুজোর সময় তো নতুন শাড়ি পরে ঠাকুর দেখতে বেরোয়, তা হলে?’

‘ঠাকুর দেখতে বেরোয় কিন্তু প্রতিমা নমস্কার করে কি? অলকা সিঁদুর দেয় না শাঁখা পরে না সেটা লক্ষ করেছিস?’

‘শাখা নোয়া তো কত এয়োই পরে না, সিঁদুরও দেয় না।’ পদ্ম ক্ষীণ একটা তর্ক জোড়ার উদ্যোগ নিল। ‘বাসন মাজতে গিয়ে আরতির দু—দুটো শাঁখা ভাঙতে ও আর শাঁখা পরে না, বলে অত শাঁখা কেনার পয়সা কোথায়। সবাই বলল না পরলে স্বামীর অমঙ্গল হবে। কই কিছুই তো হয়নি শ্যামলের, আগেও যেমন ছিল এখনও তেমনই আছে।’

‘এসব হল হিন্দুদের আচার প্রথা নিয়ম।’ বিজলি গলা নামিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন, ‘হাজার হাজার বছর আগে মুনিঋষিরা এসব বিধান দিয়ে গেছেন। ওনারাই ঠিক করে দিয়েছেন সমাজে কারা উঁচু কারা নীচু, সেইভাবেই মানুষ ভাগ করা।’ কথাগুলো বলে বিজলি দেখলেন পদ্মর চোখে আরও বিস্ময়। ‘দেবতার পুজো তাই যাকে তাকে দিয়ে করা যায় না। এসব তুই বুঝবি না। দ্যাখ তো ছাদে ভুটু কান্নাকাটি করছে কিনা। ভিজে ছাদ, কোল থেকে নামালে ঠান্ডা লেগে যাবে। কল্পনা তো ওকে বেশিক্ষণ কোলে রাখতে পারে না।’

পদ্ম ঘর থেকে বেরোচ্ছে বিজলি ডাকলেন, ‘রাধাকে গিয়ে বলে আয় দিদির ঠ্যাং ভেঙেছে এখন তোমার মতোই অবস্থা, যতদিন না জোড়ে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। অনেক দিন ওকে দেখতে যেতে পারব না। বেচারা, একজনও কেউ গিয়ে ওর সঙ্গে দুটো কথা বলে আসে না। কথা বলবেই বা কী, লোকে তো বিরক্ত হয়ে যায়।’ বিজলি রাধার কথা ভেবে বিষণ্ণ হয়ে পড়লেন। ‘আর শোন কাল তো সন্ধে দেখাসনি। আজ একটু ভালো করে গঙ্গাজলের ছড়া দিস। ভুটুর দুধ খাওয়ার টাইম হয়েছে, কল্পনা ওকে খাওয়াতে পারে না, ওকে বল আমার কাছে দুধটা দিয়ে যেতে, আমি খাইয়ে দোব।’

বালিশে পিঠ রেখে পা ছড়িয়ে বিজলি তাঁর স্বভাবমতো নিজেকে ব্যস্ত করে তোলার জন্য কাজের খোঁজ শুরু করলেন। তাঁর জন্য নানারকমের কাজ ছড়িয়ে থাকেও। শুধু সেগুলো সংগ্রহ করা আর পদ্মকে নির্দেশ দেওয়া। একটা কাজ শেষ হতেই মনে পড়ে যায় আর একটার কথা। যেমন পদ্ম ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মনে পড়ল মোমবাতি আনিয়ে রাখতে হবে। লোডশেডিং আবার শুরু হয়েছে। তারপর মনে পড়ল ঘড়ায় গঙ্গাজল কতটা আছে দেখা দরকার। ইলেকট্রিক বিল আসার তারিখ তো হয়ে গেছে, পদ্মকে রোজ বলতে হয় লেটার বক্সটা দেখতে, বিলের টাকা দেবার তারিখ পেরিয়ে গেলে রিবেট পাওয়া যাবে না এটা ওর মাথায় কিছুতেই ঢোকানো গেল না।

বই পড়ে বা টিভি দেখে অলকা কথিত ‘বোরড ফিল’ করা থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো দরকার বোধ করছেন না বিজলি। নানান ভাবনায় তাঁর মন সারাদিনই ভরে থাকে। এগারো বছর আগে বিধবা হবার পর নিঃসন্তান বিজলি বাড়িতে খুবই একা বোধ করেছিলেন। তখনই তিনি পাড়ায় এবাড়ি ওবাড়ি গিয়ে সুখদুঃখের গল্প করা শুরু করেন। বিজলি কোনো বাড়িতে গিয়ে পরচর্চা করেন না এবং সুরসিকা, কথা বলতে পারেন মজা করে তাই সব বাড়িতেই তিনি স্বাগত। জয় দত্ত স্ট্রিটে সব থেকে পরিচিত মানুষ, সাতচল্লিশের বি নম্বরের বাড়ির বিজলিবালা ভট্টাচার্য। তিনি একাধারে দিদিমা ঠাকুমা মাসিমা জেঠিমা এবং বউদিও। তাঁর আপশোস তাঁকে কাকিমা বলার লোক এখনও খুঁজে পাননি।

বিজলির স্বামী কৃষ্ণকিশোর ছিলেন পিতামাতার একমাত্র সন্তান। বিলাতি সওদাগরি অফিসে একটি বিভাগের বড়োবাবু ছিলেন। হিসেবি ও গোছানে লোক। তাঁর অফিসের নানান ধরনের ব্যবসার একটি ছিল খয়ের উৎপাদনের ও সারা ভারতে বিক্রির। বড়ো সাহেবের প্রিয় পাত্র কৃষ্ণকিশোর স্ত্রীর নামে বিহার ও ওড়িশায় খয়ের বিক্রির এজেন্সি নেন। জৌনপুর থেকে চটের মোড়কে খয়ের আসত, বাড়ির একতলার ঘরে বস্তাগুলি রাখা হত আবার তা চলে যেত পুরী কটক পাটনা গয়া প্রভৃতি স্থানে মহাজনদের কাছে। এই ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায় সাহেবরা যখন ভারতীয়দের কাছে তাদের প্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দেশে ফিরে গেল। তত দিনে কৃষ্ণকিশোর হাজার পঞ্চাশ টাকা উপার্জন করে ফেলেছেন। রক্তে শর্করাধিক্যের রোগে তিনি মারা যান চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার তিন মাস পরেই।

কৃষ্ণকিশোর মিতব্যয়ী ছিলেন কিন্তু কঞ্জুস নন। ব্যবসা থেকে সঞ্চিত টাকা ও অবসর গ্রহণকালে অফিস থেকে প্রাপ্য টাকা ভবিষ্যতের কথা ভেবে স্ত্রীর নামে গচ্ছিত করেন ডাকঘরের টাকা দ্বিগুণ করা জাতীয় সঞ্চয় সার্টিফিকেটে এবং ব্যাঙ্কে। সেই টাকার পরিমাণ এখন দুই লক্ষাধিক। বিজলিবালাকে কদাচিৎ হাত দিতে হয়েছে ডাকঘরের টাকায়। কেন না হুগলি জেলার ভেনিয়াপুকুরে তাঁর বাবা মহিমারঞ্জন হালদারের স্থাবর সম্পত্তির অর্ধেকের উত্তরাধিকারী হন তিনি বাবার মৃত্যুর পর। বিজলির অসীম সৌভাগ্য স্নেহময় বিবেকবান সৎ সীতেশরঞ্জনকে দাদা পাওয়ায়। প্রতি বছর জমির ফসল বিক্রির, পুকুর ও আমবাগান জমা দেওয়ার টাকার ভাগ তিনি একমাত্র বোনের কাছে নিয়মিত নিজে পৌঁছে দিয়ে যান। সেই টাকার পরিমাণ বছরে পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা হয়।

বিজলির একতলা দীর্ঘ দিন খালি পড়ে থাকে তাঁর পছন্দের ভাড়াটিয়া না পাওয়ার জন্য। কয়েকজন দালালকে প্রত্যাখান করেছেন, দু—হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়ার প্রস্তাবও নাকচ করেছেন। তিনি চান ভদ্র শিক্ষিত মার্জিত এবং কম লোকের এমন পরিবারকে যারা ঝগড়া করবে না নোংরা করবে না এবং ভাড়া ফেলে রাখবে না। প্রতিবেশীরা বলল, আজকের দিনে এমন শর্ত পূরণ করার মতো ভাড়াটিয়া পাওয়া কঠিন। অবশেষে ভাড়াটিয়া এনে দিল পলাশ।

‘দিদিমা দিদিমা শুনুন।’ রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন বিজলি। পলাশের ডাক শুনে দাঁড়ালেন। সত্যর চায়ের দোকান থেকে ছুটে এল পলাশ।

‘আপনার একতলার জন্য ভাড়াটে পেয়েছেন?’

‘না।’

‘আমার পিসতুতো দাদার বন্ধু, যাদবপুরে ওর সঙ্গে এম এসসি পড়েছে। এখন স্কুলমাস্টার, হাজার চোদ্দো—পনেরো মাইনে, বউও চাকরি করে। একটা শুধু বাচ্চচা মাস ছয়েক বয়স। দু—জনেই ভদ্রলোক, দু—জনেই রোজগেরে, ভাড়া ঠিক সময়ে পেয়ে যাবেন। আপনি যে ভয় পাচ্ছেন ছ্যাঁচড়া হবে কিনা, দাদা বলল অত্যন্ত ঠান্ডা নিরীহ ছেলে। বউও খুব পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন। গড়িয়ায় থাকে এদিকে বাসা পেলে দু—জনেরই সুবিধা হয়। আমি বলেছি আমাদের পাড়ায় দুটো বড়ো বড়ো ঘর আছে একতলায়, ওরা রাজি, দেবেন ভাড়া?’

বিজলি কথাগুলো শুনে বলেন, ‘জাত কী?’

‘বামুন বামুন, এই দ্যাখো আসল কথাটাই বলা হয়নি, চক্রবর্তী, জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী।’

ভুটুকে নিয়ে জ্যোতির্ময় আর হাসি এসে দেখা করে বিজলির সঙ্গে। একপলক দেখেই দু—জনকে তাঁর ভালো লেগে যায়। ভুটুকে কোলে নেওয়ার এক মিনিটের মধ্যে সে হিসি করে দেয় বিজলির কাপড়ে। সঙ্গে সঙ্গে উচ্ছ্বসিত হয়ে বিজলি বলে ওঠেন, ‘ব্যাটা ঠিক চিনেছে আমাকে। কোলে উঠেই জানিয়ে দিল তোমাকে জ্বালাতন করব। এ তো আমার গোপাল ঠাকুর গো। সামনের পয়লা তারিখেই তোমরা চলে এসো, কত ভাড়া দেবে বল?’

জ্যোতির্ময় ভয়ে ভয়ে বলেছিল, ‘আটশো টাকা পর্যন্ত দিতে পারি।’

‘ঠিক আছে চলে এসো, তবে বাপু ভাড়া ঠিক পয়লা তারিখে দিতে হবে আর লোক এলে সদর দরজা খুলে দেবে, রোজ সকালে জমাদার এলে উঠোন ধোয়ার জল দেবে, আর স্বামী—স্ত্রীর ঝগড়া যেন আমার কানে না পৌঁছায়। আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, শান্তি ভঙ্গ করলে কিন্তু আমি অন্য মানুষ, ঝেঁটিয়ে তোমাদের তাড়াব এটা মনে রেখো।’

সন্ধ্যা নামার মুখে এল পলাশ। ভুটুকে তখন খাটে বসিয়ে একহাতে জড়িয়ে ধরে বিজলি বোতলে দুধ খাওয়াচ্ছিলেন।

‘এসো পলাশ, কই টাকাপয়সার কথা তো কিছু বলল না ওরা?’ বিজলি অস্বস্তিভরে বলে ভুটুকে কল্পনার হাতে দিয়ে বললেন, ‘এবার তুই খাওয়া।’

‘বলেনি আমি বারণ করেছিলুম বলে। বলেছিলুম বিল আগে আমাকে দেবেন। দিদিমা, এরা অনেক কিছু বাড়িয়ে দেয়। যে—ওষুধ কেনা হয়নি তার দাম ধরে দেয়, যে—অক্সিজেন ব্যবহার করা হয়নি সেটাও বিলে ঢুকিয়ে দেয়, আয়া না রাখলেও বলবে রাখা হয়েছে। এসব তো আপনি ধরতে পারবেন না। তাই বলে রেখেছিলুম আগে আমি বিল চেক করব।’

‘চেক করে দেখলে?’

‘না কোনো কারচুপি করেনি। করবে না অবশ্য জানতুম।’ পলাশ পকেট থেকে বার করল লোটাস নার্সিংহোমের খাম। তার থেকে বার করল চারটে বিল। তার তিনটি সূর্য মেডিক্যাল হলের।

‘দিদিমা সব মিলিয়ে মোট আঠারোশো টাকা। আজকেই দেব বলেছি।’ পলাশ খাটের তলা থেকে টুল টেনে বার করে বসল। ‘যন্ত্রণাটন্ত্রণা হচ্চেচ? হলে যে ক্যাপসুল খেতে বলে দিয়েছে খাবেন। ডাক্তার বলেছে খুব শক্ত ধাতের মহিলা, এই বয়সেও শরীর খুব মজবুত।’

‘তা তো বুঝলুম কিন্তু বিলটাও তো বেশ জম্পেশ।’ বিজলি চোখ পিটপিট করে বিল তুলে ধরে বললেন। ‘জগন্নাথদেবের আশীর্বাদ এটা।’

পদ্ম বলল, ‘আর কখনো রিকশায় চেপো না এটাই বলে দিলেন জগন্নাথ।’

‘পা—টা তো ভাঙলি তুই। হুড়মুড়িয়ে পড়লি আমার পায়ের ওপর অমনি মট করে শব্দ হল। এখন দে আঠারোশো টাকা।’ বিজলি ছদ্মকোপ দেখিয়ে বললেন।

‘আহাহা আমি কি ইচ্ছে করে তোমার পায়ের ওপর পড়েছি নাকি? টাকা তোমার বালিশের নীচে রাখা আছে।’

বিজলি বালিশের তলা হাতড়ে টাকার ছোট পুঁটুলিটা বার করলেন। দাদার দিয়ে যাওয়া নগদ টাকা তিনি ঘরেই রাখেন, কখন কীজন্য হঠাৎ টাকার দরকার পড়ে কে বলতে পারে। পুঁটলির গেরো খুলে গুনে গুনে আঠারোশো টাকা বার করে দিলেন পলাশকে।

টাকা হাতে উঠে দাঁড়িয়ে পলাশ ঠোঁট টিপে হেসে বলল, ‘দিদিমা এবার সত্যি কথাটা বলি, লোটাসের মালিককে বলেছি দিদিমা এত টাকা দিতে পারবেন না, তিনশো কমিয়ে দেড় হাজার করুন। তাই করে দিল। বিলটা আপনি ভালো করে তো দেখলেনই না। লেস থ্রি হান্ড্রেড তা হলে চোখে পড়ত।’

‘তাই তো!’ বিজলি অবাক হয়ে বিলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘এক কথায় তিনশো টাকা কমিয়ে দিল?’

‘দেবে না মানে? কত হাজার টাকা বাঁচিয়ে দিয়েছি। যখন লোটাসের দুটো কর্মচারীকে গাফিলতির জন্য বরখাস্ত করে তখন কর্মচারীরা গেট বন্ধ করে দিয়ে ধর্মঘট শুরু করেছিল, মেরে সরিয়ে দিয়েছিল তো আমাদের ছেলেরাই, মালিক তো সেটা মনে রেখেছে। তবে দিদিমা এবার নাতির একটা আবদার রাখতে হবে।’ জিজ্ঞাসু চোখে বিজলি তাকাতে সে বলল, ‘ছেলেরা অনেকদিন পেট ভরে মাংস খায়নি।’

‘ঠিক আছে ঠিক আছে, ও টাকা আর আমাকে ফেরত দিতে হবে না। অনেকগুলো ছেলে, মাংসের দাম যা হয়েছে, তিনশো টাকায় কি হবে?’

‘হবে না। আরও অন্তত দুশো চাই।’ পলাশ পরিষ্কার দাবি জানাল।

বিজলি আবার পুঁটলি খুলে দুশো টাকা দিতেই পলাশ নাটকীয়ভাবে কপালটা বিজলির পায়ের প্লাস্টারে ঠেকিয়ে ‘লং লিভ দিদিমা।’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বিজলি মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘কাণ্ড দ্যাখো আমাকে জক দিয়ে গ্যালো।’

পদ্ম বলল, ‘কিন্তু বাপু তোমার জন্য করেছেও অনেক। ওরা না থাকলে কী আতান্তরে যে পড়তুম ভগবানই জানেন।’

‘ওদের জন্যই তো নিশ্চিন্তে আছি, মরলে শ্মশানে ঠিক পৌঁছে যাব। তুই আমার শ্রাদ্ধে ওদের ভালো করে খাওয়াস।’

‘আমার টাকা কোথায় যে ওদের খাওয়াব,’ ঠোঁট ফুলিয়ে পদ্ম বলল।

বিজলি অবাক হয়ে বললেন, ‘টাকা কোথায় মানে? আলমারিতে এখনও বারো হাজার রয়েছে, সব তো তোর জিম্মায়।’

‘বারো হাজার টাকায় তোমার ছেরাদ্দ? মাথা খারাপ হয়েছে তোমার। গোটা পাড়ার লোককে না খাওয়ালে তোমার মান থাকবে, তোমাকে মনে রাখবে? লোকে বলবে মাসিমা কেমন ছিল, দায়সারা করে কাজ সেরেছে আর সবাই দুষবে আমাকে। না বাপু আমাকে এর মধ্যে জড়িয়ো না।’

‘তার মানে তুই বলছিস আমার শ্রাদ্ধ হবে না! আমার আত্মার গতি হবে না? আমি প্রেত হয়ে ঘুরে বেড়াব?’ বিজলি উত্তেজিত হয়ে গলা চড়িয়ে বললেন।

সন্ত্রস্ত হয়ে পদ্ম বলল, ‘এই দ্যাখো তোমার ছেরাদ্দ হবে না কখন বললুম! বারো হাজারে ক—টা লোক খাওয়াব বলো? আমাদের বস্তিতে কনকের বিয়েতে শুধু ভাত ডাল মাছ আর রসগোল্লা খাওয়াতেই পাঁচ হাজার টাকা গলে গেল। আর এপাড়ায় তিরিশ—চল্লিশ ঘর লোক, তার মানে দেড়শো—দুশো মুখ। নিয়মভঙ্গে তুমি তো চাইবে শুধু মাছ নয় সঙ্গে মাংসও। তারপর মিষ্টি, এখন হিসেব করো কত খরচ হবে। এরপর আছে প্যান্ডেল, কেত্তন, ফুল, বামুনকেও কত কী দান করতে হবে। না মাসিমা বারো হাজারের মধ্যে আমি নেই। আমাকে মাপ করো তুমি অন্য লোক দ্যাখো।’

বিজলি গম্ভীর হয়ে গেলেন। ‘লোকে বলবে মাসিমা কেপ্পন ছিল’ পদ্মর এই কথাটা তাঁর মনের গভীরে নাড়া দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত লোকে কি তাঁকে এইভাবেই মনে রাখবে? ভাবতেই তাঁর চেতনায় ছড়িয়ে পড়ল ভয়, বিস্মরণে চলে যাবার ভয়।

‘পদ্ম, পোস্টাপিসে আর ব্যাঙ্কে যত টাকা আছে সব আমি তুলে তোর কাছে রাখব। তুই আমার শ্রাদ্ধটা ভালো করে করিস, কোনো কার্পণ্য করবি না কথা দে আমায়।’

হতভম্ব পদ্ম। বিজলির পায়ের প্লাস্টারে হাত রেখে বলল, ‘মাসিমা তুমি বলছ কী? আমি টাকা গুনতে পারি না। অত টাকা হাতে পেলে তো আমার মাথা ঘুরে যাবে। তুমি বরং নীচের দাদাকে ডেকে কথা বল।’

‘পদ্ম একটা কথা দে, গয়ায় গিয়ে আমার পিণ্ডি দিবি। নয়তো আমার মুক্তি ঘটবে না রে, আবার তা হলে আমাকে জন্মাতে হবে!’

‘আবার জন্মালে কী এমন ক্ষতি হবে?’

‘ওরে কী হয়ে জন্মাব তা তো আমি জানি না, কুকুর হয়ে জন্মাতে পারি ছারপোকা হয়ে জন্মাতে পারি রাজার ঘরেও জন্মাতে পারি, আবার দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা ভোগ করা, তার থেকে একেবারে মুক্তি পেয়ে যাওয়া অনেক ভালো, তুই আমার মুক্তির ব্যবস্থা করবি, কথা দে।’

বিজলির দু—চোখ দিয়ে নামা জলের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনতে শুনতে পদ্মর বুকের মধ্যে কেমন যেন হতে থাকল। সে দু—হাত বাড়িয়ে প্রায় ছুটে এসে বিজলিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ‘মাসিমা তুমি অমন করে বোলো না, আমি কথা দিচ্ছি যে—করেই হোক গয়ায় গিয়ে তোমার পিণ্ডি দেব, মুক্তির ব্যবস্থা করব। কুকুর ছারপোকা হয়ে তোমাকে জন্মাতে না হয় সেই পাত্থনা শ্রীধরের কাছে আমি রোজ করব।’

তিন

‘এই গরদের থানটা নাও। নীচে তোমার ঘরে গিয়ে পরে এসো। ভেতরে বাসি—পরা কাপড় কিছু রেখো না। আমি পুজো শুরু করি শাশুড়ির লালপাড় গরদের শাড়ি পরে সেটার তো তখন কুটিকুটি অবস্থা, গা ঢাকব কী! এদিক ছেঁড়া ওদিক পেঁজা। তাই পরেই ক—টা বছর চালালুম, বিধবা হবার পর এই থানটা কিনলুম। যাও পরে এসো।’

বিজলি তাঁর এগারো বছরের পুরোনো বস্ত্রটি এগিয়ে ধরলেন। হাসি সেটা হাতে নিয়ে ইতস্তত করে বলল, ‘বাসি—পরা কাপড় রাখব না মানে!’

পদ্ম হেসে ফেলল। ‘মানে সায়া বেলাউজ আর বেচিয়ার গায়ে রাখবে না, আমরা তো দুটো মেয়েমানুষ। বাড়িতে এখন ব্যাটাছেলে বলতে তো ভুটু। লজ্জা করার কিছু নেই। যাও সব ছেড়ে থানটা পরে এসো।’

কাপড়টা নিয়ে হাসি বেরিয়ে যাবার পর পদ্ম বলল, ‘দেখলে মাসিমা বাসি কাপড় গায়ে রেখো না বলায় ওর মুখখানা কেমন হয়ে গেল।’

‘অল্পবয়সি মেয়ে, লেখাপড়া করা, বাইরে যায়, এরা কি চট করে গা—গতর আঢাকা করতে পারে? আমি যা পারি হাসির পক্ষে তা কি করা সম্ভব? মেয়েটা খুব সভ্য। বাড়ির শিক্ষা থেকেই এসব পায়, বুঝলি রে! ধুনুচিতে আর দুটো কাঠকয়লা দে, পিদিমটা এবার জ্বালা। আসনটা গুটিয়ে আছে কেন ঠিক করে পাত। রেকাবিতে শুধু বাতাসা! এলাচদানাও রাখ, ভুটু আছে না! পাঁচালি বইটা বার করে আমায় দে, হাসিকে দেখিয়ে দিতে হবে কোথা থেকে কোথা পর্যন্ত পড়বে।’

বালিশে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে বিজলি ঘরের কোণে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে একে একে নির্দেশ দিয়ে গেলেন। ঠাকুরের ছোটো আলমারি থেকে পাঁচালির বইটা বার করে পদ্ম বিজলির হাতে দিল।

‘মাসিমা বইটা এবার গঙ্গায় ভাসিয়ে দিয়ে নতুন একটা কেনো, পাতাগুলো ঝুরঝুর করছে। এই দ্যাখো দ্যাখো পাতাটা খসে গ্যালো।’ পদ্মর হাতে পাতলা বইটা থেকে একটা পাতা ঝরে পড়ল মেঝেয়। সে সেটা তুলে বিজলির হাতে দিল।

‘থাক না রে। গোটা আলমারি তো দখল করে নেই, বিসর্জন দেব কেন।’

খসে—পড়া পাতাটা সযত্নে পাঁচালি বইয়ের মধ্যে তিনি ঢুকিয়ে রাখলেন। ‘আট বছর আগে কেনা বইটা বুড়ো হয়ে গেছে, দেখেছিস কেমন পাকা চুলের মতো কাগজের রং, দাঁত পড়ার মতো খসে পড়ছে পাতা, চোখের নজরের মতো আবছা হয়েছে অক্ষর। বুড়ো হলেই কি গঙ্গায় পাঠিয়ে দিতে হয়, এই সময়ই তো যত্ন করতে হয়, সেবা করতে হয়।’ বিজলির স্বর ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে অদৃশ্য হল।

হাসি ঘরে ঢুকল, তার পিছনে ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা। হাসি আষ্টেপৃষ্ঠে গরদের থানটা শরীরে জড়িয়েছে। বিজলি মুচকি হাসলেন।

‘অত লজ্জা কীসের? ঘোমটা দিয়ে আঁচলটা গলায় জড়িয়ে নাও। এবার ধরো পাঁচালি বইটা, আমি পাতাটা খুলেই রেখেছি দশ—বারো পাতা। বেশি নয় আধঘণ্টার মধ্যেই পড়া হয়ে যাবে।’

বইটা হাতে নিয়ে হাসি ছেঁড়া মলাটের দিকে তাকিয়ে রইল। শিরোনামে রয়েছে ‘প্রতি বৃহস্পতিবারের শ্রীশ্রী লক্ষ্মীদেবীর ব্রতকথা ও পাঁচালি’। লেখার নীচে লক্ষ্মীদেবীর রঙিন ছবি, সিংহাসনে বসে কোলে ঝাঁপি, মাথায় মুকুট, দুই পা পদ্মফুলের উপর রাখা। তাঁর দুই পাশে নতজানু হয়ে প্রণাম জানাচ্ছে এক সধবা ও এক পুরুষ। বোধহয় স্ত্রী ও স্বামী। হাসি কৌতূহলভরে কিছুক্ষণ ছবিটা দেখে বলল, ‘মাসিমা ব্রতকথার শুরুতে যে বাংলায় চারলাইন সংস্কৃত কথা রয়েছে ও আমি পড়তে পারব না। ভুলভাল উচ্চচারণ করে শেষে অমঙ্গল ডেকে আনব!’

বিজলি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘না না ওসব না পড়লেও চলবে। আমিও তো উচ্চচারণ করতে পারি না বলে বাদ দিয়ে পড়ি। তুমি ওইখান থেকে পড়বে। এই বলে তিনি সুর করে মুখস্থ বলে গেলেন—’দোল পূর্ণিমানিশি নির্মল আকাশ। মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় বাতাস।। লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ। করিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন।।’ যাও ওই আসনে বসে কোষাকুষি থেকে গঙ্গাজল হাতের চেটোয় নিয়ে মুখে দাও, হাতটা মুছে নাও মাথায় তারপর প্রণাম করে শুরু করো।’

হাসি কম্বলের আসনে বসে হাতজোড় করে লক্ষ্মীর বাঁধানো ছবিকে প্রণাম করে যেভাবে বিজলি সুর করে চার লাইন মুখস্থ বলেছিলেন সেই ভাবে পড়তে শুরু করল। তার পাশে বসে পদ্ম। ধুনুচিতে ধুনোর গন্ধে ম ম করছে সারা ঘর। একগোছা ধূপও জ্বলছে পটের সামনে। ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা খাটের ধারে মেঝেয় বসল। দুই দেওয়ালে দুটি নিয়ন আলোয় ঘর উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। বিজলি বুকের উপর দুই কর রেখে আধবোজা চোখে হাসির দিকে তাকিয়ে। পাকা সোনার মতো প্রদীপ শিখার কাঁপা আলো হাসির শ্যামবর্ণ গালে কপালে নাকের ডগায় কানের লতিতে যেন চামর বুলিয়ে চলেছে। বিজলির মনে হল, মন্দ মন্দ মলয় বাতাস যেন হাসির মুখের উপর দিয়ে বহিতেছে।

সারা পাঁচালিটা গত পঁয়তাল্লিশ বছরে অন্তত দু—হাজার বার বিজলি পড়েছেন। এখন তাঁকে আর বই দেখে পড়তে হয় না, মুখস্থ বলে যান। হাসির পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে তিনিও পড়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ হাসি পড়া থামিয়ে বইয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল।

‘কী হল?’ ব্যস্ত হয়ে বিজলি জানতে চাইলেন।

‘মাসিমা এ জায়গাটায় পড়া যাচ্ছে না, অক্ষরগুলো মুছে গেছে।’

‘আগের লাইন দুটো বলো।’

হাসি পড়ল,

‘সহিতে না পারি আর সংসার যাতনা।

ত্যজিব জীবন আমি করেছি বাসনা।।’

হাসি শেষ করা মাত্র বিজলি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘নারায়ণী বলে শুনো আমার বচন। আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন।। অবন্তী নগরের লক্ষপতি ধনেশ্বর রায়ের বিধবা ছেলে বউদের অত্যাচারে ঘরে তিষ্টোতে না পেরে বনে চলে গেল মরবে বলে। এমন সময় নারায়ণী সেখানে ছদ্মবেশে হাজির হয়ে ওকে কথাগুলো বললেন। নাও পড়ো এবার, যাও সতী গৃহে গিয়ে কর লক্ষ্মীব্রত—।’

হাসি আবার পড়া শুরু করল। পাঁচালির সুর অন্যের মুখে বিজলি বহু বছর পর শুনছেন। শুনতে শুনতে একটা ঘোর তাঁকে আচ্ছন্ন করতে লাগল। শাঁখের আওয়াজ তাঁর ঘোর কাটিয়ে জানিয়ে দিল পাঁচালি পড়া শেষ হয়েছে।

‘এই তো কী সুন্দর পড়লে! এবার প্রসাদ মুখে দাও।’ বিজলি স্মিত মুখে বললেন।

হাসি বলল, ‘যা ভয় ভয় করছিল, মাসিমা আমি ঠিকমতো পড়েছি তো?’

‘বললুম তো সুন্দর পড়েছ, তোমার গলার স্বরটা তো খুব মিষ্টি, গানের মতো লাগছিল। পদ্ম, ভুটুকে এলাচদানা দে, কীরকম চুপ করে ব্যাটা মায়ের পড়া শুনছিল! ক—টা বছর যাক, বই পড়তে শিখুক, তখন ওকে দিয়ে পাঁচালি পড়াব। জানো হাসি তোমার মেসোমশাই তখন দশ বছরের, আমার শাশুড়ি ওকে দিয়ে বেস্পতিবারে পাঁচালি পড়াতেন।’

হাসি একটা বাতাসা মুখের মধ্যে দিয়ে চিবোতে থাকল। পদ্ম নীচু গলায় বলল, ‘আগে কপালে ঠেকিয়ে তবে মুখে দেবে।’

আর একটা বাতাসা রেকাবি থেকে তুলে কপালে ঠেকিয়ে মুখে পুরে হাসি বলল, ‘এবার হয়েছে? কত যে নিয়মকানুন। মাসিমা আপনার এখানে কত দেবদেবী আছেন বলুন তো? এ তো প্রায় একটা মিউজিয়াম। পাথরের মূর্তি পেতলের মূর্তি, ছবি। এত জনকে আপনি সামলান কী করে?’ সিংহাসনের সামনে লাল কাপড় মোড়া লম্বা কাঠের পাটাতনটা সে দেখাল।

পদ্ম বলল, ‘রোজ সকালে এক ঘণ্টা ধরে তো মাসিমা ওদের নিয়েই থাকে। আমাকে তো ছুঁতে দেয় না।’

‘সব না হলেও বেশিরভাগই আমার কেনা।’ বিজলি উৎসাহভরে নড়ে উঠেই সতর্ক হলেন পায়ের কথা ভেবে।

‘পদ্ম পিঠের বালিশটা ঠিক করে দে।’ হাসির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ওই যে নারায়ণ শিলা দেখছ ওটা দিয়েছেন আমার শাশুড়ি। তিনিও পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে। ওই যে কৌটোটা ওটা হল গাছকৌটো, কিনেছিলুম কালীঘাট থেকে। দ্বিতীয় বার পুরী গিয়ে কিনেছিলুম পাথরের জগন্নাথ সুভদ্রা বলরামের ওই মূর্তি। তারকেশ্বরের থেকে কিনেছি পাথরের তারকনাথ।’

বিজলি তিন ইঞ্চি উঁচু একটি শিবলিঙ্গ তর্জনী বাঁকিয়ে দেখালেন। ‘একটু সরে বোসো, এবার দ্যাখো ওই যে পঞ্চমুখী একরত্তি মূর্তিটা উনি হলেন গায়ত্রী দেবী। ওঁর পাশে গণেশবাবাজি। তোমার ছেলের ভীষণ পছন্দ ওঁকে। বালগোপাল দেখেছ? ওই যে ওখানে তারা মায়ের ছবির নীচে হামা দিচ্ছেন। ওই ছবিটা তো নিশ্চয় চেনো, তিরুপতি নাথ।’ বিজলি থামলেন। কল্পনার কোল থেকে নেমে ভুটু দাঁড়িয়ে উঠে খাটটা ধরে বিজলির সাদা প্লাস্টারে চাপড় বসিয়েছে।

‘ধর কল্পনা ধর।’ হাসি ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ‘লেগেটেগে যাবে, একটু হুঁশ রাখবি তো?’

বিজলি বললেন, ‘হাসি, এটা পাথরের মতো শক্ত, দ্যাখো ওর হাতে ব্যথা লেগেছে কিনা।’

দুরন্ত ছেলেকে এই ঘরে আর রাখতে না চেয়ে হাসি ভুটুকে নিয়ে নীচে চলে গেল। যাবার আগে বলে গেল, ‘কাপড়টা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

‘একদম কিছু জানে না হাসিদি।’ পদ্ম বলল, ‘শুধু লেখাপড়াই করেছে। তবে হ্যাঁ গলাটা খুব মিষ্টি, পড়েছেও বেশ পষ্ট করে।’

‘তা তো বুঝলুম। তোকে যে বললুম রাধাকে গিয়ে বলে আসতে আমার পা ভেঙেছে বলেছিস?’ বিজলি চড়া গলায় বললেন।

‘ওই দ্যাখো! একদম ভুলে গেছি। এখুনি যাচ্ছি।’ পদ্ম জিভ কেটে ছুটে বেরিয়ে গেল।

বিজলি এখন একা এবং একা হলেই নানান কথার বিষয় তাঁর মাথায় ভিড় করে। প্রথমেই মনে হল হাসি কাল এক্সরে করাতে গেছিল, ওকে তো জিজ্ঞাসা করা হল না কী পাওয়া গেল ছবিতে? শ্রীধর, খারাপ কিছু যেন ছবিতে না বেরিয়ে আসে। বিজলি মুখ ফিরিয়ে পিতলের রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজলেন। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে বিড়বিড় করলেন, ‘আচ্ছা মেয়ে তো, বলবে তো আমায় ছবিতে কী পাওয়া গেল। যেচে যেচে আমাকেই জিজ্ঞেস করতে হবে। কেন?’ এই কেনর সন্ধান করতে গিয়ে বিজলি ক্রমশ নিজের উপর বিরক্ত হতে থাকলেন। ‘যত উটকো ঝামেলা নিয়ে মাথা ঘামানো।’

এই সময় ‘দিদিমা আসব?’ দরজার কাছ থেকে ডাক শুনে বিজলি তাকালেন এবং বললেন, ‘আয়, তপতী। আমার ইলেকট্রিক বিল কিন্তু এখনও আসেনি।’

তপতী, আঠারো—উনিশ বয়সি বউ। তার পরনের সস্তা শাড়ি, রুক্ষ গাত্রত্বক এবং আভরণহীনতা বুঝিয়ে দেয় দারিদ্র্যের কিনার ঘেঁষে সে জীবনযাপন করে। লাজুক কোমল স্বভাবের মেয়েটিকে এক দুপুরে পলাশই পরিচয় করাতে বিজলির কাছে এনেছিল।

‘দিদিমা এই হচ্ছে তপতী, আমার বন্ধু দুলাল, তাকে চেনেন তো, না চিনলেও নামটা তো শুনেছেন, এ হচ্ছে দুলালের বউ। দুলাল ওয়াটার পোলো খেলত হেদোয় সেন্ট্রাল ক্লাবে, খুব ভালো প্লেয়ার ছিল, বেঙ্গলে খেলেছে, ইস্টার্ন রেলে চাকরি প্রায় হয়েই গেছিল। কিন্তু—।’

‘কিন্তু কী? আমি শুনেছি বোমা বাঁধতে গিয়ে ডান হাতটা কবজি থেকে উড়ে গেছে।’ বিজলি কঠিন কর্কশ স্বরে পলাশকে শুনিয়ে দিয়েছিলেন। ‘যারা বোমাটোমা নিয়ে কারবার করবে তারা বিয়ে করে কেন বল তো? দ্যাখ তো এই একরত্তি মেয়েটা বিয়ে করে কী বিপদে পড়ল। স্বামীর হাত নেই। রোজগার করার জন্য একমাত্র তো সম্বল ছিল ওই হাত, এবার খাবে কী? বিয়ে দেবার আগে বাপ—মা কি একটু খোঁজখবরও নেয় না, কেমন ছেলের হাতে মেয়েকে দিচ্ছে।’

‘দিদিমা, বাপমা বিয়ে দেয়নি, তপু নিজেই বিয়ে করেছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে। দুলাল কিন্তু বাজে ছেলে নয়। বাড়ির বড়ো ছেলে, গরিব, মাধ্যমিক পাশ। বাবা খবরের কাগজ বিক্রি করে। তাই দিয়ে বাড়িভাড়া মিটিয়ে সাতটা লোকের সংসার চালানো যায় না। দুলাল কার জন্য কাদের জন্য বোমা বাঁধত সে প্রশ্ন করবেন না। দিদিমা এই মেয়েটা দাঁড়াতে চায় একে একটু সাহায্য করুন।’

বিজলি একদৃষ্টে পলাশের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনেছিলেন। তারপর তাকান তপতীর দিকে। মাথা নামিয়ে ছিল মেয়েটা, মাথা—ভরতি ঘন চুলের মধ্যিখানে সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর, হাতে শাঁখা লোহা পলা। মেয়েটা একবার মাথা তুলে তাকায় বিজলির দিকে, ভীত ত্রস্ত চাহনি। বিজলি জিজ্ঞাসা করেন, ‘ভাত খেয়েছিস?’

তপতী চুপ করে থাকে।

‘পদ্ম ভাত চড়া।’ বিজলি চেঁচিয়ে ওঠেন। তারপর পলাশের দিকে তাকান। ‘বল এবার আমাকে কী করতে হবে?’

‘পাড়ার সব বাড়িতেই আপনি যান, সব বাড়িকেই ইলেকট্রিক অফিসে বিল জমা দিতে হয়, টেলিফোন আছে তেরোটা বাড়িতে তাদেরও বিল জমা দিতে হয়। পোস্টাপিসে টাকা তোলা জমা দেওয়া অনেককেই করতে হয়। কর্পোরেশন ট্যাক্সও সবাইকে দিতে হয়। যা সব বললুম সবগুলোতেই লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হয়। তপুকে যদি চারটে করে টাকা দেয় তা হলে আর লাইনে দাঁড়াতে হবে না, লাইন দিয়ে কাজটা ওই করে আসবে। আপনি যদি ওকে নিয়ে বাড়িগুলোয় একটু ঘোরেন। আমিও এটা করতে পারতুম তবে আমাকে তো বিশ্বাস করবে না, আপনাকে কিন্তু করবে।’

সেই দিনই বিকেল থেকে বিজলি জয় দত্ত স্ট্রিটের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন পদ্ম আর তপতীকে সঙ্গে নিয়ে। ‘গরিব মেয়ে, স্বামীর রোজগার নেই, খেটেখুটে ক—টা টাকা আয় করতে চায়। ওকে আপনারা একটু দেখুন না। আমি ওকে চিনি, এই অ্যাতোটুকু বয়স থেকে দেখে আসছি। আপনারা নিশ্চিন্তে নির্ভয়ে ওর হাতে টাকা দিতে পারেন আমি জামিন থাকব।’

দু—দিনেই পাড়ার পঁচাত্তর শতাংশ পরিবার তপতীর খদ্দের হয়ে যায়। পদ্ম একবার বলেছিল, ‘মাসিমা তুমি বললে কী করে মিথ্যে কথাটা, তপুকে অ্যাতোটুকু বয়স থেকে দেখে আসছি, ওকে তো সেদিনই প্রথম দেখলে।’

‘মিথ্যে কথা বলেছি তো কী হয়েছে?’

‘মিথ্যে বললে পাপ হয় না?’

‘হয় তো হোক। শ্রীধর জানেন আমি কেন কীজন্য বলেছি, আমি মানুষ চিনি। তোর মতো রাস্তার চাপাকল থেকে জল এনে বলি না গঙ্গা থেকে নিয়ে এলুম।’ বলেই পদ্মর সামনে থেকে দ্রুত পা চালিয়ে নীচে নেমে এসে অলকাদের বাড়ি চলে যান।

‘পদ্মকে খেপিয়ে দিয়েছি এখন আধঘণ্টা বাড়ি ঢুকতে পারব না।’ বলে সময় কাটাতে বকরাক্ষসের গল্প শোনাতে শুরু করেন বাচ্চচু আর মিঠুকে।

বিজলি একা শুয়ে হাসির এক্সরে করা এবং তার ফলাফল তাকে না জানানোয় মাথা গরম করে যখন নিজের উপর বিরক্ত সেই সময় ‘দিদিমা’ বলে তপতী হাজির হল।

‘এত রাত্রে কী ব্যাপার, হাতে ওটা কী?’

‘নিমপাতা, আপনি নিমের ঝোল খেতে ভালোবাসেন বলেছিলেন। আমাদের সামনের বাড়িতে নিমগাছ আছে। মাঝেমাঝে ডাল ছাঁটে আজ ছাঁটছিল আমি সেখান থেকে দুটো কঞ্চি নিয়ে রেখেছি আপনার জন্য।’

‘ভালো রেখে যা। কাজকম্মো কেমন চলছে, খদ্দের বাড়ল?’

‘বাড়ছে আর কই, সবাই বলে আমাদের বিল দেবার লোক আছে। ওই তো আপনার সামনের বাড়ির শঙ্করবাবু, আজ গেছিলুম, অন্নপূর্ণাদি বলল, টেলিফোনের বিল আর তোমাকে দিতে হবে না। ব্যাঙ্কের সঙ্গে ব্যবস্থা হয়েছে, তারাই টেলিফোন অফিসে টাকা পাঠিয়ে দেবে।’ তপতী হতাশ চোখে তাকাল। ‘এরপর তো অন্যরাও একই পথ ধরবে।’

‘তোর বর করছে কী?’

‘বাঁ হাত দিয়ে যতটা পারে চেষ্টা করছে। একজন বলেছে নকল হাত করালে কাজ করতে সুবিধে হবে। সেও তো কত টাকার ব্যাপার!’

‘কত টাকার খোঁজখবর নিয়েছিস?’

তপতী কিন্তু কিন্তু করে বলল, ‘হাজার পাঁচ—ছয় পড়বে বলেছে।’

‘পাঁচ—ছ—হাজার বলে হাত আটকে থাকবে?’ ধমক দিয়ে বিজলি কড়া চোখে তাকালেন, ‘একটা হাতের গুরুত্ব মানুষের জীবনে কত তা কি তুই বুঝিস? এখনও কত বছর বাঁচবে, তোর বর, সে কি ওই নুলো হয়ে? এরপর ছেলেপুলে হবে, রোজগারপাতি বাড়াতে হবে, দুটো হাত, তা যেমন তেমনই হোক না, থাকলে তো সুবিধেই হবে। আমার তো তিনকাল গিয়ে এককাল ঠেকেছে, এই খোঁড়া হয়ে শুয়ে রয়েছি, জানি না জীবনে আর ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারব কিনা, তবু তো আমার ইচ্ছে করে তোদের মতো হাঁটতে ফিরতে চলতে।’ দ্রুত কথাগুলো বলে বিজলি তাকিয়ে রইলেন। মাথা নীচু করে বসে তপতী, মুখটি শুকিয়ে করুণ।

‘কবজি থেকে চেটো নেই জেনেই বিয়ে করেছিস?’

‘হ্যাঁ।’ ক্ষীণস্বরে তপতী বলল।

‘কেন?’

‘আমার ভালো লেগেছিল ওকে।’ আরও ক্ষীণ গলায় বলল।

‘কেন ভালো লাগল?’

‘জানি না দিদিমা।’ তপতী মাথা নাড়ল, ‘আমি জানার চেষ্টাও করিনি। ও বারণ করেছিল, বলেছিল, তোমাকে কষ্ট করে থাকতে হবে। আমি বলেছিলুম সীতা যদি স্বামীর সঙ্গে বনে গিয়ে কষ্ট করে থাকতে পারে তা হলে আমিও পারব।’

বিজলি চুপ করে রইলেন। তপতী লক্ষ করল দিদিমার চোখ বোজা মুখখানি ফেরানো রয়েছে ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে। মুখটি মমতায় মায়ায় কোমল।

‘টাকার ব্যাপারটা খোঁজ নে। হাজার পাঁচেকের মধ্যে হলে আমাকে বলিস। আর শোন সেলাই জানিস?’

‘না।’

‘বরকে বল খোঁজ নিতে কাছাকাছি কোথায় সেলাই শেখবার ইস্কুল আছে, ভরতি হয়ে যা। বাড়িতে বসেই জাঙিয়া, ফ্রক, সায়া, ব্লাউজ তৈরি করতে পারবি। পাঁচ নম্বর বাড়ির দুর্গাচরণ হাওড়ার মঙ্গলাহাটে এইসব বিক্রি করে। ওকে আমি বলব তোকে যেন অর্ডার টর্ডার দেয়। লোকটা ভালো।’

‘দিদিমা আমার তো সেলাই মেসিন নেই। কী করে জাঙিয়া, ফ্রক করব?’

‘আহহ এই হল তোদের দোষ।’ বিরক্তিতে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বিজলি। ‘ধৈর্য বলে কোনো পদার্থ আজকাল ছোঁড়াছুঁড়িদের নেই। ভালো লেগেছে তো পট করে বিয়ে করে ফেলল। আগে গাছে তো ওঠ তারপর তো এককাঁদি পাবি। সেলাই কাটা কাঁচি ধরা এসব আগে শেখ তারপর তো মেসিন লাগবে। চোদ্দো নম্বর বাড়ির দোতলার ভাড়াটেবউ একটা নতুন মেসিন কিনেছে তাতে এমবয়ডারি করা যায়। কথায় কথায় আমাকে বলেছিল পুরোনোটা বিক্রি করে দেবে দু—হাজার টাকা পেলে। এক্ষুনি গিয়ে দ্যাখ ওটা আছে না বিক্রি হয়ে গেছে। থাকলে বলবি আমি কিনব, মানে তুই কিনবি। চিনিস তো বাড়িটা? রাস্তার আলো যে—বাড়িটার গায়ে লাগানো, দোরগোড়ায় একটা টিউয়েল ছিল।’

‘চিনি। কালো রোগা লম্বা চশমা পরা বউ তো? ওদের টেলিফোন ইলেকট্রিক বিল তো আমিই দিই, মাসে মাসে পোস্টাপিস থেকে তো সাড়ে তিনশো টাকা আমি তুলে আনি।’

‘দৌড়ে যা এক্ষুনি।’

আক্ষরিক অর্থেই তপতী পায়ে হাওয়াই চটি গলিয়ে বারান্দা দিয়ে ছুটে গেল। সিঁড়িতে ওর চটির দ্রুত ফটফট শব্দ থেকে বিজলি বুঝলেন, মেয়েটার দাঁড়ানোর আগ্রহ কতটা। খড়কুটো যা পাবে এখন আঁকড়ে ধরবে। এবং এটাও বুঝলেন নরম মনের শান্ত স্বভাবের একরত্তি তপতী লড়বে, দাঁড়াবে।

সারা দিনে এই সময়টাই বিপন্নবোধ করেন বিজলি। সব বাড়িই এখন সংসারের কাজে ব্যস্ত, যাওয়া যায় না। ঘরে কতক্ষণ আর পদ্মর সঙ্গে কথা বলা যায়। ওই টিভি বা টেলিফোন থাকলে সময় কাটানো যায় কিন্তু এর কোনোটাই তাঁর নেই বা রাখতে চাননি। কথা বলার মতো কেউ এলে তিনি খুশি হন। সমবয়সি বুড়িদের সঙ্গে কথা বলতে তাঁর একদমই ভালো লাগে না। ওরা এত নীরস নিষ্প্রাণ, যে দুটো কথা বলার পরই তিনি ক্লান্ত বোধ করেন।

তপতী চলে যাবার পর একা ঘরে তাঁর মনে হল টিভি থাকলে তবু সময় কাটানো যায়। টেলিফোন থাকলে কারোর সঙ্গে কথা বলা যায়। কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলবেন? কথা বলার মতো লোকজন তো সব পাড়াতেই রয়েছে তাদের সঙ্গে কি ফোনে কথা বলতে হবে! ভেনিয়াপুরে দাদার বাড়িতে অবশ্য টেলিফোন আছে। কিন্তু শুধু একজনের সঙ্গে কথা বলার জন্য টাকা খরচ করে ওটা রাখার মানে হয় না। বিজলি বাংলা খবরের কাগজ রাখতেন। বছর চারেক আগে হাসপাতালে কুকুরে আধখাওয়া এক শিশুর ছবি কাগজে দেখার পর তিনি কাগজ নেওয়া বন্ধ করে দেন। গ্রামোফোন ছিল। তাঁর বিয়ের আগে শ্বশুর কিনেছিলেন। এখন সেটা কাঠের সিন্দুকটার মধ্যে ভাঙা স্প্রিং নিয়ে পড়ে আছে। প্রায় সত্তরটা রেকর্ড বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। নেবার লোক পাননি। টেপরেকর্ডার আর ক্যাসেটের যুগ এখন। একই গান কতবার আর শোনা যায়? সাত—আটবার শোনার পর একঘেঁয়ে লাগতে শুরু করে। রেকর্ডগুলো কিলো দরে বিক্রি করে দিয়েছেন।

বিজলির এখন মনে হল তাঁর একটা ছেলে থাকলে বউমা নাতি নাতনিতে সংসার ভরে থাকত। তিনিও এমন একা নিঃসঙ্গ হয়ে থাকতেন না। শ্রীধরের কাছে নিত্য প্রার্থনা করেছেন সন্তানের জন্য, কত নামকরা দেবদেবীর স্থানে মানত করে হত্যে দিয়েছেন, গাছে ঢিল বেঁধেছেন, এঁদো পুকুরে স্নান করে পুজো দিয়েছেন, বুক চিরে রক্ত বার করেছেন কিন্তু কিছুতেই গর্ভে সন্তান আসেনি। একসময় দত্তক নেবার কথাও ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু কৃষ্ণকিশোর রাজি হননি। তাঁর বংশধারায় অন্য ধারার রক্ত নিয়ে আসায় প্রবল আপত্তি ছিল। বিজলি ডাক্তারের কাছে তাঁকে নিয়ে যাবার কথা বলেছিলেন, স্বামী রাজি হননি। কেন রাজি হননি সেটা এখনও তাঁর কাছে হেঁয়ালি হয়ে রয়েছে।

বারান্দায় পায়ের শব্দে চোখ খুলে বিজলি তাকালেন। পদ্ম চটি খুলে ঘরে ঢুকল।

‘বলেছিস রাধাকে?’

‘বলেছি।’

‘শুনে কী বলল?’

বিজলির পাশে এসে কানের কাছে মুখ রেখে পদ্ম ফিসফিসিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ বলল, আমাকে বিষ এনে দিবি?’

অবাক চোখে বিজলি তাকিয়ে বললেন, ‘কেন?’

‘কেন, তা বলার মতো ক্ষমতা থাকলে তো বলবে, তুমি আন্দাজ করে নাও, একটা মানুষ বিষ খেয়ে মরতে চায় কেন!’ পদ্ম জিজ্ঞাসু চোখে বিজলির বিমূঢ় দৃষ্টির মোকাবিলা করে নিজেই উত্তরটা দিল, ‘আট বছর ধরে চাকা লাগানো চেয়ারে বসা আর খাটে শোয়া; দাঁড়ানো নয় চলা নয়, পরিষ্কার করে কথাও বলতে পারে না; এমনভাবে জীবন কাটাতে কার ভালো লাগে বলো?’

বিজলি চট করে উত্তর দিতে পারলেন না। নিজেকে নিয়ে একটু ভাবলেন। একটা পা ভেঙে দুটো দিন মাত্র বিছানায় শুয়ে আছেন, বাইরের লোক আসছে, কথা দিব্যি বলছেন, এবং এটাও জানেন পা আবার ভালো হয়ে যাবে। আগের মতো হাঁটাচলা করবেন, এবাড়ি ওবাড়ি যাবেন। জীবন যেমন ভাবে চলে এসেছে সেই ভাবেই চলবে। এটা জানা সত্ত্বেও তো দুটো দিন কি একঘেয়ে বিরক্তকর লাগেনি? চলাফেরা কিংবা গতি না থাকলে জীবন যেন অর্থহীন হয়ে যায়—বিজলির এটাই মনে হচ্ছে এখন।

রাধা তো আট আটটা বছর বেঁচে মরা হয়ে রয়েছে। ওষুধ খেয়ে সেবাযত্ন পেয়ে হয়তো আরও দশ—পনেরো বছর বেঁচে থাকবে। কিন্তু সে বাঁচা তো মরার বাড়া। চতুর্দিকে লোক হাঁটছে ছুটছে ইচ্ছেমতো কাজকম্মো করছে, নানান ব্যাপার দেখছে তাইতে হেসে উঠছে, দুঃখ পাচ্ছে, ছুটে বারান্দায় এসে ঝুঁকে রাস্তা এধার—ওধার দেখছে, ফেরিওয়ালাকে ডাকছে, এসবের তো কিছুই রাধা পাচ্ছে না! ওর মনে ওঠানামাও তো মরেই গেছে!

‘রাধার কথা শুনে তুই কী বললি পদ্ম?’

‘বললুম এমন কথা মুখে এনো না। জানো না আত্মহত্যা মহা পাপ, নরকে গমন? তাই শুনে মাথাটা শুধু কাত করল। মনে হল জানে আত্মহত্যা করলে নরকে যেতে হবে!’ পদ্মকে অবাক দেখাল।

‘তবু বিষ খেতে চায়! পাঁচালির কথাগুলো এখন মনে হচ্ছে কেমন জানি অচল হয়ে যাচ্ছে রে পদ্ম, কেউ আর তেমন গ্রাহ্যি করে না। করবেই বা কেন, শরীর পঙ্গু হয়ে গেলে তার আর নরকের ভয় থাকে না। রাধুর চলে যাওয়াই ভালো।’ মন্থর ভগ্ন স্বরে বিষণ্ণ গলায় বিজলি বললেন। তারপরই মনে পড়ল হাসি তো গরদের থানটা ফেরত দিয়ে যায়নি এখনও।

‘ওরে পদ্ম নীচে গিয়ে দেখ তো হাসি কাপড়টার কী করল। অনেকদিনের পুরোনো, ছিঁড়েটিড়ে না ফেলে।’

নীচের থেকে ঘুরে এল পদ্ম। হাতে ভাঁজ—করা গরদের কাপড়টা। ‘হাসিদি বেরিয়েছে বুকের ছবিটা আনতে, ডাক্তারের কাছে হয়ে বাড়ি ফিরবে। কল্পনাকে বলে গেছিল কাপড়টা ফেরত দিয়ে আসতে। ভুটুকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে ও নিজেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি ডেকে তুললুম।’

‘হাসি কখন ফেরে একটু নজর রাখিস। ফিরলেই নীচে গিয়ে জেনে আসবি এক্সরে রিপোর্টে কী বলেছে। কেন জানি আমার ভালো লাগছে না। তুই বরং নীচে গিয়ে সদরে দাঁড়িয়ে থাক।’

কিছুক্ষণ পরেই হাঁফাতে হাঁফাতে এল তপতী।

‘দিদিমা আছে এখনও, বিক্রি হয়নি।’ উত্তেজনায় উদ্দীপনায় টসটস করছে তপতীর মুখ। ‘প্রথমে বলল তিন হাজার, এখন নতুনের দামই পাঁচ হাজার, আমি বললুম দিদিমাকে তো বলেছেন দু—হাজার পেলেই বেচে দেবেন। তাইতে বলল তখন বলেছিলুম তখনকার দাম, এখন বেড়ে গেছে। আমি তারপর বললুম মেশিন দিদিমা কিনবে। অমনি বলল ঠিক আছে দু—হাজারেই দোব তবে তিন দিনের মধ্যে পুরো দাম চুকিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

‘আমার নাম করলি? বারণ করেছিলুম না?’ বিজলির গলায় ভর্ৎসনা।

অপ্রতিভ হয়ে কুঁকড়ে গেল তপতী। ‘কী করব। মেশিনটা দেখলুম চোখের সামনে ঢাকনা দেওয়া রয়েছে। মনের মধ্যে কীরকম যেন একটা করে উঠল, আমি বলে ফেললুম আপনার নাম।’ মুখ নামিয়ে সে ভাঙা গলায় বলল, ‘আমার দোষ হয়েছে, মাপ চাইছি।’ বিলির প্লাস্টারে হাত রাখল তপতী।

‘কাল এসে টাকাটা নিয়ে যাস। আর সেলাই মেশিনটা আমাকে দিয়ে যাবি। যত দিন না সেলাই শিখবি তত দিন ওটা আমার এই ঘরে থাকবে। আমি দেখব তুই আমার চোখের সামনে বসে ভুটুর জাঙিয়া, পদ্মর ছায়া আর আমার ব্লাউজ সেলাই করেছিস তবেই ওটা পাবি নইলে পাবি না। যা বলেছি এখুনি সেলাই ইস্কুলে ভরতি হয়ে যা। তোর কাজ দেখার পর দুর্গাচরণকে বলব।’

‘কাল কখন আসব দিদিমা?’ তপতী উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল।

‘দশটা এগারোটার সময় আসিস আর দুটো ছেলে জোগাড় করে আনবি—ওটা তো বয়ে আনতে হবে।’

তপতী চলে যাবার পর বিজলি টাকার পুঁটলিটা খুললেন। গুনে গুনে দু—হাজার টাকার একশো—পাঁচশোর নোট বার করে আলাদা রেখে বাকি টাকা গুনে পুঁটলিতে বেঁধে রাখলেন। বিড়বিড় করলেন, ‘আর খরচ করা নয়, এখনও দুটো মাস চালাতে হবে। দাদাকে খবর দিতে হবে পা ভেঙে বিছানায় পড়ে আছি।’

আবার একা। মনে পড়ল মুখ থেকে বেরিয়ে আসা পদ্মকে বলা কথাটা : ‘পঙ্গু হয়ে গেলে তার নরকের ভয় থাকে না।’ কথাটা কি মন থেকে বেরিয়ে এসেছিল? তাঁর কি নরকের ভয় নেই। বিজলি সাত পাঁচ ভেবে বললেন। দেখতে পেলেন বারান্দা দিয়ে গুটি গুটি ছাই রঙের হুলো বেড়ালটা আসছে। প্রায়ই আসে, রান্নাঘরে ঢোকে, এটাওটা শুঁকে বেরিয়ে যায়। নিরিমিষ হেঁসেল। ওঁর খাবার মতো কিছু থাকলে তো! বিজলি ‘হেই হেই’ বলে চিৎকার করলেন, ‘কিছু নেই যা ভাগ ভাগ।’ এধার ওধার তাকিয়ে তিনি খুঁজলেন লাঠির মতো কিছু পাওয়া যায় কিনা। না পেয়ে তালু দিয়ে বিছানায় চাপড় দিয়ে আবার চিৎকার করলেন। হুলো মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে আবার গদাইলশকরি চালে ফিরে গেল। বোঝা গেল, এই বাড়িতে কখনো প্রহার জোটেনি। তাই কাউকে তোয়াক্কা করে না।

বিজলির চিৎকার শুনে তাড়াতাড়ি সদর থেকে পদ্ম উঠে এসেছে।

‘সেই হুলোটা এসেছিল। বোধহয় আজ খাওয়াটাওয়া জোটেনি। চেঁচিয়ে তাড়ালুম। দুধ আছে তো তোলা, তাই থেকে খানিকটা ওকে দে। দ্যাখ ধারেকাছেই কোথাও আছে। মা ষষ্ঠীর বাহন উপোস দিয়ে থাকবে?’

নীচের থেকে কল্পনার গলার আওয়াজ আর ঝাঁটা মারার শব্দ ভেসে এল। বিজলি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘ওরে পদ্ম নীচে রয়েছে। এখুনি দুধটা দিয়ে আয়, মারতে বারণ কর।’

পদ্ম ছুটে বারান্দায় গিয়ে ঝুঁকে পড়ল। ‘কল্পনা ওকে মারিসনি। আমি ওর দুধ নিয়ে যাচ্ছি, খাওয়াব।’

পদ্ম প্লাস্টিকের বাটিতে দুধ নিয়ে নেমে গেল। মিনিট দশেক পর ফিরে এল, সঙ্গে হাসি। হাসির হাতে হলুদ রংয়ের একটা বড়ো খাম।

‘তোমার ব্যাপার কী বলো তো?’ বিজলি অনুরোগ অভিমান রাগ একসঙ্গে মিশিয়ে দিলেন তারস্বরে। ‘ডাক্তার দেখাচ্ছ এক্স—রে করছ অথচ আমায় কিছু বলছ না। অবিশ্যি আমি কে যে আমায় বলবে।’

‘ভালো কিছু খবর থাকলে নিশ্চয় বলব।’ স্বাভাবিক অনুত্তেজিত স্বর হাসির, ‘ডাক্তার সন্দেহ করছেন ক্যানসার, নিশ্চিত হবার জন্য বায়োপসি করাতে বললেন।’

বিজলি স্তম্ভিত চোখে হাসির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, মুখ দিয়ে কথা সরছে না।

‘এই হচ্ছে ব্যাপার। আমি যাই মাসিমা।’ হাসি কথাটা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বিজলির বিমূঢ় ভাব তখনও কাটেনি। পদ্ম বলল, ‘হাসিদি কী অসুখ হয়েছে বলল?’

‘ক্যানসার, তুই বুঝবি না। একে বলে কর্কট রোগ। কর্কট মানে কাঁকড়া। এই রোগে কাঁকড়ার কামড়ের মতো অসহ্য যন্ত্রণা হয়, তাই এই নাম। এ রোগে বাঁচে খুব কম।’ বিজলি ক্ষীণ স্বরে বললেন, বুকের মধ্যেটা যা তাঁর খালি লাগছে। বিশ্বাস হচ্ছে না তাঁর থেকে এত অল্পবয়সির এমন একটা রোগ হতে পারে।

পদ্মর চোখ বিস্ফারিত হল বিজলির কথা শুনে। ‘বলে কী মাসিমা, হাসিদি বাঁচবে না? কাঁকড়ার কামড় খেতে খেতে মরে যাবে! এ কী রকমের অসুখ, আমি তো কাউকে এমনভাবে মরতে দেখিনি, শুনিনি।’

‘জীবনে তুই কতটুকু আর দেখেছিস শুনেছিস? আমার নন্দাই এই রোগে মারা গেছিল। বুকের কলজেদুটো খেয়ে ফেলেছিল, সারা শরীরে রোগ ছড়িয়ে গেছিল, গা ফেটে রক্ত বেরোত। খুব সিগারেট খেত দিনে তিরিশ—চল্লিশটা।’

‘হাসিদি তো সিগারেট খায় না!’

‘না খেলেও নয় । কখন যে কার হবে কেউ বলতে পারে না। এই পাশের বাড়িতে অলকাদের আগ যারা ভাড়া থাকত তাদের গিন্নির হয়েছিল পেটে। অপারেশন করার পর ক—টা দিন ভালো ছিল, ওর কিন্তু যন্ত্রণা হত না। তারপর আবার রোগ ছড়িয়ে শ্বাসনালিটায় ধরে, শ্বাস নিতে পারত না, সাত দিন বেঁচেছিল।’ বিজলির এখন পর পর মনে পড়ছে ক্যানসারে মারা যাওয়ার ঘটনাগুলো, পদ্মর ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি চুপ করে রইলেন।

‘মাসিমা কখন কার হবে কেউ জানবে না! বলছো কী তুমি, আমার হলে তা হলে আমিও জানব না?’ ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে পদ্মর কণ্ঠস্বর।

বিজলি কান দিলেন না পদ্মর কথায়। মনের মধ্যে হাসির মুখটা বড়ো হয়ে ফুটে উঠছে। শান্ত অচঞ্চল চোখদুটো। ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা যেন আগেই চুকিয়ে ফেলেছে। মৃত্যু নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আর কোনো লাভ নেই, তিরিশ—চল্লিশ বছর পরে তো মরতুমই নয় তিরিশ—চল্লিশ বছর আগেই মরব এমন একটা ভাব যেন ওর বলার ভঙ্গিতে ছিল। কিন্তু হাসি তোয়াক্কা না করলেও তিনি তো করেন। তাঁর বুকের মধ্যেটা যে খালি লাগছে। বিশাল বিশাল গাছের একটা বন ছিল, গাছগুলো আচমকা প্রচণ্ড ঝড়ে মড়মড় করে ভেঙে পড়ে তৈরি করে দিল ফাঁকা জমি। এই ফাঁকা জমিতে চারদিক থেকে বাতাস ছুটে আসছে। ধুলো বালিতে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে চোখ।

বিজলি বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে বাহু চোখের উপর রেখে বললেন, ‘রাতে আর খাব নারে, তুই খেয়ে নে। আলোটা নিভিয়ে দে, চোখে লাগছে।’

চার

প্রতিদিন ভোরে যখন বিজলির ঘুম ভাঙে তখনও ঘরটা আবছা থাকে। জয় দত্ত স্ট্রিটের ঘরে ঘরে সূর্যের আলোর আভা উজ্জ্বল হয়ে উঠতে সাতটা বেজে যায়। মধ্যরাত পর্যন্ত তিনি ঘুমোতে পারছেন না দু—দিন ধরে। অজস্র রকমের ভয়ংকর চিন্তা তাঁকে গ্রাস করে থাকে। শেষ রাতে তাঁর মাথাটা ঝিমিয়ে আসে। চিন্তা ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়, তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।

‘মাসিমা, ও মাসিমা কী কাণ্ড হয়ে গ্যাছে ওদিকে, ওঠো ওঠো।’

পদ্মর ঠেলা খেয়ে বিজলি চোখ খুলেই বললেন, ‘হাসির কী হল?’

‘হাসি নয় হাসি নয়, ও বাড়ির রাধু মাসিমা। ধরাধরি করে ওঁকে শঙ্করবাবু আর নাথু গাড়িতে তুলল, সঙ্গে অন্ন। হাসপাতালে নিয়ে গেল। বাড়ির সামনে লেকে জমে গেছে, বলাবলি করছে রাতে বিষ খেয়েছে নাকি! রাধু মাসিমা বিষ পেল কী করে?’

বিজলি যেসব চিন্তা রাতে করেছেন তাতে রাধুকে তিনি চিন্তার গণ্ডির মধ্যে আনেননি। কেন আনেননি ভেবে অবাক হলেন। রাধুই তো এতকাল ছিল তাঁর দুশ্চিন্তা!

‘ওদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নে। জবার মা তো ভোরে কাজ করতে আসে। নিশ্চয় কথাবার্তা যা হচ্ছিল শুনেছে? ওকে জিজ্ঞেস কর। আর নীচের দাদাকে দেখতে পেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বল। হাসিকে কী যেন একটা পরীক্ষা করতে বলেছিল ডাক্তার, তার কী হল সেটা জানতে হবে।’

এরপর শুরু হল বিজলির ছটফটানি। ইচ্ছে হচ্ছে ছুটে যেতে সামনের বাড়িতে। রাধুকে কোথায় নিয়ে গেল, কেমন রয়েছে, কী করে বিষ খেল, বাঁচবে না মরবে এমন অজস্র প্রশ্ন তাঁর মাথায় কেঁচোর মতো নড়েচড়ে উঠছে। উত্তরগুলো সংগ্রহ করে ফেলতে পারতেন যদি চলাফেরা করতে পারতেন। না পারার জন্য রেগে উঠলেন নিজের ভাঙা পায়ের উপর। ‘হতচ্ছাড়া পা, ভাঙার আর সময় পেলি না, পদ্মটাও তেমনি একটা রোগাপটকা বুড়ো রিকশাওয়ালাকে ধরে আনল, শক্ত জোয়ান হলে রিকশাটা ঠিক ধরে রাখত, উলটোত না।’

রাধাকিঙ্করীর জন্য বিজলির অস্থির বোধ করার যুক্তি আছে। তিরিশ বছর আগে রাধু যখন বিয়ের পর প্রথম শ্বশুরবাড়িতে আসে তখন তাকে বরণ করে যাঁরা তোলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সামনের ভটচায বাড়ির বউ বিজলি। এক ঘড়া জল তিনি মোটরের দরজার সামনে রাস্তায় ঢালেন। গাড়ির দরজা খুলে নতুন বউ জল ধোওয়া রাস্তায় প্রথম পা ফেলেছিল। তারপর থেকে তিনি তিরিশ বছর রাধুর ‘দিদি’। ওদের ছাদটা বড়ো। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাঁশের লম্বা ঝুলঝাড়াটা নিয়ে রাধু ছোটাছুটি করে কাটাঘুড়ি ধরছিল। এ—বাড়ির ছাদ থেকে বিজলি হাততালি দিয়ে বলেছিল, ‘রাধু ওড়া তো দেখি।’ ঘুড়িটার সঙ্গে ছিল অনেকখানি সুতো। রাধু টুঙ্কি দিয়ে দিয়ে ঘুড়িটা আকাশে অনেকখানি তুলেছিল। সুতো শেষ প্রান্তে পৌঁছোতে হাত থেকে ছেড়ে দেয়। ‘এই যাহহ’ বলে সে হেসে উঠেছিল। বিজলি আপশোস করে বলেছিলেন, ‘ছেড়ে দিলি কেন বেশ তো উড়ছিল!’ রাধু বলেছিল, ‘ছাড়ব কেন, সুতো ফুরিয়ে গেছে, খেয়াল করিনি।’

ঘুড়িটা বাচ্চচার হাঁটার মতো টলতে টলতে আকাশে ভাসতে থাকে। বিজলি খাটে আধবসা হয়ে সেদিনের ঘুড়িটাকে দেখে যাচ্ছেন। মনে পড়ছে চেঁচিয়ে বলা রাধুর কথাগুলো। খেয়াল করিনি, এটা বাজে কথা। পরিষ্কার দেখেছি সুতোটা ইচ্ছে করে ছেড়ে দিল। এবারও ইচ্ছে করেই নিজের জীবনটা ছেড়ে দিল। ভালো করল না মন্দ করল কে বলবে?

‘মাসিমা আমাকে ডেকেছেন?’ দরজার কাছে জ্যোতি দাঁড়িয়ে।

‘এসো বাবা,’ জ্যোতিকে ধুতি পাঞ্জাবি পরা দেখে বললেন, ‘ইস্কুলে যাচ্ছ?’

‘হ্যাঁ।’ ঘরে ঢুকে জ্যোতি বিজলির পায়ের দিকে তাকিয়ে হালকা সুরে বলল, ‘খুব অসুবিধে হচ্ছে তো? হাঁটাচলা একদম বন্ধ।’

‘আমি বিছানায় পড়ে আর কত কী ঘটে যাচ্ছে। সামনের বাড়িতে আমার ছোটো বোনের মতো রাধু সে একটা কী কিত্তি করে বসেছে। এদিকে হাসি সেও একটা খারাপ অসুখের কথা বলে দিব্যি হাসি হাসি মুখ করে সেই যে নীচে নেমে গেল এখনও পর্যন্ত একটু জানাল না, কী যেন পরীক্ষাটা?’

‘বায়োপসি, আরও তিন দিন পরে রিপোর্ট পাওয়া যাবে।’

বিজলি লক্ষ করলেন জ্যোতির মুখে কোনো উদবেগ নেই। ভাবখানা যেন ক্যানসার কালান্তক রোগই নয়, সর্দিকাশির মতো একটা ব্যাপার। বিরক্ত হয়ে বিজলি বললেন, ‘রোগটকে তোমরা দু—জনেই গুরুত্ব দিচ্ছ না, এটা কেমন কথা?’

‘দিচ্ছি না কে বলল মাসিমা। ডাক্তার যখনই বলল তার সন্দেহ হচ্ছে হাসির বুকের লাম্পটা ক্যানসারাস, এক্স—রে করুন, সেই রাতে আমরা ঘুমোইনি। দু—জনে দু—জনের দিকে তাকিয়ে জেগেছি, কথা বলে গেছি ভুটুকে মাঝে রেখে। সেই রাতেই আমরা তৈরি হয়ে যাই, যা হবেই যাকে আটকানো যাবে না তা একদিন হবেই। তত দিন জীবনটাকে বিস্বাদ বিশ্রী করে রাখার কোনো মানে হয় না। মাসিমা মরার আগেই হাসি মরতে চায় না।’

জ্যোতি বিজ্ঞানের শিক্ষক, ক্লাসে ছাত্রদের পড়া বোঝাবার জন্য ব্যাখ্যা করে, স্পষ্ট উচ্চচারণ অনর্গল বলে যায়। বিজলি স্তম্ভিত হয়ে শুনে যাচ্ছিলেন। কত সহজে এই অল্পবয়সি দম্পতি মৃত্যুকে গ্রহণ করছে। এই পৃথিবী, এই সংসার, আদরের ছেলেকে ফেলে চলে যেতে হাসির কষ্ট হবেই তবু সে তাঁর অনুরোধ লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়ে গেল। একটুও টের পেতে দিল না কালব্যাধি তার শরীরে বাসা বেঁধেছে! কত বড়ো মন, কী সাহস মেয়েটার! বিজলির চোখের সামনে থেকে থিয়েটারের যবনিকা যেন ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। মঞ্চে কুশীলবরা—জ্যোতি, হাসি, রাধু, তপতী, পলাশ, অলকা, পদ্ম, পাড়ার ছেলেরা। সবাই ভালো সবাই ভালো।

বিজলি চোখ বন্ধ করলেন। মনে মনে বললেন, ‘শ্রীধর এরা নিজের—নিজের মতো করে বেঁচে থাকুক, তুমি ওদের দেখো।’

কিছুক্ষণ পর চোখ খুলতে দেখলেন জ্যোতি চলে গেছে। সিঁড়িতে পটপট হাওয়াই চটির শব্দ, তপতী এল।

চটি খুলে ঘরে ঢুকে তপতী বোকার মতো হেসে বলল, ‘দিদিমা আমি এসেছি।’

‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বলেছিলুম সঙ্গে করে লোক আনতে, এনেছিস?’

‘হ্যাঁ, তিন জনকে পেলুম।’

বিজলি বালিশের তলা থেকে টাকা বার করলেন। ‘গুনতে পারবি তো, যোগ করা শিখেছিস?’ নোটগুলো হাতে দেবার সময় বললেন, ‘গুনে দ্যাখ।’

‘আমি এইট ক্লাস পর্যন্ত পড়েছি দিদিমা।’

‘পড়েছিস তো, শিখেছিস কিছু?’

তপতী গোনার সঙ্গে সঙ্গে বিড়বিড় করে যোগ করছিল। ‘দু—হাজার দিদিমা, আমি যাই ওরা নীচে দাঁড়িয়ে আছে।’

তপতী চলে যাচ্ছে। বিজলি একটা পঞ্চাশ টাকার নোট হাতে নিয়ে ডাকলেন, ‘ওরে অঙ্কের পণ্ডিত এটা নিয়ে যা। তোকে পঞ্চাশ টাকা কম দিয়েছি। আনন্দে নাচতে নাচতে তো টাকা গুনে বললি দু—হাজার। কেলাস এইট পর্যন্ত পড়েছি।’ ভেংচে উঠলেন বিজলি। ‘এই বিদ্যে নিয়ে রোজগার? আমার টাকাটাই দেখছি জলে গেল।’ তারপর দাবড়ানি, ‘ভাগ আমার সামনে থেকে।’

আবার বোকার মতো হেসে তপতী চলে গেল। এক ঘণ্টা পর পদ্ম এসে জানাল, ‘রাধু মামিমাকে লোটাসে নিয়ে গেছে। নাথু ফিরে বলল বোধহয় বাঁচবে না। আর কী বলল জানো? বলল, বিষ খায়নি ঘুমের বড়ি খেয়েছে। বড়ি পেল কী করে বলো তো?’ পদ্ম অবাক চোখে প্রশ্ন করল।

‘কী করে পেল তা আমি জানব কী করে? তুই এক কাজ কর অলকাদের বল ভেনিয়াপুরে দাদাকে ফোন করে জানিয়ে দিতে, আমি পা ভেঙে শয্যাশায়ী। ওইটুকু বললেই হবে। ফোন নম্বরটা লিখে দিচ্ছি নিয়ে যা।’

সন্ধ্যাবেলাতেই বিজলি জেনে গেলেন রাধাকিঙ্করীকে রাত্রে খাটে শোয়াবার জন্য হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল অন্নপূর্ণা। রাধু তখন জল খেতে চায়। হুইলচেয়ার থামিয়ে অন্নপূর্ণা জল আনতে ঘরের বাইরে যায়। চেয়ারটা ছিল টেবল ঘেঁষে, টেবলে ছিল ওষুধ রাখার প্লাস্টিকের বাক্সটা। রাধু তখন হাত বাড়িয়ে বাক্স থেকে তুলে নেয় আধ—ভরতি ঘুমের বড়ির ছোট্ট সরু শিশিটা। বড়িগুলো বাঁ হাতে ঢেলে মুঠোবন্ধ করে রাখে। ডান হাতে গেলাস ধরে জল খায়। মুখের মধ্যে জল ধরে রেখে গেলাস ফিরিয়ে দেয়, অন্নপূর্ণা গেলাসটা টেবলে রাখতে যেই মুখটা ঘুরিয়েছে তখুনি রাধু মুঠো—ভরতি বড়ি মুখে পুরে জল সমেত গিলে ফেলে। অন্নপূর্ণার সন্দেহ হয়, কী যেন একটা মুখে পুরল রাধুবউদি। ‘কী মুখে দিলে, দেখি দেখি হাঁ করো।’ সে বলেছিল। রাধাকিঙ্করী মুখ খোলেনি।

বাঁচেনি রাধাকিঙ্করী। এটা পরিকল্পিতভাবে খুন না আত্মহত্যা তার তদন্তে পুলিশ আসে। বাড়ির লোকেদের জেরা করে থানার তরুণ এক অফিসার। তারপর রাধাকিঙ্করীর সঙ্গে যাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল তাদের খোঁজ করে অফিসারটি। পাড়ার লোকেরা তাকে জানায় বিজলির নাম। বিজলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে অফিসার দোতলায় আসে। হাতে ফাইল, সাদা ইউনিফর্ম, মাথায় কালো ক্যাপ, কাঁধে রঙিন ফিতে, অফিসারটি ঘরে জুতো সমেত ঢুকতে যাচ্ছিল। পদ্ম তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ঘরে ঠাকুর আছে, জুতো খুলে ঢুকুন। মাসিমা কাউকে জুতো পরে ঘরে ঢুকতে দেন না।’

পারিবারিক, সামাজিক আচার আচরণ পালনের নিয়ম মান্য করার রীতিটা এই অল্পবয়সি অফিসার এখনও ভুলে যায়নি। অপ্রতিভ হয়ে সে জুতো খুলে ঘরে ঢুকল, সন্তর্পণে তাকাল ঠাকুরের সিংহাসনের দিকে। বিজলি বললেন, ‘পদ্ম ওকে বসার টুলটা এনে দে।’ তরুণটি টুলে বসার পর বিজলি বললেন, ‘রাধুকে আমি তিরিশ বছর ধরে জানি। খুব সুখেরই সংসার ছিল ওর। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যথেষ্ট মনের মিল ছিল, ভালোবাসাও ছিল। আপনি হয়তো পাড়ার লোকের কাছে শঙ্কর ঠাকুরপো সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছেন বা শুনবেন। সব মিছে কথা।’

‘কীসের ভিত্তিতে আপনি বলছেন মিছে কথা?’ অফিসার জানতে চাইল।

‘আট বছর আগে রাধুর যখন দুর্ঘটনা ঘটল, এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে ফিসফাস হল, বউকে সিঁড়ি দিয়ে ইচ্ছে করে ঠেলে দিয়েছে শঙ্কর চাটুজ্যে। রাধু নিজে আমাকে পরে বলেছে একদম বাজে কথা, হ্যাঁ, রাধু নিজে আমাকে বলেছে সে অন্ধকারে সিঁড়ির ধাপ ফসকে গড়িয়ে পড়েছিল। আর এই যে মারা গেল, যেজন্য আপনি খোঁজ নিতে এসেছেন, নিশ্চয় আপনাকে কেউ—না—কেউ বলেছে, চুপি চুপি বলেছে, ওকে ঘুমের বড়ি ইচ্ছে করে খাইয়ে মেরে ফেলা হয়েছে। ঠিক কিনা?’ উত্তরের জন্য বিজলি স্থির দৃষ্টিতে তরুণটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘অতগুলো বড়ি কি ইচ্ছেমতো গিলিয়ে দেওয়া যায়।’

ইতস্তত করে অফিসারটি বলল, ‘একজন অভিযোগ করেছে ফোনে।’

‘নাম বলেছে?’

‘নাম ঠিকানা তো বলতেই হবে। নয়তো অভিযোগ আমরা অ্যাকসেপ্ট করব কেন। উড়ো ফোন তো অনেক আসে। কত লোকের কত রকম উদ্দেশ্য থাকে।’

‘রাধুদের পেছনের বাড়ি বিনোদ ঘোষের। ছাদে বেআইনি বাথরুম তুলেছিল। শঙ্কর ঠাকুরপো কর্পোরেশনে খবর দিয়ে বাথরুমটা ভেঙে দেয়। সেই থেকে বিনোদ ঘোষ ছুতোনাতায় ওদের পেছনে লেগে আসছে। শঙ্কর ঠাকুরপো আর অন্নপূর্ণাকে জড়িয়ে নোংরা কথাবার্তা ওই লোকটাই চাউর করেছে পাড়ায়। রসালো কেচ্ছা, সবাই গপগপিয়ে গিলেছে। আর এবার তো আরও ভয়ংকর খুনের গপ্প রটানোর সুযোগ পেয়ে গেছে। তবে আপনাকে আমি পষ্ট করে বলছি এটা মেরে ফেলা নয়, আত্মহত্যাই। রাধু অনেক বার আমাকে বলেছে, ‘দিদি এভাবে আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না।’ বলত আর দু—চোখ দিয়ে দরদরিয়ে জল নামত। খুব ছলবলে ছিল, দিনের মধ্যে কতবার যে ছুটে ছুটে একতলা দোতলা করত তার ইয়ত্তা নেই।’

বিজলির চোখের কোলে জল টলটল করছে, গলা ধরে এসেছে। তরুণ অস্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে বলল, ‘রাধাকিঙ্করী চ্যাটার্জি মনে হচ্ছে খুব প্রাণবন্ত ছিলেন, এমন মানুষ তো আরও বেশি করে বাঁচতে চাইবেন, তাই না?’

‘এর উলটোটাও তো হতে পারে। রাধুকে দেখেছি ঘুড়ি ওড়াতে, বৃষ্টি হলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছাঁট মুখে লাগাতে, মশলাধোসাওলাকে ডেকে কিনতে। একদিন রাতে কোকিলের ডাক শুনে ও আমাকে বলেছিল রাতে ঘুমোতে পারেনি। এমন মেয়ে যদি অথর্ব পঙ্গু হয়ে যায় তা হলে কি তার আর বাঁচতে ইচ্ছে করে? তার কষ্ট তো হাজারগুণ বেড়ে যাবে। দগ্ধে দগ্ধে মরার থেকে একেবারে মরা খারাপ কী! এই আমি পা ভেঙে বিছানায় পড়ে আছি, আমার অবশ্য মরে যেতে ইচ্ছে করছে না কিন্তু যদি জানি চিরকাল এভাবেই থাকতে হবে তা হলে অন্যরকম তো ভাবতেই পারি, রাধুও অন্যরকম ভেবেছিল। এই তো দু—দিন আগে ও পদ্মকে বলল বিষ এনে দিতে।’

তরুণ অফিসার তাকাল পদ্মর দিকে। ‘ইনি কে?’

‘আমার দিনরাতের সঙ্গী। ধৃতরাষ্ট্রের যেমন ছিল সঞ্জয় আমার তেমনি পদ্ম। বাইরের সব খবর আমি পাই ওর কাছ থেকে।’

‘আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে এই মৃত্যুতে আপনি দুঃখ পাননি, এতে যেন আপনার সায় আছে।’ তরুণটি তার তদন্তের বিষয়ের বাইরে গিয়ে কৌতূহল দেখাল।

‘রাধু মনের কষ্ট, শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে তিলতিল করে মরণের দিকে এগোচ্ছে সেটা দেখতে কি খুব ভালো লাগে? বাঁচব কি মরব সেটা তো নিজের বিষয়, রাধুকেই তা ঠিক করতে দেওয়া উচিত, নয় কি?’ বিজলি উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলেন।

প্রশ্নটায় তরুণ অফিসার বিব্রত হয়ে পড়ল। গলাখাঁকারি দিয়ে এধার—ওধার তাকাল। এই বৃদ্ধার কাছে এমন একটা বেমক্কা অবস্থায় পড়তে হবে জানলে সে কথাবার্তা অনেক আগেই চুকিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারত। দেশের আইন বলছে আত্মহত্যার চেষ্টা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, পুলিশ আইনের রক্ষক। পুলিশের উর্দি পরে সে কী করে আত্মহত্যাকে সমর্থন করবে? আবার এই বৃদ্ধার যুক্তিটাও সে ফেলে দিতে পারছে না। এখনও ভোঁতা হয়ে যায়নি তার অনুভূতি।

অফিসারের দোনামনা ভাব দেখে বিজলি বললেন, ‘আপনি যদি ব্যাপারটা এইভাবে দেখেন তা হলে বোধহয় আমার পক্ষে বোঝাতে সুবিধা হয়। প্রত্যেক ট্রেনেরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে স্টেশন থেকে ছাড়ার। যদি কেউ ট্রেনে উঠে কোথাও যেতে চায় তা হলে সেই লোকটিই ঠিক করবে কবে, ক—টার ট্রেন সে ধরবে। রাধু নির্দিষ্ট সময়ে তার ট্রেনে উঠেছে নিজের ইচ্ছায়, আপনি আমি বাধা দেবার কে?’

অফিসার হাতের ঘড়ি দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল। ‘আমাকে আর এক জায়গায় যেতে হবে।’

.

তিন দিন পর বেলা এগারোটায় হাজির হলেন সীতেশরঞ্জন। সাদা ফুলশার্ট, ধুতি ও পাম্পশ্যু পরা, ছিপছিপে দীর্ঘদেহী সত্তর বছর বয়সি লোকটি ব্যস্ত থাকেন সবসময় হাঁটাহাঁটি করেন প্রচুর। চাষবাস তদারক করেন নিজে। দুই ছেলে দুই মেয়ে। ডাক্তার ছেলে থাকে বর্ধমানে, কাঠের ব্যবসায়ী ছেলে থাকে শিলিগুড়িতে। মেয়েদের বিয়ে হয়েছে দুর্গাপুরে ও চন্দননগরে। তারা সচ্ছল ও সুখী। সীতেশরঞ্জনের ঝাড়া হাত—পা। স্বামী—স্ত্রী, গোরু বাছুর, ফলমূলের গাছ, ধানের গোলা, পুকুরের মাছ ইত্যাদি নিয়ে এখন তাঁর সংসার। দেড়শো বছর আগের গ্রামবাংলার মানুষ ও মানসিকতা নিয়ে যদি কেউ গবেষণা করতে চান তা হলে হুগলি জেলার এই মানুষটিকে অনুধাবন করেই প্রার্থিত যশোলাভ করতে পারবেন।

‘কীরে বুড়ি, পা ভাঙলি কী করে?’

দরজার বাইরে জুতো খুলতে খুলতে সীতেশ হালকা চালে বললেন। বিজলি বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে দু—হাতে চোখের সামনে গরদের থানটা তুলে ধরে খুঁজছিলেন কোথায় কোথায় ছিঁড়েছে কোথায় পিঁজে গেছে। ‘বুড়ি’ শুনেই ঝুপ করে হাত নামিয়ে বাচ্চচা মেয়ের মতো ‘দাদা’ বলে চিৎকার করে উঠলেন।

সীতেশের কাঁধে একটা ঝোলা। সেটা নামিয়ে হাঁক দিলেন, ‘পদ্ম কোথায় গেলি রে। কী ভিড় রে বাবা ট্রেনে, তার আগে ট্রেকারে তো লোকের কোলে বসে ইস্টিশনে এলুম।’ বলেই তিনি মুখ তুলে পাখার দিকে তাকালেন। ‘একটু জোর করে দে তো, যা ভ্যাপসা গরম। ক—দিন ধরে আমাদের ওদিকে খুব বৃষ্টি হচ্ছে, তোদের এখানে কেমন?’

বিজলি বিহ্বল চোখে দাদার দিকে তাকিয়ে, পদ্ম রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে প্রণাম করে বলল, ‘মামাবাবু কতদিন পর, ভাত চড়াই?’

‘দাঁড়া দাঁড়া এটা ধর।’ সীতেশ তার কাঁধের ঝোলাটা তুলে দিলেন পদ্মর হাতে। পদ্ম ঝোলার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বার করল গাওয়া ঘিয়ের শিশি, একটা বড়ো পেঁপে, দুটো নারকেল, একটা বড়ো ওলের আধখানা আর মিষ্টির বাক্স।

‘পদ্ম পেঁপেটা দু—দিন রেখে খাবি, এখনও পাকেনি। ঝুলিতে রয়ে গেছে কাঁচালঙ্কা। বুঝলি বুড়ি তুই যেমন ঝাল ভালোবাসিস ঠিক তেমনি কষকষে ঝাল! ওলভাতে ঘি আর কাঁচালঙ্কা মেখে খেয়ে দেখিস। মা মেখে গোল্লা করে তোর মুখে দিত আর ভয়ে ভয়ে বলতিস কুটকুট করবে না তো, মনে আছে তোর?’

‘খুব মনে আছে। আর তুমি অমনি মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলতে, বুড়ি খাসনি ভীষণ কুটকুটে, মা আমাকে দাও। মা তোমাকে ধমকে বলত এখনও তোর পাতে মাখা রয়েছে আগে শেষ কর, এটা বুড়ি খাবে।’

ঝকঝক করছে বিজলির চোখ, দাদাকে পেয়ে প্রায় ষাট বছর আগে পিছিয়ে গেছেন। সীতেশ বললেন, ‘আধখানা ওল আমি আর তোর বউদি খেয়েছি, বাকিটা তোর জন্য আনলুম। পদ্ম ভাত চড়াই বলে দাঁড়িয়ে রইলি কেন! আমি খেয়েই কিন্তু বেরোব, অনেক কাজ আছে। বুড়ি তোকে দেখে মনে হচ্ছে পা ভেঙে ভালোই হয়েছে, বিশ্রাম পেয়েছিস। হাড় সেট হতে ক—দিন লাগবে বলেছে ডাক্তার?’

‘দু—মাস পর ভালো করে হাঁটতে পারব। তুমি চান করবে তো? পদ্ম আমার একটা কাপড় আলমারি থেকে বার করে দে।’

সীতেশ স্নান করতে যাওয়ার পর বিজলি পদ্মকে বললেন, ‘শুধু ডাল ভাজা আর ঝিঙে কুমড়ো মামাবাবুকে খাওয়াবি? চট করে শীতলার থেকে দই আর রসগোল্লা নিয়ে আয়। দাদা দই খুব ভালোবাসে।’ বালিশের তলা থেকে বিজলি টাকা বার করে দিলেন।

সীতেশ ঘরের মেঝেয় বসে ভাত খেলেন। খেতে খেতে বিজলির ভাইপো ভাইঝিদের খবর জানার কৌতূহল মিটিয়ে রান্নার গ্যাস নেওয়ার কথাও জানিয়ে দিলেন।

‘দু—মাইল দূরের থেকে সাইকেল রিকশায় সিলিন্ডার আনা এক ঝামেলা, তা হলেও কয়লার হাত থেকে তো বেঁচেছি। তোর বউদি তো এবেলার রান্না ওবেলা খায় না, নইলে ফ্রিজটাও নিয়ে ফেলতুম। ঘণ্টুর তো দুটো ফ্রিজ বর্ধমানের বাড়িতে, একটা পাঠিয়ে দেবে বলেছিল। তোর তো ফ্রিজ নেই, বলব ঘণ্টুকে?’

‘থাক দাদা, টিভি ফ্রিজ টেলিফোন ছাড়াই বড়ো হয়েছি, ওসব ছাড়াই বাকি জীবনটা কেটে যাবে। যন্তরপাতি ঢোকানো মানেই ঝঞ্ঝাট ঢোকানো, দেখি তো সব এবাড়ি ওবাড়িতে। আজ এই ওটা খারাপ হচ্ছে কাল সেটা খারাপ হচ্ছে ডাক মিস্তিরিকে খবর দে অফিসে। তা ছাড়া অমনি অমনি তো আর টিভি টেলিফোন চলে না, টাকা দিতে হয় মাসে মাসে। আমার অত টাকা কোথায়? এই বেশ সুখে আছি সেধে ভূতের কিল খেতে যাব?’

‘তা বটে। আমাদের ওখানে দিনে ছ—ঘণ্টা কারেন্ট থাকে না। কখন যাবে কখন আসবে কেউ জানে না। সবথেকে অসুবিধে হয় ছেলেমেয়েদের, সেই হ্যারিকেনের আলোতেই লেখাপড়া করতে হচ্ছে যেমন আমরা করেছিলুম।’

‘দাদা জামরুল গাছটার জায়গায় তো পেয়ারা গাছ লাগিয়েছ, হয়েছে পেয়ারা?’

‘হবে না কেন! এখনও পাকেনি, তুই ডাঁশা খেতে পারবি কি পারবি না ভেবে আর আনুলম না।’

‘পারবি কি পারবি না মানে?’ বিজলির ভঙ্গিতে ও স্বরে ঝগড়া ঘনিয়ে উঠল। ‘এই দ্যাখো আমার দাঁত। এখনও আখ দাঁত দিয়ে ছাড়িয়ে চিবিয়ে খাই।’ বিজলি ঠোঁট টেনে ফাঁক করে দাঁত দেখালেন।

সীতেশ বোনের মুখের দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘ডান দিকে ওপরের পাটির কষের দাঁতটা তো এখনও গজাল না, আখ চিবোস কী করে?’ দইমাখা হাত চাটতে চাটতে সীতেশ আড়চোখে তাকিয়ে বললেন।

বারো বছর বয়সে বিজলির দাঁতটা ভেঙে ছিল জামরুল গাছ থেকে তাড়াহুড়ো করে নামার সময় পড়ে গিয়ে, সীতেশ দোতলার ছাদে দাঁড়িয়ে গাছ থেকে বোনের জামরুল পাড়া দেখছিলেন। তখনই মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি ভর করে। চেঁচিয়ে উঠেছিলেন, ‘বুড়ি হাবিদা আসছে রে, নেমে পড় নেমে পড়।’

হালদারবাড়ির বাগানে এই জামরুল গাছটির মালিক গ্রামেরই ছেলে হাবিবুল্লা চৌধুরী। তার মালিকানা পাওয়ার ব্যাপারটাও একটা গল্প। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিল মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের ছেলে হবিবুল্লা, ম্যাট্রিক পরীক্ষায় জেলার মধ্যে প্রথম এবং সারা বাংলায় সপ্তম হয়। ভেনিয়াপুর গ্রামের মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে দলে দলে মণিরুল চৌধুরির টিনের চালের বাড়িতে যায়। কারোর হাতে নতুন পাজামা কারোর হাতে কাতলা মাছ, কেউ দিল এক হাঁড়ি রাজভোগ কেউ দিল টর্চ, পাউডারের কৌটো। রাজু ঘোষাল পইতেটা হাবিবুল্লার মাথায় ছুঁইয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের মুখোজ্জ্বল করেছ বাবা, দীর্ঘজীবী হও, আরও বড়ো হও।’ হাবিবুল্লা রাজু ঘোষালকে প্রণাম করে স্মিত মুখে দাঁড়িয়ে থাকে।

পরের দিন সে যায় হালদারি বাড়িতে। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট মহিমারঞ্জন স্নান করে তখন পুজোয় বসেছিলেন, হাবি এসে অপেক্ষা করছে জানতে পেরে পুজো ফেলে উঠে আসেন। সদর ঘরে দাঁড়িয়ে ছিল হাবিবুল্লা, তাঁকে প্রণাম করতেই মহিমারঞ্জন জড়িয়ে ধরেন।

‘ওগো কোথায় তুমি, নাড়ু নিয়ে এসো, পুজোর থালায় সন্দেশ রয়েছে শিগগিরি আনো। কতবড়ো মানুষ আমার বাড়িতে এসেছে, সারা হুগলি জেলায় প্রথম হওয়া কি চাট্টিখানি কথা! হাবি তো আমাদের গর্ব।’ বাবার চিৎকার শুনে হাফপ্যান্ট পরা সীতেশ ও ফ্রক পরা বিজলি ছুটে আসেন।

মহিমারঞ্জন আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, ‘বাবা খালি হাতে তো আশীর্বাদ হয় না। তোকে তো এখন একটা কিছু দিতে হয়, কিন্তু কী দিই বল তো!’ তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেবার জিনিস খুঁজলেন। দেবার মতো কিছুই হাতের কাছে নেই। জানলা দিয়ে চোখে পড়ল জামরুল গাছটা, তাতে ফলও ধরে রয়েছে।

‘হাবি ওই জামরুল গাছটা তোকে দিলুম। আজ থেকে ওটা তোর। ওতে যা ফলবে সব তোর।’

ঘরের সবাই হতভম্ব মহিমারঞ্জনের এই দান দেখে। বিব্রত হাবিবুল্লা বলল, ‘কাকা এই গাছ নিয়ে আমি কী করব। আমি থাকি গ্রামের শেষ প্রান্তে আর এই গাছ এখানে আপনার বাগানে, আমি তো গাছটা তুলে নিয়ে যেতে পারব না। এটা আপনারই থাক।’

‘ব্রাহ্মণের মুখ থেকে একবার যে—কথা বেরিয়েছে তা তো আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।’ মহিমারঞ্জন দৃঢ় ও গাঢ় স্বরে বলেছিলেন, ‘ও গাছ তোমার। ফিরিয়ে নিলে আমি ধর্মচ্যুত হব। তাই কি তুমি চাও?’

নির্বাক হবিবুল্লা মাথা নীচু করে মেনে নিয়েছিল এই দান। সীতেশ আর বিজলি মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল। বিজলি পরে দাদাকে বলে, ‘বাবা যেন কী! দিয়ে দিল অমন জামরুল গাছটা?’

সীতেশ বলেছিলেন, ‘দিয়েছে তো কী হয়েছে? হাবিদা কি এতদূর আসবে জামরুল খেতে? ও গাছ আমাদেরই থাকবে।’

তাই—ই ছিল। মহিমারঞ্জনই বরং মরশুমে ফল ধরলে ধামায় করে জামরুল হাবির জন্য খেতে পাঠিয়ে দিয়েছেন, যত দিন সে ভারতে ছিল। হাবিবুল্লা শিবপুর এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে পাশ করে জলপানি পেয়ে মেটালার্জিতে গবেষণা করতে আমেরিকা চলে যায়। সেখানই বড়ো এক ইস্পাত প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়ে বিয়ে করে বসবাস শুরু করে, আর গ্রামে ফিরে আসেনি। তবে আমৃত্যু সে মাসে মাসে মাকে পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে গেছে।

জামরুল গাছটা হালদারদেরই অধীনে ছিল। শিবপুর থেকে ছুটিছাটায় হবিবুল্লা গ্রামে এলে গাছটা দেখতে আসত। সীতেশ বলেছিলেন বিজলিকে, ‘মনে রাখিস এটা পরের গাছ। পরের দ্রব্য না বলিয়া লইলে চুরি করা হয়। তুই তো হাবিদাকে বলে গাছে উঠে জামরুল পাড়িস না। এটা চুরিই, ধরা পড়লে হাবিদা তোকে পুলিশে দেবে। পুলিশ কোমরে দড়ি বেঁধে সারা গ্রামে ঘোরাবে।’

শুনে বিজলির বুক ঢিপঢিপ করলেও মুখে তেজ দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘ঘোরাক কোমরে দড়ি বেঁধে। জামরুল আমি পাড়বই, হাবিদা জানতে পারলে তো!’

বিজলি যেদিন গাছ থেকে পড়ে দাঁত ভাঙেন তার আগের দিন হাবিবুল্লা বাড়ি এসেছে এটা তিনি জানতেন। ‘হাবিদা আসছে রে, নেমে পড়’, শোনামাত্র তিনি আঁকুপাকু করে নামতে গিয়ে জমিতে পড়ে যান। একটা ইটে ঠোক্কর লেগে দাঁতটা ভাঙে। এখনও বড়ো করে হাসলে বিজলির দাঁতের পাটিতে একটা খালি জায়গা দেখা যায়।

পঞ্চাশ বছরেরও বেশি হয়ে গেল দাঁতের এই শূন্যতার বয়স। মনে থাকে না, দাদা মনে পড়িয়ে দিল। জামরুল গাছটা বুড়ো হয়ে আর ফল দিতে পারত না, কেটে ফেলে সেখানে লাগানো হয়েছে পেয়ারা গাছ। গাছটার সঙ্গে জড়ানো আছে বাবার স্মৃতি ‘ব্রাহ্মণের মুখ থেকে একবার যে—কথা বেরিয়েছে তা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না, নিলে ধর্মচ্যুত হব।’ হাবিদার কথা : ‘কাকা এই গাছ নিয়ে আমি কী করব এটা আপনারই থাক।’

কিন্তু রইল আর কোথায়? হাবিদা গ্রামে রইল না, গাছটাও কেটে ফেলা হল। আর আমি? বিজলি ভারী নিশ্বাস ফেললেন। ভিজে গামছায় হাত মুছছেন সীতেশ।

‘বুঝলি বুড়ি এবার যেদিন আসব আগে ফোন করে দোব। অলকাদের নম্বরটা তো আমার কাছে আছে। পদ্ম তা হলে অনেক রকম রান্না করে রাখার সময় পাবে। ওর হাতের রান্না বড়ো ভালো।’

আনন্দে পদ্ম বিগলিতপ্রায়। ‘আমি আর রান্নার কী জানতুম। সব তো মাসিমার কাছে শেখা। মামাবাবু আপনাদের যজ্ঞিডুমুর গাছ আছে শুনেছি। এবার যখন আসবেন নিয়ে আসবেন তো খানিকটা। মাসিমা বলেছে শিখিয়ে দেবে ডুমুরের ডালনা।’

‘বুড়ি তোর অর্ডার কী?’

‘কিছু না। বাপের বাড়ির থেকে যা আসবে তাই আমার কাছে সোনার তুল্য।’

ধুতির কষি আঁটতে আটতে সীতেশ বললেন, ‘তোর বউদিও বলে বাপের বাড়ির জিনিসের দাম হয় না, অমূল্য! গত বছর জামাইষষ্ঠীতে ছোটো শালা বাড়ির গাছের আম পাঠিয়েছিল, দবির খাস। আজকাল এই আম তো বাজারে মেলে না। তোর বউদি দিনে একটার বেশি দিত না পাছে ফুরিয়ে যায়। দশদিন ধরে দশটা খেয়েছি। ভালো কথা, মিষ্টির বাক্সটা খুলে দেখলি না, গুণোময়রার বোঁদে! মনে আছে, মা—র কাছে থেকে পয়সা নিয়ে কিনতে গেলে গুণো বলত, ‘এ পয়সা অচল, তামার পয়সা আনো।’ তখন ফুটো পয়সা গরমেন্ট চালু করেছিল। গুণো তো এখন হরে ভূত। ওর নাতি নাদু এখন দোকান চালাচ্ছে, অনেক রকম মিষ্টি বাড়িয়েছে, কাচের শো কেস করেছে, তবে বোঁদেটা ঠাকুরদার আমলের মতোই রেখেছে, খেয়ে দেখিস।’

‘ভাত খেয়েই ছুটছ, কী এমন কাজ তোমার? এতকাল পরে এলে দুটো কথা যে বলবে তাও তোমার সময় হয় না।’ বিজলি প্রায় ঠোঁট ফুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন।

শার্টটা মাথায় গলিয়ে সীতেশ বললেন, ‘কাজ কি একটারে, হ্যারিসান রোডে গিয়ে অমিয় বিশ্বাসের জন্য হোমিয়োপ্যাথি ওষুধ কিনতে হবে, হাঁপানিতে খুব কষ্ট পাচ্ছে। বড়োবাজারে একটা মশারি কিনব আর ভালো হিং পাওয়া যায় কিনা দেখব। পাঁচটা বত্রিশের ট্রেনটা না ধরলে সন্ধে সন্ধে বাড়ি পৌঁছোতে পারব না। তুই হাঁটাচলা শুরু কর তখন এসে দুটো কেন দুশো কথা বলব। তুই বরং আয় না আমাদের ওখানে। তোর বউদি তো প্রায়ই বলে কত বছর ঠাকুরঝিকে দেখি না, আসবি।’

বিজলি হতাশ চোখে তাকালেন শ্রীধরের সিংহাসন আর দেবদেবীদের দিকে। ‘এদের ফেলে রেখে যাব কী করে দাদা। আমি যে নিজের হাত পা নিজেই বেঁধে ফেলেছি। কবে যে মুক্তি পাব!’

সীতেশের সঙ্গে পদ্মও একতলায় নেমে তাঁকে সদর দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ওপরে ওঠার সময় দেখল ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে।

‘কী কচ্ছিস?’

‘কী আবার করব, ছেলে আগলাচ্ছি। মা কখন ফিরবে কে জানে।’ বিরক্ত স্বরে বলল কল্পনা।

‘কোলে নিয়ে আছিস কেন, ছেড়ে দে হাঁটুক। চাদে নিয়ে যা।’

পদ্মকে দেখে ভুটু হেলে পড়ল দু—হাত বাড়িয়ে, পদ্ম তাকে তুলে নিল কল্পনার কোল থেকে।

‘আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। হাসিদি এলে ওকে নিয়ে আসিস।’

‘হাসিদি তো কাল সকালে নার্সিংহোমে ভরতি হবে। বুকে কী হয়েছে অপারেশন করবে।’

‘কই আমাদের তো বলেনি!’ পদ্ম রীতিমতো অবাক।

‘ওরা অমনই, কাউকে কিছু বলে না, নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় বলাবলি করে।’

‘হাসিদি নার্সিংহোমে গেলে ভুটু কার কছে থাকবে?’ পদ্ম আরও অবাক হয়ে বলল।

‘আমার কাছে। তা ছাড়া আর কার কাছে থাকবে?’

‘আর রাতে?’ পদ্মর বিস্ময়ের ঘোর এখনও চলছে।

‘বাবার কাছে থাকবে।’ কল্পনা বলল সহজ কথায়।

‘অ।’ ছোট্ট একটা শব্দে পদ্ম তার ক্ষোভ বিরগ আপত্তি প্রকাশ প্রকাশ করে ভুটুকে কোলে নিয়ে উপরে উঠে গেল।

বিজলির ঘরে ঢুকেই পদ্ম গজগজ করে উঠল। ‘আমাদের পর ভাবে নইলে একবার বলতে তো পারত, মাসিমা ভুটুকে আপনারা রাখুন যত দিন না নার্সিংহোম থেকে ফিরে আসছি। কল্পনা সারাদিন ওকে দেখবে ভেবেছো? কুঁড়ের বেহদ্দ, কুম্ভকন্যের মাসতুতো বোন, পড়ে পড়ে তো শুধু ঘুমোবে।’

‘হয়েছে কী? অত রাগ কেন?’

‘রাগব না? হাসিদি একবার বলল না অপারেশন করাতে যাবে আর কালকেই যাবে! আমরা জানলে কি ওকে যেতে দোব না? বুঝলে মাসিমা যতই তুমি ওদের আপন ভাবো, পাঁচালি পড়াও ওরা কিন্তু তোমাকে আপন ভাবে না, এই আমি বলে দিলুম।’

ভুটুকে সে বসিয়ে দিল বিজলির পাশে। সঙ্গে সঙ্গে ভুটু পা ছড়িয়ে বসা বিজলির দুই ঊরুর উপর উঠে দু—ধারে দুটো পা দিয়ে ঘোড়ায় চড়ার মতো বসে শরীর দোলাতে শুরু করল।

‘হয়েছে হয়েছে, বাবা আমার লাগছে, তুমি এখন আমার পাশে লক্ষ্মী ছেলের মতো বসো তো।’ বিজলি দু—হাত দিয়ে ধরে ভুটুকে বিছানার উপর রাখলেন। এবার উঠে দাঁড়িয়ে ভুটু দু—হাত দিয়ে বিজলির গলা জড়িয়ে ধরে নাকটা মুখের মধ্যে পুরে নিল।

‘পদ্ম পদ্ম ধর ধর। আমার নাক গেল।’ বিজলি আর্তনাদ করে উঠলেন। পদ্ম দ্রুত ভুটুকে ধরে মেঝেয় নামিয়ে দিল।

‘ব্যাটার চারটে দাঁত উঠেছে, দ্যাখ তো রক্তটক্ত বেরিয়েছে কিনা?’

‘না কিছু হয়নি।’ বিজলির আঁচল দিয়ে নাক থেকে লালা মুছে দিল পদ্ম।

‘হাসি কাল নার্সিংহোমে যাবে কে বলল তোকে, কল্পনা? বলবে নিশ্চয়। এক বাড়িতে থাকি যখন, এতবড়ো একটা ব্যাপার হতে যাচ্ছে, না বলে পারবে? তুই রাগারাগি করছিস কেন!’ বিজলি প্রত্যয় ভরে শান্ত স্বরে বললেন।

‘দ্যাখো বলে কিনা।’ পদ্ম ঠোঁট উলটিয়ে কথাটা বলেই লাফিয়ে গিয়ে ধরল ভুটুকে। ‘তোমার এই ঠাকুরদেবতার সব্বোনাশ কিন্তু এই ছেলের হাতেই হবে বলে রাখছি।’

বিজলি হাসতে শুরু করলেন। স্নেহ মমতায় তাঁর দু—চোখ ভরা। ‘সব্বোনাশ হলে তো ভালোই, মুক্তি পাব এঁদের হাত থেকে। বাক্সটা খুলে ওকে দুটো বোঁদে দে, মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসে।’

‘কল্পনা বলল রাতে ভুটুকে রাখবে ওর বাবা। এই বাচ্চচাকে রাখবে পুরুষমানুষ!’ পদ্মর ভ্রু কপালে উঠল।

বিজলি অবাক হয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘এটা ওকে বাড়াবাড়ি। আমি নয় শয্যাশায়ী কিন্তু তুই তো আছিস। হাসি তো বলতে পারত ভুটুকে রাতে তোর কাছে রাখতে। রাতে কত রকমের কাজ থাকে বাচ্চচার, সেসব কি ব্যাটাছেলে করতে পারবে? হাসি এলে তুই গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলবি, জানিয়ে দিবি মাসিমা খুব দুখ্যু পেয়েছে তোমাদের ব্যবহারে।’

পাঁচ

হাসি ঘরে পা দেওয়ামাত্র ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বিজলি। ‘তোমাদের কত্তাগিন্নির ব্যাপার কী বলো তো? আমাদের কাছে ভুটুকে রেখে গেলে কি ও জলে পড়ে যাবে? জ্যোতি পারবে রাত্তিরে ওকে রাখতে?’

বিব্রত হয়ে হাসি বলল, ‘ভাঙা পা, আপনার তো অসুবিধে হবে। তাই—’

হাসির কথা শেষ হবার আগেই বিজলি প্রায় ধমকে উঠলেন। ‘তাই ভদ্রতা দেখিয়ে আমাকে আর বলোনি। ক—দিন থাকবে নার্সিংহোমে?’

‘ছ—সাত দিন।’

‘আমার পা ভাঙা কিন্তু পদ্মর তো পা ভাঙেনি! ভুটু ওর ন্যাওটা, পদ্মর কাছে ও সবথেকে ভালো থাকবে। ওর বিছানা, কাঁথা, দুধের বোতল, জামা সব কল্পনাকে দিয়ে কাল ওপরে পাঠিয়ে দেবে আর খেলনা যা আছে তাও যেন দিয়ে যায়।’

হাসি মাথা হেলাল, মুখে স্পষ্ট স্বস্তি।

‘নার্সিংহোমটা কোথায়, আমাদের লোটাস?’

‘বউবাজারে রোজমেরি নার্সিংহোম। জ্যোতির এক ছাত্রের বাবার। উনি চারটে ইনস্টলমেন্টে টাকা নেবেন তবে ডাক্তারদের ফি একসঙ্গে একেবারে দিতে হবে।’

‘ডাক্তাররা কত নেবে?’

‘সেটা আমি ঠিক জানি না মাসিমা।’

‘তোমার এখন কোনো কষ্ট হচ্ছে?’

‘না।’

‘তোমরা ওল খাও?’

হাসি অবাক হয়ে বলল, ‘খাই। হঠাৎ ওল খাই কিনা জিজ্ঞাসা করছেন?’

‘আমার দাদা দিয়ে গেছেন। রাতে তোমরা তো ভাত খাও, পদ্ম ডালনা করে দিয়ে আসবে। ওল খেলে রক্ত পরিষ্কার হয়। আপিস থেকে ছুটি নিয়েছ কত দিনের?’

‘একমাসের।’

‘এরপর আপিস যাতায়াত করবে খুব সাবধানে, যা ভিড় হয়, লেগেটেগে যেন না যায়।’

‘মাসিমা আপনার একটা নতুন পাঁচালির বই জ্যোতিকে আনতে বলেছি।’

‘বই দিয়ে আর কী হবে। বেস্পতিবারের পাট এখন তো বন্ধ। তুমি ফিরে এসো, তত দিনে মনে হয় পা ফেলতে পারব। ঠাকুরদের ফুল মালা চন্দন দেওয়া, শোয়ানো, নারায়ণকে স্নান করানো কিছুই হচ্ছে না। জ্যোতিকে বোলো আমাকে যেন রোজ তোমার খবরটা দেয়। পোড়া পায়ের এই অবস্থা না হলে আমি নিজে গিয়ে খোঁজখবর নিতুম। জ্যোতি ছুটি নিয়েছে?’

‘কালকের দিনটা নিয়েছে। অন্যদিনগুলোয় স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে চলে আসবে। এর আগেও দু—দিন তাড়াতাড়ি স্কুল থেকে বেরিয়ে আমাকে দেখিয়ে এনেছে ওখানে। স্ক্যান করাতে বায়পসি করাতেও নিয়ে গেছিল। ওকে হেডমাস্টার বলেছিলেন ছুটি নিন, ও নেয়নি। অপারেশন কালকেই যে হবে এমন কোনো কথা নেই পরশুও হতে পারে। যদি পরশু হয় তা হলে পরশুও স্কুলে যাবে না।’

‘ভালোয় ভালোয় ফিরে এসো ভগবানের কাছে এই প্রার্থনাই করি।’

পরদিন সকাল আটটা নাগাদ স্বামীর সঙ্গে হাসি ট্যাক্সিতে উঠল। ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা দাঁড়াল সদর দরজায়। ভুটু ঝুঁকে পড়ে দু—হাত বাড়িয়ে দিল গাড়িতে বসা মায়ের দিকে। কল্পনা তাকে আঁকড়ে ধরে সামলাতে লাগল। শুরু হল ভুটুর কান্না। হাসি গাড়ি থেকে নেমে এসে ছেলেকে বুকে জড়িয়ে দু—গালে চুমু দিয়ে কল্পনার হাতে ফিরিয়ে দিল। দ্রুত গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করেই সামনে তাকিয়ে বলল ‘চলো।’

বিজলি পরের দিন সন্ধ্যায় খবর পেলেন হাসি ভালো আছে। ডান স্তনটা কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে। জ্ঞান ফিরেছে কথা বলেছে। প্রথম দিন ভুটু দিনের বেলায় একতলায় কল্পনার কাছে ছিল। সন্ধ্যায় তাকে বিজলির খাটের উপর পদ্ম তুলে দেয়। কাপড়ের একহাত লম্বা একটা পাণ্ডা ভালুক, হাওয়া ভরা প্লাস্টিকের ডলফিন, প্যাঁচ দেওয়া লাঠির মতো বেলুন, দুটো প্লাস্টিকের চাকাভাঙা মোটরগাড়ি, এইসব সামগ্রী নিয়ে বিজলির সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলার পর ভুটু উৎসাহ হারিয়ে খাট থেকে নামার জন্য বায়না জোড়ে। পদ্ম এলাচদানা দিয়ে শান্ত করে। এলাচদানা ফুরিয়ে গেলে আবার কান্না শুরু হয়।

‘সন্ধের সময় বাচ্চচাদের মাকে মনে পড়ে।’ বিজলি বললেন পদ্মকে, ‘হাসি আপিস থেকে ফিরে ওকে নিয়েই তো থাকত। পদ্ম ওকে এবার একটু রাস্তায় ঘুরিয়ে আন, গাড়িঘোড়া লোকজন দেখে ভুলে থাকবে।’

পদ্ম ভুটুকে নিয়ে জয় দত্ত স্ট্রিট থেকে বড়ো রাস্তার মোড় পর্যন্ত যায়। ভুটু যানবাহন আলো শব্দ মানুষজন মুগ্ধ কৌতূহলে দ্যাখে। দেখতে দেখতে একসময় ক্লান্ত হয়ে পদ্মর কাঁধে মাথা রেখে ঝিমিয়ে পড়ে। পদ্ম ফিরে আসে ঘুমন্ত ভুটু আর একটা পকেট ট্রানজিস্টর হাতে নিয়ে।

‘কোথায় পেলি এটা?’ বিজলি অবাক।

ভুটুকে খাটে শুইয়ে দিয়ে পদ্ম বলল ‘নীচের দাদা দিল, এটা হাসিদির। বলল মাসিমাকে দাও উনি শুনবেন। আমি বললুম আপনি শুনবেন না? তাইতে বলল আমার শোনার জন্য একটা আছে। এই বলে একটা ক্যাসেট টেপ রেকর্ডারে ঢুকিয়ে চাবি টিপল আর অমনি গান বাজতে লাগল।’

রেডিয়োটা হাতে নিয়ে বিজলি বললেন, ‘হাসি গান শুনতে ভালোবাসে। মাঝে মাঝে অনেক রাত্তিরে নীচের থেকে গান ভেসে আসত।’ একটা কথিকা হচ্ছে, তিনি ডায়ালের কাঁটা ঘোরাতেই গান বেজে উঠল। লোকসংগীত পুরুষের গলায়, তিনি শুনতে লাগলেন।

‘মাসিমা মেঝের কোন দিকটায় ভুটুকে শোয়াব? এই দিকে তোমার খাটের পাশে বিছানা পাতি? তুমি তো আর নামছ না।’

অনেক বছর পর বিজলি মন দিয়ে গান শুনছেন। শুনতে ভালো লাগছে। পদ্মর কথায় আলগাভাবে বললেন ‘যা ভালো বুঝিস কর। ঘুম থেকে তুলে ওকে দুধটা খাইয়ে দে। কলঘরে গিয়ে মুতিয়ে আনবি।’

ছোট্ট তোষকের উপর রাবার ক্লথ ও কাঁথা পেতে মাথার বালিশটা রাখতেই বিজলি হাঁ হাঁ করে উঠলেন, ‘পদ্ম করলি কী? উত্তর দিকে মাথার বালিশ? তোকে সেদিনই বললুম না গণেশের মাথাটা কেন হাতির হল? বালিশ এদিকে রাখ।’

অপ্রতিভ পদ্ম তাড়াতাড়ি বালিশটা বিছানার অন্য দিকে রেখে বলল, ‘ও দিকটা যে উত্তর জানতুম না, ভাগ্যিস বললে। ভুটুর মাথাটা কাপড় দিয়ে ঢেকে দোব মাসিমা?’

‘তুই ভেবেছিস তা হলে শনির দৃষ্টি আটকানো যাবে? মুখ্যু কোথাকার, ঠাকুর দেবতার দৃষ্টি কাপড় দিয়ে আড়াল করা যায় না। পুণ্যি অর্জন করলেই দেবতার শুভ দৃষ্টি পাওয়া যায়।’

পরের দিন দুপুরে এক কাণ্ড ঘটল। ঘরের দরজা খুলে কল্পনা দুপুরে ঘুমোচ্ছিল পাশে ভুটুকে শুইয়ে। একসময় ঘুম ভেঙে ভুটু উঠে বসে খাটের তলায় ঝুড়িতে জমিয়ে রাখা পুরোনো কাপড়গুলো টেনে বার করে সময় কাটাচ্ছিল। সেই সময় হুলো বেড়ালটা ঘরে ঢুকে একটা বাচ্চচা ছেলেকে দেখেই অত্যাচারিত হওয়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে শুরু করে। ভুটু হামা দিয়ে হুলোর পিছু নেয়। ভুটু দোতলার শেষ ধাপে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং টলমল করতে করতে পিছন দিকে উলটে যায়।

বিজলির ঘুম পাতলা। ‘ঢপ’ একটা শব্দ এবং ভুটুর চিৎকার ও কান্না শুনেই বিছানায় উঠে বসে তারস্বরে বলতে থাকেন, ‘কী হল, অ কল্পনা ভুটু বোধহয় পড়ে গেছে, দ্যাখ দ্যাখ ভুটু বোধহয় সিঁড়িতে পড়ে গেছে।’

ভুটু তখনও চিৎকার করে যাচ্ছে শুনে বিজলি বুঝে গেলেন কল্পনা নীচে নেই বা এখনও ঘুমোচ্ছে। পদ্মও বাড়িতে নেই, মাইনে বাবদ বিজলির দেওয়া মাসের বরাদ্দ তিনশো টাকাটা মাকে দিতে গেছে। বিজলি বিছানায় বসে আবার চিৎকার করলেন, ‘ওরে কল্পনা, ভুটু সিঁড়িতে পড়ে গেছে গিয়ে দ্যাখ।’

কান্নাটা এখন ফুঁপিয়ে হচ্ছে। বিজলি খাট থেকে দুটো পা ঝোলালেন। ধীরে ধীরে ভালো পা—টা মেঝেয় রেখে প্লাস্টার করা পা—টা এক বিঘৎ মেঝে থেকে তুলে রেখে খাটে দু—হাতের ভর রেখে লাফিয়ে লাফিয়ে খাটের শেষ প্রান্তপর্যন্ত গিয়ে বারান্দার দিকে মুখ করে চিৎকার করলেন, ‘ওরে হারামজাদি কল্পনা। মুখপুড়ি তুই কোথায়?’ কল্পনার সাড়াশব্দ না পেয়ে এবার তিনি ধীরে ধীরে একপায়ে ভর রেখে উবু হয়ে বসে দু—হাত মেঝেয় রাখলেন। তারপর হামা দিয়ে বারান্দায় এসে দুই রেলিঙের মাঝে মুখটা চেপে কর্কশ স্বরে চিৎকার করলেন। ‘ভুটু যে মরে গেল! হারামজাদির কালঘুম এখনও ভাঙল না? ওরে আবাগির বেটি উঠে দ্যাখ ছেলেটার কী হল, বাঁচল না মরল সেটা দ্যাখ।’

পাশের বাড়ির জানলা থেকে এক গৃহিণী বললেন, ‘কী হল দিদি অমন চ্যাঁচাচ্ছেন কেন?’

‘আর বোলো না। এই এক ঘুমকাতুরে মেয়ের হাতে বাচ্চচা রাখার দায়িত্ব দিয়ে গেছে বাবা, মা গেছে নার্সিংহোমে অপারেশন করাতে। টাকা নিয়ে কাজ করছিস, কাজটা অন্তত কর তা নয় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে! ছেল এদিকে সিঁড়িতে পড়ে গিয়ে চিক্কুর দিয়ে উঠেছে। মাথাটাথা ফেটেছে কিনা কে জানে। ওই শোনো ভুটু এখনও কাঁদছে।’

তাই শুনে পাশের বাড়ির গৃহিণী বিজলির সাহায্যে নেমে বাজখাঁই কণ্ঠে চেঁচালেন, ‘ওরে কল্পনা উঠে দ্যাখ কী কাণ্ড হয়েছে।’

ভুটুর কান্না বন্ধ। বিজলি বুঝে গেলেন কল্পনা ঘুম থেকে উঠেছে।

‘দিদি আপনার পা এখন কেমন? ওই পা নিয়ে আপনি বারান্দায় বেরিয়ে এসেছেন!’ পাশের বাড়ির গৃহিণী যুগপৎ তারিফ ও বিস্ময় তাঁর কণ্ঠে ধরে দিলেন।

‘কী করব ভাই ছেলেটাকে তো দেখতে হবে। একটা অসহায় বাচ্চচা, ভিখিরির ছেলে তো নয় ভদ্র বামুনের ঘরের ছেলে।’

‘শুনলাম ওর মায়ের ক্যানসার, সত্যি?’

‘হ্যাঁ সত্যি।’

‘ইসস কী যন্ত্রণা পাচ্ছে বলুন তো! এখন বাঁচলেই ভালো।’

ভুটুকে কোলে নিয়ে কল্পনা দোতলায় উঠে এল। বিজলি তখনও বারান্দায় হাঁটু গেড়ে। ভুটুর রক্তপাত হয়নি, রগের কাছটা ফুলে লাল হয়ে রয়েছে। বিজলিকে দেখে সে ফুঁপিয়ে উঠল। তিনি দু—হাত বাড়িয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলে। নানান সান্ত্বনা বাক্যে ভুটুকে তুষ্ট করতে করতে তিনি বুঝলেন এখন তিনি বিপন্ন। উঠে দাঁড়াতে হলে দু—পায়ের উপর চাপ দিয়ে দাঁড়াতে হবে।

‘ধর ওকে।’ ভুটুকে তুলে দিলেন কল্পনার হাতে। তারপর হামা দিয়ে ঘরে ফিরে এসে খাটের পায়া ধরে দাঁড়ালেন এক পা মেঝে থেকে তুলে।

‘মাসিমা তোমাকে ধরব?’ ভয়ে ভয়ে কল্পনা বলল।

‘ধরে ধরে নিয়ে চল।’ অসহায়ভাবে বললেন বিজলি। ভেবেছিলেন প্রচণ্ড বকুনি দেবেন, কিন্তু ওর সাহায্যটাও এখন দরকার। যা বলার পরে বলবেন।

‘কী করব আমার খালি ঘুম পায়। মা বলে এটা নাকি আমার ব্যামো।’ ভুটুকে খাটে বসিয়ে কল্পনা বিজলির একটা হাত গলায় জড়িয়ে তাঁকে খাটের ধারে নিয়ে যেতে যেতে বলল।

‘ঘরের দরজাটা বন্ধ করে যদি ঘুমোতিস ভুটু তা হলে বেরোতে পারত না।’ বিজলি শান্ত গলায় বললেন, কল্পনার অকপটতা তাঁকে স্পর্শ করেছে।

‘এবার থেকে তাই করব। নাও বোসো, আমি দুটো পা খাটে তুলে দিচ্ছি তুমি গড়িয়ে চিত হয়ে যাও।’

কল্পনার কথামতো বিজলি তাই করলেন। টের পেলেন পায়ের ভাঙা জায়গাটায় ছুঁচ ফোটার মতো একটা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।

পরের দিন দুপুরে কথায় কথায় পদ্ম বলল, ‘রাধুমাসিমার শ্রাদ্ধ হবে না?’

‘কেন, তোর তাতে কী?’

‘আমার আবার কী হবে। মা—র কাছে শুনলুম আত্মঘাতী হলে নাকি ওরা ভূত হয়ে বেঁচে থাকে, ওদের মুক্তি হয় না, সত্যি?’

বিজলি মুশকিলে পড়লেন, আত্মঘাতী হলে শ্রাদ্ধ করা যায় কি না সেটা ঠিক জানেন না। তাঁর জীবনে আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতদের মধ্যে কেউ আত্মহত্যা করেনি, তবে অপঘাতে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে, তাদের শ্রাদ্ধও হয়েছে। যতদূর শুনেছেন আত্মহত্যা করলে শ্রাদ্ধ নয় প্রায়শ্চিত্ত করাতে হয়। অবশ্য তাতে আত্মার মুক্তি ঘটে কিনা সে সম্পর্কে তাঁর সন্দেহ আছে।

‘রাধুমাসি ভূত হবে বলছিস?’ বিজলি গম্ভীর স্বরে বললেন।

‘আমি নয় মা বলল।’

‘মেয়েমানুষ ভূত হয় না পেত্নি হয়, এটা তোর মা জানে না?’

‘ভূতেরা তো ঘাড় মটকায়।’

‘পেত্নিরাও মটকায়। বেঁচে থাকতে যারা শত্রুতা করেছে, কষ্ট দিয়েছে মারা গিয়ে তাদের ঘাড় মট করে ভেঙে দেয়। খুব সাবধান পদ্ম। তোর কাছে বিষ চেয়েছিল তুই দিসনি, মনে আছে?’

‘ওকে বাঁচাতেই চেয়েছি, এটা কি শত্রুতা?

বিজলির চোখ দিয়ে বিস্ময় ঠিকরে বেরোল। ‘তোর কাছে চাইল আর তুই দিলি না এটা কি রাধু ভুলে যাবে ভেবেছিস?’ পদ্মর মুখ কাঁদোকাঁদো হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি আশ্বাস দিলেন, ‘ভয় পাচ্ছিস কেন? সেই মন্তরটা বলবি ‘ভূত আমার পুত পেত্নি আমার ঝি। রামলক্ষ্মণ বুকে আছে করবি আমার কী।’ ব্যস তিন বার বলবি রাত্তিরে ঘুমোবার আগে, তোর ধারেকাছে ভূত পেত্নি আসবে না। জানলা দিয়ে হাত বাড়াবে কিন্তু তোকে ছোঁয়ার সাহস হবে না।’

বিকেলেই পদ্ম শোভাবাজারে গিয়ে রাম সীতা ও লক্ষ্মণের রঙিন একটা কাচে বাঁধানো এক ফুট লম্বা ছবি কিনে আনল।

‘তুই আবার রামভক্ত কবে থেকে হলি রে পদ্ম?’ বিজলি মুচকি হেসে বললেন।

হাসিটা দেখে পদ্ম চটে গেল। শুকনো স্বরে বলল, ‘তুমি এতগুলো দেবদেবীর ভক্ত হতে পারো আর আমি রামের ভক্ত হলেই দোষ! সবারই নিজের নিজের ভক্তি করার দেবতা আছে।’

‘তা তো আছে কিন্তু রাম লক্ষ্মণকে রাখবি কোথায়? আমার ওখানে তো জায়গা নেই।’

‘মাথার কাছে রাখব।’

‘সে তো রাতে আর দিনেরবেলায়?’

‘খাটের নীচে।’

বিজলি ধমকে উঠলেন, ‘খবরদার, দেবতাদের মাথার উপরে শুয়ে আমি পাপ কুড়োতে পারব না, তুই অন্য জায়গা দ্যাখ। খাটের নীচে রাখলে তো ভুটুর হাতে পড়বে তখন তো তিনটুকরো হয়ে যাবে তোর দেবতা।’

বিব্রত মুখে পদ্ম ঘরের এধার—ওধার তাকিয়ে বলল, ‘ওই সেলাইকলটার ওপর দিনের বেলায় রাখব,’ ঘরের কোণে তপতীর জন্য কিনে রাখা সেলাইকলটা সে দেখাল।

আলো নিভিয়ে রাতে ভুটুকে নিয়ে শুয়ে পদ্ম ছবিটা তার বালিশের নীচে রাখল। বিজলি শুনতে পেলেন পদ্ম বিড়বিড় করছে। একটু পরে পদ্ম উঠে তার পায়ের দিকের জানলাটা বন্ধ করল।

‘কী রে জানলা বন্ধ করলি যে?’

ভারী গলায় পদ্ম বলল, ‘মেঘ করেছে বৃষ্টির ছাট এসে সব ভিজিয়ে দেবে।’

পাঁচ দিন পর যখন ফিরে এল হাসি, তখন বিজলি আবার লোটাস নার্সিং হোমে গেছেন পায়ের যন্ত্রণা অব্যাহত থাকায় এক্সরে করাতে। পাড়ার ক্লাবের সেই ছেলেরাই তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে গেল এবং ফিরিয়ে দিয়ে গেল, সঙ্গে ছিল পদ্ম এবং অলকা। তার পায়ের অবস্থার কথা শুনে অলকাই লোটাসে গিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে তাঁকে নিয়ে যায়। লোটাস থেকে ফিরেই তিনি শুনলেন হাসি ফিরে এসেছে এবং ভালো আছে। তিনি নিজেই পদ্মকে বললেন, ‘ভুটু রাতে মায়ের কাছে থাকবে, এটা বলে আয় ওদের। অনেকদিন ছেলে ছাড়া হয়ে আছে এবার ছেলেকে কাছে নিক। আর বলিস সঙ্গে করে এক বিছানায় যেন না শোয়, বুকে অতবড়ো অপারেশন হয়েছে, ভুটু যা হাত—পা ছোড়ে লেগেটেগে যেতে পারে।’

রাতে অন্ধকার ঘরে মেঝেয় শোয়া পদ্ম একসময় বলল, ‘মাসিমা কীরকম খালি খালি লাগছে, তোমার?’

‘আমারও।’

একমাস পর হাসি অফিসে গেল। এক্সরে দেখার পর ডাক্তারের নির্দেশ ‘একমাস একদম নড়াচড়া নয়। অমন করে খাট থেকে নেমে বারান্দায় না গেলে জোড়াটা ঠিকমতো লেগে যেত। খুব বেশি ক্ষতি হয়নি, একটু বেঁকে থাকবে। বলেন তো আর একবার অপারেশন করে ঠিক করে দিতে পারি।’

বিজলি আঁতকে উঠে বলেছিলেন, ‘রক্ষে করো। অজ্ঞান হতে পারব না।’

বিজলি এরপর থেকে কঠিনভাবে ডাক্তারের নির্দেশ পালন করে যাচ্ছেন। ভুটুকে আর খাটে তোলেন না। পদ্ম বা কল্পনার কাছ থেকে হাসির এবং পাড়ার খবর নেন। অলকা প্রায়ই আসে। জ্যোতি ঘরভাড়া দিতে এলে তিনি জানিয়ে দেন, ‘আমার এখন টাকার জন্য ব্যস্ততা নেই। তোমাদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে, আরও হবে। ও টাকা তুমি রেখে দাও পরে সুবিধেমতো ভাড়া দিয়ো।’

হাসি মাসখানেক অফিস করার পর আবার অসুস্থ হয়ে পড়ে। আবার সে ডাক্তার দেখায়, এক্সরে করে। চার দিন পর বিজলি শুনলেন, ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে ফুসফুসে, গলায়। প্রথম বার অপারেশন করাতে বা ডাক্তার দেখাতে গড়িমসি করায় ক্যানসার বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যায়। যদি কোনো ক্যানসার বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রথমেই দেখাত তা হলে এখনকার এই অবস্থা হত না। বিজলি বললেন, ‘কপাল! যার যা কপালে লেখা আছে, কে তা খণ্ডাতে পারে।’

রাত্রে ভুটুকে দোতলায় দিতে এসেছিল জ্যোতি। বিজলি তাকে চেপে ধরলেন, ‘সত্যি করে বলো তো হাসির অবস্থাটা কেমন, সেরে উঠবে কিনা?’

ইতস্তত করে জ্যোতি বলে, ‘ডাক্তার তো বললেন ছড়িয়ে গেছে। ছড়ানোটা বন্ধ করতে রেডিয়ো থেরাপি করাতে বললেন। আমার এক ছাত্রের দাদা এন আর এসে হাউসস্টাফ। তাকে বলেছি ওখানে রে দেবার ব্যবস্থা করে দিতে। পরশু থেকে শুরু হবে, দশ বার নেবে।’

‘তা হলেই হাসি ভালো হয়ে যাবে?’

‘না।’ দ্রুত উত্তর দিল জ্যোতি। বিজলির মনে হল উত্তরটা তৈরি হয়েই ছিল। শুধু অপেক্ষা করছিল মুখ থেকে বার করে দেবার সময়ের জন্য।

‘হাসি জানে?’

‘এখন বোধহয় জেনে গেছে। মাসিমা ভুটু রইল।’

জ্যোতি চলে যাবার পর বিজলি চিত হয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। রাতে ঘুম এল না।

হাসি রেডিয়ো থেরাপি করাতে যায় ট্যাক্সিতে, দুপুরে সঙ্গে যায় কল্পনা। বাড়িতে পদ্ম আগলে রাখে ভুটুকে। জ্যোতি যথারীতি সকালেই স্কুল বেরিয়ে যায়। দশটা রে নেবার পর ডাক্তার শেষ চেষ্টা হিসাবে কেমোথেরাপি করতে বলে। বিজলি বিছানায় বসে উদবিগ্ন হয়ে পদ্মকে বলেন, ‘হ্যাঁরে কেমোথেরাপিটা কী জিনিস? একবার জ্যোতিকে জিজ্ঞাসা করে আয় না। রেডিয়ো থেরাপির মতো কি?’

পদ্ম রাতে জ্যোতির কাছ থেকে শুনে এসে বলে, ‘এটা অন্য ভাবে করে। হাতে ছুঁচ ফুটিয়ে উঁচু থেকে নল দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে শরীরে ওষুধ ঢোকায়। চার—পাঁচ ঘণ্টা কি তার বেশি সময় লাগে। দশ দিন অন্তর নিতে হবে হাসিদিকে।’

‘তখন কি খুব কষ্ট হয়?’

‘তা তো জিজ্ঞেস করিনি! দাঁড়াও জিজ্ঞেস করে আসি।’

‘থাক আর জিজ্ঞেস করতে হবে না। বার বার অসুখের কথা তুললে ওর খারাপ লাগবে।’ কেমো নেবার এক মাসের মধ্যে হাসির মাথার চুল ঝরে পড়ল। তিন বার কেমো নেবার পর ডাক্তার জ্যোতিকে বলেছেন, আর খরচ করার দরকার নেই। ওনার যা খেতে ইচ্ছে হয় খেতে দিন।

শেষের কথাটা বিজলির কানে আসতেই পদ্মকে তিনি বললেন, ‘জেনে আয় তো হাসির কাছে থেকে কী খেতে ভালোবাসে তবে নিরিমিষ্যি কিন্তু।’

‘ওম্মা চিবিয়ে খাবে কী, গলা দিয়ে কিছু কি নামে? নালিটালি সব তো ক্যানসারে খেয়ে ফেলেছে। এখন তো শুধু জলের মতো জিনিস চামচে করে খায়!’

বিজলি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এতবড়ো একটা ব্যাপার কয়েক দিনের মধ্যে তাঁর ঘরের নীচে ঘটে গেল আর তিনি রয়েছেন অন্ধকারে। গুম হয়ে বসে তিনি নিজের ভাগ্যকে দুষলেন। কেন যে মরতে রথ টানতে গেলুম, কেন যে ওই রোগাপটকা রিকশাওয়ালাটার রিকশায় উঠলুম, কেন যে রাস্তা খুঁড়ে সারায় না। ভাবতে ভাবতে তাঁর মাথা গরম হয়ে উঠল। হাসির গলা দিয়ে কিছু নামে না তার মানে ও মরছে। বাচ্চচাটা এবার কী করবে, কোথায় কার কাছে থাকবে? ভেবে কূলকিনারা পেলেন না।

থালায় ভাত, চচ্চচড়ি, করলাভাতে, বাটিতে ডাল নিয়ে পদ্ম টুলটা টেনে এনে খাটের ধার ঘেঁষে রাখল। থালাটা তার উপর রেখে বলল ‘জানো মাসিমা বাজারে আজ ফুলকপি দেখলুম, অসময়ের কপি, ভাবলুম কিনে ফেলি তুমি তো ফুলকপি ভালোবাস। এইটুকু একটা বলল কিনা কুড়ি টাকা। কী দাম—’

তার কথা শেষ হবার আগেই ঝনঝন শব্দে কাঁসার থালা মেঝেয় ছিটকে পড়ে ছড়িয়ে গেল ভাত, ছিটকে পড়ল ডাল। বিজলি তারপর টুলটাও উলটে ফেলে দিলেন।

‘মেয়েটা খেতে পারছে না কষ্ট পাচ্ছে, আর আর আমি চিবিয়ে চিবিয়ে কপি গিলব? দূর কর সব আমার সামনে থেকে।’

বিজলির মুখের ভাব দেখে ফ্যাকাশে হয়ে গেল পদ্ম। ছিটকে যাওয়া ভাতের কয়েকটা ঠাকুরের সিংহসন পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। সিংহাসন ছোঁয়া তার বারণ, তা মনে না রেখে রাধাকৃষ্ণর পায়ের উপর থেকে পদ্ম কুড়িয়ে নিল ভাতগুলো। ঝাঁটা এনে জড়ো করল মেঝেয় ছড়ানো ভাত, ন্যাতা দিয়ে মুছল মেঝে, একটি কথাও এতক্ষণ সে বলেনি।

‘তুই খেয়ে নে।’ বিজলি গম্ভীর গলায় হুকুম করলেন। কোনো কথা না বলে পদ্ম ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মাথার নীচে দু—হাতের তালু রেখে শুয়ে রইলেন বিজলি। পদ্ম ঘরে ঢুকল বিকেলে।

‘ভাত খেয়েছিস?’

পদ্ম চুপ।

‘কীরে জবাব নেই কেন?’

‘না।’ বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ছয়

ভুটুকে বুকের কাছে আঁকড়ে বিজলি বিছানায় শুয়েই শুনলেন হরিবোল ধ্বনি। বিজলির টাকায় পাড়ার ছেলেরা খাট আনে ফুল আনে। পদ্ম চন্দন বেটে হাসির কপালে লবঙ্গ দিয়ে ছাপ দেয়। চওড়া করে সিঁথিতে সিঁদুর দেয়। বেনারসি নেই, রেশমের শাড়ি পরিয়ে দু—পায়ে আলতা দেয়। ফুল দিয়ে ঢেকে দেয় কেশবিহীন মাথাটা। কে একজন একটা গীতা হাসির বুকের উপর রেখে দিল।

জয় দত্ত স্ট্রিটের দু—ধারের বাড়ির দরজায় মানুষ, বারান্দা জানলা ছাদেও মানুষ। এত অল্পবয়সি এয়োতি স্মরণকালের মধ্যে এ পাড়ায় মারা যায়নি। অল্পবয়সি বউয়েরা হাসির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম জানিয়ে কামনা করল তার মতো সিঁথির সিঁদুর বজায় রেখে যেন চিতায় উঠতে পারে।

ছটফট করছে ভুটু। তাকে দু—হাতে আঁকড়ে রয়েছেন বিজলি। অবশেষে বিজলির বাহু বন্ধন থেকে মুক্তি না পেয়ে সে কান্না জুড়ে দিল। পদ্ম, কল্পনা, সবাই নীচে। অসহায়ভাবে তিনি শিশুর কান্না শুনে যেতে লাগলেন। এই বাড়িতে চিৎকার করে কাঁদছে শুধু একজনই আর একজনেরই চোখ দিয়ে নীরবে দরদর করে জল নামছে। অলকা দরজায় এসে দাঁড়াল। বিজলি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চলে গেছে?’

‘হ্যাঁ। ওকে আমার কাছে দিন।’ অলকা তুলে নিল ভুটুকে। ‘এর কী হবে এখন?’

‘শ্রীধরই জানেন, তিনিই দেখবেন।’

‘জ্যোতিবাবুর মা—বাবা আছেন তো?’

‘জানি না, ওদের সম্পর্কে কিছুই জানি না, জিজ্ঞেস করতে হবে।’

‘সেখানে ওকে পাঠিয়ে দিলেই তো হয়।’

‘তা তো হয়, জ্যোতিকে বলব। দুটো দিন থাক শোকটা কমুক তখন বলব।’

‘হাসির বাপের বাড়ির কেউ এসেছিল কি?’

‘জানি না। আমি তো ওপরে এই অবস্থায়। কে এল না এল জানার তো উপায় নেই আমার।’ ক্লান্ত স্বরে টেনে টেনে কথা বলে যাচ্ছেন বিজলি। ‘পদ্মকে দেখলে?’

‘পদ্ম তো এদের সঙ্গে শ্মশানে গেল।’

‘ও আবার গেল কেন, বাড়িতে এখন কত কাজ। শ্মশান থেকে ফিরলে ওদের জন্য নিমপাতা, মটরডাল, লোহা, ঘুঁটের আগুন সদর দরজায় রাখতে হবে, এসব তো হিন্দুদের সংস্কার, মানা উচিত। শ্মশানযাত্রীদের অন্তত দুটো মিষ্টি খাওয়াতে হবে, তুমি বউমা এগুলো একটু দ্যাখো।’ বিজলি বিব্রত স্বরে বললেন।

‘ঘুঁটে এখন কোথায় পাব, দেখি আমাদের কাজের মেয়েটাকে বলে।’ অলকা ভুটুকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

রাত দশটা নাগাদ পদ্ম ফিরল শ্মশান থেকে। তার একটু পরেই ঘুমন্ত ভুটুকে নিয়ে এসে অলকা বলল, ‘জেঠিমা ভুটু যদি রাত্রে আমার কাছে থাকে তা হলে আমার কোনো অসু!বেধ হবে না।’

‘তা জানি, তবে পদ্মর সঙ্গেই এর ভাব বেশি। রাতে পদ্মর সঙ্গেই শোয়। ও বরং এখানেই থাকুক।’

অলকার কাজের মেয়েটিকে দিয়ে বিজলি একশো টাকার রসগোল্লা আনিয়ে ছিলেন। পদ্ম সেগুলো বিলি করে উপরে এল, একটা কোরা কাপড়ের সরু ফালিতে বাঁধা চাবি হাতে নিয়ে।

‘এটা কী হবে?’ বিজলি বিস্মিত।

‘ভুটু গলায় পরবে। বাপ—মা মরলে ছেলেরা পরে।’ পদ্মর স্বরে বিশ্বাস ও ভক্তি।

‘রাখ ওসব।’ বিজলি ধমক দিলেন, ‘ওইটুকু ছেলের গলায় ওসব পরাতে হবে না।’

‘মাসিমা এটাই তো নিয়ম। বাবা মারা যেতে দেখেছি দাদারা সবাই পরেছিল।’

‘ওসব নিয়মটিয়ম রাখ তো। ভুটুর গলায় চাবি ঝোলালে লোকে দেখে হাসবে। ও তো এক মিনিটেই গলা থেকে খুলে ফেলবে নয়তো মুখে পুরে দেবে। কাণ্ডজ্ঞান মেনে তো নিয়ম মানবি! তা ছাড়া ওর বাবা আছে তাকে জিজ্ঞাসা না করে এসব পরানো উচিত নয়, জ্যোতির তো আপত্তি থাকতে পারে। যদি বলে কোনো শাস্ত্রে লেখা আছে যে গলায় চাবি ঝোলাতে হবে? তুই দেখাতে পারবি?’

বিজলির কথার ঝাঁঝে পদ্ম মিইয়ে গেল। চাবিটা সে বালিশের তলায় রেখে দিয়ে বলল, ‘দাদা কাঠের চুল্লিতে পোড়ালো না, ইলেকট্রিকে দিল। একটা বামুন এল, হাতের সরায় শিশিতে ঘি ফুল আর কী কীসব ছিল, মুখে আগুন দেবার প্যাকাটিও এনেছিল। দাদা বামুনকে বলল, ওসব কিছু দরকার নেই। বামুন তো ঝগড়া শুরু করল, বলল এসব না করলে শ্মশানের অকল্যাণ হবে, অপদেবতা ভর করবে। আমাদের বাবলা তখন দাদাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে কী সব বলল তারপর তিরিশটা টাকা এনে বামুনকে দিয়ে ঝামেলা থামাল।’

বিজলি উদবিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন, ‘মুখে আগুনটা দিয়েছে?’

‘না দেয়নি। দাদা কী রকম যেন।’ পদ্মর স্বরে অনুযোগ : ‘বড্ড একগুঁয়ে। কত করে বললুম কিছুতেই রাজি হল না, ছেলেরা চারশো টাকা চাইল অমনি দিয়ে দিল, ওখানেই কোথায় গিয়ে তখুনি ওরা মদ গিলে এল।’

‘তুই নীচের ঘরে আমার এই পিলসুজ আর পিদিমটা নিয়ে গিয়ে জ্বালিয়ে রেখে আয়। জ্যোতি আপত্তি টাপত্তি করলে বলবি এটা মাসিমার বাড়ি, এ বাড়িতে মাসিমার নিয়ম মেনে চলতে হবে, বাড়ির একটা ধর্ম আছে, সেটা রক্ষা করতে হবে। নাস্তিকপনা যদি দেখাতে হয় সেটা বাড়ির বাইরে গিয়ে দেখাও গে। পারবি বলতে?’

অনিশ্চিত স্বরে পদ্ম বলল, ‘হুঁ।’

প্রদীপে তেল ঢেলে তাতে সলতে দিয়ে পদ্ম পিলসুজটা হাতে নিয়ে নীচে নেমে গেল। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, ‘কিছু বলতে হয়নি। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রেকর্ডারে খুব আস্তে গান শুনছিল। আমি আলো জ্বাললুম, দেখি চোখ মুছল। বলল, জানলার ওই ধারটায় জ্বালিয়ে রাখো। তোমার হাসিদি ওইখানে মোড়া পেতে বসে গল্প করত, ওটা ওর খুব পছন্দের জায়গা ছিল। জানো মাসিমা আমার মনে হল বউকে খুব ভালোবাসত তবে বাইরে সেটা দেখাত না, খুব দুঃখু পেয়েছে।’

বিজলি চুপ করে রইলেন।

অলকার কথাটা বিজলির মাথায় ঘুরছিল, মা—বাবার কাছে ছেলেকে পাঠিয়ে দিতে পারে জ্যোতি! পদ্মকে দিয়ে চার দিন পর তিনি রাত্রে জ্যোতিকে ডাকিয়ে আনলেন।

‘ভুটু কি এইভাবে থাকবে? একটা কিছু তো ব্যবস্থা করতে হয়।’ পায়ের দিকে দাঁড়ানো জ্যোতিকে লক্ষ করে বললেন। ভুটু তখন খাটে বিজলির পাশে ঘুমোচ্ছে। পদ্ম তাঁর মাথার দিকে খাটের বাজু ধরে দাঁড়িয়ে।

অসহায় দেখাল জ্যোতিকে। ‘হ্যাঁ ব্যবস্থা কিছু তো করতে হবে। কিন্তু কী করব ভেবে উঠতে পারছি না। আমার এক কলিগ বললেন, অশোকনগরে তার চেনা এক নিঃসন্তান ফ্যামিলি আছে। তাদের কাছে যদি রাখতে রাজি হই তা হলে তিনি কথা বলতে পারেন। ফ্যামিলিটির মুদির দোকান আছে লেখাপড়া তেমন করেনি। মাসে মাসে কয়েকশো টাকা দিলেই হবে।’

‘ওইরকম ফ্যামিলিতে তোমার ছেলে মানুষ হবে ভেবেছ?’ বিজলির স্বরে বিরক্তি ও আপত্তি গোপন রইল না। জ্যোতিকে দেখে তাঁর মনে হল এটা যেন জ্যোতিরও মনের কথা।

‘আমি তো আর বিশেষ কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছি না। ওকে তো আপনারাই যেমন রাখছেন তেমনি রাখতে পারেন।’

‘আমার বয়স হয়েছে আজ আছি কাল নেই। এখন কাজ চালাবার মতো নয় রাখছি। পরে কী হবে?’

এইসময় পদ্ম হঠাৎ বলে বসল, ‘দাদা তো আবার বিয়ে করতে পারেন।’

‘তুই থাম’ বিজলি দাবড়ানি দিলেন। ‘সব ব্যাপারে তোর নাক গলানো চাই। আর একটাও কথা বলবি না।’

পদ্মর কথায় হেসে ফেলেছে জ্যোতি। ‘মাসিমা ওকে বকবেন না। এরকম ক্ষেত্রে সবাই যা ভাবে সেটাই পদ্ম বলে ফেলেছে। আমি আর আমার বোন যখন স্কুলে পড়ি তখন আমার মা মারা যান জলে ডুবে। ছ—মাসের মধ্যে জ্যাঠামশাই কৃষ্ণপদ চক্রবর্তী তার ভাই বিপ্রদাসের বিয়ে দেন তাঁর দূর সম্পর্কের শালির সঙ্গে। যুক্তিটা ছিল এই একই, ছেলেমেয়েদের দেখাশোনা। তারপর আমার চার ভাইবোন হয় কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতাটা খুব ভালো হয়নি। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেই আমি বাড়ি ছাড়া হই, বোনের বিয়ে হয় জমিজমা আছে পাশের গ্রামের এক অশিক্ষিত পূজারি ব্রাহ্মণের সঙ্গে। এখন তার দুটি ছেলেমেয়ে।’

‘তোমার বাড়ি কোথায়?’

‘বর্ধমান থেকে কাটোয়া যাবার রাস্তায় কৈচরের আগে মল্লিকপুর নামে একটা গ্রাম। আপনি কখনো কি ওদিকে গেছেন?’

‘না যাইনি। বিষয় সম্পত্তি আছে?’

‘আছে। ধানজমি, পুকুর, বর্ধমান শহরে একটা বাড়ি, চালের আড়ৎ আরও ছোটোখাটো কী সব ব্যবসা।’

‘অবস্থা তো বেশ ভালোই।’ মন্তব্যটি করে বিজলি বললেন, ‘সব মেয়েই যে ডাইনি হবে, সতীনের ছেলেকে আদর—যত্ন করবে না, তা তো নয়, লেখাপড়া জানা শিক্ষিত শহরের মেয়েরা অন্যরকম হয়, তুমি পদ্মর কথাটা ভেবে দেখতে পারো।’

জ্যোতি চলে যাবার পর পদ্ম বিজলির গলা নকল করে চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুই থাম, আর একটা কথাও বলবি না। এখন সেই তো পদ্মর কথাটাই মুখ দিয়ে বেরোল। মুখ্যু হতে পারি কিন্তু যা বলি কড়ায়—গণ্ডায় ঠিক বলি।’

বিজলি আড় চোখে পদ্মর মুখটা দেখে নিয়ে বললেন, ‘বিছানা কর। ভুটুকে শুইয়ে দে আর জানলাটা কাল ভালো করে বন্ধ করিসনি কেন? মড়মড় মড়মড় করে রাতে শব্দ হচ্ছিল।’

পদ্ম আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। চুপ করে জানলার দিকে তাকিয়ে রইল।

.

দু—মাস পর বিজলির পায়ের প্লাস্টার খোলা হল। পদ্ম নিয়মিত রোজ মালিশ করে দেয় পায়ে, তিনি লাঠিতে ভর দিয়ে বারান্দায় হাঁটেন, সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারেন না এখনও। দেবতাদের নিত্য দিনের পরিচর্যা শুরু করেছেন। ভুটু এখন একতলা—দোতলা করে ইচ্ছেমতো। তিনতলার ছাদেও উঠে যায়। বিজলি যখন সকালে পুজোয় বসেন তখন ভুটুর উপদ্রবের ভয়েই ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দেন। কল্পনা ঘরের এবং রান্নার কাজ করে, যথারীতি দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ে, সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যায়। ভুটুকে দেখাশোনার দায়িত্ব পদ্ম নিজের হাতে তুলে নেওয়ায় কল্পনার এখন কাজ কমে গেছে। জ্যোতি এখন রাত করে ফিরছে, শিক্ষক রাজনীতিতে নিজেকে জড়িয়ে নেওয়ায়।

বিজলি মাঝে মাঝে দুপুরে বারান্দায় এসে টুলে বসেন। রাস্তা দিয়ে লোক চলাচল দেখেন, সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। রাধাকিঙ্করীকে মনে পড়ে, অল্পবয়সি পুলিশ অফিসারকে বলা কথাগুলো মনে করার চেষ্টা করেন। মাথা নীচু করে অফিসারটি তাঁর কথাগুলো লিখতে লিখতে ভ্রু তুলে তাকানো অবশেষে লেখা বন্ধ করে শুধু শুনে যাওয়া। সেদিন তিনি কী বলেছিলেন? রাধু ঠিক করেছে, এখনও কি তিনি তাই মনে করেন? মনে করেন কি রাধু নরকে যাবে। ভাবতে ভাবতে মাথা ভার হয়ে এলে ঘরে ফিরে শুয়ে পড়েন।

এক হাত দেওয়ালে অন্য হাতে পদ্মর কাঁধে রেখে সিঁড়ি দিয়ে একদিন নীচে নামলেন। শোয়ার ঘরের দরজা খোলা দেখে ঢুকলেন। হাসিরা ভাড়া নেবার পর এ ঘরে এক বার কি দু—বার ঢুকেছেন তারপর আজ। কল্পনা মেঝেয় ঘুমোচ্ছে। চারপাশ চোখ বোলালেন। দেওয়ালে ছবি বা ক্যালেন্ডার নেই। খাট, টেবল। তার উপর রুপোলি ফ্রেমে বাঁধানো হাসির মুখের ছবি, স্টিলের বইয়ের র‌্যাক। টেবিলের পাশে দুটো মোড়া, নীচু টুলের উপর স্তূপ হয়ে খবরের কাগজ। দরজা জানলায় গেরুয়া পরদা ধুলোয় মলিন। কাগজ ফেলার ঝুড়িতে জমে আছে পাঁউরুটি ও বিস্কুটের মোড়ক। আলনায় জ্যোতির ব্যবহৃত ময়লা ধুতি ও পাঞ্জাবি। স্টিলের আলমারির মাথায় দুটো সুটকেস।

একঝলক দেখে নিয়ে বিজলি বুঝলেন খাওয়া ও শোয়া ছাড়া জ্যোতির কাছে এই ঘরের আর কোনো প্রয়োজন নেই। টেবিলের কাগজপত্র উলটেপালটে দেখে বইয়ের র‌্যাকে চোখ দিলেন। সবই প্রায় ইংরিজি বই, দু—তিনটি বাংলা বই তাঁর চোখে পড়ল। বইগুলো আঙুল দিয়ে টেনে একে একে বার করে দেখলেন পাতা খুলে। তার মধ্যে থেকে একটা বই পদ্মর হাতে দিয়ে বললেন, ‘ধর এটা। পড়তে হবে।’

‘কী বই গো মাসিমা?’

‘রামকৃষ্ণদেবের নাম শুনেছিস তো, দক্ষিণেশ্বরে আমার সঙ্গে গেছিলিস মনে নেই? তিনি যেখানে যা বলেছেন তাঁর এক ভক্ত সব টুকে রেখেছেন, সেইসব কথা নিয়ে বই। এর নাম কথামৃত, তোকে পড়ে শোনাব। কিন্তু বইটা এখানে কে পড়ে, তোর কাকে মনে হয়?’

চোখ কুঁচকে দু—লহমা ভেবে নিয়ে পদ্ম বলল, ‘হাসিদি।’

‘কেন তোর হাসির কথাই মনে হল?’

‘দ্যাখো বাপু ধম্মোকম্মো মতি মেয়েদেরই হয়। দাদা কেমন যেন কাঠখোট্টা ধম্মো মানে না, শ্মশানেই তো দেখলাম। ছেরাদ্দটা তুমি না করালে তো হাসিদির মুক্তিই হত না। পাঁচালি পড়ে হাসিদি যেভাবে পেন্নাম করল দাদা কি সেভাবে পারবে? ওই দিয়েই তো বুঝলুম।’

‘এই ঘরের ছিরি দেখে এবার কী বুঝছিস।’

‘কল্পনাকে আমিই এখানে কাজে লাগিয়েছি আমিই ঝেঁটিয়ে বিদেয় করব। এত টাকা মাইনের এমন সুখের কাজ কোথাও পাবে নাকি? দ্যাখো মাসিমা কেমন ভোঁসভোঁস করে মড়ার মতো ঘুমোচ্ছে, দুটো লোক যে ঘরে ঢুকেছে সেদিকে খেয়াল নেই, যদি আমরা চোর হতুম?’

ঘর থেকে বেরিয়ে বিজলি বললেন, ‘তোরও খেয়াল নেই, কী বললি। মড়া কখনো ভোঁসভোঁস করে ঘুমোয়? চোর আসবে সদর দরজা খোলা থাকলে। দেখে সে দরজা দিয়েছে কিনা।’

বিজলি সিঁড়ি দিয়ে ওঠা শুরু করলেন, সাত—আটটা ধাপ উঠেছেন পদ্মর উত্তেজিত স্বর শুনলেন, ‘মাসিমা চিঠির বাসকে একটা খাম। চাবিটা দাও।’

বিজলি অবাক হলেন। চিঠি কার! কে লিখল? দাদর চিঠি আসে বিজয়ার পর। তা ছাড়া চিঠি দেওয়র আর তো কেউ নেই। জ্যোতি বা হাসির কোনো চিঠিপত্র আজ পর্যন্ত আসেনি। এলে জানতে পারতেন, লেটার বক্সের তালার চাবি তাঁর কাছে। আঁচল থেকে চাবির তোড়াটা খুলে পদ্মর হাতে দিয়ে কৌতূহল ভরে দাঁড়িয়ে রইলেন।

একটা ধূসর রঙের ঘাম হাতে নিয়ে এসে পদ্ম বিজলির হাতে দিল। অভ্যাস না থাকলেও ইংরেজি পড়তে এবং কিছুটা বুঝতে পারেন বিজলি। খামের উপর প্রাপকের ইংরেজিতে টাইপ করা নামটা দেখেই তাঁর চোখ গাঢ় হয়ে উঠল। পদ্মকে বললেন, ‘পিয়োন ভুল করে দিয়ে গেছে রে। এ নামে এখানে কেউ থাকে না।’

‘কী নাম মাসিমা?’ স্বাভাবিক কৌতূহল পদ্মর গলায়।

‘হাসিনা বানো। তবে ঠিকানাটা এই বাড়িরই।’ বলেই তিনি তাকিয়ে থাকলেন পদ্মর চোখের দিকে।

‘ভুল নাম অথচ বাড়ির নম্বর ঠিক, মাসিমা খুলে দ্যাখো তো?’

বিজলি খামটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে বাকি সিঁড়ি ভেঙে ঘরে এসে খাটে বসলেন। খামের একটা দিক ছিঁড়ে বার করলেন টাপে করা একটা ইংরেজি চিঠি। ইংরেজি পড়ার চেষ্টা করে তিনি কিছু বুঝতে পারলেন না। কিন্তু চিঠিটা এই বাড়ির ঠিকানায় কেন? হাসিনা বানোই বা কে? এ তো মুসলমানি নাম! তার মাথার মধ্যে নাগরদোলার মতো হাসিনা শব্দটা ওঠানামা করতে করতে হঠাৎই মনে হল হাসিনাটা হাসি নয়তো! নাগরদোলা থেকে গিয়ে তাঁর মাথা ঘুরতে লাগল। অসম্ভব, এ হতে পারে না। হাসি কিছুতেই মুসলমান নয়।

বিজলি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে হাসির চলনবলন হাবভাব কথার উচ্চচারণ পরতে পরতে বিছিয়ে গেলেন মাথার মধ্যে। কোথাও এমন কিছু দেখতে পেলেন না যা দিয়ে তাকে অলকা বা রাধুর থেকে আলাদা করা যায়। তিনি ভাবতে চেষ্টা করলেন পিয়োন ভুল করেছে। হাসিনা বানো যে হাসিই হবে এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু মাঝে ৪৭বি জয় দত্ত স্ট্রিট দেখেই তো পিয়োন লেটার বক্সে ফেলে গেছে, ভুল তো করেনি! বাড়ির নম্বর আর রাস্তার নামটা এমনই যে অন্যমনস্ক হয়ে বা ভুল করে টাইপ করে ফেলেছে বলা যাবে না।

মুখ ঘুরিয়ে বিজলি শ্রীধরের সিংহাসন, তার দু—পাশের দেবদেবীর ছবি ও মূর্তির দিকে তাকালেন। দেখতে পেলেন প্রদীপ জ্বলছে, গরদের থান—পরা হাসি পাঁচালি পড়ছে, প্রদীপের আলো হাসির শ্যামবর্ণ মুখের উপর কাঁপছে, হাসির স্পষ্ট উচ্চচারণ তিনি শুনতে পেলেন, ‘গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি নারীগণে। করিবে লক্ষ্মীর ব্রত হরষিত মনে।’ হিন্দুর মেয়ে ছাড়া পাঁচালির সুর অন্য ধর্মের মেয়ে এভাবে গলা থেকে বার করে আনতে পারবে না। বিজলি নিজেকে আশ্বস্ত করতে স্থির সিদ্ধান্তে এলেন হাসিনা বানো আর হাসি চক্রবর্তী কিছুতেই একই লোক নয়। তবু জ্যোতিকে একবার জিজ্ঞাসা করা দরকার।

‘পদ্ম, জ্যোতি এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবি আর তখন তুই ভুটুকে নিয়ে নীচে থাকবি।’

রাত প্রায় দশটা, তখন জ্যোতি ফিরল। পদ্ম সদর দরজা খুলেই বলল, ‘মাসিমা আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।’

জ্যোতি নিজের ঘরে না গিয়ে সোজা দোতলায় উঠে এল। তাকে দেখেই বিজলি চিঠি ভরা খামটি বাড়িয়ে ধরলেন। বিস্মিত জ্যোতি খামটার উপরের লেখা ঠিকানাটা পড়ে কয়েক লাইনের চিঠিটা এক ঝলকে দেখে নিয়ে বিজলির মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলুন?’

‘এই হাসিনা বানো কে?’

‘আমার বউ।’

‘হাসি?’

‘হ্যাঁ।’

গম্ভীর হয়ে চুপ করে রইলেন বিজলি। একটা যন্ত্রণা তাঁর চোয়ালের পেশি মুচড়ে চলেছে। জ্যোতি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। প্রায় এক মিনিট ধরে দু—জনের মধ্যে নীরবতা দেওয়া—নেওয়া চলার পর বিজলি বললেন, ‘আমাকে ঠকালে কেন?’

‘নিরুপায় হয়ে। মাসিমা, ঘর ভাড়া নিতে গেছি, বউ মুসলমানের মেয়ে শুনে ভাড়া দেয়নি। ভাড়া নিয়ে একমাস থেকেছি, বাড়িওয়ালা পাড়ার লোক দিয়ে তুলে দিয়েছে। শেষে হাসিনাকে হাসি করে ঘর পাই। কিন্তু সেই গড়িয়া থেকে কাজের জায়গায় যেতে আমাদের দু—জনেরই খুব অসুবিধে হচ্ছিল। ভুটু তখন সবে জন্মেছে। আমরা এদিকেই ঘর খুঁজছিলুম, আপনার এখানে পেয়ে চলে এলুম। আমি কিন্তু আপনাকে ঠকাইনি। আপনি আমার বা হাসির ধর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেননি। আমরাও সেধে তা বলার দরকার মনে করিনি, এতে ঠকানো হল কোথায়?’

বিজলি চুপ করে রইলেন। জ্যোতি বলে চলল, ‘কোনো হিন্দু মেয়ের সঙ্গে কি হাসির তফাত করতে পারবেন শুধু তার নামটা ছাড়া? এই খামের উপরের লেখাটা পড়ার আগে পর্যন্তও আপনি ওকে হিন্দু বলে বিশ্বাস করে এসেছেন। তাকে দিয়ে পাঁচালিও পড়িয়েছেন, সে আপনার ঠাকুর দেবতাও ছুঁয়েছে। চক্রবর্তীর বউ বলেই ওকে দিয়ে এসব করিয়েছেন, ধরেই নিয়েছিলেন হাসি ব্রাহ্মণ। এখন সেই ধারণাটাই ধরে থাকুন না যে হাসি মুসলমান নয় সে হিন্দু চক্রবর্তী।’

‘জানার পর তা সম্ভব নয়। তোমরা অদ্ভুত লোক তো।’

বিজলির স্বর তীব্র ও কর্কশ হয়ে উঠল, জ্যোতির কথাগুলো তাঁর এত বছরের লালিত ধর্মবোধকে কোণঠাসা করে দিচ্ছে এটা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। নিজেকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য মরিয়া হলেন। ‘কী চমৎকার ভাবে তোমরা নিজেদের লুকিয়ে রেখেছিলে। আমি তো জীবনেও জানতে পারতুম না হাসি মুসলমান, জানলে কি ওকে ঠাকুর ছুঁতে দিতুম? আর হাসিই বা কোন আক্কেলে পাঁচালি পড়ল? ওর ধম্মেও তো এসব করা বারণ। এটা পাপ। তুমিও ধম্মো মানোনা, মানলে মুসলমান মেয়ে বিয়ে করতে না।’

বিজলির গলা থেকে ঝরে পড়ছে তিক্ততা। তিনি আবার শুরু করলন, ‘এবার হয়তো কোনদিন শুনব তুমি তোলাবাজদের পাণ্ডা কি নোট জাল করো সেটা জানতে পারব বাড়িতে পুলিশ এলে। একটা কথা বলো, তুমি হাসিকে ফুসলিয়ে বার করে আনোনি তো? ঠিকমতো বিয়েটা করেছ তো?’

‘করেছি। স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্টে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়েছে। আর ফুসলিয়ে আনার প্রশ্নই ওঠে না, ও সাবালিকা।’

‘হাসির এতবড়ো অসুখ হল ওর বাপের বাড়ির কাউকে তো আসতে দেখলুম না। এমনকী মারা যাবার পরও কেউ এল না, কী ব্যাপার?’

‘হাসির বাপের বাড়ি আপনার থেকেও বেশি গোঁড়া। সেই বাড়ির মেয়ে হিন্দুকে বিয়ে করলে কী ঘটতে পারে অনুমান করুন। হাত—পা বেঁধে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল সাতদিন, জলটুকুও খেতে দেয়নি।’

বিজলির মনে পড়ল তাঁদের গ্রামের দত্তবাড়ির মেয়ে কলকাতার পি জি হাসপাতালে নার্সের চাকরি করত। বিয়ে করেছিল খ্রিস্টান হয়ে এক খ্রিস্টান ডাক্তারকে। মেয়েটি আর গ্রামে ফিরতে পারেনি, দত্তদের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল। বাহান্ন বছর আগের ঘটনা। তাঁকেও তো প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। পাড়ার লোকেরা যখন শুনবে হাসি মুসলমানের মেয়ে ঠাকুরের সিংহাসনে শুধু হাতই দেয়নি বিজলির অনুরোধে লক্ষ্মীর পাঁচালিও পড়েছে তখন কোথায় মুখ লুকোবেন! ঠাকুরদেবতা ফেলে দেবেন? ভুটু নারায়ণ শিলা মুখে পুরেছিল সেটাও কি গঙ্গায় বিসর্জন দেবেন? শিলাটা শাশুড়ির কাছ থেকে পাওয়া। তিনি পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ির কাছ থেকে। বংশের অতীতের সঙ্গে যোগসূত্র বলতে এখন ওই শিলাটি। একশো বছরের পুরোনো নারায়ণ শিলার গল্প তিনি পাড়ার বহু বউ—ঝিয়ের কাছে করেছেন।

তাঁর মনে হল ব্যাপারটা জানাজানি না হওয়াই ভালো। কেউ না জানলে পুরুতমশাইকে দিয়ে শোধন করিয়ে নিলেই হবে, তার আগে জ্যোতিকে এই বাড়ি থেকে বিদায় করতে হবে, তার সঙ্গে ভুটুকেও।

‘এই চিঠিটা কীসের? হাসিনা বানো কেন?’

‘এই নামেই হাসি বি এসসি পাশ করেছে, এই নামেই ও চাকরি পেয়েছে বিয়ের আগেই, এই নামেই ওর প্রভিডেন্ট ফান্ড হয়েছে। এই চিঠিটা প্রভিডেন্ট ফান্ড অফিসের।’

‘পদবিটা যদি বদলে নিত অফিসে ঢোকার সময় তা হলে ঠিকানায় লেখা এই নামটা আমি জানতেই পারতুম না।’ বিজলির কণ্ঠে আপশোস। ‘তাহলে আমাকে এই নরকযন্ত্রণার মধ্যে পড়ে দগ্ধাতে হত না। এখন আমাকে দেখে সবাই আঙুল দেখিয়ে হাসবে আর বলবে, ‘ওই যে ভটচায বাড়ির বিজলিবালা অন্য জাতের মেয়েকে দিয়ে পুজো করিয়ে ধম্মের বড়াই কর।’ আমি জানতুম না বললেও কেউ কি বিশ্বাস করবে?’

জ্যোতি মুখ নীচু করে শুনছিল ও ভাবছিল। এখন বলল, ‘এক্ষেত্রে আমার চলে যাওয়াই উচিত। আপনি দেখুন ঘটনাটা যেন জানাজানি না হয়, আপনি—আমি ছাড়া আর কেউ তো ব্যাপারটা জানে না। কালই আমি স্কুলে খোঁজ নেব ওখানে কোনো পরিবারে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকা যায় কিনা। মনে হয় পেয়ে যাব। ভুটুরও একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। যত দিন না সেটা হচ্ছে তত দিন পর্যন্ত ওকে আপনি যদি রাখেন তা হলে আমি খুব কৃতজ্ঞ থাকব।’

‘তুমি তো ‘জানাজানি না হয় যেন’ বলে চলে যাবে কিন্তু যে আঁচড় আমার বুকে পড়ল তার ঘা তো আর শুকোবে না।’ বিজলি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার এত দিনের ঠাকুর তাকে কত যত্নে আগলে রেখেছি, আমার এত দিনের পুজো এত দিনের ভক্তি সব সব তোমরা মিথ্যে করে দিলে নস্যাৎ করে দিলে।’ বিজলি ফুঁপিয়ে উঠলেন।

জ্যোতি ম্লান চোখে তাকাল। ‘আমাকে ক্ষমা করবেন।’

নিঃশব্দে জ্যোতি সরে গেল বিজলির সামনে থেকে। দু—চোখের কোণে জমা জল মুছে তিনি খাটে পড়ে থাকা ভাল্লুকটা মেঝেয় ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে থমকে আস্ত নামিয়ে রাখলেন, মনে মনে বললেন, ‘ওর আর দোষ কী।’

সাত

যেন জানাজানি না হয়, জ্যোতির এই কথাটা বিজলির মাথার মধ্যে গেঁথে গেল। তিনি তাঁর সব রকমের ভাবনার সঙ্গী, যার সঙ্গে মতামত বিনিময় করেন অহরহ, সেই পদ্মের কাছেও ব্যাপারটা গোপন রাখলেন। তিনি বেশ ভালো মতোই জানেন ওর পেটে কথা থাকে না। কখন যে কোন বাড়ির কাজের মেয়েকে গল্প করতে করতে বেফাঁস বলে ফেলবে তা সে নিজেও জানে না।

জ্যোতি কয়েক দিন আগে এসে জানায়, সে হাবড়াতেই থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে। স্কুলের কাছে তার এক প্রাইভেট ছাত্রের বাড়িতে আলাদা ঘরে থাকা ও খাওয়া বাবদ দু—হাজার টাকা দেবে, ছাত্রটিকে পড়াবার জন্য সে টাকা নেবে না। সে আরও জানাল, এই বাড়ির ঘর আপাতত ছাড়বে না, মাসে মাসে যেমন ভাড়া দিয়ে যাচ্ছে তেমনই দিয়ে যাবে। ভুটুকে বিজলি আপাতত রাখতে রাজি হয়েছেন, সেজন্য জ্যোতি প্রভূত কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে, ‘মাসিমা বিয়ে করতে বলবেন না, হাসিকে সারা জীবনে ভুলতে পারব না, ভোলা উচিত নয়, সম্ভবও নয়। ওর স্মৃতি মুছে দেবার মতো যোগ্যতা এই পৃথিবীতে কোনো মেয়ের আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। আপনিও বোধহয় কখনো হাসিকে ভুলতে পারবেন না।’

নীচের ঘর সারা দিনই প্রায় তালা দেওয়া থাকে, চাবি থাকে পদ্মর কাছে। কল্পনাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর এক বাড়িতে তাকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে পদ্ম। প্রতিদিন নীচের ঘর সে পরিষ্কার করে মাঝে মাঝে দুপুরে ভুটুকে নিয়ে শোয়। রাতে তারা শোয় বিজলির ঘরে মেঝেয়। একদিন বিজলিই বললেন, ‘আমার খাটটা তো অনেক বড়ো, ওকে আমার পাশে শুইয়ে দে।’

‘না মাসিমা বড্ড নড়াচনা করে, পড়েটড়ে যাবে। থাক না নীচে।’

বিজলি বুঝলেন পেত্নির লম্বা হাতের ভয়ে সে একা শুতে চায় না। তা ছাড়া স্নেহ—মমতা দেবার ও আদর করার জন্য ওর বাৎসল্যের খিদেটা দেখেছেন ক্রমশ বাড়ছে। সন্তান নেই, হবার কোনো সম্ভাবনাও নেই এই স্বামী পরিত্যক্তার। একটা শিশুকে অবলম্বন করে মা হবার সাধটা যদি মেটাতে চায় তো মেটাক না। বিজলি তাই ভুটুকে পালন করার দায়িত্ব পদ্মর হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। জ্যোতি রবিবার এসেছিল, বলেছে, তার ইচ্ছা নয় মুদির বাড়িতে রেখে ছেলেকে মানুষ করার। ‘শিক্ষিত কালচার্ড নিঃসন্তান এমন পরিবার নিশ্চয়ই আছে, শুধু খুঁজে বার করে নিতে হবে।’

বিজলি বলেছিলেন, ‘রক্তের সম্পর্ক থাকলে তবেই ও ঠিক ঠিক যত্ন পাবে। তোমার কি হাসির আত্মীয়দের মধ্যে খোঁজ নাও, কেউ যদি ওকে রাখে।’

জ্যোতি মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘কেউ ওকে রাখবে না।’

বিজলির মনে হয়েছিল রাখবে কি রাখবে না সেটা যাচাই না করেই জ্যোতি বলে দিল কত সহজে! যদি হাসির বাপের বাড়ির ঠিকানাটা তিনি পেতেন তা হলে নিজে গিয়ে ওর বাপ—মাকে ধরে পড়তেন মরা মেয়ের ছেলেটাকে আশ্রয় দিতে। বলতেন, হলই বা হিন্দু বাপ, ওর মা তো আপনার মেয়ে, মুসলমান রক্ত তো ওর শরীরে আছে। ওকে আপনাদের ধর্মের বিধানমতো মুসলমান করে নিন, তা হলে ও একটা নিজের পরিবার পাবে, যত্ন পাবে শাসন পাবে, তা না পেলে ছেলেমেয়েরা মানুষ হয় না। কেন আপনাদের নাতিকে একটা হিন্দু বিধবার হাতে ছেড়ে দেবেন?

দুপুরে খাটে শুয়ে বিজলি রেডিয়ো চালিয়ে সেতার শুনছিলেন। রাগ—রাগিণীর কিছুই বোঝেন না, তবে বাজনাটার আওয়াজ তাঁর ভালো লাগে, একধরনের আমেজ তৈরি করে দেয়। সেতার শুনতে শুনতে তিনি দেখতে পেলেন বারান্দায় ভুটু দু—হাতে হুলো বেড়ালটাকে চটকাচ্ছে, হুলোটা চিত হয়ে শরীরটা ওলটাচ্ছে পালটাচ্ছে আর থাবা দিয়ে ভুটুকে মারছে। দু—জনে খেলছে। বিজলি শুনেছেন বেড়াল থেকেই ডিপথেরিয়া হয়। মারাত্মক রোগ, তাতে মারাও যায়।

ধড়মড়িয়ে তিনি খাট থেকে নেমে বারান্দার দিকে ‘হেই ভাগ ভাগ’ বলতে বলতে এগোলেন। তাঁকে দেখেই হুলো পালাল। বিজলি ভুটুকে নিয়ে কলঘরে গিয়ে দুটো হাত সাবান দিয়ে ধুইয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন পদ্মর জন্য। উড়ে পাড়া বস্তিতে কার গায়ে হলুদ, রান্নাবান্না শেষ করেই পদ্ম সেখানে গেছে। ভুটুকে বিছানায় চেপে ধরে চাপড়াতে লাগলেন ঘুম পাড়াবার জন্য, তখন সেলাই মেশিনের উপর থাকা কথামৃতর উপর তাঁর চোখ পড়ল। বইটা কবে যেন নীচের ঘর থেকে এনেছিলেন আজও খুলে দেখা হয়নি। পদ্ম বলেছিল ‘ধম্মের বই পড়ে মেয়েরাই’, তাই ওর ধারণায় কথামৃত হাসিই পড়ার জন্য এনেছে বা কিনেছে।

ভুটু ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষণের মধ্যেই। কথামৃত হাতে নিয়ে বিজলি পাতা উলটে যেতে লাগলেন। তখন একটা সাদা কাগজ বই থেকে পড়ে গেল। সেটা তুলে তিনি এপিঠ—ওপিঠ দেখলেন। দোকানের সাদা বিল, তাতে লেখা কয়েক লাইনের চিঠি। হাতের লেখা বাংলায়, পরিচ্ছন্ন স্পষ্ট। চিঠির নীচে লেখা ‘আব্বা’। শব্দটা দেখেই তিনি সচকিত হয়ে উঠলেন। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে পড়ে ফেললেন। হাসিকে লেখা তার বাবার চিঠি। পড়ে বুঝলেন হাসি মাকে চিঠি দিয়ে তার ছেলে হওয়ার খবর দেয়। সেই চিঠির জবাব দিচ্ছে তার বাবা।

‘হাসি, তোর সাহস দেখে তাজ্জব হয়েছি। আম্মিকে তুই যে লুকিয়ে চিঠি লিখিস তা আমি জানতুম না। আমাদের গ্রামে সবাই জানে তুই মরে গেছিস। তুই মরেই থাক। তোর মরার খবর দিয়ে চিঠি পেলে আমি খুশি হব। যে—মেয়ে পরিবারের মুখ পুড়িয়ে হিন্দুর ছেলে পেটে ধরে তার হাতের লেখার উপর চোখ রাখলে খোদাতালা আমায় অন্ধ করে দেবেন। আর কখনো চিঠি লিখবি না। ইতি আব্বা।’

খুব দ্রুত লেখা শিক্ষিত হাতের এই চিঠি পড়ে বিজলির মাথার মধ্যে ধিকিধিকি জ্বলতে শুরু করল ক্রোধ। ‘হিন্দুর ছেলে পেটে ধরে কথাগুলো এমন ঘৃণার সঙ্গে লেখা যে তাঁর কাছে অসহ্য মনে হচ্ছে। জ্যোতির মতো ছেলেকে জামাই পেয়ে লোকটার বর্তে যাওয়ার কথা। জাত ধর্মটাই বড়ো হল, ছেলে কেমন সেটা বিবেচনা করবে না? বাপ হয়ে কী করে লিখতে পারল ‘তোর মরার খবর দিয়ে চিঠি পেলে খুশি হব’! মেয়ের ইচ্ছে অনিচ্ছেটা দেখবে না?

চিঠিটা পুরোনো, হয়তো জানে না মেয়ে সত্যি সত্যিই মারা গেছে। লোকটাকে জানানো দরকার, আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়েছে, আপনাকে আর অন্ধ হতে হবে না। চিঠির মাথায় মোটা অক্ষরে ইংরেজিতে ছাপা ‘আলম ফার্নিচারস’ শব্দ দুটির শেষেরটি বিজলি পড়তে পারলেন না, তার নীচে ‘হায়ার অ্যান্ড পারচেজ’ বানান করে পড়লেন অবশ্য অর্থটা বোধগম্য হল না। অলকাকে দিয়ে মানেটা জেনে নিতে পারেন বটে কিন্তু তা হলে তো চিঠিটা ওর হাতে দিতে হয়! হাতে পেয়ে অলকা চিঠিতে চোখ বুলোবেই আর হাসির পরিচয় জানতে কিছুই বাকি থাকবে না।

দরকার নেই অলকার। ছাপা ঠিকানা রয়েছে বিলে এবং ফোন নম্বরও। রাস্তার নামটা বড়ো বড়ো। পড়ে উঠতে পারলেন না। বিজলির মনে হল ফোনে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন হাসির বাবার হদিশ করা যায় কিনা। কিন্তু ফোন করবেন কোথা থেকে! পাড়ার কোনো বাড়ি থেকে করা যাবে না। টেলিফোনের কাছে কেউ—ন—কেউ দাঁড়িয়ে থাকবেই কথা শোনার জন্য।

এবার তাঁর মনে পড়ল বড়ো রাস্তার দোকানগুলোতে টেলিফোন আছে। দেখেছেন পয়সা দিয়ে বাইরের লোককে ফোন করতে। তিনি ঠিক করলেন দোকান থেকেই ফোন করবেন, তবে কাছেপিঠের কোনো দোকান থেকে নয়।

ভুটু ঘুমোচ্ছে, পদ্ম এখনও ফেরেনি। সে না ফিরলে ভুটুকে একা রেখে কী করে বেরোবেন! পরের বাড়ির গায়েহলুদ, তোর সেখানে থাকার কী দরকার? বিজলি বিরক্ত হতে হতে ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। মাথার মধ্যে পিঁপড়ের মতো নড়ে বেড়াচ্ছে চিঠির অক্ষরগুলো। এক্ষুনি লোকটার খোঁজ নিতে হবে, দু—কথা শুনিয়ে দিতে হবে। বারান্দা থেকে ঘরে এসে চিঠিটা পড়লেন। পাট পাট ভাঁজ করলেন বিলটা, এমনভাবে চিঠির অংশটা যাতে পড়া না যায়, শুধু দোকানের নাম ঠিকানা ফোন নম্বরটা দেখা যাচ্ছে। সেটা ভাঁজ করে তাঁর টাকার ব্যাগে রাখলেন। এবার ভুটুকে নাড়া দিয়ে জাগিয়ে তুললেন। গাঢ় ঘুম হঠাৎ ভাঙায় ভুটু অবাক চোখে প্রথমে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট উলটে ফুঁপিয়ে উঠল।

ভুটুকে কোলে তুলে বিজলি একতলায় নেমে এসে রাস্তায় বেরোলেন। সদর দরজায় তালা দিয়ে গেলেন পাশের বাড়িতে অলকার কাছে।

‘ভুটুকে একটু রাখো তো, খুব দরকারে আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে ননদের বাড়ি, খবর দিয়ে গেল এখন—তখন অবস্থা, দু—বছর ধরে আলসারে ভুগছে।’

অলকা বলল, ‘পদ্ম বাড়িতে নেই?’

‘সে থাকলে তো ঝক্কি চুকেই যেত। চার ঘণ্টা আগে বেরিয়েছে উড়ে পাড়ায় কার গায়েহলুদ দিতে, এখনও ফেরার নাম নেই। সদরের চাবি আমার কাছেই রইল, পদ্ম এলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে।’

অলকার জিম্মায় ভুটুকে রেখে বিজলি ধীরে ধীরে হেঁটে বড়ো রাস্তায় এলেন। কয়েক মাস পর এতটা পথ হাঁটলেন। পায়ে খচখচ লাগছে, ব্যথা শুরু হয়েছে। তাঁর মনে হল আরো কিছু কিছুদিন পর রাস্তায় বেরোলে ভালো করতেন। ডাইনে—বাঁয়ে তাকিয়ে বাঁ দিকে এগোলেন। ফুটপাথে একটা রেলিং—ঘেরা শান বাঁধানো চাতাল, তার মাঝে সিঁদুর মাখা বাসি মালা দেওয়া পাথর। বিজলি দু—হাত মাথায় কপালে ঠেকিয়ে এগিয়ে চললেন, শিবরাত্রিতে মাইক লাগিয়ে ধুমধাম হয় এখানে। পর পর দোকান। তীক্ষ্ন চোখে টেলিফোন খুঁজতে লাগলেন। সামনের কাউন্টারের উপরই থাকে অথবা পিছনে মালিকের টেবিলে। এক ছিট—কাপড়ের দোকানে দেখতে পেলেন টেলিফোন। কিন্তু চার—পাঁচ জন খদ্দের রয়েছে। তারপরে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির দোকানে ফোন নেই তারপরে রঙের দোকানে, আছে।

কাউন্টারে ফোন, একটিও খদ্দের নেই শুধু এক তরুণ মাথা নীচু করে একটা ইংরেজি সিনেমা ম্যাগাজিন পড়ছে বা ছবি দেখছে।

‘হ্যাঁ বাবা ফোন করা যাবে এখান থেকে?’

তরুণটি মুখ তুলে এক বৃদ্ধাকে দেখে বলল, ‘যাবে।’

‘কত লাগবে?’

‘দু—টাকা।’

‘একটা কাজ করে দেবে বাবা, এটা একটু পড়ে দেবে।’ বিজলি ব্যাগ থেকে ভাঁজ করা বিলটা বার করে তরুণটির হাতে দিল। বিলটিতে চোখ বুলিয়ে সে বলল, ‘পুরোনো ফার্নিচার কেনা—বেচা আর ভাড়া দেওয়ার দোকান। প্রোপাইটার অর্থাৎ মালিকের নাম মেহমুদ আলম, দোকানটা রফি আহমেদ কিদোয়াই স্ট্রিটে। আর রয়েছে ফোন নম্বর।’ বৃদ্ধাকে সাহায্য করতে পেরে তরুণটিকে উৎসাহী লাগছে। ‘আপনি কি এই নম্বরে ফোন করবেন?’

‘হ্যাঁ বাবা, তুমি নম্বর টিপে ফোন লাগিয়ে দেবে? আমার এসব ঠিক আসে না।’

তরুণ বোতাম টিপে টিপে অপেক্ষা করল। ওধার থেকে সাড়া পেতেই বলল, ‘এটা কি আলম ফার্নিচারস?… একটু ধরুন একজন আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’

তরুণ রিসিভারটি এগিয়ে দিল বিজলির দিকে। বিজলির কানে লাগিয়ে ভূমিকা না করে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, ‘হাসি আপনার কেউ হয়?’

ওধারে কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর পালটা প্রশ্ন হল, ‘আপনি কে বলছেন?’

‘আগে আমার কথার উত্তর দিন তারপর আপনাকে বলব আমি কে।’

‘হাসি আমার মেয়ে।’ একটা অনিচ্ছুক উত্তর এল দোখনো টানে।

‘আমি বিজলিবালা ভটচায। হাসি আর তার স্বামী আমার ভাড়াটে। ওদের একটি চোদ্দো মাসের ছেলে আছে, ভুটু। হাসি একটা চিঠি দিয়ে বোধহয় ওর মাকে তার ছেলে হওয়ার খবর জানিয়েছিল। হয়তো সেই চিঠি আপনি দেখেছেন। তার একটা জবাব আপনি দিয়েছিলেন একটা বিলের ওপর লিখে। সেই চিঠিটা আজ আমার হাতে পড়তেই এই ফোন করছি।’ বিজলি দ্রুত বলে গেলেন। কণ্ঠ ঈষৎ উত্তেজিত। এবার স্বর তীব্র করে ধমকে উঠলেন, ‘হিন্দু ছেলে বিয়ে করেছে বলে আপনি ওকে মরতে বলেছেন, এ কীরকম বাবা আপনি, ছি ছি ছি। আপনি ছেলেটিকে জানেন? আর অন্য ধর্মের হলেই সে অচ্ছুৎ হয়ে যাবে?’ বিজলির হাতের রিসিভার থরথর করছে।

‘এ ভাবে আপনি কথা বলছন কেন? আমার মেয়েকে যাই লিখি না কেন আপনি তাই নিয়ে বলার কে?’ ও পক্ষেও স্বর চড়ে উঠছে। তরুণটি অবাক হয়ে বিজলির দিকে তাকিয়ে।

‘আমি কে সেটা তো গোড়াতেই বলেছি। আমি আপনার কাছে বিধর্মী, আপনি থাকুন আপনার ধর্ম নিয়ে, আমি তা নিয়ে মাথা ঘামাতে যাব না। কিন্তু একটা মেয়ে যখন একটা ছেলেকে ভালোবাসে তখন সেটা অন্য ব্যাপার হয়ে যায় আলমবাবু, ধর্মকে তখন পিছু হটতে হয়। ওদের পরিচয় তখন হয় শুধুই মানুষ। আর সেটা স্বীকার করাকে বলে মনুষ্যত্ব। আপনি মারধর করেও তো হাসিকে থামাতে পারেননি কারণ ও তখন মানুষ হয়ে গেছে।’

‘আপনি সত্যিই বাড়াবাড়ি করছেন। কোথায় থাকেন আপনি?’ ধমকের সুর ওপ্রান্ত থেকে শোনা গেল।

‘ঠিকানা নিয়ে কী কববেন, এসে মারবেন? লিখুন ঠিকানা সাতচল্লিশের বি বিজয় দত্ত স্ট্রিট, কলকাতা পাঁচ। নর্থ ক্যালকাটার একটা গলি।’

‘আপনাকে মারতে যাব এমন ছোটোলোক ভাবলেন আমায়!’ আহত স্বরে বলল মেহমুদ আলম।

‘মেয়ের চিঠি পড়লে অন্ধ হয়ে যাবে যে বাবা লেখে, তার মতো নিষ্ঠুর লোক সম্পর্কে আর কী ভাবব! তবে আপনি জেনে আশ্বস্ত হবেন আপনাকে আর অন্ধ হতে হবে না?’

‘তার মানে?’ আলমের সন্ধিগ্ধ স্বর।

‘মানে হাসি মারা গেছে, শুনে সুখী হলেন তো?’

‘কী বললেন, কী বললেন, কী বললেন? হাসির কী হয়েছে।’ আলমের গলায় আর্তনাদ, অবিশ্বাস, আতঙ্ক।

‘চার মাস হল ক্যানসারে মারা গেছে। তার ছেলেটি একা, দেখার কেউ নেই।’ কথাটা বলার পর বিজলির মনে হল ওপ্রান্তে ডুকরে ওঠার মতো শব্দে আলম, ‘হাসি হাসিরে’ বলে উঠল। বিজলি রিসিভার রেখে দিয়ে ব্যাগ থেকে টাকা বার করে দিলেন।

‘খুব আচ্ছাসে দিলেন তো লোকটাকে।’ তরুণটি তারিফ ভরা সুরে বলল, ‘ঠিক বলেছেন ভালোবাসলে ধর্মটর্ম হটে যায়।’

বিজলি শুনে শুকনো হাসলেন। তাঁর দেহের যাবতীয় আবেগ নিঃশেষিত হয়ে তাঁকে অবসন্ন করে দিয়েছে। ধীর মেদুর পায়ে তিনি বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বার বার শুনে যেতে লাগলেন, ‘হাসি, হাসিরে।’ এইবার অনুশোচনার আগুনে পুড়বে লোকটা, নরকযন্ত্রণা ভোগ করবে। বিজলি কষ্ট বোধ করলেন হাসির বাবার জন্য। নিশ্চয় বাড়ি গিয়ে খবরটা দেবে, হাসির মা কী করবে? আর ভাবতে চাইলেন না বিজলি।

সদর দরজায় তালা দেওয়াই রয়েছে। পদ্ম কি এখনও ফেরেনি? তিনি অলকার কাছে খোঁজ নিতে গেলেন।

অলকা বলল, ‘আপনি যাবার একটু পরেই পদ্ম এসে হাজির, দেখেই ভুটু বায়না জুড়ল। পদ্ম ওকে নিয়ে ঘুরে আসতে গেছে। কেমন দেখলেন ননদকে?’

‘ভালো নয়। ডাক্তার জবাব দিয়ে গেছে।’ ক্লান্ত স্বর বিজলির। অবসাদে মুখ বসে গেছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পায়ের ব্যথাটা আবার অনুভব করলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সামনের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাধুর বারান্দা শূন্য। এই সময় অন্নপূর্ণা ওকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে বারান্দায় রেখে যেত। অন্নপূর্ণা কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। রাধুর মৃত্যু নিয়ে পুলিশ টানাহ্যাঁচড়া করেনি। পাড়ার দু—চার জন বলেছিল শঙ্কর চাটুজ্যে টাকা খাইয়ে পুলিশের মুখ বন্ধ করেছে।

বিকেলের এই সময়টায় সূর্যের দাপট যখন ক্ষমতা হারাতে শুরু করে, তখন জয় দত্ত স্ট্রিটের বাড়িগুলোর শরীরে জরা ফুটে ওঠে। বিজলি লক্ষ করেছেন, এই সময়ই পাড়াটা নিজের মনের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়, হইচই হট্টগোল ঝিমিয়ে পড়ে কিছুক্ষণের জন্য। তার পরই বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয় টিভি—র চিৎকার, শোনা যায় শাঁখের আওয়াজ। কয়েক বছর আগে শোনা যেত কিশোরী কণ্ঠে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান সাধা। এখন গান না জানলেও মেয়েদের বিয়েতে অসুবিধে হয় না।

পশ্চিমের বাড়ির জন্য বিকেল থেকে বিজলির ঘরে আলো কম হয়ে যায়। বারান্দা থেকে তিনি ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আবার শুনতে পেলেন আর্তনাদটা ‘হাসি, হাসিরে।’ লোকটিকে অমন কঠোরভাবে বলা ঠিক হয়নি। মুখ দিয়ে তখন অনেক কথা রাগের মাথায় বেরিয়েছে। সেগুলো তো আগে থাকতে তৈরি করে রাখা ছিল না। মানুষ কাকে বলে—সেটা তো তখনই মনের মধ্যে কীভাবে যেন এসে গেল। ভালোবাসলে ধর্ম থাকে না, এই বোধটা যে তাঁর মধ্যে ছিল, এটাই তিনি জানতেন না। জ্যোতির কাছ থেকে হাসির উপর অত্যাচার আর তা সহ্য করে যাওয়ার কথা শোনার পর তাঁর মনে হয়েছিল হাসি নিছকই মুসলমান মেয়ে নয়, হিন্দুর বউও নয়, ও একটা মানুষ।

বিজলির মনে হল, পুজোআচ্চচা তো মানুষ হয়ে ওঠার জন্যই করা। পুজো না করেও তো হাসি আর জ্যোতি যথেষ্ট মানুষ হতে পেরেছে। মৃত্যুর পরোয়ানা পাবার পরও মেয়েটা পাঁচালি পড়ে গেল। কী বুকের পাটা!

বিজলি মুখ ফিরিয়ে, মলিন আলোয় শ্রীধরের সিংহাসন, নারায়ণ শিলা, গাছকৌটো, গায়ত্রীদেবী, লক্ষ্মীর ছবি, জগন্নাথদেব, গণেশমূর্তির উপর দিয়ে চোখ বোলালেন। স্পষ্টভাবে কিছুই দেখতে পেলেন না, সবই কেমন আবছা, ধ্বক করে উঠল বুকের মধ্যে। প্রদীপের আলোয় কাঁপা একটা শ্যামলা মুখ পাঁচালি পড়ছে—উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠল তাঁর চোখে। চোখ বন্ধ করে তিনি মাথাটা ঝাঁকিয়ে দৃশ্যটা বন্ধ করে দিলেন। ও মুসলমানের মেয়ে।

বকবক করতে করতে পদ্ম উঠছে সিঁড়ি দিয়ে। বিজলি তৈরি হলেন ওকে বকুনি দেওয়ার জন্য।

‘দ্যাখো তো কী কাণ্ড, পার্কে নিয়ে গেছিলুম। একটা মেয়ে আলুকাবলি খাচ্ছিল, আদিখ্যেতা করে এতোটা ভুটুর মুখের সামনে ধরল আর ছেলে অমনি গপ করে মুখে ঢুকিয়ে নিল। তারপরই ঝাল লেগে চিল চিৎকার। শেষে আইসক্রিম কিনে মুখে দিতে ঠান্ডা হল।’

বিজলি শান্ত গলায় বললেন, ‘পদ্ম এরকম ঝামেলা অনেক হবে। আমাদের দু—জনের পক্ষে সব সামলানো সম্ভব হবে না। ঘরে পুরুষমানুষ নেই, কখন কী বিপদ—আপদ ঘটিয়ে ফেলে তার ঠিক নেই। ওকে বরং ওর বাবার দেশের বাড়িতে ঠাকুরদা ঠাকুমার কাছে পাঠিয়ে দেওয়াই ভালো।’

শুনেই মুখভার হয়ে গেল পদ্মর। বলল, ‘কী আর এমন ঝামেলা করে ভুটু, ও আমি সামলে নোব।’

‘নারে সেরকম সামলাবার কথা হচ্ছে না।’ বিজলি আরও শান্ত স্বরে বললেন, ‘বড়সড় নানারকম বিপদ হতে পারে। ওর মা—র মতো যদি কিছু হয়, আমরা তো দু—জন মুখ্যু মেয়েমানুষ, তখন কী করব? তা ছাড়া পরের ছেলে এটা মনে রাখিস। চল ওকে নিয়ে জ্যোতিদের বাড়িতে গিয়ে রেখে আসি।’

‘তুমি বাড়ি চেনো?’

‘জ্যোতি তো বলল গ্রামের নাম মল্লিকপুর। বর্ধমান থেকে কাটোয়া যাবার রাস্তায় পড়বে। তোর মেসোমশায়ের সঙ্গে মোটরে একবার গেছিলুম কাটোয়া, ওনার বন্ধুর মেয়ের বিয়েতে। বর্ধমান থেকে বাস যায়। বাসে উঠে কনডাকটরকে বললে মল্লিকপুরে ঠিক নামিয়ে দেবে। তারপর জ্যোতির জ্যাঠার নাম করব। কেউ—না—কেউ ঠিক বাড়ি দেখিয়ে দেবে। অত ঘাবড়াছিস কেন, বেরিয়ে তো পড়ি। বর্ধমান আর কতটুকু পথ—রোজ কত লোক কলকাতায় এসে চাকরি করে বর্ধমান ফিরে যায়। যদি খুঁজে না পাই তা হলে ফিরে আসব।’

‘তার থেকে বরং দাদাকে জিজ্ঞেস করে সব জেনে নিয়ে যাওয়াই ভালো, রোববার তো আসবে।’

‘জ্যোতি আমাদের যেতে বলবে না। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নেই ওর। তাতে আমাদের কী। ছেলেকে কোথাও রাখার ব্যবস্থা যদি না করে তা হলে সেটা আমাদেরই করতে হবে।’

দু—দিন পর ওরা সকাল ন—টা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল হাওড়া স্টেশনের উদ্দেশে। পদ্মর কোলে ভুটু, বিজলির কাঁধে একটা কাপড়ের ঝোলা। তাতে ভুটুর জন্য দুধ বিস্কুট কমলালেবু সোয়েটার প্যান্ট। বাসে ওরা স্টেশনে পৌঁছে একজনকে জিজ্ঞাসা করে টিকিটঘরে পৌঁছোল। অন্তত কুড়িজনের লাইন জানলার সামনে। বিজলি লাইনে দাঁড়ালেন। মিনিট দশেকের মধ্যেই টিকিট পেয়ে আবার একজনকে জিজ্ঞাসা করতেই লোকটি দু—নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘বর্ধমান লোকাল, এখুনি ছাড়বে দৌড়ে যান।’

তারা দু—জনে আধা দৌড়—আধা—হাঁটা অবস্থায় গার্ডের কামরা পার হয়েই প্রথম যে দরজাটি পেল তাতে উঠে পড়ল। বসার জন্য জায়গা নেই, ভিড় আছে কিন্তু কষ্টকর নয়। পদ্ম হাঁ করে শ্বাস নিতে নিতে বলল, ‘মাসিমা হার্ট ফেল হয়ে যাবে আমার।’

‘ফেল হয় হোক ট্রেনটা তো ধরা গেল।’ বিজলির কথা শেষ হওয়া মাত্র ট্রেন ছেড়ে দিল। ‘দেখলি তো, না দৌড়োলে পরের ট্রেনের জন্য এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হত। এক কাজ কর, দেখছিস বসার সিটগুলোর মাঝখানে লোক দাঁড়িয়ে। তুই ভুটুকে নিয়ে ঢুকে যা, সিট খালি হলেই বসে পড়বি।’

পদ্ম তাই করল। সিটে বসা একটি অল্পবয়সি বউ ভুটুর দিকে দু—হাত বাড়িয়ে বলল, ‘আমার কাছে দিন।’ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পদ্ম। কিছুক্ষণ পর সে বউটিকে জিজ্ঞেস করল, ‘কত দূর যাবেন?’

‘শ্যাওড়াফুলি।’

নামটা পদ্মর শোনা কিন্তু কতদূরে জায়গাটা, কতক্ষণ যেতে লাগবে জানে না। আধঘণ্টা পরে পাশে বসা পুরুষটি উঠে দাঁড়াতেই বউটি বলল, ‘এবার নামব আপনি বসুন।’

ভুটুকে কোলে বসিয়ে পদ্ম তাকাল বিজলির দিকে। বিজলি তাকে হাত নেড়ে বসে থাকতে বললেন। ঘণ্টাখানেক পর বিজলিও বসার জায়গা পেয়ে গেলেন। বর্ধমান স্টেশনে নেমে কাটোয়ার বাসের জন্য আবার একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন বিজলি।

‘তিনকোনিয়া যান সেখানে থেকে ছাড়ে কাটায়োর বাস।’

‘কত দূরে তিনকোনিয়া?’

লোকটি তাঁদের দু—জনকে আপাদমস্তক দেখে বলল, ‘রিকশা করুন।’

রিকশায় মিনিট পাঁচেক গিয়ে বাস টার্মিনাস। বাসের রুট বোর্ডে নাম দেখে, কনডাকটরকে জিজ্ঞাসা করলেন বিজলিবালা, ‘হ্যাঁ বাবা, এই বাস মল্লিকপুর যাবে?’

‘যাবে।’

‘কতক্ষণ লাগবে যেতে?’

‘পঞ্চাশ মিনিট।’

পদ্ম বলল, ‘ভাড়া কত?’

‘তেরো টাকা’ বলেই কনডাকটর যোগ করল, ‘এটা সুপার বাস।’

তারা বাসে উঠল এবং বসার জায়গা পেল। টিকিট কেনার সময় বিজলি বললেন, ‘বাবা মল্লিকপুরে নামিয়ে দিয়ো, আমরা নতুন যাচ্ছি, কিচ্ছু চিনি না।’

দশ মিনিট যাবার পরই বিজলি উদবিগ্ন স্বরে বলে উঠলেন, ‘মল্লিকপুরে নামব, মনে আছে?’

অল্পবয়সি কনডাকটর চিৎকারে ভাঙা গলা যথাসাধ্য কোমল করে বলল, ‘ঠিক নামিয়ে দোব দিদিমা, ব্যস্ত হবেন না।’

মিনিট চল্লিশ পর সে বলল, ‘দিদিমা মল্লিকপুর। গেটের কাছে আসুন।’

বাস থেকে নেমে তারা এধার—ওধার তাকাচ্ছে। এক ভ্যান রিকশাওয়ালা তাকে লক্ষ করছিল। বলল, ‘যাবেন কোথায়?’

‘মল্লিকপুর।’

‘কাদের বাড়ি।’

‘চক্রবর্তীদের।’

‘কোন চক্রবর্তী, নাম কী?’

মুশকিলে পড়লেন বিজলি। জ্যোতির বাবার নাম একবার মাত্র শুনেছেন,এখন মনে পড়ছে না, জ্যাঠার নামও জ্যোতি বলেছিল সেটাও ভুলে গেছেন।

তাঁর বিপন্ন ক্ষুব্ধ মুখ দেখে রিকশাওয়ালা সাহায্য করল।

‘ওই বইয়ের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে আসুন।’

খাতা কাগজ কলমের রিফিল আর স্কুলপাঠ্য বইয়ের সঙ্গে পাঁজি এবং উপন্যাস নিয়ে বইয়ের দোকান। দুপরে ক্রেতা নেই। এক প্রৌঢ় কাউন্টারের পিছনে টুলে বসে।

বিজলি শুরু করলেন, ‘জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী নামে একটি ছেলে থাকত মল্লিকপুরে। বাড়ির অবস্থা ভালো। বর্ধমান শহরে বাড়ি আছে, চালের আড়তও আছে। বোনের বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে পুজুরি ব্রাহ্মণের সঙ্গে। জ্যোতির্ময়ের বাবার নাম জানি না, আপনি কি বলতে পারবেন ওনার বাড়িটা কোথায়?’

প্রৌঢ় একমনে শুনে বললেন, ‘বিপ্রদাস চক্রবর্তী। দ্বিতীয় পক্ষের বউ।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। জ্যোতির্ময় প্রথম পক্ষের।’ বিজলি স্রোতে ভাসতে ভাসতে ধরার মতো একটা কাঠ যেন পেলেন।

‘তা বিপ্রদাসকে কী দরকার। তার তো হাঁপানি, বাতেও পঙ্গু। শয্যাশায়ী।’

‘ওর সঙ্গে দুটো কথা বলতে এসেছি।’

‘বিপ্রদাসের বাড়ি এখান থেকে একমাইল—তেঁতুলতলায়। রিকশা করে যান, রাস্তা খুব খারাপ, হাঁটতে পারবেন না।’

ভ্যান রিকশায় দুটি লোক উঠে পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে। পদ্ম উঠে রিকশার পাটাতনে ভুটুকে কোলে নিয়ে বসল। বিজলিবালা চাকার পাশে বসলেন পা ঝুলিয়ে, পদ্ম জিজ্ঞাসা করল, ‘মল্লিকপুর যেতে পড়বে কত?’

‘পাঁচটাকা করে।’

বিজলিবালার কানের কাছে মুখ এনে পদ্ম বলল, ‘কলকাতার থেকে সস্তা, তাই না মাসিমা।’

প্রৌঢ় ঠিকই বলেছিলেন। রাস্তা যে এত ভাঙা হতে পারে, এত গর্ত থাকতে পারে সে ধারণা ওদের ছিল না। পদ্ম একবার শুধু বলে, ‘মাসিমা বাড়ি ফিরে দু—দিন শুয়ে থাকব,গায়ের ব্যথা মারতে।’

একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে রিকশাওয়ালা বলল ‘এই বিপ্রদাস চক্রবর্তীর বাড়ি।’

বাড়িটা চৌকো গড়নের। উপরে নীচে সার দিয়ে সাত—আটটা জানালা। বাড়ির মাঝামাঝি সদর দরজা। ভুটু বাসে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিয়েছে, এখন সে চনমনে। ওকে হাঁটিয়ে নিয়ে বিজলি সদর দরজার দিকে এগোলেন। দোতলায় জানলা থেকে সরে গেল এক স্ত্রীলোকের মুখ।

সদর দরজা খোলা রয়েছে। ইতস্তত করে বিজলি ভিতরে ঢুকলেন। একটা উঠোন থেকে ঘিরে রক। দোতলায় বারান্দা। সেখানে দাঁড়িয়ে এক বছর পঞ্চাশ বয়সি মহিলা।

‘কাকে চাই।’ গলার স্বর ভারী ব্যক্তিত্বপূর্ণ।

‘আমরা কলকাতা থেকে আসছি। বিপ্রদাসবাবুর সঙ্গে একবার কথা বলতে চাই।’ বিজলি যথাসম্ভব বিনীত স্বরে বললেন।

‘ওপরে আসুন, ডান দিকে সিঁড়ি। উনি অসুস্থ, ঘুমোচ্ছেন। কিছু বলার থাকলে আমায় বলতে পারেন।’

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পদ্ম চাপা স্বরে বলল, ‘মাসিমা গলায় স্বর শুনলেন! সোজা লোক নয়।’

‘একদম কথা বলবি না।’

সিঁড়ি শেষ হয়েছে লম্বা দরদালানে। তার একদিকে পর পর ঘর। সারা বাড়িতে সাড় নেই। কোনো লোকজনও দেখলেন না। দালানটা চকচকে লাল সিমেন্টের। পুরোনো বাড়ি। মোটা দেওয়াল, খড়খড়ির জানলা। দালানের এক প্রান্তে ঝাঁঝরি বসানো নর্দমার ধারে প্লাস্টিকের বড়ো একটা জলের ড্রাম। তার ঢাকনার উপর একটা প্লাস্টিকের লাল হাতল ভাঙা মগ। হাত—পা ধোয়ার জল রাখা হয়। বিজলিবালার চোখ পড়ল জলচৌকিতে রাখা একটা তামার টাটে তার উপর রাখা কোষাকুষি আর পুজোর ঘণ্টা। বুঝলেন এ বাড়িতে দেবতার নিত্যপুজো হয়। মহিলা একটি ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কৌতূহল ও বিস্ময় নিয়ে। পরনে সাদা শাড়ি নকশাদার সবুজ পাড়, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর। গলায় সরু হার, হাতে দু—গাছা করে সোনার চুড়ি। মাথায় আধ ঘোমটা। গায়ের রং ফরসা। তিনি কিছু বলার আগেই বিজলি বললেন, ‘আমার নাম বিজলিবালা ভটচায। কলকাতায় আমার বাড়ি। জ্যোতির্ময় নামে এই বাড়ির কোনো ছেলে আছে?’

‘ছিল। বাড়ির সঙ্গে এখন তার সম্পর্ক নেই। হঠাৎ ওর খোঁজ নিতে এলেন কেন?’

‘বলছি। আপনি ওর কে হন?’

‘সৎমা।’

বিজলি হুঁশিয়ার হয়ে গেলেন। ভুটুকে বিস্কুট দিল পদ্ম, সে ফেলে দিল। থার্মোফ্লাসকে দুধ এনেছে, দু—চুমুক দিয়ে খেল না। মহিলা ভুটুকে দেখতে দেখতে বললেন, ‘আপনার নাতি?’

হেসে বিজলি বললেন, ‘আপনার নাতি’।

মহিলা অবাক হয়ে ভ্রু তুলে তাকালেন, ‘আমার!’

‘এ জ্যোতির ছেলে। এর জন্যই আমি এসেছি। জ্যোতি আমার ভাড়াটে। চার মাস আগে জ্যেতির বউ মারা গেছে। এই বাচ্চচাকে দেখার কেউ নেই। আমি ওকে রাখছি। কিন্তু আমার মনে হয় ওর নিজের রক্তের সম্পর্কের লোকেদের হাতেই বড়ো হওয়া উচিত। তাই নিয়ে এসেছি।’

‘আপনি এনেছেন না জ্যোতি পাঠিয়ে দিয়েছি, সম্পত্তির ভাগ নেবার জন্য এই দাবিদারটি তৈরি করে। দেখুন আমরা যথেষ্ট খোঁজ নিয়েছি, খবরও রাখি। জ্যোতি একটা মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এই ছেলেটি সেই মুসলমান মায়ের সন্তান।’

‘মাসিমা হাসিদি—!’ পদ্মর বিস্ফারিত চোখ স্তিমিত হয়ে গেল বিজলির একটি চাহনিতেই।

‘দেখুন এই দোতলায় আমাদের কুলদেবতা রয়েছেন। কথা বলতে চান যদি তাহলে নীচে চলুন।’ মহিলা কঠিন গলায় বললেন। বিজলির দু—কান গরম হয়ে উঠল। হঠাৎ নীচে যেতে বলার পিছনের কারণটা স্পষ্ট। দোতলায় কুলদেবতা এবং মুসলমান মায়ের সন্তান দু—জনের থাকা চলবে না। কিন্তু তিনি এসেছেন প্রার্থী হয়ে, যা বলে বলুক হজম করতে হবে।

ধানের বস্তায় অর্ধেক ভরা নীচে মহিলা তিনজনকে নিয়ে এসে একটা ঘরে তক্তপোশে বসালেন। বিজলি বললেন, ‘জ্যোতির সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি সে সম্পত্তির অংশ দাবি করবে না। আর এই শিশুটিকে আমিই এনেছি। জ্যোতি পাঠায়নি। এমনকী সে জানেও না। ওর নিজের বংশের লোকেদের সঙ্গে থেকে মানুষ হওয়া উচিত বলেই মনে করে ওকে এনেছি, ও আপনার নাতি এটা ভেবেই ওকে আপনার কাছে রাখুন।’

‘নাতি!’ মহিলা প্রায় চিৎকার করে উঠলেন। ‘এই বাড়িতে মুসলমান মায়ের ছেলে থাকবে? দেখুন আপনি ধর্ম মানেন কিনা জানি না কিন্তু আমরা মানি।’

এই সময় পদ্ম বলে উঠল, ‘একটু জল দেবেন, ভুটু সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখনও পর্যন্ত জল খায়নি।’

মহিলা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। পদ্ম অবসন্ন ভুটুকে পাশে বসিয়ে জনিয়ে ধরে রইল। মহিলা ফিরে এলেন প্লাস্টিকের হাতলভাঙা লাল মগে জল নিয়ে। দেখেই মগটাকে তিনি চিনতে পারলেন। তার মাথার মধ্যে অগ্ন্যুৎপাত ঘটে গেল।

‘পদ্ম ও জল ছুঁবি না।’

ঘরে যেন বাজ পড়ল। বিপ্রদাস চক্রবর্তীর বউয়ের হাতের মগ কেঁপে উঠল। পদ্মরও তটস্থ অবস্থা।

‘আমাকে ধম্মো শেখাবেন উনি? পায়খানার মগে করে জল এনেছেন ভুটুকে খাওয়াবার জন্য! পদ্ম ওঠ, এ বাড়িতে আর এক মুহূর্তও নয়!’

বিজলিবালা কথাটা বলেই দ্রুতপায়ে এগোলেন সদর দরজার দিকে। ভুটুকে কোলে তুলে পড়িমরি তাকে অনুসরণ করল পদ্ম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে তারা হাঁটতে লাগল। এখানে রিকশা পাওয়া যায় না। রাস্তার গর্তে পা পড়ে ভুটুকে নিয়ে পদ্ম হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল। কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলল, ‘মাসিমা আর একটু ভালো করে বললে না কেন, ধম্মো কি গায়ে লেখা থাকে? না ভড়ং দেখিয়ে পুজো করলেই ধাম্মিক হওয়া যায়। ধম্মো তো অন্তরে থাকে তাই না মাসিমা?’

বিজলি শুধু বললেন, ‘হুঁ।’

‘মাসিমা ওই টিনের চালের বাড়ির সামনে একটা বুড়ি, একটু জল চাও না।’

বিজলি এগিয়ে গেলেন বুড়ির দিকে। ‘মা এই শিশুটা অনেকক্ষণ জল খায়নি, একটু জল দেবে?’

কথাটা শুনে বুড়ি ‘দাঁড়াও বাছা’ বলে হনহনিয়ে বাড়ির ভিতর চলে গেল। একটা ছোট্ট রেকাবিতে চিনি আর ঝকঝকে স্টিলের গ্লাসে জল নিয়ে এল। ভুটু আধ গ্লাস জল শেষ করল বাকিটা আলগোছে খেল পদ্ম।

‘আর জল খাবে?’ বুড়ি জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ।’ বলেই পদ্ম খানিকটা চিনি মুখে দিয়ে রেকাবিটা বিজলির সামনে ধরল।

‘তুমি।’

‘আমিও।’ বিজলি বললেন রেকাবিটা হাতে নিয়ে।

জল খেয়ে ওরা রওনা হল বাস ধরতে। কিছুটা হেঁটে বিজলি বললেন, ‘ওরে আমি আর পারছি না, পায়ের যন্ত্রণাটা আবার চাগাড় দিয়েছে।’

‘তা হলে একটু দাঁড়াও, কমুক যন্তাোন্নাটা।’ ভুটুকে কোল থেকে সে নামাল।

বিজলি দাঁড়িয়ে পড়লেন। পদ্ম কিন্তু কিন্তু করে জিজ্ঞাসা করল, ‘হাসিদি মুসলমান, একথাটা তো আমায় বলোনি।’ গলার স্বরে অভিমান স্পষ্ট।

‘তোর মনে আছে হাসি লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়েছে, নারায়ণ শিলা ছুঁয়েছে!’

‘তোমার মতো করে পেন্নামও করছে।’

‘লোকে জানলে কী বলবে কী ভাববে সেই ভয়ে আমি তোকে বলিনি। তোর পেটে তো কথা থাকে না! চল হাঁটি। দাঁড়িয়ে থেকে যন্ত্রণা কমবে না। ভুটুকে এবার মুতিয়ে নে।’

ওরা একটা মিনিবাস পেয়ে গেল। বর্ধমানে নেমে পদ্ম বলল, ‘মাসিমা এখানকার মিহিদানার খুব নাম, তুমি খেয়েছ?’

বিজলি কথার জবাব না দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বার করে পদ্মর হাতে দিয়ে বললেন, ‘লোককে জিজ্ঞেস কর এখানে নাম করা দোকান কোনটে, এতে যতটা হয় কিনে আন। আমি ভুটুকে নিয়ে দাঁড়াচ্ছি।’

এবার ট্রেনে উঠে ওরা বসার জায়গা পেল। কামরার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মাথা ঠেকিয়ে বিজলি চোখ বুজলেন। জানলার ধারে বসে পদ্ম কমলালেবু খাওয়াতে লাগল ভুটুকে। এক একটা স্টেশন আসছে, যাত্রীরা ওঠানামা করছে, হকার চেঁচাচ্ছে, বিজলির চোখ একবারও খুলল না।

‘মাসিমা ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?’

‘কেন?’ চোখ না খুলে বললেন বিজলি। পায়ের যন্ত্রণাটা এখন তাঁর মুখে ছাপ ফেলেছে।

‘ভুটু থাকবে আমাদের বাড়িতে?’ মুখে উৎকণ্ঠা নিয়ে পদ্ম জানতে চাইল।

জবাব দিলেন না বিজলি। হাওড়া স্টেশনে ট্রেন থেকে অনেকটা পথ প্ল্যাটফর্ম দিয়ে হেঁটে গেটে টিকিট দিয়ে বেরিয়ে এসে বিজলি বললেন, ‘শরীর আর বইছে নারে পদ্ম, ট্যাক্সি করে বাড়ি যাব।’

ট্যাক্সিতেই তারা বাড়ি ফিরল। বিজলি দেওয়াল ধরে ধরে দোতলায় উঠে খাটে শরীর এলিয়ে দিয়ে পদ্মকে বললেন ‘আলো নিভিয়ে পাখাটা খুলে দে। আমাকে এখন জ্বালাতন করবি না।’

‘আয় ভুটু আমরা নীচে গিয়ে মিহিদানা খাই।’ পদ্ম ভুটুর হাত ধরে সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছে। মিহিদানার বাক্সটা থলির মধ্যে ঘরেই রয়ে গেছে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। পদ্ম চেঁচিয়ে উঠল ‘কে?’

‘আমায় চিনবেন না। একবার দরজাটা খুলুন।’

‘দাঁড়া ভুটু কে এল দেখে আসি।’

ভুটুর হাত ছেড়ে দিয়ে সে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। গুটি গুটি পায়ে ভুটু বিজলির ঘরে ফিরে এল। সদর দরজা খুলে পদ্ম অবাক। হাঁটু পর্যন্ত সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরা কৃষ্ণকায় এক দীর্ঘদেহী পুরুষ, গালে চাপ দাড়ি। সন্ধ্যার মুখের এমন একটি অচেনা লোককে সদরে দেখে তার বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। ঢোক গিলে বলল ‘কাকে চাই?’

‘এই বাড়িতে হাসিনা থাকে?’ গলার স্বর মৃদু, চাপা। পদ্ম ভরসা পেল।

‘হাসিনা আবার কে? হাসিদি থাকত, সে তো মারা গেছে।’

‘আমি হাসির বাবা। আমাকে যিনি ফোন করেছিলেন তিনি কি আছেন?’

পদ্মর গলার স্বর মৃদু ও ব্যথিত হয়ে গেল। বলল, ‘কে ফোন করেছিল তা তো আমি জানি না। আচ্ছা দাঁড়ান মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করে আসি।’

পদ্ম ছুটে দোতলায় উঠে ঘরের দিকে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। কীরকম একটা শব্দ হচ্ছে, মেঝেয় পাথর গড়ানোর মতো। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। এমন সময়েই তো রাধুমাসিরা বেরোয়! কান খাড়া করে শুনল, কেমন যেন একটা গলার আওয়াজ, তারপরই কিছু একটা পড়ার শব্দ আর ভুটুর কেঁদে ওঠা, পদ্ম দ্রুত ঘরে ঢুকে আলোর সুইচ টিপল। যা দেখল তাতে চোখ কপালে ওঠার উপক্রম হল। খাটের দিকে তাকিয়ে দেখল বিজলি ওপাশ ফিরে বালিশ জড়িয়ে শুয়ে।

তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল পদ্ম, ‘ও মাসিমা গো দ্যাখো গো, কী সব্বোনেশে কাণ্ড করেছে ভুটু। দ্যাখো উঠে একবার দ্যাখো।’

নারায়ণ শিলা খাটের তলায়। সিংহাসন সমেত রাধাকৃষ্ণ মেঝেয় উপুড় হয়ে, জগন্নাথ আলাদা হয়ে রয়েছে সুভদ্রা বলরামের সঙ্গে। গায়ত্রী দেবীর মাথা নিখোঁজ। ভয়ে জড়সড় ভুটু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে।

মুখ না ফিরিয়ে বিজলি বললেন, ‘তুই দ্যাখ,ভাঙাভাঙির আওয়াজ আগেই পেয়েছি।’ বিজলি এবার পাশ ফিরে পদ্মর দিকে তাকালেন, ‘তোকে আর গয়ায় গিয়ে পিণ্ডি দিতে হবে না, মুক্তি দেবার লোক আমি পেয়ে গেছি। কে এসেছে নীচে?’

‘হাসিদির বাবা।’

‘যা ওনাকে এখানে নিয়ে আয়। আমার পায়ের যন্ত্রণা এখনও কমেনি।’

একা হয়ে যাওয়া

সকালে দাড়ি কামাবার সময় তরুণকান্তি টেলিভিশনে খবর দেখেন। খাওয়ার দালানের বেসিনের উপর আয়না। টেলিভিশন সেটটা ডানদিকে একটা চাকালাগানো টেবলের উপর, মুখটা সামান্য ঘুরিয়ে তাকালেই ছবি দেখা যায়, তাই দেখছিলেন।

সকাল আটটা—এখন আর আজকের খবর কী করে দেবে, সবই গতকালের বাসি, তরুণকান্তি তাই দেখছেন। এই সময় খবরের কাগজটা পড়ে নেয় ছেলে মৃণালকান্তি, কেন না তাকে পৌনে দশটায় আহিরিটোলা ফেরিঘাটে গিয়ে লঞ্চ ধরে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে ট্রেন ধরতে হবে। মৃণালকান্তি ট্রেনে চল্লিশ কিলোমিটার যাবে, তারপর দেড় কিলোমিটার ট্রেকারে এবং মধুসূদন বিশ্বাস সেন্টিনারি কলেজে সে সাড়ে বারোটায় ক্লাসে ঢুকবে। কলেজটির এখন বয়স আটচল্লিশ। মৃণালকান্তি এখানে ইতিহাসের শিক্ষক গত দু—বছর।

তরুণকান্তি টিভিতে খবর দেখতে দেখতে ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন, সেফটি রেজারটা গালের থেকে সরিয়ে রেখে চেঁচিয়ে ছেলেকে ডাকলেন, ‘মিনু মিনু, শিগগিরি আয়, দেখে যা।’

ঘর থেকে খবরের কাগজ হাতে মৃণালকান্তি বেরিয়ে এল যখন, শববাহী কাচের গাড়িটার পিছন দিক, মুখ আঁচল চেপে ফোঁপানো মাঝবয়সি দুজন মহিলা আর শোক প্রকাশের জন্য ব্যাঙের মতো মুখ করা কয়েকটা লোককে তখন দেখা গেল একঝলক।

‘ইসস, অম্বিকা লাহিড়ী কাল দুপুরে মারা গেল! আগে জানলে নার্সিং হোমে যেতুম।’ তরুণকান্তির স্বরে আপশোস, ‘নিশ্চয় কাল সন্ধের খবরে দেখিয়েছে।’

মৃণালকান্তি বলল, ‘দুপুর থেকে ওয়ান—ডে ম্যাচটা যদি না দেখতে তা হলে খবরটা মিস করতে না। কিন্তু নার্সিং হোমে যাওয়ার কি খুবই দরকার ছিল? খুব কি বড়ো সাহিত্যিক! ইদানীং তো ওঁর লেখা পড়া যায় না, লোকে বলত।’

‘লোক?’ তরুণকান্তি বিরক্ত চোখে তাচ্ছিল্যভরে বললেন, ‘লোক না পোক। লোকের কথা শুনে সাহিত্য শিল্পের জাত বিচার হয় নাকি?’ আবার তিনি গালের উপর অসমাপ্ত কাজটা শেষ করায় মন দিলেন। ছেলের মুখ অপ্রতিভ হয়ে যাওয়াটা লক্ষ করেছিলেন। মনে একটা খচখচানি শুরু হয়ে গেল। গলার স্বর এতটা রুক্ষ না করলেই হত।

মৃণালকান্তি যখন ভাত খেতে বসেছে, খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে টেবলে ছেলের মুখোমুখি বসে বললেন, ‘ছবিটা ওর যৌবনকালের, এখনকার নয়। আমি প্রথমে যখন দেখি তখন এইরকম চেহারা ছিল।’

তরুণকান্তি খবরের কাগজের ষোলো পাতাটা একটু তুলে ধরলেন। মৃণালকান্তি একবার তাকিয়ে খাওয়ায় মন দিল। ছেলের নিরাসক্ত মুখ দেখে তরুণকান্তি খচখচানিটা আবার টের পেলেন। রান্নাঘর থেকে বাটিতে মাছের ঝোল এনে টেবলে রাখল মৌসুমী। তরুণকান্তি ছেলের সঙ্গে রফা করার একটা সুযোগ চাইছিলেন, পুত্রবধূকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘বউমা তুমি তো গল্প উপন্যাস পড়োটড়ো। অম্বিকানাথের লেখা কেমন লাগে?’

খবরের কাগজে অম্বিকা লাহিড়ীর মৃত্যুসংবাদটা দেখা হয়ে গেছে মৌসুমীর। শ্বশুরের প্রশ্নটার একটা প্রাসঙ্গিকতা আছে এটা সে বুঝল কিন্তু তাকে কেন জিজ্ঞাসা করা ‘কেমন লাগে?’ তাই সে অবাক হয়ে সব দিক বজায় রেখে বলল, ‘ভালোই তো। বেশ ঝরঝরে গদ্য, টানা গল্প বলে যাওয়া। খুব স্মার্ট সংলাপ, ওঁর যে বয়স আশির কাছাকাছি একদমই বোঝা যায় না লেখা থেকে।’

তরুণকান্তির চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ‘ঠিক এইজন্যই ওঁর প্রথম উপন্যাস পড়েই, নামটা বোধহয় ‘গ্রীষ্মের দুপুর’, তখন কলেজে পড়ি, ওঁর ভক্ত হয়ে যাই। বাম ঘেঁষা লেখা, স্ট্রাইক চলছে এমন এক কারখানার শ্রমিক আর তার পরিবার নিয়ে লেখা। তখনও জানতুম না উনি আমাদের পাড়ার ব্যানার্জিদের দূরসম্পর্কের জামাই। পাড়ার কালীপুজো উদবোধনে ওঁকে একবার আমরা আনিয়েছিলাম। সুন্দর একটা বক্তৃতা দিলেন। তারপর ব্যানার্জিরা নিয়ে গেল খাওয়ার জন্য। আমরা দু—তিনজন, যারা ওঁর ভক্ত সঙ্গে গেলুম। ওঁকে একেবারে শোওয়ার ঘরে খাটে বসানো হল। উনি বালিশটা বগলে নিয়ে খাটে পা ছড়িয়ে কাত হয়ে গল্প শুরু করলেন। একেবারে ঘরোয়া। চলে আসার আগে প্রণাম করলুম। তখন দেখলুম পায়ের নখগুলো বেশ বড়ো আর ময়লা, আর গোড়ালিতে লম্বা লম্বা ফাটার দাগ আর ফাটার মধ্যেও ময়লা জমে। লোকে তো আর পা দেখে না তাই পায়েরও যত্ন নেয় না। যারা ধুতি আর চটি পরে তাদের কিন্তু নেওয়া উচিত। আজ যখন টিভি ক্যামেরা ওঁর পা দেখাল ক্লোজআপে, তখন কী আশ্চর্য, সেই ফাটা গোড়ালিই দেখতে পেলুম। এত বছরেও ওঁর হুঁশ হয়নি, তাঁর শরীরে একটা অপরিচ্ছন্ন জায়গা রয়ে গেছে।’ বেশ হতাশ হয়েই তিনি কথা শেষ করলেন।

‘কিছু একটা গলদ ওঁর রয়ে গেছিল।’ মৃণালকান্তি মুখ থেকে মাছের কাঁটা বার করতে করতে বলল।

‘কী গলদ?’ তরুণকান্তি প্রশ্ন করলেন।

‘বড্ড বেশি লিখতেন। যতটা পুঁজি তার থেকে বেশি খরচ করতেন।’

রান্নাঘর থেকে ইন্দ্রাণী চেঁচিয়ে বললেন, ‘মিনু আর ভাত দেব?’

‘না।’ উত্তর দিয়ে মৃণালকান্তি নিজেকে বলল, ‘এক গাদা ভাত খেয়ে দৌড় দিয়ে লঞ্চে ওঠা তারপর দৌড়ে গিয়ে ট্রেন ধরা। পারা যায় না।’

খাওয়া দ্রুত শেষ করে সে উঠে পড়ল। মৌসুমী থালাবাটি তুলে নিয়ে রান্নাঘরের এক ধারে রাখতে গেল। তরুণকান্তি ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজটা খুলে চোখের সামনে ধরলেন।

ধুতি পরতে পরতে মৃণালকান্তি বলল, ‘পঞ্চাশটা টাকা দাও তো, আজও মাইনে পাওয়া যাবে কি না জানি না।’

মৌসুমী বলল, ‘পঞ্চাশ হবে না, গোটা কুড়ি দিতে পারি।’

‘তা হলে মা—র কাছ থেকে চেয়ে দাও। বলো আমি ধার চাইছি, শোধ দিয়ে দেব। কাছাটা গুঁজে কোঁচার দৈর্ঘ্য ঠিক করায় সে ব্যস্ত হল। ভ্রূ কুঁচকে কী ভেবে ঝুলটা বাড়িয়ে আঙুল ঢেকে দিল।

‘মা পঞ্চাশটা টাকা দিন। ধার।’ মৌসুমী মৃদু কুণ্ঠিত স্বরে বলল।

ইন্দ্রাণী শুধু বললেন, ‘আবার!’

শোওয়ার ঘরে এলেন, পিছনে পুত্রবধূ। চাবি ঢুকিয়ে দেরাজ খুলতে খুলতে বললেন, ‘কী কলেজ রে বাবা, মাইনে ঠিক সময়ে দেয় না! ছেড়ে দিক এমন চাকরি, অন্য কলেজ দেখুক।’

টাকাটা এনে স্বামীর হাতে দিল মৌসুমী। মুখ থমথমে।

‘মা কিছু বলল?’

‘অন্য কলেজ দেখতে বললেন।’ শুকনো স্বর মৌসুমীর।

বাইরে ইন্দ্রাণীর খিঁচিয়ে বলা কথা শোনা গেল। ‘রমার মা, আবার তুমি দাদার বেরোনোর সময় ঘর মুছতে এসেছ? কতদিন বলেছি ঝাঁটা, খালি বালতি দেখে বাড়ি থেকে বেরোলে অকল্যাণ হয়। দাঁড়াও এখন, আগে দাদা বেরোক।’

রমার মা সকালে এসে বাসন মেজেই অন্য দুটো বাড়ি দৌড়য় কাজ সারতে। তারপর ফিরে এসে ঘর ঝাঁট ও মোছার কাজ করে। সাধারণত সে মৃণালকান্তি বেরিয়ে যাবার পরই আসে, আজ সময়ের হিসেবে ভুল করে ফেলেছে।

‘তা হলে মাকেই বল অন্য কলেজটা দেখে দিতে।’ কথাগুলো বলে পোর্টফোলিও ব্যাগটা তুলে চট করে আয়নায় মুখ দেখে নিয়ে, মৌসুমীর ঠোঁটে আলতো চুমু দিয়ে পর্দা সরিয়ে বেরিয়ে গেল। ওদের বিয়ে হয়েছে এগারো মাস। গাঢ় চুম্বন ক্রমশ আলতো হয়ে আসার পর্যায়ে পৌঁছেছে।

.

মৌসুমী বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। স্বামী ক্যানসারে মারা যেতে ইউনিয়নের চেষ্টায় হৈমন্তী স্বামীর ব্যাঙ্কের অফিসেই যখন চাকরি পায় মৌসুমী তখন পাঁচ বছরের। অভিভাবকহীন হয়েই সে বড়ো হয়েছে। ঘরে বেশিরভাগ সময় একা, দ্বিতীয় মানুষ বলতে ছিল দিনরাতের এক বৃদ্ধা কাজের লোক—সতীমাসি। সঙ্গীহীন মৌসুমী ধীরে ধীরে জেদি, একরোখা, চাপা স্বভাবের হয়ে ওঠে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে হয়ে ওঠে সুমুখশ্রী, লাবণ্যময়ী ও গড়নে সুঠাম এক তরুণী। স্বাভাবিকভাবেই কলেজে কয়েকজন ছেলে তার ঘনিষ্ঠ হতে চায়। মৌসুমী তাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তাদের সে বন্ধু হিসাবে ভাবতে রাজি তার বেশি আর কিছু নয়। তাই শুনে সবকটি ছেলেই পিছিয়ে যায়। বাংলা অনার্সের ছাত্রী মৌসুমী পড়াশুনোয় ছিল সাধারণ মানের, তবে পাশ করেছিল অনার্স সহ দ্বিতীয় বিভাগের উঁচু দিকে থেকে।

তার বিয়েটা সম্বন্ধ করে বা প্রণয়জনিত কারণে হয়নি। ভবানীপুরে ব্যাঙ্কের এক সহকর্মীর ছেলের বউভাতে মেয়ে—সহ হৈমন্তী নিমন্ত্রিত হয়ে যান। নিমন্ত্রিত ছিল তরুণকান্তিও সপরিবারে। নববধূকে যে বড়ো ঘরে বসানো হয়েছিল সেখানেই বসেছিল নিমন্ত্রিত মহিলারা। ইন্দ্রাণীর পাশেই বসেছিলেন হৈমন্তী। রজনীগন্ধা, বেল, জুঁই আর সেন্টের গন্ধের সঙ্গে ভ্যাপসা গরমে হৈমন্তীর গা গুলিয়ে উঠেছিল। বিড়বিড় করে বলে ওঠেন, ‘নাহ আর বসা যায় না, মাথা ধরে যাবে।’

‘ঠিক বলেছেন’, ইন্দ্রাণী বলে ওঠেন। ‘চলুন বাইরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।’

দুজনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন কথা বলছেন, তখন মৌসুমী মায়ের কাছে এসে বলে, ‘মা তুমি এখানে? আমি সারা বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমাদের ক্লাসের বিনীতার সঙ্গে দেখা হল। পাশের বাড়িতেই থাকে, আমি এখন ওদের বাড়িতে যাচ্ছি। পাঁচ মিনিট। তুমি আবার যেন খোঁজাখুঁজি শুরু করে পুলিশে খবর দিয়ো না।’ বলেই সে দ্রুত চলে যায়।

ইন্দ্রাণী দেখছিলেন টকটকে লাল সিফনের শাড়িতে জড়ানো ছিপছিপে সুঠাম দেহের ফর্সা মেয়েটিকে। আয়ত চোখ, টিকলো নাক, শাঁখের মতো গলা, খইয়ের মতো দাঁত আর মিষ্টি স্বর। তিনি মুগ্ধ হলেন।

‘মেয়ে বুঝি!’ বলাটা নিরর্থক বুঝেই তিনি যোগ করেন, ‘ওরা ক—ভাইবোন?’

‘আমার এই একটিই সন্তান। এবার বিএ পাশ করল।’

‘আরও পড়বে?’

‘যদি ইচ্ছে হয় পড়বে। পড়াশুনোর ব্যাপারে কখনো নাক গলাইনি, ছেলেমেয়ের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করায় আমি বিশ্বাসী নই। আমি চাই বিয়ে দিয়ে দিতে। একা মানুষ, দেখার কেউ নেই, যা দিনকাল পড়েছে ঘরে রাখতে অস্বস্তি হয়। ওকে বলেওছি, জবাব এক কথা, বিয়ে তো যখন তখন করা যায়, এত ব্যস্ত হবার কী আছে?’

‘ছেলে দেখেছেন?’

‘দেখার সময় কোথায় আমার! ওই অফিসের দু—তিনজনকে বলে রেখেছি। ভাবছি এবার ওকে বলব, নিজের পছন্দের কাউকে যদি বিয়ে করতে চাস তো করে ফেল।’ হৈমন্তী হাসলেন, নিরুপায়ের হাসি। ‘মেয়ে বিয়ে করে একটা ছেলেকে সঙ্গে করে এনে বলবে, মা তোমার জামাই আনলুম, অমন বিয়ে আমি মেনে নিতে পারব না।’

‘আমার জাঠতুতো দেওর এমনটা করেছিল, চল্লিশ বছর আগে। ঘোমটা দেওয়া সিঁথিতে সিঁদুর লেপা শাঁখাপরা একটি মেয়েকে এনে বলল, মা তোমার দাসী এনেছি। মা তো ভিরমি খেয়ে পড়ল। ডাক্তার ডাক, ডাক্তার ডাক, হুলুস্থুলু কাণ্ড। এখন আর ওভাবে লুকিয়ে বিয়ে করে না কেউ, বলেকয়েই করে।’

হৈমন্তী জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনারা থাকেন কোথায়?’

‘আহিরিটোলায়। আপনি?’

‘এখানেই, ভবানীপুরে। যার বউভাত সে আমার কলিগের ছেলে।’

‘ও হল আমার খুড়তুতো বোনের ছেলে, আপনার কলিগ হলেন আমার ভগ্নিপতি। এতক্ষণ কথা বললুম, আপনার নামটি কিন্তু জানা হল না ভাই। আমার নাম ইন্দ্রাণী, পদবি চাটুজ্জে।’

‘আমি হৈমন্তী মৈত্র। এইরকম অনুষ্ঠানে এলে একটা লাভ হয়, নতুন নতুন লোকের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়।’

ব্যস্ত হয়ে তখন এলেন ছেলের মা। ইন্দ্রাণীকে বললেন, ‘ন—দি এবার বসে পড় ছাদে পাত খালি হয়েছে। মিসেস মৈত্র আপনিও। মেয়ে কোথায়?’

‘পাশেই বন্ধুর বাড়িতে গেছে। চলুন দিদি, ছাদের কাজটা সেরে ফেলি। মৌসুমীর জন্য অপেক্ষা করে কাজ নেই, কাল আমার অফিস আছে।’

‘তাই চলুন, আমারও সকালে রান্নার তাড়া আছে। ছেলেকে ন—টার মধ্যে ভাত দিতে হবে।’

তিনতলায় পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হয় বিয়ের জন্য। চারতলায় ছাদ। ওঁরা দুজন ছাদে এসে দেখেন, খাওয়ার টেবিলে জায়গা পাবার জন্য মিউজিক্যাল চেয়ার চলছে।

‘মা এই যে এখানে।’ মৌসুমী দাঁড়িয়ে উঠে হাত নাড়ছে। তার পাশে একটা খালি চেয়ার দখল করে রেখেছে মায়ের জন্য।

হৈমন্তী বিব্রত হয়ে বলল, ‘মৌ এনাকে বসার একটা চেয়ার দেখে দে।’

‘আপনি আমারটায় বসুন, আমি একটা জায়গা দেখে নিচ্ছি।’ ইন্দ্রাণীকে হাত ধরে বসাল মৌসুমী।

এই সময় চেয়ার দখলটা অতি দ্রুতবেগে করে ফেলতে হয়। মৌসুমী তাই করল। সে দেখল উলটো দিকের সারিতে একটা খালি চেয়ার। ঠেলেঠুলে গিয়ে সেই চেয়ারে বসতে যেতেই পাশের চেয়ারে বসা যুবকটি বলল, ‘এখানে লোক আছে।’

‘কোথায় লোক?’ চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মৌসুমী বলল।

যুবকটি আঙুল তুলে দেখাল। মৌসুমী দেখে বলল, ‘উনি তো আমার চেয়ারে বসেছেন, আমিই ওঁকে বসতে দিয়েছি, এই চেয়ারে আমি বসব।’ প্রায় ঝগড়ার সুরে বলল মৌসুমী। ম্রিয়মাণ যুবক মন দিল বেগুনভাজায়।

ইন্দ্রাণী লক্ষ করলেন, সুরূপা একটি মেয়ের পাশে তার ছেলেকে উজ্জ্বল ও সুদর্শন দেখাচ্ছে। দেখে গভীর তৃপ্তি অনুভব করেন এবং তখনই একটা ইচ্ছা তার মনে জাগল। পাশে ঝুঁকে বলেন, ‘আপনার মেয়ের পাশে যাকে দেখছেন ওটিই আমার ছেলে। একমাত্র সন্তান, আপনার মেয়ের মতোই।’

হৈমন্তী বারকয়েক তাকিয়ে দেখে নিলেন ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি পরা গৌরবর্ণ, রমণীসুলভ সুকুমার মুখশ্রীর যুবকটিকে। তারপর বলেন, ‘আপনার ছেলে কী করে?’

‘প্রফেসার। কলেজে পড়ায়।’ ইন্দ্রাণীর কণ্ঠে এমন একটা স্বর ছিল যেটা একটা খাদের মধ্যে ধ্বনিত হওয়া শব্দের মতো শোনাল। রোমাঞ্চিত হলেন হৈমন্তী।

‘কোন কলেজে? কী পড়ায়?’

‘এই তো সবে এক বছর হল পাশ করে বেরোল, ইতিহাস পড়ায়। এখন মফস্সলের একটা কলেজে আছে বলদেবপুরে। বেশি দূর নয়, লোকাল ট্রেনে এক ঘণ্টা হাওড়া থেকে।’

ব্যস! এই খবরটুকুই যথেষ্ট মনে হল হৈমন্তীর। তিনি আর কিছু জিজ্ঞাসা করার দরকার বোধ করলেন না। ‘প্রফেসার’ শব্দখণ্ডটি ঠং ঠং করে তার মাথার মধ্যে বেজে যেতে লাগল।

পাতে চাটনি পড়ার পর হৈমন্তী বললেন, ‘আমার মেয়েকে তো দেখলেন, কেমন লাগল?’

ইন্দ্রাণী ইতিপূর্বে নেওয়া বাসনাটি কীভাবে প্রকাশ করবেন মনে মনে তাই নিয়ে অস্বস্তি বোধ করছিলেন, হৈমন্তীর প্রশ্নটায় হাঁফ ছাড়লেন। ‘কেমন লাগল’ কথাটা তিনি এর আগে তিনবার শুনেছেন এবং প্রতিবারই বলেছেন ‘ভালোই তো’। তারপর কন্যাপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছেন পছন্দ হয়নি। কিন্তু এখন পছন্দটা তো নিজেই আগ বাড়িয়ে মনে মনে করে ফেলেছেন। কেমন লাগল মানে পছন্দ হয়েছে কি না জানতে চাইছে মেয়ের মা। তার মানে সম্বন্ধের প্রস্তাবটা দেওয়া, তবে কিনা তার উত্তরের উপর সেটা নির্ভর করছে। ইন্দ্রাণী গম্ভীর হয়ে গেলেন, মেয়ের মায়ের কাছে ছেলের মায়ের যতটা ব্যক্তিত্ব বিচ্ছুরণ করতে হয় গলার স্বরে তার চেষ্টা করে, এঁটো তর্জনীটা তুলে বললেন, ‘বেশ ভালোই তো। গায়ের রং, গড়ন, পেটন, হাইট, গলার স্বর, মাথার চুল, বিএ পাশ—রান্নাটা বোধহয় জানে না।’

‘না, না, জানে।’ ব্যগ্র উৎকণ্ঠা নিয়ে হৈমন্তী বললেন, ‘মৌ খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারে। আমার অফিসের রান্না কতদিন তো ওই করে দিয়েছে।’

‘ভালো।’ ইন্দ্রাণী চাটনি মাখিয়ে আঙুলটা চুষে নিয়ে বললেন, ‘অফিসের রান্না আর লোকজনকে খাওয়ানোর রান্না তো এক জিনিস নয়। এসব রান্না শিখতে হয়। আমি শিখেছি শাশুড়ির কাছে, তিনি শিখেছিলেন তার শাশুড়ির কাছে, এভাবেই আমাদের বংশের একটা খাওয়ার রুচি তৈরি হয়েছে। বাপের বাড়ির রান্না শিকেয় উঠে গেছে। আপনার মেয়ে সেটা পারবে তো! যদি পারে তা হলে আমাকে একটা ফোন করবেন।’

দুজনের মধ্যে একবারও বিয়ের কথা কেউ তুললেন না। দুজনেই যেন জেনে গেছেন—তাদের মনের ইচ্ছাটা কোন পথ ধরে চলেছে। দুজনেই যেন জানে কথাটা একবার পাড়লেই অপরজন রাজি হয়ে যাবে। দুজনেই জানে, এটা হল শুধুই প্রাথমিক সম্মতিপর্ব, তারপর হবে লাখ কথা এবং এন্তার দাবিদাওয়ার সমাধান হলে তবেই দু—হাত এক হবে।

‘আপনার কাছে কলম আছে?’

‘আছে।’ হৈমন্তী বাঁ হাতে ধরা ছোট্ট হাতব্যাগ, যেটা সর্বদা হাতে রাখেন, সেটা এঁটো হাতেই খুলে কলম বার করলেন। খাওয়ার পর হাত মোছার জন্য কাগজের রুমাল রাখা ছিল, সেটা টেনে নিয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনার নম্বরটা বলুন।’

মেট্রোয় ফেরার সময় ইন্দ্রাণী তরুণকান্তিকে বললেন, ‘মিনুর জন্য মেয়ে দেখলুম, আমার খুব পছন্দ হয়েছে, বারিন্দির বামুন, তা হোক। মেয়ের মা ফোন করবে কালপরশুই, ভালো করে কথা বোলো।’

‘মিনু মেয়ে দেখেছে?’ অবাক তরুণকান্তি মাথাটা পরিষ্কার রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত হলেন।

‘নিশ্চয় দেখেছে, ওর পাশে বসেই তো খাচ্ছিল।’

ফোনটা এল পরশু দুপুরেই। অফিস থেকে হৈমন্তী জানায় ‘মৌসুমী বলেছে পারবে, যদি আপনি শিখিয়ে দেন।’

‘নিশ্চয়ই দেব। আমার শাশুড়ি তো তাই করেছিলেন। আপনি তা হলে সামনের রবিবার আমাদের বাড়িতে আসুন। নিজের চোখে দেখে যান ছেলের বাড়ি ঘরদোর…না, না, আমার কোনো দরকার নেই আপনার বাড়ি দেখার, মিনু তো আর থাকতে যাবে না আপনার সংসারে।’

রবিবার দুপুর শেষে হৈমন্তী এলেন এক বাক্স সন্দেশ হাতে নিয়ে। ঘুরে দেখলেন ইন্দ্রাণীর সঙ্গে পুরোনো একশো বছরের বাড়ি। মোটা দেওয়াল, কাঠের কড়িবরগা, খড়খড়ির পাল্লার জানলা। রাস্তার উপর বারান্দায় ঢালাই লোহার নকশাকাটা রেলিং, বারান্দাটাকে ধরে রেখেছে দেওয়ালে আঁটা লোহার ব্র্যাকেট।

তরুণকান্তি বললেন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে হৈমন্তীকে ‘তখন আমার বাবার সদ্য বিয়ে হয়েছে। এখানে তখন সরু সরু রাস্তা বড়োবাজার পোস্তা গেছে। লরি আর মোষের গাড়ির যেতে খুব অসুবিধে হত তাই সি আই টি নতুন চওড়া রাস্তা তৈরি করল বাড়ি ভেঙে। যাদের বাড়ি ভাঙা পড়ল তারা টাকা পেয়ে কলকাতার বাইরের দিকে, কেউ হাওড়ায় কেউ দক্ষিণেশ্বরে বাড়ি করে কিংবা কিনে চলে গেল। আমাদের বাড়িটা বেঁচে গেল কান ঘেঁষে। শুধু গাড়ি বারান্দাটার খানিকটা ভাঙা পড়ল। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেটা সেই ভাঙা বারান্দার অংশ। এরকম ঘটেছে অনেক বাড়ির। এই আমাদের পাশের দত্তবাড়ি। ওদের তো আধখানা বাড়িই ভেঙে ফেলা হল ফুটপাথ বার করার জন্য। বেআব্রু হয়ে গেল বাড়িটা। ছাদে চলুন দেখাচ্ছি।’

তরুণকান্তি ছাদে নিয়ে এলেন হৈমন্তীকে, সঙ্গে ইন্দ্রাণী। ছাদের তিনদিকে পাঁচিল। পাঁচিলের ধারে গিয়ে হৈমন্তী ঝুঁকে দেখতে লাগলেন। জন্ম থেকেই তিনি ভবানীপুরে লালিত। উত্তর কলকাতা দেখেছেন বাসে বা ট্যাক্সিতে যেতে যেতে। আজই প্রথম তিনি কলকাতার প্রাচীনত্বকে কাছের থেকে চাক্ষুষ করছেন। যে বাড়িটিকে দত্তবাড়ি বলে তরুণকান্তি দেখালেন সেটি দেখে অদ্ভুত লাগল হৈমন্তীর। চারতলা বাড়িটা যেন চাকলা করে বঁটি দিয়ে কাটা একটা ওল। বিবর্ণ লালচে শুকিয়ে আসা ঘায়ের মতো, বৃষ্টির জলের ঝাপটায় বালি বেরিয়ে এসেছে। দেওয়ালের দু—ধারের ঘরে দুটো করে জানলা, মাঝে দালান দেখা যাচ্ছে। দোতলার বাঁদিকের ঘরের জানলার পর্দা সরিয়ে একটি অল্পবয়সি বউ কৌতূহল নিয়ে প্রায় কুড়ি গজ দূর থেকে হৈমন্তীকে লক্ষ করছে। এই কুড়ি গজে রয়েছে খোলার চালের একটি বস্তি।

ইন্দ্রাণী বললেন, ‘দত্তরা এখানকার নামকরা বনেদি পরিবার। এখন অবস্থা পড়ে গেছে। ভাইয়ে—ভাইয়ে ঝগড়া, সম্পত্তি নিয়ে মামলা—মোকদ্দমা। ওটি ছোটোবউ।’

বউটি বুঝতে পারল ওরা তার দিকে তাকিয়ে। পর্দা নামিয়ে দিল। হৈমন্তী এধার ওধার চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন, একটু হতাশই হলেন।

‘গঙ্গা এখান থেকে কত দূরে?’

তরুণকান্তি জানালেন, ‘হেঁটে মিনিট পাঁচেক।’

হৈমন্তী বললেন, ‘তাহলে তো আপনারা রোজই গঙ্গাস্নান করতে পারেন।’

ইন্দ্রাণী হাসতে হাসতে বললেন, ‘এত বছর বিয়ে হয়েছে। আমি তিন—চার বারের বেশি গঙ্গাচ্চচান করিনি। যা নোংরা জল, তা ছাড়া সাঁতার জানি না। যদি ডুবে যাই! তবে বান দেখতে অনেকবার গেছি। একবার গেছি চক্ররেল কেমন চলছে দেখতে। চলুন এবার নীচে যাই।’

মৃণালকান্তি বাড়ি ছিল না দুপুর থেকে। এইমাত্র ফিরল। ইন্দ্রাণী ডাকলেন তার ঘরে। ‘মিনু শুনে যা, ইনি হলেন মৌসুমীর মা আর এই হল আমার ছেলে।’

ইতস্তত করছিল মৃণালকান্তি নমস্কার না প্রণাম কোনটা করবে, মা—র চোখের ইশারায় দ্বিতীয়টিই করল। হৈমন্তী এই প্রথম কাছের থেকে দেখলেন হবু জামাইকে। তার মনে হল ছেলেটি দুবলা, লাজুক, মুখের আদল মায়ের মতো, চাহনিতে নম্রতা। ওর গলার স্বর কেমন, তা শোনার জন্য তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সেদিন বউভাতে চেয়ারে বসা নিয়ে মৌ তোমাকে কিছু বোধ হয় বলেছিল। আমাকে ও পরে বলল। লজ্জা পেয়েছে। তুমি কিছু মনে কোরো না।’

ব্যস্ত হয়ে মৃণালকান্তি বলল, ‘না না কিছু মনে করিনি। আমি তো ব্যাপারটা ভুলেই গেছি। নেমন্তন্ন বাড়িতে ওরকম একটু—আধটু হয়েই থাকে।’

হৈমন্তী সন্তুষ্ট হলেন কণ্ঠস্বরে। কলেজে পড়ায়, ক্লাসে লেকচার দিতে হয়। উচ্চচারণ এমন মার্জিত স্পষ্ট না হলে চলবে কেন!

‘বাড়ি থেকে কখন কলেজে বেরোও?’ কিছু একটা বলতে হবে তাই হৈমন্তী প্রশ্নটা করলেন বাক্যালাপ চালু রাখার জন্য।

‘সাড়ে ন—টায় বেরোই। প্রথম ক্লাসটা সাড়ে বারোটায়।’

‘তিন ঘণ্টা আগে, অত সকাল সকাল বেরোও!’ হৈমন্তী অবাক হলেন।

মৃণালকান্তি ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। হৈমন্তী দেখলেন সাজানো দাঁত এবং মাড়ি বেরোল না। হাসিটা ভালো।

‘তিন ঘণ্টাতেও এক একদিন সাড়ে বারোটার ক্লাস মিস করি। তিন রকম বাহনে আমাকে যেতে হয়। প্রথমে লঞ্চে হাওড়া স্টেশন, যদি জোয়ার থাকে তা হলে লঞ্চ পনেরো মিনিটের পথ নেবে পঁচিশ মিনিট। তারপর ট্রেন। লেট থাকতে পারে, বিদ্যুৎ চলে যেতে পারে, লাইনে বসে পড়ে নানান তুচ্ছ কারণে অবরোধ হতে পারে। এই সব কারণের কিন্তু বাপ—মা নেই। ধর্ষণ, ডাকাতি, পঞ্চায়েত ইলেকশনে ফলস ভোট, গলায় দড়ি, বিদ্যুৎ না থাকা, মন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি—সে যে কত রকমের অজুহাত হতে পারে রেল লাইনে বসে পড়ার তার ইয়ত্তা নেই। ট্রেন যদি গড়গড়িয়ে চলে তো ভালো। তারপর ট্রেকারে এক মাইল। যাতায়াত করে দুটি মাত্র ট্রেকার। স্টেশনে নেমে দেখলেন একটিও নেই। এবার কী করবেন?’ মৃণালকান্তি ছুড়েই দিল প্রশ্নটা হবু শাশুড়ির দিকে।

হৈমন্তী মজা পাচ্ছিলেন, তার মনে হচ্ছিল ছেলেটির রসবোধ আছে, কথা বলতে ভালোবাসে, বাস্তব জ্ঞানটাও ভালো, এ ছেলে মফস্সল কলেজ থেকে একদিন কলকাতায় কোনো কলেজে চলে আসবে, নয়তো ডিফিল করে যাবে মফস্সলের কোনো ইউনিভার্সিটিতে, এমন কথাই বলেছে তার ব্রাঞ্চ ম্যানেজার।

গাছে না উঠতেই এককাঁদি এই অধৈর্য তত্ত্বে তিনি একদমই বিশ্বাসী নন। অতএব মৃণালকান্তির মফস্সল কলেজে ‘প্রফেসর’ থাকাকে সবুরের অফলিত মেওয়া হিসাবেই ধরে নিচ্ছেন।

মৃণালকান্তির কথা শুনতে শুনতে হৈমন্তীর মুখে মৃদু হাসি ফুটেছিল। সেটা লক্ষ করে ইন্দ্রাণী বললেন, ‘এবার কাজের কথাটা হোক। মিনু তুই এখন ঘরে যা।’

মৃণালকান্তি নিজের ঘরে চলে যাবার পর ইন্দ্রাণী স্বামীকে বললেন, ‘তুমিই বলো।’

তরুণকান্তি কেশে গলা পরিষ্কার করলেন। কপালের থেকে চুলের রেখা পিছনে সরে গেছে যতদূরে, সেখানে হাত বুলোলেন, তারপর বললেন, ‘মেয়ে তো ওনার মানে আমাদের পছন্দ হয়েছে, মনে হয় ছেলেকেও আপনি পছন্দ করেছেন।’ তিনি তাকিয়ে রইলেন মেয়ের মায়ের দিকে।

হৈমন্তী ঘাড় নেড়ে অস্ফুটে বললেন, ‘হ্যাঁ’।

‘তা হলে আমরা নেক্সট স্টেপ যেতে পারি। পাকা দেখা আর বিয়ের দিন ঠিক করা। তাড়াহুড়োর কিছু নেই । আমাদের দুই পরিবারেরই একমাত্র সন্তান। বুঝতেই পারছেন দুজনেই খুব আদরের। এই বিয়েতে পাড়া—প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের না ডেকে আমরা থাকতে পারব না। এই ডাকার মানে, বিয়ে আর বউভাতের জন্য খরচ, সেটা কিন্তু মোটেই কম নয়। এর জন্য টাকার জোগাড় রাখতে হয়। মিসেস মৈত্র আপনি কি এজন্য প্রস্তুত?’ বলার ভঙ্গি হৈমন্তীকে বুঝিয়ে দিল তরুণকান্তি কথাগুলো সাজিয়ে রেখেছিলেন।

‘আমি আমার সাধ্যের মধ্যে প্রস্তুত।’ হৈমন্তী হাসলেন এবং হাসিটা মোলায়েম ঠেকল না হবু বেয়াই ও বেয়ানের কাছে। তা হলেও তাঁরা হৈমন্তীর ‘সাধ্যের মধ্যে প্রস্তুত’কে নিয়ে জানতে চাইলেন না কতটা প্রস্তুত।

হৈমন্তী বললেন, ‘বিয়েতে যা দিতে—থুতে হয় সেসব তো দেবই। আপনাদের এ ছাড়াও কোনো দাবিদাওয়া থাকলে বলতে পারেন। মৌয়ের বাবা নেই, তিনি থাকলে যে—খরচ করতেন তা তো আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তবু গা সাজিয়ে দিতে না পারলেও বারো ভরির গয়না দেব, খাট—বিছানা, আলমারি দেব। এ ছাড়াও ফুলশয্যার তত্ত্ব, বিয়েতে লোক খাওয়ানো, ছেলের ঘড়ি বোতাম আংটি—।’ তরুণকান্তিকে হাত তুলতে দেখে হৈমন্তী থমকে গেলেন।

‘আপনি তো চাকরি করে সংসার চালান এতসব দেবেন কী করে?’ প্রশ্ন এবং বিস্ময় তার চোখে।

‘মৌয়ের বাবা কিছু টাকা রেখে গেছেন, লাইফ ইনসিয়োরেন্স থেকেও কিছু পেয়েছিলাম সেটা রেখে দিয়েছি, আমার বারো ভরি সোনা। তা ছাড়া আমিও প্রতি মাসে কিছু কিছু করে জমিয়েছি, দরকার হলে পি এফ থেকে তুলব। সব মিলিয়ে মোটামুটি পেরে যাব, সংসার তো আমার খুব বড়ো নয়। খরচ যা হয়েছে তা শুধু মৌয়ের পড়াশুনোর জন্য, ওর বিয়েটা হয়ে গেলে আমি তখন একা, ঝাড়া হাত—পা।’ হৈমন্তী হাসলেন ম্লানভাবে।

বিয়ের এই দেনা—পাওনা ব্যাপারটা নিয়ে স্বামী—স্ত্রী নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, একা চাকরি করে মেয়ের মা এতগুলো বছর চালিয়েছেন এজন্য নিশ্চয় তাকে কষ্ট করতে হয়েছে। যা কিছু সঞ্চয় করেছেন তা যদি মেয়ের বিয়েতেই নিঃশেষ করে ফেলেন, তা হলে জীবনের বাকি দিনগুলো তো আরও কষ্ট করে কাটাতে হবে।

‘পেনশন একটা পাবেন বটে কিন্তু তাতে কতটা সুরাহা হবে সে তো নিজেকে দিয়েই বুঝেছি। বাড়ির ট্যাক্স থেকে পুজোর চাঁদা প্রতিটি ব্যাপারে খরচ বেড়েছে।’ তরুণকান্তি স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘মৌসুমী তো আর ছেলে নয় সে মায়ের ভরণপোষণ করবে, বিয়ে হলে তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, বাপের বাড়ির কোনো দায় ওর উপর থাকবে না। ভেবে দ্যাখো, মিনু যদি মেয়ে হত তা হলে আমার অবস্থাটা কী দাঁড়াত? তা ছাড়া এই যে মেয়ের বাড়ি থেকে জিনিসপত্তর নেওয়া এটা তো নিজেদের ছোটো করা।’

ইন্দ্রাণী এই বক্তৃতার চাপে সংকুচিত হতে হতেও মাথা তোলার চেষ্টায় তার যুক্তিটা দেখাবার চেষ্টা করেছিলেন, ‘যদি ওরা দিতে চায় নেব না কেন? সমাজে তো এইরকম দেওয়া—নেওয়া চলে। ওরা যদি ওদের মেয়েকে সাজিয়ে দিতে চান তা হলে আমরা আপত্তি করার কে? সংসারে একটা লোক এলে খরচ বাড়ে না? ওদেরও তো খরচ কমবে। তা ছাড়া খালি হাতে বউ এলে লোকে কী বলবে?’

‘লোক না পোক।’ সুযোগ পেলেই তরুণকান্তি কথাটা বলে দেন। ‘লোকের কথা শুনে চললে দুনিয়ায় বাস করা যায় না।’

মুখ ভার করে ইন্দ্রাণী বলেছিলেন, ‘এতকাল ধরে দুনিয়ায় লোক বাস করে এল আর তোমারই অসুবিধে হচ্ছে।’

‘হ্যাঁ হচ্ছে।’ তরুণকান্তি রুক্ষস্বরে বলেছিলেন, ‘দুনিয়াটা আর আগের মতো নেই, বদলে গেছে, আমাদেরও বদলাতে হবে। যদি ওঁরা মেয়েকে গয়নাগাটি দিতে চান দেবেন, তার বেশি আর কিছু নয়। না খাট—বিছানা, না টিভি, ফ্রিজ—ওসব আমাদের আছে।’

‘মিনুকে যদি কিছু দিতে চায়?’

‘ওটা মিনুর ব্যাপার। যদি নিতে ইচ্ছে করে নেবে।’

ইন্দ্রাণী স্বামীর এই কথাটা মনে রেখেছিলেন। হৈমন্তীকে যখন তরুণকান্তি বললেন, ‘এতসব দেবেন কী করে?’ এবং হৈমন্তী যখন জানালেন এতসব দেবার জন্য তার সঞ্চয়ের কথা, ইন্দ্রাণী তখন বললেন, ‘মেয়ের বিয়েতে সবই খরচ করে দেবেন, এটা কীরকম কথা! না না অত খরচ করতে যাবেন না, নিজের জন্য কিছু রাখুন। আমাদের যা খাট বিছানা চেয়ার টেবিল তাতে আশা করি আপনার মেয়ের অসুবিধে হবে না।’

‘না, না, অসুবিধে হবে কেন? সাধারণ গেরস্তভাবেই ও মানুষ হয়েছে। যেকোনো অবস্থার সঙ্গে মৌ মানিয়ে নিতে পারে। এই গুণটা আমার মেয়ের আছে। তা হলে আমি কি ধরে নিতে পারি আপনাদের চাওয়ার কিছু নেই।’ হৈমন্তী মৃদু স্বরে জানতে চেয়ে দুজনের মুখের দিকে প্রত্যাশাভরে তাকালেন।

‘আমার বা আমার স্ত্রীর চাওয়ার কিছু নেই। না যৌতুক না পণ। আংটি, ঘড়ি, খাট, বিছানা, কোনো জিনিসপত্তর নয়। স্ট্রিক্টলি বারণ।’ তবে ছেলের কিছু চাওয়ার থাকতে পারে, এই বাক্যটি অনুক্ত রাখায় কয়েক সেকেন্ড তরুণকান্তি মনে একটা খচখচানি বোধ করলেন, তবে সেটা ঢেকে গেল একটা ফুরফুরে সুখে। কাজের মতো একটা কাজ তিনি করলেন, জীবনে এই প্রথম। সাধারণ স্তর থেকে নিজেকে তুলতে পেরেছেন। হৈমন্তীর চোখে কৃতজ্ঞতার হালকা ছায়া ভেসে যেতে দেখে তিনি আনন্দ ও সুখ দুটোই বোধ করলেন।

‘বিয়ের দিনক্ষণটা আপনিই ঠিক করে আমাদের জানাবেন, পাকাদেখার কোনো দরকার আছে বলে তো মনে হয় না।’ তরুণকান্তি বললেন।

‘আপনি যা বলবেন সেইরকমই হবে।’

ইন্দ্রাণী বললেন, ‘ব্যস্ত হবেন না। গুছিয়ে জোগাড়যন্ত্র করতে সময় লাগবে। আমাদের তাড়া নেই।’

‘তা হলে এবার আমি আসি।’ উঠে দাঁড়ালেন হৈমন্তী।

‘আপনি যাবেন কীভাবে, মেট্রো দিয়ে?’ তরুণকান্তি জানতে চাইলেন।

‘ট্যাক্সিতেই যাব।’ হৈমন্তী এখন খুশির মেজাজে। কয়েকটা টাকা বেশি খরচ হবে। হোক। ব্যাঙ্কের চাকরিটা পাওয়ার চিঠি হাতে নিয়ে ট্যাক্সিতে বাড়ি ফিরছিলেন, তারপর আজ পেলেন। এই নিশ্চিন্তি। ঘর থেকে বেরোনোর জন্য পা বাড়ালেন।

‘দাঁড়ান। মিনু আপনার সঙ্গে যাক, ট্যাক্সি ধরে দেবে।’ তরুণকান্তি ব্যস্ত হয়ে বললেন। ইন্দ্রাণী দ্রুত গেলেন মৃণালকান্তির ঘরে।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে হৈমন্তী পিছু ফিরে মুখ তুলে দেখলেন বারান্দায় স্বামী—স্ত্রী দাঁড়িয়ে। ইন্দ্রাণী হাত নাড়লেন। হৈমন্তীর মনে হল বাড়িটার মতো এরা তত পুরোনো নয়। মৌয়ের অসুবিধা হবে না মানিয়ে নিতে। সদর দরজার পাশে দুটো ঘর। মাথায় সাইনবোর্ড। দরজা বন্ধ সাইনবোর্ড থেকে হৈমন্তী বুঝলেন একটিতে বসেন হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার, অন্যটি ইলেকট্রিক্যাল দ্রব্য সারাইয়ের।

মৃণালকান্তি বলল, ‘আমাদের ভাড়াটে। খুব ধরাধরি করায় বাবা বছর দুয়েক হল ওদের দিয়েছে। নয়তো খালিই পড়েছিল।’

বড়ো রাস্তায় খদ্দেরের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল একটা ট্যাক্সি। মৃণালকান্তি বলল, ‘ভাগ্য ভালো। আজ রবিবার বলে পেলুম, অন্য দিন হলে এত সহজে ট্যাক্সি মিলত না।’

মৃণালকান্তি প্রণাম করতেই হৈমন্তী স্মিত হেসে মাথায় হাত রেখে বললেন, ‘থাক বাবা দীর্ঘজীবী হও, সুখে থাকো।’

বাড়ি ফেরার সময় রমার মায়ের সঙ্গে রাস্তায় তার দেখা হল। কৌতূহলে টসটস করছে রমার মা—র মুখ। ‘দাদাবাবু আজ যার আসার কথা ছিল আপনাকে দেখতে ইনিই কী সেই?’

‘হ্যাঁ।’

‘খুব সুন্দর দেখতে তো, মেয়েও নিশ্চয় সুন্দরী হবে।’

‘হতে পারে।’ মৃণালকান্তি এড়িয়ে যেতে চায় এই স্ত্রীলোকটিকে। এ—বাড়ির হাঁড়ির কথা সে—বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ায় রমার মা যে অতীব পারদর্শী, সেটা সে জানে। সে চায় না তার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা হচ্ছে এই খবর পাড়ায় এখনই ছড়িয়ে পড়ুক। কিন্তু এখন বুঝে গেল খবরটা আর গোপন থাকল না। শকুনের মতো ওর দৃষ্টি। তল্লাটে কখন কোথায় কী ঘটনা তৈরি হচ্ছে, কে কী বলল বা করল, সব যেন ও টের পায় বা শুনতে পায়। তারপরই ঝাঁপিয়ে খবর থেকে নাড়িভুঁড়ি বার করে ছড়িয়ে দেয়। মৃণালকান্তির এক এক সময় মনে হয় রমার মাকে পুলিশের চরের কাজ নিতে বলবে।

বাড়ি ফিরতেই ইন্দ্রাণী বললেন,’দেখলুম রমার মাকে তোর সঙ্গে কথা বলতে।’

‘জিজ্ঞেস করল, ইনিই কী সেই যার আসার কথা ছিল। তুমি বুঝি ওকে বলেছিলে ওই ভদ্রমহিলা আজ আসবেন?’

‘বলেছিলুম, তাতে হয়েছে কী? একদিন তো সবাই জানতেই পারবে। ও তো এবার এসে জিজ্ঞাসা করবে বিয়েতে দাদাবাবু কী কী পাবে। যা যা বলব দু—দিনের মধ্যে পাড়ার লোক জেনে যাবে।’

‘কী কী পাব?’ মৃণালকান্তির মুখে কৌতুক মেশানো কৌতূহল।

‘ঘর ঠান্ডা করার যন্ত্র, ফ্রিজ, টিভি, পাউরুটি সেঁকা আর খাবার গরম করার আর টিভিতে সিনেমা দেখার যন্তর, তা ছাড়া বক্সখাট, স্টিলের আলমারি, খাওয়ার টেবিল, সোফা, স্টিলের বাসনের সেট—’

‘বলো কী!’ মৃণালকান্তির চোখ বিস্ফারিত। ‘মোটরগাড়ি দেবে না?’

‘না, অতটা বললে লোকে বিশ্বাস করবে না’ ইন্দ্রাণী হেস উঠলেন।

‘সত্যি সত্যিই কি এত দেবে বলেছে?’

‘দিতে চেয়েছে তবে এতসব নয়। রমার মাকে বলার জন্য বাড়িয়ে বলতে তো হবে।’

‘কিন্তু লোকে যখন দেখবে অতসব জিনিস এল না, তখন?’ মৃণালকান্তির চোখে আতঙ্ক ফুটল।

ইন্দ্রাণী হাসতে শুরু করলেন। ডান হাতের তর্জনীটা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, ‘একটা জিনিসও আসবে না। তোর বাবা সব বাতিল করে দিয়েছে।’ বলেই গম্ভীর হয়ে গেলেন।

মৃণালকান্তি বলল, ‘বাতিল মানে, নেবে না?’

‘হ্যাঁ, আমরা নোব না। ওরা বারো ভরি সোনার গয়না, খাট, বিছানা, আলমারি দেবেন তা ছাড়া বরাভরণ, ফুলশয্যার তত্ত্ব, নমস্কারি শাড়ি এসব যা যা দিতে হয় দেবেন। তোর বাবা শুনে বলল, মেয়েকে যা দিতে চান দেবেন তবে আমরা কোনো পণ—যৌতুক বা জিনিসপত্তর নোব না। আমরা মানে তুই বাদে আমরা দুজন। তোর তো খুব ভালো একটা ঘড়ির শখ ছিল, সেটাই বলব দিতে।’

শুনতে শুনতে মৃণালকান্তির দৃষ্টি স্থির হয়ে এল। যখন সে ভাবতে শুরু করে তখন তার চোখের মণি নড়ে না। বলল, ‘দিতে হবে না ঘড়ি। কিছুই না নিলে ওরা ক্ষুণ্ণ হতে পারেন, ভাববেন দয়া দেখাচ্ছে। ওই বরাভরণে জামা, জুতো যা দেবে সেটুকু মাত্র নেব, ব্যস। আর রমার মাকে কী বলবে সেটা ঠিক করো।’

‘বললুম তো, মেয়েপক্ষ এই এই দেবে বলেছে। শুনেই দাদাবাবু বলল একটাও কিছু নোব না, আমরা কি ভিখিরি? শ্বশুরবাড়ির দেওয়া জিনিস নিয়ে ফুটুনি করব? তুই বরং একবার ওকে শুনিয়ে এসব বলিস।’

মৃণালকান্তিকে আর বলতে হয়নি। রমার মা বিকেলে কাজে এল না। বারো বছরের রমা সন্ধ্যাবেলায় এসে বলল, ‘মা—র পা ভেঙেছে। সাবান জল দিয়ে দত্তবাড়ির সিঁড়ি ধুচ্ছিল। পিছলে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়। মা কাজে আসতে পারবে না যতদিন না পা জোড়া লাগে।’

শুনেই ইন্দ্রাণীর মাথায় বাজ পড়ল। জ্বরজারি নয় যে দু—চারদিন পরে আসবে। ‘তা হলে কাজ করবে কে? মাকে বল একটা কাউকে ঠিক করে দিতে আর বাসনগুলো তুই মেজে দিয়ে যা।’

বিয়ের কয়েকদিন আগে পাঞ্জাবির মাপ দিতে আর জুতো কিনতে মৃণালকান্তিকে নিয়ে হৈমন্তী দোকানে গেলেন। সঙ্গে নিলেন অফিসের তরুণ সহকর্মী দাশগুপ্তকে। সে হালের ফ্যাশনট্যাশনে খুব রপ্ত। দাশগুপ্ত ওদের নিয়ে গেল শেক্সপিয়র সরণিতে চর্মদ্রব্যের এক দোকানে, এখানে বিদেশি জিনিস পাওয়া যায়। মৃণালকান্তির পাম্পশু চাই ধুতির সঙ্গে পরার জন্য। চটির দাম দেড় হাজার টাকা। দেখেই সে বুঝে নিল পাম্পশু—র দাম দুই—আড়াই হাজারের কমে হবে না। সে আড়চোখে বগলে ব্যাগ চেপে রাখা ভাবী শাশুড়ির দিকে তাকাল। হৈমন্তী তখন চোখে মুগ্ধতা মাখিয়ে ব্যাকেটে ঝোলানো খয়েরি রঙের চামড়ার একটা পোর্টফোলিও ব্যাগের দিকে তাকিয়ে। মৃণালকান্তির চোখও ঝকঝক করে উঠেছে। হৈমন্তী ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের ইংরিজির প্রফেসার এইরকম একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে কলেজে আসতেন। তুমি ধরো তো এটা।’ মৃণালকান্তি ভূতে পাওয়ার মতো ব্যাগটা হাতে ধরল। ঘাড় কাত করে হৈমন্তী দেখলেন, হাসি ছড়িয়ে পড়েছে মুখে।

‘দাশগুপ্ত, দ্যাখো তো, এবার প্রফেসার বলে মনে হচ্ছে কি না!’

.

মৃণালকান্তি পোর্টফোলিয়ো ব্যাগ হাতে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে ব্যাজার বোধ করল। মা কথাটা বউকে বলতে গেল কেন, ‘অন্য কলেজ দেখুক’, বলার মানেটা কি মা বোঝে? অন্য কলেজেই যদি পাওয়া যায় তা হলে মরতে তিন রকম বাহনে চড়ে দু—ঘণ্টা রাস্তা ঠেঙিয়ে ‘মধু’ কলেজে যাব কেন?

বি কে পাল অ্যাভেনু ছেড়ে মৃণালকান্তি আহিরিটোলা স্ট্রিটে ঢুকল। এই রাস্তাটি সোজা চলে গেছে গঙ্গার পাড়ে। তারপর বাঁদিকে কিছুটা হাঁটলে লঞ্চঘাট, তারপর নিমতলা শ্মশান। গঙ্গা পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তাটির দু—ধারে বাজার বসে সরু করে দিয়েছে। তার মধ্যে দিয়ে অটোরিকশাগুলোর ভ্রূক্ষেপহীন দ্রুতগতির যাতায়াত, ভাঙা রাস্তায় জমে থাকা জল ও কাদা, ট্যাক্সি, মন্থরগতির বৃদ্ধা, উবু হয়ে দরদাম করা ক্রেতা, আনাজের খোসা আর পাতা, মাছের আঁশটে গন্ধ, টানা একটা শব্দের আস্তরণে ঢাকা এই রাস্তা, দু—ধারে পলি জমা একদা চওড়া খালের মাঝখান দিয়ে সংকীর্ণ নালার মতো এই রাস্তাটা কোনোক্রমে মানুষ আর গাড়ি ঠেলে নিয়ে চলেছে।

ধবধবে ধুতি—পাঞ্জাবি, ঝকঝকে বিদেশি পোর্টফোলিয়ো ব্যাগটি জলকাদা ও ধাক্কাধাক্কি থেকে সামলে, বিশেষ করে জুতোর ঔজ্জ্বল্য, মৃণালকান্তি যখন ঘাটে এসে টিকিট কাটছে তখন দেখল বাগবাজার থেকে যাত্রী বোঝাই লঞ্চটি জেটিতে ভিড়ছে। এরপর দৌড়। যত লোক নামল তার দ্বিগুণ লঞ্চে উঠল। ঠেলাঠেলি করে ওঠার কিছুক্ষণ পর মৃণালকান্তির হুঁশ হল সে কারও পা মাড়িয়ে দিয়েছিল। আশপাশের কয়েকটি মুখ দেখে নিয়ে সে বুঝল এরা কেউ নয়। তার দিকে তাকিয়ে কেউ রাগি চোখে মুখ বিকৃত করছে না। আশ্বস্ত হয়ে সে ঘড়ি দেখল। ভাটার টানে লঞ্চ নির্দিষ্ট গতিতেই চলছে, ঠিক সময়েই পৌঁছে ট্রেনটা পেয়ে যাবে। হাওড়া ব্রিজের তলা দিয়ে যাবার সময় প্রতিবারের অভ্যাসমতো ব্রিজের তলাটা দেখল।

মৃণালকান্তি ছ—নম্বর প্ল্যাটফর্মে পৌঁছানো মাত্র একটা ট্রেন ঢুকল। এটাই যাবে বলদেবপুর। সে তাড়াহুড়ো না করে ট্রেনে উঠল এবং বসার জায়গা পেল যা সচরাচর অন্যান্য দিনে পায় না। এবার সে সকাল থেকে এখন পর্যন্ত গত কয়েক ঘণ্টাকে ফিরে দেখার অবকাশ পেল এবং একবার মাত্র হোঁচট খেয়ে দেখল মসৃণভাবে বাকি সময়টা কাটাতে পেরেছে। হোঁচটটা মায়ের ওই কথাগুলো ‘অন্য কলেজ দেখুক’ আর মৌসুমীর থমথমে মুখ। এসবও মুছে যাবে যদি গত মাসের টাকাটা আজ পাওয়া যায়। কলেজে পৌঁছেই কালোবাবুর কাছে যেতে হবে। কালোবরণ ঘোষ ক্যাশিয়ার, সহৃদয় মানুষ। ক্যাশে টাকা থাকলে এবং প্রিন্সিপ্যাল বঙ্কিম সাহার অনুমতি পেলে সঙ্গে সঙ্গে টাকা দিয়ে দেন। উনি বলেছিলেন তেরো—চোদ্দো তারিখে একবার আসুন। আজ তো তেরো!

বলদেবপুর বর্ধিষ্ণু এবং প্রাচীন জায়গা। মধুসূদন বিশ্বাস জমিদার ও ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বাড়িটিও বিশাল। সেই বাড়ির লাগোয়া হয়েছে সিনেমা হল এবং বাসস্ট্যান্ড, সাইকেল রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে সার বেঁধে। ট্রেকার ছাড়ে এখান থেকেই। মৃণালকান্তি প্রথম চার দিন রিকশাতেই কলেজ গিয়েছিল। পঞ্চম দিনে রিকশার টায়ার ফেটে যাওয়ায় তাকে বাকি পথ হেঁটে কলেজে যেতে হয়। বঙ্কিম সাহা বলেছিলেন, ‘শুরুতেই লেটে আসা আরম্ভ করলেন!’ তার মুখভাব আর গলার স্বরে মৃণালকান্তির বুক দুরদুর করে উঠেছিল। অনেক যোগাযোগের সূত্র ধরে হাঁটাহাঁটি করে কাজটা সে পেয়েছে। চাকরিটা স্থায়ী নয়, প্রিন্সিপ্যালের মর্জির উপর তাকে টিকে থাকতে হবে এটা সে জেনে গেছে।

ট্রেন সময়মতো চলেছে। মৃণালকান্তির টেনশন হয়নি, যা অন্যান্য দিনে হয়। কলেজে ঠিক সময়েই পৌঁছতে পারবে, এই সম্ভাবনাটায় হালকা লাগছে তার নিজেকে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে তার প্রথম কাজ বলরামের পুষ্প ভ্যারাইটি স্টোর্স থেকে চারটি ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুট কেনা। তিনটের সময় সে বিস্কুট এবং এক গ্লাস জল খাবে। বলরামের ছেলে কিশোর, কলেজে উচ্চচ মাধ্যমিকের ছাত্র। এই তল্লাটে উচ্চচ মাধ্যমিক পড়ার স্কুল নেই তাই মধু কলেজে পড়াতে রাজি হয়। এমন দায়িত্ব এ রাজ্যের বহু কলেজ নিয়েছিল, পরে ছেড়েও দিয়েছে কিন্তু মধু কলেজ ছাড়েনি তাই এগারো—বারো ক্লাস এই কলেজে রয়ে গেছে।

বলরাম খাতির করে মৃণালকান্তিকে। তার ছেলেকে আলাদাভাবে অঙ্ক শেখাবার জন্য অনুরোধ করেছে কয়েকবার। মৃণালকান্তি তাকে বলে দিয়েছে, ‘প্রাইভেট কোচিং আমি করব না।’ বলরাম তবুও হাল ছাড়েনি।

আজ বলরামের দোকানে দাঁড়ানো মাত্র সে মৃণালকান্তিকে বলল, ‘স্যার কলেজে আজ ঝামেলা হতে পারে, হায়ার সেকেন্ডারির প্রি—টেস্টে যে সাতটি ছেলে তিন—চারটি বিষয়ে পাশ করেনি তাদের টেস্টে বসতে দিতে হবে, এই দাবিতে ইউনিয়ন নাকি আজ প্রিন্সিপ্যালকে ঘেরাও করবে বলে ছেলের কাছে শুনেছি।’

দু—দিন আগে মৃণালকান্তিও স্টাফ রুমে শুনেছে এইরকমই একটা কথা। তার সহকর্মীদের কথাবার্তা থেকে বুঝেছিল ছাত্রদের দাবি বঙ্কিম সাহা মেনে নেবেন না। ছাত্র ইউনিয়নের সেক্রেটারি ধীরাজকে সে মনে মনে ভয় পায়। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। ইউনিয়ন দখলের ইলেকশন জিততে ছুরি বার করেছে, বোমা ফাটিয়েছে, বিরোধী প্রার্থীদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বাবা—মাকে বলে এসেছে ছেলের শ্রাদ্ধের জন্য পুরুত ঠিক করুন। মৃণালকান্তির ভয়ের আর একটা কারণ, ফেল করা সাতটি ছেলের অঙ্কের খাতা সে দেখেছে, তাদের মধ্যে সর্বোচ্চচ যে পেয়েছে তার নম্বর সতেরো। বঙ্কিম সাহা তাকে ডেকে পাঠিয়ে বলেন, ‘করেছেন কী? আট, ছয়, দশ এসব কী নম্বর দিয়েছেন? আপনিই তো অঙ্ক শিখিয়েছেন! এত কম নম্বর পেলে তো আপনারই বদনাম হবে।’

‘যদি হয় তো হোক।’ মৃণালকান্তি বলেছিল। ‘শুধু আমিই তো কম নম্বর দিইনি। ইংরেজি, বাংলা, বিজ্ঞান এগুলোতেও তো ফেল করেছে। ক্লাসে তো এদের মুখই দেখতে পাই না। এদের অ্যানসার পেপারগুলো আপনি নিজে একবার দেখুন। স্যার, এরা টেস্ট পরীক্ষায় বসার উপযুক্তই নয়। ডাহা ফেল করবে।’

বঙ্কিম সাহা গম্ভীর মুখে টেবলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘খাতাগুলো আমি দেখব, ধীরাজকেও দেখাব।’

তিন দিন পর মৃণালকান্তি প্রিন্সিপালকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘স্যার খাতাগুলো দেখলেন?’

‘দেখেছি, ঠিকই নম্বর দিয়েছেন। ধীরাজকেও দেখতে বলেছিলুম।’

‘কী বলল ধীরাজ?’

‘যেমনই অ্যানসার করুক না কেন ওরা গরিবের ছেলে পাশ করিয়ে দিতে হবে। ও খাতা না দেখেই বলেছে।’

‘পাশ করিয়ে দেবেন?’

‘দেখি।’

মৃণালকান্তি তখনই বুঝে গিয়েছিল একটা গণ্ডগোল ধীরাজরা পাকাবে। এটাই ওরা চায়। ম্যানেজিং কমিটি ওদের বিরোধী রাজনীতি করা লোকদের হাতে। এটা এখন হবে রাজনৈতিক লড়াই।

বলরামের চোখে উৎকণ্ঠা। বলল, ‘আজকের দিনটায় কলেজে নাই গেলেন। কিছু একটা হয়েটয়ে যদি যায়।’

মৃণালকান্তি বলল, ‘কিছু তো নাও হতে পারে। গিয়ে দেখব ঝামেলা মিটে গেছে। মিছিমিছি ভয় পেয়ে একটা দিন কেন নষ্ট করব। দিন বিস্কুট।’

ভয়ের থেকেও সে এখন মরিয়া। কালোবরণকে তার চাই। তেরো—চোদ্দো তারিখ বলেছে। প্রিন্সিপালকে তো দোতলায় তার ঘরে ঘেরাও করবে। অফিসঘরটা একতলায়। সেখানে নিশ্চয় কাজকর্ম যেমন চলে চলবে। মৃণালকান্তি ঘেরাও শব্দটি শুনেছে,কাগজে পড়েছে, কখনো চোখে দেখেনি। এটা যে কী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে সেটা তার ধারণায় ছিল না। ট্রেকার না পেয়ে সে একটা রিকশায় উঠে কলেজ রওনা হল।

কলেজের কাছাকাছি আসতেই সে দেখল ছাত্ররা রাস্তায় জটলা করে রয়েছে। রিকশা থেকে মৃণালকান্তি নেমে পড়ল। তার মনে হচ্ছে কলেজে অস্বাভাবিক কিছু ঘটেছে। একটি ছেলেকে ডেকে বলল, ‘ব্যাপার কী তোমরা এখন কলেজের বাইরে যে!’

হাসিমুখে ছেলেটি বলল, ‘সকাল দশটায় কলেজে আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রিন্সিপালকে তার ঘরে ঘেরাও করেছে ধীরাজরা, সত্যবাবু, মন্মথবাবুরা তখন ওর সঙ্গে কথা বলতে এসেছিলেন তাঁরাও ঘেরাও হয়ে গেছেন। আপনি যাবেন না স্যার গেলে আপনাকেও ঘরে ঢুকিয়ে আটকে দেবে।’

‘অফিসঘরটাও কি ঘেরাও হয়েছে?’

‘খোলেইনি তো ঘেরাও করবে কাকে?’

মৃণালকান্তি বুকের থেকে সবটুকু বাতাস বেরিয়ে গেল। শ্বাস নিতে গিয়ে ব্যথা উঠল। সে কলেজের দিকে এগোল। ছেলেটির কথা সত্যি কি না স্বচক্ষে দেখে যাচাই করবে। একফালি জমি পেরিয়ে কলেজের কোলাপসিবল গেট। দোতলার বারান্দায় ছেলেরা ভিড় করে। হই—হট্টগোল চলছে। মৃণালকান্তি একজনও শিক্ষককে দেখতে পাচ্ছে না। স্টাফ রুমটা দোতলায়। হয়তো সেখানে তাঁরা বসে আছেন।

মন্থর পায়ে সে দোতলায় উঠে এল। দোতলার করিডরে গিজগিজে ভিড়। প্রিন্সিপালের ঘর থেকে চিৎকার ভেসে আসছে। স্লোগান চলছে। মৃণালকান্তির কানে ছেঁড়াছেঁড়া শব্দ ‘অন্যায় জুলুম’, ‘গরিব ছাত্র’ ‘কলেজ বনধ’ ভেসে এল।

স্টাফ রুমে শান্তি গাঙ্গুলি আর প্রিয় চৌধুরি বসে। তাঁকে দেখে যেন তাঁরই প্রতীক্ষা করছেন এমনভাবে সমস্বরে তাঁরা বলে উঠলেন, ‘আসুন।’

শান্তি গাঙ্গুলি বললেন, ‘অফিসঘর কি খোলা দেখলেন?’

‘বন্ধ।’

প্রিয় চৌধুরি বললেন, ‘বলছে দাবি মেনে না নিলে সারারাত ঘেরাও করে রাখবে। সত্যবাবু আর মন্মথবাবু কেন যে তখন প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকতে গেলেন! সত্যবাবুর আবার হাই ব্লাড প্রেশার। এইরকম পরিস্থিতিতে ওঁর কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। ধীরাজকে কি বলব ওকে ছেড়ে দিতে?’ অনুমোদনের জন্য তিনি দুজনের মুখের দিকে তাকালেন।

‘লাভ হবে না। যদি পুলিশ ডাকে তা হলে উদ্ধার পেতে পারে।’ শান্তি গাঙ্গুলি বললেন, ‘তবে তাতে আগুনে ঘি পড়বে, ঘেরাওটা তখন ধর্মঘট হয়ে যাবে।’

‘তখন তো মারা পড়ব আমরা গেস্ট লেকচারাররা।’ প্রিয় চৌধুরী শুকনো হাসলেন, ‘নো ওয়ার্ক নো পে। দাবিটা তো সামান্য, ক—জনকে পাশ করিয়ে দিলে কলেজের কী এমন ক্ষতি হবে!’

বেয়ারা বিনয় ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কি বসে থাকবেন?’

‘তা হলে আর কী করব?’ মৃণালকান্তি বলল।

‘বাড়ি চলে যান। ক্লাস তো হবে না মিছিমিছি সময় নষ্ট করছেন।’

‘তা হলে।’ শান্তি গাঙ্গুলি উঠে পড়লেন। তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে প্রিয় চৌধুরি তিক্তস্বরে বলল, ‘ওনার আর কী, কলেজ খোলাই থাকুক আর বন্ধ থাকুক ফুলটাইম লেকচারার, মাস গেলে তো হাজার বিশেক টাকা গ্যারান্টেড। ক্লাস পিছু দিনে আমাদের মতো পঁচাত্তর টাকার জন্য উঞ্ছবৃত্তি করতে তো হয় না ওনাকে। শুনেছি বর্ধমানের বাড়িতে কোচিং স্কুল খুলে ফেলেছেন। তাতে কত হাজার টাকা কামাচ্ছেন কে জানে!’

চোখে সহানুভূতি নিয়ে মৃণালকান্তি চুপ করে প্রিয় চৌধুরির মনের জ্বালার তাপ অনুভব করল। কথাগুলো তো তার নিজেরও।

‘জানেন মৃণালবাবু, ছোটো ছেলেটার টাইফয়েড হল এক হপ্তা কলেজে আসতে পারিনি, সাড়ে চারশো টাকা লস হল। আঠারোশো টাকা থেকে অতগুলো টাকা চলে গেলে কী থাকে বলুন? পাঠশালার মাস্টারেরও অধম আমরা।’

মৃণালকান্তি ঢোঁক গিলল। বাড়ির কেউ এখনও জানে না তার এই অধমত্ব। সবাই জানে সে গরিব দুঃস্থ এক মফস্সল কলেজের প্রফেসার যে—কলেজ প্রফেসারদের ঠিক সময়ে মাইনে দিতে পারে না। তার ভাগ্য ভালো সংসারটা এখনও ব্যাঙ্কের রিটায়ার্ড অফিসার বাবাই চালাচ্ছে। পেনশন পোস্ট অফিসের সুদ আর দোকানভাড়ার টাকায়। ভয় মৌসুমীকে নিয়ে। সে এখনও জানে তার স্বামী প্রফেসার। কথাটার অর্থ কি ও জানে?

‘মৃণালবাবু প্রাইভেট টিউশনি শুরু করুন। আপনি তো ভাগ্যবান মশাই, টুয়েলভে অঙ্ক করান আর বিএ ক্লাসে ইতিহাস পড়ান, আমার ডাবল রোজগার করেন। অনেক ছাত্র পেয়ে যাবেন, শুরু করুন শুরু করুন।’ বলতে বলতে প্রিয় চৌধুরি উঠে দাঁড়ালেন। ‘চলুন ওদিকে কী হচ্ছে একবার খোঁজ নেওয়া যাক।’

মৃণালকান্তির কানে ক্ষীণভাবে একটা ঈর্ষার সুর ছুঁয়ে গেল। দুটো বিষয় পড়ালে রোজগার তো দ্বিগুণ হবেই আর কে না আয় বাড়াতে চায়। বিএ—তে তার স্পেশাল পেপার ছিল অঙ্ক, অনার্স ছিল ইতিহাসে। যজ্ঞেশ্বরবাবুর মেয়ে একটি ছেলের সঙ্গে নিরুদ্দেশ হওয়ায় তিনি কলেজে আসছিলেন না, পরপর তিন দিন টুয়েলভ ক্লাসে অঙ্ক পড়ানো যায়নি। চিন্তায় পড়ে যান বঙ্কিম সাহা। মৃণালকান্তি নিজের থেকেই তাঁকে বলে, ‘স্যার যদি বলেন তো আমি অঙ্কের ক্লাসটা নিতে পারি। বিএ—তে আমার স্পেশাল পেপার অঙ্ক ছিল। হায়ার সেকেন্ডারিতে লেটার পেয়েছি।’ প্রিন্সিপ্যাল সেই দিনই তাকে ক্লাস নিতে পাঠান। মৃণালকান্তি যখন অঙ্ক পড়াচ্ছে তখন তিন মিনিট ক্লাসের দরজায় এসে তিনি দাঁড়ান, দেখেন, শোনেন এবং ফিরে যান। সেই দিনই তিনি মৃণালকান্তিকে ডেকে বলেন, ‘কাল থেকে আপনি ইলেভেন—টুয়েলভে অঙ্ক করান। ক্লাস পিছু চল্লিশ টাকা পাবেন। রাজি থাকেন তো করুন।’ সে ঘাড় নেড়ে বলেছিল ‘করব।’ তাকে হপ্তায় দশটা অঙ্কের ক্লাস নিতে হয়। আয় বাড়ল। এটাকেই প্রিয় চৌধুরি বললেন, ‘ডবল রোজগার’।

স্টাফ রুম থেকে দুজনে বেরিয়ে এসে দেখল ছাত্রদের উত্তেজিত মুখ। মৃণালকান্তির মনে হল এমন মুখ যে দেখেছে ফুটবল ম্যাচের শেষ মুহূর্তে মাঠের গ্যালারিতে। বদ্ধ জলাশয়ে যেন ঢিল পড়েছে। একটা ঘটনা ঘটেছে, যে ঘটনার মধ্যে বিস্ফোরক দ্রব্য ভরা আছে। সেটাকে খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে অথচ ভয়ও হচ্ছে। রোমাঞ্চক উত্তেজনার ঘোর চোখেমুখে। প্রিন্সিপালের ঘর থেকে ধীরাজের ধমক শোনা গেল। কী বলছে বুঝতে পারল না মৃণালকান্তি।

‘তোমাদের দাবির কত দূর কী হল?’

নিরীহ ধরনের যাকে জিজ্ঞাসা করলেন প্রিয় চৌধুরী সেই ছেলেটি অপ্রতিভ হয়ে বলল, ‘জানি না স্যার, আমি এইমাত্র আসছি।’ বলেই সরে গেল।

সঙ্গে সঙ্গে আর একটি ছেলে, দেখতে সপ্রতিভ, বলল, ‘প্রিন্সিপ্যাল বলেছেন সাতজনকে পাশ করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা বিবেচনা করবেন তবে পাশ কোর্সের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রদের ফি মকুব করতে পারবেন না, ছাত্রদের ভরতির কনসেশন দেবেন না। উনি কিন্তু অনেককে কনসেশন দিয়েছেন, পার্টির নেতাদের চিঠি নিয়ে যারা এসেছে তাদের দিয়েছেন অথচ প্রকৃত গরিব ঘরের ছেলেরা পায়নি। এটা তো পক্ষপাতিত্ব, নয় কি?’ তারা দু—জন অস্বস্তিতে পড়ে চুপ করে রইল। ছেলেটি বলে চলল, ‘আপনারা তো দেখছেন গ্রামের ছেলেই বেশিরভাগ, গ্রামের স্কুলে কী পড়ানো হয় তাও জানেন। একটু সহানুভূতি নিয়ে তো এদের দেখা উচিত। এভাবে ফেল করিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয়?’

প্রিয় চৌধুরি চিমটি কাটলেন মৃণালকান্তির কনুইয়ে। ‘চলুন মৃণালবাবু, মনে হচ্ছে সমস্যাটা এখুনি মিটবে না, ঘেরাও চলবে।’ সিঁড়ির দিকে যেতে যেতে গলা নামিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাদেরই টাকা দিতে পারে না ঠিক সময়ে আর কনসেশন দেবে!’

‘ওঁরা কতক্ষণ ঘেরাও হয়ে থাকবে? সত্যবাবুর শরীর তো ভালো নয়।’ মৃণালকান্তির স্বরে উদবেগ।

‘শরীরটরির নিয়ে ওরা মাথা ঘামায় না। দাদারা বলে দিয়েছে ঝামেলা পাকাও, আন্দোলন করো, তাতে দু—একটা মরলে আন্দোলনটা ঝড়ে পরিণত হবে। দোষটা কলেজের ঘাড়ে ফেলা যাবে। কলেজ বন্ধ থাকবে মরবে পার্ট টাইম শিক্ষকরা। মৃণালবাবু কোমরে গামছা বাঁধার জন্য তৈরি হন। এখন যাবেন কোথায়?’

‘স্টেশনে।’

‘চলুন একটা রিকশা নেওয়া যাক শেয়ারে যাওয়া যাবে।’

প্রিয় চৌধুরি যাবেন হাওড়ার উলটো দিকে জৌগ্রামে, ট্রেনে আধ ঘণ্টার পথ। রিকশা থেকে নেমে তিনি গেলেন প্ল্যাটফর্মে, মৃণালকান্তি এল বলরামের দোকানে। দোকানটির সম্মুখভাগ বেশি বিস্তৃত, কাচ ও কাঠের তৈরি কাউন্টারটিও চওড়া। শুধু মনোহারী জিনিসই নয়, নানাবিধ খেলনা ও উপহারসামগ্রী, কিছু গল্প—উপন্যাসের বই, নিরীহ ওষুধপত্রও বিক্রি হয় বেবি ফুড, লিপস্টিক, বিস্কুট, বডি লোশনের সঙ্গে। জিনিস বিক্রির জন্য আছে দুজন কর্মচারী। পুষ্প ভ্যারাইটি বলদেবপুরের অন্যতম সমৃদ্ধ দোকান এবং বলরাম রায় বৈষয়িক বুদ্ধিতে অত্যন্ত দড়, সম্পন্ন কৃষিজীবী। বর্গাদারদের অভাবের সুযোগ নিয়ে তাদের কিছু টাকা ধরিয়ে বা জমির আংশিক মালিকানা দিয়ে একটু একটু করে নথিভুক্ত জমি হাতিয়ে এখন সে ধানের বড়ো ব্যবসায়ী। তার প্রবল ইচ্ছা বা সাধ ছেলে কিশোরকে গ্র্যাজুয়েট করবে, বংশে যা কেউ হয়নি।

মৃণালকান্তি কাউন্টারের উপর পোর্টফোলিয়ো ব্যাগটি রাখল।

বলরাম হেসে বলল, ‘ঝামেলা চলছে? কলেজ করা হল না।’

‘না। মনে হয় কিছুদিন চলবে।’ মৃণালকান্তির স্বরে হতাশা, সেটা লক্ষ করল বলরাম।

‘তা হলে কী করবেন? বাইরে দাঁড়িয়ে কেন ভেতরে এসে বসুন।’

ট্রেনের অনেক দেরি, বিস্কুটগুলোও খেতে হবে। মৃণালকান্তি কাউন্টারের ওধারে গিয়ে টুলে বসল। ব্যাগ থেকে বিস্কুট বার করে বলল, ‘এক গ্লাস জল হবে?’

জলের গ্লাস কাউন্টারের উপর রেখে বলরাম বলল, ‘এখন কী করবেন?’

জল খেতে খেতে মৃণালকান্তির মনে হল এই লোকটা জানে সে গেস্ট লেকচারার। বোধ হয় জানে ক্লাস পিছু সে কত টাকা পায়। বোধ হয় জানে সামার ভেকেশনে, পুজোর ছুটিতে, সেকেন্ড ইয়ার আর থার্ড ইয়ারে যখন ছাত্র থাকে না তখন ক্লাসও থাকে না। ক্লাস না থাকলে, বলরাম নিশ্চয় খবর রাখে এইসব মাস্টাররা তখন দয়ার পাত্র হয়ে ওঠে।

‘কী আর করব! আসব কলেজে, ক্লাস হলে করব, না হলে চলে যাব।’

‘চলে যাবার আগে কয়েকটা টাকা রোজগার করে তারপর চলে যান।’

বলরামকে মিটমিটিয়ে হাসতে দেখে মৃণালকান্তি বুঝে গেল ও কী বলতে চায়।

‘কিশোরকে অঙ্কে পণ্ডিত করে দেওয়া?’

‘এই তো ধরেছেন কথাটা। শুধু কিশোর কেন আরও কয়েকটা ছেলে জুটিয়ে দেব। অঙ্ক বড়ো জটিল সাবজেক্ট, হায়ার সেকেন্ডারির অঙ্ক তো কড়াকিয়া গণ্ডাকিয়া নয়! হেল্প না পেলে মাথায় ঢোকে না। আমার বারবাড়ির একতলার দালানে ধানের বস্তাগুলো সরিয়ে জায়গা করে দেব। আপনি কোচিং খুলে ফেলুন। ভাড়া দিতে হবে না। কিশোর বলছিল আপনি নাকি দারুণ সহজ করে বোঝান।’

প্রিয় চৌধুরির কথাগুলো মৃণালকান্তির মাথার মধ্যে ঝনাত করে উঠল—’প্রাইভেট টিউশনি শুরু করুন—কোমরে গামছা বাঁধার জন্য তৈরি হোন।’ মা—র কথাটাও মনে পড়ল, ‘অন্য কলেজ দেখুক।’ মুখ নীচু করে মৃণালকান্তি এক মিনিট ভাবল, মুখ তুলে চোখ বন্ধ করে বলল, ‘ঠিক আছে, করব।’

‘তা হলে দুটো দিন সময় দিন গুছিয়েগাছিয়ে নেবার জন্য। একটা ব্ল্যাকবোর্ড তো লাগবেই। মাদুরে বসবে ছেলেরা, বাড়িতে চেয়ার আছে, ইলেকট্রিক আলো আছে। কলেজ করে চলে আসবেন। মাইনেটা কলকাতার মতো নিলে কিন্তু হবে না, বেশিরভাগ তো গরিব ঘরের ছেলে।’

‘বলরামবাবু, আমাকে কি শ—পাঁচেক টাকা এখন দিতে পারবেন?’

ক্লান্ত করুণ স্বরে বলল মৃণালকান্তি।

‘কেন দিতে পারব না, এটা কী একটা কথা হল!’

.

বলরাম যখন মৃণালকান্তিকে বলল, ‘আজ কলেজে ঝামেলা হতে পারে’ সেই সময় মৌসুমী রান্নাঘরের তাক থেকে কৌটো, শিশি—বোতল নামিয়ে ঝাড়মোছ করছিল। ইন্দ্রাণী পরিষ্কার করছিলেন গ্যাস বার্নারটা। মাসে একবার তাঁরা এই কাজটা করেন। দত্তবাড়ির দোতলার ঘরে হঠাৎ পুরুষের গলায় একটা ক্রুদ্ধ গর্জন আর মেয়ে গলায় চিৎকার উঠল।

‘অই আবার শুরু হল, ক—দিন বন্ধ ছিল, ভাবলুম শান্তিতে থাকা যাবে।’ ইন্দ্রাণী নির্বিকার মুখে হাতের কাজ করে চললেন।

মৌসুমী জানলায় গিয়ে দাঁড়াল। দত্তবাড়ির দোতলার ঘরের জানলাটা তাদের রান্নাঘরের জানলার প্রায় মুখোমুখি, মাঝখানে একতলা নীচু খোলার চালের ঘর। গর্জন ও চিৎকার থামছে না, সঙ্গে শব্দও হচ্ছে। যে—কেউই শুনলে বুঝবে একজন আর একজনকে প্রহার করছে।

‘ওদের বাড়িতে তো এত লোক, কেউ কিছু বলে না? এসে অন্তত থামাতে তো পারে!’

‘থামাবে কী? সবাই তো চাঁদুর মতোই বউ ঠ্যাঙানে। ওর বাবাও চাঁদুর মাকে পেটাত। ওই ঘরেই ওরা থাকত। তোমার মতো রান্নাঘর থেকে বিয়ের পর প্রথম দিন দেখে আমি তো ভয়ে কাঁটা হয়ে গেছলুম। কেমন জায়গায় বিয়ে হল রে বাবা! তোমার শ্বশুরকে বলতেই বলল, ‘পরের বাড়িতে যা হচ্ছে হোক তোমাকে তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। যখন ওরকম হবে তখন জানলাটা বন্ধ করে দেবে।’ আমি তাই করতুম।’ ইন্দ্রাণী কথাগুলো বলে জুড়ে দিলেন, ‘তুমিও তাই করবে।’

ঠিক তখনই মৌসুমী দেখল চাঁদুর বউ ঘর থেকে ছিটকে বারান্দায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তার মনে হল চাঁদুর লাথি খেয়েছে বউটি অথবা গলাধাক্কা।

‘ইসস, দেখুন মা দেখুন, বউটার অবস্থা দেখুন।’

‘তুমি দেখ গে, আমার অনেক দেখা আছে। জানলা থেকে সরে এসো বউমা।’ নির্দেশটা দিলেন গলা চড়িয়ে একটু অধৈর্য স্বরে।

মৌসুমী সরে এল। আড়চোখে দেখল বউটি উবু হয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ গুজে বারান্দায় বসে। জামা পরতে পরতে চাঁদু ঘর থেকে বেরিয়ে তার পাশ দিয়ে নীচে চলে গেল।

‘বউটা তো মা বাপের বাড়ি চলে যেতে পারে।’

‘তা তো পারেই। গেছলও দু—বার।’

‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘রমার মা থাকতে জানার অভাব হয়। দু—বারই ওর বাবা—মা ওকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। বাপের বাড়ি তো কলুটোলায়, বেশি দূর নয়। বাবার সোনার গয়নার দোকান বউবাজারে। চার বোন তিন ভাই ওরা। ওই বড়ো মেয়ে। অবস্থা বেশ ভালোই।’

‘দেখতেও ভালো, বয়স তো খুবই কম। তা হলে এমন অত্যাচার হয় কেন?’ মৌসুমী অবাক হয়ে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে রইল।

‘টাকা চায়। এটা তুমি বুঝবে না। তোমার মায়ের কাছে আমরা টাকা চাইনি, কোনো কিছুই চাইনি।’ ইন্দ্রাণীর গলায় প্রচ্ছন্ন গর্ব। ‘মিনুর বাবা তোমার মাকে কী বলেছিলেন নিশ্চয় তুমি শুনেছ।’

ইন্দ্রাণী পুত্রবধূর মুখভাব লক্ষ করলেন। দেখে সন্তুষ্ট হলেন। মনে মনে বললেন, মেয়েটা ভালো, পছন্দে ভুল করিনি। মিনুর বাবাও তাই বলে, মা—মেয়ে দু—জনেই কৃতজ্ঞ রয়েছে।

‘চাঁদু লোকটা কী করে?’

‘ওদের সর্ষের তেলের আড়ত আছে পোস্তায়, পাশের বস্তিটা ওদের, গোটা দুয়েক বাড়িও আছে, ছিল পাঁচ—ছটা। একে একে বিক্রি করেছে, এ ছাড়া কিছু করে বলে তো জানি না, আর যা করে সেটা বলার মতো নয়—গুন্ডামি, মস্তানি। ওর একটা দল আছে ইলেকশনের সময় টাকা নিয়ে কাজ করে, শুনেছি রাস্তার বাজারে তোলা আদায়ের কাজও করে।’

ইন্দ্রাণী হাতের কাজ শেষ করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মৌসুমী জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। বউটি একইভাবে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে রয়েছে। দেখে ওর মায়া হল, বেচারা, কত দিন ধরে এভাবে মার খাচ্ছে কে জানে! খবরের কাগজে রোজই তো একটা দুটো খবর থাকে গৃহবধূ হয় আগুনে পুড়েছে, নয়তো গলায় দড়ি দিয়েছে, কখনোবা বাচ্চচাকে বিষ খাইয়ে নিজেও খেয়ে মরেছে।

দুপুরে মৌসুমী একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। দুপুরে সে ঘুমোয় না। রান্নাঘরে ঠক করে বাসন সরানোর শব্দ হল। সে দ্রুত উঠে এসে দেখল একটা শালিক ভাত খেতে থালায় উঠেছে। তাকে দেখে পাখিটা জানলা দিয়ে উড়ে গেল। বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সে জানলার কাছে এল। আপনা থেকেই চোখ চলে গেল দত্তবাড়ির বারান্দায়। ঘরের জানলাটা খোলা, পর্দাটা সরানো। ঘরের ভিতর খাটের এক দিকের বাজু আর সিলিংয়ে ঝোলানো পাখাটা দেখা যাচ্ছে।

তাকিয়ে দেখেই মৌসুমী আর্তনাদের মতো চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই এই কী করছ, কী করছ। নামো নামো, শিগগির নামো।’

বউটি টুলের উপর দাঁড়িয়ে একটি ওড়না ছুড়ছে পাখা লক্ষ্য করে। ওড়নার অন্য প্রান্ত গলায় বাঁধা। মৌসুমীর চিৎকার শুনে থতমত হয়ে বউটি ভীত চোখে তাকাল। তাড়াতাড়ি টুল থেকে নেমে এসে জানলা বন্ধ করে দিল। থরথর করে কাঁপছে মৌসুমীর গোটা শরীর। বউটি কি আবার টুলে উঠবে! বাড়ির দোতলা তিনতলার বারান্দায় লোক নেই। দুটো ঘরের জানলা খোলা কিন্তু সে কারও নাম জানে না যে চেঁচিয়ে ডেকে বলবে কী কাণ্ড হতে চলেছে তাদের বাড়িতে।

দু—হাতে জানলার গরাদ ধরে সে দাঁড়িয়ে রইল। কাউকে দেখতে পেলে ডেকে বলবে দোতলা ঘরের বউ গলায় ফাঁস লাগাচ্ছে শিগগির ওকে ধরে ফেলুন। বন্ধ জানলার ওধারে এখন কী হচ্ছে কে জানে! আবার কি ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ার চেষ্টা শুরু করবে? কতক্ষণ লাগবে পাখার হাঁড়িটায় ওড়না জড়াতে? সময়ের হিসেব করল মৌসুমী। বড়োজোর দু—মিনিট। গলায় ফাঁস তো আগেই দিয়ে রেখেছে। টুলটা এবার পা দিয়ে ফেলে দেওয়া তারপর দম বন্ধ হয়ে মরে যেতে কতক্ষণ লাগবে? এক মিনিট দু—মিনিট তিন মিনিট—গুনতে গুনতেই মৌসুমীর চোখ বিস্ময়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল।

বউটি ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এসে তাদের রান্নাঘরের জানলার দিকে তাকিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়াল। মৌসুমী জানলা দিয়ে হাত বার করে নাড়তে নাড়তে চেঁচিয়ে বলল, ‘না, না, কোরো না।’

বউটি ক্লান্তভাবে মাথাটি হেলিয়ে দিল, একচিলতে হাসি খেলে গেল ঠোঁটে। আঁচল দিয়ে মুখ মুছল। মৌসুমীর মনে হচ্ছে ও ভীষণ নার্ভাস। বোধহয় বুঝতে পেরেছে যমের বাড়ি থেকে ফিরে এল। সে আবার বারণ করার ভঙ্গিতে দু—হাত নাড়ল। এখন তার নিজেরই নার্ভাস লাগছে। বাধা পাওয়ায় রেগে গিয়ে যদি আবার চেষ্টা করে? বউটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। ধীরে ধীরে হাসি ফুটে উঠল যেটা আগের নির্বোধ—হাসিটার মতো নয়, এতক্ষণে নিশ্চয় মাথায় সাড় ফিরে এসেছে নইলে এমনভাবে হাসতে পারত না। একটা জীবন রক্ষা করার আনন্দ এখন মৌসুমীর চেতনাকে ধুইয়ে দিচ্ছে, তার মনে হল বউটির সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার। ওকে বুঝিয়ে বলতে হবে বেঁচে থাকার থেকে কাম্য আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু কী করে কথা বলা যায়? ওদের বাড়িতে তাকে শ্বশুর—শাশুড়ি যেতে দেবেন না আর ওর পক্ষেও এ বাড়িতে আসা সম্ভব নয়। ওদের ঘরে টেলিফোন আছে কি?

মৌসুমী হাত তুলে চেঁচিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও।’ তারপর ছুটে শোবার ঘরে এল। খাতা থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে দ্রুত লিখল—যদি টেলিফোন থাকে তা হলে এই নম্বরে এখুনি আমায় ফোন কর। কথাগুলোর নীচে বড়ো অক্ষরে তাদের নম্বরটা লিখল।

এবার এটা ওর কাছে পৌঁছে দিতে হবে এবং গোপনে। একমাত্র উপায় ছুড়ে দেওয়া। অতদূর পর্যন্ত চেঁচিয়ে কোনোভাবে কথা হয়তো পাঠানো যায় কিন্তু এই কাগজটা? ঘরের চারধারে তাকাল সে ভারী একটা কিছুর খোঁজে। যা কিছুই চোখে পড়ল সবই হালকা, তাই দিয়ে ছুড়ে দিলে অতদূর পৌঁছবে না। কাশির সিরাপের খালি শিশিটা দেখে তার মনে হল বোধহয় এটায় চলবে। হাতে নিয়ে শিশিটার ওজন অনুমান করে দেখল বেশ ভারীই। কাগজটা ভাঁজ করে তার মধ্যে ঢুকিয়ে সে রান্নাঘরে এল। পলিথিনের থলিগুলো একধারে জড়ো করে রাখা তারই একটার মধ্যে শিশিটা ভরে প্যাঁচাল, রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধল। জানলা দিয়ে দেখল বউটি এখনও দাঁড়িয়ে, মৌসুমী ছাদে যাবার জন্য সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়ে শ্বশুরের ঘরের ভেজানো দরজাটা সামান্য খুলে দেখে নিয়ে ছাদে উঠে গেল।

ঢিলটিল সে কোনোদিন ছোড়েনি। তার ভয় হল যদি শিশিটা দত্তবাড়ির বারান্দা পর্যন্ত না পৌঁছয়, যদি নীচের বস্তির খোলার চালের ওপর পড়ে! সে হাত তুলে পলিথিনের মোড়কটা বউটাকে দেখিয়ে ছোড়ার ভান করে বুঝিয়ে দিল এটা এখন ছুড়ব।

পাঁচিল থেকে দু—পা পিছিয়ে এসে একটু জোরে এগিয়ে গিয়ে মৌসুমী প্রাণপণে ছুড়ে দিল। বউটির চোখে বিস্ময়, কিন্তু মৌসুমী চোখে ভয় নিয়ে দেখল মোড়কটা দোতলার বারান্দার রেলিংয়ে লেগে ঠকাস একটা শব্দ করে নীচে পড়ে গেল। বউটি নীচে একবার তাকিয়েই সিঁড়ির দিকে ছুটল।

দুরু দুরু বুকে মৌসুমী অপেক্ষায় রইল। কী আছে নীচে? গলি? লোক চলছে? যদি কেউ ওটা তুলে নেয়? এক মিনিটের মধ্যেই বউটি উঠে এসে নিজের ঘরে ঢুকে গেল, হাতে মোড়কটা। মৌসুমীর বুক থেকে পাষাণভারটা নেমে গেল।

পর্দা সরিয়ে জানলায় মুখ দেখাল বউটি, হাতের কাগজটা নাড়িয়ে ফোন করার ভঙ্গিতে কানের পাশে মুঠো রাখল। মৌসুমী ছুটে নেমে এল দোতলায়।

টেলিফোনটা খাওয়ার টেবলের পাশে একটা টুলের ওপর। সে চেয়ারে বসা মাত্র ফোন বেজে উঠল। ‘ক্রিং’ শব্দ হতেই সে রিসিভার তুলে নিল। বেশিক্ষণ বাজলে শ্বশুর বা শাশুড়ির ঘুম ভেঙে যেতে পারে।

চাপা স্বরে মৌসুমী বলল, ‘কে বলছেন?’

‘আমি পার্বতী। আমাকে ফোন করতে বলেছেন। আপনার নাম কী?’

‘মৌ, মৌসুমী। কতদিন আপনার বিয়ে হয়েছে?’

‘তিন বছর, মাধ্যমিক পাশ করতেই বিয়ে হয়।’

মৌসুমী বুঝল ওর বয়স মোটামুটি কুড়ির আশেপাশে। তার থেকে দু—তিন বছরের ছোটোই হবে। পার্বতীকে ‘তুমি’ বলা যায়।

‘কতদিন ধরে মার খাচ্ছ? তোমার স্বামীকে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কিছু বলে না?’

‘না, বলে না। প্রথমদিন মার খেয়ে ছুটে বড়ো জা—র ঘরে ঢুকেছিলুম, আমাকে ঠেলে বার করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।’

‘তোমার বর তোমায় মারে কেন?’

‘বিয়ের আগে বাবার কাছে এক লাখ টাকা চেয়েছিল একজনের সঙ্গে বখরায় হেলথ ক্লাব করবে বলে। বাবা বলেছিল, অত টাকা এখুনি দিতে পারব না। মেজো বোনের বিয়ের কথাবার্তা তখন চলছিল, বড়দা ডাক্তারিতে ভরতি হবে। মা—র কিডনি অপারেশন হবে তখন অনেক টাকার দরকার। বিয়ের পর এরা টাকা চাইতে শুরু করে। বাবা পঁচিশ হাজার দেয়। তারপর আর দিতে পারেনি, শুরু হয় মারধর।’

‘তুমি বাপের বাড়ি গিয়ে থাকো না কেন?’

‘দু—বার চলে গেছলুম, বাবা থাকতে দিতে রাজি নয়, বলে, এত টাকাপয়সা গয়না দিয়ে বিয়ে দিলুম সে কি বাপের বাড়িতে থাকার জন্য? মা বলল, শ্বশুরবাড়িই মেয়েদের ঘর। লাথি—ঝাঁটা খেয়েও ওখানে পড়ে থাকবি। ভাই কী বলব, এইসব শুনে ঘেন্না ধরে গেল নিজের ওপর। মা বলল, তোর দাদাদের বিয়ে হবে, তাদের বউয়েরা তোকে তো দাসী করে রাখবে, আমরা আর ক—দিন তারপর তোকে দেখবে কে? মাকে গায়ের কাপড় খুলে মারের দাগগুলো দেখালুম, বললুম ও বাড়িতে আমাকে আর যেতে বলো না, এবার আমি ঠিক মরে যাব।’

মৌসুমী কান্না চাপার শব্দ পেল। কী বলে সান্ত্বনা দেবে সে ভেবে পেল না। নিজেকে সামলে নিয়ে পার্বতী আবার বলতে শুরু করল, ‘জানেন আমার পেটে একটা বাচ্চচা এসেছিল, সাত মাসে সেটা নষ্ট হয়ে যায় ওর ঘুসি খেয়ে। আজও পেছন থেকে এমন একটা লাথি মারল যে ছিটকে ঘরের বাইরে পড়ে গেলুম।’

‘দেখেছি সেটা। তুমি এখন চুপচাপ থাক। ঝগড়াঝাঁটি করে বরকে চটিয়ে দিয়ো না। তোমার ফোন নম্বরটা দাও। কখন ফোন করব?’

‘এই রকম সময়ে করবেন, আমিও করব। আজ আপনি যদি না চেঁচিয়ে উঠতেন তা হলে ঠিক আমি ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়তুম। এইভাবে বেঁচে থাকতে আর ইচ্ছে করে না।’

‘এখন কী ইচ্ছে করছে?’

উত্তরের জন্য উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করল মৌসুমী। কিছুক্ষণ পর ক্ষীণ স্বরে পার্বতী বলল, ‘হ্যাঁ,’ আর একটু পর বলল, ‘কতদিন ইচ্ছে করবে জানি না। এ বাড়িতে কেউ আমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না, আমার বাইরে বেরনো বারণ। মাঝে মাঝে মনে হয় যেদিকে দু—চোখ যায় চলে যাই।’

‘তোমার ফোন নম্বরটা এখনও বলনি। দাঁড়াও কাগজ আনি।’

মৌসুমী ঘর থেকে খাতা আর কলম নিয়ে এসে দেখল শাশুড়ি কলঘরে যাচ্ছে। সে রিসিভার তুলে বলল, ‘বলো।’ নম্বরটা লিখে নিয়ে বলল, ‘আজ এই পর্যন্ত, এখন আমি ফোন রাখছি।’

‘কে ফোন করেছিল বউমা?’ ইন্দ্রাণী কলঘর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমার এক বন্ধু।’

রাত্রে বিছানায় শুয়ে মৌসুমী বলল, ‘আজ একটা ব্যাপার হয়েছে।’

মৃণালকান্তি অবাক হয়ে বলল, ‘ব্যাপার! আমারও তো আজ একটা হয়েছে। আগে শুনি তোমার ব্যপারটা।’

মৌসুমী তার সঙ্গে পার্বতীর টেলিফোনে যেসব কথাবার্তা হয়েছে তা বলল। মৃণালকান্তি ভারী স্বরে বলল, ‘তুমি একটা প্রাণ বাঁচিয়েছ। কাজটা খুব ভালো, তবে পার্বতীর ওই ভাবে বাঁচতে কতদিন ইচ্ছে করবে জানি না। ব্যাপারটা কিন্তু খুব গোলমেলে। এদের মতিস্থিরতা খুব কম, এরা খুব ইমোশনাল হয়, হয়তো কালই দেখবে ঝুলে পড়েছে।’

শুনেই মৌসুমীর বুকের ভিতরটা বসে গেল, নিজেকে সাহস জোগাবার জন্যই যেন বলল, ‘ও নিঃসঙ্গ বলেই এত ডিপ্রেশনে ভুগছে, জীবন সম্পর্কে এমন নেগেটিভ মনোভাবের খপ্পরে পড়েছে। আমি ভাবছি এবার থেকে ওর সঙ্গে কথা বলব। আচ্ছা তুমি ওর স্বামীকে চেনো? তোমার পাশের বাড়িরই তো ছেলে।’

‘চাঁদু আমার থেকে বয়সে একটু বড়ো। মাধ্যমিকটা টুকে পাশ করেছে তারপর আর পড়া এগোয়নি, পাড়ার ছেলে হলেও আড্ডাটা দিত অন্য পাড়ায়। এখানে ও মনের মতো বন্ধু পায়নি। রাস্তায় দেখা হলে, ‘কেমন আছিস’, আলাপটা ওই পর্যন্ত। যারা লেখাপড়া করত তাদের ও দু—চক্ষে দেখতে পারত না, আমাকে তাই খুবই অপছন্দ করে। ওদের বাড়ির শিক্ষাদীক্ষা কালচার কেমন সেটা তো পার্বতীর কথা থেকেই বুঝে গেছ। খুব বড়ো ধরনের মাস্তান না হলেও আমাদের আর আশপাশের মধ্যবিত্ত পাড়ার পক্ষে যথেষ্ট ভয়াবহ, ক্ষতিকর। ঘরের মধ্যে চাঁদু কাকে মারধর করছে তাই নিয়ে ওকে ঘেন্না ছাড়া আর কী করতে পারি!’

‘পার্বতী কোর্টে যেতে পারে। স্বামী অত্যাচার করে বলে ডিভোর্স চাইতে পারে খোরপোশ সমেত।’

অত্যাচার যে করে তার প্রমাণ দিতে হলে সাক্ষী দরকার। একজন সাক্ষীকেও পার্বতী কোর্টে নিয়ে যেতে পারবে না। তার থেকে বরং তুমি ওকে জিজ্ঞেস করো ওর কোনো প্রেমিক ছিল কি না। যদি থাকে তা হলে খোঁজ নিতে বলো সে এখনও আনম্যারেড কি না, যদি আইবুড়ো থেকে থাকে তা হলে এক্ষুনি যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রেমটা ঝালিয়ে নেয়। তারপর বাড়ি থেকে টুক করে কেটে পড়ে প্রেমিককে বিয়ে করে ফেলুক। ছেলেপুলে নেই অসুবিধে হবে না। হেসো না, এমন ঘটনা এই পাড়াতেই ঘটেছে, তা না হলে বুদ্ধিটা আমার মাথায় এল কী করে?’

‘ডিভোর্স না করেই আবার বিয়ে করা যায় নাকি?’

‘না, না, আগে ডিভোর্স।’

‘মামলাটা এখানে থেকেই করবে?’

‘তা কেন, বাপের বাড়িতে গিয়ে সেখান থেকে করবে।’

‘বাপ—মা করতে দেবে না।’

‘দেবে, দেবে, আগে নিজের বিয়ের ব্যবস্থাটা করে ফেলুক তখন দেবে।’

.

‘পার্বতীর কথা থাক এবার বলো তোমার আজ কী ব্যাপার হয়েছে।’

মৌসুমী পাশ ফিরে স্বামীর বুকের উপর হাত রাখল। মৃণালকান্তি চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ পর অধৈর্য হয়ে মৌসুমী বলল, ‘কী হল, চুপ করে আছ কেন?’

‘বলছি। তোমাকে যে পাঁচশোটা টাকা দিলুম, কীভাবে টাকাটা পেয়েছি জান?’

‘না বললে কী করে জানব!’

‘প্রাইভেট টিউশনি কখনো করব না, মন দিয়ে ছাত্র পড়াব, নিজে পড়াশুনো করব, ফাঁকি দেব না পড়াতে—আমার এই প্রতিজ্ঞা বিক্রি করে টাকা এনেছি।’ মৃণালকান্তি উত্তেজিতভাবে উঠে বসল। ‘আমি তোমাদের ঠকিয়েছি। আমি মোটেই প্রফেসর নই, গেস্ট লেকচারার, অতিথি—শিক্ষক, কী গালভরা একটা নাম। যেকোনো সময় কলেজ আমায় ছাঁটাই করে দিতে পারে। এসব তোমরা জানতে না, তোমরা খোঁজখবর করনি।’

‘কে বলল আমরা করিনি!’ মৌসুমী ছাড়া গলায় বলল। ‘মা অফিসের একজনকে দিয়ে মধুসূদন বিশ্বাস কলেজে দু—তিনজনের কাছে খোঁজ নিয়েছিল। তোমার চাকরি সম্পর্কে সব শুনেও মা রাজি হয়েছে। আমিও সব শুনেছি। মাইনে প্রায় কিছুই নয়, তাতে কী হয়েছে, বিয়ের জন্য ওটাই কি একমাত্র ক্রাইটেরিয়া?’

‘কী বলছ, রোজগারটাই তো আসল জিনিস!’ মৃণালকান্তিও অবাক হল। সে আশা করেনি তার বউ এমন সহজভাবে ব্যাপারটা নেবে।

‘রোজগার তো লোক ঠকিয়ে বহু লোক করে, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ টাকা করে, শুধু তারাই কি ভালো লোক, ভালো জামাই, ভালো স্বামী? মা বলেছিল ‘মৌ তোকে একটা সৎ ছেলের হাতে দিতে চাই, একটা ভদ্র শিক্ষিত ঘরে দিতে চাই, তুই সুখে থাক আজীবন। বেশি আকাঙ্ক্ষা বেশি লোভ করিসনি।’ মৃণাল, আমি আকাঙ্ক্ষা করি কিন্তু লোভী নই।’ মৌসুমী অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে খুঁজল মৃণালকান্তির হাত। সেটা পেয়ে আঁকড়ে ধরে বলল, ‘তোমার বোধহয় ভয় হত?’

‘কীসের ভয়?’

‘প্রফেসর নও এটা যদি জেনে ফেলি!’

‘হ্যাঁ হত। বুকের মধ্যে একটা জায়গা সবসময় কুঁকড়ে থাকত। সবার কাছে নানাভাবে চাপা দেবার চেষ্টা করে গেছি, মা এখনও জানে না। বাবা জানে আমি ফুলটাইমার নই, সামান্য টাকা পাই, তাই ইলেকট্রিক বিলের টাকা ছাড়া আর কিছু চাননি আমার কাছে। ওটাও নেন আমার মুখরক্ষার জন্য, যাতে আমি ভাবি, সংসারে কিছু দিচ্ছি। কিন্তু আমি জানতুম না তুমিও আমায় এত দিচ্ছ।’

‘কী দিচ্ছি?’

মৃণালকান্তি জবাব দিতে গিয়ে চুপ করে গেল।

‘বলো না, কী দিচ্ছি।’ স্বামীর ঊরুতে চিমটি কাটল মৌসুমী।

‘সহানুভূতি। এটা যে কী বিরাট ভরসা আর সাহস এখন আমাকে দিল, কী যে হালকা লাগছে নিজেকে! তুমি যে আমার পাশে প্রথম দিন থেকেই আছ এটা জানতুম না। বুক থেকে একটা পাষাণভার নেমে গেল।’

মৌসুমীর হাতের তালু নিজের বুকে চেপে ধরে মৃণালকান্তি বলল, ‘দেখো।’

মৌসুমী বুকে হাত বুলিয়ে বলল, ‘সেই জায়গাটা কই যেখানটা সবসময় কুঁকড়ে থাকত?’

‘ভালো করে না খুঁজলে পাবে কী করে?’

‘তা হলে খুঁজি।’ মৌসুমী গলা ধরে স্বামীকে টেনে আনল বুকের উপর।

‘আমি কিন্তু আর প্রফেসর নই এখন থেকে অতিথি—শিক্ষক। মনে থাকবে?’

.

পরদিন মৌসুমী দুপুরে ফোন করল। একবার বাজতেই রিসিভার উঠল তাইতে সে বুঝল পার্বতী ফোনের অপেক্ষায় ছিল।

‘কে, পার্বতী? আমি মৌ, আর গোলমাল হয়নি?’

‘হয়নি।’

‘একটু তাড়াতাড়ি উত্তর দেবে। শ্বশুর—শাশুড়ি ঘুমোচ্ছে, ওরা জানে না তোমার সঙ্গে কথা বলেছি, তবে আমার বরকে জানিয়েছি। শোনো পার্বতী তোমার কোনো দেবদাস আছে?’

‘মানে!’

‘মানে কখনো প্রেম করেছ?’

ওধারে চুপ। মৌসুমী বুঝল প্রশ্নের উদ্দেশ্যটা বুঝতে চাইছে। কিছু একটা ব্যাপার একসময় কারও সঙ্গে ছিল। লজ্জায় বলছে না।

‘কী হল চুপ কেন, আরে বলো বলো আমার সময় কম।’

‘হ্যাঁ।’ অস্ফুটে বলল পার্বতী। ‘তবে ওপর ওপর। কেন জিজ্ঞেস করছেন?’

‘ওই যে বললে যেদিকে দু—চোখ যায় চলে যেতে ইচ্ছে করে। তাই একটা মতলব আমার বরের মাথায় এসেছে। এ ছাড়া তোমার পক্ষে বাঁচার আর কোনো রাস্তাও দেখছি না। শোনো তোমাকে সাহসী হতে হবে, বেপরোয়া হয়ে একটা কাণ্ড করে ফেল তো।’

‘কী করব?’ গলাটাকে উৎসুক মনে হল মৌসুমীর।

‘সে লোকটা কে যার সঙ্গে ওপর ওপর মানে, কীরকম ওপর ওপর? তোমার কি মনে হয় এখনও সে তোমাকে মনে রেখেছে?’

‘জানি না। বিয়ের আগে বাড়িতে ফোন করত, দাদার সঙ্গে খুব ভাব ছিল, আমাদের পাশের পাড়ার। অন্য কেউ ফোন ধরলেই দাদাকে চাইত।’

‘চিঠিপত্র দিত?’

‘হ্যাঁ।’

‘তুমি দিয়েছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার কাছে ওর চিঠি আছে?’

একটু চুপ থেকে, ‘আছে।’

‘একসঙ্গে কোথাও গেছ?’

‘দু—বার সিনেমায়, ম্যাটিনি শোয়ে। তা ছাড়া স্কুলে যাবার সময় ও সঙ্গে সঙ্গে যেত।’

‘কতদিন এটা চলছে?’

‘ক্লাস এইট থেকে।’

‘শোনো পার্বতী, ওর বাড়ির লোকজন, অবস্থা কেমন? বিয়ে—থা হয়ে গেছে কি না জান?’

‘হয়নি। ওরা দুই ভাই, ও বড়ো, আর আছে বাবা মা। নিজেদের বাড়ি। বি এ পাশ। ছিট কাপড়ের দোকান আছে হাতিবাগানে। রাধা সিনেমার কাছে । দোকানটার নাম ‘ভগবতী’। ওর ঠাকুরমার নাম। ‘দ্রুত বলে গেল পার্বতী।

‘ওর নাম কী?’

‘প্রসাদ, ওরা বসাক।’

‘আমি যদি গিয়ে প্রসাদের সঙ্গে কথা বলি তাতে তোমার আপত্তি আছে?’

‘কী জন্য কথা বলবেন?’

‘তোমাকে বিয়ে করার জন্য।’

‘আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘হোক না, আবার করবে। মেয়েরা কি দু—বার বিয়ে করতে পারে না? পার্বতী, এই যে মার খাচ্ছ, আত্মহত্যা করতে যাচ্ছ এসব তো উচিত নয়। তোমার লেখাপড়া বেশিদূর নয়, ভালো কোনো কাজ তুমি পাবে না যে ডিভোর্স করে আলাদা থাকতে পারবে। হ্যাঁ, তোমাকে এই স্বামীর থেকে আলাদা হয়ে যেতে হবেই চিরকালের মতো। তুমি নিশ্চয় এই লোভী নিষ্ঠুর লোকটাকে ভালোবাস না।’

‘না। একদমই না। আমি যদি বিধবা হয়ে যাই তা হলে সুখে থাকব। ভগবানের কাছে এই প্রার্থনাই করি আমাকে বিধবা করে দাও।’ মৌসুমী এই প্রথম পার্বতীকে উত্তেজিত গলায় কথা বলতে শুনল। তার মনে হল কথাগুলো সে অন্তর থেকে বলল।

‘বিধবা হতে হবে না, সধবা থাকারই চেষ্টা করো! তোমার একটা আশ্রয় চাই। দেখি প্রসাদ সেটা দিতে পারে কিনা। ও কখন দোকানে থাকে জানো?’

‘তখন তো সকালে ওর বাবা দোকান খুলত, ও যেত দুপুরে, খেয়েদেয়ে সন্ধেবেলায় ভাই যেত। দু—জন কর্মচারী ছিল। আচ্ছা দিদি আপনি কবে যাবেন ওর সঙ্গে দোকানে দেখা করতে?’

‘দেরি করব না, কাল দুপুরেই তিনটে নাগাদ যাব। এখন ফোন রাখছি অনেকক্ষণ কথা হল।’

পরদিন দুপুর তিনটেয় মৌসুমী বাড়ি থেকে বেরোল। ইন্দ্রাণীকে বলে রেখেছিল হাতিবাগানে যাবে ব্লাউজের কাপড় কিনতে। অটোরিকশা নেবে কি না একবার ভেবে নিয়ে সে হাঁটতে শুরু করল। মিনিট দশেক পর হাতিবাগানের মোড়ের কাছে পৌঁছে সে অবাক হয়ে দাঁড়াল। ঢাকাই শাড়ি পরা, ঘোমটা দেওয়া শ্যামবর্ণা মিষ্টিমুখের যে বউটি ট্রাম স্টপে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে, ওই তো পার্বতী! কী আশ্চর্য ও এখানে কেন? প্রসাদের সঙ্গে দেখা করবে বলে!

‘তুমি বাড়ি থেকে এত দূরে একা এসেছ? সাহস তো কম নয়! বাড়ির কেউ জানে?’

‘পাগল। চুপি চুপি বেরিয়ে পড়েছি। আমি কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করব না। একবার শুধু ওকে দেখব বাইরে থেকে।’ পার্বতী হাসল।

ঝকঝক করে উঠল মুখটি। ‘একা বেরিয়েছি জানলে কপালে মার আছে।’ আবার সে হাসল।

‘দোকানটা নিশ্চয় তুমি আগে দেখেছ।’

‘দেখেছি।’

‘তা হলে দূর থেকে আমায় দেখিয়ে দাও। আর প্রসাদকে দেখতে কেমন?’

‘ফর্সা। বাঁদিকে পাট করে আঁচড়ানো চুল। ফুল হাত সাদা শার্ট পরত, এখনও পরে কি না জানি না—।’

‘ব্যস, ওতেই হবে।’

পার্বতী পনেরো গজ দূর থেকে ‘ভগবতী’কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে, সামনে মুখ তুলে সোজা হেঁটে চলে গেল, মৌসুমী দোকানে ঢুকল। ডানদিকে ইংরেজি ‘এল’ আকৃতির মতো লম্বা কাউন্টার, তার পিছনে দেওয়ালে দুই থাকে কাচের শো—কেস। নানা রঙের দামি ব্লাউজের কাপড় পাকিয়ে রিল করে এবং ভাঁজ করে সার দিয়ে দাঁড় করানো। কাউন্টারের উপর স্তূপ করা শার্ট ও ট্রাউজার্সের কাপড়। আর একদিকে বেডকভার ও পর্দার কাপড়। ফ্লুরোসেন্ট আলো কাচে প্রতিবিম্বিত হয়ে ঘরটা ঝকমকে দেখাচ্ছে। দিনের এই সময়ে দোকানে ক্রেতা কম থাকে, ভগবতীতে এখন একজনও খদ্দের নেই। মৌসুমী খুশি হল।

কাউন্টারের লোকটি এগিয়ে এল। এ যে প্রসাদ নয় দেখেই মৌসুমী বুঝল। বরং কাউন্টারের শেষ প্রান্তে মাথা নামিয়ে খবরের কাগজ পড়া টুলে বসা লোকটিকেই তার মনে হল প্রসাদ। গায়ের রং, চুল আর শার্ট পার্বতীর বলা বর্ণনারই মতো। লোকটি তাকে একবার দেখে নিয়ে আবার পড়ায় মন দিল।

‘ব্লাউজের কাপড় চাই রানি রঙের।’

কর্মচারীটি একটি কাপড় জড়ানো রিল বার করে গড়িয়ে দিয়ে মেলে ধরল। মৌসুমী আঙুল ঘষে কাপড়ের মসৃণতা পরখ করে বলল, ‘মিটার কত করে?’

‘আশি টাকা।’

‘এর থেকে ভালো আছে?’

ঘুরে দাঁড়িয়ে লোকটি আর একটা রিল বার করছে। মৌসুমী তখন চট করে দেখে নিল কাগজ—পড়া লোকটিকে। হাতে কাগজ ধরে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে।

‘এটা দেখুন একশো টাকা মিটার।’

পঁচাশি সেন্টিমিটার ব্লাউজের কাপড় কিনে লোকটির কথামতো বিলটা হাতে নিয়ে মৌসুমী দাম দিতে সরে গেল কাগজপড়ার দিকে। দাম দিয়ে খুচরো ফেরত নিয়ে সে ঝুঁকে বলল, ‘আপনি কি প্রসাদবাবু?’

খুবই অবাক হয়ে প্রসাদ বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘আপনি পার্বতীকে চেনেন?’

ভ্রূ কুঁচকে উঠল প্রসাদের, ‘চিনি। কেন?’

ফিসফিস করে মৌসুমী বলল, ‘পার্বতীর খুব বিপদ আপনার সাহায্য দরকার।’

‘বিপদ! আমার সাহায্য? কী ব্যাপার বলুন তো? আপনি কে?’

‘আমি ওর পাশের বাড়িতে থাকি। আমার নাম মৌসুমী। আপনি কি শুনেছেন ওর স্বামী লোকটি কেমন?

‘আহিরিটোলায় আমার চেনাশোনা অনেক লোক আছে তাদের কাছ থেকে আর আমার বন্ধু পার্বতীর দাদা পূর্ণেন্দুর কাছ থেকে যা শুনেছি তাতে তো ও একটা রাসকেল। বরং জানোয়ার বললেই ঠিক বলা হয়।’

মৌসুমী কর্মচারীটির দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করল। প্রসাদ তা লক্ষ করে বলল, ‘আপনি ভেতরে এসে কথা বলুন।’

কাউন্টার ঘুরে মৌসুমী ভিতরে গেল। প্রসাদ একটা টুল এগিয়ে দিতে সে দরজার দিকে মুখ করে বসল।

‘আপনি ঠিকই শুনেছেন লোকটা একটা জানোয়ারই। আমাদের বাড়ি থেকে ওদের ঘরটা দেখা যায়। দেখি তো পার্বতীকে যে কী মার মারে, দেখে শিউরে উঠতে হয়!’

মৌসুমী দেখল প্রসাদের মুখে বেদনার ছায়া পড়ল। খবরের কাগজটা মুঠোয় পাকিয়ে দুমড়ে ফেলল। ‘কেন, কেন এই অত্যাচার?’

‘টাকার জন্য।’

‘আমিও তাই শুনেছি পূর্ণেন্দুর কাছে।’

‘অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পার্বতী গলায় দড়ি দিচ্ছিল, আমি দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে না উঠলে ও ঠিক ঝুলে পড়ত। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।’ মৌসুমী তখন দেখল বড়ো করে ঘোমটা দিয়ে পার্বতী দোকানের সামনে দিয়ে চলে গেল। চট করে একবার দোকানের ভিতরে তাকিয়েও নিল।

‘ওকে এখন বাঁচাতে হবে আর আপনিই তা পারেন। আপনি কি ওকে অন্তর থেকে ভালোবেসেছিলেন?’

প্রসাদ আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল কে জানে! একটার পর একটা বিস্ময়ের ধাক্কায় সে বিভ্রান্ত হয়ে চলেছে।

‘ওসব কথা এখন আসছে কেন, পার্বতী এখন পরস্ত্রী।’

‘ওকে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে আর আপনিই পারেন ওকে বার করে আনতে।’

স্থির চোখে তাকিয়ে রইল প্রসাদ। মৌসুমী অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। দু—জন মহিলা ক্রেতা দোকানে ঢুকল। অবশেষে প্রসাদের চোখ নড়ে উঠল, পলক পড়ল।

‘বেরিয়ে এসে ও যাবে কোথায়?’

‘বাপের বাড়িতে। ওকে যাতে থাকতে দেয় সেই ব্যবস্থাটা আপনাকে করতে হবে আপনার বন্ধুকে বলে। হয়তো জানেন দু—বার ও বাপের বাড়িতে এসে আশ্রয় চেয়েছিল, বাবা—মা ফিরিয়ে দেয়। এবার যাতে ফিরিয়ে না দেয়ে সেটা আপনি করুন আর একটা কাজ করুন, মানবতার খাতিরে করুন, পার্বতীর ডিভোর্সটা। একজন উকিলের সঙ্গে কথা বলা দরকার, সেটাও আপনাকে করতে হবে।’

‘এতসব কাজ আমাকে কেন করতে হবে, আর কি লোক নেই?’ প্রসাদ অধৈর্য বিরক্ত গলায় বলে দাঁড়িয়ে উঠল। খদ্দেররা দাম দিতে এসেছে প্রসাদ সরে গিয়ে কাউন্টারের ড্রয়ার খুলল। মৌসুমী উঠে দাঁড়াল।

‘আপনার টেলিফোন নম্বরটা দিন পরে কথা বলব। যদি পার্বতীর সঙ্গে কথা বলতে চান তা হলে ওর নম্বরটাও দিতে পারি।’

‘দরকার নেই।’ প্রসাদ খবরের কাগজের ওপর দিকের সাদা অংশে তার মোবাইল ফোনের নম্বর লিখে ছিঁড়ে দিল। ‘রাত দশটার পর আর সকাল বারোটার আগে দরকার হলে করবেন।’

‘আমার সুবিধে দুপুরে। তখন তো দোকানেই থাকবেন।’ হাতব্যাগে কাগজের টুকরোটা রেখে ফিসফিস করে মৌসুমী বলল, ‘পার্বতী আপনাকে এখনও ভালোবাসে। আপনার চিঠিগুলো ও রেখে দিয়েছে।’ বলেই সে দরজার দিকে এগোল। দোকান থেকে বেরোবার সময় ফিরে পিছনে তাকিয়ে দেখল প্রসাদ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

বেরিয়ে এসে পার্বতীকে দেখতে পাচ্ছে না মৌসুমী। এদিক—ওদিক তাকিয়ে খুঁজল। ধরে নিল বাড়ি চলে গেছে। এতদূর তো একাই এসেছে একাই ফিরে যেতে পারবে, তা ছাড়া লুকিয়ে বেরিয়েছে, তাড়াতাড়ি ওর ফিরে যাওয়াও উচিত।

হাতিবাগান মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরেই সে দেখল ট্রাম স্টপে পার্বতী দাঁড়িয়ে। মুখ বিব্রত, থমথমে।

‘এখানে তুমি আর আমি খুঁজছি কোথায় গেলে!’

‘আমার এভাবে সিনেমা হলের সামনে হাঁটাহাঁটি করাটা ঠিক হয়নি। দুটো লোক পাশে এসে এমন অসভ্য কথা বলল আমি ভয় পেয়ে গেছলুম।’

‘কী অসভ্য কথা বলল?’ হাঁটতে হাঁটতে মৌসুমী বলল।

‘সে আমি বলতে পারব না। আমাকে খারাপ মেয়ে ভেবেছিল। যা লজ্জা করল। আমাকে দেখে কি রাস্তার মেয়ে মনে হয়?’

‘একদম নয়। লোকগুলোই খারাপ। এত দামি ঢাকাই শাড়ি রাস্তার মেয়ের পাবে কোথায়?’

‘এ শাড়িটা কেন পরেছি জানো? ও এটা দিয়েছিল আমার বিয়েতে।’

আড়চোখে ঝট করে মৌসুমী ওর মুখটা দেখে নিল। পার্বতীর চোখে আলো।

‘অনেকক্ষণ তোমরা কথা বলেছ, কী বলল?’

‘বিশেষ কিছু বলল না, শুনে গেল। বললুম পার্বতীকে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, ওর দাদাকে বলে বাপের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিন, ওর ডিভোর্সটাও যাতে হয় সেই চেষ্টাও করুন। বলল, এসব কাজ আমাকে করতে হবে কেন?’

কিছুটা হাঁটার পর পার্বতী বলল, ‘তুমি আর কিছু বলনি?’

‘আর কী বলব?’

‘ডিভোর্সের পর আর যেটা করতে হবে।’

‘না। দোকানে খদ্দের আসতে শুরু করল তখন ওসব বলার সুযোগ ছিল না। হুট করে কি সিরিয়াস কথা বলা যায়? ফোন নম্বর নিয়েছি, ফোনেই বলব।’

.

স্টেশনেই একটি ছেলে বলল, ‘স্যার যাচ্ছেন কোথায়, কলেজ তো বন্ধ।’

মৃণালকান্তি অবাক হয়ে বলল, ‘সে কী! এখনও ঘেরাও চলছে?’

‘ঘেরাও তো রাত দশটায় পুলিশ এসে ভেঙে দিয়েছে। সত্যবাবু অজ্ঞান হয়ে পড়াতে ওঁকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। তারপরই ম্যানেজিং কমিটির কেউ পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ প্রিন্সিপাল আর মন্মথবাবুকে ঘর থেকে বার করে নিয়ে আসে। আজ কলেজে এসে দেখলুম গেটে একটা নোটিশ লটকানো, অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ রাখা হল। আপনি আর গিয়ে কী করবেন, পরের ট্রেনেই বাড়ি ফিরে যান।’

বর্ধমানের ট্রেন আসছে। ছেলেটি ছুটল ট্রেন ধরতে। সত্যরঞ্জন ঘোষের বাড়ি বলদেবপুরেই। মৃণালকান্তির প্রথমেই মনে হল ওঁকে একবার দেখে আসা উচিত। তারপরই মাথায় ঘা দিল ছেলেটির কথাগুলো। অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ রাখা হল। তার মানে অফিসঘরও বন্ধ। কালোবাবুর সঙ্গে কবে দেখা হবে তার ঠিক নেই।

বলরামের দোকানের দিকে সে হাঁটতে শুরু করল। এখন এই লোকটিই তার ভরসা। ভাগ্যিস, কাল সে ওর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিল। এখন তো এই প্রাইভেটে ছেলে পড়ানোই তাকে বাঁচাবে। বলরাম এর মধ্যে কী ব্যবস্থা করল সেটার খোঁজ নেওয়া দরকার। করিতকর্মা লোক। বলা মাত্র হাতে পাঁচশো টাকা ধরিয়ে দিয়েছে যখন টাকাটা তুলে নেবার জন্য তখন চেষ্টা তো করবেই। কোচিংয়ের জন্য ঘর দিচ্ছে, ছাত্রও জুটিয়ে আনবে শুধু কিশোরকে গ্র্যাজুয়েট করার জন্য। হোক গ্র্যাজুয়েট।

দোকানে এসে মৃণালকান্তি আবার অবাক হল। লাল কালিতে বড়ো অক্ষরে লেখা একটা পোস্টার দরজায় সেঁটে ঝুলিয়ে দেওয়া—’ছাত্রদের জন্য সুখবর। অঙ্ক ও ইতিহাস শিক্ষার মহা সুযোগ। মধুসূদন বিশ্বাস সেন্টিনারি কলেজের সুযোগ্য ও শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক শ্রীমৃণালকান্তি চ্যাটার্জি, এমএ (গোল্ড মেডেলিস্ট) কলেজ ছুটির পর সপ্তাহে দু—দিন একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রদের অঙ্ক ও ইতিহাস কোচিং করবেন। অনুসন্ধান করুন এই দোকানে।’

‘গোল্ড মেডেলিস্ট’ দেখে মৃণালকান্তির কান গরম হয়ে উঠল। বলরাম বলল, ‘ঘর রেডি, ব্ল্যাক বোর্ড আজই পেয়ে যাব, রংটা শুকোতে দু—দিন সময় লাগবে। চেয়ার আছে, শেতলপাটিও আছে, টেবিলের কি খুব দরকার?’

‘হলে ভালো হয়, কিন্তু এটা কী লিখেছেন, ‘গোল্ড মেডেলিস্ট’? আমি গোল্ড কেন ব্রোঞ্জেরও মেডেল পাইনি।’

বলরাম ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, ‘চুপ চুপ। গ্রামেগঞ্জে এসব ভালো খায়, ইমপ্রেসড হয়। ওই যে শুভেন্দু ডাক্তার ওর এম বি বিএস—এর পাশে যে ডিজিএফ, ডিএমএস লেখা—এই নামে কোনো ডিগ্রি আছে নাকি? দেখুন গিয়ে চেম্বার ছাপিয়ে বাইরের রাস্তায় রুগি বসে।’

‘ওর এম বিবিএস—টা তো সত্যি।’

‘আপনার এমএ—টাও তো সত্যি। আপনি কি এখন কলেজে যাবেন? যা শুনছি তাতে কলেজ খোলার জন্য আন্দোলন হবে। আর সত্য ঘোষ যদি মরে—টরে যায় তা হলে এ কলেজ কত মাস যে বন্ধ থাকবে কেউ বলতে পারবে না। যত বন্ধ থাকবে তত আপনার কোচিংয়ে ছাত্র আসবে, ওদের তো পরীক্ষায় পাশ করতে হবে। আপনি ইংরেজি পড়াতে পারবেন? পারলে আপনারও রোজগার তিনগুণ বেড়ে যাবে।’

মৃণালকান্তি দ্রুত ভেবে নিল। বলরাম মন্দ পরামর্শ দেয়নি। সে বলল, ‘ভেবে দেখি। মাধ্যমিকের ইংরিজিটায় মনে হয় অসুবিধে হবে না, চালিয়ে দিতে পারব। ক্লাস ফাইভে এ বি সি ডি শেখা মাস্টারদের থেকে তো ভালো পারব। আপনাকে পরে জানাব। কিশোর কোথায়, সত্যবাবুর বাড়িটা চিনিয়ে দিত। ওকে একবার দেখে আসা উচিত।’

‘চলুন, আমি ওঁর বাড়ি চিনি, আমিও দেখে আসি। কয়েকবার ওঁর কাছে হাঁটাহাঁটি করেছি। সায়েন্সের লেকচারার। ইচ্ছে ছিল কিশোরকে ওর কাছে দিই। আসলে ওঁকে দিয়েই কোচিং খোলাব ভেবেছিলুম। আজ সকালে যা শুনলুম মনে হয় না উনি আর টিউশনির বাড়তি ধকল নিতে পারবেন।’ চলতে চলতে বলছিল বলরাম। হঠাৎ উত্তেজিত উৎসাহভরে সে বলে উঠল, ‘ভালোই হয়েছে। ওনার গোটা বারো ছাত্র আছে। সেগুলোকে আমাদের অঙ্কের কোচিংয়ে আনতে পারলে অনেক টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’

সত্য ঘোষের বাড়িটি একতলা। বাড়ির বাইরের দেওয়ালের আধখানায় প্লাস্টার হয়েছে। ছাদের কংক্রিট ঢালাইয়ের লোহার শিকগুলো এক হাত বেরিয়ে। টাকা জমিয়ে জমিয়ে সত্যবাবু বাড়িটি বানাচ্ছেন। এখন সকাল—বিকেল—রাত্রি তিন শিফটে পড়াচ্ছেন। রান্নাঘরের টালির চালটা এই মাসেই পাকা করবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন।

খাটে চিত হয়ে শুয়েছিলেন। ওদের দু—জনকে দেখে কাত হয়ে বিছানায় চাপড় দিয়ে সত্য ঘোষ বললেন, ‘বসুন, বসুন। কী পাপের ভোগ দেখুন, প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে আর মন্মথবাবুকে আর তখনই ধীরাজ হুড়মুড় করে দলবল নিয়ে ঢুকে পড়ল। তোরা তো প্রিন্সিপালকে ঘেরাও করতে এসেছিস আমাদের তা হলে ছেড়ে দে। দিল না। বললুম ডায়াবিটিস, ব্লাডপ্রেশার হাই, ইসকেমিক হার্ট। কে শোনে সে কথা! প্রিন্সিপাল জল খেতে চাইলেন, দিল না। মন্মথবাবু বাথরুম যেতে চাইলেন, দিল না। আমি পাখা চালাতে চাইলুম, দিল না। উৎকট বীভৎস গুমোট একটা পরিস্থিতি আর সেই সঙ্গে কানের পাশে স্লোগান।’

মৃণালকান্তি বলল, ‘বেশি কথা বলবেন না। এখন আপনার দরকার বিশ্রাম আর ঠিকমতো ওষুধ খেয়ে যাওয়া।’

বলরাম বলল, ‘দীর্ঘ বিশ্রাম। কম করে তিন মাস। কলেজে ছুটি নিন। বাড়িতে কোচিং বন্ধ করুন।’

‘ছুটি নিলে খাব কী? আঠারো বছর আগে মাসে একশো টাকায় ঢুকেছিলুম পার্ট টাইম লেকচারার হয়ে, আজও তাই। টাকাটা একটু যা বেড়েছে। গাধার মতো টিউশনি করে গেছি দিনে আট—ন ঘণ্টা। তার ফল এখন ফলছে। এত রকমের রোগ দেহে বাসা বেঁধেছে। এই কোচিংই আমার সংসারকে বাঁচিয়ে রেখেছে আর বলছেন কিনা বিশ্রাম নিতে! কথা কম বলতে?’ রাগ ক্ষোভ হতাশা সত্যবাবুর কথাগুলো থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে ঝরে পড়ল।

‘ডাক্তার দেখিয়েছেন?’ মৃণালকান্তি নরম গলায় সহানুভূতি দেখাল।

‘শুভেন্দুবাবু এসেছিলেন। প্রেশার মেপে বললেন নার্সিং হোমে ভরতি হয়ে যান, এখানে নয় শ্রীরামপুরে। অত পয়সা কোথায় যে নার্সিং হোমের টাকা গুনব। ভাবছি সরকারি হাসপাতালে ভরতি হব।’

বলরাম আঁতকে উঠল, ‘না, না, তার থেকে বাড়িতেই থাকুন সেবাযত্নটা অন্তত পাবেন।’

ফিরে আসার সময় বলরাম বলল, ‘তিন মাস কেন, তিন বছর বিশ্রাম নিলেও আর আগের মতো পারবেন না, অবশ্যি যদি বেঁচে থাকেন। মৃণালবাবু, আমার দালানটা বেশ বড়ো একসঙ্গে জনাতিরিশ বসতে পারবে। চলুন দেখবেন চলুন, এখনও তো দেখলেন না।’

‘তাই চলুন। অনির্দিষ্টকালটা যে কত দিনের জন্য কে জানে!’

.

সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে এল মৃণালকান্তি। নিজের ঘরে চা খেতে খেতে সে মৌসুমীকে বলল, ‘কলেজ বন্ধ করে দিয়েছে ম্যানেজমেন্ট কমিটি। চিন্তায় পড়ে গেছলুম, উদ্ধার করল বলরাম।’ মৌসুমীকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘যে কোচিং সেন্টারটা খুলব বলেছিলুম তার ঘর রেডি করে ফেলেছে বলরাম। লোক বটে একখানা, ওখানে সবথেকে বেশি ছাত্র পড়ায় আমাদের কলেজেরই সত্য ঘোষ, ফিজিক্সের লেকচারার, আমার মতোই পার্ট টাইমার। ভদ্রলোক কাল ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে গেছলেন। হার্টের রুগি চাপ সহ্য করতে পারেননি। অজ্ঞান হয়ে যান। ওঁকে দেখতে গেছলুম, সঙ্গে ছিল বলরাম। যা দেখলুম তাতে মনে হল না আবার আগের মতো কাজ করতে পারবেন। বলরামটা একটা শকুনি। নজর ভাগাড়ের দিকে, ভাগাড় মানে টাকা।’ খালি কাপটা মৌসুমীর হাতে দিয়ে বিছানায় গড়িয়ে পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরল মৃণালকান্তি। ‘ভালো কথা, ওখানে ইংরিজি মাস্টারের ভালো ডিমান্ড আছে। পড়ালে বেশ কিছু ছাত্র পাওয়া যাবে। তুমি কেমন ইংরিজি জান?র্’

‘কেন আমাকে দিয়ে পড়াবে?’

‘না, না, তুমি ওখানে যাবে কেন। তোমার কাছ থেকে স্কুলের ইংরিজির এখনকার ব্যাপারটা বুঝে নিতুম। কতকাল আগে পড়েছি, বারো—চোদ্দো বছর তো হবে।’

‘বলরামকে শকুন বলছ কিন্তু এই লোকই তোমার ত্রাণকর্তা হয়ে এখন দেখা দিয়েছে। এদের নিয়ে ঠাট্টা করো না। ওর গাইডেন্সেই চলার চেষ্টা করো। আমাদের এটাও কিন্তু টিকে থাকার লড়াই।’ কথা বলতে বলতে মৌসুমীর চোখ পড়ল মৃণালকান্তির ব্যাগটায়। ‘এ কী চুনের দাগ লাগল কী করে?’ শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘষে চুন তুলে বলল, ‘এটা সবসময় হাতে রাখবে।’

‘রাখব। তোমার পার্বতীর খবর কী?’

‘ওহ, বলতে ভুলে গেছি, আজ দুপুরে দেবদাসের দোকানে ব্লাউজপিস কিনতে গেছলুম।’

‘তুমি কিছু বললে?’

বললুম ওকে উদ্ধার করুন নইলে ও মরে যাবে, এখনও আপনাকে ভালোবাসে, এইসব। লোকটা মানে প্রসাদ বসাক দেখলুম চাঁদুকে জানে। চাঁদুর সম্পর্কে খবর রাখে। বলল, ও তো রাসকেল জানোয়ার।’

‘তাই নাকি! তা হলে উদ্ধার করতে এগোবে?’

‘কথা শুনে তো মনে হল না। ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল, এত কাজ আমাকে কেন করতে হবে, আর লোক নেই? পার্বতীর ফোন নম্বরটা নিল না, তার মানে কথা বলতে চায় না। তোমার কী মনে হচ্ছে?’

‘বোধহয় প্রেমট্রেম উবে গেছে। আর এটাও তো এক ঝামেলার ব্যাপার। মামলা—মোকদ্দমা, টাকা খরচ, দৌড়োদৌড়ি, কে আর পুরোনো প্রেমের জন্য এসব ঝক্কি পোয়াতে চাইবে!’

উদবিগ্ন স্বরে মৌসুমী বলল, ‘তা হলে পার্বতীর কী হবে?’

শিথিল গলায় মৃণালকান্তি বলল, ‘কী আর হবে, যেমন চলছে তেমনই চলবে। তুমি যেমন ফোনে কথা বলছ তেমনই কথা বলবে আর গলায় দড়ি দিতে দেখলে চিৎকার করে থামিয়ে দেবে। এ ছাড়া আর কী তুমি আমি করতে পারি? নিজের বাবা—মাই যদি ওর পাশে দাঁড়াতে না চায় আমরা তো পর।’

মৃণালকান্তির কথা শেষ হতে—না—হতেই দত্তবাড়ির দোতলা থেকে চাঁদুর কর্কশ চিৎকার আর বাসন ছোঁড়ার শব্দ উঠল।

‘ওই শুরু হল।’ মৌসুমী ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গেল। পার্বতীর ঘরের জানালা বন্ধ দেখে ফিরে এল।

‘দেখতে পেলে?’ মৃণালকান্তি হাতের ম্যাগাজিনটা নামিয়ে জানতে চাইল।

‘জানলা বন্ধ। কাল ফোন করব।’

পরদিন দুপুরে মৌসুমী ফোন করল।

‘কাল কী হয়েছিল? জানতে পেরেছে কি কোথায় গেছলে?’

‘না জানে না। রান্নায় নাকি নুন বেশি হয়েছে, আসলে নুন ঠিকই ছিল। মারধোর করার জন্য একটা ছুতো দরকার তো। দিদি ওর কাছ থেকে যে টেলিফোন নম্বরটা আনলে সেটা দেবে? আমি নিজে ওর সঙ্গে কথা বলব।’

প্রসাদের মোবাইল নম্বর দিয়ে মৌসুমী বলল, ‘দুপুরে কোরো তখন দোকানে থাকে।’

দিন তিনেক পর পার্বতী ফোন করল দুপুরে। মৌসুমী তখন টিভি দেখছিল শব্দ কমিয়ে। ফোনটা কাছেই ছিল, দ্বিতীয় রিং হবার আগেই তুলে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলল।

‘পার্বতী।’

‘খবর কী?’

ওধারে চুপ।

‘আরে খবর কী, ফোন করেছিলে দেবদাসকে?’

‘হ্যাঁ’। মৌসুমী ফোঁপানির শব্দ পেল। বুঝে নিল প্রসাদ নির্ঘাত বলেছে এত লোক থাকতে আমি কেন? বা এই রকম কিছু।

‘পরে কেঁদো, এখন বলো কী বলেছে?’

‘বলেছে অল্প বয়সে যা হয়েছে ওসব কেউ মনে করে রাখে না। ওরকম একটু—আধটু সবার জীবনেই ঘটে আবার ভুলেও যায়, তুমিও ভুলে যাও। বলল আর যেন ফোন না করি ওকে। দিদি আমি বিশ্বাস করেছিলুম ও আমাকে ভালোবাসে। এখন দেখছি ভুল ভেবেছিলুম—ভুল ভুল ভুল। মানুষ কীভাবে যে বদলে যায়!’

‘তা হলে তুমিও এবার বদলে যাও। সবথেকে ভালো হয় তুমি একা হয়ে যাও।’

‘তাই যাব।’ পার্বতী ফোন রেখে দিল।

মৌসুমী বিষণ্ণ বোধ করতে লাগল। টিভি বন্ধ করে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করতে শুরু করল নিজের বলা ‘একা হয়ে যাও’ কথাটা নিয়ে, কথাটা আলটপকা মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল কিন্তু এর কোনো মানে হয়? চেষ্টা করলেই কি একা হওয়া যায়? এজন্য মনের বিশেষ একটা অবস্থা তৈরি হওয়া দরকার সেটা পার্বতী পাবে কী করে? একা তো জগৎসংসার স্বামী স্বজনদের কাছ থেকেই হয়ে যাওয়া নয়, নিজের কাছ থেকেও একা হয়ে যাওয়া, এটা হতে পারার ক্ষমতা পার্বতীর নেই। সুতরাং যন্ত্রণার মধ্যে ওকে আজীবন বাস করতে হবে। এইরকম ভাবতে ভাবতে মৌসুমী ঘুমিয়ে পড়ল, বহুদিন পরে দুপুরে।

বিকেলে ঘুমটা ভেঙে গেল বিরাট একটা হইচইয়ের আওয়াজে।

‘ও বউমা শিগগির এসো, দেখে যাও।’

ইন্দ্রাণীর উত্তেজিত ডাক শুনে মৌসুমী ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। শাশুড়ি রান্নাঘর থেকে ডাকছেন। সে দ্রুত রান্নাঘরে গেল। শাশুড়ি জানলায় দাঁড়িয়ে।

‘দেখো দেখো, বউটার কাণ্ড দেখো!’

মৌসুমী যা দেখল তা স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো। দোতলার দু—ধারের ঘরের মাঝের বারান্দায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। আগুনের একদিকে লাল শাড়ি পরা পার্বতী, হাতে টিন, তাই থেকে কেরোসিন বা পেট্রোল ঢালছে বারান্দায় ছড়িয়ে ছড়িয়ে। আগুনের আর একদিকে দাঁড়িয়ে তার মেজো জা সঙ্গে দুটি ছোটো ছেলে। ওরা আগুনের ভয়ে চিৎকার করছে। পাশের বস্তির লোকেরা মুখ তুলে চেঁচাচ্ছে ‘দমকল ডাকুন, দমকল, নইলে সারা বাড়ি পুড়ে যাবে।’

মৌসুমী দেখল পার্বতী ঘরে ঢুকে দু—হাত ভরতি শাড়ি জামা প্যান্ট এনে আগুনে ছুড়ে দিল। আগুন আরও দাউদাউ করে উঠল। পার্বতী আবার ঘরের ভিতর গেল।

এবার টানতে টানতে যে জিনিসটা আনল তা দেখে মৌসুমী মুখে হাত চাপা দিয়ে দমবন্ধ হওয়া মানুষের মতো আর্তনাদ করে উঠল। জিনিসটা চাঁদু।

মৃত চাঁদুর দেহটা আগুনে ঠেলে দিয়ে ঘরে থেকে বিছানার চাদর বালিশ এনে চাঁদুর উপর রাখল। তিনতলা থেকে লোক নেমে এসেছে, একতলা থেকেও উঠে এসেছে। জা আর তার দুই ছেলেকে তারাই সরিয়ে নিয়ে গেল। পার্বতীর হাঁটাচলার মধ্যে মৌসুমী উন্মত্ততার কোনো চিহ্ন খুঁজে পেল না।

দমকলের ঘণ্টি শোনা গেল। উপরতলা আর নীচের তলা থেকে বালতি করে জল এনে ততক্ষণে আগুন নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। পার্বতী তখন শান্ত পায়ে রেলিংয়ের কাছে এসে দু—হাত মাথার উপর তুলল, যেভাবে পদক গলায় ঝুলিয়ে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে বিজয়ীরা দু—হাত তোলে। চেঁচিয়ে কী যেন বললও। মৌসুমী শুনতে পেল শুধু একটি শব্দ—’বিধবা’ আর দেখতে পেল মেঝেয় কাত হয়ে পড়ে থাকা চাঁদুকে।

পার্বতীর কাঁধ ঝুঁকে পড়েছে। অবসন্ন শরীরটাকে ধীরে বসিয়ে দিয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দিল। দুই হাঁটুর মধ্যে মুখটা গুঁজে রাখল। এবার ওকে ঘিরে দাঁড়াল বাড়ির ও বাইরের কয়েকটা লোক। পার্বতীকে কিছুক্ষণ পর মৌসুমী দেখতে পেল ওরা যখন দুটি বাহু ধরে ওকে ধীরে ধীরে নীচে নিয়ে গেল।

‘বিশ্বাস করতে পারছি না বউমা, এ কী দৃশ্য দেখলুম! কল্পনাতেও এমন ঘটনার কথা ভাবতে পারব না। এই দেখো এখনও আমার হাত—পা কাঁপছে।’ ইন্দ্রাণী দুটো হাত বাড়িয়ে ধরলেন। মৌসুমী দেখল সত্যিই আঙুলগুলো থরথর করছে। তরুণকান্তি বাড়ি নেই , চন্দননগরে বন্ধুর বাড়িতে গেছেন।

‘ওকে এখন কী করবে বউমা?’

‘পুলিশ হয়তো এসে গেছে। ওই দেখুন বলতে বলতেই—’

ওরা দেখল খাঁকি আর সাদা পোশাকে চার—পাঁচজন পুলিশ বারান্দায়। দু—জন ঝুঁকে রয়েছে দাঁদুর উপর বাকিরা ঘরে ঢুকেছে। একজন ঘর থেকে বেরিয়ে এল একটা বঁটি হাতে।

‘আর দেখতে হবে না। চায়ের জল বসাও।’

চা খেতে খেতেই এসে গেল রমার মা।

‘গেছলে নাকি ও বাড়িতে?’ ইন্দ্রাণী জানতে চাইলেন।

‘যাব না!’ রমার মা ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘ও বাড়ির দুটো ঘরে কাজ করি, যাব না? তোমরা তো সবই রান্নাঘর থেকে দেখেছ আমি দেখেছি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। এই এত কাছের থেকে।’ হাতটা বাড়িয়ে সে চার হাত দূরের একটা জায়গা দেখাল।

মৌসুমী বলল, ‘আমরা সব দেখিনি, ঘরের মধ্যে কী হয়েছে আমরা জানি না। পুলিশকে দেখলুম একটা বঁটি হাতে বেরোল।’

রমার মা গলা নামিয়ে গোপন খবর দেওয়ার মতো করে বলল, ‘আরে ওই বঁটি দিয়ে তো বউদি দাদাবাবুর নলিটা কেটেছে। দুপুরে বাড়ি এল মদে চুরচুর হয়ে। দোতলাতে উঠতে গিয়ে সিঁড়িতে পড়ে যায়। মেজো বউদি ধরে তোলে। ঘরে এসে বিছানায় ধপাস করে পড়েই বেহুঁশ। তখনই তো গলায় বঁটিটা বসায়, কী সাহস বলো তো! তুমি আমি পারব স্বামীকে এভাবে খুন করতে! তারপরই তো রান্নাঘর থেকে কেরোসিন তেলের টিনটা আনল। কালকেই আমি টিন ভরতি তেল এনে দিয়েছি, সবটা ঢেলেছে।’

‘ওকে পুলিশ নিয়ে গেছে?’ ইন্দ্রাণী বললেন।

‘যাবে না তো কি রেখে দিয়ে যাবে? শান্তশিষ্ট লক্ষ্মীমেয়ের মতো গুটিগুটি গিয়ে জিপে উঠল। আর দাদাবাবুকে কাটাছেঁড়া করতে নিয়ে গেল।’

রাত্রে মৃণালকান্তি বউয়ের পাশে শুয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা খুব ট্র্যাজিক, মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে, তোমার হচ্ছে না?’

মৌসুমীর মনে হল প্রশ্নটার জবাব না দিলেও চলে। সে বলল, ‘ও বিধবা হতে চেয়েছিল, সফল হল। অনেকেই কিছু একটা করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেও করে ফেলে, তারা কখনো একা হতে পারে না। পার্বতী কিন্তু সত্যিই আজ একা হয়ে গেল, নিজের কাছেও।’

 দুটি তিনটি ঘর

এক

সমবায় আবাসনটির নাম ‘আনন্দ নিকেতন’। সবাই ছোটো করে বলে আনন্দ। চারতলা পাঁচটি বাড়িতে আশিটি ফ্ল্যাট এই আবাসনে আছে, এর অর্ধেক দুই শয্যাঘরের বাকিগুলি তিন শয্যাঘরের। মফসসল কলেজের অধ্যক্ষপদ থেকে অবসর নেবার ছ—মাস আগে থেকে পূর্ণেন্দু গুপ্ত যখন তার স্ত্রী, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে কলকাতায় বসবাসের জন্য বাড়ি খুঁজছেন কিন্তু দামের অঙ্ক শুনে মুখ শুকিয়ে ফেলছেন তখন বাল্যবন্ধু কল্যাণ দত্তর সঙ্গে রাণাঘাট লোকাল ট্রেনে হঠাৎ তার দেখা হয়ে যায়। কথা প্রসঙ্গে কল্যাণ জানায় সে সল্ট লেকে বাড়ি করে বাস করছে এবং একটি বড়ো ব্যাঙ্কের মানিকতলা শাখার ম্যানেজার। তার শাখার এক কাস্টমার শুভেন্দু হালদার বাগমারিতে একটি সমবায় আবাসনের সেক্রেটারি। শুভেন্দু তিনদিন আগে কথায় কথায় তাকে বলেছিল তার আবাসনে এখনও একতলার দুটি ছোটো ফ্ল্যাট রয়ে গেছে। কিন্তু উচ্চচশিক্ষিত, ভদ্র এবং ভালো পদে চাকরি করে অথবা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার এমন লোককে ছাড়া সমবায়ের মেম্বার করানো হবে না এবং দু—কামরার ফ্ল্যাট নেবার জন্য তেমন লোক শুভেন্দু এখনও পায়নি।

ট্রেনে সেদিন কল্যাণ তাকে বলে সে যদি আগ্রহী হয় তা হলে ‘শুভেন্দুর কাছে কলেজ প্রিন্সিপালের নাম রেকমেন্ড করবে।’ পূর্ণেন্দু সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন বাল্যবন্ধুর দুটি হাত ধরে। উত্তর কলকাতার ভাড়াবাড়িতে ফিরে পূর্ণেন্দু খবরটা স্ত্রী মায়াকে দেন। সব শুনে মায়া প্রথমেই বলেন, ‘শোবার ঘর তো দুটো, একটায় রবু আর নবু শোবে, অন্যটায় আমরা দুজন, তাহলে ছায়া শোবে কোথায়? বাইরের লোকজন এলে বসবেই বা কোথায়?’

পূর্ণেন্দু বিব্রত হয়ে বলেন, ‘শোয়াশুয়ির কথা ভাবলে আমরা যা পুঁজি তাতে ফ্ল্যাট নেওয়া যাবে না।’

বিরক্ত হয়ে মায়া বলেন, ‘ফ্ল্যাট তো কিনব থাকার জন্য, তা হলে শোয়াবসার কথা আগে ভাবব না?’

পূর্ণেন্দু বোঝাবার চেষ্টায় বলেন, ‘আগে দরকার মাথা গোঁজার একটা ঠাঁই সেটা পেলে তখন শোয়াবসাটা ম্যানেজ করে নেওয়া যাবে। হয়তো একটু অসুবিধে হবে, তা হোক। ভাড়াবাড়ি নয় নিজস্ব মালিকানা। নতুন বাড়ি, নতুন পরিবেশ, নতুন প্রতিবেশী নতুন করে জীবন শুরু করা এটাই তো বড়ো লাভ।’

মায়া বলেন, ‘তা হোক নেবার আগে একবার গিয়ে দেখে আসা দরকার। তুমি কল্যাণবাবুকে বলো আমরা ফ্ল্যাটটা আগে দেখব।’

পূর্ণেন্দু অতঃপর কল্যাণের ব্যাঙ্কে যান খবর নিতে। কল্যাণ হাসিমুখে তাকে জানায়, ‘বলেছি তোর কথা শুভেন্দুবাবুকে। ওদের হাউজিংয়ে হেডমাস্টার আছে কিন্তু প্রিন্সিপাল নেই। রাজি হয়ে গেছে। আমি বুঝিয়ে বলেছি এডুকেশনিস্টরা মার্জিত নম্র ভদ্র হয়, সাতেপাঁচে থাকে না, ঝগড়া করে না, ঘোঁট পাকিয়ে দলাদলি করে না, যা হয় এইসব হাউজিংগুলোয়। তবে একটা কথা যেটা শুভেন্দুবাবু বলল, ওকে কিন্তু সব ব্যাপারে তোকে সাপোর্ট দিতে হবে। কমিটি গড়ার জন্য যখন ভোট হবে তখন ওর প্যানেলকে ভোটটা দিবি, অর্থাৎ তুই ওখানে ওর লোক হয়ে থাকবি।’

ঘাড় নেড়ে পূর্ণেন্দু সম্মতি জানিয়ে বলেন, ‘ফ্ল্যাটটা আগে কী একবার দেখা যায় না?’

‘কেন যাবে না? দাঁড়া ওকে পাওয়া যায় কি না দেখি। কেরোসিন স্টোভ তৈরির ব্যবসা করে, হয়তো এখন বাড়িতে আছে।’ কল্যাণ ফোন তুলে ডায়াল করল। পূর্ণেন্দু উৎকণ্ঠিত চোখে কল্যাণের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝলেন শুভেন্দু হালদার তার ফ্ল্যাটে রয়েছে।

‘শুভেন্দুবাবু? কল্যাণ দত্ত বলছি। আমার সেই প্রিন্সিপালবন্ধু যার কথা বলেছিলাম সে একবার ফ্ল্যাট দেখতে চায়।…আজই দেখাতে পারেন?’ ফোনের মুখে হাতটা চেপে কল্যাণ বলল, ‘হ্যাঁরে আজ যাবি?’

পূর্ণেন্দুর মনে চট করে ভেসে উঠল মায়ার বিরক্ত মুখটা। তিনি বলেন, ‘কাল সকাল দশটায় বল।’

কল্যাণ ফোনে কথাগুলো বলে উত্তর শুনে ফোন রেখে বলল, ‘তা হলে কাল দশটায় গিয়ে দেখে আয়। ‘আনন্দ কোথায়’ তোকে তো বলেই দিয়েছি। শুভেন্দুবাবু থাকে গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ দিকে বি ব্লকের দোতলায়, ফ্ল্যাট নম্বর চার। ওর থ্রি বেডরুম ফ্ল্যাট। তোর জন্য অপেক্ষা করবে।’

পরদিন সকাল পৌনে দশটায় কাঁকুড়গাছি রেল ব্রিজের পরের স্টপে ওরা দুজন বাস থেকে নামে। বাঁদিকে রাস্তা, দু—ধারে দোকান, বাড়ি। দুশো গজ গিয়ে ডান দিকের প্রথম রাস্তা ছেড়ে আরও দুটো বাড়ি পরে দ্বিতীয় রাস্তাটিতে তারা ঢুকল। তখন মায়া মন্তব্য করেন, ‘রাস্তাগুলো বেশ সোজা সোজা, নোংরা নয়।’ মিনিট দুয়েক হাঁটার পর প্রায় একশো গজ লম্বা পাঁচিল। মধ্যিখানে গাড়ি ঢোকার মতো চওড়া লোহার ফটক। তার পাশে একটা কাঠের বাদামি বোর্ডে চওড়া সাদা অক্ষরে লেখা ‘আনন্দ নিকেতন।’

ঢুকেই একটা ঘাসবিহীন ছোটো মাঠ। তার তিনদিকে পাঁচটি বাড়ি। বাড়িগুলোর মাঝে সাত—আট হাত করে ফাঁকা জমি। প্রতি বাড়িতে দুটি করে সিঁড়ি। প্রতি সিঁড়িতে আটটি ফ্ল্যাট। কল্যাণের নির্দেশমতো শুভেন্দু হালদারের ফ্ল্যাট খুঁজে নিতে পূর্ণেন্দুর অসুবিধে হল না। কলিং বেলের বোতাম টেপার আগে নিজের ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবির দিকে মুখ নামিয়ে দেখে নিলেন। জুতোজোড়া অল্পদিন আগে কেনা এবং চকচকে। বাঁ কাঁধের মুগার চাদরটি আর একবার বিন্যস্ত করলেন। মায়া অনেকদিন পর জরির চওড়া পাড় সাদা শাড়ি, তুলে রাখা চটি এবং সোনার বালাজোড়া পরেছেন। শুভেন্দু হালদার ওদের সাধারণ মধ্যবিত্ত যেন না ভাবে সে জন্য দু—জনে সাধ্যমতো যত্ন নিয়েছেন পরিচ্ছেদে।

দরজা খুললেন শুভেন্দু হালদার। পরনে ঢিলে পাজামা ও আদ্দির পাঞ্জাবি, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। আঙুলে দুটি আংটি। পূর্ণেন্দু প্রথমেই বুকের কাছে দুই করতল জোড়া করে নমস্কার করলেন, শুভেন্দু ডান হাতের মুঠো গলা পর্যন্ত তুলে নামিয়ে ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছি। এখুনি ফ্যাক্টরিতে যেতে হবে, একটা মেশিন বিগড়ে কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। চলুন আপনাদের ফ্ল্যাট দুটো দেখিয়ে আনি।’

আনন্দ নিকেতনের উত্তরের দুটি বাড়ির একটির একতলায় সিঁড়ির দু—ধারে ফ্ল্যাট দুটি। ঘরের জানলাগুলো বন্ধ ছিল। শুভেন্দু যখন জানলা খুলছে মায়া তখন ফিসফিস করে বললেন, ‘ঘরগুলো বড্ড ছোটো ছোটো।’ পূর্ণেন্দু জবাব দেননি।

শুভেন্দু একের পর এক দেখিয়ে বলে গেলেন, ‘এই কিচেন এই বাথরুম, এই ডাইনিং স্পেস, ওদিকে, একটা ছোটো বারান্দা রয়েছে দেখে যান।’

ওরা দু—জন ঘরের মধ্যে দিয়ে গিয়ে তিনহাত চওড়া একটা গ্রিলঘেরা বারান্দায় এলেন। পূর্ণেন্দু প্রফুল্লস্বরে মন্তব্য করলেন, ‘পূর্বদিকটা খোলা দেখছি।’

‘সদর দরজার পাশে যে ফালি জায়গাটা রয়েছে ওখানে একটা ছোটো সোফা একটা চেয়ার কী টেবল রাখা যেতে পারে, এটাকে বসার পারপাসে ইউজ করা যায়, এখানকার অনেকেই তাই করেছেন।’ শুভেন্দু পরামর্শ দিলেন।

ওরা মিনিট দশেক ছিলেন ফ্ল্যাটের মধ্যে। বাড়ি ফিরে এসে মায়া বলেন, ‘জামাকাপড় শুকতে দেওয়া হবে সমস্যা। চারতলার ছাদে কে উঠতে যাবে? বাইরে দিলে তো চুরি হবে। তার থেকেও বড়ো কথা রবু নবুর তো একদিন বিয়ে হবে তখন থাকবে কোথায়? ছায়া নয় বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে কিন্তু আমরা দুজন তখন থাকব কোথায়, ওই একচিলতে বসার জায়গাটায়?’

পূর্ণেন্দু একটু রেগে একটু হতাশ হয়ে বলেন, ‘তা হলে যেমন আছি তেমনই থাকি। যেদিন তিন বেডরুমের পাব আর কেনার জন্য পয়সা দিতে পারব সেদিনই নয় ফ্ল্যাট কিনব। রবু কি নবু বউ নিয়ে কী আলাদা থাকতে পারবে না?’

রবিন্দু তখন বিকম প্রথম বর্ষের ছাত্র, নবেন্দু স্কুলে একাদশ শ্রেণিতে পড়ে, ছায়া নবম শ্রেণিতে। সে দিন মায়া স্বামীর সঙ্গে তর্কে নামেননি শুধু মুখভার করে বলেছিলেন, ‘যা ভালো বোঝ তাই করো তবে মনে রেখো জীবনে কয়েকটা জিনিস আছে যা একবার করে ফেললে তা আর শুধরে নেওয়া যায় না।’

পূর্ণেন্দু বলেন, ‘যেমন?’

‘যেমন বিয়ে করা, যেমন বাড়ি করা।’

পূর্ণেন্দু হিসেব করে ঠিক করেছিলেন ছ—মাস পর রিটায়ার করে যে টাকা হাতে পাবেন তাই থেকে তিরিশ হাজার টাকা দিয়ে জাতীয় সঞ্চয়পত্র কিনবেন সেটা সাড়ে পাঁচ বছরে ডবল হবে তখন ছায়াও বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠবে। অবশ্য সব টাকাই তিনি ছায়ার বিয়েতে খরচ করবেন না। অতঃপর ফ্ল্যাট কেনার জন্য, শুভেন্দু হালদার যা বলল তাতে লাগবে চল্লিশ হাজার। এরপর যা হাতে থাকবে সেটা রেখে দিতে হবে। সংসারের হাল ধরার মতো ক্ষমতা হতে দুই ছেলের আরও অন্তত পাঁচটা বছর তো লাগবে।

হিসেবটা তিনি মনে মনে কষে রেখেছিলেন মায়াকে জানাননি। নতুন ফ্ল্যাটে মালপত্তর নিয়ে আসা এক ঝকমারির ব্যাপার। সেই ঝামেলাটা চমৎকারভাবে সামলায় রবিন্দুর কলেজের বন্ধু অমিয় বিশ্বাস। থাকে বৌবাজারে। অবস্থাপন্ন। বাড়ির কাছেই ওদের যে ফার্নিচারের দোকান, সেটা চালায় বাবা। অমিয় এখন থেকেই সেখানে বসছে। ছেলেটি চটপটে, চতুর ও মিশুকে। সব বিষয়েই কিছু না কিছু খবর রাখে। একটু বেঁটে, স্বাস্থ্যটা ভালোই এবং মুখ সুশ্রী। অমিয় দু—দিনেই মায়ার প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে।

বুদ্ধিটা অমিয়ই দিয়েছিল, ‘মেসোমশাই এমন একটা বাসা অমনি অমনি ছেড়ে দেবেন? জানেন এখন কলকাতায় ঘরের ডিমান্ড কেমন? আপনি ছাড়লেই বাড়িওলা পঞ্চাশ হাজার টাকা সেলামি নিয়ে এক হাজার টাকায় পুরো দোতলাটা ভাড়া দিয়ে দেবে। আপনি তো দিচ্ছেন মাসে তিনশো টাকা। আপনি উঠে গেলে বাড়িওলার কী লাভটা হবে ভাবুন! কিছু টাকা ওর কাছ থেকে আদায় করে নিন। এভাবে সবাই নেয়।’

পূর্ণেন্দু আপত্তি জানিয়ে বলেন, ‘না, না, না, এটা খুব অনৈতিক কাজ হবে। এভাবে টাকা নিলে আত্মমর্যাদা থাকে না, নিজের কাছে ছোটো হয়ে যেতে হয়।’

.

অমিয় পূর্ণেন্দুবাবুর গলার স্বর ও মুখের ভাব দেখে চুপ করে যায় কিন্তু মায়া মুখর হয়। ‘কী এমন অন্যায় কথা অমিয় বলেছে? বাড়িওলা যদি সেলামি নিতে পারে তা হলে আমরাও টাকা চাইতে পারি তাকে ঘর ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।’

সমর্থন পেয়ে অমিয় বলে, ‘টাকা যদি না দেয় তা হলে ঘরও ফেরত পাবে না, আমরা ভাড়াটে বসিয়ে দিয়ে যাব, নাও এবার ঠ্যালা বোঝো। মাসিমা বাড়িওয়ালা যদি বুদ্ধিমান হয় তা হলে হাজার দশেক তো দেবেই।’

‘দশ বাজার!’ মায়ার চোখ চকচক করে উঠেছিল। পূর্ণেন্দুকে তখন বলেন, ‘তুমি আজই হরেনবাবুর কাছে গিয়ে বলো, দশ হাজার পেলে ঘর ছেড়ে দেব।’

গোঁয়ারের মতো মুখ নামিয়ে পূর্ণেন্দু, ‘আমি পারব না’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। অমিয় বলল, ‘মাসিমা আপনি বাড়িওলাকে চেনেন?’

‘চিনি, কাছেই বেনেটোলায় থাকে।’

‘চলুন আমি আর আপনি গিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলি। এতগুলো টাকা যখন পেতে পারি তখন মিছিমিছি নৈতিকতার কথা তুলে ছেড়ে দেব কেন।’

মায়া এবং অমিয় হরেন রায়চৌধুরির সঙ্গে দেখা করে, পূর্ণেন্দু ঘুণাক্ষরেও তা জানেন না। ওরা পনেরো হাজার টাকা চেয়েছিল, পাঁচ মিনিটেই রফা হয়ে যায় দশ হাজারে। স্থির হয় মালপত্তর গাড়িতে উঠলে পর তখন ক্যাশ টাকা মায়ার হাতে দিয়ে হরেনের লোক ঘরগুলোয় তালা লাগিয়ে দেবে। ফিরে আসার সময় আপশোস করে অমিয় বলে, ‘মাসিমা লোকটা এভাবে রাজি হয়ে যাবে জানলে আর একটু বাড়িয়ে পঁচিশ হাজার বলতুম, তা হলে নির্ঘাত কুড়ি হাজার পাওয়া যেত।’

‘যাক গে, পড়ে পাওয়া ধন চোদ্দোআনা। তুমি কিন্তু বাবা, রবুকে এই ব্যাপারে একটি কথাও বলবে না। ও আবার বাপের ধাঁচ পেয়েছে।’

বত্রিশ বছরের ঘরকন্নার জমে ওঠা মালপত্র বাঁধাছাদা, লরি ও কুলি ভাড়া করে এনে তাতে তোলা, প্রায় একাই করল অমিয় অবশ্য রবিন্দু, নবেন্দু এবং ছায়াও তাকে সাহায্য দেয়। মালপত্রের সঙ্গে পূর্ণেন্দু লরিতে ড্রাইভারের পাশে বসেন চিনিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। দুই ছেলেও লরিতে ওঠে। রয়ে যায় মায়া এবং ছায়া। অমিয় ওদের ট্যাক্সিতে করে নিয়ে যাবে। তালা এবং টাকা নিয়ে হরেনের লোক তৈরি হয়েইছিল। টাকা যখন মায়া গুনছিল তখন ছায়া কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করে, ‘মা কীসের টাকা?’

মুচকি হেসে মায়া বলেন, ‘তোর বিয়ের গয়নার টাকা, বাড়িওলার কাছে জমিয়ে রেখেছিলুম।’

অমিয় হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ছায়ার বিয়েতে আপনাদের টাকা খরচ করতে হবে না মাসিমা। মেয়ে আপনার সুন্দরী, পাত্রপক্ষ সোনা দিয়ে মুড়ে নিয়ে যাবে।’

মায়া লক্ষ করলেন জিভ দেখিয়ে চোখে ছদ্ম কোপ প্রকাশ করে ছায়া হাতের মুঠি তুলে অমিয়কে দেখাল। দেখে তার ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠল।

.

দুই

নতুন আবাসে নতুন পরিবেশের সঙ্গে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে গুপ্ত পরিবারের অসুবিধা হল না। মায়া খুশি, কয়লার উনুনে রান্না করার বদলে তিনি এখন গ্যাসের উনুনে রাঁধেন, একটা দেশলাই কাঠি জ্বালালেই আগুন, রান্নাঘরেই চব্বিশ ঘণ্টা জল পড়ছে কল খুললে, মেঝেয় বসে খাওয়ার বদলে তারা এখন খায় চেয়ারে বসে টেবলে, রান্না করা খাবার থাকছে ফ্রিজে। অসুবিধা এবং বড়ো রকমের অসুবিধা স্থান সংকুলানের। রবু নবু একঘরে দুটো খাটে, বাকি তিনজন অন্য ঘরটায়। পূর্ণেন্দু সোফা কাম বেড কিনেছেন তাইতে শোন। সকালে উঠে এলেন গায়ে ব্যথা করছে। সরু ফালি জায়গাটা হয়েছে বসার ঘর, সেখানে রয়েছে একটা ছোটো সোফা, দুটো মোড়া আর একটা টেবলের উপর টিভি স্টে। সন্ধ্যা থেকে পূর্ণেন্দু টিভি দেখে সময় কাটান। এখন খবরের কাগজ ছাড়া আর কিছু পড়েন না। মায়ার হাঁটুতে বাত, বেশি চলাফেরা করলে যন্ত্রণা হয়।

আবাসনে দুর্গাপুজোর সময় পূর্ণেন্দু একটা ব্যাপারে উত্যক্ত হয়ে প্রতিবেশীদের কাছে চিহ্নিত হয়ে যান ‘ঝামেলার লোক’ বলে। সপ্তমীর সকাল থেকে মাইকে ইংরেজি গান বেশ জোরেই বাজানো হচ্ছিল। অ্যামপ্লিফায়ারের বাক্সটা তার ফ্ল্যাটের দিকে মুখ করিয়ে বসানো ছিল বারান্দার কাছেই। পুজোর সময়টুকু বাদে সারাক্ষণ বাজছিল, জানলাগুলো বন্ধ রেখেও শব্দের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছিল না। পূর্ণেন্দু সুরেলা গান পছন্দ করেন কিন্তু তার আবাল্য পরিচিত সুরের সঙ্গে এই ইংরেজি গানের সুরকে একদমই মেলাতে পারছিলেন না। তার মনে হচ্ছিল প্রচুর ঢাকঢোল বাজছে আর চিৎকার করে যাচ্ছে এক বা একাধিক বলির পাঁঠা। অষ্টমীর দুপুরে অসহ্য বোধ করে তিনি পুজো প্যান্ডেলে হাজির হন।

তিনটি কিশোর দুটি মহিলা চেয়ারে বসেছিল। পূর্ণেন্দু ছেলেদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ক্যাসেট চালানো এবার বন্ধ করো, শুনতে হয় নিজেদের ঘরে বসে শোনো। অন্যকে জ্বালাতন করা কেন?’

ছেলে তিনটে প্রথমে অবাক হয়ে শোনে তারপর একজন বলে, ‘কই আর কেউ তো বলেনি জ্বালাতন হচ্ছে!’

‘কেউ বলেনি তো কী হয়েছে, আমি বলছি।’ পূর্ণেন্দু অবাধ্য ছাত্রদের ধমক দেওয়ার মতো স্বরে বললেন। ‘এটা কী গান হচ্ছে? গানের কথাগুলো কী তোমরা বলতে পারবে?’

ছেলেরা চুপ করে রইল দেখে তিনি বললেন, ‘গানের কথাই যদি বুঝতে না পারলে তা হলে সে গান শুনে লাভ কী? বাংলা গান বাজাও, রবীন্দ্রসংগীত, পল্লিসংগীত কিংবা সানাই কী সেতার!’

একটি ছেলে বলল, ‘কথার থেকেও বড়ো জিনিস রিদম, আমরা রিদম শুনি। নেকিয়ে নেকিয়ে গাওয়া বাংলা গান, রবীন্দ্রসংগীত আর ভালো লাগে না।’

মহিলা দুজনের যিনি মধ্যবয়সি তিনি তখন বলেন, ‘পুজো তো মোটে চারটে দিনের জন্য। দু—দিন তো কেটেই গেল, আর দুটো দিন একটু কষ্টেসৃষ্টে কাটিয়ে দিন দাদা। পুজো তো ছেলেপুলেদের জন্যেই।’

‘মানছি কিন্তু বুড়োদের কথাটাও তো তাদের ভাবা উচিত।’ পূর্ণেন্দু যতদূর সম্ভব উত্তেজনা সংযত রেখে বলেন। ‘এই বক্সটা আমার বারান্দার সামনে থেকে সরিয়ে অন্যদিকে মুখটা ঘুরিয়ে বসাও। আর বাজাতে হলে ভল্যুম কমাও।’ এই বলে তিনি চলে আসেন। আধঘণ্টা পরে যখন তিনি দেখলেন বক্সটা সরল না, ভল্যুমও কমল না, তখন তিনি গিয়ে বক্সের মুখ বিপরীত দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে আসেন।

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন বিশ্বনাথ ঘোষ। তিনি মন্তব্য করেন, ‘ঠিক করেছেন দাদা, কানোর পোকা বার করে দিচ্ছিল।’

‘তা হলে প্রতিবাদ করেননি কেন?’ পূর্ণেন্দু কড়া চোখের মারফত ধমকালেন।

‘ছেলেছোকরাদের চটাবার দরকার কী!’ অপ্রতিভ বিশ্বনাথ এই বলে ঘরে ঢুকে গেলেন।

কিন্তু অন্য একটা কারণে মায়া চটলেন। ছায়া উচ্চচমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য দিন গুনছে। রবিন্দু ভালোভাবেই বিকম পাশ করেছে। পূর্ণেন্দু তার অধ্যাপকজীবনের প্রথম দিকের ছাত্র সুরেশ্বর বোসকে অনুরোধ করে তারা চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট অফিসে রবিন্দকে শিক্ষানবিশ করে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। নবেন্দু দ্বাদশ শ্রেণিতে উঠতে পারেনি এখন সে কলকাতার দ্বিতীয় ডিভিশন ফুটবল লিগে সবুজ সংঘের মিডফিল্ডার। উদীয়মান হিসাবে দু—তিনটি প্রথম ডিভিশন ক্লাবের রিক্রুটারদের চোখে সে পড়েছে। লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার জন্য পূর্ণেন্দু তাকে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। মায়া অবশ্য বলেছিলেন, ‘নবু লোকে বলবে কী! এমন বাপের এমন মুখ্যু ছেলে! অন্তত হায়ার সেকেন্ডারিটা পাশ কর। তোর বাবা মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছেন, বলছিলেন পঁয়ত্রিশ বছর পড়িয়ে কত ছাত্রকে শিক্ষা দিলাম আর আমার ঘরেই অশিক্ষিত তৈরি হল। প্রদীপের নীচেই অন্ধকার।’

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নবু চোখ কুঁচকে শুনল। তারপর বলল, ‘আমাকে নিয়ে বাবা, তুমি, দাদা আজ লজ্জা পাচ্ছে। কিন্তু আর তিন—চার বছরের মধ্যেই দেখবে মোহনবাগান কী ইস্টবেঙ্গলে যখন খেলব তখন আমাকে দেখিয়ে তোমরা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছ। লোকের কাছে তখন বলবে নবেন্দু গুপ্ত আমার ছেলে। লেখাপড়া তো টাকা রোজগারের জন্য। যদি ফুটবল খেলে বছরে পঞ্চাশ—ষাট হাজার টাকা রোজগার করতে পারি তা হলে ডিগ্রি দিয়ে আমার কী দরকার। ওই তো একজন ডিগ্রি বাগিয়ে অফিসে কলম ঘষে মাসে তিনশো টাকা পাচ্ছে, বছরে ছত্রিশ শো।’

‘রবু পার্মানেন্ট হবে ছ—মাস পরেই তখন শুরু হবে আটশো দিয়ে। তোর বাবা শুরু করেছিল দেড়শো দিয়ে। তুই কী ভেবেছিস তিরিশ—চল্লিশ বছর ধরেই বছরে পঞ্চাশ—ষাট হাজার টাকা ফুটবল খেলে আয় করবি? কিন্তু রবু করবে।’

‘তুমি জানো না মা, বড়ো ক্লাবে যারা যায় তারা একটা চাকরিও আদায় করে নেয়। আমি তো স্কুল ফাইনাল পাশ, চাকরি ঠিক পেয়ে যাব। কয়েকটা বছর শুধু অপেক্ষা করা।’ নবুর গলায় প্রত্যয় ফুটে ওঠে।

কিন্তু মায়া খুব ভরসা পেলেন না নবুর কথায়। নবু কেমন খেলে, কত বড়ো ফুটবলার হবে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। স্বামীর কাছে শুনেছেন, খেলে প্রতিষ্ঠা পাওয়া, অর্থ পাওয়া সবার ভাগ্যে জোটে না, এটা লটারির মতো। সবাই বড়ো প্লেয়ার হয় না কেউ কেউ হয়। হাজার হাজার ছেলে বড়ো হবার স্বপ্ন দেখে, বড়ো হয় একজন কী দু—জন। খবরের কাগজে কখনো নবুর নামও তিনি দেখেননি অবশ্য দ্বিতীয় ডিভিশনের খেলার রিপোর্ট কাগজে ছাপাও হয় না। কিন্তু নবেন্দু গুপ্ত একদিন কাগজের খেলার পাতার খবর হল।

পূর্ণেন্দু খবরের কাগজের খেলার পাতাটা খুঁটিয়ে পড়েন। এক রবিবার তার চোখ আটকে গেল একটা মোটা হেডিংয়ে—’রেফারিকে ঘুসি মেরে ফুটবলার গ্রেপ্তার।’ খবরের প্রথম বাক্যটি পড়েই তার মাথা ঝিমঝিম করে উঠল। ‘রেফারি বিপুল নাগকে ঘুসি মেরে পুলিশ হেফাজতে গেল সবুজ সংঘের ফুটবলার নবেন্দু গুপ্ত।’ এরপর তার হাতের কাগজ থরথর কেঁপে উঠল। কাগজটা শক্ত করে মুঠোয় ধরে পড়ে গেলেন: ‘শনিবার দ্বিতীয় বিভাগীয় খেলায় ওয়াই এমসিএ মাঠে মুখোমুখি হয়েছিল সবুজ সংঘ ও টালিগঞ্জ ইনস্টিটিউট। খেলা শেষের মিনিট তিনেক আগে টালিগঞ্জ গোলরক্ষকের সঙ্গে এক সংঘষে আহত হন সবুজ সংঘের বলাই দাস। মাঠে পড়ে থাকা বলাইকে ঘিরে সবুজ সংঘের ফুটবলারদের সঙ্গে হঠাৎই ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় রেফারি বিপুল নাগের। সেই সময় বিপুল সবুজের নবেন্দু গুপ্তকে রেডকার্ড দেখান। এরপরই নবেন্দু রেফারির কানের নীচে ঘুসি মারে। বিপুল তৎক্ষণাৎ ঘোড়াপুলিশের সাহায্য চান। ঘোড়াপুলিশ এসে নবেন্দুকে মাঠের বাইরে নিয়ে যায়। তারপর তারা নবেন্দুকে তুলে দেয় হেস্টিংস থানার পুলিশের হাতে। পরে অবশ্য তাকে জামিনে ছেড়ে দেওয়া হয়। প্রায় মিনিট দশেক বন্ধ থাকার পর খেলাটা কোনোক্রমে শেষ করেই আবার মাঠে শুয়ে পড়েন বিপুল। তাকে তখন অ্যাম্বুলেন্সে করে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পরই তিনি ছাড়া পেয়ে যান। হেস্টিংস থানার রাতে এফ আই আর করেছেন বিপুল। তার বক্তব্য, খেলা শেষের তিন মিনিট আগে টালিগঞ্জ গোলরক্ষকের সঙ্গে সংঘর্ষে বলাই পড়ে গেলে আমি স্ট্রেচার ডাকি। তখনই নবেন্দু আমায় গালাগালি করলে লালকার্ড দেখাই। কার্ড দেখাতেই ও আমায় মারে। বাধ্য হয়ে পুলিশকে ডাকি। নবেন্দু থানায় বসে জানান, জীবনে কখনো লালকার্ড দেখিনি। বলাইকে পড়ে থাকতে দেখে বললাম ও জল চাইছে। তাই নিয়ে কথা কাটাকাটি হতেই কার্ড দেখাল। তারপর পুলিশকে ডেকে নাম করে বলল আমার বার করে দিতে। আমি ওকে মারিইনি।’

এর পাশেই আর একটা সরু হেডিং : ‘সাসপেন্ড হচ্ছে নবেন্দু’। পূর্ণেন্দু সেটাতে চোখ রাখলেন : ‘রেফারি বিপুল নাগের ওপর সবুজ সংঘের ফুটবলার নবেন্দু গুপ্তর হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন আই এফ এ এবং সি আর এ—র কর্মকর্তারা। আই এফ এ সচিব বলেন, ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এখন রেফারির রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করবে আই এফ এ পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য। শৃঙ্খলারক্ষাকারী কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে ফুটবলারটির ব্যাপারে। রেফারির রিপোর্ট সোমবার আই এফ এ—তে জমা পড়বে।’

পূর্ণেন্দুর প্রথমেই মনে হল এই খবরটা অন্য সব কাগজেও নিশ্চয় বেরিয়েছে। আনন্দর সব ফ্ল্যাটেই কাগজ রাখে। প্রত্যেকে এটা পড়বে। তিনি মায়াকে ডেকে কাগজটা তার হাতে দিয়ে বললেন, ‘পড়ে দেখো। গুণধর ছোটো ছেলের কীর্তি।’ মায়া পড়লেন, পড়ে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন। পূর্ণেন্দু বললেন, ‘কাল অত রাত্রে ফিরল কেন, কারণটা এখন বুঝতে পারছ, নবু কী করছে?’ মায়া বললেন, ‘ভোরে উঠে বেরিয়ে গেছে, কিছু বলে যায়নি। আচ্ছা সাসপেন্ড হচ্ছে কথাটার মানে কী? আজীবনের জন্য খেলা বন্ধ করে দেওয়া?’ পূর্ণেন্দু মাথা নেড়ে জানালেন তিনি বুঝতে পারছেন না।

বেলা দশটা নাগাদ মোটরবাইকে দুজন লোক এল নবেন্দুর খোঁজে। পূর্ণেন্দু তাদের বসার ঘরে আনলেন। তারা প্রথমে নবেন্দু আছে কি না জানতে চাইল। নেই শুনে, তাদের মধ্যে লাল—কালো ডোরাকাটা স্পোর্টস শার্ট আর জিনস পরা বলিষ্ঠ চেহারার, গালে লম্বা একটা ক্ষতের দাগটানা যুবকটি নিজের পরিচয় দিল, ‘আমার নাম সমরেশ ঢালি, আমি সবুজ সংঘের কোচ আর ইনি হলেন বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি ক্লাবের সেক্রেটারি। কাগজে নিশ্চয় দেখেছেন কালকের ঘটনার কথা। নবাকে নিয়ে যত্তোসব আজেবাজে কথা লিখেছে, গপ্পো ফেঁদেছে। আপনি অযথা মন খারাপ করবেন না কাকাবাবু, সব ম্যানেজ হয়ে যাবে। ওই রেফারি আমাদের ওদিকেই বাগুইহাটিতে থাকে। একটু চমকে দিলেই ওর রিপোর্টের ভাষা বদলে যাবে।’

পূর্ণেন্দু অবাক হয়ে বললেন, ‘চমকে দেওয়া মানে!’

সমরেশও অবাক হয়ে তাকাল, তার ভাবখানা লোকটা তো আচ্ছা গাড়োল, চমকে দেওয়ার মতো সহজ কথাটার মানে জানে না? বলল, ‘চমকে দেওয়া হল একটু ভয়টয় দেখানো। বউ—বাচ্চচা নিয়ে সংসার, রেশন অফিসে চাকরি করে একদম ছাপোষ।’

‘কী ভয় দেখাবেন?’ পূর্ণেন্দু গম্ভীর স্বরে জানতে চেয়ে খবরের কাগজটা ভাঁজ করতে শুরু করলেন।

ধুতি পাঞ্জাবি পরা বছর চল্লিশ বয়সি সেক্রেটারি বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি এবার মুখ খুললেন, ‘আমরা প্রথমে রিকোয়েস্ট করব নবেন্দু যাতে সাসপেন্ড না হয় এমনভাবে রিপোর্ট লিখতে। একটা প্রমিসিং ফুটবলারের কেরিয়ারে যাতে দাগ না পড়ে।’

‘কিন্তু রেফারি তো থানায় নবুর বিরুদ্ধে এফ আই আর করে বলেছে নবেন্দু তাকে ঘুসি মেরেছে। এখন রিপোর্টে অন্য কথা লিখবে কী করে?’ পূর্ণেন্দু পালটা যুক্তি দিলেন।

‘লিখবে লিখবে কাকাবাবু লিখবে। দিনকে রাত করে দেবে রেফারি, যখন ওকে চ্যাংদোলা করে তুলে আনব। ওর বাচ্চচাকে সকালে স্কুলে পৌঁছে দিতে যায় ওর বউ, যখন বলব স্কুলে নয় বাচ্চচা অন্য কোথাও পৌঁছে যাবে তখন দেখবেন বিপুল নাগ রিপোর্টে লিখবে—থানায় বসে মাথা ঘুরছিল, কার নাম লিখতে কার নাম লিখে ফেলেছি ভিড়ের মধ্যে আমাকে ঘুসি মেরেছিল তাকে দেখতে পাইনি। এরকম রিপোর্ট রেফারিয়া আগেও প্রচুর দিয়েছে।’

পূর্ণেন্দু বিব্রত ও বিরক্ত মুখে কিছুটা ঝাঁঝালো স্বরে বললেন, ‘না না এভাবে একটা লোককে ভয় দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করাটা খুব অন্যায় কাজ হবে। আমি এটা অ্যাপ্রুভ করতে পারছি না।’

ওরা দুজন পরস্পর মুখচাওয়াচাওয়ি করল। বুদ্ধদেব একচোখ টিপে সমরেশকে কথা বলতে বারণ করে পূর্ণেন্দুকে নম্রগলায় বলল, ‘স্যার আপনি যখন বলছেন তখন মানতেই হবে। নবেন্দু এলে ওকে বিকেলের মধ্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে বলবেন। ওকে নিয়ে যাব রেফারির বাড়িতে। ক্ষমা চেয়ে যদি মন গলাতে পারে। এ ছাড়া তো ওর সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।’

‘তাই করুক। দোষ করলে অবশ্য শাস্তি পাওয়া উচিত।’ পূর্ণেন্দুর স্বরও নম্র হয়ে এল। ‘আমার ছেলে এমন একটা কাজ করে বসল, ভাবতে কষ্ট হচ্ছে।’

‘নবেন্দু ছেলে হিসেবে তো খুবই ভালো।’ বুদ্ধদেব নরম স্বরে বলল, ‘প্রায়ই তো আমাদের বাড়িতে আসে। বাড়ির প্রত্যেকে ওর প্রশংসা করে।’

পূর্ণেন্দু এরপর জিজ্ঞাসা করলেন সমরেশকে, ‘আপনি কোচিং ছাড়া আর করেন কী?’

‘একটা মিনিবাস আছে তা ছাড়া বিল্ডিং মেটিরিয়াল সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করি। কোচিংটা আমার সখের ব্যাপার। দু—বছর ইস্টার্ন রেলে খেলেছি। বাঘা সোমের কোচিংয়ে ছিলুম, ওর কাছ থেকেই যা কিছু শিখেছি। কাকাবাবু আপনার ফিগার দেখে মনে হচ্ছে একসময় খেলাধুলো করেছেন।’

পূর্ণেন্দু মনে মনে খুবই প্রীতবোধ করলেন, বললেন, ‘আরে না, না খেলাধুলো যা কিছু ওই ছাত্রাবস্থায়, কলেজ আর ইউনিভার্সিটির পর মাঠে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। ক্রিকেটটা যৎসামান্য খেলেছি, বঙ্গবাসীর টিমে ছিলুম।’

‘কাকাবাবু তা হলে আসি। বুদ্ধদার আবার এগারোটার সময় পার্টি মিটিং আছে, ওকে পৌঁছে দিতে হবে।’

দুজনে উঠল। পূর্ণেন্দু ওদের সঙ্গে বাইরে এলেন। মোটরবাইকের পিছনে বসে বুদ্ধদেব চ্যাটাজি বলল, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, ব্যাপারটা যাতে ভালোভাবে মিটে যায়। সেটা আমরা দেখব।’

মায়া দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন উৎকণ্ঠিত হয়ে। বললেন, ‘ওরা কী বলল?’

‘সবই তো আড়াল থেকে শুনেছ। ওই সমরেশ ছেলেটা খুব সুবিধের নয়, সঙ্গের লোকটাও। প্রথমে কীভাবে কথা শুরু করেছিল তারপর যেই আমি আপত্তি করলুম অমনি কথা ঘুরিয়ে নিপাট ভদ্দরলোক হয়ে গেল। বলে কিনা রেফারির বাচ্চচা ছেলেকে তুলে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেবে তার মানে কিডন্যাপ করবে!’

‘মেরে তো ফেলবে না।’ মায়া কথার সুরে বোঝালেন কাজটায় তার অসম্মতি নেই। পূর্ণেন্দু তীব্র দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।

‘মেরে হয়তো ফেলবে না কিন্তু বাপ—মার ওপর কী ভয়ংকর মানসিক অত্যাচার হবে সেটা মনে করার চেষ্টা করো।’

‘মানসিক অত্যাচার কী আমাদের ওপরও হচ্ছে না? অবশ্য বলতে পার অত্যাচারটা করছে আমাদেরই ছেলে। এখানকার পাঁচজনের কাছে মুখ দেখাতে হলে নবুকে নির্দোষী প্রমাণ হবে হবে আর সেটা সম্ভব রেফারির রিপোর্ট কেমন হবে তার ওপর। আমি তো কথা শুনে তাই বুঝলুম।’

‘ঠিকই বুঝেছ। তোমার চিন্তা হল পাঁচজনের কাছে মুখ দেখানো। আর তা দেখানোর জন্য একটা বাচ্চচাকে যদি গুম করে ফেলতে হয় তো ফেলুক, কেমন, তুমি তাতে অন্যায় কিছু দেখছ না।’ পূর্ণেন্দুর চোখে চাপা আগুন, গলায় চাপা ক্রোধ। মায়া সরে গেলেন স্বামীর সামনে থেকে।

নবেন্দু সেদিন আর ফিরল না। মায়া ভীত গলায় বললেন, ‘কিছু করে টরে বসল না তো।’ শুনে পূর্ণেন্দু ঠোঁট বাঁকালেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত বারান্দায় চেয়ারে বসে রইলেন মায়া, পথ চেয়ে। ছায়া বা রবিন্দু এই প্রসঙ্গে সারাদিনে একটি কথাও বলেনি, রাতে একটি ছেলে এসে জানিয়ে গেছল ‘নবু সমরেশদার বাড়িতে আছে, ওখান থেকেই কাল সোজা কোর্টে যাবে।’

সোমবার খামে ভরা সীলকরা রেফারির রিপোর্ট জমা পড়ল আইএফএ অফিসে কিন্তু খাম খোলা হল না। শৃঙ্খলারক্ষাকারী কমিটির সভায় খোলা হবে বলে তুলে রাখা হল। সোমবারই ব্যাঙ্কশালকোর্টে নবেন্দু হাজির হয়ে এক মিনিটেই জামিনে পেয়ে যায়, কোর্টে সবুজ সংঘের ফুটবলার ও কর্মকর্তারা হাজির ছিল।

সোমবার খুব সকালেই অমিয় আনন্দে এসে হাজির হয়। রবিন্দুকে সঙ্গে নিয়ে সে কোর্টে যাবে। তার চেনা উকিল আছে তাকে দিয়ে সে জামিনের জন্য আবেদন করাবে।

‘তোমায় কিছু করতে হবে না অমিয়, নবুর জন্য যা করার তা ওর ক্লাবই করবে।’ নিস্পৃহ স্বরে বলেছিলেন পূর্ণেন্দু।

মায়া প্রতিবাদ জানান, ‘যাবে না কেন, বাড়ি থেকে কারওর যাওয়া উচিত। তুমি যাবে না জানি, নীতিবাগীশ তো রবি তুই তো আবার বাপের মতো, তোর যেতে লজ্জা করবে না তো? অপিস আছে বলে পাশ কাটাসনি, ভাইয়ের বিপদ, এখন দাদার কর্তব্য পাশে দাড়ানো, অমিয়র সঙ্গে তুইও যা।’

ওরা যখন কোর্টে পৌঁছল নবেন্দু তখন জামিনে ছাড়া পেয়ে গেছে। যখন সে বেরিয়ে আসছে তখন কোর্টের গেটে তার সঙ্গে দেখা হল অমিয় ও রবিন্দুর। নবেন্দুকে ঘিরে জনাপনেরো লোক।

তাদের মধ্যে সমরেশও রয়েছে। সে নবেন্দুকে বলল, ‘এখন কোথায় যাবি, বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ, আমার দাদা এসেছে, ওই যে দাঁড়িয়ে।’ আঙুল তুলে সে রবিন্দুকে দেখাল। তিনজনকে ট্যাক্সিতে তুলে দিল সমরেশ। সারা পথে রবিন্দু শুধু একটাই প্রশ্ন করে, ‘সকাল থেকে কিছু খেয়েছিস?’

‘খিদে নেই।’

তিন

লাল কার্ড দেখার জন্য দুটি ম্যাচে বসে থাকা ছাড়া নবেন্দুর কোনো শান্তি হয়নি। কোর্ট তাকে বেকসুর খালাস দেয়, আই এফ এ—ও। রেফারির রিপোর্টে সেই কথাগুলিই ছিল সমরেশ যেমনটি বলেছিল পূর্ণেন্দুকে। খবরের কাগজে পড়ে তার সন্দেহ হয় নবেন্দুকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়ানো হয়নি, সমরেশ ও বুদ্ধদেবরা নিশ্চয় ভয় দেখিয়ে রিপোর্টটা লিখিয়েছে। এই সন্দেহটা তিনি মনের মধ্যেই গোপন করে রেখে দেন।

নবেন্দুর ব্যাপারটা নিয়ে আনন্দ আবাসনের একটি লোকও কৌতূহল দেখায়নি। খবরের কাগজ নবেন্দুর পক্ষ নিয়ে যা যা লিখেছে তারা সবাই পড়ে জেনেছে নবেন্দু গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার। বরং সে আবাসনের সহানুভূতিই পেয়েছে। পরের বছর নবেন্দু ক্লাববদল করে প্রথম ডিভিশনের উয়াড়িতে এসে হঠাৎই বিখ্যাত হয়ে গেল মোহনবাগান ও ইস্টবেঙ্গলকে একটি করে গোল দিয়ে। অবশ্য ম্যাচ দুটি উয়াড়ি হেরে যায়।

ফুটবল মরশুম শেষ হতেই নবেন্দুর কাছে ওই দুটি ক্লাবের লোকেরা আসা—যাওয়া শুরু করে। পূর্ণেন্দু এরপর বিশ্বাস করতে শুরু করেন, লেখাপড়ার দিকে এগোতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে তার ছোটো ছেলে ঠিক পথেই গেছে। মায়ার মাথায় নবেন্দু ‘যদি ফুটবল খেলে বছরে পঞ্চাশ—ষাট হাজার রোজগার করতে পারি’ বলে উচ্চচাশার যে ভিতটা তৈরি করে দিয়েছিল, সেটায় এবার তিনি দোতলা তুলে ফেললেন।

একদিন কথায় কথায় মায়া বললেন, ‘নবু একদিন বিয়েথা তো করবি, এ বাড়িতে বউ নিয়ে থাকবি কোথায়? আগে একটা বাড়ি করিস।’

ছায়া আর অমিয় সেখানে হাজির ছিল। ছায়া বলল, ‘না দাদা বাড়ি নয় ফ্ল্যাট, হাজার স্কোয়ার ফুটের।’

অমিয় বলল, ‘না না বাড়িই ভালো, মাসিমা ঠিকই বলেছেন, বাড়ি হল একটা নিজের ব্যাপার, নিজের রাজত্বে নিজে সম্রাট। ফ্ল্যাট বাড়ি তো পাঁচ ভূতের রাজত্ব। সিঁড়ির বালব ফেটে গেলে ছোটো সেক্রেটারির কাছে, দু দিন লাগবে বালব পালটাতে। গড়িয়ার দিকে এখনও জমি পাওয়া যাচ্ছে। আমরা দশ কাঠা কিনেছি অফিস ফার্নিচার বানাবার কারখানা করব বলে। এখন পাঁচ হাজার টাকা কাঠা, তিন কাঠা এখনই বায়না করে ধরে রাখো। লোকে এখন বাড়ি করার জন্য হন্যে হয়ে জমি খুঁজছে। জমির দামও হু হু করে বাড়ছে। নবু যা করার এখনই কর, হাজার দশেক টাকা দিয়ে বায়না করে ফেল। পরে ক্লাব থেকে অ্যাডভান্সের টাকা পেলে বাকি টাকাটা চুকিয়ে দিও।’

নবেন্দু চুপ করে মুখে হাসি লাগিয়ে শুনে যাচ্ছে। শুনতে তার ভালোই লাগছে। সে বলল, ‘বায়নার দশ হাজার এখনই পাব কোথায়?’

অমিয় নাটকীয়ভাবে চোখ সরু করে মায়ার দিকে তাকাল। মায়া অবাক হয়ে ভাবলেন, এ আবার কী!

‘মাসিমা ছায়ার বিয়ের গয়না কী গড়ে ফেলেছেন?’

‘কেন বলো তো?’ মায়ার জিজ্ঞাসু চোখ ধীরে ধীরে কঠিন হয়ে উঠল। তিনি ধরতে পেরেছেন অমিয় কেন একথা বলল। বাড়িওয়ালার কাছ থেকে নেওয়া দশ হাজার টাকাকেই খোঁচাচ্ছিল। খোঁচাটা জ্বালা ধরাল।

‘না এমনি বললুম।’ অমিয় নির্লিপ্ত করে নিল মুখভাব।

‘এমনি এমনি বললে?’ মায়ার চোখে স্ফুলিঙ্গ ছিটকে উঠল। সেটা এড়াল না অমিয়র নজর। সে প্রমাদ গুনল, বলল, ‘বিশেষ কিছু ভেবে বলিনি মাসিমা।’

‘ভেবে বলোনি? দেখ অমিয় ছায়ার বিয়ের গয়না গড়িয়েছি কী গড়াইনি তাই নিয়ে তোমার মাথা ঘামানোর কোনো দরকার নেই। বাইরের লোক তুমি, আমাদের ঘরের ব্যাপার নিয়ে বেশি মাথাব্যথা করো না। তুমি রবুর বন্ধু, দরকারের সময় আমাদের অনেক সাহায্য করেছ, ঠিক আছে। তাই বলে এতটা গায়েপড়া ভালো নয়।’ মায়া কর্কশ স্বরে গলায় তিক্ততা ঢেলে কথাগুলো বললেন।

মায়ার এমনভাবে ফেটে পড়ায় নবেন্দু এবং ছায়া বিস্ময়ের চূড়া স্পর্শ করল। তারা জানে মা খুব পছন্দ করে অমিয়দাকে। তলায় তলায় এতটা যে অপছন্দ করে কোনো দিনই বুঝতে পারেনি। মা যে ওকে ‘বাইরের লোক’ বলবে এটা তাদের কাছে কল্পনার বাইরে ছিল।

‘আমি অন্যায় করেছি মাসিমা, আমাকে ক্ষমা করবেন।’ অমিয় দু—হাত জোড়া করে বলল, মুখ শুকিয়ে গেছে এবং অপমানে কালো। মাথা নীচু করে সে বসে রইল। অস্বস্তিকর পরিবেশটা হালকা করতে প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য নবেন্দু বলে উঠল, ‘অমিয়দা তোমাদের দেশে যে নিয়ে যাবে বলেছিলে তার কী হল?’

অমিয় শুকনো হেসে বলল, ‘নিয়ে যাব। নতুন ব্যবসা এখন সারাক্ষণই লেগে পড়ে থাকতে হয়, দুটো দিনও বার করতে পারি না।’

নবেন্দু হালকা সুরে বলল, ‘বাড়ি করলে তোমাকে দিয়েই ইনটিরিয়র ডেকরেশনের কাজটা করাব।’

ছায়া থমথমে মুখে বসেছিল এবার সে দ্রুত ঘরে ঢুকে বালিশে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে পড়ল। পূর্ণেন্দু ফ্ল্যাটের বাইরে ছিলেন এখন ফিরলেন হাতে তেলে ভাজার ঠোঙা।

‘একটা লোক ফুটপাথে বসে ভাজছে, আগে কখনো দেখিনি। অনেকদিন পলতার বড়া খাইনি দেখে লোভ লাগল।’ তিনি ঠোঙাটা মায়ার সামনে ধরলেন। মায়া মাথা নেড়ে নিতে অস্বীকার করে বললেন, ‘অম্বল হবে।’ পূর্ণেন্দু অমিয়র সামনে ধরলেন, সে একটা বড়া তুলে নিল। নবেন্দুও একটা তুলল। তিনি নিজেও একটা নিলেন, চেয়ারে বসে চিবোচ্ছেন তখন অমিয় হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমি এখন যাই।’

‘অমিয়দা দু মিনিট, আমিও বেরোব।’ নবেন্দু দ্রুত ঘরে গেল জামা ও ট্রাউজার্স পরে নিতে।

‘আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।’ অমিয় এই বলে ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

নবেন্দু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজার দিকে যেতে যেতে মায়াকে বলল, ‘অমিয়দাকে এভাবে তোমার বাইরের লোক বলাটা উচিত হয়নি।’

পূর্ণেন্দু বিস্মিত চোখে তাকালেন স্ত্রীর দিকে। ‘কী বলেছ অমিয়কে?’

‘যা বলেছি ঠিকই বলেছি, বাইরের লোক নয়তো কী?’ মায়া নিজের অন্যায় বুঝতে পেরেও জেদ ধরে নিজেকে সমর্থন করলেন। ‘এমন একটা কথা বলল যে মাথা গরম হয়ে গেল, ছায়ার বিয়ের জন্য গয়না গড়িয়েছি কিনা! ছায়ার বিয়ে নিয়ে ওর কেন মাথাব্যথা তা কি আর বুঝি না? এ বাড়িতে এত আসা—যাওয়া এত মাসিমা মাসিমা করা সেকি আমার জন্য না রবুর জন্য। আস্তে আস্তে হাত বাড়াচ্ছিল ছায়ার দিকে।’

‘তাতে কী হল?’ পূর্ণেন্দু শেষ বড়াটা তুলে নিয়ে ঠোঙাটাকে মুঠোয় তালগোল পাকালেন, ‘ছায়াকে বিয়ে করতে চায়, এই তো।’

‘তুমি জানো অমিয় জাতে জেলে।’ মায়া তীব্র স্বরে বললেন।

‘তাতে কী হল!’ পূর্ণেন্দু তীব্র চোখে তাকালেন, ‘এইসব জাতগোত্তোর নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না, ঊনবিংশ শতাব্দীতে ঘামাতো। ছেলে হিসেবে অমিয় তো বেশ ভালোই। স্বাস্থ্যবান সুদর্শন, বাড়ির অবস্থা ভালো, নিজেও ব্যবসা শুরু করেছে, যথেষ্ট শিক্ষিত। তা হলে জাতের প্রশ্ন আসছে কেন?’

‘তুমি বলছ কী?’ মায়ার চোখ ফেটে বেরিয়ে এল আহত বিস্ময়। জেলের ঘরে মেয়ে দেবে? বামনু কায়েত হলেও নয় কথা ছিল। তোমার ভীমরতি ধরেছে আমার ধরেনি।’

মায়া ঝটকা দিয়ে চেয়ার সরিয়ে দাঁড়ালেন। রান্নাঘরে গিয়ে টিন খুলে আটা বার করে মাখতে শুরু করলেন। পূর্ণেন্দু বসার ঘরে এসে টিভি চালিয়ে দিয়ে পর্দার দিকে তাকিয়ে রইলেন। পর্দায় কী ভেসে উঠছে তা দেখতে পাচ্ছেন না। মাথার মধ্যে দপদপ করছে অন্ধ রাগ, তার মনের পর্দায় সায় দিয়ে ভেসে চলেছে মৃতদেহ, প্রত্যেকটাই মায়ার। কোনোটা মুণ্ডবিহীন ধড়। কোনোটার বুকে ছোরা বসান, কোনটা আগুনে পোড়া, কোনোটার শরীর পচে ফুলে উঠেছে। পূর্ণেন্দু টিভি বন্ধ করে সোফায় পা গুটিয়ে শুয়ে পড়লেন। শরীরটা কেমন করছে।

কলিংবেল বাজাল। মায়া দরজা খুললেন, রবিন্দু ফিরল। পূর্ণেন্দু শুনতে পেলেন মায়া জিজ্ঞাসা করছেন, ‘আজ যে তোর এত দেরি হল?’

‘বোস সাহেবের বাড়িতে গেছলুম। ওর ছোটো ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে, অঙ্কে কাঁচা। আমায় বললেন একটু দেখিয়ে দিতে। ওর সঙ্গেই গাড়িতে সল্টলেকে গেলুম। ছেলেটা সত্যিই কাঁচা। কী করে যে ক্লাস টেন পর্যন্ত উঠল কে জানে! আমি এখন আর কিছু খাব না, লুচি বেগুনভাজা খেতে দিয়েছিল, সন্দেশও।’

‘হঠাৎ তোকে কেন অঙ্ক পড়াতে বলল?’

‘আমার হায়ার সেকেন্ডারির মার্কশিট উনি দেখেছেন তো তাইতে ওর ধারণা হয়েছে অঙ্কটা আমি ভালো জানি।’

‘তোর সম্পর্কে তাহলে ওনার ধারণা ভালো।’

পূর্ণেন্দু, মায়ার গলায় চাপা উচ্ছ্বাসের আভাস পেলেন।

‘মনে তো হয় ভালো।’

‘রোজ পড়াতে হবে?’

‘তেমন কিছু বলেনি। আমি বললুম হপ্তায় দুদিন এসে অঙ্ক দেখিয়ে দিয়ে যাব। আমাদের এখান থেকে বাসে তো মিনিট দশেক সল্টলেকের বি সি ব্লক। অফিস থেকে বেরিয়ে সল্টলেক হয়ে বাড়ি ফিরব।’

জুতো খুলে জামা প্যান্ট বদল করতে করতে রবিন্দু কথা বলে চলেছে। চাকুরিদাতাকে খুশি করতে পারার জন্য প্রচ্ছন্ন একটা গর্ব ওর গলার স্বরে। পূর্ণেন্দুর কানে সেটা ধরা পড়ল।

মায়া জানতে চাইলেন, ‘কিছু দেবে টেবে বলল?’

‘বলেনি।’

‘তুই কিছু যেন বলতে যাসনি। যদি নিজে থেকে কিছু বলে তো বলুক।’

‘এরকম টিউশনিতে কত টাকা মাস্টারকে দেয়?’

‘একশো টাকা তো বটেই।’

‘টাকার কথা তুললে বলবি নোব না। একশো টাকা অবশ্য বোস সাহেবের কাছে কোনো টাকাই নয় কিন্তু ছেলের পাশ—ফেল করাটা মানমর্যাদার ব্যাপার। ছেলেটা পাশ করলে অফিসে তোর ভালোই হবে।’

পূর্ণেন্দু বাথরুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ পেলেন। রবু স্নান করতে গেল। এরপরই তিনি ছায়ার গলা পেলেন। মেয়েটা এতক্ষণ শোবার ঘরে বিছানায় মুখ গুঁজে শুয়েছিল।

‘অমিয়দাকে ওভাবে অপমান করাটা তোমার উচিত হয়নি মা।’ ছায়া একটা বোঝাপড়া করতে বেরিয়ে এসেছে ঘর থেকে। বি. এ. সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছে, এখন তার ব্যক্তিত্ব কিছুটা কঠিন হয়েছে। ‘এত বছর আসা—যাওয়া করছে, বাবাবাছা করে ওকে দিয়ে কতরকমের কাজ করিয়ে নিয়েছো, ওর কাছ থেকে কত উপকার পেয়েছো, তখন তোমার মনে ছিল না ও বাইরের লোক?’

পূর্ণেন্দু ইচ্ছে হল দেখতে এখন মায়ার মুখটা কেমন দেখাচ্ছে। রাগে চোখ দুটো দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে না জ্বরগ্রস্ত চোখের মতো স্তিমিত।

‘মনে ছিল না। কিন্তু সব রকম সম্পর্কেরই একটা সীমা আছে। কিন্তু ও সীমা ছাড়িয়ে কথা বলেছিল বলেই মনে পড়ল।’

‘কী কথা! সেই দশ হাজার টাকা নেওয়ার কথা তো? অমিয়দা আমাকে বলেছে কীভাবে ওই টাকা তুমি পেয়েছ। কীভাবে তুমি হরেন রায়চৌধুরীর কাছ থেকে টাকাটা আদায় করেছিলেন। আমার চোখের সামনে গুনে গুনে টাকা তুমি ব্যাগে ভরেছিলে।’

পূর্ণেন্দু কান খাড়া করলেন। তার মনে পড়ল অমিয় বলেছিল অমনি অমনি ঘর ছেড়ে দেবেন! কিছু টাকা বাড়িওয়ালার কাছ থেকে আদায় করে নিন, এভাবে সবাই নেয়, মায়া তখন অমিয়র কথাগুলোকে সমর্থন করেছিল। মায়া কী দশ হাজার টাকা আদায় করেছিল! আশ্চর্য, কিছুই আমি জানি না এতদিন ধরে।

‘যেভাবেই আমি টাকা আদায় করি না কেন, যেভাবেই আমি গুনে গুনে ব্যাগে ভরি না কেন তাতে তোর কী? গয়না আমি ঠিকই গড়িয়েছি আর সেটা তোরই জন্যে।’ মায়া প্রাণপণ চেষ্টা করছেন গলা চেপে কথাবলার জন্য। ছোটো ফ্ল্যাট একটু জোরে কথা বললে সব ঘর থেকে শোনা যাবে। এমনকী বন্ধ বাথরুমেও।

‘এতগুলো টাকা অমিয়দা না বলে দিলে তুমি পেতে না আর তাকেই বিনা বাইরের লোক বললে? ও যদি বাইরের লোক হয় তাহলে ভেতরের লোক কে?’

‘যেই হোক, জেলে কৈবত্তর ছেলেকে ভেতরের লোক করতে পারব না। তুই ওর হয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করছিস কেন তা কী আমি বুঝি না? কিন্তু জেনে রাখিস এই বদ্যি বংশের একটা মর্যাদা আছে, আত্মীয়স্বজনের কাছে মাথা উঁচু করে আমরা থেকেছি, থাকবও। এ বংশের সঙ্গে অমিয়র সম্পর্ক গড়তে আমি দোব না। তুই আর তোর বাবা যতই আধুনিক হোস এখনও জাত—বর্ণ—গোত্তর বংশ কৌলিন্যের দাম সমাজে আছে। ছায়া, সংস্কার মেপে চলতে হয়। লেখাপড়া আমিও কিছুটা শিখেছি।’ এতগুলো কথা গলা চেপে বলতে গিয়ে মায়া হাঁফিয়ে উঠলেন। শেষ দিকে কণ্ঠস্বরে অধৈর্য ফুটে উঠল। পূর্ণেন্দু ভাবলেন এখন ঘর থেকে বেরোবেন কি না, তাকে দেখলে মায়া হয়তো চুপ করে যাবে। বেরোতে গিয়ে দেখলেন বাথরুমের দরজা খুলে রবু একদৃষ্টে মায়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মায়াও একদৃষ্টে ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে, পূর্ণেন্দু ঘর থেকে বেরোলেন না, টিভি খুলে বসে রইলেন।

অমিয় আর এই ফ্ল্যাটে আসেনি, ছায়া বউবাজারে অমিয়দের দোকানে গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করে। টেবিলে মুখোমুখি বসে অমিয় নম্র কিন্তু কঠিনভাবে তাকে বলে, ‘উঁচুজাতের মেয়েকে বিয়ে করার বিন্দুমাত্রও ইচ্ছে আমার নেই। তুমি জাত—গোত্র মিলিয়ে কোনো ছেলেকে বিয়ে করে নিও। দেখতে সুন্দরী, লেখাপড়া শিখেছে, পাত্রের অভাব হবে না।’

ছায়া বলে, ‘আমরা তো রেজিস্ট্রি বিয়ে করে নিতে পারি।’

অমিয় বলে, ‘তা পারি। কিন্তু লুকিয়ে এভাবে বিয়ে করলে তো একরকম মেনেই নেওয়া হবে এই উঁচু জাত—নীচু জাত সংস্কারটাকে। আমি টোপর পরে সানাই বাজিয়ে নিজের জাতকুলের পরিচয় জানিয়ে বিয়ে করতে চাই। তোমার মা কি তা মেনে নেবেন?’

ছায়া মাথা নাড়ে। ‘বাবা মেনে নেবে কিন্তু মা নয়।’

‘তাহলে!’ অমিয় দু—হাতে টেবিল চাপড়ায়। ‘ল্যাঠা চুকেই গেল, তোমার মা—র ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাবা যেতে পারবেন না, আমি জানি।’

ছায়াও জানে। সে চুপ করে ছলছল চোখে শুধু তাকিয়ে রইল।

‘সংসারে অশান্তি গন্ডগোল পাকিয়ে লাভ কী ছায়া।’ অমিয় আড়চোখে দেখল দোকানের দু—জন কর্মচারীর একজন খাটে শিরিষ কাগজ ঘষছে, অন্যজন টেবিলে বার্ণিশ লাগাচ্ছে। ওরা তাদের দিকে বার বার তাকাচ্ছে। দোকানে খদ্দের নেই এখান থেকে কথাবার্তা ওদের কানে পৌঁছচ্ছে না বটে তবে ছায়ার চোখমুখের ভাব তো দেখতে পাচ্ছে। অমিয় অস্বস্তি বোধ করল।

‘তুমি এখন যাও ছায়া।’

‘তাড়িয়ে দিচ্ছ।’

অমিয়র এতক্ষণের কাঠিন্য, কণ্ঠের কর্কশতা এবার ভেঙে পড়ল। তার মুখে বেদনার আভাস ফুটে উঠল। গাঢ়স্বরে প্রায় অস্ফুটে সে বলল, ‘ছায়া এই বুকের মধ্য থেকে জীবনে কখনো তোমার ছায়া সরবে না। আমার কষ্ট আমার যন্ত্রণা আমার ভালোবাসা আজীবন তোমার ছায়াকে ঘিরে থাকবে।’ অমিয়র গলা কেঁপে উঠল। সে আলতো করে হাত রাখল টেবিলে রাখা ছায়ার হাতের উপর।

‘ভালোবাসার থেকেও বড়ো হল তোমার জেদটা।’ ছায়ার গলার অভিযোগ আর অভিমান।

অমিয় হাসার চেষ্টা করলে তাইতে মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল। ‘পুরুষ মানুষের অনেক রকম দোষ থাকে যেগুলো সে কাটিয়ে উঠতে পারে না বা চায় না তার একটা হল আত্মমর্যাদা বোধ। এটা নষ্ট হলে আমি আর আমি থাকব না।’

দোকানে ঢুকল এক প্রৌঢ় দম্পতি। তারা তিনটি ড্রেসিং টেবিলের একটির সামনে দাঁড়িয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করল। একজন কর্মচারী গেল তাদের কাছে। ছায়া উঠে দাঁড়াল, ‘আমি যাই। তবে জেনে রেখো মর্যাদাবোধটা মেয়েদেরও আছে। আমি আর কখনো আসব না।’

অমিয় ছায়ার সঙ্গে দোকানের দরজা পর্যন্ত গেল। ছায়া আর একটি কথাও বলল না, অমিয়র চোখে লহমার জন্যও চোখ রাখল না। দোকান থেকে বেরিয়ে সে ক্লান্ত মন্থর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। যতক্ষণ ওকে দেখা যায় অমিয় দেখল।

এরই দিন কুড়ি পর বিকেলে কলিংবেল বাজতে পূর্ণেন্দু দরজা খুললেন। এখানকারই এক গৃহিণী দাঁড়িয়ে থাকে তিনি সন্ধ্যাবেলায় আবাসনের মধ্যে একাকী প্রায় পনেরো মিনিট ধরে জোরে হাঁটতে দেখেন। সম্ভবত সুগারটা বেশি। চোখে চশমা, ফর্সা গায়ের রঙ, মুখ সুশ্রী। বয়স পঞ্চাশ পঞ্চান্নর মধ্যে। থাকেন বোধহয় তিন ঘরের ‘বি’ ব্লকের দোতলায় শুভেন্দু হালদারের পাশের ফ্ল্যাটে। পূর্ণেন্দু অবাকই হলেন। তার পাশের ফ্ল্যাটের বউটি ছাড়া গত ছ—বছরে আর কাউকে বিশেষ আসতে দেখেননি।

ভদ্রমহিলা ঘোমটায় ছোটো একটা টান দিয়ে লাজুকভাবে হাসলেন, বাধ্য হয়ে পূর্ণেন্দুও হাসলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল তার গেঞ্জির বগলটা ছেঁড়া।

‘মিসেস গুপ্ত আছেন?’

‘আছেন, ভেতরে আসুন।’

মায়া চা করেছিলেন, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এত দিন একসঙ্গে রয়েছি প্রায় রোজ তো আপনাদের দেখি অথচ আলাপ পরিচয় হয়নি।’

পূর্ণেন্দু প্রায় বলতে যাচ্ছিল, সেটা কী এতদিন পর মনে পড়ল। নিশ্চয় কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ইনি এসেছেন।

মায়া হেসে বললেন, ‘আমিও তো আপনাকে রোজ দেখি সন্ধেবেলায় আমার বারান্দার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। অবশ্য তখন আপনাকে দাঁড় করিয়ে আলাপ করা সম্ভব নয়। আসুন ঘরে আসুন।’

ভদ্রমহিলাকে নিয়ে মায়া বসার ঘরে ঢুকলেন। পূর্ণেন্দু শোবার ঘরে গেলেন পাঞ্জাবি পরে নিতে। ছায়া এখনও কলেজ থেকে ফেরেনি। অন্য ঘরে নবেন্দু এখনও ঘুমুচ্ছে।

‘চা করছি, খাবেন?’

‘আধ কাপ, চিনি ছাড়া।’

তখন পূর্ণেন্দু ঘরে ঢুকলেন। ‘আপনার কী সুগার বেশি?’

ভদ্রমহিলা স্মিত হেসে মাথা হেলালেন।

মায়া বললেন, ‘আপনার নাম কিন্তু এখনও জানা হয়নি। নাম না জেনে আলাপ করতে খুব অসুবিধে হয়। আমার নাম মায়া, ওনার নাম পূর্ণেন্দু আমাদের পদবি গুপ্ত।’

‘ওনার নামটা জানি আপনারটা জানতুম না। আমার নাম বাসন্তী দাসগুপ্ত। থাকি বি ব্লকে দোতলায় তিন নম্বরে। এই হাউজিংয়ে বদ্যি শুধু আমাদের এই দুটো পরিবার।’ বাসন্তী তাকালেন এমনভাবে যেন জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে ঘুরতে হঠাৎ লোকালয় দেখতে পেলেন। মায়া চা আনতে গেলেন।

‘এখানে আসার আগে আপনারা কোথায় থাকতেন?’ পূর্ণেন্দু আলাপটাকে সচল রাখার জন্য কথা পাড়লেন।

‘থাকতুম হাতিবাগানে। শ্বশুরদের শরিকি বাড়ি, খুব অসুবিধে হত।’

‘আপনার কথায় বাঙালে টান পাচ্ছি। দেশ কোথায় ছিল?’

‘বরিশালে, ঝালকাঠিতে। আপনাদের?’

‘গুপ্তিপাড়ায়।’

‘আমি এসেছি কিন্তু একটা বিশেষ প্রস্তাব নিয়ে।’ বাসন্তী ঘোমটায় চিমটি কেটে টান দিলেন। মুখে মৃদু হাসি ফোটালেন। পূর্ণেন্দু জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলেন। একটা প্লাস্টিকের ট্রে—তে তিন কাপ চা নিয়ে ঢুকলেন মায়া। দুজনে একটি করে কাপ তুলে নিল, মায়া তৃতীয়টি হাতে নিয়ে বসলেন।

‘বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আমি এসেছি।’ কাপে চুমুক দিয়ে বাসন্তী শুরু করলেন। ‘আপনাদের মেয়েটিকে আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের একমাত্র ছেলে সুকুমার এমটেক. পাশ করে বোম্বাইয়ে বিলিমোরিয়া অ্যান্ড ওয়াদওয়ানি নামে খুব বড়ো একটা কনস্ট্রাকশন ফার্মের প্ল্যানিং ডিভিশনে চাকরি পেয়েছে। আমাদের ইচ্ছে ও বোম্বে যাওয়ার আগেই ওর বিয়ে দিয়ে দি। আপনাদের মেয়ের নাম তো ছায়া, আপনারা বোধহয় সুকুকে দেখেছেন কিংবা দেখে থাকলেও হয়তো তেমন করে লক্ষ করেননি। সুকুরও পছন্দ হয়েছে ছায়াকে।’ টানা বলে গিয়ে বাসন্তী থামলেন। পূর্ণেন্দু মনে মনে তারিখ করল ওর গুছিয়ে বলার ভঙ্গি এবং উচ্চচারনকে, ইতিহাস বা অর্থনীতির ভালো ক্লাস নিতে পারবেন, এই মহিলা।

মায়া দ্বিতীয় চুমুক দিয়ে পূর্ণেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার চাহনিতে নির্দেশ, যা বলার তুমিই বল। নির্দেশটা আন্দাজে বুঝে পূর্ণেন্দু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘এতো আমাদের কাছে পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। কী বল?’ তিনি অনুমোদনের জন্য মায়ার দিকে তাকালেন।

‘নিশ্চয়’। অপ্রত্যাশিত আনন্দের ধাক্কায় মায়ার বুকের মধ্যে হাসফাঁস শুরু হল। তিনি কয়েকদিন ধরেই ভাবছিলেন অমিয়র প্রতি টানটা থেকে ছায়াকে বার করে আনতে হলে এখুনি ওকে একটা ভালো ছেলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া দরকার। বিএ পাশ করার জন্য অপেক্ষা করে থাকার নেই। ওদের সম্পর্কটা কতটা গভীর তা তিনি জানেন না। বিয়ের ব্যবস্থা করলে ছায়া বেঁকে বসবে কিনা, সেটাই শুধু তাকে উদবিগ্ন করে তুলল।

‘সুকুর এখন মাইনে হবে তিন হাজার টাকা, ফার্নিশড কোয়ার্টার পাবে। ওর ইচ্ছে একেবারে বউ সঙ্গে নিয়েই কাজে জয়েন করবে।’ গুপ্ত দম্পতির মুখভাবে আপ্লুত ভাব লক্ষ করে বাসন্তীর কণ্ঠস্বরে ভারিক্কি চাল এসে গেল।

‘কিন্তু ছায়া তো এখন সেকেন্ড ইয়ারে। গ্র্যাজুয়েশনটা তাহলে হবে না এখন বিয়ে হলে।’ পূর্ণেন্দু দোটানা ভাব দেখালেন।

বাসন্তী বললেন, ‘বোম্বাইয়ে গিয়েও তো পড়াশুনো চালাতে পারবে।’

মায়ার কপালে ভাঁজ পড়ল। পূর্ণেন্দু আবার পড়াশুনোর ফ্যাকড়া তুলল কেন? যত তাড়াতাড়ি ছায়ার বিয়ে হয়ে যায় ততই ভালো। এমন ছেলে হাতছাড়া করলে আর কী এত ভালো পাত্র পাওয়া যাবে। দরকার কী ছায়ার বি.এ. পাশ করার, ওতো আর চাকরি করতে যাবে না। মায়া তাড়াতাড়ি বাসন্তীর কথার খেই ধরে জুড়ে দিলেন, ‘বোম্বাইয়ে অনেক ভালো ভালো কলেজ আছে শুনেছি, ছায়ার কোনো অসুবিধে হবে না।’

পূর্ণেন্দু মায়ার কথার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘সুকুমারকে তো একবার দেখতে হয়, একটু আলাপ করতে পারলে ভালো হত।’

‘নিশ্চয় আলাপ করবেন। যাকে জামাই করবেন তাকে তো আগে যাচাই করে নেবেনই। আলাপ করে আপনি খুশিই হবেন। একটু লাজুক মুখচোরা, স্বভাবটা খুব শান্ত। গান ভালোবাসে, কোনোরকম নেশা নেই, সব সময় বই হাতে। আসুন না রবিবারে, উনি সিটি সিভিল কোর্টে চাকরি করেন। ছায়াকেও সঙ্গে করে আনবেন, সেও দেখুক তারও তো পছন্দের ব্যাপার আছে। আপনার বড়ো ছেলেটিও যদি আসে তাহলে খুবই ভালো হয়, ভারী সুন্দর দেখতে, সিনেমায় নামার মতো চেহারা।’

বাসন্তীর কথা থেকে দুজনেই বুঝল এই বিবাহ প্রস্তাবের পিছনের কারণ ছায়ার সৌন্দর্য। রবিন্দু এই আবাসনের সকলের চোখে পড়েছে। তার কান্তির জন্য।

‘বিয়েটা হলে, কবে দিতে চান?’ মায়া জানতে চাইলেন।

‘পয়লা ফেব্রুয়ারি আঠারোই মাঘ সুকুর জয়েনিং ডেট। চোদ্দোই মাঘ বিয়ের একটা তারিখ আছে সেদিনই হতে পারে।’ বাসন্তী জানালেন।

পূর্ণেন্দুর মনে হল বাসন্তী দাশগুপ্ত বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক করে বলতে এসেছেন। উনি ধরেই নিয়েছেন এই বিবাহ প্রস্তাব গুপ্ত পরিবার খারিজ করতে পারবে না, করার মতো জোরালো অবস্থা নয়। দু ঘরের ফ্ল্যাটে যারা বাস করে তাদের পুঁজিপাটা কতটা থাকতে পারে সে সম্পর্কে এই মহিলা যেন স্বচ্ছ একটা ধারণা তৈরি করে রেখেছেন। পূর্ণেন্দুর ইচ্ছে করল বিয়েটায় রাজি না হয়ে ধারণাটা ভেঙে দিতে। চার—পাঁচ সেকেন্ড পরেই তিনি ইচ্ছেটা প্রত্যাহার করে নিয়ে হাঁফ ছাড়লেন। মনে মনে নিজেকে বললেন বয়স হয়েছে, এখন তুমি অবসরপ্রাপ্ত এখন যে কোনোরকম হঠকারিতা তোমার বা পরিবারের পক্ষে হিতকর হবে না। তুমি এখন আর কলেজের প্রিন্সিপ্যাল নও, এই মহিলাও তোমার ছাত্রী নন। এর ছেলেটি সোনার টুকরো তার সঙ্গে তোমার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সুযোগটা নষ্ট কোর না।

মায়া চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘মাঘ মাস তো এসে গেল আর তো মাত্র ক—টা দিন হাতে। এর মধ্যে সবকিছু জোগাড়যন্ত্র করা তো সম্ভব হয়ে উঠবে না।’

বরাভয় দেবার ভঙ্গিতে বাসন্তী ডান হাত তুলে বললেন, ‘আরে রাখুন তো জোগাড়যন্ত্র। শুধু শাঁখা সিঁদুর দিয়েই বউ নিয়ে যাব। ঠাকুরের কৃপায় আমার কোনো অভাব নেই।’ বাসন্তী উঠে দাঁড়ালেন। ‘ছায়া বোধহয় কলেজে, কোনোদিন কথা বলা হয়নি ওর সঙ্গে। রবিবার বিকেলে তাহলে আসছেন বড়ো ছেলে আর ছায়াকে নিয়ে।’

বাসন্তীকে বাড়ির বাইরে মাঠ পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন পূর্ণেন্দু ও মায়া। ফ্ল্যাটে ফিরে এসে পূর্ণেন্দু বললেন, ‘কথা থেকে মনে হল আমাদের সম্পর্কে ভালোই হোমওয়ার্ক করে তবে এসেছেন। নবুর নাম পর্যন্ত করল না। থানা পুলিশ কোর্ট জামিন করেছে বলেই বোধহয় ক্রিমিনাল তাই নবুকে যেতে বলল না। কিন্তু আমরা তো ওদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। ওরা বদ্যির ছদ্মবেশে নমোশুদ্দুর কিনা, ছেলেটি আসলে এম. টেক. না হায়ার সেকেন্ডারি, বোম্বাইয়ের চাকরিটা বেয়ারার না প্ল্যানারের এ সবের খবরাখবর নেওয়া দরকার, কিন্তু কে নেবে? ছেলেটিকে শুধু চোখের দেখা দেখে আর দুটো কথা বলেই কী সব জানা বোঝা হয়ে যায়? শরীরে কোনো রোগ—টোগ আছে কিনা সেটাও তো জানা যাবে না। তবু ভালো কুষ্ঠি—ঠিকুজির কথা তোলেনি।’

.

‘হ্যাঁ এতেই সব জানা বোঝা হয়ে যায়।’ মায়া হালকা গলায় বললেন। এখন তার সারা দেহে বইছে স্বস্তির আর সুখের প্রবাহ। ছায়ার জন্য এমন একটা সুপাত্র বাড়ি বয়ে এসে ধরা দেবে, এমন ব্যাপার তো রূপকথার গল্পেই ঘটে। ‘আমার বাবা তো তোমাকে মিনিট দশেক দেখেই পছন্দ করেছিল, বাড়িতে এসে বলেছিল একটা ভালো ছেলে পেয়ে গেছি।’ মায়া অনেকদিন পর তার যৌবনকালের হাসি হাসলেন।

পূর্ণেন্দু বললেন, ‘ছায়ার মতামতটা আগে নেওয়া উচিত। আমরা রাজি হলেই তো হবে না যার বিয়ে তাকে আগে জিজ্ঞাসা করা দরকার। তোমাকে করেনি?’

‘না।’ মায়া জবাব দিয়েই যোগ করলেন, ‘বাবার পছন্দ হয়েছে তারপর আর জিজ্ঞাসা করার কী থাকতে পারে!’

‘এখন অন্যরকম দিনকাল, ছায়ার মতটা জানা দরকার। তোমার আমার পছন্দ হলেই তো হবে না। মেয়েরও নিজস্ব পছন্দ আছে।’

‘মত জানতে তুমিই ওর সঙ্গে কথা বল।’ মায়া দায়টা স্বামীর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেও তাকে নিশ্চিন্ত দেখাল না।

আধঘণ্টা পর ছায়া কলেজ থেকে ফিরল। তারও আধঘণ্টা পরে পূর্ণেন্দু ছায়াকে ডাকলেন।

‘আজ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে। বিকেলে কলিংবেল বাজতে দরজা খুলে দেখি এখনকার এক মহিলা দাঁড়িয়ে। তুই নিশ্চয় তাকে দেখেছিস, বি ব্লকের দোতলায় চার নম্বর ফ্ল্যাটে থাকে।’

ছায়া বলল, ‘দাসগুপ্ত?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’

‘ওদের মেয়ের সঙ্গে অনেকদিন আগে একবার পরিচয় হয়েছিল, ডাল, বেশিক্ষণ কথা বলা যায় না। খুব সিনেমা দেখে আর শুধু তারই গপ্পো। মহিলা মানে ওর মা এসেছিল, হঠাৎ?’

‘ওর একটি ছেলে আছে তারই জন্য বিয়ের সম্বন্ধ করতে।’ কথাটা বলে পূর্ণেন্দু মেয়ের মুখভাব লক্ষ করতে লাগলেন, ছায়ার কৌতূহলী মুখ পলকের জন্য গম্ভীর হয়ে স্বাভাবিক হল।

‘সম্বন্ধ কি আমার সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য?’ সহজ স্বরে ছায়া জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ।’ পূর্ণেন্দু আটকে যাওয়া শ্বাসটা স্বস্তিতে বার করলেন। ‘ছেলেটি লেখাপড়া করেছে। এম. টেক.। বোম্বাইয়ে ভালো একটা চাকরি পেয়েছে। ওখানেই থাকবে। ছেলেটিকে নিশ্চয় দেখেছিস, সুকুমার নাম।’

স্বাভাবিক স্বরে ছায়া বলল, ‘হ্যাঁ দেখব না কেন। ভালো ছেলে। তুমি দেখেছ?’

‘হয়তো দেখেছি। এখানে তো কতই ছেলে রয়েছে। আমার পক্ষে ছেলেছোকরাদের সঙ্গে আলাপ করা তো সম্ভব নয়। রোববার ছেলেটিকে দেখতে যাব। কিন্তু তার আগে তোর মতামত আমাদের জানা দরকার। অমত থাকলে ওদের জানিয়ে দেব আর মত থাকলে দেখতে পাব।’ পূর্ণেন্দু অনুভব করছেন জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবার ছায়াকে নিতে হবে। যদি হ্যাঁ বলে তাহলে তো সমস্যার কিছু থাকবে না। যদি না বলে তাহলে সমস্যা তৈরি করবে ওর মা।

‘তুমি বললে বিয়ের পর বোম্বাইয়ে থাকবে, তাই তো?’ ছায়া যাচাই করার জন্য প্রশ্নটা করল।

‘হ্যাঁ তাই তো বললেন ভদ্রমহিলা।’

ছায়া দ্বিতীয়বার আর ভাবল না, বলল, ‘আমার আপত্তি নেই। তুমি রোববার গিয়ে ছেলে দেখে আসতে পার।’

‘তোকেও যেতে হবে। উনি চান তুইও সুকুমারের সঙ্গে আলাপ করিস। রবুকেও যেতে বলেছেন।’

ছায়া অসহায়ের মতো গলায় বলল, ‘আমি আবার কী আলাপ করব। বিয়ে যখন হবেই তখন এইরকম আলাপটা একেবারেই ফালতু ব্যাপার। ধরো আলাপ করে খুব খারাপ লাগল, তাহলে কি সম্বন্ধ ভেঙে যাবে?’

পূর্ণেন্দু জবাব দিলেন না। ছায়ার নিস্পৃহভাবে কথা বলার ধরনটা তাকে ভাবাল। বিয়ের কথায় যে স্বাভাবিক লজ্জা মেয়েদের চোখেমুখে আলতো একটা মেদুর প্রলেপ লাগায় ছায়ার মুখে বা কণ্ঠস্বরে তার ছিটেফোঁটাও তিনি পাচ্ছেন না। ও কি বাবা—মাকে খুশি করার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হল!

‘তুই ভেবে চিন্তে মত দিচ্ছিস?’

‘হ্যাঁ দিচ্ছি। বিয়ে একদিন না একদিন তো করতেই হবে।’

‘রোববার আমরা তাহলে যাচ্ছি, তুইও।’

রবিবার বিকেলে সদরে তালা দিয়ে ওরা চারজন দাসগুপ্তের ফ্ল্যাটের উদ্দেশে রওনা হল। বেরোবার আগে মারা আলমারিতে রাখা শাড়ির তলা থেকে, পূর্ণেন্দু পাঁচ বছর আগে কলেজে যেতেন যে পাটকরা চাদরটি বাঁ কাঁধে ফেলে, সেটি বার করে হাতে দিয়ে বলেন, ‘এটা নাও।’ অনেকদিন পর চাদরটি ব্যবহারের সুযোগ পেয়ে তিনি খুশি হলেন। রবিন্দু মন্তব্য করে, ‘বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ফর্মে আবার ফিরে এসেছে।’ ছায়াকে সিল্কের শাড়ি পরতে বলেছিলেন মায়া, সে পরেনি। বলেছিল, ‘আমি তো ছেলে দেখতে যাচ্ছি, দরকার কী আমার সাজগোজের।’ নবেন্দু প্রতি রবিবার সকালেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় ফেরে রাত্রে। ফিরে বলে ‘সমরেশদার বাড়িতে খাইয়ে দিল।’

কলিং বেলের বোতাম টিপল রবিন্দু। তার পিছনে পূর্ণেন্দু সবার শেষে দাঁড়িয়ে ছায়া। দরজা খুলল সুকুমারের বোন সীমন্তি। মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘আসুন।’

ঘোর কৃষ্ণবর্ণ গায়ের রঙ, ঘনজোড়া ভুরু, নীচের ঠোঁটটি উপরের তুলনায় পুরু তাতে গাঢ় লাল রঙ, লাল রিবন বাঁধা কোঁকড়া চুল পিঠে ছড়ান, কপালটি ছোটো। লম্বা দেহ, ছিপছিপে গড়ন। একে দেখে কেউ মেলাতে পারবে না বাসন্তীর সঙ্গে। সীমন্তি যার মুখশ্রী ও রঙ পেয়েছে তিনি পিছনেই দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে অভ্যর্থনা জানালেন। ছ—ফিটের উপর লম্বা, শীর্ণ দেহ কোমর থেকে নোয়ানো, মাথার সামনের অর্ধেকটায় চুল নেই, সিল্কের পাঞ্জাবি চেক লুঙ্গি পরনে, দু—হাতের আঙুলে পাথর বসানো চারটি আংটি।

‘আসুন আসুন, আমি সুকুমারের বাবা সূর্যশেখর গুপ্ত।’ মাথা নোয়ালেন বিনয় দেখিয়ে। কথা বলার সময় সামনের বড়ো বড়ো দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল।

চন্দনধূপের গন্ধে ঘর ম—ম করছে। ঘরটা বড়ো। দেওয়াল ঘেঁষে সমকোণে দুটি সোফা। দুটি চেয়ার, কাচের ছোটো সেন্টারটেবল। টেবলে ফুলদানিতে রজনিগন্ধার ছড়। বিপরীতে একটা কাচের পাল্লার আলমারিতে রবীন্দ্র রচনাবলীর সেট, কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল লক্ষ্মীসরা দেওয়ালে সাঁটা। একসঙ্গে বসা রামকৃষ্ণ—সারদামণির রঙিন ছবি ছাড়া আর কোনো ছবি নেই। ছবিতে বেলফুলের মালা জড়ানো, চন্দনের ছিটে লাগা। ঘর দেখে যেমন প্রীত হলেন পূর্ণেন্দু তেমনি সন্দিহানও। ছেলেও কী হবে নাকি বাবার মতো দেখতে? আস্বস্ত হলেন বাসন্তীর সঙ্গে সুকুমারকে ঢুকতে দেখে, মা হাত ধরে টেনে আনলেন নত মুখ লাজুক ছেলেকে। পূর্ণেন্দু হাঁফ ছাড়লেন, সুকুমার মায়ের মতোই দেখতে। সাধারণ উচ্চচতা, একটু মোটা গড়ন, পাজামা পাঞ্জাবি পরে থাকলেও পূর্ণেন্দুর মনে হল সামান্য ভুঁড়ি আছে। পাতাকাটা চুলের ডগা কপালের উপর এসে পড়েছে। বয়স তিরিশের নীচে মনে হয়, সুকুমারকে বোধহয় আবাসনেই দেখে থাকবেন, মুখটা চেনা লাগছে।

বাসন্তী ছেলেকে পূর্ণেন্দু ও মায়ার মাঝে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই দেখুন ছেলেকে।’ তিনি গিয়ে বসলেন অন্য সোফাটিতে ছায়ার পাশে। পূর্ণেন্দু বিব্রত বোধ করলেন। কথা বলতে হবে, কিন্তু কী কথা বলবেন? বিজ্ঞানের কিছুই জানেন না, তিনি ইতিহাসের লোক। একে কী জিজ্ঞাসা করা যায় পলাশীর যুদ্ধে নবাবের ফৌজের হার কী কী কারণে হয়েছিল? ছায়া মুখ ঘুরিয়ে আলমারির দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্র রচনাবলী দেখছে। রবু ফর্সা মুখটা লম্বা করে কাঠ হয়ে বসে কেননা সীমন্তি একদৃষ্টে তার মুখের দিকে তাকিয়ে। একঘর লোকের মাঝে একটি তরুণের মুখের দিকে পরিচয় না থাকা কোনো তরুণী এভাবে তাকিয়ে থাকলে, পূর্ণেন্দুর ধারণায় মেয়েটি বেহায়া অথবা বোধ বুদ্ধিহীনা।

তুমি কোন স্কুলে পড়েছ? অবশেষে পূর্ণেন্দু শুরু করতে পারলেন।

‘হিন্দু স্কুলে।’ সুকুমারের গলাটি মিহি, নম্র স্বর, প্রায় শোনাই গেল না।

‘কলেজ?’

‘প্রেসিডেন্সি।’

‘রবীন্দ্র রচনাবলী কি তুমি কিনেছ?’

‘না।’

পূর্ণেন্দু তাকালেন বাসন্তীর দিকে। ছায়ার একটা হাত কোলে নিয়ে বাসন্তী তখন অভিযোগের সুরে বলছেন, ‘সাজগোজের দিকে এত অমনোযোগী কেন, মুখে একটু কিছু তো লাগাবে, চুলটাও ঠিকমতো বাঁধোনি।’

ছায়া উত্তর না দিয়ে হাসল। মায়া বললেন, ‘ও ছোটোবেলা থেকেই অমন। নিজের সম্পর্কে একটুও হুঁশ নেই।’

বাসন্তী বললেন, ‘সুন্দর মেয়েরা ধরেই নেয় তাদের আর সাজগোজের দরকার কী, খোদার উপর খোদকারী না করলেও চলে। সাজলে—গুজলে রূপ যে আর একটু খোলে তাতে পাঁচটা লোকের যে চক্ষু সার্থক হয় এটা ওরা বোঝে না।’

পূর্ণেন্দু দেখলেন ছায়ার চোখে বিরক্তি ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেল।

‘তুমি রবীন্দ্রনাথ পড়েছ?’ পূর্ণেন্দু সুকুমারকে নিয়ে পড়লেন।

‘সব নয়, কিছু কিছু।’

‘ওর কোনো রচনা তোমার ভালো লাগে, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ না নাটক?

‘কবিতা।’

পূর্ণেন্দু ইচ্ছে হল বলতে, একটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনাবে? বললেন না।

‘রবীন্দ্রসংগীত?’

‘রোজ রাতে শুনি, ক্যাসেট।’

পূর্ণেন্দু ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার নম্বর দিলেন সুকুমারকে।

সূর্যশেখর একটা চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি রবিন্দুকে নিঃসঙ্গ দেখে আলাপ শুরু করলেন।

‘তুমি কী কর?’

‘একটা অডিট ফার্মে কাজ করি, ল পড়ি আর হায়ার সেকেন্ডারির দুটো কমার্সের ছেলেকে পড়াই।’

‘তাহলে তো সারাদিনই ব্যস্ত থাকো, কাজের লোক!’ সূর্যশেখরের গলায় তারিফ ধরা পড়ল।

মায়ার কান ওদের কথার দিকে ছিল, বললেন, ‘কাজের লোক বললে তো কম বলা হবে। এর উপর রয়েছে ইউনিট ট্রাস্ট, এল আই সি, পোস্টাপিসের এজেন্সি!’

সূর্যশেখর মুগ্ধ চোখে রবিন্দুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অ্যাত্তোসব! ভাবতেই পারি না। মনে হয় নাওয়া—খাওয়ার সময় পাও না, ঠিক কিনা?’

সীমন্তি আঁকপাকু করছিল রবিন্দুর সঙ্গে কথা বলার জন্য। এবার সে সুযোগ নিল। ‘আপনি স্কুলের ছেলেদের পড়ান, কলেজের মেয়েদের পড়ান না?’

‘সময় কোথায়।’ রবিন্দুর স্বর আড়ষ্ট।

সীমন্তি আবদারে গলায় বলল, ‘করুন না একটু সময়, তা হলে আমি আপনার কাছে অ্যাকাউন্টেন্সিটা পড়তুম।’

ছায়া বাদে ঘরের সবাই রবিন্দুর মুখের দিকে তাকাল। দাশগুপ্তদের চোখে ফুটে রয়েছে সম্মতি পাবার প্রত্যাশা। গুপ্তদের চাহনিতে দ্বিধা, অস্বস্তি। পূর্ণেন্দুর মনে হল মেয়েটি গায়ে পড়া।

মায়া হিসেবি গলায় বললেন, ‘যদি সময় করে উঠতে পারে তাহলে পড়াবে না কেন, নিশ্চয় পড়াবে।’

সীমন্তি অধৈর্য বাচ্চচার মতো পা ঠুকে দু হাত ঝাঁকিয়ে বলল, ‘না মাসিমা না, সময় করতেই হবে। কোনো কথা শুনব না। অ্যাকাউন্টেন্সিতে আমি ঠিক ফেল করব।’

মায়া সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে বললেন, ‘যখন তোমার দরকার পড়বে যেও, রবু নিশ্চয় পড়া দেখিয়ে দেবে।’

পূর্ণেন্দুর মনে হল, ছায়ার এই সম্বন্ধটা জমাট করে তোলার জন্যই মায়া কথাটা বলল, নয়তো এককথায় নাকচ করে ওর আহ্লাদীপনা ঘুচিয়ে দিত।

‘ঠিক বলছেন তো? আমি কিন্তু তাহলে কালই যাব।’

রবিন্দুর করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে পূর্ণেন্দুর মনে হল ছেলেকে বাঁচানো দরকার। তিনি বললেন, ‘সূর্যবাবু যা বললেন, রবুর সত্যিই নাওয়া—খাওয়ার সময় নেই। ভয় হয় অসুখবিসুখে না পড়ে যায়। কিছুদিন আগেই জন্ডিস থেকে উঠল। এখন ওর রেস্ট দরকার। বিয়েটা চুকে যাক তারপর তুমি পড়তে এসো বা রবু এসে পড়িয়ে যাবে।’

জন্ডিস তো নয়ই গত এক বছরে রবিন্দুর সর্দি পর্যন্ত হয়নি। নিরীহ মিথ্যাটা বলে নিজের বুদ্ধির প্রমাণ দাখিল করতে পেরে পূর্ণেন্দু মায়ার প্রশংসিত চোখ দেখার জন্য মুখ ফেরাতেই দেখলেন সুকুমার ছায়ার দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে এবং ছায়া সোফায় হেলান দিয়ে লক্ষ্মীসরার দিকে তাকিয়ে আনমনে কানের পাশের চুল টেনে যাচ্ছে। তাচ্ছিল্য স্পষ্ট ওর বসার ভঙ্গিতে।

বাসন্তী বললেন, ‘সীমু চিরুনিটা আনত ছায়ায় চুলটা আঁচড়ে দি। এত সুন্দর চুল অথচ যত্ন নেয় না।’

ছায়া প্রতিবাদ করে উঠতে যাচ্ছিল। মায়া কড়া চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাকে নিরস্ত করলেন।

সূর্যশেখর রবিন্দুর দিকে ঝুঁকে বললেন, ‘ভাবছি কিছু টাকা ইনভেস্ট করব, কিসে লাগান যায় বল তো? করলে অবশ্য তোমাকে দিয়েই করাব।’

‘ইউনিট ট্রাস্টে করতে পারেন, এল আই সি—রও কয়েকটা ভালো স্কিম আছে, পোস্ট অফিসে এন এস সি কিনতে পারেন সাড়ে পাঁচ বছরে টাকা ডবল হবে। বাজারে অনেক নন—র‌্যাঙ্কিং চিট ফান্ড কোম্পানি হয়েছে, প্রচুর সুদ দেয়, আমার মনে হয় সুদের লোভে ওসব জায়গায় টাকা রাখা ঠিক হবে না। সেফ হচ্ছে গভর্নমেন্টের ঘরে টাকা রাখা।’

‘ঠিক বলেছ বাবা,’ বাসন্তী উৎসাহে নড়েচড়ে বসলেন। ‘আমিও তাই বলি। পাশের ফ্ল্যাটের শুভেন্দুবাবু এক লাখ টাকা রেখেছে সঞ্চয়িতা নামে একটা কোম্পানিতে। ওকে বাড়ি বয়ে মাসে মাসে নাকি চার হাজার টাকা সুদ দিয়ে যায়, আমাদের নীচের অনুপবাবু রেলের ড্রাফটসম্যান উনি প্রভিডেন্ড ফান্ড থেকে তুলে লাগিয়েছেন ষাট হাজার। আর দেড় বছর পরই রিটায়ার করবেন, মাসে মাসে পান প্রায় আড়াই হাজার। এটা তো উপরি আয়। কী খাওয়া—দাওয়া, জিনিসপত্তর কেনার ঘটা। ওই দেখে উনিও নেচে উঠলেন, টাকা লাগাবেন। অনেক কষ্টে আটকে রেখেছি। বেশি লাভ ভালো নয়। শুনলে তো রবিন্দু কী বলল, সেফ হচ্ছে গরমেন্টের ঘরে টাকা রাখা!’ বাসন্তী হাত বাড়িয়ে সীমন্তির কাছে থেকে চিরুনিটা নিয়ে ছায়ার চুল আঁচড়াতে শুরু করলেন।

মায়া মৃদুস্বরে সুকুমারকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোয়ার্টার কী ঠিক হয়েই আছে, নাকি চাকরিতে জয়েন করার পর ঠিক হবে।’

‘জয়েন করেই পাব। সেই রকমই তো লিখেছে।’

‘ফার্নিসড কথাটা বলতে কী বোঝায়, খাট পর্দা, বাসনকোশন, উনুন, চেয়ার—টেবিল এই সবই কী?’ মায়া বুঝে নিতে চাইলেন তার মেয়ে প্রথমেই কোনো অসুবিধাগুলোর সামনে পড়বে কিংবা পড়বে না।

‘আমি ঠিক বলতে পারব না।’ সুকুমার জানাল।

মায়া এবার মুখ নীচু করে চাপা স্বরে মোক্ষম প্রশ্নটা করলেন, ‘ছায়াকে তোমার পছন্দ হয়েছে?’

লাল হতে গেলে যতটা ফর্সা হতে হয় সুকুমার ততটা ফর্সা নয় বলে তার গালে শুধু বার্নিশের পোঁচ পড়ল। চোখ নামিয়ে সে বলল, ‘আমি তো ওকে অনেকবার দেখেছি। আমিই তো মাকে ওর কথা বলেছি।’

মায়া বুঝলেন ছেলের চাপে পড়েই এই বিবাহ প্রস্তাব। তার মন প্রসন্ন হয়ে উঠল এই ভেবে, ছায়া বাধ্য অনুগত একটি স্বামী পাবে। মেয়ে বিয়ের পরই আলাদা সংসার পাতবে, তিন কামরার ফ্ল্যাটের ছোটো গণ্ডিতে শ্বশুর শাশুড়ি ননদ নিয়ে ঘর করতে হবে না এটাকে তিনি ছায়ার সৌভাগ্যই বিবেচনা করেছেন। রবু হওয়ার আগে পর্যন্ত শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারে তাকে কাটাতে হয়েছে, তিনি জানেন নতুন বউয়ের সংকুচিত, গণ্ডিবদ্ধ আপন ইচ্ছাকে বিসর্জন দেওয়া জীবনটা কেমন হয়। নিজের পরিবারে নিজে কর্ত্রী হওয়ার সুখ ছায়া প্রথম থেকেই পাবে এমন ভাগ্য তাঁর নিজের হয়নি। এই বিয়েটা তাই মনেপ্রাণে তিনি চাইছেন।

‘তোমার সঙ্গে বিয়ের কথা পাড়তেই ছায়া একবাক্যে হ্যাঁ বলে দেয়।’

মায়া দেখলেন কথাটা শুনে সুকুমারের মুখ ভিজে উঠল তরল আবেগে। সে আবার ছায়ার দিকে তাকাল। ছায়া হেসে কথা বলছে বাসন্তীর সঙ্গে।

‘রান্না তো মা আমাকে করতেই দেয় না। অন্য কারুর হাতের রান্না বাবা মুখে দিতে পারেন না, কী করে আমি তাহলে শিখব?’

সীমন্তি প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল, ‘আমারও ঠিক তাই, মা তো রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয় না, শ্বশুরবাড়িতে যে কী খোঁটা খেতে হবে তা ভেবে এখন থেকে আমার ভয় ধরে যাচ্ছে।’

‘আচ্ছা খুব হয়েছে।’ বাসন্তী মেয়েকে কপট ধমক দিলেন। ‘খোঁটা দেবে না এমন একজন ভালো শাশুড়ির ঘরে তোর বিয়ে দোব।’ এই বলে তিনি মায়ার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

সূর্যশেখর চেয়ার থেকে ঝুঁকে পড়লেন রবিন্দুর দিকে। ‘নগদে না চেকে দিতে হবে?’

‘চেকে দিলে মাসখানেক কী দেড়েক দেরি হবে সার্টিফিকেট পেতে, নগদে দিলে পরের দিনই পাবেন।’

‘হাজার কুড়ি টাকা, ব্যাঙ্ক থেকে তুলে রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে নিয়ে আসব।’

সূর্যশেখর চিন্তাগ্রস্ত কণ্ঠে বলতে লাগলেন, ‘যা দিনকাল! রোজই তো কাগজে দেখছি রাহাজানির খবর। এই তো কালই পড়লুম পেট্রল পাম্পের প্রায় লাখ টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিতে যাচ্ছিল কর্মচারী, তাকে ভোজালি মেরে টাকার থলি ছিনিয়ে, ভিড় রাস্তার মধ্যে দিয়েই ছুটে পালাল দুটো লোক। ধরা পড়েনি।’ সূর্যশেখরের বিস্ফারিত দৃষ্টি রবিন্দুকে মজা পাওয়াল। অদ্ভুত গোলাকার চোখ। বোঝা যাচ্ছে বাপের কাছ থেকে সীমন্তি পেয়েছে।

রবিন্দু হেসে বলল, ‘চেকটা আমাকে দেবেন আমিই ভাঙিয়ে নিয়ে নগদ টাকা পোস্ট অফিসে জমা দিয়ে, সার্টিফিকেটটা আপনাকে এনে দেব। আপনার আর মাসিমার নামে জয়েন্টলি করবেন তো?’

‘না না না, সীমন্তির নামে করব। এটা হবে ওর বিয়ের যৌতুক। মানে সাড়ে পাঁচ বছর পর চল্লিশ হাজার টাকাটা তো ওর স্বামীই পাবে। সুকুর বিয়েটা চুকুক, তারপর চেকটা তোমায় দেব।’

পূর্ণেন্দু চুপ করে দেখে ও শুনে যাচ্ছেন। তার মনে হচ্ছে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে এরা কথা বলছে। রবুকে কী ওরা সীমন্তির সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়? তাহলে এরা ভুল চিন্তা করছে। এই মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে তিনি ভাবতে রাজি নন। তিনি নিশ্চিত রবুও রাজি হবে না। পাঞ্জাবির হাতা টেনে তুলে ঘড়ি দেখলেন। বাসন্তীর সেটা নজরে পড়ল।

‘একটু মিষ্টিমুখ এবার হোক।’

সূর্যশেখর স্ত্রীর হয়ে কথার খেই ধরে বললেন, ‘আজ প্রথম এলেন, একটু মিষ্টি মুখে না দিয়ে ছাড়ি কী করে। গেরস্তর অকল্যাণ হবে।’

‘অগত্যা’! এমন একটা ভাব দেখালেন পূর্ণেন্দু। কিছু যে এরা খেতে দেবেই সেটা তো জানা কথা। বাসন্তী আর সীমন্তি রান্নাঘরে গিয়ে চারটে প্লেট হাতে নিয়ে ফিরল।

‘সামান্য একটু, হাতে হাতেই দিচ্ছি।’ বাসন্তী এই বলে তার হাতের প্লেট দুটো পূর্ণেন্দু ও মায়ার হাতে তুলে দিলেন। সীমন্তি দিল বাকি দুজনের হাতে। আট দশটি নানান আকৃতির ও রঙের সন্দেশ, রাজভোগ ও খাস্তার কচুরি ভরা প্লেটের দিকে তাকিয়ে পূর্ণেন্দু বললেন, ‘আমি তো মিষ্টি খাই না, আর খেলেও এতগুলো অসম্ভব।’

‘আপনারও সুগার?’ সূর্যশেখরকে উৎফুল্ল দেখাল।

‘আমাদের দুজনেরও আছে, আমার কম ওর বেশি।’

বাসন্তী ছোট্ট ঝামটা দিয়ে বললেন, ‘আহা কত যেন বেশি, তোমার পিপি একশো আশি আমার আড়াই শো। মাত্র তো সত্তর বেশি।’

‘ডায়বিটিস শুনেছি বাবা মায়ের থাকলে সন্তানদেরও হতে পারে এটা হেরিডিটারি।’ পূর্ণেন্দু এই বলে প্লেট থেকে একটা খাস্তা কচুরি তুলে প্লেটটা সেন্টার টেবলে রেখে দিলেন।

কথাটা বাসন্তীর কান এড়াল না। তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘তাই বলে সুকু আর সীমুর আছে ভাববেন না। সুকু তুই তো গত হপ্তায়ই ব্লাডটেস্ট করিয়েছিস, কত হয়েছিল?’

‘একশো নয়।’ সুকুমার কথাটা বলে উঠে গিয়ে আলমারিতে রবীন্দ্র রচনাবলীর ফাঁকে গুঁজে রাখা ব্লাড রিপোর্টটা এনে পূর্ণেন্দুর হাতে দিল। তিনি একবার চোখ বুলিয়ে কাগজটা ফিরিয়ে দিলেন।

সীমন্তি বলল, ‘আমারও সুগার ফুগার নেই।’

মায়া বললেন, ‘না থাকলেই ভালো। তবে এত মিষ্টি খেলে সুগার না থাকলেও সুগার হয়ে যাবে। একটা প্লেট আনুন তুলে দিই।’

হাহা করে উঠলেন সূর্যশেখর, ‘সেকি সেকি, মাত্র তো এই কটা।’

পূর্ণেন্দুর মনে হল যেন প্রদর্শনী খোলা হয়েছে, কত রকমের মিষ্টি খাওয়াতে পারি এবার সেটা দেখো। একই জাতের মিষ্টি চার পাঁচটা শুধু রঙ আর আকৃতিটা ভিন্ন। এরা খাওয়াতে জানে না, টাকা খরচ করতে চায়। প্লেট হাতে নিয়ে রবিন্দু ও ছায়া চুপ করে বসে। বাসন্তী বললেন, ‘তোমরাও কী মায়ের দলে?’

‘হ্যাঁ; সত্যিই এত খাওয়া যায় না।’ রবিন্দু বলল।

‘ছায়া তুমি?’ বাসন্তী শুকনো গলায় হেসে জানতে চাইলেন।

‘আমি দাদার দলে।’ বলেই সে সুকুমারের দিকে সোজা তাকিয়ে বলল, ‘নিন না এখান থেকে।’

সুকুমারের কাছে প্রস্তাবটা অপ্রত্যাশিত। সে ইতস্তত করছে দেখে প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘ধরুন।’

ছায়ার কণ্ঠস্বরে কী যেন ছিল, সুকুমার উঠে গিয়ে প্লেটটা ধরল। ছায়া একটা সন্দেশ তুলে নিয়ে বলল, ‘সুগার তো নেই, প্লেটটা এবার খালি করে দিন।’

রবিন্দু তার হাতের প্লেট বাড়াল সীমন্তির দিকে। সে একটা কচুরি তুলে নিয়ে বলল, ‘সব খেতে হবে, কোনো ওজর শুনব না। না খেলে প্যাকেট করে বাড়িতে দিয়ে আসব।’

রবিন্দু একসঙ্গে দুটো সন্দেশ মুখে পুরে চিবোতে শুরু করে দিল। দেখে পূর্ণেন্দু কোনোক্রমে হাসি চাপলেন। বেচারা, মেয়েটার প্যাকেট দিতে যাওয়া বন্ধ করতে রবুকে এ বার পুরো প্লেটটাই শেষ করতে হবে।

ছেলে দেখার পর্ব শেষ করে ফিরে আসার সময় সুকুমার ও সীমন্তি তাদের সঙ্গে এল ফ্ল্যাটের দরজা পর্যন্ত। পাশে পাশে হাঁটছিল সুকুমার, মায়া তাকে বলেন, ‘ছায়ার পড়াটা যেন বন্ধ না হয় সেটা দেখো বাবা।’

ব্যস্ত হয়ে সুকুমার বলে, ‘না না পড়া বন্ধ হবে কেন, উনি পড়তে চাইলে নিশ্চয় পড়বেন, আর একটা কথা, যদি কিছু মনে না করেন তো বলি।’

‘বলো।’ মায়ার বুকের মধ্যে দুরু দুরু করে উঠল, কী বলতে চায়? ছায়ার সম্পর্কে কিছু কী? তাদের সামনে চলেছে রবিন্দু তার গা ঘেঁষে সীমন্তি। তাদেরও আগে পূর্ণেন্দু ও ছায়া।

‘আমাকে যতটুকু দেখলেন তাতে কী ধারণা হল আপনার?’

হাঁফ ছাড়লেন মায়া। চলা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, ‘ছায়ার জন্য যেমন ছেলে চাইছিলাম তুমি ঠিক তেমনটি।’

‘আপনারা আমাকে কিছু দেবেন না। দেখেছি তো বিয়েতে কত জিনিস মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলেকে দেয়, আপনারা কিন্তু কিছু দেবেন না।’

‘মেয়েকে যদি দি তাহলে কি তুমি আপত্তি করবে?’

‘না, কিন্তু আমাকে নয়।’

রবিন্দুকে জিজ্ঞাসা করল সীমন্তি, ‘আপনি অত সকালে সল্ট লেকে ছেলে পড়াতে যান আবার বাড়ি ফিরে এসে তখুনি অফিস যান। কষ্ট হয় না?’

‘হয়।’

‘বাড়ির কাছে টিউশানি করেন না কেন?’

‘ভালো মাইনে দিলে করব।’

‘কত করে নেন আপনি?’

‘হপ্তায় দুদিন, আড়াই শো টাকা।’

‘আপনার কী খুব টাকার দরকার?’

‘কার না টাকার দরকার হয়।’

সীমন্তি কথা বাড়াল না। পূর্ণেন্দু আরা ছায়া তালা খুলে ফ্ল্যাটের ভিতর ঢুকে গেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে সীমন্তি বলল, ‘সকালে অত দূরে গিয়ে না পড়িয়ে আমাকে পড়ান না।’

‘আগে মেয়েদের পড়িয়েছি এখন আর পড়াই না।’ রবিন্দু হালকা চালে কিন্তু দৃঢ় স্বরে বলল।

‘কেন?’

‘ঝামেলা তৈরি হয় সেটা আমার ভালো লাগে না।’ বলেই রবিন্দু বিদায় জানাতে মাথা একবার হেলিয়ে হেসে ভিতরে ঢুকে গেল।

সুকুমারের সঙ্গে মায়া এসে পৌঁছলেন।

‘সীমন্তি, মাঝে মাঝে এসো না, ছায়ার তো বাড়িতে কথা বলার লোকই নেই।’

শুকনো মুখে সীমন্তি বলল, ‘আমি এলে ঝামেলা হবে না তো?’

মায়া ওর গাল টিপে দিয়ে বললেন, ‘একদম হবে না।’

বসার ঘরে ছেলে বউয়ের সঙ্গে বসলেন পূর্ণেন্দু।

‘রবু কেমন লাগল সুকুমারকে, আমার তো ভালোই লাগল, বেশ ভালো লাগল।’ পূর্ণেন্দু ‘ভালো লাগল’—টা পুনরাবৃত্তি করে বুঝিয়ে দিলেন তিনি বিয়েতে মত দিচ্ছেন।

‘আমারও ভালো লেগেছে। কোয়ালিফায়েড, ভালো চাকরি পেয়েছে। দেখতে শুনতে কথাবার্তায় ভালো, নিজেদের ফ্ল্যাট—’

রবিন্দুর কথা শেষ করতে না দিয়ে মায়া ব্যগ্র হয়ে বলে উঠলেন, ‘তিন বেডরুমের ফ্ল্যাট, ছায়ার থাকতে কোনো অসুবিধে হবে না। তাছাড়া ভাইটাইও নেই। বিয়ে হলে বোন তো শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, গোটা ফ্ল্যাট টাই হবে ছায়া—সুকুমারের। এদিক থেকে ছায়ার যে লাভটা হচ্ছে সেটা ভেবে দেখো!’

পূর্ণেন্দু মাথা নেড়ে স্ত্রীর কথাগুলো মেনে নিয়ে বললেন, ‘সুকুমার যদি চাকরিটায় রয়ে যায় তাহলে বোম্বাইতেই থেকে যাবে, এই ফ্ল্যাটে আর ফিরছে না। শুধু ওর বাবা—মা—ই তিনটে ঘর নিয়ে থাকবে।’

রবিন্দু ঠাট্টায় সুরে বলল, ‘মনে হচ্ছে, বাবার যেন হিংসে হচ্ছে।’

‘তা একটু হচ্ছে। যখন কল্যাণের কাছে খবর পেলুম তখন দুটোমাত্র দু—ঘরের ফ্ল্যাট খালি পড়েছিল। অগত্যা তাই নিতে হল।’ পূর্ণেন্দুর স্বরে আপশোস। ‘একটা ছেলে থাকলে ফ্ল্যাটে বাস করে সুবিধে আছে। আগে যদি জানতুম ফ্ল্যাটে এসে উঠতে হবে তাহলে—

‘তাহলে কী?’ মায়া তীক্ষ্ন স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন।

‘কিছু না।’ পূর্ণেন্দু খোলার জন্য পাঞ্জাবিটা মাথার উপর দিয়ে গলাতে লাগলেন।

‘জায়গা নেই, চলাফেরা করা যায় না। ঘেঁষাঘেঁষি, ঠাসাঠাসি, এই সব বলে তোমাকে আর গজগজ করতে হবে না। নবু বড়ো ক্লাবে যাচ্ছে, ত্রিশ হাজারে পাকা কথা হয়ে গেছে। আদ্দেক পেমেন্ট পেলেই জমি বায়না করবে বাগুইহাটিতে, ওর সমরেশদা জমি কিনিয়ে দেবে বলেছে, মিস্ত্রি দিয়ে বাড়িও করিয়ে দেবে।’

‘কবে!’ পূর্ণেন্দু প্রত্যাশা আর বিস্ময় মিশিয়ে তাকালেন। ‘নবু এতদূর এগিয়েছে তা তো জানতুম না, একেবারে জমি—বাড়ি পর্যন্ত।’

‘বলবে কী, তুমি কী কখনো খোঁজ রেখেছ না জানতে চেয়েছ। ওর সঙ্গে তো কথাও বলো না।’

‘বলব কী, যদি ক্রিকেট খেলত তাহলে নয় কথা বলা যেত। নবু কতক্ষণ আর বাড়িতে থাকে!’

রবিন্দু গলা ঝেড়ে বলল, ‘এই সমরেশ লোকটা সম্পর্কে কিছু কথা শুনেছি। ওর এলাকায় বাড়ি করতে গেলে নাকি ওকে পাঁচ হাজার টাকা সেলামি দিতে হয় আর ওর কাছ থেকেই বাড়ি তৈরির জিনিসপত্তর কিনতে হবে। তা নইলে বাড়ি তৈরির জন্য জমিতে যে সব মালমশলা এনে রাখা হবে, সব রাতারাতি হাওয়া হয়ে যাবে। ওর একটা বড়ো গ্যাং আছে, রেলের ওয়াগন ভেঙে লুট করে। আমাদের অফিসের একজন বাগুইহাটিতে থাকে, সে বলছিল। সমরেশের ভয়ে নাকি সবাই তটস্থ।’

পূর্ণেন্দু বললেন, ‘নবু বাচ্চচা ছেলে নয়, নিশ্চয় এসব কথা সে জানে।’

মায়া বললেন, ‘জানে নিশ্চয় তবে ওর তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না, ওকে ভালোবাসে সমরেশের বাড়ির লোকেরা। বড়ো ক্লাবের সঙ্গে কথাবার্তা তো সমরেশই বলছে। বাড়িটা হলে নবু এখানে আর থাকবে না তখন রবুর বিয়ে দোব।’

ক্ষীণভাবে হেসে রবিন্দু বলল, ‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।’

‘কেন, কারুর সঙ্গে ভাবসাব হয়েছে নাকি? এখনি পরিষ্কার করে বল। নইলে মেয়ে দেখে কথাবার্তা এগোবার পর তখন বলবি বিয়ের পাত্রী নিজে ঠিক করে রেখে দিয়েছি, তখন লজ্জায় পড়ে যাব।’ মায়ার হালকা সুরের আড়ালে থাকা উৎকণ্ঠা পূর্ণেন্দু ধরতে পারলেন। তাঁর মনে হল মায়া ঠিকই বলেছে, যদি কোনো মেয়েকে ভালো লেগে থাকে তাহলে এখনই তা বলে দেওয়া ভালো। রবুর পছন্দের উপর তাঁদের আস্থা আছে। মায়ার অবশ্য আপত্তি হবে মেয়ে যদি ছোটো জাতের হয়। এটা রবু জানে।

রবিন্দু স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘সেসব কিছু নয়। উন্নতি করতে হলে এখনই খাটার সময়। রোজগার পাঁচ হাজারে না পৌঁছলে বিয়ের কথা ভাবতে রাজি নই। এখন ছায়ার বিয়ের কথাটা ভাবো তো।’

‘রবু ঠিকই বলেছে ছায়ার বিয়ের তারিখ তো চোদ্দোই মাঘ ঠিক হয়েছে। কটা দিন আর বাকি। তোড়জোড় তো এখন থেকেই শুরু করতে হয়।’ পূর্ণেন্দু উঠে গিয়ে ইংরিজি—বাংলা তারিখ দেওয়া ক্যালেন্ডারের পাতা ওলটালেন।

‘আসার সময় সুকুমার একটা কথা বলল, শুনে ওকে আরও ভালো লাগল।’ মায়া একটা নাটকীয় নীরবতা তৈরি করে দুজনের জিজ্ঞাসু চোখকে সময় দিলেন অধৈর্য হয়ে ওঠার জন্য।

‘বলল, বিয়েতে আমাকে একটা কিচ্ছু দেবেন না, ভাবতে পার?’ মায়ার চোখে ঝিলিক দিল গর্ব ও তৃপ্তির ছটা। ‘এখনকার দিনে এমন ছেলে পাওয়া যায়। সব তো হাত বাড়িয়ে থাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে ভিক্ষে পাবার জন্য।’

‘শ্বশুরবাড়িরই তো দোষ। ভিক্ষে দেয় কেন? ভিখিরি তো ওরাই তৈরি করে। সুকুমারের বাবা বলল, শুনলে না, সাড়ে পাঁচ বছর পর জামাই পাবে চল্লিশ হাজার টাকা। এর মানে কী?’ দাঁত চেপে বলল রবিন্দু। ‘ওই মেয়েকে যে বিয়ে করবে সে চল্লিশ হাজার নগদ পাবে, তা ছাড়া হ্যানাতানা নানান জিনিস, গয়নাগাটি এসব তো আছেই।’ রবিন্দু উত্তপ্ত হয়ে উঠে গেল নিজের ঘরে।

দুজনে মুখ চাওয়া—চাওয়ি করলেন। ছেলের হঠাৎ রেগে ওঠার কারণ তাঁরা ভেবে পেলেন না।

‘সুকুমারকে বললুম তুমি নয় নেবে না কিন্তু আমরা যদি মেয়েকে কিছু দিই, বলল দেবেন কিন্তু আমাকে নয়।’

‘কিন্তু তাই বলে খরচ যে কিছু কম হবে তা ভেবো না। লোকজন খাওয়ানো, নানান আনুষ্ঠানিক খরচ, মেয়ের কিছু গয়নাগাটি। এসবেই তো বহু হাজার টাকা বেরিয়ে যাবে।’

‘সুকুমারের মা তো বললেন, শুধু শাঁখা সিঁদুর দিয়ে বউ নিয়ে যাবেন।’

‘ওটা মুখের কথা, ওটা ধরো না। বলেছে কি কত ভরি সোনা চাই?

‘এখন ভরি কত করে, দু—হাজার টাকা?’

‘গয়নার কথা ওঠেইনি। তবে আমি পাঁচ ভরি গয়না গড়িয়ে রেখেছি, দু—বছর আগেই।’

অবাক পূর্ণেন্দু প্রশ্ন করলেন, ‘টাকা পেলে কোথায়?’

‘ছিল আমার কাছে।’

ভ্রূ কুঁচকে পূর্ণেন্দু তাকিয়ে রইলেন ঠোঁট টিপে কঠিন মুখে বসে থাকা মায়ার দিকে। বুঝে গেলেন এই প্রসঙ্গে তাঁর স্ত্রী আর একটিও কথা বলবে না।

‘বিয়ে হবে কোথায়?’ পূর্ণেন্দু প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর দিলেন, ‘সামনের মাঠে?’

‘এখানে সব বিয়ে তো মাঠেই প্যান্ডেল করে হয়, ফ্ল্যাটে জায়গা কোথায়?’

‘ডেকরেটর ঠিক করতে হবে তারপর আছে কেটারার ঠিক করা। এই সময়ই অমিয়কে দরকার ছিল, ছেলেটা কোথায় যে গেল, বহুদিন আর আসে না। ও থাকলে কিচ্ছু ভাবতে হত না।’ পূর্ণেন্দুর আক্ষেপে মায়া বিরক্ত হলেন।

‘তোমার দুটো ছেলে কী অপদার্থ না তাদের পক্ষাঘাত হয়েছে! বোনের বিয়েতে তারা কী খাটাখাটনি করতে পারবে না? এইটুকু ব্যাপারেই অমিয় অমিয় করে হেদিয়ে মরছ!’

পূর্ণেন্দু অপ্রতিভ হলেন, সত্যিই তো, নিজের ছেলেদের প্রতি আস্থা না থাকার তো কোনো সংগত কারণ তাঁর জানা নেই। ওরা নিজেরাই নিজেদের কেরিয়ার তৈরি করছে, তিনি রবুকে চাকরি পেতে সাহায্য করা ছাড়া আর কিছু তো করেননি। নবু তো নিজেই বেছে নিয়েছে তার পথ। তিনি ভেবেছেন শুধুই ছায়ার ভবিষ্যৎ। দু—মাস আগে জাতীয় সঞ্চয় পত্রগুলোর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় তিনি ষাট হাজার টাকা পেয়েছেন। টাকা ব্যাঙ্কে রয়েছে। ছায়ার বিয়ের কথা ভেবেই এই পত্র কিনেছিলেন। মেয়াদ পূর্ণ হতে না হতেই বিয়ে স্থির হয়ে গেল। একে পূর্ণেন্দু, যা কখনো বিশ্বাস করেন না সেই, ভাগ্যের আশীর্বাদ পেয়েছেন বলে মনে করলেন।

বিয়ের জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন সূর্যশেখর, এমনকী পুরোহিত জোগাড় করা পর্যন্ত। পরামর্শ দিলেন, ‘শুধু এই বাড়ির আটটা ফ্ল্যাট ছাড়া এখানকার আর কাউকে নেমন্তন্ন করবেন না। এখানে এটাই রেওয়াজ।’ নিমন্ত্রিতদের নামের ফর্দ মায়া সবাইকে জিজ্ঞাসা করে তৈরি করলেন। নবুই লক্ষ করে অমিয়র নাম ফর্দে নেই।

‘মা এটা কী করলে, এত বড়ো ভুল। অমিয়দার নামটাই বসাতে ভুলে গেলে।’

‘ছায়া তো বলল, নেমন্তন্ন করার দরকার নেই। যার বিয়ে সেই যদি বারণ করে তাহলে আমি আর কী করব।’ মায়ার গলার স্বরে কোনোরকম দ্বিধা বা মালিন্য নেই।

সুচারুভাবে সম্পন্ন হল বিয়ে। শুধু বিয়ের এক ঘণ্টা আগে কিছুক্ষণের জন্য পাওয়ার কাট হওয়া ছাড়া আর কোনো বিঘ্ন ঘটেনি, অবশ্য জেনারেটর থাকায় এটাকে বিঘ্ন বলা যায় না। ফুলশয্যার পরের দিনই সুকুমার বোম্বাই রওনা হল ছায়াকে নিয়ে ট্রেনে। সঙ্গে গেল রবিন্দু আর বাসন্তী নবদম্পতির সংসার পেতে দিয়ে আসার জন্য। ট্রাঙ্ক কলে কথা বলে সুকুমার আগেই জেনে নিয়েছিল তাদের জন্য সান্তাক্রুজ ইস্টে এক গুজরাতি হাউজিং সোসাইটিতে একটা তিন ঘরের ফ্ল্যাট আসবাব সমেত প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। তারা ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশন থেকে সোজা চলে যেতে পারে। তাকে আর একটা কথা বাঙালি বলেই জানিয়ে দেওয়া হয়, আবাসনটি পুরো নিরামিষ। মাছ মাংস ডিম ওর চৌহদ্দির মধ্যে রান্না করা বা খাওয়া চলবে না। আবাসনে রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে।

তারা ঠিকমতো নির্বিঘ্নেই পৌঁছল। সেদিন সন্ধ্যাতেই বাসন এবং খাওয়ার জিনিস কিনতে বেরোয় তারা। আবাসন থেকে বেরিয়েই দোকান আর বাজার, স্টিলের বাসন আর দুটো প্লাস্টিকের বালতিতে মুদির দোকানের ঠোঙা, সর্ষের তেলের টিন, থলি ভরা কাঁচা বাজার আর টিফিন কেরিয়ারে ডাল—ভাত, চারজনে হাতে নিয়ে ফিরল।

‘ভাগ্যিস বড়দা এসেছে নইলে এত জিনিস হাতে করে রয়ে আনতে পারতুম না, সুকুমার খাটে পাতা ছোবড়ার গদিতে বসে ওয়াড়হীন ময়লা বালিশ কোলে টেনে নিয়ে হাঁফ ছাড়ার ভান করল।

রবিন্দু বলল, ‘এরকম আরও কয়েকবার তোমাকে দোকান বাজার থেকে জিনিসপত্তর আনতে হবে সুকু। দুটো ঘরে দুটো খাটের গদির যা অবস্থা, ওর ওপর তোষক না পাতলে শুতে পারবে না। চাদর, বেডকভার, বালিশ, দরজা জানলার পর্দা তো সর্বাগ্রে চাই। তারপর আরও কত কী যে লাগবে সেটা সংসার করতে করতে টের পাবে। হোটেলের থেকে টিফিন কেরিয়াবে ভাত এনে কদিন আর চালাবে। কাল সকালে প্রথমেই কেরোসিন আর উনুন কিনে আনব।’

সুকুমার বলল, ‘গ্যাসের ব্যবস্থা নিশ্চয় অফিস করে দেবে।’

বাসন্তী নীচের ঠোঁট উলটে বললেন, ‘এই তোর ফার্নিশড কোয়ার্টার!’ এরকম জানলে দুদিন আগে এসে কেনাকাটা গোছগাছ করে দিতুম, দেখত ছায়ার কত কষ্ট হবে। দুদিন থেকে কতটা আর গুছিয়ে দিয়ে যেতে পারব।’

‘মা জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার। এইবার আমি তোমার বউমার সাঁতার কাটাটা দেখব।’

‘পারবে পারবে, ডুববে না। কী গো ছায়া পারবে না?’ বাসন্তী নিশ্চিন্ত স্বরে বললেন।

ছায়া মনে মনে উত্তেজিত। নতুন ঘর পেতে বসাটা তার কাছে চ্যালেঞ্জের মতো লাগছে। সে বলল, ‘এখন দু—চারদিন পিকনিকের মতো ব্যাপারটা হবে। যে কষ্ট করতে পারবে না সে যেন বাইরে খাওয়ার ব্যবস্থা করে।’ ছায়া আড়চোখে সুকুমারের দিকে তাকিয়ে মুখ গম্ভীর করল।

ছায়া—সুকুমার খুনসুটি দেখে রবিন্দুর মনে হল বিয়েটা ভালোই হয়েছে। মনের মিলটা খুব তাড়াতাড়িই ঘটে গেছে। আসার সময় ট্রেনে দুজনে জানলার ধারে পাশাপাশি বসে বহুক্ষণ গল্প করেছিল। এক সময় রবিন্দুর একটা ক্ষীণ সন্দেহ ছিল ছায়া বোধহয় অমিয়র প্রতি অনুরক্ত। বন্ধুর সুন্দরী বোনের প্রতি দুর্বলতা যেকোনো তরুণেরই ঘটতে পারে। অমিয় সম্পর্কে এটা রবিন্দুর মনে হত। ওর যখন তখন আসা মায়ার মন জুগিয়ে কথা বলা, দরকার দেখলে যেচে সাহায্য করা—এসব থেকেই রবিন্দুর মনে হয়েছিল ছায়ার সঙ্গে অমিয়র মানসিক যোগ গড়ে উঠেছে। কোনো মেয়ের সঙ্গে টানা পনেরো মিনিট কথা বলার সুযোগ আজও তার জীবনে আসেনি, এলে কী হত তাই নিয়ে সে ভাববার অবকাশই পায়নি। বহু ছেলেমেয়ের জীবনে হালকা মেঘের মতো বিয়ের আগে প্রেম উড়ে আসে, আবার উড়ে চলে যায়, ছায়ার ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে।

‘একটা ঝাঁটা সবার আগে কেনা উচিত ছিল, এটা আর কারুর মনে পড়েনি। কী ধুলো ময়লা দেখেছ!’ বাসন্তী চারিদিকে তাকিয়ে ধুলোর উপস্থিতি বোঝালেন মুখ বিকৃতি করে।

কলিং বেল বাজল। সবাই অবাক হয়ে মুখ চাওয়া—চাওয়ি করল, এখানে চেনা তো কেউ নেই যে দেখা করতে আসবে। ভুল করে কেউ বেল বাজাল না তো! সুকুমারই দরজা খুলতে গেল।

শ্যামবর্ণা, চশমা পরা এক মহিলা, বাসন্তীর কাছাকাছি বয়সি। সপ্রতিভ স্বরে বললেন, ‘আপনারা তো আজই এলেন, আমি দোতলায় ঠিক আপনাদের উপরেই থাকি। বারান্দা থেকে দেখলুম আপনারা এলেন, আগেই জেনেছিলুম এক বাঙালি পরিবার আসছে। শুনে কী আনন্দ যে হয়েছিল, এখানে চল্লিশটা পরিবার, বাঙালি শুধু একা আমরা। আমার স্বামী একটা টেক্সাটাইল ডিজাইনিং ফার্মে কাজ করেন। আলাপ করতে এলুম!’ ভদ্রমহিলা হাসলেন। হাসিটা সুকুমারের কাছে খুবই মিষ্টি লাগল। ভিতর থেকে ছায়া এসে তার পাশে দাঁড়াল।

সুকুমার ছায়াকে বলল, ‘ইনি ওপরে থাকেন, বাঙালি, আলাপ করতে এসেছেন।’

ছায়া নমস্কার করে বলল, ‘থাকব আমরা দুজন। আমার দাদা শাশুড়ি পরশু চলে যাবেন।’

‘কদ্দিন বিয়ে হয়েছে?’

‘ফুলশয্যা হয়েছে তিন দিন আগে।’

‘দেখে মনে হয়েছিল অল্পদিন বিয়ে হয়েছে কিন্তু সেটা যে এত অল্পদিন বোঝা যায় না।’

‘ভেতরে আসুন, মা—র সঙ্গে আলাপ করবেন।’ ছায়া হাত ধরে মহিলাকে ভিতরে আনল।

কলকাতায় ফেরার সময় ট্রেনে বাসন্তী বললেন রবিন্দুকে ‘কী ভাগ্য দেখো ওদের, মেঘ না চাইতেই জলের মতো ওপর থেকে নেমে এল ভগবতী ঘোষ। বোম্বাইয়ে দু—বছর আছেন, এখানকার হালচাল বেশ ভালোই জানেন, ছায়ার কোনো অসুবিধে হবে না।’

‘ছায়ার ভাগ্যটা সত্যিই ভালো।’

‘রবু তুমি কোষ্ঠী ঠিকুজি মানো?’

রবিন্দু ইতস্তত করে বলল, ‘খানিকটা খানিকটা বিশ্বাস করি।’

‘আমি পুরোটাই বিশ্বাস করি।’ বাসন্তীর চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। ‘তোমার মেসোমশায়ের কোষ্ঠীতে সম্পত্তি, অর্থহানির সম্ভাবনার কথা লেখা আছে। আমি ওকে সঞ্চয়িতায় টাকা রাখতে দিইনি আর দেখো কী ঘটে গেল। শুভেন্দুবাবু চারদিন খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে বিছানায় পড়েছিলেন। উনি নয় ব্যবসায়ী, পয়সাওলা লোক, লাখ টাকা চোট খাবার ধাক্কাটা সামলে নেবেন কিন্তু অনুপবাবুর কথাটা ভাবো, দেড় বছর পর রিটায়ার করবেন। প্রভিডেন্ট ফান্ড ভেঙে ষাট হাজার টাকা তুলে সঞ্চয়িতায় রাখলেন, দুটো মেয়ে রয়েছে, বিয়ে দিতে হবে, ভদ্রলোক তো পাগলের মতো হয়ে গেছেন। ওই অবস্থা তো তোমার মেসোমশায়েরও হতে পারত। আমি বারণ করেছি, তুমিও নিষেধ করলে, তাই না উনি লোভ সামলালেন।’ বাসন্তী নিজের কৃতিত্বের অর্ধেকটা রবিন্দুকে দিয়ে লক্ষ করলেন কতটা ভাবান্তর ওর চোখেমুখে ঘটল। ঘটেছে দেখে আবার বললেন, ‘আসলে আমার বারণ উনি শুনতেন না, তুমি বলায় উনি পিছিয়ে গেলেন, তোমার উপর ওনার ভীষণ বিশ্বাস, শুধু ওর কেন আমাদের সবাইয়েরই বিশেষ করে সীমুর।’

‘আমার ওপর বিশ্বাস! কেন? রবিন্দু অবাক হয়ে জানতে চাইল।

‘এই কেনর কোনো জবাব তো জানা নেই। সীমুর কোষ্ঠীতে আছে, কুড়ি বছর বয়সে কোনো হিতাকাঙ্ক্ষী পুরুষ দ্বারা উপকৃত হবে। এখন ওর বয়স কুড়ি। আমি অনেক খুঁজে এমন কোনো পুরুষ দেখতে পাইনি যে ওর উপকারে আসতে পারে, এক তুমি ছাড়া।’

‘আমি! আমি ওর কী উপকার করতে পারি?’

‘ওকে পড়াতে পার, বি কম—টা পাশ করিয়ে দিতে পার। আমাদের কাছে এখন তো তুমি হাউজিংয়ের আর পাঁচটা ছেলের একজন নও, এখন তুমি সীমুর দাদার শালা, আত্মীয়, আমাদের ফ্ল্যাটে তো সবসময়ই আসতে পার কেউ কিছু মনে করবে না। এই ক—দিনেই আমি দেখেছি তুমি বুদ্ধিমান, বিবেচক, অগ্রপশ্চাৎ ভেবে কাজ কর, এমন একজন লোকের পরামর্শ নিয়ে চললে বৈষয়িক ব্যাপারে কখনো ঠকতে হবে না। এতদিন পরামর্শ নিতুম সুকুর কিন্তু এখন তো আর চট করে তাকে পাব না কিন্তু তোমাকে পাব।’

‘আমি কী পরামর্শ দোবো।’

‘পরামর্শ দেবার মতো ব্যাপারের কী অভাব আছে। লেখাপড়ার ব্যাপারটা আমাদের থেকে তুমি ভালো বোঝো। সীমুর পড়াশুনোটা তো তুমি গাইড করতে পার, পার না কী? সিমুর জন্য ওর বাবা পোস্ট অফিসের যে সার্টিফিকেট কিনল সেটা ম্যাচুওর করলে টাকাটা ও কী করবে, সেটা তো তুমি বলে দিতে পার।’

‘ততদিনে ওর বিয়ে হয়ে যাবে নিশ্চয়, তখন তো ওর স্বামীই বলে দিতে পারবে!’ রবিন্দু আশ্চর্য বোধ করল বাসন্তীর হিসেবে এমন ভুল হওয়ায়।

‘তা পারবে, কিন্তু কেমন পারবে তাতো এখন জানি না তবে এখন জানি তুমিই পারবে।’

রবিন্দুর অস্বস্তি লাগছে এই সব দায়িত্ব ঘাড়ে এসে যাচ্ছে বুঝতে পেরে। বোনের শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ করে তার লাভ কী? সীমুকে গাইড করে পাশ করিয়ে দিতে হবে। পাস করাটা কী হাতের মোয়া! আর আমিই বা অমন ফাঁকিবাজ মাথামোটা, আহ্লাদী মেয়ের দায়িত্ব নিয়ে শেষে বদনাম কুড়তে যাব কেন? মেয়ে চল্লিশ হাজার টাকার মালিক হবে, একথা বারবার শোনাচ্ছেন কেন? মতলবটা কী? ভদ্রমহিলা বাড়াবাড়ি রকমের প্রশংসা করছেন। উদ্দেশ্যটা বুঝে নেবার চেষ্টা করল রবিন্দু।

‘না, আমি পরের টাকা সম্পর্কে কোনো পরামর্শ দিতে পারব না। তাছাড়া পরামর্শ দেবার আছেটাই বা কী! ম্যাচুওর করবে আবার তাই দিয়ে সার্টিফিকেট কিনবে নয়তো টাকাটা খরচ করবে যদি প্রয়োজন দেখা দেয়, ব্যস। এ জন্য পরামর্শ নেবার কী দরকার তাতো বুঝছি না।’ রবিন্দুর স্বরে বিরক্তি ও উগ্রতা প্রকাশ পেল, বাসন্তী গম্ভীর হলেন।

রবিন্দু জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ কেউই কথা বলল না। বাসন্তীই শুরু করলেন, ‘মনে হচ্ছে তুমি আমার কথায় বিরক্ত হয়েছো। আচ্ছা রবু, সীমুকে কী তোমার পছন্দ নয়?’

ঝুলি থেকে তাহলে বেড়ালটা বেরোল। এই ধরনের একটা প্রশ্ন আসতে পারে সেটা অনুমান করেছিল। রবিন্দু মনে মনে হাসল এবং সতর্ক হল। ‘এ কথা বলছেন কেন?’

‘সীমুর জন্য আমরা তোমাকে পাত্র ঠিক করেছি।’ শান্ত গলায় বাসন্তী ভণিতা না করে সহজভাবে বললেন।

‘ঠিক করে ফেলেছেন?’ রবিন্দুর মাথা গরম হয়ে উঠল। মুখটা কঠিন করে সে আবার জানলার বাইরে তাকাল। ভদ্রমহিলা এমনিতে কথাবার্তায় বেশ ভালো, আন্তরিক, ওর মনে আঘাত দিতে তার ইচ্ছে করছে না। সীমুকে বিয়ে? একদমই ভাবা যায় না। ছায়ার বিয়ের কথা বলতে এসেছিলেন নিজেরা ঠিকঠাক করে একদম নিশ্চিন্ত হয়েই। ধরেই নিয়েছিলেন তার ছেলেকে এরা লুফে নেবে। ব্যাপারটা তাই—ই হয়েছিল। তবু রবিন্দুর মনে খচখচ করেছিল একটা কথা, আমাদের কী এতই দীন মনে হয়, দু—ঘরের ঘিঞ্জি ফ্ল্যাটে বাস করি বলে, বড়োমানষি দেখাবার মতো চাকরি নেই বলে? সম্বল শুধু মুখশ্রীটুকু! একবার মুখের দিকে তাকালে আর একবার ফিরে দেখতে হয়। আর সেই জন্যই ছায়াকে এরা পুত্রবধূ করেছে। তাই বলে শুধু এই কারণে তাকেও জামাই করতে চায়? মুখশ্রী ছাড়া কী এমন তার যোগ্যতা? সামান্য একটা চাকরি, দুটো টিউশনি আর শেয়ার সার্টিফিকেট, ডিবেঞ্চার, নানান কোম্পানির পাবলিক ডিপোজিট স্কিম ফিরি করে বেড়ানো এই তো তার উপার্জনের হাতিয়ার। এগুলো দিয়ে অগুস্তি পদাতিকের একজন হওয়া যায়, ছোটোখাটো সেনাপতিও হওয়া যায় না।

তাকে এরা জামাই করবেন বলে ঠিক করে ফেলেছেন এবং বোধহয় ধরেই নিয়েছেন ছেলেটি না বলবে না, রবিন্দু ঠান্ডা মৃদুস্বরে বলল, ‘আমি বুদ্ধিমান, বিবেচক, অগ্রপশ্চাৎ ভেবে কাজ করি, মাত্র এই কটা গুণ দেখেই আপনারা আমায় বাছাই করে ফেললেন? বিয়ে করে বৌকে নিয়ে থাকার ঘর আমার নেই সেটা তো জানেন।’

‘জানি। যতদিন না থাকার মতো ঘর পাচ্ছ ততদিন সীমু আমাদের কাছেই থাকবে। সুকু নেই ওর ঘরটা খালিই রয়ে যাবে, সেখানে তোমরা দুজন থাকবে, মনে হয় সুকু বোম্বাইতেই থেকে যাবে, কলকাতায় শিগ্গিরি আসার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে দিয়েছে। এত ভালো চাকরি কলকাতায় কোথায় পাবে?’ বাসন্তী কথা থামিয়ে লক্ষ করলেন রবিন্দু মন দিয়ে তার কথা শুনছে। উৎসাহিত হয়ে তিনি যোগ করলেন, ‘সুকুর জন্য সল্টলেকে তিন কাঠা জমি কেনা আছে, ও বাড়ি করে নেবে। ফ্ল্যাটটা আমরা সীমুকেই দেব ঠিক করেছি।’

‘আমি তো দেখছি বেশ ভালোই আটঘাট বেঁধে আপনারা পাত্র ধরার কাজে নেমেছেন, যা অফার দিচ্ছেন তাতে আমার থেকেও অনেক ভালো ছেলে পেয়ে যাবেন, তাহলে আমাকে কেন?’ রবিন্দুর কথাগুলো হালকা ব্যঙ্গের মোড়কে মোড়া। বাসন্তী কিন্তু মোটেই উত্তেজিত হলেন না বরং মুখ টিপে হাসলেন।

‘হ্যাঁ, তোমার থেকে ভালো পাত্র পেয়ে যাব, পেয়েছিলুমও কিন্তু কেউ তোমার মতো দেখতে সুন্দর নয়। আমরা সুন্দর বউ চাই, সুন্দর জামাই চাই।’

‘কিন্তু আমিও যে সুন্দরী বউ চাইতে পারি, এটা বোধহয় খেয়ালে রাখেননি। আপনার মেয়ে কি সুন্দরীর পর্যায়ে পড়ে?’

‘একদমই না। আর সে জন্যই তার সুন্দর স্বামী চাই। আমরা চাই সুন্দর চেহারার নাতি নাতনি, সুন্দরের বংশ তৈরি করতে। সুকুর ছেলেমেয়েরা সুন্দর হবে, সীমুরও তাই হোক, এটাই চাই।’

রবিন্দু অবাক হয়ে বাসন্তীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বলে কী! সুন্দরের বংশ তৈরি করার জন্য মানুষ এইভাবে পরিকল্পনা করে এগোতে পারে, এটা তার ধারণার বাইরে ছিল।

‘তুমি খুব অবাক হচ্ছ রবু আমার কথা শুনে, হবারই কথা। সুকুর বউভাতে আমাদের যে আত্মীয়স্বজনরা এসেছিল তাদের তুমি দেখেছ প্রত্যেকেই চলনসই রকমের হ্যান্ডসাম তার মধ্যে তোমার মেসোমশাই আর সীমুকে কী বেখাপ্পা লাগছিল সেটা হয়তো তুমি নজর করোনি কিন্তু আমি করেছি। আমি দেখেছি সবাই তোমার সঙ্গে তোমার বাবার সঙ্গে অন্যরকম ভঙ্গিতে অন্যরকম গলায় কথা বলছিল। এর প্রধান কারণ চেহারা আর ব্যক্তিত্ব। আমি এই দুটো চাই ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্য।’ বাসন্তী নিজের মনের বাসনা আর গোপনে রাখলেন না, কেন রবিন্দুকে জামাই রূপে পেতে চান তা খোলাখুলি বলে দিলেন। তিনি বুঝে গেছেন, রবিন্দুকে আয়ত্তে আনতে হলে স্পষ্টাস্পষ্টি কথা বলাই ভালো।

রবিন্দু আবার জানলার বাইরে তাকাল অন্যমনস্ক ভাবে। বাসন্তীর এই চাওয়াটাকে কী বাতিক বলা যায়? জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার সুন্দরের বংশ তৈরি করেছে বেছে বেছে সুন্দরী মেয়েদের বউ করে এনে। বাসন্তীও সেই পন্থা নিয়েছেন সামাজিক সম্ভ্রম পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেজন্য তাকে কেন হাড়িকাঠে মাথা দিতে হবে। সীমন্তির সঙ্গে আজীবন কাটানোর কথা ভাবতে গিয়ে তার শরীর মন বিমর্ষ বোধ করতে শুরু করল। বাসন্তী টাকা আর ফ্ল্যাটের টোপ রেখেছে। এ দুটো জিনিস খেটেখুটে সংগ্রহ করা যায় কিন্তু সীমন্তি একবার ঘাড়ে চেপে বসলে তাকে নামানো যাবে না।

‘মাসিমা, আমি এখন বিয়ের কথা একদমই ভাবছি না, অন্তত তিন—চার বছর ভাবব না।’

‘তারপর ভাববে তো? সীমুর বয়সও এমন কিছু নয়, তিন—চার বছর সে অপেক্ষা করে থাকতে পারবে।’

বাড়িতে ফিরে এসে ছায়ার নতুন সংসার বিষয়ে পূর্ণেন্দু ও মায়ার অজস্র কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর দিতে হল রবিন্দুকে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও সে বলল না ট্রেনে বাসন্তীর সঙ্গে তার কী কথাবার্তা হয়েছে। সে এটা বুঝেছে বাসন্তীর প্রস্তাব রীতিমতো অমর্যাদাকর এবং শুনলে তার বাবা ওদের সঙ্গে হয়তো বাক্যালাপ বদ্ধ করে দেবে। সম্পর্কটা তিক্ত যাতে না হয় সেজন্যই সে মুখ বুজে রইল।

বোম্বাই থেকে ফিরে আসার এক সপ্তাহ পরই রবিন্দু শুনল মোহনবাগান থেকে নবেন্দু ত্রিশের অর্ধেক পনেরো হাজার টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছে। খবরের কাগজে সম্ভাব্য দলবদলের আলোচনার মধ্যে খবরটা বেরোয় এবং তাতেই নবেন্দু আনন্দ আবাসনে এবং উল্টোডাঙ্গা—বাগমারি এলাকায় পরিচিতি পেয়ে গেল। মাদার ডেয়ারির দুধ আর মুরগির মাংস বিক্রি করে যে লোকটি সে একদিন পূর্ণেন্দুকে বলল, ‘আপনি নবেন্দু গুপ্তর বাবা। আমার খদ্দের, দোকানের কাছেই থাকেন অথচ আপনাকে চিনি না!’ লোকটিকে খুব লজ্জিত দেখায়।

‘হ্যাঁ তাতে হয়েছি কী, সেজন্য আপনি কী একশো গ্রাম মাংস বেশি দেবেন?’ মজা করেই পূর্ণেন্দু বলেন।

লোকটি অপ্রতিভ হয়ে বলে, ‘আমাদের এদিকে বড়ো ক্লাবের প্লেয়ার তো কেউ এতদিন ছিল না, অভাবটা পূর্ণ হল।’

‘আপনি ফুটবল ভালোবাসেন।’

‘দু—বছর আগেও রেগুলার মাঠে যেতুম মোহনবাগানের খেলা থাকলে। এখন দোকান ফেলে আর যেতে পারি না।’ লোকটির স্বরে আক্ষেপ ফুটে উঠল।

‘নবেন্দুর খেলা আপনি দেখেছেন?’

‘দেখব কী করে, ও তো মোহনবাগানে আগে কখনো খেলেনি। গতবছর একটা গোল দিয়েছে তখনই তো নামই জানলুম, অবশ্য ইস্টবেঙ্গকেও একটা দিয়েছে। ওকে যে মোহনবাগান তুলে নেবে সেটা তখন বুঝে গেছলুম।’ লোকটির মুখে ছড়িয়ে পড়ল নিজ অনুমান সফল হওয়ার হাসি। ‘এল তো কিন্তু খেলার চান্স পাবে কিনা বলা শক্ত। সেট টিম, কাকে বসিয়ে ওকে খেলাবে?’ একটু উদবেগ মাখান মুখে লোকটি পূর্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে রইল।

পূর্ণেন্দু মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়লেন প্রশ্নটাকে গুরুত্ব দিয়ে। ফুটবল, মোহনবাগান এই দুয়ের কোনোটা নিয়েই তিনি মাথা ঘামান না শুধু ক্রিকেট ছাড়া, পূর্ণেন্দুর মুখ দেখেই লোকটি বুঝে গেল ময়দানের গূঢ় ব্যাপার—স্যাপার এই প্রৌঢ় কিছুই জানেন না। সে গলা নামিয়ে বলল, ‘এরকম উঠতি বিপজ্জনক প্লেয়ারদের ক্লাব ক্যাচ করে নিয়ে এসে বসিয়ে রেখে দেয়, না খেলিয়ে খেলিয়ে নষ্ট করে দেয়। একবছর বসে থেকে সেই প্লেয়ার যখন বিরক্ত হতাশ হয়ে অন্য ক্লাবে চলে যায় তখন আর আগের মতো খেলতে পারে না। এরকম অনেক দেখেছি। আপনার ছেলেকে বলবেন পলিটিক্স করে হোক বা অন্য যেভাবেই হোক এক আধটা ম্যাচে যেন খেলার জন্য চান্স করে নেয়। ক্লাবে ওর মুরুব্বি কে?’

পূর্ণেন্দু মাথা নেড়ে বললেন, ‘জানি না।’

‘নিশ্চয় কেউ আছে। সেই মুরুব্বির ক্লাবে ক্ষমতা কতটা? ক্ষমতা যদি থাকে তাহলে নবেন্দু খেলার চান্স পেতে পারে, আর একবার মাঠে নামার সুযোগ পেলেই যেন সাপোর্টারদের বুঝিয়ে দেয় ওকে বসিয়ে রেখে ভুল করা হয়েছে। আমার কথাগুলো ছেলেকে বলবেন। আর বলবেন ভুনোদার গ্রুপটা এখন ভেরি স্ট্রং, ওর কথামতো টিম হয়।’

পূর্ণেন্দু মাথা নেড়ে, সাড়ে সাতশো গ্রাম মুরগির মাংস নিয়ে ফিরে আসেন।

.

চার

মাংসের দোকানদার যা বলেছিল ঠিক তাই ঘটল। খবরের কাগজে মোহনবাগানের খেলা থাকলেই পূর্ণেন্দু খেলার পাতাটা পড়েন। মোহনবাগান টিমে নবেন্দু গুপ্ত নামটা একদিনও দেখতে পাননি। তখন দোকানদারের কথাগুলো তার মনে পড়ে। ভাবেন নবুকে জিজ্ঞাসা করবেন। জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে আড়ষ্ট বোধ করেন। লক্ষ করেছেন তার ক্লাবের খেলার দিনে নবু খিটখিটে অধৈর্য হয়ে ওঠে। ফ্ল্যাট থেকে আর বেরোতেই চায় না।

এই রকম একটা দিনে পূর্ণেন্দু দেখলেন বিকেলে বিছানায় শুয়ে রয়েছে। অবাক হয়ে বললেন, ‘আজ তো মোহনবাগানের খেলা হয়েছে, তুই গেলি না?’

নবেন্দু কোনো জবাব দিল না। পূর্ণেন্দু আবার জিজ্ঞাসা করায় সে বলল, ‘শরীরটা ভালো নেই।’

ওর বলার ভঙ্গিতে পূর্ণেন্দু বুঝলেন, এই প্রসঙ্গে আর কথা বলতে চায় না। রাত্রে একসঙ্গে খেতে বসে পূর্ণেন্দু কথাটা তুললেন, ‘ব্যাপার কী বলত, খেলার দিন আজকাল তুই বাড়িতেই থাকিস! তোকে কি খেলায় চান্স দিচ্ছে না?’

নবেন্দু গুম হয়ে থালার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

‘লিগের একটা ম্যাচেও তো টিমে তোর নাম দেখলুম না। সাত—আটটা ম্যাচ হয়ে গেছে!’

নবেন্দু কথা না বলে রুটি ছিঁড়ে তাই দিয়ে তরকারি তুলে মুখে দিল।

‘ক্লাবে নাকি পলিটিক্স হয়? অনেকগুলো গ্রুপ আছে, সত্যি?’

‘তোমায় কে বলল?’

‘মুরগির মাংসা বিক্রি করে যে লোকটা, সে বলেছে।’

‘ঠিকই বলেছে।’

‘বলেছে তুই একটা গ্রুপে ঢুকে পড়, ভুনোদার গ্রুপে ঢুকলে চান্স পাবি।’

‘আমাকে সমরেশদা নিয়ে গেছল, সমরেশদা বরুণ ভটচাযের গ্রুপের লোক। বরুণদা আবার ভুনোদার অ্যান্টি গ্রুপের। আমি বরুণদার লোক বলে দাগি হয়ে গেছি। আসলে এখনই বড়ো ক্লাবে যাওয়াটাই আমার ভুল হয়ে গেছে। সমরেশদার কথাতেই গেছি, বলেছিল তিনটে ম্যাচ খেলিয়ে দেবে এখন দেখছি ওর কোনো পাওয়ারই নেই।

‘তোকে শুধু বসিয়ে রাখার জন্য ক্লাব তিরিশ হাজার টাকা খরচ করবে?’ পূর্ণেন্দুর গলায় আগাগোড়া অবিশ্বাস।

‘তিরিশ হাজার নয় পনেরো হাজার। বাকি পনেরো আর কোনোদিন আদায় করা যাবে না।’ নবেন্দু নিশ্চিত স্বরে কথাটা বলল। তাতে হতাশা নেই। সে যেন জানে টাকা না পাওয়াটাই নিয়ম।

‘এবার সমরেশকে গিয়ে বল, তোমার কথা শুনেই আমার কেরিয়ারের ক্ষতি হল। তুই নিজেও কী বুঝিস না নিজের ভালো কিসে হবে আর কিসে হবে না?’ বহু বছর পর পূর্ণেন্দু প্রায় ধমক দিলেন নবেন্দুকে। বরাবরই অবাধ্য ও উদ্ধত তার ছোটো ছেলে, তাই শাসন করতে যেতেন না মান খোয়াবার ভয়ে।

মুখ নামিয়ে রইল নবেন্দু। মায়া শুনছিলেন ওদের কথা। পাংশু মুখে ভীত স্বরে বললেন, ‘আর টাকা দেবে না? জমি কেনা, বাড়ি করা এ সব তা হলে হবে না? হ্যাঁ রে নবু কিছুই তাহলে হবে না?’

নবেন্দু মরা মাছের মতো ফ্যাকাসে চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে পূর্ণেন্দুকে বলল, ‘সমরেশদাকে আমি বলেছি তুমি আমার যে ক্ষতি করলে তা আর কোনোদিন পূরণ করা যাবে না। এই উঠতি সময়ে একটা বছর নষ্ট হলে মন ভেঙে যায়। ভাঙা মন নিয়ে বড়ো হওয়া যায় না।’

‘সমরেশ কী বলল?’ পূর্ণেন্দু তার অজানা এক জগতের দরজায় দাঁড়িয়ে টোকা দেবার মতো করে জানতে চাইলেন।

‘বলল, আবার তুই কোনো ছোটো ক্লাবে গিয়ে শুরু কর। মোহনবাগান থেকে যাব ছোটো ক্লাবে? লোকে হাসবে কিন্তু কিছু করার নেই। বলেছিল ব্যাঙ্কে চাকরি পাইয়ে দেবে। তাও আর হবে না। বড়ো ক্লাবের বড়ো প্লেয়ারকেই ব্যাঙ্ক নেবে, আমাকে নেবে কেন? নতুন করে আবার উঠে দাঁড়াবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। হ্যাঁ ছোটো ক্লাবেই যাব, আবার গোল দিয়ে মোহনবাগানকে শিক্ষা দোব নইলে হাজার মাধ্যমিক পাশ করাদের একজন হয়েই আমাকে বাঁচতে হবে।’ নবেন্দু খাবারের থালা ঠেলে দিয়ে বেসিনে হাত ধুতে গেল। পূর্ণেন্দু আর মায়া ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন! হাত ধুয়ে প্রায় ছুটেই নবেন্দু ঘরে চলে গেল।

একটা তিনতলা বাড়ি ধসে পড়ছে মায়ার চোখের সামনে আর তিনি ভাঙা বাড়ির চাঙড় সরিয়ে সরিয়ে খুঁজতে লাগলেন এই দুই ঘরের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথটা। পথ না পাওয়া বিভ্রান্ত চোখ দুটি স্বামীর দিকে মেলে তিনি বললেন, ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না।’

একই ভাবে তাকিয়ে পূর্ণেন্দু বললেন, ‘আমিও পারছি না।’

‘ওকে ভালো করে জিজ্ঞেস করে দেখো না। রবু তো বলেছিল সমরেশ লোকটা ভালো নয়।’

‘ক্লাবের ব্যাপার—স্যাপার আমি একদম বুঝি না, এখন জিজ্ঞেস করে দরকার নেই। নবুই ভালো বোঝে, যা করার ওই করবে।’

রবিন্দু ফিরল একটু রাত করে। পূর্ণেন্দু তাকে বসার ঘরে ডেকে নিয়ে নীচু গলায় নবেন্দুর হতাশা ও ভেঙে পড়ার কথাটা বললেন।

চিন্তিত মুখে রবিন্দু বলল, ‘এরকম হয় শুনেছি। টিমের পক্ষে বিপজ্জনক হতে পারে এমন অপোনেন্ট প্লেয়ারকে রিক্রুট করে তারপর তাকে বসিয়ে রেখে নষ্ট করে দেয়। আর সব অল্পবয়সি ছেলেরই তো স্বপ্ন বড়ো ক্লাবের জার্সি পরা। আশ্চর্য ব্যাপার, নবুকে একটা ম্যাচেও খেলাল না।’

স্বপ্ন রবিন্দুও দেখেছিল, ভাই বাড়ি করবে তারপর এই ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে সেই বাড়িতে নবু উঠে যাবে। একটা ঘরে দুটো খাটে তারা দুজন শোয়, একটা আলনা ভাগ করে দুজনে ব্যবহার করে, টুলের মতো দুটো টেবলে তারা ছোটোখাটো জিনিস রাখে, খাটের নীচে দুজনের দুটো সুটকেশ, ঘরে নড়াচড়ার জায়গা নেই। রবিন্দুর আশা ছিল পুরো ঘরটাই একদিন তার হবে। হলে হাঁফ ছাড়ার সুযোগ পাবে। এমনকী তখন বিয়ের কথাও সে ভাবতে পারবে।

রবিন্দু বলল, ‘কিন্তু ও ক্লাবে যাওয়া বন্ধ করল কেন? এটা ঠিক কাজ নয়। যাক, রোজ যাক। বলা তো যায় না একদিন চান্স তো পেয়েও যেতে পারে।’

‘সেটা তুইই ওকে বুঝিয়ে বল। আমি বললে শুনবে না।’

অন্ধকার ঘরে চিৎ হয়ে নবেন্দু শুয়ে, কপালে আড়াআড়ি রাখা দুটো হাত। দেখেই রবিন্দু বুঝল ঘুমোয়নি, ভাবছে।

নবেন্দুর পাশে খাটে বসে সে বলল, ‘যাচ্ছিস না কেন ক্লাবে? ভুল করছিস, নজরের বাইরে থাকলে তোকে তো ওরা ভুলে যাবে। ফুটবল এমন একটা খেলা কখন যে কাকে দরকার পড়ে যাবে কেউ বলতে পারে না। বড়ো ক্লাবে মান অভিমান চলে না আর তুই এতবড়ো প্লেয়ার নোস যে বাড়িতে এসে সাধাসাধি করবে। ধৈর্য ধরে থাকতে হয়। কালই যাস।’

দাদার সহানুভূতি ভরা আন্তরিক স্বর নবেন্দুর মাথায় ঢুকল। পরদিন থেকে সে ক্লাবে গিয়ে সকালের প্র্যাকটিসে যোগ দিল। রবিন্দু যা বলেছিল ঠিক তাই ঘটল। মিড ফিল্ডার গৌতম পালের কুঁচকির পুরোনো চোটটা আবার ফিরে এল ইস্টার্ন রেলের সঙ্গে খেলায়, পরের ম্যাচ এরিয়ান্সের বিরুদ্ধে সে খেলতে পারবে না। স্থির হল দুই নবাগত সমীর পোল্যে আর নবেন্দু গুপ্তকে ম্যাচটায় খেলানো হবে আধাআধি করে, প্রথমার্ধে সমীর দ্বিতীয়ার্ধে নবেন্দু। খবরটা নবেন্দু বাড়িতে জানাল ম্যাচের আগের দিন।

পূর্ণেন্দু কখনো ফুটবল ম্যাচ দেখতে ময়দানে যাননি, মোহনবাগান মাঠটাও চেনেন না। ঠিক করলেন ম্যাচটা দেখতে যাবেন। বেলা তিনটে নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহিদ মিনারের কাছে বাস থেকে নেমে একটি অল্পবয়সি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নিলেন মোহনবাগান মাঠটা কোন দিকে। ছেলেটির আঙুল তুলে দেখিয়ে দেওয়া দিক লক্ষ করে কয়েকটা রাস্তা ও মাঠ পেরিয়ে পৌঁছলেন সবুজ গ্যালারির টিকিটের জন্য দাঁড়ানো লাইনে। মিনিট পনেরো পর তিনি জীবনে প্রথম ঘেরা মাঠে ঢুকলেন।

গ্যালারির মাঝ বরাবর বসে তিনি সামনে ঝুঁকে আধাবয়সি লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্লেয়াররা মাঠে নামবে কোনখান দিয়ে?’

লোকটি মাথা ঘুরিয়ে কয়েক সেকেন্ড পূর্ণেন্দুর মুখ দেখে নিয়ে মাঠের ওপারে সিমেন্টের সদস্য গ্যালারির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘ওর মাঝে যে সরু পথটা দেখছেন ওখান দিয়ে। মাঠে আজ প্রথম এলেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

যখন এসে বসেন তখন গ্যালারি অর্ধেক ভরা ছিল, ক্রমশ ঠাসাঠাসি হয়ে ভরে উঠল। পূর্ণেন্দুর মনে হল মাঠের তিন দিক ঘিরে হাজার কুড়ি পঁচিশ লোক তো হবেই। চতুর্থ দিকে কোনো গ্যালারি নেই। গোলপোস্টের পিছনে কিছুটা ফাঁকা জমি তারপর বেড়া। তার ওধারে কেল্লার ঢালু জমিতে থিকথিক করছে লোক। এই ঢালে দাঁড়িয়ে মাঠটা দেখা যায়। পূর্ণেন্দু ভেবে পেলেন না অতদূর থেকে লোকগুলো খেলার কতটা দেখতে পাবে!

চারপাশের লোকেদের কথাবার্তা থেকে তার মনে হল সবাই মোহনবাগানের সমর্থক আর সহজেই জিতে যাব এমন ধারণা কেউ করছে না।

‘আরে মশাই সবার ধারণা ইস্টবেঙ্গলই বুঝি মোহনবাগানের চির প্রতিদ্বন্দ্বী, ভুল ভুল, চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হল এরিয়ান্স সেই জন্মের সময় থেকে।’ পূর্ণেন্দুর পিছনে কেউ একজন বলল। ‘বাগবাজার আর শ্যামপুকুর দুটো পাড়ার রেষারেষি আকচাআকচি থেকে খেয়োখেয়ি। আশি নব্বুই বছর আগের কলকাতার সঙ্গে গ্রামের কোনো তফাত ছিল না।’

‘দাদা আজও কী কোনো তফাত আছে।’ কেউ ফোড়ন কাটল।

‘দেখবেন মোহনবাগানের সঙ্গে খেলা পড়লেই নড়বড়ে এরিয়ান্স কী রকম শক্ত হয়ে যায়। আলাদা একটা জেদ ওদের ওপর চেপে বসে। সেই দুখিরামবাবুর আমল থেকে এটা হয়ে আসছে।’

কে দুখিরামবাবু? পূর্ণেন্দু সামনের লোকটিকে জিজ্ঞাসা করবেন ভাবলেন। কিন্তু সেই চাহনি আর ‘মাঠে প্রথম এলেন’ তাকে দমিয়ে রাখল।

‘গৌতম পাল আজ খেলছে না, তার জায়গায় দুটো হাফে দুটো নতুন ছেলেকে খেলিয়ে দেখবে। ওদের খেলা দেখেছেন নাকি?’

‘সমীর ছেলেটা স্পোর্টিংয়ের এগেনস্টে সেকেন্ড হাফে খেলেছিল, চলনসই তবে নবেন্দু ছেলেটাকে দেখিনি।’

পূর্ণেন্দু উৎকর্ণ হলেন নবেন্দুর নাম শুনে।

‘গত বছর মোহনবাগানকে গোল দিয়েছিল। এ বছর একটাও ম্যাচ খেলেনি।’

‘গোলটা দেখেছি, বিশ গজ থেকে মেরেছিল, ছেলেটার মাথাটা পরিষ্কার, দু পায়ে শট আছে, ভিড়ে ঢুকে ধাক্কাধাক্কি করতে পারে, কেন যে বসিয়ে রেখেছে বুঝতে পারছি না।’

কথাগুলো যে বলল তার গলায় দরদের ছোঁয়া পেয়ে পূর্ণেন্দুর মন কৃতজ্ঞতায় ফেঁপে উঠল, মাঠের একটা কোণের দিকের গ্যালারি থেকে মৃদু হাততালি উঠল। এরিয়ান্স দল মাঠে নেমেছে। তিন মিনিট পর বিপুল হো হো ধ্বনি আর সারা মাঠের হাততালির সঙ্গে গ্যালারির মানুষরা দাঁড়িয়ে পড়ল। পূর্ণেন্দুও উঠে দাঁড়ালেন। মোহনবাগান দল মাঠে আসার জন্য সরু পথটা দিয়ে এগিয়ে আসছে। খেলোয়াড়দের আসতে দেখেই এই সম্বর্ধনা। জমিতে হাত ঠেকিয়ে হাত কপালে ছুঁয়ে ওরা চোদ্দোজন মাঠে পা রাখল। পূর্ণেন্দুর চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে নবেন্দুকে। অবশেষে দেখতে পেলেন।

চারটে বল নিয়ে মোহনবাগান মাঠে নেমেছে। গোলে শট নিচ্ছে, নিজেদের মধ্যে দেওয়া নেওয়া করছে যারা তাদের একজন নবেন্দু। কিছুক্ষণ পর রেফারির বাঁশি শুনে নবেন্দু আরও দুজনের সঙ্গে মাঠের বাইরে এসে বেঞ্চে বসল। প্রথমার্ধের খেলায় কোনো দল গোল করতে পারল না। পূর্ণেন্দু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করলেন দ্বিতীয়ার্ধের জন্য। দেখলেন নবেন্দু নেমেছে। বলের জন্য ছোটাছুটি করছে, তাড়া করছে। একবার বল পেয়ে ডানদিকে একজনকে এমন ঠেলে দিল যে বলটা এরিয়ানসের প্লেয়ারের পায়ে জমা পড়ল।

পূর্ণেন্দুর মনে হচ্ছে নবু একটা কিছু করে দেখাবার জন্য মরিয়া হয়ে এলোমেলো করে ফেলছে তার খেলা। এইভাবে খেলতে খেলতে নবেন্দু একটা পঁচিশ গজের শট নিল। গোলকিপার কোনোক্রমে বলটা বারের উপর তুলে দিল। কর্নার, কর্নার কিক থেকে বলটা গোলের সামনে উঁচু হয়ে পড়ছে। গোলকিপার বল ধরার জন্য এগিয়ে এসেও পিছিয়ে গেল। মোহনবাগানের লম্বা বাক্যটি উঠে এসেছে সে হেড করে বল গোলের মধ্যে পাঠিয়ে দিল।

গগনবিদারী চিৎকার কী বস্তু পূর্ণেন্দু জীবনে এই প্রথম তার স্বাদ পেলেন। চিৎকার সবে থিতিয়েছে তখনই মোহনবাগান গোল খেয়ে গেল। দোষটা ছিল ওই লম্বা ব্যাকেরই। গোলের সামনে সে পায়ে বল নিয়ে অযথা বাহাদুরি দেখাতে বিপক্ষ ফরোয়ার্ডকে একবার কাটিয়ে আবার কাটাতে গেল। বলটা পা থেকে একটু বেরিয়ে যেতেই ফরোয়ার্ডটি দুম করে বলটা গোলে মেরে দেয়। গোলকিপারকে হতভম্ভ করে বলটা গোলে ঢুকে যায়। সারা মাঠ স্তব্ধ।

দশ মিনিট পর মাঝমাঠ থেকে বল দিয়ে নবেন্দু বুনো মোষের মতো সোজা ঢুকল এরিয়ান্স রক্ষণের মধ্যে। দুজনকে শুধু গতিতে পার হয়ে বলটা পাশে একজনকে ঠেলে দিতেই সে সঙ্গে সঙ্গে বলটা ছুটন্ত নবেন্দুর সামনে বাড়িয়ে দিল। বাঁক নেওয়া পনেরো গজের প্রচণ্ড একটা শট এবং গোল। আবার গগনবিদারী চিৎকার। সহখেলোয়াড়রা জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে নবেন্দুকে। থরথর কেঁপে উঠলেন পূর্ণেন্দু। সবার সঙ্গে তিনিও চিৎকার করে উঠেছিলেন। নবু এখন মাঠের হিরো। চেঁচিয়ে তার বলতে ইচ্ছে করছে, ‘ও আমার ছেলে, আমার ছেলে।’

‘বহুদিন পরে একটা গোলের মতো গোল দেখলুম মশাই।’ সামনের লোকটি মুখ ফিরিয়ে বলল।

‘ছেলেটাকে এতদিন বসিয়ে রেখেছিল।’ পূর্ণেন্দু ক্ষুব্ধ স্বরে বললেন সবাইকে উদ্দেশ্য করে।

খেলা যত এগিয়েছে পূর্ণেন্দু ততই খেলার সঙ্গে মিশে যেতে লাগলেন। হাজার হাজার দর্শকের সঙ্গে একাত্ম বোধ করছেন। এমন ভাবে কখনো তিনি নিজেকে উপভোগ করেননি। দুই মুষ্ঠিবদ্ধ হাত উপর দিকে ছুঁড়লেন, পা ঠুকলেন, চিৎকার করলেন এবং নিজের বয়সটা ভুলে গেলেন। নবেন্দুকে নিয়ে প্রশংসার ঘূর্ণির মধ্যে তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন। উঠে এল নবু, সমর্থকরা ওর পিছনে এসে দাঁড়াবে। আর ওকে বসিয়ে রাখা যাবে না। খেলায় নবেন্দুর গোলেই মোহনবাগান জিতল। ভিড়ের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে এসপ্ল্যানেডে আসার পথে তিনি অনেকবার মায়ার মুখটি দেখতে পেলেন।

বাস থেকে নেমে বহুদিন পর মুরগির মাংসের দোকানের সামনে দিয়ে আজ তিনি এলেন। দোকানদার তাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কাকাবাবু, রিলেতে শুনলুম নবেন্দুর গোলে আমরা জিতেছি।’

পূর্ণেন্দু চোখেমুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললেন, ‘তাই নাকি! বাঃ বেশ ভালো খবর দিলেন।

‘মাংস নেবেন না? আজই তো খাবার দিন।’

ইতস্তত করে তিনি বললেন, ‘দিন এক কেজি।’

.

পাঁচ

রবিবার সন্ধ্যাবেলায় টিভি—তে বাংলা সিনেমা দেখছিলেন মায়া ও পূর্ণেন্দু। ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই। কাজের মেয়েটি এইমাত্র চলে গেল। এমন সময় কলিং বেল বাজল। মায়া উঠতে যাচ্ছিলেন তাকে হাত তুলে বারণ করে পূর্ণেন্দু উঠলেন। মায়ার বাতের ব্যথা দিনকয়েক হল বেড়েছে। দরজা খুলে পূর্ণেন্দু অবাক।

‘আরে অমিয়, তুমি!’

‘অবাক করে দিলুম তো। প্রায় দু—বছর পর।’

‘হ্যাঁ প্রায় দু—বছর পর এলে। ভেতরে এসো।’ পূর্ণেন্দু টিভি বন্ধ করলেন।

অমিয় বসার ঘরের একমাত্র চেয়ারটায় বসে বলল, ‘মাসিমা কেমন আছেন?’ মায়ার মুখে স্বচ্ছন্দ হাসি ফুটে উঠল। ছায়ার বিয়ে হয়ে গেছে। তার বাচচা হওয়ার তারিখ আর পাঁচমাস পর। বোম্বাইয়েই হবে। তখন ওখানে গিয়ে তার মাস দুই থাকার ইচ্ছা। অমিয় এখন আর তার কাছে অবাঞ্ছিত নয়, সুতরাং হাসতে পারেন।

‘এতদিন পর আমাদের মনে পড়ল।’ মায়া প্রথামাফিক অনুযোগ করলেন।

‘মনে ঠিকই পড়ত, আসার সময় করে উঠতে পারিনি। কাঁকুড়গাছিতে একটা কাজ শুরু করেছি তাই এদিকে আসতে হচ্ছে।’

‘তুমি তো ইনটিরিয়ার ডেকরেশনের ব্যবসা শুরু করেছিলে। সেটাই চালিয়ে যাচ্ছ?’ পূর্ণেন্দু কৌতূহল দেখালেন।

‘হ্যাঁ, যাচ্ছি। এই উল্টোডাঙ্গার মোড়ে একটা বড়ো চশমার দোকান হচ্ছে, সেটারই কাঠের ব্যতীত কাজ, আর্ট ডেকরেশন এইসব করছি। গুজরাতি মালিক কলকাতায় চারটে দোকান, ওখানে প্রচুর পয়সা ঢালছে। আপনাদের এই দিকটা, বেলেঘাটা থেকে উল্টোডাঙ্গা পর্যন্ত সল্টলেকে আর এয়ারপোর্টে যাবার রাস্তাটা বিরাট উন্নতি করবে, দশ বছর পর আর চেনা যাবে না। কলকাতার সেরা জায়গা হবে।’

‘কী করে বুঝলে তুমি?’ পূর্ণেন্দু আগ্রহ দেখালেন।

‘রাস্তার দু—ধারে পয়সাওলা লোক বেশিরভাগই মাড়োয়ারি বা অবাঙালিতে ভরে যাচ্ছে। দামিদামি জিনিসের দোকান হচ্ছে, প্রত্যেকটা বড়ো ব্যাঙ্ক এখানে ব্রাঞ্চ খুলেছে, গন্ডায় গন্ডায় হাউজিং হচ্ছে তাতে বাস করছে উচ্চচ মধ্যবিত্তরা। মেসোমশাই আপনাদের এদিকটায় লোকের হাতে প্রচুর টাকা।’

‘কই আমার হাতে তো টাকা নেই। এই দেখোনা আমার ঘরদোরের অবস্থা, যা তুমি দেখে গেছলে এখনও তাই রয়েছে একটা নতুন জিনিসও বাড়েনি,’ পূর্ণেন্দু হাত দিয়ে ঘরের চারপাশটা দেখালেন।

‘বাড়েনি বলছ কী!’ মায়া ছদ্ম গাম্ভীর্য মুখে এনে বললেন, ‘আমার বাতের ব্যথাটা বেড়েছে না?’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়, আর আমার চশমার পাওয়ার।’ পূর্ণেন্দু হাসলেন, তার সঙ্গে অমিয়ও।

‘কাগজে নবুর নাম দেখি, ভালোই খেলছে।’ অমিয় কথা চালাবার জন্য বলল, ‘জমিটমি কিনেছে? বলেছিল আমাকে দিয়ে ইন্টিরিয়র ডেকরেশন করাবে। বলেছিলুম গড়িয়ার দিকে কিনতে, এখন দাম বিশ হাজারে উঠে গেছে।’

‘আর জমি কেনা!’ পূর্ণেন্দু সোফায় হেলান দিলেন হতাশভঙ্গিতে। ‘তখন বলেছিল বটে বাড়ি করব, এখন বলছে হাতে লাখ দুয়েক টাকা না জমলে বাড়ি করতে যাওয়াটা বিপজ্জনক। প্রথম বছরেই যে ভাবে বসিয়ে রেখেছিল তাতে ওর শিক্ষা হয়ে গেছে। আবার যে বসতে হবে না তার কী কোনো গ্যারান্টি আছে? প্লেয়ার সব সময় ফর্মে থাকবে তার নিশ্চয়তা কী কেউ দিতে পারে? যে কটা টাকা পেয়েছে তা জমি বাড়িতে ইনভেস্ট করল, ওদিকে টিম থেকে বসিয়ে দিল, চাকরিবাকরিও নেই অবস্থাটা তখন কী হবে একবার ভাব!’

পূর্ণেন্দু অমিয়কে ভাববার জন্য চার—পাঁচ সেকেন্ড সময় দিয়ে নিজেই সমাধানের সূত্রটা তুলে নিলেন। ‘ও যা বলেছে আমার মনে হল সেটাই ঠিক, এখন তো প্লেয়ারদের দর লাখ টাকায় উঠেছে। মজিদ বাসকার পেয়েছে আরও অনেকে লাখের কাছাকাছি পাচ্ছে। আমি বলছি না নবু মজিদের ক্লাসের, তবে বছর দশেক যদি বড়ো ক্লাবে খেলতে পারে ফর্ম রেখে আর চাকরি যদি একটা পায় তাহলে সাত—আট লাখ জমিয়ে ফেলতে পারে, পারবে না?’

পূর্ণেন্দুর ও মায়ার মুখ দেখে অমিয় বুঝে নিল তাকে কী উত্তর দিতে হবে। ‘সাত—আট লাখ কেন, দশ বছরে প্লেয়ারদের এক একটা সিজনের জন্য পাঁচ—ছ লাখে পৌঁছে যাবে। নবু দশ বছর খেলতে পারলে পনেরো ষোলো লাখ কামাবে। ততদিনে নিশ্চয় একটা চাকরিও পেয়ে যাবে।’

মায়া খুশি হয়ে বললেন, ‘অমিয় চা খাবে?’

‘এই একটা নেশা, কখনো না বলতে পারি না। দিনে বারো—চোদ্দো কাপ হয়ে যায়।’

মায়া সোফা থেকে উঠতে গিয়ে ‘আহহ’ বলে হাঁটু ধরে আবার বসে পড়লেন। ‘ব্যথাটা সকাল থেকে আবার চাগিয়েছে। কাজের মেয়েটা এই একটু আগে চলে গেল, থাকলে চা—টা করে দিত।’

‘আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না মাসিমা, চা না খেলেও এখন চলবে।’

‘এই একটা রোগ মানুষকে অথর্ব করে দেয়।’ মায়া চেষ্টা করে এবার উঠে দাঁড়ালেন, ‘তুমি বোসো অমিয় অনেকদিন পর এলে, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যাও।’

মায়া ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর অমিয় বলল, ‘মেসোমশায়ের এখন সময় কাটছে কেমন করে?’

‘টিভি দেখে। অখাদ্য প্রোগ্রাম, যা দেখায় সেটাই গিলতে হয়। মনোপলির এই এক ঝামেলা, কম্পিটিটার নেই ফলে উন্নতির কোনো চেষ্টাও নেই।’

পূর্ণেন্দুর কথা শেষ হওয়া মাত্রই বিকট শব্দে বাইরের মাঠে একটা পটকা ফাটল। তিনি উঠে গিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দেখে ফিরে এলেন।

‘বোধহয় একটা রয়ে গেছল সেটাই ফাটাল। দুদিন ধরে যা হল, কান ঝালাপালা করে দিয়েছিল। টিভি—তে দেখলুম, অমিয় তুমি দেখেছ? কপিল কী ক্যাচটাই নিল ভিভ রিচার্ডসের!’

‘ক্যাচ বলে ক্যাচ! পনেরো কুড়ি গজ পিছনে ছুটে গিয়ে ওইভাবে ধরা! ম্যাচটাতো তখনই ঘুরে গেল। ভিভ থাকলে একশো তিরাশি তো হেসে খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তুলে নিত।’ অমিয় চেয়ারের কিনারে এগিয়ে এল উত্তেজিত হয়ে।

‘তুমি বলছ ম্যাচের ওটাই টার্নিং পয়েন্ট? কিন্তু জিম্বাবোয়ের এগেনস্টে যে ইনিংসটা কপিল খেলল তাকে কী বলবে? ওটা তো সারা টুর্নামেন্টের টার্নিং পয়েন্ট!’

‘হান্ড্রেড পারসেন্ট একমত আপনার সঙ্গে। টার্ন ব্রিজ ওয়েলসে ওইরকম ব্যাটিং…সতেরো রানে পাঁচটা উইকেট পড়ে গেছে—’।

‘অমিয় কথাটা টার্ন নয় টান, টান ব্রিজ ওয়েলস।’

পলকের জন্য অমিয়র মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। সামলে নিয়ে সপ্রতিভ ভাবে লঘু স্বরে সে বলল, ‘এই আমার বড়ো ঘাটতি মেসোমশাই, ইংরিজি উচ্চচারণটা ঠিকঠাক হয়না, পেস বোলিংটা স্পেস বোলিং হয়ে যায়, ডাইভ হয়ে যায় ড্রাইভ।’ কথা শেষে সে বোকার মতো হাসল।

‘এই যে ভুল উচ্চচারণের কথা বললে, এর বড়ো কারণ শব্দগুলো যখন পড় তখন বানানটা লক্ষ করোনা। অভ্যাসটা ছোটোবেলা থেকে তৈরি হয়ে গেছে। এই যে ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যানদের অফ স্টাম্পের বাইরে ব্যাট বাড়িয়ে স্লিপে ক্যাচ দেওয়া, এটাও সেই অভ্যাসের ব্যাপার।’ অধ্যক্ষ পূর্ণেন্দু গুপ্তকে বহুদিন পর যেন ফিরে পেলেন পূর্ণেন্দু। ক্লাসে এই ভঙ্গিতেই ছাত্রদের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিতেন।

‘মেসোমশাই, সত্যিকারের একটা ফাস্ট বোলার নেই, একটা স্পিনার নেই, তা সত্ত্বেও লয়েডের টিমকে একশো চল্লিশ রানে শেষ করে দেওয়াটা স্রেফ মিরাকল।’

পূর্ণেন্দু বহুদিন পর ক্রিকেট নিয়ে কথা বলারও শ্রোতা পাওয়ার সুযোগ পেয়ে সুদীপ্ত হয়ে উঠলেন। নবুর সঙ্গে ফুটবল ছাড়া আর কিছু নিয়ে কথা বলা যায় না, রবুর কোনো খেলাই পছন্দ নয়, মায়ার কাছে বিশ্বকাপের থেকে চায়ের কাপ অনেক মূল্যবান।

‘অমিয় ওই জয়টা মিরাকল বা ফ্লুক বলতে পার কিন্তু দ্বিতীয়বার এটা ঘটবে না, এ জিনিস একবারই হয়। খবরের কাগজটা মন দিয়ে যদি পড়তে তাহলে একটা খবর তোমার চোখে পড়ত, এবার ইংল্যান্ডে সিজনের গোড়ায় খুব বৃষ্টি হয়েছিল। মাঠ, পিচ ভিজে ছিল, আবহাওয়াও স্যাঁতসেঁতে, উইকেট স্লো, বল যতটা সীম করে তার থেকেও বেশি করেছে। এই রকম কন্ডিশনে মারাত্মক হয়ে ওঠে সেই সব মিডিয়াম পেসারেরা যাদের লেংথ, লাইন আর সুইংয়ের ওপর ওস্তাদি আছে, ইন্ডিয়ান বোলারদের তা ছিল, ঠ্যাঙাড়ে ব্যাটসম্যানদের ঠান্ডা করে দেওয়ার মতো আইডিয়াল কন্ডিশন আমাদের বোলাররা পেয়ে গেছল। আমার কথার পয়েন্টটা কী তুমি ধরতে পারছ?’ পূর্ণেন্দু উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকলেন।

‘বরাত জোরে আমরা জিতেছি।’ অমিয় একটি বাক্যে সার কথাটা বলে দিল।

‘আর কমাস পরেই তো ওরা ভারতে ট্যুর করতে আসছে। দেখো ইন্ডিয়ান কন্ডিশনে কী হয়, দুরমুস করে দিয়ে যাবে।’ পূর্ণেন্দু প্রত্যয় ভরে বললেন।

অমিয় মাথা নেড়ে বলল, ‘আপনি এত নেগেটিভ চিন্তা করছেন কেন, আমরা তো ওদের হারাতেও পারি।’

পূর্ণেন্দু স্থির চোখে সামনে বসা উদীয়মান ব্যবসায়ীটিকে লক্ষ্য করতে করতে বললেন, ‘নেগেটিভ চিন্তা নয় এটা হল যুক্তিযুক্ত বিবেচনা প্রসূত ধারণা, নানান দিক দেখে একটা সিদ্ধান্তে আসা। আমার এই মানসিকতাই পেয়েছে শুধু রবু কিন্তু নবু পায়নি। তবে একটা কথা কী জানো, কখন যে কোথা থেকে অজানা ঘটনা এসে সব হিসেব নিকেশ, কষে রাখা ছক তছনছ করে দেবে কেউ তা জানে না; তেমনই ভালো ঘটনাও ঘটে যায় ছায়ার বিয়েটার মতো।’

পূর্ণেন্দু লক্ষ করলেন না অমিয়র বসাটা হঠাৎ শক্ত হয়ে গেল। বলার ঝোঁকে তিনি বললেন, ‘আমি তো ভেবেছিলুম চেনাশোনা লোকেদের কাজে পাত্রের কথা বলতে হবে, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে দেখে চিঠিপত্র লিখতে হবে। তখনই বাড়িতে বেল বাজিয়ে ছেলের মা হাজির। এম টেক, উচ্চচশিক্ষিত, বোম্বাইয়ে তিন হাজার টাকা মাইনের চাকরি, দেখতে ভালো, ভদ্র মার্জিত রুচি, বয়স কম, দাবি দাওয়া নেই, সব থেকে বড়ো কথা স্বজাতি স্বগোত্র—আর কী চাই! ভাবতে পার অমিয়, এটাকে মিরাকল বলবে না?’

‘নিশ্চয় মিরাকল, ইন্ডিয়ার ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার মতো।’ অমিয় প্রয়োজনের অতিরিক্ত উৎসাহ দেখিয়ে বলল, ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ কাকে বলবেন?’

‘তোমার মাসিমা।’

তখন ট্রেতে চায়ের কাপ আর পাঁপর ভাজা নিয়ে মায়া ঘরে ঢুকলেন।

‘আমার কথা যেন হচ্ছে মনে হল।’

‘ছায়ার বিয়েটাকে অমিয় ওয়ার্ল্ড কাপ জেতার মতো বলল। আমি বললুম ম্যান অব দ্য ম্যাচ তোমার মাসিমা।’ পূর্ণেন্দু নিঃশব্দে হেসে একটা পাঁপড় তুলে নিয়ে বললেন, ‘অমিয় শুরু করো।’

মায়া বিব্রত স্বরে অমিয়কে বললেন, ‘এত তাড়াহুড়োয় বিয়েটা হল যে সবাইকে নেমন্তন্ন করা গেল না।’

অমিয় কথাটা না শোনার ভান করে বলল, ‘মাসিমা এই পা নিয়ে কষ্ট করে রান্না ঘরে যাচ্ছেন কেন, একটা রাঁধুনি রাখলেই তো পারতেন, কত আর খরচ? আড়াইশো বড়োজোর তিনশো।’

‘ব্যাপারটা তো খরচের নয় পারিবারিক রীতির। এনাদের আবার বাইরের লোকের হাতে রান্না মুখে রোচে না।’ মায়া ঠোঁট মুচড়ে স্বামীকে আঙুল দিয়ে দেখালেন। ‘তাই বাড়ির মেয়ে—বউয়েদের দিয়ে রাঁধান। এই রীতি নাকি ঠাকুরদার বাবার আমল থেকে চলে আসছে। কত শিক্ষিত শিক্ষিত ছেলে তো এদের বংশে জন্মেছে কেউ কিন্তু মেয়েদের মুখ চেয়ে এই রীতিটা ভাঙার চেষ্টা করেনি, ইনিও সেই দলের।’ মায়া আবার আঙুলটা স্বামীর দিকে তুলে দেখালেন। অমিয় বুঝতে পারল মায়ার অভিযোগের আড়ালে প্রশ্রয় রয়েছে।

‘আসলে কী জান অমিয়, তোমার মাসিমার হাতের রান্না একবার খেলে অন্য কারুর রান্না আর মুখে দেওয়া যায় না। যদি উনি চান তাহলে আমি রীতি ভাঙতে রাজি আছি।’ পূর্ণেন্দু ঠোঁট টিপে তেরছা চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।

‘থাক থাক এই বুড়ো বয়সে রীতি ভেঙে আর কাজ নেই। মায়ার কথার মধ্যে তিক্ততা আর পরিহাস দুটোই রয়েছে।

‘মাসিমা ঠিকই বলেছেন, রীতি ভাঙতে যাবেন কেন। ওনার এখন কষ্ট হয়। রবুর বিয়ে দিন, রান্নাঘরটা ছেড়ে দিন বউমার হাতে, প্রবলেম সলভড!’ অমিয় দুটো কাঁধ তুলে সমস্যার ফয়শালা বুঝিয়ে দিল, দুই প্রৌঢ়র মুখের ভাব সে লক্ষ করল। সেখানে দ্বিধা জড়িত অনুমোদন।

‘কিন্তু রবু কী এখন বিয়ে করতে রাজি হবে?’ পূর্ণেন্দু সন্দেহ প্রকাশ করলেন।

‘রাজি না হবার কী আছে। বয়স বত্রিশ—তেত্রিশ তো হল, আর কবে বিয়ে করবে?’

‘একটা রিজনেবল লেভেলে রোজগার না হলে কী বিয়ে করা যায়? রবু বলেছিল মাসে হাজার পাঁচেক আয় করতে পারলে আর নবু বাড়ি করে চলে গেলে তখন বিয়ের কথা ভাববে।’

অমিয় অবাক হয়ে বলল ‘কিন্তু আপনি যে এইমাত্র বললেন নবু এখন বাড়ি করবে না, হাতে লাখ দুয়েক জমলে তখন করবে।’

‘রবু বলেছিল অনেকদিন আগে তখন নবু বাড়ি করবে বলেছিল, তার পর মত বদলায়। আমি ওকে বলি তুই কোথাও বাসভাড়া করে থাক না। তাইতে নবু বলে ক্লাব থেকে যে টাকা পাই তাই দিয়ে বাসভাড়া করে থাকতে পারব বটে কিন্তু যদি কোনো কারণে ক্লাব খারাপ ব্যবহার শুরু করে, যদি টাকা আটকে দেয়, লিখিত তো নয় সবই মৌখিক চুক্তি। প্রথম সিজনটা নবু খুব ভালো খেলে টিমে জায়গা করে নেয়, পরের বছর তত ভালো খেলতে পারেনি, পরপর ছটা ম্যাচে গোল পায়নি, ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ভাইটাল ম্যাচে দুটো প্রায় ওপেন নেট মিস করে। ওকে বসিয়ে দেওয়ার কথা উঠেছিল। নবু সেই যে তখন নিজের ওপর আস্থা হারাল আজও তা উদ্ধার করতে পারেনি।’

পূর্ণেন্দুর কথায় সুর থেকে অমিয়র কানে ধরা পড়ল এই পরিবারের জীবনযাপনের মধ্যে অসঙ্গতি এবং সেটা শুধুই নবুর ফুটবল কেরিয়ারকে উপলক্ষ্য করে, নবু যেমন চাপের মধ্যে রয়েছে তেমনি এই দুই প্রৌঢ়, হয়তো রবুও।

‘মাসিমা আপনি কতদিন আর কষ্ট করে এ ভাবে রান্না করে সংসার দেখাশোনা করবেন? আপনার তো এখন বিশ্রাম নেবার কথা। মেসোমশাই আপনাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ছেড়ে এবার বেরিয়ে আসুন, একটা রাঁধুনি আর নয়তো রবুর বিয়ে দিয়ে একটা বৌমা আনুন।’

পূর্ণেন্দু সিধে হয়ে বসে গলা চড়িয়ে বললেন, ‘আমি তো বলেছি রাঁধুনি রাখো। কিন্তু এই উনি—’ তিনি আঙুল তুললেন মায়ার দিকে আর তখনই দরজায় বেল বাজল। অমিয় দ্রুত উঠে গিয়ে দরজা খুলল। রবিন্দু দাঁড়িয়ে। অমিয়কে দেখে বিস্ময়ে তার ভ্রূ উঠে গেল।

অমিয় বলল, ‘আয়, তোর কথাই হচ্ছিল।’

‘এতদিন পর এলি আমার কথা বলার জন্য!’ রবিন্দু ঘরে এসে বসার জায়গা না পেয়ে খাওয়ার টেবিলের একটা চেয়ার নিয়ে এল।

‘তুই বিয়ে করছিস না কেন? মাসিমার কষ্ট কী তার চোখে পড়ে না?’

রবিন্দুর হাসি মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। চোখ কুঁচকে মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা আমি করিনি। বিয়ে করে থাকব কোথায়?’

অমিয় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘কেন, এই ফ্ল্যাটে।’

‘নবু তাহলে থাকবে কোথায় আর বাবা মা? ঘর তো মোটে দুটো!’

‘তুই বিয়ে করবি বল, নবুর থাকার ব্যবস্থা আমাদের গড়িয়ার নতুন বাড়িতে করে দোব। ব্যাচিলার, একটা ঘর হলেই তো চলে যাবে, কোনো অসুবিধে হবে না থাকতে। নবু নিশ্চয় দাদার মুখ চেয়ে রাজি হয়ে যাবে। তার আগে তুই বল, তুই রাজি?’

দরজায় বেল বাজল, রবিন্দু উঠে গিয়ে দরজা খুলল। ঘর থেকে ওঁরা শুনতে পেলেন একটি মেয়ের গলা, ‘জানলা থেকে দেখলুম আপনি ফিরছেন তাই ভাবলুম অঙ্কটা একটু ঝালিয়ে নিয়ে আসি। আপনি কী খুব ব্যস্ত?

‘আমার এক পুরোনো বন্ধু এসেছে।’

‘তাহলে আমি এখন যাই।’

‘না না বোসো, পরীক্ষার তো আর এক মাসও বাকি নেই। তুমি বরং খাওয়ার টেবলে বোসো।’

রবিন্দু ঘরে বসে অমিয়কে বলল, ‘মিনিট পনেরো একটু বোস, পড়তে এসেছে সামনেই পরীক্ষা।’

রবিন্দু চেয়ারটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিল। অমিয় জিজ্ঞাসু চোখে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ছাত্রী?’

মায়া বললেন, ‘কুটুম, ছায়ার ননদ এই হাউজিংয়েই থাকে।’ তারপর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে জুড়ে দিলেন, ‘ছায়ার শাশুড়ি রবুর সঙ্গে বিয়ে দেবার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে, নানান টোপ ফেলে যাচ্ছে। রবুও গিলছে না আমরাও গিলছি না।’

পূর্ণেন্দু বললেন, ‘বিয়ের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।’

গুরুতর বিষয়ে আলোচনার মতো স্বরে অমিয় বলল, ‘যদি বলেন তো রবুর জন্য পাত্রী আমি দেখতে পারি।’

দুজনেরই ভ্রূ কুঁচকে উঠল, পূর্ণেন্দু বললেন, ‘তোমার হাতে আছে নাকি?’

‘আছে, তবে বদ্যি নয়, চলবে?’

‘কেন চলবে না।’ মায়া কিছু বলে ওঠার আগেই পূর্ণেন্দু তাড়াতাড়ি বললেন, ‘বিজ্ঞাপনের ভাষায় যা সব লেখা হয়—শান্ত, কোমলস্বভাবা, গৃহকর্মনিপুণা, সুমুখশ্রী, গৌরবর্ণা, স্বাস্থ্যবতী, পাঁচফুট তিন ইঞ্চি, বিএ পাশ, বয়স তেইশ—চব্বিশ হলেই চলবে।’

‘মেসোমশাই বোধহয় খবরের কাগজের পাত্র—পাত্রী কলাম খুব পড়ছেন।’

‘সমাজের শিক্ষিতরা জাত—গোত্রের সংস্কারে এখনও যে কতটা আচ্ছন্ন সেটা বোঝার সেরা উপায় হল পাত্রপাত্রী কলামে চোখ বোলানো। তোমার মনে হবে একশো বছর আগের খবরের কাগজ পড়ছি। এই দেখো না—’পূর্ণেন্দু তার পাশেই সোফার উপর পড়ে থাকা ভাঁজ করা খবরের কাগজটা মুখের সামনে ধরে বললেন, ‘শুধু একটা কলামেই কতগুলো গোত্রের নাম পেলুম জান? শাণ্ডিল্য, গৌতম, মউদগল্য, কাশ্যপ, ব্যাসঋষি, আলিম্মান, অবৎস্য।’ সাতটা, প্রত্যেকটা বিজ্ঞাপনে পাত্র বা পাত্রী পূর্ববঙ্গের না পশ্চিমবঙ্গের তাও বলা আছে। এটা বলার কি কোনো দরকার আছে? লেখাপড়া জানা উচ্চচবর্ণের বাঙালি হিন্দুরা সাবেকি রীতির পিছু পিছু অন্ধের মতো এখনও চলেছে। সেকেলে চিন্তাধারার কিছু বদলায়নি। অথচ আধুনিক কবিতা, গল্প—উপন্যাস, ফিল্ম, পেইন্টিং, নাটক তৈরি হচ্ছে, লেখা হচ্ছে, এসব পড়ে বা দেখে কতজন?’ পূর্ণেন্দু উত্তরের জন্য অমিয়র দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘শতকরা পাঁচজনও নয়।’ অমিয় নির্বিকার মুখে বলল।

মায়া অধৈর্য হয়ে পড়েছেন, পূর্ণেন্দুর কথাগুলো শুনতে শুনতে বললেন, ‘তোমার বকবকানি থামাও তো। অমিয় যা বলেছিলে বল, মেয়েটি বদ্যি নয়, তাহলে কী জাত?’

‘বামুন।’

মায়ার মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল।

‘মেয়েটির বাবা নেই। বিধবা মা, দাদা আর ছোটোভাই, অবস্থা ভালো নয়, থাকে গ্রামে।’ এই পর্যন্ত বলে অমিয় আর বলবে কিনা জানার জন্য দুজনের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগল।

পূর্ণেন্দু বললেন, ‘গরিবঘরের মেয়েতে আপত্তি নেই।’

মায়া বললেন, ‘দেখতে শুনতে কেমন, পড়াশুনো কদ্দুর?’

অমিয় বুঝল এরা শুনতে অনাগ্রহী নয়। ভেজানো দরজার ওধারে রবিন্দু এই ঘরের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে না, এটা ধরে নিয়ে সে বলল, ‘মেসোমশাই বিজ্ঞাপনের পাত্রীর যে বর্ণনা দিলেন তার মধ্যে মাত্র দু—তিনটির সঙ্গে মিল এই পাত্রীর রয়েছে যেমন সুমুখুশ্রী, গৃহকর্মে নিপুণা, স্বাস্থ্যবতী তবে মোটা বা আলগা গড়ন নয়, ছিপছিপে। মিলছে না যেগুলোর সঙ্গে, শান্ত কোমলস্বভাবা নয়, ছটফটে, সাহসী, ডানপিটে ভদ্র—সভ্য নম্র, ফরসা নয় কালো, পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি বাঙালি মেয়ের পক্ষে বেশ লম্বাই, বিএ পাশ নয় উচ্চচমাধ্যমিক পরীক্ষা সামনের বার দেবে, বয়স তেইশ—চব্বিশ নয় আঠারো—উনিশ।’

পূর্ণেন্দু বললেন, ‘রবুর সঙ্গে বয়সের পার্থক্য অনেক, বারো—তেরো বছরের।’ মায়া হালকা প্রতিবাদ করলেন, ‘হোক অনেক, আমার ঠাকুমার থেকে ঠাকুরদা বাইশ বছরের বড়ো ছিলেন। মেয়ে কালো বললে, কতটা কালো?’

‘কয়লার মতো নয়, বলতে পারেন, বেলে মাটির মতো। ছেলে হলে ওটা কালো গন্য হবে না।’

মায়া স্বামীকে প্রশ্ন করলেন, ‘পাঁচ ফুট ছ—ইঞ্চিটা কতখানি হবে বল তো?’

পূর্ণেন্দু ডান হাতের বুড়ো আঙুল ও তর্জনী খানিকটা ফাঁক করে তুলে ধরে বললেন, ‘তোমার থেকে এতটা লম্বা।’

মায়া চোখ সরু করে আন্দাজ করতে করতে বললেন, ‘রবুর কাছাকাছি হবে।’

পূর্ণেন্দুর মনে ধরে গেছে মেয়েটি সাহসী ডানপিটে শুনে, বললেন, ‘মেয়েদের লম্বা হওয়াটা খারাপ নয়, ছেলেপুলেরাও লম্বা হবে।’

‘অমিয় বামুন বললে, কোন শ্রেণির?’ মায়া আবার জেরা শুরু করলেন।

‘শ্রেণিট্রেনি তো বুঝি না জানিও না তবে চাটুজ্জে।’

‘তুমি কতটা চেনো?’ মায়ার প্রশ্ন।

‘জন্ম থেকেই। মেয়েটি আমার ভাগনি, আপন দিদির মেয়ে।’

ঘরের মধ্যে বোমা ফাটল যেন। ওরা দুজন স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। অমিয় এটাই আশা করেছিল। হাসি পেলেও সে মায়ার মুখ দেখে উৎকণ্ঠিত হল।

‘দিদি শ্যামবাজারে শ্যামল চ্যাটার্জির কাছে গান শিখতে যেন। তিনিই ওকে বিয়ে করেন, জাত নিয়ে জামাইবাবুর বাড়িতে আপত্তি উঠেছিল। উনি তা অগ্রাহ্য করে দিদিকে রেজেস্ট্রি বিয়ে করেছেন। বিয়ের দশ বছর পর ক্যানসারে মারা যান। বড়ো, একান্নবর্তী পরিবার, ওর রোজগার অন্যদের তুলনায় কমই ছিল। আধুনিক গানের দু—খানা রেকর্ড করেছিলেন, বিক্রি হয়নি। চিকিৎসা করতে গিয়ে দিদির সব গয়না বিক্রি করতে হয়। তারপর থেকেই বড়ো ভাসুর আর তার পরিবার দিদিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করে, নানাভাবে চাপ দিতে থাকে যাতে অতিষ্ঠ হয়ে বাড়ির অংশ ভাসুরকে বিক্রি করে চলে যায়। একটা মেয়ে আর দুটো ছেলে সবাই বাচ্চচা, তাদের নিয়ে কপর্দকশূন্য অবস্থায় দিদির বাস করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। তখন আমার বাবাই বললেন, থাকতে হবে না ওখানে বাড়ির অংশ বেচে দিয়ে বর্গাপুরে গিয়ে থাক। আমিই তোকে দেখব। আমি মরে গেলে ভাইয়েরা তোকে দেখবে। আঠারো হাজার টাকায় দিদি তার ভাগের অংশ বিক্রি করে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে চলে আসে আমাদের দেশের বাড়ি বর্গাপুরে। টাকাটা বাবা ফিক্সড করে দিয়েছে বর্গাপুরে পোস্ট অফিসে আর দশ বিঘে ধেনোজমি লিখে দিয়েছেন দিদির নামে, একটা দেড় বিঘের পুকুর আছে, তার জমা দেওয়ার টাকা আমরা নিই না, দিদিই পায়, ছোটো একটা আমবাগান আছে সেটারও জমা দেওয়ার টাকা আমরা দিদিকেই দিই। বাবা বড়ো নাতিটাকে কলকাতায় নিজের কাছে এনে রাখেন লেখাপড়া করাতে। বিএ পাশ করে এখন সে আমার ব্যবসায় আমার ডান হাত হয়ে কাজ করছে। মাসিমা এই হল পাত্রীর পরিচয়। মোনার আর্ধেকটা ব্রাহ্মণ আর্ধেকটা কৈবর্ত। এতে কী আপনাদের আপত্তি হবে? রবুকে জানি বলেই প্রস্তাবটা দিলুম, মোনা আমাদের ফ্যামিলির আদরের নাতনি, সে সুখী হোক এটাই আমি চাই।’

অমিয় অনেক আশা নিয়ে ওদের দু—জনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। পূর্ণেন্দুর মুখের উপর আবেগ ঘোরাফেরা করছে, মায়ার মুখও অল্পবিস্তর নরম।

‘অমিয় তোমার ভাগনিকে দেখাবার ব্যবস্থা কর, আমাদের জন্য নয়, রবুর জন্য। আগে ও দেখুক।’ পূর্ণেন্দু গম্ভীর স্বরে কর্তৃত্ব ভরা গলায় বললেন, মায়ার দিকে না তাকিয়ে, মায়া বুঝে গেলেন এখন চুপ করে থাকতে হবে।

পূর্ণেন্দু কপালে আঙুলের টোকা দিতে দিতে বললেন, বিয়ে করার জন্য মেয়ে দেখছি এভাবে নয়, তাহলে মনটা আগে থেকেই সমালোচকের মতো তৈরি হয়ে থাকে খুঁত ধরার জন্য, তখন ভুলে যায়, খুঁত মানুষমাত্রেরই আছে। এই ভুলটাই তখন ঘটে, পাঁচ মিনিটেই বিচার করে ফেলে। তার থেকে তোমার ভাগনিকে রবু দেখুক কিছু না জেনেই।’ পূর্ণেন্দু ভেজানো দরজার দিকে সন্তর্পণে তাকিয়ে গলা নামিয়ে নিলেন, ‘ওকে বরং তোমাদের বাড়িতে একদিন নেমন্তন্ন কর, ভাগনি খাবারটাবার পরিবেশন করুক, মামার বন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তা বলুক, একটা ঘরোয়া স্বাভাবিক পরিবেশে দু—জনে দু—জনকে দেখুক কিছু না জেনেই। মেয়েরও একটা পছন্দ—অপছন্দ আছে এটাও মান্য করা উচিত, কী বলো?’

সদর দরজা বন্ধ করার শব্দ এল, রবিন্দু এখন ঘরে আসবে। ওরা কথা থামিয়ে রাখলেন। রবিন্দু চেয়ারটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল। মুখে বিরক্তি।

‘টেনেটুনে পাশটা হয়তো করে যাবে। একদম খাটে না, এতদিন ফাঁকি দিয়ে এসে পরীক্ষার দু—দিন আগে বই খাতা নিয়ে বসলে আমি কী করতে পারি!’ রবিন্দু গজগজানি থামিয়ে অমিয়কে বলল, ‘তোদের দোকানে দু—দিন ফোন করেছিলুম তোকে পাইনি। খুব ব্যস্ত থাকিস মনে হচ্ছে।’

‘ঘুরে বেরিয়ে কাজ দেখতে হয়। দোকানে কম সময়ই থাকি। এই দেখনা এদিকে কাজ শুরু করেছি বলে তাই আসার সময় আর সুযোগ পেলুম। দেশ থেকে দিদি চিঠি পাঠিয়েছে ভাগনের হাত দিয়ে, যে লোকটার উপর বর্গা চাষের দায়িত্ব দেওয়া ছিল সে হঠাৎ আন্ত্রিকে মরে গিয়ে গন্ডগোল পাকিয়েছে, যেতে হবে আমাকে। চল না আমার সঙ্গে তিন—চারটে দিন বর্গাপুরে কাটিয়ে আসবি। সাত বছর আগে তো আমার সঙ্গে একবার গেছলি। দিদির হাতের এঁচোড়ের ডালনা আর মৌরলামাছের অম্বল খেয়ে কী বলেছিলিস মনে আছে? আবার খেতে আসব বলে আর তো গেলি না, দিদি অনেকবার তোর কথা বলেছিল, ছেলেটি বড়ো শান্ত, ছেলেটির স্বভাবটি খুব মিষ্টি, দেখতে খুব সুন্দর।’ অমিয় হেসে উঠল।

রবিন্দু মুখ নীচু করে নিল লজ্জায়। ফর্সা গালে টোল পড়ল। পাতলা গোলাপি অধর দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল। গভীর চাহনির টানা চোখ দুটি তুলে বলল, ‘সত্যিই আমার অনেকবার ইচ্ছে করেছিল যাওয়ার। শুধু দিদির হাতের রান্না খাওয়ার জন্যই নয়, গ্রাম দেখতে আমার ভালো লাগে। আমাকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল তোর ভাগনি, কী যেন নামটা?’

‘মোনা।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মোনা। বিশাল একটা বাঁশবন, ইটের ভাঁটি, বিশাল একটা দিঘি তাতে হাজার খানেক পদ্মগাছ আর ধানখেত ধু ধু করছে, প্রায় মাইল দেড়—দুই তারপর একটা গ্রাম। ধানকাটা চলছে, তখনও অনেক জমিতে ধান রয়ে গেছে। শীতকাল ছিল বোধহয় জানুয়ারির শেষাশেষি, অল্প অল্প ঠান্ডা বাতাস, রোদ্দুরটা যে কী ভালো লাগছিল! অমিয়, ভাবলে সত্যিই মন কেমন করে।’

‘শীতকালে গেছিস এবার বর্ষার শুরুতে চল। ভাগ্যে থাকলে গ্রামের বৃষ্টি দেখতে পাবি। আমাদের আমবাগানটা তো দেখেছিস, ভালো হিমসাগর হয়েছে, খাবি।’ অমিয় রবিন্দুর গ্রামপ্রীতিটা উসকে দেবার জন্য কথাগুলো বলে পূর্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে এমনভাবে মাথাটা হেলাল, যার দ্বারা সে বলতে চাইল, মেসোমশাই রবু যাচ্ছে।

‘তোর ভাগনে ভাগনিরা কত বড়ো হয়েছে?’

‘সাত বছরে যত বড়ো হওয়া উচিত তত বড়োই হয়েছে। মোনা এখন রীতিমতো তরুণী, দেখলে চিনতে পারবি না, ক্লাস টুয়েলভে পড়ে আর বাবু ক্লাস সিক্সে। কবে যাবি বল?

‘যাব বললেই কী দুম করে যাওয়া যায়। তোর মতো ব্যবসা তো করি না, চাকরি করার অনেক ফ্যাসাদ। ছুটি চাইতে হবে, যদি তেমন কাজকর্ম না থাকে তাহলে ছুটি পাব।’

‘আমি তো এদিকে আসছিই, চার—পাঁচ দিন পরে এসে খোঁজ নেব।’ অমিয় উঠে দাঁড়াল। ‘দিন সাতেকের জন্য ছুটি নে।’

অমিয় চলে যাবার মিনিট পাঁচেক পরই নবেন্দু ফিরল একটা মোটরবাইকের পিছনে বসে। পূর্ণেন্দু বারান্দায় বেরোলেন বাইকের ইঞ্জিনের শব্দে। দেখলেন সন্তর্পণে নবু নামল। বাঁ পা ফেলেই ঝুঁকে পড়ল। বাইকটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে অল্পবয়সি চালক নবুর পাশে গিয়ে ওর একটা হাত নিজের কাঁধে রেখে বলল, ‘হাঁটতে পারবি?’

কাঁধে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে নবু ফ্ল্যাটের দরজায় এল। তার আগেই দরজা খুলে পূর্ণেন্দু আর রবিন্দু দাঁড়িয়ে।

‘কী হয়েছে?’ পূর্ণেন্দু উদবিগ্ন চোখে তাকালেন।

নবেন্দুর সঙ্গের ছেলেটি বলল, ‘অ্যাঙ্কেলটা টুইস্ট করে গেছে, মাঠটা খুব বাজে ছিল। হাবড়াতেই ডাক্তার দেখান হয়েছে। মলম মাখিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন আর বলেছেন কালকেই যেন এক্স—রে করে দেখা হয়। হাঁটাচলা যেন একদম না করে, পা—টাকে রেস্টে রাখতে হবে। এখনও ব্যথা করছে?’ ছেলেটি নবেন্দুকে জিজ্ঞাসা করল।

নবেন্দু মুখ বিকৃত করে বলল, ‘করছে।’

রবিন্দু এবার ওর একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে নিল, অন্য হাতটা পূর্ণেন্দু কাঁধে নিতেই ছেলেটি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আপনি ছাড়ুন, আমি ধরছি।’ পূর্ণেন্দু সরে দাঁড়ালেন।

দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে একটা একটা করে পা ফেলে নবেন্দু ঘরে এল। ওকে খাটে শুইয়ে দিল রবিন্দু। ছেলেটি যাবার সময় মনে করিয়ে দিয়ে গেল, ‘কালই যেন এক্স রে করা হয়।’

সন্তর্পণে নবেন্দুর পা—টা তুলে তার নীচে বালিশ রাখতে রাখতে মায়া জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ছেলেটি কে?’

‘গোলকিপার খেলে, থাকে দমদমে।’

‘হাবড়ায় কীসের খেলা ছিল?’ পূর্ণেন্দু জানতে চাইলেন।

‘এগজিবিশন ম্যাচ।’

‘মোহনবাগান খেলল?’

‘না। প্রাইমারি স্কুলের ঘর তোলার জন্য এম এল এ—র দলের সঙ্গে জেলা সভাধিপতির দলের খেলা ছিল।’

‘ক্লাবের প্র্যাকটিস তো পয়লা বোশেখের পর শুরু হবে, আর কটা দিনই বা রয়েছে, তাড়াতাড়ি সেরে ওঠা দরকার।’ পূর্ণেন্দুর মুখে চিন্তার মেঘ জমে উঠল। নবেন্দুর মুখের উপর দিয়ে উড়ে গেল হালকা একটা ভয়ের মেঘ।

রাত্রে পাশের খাটে শুয়ে রবিন্দু বলল, ‘এইসব ম্যাচ খেলা তোর উচিত নয় নবু। নিশ্চয় টাকা দিয়েছে?’

ক্ষীণ স্বরে নবেন্দু বলল ‘হ্যাঁ। না হলে যাব কেন খেলতে।’

রবিন্দু টাকার অঙ্কটা জানতে চাইল না। ভর্ৎসনার সুরে বলল, ‘ক—টা টাকার জন্য খারাপ মাঠে খেপ খেলতে নেমে চোট পেয়ে গেলি। টাকা দু—দিনে ফুরিয়ে যাবে, চোটটা দু—দিনে যাবে না।’

‘কাল সকালে আমাকে এক্স—রে করাতে নিয়ে যাবে দাদা?’ নবেন্দুর স্বরে কাতরতা আর ভয় স্পষ্ট ফুটে উঠল।

এক্স—রে রিপোর্টে পাওয়া গেল হেয়ারলাইন ফ্র্যাকচার। ডাক্তার বাঁ পায়ের গোড়ালি আর পাতা প্লাস্টার করে দিলেন। পাঁচ দিন পর অমিয় এল রবিন্দু ছুটি পেয়েছে কি না জানতে। সে জানিয়ে দিল নবেন্দুর এখন সাহায্য দরকার, বাড়িতে শুধু বাবা—মা। ওদের ভরসায় ভাইকে রেখে বর্গাপুরে এখন সে যেতে পারবে না। দ্রুত সেরে ওঠা দরকার নবেন্দুর কেননা আর দু—সপ্তাহ পরেই ক্লাবের প্র্যাকটিস শুরু হবে ওকে মাঠে নামতে হবে।

প্র্যাকটিস শুরু হবার তিন দিন পর নবেন্দু সকালবেলায় মাঠে গেল। ক্লাবের গেটের সামনে ট্যাকসি থেকে নেমে যখন টেন্টের দিকে যাচ্ছে তখন কেউ যদি ওর হাঁটাটা একটু মন দিয়ে লক্ষ করত তা হলে ধরতে পারত নবেন্দু বাঁ—পাটা আলতো করে জমিতে ফেলছে, এখনও সে পুরো সেরে ওঠেনি। কোচকে বলে সে বিশ্রাম নিতে পারে। কিন্তু এই বলাটাকেই সে ভয় পেল। চোট আছে, এই কথাটা চাউর হলে বিপদ, খেলায় সামান্য ত্রুটি ঘটলেই চোটের কথা বলে তাকে সরিয়ে রাখা হবে। টিমে ফিরে আসা তখন কঠিন হয়ে পড়বে। নবেন্দু প্র্যাকটিসে এসে বোঝাতে চাইল চোটটা খুবই সামান্য ছিল, এখন সে ফিট।

নবেন্দু মাঠে যাচ্ছে দেখে রবিন্দু অফিসে ছ—দিনের ছুটি চাইল এবং তা মঞ্জুর হয়ে গেল। অফিস থেকেই সে অমিয়র দোকানে ফোন করে তাকে পেয়ে গেল।

‘সোম থেকে শনি ছ—দিন আর দুটো রোববার মোট আট দিনের ছুটি পেয়েছি। ছুটি শুরু হবে পঁচিশে এপ্রিল রবিবার থেকে, ওই দিনই বর্গাপুর রওনা হলে কেমন হয়?

অমিয় বলল, ‘খুব ভালো হয়। তবে তিন দিনের বেশি আমি থাকতে পারব না, ওখানকার কাজ মিটে গেলেই চলে আসব, এখানে অনেক কাজ হাতে রয়েছে, আমার থাকা দরকার। তুই বর্গাপুরে আট দিনই থেকে থেকে যাস, কোনো অসুবিধে হবে না। থাকে তো মোটে তিনটে লোক, কেউই তোর অপরিচিত নয়। রবু তাহলে পঁচিশে সকাল নটায় হাওড়ায় বড়ো ঘড়ির নীচে থাকিস, ট্রেন নটা সতেরোয়। এই কথা রইল। আমি দিদিকে কালই খবর পাঠাচ্ছি।’

.

রাতে খাওয়ার পর ঘরে শুতে এসে রবিন্দু দেখল বিছানায় চিত হয়ে নবু বাংলা কমিকস পড়ছে। ছবিওলা বাচ্চচাদের বই পড়তে ভালোবাসে। পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে গোছা করে এই বইগুলো কিনে আনে। রবিন্দু একদিন বলেছিল ‘কী সব হাবিজাবি বই পড়িস, ভালো বই পড়তে পারিস না! পথের পাঁচালি পড়।’ নবু বলেছিল ‘দেখা হয়ে গেছে।’ এরপর ভেবেচিন্তে রবিন্দু বলে, ‘আবোল তাবোলও তো পড়তে পারিস।’ উত্তর পেয়েছিল ‘পাউরুটি আর ঝোলাগুড় তো, স্কুলে পড়েছি।’ রবিন্দু আর কখনো নবুকে ভালো বই পড়তে বলেনি।

আজ সে বলল, ‘তোর একটা বগলে ঝোলানর বড়ো নাইলনের ব্যাগ এক সপ্তাহের জন্য আমায় দিতে পারিস?’

‘কী জন্য, কোথাও যাবে?’

‘অমিয়দের দেশের বাড়িতে যাব। সুটকেস নেওয়ায় হ্যাঙ্গামা অনেক লোকাল ট্রেনে, বাসে।’

‘ওটা নিয়ে যাও’ নবেন্দু আঙুল দিয়ে মেঝেয় পড়ে থাকা দেড় হাত লম্বা, চেইন দেওয়া ব্যাগটা দেখাল। ‘নোংরা করো না যেন।’

সেই ব্যাগ বগলে ঝুলিয়ে রবিবার সকাল নটায় রবিন্দু হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখল অমিয় বর্ধমান লোকালের টিকিট কেটে অপেক্ষা করছে। তাকে দেখেই তাড়া দিল অমিয়, ‘তাড়াতাড়ি চল নয়তো বসার জায়গা পাবি না, সরকারি অফিসের বাবুরা এই ট্রেনটা ধরে।’

‘এই ট্রেনে গেলে তো অফিসে লেট হয়ে যাবে।’ রবিন্দু অবাক সুরে বলল।

‘লেটই যদি না হল তাহলে সরকারিবাবু হবে কী করে? সরকারি অফিসে তো চাকরি করিস না বুঝবি কী করে!’

মিনিট পনেরো লেট করে ট্রেন তালান্ডু স্টেশনে পৌঁছল। ভ্যান রিকশা চেপে অমিয়দের বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেল।

.

.

ছয়

পুরোনো দোতলা বাড়ি। মানুষসমান উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। আলকাতরা মাখানো কাঠের দরজা দিয়ে ঢুকেই মাটির উঠোন। তার প্রান্তে একটা মরাই। তার পিছনে খড়ের চাল দেওয়া উঁচু মাটির ঘরে রান্না হয়। তার পাশে টিউবওয়েল, দেওয়াল ঘেরা টালির চাল দেওয়া স্নানের জায়গা। একটা ঘোড়া নিমগাছ, তুলসীমঞ্চ, আর রান্নাঘরের চালে চালকুমড়ো, পাঁচিল ঘেঁষে কয়েকটা নয়নতারা ছাড়া উঠোনে আর কোনো গাছ নেই। উঠোনের ডান দিকে উঁচু টানা চওড়া রক। চারটে সিঁড়ি ভেঙে রকে উঠে বাড়িতে ঢুকতে হয়। ঢুকেই রকের সমান্তরাল টানা দাওয়া। লাগোয়া তিনটে ঘর আর উপরে ওঠার সিঁড়ি। দাওয়ার ঠিক উপরে দোতলায় দক্ষিণে টানা রেলিং দেওয়া বারান্দা, কাঠের খুঁটির উপর টালি দিয়ে বারান্দাটা ঢাকা। দোতলায় বড়ো দুটি ঘর।

রবিন্দু উঠোনে দাঁড়িয়ে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে বলল, ‘আরে কিছুই তো বদলায়নি, সব তো একই রকম আছে!’

অমিয় তার ছোটো সুটকেস আর রবিন্দুর ব্যাগটা, হাফপ্যান্ট আর রঙিন স্পোর্টস শার্ট পরা শ্যামলা রঙের লম্বা ছিপছিপে ছেলেটির হাতে দিয়ে বলল, ‘ওপরে বড়োঘরে রেখে আয়।’ তারপর রবিন্দুকে বলল, ‘দিদি খুব গুছোনো আর খুঁতখুঁতে। একটা জিনিসও এধার ওধার হবার উপায় নেই। ভোররাতে উঠে আগে উঠোন ঝাঁট দেয়।’

রবিন্দু একবার উপর দিকে তাকাল। বারান্দায় খুঁটি ধরে ঝুঁকেছিল একটি মুখ। রবিন্দু শুধু দেখল ঝুলে পড়া চুলের মধ্য দিয়ে হালকা শ্যামবর্ণ একটা মেয়ের মুখ আর বড়ো বড়ো টানা চোখ তার দিকে কৌতূহলভরে তাকিয়ে। তাকে মুখ তুলতে দেখেই চট করে সরে গেল।

‘রবু ডাব খাবি? হ্যাঁরে সোনা, বাসু কোথায় রে? ওকে ডাব কেটে দিতে বল।’

দোতলায় ব্যাগ ও সুটকেস রেখে সোনা ফিরে এসে রবিন্দুকে কৌতূহলী চোখে নিরীক্ষণ করায় ব্যস্ত। সে বলল, ‘বাসুদা তো ডাব পেড়ে দিয়ে বাড়ি চলে গেছে। ডেকে আনব?’

‘থাক পরে খাব।’ রবিন্দু বলল।

‘এই সোনা, শোন।’ আধভেজানো দরজার পাশ দিয়ে একটা হাত হাতছানি দিল। তুঁতে রঙের শাড়ির আঁচল দেখতে পেল রবিন্দু। সোনা ‘কী’ বলে রকে উঠে দরজার কাছে গেল। সেখান থেকেই বলল, ‘দিদি ডাব কেটে দিচ্ছে।’

‘কাটারি দিয়ে ডাব কাটবে! না না দরকার নেই।’ রবিন্দু প্রায় আঁতকে উঠল। সে ভাবতে পারে না, হাতের তালুতে ভাব রেখে খচাত খচাত করে কাটারির কোপ দিয়ে কোনো মেয়ে ডাব কাটছে। যদি একটা কোপ হাতের উপর পড়ে!

ততক্ষণে খচাত খচাত শব্দ শুরু হয়ে গেছে। অমিয় হাসছে।

‘তোকে ডাবের জল না খাইয়ে ছাড়বে না মোনা।’

সোনা দুটো কাচের গ্লাসে ডাবের জল নিয়ে এল। রকের সিঁড়িতে বসে দু—জনে দু—গ্লাস করে জল খেল।

অমিয় বলল, ‘ওপরে চল, জামা প্যান্ট ছাড়বি, সোনা, দিদি কোথায় রে, রান্নাঘরে তো?’

‘মা সকাল থেকে শুয়েছিল, এখন রান্নাঘরে গেল।’

অমিয় বিব্রত স্বরে বলল, ‘আবার শরীর খারাপ? কী হয়েছে, সেই শ্বাসের টান?’

‘হ্যাঁ, কাল থেকে।’ সোনা ম্লান স্বরে বলল।

‘তাহলে তো মুশকিল হল।’ অমিয়কে চিন্তিত দেখাল। ‘তোকে দিদির হাতের রান্না খাওয়াব বলে আনলুম।’

রবিন্দু ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘তাতে কী হয়েছে। নাইবা ডালনা ঘণ্ট অম্বল হল, ঝোল—ভাতই খাব।’

অমিয়র দিদি অরুণা রান্নাঘর থেকে গেলেন। বয়স পঁয়তাল্লিশের মধ্যে, কৃশকায়, শ্যামবর্ণ, মুখাকৃতি ডিমের মতো, দীর্ঘ চোখ, পরনে কালো পাড় সাদা শাড়ি। দু—হাতে একগাছা করে সরু সোনার চুড়ি।

‘ঝোল ভাত খাবে কী!’ রবিন্দুর প্রণাম নিতে নিতে বললেন। তাই দেখে সোনার এতক্ষণে খেয়াল হল, সে তাড়াতাড়ি রবিন্দুকে প্রণাম করল।

‘বাড়িতে কী রান্না করার লোক নেই? আমি তো শুধু কচুর শাকটা করে দিচ্ছি। রবিন্দু তুমি কিন্তু রোগা হয়ে গেছ।’

‘বলছেন কী দিদি! নীচু হয়ে মোজা পরতে গেলে এখন পেটে চাপ পড়ে।’

অমিয় হালকা চালে বলল, ‘থাক এখানে সাতদিন, মোজা পরাই তোর বন্ধ করে দেবে দিদি।’

অরুণা তাড়া দিলেন, ‘বারোটা বেজে গেছে, এবার চানটান করে খেয়ে নাও। কলঘরে জল ধরা আছে।’

দোতলায় উঠেই প্রথম ঘরটা বড়ো ঘর। পালঙ্কের মতো জমকালো একটা খাট, পুরু গদি, দুটো মাথার ও দুটো পাশবালিস। ধবধবে চাদর। নতুন ইলেকট্রিক ওয়্যারিং, সিলিং ফ্যান। বর্গাপুরে বিদ্যুৎ এসেছে। রবিন্দু চেইন টেনে ব্যাগ খুলতেই চোখে পড়ল সোনালি মোড়কে দুটো চকোলেট বার। সকালে বাসে ওঠার আগে কিনেছিল অমিয়র ভাগনেভাগনিকে দেবার জন্য, ভুলে ছিল এতক্ষণ। পরে দেবে ভেবে রেখে দিল।

স্নান করে দুজনে খেতে এল একতলার লম্বা দালানে। রঙিন পশমের নকশা করা আসন, কাঁসার বগি থালার মাঝখানে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা ভাতের স্তূপ, তার ধারে আলু ও বেগুন ভাজা, পাতিলেবুর টুকরো, নুন, দুটো কাচালংকা। থালা ঘিরে চারটি বাটি ও ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাস। ধাতব বাসনগুলি ঝকঝকে। সারা ব্যাপারটার যত্ন ও আন্তরিকতা ছড়িয়ে রয়েছে। দেখেই, রবিন্দুর মন প্রসন্ন হয়ে উঠল। বহু বছর পর সে বাবু হয়ে খেতে বসল।

বসেছিলেন অরুণা হাতপাখা নিয়ে, আস্তে আস্তে সেটা নাড়ছেন থালার উপর যদিও কোনো মাছি নেই। তার পাশে দাঁড়িয়ে মোনা। এখানে এসে এই প্রথম রবিন্দু ভালো করে দেখল মোনাকে। লম্বা, ছিপছিপে, দৃঢ় গড়ন। পরিপূর্ণভাবে যৌবনের ফুটে ওঠার জন্য অপেক্ষা করছে দেহ। স্নান করে পরেছে হলুদ ডুরে শাড়ি, ভিজে চুল পিঠে ছড়ানো। চোখে সরু কাজল, খয়েরি টিপ, মুখের গড়ন মায়েরই মতো ডিম্বাকৃতি, নাকটি টিকালো, পায়ের নখে খয়েরি রঙ। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে সে তাকিয়ে রয়েছে রবিন্দুর মুখের দিকে। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল।

‘দিদি ভাত তুলুন, যা দিয়েছেন তাতে আমার দু—বেলার খাওয়া হয়ে যাবে।’

‘সে কী, এই ক—টা ভাত খেতে পারবে না! খুব পারবে।’

অমিয়র পাতেও সমান আকারের স্তূপ। সে ভাত ভেঙে তাতে ডাল ঢালতে ঢালতে বলল, ‘খেয়ে নে খেয়ে নে, না পারিস তো ফেলে রাখবি।’

‘না রে, অমিয়, সত্যি বলছি পারব না। ফেলে নষ্ট করাটা ঠিক হবে না।’

অরুণা চোখের ইশারায় মোনাকে ভাত তুলতে বললেন। একটা ছোটো থালা হাতে সে রবিন্দুর পাতের সামনে ঝুঁকে ছোট্ট মুঠোয় ভাত তুলল। যেন কঠিন দুঃসাধ্য কোনো কাজ তাকে করতে হচ্ছে মুখের ভাব এমনই। মুঠোয় ভাত নিয়ে সে অনুমোদনের জন্য রবিন্দুর মুখের দিকে তাকাল।

‘একে কী তোলা বলে? আরও তোলো।’ রবিন্দু হালকা স্বরে বকুনির মতো বলল।

গম্ভীর মুখে দুই ঠোঁট টিপে মোনা আবার ভাত তুলল মুঠোটা আরও ছোটো করে।

‘উঁহু, এইভাবে তোলো।’ রবিন্দু হাতের চেটো থাবার মতো মেলে ধরে দেখাল।

মোনা এই প্রথম কথা বলল, ‘এটুকু খেতে পারবেন।’ কথাটা বলেই সে থালা হাতে উঠে দাঁড়িয়ে বুঝিয়ে দিল আর সে ভাত তুলবে না।

‘দিদি এটা কী?’ রবিন্দু একটা বাটি আঙুল দিয়ে দেখাল।

‘চালকুমড়োর পাতুরি, নারকোল আর সর্ষেবাটা দিয়ে। আমি তো আজ রান্নাঘরে যেতেই পারিনি, সব তো মোনাই রেঁধেছে। মুখে যতটুকু পেরেছি বলে দিয়েছি। দেখো তো খেয়ে কেমন হয়েছে!’

রবিন্দু চালকুমড়োর একটা চাকলা তুলে ভাতের সঙ্গে মেখে প্রথম গ্রাস মুখে দেবার সময় আড়চোখে মোনার মুখটা দেখে নিল। উৎকন্ঠায় পাংশু হয়ে রয়েছে।

‘ইসস একদম নুনে পোড়া।’ রবিন্দু মুখ বিকৃতি করল।

‘সে কী রে, কই আমার তো নুন ঠিক লাগল!’ অমিয় খুবই অবাক হয়ে বলল। অরুণাকে সন্ত্রস্ত দেখাল।

রবিন্দুর মনে হল মোনার মুখ থেকে পলকের জন্য রক্ত সরে গেল। ‘আপনাকে ওটা খেতে হবে না’ বলে থমথমে মুখে সে বাটিটা প্রায় ছোঁ মেরে তুলে নিল।

‘তুমি একটু টেস্ট করে দেখো।’ রবিন্দু নির্দেশ দিল গম্ভীর মুখে।

মোনা বাটি থেকে আঙুলে কোরা নারকোল ও বাটা সর্ষের কাই তুলে মুখে দিয়ে জিভে পরখ করে ঢোঁক গিলেই শিউরে উঠল, ‘মাগো কী মারাত্মক নুন। পরেশ মুদি এবার নুন দিয়েছে, একেবারে বিষের মতো।’ হাসিতে ঝকমক করে উঠল তার চোখের মণি।

রবিন্দু বুঝে গেল মোনা রসিকতা বোঝে এবং পালটা করতেও পারে। অরুণাও মোনার কথা থেকে বুঝে গেলেন রবিন্দু ঠাট্টা করেছে।

‘বাটিটা দাও। নুন যখন একবার খেয়েছি তখন গুণও গাইব।’ রবিন্দু হাত বাড়াল। ‘দিদি এমন জিনিস কখনও খাইনি, অপূর্ব। নুন খেয়ে কিন্তু বলছি না, দ্রৌপদীও হার মেনে যাবে।’

‘এঁটো হয়ে গেছে বদলে আনি।’ মোনা রান্নাঘরের দিকে ছুটল এবং একই গতিতে অন্য একটা বাটিতে পাতুরি নিয়ে ফিরে এল। রবিন্দু বাটি উপুড় করে পাতে ঢালল।

কুচো চিংড়ি আর ছোলা দিয়ে কচুশাকের ঘণ্ট এবং মসুর ডাল দিয়ে ভাত খাবার পর একটা বাটিতে ঝোলে ডুবে থাকা একটা বড়ো গলদা চিংড়ির মাথা দেখে রবিন্দু বলল, ‘আমাকে দিয়েছেন কিন্তু অমিয়কে তো দেননি?’

অরুণা কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘পুকুরে জাল দিয়ে ওই একটাই পাওয়া গেছে।’

‘অমিয় এটাকে তাহলে ভাগাভাগি করা যাক। তুই ধড়টা নে আমি মাথাটা নিচ্ছি।’

আপত্তি করে উঠল অমিয়। মোনা বলল, ‘চিংড়ি মাছে মামার অ্যালার্জি আছে, আপনি একাই খান।’

‘আমারও অনেক কিছুতে অ্যালার্জি আছে।’

রবিন্দু বুঝে যাচ্ছে না তার মধ্যে কী এমন ঘটল যে এইভাবে সে ছেলেমানুষের মতো কথা বলে যাচ্ছে! হঠাৎ একটা সজীব প্রফুল্লতায় সে আক্রান্ত হল কেন? সবাই তার সম্পর্কে প্রশংসা করে বলে বিবেচক, বিচক্ষণ, অগ্রপশ্চাৎ ভেবে কাজ করে, আবেগের বশে কিছু করে না। অথচ যুক্তির এবং বিজ্ঞতার গণ্ডির বাইরে বেরোবার জন্য তার মধ্যে কী একটা যেন ফাঁপিয়ে উঠছে। এখন তার কৈশোরে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।

রবিন্দুকে অবশ্য গোটা গলদাটাই খেতে হল। তারপর চালতার টক। অরুণা জানালেন টাটকা মৌরালা মাছ বাজারে আজ ওঠেনি, পরে অম্বল করে খাওয়াবেন। খাওয়ার পর রবিন্দু হাত ধুতে বাইরের রকে এল। বালতিতে জল আর মগ হাতে নিয়ে মোনা দাঁড়িয়ে, অন্য হাতে গামছা ও সাবান। হাতে সাবান মাখতে মাখতে রবিন্দু নীচু গলায় বলল, ‘তোমাকে চেনাই যায় না, বড়ো হয়ে গেছ।’

‘হবেই তো, বয়স বাড়লে তো বড়োই হয়। আপনি কিন্তু একটু মোটা হয়েছেন, মা যাই বলুক।’

ভিতরের দালানে অমিয় তখন দিদিকে বলছে চাপা গলায়, ‘মনে হচ্ছে ফার্স্ট টার্ম পরীক্ষাটায় মোনা ফার্স্ট ডিভিশন পাবে, ফাইনালে কী হয় সেটাই ভাবাচ্ছে।’

.

অমিয় যখন বর্গাপুরে তার দিদিকে কথাটা বলছিল সেই সময় কলকাতায় আনন্দ নিকেতনে পূর্ণেন্দুর ফ্ল্যাটের দরজার বেল বাজল। পূর্ণেন্দু তখন খেয়ে উঠে বসার ঘরে সোফায় শুয়ে খবরের কাগজের সম্পাদকীয় পড়ছিলেন। মায়া পাশের ঘরে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। এই সময় কে এল! রবু কলকাতায় নেই, নবু ক্লাবের ক্যান্টিনে ভাত খেয়ে কোনোদিন ফিরে আসে কোনোদিন ফেরে না। আর ওর আসার সময় পার হয়ে গেছে। তাহলে ভরদুপুরে কে এল!

দরজা খুলে দেখলেন একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। একে আগে কখনো দেখেননি। এই সময় নানান রকম জিনিস বিক্রি করতে আসে মেয়েরা, কিন্তু এর হাতে তো চামড়ার লেডিজ ব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই। বোধহয় ফ্ল্যাট ভুল করেছে।

‘কাকে চাই?’

‘আপনি কী পূর্ণেন্দু গুপ্ত?’ দ্রুত অস্থিরভাবে মেয়েটি বলল।

পূর্ণেন্দু বিস্মিত চোখ নিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ আমিই।’

‘আপনার সঙ্গে কথা আছে, ভেতরে যেতে পারি?’

‘আসুন।’ বলেই পূর্ণেন্দু মেয়েটির আপাদমস্তক দেখে নিলেন। বেশ ফর্সা, মাঝারি উচ্চচতা, বয়স বাইশ—চব্বিশ হবে, গোলগাল শরীর। মুখটি চোখা, প্রসাধন নেই শুধু ঠোঁটে হালকা রঙ, চোখের চাহনি তীক্ষ্ন, রঙিন ফুলছাপ ভয়েলের শাড়ি, রিস্টওয়াচ, একহাতে সোনার বালা, লাল পাথরের আংটি। মনে হয় গেরস্থ ঘরেরই।

বসার ঘরে এসে বলার আগেই মেয়েটি সোফায় বসে পড়ল। সামনের চেয়ারে বসলেন পূর্ণেন্দু। ‘বলুন কী দরকার?’

‘আমাকে আপনি চিনবেন না আমার নাম স্মৃতি চ্যাটার্জি। আমার দাদার নাম বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি একবার তিনি এখানে এসেছিলেন।’

পূর্ণেন্দুর মনে পড়ল সমরেশের মোটরবাইকের পিছনে বসে ধুতি পাঞ্জাবি পরা যে লোকটা একদিন এসেছিল, তার নাম বলেছিল বুদ্ধদেব। সবুজ সংঘের সেক্রেটারি, ওর ক্লাবেই খেলত নবু। সেদিন বুদ্ধদেব চ্যাটার্জিকে এখান থেকেই পার্টির মিটিংয়ে নিয়ে যায় সমরেশ।

‘হ্যাঁ বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি একদিন এসেছিলেন।’

‘নবেন্দুকে আমার দাদা খুব পছন্দ করতেন। নবেন্দু সমরেশদার বাড়িতে প্রায়ই যেত, আমিও যেতাম, একই পাড়ায় আমরা থাকি। ওখানেই আমার সঙ্গে আলাপ হয় নবেন্দুর। তখন ও প্রমিসিং উঠতি প্লেয়ার। বড়ো কিছু একটা হবে আমাদের সেই রকম ধারণাই হয়েছিল। নাম হবে, টাকা হবে ও আমাকে বুঝিয়েছিল। আমি বিশ্বাসও করেছিলুম। দাদাই সমরেশদাকে বলে ওকে মোহনবাগানে ঢোকায়। কিন্তু যা হতে পারত তা হল না। আর বোধহয় হবেও না। ওর পায়ে একটা ইঞ্জুরি হয়েছে সেটা লুকিয়ে রেখেছিল। এখন ক্লাবের সবাই তা জেনে গেছে। নবেন্দু আগে বাগুইহাটি যেত এখন আর যাচ্ছে না। এসব কথা বলে আমি বোধহয় আপনাকে বিরক্ত করছি। ভাবছেন দুপুরবেলায় একটা মেয়ে এসে কী আবোল—তাবোল বকছে।’ স্মৃতির চোখ দুটি তীক্ষ্ন হয়ে উঠল। চোয়ালের নীচে শক্ত হয়ে গেল মাংসের দলা। চোখ নামিয়ে কী একটা ভেবে নিয়ে বলল, ‘আমি আপনার আর সময় নষ্ট করব না।…আমি মা হতে চলেছি, বাবা নবেন্দু।’

কথাটা ভালো করে পূর্ণেন্দুর মাথার মধ্যে বসতে সেকেন্ড দশেক সময় লাগল। ‘কী বললে তুমি!’

‘আমি প্রেগনান্ট, চার মাস চলছে।’

পূর্ণেন্দুর মাথার মধ্যে অন্ধকার নেমে এল। স্তম্ভিত হয়ে পাথরের মতো বসে রইলেন, স্মৃতির মুখ ঝাপসা হয়ে আসছে। সারা শরীরের রক্ত দ্রুত বুকে এসে জমা হচ্ছে। একটা কাতরধ্বনি অস্ফুটে তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। তিনি ধীরে ধীরে শরীরটাকে আলগা করে চেয়ারে হেলান দিয়ে জানলার দিকে মুখ ফেরালেন।

‘নবেন্দুকে বলেছ?’

‘ও জানে।’

‘আর কেউ?’

‘না। শুধু আপনি এখন জানলেন। একথা কী কাউকে জানানো যায়।’

‘নবেন্দু কী বলছে!’

‘যা বলেছে সেটা আমি পারব না, সন্তান নষ্ট করব না, তা ছাড়া অ্যাবরশনের সময়ও পার হয়ে গেছে।’

‘এখন তুমি কী করতে চাও?’

‘বিয়ে।’ পুকুরে ঢিল ফেলার মতো একটা শব্দ যেন উঠে এল স্মৃতির উচ্চচারণে।

পূর্ণেন্দুর মনে হচ্ছে দৃঢ় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে মনস্থির করে সেই মেয়েটি একবার শেষ চেষ্টা করতে তাঁর কাছে এসেছে।

‘নবেন্দু বিয়েতে রাজি নয়। স্বীকার করতে চায়নি, বলছে অন্য কেউ এর বাবা।’ স্মৃতি পেটের উপর দুটি তালু চেপে ধরল। পূর্ণেন্দু দুটি চোখ আবার জানালার বাইরে রাখলেন।

‘নবেন্দু এভাবে আমার চরিত্রে কালি ছিটোবে আমি ভাবিনি।’ স্মৃতির ঠোঁট কাঁপছে। চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল ক্রোধের হলকা। আঙুলগুলো দুমড়ে বেঁকে উঠল। চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেকে ধরে রাখতে, শেষ পর্যন্ত পারল না। চোখ থেকে দরদর করে জলের ধারা নামতে শুরু করল।

‘আমার দাদাকে আমি জানি, মারাত্মক লোক। ওর পলিটিক্যাল প্রোটেকশনেই টিকে আছে সমরেশ ঢালির মতো দু—তিনটে খুনি যারা দাদার কথায় কাজ করে। দাদা যদি একবার শোনে, আমার এই হাল কে করেছে তাহলে কী যে কাণ্ড ঘটবে তা ভাবতেও পারছি না।’

স্মৃতি সোফা থেকে নেমে আচমকা পূর্ণেন্দু দুটো পা জড়িয়ে ধরল। ‘বিশ্বাস করুন আমার পেটে নবেন্দুরই বাচ্চচা। ও যদি বিয়ে না করে তা হলে আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।’

পূর্ণেন্দু ডান হাতটা সামান্য তুললেন নিষেধ করার ভঙ্গিতে। শ্রান্ত স্বরে বললেন, ‘বিয়ে হয়তো করতে হবে কিন্তু তুমি ওকে এতটা প্রশ্রয় কেন দিলে? তোমার কথা বলা থেকে মনে হচ্ছে কিছু লেখাপড়া শিখেছ।’

মাথা নামিয়ে স্মৃতি চুপ করে রইল।

‘যাও উঠে বসো। নবেন্দুর বাবা আমি, যতটা লজ্জা পাওয়ার আমি পাচ্ছি। সে এখন বড়ো হয়েছে, সাবালক। নিজের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা তার নিশ্চয় হয়েছে। যা করেছে তার দায় তাকেই নিতে হবে। আমি বড়ো জোর তাকে ত্যাজ্য পুত্র করতে পারি, এই ফ্ল্যাট থেকে বার করে দিতে পারি, এর বেশি আর কী করতে পারি যদি সে আমার কথা না শোনে? নবেন্দু এখন স্বাবলম্বী।’

দিগভ্রষ্ট পথিকের মতো স্মৃতি বলল, ‘আপনি কী আমায় কোনো সাহায্যই করতে পারেন না?’ পূর্ণেন্দু আবার হাতটা তুললেন।

‘ওকে আমি নিশ্চয় বলব বিয়ে করতে। কিন্তু মা তুমি কী এই বিয়ের পর সুখী হবে?’ পূর্ণেন্দু আবার হাতটা তুললেন।

‘ওকে আমি নিশ্চয় বলব বিয়ে করতে। কিন্তু মা তুমি কী এই বিয়ের পর সুখী হবে? তোমাদের সম্পর্ক তো কখনো স্বাভাবিক হবে না। নবেন্দু বলছে, সে পিতা নয়, তার মানে সে দায় এড়িয়ে পালাতে চায়। কেন পালাতে চাইছে? উত্তরটাও সহজ—তোমাকে ভালোবাসে না। এমন লোককে তুমি বিয়ে করবে!’ পূর্ণেন্দু কথার শেষে সামনে ঝুঁকে পড়লেন জবাবের অপেক্ষায়। স্মৃতির মন এখন কীভাবে কাজ করছে সেটা তাঁর জানা দরকার। ‘বলো, এমন একটা স্বামী কী তুমি চাও?’

‘কিন্তু সমাজে আমি মুখ দেখাব কেমন করে, মাথা তুলে চলব কেমন করে? সবাই ছি ছি করবে। বিয়ে না হওয়া মা বিদেশে চলে, আমাদের উঁচু সমাজে চলে আর ঝুপড়ি বস্তির সমাজে চলে কিন্তু মধ্যবিত্ত সমাজে চলে না। আপনার ছেলেকে বিয়ে করতে আপনি বারণ করছেন। না, আমি বিয়ে করতে চাই চাই চাই।’ উত্তেজিত হয়ে স্মৃতি উঠে দাঁড়িয়ে আবার সোফায় বসে পড়ল। তার চোখ দিয়ে ধকধক করে বেরিয়ে আসছে হিংস্রতা।

ঠান্ডা গলায় পূর্ণেন্দু বললেন, ‘বিয়ে করতে আমি বারণ করছি না, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। শুধু বলতে চাইছি ওটা নিছকই পুতুলের বিয়ের মতো ব্যাপারে দাঁড়াবে। প্রেমহীন দাম্পত্য, যা বেশিরভাগ পরিবারেই তুমি দেখতে পাবে, যদিও তারা বাইরে দেখায় খুবই সুখী দম্পতি, এমন একটা সম্পর্ক কী তুমি আজীবন চাও? দিনকাল যে বদলেছে, মানুষের চিন্তা যে এগিয়ে গেছে এটা কী তুমি বুঝতে পারো না?’

স্মৃতিকে বিভ্রান্ত দেখাল। পূর্ণেন্দু বুঝলেন তাঁর থেকে বয়সে কম করে চার দশকের ছোটো একটি মেয়ে বিপন্ন হয়ে তাঁর কাছে জীবনের ব্যক্তিগত লজ্জার কথা খুলে ধরেছে কিন্তু নিজের অবস্থানটিকে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না। এই বিপন্নতা কোনোকালে নবেন্দুর মতো কোনো পুরুষ অনুভব করতে পারবে না যা এই মেয়েটির জীবনে এসেছে। ওর ধারণা বিয়ে করলেই বোধহয় সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু একটি পুরুষ ও নারীর মধ্যে গূঢ় বোঝাপড়ার সম্পর্কটা সাতপাকে বাঁধার বা মালাবদলের দ্বারাই তো স্থির হয়ে যায় না! ‘

স্মৃতির চোখে আবার জ্বলে উঠল আগুন। কণ্ঠস্বর চেপে বলল, ‘দেখুন আমি অতশত কথার মধ্যে যেতে চাই না, নবেন্দুকে বিয়ে করতেই হবে নয়তো আমি এই হাউজিংয়ের ঘরে ঘরে গিয়ে আপনার ছেলের কীর্তির কথা বলে আসব। একটা কথা বলে রাখছি, নবেন্দুর জীবন কিন্তু নিরাপদ থাকবে না, স্মৃতি চ্যাটার্জির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ফল ও হাতে হাতে পাবে। এটা আপনার ছেলেকে বলে দেবেন, আমার চরিত্রে কাদা ছিটিয়ে ও যদি ভাবে পার পেয়ে যাবে, তাহলে ভুল করবে। নবেন্দুকে আমি ভালোবাসি, হ্যাঁ, এত কিছু বলার পরও।’

‘তাহলে তুমি নবেন্দুর সঙ্গেই বোঝাপড়া করে নাও। আমাকে এখানে এসে হুমকি দিচ্ছ কেন?’ পূর্ণেন্দু বিরক্ত ও তিক্ত স্বরে বললেন ধমক দিয়ে, তিনি ইতিমধ্যেই যথেষ্টভাবে বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত। এই নির্বোধ মেয়েটির কাছ থেকে আর কিছু শুনতে চান না।

‘বেশ তাই হবে। নবেন্দুকে শেষবারের মতো বলব, যদি রাজি হয় তাহলে ভালো। নয়তো—’ কথা অসমাপ্ত রেখে সে ঘর থেকে বেরিয়েই থমকে পাশে তাকাল। মায়া দেয়ালে হাত রেখে ফ্যাকাসে মুখে দাঁড়িয়ে। স্মৃতি সদর দরজা খুলে বেরিয়ে আস্তে পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিল।

পূর্ণেন্দু মুখ তুললেন মায়াকে দেখে। বজ্রাহাতের মতো মায়া সামনে বসলেন। কেউই কোনো কথা বলছেন না। অবশেষে নীরবতা অসহ্য হয়ে উঠতে মায়া মুখ খুললেন, ‘এখন কী করব?’

‘নবেন্দুকে বলব।’

‘বিয়ে করতে? এমন মেয়েকে?’

‘এমন ছেলের জন্য এমন মেয়েই তো যোগ্য।’ যেন কালমেঘ পাতা চিবিয়ে ফেলেছেন এমনভাবে পূর্ণেন্দু বললেন, ‘বিয়ে ওকে করতেই হবে, নয়তো যা মেয়ে দেখলুম, নির্ঘাৎ এখানে এসে হুলস্থুল বাধাবে। তুমি কী চাও আমরা এখানে মাথা নীচু করে বাস করি, ফ্ল্যাট বেচে দিয়ে চলে যাই? আমার আরও একটা ছেলে আছে তারও বিয়ে দিতে হবে, মেয়ে—জামাই আত্মীয়স্বজন আছে।’

‘রবু ফিরে আসুক, ওর সঙ্গে কথা বলে যা ঠিক করার করো।’

‘কেন, রবুর সঙ্গে কথা বলতে হবে কেন? আমি কী নিজেই ঠিক করতে পারি না?’ পূর্ণেন্দু চিৎকার করে উঠলেন, ‘আমার থেকে রবুর বিদ্যেবুদ্ধিটা কী বেশি?’

স্বামীর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মায়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পূর্ণেন্দু বেসিনে গিয়ে ঘাড়ে মুখে জল দিয়ে এসে সোফায় শুয়ে পড়লেন।

নবেন্দু আজ ফিরল তাড়াতাড়িই। বাঁ পায়ে নতুন করে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বাঁধা। খোঁড়াচ্ছে। মায়াকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে বলল, ‘আজ আবার লাগল, আবার এক্স—রে করাতে হবে।’

মায়া কথা না বলে রান্নাঘরে ঢুকলেন। খাওয়ার টেবলে একা বসে থেকে বিরক্ত হয়ে নবেন্দু নিজ মনে বিড়বিড় করল, ‘টিভি—টা বন্ধ কেন, এখন তো সিরিয়াল হয়!’ সে উঠে অন্ধকার বসার ঘরে ঢুকল। আলো জ্বালতেই দেখল পূর্ণেন্দু চিত হয়ে সোফায় শুয়ে।

‘অন্ধকার শুয়ে যে! টিভি দেখছ না?’

‘আজ একটা মেয়ে এসেছিল নাম বলল স্মৃতি চ্যাটার্জি।’ পূর্ণেন্দু উঠে বসলেন। নবেন্দুকে তিনি মানসিক প্রস্তুতি নেবার সময় দিতে চান না, কোনো ভূমিকা না করেই বললেন, ‘কেন এসেছিল নিশ্চয় তা অনুমান করতে পারছিস। নোংরা কথাটা আমি আর উচ্চচারণ করতে চাই না।’

নবেন্দু টিভির সুইচে আঙুল সবে দিয়েছে, সরিয়ে নিল। চোখ কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘স্মৃতি এখানে এসেছিল! আশ্চর্য, সাহস তো কম নয়! বারণ করেছিলুম তা সত্ত্বেও?’

‘ব্যাপারটা যখন চরম লজ্জার মেয়েরা তখন সাহসী হয়ে ওঠে।’

‘কী বলল?’

‘বিয়ে না করলে এখানে এসে ঘরে ঘরে বলে যাবে তোর কীর্তির কথা। আর তোর জীবন নিরাপদ থাকবে না।’

‘তার মানে মেরে ফেলবে? তা ওর দাদা পারে, একটা মাফিয়া!’

‘তোর জীবন নিয়ে আমি ভাবছি না কিন্তু অন্য ব্যাপারটা আমায় ভাবাচ্ছে—তোকে বিয়ে করতে হবে।’ অচঞ্চল অনুত্তেজিত পূর্ণেন্দুর গলা।

‘কেন করতে হবে?’ নবেন্দুর ভঙ্গিটা তেরিয়া হয়ে গেল। ‘প্রমাণ করুক আগে, ব্লাড টেস্ট করতে হয় তো করুক। আমি কী একা নাকি, ওর তো আরও বয় ফ্রেন্ড আছে।’

‘তাহলে এমন মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছিলিস কেন? এখন তো খেসারত দিতেই হবে। মেয়েটা কিন্তু বাজে থ্রেট করে যায়নি নবু, খুব সিরিয়াস, মরিয়া।’

‘আমার ব্যাপার আমি বুঝব, তোমাদের মাথা ঘামাতে হবে না।’

‘হবে।’ চিৎকার করে ধমকে উঠলেন পূর্ণেন্দু।

ঘর থেকে দ্রুত বেরোতে যাচ্ছিল নবেন্দু, ‘উহহহ’ বলে মুখ বিকৃতি করে দাঁড়িয়ে পড়ল চেয়ার ধরে। বাঁ পা তুলে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন মায়া। তিনি বললেন, ‘এ মেয়ে বউ হয়ে এলে সংসার ছারখার করে দেবে।’

‘কে বিয়ে করতে যাচ্ছে! ঘরে ঘরে বলে বেড়াবে, আমিও ওর পাড়ায় বাড়ি বাড়ি বলে আসব। কত ধানে কত চাল বুঝিয়ে দোব।’

.

নবেন্দু যখন কলকাতায় ওই কথাগুলো বলছিল তখন বর্গাপুরে অমিয়দের পাশের বাড়িতে বড়ো জ্যাঠা কমলাপতি বিশ্বাসের শোবার ঘরে বসে রবিন্দু গল্প করছিল সাতাত্তর বছরের বৃদ্ধ পাঠশালার প্রাক্তন শিক্ষকের সঙ্গে।

বৃদ্ধ কমলাপতি পিঠে উঁচু করে রাখা বালিসে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে আধশোয়া। তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে মোনা চুলে আঙুল ডুবিয়ে মাথা টিপে দিচ্ছে। রবিন্দু খাটের ধারে একটা টুলে বসে, পায়ের কাছে বিছানায় বসে সোনা।

‘কী নাম বললে? ভগবতী পাঠশালা, সেখানে তুমি পড়েছ? কলকাতায় এখনও তা হলে পাঠশালা আছে!’

রবিন্দু বলল, ‘এখনও পর্যন্ত আছে। তবে ইংলিশ মিডিয়াম পাঠশালা যেভাবে গজাচ্ছে তাতে বাংলা পাঠশালায় গরিবরা ছাড়া আর কেউ পড়বে না।’

‘কেন পড়বে না?’ কমলাপতি কৌতূহলী হলেন।

‘মাইনে। ইংলিশ মিডিয়ামে চার—পাঁচ বছরের বাচ্চচাকে দিতে হয় মাসে ষাট টাকা, তাও ভরতির জন্য কী ভিড়! গত বছর ছিল চল্লিশ টাকা, সামনের বছর হবে পঁচাত্তর টাকা এইভাবে বেড়ে চলেছে মাইনে। শুনছি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত ইংরিজি পড়ানো বন্ধ করে দেবে গভর্নমেন্ট স্কুলে।’

‘জানো রবু, আমাদের ছোটোবেলায় গ্রামের পাঠশালায় ধনী—দরিদ্র সবাই একসঙ্গে পড়ত। মাইনে ছিল শিশু শ্রেণিতে দু আনা, প্রথম শ্রেণিতে চার আনা, প্রথম মান ছ আনা, দ্বিতীয় মান আট আনা, পঁচিশ—তিরিশজন ছাত্র ছিল, মোট আদায় হত সাত—আট টাকা। ছাত্র পিছু মাসে এক সের করে চাল সিদে বাবদ দিতে হত। সত্তর বছর আগে কালীমাস্টারের এই ছিল মাসে রোজগার।’ এই বলে বৃদ্ধ চোখ পিটপিট করে মুখ টিপে হাসলেন।

‘ভাবা যায় না এখনকার সঙ্গে তুলনা করলে।’ রবিন্দু বলল।

‘কালীমাস্টার প্রথমে মেনুয়া গ্রামে মাস্টারি করতেন। স্টেশন থেকে দশ—বারো মাইল দূরে, অতটা রাস্তা তাকে হেঁটে যেতে হত, ভাবতে পার! তারপর আমার ঠাকুরদা বেণীমাধব বিশ্বাস ওনাকে বর্গাপুরে আনেন। আমাদের বৈঠকখানা ঘরেই থাকতেন। পরে বংশগোপাল দাস মশায়ের বৈঠকখানা ঘরে থাকতেন। ঘরের বারান্দায় পাঠশালা। একটা টিনের চেয়ারে বসে উনি পড়াতেন।’

কমলাপতি ঝরঝরেভাবে টানা বলে যাচ্ছেন তাঁর বাল্যকালের পাঠশালার কথা, খুঁটিনাটি কিছুই ভোলেননি, তখন রবিন্দু লক্ষ করল মোনা অপলকে তার দিয়ে চেয়ে রয়েছে। চোখাচুখি হতেই চোখ নামিয়ে মুখ নীচু করে বৃদ্ধের মাথা দিয়ে ব্যস্ততা দেখাল। রবিন্দু নড়েচড়ে চোখে একাগ্রতা ফুটিয়ে বৃদ্ধের মুখের দিকে চোখ ফেরাল কিন্তু মোনার মুখটি তার দৃষ্টির অন্তর্গত করে রাখল।

‘তারপর জ্যাঠামশাই।’ রবিন্দু মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা নিল।

‘কালীমাস্টার গরমের আর পুজোর ছুটিতে বাড়ি যেতেন, নয়তো দশ মাসই দিনরাত পড়ানো নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।’

মোনা অবাক হয়ে বৃদ্ধের দিকে তারপর রবিন্দুর দিকে তাকিয়ে চোখ বিস্ফার করে বলল, ‘দিনরাত পড়াতেন! বাব্বা, ছাত্রদের কী অবস্থা হত?’

রবিন্দু মুগ্ধ দৃষ্টিতে মোনার চোখদুটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যারা হায়ার সেকেন্ডারিতে ফেল করতে চায় না তাদের জন্য দরকার এই কালীমাস্টারের মতো পড়াবার লোক।’ যাকে উদ্দেশ্য করে বলল সে মুখ নীচু করে মৃদুস্বরে বলল, ‘ফেল করায় আমার অ্যালার্জি আছে, জীবনে ফেল করিনি।’

‘তারপর জ্যাঠামশাই।…দিনরাত উনি পড়াতেন।’

মোনা এতক্ষণে কথা বলল, ‘বড়োদাদু মাস্টারমশাই খেতেন কোথায়?’

‘কেন নিজে রেঁধে খেতেন। সিদেয় পাওয়া চাল ছাড়াও ছাত্ররা এটাসেটা আনাজ তেল নুন এনে দিত। পালা করে ছেলেরা জল আনা, উনুনে আঁচ দেওয়া, ঘর পরিষ্কার করা, কাপড়জামা কাচার কাজ করে দিত।’

বড়োজ্যাঠাকে কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য রবিন্দু একটা কৌতূহল ধরিয়ে দিল, ‘শুনেছি তখনকার পাঠশালায় খুব ভালো অঙ্ক শেখান হত?’ মোনার সঙ্গে যতবার দৃষ্টি বিনিময় হয়েছে তার বুকের মধ্যে তিরতিরে একটা ভাব হালকা ছলক দিয়েছে, এমনভাবে শরীরটা কখনো পালকের মতো লাগেনি।

‘শেখানো হত মানে! আট—ন বছর বয়সে আমরা পাটিগণিতের যেসব অঙ্ক শিখেছি হাইস্কুলে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত তাই ভাঙিয়ে চলে গেছে। তার সঙ্গে ছিল শুভঙ্করের অঙ্ক—মনকষা, সেরকষা, মাসমাইনে, বিঘাকালি, কাঠাকালি। প্রত্যেকটার জন্য আলাদা আলাদা আর্যা মুখস্থ করতে হত। এখনকার ছেলেমেয়েদের তো শিখতেই হয় না, এ সবের নামও শোনেনি, এখন তো মিটার লিটার ডেসিমেল। বিঘাকালির আর্যা কী ছিল জান?—কুড়ুবা, কুড়ুবা কুড়ুবা লিহ্যে, কাঠায়া কুড়ুবা কাঠায় লিহ্যে; কাঠায় কাঠায় ধূল পরিমাণ, বিশধূলে হয় কাঠায় প্রমাণ। কুড়ুবা মানে বিঘে, ধূল মানে গণ্ডা বুঝলে কিছু?’ বৃদ্ধ মিটমিট চোখে হাসতে লাগলেন।

সেই সময় বাড়ির বাইরে থেকে নারীকণ্ঠ চেঁচিয়ে ডাকল ‘মোনা সোনা শিগ্গিরি এসো, দিদি তোমাদের বাড়ি আসতে বলছে।’

মোনা জানলায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কেন গো কাতুর মা?’

‘কেন আবার কী, সন্ধে হয়ে গেছে তোমরা পড়তে বসবে না? মাস্টারমশায়ের আসার টাইম হয়ে গেছে।’

জিভ কেটে মোনা ‘সোনা আয়’ বলেই সিঁড়ির দিকে ছুটল।

রবিন্দু উঠে দাঁড়াল, ‘জ্যাঠামশাই আজ তা হলে আসি। আবার এলে দেখা করব।’

ফিরে এসে রবিন্দু দেখল খাওয়ার দালানের একধারে মাদুর পেতে দুই ভাইবোন পড়তে বসার জন্য তোড়জোড় করছে। সে দোতলায় উঠতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। ‘মোনা গল্পের বইটই কিছু আছে?’

মোনা একতলার শোবার ঘর থেকে দুটো বই আনল, বঙ্কিম গ্রন্থাবলী আর রামকৃষ্ণ কথামৃত।

‘কার বই এগুলো?’

‘মায়ের।’

‘তুমি পড়েছ?’

‘একটু একটু…চা খাবেন?’

‘খাব, তোমার কপালের কাটা দাগটা কীসের?’

কপালের কাটা দাগটায় আঙুল ঠেকিয়ে মোনা হাসল, ‘পড়ে গিয়ে।’

মোনা চা করে আনতে রান্নাঘরের দিকে যেতেই সোনা বলল, কী করে পড়ে গেছল জানেন রবু মামা? হনুমান সাইকেল থেকে দিদিকে ফেলে দিয়েছিল।’

‘সাইকেল থেকে মানে!’ রবিন্দু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

‘আমাদের জামরুল গাছে বসে একদিন পাঁচ—ছ—টা হনুমান জামরুল খাচ্ছিল আর চারিদিকে ছড়াচ্ছিল। দিদি একটা বাঁশ নিয়ে ওদের তাড়া করে, গোদাটাকে এক ঘা বসিয়েও দেয়। পরদিন দিদি মহাকালীর মাঠে কবাডি খেলে যখন সাইকেল চালিয়ে আমাদের পুকুর ধারের বাঁশবনের পাশ দিয়ে আসছে তখন বাঁশবন থেকে গোদা হনুমানটা দিদির ঘাড়ের উপর লাফ দিয়ে পড়ে এক চড় কষায়। দিদি ছিটকে রাস্তার ইটের ওপর পড়ে, তাইতেই কপালটা কেটে যায়। লজ্জায় দিদি কাউকে বলে না হনুমানের চড় খেয়েছে’ সোনার চোখমুখ এই গোপন তথ্যটি ফাঁস করার মজায় ঝকঝক করে উঠল। ‘জানেন রবুমামা, হনুমানটার সাইজ প্রায় আমার কাঁধ সমান, গায়ে খুব জোর, ওর একটা চড় খেলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাব, দিদি হয়নি। হনুমানটা আমাদের ছাদ থেকে লাফিয়ে বড়োদাদুর ছাদে চলে যায়। সেদিন দিদি মহাবাঁচান বেঁচে গেছল।’

‘তোমার দিদি সাইকেল চালাতে জানে?’

‘হ্যাঁ দিদির তো সাইকেল আছে, বড়োমামা কিনে দিয়েছে। ওই যে শেকলতোলা ঘরটা, ওর মধ্যে রাখা আছে, দেখবেন?’

‘না না থাক এখন।’

‘আপনি সাইকেল চালাতে জানেন?’

‘না, কলকাতায় এত গাড়ি লোকে সাইকেল আর চড়ে না। স্কুটার আর মোটরবাইকে চাপে নয়তো ট্রাম বাসে। তোমার দিদি কবাডি খেলে?’

‘আপনি জানেন না! দিদি তো মাধ্যমিক পাশ করার আগে পর্যন্ত মহাকালী সংঘে খেলত। চন্দননগর, চুঁচড়ো কত জায়গায় খেলে এসেছে মেডেলও পেয়েছে। আপনি কবাডি খেলেছেন?’

‘না।’ রবিন্দু জীবনে কোনো খেলাই খেলেনি লুডো আর ক্যারম ছাড়া। প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য তাড়াতাড়ি বলল, ‘তোমার দিদি আর কী কী পারে, সাইকেল কবাডি ছাড়া?’

সোনা নাকে আঙুল ঠেকিয়ে পাঁচ—ছ সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল, ‘ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে পারে, ডুব সাঁতারে মাঝ পুকুর পর্যন্ত যেতে পারে, বড়ি দিতে পারে—’

চায়ের কাপ হাতে মোনাকে আসতে দেখে সে চুপ করল। তখনই উঠোন থেকে গম্ভীর গলায় ‘মোনা সোনা।’ বলে ডেকে উঠল কেউ।

‘ওরে বাবা মাস্টারমশাই।’ সমীহ আর ভয় ফুটে উঠল মোনার গলায়। চায়ের কাপ আর বই দুটো হাতে নিয়ে রবিন্দু দোতলায় উঠে এল। খাটে চিত হয়ে শুয়ে কথামৃতের প্রথমেই যে পাতাটা খুলল সেখান থেকে পড়তে শুরু করল—

‘ভক্ত—সংসারে কেন তিনি রেখেছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ—সৃষ্টির জন্য রেখেছেন। তাঁর ইচ্ছা। তাঁর মায়া। কামিনীকাঞ্চন দিয়ে ভুলিয়ে রেখেছেন।

ভক্ত—কেন ভুলিয়ে রেখেছেন? কেন তাঁর ইচ্ছা?’

শ্রীরামকৃষ্ণ—তিনি যদি ঈশ্বরের আনন্দ একবার দেন তা হলে আর কেউ সংসার করে না, সৃষ্টিও চলে না।

চালের আড়তে বড়ো বড়ো ঠেকের ভিতরে চাল থাকে। পাছে ইঁদুরগুলো ওই চালের সন্ধান পায়, তাই দোকানদার একটা কুলোতে খই মুড়কি রেখে দেয়। ওই খই মুড়কি মিষ্টি লাগে, তাই ইঁদুরগুলো সমস্ত রাত কড়রমড়র করে খায়। চালের সন্ধান আর করে না।

কিন্তু দ্যাখো, এক সের চালে চোদ্দোগুণ খই হয়। কামিনীকাঞ্চনের আনন্দ অপেক্ষা ঈশ্বরের আনন্দ কত বেশি। তাঁর রূপচিন্তা করলে রম্ভা তিলোত্তমার রূপ চিতার ভস্ম বলে বোধ হয়।

রবিন্দু এই পর্যন্ত যখন পড়েছে তখন ঘরে এল অমিয়। সকালে বেরিয়ে ছিল। মুখচোখ বসে গেছে।

রবিন্দু বই বন্ধ করে বলল, ‘কাজ কত দূর হল?’

অমিয় বলল, ‘অনেকটা এগিয়েছে। ঘটপুকুরের জমিটা নিয়েই গন্ডগোল। কুড়ি বিঘে জমি, বর্গাদার ছিল আমাই শেখ। ও হঠাৎ আন্ত্রিক রোগে মরে গেল, রেখে গেল বউ আর দুটো বাচ্চচা। ওরা তো আর ব্যক্তিগতভাবে চাষ করতে পারবে না। কী হবে?’

‘কেন তুই চাষ করবি।’

‘অত সোজা নয় রে, ভূমিসংস্কার আইন বলে একটা আইন আছে। বর্গাদার মরে গেলে তার বৈধ ওয়ারিশদের থেকে একজন বর্গাদার হবে। আমাই—এর বউ দুই ছেলে নিয়ে এখান থেকে আট মাইল দূরে হাদিসপুরে বাপের বাড়ি চলে গেছে। সে আর চাষ করতে চায় না।’

‘ভালোই তো এবার তোর জমি তুই ফেরত নিয়ে লোক দিয়ে চাষ করা।’

‘করা যাবে না। নিয়ম হচ্ছে ভূমিহীন কাউকে দিয়ে বর্গায় চাষ করাতে হবে। জমি আমার হলেও ফেরত পাব না। মুশকিলটা হয়েছে তিনজন চাইছে বর্গাদার হতে। গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতে গেছলুম, সে ঠিক করে দিক তিনজনের মধ্যে কাকে বর্গাদার করা হবে। ঠিক করবে কী, ওখানে বিরাট দলাদলি। পার্টির ব্যাপার, দুটো তিনটে উপদল। গেলুম আর আই অফিসে। ইন্সপেক্টরবাবু অসহায়। দলাদলিতে যে পক্ষেই যান না কেন তার সরকারি চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে।’

‘তা হলে কী করবি?’

‘তিন জনকেই বর্গাদার করে দেব বলে এসেছি। জমি ছ—মাস পড়ে রয়েছে, এতদিনে দুটো ফসল তো তোলা যেত। একজন চাষ করলে আমার ভাগে যা পাব, দশজন চাষ করলেও তাই পাব তা হলে আমি কেন দলাদলির ঝামেলায় যাব। চাষের খরচখরচা আমি দিচ্ছি, ফসলের ফিফটি পারসেন্ট ভাগ আমার পেলেই হল। তোর কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো? বড়ো জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে কথা বলে এলি?’

‘হ্যাঁ। চমৎকার লোক, স্মৃতিশক্তি প্রখর।’

‘কালও তোকে একা থাকতে হবে। জমি ইন্সপেকশন করতে আসবে আমাকে থাকতে হবে। যদি কাজ হয়ে যায় পরশু আমি কলকাতায় ফিরে যাব।’

পরদিন সকালে রবিন্দু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁতে ব্রাশ করছে। তখনই চোখে পড়ল উঠোনের নিমগাছটায় মোনা উঠে ডাল ভেঙে নীচে ফেলছে কুড়োচ্ছে সোনা। ব্রাশ চালানো বন্ধ করে রবিন্দু হাঁ করে তাকিয়ে রইল। পড়ে গেলে তো হাত—পা ভাঙবে। মোনা নামতে শুরু করল। সাবধানে পা ফেলে এ ডাল ও ডাল করে নামছে। নীচের দিকের একটা ডাল দু—হাতে ধরে ঝুলে পড়ল। জমি থেকে প্রায় চারফুট উপরে ঝুলছে তার পা। হাত ছেড়ে দিয়ে ঝপাৎ করে মোনা মাটিতে পড়ল। চোখ তুলেই রবিন্দু তাকিয়ে আছে দেখে লজ্জায় মুখ নীচু করে ছুটে পালাল।

রবিন্দু হাঁফ ছেড়ে আবার ব্রাশ করতে শুরু করল। বারান্দা থেকে পুকুরটা দেখা যায়। একটা লোক খ্যাপলা জাল ফেলে মাছ ধরছে। তার খুব ইচ্ছে করল পুকুর পাড়ে গিয়ে মাছ ধরা দেখতে। মুখ ধুয়ে সে নীচে নেমে এল। খিড়কির দরজা দিয়ে পুকুরে যেতে হয়। সে দরজার দিকে এগোচ্ছে তখন সোনা তার সঙ্গ নিল।

‘জালফেলা দেখতে যাচ্ছি। চলো আমার সঙ্গে।’

‘আপনি কখনো দেখেননি?’

‘না। সিনেমায় দেখেছি।’

‘বাসুদা খুব ভালো জাল ফেলে। বেছে বেছে ঠিক জায়গাটায় ছুঁড়বে।’

নারকোল গাছের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ঘাটটা থেকে একটু দূরে পাড়ে দাঁড়িয়ে বাসু জালটা ঘোরাতে ঘোরাতে পুকুরে ছুঁড়ল। শূন্যে ছাতার মতো ছড়িয়ে গিয়ে জলে পড়ল। একটু পরে ধীরে ধীরে টেনে তুলতে লাগল। রবিন্দু উৎকণ্ঠিত হয়ে অপেক্ষায় রইল, জালে কী ওঠে! কটা মাছ, কী জাতের মাছ? এই সময়টাই মাছ শিকারের আসল সময়, এই প্রত্যাশাটা। বাসু জালটা টেনে ডাঙায় তুলল। ছটফটাচ্ছে জালে বন্দি কয়েকটা মাছ। তেলাপিয়া, চারাপোনা, বাটা, কই, একটা প্রায় আধ কিলো ওজনের কাতলা, কিছু গেঁড়ি আর গলদার বাচ্চচা।

রবিন্দু হতাশ হল, এত ছোটো ছোটো মাছ! ভেবেছিল দু—তিন কেজি ওজনের রুই কাতলা জালে উঠবে। সোনা বলল, ‘বড়ো বড়ো মাছ উঠবে টানা জাল দিয়ে যখন ধরবে। এই তো মাসখানেক আগে, যারা পুকুর জমা নিয়েছে তারা ধরল।’

‘তোমাদের এখানে এসে মাছ ধরা দেখলুম, আর কী দেখার আছে বল তো?’

‘দেখার।’ সোনা নাকে আঙুল ঠেকাল। ‘হালদারের রাধাগোবিন্দ মন্দির। মন্দিরের গায়ে পোড়া মাটির দেবদেবীর মূর্তি আছে, হাটতলার রথটা তিনতলা উঁচু, রথের সময় খুব বড়ো মেলা বসে, আমাদের স্কুল বাড়ি।’ আর কিছু সে খুঁজে পেল না।

‘মাত্র এই কটা, আর কিছু দেখার নেই?’

‘আপনি বুঝি শুধু বর্গাপুর দেখতে এসেছেন? আপনি তো এসেছেন দিদিকে দেখতে!’

‘দিদিকে দেখতে, কেন?’ রবিন্দু কথাটা বলল, আমোদ পেয়ে।

সোনা চুপ করে রইল। তারপর ইতস্তত করে বলল, ‘মা তো বলল, দিদিকে দেখতে বড়ো মামার বন্ধু আসবে।’

রবিন্দুর মাথার মধ্যে একটা চমকানি লাগল। ‘বড়োমামার বন্ধু কী জন্য দিদিকে দেখতে আসবে?’ তার কৌতূহল এবার তীক্ষ্ন হয়ে উঠেছে।

‘বারে, বিয়ের আগের মেয়েকে দেখতে আসে না? দেখে পছন্দ হলে তবেই তো বিয়ে হবে।’ সোনা বিজ্ঞের মতো মুখভঙ্গি করল।

বলে কী, বিয়ে হবে! রবিন্দু সোনার সরল মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সে তো এই সবের কিছুই জানে না, অমিয় তো তাকে কিছুই বলেনি কী উদ্দেশ্যে তাকে বর্গাপুরে নিয়ে আসছে। দিদির হাতের রান্না, গ্রামের মিষ্টি, হিমসাগর আম এই সবই তো বলেছিল, মেয়ে দেখানোর কথা তো বলেনি।

‘আপনি কিন্তু কাউকে বলে দেবেন না আমি এ কথা বলেছি। মা বারণ করে দিয়েছে।’ সোনার মুখে অস্বস্তি আর মিনতি।

‘না না বলব না, তোমার দিদি জানে?’

সোনা মাথা কাত করে বলল, ‘হ্যাঁ।’

বড়ো জ্যাঠার মাথার কাছে দাঁড়ানো মোনার চোখ ও চাহনি এখন রবিন্দুর কাছে বিশেষ অর্থ নিয়ে ধরা দিল। চেপে রাখা পুলক উচ্ছ্বসিত হয়ে মোনার চোখের মণি দুটিকে উজ্জ্বল করে রেখেছিল। অল্প বয়স তাই জীবনের প্রথম ভালোলাগা পুরুষটির কাছে সে আবেগ গোপন করতে পারছিল না। হৃদয়ের অঙ্কুরিত ভীরু লজ্জা দিয়ে সে স্বাভাবিক চঞ্চলতার রাশ টেনে ধরতে চেষ্টা করে হার মানছিল। রবিন্দুর কাছে সোনার ভাবভঙ্গি কথাবার্তার বিশ্লেষণ অন্য এক মোনাকে তার সামনে দাঁড় করাল।

‘তুমি আজ স্কুলে যাবে না?’

‘না, দিদিও যাবে না। আপনার দেখাশোনা করতে হবে, বড়োমামা বলে দিয়েছে। মা ঘরে থেকে বেরোয়নি, হাঁপানির টানটা বেড়েছে।’

‘তা হলে এখন কী করে সময় কাটানো যায়?’ রবিন্দু হালকা চালে বলল। সে যে এখানে তাকে আনার উদ্দেশ্যটা জানে না, সেটাই বজায় রাখবে ঠিক করল। এরা সবাই আশাই আশায় থাকবে। অমিয় একি ফ্যাসাদ তৈরি করল। মোনাকে বিয়ে! ঠাট্টা তামাশা ছেলেমানুষি কথাবার্তা বেশ লাগছে কিন্তু স্ত্রী হিসেবে ভাবতে গেলেই মনে কী যেন একটা খচখচ করছে। বড্ড ছেলেমানুষ, বড্ড কম বয়স। তবে সীমন্তির থেকে সব দিক দিয়েই ভালো।

‘আপনি ছিপ ফেলতে জানেন?’ সময় কাটানোর একটা ভালো উপায় বার করতে পেরে সোনা খুশিতে চোখ ভরিয়ে ফেলল।

‘দি আইডিয়া, গুড, ভেরিগুড।’ রবিন্দু উৎসাহ দেখাতে বাতাসে ঘুঁষি মারল। ‘ছিপ আছে?’

‘দিদির আছে।’

দুজনে ফিরে এল বাড়ির মধ্যে। মোনা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল।

‘আম খাবেন?’

‘নিশ্চয়। অমিয় বলেছিল খুব হিমসাগর হয়েছে।’

মোনা একটা থালাভরে রবিন্দুর জন্য কাটা আম নিয়ে এল আর একটা আস্ত আম নিজের জন্য। আমের তলায় দিকটায় দাঁত দিয়ে ফুটো করে মোনা চুষতে শুরু করল। ওইভাবে আম খাওয়া রবিন্দু দেখেনি আগে। থালাটা রেখে দিয়ে সে বলল, ‘আমিও ওইভাবে খাব, আম আর আছে?’

ছুটে রান্নাঘরে গিয়ে মোনা একটা বড়ো পাকা আম এনে দিল রবিন্দুকে। ফুটো করে টিপে রস বার করে সে চুষতে লাগল মোনার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটা কথাই, মেয়েটি জানে না আমি অনেক কিছুই জেনে ফেলেছি। যাবতীয় যত্নআত্তির পিছনে একটা স্বার্থ কাজ করছে। তাকে ঘিরে এই বাড়িতে একটা সুখস্বপ্ন সবাই দেখছে। মোনার চোখেও সে দেখতে পাচ্ছে সুখাবেশ। রবিন্দু বুঝতে পারছে সে একটা বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। এরা খুবই ভালো, আন্তরিক। সে অসহায়ভাবে জেনে যাচ্ছে মায়া মমতা তাকে কোণঠাসা করে দিয়ে প্রত্যাখ্যান করার ক্ষমতাটা কেড়ে নেবে।

‘মোনা তোমার ছিপ আছে শুনলাম, দেবে একবার। কখনো মাছ ধরিনি। বর্গাপুর থেকে এবার একটা নূতন অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরব।’

মোনা ভাইকে বলল, ‘পেয়ারা গাছে দেখ তো পিঁপড়ের ডিম পাস কিনা। কী মাছ ধরবেন তিনি না পুঁটি?’

‘তোমাদের পুকুরে ইলিশ নেই?’

‘কেন থাকবে না! আমাদের জানলা দরজা দেখছেন না, সব ধানগাছের তক্তায় তৈরি।’ মুখটিপে মোনা হাসল। রবিন্দু সরলমনে হাসিটা নিতে পারল না। এদের কথাবার্তা সেবাযত্নের মধ্যে অর্থ খুঁজে না পাবার জন্য তাঁকে নিজের সঙ্গে তর্ক করতে হচ্ছে।

পিঁপড়ের ডিম পাওয়া গেল। ছিপ আর খালুই হাতে সোনা পুকুরঘাটে এল, পিছনে রবিন্দু। ঘাটের নারকেল গুঁড়ি শ্যাওলায় পিছল। সোনা বারণ করল যেতে।

‘এখানে না বসে বরং ওদিকে নারকেল গাছটার পাশে বসুন।’ সোনা পরামর্শ দিল।

‘সোনা, পিঁড়িটা নিয়ে যা, মাটি এখনও ভিজে রয়েছে।’ খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে মোনা চেঁচিয়ে বলল। সোনা দৌড়ে গিয়ে দিদির হাত থেকে পিঁড়িটা নিয়ে এল। রবিন্দু যেখানে পিঁড়ি রাখল সেখানে জমি খাড়াভাবে পাড় থেকে পুকুরে নেমেছে। ঝাঁঝি আর নলখাগড়া পুকুরের ধারটাকে জঙ্গলের মতো করে রেখেছে। জায়গাটা রবিন্দুর পছন্দ হল না, এধার ওধার তাকিয়ে সে ভালো করে বসার মতো কোনো জায়গা দেখতে পেল না। কলাপাতায় মুড়ে ভাতের মতো কয়েকটা লাল পিঁপড়ের ডিম সোনা এনেছে, তার একটা সে বঁড়শিতে গাঁথল।

‘সোনা, মামা চা খাবেন কিনা জিজ্ঞাসা কর।’ খিড়কির দরজা থেকে মোনা আবার চেঁচিয়ে বলল।

রবিন্দু মুখ ফিরিয়ে অ্যাসশ্যাওড়া গাছের ফাঁক দিয়ে তুঁতে রঙের শাড়ি দেখতে পেল। মোনা দাঁড়িয়ে খিড়কির দরজায়। ‘না খাব না।’ রবিন্দু চিৎকার করে জানিয়ে পিঁড়িটা পাড়ের কিনারে টেনে নিয়ে গিয়ে বসল।

ছিপটা ধরে রবিন্দু পিছন থেকে সামনে ঝাঁকাল, বঁড়শি সমেত গিয়ে পড়ল নলখাগড়ার ঝোপের উপর। বিরক্ত হয়ে সে বলল, ‘এতটুকু সুতো দিয়ে কী মাছ ধরা যায়।’

কুণ্ঠিত স্বরে সোনা বলল, ‘একটু সরিয়ে ওই দিকটায় ফেলুন না।’

রবিন্দু কথাটা কানে না তুলে ছিপ হাতে এগিয়ে গেল পাড়ের একদম কিনারে। নরম পিছল মাটি, আঙুল দিয়ে আঁকড়ে সে দাঁড়াল। ছিপে ঝাঁকুনি দিয়ে সুতো ছুঁড়ল, আবার পড়ল নলখাগড়ার ঝোপে এবং বঁড়শি আটকে গেল খাগড়ায়। রবিন্দু সুতোয় জোরে টান দিতেই বঁড়শিটা খাগড়ায় গেঁথে গেল। বঁড়শি ছাড়াতে সুতোটা আলগা করার জন্য সে ঝুঁকল এবং আরও ঝুঁকল তারপরই পায়ের নীচের মাটি আলগা হয়ে পুকুরে ভেঙে পড়ে গেল রবিন্দুকে নিয়ে।

সোনা মজা দেখার মতো করে দেখছিল রবিন্দুর কাণ্ড। ওকে জলে পড়ে যেতে দেখে চিৎকার করে উঠল, ‘দিদি শিগগির আয়…ডুবে যাচ্ছে মামা, ডুবে যাচ্ছে।’

খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল মোনা। সোনার ভীত চিৎকার শুনে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। রবিন্দু তখন দু—হাত তুলে ডুবছে আর উঠছে। হাঁ করে শ্বাস নিয়ে আর একবার যখন ডুবল মোনা তখন পাড়ে পৌঁছে গেছে। রবিন্দুর দিকে একবার তাকিয়েই সে হ্যাঁচকা দিয়ে পরণের শাড়িটা খুলে একটা প্রান্ত নিজের হাতে ধরে রেখে ছুঁড়ে দিল রবিন্দুকে লক্ষ্য করে।

‘ধরুন ধরুন শাড়ি ধরুন।’ মোনা চিৎকার করল। রবিন্দু তখন কোনো শব্দ শোনার বা শাড়ির কোনো অংশ ধরার মতো অবস্থায় নেই।

জল থেকে শাড়িটা টেনে তুলে ভাইয়ের হাতে ছুঁড়ে দিয়েই মোনা পুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার নিম্নাঙ্গে শুধু সবুজ রঙের সায়া। পাড় থেকে বেশি দূরে নয় কিন্তু জল সেখানে দেড় মানুষ গভীর। দু—তিনটি হাত পাড়ি দিয়ে সে যখন পৌঁছল রবিন্দু তখন নীচের দিকে নেমে চলেছে। মোনাও ডুব দিল। চার—পাঁচ সেকেন্ড পরই সে রবিন্দুকে তুলল চুলের মুঠি ধরে। নেতিয়ে পড়েছে রবিন্দু। এই সময় প্রাণ বাঁচাবার জন্য ডুবন্ত মানুষ হাতের নাগালে যা পায় সেটাই আঁকড়ে ধরে। মোনাকে আঁকড়ে ধরবে সেই ক্ষমতাটাও তখন তার নেই।

এক হাতে রবিন্দুকে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত তুলে মোনা ভাইকে চেঁচিয়ে বলল, ‘শাড়িটা ছোড়।’

সোনা একটা প্রান্ত ধরে রেখে শাড়িটা ছূড়ল মোনা এক হাতে ধরল। ‘টান এবার।’

সোনা শাড়ি টেনে আনল পাড়ে সেই সঙ্গে মোনা রবিন্দুকে। পাড়টা উঁচু ও খাড়াই। দু বগলের নীচে হাত রেখে উঁচু করে তুলে ধরার চেষ্টা করেও রবিন্দুকে তুলতে পারল না মোনা।

‘সোনা ছুটে বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাস কি না দেখ। আমি ধরে দাঁড়িয়ে আছি।’

সোনা ছুটল এবং আধ মিনিটের মধ্যে হস্তদস্ত হয়ে ছুটে এল বাসু। সে টেনে তুলল রবিন্দুকে। উপুড় করে শুইয়ে কোমরের কাছে বাসু দু—হাতে ধীরে ধীরে চাপ দিতেই রবিন্দুর মুখ থেকে জল বেরিয়ে আসতে লাগল। মোনা জল থেকে উঠে পা ছড়িয়ে বসে হাঁফাচ্ছে। উপুড় হয়ে পড়ে থাকা রবিন্দুর দিকে সে তাকাল। তার চোখে কোনো ভাব নেই, কোনো আগ্রহ নেই। ঘটতে যাওয়া একটা বিশাল বিপর্যয় রোধ করার সাফল্যে সে আন্দোলিত হচ্ছে না। তার চাহনির শূন্যতা জানিয়ে দিচ্ছে মস্তিষ্ক অসাড় অবস্থায় রয়েছে। শাড়িটা তার গায়ের উপর রেখে সোনা বলল, ‘পরে নে।’ মোনা ফ্যাল ফ্যাল করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল।

কী যেন একটা হইচই হচ্ছে পুকুরঘাটের দিকে, অরুণা উৎকর্ণ হলেন। একতলায় নিজের ঘরের খাটে কোলে পাশবালিস নিয়ে সামনে ঝুঁকে বসে ছিলেন। সকাল থেকে আক্ষেপ করে যাচ্ছেন, এতদিন পর রবু এল দিদির হাতের রান্না খাওয়ার জন্য আর হাঁপের টানটা কিনা এই সময়ই বাড়ল। দু—চারটে রান্না যে রাঁধবেন তারও জোর শরীরে নেই। রেঁধে না দিতে পারার থেকেও তার দুশ্চিন্তা মোনাকে কী পছন্দ হবে রবুর? অমিয় চিঠিতে জানিয়ে ছিল মোনা সারাদিন যেভাবে থাকে ঠিক সেইভাবেই যেন রবুর সামনে থাকে, বাড়তি কোনোরকম সাজগোজ বা অতিরিক্ত সভ্য ভব্য হবার চেষ্টা যেন না করে। সাজগোজ যে করেনি সেটা তো ঘরে বসে দেখতে পাচ্ছেন কিন্তু ঘরের বাইরে মোনা কী বলছে বা করছে সেটা তো দেখতে পাচ্ছেন না। এই নিয়েই তার আশঙ্কা। বারবার তিনি রাধাগোবিন্দকে স্মরণ করে মিনতি জানিয়েছেন ‘ওর দস্যিপনাটা এই কটা দিনের জন্য থামিয়ে রেখো, রবু যেন ওকে পছন্দ করে।’

হঠাৎ তার কানে এল সোনার ব্যস্ত উত্তেজিত গলা, ‘আমি যাচ্ছি ডাক্তারবাবুকে ডাকতে।’

অরুণা সোজা হয়ে বসলেন। কী ব্যাপার, সোনা কেন ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছে? দালানে সাইকেল বারকরার শব্দ পেলেন। গ্রামের ডাক্তারবাবুর চেম্বার আধমাইল দূরে হাটতলায়। সোনা—মোনা দুজনেই সাইকেল চালাতে জানে। মোনা কোথায়? কিছু করে বসেনি তো? খাট থেকে নেমে ঘর থেকে বেরোতেই তিনি দেখলেন বাসু পাঁজাকোলা করে রবিন্দুকে এনে বাইরের রকে শুইয়ে দিল। রবিন্দু অজ্ঞানের মতো নেতিয়ে রয়েছে। সারা শরীর ভিজে সপসপে।

‘কী হয়েছে ওর বাসু?’ অরুণা চিৎকার করে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়লেন। থরথর করে কাঁপছেন, একি দৃশ্য। তিনি দেখছেন! রবু কী মারা গেছে? কী হয়েছে ওর?

বাসু বলল, ‘পুকুরে ডুবে গেছলেন। মোনাদিদি ঝাপ্পে পড়ে টেনে তুলল। দিদি না তুললি অ্যাতোক্ষণে—’ চোখদুটো উলটে বাসু আকাশের দিকে তুলল। আর্তনাদ করে উঠলেন অরুণা।

বাসু বলল, ‘এখন আর ভয়ের কিছু নেই। যে জল খেয়েছিল সব বার করি দিচি। এখন শুকনো জামাকাপড় পইরে শুইয়ে দিন।’

‘বাসু ওকে আমার ঘরে তুলে নিয়ে গিয়ে খাটে শুইয়ে দে। কাতুর মা দৌড়ে ওপরের ঘরের থেকে মামাবাবুর ধুতি জামা এনে দে।’ অরুণা ব্যস্ত হয়ে বললেন। জলে ডোবা মানুষের চিকিৎসা কী তিনি জানেন না। কখনো কাউতে জলে ডুবতে দেখেননি। উদবেগে আশঙ্কায় তিনি ভুলে গেছেন মোনার কথা। বারবার তিনি বলে যেতে লাগলেন, ‘কী সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছিল! দু—দিনের জন্য বেড়াতে এসে একি বিপদের মধ্যে আমাদের ফেলে দিল। ওর বাবা—মার কাছে মুখ দেখাতুম কী করে। বাড়িতে একটা লোকও নেই, অমিয় কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। মোনা গেল কোথায়? অ বাসু, দেখোতো মেয়েটা কোথায়?’

‘মোনা দিদি তো পুকুর পাড়ে বসে।’

বাসুর কথা শেষ হতে—না—হতেই মোনা এসে হাজির। পরনে ভিজে শাড়ি, ভিজে চুল দড়ির মতো পাকিয়ে রয়েছে। দু—চোখে ভয়।

‘বাসুদা, আছে কেমন?’

‘মনে তো হচ্ছে দুর্ভোগ কেটে গেছে। নাও পায়ের দিকটা ধরো, ঘরে নেই যাই।’

বাসু আর মোনা, রবিন্দুকে ধরে অরুণার ঘরে এনে মেঝেয় শুইয়ে রাখল। রবিন্দু চোখ খুলে তাকাল। তার গায়ের গেঞ্জিটা ধরে উপরের দিকে টেনে মোনা বলল, ‘হাত দুটো তুলুন, পারবেন তুলতে?’

জবাব না দিয়ে রবিন্দু উঠে বসতে গেল। পারল না। অসহায়ভাবে মোনার মুখের দিকে তাকিয়ে দু—হাত তুলল আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে। মোনা গেঞ্জিটা মাথা দিয়ে গলিয়ে খুলে নিল। দোতলার বারান্দায় অমিয়র লুঙ্গি ও শার্ট শুকোচ্ছিল দড়িতে। কাতুর মা দৌড়ে দোতলায় উঠে চোখের সামনে তাই দেখে তুলে এনেছে। শার্টটা পরিয়ে দিল মোনা। পাজামার কোমরের দড়িটা খুলে দিয়ে মোনা বলল, ‘লুঙ্গিটা নিজে পরতে পারবেন?’

ঘাড়নেড়ে রবিন্দু বলল, ‘পারব।’

ঘর থেকে সবাই বেরিয়ে যেতে রবিন্দু উঠে বসে পাজামা ছেড়ে লুঙ্গি পরে নিল।

একটু পরেই সোনা ডাক্তারকে সাইকেল রিকশায় বসিয়ে, পিছু পিছু নিজে সাইকেল চালিয়ে এসে হাজির হল। ততক্ষণে রবিন্দু অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। ডাক্তার নাড়ি দেখলেন, বুক পরীক্ষা করলেন, পেট টিপলেন এবং যেহেতু চিকিৎসা করতে এসেছেন তাই একটা কাগজ চেয়ে নিয়ে দুরকম ক্যাপসুলও একটি টনিকের নাম লিখে দুবেলা একটি করে ক্যাপসুল ও দু—চামচ টনিক খাওয়ার নির্দেশ দিয়ে হেসে বললেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। শক্ত খাবার কিছু দেবেন না। গরম দুধ দিতে পারেন, দরকার এখন রেস্ট। ওষুধ খাওয়ার পর ঘুমোবে। শক পেয়েছে, কালকেই ঠিক হয়ে যাবে। বেশি কথা বলবেন না। জল অল্পই পেটে গেছে, মনে তো হয় না লাংয়ে জল গেছে। ভাগ্য ভালো খুব তাড়াতাড়িই জল থেকে তুলে ফেলা গেছে।’

রবিন্দু চোখ বুঁজে ডাক্তারের কথা শুনছিল। ওর শেষ কথাটিতে সে চোখ মেলে ঘরের এধার ওধার তাকিয়ে মোনাকে খুঁজে পেল না। মাথার খুলিতে চুলের গোড়ায় ব্যথা করছে। শক্ত মুঠিতে চুল ধরে হ্যাঁচকা দিয়ে তাকে টেনে তুলেছে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখের ভিতর থেকে…বাঁ হাতটা গলায় জড়িয়ে বুকের কাছে তাকে চেপে ধরে ডান হাত তুলে ভাইকে চেঁচিয়ে কী যেন বলল…কী যেন বলল…তখন আর শোনার মতো জ্ঞান তার ছিল না।…ডাক্তার বলল ভাগ্য ভালো…কার ভাগ্য, এদের না আমার? রবিন্দু আবার চোখ বুঁজল, তার ঘুম পাচ্ছে, ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এখন আর সে কিছুই ভাবতে চায় না।

চারঘণ্টা টানা ঘুমোবার পর রবিন্দুর ঘুম ভাঙল। চোখ খুলে দেখল অমিয় খাটে তার পাশে বসে মুখের দিকে তাকিয়ে। দিদি, সোনা আর মোনা দাঁড়িয়ে, ওদের চোখেমুখে উদবেগ। তাকে চোখ খুলতে দেখে অরুণা দু—হাত কপালে ঠেকিয়ে বিড়বিড় করলেন: ‘মুখ রেখেছ ঠাকুর।’

অমিয় বলল, ‘এখন কেমন বোধ করছিস।’

‘আমার কিছু হয়নি।’ বলে রবিন্দু উঠে বসতে গেল। অমিয় কাঁধে হাত দিয়ে ঠেলে ওকে শুইয়ে দিল।

‘হয়নি বলছিস কী, যে কাণ্ড বাধিয়ে ছিলিস, প্রাণে যে বেঁচেছিস সেটা তোর সাতজন্মের পুণ্যের ফল।’

রবিন্দু ম্লান হাসল। তাকাল মোনার দিকে। মুখ নামিয়ে সে দাঁড়িয়ে রবিন্দু গভীর গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। মোনা একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল। রবিন্দুর মনে হল মোনা যেন সতেরো—আঠারো বছরের কিশোরী নয় আজকেই ওর বয়স সাত—আট বছর বেড়ে গেছে।

‘তোকে নিয়ে আসাই আমার ভুল হয়ে গেছে।’ অমিয় ক্ষুব্ধ স্বরে বলল। ‘এমন একটা কাণ্ড বাধাবি জানলে আসতে বলতুম না।’

রবিন্দু হাসবার চেষ্টা করে বলল, ‘কাণ্ডটা না বাধালে আমিও নিজের সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারতুম না। বকাঝকা পরে করবি অমিয়, এখন একটু চা খাওয়া। খুব খিদে পাচ্ছে, দিদি মুড়িটুড়ি আছে?’

‘ডাক্তারবাবু তো শক্ত জিনিস খেতে বারণ করেছেন, তুমি বরং দুধ খাও।’ অরুণা বললেন, ‘মোনা এক গ্লাস দুধ গরম করে আন।’

সোনা বলল, ‘ডাক্তারবাবু বলেছিলেন রবুমামা কেমন থাকেন সেটা ওকে জানিয়ে আসতে।’

‘কী আবার জানানোর আছে, আমি দিব্যি ফিট।’ গায়ের উপর রাখা পাতলা সুতির চাদরটা সরিয়ে রবিন্দু উঠে বসল। ‘একটা রিকোয়েস্ট তোকে, আমার এই কীর্তির কথাটা ঘুণাক্ষরেও যেন আমাদের বাড়িতে না পৌঁছয়।’

‘পৌঁছলে তো আমারই সর্বনাশ। মাসিমা আমার ওপর এমনিতেই চটা তার ওপর আমাদের বাড়িতে এসে তুই ডুবে মরতে বসেছিলি শুনলে জীবনে আর আমার মুখদর্শন করবেন না। লাভের মধ্যে হল কাল আমার কলকাতায় ফিরে যাওয়াটা আর হল না।

‘কেন?’

‘তোকে এখন ফেলে রেখে কী যাওয়া সম্ভব?’

‘খুব সম্ভব। তোর সঙ্গে আমিও যাব।’ রবিন্দু খাট থেকে নেমে মেঝেয় দাঁড়িয়েই টলে গেল। অমিয় তাকে ধরে খাটে শুইয়ে দিয়ে বলল, ‘থাক আর বাহাদুরি দেখাতে হবে না। কলকাতায় গিয়েই গোলদিঘিতে একটা ক্লাবে ভরতি হয়ে সাঁতারটা শিখে নিবি।’

দুধের গ্লাস হাতে মোনা এল। রবিন্দু উঠে বসে গ্লাসটা নিয়ে চুমুক দিতে দিতে লক্ষ করল মোনা ইসারায় সোনাকে ডেকে নিয়ে ঘরের বাইরে গেল। দুধ শেষ করে সে আবার শুয়ে চাদরটা বুক পর্যন্ত টেনে দিল।

‘যাই একবার ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসি।’ অমিয় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সোনা ফিরে এল ডানহাতটা পিছন দিকে রেখে। মায়ের দিকে সে সন্তর্পণে তাকিয়ে খাটে বসে রবিন্দুর গায়ে ঢাকা চাদরের মধ্যে ডান হাতটা ঢুকিয়ে দিল। রবিন্দুর হাতের তালু খুঁজে নিয়ে সে একমুঠো নারকোল নাড়ু তালুতে গুঁজে রাখল। রবিন্দু জিজ্ঞাসু কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই সে দরজার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘দিদি দিল।’

.

দুর্গাপুরে রবিন্দু যখন চাদর মুড়ি দিয়ে একটা একটা করে ছ—টা নারকোল নাড়ু খেয়ে শেষ করছে তখন কলকাতায় আনন্দ নিকেতনের ফটকে একটা ট্যাক্সি এসে থামল। ট্যাক্সি থেকে নামল নবেন্দু। পায়ে এক্স—রে করে ফিরছে। সকালে প্র্যাকটিস ম্যাচে পিছন থেকে করা একটা ট্যাকলিংয়ে তার চোটের জায়গাটায় আবার লাগে। মাঠ থেকে সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বেরিয়ে আসে। বিকেলে পার্ক স্ট্রিটে ক্লাবের ডাক্তারের চেম্বারে যায়। সেখান থেকে এক্স—রে ক্লিনিকে তারপর বাড়িতে।

ফটক থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে দুটো মোটরবাইকে চারজন লোক বসে। রাস্তায় আলো কম, পথচারী পাঁচ—ছ জন মাত্র। রাস্তার ধারে তিন—চারটি মোটর দাঁড়িয়ে। ফটকের সামনেটা নির্জন। নবেন্দু ট্যাক্সি থেকে নেমে মিটার দেখছে। তখন মোটরবাইক স্টার্ট করার শব্দে সে একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।

‘কত হয়েছে?’

‘বারো টাকা সত্তর পয়সা।’

নবেন্দু তেরোটা টাকা দিয়ে ‘ঠিক আছে’ বলে বাঁ পা আলতো করে ফেলে ফটকের দিকে এগোল। ট্যাক্সিওয়ালা মিটার ঘুরিয়ে নিয়ে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল আর তখনই মোটরবাইক দুটো এগিয়ে আসতে লাগল। নবেন্দু যখন লোহার ফটকে তখন বাইক দুটো তার কাছে এসে পড়েছে। দুটো বাইকে পিছনে বসা দুজন পরপর দুটো বোমা ছুড়ল নবেন্দুর দিকে। বিকট শব্দে ফেটে ধোঁয়ায় ভরে গেল এলাকাটা। এঞ্জিনের গর্জনতুলে বাইক দুটো মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হই হই করে দু—পাশের বাড়ির লোক বেরিয়ে এল। আনন্দ নিকেতন থেকে বেরোল জনা তিনেক। ফটকের কাছে পড়ে রয়েছে নবেন্দু। তার দুই পা থেকে ঝরঝর করে রক্ত বেরোচ্ছে, গালে কপালে গর্ত হয়ে রক্ত পড়ছে। একটা বোমা পড়েছে তার পায়ের কাছে অন্যটা ফটকের লোহার রেলিং—এ।

হাউজিংয়ে দরোয়ান ছুটে গেল খবর দিতে। বোমার শব্দে পূর্ণেন্দু বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দরোয়ান বাইরে থেকে চেঁচিয়ে বলল, ‘শিগগির আসুন, আপনার ছোটো ছেলেকে বোমা মেরেছে, গেটের কাছে পড়ে আছেন।’ শুনেই পূর্ণেন্দু অস্ফুটে বলে উঠলেন, ‘বাজে হুমকি দেয়নি।’

রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা মোটরগুলির একটির অবাঙালি মালিক তার ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে যখন বলছিলেন, ‘উঠাকে জলদি হসপিটালমে লে যাও।’ তখনই পূর্ণেন্দু ও মায়া ফটকে পৌঁছলেন। সেই গাড়িতে নবেন্দুর সঙ্গে তারা দুজনে উঠলেন। নবেন্দুর আঘাত বড়ো রকমেরই কিন্তু সে জ্ঞান হারায়নি।

‘সত্যি সত্যিই তোকে মারার চেষ্টা করেছে।’ গাড়িতে পূর্ণেন্দু ফিসফিস করে বললেন।

মায়ের কাঁধে মাথা রেখে বসা নবেন্দু বলল, ‘মারার চেষ্টা সত্যি সত্যি করলে এখনও বেঁচে থাকতুম না। এটা ওয়ার্নিং দিল।’

গাড়ি যখন আর জি কর মেডিক্যাল হসপিটালে ঢুকছে। পূর্ণেন্দু তখন বললেন, ‘তা হলে বিয়েটা করেই ফেল। আমাকে ঠিকানাটা দিস গিয়ে কথা বলে আসব।’

পূর্ণেন্দুকে আর স্মৃতিদের বাড়িতে গিয়ে কথা বলতে হল না, পরদিনই দুপুর বারোটা নাগাদ স্মৃতিই এসে হাজির হল আনন্দ নিকেতনে। চোখমুখ শুকনো। কোনো প্রসাধনের চিহ্ন নেই মুখে, চাহনি এলোমেলো। পূর্ণেন্দু তাকে বসালেন খাওয়ার টেবলে। স্মৃতিকে দেখেই তিনি মেজাজ হারিয়ে ফেলেছিলেন কোনোমতে নিজেকে সংযত রেখে বললেন, ‘তোমার দাদা একটা পলিটিক্যাল মাফিয়া জানি তাই বলে এটা কী করলেন? নবুকে শিক্ষা দিতে গিয়ে তো নিজের বোনের সর্বনাশ করলেন।’

‘সর্বনাশ!’ স্মৃতি প্রায় চমকে উঠল। ‘কী সর্বনাশ হয়েছে নবুর, এমন কেমন আছে? বিশ্বাস করুন আমি আজই সকালে শুনলাম ঘটনাটা। আমি বুঝতে পারিনি দাদা এমন একটা ব্যাপার ঘটাবে। দাদাও বোঝেনি সমরেশদা এতদূর পর্যন্ত যাবে। দাদা ওকে বলেছিল শুধু একটু কোড়কে দিতে, বোমা মারতে বলেনি। নবু এখন কোথায়, কেমন আছে?’

পূর্ণেন্দু তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তাকালেন স্মৃতির মুখের দিকে। মেয়েটির মুখে চোখে সত্যিকারের উদবেগ ব্যাকুলতা আতঙ্ক দেখতে পেলেন।

‘ইনজুরি কী খুব মারাত্মক?’ স্মৃতি গলা নামিয়ে বলল।

‘হ্যাঁ।’ পূর্ণেন্দু গম্ভীর হয়ে জানালেন। ‘অপারেশন হয়েছে, গোড়ালির হাড় তিনটুকরো হয়ে গেছে, ওর ফুটবল কেরিয়ার শেষ। এ তুমি কী করলে? নিজের পায়ে তো নিজেই কুড়ুল মারলে।’

মায়া এসে বসলেন টেবলে স্মৃতির বিপরীতে। মুখ নীচু করে নিল স্মৃতি।

পূর্ণেন্দু বলে চললেন, ‘নবুকে এবার পরের দয়ার ওপর জীবন কাটাতে হবে, আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেল। কোথায় কাজ পাবে, কে ওকে কাজ দেবে! লেখাপড়া তো মাধ্যমিক। লাখ লাখ মাধ্যমিক সক্ষম বেকার ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন ছেলেকে কী বিয়ে করবে? এখনও কী তুমি সেদিনের মতো বলবে, বিয়ে করতে চাই চাই চাই।’ পূর্ণেন্দুর স্বরে প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ।

স্মৃতির চোয়ালের পেশি শক্ত হয়ে উঠল। মুখ নামিয়ে রেখেই সে বলল, ‘হ্যাঁ এখনও চাই, আরও বেশি করে চাই।’

পূর্ণেন্দু ও মায়া চোখাচোখি করলেন বিস্মিত হয়ে, দুজনের কেউই আশা করেননি এমন উত্তর শোনার জন্য।

‘বিয়ে করে আমার এখানে থাকার জায়গা হবে না। দুটো মাত্র শোবার ঘর আরও একটা ছেলে আছে তারও বিয়ে দিতে হবে।’ গলাটা কর্কশ করে মায়া বললেন।

‘যতদিন না দাদার বিয়ে দিচ্ছেন ততদিন থাকতে দিন তারপর নয় কোথাও চলে যাব।’ ধীরগলায় স্মৃতি বলল।

‘তা নয় যাবে কিন্তু চলবে কী করে, সংসার চালাতে তো রোজগার চাই।’ মায়া বাস্তব দিকটার দিকে আঙুল দেখালেন।

‘কিছু একটা ব্যবস্থা নিশ্চয় হয়ে যাবে, দাদার সঙ্গে কথা বলি আগে। দোষ আমারও যেমন তেমনি দাদারও। কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবে।’ স্মৃতির স্বরে প্রত্যয় নেই কিন্তু হতাশাও নেই। ‘কিছু না হলে আমিই রোজগারের চেষ্টা করব। হিস্ট্রি অনার্স গ্র্যাজুয়েট আমি। নবুর তো একটা পা অক্ষত আছে, তাই দিয়ে যতটা চলাফেরা করা যায় তাই করে রোজগারের চেষ্টা করবে। দোষ তো ওরও খানিকটা আছে।’

‘খানিকটা নয় পুরোটা।’ পূর্ণেন্দু স্বরে আর আগের কাঠিন্য নেই। স্মৃতির আন্তরিকতাপূর্ণ কথা আর অসহায় অবস্থাটা অনুভব করে তার মধ্যে সহানুভূতির প্রলেপ পড়ছে। ‘সব কিছুর মূলে তো সেই। ফুটবল খেলে লাখ লাখ টাকা কামাবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে মনের ব্যালান্স হারিয়ে নিজের আর সেই সঙ্গে একটা মেয়ের সর্বনাশ করে বসল।’

‘তুমি শুধু নবুরই দোষ দেখছ, আর একজন কী কচি খুকি?’ মায়া ধারালো গলায় কথাটা বলে স্মৃতির দিকে আগুন ঝরান চোখে তাকিয়ে রইলেন। মাথা নিচু করে স্মৃতি বসে রইল। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না।

‘কাল পুলিশ এসেছিল ইনভেস্টিগেট করতে।’ পূর্ণেন্দু নীরবতা ভাঙলেন। মুখ তুলে স্মৃতি জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। ‘কাউকে সন্দেহ করছি কিনা জানতে চায়। আমি কারুর নাম করিনি, বলেছি দমদমে খেলতে গিয়ে মারপিট করেছিল বোধহয় সেখানকারই কেউ শোধ নিতে একাজ করতে পারে। আমি কোনো কমপ্লেন করতে চাইনি ওরা তাইতে হাঁফ ছেড়ে খুশি হয়েই চলে গেল। কেলেঙ্কারি বাড়িয়ে লাভ কী।’

‘নবু কোন হাসপাতালে আছে?’

‘আর জি কর—এ।’

‘কবে বাড়ি আসবে?’

‘আরও দিন দুয়েক তো থাকবে।’ পূর্ণেন্দু আন্দাজে বললেন।

‘নবুর চিকিৎসার সব খরচ দাদা দেবে বলেছে।’ স্মৃতি দ্বিধা জড়িত স্বরে বলল। সে যেন জানেই প্রত্যাখ্যাতা হবে।

‘জুতো মেরে গোরু দান!’ পূর্ণেন্দুর মুখ বিকৃত হয়ে উঠল রাগে, ‘তোমার দাদার স্পর্ধা তো কম নয়!’

মায়া বললেন, ‘বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি চুকে যায় ততই ভালো। লোকজন ডেকে নেমন্তন্ন করে নয়, এই ঘরে হবে। বিয়ের পরই বাচ্চচা হবে, শুনলে লোকে কী বলবে, আত্মীয়স্বজনের কাজে মুখ দেখাব কী করে। তুমি বাপু এখন থেকেই ঘরটর দ্যাখো।’

পূর্ণেন্দু বললেন, ‘তোমাদের ওদিকে তোমার দাদার তো খুব দাপট আছে তাকে বলোনা ঘর জোগাড় করে দিতে।’

স্মৃতি অস্ফুটে বলল, ‘তাই বলতে হবে।’

.

সেইদিনই বর্গাপুরে দোতলার বারান্দায় মুখোমুখি দুটো মোড়ায় বসে রবিন্দু আর অমিয় কথা বলছিল। রবিন্দুর ঘটনাটার পর অমিয় কলকাতায় ফেরার সিদ্ধান্ত বাতিল করে রয়ে যায়। মানসিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে রবিন্দুর বেশি সময় লাগেনি। শুধু শরীরের উপর ধকলটা তাকে দুর্বল করে রেখেছে।

‘অমিয় আমার ছুটি কিন্তু অনন্ত কালের জন্য নয়। কাল দুপুরেই ফিরব।’

‘আর দুটো দিন থেকে যা।’

‘পরে এসে থেকে যাব। তোর মনে আছে কী, আমাদের বাড়িতে বসে আমাকে বলেছিলি যদি বিয়ে করিস তাহলে নবুর থাকার ব্যবস্থা আমি করে দেব গড়িয়ার নতুন বাড়িতে। নবুকে একটা ঘরে থাকতে দিবি বলেছিলিস। মনে আছে?’

‘আছে।’

‘অফারটা কী এখনও খোলা আছে?’

‘আছে।’

‘যদি থাকার লোকটা বদলে যায় তোর আপত্তি হবে?’

‘সেই বদলি থাকার লোকটা কে, না জেনে কথা দিতে পারব না।’

‘ধর আমি।’

‘হঠাৎ তোর থাকার ঘরের দরকার হল কেন?’

‘আমি বিয়ে করলে নবু থাকবে কোথায়? আমাদের ফ্ল্যাটটা তো দেখেছিস।’

শুনেই অমিয় দমে গেল। রবিন্দুকে বর্গাপুরে আনা তা হলে একেবারেই ব্যর্থ হয়ে গেল। সে শুকনো গলা বলল, ‘বিয়ে কী ঠিক হয়ে গেছে?’

‘আমি হ্যাঁ বললেই হয়ে যাবে।’

‘কবে হ্যাঁ বলবি?’ অমিয় নিস্পৃহ ভঙ্গিতে বলল।

‘আজই।’

অমিয় হতভম্ভ হয়ে বোকার মতো তাকিয়ে রইল রবিন্দুর মুখের দিকে। ‘আজই! আজ কলকাতা যাবার ট্রেন ধরতে হল তোকে এখনই বেরতে হবে।’ অমিয়র মুখ ব্যাজার হয়ে উঠল।

‘কলকাতায় যাবার দরকার নেই, বর্গাপুরেই বলা যায়।’ রবিন্দু হাই তোলার চেষ্টা করল নির্লিপ্তি দেখাতে।

‘বর্গাপুরে কোন বাড়িতে?’ অমিয় ঝুঁকে পড়ল ভ্রূ কুঁচকে ‘এখানকার সব বাড়িই আমি চিনি। কিন্তু তোর বিয়ে করার মতো মেয়ে তো—’অমিয় কথা শেষ করল না।

‘এই বাড়িটা অমিয় বর্গাপুরের মধ্যেই পড়ে। কাকে হ্যাঁ বলতে হবে, তোকে না দিদিকে? বড়ো করে তো মেয়ে দেখাতে এনেছিস, আমি কিছু জানি না ভেবেছিস? ওরে ব্যাটা একসের চালে চোদ্দোগুণ খই হয়, ঠাকুরের কথা! চাল আমি পেয়ে গেছি। খই মুড়কি চিবোবার মতো আহাম্মক আমি নই। এবার বল তোর গড়িয়ার ঘরটা কী পেতে পারি?’

অমিয়র এবারের হতভম্ব ভাবটা নিমেষে উধাও হল। দু—হাতে রবিন্দুর দুটো কাঁধ ধরে প্রচণ্ডভাবে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘একটা কিরে দুটো তিনটে ঘর পেতে পারিস। হ্যাঁ—টা আমাকে নয় দিদিকে বলবি, চল।’

দু—হাতে চায়ের দুটো কাপ নিয়ে মোনা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিল। অমিয় লাফাতে লাফাতে চিৎকার করে তার পাশ দিয়ে নেমে গেল।

‘দিদি দিদি, ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট পেয়ে ফাইনালে পাশ করেছে…পাঁজি, পাঁজি বার করো।’

একটা কাপ রবিন্দুর হাতে দিয়ে মোনা অবাক স্বরে বলল, ‘বড়োমামা হঠাৎ পাঁজি পাঁজি বলে বাড়ি মাথায় করে তুলল কেন! মাথা তো একটু আগেও ঠিক ছিল, বলল চা খাবো!’

চায়ে চুমুক দিয়ে রবিন্দু বলল, ‘মাথা ওর ঠিকই আছে বরং আমারটাই গোলমেলে হয়ে গেছে। হবে না? যে ভাবে চুলের মুঠি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরেছ এখনও ব্যথা করছে।’

অপ্রতিভ স্বরে মোনা বলল, ‘তা না হলে আপনাকে তো তুলতে পারতুম না।’

‘তুলেই তো আমার মাথাটা খারাপ করে দিলে। ওটা এবার থেকে তোমাকে ঠিকঠাক করে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে—আত্মজীবনের জন্য, রাজি?’

রবিন্দুর কথাগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে মোনার দশ সেকেন্ড সময় লাগল এবং তারপরই হাত থেকে চায়ের কাপটা মেঝেয় পড়ে ভেঙে ছড়িয়ে গেল।

বুড়ো লোকটি

‘হারামজাদা। নিজের জন্য পান কিনতে তো ভুল হয় না, আমি কিছু আনতে বললেই মনে থাকে না!’ কাশীনাথের শীর্ণ অষ্টআশি বছরের কাঠামোটা চিৎকারের দমকে দুমড়ে ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হল।

পুলিন দ্রুত এগিয়ে এসে বাবার দুটো কাঁধ ধরে খাটে বসাল। ‘এনে দিচ্ছি বাবা জিলিপি এনে দিচ্ছি, তুমি চুপ করে বোসো তো।’ অপ্রতিভ তিক্ত স্বরে কাশীনাথকে শান্ত করিয়ে পুলিন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দালানে টেবলে ভাত খেতে ব্যস্ত বলাকাকে বলল, ‘বউমা ড্রুকের জেলি পেলুম না, কিষানেরটা এনেছি।’ কথাটা বলে সে বলাকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অনুমোদনের আশায়। বলাকা মাছের ঝোল মাখা ভাত চিবোতে চিবোতে একটা কাঁটা দাঁতে ধরে ফেলেছে। সেটা মুখ থেকে টেনে বার করতে করতে বলল, ‘বাবা ছোটো মাছ আনবেন না, কাঁটা বেছে খেতে দেরি হয়ে যায়। আজ তো এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে, তার ওপর বাজারও এল দেরি করে।’

পুত্রবধূর বিরক্ত মুখে বলা—কথা এবং বাবার ‘হারামজাদা’, দুটো ধাক্কা পরপর পেয়ে পুলিন পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল ফ্ল্যাট থেকে। রান্নাঘরে তখন পাউরুটিতে জেলি মাখাতে মাখাতে ভারতী একটু গলা তুলে বলল, ‘বউমা পাউরুটি সেঁকে খেলে অম্বল হবে না, দোব সেঁকে?’

‘না না না, ঘণ্টা দুয়েক পরে ওগুলো চিমড়ে সুখতলা হয়ে যাবে, মুখে দিতে পারব না।’

‘পেঁপে দিলুম, পেট ঠান্ডা রাখবে। ডিমের খোসা ছাড়ালুম না।’

‘কুচুনের সন্দেশ এসেছে?’

‘দুটো এনেছে, তোমায় একটা দোব।’

‘না, ওকে বিকেলে একটা দেবেন, বাকিটা ফ্রিজে তুলে রাখুন। কাল ওকে টিফিনের সঙ্গে দেবেন।’

হাতঘড়ি দেখে বলাকা প্রায় লাফিয়ে উঠল। পাতে ভাত আর আধখাওয়া মাছ ফেলে রেখে বেসিনে গিয়ে হাত ধুতে ধুতে বলল, ‘মা আর দু—মিনিট নয়তো ন—টার শান্তিপুরটা পাব না। এটা মিস করলে সেই ন—টা কুড়ির কৃষ্ণনগর। তাহলে ব্যাঙ্কে পৌঁছতে পৌঁছতে, ট্রেন লেট করলে সাড়ে দশটা, আর ম্যানেজারের বিরক্ত মুখ দেখতে হবে।’

স্টিলের টিফিন বক্স বলাকার ব্যাগে ভরে দিয়ে ভারতী অপেক্ষা করল। দালানের অন্য প্রান্তে টাঙিয়ে দেওয়ালে রাখা রামকৃষ্ণ—সারদা—বিবেকানন্দ এবং তাদের পিছনে দাঁড়ানো কালীমাতার একটি বাঁধানো ছবি। বলাকা ছবিটির সামনে আধমিনিট চোখ বন্ধ করে জোড় হাতে দাঁড়াবে। তারপরই শাশুড়ির হাত থেকে এক হাত লম্বা ব্যাগটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়েই কাঁধে টাঙাতে টাঙাতে জুতো পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যাবে।

ভারতী তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে নামা তার বউমার পায়ের শব্দ দোতলা পর্যন্ত শোনে দরজা বন্ধ করতে এসে।

দালানের লাগোয়া দুটি শোবার ঘর, একটি কাশীনাথের অন্যটি অনীশের, পুলিন ও ভারতীর নিজস্ব কোনো ঘর নেই। দুটি ঘরের মধ্য দিয়ে যাওয়া যায় রাস্তার দিকে তিন হাত চওড়া আট হাত লম্বা বারান্দায়। ভারতী ছেলের ঘরের মধ্য দিয়ে বারান্দায় এল কাশীনাথের ঘর এড়িয়ে। ছেলেমানুষের মতো খাই—খাই বাতিক হয়েছে শ্বশুরের। যেহেতু রান্নাবান্নার দায়িত্বে সে তাই তার উপরই বুড়োর চোটপাট।

গতকালই কাশীনাথ তাকে বলে, ‘পুলিনটা অ্যাতো তেল দেয় কেন অনীশ আর বলাকাকে, ওরা হাজার হাজার টাকা রোজগার করে বলে? এ সংসারে খাবার লোক কি শুধু ওই দুজনই, আমি কি কেউ নই? আমার পেনশনের টাকা কি শুধু আমি একাই খাই, সংসারে দিই না? পুলিন তো শুধু বাজার খরচটা দেয়, তাও কেপ্পনের মতো বাজার করে, বলেছিলুম বড়ি দিয়ে তেঁতুলের অম্বল করতে, করেছিলে? বললে দোকানে বড়ি পাওয়া যায়নি। কলকাতা শহরে কি একটাই বড়ির দোকান? বাপের জন্য কি একটু দরদও নেই ছেলের? কত কষ্ট করে পয়সা খরচ করে বড়ো করলুম ছেলেকে, বুড়ো বয়সে সেই ছেলে আমাকে দেখবে শুনবে এটা তো আশা করবে যেকোনো বাপই, ঠিক কিনা?’

ভারতী মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিল। অভিজ্ঞতা থেকে জানে জবাব দিলেই শ্বশুর চিৎকারে ফেটে পড়ে নোংরা কথা বলা শুরু করবে। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও বিপদ, চিৎকারটা তাড়া করবে।

আজকের দাবি বড়ির অম্বল নয় জিলিপি। কাশীনাথ পুরুলেন্সের চশমার ছয় ইঞ্চি সামনে কাগজটা ধরে খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়ে। প্রতিদিনের বাজারদর থেকে সে ক—দিন আগে জেনেছিল ইলিশমাছ শ্যামবাজার, মানিকতলা বাজারে দেড়শো টাকা কিলোয় বিকিয়েছে। সেই রাতেই সকলকে শুনিয়ে গজগজ করল, ‘বাজারে ইলিশ উঠেছে অথচ একদিনও খেতে পেলুম না। কবে একশো টাকায় নামবে তার জন্য বসে থাকো আর তেলাপিয়া খেয়ে যাও।’

পুলিনের মনে পড়ল তখন তার বয়স বছর সাত, বাবা বাজার করে ফিরে থলিটা নামিয়ে বলল, ‘ইলিশ খাব কী, সাড়ে চার টাকা সের, ভাবতে পার?’

পুলিন বলে, ‘খবরের কাগজের দরে আর বাজারের দরে অনেক তফাত। কাল তোমাকে ইলিশ খাওয়াব, দেখি কত খেতে পার।’

ভারতী শুনেই আঁতকে উঠে বলেছিল, ‘কত খেতে পার মানে? এই বয়সে গুচ্ছের ইলিশ খেয়ে হজম করতে পারবেন? তারপর যে কাণ্ড হবে সে তো তোমাকেই পরিষ্কার করতে হবে।’

শুনেই কাশীনাথের চিৎকার, ‘হ্যাঁ পরিষ্কার করতে হবে। যত দিন আমি বাঁচব তত দিন পরিষ্কার করতে হবে, না পারলে এ সংসার থেকে দূর হয়ে যাও।’ এরপর বহুবার বলা কথাটা কাশীনাথ বলে, ‘এ ফ্ল্যাট আমার নামে ভাড়া নেওয়া বেয়াল্লিশ সাল থেকে। এখনও আমিই ভাড়া গুনি। ইলেকট্রিক বিল, ঝিয়ের মাইনে, গ্যাসের দাম দিচ্ছি পেনশনের টাকা থেকে। এটা মনে রাখিস।’

পুলিন মুখ বুজে মাথা নীচু করে শুধু শুনে যায়। কোথাও সরে গিয়ে যে মুখ লুকোবে তেমন একটা জায়গা এই ফ্ল্যাটে নেই।

কাশীনাথ এই ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়, যখন জাপানি সেনা হু হু করে এগিয়ে আসছে ভারতের দিকে। রেঙ্গুন দখল করে ফেলেছে। হেঁটে জঙ্গল, পাহাড়, নদী পার হয়ে বহু বাঙালি পরিবার তখন কলকাতায় পৌঁছতে শুরু করেছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখছে কলকাতার মানুষ। এ আর পি, সিভিক গার্ড, ব্ল্যাক আউট দেখতে দেখতে আর ধ্বংসের গুজব শুনতে শুনতে মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াল এবার নির্ঘাৎ কলকাতাকে জমিতে মিশিয়ে দেবে জাপানি বোমা। দলে দলে পরিবার প্রাণভয়ে গ্রামের দিকে পালাতে শুরু করল কলকাতার নিজস্ব বা বাসাবাড়ি ছেড়ে। খালি বাড়ি বা ঘর বা ফ্ল্যাট তখন যথেচ্ছ পাওয়া যাচ্ছে। জলের দরে বাড়ি বিক্রি হচ্ছে, নামমাত্র ভাড়ায় ঘর পাওয়া যাচ্ছে। তখন কাশীনাথ বি অ্যান্ড এ রেলওয়েতে মালগাড়ির গার্ডের চাকরিতে। খবর পেল চারতলা ‘গুহ ভবন’ বাড়ির তিনতলায় দু—ঘরের একটা ফ্ল্যাট খালি রয়েছে। গুহ এস্টেটের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে সে ভাড়া নেয়। ওরা চেয়েছিল পঞ্চাশ টাকা মাসিক ভাড়া, কাশীনাথ বলেছিল চল্লিশ টাকা, এককথায় ম্যানেজার রাজি হয়ে যায়। পরে সে আফশোস করে, তিরিশ টাকা বললে হত!

এই ফ্ল্যাটেই কাশীনাথ বিয়ে করে, ছাদে হোগলার ম্যারাপ বেঁধে লোক খাওয়ায়, এই ফ্ল্যাটেই পুলিন জন্মায়, তার ঠাকুরদা, ঠাকুমা আর মা এখানেই মারা যায়, এখন ফ্ল্যাট ভাড়া আটান্ন বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুশো টাকা। তেমনি কাশীনাথের পেনশনও বেড়েছে। আর বেড়েছে তার অধৈর্যতা, তিক্ত কথাবার্তা, চিৎকার, খুঁত ধরা, কর্তৃত্ব ফলানো, অভিমান আর ছেলেমানুষি কাজকর্ম।

একবার হঠাৎ কাশীনাথের ইচ্ছে হল পেঁয়াজি খাবে। ছেলেকে ইচ্ছাটা জানিয়ে বলে, ‘এখুনি কাত্তিকের দোকান থেকে আটটা নিয়ায়।’

‘আটটা!’ পুলিন অবাক হয়ে বলেছিল, ‘এই বয়সে আটটা!’

‘হ্যাঁ আটটা। তোর বয়সে বারোটা খেতুম। যা যা দৌড়ে যা।’

‘সাড়ে এগোরোটা বাজে, এখন সকালের ভাজা ঠান্ডা বাসি হয়ে গেছে, বিকেলে এনে দোব।’

‘ঠিক দিবি তো।’

পুলিন বিকেলে এনে দিয়েছিল। ঠোঙার মুখ ফাঁক করে কাশীনাথ একটা একটা করে গুনে দেখে, দাঁড়িয়ে থাকা ছাপ্পান্ন বছর বয়সি ছেলের হাতে একটা পেঁয়াজি তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘যা।’ পঞ্চাশ বছর আগে সে এইভাবেই গুজিয়া তুলে দিত পুলিনের হাতে।

পুলিন ইতস্তত করতেই কাশীনাথ খেঁকিয়ে বলে ওঠে, ‘তেলেভাজা এখন বুঝি আর মুখে রোচে না বাবুর, তবে কি চপ কাটলেট ফিসফ্রাই চাই?’

পেঁয়াজিটা হাতে নিয়ে পুলিন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

আজ কাশীনাথের ইচ্ছে হয়েছে জিলিপি খাবার।

বাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে বগলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। জন্ম থেকেই দোকানটা দেখে আসছে পুলিন। বগলার পাশে বছর পাঁচেক হল আর একটা মিষ্টির দোকান হয়েছে, ‘মিঠাইরাজা।’ নামটা পুলিনকে প্রথমে একটু অবাক করে। যত মিষ্টির দোকান সে এ পর্যন্ত দেখেছে তাতে ‘ভাণ্ডার’ বা ‘অ্যান্ড সন্স’ নামের শেষে জোড়া থাকে। দোকানটাও সাজানো গোছানো ফিটফাট। কাচের কাউন্টার, আলমারি, বসে খাওয়ার জন্য ছোটো ছোটো চারটে টেবল। সফট ড্রিংকস, আইসক্রিম, দই রাখার জন্য দুটো বিরাট রেফ্রিজারেটার, বনবন ঘুরছে পাখা, গোটা ছয়েক টিউব লাইটের আলো কাচে ধাক্কা দিয়ে জেল্লা বাড়িয়েছে। কাজের লোকগুলো পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় পরা! স্টিলের ট্রে—তে রাখা বেশিরভাগ মিষ্টিই ছানার এবং রসছাড়া। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টিগুলো দেখতে দেখতে পুলিনের চোখ ঝকঝক করে উঠেছিল চন্দ্রপুলি দেখে।

ছোটোবেলায় বড়ো তিজেল হাঁড়ি মাথায় চন্দ্রপুলিওলাকে তিনতলার বারান্দা থেকে দেখলেই সে চিৎকার করে ডেকে দাঁড় করাত। মা—র কাছ থেকে দু—আনা পয়সা নিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে আসত। নারকোল আর চিনির পাকে তৈরি দুটো চন্দ্রপুলি শালপাতার উপরে রেখে সে উঠে আসত ধীরে ধীরে। মা—র সামনে শালপাতাটা ধরে বলত, ‘তুমি একটা নাও।’ মা প্রথমে না না করে শেষে আধখানা ভেঙে মুখে দিত।

পুলিন অবশেষে দোকানে বসা লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘চন্দ্রপুলির দাম কত?’

‘চার টাকা পিস।’

‘একটা চার টাকা!’ অবাক হয়ে পুলিন তাকিয়ে থেকেছিল তার ছোটোবেলার এক আনার চন্দ্রপুলির দিকে।

লোকটি লক্ষ করেছিল পুলিনের মুখের ভাব পরিবর্তন। পরামর্শ দেবার মতো গলায় বলল, ‘ক্ষীরের চন্দ্রপুলি, একটা খেয়ে দেখুন না।’

‘না থাক।’

পুলিন ফিরে এল বাড়ির কোলাপসিবল গেট পর্যন্ত। কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে ফিরে গেল মিঠাই রাজায়। একটা ক্ষীরের চন্দ্রপুলি কিনল। দোকানের লোকটি হেসে বলল, ‘আগেকার চন্দ্রপুলির সঙ্গে এটার কতখানি তফাত বুঝতে পারবেন একটু মুখে দিলেই। যারাই খেয়েছে আবার কিনতে এসেছে। কলকাতা শহরে তিন—চারটে মাত্র দোকানে এমন চন্দ্রপুলি পাবেন।’

সাইজটা ছোটোবেলার চন্দ্রপুলির থেকে লম্বায় প্রায় এক ইঞ্চি বেশি। বাড়ির গেটের কাছে এসে পুলিন একটা কোনা ভেঙে মুখে দিয়ে জিভ আর টাকরায় মাখিয়ে তারিয়ে তারিয়ে যখন খাচ্ছে তখনই বাড়ি থেকে বেরোচ্ছিল চারতলার প্রণববাবু, কলেজে ফিজিক্স পড়ান। তাকে দেখেই পাতলা কাগজে মোড়া চন্দ্রপুলিটা সে পকেটে ঢুকিয়ে নিল।

‘পুলিনবাবু কাল আপনাকে খুব মিস করেছি।’ প্রণববাবু তড়বড় করে বলে যান, ‘ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড আর জুভেন্টাসের খেলা ছিল। ভাবলুম আপনাকে ডেকে আনি। ফুটবল ম্যাচ একা একা দেখে সুখ নেই। তারপর মনে হল রাত সাড়ে এগারোটায় কোনো ভদ্দরলোককে ডেকে এনে খেলা দেখা, যথেষ্ট পাগলামি হয়ে যাবে।’

‘ইসস আমাকে ডাকলেন না?’ পুলিন ক্ষুব্ধ গলায় বলেছিল। যদিও প্রণববাবু কথিত ক্লাব দুটোর নাম সে এই প্রথম শুনল।

‘অত রাতে আপনি আসতেন? মিসেস আপত্তি করতেন না?’

‘আমার মিসেস তেমন নয়।’ তারপর গলা নামিয়ে চোখ টিপে বলল, ‘দু—জনেই ফিফটি পেরিয়ে গেছি, রাতে একজন না থাকলে অন্যজন হাত—পা ছড়িয়ে আরামে শোবার একটা তো সুযোগ পাবে।’

একটা দারুণ ভালো রসিকতা করা হল ভেবে পুলিন একাই হেসে উঠেছিল। কুঁড়ে, মাটো, লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারে না, এইসব বিশেষণই সে নিজের সম্পর্কে শুনে এসেছে কৈশোর থেকে এবং এখনও শুনতে হয় বিশেষ করে বাবার কাছ থেকে। কিন্তু সে যে কুঁড়ে নয়, বুদ্ধিহীন নয় এবং বাইরের লোকের কাছে সপ্রতিভ এটা বোঝতে সুযোগের জন্য সে ওঁত পেতে থাকে। তার মনে হল প্রণববাবুকে অন্তত বোঝাতে পেরেছে সে মাটো নয়, যথেষ্ট রসিক।

ক্ষীরের চন্দ্রপুলি পকেটে নিয়ে পুলিন তিনতলায় উঠে এসে ভারতীকে চোখের ইশারায় রান্নাঘরে ডেকে এনে চন্দ্রপুলিটা দেখায়। আধখানা ভেঙে নিজে মুখে পুরে বাকিটা ভারতীকে দিয়ে বলে, ‘খাও।’

‘বাহ, খুব সুন্দর খেতে তো, পেলে কোথা?’ চিবোনোর বদলে ভারতী চকোলেট চোষার মতো করে চুষতে লাগল।

‘বগলার পাশেই মিঠাই রাজা বলে একটা মিষ্টির দোকান হয়েছে বছর পাঁচেক। খুব সাজিয়ে ছিমছাম করে চালাচ্ছে, যেমন বিক্রি তেমনি মিষ্টিরও দাম, ওখানেই দেখলুম চন্দ্রপুলি,লোভ সামলাতে পারলুম না। অনেকদিন খাইনি। দাম বলল এক—একটা চার টাকা। ভাবো একবার, ছোটোবেলায় খেতুম এক আনায় একটা!’ পুলিন চোখ বড়ো করে তাকাল ভারতীর দিকে।

ভারতী বলল, ‘দিনকাল কীভাবে বদলে গেছে দেখেছ! তবে সেই চন্দ্রপুলির থেকে এটা কিন্তু খেতে অনেক ভালো, বেশি দাম দিয়েও খাওয়া যায়।’

‘সেইজন্যই দোকানটার এত বিক্রি, অবশ্য বগলারও বিক্রি আছে।’

এবার ভারতী গলা নামিয়ে বলল, ‘এই চন্দ্রপুলির গপ্পো যেন বাবার কাছে কোরো না, তাহলেই হুকুম হবে এখুনি চারটে নিয়ে আয়, তার মানে ষোলো টাকা।’

‘পাগল হয়েছ। বাবা জানেই না মিঠাইরাজা বলে একটা দোকান এখানে হয়েছে। জানিয়ে আর কাজ নেই।’

কাশীনাথ পাঁচ বছর আগেও হেঁটে পার্কে গিয়েছে, একদিন সাইকেলের ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। দুটি ছেলে তাকে তিনতলায় তুলে দিয়ে বলে যায়, ‘দাদু একা আর রাস্তায় বেরোবেন না, গাড়ি চাপা যাবেন।’ এরপর কাশীনাথ শুধু মাসে একবার পেনশন তুলতে পুলিনকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাঙ্কে যায়, গলি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে পঞ্চাশ গজ গেলেই ব্যাঙ্ক, মিঠাইরাজা দোকানটা ডানদিকে, তাই নতুন কোনো দোকান হল বা পুরোনো কোনো দোকান উঠে গেল তা জানে না।

বাবার আবদারের জিলিপি কিনতে পুলিন যখন বগলা মিষ্টান্নের সামনে তখন তার পিছন দিয়ে বলাকা হনহন করে হেঁটে গেল মেট্রো রেলের স্টেশনের দিকে, শ্বশুরকে দেখেও দেখল না। পুলিন কিন্তু দেখতে লাগল পিছন থেকে। বলাকা আগের থেকে একটু ভারী হয়ে গেলেও লম্বা বলে বেঢপ লগে না। বলাকার মা বিয়ের আগে মেয়ের যা বয়স বলেছিল সেই হিসাবমতো সে অনীশের থেকে এক বছরের ছোটো। ওর পাশে অনীশকে কম বয়সিই মনে হয়। পুলিন ভালো করে লক্ষ করল পুত্রবধূকে পিছন থেকে। মুখ বাদে শরীরের বাঁধুনি তাকিয়ে দেখার মতো এবং রাস্তার লোকেরা দেখছেও। মুখটা বাদে কারণ বলাকার চোয়াল কানের কাছ থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ ঝুলে চিবুকটা গলার কণ্ঠার সামনে থেমেছে। ফলে গাল দুটি অস্বাভাবিক লম্বা, সেই অনুপাতে কান দুটিও। ঠোঁট দুটি ছোট্টে এবং রং মরচে ধরা লোহার মতো, চোখ দুটি বড়ো এবং গোলাকার। ওকে কদাচিৎ হাসে দেখেছে পুলিন। এক ধরনের শুকনো কাঠিন্য ছড়িয়ে থাকে মুখে, যেজন্য সে ছেলের বউকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে।

.

বিয়ের আগে প্রথম যেদিন অনীশ বাবা—মায়ের সঙ্গে পরিচয় করাতে আনে, বলাকার আগে ছিল সন্দেশের বাক্স। অনীশ বলেছিল তার বান্ধবী ব্যাঙ্কে কাজ করে, এম এ পাশ, বাক্সটা ভারতীর হাতে দিয়ে বলাকা প্রণাম করে, পুলিনকেও। তাকে শ্বশুরের ঘরে না বসিয়ে ভারতী নিয়ে যায় নিজেদের ঘরে, যেটা এখন বলাকা আর অনীশের শোয়ার ঘর। পুলিন লক্ষ করেছিল মেয়েটি খুঁটিয়ে ঘরের আসবাবপত্র, জানালা, দেওয়াল, খাট, বিছানা, পাখা দেখছে কথাবার্তার ফাঁকে। পুলিন অস্বস্তিবোধ করে ওর সঙ্গে চোখ বোলাচ্ছিল জিনিসপত্রের উপর। বিছানার চাদরের সবুজ নকশা আর জানালার সবুজ পাল্লা রংচটা একই চেহারা নিয়েছে। পেতলের ফুলদানিটা মাটির মতো মনে হচ্ছে। পাপোষের রোম উঠে নারকেলদড়ি বেরিয়ে এসেছে, ইলেকট্রিক জয়েন্ট বক্সের কাঠের ঢাকনা নেই, তালগোল পাকানো তারে ঝুল জমে। একে একে সে ঘরের মধ্যে অনেক খুঁত আর অন্যমনস্ক অবহেলা খুঁজে পেয়ে সংকোচ বোধ করেছিল।

বগলা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের শোকেসের উপর কাঠের বারকোসে রাখা আঢাকা জিলিপিগুলো দেখে সে বিরক্ত স্বরে দোকানের লোকটিকে বলল, ‘ঢেকে রাখতে পার না? রাস্তার ধুলো পড়ছে।’

সেদিন বলাকাকে মেট্রোরেলে তুলে দিয়ে আসার জন্য অনীশ বেরিয়ে যেতেই সে ঠিক এইরকম গলায় ভারতীকে বলেছিল, ‘ফুলদানিটা মেজেঘষে চকচকে করে রাখতে পার না?’

দোকানি তার কথা গায়ে না মেখে বলল, ‘জিলিপি ভেজে আসে আর উড়ে যায়, ধুলো পড়ার টাইমই পায় না, ক—টা দোব?’

‘দশটা।’

সেদিন ভারতী রাত্রে ফুলদানিটা মেজে চকচকে করে বলেছিল, ‘কালই বাজার থেকে ফুলো এনো, রজনীগন্ধা।’

শালপাতায় মুড়ে ছ—টা রজনীগন্ধার ছড় পরদিনই বাজার থেকে পুলিন আনে। কাশীনাথ তখন সবে কলঘর থেকে বেরিয়েছে। চোখে পড়ল রজনীগন্ধার গোছাটা খাওয়ার টেবলে।

‘এটা কীরে?’ পুরু কাচের আড়াল থেকে তার চোখদুটো খোসা ছাড়ানো লিচুর মতো দেখাল।

পুলিন বলল, ‘ফুল, রজনীগন্ধা।’

‘ফুল কী হবে, আমাদের ঘরে তো ঠাকুর দেবতা নেই। আছে তো শুধু রামকৃষ্ণর ছবিটা তাও উঁচুতে টাঙানো, মালা হলে তবু দেওয়া যেত।’

‘পুজোর জন্য না হলে কি ফুল কিনতে নেই?’

‘কেন নেই! মড়ার খাটে বাঁধার জন্য ফুল লাগে। তুই ওগুলো বরং আমার খাটের চারকোণে বেঁধে দে, খাটে শুয়ে মনে হবে তোর কাঁধে চড়ে নিমতলায় যাচ্ছি।’

ভারতী আঁতকে উঠে বলে, ‘এ কি অলুক্ষুণে কথা বলছেন বাবা!’

কাশীনাথ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ‘অলুক্ষুণে কেন? আমি কি কোনোদিন মরব না? পুলিন কি খাটে কাঁধ দিয়ে নিয়ে যাবে না?’

পুলিন ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘ফুল কিনে আনাই দেখছি ভুল হয়েছে। এইসব কথা শুনতে হবে জানলে আনতুম না।’

কাশীনাথ বলল, ‘ভুল কেন হবে, ফুল তো ভালো জিনিস, দেখলে মন ভালো হয়, গন্ধে ফুরফুর করে মেজাজ, ফুলগুলো বিছানায় ছড়িয়ে দিয়ে শুবি। ভালো ফুলশয্যে হবে।’

রাগে টকটকে হয়ে উঠল পুলিনের ফরসা মুখ। রজনীগন্ধার ছড়াগুলো মুঠোয় ধরে মুচড়ে দালানের কোনায় ছুড়ে ফেলে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘মরো মরো, আমি নাচতে নাচতে খই ছড়িয়ে ঘাটে নিয়ে যাব। কাকে কী বলতে হয় সেই জ্ঞানটুকু হারিয়েছ?’

কাশীনাথ গায়ে মাখল না কথাগুলো, বলল, ‘আমি মরলে তোর কি কিছু সুবিধে হবে? তাহলে বল আজই আমি গঙ্গায় গিয়ে ডুবে মরব।’

‘তাই মরো, হাড়ে বাতাস লাগবে।’ বলেই পুলিন নিজের ঘরে ঢুকে যায়।

কাশীনাথ দলাপাকানো ফুল আর কুঁড়িগুলো মেঝে থেকে তুলে নিয়ে নিজের ঘরে এসে খাটে ছড়িয়ে দিয়ে ভারতীকে ডাকল।

‘বউমা আমি কি খুব খারাপ কথা বলেছি? এই বিছানায় শুলে তো ফুলশয্যাই হবে নাকি?’

‘তা হবে; তবে ফুল ছড়ানো বিছানায় শোয়ার একটা বয়স আছে, আপনি আশি পার হয়ে গেছেন, এটা মনে রাখেন না কেন?’ নরম গলায় বলে ভারতী। শ্বশুরকে দেখে সে অন্তর থেকেই কষ্ট পায়, মায়া বোধ করে। পঞ্চাশ বছর আগে ক্যানসারে বউ মারা যায়। ভারতী তার শাশুড়িকে দেখেনি। আটত্রিশ বছর ধরে নিঃসঙ্গ, বিপত্নীক, নির্বান্ধব মানুষটিকে সে বোঝার চেষ্টা করে চলেছে, তবে বুঝে ফেলেছে এমন দাবি করার মতো অবস্থায় এখনও সে আসেনি।

‘আশি বছর হলে কি ফুলের গন্ধ নেওয়া বারণ, ফুলের পাপড়ি গায়ে লাগানো অন্যায়?’ কাশীনাথের চোখ দুটো অসহায়ের মতো দেখাল পুরু কাচের ওধারে।

‘কে বলল বারণ! এখন তো আপনি বেশি করে আরাম করবেন, শখ মেটাবেন! জীবনের বেশিরভাগটাই খাটাখাটুনিতে কাটিয়েছেন, এবার হাত—পা ছড়িয়ে বাকি দিনগুলো কাটাবেন।’

কাশীনাথ অবাক চোখে পুত্রবধূর দিকে তাকিয়ে ছিল, ‘তুমি বলছ আরাম করব, শখ মেটাব, বলছ?’

‘হ্যাঁ বলছি। বলুন কী শখ আছে আপনার?’

‘একবার ধুতি পাঞ্জাবি পরে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যাব, তুমি থাকবে আমার সঙ্গে। পুলিনের বিয়ের সময় করানো তসরের পাঞ্জাবি আর কাঁচি পাড় ধুতি তোমার ঘরের দেরাজে আছে, এনে দেবে?’

ভারতী কাঠের আলমারির নীচের তাকে পুরোনো শাড়ি, ধুতি, প্যান্ট, বাতিল বেডকভার আর বালিশের ওয়াড়ের তলা থেকে বার করল কাশীনাথের তসরের পাঞ্জাবি। রং জ্বলে গেছে, খয়েরি ছোপ পড়েছে, ভাঁজ থেকে কাপড় কেটে গেছে। কাঁচি ধুতিটারও একই অবস্থা। শ্বশুরকে সে দেখিয়ে বলল, ‘বাবা এ দুটো তো ফেলে দিতে হবে। বাসনউলিও এগুলো নেবে না।’

‘তোমরা একটু নজরও রাখনি? বার করে যদি মাঝে মাঝে রোদে দিতে তাহলে এখনও পরার মতো থাকত। শুধু নিজেদের জামাকাপড়ের যত্ন নিলেই কি হয়ে গেল!’ তিক্ত তীক্ষ্ন স্বর ফিরে এল কাশীনাথের গলায়। ভারতী অপরাধীর মতো মুখ নামিয়ে রইল। তার হাত থেকে পাঞ্জাবি আর ধুতিটা নিয়ে কাশীনাথ মেঝেয় ফেলে দু—পা দিয়ে মাড়িয়ে রাগ চাপতে চাপতে বলল, ‘যাও ফেলে দিয়ে এসো, আমার শখ মিটে গেছে।’

এর মাস ছয়েক পর অনীশ যখন মাকে জানাল বলাকার বাবা—মা বিয়ের কথা পাকা করতে আসবে, ভারতী ছেলেকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলে, ‘আমাদের তো কোনো দাবিদাওয়া নেই, শুধু একটা জিনিস চাইব, তোর দাদুর জন্য তসরের একটা পাঞ্জাবি আর কাঁচিপাড় একটা ধুতি।’

অনীশ শুনেই বলেছিল, ‘ওরা নিজের থেকেই মেয়েকে অনেক কিছু দেবে। সোফা, খাট, স্টিলের আলমারি, ফ্রিজ, ড্রেসিংটেবল, টি—ভিও। কিন্তু এসব রাখার জায়গা কোথায়? বলাকাকে বলেছি কিছু দেবার দরকার নেই। আমাদের যা আছে তাই দিয়েই তোমাকে থাকতে হবে। মা, এটা প্রেস্টিজের ব্যাপার। আমি যে রাতে দাদুর খাটের পাশে ফোল্ডিং খাটে শুই, এটা বলাকা জানে না। বলেছি দাদু মেঝেয় শোয় আমি খাটে শুই। ধুতি, পাঞ্জাবি চাইলে মান থাকবে না। ও দুটো আমিই দাদুকে কিনে দেব।’

কথা রেখেছিল অনীশ। দর্জি আনিয়ে কাশীনাথের মাপ নিয়ে তসরের পাঞ্জাবি বানিয়ে দেয়, কিনে আনে বাক্সেভরা ময়ূরপুচ্ছ ধুতি যার পাড় ছয় ইঞ্চি চওড়া। খুব খুশি হয়েছিল কাশীনাথ। কিন্তু সেগুলো পরে তার আর বড়ো রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যাওয়া হয়নি। তার আগেই সাইকেলের ধাক্কার জের সামলাতে গৃহবন্দি হয়ে পড়ে।

.

দশটা জিলিপি কাগজের ঠোঙায় নিয়ে পুলিন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় নামছিল দোতলার উমা। সালোয়ার কামিজ পরা, বয়স পঁচিশ, দীর্ঘদেহী বলিষ্ঠ গড়ন, মুখে আলগা একটা লাবণ্য আছে, সাধারণ সায়ান্স গ্র্যাজুয়েট। ওকে শিশু বয়স থেকে দেখে আসছে পুলিন।

‘চললে কোথায়?’

‘কাজে।’

‘আজ ক—টা?’

‘তিনটে।’

‘কোথায় কোথায়?’

‘একটা শোভাবাজারে, একটা সল্টলেকে আর একটা ফুলবাগানে, দুটো অবাঙালি।’ ব্যস্তভাবে উমা নেমে গেল।

উমার কাজ মেয়েদের ফিজিয়োথেরাপি আর মালিশ করা। দিনে তিন—চারটি মহিলাকে মালিশ ও ফিজিয়োথেরাপি করে। বাড়ি গিয়ে একঘণ্টার মালিশে ষাট টাকা, ফিজিয়োথেরাপিতে একশো টাকা। দুটোই সে শিখেছে টাকা খরচ করে। তা ছাড়া সে যুক্ত একটি হেলথ ক্লাবের সঙ্গে। সেখান থেকেও মন্দ আয় হয় না। নানারকমের বাতের আর হাড়ের অসুখ যত বাড়ছে ততই উমার রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এখন সে মাসে কমকরে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করে। বছর চারেক আগে উমা যখন কলেজছাত্রী, ভারতী তখন এক রাত্রে পাশাপাশি শুয়ে পুলিনকে বলেছিল, ‘উমাকে আমার খুব ভালো লাগে, তোমার কেমন লাগে?’

‘আমারও লাগে। স্বভাবটা খুব নরম, ব্যবহার মিষ্টি, সাজগোজের বাহার নেই। দেখা হলেই জিজ্ঞাসা করে ‘কাকাবাবু কেমন আছেন?’ ভালো আছি বললে কাকিমার কথাও জিজ্ঞেস করে।’

ভারতী বলে, ‘ওদের পরিবারটা অবস্থাপন্ন নয়, কিন্তু অল্পের মধ্যেই কী সুন্দর গুছিয়ে চলে, একটুও বাজে খরচ নেই। ছেলেমেয়েরা যেমন চালচলনে ভদ্র তেমনি খুব পরিশ্রমীও। এই গুণগুলো ওরা পেয়েছে মায়ের কাছ থেকে।’

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ভারতী প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল, ‘উমাকে বউ করে আনতে খুব ইচ্ছে করে, একটা লক্ষ্মীশ্রী আছে ওর মুখে। ওরাও তো বামুন, তুমি কী বলো?’

‘আমি বললেই তো হবে না, অনি কী বলে সেটাই আসল কথা। ছেলে লেখাপড়া শিখেছে। নিজস্ব বোধবুদ্ধি তৈরি হয়েছে, বড়ো সার্কেলে ঘোরাঘুরি করে, অতবড়ো কোম্পানিতে ভালো পোস্টে ঢুকেছে, ভবিষ্যতে আরও ওপরে উঠবে। ওর রুচির সঙ্গে আমাদের রুচি মিলবে এমন তো কোনো কথা নেই। তবে উমা আমাদের সংসারে এলে খুব খুশি হব।’

আমি ভাবছি একবার অনির কাছে কথাটা পাড়ব। আমার কেমন যেন মনে হয় একটা সম্পর্ক ওদের মধ্যে গড়ে উঠেছে। তোমার মনে আছে উচ্চচমাধ্যমিক পরীক্ষার আগে উমা সন্ধেবেলায় অনির কাছে বিজ্ঞান আর অঙ্ক পড়তে আসত, এই ঘরে বসে অনি পড়াত?’

‘মনে আছে।’

‘আমি রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকতুম, তুমি বাবার ঘরে বসে টিভি দেখতে। একদিন কী একটা দরকারে ঘরে গিয়ে দেখি ওরা দু—জন নেই, বইখানা পড়ে রয়েছে।’

‘ওরা কোথায় ছিল?’

‘বারান্দায়, অন্ধকার বারান্দায়, আমার সাড়া পেয়ে তাড়াতাড়ি চোরের মতো দু—জনে ঘরে ঢুকে এল। তখনই আমার মনে হয়েছিল কিছু একটা চলছে, তোমাকে তখন বলিনি।’

‘অনির বয়স কম, উমারও। উঠতি বয়সে ওরকম একটু—আধটু হয়ে থাকে। ও নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। একটু বয়স বাড়লেই সব ঠিক হয়ে যায়। তোমার হয়নি?’

‘নাহ।’

‘লজ্জা পাচ্ছ কেন, বলেই ফেলো না।’

‘বললুম তো, কিছু হয়নি।’

‘আমারও হয়নি।’

‘জানি।’

‘জানি মানে? কী করে জানলে প্রেম করিনি? তুমি তো আমাদের পাড়ায় থাকতে না, এখান থেকে আধমাইল দূরে ছিল তোমার বাপের বাড়ি, তা হলে জানলে কী করে?’

উলটোমুখে পাশ ফিরে শুতে শুতে ভারতী বলল, ‘জানার জন্য পাড়ায় থাকতে হবে কেন? এত বছর ঘর করে তা হলে কী বুঝলুম, ওকাজ তোমার দ্বারা সম্ভব নয়।’

এরপর পুলিন ‘তোমার দ্বারা সম্ভব নয়,’ কথাটার অর্থ উদ্ধার করতে ক্রমশ জীবনটাকে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে কৈশোর পর্যন্ত পৌঁছল এবং অবাক হয়ে গেল এমন একটি মেয়েকেও খুঁজে না পেয়ে যার কাছ থেকে সে সামান্যতম ইঙ্গিত পেয়েছে যাতে হৃদয় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে সে নিজের অতীত জরিপ করার ফলটা মনে মনে নিজেকে শুনিয়ে দিল—চেষ্টা করলে কি আর প্রেমে পড়তে পারতুম না। চেষ্টাই করিনি। আসলে আমি ভালো ছেলে ছিলুম।

.

ছেলেকে খাওয়ার টেবলে একা পেয়ে ভারতী জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘উমাকে তোর কেমন লাগে রে অনি?’

হঠাৎ এমন প্রশ্নে যে—কোনো বুদ্ধিমান যুবক মুহূর্তে হুঁশিয়ার হয়ে যায়, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়া তুখোড় যুবক, এ দেশে ব্যবসায়ে সদ্য প্রবেশ করা সুইডিশ রং প্রতিষ্ঠান স্টান্ডার্ড পেইন্টসের ট্রেনি মার্কেটিং একজিকিউটিভ অনীশ আলগা ভঙ্গিতে বলল, ‘উমাকে তো ভালোই লাগে। যথেষ্ট সরল যা ওর বয়স মেয়েদের মধ্যে চট করে দেখা যায় না। পড়াতে গিয়ে দেখেছি তো কী পরিশ্রম করে এক—একটা ব্যাপার বোঝার জন্য, সত্যিই এজন্য ওকে শ্রদ্ধা করতে হয়। হায়ার সেকেন্ডারিতে ফার্স্ট ডিভিশন পাবে এটা আশা করিনি।’

শ্রদ্ধা শব্দটি ভারতীকে একটু দমিয়ে দিল। এমন গম্ভীর মনোভাব যার প্রতি তাকে বিয়ে করার মতো হালকা—ভারতীর মনে হয় বিয়ে বা দাম্পত্য জীবনকে গুরুতরভাবে নেওয়ার কোনো মানে হয় না—প্রস্তাব ছেলের কাছে পাড়া যায় কি না সেটাও ভেবে দেখা দরকার। পুলিন বলেছিল ছেলের রুচির সঙ্গে ওর বড়ো চাকরির সঙ্গে আমাদের ইচ্ছে মিলবে এমন কোনো কথা নেই।

অনীশ নিজের থেকেই বলল, ‘হঠাৎ উমাকে কেমন লাগে একথা আচমকা জিজ্ঞাসা করলে কেন, ব্যাপারটা কী? বিয়েটিয়ের কথা ভাবছ নাকি?’

ভারতী অপ্রতিভ হয়, ধরা পড়ে। ঢোঁক গিলে বলে, ‘যদি ভেবেই থাকি তাতে দোষের কী? তুই কি ওর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হোসনি? অনি, আমার চোখ কিন্তু শকুনের মতো।’

চোখ বড়ো করে অনি বলে, ‘শকুনের চোখ থাকে ভাগাড়ের দিকে। তুমি আমাকে ভাগাড় ভাবলে।’ বলে হতাশায় মাথা নাড়ল সে।

‘কথা ঘোরাসনি, তোকে আমি কী ভাবি তা ভালো করেই জানিস। উমাকে আমার, আমাদের খুব পছন্দ। ওকে বউ করে আনলে সংসারটা সুখের হবে।’

হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল অনীশ। টেবল থেকে উঠে বেসিনে গিয়ে হাত ধুয়ে তোয়ালেতে হাত মুখ মুছে বলল, ‘সংসার সুখের হবে তুমি ভাবলে কিন্তু আমার কথাটা তুমি ভাবলে না। হ্যাঁ, উমার সঙ্গে সামান্য ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল তখন আমি কলেজে পড়ি। কিন্তু তারপর আমার বয়স বাড়ল অভিজ্ঞতা বাড়ল, সময়ও বদলে গেল, আমার জগৎ এই ছোট্ট সংসার ছাড়িয়ে বাইরে ছড়াতে লাগল, আমি আরও ওপরে তাকাতে শিখলাম, আমি ঠিক করে ফেললাম নিজেকে আরও বাড়াতে হবে, উন্নতি করতে হবে, প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এর মধ্যে অন্যায় তো কিছু নেই। আমার অ্যাম্বিশানের মধ্যে উমাকে জায়গা দেওয়া যায় না, মা।’

ভারতী একদৃষ্টে তাকিয়েছিল ছেলের দিকে। তাদের একমাত্র সন্তান। বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চোখ, সুন্দর নাক কপাল, চুলের একটা গুচ্ছ ফরসা কপালের উপর ছোরার মতো বেঁকে ঝুলে রয়েছে, গলার স্বর জলস্রোতের মতো মসৃণ, উচ্চচারণ স্পষ্ট। প্রায় ছয় ফুট দীর্ঘ, ছিপছিপে। ওর কথা বলা, হাসির শব্দ, তাকানো, হাঁটার ভঙ্গি এই পরিবারের বা এই বাড়ির এমনকী এই পাড়ারও কারোর সঙ্গে মেলে না। ভারতী গর্বিত তার ছেলের জন্য।

অনীশের কথাগুলো মুগ্ধের মতো শুনছিল ভারতী। শুনতে শুনতে তার মনে হয় সত্যিই অন্যায় হবে তাদের পছন্দ অনির উপর চাপিয়ে দিলে। বড়ো হয়েছে, লেখাপড়া শিখেছে। ওর মাপের মেয়ে উমা নয়, ওর সঙ্গে খুব খাপ খাবে না এটা সে বোঝে। তবুও উমাকে তার পছন্দের বড়ো কারণ মেয়েটি এই সংসারের মানসিকতার সঙ্গে মানানসই হবে। সহজভাবে দুধের সঙ্গে দুধ মেশার মতো মিশে যাবে, ছানাকাটা হয়ে যাবে না।

অনীশ স্পষ্টভাবে তার উচ্চচাকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়ে দেওয়ায় ভারতী ক্ষুণ্ণ হল না, অভিমানও জমল না তার মন বরং হাঁফ ছেড়েই বাঁচল। অনি বড়ো হতে চায় এবং হওয়ার পথে একধাপ এগিয়েছে। রোজ সকাল আটটায় একটা সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি এসে দাঁড়ায় গলি আর বড়ো রাস্তার মোড়ে। অফিসের গাড়ি, তাতে আরও দু—জন থাকে। কোট—টাই পরা অনি ছোটো চামড়ার ব্যাগ হাতে গাড়ির পিছনের সিটে বসে। ভারতী বারান্দা থেকে দেখে গলির বা এ—বাড়ি ও—বাড়ি থেকে কেউ অনিকে দেখছে কি না। চাকরি করতে অফিস গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে যায়, এটা তো বড়ো কাজ করারই লক্ষণ, ছেলের বড়ো হওয়ার পথে একটা ঢিলও পড়ে থাকলে ভারতী তা সরিয়ে ফেলে দেবে।

সেই রাতেই অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভারতী গলা নামিয়ে পুলিনকে জানাল, ‘অনিকে বলেছি।’

‘কী বলেছ?’ ভ্যাপসা গরম, হাওয়া নেই। ভিজে গামছায় গা মুছে গামছাটা শরীরে জড়িয়ে পুলিন টুলে বসেছিল।

‘উমার কথা।’

‘নিশ্চয় রাজি হয়নি।’

ভারতী অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি জানলে কী করে?’

পুলিন বাবার অন্ধকার ঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনি কি ঘুমিয়ে পড়েছে?’

‘তাড়াতাড়ি না ঘুমোলে সকাল আটটার মধ্যে তৈরি হওয়া যায় না। ওর জন্যই বাবা আগের মতো বেশি রাত পর্যন্ত টিভি দেখতে পারেন না।’

সাত বছর আগে কাশীনাথ দেড় হাজার টাকায় একটা সাদা—কালো ছোটো টিভি সেট কেনে। সারা গুহভবনে এখন ওই একটিই সাদা—কালো সেট টিকে রয়েছে। পুলিন একবার বলেছিল, ‘বাবা এবার একটা কালার টিভি কেনো।’ শুনেই কাশীনাথ জানতে চায়, ‘দাম কত?’

পুলিন বলেছিল, ‘হাজার বারো—চোদ্দো পড়বে।’ নির্বিকার স্বরে কাশীনাথ জানিয়ে দিয়েছিল ‘তা হলে তুই কিনে দ্যাখ।’

‘অনি কোনোদিনই টিভি দেখা পছন্দ করেনি, দেখলে নাকি বুদ্ধি মোটা হয়ে যায়। কী জানি! আমার তো বেশ ভালোই লাগে।’ কথাটা বলে পুলিন অন্ধকারে ভারতীর মুখ দেখার চেষ্টা করল।

‘কোনটা যে তোমার খারাপ লাগে এখনও তো সেটা জানলুম না।’

‘অনেক কিছুই তো তুমি জান না, এটাও নয় নাই জানলে। অনি যে রাজি হবে না সেটাও তুমি জানতে না। ছেলেটা যে বদলে যাচ্ছে সেটা তুমি একদমই লক্ষ করোনি। করলে উমার সঙ্গে কেন, আমাদের পছন্দের যেকোনো মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দেওয়ার চিন্তা তুমি করতে না। গোবর গণেশ মার্কা ছেলে নয়, ভীষণ পরিশ্রমী, এরা নিজের ভালোমন্দ সম্পর্কে টনটনে হয়। মেয়ে পছন্দটা ওকেই করতে দাও। চলো ঘরে যাই।’ পুলিন উঠে দাঁড়াল।

বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে প্রায় পাঁচ মিনিট কাটাবার পর ভারতী বলল, ‘ঘুমোলে?’

‘না।’

‘একটা কথা মনে এল।’ ভারতী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘বিয়ের পর অনির জন্য তো একটা ঘর দরকার হবে।’

‘হবেই তো।’

‘কোন ঘরে থাকবে?’

‘কেন, এই ঘরে!’ দ্রুত উত্তর দিয়েই পুলিনের খেয়াল হল ভারতীর গলার স্বরে কেমন যেন দ্বিধা আর অস্বস্তি ছিল। স্ত্রীর দিকে পাশ ফিরে সে বলল, ‘তোমার তাতে আপত্তি আছে?’

‘আপত্তি কেন হবে, তা হলে আমরা থাকব শোব কোথায়? ঘর তো মোটে দুটো। ও ঘরে রয়েছে বাবা। আমরা ও ঘরে গেলে বাবা যাবেন কোথায়?’

সমস্যাটা এবার বুঝতে পারল পুলিন। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর ভারতী এই সংসারে আসে। তখন এই ঘরটা তারা দু—জন পায়। সংসারে লোক মাত্র তিনজন। কাশীনাথ স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে দ্বিতীয় ঘরে, একটা ক্যাশবাক্স আর সিঙ্গল খাট, কাঠের আলমারি, টেবল, চেয়ার নিয়ে কাশীনাথ তিরিশ বছর ধরে রয়েছে সেই ঘরে। অনীশ পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বাবা—মায়ের সঙ্গে শুয়েছে। এক রাত্রে ভারতী টের পায় ছেলে জেগে রয়েছে। পরদিনই সে স্বামীকে বলে ‘তুমি মেঝেয় শোও, অনিকে নিয়ে আমি খাটে শোব। ও বড়ো হচ্ছে, অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে।’

ক্লাস এইটে পড়র সময় অনীশ বলল সে দাদুর ঘরে শোবে। কাশীনাথ খুশি হয়ে বলল, ‘দাদুভাই আমার সঙ্গেই খাটে শোবে।’ অনীশ শুধু একরাত সেই সিঙ্গল খাটে দাদুর সঙ্গে শোয়ার পরই বলেছিল ‘আমি কাল থেকে মেঝেয় শোব, দু—জনে ওই খাটে শোয়া যায় না।’

খাটের পাশে আড়াই হাত খালি জায়গা তারপরই কাঠের আলমারি আর টেবল। টেবলটা সরিয়ে ঘরের অন্য কোথাও রাখার জায়গা না—পাওয়ায় সেই আড়াই হাতেই অনি রাতে কয়েকদিন শোয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে শতরঞ্চি সমেত তোষক আর বালিশ গুটিয়ে খাটের নীচে ঠেলে দিত। তারপর সে কিনে আনে একটা ফোল্ডিং খাট। বিয়ের আগে পর্যন্ত তাতেই সে শুয়ে এসেছে।

‘তা হলে আমরা থাকব শোব কোথায়?’ সমস্যাটা পুলিন আর ভারতীকে মনে মনে সিঁটিয়ে রেখেছিল। সমাধান খুঁজতে অবাস্তব প্রস্তাব নিয়ে দু—জনে কথা বলত। ভারতী বলেছিল, ‘রাতে বারান্দায় শুলে কেমন হয়?’

পুলিন চোখ কপালে তুলে বলে, ‘ওই খোলা বারান্দায়? পাগল হয়েছ? বৃষ্টি এলে তখন কী করবে? শীতকালে ঠান্ডায় তো নিমোনিয়া ধরবে। তা ছাড়া বারান্দাটায় দু—জন শোয়ার মতো জায়গা কোথায়? কাঠের পুতুলের মতো সারারাত চিৎ হয়ে থাকতে হবে,আমার দ্বারা তা হবে না।’

ভারতী কোনো তর্কের মধ্যে আর যায়নি। দু—জনের মাথার মধ্যে অবিরাম শোবার জায়গা নিয়ে খোঁজাখুঁজি চলেছিল দু—মাস ধরে। তারা যে অনীশের বিয়ে হলে অথৈ জলে পড়বে তাই নিয়ে ছেলের মধ্যে কোনো উদবেগ দেখতে না পেয়ে পুলিন ক্ষুব্ধ হয়ে স্ত্রীকে বলে, ‘লক্ষ করেছ আমাদের রাতের থাকা নিয়ে ও একটি কথাও বলছে না। এটা যে কত বড়ো সমস্যা সেটা কি ও বুঝতে পারছে না?’

‘পারবে না কেন!’ ভারতী ক্ষোভের সঙ্গে অভিমান মিশিয়ে বলে, ‘বুদ্ধিমান লেখাপড়া জানা ছেলে বাবা—মায়ের অসুবিধের দিকটা একবারও ভাববে না তাই কি হয়?’

সেই মুহূর্তে পুলিনের মনে বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হয়েছিল, বাবার এত বছর ধরে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়?

‘আচ্ছা, বাবাকে অনির ফোল্ডিং খাটটায় শুতে বললে কেমন হয়।’ চিন্তাটা হঠাৎই এসে গেল পুলিনের মাথায়।

ভারতী আঁতকে উঠে বলে, ‘শুনলেই বাবা যা বলবেন তাতে বাড়ি ছেড়ে হয় চলে যেতে হবে নয়তো দু—জনকেই গলায় দড়ি দিতে হবে। তুমি বলে দেখতে পার।’

পুলিন তার যাবতীয় সাহস জড়ো করে বাবার ঘরে আসে, কাশীনাথ তখন প্রতিদিনের মতো দেওয়ালে বালিশ রেখে ঠেস দিয়ে দু—পা ছড়িয়ে টিভি দেখছিল। পুলিন খাটের একধারে বসে টিভির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। একটা বাংলা সিরিয়াল দেখানো হচ্ছে। এটা সে এক বছর আগেও চলতে দেখেছিল। বিজ্ঞাপন দেখানোর বিরতি সময়ে পুলিন বলল ‘কত পর্ব চলছে?’

‘পাঁচশো দশ।’ দ্রুত উত্তর দিল কাশীনাথ।

‘ভালো লাগছে দেখতে?’

‘প্রত্যেকটা পর্ব দেখেছি একটাও মিস করিনি। তুই দেখিস না কেন, বউমা এসেও তো দেখতে পারে।’

পুলিনের মনে হল বাবার মেজাজ আজ নরম রয়েছে, নয়তো এমন উদার আহ্বান সচরাচর ঘটে না। সিরিয়াল আবার শুরু হল বিজ্ঞাপন দেখানোর পর। ভারতী তার মধ্যে একবার এসে বলল, ‘বাবা চা খাবেন?’ কাশীনাথ মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।

সিরিয়াল শেষে পুলিন বলল, ‘বাবা, অনির এবার বিয়ে দোব ঠিক করেছি।’

‘কার সঙ্গে? ওই দোতলার মেয়েটা?’

‘না। অনি নিজেই ঠিক করেছে।’

‘তা হলে তুই বিয়ে দিবি বললি কেন, ও তো নিজেই বিয়ে করছে, যেমন তুই করেছিলি?’

পুলিন চোখ নামিয়ে মাথা নীচু করল। বাবা অসত্য কিছু বলেননি, তবে তফাত একটা আছে। অনি ভাবসাব করে বিয়ে করছে। ভারতীকে সে তিন—চার বার মাত্র চোখে দেখেছিল বিয়ের আগে আর, কথা যা বলেছিল সেটা না—বলারই মতো। যেমন দিলীপ বাড়ি আছে? দরজা থেকে ভারতী বলেছিল, ‘দাদা এইমাত্র বেরোল। কিছু বলতে হবে?’ ‘না থাক। বোলো আমি এসেছিলুম।’ আর একবার পুলিন কড়া নাড়তে ভারতী দরজা খোলে। ‘কাকাবাবু আছেন?’ ‘আছেন। বাবা আহ্নিক করছেন, আপনি বাইরের ঘরে বসুন।’ এই রকমই ছিটেফোঁটার বেশি কথা বন্ধুর বোনের সঙ্গে হয়নি অথচ কাশীনাথ বলে দিল অনির মতো সে নিজেই বিয়ে করেছে।

বাবা খুব ভালোভাবেই জানে তার বিয়েটা ভাবসাবের বিয়ে নয়। ভারতীর বাবা এসে বিয়ের কথা পাড়ে, কাশীনাথ ওদের বাড়ি গিয়ে মেয়ে দেখে সম্মতি দিয়েছিল।

পুলিন এটা নিয়ে কিছু বললেই কাশীনাথের সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হবে এবং সে তিরিশ বছর পর এখন কোনো প্রমাণই দাখিল করতে পারবে না যে ভারতীর সঙ্গে বিয়ের আগে তার হৃদয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। এমনকী ভারতীকে বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও তার মনে কখনো উঁকি দেয়নি যদিও সামান্য খাটো মাথার, গৌরাঙ্গী মাধ্যমিক পাশ সুন্দর মুখশ্রীর বন্ধুর বোনের প্রতি সে দুর্বলতা দেখাতে পারত।

‘সেদিন একটা মেয়ে এসেছিল। আগে কখনো দেখিনি, ওই মেয়েটাকেই কি অনি বিয়ে করবে বলছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আমাকে দেখল, ভাবলুম বলি, কী দেখছ অমন করে, আমি কি জেলেপাড়ার সং?’

পুলিন শিউরে উঠল, ‘ভাগ্যিস বাবা বলেনি। মেয়েটি তা হলে হবু শ্বশুর ঘর সম্পর্কে কী ধারণা করে বসত।

‘তা অনি আর মেয়ে পেল না। অমন ঘোড়ার মতো মুখওলা মেয়েকে পছন্দ করল কী করে?’

পুলিন চুপ করে রইল। কাশীনাথের প্রশ্নটা ভারতীও রাত্রে বিছানায় শুয়ে ক্ষুব্ধ বিস্ময় নিয়ে বলেছিল, ‘মুখটা যেন কেমন, গোল গোল চোখে যেভাবে তাকিয়ে কথা বলছিল মনে হচ্ছে যেন ধমকাচ্ছে, গলার স্বরটাও তেমনি পুরুষ মানুষের মতো।’

‘যাকগে, এ নিয়ে তুমি যেন অনিকে কিছু বলতে যেয়ো না।’ পুলিন বউকে ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘মানিয়ে নেবার চেষ্টা কোরো। অনি যদি ওকে নিয়েই সুখী হয় তাতে আমাদের কী বলার আছে।’

সেদিন বাবার কথার পিঠে কথানা বলে পুলিন মাথা নামিয়ে থেকে ‘যেমন তুইও করেছিলি’ মিথ্যেটা মেনে নেয়। বাবার সঙ্গে যে কথাটা বলার জন্য সে এসেছে সেটা অনেক জরুরি। পুরোনো কাসুন্দি ঘেঁটে আসল কথা থেকে সরে গেলে চলবে না। বাবার মেজাজ আজ নরম রয়েছে।

‘বাবা, বিয়ে হলে তো অনিকে আমার ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে।’

‘তা তো হবেই, তোর বিয়ের পর তো ও ঘরে আমি তোদের থাকতে দিয়েছিলুম।’

‘তা হলে আমরা কোথায় যাব, মানে আমরা কোথায় থাকব?’

পুলিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল, তার মনে হল কাশীনাথ থমকে গিয়ে উত্তর খুঁজছে। খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে চোখের সামনে ধরল। পুলিন বুঝল বাবা বিব্রত হয়েছে। রাতে খবরের কাগজ পড়তে পারে না, কাগজটা চোখের সামনে ধরা মানে চিন্তা করছে।

মিনিট দুয়েক পর পুলিন নীচু গলায় বলল, ‘বাবা, বলছিলুম কি আমরা এই ঘরেই রাতে শোব। দিনের বেলায় দরকার হবে না। অনি আর বউ তো কাজে বেরিয়ে যাবে তারপর সারাদিন আমরা ও ঘরে থাকব, শুধু রাতে—।’

পুলিনের কথা শেষ হতে না দিয়ে কাশীনাথ বলে, ‘এ ঘরে জায়গা কোথায় যে তোরা শুবি?’

‘জায়গা হয়ে যাবে যদি তুমি অনির ফোল্ডিং খাটটায় শোও। আর এই খাটটা যদি বার করে দেওয়া যায় তা হলে অনেকটা জায়গা বেরোবে, আমরা মেঝেয় শোব।’

‘খাটটা বার করে কোথায় রাখবি?’

কাশীনাথের উৎসুক স্বর শুনে পুলিন হালকা বোধ করল। সহজ গলায় বলল, ‘বার করে রাখব কেন, খাটটা বিক্রি করে দোব।’ কথাটা বলে পুলিন বাবার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝল বিরাট ভুল করে ফেলেছে।

‘হারামজাদা!’ যে কটা দাঁত এখনও রয়েছে কাশীনাথ সেগুলো চেপে ধরে বলল ‘বিক্রি করে দোব, বলতে লজ্জা করল না? আমার চাকরির টাকায় এই খাটটা কিনেছি। পেরেছিস তুই একটা কিছু নিজের পয়সায় কিনতে?’

চা নিয়ে এল ভারতী। কাশীনাথের শেষ বাক্যটি তার কানে গেছে। জড়োসড়োভাবে কাপটাকে শ্বশুরের সামনে ধরল।

‘এত দেরি হল কেন? জল চড়িয়ে চা—পাতা কিনতে গেছলে?’

ভারতী চুপ করে রইল। চেঁচাবার জন্য শ্বশুর একটা উত্তর চাইছে, উত্তরটা সে জোগাল না।

‘খাট বিক্রির বুদ্ধিটা কি তোমার মাথা থেকে বেরিয়েছে?’

ভারতী চুপ। কাশীনাথের অনুমানটা অর্ধেক সত্য। পুলিন আর ভারতী দু—জনে মিলে মাথা ঘামিয়ে শোবার জায়গা বার করতে গিয়ে খাটটাকে বিদায় দেওয়াই বাস্তব পন্থা বলে মনে করে গত রাতে নিজেদের মধ্যে কথা বলে।

‘কী, চুপ করে আছ কেন? আমি জানি এসব কুচুটে বুদ্ধি পুলিনের মাথা থেকে বেরোবে না, ও চিরকাল বোকা, চালাক হলে পয়সা রোজগার করতে পারত।’

‘পয়সা রোজগারটাই কি মানুষের জীবনে বড়ো ব্যাপার, বাবা?’ ভারতী মৃদুস্বরে অনিশ্চিতভাবে বলল।

‘নিশ্চয় বড়ো ব্যাপার’, কাশীনাথ ধমকে উঠল। ‘টাকার জোরেই মানুষ বড়ো হয়, খাতির পায়, পুলিনকে কেউ কি সমীহ করে, না পাত্তা দেয়?’

‘না, কেউ দেয় না সমীহও করে না।’ ভারতীর কণ্ঠস্বরে চাপা আগুন। পুলিন প্রায় চমকে উঠে বউয়ের দিকে তাকাল, ধকধক করছে ভারতীর চোখ। ‘আপনাকেই বা ক—জন খাতির করে? উঠতে বসতে ছেলেকে অপমান করেন কেন, কী অপরাধ করেছে সে? একটা ছেলেকে তবু সে তৈরি করেছে, এই পাড়ায় কেউ নেই অনির মতো এত বড়ো চাকরি করে। আপনি তো পারেননি নিজের ছেলেকে তৈরি করতে। আপনার থেকে আপনার ছেলে অনেক মান বাড়িয়েছে এই রায় পরিবারের।’

অনুচ্চচ কঠিন গলা ভারতীর। পুলিন তার বউয়ের এমন কঠোর ভঙ্গি এই প্রথম দেখছে। এই প্রথম একজন বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখাল আর সেটা করল কি না অত্যন্ত নরম শান্ত স্বভাবের ভারতী। শ্বশুরের সামনে যে মাথায় কাপড় না দিয়ে কখনো থাকে না এখন তার ঘোমটা খসে পড়েছে, চোখের কোল চিকচিক করছে জলে।

কাশীনাথও অবাক হয়ে গেছে। পুরু কাচের পিছনে তার চোখের অবিশ্বাসী মণি বিস্ফারিত, হাতে ধরা কাপটা থর থর কেঁপে উঠল। বাবার মুখ দেখে পুলিন বুঝল আঘাত পেয়েছে। বউকে মৃদু ধমকে বলল, ‘যাও এখান থেকে।’

ভারতী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পুলিন অপরাধীর মতো হাত জোড় করে বলল, ‘ওর কথায় কিছু মনে কেরো না বাবা, আমি ওর হয়ে মাপ চাইছি। ইদানীং খুব দুশ্চিন্তায় রয়েছে।’

‘কীসের দুশ্চিন্তা! শোয়ার জায়গা নিয়ে?’ চায়ে চুমুক দিয়ে কাশীনাথ বলল।

‘শুধু শোবার জায়গা নয়, ওই মেয়েটিকে তোমার বউমারও ভালো লাগেনি।’

‘তা হলে বিয়ে দিচ্ছিস কেন?’

‘অনি পছন্দ করেছে।’

‘অনি পছন্দ করেছে বলেই তাকে বউ করে ঘরে তুলতে হবে? আমি যদি বউমাকে দেখে পছন্দ না—করতুম তা হলে কি ভারতী এই পরিবারে ঢুকতে পারত?’

‘দিনকাল পালটে গেছে বাবা।’

‘পালটে গেছে যে সেটা তো এক্ষুনি বুঝতে পারলুম। মেয়েটার নাম কী? বাড়িতে আছে কে কে?’

‘নাম বলাকা। আছে বাবা—মা আর দুই বোন এক ভাই। বাবা আসামে চা—বাগানে ছিল বড়োবাবু। রিটায়ার করে টালিগঞ্জে বাড়ি করে রয়েছে। এই বঙ্গেরই লোক, পৈতৃক বাড়ি বর্ধমানের কৈচর বলে একটা গ্রামে। সেখানে খুড়তুতো ভাইয়েরাই জমিজমা ভোগ করছে। ওরা কখনো যায় না। বলাকা চাকরি করে ইস্ট ইন্ডিয়া ব্যাঙ্কের শ্যামনগরের ব্রাঞ্চে। দুই বোনের একজন স্কুলে পড়ায় আর একজন কাজ করে একটা ট্র্যাভেল এজেন্সিতে। ভাই যাদবপুরে বিএ পড়ছে।’

স্ত্রীর কাছ থেকে যতটুকু শুনেছিল পুলিন সেটাই সংক্ষেপে বলে।

মন দিয়ে শুনে কাশীনাথ বলে, ‘চা—বাগানের বড়োবাবু ছিল যখন তখন বেশ দু—পয়সা কামিয়েছে। মেয়েরাও রোজগেরে। মনে হয় অবস্থাপন্ন সচ্ছল, দেবেথোবে ভালোই।’

পুলিন ঢোক গিলে বলে, ‘অনি বলেছে কোনো দাবিদাওয়া নয়। এমনকী কোনোরকম জিনিসপত্তরও চাওয়া চলবে না।’

কাশীনাথ অবাক হয়ে বলে, ‘বউভাতের খরচ, ঘড়ি, আংটি, সোনার বোতাম এগুলো দেবে তো? তোর শ্বশুর তো দিয়েছিল।’

‘বউভাতের খরচ অনি নিজে দেবে, বাড়িভাড়া করে লোক খাওয়াবে। অনি আংটি পরে না, সোনার বোতামও নয়, ওর দু—হাজার টাকা দামের ঘড়ি আছে তাই ওসবের কোনো দরকার নেই বলে দিয়েছে।’

‘বাব্বা, তোর ছেলে তো খুব পয়সা করে ফেলেছে! কিছুই নেবে না যখন তখন কোন দুখ্যে অমন একটা মদ্দকে বিয়ে করা? একটা সুন্দর নরমসরম চেহারার মেয়েকে তো বিয়ে করতে পারে।’

এবার পুলিন যতটা সম্ভব গলাটা শক্ত করে বলল, ‘বাবা, অনির হবু শ্বশুর শাশুড়ি সামনের রোববার আসবে পাকা কথা বলতে, তুমি একটু বুঝে শুনে ভদ্রভাবে কথা বোলো।’

‘তার মানে? আমি কি অভদ্র?’

জবাব না দিয়ে পুলিন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সেদিন রাতে তাদের দু—জনের মধ্যে শোয়ার সমস্যা নিয়ে আবার কথা হয়েছিল। পুলিন হতাশ হয়ে বলে, ‘শেষ পর্যন্ত ওই ফোল্ডিং খাটের জায়গাটাতেই আমাদের দু—জনকে মেঝেয় শুতে হবে।’

ভারতী বড়ো করে শ্বাস ফেলে বলে, ‘অনেক কিছুই মেনে নিয়েছি এটাও মেনে নিতে হবে। ছেলের বিয়ে দিয়ে যে এমন আতান্তরে পড়তে হবে আগে কি ভেবেছিলুম।’

‘আগে ভাবলে কী করতে শুনি? বিয়ে করতে বারণ করতে?’

‘সেকী! অত স্বার্থপর হব কেন। শুধুমাত্র রাতে শোয়ার জায়গার জন্য অনিকে বঞ্চিত করব, একথা বলতে পারলে কী করে?’

‘কী বললুম আর কী তার মানে করলে! বঞ্চিত করার কথা উঠছে কেন। একটা জোয়ান ছেলের তো এই বয়সেই বউ দরকার তা কি আমি বুঝি না? রাতে অন্য কোথাও শোওয়া, মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য, তেমন একটা ব্যবস্থার কথা ভাবা দরকার। যতদিন না ব্যবস্থা হয় অনি বিয়ে পিছিয়ে দিক।’

উত্তেজিত স্বরে ভারতী বলল, ‘বলছ কী! রোববার ওরা বিয়ের কথা বলতে আসবেন আর এখন বলব বিয়ে পিছিয়ে দিতে, তাও এমন একটা কারণে যা শুনলে লোকে হাসবে আর আমাদের মাথা খারাপ হয়েছে ভাববে।’

‘একটু শান্ত হও, আজ তোমার মাথাটা সত্যিই গরম হয়েছে। বাবাকে যেভাবে বললে তাতে আমার চোখ কপালে উঠে গেছল। এত বছর পর এই প্রথম তোমায় সত্যিকারের রাগতে দেখলুম, অবশ্য রাগারই কথা।’

অনুতপ্ত স্বরে ভারতী বলল, ‘কী যে হয়ে গেল তখন মাথার মধ্যে। ‘কুচুটে বুদ্ধি’ কথাটা শুনেই মাথায় রক্ত উঠে গেল। এমন কথা জীবনে কেউ কখনো আমার সম্পর্কে বলেনি। যত বয়স বাড়ছে বাবা যেন আমাদের ওপর নিষ্ঠুর হয়ে উঠছেন।’

‘বলে ভালোই করেছ। কখনো কেউ প্রতিবাদ করেনি, পালটা জবাব দেয়নি তাই যখন তখন অপমান করে গেছে। আসলে দোকানটা থেকে যদি দু—হাত ভরে টাকা রোজগার করতে পারতুম তাহলে আজ এভাবে অপমান করতে পারত না।’

.

পুলিন যে দোকানটার কথা বলল আসলে সেটি ছিল ভারতীর বাবা দুর্গাশঙ্করের ঘড়ি সারাইয়ের দোকান। একসময় তিনি রোলেক্স ঘড়ি কোম্পানিতে মেকানিক ছিলেন। মেয়ে জন্মাবার পরই দোকান করেন। নাম দেন ‘ভারতী ওয়াচ রিপেয়ারার।’ একমাত্র ছেলে দিলীপকে তিনি কাজ শিখিয়ে তৈরি করেছিলেন দোকানে বসাবার জন্য। দোকানটা ছিল চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ওপর চোরবাগানে মহাজাতি সদনের কাছাকাছি, ব্যবসার পক্ষে খুব ভালো জায়গা। ছেলের বন্ধু সরল সাদাসিধে ঠান্ডা স্বভাবের পুলিনকে তিনি খুব পছন্দ করতেন। তৃতীয় বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করার পর পরীক্ষার মার্কশিট হাতে নিয়ে কাশীনাথ তার ছেলেকে জানিয়ে দেন ‘অনেক হয়েছে, পয়সা নষ্ট করে আর পড়ে কাজ নেই। এবার হাতের কাজটাজ কিছু শেখ নইলে ভবিষ্যতে দু—মুঠো অন্নও জুটবে না।’

মাথা নীচু করে পুলিন শোনে এবং পরের হপ্তায় হেদুয়ার কাছে রেডিয়ো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামে তিনটি ঘর নিয়ে গড়া কলেজে ভরতি হয়। সেখান ছ—মাস শিক্ষা নেবার পরে নিজের হাতে একটা ট্রানজিস্টার তৈরি করে কাশীনাথকে চমৎকৃত করে দেয়। কাশীনাথই পরামর্শ দেয় ‘তুই এবার ট্রানজিস্টার তৈরি করে বিক্রির ব্যবসা কর। রিটায়ার করছি চারমাস পর। পি এফ গ্র্যাচুইটি, ছুটি বিক্রি আর খানিকটা পেনশন বিক্রি করে হাজার সত্তর—পঁচাত্তর মতো পাব, আমাদর রেলের কয়েকজন মিলে কো—অপারেটিভ করে ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবে বেলঘরিয়ায়, জমি কেনা ঠিক হয়ে গেছে। আমাকে বলছে মেম্বার হতে, তিন ঘরের ফ্ল্যাট ষাট থেকে সত্তর হাজার টাকা পড়বে। লোন পাওয়া যাবে। যদি ব্যবসা করতে পারিস তো বল। আগেকার ভালভওলা রেডিয়ো তো লোপাট হয়ে গেছে, এখন তো ট্রানজিস্টারের যুগ। ভালো করে আগে ভেবে দেখ, যদি এটা তৈরির ব্যবসা করতে পারবি মনে করিস তাহলে হ্যাঁ বলবি, আমি তাহলে ওদের বলে দোব মেম্বার হব না। আর যদি পারবি না ভাবিস তাহলেও বলে দিবি, তাহলে কো—অপারেটিভের মেম্বর হয়ে যাব। দেরি করিসনি, একমাসের মধ্যে জানাবি।’

ব্যবসার কিছুই জানে না পুলিন, সে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল দুর্গাশঙ্করকে। তিনি প্রবলভাবে বাঙালির ব্যবসায়ে নামায় বিশ্বাসী; নিজে চাকরি ছেড়ে দোকান করেছেন এবং তার কাজের গুণে খদ্দের পেয়েছেন এবং নামও ছড়িয়েছে। চাকরি থেকে যে বেতন পেতেন এখন তা দ্বিগুণ রোজগার করেন। ছেলের বন্ধুকে তিনি উৎসাহ দিয়ে বললেন, ‘এই তো চাই। বাঙালিরা শুধু চাকরি খোঁজে, যেমন তেমন একটা চাকরি পেলেই খুশি। অবাঙালিদের দেখো তো, সামান্য পুঁজি নিয়ে শুরু করে, এইতো ভগবতীলাল ছ—বছর আগেও হাতিবাগান বাজারে বসে কাটাকাপড় বেচত, এখন দ্যাখো ওখানেই ট্রামরাস্তার ওপর কাটপিসের দোকান দিয়েছে। ঝকঝকে কাউন্টার দেওয়ালে কাচের মস্ত বড়ো শোকেস। কী করে উন্নতিটা করল বলো তো?’

পুলিন হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে দুর্গাশঙ্করের দিকে তারপর পাশে দাঁড়ানো মেয়ে ভারতীর দিকে। ছ—বছরে ভগবতীলালের উন্নতির কারণ জানতে তারপর সে এধার—ওধার তাকায়। দুর্গাশঙ্করই তাকে উদ্ধার করে বলেন, ‘পরিশ্রম। যেটা বাঙালিরা একদমই করে না, সেই পরিশ্রম। লজ্জা ঘেন্না ত্যাগ করে মুটের মতো ভগবতী খেটেছে দিনে আঠারো ঘণ্টা। আজ দেখো সে কোথায় উঠে গেছে। অবশ দেশওয়ালি ভাইরাও নানাভাবে ওকে সাহায্য করেছে।’

পুলিন নীচু গলায় তখন বলেছিল, ‘দিলীপও খুব খাটে, ও ঠিক উন্নতি করবে।’

‘নিশ্চয় করবে। ও কি আমার মতো বসে বসে শুধু ঘড়িই সারাবে? নামি বড়ো বড়ো কোম্পানির ঘড়ি বিক্রির এজেন্সি নিয়ে শো রুম খুলবে। আমার দোকানের পোজিশানটা দেখেছ? তুমি বাবা চাকরির দিকে যেয়ো না। ট্রানজিস্টার পাশে রেখে নাপিত দাড়ি কামাচ্ছে দেখেছি, মুচি জুতো সারাচ্ছে তাও দেখেছি, শুনেছি চাষি খেতে হাল দিচ্ছে আলের ওপর রাখা ট্রানজিস্টারের গান শুনতে শুনতে। জিনিসটার বাজার বিরাট। দেখতে সুন্দর এমন খোলের মধ্যে ভরে, কমদামে যদি মফস্সলের দিকে ভালো সেলসম্যান দিয়ে বিক্রি করতে পার তাহলে নিশ্চয় ব্যবসা দাঁড়াবে। কিন্তু তুমি একা একা মাসে ক—টা ট্রানজিস্টার তৈরি করতে পারবে? তোমাকে তো অনেকগুলো লোক রাখতে হবে, তাদের মাইনে দিতে হবে, একটা ছোটো কারখানা মতন করতে হবে, একটা অফিসও চাই, অনেক টাকার ব্যাপার!’

পুলিন বলেছিল, ‘বাবা ষাট—সত্তর হাজার টাকা দিতে পারবেন বলেছেন।’

দুর্গাশঙ্কর টাকার অঙ্ক শুনে হেসে ফেলে বলেন, ‘লাল সাদা সবুজ নানান রঙের ক্যাবিনেটে ছোটো ছোটো পকেট ট্রানজিস্টার বিক্রি হচ্ছে দেড়শো টাকায়। তুমি বরং তোমার ক্যাপিটালের জোর অনুযায়ী নাপিত মুচি চাষিদের কথা ভেবে কমদামি ট্রানজিস্টার তৈরি করো।’

পুলিন চাঁদনিচক বাজারের এক ট্রানজিস্টার ক্যাবিনেট নির্মাতার কাছ থেকে কাঠের কমদামি ক্যাবিনেট কিনে ঘরে বসেই সাতটি ট্রানজিস্টার তৈরি করে ফেলল বাবার দেওয়া টাকায়। কলকাতা আর বিবিধ ভারতী ছাড়া তাতে অন্য কোনো কেন্দ্র ধরা যায় না। সেগুলোর একটি নিয়ে শ্যামবাজারে এক বড়ো গ্রামোফোন রেকর্ড, টেপরেকর্ডার ও রেডিয়ো বিক্রেতার দোকানে যায় যদি তারা বিক্রির জন্য রাখে। তার ট্রানজিস্টারের চেহারা দেখেই দোকানের মালিক সবিনয়ে জানিয়ে দেন প্রদর্শনের জন্য তারা রাখতে পারবেন না। পরামর্শ দেন বিরাটি কি চাকদায় বরং বিক্রির চেষ্টা করুন। পুলিন কিন্তু দমে যায়নি। সে সত্যি সত্যিই বিরাটিতে গিয়ে এক স্টেশনারি দোকানের মালিককে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বেশি কমিশনের প্রস্তাব দিয়ে রাজি করায়। দশদিন পরে গিয়ে সে স্তম্ভিত হয়ে শুনল যে দুটি ট্রানজিস্টার রেখে গেছল সে দুটিই বিক্রি হয়ে গেছে।

সেদিন পুলিন বাড়ি ফেরে আড়াইশো গ্রাম রাবড়ির ভাঁড় হাতে নিয়ে। কাশীনাথ অবাক হয়ে বলে ‘ব্যাপার কী?’

লাজুক হেসে পুলিন বলেছিল, ‘আজ প্রথম রোজগার করলুম।’

‘আজ আর রুটি নয় লুচি দিয়ে রাবড়ি খাব।’ এই বলে কাশীনাথ টিন থেকে ময়দা বার করে মাখতে শুরু করে। আনন্দ হলে অন্তরে খুশি উপচে পড়লে লুচি খাবার ইচ্ছা তাকে তাড়না করে। স্ত্রী মারা যাবার পর সে রাঁধুনি রেখেছে। সন্ধ্যাবেলায়ই রাতের রান্না করে ঢাকা দিয়ে রেখে সে চলে যায়। তার যাবার পরই পুলিন রাবড়ি নিয়ে আসে তাই কাশীনাথকেই ময়দা মেখে লুচি ভাজতে হয়।

দালানে তখন খাওয়ার টেবল ছিল না। ঘরের টেবলে বসে খেয়েছিল পুলিন, আর কাশীনাথ খাটে দেওয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে কোলে থালা নিয়ে আলগা অলসভাবে রাবড়ির ঝোল মাখানো লুচি চিবোতে চিবোতে বলেছিল, ‘তাহলে তুই রোজগার করলি। আমি তো ভেবেছিলুম যে টাকাটা তোকে দিয়েছি সেটা আর ফিরে আসবে না, মানুষ যে কত ভুল ভাবে!’

পুলিন কথা না বলে টেবলে ডেকচিতে রাখা লুচি তুলে খেয়ে যেতে থাকে। রাবড়ির সবটাই বাবা খাক এটাই তার মনোগত বাসনা। কাশীনাথ লক্ষ করে পুলিন শুধু লুচি খাচ্ছে। রাবড়ির ভাঁড়টা ছেলের দিকে বাড়িয়ে ধরে সে বলে, ‘খেয়েনে। রাতে এত ভারী জিনিস খেলে আমার অম্বল হবে।’

পুলিন ভাঁড়টা নিয়ে নেয়। কাশীনাথ আঙুল চাটতে চাটতে বলে, ‘একটু বড়ো করে এবার শুরু কর। তোকে যেভাবে খাটতে দেখলুম মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে যাবি। এই দুটো ঘরে তো আর কারখানা হয় না। আরও বড়ো জায়গা চাই, টেবিল চাই, আলমারি চাই, যন্ত্রপাতি চাই, গোটা দুয়েক লোকও রাখতে হবে, তাদের মাইনে দিতে হবে। ইনভেস্ট করতে হয়রে, যাকে বলে লগ্নি। কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে মাল তৈরি করলে বিক্রিও হবে তেমনি করে, ওতে ব্যবসা চলে না। তুই একটু বেশি টাকা ঢাল।’

পুলিন লক্ষ করেছিল কথাগুলো বলার সময় কাশীনাথের চোখদুটো উদ্দীপনায় ঝকঝক করে উঠল চশমার পিছনে, উৎসাহে তেজি গলার স্বর যুবকদের মতো। এ যেন অন্য এক কাশীনাথ। ব্যাজার মুখো খিটখিটে লোকটা ছেলের দুটো ট্রানজিস্টার বিক্রির সাফল্যেই চনমন করে উঠেছে। পুলিনের মনে হয়েছিল বাবা বোধহয় মনে মনে তাকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবছে। মৃদস্বরে সে বলেছিল, ‘টাকা ঢালতে বলছ কিন্তু টাকা কোথায়?’

কাশীনাথ বলেছিল ‘সে তোকে ভাবতে হবে না। প্রথমে অল্প টাকা দিয়ে শুরু কর, বাজার বুঝে নে। তুই আনকোরা নতুন আমিও তো এই ব্যবসার কিছু জানি না, বুঝিও না। একত্রিশ বছর ধরে শুধু গার্ডের চাকরিই করেছি আর সংসার চালাবার কথা ভেবেছি। তোরা মায়ের চিকিৎসায় যে ক—টা টাকা জমিয়েছিলুম তাও গেল, উপরন্তু ধারও হল। আস্তে আস্তে সেটা শোধ করলুম। তাই বলছিলুম প্রথমেই বেশি টাকা লাগিয়ে শুরু না করে বরং পরিশ্রম দিয়ে পুষিয়ে নে। তোর তো ঝাড়া হাত—পা। বউ—বাচ্চচা নেই, সংসারও চালাতে হয় না, আমি তোকে হাজার তিরিশ দেব।’

পুলিন অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তাহলে তোমার কো—অপারেটিভের ফ্ল্যাট! সেটার কী হবে?’

‘কী আবার হবে! ফ্ল্যাট হবে না।’ কাশীনাথ নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বলে হেসেছিল। ‘তোর দরকারটা আগে। আমাদের দুটো ঘর তো রয়েছে, বাপবেটার চলে যাবে।’

শুনে গভীর সুখ পেয়েছিল পুলিন। ট্রানজিস্টার বিক্রির খবরটা দিলীপের বাবাকে জানাবার জন্য পরদিনই সে ওদের বাড়ি যায়। প্রায় একমাস পর সে এল। সদর দরজা খুলল ভারতী। ভারী চোখ থমথমে মুখ। অন্যান্যবারের মতো পাতলা হাসি ফুটল না। পুলিনকে ভিতরে আসার জন্য ‘আসুন’ বলল না। ভিতর থেকে ওর মা—র গলা শোনা গেল, ‘কে এলোরে খুকি?’ জবাব দিল পুলিন, ‘আমি কাকিমা।’ ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন দিলীপের মা কিরণ। ময়লা শাড়ি চুল আলুথালু।

পুলিন বলল, ‘দিলীপ বাড়ি আছে?’

কিরণ আঙুল আকাশের দিকে তুলে বলেন, ‘ওখানে আছে।’ এই সময় আঁচলটা দাঁতে চেপে ডুকরে উঠে ভারতী ছুটে ভিতরে চলে যায়।

শোনামাত্র ধক করে ওঠে পুলিনের বুক। ওখানে আছে তার মানে মারা গেছে কি? আশঙ্কার কথাটা মুখ দিয়ে বার করতে না পেরে বলল, ‘ওখানে মানে?’

প্রাণপণে কান্না চেপে কিরণ বললেন, ‘দিলীপ পিকনিক করতে গেছিল পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে জয়নগরে, সেখানে পুকুরে ডুবে মারা গেছে, দশ দিন আগে।’

শুনেই পুলিনের মাথা থেকে সব রক্ত বুকে নেমে এসে জমাট বেঁধে গেল। মাথাটা খালি, দৃষ্টি ঝাপসা, জিভ আড়ষ্ট, কানেও কোনো শব্দ ঢুকছে না। মুখ দিয়ে আর্তনাদের মতো ‘আহহ’ ছাড়া আর কোনো শব্দ বেরোল না।

‘শোনামাত্রই ওনার স্ট্রোক হয়, এখন একটু ভালো।’ কিরণ অসহায় চোখে পুলিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। একটা ভয়ংকর বিপর্যয় এই পরিবারের উপর নেমে এসেছে সম্পূর্ণ আচমকা। এখন দুটো ট্রানজিস্টার বিক্রির কথা হাসিহাসি মুখে বলা যায় না। সে বিছানায় শোয়া দুর্গাশঙ্করের পাশে গিয়ে তার হাত মুঠোয় ধরে বসে থাকে। দুর্গাশঙ্কর ক্ষীণস্বরে বলে যান, ‘সাঁতার জানত না তবু বন্ধু ডুবে যাচ্ছে দেখে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কেন যে অমন বোকামি করতে গেল। পুলিন আমি বড়ো একা হয়ে গেলুম। কত আশা ছিল ওর ওপর। নিজে ডুবল আমাকেও ডুবিয়ে দিয়ে গেল।’ দুর্গাশঙ্করের চোখের জল গড়িয়ে নামল কানের পাশ দিয়ে।

দুর্গাশঙ্কর এর পর কয়েকদিন মাত্র দোকানে গেছেন মেরামতির জন্য নেওয়া ঘড়িগুলো খদ্দেরদের ফেরত দিতে। নতুন একটিও কাজ আর নেননি। কাজ করার ইচ্ছা এবং সামর্থ্য তিনি হারিয়ে ফেলেন, দোকান বন্ধ হয়ে থাকে। তিনি নিজেই একদিন বিছানায় শুয়ে জিজ্ঞাসা করেন পুলিনকে ‘তোমার রেডিয়ো তৈরির ব্যবসার কতদূর? শুরু করেছ?’

পুলিন বলেছিল, ‘করব তো ভেবে রেখেছি, প্রথমে দরকার একটা ঘর। তৈরি করে প্রথমে লোককে দেখাতে হবে জানাতে হবে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে অনেক খরচ। মালপত্র কেনা, কারিগর রাখা, দোকান সাজানো এসবের জন্য হাজার পঞ্চাশ টাকা নিয়ে না নামলে শুরু করা যাবে না। বাবা দেবে তিরিশ হাজার, ভাবছি ওই দিয়েই শুরু করব।’

শুনে দুর্গাশঙ্কর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, ‘তুমি কাল সকলের দিকে একবার আসতে পারবে?’

পুলিন পরদিন সকাল দশটায় যায়। দুর্গাশঙ্করের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে কিরণ, ভারতীকে দেখতে পেল না সে। ধীর স্বরে থেমে থেমে দুর্গাশঙ্কর বললেন, ‘আমার শরীর খুব ভালো নয় পুলিন, যেকোনো সময় যেকোনো দিন আমার আয়ু শেষ হয়ে যেতে পারে, তার নোটিশ যমরাজ আমায় ধরিয়ে দিয়েছে।’ তিনি স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলেন। কিরণের মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। শক্ত মনের মানুষ। ভবিষ্যৎকে মেনে নিয়েছেন, ভেঙে পড়েননি।

পুলিন বিচলিত হল দুর্গাশঙ্করের কথায়। বাঁ—হাতের মুঠোয় ওঁর হাতটা ধরে সে বলল, ‘এসব কথা থাক কাকাবাবু, আপনি এখনও অনেকদিন বাঁচবেন।’

ম্লান হেসে দুর্গাশঙ্কর বলেন, ‘তোমার কাকিমাও তাই বলেছে। কিন্তু আমি তো বুঝি যার একটা স্ট্রোক হয়ে গেছে আর একটা যেকোনো দিন হতে পারে। ভয়ে ভয়ে সারাক্ষণ থাকার মতো কষ্টকর আর কিছু হতে পারে না।’

‘ভয়টাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করলেই তো পারেন।’ কথাটা বলে পুলিনের মনে হয়েছিল খুব বোকার মতো বলা হল। ভয় এমন ব্যাপার যত ভুলে থাকার চেষ্টা করা যায় ততই চেপে বসে। এটা সে ছোটোবেলা থেকে জানে। কাশীনাথ শিশু পুলিনের রাস্তায় বেরিয়ে যাওয়া বন্ধ করতে বলেছিল, একতলার সিঁড়ির পাশের ঘরটায় জটে বুড়ি দুপুরে চুপটি করে একটা থলি নিয়ে বসে থাকে। বাচ্চচাদের একা পেলেই খপ করে ধরে থলিতে পুরে নেয়। তার পর মাঝ রাত্তিরে কেটে টুকরো করে কালিয়া রেঁধে খায়, খবরদার দুপুরে নীচে নামবে না। পুলিন এখনও সিঁড়ির পাশের ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় একবার ঘরটার দিকে তাকায়।

দুর্গাশঙ্কর তারপর বলেন, ‘ভুলে থাকার জন্যই তো বাবা তোমাকে আজ আসতে বললুম। আমার দোকানটা দু—মাস বন্ধ রয়েছে। আর কোনোদিন খুলতে পারব বলে মনে হয় না। এদিকে ভারতীও বেশ বড়ো হয়েছে। ওর বিয়ের কথাও ভাবতে হচ্ছে।’

স্থির দৃষ্টিতে পুলিনের মুখের দিকে তাকিয়ে দুর্গাশঙ্কর। অস্বস্তি বোধ করে সে চোখ সরিয়ে নিতেই দেখল কিরণও তার মুখের দিকে তাকিয়ে। অবশেষে কিরণই কোনো ভণিতা না করে সহজভাবে বললেন, ‘দোকানটা যৌতুক দেব যদি ভারতীকে বিয়ে করো।’

পুলিনের কানে ‘যদি’ শব্দটা খচ করে লাগল। একটা দোকান করার মতো জায়গা সে খুঁজছে। যে জায়গায় ‘ভারতী ওয়াচ’ সেখানে দোকান পাওয়া সে স্বপ্নেও ভাবতে সাহস পায়নি। ভারতীকে তার ভালো লাগে ঠিকই, কিন্তু সেটা হৃদয়ের উপরের স্তর ছুঁয়ে, ভালো লাগাটা কামনার স্তর পর্যন্ত এখনও পৌঁছায়নি। দোকান ঘর এবং ভারতী এই দুয়ের প্রভাবে তার মনের মধ্যে এখন যে এলোমেলো অবস্থা তৈরি হল ‘যদি’ শব্দটা তার ফলে চাপা পড়ে গেল।

‘এ ব্যাপারে আমি আপনাদের কোনো কথা দিতে পারব না, আমার বাবাকে বলুন।’ নম্রস্বরে পুলিন জানায়।

‘তা তো বলবই’, দুর্গাশঙ্কর বলেন, ‘তার আগে তোমার মতটা জানা দরকার। ভারতীকে তোমার কেমন লাগে, পছন্দ হয়?’

মুখ নামিয়ে পুলিন অস্ফুটে বলেছিল, ‘হ্যাঁ।’ আড়চেখে দেখে দু—জনের মুখে স্বস্তির ছায়া পড়ল।

সন্ধ্যায় ছেলের তৈরি ট্রানজিস্টারে খবর শুনছিল কাশীনাথ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল পুলিন। খবর শেষ হতে সে ঘরে ঢুকল। রেডিয়ো বন্ধ করে কাশীনাথ বলল, ‘আওয়াজ বেশ পরিষ্কার আসছে।’

‘বন্ধ করলে কেন। এরপর তো গান হবে, শুনবে না?’

‘ব্যাটারি খরচ হবে।’ এক কথায় কাশীনাথ জানিয়ে দিল গান শোনার থেকে টাকার সাশ্রয়ে তার সুখ বেশি।

ইতস্তত করে পুলিন বলল, ‘দিলীপের বাবা আজ একটা কথা বললেন, দোকানটা আর তিনি রাখবেন না। ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকেই, একদম ভেঙে পড়েছেন, কাজ করার ক্ষমতাও আর নেই। মনে হয় না বেশিদিন বাঁচবেন।’

ছেলের বন্ধুর বাবার বাঁচা—মরা নিয়ে কাশীনাথ সমবেদনা জানাতে একটি কথাও খরচ না করে উৎসুক হয়ে জানতে চাইল, ‘দোকানটা তাহলে কী করবে, বেচে দেবে?’

‘ওটা আমাকে দিয়ে যেতে চান,’ বলেই পুলিন বাবার মুখে কীরকম ভাবান্তর ঘটে দেখার জন্য তাকাল। কাশীনাথ বিমূঢ়। ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে গেল। স্ত্রী মারা যেতে যে ধাক্কা লেগেছিল তার অন্তরে এটা যেন তার থেকেও বেশি। গলার কণ্ঠা দু—তিনবার নড়ে উঠল। বিশ্বাস করতে পারছে না চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের উপর অমন ব্যবসার জায়গায় দোকানটা দিয়ে দেবে ছেলের বন্ধুকে, তাই কখনো হয়!

‘তুই ঠিক বলছিস? লোকটা নিজে তোকে বলেছে?’

‘হ্যাঁ, আমাকে বলেছেন আজ সকালেই।’

‘অমনি অমনি দিয়ে দেবে? কিছু নেবেটেবে না?’

পুলিন চুপ রইল। বলতে অস্বস্তি হচ্ছে, শুনলেই বাবা যদি ‘না’ বলে দেয়!

‘কীরে টাকার অ্যামাউন্টটা কত?’

‘টাকা চাননি।’

‘তবে?’

‘মেয়ের বিয়ে দিতে চান।’

‘তোর সঙ্গে?’

পুলিন মুখ নামিয়ে নিরুত্তর। কাশীনাথ ‘হুমম’ শব্দ করে চিন্তায় ডুবে গেল। পুলিন একটু একটু করে আশার আলো দেখতে থাকল। বাবা এককথায় নাকচ করেনি।

‘খুঁতো মেয়ে?’

‘না।’

‘কানা—খোঁড়া, বোবা—কালা নয়তো?’

‘না।’

‘দেখতে শুনতে কেমন? তোর সঙ্গে আলাপ—সালাপ কত দিনের?’

পুলিন ফাঁপরে পড়ল। ‘আলাপ—সালাপ’ বলতে বাবা কী বোঝাতে চায় সেটা সে আন্দাজ করে হুঁশিয়ার হয়ে গেল। ‘কত দিনের’ শব্দটাই ভয়াবহ। ছেলে কত বছর হল বখেছে বাবা এটাই জেনে নিতে চাইছে।

‘দু—তিনবার দেখেছি। রং ফরসা তবে একটু বেঁটে। মাধ্যমিক পাশ।’

‘কত ফরসা, তোর মায়ের থেকেও?’

কাশীনাথ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ এবং গৌরবর্ণের প্রতি প্রবলভাবে দুর্বল আর সেই কারণেই আটটি পাত্রী নাকচ করে ধবধবে রঙের একটি সুন্দরী গরিব নিরক্ষর মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনে নিজে খরচ দিয়ে। কাশীনাথের বাবা—মাও ছিলেন কালো। এবার তার বংশ ফরসা রঙের হবে এই আশা নিয়ে স্ত্রীকে গর্ভবতী করে হৃৎপিণ্ড গলার কাছে তুলে এনে অপেক্ষা করছিল কয়েকটা মাস। পুলিন মায়ের রং আর মুখশ্রী পাওয়ায় কাশীনাথ গুহ ভবনের পাঁচটি ফ্ল্যাটের এবং একতলার দোকানের কর্মচারীদের টেবল পেতে ছাদে খাওয়ায় ছেলের অন্নপ্রাশনে। দ্বিতীয় সন্তান অবধারিত বাবার রং পাবে এই বদ্ধমূল ধারণায় সে দ্বিতীয়বার পিতা হয়নি।

‘মায়ের মতো অতটা নয় তবে গৌরবর্ণ।’ পুলিন এই বলে আতঙ্কিত চোখে তাকায়। কাশীনাথ একটি ‘হুমম’ দিয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয় পড়ে। কয়েক সেকেন্ড পর সে বলে, ‘বিয়ের পরে না আগে দোকানটা লেখাপড়া করে দেবে?’

‘সেটা তুমিই জিজ্ঞেস করে নিয়ো।’

‘তুই ওনাকে এসে দেখা করতে বল।’

পুলিন রিকশায় করে নিয়ে আসে দুর্গাশঙ্করকে। তিনতলায় উঠতে তিনি দু—বার সিঁড়িতে জিরোন। কাশীনাথ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে ‘আসুন আসুন’ বলে দুর্গাশঙ্করকে হাত ধরে নিয়ে ঘরের একমাত্র চেয়ারটিতে বসায়। পুলিন অবাক হয়ে গেছিল বাবার অমায়িক আচরণে ও কথায়, এক ঘণ্টা আগে সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল দুর্গাশঙ্করকে নিয়ে আসতে। দেখে গিয়েছিল ময়লা গেঞ্জি আর পাজামা পরা, গালে পাঁচ দিনের দাড়ি, চুলও সেই রকম। এখন একেবারে অন্য চেহারা। ধবধবে পাঞ্জাবি আর পাজামা, কামানো চকচকে গাল, পাট করে আঁচড়ানো চুল, নতুন চেহারার এক কাশীনাথ! হবু বেয়াইয়ের সামনে নিজেকে পরিচ্ছন্ন মার্জিত সজ্জন সদালাপী প্রমাণ করার জন্য ভোল পালটে ফেলেছে এক ঘণ্টার মধ্যেই। পুলিন বুঝল বাবা ইতিমধ্যেই নীচের চুলকাটার সেলুনে গিয়ে দাড়ি কামিয়ে এসেছে, বেড কভারটা বদলে দিয়েছে, বালিশের ওয়াড় ময়লা ছিল, বালিশগুলোই পাশের ঘরে চালান হয়ে গেছে।

‘ছেলের কাছে সব শুনেছেন নিশ্চয়।’ দুর্গাশঙ্কর কথা শুরু করেছিলেন নম্র বিনীত ভাবে। হাত জোড় করে প্রার্থীর মতো বলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়েটিকে দয়া করে আপনার পুত্রবধূরূপে গ্রহণ করে আমাকে যদি উদ্ধার করেন এই আশা নিয়েই এসেছি।’

কাশীনাথ দু—হাতে দুর্গাশঙ্করের মুঠো ধরে ব্যস্ত হয়ে বলে, ‘আরে আরে এ তো আমার সৌভাগ্য। দুর্গার কন্যা মা লক্ষ্মী আমার ঘরে আসবে আমি তো ভাবতেই পারছি না। আমিই তো উদ্ধার হব।’

পুলিন তখন ভাবল, বাবা এমনভাবে কথা বলা শিখল কবে, পুরোটাই তো অভিনয়! ছেলে একটা দোকান পাবে এটাই তো ওর একমাত্র স্বার্থ এই বিয়েতে রাজি হওয়ার পিছনে।

‘আমি খুব গরিব—।’

দুর্গাশঙ্করকে থামিয়ে কাশীনাথ বলে ওঠে, ‘আহাহাহা, গরিব বড়োলোকের কথা আসছে কেন। আমার কোনো দাবি নেই, যা দেবেন পুলিনকেই দেবেন। আমি শুধু একবারটি মা লক্ষ্মীকে দেখে আসব।’

মেয়ে দেখতে কাশীনাথ গিয়েছিল। চল্লিশ মিনিট ছিল। পুলিন সঙ্গে যায়নি। ফিরে এসে কাশীনাথ বলে, ‘লোকটা ভদ্দরলোক, দোকানটা বিয়ের আগেই লিখে দেবে বলেছে। বুদ্ধিমতী মেয়ে। ক—টা কথা জিজ্ঞেস করলুম, দু—একটা উত্তরে ধোঁকা দিল। সংসার চালাতে এমন মেয়েই দরকার। রংটা ফরসা কিন্তু তোর মায়ের মতো অতটা নয়। বিয়ের দিন ঠিক করে এলুম সামনের ফাল্গুনে।’

বিয়ের দু—সপ্তাহ পর রাতে বিছানায় এটা সেটা গল্প করতে করতে ভারতীকে জিজ্ঞাসা করেছিল পুলিন, ‘বাবা কী বলেছিল তোমাকে দেখতে গিয়ে?’

‘বিশেষ কিছু নয়। প্রথমেই বললেন শাশুড়ি, ননদ, দেওর পাবে না, একা সংসার করতে হবে, পারবে? রান্না জানো? আমি ঘাড় নাড়লুম। তারপর, সিনেমা দ্যাখো? বললুম, না। গান শোনো? বললুম, হ্যাঁ। কী গান? বললুম কীর্তন আর শ্যামাসংগীত। হাসি হাসি মুখ দেখে বুঝলুম আশি নম্বর পেয়ে গেছি। তার পর বললেন, দুর্যোধনের বোনের নাম কী? বললুম দুঃশলা। তার পর, বিকর্ণ কর্ণের কে হন? বললুম কেউ না, দুর্যোধনের ভাই ছিলেন বিকর্ণ। ব্যাস আর কিছু জিজ্ঞাসা করেননি।’

‘তাই বাবা বলেছিল বুদ্ধিমতী মেয়ে! সিনেমা দেখি না, কীর্তন শ্যামাসংগীত শুনি, তুমি কি ভেবেছ বাবা ওসব বিশ্বাস করেছে? মোটেই নয়। অত ভালো মেয়ে সাজতে গেলে কেন?’

‘ওর ঠেঁটো ধুতি—পাঞ্জাবি, কাঁধের উড়ুনি আর খোঁচা খোঁচা চুল দেখে মনে হল সেকেলে লোক। যে উত্তর পেলে খুশি হবেন তাই বলছি।’

‘বাবা কিন্তু ঠিক ধরে ফেলেছে। আমাকে সেদিনই বলেছিল ধোঁকা দিয়ে মিথ্যে উত্তর দিয়েছে, বুদ্ধিমতী মেয়ে। সাবধানে থেকো। পরে কোনোদিন এটা নিয়ে তোমাকে খোঁটা দেবে।’

.

তিরিশ বছর পর সেদিনের সেই রাতের মতো বিছানায় শুয়ে পুলিনের মনে পড়ল ভারতীকে সে বলেছিল পরে কোনোদিন বাবা খোঁটা দেবে। ‘কুচুটে বুদ্ধি’ কথাটা সেই খোঁটাই। আসলে খাট বিক্রি করে দেওয়ার কথাটা তার মুখ থেকেই প্রথমে বেরোয়। ভারতী তাতে সায় দিয়েছিল মাত্র। ওকে কুচুটে বলায় সেও মনে আঘাত পায়।

ভারতী পাশ ফিরে বলল, ‘রাতে শোয়ার সমস্যাটা তো শুধু আমাদের একার নয়, এ পাড়ায় অল্পবিস্তর সব ঘরেই রয়েছে। নীচের উমাদেরই কথা ধরো না! স্বামী—স্ত্রী, তিন ছেলে এক মেয়ে। ওরা রাতে কী করে শোয়? ওই যে সামনের একুশ নম্বর বাড়ি ওখানে একতলা দোতলায় তো চার ঘর ভাড়াটে, চারটে পরিবার থাকে চারটে ঘর নিয়ে। কী করে থাকে?’

‘ওপরের প্রণববাবু, আমাদের পাশের মজুমদাররা এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত। দু—জনেরই একটি করে মেয়ে। বিয়ে হলে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে। তখন বাবা—মা হাত—পা ছড়িয়ে দুটো ঘরে থাকবে। অনি যদি মেয়ে হত তা হলে আমাদের এমন ঝঞ্ঝাটে পড়তে হত না।’

ক্ষীণ একটা আপশোস পুলিনের গলায় পেয়ে ভারতী বলল, ‘ছেলেরা রোজগার করে বাপ—মাকে খাওয়ায়। মেয়ে রোজগেরে হলেও তাকে তো শ্বশুরবাড়ি যেতে হবে। টাকা তো তখন আর বাপের বাড়িতে দেবে না। অনি যাকে বিয়ে করছে সেও তো চাকরি করে, সে কি মাইনের টাকা বাড়িতে দিয়ে আসবে?’

‘মেয়ে যে শ্বশুরবাড়ি যাবেই এটা ধরে নিচ্ছ কেন? অনেক ছেলে ভাগনে—ভাগনি ভাইপো— ভাইঝিদের মানুষ করার জন্য যেমন আইবুড়ো থেকে যায় আজীবন তেমনি অনেক চাকুরে মেয়েও বিয়ে না করে বাপের সংসার টানে যতদিন না কোনো ভাই কি বোন রোজগার শুরু করছে।’

কৌতূহলে টান হয়ে ভারতী জিজ্ঞেস করল, ‘তার পর সে কী করে?’

হাই তুলে পুলিন বলল, ‘যদি প্রেমিকট্রেমিক থাকে তখন তাকে বিয়ে করে, নয়তো পলিটিক্স করে কিংবা কোনো গুরুর কাছে দীক্ষা নেয়। তোমাকে তো বলেছিলুম ব্রতীনের কথা, বতু বিয়ে করল আটচল্লিশ বছর বয়সে, রেখার বয়স তখন পঁয়তাল্লিশ। বোন নার্সিংয়ের চাকরি পেল, ভাই একটা প্রাইভেট ফার্মে ঢুকল তারপর ওরা রেজিস্ট্রি করল। ব্রতীন আঠারো বছর অপেক্ষা করেছিল। একেই বলে প্রেম।’ পুলিন পাশ ফিরে ভারতীকে একহাতে জড়িয়ে ধরে কথা শেষ করল, ‘তুমি বিয়ের আঠারো মাসের মধ্যেই আমাকে ভুলে গেছিলে।’

ভারতী পুলিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে বলল, ‘গেছিলুমই তো।’ পাছার উপরে ব্যস্ত পুলিনের হাতটা আঁকড়ে ধরে আবার বলল, ‘জ্বালাতন করলে আঠারো মিনিটেই ভুলে যাব।’

‘আঠারো মিনিট নয়। আট মিনিটের বেশি লাগবে না, তারপর আমাকে ভুলে যেতে হয় যেয়ো। তোমাকে তখন কী দারুণ দেখাচ্ছিল যখন বাবাকে বললে আপনি তো পারেননি ছেলেকে তৈরি করতে, আমরা পেরেছি। সারা মুখে কি তেজ, চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরোচ্ছে, নাকের পাটা ফুলে উঠেছে যেন মা দুগ্গা মহিষাসুর বধ করছে!’

‘এখন মায়ের নাম মুখে এনো না, পাপ হবে।’

অন্যদের রাতে শোয়ার সমস্যাটা জানতে ভারতী পরের দিন দোতলায় উমাদের ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজাল। দরজা খুললেন উমার মা জয়ন্তী। ভারতীকে দেখেই অবাক এবং সাদর আহ্বান, ‘আসুন, ভেতরে আসুন। কতকাল পরে দেখা পেলুম। সেই সাত—আট মাস আগে সিঁড়িতে একবার দেখা হয়েছিল তারপর এই।’

‘আমি তো বছরে তিন—চারবার বেরোই। দেখা হবে কী করে। আপনি তো রোজ টিউশনিতে বেরোন, বেশ আছেন। মাঝে মাঝে কষ্ট করে ক—টা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে এলেই তো পারেন।’ বলতে বলতে ভারতী ভিতরে ঢুকে এল। তার হাতে পুলিনের একটা পাঞ্জাবি। সেটা তুলে দেখিয়ে বলল, ‘কী মুশকিলে পড়ে গেছি ভাই, বিকেলে উনি বেরোবেন, লন্ড্রি থেকে কাচিয়ে আনা পাঞ্জাবিটা বার করে দেখি দুটো বোতাম ভাঙা, ছুঁচ সুতোর বাক্স খুলে দেখি একটাও বোতাম নেই। দোকান থেকেও যে এনে দেবে এমন কেউ নেই। উনি বেরিয়েছেন ফেরার ঠিক নেই, আর আমার শ্বশুরকে তো জানেনই।’ বাকিটা আর বলার দরকার মনে করল না ভারতী, জয়ন্তী শুধু হাসল।

‘আপনার দুটো বোতাম দরকার এই তো, বসুন, দেখছি আছে কি না।’

বসার জন্য ভারতী নিজেই ঘরে ঢুকল। এটা কাশীনাথের ঠিক নীচের ঘর। ঘরে খাট তক্তপোশ নেই, শুধু বই খাতায় ভরা একটা টেবল আর স্টিলের দুটো ফোল্ডিং চেয়ার। দেওয়ালে সাঁটা আলনা থেকে ঝুলছে শার্ট—প্যান্ট, পাজামা, লুঙ্গি। পরিপাটি ভাঁজ করা ঘরের একধারে গোটানো তোষক আর বালিশ। ভারতী বুঝে গেল তিন ভাই এখানে রাতে শোয়। বাবা—মা—মেয়ে শোয় পাশের ঘরে। একসঙ্গে? কিন্তু খাটটা তো অতবড়ো নয়! একজন তাহলে মেজেয় শোয়। কে? একটা প্লাস্টিকের বাক্স হাতে নিয়ে জয়ন্তী পাশের ঘর থেকে এলেন।

‘আপনার দুটো বোতামের একটা পেয়েছি আর একটা—’ জয়ন্তী আলনায় ঝোলানো শার্টগুলোর কাছে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বললেন, ‘নাঃ বোতামগুলো বড়ো বড়ো। আচ্ছা বসুন ওনার পাঞ্জাবিটা দেখি।’

‘না না না আপনি অত ব্যস্ত হবেন না।’ বলতে বলতে ভারতী জয়ন্তীকে অনুসরণ করে পাশের ঘরে ঢুকল। দেওয়াল থেকে হ্যাঙ্গার সমেত পাঞ্জাবি তিনি নামিয়ে ফেলেছেন।

‘গলার কাছের বোতামটা কখনো ওনাকে লাগাতে দেখিনি। এখন আপনি নিয়ে যান। কালকেই কিনে এনে আমি লাগিয়ে দেব।’ জয়ন্তী ছোট্ট কাঁচি দিয়ে বোতামের সুতো কাটতে শুরু করলেন। ভারতী আর আপত্তি করল না। একনজরে সে দেখে নিল ঘরটা। উমার বাবা সামান্য চাকরি করেন এক বিলিতি ওষুধ কোম্পানির গোডাউনে। অসচ্ছল পরিবার। ঘরের সবকিছুই বিবর্ণ, পালিশচটা, কিন্তু গুছিয়ে রাখা। খাটের নীচে তাকিয়ে যা দেখবে ভেবেছিল সেটি নেই—শতরঞ্চিতে মোড়া গোটানো তোষক। ভারতীর ভ্রু কুঁচকে উঠল।

‘শুনলাম অনীশের নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’ জয়ন্তী বললেন, স্বরে কোনো ঔৎসুক্য নেই।

‘মোটামুটি ঠিক। রোববার মেয়ের বাড়ির লোক আসবে পাকা কথা বলতে।’ ভারতী সংযত গলায় বলল।

অনির বিয়ের জন্য কথা হচ্ছে এ খবর দোতলা পেল কী করে? তারা তিনজন আর অনি ছাড়া আর কারোর তো জানার কথা নয়!

ভারতী ভাবতে শুরু করল। নিজেকে আর শ্বশুরকে শুরুতেই বাদ দিল। উনি হয়তো নীচের দোকানদারদের কাউকে বলে থাকতে পারেন। অনি সকালে বেরিয়ে রাতে ফেরে। এ বাড়ির কারোর সঙ্গে তার দেখা হয় না।

‘অনীশ বিয়ের পর এ বাড়িতেই থাকবে?’ জয়ন্তীর গলায় এবার সামান্য কৌতূহল।

‘এখানে থাকবে না তো যাবে কোথায়?’ ভারতী যথাসম্ভব বিস্মিত হল।

‘বিয়ে মানে তো একজন লোক বাড়া, ওদের জন্য আলাদা ঘরও চাই। তাই বলছিলুম অনীশ এখন অনেক টাকার চাকরি করে, হয়তো বড়ো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে অন্য কোথাও থাকবে।’

‘থাকতে চায় যদি থাকবে, কী আর করা যাবে। যাদের ছেলে আছে ঘর কম তাদেরই এই সমস্যায় পড়তে হবে। আপনাকেও কি পড়তে হচ্ছে না? তিন ছেলে এক মেয়ে আপনারা দু—জন, রাতে শোন কীভাবে?’

ভারতী উত্তরের জন্য তাকিয়ে রইল। প্রশ্নটা কথার পিঠে স্বাভাবিক করতে পেরে সে স্বস্তি পেয়েছে। জয়ন্তীকে বিচলিত দেখাল না।

‘রমু ওর বন্ধুর সঙ্গে পড়াশোনা করে রাতে ওদের বৈঠকখানাতেই শোয়। আর বাচ্চচু আমাদের পাড়ার নবজীবন সংঘের ক্লাব ঘরে শোয়, পাহারার কাজটাও হয়। ও ঘরে উমার বাবা আর তপু। এঘরে আমি আর উমা। তবে ছেলেদের বলে দিয়েছি বড়ো হয়ে বিয়েথা যখন করবে তখন কিন্তু আলাদা হয়ে সংসার পাতবে। এখানে একসঙ্গে থাকা চলবে না।’

.

যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। ভারতী উঠে দাঁড়াল, ‘যাই, এখন গিয়ে পাঞ্জাবিতে লাগাই। কালকেই আমি বোতাম দিয়ে যাব।’.

‘একদম নয়। এই সামান্য জিনিস কেউ ফেরত নেয় না ফেরত দেয়ও না। আপনি ফেরত দিলে কিন্তু আমি লজ্জা পাব।’

ভারতী হাসিমুখে ফিরে এল। শোয়ার সমস্যা এরা যেভাবে সমাধান করেছে তাদের পক্ষে সেভাবে সম্ভব নয়। একুশ নম্বর বাড়ির ভাড়াটেরা কী করে সেটা পুলিনকে দিয়ে খোঁজ করাতে হবে। সন্ধ্যাবেলায় সে রান্নাঘরে পুলিনকে ডেকে দোতলায় যা দেখে আর শুনে এসেছে তা জানিয়ে বলল, ‘একুশ নম্বরের চণ্ডীবাবু তো তোমার খুব চেনা, ওকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখো না।’

পুলিন তখনই বেরিয়ে গেল চণ্ডীবাবুকে ধরতে। একটু পরেই অফিস থেকে ফিরল অনীশ। হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ, তাতে দোকানের নাম ছাপা। ভারতী একটু অবাক হয়েই বলল, ‘আজ যে এত তাড়াতাড়ি!’

কিছুদিন হল অনীশ অফিসের ছুটির পর টালিগঞ্জে বলাকাদের বাড়ি ঘুরে শেষ মেট্রোয় বাড়ি ফিরছে।

‘এগুলো কিনতে নিউ মার্কেটে গেছলুম। দ্যাখো তো কেমন হল। দুটো বেডকভার, তোমাদের আর দাদুর খাটের জন্য, রোববার পেতে দিয়ো। পুরোনোগুলোর যা চেহারা হয়েছে। আর ফ্ল্যাটটা একটু পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন করে রেখো, রান্নাঘরটাও। বলাকার মা আসতে পারেন।’

অনীশ স্নান করতে যাওয়ার পর ভারতী বেডকভার দুটো খুলে যখন দেখছে তখন পুলিন ফিরে এল। ভারতী মুগ্ধ চোখে বলল ‘এই দ্যাখো, অনি কিনে আনল। সুন্দর না? ময়ূরগুলো কত বড়ো বড়ো, চার কোণে চারটে হরিণ সঙ্গে বাচ্চচা।’

পুলিন একটা বেডকভার হাতে নিয়ে দুই আঙুল দিয়ে কাপড় ঘষে ভারী গলায় বলল, ‘দামি, দুটো শ—পাঁচেক টাকা তো হবে, আমাদের ঘরে বেমানান, তুলে রাখো এখন, বাবার চোখে যেন না পড়ে। দেখতে পেলে খ্যাচ খ্যাচ করবে টাকার ছেরাদ্দ হচ্ছে বলে।’

অনি কলঘর থেকে বেরিয়ে ওদের দু—জনের পাশ দিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, ‘পছন্দ হয়েছে?’

‘খুব সুন্দর।’ ভারতী উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, ‘এত দামি জিনিস কিনতে গেলি কেন?’

‘ওদের দেখাবার জন্য।’

অনীশ ঘরে ঢুকে গেল। পুলিন আর ভারতী পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল বিভ্রান্তের মতো। অনীশ এখন খাটে শুয়ে সকালের দুটো ইংরেজি খবরের কাগজ উলটেপালটে দেখবে, পড়বে। তারপর নীচু স্বরে টেপ রেকর্ডারে চোখ বুজিয়ে কিছুক্ষণ শুনবে কোনো খেয়াল বা ঠুংরি। ততক্ষণ পুলিন ও ভারতী বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বা টুলে চুপ করে বসে থাকবে, কাশীনাথ তার ঘরে তখন টিভি দ্যাখে।

আজ বারান্দায় পুলিনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় ভারতী বলল, ‘চণ্ডীবাবুর কাছে গেছলে?’

পুলিন বলল, ‘গেছলুম। যা দেখলুম আমাদের পক্ষে ওভাবে থাকা সম্ভব নয়। স্বামী—স্ত্রী তিনটে ছেলে। দশ, আট আর চার বছরের। একটা মাত্র শোওয়ার ঘর। রান্নাঘরটা টালির চালের। তক্তপোশটার প্রতি পায়ায় তিনটে ইট। ওর নীচে দুটো ছেলে ঘুমোয়। ছোটটাকে নিয়ে ওরা তক্তায় শোয়। ওভাবে আমরা খাটের নীচে শুতে পারব না।’

‘কেন পারব না! তিনটে ইটের ওপর খাট থাকলে সেটা কী কম উঁচু হবে? হামাগুড়ি দিয়ে ঢোকা যায়।’

‘তুমি বেঁটে, পারবে আমি পারব না।’

‘তুমি হামাগুড়ি দেবে কেন, মেঝেয় শুয়ে একপাক গড়িয়ে গেলেই ঢুকে যাবে। খাটের তলায় বসে তো আর নাম জপ করবে না, শুধু শোবে।’

‘তাহলে বাবাকে গিয়ে তুমি বলো।’

‘আমি! পাগল হয়েছ, সেদিন বললেন কুচুটে বুদ্ধি, এবার বলবেন ডাইনি বুদ্ধি। তার থেকে তুমিই বলে দেখো।’

পুলিন আর কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইল। একটু পরে ভারতী বলল, ‘নীচের উমার মা জিজ্ঞেস করল বিয়ের পর অনি কি এ বাড়িতেই থাকবে, না বড়ো ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে অন্য কোথাও থাকবে?’ গলা আরও নামিয়ে এরপর সে বলল, ‘অন্য কোথাও থাকলে তো ভালোই। তাতে ওরও সুবিধে আমাদেরও সুবিধে।’

‘সুবিধে তো হবেই। ও যে মাপের চাকরি করে তাতে এইরকম বাড়িতে থাকা মানায় না, এতে সম্মান নষ্ট হবে । কত বাইরের লোকজন আসবে তাদের বসাবে কোথায়? যখন ছাত্র ছিল তখন বন্ধুরা এলে দাদুর ঘরে বসাত। বাবা খালি গায়ে লুঙ্গি পরে থাকত। অল্পবয়সি ছেলেরা ওদিকে তাকাতই না। কিন্তু এখন অনির স্ট্যাটাস তো অন্যরকম। ওর নিজেরই উচিত সল্টলেক ফল্ট লেকের দিকে ফ্ল্যাট ভাড়া করে চলে যাওয়া। নিশ্চয় ও ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের আগেই ভেবেছে তবু ওকে একবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জিজ্ঞেস কোরো।’

যতটা সম্ভব গলা চেপে ভারতী ঝেঁঝেঁ উঠে বলল, ‘সবসময় তুমি বলো তুমি জিজ্ঞেস করো, তোমার এই কুঁকড়ে পিছিয়ে যাওয়া স্বভাবের জন্যই ব্যবসাটা লাটে ওঠে। সেই সময় থেকেই বাবা আমাদের সঙ্গে শেয়াল কুকুরের মতো ব্যবহার শুরু করেন। ওনাকে দোষ দোব কী, কষ্ট করে রোজগারের অতগুলো টাকা যদি নর্দমা দিয়ে চলে যায় তাহলে দাগা পাবেন না? তিন ঘরের কো—অপারেটিভ ফ্ল্যাট পেয়েও পেলেন না, সেই দুঃখ কী কোনোদিন ভুলতে পারবেন?’

গলায় উঠে আসা বাষ্প চাপতে চাপতে ভারতী থেমে গেল। পুলিন অপ্রতিভ। ছাব্বিশটা বছর কেটে যাওয়ার পর, ট্রানজিসটার তৈরি করে ব্যবসায়ী হবার উচ্চচাকাঙ্ক্ষা ধুলোয় লুটিয়ে পড়ার পর, ভারতী তাকে ধিক্কার দিল। এতগুলো বছর তাহলে সে মনে মনে স্বামীকে কী চোখে দেখেছে, কত অশ্রদ্ধা করেছে? বারান্দার পাঁচিল আঁকড়ে পুলিন ভিতরে ভিতরে ধসে পড়তে লাগল। কথাগুলো এতকাল না বলে পুষে রেখেছিল কেন, সম্পর্কটা সুন্দরভাবে ধরে রাখার জন্য? আর ক—টা বছরই বা বাঁচব! ততদিন কি ভারতী তার ক্ষোভ, রাগ ধরে রাখতে পারত না।

আড়চোখে পুলিন তাকাল। রাস্তার আলো আবছা হয়ে লেগে রয়েছে ভারতীয় মুখে, শক্ত হয়ে রয়েছে চোয়াল, এক দৃষ্টে সামনে তাকিয়ে। একটি কথাও না বলে পুলিন ঘরের ভিতরে এল। অনীশ তার পায়ের শব্দ চোখ খুলে দেখে নিয়েই চোখ বন্ধ করল।

‘অনি একটা কথা ছিল।’

অনীশ এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। এমন গম্ভীর ব্যক্তিত্বপূর্ণ স্বর বাবার গলা দিয়ে বেরোতে পারে তার ধারণায় ছিল না।

‘বলো।’

‘তোর বিয়ে হলে আমি আর তোর মা শোব কোথায় সেটা ভেবেছিস?’

অনীশ আবার চোখ বন্ধ করে পাঁচ সেকেন্ড পর খুলে বলল, ‘তুমি ভেবেছ?’

ফাঁপরে পড়ল পুলিন, তারা যা ভেবেছে সেটা বলা যায় না। নিজেকে কঠিন করে নিয়ে বলল, ‘কোথায় একটা ফ্ল্যাট নিয়ে যদি থাকিস তাহলে সবারই সুবিধে হয়।’

‘এটা কি মায়েরও ইচ্ছে?’

‘হ্যাঁ, ওরও।’

‘এখন ডিসেন্ট একটা ফ্ল্যাটের ভাড়া কত জানো?’

পুলিন জানে না। ইতস্তত করে বলল, ‘কত?’

‘একটু ভালো জায়গায় পাঁচ হাজার টাকা, আটশো স্কোয়ার ফুট সাইজটা আমাদের এই ফ্ল্যাটের মতো, তাও কলকাতার কিনারে ভি আই পি, সন্তাোষপুর, বেহালার মতো জায়গায়। বলাকার অসুবিধে হবে শ্যামনগর যাতায়াতে।’

‘তোর কোম্পানি তোকে দেবে না?’

‘এখন নয়, আর এক ধাপ উঠলে পাব।’

‘কবে উঠবি?’

অনীশের মুখে বিরক্তি ফুটে উঠল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘কবে উঠব সেটা জ্যোতিষী বলতে পারবে। এই তো চাকরিতে ঢুকলুম মাস ছয়েকও হয়নি।’

‘তাহলে এখনি বিয়ে করছিস কেন?’

অনীশ উঠে বসল বিছানায়। চোখে দপ করে উঠল রাগ। তীব্র স্বরে বলল, ‘ব্যাপার কী? এভাবে কথা বলছ যে! আমার বিয়ে করায় তোমাদের আপত্তি আছে কিনা সেটা পরিষ্কার করে খুলে বলো।’

পুলিন জানত না কথায় কথায় প্রসঙ্গটা এমন জায়গায় এসে পড়বে। বিপন্ন হয়ে সে বারান্দার দরজার দিকে তাকাল। ভারতী দাঁড়িয়ে।

‘মা তোমাকেও বলছি স্পষ্ট করে বলো বিয়েতে তোমার মত আছে কি নেই?’

‘আছে। তুই বিয়ে করবি আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।’

অনীশ তাকাল তার বাবার দিকে। পুলিন মুখ কালো করে ঘর থেকে দালানে বেরিয়ে এসে খাবারের টেবলের চেয়ারে বসে পড়ল। একটু আগে ভারতীই বলেছিল আমি অন্য কোথাও থাকলে তো ভালোই। ওরও সুবিধে আমাদেরও সুবিধে। অথচ কী নির্বিকারভাবে বলল আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না। এভাবে কথা পালটে নিয়ে তার মুখ পুড়িয়ে দেবে এমনটা সে কল্পনাও করতে পারে না। পুলিন দুই মুঠোয় চুল টেনে ধরল। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল টেবলে পড়ে থাকা রঙিন পলিথিন ব্যাগটার দিকে। সে তো চেষ্টা করল কুঁকড়ে পিছিয়ে যাওয়ার স্বভাবটা থেকে নিজেকে বার করে আনতে। আনা হল না। অনি এখন থেকে কী ভাববে তার সম্পর্কে!

তার চটকা ভাঙল ভারতীর কথায়, ‘ঘরে যাও, অনিকে খেতে দোব।’

পুলিন উঠে কাশীনাথের ঘরে ঢুকল। টিভি—তে খবর পড়া হচ্ছে। খাটের একধারে বসে সে তাকিয়ে রইল টিভি—র দিকে। কানে কিছু ঢুকছে না। স্ক্রিনে কালো কালো কিছু মূর্তি নড়ে চড়ে উঠছে। পুলিন স্পষ্টভাবে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। খবর শেষ হতেই কাশীনাথ বলল, ‘সুইচটা অফ করে দে।’ কথাটা পুলিনের কানে পৌঁছল না। কাশীনাথ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘কীরে কথাটা কানে গেল? টিভি বন্ধ করে দে।’ পুলিন উঠে গিয়ে বন্ধ করল। ‘হল কী তোর?’ কাশীনাথ অবাক হয়ে বলল।

‘কিছু না।’ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে পুলিন বলল, ‘আচ্ছা বাবা, আমাকে ব্যবসার জন্য টাকাটা না দিলে আজ তুমি বেলঘরিয়ায় তিন ঘরের একটা ফ্ল্যাটে থাকতে, এর থেকে ভালোভাবে থাকতে, ঠিক কিনা।’

‘ভালোভাবে থাকতুমই তো।’

‘তাহলে আমাকে শেয়াল—কুকুর ভাবতে না, মনের শান্তি নিয়ে আজ থাকতে।’

কাশীনাথ যেন ধাঁধায় পড়ে গেল। সেইভাবে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। বাবার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে পুলিন বলল, ‘তোমার মনের শান্তি আমি নষ্ট করেছি আমার অযোগ্যতা দিয়ে।’

‘হঠাৎ এসব কথা বলছিস কেন?’

‘বলছি না, স্বীকার করছি, ছাব্বিশ বছর পর মনটাকে হালকা করলুম।’

‘এভাবে দুম করে আমি অযোগ্য বললেই কি মন হালকা হয়ে যায়? দেখবি ওই হালকা জায়গাটার আবার একটা ওজন বসে গেছে। দাঁড়িপাল্লায় পাষাণ ফেরানোর জন্য যেমন দু—দিকে সমান সমান ওজন চাপাতে হয় তেমনি মনটাকে ঠিক রাখতে শান্তি আর অশান্তি দুটোই সমানভাবে চাই।’

পুলিন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দেখে কাশীনাথ আবার বলল, ‘বুঝতে পারলি না?’

পুলিন মাথা নেড়ে বলল, ‘খানিকটা বুঝেছি।’

‘বয়স আর একটু বাড়ুক পুরোটা বুঝতে পারবি।’

অনীশ ঘরে ঢুকল, এবার সে ফোল্ডিং খাটটা পাতবে। পুলিন তার মুখের দিকে না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

পুলিনের খিদে নষ্ট হয়ে গেছে। একটা রুটি কোনোরকমে খেয়ে সে ঘরে এসে আলো নিবিয়ে খাটে শুয়ে পড়ল দেওয়ালের দিকে মুখ করে। বাইরে খাওয়ার টেবলে ভারতী। পুলিনের চোখে ঘুম নেমে আসছে। দালানে চেয়ার সরাবার, রান্নাঘরে বাসন রাখার শব্দ সে শুনল। টের পেল ভারতী ঘরে ঢুকল, আলো জ্বেলে নেবাল। বিছানায় তার পাশে শুয়ে পড়ল। অন্যদিন বাহুতে ছোঁয়া লাগে, এখন লাগছে না। ধীরে ধীরে পুলিন ঘুমের মধ্যে ডুবে যেতে লাগল।

পচা গরমে দখিনা বাতাস শরীরের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়ার মতো একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি পুলিনকে ঘুমের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে তুলে দিচ্ছে। শিশুকে আদর করার মতো মমতা—ভরা একটা হাত তার বাহু গলা ঘাড়ের উপর সান্ত্বনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। পুলিন নিশ্বাস চেপে রইল। হাতটা ভারতীর।

‘আমার কী যেন হয়েছে’ ফিস ফিস করে নিজেকে শোনাবার জন্যই যেন ভারতী আবেদনের মতো মিনতিভরা স্বরে বলে চলল, ‘তোমাকে আজ অপমানই করলুম। কটু কথা বলেছি, ছেলের সামনে মিথ্যেবাদী করে দিয়েছি। অনিকে বলে দিয়েছি বিয়ে করলে অসুবিধে হবে একথা আমিও বলেছি। কিন্তু অনি আমার ছেলে, একমাত্র ছেলে। ওর মনে আঘাত লাগুক এমন কোনো কথা ওকে বলতে পারব না, এমন কোনো কাজও আমি করতে পারব না। তুমি ভুল বুঝো না আমায়।’

ভারতী কথা বলা কয়েক সেকেন্ড থামিয়ে আবার শুরু করল, ‘বড়ো এলোমেলো অস্থির হয়ে পড়ছি। অনেকদিনের জমে থাকা রাগ আর চেপে রাখতে পারছি না। এমন কিন্তু আমি ছিলুম না। তোমাকে আজও আমি আগের মতো ভালোবাসি, ভক্তি করি। মেয়ে ছিলুম, বউ হলুম এখন মা হয়েছি। আমার বদলটাকে দয়া করে বোঝো, রাগ করতে হয় কোরো কিন্তু সেই সঙ্গে বোঝার চেষ্টাটাও কোরো।’

পুলিন নিঃসাড়ে একইভাবে ঘুমের ভান করে রইল। ভারতীর হাত তার বাহু থেকে সরে গেছে। পুলিন সুখাবেশে তলিয়ে যেতে লাগল।

.

রবিবার সকাল থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল অনীশ। পুলিন গামছা মাথায় জড়িয়ে সিলিঙের কোনা থেকে ঝুল ঝাড়ল, পাখার ব্লেডে জমা ঝুল পরিষ্কার করল, দালানের মেঝেয় সোডা ছড়িয়ে ঝাঁটা দিয়ে ঘষল, ন্যাতা দিয়ে মুছে দিল ভারতী। বেডকভার দুটো বিছানায় পাতবে বলে বার করল পুলিন। অনীশ তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘এখন নয় ময়লা হয়ে যাবে, বিকেলে পাঁচটায় ওরা আসবে তার আগে পাতবে।’ সকলের উৎসাহ কর্মতৎপরতার সঙ্গে শামিল হবার চেষ্টা কাশীনাথের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। কোথায় কী নোংরা জমে, কোনটা অগোছালো, ফোল্ডিং খাটটা বারান্দায় বার করে দেওয়া, চারতলার প্রণববাবুর থেকে দুটো বেতের চেয়ার চেয়ে আনা ইত্যাদি নির্দেশ ও পরামর্শ দিতে দিতে বলল, ‘ওদের তো জলখাবার দিতে হবে, কী খেতে দেওয়া হবে?’

পুলিন বলল, ‘রাজভোগ সন্দেশ শিঙাড়া, আবার কী?’

কাশীনাথ বলল, ‘বাজার থেকে এনে তোর শ্বশুরকে তাই দিয়েছিলুম, এদেরও কী তাই দেওয়া যায়!’

পুলিনের মাথায় ‘এদেরও কী’ কথাটা ধাক্কা দিল। সে কথাটা কঠিন করে বলল, ‘কেন এরা কী? লাটসাহেব? মেয়ের বাড়ির লোক তো, তবে?’

কাশীনাথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই ভারতী বলল, ‘খাবার কীসে করে দেবে? ভালো কাপ ডিশ গেলাস চামচ তো নেই, প্লেটও নেই। স্টিলের প্লেটে কী ওদের খেতে দোব, না ওই মোটা কাচের গেলাসে জল দোব? আগে ওগুলো কিনে আনো তবে খাবারের কথা ভাবো।’

পুলিন উদবিগ্ন হয়ে অনীশকে বলল, ‘আজ রোববার সব জায়গায় দোকান বন্ধ, তুই এখুনি শ্যামবাজারে যা, মনে হয় পেয়ে যাবি।’

অনীশ বেরিয়ে পড়ল তখনি। সিঁড়ি দিয়ে সে নেমে যাচ্ছে তখন ভারতী ছুটে দরজার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘অনি দুশো গ্রাম চা আনিস আড়াইশো টাকা কিলোর।’

দালানে দাঁড়িয়ে পুলিন ইলেকট্রিক বালবের কাচের শেডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওটা পরিষ্কার করা হল না।’

ভারতী বলল, ‘থাকগে, অত কেউ নজর করবে না। আর শোনো বগলা থেকে মিষ্টি এনো না, মিঠাইরাজার মিষ্টি অনেক ভালো। ক্ষীরের চন্দ্রপুলিটা যদি পাওয়া যায় তা হলে অবশ্যই এনো।’

মেট্রোর গিরিশ পার্ক স্টেশনে অপেক্ষা করছিল অনীশ। তিনজন এসেছে, বলাকার বাবা শিবেন, মা গীতা আর ছোটোবোন বিশাখা। তিন মিনিট হেঁটেই তারা গুহ ভবনে পৌঁছে যায়। কাশীনাথ আর পুলিন পাটভাঙা ধুতি আর পাঞ্জাবি এবং ভারতী চওড়া জরি পাড় বুটিদার সাদা টাঙ্গাইল পরে তিনজনকে অভ্যর্থনা জানিয়ে কাশীনাথের ঘরে নতুন বেডকভার পাতা খাটে এবং বেতের চেয়ারে বসাল। বালিশগুলো উঁচু হয়ে রয়েছে বেডকভারের নীচে। জিনস আর কালো টি শার্ট পরায় অনীশকে যেন আরও ফরসা দেখাচ্ছে। সে ওদের পরিচয় করিয়ে দিল বাবা মা দাদুর সঙ্গে।

কাশীনাথ কথা শুরু করল, ‘আসতে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?’

‘না না কিচ্ছু অসুবিধে হয়নি।’ শিবেন দ্রুত জবাব দিলেন, ‘মেট্রো হয়ে খুব সুবিধে হয়েছে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আপনাদের এখানে পৌঁছতে ঠিক পঁয়ত্রিশ মিনিট লাগল, বাসে এলে কম করে পঞ্চাশ মিনিট তো লাগতই।’

‘উইক ডে হলে লাগবে এক ঘণ্টা।’ পুলিন নিজেকে কথাবার্তার মধ্যে ঢুকিয়ে নিল। ‘আপনারা সাউথ ক্যালকাটায় কতদিন আছেন?’

‘টালিগঞ্জে বাড়ি করেছি বছর দুই, তার আগে পাঁচ বছর ছিলাম চেতলায়, তার আগে আসামে। বলাকা কলেজে আর ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে কিন্তু কলকাতায়।’

গীতা বললেন, ‘বেকবাগানে আমার মেজদার বাড়িতে থেকে পড়ত। আমার বাপের বাড়ি কলকাতায়, আপনাদের বাড়ি থেকে বেশি দূর নয় আহিরিটোলায়।’

‘তাই নাকি!’ কাশীনাথ উৎসাহিত হল, ‘আহিরিটোলার কোথায়?’

‘বি কে পাল পার্কের উলটোদিকে।’

ভারতী লক্ষ করছিল ওদের হাবভাব কথা বলার ধরন, তার ভালো লাগল। বলার ভঙ্গিতে গেরস্থালি ঢঙ, নাক উঁচু ভাব নেই। যেটার সে আশঙ্কা করেছিল অনির সমীহ করে ওদের সম্পর্কে কথাবলা থেকে। এখন তার মনে হচ্ছে নিজেদের অত খাটো করে ভাবার কোনো দরকার নেই। স্বচ্ছন্দ বোধ করে সে বলল, ‘কলকাতার এদিককার লোক পেলে বাবার আর কথা নেই, খালি পুরোনো দিনের গল্প করে যাবেন আর বলবেন কী ছিল আর কী হয়েছে।’

‘এদিককার লোক বলতে কিন্তু শুধু আমি একাই। উনি আর আমার মেয়েরা কিন্তু নয়। ওরা উত্তর কলকাতা একদম চেনে না।’

ভারতী হাসিমুখে বলল, ‘মামার বাড়িতে তো গেছে।’

গীতা বলল, ‘ছোটোবেলায় কয়েকবার গেছে, দু—দিনের বেশি থাকেনি। এত লোক আমাদের বাড়িতে, তিন ভাইয়ের এগারোটি ছেলেমেয়ে, থাকার জায়গা কোথায়! তাও তো মেজদা থাকত না।’

ভারতী কৌতূহলী হল, ‘কোথায় থাকতেন?’

উত্তর দিলেন শিবেন, ‘মেজোশালা প্রথম চাকরি নিয়ে যান সুইজারল্যান্ডে। আট বছর সেখানে থেকে যান জার্মানির বায়ার্স কোম্পানিতে, সেখানেও ন—বছর কাটিয়ে ছ—বছর আগে ফিরে এসে জয়েন করেন এই স্টান্ডার্ড পেইন্টসে। ইস্টার্ন রিজিয়নে মার্কেটিঙের টপম্যান এখন। উনিই তো অনীশকে সিলেক্ট করেন।’

বিশাখা চুপ করে বসে আছে দেখে অনীশ বলল, ‘মামা, মামার বাড়ি, মেজদা এসব তো হল, জানো মা বিশাখার নজরুলের গানের ক্যাসেট বেরিয়েছে!’

‘ওমা, তাই নাকি!’ ভারতী সত্যিই অবাক হল। ‘কই আমাকে তো তুই আগে বলিসনি। নজরুলের গান আমার ভীষণ ভালো লাগে। ছোটোবেলায় রেডিয়োয় নজরুলগীতি হলেই শুনতে বসে যেতুম, অনি ওর ক্যাসেট কিন্তু আমায় শোনাবি।’

কাশীনাথ এবার বলল, ‘আমাদের স্কুলে নন্তু বলে একটা ছেলে ছিল খুব নজরুলের গান গাইত। তখন রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার এত চল ছিল না।’

পুলিন অনেকক্ষণ কথা বলেনি। এবার তার মনে হল একটা কথা সে বলতে পারে। ‘বাবা কিন্তু ভালো তবলা বাজাতেন। ছোটোবেলায় একবার দেখেছি পাড়ায় লক্ষ্মীপুজোর জলসায় বাবা সংগত করেছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের গানের সঙ্গে।’

‘ওরে বাব্বা, তাহলে তো উনি খুবই ভালো বাজাতেন।’ শিবেন বললেন।

কাশীনাথ মুখে হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘ছেলে বাপের প্রশংসা তো করবেই। আমি খুব ভালো বাজাতুম না, ইচ্ছে ছিল খুব বড়ো তবলচি হব। বউবাজারে কেরামত উল্লা খাঁ সাহেবের কাছে যেতুম, মসিত খাঁর ছেলে, ফারুকবাদ ঘরানার স্টাইল আর টেকনিক গিলে খেয়েছিলেন। কিন্তু আমার যা চাকরি তাতে ওর উগরে দেওয়া জিনিস চেটে নেওয়ারও টাইম পেতুম না। শেষকালে রেওয়াজ ছেড়ে দিলুম, একসময় তবলাটাও ভুলে গেলুম।’

কাশীনাথের হাসিটা যে কষ্টের হাসি পুলিন এবং ঘরের সকলেই বুঝতে পারল। ভারতী তার শ্বশুরকে একটা নতুন ভূমিকায় দেখতে পেল। মানুষটির এই গুণের কথা তিরিশ বছরেও সে জানত না এমনকী পুলিনও কখনো তাকে বলেনি। থিয়েটারের পর্দার মতো ধীরে ধীরে তার অশ্রদ্ধা বিতৃষ্ণা সরে গিয়ে মঞ্চে কাশীনাথকে সামনে এনে দিল নায়ক চিহ্নিত করে। ঘরের সবাই ঘোর কৃষ্ণবর্ণ অষ্টআশি বছর বয়সি শীর্ণ লোকটির উপস্থিতিকে আর অগ্রাহ্য করতে পারছে না।

এবার বিশাখা বলল, বলার জন্য উপযুক্ত কারণ ছাড়াই, ‘ছোটো মামার শালির কবিতার বই গত বছর সাহিত্য আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে।’

পুলিন বলল, ‘তাই নাকি!’

কবিতার বই বা অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড ঘরের কাউকে আকর্ষণ করল না। অনীশ বলল, ‘মা এবার একটু চায়ের ব্যবস্থা করো।’

শিবেন বলে উঠলেন, ‘শুধু চা কিন্তু সঙ্গে টা নয়।’

গীতা বললেন, ‘আজ বেলায় খাওয়া হয়েছে একদম খিদে নেই।’

ভারতী অনুযোগ মিশিয়ে বলল, ‘প্রথম এলেন মিষ্টিমুখ করাব না তাই কী কখনো হয়। বসুন।’

শিবেন বা গীতা আর কথা বাড়াল না। ওদের মুখ দেখে ভারতীয় মনে হল ঘর পছন্দ হয়েছে, ওরা এখানে মেয়ে দেবে। ঘর থেকে তার সঙ্গে অনীশও বেরিয়ে এল। রান্নাঘরে বাক্সে আর ভাঁড়ে মিষ্টি রয়েছে। নতুন কেনা প্লেটে অনীশ সেগুলো সাজাতে লাগল, ভারতী চায়ের জল চড়াল বার্নারে।

‘আমার তো বেশ ভালোই লাগল।’ ভারতী বলল। ‘ক—দিন ধরে তুই যা বলছিলিস ভাবছিলুম না জানি কী। হ্যাঁরে বলাকার মামা তোকে চাকরি দিয়েছে বলল, কই সেটা তো আমাদের জানাসনি!’

‘এটা কী একটা জানাবার মতো কথা! চাকরি দেবে আবার কী? এটা কর্পোরেট কোম্পানি, কারোর নিজের ব্যবসা নয় যে ধরাধরি করলেই চাকরি দিয়ে দেবে।’

ছেলের গলার স্বরে বিরক্তি আর ঝাঁঝ দেখে ভারতী অনুতপ্তের মতো বলল, ‘সিলেক্ট করেছে বলল কি না, তাই বললুম।’

‘ও নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। এদিকে দেখো ঠিকঠিক দেওয়া হল কি না।’

ভারতী তিনটে প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। তুই দুটো প্লেট নে আমি বাকিটা নিচ্ছি। পরে জলের গ্লাস নিয়ে যাব। ততক্ষণ চা—টা ভিজুক।’

‘একটা ট্রে থাকলে ভালো হত, তখন বললে না কেন কাপ ডিশের সঙ্গেই কিনে আনতুম।’

প্লেট হাতে ঘরে ঢোকার সময় ভারতী শুনল শিবেন বলছেন, ‘মেজোশালা ভীষণ ভালোবাসে বলাকাকে, অনীশের কথা তো উনিই আমাদের বলেন। মেজদাই তো ওকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসে আলাপ করিয়ে দিলেন। বলাকার সঙ্গে তো অনীশের পরিচয় হল তখনই।’

ভারতী তার প্লেট গীতার হাতে দেবার জন্য বাড়িয়ে ধরল, ‘একি এত মিষ্টি!’ বলে গীতা আঁতকে ওঠার ভান করল।

শিবেন আর বিশাখার হাতে প্লেট না দিয়ে অনীশ খাটের উপর রেখে বলল, ‘টেবল থাকলে চলাফেরার অসুবিধে হবে বলে রাখিনি। বিশাখা একটাও ফেলে রাখবে না।’

গীতা বললেন, ‘খুকু মিষ্টি খেতে ভালোবাসে।’

শিবেন প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কোথাকার মিষ্টি, দেখছি সীতাভোগ রয়েছে।’

পুলিন বলল, ‘হ্যাঁ, আপনার দেশের। এখানকার একটা দোকান তৈরি করে আর চন্দ্রপুলিটা আমাদের এখানকার। খেয়ে দেখুন কলকাতার আর কোনো জায়গায় এমন টেস্টফুল চন্দ্রপুলি পাবেন না।’

শিবেন চামচ দিয়ে চন্দ্রপুলির একটা কোনা ভেঙে মুখে দিয়ে চোখ বন্ধ করে চিবিয়েই চোখ খুলে বললেন, ‘চমৎকার’। স্ত্রীকে বললেন, ‘খেয়ে দেখো, খুকু তুই আগে এটা খা।’

পুলিন আর চুপ করে থাকতে পারল না, বলল, ‘এটা কিন্তু আমি পছন্দ করে এনেছি। অনি মিঠাইরাজা থেকে কিনে যাবার সময় ওদের দিস।’

‘না না, কিনে দিতে হবে না,’ ‘শিবেন আপত্তি করে উঠল। ‘আমরা কিনে নোব।’

ভারতী আরও চন্দ্রপুলি নিয়ে এল। প্রত্যেকের প্লেটে দুটি করে দিয়ে বলল, ‘অনি কিনে দেবে আমার তরফ থেকে বলাকার জন্য।’ এই বলে সে চা আনতে গেল, সঙ্গে গেল পুলিন।

‘ভদ্দরলোক তখন কী যেন বলছিল? অনির কথা নাকি বলাকার মেজোমামাই ওদের বলেন? ‘ ভারতী চা কাপে ঢালতে ঢালতে বলল, ‘হঠাৎ একথা উঠল যে?’

‘বাবাই জিজ্ঞেস করল অনির খবর আপনারা পেলেন কী করে তাইতেই উনি এটা বললেন। তুমি কী ভেবেছ ওপরওলার ভাগনি বলে অনি বিয়ে করতে রাজি হয়েছে, পরে উন্নতি করে দেবে?’

পুলিন মাথা নাড়ল। ‘অনি ভালোবেসেই বিয়ে করছে, মেয়েটার গুণ অনেক।’

অনীশ রান্নাঘরে এসে বলল, ‘হয়েছে? আমাকে দুটো কাপ দাও। আর একটু দুধ দাও, ওরা বেশি দুধ দিয়ে খায়। বাবা বেশ ভালোই মিষ্টি কিনে এনেছে, তবে রাজভোগ কেউ খায়নি।’

ভারতী বলল, ‘গোটা দশেক চন্দ্রপুলি কিনে দিস।’

বিয়ের প্রস্তাব দিলেন গীতা। ‘আমরা সামনের মাঘেই ওদের বিয়ে দিতে চাই।’

শিবেন বললেন, ‘ও মাসে পাঁচটা বিয়ের দিন আছে। একুশ তারিখ রবিবার পড়ছে। মেজোশালা মঙ্গলবার কুয়ালালামপুর চলে যাবেন, সেখান থেকে ব্যাঙ্কক হয়ে ফিরতে ফিরতে দিন পনেরো হয়ে যাবে। ওর যাবার আগেই শুভ কাজটা সেরে ফেলতে চাই।’

খাটের একধারে চুপচাপ পা ঝুলিয়ে এতক্ষণ বসেছিল কাশীনাথ। কথাবার্তায় অংশ নেয়নি। হঠাৎ সে বলে উঠল, ‘আপনার মেজোশালা ফিরে আসুক, তখনই বিয়েটা ফাল্গুন মাসে হবে।’

সবাই তটস্থ হয়ে তাকাল তার দিকে। কাশীনাথের গলার স্বর রূঢ়, তার তাকানোটাও গোঁয়ারের মতো। যেন ইচ্ছে করেই নিজের কর্তৃত্ব দেখাবার জন্য চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

‘কেন মাঘে হলে অসুবিধে কী?’ পুলিন বলল।

‘আমার বিয়ে ফাল্গুনে হয়েছে, তোর বিয়েও ফাল্গুনে হয়েছে, অনির বিয়েও ফাল্গুনে হবে।’

কথা হুকুম দেওয়ার মতো ঘোষণা করে কাশীনাথ উঠে দাঁড়াল। সবার অবাক হওয়া মুখের উপর চোখ বুলিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, ‘বরের বাড়ি যেমন চাইবে তেমনভাবেই বিয়ে হবে।’

কাশীনাথ ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে ইতস্তত করে সিঁড়ি ধরে ছাদে উঠে গেল।

প্রথম কথা বলল ভারতী। ‘ওনার বয়স হয়েছে, শরীরটাও ভালো নেই, আপনারা কিছু মনে করবেন না। বিয়ে মাঘ মাসেই হবে।’

পুলিনও বলল, ‘হ্যাঁ, মাঘ মাসেই হবে, ছেলের বাবা হিসেবেই বলছি।’

‘না না আমরা কিছু মনে করছি না। বুড়োমানুষ অনীশের কাছে শুনেছি আশি পার হয়েছেন এই বয়সে উলটোপালটা কথা বলতেই পারেন।’ শিবেন সান্ত্বনা দেবার মতো করে বললেন।

ভারতী হাত ধরল গীতার। ‘আসুন, বিয়ের পর অনিরা যে ঘরে থাকবে সেটা এখনও আপনার দেখা হয়নি।’

পাশের ঘরে বিশাখা আর গীতা এসে চোখ বুলিয়ে দেখে খাটে বসল।

গীতা বলল, ‘ও ঘরের থেকে মনে হচ্ছে এটা যেন বড়ো।’

‘হ্যাঁ, দু—দিকেই দু—ফুট করে বড়ো। আমার বিয়ে হতে আমি এই ঘরটা পেয়েছিলুম, এবার পাবে বলাকা।’

আচমকা বিশাখা বলে উঠল, ‘তা হলে আপনারা থাকবেন কোথায়, আর কোনো ঘর আছে?’

সঙ্গে সঙ্গে ভারতী বলল, ‘ছাদে একটা খালি ঘর আছে, সেটা ভাড়া নেবার কথা হচ্ছে।’

পরে ভারতী ভেবে দেখেছিল, এমন একটা মিথ্যা কথা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরোল কেন! ওদের চোখে ছোটো হয়ে যাওয়ার ভয়ে? ছোটো হয়ে যাবে অনীশ সেইজন্য? ছাদের ঘরের কথা বলে তখনকার মতো সামাল দিয়ে সে অনেকটা ভরসা এই ভেবে পায় যে, ওরা নিশ্চয় ছাদ দেখতে যাবে না। ছাদে কোনো ঘর নেই।

‘ঘরটা অনেক দিন মনে হয় পেইন্ট করা হয়নি, ইলেকট্রিক অয়ারিং বদলানোও দরকার। গদিটা কত দিনের মাসিমা?’

ভারতীর মনে হল মেয়েটি ইচ্ছে করেই তাদের প্রাচীনত্ব নিয়ে খোঁচা দিয়ে বলল, আরও হয়তো বলত, হাতে মায়ের একটা চিমটি পেয়ে চুপ করে গেল। কাশীনাথের একগুঁয়েমিরই পালটা প্রতিক্রিয়া এগুলো।

পুলিন এসে তাগিদ দিল, ‘শিবেনবাবু ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যাবার জন্য।’

যাবার সময় ভারতী আবার বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। শ্বশুরকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়, যত বয়স বাড়ছে ছেলেমানুষ হয়ে যাচ্ছেন।’

শিবেন বললেন, ‘ছেলেমানুষ হয়ে যেতে পারা তো ভাগ্যের কথা। আমি রোজ চেষ্টা করি ছেলেমানুষ হয়ে যেতে, পারছি কই।’ বলেই হেসে উঠে পরিবেশ হালকা করতে চাইলেন।

গীতা এতক্ষণে বুঝে গেছেন আসল কথাবার্তা কার সঙ্গে বলতে হবে; তাই ভারতীর হাত ধরে তিনি বললেন, ‘বিয়ের তারিখ ঠিক করে পরে জানিয়ে দোব। কিছু নেবেন না বললে আমরা কিন্তু শুনব না। আমার তিন মেয়ে। বুঝতেই পারছেন দায় সামনে কতটা, তাহলেও বড়ো মেয়েকে যতটা পারি সাজিয়ে দোব। খাট আলমারি না নিলেও ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন দুই মেয়ে তাদের দিদিকে বলে নিশ্চয় আপত্তি করবেন না। অনীশকে আমি বুঝিয়ে রাজি করাব।’

মাথা হেলিয়ে চওড়া হাসি ছাড়া ভারতী আর কোনোভাবে সম্মতি জানাতে পারল না। সে দেখল গীতা চোখের ইশারায় তার পা দেখিয়ে বিশাখাকে প্রণাম করতে ইঙ্গিত করছেন। সে পরপর পুলিন ও ভারতীকে প্রণাম করে বলল, ‘আমি কিন্তু আবার আসব, মাসিমা মেসোমশাই আপনারাও যাবেন আমাদের বাড়িতে।’

পুলিন আপ্লুত। অনীশকে বলল, ‘ওদের সঙ্গে যা, ট্রেনে তুলে দিয়ে আয়।’

ভারতী সিঁড়ির মাথা পর্যন্ত এসে দাঁড়াল। যতক্ষণ পায়ের শব্দ পাওয়া যায় শুনে ফিরে এসেই পুলিনকে বলল, ‘একবার শিগগিরি রাস্তাটা দেখে এসো, বাবা কোথায় গেলেন, খুঁজে দেখো।’

ব্যস্ত উদবিগ্ন পুলিন পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল, ভারতী কাপ ডিশ প্লেটগুলো রান্নাঘরের বেসিনে রেখে বারান্দায় এসে ঝুঁকে যতদূর সম্ভব সদ্য সন্ধ্যার এবং ম্লান রাস্তার আলোয় দেখা যায় দু—দিক তাকিয়ে শ্বশুরকে খোঁজার চেষ্টা করল। দেখল পুলিন সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর মোড়ে দাঁড়িয়ে এধার—ওধার তাকিয়ে বাবাকে খুঁজছে।

ভারতীর মন হল কাশীনাথ রাস্তায় নেই। সে পাঁচ তলার ছাদে উঠে এল। চৌকো ছাদ, তার এককোণে ইটের চারটে পায়ার উপর লম্বা জলের ট্যাঙ্ক। একতলা থেকে পাম্পে জল তুলে রাখা হয়। ছাদে আর আছে দুটো টিভি অ্যান্টেনা, এর একটা কাশীনাথের অন্যটা চারতলার এক গুজরাটি পরিবারের। ভারতী শ্বশুরকে বলেছিল, ‘মাসে নব্বুই টাকা। বাবা কেবল কানেকশানটা নিয়ে নিন না, সবাই তো নিয়েছে। অনেক রকমের জিনিস, খেলা, সিনেমা দেখতে পাবেন।’

‘সবাই নিলেই কী আমায় নিতে হবে। কাজকম্ম সিকেয় তুলে তখন তুমিই তো সিনেমা দেখতে বসে যাবে, তাও রক্ষে ঘরে পড়াশুনোর পাট নেই। দোতলার ওদের তো টিভি নেই, ছেলেমেয়েরা পড়াশুনো করে বলে নেই।’

ভারতী ছাদে ট্যাঙ্কের গা ঘেঁষে রাস্তার দিকের পাঁচিলে হাত রেখে কাশীনাথকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। এই রাস্তায় তাদের ছাদটিই পাঁচতলায়। অনেকদূর পর্যন্ত চোখ গিয়ে সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর ওপারে পাশাপাশি দুটো ছ—তলা বাড়িতে দৃষ্টি রাখা যায়। বিস্তৃত একটা শূন্যতা, নেমে আসা হেমন্ত সন্ধ্যার ঘোলাটে আলো, তার পটভূমিতে সাদা পাঞ্জাবি পরা শীর্ণ চেহারাটিকে ভারতীর মনে হল চারদিক থেকে তাড়াখাওয়া বেড়ালের মতো কাশীনাথ একটা কোণে আশ্রয় নিয়েছে আত্মরক্ষার জন্য। কাশীনাথের শরীরটা যদি একটু নড়ে উঠত তা হলে সে অন্যরকম ভাবত। বৃদ্ধ মানুষটিকে তার অন্তত আশ্রয়প্রার্থী মনে হত না।

‘বাবা, হিম পড়বে, ঠান্ডা লাগবে নীচে আসুন, ওরা চলে গেছে।’

মন্থরভাবে কাশীনাথ ঘুরে দাঁড়াল।

‘আমি কি খুব অসভ্যতা করলুম?’

ভারতী উত্তর দিল না।

‘আমার জন্য অনির বিয়ে কি ভেঙে যাবে?’

‘না।’

‘তোমার বাবা কিন্তু হাত জোড় করে আমার কাছে এসেছিলেন।’

‘তখন ওটাই রীতি ছিল, সময় তো বদলে গেছে।’

‘কতটা বদলেছে?’

‘আজ তো দেখলেনই। বাবা, এদের কাউকে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। আপনি একটা সময়ের, এরা আর একটা সময়ের।’

‘তুমি মধ্যিখানের সময়ের!’

‘হ্যাঁ। এবার নীচে আসুন।’

‘কয়েকটা কথা বলার আছে বউমা, খুব গুরুতর কিছু নয়, চলো নীচে যাই।’

ফিরে এসে ভারতী বলল, ‘চা খাবেন? অনি ভালো চা এনেছে।’

‘এদের জন্য এনেছে, অন্য দিন তো আনে না! এই ব্যাপারটাই বলতে চাই। দুপুর থেকে তোমাদের মধ্যে এমন একটা ভাব দেখলুম যেন বাড়িতে লাটসাহেব আসবে। ঘরদোর পরিষ্কার কী নতুন চাদর পাতা, কাপ ডিশ কেনা, চা কেনা এসব ঘরের লোকের জন্য তোমরা করো না। ভাবতে ভাবতে মাথাটা গরম হয়ে উঠেছিল, তখনই লোকটা বলল, ওর মেজোশালা অনিকে সিলেক্ট করেছে। তার মানে তার অনুগ্রহেই চাকরিটা পেয়েছে। শুনেই মনে হল বুঝিয়ে দেওয়া দরকার চাকরি দিয়ে মাথা কিনে নাওনি।’

ভারতী বলল, ‘বাবা শিবেনবাবু কিন্তু মাথা কিনে নেওয়ার মতো করে কথা বলেননি, বেশ ভদ্র বিনয়ীই তো দেখলুম। বসুন চা করে আনি।’

চা করছিল ভারতী তখন ফিরে এল পুলিন। ঘরে উঁকি দিয়ে টিভি চালিয়ে কাশীনাথকে বসে থাকতে দেখে তার চোখ বিরক্তিতে ভরে গেল।

‘কোথায় গেছলে তুমি? গোরু খোঁজার মতো এধার—ওধার ছাতুবাবুর বাজার পর্যন্ত ঘুরে এলুম।’ গলা চড়ে গেল পুলিনের, ‘আমাদের সঙ্গে যা করো তা করো সেটা ওদের সঙ্গে করতে গেলে কেন? কীরকম ছোটোলোক ভাবল আমাদের, ছি ছি লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল।’

কাশীনাথ টিভি বন্ধ করে দিল। দেওয়ালে হেলান দিয়ে খাটে পা ছড়িয়ে বসল। ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বলল, ‘লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল? কই তোর মাথাটা তো দেখছি ঘাড়ের ওপর ঠিকই রয়েছে।’ চোখ পিট পিট করল কাশীনাথ।

এমন হালকা কথার কী জবাব দেবে ঠিক করতে না পেরে পুলিন বলল, ‘এটা ফাজলামো করার মতো ব্যাপার নয়। তোমাকে সামনে রেখে ভদ্রলোকদের সঙ্গে কথা বলা যায় না। কী কুক্ষণেই যে তোমার ছেলে হয়ে জন্মেছিলুম।’

কাশীনাথের চোখ দুটি স্থির হয়ে গেল। গাঢ় হয়ে উঠল মণি। চশমার পুরু কাচ ভেদ করে ধিক্কার আর ঘৃণার মতো চাহনি বেরিয়ে আসছে।

‘হাঁ কুক্ষণেই, তবে তুই নয় আমি। কী কুক্ষণে তোকে জন্ম দিয়েছি সেটাই ভেবে আসছি যেদিন তুই বললি বাবা ব্যবসা আর চালাতে পারছি না, দোকানটা তুলে দোব। মনে পড়ে? মাত্র দু—বছর চালালি।’

পুলিনের অন্তরাত্মা কেন্নোর মতো গোল হয়ে গুটিয়ে গেল বাবার কথার ছোঁয়ায়। সে জানে এবার শুনতে হবে, আমার টাকা শোধ করে দিবি বলেছিলিস। পঁচিশ বছর হয়ে গেল একটা আধলাও শোধ করতে পারিসনি। দোকানটা একটা মেড়োকে ভাড়া দিয়েও আজও তুই বসে বসে ভাড়ার টাকা খাস।

‘কী রে পুলিন, মাথাটা তো দেখছি এখনও ঘাড়ের ওপর ঠিক রয়েছে, বাবুর চুলে আবার টেরি কাটা!’ এরপরই গলার স্বর বদলে গেল, ‘হারামজাদা, তোর জন্য আজ আমার এই দুরবস্থা। ছোটোলোক বানিয়েছিস তো তুই, সংসারটাকে গরিব করেছিস তো তুই। কোথায় শোব এই সমস্যায় আজ কী পড়তে হত তোকে?’

চা নিয়ে আসছিল ভারতী, শ্বশুরের গলা শুনে থমকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে পড়ল, পুলিন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ভারতীর মুখের দিকে একঝলক তাকিয়ে দালানে চেয়ারে বসল দু—হাতে মুখ ঢেকে। চা নিয়ে ঘরে ঢুকল ভারতী, থমথমে মুখ।

‘টেবিলে রেখে যাও।’

কাপটা রেখে বেরিয়ে এসে সে দেখল পুলিন ফোঁপাচ্ছে। ভারতী তার পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে আলতোভাবে মাথায় হাত রাখল। পুলিন মুখ তুলল, চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে।

‘আমি আত্মহত্যা করব। সত্যিই অপদার্থ! বেঁচে থাকার মানে হয় না।’

ভারতী এর আগেও স্বামীর মুখে এমন কথা শুনেছে। সে শুধু পুলিনের মাথায় হাত রেখে নীরবে দাঁড়িয়ে রইল।

তার মতো আর কেউ জানে না দুটো বছর ধরে পুলিন নিরন্তর কী পরিশ্রম করে গেছল।

একবার হতাশ হয়ে পুলিন বলেছিল, ‘এত কম টাকা নিয়ে এমন ব্যবসা দাঁড় করানো যায় না। পাঁচ—ছ লাখ টাকা নিয়ে নামলে কলকাতার বাইরে গ্রামের দিকে বিক্রি হবার তবু একটু আশা থাকত। বড়ো বড়ো কোম্পানি কী সুন্দর সুন্দর ক্যাবিনেটে কম দামে ট্রানজিস্টার বিক্রি করছে সারা দেশ জুড়ে। এদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যায় না।’

আর একদিন বলেছিল, ‘এবার দোকানটা বন্ধ করে দোব, গত তিনদিনে চারটে মাত্র বিক্রি হয়েছে। দুটো মাত্র মেকানিক, মাইনে দিতে পারিনি তাদের। কতদিন আর বাবার টাকা দিয়ে চালাব।’

পুলিন ব্যবসার কথা ভারতীর সঙ্গে আলোচনা প্রথম দিকে করত তারপর আর করত না। ভারতীও ঔৎসুক্য দেখাত না, কী খারাপ খবর শুনতে হবে এই ভয়ে। অবশেষে একদিন রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়ার পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিশ্চিন্ত স্বরে পুলিন বলেছিল, ‘বন্ধ করে দিয়ে এলুম, পাকাপাকি। তোমার নামে ব্যবসা, ঘরটা ভাড়াও নেওয়া তোমার নামে, চাবি তোমার কাছে রেখে দিয়ো। ভাড়া তিন মাসের বাকি।’

শুনেই কেঁপে গেছল ভারতীর বুক। অস্ফুটে বলেছিল, ‘একেবারে বন্ধ করে দিলে?’

‘হ্যাঁ, দেনা বাড়িয়ে লাভ কী?’

‘চেষ্টা করে দেখো না।’

‘নাহ, হবার নয়।’

দু—দিন পর কাশীনাথ ভারতীকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পুলিন ঘরে বসে কেন, বেরোবে না?’

ক্ষীণস্বরে ভারতী বলেছিল, ‘শরীর ভালো নয়, জ্বরজ্বর লাগছে।’

তিন—চার দিন পর কাশীনাথ রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘জ্বর কি এখনও সারেনি?’

ভারতী আর মিথ্যা বলার সাহস পেল না, বলল, ‘ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। দোকান আর খুলবেন না।’

কাশীনাথ বজ্রাহতের মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে গিয়ে গুম হয়ে বসে থাকে। তিন—চার দিন সে কারোর সঙ্গে কথা বলেনি। ভারতী দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করে কবে কাশীনাথ ফেটে পড়বে। ফেটে পড়েনি। সকালে সে বেরিয়ে যায় দুপুরে ফিরে ভাত খেয়ে ঘুমিয়ে আবার বিকেলে বেরিয়ে রাত্রে ফেরে। কোথায় যায় কী করে কেউ জানে না।

একদিন একটি লোক এসে পুলিনকে খুঁজল। ফ্ল্যাটের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে লোকটির সঙ্গে দু—চারটা কথা বলেই সে ঘরে এসে প্যান্ট পরতে লাগল বেরোবার জন্য। ভারতী জিজ্ঞাসা করল, ‘কোথায় বেরোচ্ছ?’

‘স্বরূপ পোদ্দার কথা বলতে চায়, লোক পাঠিয়েছে যাই শুনে আসি কী বলে।’

ঘণ্টাখানেক পরে পুলিন ফিরে আসে। ভারতী জিজ্ঞাসু চোখে শুধু তাকিয়ে থাকে। পুলিনের মুখে চোখে উদ্দীপনার ছোঁয়া দেখে তার মনে হল কিছু একটা ভালো খবর সে দেবে। হাওয়াই শার্ট খুলতে খুলতে পুলিন বলল, ‘ব্যবসায়ী বটে। ঠিক নজর রেখেছে আমার দোকান ঘরটার দিকে। ক—দিন বন্ধ দেখেই বুঝেছে আমি আর বোধহয় খুলব না। কী বলল জান?’ ধাঁধা জিজ্ঞাসা করার মতো চোখ নিয়ে পুলিন তাকিয়ে ছিল।

ভারতী বলল, ‘ঘরটা নিতে চায়।’

পুলিনের চোখের উপর দিয়ে মুহূর্তের জন্য হতাশার মেঘ ভেসে গিয়ে আবার রোদ ফুটে উঠল। ‘ভারতী নামটাও নিতে চায়। আমার দোকান থেকে প্রায় একশো গজ দূরে ওর শাড়ির দোকান সরস্বতী। এয়ারকন্ডিশনড, কাচের দরজা। রাজস্থান থেকে ওদের জরিটরি বসানো দামিদামি শাড়ি আনায়। আমার ছোট্ট সাইনবোর্ডে ভারতী ট্রানজিস্টরস নামটা চোখে পড়া থেকেই স্বরূপ পোদ্দারের ইন্টারেস্ট তৈরি হয়। আজ বলল, আপনার দোকানটা একদিন বাইরে থেকে দাঁড়িয়ে দেখলাম, দেখেই বুঝে গেলাম বেশিদিন চলবে না। তালা পড়তেই বুঝলাম আপনি ব্যবসা তুলে দিয়েছেন।’

ভারতী অধৈর্য হয়ে বিরক্ত স্বরে বলল, ‘এইসব বলার জন্য লোকটা ডেকে নিয়ে গেল?’

‘আরে না, সরস্বতীর সঙ্গে মিল রেখে ভারতী নাম দিয়ে ও ফ্রিজ আর টিভি—র দোকান খুলতে চায়। কলকাতায় টিভি শুরু হয়েছে এবার টিভি সেট কেনার ধুম পড়ে যাবে। ওই সঙ্গে টেপ রেকর্ডার, ক্যাসেট ম্যাসেট আরও কী কী সব রাখবে।’

‘বুঝলুম, তাতে তোমার কী?’

‘আমাকে পঁচিশ হাজার টাকা দিতে চেয়েছে যদি ঘরটা ওকে ছেড়ে দিই।’ বলেই পুলিন অপেক্ষা করল ভারতীয় চোখ কতটা জ্বলজ্বল করে ওঠে দেখার জন্য। তার বদলে পেল কঠিন দৃষ্টি।

‘পঁচিশ হাজার টাকা নিয়ে করবে কী?’

‘বাবাকে দিয়ে দোব।’

‘তারপর খাবে কী? বাচ্চচা ছেলেটাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে হবে। তুমি কি ভেবেছ সেজন্য বাবা টাকা দেবেন? সে আশা কোরো না।’

‘তা অবশ্য করি না কিন্তু যেভাবে বাবা কথা না বলে বাইরে বাইরে থাকছেন তাতে মনে হচ্ছে এটা ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ। ঝঞ্ঝাট বাধাবার আগেই সেটা থামিয়ে দিতে চাই। পঁচিশ হাজার পেলে অনেকটা তো নরম হবেন।’

‘না, টাকা এখন দেওয়ার দরকার নেই।’

ভারতীর গলা রূঢ়, দুটো ঠোঁট টিপে তার আপত্তিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। তার চিন্তা বৃদ্ধ শ্বশুরের ছোড়া বাক্যবাণ নিয়ে নয়, দু—বছরের অনীশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

‘বাবার কষ্টে রোজগারের টাকা নষ্ট করলুম সেটা ওকে ফেরত দোব না, বলছ কী!’

‘ঠিকই বলছি। তোমাকে টাকা দিয়েও রিটায়ার করে পাওয়া টাকা এখনও ওনার ব্যাঙ্কে রয়েছে, আর এখন পেনশন যা পাচ্ছেন এগুলো যোগ করে যদি দেখো তাহলে হেসে খেলে বাবার বাকি জীবন চলে যাবে। আমাদের সংসারে তো কোনো বাজে খরচ নেই। কারোর কোনো নেশা নেই, সিনেমা থিয়েটারে যাওয়া নেই, লোকজনও কেউ আসে না, আমরাও কোথাও যাই না। টাকা ফেরত দেওয়ার থেকে অন্য কিছু ভাবো।’

‘আর কী ভাবব। পোদ্দারকে বলেছি ঘর নেওয়া আছে বউয়ের নামে, শ্বশুরই এটা পঞ্চান্ন সালে ভাড়া নিয়েছিলেন, বউকে জিজ্ঞেস না করে আপনাকে কিছু বলতে পারব না, কালকে আপনাকে জানাব।’

‘ভালোই বলেছ। এখনও চব্বিশ ঘণ্টা হাতে আছে, ভেবেচিন্তে ভবিষ্যতের কথা ভেবে বলবে।’

‘আচ্ছা চল্লিশ হাজার টাকা চাইলে কেমন হয়?’ সমর্থন পাবে আশা নিয়ে পুলিন তাকাল ভারতীর দিকে।

মাথা নাড়ল ভারতী, ‘অনিকে মানুষ করতে হলে এখনও কুড়ি—বাইশ বছর লাগবে। চল্লিশ হাজারে কতদিন আর চলবে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানোর খরচ যা তাতে ওই টাকা তো পাঁচ—সাত বছরেই শেষ হয়ে যাবে। অন্য কিছু ভাবো। বাবাকে কিন্তু ঘুণাক্ষরেও কিছু বোলো না।’

ভেবে বার করল ভারতীই, চব্বিশ ঘণ্টা নয় চার ঘণ্টাতেই সে ভেবে ঠিক করে ফেলেছে। বিকেলে কাশীনাথ বেরিয়ে যাবার পর পুলিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। ভারতী তাকে ঘরে ডাকল।

‘শোনো থোক টাকা নয়, আমার কাছ থেকে লেখাপড়া করে ভাড়া নিক। আমরা চোরবাগানে যে বাড়িতে থাকতুম সেটা বাবা ওইভাবেই নিয়েছিলেন দত্তবাবুর কাছ থেকে। উনিই ছিলেন মূল ভাড়াটে। এখানে আমি মূল ভাড়াটে। তখন বাবা দোকানঘরটা ভাড়া নিয়েছিলেন পঁচাত্তর টাকায়। সেই ভাড়াই এখনও চলে আসছে। কেউ যদি এখন ওপাড়ায় এমন জায়গায় একটা দোকান ভাড়া নিতে চায় তাহলে কত সেলামি আর কত ভাড়া দিতে হবে?’

‘ওরে বাব্বা এখন তো লাখ টাকা সেলামিই দিতে হবে, বেশিও হতে পারে। ভাড়া ধরো হাজার টাকা।’

‘আর তুমি পঁচিশ হাজার শুনেই লাফাচ্ছ!’

‘তাহলে কত বলব, লাখ টাকা?’

‘হাঁস মেরে সব ডিম একসঙ্গে পাওয়ার লোভটা সামলাও। সেলামি টেলামি চাই না, মাসে মাসে দু—হাজার টাকা ভাড়া দিক আমাদের আর বাড়িওলার যা ভাড়া সেটা তাকে দিক। গিয়ে বলো। দেখবে প্রথমে রাজি হবে না। ঝানু ব্যবসায়ী ওরা, ঠিক বোঝে পঁচিশ তিরিশ বছর পর ওই ঘরটার দাম কত দাঁড়াবে। তুমি কিন্তু কোনো গরজ দেখাবে না।’

পরদিন পুলিন যায় স্বরূপ পোদ্দারের সঙ্গে কথা বলতে। ফিরে এসে একগাল হেসে ভারতীকে বলল, ‘তোমার একখানা মাথা আছে বটে। অত টাকা ভাড়ার কথা বলব, এটা তো ভাবতেই পারতুম না, পারলেও বলতে সাহসে কুলোত না।’

‘ভণিতা রাখো। লোকটা রাজি হল?’

‘কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কী ভেবে নিয়ে বলল, ঠিক আছে তবে দু—হাজার নয় দেড় হাজার।’

‘তুমি রাজি হয়ে গেলে?’

‘পাগল। বললুম এক পয়সাও কম নয়। বউ তাহলে মাথা ফাটিয়ে দেবে।’ বলেই পুলিন জোরে হেসে উঠল। এভাবে শব্দ করে ওকে এই প্রথম ভারতী হাসতে শুনল, বোধহয় কাশীনাথ অনুপস্থিত বলে। ‘দু—হাজারেই রাজি হল। এক মাসের ভাড়া অ্যাডভান্সও দিয়ে দিল, এই দেখো।’ পুলিন পকেট থেকে একগোছা নোট বার করে ভারতীর চোখের সামনে ধরল। ‘কাল স্ট্যাম্পপেপার নিয়ে একজন কর্মচারী আসবে তোমাকে সই করাতে।’

‘কখন আসবে?’ ভারতী ভীতস্বরে বলে উঠল, ‘বাবা থাকার সময় যেন না আসে।’

‘আরে আমি কী অত বোকা, বলেছি এই সময়ে এগারোটায় আসতে।’ নোটগুলো স্ত্রীর হাতে দিয়ে পুলিন বলল, ‘এবার থেকে বাজার খরচটা আমি দোব বাবাকে বলে দিয়ো।’

‘বললেই বলবেন, টাকা পেলে কোথায়?’

‘বলবে চাকরি পেয়েছি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে।’

‘তাহলে তোমাকে রোজ ন—টায় খেয়েদেয়ে জামাপ্যান্ট পরে বেরোতে হবে।’

পুলিন বিপন্নের মতো বলল, ‘তাই তো! খেয়াল করিনি!’

ভারতী বলল, ‘আমার মনে হয় ওনাকে বলে দেওয়াই ভালো। একদিন তো জানতে পারবেনই।’

‘সেই ভালো, তুমি কালই বলে দিয়ো নইলে কাঁটার মতো খচখচ করবে।’

‘আমি কেন তুমি বলতে পার না? সব ব্যপারেই আমাকে সামনে ঠেলে দেওয়া!’ প্রায় মুখঝামটা দিয়ে ভারতী দ্রুত ঘরে ঢুকে গেল টাকাটা রেখে আসতে।

তিনদিন পর কাশীনাথ ভাত খেয়ে ঘুমোবার উদ্যোগ করছে, পুলিন ইশারায় ভারতীকে ঘরের দিকে আঙুল দেখিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে যায়।

একটা বছর দশেকের পুরোনো পাতলা র‌্যাপার গায়ে দিয়ে পাশ ফিরে কাশীনাথ শুয়ে। ভারতী খাটের ধারে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাবা ঘুমিয়ে পড়েছেন?’

মুখ না ফিরিয়েই কাশীনাথ বলল, ‘না’।

‘একটা কথা বলব বলে এসেছি। দোকানঘরটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে।’

কাশীনাথের দিক থেকে সাড়া এল না।

‘আপনার ছেলে বলছিলেন এবার থেকে বাজার খরচটা উনিই দেবেন।’

কাশীনাথ নীরব। ভারতী মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে থেকে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

পুলিন চিলড্রেনস পার্কের বেঞ্চে ঘণ্টাখানেক বসে থেকে ফিরে এল। গুহ ভবনের কোলাপসিবল গেট পেরিয়ে সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন। বাঁদিকে ওপরে যাবার সিঁড়ির আগে সাত—আট হাতের একটা চাতাল। তার একদিকে দেওয়ালে ইলেকট্রিক মিটার বক্সগুলো, অন্যদিকে সার দিয়ে লেটারবক্স। সিঁড়িটা ঘুরে দোতলায় উঠেছে, ঠিক তার তলার ফাঁকা জায়গাটিতে পাঁচিল তুলে বানানো হয়েছে ছোট্ট একটা ঘর। তাতে দরজা আছে, মাথায় আছে টিনের আচ্ছাদন। ঘরে কেউ বাস করে না কারণ বাসযোগ্য নয়। ঘরটিকে সবাই ‘ফালতু ঘর’ বলে।

ছ—টা ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটির লেটার বক্স আছে। পুলিন তাদের বক্সে শেষ কবে চিঠি পেয়েছে মনে করতে পারে না। উঠোন থেকে চাতালে পা রেখেই দেখল চারতলার প্রণববাবু লেটার বক্স থেকে চিঠি বার করছেন। পুলিনকে দেখে তিনি বললেন, ‘এই দুপুরে! কোথা থেকে?’

‘একটু কাজে বেরিয়েছিলুম। আপনি চললেন কোথায়, কলেজে?’

‘হ্যাঁ, তিনটের সময় ক্লাস।’ প্রণববাবু দক্ষিণ কলকাতায় একটি কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষক।

‘পুলিনবাবু একটা কথা জিজ্ঞাসা করব। আপনার বাবা কি এখান থেকে চলে যাবেন?’

হতভম্ব পুলিন শুধু বলল, ‘তার মানে!’

‘এমনিই বললাম, আমার এক ছাত্রকে পড়াতে যাই ভবানীপুরে। ছাত্রটির বাবা ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করে বিক্রি করেন। পরশু পড়াতে গেছি দেখি আপনার বাবা ছাত্রের বাড়ি থেকে বেরোলেন, আমার পাশ দিয়েই গেলেন আমাকে দেখতে পেলেন না। কৌতূহল হল। ছাত্রের বাবাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ধুতিপরা যে ভদ্রলোক এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন তিনি আমার নীচের ফ্ল্যাটে থাকেন; পাশ দিয়েই গেলেন অথচ আমাকে চিনতে পারলেন না! তখন তিনি বললেন, বেহালার পর্ণশ্রীতে একটা ষোলো ফ্ল্যাটের বাড়ি করছি। ওই ভদ্রলোক ঘুরতে ঘুরতে বাড়ি তৈরি হচ্ছে দেখে খোঁজ নেন। কেয়ারটেকারের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এসেছিলেন কথা বলতে। উনি একটা একঘরের ফ্ল্যাট চান। একঘরের ফ্ল্যাট দুটি মাত্র, আর দুটিই বুকড হয়ে গেছে। শুনে ভদ্রলোকের কী আপশোস। বারবার বলতে লাগলেন কেউ যদি বুকিং ফিরিয়ে নেয় তাহলে অবশ্যই যেন ওকে একবার চিঠি দিয়ে জানাই। ঠিকানাও লিখে দিয়ে গেছেন, এই বলে তিনি কাগজটাও দেখালেন। দেখি আপনার বাবা কাশীনাথ রায়ের নাম আর এ বাড়ির ঠিকানা লেখা। বুড়ো মানুষ একা ফ্ল্যাটে থাকবেন কী করে, এটা তো যেকোনো মানুষকেই ভাবাবে, তাই জিজ্ঞাসা করলাম। আপনি কিছু মনে করলেন না তো।’

কথাগুলো বলতে প্রণববাবুর খুব বেশি দেড় মিনিট লাগল, পুলিনের জীবনের সবথেকে অবাক আর চেতনা অসাড় করা দেড়টা মিনিট।

‘না না না মনে করব কেন, বাবা রিটায়ার করার পর থেকেই তো একা থাকতে চাইছিলেন। হাঁপিয়ে উঠেছিলেন একই বাড়িতে একই ঘরে টানা প্রায় ষাট বছর বাস করে। একটা পরিবর্তন চাইছেন।’

প্রণববাবু আর কথা বাড়াননি। পুলিন উত্তেজিতভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে এল তিনতলায়। ভারতী দরজা খুলে দিল। ভিতরে ঢুকেই পুলিন প্রথমে ঘরের ভিতরে তাকিয়ে দেখল কাশীনাথ র‌্যাপার মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। ফিসফিস করে সে ভারতীকে বলল, ‘এ ঘরে এসো, কথা আছে।’

পুলিনের মুখের ভাব দেখে ভারতীর প্রথমেই মনে হল, স্বরূপ পোদ্দার কি ঘরটা নেবে না বলেছে? সে স্বামীর পিছনে প্রায় দৌড়ে গেল।

‘বাবা রোজ বেরিয়ে যায় কেন এইমাত্র জানতে পারলুম। উফফ কী লোক রে বাবা! নীচে প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা, তিনি যা বললেন সে এক অবিশ্বাস্য কাণ্ড!’

‘কী বললেন প্রণববাবু?’

এরপর পুলিন যা শুনেছে হুবহু তা বলে গেল। শুনতে শুনতে ভারতীর চোখ কখনো বিস্ফারিত হল কখনো পাতা কুঁকড়ে গেল। কথা শেষ করে পুলিন পাশের ঘরের দেওয়ালের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘এতসব ভেবে রেখেছেন অথচ কিচ্ছুটি জানতে দেননি।’

ভারতী গালে হাত দিয়ে আনমনার মতো দেওয়ালটার দিকে তাকিয়ে। পুলিন বুঝল ভাবছে। ভাববার জন্য একটা সূত্র ধরিয়ে দিতে সে বলল, ‘প্রণববাবুকে তার ছাত্রের প্রোমোটার বাবা নিশ্চয় আরও কিছু বলেছে যেটা উনি আমাকে বলেননি।’

‘প্রণববাবুকে আরও কিছু বলেছে মানে?’

‘মানে একটা বুড়ো লোক একা একঘরের ফ্ল্যাটে থাকবেন কেন? নিশ্চয় কৌতূহলী হয়ে ভদ্রলোক বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, বাবাও একটা কারণ বলেছেন। কারণটা কী হতে পারে বলে তোমার মনে হয়? আমি তো প্রণববাবুকে একটা কারণ তখন মান বাঁচাতে বলে দিলুম। কিন্তু সেটা তো ঠিক নয়, বাবার মোটেই এই পাড়া এই বাড়ি এই ফ্ল্যাট একঘেয়ে লাগে না বরং অন্য কোথাও গেলে ডাঙায় তোলা মাছের মতো অবস্থা হবে।’

ভারতী বলল, ‘আমাদের পাড়ায় এক বিধবা বুড়ি ছিল। সে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেতে চাইত, বলত ছেলেরা খেতে দেয় না, ছেলের বউয়েরা দুর ছাই করে বলে ঘাটে যাবেন কবে, নাতি—নাতনিরা একটুও মানে না। লোকেরা সহানুভূতিতে গলে গিয়ে খেতে দিত, পুরোনো ধুতিকাপড় পরার জন্য দিত। এমনকী এক আধ দিন থাকতেও দিত। বুড়ির ছেলে বউয়েরা সেইসব লোকেদের বাড়ি গিয়ে বলত, সব মিথ্যে কথা, ওকে খেতে যথেষ্টই দেওয়া হয়, পরার কাপড় বিছানা—বালিশ সব দেওয়া হয়, এমনকী হাতে দু—চার টাকাও দেওয়া হয়। বুড়ি সাতাত্তর বছর পেরিয়েছে তাই ভীমরতিতে ধরেছে। লোকে কিন্তু বিশ্বাস করেছিল বুড়িকেই। মারা যাওয়ার পর, যে ঘরটায় বুড়ি থাকত সেখানে একটা পলিব্যাগ থেকে আটশো টাকা, চারটে নতুন থানকাপড় আর বহুকালের বাসি সন্দেশ জিবেগজা বেরোল। বাবা এই বুড়ির মতো কিছু বলেননি তো?’

পুলিন চিন্তিত মুখে বলল, ‘হতেও পারে, আশ্চর্যের কিছু নয়। হয়তো বলেছেন ছেলে আর ছেলের বউ আমাকে দেখে না, ভালো করে খেতে দেয় না, বিদায় করতে পারলে বাঁচে, এমন হতশ্রদ্ধার মধ্যে আর থাকতে চাই না তাই আলাদা হয়ে থাকার জন্য একটা ফ্ল্যাট খুঁজছি।’

‘তোমার ধারণা যদি সত্যি হয় মানে বাবা যদি এইরকম কথা লোকটিকে বলে থাকেন, আর তিনি যদি তা প্রণববাবুকে বলে দেন তা হলে তো এ—বাড়িতে আমাদের মুখ দেখানোই দায় হবে।’ ভারতীর চোখে ভয় ফুটে উঠল।

‘হবেই তো। তবে এটা আমার অনুমান। অত ঘাবড়াচ্ছ কেন। ব্যাপারটা আসলে কী সেটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নেবার চেষ্টা করব। ভালো কথা বাবা কী বললেন বাজার করা নিয়ে?’

‘জবাব দেননি, ঘুমের ভান করে রইলেন।’

শুনে কালো হয়ে গেল পুলিনের মুখ। বলল, ‘বিকেলে চা দেবার সময় একবার বোলো।’

কাশীনাথ বেরোবার জন্য ধুতি পাঞ্জাবি পাম্পশু পরে তৈরি। ভারতী চায়ের কাপ নিয়ে ঢুকল।

‘বউমা কী যেন বলছিলে তখন?’ কাপটায় চুমুক দিয়ে কাশীনাথ তাকিয়ে রইল।

‘দোকান ঘরটা একজনকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আপনার ছেলে বলছিল এবার থেকে বাজারটা উনিই করবেন, আপনাকে আর টাকা দিতে হবে না।’ ভারতী আশা—নিরাশা মেশানো অনুভূতি নিয়ে অপেক্ষা করল।

‘ভালোই তো! পুলিন বড়ো হয়েছে, বাবাও হয়েছে, খরচ—খরচার সব দায়িত্ব তো ওরই নেওয়ার কথা। আমিও এইভাবে নিয়েছিলুম। তোমাদের ছেলেটিও ভবিষ্যতে নেবে। শুধুই বাজার করা, আর সব খরচ নেবে না কেন?’

ভারতী শ্বশুরের প্রথমদিকের কথায় আশান্বিত হচ্ছিল, শেষ বাক্যটিতে প্রমাদ গুনল। দু—হাজার টাকায় মাস চালানো হয়তো যায় কিন্তু সেটা হবে গরিবদের মতো। সামনের বছরই অনিকে কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভরতি করাবে বলে তারা ভেবে রেখেছে। সেও একটা খরচ যা বছর বছর বাড়তে থাকবে, ভাড়ার টাকা আর বাড়বে না!

‘ভাড়ার টাকাটা এমন নয় যে সব কিছু খরচের দায় নেওয়া যায়।’

ভারতীর স্বরে প্রায় ভিক্ষুকের মিনতি, ‘বাকি সবকিছু আপনি যেমন দিচ্ছেন তেমনিই দেবেন।’

‘না, দোব না’।

ভারতী অবিশ্বাসী চোখে তাকাল। রূঢ় প্রত্যাখান সে আশা করেনি, তার চোখে জল এসে গেল।

‘বাবা তাহলে আমরা যে বিপদে পড়ে যাব।’

‘পড়লে পড়বে। যদি রান্নাবান্না বন্ধ হয়ে যায় যাবে। ইলেকট্রিক লাইন যদি কেটে দেয় দেবে। ভাড়া বাকি পড়লে যদি মামলা হয় হবে। আমি আর কোনো কিছুর মধ্যে নেই।’

ভারতী মাথা নামিয়ে দাঁড়িয়ে। খালি কাপ রেখে দিয়ে কাশীনাথ তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ভারতী ডাকল, ‘বাবা। আমরা কী অপরাধ করেছি?’

থমকে দাঁড়াল কাশীনাথ। ‘তোমরা করোনি আমি করেছি। অপদার্থ পুত্রের জন্ম দিয়ে। আমার কষ্ট তোমরা বুঝবে না, ছেলে বড়ো হোক তখন টের পাবে।’ বলেই সে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে গেল।

ভারতীর মনে হল কাশীনাথ এমনভাবে ‘তখন টের পাবে’ কথাটা উচ্চচারণ করল যেন অভিশাপ দিল। অনি বড়ো হলে কী হবে, আর এক পুলিন? সে খাটের উপর ধীরে ধীরে বসে পড়ল। অনেকক্ষণ থম হয়ে থেকে সে ঠিক করে ফেলল অনিকে সে নিজে বড়ো করে তুলবে। সেজন্য শ্বশুরের সব গঞ্জনা সে সহ্য করবে। যত কষ্ট করতে হয় করবে, ছেলের গায়ে কষ্টের আঁচড়টুকু লাগতে দেবে না।

সেদিন রাতে পুলিন চারতলায় গেল প্রণববাবুর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি রেডিয়ো শুনছিলেন। পুলিনকে দেখে অবাক হয়ে বললেন, ‘ব্যাপার কী?’

‘ব্যাপার কিছুই নয়, একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি। ভবানীপুরে আপনার ছাত্রের বাবাকে একটা কথা যদি বলে দেন তা হলে আমরা শান্তি পাব স্বস্তি পাব।’

‘কীরকম অনুরোধ?’

‘তিনি যেন বাবাকে ফ্ল্যাট বিক্রি না করেন। কেউ বুকিং ছেড়ে দিলেও যেন চিঠি দিয়ে বাবাকে না জানান। বাবার শরীর একদম ভালো নয়, একটা স্ট্রোকের মতো হয়ে গেছে, ডায়বিটিসও আছে। একা থাকবেন, যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায়, তখন কে দেখবে, কে ডাক্তার ডাকবে, কে হাসপাতালে নিয়ে যাবে? এসব কথা ভদ্রলোককে জানিয়ে দেবেন। বাবা এইসব কথা জানিয়েছে কিনা জানেন?’ পুলিন সাক্ষীকে জেরা করা উকিলের মতো তাকিয়ে রইল।

‘আমি বলতে পারব না কী জানিয়েছেন। তবে এইটুকু বলতে পারি লোকটি অত্যন্ত ব্যস্ত মানুষ, যা করবেন না বা পারবেন না তাই নিয়ে সময় নষ্ট করেন না। আপনার বাবার সঙ্গে পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলেছেন বলে তো মনে হয় না। তার মধ্যে অসুখবিসুখের কথা শুনবেন এমন লোক উনি নন। যাই হোক চা খাবেন?’

পুলিন মনে মনে আশ্বস্ত বোধ করছে। বাবা মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ছেলেবউয়ের নামে নিন্দে মন্দ করে ফেলতে পারবে না। এজন্য কম করে মিনিট পনেরো কথাবার্তা আর শ্রোতার আগ্রহ থাকা দরকার, দুটোই নিশ্চয় পাননি।

চা খেয়ে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের কট্টর ভক্ত প্রণবের সঙ্গে মোহনবাগান সমর্থক, যদিও কখনো খেলা দেখতে ময়দানে যায় না, পুলিন কলকাতার ফুটবলে কে সেরা তাই নিয়ে কিছু তর্কাতর্কি করে সময় কাটিয়ে নীচে নেমে আসে।

‘কথা বললুম প্রণববাবুর সঙ্গে, নিশ্চিন্ত থাকতে পার বাবা আমাদের সম্পর্কে কিছু বলেননি। ওহহ কী ভয়েই না ছিলুম।’ পুলিন রাত্রে খাবার টেবিলে বসে নীচু গলায় বলে। ভারতী কোনোরকম আগ্রহ দেখাল না এই নিয়ে কথা বলায়। পুলিন তাইতে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘আমার কথাটা কী শুনতে পেলে না?’

‘পেয়েছি।’

ঘুমন্ত অনিকে কলঘর থেকে ঘুরিয়ে এনে বিছানায় শুইয়ে ভারতী ভূমিকা না করেই বলল, ‘বাবা বলেছেন আর সংসারের খরচ দেবেন না। তোমাকেই সব টানতে হবে।’

ধড়মড়িয়ে উঠে বসল পুলিন।

‘সব খরচ মানে?’

‘সব খরচ মানে সব খরচ। ঝিয়ের মাইনে থেকে গ্যাসের দাম, কাগজের দাম, ইলেকট্রিক বিলও।’ নিস্পৃহ গলায় বলল ভারতী। অন্ধকারে স্ত্রীর মুখটা দেখার ব্যর্থ চেষ্টা করে পুলিন বলল, ‘এইভাবে টাইট দিচ্ছেন। ঠিক আছে আমিও দোব। কাল থেকে সবাই কচু ভাতে ভাত খাব, বাবাকেও তাই দিয়ো।’

‘আমি নয় তুমি দিয়ো। তবে বলে রাখছি অনিকে কচু ভাতে কিন্তু খাওয়াতে পারব না।’

পরদিন পুলিন বাজার থেকে আর কিছু না কিনে মানকচুর একটা দু—কেজির খণ্ড কিনে আনল। দেখে হতভম্ব হয়ে গেল ভারতী।

‘সত্যি সত্যিই তা হলে আনলে! ঠিক আছে সেদ্ধ করে দিচ্ছি তোমরা খেয়ো, আমি পারব না উপোস দোব।’

ভারতী কচু সেদ্ধ করে তেল নুন কাঁচালঙ্কা দিয়ে চটকে দলা পাকিয়ে রেখে ভাতের হাঁড়ি টেবলে বসিয়ে দিয়ে, গলা চড়িয়ে ঘরে শুয়ে কাগজ পড়া পুলিনকে উদ্দেশ করে বলল, ‘বাবা এলে ভাত বেড়ে দিয়ো। তুমিও খেয়ে নিয়ো। অনিকে নিয়ে আমি বেরোচ্ছি।’

‘বেরোচ্ছি মানে!’ খবর কাগজ হাতে পুলিন ঘর থেকে বিস্মিত মুখে বেরিয়ে এল। ‘এখন এগারোটার সময় কোথায় যাবে।’

বাচ্চচা অনিকে জুতো পরাতে পরাতে ভারতী বলল, ‘যেদিকে দু—চোখ যায় যাব। বুড়ো মানুষকে আমি শুধু কচুভাতে ধরে দিতে পারব না।’

‘শুধু কচুভাতে কেন? কাল বেগুন এনেছি কুমড়ো পটল আলু এনেছি। এসবই কি রেঁধে ফেলেছ কাল?’

‘কিছু আছে এখনও। ওগুলো রাঁধলে তুমি টাইট দেবে কী করে? ভাড়ার টাকাগুলো আলমারির ওপরের তাকে আছে, ওখান থেকে যা পারো কিনে এনে খেয়ো।’

দড়াস করে দরজা বন্ধের শব্দ পুলিনকে ভাবিয়ে দিল। ভারতীর মধ্যে এত রাগ থাকতে পারে সেটা জানা ছিল না তার। ছেলেকে নিয়ে এখন গেল কোথায়, এই বাড়িরই অন্য কোনো ফ্ল্যাটে না শ্যামসুন্দরের মন্দিরে? কোন ফ্ল্যাটে সে খোঁজ নেবে? দু—ঘরের ফ্ল্যাটে দুপুরবেলায় বাইরের স্ত্রীলোক এসে বসে থাকলে বাসিন্দারা যে বিরক্ত হবে এ বোধটা ভারতীর আছে। আর একটা জায়গার কথা তার মনে পড়ল, বাপের বাড়ি! এটা তার প্রথমেই ধরে নেওয়া উচিত ছিল।

পায়ে চটি গলিয়ে পুলিন বেরিয়ে পড়তে যাচ্ছে তখনই ফিরল কাশীনাথ। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ঘরে ঢুকে গেল।

দরজার কাছ থেকে পুলিন চেঁচিয়ে বলল, ‘টেবিলে ভাত আছে খেয়ে নিয়ো।’

জবাবে কাশীনাথ বলল, ‘বউমাকে দেখলাম ছেলেকে নিয়ে পার্কে বসে রয়েছে।’

পুলিন বেরোল তবে শ্বশুড়বাড়ির দিকে নয়, পাড়ার চিলড্রেন্স পার্কের উদ্দেশে। ঘিঞ্জি বসতবাড়ি সমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে ওয়েসিসের মতো একচিলতে খোলা রেলিংঘেরা জমি। অল্প ঘাস আছে, মাঝখানে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, পাঁচ বছর আগেও পার্কটি রেলিংঘেরা ছিল, এখন কোমর সমান ইটের পাঁচিল। চারদিকে চারটি কাঠের বেঞ্চ ছিল, এখন তা সিমেন্টের। তার একটিতে ভারতী বসে, অনি পাঁচিলের মাথা ধরে ঘুলঘুলিতে পা রেখে ওঠা যায় কী করে সেই চেষ্টায় ব্যস্ত।

‘একী! এখানে এভাবে বসে? লোকে দেখলে বলবে কী?’ পুলিন বিরক্ত ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘চলো, বাড়ি চলো। খুব রাগ দেখানো হয়েছে, বাবা ফিরেছেন।’ অনিকে কোলে তুলে নিল পুলিন। ভারতী কথা না বলে থমথমে মুখে উঠে দাঁড়াল।

বাইরের দরজা ভেজানো। পুলিন পাল্লা ঠেলে ঢুকতে গিয়ে থমকে রইল। কাশীনাথ টেবলে বসে ভাত খাচ্ছে। ভারতী পিঠে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘ঢোকো।’

দু—জনকে দেখে কাশীনাথ বলল, ‘বউমা ভাতে করলে কেন, পুলিন খুব ভালো কচুই এনেছে, বাটা করলে আরও ভালো খেতে লাগত। কাল বাটা কোরো।’

অনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়েছে পুলিন। কাশীনাথ হাত বাড়িয়ে ডাকল, ‘এসো দাদু একটু খেয়ে যাও।’

‘না।’ বলেই ভারতী টেনে নিল ছেলেকে।

কাশীনাথ অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, ‘যে খাবার ওকে খেতে দেবে না সেটা বুড়ো শ্বশুরকে খেতে দেওয়া যায়! এ খাবার তোমরাও খাওনি তার বদলে বাইরে থেকে খেয়ে এলে।’

‘না আমরা বাইরে খাইনি।’ পুলিন জোরে প্রতিবাদ করতে চেষ্টা করল কিন্তু গলার স্বর বসে গেল।

ভারতী ছুটে গিয়ে ভাতের থালাটা তুলে নিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে বলল, ‘আর খেতে হবে না আপনাকে। ঘরে যা আছে তাই দিয়ে আপনাকে রেঁধে দিচ্ছি।’

কাশীনাথ মিট মিট করে ছেলের দিকে তাকিয়ে নীচু গলায় বলল, ‘হারামজাদা, জব্দ করবি ভেবেছিলিস? জব্দ করতে হলে ক্ষমতা থাকা চাই। তোর মতো অপদার্থ রামছাগলের কম্ম নয় কাশীনাথ রায়কে জব্দ করা।’ এরপরই গলা তুলে বলল, ‘কাল ইলেকট্রিক বিল জমা দেবার শেষ দিন। মনে করে টাকা নিয়ে যাবি।’

বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে পুলিন নিজের ঘরে ঢুকে গেল। কাশীনাথ উঠে রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল।

‘এই কুচুটে বুদ্ধিটা কার, তোমার?’

দুটো বার্নার জ্বালিয়ে ভারতী রাঁধছিল। মুখ না ফিরিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, ‘হ্যাঁ। কাল—পরশুই গ্যাস দিয়ে যাবে, টাকাটা বার করে রাখবেন আর সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়ানোটা বন্ধ করুন, ওভাবে ফ্ল্যাট খুঁজে বার করা যায় না।’

কাশীনাথ বলল, ‘ফ্ল্যাট খুঁজছি কে বলল?’

‘আমার কুচুটে বুদ্ধি বলল। এখানে আপনার অসুবিধেটা কী হচ্ছে?’

‘কিছুই হচ্ছে না, শুধু পুলিনটাকে সহ্য করতে পারছি না।’ বলেই কাশীনাথ তার ঘরে ফিরে এল।

এরপর কাশীনাথ তৈরি হতে থাকা বাড়ি খুঁজে বার করার জন্য আর কলকাতা চষে বেড়ায়নি। তার বদলে গুহ ভবনের তিন তলায় নিজের ঘর থেকেই ছেলে আর ছেলের বউ—এর জীবন নাজেহাল করে তোলায় ব্যস্ত থেকেছে বছরের পর বছর। বয়স যত বেড়েছে ততই রুক্ষ অযৌক্তিক হয়েছে তার আচরণ, বাজার খরচ বাদে সংসারের যাবতীয় খরচ মায় নাতির বিদ্যাশিক্ষার দায়ও সে বহন করে গেছে। একমাত্র সেই যে পরিবারের প্রধান পুরুষ এই অভিধাটিকে পুলিন ও ভারতীর চেতনায় ঢুকিয়ে দিতে দিনের পর দিন সে কঠিন কর্কশ বাক্যে, ক্রীতদাসদের প্রতি প্রভুর মতো ব্যবহারে, সুযোগ পেলেই পুলিনকে অপমানকর কথা বলে বুঝিয়ে দিয়েছে এই সংসার টিকে আছে তার দয়ায় তার টাকায়।

বিরাট আশা ছিল কাশীনাথের ব্যবসা করে পুলিন ধনী হবে নামি হবে। আশাভঙ্গের যন্ত্রণা সে শোষণ করে নিতে পারেনি, যন্ত্রণা সে ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিনকে। তার দৃঢ় ধারণা বা বদ্ধমূল বিশ্বাস ছেলে তাকে ঠকিয়েছে, তার প্রত্যাশার অবমাননা করেছে, মমতাহীন ছিল সে পুলিনের প্রতি। ভারতীর জন্য বরাবরই একটা চাপা স্নেহ সে লালন করে এসেছে। নিজে পছন্দ করে যাকে ঘরে এনেছে সে কখনো মন্দ হতে পারে না, তার কোনো খুঁত থাকতে পারে না এমন একটা আত্মম্ভরিতা সে পোষণ করে।

কাশীনাথের সবথেকে দুর্বল জায়গা তার নিজের চেহারা। সে জানে হাস্যকরভাবে সে অসুন্দর। একবার হাওড়ায় যাচ্ছিল বাসে কাজে যোগ দিতে। বাসে একজনের পকেটমার হয়। সারা বাস পকেটমার সন্দেহে তার দিকেই তাকাতে থাকে। বাস থেকে নামিয়ে তার শরীর তল্লাসি করেছিল তিনজন। ভিড় জমে যায়। সেদিনের অপমান আর লজ্জা এখনও সে বহন করে চলেছে। তার ধারণা এটা ঘটেছিল তার চেহারার জন্য। এইজন্য সে উপেক্ষিত হয় লোকবহুল অনুষ্ঠানে এবং কর্মস্থলেও।

অনীশের স্কুলের বা কলেজের বন্ধুরা প্রায়ই আসত। তারা এলেই ছুতো করে কাশীনাথ বেরিয়ে যেত গুহ ভবন থেকে। অনীশ এটা লক্ষ করে একদিন বলেছিল, ‘দাদু আমার বন্ধুরা এলেই দেখেছি, তুমি বেরিয়ে যাও, কেন?’

কাশীনাথ দুর্বল একটা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে বলেছিল, ‘কে বলল তোর বন্ধুরা এলেই বেরিয়ে যাই। বাইরে কী আমার কাজকম্ম থাকতে পারে না? তোদের কথার মধ্যে আমি বসে থেকে কী করব। তার থেকে বরং ওই সময় লন্ড্রি থেকে কাপড়গুলো আনা যায়। সেদিন কলঘরের টিউবলাইটটা কিনতে বেরিয়েছিলুম।’

বাইরের কেউ উপেক্ষা বা অবজ্ঞা করলে কাশীনাথ তা সহ্য করতে পারে না।

অনীশের এক কলেজের বন্ধু তার খোঁজে প্রথমবার এসে দরজা খুলেই দাঁড়ানো কাশীনাথকে বলেছিল, ‘অনীশ আছে?’ কাশীনাথ বলেছিল, ‘বেরিয়েছে।’ বন্ধুটি ইতস্তত করে বলে, ‘খুব দরকার ছিল, এই বইটা ওকে দিয়ে দেবেন রেয়ার দামি বই, হারাবেন না যেন। আর বলবেন আজ বিকেলে যেন অবশ্যই কফি হাউসে অপুর সঙ্গে দেখা করে।’ এই বলে অনীশের বন্ধু মোটা একটা পুরোনো বই কাশীনাথের হাতে দিল। ঠিক তখনই ভিতর থেকে পুলিন উৎসুক মুখে বেরিয়ে আসে। তাকে দেখা মাত্র অনীশের বন্ধু কাশীনাথের হাত থেকে বইটি প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে পুলিনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি কি অনীশের বাবা?’ পুলিন ‘হ্যাঁ’ বলতে সে বইটা পুলিনের হাতে দিয়ে বলে, ‘এটা অনিশকে দিয়ে দেবেন, ও চেয়েছিল। ছেঁড়াখোড়া বই একটু যত্ন করে রেখে দেবেন। আমার নাম অপু, বিকেলে কফি হাউসে থাকব, ও যেন আমার সঙ্গে দেখা করে।’ যাবার আগে বন্ধুটি আবার বলল, ‘বইয়ের অনেক পাতা খোলা রয়েছে, আপনি যেন খোলাখুলি করবেন না।’

তরুণটি চলে যাবার পরই কাশীনাথ রাগে ফেটে পড়ল।

‘আপনি কি অনীশের বাবা?’ অনীশের বন্ধুর গলা নকল করে ভেংচে ওঠে কাশীনাথ। ‘আমাকে বিশ্বাস করল না। অনির সঙ্গে আমার চেহারার মিল নেই তাই করল না।’

এর পাঁচ বছর পর অনীশের হবু শ্বশুর শিবেন ভট্টাচাযকে তার স্ত্রী ও মেয়ের সামনে কাশীনাথ বলে দেয়, ‘বরের বাড়ি যেমন চাইবে তেমনভাবেই বিয়ে হবে।’

বিয়ে অবশ্য তেমনভাবে হয়নি। অনীশ যেমন চেয়েছিল সেইভাবেই হয়। পুলিন ও ভারতী আর বরের সঙ্গে বরযাত্রী হয়ে প্রণববাবু, উমার দুই ভাইও টালিগঞ্জে যায় ভাড়া করা মিনিবাসে, কাশীনাথ একা ছিল ফ্ল্যাটে। বউভাতেও সারা গুহভবন মায় দারোয়ান ও ঠিকে ঝি পর্যন্ত বাড়ির আধ মাইল দূরে ভাড়া নেওয়া ‘মিত্রা হাউসে’ নিমন্ত্রণে যায়, কাশীনাথ থেকে যায় ফ্ল্যাটে একা।

‘যাব না। আমার ইচ্ছে। আর কিছু বলার আছে?’ তিনটি বাক্যে কাশীনাথ বুঝিয়ে দিয়েছিল তাকে নড়ানো যাবে না সিদ্ধান্ত থেকে। কেউই তাকে জোরাজুরি কী মিনতি পর্যন্ত করেনি।

তারা রাত্রে কোথায় শোবে? প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে শেষপর্যন্ত বউভাতের এক সপ্তাহ আগে ভারতী হাল ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘বাবার খাটের পাশে, যেখানে ফোল্ডিং খাটে অনি শোয়, সেখানেই মেঝেতে শোব, কী আর করা যাবে! ইট দিয়ে ওনার খাট উঁচু করতে রাজি না হলে তখন কষ্ট করে রাত কাটানো ছাড়া আর উপায় কী?’

পুলিন বলেছিল, ‘ইটের কথাটা বাবাকে বলে দ্যাখো। ওখানে যদি শুতে হয় তাহলে সাইজমতো তোশক করাতে হবে। এতবড়ো বালিশগুলো জায়গাটায় আঁটবে না।’

‘দোকান থেকে রেডিমেড কিনে আনো। আমাদের পুরোনো বালিশে নতুন ওয়াড় পরিয়ে আপাতত ওরা কাজ চালাক। অনি বলেছে আস্তে আস্তে সব নতুন করে নেবে। দরজা জানলায় পর্দাও ঝোলাবে। খাওয়ার টেবিলটা বাঁদিকে একটু সরাতে হবে ফ্রিজ রাখার জন্য। নতুন টিভিটা আমি বলি কী ওদের ঘরেই থাকুক। কেবলওয়ালাকে তুমি বলে রেখো লাইন নোব। বাবার ঘরেরটা যেমন আছে তেমনই থাকুক।’

পুলিন শিউরে উঠে বলে, ‘ওরে বাবা, এই সেটটা তো ওনার স্মৃতিস্তম্ভ। নড়ানড়ির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ফ্রিজ, কালার টিভির কথা কিচ্ছু এখন ওকে বোলো না। আগে ইটের কথাটা পেড়ে দেখো কী হয়!’

সাইকেলের ধাক্কা খাওয়ার পর কাশীনাথ গুহ ভবনের গেটের বাইরে একা যান না, শুধু মাসে একবার বাড়ি থেকে তিনশো গজ দূরের ব্যাঙ্কে পেনশন তুলতে যান, সঙ্গে থাকে পুলিন কেননা সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুটা পার হতে হয়। ট্র্যাফিক পুলিশ গাড়ি থামিয়ে ওকে রাস্তা পার হতে সাহায্য করে।

বিকেলে ছাদে পায়চারি করে নেমে আসতেই ভারতী চা দিয়ে কাশীনাথকে বলল, ‘বাবা এখন কিছু খাবেন?’

শ্বশুরকে নরম অবস্থায় পাওয়ার জন্য কী করতে হবে ভারতী তা জানে। যেসব মুখরোচক খাদ্য বা কুখাদ্য পঞ্চাশ—ষাট বছর আগে খেয়েছিলেন স্মৃতি থেকে সেগুলো এখন টেনে বার করাই তার শখ।

‘খিদে তেমন এখন পাচ্ছে না। বাড়িতে পলতা আছে?’

‘নেই।’

‘থাকলে বলতুম ব্যাসন দিয়ে পলতার বড়া ভেজে দাও। পুলিনকে কাল বাজার যাওয়ার সময় বলে দিয়ো যেন কাঁকড়া আনে, কোম্পানির বাগানের কাছে ফটিকের দোকানে লঙ্কা মাখানো লালরঙের কাঁকড়া ভাজা পাওয়া যেত, যেমন ঝাল তেমনি টেস্ট। ওর দোকানটা মোদো মাতালের আড্ডা ছিল। কাছেই তো রামবাগান!’

ভারতী শুনেছে রামবাগান বেশ্যাপাড়া। দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। ‘বাবা আপনি রামবাগানে মাতালদের দোকানে গিয়ে খেতেন?’

ভারতীর চোখেমুখে গলার স্বরে বিস্ময় ভেঙে পড়ল। কাশীনাথ তাই দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘রামবাগানে কে বলল, কোম্পানি বাগানের কাছে বলেছি। আমি তো একদিন মাত্র বিকেলে কিনে খেয়েছি, আমার সঙ্গে বাদু আর সত্যও ছিল। মাতালরা তো বিকেলে আসত না, সন্ধের পর আসত।’

কটুভাষী বদরাগী শ্বশুরকে এভাবে কৈফিয়ত দিতে দেখে ভারতী বুঝে গেল সর্বদা উঁচিয়ে থাকা ওর আক্রমণের অস্ত্রগুলো এখন নীচে নেমে গেছে। সে সুযোগটা নিয়ে বলল, ‘বাবা, একটা কথা বলব। অনির বিয়ে হলে আমাদের দু—জনের রাতে শোয়ার অসুবিধা হবে সেটা তো জানেন।’

‘জানিই তো।’

‘এই ঘরেই মেঝেতে শুতে হবে এইটুকু ফালি জায়গায়। তাই বলছিলুম কী খাটটা যদি ইট দিয়ে একটু তুলে দেওয়া যায় তাহলে কিছুটা জায়গা বেরোবে। অনেকের বাড়িতেই তো এভাবে শোয়।’ ঝুলি থেকে বেড়ালটা বার করে ভারতী দুরুদুরু বুকে তাকিয়ে রইল।

‘পারবে ওভাবে দু—জনে শুতে? যদি পারো তাহলে তুলে দাও, শুধু তো রাতটুকু থাকা।’

হাঁফ ছেড়ে ভারতী বলল, ‘কালই পলতার বড়া আপনাকে খাওয়াব। কিন্তু বাবা, কাঁকড়া কী করে ভাজতে হয় আমি জানি না।’

‘জান না! ঠিক আছে অন্যভাবে রাঁধো। তোমার শাশুড়ি কাঁকড়া বানাত লাউ চিংড়ির মতো। পুলিনকে বোলো কাল একটা লাউও আনতে।’

‘সে তো কালকের ব্যাপার, এখন কী খাবেন?’ ভারতী খুশি চাপতে চাপতে বলল। ইট এখন সে চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে পারে। চিড়ে ভাজা করে দোব? পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা, চিনে বাদাম, ধনেপাতা, গোলমরিচ গুঁড়ো দিয়ে?’ ভারতী দু—সেকেন্ড থেমে বলল, ‘শশা আছে দোব? ঝুরি ভাজাও আছে।’

ভারতী দেখল তার চুরাশি বছর বয়সি শ্বশুরের গলার কণ্ঠা নড়ে উঠল।

বলাকার সঙ্গে মানিয়ে নিতে কোনো অসুবিধে হয়নি ভারতীর কেননা শাশুড়িদের মতো বিধিনিষেধ আরোপ বা বউয়েদের করণীয় কাজ সম্পর্কে সে কখনো একটি কথাও বলেনি। সে জানে মেয়েটি চাকরি করে, প্রায় আট—ন ঘণ্টা বাইরে থাকে, লেখাপড়া করেছে। হাসে না, কথা কম বলে এবং যথেষ্ট পরিণত। বলাকা যতক্ষণ ফ্ল্যাটে থাকে নিজের ঘরেই বেশিরভাগ সময় থাকে। সে অফিসে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘরটার দখল পায় পুলিন আর ভারতী।

প্রায় তিরিশ বছর যে ঘরে দু—জনে দিনরাত বাস করেছে, সে ঘরকে তারা বলে এসেছে ‘আমাদের ঘর’ সেই ঘরই এখন তাদের কাছে অন্যরকম লাগে। এটা এখন ‘ওদের ঘর’। অভ্যাস বশে ভারতী একবার ঢুকে পড়েছিল, বলাকা তখন গা ধুয়ে খাটে লম্বা হয়ে শুয়ে ট্রেনে কেনা ম্যাগাজিন পড়ছিল। মুখের সামনে থেকে সেটা নামিয়ে জিজ্ঞাসু চোখে শুধু তাকায়। অপ্রতিভ ভারতী তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসেছে।

ঘরের কাঠের আলমারিটা ছিল ভারতীর শাশুড়ির, সেটাই সে তিরিশ বছর ধরে ব্যবহার করে এসেছে, এটাকে ঘর থেকে বার করে নেওয়া হয়নি কেননা আর কোথাও রাখার জায়গা নেই। এখনও তার আর পুলিনের এবং কাশীনাথেরও জামাকাপড় তাতে রয়েছে। অনীশ আয়না লাগানো একটা স্টিলের আলমারি থেকে বার করা দরকার। ইতস্তত করে ভারতী ঘরে ঢুকে চাবি দিয়ে পাল্লা খুলে জিনিসটি বার করে নিয়েই দ্রুত বেরিয়ে এসেছে। তার তখন মনে হয় নিজেকে অনধিকারীর মতো।

দুপুরে ওদের ঘরের খাটে পুলিন আর ভারতী পাশাপাশি শুয়ে সকাল থেকে দাঁড়ানো, চেয়ারে বসা আর হাঁটাচলা করা শরীরকে বিশ্রাম দেয়। এমনই এক দুপুরে ভারতী বলে, ‘মনে হচ্ছে না চুরি করে অন্যের ঘরে শুয়ে আছি।’

পুলিন বলে, ‘ঘরের কোনো জিনিসে হাত দিতে ভয় করে। এধার—ওধার হলে ধরে ফেলতে পারে বউমা, আর তখন যদি দুটো কথা শোনায়! অবশ্য জানি কিছু বলবে না, তেমন মেয়ে নয় তাহলেও—।’

‘তাহলেও কী?’

‘তাহলেও কেন জানি মনে হয় হয়তো বলবে এবার থেকে ঘরে তালা দিয়ে বেরোব।’

ভারতী বলল, ‘তুমি একটু বেশি বেশি ভাব। বউমা মোটেই ওরকম মেয়ে নয়। অত্যন্ত ভদ্র আমাকে সম্মান দিয়ে কথা বলে, সংসারের কোনো ব্যাপারে নাক গলায় না।’

পুলিন বলল, ‘বড্ড গম্ভীর, ভালো করে কথা বললেও মনে হয় যেন অসন্তুষ্ট হয়ে কথা বলছে। বোধহয় নানা ধরনের লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এমন গলা হয়ে গেছে। ব্যাঙ্কের চাকরি তো।’

ভারতী বলল, ‘গম্ভীর মনে হয় ওর মুখটার জন্য। ছেলেমেয়েরা যেন মায়ের মুখ না পায়।’

‘আমি কিন্তু মায়ের মুখ পেয়েছি, গায়ের রংটাও, বাবা তাই চেয়েছিলেন।’

‘অনির মুখ কার মতো হোক চেয়েছিলে?’

‘ওর মায়ের মতো।’

ভারতী পুলিনের বাহুতে চিমটি কেটে বলল, ‘মিথ্যে কথা এই বুড়ো বয়সে আর বোলো না।’

‘বলব না কেন, অনির মাকে তার শ্বশুর পছন্দ করেছিল তো মুখ আর রং দেখে। বাবা কিন্তু বলাকাকে কেন জানি একদম পছন্দ করেন না। ভয় হয় কোনোদিন কী ফট করে ওকে বলে বসেন।’

ভারতী বলল, ‘বুঝতে পারি না অনি কী দেখে বলাকাকে পছন্দ করল, মনে হয়তো দু—জনে সমবয়সি।’

পুলিন বলল, ‘আমারও মনে হয়েছে কী করে পছন্দ করল, বোধহয় চাকরি করে বলে, এখন তো ব্যাঙ্কের মাইনে ভালো।’

ক্ষুব্ধ স্বরে ভারতী বলল, ‘তুমি বলছ টাকার লোভে অনি বিয়ে করেছে?’

পুলিন লজ্জিত স্বরে বলল, ‘আরে না না তুমি ওইভাবে দেখছ কেন, কখন কী হয়ে যায় মানুষের কেউ কী তা বলতে পারে, বউ স্বাবলম্বী হলে বউ ছেলেমেয়ে বিপদে পড়বে না। অনি ভালোই করেছে।’

কিছুক্ষণ দু—জনে চুপ থাকার পর ভারতী বলল, ‘মনে হয় বউমার বাচ্চচা হবে।’

পুলিন কথা বলল না। ভারতী পিঠ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করল।

বলাকার সন্তান প্রসবের কুড়ি দিন আগে বিরোধের মেঘ ঘনিয়ে উঠল। বিকেলে কাশীনাথ পুত্রবধূকে ডেকে জানতে চাইলেন, ‘নাতবউয়ের বাড়ির লোকেদের বলেছ মেয়েকে নিয়ে যেতে।’

‘কেন বাবা?’ ভারতী হঠাৎ এমন একটা কথায় অবাক হল।

‘কেন কী! মেয়েদের প্রথম সন্তান বাপের বাড়িতে হয়। পুলিন হয়েছিল, আমিও হয়েছি। তুমি কোথায় হয়েছ?’

‘হাসপাতালে, তবে আমি প্রথম সন্তান নই। দাদা হয়েছে মামার বাড়িতে কোতরংয়ে।’

‘তবে! অনিকে বলো শ্বশুরবাড়িতে জানাতে। ওদেরও তো দায়দায়িত্ব আছে প্রথম মেয়ের প্রথম সন্তান। ওদের তো নিজের থেকে বলা উচিত।’

শ্বশুরের কথাটা ভারতীর মনে ধরল। সন্ধ্যায় শ্যামনগর থেকে বলাকা ফিরে আসার পর যখন সে গা ধুয়ে ঘরে এসেছে তখন ভারতী পরোটা আর তরকারির প্লেট ছোট্ট টেবলটায় রেখে বলল, ‘বউমা তোমার মা কী বলেছেন কোথায় ডেলিভারি হবে?’

বিস্মিত চোখে বলাকা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, ‘কেন, নার্সিং হোমে হবে! যে ডাক্তারকে দেখাচ্ছি তিনি ‘পরিচর্যা’ নার্সিং হোমের সঙ্গে অ্যাটাচড, ওখানেই ভরতি হব।’

শুনে থিতিয়ে গেল ভারতী। নার্সিং হোমের ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই তাহলে করে রাখা হয়েছে অথচ সে তা জানে না। ব্যবস্থাটা নিশ্চয় অনিই করেছে, তাকে একবার বলতেও তো পারত।

‘প্রথম সন্তান, বাপের বাড়িতে হলে ভালো হত।’

পরোটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলাকা বলল, ‘একই ব্যাপার। বাড়িতে তো এখন আর হয় না, হয় হাসপাতালে বা নার্সিং হোমে। সেটা টালিগঞ্জে না হয়ে শ্যামবাজারে একই কথা। সাত তারিখ থেকে দেড় মাসের ছুটি নিচ্ছি।’

ভারতীর মনে হল, বলাকার যুক্তিও ফেলে দেবার মতো নয়, ‘একই কথা’। ডেলিভারির পর বাপের বাড়ি গিয়ে থাকতে পারে। মা আছে, দুই বোন আছে যত্ন আত্তিতে কার্পণ্য হবে না। বাচ্চচা নাড়ানাড়ি তার থেকে বলাকার মা বেশি করেছেন।

কাশীনাথ আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘বলেছ বউমা?’

‘বলেছি। শ্যামবাজারে নার্সিং হোমে ডেলিভারি হবে।’

ভারতী ভাবতে পারেনি কথাটা শুনে কাশীনাথ রাগে জ্বলে উঠবে। গলা চড়িয়ে সে বলে উঠল, ‘না হবে না, হবে না, আমি বলছি হবে না। এ বংশের বউয়েরা প্রথম সন্তান বিইয়েছে তাদের বাপ—মায়ের কাছে। তুমিও তো বাপের বাড়ি গিয়ে থেকেছিলে, সেখান থেকে তোমার বাবাই মেডিকেল কলেজে ভরতি করায়। প্রথমবার বাপের বাড়িতে থাকাটাই আমাদের নিয়ম। বিয়োতে গিয়ে যদি মরে তাহলে বাপ—মা আমাদের দুষতে পারবে না।’

ভারতী বিরক্ত হয়ে বলল, ‘এসব কী অলুক্ষুণে কথা বলছেন!’

কাশীনাথ প্রায় চিৎকার করে উঠল ‘ঠিকই বলছি, আমার পিসি মরেছে, একমাত্র বোনও মরেছে। এসব তো তুমি জান না।’

গলা চেপে ভারতী বলল, ‘বাবা আস্তে বলুন, ও ঘরে বলাকা রয়েছে শুনতে পাবে।’

‘শুনবে পাবে পাক, আমি ভয় করি নাকি।’

স্বর প্রখর করে ভারতী বলল, ‘কাউকে আপনার ভয় করতে হবে না, বলাকার ডেলিভারি ও যেখানে চাইছে সেখানেই হবে, আপনি মাথা গলাবেন না।’

‘বটে, তুমিও দলে ভিড়ে গেছ!’

‘বলাকা আমার ছেলের বউ, ওর শাশুড়ি আমারও মতামত দেবার অধিকার আছে আর সেটা আপনার থেকে বেশিই আছে।’

চশমার পিছনে কাশীনাথের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। দাঁত চেপে একান্ন বছর বয়সি পুত্রবধূকে বলল, ‘বেশিই আছে, অধিকার বেশিই আছে! বেরোও ঘর থেকে, আর একটা কথা বললে এই ফ্ল্যাট থেকে বার করে দোব।’

ভারতী কথা না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চেয়ারে বসে রইল গুম হয়ে। একবার তাকাল বলাকার ঘরের দিকে। ঘরে পাখা ঘুরছে, পর্দাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, আলো জ্বলছে, বোধহয় কিছু একটা পড়ছে। নিশ্চয় কাশীনাথের চেঁচিয়ে বলা কথাগুলো কানে গেছে। কোনো একটা ছুতো করে ঘরে গিয়ে বলাকার মুখের ভাবটা এখন কেমন দেখার ইচ্ছে হল ভারতীর।

‘বউমা’ বলে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল ভারতী। আয়নার সামনে বসে চুল এলিয়ে বলাকা চিরুনি চালাচ্ছে মাথা থেকে চুলের ডগা পর্যন্ত। মুখ ফিরিয়ে তাকাল সে।

‘কাল তোমায় টিফিনের জন্য পরোটা করে দোব, রোজ রোজ পাঁউরুটি একঘেঁয়ে লাগে না? কেমন হয়েছে আজ পরোটা? এক একদিন এক একরকম খেলে মুখের অরুচিটা কাটাবে। লেবুর আচার খানিকটা দিয়ে দোব, আর ঝালঝাল আলু পেঁয়াজের চচ্চচড়ি।’

যতক্ষণ ধরে সে বলে গেল বলাকা স্থির চোখে তার মুখের দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে রইল। ভারতী বুঝে গেল বলাকা ও ঘরে চেঁচিয়ে বলা কাশীনাথের কথাগুলো শুনেছে।

‘আপনি রোজ যা দেন তাই দেবেন।’ বলেই মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চল আঁচড়াতে শুরু করল।

এরপর আর ঘরে থাকা যায় না। ভারতী রান্নাঘরে ফিরে এল রুটি করার জন্য। পুলিন গেছে নবজীবন সংঘের বার্ষিক মিটিঙে, সেখানে সে পাঁচজন সহ—সভাপতির একজন। কিছুক্ষণ পর অফিস থেকে ফিরল অনীশ। দালানে পা দিয়েই ভারতীকে উদ্দেশ করে বলল, ‘কাল টেলিফোনের লোক আসবে কানেকশান দিতে। দুপুরে তৈরি থেকো।’ বলেই সে ঘরে ঢুকে গেল।

আধঘণ্টা পর অনীশ দালানে চেয়ার টেনে বসে বলল, ‘মা খেতে দাও।’

টেবলে খাবার থালা রেখে ভারতী বলল, ‘কই বউমা এল না?’

অনীশ আর বলাকা রাতের খাওয়া একসঙ্গে খায়। দু—জনকেই সকালে সাড়ে আটটার মধ্যে বেরোতে হয়। অন্যদের থেকে ওরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে।

অনীশ মুখ নামিয়ে বলল, ‘খাবে না, মাথা ধরেছে।’

ভারতীর অসুবিধা হল না বুঝতে কেন খাবে না। সে এই নিয়ে কোনো কথা না বলে অন্য প্রসঙ্গে গেল। ‘তোর বাবা অনেকদিন আগে বলেছিল একটা ফোন এবার থাকা দরকার, বাড়িতে দুটো চাকরে লোক, কত রকমের দরকার পড়তে পারে। আগে চাকরে বলতে ছিল তোর দাদু, সে তো আজ চব্বিশ বছর আগের কথা। তোর ফোনটোন যা আসত ওপরে, ওরা ডেকে দিত।’

খাওয়া থামিয়ে অনীশ বলল, ‘বলাকার ডেলিভারি এখানেই নার্সিং হোমে হবে। বংশের কার কোথায় হয়েছে ওসব নিয়ে চুরাশি বছরের একটা লোক কী বলল না বলল তাই নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। দাদুকে চুপ করে থাকতে বোলো। যা শুনলুম তাতে লজ্জায় মাথাকাটা যায়।’

অনীশের থমথমে মুখে, গাঢ় গলায় বলা কথাগুলো শুনে ভারতী স্বর নামিয়ে বলল, ‘বলেছি তো, আপনি এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না, বললেই কী শোনেন, আমাকে বললেন ফ্ল্যাট থেকে বার করে দোব।’

‘হুঁ উউউ,’ অনীশ গম্ভীর হয়ে গেল। খাওয়া শেষ করে ঘরে গিয়ে দু—মিনিট পর বেরিয়ে এল, হাতে নোটের গোছা।

‘এই নাও দু—হাজার, মাসে মাসে যা দিচ্ছি তার সঙ্গে আরও দু—হাজার করে দেব। দাদু যা যা খরচ করে সেই সেই খরচ তুমি এই টাকা থেকে করবে। কুলোবে?’

ভারতী ঘাড় নাড়ল, ‘হয়ে যাবে।’

‘দেখি বিষদাঁত ভাঙে কিনা।’ বলে অনীশ ঘরে ফিরে গেল।

পুলিন ফিরে আসামাত্র ভারতী হাতছানি দিয়ে ডেকে তাকে রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করল।

‘কী ব্যাপার!’

পুলিনকে একটার পর একটা শিহরন জাগিয়ে ভারতী সন্ধ্যা থেকে যা যা ঘটেছে সংক্ষেপে দ্রুত বলে গেল নীচু স্বরে।

‘ছি ছি ছি বাবা এভাবে বললেন। এখন তো ছেলের বউয়ের কাছে মুখ দেখানো দায় হয়ে উঠবে। টাকাটা মনে হচ্ছে বউমাই দিয়েছে।’

‘আমারও তাই মনে হচ্ছে, টাকাগুলো এখন রাখি কোথায়। এখন ও ঘরে গিয়ে আলমারি খুলে টাকা রাখতে পারব না। বাবার ঘরেও রাখা যাবে না।’

‘আঁচলে ভালো করে বেঁধে নাও। শুতে এমন কিছু অসুবিধে হবে না। কাল আলমারিতে তুলে রেখো।’

পরদিন টেলিফোনের তার রাস্তা থেকে বাড়ির গা বেয়ে উঠল। রিসিভারটা রাখা হল অনীশের ঘরে টেবলের উপর। কাশীনাথ বারান্দায় দাঁড়িয়ে টেলিফোন মিস্ত্রিদের কাজ নীরবে দেখল, পরীক্ষা করার জন্য একজন লাইনম্যান নীচে থেকে ফোন করল। ঘরের রিসিভার বেজে উঠতে ভারতী আর পুলিন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ভারতীই বলল, ‘তুমি ধরো।’

পুলিন রিসিভার তুলে বলল ‘হ্যালো’।

‘ঠিক শুনতে পাচ্ছেন তো?’

‘পাচ্ছি।’

‘আপনার টেলিফোন নম্বরটা অফিস থেকে আজই জানিয়ে দেবে, এখন রাখুন।’

রিসিভার রেখে পুলিন উত্তেজিত মুখে ভারতীর দিকে তাকাল। সে এই দ্বিতীয়বার ফোনে কথা বলল, তাও আট বছর পর। অনীশের এক বন্ধু ফোন করেছিল। প্রণববাবুর ছেলে নেমে এসে খবর দেয়। অনীশ বাড়ি ছিল না, পুলিন উপরে গিয়ে ফোনে কথা বলেছিল।

‘বেশ সুন্দর, রংটা পাকা টমেটোর মতো!’ ভারতী সন্তর্পণে আঙুল দিয়ে রিসিভারটা ছুঁয়ে লাজুক স্বরে বলল, ‘আমি কখনো ফোনে কথা বলিনি।’

‘বলো না। কার সঙ্গে কথা বলবে?’

‘কারোর নম্বরই তো জানি না। জানলে অনির সঙ্গে কথা বলতুম।’

‘এবার থেকে একটা নোট বইয়ে সবার নম্বর লিখে রেখে দিতে হবে। অনির অফিসের, বউমার অফিসের, অনির শ্বশুর বাড়ির।’ থেমে গেল পুলিন। সে আর কাউকে পেল না যাকে ফোন করা যায়।

ভারতী বলল, ‘এ বাড়িতে এই নিয়ে চারটে ফোন হল।’

বিকেলে কাশীনাথকে চা দিয়ে ভারতী বলল, ‘ফোনটা দেখেছেন বাবা, ভারি সুন্দর রংটা। দেখুন না গিয়ে।’

‘তোমরা দ্যাখো। টেলিফোন একটা দেখার জিনিস নাকি, কলকাতা শহরে অমন হাজার হাজার আছে’। কথাটা বলে কাশীনাথ চায়ে চুমুক দিল। ভারতীর মুখের ঔজ্জ্বল্য মলিন হয়ে গেল।

পয়লা তারিখেই গুহ এস্টেটের সরকার বিমানবাবু সকাল দশটায় প্রতি মাসের মতো কলিংবেল বাজাল। দরজা খুলে পুলিন অন্যান্যবারের মতো বলল, ‘দাঁড়ান।’ এরপর এত বছর যা করেছে—কাশীনাথের কাছে গিয়ে বলা, ‘বাবা ভাড়া নিতে এসেছে’—তা না করে সে ভারতীর কাছে গিয়ে বলল, ‘ভাড়ার টাকাটা দাও।’

ভাড়ার টাকা নিয়ে বিল দিয়ে ব্যস্ত বিমানবাবু চলে গেল। অন্যান্য ফ্ল্যাট আর নীচের দোকানগুলো থেকে তাকে ভাড়া নিতে হবে। বিলটা ভারতীকে দিয়ে পুলিন বলল ‘আলমারিতে রেখে দাও, বাবাকে বলার দরকার নেই। দশরথের মায়ের মাইনেটা আজই দিয়ে দিয়ো।’

রাত্রে পুলিন আর ভারতী মেঝেয় শুয়ে। চারটি পায়ার নীচে আটটা ইট দিয়ে তোলা খাটে কাশীনাথ শুয়ে। দু—জনের শরীরের নিম্নাংশ খাটের নীচে।

‘হ্যাঁরে পুলিন, আজ যে ভাড়া নিতে এল না!’

পুলিন জবাব দেবার আগেই ভারতী বলল, ‘এসেছিল বাবা, আপনি তখন কলঘরে ছিলেন, বললুম একটু পরে আসতে তাইতে বিমানবাবু বললেন কাল আসবেন।’

ভারতী ফিসফিস করে পুলিনকে বলল, এত রাতে কিছু বোলো না। কী শুরু করে দেবেন কে জানে।’

‘বউমা দশরথের মায়ের টাকাটা কাল চেয়ে নিয়ো।’

‘নোব, এখন আপনি ঘুমোন।’

পরদিন দুপুরে ভাত খেতে বসে কাশীনাথ আবার বলল, ‘কই বিমানবাবু তো এল না যে?’

শ্বশুর কী তাণ্ডব শুরু করে দেবেন ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে শুনলে, সেই আতঙ্কে ভারতীর মাথায় কী দুর্বুদ্ধি চাপল কে জানে, কিছু না ভেবেই সে বলে দিল, ‘এসেছিলেন, বললেন ভাড়ার টাকা ওদের সেরেস্তায় গিয়ে দিয়ে আসতে। নতুন নিয়ম করেছে এখন যে মালিক হয়েছে, পয়লায় না দিলে ওদের ওখানে গিয়ে দিতে হবে। আপনি টাকাটা দিন উনি বিকেলে দিয়ে আসবেন।’

‘এরকম নিয়ম করেছে, কই আগে তো জানায়নি! জানানো উচিত ছিল। এবার থেকে টাকা রাতেই তোমাকে দিয়ে রাখব, দশরথের মায়েরটাও।’

কাশীনাথ তার ক্যাশবাক্সের তালা খুলে দুশো টাকা বার করে ভারতীর হাতে দিয়ে বলল, ‘বিলটা আমাকে দিয়ো। আর শোনো, টেলিফোনের টাকা কিন্তু আমি দোব না। আমাকে না জানিয়ে তোমরা এটা নিয়েছ, আমার কোনো দায়দায়িত্ব নেই।’

সন্ধ্যায় ভারতী ভাড়ার বিলটা কাশীনাথকে দিয়ে বলল, ‘বাবা এই যে বিল। এবার থেকে ভাড়ার টাকা আগের রাতেই দিয়ে রাখবেন।’

কাশীনাথের দেওয়া দুশো টাকা ভারতী কোথায় রাখবে ঠিক করতে সাত—পাঁচ ভেবে অবশেষে বলাকাকে বলল, ‘বউমা তোমার কাছে ছেঁড়া ফাটা কোনো ব্যাগ আছে আমি টাকা রাখব।’

‘কত বড়ো।’

‘এই যেটা নিয়ে তুমি অফিস যাও অতবড়ো হলেই হবে।’

‘ওটা তো বেশ বড়ো, কত টাকা রাখবেন?’

বলাকার অবাক হওয়া দেখে ভারতী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, ‘অল্প টাকা মাসে মাসে রাখব।’

‘আপনি ব্যাক সেভিংসে রাখুন না। এই তো এখানেই আমাদের একটা ব্রাঞ্চ রয়েছে। আমি টেলিফোনে শ্যামনগর থেকে বলে দেব।’

ব্যাঙ্ক, চেকবই, পাসবই, সইকরা এগুলো নিয়ে সে শ্বশুরকে ব্যস্ত থাকতে দেখেছে। অত হিসেবনিকেশ আর সই করতে হবে ভেবে ভারতী অস্বস্তি বোধ করে বলল, ‘সামান্য টাকার জন্য আবার ব্যাঙ্ক কেন, হুটপাট দরকারের জন্য হাতের কাছে ক—টা টাকা রাখব।’

বলাকা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘তাহলে আমার এই ব্যাগটাই নিন না। আমি তো ছুটি নিচ্ছিই, ব্যাঙ্কে যাব না। পরে একটা কিনে নেব।’

সেই থেকে শুরু হল ভারতীর গোপনে টাকা জমানো। কাশীনাথের মাসে মাসে দেওয়া যাবতীয় টাকা সে বলাকার দেওয়া হাত ব্যাগটায় ভরে দেয়। শ্বশুরকে না জানিয়ে তার দেওয়া খরচের টাকা সরিয়ে রেখে, ছেলের দেওয়া টাকা আর দোকান ভাড়ার দু—হাজার টাকা দিয়ে তার সংসারের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের ব্যাপারটি আর জানে শুধু পুলিন।

ছেলের আত্মমর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে সে যে শ্বশুরের সঙ্গে চাতুরি করছে এটাই তার মনের মধ্যে গুমোট তৈরি করে এক এক সময় দমবন্ধ করে দেয়। মাঝে মাঝে তার আপশোস হয়, মুখ ফসকে বলা মিথ্যেটা সে বলেছিল শ্বশুরের তাণ্ডব শুরুর ভয়ে। সংসারের একচ্ছত্র অধিপতির সিংহাসনে বসে একটা লোক প্রায় ষাট বছর রাজত্ব করে আসছে প্রবল প্রতাপে। হঠাৎ তার হাত থেকে শাসন ও পালনের দায়িত্বটা আচমকা কেড়ে নিলে এই তিরাশি বছর বয়স্ক মানুষটি যে কীভাবে খেপে উঠবেন সেটা মনে হতেই ভয়ে কিছু না ভেবেই হঠাৎ এমন একটা মিথ্যা কথা বলার জের তাকে টেনে চলতে হবে, সেটা কল্পনাতেও আনতে পারে না।

পুলিন বলেছিল, ‘বলেছ ঠিক আছে, কাউকে জানিয়ো না, বাবাকে নয় অনিকেও নয়। বাবা টাকা দিলেই নিয়ে নিয়ো, না নিলে কিন্তু ধরা পড়ে যাবে।’ একটা অপরাধ ঢাকতে আর একটা অপরাধ করার মতো ভারতী প্রতি মাসে টাকা নিয়েছে। আর ব্যাগে রেখে দিয়েছে। কাশীনাথ জানে সংসারের প্রধান খরচগুলো মেটাচ্ছে সে। তার বিরক্তি, রাগ, হুকুম, গালমন্দ সে অব্যাহত রেখেছে।

বলাকার ছেলে হল নার্সিং হোমে সিজারিয়ান করে। সুস্থ সবল শিশু সাত পাউন্ড ওজন। ভারতী পাঁচটা ফ্ল্যাটে সন্দেশ দিয়ে এসেছিল নিজে।

‘এবার তো ঠাকুমা হলেন’ কথাটা সব জায়গাতেই শুনতে হয়েছে। শুনে তার বুক ভরে গেছল খুশিতে। টালিগঞ্জ থেকে সবাই এসেছিল নার্সিং হোমে এবং শ্যামবাজার থেকেই মেট্রোয় চড়ে তারা ফিরে যায়। ভারতীর অনুরোধেও তারা গুহ ভবনে আসেনি, তার মনে হয়েছিল কাশীনাথের জন্যই তারা এল না। হয়তো বলাকা টেলিফোনে ওদের বলেছে কাশীনাথের কথা।

তার নাতি হওয়ার কথা সন্দেশ হাতে নিয়ে কাশীনাথকে জানাতেই প্রথম প্রশ্ন।

‘দেখতে কেমন হয়েছে? মায়ের মতো নয়তো? রং কেমন?’

‘সদ্য জন্মাল। এখন তো সব বাচ্চচাকেই একই রকম লাগবে। ক—টা মাস যাক মুখ চোখ তৈরি হোক তবে কেমন দেখতে হয়েছে বলা যাবে। আর গায়ের রং বাপের মতোই হয়েছে।’

‘পেট কেটে বাচ্চচা হয়েছে বললে। এই আজকালকার একটা ফ্যাশান।’

‘ফ্যাশান নয় বাবা এটার দরকার ছিল। আপনার পিসি আর বোন হয়তো মরতেন না যদি সিজারিয়ান করে বাচ্চচা হত। তখন গ্রামে এসব ব্যবস্থা ছিল না।’

‘আমিও তো গ্রামে দাইয়ের হাতে জন্মেছি, কই মা তো মরেনি!’

‘সেটা তাঁর ভাগ্য।’

এগুলো কি আমায় খেতে হবে?’ প্লেটে চারটে সন্দেশের দিকে কাশীনাথ বলল আঙুল দেখিয়ে।

‘খাবার জন্যই তো দিয়েছি!’ ভারতী বিভ্রান্তের মতো তাকাল।

‘নিয়ে যাও, নষ্ট কোরো না।’

প্রথম ঠাকুমা হওয়ার আনন্দ দপ করে উবে গেল ভারতীর অন্তর থেকে তিক্ত স্বরে বলল, ‘ঠিক আছে আপনাকে খেতে হবে না, নীচের দারোয়ানকে দিয়ে দোব,’ প্লেটটা তুলে নিয়ে সে চলে যায়।

নার্সিং হোম থেকে বলাকা তার বাচ্চচা নিয়ে সোজা বাপের বাড়ি চলে গিয়ে ফিরে আসে গুহ ভবনে একমাস পর। উমা যখন বেরোচ্ছিল সেই সময় ট্যাক্সিটা এসে গেটের সামনে থামে। প্রথমে নামল অনীশ, হাত বাড়িয়ে তোয়ালে জড়ানো শিশুকে সে দু—হাতে নিল, বলাকা ট্যাক্সি থেকে নামছে, উমা ছুটে গিয়ে অনীশের হাত থেকে বাচ্চচাকে দু—হাতে প্রায় কেড়ে নিয়ে বলল, ‘আমাকে দাও অনিদা।’

উমা অনির ছেলেকে নিয়ে তিনতলায় এল। ওর হাত থেকে নাতিকে নিয়ে ভারতী হাতে নাচিয়ে পুলিনের হাতে দিল। পুলিন ঘরে গিয়ে কাশীনাথের সামনে ধরে বলল, ‘বাবা অনেক ভাগ্য করলে লোকে পুতির মুখ দেখে।’

মিটমিট করে তাকিয়ে কাশীনাথ ক্যাশবাক্সের চাবিটা ফতুয়ার পকেট থেকে বার করে ছেলের দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘বাক্সটা খোল, ডানদিকের নীচের খোপে দুটো রুপোর টাকা আছে, একটা নিয়ে ওর হাতে দে। হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, চাবিটা নে।’

ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলাকা, অনীশ, উমা আর ভারতী। এক হাতে তোয়ালে জড়ানো ঘুমিয়ে কাদা হয়ে থাকা নাতি, অন্য হাতে চাবি নিয়ে পুলিন ক্যাশবাক্স খুলে ডানদিকের নীচের খোপ থেকে পঞ্চম জর্জের মুখের ছাপ দেওয়া একটা রুপোর টাকা বার করল।’

‘এবার এটা ওর হাতে দে।’

পুলিন ঘুমন্ত বাচ্চচার মুঠোয় টাকাটা গুঁজে দেবার চেষ্টা করছে তখনই বলাকা শ্বশুরের হাত থেকে ছেলেকে ছিনিয়ে নিয়ে, টাকাটা ছুড়ে দিল। সেটা লাগল কাশীনাথের বাহুতে।

‘দরকার নেই অমন টাকায়।’ এই বলে বলাকা প্রকাশ্যে দাদাশ্বশুরের বিরুদ্ধে ঘোষণা করে দিল তার যুদ্ধ, যেটা আগেই ঘোষণা করেছিল তার স্বামী। ভারতী আর উমা হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে।

কেউ কথা না বলে ফিরে এল দালানে। ছেলেকে নিয়ে বলাকা তার ঘরে ঢুকল। একটা বিশ্রী পরিস্থিতির কবলে পড়েছে সবাই। উমা বাইরের লোক, সব থেকে অপ্রতিভ সে। ‘আমি যাই’ বলে সে ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছাড়ল।

‘কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না।’ চুলে আঙুল ডুবিয়ে অনীশ বলল, ‘ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি দাদুর এই ধরনের ব্যবহার। কিছু করার নেই, কোথাও যে ফ্ল্যাট দেখে উঠে যাব তাও সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের অফিসটা আবার দুদিকে এতদূর যে, মেট্রো থেকে দূর হয়ে গেল বলাকার অসুবিধা হবে। এই বাড়িটা সব থেকে সুবিধাজনক বলেই অন্য কোথাও থাকার চেষ্টা করিনি। এবার দেখছি করতে হবে।’

অনীশ নিজের ঘরে চলে যাবার পর ভারতী বলল, ‘নতুন অতিথি এল আর কী অভ্যর্থনা পেল!’

পুলিন গলা চেপে বলল, ‘বাবার বয়স হয়েছে, আর ক—দিনই বা থাকবেন। একটু ধৈর্য ধরে থাকো।’

ক—দিন নয়, কাশীনাথ দিব্যি বহাল তবিয়তে পাঁচটা বছর কাটিয়ে অষ্টআশিতে পড়ল এবং পাঁচটা বছরে নিজের পুত্র আর পুত্রবধূ ছাড়া আর কাউকে তার বিষাক্ত গঞ্জনার শিকার করেনি। অনীশের অন্য কোথাও থাকার চেষ্টাটা ধীরে ধীরে থিতিয়ে এসেছে। অন্যত্র ফ্ল্যাট নিয়ে থাকতে হলে মাসে মাসে যে টাকা ভাড়া দিতে হবে সেটা বাঁচিয়ে জমাচ্ছে স্বামী—স্ত্রী। জমানো টাকার সঙ্গে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কিনতে বদ্ধপরিকর হয়েছে বলাকা। অনীশও লোন পাবে তার অফিস থেকে আর দু—বছর পর পাবলিক রিলেশনস ম্যানেজারের পদে অধিষ্ঠিত হলে। বলাকার মেজোমামা অনীশকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন।

কম কথাবলা বলাকা কথা বলা আরও কমিয়ে দিয়েছে। যতটুকু বলে তা শুধু শাশুড়ির সঙ্গেই। সে অফিসে চলে যাবার পর বাচ্চচা কুচুন তার ঠাকুমার সবটুকু সময় দখল করে নেয়। বলাকার দেওয়া ব্যাগে টাকা রাখতে রাখতে আর জায়গায় কুলোচ্ছিল না। পুলিনকে দিয়ে সে একটা সুদৃশ্য ঝোলা কিনে আনিয়েছে। তার মধ্যে রেখেছে মুঠো মুঠো নোট।

একদিন দুপুরে অনীশের ঘরে টিভি দেখতে দেখতে পুলিন বলল, ‘কত জমল গুণে দেখেছ কী? মাসে মাসে বাবা দিয়েছে প্রায় আট—নশো টাকা। কুচুনের জন্মানোর সময় থেকে দিচ্ছেন। একদিন গুনে দেখতে হবে।’

কুচুনকে অনীশ এন্টালির এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভরতি করে দিয়েছে। স্কুলের বাস আসে সকাল সাড়ে ছ—টায় সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুর মোড়ে দাঁড়ায়। পুলিন তাকে বাসে তুলে দিয়ে আসে। স্কুল ছুটি হয় সওয়া এগারোটায়। বাস কুচুনকে নামিয়ে দিয়ে যায় বারোটায়। ভোরে ঘুম থেকে ওঠা কুচুন ক্লান্ত হয়ে ফেরে। স্নান করে ভাত খেয়েই সে ঘুমিয়ে পড়ে।

দুপুরে ঘুমন্ত কুচুনের পাশে খাটে শুয়ে ভারতী বলল, ‘অনেক টাকা, ঝোলাটার পেট ফুলে উঠেছে। অত টাকা নিয়ে আমরা কী করব বলো তো? কী ঠিক করেছি জানো, টাকাগুলো অনিকে দিয়ে দোব।’

পুলিন চমকে উঠল। ‘তার মানে?’

‘ফ্ল্যাট কিনতে ওদের সময় লাগছে টাকার জন্য। পাঁচ—সাত লাখ টাকা জমানো কী সোজা কথা! এই টাকাটা পেলে ওদের সুবিধে হবে।’

‘ঝোলাটা বার করো, গুনে দেখা যাক।’

ভারতী চাবি দেওয়া আলমারি খুলে রঙিন ঝোলাটা বার করে হাতে তুলে ধরে ওজন পরখ করে বলল, ‘এক কিলো তো হবেই।’

‘দরজা দুটো বন্ধ করো, পাখাটাও। নয়তো হাওয়ায় নোট উড়বে।’

ভারতী ঝোলা উপুড় করে মেঝেয় নোটগুলো ঢেলে বলল, ‘বাব্বা, এত নোট, একটুও তো বুঝতে পারিনি। টাকা পেতুম আর চোখ বুজে ঝোলায় ঢুকিয়ে দিতুম। আচ্ছা তুমি একসঙ্গে এত নোট কখনো দেখেছ?’

পুলিন স্তূপ করা নোট মুঠোয় তুলে ধরে মেঝেয় ফেলে দিতে দিতে বলল, ‘দেখিনি। বউমা নিশ্চয় রোজ দেখে। এবার এক কাজ করো, নোটগুলো আলাদা আলাদা করো। পাঁচ, দশ, পঞ্চাশ, একশো করে ভাগা দিয়ে রাখো।’

দু—জনে দ্রুত হাতে চারভাগা করার পরও এক টাকা ও দু—টাকার প্রচুর নোট থেকে গেল।

পুলিন বলল, ‘ওগুলো পরে গুনব, আগে এই বড়োগুলো গুনে ফেলা যাক। তাড়াতাড়ি করো।’

ভারতী বলল, ‘গুনে গুনে তো যোগ দিতে হবে, দাঁড়াও কাগজ আর পেনটা আনি।’

টেলিফোনের পাশে রাখা ডটপেন আর প্যাঠ, ভারতী নিয়ে এল। দু—জনে নোটগুলো গুনে কাগজে টুকে রেখে যোগ দিল। পুলিন যোগফল দেখে বিশ্বাস করতে না পেরে আবার যোগ করল। তারপর ভারতীকে বলল, ‘তুমি একবার যোগ দাও তো।’ ভারতী যোগ করে বলল, ‘ঠিকই তো আছে, একান্ন হাজার সাতশো বাইশ। খুচরো এক—দুটাকাগুলো তাও গোনা হয়নি। গুনলে আরও দু—তিনশো হবে।’

‘তার মানে বাহান্ন হাজার টাকা!’ পুলিনের মুখ দিয়ে আর কথা সরল না।

‘হবে না? সাড়ে চার বছরের জমানো টাকা।’

‘বাবা এখনও পর্যন্ত জানেন তার টাকাতেই বাজার ছাড়া আর সব খরচ চলছে। আর তার দেওয়া টাকাগুলো যে—।’ পুলিন আঙুল দিয়ে মেঝেয় থোক করে রাখা নোটগুলো দেখাল।

ভারতী শুনে মুচকি হাসল। ‘ব্যাঙ্কে বাবার কত টাকা জমেছে এতদিনে আমরা জানি না। মাসে মাসে পেনশন যা পান সেটা তো কম নয়।’

‘চার বছর আগে পেনশন বেড়ে হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা! এটা আমি জানি।’

রান্নাঘরে জমিয়ে রাখা আছে রাবার ব্যান্ড। ভারতী তার গোটা দশেক এনে নোটগুলো বান্ডিল করে ঝোলায় ভরে রাখল। ঝোলার পেটমোটা ভাবটা কমে গেল।

‘একটা কথা ভেবে দেখো, অনিকে টাকাগুলো দিতে গেলেই জিজ্ঞেস করবে পেলে কোত্থেকে, তখন কী বলবে? বাবার কাছ থেকে নিয়েছি, তোর কাছ থেকেও নিয়েছি, এই কথা বলবে?’ পুলিন জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।

ভারতীর কপালে ভাঁজ পড়ল, বলল, ‘ যা সত্যি তাই বলব, এ টাকা তোর ঠাকুরদা মাসে মাসে দিয়েছে, আমি তুলে রেখেছিলুম।’

‘আর অমনি হাত পেতে অনি নিয়ে নেবে? ঠাকুরদার টাকা নেওয়া বন্ধ করার জন্যই তো ও টাকা দিয়ে যাচ্ছে। তুমি গাছেরও খেয়েছ তলারও কুড়িয়েছ।’

‘আমিই শুধু খেয়েছি আর কুড়িয়েছি! তুমিই তো রাস্তা দেখলে। বিমানবাবুকে দাঁড় করিয়ে বাবার কাছে না গিয়ে আমার কাছে এসে টাকা চাইলে, মনে পড়ে? এখন তুমি তুমি বলে আমাকে দেখাচ্ছ।’ ক্রুদ্ধ ভারতী ঝোলাটা আলামারিতে রেখে চাবি দিয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

বিকেলে চা খেতে খেতে ভারতীকে পুলিন বলল, ‘এখন অনিকে কিছু বলার দরকার নেই। সাড়ে চার বছর যখন কেটেই গেল আর দু—তিনটে বছর যাক। কুচুনকে জামাজুতো পরিয়ে দাও পার্কে নিয়ে যাব।’ তারপর যোগ করল, ‘বাবাকে কোনোভাবে চটিয়ো না, যা খেতে চাইবে দেবে। দেখি ঝালমুড়িওলাটাকে পাই কি না।’

কুচুনকে নিয়ে পুলিন বেরিয়ে যাবার পর ভারতী শ্বশুরকে চা দিতে গিয়ে দেখল কাশীনাথ বেডকভার মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে।

‘বাবা চা এনেছি।’

কাশীনাথ সাড়া দিল না। ভারতী আবার ডাকল। সাড়া মিলল না। এবার সে শ্বশুরের কাঁধ ধরে নাড়া দিয়ে বলল, ‘উঠুন, ‘পাশ ফিরল কাশীনাথ, ঘোলাটে চোখে তাকিয়ে রইল, মুখ দেখে ছ্যাঁৎ করে উঠল ভারতীর বুক। শ্বশুরের কপালে হাত রেখে বলল, ‘এ কি গা পুড়ে যাচ্ছে!’

ভারতী জলপটি নিয়ে কাশীনাথের পাশে বসল। দ্বিতীয় কেউ এখন ফ্ল্যাটে নেই। সে অসহায় বোধ করল। থার্মোমিটার বাড়িতে নেই। ভারতী ছুটল চারতলায়। প্রণববাবুর বউয়ের কাছে থেকে থার্মোমিটার এনে কাশীনাথের জ্বর দেখল, একশো চার ডিগ্রি!

এবার সে কাশীনাথকে ঘুরিয়ে মাথার নীচে কুচুনের রাবারক্লথ রেখে মাথায় জল ঢালতে শুরু করল। একটু পরেই পুলিন ফিরল কুচুনকে নিয়ে, হাতে বাবার জন্য ঝালমুড়ির ঠোঙা।

‘কী হয়েছে বাবার?’

‘ভীষণ জ্বর, ডাক্তারবাবুকে একবার ডাকতে হবে।’

তিনটে বাড়ির পরেই থাকেন ডাক্তার চক্রবর্তী। পুলিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘উনি তো এখন বেরিয়ে গেছেন বড়োবাজারের চেম্বারে বসার জন্য।’

‘তাহলে কাছাকাছি কোনো ডাক্তারখানায় দেখো কাউকে পাও কিনা, পপুলার মেডিক্যালে তো একজন বিকেলে বসে শুনেছি। যত টাকা ফি চাইবে দোব।’ ভারতী ব্যাকুল স্বরে বলল।

পুলিন ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। মাথায় জল ঢালা ছাড়া আর কী করবে ভারতী ভেবে পাচ্ছে না। চোখ বন্ধ করে কাশীনাথ আচ্ছন্নের মতো শুয়ে। শ্বাস গভীরভাবে নিচ্ছে, মুখ থেকে ক্ষীণ ঘরঘর শব্দের সঙ্গে সে মাথাটা এপাশ ওপাশ করল। ভারতী পাশের ঘরে গিয়ে ফোন করল অনীশকে।

দাদুর হঠাৎ ভীষণ জ্বর, আমার ভালো ঠেকছে না। তোর বাবা ডাক্তার ডাকতে গেছে। পারলে তুই এখুনি চলে আয়।’

পুলিনের সঙ্গে এল অল্পবয়সি এক ডাক্তার। নাড়ি দেখলেন, রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে। প্রশ্ন করলেন, ‘কখন থেকে জ্বর হয়েছে?’

ভারতী বলল, ‘দুপুরে ভাত খেয়ে শুয়েছেন। তখনও দেখেছি অন্যদিনের মতোই স্বাভাবিক, ঘণ্টাখানেক আগে চা দিতে এসে দেখি জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।’

‘বয়স কত এনার?’

পুলিন বলল, ‘অষ্টআশি।’

ডাক্তারের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। চোখের পাতা টেনে তুলে দেখে বললেন, ‘মনে হচ্ছে ম্যালেরিয়া, ম্যালিগনান্ট হতে পারে। ওঁকে হসপিটালাইজ করুন, নয়তো কোনো নার্সিং হোমে নিয়ে যান। জ্বরের জন্য একটা ট্যাবলেট দিচ্ছি, তবে ওর রক্ত পরীক্ষা করা দরকার।’

বাড়িতে আসার জন্য ডাক্তারবাবু ডবল ফি নিলেন আশি টাকা। তিনি চলে যাবার পর পুলিন বিপন্ন মুখে বলল, ‘নার্সিং হোম কী হাসপাতাল যেখানেই যাই না কেন বাবাকে নিয়ে যাবটা কেমন করে?’

‘অ্যাম্বুলেন্স করে। নয়তো কীসে করে এমন অবস্থায় নিয়ে যাবে? একটু আগে অনিকে ফোন করেছি, ও আসছে, যা করার ওই করবে। তুমি আগে ওষুধটা আনো।’

সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় উমার বাবার সঙ্গে দেখা হতে পুলিন তাকে জানিয়ে দিল বাবার ম্যালিগনান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছে। একটু পরেই জয়ন্তী হাজির হল উদবিগ্ন মুখে।

ভারতীর কাছে সব শুনে তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন। কারোরই এখন কিছু করার নেই কাশীনাথের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। জয়ন্তী একবার শুধু অস্ফুটে বলল, ‘বয়সও তো হয়েছে, এখন ধাক্কাটা সামলানো শক্ত।’

অনীশ এসে পৌঁছল ট্যাক্সিতে। ভারতীর কাছে সব শুনে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে দিল পরিচর্যা নার্সিং হোমে। ওদের নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্স আছে।

পুলিনের আনা ট্যাবলেট প্রায় অজ্ঞান কাশীনাথকে খাওয়ানো বা গেলানো সম্ভব হল না। পুলিন নীচে নেমে গেটে দাঁড়িয়ে রইল। অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি দেখেই হাত নেড়ে থামিয়ে স্ট্রেচারসহ দু—জনকে ওপরে নিয়ে আসে।

কাশীনাথকে যখন অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে তখন তার মুখ থেকে রক্ত বেরিয়ে এল। অনীশ তা লক্ষ করেছিল, সঙ্গে থাকা পুলিনকে কিছু বলল না।

নাতিকে নিয়ে ভারতী তিনতলার বারান্দা থেকে দেখল কাশীনাথের নার্সিং হোমে যাওয়া। কিছুক্ষণ পরেই বলাকা ফিরল।

‘বাবাকে অনি নার্সিং হোমে নিয়ে গেল একটু আগে।’

হতভম্ব বলাকা বলল, ‘কী হয়েছে? সকালে তো দেখলাম দিব্যি রয়েছেন।’

‘তোমার শ্বশুর একজন ডাক্তার ডেকে আনেন, তিনি বলে গেলেন ম্যালেরিয়া হতে পারে। কী যে হবে কে জানে।’ ভারতী শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কাশীনাথের খাটের দিকে। টেবিলের উপর পড়ে রয়েছে ঝালমুড়ির ঠোঙা। ভারতী বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে এসে খাটে বসে পড়ল। তখন মনে পড়ল বলাকাকে খেতে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের জল চড়াল।

‘বউমা কী খাবে এখন, চিড়ে ভেজে দোব?’

‘থাক মা খিদে নেই। দাদুর কথা শুনে খাওয়ার ইচ্ছে চলে গেছে। বরং চা দিন।’

বলাকাকে চা দিয়ে ভারতী কাশীনাথের ঘরে এল। বিছানায় বেডকভারটা পেতে বালিশটা মাথার দিকে রাখতে গিয়ে মেঝেয় পড়ে গেল ক্যাশবাক্সের চাবিটা। এটা যক্ষের ধনের মতো কাশীনাথ সঙ্গে করে রাখে। চাবিটা সে ক্যাশবাক্সের উপর রেখে দিল। আবার সে খাটে বসে বাহুতে বাহু রেখে মাথা হেলিয়ে দিল। উৎকণ্ঠা তাকে গ্রাস করেছে। অবসন্ন হয়ে পড়ছে হৃদয়। বুড়ো মানুষটা তাকে বলেছিল ‘ধুতি—পাঞ্জাবি পরে একবার বড়ো রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যাব, তুমি থাকবে আমার সঙ্গে।’ সাইকেলের ধাক্কা খাওয়ার পর বুড়োমানুষটার হেঁটে যাওয়া আর হয়নি। অনি তসরের পাঞ্জাবি তৈরি করে দিয়েছিল আর কিনে এনেছিল ছয় ইঞ্চি পাড়ের ধুতি। সে দুটো এখনও আলমারিতে তোলা আছে।

ঘণ্টা দুয়েক পর ফোন বেজে উঠল পাশের ঘরে। ভারতী ছুটে গেল। রিসিভার কানে লাগিয়ে শুনে যাচ্ছে বলাকা। কাকে যেন বলল, ‘হ্যাঁ মাকে বলছি।’

ভারতী ব্যগ্র হয়ে বলল, ‘বউমা, অনির ফোন? বাবা কেমন আছে?’

‘দশ মিনিট আগে মারা গেছেন। আপনি কাউকে সঙ্গে নিয়ে এখুনি যান, নার্সিং হোমটা তো চেনেন, আমাকে দেখতে যেতেন। দাদুকে আর ওরা বাড়িতে আনবেন না। ওখান থেকেই শ্মশানে নিয়ে চলে যাবেন।’

একবার থরথর করে কেঁপে উঠেই বিহ্বলতা কাটিয়ে শত হয়ে গেল ভারতী।

‘ভাল কথা, কিছু টাকাও সঙ্গে করে নিয়ে যেতে বলল, ওর কাছে বেশি টাকা নেই।’

ভারতী আলমারি খুলে ঝোলাটা বার করল। নোটের বান্ডিলগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। বলাকাও তাকিয়ে রয়েছে চোখে বিস্ময় নিয়ে। ভারতী একটা বান্ডিল বার করে নিয়ে বলল, ‘এটা এখন তোমার কাছে রেখে দাও।’ তারপর সে কাপড়ের থাকের নীচের থেকে টেনে বার করল তসরের পাঞ্জাবি আর ময়ূরপুচ্ছ ধুতিটা।

‘বউমা সেদিন অনি যে ব্যাগটায় করে শার্ট কিনে আনল, সেটা আছে? থাকলে দাও। আর চিরুনিটাও দাও।’

বলাকা স্টিলের আলমারি থেকে শার্টটা বার করে নিয়ে খালি পলিথিনের ব্যাগটা দিল। টাকা, ধুতি, পাঞ্জাবি, চিরুনি তাতে ভরে নিয়ে ভারতী বলল, ‘দেখি উমার ভাই যদি যায় তো ওকে নিয়েই যাব।’

শাড়ি বদলিয়ে চটি পরে ভারতী বেরিয়ে পড়ল। দোতলায় উমাদের সকলেই ফ্ল্যাটে রয়েছে। ভারতী বলামাত্র জয়ন্তী বললেন, ‘নিশ্চয় যাবে। এতরাতে আপনি একা যাবেন কী! রমু যাবে সঙ্গে।

রমু আর ভারতী ট্যাক্সিতে পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে গেল। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে অনীশ আর পুলিন। তারা ভারতীকে নিয়ে গেল দোতলায়। একটা ছোট্ট কেবিনে কাশীনাথ খাটে শুয়ে। চোখে চশমা। পরনে ফতুয়া—পাজামা। ব্যাগ থেকে ভারতী ধুতি আর পাঞ্জাবি বার করল। টাকার বান্ডিলটা ছেলের হাতে তুলে দিয়ে বলল,

‘অনি, এ দুটো চিনতে পারিস?’

‘হ্যাঁ।’

‘দাদুকে পরিয়ে দে। আয় তুলে ধর।’

দু—জনে ধুতি পরাল পাজামার উপরেই। ফতুয়া খুলে পরাল পাঞ্জাবিটা। ভারতী চিরুনি দিয়ে কাশীনাথের যে ক—টা চুল রয়েছে পাতা কেটে আঁচড়ে দিল।

‘চন্দন পেলে ভালো হত। ফুল দিবি না?’

‘ওহ হ্যাঁ, নিশ্চয়। বাবা তুমি চট করে যাও শ্যামবাজার বাজারে। আর দু—প্যাকেট ধূপও আনবে।’

‘শোনো। রজনীগন্ধা আনবে।’

অনীশের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুলিন বাজারের দিকে রওনা হল, সঙ্গে রমু।

‘হ্যাঁরে অনি, কীভাবে নিয়ে যাবি?’

‘গুরুদুয়ারা শিখ প্রবন্ধকের গাড়িতে। নার্সিং হোম থেকেই ফোন করে দিয়েছে।’

‘চল বাইরে গিয়ে দাঁড়াই।’

দু—জনে নেমে এসে গেটের সামনে দাঁড়াল। ভারতী জিজ্ঞাসা কর,. ‘কী হয়েছিল দাদুর?’

‘বাড়িতে ডাক্তার যা আন্দাজ করেছিল তাই। কলকাতায় এখন খুব হচ্ছে এই টাইপের ম্যালেরিয়া। এখানে কিছু করার ছিল না।’

‘এবার থেকে মশারি টাঙিয়ে শুবি, কুচুনের জন্যই বিশেষ করে।’

‘রমুকে কী বাড়ি চলে যেতে বলব? দাহ শেষ হতে ভোর হয়ে যাবে।’

‘কীসে দাহ হবে? চিতা সাজিয়ে না ইলেকট্রিক চুল্লিতে? আমাদের বংশের সবাই কিন্তু চিতায় উঠেছে।’ ভারতীর মুখে পাতলা হাসি খেলে গেল।

‘দাদুকে দিয়েই ট্র্যাডিশনটা ভাঙব।’ অনীশও হাসল।

‘এখানকার বিল মিটিয়ে দিয়েছিস? ঠিক কত টাকা বান্ডিলটায় আছে জানি না, টাকাগুলো তোর দাদুর।’

অনীশ ভ্রূ তুলল সঙ্গে কাঁধও। তাই দেখে ভারতী বলল, ‘নিজের জন্য কাউকে একটা পয়সাও খরচ করতে দেননি। আমার বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি অন্তত দেখিনি।’

নার্সিং হোমের টাকা মিটিয়ে দিতে অনীশ ভিতরে গেল। এসে পড়ল রমু আর পুলিন। একজনের হাতে রজনীগন্ধা স্টিকের বোঝা, অন্যজনের হাতে পদ্মফুল।

‘রমু তুমি কি এখন বাড়ি যাবে?

‘না জেঠিমা, মা বলেছে শেষপর্যন্ত থাকতে।’

অনীশ বেরিয়ে এল। ‘ফোন করলাম, বলে কুড়ি মিনিট আগে গাড়ি বেরিয়ে গেছে। আরে ওই তো এসে গেছে।’

কাচের গাড়ি থেকে দুটি লোক স্ট্রেচার নামাল। দোতলায় গেল। স্ট্রেচার মেঝেয় পাততেই ভারতী রজনীগন্ধার কলি স্টিক থেকে ছিঁড়ে নিয়ে স্ট্রেচারে ছড়িয়ে দিল কয়েকমুঠো।

‘এবার শোয়ান ওকে।’

লোকদুটি কাশীনাথকে শোয়াবার পর ভারতী বাকি স্টিকগুলো দেহের দুপাশে সাজিয়ে রাখল। পদ্মর পাপড়ি ছড়িয়ে দিল দেহের উপর। চুলে আর একবার চিরুনি দিয়ে বলল, ‘দাড়িটা খোঁচা খোঁচা হয়ে রয়েছে। এখন তো কামিয়ে দেওয়া যাবে না।’

ড্রাইভারের পেছনে লম্বা টানা সিটে বসল চারজন। ফুলছড়ানো শয্যায় শুয়ে তসরের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে বউমাকে সঙ্গে নিয়ে কাশীনাথ চলল নিমতলা শ্মশানের উদ্দেশে।

.

দু—দিন পর দুপুরে ভারতী কাশীনাথের ক্যাশবাক্সটি খুলে পেল ব্যাঙ্কের পাসবই চেকবই, এক খণ্ড কাগজ আর একশো টাকা। পাসবই খুলে দেখল জমার ঘরে রয়েছে দু—লক্ষ চল্লিশ হাজার পঁয়ষট্টি টাকা। কাগজে তিন লাইনে পরিষ্কার অক্ষরে লেখা রয়েছে—’আমার মৃত্যুর পর ব্যাঙ্কে আমার যত টাকা আছে সবই আমার ছেলে আইনতই পাবে কিন্তু আমার শোয়ার খাটটি পাবে বউমা। ওর শুতে খুব কষ্ট হয়। আর হবে না । ইতি শ্রীকাশীনাথ রায়।’

মালবিকা

ঘটনাটার শুরু এই বাড়ি থেকেই, তাই গৃহস্বামী ও গৃহকর্ত্রীকে আগে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক।

সুধাংশুকুমার গাঙ্গুলি বাংলা খবরের কাগজে চিফ সাব—এডিটরের চাকরি করেন। পঁয়ত্রিশ বছরের সাংবাদিক জীবনে তিনটি কাগজে কাজ করেছেন। খুব ছোটোই তাঁর সংসার। স্ত্রী উমা, তিনমাস—বিয়ে—হওয়া একমাত্র ছেলে প্রভাংশু আর ছেলের বউ সুচিত্রা। অবশ্যই একটি চাকর আছে, কল্যাণ। ইতিহাসের এম এ সুধাংশু সাবধানী এবং হিসেবি কিন্তু কৃপণ নন। একটু রক্ষণশীল কিন্তু যুগের সঙ্গে তাল রেখে উদারও। ঔদার্যের চরম সীমা এখন পর্যন্ত ছুঁয়েছেন ছেলের বিয়েতে। প্রভাংশু সুবর্ণবণিকের মেয়ে বিয়ে করতে চাইলে তিনি আপত্তি করেননি। সুচিত্রা রূপবতী, ধনী কন্যা এবং বাংলা অর্নাসসহ গ্র্যাজুয়েট। প্রায় পনেরো ভরি সোনার গহনা সে বাপের বাড়ি থেকে এনেছে। সুধাংশু এটা রোধ করতে না পারলেও রঙিন টিভি সেট ও রেফ্রিজারেটর কিছুতেই নিতে রাজি হননি। ওগুলো তাঁর আছে। কিন্তু থাকলেও অনেক ছেলের বাপ তো লোভ সামলাতে পারেন না কিন্তু তিনি পেরেছেন। নিজের সম্পর্কে সুসভ্য ও শিক্ষিত বলে তাঁর চাপা একটা গর্ব আছে।

চাকরি—জীবন শুরু করে বড়দার কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ধার নিয়ে সুধাংশু কলকাতার উপকণ্ঠে পাতিপুকুরে তিন কাঠা জমি কিনে ফেলেন। কলকাতা অদূর ভবিষ্যতে বাড়বে এবং পাতিপুকুর কলকাতার মধ্যে ঢুকে যাবে এটা তিনি পঁয়ত্রিশ বছর আগেই বাস্তব হালচাল থেকে বুঝে গেছলেন। দাদার ঋণ তিন বছরেই শোধ করে, তিনতলার ভিত গেঁথে প্রথমে একতলা একটি বাড়ি তৈরি করেন। এ—জন্য দু—বছর ধরে নানান জায়গা থেকে সস্তায় গৃহনির্মাণ সামগ্রী তাঁকে সংগ্রহ করতে হয়েছিল।

যতটা পরিশ্রম ও অধ্যবসায় নিয়ে সুধাংশু একতলা বাড়িটাকে দোতলায় পরিণত করেন ঠিক ততটা যত্ন ও নিষ্ঠা নিয়েই তিনি প্রতিদিন প্রভাংশুকে পড়াতে বসতেন। ছেলের শিক্ষার ভিতটা উচ্চচ মাধ্যমিক পর্যন্ত গেঁথে দেওয়ায় সে শিবপুর থেকে উচ্চচ প্রথম শ্রেণি পাওয়া ধাতুবিদ্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিশাখাপত্তনমে ইস্পাত কারখানায় এখন মোটা বেতনের চাকুরে।

ছেলের সম্পর্কে সুধাংশু যতটা নিশ্চিন্ত, উমা সম্পর্কে ঠিক ততটা নন। গ্রামের স্কুল থেকে কোনোক্রমে মাধ্যমিক পাশ করা, সাদাসিধা সরল উমা, একজন চিফ সাব—এর বউয়ের পক্ষে যতটা চৌকশ হওয়া উচিত, সুধাংশুর ধারণায় ততটা নয়। উমা বাইরে একা চলাফেরা করেন, দোকানে বাজারে যান, দর করে দামও কমাতে পারেন, কম তেল মশলায় সুস্বাদু করে রাঁধতে পারেন, সর্বোপরি একত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনে একবারও গলা চড়িয়ে স্বামীর সঙ্গে কথা বলেননি। ঠান্ডা, নরম, ভালোমানুষ বিশেষণগুলো যেন গহনার মতো উমার অঙ্গে শোভা পায়।

কিন্তু সুধাংশুর চাপা একটা খেদ রয়ে গেছে। বাইরের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে গেলে, সাংসারিক বিষয়ের বাইরে কথাবার্তা হড়কে গেলেই উমা হাবুডুবু খায়। পৃথিবীতে কত কী ঘটছে, ভারতেও কত কী ওলটপালট হচ্ছে তার কোনো খবরই উমা রাখে না। মণ্ডল কমিশন, রামজন্মভূমি, বোফর্স, গ্লাসনস্ত, পেরোস্ত্রৈকা, খোলা বাজার, রুশদি, তেন্ডুলকর, ম্যান্ডেলা এইসব বেশি তলিয়ে বোঝার হয়তো দরকার নেই কিন্তু ব্যাপারটা কী বা লোকগুলো কেন বিখ্যাত সেই সম্পর্কে তো ওপর ওপর কিছু জেনে রাখা দরকার। ইংরেজি বাংলা দুটো খবরের কাগজ বাড়িতে আসে। বাংলা কাগজের হেডিংগুলো পড়লেও তো কিছু জানা যায়। কিন্তু উমার প্রবল আলস্য কোনো কিছু পড়ায়। গল্প—উপন্যাসও পড়ে না।

তাই সুধাংশু প্রায়শই সকালের বাজার এনে রান্নাঘরের দরজার কাছে চেয়ারে বসে, উমার জানা দরকার এমন সব হেডিং কাগজ থেকে পড়ে শোনান। ইংরেজি কাগজ হলে ইংরেজির সঙ্গে বাংলা তর্জমাও করে দেন। কুটনো কোটা আর দুনিয়া সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়ার কাজ উমা একসঙ্গেই চালান।

আজ রবিবার। সকাল প্রায় দশটা। একটু আগে বউকে নিয়ে প্রভাংশু চন্দননগরে শ্বশুরবাড়ি গেল। সেখানে রাত্রিবাস করে কাল বিকেলে ফিরবে, পরশু সে বউকে নিয়ে বিশাখাপত্তনমে চলে যাবে। উমা আজ দুপুরে বকুল আর তার মেয়ে মালবিকাকে নিমন্ত্রণ করেছেন। মালবিকার বিয়ে আর আট দিন পরেই, উমা তাকে আইবুড়ো ভাত খাওয়াবেন। ঠিক করেছেন, কাঁচালঙ্কা সর্ষেবাটা দিয়ে চিংড়ি মাছের ভাপা রাঁধবেন, এটা তাঁর খুবই পছন্দের। ইঞ্চিচারেক সাইজের চিংড়ি রোজ পাওয়া যায় না, আজ ভোরে বাজারে গিয়ে সুধাংশু পেয়ে গেলেন। দিনটা তা হলে ভালো যাবে, এমন এক আনন্দের বশবর্তী হয়ে চল্লিশ টাকা দিয়ে আধ কেজি চিংড়ি কিনে ফেললেন।

সুধাংশু তিন সপ্তাহ আগে ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা ভেঙেছিলেন বাস থেকে নামার সময় পড়ে গিয়ে। আঙুলের প্লাস্টার কাটা হয়েছে বটে কিন্তু কলম ধরে লিখতে পারছেন না। আশা করছেন এক মাসের ছুটিটা ফুরোবার আগেই বোধহয় পারবেন। আঙুলের জোর পরখ করার জন্যই চিংড়ি ও রুই মাছ ভরা আটশো গ্রামের থলিটি তিনি ডান হাতে ধরে বাড়ি ফিরলেন, পিছনে আর একটি থলি হাতে কল্যাণ।

ঘটনাটির কেন্দ্রে রয়েছে মালবিকা, অতএব তার এবং তার মা বকুলের কথা এবার বলা যাক।

পিতৃমাতৃহীন বকুল লালিত হয়েছে মামার বাড়িতে। মামারা ছাপোষা গেরস্ত। ভাগ্নিকে তাঁরা গলগ্রহ মনে করতেন। কোনোক্রমে ক্লাস নাইন পর্যন্ত বকুলকে পড়িয়ে আর তাঁরা পড়াননি। লাস্যে ভরা, চপল প্রকৃতির বকুল এজন্য মোটেই দুঃখ পায়নি। ভাঙাচোরা, স্যাঁতসেঁতে, অপরিচ্ছন্ন বাড়িতে স্থানাভাব তাই সুযোগ পেলেই সে পাড়ার এবাড়ি—সেবাড়ি করে বেড়াত। তাই করতে করতে সে একসময় পাড়ার বাইরেও পা বাড়াল। সিনেমায়, রেস্টুরেন্টে, ট্যাক্সিতে তাকে দেখা গেল পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গে। অচিরেই বকুলের গতিবিধি সম্পর্কে নানান মুখরোচক খবর মামিদের মারফত মামাদের কানে পৌঁছল। তাঁরা বকুলের বিয়ের ব্যবস্থায় উদ্যোগী হলেন।

মামাদের নিষ্কৃতি দিয়ে হঠাৎই এক সন্ধ্যায় সিঁথিতে চওড়া করে সিঁদুর দেওয়া বকুল বাড়ি ফিরল। বাড়ির লোকেরা প্রথমে ঠিক করতে পারেননি, কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তাঁরা প্রকাশ করবেন। একটা বড়ো খরচ বেঁচে গেল, এই স্বস্তিটা চেপে গিয়ে কেউ রাগ দেখালেন, কেউ বললেন বেশ করেছে। বকুল মিনিট দশেকের বেশি বাড়িতে থাকেনি।

দেড়শো বছরের পুরোনো বিশাল এক বাড়ির, বহু শরিকের অন্যতম দিলীপরঞ্জন দত্তকে বকুল রেজেস্ট্রি বিয়ে করে। সুশ্রী, গৌরবর্ণ, দীর্ঘদেহী এবং বাকচতুর দিলীপরঞ্জন বাড়ির একটিমাত্র ঘরের অধিকারী, ইস্টার্ন রেলওয়ের কেরানি এবং পেশাদার মঞ্চে অনিয়মিত ক্ষুদ্র এক অভিনেতা। তার সঙ্গে দিলীপরঞ্জনের বয়সের তফাত পনেরো বছরের হলেও বকুল মনে করেছিল সে লটারির প্রথম পুরস্কার জিতেছে। পরে সে ধীরে ধীরে বুঝতে পারে লটারির টিকিটটি ছিল জাল। আভিজাত্যপূর্ণ চালচলন, কথাবার্তা ও চেহারাটাই শুধু সে দেখেছিল কিন্তু এইসবের আড়ালে দিলীপরঞ্জনের বৈষয়িক অবস্থা বা তার চরিত্রের দৈন্যদশা সে লক্ষ করেনি। বিয়ের চার মাস পরই তার স্বামী সাসপেন্ড হয় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে। যেভাবেই হোক দিলীপরঞ্জন সেটা সামাল দেয়। মেয়ে মালবিকা জন্মায় বিয়ের পর অষ্টম মাসে। তাই নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ও মামার বাড়িতে যেসব অশ্লীল মন্তব্য ও হাসাহাসি হয় তার অধিকাংশই বকুলের কানে আসে এবং সে নীরবে তা হজম করে, কেননা ঘটনাটা সত্য। দিলীপরঞ্জনকে বিবাহে বাধ্য করার জন্য তাকে দিয়ে কৌমার্য ভঙ্গের কাজটি সে করিয়ে নিয়েছিল, এই তথ্যটি মালবিকা বারো বছর বয়সে একদিন বাবা—মায়ের তিক্ত ঝগড়ার মধ্য দিয়ে জেনে গিয়েছিল।

মালবিকা বড়ো হয়ে ওঠে এমনই পরিবেশে যেখানে বাবা মাঝেমধ্যে রাতে বাড়ি ফেরে না, মাঝেমধ্যে মাতাল হয়ে ফেরে, বাবার হাতে মা মার খায়। বাড়ির অন্যান্য অংশে বসবাসকারী জ্যাঠা, কাকা, তাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা তাকে এবং তার মাকে ঠারেঠোরে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হেয়জ্ঞান করে এটা সে বাল্য থেকেই দেখে এসেছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে ভর করে জীবন সম্পর্কে একটা অনিশ্চিত বোধ, আশ্রয়চ্যুত হবার ভয়, নিরাপদ স্থিতি পাওয়ার ব্যাকুলতা এবং নিছকই জৈব অস্তিত্ব রক্ষার জন্য দরদভরা অবলম্বন খোঁজার চেষ্টা আর এইগুলো থেকেই তার মধ্যে গড়ে উঠেছে ফলাফলের পরোয়া না করা, বাস্তববোধ বর্জিত, অন্ধ আবেগে ভরা এমন এক মানসিকতা যার সঙ্গে তার মা বকুলের বহু জায়গায় মিল রয়েছে। যেমন মিল আছে দু—জনের প্রায় একই ধরনের পারিবারিক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে বড়ো হয়ে ওঠার। মায়ের থেকে স্কুলে দুই ক্লাস বেশি পড়ে মেয়ে পড়া ছেড়েছে।

মালবিকা তার মাকে পছন্দ করে না এবং অবহেলাও করে না, একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে সে ভালোবাসে বকুলকে। তবে বাবাকে সে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকী বাবার মতো গৌরবর্ণ, লম্বা চেহারার পুরুষদের দেখলে তার ভিতরটা কুঁকড়ে শক্ত হয়ে যায়। সে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে থাকে যতক্ষণ না লোকটি চোখের সামনে থেকে সরে যায়।

হয়তো এই প্রতিক্রিয়া থেকেই সে আকৃষ্ট হয় সমীরণ মিত্রের প্রতি।

বকুল বুঝে গেছল লেখাপড়া মালবিকার দ্বারা হবে না। কিন্তু সে লক্ষ করেছে মালবিকার গানের গলাটি খুব সুন্দর। সুরেলা এবং মধুর। লতা মঙ্গেশকর বা আশা ভোঁসলের গাওয়া ফিল্মের গানগুলো হুবহু অবলীলায় গেয়ে দেয়। সে স্থির করে মেয়ে যেন তার মতো একটা অকেজো, রান্না—খাওয়া—ঘুমসর্বস্ব গৃহপালিত জন্তু না হয়ে ওঠে। জীবনে তার যা—সব আকাঙ্ক্ষা ছিল—একটা মোটরগাড়ি, খরচ করার জন্য হাতে প্রচুর টাকা, নিজস্ব একটা বাড়ি, তাতে সাজানো ঘর, রোমান্টিক অনুগত স্বামী এবং স্বাধীনতা, এসব তার কাছে স্বপ্নই রয়ে গেল। কিন্তু মেয়ের ভাগ্যে যেন স্বপ্নটা সম্ভব হয়, যেন বিরাট গায়িকা হয়ে প্রচুর বিত্ত অর্জন করতে পারে এই আশা সে মনে লালন করতে থাকে। সে জানে, শুয়ে বসে শুধুই আকাশকুসুম দেখলে, যেটা সে নিজে করেছে, কোনোদিনই সেই কুসুম পৃথিবীর মাটিতে ফুটিয়ে তোলা যাবে না।

মেয়েকে গান শেখাবার জন্য উদ্যোগী হল বকুল। সেজোজায়ের মেয়েকে গান শেখাতে আসত এক মহিলা, বকুল তাকেই মালবিকার শিক্ষিকা রাখল। মাস দুয়েক পর সে বুঝল এই মহিলা বারো বছরের মেয়েকে গান শেখাতে পারবেন, উনিশ বছরের মেয়েকে নয়। এই সময়ই একদিন বকুলের আলাপ হল উমা ও সুধাংশুর সঙ্গে।

কাগজের সিনেমা—নাটক বিভাগের সম্পাদকের সঙ্গে সুধাংশুর হৃদ্যতা আছে। ম্যাজিক, নাচ, যাত্রা, অফিসের নাটক, জলসা ইত্যাদির কার্ড প্রায়শই সে চেয়ে নেয়, অনুষ্ঠান দেখে দু—চার প্যারাগ্রাফ লিখে দেবার বিনিময়ে। মহাজাতি সদনে একটা ব্যাঙ্ক রিক্রিয়েশন ক্লাবের নাচ—গান ও নাটক অনুষ্ঠানের দু—খানা কার্ড সুধাংশু চেয়ে নিয়েছিলেন একটি কারণেই, সমীরণ মিত্র গান গাইবে।

বৈঠকি চালে টপ্পা, খেয়াল ঢঙের পুরাতনী আর থিয়েটারের গান গেয়ে সমীরণ আসরের পর আসর মাত করে এখন জনপ্রিয়তম গায়কদের একজন। ইতিমধ্যেই তার বারোখানা গানের ক্যাসেট বাজারে বিকোচ্ছে। শুধু কলকাতায়ই নয় গৌহাটি, পাটনা, কটক তো বটেই দিল্লি বোম্বাই বাঙ্গালোর থেকে বাঙালি সমাজের ডাক তার কাছে আসে। আমেরিকার নিউ জার্সির বাঙালিদের আমন্ত্রণও এসেছিল কিন্তু সেই সময় জন্ডিস হওয়ায় যেতে পারেনি। কিন্তু সমীরণ মিত্রর সংগীত—ভক্ত হিসাবে সুধাংশু বা উমা এই অনুষ্ঠানে আসেননি। সমীরণ তাঁদের পাড়ার ছেলে।

তাঁদের তিনখানা বাড়ির পরই থাকত সমীরণরা। ভাড়া দু—খানা ঘরে আটজন লোক। ওর বাবা ছিল আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে কম্পাউন্ডার। সমীরণকে তার কৈশোর থেকেই তাঁরা চিনতেন। একটু বাউন্ডুলে স্বভাবের, লেখাপড়ায় কলেজ পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিল বাবার জুতোপেটার জোরে, ছোটো বয়সেই ভালো তবলা বাজাত আর জোড়াসাঁকোয় তখনই কোনো এক ওস্তাদের কাছে তালিম নিতে শুরু করেছিল। তাঁদের বাড়িতেও সে আসত, উমাকে ডাকত মাসিমা বলে। ক্রমশ নামডাকের সঙ্গে এল প্রচুর অর্থ এবং ব্যস্ততা। সমীরণ বিয়ে করল তারই ছাত্রী শিঞ্জিনীকে এবং মানিকতলার কাছে বাড়িভাড়া নিয়ে পাতিপুকুর ছেড়ে চলে যাবার পর যোগাযোগটা এখন ক্ষীণ হয়ে গেছে।

সমীরণ সেদিন গাইল আটখানা গান, প্রতি গান পাঁচ মিনিটের। তৃতীয় গানটি যখন গাইছে উমা তখন চাপা গলায় স্বামীকে বলেন, ‘যে ক্যাসেটটা আমাদের দিয়েছিল তাতে এই গানটা আছে।’ সুধাংশু তখন বলেন, ‘ওর আগমনী গানের একটা ক্যাসেট আছে, সুন্দর নাকি গেয়েছে, ভাবছি টেলিফোন করে একটা চাইব।’

ওঁদের এই কথোপকথন উমার পাশের আসনে বসা বকুল শুনেছিল। তার পাশে ছিল মালবিকা। সমীরণের তৃতীয় গানটি শেষ হতেই সে উমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বিনীত স্বরে বলে, ‘ওঁকে কী আপনি চেনেন?’

‘কাকে, সমীরণকে? ওকে তো ছোটোবেলা থেকেই চিনি। আমাদের প্রতিবেশী ছিল।’ উমা চাপা গর্বে কিঞ্চিৎ ফেঁপে উঠে অতঃপর বলেন, ‘আমাকে মাসিমা বলে।’

দ্রুত চিন্তা করে নিয়ে বকুল বলে, ‘খুব নাম ওনার, খুব ভালো গান। আমার মেয়ের খুব ইচ্ছে ওঁর কাছে গান শেখার।’

‘শিখুক না।’ যেন একটা ছাড়পত্র দিলেন উমা এমন ভঙ্গিতে বলেন।

‘শুনেছি খুব খুঁতখুঁতে, যাকে মনে করবেন কিছু হবে শুধু তাকে ছাড়া আর নাকি কাউকে শেখাতে চান না।’

‘ওর স্কুলে অত ছেলেমেয়ে সবাই কি সন্ধ্যা মুখুজ্জে না লতা মঙ্গেশকর হবে?’

‘না না স্কুলে নয়, পার্সোনালি আলাদা করেও উনি শেখান।’

‘তাই নাকি!’

‘আপনি একটু ওঁকে বলবেন দিদি?’ ঝুঁকে উমার হাত চেপে ধরে বকুল।

‘আপনার মেয়ে কেমন গায় তা না জেনে কী করে বলব?’ উমা হঠাৎ সাবধানী হয়ে যান।

‘সে তো নিশ্চয়। তবে একবার পরীক্ষা করে যদি দেখেন…দিদি আপনি একটু ওঁকে বলুন না।’ বকুল মিনতি করে হাতটা উমার হাঁটুতে ছোঁয়ায়।

‘আচ্ছা বলব, তবে কথা রাখবে কি না জানি না। খুব বড়ো হয়ে গেছে তো!’

সমীরণের অষ্টম গানটি শেষ হতেই সুধাংশু ওদের নিয়ে আসেন গ্রিনরুমে। কিছু লোক ঘিরে রয়েছে তাকে। সমীরণ কাকে যেন বলছিল তার নিজস্ব সঙ্গতকারদের গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবার জন্য। একজন জুঁই ফুলের গোড়ে তার হাতে তুলে দিয়ে প্রণাম করল। চার রকমের বৃহদাকার মিষ্টির প্লেট নিয়ে দাঁড়ানো লোকটি অনুনয় করল, ‘অন্তত একটা’, সমীরণ তাকে হাত দিয়ে সরিয়ে, ‘একটাও নয় ভাই। চল্লিশে পা দিয়েছি, মিষ্টি খাওয়া বনধ।’ এই বলেই সে উমা ও সুধাংশুকে দেখতে পেল।

‘আরে মাসিমা!…মেসোমশাই।’ সমীরণ এগিয়ে এসে প্রণাম করল। উমা গর্বে আপ্লুত হয়ে পিছনে দাঁড়ানো বকুলের দিকে মুখ ফেরালেন, মুখের ভাবখানা, দেখলে তো! বকুল বিশ্বাস করল, এই মহিলার অনুরোধ সমীরণ ফেলতে পারবে না।

‘তোমার গান শুনতে এসেছি।’ উমা বললেন।

‘তা হলে এই মিষ্টিগুলো আপনার। এতক্ষণ কান তেতো করেছেন এবার মুখটা মিষ্টি করে নিয়ে বলুন কেমন লাগল।’ সমীরণ লঘুস্বরে কথাগুলো বলে প্লেটটা লোকটির হাত থেকে নিয়ে উমার সামনে ধরল।

‘তোমার গানের সুখ্যাতির জন্য আমার জিভ মিষ্টি করার দরকার হয় না।’ উমা প্লেটটা নিয়ে বকুলের দিকে এগিয়ে ধরে বললেন, ‘নাও, তুলে নাও।’ নিজেও একটা তুলে নিলেন।

বকুল একটা সন্দেশ তুলে নিল বিনা বাক্যব্যয়ে। উমার খুশির সঙ্গে তাল রাখতে সে এখন বদ্ধপরিকর। উমা প্লেটটা ধরলেন মালবিকার সামনে। সে একটা রসে ভেজা চিত্রকূট তুলে নিল। সুধাংশুও বাদ পড়লেন না।

মালবিকা একদৃষ্টে সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে। লোকটার মধ্যে কীরকম যেন এক সম্মোহন ক্ষমতা রয়েছে যে—জন্য তার উনিশ বছরের হৃৎপিণ্ডটার স্পন্দন হঠাৎই বেড়ে গেল! মাঝারি উচ্চচতা, মাঝারি গড়ন। ফুলহাতা গরদের পাঞ্জাবির আড়ালে একটা বলিষ্ঠ শরীরের আভাস। সমীরণের গায়ের রং মালবিকাকে তাদের বাড়ির পুরনো মেহগনি কাঠের টেবলটাকে মনে পড়াল। টেবলটার পালিশ উঠে গেছে কিন্তু এই লোকটার মুখের চামড়ায় যেন ঘাম তেল মাখানো।

এত কালোর উপর এত সুন্দর মুখ সে কখনো দেখেনি। কপালটা সামান্য চওড়া, মাথাটা ছোটো কিন্তু অবিন্যস্ত চুল দিয়ে সেটা মানানসই করে নেওয়া, তাতে জুলফি নেই। লম্বাটে ডিমের মতো মুখের আকৃতি, লম্বা কান, পাতলা ঈষৎ গোলাপি ঠোঁট, ঠোঁটের উপরে ডান নাকের নীচে একটা তিল, বাঁকা ভুরু দুটি যেন পেনসিল দিয়ে আঁকা। আর চোখ!

সমীরণের চোখ দুটোই মালবিকাকে সম্মোহিত করেছে।

মণি দুটো ঈষৎ পিঙ্গল এবং সাদা অংশের থেকে বেশি জায়গা নিয়েছে। বুলবুলির মতো মণি দুটো ছটফট করে যাচ্ছে সারাক্ষণ। কথা বলতে বলতেই ঘরের এদিক—ওদিক তাকাচ্ছে, চাহনিতে মজা পাওয়া বাচ্চচাদের মতো চঞ্চলতা। উমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে সমীরণ দু—তিনবার মালবিকার দিকে তাকাল। চাহনিটা হালকা বাতাসের মতো কপাল থেকে নেমে বুকের উপর কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়েই ঝরে পড়ল। শিরশির করে উঠল মালবিকার সারা দেহ।

প্রতিবারই কেঁপে উঠল তার বুক। চুন্নিটা বুকের উপর থেকে সামান্য সরে রয়েছে সেটা বিছিয়ে দেবার জন্য সে কোনো চেষ্টা করল না।

‘এ কী তুমি খাচ্ছ না যে! আমার মতো মিষ্টি খাওয়া ছেড়েছ নাকি?’ সমীরণ কথাটা বলে হাসল। সরলভাবে মাড়িতে বসানো ঝকঝকে দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল আর গালের পেশি কুঞ্চিত হয়ে ভাঁজ ফেলল। চোখের মতো মুখটাও নড়াচড়া করে।

বকুল চাপা কঠিন স্বরে বলল, ‘খেয়ে নে।’

‘না।’ মায়ের নির্দেশ অমান্য করে মালবিকা জেদি গলায় বেপরোয়ার মতো বলল, ‘আমিও মিষ্টি ছেড়ে দিয়েছি।’

‘এত কম বয়সেই! কবে ছেড়েছ?’

‘এই মাত্র।’

সমীরণ কিছু একটা বলতে গিয়ে থমকে অবাক চোখে তাকাল। চিত্রকূটটা প্লেটে রেখে দিল মালবিকা।

‘তা হলে অভিনন্দন। এই নাও।’ জুঁই ফুলের গোড়েটা সে এগিয়ে দিল। গোড়েটা নেবার সময় সমীরণের আঙুল সে মুহূর্তের জন্য ইচ্ছে করেই স্পর্শ করল। ভ্রূ তুলে সমীরণ তাকাতেই মালবিকার গৌরবর্ণ মুখটা গরম হয়ে উঠল, চোখ আনত হয়ে এল। মালাটা আলতো করে বুকে চেপে ধরল।

বকুলের চোখে কিছুই এড়ায়নি। তার শুধু মনে হল, কথাটা পাড়ার জন্য এখনই মোক্ষম সময়।

‘দিদি, বলুন না কেন এসেছি।’

উমা এতক্ষণ মুখে হাসি ফুটিয়ে মালবিকা আর সমীরণের কথা শুনে যাচ্ছিলেন। প্লেটটা নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা সুধাংশুর হাতে তিনি ধরিয়ে দিলেন, ‘এটা শেষ করো।’

সমীরণ হাতঘড়ি দেখল। একটি লোককে, বোধহয় ড্রাইভারকে বলল, ‘গাড়িটা এনে গেটের কাছে রাখুন।’

‘তোমার কি তাড়া আছে, কোথাও যাবে?’ উমা বললেন।

‘হাওড়ায় যাব।’

‘সমীরণ তো এখন দিনে দু—তিনটে ফাংশান করে।’

সুধাংশু এতক্ষণ কথা বলার একটা উপলক্ষ খুঁজে বার করলেন।

‘না মেসোমশাই, বন্ধুর ছেলের অন্নপ্রাশনের নেমন্তন্নে যেতে হবে। আর দিনে দু—তিনটে ফাংশান কোনোকালেই আমি করিনি।’

‘কিন্তু আমি যেন শুনেছিলাম—’ অপ্রতিভ সুধাংশু থেমে গেলেন।

‘তোমার ছেলে কত বড়োটি হল? বউমা কেমন আছে, গানটান করে?’

‘ছেলে এখন ক্লাস সিক্সে পড়ছে, ক্যালকাটা বয়েজে। আর শিঞ্জিনী মাঝে মধ্যে তানপুরা নিয়ে বসে বটে তবে সে কিছু নয়। এখন গানের স্কুলটা দেখাশোনাতেই ব্যস্ত থাকে।’

‘দিদি—’

‘বলছি, বলছি। যাব যাব করেও আর যাওয়া হয়ে ওঠে না, সমীরণ এবার তোমার বাড়িতে একদিন যাব।’

‘গেলে তাড়াতাড়ি আসুন। পার্ক সার্কাসে একটা ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা হচ্ছে। পেলে স্কুলটা মানিকতলায় রেখে পার্ক সার্কাসে আমরা গিয়ে থাকব। কালোয়ারপটিতে থাকতে আর ভালো লাগছে না।’

‘স্কুল না হয় রয়ে গেল কিন্তু তুমি যে স্পেশাল করে শেখাও তার কী হবে?’

সমীরণ একটু অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি জানেন দেখছি! তেমন বুঝলে স্পেশাল ক্লাস পার্ক সার্কাসেই তখন করব।’

‘তোমাকে এই মেয়েটিকে স্পেশালে শেখাতে হবে। খুব ভালো গায়। তোমার কাছে ছাড়া কারুর কাছে শিখবে না, মেয়ের একেবারে ধনুক ভাঙা পণ! তুমি কিন্তু না বলতে পারবে না। তোমাকে বলার জন্য ওর মা, এই যে ইনি আমার বোনের মতো, আমাকে খুব ধরেছে।’

উমা এইরকমই। কিছুক্ষণ আগে মাত্র আলাপ, একদমই জানেন না মেয়েটির গলায় গান না মেশিনগান কোনটা রয়েছে অথচ তদবির শুরু করলেন এমনভাবে যেন নিজের মেয়ের জন্য বলছেন।

সমীরণ মিটমিট চোখে মালবিকার দিকে তাকাল। কী যেন সে মুখটায় দেখল। ধীরে ধীরে মৃদু স্বরে বলল, ‘কিন্তু মাসিমা, আলাদা করে যাদের শেখাই আগে তাদের গান শুনি, নিষ্ঠা আছে কি না দেখি। আমি যে পরিশ্রম করব সেটা যে বেনাবনে মুক্তো ছড়ানো হবে না সেটা তো আগে আমায় বুঝে নিতে হবে। এরকম ঘটেছে, ভস্মে ঘি ঢেলেছি।… তোমার নাম কী?’

মালবিকার গলা দিয়ে স্বর বেরোতে চাইল না। ঢোঁক গিলে কোনোরকমে বলল, ‘মালবিকা দত্ত।’

‘বাহ, বেশ নাম। থাকো কোথায়?’

‘রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে, গৌরীবাড়ির কাছে।’

‘তা হলে তো খুব কাছেই। কারুর কাছে গান শেখো?’

‘একজনের কাছে বাড়িতে কিছুদিন শিখেছিলুম। কয়েকটা ভজন আর রবীন্দ্রসংগীত।’ কুণ্ঠিত স্বরে মালবিকা বলল।

উমা মনের জোর পেয়ে গেছেন। এত জিজ্ঞেস করছে যখন তা হলে স্পেশালে মেয়েটাকে নেবেই। ‘কবে যাবে গান শোনাতে?’

সমীরণ যাকে গেটের কাছে গাড়ি আনতে বলেছিল, সেই ধুতিপরা প্রৌঢ় লোকটি এসে বলল, ‘গাড়ি এনেছি, গেটের সামনেই আছে।’

‘গাড়িতে থাকুন, আমি যাচ্ছি।’ সমীরণ এবার উমার দিকে ফিরে বলল, ‘আপনারা কি নাটকটা দেখবেন না বাড়ি যাবেন? যান তো তা হলে—’ সমীরণ একটু তফাতে দাঁড়িয়ে থাকা একটি যুবকের দিকে তাকাল। ‘তা হলে গাড়ির ব্যবস্থা হতে পারে।’

‘মালি কবে কখন যাবে?’ বকুল তার উৎকণ্ঠা চেপে রাখতে পারল না। ব্যাপারটা সে আধপাকা করে রাখার পক্ষে নয়।

‘ডাকনাম বুঝি মালি?… আসুন তিন—চারটে দিন বাদ দিয়ে। কাল জামশেদপুর যাব। সকাল দশটা—এগারোটা নাগাদ আসুন, আমার ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়।… মাসিমা?’

‘আর নাটক দেখে কী হবে বলো?’ উমা প্রশ্নটাকে সিদ্ধান্তের আদলে বকুলের দিকে পাঠাল।

‘ও আর দেখার কী আছে।’ বকুল সঙ্গে সঙ্গে সমর্থন জানিয়ে দিল।

‘মিহির।’ সমীরণ দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটিকে ডাকল। দ্রুতপায়ে প্রায় কৃতার্থের মতো সে সমীরণের কাছে এল।

‘আমার ছাত্র মিহির, মিহিরচাঁদ শীল। ওর গাড়ি আছে, ও আপনাদের পৌঁছে দেবে। মিহির, ইনি আমার মাসিমা। এঁদের সবাইকে বাড়ি পৌঁছে দাও।’ প্রায় হুকুমের সুরেই সমীরণ নির্দেশ দিল। মিহির অনুগৃহীতের মতো মাথা নেড়ে গেল।

‘তোমার কোনো অসুবিধে হবে না তো?’ নিছকই ভদ্রতাসূচক একটা অপ্রয়োজনীয় কথা বলল সমীরণ।

‘না না, একদমই না।’ মিহির শশব্যস্তে উত্তর দিল।

সমীরণ দরজার দিকে এগোল। ‘আপনারা একটু দাঁড়ান আমি আসছি।’ বলে মিহির পিছু নিল সমীরণের। ঘরে এখন নাটকের লোকদের ভিড়। পোশাক, মেকআপ ইত্যাদির ব্যস্ততার মধ্যে ওরা চারজন দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে।

‘তোমার নামটি তো এখনও জানলুম না।’ উমা জিজ্ঞাসা করলেন বকুলকে।

‘বকুল দত্ত।’

‘ছেলেমেয়ে ক—টি?’

‘এই মালিই, আর হয়নি।’

‘হয়নি না হওয়াওনি।’ উমা মুখ টিপে হেসে বললেন, ‘আমারও এক ছেলে, ইঞ্জিনিয়ার। এই তিন মাস হল বিয়ে হয়েছে। আগে থেকে ওদের ভাবসাব ছিল। উনি খবরের কাগজে চিফ সাব—এডিটার’—মিহিরকে দেখে তিনি থেমে গেলেন।

‘সমীরণদাকে তুলে দিয়ে এলুম। আসুন আপনারা।’

মাখন রঙের অ্যাম্বাসাডর গাড়ি। মিহিরের সঙ্গে তার এক বন্ধু রয়েছে। পিছনের সিটে মেয়েরা তিনজন, সামনের সিটে চালক মিহির ছাড়া তার বন্ধুটি ও সুধাংশু।

‘আমার বন্ধু বেলেঘাটা যাবে, ওকে যদি আগে নামিয়ে দি তা হলে কি আপনাদের অসুবিধে হবে?’ মার্জিত, নম্র বাকভঙ্গি, গলার স্বর সরু। ঘাড় ফিরিয়ে মিহির তাকাল পিছনে, আসলে তাকাল উমার দিকে।

মালবিকার ভালো লাগল না এটা অর্থাৎ তাদের দু—জনকে অগ্রাহ্য করে উমার দিকে অনুমতি চাওয়ার মতো করে তাকানোটা। এর আগেও সমীরণ যখন বলল, ‘মিহির, ইনি আমার মাসিমা?’ তখনও তারা দুজন উপেক্ষিত হয়। তখন সে রাগেনি, দুঃখও পায়নি। শুধু একটা অকারণ অভিমান বুকের মধ্যে ফেঁপে উঠেছিল। বাড়িতেও বাইরের কেউ এলে বলা হয়, ‘আমার সেজোজায়ের মেয়ে’। ব্যস, নামটুকু পর্যন্ত নয়।

মালবিকা আন্দাজ করতে পারে কেন তারা যথেষ্ট মনোযোগ লোকেদের কাছ থেকে পায় না। সব জায়গাতেই তাদের ভূমিকাটা থাকে অনুগ্রহপ্রার্থীর। মায়ের বাপের বাড়ির তরফে বংশগৌরব নেই, পরিচয় দেবার মতো মান্যগণ্য, ধনী কোনো আত্মীয় নেই। মা বা সে নিজে লেখাপড়া করেনি।

তার বাবা দিলীপরঞ্জন রেলের কেরানি এবং সবাই তাকে দুশ্চরিত্র বলেই জানে।

একটা মিষ্টি সুশ্রী মুখ আর ধারালো দেহ ছাড়া সে জানে তার আর কোনো সম্পদ নেই। সে আরও জানে, এই সম্পদ ভাঙিয়েই তাকে জীবন গুছিয়ে নিতে হবে। তার গলায় সুর আছে কী নেই, বড়ো গাইয়ে হবে কী হবে না, সে—সব পরের কথা, এখন তাকে সমীরণ মিত্রর গানের স্পেশাল ক্লাসে জায়গা করে নিতেই হবে। গান এবং সমীরণের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই বন্ধ গলি থেকে রাজপথে যাওয়ার।

মিহির তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে উমা ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘কোনো অসুবিধে হবে না বাবা, আমাদের এখন কোনো তাড়া নেই। কী গো বকুল, তোমার কী তাড়া আছে?’

‘না দিদি। যখন হোক পৌঁছলেই হল।’ বকুল শুধু খুশিই নয় তৃপ্তও।

কতদিন পর যে সে মোটরগাড়িতে চড়ল। বাড়িতে বড়োভাসুরের মোটর আছে, মেজোভাসুরের ছেলের স্কুটার আছে। আজ কুড়ি বছর প্রায় বিয়ে হয়েছে কিন্তু বড়োভাসুরের গাড়িতে দু—তিনবার ছাড়া তার চড়া হয়নি। মোটরে চড়ার দুর্নিবার আকর্ষণটা বকুলের ছোটোবেলা থেকেই। দিলীপরঞ্জনের একটা মরিস মাইনর ছিল। চার হাত ফেরতা ছোট্ট গাড়ি। রংচটা, জানলার কাচ ওঠে না, সিটের স্প্রিং বসে যাওয়া গাড়িটাতেই বকুল বিয়ের আগে দিলীপরঞ্জনের সঙ্গে ঘুরেছে। যতই পুরোনো ঝরঝরে হোক মোটরগাড়ি তো বটে! চড়লেই নিজেকে রাস্তার লোকেদের থেকে যথেষ্ট আলাদা বোধ হয়। কিন্তু বিয়ের মাস কয়েক পরই গাড়িটা আর রইল না। ঘুষ নিতে গিয়ে দিলীপরঞ্জন ধরা পড়ল, গাড়িটা সে তখনই বিক্রি করে দেয়।

‘শ্বশুরবাড়িতে কে কে আছেন?’ উমা তাঁর কৌতূহল মেটাবার কাজ শুরু করলেন।

‘শ্বশুর—শাশুড়ি নেই, তা ছাড়া সবাই আছেন। খুবই বনেদি, বড়ো পরিবার।’ বকুলের উত্তরের মধ্যে ঝোঁকটা পড়ল ‘বড়ো পরিবার’ শব্দ দুটোয়।

‘আলাদা হাঁড়ি?’

‘হ্যাঁ। শাশুড়িই আলাদা করে দিয়ে গেছেন।’

‘ভায়ে ভায়ে সদভাব নেই বুঝি?’

‘না না, ঠিক তা নয়। খুব বুদ্ধিমতী ছিলেন তো! বলতেন, যতদিন আমি আছি ততদিন সদ্ভাব থাকবে, এক হেঁসেলে চলবে কিন্তু আমার মরার পর কে কীরকম হয়ে যাবে তা তো জানি না, দিনকাল তো আর একরকম থাকে না।’

‘ভালোই বলেছেন। দিনকাল যে কীভাবে বদলেছে, কত রকমের কাণ্ড যে চারদিকে ঘটছে। চোর ডাকাত খুনিতে দেশটা ভরে যাচ্ছে। হুট হুট করে কত বড়োলোক এখন গজাচ্ছে আর গরিবরা আরও গরিব হচ্ছে।’

উমার কথাটা শুনে সামনের সিটে সুধাংশু হর্ষ এবং আশ্বস্ত বোধ করলেন। একটু—আধটু রাজনীতির হালচাল মেয়েদের জানা থাকা ভালো। খবরের কাগজের হেডলাইন পড়ে শোনানোটা যে বৃথা যায়নি সেটা বুঝতে পারছেন।

মেট্রো রেলের জন্য মহাজাতি সদনের সামনের চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের মাঝখানটা খোঁড়া রয়েছে প্রায় দশ বছর। দু—পাশের সরু পথ ধরে বাস ট্রাক মোটর চলাচল করে। সেই পথের দুর্দশা বর্ণনার অযোগ্য। এর উপর রয়েছে ট্র্যাফিক জ্যাম। মিহিরের মোটর এখন জ্যামে পড়েছে। একহাত—দু—হাত করে গাড়ি এগোচ্ছে মহাত্মা গান্ধী রোড মোড়ের দিকে।

‘এই যে দু—পাশের বাড়ি দেখছ,’ সুধাংশু তাঁর স্ত্রীর কথারই জের টেনে বললেন, ‘এগুলো সব মারোয়াড়িরা কিনে নিয়েছে। একটাও আর বাঙালির নেই, বিক্রি করে দিয়ে কলকাতার আশেপাশে চলে গেছে।’

‘একটাও নেই বোলো না, তোমার জটুদারা তো থাকে বিডন স্ট্রিটের মোড়ে।’

‘ওই দু—তিনটে বাড়ি পাবে। ব্ল্যাকমানির জোরে এমন লোভ দেখায় যে পড়তি অবস্থার বাঙালিরা আর লোভ সামলাতে পারে না। আসলে বাপ—ঠাকুর্দার জমানো টাকা পায়ের উপর পা তুলে খেয়ে খেয়ে এমন একটা কুঁড়েমির অভ্যাসে—’

‘এটা কিন্তু ঠিক কথা নয় মেসোমশাই।’

বকুল ঝাঁকুনি খেয়ে সোজা হয়ে মেয়ের ঊরুতে একটি রামচিমটি কাটল। সেটা অগ্রাহ্য করে মালবিকা বলল, ‘সব বাঙালিই কুঁড়ে নয়। ব্যবসা করে সবাই বড়োলোক হতে চাইলে গানটা তা হলে গাইবে কে? সমীরণ মিত্র নিশ্চয়ই কুঁড়ে নন। খেটেছেন বলেই আজ এমন উঁচু জায়গায় পৌঁছেছেন। কলকাতার ক—টা মারোয়াড়ির অটোগ্রাফ নিতে মানুষ ভিড় করে?’

মিহির সন্তর্পণে মুখ ফিরিয়ে মালবিকার মুখটা একবার দেখার চেষ্টা করল আর উমা দ্বিগুণ উৎসাহে বলে উঠলেন, ‘বাঙালি যদি কুঁড়েই হত, তোমার কথাই ধরো না, অত খেটে কি বাড়িটা করতে পারতে? ছেলেকে নিয়ে যে রোজ পড়াতে বসতে, কুঁড়ে হলে কি বসতে? মালবিকা ঠিকই বলেছে।’

সুধাংশু নীরব রইলেন এবং এই নীরবতা অনুধাবন করে বকুল বুঝে নিল ভদ্রলোককে নয় তার স্ত্রীকেই পাত্তা দিতে হবে। সমীরণ মিত্র একে প্রণাম করে, মাসিমা বলে!

‘ঠিকই বলেছেন দিদি, দাদা যদি কুঁড়ে হতেন তা হলে ছেলে কি ইঞ্জিনিয়ার হতে পারত?’

সুধাংশু এবং উমা উভয়েই প্রীত হলেন। এবং বকুলকে পালটা প্রীত করার জন্য উমা বললেন, ‘তুমিও বাপু কুঁড়ে নও। মেয়েকে গান শিখিয়ে বড়ো করার জন্য ঠিক ঠিক লোককে ধরার কাজে তো তুমি গাফিলতি করোনি। …এটা কিন্তু ভালোই। যাকে দিয়ে করিয়ে নিলে কাজ হবে, তুমি তাকে দিয়ে নিশ্চয় করিয়ে নেবে, চক্ষুলজ্জা করলে চলবে না।’

বকুল ঠিক করতে পারল না সে হাসবে না গম্ভীর হবে। তাকে কতটা ঠেস দেওয়া বা প্রশংসা করা হল এটা সে বুঝতে পারছে না। মাঝামাঝি পথ ধরে সে বলল, ‘আপনি ঠিক আমার শাশুড়ির মতোই কথা বলেন।’

‘বলবই তো! কত বয়সে উনি মারা যান?’

‘ছিয়াত্তর বছরে।’

‘আমার এখন পঞ্চান্ন। কত আর পার্থক্য, আমরা একই রকমের কথা তো বলবই!’

অবশেষে গাড়ি চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ থেকে বাঁ দিকে মহাত্মা গান্ধী রোডে মোড় নিল। খানিকটা স্বচ্ছন্দে গিয়ে আটকা পড়ল কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে।

‘উমা দ্যাখো, এই ডান দিকে ইউনিভার্সিটি, স্যানসক্রিট কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, কফি হাউস, হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল, সব এই জায়গাটায়।’ সুধাংশু স্ত্রীকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহের দায়িত্বটা পালন করলেন। তাঁর ধারণা, কলকাতার কোথায় কী রয়েছে সেটা মেয়েদের জেনে রাখা দরকার। উমা ঝুঁকে জানলা দিয়ে তাকালেন ডান দিকে, আর পাঁচটা অপরিচ্ছন্ন, ভাঙাচোরা বড়ো রাস্তার মতো কলকাতার একটা ট্রাম রাস্তা দেখলেন মাত্র।

মিহির এখনও পর্যন্ত চুপচাপ, তার বন্ধুটিও। উমার মনে হল, যার গাড়িতে চেপে যাচ্ছি, ভদ্রতা বা কৃতজ্ঞতাবশতও তার সঙ্গে কিছু কথা বলা উচিত।

‘হ্যাঁ বাবা, তুমি কতদিন সমীরণের কাছে গান শিখছ?’

‘বছর চারেক।’ মিহির বলল।

আমহার্স্ট স্ট্রিটের মোড়ে পুলিশ হাত তুলে রয়েছে। শেয়ালদার দিকে যাবার রাস্তাটা খোলা। মোড়টা তাড়াতাড়ি পেরিয়ে যাওয়া দরকার, তাই সে উমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, ‘কতটা শিখেছ’—র উত্তর সঙ্গে সঙ্গে দিতে পারল না। রাস্তার দু—ধারের ফুটপাথে কাঁচা সবজি আনাজের বাজার বসেছে। উমার চোখ ইতিমধ্যে সেই দিকে নিবদ্ধ হল।

‘অল্প দিন শিখছি।’ সামনে দাঁড়ানো বাস—এর পিছনে গাড়ি থামিয়ে মিহির বলল। গোটা পনেরো ওল—এর একটা টিলার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা উমার কানে বোধহয় কথাটা ঢোকেনি। বকুলেরও কিছু জানার কাছে তাই সে শুরু করল কথাবার্তা।

‘রোজ শিখতে যাও?’

‘হপ্তায় একদিন, রবিবার।’

‘কতক্ষণ শেখান?’

‘ঘণ্টাখানেক।’

‘কত করে দাও?’

‘মাসে দু—শো।’

বকুল চুপ করে রইল। মনে মনে দ্রুত একটা হিসাব করে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে সিটে হেলান দিল। মেয়েটার বোধহয় আর সমীরণ মিত্রর কাছে শেখা হল না। হঠাৎ তার মনে হল, উমা নামের তার পাশের এই প্রৌঢ়া যদি অনুরোধ করে তা হলে সমীরণ কি তা ফেলতে পারবে? অনেক ছাত্র—ছাত্রীর মধ্যে কেউ যদি অর্ধেক মাইনেতে শেখে তাতে সমীরণের মতো পয়সাওলার কিছু যাবে আসবে না।

কিন্তু সে পুরোপুরি হতাশও হচ্ছে না। সমীরণের চোখ দুটো যখন মালির মুখের দিকে তখন কি মুখটাই শুধু দেখছিল? আর ওর নজরের মধ্যে বার কয়েক যে—জিনিসটা ফুটে উঠছিল, মালির এই বয়সের বকুল বহু পুরুষের চোখে একদা তা দেখেছিল। বকুল সে—সব অগ্রাহ্য করেও শেষ পর্যন্ত দিলীপরঞ্জনের পুরোনো মরিস মাইনরের, বাকপটুতার আর গৌরকান্তির কাছে হার মেনেছিল।

গাড়ি শিয়ালদহ ফ্লাইওভারের দক্ষিণ দিকে এসে বাঁ দিকে ঘুরল। রেলব্রিজ পেরিয়ে এখন ঢুকেছে বেলেঘাটার ঘিঞ্জি রাস্তায়। গাড়িতে কথাবার্তা আর হচ্ছে না। বকুল বুঝতে পারছে না গাড়ির অন্যান্যরা মনে মনে এখন কী চিন্তা করছে? জুঁইয়ের মালা হাতে মেয়েটা ঠায় সামনের দিকে তাকিয়ে। কী ভাবছে সে জানে! সমীরণের চাহনির জবাবে ওর চোখ যে সংকেত পাঠাচ্ছিল বকুলের কাছে তার অর্থ খুবই স্বচ্ছ। আর সেইজন্যই সে অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। তবে মালি বোকা মেয়ে নয়, শুধু এইটাই তার ভরসা।

মিহিরের বন্ধু নেমে গেল রাসমণির মোড়ে। সুধাংশু হাত—পা শিথিল করে বসার সুযোগ পেয়ে মিহিরের সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন।

‘গাড়ি কতদিন চালাচ্ছেন?’

‘আপনি নয় তুমি বলুন।’

‘বেশ। কতদিন শিখেছ?’

‘বারো—তেরো বছর।’

‘খুবই অল্প বয়সেই। গাড়িটা তোমাদেরই।’

‘হ্যাঁ। বাবার।’

‘তোমার বাবা কী করেন?’ পিছন থেকে উমা বললেন।

‘আমাদের একটা প্রেস আছে। এন্টালিতে, বাড়ির কাছে। পঞ্চান্ন বছর আগে বাবাই শুরু করেন, খবু অল্প বয়সে, ছোট্ট একটা ঘরে। অসম্ভব পরিশ্রম করে প্রেসটাকে বড়ো করেন। সাতটা ভাষায় কম্পোজ আর ছাপার কাজ হত।’

‘এখন হয় না?’ আবার উমার প্রশ্ন।

‘হয় না কারণ সময় বদলেছে। একটু আগে আপনি বললেন, দিনকাল যেভাবে বদলেছে, টেকনোলজির ব্যাপারেও তাই। এত অবিশ্বাস্য উন্নতি ঘটে গেছে যে তার সঙ্গে তাল দিয়ে না চললে আপনি পিছিয়ে যাবেন। আমরাও পুরোনো মেশিনপত্র বিক্রি করে পিটিএস কিনেছি, চার কালারের অফসেট মেশিন কিনেছি।’

‘আমাদের অফিসেও পিটিএস—এ কম্পোজ হয়।’ সুধাংশু এই বলে পিছনে মাথা ঘুরিয়ে উমাকে তারপর জানালেন, ‘টাইপরাইটারের মতো ছোটো ছোটো মেশিন। আগে যেমন ময়লা কাপড়—চোপড় পরে লাইনো অপারেটররা কম্পোজ করত, পিটিএস—এ তা করতে হয় না। অনেক মেয়েও কাজ করে। একেবারে অফিসের টাইপিস্টের মতো কাজ। তবে ঘরটাকে ভীষণ ঠান্ডা রাখতে হয়, কম্পিউটার আছে তো।’

সুধাংশুর মনে হল, এখন এর বেশি স্ত্রীকে আর কিছু তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। টেকনোলজির গূঢ় কাজকর্মের ব্যাপারগুলো মোটরগাড়ির থেকে বাড়িতে বসে জানিয়ে দেওয়াই ভালো। অবশ্য তার আগে পিটিএস সুপারভাইজারের কাছ থেকে অনেক কিছু জেনে নিতে হবে।

‘আপনাদের প্রেসে কী কী ছাপা হয়?’ প্রশ্নটা এল মালবিকার কাছ থেকে। এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ তার এই কৌতূহলে একমাত্র অবাক হল বকুল।

গাড়ি তখন ফুলবাগান, কাঁকুড়গাছি ছাড়িয়ে উল্টোডাঙা মোড়ের কাছাকাছি। গাড়ি মন্থর করে, ট্র্যাফিক সামলাতে ব্যস্ত মিহির থেমে থেমে বলল, ‘অনেক কিছুই হয়। টেক্সট বই, গল্প, উপন্যাস, তার মলাট, ম্যাগাজিন, অফিসের ফর্ম, চালান, বিল, স্যুভেনির। আমাদের একটা বাইন্ডিং সেকশানও আছে।’

‘কে দেখাশুনো করেন?’ বকুলের প্রশ্ন।

‘আমিই মেইনলি তবে বাবাই সব দেখেন। পঁচাত্তর বয়স কিন্তু রোজ দু—ঘণ্টা এসে বসেন।’

‘ভাইবোন ক—টি?’ উমা জানতে চাইলেন।

‘দুই দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। ভাই নেই। ছোটোবোন আমেরিকায় পেনসিলভানিয়ায় ডক্টরেট করছে।’

‘আমেরিকা’ শব্দটা শুনেই গাড়িটা সমীহতায় তটস্থ হয়ে গেল। গাড়ি লেকটাউনে ঢুকল। মিহির বলল, ‘এখানকার রাস্তা কিন্তু আমি একদম চিনি না, পাতিপুকুর পর্যন্ত গাইড করতে হবে।’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়, এই আর একটু এগিয়েই বাঁ দিকের রাস্তাটা।’ সুধাংশু নড়েচড়ে সোজা হলেন।

দু—তিনটি বাঁক ঘুরে সুধাংশুর নির্দেশমতো মিহির গাড়ি থামাল। গাড়ি থেকে নেমে সে পিছনের দরজা খুলে ধরে রইল। উমা নামলেন এবং তার পিছনে বকুলও।

‘এই আমাদের বাড়ি। ভেতরে এসো, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যাও।’ মিহিরকে বলে উমা বকুলের দিকেও তাকালেন।

‘না মাসিমা আজ থাক।’ মিহির নম্রভাবে জানাল। ‘বাড়িতে দিদি জামাইবাবুর আসার কথা, আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আর একদিন এসে বরং চা খেয়ে যাব, বাড়ি তো চিনে গেলুম।’

‘মিহির ওই যে বাড়িটা দেখছ,’ সুধাংশু তার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া প্রায়ান্ধকার সরু গলিটা লক্ষ করে আঙুল তুললেন। ‘ওই যে পর্দা দেওয়া জানলাটা, ওটাই সমীরণদের। ওখানেই ও থাকত, এখন থাকে ওর ভাইয়েরা, বাবা—মা তো অনেকদিনই গত হয়েছেন।’

সবাই গলিটার ভিতরে কিছুক্ষণ চোখ রাখল। এরপর উমা বললেন, ‘মিহিরের দেরি হয়ে যাবে, নয়তো বকুল আর মালবিকাকে বলতুম চা খেয়ে যেতে।’

বকুল সংকটে পড়ল। দ্রুত ভেবে নিল উমার সঙ্গে আলাপটাকে ঘনিষ্ঠ করে তোলা দরকার এবং চা খেতে খেতে সেই কাজটা মসৃণভাবে করা যায়। মালিকে সামনের দিকে ঠেলে নাম করিয়ে দেওয়ার জন্য উমা যদি অনুরোধ বা আবদার জানায় তা হলে সমীরণ কতটা তা রক্ষা করবে, সেটা সম্পর্কে কোনো দৃঢ় ধারণায় আপাতত সে আসতে পারেনি। তবে সমীরণের মাসিমার স্নেহের বোন হওয়ার জন্য অবশ্যই তাকে চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু সেই চেষ্টা এখন করতে গেলে গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফেরার এই সুযোগটা তাকে তা হলে হারাতে হবে।

সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে সে নিমেষেই সিদ্ধান্ত দিল, মেয়ের ভবিষ্যৎ অনেক গুরুত্বপূর্ণ গাড়ি চড়ার থেকে।

‘দিদির বাড়িতে প্রথমবার এসে বোন চা খাবে না তাই কি হয়?’ বকুল চেষ্টা করল গদগদ স্বর গলায় আনার।

‘মা।’ মোটরের ভিতর থেকে মালবিকার তীব্র স্বর বেরিয়ে এল। ‘বাবা ন—টায় ফিরবে। এখন সাড়ে আটটা।’

‘ওহহ দেখছ, একদমই ভুলে গিয়েছি। মালির বাবাকে ঘড়ি ধরে ন—টার সময় খেতে দিতে হয়। ডাক্তারের কড়া হুকুম, তারপর খাওয়াতে হয় ক্যাপসুল। না দিদি আজ থাক, আর একদিন এসে চা খেয়ে যাব।’

‘অসুখবিসুখ?’ উমা উদবেগ জানালেন, হঠাৎ পাওয়া বোনটিকে তাঁর মন্দ লাগেনি। মুখটি ভারি মিষ্টি, কথাবার্তাও তেমনি। কেমন যেন সরল আর ঘরোয়া ভাব পাচ্ছেন বুকলের মধ্যে।

‘মাথায় বহুদিন ধরেই একটা যন্ত্রণা হয়। মাঝে মাঝে সেটা বাড়ে। ডাক্তার অনেক দেখানো হয়েছে কিন্তু কেউই ঠিক করতে পারছে না।’ করুণ স্বরে বকুল বলল।

‘এক্স রে করানো হয়েছে?’ সুধাংশু জানতে চাইলেন।

‘হয়েছে, কিছু পাওয়া যায়নি।’

‘মা।’ এবার মালবিকার স্বরে চাপা বিরক্তি।

মিহির চুপ করে শুধু দেখে ও শুনে যাচ্ছিল। এবার কুণ্ঠিত স্বরে সে বলল, ‘আমার কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘ওহহ তাই তো! দেখেছ ভুলেই গেছি।’ বকুল ব্যস্ত হয়ে গাড়িতে উঠল। মিহির দরজা বন্ধ করে গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে এল। আর তারই মধ্যে মালবিকা চাপাস্বরে তার মাকে বলল, ‘কী আজেবাজে কথা বলে গেলে? দরকার কী এসব বলার?’

মিহির গাড়িতে উঠেছে। বকুল মেয়েকে উত্তর না দিয়ে জানলা দিয়ে হাত বার করে নাড়ল।

‘এই রাস্তা দিয়ে গিয়ে বাঁ দিকের প্রথম রাস্তাটা ধরবে, তারপর সোজা গিয়ে যশোর রোড।’ সুধাংশু জানিয়ে দিলেন মিহিরকে। সে মাথা কাত করে গাড়িকে প্রথম গিয়ারে দিল।

পঞ্চাশ—ষাট মিটার যাবার পরই মিহির শুনতে পেল মা ক্ষুব্ধ স্বরে মেয়েকে বলছে, ‘দরকার আছে কি না তা তুই বুঝবি না।’

‘না বোঝার কী আছে?’

‘আছে, আগে তুই মা হ তারপর বুঝবি মায়ের কী জ্বালা আর অশান্তি।’

‘ডায়ালগ এখন থামাও তো। আমাকে নিয়ে তোমার কীসের অশান্তি হল শুনি? এখন চুপ করে থাকো।’

‘তোর বাবার মতো যদি—’, বকুলের কথা অর্ধ সমাপ্ত হয়ে গেল।

‘আচ্ছা মিহিরবাবু, আপনি কি ফাংশানে গান করেন?’

মালবিকার প্রশ্নটা এল তার মায়ের কথা শেষ না হতেই।

‘না।’

‘চার বছর ধরে তা হলে কী শিখলেন?’

‘বলতে পারেন কিছুই শিখিনি।’

‘অ্যা!’ এবার স্তম্ভিত বকুলের কণ্ঠস্বর, ‘চার বছরেও কিছু শিখতে পারলে না। তা হলে নাম করবে কবে?’

‘নামটাম করার ইচ্ছা নিয়ে শিখছি না। প্রাচীন বাংলা গানের কথা আমার ভালো লাগে, বিশেষ করে নিধুবাবুর গান। সমীরণদার কাছে গানের প্রচুর স্টক রয়েছে আমি তার থেকে কিছু কিছু তুলে নিচ্ছি।’

‘তুলে নিয়ে কী করবেন?’ মালবিকার জিজ্ঞাসা।

‘গাইব, তবে পাঁচজনের সামনে নয়। নিজের মনেই গাইব।’

‘অদ্ভুত তো!’

‘অদ্ভুত কেন হবে?’ বকুল মেয়ের কথার মৃদু প্রতিবাদ করল। ‘অনেকেই তো আপন মনে গায়। যার টাকার দরকার সে ফাংশান করে, ক্যাসেট করে—’

‘থামো তো। সবাই শুধু টাকার জন্যই গায় না।’ ছোট্ট ধমকটা দিয়ে মালবিকা জুঁইয়ের গোড়েটা মায়ের নাকের কাছে ধরে বলল, ‘শুঁকে দ্যাখো, গন্ধটা কিন্তু ভারি মিষ্টি।’

‘সমীরণ মিত্তিরের টাকার অভাব নেই। গাড়ি করেছেন, পার্ক সার্কাসে ফ্ল্যাট কিনছেন, গানের স্কুল থেকেও যথেষ্ট আয়। উনি এখন কি শুধু টাকার জন্যই গান?’ মিহির আরজিকর হাসপাতাল পেরিয়ে খালের ব্রিজের উপর দিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ‘একটা জায়গায় উঠে গেলে আর তখন নামা যায় না। বলতে পারেন নেশার মতো তখন গান গাওয়াটা পেয়ে বসে।’

‘ঠিক বলেছেন।’ মালবিকা তারিফ না জানিয়ে পারল না।

বকুলের মনে হল, তাই যদি হয় তা হলে মালিকে তো ফ্রি—তেই স্পেশ্যালে ভরতি করে নিতে পারে!

‘সমীরণের ওখানে মাইনেটা বড়ো বেশি।’ কথাটা বলামাত্রই পাঁজরে একটা কনুইয়ের ধাক্কা পেল বেশ জোরেই।

‘সমীরণবাবু বলো।’ ফিসফিসিয়ে মালবিকা বলল।

‘হ্যাঁ একটু বেশি, এটা ভিড় এড়াবার জন্য। আলাদা করে না শিখলে পঞ্চাশ টাকা।’ গাড়িটাকে বাঁ দিকে রাজা দীনেন্দ্র স্ট্রিটে ঢুকিয়ে মিহির চট করে একবার পিছনের সিটের দিকে তাকিয়ে নিয়ে যোগ করল, ‘আপনাদের কাছে দুশো চাইবেন না।’

‘কেন’, মালবিকা উত্তর দাবি করল। মিহির উত্তর দিল না, শুধু তার মুখে এক চিলতে হাসি খেলে গেল।

‘এ—কথা বললেন কেন?’ মালবিকার স্বর এবার কৌতূহলে নরম।

‘সমীরণদা ভালো গলা পেলে আর যদি সুন্দরী হয় তা হলে কমেতেও শেখান।’

‘এখানে এখানে, এই বাঁ দিকের রাস্তাটায়।’

বকুলের ব্যস্ত গলা মিহিরকে ব্রেক কষাল। দেশবন্ধু পার্কটা তারা ছাড়িয়ে এসেছে। পাশাপাশি দুটো মোটর যাবার মতো একটা রাস্তা বাঁ দিকে।

‘আপনি ভালোই কথা বলতে পারেন।’

মিহির পুরো মুখ ফিরিয়ে মালবিকার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ব্যবসা করে খাই তো।’

‘আপনার বাড়িতে সত্যিসত্যিই কি দিদি জামাইবাবুর আসার কথা?’

‘দিদি কাল এসেছে। জামাইবাবুর আসার কথা নেই।’

‘তা হলে মিথ্যে কথা?’

‘বলেইছি তো ব্যবসা করে খাই। আমার তখন চা খাবার ইচ্ছে ছিল না। সে—কথা না বলে এই কথাটা বললুম, একই ব্যাপার।’

‘এই যে, এই যে।’

বকুলের কথায় মিহির গাড়ি দাঁড় করাল একটা লোহার ফটকের সামনে। ফটকের ধারেই রাস্তার ইলেকট্রিক ল্যাম্প পোস্ট। জায়গাটায় যথেষ্ট আলো। ফটক থেকে সোজা একটা পথ ভিতরে গেছে। তার শেষে একটা কাঠের পাল্লা দেওয়া মোটর গ্যারেজ। বাড়িটা পথের ডান দিকে। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল মিহির। ওরা দুজনও নেমেছে।

‘কী দেখছেন? খুব পুরনো বাড়ি, দেড়শো বছর বয়স। একতলার দেয়ালগুলো আমার হাতের দু—হাত চওড়া।’ মালবিকা তার দু—হাতের আঙুলের ডগা বেঁকিয়ে হাতটা সমান্তরাল করে দেখাল।

‘আমাদের বাড়ির দেয়াল আড়াই হাত চওড়া। দিদিদের শ্বশুরবাড়ির দেয়ালও তাই।’

বকুল বাড়ির দোতলার বারান্দা আর খড়খড়ি দেওয়া জানলাগুলোর দিকে দু—তিনবার তাকাল। ট্যাক্সিতে নয় একটা প্রাইভেট গাড়িতে চড়ে এসেছে অথচ বাড়ির কেউ সেটা দেখল না তা তো হতে পারে না।

‘আচ্ছা, সমীরণবাবু মালিকে কী টেস্ট করবে বলতে পারো?’ বকুল রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রশ্নটা করল, গাড়িটাকে কিছুক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য। খড়খড়ি তুলে কেউ—না—কেউ নিশ্চয়ই দেখবে আর সারা বাড়িতে চাউর করবে, এটাই সে এখন চায়।

‘একটা দুটো গান গাওয়াবেন, তাল টাল নিয়ে দু—চারটে প্রশ্ন করবেন—’

‘তাল! মালি তুই জানিস তো?’ বকুল উদবিগ্ন হয়ে পড়ল। ‘তবলার সঙ্গে তো ও গান শেখেনি।’

‘আমাদের বাড়িতে তবলা নেই। তবলার আওয়াজ আমার জ্যাঠারা পছন্দ করেন না।’ মালবিকার স্বরে কিঞ্চিৎ শ্লেষ।

‘অনেকটা আমার বাবার মতোই। উনি গানবাজনাটাই পছন্দ করেন না, অথচ মা করেন।’

‘তা হলে আপনি যে শিখছেন?’

‘বাবা জানে না। বাড়ির সামনেই আমাদের পুরনো প্রেসবাড়িটা। ওর তিনতলায় পিছন দিকে একটা ঘরে সময় পেলে বসি। আচ্ছা মাসিমা এবার আমি যাব।’

হেলমেট পরা একজন স্কুটারে বসে ফটক দিয়ে ঢোকার সময় তাদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে গেল। বকুল হাঁফ ছাড়ল। তার মনস্কামনা পূর্ণ হয়েছে। ভটু নিশ্চয়ই কাউকে— না—কাউকে বলবে, দেখলুম ছোটোকাকিমা আর মালি মোটরে কোথা থেকে যেন ফিরল।

‘তুমি তো বাবা চা খাও না, নইলে বলতুম একটু বসে গিয়ে এককাপ চা খাওয়ার জন্য।’

‘আর একদিন এসে খেয়ে যাব মাসিমা।’

‘এটা কি ব্যবসাদারের কথা?’ মালবিকা ঠোঁট ছড়িয়ে দিল। তার মনে হয়েছে, অতি সাধারণ দর্শন এই যুবকটি রসিকতা যখন করতে পারে তখন নিতেও পারে।

‘এতে একটুও ব্যবসা নেই। আবার তো দেখা হচ্ছে সমীরণদার ওখানে, তখন নয় চা খাওয়ার দিন ঠিক করে নোব।’

‘তুমি কী বাবা টেস্টের সময় থাকবে?’ বকুল আর একবার উদবিগ্ন হল।

‘বলেন যদি থাকব, তবে সমীরণদা ওকে নিয়ে নেবেন।’

‘তুমি থেকো বাবা। আর মাইনের ব্যাপারটা, কমসম করবে কি?’

‘বলে দেখুন না। আপনারা শনিবার দশটা—সাড়ে দশটা নাগাদ যাবেন।’

মিহির গাড়িতে উঠল। বকুল মালবিকা ফটকের দিকে এগোল। গাড়িতে স্টার্ট সবে দিয়ে মিহির দেখল, মালবিকা দ্রুত তার দিকে আসছে।

‘কী ব্যাপার!’

জানলায় মাথা ঝুঁকিয়ে চাপা স্বরে মালবিকা বলল, ‘আচ্ছা তখন একটা কথা বললেন, সমীরণদা ভালো গলা আর সুন্দরী হলে কমেতে শেখান, এ—কথা কেন বললেন?’

‘কেন মিথ্যে বলেছি নাকি? আপনি সুন্দরী নন?’

মালবিকাকে এই প্রথম, প্রায় অপরিচিত একজন, আচমকা সুন্দরী বলল। রমণীয়ভাবে সে অপ্রতিভ বোধ করল।

‘বেশ তাই নয় হলুম কিন্তু আমার গলা ভালো এটা জানলেন কী করে? আমি তো কখনো আপনার সামনে গাইনি।’

‘এটা নিছকই অনুমান করে বললুম। গলা আপনার হেঁড়ে নয় আর আপনি গান শেখায় আগ্রহী, ব্যস। ভালো গাইয়ে হওয়ার জন্য এটাই তো যথেষ্ট।’

রিভার্স গিয়ার দিয়ে মিহির ক্লাচ ছেড়ে দিল। গাড়ি পিছু হটে গলি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। মালবিকা তাকিয়ে রইল।

‘ছেলেটার পয়সাকড়ি আছে, বড়োলোক, মনটাও ভালো।’

মালবিকা প্রায় চমকে উঠে পিছনে তাকাল। বকুল কখন যেন তার পিঠের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।

‘তাতে কী হল, অত্যন্ত বেঁটে।’

‘তাতেই বা কী হল! টাকার উপর দাঁড়ালেই লম্বা হয়ে যায়।’

‘কিছুই হয় না, চলো ভেতরে যাই। ওর ঘাড়ে, গেঞ্জির গলার কাছে বোতামের সাইজের একটা সাদা স্পট দেখলুম, বোধহয় শ্বেতি।’

.

যে ঘটনাটার কথা বলা হবে তাতে মিহিরেরও একটা বড়ো অংশ আছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবকটি লোকেরই যৎকিঞ্চিৎ পরিচয় দেবার চেষ্টা এতক্ষণ করলাম। ঘটনাটি ঘটবে কিন্তু বিরানব্বই সালের ছয় ডিসেম্বর। দিনটা ছিল রবিবার। সুধাংশু গাঙ্গুলি সেদিনই বাজারে গিয়ে চার ইঞ্চি সাইজের হাফ কেজি চিংড়ি কিনে ফেলবেন।

কিন্তু এখন মা ও মেয়ে প্রসন্ন ও কিঞ্চিৎ উত্তেজিত মনে বাড়িতে ঢুকল। দোতলায় উঠেই সিঁড়ির মুখে দেখা হল বকুলের বড়োজা পার্বতীর সঙ্গে। বয়স ষাটের কাছাকাছি। স্থূলকায়া, রাশভারী চালচলন, কথাবার্তায় বুঝিয়ে দেন হাঁড়ি আলাদা হলেও এই পরিবারের তিনিই প্রধানা।

‘কীসের মালা রে?’

‘দিদি, ওকে সমীরণ মিত্র নিজের হাতে দিয়েছে।’ বকুলের চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

‘কে সমীরণ মিত্র?’ পার্বতী স্থির ঠান্ডা চোখে ও গলায় বুঝিয়ে দিলেন নামটা এই প্রথম শুনলেন। বকুল বাকরহিত হয়ে রইল।

‘গান করেন। খুব নাম এখন।’ মালবিকা জানিয়ে দিল।

‘অ। তোকে মালা দিল কেন, চেনে?’

‘আজই প্রথম আলাপ হল। মহাজাতি সদনে একটা ফাংশান ছিল, আমি আর মালি শুনতে গেছলুম। সেখানে আমার এক দিদি গান হয়ে যাবার পর আমাদের গ্রিনরুমে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতেই কী ভেবে জানি না মালিকে উনি মালাটা উপহার দিলেন!’ এক নিশ্বাসে বকুল কথাগুলো বলল। ‘আমি তো অবাক। পরিচয় হতে—না—হতেই…আর বললেন, আমার গানের স্কুলে এসো, স্পেশাল ক্লাসে গান শেখাব।’

‘ভালো।’ পার্বতী পাশ কাটিয়ে নেমে গেলেন।

বকুলের শেষের কথাটা সেজোজা অর্চনা শুনতে পায় ঘর থেকে। বেরিয়ে এসে সে ডাকল বকুলকে।

‘মালি গান শিখবে বুঝি সমীরণ মিত্তিরের কাছে?’

‘হ্যাঁ। স্পেশালে শেখাবে…শেখাবেন।’

‘কত করে নেবে?’

‘ওইটেই তো সেজদি মুশকিলে ফেলেছে…দুউউশো! তোমার দেওরকে তো জানোই, মাসে মাসে এতগুলো টাকা বাড়তি খরচ!’

‘নামি লোকের কাছে গান শেখাতে গেলে খরচ তো করতেই হবে। অবুকে ভাবছি ভালো কারুর কাছে শিখতে দেব, তুমি একটু দ্যাখো না?’

অর্চনার অনুরোধটা অনুনয়ের ধার ঘেঁষে গেল। ঘর থেকে অবু অর্থাৎ অবন্তি এইসময় বেরিয়ে এসে মায়ের পাশে দাঁড়াল। বিয়ের এগারো বছর পর বহু ডাক্তার—বদ্যি দেখিয়ে ঠাকুর দেবতার দোর ধরে মানত করে অর্চনার অবশেষে কন্যালাভ হয়। অবু মায়ের মতোই কৃশ, লম্বা, বছর বারো বয়স। মুখটি খুবই মিষ্টি। এরই গানের শিক্ষিকার কাছে মালবিকা কিছুকাল গান শিখেছে।

বকুল দ্রুত চিন্তা করে নিল, সেজদির ঘরে ফোন আছে। যদিও আজ পর্যন্ত তাকে ফোন করতে বা ধরতে ওই ঘরে যেতে হয়নি কিন্তু এবার যদি কেউ তাকে করে? উমা বা মিহির কিংবা কোনো কারণে সমীরণ মিত্র যদি তাকে বা মালিকে ফোনে ডাকে? কাউকে ডেকে ফোন দেওয়ার ব্যাপারে তার এই সেজোজা—টি খুবই বিরক্ত হয়। বহু সময় বলে দেয় ‘বাড়ি নেই’। এজন্য তো বটেই তা ছাড়া এই বাড়িতে পুরুষ—মেয়ে মিলিয়ে সবার মধ্যে অর্চনাই একমাত্র এম.এ, দর্শন শাস্ত্রে। তাকে সবার অপছন্দের অন্যতম কারণ, এই তথ্যটি সুযোগ পেলেই সে জানিয়ে দেয়। বড়োজা পার্বতীও তাকে এড়িয়ে চলেন। সেজোভাসুর কেমিক্যালসের ব্যবসায়ী, রোজগার ভালো।

সেজোজা—কে হাতে রাখা দরকার, বকুলের দ্রুত চিন্তার সেটাই শেষ কথা। ‘নিশ্চয় বলব সেজদি। এখনও তো অবুর গলা তেমন তৈরি হয়নি, ওকে স্পেশালে দেবার দরকার কী? পঞ্চাশ টাকার ক্লাসে ভরতি করিয়ে দাও না। ওখানেও খুব মন দিয়ে শেখায়। তবে এত ভিড় যে নতুন ভরতি করছে কি না জানতে হবে।’

‘তবু দ্যাখো না একবার। গুণী লোকের কাছে প্রথম থেকেই শেখা ভালো।’

বকুল তিনতলায় যাবার সিঁড়িতে যখন পা রেখেছে পিছন থেকে তখন অর্চনা বলল, ‘আচ্ছা তুমি কার গাড়িতে এলে গো?’

‘তোমায় কে বলল?’ বকুল প্রশ্নটা পেয়ে খুশি হল।

‘শুনলুম ভটু বড়দিকে বলছিল ছোটোকাকি মোটরে করে বাড়ি এল।’

‘এই দ্যাখো, সামান্য একটা ব্যাপার সেটাও বাড়িতে খবর হয়ে গেল। আচ্ছা সব লোক বাবা! সমীরণ তো, ইয়ে সমীরণবাবু তো তাঁর নিজের খাবারের প্লেটটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘সবই আপনার। শেষ করতেই হবে।’ এই অ্যাত্তো বড়ো বড়ো তিন টাকা চার টাকা দামের গোটা ছয়েক মিষ্টি।’ হাত দিয়ে মিষ্টির আকার দেখাবার সময় সে আড়চোখে একবার মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিল। মালবিকার মুখের বিরক্তি সে গ্রাহ্য করল না।

‘তা দু—জনে মিলে তো শেষ করলুম। লোকটা কী ভদ্র আর বিনয়ী দ্যাখো সেজদি। এই তো সবে প্রথম আলাপ, তারপর বলল…বললেন, ‘আপনাদের বাড়ি পৌঁছে দেবে আমার এক ছাত্র।’ ছেলেটির নাম মিহির, দুশো টাকা দিয়ে গান শেখে। বিরাট প্রেসের মালিক। কলকাতায় সাত—আটটা বাড়ি, গাড়িই দু—খানা, এক বোন আমেরিকায় ডাক্তারি করছে। খুবই শিক্ষিত, গান শিখছে শখ করে। দিদিকে পাতিপুকুরে পৌঁছে দিয়ে সে আমাদের নামিয়ে দিল।’

‘তোমার দিদি আছে জানতাম না তো!’

‘বলিনি, পিসতুতো দিদি। আমার কে কোথায় আছে সে খবর তো এ বাড়ির কেউ জানতে চায় না, তাই আর বলিও না।’ বকুলের চোখেমুখে সামান্য অভিমান ফুটে উঠল। ‘দিদি একবার ফোন নম্বর চেয়েছিল আমি বলেছিলুম আমাদের বাড়িতে ফোনটোন নেই।’

‘সে কী, নেই বললে কেন?’ অর্চনা বিব্রত হল, বাড়িতে টেলিফোন নেই, এমন এক লজ্জাজনক মিথ্যা খবর ছোটোজারের পিসতুতো দিদির কাছে পৌঁছে গেছে, এতে সে ক্ষুব্ধ হল। ‘এক্ষুনি ওনাকে ফোন করে আমার নম্বরটা বলে দাও।’

ফাঁপরে পড়ল বকুল। উমার বাড়িতে ফোন আছে কি না সেটা তার জেনে নেওয়া হয়নি। মায়ের মুখ দেখেই মালবিকা বুঝে নিল বাড়াবাড়িটা রাশছাড়া হয়ে গেছে।

‘মাসির বাড়িতে ফোন করবে কী, আজ এগারো দিন হল ডেড হয়ে রয়েছে না? তুমি তা হলে তখন শুনলে কী?’ মালবিকা মাকে ছোট্ট ধমক দিল। ‘এখন চলো, বাবা এসে পড়বে।’

‘হ্যাঁ চল। সেজদি, আমি অবুর কথা বলব।’

তালা খুলে ঘরে পা দিয়েই বকুল সিল্কের শাড়ি খুলতে খুলতে বলল, ‘মালি, চট করে রুটিগুলো বেলে দে। দেরি হয়ে গেছে বড্ড।’

শাড়িটা খাটের উপর ছুড়ে দিয়েই সে আলনা থেকে আধময়লা তাঁতের শাড়ি তুলে নিল। ঘরের উত্তরের দেয়ালে মালবিকার ছোট্ট ঘরটার দরজা। দরজায় এসে উঁকি দিল বকুল। মালবিকা জুঁইয়ের গোড়েটা তার বালিশের উপর বিছিয়ে রাখছে। ভ্রূ কুঁচকে বিরক্ত স্বরে বকুল বলল, ‘আদিখ্যেতা এখন রাখ। আটা মাখাই আছে, বেলে দে, আমি তাড়াতাড়ি রুটি করে ফেলছি। ইসস বড্ড দেরি হয়ে গেল।’

দু—বেলার রান্না সকালেই সেরে রাখে। রাতে শুধু রুটি করা, আর রান্নাগুলো গরম করে নেওয়া। ঘরের বাইরের বারান্দা দিয়ে যেতে হয় রান্নাঘরে ও কলঘরে। মা ও মেয়ে দুজনেই যখন রান্নাঘরে তখন শোবার ঘর থেকে দিলীপরঞ্জনের ডাক শোনা গেল।

‘শুনে আয় তো কেন ডাকছে।’

‘তুমি যাও, আমি এগুলো করে ফেলছি। আর মাইনের কথাটা বোলো। দুশো টাকা শুনেই যেন না লাফিয়ে ওঠে।’

বকুল শোবার ঘরে ঢোকামাত্র খাটে পা ঝুলিয়ে পাজামা পরা, খালি গায়ে দিলীপরঞ্জনের চোখ কুঁচকে গেল। চাপা গলায় সে বলল, ‘গাড়িটা কার?’

‘কার মানে!’ বকুল বুঝে উঠতে পারল না প্রশ্নের আড়ালে কী জমা রয়েছে।

‘কার মানে কার। এর থেকে সোজা বাংলা আর কী হতে পারে। কার গাড়িতে চেপে এলে?’

‘তোমাকে তো বলেই ছিলুম, মায়া আর তার বর অফিসের ফাংশান দেখতে যাবে না বলে কার্ড দুটো আমাদের—’

বকুলকে থামিয়ে দিয়ে দিলীপরঞ্জন বলল, ‘কার্ডের কথা নয় গাড়ির কথা জানতে চেয়েছি।’ কিছুক্ষণ বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সে আবার বলল, ‘ছোকরা কে, যার গাড়ি চড়ে এলে?’

‘তুমি দেখেছ?’

‘দেখেছি। মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলুম। দেখলুম গাড়িটা ঢুকল গলিতে। দূর থেকে দেখলুম খুব গল্প হচ্ছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ব্যাপারটা কী?’

বকুলের মনে হল তার স্বামী অল্পই খেয়ে এসেছে। এখন আর টাকা খরচ করার সামর্থ্য নেই, দেশি চোলাই দিয়েই নেশাকে সন্তুষ্ট রাখে। খুব বেশি খেয়ে দিলীপরঞ্জন তিনতলা পর্যন্ত টলমল অবস্থায় পৌঁছে গেলে বকুলের উদবেগ ও শারীরিক যাতনাটা কিছু কমে। নিয়ন্ত্রণ হারানো দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে, ঠেলেঠুলে খাটের উপর ফেলে দিতে পারলেই কাজ চুকে যায়। এতে মালিও তাকে সাহায্য করে।

কিন্তু অল্প খেয়ে সামান্য নেশা নিয়ে বদমেজাজ তৈরি করে ফিরলে বকুল প্রমাদ গোনে। আজও সে প্রমাদ গুনল।

‘নিজে মোটরে চড়ছ চড়ো, আমার এখন তো আর মোটর নেই, অন্যের মোটরে তো চড়বেই। তাই বলে মেয়েটাকে চড়তে শেখাচ্ছ কেন?’ দিলীপরঞ্জনের ধীরে ধীরে শান্ত কঠিন গলায় বলা কথাগুলো বকুলের রক্ত হিম করে দিল। নিশ্চয় পুরোনো কথা তুলে চিৎকার করবে ‘ফাংশানে সমীরণ মিত্রের সঙ্গে একজন আলাপ করিয়ে দিল, তিনিই তাঁর এক ছাত্রকে গাড়ি করে আমাদের পৌঁছে দিতে বললেন, এঁদের কাউকেই কখনো আগে দেখিনি, আলাপও ছিল না। বিশ্বাস করো।’ বকুল ক্ষমাপ্রার্থীর মতো স্বরে বলল।

‘চোখে দ্যাখোনি, আলাপও ছিল না আর অমনি অমনি সমীরণ মিত্তির গাড়ির ব্যবস্থা করে দিল? কেন? তার কীসের অত আঠা যে মা আর মেয়েকে দেখেই রসে চপচপে হয়ে পড়ল।

বকুল এসব কথার কী জবাব দেবে। সে চুপ করে রইল। রান্নাঘরে মালি রুটি সেঁকছে না বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছে, সেটাই তাকে ভাবনায় ফেলল। স্বামী বহুদিন, বহুভাবে মেয়ের সামনে তাকে হেনস্থা করেছে, মারধোরও। কিন্তু মালি এখন উনিশ বছরের। এসব এখন বন্ধ করা উচিত। বয়স্ক বাবা—মার কুৎসিত কথাবার্তা আচরণের প্রভাব যতটুকু মালির উপর পড়েছে তাতেই ওর যথেষ্ট ক্ষতি হয়ে গেছে। কিন্তু আর এটাকে বাড়তে দেওয়া যায় না।

কিন্তু কী করে সে বন্ধ করবে। তার অত ক্ষমতা কোথায়? সে তো স্বামীর হাততোলা! পালটা সেও যদি চিৎকার করে? তাতে তার স্বামী লজ্জা পাবে না, মুখও বন্ধ করবে না। বরং সারা বাড়ি তার বিরুদ্ধে যাবে। এই বাড়িতে সে বাইরের লোক। মারধোর করলে পালটা মার দেবে? তার অত গায়ের জোর কোথায়? বরং বাধা না দিয়ে মার খেলে অল্পক্ষণেই তার স্বামীর প্রহারের উৎসাহটা কমে যায়।

কোনো কোনো গভীর রাতে চেতনায় অপমান আর শরীরে যন্ত্রণা নিয়ে বেঘোরে ঘুমোনো স্বামীর পাশে শুয়ে বকুল তার ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছে, ‘আমাকে বিধবা করে দাও। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আর কোনো উপায় আমার সামনে নেই।’ মনে মনে সে বহুবার তার স্বামীর মৃতদেহ দেখেছে। বাসের তলায়, জলে ডুবে, সাপের কামড়ে, চারতলার ছাদ থেকে পড়ে, ভেজাল চোলাই খেয়ে দিলীপরঞ্জন মারা যাচ্ছে, এমন ছবি তার চোখে ভেসে উঠেছে। দেখতে দেখতে উত্তেজিত মাথা একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়লে সে ভয়ে কাঁটা হয়ে তারপর ভেবেছে, আমার আর মালির তখন কী হবে? আমাদের খাওয়াবে পরাবে কে? দিন চলবে কী করে? ভাসুরদের দয়ায়? সংসারে ঝি হয়ে?

বেঁচে যাওয়ার একমাত্র উপায় হিসাবে অতঃপর সে দেখতে পায় নিজের মেয়েকে। যদি তার মেয়ে রোজগার করতে পারে সে ঠিক করে রাখল, তা হলে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে এই বাড়ি ছেড়ে। কখনো—না—কখনো তার দিন আসবেই, এই চিন্তাটাই তাকে আশা দিয়ে সব অত্যাচার সহ্য করিয়ে গেছে। কিন্তু কীভাবে যে লক্ষ্যপূরণ হবে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। মালবিকার লেখাপড়ায় মাথা নেই কিন্তু সুন্দর একটা গানের গলা আছে। এই সংক্ষিপ্ত জানাটুকুর সঙ্গে তার বাস্তববোধ যুক্ত করে সে বুঝেছে, গান ছাড়া তার মেয়ের বড়ো হয়ে ওঠার মতো আর কোনো সংগতি নেই। অপ্রত্যাশিতভাবে সমীরণ মিত্রর সঙ্গে আলাপ হয়ে যাওয়াটাকে সে ভগবানের দান হিসাবে গণ্য করেছে। এই দান সে দু—হাতে আঁকড়ে ধরবে, সেজন্য যত অত্যাচার সহ্য করতে হয় সে করবে।

বকুল ও দিলীপরঞ্জনের মধ্যে কথাবার্তার মাঝে, কাহিনির প্রবাহ বন্ধ করে এত যে কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হল, তার কারণটি খুবই প্রাঞ্জল। বকুল তার অসহায় অস্তিত্বের মধ্যে ডুবে রয়েছে এবং মেয়েকে কোথাও একটা শক্ত জমিতে দাঁড় করিয়ে নিজে ভেসে থাকতে চাইছে। এই দুই বিপরীত অবস্থার সংঘাত তার মধ্যে আলোড়ন তুলছে এবং তার ফলে তার আচরণে ও কথায় মরিয়া ভাব এসে যাওয়া যে স্বাভাবিকই, সেই কথাটাই বলে দেওয়া হল।

দিলীপরঞ্জন যখন তাকে বলল, ‘তার কীসের অত আঠা যে মা আর মেয়েকে দেখেই রসে চপচপে হয়ে পড়ল!’ তখন বকুলের দীন করুণ ভাবটা নিমেষে বদলে কঠিন হয়ে উঠল।

‘কেউ যদি আমাদের দেখে চপচপে হয়, তা হলে আমরা কী করতে পারি।’

‘কী করতে পারি মানে?’ ধমক দিয়ে উঠল দিলীপরঞ্জন। ‘তুমি কী জানো লোকটা কেমন? জানো না বোলো না, বহু লোক একসময় চরিয়েছ লোক চেনো না বোলো না। সমীরণ মিত্তির একের নম্বরের ক্যারেক্টারলেস, শুয়োরের বাচ্চচা, অনেক মেয়ের সর্বনাশ করেছে। ওর সম্পর্কে অনেক কথা শুনেছি। বউ তো দু—বার ওকে ছেড়ে চলে গেছল। ওর এক ছাত্রী রেপিং চার্জ এনেছিল ওর নামে, পুলিশকে খাইয়ে শেষ পর্যন্ত কেস ভন্ডুল করে দেয়। লম্পট মাতাল কোথাকার।’ খাট থেকে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে উঠল দিলীপরঞ্জন। ঘৃণায় তার মুখের পেশি বিকৃত।

‘তুমি অন্য লোককে মাতাল বলো কী করে? তোমার নামেও তো ঘুষ নেওয়ার চার্জ তোমার অফিস এনেছিল। তুমিও তো গাড়িটা বিক্রি করে টাকা খাইয়ে চাকরি বাঁচিয়েছ।’ বকুল জানে তার কথার প্রতিক্রিয়াটা মারাত্মকভাবে হবে। তাই হোক, তবু সে আজ কথা বলবে।

দিলীপরঞ্জন অদ্ভুত চোখে তার বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইল। দরজায় দাঁড়িয়ে মালবিকা বলল, ‘খাবার গরম করেছি, দিয়ে যাব?’

‘নিয়ায়।’ বকুল উঠে গেল একধারের দেয়াল ঘেঁষে রাখা টেবলটায়। শোবার ঘরের মধ্যেই তাদের খাওয়া সারতে হয়। একসময় যে ঘরে তারা খেত সেটা এখন মালবিকার ঘর।

‘সমীরণের হয়ে ওকালতি করছ যে, ব্যাপার কী?’

‘কোথায় আবার ওকালতি করলুম!’

‘আমি মদ খাই ঠিকই কিন্তু পরের বউ—মেয়ের দিকে হাত বাড়াই না। ও আর আমি এক জিনিস নই।’

দুটো বড়ো বাটিতে ডাল আর ডিমের ঝোল হাতে নিয়ে মালবিকা ঘরে ঢুকে টেবলে রেখে বেরিয়ে গেল। বেরোবার সময় একবার বাবার মুখের দিকে তাকাল।

‘হ্যাঁ, তুমি শুধু নিজের বউয়ের দিকেই হাত বাড়াও, তফাতটা শুধু এই।’

‘চুপ কর হারামজাদি, যত বড়ো মুখ নয় তত বড়ো কথা! জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব।’

দিলীপরঞ্জন দু—পা এগিয়ে গেল। বকুল একপা পিছিয়ে চেয়ারের পিঠ আঁকড়ে ধরল। সে খুন দেখতে পাচ্ছে স্বামীর চোখে। বোকার মতো কথাটা সে বলে ফেলেছে তো বটেই। মালির গান শেখার জন্য টাকা এই লোকটার কাছ থেকেই পেতে হবে।

‘আমাকে গালাগাল দিয়ে, মারধোর করে তুমি যেন কী একটা জ্বালা জুড়োও, কীসের জ্বালা?’

একটা ডেকচিতে রুটি নিয়ে মালবিকা আবার ঘরে এল। টেবলের উপর সেটা রেখে বলল, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমোতে যাচ্ছি।’

‘এই হচ্ছে আমার আর—একটা জ্বালা।’ দিলীপরঞ্জন দাঁত চেপে আঙুল তুলে মালবিকার ঘরের দরজাটা দেখাল। ‘মায়ের থেকেও এককাঠি ওপরে যাবে।’

‘যাক না। মায়ের মতো ভুল যদি না করে—’

‘কীসের ভুল? ভুল তো আমি করেছি।’ দিলীপরঞ্জন দু—হাতে বকুলের কাঁধ আঁকড়ে ধরে ঝাঁকানি দিয়ে শাড়ির আঁচলটাকে টেনে মেঝের উপর ফেলে দিল।

বকুল স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। স্বামীকে বাধা দেবার কোনো চেষ্টা তার মধ্যে নেই। আঁচলটাও কাঁধের উপর তুলল না। দিলীপরঞ্জন কর্কশ দৃষ্টিতে বকুলের বুকের উপর চোখ রেখে বলল, ‘সমীরণকে পটাবার জন্য দেখছি খুব তুলে দিয়েছ, বুঝি না কিছু ভেবেছ?’

এইসব কথা বকুলের কাছে নতুন নয়। দিলীপরঞ্জন একদিন একটু মত্ত হয়ে দু—হাতে ব্লাউজের গলা ধরে হ্যাঁচকা টানে হুকগুলো ছিঁড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর হেসে উঠে হাঁ করে একটা স্তন মুখে পুরে জোরে কামড়ে ধরে। বকুল চিৎকার করে উঠতে গিয়েও করেনি, পাশের ঘর থেকে মেয়ে তা হলে বেরিয়ে আসবে। এখন তার মনে হচ্ছে দিলীপরঞ্জন ওইরকম কিছু একটা করতে চাইলে এতক্ষণে তা করে ফেলত। করেনি যখন তার মানে নেশার ঘোরটা কেটে গেছে।

‘আমি তো বলেইছি, সমীরণের সঙ্গে আলাপ হবে তা আমি জানতুমই না। হঠাৎ—ই হয়ে গেল।’

‘আর অমনি মুখখানি দেখেই গাড়িতে তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দিল!’

‘ওঁর এক ছাত্রর এদিকেই বাড়ি। তাকে বললেন আমাদের বাড়ি পৌঁছে দিতে। আমি ঠিক করেছি মালিকে ওঁর কাছে গান শেখাব।’ কথা বলতে বলতে বকুল আঁচলটা তুলে নিল। টেবলে গিয়ে থালা পেতে ডেকচি থেকে ঢাকনা তুলে বলল, ‘ক—টা রুটি দোব?’

‘ওই দুশ্চরিত্রের কাছে মেয়েকে গান শিখতে পাঠাবে?’

‘আমার তো মনে হল উনি ভদ্রলোক।’

‘ভদ্দরলোকের তুমি কী জানো? ক—টা ভদ্দরলোক তুমি আজ পর্যন্ত দেখেছ?’

‘একজনকেও নয়।’ বকুল চারখানা রুটি থালায় রাখল। দিলীপরঞ্জন এক ঝটকায় থালাটা মেঝেয় ফেলে দিল।

‘আমাকে অপমান করার সাহস কোথায় পেলে?’

মেঝে থেকে থালা আর রুটি টেবলে রেখে বকুল বলল, ‘খাওয়ার ইচ্ছে আছে না নেই?’

‘আগে আমার কথার জবাব দাও।’

‘মালিকে আমি সমীরণ মিত্রের কাছে গান শেখাব। ওকে বড়ো করব, পাঁচজনের একজন হবে, ভালো বিয়ে দেব। আমার মতো দুর্ভাগ্য যাতে ওর না হয় সেজন্য আমি সব করব, সবকরব,’ দাঁত চেপে, দু—হাতের মুঠো ঝাঁকিয়ে বকুল জানিয়ে দিল সে বদ্ধপরিকর।

দিলীপরঞ্জন বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল তার বউয়ের দিকে। বকুলের এমন মূর্তি কখনো সে দেখেনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নীচু গলায় বলল, ‘খেতে দাও।’

টেবলে দু—হাত রেখে দিলীপরঞ্জন গোঁজ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, ‘টাকা আমি দোব না।’

‘লোকের বাড়ি বাসন মেজে আমি টাকা তুলব।’

‘তাই কোরো।’

পরদিন সকালে মালবিকা তার মাকে জানাল, ‘বাবার টাকার দরকার নেই, তোমাকেও বাসন মাজতে হবে না। গান আমি শিখব না।’

.

কিন্তু বকুল ও মালবিকা শনিবার সকাল দশটায় সমীরণ মিত্রর বাড়িতে পৌঁছল। একতলায় স্কুল, দোতলায় সে স্ত্রী ও ছেলে নিয়ে থাকে। সকালে স্কুল বসে না। একতলার দুটো ঘরে তালা দেওয়া। ওরা দোতলায় উঠে এল।

সিঁড়ি থেকেই সামনে একটা ঘর। বড়ো বড়ো গোলাপ ফুলের প্রিন্ট করা ভারী পর্দা দরজায়। ডান দিকে দালান চলে গেছে। সেখানেও পরপর দুটো খোলা দরজায় একই প্রিন্টের হলুদ আর আসমানি রঙের পর্দা ঝুলছে। বকুল সামনের ঘরের পর্দা সরিয়ে উঁকি দিল। ঘরে একমাত্র লম্বা সোফাটায় জড়োসড়ো হয়ে দুটি লোক বসে। বকুলকে দেখেই তারা দাঁড়িয়ে উঠে নমস্কার করল। বকুল হতভম্ব।

চট করে ঘরের চারপাশটা সে দেখে নিল। আর কেউ নেই। বেশ বড়োই ঘর। তিনটে ফোম রাবার আসনের বেতের চেয়ার, বেতের সেন্টার টেবল। দেয়ালে সোনালি পাড় দেওয়া গোল একটি ঘড়ি, যার কাঁটা দুটি রুপালি। ঘরের আধখানা জুড়ে শতরঞ্জির উপর সাদা চাদর, তাতে দুটি গেরুয়া ওয়াড় দেওয়া মোটা তাকিয়া। হারমোনিয়াম, বাঁয়া—তবলা, তানপুরা, অ্যাশট্রে। নিরাভরণ, অগোছালো, অযত্নে রাখা। দেয়ালে দু—তিন জায়গায় পলেস্তারা ফাটা। মেঝে থেকে এক মানুষ সমান লম্বা জানলা, যার তলার অর্ধেকটার খড়খড়ি দেওয়ালে আঁটা, খোলা যায় না। উপরের ভাগের পাল্লা হেলে পড়েছে কবজা থেকে, বহুকাল জানলায় রং করা হয়নি। এমন এক বিমর্ষকর ঘরে খুবই বেমানান লাগে এক ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ীর বিরাট ক্যালেন্ডারটা। উজ্জ্বল হাসিভরা দুটি শিশু লোমশ একটা কুকুরছানা নিয়ে বাগানে খেলছে, অবশ্যই একটা ট্রানজিস্টর ঘাসের উপর রাখা। নতুন সিলিং ফ্যানটাও কড়িকাঠের সঙ্গে খাপ খায় না।

লোক দুটিকে কী বলবে বকুল ভেবে পেল না। মালবিকাই এই অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে তাকে উদ্ধার করল।

‘আমরাও কিন্তু সমীরণবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’ মালবিকা ঠেলে বকুলকে ঘরের ভিতরে পাঠাল।

লোক দুটি লজ্জায় পড়ল। ওদের মধ্যে কমবয়সিটি আবার সোফায় বসে পড়ে বলল, ‘আমরা গোবরডাঙা থেকে আসছি। আমরা ভেবেছিলুম আপনি বোধহয় সমীরণ মিত্রের স্ত্রী। লোকটা আমাদের বসিয়ে বলল, ‘মাকে ডেকে দিচ্ছি’, তারপরই আপনি উঁকি দিলেন। তাই আমরা ভাবলুম—।’

‘না, না, আমি ওনার স্ত্রী নই, আমরাও একটা দরকারে ওঁর কাছে এসেছি।’

বকুল একটা বেতের চেয়ারে বসল, তার পাশেরটায় মালবিকা। পর্দা সরিয়ে একটি লোক তাদের দেখে নিয়ে চলে গেল। এতবড়ো একজন নামী গাইয়ে পুরোনো বাড়িতে আর এমন একটা বসার ঘর নিয়ে বাস করে, এটা দেখে বকুল একটু দমে গেল। সিনেমায় বা টিভি—তে বড়ো বড়ো লোকেদের বসার ঘরের সঙ্গে একফোঁটা মিলও সে খুঁজে পাচ্ছে না।

মালবিকা মুখটা বকুলের কানের পাশে এনে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘মা কে?’

‘বোধহয় ওর বউ।’

বয়স্কজনটি কথাটা শুনতে পেয়ে বলল, ‘কমার্শিয়াল ব্যাপারটা ওঁর স্ত্রী শিঞ্জিনী দেবীই তো দেখেন। যা কিছু কথাবার্তা উনিই বলেন, উনিই টাকাপয়সা ঠিক করে দেন।’

লোকটির কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পর্দা সরিয়ে একজন ঘরে ঢুকল, যাকে দেখামাত্র ওরা বুঝে নিল, এই হচ্ছে শিঞ্জিনী। মাথা ঘুরিয়ে চারজনের দিকে ওর তাকানোর ভঙ্গিতে কর্তৃত্ব প্রয়োগের একটা ঔদ্ধত্য রয়েছে। শিঞ্জিনী ভ্রূ কুঁচকে বকুল—মালবিকাকে দেখে নিয়ে গোবরডাঙার দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কে বিকাশ মুখোপাধ্যায়?’

‘আ—আমি।’ কমবয়সি উঠে দাঁড়াল।

‘আপনি মল্লিকার চিঠি নিয়ে এসেছেন?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আমার বউ।’

‘কিন্তু ভাই টাকা তো আমি কমাতে পারব না ওঁর যা রেট—’

‘না, না, না, টাকা কমাবার কোনো প্রশ্নই নেই। উনি যা নেন তাই নেবেন। আমার অনুরোধ প্রোগ্রামটা শনিবারের বদলে রবিবার হচ্ছে, উনি যদি রবিবারে আসেন তা হলে আমরা ধন্য হব।’ বিকাশ করজোড়ে তাকিয়ে রইল শিঞ্জিনীর দিকে।

দুই ভুরুর মাঝখানটা চুলকিয়ে একটু বিব্রত গলায় শিঞ্জিনী বলল, ‘রবিবার তো একটা ঘরোয়া আসরে ওঁর গাইবার কথা। সাহিত্যিক, ফিল্ম ডিরেক্টর, আইএএস, আইপিএস—দের বউয়েরা, দু—একজন জার্নালিস্টও আসরে থাকবেন। সমীরণের তো এখানে কথাও দেওয়া হয়ে গেছে।’

‘কথা কি পাকাপাকি দেওয়া হয়ে গেছে? ডেটটা চেঞ্জ করা যায় না?’

‘প্রায় একরকম পাকাপাকিই বলা যায়।’

‘একটু ওঁদের বলে দেখুন না যদি অন্য দিনে হয়। আমরা তা হলে দশ হাজার দেব যদি উনি রবিবারে আসেন।’

‘দেখুন ওঁর শরীরটা খুব খারাপ। কাল রাতে জামসেদপুর থেকে ফিরলেন কী যে শরীর নিয়ে! এতটা লং জার্নি মোটরে করাই উচিত হয়নি।’

‘আমরা ওঁকে ট্রেনে গোবরডাঙা নিয়ে যাব। বিটি রোড, যশোর রোডে ওঁর গাড়ির চাকাই পড়বে না। ম্যাডাম, আপনি কিছু ভাববেন না, ট্রেনে কলকাতার রাস্তার মতো গর্তটর্ত, ঝাঁকুনি নেই।’

শিঞ্জিনী তৃতীয় বেতের চেয়ারটায় বসে ভ্রূ কুঁচকে কপালে আঙুলের কয়েকটা টোকা দিল। লোক দুটি জলে পড়েছে, কী করে তাদের উদ্ধার করা যায়, এমন একটা সমস্যা তার মুখে ফুটে উঠল। ‘দশ নয় ওটা বারো করুন। তা হলে রবিবারের ওই আসরটা থেকে সমীরণকে তুলে আনা যেতে পারে। টাকাটা কিন্তু আগাম পুরোই চাই, ক্যাশে।’

‘তা হলে আপনি দায়িত্ব নিন ওঁকে নিয়ে যাবার। বারোতেই আমরা রাজি। কাল কী পরশু এসে কনট্রাক্ট করিয়ে টাকা দিয়ে যাব।’

‘আমি আর ওঁকে নিয়ে যাব না, উনি নিজেই যাবেন । দুটো গাড়ি ঠিক সময়ে পাঠাবেন আর এগারোটার মধ্যে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু খেতেটেতে চাইলে দেবেন না। ঠিক দু—ঘণ্টা গাইবেন।’ শিঞ্জিনী ফর্দ পড়ার মতো বলে গেল।

ওরা দুজন উঠে দাঁড়াল। মুখে বিগলিত হাসি। নমস্কার করে তারা চলে যাবার পর শিঞ্জিনী বকুল ও মালবিকার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘আমাদের সমীরণবাবু আসতে বলেছেন। এই আমার মেয়ে মালবিকা, ওর গান শেখার ব্যাপারেই আসা।’

মালবিকা প্রণাম করল শিঞ্জিনীকে। বকুল একবার ভাবল সে—ও করবে কি না, কিন্তু প্রায় সমবয়সি বা ছোটোই হবে বিবেচনায় শুধু স্মিত মুখে সে তাকিয়ে রইল।

‘তা হলে তিনটের পর আসুন তখন স্কুল খুলবে।’ শিঞ্জিনী তীক্ষ্নচোখে মালবিকার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

‘ওকে স্পেশালে শেখাবেন বলেছেন, তার আগে গান শুনবেন। সেজন্য আসা।’ বকুল নম্রস্বরে বলল।

‘কার কাছে গান শেখে?’

‘কারুর কাছে নয়। বহু আগে একজনের কাছে শিখেছে, সে না—শেখারই মতো।’

‘হারমোনিয়াম বাজাতে পারে তো?’

‘তা পারে।’

দু—জনের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে, কোনো কথা না বলে শিঞ্জিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার ভঙ্গিতে প্রকট ছিল অবহেলা, মালবিকার সেটা ভালো লাগল না।

‘বেশ সুন্দরীই।’ বকুল মাথা হেলিয়ে চাপা গলায় বলল।

‘এককালে ছিল।’ মালবিকা কথাটা বলেই যোগ করল, ‘মেক—আপ করেছে বলে অমন দেখাচ্ছে।’

‘তা কেন, মুখখানি বেশ সুন্দরই তো। শরীরের গড়নও ভালো। রং ফরসা, কোমর—টোমর সরু রেখেছে। শুধু চোখদুটোই যা ছোটো ছোটো।’

‘তুমি একে ভালো ফিগার বলো কী করে? কেমন একটা কাঠ—কাঠ ভাব, গায়ের চামড়াটাও খসখসে। গালে ব্রণর দাগগুলো লক্ষ করেছ?’

‘আস্তে বল।’

কিছুক্ষণ ওরা চুপচাপ বসে থাকার পর উসখুস শুরু করল। সেন্টারটেবলের নীচের তাকে কয়েকটা ম্যাগাজিন দেখে মালবিকা একটা তুলে নিল। বাচ্চচাদের ম্যাগাজিন, বোধহয় সমীরণের ছেলের। কয়েক পাতা উলটে সে রেখে দিল।

‘আমরা যে এসেছি সেটা বোধহয় ওকে জানানো হয়নি।’ মালবিকা বলল।

‘নিশ্চয় জানিয়েছে। দেরিতে ওঠেন তো বলেই দিয়েছিলেন। মিহির আসবে বলেছিল, কই এখনও তো এল না।’

‘রেখে দাও ওসব আসা—টাসার কথা। বলার জন্যই বলা।’

‘ছেলেটি কিন্তু বেশ।’

‘তোমার সব কিছুতেই ‘বেশ’। এটা বলা থামাও তো।’

দুজনে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। ক্রমশ ব্যাজার হতে হতে বকুল কথা শুরু করল।

‘বারো হাজার টাকা নেন মাত্র দু—ঘণ্টা গাইতেই।’

‘বারো হাজার না আরও কিছু। ওরা তো ডেট বদলাতে চেয়ে দশ হাজার অফার করল। তার মানে আগে আরও কমে কথা হয়েছিল। এখন ইনি গরজ বুঝে মোচড় দিয়ে ওটাকে বারোয় তুলল। রবিবারে কোথায় যেন গাইবার কথা আছে বলল না? সব ফলস। খুব জাঁহাবাজ মেয়েমানুষ।’

‘তোর দেখছি ওকে একদমই ভালো লাগেনি।’

‘না। ভাবভঙ্গিটা দেখলে না? প্রণাম করলুম, একটা কিছু তো লোকে বলে। অথচ যেন দেখতেই পায়নি এমন একটা ভাব করল। নিজে অত সেজেছে আর ঘরটা কী করে রেখেছে?’

‘গাইয়ে বাজিয়েদের ঘর এইরকমই হয়।’

‘মোটেই তা নয়। আসলে দরকার ইচ্ছে, সেটা থাকলে ঘরটা পরিচ্ছন্ন করে রাখা যায়। পর্দাগুলো এত দামি আর দেয়ালটা দ্যাখো!’

বকুল চারদিকের দেয়ালে চোখ বোলাল। সেই সময় রাস্তা থেকে কয়েকবার মোটরের হর্ন বাজল। পাশের ঘরের জানলা থেকে শিঞ্জিনীর গলা শোনা গেল, ‘যাচ্ছি, এক মিনিট।’

মালবিকা উঠে গিয়ে জানলা থেকে দেখল বাড়ির সামনে একটা সবুজ রঙের মারুতি দাঁড়িয়ে। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি নিশ্চয় ড্রাইভার।

ঘরের সামনে ব্যস্ত চটির শব্দ হল। পর্দা সরিয়ে শিঞ্জিনী বলল, ‘আপনারা বসুন, আসছেন।’ পর্দা পড়ল। চটির শব্দ একতলায় নেমে গেল। মালবিকা জানলা থেকে শিঞ্জিনীর গাড়িতে ওঠা দেখল।

‘মারুতি গাড়ি।’ মালবিকা চেয়ারে ফিরে এসে বসল। ‘বউই চড়ে বেড়ায়।’

‘কত দাম?’

‘লাখ দুয়েক—দেড়েক হবে।’

‘অ্যাতো! তুই পারবি অমন একটা গাড়ি কিনতে?’ গলায় ক্ষীণভাবে আবদারের মতো সুর ফুটে উঠল।

মালবিকা মুখ ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। হালকা একটা বিষণ্ণ হাসি তার চোখে ভেসে এল। ‘মাইনের টাকাটা কত বলে সেটা আগে জেনে নাও। আকাশকুসুম দেখতে শুরু কোরো না।’

দরজার পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকল সমীরণ মিত্র। আদ্দির পাঞ্জাবি আর ঢোলা পাজামা, সাদা রাবারের চটি। চুলে চিরুনি পড়েনি। ফুলো ফুলো দুই চোখ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি কিন্তু খুব দেরি করিনি, আপনারাই আগে এসে পড়েছেন। আসলে হয়েছে কী, কথা ছিল ট্রেনে ফেরার। সঙ্গে ছিল তিনজন, তবলা আর খোল বাজাবার দুজন আর তানপুরো ছাড়ার মেয়েটি, আমারই ছাত্রী প্রতিভা। টাটার এক অফিসার কলকাতায় আসছিলেন গাড়ি করে। আমি দেখলুম ভোররাতে উঠে স্টিল এক্সপ্রেস ধরা আমার দ্বারা হবে না। তার থেকে বরং—’, সমীরণ সোফায় বসে গা এলিয়ে দিল।

তখনই মালবিকা তাকে প্রণাম করতে এগিয়ে গেল। হাঁটু গেড়ে বসে সমীরণের দুই পায়ের পাতা দু—হাতে ধরে সে নুয়ে পড়ল। কপাল ঠেকল পাতায়।

‘আরে আরে।’ সমীরণ সোজা হয়ে বসে মালবিকার দুই কাঁধ ধরে ‘থাক থাক’ বলে তাকে তোলার চেষ্টা করল। মালবিকা তখন অনুভব করল, আঙুলগুলো তার ঘাড়টাকে বার দুই যেন হালকাভাবে কচলাল। সহজাত বোধ তাকে জানিয়ে দিল, এই কচলানিটা কিছু একটা ইঙ্গিত দেবার জন্য। সে চোখ তুলে সমীরণের চোখে বিহ্বল দৃষ্টি রেখে ধীরে ধীরে চোখ নামিয়ে নিল।

‘বোসো বোসো।’ সমীরণ হাত ধরে মালবিকাকে তার পাশে বসাবার সময় সামান্য একটা টান নিল। মালবিকা তার গা ঘেঁষে বসল। বকুল এত নামি গায়কের এমন সারল্য দেখে পুলক বোধ করল। তার মনে আশা জাগল, বোধহয় মেয়েটার একটা হিল্লে হবে। এখন মাইনের ব্যাপারটায় যদি একটু বিবেচনা করেন!

‘মালির গান শুনে বলুন, ওর কিছু হবে কি না।’ বকুল নড়েচড়ে বসল।

সমীরণ তার ঝকঝকে চটুল চাহনি মালবিকার চোখের উপর রেখে বলল, ‘হবে না কেন? যদি পরিশ্রম করে, খাটে, আমার কথামতো যদি রেগুলার সাধনা করে তা হলে নিশ্চয় হবে। কী বলো, হবে না?’ কথাটা বলে সমীরণ মালবিকার ডান হাতের মুঠি বাঁ হাতে চেপে ধরল।

মালবিকা মাথা নামিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আপনি যদি আমাকে গাইড করেন।’

সমীরণ কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘আচ্ছা তোমার গলাটা একটু শুনি। যে—কোনো একটা গান গাও, খালি গলায় কিন্তু।’

গান গাইবার জন্যই আসা সুতরাং কয়েকটা গান সে স্থির করেই এসেছে। মালবিকা কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে থেকে গান শুরু করল। ‘সখী, বহে গেল বেলা, শুধু হাসি খেলা এ কি আর ভালো লাগে।’

রেকর্ড থেকে হুবহু তোলা, শুধু গলাটাই যা মিহি এবং তীক্ষ্ন। কয়েকবার স্বর কেঁপে গেল, শ্বাস নেওয়া ও ছাড়ায় ভুল করল, সুরচ্যুতি ঘটল এবং অবাক চোখে সমীরণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। গান শেষ হবার পর ঘর নীরব রইল কিছুক্ষণ। মালবিকা উৎকণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে রইল সমীরণের বন্ধ চোখের দিকে।

‘তুমি যে এইরকম একটা গান শোনাবার জন্য বেছে নেবে, সেটা আমি ভাবতে পারিনি। গলায় এখনও সুর বসেনি তবে মোটামুটি তুমি উতরে গেছ তোমার ভগবান—দত্ত মিষ্টি গলাটার জন্য। আমি রবীন্দ্রসংগীত জানি না, গাইও না, কিন্তু তোমারও এটা লাইন নয়। তুমি অন্য ধরনের গান শেখো।’

‘বেশ তো আপনিই ঠিক করে দিন কোন লাইনে ও যাবে।’ বকুল ব্যগ্র স্বরে বলল।

‘সা রে গা মা থেকে ওকে শিখতে হবে। এখন যা শুনলেন সেটা অশিক্ষিত পটুত্ব, বেশিদূর যাওয়া যাবে না। রোজ তিন—চার ঘণ্টা চর্চা করতে হবে।… কী গো মালি ভয় পাচ্ছ নাকি?’

মুখ নামিয়ে মালবিকা শুনছিল। মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছে। গান শেখাবে কী শেখাবে না, সেটা স্পষ্ট করে ওর কথা থেকে বোঝা যাচ্ছে না। কিছু উপদেশ দিয়ে হয়তো বলবে, যাও বাড়িতে বসে গলা সাধো। ‘ভয় পাচ্ছ নাকি’, বলে সমীরণ তার পিঠে ছোটো একটা চড় বসিয়ে হাতটা আর তোলেনি। তার এই একটিই ব্লাউজ এবং এটি এমনই, পরিধান করলে পিঠটা অর্ধেক প্রায় খোলা থাকে আর কাঁধ থেকে স্তনের উপরিভাগ পর্যন্ত অনাবৃত রয়ে যায়। বাড়িতে ব্লাউজটা সে কখনোই পরে না। বাইরে বেরোবার সময় পাড়ার মোড় পর্যন্ত আঁচল দিয়ে ঊর্ধ্বাঙ্গ জড়িয়ে রাখে। আজ সে ইচ্ছে করেই পরে এসেছে।

সমীরণের আঙুলের ডগা পিঠের ছয় ইঞ্চি জায়গা জুড়ে আলতো ঘোরাফেরা করছে। শিরশির করছে পিঠ এবং সারা শরীরে সেটা ছড়িয়ে যাচ্ছে। মালবিকা চট করে একবার বকুলের দিকে তাকাল। বকুলের দ্রুত চোখ সরিয়ে নেওয়া দেখে তার মনে হল, সম্ভবত মা ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। কিছু কি ভেবে নিচ্ছে?

‘প্রতিভা আমার স্কুলে গান শেখায়। গান শেখেও আমার কাছে। ওর বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এই সামনের মাসেই। বলেছে গান ছাড়বে না তবে আমার সঙ্গে এখানে ওখানে যাওয়াটাও আর সম্ভব হবে না, স্কুলেও শেখাতে পারবে না। কনজারভেটিভ শ্বশুরবাড়ি, আপত্তি করবে বলেছে। গান নিয়ে যদি কেউ সারাক্ষণ পড়ে না থাকে তার কিছু হবে না। আমার ছাত্রীদের মধ্যে ওই ছিল সেরা।’ সমীরণের স্বর আফশোস আর দুঃখেই বোধহয় ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ল। মালবিকার পিঠে আলতো বোলানো আঙুল এখন আঁচড় কাটছে নখ দিয়ে।

‘তানপুরো ছাড়ার জন্য আমার একজন কাউকে এখন চাই।’ সমীরণ তাকাল মালবিকার দিকে, মালবিকা মায়ের দিকে। বকুল মনে মনে বলল ভগবান, উনি যেন মালির হাতেই তানপুরাটা তুলে দেন।

‘আমার তো মনে হয়, শিখিয়ে নিলে মালির কাছে এটা শক্ত ব্যাপার হবে না। আসরে আমার পাশে বসেই অনেক কিছু শিখতে পারবে। অবশ্য মা—বাবার যদি আপত্তি না থাকে—।’ সমীরণ জিজ্ঞাসু চোখে বকুলের দিকে তাকাল। ‘এখানে ওখানে যেতে হবে, রাতেও হয়তো থেকে যেতে হতে পারে।’

ভগবান তা হলে শুনেছেন! চেয়ার থেকে হুমড়ি খেয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিল বকুল। ‘প্রণাম কর, প্রণাম কর। এত ভাগ্যি তোর! আপত্তি করব কী!’

মালবিকা কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল। তার পিঠের উপর সমীরণের পাঁচ আঙুল মাংস খাবলাবার চেষ্টা করছে। চর্বি না থাকায় জুত করতে পারছে না। সোফা থেকে নেমে মালবিকা আবার পায়ের দুটো পাতা দুই মুঠোয় ধরল এবং কী একটা ভেবে নিয়ে পাতাদুটোর ওপর আলতো চিমটি কাটল।

‘বারবার প্রণাম কেন, বসো বসো।’ সমীরণ দুই বাহু ধরে মালবিকাকে পাশে বসাল। মুখ টিপে হেসে বোঝাবার চেষ্টা করল, চিমটি কাটা সে উপভোগ করেছে।

এই সময়ই ঘরে ঢুকল মিহির। তাকে দেখে সমীরণ মালবিকার বাহুধরা হাতটা সরিয়ে নিল।

‘আয় আয় মিহির, বোস। প্রতিভার তো বিয়ে, তাই ঠিক করলুম মালিই এবার থেকে তানপুরো নিয়ে আমার সঙ্গে বসবে। পারবে না?’

‘পারতে চাইলেই পারবে।’ মিহির একটা চেয়ারে বসল। পাশে বসা বকুলকে নীচু গলায় বলল, ‘বলেছিলুম আসব, এসেছি।’

‘জানো বাবা, মালির গান শুনে উনি বললেন, খাটলে হবে, গলাটা খুব মিষ্টি।’

‘সমীরণের মুখে প্রশংসা! সহজে তো উনি এটা করেন না। কোকিল ডাকলে উনি বলেন কাক ডাকছে। তাও আবার ‘খুউব’ মিষ্টি বলেছেন? আমি কিন্তু মাসিমা, গান না শুনে আগেই বলেছি।’

মিহির মুখ টিপে মালবিকার দিকে তাকাল।

‘ঠাট্টা নয় মিহির, গলাটা সত্যিই মিষ্টি।’

কয়েক মিনিটের মধ্যে দুটি পুরুষমানুষ মুখ টিপে তার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। মালবিকার মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা ঘোর লাগছে। তার মনে হচ্ছে, এরা তার কাছে কিছু যেন চায়। কিন্তু তার আছে কী দেবার মতো? সে নিজেই তো সকলের অনুগ্রহ চায়!

‘সমীরণদা বউদি কোথায়?’

‘পার্ক সার্কাস গেছে, ইলেকট্রিক ফিটিংসের কাজ দেখতে।’

.

মিহিরের গাড়িতে সেদিন ওরা দুজন বাড়ি ফিরেছিল। ফেরার পথে মিহির বলে, ‘তানপুরা নিয়ে গান গাওয়ার অভ্যাসটা আপনার দরকার, হারমোনিয়াম দিয়ে ওটা হবে না।’ মুখ ফিরিয়ে সে পিছনে বসা মালবিকার মুখটা দেখে নিল।

‘মালিকে আবার ‘আপনি’ বলছ কেন বাবা, ও তোমার থেকে অনেক ছোটো।’

‘আপনি আমার বয়স জানেন?’ মিহির মজা করেই বলল। ফাঁপরে পড়ল বকুল, সে মেয়ের দিকে তাকাল। মালবিকা মিহিরকে শুনিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘বলো একশো।’

‘উঁহু, হল না। বয়স ষোলো।’ মিহির স্বাভাবিক গলায় বলল।

‘অ্যাতো বয়স?’ মালবিকা গলা অবাক করে ভ্রূ তুলল। ‘আমার থেকে তো অনেক বড়ো, আমি তো সবে আটে পড়েছি।’ সে মিহিরের মুখ দেখার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল গাড়ির সামনের কাচের উপর দিকে চালে আঁটা পিছন দেখার আয়নাটা দিয়ে মিহির তাকে দেখছে। ঠোঁট মুচড়ে হেসে মালবিকা একটু সরে বসল। মিহির বাঁ হাত তুলে আয়নাটা সামান্য ঘোরাল। আবার ওর মুখ মালবিকা দেখতে পাচ্ছে। সে এবার সরে এল বকুলকে ঘেঁষে। মিহির আয়নাটা আবার ঠিক করে নিল।

অসমান রাস্তার জন্যই গাড়িটা অস্থির, আয়নাটা কাঁপছে, মিহিরের মুখটাও। উঁচু কলারের হাওয়াই শার্ট। মালবিকার মনে হল, ঘাড়ের সাদাটা ঢাকার জন্যই এমন একটা জামা পরেছে। তাদের পাড়ার স্টেশনারি দোকানের রাজেনদার দুই চোখের কোণে প্রথমে ফুটকির মতো সাদা দাগ হয়। ক্রমশ সেটা বড়ো হতে হতে সারামুখে ছড়াতে থাকে। তিন—চার বছরের মধ্যে রাজেনদা পুরো সাদা হয়ে যায়। ছোটোরা ওকে সাহেবদা বলে ডাকতে শুরু করে। ওকে দেখলেই মালবিকা কীরকম যেন একটা অস্বস্তি বোধ করত। সে শুনেছে এটা কোনো রোগ হয়, ছোঁয়াচেও নয়। তবু সে রাজেনদার দোকান থেকে জিনিস কেনা বন্ধ করে।

মিহিরের ঘাড়ের দাগটা চামড়া পুড়ে যাওয়ার জন্যও হতে পারে। মালবিকা মনে মনে বলল, তাই যেন হয়। নয়তো তিন—চার বছর পর ধবধবে মিহিরের চেহারা যে কেমন দেখতে হবে, সে কল্পনাও করতে পারল না। জানলা দিয়ে সে বাইরে তাকিয়ে রইল। যে উত্তেজনা নিয়ে সে সমীরণের বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল, আপ্লুত আশায় যে গড়াগড়ি তার মনের মধ্যে চলেছে সেটা ক্ষণেকের জন্য স্তিমিত মৃদু হয়ে পড়ল। বেচারা! তারপরই সে ভাবল, ও তো মেয়ে নয়। প্রচুর টাকা আছে কোনো অসুবিধে হবে না।

পথটা একেবারে চিনে গেছে মিহির। বাড়ি পর্যন্ত ঠিকই চলে এল। গাড়ি থেকে নামবার আগে মালবিকা বলল, ‘আর একদিন এসে চা খেয়ে যাবেন বলেছিলেন। নিশ্চয়ই সেই আর একদিনটা আজ নয়?’

‘এই দুপুরবেলায় চা খেতে বলছেন?’

‘না, বলছি না।’ মালবিকা গাড়ি থেকে নেমে আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিল। চোখ তুলে তিনতলায় নিজেদের ঘরের জানলাটাও দেখে নিল। পর্দাটা গুটিয়ে তুলে রাখা। জানলায় তার বাবার মুখটা নেই।

‘দুপুরে লোকে ভাত খায়, কই ভাত খাওয়ার কথা তো বললেন না?’

‘খাবে বাবা?’ বকুল ঝুঁকে জানলাটা ধরে মিহিরকে অনুরোধ জানাল।

‘না মাসিমা, আর একদিন…এই দেখুন আবার বলে ফেললুম আর একদিন। আমার মা বসে থাকবেন ভাত নিয়ে, এক ছেলে হওয়ার এই এক প্রবলেম। আর শুনুন।’ একটু জোরেই মিহির ডাকল বাড়ির ফটকে পৌঁছে যাওয়া মালবিকাকে।

‘তানপুরা নিয়ে গলা সাধতে হলে আগে একটা তানপুরা চাই, সেটা আছে কি?’

‘নেই।’ মালবিকার হঠাৎই খেয়াল হল সমীরণের মতো মিহির তানপুরাকে ‘তানপুরো’ বলে না।

‘আমার একটা আছে, সেটা দিয়ে যাব।’

‘আর একদিন এসে, তাই তো?’

‘আজই, সন্ধেবেলায়। চা—ও খাব।’

‘তানপুরাটা দিয়ে দিলে আপনি কী নিয়ে গাইবেন?’

‘আমার দুটো আছে।’

মিহির গাড়ি ছেড়ে দিল।

.

একটি দিনেই প্রধান চরিত্রগুলোকে নিয়ে কাহিনিটি পৌঁছল আর এক পর্যায়ে। আরও দু—তিনটি পর্যায় পেরিয়ে পৌঁছবে মালবিকার আইবুড়ো ভাত খাওয়াবার সেই রবিবারে। তার মধ্যে দ্রুত সম্পর্কের হেরফের ঘটে যাবে, তার কিছু কিছু অংশ এবার বলা যাক।

যেমন শনিবার সন্ধ্যায় মিহির তানপুরাটা দিতে এল। হঠাৎ একজন অপরিচিত একা লোকের পক্ষে বাড়ির মধ্য দিয়ে তিনতলায় উঠে আসা, এ—বাড়িতে সম্ভব নয়। অসুস্থ মেজোভাসুরের অফিসের লোক একবার উঠে এসেছিল না বলে। পার্বতী ডেকে মেজোজাকে বলে দেন, ‘এটা ফ্ল্যাট বাড়ি নয়।’

মালবিকা আর বকুল পালা করে সন্ধে থেকে তিনতলার জানলা দিয়ে রাস্তায় চোখ রাখে। দিলীপরঞ্জনকে বলে রেখেছিল বকুল, ‘সেই ছেলেটি আসবে যে গাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গেছে।’

কী যেন ভেবে দিলীপরঞ্জন বলেছিল, ‘আমাদের স্বজাতি?’

‘হ্যাঁ, শীল। বিকেলে যদি বেরোও তা হলে রাত করে ফিরো।’

রেগে খেঁকিয়ে ওঠার বদলে স্বাভাবিক গলায় দিলীপরঞ্জন বলেছিল, ‘শরীরটা ভালো লাগছে না, আজ বেরোব না।’

বকুল অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। শনি—রবি পরপর দু—দিন অফিসের ছুটি, অথচ মদ খেতে বেরোবে না! তখন সে বলেছিল, ‘বিকেলে তা হলে একটু বাজারে যেয়ো।’

গাড়িটা ফটকের সামনে থামতে দেখেছিল মালবিকাই। ‘এসেছে।’ বলেই সে ছুটে নেমে যায় মিহিরকে উপরে আনতে। দিলীপরঞ্জন তখন পাঞ্জাবিটা ট্রাউজার্সের উপর ঝুলিয়ে আয়নায় দাঁড়ায় চুল আঁচড়ে নিতে। বকুল কলঘর থেকে ভিজে শরীরে কোনোরকমে শাড়ি জড়িয়ে ছুটে এসে মালির ঘরে ঢুকল, ঢোকার আগে লন্ড্রি থেকে আনা শাড়িটা আলনা থেকে তুলে নেয়।

মিহির প্রায় তিন ঘণ্টা ছিল। তার মধ্যে সে বুঝে নিল এদের তিনজনের পারস্পরিক সম্পর্কটা কেমন। দিলীপরঞ্জন জেনে নিল মিহিরের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর খবর ও পারিবারিক অবস্থা। বকুল খোঁজ করল, মালবিকার বড়ো গাইয়ে হবার জন্য কতদিন সময় লাগবে আর মালবিকার মনে হল মিহিরের তাকে ভালো লেগেছে এবং সেটা কিছু জটিলতা তৈরি করবে।

তানপুরা কীভাবে বাঁধতে হয়, কীভাবে সুর ছাড়তে হয় মিহির খাটের উপর বসে পদ্ধতিগুলো শিখিয়ে দিল। শেখাবার সময় অবশ্যই কয়েকবার সে মালবিকার করস্পর্শ করল! তার আঙুল ধরে, যার কোনো দরকারই ছিল না, মিহির যখন দেখিয়ে দিচ্ছিল কীভাবে তারের উপর দিয়ে পরপর টেনে নিয়ে যাবে তখন সে ওর ঘাড়ের সাদা দাগটা দেখার চেষ্টা করেছিল। উঁচু কলারের পাঞ্জাবি এবং বোতামগুলো তৃতীয় ঘর পর্যন্ত আঁটা থাকায় দেখতে পায়নি। সে স্বস্তি পেয়েছিল।

‘বাবা, একটু বলে দাও তো তানপুরা দিয়ে ও কীভাবে গলা সাধবে?’ বকুল জানতে চায়।

‘আহহ মা! যার কাছে শিখব তিনিই বলে দেবেন। তুমি অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন বলো তো।’ মালবিকা বিরক্ত হল। বকুল অপ্রতিভ।

‘ঠিকই বলেছেন।’ মিহির সায় দিল।

‘আমাকে ‘বলেছেন’ ‘করেছেন’ বলবেন না, শুনলে বয়স বেড়ে যায়।’ মালবিকা এবার মিষ্টি ধমক দিল। খুশি হল মিহির।

‘আচ্ছা আচ্ছা আর বলেছেন নয়। মাসিমা, মালি যা বলল সেটাই উচিত। সমীরণদার কাছে শিখবে, অথচ আমি বলে দেব, তা হয় না। জানতে পারলে সমীরণদা ওকে আর ও বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। তা ছাড়া আমি তো সবে শিখছি, মাস্টারি করার বিদ্যে এখনও হয়নি।’

‘ওরে বাবা, না না তোমাকে আর বলেটলে দিতে হবে না। সমীরণবাবু যা শিখিয়ে দেবেন তাই করবে। আমি চা নিয়ে আসি।’ বকুল ত্রস্ত হয়ে উঠে গেল।

খাটের আর একদিকে বসে দিলীপরঞ্জন শুনছিল ওদের কথা। গলাখাঁকারি দিয়ে সে বলল, ‘সমীরণ মিত্তির লোকটা কেমন বলো তো? শুনেছি খুব মদ খায়, মেয়েঘটিত কেলেঙ্কারিও আছে।’

মিহিরকে হুঁশিয়ার দেখাল। কুণ্ঠিত স্বরে বলল, ‘আমি গান শিখতে যাই, ঘণ্টা দেড়—দুই থেকে চলে আসি। আমরা তিন—চারজন শিখি। এর মধ্যে কিছু আমি দেখিনি।’

‘আহা তা কী করে দেখবে, এসব কী দেখিয়ে কেউ করে। শুনেছ কিছু?

মিহির ইতস্তত করে চুপ রইল। সমীরণদা সম্পর্কে যা শুনেছে সেগুলো বলতে তার বাধছে। অশোভনও হয়ে যাবে। বললে হয়তো মেয়েকে গান শেখাতেই পাঠাবে না। তাতে ক্ষতি হবে মালবিকারই।

মাথা নেড়ে সে বলল, ‘আমি তো কিছু শুনিনি।’

দিলীপরঞ্জন তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে ছিল। বুঝে নিল ছেলেটি চেপে যাচ্ছে।

‘তুমি শোনোনি এক ছাত্রীকে সমীরণ রেপ করেছিল। কেস হয়। প্রমাণ না হওয়ায় খালাস হয়ে গেছল। অবশ্য বছর দশেক আগের কথা। আমাদের অফিসের একজনের পাড়ার মেয়ে। মেয়েটার আজও বিয়ে হয়নি।’

‘হ্যাঁ, এরকম একটা কথা শুনেছিলুম বটে। মেয়েটি নাকি রেগুলার ওর কাছ থেকে টাকা নিত। টাকা দেওয়া বন্ধ করতেই নাকি কেস করে।’

‘অ। বউয়ের সঙ্গে সমীরণ মিত্তিরের সম্পর্ক কেমন?’

‘কেন, ভালোই তো!’ মিহির আবার হুঁশিয়ার হল।

‘স্বামীকে ছেড়ে ক—বার চলে গেছল? জানো কি সেটা?’

‘না তো। আপনি জানলেন কী করে?’

‘হুঁ হুঁ, বহু জায়গায় আমার আড্ডা, কানে খবর ঠিকই আসে। ওই কেসটা হওয়ার পর থেকে ওদের রিলেশনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। টাকাপয়সা সব তো এখন বউয়েরই কন্ট্রোলে। বউ তো একসময় ওরই ছাত্রী ছিল। বাপের বাড়ির অমতে অনেক লটঘট করে বিয়েটা করেছিল। এখন পস্তাচ্ছে।’ দিলীপরঞ্জন বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে মেয়ের দিকে তাকাল।

মাথা নামিয়ে মালবিকা আদরের মতো করে আঙুল বোলাচ্ছিল তানপুরায়। এই সময় চকিতে তার মনে পড়ল, অনেকটা এই ভাবেই তার পিঠে একটা আঙুল নড়ে বেড়িয়েছিল। শিরশির করেছিল পিঠ। তানপুরা থেকে আঙুলটা তুলেই বাবাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘বউয়ের সঙ্গে সমীরণ মিত্রের সম্পর্ক দিয়ে আমার কী আসে যায়। আমি তো যাব গান শিখতে।’

কিছু একটা ভেবেই মালবিকা আর বলল না, ‘এখানে ওখানে যেতে হবে, রাতেও হয়তো থেকে যেতে হতে পারে।’ এতসব কথার পর এই কথা আর বলা যায় না। বাবাকে সে ভালোই জানে।

‘হ্যাঁ, শুধু শিখতে, শেখা হলেই বাড়ি চলে আসবে।’

‘ওঁর সঙ্গে ফাংশানেও যেতে হবে, বলে দিয়েছেন।’

দিলীপরঞ্জনের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ‘কেন?’

মিহির তাড়াতাড়ি বলল, ‘ছাত্রছাত্রীরা গুরুর গান শুনতে তো যায়ই, আমিও তো যাই। এই যে গোবরডাঙায় সমীরণদা গাইতে যাবেন, আমিও তো যাব।’

‘সত্যি! আমাকে নিয়ে যাবেন?’ মালবিকা প্রায় লাফিয়ে ওঠার মতো ভঙ্গি করল।

মিহির তাকাল দিলীপরঞ্জনের দিকে। তার মনে হল লোকটা কী যেন ভেবে নিল।

‘আর কে সঙ্গে যাবে?’

‘দু—তিনজন মিউজিক হ্যান্ডস, আর প্রতিভা তো যাবেই।’ একটি মেয়ে যাবে শুনে হয়তো মেয়েকে যেতে দিতে পারে ভেবেই মিহির প্রতিভার নাম জুড়ে দিল।

‘ওর না বিয়ে?’ মালবিকা বলল।

‘এখনও দিন পনেরো তো বাকি। হয়তো এইটেই ওর শেষবারের মতো তানপুরা নিয়ে বসা হবে।’

মালবিকা মনে মনে বলল, ‘তারপর আমি।’

‘যাবে—আসবে কীসে, মোটরে?’ দিলীপরঞ্জন আরও জানতে চাইল।

‘দুটো মোটর যাবে, তাই না মিহিরদা?’ মালবিকার মুখ থেকে আপনা থেকেই ‘মিহিরদা’ বেরিয়ে এল। মিহির হাসল।

‘সমীরণদা তো মোটরে একাই যান, বরাবরই। অন্য মোটরে হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরা আর হ্যান্ডসরা।

‘আমি কিন্তু আপনার মোটরে যাব, যাব বাবা?’ মালবিকা আদুরে গলায় বলল। মনে মনে কিন্তু সে জানে, বাবা রাজি না হলেও সে যাবে। তাকে সমীরণ মিত্রর কাছাকাছি হতেই হবে।

প্লেটে গরম লুচি আর বাটিতে রান্না মাংস নিয়ে বকুল ঘরে ঢুকল। টেবলে ওগুলো রেখে বলল, ‘এসো বাবা, আজ প্রথম দিন এলে, কিছু রাঁধার তো সময়ই পেলুম না। একটু মুখে দাও। চা পরে দোব। মালি, রান্নাঘর থেকে সন্দেশের প্লেটটা এনে দে।’

মিহির কোনো ওজর—আপত্তি না তুলে উঠে টেবলে এল। সে বুঝে গেছে নাছোড়বান্দা এই মহিলা সত্যি দুঃখ পাবে যদি সে কিছু না খায়। শুধু বলল, ‘যা দিয়েছেন এটা আমার দু—দিনের খাদ্য। অর্ধেক তুলে নিন।’

বকুল তুলল না এবং মিহির সবটাই খেয়ে নিল যেহেতু মাংসের রান্নাটা উপাদেয় লাগায়। বিদায় নেবার সময় বকুল বলল, ‘একদিন তোমাদের বাড়িতে গিয়ে তোমার মা—র সঙ্গে আলাপ করে আসব।’

‘যাবেন। আমি এসে নিয়ে যাব।’ মিহির কথাটা বলে মালবিকার দিকে তাকাল।

‘আমিও মা—র সঙ্গে যাব।’ মিহিরের চোখে অনুরোধ দেখে সে নিরাশ করল না।

দিলীপরঞ্জন বলল, ‘তোমাদের প্রেসটা একদিন দেখে আসব। নতুন ধরনের যন্ত্রপাতি, কালিঝুলি, ঘটংঘটং শব্দের কোনো ব্যাপারই নেই! একবার তো দেখতেই হয়।’

তিনতলা থেকে মিহিরের সঙ্গে মালবিকাও নামল। দু—তিনটি ঘর থেকে কৌতূহলী মুখ উঁকি দিয়ে মিহিরকে দেখল। জানলা থেকে দিলীপরঞ্জন দেখল গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ওরা দুজন কথা বলছে।

‘ছেলেটাকে ভালোই মনে হল। ব্যবসা—ট্যাবসা কেমন চলছে সেটা বোঝা দরকার। গাড়ি থাকলেই তো আর বড়োলোক হয় না। প্রেসটা দেখে আসতে হবে।’ খাটে পা ঝুলিয়ে বসে বকুলকে ইশারা করে বলল, ‘ওটা এবার আনো।’

রান্নাঘর থেকে বকুল দিশি মদের বোতলটা এনে টেবলে রাখল, সঙ্গে কাচের গ্লাস। বিকেলে বাজার থেকে ফেরার সময় পান সিগারেটের দোকান থেকে দিলীপরঞ্জন এটা কিনে এনে বকুলকে রান্নাঘরে রাখতে দিয়েছিল।

‘মালি তো গানের টিউশনিও করতে পারবে।’

বকুল চেয়ারে বসল স্বামীর মুখোমুখি হয়ে। গ্লাসে ছোটো একটা চুমুক দিয়ে মুখবিকৃতি করে দিলীপরঞ্জন বলল, ‘নামি গাইয়ের ছাত্রী হলে দরটা বাড়বে।’

বকুল আশ্বস্ত হল। মিহির সম্পর্কে তো নয়ই এমনকী সমীরণ সম্পর্কেও দুশ্চরিত্র, মাতাল বলে তার স্বামীর এখন আর কোনো আপত্তি নেই। হঠাৎ তার বুকের মধ্যে ক্ষীণ একটা কষ্ট এই লোকটির জন্য তৈরি হল।

সেই সময় গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে মালবিকা বলল, ‘তা হলে সত্যি সত্যিই আর একদিন আর হল না।’

‘হত, কিন্তু দেখলুম বেশিদিন দেরি হয়ে গেলে আমাকে তোমরা আর মনে রাখবে না। মনে রাখার মতো তো আমার চেহারা নয়, গুণও কিছু নেই।’

‘কে বলল নেই?’ মালবিকার স্বর মৃদ গাঢ় হয়ে এল।

‘তানপুরাটা দিলেন, আমার উপকারই করলেন। কিনতে হলে বাবাকে খুবই অসুবিধেয় পড়তে হত। আপনার হৃদয় আছে আর পুরুষমানুষের রূপ তো তার হৃদয়, এটা ক—জনের থাকে?’

‘পুরুষদের থাকে কি না জানি না তবে সুন্দরী মেয়েদের বোধহয় থাকে না।’

‘আপনি জানেন?’ মালবিকা মুখ টিপল। এখন সে বেশ সহজ ঝরঝরে বোধ করছে। মিহিরকে তার ভালো লাগছে ওর কথাবার্তা আর আচরণের জন্য। তবে এটাই তার কাছে ভালো লাগার শেষ কথা নয়। সে পুরুষদের কাছ থেকে আরও কিছু চায়।

‘জানার চেষ্টা করছি।’

‘করে কী বুঝছেন?’

‘আরও চেষ্টা করতে হবে।’ মিহিরের চোখে ঝিলিক দিল প্রত্যাশা।

‘কী চেষ্টা করবেন সুন্দরীদের হৃদয় বুঝতে?’

‘নিজেকে তুমি তা হলে সুন্দরী স্বীকার করলে।’

‘কে বলল? আমি তো একজন সুন্দরীর কথা বলিনি, বলেছি সুন্দরীদের কথা।’ মালবিকা গাড়ির জানলায় হাত রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। উপরে তাকিয়ে দেখল তিনতলার জানলায় কেউ নেই। রাস্তা দিয়ে অল্প লোক চলাচল করছে। দু—বার কেউ তাকাল না তাদের দিকে।

‘আমি তো একজনকেই সুন্দর জানি।’ মিহিরও গাড়ির জানলায় হাত রাখল।

‘খুব হয়েছে, উঠুন এবার।’

‘সুন্দরী মেয়েদের যে হৃদয় থাকে না নিজেই কিন্তু তা প্রমাণ করে দিলে। ‘উঠুন এবার’, এমন একটা কুচ্ছিত কথা কার পক্ষে বলা সম্ভব?’

‘আমি তা হলে কুচ্ছিত?’

‘অবশ্যই।’

‘দূর হও আমার সামনে থেকে।’ মালবিকা মিহিরের হাতের উপর চড় মেরে ঠোঁট ওলটাল।

মিহির অবিশ্বাস ভরে মালবিকার দিকে তাকাল। ‘হও’ বলল। দূর ‘হোন’ নয়। মালবিকার আঙুলগুলো মুঠোয় রেখে সাহস পেয়ে ধরা গলায় মিহির বলল, ‘তোমাকে আমার ভালো লাগে মালি।’

‘হাত ছাড়ো, বাড়ি থেকে দেখছে।’ মালবিকা ফিসফিসিয়ে বলার ধরনে মিহির দ্রুত হাত সরিয়ে নিল। তিনতলার জানলায় অবশ্য কেউ ছিল না।

‘কাল যেয়ো সমীরণদার ওখানে, আমিও যাব।’ দরজা খুলে মিহির গাড়িতে উঠল।

‘যাচ্ছ তো? গোবরডাঙায়?’

‘হ্যাঁ। তোমার সঙ্গে গেলে সমীরণদা কিছু মনে করবে না তো!’

গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নিল। ‘মনে করার কী আছে। বরং খুশিই হবেন। তখন তোমার বাবাকে বললুম সমীরণদা গাড়িতে একাই যান। মোটেই যান না, ওঁর সঙ্গে আর একজন যায়। প্রতিভা।’ প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য মিহির অপেক্ষা করল না।

গাড়ি চলতে শুরু করার পর মালবিকার মনে হল সে যেন মিহিরের ঘাড়ে সাদা একটা দাগ দেখল।

সমীরণ খুশি হয়েছিল। কেন হয়েছিল সে—কথা এবার বলা দরকার কেননা গোবরডাঙা থেকে ফেরার সময় মালবিকা বুঝে যায় তার জীবন এবার অন্য একটা খাত ধরে বইবে এবং সেই খাতটা শুধুই কাদায় ভরা।

আসরটা মূলত গানের নয়, যাত্রার। টিন দিয়ে ঘিরে হাজার আষ্টেক লোক বসার ব্যবস্থা হয়েছে। যাত্রা হচ্ছে তিন দিন ধরে। সমীরণ মিত্রের গানের পর রাত ন—টায় ‘তোমার মতো বউ হয় না’ পালা শুরু হবে। মিহিররা পৌঁছে দেখল টিকিট ঘরের সামনে প্রায় যুদ্ধ চলছে। চাউমিন, ঘুগনি, রোল, ওমলেট ইত্যাদির দোকান বসে গেছে। যাত্রাকে ঘিরে একটা মেলা—মেলা ভাব। মিহির একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল, দলবল নিয়ে সমীরণ একটু আগে পৌঁছেছে, বিশ্রাম নিচ্ছে ক্লাবের সেক্রেটারির বাড়িতে। সেই লোকটিকেই গাড়িতে তুলে নিয়ে মিহির সেক্রেটারির বাড়িতে পৌঁছল এক মিনিটেই।

ঘরে সোফায় বসেছিল সমীরণ, তার পাশে প্রতিভা। অন্য সোফায় বসে বিজনবাবু, সোমনাথবাবু। তবলা আর সারেঙ্গি নিয়ে সংগত করছেন দুজনে। তাদের দেখেই সমীরণ বলে উঠল, ‘আয় আয় মিহির, বোস এখানে।’ মালবিকাকে বলল, ‘ভাবতেই পারিনি তুমি আসবে, বসো।’

মালবিকা সবাইকেই গানের স্কুলে দেখেছে। প্রতিভা অল্পবয়সিদের গান শেখায়। সমীরণ ওর কাছেই মালবিকাকে গান শিখতে বলেছে। ‘যতদিন প্রতিভা রয়েছে, ওর কাছেই প্রাথমিক শেখাটা শিখে নাও। ক্ল্যাসিকাল জানে, শেখাবার কায়দাটা খুব ভালো। যেরকম বলবে, দেখিয়ে দেবে সেইভাবে বাড়িতে করবে।’ মঙ্গল আর বুধবার প্রতিভা ক্লাস করে। মালবিকা দু—দিন ক্লাস করেছে। দিলীপরঞ্জন অফিসে যাবার পর গত চারদিন সে নিজের ছোটো ঘরটায় প্রবল উৎসাহে তানপুরা নিয়ে বসেছে।

প্রথম দিন ক্লাসের শেষে প্রতিভা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’

‘কাছেই, এই গৌরীবাড়িতে। আপনার?’

‘আমারও কাছেই বাড়ি তবে তোমার উলটোদিকে, রাজাবাজারে।’

‘ওটা তো মুসলমান পাড়া?’

‘হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?’

‘ভয় করে না?’

প্রতিভা হেসে উঠে মাথা নাড়ে। ‘আজ চব্বিশ বছর ওখানে আছি। রাজাবাজারের মোড়ে বড়ো মসজিদটা দেখেছ? তার পাশেই আমরা ভাড়া থাকি। হিন্দু—মুসলমানের মধ্যে কোনো দাঙ্গা বা গোলমাল হতে দেখিনি। শুনেছি চৌষট্টি সালে দাঙ্গা বাধাবার চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু ওখানে বাধেনি। বেশ, তুমি চলো আমার সঙ্গে, নিজের চোখে দেখে আসবে। বাড়ি ফেরার তাড়া নেই তো?’

‘চলুন, আমার কোনো তাড়া নেই।’

মালবিকার খুব ভালো লেগে গেছে প্রতিভাকে। গড়পড়তা বাঙালি মেয়েদের থেকে লম্বা এবং আনুপাতিক হারে চওড়া। মোটা কবজি, চওড়া কাঁধ। ঘাড়ে পিঠে মেদ জমেছে, তলপেটের পেশি আর টানটান নেই। শান্ত চোখ, কথাও বলে শান্ত ভাবে। প্রথম দিনেই ধৈর্য ধরে সে মালবিকার অপটুত্বকে যত্ন নিয়ে শোধরাবার চেষ্টা করেছে।

মালবিকার শুধু একটাই ভয় ছিল, তাচ্ছিল্য বা বাঁকা মন্তব্য যেন না তাকে সইতে হয়। হয়নি। প্রতিভাকে সত্যিই তার দিদি বলে মনে হয়েছে।

আমহার্স্ট স্ট্রিট অর্থাৎ রামমোহন রায় সরণি ধরে দক্ষিণ দিকে ওরা হাঁটছিল। মালবিকা কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘প্রতিভাদি, সামনের মাসেই আপনার বিয়ে?’

‘কে বলল?’

‘সমীরণদার কাছে শুনেছি। উনি দুঃখ করে বলেন আপনার বোধহয় আর কিছু হবে না। সারাক্ষণ গান নিয়ে পড়ে না থাকলে তার কিছু হয় না। আপনাকে ওঁর সেরা ছাত্রী বললেন।’

‘শুধু ছাত্রী, আর কিছু নয়?’

প্রতিভার স্বরে কেমন যেন একটা বিদ্রূপের মতো স্পর্শ ছিল যেটা মালবিকাকে আরও কৌতূহলী করে দেয়।

‘আর কিছু মানে?’

প্রতিভা জবাব দেয়নি। মালবিকা হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে দেখল নরম মুখটা হঠাৎ যেন কঠিন হয়ে গেল।

‘যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তিনিও কি গান করেন?’

‘একদমই না। ভদ্রলোক বর্ধমান জেলার কোনো এক থানার ছোটোবাবু। বউ গায়ে আগুন দিয়ে মরেছে। সম্বন্ধটা এনেছে আমার দূর সম্পর্কের এক বউদি। ভদ্রলোকের ছেলেপুলে নেই, বর্ধমান শহরের ধারে দোতলা বাড়ি করেছেন, বয়স বিয়াল্লিশ, মাসে উপরি হাজার পাঁচেক টাকা। এমন পাত্র ভারতবর্ষে ক—টা পাবে? বাবা, মা দিনরাত শোনাচ্ছে, এখনই আমার বিয়ে করে ফেলা উচিত। আমার ছোটো দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মালবিকা, আমার বয়স এখন বত্রিশ, ওদের মতে এই বয়সে চার সন্তানের মা হয় মেয়েরা, আমি কেন এখনও হইনি? এ তো এক বড়ো বিদঘুটে সমস্যা।’

প্রতিভার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। মালবিকাও হাসল। ‘আপনি তো লেখাপড়া শিখেছেন?’

‘বিএ, ইতিহাসে অনার্স ছিল।’

‘এত ভালো গান জানেন!’

‘তাতে কী হল? এত গুণ আছে যখন চাকরিও তখন পেতে পারি, তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘একটি চাকরি জোগাড় করে দিতে পারো?’

মালবিকা চুপ করে পাশাপাশি হেঁটে বলল, বাঁ দিকে একটা পার্ক। সেটা ছাড়িয়ে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানা তার উলটোদিকে সিটি কলেজ।

‘লোকের মুখে সবসময় শুনবে, লেখাপড়া জানে তা হলে চাকরি করে না কেন? আরে বাবা চাকরি করতেই তো চাই, পাচ্ছি কোথায়? এখানে গান শিখিয়ে, দুটো গানের আর একটা মাধ্যমিক ছাত্রীর টিউশানি করে, সমীরণদার সঙ্গে তানপুরায় বসে গড়ে মাসে আট—ন—শো টাকা হয়। এতে কি চলে?’

‘ছোটোখাটো ফাংশান তো কতই হয়, গাইতে পারেন তো?’

‘আমাকে নেবে না। পাবলিসিটি, ব্যাকিং, গ্ল্যামারাস সাজ, এখন এসব খুবই বড়ো ফ্যাক্টর। ভেবেছিলাম সমীরণদা আমায় দেখবেন।’

প্রতিভা চুপ করে মাথা নামিয়ে মন্থরভাবে হাঁটতে লাগল। মালবিকার মনে হল প্রতিভাদির আরও কিছু বলার কথা আছে, কিন্তু সদ্য পরিচিতের কাছে সেগুলো বলতে চান না।

‘জয় মা মনসা’ ফিল্মটা দেখেছ?’

‘না।’

‘সমীরণদা মিউজিক দিয়েছেন। আমাকে একটা গান দিয়েছিলেন। ওই পর্যন্তই। ছবিটা মফসসলে খুব চলেছে। গানটা ভালোই গেয়েছিলুম। দু—তিনটে জলসায় আমাকে গাওয়ার চান্স করে দিয়েছিলেন। রেডিয়োর অডিশনের ব্যবস্থা করেছেন, বছরে পেয়েছি তিনবার প্রোগ্রাম। একটা ক্যাসেট বার করে দেবেন বলেছিলেন, চেষ্টা করলে পারতেন কিন্তু করেননি। এইভাবে কি দিন চলে? সবটাই ভাগ্যের ব্যাপার মালবিকা, নাম করা, টাকা রোজগার করা এসব ভাগ্য না থাকলে হয় না।’

‘আপনাকে কেন সংসারের কথা ভাবতে হবে?’

‘একটা ভালো কথাই বলেছ। আমিও নিজেকে এই প্রশ্নই করি। আমি অনেক কিছু করেছি, এখনও করছি।’

প্রতিভা এত জোরে ‘এখনও করছি’ বলে উঠল যে মালবিকা ওর হাত চেপে ধরল। রাস্তার দু—তিন জন তাকিয়ে দেখে গেল।

‘আস্তে প্রতিভাদি।’

গলা নামিয়ে প্রতিভা বলল, ‘বলির পাঁঠা কিন্তু আমি হব না। আমি এখনও ঠিক করিনি বিয়েটা করব কি না। ভাবতে পারো, ছেলের বাড়ি থেকে কিছু চাই না বলেও নগদ মাত্র আট হাজার শুধু চেয়েছে বউভাতের খরচের জন্য। এই টাকা আমাকেই জোগাড় করতে হবে। কোন দেশে কোন সময়ে আমরা রয়েছি? লেখাপড়া শিখে এসব আমি মেনে নেব?’

‘আস্তে প্রতিভাদি।’

‘কেন আস্তে হব? সবাই জানুক, পণপ্রথা তুলে দাও, জাতপাত তুলে দাও, বিচ্ছিন্নতাবাদ ঠেকাও, অপসংস্কৃতি ধ্বংস করো বলে মিছিল, মিটিং সেমিনার প্রবন্ধ লেখা হয়। সব বাজে সব বাজে। মালবিকা, তুমি বাচ্চচা মেয়ে, জানো না কী ভণ্ডামিতে দেশটা ছেয়ে গেছে। আর এরই ধাক্কায় আমি—আমিও নিজেকে নীচে নামিয়েছি।’

প্রতিভা আর কথা না বলে জোরে হাঁটতে শুরু করল। ওর সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে মালবিকাকে আধা—দৌড় দিতে হচ্ছে।

‘আস্তে প্রতিভাদি।’

প্রতিভা মন্থর হয়ে হেসে ফেলল, ‘খুব জোরে হেঁটে ফেলেছি, না? মোটা হয়ে গেলেও আমি কিন্তু হাঁটায় তোমায় হারিয়ে দিতে পারি। এইবার বাঁ দিকে কেশব সেন স্ট্রিটে।’

ওরা বাঁ দিকের রাস্তা ধরে রাজাবাজারের মোড়ের কাছাকাছি এসে বড়ো মসজিদের আগের গলিটায় পৌঁছল।

‘কি, ভয় করছে?’ প্রতিভা দাঁড়িয়ে পড়ল।

মালবিকা দু—ধারে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

কলকাতার যে—কোনো একটা বড়ো রাস্তার মোড় যেমন হয় এই মোড়টা তার কাছে তেমনই লাগল, শুধু দারিদ্র্যের ছাপটাই প্রকট। দোকানগুলোয় ঔজ্জ্বল্য নেই, ভিড়ে রাস্তায় চলা বিরক্তিকর, ফুটপাথ আছে কী নেই বোঝা যায় না। পোশাক বা দোকানের সামগ্রী থেকে বোঝা যায় এখানে অভাবী মানুষই বেশি। অনেকগুলো খাওয়ার হোটেল। কাঠের টেবল আর বেঞ্চ ছাড়া হোটেলে আসবাব নেই। হিন্দু নামের সাইনবোর্ড লাগানো কয়েকটা মিষ্টির দোকান দেখে মালবিকা বলল, ‘প্রতিভাদি এইসব হোটেলে, মিষ্টির দোকানের মিষ্টি কখনো খেয়েছেন?’

প্রতিভা গলির মধ্যে ঢুকল। সরু গলি। পাকা বাড়িগুলোর সঙ্গে টালি ও টিনের ছাদওলা কাঠের দোতলা বাড়িও রয়েছে। একটা ঠেলাগাড়ির জন্য দেয়ালে প্রায় লেপটে গিয়ে প্রতিভা বলল, ‘না, একদম বাজে খাবার। তবে বাড়ির থেকে হোটেলে খাওয়াটা সস্তায় হয়, রুটি আর গোরুর মাংস। একটু পরে দেখবে হোটেলগুলোয় কী ভিড়!’

রাস্তা থেকে একহাত উঁচুতে সদর দরজা। দরজার কাঠের অবস্থা শোচনীয়। একফালি পথ, দু—ধারে ঘর, ঘরগুলোয় একটিমাত্র ছোটো জানলা, তারপর দোতলার সিঁড়ি যেটা চওড়ায় দু—হাত।

‘দেখে উঠো, সিঁড়িতে নানান জিনিস পড়ে থাকে অনেক সময়।’

দোতলায় সরু শিক লাগানো বারান্দা। পর পর দুটি ঘর প্রতিভাদের। দ্বিতীয় ঘরটায় থাকে সে। দরজায় নীল রঙের পর্দা। ঘরের একধারে তক্তপোশ। অন্যধারে একটা তানপুরা আর হারমোনিয়াম। প্রতিভার বাবার বৈঠকখানায় একটা লন্ড্রি আছে, এখন তিনি দোকানে। ওর মা—র সঙ্গে আলাপ করে মালবিকার ভালো লাগল।

প্রতিভার মা দুর্গা ঘর দুটো পরিষ্কার ফিটফাট রেখেছেন। চারদিকের নোংরা অপরিচ্ছন্নতার মধ্যে এদের সংসারটা যেন একটা বাগান।

‘আমি চা করে আনছি।’ দুর্গা রান্নাঘরে যাবার জন্য খাট থেকে উঠলেন। চারটে কাঠ দিয়ে উঁচু করা খাটটা বোধহয় ওনার বিয়েতে পাওয়া। খাটের নীচে সংসারের নানান জিনিস রাখা।

‘শুধু চা কিন্তু মাসিমা।’ মালবিকা তাড়াতাড়ি জানিয়ে দিল।

‘কেন! একটু মিষ্টিমুখ করবে না? প্রথম দিন এলে।’

‘মিষ্টি আমি একদম খাই না।’

‘একটু আগেই আমি ওকে বলেছি এখানকার খাবারগুলো বাজে।’ বলেই প্রতিভা জোরে হেসে উঠল।

‘না না, সে জন্য নয়। সত্যিই আমি মিষ্টি খাই না।’ কথাটা বলে মালবিকার হাসি পেল। মহাজাতি সদনে সমীরণের দেওয়া মিষ্টি সে খায়নি, বলেছিল, ‘খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।’ বলেছিল, ‘এইমাত্র ছেড়েছি।’ কীরকম অবাক চোখে সমীরণ তার দিকে তাকিয়ে জুঁই ফুলের মালাটা তাকে উপহার দিয়েছিল। মালবিকার মনে হয়েছে ওইটেই সেই মুহূর্ত যখন সে সমীরণের চোখ টেনেছিল। পরে সংশোধন করে নিজেকে সে বলে, সমীরণের মন টেনেছিল, তা যদি না হত, তা হলে সমীরণ কেন তার পিঠে আঙুল দিয়ে—।

‘কী ভাবছ অত? বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাচ্ছে?’ প্রতিভা জিজ্ঞাসা করল।

‘আমার বাবা একটু ভিতু ধরনের। মেয়ের বাড়ি ফিরতে দেরি হলে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে।’ মালবিকা কথাটা বলে মজা পেল। বাবা তার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে, ভাবা যায়!

চা—এর সঙ্গে দুটো বিস্কুট খেয়ে সেদিন মালবিকা বেরিয়ে আসে। প্রতিভা তাকে বাস স্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চেয়েছিল। সে বারণ করে।

.

সমীরণ ঠিক দু—ঘণ্টাই গাইল। দেড় হাত উঁচু আসর ঘিরে জমি ও গ্যালারিতে কয়েক হাজার শ্রোতা। যাত্রার জন্য সাত—আটটা মাইক্রোফোন আসরের উপর ঝুলছে। মালবিকা আর মিহির জমিতে ফরাসের উপর বসে। তাদের মুখোমুখিই আসরের মাঝখানে বসেছিল সমীরণ আর তার সামান্য পিছনে, বাঁ দিকে ছিল প্রতিভা।

সমীরণের আসরে এসে বসা, গান গাইবার সময় শ্রোতাদের দিকে তাকানো, তবলচির দিকে মুচকি মুচকি হাসি, মাথা নাড়া, চোখ বন্ধ করা ইত্যাদি ওর প্রত্যেকটি সঞ্চালনই যেন মেপে করা এবং দেখতে ভালো লাগে। ওর জনপ্রিয়তার পিছনে এইগুলিরও অবদান রয়েছে।

মালবিকা প্রথম গান থেকেই লক্ষ করল সমীরণ গাইছে তার দিকেই তাকিয়ে। মাথার দোলানি, ভ্রূ তোলা, মুখ টিপে হাসা সবই যেন তার জন্য। নিধুবাবুর একটা গানের শেষ দুটো পঙক্তি ছিল—’ছলে বলে কৌশলে, মালিনীরে ফাঁকি দিলে। উভয়ের মন অন্তঃশীলে, বহে ফল্গু নদী যেমন।’ সমীরণ মালিনী শব্দটাকে দু—ভাগ করে শুধুই ‘মালি’ শব্দটাকে গলায় খেলাতে থাকে অনেকক্ষণ পরে। ঊর্ধ্বাঙ্গ দুলিয়ে, কখনো চোখ টিপে, সাজানো দাঁতগুলোর ঝলসানি দিয়ে বারবার সে ‘মালি’ শব্দটাকে সুরের বাহারে সাজিয়ে তুলতে লাগল এবং মালবিকার দিকে তাকিয়ে।

ব্যাপারটা যে সে বুঝেছে সমীরণকে তা জানাবার জন্য মালবিকা ভ্রূকুটি করে নাক কুঁচকে কয়েকবার হাসল। তারপর পাশে বসা মিহিরকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখল মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে আর গম্ভীর। ব্যাপার কী? সমীরণ তার নামটা নিয়ে এমন করে গাইছে বলে মিহিরের কি পছন্দ হচ্ছে না? এত লোক শুনছে অথচ মিহির ছাড়া কেউ জানে না সমীরণের এই ‘মালি’টি কে! এটা ভেবে মালবিকা মজা পেল।

‘সমীরণদার কাণ্ডটা দেখেছ?’ মালবিকা ফিসফিসিয়ে বলল। মিহির কথা বলল না। কিছুক্ষণ পর অস্ফুটে মিহির বলল, ‘ড্রিঙ্ক করেছে।’

মিহিরের সঙ্গে দু—তিনবার কথা বলার চেষ্টা করল মালবিকা। হুঁ, হ্যাঁ ছাড়া জবাব পেল না। এবার মালবিকা বিরক্ত হয়ে ভাবল, তানপুরা দিয়ে আর মোটরে চড়িয়ে কি ভাবছে আমি ওর কেনা বাঁদি হয়ে গেছি? হঠাৎ—ই মিহিরের প্রতি বিতৃষ্ণা বোধ করল, আর মনে পড়ল ওর কাঁধে একটা সাদা দাগ আছে।

মালবিকা গোনেনি সমীরণ ক—টা গান গাইল। নিধুবাবু, নজরুল, নিজের দেওয়া সুরে রাগপ্রধান, দ্বিজেন্দ্রলাল, নানান জনের লেখা বোধহয় পনেরোটি গান।

‘ক—টা গাইল গুনেছ?’ সে মিহিরকে জিজ্ঞাসা করল।

‘না। গোনার জন্য আসিনি, শোনার জন্য এসেছি।’

মিহিরের বলার ভঙ্গিতে মালবিকা অপ্রতিভ হয়ে চুপ করে রইল।

‘এগারোটার মধ্যে পৌঁছে দেব বলে এসেছি। আমি গাড়িতে আছি তুমি তাড়াতাড়ি এসো।’ মিহির তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল।

আসর থেকে বেরিয়েই সমীরণদের গাড়িতে ওঠার কথা। একটু হেঁটে গিয়ে গাড়িতে উঠতে হবে। বাইরে আসামাত্র অটোগ্রাফ নেবার জন্য একটা ভিড় সমীরণকে ঘিরে ফেলল। কখনো দাঁড়িয়ে কখনো চলতে চলতেই সে সই করে যাচ্ছিল।

কাঁধে একটা টোকা পড়তেই মালবিকা পিছনে তাকাল।

‘প্রতিভাদি।’

‘তুমি আমাদের গাড়িতে এসো।’

‘সে কী! আমি তো মিহিরদার গাড়িতে এসেছি।’

‘ফেরাটা নয় আমাদের গাড়িতেই হোক। এসো না।’

কীরকম একটা কাতর আবেদনের মতো শোনাল ‘এসো না’। মালবিকা ইতস্তত করে বলল, ‘মিহিরদা কী মনে করবেন।’

‘কিছু মনে করবে না। বলবে প্রতিভাদি অনেক করে বলছেন।’

‘সমীরণদাকে বলা দরকার।’

‘বলো। তবে আমার নাম কোরো না।’

মালবিকা প্রায় ছুটেই সমীরণের কাছে গেল। কয়েকজন কর্মকর্তা তখন ওর সঙ্গে চলেছে তাকে গাড়িতে তুলে দিতে।

‘সমীরণদা একটা কথা।’

মোটরের কাছে দাঁড়িয়ে পড়ল সমীরণ। মালবিকা তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নীচু গলায় বলল, ‘আমি আপনার সঙ্গে যাব।’

‘আমার গাড়িতে? কিন্তু মিহির কিছু মনে করবে না?’

‘করুক। আমি আপনার সঙ্গে যাব।’ গলায় আবদার ছাড়াও মালবিকা অনুরোধকে আন্তরিক করতে সমীরণের কনুই আঁকড়ে ধরল। মদের গন্ধ সে চেনে, সমীরণের মুখ থেকে ক্ষীণভাবে সে গন্ধ পেল। বোধহয় আসরে আসার আগে সেক্রেটারির বাড়িতে অপেক্ষার সময় খেয়েছে। প্রতিভা গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে, তাকিয়ে রয়েছে তাদের দিকে।

‘বেশ, চলো।’ সমীরণ গাড়ির দরজায় হাতলে হাত রাখল। ‘মিহিরকে বলে এসো।’

একটু দূরে মিহির তার গাড়িতে বসে অপেক্ষা করছে। মালবিকাকে হনহনিয়ে আসতে দেখে সে ইঞ্জিন চালু করল।

‘আমি সমীরণদার গাড়িতে যাব।’

‘সে কী!’

‘সমীরণদা বললেন একপিঠ তো মিহিরের গাড়িতে এলে এবার ফেরাটা আমার গাড়িতে। এমনভাবে বললেন যে না করতে পারলুম না।’

‘সে কী!’ মিহিরের স্বরে এবার বিস্ময়ের বদলে ফুটে উঠল অধৈর্যতা। ‘যার সঙ্গে এলে তার সঙ্গেই তো ফেরার কথা! আর তুমি হ্যাঁ বলে দিলে?’

‘কী করব। বললুম তো, এমনভাবে উনি বললেন যে—’, মালবিকা থমথমে মুখটা দেখে কথা অসমাপ্ত রাখল।

‘এমনভাবে বললেন। কীভাবে বললেন? ওর মুখে গন্ধ পাওনি?’

‘পেয়েছি। মদ খেয়েছেন। তা কী হয়েছে? উনি কী গাড়িতে আমার রেপ করবেন? ড্রাইভার রয়েছে, প্রতিভাদি রয়েছে। এত নীচ কেন তোমার মন?’ কথাটা বলেই তার মনে হল, না বললেই ভালো হত। মিহিরকে তার আরও অনেকবার দরকার হবে। কিন্তু সমীরণকে দরকার আরও বেশি। তার ভবিষ্যৎ তৈরি করে দেবার লোক তো ওই একজনই। বকুলও তাই বলে।

‘এটা ভদ্রতারও ব্যাপার। যার সঙ্গে আসা, উচিত তার সঙ্গেই যাওয়া। ঠিক আছে যাও তুমি’। মুখটা কালো হয়ে বসে গেছে। মিহির দাঁত চেপে নিজেকে সামলে রাখল।

‘রাগ করলে?’ জানলা গলিয়ে মিহিরের কাঁধে হাতটা রেখেই সে তুলে নিল। মিহির গাড়ি ছেড়ে দিল।

গাড়িতে বসে সমীরণ আর প্রতিভা অপেক্ষা করছে। অন্য গাড়িটা বিজনবাবু, সোমনাথবাবু আর বাজনাগুলো নিয়ে রওনা হয়ে গেছে। প্রাইভেট ট্যাক্সি, অবাঙালি হিন্দিভাষী ড্রাইভার, গ্যারেজ কলকাতায়। ওধারের জানলায় প্রতিভা, মাঝখানে সমীরণ। মালবিকা গাড়িতে উঠে সমীরণের ডানদিকে বসল।

গাড়ি গোবরডাঙা থেকে বেরোবার পরই সমীরণ ক্লান্ত শরীরটা পিছনে হেলিয়ে, নাগরা জোড়া খুলে পা দুটো ছড়িয়ে বলল, ‘এতগুলো গান গাওয়া সত্যিই কষ্টের।’

একটা পা মালবিকার বাঁ পায়ের পাতার ওপর রাখা। টেনে নিতে গিয়েও সে নিল না। বলল, ‘তা হলে কম গাইলেই তো পারেন।’

‘পারি না। প্রতিভা জানে কেন পারি না।’

‘আমি? আমি কী করে জানব।’ প্রতিভা এতক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। মুখ ফিরিয়ে সে কথাটা বলার সঙ্গেই, মালবিকার মনে হল, ডান পা টেনে নিয়ে বাঁ দিকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল।

‘তুমি জানো না? ন্যাকামো কোরো না। আমার বউ কী জিনিস তুমি জানো না?’ সমীরণ মাথাটা পিছনের গদিতে চেপে মুখ তুলে বড়ো একটা শ্বাস ফেলল। আড়মোড়া ভাঙার মতো করে দু—হাত তুলল। ডান হাত নামাল, বাঁ হাত প্রতিভার কাঁধের পিছনে সিটের উপরে রাখল।

প্রতিভা জবাব দেয়নি। সমীরণ আবার বলল, ‘আমার অসুবিধেটা তুমি জানো প্রতিভা।’

মালবিকা ডান দিকে মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকিয়ে। অন্ধকার রাস্তা। বাড়ির আর দোকানের ছাড়া কোনো আলো নেই। একঘেয়ে অন্ধকার। কিন্তু তার বাঁ দিকে একটা ব্যাপার হচ্ছে যেটা একঘেয়ে নয়।’

‘হ্যাঁ জানি। আর জানি বলেই—’

‘তোমাকে কী বিয়েটা করতেই হবে? না করলেই নয়?

‘করতে হবে। না করলেই নয়।’

‘কিন্তু কেন? তুমি কী আমাকে বিশ্বাস করো না?’

এবার নীরবতা। কিছুক্ষণ পর প্রতিভার গলা মালবিকা শুনল, ‘আর করি না।’ স্বরটা খুব নরম।

‘ওহহ।’

কিছুক্ষণ পর সমীরণ ডান দিক ফিরে মালবিকাকে বলল, ‘অর্ধেকটা খেয়েছি, বাকিটা যদি এখন খাই তোমার অসুবিধে হবে?’

‘না। আমার বাবাও তো খায়।’

ডান দিকের পকেট থেকে সমীরণ হুইস্কির পাঁইটটা বার করল। বোতলটা ডান হাতে মালবিকার সামনে ধরে বলল, ‘ছিপিটা খুলে দাও।’

ছিপির প্যাঁচ ঘোরাবার সময় মালবিকার হাত কেঁপে গেল। সমীরণ কাঁচা মদ ঢক ঢক গিলে নিয়ে গুম হয়ে রইল চোখ বন্ধ করে।

‘কেন যে খাই লোকে তা বোঝে না, তুমি কখনো খেয়েছ?’

‘না।’ মালবিকার গলা থেকে কোনোক্রমে শব্দটা বেরোল। এমন প্রশ্ন কখনো সে শোনেনি। এখন যদি খেতে বলে?

বোতলটা প্রতিভার মুখের সামনে ধরে সমীরণ বলল, ‘নাও।’

‘কী হচ্ছে কী?’ তিক্তস্বর প্রতিভার। ‘একটি অল্পবয়সি মেয়ে, একেবারে নতুন, তার সামনে এইসব বলে তুমি নিজেরই মান খোয়াচ্ছ।’

‘তুমি’? মালবিকা অবাক হল। তা হলে তলায় তলায় এদের সম্পর্কটা তুমির। সম্পর্ক যে একটা আছে সেটা সে আন্দাজ করেছিল, এখন নিশ্চিত হল এবং উত্তেজিতও।

‘নতুন তো একদিন পুরনো হবে, জানবে আমি লোকটা কেমন। কিন্তু পুরনো মদের কী তুলনা আছে। আর লজ্জা করতে হবে না। নাও, নাও।’ অমার্জিত কর্কশ স্বরটা আদেশের মতো। কথাটা বলেই বাঁ দিকে কাত হয়ে সমীরণ বাঁ হাতে প্রতিভার গলা ছড়িয়ে ঠোঁটের উপর হামলা চালাল।

কাঁটা হয়ে রইল মালবিকা। বাঁ দিকে তাকাবার সাহসও সে হারিয়ে ফেলেছে। ডান হাতে ধরা বোতলটা কাত হয়ে যাওয়ায় সমীরণের পাঞ্জাবির উপর অনেকটা মদ পড়ে গেল। মালবিকা বোতলটা আস্তে তুলে নিল নিজের হাতে। একবার আড়চোখে সে তাকাল। ধস্তাধস্তির মতো একটা ব্যাপার চলেছে। সমীরণ দু—হাতে প্রতিভাকে জড়িয়ে ওর বুকে মুখ ঘষছে। প্রতিভা একহাতে ঠেলে মুখটা সরাবার চেষ্টা করছে। কারুর মুখে কথা নেই, শুধু শ্বাস—প্রশ্বাসের ভারী শব্দ। মালবিকার বুঝতে অসুবিধে হল না ব্যাপারটা প্রতিভার মোটেই পছন্দের হচ্ছে না। অবশেষে চওড়া কবজিওয়ালা হাতের মুঠোয় সমীরণের চুল ধরে প্রতিভা মাথাটা সোজা করে দিল হ্যাঁচকা টানে। সমীরণ চাপা স্বরে ‘উহহ’ করে উঠল।

মুঠি থেকে চুলের গোছা ছেড়ে দিয়ে প্রতিভা গুম হয়ে জানলার দিকে বাইরে তাকিয়ে রইল। সমীরণ মালবিকার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে বোতলটা মুখ ধরে উঁচু করল। আর কিছু অবশিষ্ট আছে কি না মালবিকা বুঝতে পারল না তবে বিশ্রী একটা গালাগাল দিয়ে সমীরণ বোতলটা বাইরে ছুড়ে ফেলে দিল।

প্রতিভা নিশ্চয়ই অনুমান করেছিল এইরকম কিছু ঘটতে পারে আর সেজন্যই বোধহয় তাকে সঙ্গে যেতে বলেছে। নতুন ছাত্রীর সামনে সমীরণ অসভ্যতা করবে না, এটাই সে ভেবে নিয়েছিল। মালবিকা বুঝে উঠতে পারছে না এখন সে কী করবে। কিন্তু তার করারই বা আছে কী? ব্যাপারটা সম্পূর্ণতই ওদের দুজনের মধ্যে, এ—ক্ষেত্রে তার নিরপেক্ষ থাকাই উচিত। বাড়ি থেকে অনেক দূরে, অন্ধকারের মধ্যে ছুটন্ত মোটরগাড়িতে, অল্প পরিচিত দুটো মানুষ আর একদমই অপরিচিত ড্রাইভার, পরিস্থিতিটা থমথমে এবং বিস্ফোরক। এমন অবস্থার মধ্যে পড়ে তার বুক শুকিয়ে যাচ্ছে। দেহ শক্ত করে কাঠের মতো বসে থাকা আর প্রতিভার জন্য সহানুভূতি জড়ো করা ছাড়া তার আর কী করার আছে? এখন তার মনে হচ্ছে মিহিরের গাড়িতে উঠলেই ভালো হত।

বুকের কাছে মুখ ঝুলিয়ে দিয়ে সমীরণ বসে। বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। মালবিকা শোনার করল চেষ্টা।

‘এত করেছি, তবু আরও চাই…বিয়ে করতে হবে, কেন?…ফুঃ, বিয়ে করলে মুটকিটাকে কেন করব! উঃ, এই ধুমসিকে?’

মালবিকার বাম ঊরুর উপর সমীরণের হাত এসে পড়ল। চমকে উঠে সে প্রথমেই ভাবল, হাতটা সরিয়ে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল মদ খেয়ে বাড়ি ফেরা দিলীপরঞ্জনকে। যখন চড়চাপড় মারে, মা না চেঁচিয়ে ঝগড়া না করে বাবাকে ধরে শোয়াবার চেষ্টা করে। উত্তেজনা উসকে দেবার মতো কোনো বাধা না পেয়ে বাবা ঝিমিয়ে আসে। সমীরণের হাতটা সে সরাল না। চড়চাপড় হয়তো মারবে না তবে গাড়ি থামিয়ে এখন যদি বলে ‘নেমে যাও!’ তা হলে সে কী করবে!

সমীরণের মাথাটা আর একটু ঝুলে পড়েছে। চাকা গর্তে পড়ে গাড়ি যখন লাফিয়ে উঠছে সমীরণের তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হচ্ছে। একবার সামনের সিটে মাথা ঠুকে গেল।

‘মালবিকা ওকে সিধে করে বসিয়ে দাও তো।’

প্রতিভা মুখ বাইরের দিকে রেখেই বলল। স্বরের মধ্যে নিস্পৃহতা ছাড়া আর কিছু নেই। মালবিকা দুটো কাঁধ ধরে সমীরণকে টেনে তুলে সিটের পিছনে হেলান দেওয়াল। সবল, পুষ্ট কাঁধ আর বাহুর পেশি। সে দু—হাতের আঙুল ছড়িয়েও আঁকড়ে ধরতে পারছে না।

‘আমি ঠিক আছি।’ বলে সমীরণ সিধে হয়ে বসতে চেষ্টা করল। ‘ওইটুকু খেয়ে সমীরণ মিত্তিরের কিছু হয় না।’

মালবিকা জোর করে চেপে ধরে রইল। সমীরণ তার দিকে মুখ ফিরিয়ে অনেকক্ষণ কী যেন দেখার চেষ্টা করল। গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে আসা হালকা কুয়াশার মতো অস্বচ্ছ আলোয় মালবিকা দেখল পাতলা ঠোঁট, একটা তিল, বাঁকা দুটি সরু ভুরু আর স্থির দৃষ্টিতে থাকা দুটি হালকা ধূসর চোখের মণি। মহাজাতি সদনে এই চোখের চাহনিতে তার বুক কেঁপে উঠেছিল।

‘তুমি ভালো। দেখামাত্র তোমাকে ভালো লেগেছে।’ ফিসফিস করে সমীরণ বলল। ‘প্রতিভাও ভালো।’

‘হ্যাঁ প্রতিভাদি ভালো।’

‘কিন্তু যেমনটি চাই ও তা নয়।’

মালবিকা দেখল মাথা নীচু করে কপালে হাত দিয়ে রয়েছে প্রতিভা। মুখ দেখা গেল না। সমীরণের ডান হাত এখনও তার ঊরুর উপর। একবার জোরে আঁকড়ে ধরেই শিথিল করল আঙুলগুলো। কাঁধ ধরা হাত দুটো এবার সরিয়ে নেবে কি না মালবিকা বুঝতে পারছে না। যদি আবার সামনে ঝুঁকে পড়ে!

সেই সময় ঊরু থেকে হাতটা উঠে এল মালবিকার মাথার পিছনে। মাথাটাকে সামনের দিকে আলতো করে হাতটা ঠেলল। তার মুখটাও নিয়ে গেল সমীরণের মুখের দিকে। মদের কটু গন্ধ তার মুখে ছড়িয়ে যাচ্ছে। মাত্র তিন—চার ইঞ্চির ব্যবধান। দূরত্বটা ঘুচিয়ে দেবে কী দেবে না? তার শরীর, মন আর যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারছে না। আড়চোখে সে দেখল, প্রতিভা একইভাবে কপালে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে স্থির রয়েছে। মিহিরকে তার মনে পড়ল। ‘ঠিক আছে, যাও তুমি।’ ওর ঘাড়ের কাছে একটা সাদা—।

মালবিকা সদ্য যুবতী, বোধ অপরিণত। বয়সকালের আবেগ সে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। সে বড়ো হয়ে উঠেছে শিক্ষা ও রুচিবর্জিত, জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণাবিহীন। তরল মানসিকতাসম্পন্ন অভিভাবকদের আওতায়। সময় এখন একটা ছুটন্ত নেকড়ের মতো, তার থাবার আঁচড় সে দেগে দিচ্ছে মানুষের চেতনায়। মালবিকা উচ্চচাকাঙ্ক্ষী হয়েছে সময়ের দাগানো নির্দেশ মেনে নিয়ে। তার অনেক কিছুই চাই এবং খুবই তাড়াতাড়ি। তার কোমল একটি হৃদয় আছে এবং সময়বিশেষে সেটি কঠিন, স্বার্থপর হয়ে যায়। তার শিক্ষা নেই, ধৈর্য নেই। গুণাবলীও কিছু নেই। অথচ প্রচারমাধ্যমগুলি নিয়ত যে রাশি রাশি স্বপ্ন তৈরি করে চলেছে সেগুলি থেকে নিস্তার পাবার মতো মানসিক জোরও তার নেই। তার বয়সিদের মধ্যে ক—জনেরই বা তা আছে? মালবিকা স্বভাবজাত বাস্তববোধ থেকে এইটুকু বুঝে গেছে, তার তারুণ্য, তার চাপল্যই তার সহায়, পুরুষদের হাতেই যাবতীয় ক্ষমতা এবং পুরুষদের প্রতিরোধশক্তি খুবই ক্ষীণ, তাতে বহু রন্ধ্র আছে। তার একজন পুরুষ দরকার ছিল নিজের ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য। সে পেয়েছিল সমীরণ মিত্রকে। সে দেখতে পেয়েছিল সমীরণের রন্ধ্রগুলোকে, তার দুর্বলতাকে। চার ইঞ্চির ব্যবধানটা সেদিন ঘোচানোমাত্রই সে চূর্ণ করে দিয়েছিল বিখ্যাত ও জনপ্রিয় গায়কটিকে আর সেই সঙ্গে পা বাড়িয়ে দেয় বেপরোয়াভাবে কর্দমাক্ত পথে চলার সাহস। নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে নেবার জেদ তাকে পেয়ে বসে। সে জানে তাকে শক্ত হতে হবে, দ্বিধা—সংকোচ মানেই পতন।

উদ্ভট ও অদ্ভুত একটা দৃশ্য দেখা গেছল গোবরডাঙা থেকে ফেরা মোটরগাড়িটার মধ্যে। দু—পাশে দুই নারী মধ্যে এক পুরুষ। পুরুষটির জীবন থেকে এক নারী অস্তাচলে। অন্য নারী উদীয়মানা। পাশাপাশি বসে তারা বিচিত্র একটা পরিস্থিতি তৈরি করল। এর মধ্যে কে যে নির্মম, কে যে করুণ, কে যে সজীব সেটা বিচার করার দায় আমার নয়।

গোবরডাঙা থেকে একা মোটরে ফেরার সময় মিহিরও অসহ্য এক জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে ভেবেছিল, তার ঘাড়ে একটা দায় চাপল। এই আচরণ এই প্রত্যাখান আর অপমানের শোধ নেওয়ার দায়। সে শিক্ষিত, মার্জিত ও আর্থিক দিক থেকে সম্পন্ন এবং সে জানে মেয়েদের আকর্ষণ করার মতো চেহারা অথবা বিশেষ কোনো গুণ তার নেই। কিন্তু সে চেয়েছিল কারুর কাছ থেকে সাড়া পেতে। হৃদয়ের সাড়া। সে জানে চেহারাটাকে বদলানো, কান্তিমান করে তোলা, আরও দীর্ঘদেহী হওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কোনো গুণ অর্জন, চেষ্টা করলে হয়তো সম্ভব। সে খেলাধুলা করেনি, অভিনেতা হওয়ার যোগ্যতা নেই, গল্প—কবিতা লিখতে পারে না, ছবি আঁকতে জানে না। জনপ্রিয় হবার কোনো পথই তার সামনে নেই। শুধু গানের পথটাই সে দেখতে পায় এবং ক্রমশ সে বুঝে যায় এ—পথেও তার সাফল্য আসবে না। অতি সাধারণ এক গায়ক হওয়া ছাড়া সে আর কিছু হতে পারবে না। সে কোনো মেয়েরই হৃদয় জয় করতে পারবে না। হীনন্মন্যতায় সে আক্রান্ত হয়।

মালবিকাই তাকে প্রথম আশার আলো দেখিয়েছিল। মহাজাতি সদন থেকে গাড়িতে বকুল ও মালবিকাকে রাত্রে বাড়ির সামনে নামিয়ে দেবার পর মালবিকা তার সঙ্গে আলাদা দু—চারটে কথা বলেছিল। মিহিরের সেটা ভালো লাগে। দ্বিতীয় দিন ওদের নিয়ে সমীরণের বাড়ি থেকে ফেরার সময় তার মনে হয়েছিল মালবিকা তার সম্পর্কে কৌতূহলী। সেদিনই সন্ধ্যার তানপুরাটা সে দিয়ে আসে। ফেরার সময় মালবিকা তার সঙ্গে তিনতলা থেকে নেমে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাকে চটুল আলাপের মধ্যে টেনে নেয়। ‘দূর হও’ বলে মালবিকা তাকে আকাশে ওড়ার জন্য পাখা লাগিয়ে দিয়েছিল। গোবরডাঙায় আসার সময় মিহিরকে সে কয়েকবার হাত ধরতে দেয়।

আমাকে নিয়ে খেলা করার জবাব ওকে আমি দেব, এই চিন্তাটাই মিহিরকে পেয়ে বসে। এক একসময় সে নিজের উপরও রেগে ওঠে। কেন সে চিনতে পারেনি মালবিকাকে। কেন শুধু ওর প্রখর যৌবন, সুন্দর মুখ আর রঙ্গভরা আলাপে নিজের বোধবুদ্ধি হারাল? যতই সে ভেবেছে ততই বুকের মধ্যে ধিকি ধিকি জ্বলেছে অপমানের আগুন। আর একজন হল ওই সমীরণ মিত্তির। তার সামনে থেকেই ছিনিয়ে নিয়ে গেল তার মধুর ভবিষ্যৎ, তাকে উপহাসের স্তরে নামিয়ে দিয়ে।

কিন্তু কীভাবে সে শোধ নেবে? ভেবেচিন্তে সে ঠিক করল মালবিকাকে আগে মুঠোয় আনতে হবে। সে ওকে বিয়ে করবে। তারপর ওর উচ্চচাকাঙ্ক্ষা ঘোচাবে। বাড়ি থেকে এক পা—ও যদি বেরোয় তা হলে হাত—পা বেঁধে চাবকাবে। যতই সে এইভাবে ভেবেছে ততই একটা তপ্ত শলাকা তার হৃৎপিণ্ডের গভীরে ধীরে ধীরে ঢুকে গেছে। রক্তাক্ত করেছে তার প্রতিশোধ বাসনাকে।

মিহিরের মতো স্থিরবুদ্ধির যুবক যে ভুল চিন্তা করেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কখনো কখনো মানুষ ষড়রিপুর তাড়নায় দিগবিদিক বোধ হারায়, মনের ভারসাম্যতা নষ্ট করে। মিহিরেরও তাই ঘটল। সে মালবিকাদের বাড়িতে যাতায়াত বন্ধ করল না। আগের মতোই রসিকতা করে সে কথা বলে, মোটরে বকুল আর মালবিকাকে সে কয়েকবার নিয়ে গেল পাতিপুকুরে। উমার নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করল। সুধাংশুর পরামর্শ : ডেস্কটপ পাবলিশিং অর্থাৎ ডিটিপি তার প্রেসে চালু করার যৌক্তিকতা মেনে নিল। দক্ষিণেশ্বরে উমা ও বকুলকে নিয়ে পুজো দিয়ে এল। আর একটা কাজ সে করেছে, সমীরণ মিত্রর কাছে আর সে গান শিখতে যায় না। আরও একটা কাজ করেছে, বকুল, দিলীপরঞ্জন ও মালবিকাকে বাড়িতে এনে তার বাবা ও মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছে।

পুত্রবধূ করায় মায়ের আপত্তি নেই, মালবিকাকে তাঁর পছন্দ হয়েছে। ছেলের পছন্দ যখন, বাবা তা মেনে নিতে আপত্তি তুললেন না। এরপর মিহির প্রস্তাবটা দেয় বকুলের কাছে।

ইতিমধ্যে আমরা মালবিকা ও সমীরণের সম্পর্কের খোঁজ নিতে পারি।

গোবরডাঙা থেকে ফেরার সময়কার ঘটনার পর প্রতিভা আর গানের স্কুলে আসেনি। মালবিকা একবার ভেবেছিল খোঁজ নিতে রাজাবাজারে যাবে। কিন্তু কী এক কুণ্ঠা তাকে বাধা দেয়। কপালে হাত দিয়ে সেদিন মুখ ঢেকে থাকলেও কান তো খোলা ছিল। প্রতিভা এখন তাকে কী চোখে দেখবে, কী ধরনের কথা বলবে তা বুঝে উঠতে না পারায় সে আর যায়নি। সমীরণ এখন নিজে তার সংগীত শিক্ষার তত্ত্বাবধায়ক।

মালবিকা সমীরণের সঙ্গে নানান ধরনের আসরে এখন বসছে তানপুরা নিয়ে। দূরদর্শনেও সমীরণের পিছনে তাকে দেখা গেছে। ফলে দত্তবাড়িতে তাকে এখন যে—নজরে দেখা হয়, সেটাই সে চেয়ে এসেছে—গুরুত্ব! সমীরণ প্রতিভাকে টাকা দিত, মালবিকাকে দিল তার থেকে বেশি, তিনশো টাকা।

দোতলায় ছাত্রছাত্রীরা চলে যাবার পর মালবিকাও যখন যাওয়ার উদ্যোগ করছে, তখন সমীরণ তাকে অপেক্ষা করতে বলে পাশের শোবার ঘরে যায়। ফিরে এল তিনটি একশো টাকার নোট নিয়ে।

‘এই নাও, তোমার পরিশ্রমের জন্য।’

জীবনে তার প্রথম রোজগার। মালবিকার ঠোঁট কেঁপে ওঠে কথা বলতে গিয়ে। কথার বদলে চোখ ভরে ওঠে জলে। সে তা হলে একটা কিছু হয়েছে, একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছে। সমীরণের পায়ের উপর সে ভেঙে পড়ে। আঁকড়ে ধরে পাতা দুটো।

সমীরণ দুই বাহু ধরে তুলে শুধু একদৃষ্টে মালবিকার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী সে দেখছিল, খুঁজছিল মালবিকা তা বুঝতে পারল না।

‘কী দেখছেন?’

‘হালকা লাইট গান গাও, ভারী গান তোমার হবে না। সুরেলা গলা দিয়েছেন ভগবান, তাড়াতাড়ি উঠে আসবে তুমি।’

‘শুধু এইটুকুই দেখলেন, আর কিছু দেখতে পাচ্ছেন না?’ মালবিকা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে ধরল।

সমীরণের দু—হাত মালবিকার কাঁধে। কাছে টানল সমীরণ। সে পিছিয়ে গেল।

‘বললেন না তো কী দেখতে পেলেন?’

‘বলব সন্ধেবেলায় এসো।’

‘বউদি?’

‘থাকবে না।’

তিনশো টাকা হাতে নিয়ে বকুল আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল। এই তিনশো হবে তিন হাজার, তিন হাজার হবে তিন লাখ। সে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল একটা বাড়ি, যেখানে থাকে শুধু মা আর মেয়ে। সদর দরজার বাইরে কৃপা—ভিক্ষুকের মতো বসে আছে দিলীপরঞ্জন। অনেক কষ্ট অনেক অপমান বকুল সহ্য করেছে।

সন্ধ্যাবেলায় আসে মিহির। মালবিকা নেই, বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে বলে যায়নি। এখন বলে যাওয়ার দরকার আর হয় না। বকুল প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘মালির প্রথম রোজগারের টাকায় কেনা, সব তোমায় খেতে হবে বাবা।’

‘নিশ্চয় খাব।’ মিহিরের হাসিতে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ল। তার চোয়াল শক্ত হওয়াটা বকুল লক্ষ করল না।

‘মাসিমা, একটা কথা।’

‘কী?’

‘মালিকে আমি বিয়ে করতে চাই। বাবা—মার এতে অমত নেই। আপনারা মত দিলেই—।’ মিহির শুধু ‘হ্যাঁ’ শোনার জন্য তাকিয়ে রইল। সে এদের মানসিক ও আর্থিক দৈন্যের আদ্যোপান্ত জেনে গেছে।

‘আমাদের মত! বলছ কী বাবা, এ তো আমাদের পরম ভাগ্যি, মালিরও ভাগ্যি।’

কথাটা বলার পর বকুলের চোখ দিয়ে টসটস জল পড়ল। ‘এত বড়ো ঘর! এত ভালো ছেলে! আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। বাবা তুমি সত্যি বলছ তো?’

ঠিক সেই সময় সমীরণের শোবার ঘরে খাটের উপর শিথিলভাবে মালবিকা শুয়ে। সমীরণ বসে তার পাশে।

‘সত্যি বলছ?’ মালবিকার চোখে গাঢ় আবেগ।

‘সত্যি বলছি।’ সমীরণ ঝুঁকে মুখ নামিয়ে আনল। কপালে, গালে, চোখে তারপর আলতো চুমু দিল ঠোঁটে। চোখ বন্ধ হয়ে এল মালবিকার। দু—হাতে সমীরণের মুখটা ধরে ফিসফিস করল, ‘আমিও ভালোবাসি, সত্যি বলছি। তোমাকে ছুঁয়ে।’

মালবিকার বুকে মুখ চেপে ধরল সমীরণ। ওর চুলের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মালবিকা বলল, ‘সারাজীবন ভালোবাসবে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমিও বাসব। সারাজীবন তোমার থাকব।’

‘আমিও থাকব।’

‘আমাকে ছুঁয়ে বলো।’

সমীরণ মুখ তুলল। মালবিকা আকুল দৃষ্টিতে উত্তরের অপেক্ষায়। তার মনে হল, মেয়েটা সত্যিই ছেলেমানুষ। ছুঁয়ে বললেই ও বিশ্বাস করে নেবে, নাকি এই সময় এই ধরনের কথাই বলতে ভালো লাগে!

‘কোথায় ছুঁয়ে বলব? এখানে ছুঁয়ে?’ সমীরণ ওর বুকের উপর হাত রাখল।

‘হ্যাঁ, ওখানে ছুঁয়ে।’

‘ব্লাউজটা না খুললে ছোঁব কী করে?’

‘পাজি কোথাকার! যত বদ বুদ্ধি!’

‘তা হলে ব্লাউজ ছুঁয়েই বলি?’

‘না।’ মালবিকার স্বর খসখসে হয়ে এল। চোখ আধ খোলা। সামান্য ফাঁক হয়ে রয়েছে ঠোঁট। কপাল ঘেমে উঠেছে। ‘ওরা এসে পড়বে না তো?’

‘থিয়েটার ভাঙতে এখনও অনেক দেরি। রবীন্দ্রসদন থেকে আসতেও সময় লাগবে।’

ব্লাউজের হুকে হাত দিয়ে মালবিকা বলল, ‘আলোটা নিভিয়ে দাও।’

প্রায় এক ঘণ্টা পর শিঞ্জিনীর ড্রেসিং টেবলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচির পাট ঠিক করতে করতে মালবিকা বলল, ‘দেরি হয়ে গেল। বলে এসেছি আটটার মধ্যে ফিরব। এখনই আটটা বাজে।’

‘কেন, কেউ কী অপেক্ষা করবে?’ সমীরণ বিছানায় আধ শোওয়া হয়ে দেখছে কত দ্রুত মালবিকা নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। ‘চুলটা আঁচড়ে নাও।’

শিঞ্জিনীর চিরুনিটা তুলে নিয়ে মালবিকা বলল, ‘কে আবার অপেক্ষা করবে? আমার জন্য তো ভাবে আমার মা।’ আড়চোখে সে সমীরণের দিকে তাকাল। ‘আর কেউ না।’

সমীরণ চোখ মিটমিট করে হাসল। ‘তবু তোমার মা আছে ভাববার জন্য, আমার তো কেউ নেই।’

‘কেন তোমার বউ?’

‘ভাবে না। আলাদা থাকতে চায়।’

‘ডিভোর্স করবে?’ মালবিকার অজান্তেই তার গলায় প্রত্যাশার ছোঁয়া লাগল। সমীরণের কানে সেটা ধরা পড়ল। মনে মনে সে হাসল।

‘এখনও তো ওর শরীর ভালোই রয়েছে বিয়ে করতে পারবে।’ মালবিকা আয়নায় নিজেকে শেষবারের মতো দেখে নিল। সমীরণ উঠে বসল।

‘তা পারবে, আমিও পারব।’ ইঙ্গিতে ভরা হাসি সমীরণের মুখে খেলে গেল। মালবিকার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হল। ‘আমিও পারব’ বলে সমীরণ কী বোঝাতে চাইল?

নীচের থেকে ‘সমীরণদা আছেন নাকি?’ বলে কার ডাক শোনা গেল। সমীরণ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘কে ভব নাকি? আয় আয়, ঘরে গিয়ে বোস, আমি আসছি।’

ঘরে ফিরে এসে সে মালবিকাকে বলল, ‘আমি ও—ঘরে যাচ্ছি, তুমি চুপচাপ বেরিয়ে যেয়ো।’ পাশের ঘরে যাবার জন্য পা বাড়িয়েও সে ঘুরে এল। মালবিকাকে দু—হাতে বুকে টেনে নিয়ে পিষে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ গভীর চুমু দিল। সমীরণ ছেড়ে দিয়ে মুখ তোলামাত্র মালবিকা বলল, ‘আমি কিন্তু সবসময় তোমার জন্য ভাবব।’

সমীরণ মনে মনে আর একবার হাসল।

.

মালবিকা যথেষ্ট বুদ্ধিমতী আবার যথেষ্ট বোকাও। তার মায়ের মতোই আবেগ, অনুভব, হর্ষ, বেদনা সে চাপা দিয়ে রাখতে পারে না। পার্থিব সুখগুলি পাওয়ার জন্য তার ব্যাকুলতা যে—কোনো চতুর লোকের কাছেই ধরা পড়ে যায়। সে মিহিরকে অপছন্দ করে যেহেতু তার রূপ নেই, গুণ নেই, পরিচিতি নেই। আছে শুধু বিত্ত, যেটা মালবিকার বয়সের চোখে পছন্দের তৃতীয় সারিতে। এর উপরে কাঁধের চামড়ায় রয়েছে একটা সাদা দাগ। আবার মিহিরের মোটরে বেড়াতে, চিনা বা মোগলাই রেস্টুরেন্টে মিহিরের অর্থে খেতে, বাড়ির এবং পাড়ার লোকেদের দেখিয়ে মিহিরের মোটরে চড়তেও তার ভালো লাগে। তার চরিত্রের দুটো বিপরীত দিক রয়েছে এবং তাদের মধ্যে এতকাল কোনো সংঘাত ছিল না। কিন্তু এবার সেটা শুরু হল সমীরণের শোবার ঘর থেকে।

মালবিকা বাড়ি ফিরে দেখে ঘরে কেউ নেই। এই সময় বাবার থাকার কথা নয়, কিন্তু মা? বকুল তখন দোতলায় বড়োজয়ের ঘরে। মেয়ে ফিরেছে খবর পেয়ে তিনতলায় ছুটেই উঠে এল।

‘খবরটা বড়দিকে দিতে গেছলুম।’

‘কী খবর?’

‘দারুণ খবর।’ বকুল খাটে বসেই আবার উঠে দাঁড়াল। ‘তোর বিয়ে! মিহির এই সন্ধেবেলায় বলে গেল তোকে বিয়ে করতে চায়।’

‘ধ্যাত, কী আজেবাজে কথা বলছ!’ মালবিকা শাড়ি বদলাবার জন্য নিজের ঘরে ঢুকল। বকুল তার পিছু নিল।

‘আজেবাজে বলছিস কেন, তোর মত নেই নাকি?’

‘মত—অমতের কথা নয়। এখন বিয়েটিয়ে করা সম্ভব নয়, একদমই নয়। তা হলে গান শেখার বারোটা বেজে যাবে।’

‘সে কী কথা! বিয়ে করে কেউ গাইয়ে হয়নি নাকি! ওসব বাজে কথা ছাড়। আমি রাজি, তোর বাবার ইচ্ছেটাও জানি। দোতলার ওরা তো বলল, মালি ভাগ্য করে এসেছে বটে। উঁচু ঘর, বাপের এক ছেলে, এত ভালো ব্যবসা!’

‘ব্যস, তা হলেই খুব সুপাত্র।’ মালি রেগে উঠল। ‘আমার ওকে পছন্দ নয়।’

বকুল স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে রইল মেয়ের কথা শুনে। বলছে কী? মিহির সুপাত্র নয়!

‘মিহিরকে তোর পছন্দ নয় কেন? বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা, বয়সও কম, দেখতে কুচ্ছিত নয়, লেখাপড়া করেছে, বংশ ভালো। বোন আমেরিকায় পড়ছে—।’

‘থাক থাক। তোমায় আর ওকালতি করতে হবে না। কেন পছন্দ নয় তা অত বুঝিয়ে বলতে পারব না। আমার মোট কথা ওকে ভালো লাগে না।’

‘এটা কি একটা কথা হল? আমাদের সবাইয়ের পছন্দ, তার কি কোনো দাম নেই?’

‘না নেই। বিয়ে করব আমি, আমার পছন্দেরও কি কোনো দাম নেই?’

‘তুই এখনও ছোটো, অভিজ্ঞতা নেই। দামাদামির কী বুঝিস।’

‘ছোটো বলেই তো এখন বিয়ে করতে চাই না। অভিজ্ঞতা আর একটু হোক। ততদিন বিয়ের কথা তুলো না।’

‘এসব কী বোকার মতো বলছিস! অভিজ্ঞতা হতে হতে তো বুড়ি হয়ে যাবি। আমি কোনো কথা শুনতে চাই না, মিহিরকে বিয়ে করতে হবে তোকে। আহ্লাদিপনা দেখলে গা জ্বালা করে। পেটে ধরলুম, মানুষ করলুম, আর আমার ইচ্ছে—অনিচ্ছের কোনো দাম নেই।’ বকুলের গলা চড়ে উঠল। চোখের কোণে চিকচিক করছে জল। মালবিকার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে খাওয়ার টেবলে একটা চেয়ারে গুম হয়ে বসে রইল।

সমীরণের কাছ থেকে জীবনে প্রথম পাওয়া মাদকীয় সুখ দেহে বহন করে, একটা রমণীয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন চোখে ধরিয়ে, উছলে ওঠা রোমাঞ্চের ধকল সামলাতে সামলাতে বাড়ি ফিরেই এ কী অবস্থার মধ্যে পড়তে হল! মালবিকা নিজের ঘরে খাটে বসল। মাথার মধ্যে এলোমেলো বাতাস আর শনশন শব্দ। বিছানায় গড়িয়ে পড়ে সে কপালের উপর দুই বাহু রেখে চোখ বন্ধ করল। এখন তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।

আধো ঘুম, আধো জাগরণের মধ্যে সে টের পেল বাবা ফিরল। মদ খেয়ে আসেনি। দুজনের কথা হচ্ছে তাকে নিয়েই। বিয়েরই কথা। একবার বাবা চেঁচিয়ে উঠল, ‘চাবকে পিঠের চামড়া তুলে দোব।’

‘আস্তে আস্তে।’

‘বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করে দাও। গান শিখতে যাওয়া?…অত বাইরে বেরোলে বিগড়োবে না?…অপছন্দ! বাবা—মা যাকে পছন্দ করে দেবে তাকেই বিয়ে করতে হবে।…এসব হয়েছে তোমার জন্য।’

‘আমার জন্য?’

‘তবে না তো কী। যেমন বিদ্যেধরী মা তেমনি তার মেয়ে।’

‘মেয়ে তো তোমারও।’

‘হ্যাঁ আমারও। আর সেই জন্যই বলছি বাইরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। নিজের কথা মনে নেই? কত ছেলে চরিয়ে বেড়াতে? আমাকে ফাঁসিয়ে তো বিয়েটা করলে, দ্যাখো গে মেয়ে এবার কাকে ফাঁসাচ্ছে।’

শুনতে শুনতে মালবিকার মনে হচ্ছিল, বাবা যদি মদ খেয়ে এসে মাকে দু—ঘা দিত তাহলেও ভালো ছিল। রাগটা বেরিয়ে গেলেই ঘুমিয়ে পড়ত। এভাবে নোংরা নোংরা কথা তা হলে আর শুনতে হত না।

কিছুক্ষণ পর তার মনে হল, সমীরণকে সে কি ফাঁসাচ্ছে? সে—ও কি প্রেগনান্ট হবে! শিউরে উঠে মনে মনে বলল, না, না, না, এভাবে নয়। তা হলে মায়ের মতো দশা হবে তার। বরং সমীরণের সঙ্গে কথা বলবে, ওর পরামর্শ চাইবে…পরামর্শ নয়, একটা আশ্বাস।

‘মিহিরের বাড়িতে গিয়ে ওর বাবা—মার সঙ্গে কথা বলে দিন পাকা করব। তুমিও যাবে। দেনা—পাওনার কথা কিছু বলেছে?’

‘শুধু শাঁখা—সিঁদুর। ওরাই গয়না দিয়ে সাজিয়ে নিয়ে যাবে, বরযাত্রী খাওয়ানোর খরচও দেবে।’

‘খরচ তো আমাদেরও আছে। টাকার জোগাড় করতে হবে। খেতে দাও।’

পরদিন দুপুরে মালবিকা সেজোজেঠি অর্চনার ঘর থেকে সমীরণকে ফোন করল। অবুকে মালবিকাই সঙ্গে নিয়ে গিয়ে গানের ক্লাসে ভরতি করিয়ে দিয়েছে। চাকরের সঙ্গে সে বাসে যায় ও ফেরে। মালবিকার প্রতি অর্চনা প্রসন্ন।

ফোন ধরল সমীরণের চাকর অবনী।

‘কে বলছেন?’

‘আমি মালবিকা, সমীরণদাকে একবার ডেকে দেবে?’

‘দাদা বাইরের ঘরে কথা বলছে, লোক এয়েছে।’

‘বলো এক মিনিটের জন্য আসতে।’ মালবিকা আড়চোখে অর্চনার দিকে তাকাল। পিছন ফিরে বালিশে ওয়াড় পরাচ্ছে। সমীরণের ফোন শোবার ঘরে। নিশ্চয় শিঞ্জিনী এখন ঘরে নেই, থাকলে ফোনটা সেই ধরত।

‘হ্যালো, আমি মালি। একটু কথা বলার ছিল।’ আড়চোখে সে অর্চনাকে দেখে নিল। ওয়াড় পরানো আর শেষই হচ্ছে না।

‘খুব জরুরি কি?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাড়িতে কিছু কি বলেছে দেরি হওয়ার জন্য?’ সমীরণের স্বরে উৎকণ্ঠা।

‘না, অন্য ব্যাপারে কথা বলব।’

‘কাল বললে হবে?’

‘হবে।’ গলা নামিয়ে মালবিকা বলল, ‘বাড়িতে নয়।’

ওদিকে কিছুক্ষণ চুপ। ‘সিরিয়াস কিছু?’

‘হ্যাঁ।’

‘কাল একটায় কলামন্দিরের সামনে থেকো, তুলে নিয়ে ক্লাবে যাব। ওখানেই লাঞ্চ। ঠিকমতো চিনে যেতে পারবে তো?’

‘পারব। ঠিক আছে।’

ফোন রাখতেই অর্চনা বলল, ‘তোর মা—র কাছে কাল শুনলুম। মিহিরের বাড়িতে কবে কথা বলতে যাবে?’

‘আজ—কালের মধ্যে যাবে।’

‘মিহিরও তো গান শেখে, এবার দুজনে একসঙ্গে শিখবি। স্বামী—স্ত্রীর একই রকমের হবি থাকলে মন কষাকষি হয় না।’

‘দেখি হয় কি না হয়।’ মালবিকা পা বাড়াল লাজুক সুরে কথাটা বলে।

‘দেখিস তোদের মনের মিল হবে, ছেলেটা ভালো।’

‘আর মেয়েটা ভালো নয় বুঝি?’

মালবিকা উত্তর পাওয়ার জন্য আর অপেক্ষা করেনি।

পরদিন একটার আগেই মালবিকা থিয়েটার রোডের মোড়ে মিনিবাস থেকে নামল।

সার্কুলার রোড পার হয়ে কলামন্দিরের ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল। হাতঘড়ি দেখে মনে মনে সময়ের একটা হিসেব করল। সমীরণের সঙ্গে কথা বলা, খাওয়া, বাড়ি ফিরে যাওয়া চারটের মধ্যে সম্পূর্ণ করতে হবে। সকালে দিলীপরঞ্জন চাঁচাছোলা ভাষায় তাকে জানিয়ে দিয়েছে, বাড়ি থেকে বেরোলে ঠ্যাং ভেঙে দেবে। মালবিকা বিশ্বাস করে তার বাবা এই কাজটা করতে পারে। বকুল বারণ করেছিল। চারটের মধ্যে ফিরে আসবে কথা দিয়ে সে বেরিয়েছে। শুধু বলেছিল, ‘সমীরণদাকে বলে আসব, এবার থেকে আর গান শিখতে যাব না।’

ট্যাক্সিটা তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে দাঁড়াল। রোদ—চশমা পরা সমীরণের মুখ জানলা দিয়ে একটু বার হয়ে তার দিকে তাকিয়ে। মালবিকা বুঝতে পারেনি। হাতছানিটা দেখে সে দ্রুত গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল।

‘চিনতেই পারিনি।’

‘চলিয়ে ভাই।’ ট্যাক্সি চলতে শুরু করার পর সমীরণ বলল, ‘সেই জন্যই পরা। মানুষের চোখ ডেকে দিলে তাকে চেনা শক্ত।’

ট্যাক্সিওয়ালাকে সমীরণ বলেই রেখেছিল কোথায় যেতে হবে। ফটক দিয়ে ঢুকে ক্লাবের দরজায় ট্যাক্সি থামল। বাড়িটার জীর্ণ অবস্থা। কয়েক ধাপ উঠে সামনেই কাউন্টার। বাঁ দিকে কাঠের সিঁড়ি দোতলায় উঠে গেছে। ধাপগুলো ক্ষয়া। ইংরেজ আমলের ক্লাব। কাউন্টারে টাই পরা মাঝবয়সি একটি লোক বসে। দেখে মনে হয় পুরোনো কর্মচারী। সমীরণকে দেখে হাসল। খাতায় সই করে সমীরণ বলল, ‘সুইমিং পুলের ধারেই বসা যাক।’

মালবিকা কখনো এমন জায়গায় আসেনি। একটা হলঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে সে অন্য পাশে একটা ঘরে চড়া মেকআপ করা কয়েকজন বয়স্ক মহিলাকে তাস খেলতে দেখল। পুলের ধারে সার সার সাদা রং—করা টেবল ও কাঠের চেয়ার। প্রায় টেবলেই লোক বসে খাচ্ছে। বাচ্চচা ছেলেমেয়েরাও রয়েছে । ওরা যে টেবলে বসল তার পাশেরটিতে এক মাঝবয়সি মহিলা। মুখটা ভালো, শরীর ভারী। দুজন পুরুষের সঙ্গে বসে। ওরা সবাই বিয়ার খাচ্ছে। মহিলাটি সমীরণের দিকে তাকিয়ে হাসল।

‘তোমায় চেনে।’

‘আগে থিয়েটার করত এখন যাত্রায় গেছে। অনেকদিন পরে দেখছি।’ কথাটা বলে টেবলে এসে দাঁড়ানো ওয়েটারের সেলাম নিয়ে সমীরণ বলল, ‘একটা বিয়ার, একটা অরেঞ্জ স্কোয়াশ, এই দিয়েই শুরু করা যাক। খাবারটা পরে হবে না কি এখনই বলব?’

মালবিকার কাল থেকেই খিদে পাচ্ছে না। উত্তেজনা, উদবেগ, ভয় সব মিলিয়ে খাওয়ার ইচ্ছেটা লোপ পেয়ে গেছে।

‘আমার খিদে নেই।’

সমীরণ অপেক্ষমাণ ওয়েটারকে বলল, ‘ঠিক আছে আগে এটাই আনো।’ তারপর মালবিকার দিকে তাকিয়ে রইল কোনো কথা না বলে।

মালবিকার বুকটা কেঁপে গেল একবার। কালো কাচের চশমা পরা একটা নিথর মুখ কথা না বলে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন একটা মুখোশ। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় না। আর তা না করতে পারলে সে আশ্বাস পাবে কী করে? তার মনে হচ্ছে সমীরণ তাকে কাছে আসতে দিতে চায় না।

‘আমার…আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।’ মালবিকা চোখ নামিয়ে আবার তুলল। সমীরণের মুখে কোনো ভাবান্তর হতে সে দেখল না। শুনে চমকে উঠল না কেন সমীরণ!

‘কী করব?’ আকুল স্বরে জানতে চাইল মালবিকা।

জবাব পেল না।

‘শুনতে পাচ্ছ?’

‘আজ সকালে টেলিফোন করে মিহির আমাকে বলেছে।’ সমীরণের কণ্ঠ শীতল, তাতে বিচলন নেই।

‘কী বলেছে?’ মালবিকা টেবলে হাত রেখে ঝুঁকে পড়ল।

‘অনেক কথাই বলেছে। সবই আমার সম্পর্কে, তোমার তা শুনে কাজ নেই। শুয়োরের বাচ্চচাকে আমি শিক্ষা দেব।’

মুখোশে কোনো ভাঁজ পড়তে দেখল না মালবিকা। ক্রোধ চাপার চেষ্টায় যে বিকৃতি ঘটে তার লেশমাত্র নেই। স্বরেও কোনো বৈকল্য নেই।

‘বিয়ে তুমি করবে না। করলে তোমার সর্বনাশ হবে। ওর কথা শুনে মনে হল, কোনো মতলব এঁটে বিয়েটা করতে চাইছে। একবার গোবরডাঙার কথাটা বলল। ওর গাড়ি থেকে আমার গাড়িতে, আমি নাকি জোর করে তোমাকে তুলিয়েছি।’

‘সে কী! প্রতিভাদির অনুরোধেই তো আমি তোমার গাড়িতে গেছি।’ মালবিকার সাহস হল না, মিহিরকে সে আসলে তখন কী বলেছিল, এখন সে—কথা বলতে।

‘তাই বলেছিলে না আমার অনুরোধে বলেছিলে?’

মালবিকার বুক ধড়াস করে উঠল ভয়ে। মিথ্যা একবার যখন বলেইছে তখন সেটাই আঁকড়ে থাকা ভালো।

‘মিহিরকে আমি প্রতিভাদির কথাই বলেছি। হয়তো ও ধরে নিয়েছে—’, সমীরণের হাত তোলা দেখে সে কথা থামাল। বেয়ারা এসে গেছে টেবলে। কমলারঙের পানীয় মালবিকার সামনে রাখল। গ্লাসে বিয়ার ঢেলে বোতলটা রেখে বিলে সই করাল। সমীরণ তাকে বলল, ‘দু—প্লেট ফিশ ফিঙ্গার দিয়ো।’

‘আমি তোমার নামই করিনি। কিন্তু এসব কথা ফোনে তুলল কেন?’ বেয়ারা চলে যেতেই মালবিকা বলল।

‘জানি না। পুরনো একটা ঘটনা তুলে বলল রেপ করার জন্য আমি মেয়েদের গাড়িতে তুলি। ও নাকি আমাকে এক্সপোজ করবে। আমার খপ্পর থেকে তোমাকে উদ্ধার করবে…শুয়োরের বাচ্চচা, গাধার মতো একটা গলা, গান গেয়ে কিনা নাম করবে! সমীরণ মিত্তিরের রাইভাল হবে!’ সমীরণ একচুমুকে গ্লাসের তিনভাগ শেষ করে আবার বোতল থেকে ঢেলে পূর্ণ করল।

মালবিকা মুখোশটায় এবার ফাটল দেখছে। গলার স্বরে উত্তাপ। ‘বিয়ে তুমি করবে না। করলেও মিহিরকে নয়।’

‘মাকে আমি তাই বলেছি। ওকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। কিন্তু বাবা বলেছে বিয়ে করতেই হবে, মা—ও তাই চায়। আমি এখন কী করব?’ মালবিকার অভ্যন্তরে ধস নামছে। কিছু একটা আঁকড়ে ধরার জন্য সে হাতড়াচ্ছে।

‘আমার বিরুদ্ধে বাড়ির সবাই। আমার কোনো সহায় নেই। আমাকে তো বাবার আশ্রয়েই থাকতে হয়!’ মালবিকার হঠাৎ—ই প্রতিভার একটা কথা এখন মনে পড়ল: ‘লেখাপড়া শিখে এসব আমি মেনে নেব না’, ‘বলির পাঁঠা আমি হব না।’ মনে মনে সে বলল, কিন্তু প্রতিভাদি আপনি তবু লেখাপড়া আর গান শিখেছেন, আমি যে কিছুই শিখিনি। আমাকে তো মেনে নিতেই হবে। মালবিকা মাথা নীচু করে রইল।

বিয়ার শেষ করে সমীরণ মুখ ঘুরিয়ে একটা আঙুল তুলে বেয়ারাকে ইশারা করল আর একটা বোতল আনার জন্য।

‘আমাকে কিছু বলো।’

‘বলেইছি তো। এ—বিয়ে তুমি করবে না।’

‘বাবা লাথি মেরে বার করে দেবে বাড়ি থেকে।’

‘দিলে বেরিয়ে আসবে।’

‘যাব কোথায়, থাকব কোথায়?’

‘চট করে এখনই বলা সম্ভব নয়। ভেবে বলতে হবে। রিসক আছে।’

পাশের টেবলে হাসির শব্দ উঠল। মালবিকা মুখ ঘুরিয়ে দেখল মহিলার আঙুলে সিগারেট। বুকের আঁচল সরে গেছে। টেবলের পাশে মেঝেয় পাঁচ—ছটা খালি বিয়ারের বোতল।

ফিশ ফিঙ্গার আর বিয়ার এল। বিলে সই হল। সমীরণ গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, ‘খাচ্ছ না যে?’

‘খেতে ইচ্ছে করছে না, আচ্ছা খাচ্ছি।’ মালবিকা এক চুমুকে স্কোয়াশ শেষ করল। একটা ফিশ ফিঙ্গার তুলে কামড় দিল। চিবিয়ে গলা দিয়ে নামাবার জোর পাচ্ছে না। টুকরোটা মুখের মধ্যে রেখে দিল।

গ্লাস শেষ করে সমীরণ একদৃষ্টে পুলের জলের দিকে তাকিয়ে। মালবিকা চিবোতে শুরু করল। তারপর আর একটা তুলে সেটা হাতে ধরে বসে থাকল। মিনিট পাঁচেক পর দ্বিতীয় বোতলটা শেষ করে সমীরণ মুখ ফেরাল। মুখ লালচে দেখাচ্ছে।

‘বিয়ের তোড়জোড় কতদূর?’

‘কালই তো সবে কথা হল। এখনও তো বিয়ের দিনই ঠিক হয়নি, তারপর পাকাদেখা, কেনাকাটা, নেমন্তন্ন করা।’

‘অ। তা হলে এখনও অনেক দেরি আছে।’

‘অনেক আর কোথায়? দিন ঠিক হলে সাত দিনেও বিয়ে হয়।’

মালবিকার মনে হল কালো কাচের আড়াল থেকে একজোড়া তীব্র দৃষ্টি তাকে লক্ষ করছে। তার অন্তঃস্থল পর্যন্ত দেখে নিচ্ছে।

‘মন শক্ত করতে পারবে?’

‘পারব।’ মালবিকা অচঞ্চল স্বরে জানাল।

‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে?’

‘পারব।’ মালবিকার গলা এবারও কাঁপল না।

‘আর কিন্তু ফিরতে পারবে না।’

‘জানি।’ মালবিকার গলা কঠিন হল।

সমীরণ কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বলল, ‘ঠিক দু—হপ্তা পর তোমাকে ফোন করব। আজ কুড়ি তারিখ, চোদ্দো দিন পর চার তারিখ। দুপুর একটা থেকে সওয়া একটার মধ্যে ফোনের কাছে থাকবে। নম্বরটা আমার কাছে আছে।’

‘ফোনের কাছে সেজজেঠি থাকে।’

‘আমি সেইভাবেই কথা বলব।’

‘কী বলবে তুমি ফোনে?’

সমীরণের মুখে হাসি ফুটল। পাতলা ঠোঁট দুটো ছড়িয়ে গেল। সাদা দাঁতগুলো ঝলসানি দিল। তিলটা সরে গিয়ে ফিরে এল। ভ্রূ দুটো বেঁকে রয়েছে। মালবিকা বিমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল। তার ইচ্ছে করছে ঝাঁপিয়ে ওর পাঞ্জাবিটা ছিঁড়ে ফালাফালা করে বুকে মুখটা ঘষতে। আর তার ভয় করছে না। কিছু একটা সমীরণ করবে তার জন্য। তাকে বাঁচাবে। মিহিরকে আর বিয়ে করতে হবে না। ওর ঘাড়ের সেই সাদাটা ওত পেতে রয়েছে। আমাকে সমীরণ বাঁচাবে।

মালবিকার মুখের উপর যা কিছু ফুটে উঠল সমীরণ তা লক্ষ করে যাচ্ছিল। ঝুঁকে মালবিকার মুখের দিকে মুখ এগিয়ে এনে গোপন কথা বলার মতো করে বলল, ‘বলব, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

সমীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মালবিকার দুই চোখের কোণ বেয়ে জল নামল। সে মোছার চেষ্টা করল না।

‘তোমাকে কখন বাড়ি ফিরতে হবে?’

‘চারটের ভেতরে যেতেই হবে, মাকে কথা দিয়ে এসেছি। যদি বাবা এসে পড়ে? এখন তো আমায় চোখে চোখে রাখবে।’

‘আমার মনে হয় মিহির তোমার মুভমেন্টের ওপর নজর রাখবে।’

‘মতলব এঁটে বিয়ে করতে চাইছে বললে, কী মতলব?’

‘সেটা কী ও খুলে আমায় বলবে? ওর কথা বলার ঢং থেকে মনে হল। হয়তো প্রতিভা ওকে কিছু বলে থাকতে পারে।’

প্রতিভা আর গান শেখাতে আসে না, মিহিরও আসে না গান শিখতে তা হলে ওদের দুজনের দেখা হবে কী করে? মালবিকা দ্রুত ভেবে নিল। যদি ওদের দেখা হয়ে থাকেও তা হলে প্রতিভা যা বলবে তা শুনলে মিহিরের তো তাকে বিয়ে করতে চাওয়া উচিত নয়। মালবিকা নিশ্চিন্ত বোধ করল, প্রতিভার সঙ্গে মিহিরের দেখা না হওয়া সম্পর্কে। কিন্তু মিহিরের উপর সমীরণ এত রেগে গেল কেন? কী বলেছে সে যেজন্য সমীরণ ‘শুয়োরের বাচ্চচা’ বলল!

‘এখন থেকে তুমি বাধ্য মেয়ের মতো বাড়িতে থাকবে। যে যা বলবে করবে। বিয়ে করতে রাজি নও, এসব কথা একদম বলবে না, কেমন? দেখি কী করা যায়।’

‘করবে তো?’

সমীরণ জবাব দিল না। শুধু তাকিয়ে রইল মালবিকার মুখের দিকে। ছমছম করে উঠল মালবিকার বুক। জীবনে এই প্রথম সে এমন একটা সংকটের মধ্যে পড়েছে, যেখানে সে পুরোপুরি অন্য একজনের নিয়ন্ত্রণের আওতায় চলে গেছে। এমন একটা কাজ তাকে করতে হবে যার ফলাফল সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। নিজের ভাগ্য নিজে গড়ার মধ্যে অদ্ভুত এক ধরনের উত্তেজনা, ছমছমে ভয়, রহস্যে ভরা ভবিষ্যৎ, সব মিলিয়ে ব্যাপারটা তার কাছে জুয়া খেলার মতো লাগছে। যদি হার হয়? তাহলে কী যে তার অবস্থা হবে সে জানে না। মনে মনে সে বলল, ভগবান তুমি আমাকে দেখো।

সেইদিন সন্ধ্যাবেলায় মিহির এল। তার গাড়িতেই বকুল ও দিলীপরঞ্জনকে নিয়ে গেল তাদের বাড়িতে। ঘণ্টা দুই পরে তাদের সে ফিরিয়ে দিয়ে গেল। তিনতলায় আর উঠল না। উচ্ছ্বসিত বকুল মালবিকাকে বলল, ‘ওরা তো এইমাসেই বিয়ে দিতে চায়। মিহিরের মা বলল, পৌষ মাস পড়ে গেলে আরও প্রায় দু—মাস দেরি হয়ে যাবে। অঘ্রানের আজ চার তারিখ। আঠাশ তারিখই ঠিক হল। মাঝে চব্বিশটা দিন। কীভাবে যে কী হবে!’

মালবিকা চুপ করে রইল। তার কথা বলার কিছু নেই। বকুল তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকাল। মুখে প্রতিবাদ না দেখে সে আশ্বস্ত হল। ‘আর না বলিসনি মালি। বিয়ের দিন পর্যন্ত পাকা হয়ে গেছে, এরপরও যদি এ—বিয়ে না তা হলে আমাদের মুখ দেখাবার উপায় থাকবে না। না ওদের কাছে, না এই বাড়িতে। তোর বাবার তো টাকাকড়ি বলতে কিছুই নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে হাজার পঁয়ত্রিশ হয়তো তুলতে পারবে, এ ছাড়া আর কিছুই নেই। আমি তো সোনাদানা নিয়ে এ—বাড়িতে আসিনি, শাশুড়ি দিয়েছিল সাড়ে তিন ভরির একটা গলার হার। তোর জেঠিরা যদি হাতে কানে গলায় একটা করে দেয়। উনি তাই কথা বলতে গেলেন দাদাদের সঙ্গে কিছু যদি পাওয়া যায়।’ মেয়ের হাত ধরল বকুল তারপর হাতটা কাঁধে রাখল।

‘তোমরা দিন যখন ঠিক করে ফেলেছ তারপর আর না বলি কী করে।’ মালবিকা নম্র করে চোখে মুখে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে বলল। বাবার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে জীবনে এই প্রথম।

বকুলের বুক থেকে যেন পাষাণ ভার নেমে গেল। খুশি চাপতে চাপতে বলল, ‘দেখিস এ বিয়েতে তোর ভালোই হবে। বাপ—মা কি হাত—পা বেঁধে মেয়েকে জলে ফেলে দিতে চায়? টাকা না থাকলে সুখ—শান্তি আসে না। মিহির ছেলে ভালো, টাকাকড়িও আছে। দেখতে—শুনতেও তো খারাপ নয়।’

মালবিকার এক্ষেত্রেও কথা বলার কিছু নেই। তবু বলার জন্য বলল, ‘আমার বিয়ের জন্য বাবা ধারদেনায় জড়িয়ে পড়বে সেটা ভাবতে আমার খারাপ লাগছে। বড়োজেঠিকে তো চিনি, তারপর চিমটি কেটে ঠেস দিয়ে কথা শোনাবে।’

‘শোনাক। ওর নাতনিদের বিয়ে তোর থেকে ভালো ঘরে হয় কি না দেখব। এই চব্বিশটা দিন তুই আর বাড়ি থেকে বেরোসনি। কথা দে।’

‘দিলুম।’

‘বাঁচালি আমায়।’

চারশোর মতো লোককে নেমতন্ন করা হবে। মালবিকা জানিয়ে দিয়েছে পাড়ার বা স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই, সুতরাং বলার মতো কেউই তার নেই। সমীরণ মিত্র আর শিঞ্জিনী বউদিকেও বলবে না। আত্মীয়স্বজন বলতে জেঠিদের বাপের বাড়ি, বড়োজেঠির বেয়াই বাড়ি, তিন পিসি আর বাবার দুই মামা। বাবার অফিসে, পাড়ার কয়েকটা বাড়িতে আর বরযাত্রীরা সব মিলিয়ে ধরা হয়েছে চারশো লোক।

বকুলের অ্যাডভোকেট বড়োভাসুর লিস্টিটা কাটছাঁট করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কথায়: ‘অ্যাতো লোককে বলার দরকার কী, খরচের দিকটাও তো দেখতে হবে? দিলুর যা সঙ্গতি তাতে এই বাজারে চারশো লোককে খাওয়ানো, ওর পক্ষে বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।’

বকুলের আপত্তিতে লিস্টি ছাঁটাই হয়নি।

দিলীপরঞ্জনকে সে বলে দিয়েছে, ‘দশটা নয়, দুটো নয় আমার একটাই মেয়ে। হোক খরচ। ওনার মেয়ের বিয়েতে বারোশো লোক খাইয়েছেন আর তোমার মেয়ের বিয়েতে চারশোও তুমি খাওয়াতে পারবে না? খরচ তো উনি দিচ্ছেন না।’

‘তুমি চটছ কেন। আমার মুখের দিকে চেয়েই বড়দা কথাটা বলেছে। উনি বললেই আমি রাজি হব নাকি? আত্মীয় বাড়ি, বেয়াই বাড়ি না বললে হয়? এদের বাদ দিয়ে আমাদের বংশে কখনো কোনো বিয়ে হয়েছে? আমার বিয়ের কথাটা বাদ দাও, ওটা একসেপশন।’ দিলীপরঞ্জনের শেষ বাক্যটি কোনো জ্বালা বা তিক্ততা নিয়ে মুখ থেকে বেরিয়ে এল না। বরং বংশের ঐতিহ্য ভাঙা এই দুঃসাহসিক কাজটার জন্য প্রচ্ছন্ন একটা গর্ব যেন রয়েছে।

‘আজকাল কত মেয়ে যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে।’ কথাটা বকুল বলল নিশ্চিন্ত স্বরে। মেয়ের বিয়েকে কেন্দ্র করে এখন স্বামীর সঙ্গে তার সখ্য গড়ে উঠছে। জীবনে এই প্রথম।

বকুলের লিস্টিতে শুধু তার মামারা আর দাদা—দিদি অর্থাৎ সুধাংশু এবং উমা। নিমন্ত্রণের কার্ড ছেপে আসার পর সে সন্ধ্যাবেলায় অর্চনার ঘর থেকে উমাকে ফোন করল।

‘দিদি আপনার কাছে এই রোববারেই যাচ্ছি একটা ভালো খবর নিয়ে।’

‘কী ভালো খবর?’

‘বলুন তো কী হতে পারে।’

‘ছেলেপুলে হবে নাকি?’

‘ধ্যেত, কী যে বলেন না। এই বয়সে আবার ওসব—’, হর্ষে, পুলকে বকুলের বাকরোধ হল।

‘এই বয়সে মানে? তোমার আর বয়স কত? তোমাকে দেখলে তো বিয়ে হয়েছে বলে মনেই হয় না। ভালো খবরটা কী? দিলীপবাবুকে তালাক দিয়ে আবার বিয়েটিয়ে করছ নাকি?’

সুখের সায়রে বকুল আবার অবগাহন করল। ‘আমি নয়, বিয়ে করছে আমার মেয়ে আর পাত্রটি হল মিহির।’

বলো কী! সত্যিই ভালো খবর। রোববার আসছ? মালিকেও নিয়ে এসো, ওকে আইবুড়ো ভাত খাওয়াব। এদের যে বিয়ে হতে পারে সেটা কিন্তু বকুল, আমি আঁচ করতুম। মিহির যেভাবে মালির দিকে তাকাত টাকাত, মুখচোখের ভাব যেরকম হয়ে যেত তাতেই বুঝে গেছলুম একটা কিছু হতে পারে।’

‘বিয়ের কথা মিহিরই পাড়ে।’

‘পাড়বেই তো, মালি তো মায়ের মতোই সুন্দরী।’

‘দিদি আপনি বড্ড আমার পেছনে লাগেন।’

‘আহা আমি যেন বাজে কথা বলছি মালির গড়নপেটন, মুখশ্রী তোমার মতো কি নয়?’

‘নিজের মেয়ে বলে বলছি না দিদি, মালি আমার থেকেও দেখতে ভালো, আমার থেকেও লম্বা, আর,’ ফোনে ঠোঁট প্রায় লাগিয়ে বকুল বলল, ‘আর ভীষণ সেক্সি। সেজন্যই তো ওকে নিয়ে আমার ভয় ছিল। বিয়েটা হয়ে গেলে আমি বেঁচে যাই।’

‘রোববার তা হলে ওকে নিয়ে আসছ তো?’

‘হ্যাঁ, এগারো—বারোটা নাগাদ যাব।’

মালির চারিদিকে ব্যস্ততা, সে কোনো কিছু নিয়ে ব্যস্ত নয়। কোনো ব্যাপারেই আগ্রহ দেখায় না আবার উদাসীনতাও নেই।

তিনতলা থেকে সে প্রায় নামেই না। সেজজেঠির কাছ থেকে কয়েকটা সিনেমা ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছে, তারই পাতা ওলটায়। টেপরেকর্ডারে ফিল্মের গান শোনে। মিহিরের দেওয়া তানপুরাটা তার ছোটো ঘরের এককোণে ফেলে রেখে দিয়েছে। নিজের অজান্তেই সে দিনে দু—তিনবার ক্যালেন্ডারের দিকে তাকায়।

সত্যি কী সমীরণের ফোন আসবে? নিশ্চয় আসবে। না আসবে না। আশায় এবং নিরাশায় দোলাদুলি করতে করতে মন ঠিক এইরকম অবস্থাটাই বেছে নেয়। ঝোঁকটা তখন বেশি পড়ে নৈরাশ্যের দিকেই। যতই তার মনে হতে থাকে সমীরণের ফোন আসবে না ততই তার ইন্দ্রিয়গুলো প্রখর হয়ে উঠতে শুরু করে, নিজেকে বিশ্লেষণ করার প্রবণতা বাড়ে। বহুবার সে নিজেকে প্রশ্ন করেছে, ‘ভুল করছি না তো?’ উত্তর খুঁজতে গিয়ে সে অনেক রকমের উত্তর পায়। তাইতে সে ধাঁধায় পড়ে যায়।

বাড়িতে এখন উৎসবের মতো পরিবেশ। সবাই কোনো—না—কোনো ভাবে খুশির উত্তেজনা নিয়ে চলাফেরা করছে, কথা বলছে। সবথেকে বড়ো কথা, দিলীপরঞ্জন তার ভবিষ্যৎ পুঁজির অর্ধেকেরও বেশি ভাঙিয়ে এই উৎসবটা তৈরি করছে। বকুল তার অপমানিত জীবনকে সম্ভ্রম দেবার চেষ্টা করছে। এগুলোকে ধ্বংস করতে হবে ভাবতে মালবিকা বেদনা বোধ করে।

আবার সে এটাও ভাবে, যাকে ঘিরে ওরা আনন্দের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে তার ইচ্ছা—অনিচ্ছাকে কোনো দামই ওরা দিল না। উৎসবে বলি হবার জন্য তাকে রেওয়াজ করে তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু কেন আমি পাঁঠা হব। প্রতিভাদি বলেছে, সে মেনে নেবে না। ভালো কথা। কিন্তু মেনে না নিয়ে সে কী পাচ্ছে এই ত্রিশ বছর বয়সে? সমীরণ মিত্তিরের কাছ থেকে অনেক পাবে ভেবে প্রতিভাদি, নিশ্চয় ওর সঙ্গে শুয়েছে। কিন্তু ভালোবেসে শুয়েছে কী? সমীরণের মধ্যে ভালোবাসা পাবার জন্য একটা কাঙাল রয়েছে। প্রতিভাদি কি সেই কাঙালটাকে, ভূরিভোজ করতে পেরেছে? সমীরণ ভীষণভাবে শরীর চায়। প্রতিভাদি কি ভীষণভাবে শরীর দিতে পেরেছে? আমি সেটা পারব।

মালবিকার এক একসময় চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে—নেমন্তন্নর কার্ডগুলো ছিঁড়ে ফেলে দাও। ডেকরেটারকে অ্যাডভান্সের টাকা দিয়ো না। ভিয়েনের বামুনের সঙ্গে কথা বোলো না। বেনারসি শাড়ি, পাঞ্জাবির তসরের কাপড়, জুতো, সোনার বোতাম, আংটি, নমস্কারির শাড়ি এসবের জন্য টাকা খরচ কোরো না। তোমরা কেউ জানো না আমি কী এক ভয়ংকর কাজ করতে চলেছি। আমার ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য আমি জীবনকে বাজি ধরেছি।

মালবিকা এ—সময় স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছল। কাজটা সে করবেই। মায়ের মতো আমি হব না। একটা বাজে লোককে বিয়ে করার জন্য মা আমাকে পেটে ধরেছিল। আমি এই ভুল করব না। সমীরণকে বিয়েতে বাধ্য করাতে চাই না। যেমন স্বামী হয়ে রয়েছে তেমনই শিঞ্জিনীরই থাকুক। ও শুধু আমাকে ভালোবাসুক, ওর মন আমার দখলে থাকুক। সমীরণ খুব সুন্দর, আমি পছন্দ করি সুন্দর পুরুষকে। আমি চাই নিজের মতো করে জীবনকে ভোগ করতে। কেন ভোগ করব না? জীবনটা তো আমারই। তোমরা কেন তাকে ঘাড় ধরে খাঁচায় পুরতে চাও? আমার স্বাধীনতা আমারই হাতে থাকবে।

‘প্রায়ই দেখি তুই আপনমনে বিড় বিড় করছিস, ব্যাপার কী?’ বকুল একসময় বলল। মালবিকা তখন তার ঘরে শুয়ে।

‘কই, কিছু তো নয়! বিড় বিড় করেছি নাকি?’ উঠে বসল মালবিকা।

‘তোর মনে এখনও বোধহয় এ—বিয়েতে আপত্তি রয়ে গেছে।’

‘না না, আমি তো রাজি বলেইছি।’

বকুল তীক্ষ্ন চোখে মেয়ের মুখ লক্ষ করল। অবশেষে কঠিন হয়ে গেল তার দৃষ্টি।

‘মনকে ঠিক করে নে মালি। এ—বিয়েতে সবার ইচ্ছে রয়েছে এটা ভুলে যাসনি।’

‘আমি মনকে ঠিক করেই নিয়েছি।’

‘তোর মুখে হাসি নেই, কেন?’

‘হাসতেই হবে এমন কোনো কথা আছে?’

‘লোকে দেখলে বলবে কী? আজ বাদে কাল বিয়ে হতে যাচ্ছে যার, তার মুখে হাসি নেই, দৃষ্টিকটু লাগে।’

‘আচ্ছা হাসব।’ মালবিকা শুয়ে পড়ল।

‘রোববার পাতিপুকুরে মুখে যেন হাসি থাকে।’

সমীরণের বলে দেওয়া চোদ্দো দিন এল শুক্রবারে। মালবিকা একটার মিনিট পাঁচেক আগেই অর্চনার ঘরে একটা ম্যাগাজিন হাতে হাজির হল।

‘কী রে এই সময়ে?’ অর্চনা আলমারির পাল্লায় আঁটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে মুখে ময়েশ্চারাইজার লোশন ঘষা বন্ধ রেখে বলল। স্নান সেরে এইমাত্র সে ঘরে এসেছে।

‘এটা ফেরত দিতে এলুম।’ একটু থেমে মালবিকা বলল, ‘গানের স্কুলের প্রতিভাদিকে বলেছিলুম একটা নাগাদ ফোন করতে, এখানে।’ সে ফোনের এমন কাছাকাছি দাঁড়াল যাতে বেজে ওঠামাত্র হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলে নিতে পারে।

‘উনি তো গানের স্কুল ছেড়ে দিয়েছেন, অবু কবে যেন বলল।’

‘হ্যাঁ, কী নিয়ে যেন শিঞ্জিনী বউদির সঙ্গে খটাখটি হতেই ছেড়ে দিয়েছেন। প্রতিভাদি মানুষটি খুব ভালো, যত্ন নিয়ে শেখান, আমাকে তো উনিই শেখাতেন। ওঁকে বলে রেখেছি আমার বিয়েতে আসতেই হবে।’

‘এলে আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিস তো। বাড়িতে এসে যদি অবুকে শেখাতে রাজি হন, তা হলে রাখব।’

‘বলব। তবে বিয়ের দিন আসতে পারবেন কি না সেটাই ফোনে জানিয়ে দেবেন। প্রতিভাদির শিরদাঁড়ায় কী যেন একটা হয়েছে, এই মাসেই অপারেশন হবার কথা।’

‘শিরদাঁড়ায়? তাহলে তো মেজর অপারেশন। তোর বিয়ের আগে হলে আর আসতে পারবেন না।’

এই সময়ের ফোন বেজে উঠল এবং ঝটকা দিয়ে মালবিকার হাত তুলে নিল রিসিভারটা।

‘হ্যালো কে, প্রতিভাদি? আমি মালবিকা।’

‘তোমার সেজজেঠি কি পাশেই?’

‘হ্যাঁ, তোমার অপারেশন কবে?’

‘পরশু রোববার, গানের স্কুল সাতটায় বন্ধ হবে। তারপরই তুমি চলে এসো। শিঞ্জিনী পার্ক সার্কাসের ফ্ল্যাটে যাবে, অবনীও ওর সঙ্গে যাবে। আমাদের খাট—বিছানা, আলমারি এমনকী টিভি, ফ্রিজও ওখানে পরশু চলে গেছে। সোমবার সকালে তোমায় কল্যাণীতে একজনের বাড়িতে নিয়ে ঘিরে রেখে আসব। কোনো ভয় নেই। ও কে? তুমি আসছ?’

‘হ্যাঁ। আটাশে অঘ্রান মানে চোদ্দোই ডিসেম্বর বিয়ের দিন তুমি তা হলে আসতে পারবে না।?’

‘দিন পাক্কা হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ। কী করে আর আসতে বলব, ডাক্তার যখন দিন ঠিকই করে ফেলেছে।’

‘তা হলে পরশু। ভয় করছে?’

‘না, একদমই না।’

ওধারে সমীরণ ফোন রেখে দিল। অর্চনা খাটের উপর পড়ে থাকা সেদিনের খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে। মালবিকা বলল, ‘প্রতিভাদির অপারেশনের ডেট পরশু।’

‘কী যে হচ্ছে এই রাম জন্মভূমি আর বাবরি মসজিদ নিয়ে, পরশু আবার করসেবা করবে।…হ্যাঁ, কী বললি, প্রতিভাদির অপারেশন হবে পরশু? তা হলে তোর বিয়েতে আসছেন না।’ বলেই অর্চনা খবরের কাগজটা তুলে নিল।

‘রাম জন্মভূমি নিয়ে পরশু কী হবে?’ মালবিকা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল। সমীরণ বলেছে পরশু সন্ধ্যা সাতটায়।

‘অযোধ্যায় রাম জন্মভূমি ঘিরে একর তিনেকের একটা জমি নিয়ে মামলা হচ্ছে এলাহাবাদ হাইকোর্টে। রায় বেরোবে এগারো তারিখে। সেই জমিটায় মন্দির করতে চায় হিন্দুরা। পরশু লাখ লাখ লোক গিয়ে সেখানে ঝাঁট দিয়ে, গর্ত টর্ত বুজিয়ে, জল ঢেলে পরিষ্কার করবে। লিখেছে, প্রায় দেড়লাখ করসেবক দেশের নানা জায়গা থেকে অযোধ্যায় হাজির হয়ে গেছে। তার মানেই ঝামেলা, একটা বড়ো রকমের গন্ডগোল হবে। অবশ্য দুজন নেতা প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছে সংঘাত হবে না। কিন্তু নেতাদের কথা আজকাল কি কেউ আর মানে?’ অর্চনা খবরের কাগজ থেকে খুঁটে খুঁটে খবর তুলে তার সঙ্গে জুড়ে দিল নিজের মন্তব্যটা।

‘অযোধ্যায় সেদিন গণ্ডগোল হলে কলকাতায়ও কি হবে?’ মালবিকার অস্বস্তি লাগছে। রবিবারে এই গণ্ডগোল সম্ভাবনার কথাটা শুনে। রবিবারেই সমীরণ তাকে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বলেছে।

‘কলকাতায় কখন যে কী হয় কেউ কি বলতে পারে? এই তো আড়াইমাস আগে ফুলবাগান থানায় কী হল? তার আগে বানতলা? কিছু বলা যায় না। ইন্দিরা গান্ধী যখন মারা গেলেন তুই তখন অবুর বয়সি। তোর মনে আছে কি না জানি না, দুপুর থেকে কলকাতায় সে কী হাঙ্গামা, গন্ডগোল। ট্রাম বাসে আগুন, লুটপাট, বাচ্চচাদের স্কুল বাসকেও রেহাই দেয়নি ট্রেন বন্ধ।’

‘ওসব তো গুণ্ডাদের কাজ।’

‘তবে না তো কী! চারিদিকে গুণ্ডারা ওত পেতে রয়েছে, একটা ছুতো পেলেই হল। শুধু তো রাম নয় তার সঙ্গে বাবরিও রয়েছে। অযোধ্যায় কিছু একটা ঘটে গেলে সারা দেশে আগুন লেগে যাবে। অবু বড়ো হচ্ছে, এইবার আমার দুর্ভাবনা শুরু হল।’

মালবিকা হেসে বলল, ‘আমাকে নিয়ে দুর্ভাবনা হয় না?’

‘হয় না আবার!’

কাহিনি যেখান থেকে শুরু হয়েছিল এবার আমরা ফের সেখানে চলে যাব। সুধাংশু এবং উমার বাড়িতে। রবিবার মালবিকা তার মায়ের সঙ্গে সেখানে আসছে আইবুড়ো ভাত খেতে। সুধাংশু বাজার থেকে চিংড়ি এনেছেন। রান্নাঘরের ভিতরে কল্যাণ চিংড়ির খোসা ছাড়াতে বসেছে। ঘণ্ট করবেন বলে উমা গতকাল একটা মোচা কিনে রেখেছেন আর কিনেছেন দেড়শো টাকা দিয়ে মালবিকার জন্য একটা ছাপা শাড়ি।

রান্নাঘরের দরজা থেকে একটু দূরে চেয়ারে বসে সুধাংশু খবরের কাগজ থেকে দেশের হালচাল সম্পর্কে স্ত্রীকে ওয়াকিবহাল করার জন্য একটু গলা চড়িয়ে খবর শোনাচ্ছেন। উমা তখন চা তৈরি করায় ব্যস্ত।

‘শুনছ, আজ অযোধ্যায় করসেবা। সরযূ নদী থেকে হাতে করে, চাদরে করে বালি এনে জন্মভূমি পরিসরে তৈরি কংক্রিট প্ল্যাটফর্মের আশপাশের গর্ত ভরাট করবে। এক হাজার এক হাজার করে এক—একটা ব্যাচে আসবে বালি দিয়ে গর্তটর্ত ভরিয়ে চলে যাবে। এর পাশাপাশি চলবে প্ল্যাটফর্মটা সাফাইয়ের কাজ। তোমায় তো কাল বলেই ছিলুম হাইকোর্টের নির্দেশ রয়েছে যতক্ষণ না তারা রায় দিচ্ছে ততক্ষণ কোনো নির্মাণ করা যাবে না। বিজেপি—আরএসএস বলেছে, প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছে আদালতের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে তারা পালন করবে। গন্ডগোল সৃষ্টি হয়ে পরিস্থিতি যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সেদিকে নজর রাখবে।’

‘তা হলে বলছ ভালোয় ভালোয় করসেবা হয়ে যাবে?’ রান্নাঘর থেকে উমা জানতে চাইলেন।

‘হয়ে যাওয়া তো উচিত। নেতারা তো ছেলেমানুষ নয় যে প্রধানমন্ত্রীকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবে।’

‘প্রধানমন্ত্রী তো সাধুদের সঙ্গেও কথা বলেছেন।’

‘তাইতেই তো জ্যোতিবাবু রেগে গেছেন। কাল তোমায় শোনালুম না, ময়দানের একটা মিটিংয়ে উনি বলেছেন—প্রধানমন্ত্রী সাধুসন্তদের সঙ্গে কথা বলছেন কেন? স্বাধীনতার পঁয়তাল্লিশ বছর পরও সাধুরা দেশের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেবেন নাকি?’

‘ঠিকই তো বলেছেন…হ্যাঁ গো, জ্যোতিবাবু ঠিক বলেছেন তো?’ উমা কিঞ্চিৎ উদবিগ্ন স্বরে জানতে চাইলেন, জ্যোতিবাবুকে সমর্থন করাটা তার ঠিক হয়েছে কি না।

সুধাংশু স্ত্রীর উদবেগ প্রশমনের চেষ্টা না করে অন্য খবরে চলে গেলেন। ‘জ্যোতিবাবুর নির্বাচনী কেন্দ্র সাতগাছিয়ায় কাল মমতা ব্যানার্জি মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে এসেছে।’

‘সত্যি!’ উমা রান্নাঘরের দরজায় প্রায় ছুটে এলেন। ‘যাই বলো বাপু, মেয়েটা করে দেখাল বটে। জ্যোতিবাবুর ঘণ্টাও বাজিয়ে দিয়ে এল? এবার কোথাও ঘণ্টা বাজলে আমাকে বোলো তো, শুনে আসব।’

‘আচ্ছা বলব তোমায়।’ সুধাংশু মৃত্যুঘণ্টার পাশের খবরটায় চলে গেলেন এবং কাগজের উপর ঝুঁকে পড়লেন। চায়ের কাপ টেবলে রেখে উমা ফিরে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মনে হল সুধাংশু যেন বললেন, ‘সর্বনাশ!’

‘কীসের সর্বনাশ? কার সর্বনাশ?’

‘লরি, টেম্পো, ট্রাক, ম্যাটাডোরে মড়া নিয়ে যেতে দেবে না কর্পোরেশন। কারণ ওই সমস্ত গাড়িতে করেই ফলমূল, শাকসবজি, মাছ নিয়ে যাওয়া হয়। বলছে, সংক্রামক রোগের জীবাণু মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে মানুষের শরীরে, যেমন যক্ষ্মার জীবাণু। তার মানে লরি টেম্পোর রোগের জীবাণু রয়ে যায় আর সেগুলো সংক্রামিত হয় কলমি—পালং, আলুপটল, চিংড়ি, ট্যাংরা, তেলাপিয়ায়। সাংঘাতিক। এগুলোই তো খাই।’

উমা ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইল স্বামীর দিকে। সুধাংশুর দিশাহারা দৃষ্টি স্ত্রীর মুখে।

‘এখান থেকে নিমতলা ঘাট কতদূর জানো?’

‘টেম্পো ম্যাটাডোর বন্ধ করে দিলে আমাদের জন্য খোকার কত কষ্ট হবে ভাবো তো,’ উমা বিপন্ন স্বরে বলল।

‘চিংড়িমাছ, মুলো, পালং এই যে বাজার থেকে আনলুম এগুলো লরি কি ম্যাটাডোরেই তো বাজারে এসেছে।’ সুধাংশু চিন্তায় পড়ে গেলেন। খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে টিভি সেট খুলে সোফায় বসলেন। জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য তখন দূরদর্শনে কনসার্ট বাজছে। উমা রান্নাঘরে গিয়ে বঁটি পেতে বসলেন মোচাটা নিয়ে।

ওরা বারোটা নাগাদ এসে পৌঁছল। সন্দেশের বাক্সটা উমার হাতে দিয়ে বকুল ইশারা করল মালবিকাকে প্রণাম করার জন্য। ‘আর বলবেন না দিদি, বেলগাছিয়ার মোড়ে যা ট্র্যাফিক জ্যাম।’

প্রণাম নিয়ে মালবিকার চিবুক নেড়ে উমা বললেন, ‘সুখী হও মা। স্বামীর ভালোবাসা পাও, শতপুত্রের জননী হও—’

‘গান্ধারী হতে বলছেন মাসিমা?’

উমা থতমত হয়ে হেসে ফেলেন। ‘হ্যাঁ তাই হতে বলেছি।’

‘আপনাদের দুজনেরই কিন্তু একটি করে। বাকি নিরানব্বইটি এখনও ডিউ রয়েছে।’

উমার হাসির শব্দে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সুধাংশু।

‘মেয়ের কথা শোনো। বলে কিনা বাকি নিরানব্বইটা কই?’ উমা হাসি থামিয়ে হাসির কারণটা বলতেই সুধাংশুও হেসে উঠলেন।

‘তোমার তো আর বয়স নেই, নইলে চেষ্টা করে দেখতে পারতে, তবে বকুল কিন্তু ইচ্ছে করলেই নিরানব্বইকে নব্বুই করতে পারে।’

‘ধ্যাত, কী যে বলেন, আপনার জিভের কোনো আড় নেই।’

বকুলের মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্য মালবিকার মনে হল তার মা শুধু সুন্দরীই নয়, তারই সমবয়সি। তারপরই বিষাদ তাকে স্পর্শ করল। তার হাতব্যাগে কয়েক লাইনের একটা চিঠি রয়েছে। মাকে লেখা। সেই চিঠি পড়ে মায়ের এই সুখের উচ্ছলতা আর কয়েক ঘণ্টা পর কীসে যে রূপান্তরিত হবে মালবিকা আন্দাজ করতে ভয় পেল।

এখন তাকে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সবার চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে তো যেতেই হবে, তাই নয়, তার বাসে ওঠার আগে পর্যন্ত কেউ যেন না বুঝতে পারে সে বেরিয়ে গেছে। এজন্য কম করে দশটা মিনিট তার চাই। খোঁজ করতে নিশ্চয় বাস—স্টপ পর্যন্ত ওরা ছুটে আসবে, তার আগেই তাকে বাসে উঠে পড়তে হবে। প্রচুর বাস শ্যামবাজারের দিকে যায়। যেকোনো একটায় উঠে পড়া। শ্যামবাজার থেকে মানিকতলা মোড়। সেখান থেকে হেঁটে আমহার্স্ট স্ট্রিট।

সমীরণ বলেছে স্কুল বন্ধের পর সাতটায় যেতে। কিন্তু তাকে তো অনেক আগেই এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। বেরিয়ে সে সাতটা পর্যন্ত সময় কাটাবে কী করে? রাস্তায় ঘোরাঘুরি তো কোনোমতেই নয়, চেনা লোকেরা তাকে দেখে ফেলতে পারে।

বসার ঘরে মালবিকা আর সুধাংশু টিভি—তে একটা তামিল ফিল্ম দেখছিল। ইংরেজি সাব—টাইটেলের সব কথা বুঝতে না পারলেও ছবিটা মালবিকার মজারই লাগছিল। তখন উমা আর বকুল ঘরে ঢুকল।

‘মালি এই নে, তোর আইবুড়ো ভাতের কাপড়।’

উমা সেলোফোনের মোড়ক থেকে ছাপা শাড়িটা বার করে মালবিকার হাতে দিলেন। সে জানত একটা কাপড় পাবেই তাই অবাক হল না বা হবার ভান করল না। শাড়ির প্রিন্ট দেখেই তার ভালো লাগল। বড়ো বড়ো লাল ফুল তার খুব পছন্দের।

‘পছন্দ হয়েছে?’

মালবিকা হাসল। তিনজনকে প্রণাম করল, আর তখনই একবার মিহিরকে তার মনে পড়ল। বেচারা। শুধু বাড়ি, গাড়ি, টাকাপয়সা আর শিক্ষাই একটা মেয়ের কাছে সব নয়। আরও কিছু তার দরকার। দরকার শরীর আর মনকে মাতিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা। তুমিও হাত ধরেছ, সমীরণও হাত ধরেছে কিন্তু শরীর ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল একজনের ধরাতেই। এটা একটা মেয়ের কাছে কম কথা নয়।

‘হবে না কেন, আমারই তো পরতে ইচ্ছে করছে।’ বকুল বলল। শুনে উমার মুখে খুশি ফুটল। বকুল এটাই চেয়েছিল।

‘দুটো প্রায় বাজতে চলল। আর দশ মিনিটের মধ্যেই খেতে দিচ্ছি। এসো বকুল আমাকে একটু সাহায্য করো’, বকুলকে নিয়ে উমা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুধাংশু ও মালবিকা কিছুক্ষণ টিভি স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকার পর একটা গানের দৃশ্যে ঘাসে চিতপাত নায়কের বুকের উপর নায়িকার শরীরঘর্ষণ সুধাংশুকে অস্বস্তিতে ফেলল। তিনি উশখুশ করে আড়চোখে দেখলেন মালবিকা মন দিয়ে দৃশ্যটা দেখছে, চোখদুটি উজ্জ্বল।

‘সমীরণের কাছে গান শিখছ?’ সুধাংশু চাইলেন দৃশ্যটাকে কথা দিয়ে আড়ালে পাঠিয়ে দিতে।’

‘না।’ মালবিকা চোখ ফিরিয়ে আনল স্ক্রিন থেকে।

‘সমীরণ শেখাচ্ছে না?’

‘আমিই আর শিখতে যাই না।’ সুধাংশু পরের প্রশ্নের আগেই মালবিকা বলল, ‘শিখে আর কী হবে, বিয়ে তো হয়েই যাচ্ছে।’

‘হোক না বিয়ে, তাই বলে শেখা বন্ধ হবে কেন!’

‘মিহির পছন্দ করে না সমীরণ মিত্রকে। ওনার সম্পর্কে মিহিরের ধারণা খুব খারাপ, স্বভাবচরিত্র নাকি ভালো নয়।’

সুধাংশু অপ্রতিভ বোধ করলেন। সমীরণকে তিনি ওর বালক বয়স থেকে চেনেন। পাড়ার ছেলে। বাড়িতেও আসা যাওয়া ছিল। তাকে শ্রদ্ধা করে। তার সম্পর্কে মন্দ কথা শুনতে ভালো লাগল না। ‘মিহির তো ওর ছাত্র, সে এমন কথা বলল! তোমার কী মনে হয় সমীরণ সম্পর্কে?’

‘মিহির ওর কাছে শেখা ছেড়ে দিয়েছে। আমার নিজের মনে হয় সমীরণদার চরিত্র খুব ভালো। কেন জানি মিহির ওকে হঠাৎ—ই অপছন্দ করতে শুরু করেছে। বিয়ের পর মিহির নিশ্চয়ই ওর কাছে আমায় গান শিখতে দেবে না।’ মালবিকা সহজ সুরে বলে গেল। মুখে যে বিমর্ষতা থাকার কথা তা নেই।

‘এবার এসো তোমরা, ভাত দিয়েছি।’ ভিতর থেকে উমার গলা ভেসে গেল। ওরা দুজন টেবলে গিয়ে বসল।

‘বেশি কিছু করিনি। সুক্তো, ডাল, বেগুনভাজা, দু—রকম মাছ আর দই মিষ্টি। বকুল বসে পড়ো।’

‘দিদি আপনি?’

‘আমি পরে বসছি।’

খাওয়ার সময় হাসিঠাট্টা হল। সবার সঙ্গে মালবিকাও হাসল। সর্ষে—চিংড়ি চেয়ে নিয়ে খেল। মিহিররা শুধু শাঁখা সিঁদুর ছাড়া আর কিছু নেবে না শুনে উমা জানিয়ে দিলেন, প্রভাংশুকে টিভি সেট, ফ্রিজ দিতে চেয়েছিল শ্বশুর, কিন্তু তাঁরা নেননি। এরপর সুধাংশু কথাটা তুললেন, ‘মিহির নাকি সমীরণকে পছন্দ করে না, মালিই বলল। ওর নাকি স্বভাব— চরিত্র ভালো নয়।’

‘কেন, ও তো ভালো ছেলে!’ উমা অবাক হলেন। ‘মিহির এটা ঠিক বলেনি। কবে থেকে ওকে চিনি।’

‘তুমি যখন চিনতে তখন ভালো ছিল, এখন হয়তো বদলে গেছে। মানুষ কী চিরকাল একরকম থাকে?’ কথার সুরে বুঝিয়ে দিলেন সুধাংশু আলোচনাটা বন্ধ থাক।

খেয়ে উঠে বেসিনের কলে হাত ধোবার সময় বকুল চাপাস্বরে মেয়ের কাছে জানতে চাইল, ‘মিহির তোকে সমীরণ মিত্র সম্পর্কে কী বলেছে?’

‘মিহির তো বলেনি। সমীরণদাই আমাকে বলেছেন।’

‘কবে তোকে বলেছেন?’

‘তা দিয়ে তোমার কী দরকার?’ বিরক্তি জানাল মালবিকা। ভালো মেয়ে হয়ে সে ক—টা দিন কাটিয়েছে, সব কথায় সায় দিয়ে গেছে। এখন আর কীসের পরোয়া?

‘এসব কথা এখানে বলার কী দরকার।’

‘বেশ করেছি বলেছি, চুপ করো তো।’

শোবার ঘরের খাটটা বেশ বড়ো। উমা আর বকুল পাশাপাশি শুয়ে কথা বলছে। সুধাংশু ছেলের ঘরে খাটে শুয়ে খবরের কাগজ চোখের সামনে ধরে রবিবারের গল্পটা পড়ছেন। মালবিকা বসার ঘরে সোফায় কাত হয়ে, টিভি—তে চোখ রেখে শুয়ে আছে। ইংরেজি খবর হয়ে গিয়ে ফিল্মের শেষ অংশটা এবার শুরু হয়েছে।

চোখ টিভি—র স্ক্রিনে থাকলেও মালবিকা ফিল্ম দেখছিল না। এই সময় তার মাথায় ঘুরছে একটা ফিল্ম প্রোজেক্টার যন্ত্র। তার মনের পর্দায়, সারি দিয়ে চলছে টুকরো টুকরো ঘটনা, কথা। সে কখনো ঝাপসা, কখনো স্পষ্টভাবে দেখতে পেল তার শৈশব, বাল্য, কৈশোর থেকে আজ পর্যন্ত। এইগুলোর মধ্য থেকে সে সহানুভূতি দরদ আর ভালোবাসা শুধু সমীরণ ছাড়া আর কারুর মধ্যেই দেখতে পেল না। সে বারবার বকুলকে খোঁজার চেষ্টা করল তার বিশ্বাস, আস্থা সমর্পণ করার মতো একটা মানুষ হিসেবে। সে পারল না।

একসময় সে ঘড়িতে সময় দেখল। উঠে বসল। সাতটা বাজতে এখনও তিন ঘণ্টা বাকি। টিভি বন্ধ করে নিঃসাড়ে সে শোবার ঘরে এল। বকুল পাশ ফিরে আর উমা চিত হয়ে ঘুমোচ্ছে। শ্বাস প্রশ্বাস দেখে সে বুঝল ওরা ঘুমের গাঢ় অবস্থায়। পাশের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল সুধাংশু গভীর ঘুমে, খবরের কাগজটা মেঝেয় পড়ে রয়েছে। কল্যাণকে সে দেখতে পেল না।

এইটেই সময়। আর দেরি করলে ওরা উঠে পড়বে। মালবিকা সেলোফেন মোড়কে ভরা আইবুড়ো ভাতের শাড়িটা সাবধানে তুলে নিল। বকুলের কাশ্মীরি শালের নীচে তার হাত—ব্যাগটা চাপা রয়েছে। ব্যাগটা বার করে চেইন টেনে খুলল। ছোটো একটা চিঠি বার করে চারধারে তাকাল। কোথায় রেখে যাবে?

ডাইনিং টেবলের উপর? এই শালটার নীচে। আয়নার সামনে চিরুনি চাপা দিয়ে? ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে যেন না চিঠিটা পায় এই ভেবে সে ঘরের বাইরে এল। পাম্প শ্যু পরল। বসার ঘরে টিভি সেটটা চোখে পড়তেই তার মনে হল ওর উপর রাখলে টিভি চালাতে গিয়ে একসময় চোখে পড়বে। চিঠিটা সেটের উপর রেখে মালবিকা অ্যাশট্রে চাপাল তার উপর।

আর কী তার করার আছে? আছে, ঊর্ধ্বশ্বাসে এবার বাস স্টপের দিকে যাওয়া। সন্তর্পণে সদর দরজার ছিটকিনি খুলে মালবিকা বেরিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। রাস্তায় লোক চলছে, তবে কম। এখন তাকে কেউ দেখল কি না দেখল তাতে তার কিছু আসে যায় না। সে দ্রুত পা চালাল বাস রাস্তার দিকে।

বাসনমাজার ঝি সদরের বেল বাজাতে ওদের ঘুম ভাঙে। দরজাটা যে খোলাই রয়েছে সে বুঝতে পারেনি। উমা প্রথম খাট থেকে নেমে রান্নাঘরে যান। এই সময় তাঁকে চা করতে হয়। বকুল ঘুমোচ্ছে কিন্তু মালি কোথায়? মিনিট তিন—চার পর বকুল যখন ডাইনিং টেবলে বসে মাথায় হাত দিল, মালবিকা তখন শ্যামবাজারে নেমে আর একটা বাসে উঠছে। যখন সে মানিকতলায় নামবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে তখন সুধাংশু চিঠিটা দিচ্ছেন বকুলের হাতে।

‘দিদি, মালি চলে গেছে।…এবার কী হবে।’ বকুল চিঠিটি উমার দিকে বাড়িয়ে ধরে শূন্য চোখে তাকিয়ে রইল।

চিঠিটা হাতে নিয়ে উমা পড়তে এবং শোনাতে লাগলেন সুধাংশুকে। ‘মা, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দাম তোমাদের কাছে নেই। এই বিয়েটা নিজেদের তৃপ্তির জন্য দিচ্ছ। তোমাদের ইচ্ছার কাছে আমি বলির পাঁঠা হব না। আমি চলে যাচ্ছি কলকাতার বাইরে। খোঁজ করার চেষ্টা কোরো না। তুমি কষ্ট পাবে জানি কিন্তু আমি নিরুপায়। প্রণাম নিয়ো, ইতি হতভাগিনী মালি।’

চিঠিতে অনেকগুলো বানান ভুল। উমা হাত রাখলেন টেবলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদা বকুলের মাথায়। তার চোখে অসহায় বেদনা। সুধাংশু বসার ঘরে গিয়ে সোফায় আশ্রয় নিলেন।

‘দিদি ওদের সবাইকে আমি এবার কী বলব? মালির বাবার সামনে আমি দাঁড়াব কী করে? আমায় বলেছিল মেয়ে যেন বাড়ির বাইরে না যায়, এখন আমি কী জবাব দোব, বলে দিন আমায়।’ বকুল মুখ তুলে তাকাল উমার দিকে। উমার মুখ পাংশু হয়ে গেল। তাদের বাড়িতেই ঘটনাটা ঘটল! এর দায় তাদের ঘাড়েও এসে পড়ছে।

‘বলুন, বলুন দিদি, এবার গঙ্গায় ডুবে মরা ছাড়া আমার আর কী করার আছে?’

‘শান্ত হও বকুল। এখন ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। শক্ত করো নিজেকে। বাড়ি গিয়ে সবাই মিলে বসে একটা উপায় বার করতে হবে।’

‘না না দিদি, বাড়ি গিয়ে এ মুখ আমি দেখাতে পারব না।’ বকুল ছুটে শোবার ঘরে গিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ল। বালিশে মুখ চেপে ধরে দু—হাতে ঘুসি মারতে লাগল বিছানায়। একটা গোঙানি শুধু তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে।

‘ওকে এইভাবে থাকতে দাও।’ দরজায় দাঁড়িয়ে সুধাংশু বললেন উমাকে। ‘শান্ত হোক, তারপর বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসব।’

বাস থেকে নেমে মালবিকা ঘড়ি দেখল। এখনও ঘণ্টা দুয়েক সময় কাটাতে হবে। গানের স্কুল বন্ধ হবে সাতটায়। তিনটে ঘরে তালা দিয়ে অবনী চাবির তোড়াটা দোতলার দালানে পেরেকটায় ঝুলিয়ে দেবে, নয়তো শিঞ্জিনীর হাতে দেবে। তারপর ওরা চলে যাবে পার্ক সার্কাসের ফ্ল্যাটে। সদর দরজা খোলা রেখেই কি যাবে নাকি তালা দেবে। সমীরণ বাড়িতে রয়েছে কি না বোঝা যাবে তালা দেখে।

মালবিকা এখন বাড়িটার সামনে যাবে না, সামনে দিয়ে হেঁটেও নয়। দূর থেকে সে দেখতে পেল সমীরণের মারুতি গাড়িটা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। ওটা যতক্ষণ থাকবে বুঝতে হবে শিঞ্জিনী বাড়িতেই রয়েছে। সে আবার মানিকতলার মোড়ে এল। এখন সময় কাটানোই তার কাছে একটা জরুরি সমস্যা। এভাবে বড়ো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। বাড়ির না হোক পাড়ার কত লোক তো বাসে ট্রামে এখান দিয়ে যায়। তাদেরই কেউ বলে দেবে, ‘বিকেলে তো ওকে মানিকতলার মোড়ে দেখলুম।’

সময় কাটাবার একটা জায়গা আছে, খুবই ভালো জায়গা, প্রতিভাদির কাছে যাওয়া। ওর সঙ্গে স্বচ্ছন্দে সময় কাটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু ওর যে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, সেটা কি হয়ে গেছে? হয়ে গিয়ে থাকলে ফিরে আসতে হবে। তাই বা কেন, ওর মা—র সঙ্গে এটা—ওটা বলে তো সাতটা বাজিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

মালবিকা দ্রুত পা চালাল দক্ষিণে রাজাবাজারের উদ্দেশে। সায়ান্স কলেজ ছাড়িয়েই তার মনে হল কিছু একটা যেন সে অনুভব করছে। ফুটপাথে তিন—চারজনের জটলা দেখল অনেকগুলো। লোকগুলোর মুখ গম্ভীর, কথা বলছে গলা নামিয়ে। কিন্তু রাজাবাজারের মোড়ে পৌঁছে তার মনে হল আর পাঁচটা দিনের মতোই রয়েছে জায়গাটা। ওপারে রাস্তার ধার ঘেঁষে থাকা ফলের, প্লাস্টিক আর রবারের জুতোর সারি দেওয়া দোকানগুলো যথারীতি খোলা। ট্রাম, বাস, অন্যান্য গাড়ি বিকট শব্দে চলাচল করছে। এমনকী রবারের বলে ক্রিকেটও খেলা হচ্ছে। অস্বাভাবিক লাগল, রাস্তার ওপারে একটা বেঞ্চে সাদা উর্দি পরা সাত—আটজন পুলিশ দেখে। সবার হাতে রাইফেল। একটা ভ্যানও দাঁড়িয়ে।

মালবিকার বুক কেঁপে উঠল অজানা ভয়ে। এত পুলিশ কেন? অমঙ্গল কি ওর দিকে এগিয়ে আসছে? বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে সে কি ভুল করল? ভাবতে ভাবতে সে মসজিদ ছাড়িয়ে গলির মধ্যে ঢুকল। তখন একবার তার মনে হল, ফিরে যাই। তারপর মনে হল এত দূর এগিয়ে আর ফেরা যায় না। সমীরণ তাকে ভালোবাসে কিন্তু সমীরণ যদি বাড়িতে না থাকে? যদি দরজায় সে তালা ঝুলতে দেখে? তা হলে কী করবে? রাস্তায় শুয়ে থাকবে? সমীরণ তাকে ডোবাবে না। ও খুব ভালো, ও নিশ্চয় ভেবেচিন্তেই তাকে সাতটায় আসতে বলেছে। কাল কল্যাণীতে নিয়ে যাবে। কোথায় রেখে আসবে, কার কাছে? কলকাতায় কি তাকে রেখে দিতে পারে না?

দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। মালবিকা ধাক্কা দিল। অন্যান্য বাড়ির দরজার সামনে বাসিন্দারা, বেরিয়ে এসে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে উর্দুতে যার কিছুই সে বুঝছে না। ডিসেম্বরের সন্ধে নেমে আসছে। হাতের ব্যাগ আর শাড়িটা আঁকড়ে ধরে দরজায় আবার ধাক্কা দিল। প্রতিভাদিদের বারান্দায় কেউ নেই। সে ভাবল চেঁচিয়ে ডাকবে কি না।

দরজাটা সামান্য ফাঁক করে একটি মাঝবয়সি লোক তাকে দেখছে। গায়ে হাওয়াই শার্ট আর লুঙ্গি।

‘আমি উপরে যাব।’

লোকটি কথা না বলে পাল্লা খুলে সরে দাঁড়াল। একটি স্ত্রীলোক আর কয়েকটি শিশু ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভীত চোখে তাকে দেখছে। মালবিকা অন্ধকার সরু সিঁড়িটা ধরে দোতলায় উঠে এসে দেখল বারান্দায় কেউ নেই।

‘প্রতিভাদি।’ মৃদু স্বরে সে ডাকল।

‘কে?’ প্রতিভার ঘর থেকে তার মা বেরিয়ে এলেন। বারান্দায় আলো জ্বেলে মালবিকাকে দেখে বললেন, ‘তুমি! এই সময়ে। ঘরে এসো, প্রতিভার তো খুব জ্বর। আজ সকালেও ছিল একশো তিন এখন একশোয় নেমেছে।’

মালবিকা নিশ্চিন্ত বোধ করল। বিয়ে তা হলে হয়নি। প্রতিভার বুক পর্যন্ত একটা ধূসর আলোয়ান, চোখ মুখ টসটসে, তক্তপোশের নীচে একটা বাটিতে জল আর তাতে ডোবানো এক ফালি কাপড়। বালিশের পাশে দুটো ক্যাপসুল। ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘এসো মালবিকা।’

মালবিকা বসল, প্রতিভার পাশে। ‘এদিকেই এসেছিলুম, ভাবলুম যাই তোমাকে দেখে আসি।’

‘ভালো, তবে আজ না এলেই পারতে।’

‘কেন?’ মালবিকার বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল।

‘শুনছি তো অযোধ্যায় বাবরি মসজিদটা ভেঙে দিয়েছে করসেবকরা। বাবা বললেন, বিবিসি নিউজে নাকি বলেছে। মুসলমানরা ভয় পেয়ে গেছে।’

‘ভয় কেন?’

প্রতিভার মা উত্তর দিলেন, ‘চারদিকেই তো হিন্দু। অবাঙালি হিন্দুরা তো মসজিদের ফুটপাথে গাছতলায় একটা মন্দির তৈরির চেষ্টা বহুদিন ধরেই করে যাচ্ছে। বন্দুক নিয়ে পুলিশ সব সময়ই বসে থাকে। এবার ওরা চেষ্টা করবে মন্দির তৈরির জন্য হাঙ্গামা বাধাতে। ওর বাবা তো তাই বললেন, রায়ট যদি বাধে তো রামের নামে ওরাই বাধাবে। চা খাবে?’

‘হ্যাঁ।’

প্রতিভার মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই মালবিকা ঝুঁকে প্রতিভার মুখের কাছে মুখ এনে জিজ্ঞাসা করল, ‘মিহিরদা তোমার কাছে এসেছিল?’

প্রতিভা বিস্মিত হল। ভুরু কুঁচকে উঠল। ‘এ—প্রশ্ন কেন?’

‘এমনিই, বলুন না, এসেছিল কি না?’

‘এসেছিল।’

‘কিছু জিজ্ঞাসা করেছিল আমার আর সমীরণদা সম্পর্কে?’

‘করেছিল। অনেক কিছুই জানতে চেয়েছিল।’

‘কী জানতে চেয়েছিল, সেই একসঙ্গে গাড়িতে আসা?’

‘হ্যাঁ। আমি যা দেখেছি শুনেছি তাই বলেছি ওকে, রং চড়াইনি। আমার মনে হয়েছে তুমি সমীরণদার খপ্পরে চলে যেতে পারো।’

‘আমাকে বাঁচাবার জন্য তাই মিহিরদাকে সব বলে দিলেন?’

‘আমি পাশে বসে আর তোমরা যা শুরু করে দিলে, মালবিকা, আমার অস্তিত্বটাকেই অস্বীকার করে তোমরা যা করেছিলে তাতে একটু মর্যাদাবোধ যার আছে সে অপমানিত বোধ করবে। মদ খেলে সমীরণের বোধবুদ্ধি লোপ পায়, যা খুশি বলে, যা খুশি করে। কিন্তু তুমি তো মদ খাওনি। তা হলে তুমি কেন অসভ্যতা করবে, তাও আমার পাশে বসে। মনে করে দ্যাখো, সেদিন তুমি ওর কোলে বসে—’, প্রতিভা থেমে গেল। উত্তেজনায় চোখ জ্বলজ্বল করছে। স্বরে যতটা না ঘৃণা তার থেকেও বেশি আহত মর্যাদার যন্ত্রণা। শুকনো ঠোঁট চেটে নিল। হাঁফাচ্ছে। বালিশ থেকে মাথাটা তুলে ফেলেছে।

‘আপনি এসব বলেছেন?’ প্রতিভার কাঁধে চাপ দিয়ে মালবিকা মাথাটা বালিশে ফিরিয়ে দিল।

‘না। নোংরা বিষয় নিয়ে কথা বলতে গা ঘিন ঘিন করে। সমীরণ মিত্তিরের নাম তুমি আমার কাছে কোরো না। আমার যে সর্বনাশ করেছে, তা তোমায় বলতে পারব না। তবে মিহির বোকা নয়, সে সমীরণদার স্বভাবচরিত্রটা জানে, অনুমান করে নেবার মতো বুদ্ধি আছে। ও ছ্যাবলা নয়। প্রখর ওর মান—অপমান বোধ। তিন বছর ওকে দেখেছি তো।’

মিহিরের সঙ্গে তার যে বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে মালবিকা বলতে গিয়েও তা বলতে পারল না। চায়ের কাপ হাতে প্রতিভার মা ঘরে ঢুকলেন।

‘চা—টা খেয়ে মা তুমি আর থেকো না। রাস্তায় নাকি লোকজন কমে যাচ্ছে। নীচের রুকিয়ার মা বলল গোলমাল হতে পারে।’

মালবিকার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। একটা চুমুক দিয়ে সে কাপ রেখে দিল মেঝেয়। ‘প্রতিভাদি, মাসিমা, আমি এখন চলি, পরে একদিন আসব।’

মালবিকা যখন হনহনিয়ে কেশব সেন স্ট্রিট থেকে আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে চলেছে তখন তার উকিল বড়োজ্যাঠার একতলার সেরেস্তায় চলেছে এক বৈঠক। ওদের তিন ভাই আর সুধাংশু টেবল ঘিরে বসে। মেজোভাই জামসেদপুরে টেলকোয় অ্যাকাউন্টেন্ট। বউ নিয়ে সেখানেই কোয়ার্টারে থাকে। তাদের এখানকার ঘর তালা দেওয়া। এই বাড়ির সাতেপাঁচে তারা থাকে না। দু—তিন বছর অন্তর তারা আসে, তারা নিঃসন্তান।

জ্যাঠার ছেলে ভটু দরজায় দাঁড়িয়ে। এই বৈঠকে মেয়েদের থাকতে দেওয়া হয়নি। দোতলায় অর্চনার ঘরে দেওয়ালে ঠেস ও কপালে হাত দিয়ে বসে থাকা বকুলকে ঘিরে তার দুই জা তখন মালবিকার সমালোচনায় ব্যস্ত।

‘আগেই পুলিশ কেন? পুলিশ লাগানো মানেই লোক জানাজানি করা। আগে চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করে দ্যাখো ফিরে আসে কি না।’ কথাটা বলল বড়োজ্যাঠা।

‘পুলিশের এখন এইসব মেয়ে—পালানোর মতো সিলি ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় হবে না।’ ভটু গম্ভীর বিজ্ঞ স্বরে জানিয়ে দিল। বিকেলে সে স্কুটার নিয়ে বেরিয়েছিল। ‘ইউ এন আই—এ আমার এক বন্ধু আছে, সে বলল পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে বাবরি মসজিদ একেবারে গুঁড়িয়ে ধুলো করে দিয়েছে।’

‘পাঁচ ঘণ্টায় কী করে ধুলো করে? কামান নিয়ে গেছল?’ ব্যবসায়ী সেজোভাই সন্দেহ প্রকাশ করল। ‘তিন—তিনটে গম্বুজ আছে মসজিদটার, অমনি পাঁচ ঘণ্টায় ভেঙে দিল?’

‘আমি যা শুনেছি তাই বললুম। পাঁচশো বছরের কাদামাটির স্ট্রাকচার, হাজার হাজার লোক যদি শাবল, গাঁইতি, হাতুড়ি, লোহার পাইপ দিয়ে ভাঙতে শুরু করে তা হলে পাঁচ ঘণ্টায় ধুলো হবে না?’ ভটু তার কাকার অবিশ্বাসকে ভাঙার চেষ্টা করল।’

‘আচ্ছা, এসব আলোচনা পরে হবে।’ বড়োজ্যাঠা তার ছেলের দিকে হাত তুললেন। ‘পুলিশ—টুলিশ পরের কথা। তা ছাড়া ভটু যা বলল, তাতে এখানে কেন সারা দেশের পুলিশই তো এখন ল অ্যান্ড অর্ডার নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। আমাদের ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাবে না।’

‘আমি এটাই বলতে চেয়েছি।’ ভটু বলল।

‘দিলু, তুই কিছু আন্দাজ করতে পারিস ও কোথায় যেতে পারে বা মালির সঙ্গে কারোর—’, বড়োভাই শোভন হওয়ার জন্য থেমে গেল।

এতক্ষণ পাথরের মতো বসে থাকা দিলীপরঞ্জন মাথা নাড়ল।

‘বউমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি?’

‘হ্যাঁ, ও কোনো হদিশ দিতে পারল না।’

‘ইদানীং ওর চালচলনে কোনোরকম সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েছে?’

‘সন্দেহজনক মানে?’ দিলীপরঞ্জন তেরিয়া ভাবটা কোনোক্রমে চেপে রাখল। মেয়ের চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ তার ভালো লাগল না।

‘এতে আর মানেটানের কী আছে?’ ব্যবসায়ী দাদা সোজাসুজি কারবার ভালোবাসে। ‘কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেমটেম করছিল কী?’

‘সে কি বলেকয়ে প্রেম করবে?’ দিলীপরঞ্জন রাগ চেপে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘না, আমার চোখে কিছু পড়েনি।’

‘ওর চিঠিটা দেখি।’ উকিল দাদা হাত বাড়াল। ‘কোথায় চিঠিটা?’

দিলীপরঞ্জন বুকপকেট থেকে বার করে দিল। বড়োভাই চশমা পরে নিল। খুঁটিয়ে চিঠিটা দু—বার পড়ে নিয়ে চশমা খুলল। মুখে হতাশা।

‘সেরকম কিছু তো পাচ্ছি না।’

‘চেপে গেছে, বুদ্ধিমতী মেয়ে তো।’ সেজোভাই মন্তব্য করল। দিলীপরঞ্জনের ভ্রূকুটি তার নজর এড়াল না।

চুপচাপ বসে আছে সুধাংশু। তিনি বাইরের লোক। এই ধরনের কথাবার্তায় তাঁর নাক গলানো উচিত হবে কি না বুঝতে পারছেন না। ঘটনাটা যদি না তাঁর বাড়ি থেকে শুরু হত তা হলে তিনি এখানে বসে থাকতেন না। এখন তাঁর নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। কিন্তু এরা যেভাবে কথাবার্তা চালাচ্ছে সেটা তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। তাঁর মনে হচ্ছে এই মুহূর্তের জরুরি বিষয়টাই কেউ তুলছে না কেন?

‘বিয়ের আর আট দিন বাকি। কম করে অন্তত ষাট—সত্তরটা কার্ড বিলি হয়ে গেছে। তারা তো বিয়ের দিন হাজির হবে।’ সুধাংশু নিজেও শিউরে উঠলেন দৃশ্যটা কল্পনা করে।

‘আপনি কী বলতে চান মালি আর ফিরে আসবে না?’ উকিলের প্রশ্ন।

‘না না সে—কথা বলছি না।’ সুধাংশু প্রায় আঁতকে উঠলেন। ‘নিশ্চয়ই চাই ফিরে আসুক। কিন্তু অন্য সম্ভাবনাটাও মাথায় রাখা দরকার।’

‘উনি ঠিকই বলেছেন।’ দরজা থেকে ভটুর সমর্থন এল। ‘এটা খুবই ইম্পর্ট্যাণ্ট ইস্যু। আগে এটার ফয়সালা হওয়া উচিত। সবাইকে এখনই বারণ করে না দিলে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’

‘কী বলে বারণ করবি? আর সেটা করা হবেই বা কী করে?’ সেজোভাই জানতে চাইল এবং তার প্রশ্ন দুটির সারবত্তা ঘরটাকে চুপ করিয়ে রাখল।

সত্যিই তো এত লোককে কী কারণ দেখিয়ে বারণ করা যায়? মেয়ে পালিয়ে গেছে বললে শুধু দিলীপরঞ্জনেরই তো নয়, সারা পরিবারের মাথা কাটা যাবে। তাদের বংশে এমন কেলেঙ্কারি এই প্রথম। আত্মীয়স্বজন, কুটুম, বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশীদের কাছে মুখ দেখানো যাবে না। কী আতান্তরে যে মেয়েটা সবাইকে ফেলে দিল!

এরপরও সমস্যা, এত লোককে এই অল্পদিনের মধ্যে বারণ করা। সেটা কি সহজ কথা!

‘অলরেডি যাদের কার্ড দেওয়া হয়ে গেছে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে বলে আসা। যার টেলিফোন আছে তাকে টেলিফোন করা নয়তো পোস্টকার্ড ছাড়া।’ ভটু সাবলীলভাবে সমাধানের পথ দেখিয়ে দিল।

‘পোস্টকার্ড নয়। পোস্টাল সার্ভিসের যা বহর, এখান থেকে বাগবাজারের চিঠি ড্রপ করলে দেখবি দশ দিনেও পৌঁছবে না। আর টেলিফোন? কালই সল্টলেকে মামাশ্বশুরকে টেলিফোন করে পেলুম না। ডেড হয়ে গেছে। তার থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বলার কথাটাই ভাবো।’ ভটুকে তার সেজোকাকা পুরোপুরি নস্যাৎ করল না। একটা পথ খোলা রাখল।

‘বাড়ি বাড়ি যাওয়া কি চাট্টিখানি কথা! বেলঘরিয়া থেকে পুটিয়ারি। ওদিকে উত্তরপাড়া। অফিসের লোকদের নয় বলে দেওয়া যাবে। পাড়ায় সবাই বিয়ের কথা জানে। তবে এখনও কাউকে বলা হয়নি। কিন্তু আত্মীয়—কুটুমদের তো বলা হয়ে গেছে।’ দিলীপরঞ্জনের দেহকাঠামো যতটা নয় তার থেকেও বেশি ভেঙে পড়েছে তার কণ্ঠস্বর। অস্ফুটে একবার বলল, ‘আমি যে এখন কী করি!’

‘কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলেই হয়, বিয়ে স্থগিত রইল অনিবার্য কারণে।’ সেজোভাই শেষ করামাত্র বড়োভাই খিঁচিয়ে উঠল, ‘কী বুদ্ধি তোর! যারা কিছু জানত না তারাও এবার জেনে যাবে।’

‘সেজোকাকা, এখানেও একটা ব্যাপার আছে। কী কারণ দেখিয়ে তুমি স্থগিত রইলে বলবে? অনিবার্য কথাটার কোনো মানে হয় না। এতে লোকে নানা রকমের সন্দেহ করবে। একটা কংক্রিট কোনো কারণ দেখানো দরকার।’ ভটু চ্যালেঞ্জের সুরে সেজোকাকার মগজের পরীক্ষায় নামল।

‘এ তো খুব ইজি ব্যাপার, বলে দে মেয়ে মরে গেছে।’

দিলীপরঞ্জন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা তুলল। সুধাংশু বিস্ফারিত চোখে সেজোভাইয়ের দিকে তাকাল। বড়োভাই ভ্রূকুটি করল। ভটু চাপা গলায় ‘হুঁ’ বলল।

‘মরে গেছে মানে, একটা কঠিন কোনো রোগ হয়েছে মরার সম্ভাবনা আছে আমি তাই মিন করেছি। ধরো টিবি হয়েছে যদি বলি?’

‘টিবি?’ বড়োভাই চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে কী ভেবে বসে পড়ল। ‘এ রোগ তো গরিবদের হয়। আমাদের বাড়িতে টিবি ঢুকবে কী করে?’

‘তা হলে ক্যানসার। এটা বড়ো বড়ো লোকদেরও হয়। এইডসও হয়।’

‘সেজোকাকা! ভটু ধমকে উঠল। ‘এইডস কেন হয় তা জানো। মেডিক্যাল কলেজের গায়ে একটা বড়ো বোর্ডে তা লেখা আছে। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে যেতে গেলে চোখে পড়ে। মালির এইডস হয়েছে বললে কেলেঙ্কারির উপর ডবল কেলেঙ্কারি হবে।’

‘তা হলে ছেলের এইডস হয়েছে বলো।’

‘তুই চুপ কর।’ সেজোভাইকে মৃদু দাবড়ানি দিয়ে উকিল দাদা বলল। ‘ভটু তুই বললি বাবরি মসজিদ গুঁড়ো হয়ে গেছে। এতে তা হলে মুসলমানরা খেপে যাবে, কেমন? খেপে গেলে রায়ট হতে পারে, কেমন? মিহিররা এন্টালির যে দিকটায় থাকে সেদিকে মুসলমানই বেশি তাই তো? ধর ও যদি রায়টে মারা যায়, তা হলে তো বিয়ে অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে যাবে।’

‘কিন্তু রায়ট হলে তো মরবে।’

‘যদি হয়। সেজন্যই তো গোড়াতেই বলেছি চব্বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করো। তার মধ্যে মালি ফিরে আসতে পারে, তার মধ্যে রায়টও লেগে যেতে পারে। এর যেকোনো একটা হলে আমাদের মুখ রক্ষা হতে পারে।’

সুধাংশু আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। স্বার্থপর এবং মূর্খের মতো কথাবার্তায় তিনি বিরক্ত হচ্ছিলেন। এইবার বললেন, ‘আপনারা যেমন নিজেদের অসুবিধার কথা ভাবছেন ঠিক তেমনি ছেলের বাড়িও তো এই অসুবিধার সামনে পড়বে। ওঁরাও নিশ্চয় অনেককে নেমন্তন্ন করে ফেলেছেন। ওঁদের কথাটাও ভাবুন। ওঁদেরও মানসম্মান বোধ আছে। ঘটনাটা ওঁদের জানিয়ে দিন।’

সারা ঘর চুপ। শুধু দিলীপরঞ্জন বলল, ‘হ্যাঁ, এটা আমাদের কর্তব্য। আমি যেমন অনেক টাকা খরচ করে বসে আছি, তেমনই ওরাও যাতে খরচ আর না করে সেটা দেখা দরকার।’

‘তা হলে তুই জানিয়ে দে, এক্ষুনি।’ বড়োভাই টেলিফোনটার দিকে তাকাল। এ—বাড়িতে এটা দ্বিতীয় টেলিফোন কিন্তু ডায়ালে তালা দেওয়া। সকাল ও সন্ধ্যায় যখন ও সেরেস্তায় কাজে বসে তখনই শুধু টেলিফোনকে মুক্তি দেয়। অন্য সময় হাতকড়া লাগিয়ে রাখে।

দিলীপরঞ্জন মাথা নাড়ল। ‘না, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মেয়ের এই অপকর্ম নিজের মুখে আমি বলতে পারব না।’

‘তা হলে—’। সেজোভাইয়ের দিকে তাকাল।

‘আমার দ্বারা হবে না।’

‘তা হলে—’ সুধাংশুর উপর চোখ রাখল মালবিকার বড়োজ্যাঠা। ‘আপনি বাইরের লোক, আপনার তো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া মিহিরের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে।’

‘ওর নম্বরটা আমি জানি না।’

‘মালির মায়ের কাছে আছে, এনে দিচ্ছি।’

দিলীপরঞ্জন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেজোভাই তখন সুধাংশুকে বলল, ‘আপনি কি কিছু আন্দাজ করতে পারেন, মালি কোথায় যেতে পারে?’

‘একদমই নয়।’

‘অচেনা কোনো লোককে বাড়ির সামনে দেখেছেন?’

ভটু বলল, যেভাবে গল্পের গোয়েন্দারা বলে।

‘না। তবে আমার মনে হয়, পুলিশের সাহায্য ছাড়া আর কোনোভাবে ওকে খুঁজে বার করা যাবে না। বোঝাই যাচ্ছে একটা প্ল্যান করে রেখেছিল। দুঃখের বিষয় শুরুটা করল কিনা আমারই বাড়ি থেকে। বকুল তো আত্মহত্যা করবে বলেছিল।’

‘দেখা যাক।’ বড়োভাই বলল, ‘মেয়েটা হুট করে এমন একটা কাজ যে করে বসবে কে জানত! দুষ্টু লোকের হাতে পড়ল কি না কে জানে! দেখতে শুনতে তো ভালো, চটকও আছে।’

আলোচনাটা কেউ বাড়াল না। গম্ভীর মুখে সবাই নিজের ভাবনার মধ্যে ডুবে গেল। একটু পরেই একটুকরো কাগজ নিয়ে ফিরল দিলীপরঞ্জন। সেটা সে সুধাংশুর হাতে দিল।

‘বউমা কী করছে? ওকে চোখে চোখে যেন রাখা হয়।’ বড়োভাই চাবি ঘুরিয়ে তালা খুলে দিল।

‘এই সময় সিডেটিভ খাইয়ে কাকিমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা দরকার।’

ডায়াল করে নম্বরটা পেল সুধাংশু। বয়স্ক ঘড়ঘড়ে গলায় একজন ‘হ্যালো’ বলল। তাকে সে অনুরোধ করল মিহিরকে ডেকে দেবার জন্য। ‘বলুন পাতিপুকুরের সুধাংশু গাঙ্গুলি কথা বলতে চায়।’

এরপর অপেক্ষা। সবাই টানটান হয়ে উঠেছে। সুধাংশুর গলা শুকিয়ে আসছে। ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় ঘাম ফুটল তাঁর কপালে। এ কী বিদঘুটে পরিস্থিতির মধ্যে তিনি পড়লেন! ফটকের সামনে বকুলকে ট্যাক্সি থেকে নামিয়ে দিয়ে তিনি তো তখনই ফিরে যেতে পারতেন। তাই করলেই ভালো হত। কেন যে তাঁর মনে করুণার সঞ্চার ঘটল। উমা যদি এইরকম অবস্থার মধ্যে পড়ত তা হলে কী হত? ভাগ্যিস তাঁদের মেয়ে নেই। এখন কী বলবেন, কীভাবে বলবেন মিহিরকে? মেয়ের বাবা জ্যাঠারা কেউ অপ্রিয় কাজটা করতে চাইল না অথচ ওদেরই তো করার কথা।

‘হ্যালো কে মিহির।’ সুধাংশুর হাত কাঁপল, গলা কাঁপল। কীভাবে শুরু করবেন ঠিক করতে না পেরে বললেন, ‘শুনেছ কী ঘটেছে?’

‘সত্যিই খুব দুঃখের। এটা পরিষ্কার বিশ্বাসঘাতকতা হল। এমন কাজ যে হতে পারে ভাবাও সম্ভব নয়।’

.

মিহিরের গলায় যে ক্ষোভ, রাগ, তিক্ততা এবং স্বরগ্রাম সুধাংশু আশা করেছিলেন, সেটা না পেয়ে কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত হলেন।

‘হ্যালো মেসোমশাই, আপনাদের ওদিকে অবস্থা কেমন? আমাদের এখানে সব নর্ম্যাল।’

‘মিহির তুমি কী নিয়ে বলছ?’

‘কেন বাবরি মসজিদের আজ যা সর্বনাশ হল! আপনি তা হলে কী ভেবেছেন?’

‘বাবরির থেকেও বেশি সর্বনাশ হয়েছে মালিদের বাড়িতে, মালি নেই।’

‘য়্যা, মারা গেছে?’

‘না, না, মারা যাওয়া নয়। আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছি না বাবা, মালি আর তার মা আজ দুপুরে আমার বাড়িতে আইবুড়ো ভাত খেতে গেছল, ওর মায়ের নয়, মালির আইবুড়ো ভাত। দুপুরে আমরা সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সেই ফাঁকে দরজা খুলে ও বেরিয়ে গেছে এক কাপড়েই। না না, আইবুড়ো ভাতের শাড়িটা সঙ্গে নিয়ে গেছে। একটা চিঠি মাকে লিখে রেখে গেছে। পড়ব?’ সুধাংশু হাত বাড়ালেন দিলীপরঞ্জনের দিকে। চিঠিটা নিয়ে তিনি পড়ে শোনালেন মিহিরকে। পড়ার মধ্যে শুনতে পেলেন মিহির অস্ফুটে বলছে, ‘আবার আমায় অপমান করল।’

‘হ্যাঁ বাবা, এবার কী করা যায়?’

‘কী আর করা যাবে, মালির বাবা—মাকে বলুন নাকে সর্ষের তেল দিয়ে ঘুমোতে।’

‘তুমি রেগে যাচ্ছ। কিন্তু এটা কি রাগের সময়?’

‘এতে রাগব না তো কীসে রাগব? কত লোক জানে বিয়ে ওর সঙ্গে হচ্ছে। বাবার খুব একটা মত ছিল না কিন্তু আমার মুখ চেয়ে না বলতে পারেননি। এখন তার সামনে দাঁড়িয়ে কী করে বলব, তোমার ভাবী পুত্রবধূটি সটকান দিয়েছে। ছি ছি ছি কী নোংরামি করল। বিয়ে যদি নাই করতে চায় তা হলে ভদ্র পরিচ্ছন্নভাবে আমাকেও তো বলতে পারত। সবার মুখে কালি মাখিয়ে দেওয়ার কোনো দরকারই ছিল না। বুঝলেন মেসোমশাই অশিক্ষিত বাবা—মায়ের ছেলেমেয়েরা এইরকমই হয়। বাবাটা মোদো মাতাল, তাও আবার দিশি খায়। মেয়েও লেখাপড়ায় অষ্টরম্ভা, হিন্দি ফিল্মের সেক্স আর ভায়োলেন্স দেখে দেখে মাথার মধ্যে শুধু ওইসবই ঘুরছে, তার উপর জুটেছে আপনার আদরের শ্রদ্ধার কেষ্টঠাকুরটি। শুনুন মেসোমশাই, এ কাজ মালি করেছে সমীরণ মিত্তিরের কথায়। আই অ্যাম ডেড শিওর।’

‘তুমি বলছ কী মিহির?’ সুধাংশু রিসিভারটা জোরে আঁকড়ে ধরলেন যাতে হাত থেকে পড়ে না যায়। বড়োভাই, শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে ওধারের কথা শোনার চেষ্টা করছেন। কিছু কিছু শুনতেও পাচ্ছেন কেননা মিহির বেশ চেঁচিয়েই কথা বলছে। দাদার মতো একই উদ্দেশ্যে সেজোভাই টেবলের উপর উপুড় হয়ে এগিয়ে এসেছে। ভটু দাঁড়িয়ে সুধাংশুর পিঠের কাছে। শুধু দিলীপরঞ্জন কপালে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে সোজা হয়ে বসে। তার আর কোনো কিছুতে উৎসাহ নেই।

‘ওদের মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে। তার সাক্ষীও আছে। সব কিছুর মূলে কিন্তু আপনি আর মাসিমা। মহাজাতি সদনে আপনারাই ওদের গ্রিনরুমে নিয়ে গিয়ে সমীরণ মিত্তিরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। মনে পড়ে কি? যদি তা না করাতেন তা হলে আজকের এই ঘটনা ঘটত না।’

‘মিহির তোমার সঙ্গেও তা হলে মালির পরিচয় হত না। ঠিক বলেছ, এ ঘটনা ঘটত না। এই বিয়ের প্রশ্নই উঠত না। কিন্তু এখন তর্কাতর্কির সময় তো নয়। কিছু একটা তো করা দরকার।’

‘করতে হয় আপনি করুন, মালির বাবা করুন। আমি কী করতে পারি বলুন? রাস্তায় ওকে খুঁজে বেড়াব? পারলে একবার সমীরণ মিত্তিরের খবর নিন। ওর বাড়িতে যান। এখন বাবা—মার সামনে কী বলে যে দাঁড়াব—,’ রিসিভার রাখার শব্দ হল।

‘কী বলল? সমীরণ মিত্রের নাম করল বলে মনে হল?’ সেজোভাই টেবল থেকে নিজেকে টেনে তুলে বলল।

‘বলল, মালির সঙ্গে ওর একটা রিলেশন গ্রো করেছে। সমীরণ মিত্তিরের বাড়িতে যেতে বলল।’ ভটু দরজার দিকে যেতে যেতে বলল।

‘কিন্তু সব থেকে ভাইটাল পয়েন্ট হল, সুধাংশুবাবুই সব কিছুর মূলে।’ উকিল বড়োভাই ত্যারচা চোখে তাকাল সুধাংশুর দিকে। ‘তাই তো মিহির বলল।’

বুক শুকিয়ে গেল সুধাংশুর। কথাটা তো সত্যিই। সমীরণের সঙ্গে আলাপ তো তারাই করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তারপর ওদের মধ্যে যদি কিছু হয়ে থাকে তা হলে কি তিনি বা উমা দায়ী হবেন?

‘এটা আপনার করানো উচিত হয়নি। একটা বদমাশ লোকের সঙ্গে, ভাইঝি বলে বলছি না, সুন্দরী একটা মেয়ের আলাপ করিয়ে দেওয়ার আগে আপনার দু—বার ভেবে দেখা উচিত ছিল।’ বড়োভাইয়ের গলা ভরাট এবং খুবই সূক্ষ্ম একটা হুমকিও যেন রয়েছে।

‘তা হলে আমার এখন কী করার আছে?’ কাতর স্বরে সুধাংশু বললেন। এখন তিনি সত্যিই ভীত।

‘আপনি বরং সমীরণ মিত্তিরকে একটা ফোন করুন।’ ভটু সুপারিশ করল। ‘আগে জেনে নিন লোকটা বাড়িতে আছে কি না।’

‘কিন্তু ওর ফোন নম্বর তো আমার কাছে নেই, বাড়িতে রয়েছে।’

‘দাঁড়ান দাঁড়ান, অবুর গানের স্কুলের বিলে ফোন নম্বর আছে। ওটা নিশ্চয় ওর বাড়িরই ফোন।’ সেজোভাই প্রায় ছুটেই দোতলার উদ্দেশে রওনা দিল।

.

কেশব সেন স্ট্রিট দিয়ে লাল পতাকা হাতে একটা মিছিল স্লোগান দিতে দিতে রাজাবাজারের দিকে আসছে। হিন্দু—মুসলমান সম্প্রীতি রক্ষার জন্য আবেদন জানানো হচ্ছে। মালবিকা মিছিলটার পাশ দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল। এবার আমহার্স্ট স্ট্রিটে একটা পথসভা। ফুটপাথে মাইকের সামনে একটি লোক। তিনরঙা দুটো পতাকা ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা। ভিড় করে লোকজন শুনছে। ‘সারা দেশের পরিস্থিতি এখন উদবেগজনক। যে ধর্মীয় উন্মাদনা দেশকে আজ অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আঘাত হেনেছে, তার বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে…’ সভার পাশ কাটিয়ে মালবিকা দ্রুত এগিয়ে গেল। স্লোগান বক্তৃতা কিছুতেই তার দরকার নেই, কানে ঢোকাতেও চাইল না। তাই নিজের পরিস্থিতিই উদবেগজনক হয়ে রয়েছে। বাবরি মসজিদ রইল কি ভেঙে পড়ল তাই নিয়ে এই মুহূর্তে তার মাথাব্যথা নেই। সমীরণের বাড়িতে ঢুকে পড়া ছাড়া আর কিছু সে ভাবতে চায় না।

দূর থেকেই সে দেখতে পেল বাড়ির সামনে গাড়িটা নেই। তার মানে শিঞ্জিনীও নেই। সায়ন্তনও নেই, অবনীও তা হলে নেই। রাস্তার দিকে সরে এসে মুখ তুলে দেখল বসার ঘরে আলো জ্বলছে। মালবিকার বুকের মধ্য থেকে চাপটা সরে গেল। সে কলিংবেলের বোতাম টিপল।

জানলার পর্দা সরিয়ে অপরিচিত একটা মুখ উঁকি দিয়ে বলল, ‘কে?’

‘সমীরণদা আছেন?’

মুখটা ঘুরিয়ে লোকটি কার সঙ্গে কথা বলে নীচে তাকিয়ে বলল, ‘দাঁড়ান।’

মালবিকা রাস্তার দু—দিকে তাকাল। একটা পুলিশের জিপ যাওয়াকে যদি ‘উদবেগজনক’ ভাবা না যায় তা হলে রাস্তাটা অন্য যেকোনো দিনের মতোই। সে গভীর স্বস্তি বোধ করল।

‘আসুন, উনি আছেন।’

সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় লোকটি বলল ‘সমীরণদার শরীরটা ভালো নেই, টেম্পারেচার উঠেছে একশোয়।’

মালবিকার স্বস্তি বোধটা নষ্ট হয়ে গেল সমীরণের জ্বর হয়েছে শুনে। হঠাৎ—ই তার মনে হল, এটা যেন অশুভ লক্ষণ। কেন যে মনে হল তা সে জানে না।

‘কাল আবার কাঁচরাপাড়ায় ওনার একটা আসর আছে, কী যে হবে।’

লোকটির কথা বলার ধরন দেখে মালবিকার মনে হল কাঁচরাপাড়ার আসরের একজন উদ্যোক্তা এবং সমীরণের বশংবদদের একজন। একে সে কখনো দেখেনি। দোতলায় বসার ঘরের পর্দা সরানো। সমীরণ সোফায় পা তুলে বসে, গায়ে জড়ানো সাদা শাল। আরও লোক রয়েছে। স্বামী, স্ত্রী ও একটা বাচ্চচা মেয়ে।

মালবিকাকে দেখে সমীরণের কোনো ভাবান্তর ঘটল না। বরং চোখটা দু—সেকেন্ডের জন্য কুঁচকে উঠল। মালবিকার চোখে সেটা এড়াল না। মলিন হয়ে গেল তার অভ্যন্তর।

‘তুমি পাশের ঘরে বোসো, আমি এদের সঙ্গে কথা বলে নি।’

সমীরণের গলা শুকানো। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে জ্বর হয়েছে, শরীর দুর্বল। মালবিকা পাশের শোবার ঘরে এল। ঘরে আসবাব প্রায় কিছুই নেই। ড্রেসিং টেবল, আলমারি, কাঠের ওয়ার্ডরোব, দুটো ছোটো টুল, টেবল, কাচের পাল্লার দেয়াল আলমারিতে রাখা সামগ্রী, টিভি সেট, টেপ রেকর্ডার, অজস্র ক্যাসেট, ভি সি আর সবই অদৃশ্য হয়েছে। কাঠের খাটটার জায়গায় রয়েছে লোহার খাট। হাসপাতালে যেমন দেখা যায়, মাথার ও পায়ের দিকে সারি দেওয়া সরু লোহার রেলিং। পুরোনো রবার ফোমের তোশকটা খাটে পাতা, তার উপর নতুন রঙিন চাদর। খাটটায় নতুন রং। সিলিং পাখা, আর পর্দাগুলো শিঞ্জিনী নিয়ে যায়নি। আর নিয়ে যায়নি টেলিফোনটা।

মালবিকা খাটে বসল। ঘরটাকে এখন বড়ো মনে হচ্ছে, ফাঁকা লাগছে। কাপড়ের মোড়ক আর হাতব্যাগটা পাশে রাখল। ঘরে চোখ বুলিয়ে তার মনে হল সমীরণ পাকাপাকি এখানে থাকবে না। হঠাৎ প্রয়োজনে এক রাত বা এক দিন থেকে যেতে হলে, থাকার কাজ চালানোর মতো ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। বসার ঘরের কোনো জিনিস বোধহয় সরানো হয়নি।

সমীরণ ঘরে ঢুকল। ব্যগ্র চোখে মালবিকা প্রথমেই বলল, ‘আমি চলে এসেছি, একেবারে।’

বিব্রত ভাবটা চট করে লুকিয়ে ফেলল সমীরণ। চিন্তিত স্বরে বলল, ‘না এলেই ভালো করতে। হাঙ্গামা বাধার ভয় আছে। শুনছি কাল বাংলা বনধ, কংগ্রেস বামফ্রন্ট দু—দলই ডেকেছে। ওরা আজই কিনা পার্ক সার্কাস গেল। …মুসলমান পাড়া, পাশেই বস্তি।’

অবশ হয়ে আসছে মালবিকার হাত—পা। ঠোঁট দুটো টেনে যে একটু হাসির ভাব ফোটাবে সে ক্ষমতাও যেন নেই। ‘তা হলে…তা হলে কি—’

‘তুমি এসেছ যখন থাকো। আমার সকাল থেকেই কেমন জ্বর জ্বর ভাব।’ সমীরণ এগিয়ে এসে মালবিকার দুই কাঁধ ধরে ঝুঁকে পড়ল চুমু খাবার জন্য। মুখে মদের গন্ধ। মালবিকা আকুলভাবে দু—হাতে গলা জড়িয়ে সমীরণের ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ঘষতে ঘষতে বলল, ‘আমাকে তুমি ছেড়ে যেয়ো না।…সমীরণ আমার সমীরণ। মরে যাব সমীরণ—’, সে কামড়ে ধরল সমীরণের দুই ঠোঁট। মুখের মধ্যে নিয়ে চুষতে লাগল।

‘উহহ।’ মালবিকাকে ধাক্কা দিয়ে সমীরণ পিছিয়ে গিয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল। কর্কশ স্বরে বলল, ‘থাক এখন। পাশের ঘরে লোক রয়েছে।’ ঘর থেকে সে বেরিয়ে গেল।

সিঁড়ি দিয়ে একটি লোক দুড়দুড়িয়ে উঠে এসে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ‘সমীরণদা, কাল বাংলা বনধ, বাজার—টাজার করে রাখুন। দিন আমায় টাকা দিন।’

‘বাজার তো আনবি, রাঁধবে কে?’

‘সে হয়ে যাবে, আমি এসে রেঁধে দোব।’

‘তোকে আর আসতে হবে না, লোক আছে আমার। চাল, ডাল, মাছ, আনাজ সবই ফ্রিজে আছে। একটা দিন হয়ে যাবে তুই বরং—’

শোবার ঘরে এল সমীরণ। পিছনে এক যুবক। মালবিকা খাটে হেলান দিয়ে একদৃষ্টে সামনের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। সমীরণ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ফিস ফিস করে বলল, ‘মাল প্রায় শেষ, আজ রাতের মতো শুধু আছে। তুই চট করে বড়ো দুটো বোতল এনে দে। দেরি করিসনি, দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। কী খাই জানিস তো?’

সে পকেট থেকে পার্স বার করে তিনটে একশো টাকার নোট যুবকটির হাতে দিয়ে আবার বসার ঘরে ফিরে গেল।

‘গৌরী, তোমরা আর দেরি কোরো না। বাচ্চচা মেয়ে সঙ্গে রয়েছে, শুনলে তো কাল বাংলা বনধ…সুবোধের কাছেই শেখো। কীর্তনটা ও ভালো জানে, যত্ন করে শেখায়ও।’

মালবিকা বসার ঘর থেকে সমীরণের কথা শুনতে পাচ্ছে। একটু আগের কর্কশ গলাটা বদলে গেছে। স্নেহে ভরা ঘর। কাঁধে জোরেই ধাক্কাটা দিয়েছে সমীরণ। ধাক্কাটার মধ্য দিয়ে বিরক্তি অনিচ্ছুক ভাব বেরিয়ে এসেছে। অভিমানে ছেয়ে যাচ্ছে মালবিকা।

সমীরণ শোবার ঘরে এল।

‘সবাইকে বিদেয় করা গেছে।’ দেয়াল আলমারি থেকে একটা বড়োমাপের বোতল বার করে সে চোখের সামনে ধরে দেখল কতটা আর বাকি আছে। একটা গ্লাসও বার করল। মালবিকা দেখতে পায়নি এগুলো আলমারিতেই ছিল। গ্লাসই রাখার মতো শক্ত জায়গা ঘরে নেই।

‘ধরো এটা।’ গ্লাসটা বাড়িয়ে দিতেই মালবিকা ধরল। ঢাকনা খুলে বোতলটা উপুড় করে ধরল গ্লাসে। আধ গ্লাস ভরল। ঢাকনাটা লাগিয়ে সমীরণ গ্লাসটা হাতে নিল।

‘জল এনে দোব।’

‘ধেত জল।’ বড়ো বড়ো দুটো ঢোঁকে সমীরণ অর্ধেকটা পেটে চালান করে চোখ বন্ধ করল। মুখটা বিকৃত হয়ে রয়েছে। মুখে রক্ত ছুটে আসায় চামড়ার রং বদলে যাচ্ছে।

‘জ্বরটা বোধহয় আবার বাড়বে।’

‘তা হলে খেয়ো না।’ মালবিকা গ্লাসটা নেবার জন্য হাত বাড়াল। সমীরণ হাত সরিয়ে নিয়ে আবার দুটি ঢোঁকে গ্লাস খালি করে দিল। খালি বোতল আর গ্লাস আলমারিতে রেখে সে খাটে বসল। পাশ বালিশটা টেনে কোলে তুলে নিয়ে, ঝুঁকে মালবিকার মুখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। একটু একটু করে ঝিমিয়ে আসছে তার চাহনি।

মালবিকা যা আশা করেছিল তা ঘটল না। সে ভেবেছিল সমীরণ খুশিতে উচ্ছল হয়ে উঠবে। দু—হাতে বুকে জড়িয়ে ধরবে, তাকে নিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়বে। আদরে আদরে বিধ্বস্ত করে দেবে। কিন্তু কোথায় কী? তার বাবার মতোই একটা মাতাল। ছাপোষা গেরস্ত। এর মধ্যে তার প্রেমিক সমীরণ কোথায়?

ফোন বেজে উঠল। মালবিকা উঠে ফোন ধরতে যেতেই হাত তুলল সমীরণ। ‘আমি ধরছি। ফোন তুমি ধরবে না।’

খাট থেকে নেমেই টলে গেল। সামলে নিয়ে সমীরণ রিসিভার তুলল।

‘হ্যালো, কে শিঞ্জিনী? কোথা থেকে ফোন করছ…অ। ওখানে অবস্থা কেমন? য়্যা গোলমাল হবার ভয় রয়েছে? শান্ত কোথায়? শিগগিরি ওকে ডেকে আনো। না না একতলার ফ্ল্যাটেও যাবে না, কোথাও যাবে না, ঘরে বসে থাকবে, বারান্দায় বেরোবে না।… হ্যাঁ হ্যাঁ, কিন্তু একতলার লোকেরা চলে যাবে কী করে, কাল তো বাংলা বনধ, গাড়ি চলবে না।…তুমিই বা এখানে আসবে কী করে?…ফ্ল্যাট কেনার সময় আমি কি জানতুম বাবরি মসজিদটাকে ভেঙে দেওয়া হবে? এখন আমাকে ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছ কেন, ইডিয়ট। তুমিই তো জেদ ধরেছিলে…গালাগাল আবার কী, এখনও তো মুখ খুলিনি। কিছু যদি ঘটে যায়, শান্তর যদি কিছু হয় তা হলে তোমাকে লাথি মেরে তাড়াব। সবই তো হাতিয়ে নিয়েছ। ছেলেকে আমি ছাড়ব না…আচ্ছা আচ্ছা দেখা যাবে। আমি মাগিবাজি করি কী ঠাকুরপুজো করি তাতে তোমার বাপের কী? যা বললুম, এখনই ওকে ঘরে নিয়ে এসো। ছটফটে ছেলে কখন রাস্তায় বেরিয়ে যাবে বলা যায় না। চোখে চোখে রাখবে। পরশু দিন ভোরেই ওকে নিয়ে চলে আসবে।’

রিসিভার রেখে সমীরণ ঘাড় নামিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ দুটো রাগে জ্বলছে। অল্প টলছে। দু—পা এগিয়ে মালবিকার থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে দিল।

‘কাল তো কল্যাণী যাওয়া হবে না।’

‘জানি।’

‘এখনও রাত হয়নি। তুমি বাড়ি চলে যাও।’ স্বর বিকৃত জড়িয়ে যাওয়ার জন্য।

‘কী বলছ তুমি!’ মালবিকা উঠে দাঁড়াল।

‘ঠিকই বলছি। কাল বনধ। পরশু ভোরেই বউ ছেলে এসে যাবে। তখন কী হবে? য়্যা কী হবে? বড়ো খচ্চচর মাগি, আমাকে ছাড়বেও না আবার ছাড়ারও ভয় দেখায়।’

‘আমরা খুব ভোরে কল্যাণী চলে যাব।’ মরিয়া হয়ে মালবিকা বলল, ‘ওরা আসার আগেই চলে যাব।’

সমীরণ মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘হয় না। ভোরে আমার ঘুম ভাঙে না।’

‘আমি ভাঙিয়ে দোব।’

‘ধ্যাততেরি। জ্বরটা আবার বাড়ছে। …তুমিও তো দেখছি আর একটা শিঞ্জিনী।’

ফোন বেজে উঠল। সমীরণ চমকে উঠে মাথা ঝাঁকাল। ‘আবার কেন?’ বলে রিসিভার তুলল।

‘হ্যালো,…হ্যাঁ সমীরণ মিত্তির বলছি, আপনি কে …কী বললেন? জোরে বলুন…সুধাংশু গাঙ্গুলি? আরে মেসোমশাই! ….য়্যাঁ মালবিকাকে পাওয়া যাচ্ছে না? হারিয়ে গেছে?…অ, আপনার বাড়ি থেকে। তা আমাকে ফোন করছেন কেন, আমি কী ওকে হরণ করে নিয়ে এসেছি?’ সমীরণ আর দাঁড়াতে পারছে না, খাটে বসল। ‘মিহির বলল? শুয়োরের বাচ্চচার তো গাধার মতো গলা। ও বলল আর অমনি আপনি আমাকে ফোন করলেন! মেসোমশাই, আপনিও একটা শুয়োরের বাচ্চচা। মালবিকা কচিখুকি নয় যে বলামাত্র সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসবে। আপনি বিনা প্রমাণেই আমাকে ক্রিমিনাল বানিয়ে দিলেন? এটা কী কোনো ভদ্দরলোকের, শিক্ষিত লোকের পক্ষে সম্ভব না শুয়োরের বাচ্চচার পক্ষে সম্ভব? বলুন, আপনিই? বিচার করুন। …আরে বাবা না না, মালবিকা অবলা বালিকা নয়, খুব বুদ্ধি ধরে। …আমি ওকে পটাব কী ওই আমায় পটিয়ে দেবে। আপনি যে সন্দেহটা করছেন তার কোনো কি যুক্তি আছে? ওকে ভাগিয়ে এনে আমি করবটা কী? শুধু যৌবন দিয়ে তো চিরকাল চলে না! দেখুন পাড়ার কোনো ছোকরার সঙ্গে সটকান দিয়েছে…আরে দূর, গানফান ওর দ্বারা হবে না। ফুটপাথে যেসব জলসা হয়, হিন্দি ফিল্মি গানার সঙ্গে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে মাইক হাতে নিয়ে, ওইসব গানেই ও নাম করতে পারবে। আপনি বরং পুলিশেই খবর দিন। …কী বললেন পুলিশ এখন এসব কেস নেবে না? …বাবরি মসজিদ? আরে মেসোমশাই ওই বাবরিই তো আপসেট করে দিল। কালকের বাংলা বনধটাও তা হলে হত না। কাল কাঁচরাপাড়ায় গান ছিল, কল্যাণী যাবার কথা ছিল। …না না বিশ্বাস করুন, লেখাপড়া করেনি। গানের ‘গ’ জানে না, আমি ওকে নিয়ে কী করব…খারাপ কথা আপনাকে বলেছি, আমাকে ক্ষমা করবেন, আপনার পায়ে ধরে মাপ চেয়ে নোব। মাসিমা ভালো—’

হাত বাড়িয়ে রিসিভার রেখে দিয়ে আপন মনে বলল, ‘শালা কেটে দিল।’ ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে টলে পড়ছিল। মালবিকার কাঁধ ধরে সামলে ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে গেল। যদি সে মালবিকার দিকে তাকাত তা হলে দেখতে পেত, অপমানে লজ্জায় আর নিজের নির্বুদ্ধিতা বুঝতে পারা কালো একটা নিথর মুখ। চোখের পলক পড়ছে না শুধু দু—চোখ বেয়ে জল ঝরছে।

যুবকটি দু—বোতল মদ নিয়ে আসতেই সমীরণ বলল, ‘খোল। দুটো গ্লাস আন।’

‘না না সমীরণদা আমি খাব না।’

‘যা বলছি কর। গ্লাস আন, রান্নাঘরে দেখ গিয়ে।’

আধঘণ্টা পর সমীরণ শোবার ঘরে এল। পাথর হয়ে গেছে তার শরীর। খাড়া অবস্থায় দাঁড়াল মালবিকার সামনে। তার চাহনিতে মৃত অভিব্যক্তি।

‘রান্না হয়েছে?’

মালবিকা শুধু তাকিয়ে রইল।

‘এটা কী? হাটাও, আমি শোব।’ সমীরণ শাড়িটা মেঝেয় ফেলে দিল।

‘নীচের দরজায় খিল দিয়ে এসো। করসেবকরা ঢুকে পড়ে যদি?…কথা কানে গেল না। লাথি খাবি?’

হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল মালবিকা। দাঁড়িয়ে উঠে দু—হাতে জড়িয়ে ধরল সমীরণকে।

‘আমি সত্যিই তোমায় ভালোবাসি, আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার কোরো না, আমার কষ্ট লাগছে। আমি তোমায় সত্যিই ভালোবাসি, ভালোবাসি। সমীরণ তুমি আমার, আমার।’

‘কে তোর? সমীরণ মিত্তির? আমি শালা কারুর নই, শুধু আমার ছেলের, শান্তর। ওকে চিনিস? সায়ন্তন মিত্তির, আমার দেওয়া নাম। তুই শালি কে? কী বললুম যেন, হ্যাঁ, সদর দরজায় খিল দিয়ায়। কাল বাড়ি চলে যাবি, বনধ তো কী হয়েছে, হেঁটে চলে যাবি।’

‘সমীরণ তুমি আমায় এইভাবে বললে? তোমার জন্য আমি কী কাজ করেছি তা কি তুমি জানো?’ মালবিকা হিংস্র চাপা গলায় বলল। ‘নিজেকে আজ সর্বনাশের মধ্যে টেনে এনেছি তোমার জন্য, শুধু তোমার জন্য।’

কথাগুলো বোধহয় সমীরণের কানে ঢুকল না। বিছানায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে কোনোক্রমে বালিশটা মাথায় লাগিয়ে চিত হয়ে শুল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল।

মালবিকা একতলার দরজায় খিল দিয়ে এল। বসার ঘরের আলো নেভাল। বারান্দার আলো জ্বেলে রেখে শোবার ঘরের আলো নেভাল। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে রাস্তার আলো ঘরে আসছে একটা লম্বা সাদা লাঠির মতো। সিঁড়ির আলো পড়ছে ঘরের দরজার কাছে। একটা আবছা অন্ধকার ঘরটায়। মালবিকা খাটের কোণে পা ঝুলিয়ে বসে। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে সমীরণের মুখের দিকে। মুখটা দেখা যাচ্ছে না। ভারী নিশ্বাসে বুকটা ওঠানামা করছে।

ভোর রাতে মালবিকা খাট থেকে নামল। আইবুড়ো ভাতের শাড়িটা নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে বাঁটিতে দু—টুকরো করল। আবার ঘরে ফিরে এল। কিছুক্ষণ সমীরণের নিথর শরীরটার দিকে তাকিয়ে রইল। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক। ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেছে।

আবার দু—চোখ বেয়ে জল নামল মালবিকার। গাল থেকে চিবুক পর্যন্ত জলের ধারা। শুধু একবার ফুঁপিয়ে উঠেই মুখটা কঠিন হয়ে গেল। সন্তর্পণে সে সমীরণের দুটি হাত মাথার দিকে তুলে নিয়ে শাড়ির একটা টুকরো দিয়ে খাটের রেলিংয়ে বাঁধল। পা দুটি জড়ো করে শাড়ির অন্য টুকরোটা দিয়ে বেঁধে সেটা রেলিংয়ে বাঁধল।

সমীরণ একটা ন্যাকড়ার পুতুলের মতো চিত হয়ে গভীর ঘুমে অচেতন। সে জানতেও পারল না কী ভয়ংকর অবস্থার দিকে সে চলেছে। মালবিকা পাশ—বালিশটা ওর মুখের ওপর রেখে বুকের উপর বসল সমীরণের দুই পাঁজরের পাশে দুই ঊরু রেখে এবং বালিশটা মুখে চেপে ধরল।

ছটফটিয়ে উঠল সমীরণ। হাত—পা বাঁধা। টানাটানি করার সঙ্গে তলপেটটা তোলানামা করতে লাগল। বালিশটার তলায় গোঁ গোঁ একটা শব্দ হচ্ছে। মুখটা ডাইনে বাঁয়ে নাড়াবার চেষ্টা চলছে।

একটা লোক মারা যাচ্ছে। মালবিকা অবাক হয়ে দেখছে। একটা লোককে সে নিজের হাতে মেরে ফেলছে। কিন্তু কেন?

মালবিকার হাতের চাপ আলগা হয়ে গেল।

কিন্তু কেন সে মারছে!

মালবিকা বালিশটা তুলে নিল। সে তো ঠিক করেছিল এই শাড়িটা গলায় বেঁধে পাখা থেকে ঝুলে পড়বে। তা হলে সে সিদ্ধান্তটা বদলাল কেন?

সে তো নিজেকেই শাস্তি দেবে বলে মরতে চেয়েছিল।

‘আমায় খুন করছ মালবিকা?’ ধীর শান্ত স্বরে সমীরণ বলল, যেটা প্রশ্ন নয়, অনেকটা বিবৃতি দেবার ধরন তার স্বরে।

বুকের উপর থেকে মালবিকা নামল। জানলায় গিয়ে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাল। আবছা প্রভাতী আলোয়, ঠান্ডা মনোরম বাতাসে খুব সুন্দর একটা ভোর ফুটে উঠছে।

.

দু—মিনিট পর সদর দরজার খিল খুলে মালবিকা বেরিয়ে এল। দু—পাশে একবার তাকিয়ে দ্রুত পায়ে সে নিজেকে শাস্তি দেবার জন্য বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল।

.

নির্দিষ্ট দিনেই মিহির ও মালবিকার বিয়ে হয়েছে।

স্বর্ণকুমারী

এক

উনিশশো বিরানব্বই এর ২৫ মে, শুক্রবার বোম্বাই—আহমেদাবাদ—লখনৌ—পাটনা— কলকাতা, উড়াল নম্বর ২৯৬—এর বোয়িং ৭৩৭ দমদম টারম্যাকে চাকা ছোঁয়াল ছটা পঞ্চান্নয়। ছোঁয়াবার কথা পাঁচটা পঁচিশে।

বিমান থেকে বেরিয়েই সিঁড়ির মাথায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদের মুখের চামড়া সিরসির করে উঠছে গরমে। বিমান নামার আগেই এয়ার হোস্টেস জানিয়ে দিয়েছিল, বাইরের তাপমান ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

বিমান থেকে যাত্রীরা হেঁটে অ্যারাইভাল লাউঞ্জে পৌঁছল। যাদের লাগেজ সংগ্রহ করা দরকার তারা কনভেয়রের কাছে অপেক্ষা করতে লাগল। যাদের সেই প্রয়োজন নেই তারা বেরিয়ে গেল। তাদের সঙ্গেই বেরিয়ে এল মাঝারি উচ্চচতার একটি লোক। তার কাঁধে সবুজ ক্যারি ব্যাগ, চোখে গাঢ়, সান গ্লাস, ধূসর রঙের জ্যাকেট, গোড়ালির ইঞ্চি চারেক উপরে ট্রাউজার্স, লাল মোজা এবং মেরুন স্পোর্টস শ্যু। রেশমের মতো হালকা পাতলা একমাথা অবিন্যস্ত কালো চুলের কিছুটা কপালের উপর ঝুঁকে পড়েছে। মুখের তামাটে চামড়ার নীচে পেশির শক্ত ভাঁজ। চলনে মাথা ও কাঁধ সামনে ঈষৎ ঝোঁকানো, পদক্ষেপে ব্যস্ততা এবং ব্যক্তিত্বের সমন্বয়।

লোকটি চারদিকে তাকিয়ে অবশেষে এনকোয়ারি কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে জ্যাকেটের পকেট থেকে ডানহিল সিগারেটের প্যাকেট বের করল।

কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে লোকটিকে লক্ষ্য করছিল এক তরুণী। দীর্ঘাঙ্গী সুঠাম তন্বী গড়ন। স্লিভলেস খয়েরি ব্লাউজের নীচের প্রান্ত ও শাড়ির কোমরের প্রান্তের মধ্যে অন্তত একফুট অনাবৃত রয়েছে মেদহীন কিন্তু পেলব মধ্যদেশ। চোয়াল দুটি ছড়ান, ওষ্ঠদুটি ছোটো এবং পুষ্ট, বক্ষ দুটি উন্নত এবং দৃঢ়। চুল পুরুষদের মতোই প্রায় ছোটো করে কাটা, একপাশে সিঁথি। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম, গোলাকার চোখের মণিতে পিঙ্গলের আভাস। তার কাঁধ থেকে চামড়ার পটিতে ঝোলান ব্যাগটি প্রায় নিতম্বের কাছে নেমে এসেছে। খয়েরি রেশমের শাড়ি দেহের সঙ্গে লেপটে থাকায় তার নিতম্বের বতুলতা ও দৃঢ় বদ্ধতা মনোরমভাবে প্রকট। ডানহাতে একটি সোনালি ঘড়ি এবং দুই কানের লতিতে বিন্দুর মতো দুটি মুক্তো ছাড়া দেহে কোনো আভরণ নেই।

তরুণীটি তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে লক্ষ করছিল লোকটিকে। এইবার এগিয়ে এল।

‘আপনি মি. অরোরা?’

লোকটি চমকাল না। শুধু শরীরটা মুচড়ে পাশ ফিরল। ‘ইয়েস… রাহুল অরোরা। আপনি বোধহয় অর্জুন হালদারের…।’

তরুণীর চাহনিতে সমর্থন ফুটে উঠল। হালকা গোলাপি লিপস্টিক মাখা ঠোঁট ছড়িয়ে, গালে টোল ফেলে বলল, ‘প্রাইভেট সেক্রেটারি, রাধিকা পাইন।’

‘অর্জুন বলেছিল রিসিভ করার জন্য একজন থাকবে, কিন্তু সে যে এমন মনোরম একজন হবে ভাবতে পারিনি।’ রাহুল সিগারেট ধরাতে ধরাতে কালো কাচের মধ্য দিয়ে রাধিকার দেহ জরিপ করে নিল। রাধিকার অবশ্য অনুমান করে নিতে মুহূর্তেরও দেরি হল না, তার বস—এর এই বন্ধুটি সিগারেট ধরাতে এত সময় নিচ্ছে কেন!

‘চলুন’। রাহুল প্রথম ধোঁয়াটি ছেড়ে বলল। ‘ফ্লাইট দেড় ঘণ্টা লেট, তার ওপর অসহ্য এই ভ্যাপসা গরম। এই সময় কেউ কলকাতায় আসে। পৌঁছেই গলা পর্যন্ত ডুবে থাকব বাথটাবে।’

‘মি. হালদারের ছাদে একটা মিনি পুল আছে।’ এয়ারপোর্ট বাড়িটার বাইরে এসে ওরা গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে। অর্জুন হালদারের সাদা মার্সিডিজ ওদের দেখতে পেয়ে পার্কিং লট থেকে এগিয়ে আসছে।

‘জল তো টগবগ করে ফুটছে এখন। ৩৯ ডিগ্রি! ভাবা যায়?’

‘পুলের উপর শেড আছে, জল ঠান্ডা রাখারও ব্যবস্থা আছে।’

‘সত্যি! আহহ, শুনেই পাঁচ ডিগ্রি গরম কমে গেল।’

রাহুল এই বলেই জিপার টেনে জ্যাকেটটার বুক খুলে ফেলল। ভিতরে সবুজ রঙের পোলোনেক স্পোর্টস শার্ট। বুকে সাদা ছাপে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা: আই অ্যাম মেকানিক্যালি ইনক্লাইনড, আই স্ক্রু এনিথিং।’

রাধিকা চোখ সরিয়ে নিয়ে মনে মনে হাসল। লোকটা প্লে বয় টাইপের। তার উপর নির্দেশ রয়েছে, একে খুশি রাখতে হবে। এই ঢিলেঢালা সুদর্শন, চল্লিশের কাছাকাছি বয়সি কোটিপতি লোকটি, রাহুল অরোরা অ্যাসোসিয়েটস নামে বিরাট বিপণন কোম্পানির মালিক। অফিস আছে ভারতের তিনটি শহরে। একটা স্পনসরশিপের ব্যাপার রাহুলকে দিয়ে হাশিল করাতে হবে। অর্জুন এর বেশি তাকে কিছু বলেনি। রাহুলের আর এ এ, সংক্ষেপে র‌্যা, এখন ভারতের একনম্বর মার্চেন্ডাইসিং সংস্থা। ৩৭ জন নামি লোককে ম্যানেজ করা, প্রোমোট করা, ইন্সিওর করার দায়িত্বে রয়েছে র‌্যা। এদের মধ্যে আছে টিভি, সিনেমা, ফ্যাশন, সঙ্গীত এমন কী খেলার সুপারস্টাররাও। এশিয়ার কয়েকটা দেশেও সম্প্রতি ব্যবসা পেয়েছে। অত্যন্ত ব্যস্ত লোক। অর্জুনের মতোই অবিবাহিত।

রাহুলের বোম্বাইয়ের ফ্ল্যাটে অর্জুন টেলিফোনে সাত দিন আগে বলেছিল, ‘একটা বিজনেসের খবর আছে। শুক্রবার কি শনিবার আসতে পারবে কলকাতা? তা হলে রবিবারটা কাটিয়ে সোমবার চলে যেতে পার। জানি জানি খুব ব্যস্ত তুমি, তবে এলে কিন্তু ঠকবে না। একটা অদ্ভুত ধরনের ডীল হতে পারে। এখন সেটা তোমায় বলব না, জানই তো আমি ফোনে এই ধরনের ব্যাপারে কথাবার্তা বলি না। শুক্রবারই তা হলে এসো, বিকেলের ফ্লাইটে, দু—তিন দিনের একটা লং উইকয়েন্ড কাটান যাবে।’

রাহুল রাজি হয়ে গেছিল। তার ধারণা হয়, অর্জুন বোধহয় পেশাদারি সার্কিটে নাম এবং টাকা করার ইচ্ছা হয়েছে এমন কোনো গজল গাইয়ে বা ভরতনাট্যম নাচিয়ের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। হয়তো শনিবার কোনো অনুষ্ঠানে গান গাইবে বা নাচবে, সেটা শুনতে বা দেখতে যেতে হবে। ঘাড় নাড়তে হবে, মুখে ‘আহা আহা’ বলতে হবে তারপর তার এজেন্ট হবার জন্য রাজি হতে হবে। খদ্দের ধরার জন্য অন্তত সাত আটটা এজেন্সির লোক এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি ফার্ম, কনস্ট্রাকসান ফার্ম ছাড়াও ডুয়ার্সে অর্জুনের চা—বাগান আছে, ঘাটশিলায় মাইকার খনি আছে, বোম্বাইয়ে দুটি হোটেলের এক—তৃতীয়াংশ শেয়ার তারই। কিন্তু ললিত কলা, ক্ল্যাসিকাল গান ও নাচ সম্পর্কেও সে সমঝদার। হয়তো নতুন কোনো প্রতিভার দেখা পেয়ে তাকে ডেকে পাঠিয়েছে।

মোটরে রাহুল জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আপনমনে সিগারেট টেনে যাচ্ছে। একসময় বলল, ‘দশ বছর আগেও যা দেখেছিলাম আজও তাই। শুধু কিছু বাড়ি তৈরি হয়েছে আর প্রাইভেট বাসের সংখ্যা বেড়েছে।’

রাধিকা একবার বাইরে তাকিয়ে হেসে শুধু মাথা নাড়ল। শুধু চাকরির কারণেই তার মাথা নাড়া নয়, রাহুলের কথায় সত্যতাও আছে।

‘কলকাতার বয়স এখন তিনশো দুই, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার বাপ—ঠাকুরদা এখানেই ব্যবসা করেছে, আমি কলেজ জীবন পর্যন্ত এখানে ছিলাম। নকশাল পিরিয়াডে কানাডা চলে যাই। তখন থেকে আজ পর্যন্ত একটুও উন্নতি হয়নি এই শহরটার শুধু মেট্রো রেল হওয়া ছাড়া।’

‘আপনি আর মি. হালদার তো একসঙ্গে কলেজে পড়েছেন?’

‘হ্যাঁ। অর্জুন ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। পৈতৃক চা—বাগান, বাবার ইঞ্জিনিয়ারিং কনসালটেন্সি ফার্ম, ল্যান্ড স্পেকুলেশন বিজনেস, বড়োলোকই ছিল। এখন তো আরও রিচ। আমাকে খুব সাহায্য করেছে। শুধু পড়াশুনোতেই নয়, এখন যে ব্যাবসা করছি তাতেও। ও আমার সব থেকে পুরোনো বন্ধু, ও আমার স্বভাব ভালোই জানে।’

কথা বলতে বলতে রাহুল আড়চোখে রাধিকার দিকে তাকাচ্ছিল। এবং কেন তাকাচ্ছে সেটা বুঝতে পেরে রাধিকা শরীরটা সামান্য এলিয়ে দু—হাত দিয়ে চুল ঠিক করায় ব্যস্ত হল। আবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে নিজের ভাবনায় ডুবে যাবার আগে রাহুলের ঠোঁট চাপা হাসিতে মুচড়ে গেল।

আলিপুরে অর্জুনের বাড়িতে তারা পৌঁছল প্রায় সাড়ে আটটায়। উঁচু পাঁচিল ঘেরা বাড়ির গেট দিয়ে সোজা গিয়েই পোর্টিকো, বাঁ দিকে সবুজ মখমলের মতো ঘাসের জমি। সেখানে বেতের চেয়ার ও টেবল পাতা। কিন্তু কোনো লোক নেই।

দোতলায় অর্জুন অপেক্ষা করছিল। রাহুল তার ক্যারি ব্যাগটা হাত বাড়ানো চাকরের হাতে না দিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে দোতলায় উঠে এল।

‘প্লেন ডিলেড?’ সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল অর্জুন। সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পরা, পাট করে আঁচড়ানো চুল। স্নান এইমাত্র বোধহয় সারা হয়েছে।

‘ডিলেড তো বটেই! আগে স্নান তারপর কথা।’

‘ঘরে গিয়ে আগে পালটে নাও, লুঙ্গি রেখে দিয়েছি।’

‘আহহ এই হল অর্জুন!’ রাহুল মুখ ঘুরিয়ে পাশে দাঁড়ান রাধিকাকে খবরটা দিল। ‘আমার ফেভারিট জিনিসগুলোর কথা ঠিক জানে।’

‘ছাদের পুলের ধারে ককটেল লাউঞ্জ। চিলড বিয়ার নিয়ে জলে গলা ডুবিয়ে থাকো। আধঘণ্টা পর দেখা হবে।’

অর্জুন হাত তুলে বারান্দার শেষপ্রান্তের ঘরটা রাহুলকে দেখাল। রাধিকার দিকে একবার তাকিয়ে শিস দিতে হিতে রাহুল ঘরের উদ্দেশ্যে এগোল।

‘কোনো অসুবিধে হয়নি?’ অর্জুন বলল।

‘না।’ রাধিকা নম্র জবাব দিল।

‘মানুষ ভালো, নিজের চেষ্টায় পরিশ্রমে বড়ো হয়েছে।’

‘একটু ছেলেমানুষি আছে।’

‘অত্যন্ত শ্রুড বিজনেস ব্রেইন। গত বছর ওর প্রি—ট্যাক্স টার্নওভার হয়েছে সতেরো কোটি টাকা। ওকে দেখে তা বুঝতে পারবে না।’

‘আমি কি আরও কিছুক্ষণ থাকব?’

‘অসুবিধে না থাকলে…।’

‘না না অসুবিধে নেই, বাড়িতে বলেই রেখেছি আজ ফিরতে দেরী হতে পারে।’

‘প্রত্যেক ঘরেই অ্যাটাচড বাথ আছে। যেকোনো একটায় গিয়ে তুমি স্নান করে নিতে পার। সত্যিই আজ গরমটা বিশ্রী রকমের।’

‘থ্যাঙ্ক ইয়ু স্যার।’

আধঘণ্টা পর দোতলার বারান্দা—ছাদে রাহুল ও অর্জুন বসল বিয়ার নিয়ে। রাধিকার হাতে টোম্যাটো জুস।

‘রাহুল তোমাকে কেন ডেকে এনেছি সেটা এইবার বলব—দেখো তুমি আমার অনেক সাহায্য করেছ। মালেশিয়ায় ওয়াটার রিজার্ভার তৈরির কনট্রাক্ট পাওয়ার ব্যাপারটায় তুমি যা…।’

‘অর্জুন আই টুক মাই কমিশন। শুধু শুধু কারুর উপকার আমি করি না।’

‘কাল কাগজে দেখলাম চেতন বড়ুয়া স্টকহলম ওপেনে আগাসির কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরেছে। চেতন তো র‌্যা—রই ছেলে?’

‘হ্যাঁ, হি ইজ অন দ্য বুকস। চার বছর আগে ওকে আমি নিয়েছিলাম। দেখো অর্জুন একটা সময় ছিল, প্লেয়াররা নাম করলে, গ্রাঁপ্রী জিতলে, সিডেড হলে তবেই ডানলপ বা স্ল্যাজেঞ্জার বা স্পলডিং কিংবা নাইকে বা অ্যাডিডাসরা এনডোর্সমেন্ট কনট্রাক্ট নিয়ে এগিয়ে আসত। ওসব এখন ইতিহাস হয়ে গেছে। এখন এত টুর্নামেন্ট যে কেউ আর হাত গুটিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করে থাকতে পারে না। থাকলে সে একটাও বড়ো প্লেয়ার শেষপর্যন্ত আর পাবে না। এখন হল, কোনো ইয়াং প্লেয়ারের মধ্যে সম্ভাবনা আছে বুঝলেই কনট্রাক্ট করে বেঁধে ফ্যালো। এখন কোটি কোটি টাকা টেনিসে। যেকোনো প্রমিসিং ইয়াং প্লেয়ারের পকেট ভরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট টাকা। চেতনকে আমি তুলে নিয়ে টাকা ঢেলেছি, প্রোমোটার, স্পনসরার জোগাড় করেছি। এখন মনে হচ্ছে খুব ভুল করিনি। ইউ এস ওপেন টাইটেল হোল্ডারের কাছে সিক্স—টু, সিক্স—সেভেন, টু—স্কিস, থ্রি—সিক্স হেরে যাওয়াটা খুব হতাশজনক নয়!”

‘চেতন বড়ুয়ার মতো আর কাউকে পেলে?’

‘ব্যাডমিন্টনে হরিয়ানা থেকে একটি মেয়ের আর গলফে পুনে থেকে একটি ছেলের খবর পেয়েছি। দেখেছি ওদের। কনট্রাক্ট করে নেব। দাবায় তোমার কলকাতার গ্র্যান্ড মাস্টার রজত চ্যাটার্জি আমার ক্লায়েন্ট। গত এক বছর তার পারফরম্যান্স ভালো নয়। চারটে জি এম টুর্নামেন্টে ফিফথের উপর প্লেস পায়নি।’

‘অন্য খেলার দিকে নজর দিচ্ছ না কেন?’

‘অন্য খেলা? সেখানে প্লেয়ার কোথায়? ফুটবলে, হকিতে, সাঁতারে—’ রাহুল তালিকা দিতে শুরু করল।

‘অ্যাথলেটিকসে যাচ্ছ না কেন?’

‘অ্যাথলেটিকস?’ অর্জুন যদি চোর—পুলিশ খেলার কথা বলত তাহলেও নয় রাহুল গুরুত্ব দিত। ‘কি বললে অ্যাথলেটিকস?’

‘হ্যাঁ, যাকে বলে দৌড়।’

‘ধুর। এতে এমনি কোনো টাকা নেই। এখনো অ্যামেচার স্পোর্টস। হ্যাঁ কার্ল লিউইস, এডুইন মোজেস, ড্যালি টমসন, গ্রেগ লুগানিস, বা ফ্লোরেন্স জয়নারের মতো অবিশ্বাস্য কিছু করতে পারলে, তাও যদি ওলিম্পিক গেমসের মতো স্টেজে, দুশো কোটি টিভি ভিউয়ারের সামনে করতে পারে তবেই টাকা। হ্যাঁ, কোটি টাকা আয় সম্ভব তো বটেই। কুড়ি বছর আগে মার্ক স্পিৎস সাতটা গোল্ড না জিতলে, কোনো সাঁতারুর পক্ষে কোটিপতি হওয়া সম্ভব, এটা এখনো কাউকে বোঝাত পারতে না। সোল ওলিম্পিকস থেকে এখন পর্যন্ত এই চার বছরে ফ্লোরেন্স জয়নার চার কোটির ওপর রোজগার করেছে শুধুই কি তার ফ্যান্টাস্টিক পারফরমেন্সের জন্য? তার গ্ল্যামার, তার সেক্স অ্যাপিল, তার ড্রেস ফ্যাশন, প্রেসের সঙ্গে তার কথাবার্তা, এইসবই তাকে বিরাট মার্চেন্ডাইসিং প্রোপোজিশন হিসাবে বানিয়ে তোলে। নয়তো অ্যাথলেটিকস আর সার্কাসে কোনো তফাত নেই।”

অর্জুন অবশ্য সহজে পিছু হঠার লোক নয়। রাহুলের খালি গ্লাসে বিয়ার ঢালতে ঢালতে বলল, ‘মেরি লু রেটন জিমন্যাস্ট ছিল। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলিস গেমসে মেয়েদের ওভারঅল ইন্ডিভিজুয়াল গোল্ড পেয়েছিল—।’

‘জানি। হ্যাঁ কোটি টাকা রোজগার করেছে। কিন্তু কেন? প্রথম মেয়েটা দেখতে ভালো, সতেরো বছর বয়স, আমেরিকার মেয়ে আর মিডিয়া পাবলিসিটি যা পেয়েছিল কোনো সিনে অ্যাকট্রেস অস্কার জিতেও তা পায়নি। সব থেকে বড়ো কথা, জিমন্যাস্টিকসে কমিউনিস্টদের একচেটিয়া আধিপত্য ভেঙে ফ্রি ওয়ার্লডের একটা মেয়ে গোল্ড ছিনিয়ে আনল, ভাবতে পারো অর্জুন কী বিরাট ব্যাপার এটা আমেরিকানদের কাছে? এইরকম একটা কাজ যদি কোনো ভারতীয় মেয়ে করতে পারত তাহলে সেও কোটিপতি, নাকি কোটিপত্নী হতে পারত। তবে মেয়েটা চালাক কিংবা বলা যাক তার এজেন্ট আই এম জি চালাক। চটপট গরম গরম নিউজের মধ্যে থাকতে থাকতেই সে টাকা রোজগার করে সোল গেমসের আগেই রিটায়ার করে ফেলে। মেরি জানত সোলে কমিউনিস্ট দেশের মেয়েরা আসছে তার যশ খ্যাতি গুঁড়িয়ে দেবার জন্য। ১৯৭২—এ স্পিৎস, ১৯৮৪—তে মেরি গ্রেট নিউজ। কিন্তু এখন কে ওদের খবর জানতে চায়?’

.

অর্জুন মাথা নেড়ে স্বীকার করল। ‘কিন্তু তুমি এটা তো মানবে, অলিম্পিকের একটা অকল্পনীয় যোগ্যতা আছে জিনিস বিক্রি করিয়ে দেওয়ার। শুধুমাত্র টিভি কভারেজেই তা হয়।’

‘বার্সিলোনা থেকে টেলিকাস্টে একটু জায়গা পাবার জন্য এডভার্টাইজারসদের কাছ থেকে নেটওয়ার্ক কী ধরনের টাকা চেয়েছে তা কাগজে বেরিয়েছে, বোধহয় তুমি পড়েছ। অবিশ্বাস্য, তাই না? এক মিনিটের জন্য ৪০ লাখ টাকা। আমি জানি স্পোর্টসের ঘাড়ে চেপে প্রোডাক্ট বিকোয় কিন্তু এত টাকা যেখানে জড়িত সেখানে হাত দিয়ে হাত পোড়ানোর সম্ভাবনাও রয়েছে।’

‘তার মানে তুমি অলিম্পিকসের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে রাজি নও?’

রাহুল জবাব দিতে ইতস্তত করল। অর্জুন যেভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অ্যাথলেটিকসের ব্যাপরটা নিয়ে কথা চালাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ও যেন এটার মধ্যে নাক গলিয়েছে। এখন যদি সে তর্ক চালিয়ে বলে যায় অ্যাথলেটিকসের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা নেই আর একটু পরেই খাবার টেবলে যদি কোনো প্রতিশ্রুতিমান স্প্রিন্টার কি হাইজাম্পার এসে বসে তা হলে সে নিজে অপ্রতিভ হবে। বন্ধুকেও লজ্জায় ফেলে দেবে। সুতরাং যুক্তিটাও এবার একটু ঘোরানো দরকার।

‘অর্জুন ব্যাপারটাকে তুমি এইভাবে দেখো। চার বছরে একবার আমার পেশার লোকেদের তুমি পৃথিবীর নানান ট্র্যাক সিটের আশেপাশে ভনভন করতে দেখবে। অলিম্পিকস টিমে স্থান পেতে পারে এমন অ্যাথলিটদের তারা হাতে চাঁদ পাইয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেবে। কিন্তু যতক্ষণ না সোনা জিতছে ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো কিছুই পাকা নয়, আর যে স্পীডে কনট্রাক্ট তৈরি হয়ে সই হয় তাতে ডোপ করা বেন জনসনও হেরে যাবে। সইয়ের পরের দিনই তোমার স্বর্ণবিজয়ীটি সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দেবে তার সাফল্যের জন্য সে ঋণী ব্রেকফাস্ট সিরিয়াল, সফটড্রিঙ্কস, সান গ্লাস আর বাটন—ডাউন শার্টের কাছে। দু—সপ্তাহ পরেই লোকটাকে সবাই ভুলে যাবে। যাইহোক, হয়তো বাড়িয়েই বললাম, কিন্তু আমার বক্তব্যটা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ। আামার মতো ব্যবসায়ীরা এইসব থেকে একটু তফাতেই থাকতে চাই। কোয়ার্টার কি হাফ মাইলারদের সঙ্গে হাসফাঁস করে দৌড়োদৌড়ি করাটা ঠিক আমাদের পক্ষে মানায় না। তবে নজর আমরা ঠিকই রাখি।’

রাহুল এই পর্যন্ত বলে ব্যাপারটা ছেড়ে দিল। এখন অর্জুন যদি আলোচনা টানতে চায় তো টানুক।

‘আমারও তাই মনে হয়েছে।’ অর্জুন মুখ ফিরিয়ে রাধিকার দিকে তাকাল। মেয়েটি চুপ করে শুধু কথা শুনে যাচ্ছে আর রাহুলের মুখের ভাব লক্ষ করছে।

‘রাধিকা প্লেটগুলো যে খালি রয়ে গেছে। আর একটু চিকেন স্প্রিং রোল কি মাছের—’

‘না না না।’ রাহুল সোজা হয়ে বসে হাত তুলে থামিয়ে দিল চেয়ার থেকে উঠতে যাওয়া রাধিকাকে। ‘মিস পাইনের এক সেকেন্ডের অনুপস্থিতির ক্ষতি এক প্লেট চিকেন রোল দিয়ে পূরণ করা যাবে না।’

‘আমার মনে হয় সেটাই স্প্রিং রোল না খাওয়ার কারণ নয়।’ রাধিকার ঝকঝকে দাঁত ঝিলিক দিল। ‘মি. অরোরা আসলে আর ক্যালোরি নিতে চান না।’

‘কারেক্ট, জানলেন কী করে?’

‘আপনার ফিগারই জানিয়ে দিচ্ছে। কঠিনভাবে যত্ন না করলে, মিয়ম নেমে না চললে এমন বড়ি তৈরি করা যায় না।’

রাহুলের মুখ সুখে এবং চাপা গর্বে উদ্ভাসিত হল। অর্জুন তারিফ জানানো দৃষ্টি উপহার দিল রাধিকাকে। রাহুলের দুর্বল জায়গাটিতেই তির ছুড়েছে মেয়েটি। ওর কঠিন ব্যাবসায়িক বর্ম ভেদও করেছে। রাহুল এবার কিছুটা দুর্বল হবে। কমপ্রোমাইজ করবে। অর্জুন মাথা নেড়ে হেসে রাধিকাকে উৎসাহ দিল কথাবার্তা এই লাইনে চালিয়ে যাবার জন্য।

অবশ্য রাহুলের ভালোই লাগছে শরীরের ফিটনেস নিয়ে কথা বলতে। ভারতীয়দের খাদ্যাভ্যাস, শ্রম বিমুখতা, খেলা সম্পর্কে অপেশাদারি আবেগপ্রবণ মনোভাব, এইসব নিয়ে তার নিজস্ব কিছু ভাবনাচিন্তা আছে। সেগুলো শোনবার মতো শ্রোতা পেয়ে সে অনর্গল কথা বলে গেলেও একটা ব্যাপার সে ঠিকই মাথায় রেখেছে। খাবার টেবলে অর্জুন যদি কোনো অসুবিধার কথা তুলে ব্যাপারটাকে ধামাচাপা দেওয়া যেতে পারে।

নিজেকে ফিট রাখার জন্য, ওজন বাড়তে না দেবার জন্য কী খায়, কী ব্যায়াম করে তার বর্ণনা, খুঁটিয়ে দিতে দিতে রাহুল কথার মাঝে ইচ্ছে করেই নীরবতা ঢুকিয়ে দিচ্ছিল।

অর্জুন অবশ্য রাহুলের মতো ততটা সূক্ষ্মভাবে জিনিসটা নাড়াচাড়া করতে ইচ্ছুক হল না। ‘ফিটনেস নিয়ে তারাই বেশি মাথা ঘামায় যাদের হাতে টাকা আর সময় আছে। ইউরোপ, আমেরিকায় ওটা যাচ্ছে বলেই ওইসব দেশ থেকে টপক্লাস চ্যাম্পিয়ান অ্যাথলিটরা বেরিয়ে আসে, তবু দেখো, আমাদের এই গরীব দেশ থেকেও কিছু কিছু লোক তো বেরিয়েছে। মডার্ন ইকুইপমেন্টস নেই, ট্রেনিং মেথড জানা নেই, লেবরেটরি, মেডিসিন নেই তবু তিরিশ বছর আগে পর্যন্ত তো ধ্যানচাঁদ, রূপ সিং, মিলখা সিং, রামনাথ কৃষ্ণনদের মতো লোকেদের পাওয়া গেছিল। রাহুল ভাব তো এদের এজেন্ট হয়ে তুমি তখন কী টাকাটাই না লুটতে পারতে! তুমি পি টি উষার কথাই ভাব? ছ—বছর আগে সোল এশিয়াডে উষা যা করল তুমি তা থেকে কোনো ফায়দা তুললে না।’

‘ইচ্ছে করেই তুলিনি কেননা খুব বেশি তোলার সম্ভাবনা ছিলও না। উষা তো ফ্লোরেন্স জয়নার নয়। কোনো গ্ল্যামার নেই, ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলতে পারে না, ব্যক্তিত্ব নেই, ভেরি কনজারভেটিভ ইন অ্যপিয়ারেন্স, পোশাক—আসাকেও। কোনো কমমেটিকস, ফ্যাব্রিকস, গারমেন্টস, অটোমোবিল, এয়ারলাইনার, ইলেকট্রনিকস, কোনো কোম্পানিই ওকে দিয়ে তাদের প্রোডাক্ট এনডোর্স করাতে রাজি হত না শুধু বোধহয় ফার্টিলাইজার ছাড়া। আর তার পারফরম্যান্স? শুধুই এশিয়ান সার্কিটে তিন—চারটে মাত্র মিটে। সে সাকসেসফুল তাও বহু মাস পর পর। ইউরোপ, আমেরিকার সার্কিটে যদি ঘন ঘন দৌড়ত, নাম করত ওয়ার্ল্ড রেকর্ড করে তা হলেও না বলা যেত মার্চেন্ডাইসিংয়ে ওর সম্ভাবনা আছে। আর সোল অলিম্পিকসে গিয়ে তো নিজের যাবতীয় ইমেজ নিজেই নষ্ট করল। এমন ট্র্যাজিক পরিণতি হবে আমি ভাবিনি! অথচ যদি ১৯৮৪—র পর সাহস করে উষা বাইরের দুনিয়ায় বেরোত, মস্তিষ্কবান আধুনিক চিন্তার কোচিং নিত তা হলে হয়তো সোল ওলিম্পিকস থেকে গোল্ড, সিলভার, ব্রোঞ্জের মধ্যে যে—কোনো একটা মেডাল আনতে পারত। একবার তুমি ভেবে দেখ, যে অস্ট্রেলিয়ান মেয়েটা ১৯৮৪—তে ৪০০ হার্ডলসে ফিফথ হল সে তাতেই গোল্ড জিতল চার বছর পর।’

‘যদি উষা একটা মেডাল আনত তাহলে কী হত?’ এতক্ষণে রাধিকা মূল আলোচনায় প্রথম তার কণ্ঠস্বর পেশ করল।

‘ফ্যান্সাস্টিক কাণ্ড হত। মেয়েদের ট্র্যাক ইভেন্টে ১৯৮৪ পর্যন্ত মাত্র দুটি মেডেল জিতেছে এশিয়ান মেয়েরা। ১৯২৮—এ এক জাপানি মেয়ে রুপো জিতেছিল ৮০০ মিটারে। লোকে ভুলেই গেছে তার নাম, আমিও। আর ১৯৬৮—তে ১০০ হার্ডলসে তাইওয়ানের চি চেং একটা ব্রোঞ্জ! উষা যদি কিছু একটাও আনত তাহলে ভারত কেন এশিয়ার দশ বারোটা দেশ থেকে এনডোর্সমেন্টের কনট্রাক্ট নিয়ে লাইন পরে যেত।’

কথাটা লুফে নিয়ে অর্জুন বলল, ‘ধরো উষার থেকেও জিনিয়াস কোনো মেয়ে এ বছর যদি ভারতে উঠে আসে আর অলিম্পিকসে সোনা জেতে? তুমি কি তার কমার্শিয়াল রাইটস সম্পর্কে আগ্রহী হবে না?’

‘কোনো এজেন্টই এমন বিরাট কমিশন হাতছাড়া করতে চাইবে না।’ কথাটা বলে রাহুল চোখ টিপল। ‘ব্যাপারটা কী, একটু খোলসা করেই বল না। মিস পাইন কি ইন্ডিয়ান অলিম্পিকস টিমের জন্য ক্যান্ডিডেট নাকি?’

‘হ্যাঁ।’ অর্জুন কিছু বলার আগেই রাধিকা ছদ্ম গাম্ভীর্যের মুখোশ মুখে টেনে বলল, ‘কোন অ্যাথলেটিকস ইভেন্টের বলুন তো? দেখি আপনার চোখ কেমন?’

‘চোখ আমার ভালোই। আপনার ফিগার বলছে জাম্পিং ইভেন্টের।’ রাহুল বলেছিল রসিকতা করে, রাধিকাও জবাব দিয়েছে সেই ভাবে। সুতরাং কথাবার্তা ওই স্তরেই চালাবার জন্য রাহুল যোগ করল, ‘লং লেগস, ফার্ম রাউন্ড বাটকস, সেন্ডার ফ্ল্যাট স্টম্যাক… আরও বলব?’

‘আপত্তি নেই, ফ্ল্যাটরড তো বহুক্ষণই বোধ করছি, নয় আরও করব;’ রাধিকা গম্ভীর হয়ে থেকেই পায়ের উপর পা তুলে দিল। তবে চোখে কৌতুক।

‘না। এরপর কিছু বলতে হলে কালিদাস থেকে ধার করতে হবে। কিন্তু দেনাদার হয়ে থাকতে আমার বিশ্রী লাগে।’

‘তাহলে নিজের কথাতেই বলুন।’

‘আমি কবি নই সুতরাং খারাপ ভাষা দিয়ে বর্ণনা করে আপনার দেহটিকে নষ্ট করতে পারব না।’

অর্জুন মিটমিট করে হেসে ওদের কথা শুনছিল। এইবার সে বলল, ‘ধরো আমি যে অ্যাথলিটের কথা বললাম তাকে এখন পর্যন্ত লোকে চেনেই না।’

‘তাতে তাকে সেল করা মোটেই সম্ভব হবে না।’ সিরিয়াস গলায় তার যুক্তিটা দেখাতে চাইল। ‘অজানা অখ্যাত ভারতীয় বার্সিলোনায় মেডেল জিতল, এইভাবে যদি ব্যাপারটা বিরাট করে তোলা যায়।’

‘হ্যাঁ, মন্দ নয়।’ রাহুল উদার গলায় বলল। ‘আমার মনে হচ্ছে অর্জুন, তুমি জার্নালিজমে একবার চেষ্টা করে দেখতে পার। তবে যা বললে তাতে একটা খিঁচ রয়ে গেছে। তোমার এই সম্পূর্ণ অজানা অ্যাথলিটটি ভারতীয় অলিম্পিক দলে ঢুকবে কী করে?’

‘হ্যাঁ, এটা একটা ভালো হয়েন্ট বটে। অলিম্পিক দলে জায়গা পেতে হলে একটা নির্দিষ্ট যোগ্যতামানে পৌঁছতে হবে। আর সেজন্য ট্রায়াল হয়। যদি আমাদের অজানা অ্যাথলিটটি সেই মানে পৌঁছয় তা হলেই জায়গা পাবে।’

রাহুল যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। বেশ খুশি মনেই সে গ্লাসে বিয়ার ঢালল সতর্ক হাতে, একমনে। ফেনা থিতিয়ে যাবার জন্য সময় নিয়ে সে চেয়ারে হেলান দিয়ে ধীরে সুস্থে বলল, ‘তা হলে ট্রায়াল! ভালো কথা। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না অর্জুন, তোমার এই অনভিজ্ঞ অ্যাথলিট যে কখনো প্রকাশ্যে দৌড়য়নি সে কী করে ভালো কোচিং পাওয়া অ্যাথলিটদের হারিয়ে টিমে জায়গা করবে?’

‘ওহো।’ অর্জুন হাত তুলে স্বীকার করল যুক্তিটা। ‘আমি বলেছি আমাদের অথ্যালিটটি অজানা, কিন্তু অনভিজ্ঞ বলিনি। তুমি তফাতটা লক্ষ করোনি। এক্সপার্ট কোচিং পেয়েছে মেয়েটি।’

‘মেয়েটি? আমরা কোনো মেয়েকে নিয়ে কথা বলছি নাকি?’ রাহুলের বিস্ময় হালকা কথাবার্তার উপর ঝপ করে যেন ভিজে কাঁথা ফেলে দিল।

অর্জুন বলল, ‘হ্যাঁ মেয়েই। চমৎকার দেখতে। বিজ্ঞাপনের পক্ষে খুবই ভালো। তার থেকেও বড়ো কথা ফ্যান্টাস্টিক রানার। দ্যাখো রাহুল, ভারতের অ্যাথলেটিকসের অবস্থা তো তুমি জানো।’

‘আমি কেন, একটা রিকশাওলাও জানে—হাস্যকর, জঘন্য।’

‘বরাবর পুরুষরাই প্রাধান্য বিস্তার করে রেখেছিল। সেটা ভেঙে উষাই প্রথম এগিয়ে আসে। পুরুষদের নিয়েই ভারতীয় দল তৈরি হত, দু—একটা মেয়েকে কৃপা করে রাখা হত। কিন্তু ছেলেরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ল, উষাই হল মধ্যমণি। তাকে ঘিরে উঠে এল আরও কিছু মেয়ে। ছ—বছর আগে সোল এশিয়ান গেমসে আমাদের যা কিছু অ্যাথলেটিকস মেডেল তা মেয়েরাই এনে দিল। কিন্তু অলিম্পিকসে চূড়ান্ত ফ্লপ। এসব পুরোনো কথা। এখন এমনই অবস্থা অলিম্পিকে পাঠাবার মতো একটা ছেলে বা মেয়ে ৯০ কোটি মানুষের দেশে নেই। দেশের লোক হতাশ, হাল ছেড়ে দিয়েছে। তারা বিশ্বাসই করে না, আগামী পঁচিশ বছরে ভারতের কেউ অলিম্পিকস থেকে মেডেল আনতে পারবে।’

‘তাদের মধ্যে আমিও একজন।’

‘কিন্তু এই মেয়েটি পারবে।’ অর্জুনকে উত্তেজিত দেখাল। রাহুল ভ্রূ তুলে রাধিকার মুখভাব লক্ষ করে বুঝল মেয়েটি সম্পর্কে বোধহয় খবর রাখে।

‘ব্যাপার কী?’ রাহুল দাবি জানাল বিস্তারিত তথ্যের জন্য।

‘দু—বছর আগে জগ করার সময় আমার হ্যামস্ট্রিং টেনে ধরে, বোধহয় জান সে কথা।’ অর্জুন নড়েচড়ে চেয়ারের হাতলে দুটো কনুই রাখল। ‘মাঝে মাঝেই এমন টান ধরত যে হাঁটাচলা বন্ধ হয়ে যেত। ডাক্তারের পর ডাক্তার দেখালাম, কিছুই হল না। শেষে বর্ধমানের এক ফিজিওলজিস্টকে দেখাতে বলল আমার এক আত্মীয়। সেখানকার মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপনা করেন। তার চিকিৎসায় একদম সেরে উঠলাম। ডা. সরকার, দারুণ লোক।’

‘মনে পড়ছে। তুমি খুব এর প্রশংসা করেছিলে।’

‘ওর সঙ্গে প্রায়ই নানান কথা হত ফিজিয়োথেরপি ট্রিটমেন্ট চলার সময়। একদিন কথায় কথায় অ্যাথলেটিকসের প্রসঙ্গ উঠল। আমাদের দেশে কত রকমের ঘাটতি, অসুবিধে, অজ্ঞতা, দলাদলি রয়েছে তাই বলতে বলতে তিনি এই মেয়েটির কথা বললেন। দৌড়ে অসম্ভব ট্যালেন্ট রয়েছে কিন্তু কিছু একটা ব্যবস্থা না করলে ধীরে ধীরে করেছেন ভালো কোচ দিয়ে ওকে ট্রেইনিংয়ের ব্যবস্থা করাবেন লোক চক্ষুর আড়ালে। তার ধারণা দু—বছরের মধ্যেই সে অলিম্পিকসে যাবার উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারবে। ওকে গড়ে তোলার জন্য টাকার দরকার। তিনি কয়েকজন ব্যবসায়ীকে ধরে মেয়েটিকে স্পনসর করার ব্যবস্থা করলেন। ব্যাপরটা এ দেশের অ্যাথলেটিকসের ক্ষেত্রে নতুন। এইভাবে ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটা সংঘ বা কনসর্টিয়াম গড়া কখনো হয়নি। তারা ত্রিশ—চল্লিশ হাজার টাকা এক একজন দিয়েছে। যদি মেয়েটি জেতে তা হলে তারা টাকা ফেরত পাবে, সুদসহ।’

‘টাকাটা ফেরত দেবে নিশ্চয় কমার্শিয়াল বিজ্ঞাপন থেকে টাকা পেয়ে। আর মনে হচ্ছে, তুমিও বোধ হয় এই ব্যবসায়ীদের সংঘে যোগ দিয়েছ।’

‘আমি প্রথমে একটা প্রাইভেট ট্রায়ালে মেয়েটির দৌড় দেখতে গেছিলাম বর্ধমানে, জিটি রোডে। দেখে মনে হয়েছে খাঁটি সোনা।’

‘জিটি রোড? সেকি! ট্র্যাকে না দৌড়ে রাস্তায়?’

‘মেয়েটি ম্যারাথনার। তবে পাঁচ আর দশ হাজার মিটারেও তৈরি হয়েছে।’

‘মাই গড! কত দিয়েছ?’

‘বুঝলাম না!’ অর্জুন ভ্রূ কোঁচকাল।

‘বাজির টাকা। ডা. সরকারকে কত দিয়েছ?’

‘এক লাখ।’

রাহুল চোখ বুজল।

‘আমাকে সারিয়ে তোলার জন্য অত টাকাই ওর পাওয়া উচিত।’

‘ভালো। কিন্তু গোপনীয়তা কেন? ডা. সরকার কি এটার সম্পর্কে কিছু বলেছেন?’

‘প্রধানতই নাটকীয় একটা চমক জাগাবার জন্য। যদি দু—বছর ধরে মেয়েটি নানান কম্পিটিশনে নামত তা হলে ইতিমধ্যেই সে অলিম্পিক ফেভারিট হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যেত। রাহুল বিশ্বাস করো, মেয়েটি সেইরকমই, অত ভালোই। সোনা জিতলে কেউ আর তখন অবাক হবে না। কিন্তু অজানা থেকে সেটা করলে জেতাটা চাঞ্চল্যকর গণ্য হবে। তোমার কি মনে হয় না কি বিরাট প্রচার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে?’

‘ডা. সরকারের মতলবটা কী?’ রাহুল জানতে চাইল।

‘ভারত ইনডিভিজুয়াল ইভেন্টে একটি মাত্র ব্রোঞ্জ এনেছে অলিম্পিকস থেকে সেই কবে—৪০ বছর আগে, কুস্তিতে। আর ১৯০০ পারীতে নর্মান প্রিচার্ডের রুপোর মেডেল দুটো যদি ধরো তা হলে মোট তিনটে। দশকের পর দশক এত বড়ো একটা দেশ থেকে কেউ একজন এখনও একটা সোনা জিততে পারেনি! এই লজ্জা এই ক্ষোভ আর অপমান বোধ থেকেই বোধহয় তিনি এই অভিনব পন্থায় অ্যাথলিট গড়ার চিন্তা করেন। তুমি নিজেই বরং ওকে বুঝে নেবার চেষ্টা করো। উনি এখুনি এসে পড়বেন, ডিনারে ওকে বলেছি।’

‘তাই বুঝি!’ রাহুল সিধে হয়ে বসল। ‘মেয়েটিও আসছে নাকি?’

‘না। তার বদলে উনি একটা ফিল্ম আনবেন। সেটা আমি নিজেও এখনও দেখিনি। আরও একজন আসবে, যারা টাকা দিয়েছে তাদেরই একজন, নাম হীরাভাই পটেল, ডিটারজেন্ট সাবান আর টু হুইলার ম্যানুফ্যাকচারার, কলকাতারই লোক, আমেদাবাদে কারখানা।

‘হীরাভাই নামটা জানি। ওর যা প্রফিট মার্জিন তাতে লাখ দু—লাখ লোকসানে কিছু আসে যায় না।’

অর্জুনকে একটু ক্ষুণ্ণ দেখাল। বলল, ‘মনে হচ্ছে আমার কথা তোমাকে ইমপ্রেস করেনি।’

‘ঘাবড়িও না অর্জুন। তোমার অতিথিদের সামনে এভাবে কথা বলব না। তবে কী জানো পুরো ব্যাপারটা আমার যেন কেমন কেমন লাগছে।’

দুই

একটা কালো ফিয়াট গেট দিয়ে ঢুকে ড্রাইভ ওয়ে ধরে পোর্টিকোয় এসে থামল।

‘এসে গেছে।’ অর্জুন বলল, চেয়ার থেকে উঠে সে আর রাধিকা এগিয়ে গেল। রাহুল ঘাড় ফিরিয়ে প্রথম বারের মতো ডা. সরকারকে দেখতে লাগল। অতি সাধারণ দর্শন, ছোটোখাটো চেহারা মাথাভরা কাঁচা পাকা চুল। কালো প্যান্ট আর হলুদ নীল ডোরাকাটা বুশশার্ট। শীর্ণ গড়ন।

অর্জুন ওদের নিয়ে বাড়ির মধ্যে গেল। রাধিকা ফিরে এসে রাহুলকে বলল, ‘চলুন ডাইনিংয়ে যাওয়া যাক। ডিনারের পর ফিল্মটা দেখান হবে।’

ডাইনিং টেবলে রাহুলের ডানদিকে হীরাভাই বাঁদিকে রাধিকা বসল। এবং বসামাত্রই হীরাভাই বুঝিয়ে দিল সে কথা বলতে ভালোবাসে।

‘তা হলে আপনিই রাহুল অরোড়া, সুপার সেলসম্যান, কি যেন বলেন… মারচেনডাইসিং এজেন্ট না কি যেন?’

‘হ্যাঁ, ট্যাক্স ফর্মে তাই লিখি।’ রাহুল সাদামাটা স্বরে বলল। ‘তবে আমাদের পেশায় কেউ কেউ এজেন্ট শব্দটা পছন্দ করে না। তারা ম্যানেজার বা কনসালটান্ট বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসে। অবশ্য আমার যে কোনোটাতেই চলে যায়।’

‘যত্তো সব গালভরা তকমা,’ হীরাভাই বলল, ‘আমার তো সাবানের ব্যাবসা। আপনি আমাকে সাফাইওলা বলুন আমি কিছু মনে করব না যদি অবশ্য আপনি আমার মাল কেনেন।’

বহু লোকই যে হীরাভাইয়ের মাল কেনে সেটা তার দু—হাতের আঙুলে বড়ো বড়ো মূল্যবান পাথর বসান গোটাছয়েক আংটি থেকেই বোঝা যায়।

‘আমি প্রোডাকশন সাইডটা আর পারচেজটাই দেখি। সেলিংয়ের জন্য আপনাদের মতো লোকদের উপরই নির্ভর করি। ডাক্তারবাবু যখন এই ব্যাপারে টাকা লাগাতে বললেন, ওনাকে আমি সরাসরি বলে দিলাম, মশাই আমি কিন্তু স্লিপিং পার্টনার থাকব। আমি একদম নাক গলাব না—কয়েক হাজার টাকা ইনভেস্ট করব, ব্যস। আমি আমার কথা রেখেছি কিন্তু। ঠিক কিনা বলুন ডাক্তারবাবু। তারপর যখন শুনলাম ওনারা সব একজন মার্কেটিং করার লোক কী যেন আপনি নিজের টাইটেলটা বললেন?—একজনকে ঠিক করছেন, তখন ভাবলাম লোকটাকে একবার তো দেখা দরকার?’

হীরাভাইয়ের বকবকানি থামাবার জন্য অর্জুন বেয়ারাকে ইসারা করল খাবার পরিবেশনের জন্য।

‘তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে ফিল্মটা দেখতে বসা যাক, কি বলেন ডা. সরকার। আর কতটা কাজ এগিয়েছে সেটাও শোনা যাবে।’ অর্জুন বলল। ডা. সরকার মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। তিনি কথা বলেন কমই। মাঝে মাঝে শুধু তার পাশে বসা অর্জুনের সঙ্গে চাপা স্বরে কথা বিনিময় করলেন। রাহুলের মনে হল, এমন লোকের পক্ষে চালাকি করে টাকা রোজগার করা সম্ভব নয়। সে পাশে বসা রাধিকার দিকে ঝুঁকে বলল, ‘ফিল্মটা কী নিয়ে? বিষয়টা কী?’

রাধিকা ঝুঁকে রাহুলের কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে বলল, ‘বলা বারণ। প্রোজেক্ট নিয়ে ডিনার টেবলে কথা বলতে মি. হালদার বারণ করেছেন। উনি চান আগে আপনি ফিল্মটা দেখুন।’

টেবলে নানা ধরনের কথাবার্তা হল শুধু খেলার বিষয় ছাড়া। নিরামিষ খাওয়ার উপকারিতা থেকে ভারতের অর্থনীতি, ধর্ম, পাকিস্তানের পরমাণু বোমা, কলকাতার ভাঙাচোরা রাস্তা, বিদ্যুৎ ঘাটতি ইত্যাদি অনেক বিষয়েই প্রত্যেক কিছু না কিছু মন্তব্য করল। খাওয়া শেষ হলে সবাই উঠে গেল বসার ঘরে। সেখানেই ভিডিও ফিল্মটি দেখানো হবে।

ডা. সরকারের ফিল্ম দেখানোর জন্য দুটো সোফা পাশাপাশি জোড়া দেওয়া হয়েছে। তাতে অন্তত আটজন স্বচ্ছন্দে বসতে পারে। ঘরে ঢোকার সময় রাহুল একটু পিছিয়ে রইল। হীরাভাই বসার পর সে সোফার অন্য প্রান্তে বসল অর্জুন এবং রাধিকাকে মাঝখানে রেখে।

কফি এল। বেয়ারা ট্রে নিয়ে সবার সামনে ধরল। রাহুল মাথা নেড়ে সিগারেট ধরাল। অর্জুন ডা. সরকারকে জিজ্ঞাসা করল, ফিল্মের ভূমিকা হিসাবে কিছু বলবেন কি না।

‘না, ফিল্মই যা বলার বলবে।’

‘তা হলে শুরু করি।’ অর্জুন ক্যাসেট নিয়ে এগিয়ে গেল প্রোজেক্টারের কাছে।

ঘোলাটে ছাই রঙা স্ক্রিনটা কয়েক সেকেন্ড আলোর বুদবুদ কেটে, ফুলঝুরি ছড়িয়ে ধীরে ধীরে সোনালি হয়ে উঠল। হলুদেরই ফিকে থেকে গাঢ় নানান ধরনকে সোনা বলা হয় কিন্তু খাঁটি সোনার আলাদা একটা গুণ আছে যেজন্য এটাকে রং হিসাবে আলাদা করা হয়।

অন্তত দশ সেকেন্ড সোনার রঙে ক্রিনটা জ্বল জ্বল করার পর ক্রমশ গিরিমাটির রং ধরল। রাহুল এবার টের পেল, গরম মসৃণ গাত্র ত্বকের উপর বিশুদ্ধ রোদের আলো ক্লোজ আপে দেখানোর ফল যে কেমন হতে পারে সেটাই দেখান হচ্ছে। গুঁড়ি গুঁড়ি সোনালি লোমের জন্য সোনা রঙার ধরন রেশমের মতো।

একটি মেয়ের ঊরু। ধীরে ধীরে সেটা মিলিয়ে ভেসে উঠল কোমর। ক্যামেরা চক্রাকারে কোমরটাকে ঘুরে এল নাভির উপর। স্ক্রিনের উপর ফুটে উঠল শুধু একটি শব্দ: স্বর্ণকুমারী। নিথর সাদা অক্ষরগুলোর জন্য ত্বকের নড়াচড়াটা প্রকট হয়ে উঠল। কোন কলাকুশলীর নাম ফুটে উঠল না।

ক্যামেরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে এল আর স্ক্রিন জুড়ে দেখা দিল একটি মেয়ের পূর্ণ শরীর। দীর্ঘকায়া, অনস্বীকার্যভাবে সুন্দর নীল পটভূমিতে গতিহীন, বাতাসে দীর্ঘ কালো চুল উড়ছে। ছবিটা তোলা হয়েছে কোনো উঁচু জায়গায় কেননা মেয়েটির হাঁটুর পিছনে দূরের একটা টিলা দেখা যাচ্ছে। ক্যামেরা কোণ বদলাচ্ছে। মেয়েটির ডানদিকে ক্যামেরা এল অর্থাৎ সূর্যের মুখোমুখি হল। মুখের কালোছায়ার কিনারে সোনালি রেখা নাটকীয় অনুভূতি জানাল।

রাহুল অস্বস্তি বোধ করছে। মেয়েটিকে সে চিনে উঠতে পারছে না। টিভি কমার্শিয়ালে যেসব মেয়েরা মডেলের কাজ করে তাদের প্রায় সকলেরই মুখ তার চেনা। সকলের নাম অবশ্য তার মনে নেই। কিন্তু নামটা তত জরুরি নয়। একই মেয়ে দশ রকমের বিজ্ঞাপনে নামছে প্রেশার কুকার থেকে টুথপেস্ট, ফাস্ট ফুড। বিজ্ঞাপন ব্যবসায় যারা জড়িত তারা চিহ্নিত করে রাখে এদের। যে মেয়ে জাতীয় কার্যক্রমে ছেলেকে প্রতি রাত্রে জেলিমাখন পাউরুটি খাওয়াচ্ছে, কোনো কোম্পানির বড়কর্তা ম্যাগাজিন খুলেই পুরো পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে সেই মেয়েকে দেখে নিশ্চয় খুশি হবে না। বিপণনে সুদক্ষরা এমন কাজ কখনোই করে না এবং রাহুলের কাজ হল, এমন ব্যাপার যাতে না ঘটে সেটাই দেখা।

স্বর্ণকুমারী যে—কোনো এজেন্সি ক্যাটালগে নেই, সে বিষয়ে রাহুল নিশ্চিত। মুখটি এমনই যে একবার দেখলে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। গোলাকার ঈষৎ চ্যাপটা মুখের গড়ন, কিছুটা মোঙ্গোলীয় আদল ধরা পড়ে। পাতলা গোলাপি ঠোঁট। চোখে সামান্য বিষাদের ছোঁয়া। ব্যক্তিত্বে গর্বে টলমল করছে, কপালের ঢাল বেয়ে নেমে আসা সরু টিকোল নাক, জোড়া ভুরু, গালের উঁচু হাড়। সম্রাজ্ঞীর মহিমা ছড়ানো মুখমণ্ডলে। তাকে ঘিরে ক্যামেরার আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাহুল অবাক হচ্ছিল এই ভেবে যে এমন দারুণ একটি মেয়েকে বিজ্ঞাপন দুনিয়া খুঁজে পায়নি এখনও। দেহে কোনো খুঁত—টিকার দাগ, পোড়া বা ক্ষত বা জরুল আছে কি না দেখার জন্য রাহুল তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে শটগুলিতে চোখ রাখল। নিখুঁত দেহ।

ক্যামেরা দেহ আবর্তন করে আবার শুরুর অবস্থানে এসে পেটের উপর ক্লোজ আপে রইল। স্ক্রিনের উপর দিয়ে নাভিটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। যেখানে আগে টাইটেল পড়েছিল, নাভি সেইখানে পৌঁছেই থেমে গেল। সোনা রঙের পটভূমিতে সাদা অক্ষরে ভেসে উঠল সাজানো একটা পরিসংখ্যান।

স্বর্ণকুমারীর ২০ বছর বয়স পূর্ণ হবে

২৫ অগাস্ট, ১৯৯২

ওজন ৬৭ কেজি

উচ্চচতা ৫ ফঃ ৯ ইঃ

কাঁধ (ব্যাস) ১ ফুঃ ৩ ইঃ

নিতম্ব (ব্যাস) ১১ ইঃ

বাইসেপ ১০ ইঃ

ঊরু ১ ফুঃ ১০/১/৪ ইঃ

পায়ের কাফ ১ ফুঃ

লেখাগুলো মিলিয়ে গিয়ে ভেসে উঠল দ্বিতীয় পর্যায়ের ছবি। জিমন্যাসিয়াম। মেয়েটির পাশে তার কান সমান উচ্চচতায় সাদা ঢিলে সুতির কোট পরা একটি লোক, হাতে একটা জটার কলম ডা. সরকার।

সাউন্ডট্র্যাকে ডা. সরকারের গলা শোনা গেল।

‘এই তরুণীকে খুব মন দিয়ে লক্ষ করার জন্য আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি। মেয়েটি আকর্ষণীয় অবশ্যই শারীরিক দিক থেকেও কৌতূহল জাগানোর মতো। এটা আরও ভালো ভাবে বুঝতে পারবেন যদি ওর রেডিওগ্রাফি পরীক্ষা করে দেখেন।’

স্ক্রিনের উপর ডা. সরকারের পাশে প্রক্ষিপ্ত হল মেয়েটির পূর্ণ দৈর্ঘ্যের এক্স—রে।

‘ওর কাধ এবং থোরাক্সের ব্যবধানটা লক্ষ্য করুন। অ্যাভারেজের থেকেও বড়ো বুকের খাঁচার জন্য ওর ফুসফুসের ক্ষমতা অবশ্যই বেশি। মানুষের এরোবিক ক্ষমতা অর্থাৎ যাকে বলা হয়, সর্বাধিক যতটা পরিমাণ সম্ভব অক্সিজেন টেনে নিয়ে সেটা ক্রমান্বয়ে শারীরিক ক্রিয়ার মধ্যে থেকে প্রতি মিনিটে পাঠানো এবং সেটাকে ব্যবহার করা, এটা নির্ভর করে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের আকার, রক্তে হেমোগ্লোবিনের পরিমাণের এবং পেশিতে তন্তুর পরিমাণের উপর। এখন যদি আমরা পেশির সংস্থান পরীক্ষা করি—’এক্স—রে কঙ্কাল মিলিয়ে গিয়ে সেখানে ফুটে উঠল স্বর্ণকুমারীর মনোরম চেহারা,’—তা হলে আমরা দেখব চমৎকার পেশিখরা ঊরু আর পায়ের ডিম বা কাফ। এই ধরনের পা খাটো চেহারার মেয়েদেরই হয়। মেয়েদের সৌন্দর্য বিচারে চিরাচরিত যে পদ্ধতি নেওয়া হয়—বুক, কোমর এবং নিতম্বের আনুপাতিক হার—সেটা নিশ্চই বুঝতে পারছেন এখানে সুন্দরভাবে বজায় রয়েছে। বুক এবং নিতম্ব—’ ডা. সরকার তার হাতের কলম শূন্যে বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে—’অতুলনীয় ক্ল্যাসিক গড়নের।’

রাহুল চট করে দর্শকদের দিকে একবার তাকিয়ে নিল। হীরাভাই তালুতে পানপরাগ ঢেলে সেটা সব মুখে চালান করতে সময় পায়নি। অর্জুন হাতের মুঠোয় চিবুক রেখে সামনে ঝুঁকে। রাধিকা সোফায় হেলান দিয়ে, দুই হাত তুলে মাথার পিছনে রাখা। রাহুলের চোখে চোখ পড়তেই বুকের সরে যাওয়া আঁচল টেনে দিল।

‘এটা এখন প্রমাণিত যে,’—ডা. সরকার বলে চললেন, ‘গত একশো বছরে, পূর্বপুরুষদের থেকে এখনকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে একটু তাড়াতাড়িই পিউবার্টির বয়সে পৌঁছনোর লম্বা হওয়ার আর বলিষ্ঠ চেহারা পাওয়ার প্রবণতাটা বেড়ে গেছে। উপর দিকে বেড়ে ওঠার ঝোঁকটা আমেরিকায় আর পশ্চিম ইউরোপে প্রতি দশকে গড়ে এক সেন্টিমিটার। আমাদের দেশে এটা যে কত তা জানা সম্ভব নয়, কেননা এখনও এই সম্পর্কে ভারতে কোনো কাজ হয়নি। তবে এইরকম লম্বা বহু মেয়েই আমাদের দেশে দেখা যায় কিন্তু এই মেয়ের সঙ্গে তুলনীয় দৈহিক সক্ষমতা সম্পন্ন লম্বা মেয়ে বোধহয় পাওয়া যাবে না। এটা আমি আমার চল্লিশ বছরের আনথ্রোপমেট্রির অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। দৈহিক বৃদ্ধির যে ঝোঁকটার কথা বলেছি তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে একবিংশ শতাব্দীতে ভারতীয় মেয়েদের গড়ন এইরকমই দাঁড়াবে। তখন তাদের আরও বেশি ফুসফুসের ক্ষমতা গভীর বুকের খাঁচা, শক্তিশালী কার্টিওভাসকুলার সিস্টেম, পেশির উন্নতি ঘটতে পারে। এই মেয়েটি তার যুগের থেকে ইউজেনিক্যালি তিরিশ চল্লিশ বছর এগিয়ে রয়েছে। আর সেটা যে কীভাবে আপনারা এখনি তা দেখতে পাবেন।’

ফিল্ম এবার কাট করে দেখাল মেয়েটি লোহার ভারী চাকতি লাগানো রডের পাশে দাঁড়িয়ে।

‘এগুলো চল্লিশ কেজি ওজনের ট্রেনিং ওয়েট যা পুরুষ অ্যাথলিটরা ব্যবহার করে। এইবার ও দেখাবে শরীরে সাবলীলতা। এটা কিন্তু শক্তির পরীক্ষা নয়। লক্ষ্য করুন কত সহজে স্বচ্ছন্দে, চটপট কাজগুলো করছে।’ ডা. সরকার কথা বন্ধ করলেন।

নীচু হয়ে ঝুঁকে মেয়েটি বারবেল তুলে আনল বুকের সামনে মসৃণভাবে। দশবার করল। তারপর বুক থেকে কোমর এবং কোমর থেকে বুক পর্যন্ত তারপর কাঁধে বারবেল রেখে আধা—বৈঠক, তারপর বেঞ্চ প্রেস।

‘ওর নাড়ির গতি যদি নিই’, মেয়েটি যখন ব্যয়াম শেষ করে তার পাশে দাঁড়িয়ে গভীর সহজভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে তখন ডা. সরকার আবার বলতে শুরু করলেন, ‘তা হলে ব্যয়ামের সময় প্রতি মিনিটে স্পন্দন পাব ১৫০ আর দু—মিনিটেই সেটা নেমে আসবে স্বাভাবিক হার ৪৫—এ। আমেরিকা, রাশিয়া আর পশ্চিম জার্মানি থেকে পরিসংখ্যান ডাটা আনিয়ে মাসের পর মাস ওকে নিয়ে তার ভিত্তিতে ব্যাপক পরীক্ষা চালিয়ে মাপজোক করে এখন এইটুকু বলতে পারি, এইসব প্রতিটি পরীক্ষায় এই তরুণীর পারফরম্যান্স পৃথিবীর শীর্ষ পর্যায়ের তা সে যেকোনো বয়সিই হোক না, শতকরা দুই বা তিনজন মেয়ের মধ্যে পড়বে।’

ডা. সরকার হাত নেড়ে নিজের বক্তব্যকেই যেন বাতিল করে দিলেন, এমন একটা ভঙ্গিতে আবার বলতে থাকলেন, ‘কিন্তু এইসব ফিজিওলজিক্যাল ডাটা শুধু ফিজিওলজিস্টদের কাছেই প্রাসঙ্গিক। একটা ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাফ শুধু আমাকেই উত্তেজিত করতে পারে সাধারণ নরনারীর কল্পনা শক্তিকে নাড়া দেবে না। শারীরিক ক্ষমতা যাচাই করার জন্য আরও অনেক উপায় আছে যেটা লেবরেটরিতে মাপজোকের থেকে একটু কম সূক্ষ্ম তবে বহু বছর ধরে মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করার সেটা এখন স্বীকৃত হয়ে গেছে। আমি জনপ্রিয় খেলাগুলোর কথাই বলছি, যে খেলায় হিসেব নিকেশ করা যায়। বিশেষ করে ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড অ্যাথলেটিকসে। পুরুষ এবং নারীর চূড়ান্ত সাফল্যের প্রমাণ এর একাধিক ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে। স্পোর্টসের পত্রিকাগুলো সারা পৃথিবীতে প্রতি বছর ঘটে যাওয়া হাজার হাজার পারফরম্যান্সের বিবরণ ছেপে যাচ্ছে।

‘কিছু কিছু অ্যাথলেটিক কাজকর্ম আমরা বাদই দিচ্ছি কেননা আমাদের যা জানার দরকার তার সঙ্গে ওসবের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন, জাম্পিং বা থ্রোয়িং ইভেন্টগুলোর মান উঠছে টেকনিকের উন্নতির জন্য, এত দ্বারা শরীরগত মাপজোক বা পরীক্ষার জন্য সাদামাটা সরল যে সুযোগটা ছিল সেটা নষ্ট হয়েছে। তবে এখনও অনেক ইভেন্ট রয়ে গেছে যেগুলো কোচিং টেকনিকের জটিলতার হাত এড়াতে পেরেছে যেমন দূর পাল্লার দৌড়।’

এইবার ফিল্ম ফিরে গেল ঘন শাল জঙ্গলের মধ্যে লাল মাটির রাস্তায়। ডা. সরকার একটা সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে লাল শর্টস সাদা স্পোর্টস শার্ট আর স্পোর্টস শু। সূর্যের আলো একদিক থেকে গাছের ফাঁক দিয়ে এসে পড়েছে। তাই থেকে বোঝা যায় সময়টা মধ্যাহ্নের কয়েক ঘণ্টা আগে।

‘তা হলে এবার দেখা যাক আমাদের এই তরুণী রানার হিসাবে কেমন হতে পারে। একটা কথা বলে রাখা ভালো, মেয়েটি জীবনে কখনো কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়নি। প্রথমে দেখা যাক সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে সে কেমন দৌড়য়, শুধুমাত্র দৌড়ের আনন্দে দৌড়কে উপভোগ করার জন্য।’

এবার স্বর্ণকুমারীকে দেখা গেল। সোনালি সিল্কের শর্টস আর হাতকাটা সাদা জামা পরা কিন্তু খালি পায়ে। সেই লাল মাটির রাস্তা দিয়ে সে সাবলীল গতিতে ছুটে চলেছে। মাথার চুল কাঁধের উপর ঝাঁকাচ্ছে। তার সঞ্চরণের মধ্যেই জমানো শক্তি লুকিয়ে থাকার ধারণা দিচ্ছে। দুটি বাহু অনায়াসে দুলছে একই ছন্দে। ডা. সরকার কথা বলে যাই বোঝাবার চেষ্টা করুন না কেন, রাহুলের মনে হচ্ছে গতিময় এই মেয়েটি অনবদ্য, এর দৌড়ের মধ্যে শারীরিক উচ্ছ্বাস ও খুশিরই যেন প্রকাশ ঘটেছে। ওস্তাদ বীণকার তার যন্ত্রে প্রথম সুর লাগানো মাত্র হৃদয়ে যে কম্পন জাগে, এই মেয়েটির দৌড় প্রায় সেই রকমই অনুভূতি জাগাচ্ছে। রাহুল এরপর টের পেল নিজের অজান্তেই সে কার্পেটে ডান পা চেপে ধরে আছে, যেভাবে সে মোট গাড়ির অ্যাক্সিলেটর চেপে ধরে।

মেয়েটি তার দৌড়ের গতি বাড়িয়েছে। পিছনে সাইকেলে চেপে যাচ্ছিলেন ডা. সরকার। ধীরে ধীরে তিনি পিছিয়ে পড়ে ফিল্মের ফ্রেম থেকে বেরিয়ে গেলেন। মসৃণভাবে মেয়েটি গতি বাড়াচ্ছে, কালো চুলের রাশ তার পিছনে ওঠানামা করছে ঢেউয়ের মতো। দুটি মুঠো করা বাহু পিস্টন রডের মতো এগোচ্ছে পিছোচ্ছে, দুটি খালি পা সমান তালে রাস্তার মাটি কামড়ে চিবিয়ে পিছনে ফেলে দিচ্ছে। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড প্রচণ্ড গতিতে দৌড়ে ধীরে ধীরে সে মন্থর হয়ে এল। তখন আবার ডা. সরকারকে ফ্রেমের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে ঢুকতে দেখা গেল।

যে জিনিসটা রাহুলকে কৌতূহলী করল, সেটি হল, নিছক আনন্দের জন্য দৌড়চ্ছে বলা হলেও মেয়েটির মুখে কিন্তু উদ্দীপনা বা তৃপ্তির কোনো ভাব দেখা গেল না। সারা ফিল্মে যেমন তেমনই নিরাবেগ নৈর্ব্যক্তিক রয়ে গেল তার মুখ।

ডা. সরকার আবার কথা বলতে শুরু করলেন: ‘এতক্ষণে ওর গা গরম হয়েছে এবার তা হলে ওকে আরও দৌড়তে বলা যাক। আমার সাইকেলে মাইলোমিটার লাগান রয়েছে। মিটারে সংখ্যার ঘর শূন্যতে আনলাম।’ ক্যামেরার চোখ মিটারের উপর পড়ল। দেখা গেল চারটি ঘরেই শূন্য অঙ্ক। ‘আমি আগে আগে যাব। আমার গলায় ঝুলছে স্টপওয়াচ। ও দৌড়বে দশ কিলোমিটার। পুরো দৌড় দেখানো যাবে না, তাতে যত সময় লাগবে আধ ঘণ্টা তো বটেই ততক্ষণে আপনাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। আসলে মেয়েটি বন্ধুর অসমান পাহাড়ি পথে, চড়াই ভেঙে কীভাবে দৌড়চ্ছে সেটাই দেখাতে চাই।’

মেয়েটিকে এবার দেখা গেল এক পাহাড়ি নদীর কিনারে ক্ষয়ে যাওয়া ঢালু জমি ঘেঁষে দৌড়চ্ছে। নদীর অপর পারে পাহাড়। ডা. সরকারের গলা শোনা গেল: ‘সিংভূম জেলার সারাণ্ডা অরণ্যাঞ্চল এটা, নদীর নাম সঞ্জাই। ওপারে দূরের পাহাড়টার নাম চিরুবেরা। আমরা শুরু করেছি চক্রধরপুরের ঠিক বাইরে একটা জায়গা থেকে।’

মেয়েটি পাকা রাস্তা ছেড়ে মোরাম দেওয়া রাস্তায় মোড় নিল। একটা টিলায় উঠল। দু—ধারে ঢেউ খেলান জমি। আদিবাসী মেয়েরা বাচ্চচারা মহুয়া কুড়োতে কুড়োতে একবার মেয়েটির দিকে তাকাল। তাদের চোখে বিস্ময় বা ঔৎসুক্য নেই। যেন এই মেয়েটির দৌড় দেখায় তারা অভ্যস্ত। প্রচুর গাছ আর অজস্র লাল ফুলে স্ক্রিনে যেন আগুন ধরে গেছে।

রাস্তায় বড়ো বড়ো গর্ত, কোথাও ঢিবি। ডা. সরকারের সাইকেলের চাকা থেকে উড়ছে লাল ধুলো। দমকা হাওয়াতেও ধুলোর পর্দা উড়ে আবার সরে যাচ্ছে।

‘এবার যে পাহাড়টা দেখছেন ওটার নাম সাহেদবা। ওর ঠিক নীচেই টুইয়া গ্রাম। ওখানে আমরা শেষ করব।’

ডা. সরকার সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে। ক্যামেরা মাইলোমিটারে দেখাল ১০ সংখ্যাটা। স্টপওয়াচ হাতে তিনি অপেক্ষা করছেন। দৌড়ের শেষের দিকে এগিয়ে চলেছে মেয়েটি প্রচণ্ড গতিতে। ডা. সরকারকে সে অতিক্রম করা মাত্র স্টপওয়াচের বোতামে একটা তর্জনীর চাপ পড়ল। ক্লোজ আপে স্টপওয়াচটিকে দেখানো হল।

‘সময় হল ৩১ মিনিট ৩৩.৭ সেকেন্ড। এটা যদি কোনো প্রতিযোগিতায় করত তা হলে এই বছরের সেরা আধডজন মেয়েদের মধ্যে ও এসে যাবে। চার বছর আগে সোল অলিম্পিকসে এই সময় করলে ষষ্ঠ স্থান পেত। সপ্তম হয়েছিল চীনের ওয়াং। তার সময় হয়েছিল ৩১ মিনিট ৪০.২৩ সেকেন্ড। একটা কথা মনে রাখবেন দশ হাজার মিটার দৌড় হয় স্টেডিয়ামের মধ্যে সিন্থেটিক ট্র্যাকে। তাতে ওর সময় আরও কমত।’

‘কত কমত?’ রাহুল অস্ফুটে কথাটা বললেও ডা. সরকারের কানে তা পৌঁছল। তিনি মুখ ফিরিয়ে একবার তার দিকে শুধু তাকালেন।

ফিল্মে ডা. সরকারের সঙ্গে মেয়েটিকে দেখা গেল। হাঁটুতে দু—হাত রেখে কুঁজো হয়ে শ্বাস নিচ্ছে। অক্সিজেনের ঘাটতি পূরণ করতে।

‘শেষ করার আগে একটা ছোট্ট অঙ্কের কথা বলি। পৃথিবীর সেরা পনেরোটি দূরপাল্লার মেয়ের উচ্চচতা যদি হিসেব করা যায়, তা হলে আমরা দেখব তাদের গড় উচ্চচতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। এখন যে মেয়েটির দৌড় দেখলেন তার থেকে পাঁচ ইঞ্চি কম। এটা প্রমাণিত পেশি থেকে সর্বাধিক যতটা শক্তি প্রয়োগ করা যায় সেটার সঙ্গে শরীরী উচ্চচতার সরাসরি আনুপাতিক হিসেব করে এই সিদ্ধান্তে এসেছি বিশ্বের সেরাদের থেকে গড়পড়তায় ও শতকরা ৯ ভাগ লম্বা আর পেশির শক্তিতে ওর ক্ষমতা শতক ১৯ ভাগ বেশি।’

ফিল্ম শেষ হল ওই পাহাড়ি রাস্তা ধরেই ফিরে যাওয়ার দৃশ্য দিয়ে। তবে এবার সাইকেল চালাচ্ছে স্বর্ণকুমারী আর পিছনে বসে রয়েছেন ডা. সরকার। স্লো মোশানে দেখা গেল, প্যাডেলরত গোড়ালি থেকে ক্যামেরা আলতো ভাবে উঠে চলেছে উপরে। ঘাসে ভেজা ত্বকের নীচে হাঁটু ঊরুর পেশির তির তির কম্পন, হ্যান্ডেল শক্ত করে ধরা হাতের পেশির কাঠিন্য, ধুলো মাখা মুখ ঝাঁকিয়ে ওঠা চুল এবং নিরাসক্ত দৃষ্টিতে সামনে তাকানো চোখ। ফিল্ম এরপর ফ্রিজ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ কেউই কোনো কথা বলল না। রাহুল প্যাকেট থেকে সিগারেট বার করতে করতে ভাবল অর্জুন যা বলেছে সেটাই তা হলে ঠিক। একটা অজানা মেয়ে তা হলে রয়েছে যাকে মনে হল যেন দৌড়তে পারে। তবে অলিম্পিক মান অনুযায়ী কি না সেটা বলা সম্ভব নয়। ডা. সরকার বললেন দশ হাজার মিটার দৌড়ল ওই সময়ে। হবেও বা! কিন্তু উনি বললেই যে সময়টা ওইরকম হবে তার ঠিক কী? ক্যামেরার কারসাজিতে কেঁচোকেও তো অজগর বানানো যায়।

রাহুল এরপর কথা শুনে বুঝল অর্জুন বিশ্বাস করেছে ডা. সরকার যা বলছেন তাতে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। হীরাভাইও বিশ্বাস করেছে। স্বর্ণকুমারীর জন্য ওরা টাকা বিনিয়োগ করেছে সুতরাং যতটা টাকা আদায় করে নেওয়া সম্ভব। সেটা ওরা করতে চাইবেই। মেয়েটির যোগ্যতা সম্পর্কে কোনোরকম সন্দেহ প্রকাশের সময় এখন নয়। ফিল্মে যেমনটি দেখা গেল স্বর্ণকুমারী আসলে সত্যি সত্যিই ওই রকম চমকপ্রদ কিনা তাই নিয়ে কথা না বলে সে নিজেকে এর সঙ্গে জড়াবে না। না জড়াতে চাইলে সরে আসার জন্য দাখিল করার মতো যুক্তি তার জানা আছে।

রাহুলের খাতায় সুপারস্টার পর্যায়ে আছে চারজন খেলোয়াড়। পাকিস্তানের শাজাহান খাঁ যে এখন স্কোয়াশে বিশ্বের এক নম্বর, অল ইংল্যান্ড এবং এশিয়ান ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন মোহিত কাত্রে, রেসিং জকি জিমি দারুওয়ালা আর সিঙ্গাপুরের একজন গল্ফার। এখন ওরা এক একজন চলন্ত ব্যবসায়ী সংস্থা। টাকা খাটাবার জন্য নিজেদের ম্যানেজার, ট্যাক্স কনসালট্যান্ট রেখেছে। এদের সাফল্য দেখে লোকে ভাবে যেকোনো তাগড়াই বাচ্চচাকে খেলায় নামিয়ে দিলেই বুঝি ওইরকম হতে পারবে। কিন্তু আসল ব্যাপারটা যে অন্য রকম সেটা তারা জানে না। বিপণনের সুযোগ খেলার লোকেদের সহজে মেলে না। ঘটনাগতিকে যতক্ষণ না এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়ে যায় যেটা সারা পৃথিবীকে ঘাড় ধরে টিভি—র সামনে বসাচ্ছে ততক্ষণ কেউ বিপণনযোগ্য হয়ে ওঠে না। সুতরাং ঘটনা চাই অবস্থাটা তৈরি করার জন্য। একজন অ্যাথলিট যদি লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করতে চায় এবং এই ১৯৯২ সালেই, তা হলে তাকে বার্সিলোনায় যেতে হবে। কিন্তু অলিম্পিক সোনার মেডেল পেলেই যে সাবানের বিজ্ঞাপনে মুখ দেখান যাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। রূপকথার রাজকুমারের মতো দৈত্যদানোকে বধ করতে হবে। মুখ থুবড়ে পড়ে আবার উঠতে হবে এবং তার পরও জিততে হবে। স্বর্ণকুমারী প্রতিযোগিতায় নামার যার কোনো অভিজ্ঞতাই নেই তাকে এই সব করতে হবে।

রাহুলকে এই কথাগুলোই এবার এই লোকগুলোর মগজে ঢোকাতে হবে। বহু টাকা ইতিমধ্যেই মেয়েটির জন্য এরা ঢেলেছে। এখন যদি বলা যায় তাদের জিনিসটা বিক্রি করার মতো নয় তা হলে ওরা হতাশ হবে। ব্যাপারটা তার পক্ষে খুব স্বস্তিকর হবে বলে মনে হচ্ছে না। ডা. সরকার উঠে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে রাহুলের দিকে তাকিয়ে যখন বললেন, ‘কিছু কথা বলব, আপনি কি একটু এই দিকের সোফাটায় এসে বসবেন?’ তখড় সে মনের মধ্যে চাপা দুঃখের ছোঁয়া পেল।

তিন

‘মাপ চেয়ে নিয়েই শুরু করি। অর্জুনবাবু যখন ফিল্ম শুরু হওয়ার আগে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলেন তখন আমি ভূমিকার মতো কিছু বলতে অস্বীকার করি। এই অসৌজন্যতার জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।’ ফিল্মের গমগমে স্বরের পর এখন ডা. সরকারের স্বর পাতলা শোনাচ্ছে। ‘আজকের এই জমায়েতের কথা ভেবে আমি ঠিকই করেছিলাম, আমার আগাম কথা দিয়ে নয়, স্বর্ণকুমারী নিজেই নিজের সম্পর্কে ধারণা আপনাদের মনে তৈরি করে দিক। তাই এখন পর্যন্ত কোনো ব্যাখ্যা দিইনি। আজকের এই জমায়েতের কারণ সম্পর্কেও আগাম কিছু বলিনি। আপনারা ব্যস্ত লোক, অনেক জরুরি কাজ ফেলে আজ এখানে এসেছেন, সেজন্য আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। কেন আপনাদের আগাম কিছু জানাইনি সেটাই একবার বলব।’

ডা. সরকার কথা বলার সাময়িক বিরতি দিলেন। মাথা নীচু করে বক্তব্য গুছিয়ে নিয়ে দুবার গলাখাঁকরি দিয়ে বসে চললেন ‘আমার সম্পর্কে এই পরিকল্পনার বা প্রোজেক্টের সঙ্গে আমার জড়িত থাকার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আপনাদের জানানো উচিত বলে আমি মনে করি। আমার পুরো নাম সারদাচরণ সরকার। আমার জন্ম কলকাতায়, ১৯৩৫ সালে। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম বি বি এস আর হামবুর্গ থেকে পিএইচ. ডি করেছি। স্পেশালাইজ করি ফিজিওলজিতে। ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্যাল এডুকেশনের ফেলো, চণ্ডীগড় ইন্সটিটিউট অফ হিউম্যান সায়েন্সে অধ্যাপক ছিলাম ১৯৮৫ পর্যন্ত। আমার কাজের ক্ষেত্রে সর্বশেষ যা কিছু ঘটেছে তার সঙ্গে পরিচিত থাকার চেষ্টা করি। আপাতত বর্ধমানে থাকি। আমার মনে হয় আপনারাও নিজেদের যৎসামান্য পরিচয় যদি অন্যদের জানিয়ে দেন তা হলে সুবিধা হয় কথাবার্তা বলায়। মি. প্যাটেল আপনার সাবান তো লোকের ঘরে ঘরে ব্যবহৃত হয়, বহু লোক আপনার তৈরি স্কুটারে চড়ছে কিন্তু আপনার সম্পর্কে জানার কৌতূহল—।’

হীরাভাই পান মশলার কৌটো হাতে নাড়াচাড়া করছিল। থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমি আর বেশি কী বলব? পনেরো বছর আগে বাবা ছোটো একটা ঘরে গুঁড়ো সাবান তৈরির কারবার শুরু করেছিলেন, আমি সেটা একটু বড়ো করেছি কারখানা বানিয়ে। স্কুটার আমি একা তৈরি করি না, বাইশ পারসেন্ট শেয়ারের মালিক আমি। খেলায় ইন্টারেস্ট আছে। রোজ ভোরে ময়দানে ভলিবল খেলি। এখন বয়স ছেচল্লিশ। বউ আর দুটি মাত্র ছেলে আছে। এবার মি. অরোরা বলুন।’

হীরাভাই যতটা জানাল, তার থেকেও কম বলবে ঠিক করে রাহুল বলল, ‘এখন আমি দিল্লির তার আগে কলকাতারই ছিলাম। ব্যবসায়ে গোড়া থেকেই আমি শুধু মারচেনডাইজিং—য়ের দিকটাতেই আছি। নিজের এজেন্সি তৈরি করেছি। এন্টারটেইনমেন্ট আর স্পোর্টস জগতের নামি স্টারদের জন্য কনট্র্যাক্ট পাইয়ে দেওয়ার দিকেই আমার ঝোঁকটা বেশি। আমার অফিস আছে বোম্বাইয়ে, ব্যাঙ্গালোরে, দিল্লিতে তো বটেই। এশিয়ার পূবে সোল আর টোকিওয় পশ্চিমে তেহরান আর রিয়াধে, আফ্রিকায় কায়রোতেও আমার রিপ্রেজেন্টেটিভ আছে। আমার ক্লায়েন্টদের মধ্যে নাইট ক্লাব সিঙ্গার থেকে গলফার অনেক রকম পেশার লোকই আছে কিন্তু কোনো ট্র্যাক স্টার নেই।’

‘বলছেন কি মি. অরোরা? আপনি আমাদের এজেন্ট হবেন আর আপনি দৌড়ের বিষয় কিছু জানেন না?’ হীরাভাই তাজ্জব হবার ভান করল।

‘মি. পটেল এসব কথা বাদ দিন। রাহুল গজল জানে না, ভারতনাট্যম জানে না কিন্তু ওর ক্লায়েন্ট লিস্টে ভারতের সেরা সিঙ্গার আর ডান্সাররা আছে।’ অর্জুন একটু তীব্র স্বরে বলল, ‘রাহুল এখন ভারতের সেরা এজেন্ট আর সেজন্যই ওকে ডেকে এনেছি।’

হীরাভাই উত্তর দেবার আগে ডা. সরকার বললেন, ‘নিজের পেশায় মি. অরোরা খুবই নামি লোক। তিনি আজ এখানে এসেছেন কারণ আমার মনে হয়েছে এই আলোচনায় ওর উপস্থিতি থাকার এইটেই ঠিক সময়।’ কথা বলার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যাচ্ছে সরকারই এই আলোচনার নেতৃত্ব দেবেন। ‘ফিল্মটা আগে আপনারা তো কখনো দেখেননি। কেমন লাগল বলুন?’

‘মেয়েটিকে ভালোই মনে হল।’ অর্জুন প্রথম মন্তব্য করল।

‘দৌড়য়ও খুব ভালো।’ হীরাভাই বলল, ‘মি. অরোরা আপনার কী রকম মনে হল? ওকে গজল গাওয়ালে ভালো হবে না কথক নাচালে?’

‘মি. পটেল ঠাট্টা মস্করা নয়।’ অর্জুন হুঁশিয়ারি দিল।

‘আমাদের এই কনসরটিয়ামকে যদি সফলভাবে চালাতে হয়, তাহলে পরস্পরের উপর শ্রদ্ধা থাকা দরকার।’ গম্ভীর স্বরে সারদাচরণ বললেন, ‘এই ধরনের কথাবার্তা হলে, চেয়ারম্যান হিসেবে আমি তাহলে এই আলোচনা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হব।’

হীরাভাই পানমশালার কৌটো পকেটে রেখে সোফায় দেহ এলিয়ে বলল, ‘ডাক্তারবাবু কিছু মনে করবেন না, আমি এইভাবেই কথা বলে থাকি। বহুদিনের অভ্যাস। আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। আপনি জিজ্ঞাসা করলেন ফিল্মটা কেমন লাগল। খুব ভালো লেগেছে। ২৪ ক্যারেটের মেয়ে, কোনো সন্দেহ নেই। অরোরা কী বলেন?’

‘হ্যাঁ, আমি ইমপ্রেসড হয়েছি। দৌড় বিষয়ে আমি পণ্ডিত নই তবে বড়ো বড়ো অ্যাথলিটের দৌড় টিভি—তে দেখেছি। আমার মনে হয় বড়ো রানার চিনে নেবার মতো বোধবুদ্ধি আমার কাছে। তবে অন্যান্য রানারের বিরুদ্ধে আপনার স্বর্ণকুমারী কী করবে সেটাই দেখতে চাই।’

রাহুলের শেষ বাক্যটিকে সমালোচনা হিসাবে ধরার বদলে, সারদাচরণ খুশিই হলেন। ‘আমিও তাই চাই মি. অরোরা। আর সেটাই দেখব। আপনাদের আমি একটা গল্প বলব যেটা আমি ছাড়া এখনো পর্যন্ত আর কেউ জানে না। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই অনুরোধ করব, আর কারুর কাছে সেটা বলবেন না।

‘আজ থেকে প্রায় ৪৯ বছর আজে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। বর্মা ফ্রন্টে জাপানীরা হু হু করে এগিয়ে আসছে ভারতের দিকে। আজাদ হিন্দ ফৌজের যোদ্ধারা আরাকান পর্যন্ত এসে গেছে, সেই সময় পিছু হটছে মিত্রপক্ষের বাহিনী। তাড়া খেয়ে পালাতে পালাতে এক ব্রিটিশ রেজিমেন্টের সারজেন্ট দলছুট হয়ে যায়। গভীর জঙ্গল আর পাহাড়েনর মধ্যে সে পঁচিশ দিন ধরে হেঁটে ছিল শুধু বুনো ফল, নদীর জল খেয়ে। ম্যালেরিয়ায় অর্ধমৃত অবস্থায় সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, মি. আও নামে এক জঙ্গল অঞ্চলে। তাকে কুড়িয়ে নিয়ে যায় আপাতনি উপজাতিদের একটি ভ্রাম্যমাণ দল। তারা এই ব্রিটিশ সারজেন্টকে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দেয়, বুনো ভেষজ ওষুধের সাহায্যে সুস্থ করে তোলে। সেই গভীর গহন অরণ্যে যুদ্ধের ভয়াবহতা পৌঁছতে পারেনি। দরকারও হয়নি। সেই সারজেন্ট দু—বছর লুকিয়ে ছিল জঙ্গলে আপাতানিদের সঙ্গে। এরই মধ্যে এক আপাতানি মেয়ের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয় এবং মেয়েটি তার ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়ে। ব্যাপারটাকে মেয়েটির আত্মীয়রা এবং সমাজের লোকেরা ভালো চোখে দেখেনি। সাহেবকে তারা মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেটা জানতে পেরে সেই সার্জেন্ট পালায়, মেয়েটিও তার সঙ্গ নেয়। তখন সে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গভীর জঙ্গলের মধ্যে বুনো কুকুর, সাপখোপ, জোঁক, হাতি, ভালুক আর বাঘের হাত এড়িয়ে ওরা নামদাফা ফরেস্ট, যা এখন জাতীয় অরণ্য হিসেবে টাইগার প্রোজেক্টে স্থান পেয়েছে, অতিক্রম করে এসে পড়ে লেখাপনিতে। সেখান থেকে তিনসুকিয়ায় যখন পৌঁছোল তার কয়েক সপ্তাহ আগে হিরোশিমায় আণবিক বোমা ফেলা হয়ে গেছে।

‘তিনসুকিয়া থেকে ডিব্রুগড়, এখানেই সেই সাহেব মেয়েটিকে ফেলে রেখে, ঝাঁকের কৈ ঝাঁকে মিশে যাওয়ার মতোই ওখানকার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়। তারপর সে যে কোথায় গেল তার হদিশ আর পাওয়া যায়নি। সেই মেয়েটি, যার নাম আমি জানতে পারিনি, তারপর লেডোয় কয়লার খনিতে মজুরের কাজ পায় আর যথাসময়ে একটি মেয়ের জন্ম দেয়। নবজাতকের নাম রাখে মায়াকাং। মেয়েটির মার সঙ্গে সেখানে আলাপ হয় এক খাসি যুবকের। দুজনে স্বামী—স্ত্রীর মতো বাস করতে থাকে। তারপর তারা চলে আসে ডুয়ার্সের এক চা—বাগানে। মায়াকাং যখন সতেরো বছরের তখন ওর মা মারা যায় রোগে ভুগে, সম্ভবত, টাইফয়েডে। মায়াকাং সুন্দরী ছিল। তার মাতৃকুল আপাতানি। এই উপজাতিদের সৌন্দর্যের জন্য খ্যাতি আছে। ওর পিতৃকুল ইংরাজ মায়াকাং—এর চোখের রং ছিল কটা, পিঙ্গল।

‘এরপর মায়াকাং আয়ার কাজ নেয়ে নোবান চা—বাগানের ম্যানেজারের কোয়ার্টারে। সাহেব ম্যানেজার ডেনিস ম্যাকব্রাইট তার বউ আর দুটি বাচ্চচা। চা—বাগানটা বিক্রির কথাবার্তা চলছে, ভালোরিয়ারা সেটা কিনতে চায়। ব্রিটিশ চা কোম্পানিগুলো তাদের বাগান ভারতীয়দের কাছে বিক্রি করে চলে গেলেও, দু—চারটে বাগান অনেক দিন পর্যন্ত তারা রেখে দিয়েছিল, এই নোবান তাদের মধ্যে একটি। ডেনিস ম্যাকব্রাইটের বাংলোয় মায়াকাং আট—ন বছর কাটায়। এর মধ্যে তার বিয়ে হয় কিন্তু কয়েক মাস পরই বিধবা হয়ে তার পুরোনো কাজে ফিরে আসে। অবশ্য ডেনিসের ছেলেদুটি ততদিনে বড়ো হয়ে উত্তর ইংল্যান্ডে লীডসে তাদের ঠাকুমার কাছে চলে গেছে স্কুলে পড়ার জন্য।

‘বাংলাদেশ যুদ্ধ যখন শুরু হল তখন চা—বাগান অঞ্চল দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢোকার জন্য বিদেশি সাংবাদিকদের আনাগোনা শুরু হল। ম্যাকব্রাইটের কলকাতার এক বন্ধুর চিঠি নিয়ে হাজির হল এক অস্ট্রিয়ান ফোটোগ্রাফার। ডেনিস তাকে খাতির করে বাংলোয় রাখল। লোকটির নাম হান্স গুন্টার ভিঙ্কলার, বছর বত্রিশ বয়স। ১৯৬৪ টোকিও অলিম্পিকসে জার্মান রোয়িং টিমে ছিল, একটা ব্রোঞ্জ মেডেলেও পায়। ডেনিসের বাংলোকে ঘাঁটি করে সে ছবি তুলতে যেত। দু—চার দিন পর ফিরে এসে ফিল্ম ডেভেলপ, প্রিন্ট করে ডেনিসের সাহায্যে কলকাতায় পাঠাত। দিন পনেরো থেকে ভিঙ্কলার চলে যায় আর তার দু—মাস পর ডেনিসকে তার বউ জানায় মায়াকাং গর্ভবতী।’

সারদাচরণ কথা বলা থামলেন। শ্রোতাদের মুখে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখবেন আশা করে ভ্রূ তুলে রইলেন।

‘কাজটা ভিঙ্কলারের?’ হীরাভাই বলল।

‘তা না হলে আবার কার?’ অর্জুন মৃদু ধমক দিল।

‘কেন ডেনিসই কি কাজটা করতে পারে না?’ হীরাভাই তর্ক শুরুর পথ দেখতে পেরে পা বাড়াল।

‘কাজটা ভিঙ্কলারেরই।’ সারদাচরণ দুজনকেই থামিয়ে দিলেন। ‘মায়াকাংয়ের স্বীকারোক্তি থেকে এটা জানা যায়। এদিকে চা—বাগান বিক্রির কথা তখন পাকা হয়ে গেছে। ম্যাকব্রাইটরা ইংল্যান্ডে ফিরে যাবে। মায়াকাংকে নিয়ে তারা পড়লেন মুশকিলে। অবশেষে তাদের খুব পরিচিত এক রিটায়ার্ড ইংরেজ কর্নেল, বিপত্নীক, বৃদ্ধ গ্রেহাম পার্কসের কাছে তার থাকার ব্যবস্থা করলেন কার্শিয়াংয়ে। আর্মি থেকে রিটায়ার করে পার্কস সেখানে একটা বাংলো বানিয়ে রয়েছেন প্রায় বাইশ বছর। দেশে আর ফিরবেনই না ঠিক করেছেন। ওর স্ত্রী মারা গেছেন ১০৭০—এ। দেখাশোনা করার লোক দরকার ছিল।

‘কার্শিয়াংয়ে মায়াকাংয়ের একটি মেয়ে হল। আর মেয়েটিকে প্রসব করতে গিয়ে সে মারা গেল। বৃদ্ধ কর্নেল পড়লেন মুশকিলে। কে সেই বাচ্চচার লালনপালন করবে? ওখানকার এক নেপালি পরিবারে বাচ্চচাটিকে রাখলেন, সেজন্য টাকাও দিতেন। কিন্তু বছর দুই পর তারা বাচ্চচাটাকে ফিরিয়ে দেয়, কেননা তাদের সংসারে নানান বিপর্যয়ে, ঝগড়াঝাঁটিতে ভাঙন ধরায় হাঁড়ি আলাদা হয়ে গেছে। কেউই বাচ্চচাটাকে রাখতে রাজি নয়। পার্কস তখন চিঠি লিখতে শুরু করলেন নানান অনাথ আশ্রমে। অধিকাংশ চিঠিরই উত্তর এল না। শুধু দুটি অর্ফ্যানেজ অক্ষমতা জানিয়ে বলে তিন বছরের বাচ্চচাকে নিতে তারা অক্ষম।

‘সেই সময় আমি আর আমার বোন সুরুচি দার্জিলিং বেড়াতে যাই। সুরুচি বিয়ে করেনি, লা মার্টিনিয়ারের টিচার। দার্জিলিংয়ে আমরা এক আত্মীয়ের বাড়িতে ছিলাম। তিনিও রিটায়ার্ড ব্রিগেডিয়ার। আমরা একদিন জিপে কার্শিয়াং বেড়াতে যাই। আমার আত্মীয় বললেন, চলো একবার কর্নেলের সঙ্গে দেখা করে যাই। কার্টসি কল! আমরা আর বাংলোয় ঢুকলাম না, জিপ থেকে নেমে পায়ের আড়ষ্ঠতা কাটাতে হাটাচলা করতে লাগলাম। সেই সময় সুরুচি হঠাৎ বলে উঠল, ‘দাদা কী বিউটিফুল দেখো!’ কর্নেলের বাংলোর বাগানে একটা বছর পাঁচেক বাচ্চচা মেয়ে, পরনে লাল গেঞ্জি আর জাঙ্গিয়া, দুটোই ময়লা, হাতে মুখে মাটি, অপরিচ্ছন্ন চুল, একটা গাঁদা গাছের আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ করছে, দু—চোখে কৌতূহল। সুরুচি হাতছানি দিয়ে ডাকতেই একটু ইতস্তত করে পায়ে পায়ে এগিয়ে এল। ওর নাম জিজ্ঞাসা করায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বুঝলাম ভাষা বুঝতে পারছে না।

‘বাংলোর ভিতর থেকে তখন কর্নেল আর ব্রিগেডিয়ার বেরিয়ে আসছেন। সেই বাচ্চচাটিকে দেখিয়ে ব্রিগেডিয়ার বললেন, ‘এর কোনো ব্যবস্থা করতে পারলেন।’ কর্নেল বিষণ্ণমুখে মাথা নেড়ে বললেন, ‘না’। আমার এখন থেকে একে নিয়েই চিন্তা। কত জায়গায় লিখলাম, কত লোককে বললাম যদি অ্যাডপ্ট করে!’ ফিরে আসার সময় ব্রিগেডিয়ার, বাচ্চচাটি সম্পর্কে যতটুকু জানতেন আমাদের বললেন। শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। জিজ্ঞাসা করলাম ওর বয়স কত? উনি বললেন তিন। চমকে উঠলাম, তিন! আমি তো ভেবেছিলাম পাঁচ। তখন আমি মানুষের শরীরের উপর হেরেডিটির অর্থাৎ বংশ পরম্পরাক্রমে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের উপর একটা রিসার্চ প্রোজেক্টে নিযুক্ত ছিলাম। বাচ্চচাটির বয়সও শরীরের অনুপাতের মধ্যে, গড়পড়তা ভারতীয় বাচ্চচার যেরকম গঠন হয়, সেইরকম, গঠন ছিল না। বললাম ওকে আর একবার দেখব, ওর বাবা—মা সম্পর্কেও যতটা পারা যায় জানব।

‘রাতে আমার বোন সুরুচি হঠাৎ বলল, তার মায়া হচ্ছে বাচ্চচাটার জন্য, বাচ্চচাটাকে তার খুব ভালো লেগেছে, সে অ্যাডপ্ট করবে। পার্ক সার্কাসে সে একা ফ্ল্যাটভাড়া নিয়ে থাকে। ভালো বেতন পায়। ওর পক্ষে কোনো অসুবিধেই হবে না। নানাদিক থেকে ব্যাপারটা নিয়ে আমরা দুজনে অনেকক্ষণ আলোচনা করি। আমাদের প্রস্তাব শুনে ব্রিগেডিয়ার তো খুব খুশি। পরদিন সকালেই আমরা আবার কার্শিয়াং গেলাম। কর্নেল বুড়ো তো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সিন্ধুবাদের নাবিকের মতো বাচ্চচাটা তার ঘাড়ে চেপে বসেছিল। আমি বাচ্চচাটার বাবা—মায়ের কথা জানতে চাইলাম। কর্নেল পার্কস তখন ডেনিস ম্যাকব্রাইটের কাছ থেকে যা যা শুনেছিলেন তাই জানালেন আর সেটাই একটু আগে আমি আপনাদের বলেছি।

‘মায়াকাং চা—বাগান থেকে কার্শিয়াং—এ আসে একটা সুটকেশ নিয়ে। সে মারা যাবার পর কর্নেল সেটা খুলে তার মধ্য থেকে পান দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এক ব্রিটিশ স্যাপার ইউনিটের নম্বর লেখা মেটাল রিস্টব্যান্ড, ছুটি মঞ্জুরের একটি চিঠি তাতে প্রাপকের নাম রয়েছে: সার্জেন্ট জে বি স্টিভেনসন। কয়েক ছড়া পাথরের মালা যা আপাতানি মেয়েরা ব্যবহার করে। এগুলো তার মায়ের কাছ থেকে পাওয়া। আর মায়াকং—এর নিজস্ব বলতে ছিল কয়েকটি সাদাকোলো ফোটো। বলাবাহুল্য সেগুলো ভিঙ্কলারের তোলা। একটি ছিল গ্রুপ ফোটো, তাতে ম্যাকব্রাইট দম্পতি ও মায়াকাং দাঁড়িয়ে বাংলোর সামনে। তিন—চারিটি ছিল শুধুই মায়াকাং—এর, নানাভাবে পোজ দিয়ে লাজুক মুখ থেকে বোঝা যায় ফোটোগুলি ঠিক প্রকাশ্যে নয়, কারোর অনুরোধে, নির্দেশে একটু আড়ালেই তোলা। কয়েক বছর খামের মধ্যে অযত্নে পড়ে থাকায় ছবিগুলো হলুদ হয়ে গেছে। তবু বোঝা যায় কি অপরূপ সুন্দরী ছিল। মুখটা গোল, নাক চোখা, জোড়া ভ্রূ, বেশ বোঝা যায় ইংরেজ রক্ত আর শারীরিক প্রভাব এর উপজাতীয় হেরেডিটিকে বদলে দিয়েছে। গ্রুপ ফোটোয় মায়াকাং—এর পাশে দাঁড়ানো মিসেস ম্যাকব্রাইটকে খাটো দেখালো। কর্নেল আমাকে বলেন, মায়াকাং অন্তত পাঁচ ফুট ছয় বা সাত ইঞ্চি লম্বা ছিল। কিন্তু সবথেকে আকর্ষণীয় এবং মূল্যবান, অন্তত আমার কাছে, হান্স গুন্টার ভিঙ্কলারের ছবিটা। ম্যাকব্রাইটের পাশে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে। কার তোলা বলতে পারব না, হয়তো মিসেস ম্যাকব্রাইটের।

‘অন্তত সাড়ে ছ—ফুট লম্বা, উঁচু প্রশস্ত কপাল। পাতলা ভ্রূ, মেয়েদের নজরে পড়ার মতো মুখশ্রী, আর পাথরে কোঁদা শরীর। টোকিও অলিম্পিকসের পর প্রতিযোগিতামূলক রোয়িং—এ আর অংশ নেয়নি কিন্তু অভ্যাসটা যে ছাড়েনি সাত বছর পর ওর শরীর দেখে সেটা বোঝা যায়। মায়াকাংকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। ভিঙ্কলারের দেহের কাঠিন্যের মধ্যে একধরনের আকর্ষণ ছবির মধ্য দিয়েও অনুভব করা যায়।’

‘তাহলে আমাদের এই মেয়েটির নাম স্বর্ণকুমারী ভিঙ্কলার আর মায়ের নাম মায়াকাং স্টিভেনসন!’ হীরাভাই উৎসাহ নিয়ে সোফার কিনারে টেনে আনল তার নিতম্ব। ‘ইংরেজ ও অস্ট্রিয়ান রক্তের সঙ্গে এখনকার অরুণাচলের উপজাতীয় রক্ত মিশে তৈরি হয়েছে এই মেয়ে।’

‘সোলজার আর অলিম্পিক বোয়ার, এমন দুটি লোকের শরীরের খাটবার আর সহ্য করার ক্ষমতার ভাগও পেয়েছে!’ অর্জুন বলল।

সারদাচরণ এইসব কথা যেন শুনতেই পাননি, এমন ভাব মুখে ফুটিয়ে বলে চললেন, ‘বাচ্চচাটির আর তার মায়ের জন্মবৃত্তান্ত, যে সব ঘটনার যোগাযোগের মধ্য দিয়ে এই বাচ্চচা মেয়ের জেনেটিক প্রোফাইল গড়ে উঠেছে তা জানার যদি না আমি ওর সম্পর্কে আগ্রহী হইল তাহলে আমি একজন বাজে ফিজিয়োলজিস্ট হিসাবে গণ্য হব। ওকে দেখেই জেনে যাই চমকপ্রদ দেহ উত্তরাধিকারসূত্রে মেয়েটি পেয়েছে। বাচ্চচাদের দৈহিক পরিণতি লাভের ইঙ্গিত পাওয়া যায় তার অস্থিকাঠামোর বয়স ধরে, তাতে আমার মনে হয়েছিল তারিখধরা বয়সের থেকে এই শিশু অন্তত চার—পাঁচ মাস এগিয়ে। এটা চার বছরের কমবয়সিদের পক্ষে খুব তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য। ওর পেশির গড়নও ছিল চমৎকার। চার দিন পর বাচ্চচাটিকে নিয়ে আমরা কলকাতায় ফিরে আসি।’

সারদাপ্রসাদ তীক্ষ্ন চোখে শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে তার এই বৃত্তান্তের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগলেন। রাহুলের মনে হল, বাচ্চচাটিকে সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যটা যেন ওনার রিসার্চেরই একটা অঙ্গ। হয়তো সে লোকটি সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত উনি পালিত কন্যা সম্পর্কে যে ভাবে বললেন তাতে পিতৃসুলভ ভাবের থেকে বিজ্ঞানীর মনই যেন বেশি প্রকাশ পেয়েছে।

‘আপনারা নিশ্চয় লক্ষ করেছেন, আমি কিন্তু এখনও শিশুটির নাম উল্লেখ করিনি।’ সারদাচরণ চোখ রাখলেন রাহুলের উপর। ‘একটা মেয়ের পক্ষে নামটা অস্বাভাবিকই: আলি। আমি বা আমার বোন নামটা পছন্দ করিনি। কর্নেল জানিয়েছিলেন এটা ওর মায়েরই দেওয়া। কেন যে এমন একটা মুসলমানি নাম রাখল তা বলতে পারব না। নামটা পালটাব ঠিক করলাম কিন্তু তখুনি নয়। আগে সে আমাদের সঙ্গে সড়গড় হোক তারপর বদলাব। এক বছর পর, অ আ ক খ শেখার আগে, নামটাকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে সোনালি বলে ডাকতে লাগলাম। দেখলাম এটা ওর মনে ধরেছে।’

‘আমারও খুব ভালো লাগছে।’ হীরাভাই দু—হাত তুলে জানাল। ‘কানে দারুণ লাগছে—কাগজে, ম্যাগাজিনে, টিভি—তে শুধু স্বর্ণকুমারী সোনালি। হিট, সিওর হিট!’

‘এসব ব্যাপারে তখন আমরা চিন্তা করিনি। আর পাঁচটা স্কুলে যাবার বয়সি মেয়েদের মতোই সে পার্কসার্কাসে নাসিরুদ্দীন রোডের বাড়িতে বড়ো হয়ে ওঠে।”

রাহুল ভ্রূ কুঁচকে বলল, ‘স্কুলেই কি ওর স্পোর্টসের ক্ষমতাটা জাহির হয়ে যায়নি। ফিল্মে তো আপনি বললেন ও জীবনে কখনো মেয়েদের সঙ্গে কমপিট করেনি।’

‘ঠিকই। যদি ভালোভাবে আমার কথা শুনে থাকেন, আমি বলেছি ওর স্কুলে যাবার বয়সের কথা, স্কুলে গেছে এমন কথা বলিনি। আমার বোন ওকে বাড়িতেই পড়াত, এ জন্য প্রাইভেট টিউটরও ছিল।’

‘কেন?’

‘এটা আমরাই ইচ্ছাতে হয়েছে। ওর মানসিক, শারীরিক বিকাশের জন্য সম্ভাব্য সবরকম সুযোগ যাতে পায়, সেজন্যই স্কুলে দিইনি। পুষ্টি সম্পর্কে, ব্যায়াম সম্পর্কে আমার নিজস্ব যে চিন্তা সেটা থেকে পুরোপুরি উপকার পাওয়া সোনালির পক্ষে সম্ভব হত না যদি ও স্কুলে ভরতি হত। বাড়িতে আমরা ওর সুষম খাদ্যের দিকে বা দেহের ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ আর খেলাধুলার দিকে নজর দিতে পারব। শরীরের দিক থেকে ও যা পেয়েছে সেটা তো প্রকৃতিরই দান। যাদের এমন খেলোয়াড়ি শরীর তাদের এমন এক ধরনের শিক্ষা দরকার বা চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করায়, দাবি জানায়। ওর বয়সি বাচ্চচাদের স্কুলে যে শরীর শিক্ষা দেওয়া হয় সেটা একদমই বাজে। ফলে একঘেঁয়ে বিরক্তি বোধ করত আর বাড়তি ওজন শরীরে জমত।’

সারদাচরণের যুক্তি শুনতে শুনতে রাহুলের মাথা গরম হয়ে উঠছিল। নিজেকে যথাসাধ্য সংযত রেখে সে বলল, ‘ওর সামাজিক উন্নতি ঘটাবার কথাটা কি ভেবেছিলেন?’

‘নিশ্চয়। ছ—বছর বয়সে ওকে নাচের স্কুলে ভরতি করানো হয়, রবীন্দ্র সরোবরে সাঁতারের ক্লাবে গিয়ে সাঁতারও কাটত। দু—জায়গাতেই ওর বন্ধু সংখ্যা কম ছিল না। ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত সোনালি এইভাবেই বড়ো হয়ে ওঠে। ছোটো থেকেই ওকে পার্কসার্কাস ময়দানে দৌড় করাতাম। ওর অগ্রগতির হিসাব রাখতাম। ষোলো বছরে ওকে রেস কোর্সে নিয়ে গিয়ে ট্রায়াল নিলাম আর তাই থেকে একটা জিনিস বুঝলাম, ঠিকমতো ট্রেনিং ব্যবস্থা করলে আর প্রথম শ্রেণির কোচের উপদেশ পেলে সোনালি অলিম্পিকসে যাবার মতো পর্যায় দু—তিন বছরের মধ্যেই পৌঁছবে। এমনকী সোনার মেডেলও জিততে পারে। যদি বলি এই প্রথমবার আমার মনে ওর অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হবার সম্ভাবনার কথাটা জাগল, তাহলে মিথ্যে বলা হবে। এই চিন্তাটা বহু বছর আগেই মাথার মধ্যে ডিম পেড়েছিল। কিন্তু সেটা ফুটিয়ে বাচ্চচা বার হতে দিইনি অর্থাৎ আমার আকাঙ্ক্ষার বোঝা বাচ্চচার কচি কাঁধের উপর চাপিয়ে দিতে চাইনি। তবে কোনো শিশু কৈশোরে পৌঁছে যদি বিরাট ট্যালেন্ট প্রকাশ করে বা বড়ো কিছু করার সম্ভাবনা দেখায় তাহলে আমার মনে হয়, অভিভাবকদের এটা নৈতিক কর্তব্য সেই ট্যালেন্টকে লালন করার, বাড়িয়ে তোলার জন্য তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করা। পৃথিবীতে খেলার ইতিহাসে এইরকম বাবা—মায়ের কথা প্রচুর পাওয়া যাবে। যথাযোগ্য উৎসাহ পেলে ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়েরা পৃথিবীর সেরাদের হারাতে পারে।’

‘আর কমপক্ষে লাখ পঁচিশ টাকা তো ব্যাঙ্কে আসতে পারেই।’ হীরাভাই আন্দাজে একটা হিসাব দিয়ে ফেলল।

‘রানার হিসাবে সোনালির সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা আমার করা উচিত আর সে জন্য যা যা প্রয়োজন বিশেষ করে কোচ, জিমন্যাসিয়াম, দূরপাল্লা দৌড়ের জন্য উপযুক্ত রাস্তা, এগুলো যাতে সে পায় তার ব্যবস্থাও করা দরকার। এসবের জন্য টাকা লাগে কিন্তু আমার অত টাকা নেই।’

‘আর সেই টাকার ব্যবস্থা করতে ওনার সঙ্গে আমাদের যোগ দেওয়া।’ অর্জুন জানিয়ে দিল রাহুলকে।

‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা সেইরকমই।’ সারদাচরণ হাসলেন। রাহুলকে লক্ষ্য করেই বললেন, ‘স্পনসর করার মতো লোকেদের কাছে টাকার জন্য যাব ভেবে প্রথমে অর্জুনবাবুর কাছেই ব্যাপারটা বলি। উনি তো শোনামাত্রই উৎসাহিত হলেন। আমার এই প্রোজেক্টকে একটা বাণিজ্যিক প্রস্তাবের রূপ দিয়ে কয়েকজন চেনালোকের কাছে কথা পাড়ি। কিছু টাকা যদি ফিরে পাবার সম্ভাবনা না থাকে তাহলে লোককে টাকা ইনভেস্ট করার জন্য তো বলা যায় না। হীরাভাইবাবু তাদের মধ্যে একজন যিনি টাকা দিয়েছেন সোনালিকে সামনের ওলিম্পিকসে স্বর্ণকুমারী হয়ে ওঠার কাজে মদত দিতে। এ পর্যন্ত চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মোট খরচ ধরা হয়েছে, পাঁচ লাখের কিছু বেশি।’

রাহুল মুখ তুলে সিলিংয়ের দিকে তাকাল।

‘আমরা পঁচিশ লাখ কমপক্ষে আশা করছি, তাহলে সুদসমেত ইনভেস্টমেন্টের টাকাটা ফিরিয়ে দেওয়া যাবে। আর সেই জন্যই আপনাকে আমাদের দরকার।’

চারজোড়া চোখের দৃষ্টি রাহুলের মুখে বিঁধে গেল। শুকনো হেসে সে বলল, ‘পঁচিশ লাখ!’

‘আপনি কার্ল লিউইস বা রেটন বা ফ্লোরেন্স জয়নার কত টাকা কামিয়েছে তা নিশ্চয় জানেন? মার্ক স্পিৎজের কথা ভাবুন!’ হীরাভাই নামগুলো উল্লেখ করে বুঝিয়ে দিল সে এই ব্যাপারে খেলো নয়, খবর রাখে।

‘ওরা প্রত্যেকে আমেরিকান। সে দেশে টাকা ফেলে জিনিস কেনার লোকের সংখ্যা বিরাট আর তাদের কাছে ওরা কিছুদিনের জন্য দেবদেবী পর্যায়ে উঠে গেছিল, মিডিয়াই উঠিয়ে দিয়েছিল। আর ওদের সাফল্যের বহরটাও মনে রাখবেন। কেউ তিনটে, কেউ চারটে, কেউ সাতটা সোনা, তার সঙ্গে অবিশ্বাস্য বিশ্বরেকর্ড!’

‘আমাদের দেশেও লোকে এখন টাকা বার করছে মাল কেনার জন্য। অলিম্পিকসে সোনা তো বটেই কেউ একটা কাঁসার মেডেল পেলে এখন ভারতের লোক মন্দির বানিয়ে তার পুজো করবে। পঁচিশ লাখ আসবে না, কি বলছেন আপনি!’ হীরাভাইয়ের অবাক হওয়াটাকে রাহুলের মনে হল যেন তার পেশাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলা হল। কিন্তু তাতে সে উসকে উঠল না।

‘দেখুন, স্বর্ণকুমারীকে দারুণ দেখতে, চমৎকার দৌড়য়ও। কিন্তু পঁচিশ লাখ টাকা টেনে বার করতে পারার মতো জোর ওর নেই।’

‘যদি ম্যারাথন আর দশ হাজার মিটার, দুটো সোনা জেতে?’ সারদাচরণ নিরাবেগ মুখ নিয়ে প্রশ্নটা করলেন।

রাহুল হেসে উঠল। মাথা নেড়ে বলল, ‘অসম্ভব। এবার কিন্তু আমরা আজগুবি কথায় চলে গেছি। এরপর কী বলবেন ১০০ মিটারেও সোনা জিতবে?”

‘না, তা বলব না, তবে মি. অরোরা মেয়েদের ম্যারাথন মাত্র দুটো অলিম্পিকসে হয়েছে আর দশ হাজার হয়েছে মাত্র একবার। বলতে গেলে দুটোই নতুন। এখনও পর্যন্ত দূরপাল্লা দৌড়ে কোনো মেয়ে একই অলিম্পিকসে এই দুটোর সোনা জেতেনি।’

‘এবারে যে কেউ জিতবে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে কি? ওলিম্পিকসে একটা ইভেন্টের জন্য পূর্ব জার্মানিতে একডজন মেয়ে ট্রেনিং পাচ্ছে দশ বছর বয়স থেকে। রাশিয়ানরা, চীনারাও এ ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। অসম্ভব, যে দেশের অলিম্পিকস দৌড়ে মেডেল জেতার ঐতিহ্য বলে কোনো ব্যাপার নেই সে দেশে একটা মেয়ে আনবে দু—দুটো সোনা! রূপকথায় এসব হয়।’

ঠান্ডা চোখে রাহুলের দিকে তাকিয়ে সারদাচরণ কথাগুলো শুনে বললেন, ‘ঠিক আছে। এটাই যখন আপনার ধারণা তা হলে কিছুক্ষণ না হয় রূপকথার জগতেই আমরা বাস করি। মি. অরোরা আপনার সুবিজ্ঞ মতামত দিয়ে যদি একটু উপকার করেন তা হলে ধন্য মনে করব। ধরুন আজগুবিটাই সত্যি হয়ে গেল। স্বর্ণকুমারী অলিম্পিকসে গেল আর দুটো সোনাও জিতল। এক অজ্ঞাত অনামা ভারতীয় মেয়ে, আপনার কথায় যাকে দারুণ দেখতে, দুবার সে বার্সিলোনা স্টেডিয়ামে সোনা পেল, আর সেটা দেখল ইতিহাসের বৃহত্তম টিভি দর্শকরা। আপনি যদি আগাম জেনে থাকেন এইরকম একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে আর আপনি যদি সেই মেয়েটির এজেন্ট হন আর বিজয় মঞ্চ থেকে তার নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচার যন্ত্রকে চালু করার বোতামটি যদি টেপার অপেক্ষায় আপনার আঙুলের সামনে থাকে, তা হলে বাণিজ্যের দিন থেকে কত টাকা আপনি তুলতে পারবেন বলে আশা করেন?’

রাহুল কাঁধ ঝাঁকাল। ‘তা, মোটামুটি ভালোই হবে। তবে ডা. সরকার আমি দিবাস্বপ্ন নিয়ে বাণিজ্য করি না।’

‘পঁচিশ লাখ? পঞ্চাশ?’

‘হতে পারে। দেখুন, ম্যারাথন আর দশ হাজার মিটার দৌড়ের মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র সাত দিন। বিশ্ব পর্যায়ের মেয়েদের সঙ্গে ৪২ কিলোমিটার আর ১০ কিলোমিটার, দুটো এতবড়ো দৌড় টানার ধকল কোনো মেয়ের পক্ষে সওয়া সম্ভব নয়। তা ছাড়া ড্রাগ টেস্টও আছে।’

‘ড্রাগের কথা তো আমরা বলিনি!’ সারদাচরণ আহত স্বরে বললেন, ‘আমরা যে প্রস্তাব দিচ্ছি তাতে কারচুপির কোনো ব্যাপারই নেই। আপনার কাছে এ সবই নতুন ব্যাপার কিন্তু আমরা এটা নিয়ে দু—বছর কী তার বেশিই হবে, দিন কাটাচ্ছি। এই প্রোজেক্টের কাজকর্ম, এর সাফল্যের সম্ভাবনা বুঝে উঠতে আপনার কিছুটা সময় লাগবে। তাই আমি বলছি আজকের মতো আলোচনাটা মুলতুবি রেখে রবিবার আবার বসা যাক।’

‘সেই ভালো। আলোচনায় আমি বসব কেননা অর্জুনের ডাক পেয়েই এসেছি। এত দিনের বন্ধুর মনে দুঃখ দেওয়া ঠিক হবে না ভেবেই বসব। তবে যত টাকা পাবেন বলে আশা করছেন সেই বিষয়ে আগাম একটা কথা বলে নিই। যে ভাবেই হোক ব্যাপারটা আপনারা হয়তো করে ফেললেন আর মেয়েটিও দুটো সোনা জিতে গেল, তাতেই যে পঁচিশ বা পঞ্চাশ লাখ আপনারা পাবেনই তার কোনো গ্যারান্টি নেই। মনে রাখবেন, আমরা কারবার করছি একজন মানুষ নিয়ে, বাজারে বেচার সাবান বা টুথপেস্ট নিয়ে নয়। কত আদায় হবে সেটা নির্ভর করছে, মেয়েটির নিজের উপর। তার পার্সোনালিটি, তার চেহারা, স্বভাব—চরিত্র, তার কথাবার্তার ধরন—ধারণ এই সবই তখন বিচার্য বিষয় হবে। আপনারা জানেন কি সোল অলিম্পিকসের পর ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নার কত টাকার কনট্র্যাক্ট পেয়েছিল?’

রাহুল প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাল। তার মনে হল এরা সবাই সেটা জানে কিন্তু তার মুখ থেকে শোনার জন্য চুপ করে আছে। বেশ, তা হলে আবার জানুক। ‘অলিম্পিকসে মিডিয়া ওর ডাক নাম দিয়েছিল ‘ফ্লো জো’ কিন্তু দু মাসের মধ্যে সেটা বদলিয়ে নাম রাখল ‘ক্যাশ ফ্লো’। বড়ো বড়ো কর্পোরেট বিজ্ঞাপনদাতারা সোল গেমসের পর অলিম্পিয়ানদের সম্পর্কে খুব বেশি উৎসাহ দেখায়নি। তার কারণ টিভি দর্শকদের রেটিং যা আশা করা হয়েছিল তার থেকেও অনেক কম হয়, দর্শকদের নিস্পৃহতাই এই রেটিং থেকে প্রকাশ পায়, তা ছাড়া ড্রাগের ঘটনায়ও গেমসে কলঙ্ক লেগেছিল। এই দুটি কারণে তারা আগ্রহ বোধ করেনি। কিন্তু ফ্লোরেন্স তিনটে সোনা, একটা রূপোর সঙ্গে এনডোর্সমেন্ট আয়ের মেডেলটা জিতে নেয়। সোল গেমসের আগে বক্তা হিসাবে ওর হাজির থাকার কী ছিল দশ হাজার ডলার, গেমসের পর হয় ২৫ হজার ডলার।’

‘এখন এক ডলারে কত টাকা?’ হীরাভাই ফিসফিস স্বরে বলল।

‘প্রায় ষোলো টাকা।’ রাধিকা বলল।

‘তা হলে দু—চারটে কথা বলার জন্য প্রায় চার লাখ টাকা!’ হীরাভাই নির্ভেজাল বিস্ময় নিয়ে রাহুলের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘ফ্লোরেন্সের এজেন্ট এক—একটা প্রোডাক্ট এক বছরের জন্য এনডোর্সমেন্ট বাবদ তিন লক্ষ ডলার চেয়েছিল, দরাদরি করে সেটা আড়াই লক্ষ ডলারে দাঁড়ায়। পুতুল তৈরি করে এম সি এ, তারা বারবি ডল বানিয়ে বিরাট সফল হয়েছিল, সেই আদলে ‘ফ্লো জো’ ডল বানাবার চুক্তি করে ফ্লোরেন্সের সঙ্গে। সে জন্য লাইসেন্সিং কনট্র্যাক্টে সে প্রথমে পায় আড়াই লাখ ডলার আর পাচ্ছে বিক্রির একটা পার্সেন্টেজ। এ ছাড়া সফট ড্রিঙ্কস, অ্যাপারেল, ইলেকট্রনিক্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গেও চুক্তি হয়। কিন্তু কথাটা হল, কেউ এত পেল না অথচ ও পেল কেন? ১৯৮৪—তে মেরি লু রেটন জিমন্যাস্টিকস সোনা জিতে এনডোর্সমেন্ট থেকে প্রায় আধ কোটি ডলার আয় করেছিল। এত টাকাই ১৯৭২—এ পেয়েছিল মার্ক স্পিৎজ। ফ্লোরেন্সের আয় বছরে দশ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছিল। সেটা কি শুধু রেকর্ড করা পারফরমেনসের জন্যই? সে তো অনেকেই করেছিল।

‘আসল ব্যাপারটা হল ইমেজ। সোলে যাওয়ার আগে থেকেই সে নিজের একটা স্বতন্ত্র ইমেজ তৈরি করে যাচ্ছিল সযত্নে। সোলে সেটাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে অবিশ্বাস্য ১০০ মিটার রেকর্ড করে। নিউ ইয়র্ক ওয়াল্টার টমসনের ডিরেক্টর অফ ট্যালেন্ট তখন বলেছিল: ‘শী ইজ গ্রেট লুকিং, ওয়ারস কালারফুল কস্টিউমস অ্যান্ড ইজ আ পার্সোনালিটি।’ এক পা কাটা রানিং স্যুট, লম্বা লম্বা রঙিন নখ তার ইমেজকে ওরিজিনালিটি আর ফ্রেশনেস দিয়েছিল। নিউ ইয়র্কের আর একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সি, ওগিলভি গ্রুপের কাস্টিং বিভাগের হেড বলেছিল, ফ্রোরেন্স এক ধরনের চরিত্র আর ওর আপিলটা সেখানেই। বিজ্ঞাপন কোম্পানির কর্তারা ওকে কর্পোরেট প্রতিনিধি হিসাবে সব থেকে আকর্ষণীয়া মনে করেছিল বলেই এখন সে প্রায় এক কোটি ডলারের মালিক।’

‘ষোলো কোটি টাকা।’ হীরাভাই বলল।

‘আমরা তো ২৫ লাখের বেশি ভাবতে সাহসই পাইনি! পাব কী করে, ভারতে অত বড়ো বড়ো কোম্পানিই যাদের প্রোডাক্ট পৃথিবী ছড়িয়ে বিক্রি হয়! বিজ্ঞাপনে খরচ করবে কাদের জন্য? খদ্দেররা তো গরিব।’ অর্জুন বলল।

সারদাচরণ চুপ করে এতক্ষণ শুনছিলেন। এবার কথাবার্তার মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্য বললেন, ‘মি. অরোরা, একটা কথা আপনাকে বলতে পারি, লাখ পাঁচেক টাকা যের আমরা এই প্রোজেক্টে ঢেলেছি সেটা একেবারেই কিছু না জেনে, না বুঝে অজ্ঞের মতো নয়। সত্যি কথাটা হল আমরা এখন টেলিভিশন যুগে। অন্যান্য স্পোর্টসের মতো দৌড়ও এখন এত ছক কেটে হচ্ছে যার ফলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও হাড্ডাহাড্ডি হচ্ছে। বিজয়ী আর বিজিতের মধ্যে পার্থক্যটা অতি সামান্য। অনিশ্চয়তা না থাকলে নাটকীয়ত্ব থাকে না, দর্শকদের জড়িয়ে পড়াটাও ঘটে না।’

‘যে মাঠে টিভি ক্যামেরা চলবে না, সেখানে স্পনসরসও থাকবে না, স্পোর্টসও আর হবে না।’ রাহুল কথাগুলো বলল সারদাচরণের সঙ্গে সুর মিলিয়ে। ‘এ পর্যন্ত আমি আপনার সঙ্গে একমত। কিন্তু নাটকীয়তা কি দূরপাল্লার দৌড়ে সম্ভব?’

‘সম্ভব, যদি অজানার, অপ্রত্যাশিতের পরশ তাতে থাকে। কিনিয়ার অ্যাথলিটরা কেমন চমক জাগিয়েছিল নিশ্চয় আপনার তা মনে আছে। ইথিওপিয়ার আবেবা বিকিলা? খালি পায়ে দৌড়ে রোমে ম্যারাথন জিতে আবার টোকিওতেও জিতেছিল। লোকে টগবগ করে উঠেছিল। মুখে মুখে তখন কিনো, টেমু, বিকিলার নাম। আফ্রিকার এই উত্থান কিন্তু আসলে এদের আরও দশ বছর আগে শুরু হয়েছিল। ১৯৫৪—য় ভ্যাঙ্কুভার কমনওয়েলথ গেমসে কিনিয়া দু’জন কিসি উপজাতির অ্যাথলিট পাঠায় দূরপাল্লা দৌড়ে অংশ নিতে। তখন পর্যন্ত বিশ্বাস করা হত দূরপাল্লা দৌড়ে শারীরগতভাবে সাদাদের সঙ্গে কালোরা প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্য নয়। ভ্যাঙ্কুভার যাবার পথে লন্ডনে ওরা ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়নশিপসে অংশ নেয়। তখন ব্রিটিশরা দূরপাল্লা দৌড়ে পৃথিবীর সেরা দেশগুলোর অন্যতম। সেই দুই কিনিয়ানদের একজন চেপকোনি ছয় মাইল দৌড়ে শুরু থেকেই প্রচণ্ড গতিতে এগিয়ে যায়। মাইল তিনেক পর অন্যরা তাকে পেরিয়ে যায় যেহেতু সে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। দাঁড়াবার কারণটা জানলে নিশ্চয় তাকে মাপ করে দেবেন। তার হাঁটুর হাড় সরে গেছল। অন্যজনের নাম মাইওরো। সে নামে তিন মাইল দৌড়ে। শুরু থেকে সেও দারুণ গতিতে দৌড়ায়, এমনই গতি যে পৃথিবীর সেরা কয়েকজন দূরপাল্লার রানার কিছুক্ষণের মধ্যেই ৫০ মিটার পিছিয়ে পড়ে। সবাই ভাবল কয়েক চক্করের পরই দম ফুরিয়ে ট্র্যাকে মুখ থুবড়ে পড়বে। কিন্তু পড়েনি। তাকে হারাতে সেদিন নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়তে হয়েছিল।

‘ভ্যাঙ্কুভারে মাইওরো চতুর্থ আর চেপকোনি সপ্তম হয়েছিল তাদের ইভেন্টে। ট্যাকটিকস বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ থাকায় ওরা মার খায়। কিন্তু ব্যাপারটা হল ওরা সেরা পর্যায়ের দূরপাল্লা দৌড় সম্পর্কে কোনোরকম পূর্ব ধারণা ছাড়াই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় হাজির হয়েছিল। স্রেফ ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়েছিল জেতার জন্য। কাদের সঙ্গে দৌড়েছিল? বিশ্বের অভিজাতদের সঙ্গে,যারা কি না বহু বছর ধরে এক্সপার্ট কোচিং নিয়ে ফিটনেসের চূড়োয় পৌঁছেছে, নিবিড় ট্রেনিং আর নিয়মিত কম্পিটিশনের সাহায্যে। যখন সবাই ট্রেনিংয়ের গোপন রহস্যটা জানার জন্য ওদের চেপে ধরল তখন অবাক করে দিয়ে তারা বলল, হপ্তায় মাত্র তিন দিন তারা দৌড়োয়, তাও মাত্র তিন থেকে পাঁচ মাইল। এর সঙ্গে তুলনা করুন, ইউরোপীয়ান আর আমেরিকান রানারদের বাধ্যতামূলক হপ্তায় একশো মাইল দৌড়ের!’

‘অলটিচিউডের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে।’ রাহুল বলল। কোথায় যেন একটা লেখায় সে পড়েছিল। ‘হয়তো কিনিয়া পর্বতের অঞ্চলে ওর বাস করে।’

‘এটা ঠিকই কথা, হালকা পাতলা বাতাসের মধ্যে ট্রেনিং করলে দম বাড়ে কেননা ফুসফুস আর হৃৎপিণ্ডকে বেশি খাটতে হয় পেশিতে অক্সিজেন পৌঁছে দেবার জন্য। কিন্তু সমুদ্রের লেভেলে হপ্তায় ১০০ মাইল দৌড়লে যে উন্নতি হয় ততটা সম্ভব নয় ছ—হাজার ফুট উপরে হপ্তায় পনেরো মাইল দৌড়লে। না, মি. অরোরা, অলটিচিউড—এর কারণ নয়। কিনিয়ান দু—জন অত ভালো দৌড়েছিল, যেহেতু ট্র্যাকের টেকনিক্যাল ব্যাপার—স্যাপার সম্পর্কে কিছুই না জানার জন্য বা যাদের বিরুদ্ধে দৌড়চ্ছে তাদের বিরাট খ্যাতির বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ থাকার। অতি সহজ সরল ভাবে তারা দৌড়টাকে নিয়েছিল হার—জিতের চ্যালেঞ্জ হিসাবে। অ্যাথলিটরা মনে করে সেরা প্রতিযোগীদের বিরুদ্ধে নামলে নিজেদের মানের উন্নতি ঘটবে। কথাটা হয়তো সত্যি। কিন্তু উন্নতি হবে কোন পর্যন্ত? যাদের বিরুদ্ধে দৌড়োচ্ছে তাদের স্তর বা সামান্য আর একটু উপর পর্যন্ত উঠবে। একই পর্যায়ের প্রতিদ্বন্দ্বীদের সঙ্গে অবিরত প্রতিযোগিতা করার ফলে তাদের একটা ছাঁচ এসে যায়। এক মাইল দৌড়োনো মানে ট্র্যাকটা একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে চক্কর দিতে হবে। তারা বিশ্বাস করে, ট্রেনিং তাদের শারীরিক সম্ভাবনার পূর্ণতায় পৌঁছে দিচ্ছে, আসলে কিন্তু তা দিচ্ছে না। তাই যদি হত তা হলে আমাদের ধারণায় যারা যথেষ্ট ট্রেনিং পাওয়া নয়, সেই দুই কিনিয়ান ওদের সঙ্গে লড়াইয়ে রয়ে গেল কী করে?’

‘আপনি বলতে চান নিয়মিত কম্পিটিশন একজন অ্যাথলিটের উন্নতিকে সীমিত করে দেয়।’

‘ঠিক তাই।’ সারদাচরণ একটু উত্তেজিতভাবেই বলে উঠলেন। ‘স্বর্ণকুমারী যদি কোনো অ্যাথলেটিক ট্রেনিং সেন্টারে যোগ দিত তা হলে সেখানকার অন্যান্য মেয়েদের থেকে খুব খারাপ বা খুব ভালো কিছু হত না। মাঝারিয়ানার ফাঁদে যাতে না পড়ে সে জন্য ইচ্ছে করেই আমরা ওকে কম্পিটিশনের থেকে সরিয়ে রেখেছি। এজন্য অভিজ্ঞতা থেকে ও হয়তো বঞ্চিত হয়েছে কিন্তু তার বদলে লাভও করেছে কিছু। কিনিয়ানদের মতোই দৌড়কে সে ভাবমুক্ত মনে নিতে পেরেছে, পাবলিসিটির ডামাডোল শান্তি নষ্ট করছে না আর যথাসময়ে নামী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোক্ষম ঘা মারার ক্ষমতা ও রাখে। স্বর্ণকুমারী সম্পর্কে আর কিছু বলার থেকে বরং আপনার তাকে স্বচক্ষে দেখাই ভালো। পরশু রবিবার সকালে সে ম্যারাথনে নামবে। জীবনে তার প্রথম প্রকাশ্য প্রতিযোগিতা। স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়ার উদ্যোগে পুরুষ আর মেয়েদের নিয়ে এটা হচ্ছে। পাঁচ লক্ষ টাকা টোট্যাল প্রাইজমানি। দু—বিভাগেই বিজয়ী পাবে এক লক্ষ টাকা। অশোকনগর থেকে শুরু হবে সকাল আটটায়, প্রথমে পুরুষরা, তার পনেরো মিনিট পর মেয়েরা স্টার্ট করবে। ন্যাশনাল হাইওয়ে ৩৫ ধরে এসে বারাসাত, সেখান থেকে দমদম, ভি আই পি রোড ধরে উল্টোডাঙার মোড়, ইস্টার্ন বাইপাস পাস দিয়ে সল্ট লেক স্টেডিয়ামে শেষ হবে। এই রেসটা কিন্তু ওলিম্পিক ট্রায়াল হিসেবেও গণ্য হচ্ছে। আর ঠিক দু—মাস পর ৩১ জুলাই বার্সিলোনায় অ্যাথলেটিকস ইভেন্টগুলো শুরু হবে, প্রথম দিনেই থাকছে মেয়েদের ম্যারাথন।’

‘পরশু আমি দেখতে যাব।’ রাহুল দু—হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙে বুঝিয়ে দিল আর সে কথা বলতে চায় না।

চার

‘ভোরবেলাতেই সারদাচরণ আর কোচ বিজয় সিনহা মোটরে রওনা হয়ে গেছল সোনালিকে নিয়ে অশোকনগরের উদ্দেশ্যে।

রাহুল আর অর্জুন পৌঁছল ম্যারাথন শুরু হবার আধ ঘণ্টা আগে, সাড়ে সাতটায়। ফুটবল মাঠে একটা সামিয়ানা খাটানো হয়েছে তার নীচে কাঠের মঞ্চ। সেখানে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে এক যুবক অবিরাম ঘোষণা করে যাচ্ছে। তিন—চারটি ফেস্টুন রাস্তায় আড়াআড়ি দড়ি দিয়ে বাঁধা। পুলিশ আর ভলান্টিয়াররা ভিড় ঠেলে রাখার ব্যস্ত। রেস শুরু হবার আগে বক্তৃতা হবে। পশ্চিমবাংলার ক্রীড়ামন্ত্রী বন্দুক ফুটিয়ে দৌড় শুরুর সংকেত দেবেন।

আবহাওয়া আজ খুব ভালো। এখন পর্যন্ত রোদের তাত বাড়েনি। তাপমাত্রা ৩১ ডিগ্রির কাছাকাছি রয়েছে। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। পুরুষ আর মেয়ে রানারদের হাজিরা কলকাতাতেই নেওয়া হয়। সেখান থেকে বাসে তাদের আনা হয়েছে। জানিয়েই রাখা হয়েছিল, সোনালি আলাদাভাবে আসবে অশোকানগরে।

সাত—আটটা মোটর আর পনেরোটা মোটর সাইকেল সংগঠকরা রেখেছে রানারদের সঙ্গে থাকার জন্য। দুটো অ্যাম্বুলেন্সও। ঘোষণা থেকে জানা গেল পুরুষ বিভাগে প্রতিযোগী ৭০ জন। মেয়েদের সংখ্যা ২১। আড়াইশো পুরুষ নাম পাঠিয়েছিল, তার মধ্য থেকে বাছাই করে ৭০ জনকে অনুমতি দেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে সাতজন পুরুষ এসেছে,—নেপালের তিনজন, কিনিয়া ও ফিলিপিনস থেকে একজন করে ব্রিটেন থেকে দুজন। বিদেশি মেয়ে আছে চারজন। সিঙ্গাপুর, তানজানিয়া, শ্রীলঙ্কা আর অস্ট্রেলিয়া থেকে তারা এসেছে।

ছোটো গাড়ি মারুতি নিয়ে ওরা এসেছে। স্টাটিং পয়েন্ট থেকে পঞ্চাশ মিটার দূরে গাড়িতে বসে খবরের কাগজ পড়ায় ব্যস্ত দু—জনেই। খেলার পাতায় আজকের ম্যারাথন প্রসঙ্গে যা সব বেরিয়েছে, সেগুলো খুঁটিয়ে ওরা দেখছিল। কে জিততে পারে তাই নিয়ে বিজ্ঞ আলোচনা রয়েছে। সম্ভাব্য বিজয়ী হিসাবে পুরুষদের মধ্যে একজন ব্রিটিশ আর কিনিয়ান রানারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। নামকরা নয় তবে ব্রিটিশটি গত দু—বছর লন্ডন ম্যারাথন দৌড়ে ৩১ ও ৪২ স্থান পেয়েছিল। গতবছর রটারডমে কিনিয়ানটি ৪৭ জনের পর শেষ করে। শুধু এই তথ্যের ভিত্তিতেই ওরা ফেভারিট।

মেয়েদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান ডেবি ট্যাটারসলকে বিজয়ী প্রায় বলেই দেওয়া হয়েছে। গত সোল ওলিম্পিকসে সে এগারো স্থান পেয়েছিল ২ ঘণ্টা ৩২ মিনিট ৬ সেকেন্ড সময় করে। এখন বয়স ৩১। দুই ছেলের মা। সোনা বিজয়িনী পোর্তুগালের রোজা মোতার থেকে তার সময় মাত্র ছয় মিনিটরে একটু বেশি ছিল। অন্যান্যদের যা সময় দেওয়া হয়েছে তাতে ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিটের কমে আর কেউ নেই। ভারতীয় মেয়েদের মধ্যে সেরা সময় অন্ধ্রপ্রদেশের শীলা নাইডুর ২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট। তিনটি বাঙালি মেয়ে রয়েছে তাদের দু—জনের সময় সওয়া তিন ঘণ্টার কাছাকাছি। ‘তৃতীয় মেয়ে সোনালি সরকার, তার সেরা সময় কত, তা জানা যায়নি।’

মোটর থেকে নেমে রাহুল স্টার্টিং পয়েন্টের দিকে এগিয়ে গেল। প্রায় দুশো লোকের জটলা যার মধ্যে ৭০ জন দৌড়বে। সে খুঁজছিল সারদাচরণ আর সোনালিকে। সামিয়ানার পিছনের মাঠেও একটা ভিড়। মেয়ে প্রতিযোগীরা সেখানে জড়ো হয়েছে। বেশিরভাগ মেয়েই ট্র্যাকসুট পরা, ওয়ার্ম আপে ব্যস্ত।

রাহুল পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। মেয়েদের মধ্যে তাকাতে তাকাতে একজনকে দেখে তার চোখ আটকে গেল। নিশ্চয়ই স্বর্ণকুমারী। দৈর্ঘ্য, গায়ের রং আর মুখের গড়ন তার চেনা। পরশু রাতে ফিল্মে দেখা মেয়েটিকে সে এর মধ্যেই ভুলতে পারে না। সম্ভবত কুড়ি বছর পর দেখালেও চিনে ফেলবে।

দু পা ফাঁক করে ঝুঁকে ক্যারিসথেনিকসে রত সোনালি। পরনে উজ্জ্বল হলুদ ট্র্যাকসুট। হলুদ ফিতে দিয়ে চুল টেনে বেঁধে রাখা। পাশে দাঁড়িয়ে বিজয় সিনহা তার গা গরমের ব্যায়াম দেখছে আর কথা বলে যাচ্ছে। রাহুল কাছে গিয়ে দাঁড়াল। সে এই প্রথম চাক্ষুষ করছে স্বর্ণকুমারীকে।

বিজ্ঞাপনের লোকেদের সামনে কোনো প্রোডাক্টকে যখন হাজির করা হয় বা কোনো দ্রব্যের বাজারে ছাড়ার জন্য ঢাক—ঢোল পেটানোর অনুষ্ঠান হয় তখন চোখ এবং মন ভোলানোর উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত নিতম্ব, স্তন ইত্যাদি অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র প্রোডাক্টের দিকেই নজর রেখে যাওয়ার কাজটা রাহুল শিখে ফেলেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যাপারটা উলটো। এখানে কামনা করার মতো রমণীয় মূর্তি ধরে হাজির প্রোডাক্ট স্বয়ং। ক্যামেরা লেন্স মারফত সে স্বর্ণকুমারীর প্রতিটি রোমকূপের গোড়া পর্যন্ত দেখে নিয়েছে, তার পরিসংখ্যানও পড়ে ফেলেছে, তার জন্মমৃত্তান্ত জেনে গেছে, কিন্তু একটা জিনিস সে জানত না যেটা এখন জানল—মেয়েটির যৌন আবেদন। হৃৎস্পন্দন গতি দ্রুত হল, শরীরে আবেগ সঞ্চার করল, মনের মধ্যে ঝড় তুলল জাতীয় বস্তা—পচা কথা বাদ দিয়ে সোজা কথায় রাহুলের মনে হল লক্ষ মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে আলাদা হয়ে যায় পুরুষের মধ্যে যে পাশব কামনা জাগাবার ক্ষমতার জন্য, এই মেয়েটির মধ্যে তা রয়েছে।

স্বর্ণকুমারীর জন্য ট্র্যাকসুটের থেকেও আরও বেশি মোহময় পোশাকের কথা রাহুল ভাবতে পারে কিন্তু তার কোনো দরকার আছে বলে তার মনে হল না। ওর পুরো অস্তিত্ব থেকেই এটা ফুটে বেরোচ্ছে। স্বর্ণকুমারী তার থেকে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা, তা হোক। আকর্ষণের কারণটা ওর শরীরের পরিসংখ্যানের ব্যাপার নয়, যদিও চমৎকার ওর গড়নের সামঞ্জস্য। ওর শরীরের আদলের জন্যও নয়। রাহুলের মনে হল মেয়েটি তাকে আকর্ষণ করছে সফলতার জন্য। রাহুলের মনে হল মেয়েটি তাকে আকর্ষণ করছে সফলতার জন্য। যেন ও ধরেই নিয়েই, পৃথিবীর সবাইকে হারিয়ে জিতে নিয়েছে। এই ধারণা বা বিশ্বাসটাই ওর চোখে—মুখে, দেহের গতিতে ধকধক করে যাচ্ছে।

অর্জুন কাছে এসে দাঁড়াল। কাঁধ থেকে ক্যামেরা ঝুলছে। সিগারেট প্যাকেট এগিয়ে দিতে রাহুল একটা বার করে নিয়ে ধরাল।

‘স্বর্ণকুমারীকে দেখছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী মনে হচ্ছে?’

‘খুবই আকর্ষণীয়।’

এই সময় সোনালি তার ওয়ার্ম আপ শেষ করে সামনে তাকিয়ে দু—জন লোককে দেখে হেসে মাথা ঝাঁকাল। মনে হল, যেকোনো অপরিচি লোক যদি বন্ধুর মতো চাহনিতে তার দিকে তাকায় তা হলেই সে হেসে মাথা নাড়বে।

‘ডা. সরকারকে দেখছি না যে?’

‘অর্গানাইজারদের সঙ্গে কথা বলছে। পুরুষদের রেস এবর শুরু হবে, দেখবে না?’

‘বক্তৃতার ব্যাপারগুলো চুকে যাক। ততক্ষণ স্বর্ণকুমারীর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা যাক।’ রাহুলের কথা শেষ হতে—না—হতেই মাইকে গমগম করে ঘোষণা হল ক্রীড়ামন্ত্রীকে এবার মালা দেওয়া হচ্ছে। রাহুল স্বর্ণকুমারীর দিকে এগিয়ে গেল।

‘গুডমনিং, আপনিই কি সোনালি সরকার?’

‘হ্যাঁ।’ অবাক চোখে সে তাকাল।

‘আমি প্রেসের লোক, পিটিআই। কয়েকটা প্রশ্ন করব।’

‘রেসের সময় হয়ে এল, পরে প্রশ্ন—ট্রশ্ন করবেন।’ বিজয় সিনহা ভারিক্কি চালে বলল। ‘মেন্টাল প্রিপারেশন নিয়ে ফেলেছে, এখন আর ডিস্টার্ব করা উচিত নয়।’

‘না না, আমার মেন্টাল ব্যালান্স ঠিকই থাকবে। হ্যাঁ বলুন, কী প্রশ্ন?’

রাহুলের ভালো লাগল ওর স্বচ্ছন্দ ঝরঝরে ভঙ্গিতে কথা বলার ধরন। চোখে কৌতূহলের পরিমাণ দেখে তার মনে হল, জীবনে কখনো কোনো সাংবাদিকের সম্মুখীন হয়নি।

‘অনেকেরই টাইমিং কাগজে বেরিয়েছে, আপানারটা নেই। আপনি এর আগে কখনো ম্যারাথনে নামেননি। কিন্তু প্রাইভেট ট্রায়াল নিশ্চয় দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ দিয়েছি।’

‘তখন টাইমিং নেওয়া হয়েছিল নিশ্চয়।’

‘হয়েছিল।’

‘কত?’

সোনালি বললে যাচ্ছিল সময়টা কিন্তু তার আগেই বিজয় হাঁই হাঁই করে উঠল। ‘নো নো, ডোন্ট ডিজক্লোজ ইট বিফোর দি রেস।’

‘এত গোপনীয়তার কি আছে? ওয়ার্ল্ড বেস্ট টাইম কী?’ রাহুল ইচ্ছে করেই একটু ব্যঙ্গের রেশ মাখাল তার কথায়। সোনালির চোখ দপ করেই আবার হাসিতে ভরে গেল।

‘ওয়ার্ল্ড বেস্ট! হতে পারে।’ সামান্য কাঁধ ঝাঁকাল সোনালি। ক্রীড়ামন্ত্রীর বক্তৃতা অপ্রত্যাশিতভাবে এত সংক্ষিপ্ত হবে বোধহয় কেউ তা ভাবেনি। তাই রেহাই পাবার আনন্দে হাততালি খুব জোরেই পড়ল।

‘ভারত থেকে কোনো মেয়ে অলিম্পিকসে ম্যারাথনে যায়নি। আপনি কি মনে করেন যেতে পারেন? এটা তো অলিম্পিক ট্রায়ালই।’

‘ভারতের মেয়েরা নিশ্চয়ই যেতে পারে। সোল গেমসের সিকসথ পোজিশন টাইমিং টাচ করলেই কোয়ালিফাই করতে পারবে। আই ও এ সেইরকমই জানিয়েছে। অবশ্য গতবারের মতো যদি হয় তা হলে কোনো কোয়ালিফাইং টাইমিংয়ের প্রশ্নই থাকবে না।’

‘আপনি পি টি উষার সোল যাওয়ার ব্যাপারটা বলছেন?’

সোনালি উত্তর না দিয়ে শুধু হাসল।

‘সোল ওলিম্পিকসে সিকসথ পোজিশনের টাইমিংটা কত ছিল জানেন কি?’

‘দু—ঘণ্টা আটাশ মিনিট সাত সেকেন্ড।’

ব্যস্ত ভঙ্গিতে সারদাচরণকে আসতে দেখা গেল।

অর্জুন ফিসফিস করে রাহুলের কানে বলল, ‘পিটিআই এবার কেটে পড়ো।’

‘দাঁড়াও না।’

‘গুড মর্নিং মি. অরোরা, মি. হালদার। কতক্ষণ এসেছেন?’

‘মিনিট কুড়ি। কথা বলছিলাম আপনার মেয়ের সঙ্গে।’

‘নিশ্চয়। বুলন কথা।’ সারদাচরণ প্রত্যয় ভরে সোনালির দিকে তাকালেন।

‘তোমার সঙ্গে পরিচয়—’

‘হয়ে গেছে, হয়ে গেছে।’ রাহুল ওনাকে থামিয়ে দিয়ে সোনালির দিকে তাকাল। ‘আজ কি ওই টাইমিং টাচ করতে পারবেন?’

‘পারতেই হবে নয়তো বার্সিলোনা যাওয়ার জন্য। তাতেও কোয়ালিফাই করতে পারেন। কলকাতায় সল্ট লেকে তো অলিম্পিক ট্রয়ায়াল হবে সামনের মাসেই।’

‘হ্যাঁ মাস্টার্স মিট হবে।’

বন্দুকে ফায়ারিংয়ের শব্দ এবং জনতার উচ্ছ্বাস ধ্বনিতে বোঝা গেল পুরুষদের যাত্রা শুরু হল। ওরা সবাই মুখ ঘুরিয়ে দেখতে লাগল রাস্তা ধরে প্রায় ধাক্কাধাক্কি করে সত্তরটি লোক মন্থর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য পাঁচ কিলোমিটার পর থেকেই ভিড়টা পাতলা হয়ে ওরা দ্রুত পা ফেলার মতো ফাঁকা জায়গা পেয়ে যাবে।

রাহুলের চোখে পড়ল কালো ট্র্যাকসুট পরা এক শ্বেতাঙ্গ বিদেশিনীকে। পুরুষদের স্টার্টিং দেখতে গেছল, ফিরে এসে কিট ব্যাগটা তুলে নিয়ে এক কৃষ্ণাঙ্গী বিদেশিনীর সঙ্গে কথা বলছে। ক্যামেরা হাতে। কাঁধে পেটমোটাব্যাগ ঝোলান দু—জন লোক তাদের দিকে এগিয়ে গেল। বোধহয় প্রেস ফোটোগ্রাফার।

‘ইনিই নিশ্চয় ডেবি ট্যাটারসল। আর অন্যজন কে?’

‘তানজানিয়ার ক্যাথি বোডো।’ সোনালি একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বলল। ‘ডেবি ওয়ার্ল্ড ক্লাস রেসার, ক্যাথির বেস্ট টাইমিং জানি না।’

‘এই রেসে কোয়ালিফাই করার জন্য দৌড়বেন তার মানে দু—ঘণ্টা আটাশ মিনিটের মধ্যে—’ রাহুলের কথা ডুবে গেল মাইকে গাঁক গাঁক করে ওঠা ঘোষণায়। যেসব মেয়ে এখনো স্টার্টিং লাইনে আসেনি তাদের শেষবারের মতো অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

সোনালিরা দ্রুত সেদিকে রওনা হল। যাবার সময় সে হাত নেড়ে রাহুলকে চেঁচিয়ে বলল, ‘দেখা যাক, বার্সিলোনা যেতে পারি কি না।’ কথাটা বলেই সে একটা চোখ টিপল।

‘চলো, স্টার্টিংটা দেখি।’ চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে অর্জুন বলল।

‘তুমি যাও, আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি।’

‘বেশ। আমি তা হলে গোটাকয়েক স্ন্যাপ নিয়ে আসি।’

রাহুল গাড়িতে এসে পিছনের সিটে পা গুটিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ল। কাল মাঝরাতের পর ঘুমিয়ে আর ভোরে ঘুম থেকে ওঠার জন্য তার এখন ঘুম পাচ্ছে। ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে জেগে উঠলে মেয়েদর রেসের ১৫ কিলোমিটার পর থেকে দেখা যাবে। তার আগে দেখার মতো কিছু তো ঘটবে না। ১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত মেয়েরা স্বচ্ছন্দে দৌড়ে যাবে।

ঘুমে আচ্ছন্ন চেতনায় রাহুল অস্পষ্টভাবে বন্দুকের শব্দ শুনল। সময় এখন কত দেখার জন্য বাঁ হাতের কব্জিটা চোখের সামনে আনার জন্য তার মস্তিষ্ক নির্দেশ পাঠাল কিন্তু বাঁ হাত তা মানতে চাইলনা। আবার নির্দেশ গেল। বাঁ হাত চেষ্টা শুরু করল। একটু একটু করে হাতটা বুকের কাছ থেকে উঠে ঝপ করে পড়ে গেল গাড়ির মেঝেয়। আধমিনিটের মধ্যে রাহুলের বুক ওঠা—নামা করতে লাগল গভীর শ্বাস—প্রশ্বাসের নিয়মিত তালে।

একটা স্পিড ব্রেকারে গাড়িটা লাফিয়ে উঠতেই তার ঘুম ভাঙল। ধড়মড়িয়ে উঠে বসেই সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, গ্রামের মতো একটা জায়গা কিন্তু যথেষ্ট পাকা বাড়িও দেখা যাচ্ছে। দোকানগুলোয় কিছু কিছু বিলাস দ্রব্যও রয়েছে। রাস্তার ধারে সারি দিয়ে লোক। বাচ্চচা কোলে বউ থেকে লাঠি হাতে বৃদ্ধ, নানান বয়সি মানুষ, চোখে—মুখে উত্তেজনা, হাসিমুখ। চিৎকার করে অল্পবয়সিরা হাত নাড়ছে।

মাথা ঝাঁকিয়ে রাহুল বলল, ‘কতক্ষণ হল শুরু হয়েছে? আমরা এখন কোথায়? সোনালির কী হল?’

‘ট্রেস করতে পারছি না। এইসব অর্গানাইজাররা এমন ব্যবস্থা করেছে! আমাকে এগোতে দিল না বাঞ্চের সঙ্গে। বলল নিয়ম নেই। পিছন পিছন গাড়ি গেলে অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে। বললুম পাশে পাশে যাব। তাও অ্যালাওড নয়। হোয়াট আ ব্লাডি অ্যারেঞ্জমেন্ট! তোমার অ্যাম্বুলেন্সের গাড়ি,প্রেসের গাড়ি, টিভি—র গাড়ি, নিজেদের গাড়ি যাচ্ছে আর আমার কম্পিটিটার রয়েছে কিন্তু আমার গাড়ি যেতে পারবে না!’ অর্জুন প্রবল বিরক্তিভাবে ক্লাচ আর ব্লেক একসঙ্গে চেপে ধরল।

তার গাড়ির সামনে চরটি মেয়ে দৌড়োচ্ছে। কোনোরকমে পা ফেলেছে বলাই উচিত। মনে হচ্ছে আর মিনিট দশেক পরেই তুলে নিতে হবে। মুমূর্ষু, মৃত্যুমুখীন জন্তুকে দেখে শকুনিরা যেমন পাক দিতে দিতে নেমে আসে, সেইরকমই সংগঠকদের একটা ছোটো ভ্যান এই চারজনের পিছন পিছন চলেছে।

‘এদের ক্রস করে এগিয়ে যাও। তারপর তো সামনের রাস্তা ফাঁকাই।’ রাহুল অধৈর্য হয়ে বলল। ‘সবাই এগিয়ে গেছে, একজনকেও তো দেখা যাচ্ছে না। চলো চলো, ওভারটেক করো।’

অর্জুন তাই করল। মারুতিটা হঠাৎই একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গতি নিল। মেয়ে চারটিকে বাঁ দিকে রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। পথে আবার পাঁচজনকে এক বাঞ্চে দৌড়তে দেখল। তাদেরও পাশ কাটিয়ে মারুতি এগিয়ে গেল।

‘মনে হচ্ছে সোনালি প্রথম বাঞ্চে আছে।’ অর্জুন বলল।

‘কতক্ষণ হল স্টার্ট হয়েছে?’

‘ঠিক সওয়া আটটায়। এখন হল—, ‘অর্জুন কবজি তুলল। রাহুলওতার ঘড়িতে চোখ রাখল।’ ন—টা আটচল্লিশ, তার মানে এক ঘণ্টা তেত্রিশ মিনিট রেস চলছে। অযথা দেরি করিয়ে দিল। এই জায়গাটা বামনগাছি।’

পথের ধারে টেবল পাতা। সেখানে বরফজল গ্লাসে নিয়ে ভলান্টিয়াররা অপেক্ষা করছে। গ্লুকোজ, পাতিলেবুও রয়েছে। অর্জুন গাড়ি থামিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাই খবর কী? আমরা প্রেসের লোক। মেয়েদের মধ্যে প্রথম গেছে কারা বলতে পারেন?’

‘প্রথমে গেছে একজন মেমসাহেব, কী যেন নামটা?’

‘ডেবি ট্যাটারসল।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। তার প্রায় দুশো গজ পিছনে নিগ্রো মেয়েটা। আর তার কুড়ি গজ পিছনে একজন।’

‘কীরকম তাকে দেখতে, ইন্ডিয়ান কি?’

‘৫১ নম্বর। দাঁড়ান, লিস্ট দেখে বলছি।’ লোকটি টেবলে বসা একটি লোকের কাছ থেকে জেরক্স করা নামের তালিকাটা চেয়ে নিল।

‘৫১ নম্বর সোনালি সরকার। বাঙালি মেয়ে। কিন্তু দেখলে তো মনে হয় না!’

‘কতক্ষণ আগে ওই তিনজন গেছে?’

‘তবু, আন্দাজে বলুন।’

‘কী জানি ঘড়ি দেখেনি।’

রাহুল দাঁত চেপে মনে মনে অশ্রাব্য বিশেষণে তাকে ভূষিত করল। একটি বালক হঠাৎ বলল, ‘তখন সওয়া ন—টা হবে।’

‘তার মানে এক ঘণ্টায় ওরা এখানে পৌঁছেছে। ওদের পরের মেয়েরা কতক্ষণ বাদে এল?’

‘ওহহ, সে অনেক পর পর। ওদের পরের মেয়েটা তো দশ মিনিট বাদে, তার পর একসঙ্গে দুটো মেয়ে পনেরো মিনিট বাদে। ধুঁকছে, মনে হয় না শেষ করতে পারবে। বোধহয় প্রথম দিকে জোরে ছুটে ফেলে এখন আর সামলাতে পারছে না। তা স্যার আপনারা কোন কাগজের লোক?’

‘প্রাভদা।’ বলে অর্জুন মারুতি ছেড়ে দিল।

বারাসাতে ঢুকেই একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল, প্রথমে গেছে ডেবি, তার পিছনে একইসঙ্গে ক্যাথি আর ৫১ নম্বর। আর তাদেরও পিছনে দশ—বারোজন পুরুষ।

‘বুঝলেন দাদা, ওই মেয়ে তিনটের যা দম আর স্ট্যামিনা দেখলাম, অনেক পুরুষকে হারিয়ে দেবে। পনেরো মিনিট আগে স্টার্ট নিয়ে কি না মেয়েমানুষের কাছে পিছিয়ে পড়ল! রামো, রামো। ভালো করে একটু লিখে দেবেন।’

‘দোব?’

‘কী পেপার আপনার?’

‘নিউ ইয়র্ক টাইমস।’ রাহুল জানলার কাচ তুলে দিল।

মধ্যমগ্রামের মোড়ে পৌঁছবার আগেই তারা মেয়ে রানারদের পেতে শুরু করল। ক্লাসপায়ে, দরদর ঘামতে ঘামতে প্রায় জগ করার মতোই তারা এগোচ্ছে। তাদের একে একে ছাড়িয়ে গিয়ে একটি ভারত মেয়েকে পেল আর মুখে ক্লান্তির ছাপ ফুটলেও, দীর্ঘ সরু পায়ের কদমে তা ধরা পড়ছে না। হাতকাটা ব্লাউজটা ভিজে জবজবে। মাথায় বরফজল ঢালার জন্য কিংবা ঘামের জন্যও হতে পারে। মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। ওর পাশে পাশে মোটরবাইকে এসকর্ট চলছে।

‘শীলা নাসডু বোধ হয়।’

‘ওর বেস্ট টাইম তো দু—ঘণ্টা চুয়াল্লিশ মিনিট?’

‘ওই টাইটাই যদি শীলা রাখে মানে এখনো পর্যন্ত ওই গতিতেই ছুটে থাকে তা হলে সোনালিরা আরও কম টাইমে ফিনিশ করবে।’

‘কত কমে?’ রাহুল সামনে তাকিয়ে কয়েকজন পুরুষ প্রতিযোগীকে দেখতে পেল।

‘দু—ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ? দু—ঘণ্টা বত্রিশ। ওই দু—ঘণ্টা তিরিশ? পেসটা ডেবিই সেটা করেছে, ওকে চেঞ্জ করেছে দু—জন?’

‘এই টেম্পারেচারে, এমন হিউমিড কন্ডিশনে এই রকমটাইম রাখা, মনে হয় না সম্ভব।’

বাঁদিকে দমদম এয়ারপোর্টের পাঁচিল। একটা এয়ারবাস নামার জন্য এখন ইনবাউন্ড হয়ে পি—লুপ টার্ন নিচ্ছে। এবার রানওয়ের সঙ্গে একই লাইনে আসবে। রাহুল আকাশের দিকে তাকিয়ে প্লেনের অবতরণ লক্ষ করায় ব্যস্ত।

অর্জুন ব্রেক কষে মারুতিকে থামাল। রাস্তায় একটা ট্রাক উলটে রয়েছে। ভিড় জমে গেছে। ওলটানো ট্রাকের পাশ দিয়ে একটামাত্র গাড়ি যাবার জায়গা রয়েছে। হলুদ—কালো চৌখুপ্পি ঘর কাটা একটা হাইওয়ে পেট্রল জিপ দাঁড়িয়ে। গাড়ি চলাচল বন্ধ করে ম্যারাথন রানারদের আগে পথ করে দেওয়ার কাজে পুলিশ ব্যস্ত।

‘হয়ে গেল!’ হতাশ স্বরে অর্জুন দু—হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙল। ‘এখান থেকে বেরোতে বেরোতে ওরা তো ভি আইপি রোড ধরে ফেলবে।’

পুরুষ রানার ক—জন বেরিয়ে গেল। দমদম থেকে আসা কিছু গাড়ি ছাড়া পেল। শীলা নাইডুর জন্য পথ করে দিতে আবার গাড়ি চলা বন্ধ। এর পর মধ্যমগ্রামের দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে যেতে দেওয়া হল।

যশোর রোড থেকে বাঁদিকে ঘুরে ভিআইপি রোডে পড়েই অর্জুন মারুতিকে সত্তর কিলোমিটার বেগে ধাওয়া করাল। কৈখালি ফেলে রেখে বাগুইআটির মোড় পার হয়ে দেখল ক্যাথি বোডো আর তার পঞ্চাশ মিটার আগে দু—জন পুরুষ ছুটছে। সামনে যত দূর চোখ যায় আর কোনো রানারের টিকিও দেখা যাচ্ছে না।

‘সোনালি আর ডেবি, তা হলে এই দু—জনই এখন লিড করছে।’ রাহুল নিশ্চিত স্বরে বলল।

কৃষ্ণপুর আসছে। দূর থেকে ওরা দু—জনকে দেখতে পেল। দু—পাশে মোটরবাইক, পিছনে একটা ছোটো ভ্যান তাতে সাদা একটা পতাকা বাঁধা। মোটর থেকে বেরিয়ে আছে একটি মাথা, ডা. সরকারের। মারুতি গিয়ে মোটরের পিছনে ফেউ নিল।

‘রাহুল তোমার তো রুমালটা সাদাই। চটপট ওই পতাকার মতো লাগাবার ব্যবস্থা করো, নইলে আটকে দেবে।’

‘কী দিয়ে লাগাব, একটা স্টিক চাই, একটা লাঠিফাটি অন্তত যদি—।’

অর্জুন মারুতিকে রাস্তার বাঁ দিক ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে প্রায় লাফিয়েই নামল। হাত দুই লম্বা একটা বাখারি কুড়িয়ে এনে গাড়িতে উঠল।

‘এটার সঙ্গে বেঁধে নাও, আর জানলার বাইরে উঁচিয়ে ধরে থাক। আমি ঠিক ভ্যানটার পিছু পিছু যাব।’

‘রুমালটা যে বাঁধব, একটা দড়িটড়ি—’রাহুল পিছনের সিটের দিকে তাকাল।

‘জুতোর ফিতে খুলে বাঁধো।’

পাশাপাশি দু—জন ছুটে যাচ্ছে। সোনালির পরনে গাঢ় হলুদ শর্টস ও বগলকাটা গেঞ্জি। চুলের রাশ গোছা করে টেনে বাঁধা। মাথা সোজা করে রাখা। পায়ে হলুদ জুতো। সোনালি আগাগোড়াই সোনালি। তার পাশে লাল ব্লাউজ আর কালো শর্টস পরা ডেবি ট্যাটারসল। সোনালির থেকে অন্তত এক বিঘৎ খাটো। কৃশ তনু। মাথাটি একটু ডান দিকে হেলানো।

পিছন থেকে দু—জনের মুখ দেখা যাচ্ছে না। রাহুলের মনে হল ডেবি যেন একবার মুখটা সোনালির দিকে ফেরাল আর হঠাৎ গতি বাড়িয়ে দিল। বাঙ্গুর অ্যাভিন্যু ছাড়িয়ে লেকটাউন এসে গেল। ডেবি এবার থার্ড গিয়ারে তুলল তার গতি। সোনালি তার সঙ্গে লেগে রয়েছে।

এইবার রেসটা ট্যাকটিকাল পর্যায়ে পৌঁছেছে। ওয়ার্ল্ড ক্লাস রানারের সঙ্গে দৌড়বার কোনো অভিজ্ঞতাই সোনালির নেই। ডেবির জমিয়ে রাখা দম আর শরীরের ক্ষমতা কতটা সোনালিকে সেটা এবার বুঝে নিয়ে নিজের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। কিন্তু বুঝতে পারবে কি? রাহুল উৎকণ্ঠা নিয়ে লক্ষ করতে লাগল।

কিনিয়ান দুই অ্যাথলিটের কথা ডা. সরকার বলেছিল। সহজ সরলভাবে দৌড়টাকে নিয়েছিল শুধুই হারজিতের একটা চ্যালেঞ্জের মতো। তার ভাবমুক্ত মনে দৌড়য় নিজেদের স্বাভাবিক ক্ষমতাকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ঠেলে নিয়ে গিয়ে। রাহুল ভাবল, সোনালিও কি তাই করছে? ডেবি যতই ট্যাকটিকাল দৌড় দৌড়ক না, সোনালি তার ফুসফুস আর পেশির উপর ভরসা রেখে দৌড়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেও কতটা শক্তি জমানো আছে তা এখনও প্রকাশ পায়নি।

‘কটা বাজে?’ অর্জুন জানতে চাইল। রাহুল ঘড়ির দিকে চোখ রেখে সময়টা বলতে যাচ্ছে তখনই ‘আরে সোনালি—’ বলে স্টিয়ারিংয়ের উপর ঝুঁকে পড়ল।

সোনালি আচমকা গতি বাড়িয়েছে। সামনে উলটোডাঙ্গা ব্রিজ। ডেবিও সঙ্গে সঙ্গে গতি বাড়াল। রাস্তার দু—ধারে কাতারে কাতারে মানুষ। উলটোদিক থেকে আসা যানবাহন থেমে পড়েছে। প্রবল চিৎকার শুরু হয়েছে দু—জনের মধ্যে, কে এগিয়ে যাবে লড়াই শুরু হতে দেখে।

ব্রিজের শীর্ষ পর্যন্ত দু—জনে পাশাপাশি, তার পরই সোনালি একটু একটু করে ডেবিকে পিছনে ফেলে দিতে শুরু করল। ৪২,১৯৫ মিটার দৌড়ের শেষ দু—হাজার মিটারে যে এইরকম গতিতে দৌড়ানো যায় রাহুলের সেটা কল্পনার বাইরেই ছিল। তার মনে হল, ম্যারাথনের নয়, সে যেন দেড় হাজার মিটার দৌড়ের ফিনিশ দেখছে।

ভিআইপি রোড থেকে বাঁয়ে ইস্টার্ন মেট্রোপিলিটান বাইপাসে যখন সোনালি ঘুরল ডেবি তখন কুড়ি মিটার পিছিয়ে গেছে। গতিটা ধরে রেখে সোনালি, বাঁ দিকে বিধান নগর আর ডান দিকে মানিকতলা ও বেলেঘাটার মাঝ দিয়ে ছুটে যেতে লাগল। দূরে একটা বিরাট ফেস্টুন দেখা যাচ্ছে। তাতে ইংরাজিতে লেখা ‘ফিনিশ’।

সল্ট লেক স্টেডিয়ামের বাইরের ফটকের সামনে রাস্তার উপর সাদা রংয়ে দাগ টানা। সেখানে ইলেকট্রনিক ঘড়ি জ্বলজ্বল করে সময় নির্দেশ করছে। দাগের ওধারে কর্মকর্তাদের জটলা। ফিনিশের পঞ্চাশ মিটার আগে থেকে রাস্তার পাশে শাল খুঁটিতে বাঁশের বেড়া। পুলিশ দাঁড়িয়ে দশ গজ অন্তর।

আর যেতে দেওয়া হবে না গাড়িকে। পুলিশের নির্দেশে ফিনিশিংয়ের প্রায় আধ কিলোমিটার আগে অর্জুন রাস্তা ঘেঁষে মারুতিকে থামাল।

‘ফিনিশটা দেখা হল না।’ আক্ষেপ করল রাহুল।

‘যা দেখেছি তাই যথেষ্ট।’

সামনের ভ্যানটাকেও পুলিশ আটকে দিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে সারদাচরণ ও বিজয় দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। তাদের বাম বাহুতে সবুজ কাপড়ের পটি জড়ানো। সেটাই তাদের ছাড়পত্র।

‘সবুজ রুমাল আছে?’

অর্জুন মাথা নেড়ে বোঝাল নেই। দু—জনে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়াল। সোনালির মাথার চুলের গোছাটা তার পিঠের উপর ঝাপটাচ্ছে, এইটুকু ছাড়া তারা ওর আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না রাস্তায় বহু লোক নেমে পড়ায়।

সোনালি দু—হাত আকাশের দিকে তুলে দিল। একটা উল্লাস সেখানকার জনতার কণ্ঠ থেকে হাউইয়ের মতো শূন্যে উঠে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন ও রাহুল কবজি তুলে প্রায় একইসঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাল। পরস্পরের মুখের উপর অবাক চাহনি রেখে প্রায় একই সঙ্গে দু—জনে বলে উঠল, ‘দারুণ!’

‘দু—ঘণ্টা চব্বিশ মিনিট পঞ্চান্ন বা দু—চার সেকেন্ড এধার—ওধার! সোল অলিম্পিকসে তো সোনা জিতে যেতে পারত সোনালি, ইয়ে….স্বর্ণকুমারী!’ অর্জুনের উত্তেজিত স্বরে কয়েকটি ছেলে তার দিকে তাকিয়ে এগিয়ে এল।

‘হ্যাঁ, দাদা এটা কি ওয়ার্ল্ড রেকর্ড?’

‘ম্যারাথনে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড বলা হয় না, বলা হয় ওয়ার্ল্ড বেস্ট। সোনালি সরকারের টাইম যা হল সেটা ওয়ার্ল্ড বেস্ট নয় বটে তবে চার বছর আগের ওলিম্পিকসে সোনা জিতে যেতে পারত।’ অর্জুনের কণ্ঠস্বর উচ্চচগ্রামে উঠে থরথর কাঁপতে লাগল।

‘আরিব্বাস, দাদা বলছেন কী। গোল্ড জিতে যেত, এই মে দিবসের পটকাগুলো সব ফাটিয়ে ফেলেছে কি না দ্যাখতো, তাড়াতাড়ি যা।’

রাহুল হাত ধরে অর্জুনকে টেনে নিয়ে গাড়িতে উঠল।

‘দাঁড়াও ডেবি ট্যাটারসলের টাইমটা জানতে হবে, প্রায় সত্তর—আশি মিটার পিছনে পড়েছিল।’

‘আমি আর কারুর টাইমে ইন্টারেস্টেড নই।’

‘তা হলে তুমি আমাদের কনসরটিয়ামে জয়েন করছ?’

‘আগে আমি স্বর্ণকুমারীর সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই। অর্জুন তুমি ব্যবস্থা করো।’

পাঁচ

পেভমেন্ট ঘেঁষে মারুতিকে রেখে, রাহুল গাড়ি থেকে নামল। বাড়িটার দিকে একনজর তাকিয়ে সে মারুতির দরজায় চাবি দিয়ে রংচটা লোহার গেট পেরিয়ে ভিতরে এল। চটা—ওঠা, ভাঙা সিমেন্টের পথটা সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে একটা দেওয়ালে। পথের বাঁ দিকে দুটো দরজা। এই ফ্ল্যাটবাড়ির দুটো ভাগ তাই দুটো সিঁড়ি। দুটো দরজা দিয়ে ঢুকে দুটো সিঁড়ি পাওয়া যাবে।

রাহুল প্রথম দরজাটার সামনে দাঁড়াল। টেলিফোনে কাল রাতে ডা. সরকার বলে দিয়েছিলেন:’প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকে সিঁড়ি ধরে দোতলায় উঠে বাঁ দিকের ফ্ল্যাট। আমি সকালেই বর্ধমান চলে যাচ্ছি কোচ বিজয় সিনহাকে সঙ্গে নিয়ে। তাতে আপনার কোন অসুবিধে হবে না। আমার বোন তো থাকবেই। দরকার হলে তার সঙ্গেও কথা বলে নেবেন। হ্যাঁ, আমিও মনে করি স্বর্ণকুমারীর কথাবার্তা, হাবভাব, কালচারাল লেভেল বা এই ধরনের ব্যাপার সম্পর্কে না জানলে তাকে বা তার ব্যক্তিত্ব বিষয়ে কোনো ধারণা না পেলে তাকে মার্কেট করা সম্ভব নয়। আপনি ওর মা—দিদিমার কথাও তুলতে পারেন, কিছুই আমরা ওর কাছে লুকোইনি। তা হলে বিকেল পাঁচটায় আপনি আসছেন।’

রাহুল ঘড়ি দেখল। পাঁচটা বাজতে দুই এখন। দোতলায় ছোটো বারান্দাটার রেলিংয়ে একটা নীল তোয়ালে শুকোচ্ছে। তিনতলার বারান্দায় এক মহিলা নীচের দিকে তাকিয়ে। এই মুহূর্তে ভারতীয় অ্যাথলেটিকসের এক চাঞ্চল্যকর ঘটনার নায়িকা, গতকালই যে এক লক্ষ টাকার একটা চেকে পেয়েছে, আজ প্রতি কাগজে যার প্রথম পাতায় ছবি বেরিয়েছে, এমন একজন যে এই বাড়িতে রয়েছে মনে হয় না সেটা কেউ জানে। অবশ্য জানলেও, এটা এমনই এক পাড়া তাই নিয়ে হইচই কেউ করবে না।

দোতলায় উঠে এসে রাহুল কলিংবেলের বোতাম টিপল। টুং টাং আওয়াজ শোনা গেল। কয়েক সেকেন্ড পরই একটি বছর বারোর মেয়ে দরজা খুলে দাঁড়াল।

‘সুরুচি দেবী আছেন? কিংবা সোনালি?’

তার কথা শেষ হতে—না—হতেই ভিতর থেকে সোনালির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, ‘কে এসেছে রে ধনিয়া?’

বলতে বলতেই বেরিয়ে এল সোনালি।

‘ওহ আপনি, আসুন আসুন, একদম কাটায় কাটায় পাঁচটায়!…আপনার সঙ্গে কিন্তু আমার একটা ঝগড়া রয়ে গেছে। কাল মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন।’

ছোটো ফ্ল্যাট। ঢুকেই ডান দিকে রান্নাঘর, কলঘর। সোজা গেলে শোবারঘর যেটার দরজায় পুরু হ্যান্ডলুমের গেরুয়া রঙের পর্দা ঝুলছে। বাঁ দিকে বসার ঘর। রাহুল বসার ঘরে ঢুকে গদিপাতা চৌকিতে, না দুটি সোফার একটিতে, কোথায় বসবে ঠিক করতে পারছে না।

‘এই সোফাটায় বসুন।’ সোনালি আঙুল দেখিয়ে নির্দেশ করল। রাহুল বসে পড়ল। সামনের সোফায় সে নিজে বসল।

‘আপনি পিটিআই…।’

রাহুল দু—হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তখন কথা বলার জন্য একটু ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। খেলার লোকেরা মিডিয়াকে খাতির করে তো।’

‘আমার কিন্তু একদমই বারণ। পাবলিসিটির কোনোরকম ধারকাছ দিয়ে যাওয়া চলবে না।’

‘কার বারণ, ডা. সরকারের।’

‘হ্যাঁ, বাবা এ জন্য ভীষণভাবে আমাকে আড়াল করে রাখেন। খবরের কাজ, রেডিয়ো, টিভি, কাল আমাকে ইন্টারভিউ করার জন্য তো হুড়োহুড়ি শুরু করেছিল। বিজয়দা আমাকে একটা ধুতি দিয়ে মুড়ে, শুধু চোখ আর নাক খোলা রেখে, সেই ভিড়ের মধ্য দিয়ে টানতে টানতে একটা গাড়িতে তুলে পাচার করে দেন। কাগজে দেখেছেন কী লিখেছে?’

‘হ্যাঁ ইংরিজি কাগজে দেখলাম। সেনসেশ্যনাল রানিং অফ এ মিস্ট্রি গার্ল হু মপড আপ দ্য ম্যারাথন টাইটল উইথ অলিম্পিক কোয়ালিফাইং পারফরম্যানস, আরও সব…টল, আট্রাকটিভ গার্ল হু গেভ হার নেম অ্যাজ সোনালি সরকার, ইজ আননোন টু অ্যাথলেটিকস সোশালিস্টস…শী পোস্টেড টাইম অফ টু আওয়ার্স টোয়েন্টি ফোর মিনিটস ফিফটি সিক্স সেকেন্ডস…আরও বলব?’

‘আপনি তো দেখছি মুখস্থ করে ফেলেছেন।’

সোনালির চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল। দু—পা জড়ো করে হাঁটু দুটো বুকের কাছে টেনে মাতৃগর্ভে ভ্রূণাবস্থায় থাকার মতো ভঙ্গিতে সে সোফায় কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল।

রাহুল চোখ সরিয়ে নিল অস্বস্তিভরে। সোনালি অত্যন্ত হ্রস্ব একটা সুতির কালো শর্টস পরে রয়েছে যেটা তার তলপেট ও ঊরুরু সঙ্গে চেপে বসান। ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা ঢিলেঢালা সুতির লাল হাফ শার্ট যায় ওপরের বোতাম খোলা এবং প্রথম দর্শনেই রাহুলের বুঝে নিতে অসুবিধে হয়নি, সোনালি ব্রা পরেনি। কিন্তু এইভাবে গড়িয়ে কাত হতেই তার শর্টসে টান পড়ার জন্য সেটা দুই উরুর ঊর্ধ্বপ্রান্ত পর্যন্ত উঠে গেছে। তাই নয় শার্টের খোলা বোতাম দিয়ে একটি স্তনের বৃন্ত পর্যন্ত উন্মোচিত অবস্থায়।

একজন লোক কথা বলতে আসবে, সোনালি তা জানে। জেনেও সে জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখেনি উপযুক্ত পোশাক পরে। রাহুলের মনে হল, তার আসার গুরুত্বটা এই মেয়েটি ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারেনি বা বাইরের লোকের সামনে এইরকম পোশাক পরাটাকেই হয়তো ও স্বাভাবিক মনে করে। কিংবা হয়তো ওর উপর হুকুম হয়েছে, লোকটাকে তালগোল পাকিয়ে দাও যাতে সে আমাদের সঙ্গে হাত মেলায়। সে জন্য যা করতে হয় করো। যাই হোক না কেন রাহুল ঠিক করে ফেলল খুব হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলবে। সেক্স বিষয়ে কোনো চিন্তাকে মনে স্থান দেবে না। সে এসেছে তথ্য সংগ্রহ করতে। সোনালি কীভাবে বড়ো হয়ে উঠেছে সেটা জানা দরকার। নিজের শরীর সম্পর্কে সচেতন হয়ে না ওঠা বা এইরকম খোলামেলা মনোভাব ওর মধ্যে গড়ে উঠল কী করে? দেহে যৌবন আসার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েরা যে স্বাভাবিক লজ্জার, আড়ষ্টতার অন্তর্গত হয় তার ছিটেফোঁটাও সোনালির মধ্যে নেই।

‘আমার কিন্তু কাগজ পড়া বারণ ছিল।’ সোনালি বাচ্চচা মেয়ের মতো ফিসফিস করে বলল গোপন খবর জানাবার ভঙ্গিতে।

‘তাহলে পড়লে কেন?’

‘বাহ, ইচ্ছে করে না!’

‘আর কী কী ইচ্ছে করে?’

‘আর কী কী—’, সে কয়েক সেকেন্ড চিন্তায় ডুবে থেকে আচমকা বলল, ‘আপনি অরোরা, তার মানে পাঞ্জাবি, তাহলে এত ভালো বাংলা বলেন কী করে? আপনার বাব মা কি বাঙালি?’

‘আমি কলকাতাতেই জন্মেছি, বড়ো হয়েছি, আমার মেলামেশা ছিল বাঙালিদের সঙ্গে।’

‘ঠিক ঠিক। আমার মা আর দিদিমা আপাতানি ট্রাইবের ছিল। এখন যেটা অরুণাচল বলা হয় সেখানে আছে এই ট্রাইব।’

‘তুমি কী মনে করো তুমি বাঙালি নও? তোমার বাবা…’

‘আমি তো পালিত মেয়ে।’

রাহুল লক্ষ করল কথাটা বলার সময় সোনালির মুখটা দুমড়ে গেল। সেটা রাগে, না হতাশায়, না আক্ষেপে বুঝতে পারল না। প্রসঙ্গ বদলাতে সে বলল, ‘আর কাউকে এখানে দেখছি না যে? ডা. সরকারের বোন, তিনি কোথায়?’

‘পিসি? টিভি মেকানিক খুঁজতে গেছে। কাল ছেকে সেটটা চলছে না। টিভি না দেখলে পিসির ঘুম আসে না।’

রাহুল ঘরের চারধারে চোখ বোলাল। কোথাও টিভি সেট দেখতে পেল না।

‘এ ঘরে নয়, পিসির বেডরুমে আছে ওটা।’ সোনালি আঙুল দিয়ে বাঁ দিকের দেওয়ালটা দেখাল ‘ছোটোবেলায় আমিও ওইঘরে থাকতাম। এই ঘরটা ছিল আমার খেলার ঘর। কী নিয়ে খেলতাম জানেন ক্লাইম্বিং ফ্রেম, দড়ি, গরাদ ধরে ব্যায়াম। রোজ আমাকে বাধ্য করা হত এই নিয়ে খেলতে, সকালে আর বিকেলে। আমার খারাপ লাগত না। তবে বাবার একটা থিওরি আছে অক্সিজেন বেশি টানা বিষয়ে, সে জন্য আমার বুকের খাঁচাটা বড়ো করার চেষ্টা হত। দিনে একবার আমার বুকের পাঁজরে বেল্ট লাগানো মোটা কাপড় বেঁধে তারপর সেটা টানা হত। খুব লাগত, ব্যথা হত। রোজ একবার করে এটা করা হত। আমার যে কী রাগ হত, ঘেন্না করতাম। ইঞ্জেকশনকেও ঘেন্না করতাম।’

‘ইঞ্জেকশন? কীসের?’

‘বোধহয় আয়রন ঢোকানো হত শক্তি বারবার জন্য। সপ্তাহে একটা, ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত নিয়েছি। খাবারদাবার সম্পর্কেও খুব কড়াকড়ি ছিল, চিনির তৈরি কিছু একদম নয়।’

‘তোমার শরীরের জোর কতটা বাড়ছে বা কমছে, সেটা কি ডা. সরকার মাপতেন?’

‘প্রতি শনিবার, পুরো ব্যায়াম করিয়ে সব লিখে রাখেন। এখানেও তাই হয়।’

রাহুল কথাবার্তা এবার অন্যদিকে ঘোরাতে চাইল। একই বিষয়ে বেশিক্ষণ কথা না বলে নানান মুড, আবেগ, বোধ, বুদ্ধি যাতে ধরা পড়ে তাই করা উচিত।

‘কই বললে না তো, কী কী ইচ্ছে তোমার করে?’ রাহুল সিগারেট প্যাকেট পকেট থেকে বার করে কী ভেবে আবার পকেটে রাখতে যাচ্ছিল, সোনালি বারণ করল।

‘খান না। সিগারেটের গন্ধ আমার ভালো লাগে।’

‘সিগারেটের ধোঁয়া অ্যাথলিটের ফুসফুসের পক্ষে ক্ষতিকর।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু বাবা তো এখানে নেই। বিজয়দা আমাকে জিমে ওয়ার্ক করাবার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে খায়। বাবা তা জানে না।’

‘ডা. সরকারকে তোমরা ভয় করো?’

সোনালি চুপ করে রইল।

‘আচ্ছা তোমার ওয়ার্ক আউটের কথা বলো। শুনেছি খুব মর্ডান ইকুইপমেন্টস আছে তোমাদের বর্ধমানের জিমনোসিয়ামে। নানারকম ফিজিওলজিক্যাল টেস্ট করার ব্যবস্থাও আছে। সত্যি?’

‘নিজে দা দেখলে, শুধু মুখের কথা শুনে বুঝতে পারবেন না।’

‘পারব। তুমি বলো।’

‘ওখানে আমার মনের আর শরীরের কন্ডিশনিং করা হয়। বাবা আর বিজয়দা করান। যেমন ধরুন ট্রিডমিল।’ সোনালি সোজা হয়ে বসল। তার দুটি গাল ও চোখ দিয়ে উদ্দীপনার আভা ফুটে বেরোল। নিজের সাম্রাজ্যে যেন নির্বাসিতা রানি ফিরে যাচ্ছে, এমন একটা উত্তেজনা তার অবয়বে ছড়িয়ে পড়েছে।

‘ট্রিডমিল হল, রোলারের ওপর রবারের শিট পাতা থাকে। তার একদিকে থাকে ইলেকট্রিক মোটর। সেটা চালালে রোলার ঘুরতে থাকে আর সেইসঙ্গে বেল্টের মতো রাবারের শিটটাও। সেই চলন্ত রাবার শিটে দাঁড়িয়ে, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে, ছুটতে হয়। যত জোরে শিটটা চলবে তার সঙ্গে তাল রেখে তত জোরে ছুটতে হবে, ছোটার স্পিড কমলেই দড়াম করে চিৎপটাং। আমাকে দেড়ঘণ্টা ট্রিডমিল করতে হয় সপ্তাহে দুদিন। করার সময় আমাকে মন্ত্রের মতো বলতে হয় ‘আমি সোনা জেতার জন্য দৌড়চ্ছিল।’ এটা বলতে বলতে কী রকম একটা ঘোরের মতো ব্যাপার মাথায় তৈরি হয়, তখন দৌড়তে খুব কষ্ট হয় না। কাল যখন ফিনিশিং থেকে একমাইল দূরে ডেবি ট্যাটারসলকে ফেলে রেখে স্পিড তুললাম তখন এটাই মনে মনে বলছিলাম। এছাড়া করি ওয়েট ট্রেনিং। রোড রানিং, ফিল্ম দেখা, মালিশ, মোটিভেশন, আলট্রা ভায়োলেট…।’

‘প্রতিদিন, মাসের পর মাস সকাল থেকে রাত এইরকম একটা জীবন, ভালো লাগে? বিদ্রোহ করতে ইচ্ছে করে না?’

‘তার মানে?’

‘এটাই ওদেরকে বলা, যথেষ্ট হয়েছে আর নয়, এবার আমাকে কলকাতায় বেড়াতে নিয়ে চলো। সেখানে সিনেমা দেখব, নিউ মার্কেটে ঘুরব, পার্ক স্ট্রিটে রেস্তোরাঁয় খাব, মেট্রোয় চড়ব।’

‘না, বলব না এসব।’ অপ্রত্যাশিত বদলে গেল সোনালি। ‘আমি ওলিম্পিক সোনা জিততে চাই। সিনেমা দেখা, ঘোরাঘুরি খাওয়াদাওয়ার জন্য বাকি জীবন তো রয়েছে।’

‘তুমি এর থেকে কী পাবে আশা করো?’

‘জেতাটাই আমার কাজ, এই জন্যই তো জন্মেছি। কারুর যদি ট্যালেন্ট থাকে তাহলে সেটা নষ্ট করা কি উচিত? আপনার ট্যালেন্ট আপনি কীভাবে কাজে লাগান?’

‘ট্যালেন্টেড লোকেদের জন্য টাকা কামানোয়। সেই জন্যই তারা আমায় ডাকে।’

‘কারা ডেকেছে?’

‘যেমন ধরো, ইমদাদ আলি, গজল গায়। নাম শুনেছ?’

‘আহহ, ওর গানের টেপ আছে আমার কাছে। ওকে চেনেন?’

‘আমি ওর এজেন্ট। কোথায় টেপ করলে?’

‘রেডিয়ো থেকে। আচ্ছা ওর মতো লোকেদের সঙ্গে কি কথা বলার সুযোগ আমার হবে? আপনার কী মনে হয়?’

‘বার্সিলোনার পর, কে বলতে পারে হয়তো ইমদাদই তোমার সঙ্গে আলাপ করার জন্য ব্যস্ত হবে।’

‘আমি ভালো আলাপী নই।’

‘কে বললে নও, দিব্যিই তো আমার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছ।’

‘কথা বলা শেখার জন্য সপ্তাহে দু—ঘণ্টা আমাকে ইন্টারভিউ দেওয়ার ক্লাস করতে হয়।’

‘তার মানে?’ রাহুল অবাক হয়ে গেল।

‘বাবা চলে গেছেন ট্রেনিং সম্পর্কে আপনি যা জানতে চান, জানাতে শুধু, খুব ব্যক্তিগত কথা নয়। তাই আপনাকে বলছি, বার্সিলোনায় দুটো সোনা জেতার পর প্রেস ইন্টারভিউ রুমে আমাকে যেতে হবে। তখন সেসব প্রশ্ন হবে বা হতে পারে এটাকে তারই উত্তর দেওয়ার রিহার্সাল বলতে পারেন।’

‘আশ্চর্য তো! কী ধরনের প্রশ্ন করা হয়?’

‘ঘরের চারদিকে চারটে টেপরেকর্ডার থাকে। তাতে প্রশ্নগুলো নানান লোকের গলায় ইংরিজিতে টেপ করা থাকে। একের পর এক রেকর্ডারের সুইচ টিপে চালান হয়। আমি উত্তর দিতে যাই। উত্তরগুলো আগেই আমাকে লিখে দেওয়া হত, এখন আর তার দরকার হয় না আমি নিজেই উত্তর দিতে পারি।’

‘কয়েকটা প্রশ্ন বল তো।’

‘যেমন ধরুন, গেমসের আগে কি বিশ্বাস করতে তোমার পক্ষে দুটো সোনার মেডেল জেতা সম্ভব?’

‘বাহ, তুমি কী জবাব দেবে?’

‘নিজের ওপর কনফিডেন্স থাকা দরকার। একদিক থেকে বলতে গেলে আমি এখনও বিশ্বাসই করতে পারছি না দুটো সোনা জিতেছি। কিন্তু বার্সিলোনায় এসেছি জিততে, হ্যাঁ জিততে, কথাটা অবশ্য অহংকারীর মতো শোনাচ্ছে কিন্তু আমি নিজের চিন্তাকে গোপন করায় অভ্যস্ত নেই। জবাবটা কেমন হল?’

রাহুল মন্তব্য না করে বলল, ‘আর একটা প্রশ্ন।’

‘আর একটা? আচ্ছা।’ সোনালি মুহূর্তের জন্য চিন্তা না করে বলল, ‘অলিম্পিকসে এখনো পর্যন্ত ম্যারাথন যে জিতেছে সে আর অন্য কোনো ইভেন্ট সেই গেমসে আর জিততে পারেনি শুধু একজন ছাড়া চেকোশ্লোভাকিয়ার এমিল জেটোপেক, ঠিক চল্লিশ বছর আগে। এখন তুমি এটা করলে। নিজেকে এখন তোমার কেমন লাগছে? আমার উত্তর, শুনে খুবই ভালো লাগছে। তবে বেশি প্রশংসা করবেন না, হেল্টাথলনে যে মেয়েটি সোনা জিতল তারই বেশি প্রশংসা প্রাপ্য। সে দৌড়, ছোঁড়া, লাফানো কতরকমের বিষয়ে অংশ নিয়েছে, আর আমি? শুধু দৌড়েছি মাত্র। …কেমন লাগছে? আমার শৈশবে মারা যাওয়া মায়ের ছবির দিকে তাকালে যেমন লাগে সেইরকম এখন লাগছে।’

দারুণ! রাহুল মনে মনে তারিফ জানাল। মিডিয়া এই দিকটা লুফে নেবে।

‘আর একটা?—মিস সরকার আপনি যে এত কঠোর ট্রেনিং করে গেছেন, এটা কী আত্মত্যাগ নয়? উত্তর : আত্মত্যাগ? ছেলেদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি না করাটাই কী আত্মত্যাগ? সে জন্য তো দিনের শেষে কয়েক ঘণ্টা সময় তো হাতে থাকেই, সন্ধের পর তো আর মাঠে বা রাস্তায় দৌড়ানো যায় না কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যান্য কাজ তো করা যায়।…এই শুনে নিশ্চয় সবাই হেসে উঠবে।’

‘আমারই হাসি পাচ্ছে এখন।’ রাহুল মুচকি হেসে সোনালির মুখভাব লক্ষ করল। কি যেন একটা কামনার ছায়া ওর মুখে বিষণ্ণতা ছড়িয়ে ভেসে চেলে গেল।

‘কিন্তু আপনারা যা ভাবছেন তাতে আমার আপাতত কোনো আগ্রহ নেই। সন্ধ্যার পর আমার সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে।’ আর একটা প্রশ্ন : মিস সরকার একটা কি সত্যি যে ভিলেজে অন্যান্য ভারতীয় মেয়েদের থেকে আপনি একটু দূরত্ব বজায় রেখে চলেন? উত্তর : ‘সোনালি বলুন আমি কিছু মনে করব না। হ্যাঁ, কথাটা অনেকটা সত্যি। দেখুন ওরা তো বহুদিন ধরে নানান জায়গায় ট্র্যাক মিটগুলোয় নামছে, পরস্পরকে খুব ভালোই চেনে। আমি একেবারেই নতুন, মাত্র দু—মাস আগে প্রথমবার একটা রেসে নামি। সুতরাং মেয়েদের কাছে আমি অপরিচিতই। আর আমাদের স্বভাব নয় গায়ে পড়ে বন্ধুত্ব করা।’ আর একটা প্রশ্ন : ‘সোনালি তোমার কি কোনো সংস্কার আছে বা দৈবে বিশ্বাস করো? যেমন বিশেষ কোনো জুতো জামা বা ম্যাসকট?’

আহ? মাল বিক্রির কী দারুণ সুযোগ! রাহল মনে মনে উত্তরটাও বানাল: হ্যাঁ আছে। আমার কাস্টম—মেড অ্যাডিডাস জুতো আর নাইকে মোজা।

‘আমার উত্তর: না কোনো সংস্কার নেই। তবে এখন থেকে এই মেডেল দুটোই আমার তাবিজ।’

খুব বেশি ভেবেচিন্তে সোনালিকে উত্তর দিতে হচ্ছে না, আগে থেকেই এগুলো তাকে মুখস্থ করানোর জন্য। কিন্তু যেভাবে কথা বলছে তাতে একধরনের স্বতঃস্ফূর্ততা ফুটে বেরিয়েছে। চমৎকার অভিনেত্রী! রাহুলের মনে হল, প্রেস কনফারেন্স মাতিয়ে দেবার মতো ক্ষমতা ওর আছে। হয়তো মাসের পর মাস রগড়ানিরই ফল এটা। এবার আমি যদি একটা দুটো প্রশ্ন করি যেটা সম্পর্কে ওকে তৈরি করে রাখা হয়নি।

সোনালি তাকিয়ে রয়েছে রাহুলের মুখের দিকে। মুখভাব থেকেই আঁচ করে নিয়ে বলল, ‘আপনি বোধহয় কিছু প্রশ্ন করবেন। করুন। বাবা বলে দিয়েছেন উত্তর দেবার জন্য।’

‘আচ্ছা সোনালি তুমি তো এখন নামী, সফল। তুমি কি দৌড়ে আর নামবে না যেসব কমার্শিয়াল সুযোগ এখন তোমার সামনে খুলে গেছে সেগুলোর ফায়দা তুলবে?’ রাহুল নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করল জবাব শোনার জন্য।

‘ওই জিনিসগুলো কী শুধুই বিশেষ কয়েকজনের জন্য? দৌড়ব তো বটেই। কমার্স সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুবই কম। জ্ঞান বলতে যদি ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত কাগজ, ম্যাগাজিন পড়াকে বোঝায় তাহলে আমি একটা গবেট। ওহহ মি. অরোরা, আপনি কোন কমার্স কাগজের লোক?’

রাহুল হেসে ফেলল। জনসংযোগের ব্যাপারে সোনালির সোনার মেডেল পাওয়ার যোগ্যতা আছে।

‘আচ্ছা সোনালি আপনি কি কখনো পুরুষদের সঙ্গে রেসে নেমেছেন?’

‘এই সাতটা দিনই, ক্যামেরা হাতে ধরা পুরুষদের সঙ্গে তো নামতেই হল। কী তাড়া যে আমি খেয়েছি, একমাসের ট্রেনিংয়ের সমান প্রায়। তবে আপনার প্রশ্নে জবাবে বলছি, এখনও পর্যন্ত পুরুষদের বিরুদ্ধে দৌড়ইনি।

‘আপনি কি সম্পূর্ণ রমণী বলে নিজেকে মনে করেন?’ রাহুল ভালোমানুষের মতো মুখ করে জানতে চাইল।

সোনালির ভ্রূ কোঁচকাল। চোখটা নামিয়ে চট করে নিজের শরীরের উপর দিয়ে চাহনি বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘এখানে আপনাদের সামনে এসে এতক্ষণ ধরে এত কথা বললাম, তার মধ্যে কিন্তু আমার মনে হয়নি এ সম্পর্কে কারুর মনে কোনোরকম সন্দেহ জাগতে পারে।’

কথাটা বলে সোনালি দু—হাত তুলে চুলের গোড়া বেঁধে রাখা ফিতের গেরোটা খোলার জন্য টানাটানি শুরু করল। বোতাম খোলা জামা সরে গিয়ে তার স্তনের ওপরের অংশ ও তাদের মধ্যের উপত্যকা রাহুলের দৃষ্টির সামনে বেরিয়ে এল। গেরো খোলার চেষ্টায় যে আন্দোলন তার দুই বাহু বেয়ে বুকে নেমে এল তাতে সামনে বসা পুরুষটি পুলক বোধ করল। রাহুলের মনে হল এটা বোধহয় শিখিয়ে পড়িয়ে রাখা জিনিসগুলোর মধ্যে নেই, সোনালির নিজেরই ব্যাপার, নিজস্ব সংযোজন।

‘সোনালি আজকের সন্ধ্যাটা কীভাবে কাটাবেন ভেবেছেন কি?’

একটু সন্ত্রস্ত ভাব সোনালির মধ্যে দেখা গেল। সে ঠোঁট কামড়ে কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবল। ধীরে ধীরে চোখে ফুটে উঠল অসহায়তা। তারপই হেসে ফেলল।

‘এটা কি প্রেস কনফারেন্সের প্রশ্ন?’

‘না। আমার প্রশ্ন।’

‘জানি না। সন্ধ্যা আমি একাই কাটাই।’

কলিং বেল বেজে উঠল। দরজা খোলার আওয়াজ পাওয়া গেল। এক মহিলা কণ্ঠের কথা ভেসে এল, ‘কী মুশকিলে পড়লাম। মিস্ত্রি আসতে পারবে না। সেটা দোকানে দিয়ে আসতে হবে। এখন আমি দিয়ে আসি কী করে?’

‘পিসি।’ সোনালি বলল।

সুরুচি ঘরে ঢুকে রাহুলকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে সোনালির দিকে তাকালেন।

‘আজ আসবেন বলে বাবা যার কথা বলে গেছলেন।’

‘ওহ।’ সুরুচি নমস্কার করলেন। ‘দাদা তো সকালে বর্ধমান চলে গেলেন।’

‘আমায় উনি বলেছিলেন সে কথা। …আপনার টিভি সেট কি দোকানে দিয়ে আসতে হবে।’

‘ওদের দু—জন মেকানিকের মধ্যে একজন অ্যাবসেন্ট, আর একজন সার্ভিসে বেরিয়েছে। আউটডোরে যাবার মতো কেউ নেই। বলল, নিয়ে আসুন। অতবড়ো একটা ভারী জিনিস আমি নিয়ে যাই কী করে?’

‘আমার গাড়ি রয়েছে, যদি আপত্তি না করেন তো আমি পৌঁছে দিচ্ছি।’

‘আপনি!’

‘বাঃ প্রবলেম সলভড!’ সোনালি লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। ‘তাহলে আমিও যাব।’

‘তুমি যাবে?’ সুরুচি ইতস্তত করলেন। ‘দাদা বলেছিলেন বাড়ি থেকে না বেরোতে।’

‘আমি গাড়িতেই বসে থাকব। কেউ আমাকে চিনতেও পারবে না। আরে আমি এখানে গোল্ড জিতিনি, এটা তো একটা অল ইন্ডিয়া রেস মাত্র! আমার অটোগ্রাফের জন্য একজনও এখন এগিয়ে আসবে না।’

‘আচ্ছা চলো, কিন্তু এই ড্রেসে নয়!’

‘পিসি, শাড়ি পরব।’

‘না, দাদার বারণ।’

‘জানতে তো পারবে না। জানেন মি. অরোরা, বাবা আমাকে কখনো শাড়ি পরতে দেননি। শাড়িতে নাকি স্ট্রাইড খারাপ হয়ে যায়। ইন্ডিয়ান মেয়েরা লম্বা করে পা ফেলতে পারে না নাকি শাড়ির জন্য। কিন্তু আমার যা ইচ্ছে করে। আমার একটাও শাড়ি নেই।’

‘সোনা যা বলছি শোন।’ সুরুচির গলা কঠিন হল। ‘যাও ট্রাউজার্স পরে এসো।’

শোবার ঘর যেত এত অনাড়ম্বর হতে পারে রাহুলের তা ধারণায় ছিল না। একটি ডাবল ইংলিশ খাট আর একটি স্টিল আলমারি। দুটি দেওয়াল তাক তাতে দুটি পর্দা ঝুলছে। বড়ো ঘরের একদিকে টিভি স্ট্যান্ডে একটি ছ—সাত বছর আগের মডেলের সেট। প্রায় একটা সুটকেসের মতো আকারে।

রাহুল দু—হাতে সেটটা তুলেই নামিয়ে রাখল। বেশ ভারী। তবে নীচে একতলা পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতে তার অসুবিধে হবে না।

‘সরুন।’ সোনালি কাঁধ দিয়ে রাহুলকে মৃদু ঠেলে দিয়ে সরিয়ে দু—হাতে তুলে নিল সেটটা। ‘চলুন।’

যেন হালকা একটা মুড়ির ধামা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, এমন সহজভাবে সোনালি একতলায় নেমে রাস্তা পর্যন্ত এল। রাহুল দরজা খুলে সেটটা ভিতরে তোলায় সাহায্য করল।

টিভি সার্ভিসিংয়ের দোকানে পৌঁছতে মিনিট চার—পাঁচ লাগল। তোলার মতো নামানোর কাজটাও করল সোনালি। দোকানের মালিক সেটটা পিছনের ঘরে নিয়ে গেল। একটিমাত্র স্টিলের চেয়ার দেয়াল ঘেঁষে। সুরুচিকে বসার জন্য রাহুল অনুরোধ করল।

‘ঘণ্টাখানেক তো লাগবে। আপনি বসুন, আমরা গাড়িতে গিয়ে বসছি। কিছু কথাবার্তা আছে সেটা সেরে নিই।’

সুরুচি চেয়ারে বসলেন। তার আগে জেনে নিলেন, ‘সেটটা বাড়িতে আবার পৌঁছে দেবেন কি?’

‘নিশ্চয় দেব।’ রাহুল একঘণ্টা সোনালির সঙ্গে কাটাবার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয়। তারা দু—জনে গাড়িতে এসে বসল। গাড়ি থেকে সুরুচিকে দেখা যাচ্ছে না।

‘ছ—টা প্রায় বাজে, এই সময়টায় তুমি করো কী?’

‘এখনও তো সূর্যের আলো রয়েছে, দৌড়ই।’

‘এই সময় মেয়েরা বেড়ায়, ওই দ্যাখো তিনটে মেয়েকে।’ রাহুল আঙুল দিয়ে দেখাল। সোনালি একবার মুখ ফিরিয়ে দেখল মাত্র।

‘ওরা কেউ অলিম্পিকস সোনা জিতবে বলে ট্রেনিং করে না।’

রাহুল চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।

‘তোমার বাবা, মানে পালিত বাবা, চান অলিম্পিকসের পর আমি তোমার এজেন্ট হই। যখন ওকে প্রথম দেখি তখন ধরে নিই লোকটার মাথায় ছিট আছে, মনে মনে ঠিক করে ফেলি এই প্রোজেক্টের ছায়া মাড়াব না। কিন্তু যতই তুচ্ছভাবে ব্যাপারটা নিই না কেন মনের কোণে একটা লোভ তো আছে! আমি একজন ব্যবসায়ী, কিছুটা প্রতিষ্ঠিতও। ভাবতে আমার ভালোই লাগে যে আমি এগোচ্ছি। এই ভাবটা যেদিন ভাবতে পারব না সেদিনও আমার রিটায়ার করার সময় হয়েছে ধরে নেব। মনের কোণে স্বার্থসিদ্ধির ইচ্ছাটা আমায় বলল, তুমি দাঁও মারতে পার, স্বর্ণকুমারী প্রোজেক্টের কমিশন তোমার নেওয়া উচিত। এখন যদি ওরা আমাকে বলে, মশাই কি ঠিক করলেন? আমি বলব, হ্যাঁ। আমি একটা চান্স নেব। তবে এটা এখনো কিন্তু চান্সই। তুমি যে মেডেলটা জিতবে বলে আশা করছ সেটা অন্য কেউ জিতে নিতে পারে। সে জন্যও কিন্তু আমি চান্স বলছি না। আমার কাজটা খুব একটা সুন্দর ব্যাপার নয়। আমার কারাবার মানুষ নিয়ে। সফল, নামি, চ্যাম্পিয়ান এইসব হল আমার খদ্দের। বড়ো বড়ো মালটিন্যাশনালস আর কর্পোরেশনকে অফার দিই এদের পাবার জন্য দর দিন। আমার খদ্দেররা সিন্দুক ভরায় টাকায় আর আমি তার একট অংশ নিই। ব্যবস্থাটা ভালোই, অনেকের কাছে তো খুবই ভালো।’

‘ইমদাদ আলি?’

‘হ্যাঁ। চমৎকার লোক। মেয়েরা ওকে ভীষণ পছন্দ করে আর ও সেটা মনপ্রাণ দিয়ে চায়। ওর সবকিছু গেঁথে আছে একটা জিনিসেই—প্রশংসায়, তারিফে। টাকা, মেয়েমানুষ, দেশে দেশে ঘোরা এসব ওর ভালো লাগে কিন্তু তখনই চনমন করে ওঠে যখন আসরে বসে। কিন্তু অ আরও পাঁচটা বছর যাক, যখন ওর চেহারার জলুস কমবে, গলা নষ্ট হবে তখন লোকটার মধ্যে প্রাণ বলে আর কিছু থাকবে না। তখন প্রকৃত অর্থেই, অল্পবয়সি উঠতি গাইয়েদের সঙ্গে দাপট দেখাতে গিয়ে ও নিজেকে মেরে ফেলবে, অনেকেই মরেছে। আর যদি বেঁচে থাকে তাহলে জীর্ণ, শূন্য জীবন নিয়ে, হালকা চটুল গানে সফল হবার চেষ্টা করতে করতে বেঁচে থাকবে। এটা ইমদাদ জানে, এই নিয়ে আমি ওর সঙ্গে কথাও বলেছি। অন্য ধরনের কিছু করাটা ওর প্রকৃতিতেই নেই। আমার ধারণা ও আর বছর দশেক বাঁচবে। কিন্তু তাই নিয়ে আমার বিবেক মোটেই বিচলিত হচ্ছে না। শুনে আমার সম্পর্কে কী মনে হচ্ছে সোনালি? লোকটা নিষ্ঠুর, শয়তান?’

সোনালি মুখ নামিয়ে একটু ভাবল। ‘আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছি।’ থম হয়ে যাওয়া চাহনি তুলে তারপর বলল, ‘আপনি কী বলতে চান আমরাও ওইরকম হবে?’

‘বলতে চাই আমি একটা অর্থলোলুপ পিশাচ। যাতে ভাঙিয়ে টাকা রোজগার করতে পারব মনে করব, তাকে ঠেলতে ঠেলতে ধ্বংসের কিনারা পর্যন্ত নিয়ে যাব।’

‘কিন্তু তাদের কতদূর কী সম্ভাবনা সেটা আপনি প্রথমে তাদের জানিয়ে দেন নিশ্চয়।’

‘আমার মনের শান্তির জন্য সেটা করি বটে, বিবেককে চোখ ঠারা আর কী!’

সোনালি রাস্তায় লোক চলাচল দেখতে লাগল। চোখে আনমনা চাহনি। অন্যমনস্ক ভাবেই কপালে নামা চুলগুলো তুলে দিতে দিতে বলল, ‘থামলেন কেন। আমার ভাগ্যে তাহলে কী আছে সেটা বলুন।’

‘ওটাতেই গোলমাল।’

‘আহহ বলুন।’

‘ইমদাদ আলিকে আমি বুঝি, কিন্তু সোনালি সরকারকে নয়।’

‘কেন বোঝেন না? আমি সাধারণ একটা বাঙালি মেয়ে যে দুটো সোনার মেডেল জিততে চায়।’

‘কেন?’

‘কী বলতে চান?’

‘খুব মামুলি একটা কথা দিয়েই জিজ্ঞাসা করছি, সোনালি কীসের তাড়নায় তুমি জিততে চাইছ?’

ভ্রূ কোঁচকাল সোনালি। যেন হদিশ করতে পারছে না প্রশ্নের উদ্দেশ্যটাকে। ‘এটা কি খুবই দরকারি জানার জন্য?’

‘এই বিকেলে আমার কাছে দরকারি।’

‘তাহলে আর একটা মামুলি কথা দিয়েই উত্তর দিই। এটাই আমার জীবনের ধরন।’

রাহুল লক্ষ্য করল সোনালি অন্যমনস্ক হয়ে তার শার্টের গলার কাছে একটা আলগা সুতো ছেঁড়ার চেষ্টা করছে। রাহুলের মনে হল, সে আবার আটকে গেল। সোনালি মন খুলে কথা বলতে তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু ওর ভিতরে যে পাঁচিল গাঁথা হয়ে গেছে সেটা এত উঁচু, এত শক্ত যে ওর পক্ষে সেটা ডিঙোন বা ভাঙা সম্ভব হল না। ‘চল কোথায় গিয়ে চা খাই, পিসি কি আপত্তি করবেন?’

‘জানি না, তবে আমি চা খাই না।’

‘সত্যিই খাও না নাকি আমার সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে বলছ?’

‘আপনি খুব খোলাখুলি, রাখঢাক না করে আমার সঙ্গে কথা বলছেন বলে আপনাকে আমার ভালোই লাগছে। আগে কেউ কখনো আমায় বলেনি যে টাকার জন্যেই তারা এর মধ্যে জড়িয়েছে, এর মধ্যে মানে আমাকে সোনা জেতাবার প্রেজেক্টের মধ্যে। সবসময়ই শুনে আসছি, আমার ট্যালেন্টকে চিনিয়ে দিতে বা আমার সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দিতে বা ভারতের জন্য সোনা এনে দিতে ওরা এটা করছে। আপনি হাসছেন! বিজয়দা কিন্তু এটাই আমাকে অবিরত বলে যাচ্ছেন।’

‘দেশের জন্য কিছু করছি ভাবাটা খুবই জোরালো প্রেরণা। নিজের জন্য যত জোরে দৌড়বে তার থেকেও বেশি জোরে দৌড়বে ভারতের জন্য। স্পোর্টসে এটা খুবই পুরনো একটা আপ্ত বাক্য: তুমি আরও ভালো করবে যদি কোনোকিছুর প্রতিনিধিত্ব কর—কলেজ, ক্লাব বা পাড়ার। বার্সিলোনার জন্য তুমি নিঃসঙ্গ হয়ে তৈরি হয়েছ। এখন অলিম্পিকস এসে পড়েছে এখন বিজয়দা তোমাকে তেরঙ্গা ঝান্ডা দেখাবে।’

সোনালি মন দিয়ে কথা শুনছে। ওর চোখ—মুখই বলে দিচ্ছে এই ধরনের কথাবার্তার সঙ্গে ওর পরিচয় নেই।

‘আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানার আছে। এখন যে কথাগুলো বললেন, এইসব কথা আমার বোঝা দরকার।’

রাহুল গাড়িতে স্টার্ট দিল। সোনালি অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছে, তার আগেই রাহুল বলল, ‘এভাবে বসে থাকতে ভালো লাগছে না। একটু ঘুরি। টিভি সেটটা ভালো হয়ে ওঠার আগেই ফিরে আসব।’

ধীরে চালিয়ে সে জগদীশ বোস রোড ধরে দক্ষিণে গিয়ে বেকবাগান মোড়ের থেকে পশ্চিমে বেঁকে তারপর আবার দক্ষিণে শরৎ বসু রোড ধরল।

‘কেন বার্সিলোনায় জিততে চাই, আপনার এই প্রশ্নটার উত্তর আমি দেব। পরিষ্কার জানাচ্ছি, আমি জিততে চাই। এটা ডা. সরকার বা বিজয় সিনহা বলছে না, আমি বলছি।’

‘স্বর্ণকুমারীও বলছে না?’ রাহুল প্রশ্ন তুলল।

‘ঠিকই, স্বর্ণকুমারীও নয়। আলি, আমি আলি মায়াকাং দুটো সোনার মেডেল জিততে চাই। কেন চাই বলতে গেলে আমাকে কীভাবে মানুষ করা হয় সেটাও বলা দরকার। এ সম্পর্কে ডা. সরকার কিছু কি আপনাকে বলেছেন?’

‘খুব কিছু নয়। তোমাকে বাড়িতে পড়ান হয়েছে।’

‘টিউটর ছিল। কলেজে পড়ার মতো না হলেও মোটামুটি জ্ঞান আছে। শরীরের দিকে কী ধরনের নজর দেওয়া হয়েছিল সেটা তো তখন বাড়িতেই বললাম। ওরা যদি আমার শরীরের দিকে নজর না দিতেন তা হলে আমি চ্যাম্পিয়ন হতেই পারতাম না। আমার কার্ডিয়োভাসকুলার সিস্টেম অত্যড়ত ভালো।’

‘পিসির সঙ্গে তুমি দু—তিন বছর আগেও থাকতে।’

‘হ্যাঁ। ভালো মন, নরম ধরনের। স্কুল মিসট্রেস, শাসন, ডিসিপ্লিন এইসব ব্যাপার ভালোবাসেন। আমাকে অ্যাথলিট হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে কখনো মাথা ঘামননি। বাবা আমাকে বর্ধমানে নিয়ে গেলেন ওখানে নতুন হসপিটালে চাকরি পেয়ে। তখনই পুরোপুরি আমার দিকে নজর দিলেন। আর উনি অত্যন্ত জেদি প্রকৃতির মানুষ। কয়েকজনের কাছ থেকে প্রোজেক্টের জন্য টাকা পেয়ে ট্রেনিং ক্যাম্প করলেন, সারান্ডার নির্জন জঙ্গলের পথে দৌড়োবার জন্য চক্রধরপুরের কাছে বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। মেডিক্যাল টেস্টের, ফিজিওথেরাপির যন্ত্রপাতি সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। আমি আর বিজয়দা বছরের কয়েকটা মাস ওখানে কাটাই, তখন বাবাও সপ্তাহে একদিন যেতেন আমার শরীরের, ট্রেনিংয়ের প্রগ্রেস পরীক্ষা করতে। নিঃসঙ্গ, নির্জনে কী অবস্থায় যে দিন আর রাত কাটিয়েছি। ঘাম ঝরান, রক্ত ঝরান আমার ক্ষেত্রে খুব হাস্যকর ছেঁদোকথা। ট্রেনিং শেষে এক একদিন বিজয়দা কোলে করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। হেঁটে আসার ক্ষমতা থাকত না। তিনি যা ট্রেনিং শিডিউল করে দিতেন তার এক মিলিমিটার কম কাজ হলে বেত দিয়ে মেরেছেন। ওলিম্পিকে জেতার জন্য এসবও আমি মানতে রাজি। মি. অরোরা আমি জানি আমি বার্সিলোনায় জিততে পারি। সেটা নিশ্চিত করার জন্য যদি কঠিন ট্রেনিং না করি তাহলে সেটা বিশ্বাসঘাতকতাই হবে, নিজের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। বুঝতে পারছেন, আমার কাছে এখন পর্যন্ত জীবনের অর্থ, বেঁচে থাকার মানে সবকিছুই নির্ভর করছে জেতার উপর। এখন যদি সব ছেড়েছুড়ে বিয়ে করে সংসারে বসে যাই—একবার তা ভেবেও ছিলাম—তাহলে এতগুলো বছর শুধুই নষ্ট করেছি বলা ছাড়া আর কিছু কি বলা যাবে? কিন্তু আমি তা চাই না। আমি আমার সোনা দুটো চাই, আমার জীবনকে কিছু একটা দিতে চাই যাতে মনে হবে এখনো আমি বেঁচে আছি। তারপর একদিন ফুলস্টপ দিয়ে দেব।’ গাড়ির উইন্ডশীল্ডের কাচে তর্জনীর ডগ্য চেপে ধরল এবং ঘষতে ঘষতে বলল, ‘তারপর খুঁজে দেখতে থাকব আসলে আমি কে?’

‘একটা পর্যায় পর্যন্ত এটা ঠিকই আছে।’ রাহুল সামনের রাস্তা থেকে পাশের দোকানগুলোর দিকে নজর ফেরাল।

‘আমি জানি আপনি কী বলবেন। বলবেন ফুলস্টপ দেওয়া সম্ভব হবে না, তাই তো? বার্সিলোনার পর আমি স্বর্ণকুমারী হয়ে যাব। তখন আর আমি কে, এই খোঁজের সময় আর থাকবে না।’

‘তুমি কি স্বর্ণকুমারী হতে চাও?’

সোনালি মুখ ঘুরিয়ে জানলার বাইরে তাকাল। ভাবছে।

‘এটা হওয়া কি খুবই দরকারি?’ রাহুল মৃদু স্বরে চাপ দিল উত্তর পাবার জন্য।

হঠাৎ তারদিকে ঘুরে বসে সোনালি ব্যাকুল চোখে তাকল। ‘আমি চাই, স্বীকার করছি আমার দরকার।’

‘সব মেয়েই চাইবে।’

‘কিন্তু তারা সবাই এটা জানে তারা কে, কোথা থেকে তারা আসছে। এটা গোড়ার ব্যাপার, এখান থেকে তাদের শুরু হয়। আমার মনেই হয় না এটা আমার আছে।’

‘ডা. সরকারকে বলেছ?’

‘ওর কথা হল, তুমি হচ্ছ স্বর্ণকুমারী। এটা যখন মেনে নেবে তখন আর তোমার কোনো উদবেগ থাকবে না।’

রাহুল গাড়ি থামাল। নেমে গিয়ে সামনের স্টেশনারি দোকান থেকে চারটে চকোলেট বার কিনে এনে সোনালির কোলের উপর ছুড়ে দিল।

‘এসব কিন্তু খাওয়া—’ প্রতিবাদ করে উঠল সোনালি। রাহুল তাকে থামিয়ে দিল দুহাত তুলে।

‘এবার ফিরব। তার মধ্যেই ওগুলো কপাকপ শেষ করে ফেলা চাই। মাঝে মাঝে না ভাঙলে বিধিনিষেধগুলো ঠিকমতো মানছ কিনা বুঝবে কী করে!’

সোনালির মুখে হাসি ফুটল। মোড়ক ছিঁড়ে চকোলেট বার করে ভেঙে আধখানা এগিয়ে ধরল। ‘বিধিভাঙা শেখাবার জন্য এটা আপনার প্রাপ্য কমিশন।’

‘কমিশন আমি কখনো ছাড়ি না।’ চকোলেট হাতে নিয়ে রাহুল বলল, ‘তুমি কথা বলা শিখলে কার কাছে?

‘টেপ করা কয়েকশো প্রশ্ন আর তার উত্তর আমাকে সপ্তাহে দু—দিন শুনতে হয়েছে। জেতার পর বার্সিলোনায় আমাকে প্রেসের লোকেদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে না। তাও আমাকে তৈরি করান হয়েছে।’

‘তোমার শাড়ি পরতে ইচ্ছে করে?’

‘ভীষণ। কিন্তু পরা বারণ। পা ফেলায় একটা বদ অভ্যাস নাকি হয়ে যাবে।’

‘কাল ম্যারাথন দৌড়েছ এখন তো তোমার বিছানায় শুয়ে থাকার কথা। পায়ে ব্যথা হয়নি?’

‘হয়েছে। এখনও কিরকম ভারী হয়ে রয়েছে। এই রকম আড়ষ্টতা হয় লং ডিস্ট্যান্স ট্রেনিংয়ের পর।’

রাহুল মুখ ফিরিয়ে সোনালির মুখটা দেখে নিয়ে এবার গাড়ির গতি বাড়াল। অন্ধকার নেমে গেছে। রাস্তায় দোকানে আলো জ্বলে গেছে। সুরুচি তাদের দেখতে না পেলে কিছু ভাবতে পারে। রাহুলের বরয়সও সুদর্শনত্বকে অভিভাবকরা দুশ্চিন্তার কারণ মনে করলে, খুব ভুল তারা করেন না।

ঠিক সময়েই মারুতি পৌঁছল। সুইচটা বদলানো ছাড়া আর কিছু করতে হয়নি। সুরুচি কিছু বলার আগেই রাহুল বলল, ‘আমার এক বোন এখানেই থাকে, বেকবাগানে, সোনালিকে দেখতে নিয়ে গেছলাম। বোন তো দেখে বিশ্বাসই করতে পারছিল না এমন একজন নামী লোক তাঁর বাড়িতে এসেছে।’

‘কিন্তু দাদার বারণ ছিল কারুর সামনে…’

‘না না সেরকম হইচই ওখানে হয়নি।’ রাহুল লক্ষ করল সোনালির মুঠোয় তখনও ধরা দুটো চকোলেট বার, সন্তর্পণে জিনসের পকেটে সে ঢুকিয়ে দিল।

টিভি সেট নিয়ে ওরা ফিরে এল। রাহুলই দুহাতে ধরে গাড়ি থেকে নামিয়ে তুলল দোতলায়। ঘরে বসিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘এবার চলি, খুব ভালোই কথা হল। ডা. সরকারের সঙ্গে এবার কথা বলব।’

ছয়

‘তোমার একটা কল এসেছিল বর্ধমান থেকে।’

রাহুল ফেরামাত্র অর্জুন তাকে জানাল।

‘কল? দিল্লির? কিন্তু আমি তো বলেছিলাম কোনো কাজের কথা—’

‘কাজেই কথাই তবে তোমার অফিস থেকে নয়। বর্ধমান থেকে ডা. সরকারের। কাল সকালে আমার এখানে কনসরটিয়ামের মিটিং, নটায়, তুমি অবশ্যই থাকবে।’

‘কীজন্য, কিছু বলেছেন?’

‘হ্যাঁ। স্বর্ণকুমারীর কমার্শিয়াল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আলোচনা। সব মেম্বারের সামনেই সেটা হবে।’

‘ভালো। আমি এখন একটু ঘুমোব।’

‘এই সন্ধেবেলায়?’

‘হ্যাঁ। কেন জানি হঠাৎই টায়ার্ড লাগছে।’

রাহুল তার ঘরের দিকে চলে গেল। এখন সে ভাবতে চায়। এই প্রোজেক্টেরই কথা নয়, সোনালির ভবিষ্যতের কথাও। তার দুঃখ হচ্ছে মেয়েটির জন্য।

রাহুল কাঁটায় কাঁটায় ন—টায় অর্জুনের বাড়ির একতলায় মিটিং রুমে ঢুকল। ছোটো ঘর। একটা লম্বা টেবল। দুধারে আটজন বসার জন্য আটটা গদি আটা চেয়ার। টেবলের মাথায় একটি। সেখানে এখন বসে আছেন ডা. সরকার। হীরাভাইকে সে চিনল কিন্তু অন্য দুজন তারা অপরিচিত।

ডা. সরকার হাত বাড়িয়ে একটা চেয়ার দেখিয়ে তাকে বসতে বললেন। সবাই তার দিকে তাকিয়ে। অর্জুনের পাশের চেয়ারে সে বসল।

‘মি. অরোরার সঙ্গে আমাদের দু—জন মেম্বারের পরিচয় এখনও হয়নি। আমার ডানদিকে রয়েছেন সুরজ সিং, ধানবাদে থাকেন, কয়লা আর ট্রাকের ব্যাবসা’ রাহুল মাথা ঝোঁকাল। সুরজ সিং বিশাল গোলাকার মুখ থেকে একটা শব্দ বার করল। বোধহয় নমস্কার বলল। ‘আর আমার বাঁ দিকে রয়েছেন প্রণব দত্ত। কলকাতাতেই থাকেন। জমির স্পেকুলেশন, ডেভেলপমেন্ট, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং তৈরি এইসবের ব্যাবসা।’ রাহুল এবারও মাথা ঝোঁকাল। প্রণব দত্ত ডান হাতের দুটো আঙুল নাকের কাছে তুলল। ‘আর মি. অরোরার পরিচয় এখানে যারা রয়েছেন সবাই জানেন।’

সারদাচরণ সবার মুখের উপর চোখ বুলিয়ে আবার শুরু করলেন, ‘আজ সময় খুব কম। প্রণববাবু এগারোটার ফ্লাইটে বাঙ্গালোর যাবেন, সুরজবাবুও পাটনা যাবেন তার একটু পরেই, তাই যা সিদ্ধান্ত নেবার দ্রুতই নিতে হবে। আপনারা জানেন, মি. অরোরাকে এখানে আসতে বলেছি আমাদের প্ল্যান সম্পর্কে তাকে ওয়াকিবহাল করার জন্য। উদ্দেশ্যটা হল বার্সিলোনায় স্বর্ণকুমারীর জেতার পর তার হয়ে কমার্শিয়াল যা করণীয় তাই করার জন্য। মি. অরোরা, আপনি মোটামুটিভাবে এই প্রোজেক্ট সম্পর্কে একটা ধারণা ইতিমধ্যে পেয়ে গেছেন। ধরে নিতে পারি আপনার এজেন্সি এর সঙ্গে যোগ দেবে কি না সে সম্পর্কে আপনি একটা সিদ্ধান্তে এসেছেন।’

‘আপনি কি থাকবেন?’ হীরাভাই বলল।

‘প্রথমে কয়েকটা ব্যাপারে একটু পরিষ্কার হতে চাই।’ রাহুল টেবলে দুই কনুই রাখল। ‘সোনালি সরকারের এজেন্ট হিসেবে আপনারা রাহুল অরোরা অ্যাসোসিয়েকটসকে অর্থাৎ র‌্যা—কে একমাত্র স্বত্ব দিতে চেয়েছেন, যে সব কমার্শিয়াল গ্রুপ তার নাম, ছবি, পার্সোনাল এনডোর্সমেন্টে আগ্রহী তাদের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য। রেডিয়ো, টিভি, ফিল্ম, থিয়েটার, বই, ম্যাগাজিন, খবরের কাগজ—সবেরই একমাত্র স্বত্ব। কিন্তু আমার এজেন্সির সুনাম রক্ষা করার কথাও আমাকে ভাবতে হবে। বড়ো বড়ো ব্যাবসা র‌্যা—কে বেশি গণ্য করে অন্যান্য এজেন্সির থেকে তার কারণ আমাদের লিস্টে শতকরা একশোভাগ নির্ভরযোগ্য লোককে আমরা রেখেছি। কোনো ব্যবসাদারের ব্রান্ড ইমেজ রাতারাতি ধ্বংস করে এমন একজন কাউকেও আমরা নিই না। বুঝতেই পারছেন খারাপ ধরনের কিছু যদি লোকে জানতে পারে—আমি এটা হবেই যে তা বলছি না—তাহলে আমার এজেন্সি স্বর্ণকুমারীর ব্যাপারে একেবারেই হাত ধুয়ে ফেলবে।’

‘আপনি কী বলতে চান?’ সুরজ সিং বলল।

‘রক্ষাকবচ বলতে যা বোঝায়, তাই। ধরুন আপনাদের মধ্যে কেউ সতীপ্রথার পক্ষে আন্দোলনে যোগ দিলেন, আর ঠিক করলেন আপনার যুক্তির পক্ষে তার মুখ দিয়ে দু—চার কথা বলবেন। যে মুহূর্তে সে এই ব্যাপারে মুখ থেকে কথা খসাবে সেই মুহূর্তেই কমার্শিয়াল দিক থেকে সে খতম হবে।’

‘না, না, আমরা সতীপ্রথার বিরুদ্ধেই।’ হীরাভাই কথাটা বলে সুরজ সিংয়ের দিকে পানমশালার কৌটো এগিয়ে দিল।

‘স্বর্ণকুমারীর চরিত্র হতে হবে দৃষ্টান্তযোগ্য এবং বিতর্কের বাইরে, এটাই আমরা ধরে নিচ্ছি।’ সারদাচরণ বললেন। ‘তাহলে আপনাদের কারুরই এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই বলেই মনে হচ্ছে। মি. অরোরা এ ক্ষেত্রে কী আমরা—’

‘এখনও বাকি আছে। প্রোমোশনাল ক্যাম্পেনের সময়টা ঠিক করার কথাটা এখনও বাকি। অলিম্পিকের ঠিক পরেই, সব থেকে সুবিধাজনক সময়ে, যখন পাবলিক ইন্টারেস্ট একেবারে তুঙ্গে আপনারা চান ঠিক সেই সময়ে ধাক্কা দেবার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা তৈরি করে রাখতে। তা করতে হলে খুঁটিনাটি যাবতীয় কথাবার্তা অলিম্পিকসের আগেই চালাতে হবে। স্বর্ণকুমারীর সাফল্যের উপরই শর্ত সাপেক্ষে চুক্তিগুলো হবে কিন্তু গেমসের আগেই ব্যবসার কর্তাদের সঙ্গে অবশ্যই কথা বলা শুরু করতে হবে। কিন্তু তারপর ওর দুটো লং ডিস্টান্স সোনা জেতার স্বপ্ন কিন্তু আর গোপনে রাখা সম্ভব হবে না।’

‘এটাও আমরা মেনে নিচ্ছি ম্যারাথনে তো ধরেই নেওয়া যায় ও নির্বাচিত হয়ে গেছে। দশ হাজার মিটারেও হলে, তখনই তো ব্যাপারটা লোকে বুঝে নেবে।’ সারদাচরণ বললেন।

‘ট্রায়ালের পর একমাস মাত্র সময় পাচ্ছেন, তাতে হবে?’ প্রণব দত্ত এই প্রথম মুখ খুললেন। ঋজু, ব্যক্তিত্ব ভরা কণ্ঠস্বর।

‘হতেই হবে।’ রাহুল বলল।

‘মি. অরোরা আপনি কত পারসেন্ট নেবেন?’ হীরাভাই ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে পানমশলার কৌটোটা টেনে আনল সুরজ সিংয়ের সামনে থেকে।

‘এই কাজটার জন্য পনেরো পারসেন্ট।’

‘হায় নারায়ণজি, তাহলে আমাদের জন্য কত থাকবে?’ হীরাভাই শুকনো মুখে তাকাল।

‘পঁচাশি,’ রাহুল ঝুঁকে বলল, ‘হিসেব করতে সুবিধে হবে মনে হলে আপনি আমাকে কুড়িই দেবেন।’

‘আমরা কত তুলতে পারব বলে আপনি মনে করেন?’ প্রণব দত্ত দ্রুত কাজের কথায় এল। তাকে প্লেন ধরতে হবে।

‘যদি দুটোই জেতে আর তারপরও শ্বাস টেনে যায়, তাহলে আমার অনুমান ষাট লাখের মতো।’ রাহুল শান্ত গলায় বলল।

কিছুক্ষণ ঘরটা নীরব থাক। সবাই মানসাঙ্কে ব্যস্ত।

‘আমি রাজি।’ হীরাভাই বলল।

‘আমিও।’ অর্জুন নিজের মতো জুড়ে দিল।

‘মি. অরোরাকে কমিশন দিয়ে আমাদের যা থাকবে তাকে পাঁচ ভাগ করলে প্রত্যেকের নয় লক্ষের কিছু বেশি হবে।’ সুরজ সিং বলল।

‘আমার কোনো আপত্তি নেই।’ প্রণব দত্ত মাথা হেলাল।

‘এক সেকেন্ড, স্বর্ণকুমারী এর থেকে কত পাবে?’ রাহুল জানতে চাইল।

সারদাচরণ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, ‘নিশ্চয়, আমি ওর ব্যবস্থা করব। আমরা স্বর্ণকুমারীর নামে একটা কর্পোরেশন গঠন কর। আমরাই বোর্ডের সদস্য হব। লাভের আমার অংশ থেকে যা পাওয়া যাবে তাতে ওর বাকি জীবন চলে যাবে।’

‘কিন্তু বোর্ডে তো স্বর্ণকুমারী নেই।’ রাহুল বলল।

‘বয়সটা খুবই কম।’ সারদাচরণ মাথা নাড়লেন। বরং ওর তরফে একটা ট্রাস্ট ফান্ড করা হোক। আমার ভাগ্যের একটা বড়ো অংশ ওকে দেওয়া হবে।’

‘কত বড়ো অংশ?’

‘এখনও তা ঠিক হয়নি, তবে আমার ইচ্ছে অন্তত এক তৃতীয়াংশ। আপনার অনুমান ঠিক হলে, তাহলে তিনলাখ।’

রাহুল দ্রুত চিন্তা করল। বোর্ডে যোগ দিলে সোনালির বিশেষ কিছু লাভ হবে না। বরং ট্রাস্ট পড়াই ভালো। এইসব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে টাকাপয়সার ব্যাপারে দর কষাকষির সুযোগ কম, তবে যতটা নিংড়ে বার করা যায় করে দেখবে।

‘স্বর্ণকুমারী কর্পোরেশন প্রস্তাবটাই মনে হয় ভালো। কিন্তু যেটা আমাকে চিন্তায় ফেলেছে সেটা হল, আয়ের টাকার কতটা স্বর্ণকুমারী পাবে। খবরের কাগজ যদি জানতে পারে স্বর্ণকুমারীর প্রত্যক্ষ কোনো রকম অধিকার এই কর্পোরেশনে নেই তাহলে লেখালেখি শুরু হবে। এর থেকে ট্রাস্টই ভালো। কিন্তু লক্ষ লক্ষ টাকার কতটা অংশ ট্রাস্টে যাচ্ছে, এই নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। হিসেবে দাঁড়াচ্ছে পাঁচ পার্সেন্ট। খবরের কাগজ বলবে মাত্র পাঁচ! এটা তো একটা মেয়েকে শোষণ, বঞ্চনা। আমি আপনাদের সমালোচনার জন্য বলছি না, শুধু পাবলিক রিলেশনের কথা ভেবেই বলছি।’

‘আপনি বলছেন মেয়েটির অংশ বাড়িয়ে দিতে?’ প্রণব দত্ত ভ্রূ বাঁকিয়ে বলল।

‘পঞ্চাশ পার্সেন্ট করলে ভালো হয়।’

ঘরে আবার নীরবতা বিরাজ করল। সেটা প্রথম ভাঙল হীরাভাই।

‘যদি ফিফটি পার্সেন্ট করা হয় তাতে আপনার সুবিধেটা কী?’

‘আমার স্বার্থ হল লোককে কী বলা হচ্ছে। কাগজ ক্ষেপে উঠলে প্রোজেক্টের প্রচুর ক্ষতি হবে।’

‘কীভাবে স্বর্ণকুমারীর অংশ বাড়াতে বলছেন?’ সারদাচরণ হুঁশিয়ার গলায় বললেন।

‘দেখুন সত্যিকথা বলতে, আপনারা ষাট লাখ টাকা উঠবে এটা কখনো ভাবতে পারেননি। অঙ্কটা হয়তো ভুলও হতে পারে। তবে সম্প্রতি কয়েকজন সে পর্যায়ে রাস্টারের কনট্রাক্ট নিয়ে কথাবার্তা চালিয়ে আর মেয়েটির মার্কেটে বিকোবার মতো প্রবল পার্সোনালিটি দেখে মনে হয়েছে ষাট লাখের মতো উঠতে পারে। শুনে আপনারা যে অবাক হয়েছিলেন সেটা আমি দেখেছি।’ রাহুল থেমে তার পরের কথাটার জন্য ওদের প্রস্তুত করাল। ‘মি. পটেল, মি. দত্ত, মি. সিং, মি. হালদার প্রত্যেকের জন্য ছয় লাখ টাকা গ্যারান্টি দেওয়া, পাবেনই। যদি ষাট লাখ ওঠে তাহলে আমার এজেন্সিও নেবে ছয় লাখ। সোনালি পাবে মোট টাকার পঞ্চাশ ভাগ। লোকে তাই জানবে। সে নিজের ভাগ থেকে তার বাবাকে কত দেবে সেটা বাপ—বেটির নিজেদের ব্যাপার।’

‘প্রস্তাবটা ভালো।’ প্রণব দত্ত বলল, ‘কিন্তু ষাট লাখের কম উঠলে কী হবে?’

‘আপনাদের ছ লাখ টাকা আপনারা পাবেনই, ট্রাস্টে তিরিশ লাখ টাকা তাহলে হবে না। মনে রাখবেন ষাট লাখের বেশি উঠে গেলে বাড়তি টাকাটা ট্রাস্টেই যাবে।’

‘আমার সায় আছে, ছ—লাখ তো গ্যারান্টেড।’ সুরজ সিং

‘যদি দুটো সোনা জেতে।’ রাহুল মনে করিয়ে দিল।

‘তাহলে চুক্তিপত্র তৈরি করার জন্য আমার উকিলকে বলছি।’ সারদাচরণ কথার সুরে জানিয়ে দিলেন এটাই পাকা সিদ্ধান্ত।

.

সেইদিনই বিকেলের ফ্লাইটে রাহুল দিল্লি ফিরল। দমদমে সিকিউরিটি চেকিংয়ের পর সে একটা চেয়ারে বসে যখন অপেক্ষা করছে তখন তার পরিচিত এক ডাক্তারকে হাতে ব্রিফকেস নিয়ে ঢুকতে দেখে সে দাঁড়িয়ে উঠে হাত নেড়ে ডাকল। ঘণ্টা দুয়েকের জন্য একজন সঙ্গী পেলে সময়টা তাহলে আর ব্যাজার হয়ে কাটাতে হবে না। ডাক্তার সুদের বোন কানাডায় টরন্টোয় থাকে। ডা. সুদ বোস্টনের টাফটস ইউনিভার্সিটিতে বায়োকেমিস্ট্রিতে ডক্টরেট করতে গেছলেন। সেখান থেকে সাতদিনের জন্য বোনের সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখন রাহুলের সঙ্গে ওঁর আলাপ হয়েছিল।

বেঁটেখাটো, গৌরবর্ণ, টাই সুট পরা ডা. সুদ রাহুলকে দেখে তাড়াতাড়ি এগিয়ে এলেন।

‘কেমন আছেন ডা. সুদ? অনেকদিন পর, চিনতে পারছেন?’

‘অবশ্য অবশ্য। আপনি আমার খোঁজ না রাখলেও আমি কিন্তু রাখি। এখন তো আপনি বিরাট ব্যবসা বানিয়েছেন। আপনার এক ক্লায়েন্ট আমার পেশেন্ট, তার কাছ থেকে খবর পেয়েছি।’

‘কে আমার ক্লায়েন্ট?’

‘ডান্সার কৃষ্ণমোহিনী। তার পায়ের একটা ব্যাপার। নাচতে শুরু করার পরই পা ভারী হয়ে যাচ্ছে। স্টিফ হয়ে যাচ্ছে মাসল। ব্যথা শুরু হচ্ছে।’

‘কৃষ্ণমোহিনীর এরকম অবস্থা তাতো জানতাম না, কিছু তো আমায় বলেনি। এখন ও আর কোথায়?’

‘গত সপ্তাহে আমার কাছে চণ্ডীগড়ে এসেছিল।’

‘সিরিয়াস?’

‘হ্যাঁ সিরিয়াসই। নাচ একদম বন্ধ করতে বলেছি, অন্তত যতদিন না ব্লাড সুগার নর্ম্যাল হয়।’

রাহুল মনে মনে উদবিগ্ন হলেও মুখে তার চিহ্নও রাখল না। যেন কিছুই নয় এমন ভাব করে প্রসঙ্গ ঘোরাল। ‘আপনি চণ্ডীগড়ে কোথায় এখন, হসপিটালে?’

‘আমি আছি ইনস্টিট্যুট অব হিউম্যান সায়েন্সে। একদিন আসুন না।’

রাহুলের মাথার মধ্যে নামটা ধাক্কা দিল। ডা. সরকার এইখানেই তার গবেষণা নিয়েছিলেন। কীসের যেন গবেষণা?

‘আচ্ছা আপনাদের ইনস্টিট্যুটে ডা. সরকার বলে কেউ কি ছিলেন?’

‘ডা. সরকার? হ্যাঁ ছিলেন তো। চেনেন নাকি?’

‘না। তবে ওর এক আত্মীয়কে চিনতাম। তার কাছে শুনেছিলাম উনি কী একটা বিষয়ে ওখানে…।’ কথাটা অসম্পর্ণ রেখে সে ডা. সুদের মুখভাব লক্ষ করল। কিরকম যেন, তাচ্ছিল্য, শ্রদ্ধা, ভয় সব মিলিয়ে একটা ভাব ওর মুখে।

এয়ারক্র্যাফটে চড়ার জন্য ঘোষণা হচ্ছে। দরজার দিকে হুড়মুড়িয়ে সবাই ছুটেছে বাসে ওঠার জন্য।

‘প্লেনে উঠে আপনাকে বলব ওর কথা, ‘ড. সুদ যেচেই বললেন রাহুলকে।

রানওয়ে দিয়ে ছুটে জমি ছাড়ায় এবং সিট বেল্ট বাঁধার নির্দেশ জ্বলা অক্ষরগুলো নিভে যাবার পর ডা. সুদ পাশে বসা রাহুলকে একগাল হেসে বললেন, ‘এই সময়টায় আমি একটু ভগবানের নাম করি। এত কাজ যে ফুরসত পাই না।’

‘তবু তো টেকঅফের সময় করেন, ল্যান্ডিংয়ের সময় ভগবানকে ভুলে যান না তো? তখনও করবেন কিন্তু।’

‘নিশ্চয় করি। একটু বেশিই করি।’

‘ডা. সরকার সম্পর্কে বলবেন বলেছিলেন। আচ্ছা, একটা কথা বলে রাখি, কোনো একটা ব্যাপারে আমি ওর সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক। দ্য ইনফ্লুয়েন্স অব হিরেডিটি অন হিউম্যান গ্রোথ নামে উনি একটা প্রোজেক্ট শুরু করেন যখন হামবুর্গে ছিলেন, তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘একটা প্রোজেক্টে, যার সম্পর্কে আপনকে বলতে পারব না, কেননা কথা দিয়েছি কাউকে এখন জানান যাবে না, উনি এবং অনেকে ইনভেস্ট করেছেন। কেন, কী উদ্দেশ্য করেছেন সেটা বুঝতে পারছি না বলেই কেমন যেন ধাঁধার মতো লাগছে। কোন ব্যাপারটা ওকে মোটিভেট করছে? আচ্ছা ওকে আপনি চেনেন কতটা?’

‘চণ্ডীগড়ে ওর বিভাগেই আমি এক বছর ছিলাম। বছর তিনেক আগে উনি স্বেচ্ছায় রিটায়ার করে চলে যান। কাজের বাইরে ওর সম্পর্কে কিছু জানি না। শরীর সম্পর্কে ওর কিছু থিওরি আছে।’

‘কী সেগুলো?’

মানুষের শরীরের বৃদ্ধি সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়াতেই বহু বছর কাটিয়েছেন। তাই থেকে সিদ্ধান্তে এসেছেন প্রতি দশকে এক সেন্টিমিটার করে গড় মানুষের বৃদ্ধি ঘটছে। সরকারের স্টাডিটা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেই এটা সম্পর্কে আগেও স্টাডি হয়েছে। তাদের গবেষণা হয়েছিল কমবয়সিদের নিয়ে যখন শরীরের পুরো বৃদ্ধি ঘটেনি, অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে। সরকার কাজ করেন পরিণত শরীরের মানুষ নিয়ে। মুশকিলটা হল, সরকারের কথা মতো, মানুষ প্রতি দশকে এক সেন্টিমিটার করে বাড়তে থাকলে একদিন তো কিংকংয়ের আকার নেবে? দুশো বছর পরে সবাই তো কুড়ি সেন্টিমিটার বা আট ইঞ্চি লম্বা হয়ে যাব! প্রশ্নটা হল, মানুষের হাড়ের গঠন যেভাবে সাজানো তাতে কি এই বৃদ্ধির সঙ্গে তা তাল রাখতে পারবে? উনি এ সব কথা মানতে চাইলেন না।’

‘কেন তাল রাখতে পারবে না?’

‘এখন মানুষের গড় উচ্চচতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি। এটাই চূড়ান্ত আর মানুষের দেহ কাঠামো প্রস্তর যুগের মানুষের থেকে এখন পর্যন্ত খুব একটা বদলায়নি। কঙ্কাল মেপে দেখা গেছে প্রস্তর যুগে মানুষের গড় উচ্চচতা ছিল পাঁচ ফুট নয়, তাম্র যুগে পাঁচ—আট, লৌহ যুগে পাঁচ—ছয়। আবার মধ্য যুগে পাঁচ—সাত।

‘মানুষ কোঁকড়াতে শুরু করল কখন?’

‘শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে। শহরের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বসবাসের মান খারাপ হতে লাগল। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে একটা থমকানি এল। একশো বছরেরও উপর লাগল এর থেকে বেরিয়ে আসতে। তবে এখন আবার তাম্র যুগের উচ্চচতায় মানুষ ফিরে গেছে।’

‘ডা. সরকার এ সম্পর্কে কী বলেন?’

‘প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মাপের সত্যতা উনি মানতে চান না। শুধু শক্তিমান আর লম্বা প্রাণীরাই পূর্ণ বয়সে পৌঁছতে পারবে বেঁচে থেকে। তাই ওনার মতে, সভ্য যুগে যখন দুর্বলদের পক্ষেও বেঁচে থাকা সম্ভব, তখন সভ্য যুগের সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক যুগের তুলনা করাটা বোকামি, অর্থহীন। ওর মতে এখনকার গড়পড়তা লোকই পৃথিবীর ইতিহাসে সব থেকে লম্বা, আর উনি মানতে চান না যে আমরা বৃদ্ধির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি। যতদূর মনে পড়ছে একদিন উনি আমায় বলেছিলেন, মানুষের আগামীকালে যতটা বৃদ্ধি ঘটবে অন্তত পরের ছয় দশকের বৃদ্ধি ধারণ করার মতো ক্ষমতা তার দেহ কাঠামোর গঠনের মধ্যে আছে।’

রাহুলের মনে পড়ল, অর্জুনের বাড়িতে সারদাচরণ ফিল্মের মধ্য দিয়ে প্রথম স্বর্ণকুমারীকে তাদের দেখান একবিংশ শতাব্দীর স্ত্রী জাতির অবিকল নমুনারূপে।

‘এটা কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ?’ রাহুল বলল।

‘সরকারের কাছে অন্তত তাই। ওর হামবুর্গের রিসার্চ ওর কাছে জীবনের প্রধান আর একমাত্র জিনিস। ওনার যাবতীয় থিওরির মূল ভিতই এটা। ওর ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির থিওরিটা নিয়ে উনি একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে যান। কিন্তু আর কোনো বিশেষ সারবস্তু ওতে যোগ করতে পারেননি। বহু লোক, এমনকি আমরাও অবাক হয়ে ভাবি, আপনিও ভেবেছেন, সত্যিই কী এটা গুরুত্বপূর্ণ?’

প্লেনের লাউডস্পিকারে ঘোষণা হল জলপান দেওয়া হবে। প্লাস্টিকের ট্রে হাতে এয়ারহোস্টেসদের আনাগোনা শুরু হল। সামনের সিটের পিছন থেকে টেবল নামানো হতে লাগল। রাহুলও ডা. সুদ আলোচনা বন্ধ রেখে চিজ স্যান্ডুইচ ও একটি রসগোল্লা দিয়ে জলপান সারল। দুধ আর কফি—পট দু’হাতে নিয়ে একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কফি?’ রাহুল মাথা নাড়ল। তার পিছনেই এল আর একটি মেয়ে। ‘টি?’ রাহুল ‘ইয়েস’ বলতেই সে ঝুঁকে চায়ের লিকার এবং তারপর দুধ টেবলে রাখা কাপে ঢালতে লাগল। এই সময়টুকুর জন্য তার রাধিকা পাইনকে মনে পড়ল। বুক থেকে কোমরের ধরটা ঠিক একইরকম।

‘মি. অরোরা একটা কথা জানবেন, ‘ডা. সুদ আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এইসব লোকেরা এমন কিছু একটা করে ফেলতে পারেন যা আমাদের চিন্তাধারাকেই বদলে দিতে পারে। কিন্তু প্রতি একজনের সাফল্যের জন্য কয়েক ডজন লোককে ব্যর্থতা বরণ করতে হয়। পূর্ণতার বদলে তারা পায় শূন্যতা। ডা. সরকার এই শেষের দলে পড়েন। চণ্ডীগড় ছেড়ে তিক্ত মন নিয়ে তিনি চলে যান।’

‘ডা. সরকারের থিওরি সম্পর্কে এবার একটা বোকার মতো প্রশ্নই করব। তিনি প্রমাণ করতে চান, মানুষের কঙ্কাল গঠনগতভাবে দেহের বৃদ্ধিটা নেওয়ায় সক্ষম, তাই তো?’

‘তার আগে মানুষের বৃদ্ধি সম্পর্কে তাঁর যুক্তিটা কতটা নির্ভরযোগ্য সেটা দেখতে হবে। অনুপাত আর উপাদান বদল না করে কোনো প্রাণীরই নিজস্ব চেহারার বিশেষ একটা আকার ছাড়ানো, বদল ঘটানো প্রকৃতির পক্ষে অসম্ভব, এটা গত তিনশো বছর ধরে বহু বৈজ্ঞানিকই বলে এসেছেন।’

‘আচ্ছা কৃত্রিমভাবে কি শরীরের বৃদ্ধি সম্ভব?’

‘অ্যানাবলিক স্টিরয়েড? না, ওতে লম্বা হওয়া যায় না।’

‘তাড়াতাড়ি বৃদ্ধি ঘটানো যায় না?’

‘বৃদ্ধির প্রক্রিয়াটা এখনও বায়োলজিক্যাল ধাঁধা হয়ে রয়েছে।’

‘হরমোন টরমোন দিয়ে? বৃদ্ধিটা নিয়ন্ত্রণ করে তো এই দিয়েই?’

‘পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে সোমাটোট্রপিক—মানুষের বৃদ্ধির হরমোন বেরোয়—’

‘এই হরমোন কৃত্রিমভাবে যদি শরীরে দেওয়া হয় তাহলে কী হবে?’ রাহুলের ঘুরে বসার চেষ্টা থেমে গেল কোমরে বাঁধা সিটবেল্টে বাধা পেয়ে। সে অনেকখানি এগিয়েছে অন্ধকার রাস্তা দিয়ে। এখন একটা ক্ষীণ আলো যেন দেখতে পাচ্ছে।

‘বিশেষ এক ধরনের বামনদের উপর এটা প্রয়োগ—’

‘বামনটামন নয়, স্বাভাবিক শিশুদের উপর যদি প্রয়োগ করা হয় তাহলে কী হবে?’

ডা. সুদ কয়েক সেকেন্ড ভাবলেন। ‘জানি না, আমার কোনো ধারণা নেই। তা ছাড়া আমি তো কারণ দেখতে পাচ্ছি না এটা করার?’

‘কারণ হয়তো বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লম্বা হবে।’

ডা. সুদ চুপ করে রইলেন।

‘স্বাভাবিক শিশুর দেহে বৃদ্ধির হরমোন ঢুকিয়ে দেওয়া নিশ্চয় বীভৎস চিন্তা, কেউই তা করবে না। যদি কোনো ঘাটতি থাকে তাহলে ঠিক আছে কিন্তু স্বাভাবিক শরীরে উচিত নয়। ব্যায়াম করে তো লম্বা হওয়া যায়?’ রাহুল বলল।

‘খুব সামান্য। বৃদ্ধিটা একটু তাড়াতাড়ি ঘটানো যায় মাত্র, তবে আপনি তো জানতে চাইছেন স্বাভাবিক উপায়ে লম্বা হওয়া ছাড়াও আর কোনোভাবে মানুষকে লম্বা করা যায় কিনা?’

‘একেবারে ঠিক কথাটাই বললেন।’

‘মধ্যযুগে লোককে ধরে এনে অত্যাচার করার জন্য, হাত আর পা বেঁধে দু—দিকে টানা হত। এতে লম্বা বোধহয় করা যায়। অত্যাচারের সপক্ষে যুক্তি দেওয়া হত, সত্য আবিষ্কারের জন্য নাকি এটা করা হচ্ছে।’

রাহুল মাথা নেড়ে বলল, ‘এটা ভেবে দেখব।’

সাত

স্বর্ণকুমারীকে কমার্শিয়াল হাউসগুলোর কাছে বিক্রি করার কৌশল ভাঁজতে ব্যস্ত রইল রাহুল। কীভাবে প্রচার শুরু হবে, ধাপেধাপে কোনটের পর কোনটে আসবে সেটার খসড়া তৈরির কাজে সে নিজেকে এমন নিবদ্ধ রেখেছিল যে কলকাতার বা বর্ধমানের কোনো খবর রাখেনি।

একদিন বিকেলে সে অর্জুনের টেলিফোন পেল বাঙ্গালোর থেকে।

‘কী ব্যাপার অর্জুন?’

‘এসেছি স্বর্ণকুমারীর টিমের সঙ্গে।’

‘কেন? হঠাৎ বাঙ্গালোরে?’

‘তুমি কোনো খবর রাখ না দেখছি। এখানে মেয়েদের একটা মিট হচ্ছে। এটাকে অলিম্পিক ট্রায়ালের ট্রায়াল বলতে পার। ইন্দো—সোভিয়েত কালচারাল এক্সচেঞ্জ বলে একটা ব্যাপার আছে জানো তো? একটা সোভিয়েত অ্যাথলেটিক্স টিম শ্রীলঙ্কায় গেছল। ইন্ডিয়া গভমেন্ট সেটাকে ভারতে আনিয়েছে। উদ্দেশ্যে, ওদের সঙ্গে কম্পিট করিয়ে আমাদের অ্যাথলিটরা কতটা আন্তর্জাতিক মানের সেটা পরখ করা। ‘সাই’ থেকে বিশেষ করে বলা হয়েছে সোনালি দশ হাজার মিটারে যেন অবশ্যই নামে। লং ডিসট্যান্সে দুটো রুশি মেয়ে এসেছে আর আমাদের তরফে নামবে চারটে মেয়ে। তাদের একজন সোনালি। ওর ম্যারাথন টাইমিং দেখে চমকে গেছে তো! বিশ্বাসই করতে চায় না পাতিয়ালার এনআইএস কর্তারা। ওরা একবার দেখে নিতে চায় স্বচক্ষে।’

‘কিন্তু ক—দিন হল সোনালি ম্যারাথন দৌড়েছে? দু—সপ্তাহ?’ রাহুল দেওয়াল ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল। তারিখটা দেখে নিয়ে চট করে হিসেব করে ফেলল, ‘ঠিক সতেরো দিন। এর মধ্যেই আবার।’

‘ডা. সরকারও তো তাই বলছেন। তিনি তো রাজিই হননি। কিন্তু গভমেন্ট প্রেশার। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেই দিয়েছে এই মিটটায় না নামলে অলিম্পিকের জন্য সিলেকশন পাওয়া শক্ত হবে। ডা. সরকারের শর্ত, সোনালি সিলেক্টেড হলে পাতিয়ালা বা অন্য কোথাও গিয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে থাকা বা কোনো এনআইএস কোচের আন্ডারে ট্রেনিং নেওয়ায় তিনি রাজি নন। গভমেন্ট তাতে রাজি প্রোভাইডেড এই মীটে যদি তেমন কিছু ফল দেখাতে পারে।’

‘ডা. সরকার রাজি হয়েছেন তো?’

‘তা না হলে এখানে সবাই এসেছি কেন? উনি বুদ্ধিমান লোক। ব্যাপারটা কোনো জায়গায় শেষ মুহূর্তে আটকে যাক এটা চাইবেন না। তবে গজগজানি আজ বিকেলেও দেখেছি। বিজয় সিনহা সোনালিকে ওয়ার্ম—আপ করাতে নিয়ে যাবার পর আমার সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হল। তোমার কাছ থেকে আর কোনো খবর না পেয়ে উনি খুব উদবিগ্ন।’

‘আমি পেপার ওয়ার্কে ব্যস্ত। কাদের কাছে অ্যাপ্রোচ করব, কখন করব, কী বলে করব সেই সব ঠিক করায় একটু সময় লাগে। ভালো কথা, মিট করে?’

‘কাল, দুপুরে। তোমার পক্ষে আসা কি সম্ভব?’

‘এত শর্ট টাইমে! দিল্লি—বাঙ্গালোর ফ্লাইট সকালে একটা আছে। আচ্ছা আমি ট্র্যাভেল এজেন্টকে ফোন করছি, যদি পাই চলে যাব। কোথায় হবে? সোনালির ইভেন্ট তো…”

‘কান্তিরবা স্টেডিয়ামে। আমি ওয়েস্ট এন্ড হোটেলে আছি, ওরা তিনজনও রয়েছে। দ্যাখো যদি পার। গুড নাইট।’

টেলিফোন রিসিভার না রেকেই রাহুল ডায়াল করল তার ট্র্যাভেল এজেন্টের অফিসে। কথা বলে সে আশ্বস্ত হল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তারা টিকিট পাঠিয়ে দিচ্ছে। সকাল দশটায় ফ্লাইট। দুপুর বারোটা নাগাদও যদি সে বাঙ্গালোরে নামে তাহলে পৌনে একটার মধ্যে স্টেডিয়ামে পৌছতে পারবে। অবশ্য এই হিসেবটা আন্দাজের করল কেননা স্টেডিয়াম যে বাঙ্গালোরে নামে তাহলে পৌঁনে একটার মধ্যে স্টেডিয়ামে পৌঁছতে পারবে। অবশ্য এই হিসেবটা আন্দাজেই করল কেননা স্টেডিয়াম যে বাঙ্গালোর শহরে কোথায় তা সে জানে না।

পরদিন সকাল ন—টায় পালাম এয়ারপোর্টে এসে রাহুল জানল, ফ্লাইটের বিলম্ব হবে অন্তত এক ঘণ্টা। বোম্বাই থেকে প্লেনটির আসার কথা কিন্তু যথাসময়ে আসছে না। রাহুল একবার ভাবল ফিরেই যাই। নিশ্চয় ভিভি কভারেজ দেবে। লাইভ না হলেও ভিডিও করে রাতের দিকে দেখাতে পারে। তারপরই সোনালির চেহারাটা তার চোখে ভেসে উঠল। লালমাটির রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে। কাঁদের উপর চুল লাফিয়ে উঠছে। পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে গোছ থেকে শার্টস পর্যন্ত পায়ের পেশি ফুলে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। বুকে আলগোছে একটা কাঁপন লাগল। সে ঠিক করে ফেলল প্লেনের জন্য অপেক্ষাই করবে।

রাহুল বাঙ্গালোরে নেমে কান্তিরবা স্টেডিয়ামে পৌঁছে যখন গ্যালারিতে বসল, তখন মেয়েদের দশ হাজার কিলোমিটার দৌড় প্রায় শেষ হবার মুখে। স্টেডিয়ামে দর্শক হাজার দুই। অ্যাথলেটিক্স দেখতে ভারতে এখনও কোথাও ভিড় হয় না। ডা. সরকার বা অর্জুনকে খোঁজার সময় নেই। সে পাশের লোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘কত পাক এখন চলছে?’

‘কুড়ি শেষ হল।’

রাহুল দেখে অবাক হল, দুটি রুশি আর চারটি ভারতীয় মেয়ে একসঙ্গে ছুটছে। কুড়ি পাক অর্থাৎ আট হাজার মিটার পর্যন্ত ভারতের মেয়েরা এইভাবে রুশিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে, এটাই তাকে অবাক করেছে।

তার চোখ আটকে রইল সোনালির উপর। রুশি মেয়েদের নাম সে জানে না। সকালে দিল্লির কাগজে এই মিটের কথা ছোটো করে এক কোণায় ছাপা হয়েছে বলে কিন্তু কারোর নাম দেওয়া হয়নি। তবে এটুকু সে জানে শ্রীলঙ্কায় রাশিয়ানরা তাদের নামি কোনো অ্যাথলিটকে পাঠবে না। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির ছেলেমেয়েদেরই ওরা দুর্বল দেশগুরলোয় পাঠায়। গোহারান হারিয়ে দিয়ে বন্ধু দেশকে বিষণ্ণ করে দেওয়াটা ভালো কূটনীতি নয়।

রাহুল ধরে নিল এই মেয়ে দুটি উঁচুমানের নয়। সোনালিকে নয় সে বাদই দিল, অন্য তিনটি মেয়েও যখন পাল্লা দিচ্ছে তখন ওরা আন্তর্জাতিক মানের হতেই পারে না।

প্রথমে রুশি মেয়ে দুটি, তাদের গোড়ালিতেই সোনালি, সমান পদক্ষেপে। তার দশ মিটার পিছনে তিনটি ভারতীয় মেয়ে। কিন্তু এই দশ মিটার ব্যবধানটা একটুএকটু করে বেড়ে যাচ্ছে। রাহুল পাশের লোকটিকে অযাচিতই বলল, ‘এবার এই তিনজনের দম ফুরিয়ে আসছে। ওদের সঙ্গে পাল্লা না দিলেই পারত।’

লোকটি অবাক হয়ে তাকাল রাহুলের দিকে।

‘কতক্ষণ এসেছেন’

‘এই তো, এইমাত্র।’

‘অ। ওই তিনটে মেয়ে পাল্লা দেবে কী, ওরা তো সবে এ উনিশ পাক শেষ করল।’

রাহুল অপ্রতিভ হয়েও হেসে ফেলল। সে মন দিল সোনালির উপর। জোঁকের মতো লেগে আছে রুশিদের সঙ্গে পেশিতে ঠাসা দুটি পা, পাঁচ ফুটের কাছাকাছি, কোঁকড়া চুল, সাদা ব্লাউজ পরা মেয়েটি হঠাৎ গতি বাড়াল, লাল হাতকাটা গেঞ্জি পরা রুগণ চেহারার, ছেলেদের মতো ছাঁটা চুল অন্য মেয়েটিও তার পিছু নিল, সঙ্গে সঙ্গে সোনালিও। দুশো মিটার এইভাবে দৌড়ে সাদা ব্লাউজ মন্থর হতেই লাল গেঞ্জি গতি বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল। সোনালি সাদা ব্লাউজকে ধরে রইল। এই রকম আচমকা গতির হেরফের তিনবার হল।

যখন ওরা তার সামনে দিয়ে যাচ্ছে, রাহুলের মনে হল সোনালির মুখে সহজাত স্বাচ্ছন্দ্যটা যেন নেই। তার পা ফেলার মধ্যে ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠছে। রুশিরা ওর ফুসফুসকে নিংড়ে নিংড়ে দম বার করে দেওয়ার কৌশল শুরু করেছে।

পিছিয়ে পড়ছে সোনালি। দু—জনের অন্তত পনেরো মিটার পিছনে। স্টেডিয়ামের এধার—ওধার থেকে তাকে চাঙ্গা করার জন্য কিছু উৎসাহ বাক্য চেঁচিয়ে বলা হল।

আবার ওরা রাহুলের সামনে আসছে। ভালো করে দেখার জন্য সে গ্যালারি থেকে উঠে ফেন্সিংয়ের ধারে গিয়ে দাঁড়াল। চোখের নজর বাড়িয়ে সে সোনালির মুখের দিকে তাকাল। মুখটা লাল হয়ে উঠেছে, মাখানো তেলের মতো সারা শরীর ঘামে চকচক করছে। ঠোঁট ফাঁক হয়ে দাঁত দেখা যাচ্ছে। এর আগে যখন রাহুল লক্ষ করেছিল তখন ঠোঁট বন্ধ ছিল। এখন চিবুক ঝুলে পড়েছে। পা দুটো জমি থেকে আগের মতো উঠছে না।

রাহুলের মনে হল সোনালি যে একবার একটুখানি মুখটা ফেরাল। কিন্তু তাকে দেখতে পায়নি। মনে হল, ওর গতি যেন বাড়ল।

শেষ পাকের ঘণ্টা বেজে উঠল। শেষ হবে রাহুলের ডান দিকে প্রায় একশো মিটার দূরে। পাঁচ—দশ হাজার মিটারে এখন তো শেষ দু—তিনশো মিটার স্প্রিন্ট করে ফিনিশ করে। স্পোর্টস টেকনোলজি অ্যাথলিটদের শরীরের ক্ষমতা কত দূর বাড়িয়ে দিয়েছে দু—চারটে প্রবন্ধ থেকে রাহুল তা জেনে রেখেছে।

রুশিরা ফিনিশিংয়ের ধাক্কাটা দিয়েছে। ওরা দু—জন এখন নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেছে। ওদের কুড়ি মিটার পিছনে সোনালি, সেও গতি বাড়াল।

ওরা এবার তার সামনে আসছে। প্রথমে রয়েছে রুগণ চেহারার লাল গেঞ্জির মেয়েটি। তার এক মিটার পিছনে সাদা ব্লাউজ। কোথায় সোনালি? সেই কুড়ি মিটার পিছনেই। এই ব্যবধানটা বজায় রাখার চেষ্টা করে কোনোক্রমে সে দৌড়চ্ছে।

‘স্বর্ণকুমারী… হেরে যাচ্ছ।’

রাহুল চিৎকার করল। সোনালি তাকাবার কোনো চেষ্টাই করল না। তার চোখ বেয়ে জলের ধারা নামল। রুমাল বার করে সে মুছে নিল।

ফিনিশিং লাইনে চারমিটার আগে সোনালি মুখ থুবড়ে পড়ল নিজের পায়ে পা জড়িয়ে। রাহুল দেখল, বিজয় সিনহা ছুটে গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল। তার পিছনে ডা. সরকার আর অর্জুন।

স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে এল রাহুল। তার মনের মধ্যে এখন প্রচণ্ড সাইক্লোনের পরের অবস্থা। সে ঠিক করতে পারছে না এখন সে কোনখান থেকে তার চিন্তাটা শুরু করবে।

কিছু একটা গোলমাল ঘটেছে। সেটা কোথায়? মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে? দুই বিদেশির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে গিয়ে কি নার্ভাস হয়েছে? জীবনে এটা ওর দ্বিতীয় প্রকাশ্য রেস। কিন্তু প্রথমবারও তো প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বি ছিল এক অস্ট্রেলিয়ান, নামি ম্যারাথনার। অলিম্পিকসে এগারো স্থান পাওয়া। তাকে হারিয়ে সোনালি পৃথিবীর সেরা সময়গুলোর কাছাকাছি এসেছে। ওয়ার্ল্ড বেস্ট থেকে তিন—চার মিনিট দূরে। প্রচণ্ড গরমে, হিউমিড কন্ডিশনের মধ্যে দৌড়ে শেষ করেছে। শেষ হাজার মিটারে অস্ট্রেলিয়ান মেয়ের সঙ্গে ব্যবধান বাড়ানোর দৃশ্যটা রাহুলের চোখে ঝলসে উঠল। কী সবল দুটো পা! ঋজু নমনীয় দেহ। মুখে পাতলা হাসি। ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই। এখুনি আবার আর একটা রেসে নামার মতো ক্ষমতা ওর পদক্ষেপে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল।

আর সেই মেয়ে, কী বিশ্রীভাবে শুধু দৌড়লই না, শেষ করল কী অমর্যদাকরভাবে! যদি স্বাভাবিকভাবে দৌড়ে একঘণ্টা সময় নিয়েও শেষ করত তাহলে এত কষ্ট হত না। ম্যারাথনে সোনালির সময় ভারতের সব কাগজেই বেরিয়েছে, দিল্লিতে এসে রাহুল তার অফিসে রাখা আঠারোটা প্রধান ও মাতৃভাষার কাগজের ফাইল থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবর বিশ্লেষণ করে তার প্রচারের ধরন কী হবে, সেটা ঠিক করেছে।

আর এখন? কাল কী বেরোবে কাগজগুলোয়? বলবে ম্যারাথনের টাইম ধরায় গোলমাল ছিল। বলবে, ডোপ করে ম্যারাথন দৌড়েছিল। বলবে ম্যারাথন রুটের ডিসট্যান্সের মাপে গোলমাল আছে, নিশ্চয় ২৬ মাইলের কম।

কিন্তু ৬০ লক্ষ টাকার ব্যাপারটা কী হবে? এরপর সোনালির দুটো সোনা জেতার কী হবে?

রাহুল কালা—বোবা—অন্ধ হয়ে হাঁটছে, শুধুই হাঁটছে। এই টাকার একটা অংশ মাত্র সে পাবে। না পেলেও তার কিছু আসে যায় না। তার সুনাম, তার ব্যাবসা, তার বুদ্ধি ভবিষ্যতে তাকে কোটি টাকার এনে দেবে। বহু মেয়েকে, পুরুষকে সে ক্লায়েন্ট করেছে, কিন্তু তার অর্ধেকও প্রতিশ্রুতিমতো পূর্ণতা পায়নি। তাতে সে ভেঙে পড়েনি, মাথাও চাপড়ায়নি। কিন্তু এই মেয়েটি তার শরীরে—মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি জাগিয়েছে। কোথায় যে আকর্ষণ করেছে, সেটাই সে ধরতে পারছে না। ওর সঙ্গে কথা বলার পর রাহুল হঠাৎই এক বিচিত্র শূন্যতা বোধের মধ্যে কয়েকটা দিন কাটিয়েছে। সোনালির সৌন্দর্য স্বাস্থ্য, অকপটতা, সোনা জেতার স্থির বিশ্বাস, জড়তাহীন আচরণ আর যৌন বাসনা জাগানোর ক্ষমতা, সব মিলিয়ে তার কাছে একটা আবেগ হয়ে উঠেছে মেয়েটি। ওর কাঠিন্যের মধ্যে কোথায় যেন একটা অরক্ষিত জায়গা আছে যেখানে থেকে সোনালির দুর্বলতা বেরিয়ে এসে তাকে ধ্বংস করবে বলে তার মনে হয়েছে। মেয়েটিকে রক্ষা করা দরকার।

সোনালির অলিম্পিক টিমে সিলেকশন পাওয়ার এবার ঝঞ্ঝাট দেখা দেবে। ওর এইভাবে দম হারিয়ে থুবড়ে পড়াটা অ্যাথলেটিক ফেডারেশন, আই ও এ—সাই—য়ের লোকেরা সন্দেহের চোখে দেখবেই। নিজেদের ডাক্তার দিয়ে মেডিক্যাল চেক—আপ করাবেই। যদি তখন কিছু গোলমাল ওর শরীরে ধরা পড়ে? কিন্তু গোলমাল কী হতে পারে অমন টগবগে, মাসল ফেটে পড়া শরীরে?

হাঁটতে হাঁটতে রাহুল দেখল সে মাহাত্ম গান্ধী রোডে এসে পড়েছে। সারি সারি দোকান রাস্তার একদিকে। চওড়া পেভমেন্ট। রাস্তার ওপারে উঁচু জমি। দেখেই বোঝা যায় অঞ্চলটা মালভূমির মতো পাহাড়ে জমি সমান করে তৈরি করা হয়েছে, রাস্তা ঢালু হয়ে আবার উঠেছে অনেক জায়গায়। কর্ণাটক ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের স্টেডিয়াম দেখে রাহুল সেটা লক্ষ্য করে এগোল। ওর পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় ওয়েস্ট এন্ড হোটেলের দিকে।

কিন্তু সে এখন যাবে কি? রাহুল দাঁড়িয়ে পড়ল। ওখানে গিয়ে কি লাভ? কনসরটিয়ামের প্রোজেক্টকে একযু আগেই সে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখেছে। সোনালিকে ঘিরেই তো ষাট লক্ষ টাকার স্বপ্ন।

ফেরার জন্য প্লেনের ওপের টিকিট তার সঙ্গে রয়েছে। যদি সিট পায় তাহলে কাল সকালের ফ্লাইটেও যেতে পারে। তারপর রাহুলের ইচ্ছে করল সোনালিকে দেখতে। ঠিক কী ব্যাপার সেটা জানার ইচ্ছাটা ক্রমশ প্রবল হয়ে ওঠার সে একটা অটোরিকশা ডেকে তাতে চড়ে বসল।

ওয়েস্ট এন্ড হোটেলের রিসেপশন কাউন্টারে সুরেশ, সুন্দর চেহারার দুটি পুরুষ ও মহিলা। রাহুল চাইল, অর্জুন হালদারের সঙ্গে দেখা করবে, কত নম্বরে সে আছে?

‘কবে এসেছেন?’

‘বোধ হয় দু—দিন আগে, কলকাতা থেকে।’

মোটা, বিরাটাকার রেজিস্টারটার পাতা ওলটাতে ওলটাতে মহিলা দুবার ফোন তুলে প্রশ্নের জবাব দিলেন।

‘আসার তারিখটা ঠিক করে বলতে পারেন?’

‘আপনি পরশু, এগারো তারিখের—’ রাহুলের নজর ছিল রেজিস্টারের খোলা পাতর উপর, হঠাৎ সে অর্জুনের নামটা দেখতে পেয়ে গিয়ে বলল, ‘এই যে।’

‘রুম নাম্বার টু টু নাইন।’ মহিলা পিছনে তাকিয়ে দেয়ালে আটা নম্বরলেখা কাঠের খোপগুলোর দিকে তাকালেন। খোপের নীচে সেই নম্বরের ঘরের চাবি ঝুলছে। তিনি দেখে নিয়ে বললেন ‘হ্যাঁ ঘরে আছেন।’ রাহুলও দেখল চাবি ঝুলছে না।

চমৎকার লন, তাতে বেতের চেয়ার আর টেবল পাতা। লনের ধার দিয়ে ফুলের গাছ। অনেক মেয়ে—পুরুষ চেয়ারে বসে গল্প করছে। চা, কফি বা মদ খাচ্ছে। রাহুল ২২৯ নম্বর ঘরের উদ্দেশ্যে যেতে যেতে তাকিয়ে দেখছিল। একটি লোককে একা একটা টেবল বসে সিগারেট খেতে দেখে থেমে গিয়ে লোকটির দিকে এগিয়ে গেল।

‘বিজয়বাবু একা বসে যে!’

বিজয় সিনহা সিগারেট ধরা হাতটা দ্রুত টেবলের তলায় চালান করে, তারপর রাহুলকে দেখে হাতটা আবার টেবলের উপর আনল।

‘আমায় চিনতে পারছেন? মনে আছে আছে ম্যারাথনের স্টার্টিংয়ের আগে আমি সোনালির সঙ্গে কথা বলছিলাম। তখন আপনি আপত্তি—’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে।’

‘বসব?’

‘নিশ্চয় নিশ্চয়।’ বিজয় পরে জেনেছে লোকটি কে এবং কী উদ্দেশ্যে সেদিন ম্যারাথন দেখতে গেছল। ডা. সরকার ওকে বলেছিলেন, রাহুল অরোরা নামের এই লোকটা গানবাজনা, স্পোর্টস, ফিল্ম এইসব লাইনের নামি লোকেদের এজেন্ট। তাদের জন টাকা রোজগারের ব্যবস্থা করে দেয় আর সেই টাকার একটা নির্দিষ্ট পারসেন্ট কমিশন নেয়। বিরাট ব্যাবসা, এশিয়ার নামি লোক ওর ক্লায়েন্ট। সোনালি বার্সিলোনায় দুটো সোনা জিতলে রাহুলকে ওর এজেন্ট করা হবে।

এটা শোনার পর বিজয় সিনহার মনে হয়েছিল, অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নের কোচও তো হেঁজিপেজি লোক নয়। ছাত্রী নাম করলে গুরুরও নাম হবে। তখন অনেক জায়গা থেকে তাঁর ডাক আসবে। সেগুলো ম্যানেজ করার জন্য এইরকম একজন এজেন্ট থাকলে তো ভালোই হবে।

রাহুল চেয়ারে বসে তার ডানহিলের প্যাকেটটা টেবলে রেখে বিজয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে বলল, ‘দিশি সিগারেট খেয়ে কী হবে, এটা খান।’

বিজয় তার হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে, ডানহিল ধরাল, প্রথম টানটা দিয়ে আমেজ মৃদু মৃদু ধোঁয়া মুখ দিয়ে বার করল।

‘আপনি এখন এখানে?’ বিজয় জানতে চাইল।

‘বিজনেসের কাজে এসেছি। কাগজে দেখলাম আজ এখানে সোনালির—’।

রাহুলকে শেষ করতে না দিয়ে বিজয় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘আমি সেই কবে ডা. সরকারকে বলেছিলাম, একবার ওকে ভালো করে পরীক্ষা করা দরকার। ট্রেনিংয়ের পর মাঝে মাঝে বলত পা দুটো কেমন ভার হয়ে যাচ্ছে। সোনালিকে দেখাশোনা করে যে মেয়েছেলেটা তার নাম শৈলবালা। শৈলকে মাসাজ করতেও শেখানো হয়েছে। ও যখন বলত, পা আড়ষ্ট লাগছে তখন শৈলকে দিয়ে মালিশ করাতাম। ডা. সরকার বললেন, এটা সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার থেকে হচ্ছে, এটার কারণ উদবেগ। অলিম্পিকসের কথা ভেবে উত্তেজিত হচ্ছে, চিন্তা বাড়ছে। ভালো ঘুম দরকার। উনি ওকে রাতে খাবার জন্য ট্যাবলেট দিলেন।’

‘ব্যাপার কী? আজ রেসে সোনালি জিতেছে?’

‘আরে জিতবে কি। আপনি জানেন মেয়েটা এখন ঘরে বিছানায় শুয়ে। দৌড় শেষই করতে পারেনি। আমি জানতাম এ রকম একটা কিছু হবে। আজও গাড়ি থেকে নেমে স্টেডিয়ামে ঢোকার সময় চুপিচুপি বলল, ‘বিজয়দা কি যেন একটা হচ্ছে, শরীরটা কেমন ভার ভার লাগছে। আমি কিছু আর বলিনি। কিই বা বলব রেসের পরেরো মিনিট আগে?’

‘বোধহয় নার্ভাস হয়ে এটা হয়েছে।’

‘প্রত্যেক অ্যাথলিটেরই এটা হয়। না আমার মনে হয়নি নার্ভাসনেস থেকে এ সব হয়েছে।’

‘বেশ বলুন তাহলে আপনার কী মনে হচ্ছে?’

অযথাই বিজয় সিনহা চট করে চারপাশ দেখে নিয়ে বলল, ‘শরীরে কিছু হয়েছে। মনে হয় কোনো ভাইরাসঘটিত ব্যাপার। অবশ্য আমি ডাক্তার নই, হয়তো আমার ভুল হতে পারে।’

‘তাহলে ডা. সরকারের ওকে পরীক্ষা করা উচিত ছিল, করেছেন কি?’

‘করবেন বলেছিলেন কিন্তু করেননি। এটাই আমার কাছে অবাক লাগছে মি. অরোরা এত পরিশ্রম, এত খুঁটিনাটি যত্ন, এত চিন্তাভাবনা উনি করেছেন, আমিও করেছি, এত টাকা খরচ হয়েছে অথচ এই ব্যাপারটায় ওনার কীরকম যেন একটা এড়ানো এড়ানো ভাব। এই নিয়ে সেদিনও বর্ধমানে কথা কাটাকাটি হয়েছে ওর সঙ্গে। দুবছর ধরে আমি মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করেছি মেয়েটার জন্য। আহা, কী দারুণ যে রানার মি. অরোরা, কী খাটিয়ে আর কী যে ট্যালেন্টেড আপনাকে কী বলব। দুনিয়াকে দেখবার মতো একটা জিনিস ভারত পেয়েছে। আর তার কোচ, বলুন আমার কী জানার অধিকার নেই ওর শরীরে কী হয়েছে? মেয়ে কি শুধু একলা ওনারই, আমারও কি নয়?’

বিজয় সিগারেট ছুড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াল। তারপর ধীরে ধীরে আবার চেয়ারে বসল। ‘একটু আগে ওনার সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেছে। উনি রাজি হয়েছেন সোনালিকে চেক—আপ করতে। কলকাতায় ফিরে গিয়েই করাবেন।’

‘আপনি কিছু বূঝতে পারছে না, ভাইরাস ছাড়া অন্য কিছু?’

‘সত্যিই আমি বুঝছি না।’ অসহায় মুখে বিজয় তাকাল। রাহুল উঠল। ‘আমি একবার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আসি।’

রাহুল যাবার সময় সিগারেটের প্যাকেট টেবলেই রেখে গেল।

ডা. সরকার আর তার সঙ্গে দুটি লোক এগিয়ে আসছে। একটি তরুণী বছর দুয়েকের বাচ্চচার হাত ধরে রাহুলের বাঁ—পাশে গিফট স্টোর থেকে বেরোচ্ছে। বাচ্চচটি বার বার দোকানের ভিতরে তাকাচ্ছে। বোধ হয় কিছু একটা চেয়েছিল, মা কিনে দেয়নি। রাহুল চট করে বাচ্চচাটিকে কোলে তুলে নিয়ে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ওর মাকে বলল, ‘আমি বাচ্চচাদের ভালোবাসি, ওর জন্য কিছু কি কিনে দিতে পারি?’

মহিলা থতমত হয়ে আমতা আমতা করছেন। সেই সময় ডা. সরকার এবং দু—জন তার পাশ দিয়ে চলে গেল। রাহুল হাঁফ ছাড়ল। তাকে চিনতে পারেননি। মুখ নামিয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে ডা. সরকার হাঁটছেন। এভাবে হাঁটলে একটু দূরের লোককে দেখা যায় না।

‘না বলবেবেন না প্লিজ। আমি আসছি।’

রাহুল হতভম্ব মহিলাকে দাঁড় করিয়ে গিফট স্টোরে ঢুকল বাচ্চচাটিকে কোলে নিয় এবং মিনিট চারেক পরই বেরিয়ে এল। একটা একফুট লম্বা ভাল্লুক বাচ্চচার হাতে আর তার নিজের পকেটে দুটো চকোলেট বার।

‘এত সুন্দর আপনার বাচ্চচা যে আমি কিছু প্রেজেন্ট করার লোভ সামলাতে পারলাম না। না না, ধন্যবাদ দেবার দরকার নেই। আচ্ছ—’ বাচ্চচার গাল টিপে দিয়ে রাহুল এবার দ্রুত ২২৯ নম্বর ঘরের দিকে ছুটল। শ—খানেক টাকা বেরিয়ে গেল যাক। ডা. সরকারকে এখন সে এড়িয়ে যেতে চায়।

দরজার টোকা দিয়ে ‘কাম ইন প্লিজ’ শুনে রাহুল ভিতরে ঢুকল। অর্জুন টিভি—র দিকে তাকিয়ে বিছানায় পা ছড়িয়ে আধশোয়া। রাহুলকে দেখে অবাক হয়ে উঠে বসে বলল, ‘কখন এলে?’

‘ঠিক সময়ে। আমি দেখেছি স্টেডিয়ামে কী ঘটল। সোনালি কোথায়?’

‘পাশেই ২৩১ নম্বর ঘরে।’

‘ব্যাপারটা কী জানতে হবে। ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। বিজয় সিনহার সঙ্গে কথা বলেছি। ডা. সরকারের সঙ্গেও বলব কেননা পুরো প্রোজেক্ট এখন বিপদের মুখে এসে গেছে। সোনালির সিলেকশনই আটকে যেতে পারে আজকের এই ঘটনার পর। তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছ?’

‘ঠিক এই কথাটা আমারও মনে হয়েছে।’ অর্জুন উঠে বসল। ‘কখন খেয়েছ? আনাব কিছু?’

‘কয়েকটা চিজ স্যান্ডুইচ আনাও আর কফি। আমি এখনো হোটেলে চেন—ইন করিনি। সঙ্গে একটা ব্রিফকেস পর্যন্ত নেই। রাতটা কাটিয়েই চলে যাব। নীচে ট্রাভেল এজেন্টের অফিস রয়েছে। তুমি আমার যাওয়ার ব্যবস্থা করো কাল সকালেই। এই নাও টিকিট, ওর সিট পাইতে দিতে পারে। জরুরি কাজ ফেলে শুধু এই রেসটা দেখব বলেই এসেছি। আমাকে ফোন করে জানানোর জন্য তোমাকে অজস্র ধন্যবাদ অর্জুন। এখানে উড়ে না এলে, ঘটনাটা দেখলে আমি অন্ধকারেই থেকে যেতাম।’

বলতে বলতে রাহুল শার্ট খুলতে শুরু করল।

‘আমার সুটকেশটা দেখো। ফ্রেশ শার্ট—প্যান্ট পাবে। আর অন্য ব্যবস্থাগুলো রিসেপশনে কথা বলে করে দিচ্ছি।’ অর্জুন টেলিফোন তুলে রুম সার্ভিস চাইবার আগে বলল।

প্যান্ট খুলে, নগ্নদেহে তোয়ালে জনিয়ে রাহুল স্নান করার জন্য বাথরুমে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফিরে এসে টেলিফোন তুলল। অর্জুন জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘৩৩১ নম্বর ঘর আমাকে দিন, প্লিজ।’

অর্জুন চাপা গলায় বলল, ‘সোনালিকে সিডেটিভ দিয়েছেন ডা. সরকার, ওর এখন রেস্ট দরকার।’

ফোন বেজে যাচ্ছে। সাত—আটবার রিং হবার পর রিসিভার তোলার শব্দ হল।’

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

সোনালির গলা।

‘আমি রাহুল অরোরা। তুমি কি ঘুমোচ্ছিলে?’

‘না। টিভি দেখছিলাম। বাবা ট্যাবলেট দিয়েছিলেন। খাইনি। আমার এখন ঘুমোতে ইচ্ছে করছে না। আপনি কোথা থেকে বলছেন? আজ স্টেডিয়ামে ছিলেন? আমি কী বিশ্রীভাবে দৌড়লাম, পড়ে গেলাম। কেন যে—’

রাহুলের মনে হল সে যেন কান্না চাপার মতো আওয়াজ পেল।

‘আমি বাইরে থেকে ফোন করছি। তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই। জানতে চাই কেন এমন হল। কুড়ি মিনিটের মধ্যেই যাচ্ছি। ডা. সরকার তো বেরিয়েছেন তাই না!’

‘হ্যাঁ। ফেডারেশন থেকে দু—জন লোক এসেছিলেন। ওরা আজকের ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে চায়। বাবা এন আই এস অফিসে গেছেন।’

‘আমি আসছি।’

ফোন রেখে রাহুল বাথরুমে ঢুকল। বেরিয়ে এসে দেখল স্যান্ডুইচ, কফি টেবলে রাখা। অর্জুন আর তার গড়ন একই সুতরাং টি—শার্ট ও প্যান্ট ঠিকই শরীরে লেগে গেল। সে দ্রুত খেতে শুরু করে দিল।

‘রাহুল খুব সাবধানে কথা বোলো ওর সঙ্গে। কাল যখন ওকে তুলে আনা হল ট্র্যাক থেকে তখন হিস্টিরিয়ার মতো ওর হাবভাব দেখেছি। মনে হচ্ছিল মেন্টাল ব্যালন্স হারিয়ে ফেলেছে।’

রাহুল জবাব না দিয়ে খেয়ে চলল। সে তখন সোনালির ঝুলেপড়া চোয়াল, বিস্ফারিত চোখ আর শ্রান্ত পদক্ষেপ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।

২৩১ নম্বর ঘরের দরজা পিছনে বন্ধ করে রাহুল তাকাল সোনালির দিকে । তারপর ঘরের চারধার। ঘরটা একা ওর জন্যই। পাশের ঘরে ডা. সরকার ও বিজয়। টিভি বন্ধ করে সোনালি উঠে দাঁড়াল। ওর পরনে ঢলঢলে ম্যাক্সি গাউন।

‘আমি কিন্তু এখন ভালোই আছি। শুধু গলায় একটু ব্যথা আর জলতেষ্টা পাওয়া ছাড়া আর কোনো অসুবিধে নেই। প্রায় এক কলসি জল খেয়ে ফেলেছি।’ সোনালি হেসে উঠল। ‘এখনও তেষ্টা পাচ্ছে। গলার জন্য বাবা ট্যাবলেট দিয়েছেন, সেটা খেয়েছি।’

‘তোমার শরীরে ভারভার লাগা, আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া এসব তো আগে থেকেই হত। বিজয়বাবু তাই বললেন। কলকাতায় ম্যারাথনের পরও হয়েছে।’

‘কিন্তু ম্যারাথন আমি জিতেছি, আমার টাইমও ওয়ার্ল্ড বেস্ট থেকে বেশি পিছনে নয়। বার্সিলোনায় আমি ইনগ্রিড ক্রিস্টিয়েনসেনের সাত বছরের পুরোনো বেস্ট টাইমটা ভাঙবই। সেদিন অত গরমের জন্য পথে একটু বেশি জল খেয়ে ফেলেছিলাম। ৩১ জুলাই বার্সিলোনায়, ভূমধ্যসাগরের ধারে, ওয়েদার খুব ভালো থাকবে। তা ছাড়া রাস্তাও খুব ভালো পাব।’

রাহুলের মনে হল, নিজেকে চাঙ্গা করার জন্যই এইসব কথা বলছে। কিন্তু ওর কটা চোখের পিছনে ভয়ের একটা ছাড়া থেকে থেকেই ভেসে উঠছে।

‘আপনি কি খুব চিন্তায় পড়ে গেছেন? তাই তো, ষাট লাখ টাকা কামাবার প্ল্যানটা বোধ হয় ভেস্তে গেল?’

‘না। টাকার কথা ভাবছি না।’

‘তা না আর কী ভাববেন, আপনি ব্যবসায়ী।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমি মানুষও তো বটে।’

‘মানুষ তো সবাই, কিন্তু কীরকম মানুষ আপনি?’

‘সোনালি আমি তোমার ভালোমন্দর কথা ভাবি। তুমি কী ভাবো না, সোনা জেতার বাইরেও একটা জীবন আছে।’

ওর মুখের উপর দিয়ে দিশেহার একটা মেঘ ভেসে গিয়েই আবার রোদ ফুটে উঠল।

‘আগের কথা আগে। আগে বার্সিলোনার ভাবনা তারপর অন্য জীবনের ভাবনা।’

‘তুমি কি জান, কত্ত লোকের আশা—আকাঙ্ক্ষা তোমার উপর নির্ভর করছে? তোমার ওই দুটো পায়ের উপর?’

‘জানতাম না সেটা। কিন্তু সেদিন ম্যারাথনে আমি খানিকটা বুঝেছি। জানেন, ডেবির সঙ্গে ছোটার সময় বুঝতে পারছিলাম আমি ওকে হারাতে পারব। তাই ইচ্ছে করেই ওকে একটু এগিয়ে যেতে দিয়েছিলাম। ইঁদুর—বেড়াল খেলার মতো। কিন্তু জানতাম আমি জিতব, আমি জানতাম শেষ কিলোমিটারে ওকে আমি গড়াগড়ি খাওয়াব। তখন এটা মনে হতেই আমারমধ্যে অদ্ভুত একটা ভাব জেগে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল আমি কে, সেটা যেন কিছুটা টের পাচ্ছি। নিজেকে যেন খুঁজে পাচ্ছি। পুরো খুঁজে পাব যখন বার্সিলোনায় গিয়ে পৃথিবীকে হারাব।’

‘তুমি কি ঠিক জান, নিজেকে তুমি খুঁজে পাচ্ছ?’

‘তার মানে?’

রাহুল একটু সাবধানে বলল, ‘তোমার ম্যারাথনের অভিজ্ঞতা থেকে তুমি নিজের আসল প্রকৃতিটা টের পেয়েছ। তাই তো?’

‘হ্যাঁ।’

‘না। জীবনে ওটা তোমার প্রথম সুযোগ ছিল ভিতরের উদবেগ উত্তেজনা বার করে দেবার। তুমি ইঁদুর—বেড়াল খেলার মেয়ে নও?’

‘তাহলে আমি কী?’

‘আমি জানি না। তবে এখন তুমি আমার কাছে একটি মেয়েই। দুটো সোনা জেতার জন্য কঠোর ট্রেনিংয়ের চাপে যন্ত্র হয়ে যাওয়া, স্বাধীন তেতনা হারানো রোবোট নও, যে শুধু নিজেকে জাগিয়ে তোলার জন্য তোতাপাখির মতো শেখানো বুলি আওড়ায়।’

কথা বলতে বলতে রাহুল এগিয়ে এসে সোনালির সামনে দাঁড়িয়েছিল। এইবার সে অদ্ভুত একটা কাজ করল। দু—হাত দিয়ে জড়িয়ে ওকে বুকে টেনে এনে আচমকা ঠোঁটে চুমু খেল। সেইসঙ্গে অনুভব করল মৃদু একটা কম্পন সোনালির বুক থেকে ঝলকে নেমে গেল। ওর দেহ ক্রমশ আলগা, ভারী হয়ে যাচ্ছে বাহুর বন্ধনে। যেন তারিয়ে উপভোগ করছে নতুন একটা ব্যাপার। আর নয়, রাহুল হাত খুলে দিয়ে দু—পা পিছিয়ে এল।

হতভম্ব চোখে সোনালি তাকিয়ে। মুখ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। পিছিয়ে গিয়ে সে খাটে বসে পড়ল।

‘নিজেকে আর খোঁজার চেষ্টা নাই বা করলে সোনালি। এ খোঁজার শেষ কোথাও নেই।’ রাহুলের গলায় মিনতি। ‘তোমার বেঁচে থাকাটা এখন বড় কথা। লক্ষ লক্ষ লোকের উচ্ছ্বাস, আরাধনা, বন্দনা, কাগজে কাগজে ছবি আর প্রশস্তি। এ সবই এক বছর বড়োজোর দু—বছরের জন্য। তারপর দেখবে বিরাট শূন্যতা তোমায় গিলে খাচ্ছে। বহু সুপারস্টারের জীবনে এটা ঘটতে দেখেছি। সে বড়ো ভয়ংকর অবস্থা। তোমার ফেভারিট গায়ক ইমদাদ ক্রমশ ওই অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তুমিও যাবে। ভেবে দ্যাখো।’

কথাগুলো বলে রাহুল আচমকাই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সোনালি অনেকক্ষণ বন্ধ দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার পর বালিশের তলা থেকে ঘুমের ট্যাবলেটটা বার করে মুখে পুরল। তারপর বিছানায় শুয়ে মাথার বালিশটা বুকে জড়িয়ে হাত হয়ে চোখ বন্ধ করল।

আট

রাহুল দিল্লি ফিরে এসে আবার কাজের মধ্যে ডুবে গেল। এনডোর্সমেন্টে আগ্রহী হতে পারে এমন কয়েকটা কোম্পানিতে খোঁজ নিতে লাগল। শ্যাম্পু, মল্ট, ড্রিঙ্কস, সফট ড্রিঙ্কস, সাইকেল টুথপেস্ট, স্পের্টসওয়্যার, রিস্ট ওয়াচ, গায়েমাখা সাবান তৈরির ব্যাবসা সংস্থার কর্তাদের সঙ্গে দেখা করার কাজ সেরে ফেলার জন্য বোম্বাই যাবে ঠিক করল যেদিন তার পরদিনই সে কলকাতার একটা ইংরাজি সান্ধ্য পত্রিকার প্রথম পাতায় দেখল সোনালির ছবি আর পাশে বিরাট মোটা অক্ষরে হেডিং ‘সোনালিকে খঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনুমান অপহরণ করা হয়েছে।’

রাহুলের হাত থেকে কাগজটা পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। সে গোগ্রাসে খবরটা গিলতে শুরু করল: স্টাফ রিপোর্টার, কালকাতা—আসন্ন বার্সিনোলা অলিম্পিকসে পদক জেতার প্রতিশ্রুতি জাগানো মেয়ে লং ডিস্ট্যান্স অ্যাথলিট সোনালি সরকারকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বল তার বাবা ডা. সারদাচরণ সরকার আজ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশকে জানিয়েছেন। গতকাল সোনালি তাদের ধর্মমানস্থ বাসভবন ও ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য পার্ক সার্কাসে তার পিসির বাড়ি থেকে সকালে একটি ট্যাক্সিতে রওনা হয়েছিল একাই। উদ্দেশ্য, হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে বর্ধমান যাওয়া। সেখানে তার বাবা এবং কোচ বিজয় সিনহা রয়েছেন। সোনালি না পৌঁছানোয় সারাদিন তার অপেক্ষা করেন। অবশেষে পরদিন ডা. সরকার ছুটে আসেন তার বাবা এবং কোচ বিজয় সিনহা রয়েছে। সোনালি না পৌঁছানোয় সারাদিন তারা অপেক্ষা করেন। সবশেষে পরদিন ডা. সরকার ছুটে আসেন আলিপুরে ভাবানী ভবনে। পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের এক মুখপাত্র বলেছেন, সোনালিকে সম্ভবত কিডন্যাপ করা হয়েছে বলেই তাদের অনুমান।

তিন সপ্তাহ আগে সোনালি সাই—এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া ইনভিটেশ্যনাল ম্যারাথনে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল অকল্পনীয় সময় রেখে এবং জিতেছিল এক লক্ষ টাকা। তার সময় বিশ্বের সেনা সময়ের কাছাকাছি হয়। ধূমকেতুর মতো আবির্ভূতা কুড়ি বছর বয়সি এই মেয়েটির চোখধাঁধানো পারফরমেন্স তাকে অলিম্পিক পদক জয়ের জন্য চিহ্নিত করে দেয়। ১৯৫২—এ কুস্তিগীর যাদবের ব্রোঞ্জ লাভের পর এখন পর্যন্ত কোনো ভারতীয় অ্যাথলিট যা অর্জন করতে পারেনি। সবথেকে বিস্ময়কর, সোনালি সরকার সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত কেউ কিছুই জানে না, এমনকী বাংলার অ্যাথলেটিক্স সংস্থার লোকেরাও তার বিষয়ে অন্ধকারে রয়েছেন। ম্যারাথনে সে কোনো ক্লাব, জেলা বা রাজ্যের তরফ থেকে নয় ‘অসংশ্লিষ্ট’ হিসাবে সরাসরি সাই—এর কাছে নাম পাঠিয়েছেন। ঠিকানা ছিল পার্কসার্কাসে নাসিরুদ্দীন রোডে তার পিসির বাড়ির। সোনালি আগামী মাসে সল্টলেক স্টেডিয়ামে অলিম্পিক ট্রায়ালে দশ হাজার মিটার দৌড়েও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে ঠিক করেছে। বাঙ্গালোরে সদ্য অনুষ্ঠিত ইন্দো—সোভিয়েত মিটে দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে তৃতীয় স্থানে অবস্থান করার সময় ফিনিশিং লাইনের কাছে পড়ে যাওয়ার দশ হাজার মিটার রেসটি শেষ করতে পারেনি। পতনের আগে পর্যন্ত তার যা সময় হয়েছিল তাতেও অলিম্পিক পদক জয়ের মতো আশা রাখা যায়। আগামী সপ্তাহে সল্টলেক এনআইএস—এ সোনালির পতনের কারণ সম্পর্কে তার মেডিক্যাল পরীক্ষার কথা।

পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের সিআইডি, আই জি, গোপাল সিং বলেছেন, ‘এখনই নির্দিষ্ট কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তবে সোনালিকে কিডন্যাপ করার কথাটাই আমরা প্রথমে ভাবছি। মেয়েটির পদক জয়ের সম্ভাবনা যথেষ্টই, অলিম্পিকসও এসে পড়েছে। সুতরাং তার অপহরণকারীরা ভেবে থাকতে পারে বহু টাকার মুক্তিমূল্য তারা এখন আদায় করতে পারবে। বহু অর্থবান দেশপ্রেমী যারা ভারতের অলিম্পিক সাফল্য দেখতে চান, তারা হয়তো সোনালির মুক্তির জন্য টাকা নিয়ে এগিয়ে আসবেন যাতে সে বার্সিলোনায় যেতে পারে।’

এরপর যা লেখা আছে রাহুলের তা পড়ার আর দরকার নেই। সোনালির মেডিক্যাল পরীক্ষা কয়েকদিনের মধ্যেই। তা ছাড়া গেমসের জন্য ওর প্রস্তুতিও বাধা পেল। আর কিনা এখন—’

হঠাৎ তার মনে হল, সোনালি নিজেই কোথাও পালিয়ে যায়নি তো? কোনো বন্ধুর বাড়ি, আত্মীয়ের বাড়ি? কিন্তু যেভাবে ও মানুষ হয়েছে তাতে ওর কোনো বন্ধু থাকার কথা নয়। আত্মীয়দের বাড়িতে গেলে ধরা পড়ে যাবে। তা ছাড়া পিসি ছাড়া আর কোনো আত্মীয়কে কি চেনে?

পুলিশ বলছে, কিডন্যাপিং সত্যিই যদি তাই হয় তাহলে ভাবনার কথা। মাত্র একলাখ টাকা সোনালি জিতেছে। তা ছাড়া ডা. সরকারের নিজের কোনো অর্থ নেই। তবে কনসরটিয়ামের টাকা তার কাছে এবং তিনিই তা নাড়াচাড়া করেন। কিন্তু তার ফান্ডেই বা এখন কত টাকা আছে? কিডন্যাপাররা কী এটা ভেবে দেখবে না, টাকা তারা পাবে কোথা থেকে? দেশপ্রেমী ভারতীয়? কিংবা এমনও হতে পারে, স্বর্ণকুমারী প্রোজেক্টের সঙ্গে জড়িত ৬০ লক্ষ টাকার কথাটা, কোনোভাবে হয়তো বাইরের কেউ জেনে গেছে। তারা জানে সোনালিকে ফিরে পাবার জন্য কনসরটিয়াম মুক্তিমূল্য দেবেই দশ লক্ষ টাকা চাইলেও দেবে।

রাহুল যখন ভেবে কিছুই ঠিক করতে পারল না তখন সে সেক্রেটারিকে বলল কলকাতায় অর্জুনের অফিসে ফোন করতে। সে কথা বলবে।

দু—মিনিট পরই ‘হ্যালো, অর্জুন? গতকালের একটা কলকাতার কাগজে খবর দেখলাম একটা, সত্যি?’

‘সোনালি এখন ঠাকুরপুকুরের কাছে একটা প্রাইভেট নার্সিং হোমে রয়েছে।’

‘হিডন্যাপ হয়নি?’

‘না।’

‘তাহলে পুলিশে খবর দিয়ে এসব কী কথা হচ্ছে?’ বিস্ময় থেকে রাহুল এবার রাগে চলে গেল।

‘কী করা হচ্ছে বলতে পারব না তবে ওকে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে।’

‘কার ব্যবস্থা এটা, ডা. সরকারের?’

‘তা না হলে আবার কার। সোনালির পা ভারী হওয়া আড়ষ্ট হওয়ার কথা তো জান।’

‘হ্যাঁ, ভাইরাস থেকে। গলাও শুকিয়ে যাচ্ছে। তা সেটা এখনও সারেনি?’

‘না। বাঙ্গালোর থেকে ফেরার সময় প্লেনে বারবার জল চাইছিল। কলকাতায় নেমে দেখা গেল ও বেশ অসুস্থ। ভীষণ ঘামছে আর বলল দুর্বল লাগছে। দমদম থেকে ওদের সবাইকে নিয়ে আমি সোজা আমার বাড়িতে আনি। পরদিন ডা. সরকার ওকে পরীক্ষা করে সিনহাকে বললেন অনন্ত সাতদিন ট্রেনিং বন্ধ রাখতে হবে। শুনে তো সিনহা ক্ষেপে উঠল, চেঁচিয়ে বলল, আপনিই দায়ী সোনালির এই অসুস্থতার জন্য। একেই বেশি সময় হাতে নেই, তার উপর কিনা এক সপ্তাহ বাদ। ডা. সরকার বললেন, তার থেকেও জরুরি ব্যাপার, আর আটদিন পরই সোনালির মেডিক্যাল টেস্ট। তারমধ্যে ওকে তৈরি করে ফেলতে হবে। টেস্টে উতরোতে না পারলে গোটা প্রোজেক্টই চুরমার হয়ে যাবে।’

‘অর্জুন আমি বুঝতে পারছি না, অসুস্থ যদি হয়ে থাকে তাহলে সেরে ওঠার যথেষ্ট সময় এখনও হাতে রয়েছে। ওর তো এইডস বা ওইরকম কিছু তো হয়নি।’

‘কেউ জানে না ওর কী হয়েছে একমাত্র ডা. সরকার ছাড়া। একটা ব্যাপারে উনি প্রচণ্ড জেদি—ফিট না হওয়া পর্যন্ত সোনালির মেডিক্যাল টেস্টে কিছুতেই অ্যাপিয়ার হওয়া চলবে না। আমার মনে হল রাহুল, হার্টের কোনো ব্যাপার। যেভাবে ওরা ওকে গরুমোষ তাড়ানোর মতো করে অমানুষিক ট্রেনিং করিয়েছে, তাতে হার্ট জখম হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। উনি ভয় পাচ্ছেন, কার্ডিওগ্রামে এটা ধরা পড়ে যাবে।’

‘অবস্থা এখন এমনই যে প্রাইভেট নার্সিং হোমে রাখার মতো?’

‘সরকার তো বললেন আরও রেস্ট, আরও অবজারভেশনে রেখে আবার টেস্ট না করে উনি মেডিক্যালে পাঠাবেন না। তারপর সিনহার সঙ্গে আলাদা কী সব কথাটথা বলে আমাকে জানালেন, সোনালিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, এই কথাটা তিনি রটাতে চান। এটা তিনি চান, ওর সেরে ওঠার জন্য খানিকটা সময় যাতে পাওয়া যায়। সোনালি সেরে উঠলে ওকে পাঠাবেন এন আই এস ডাক্তারদের কাছে।’

‘পাগলামি স্রেফ পাগলামি।’

‘তা বলতে পার, কিন্তু আমার কাছে এটাই এই মুহূর্তে যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে। তাই আমিই আমার এক বন্ধুর নার্সিং হোমে ওকে রাখার ব্যবস্থা করেছি। কলকাতার একটু বাইরে নির্জন বাড়ি কেউ টের পাবে না। ওখানে কর্মচারী, নার্সরা সোনালিকে কেউ চিনলেও চেপে থাকবে খবরটা, চাকরি যাবার ভয় আছে তো।’

‘পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে, এটা মনে রেখো।’

‘পুলিশ এ ক্ষেত্রে কী করবে? তারা বাবার কথাই তো সত্যি বলে ধরবে। মিসিং পার্সন বলে গণ্য করে এবার মুক্তিমূল্যের জন্য টেলিফোন বা চিঠির অপেক্ষা করা ছাড়া আর কী করতে পারে?’

‘খোঁজখবর তো করবে।’

‘ডা. সরকারের দেওয়া খবর থেকে যতটা পারে রুটিনসাফিক খোঁজ করবে।’

‘এরপর সোনালি ফিরে এসে কী বলবে?’

‘বলবে একদল লোক তাকে ট্যাক্সি থেকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেছল। ডা. সরকার বললেন, তার কয়েকজন ব্যবসায়ী বন্ধু মুক্তিমূল্যের টাকাটা দিয়েছেন। কিডন্যাপররা সরাসরি তার সঙ্গে কথা বলে আর জানিয়েও দেয় পুলিশকে কিছু বললে সোনালির লাশ গঙ্গায় ভাসবে। তাই ভয়ে তিনি পুলিশকে জানাননি। রাহুল, গেমসের পর কমার্শিয়াল কনট্রাক্টে ওর সই করার কারণ হিসাবেও এটা ভালো কাজ দেবে। সোনালি বলবে, যারা তার মুক্তিমূল্যের টাকা দিয়েছিল তাদের ঋণ সে শোধ করতে চায়?’

অর্জুনের কথা শুনে রাহুল বিন্দুমাত্র উল্লসিত হল না। ‘সরকারের সঙ্গে আমি সোজাসুজি কয়েকটা কথা বলতে চাই অর্জুন। সোনালির ট্রেনিং যদি এইসব কারণে বন্ধ থাকে তাহলে কিন্তু আমি গভীর জলে পড়ে যাব। আমি স্পষ্ট জানতে চাই নার্সিং হোমে হচ্ছেটা কি? সরকার এখন কোথায়?’

‘বর্ধমানে কিংবা পার্কসার্কাসে বোনের বাড়িতে, ঠিক জানি না।’

বিরক্ত মুখে রাহুল রিসিভার রেখে দিল। পরদিন সকালেই সে নেহরু স্টেডিয়ামে সাই—এর নতুন মেডিক্যাল ডিরেক্টর ড. যোশির সঙ্গে দেখা করল, তার অফিসের একটি ছেলের ভগ্নিপতি ড. যোশি। গোলগাল ছোটোখাটো, বছর তিরিশের যুবক। পরিচয় দিয়ে রাহুল সরাসরি প্রশ্ন করল, ‘একজন অ্যাথলিটের উপর খুব বেশি ট্রেনিংয়ের চাপ পড়লে কী কী লক্ষণ ফুটে উঠবে?’

‘আপনি আর একটু নির্দিষ্ট করে বলুন। রানার কি?’

‘হ্যাঁ। লং ডিস্টানস।’

‘মাসকুলার ইনজুরির কথা বলছেন কি?’

‘না। মনে হয় হার্টের ব্যাপার।’

‘দেখুন আধুনিক যেসব জ্ঞানের ভিত্তিতে এখন ট্রেনিং পদ্ধতি গড়ে উঠছে তাতে হার্টের জখম আর হয় না। অজ্ঞদেরই এটা হতে পারে।’

‘কিন্তু লক্ষণগুলো কী?’

‘শরীরের উপর প্রচণ্ড ধকল হলে নানাভাবেই তার প্রকাশ হতে পারে। ধরুন সাধারণভাবে বমি, মাথাঘোরা, রক্তচাপ নেমে যাওয়া, হার্টেও—দেখুন অরোরাসাব আমাদের সময়টা অনেক বেঁচে যাবে যদি বলেন আপনার অ্যাথলিটের মধ্যে কি ধরনের লক্ষণ দেখা গেছে।’

‘ধরুন, অনেকটা দৌড়বার পর বা খুব হেভি ট্রেনিংয়ের পর হাত পায়ে ভার ভার লাগে।’

‘এতে চিন্তা করার কী আছে?’

‘গলা শুকিয়ে যায়’ রাহুল বলে চলল, ‘ক্লান্তি আসে, খুব তেষ্টা পায়, ওজনও কমে গেছে।’

‘খাচ্ছে কেমন, স্বাভাবিক।’

‘হ্যাঁ, তাই।’

‘খুব জল খাচ্ছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘পেচ্ছাপও বারবার করছে?’

‘বলতে পারছি না।’

‘এটা হার্টের ব্যাপার নয়। ডাক্তার দেখিয়ে ব্লাড শ্যুগার টেস্ট করান। শুনে মনে হচ্ছে ডায়াবিটিস।’

‘ডায়াবিটিস।’ রাহুলের স্বরে অবিশ্বাস স্পষ্ট। ‘ট্রেনিংয়ের বাড়াবাড়ির কারণে এটা হতে পারে নাকি?’

ড. যোশি মাথা নাড়লেন। ‘কারণে নয়। প্রত্যক্ষ ভাবে নয়। যদি কোনো অ্যাথলিটের রোগটা থেকে থাকে, তাহলে চাপের মধ্যের অবস্থায় এটার প্রকাশ ঘটতে পারে, ট্রেনিংয়ের মধ্যেও হতে পারে। যেকোনো ধরনের শারীরিক গলদ ট্রেইনড অ্যাথলিটদের মধ্যে তাড়াতাড়ি ধরা পড়ার একটা ঝোঁক থাকে। তার মানে এই নয় অ্যাথলেটিকসই এর কারণ। প্রচুর লোকের মৃদু ধরনের ডায়াবিটিস আছে কিন্তু তারা তা জানে না। এরা যদি খেলাধুলোর নামে তাহলে এদের রোগটা খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা বেশিই হবে।’

‘ডায়াবিটিস মানে, শরীর যখন আর চিনি শুষে নিতে পারে না?’

‘হ্যাঁ, চিনি, স্টার্চ।’ ড. যোশি মাথা নাড়লেন। ‘পাকস্থলীর নীচের অংশের তলায়, পেটের পিছন দিকে প্যানক্রিয়াস নামে যে গ্ল্যান্ড, সেখান থেকে যখন যথেষ্ট হরমোন ইনসুলিন আর তৈরি হয় না, তার ফলে তখন অত্যাধিক পরিমাণ চিনি রক্তে আর পেচ্ছাপে জমা হয়। চিকিৎসা না করালে রক্তে জমা বিষ ব্রেইনকে আক্রমণ করবে, তার ফলে কোমার অবস্থায় নিয়ে যাবে, তারপর মৃত্যু। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম জি রামচন্দ্রনের মৃত্যু এভাবেই হয়েছিল। শুরু হয়েছিল ডায়াবিটিস থেকে। খাওয়ার নিয়ন্ত্রণ আর ওষুধের সাহায্যে, বিশেষ করে ইনসুলিনের সাহায্যে, একে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু চিরতরে সারিয়ে তোলা যায় না। বছর সত্তর আগে ইনসুলিন চিকিৎসার পূর্ববর্তী সময়ে ডায়াবিটিস ছিল মৃত্যু পরোয়ানা।’

‘আচ্ছা প্যানক্রিয়াসের কাজ বন্ধ হওয়ার কারণটা কি আমরা জানি?’

‘জেনেছি বললে ভুল বলা হবে। যতদূর মনে হয় কিছু স্ট্রেস বা চাপের অবস্থার মধ্যে এটা হওয়া সম্ভব। যদি ওখানে কিছু দুর্বলতা থেকে থাকে তাহলে বা মোটা লোকেদের ক্ষেত্রেও মনে হয় বাড়িয়ে তোলে। গর্ভাবস্থা স্টেরসের একটা কারণ, তেমনি শারীরিক বৃদ্ধি বা গ্রোথ।’

‘গ্রোথ?’ রাহুল চেয়ার থেকে অর্ধেক উঠে শূন্যেই থমকে রইল। ‘শারীরিক বৃদ্ধি?’

‘নিশ্চয়। কৈশোরে ধকধক করে বেড়ে ওঠার সময় প্রায়ই তো ডায়াবিটিস ধরা পড়ে। যে সব অল্পবয়সিদের এটা হয়েছে গবেষণা থেকে দেখা গেছে, শরীরের বাড়ের সময়টায় তারা গড়পড়তা সমবয়সিদের থেকে কমপক্ষে অন্তত একবছর এগিয়ে। অরোরা সাব একটা কথা কিন্তু বলে রাখি, ঠিকমতো ডায়াগনোসিস না করে আগেভাগেই কিছু ধরে নিলে কিন্তু ভুল করা হবে। আপনি যেসব লক্ষণের কথা বললেন তার ভিত্তিতে আমার ব্যাখ্যা ভুলও হতে পারে। সেজন্য দরকার ব্লাড শ্যুগার টেস্ট।’

‘ধন্যবাদ ডক্টর। ওটাই যাতে হয় সেটা আমি দেখছি। আপনার পরামর্শের জন্য সত্যিই কৃতজ্ঞ রইলাম।’

নেহরু স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে সোজা নিজের অফিসে এসেই রাহুল তার ব্রিফ কেস ঘেঁটে ড. সুদের দেওয়া কার্ডটা বার করল। এককোণে চণ্ডীগড়ের ফোন নাম্বারটা রয়েছে। এস টি ডি ডায়াল করে সে পেয়ে গেল।

‘ড. সুদ। হু ইজ দিস?’

‘রাহুল অরোরা। ডক্টর সেদিন প্লেনে আপনার সঙ্গে কথা বলার সময় আপনি গ্রোথ হরমোন নিয়ে একটু বলেছিলেন। ওটার নাম কী যেন—’

‘এইচ জি এইচ, হিউম্যান গ্রোথ হরমোন—সোমাটোট্রোপিন। পিটুইটারি গ্ল্যান্ড থেকে হয়।’

‘আপনার মনে আছে কি, আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম, স্বাভাবিক শিশুদের ওপর এই জি এইচের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? তাইতে আপনি বলেছিলেন এমন কাজ লোকে কেন করবে সেটা আপনি বুঝে উঠতে পারছেন না।’

‘মনে পড়ছে।’

‘ব্যাপারটা আবার একটু জেনে নেওয়ার জন্য ফোন করছি। খুব জরুরি না হলে আপনাকে বিরক্ত করতাম না। শুধু একটা প্রশ্ন। এর উত্তরের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।’

‘বলুন।’ ড. সুদের শান্ত গলা।

‘এইচ জি এইচ প্রয়োগ সম্পর্কে আপনার আপত্তির কারণ কি এটাই যে এর সঙ্গে ডায়াবিটিসের সম্পর্ক আছে?’

‘আপনি যদি বেশ কিছু কাল ধরে বেশি পরিমাণে এইচ জি এইচ দিয়ে যান তাহলে যে অবস্থাটা তৈরি হবে তাকে হাইপারগ্লিসেমিয়া বলে। তার ফলে কতকগুলো ব্যাপার প্যানক্রিয়াসে ঘটে শেষ পর্যন্ত ক্রনিক ডায়াবিটিস দাঁড়াবে। মি. অরোরা, যারা এটা ব্যবহার করে তারা এটা জানে।’

নয়

‘বলছ কী তুমি?’

অর্জুনকে যদি কেউ বলত এইবার তোমার টেবিলে পরমাণু বিস্ফোরণের পরীক্ষাটা করে দেখানো হবে তাহলেও সে বোধ হয় এত অবাক এত সন্ত্রস্ত হত না।

‘আমি ঠিক কী ভুল সেটা জানতেই দিল্লি থেকে উড়ে এসেছি। বড়ো বড়ো কোম্পানির সঙ্গে এনডোর্সমেন্ট চুক্তি করে তারপর বোকা বনে আমার নাম খোয়াতে আমি রাজি নই। তা ছাড়া এটা যদি সত্যি হয় তাহলে একটা জীবনও নষ্ট হয়ে যাবে। আমি এখনি সোনালিকে দেখতে যাব, তারপর ডা. সরকারের সঙ্গে কথা বলব। অর্জুন এখন তুমি আমায় সেই নার্সিং হোমে নিয়ে চলো। তুমি এটাও বুঝতে চেষ্টা করো, এই প্রোজেক্টের সঙ্গে তোমারও স্বার্থ জড়িয়ে আছে। তুমি অলরেডি লাখ টাকা ঢেলেছ।’

‘নিশ্চয় আমার স্বার্থ রয়েছে।’ অর্জুন উঠে দাঁড়াল। ‘তুমি চান করে নাও। সোজা দমদম থেকে আসছ তো?’

‘চান না করলেও চলবে। চলো বেরিয়ে পড়ি।’

ডায়মন্ডহারবার রোড থেকে রাস্তাটা পশ্চিমদিকে গেছে একটা সাজানো কলোনির দিকে। চমৎকার সব একতলা বাড়ি। অনেক বাড়ি তৈরি হওয়ার পথে। পার্ক, পুকুর, খেলার মাঠ, পেরিয়ে মারুতি থামল একটা দোতলা বাড়ির সামনে।

গেট থেকে সিমেন্টের পথ ঘুরে গেছে গাড়ি বারান্দার নীচে। মারুতিকে দরজার কাছে থামিয়ে দু—জনে নামল। দারোয়ানের মতো একজন টুলে বসেছিল। উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চাইল কাকে চাই।

‘মেট্রনকে।’

‘অফিসে যান ওই ডানদিকে।’ হলঘরে দোতলায় যাবার সিঁড়ির পাশের ঘরটা সে দেখিয়ে দিল।

রাহুল দাঁড়িয়েই রইল। ‘তুমি গিয়ে কথা বল, আমি অপেক্ষা করছি এখানে।’

মাঝবয়সি, সুশ্রী মেট্রন হাসিমুখে তাকাল অর্জুনের দিকে। তিনি অর্জুনকে আগেও দেখেছেন, জানেনও এই লোকটি নার্সিং হোমের মালিক, ডা. দাশগুপ্তর বন্ধু।

‘আমি একবার সোনালি সরকারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’

‘কিন্তু স্ট্রিক্ট, নির্দেশ আছে কারুর সঙ্গে দেখা করতে না দেবার।’

‘কার নির্দেশ?’

‘ডা. দাশগুপ্তর। খবরের কাগজের লোকজন আসতে পারে বলেই এই বারণ।’

‘কিন্তু আমি তো রিপোর্টার নই। আচ্ছা আপনি ওকে একটা ফোন করে বরং বলুন অর্জুন হালদার সোনালির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’

‘আমাদের ফোনটা দু—দিন হল ডেড। তবে আমি পাশের বাড়ি থেকে করছি। আপনি কাইন্ডলি একটু বসুন।’

মেট্রন ব্যস্ত হয়ে ঘর থেকে বেরোলেন। অর্জুন না বসে বেরিয়ে এসে রাহুলকে দেখতে পেল না। চারধারে তাকাল। হলঘরেই তো ছিল, গেল কোথায়? নির্জন, শান্ত বাড়িটা। তকতকে পরিষ্কার। আমেরিকায় এগারো বছর প্র্যাকটিস করে ফিরে এসে দাশগুপ্ত আধুনিক যন্ত্রপাতি আর নিয়মশৃঙ্খলা দিয়ে এই নার্সিং হোমটা তৈরি করেছে। অর্জুন দরজার কাছে সিগারেট ধরাল।

অর্জুন যখন মেট্রনের সঙ্গে কথা বলতে গেছে তখনই রাহুল চারদিক দেখে নিয়েছিল কেউ তাকে দেখছে কি না। লোকটা টুল বসে এবং সেখান থেকে সিঁড়িটা দেখা যায় না।

রাহুল তিনলাফে সিঁড়ির মাঝের ল্যান্ডিংয়ে পৌঁছে ঘুরে গিয়েই আবার তিনলাফে দোতলার করিডোরে পৌঁছল। সার সার কেবিন একদিকে, অন্যদিকে বারান্দার রেলিং, নীচে সবুজ ঘাসের উঠোন। করিডরটা সোজা গিয়ে ডাইনে বেঁকেছে ‘এল’ অক্ষরের মতো। অন্তত পনেরোটা কেবিন, সবগুলোর দরজায় পর্দা। দরজার পাশে দেয়ালে নম্বর।

কোন কেবিনে সোনালি? নম্বরটা অর্জুন জানে। যদি সে একবার জিজ্ঞাসা করেও রাখত। এখন নীচে গিয়ে জেনে আসতে গেলে ধরা পড়ে যাবে।

ডানদিকে দরজা খোলার শব্দ হতেই রাহুল একপা পিছিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। হালকা সবুজ রঙের গোড়ালিপর্যন্ত ঢোলা রোগীর গাউন পরা মাঝবয়সি এক মহিলা একটা বই হাতে বেরোচ্ছেন। রাহুল দরজা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে কয়েকটা বই ভরা আলমারি দেখতে পেল। নিশ্চয় লাইব্রেরি।

‘শুনছেন।’ মৃদু গলায় রাহুল বলল। ‘খুব লম্বা, ফর্সা, গোলমুখ একটি মেয়ে এখানে পেশেন্ট। তার কেবিন কোনটে দয়া করে বলবেন?’ রাহুল তার সর্বোত্তম বিগলিত হাসিটা মুখে ফোটাল।

‘আপনি কে হন।’

‘দাদা। দিল্লি থেকে আসছি খবর পেয়ে। সোজা এয়ারপোর্ট থেকে এখানে।’

‘কী হয়েছে ওর?’

‘ডায়াবিটিস।’

‘ওহঃ, এই বয়সেই! সোজা যান সবশেষে বাঁ দিকেরটা।’

‘ধন্যবাদ।’

রাহুল পারলে দৌড়ত। কিন্তু সেটা সন্দেহজনক হবে বলে স্বাভাবিক ভাবেই হেঁটে গেল। পর্দা সরিয়ে দেখল দরজা বন্ধ। হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ঠেলতেই খুলে গেল।

সোনালি ঢিলে গাউন পরে বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে, সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। পাশে একটা বই খোলা অবস্থায়। তাকে দেখে ধড়মড়িয়ে সোনালি উঠে বসল। মুখটা বসে গেছে। বাঙ্গালোরে যেমন দেখেছিল তার থেকেও চোপসান মুখ।

‘তোমার কী অসুখ হয়েছে? এরা বলেছে কিছু।’

সোনালির চোখ হঠাৎ ছলছল করে উঠল। হাসবার চেষ্টা করে বলল, ‘কিছুই হয়নি আমার। খাওয়ার গোলমালে এটা হয়েছে। যা খেলে অ্যালার্জি হয় তাই খেয়েই শরীর খারাপ।’

‘চিনি বোধ হয়।’

‘হয়তো। আমাকে চায়ের সঙ্গে চিনি দেওয়া হয় না। বাবা বলেছেন ভবিষ্যতে খাওয়ার ব্যাপারে সাবধান হতে হবে।’

‘তুমি কি কাগজ পড়েছ?’

‘না। এখানে কাগজ দেওয়া হয় না, কেন, কিছু কি বেরিয়েছে? আচ্ছা ফেডারেশন কি আমার মেডিক্যাল টেস্টে না যেতে পাবার জন্য খুব রেগে যাবে? সিলেকশন আটকে দেবে? আমার অসুখের কথাটা তো বাবা ওদের জানিয়েই দিয়েছেন।’

‘তুমি কি এখনো বার্সিলোনা যাওয়ার কথা ভাবছ?’

সোনালির মুখে উদবেগ ফুটল। ‘কেন ভাবন না? ম্যারাথনে তো সিলেক্ট হয়েই গেছি। আর দশ হাজারে—ওহ বাঙ্গালোরে তো প্রায় শেষ করেই এনেছিলাম যদি না—।’

‘কীভাবে শেষ করেছিলে? হুমড়ি খেয়ে। কেন?’

‘ওটা অ্যাকসিডেন্ট।’

‘না সোনালি। আমি দেখেছি তুমি অসুস্থ ছিলে।’

‘না আমি ফিট ছিলাম।’

‘ছিলে না। আমি ট্রাকের পাশে ফেন্সিংয়ের ধারে দাঁড়িয়ে তোমার মুখ দেখেছি, তোমার পা ফেলার ধরন দেখেছি। টেকনিকের আমি কিছুই বুঝি না কিন্তু কোনো জিনিস স্বাভাবিক না হলে সেটা বুঝতে পারি।’

‘কে যেন স্বর্ণকুমারী বলে ডেকেছিল। সেটা তাহলে—’

সোনালি একদৃষ্টে রাহুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। অদ্ভুত ধরনের একটা কোমলতা রাহুল ওর চোখে দেখতে পেল। যেটা কৃতজ্ঞতার কিনার ঘেঁষে যায়।

‘তারপর আর দেখা করলেন না কেন?’ আবার কোমলতা। এবার কণ্ঠস্বরে এবং অভিমানের ছোঁয়া লাগা।

‘করিনি কারণ,’ রাহুল ইতস্তত করল। বাঙ্গালোরের হোটেলের ঘরে হঠাৎ সোনালিকে চুম্বনের প্রতিক্রিয়া সে এবার ওর চোখে, গলার স্বরে দেখতে পাচ্ছে। ‘আমি খুব ব্যস্ত ছিলাম কিছু খোঁজ খবর নেওয়ার কাজে।’

এই সময় দরজাটা খুলে গেল।

‘সেই কাজেই আপনি কি এখন এখানে?’ প্রশ্ন করলেন ডা. সরকার। তার পিছনে অর্জুনের বিপন্ন মুখটা দেখা গেল।

রাহুল চমকাল না। ডা. যোশির সঙ্গে কথা বলে সে সোনালির অসুখের পিছনে সম্ভাব্য একটা কার্যকারণ সম্পর্কের ধারণা পেয়েছিল। ডা. সুদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হবার পরসেই যম্ভাব্যতা কঠিন হয়ে সন্দেহের আকার পায়। ব্যাপারটা নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে যতই সে ভেবেছে সে রেগে উঠেছে। তার স্থির ধারণা হয়েছে ডা. সরকার তাচ্ছিল্যভাবেই সোনালির স্বাস্থ্য ধ্বংস করেছেন।

এখন তিনি ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে দরজায় দাঁড়িয়ে। এখন দরকার ধীর শান্ত ভঙ্গিতে, যুক্তিযুক্ত কথার মধ্য দিয়ে সত্যকে বার করে আনা।

সারদাচরণ বললেন, ‘আমাদের দু—জনের মধ্যে কথা হওয়া দরকার তবে এখানে নয়।’

তার মানে সোনালির সামনে নয়। রাহুল মাথা নেড়ে বলল, বিষয়টায় সোনালিরও স্বার্থ আছে সুতরাং শোনার অধিকারও আছে।’

‘ও কিছুই জানে না।’

‘ঠিকই। আর সেটা এবার আপনি জানিয়ে দিন।’

সোনালি কিছুই বুঝতে পারছে না জুজনের কথা। সে বিভ্রান্ত চোখে একবার সারদাচরণ, আর একবার রাহুলের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। শুধু আঁচ করতে পারল তাকে নিয়েই দুজনের মধ্যে কাঠিন্য গড়ে উঠেছে।

‘ওর শরীরের কথা আমাকে ভাবতে হবে।’ সারদাচরণ বললেন, ‘এখন ওর মনে আঘাত লাগার মতো কোনো কথা, ডাক্তার হিসাবেই আমি—’

‘ওসব কথা থাক। ওর বয়স এখন কুড়ি। গোলমালটা কোথায় এবং কেন এটা জানার অধিকার ওর হয়েছে।’ রাহুল এবার গলাটাকে কঠিন করল।

কথাগুলো যে সারদাচরণকে নাড়া দিয়েছে সেটা ওর মুখে ফুটে উঠল। গলাটা শক্ত দেখাচ্ছে। হাতের মুঠো খুলছেন আর বন্ধ করছেন।

‘আপনি বোধ হয় আন্দাজ করার চেষ্টা করছেন আমি কতটা জানি।’ রাহুল বলল, ‘ভাবছেন আমি বোধ হয় ধাপ্পা দিচ্ছি। না, ডা. সরকার, আমি কিছু অনুসন্ধান করেছি। গ্রোথহরমোন, কী যেন নামটা—এইচ জি এইজ বা সোমাটোট্রোপিন দিয়েই কি শুরু করব?’

‘দোহাই, সোনালির সামনে এসব কিছু বলবেন না।’ সারদাচরণ করুণ স্বরে প্রায় মিনতি করলেন।

‘বাবা আমাকে নিয়ে যদি কথা হয় তাহলে আমি শুনতে চাই।’ সোনালি এগিয়ে এসে সারদাচরণের হাত চেপে ধরল। সারদাচরণ ধীরে এগিয়ে এসে খাটের রেলিং চেপে ধরলেন। অর্জুন ধরের মধ্যে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। সোনালি খাটে বসল। রাহুল দেওয়ালে ঠেশ দিয়ে রইল।

‘আপনার হামবুর্গ রিসার্চ নিয়ে বেশি কথা বলার কোনো দরকার এখন নেই।’ রাহুল শুরু করল।

পরের প্রজন্ম যদি আগেরটির থেকে লম্বা হয় তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কেন অনির্দিষ্টভাবে আরও লম্বা হবে না? আপনার সমালোচকরা বল মানুষের কঙ্কাল গঠনগতভাবেই তার বেশি বৃদ্ধি সইতে পারবে না। ঠিক বলছি কি?’

সারদাচরণের চোয়াল শক্ত হয়ে বসে গেছে। শুধু একটু কাঁধ নাড়ালেন।

‘কিন্তু মুশকিলটা হল আপনার থিয়োরির সমর্থনে আপনি কোনো প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি। যেজন্য কেউ আপনাকে গ্রাহ্য করেনি। কোথাও আপনি পাত্তা পাননি।’

প্রতিবাদ করার জন্য সারদাচরণ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই রাহুল বলল, ‘পঁচাত্তর সালে আপনি কার্শিয়াংয়ে সোনালিকে পান এক বুড়ো ইংরেজ কর্নেলের বাড়িতে। সোনালির বোধহয় সেসব মনে নেই।’

‘আছে। আমাকে একটা জিপে করে দার্জিলিংয়ে আনা হয়। সেখানে আমার হাত—পা এত জোরে টিপেটিপে দেখেছিলেন যে ব্যথায় আমি কেঁদে উঠেছিলাম।’

সারদাচরণ মাথা ঝুঁকিয়ে সমর্থন করলেন তবে সোনালির মুখের দিকে তাকালেন না।

‘বাচ্চচাটিকে যখন দেখন তখনই আপনি বুঝতে পারেন আপনার থিয়োরিকে প্রমাণ করার, একটা সম্ভাবনা এর মধ্যে রয়েছে। যদি আপনি নির্ভুল হন তাহলে সোনালি তার মা আর দিদিমার থেকেও লম্বা হতে বাধ্য। কী দারুণ সুযোগ আপনার থিয়োরি প্রমাণের জন্য। একটা অনাথ শিশু, তাকে পালন করে তার পরিণত বয়সে পৌঁছানো পর্যন্ত সপ্তাহে সপ্তাহে তার বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করার, খুঁটিনাটি সব লিখে রাখার এমন সুযোগ আর কোথায় পাবেন। আর সেই সব থেকে সিদ্ধান্তে এসে ছাপিয়ে, আপনি আপনার থিসিসকে সমর্থনও করতে পারবেন।

‘তাহলে আমি একটা গিনিপিগ ছিলাম?’ সোনালি তীব্রস্বরে, ভর্ৎসনা মাখিয়ে বলল।

‘বাজে কথা।’ সারদাচরণ রেগে উঠলেন। ‘তোমাকে আমরা আর পাঁচটা বাচ্চচার মতোই মানুষ করেছি।’

‘তাহলে সব বাচ্চচার মতো আমাকে স্কুলে পাঠাওনি কেন?’

প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া গেল না।

‘সোনালিকে নানাভাবে পরীক্ষা করে আপনি দেখতে পান, বয়সের পক্ষে ওর দেহের ক্ষমতা অস্বাভাবিক রকমের বেশি। আর তখনই বোধ হয় অলিম্পিকসের চিন্তাটা মাথায় আসে। আপনার রিসার্চ পেপারকে চড়চড় করে বিখ্যাত করে দেবে যদি সোনালি সোনার মেডেল জেতে। মাত্র একজনকে দিয়ে অবশ্য থিয়োরির যথার্থতা প্রমাণ করা যায় না কিন্তু আপনার ধারণাটাকে তো প্রচণ্ড পাবলিসিটি দেওয়াতে পারবে। যেটা তখন আপনার খুব দরকার ছিল, কেন—না আপনার পেপার আর তখন ছাপা হয় না, আপনি কোনো নতুন কথাও বলতে পারছেন না। খুব হতাশার মধ্যেই ছিলেন।’

‘এসব কথা কে আপনাকে বলেছে?’ সারদাচরণ খরখরে স্বরে বললেন।

‘যেই বলে থাকুক, তাতে কী আসে যায়। আপনি তো ধরেই রেখেছিলেন আপনিই যথার্থ। কিন্তু প্রমাণ দিতে হবে। কীভাবে দেবেন? একবিংশ শতাব্দীর গড়পড়তা উচ্চচতর মানুষকে হাজির করে।’

সোনালি ভীত চোখে রাহূলের দিকে তাকাল। চোখে বিস্ময় এবং ভয়ও। আরও কী যে এরপর সে বলবে এবং সে সব কথায় কী ভয়ংকরতা যে লুকিয়ে আছে তা সে জানে না। আর সেজন্যই ভয়। ওর করুণ মুখ দেখে রাহূল একটু বিচলিত হল। এইভাবে এইসব কথা সবার সামনে সে বলতে চায়নি। সে চেয়েছিল একান্তে ধীরে ধীরে সোনালিকে জানাতে। কিন্তু সে বিশ্বাস করত না। সারদাচরণের সামনে এসব বলা দরকার। সে চাহনি বিশ্বাস করত না। সারদাচরণের সামনে এসব বলা দরকার। সে চাহনি দিয়ে চেষ্টা করল সোনালিকে ভরসা জানাতে। তারপর আবার শুরু করল।

‘বছর তিরিশ আগে এইচ জি এইচ এবং তাই দিয়ে মানুষের শরীরের বৃদ্ধি সংক্রান্ত গবেষণার কথা আপনি শোনেন। তখনি আপনি দেখেতে পেলেন এটাকে আপনার রিসার্চে কাজে লাগতে পারবেন। আপনি সপ্তাহে সপ্তাহে সোনালির বাড় মাপছেন, আপনি জানেন যখন ও সাবালিকা হবে তখন কতটা লম্বা হবে। কিন্তু এইচ জি এইচ দিয়ে বাড়টা অনেক আগেই করিয়ে ফেলা যাবে। তিন প্রজন্ম পরে, আপনার বিশ্বাসমতো, মানুষ যতটা লম্বা হবে সেটা সোনালিকে দিয়ে আপনি এখনই করে দেখাতে পারেন।’

সোনালি দাঁড়িয়ে উঠল। ‘আমাকে যে ইঞ্জেকশনগুলো দিতে? সেগুলো কী ছিল?’ ঠকঠক করে কেঁপে উঠে সে ছুটে গিয়ে সারদাচরণের কাছ ধরে ঝাঁকানি দিল। ‘তুমি আমাকে হরমোন ইঞ্জেকশন দিতে। বলো, বলো!’

সারদাচরণ ধীরে ধীরে সোনালির মাথায় হাত রাখলেন। ‘বিশ্বাস করো এত হালকাভাবে আমি কিছু করিনি। শরীরের বাড় সম্পর্কে যা কিছু পড়াশুনো, যা কিছু জানার সব আমি করেছি। এইচ জি এইচ আর তার প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে গভীর স্টাডি করেছি।’

‘তাই বুঝি আমি এত লম্বা। তুমি হিসেব করে আমার এই হাইট করিয়েছ।’ সোনালির মুখে আতঙ্কের আঁচড়ানি পড়ল।

‘হ্যাঁ, হিসেব করেই এটা আমি করিয়েছি। পরের শতাব্দীতে মেয়েরা যতটা লম্বা হবে ততটাই।’

‘তোমার থিয়োরি প্রমাণের জন্য তাই আমাকে একসারসাইজ করাতে, ফিজিওথেরাপি করতে, নিখুঁত শারীরিক নমুনা লোককে দেখাবার জন্য?’

‘সোনালি তুমি স্বর্ণকুমারী। আমি বলছি তুমি কী কী অর্জন করবে। খ্যাতি, গরিমা, খরচ করে উঠতে পারবে না, এতটাকা।’

‘কে পাবে ওইসব?’ দু—হাত ঝাঁকিয়ে সোনালি চিৎকার করে উঠল। ‘কে পাবে? কার্শিয়াং থেকে যে বাচ্চচাটাকে এনেছিলে? আমিই কি সেই? খ্যাতি গরিমা কি আলি মায়াকং পাবে না মড়ার শরীর থেকে বার করা হরমোনগুলো পাবে? জবাব দাও।’

‘তুমি জন্ম অ্যাথলিট।’ সারদাচরণ কেন সোনালির কথাগুলো শুনতে পাননি এমনভাবে বলতে লাগলেন। ‘তোমার বাবা ব্রোঞ্জ পাওয়া জার্মান অলিম্পিক রোয়িং টিমে ছিল। তোমার দিদিমা কঠিন পার্বত্য জঙ্গলের মেয়ে। ক্ষমতাটা তুমি জন্মসূত্রেই পেয়েছ। চ্যাম্পিয়ান রানার করার জন্য তোমার ইঞ্জেকশন দিইনি, তা দিয়ে করা যায় না। তোমাকে লম্বা করার, বিরাট করার জন্য দিয়েছি। দৌড়ের মধ্য দিয়ে তুমি প্রমাণ করছ যে তোমার কাঠামো বাড়তি বৃদ্ধিটাকে মানিয়ে নিতে পেরেছ। এর কোনো দুর্বলতা নেই। ওটাই আমার সারাজীবনের কাজের চূড়ান্ত জয়।’

‘ডা. সরকার, এই জয় কিন্তু একদমই নিরর্থক, ফাঁপা। কারণ এটা আপনি প্রকাশ করতে পারবেন না।’

রাহুলের মুখের দিকে সবাই তাকাল বিস্ময়ভরে।

‘সোনালিকে কি এবার আপনি বলবেন, কেন ওকে ওখানে রেখেছেন?’

ভীত চোখে সোনালি তাকাল রাহুলের দিকে। ‘তার মানে? কেন আমি এখানে?’

‘সেটা উনিই বলবেন।’

সারদাচরণ ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে লাগলেন মুখ নীচু করে। ‘বলতেই হবে?’

‘হ্যাঁ।’ সোনালি দাবি জানাল।

‘যখন তোমায় হরমোন দিচ্ছিলাম তখন জানতাম এর একটা ঝুঁকি আছে। তোমার শরীরের ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু জানতাম না ঝুঁকিটা কতটা। এটা জানতাম দীর্ঘদিন ইঞ্জেকশন চালিয়ে গেলে চিরকালের জন্য প্যানক্রিয়াস গ্ল্যান্ডটার ক্ষতি হতে পারে। আর সেটাই হয়ে গেছে। কেন তুমি বাঙ্গালোরে পড়ে গেছলে, ছুটতে পারছিলে না, পা ভার হয়ে যাচ্ছিল জান? তোমার ডায়াবিটিস হয়েছে। ইঞ্জেকশনই এর জন্য দায়ী।’

‘না, দায়ী নয়।’ সোনালি হিংস্র চোখে তাকাল, কথা বলল শান্ত গলায়, ‘দায়ী তুমি।’

ওকে স্পর্শ করার জন্য সারদাচরণ হাতটা বাড়ালেন কিন্তু স্পর্শ না করে সেটা ঝুলে পড়তে দিলেন, সোনালির চোখে ঘৃণা দেখে। ‘আমি ফাটকা খেলেছিলাম। এত তাড়াতাড়ি যে ঘটে যাবে ভাবিনি। চেয়েছিলাম প্রথমে তোমার সোনার মেডেল জেতাটা হয়ে যাক। তারপর তোমাকে বলতাম কেন এসব করেছি। ওলিম্পিকসের সাফল্য তোমার সব ক্ষতি পুষিয়ে দিত তাহলে। যশ, খ্যাতি, অর্থ, জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্য তোমাকে সান্ত্বনা দিত। এজন্যই আমি তোমাকে স্বর্ণকুমারী করে তোলার সবরকম চেষ্টা করেছি। টাকার আমার দরকার নেই। আমিও চাইও না। তোমার স্বাস্থ্যের বিনিময়ে আমি টাকা চাইনি, সোনালি, আমি শুধু একযা বৈজ্ঞানিক সত্যকে দেখাতে চেয়েছি।’

হঠাৎ পাগলের মতো সোনালি হাসতে শুরু করল। তীক্ষ্ন গলায় কান্নার মতো একটা শব্দ। কুঁজো হয়ে সে হেসে যাচ্ছে আর পিঠটা ফুলে ফুলে উঠছে। মাথাটা তুলে সে একবার বিছানায় চিৎ হয়ে গড়িয়ে পড়ল। আর সেই সঙ্গে হাসিটাও বেড়ে গেল। ঘরের সবাই চোখ সরিয়ে অস্বস্তিভরে অন্যত্র তাকাতে লাগল।

সোনালির হাসি একসময় বন্ধ হল। চুপ করে সে মেঝের দিকে তাকিয়ে গভীর কোনো ভাবনায় যেন ডুবে গেল। তারপর শান্ত গলায় একসময় বলল, ‘সবাই এবার ঘর থেকে বেরিয়ে যান। আমায় একা থাকতে দিন।’

.

সাতদিন পর রাত্রে রাহুলের শোবার ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল। তখন সে ভিডিয়োর সেল অলিম্পিকসে পুরুষদের ফাইনাল ১০০ মিটার দৌড় দেখেছিল। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল।

‘হ্যালো, হ্যাঁ আমি, কে অর্জুন?’

‘রাহুল, ডা. সরকার মিথ্যে করে পুলিশকে বলেছিলেন সোনালিকে পাওয়া যাচ্ছে না। আর আজ সকালে আমি সত্যি করেই নার্সিং হোম থেকে জানলাম, সোনালি ওখান থেকে কাল রাতে কোথায় চলে গেছে। কেউ জানে না। সরকার, তার বোন, বিজয় সিনহা তারাও কেউ জানে না। ওকে তো আমাদের খুঁজে বার করতে হবে।’

‘খুঁজে লাভ নেই। কোনোদিনই ওকে আর পাওয়া যাবে না।’ রাহুল রিসিভার রেখে ভিডিয়োর সামনে এসে বসল।

দ্বিতীয় আততায়ী

খুটখুট শব্দ।

রীণার ঘুম খুব সজাগ। কান পেতে রইল আবার শোনার জন্য। ঘরের দুটো জানালাই খোলা। বাইরের দালানে রতন ঘুমোচ্ছে। সম্ভবত রান্নাঘরে বেড়াল ঢুকেছে।

শব্দটা আবার হল।

রীণার মনে হল বোধহয় উপরের গৌতমবাবু। ফেরেন অনেক রাতে। খবরের কাগজের রিপোর্টার। কিছুক্ষণ আগে অফিসের গাড়ি ওকে নামিয়ে দিয়ে গেছে গলির মুখে। তন্দ্রার ঘোরেও রীণা তা টের পেয়েছিল। লোকটির নানান বাতিক, হয়তো জুতোর তলা চেঁছে গোড়ালি ঠুকছে।

আবার শব্দ—এবার একটু জোরেই।

রীণা ধড়মড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। খুটখুটুনিটা উপরে নয়, রান্নাঘরেও নয়, পাশের ছোট্ট ঘরটাতেই যেন। ও ঘরটায় আছে ভাঙা তোরঙ্গ, বেতের ঝুড়ি, ছেঁড়া লেপ, শিশি—বোতল, মাদুর, পুরোনো জুতো আর যত রাজ্যের পুরোনো পত্রপত্রিকা। দরজায় শিকল দেওয়া থাকে। দরজাটা এই ঘরের মধ্যেই।

রীণা ভয় পেল। ফ্ল্যাটে সে আর রতন। হয়তো চোর ঢুকেছে কিংবা ঢোকার চেষ্টা করছে। গৃহস্থ সজাগ এই ইঙ্গিতটুকু দিলে চোর নিশ্চয় পালাবে। রীণা গলা খাঁকাল।

খুটখুট শব্দটা হতে থাকায় ভাবল চোর নয়। রীণা ঘরের আলো জ্বালাল। চোখ পড়ল টেবলে। টেবলটা ছোটোঘরের দরজার লাগোয়া। ফুলদানিটা কিনারে সরে রয়েছে। দরজাটা খুলবে কি খুলবে না ভাবতে ভাবতে সে টেবলের মাঝখানে ফুলদানিটা সরিয়ে রাখল। রতনকে তুলে এনে একসঙ্গে ঢোকা উচিত। দিনকাল যা পড়েছে। রতন বুড়ো মানুষ তবুও যদি দাঁড়িয়ে থাকে অনেক ভরসা পাওয়া যাবে। গত পাঁচদিন হল রাহুল বাড়ি নেই। বাড়ির কেউই জানে না এখনও তার স্বামী পাঁচদিন নিরুদ্দেশ।

অকাতরে ঘুমোচ্ছে রতন। দাড়ি কামায় সাতদিন অন্তর। মুখটা হাঁ হয়ে রয়েছে। সামনের দুটো দাঁত নেই। হাতদুটো অসহায়ের মতো পাশে ছড়ানো। মায়া হল রীণার। হয়তো দেখা যাবে ইঁদুর লাফালাফি করছিল। দরকার নেই বুড়ো মানুষটার ঘুম ভাঙিয়ে। রীণা ফিরে এল।

আলো নিবিয়ে খাটে শুতে যাচ্ছে, তখন আবার শব্দ। কেউ যেন ডাকছে, শব্দটা চাপা হলেও, বাড়ির সদরে এইভাবেই আগন্তুকরা টোকা দেয়। কিন্তু ও ঘরের জানালায় তো মানুষ আসার কোনো উপায় নেই। এক, যদি পাইপ বেয়ে গলি দিয়ে কেউ উঠে আসে। কেন আসবে? চোর! তা হলে ডাকবার মতো সুর তুলে টোকা দেবে কেন? তা হলে?

ভাবতে গিয়ে রীণার হাত—পা জমে যাবার মতো অবস্থা হল এই গরমেও।

সাবধানে দরজাটার কাছে এসে শিকল খুলল। পাল্লাদুটো এঁটে রয়েছে। যাতে শব্দ না হয় তাই যথেষ্ট সময় নিয়ে চাপ দিয়ে দিয়ে খুলে ফেলল। সুইচ টিপে খেয়াল হল বালব নেই।

মেঝেয় জায়গা খুব অল্প। ধুলোয় কিচকিচ করছে। ভ্যাপসা বাসি গন্ধ। শোবার ঘরের আলো খোলা দরজা দিয়ে যতটুকু এসেছে, তাতে একমাত্র জানালাটা ঠাওর করে রীণা এগিয়ে গেল ভয়ে ভয়ে। ঘষা কাচের পাল্লা। চেষ্টা করেও রীণা ওধারে অন্ধকার থাকার জন্য কিছুই দেখতে পেল না। চাপা সুরে সে বলল, ‘কে?’

উত্তর নেই।

ওধার থেকে নখ দিয়ে যেন কেউ কাচে আঁচড় কাটল। জানালার কড়া ধরে রীণা সজোরে টানল। দীর্ঘদিন খোলা হয় না। একটুখানি কেঁপে পাল্লাদুটো আগের মতোই রয়ে গেল। বাঁ হাতে একটা পাল্লা চেপে আবার টানল, মনে হল ওধার থেকেও কেউ যেন তাকে সাহায্য করছে। একটা ক্যাঁচ শব্দ করে জানালা খুলে গেল। ছোট্ট জানালাটা জুড়ে কোমর পর্যন্ত একটা মানুষের ছায়া।

থরথর করে কেঁপে উঠল রীণা। অস্ফুটে বলল, ‘কে?’

‘আমি। আমি রাহুল।’ ফিসফিসে গলাটা ভরাট, উত্তেজিত। ‘রতন কি ঘুমোচ্ছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আলো নিবিয়ে বারান্দার দরজাটা খুলে রাখ, রতন যেন না জাগে, তাড়াতাড়ি।’ দমচাপা দ্রুত নির্দেশ দিল ছায়ামূর্তি।

রীণা শোবার ঘরে এল। আলো জ্বলছে, জানালা খোলা, পর্দা গুটিয়ে তুলে রাখা। পর্দা ফেলে সে জানালা বন্ধ করে আলো নিবিয়ে দিল। রতনের পাশ দিয়ে পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে সাবধানে খিলটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকল।

ছায়ার মতো মানুষটার ছায়া ঝুল বারান্দার পাঁচিল টপকে ঢুকে এল। নিজেই খিল দিল। নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিচ্ছিল। রীণা ফিসফিস করে বলল, ‘রতন দেওয়াল ঘেঁষে শুয়ে।’

‘তা হলে তুমি আগে যাও।’

রীণাকে অনুসরণ করে শোবার ঘরে এসে, দরজা বন্ধ করে আলো জ্বালল।

যেন আগে থেকেই তৈরি ছিল রীণা। খাটে হেলান দিয়ে দু—হাতে চোখ ঢাকল। পিছন ফিরল এবং উপুড় হয়ে বালিশে মুখ চেপে ধরল।

রাহুল বিব্রত হয়ে এপাশ—ওপাশ চাইল। দরজা—জানালা সবই বন্ধ। ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এগিয়ে এল। ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘খুব খিদে পেয়েছে, আছে কিছু?’

‘না বোধহয়। দেখি রান্নাঘরে কিছু আছে নাকি।’

উঠে দাঁড়াল রীণা। কোনোদিকে না তাকিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিল, রাহুল হাত টেনে ধরল।

‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘রান্নাঘরে।’

‘তাই বলে এত শব্দ করে। আগে আলো নেবাও, সাবধানে দরজা খুলে পা টিপে যাও।’

রীণা অবাক হয়ে রাহুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ধীরে ধীরে তার বোধশক্তি ফিরে এল। আস্তে দরজা খুলল। অন্ধকারে রতন ঘুমোচ্ছে। আন্দাজে পাশ দিয়ে হেঁটে গেল। রান্নাঘরে বালতিটা দরজার ধারেই ছিল, ঢোকামাত্র পায়ে লাগল।

‘কে?’

রতনের ঘুম ভেঙে গেছে। কাঠের মতো রীণা দাঁড়িয়ে পড়ল।

‘আমি।’

‘বউদি।’

‘হ্যাঁ।’

‘কী কচ্ছো?’

রতন উঠে রান্নাঘরের দরজায় এল। রীণা আলো জ্বালল।

‘লেবু খুঁজতে এসেছি। কীরকম চোঁয়া ঢেকুর উঠছে। জল দিয়ে খাব।’

‘দাঁড়াও আমি কেটে দি।’

বুড়ো মানুষটি গত পাঁচ বছরে একবারও নিজেকে রাঁধুনি বা চাকর ভাবতে পারেনি। রীণা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল তার লেবু কাটা। রস নিংড়ে, মিশিয়ে গেলাসটা এগিয়ে দিল। রীণা এক চুমুকে শেষ করল। মনে হল সত্যিই তার তেষ্টা পেয়েছিল।

‘আর লাগবে?’

‘না থাক, তুমি ঘুমোও।’

শোবার ঘরে এসেই রীণা অবাক। রাহুল নেই। খাটের তলা দেখল, আলমারির পাশটাও। নজরে পড়ল ছোটোঘরের দরজাটা বন্ধ। ওটা তো খোলাই ছিল এতক্ষণ। ঠেলতেই খুলে গেল। দেওয়ালে পিঠ দিয়ে রাহুল দাঁড়িয়ে। রীণাকে দেখে সে এগিয়ে এল। ইশারায় জানায় এই ঘরেই সে থাকবে।

‘বালিশ আর বেডকভার দাও।’

রীণা জিনিসগুলো দিয়ে দিল রাহুলকে।

‘বাইরে যেমন শেকল দেওয়া ছিল দিয়ে দাও।’

ঘর থেকে বেরিয়ে রীণা দরজা বন্ধ করল। আলো নিবনো। বিছানায় বসে ভাবল এবার সে কী করবে?

.

জায়গা নেই পাশ ফেরার মতো। রাহুল কোনোরকমে কাত হয়ে শুয়ে পড়ল। ঘরের মধ্যে যত রাজ্যের জঞ্জাল আর বাজে জিনিস। গুমোট ভ্যাপসা গন্ধ। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। জানালাটা খোলা। বন্ধ করা উচিত। উঠতে গিয়েও সে উঠল না। স্নায়ুগুলো টানটান, যেন প্রত্যেকটিতে পাথর বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। জানালাটা বন্ধ করে দিলে হাওয়া যেটুকু আসছে, তাও আসবে না, খোলাই থাক, রাত্রে বাইরে থেকে কেউ তাকে দেখতে পাবে না।

উত্তেজিত ক্লান্ত শরীরে ঘুম আসে না। তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো ছুটে বেড়াতে হয়েছে এই ক—টা দিন। ক—দিন? এক সপ্তাহ…এক মাস…এক বছর? আজীবন?

ঘরটা এত গরম! রীণার দেওয়া বেডকভারটায় সে শুয়ে। সেটা এত মোটা বলেই বোধহয় গরমটা বেশি লাগছে। মেঝের ধুলোয় কিচকিচ করছে। ভ্যাপসা বাসি গন্ধ। ভাঙা কাঠের চেয়ারে জড়ো করে রাখা ছেঁড়া তোশকটা থেকে আরশোলার চলাফেরার মতো শব্দ হচ্ছে। এইসব জঞ্জাল, আরশোলা, ইঁদুর, পোকামাকড় নিয়েই তাকে থাকতে হবে। রাহুল ভাবল, বেঁচে আছি। এখনও ধরা পড়িনি। হয়তো বেঁচে যাব…বেঁচে থাকব।

রীণাকে ব্যাপারটা বোঝাতে হবে। আবেগসর্বস্ব অল্পবুদ্ধির মেয়েমানুষ। একটু নাটক করতে হবে, এই যা। রাহুলের ঠোঁট মুচড়ে গেল। রতন সর্বক্ষণই বাড়িতে, দিনের বেলায় হয়তো সুযোগ হবে না। রাত্রে এই ঘরে রীণাকে ডেকে একসময় সে ওকে বুঝিয়ে দেবে।

কী বুঝিয়ে দেবে? কেন সে এমন একটা কাজ করে বসল? কিন্তু সেটা কি খুব সহজে কয়েকটা কথার জাল বুনে স্ত্রীকে বোঝানো যাবে?

সে মনে করার চেষ্টা করল সেই রাতের ঘটনাটাকে। একটা উপন্যাসে বর্ণিত কয়েকটা পাতার মতন সে ব্যাপারটা পড়তে শুরু করল চোখ বুজে—

.

সকাল থেকে মেঘ, দুপুরে বৃষ্টি ঝমঝমিয়ে। সন্ধ্যার পরই রাস্তা নির্জন। রাত তখন প্রায় আটটা। বাসস্টপ থেকে হেঁটে শর্টকাট করতে প্লাইউড কারখানার টিনের পাঁচিলের পাশ দিয়ে সে দ্রুত চলেছিল ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে। সরু রাস্তাটায় আলো নেই। কারখানার ভিতরে একটা বালব জ্বলছিল কিন্তু তার যৎসামান্যই পাঁচিল ডিঙিয়ে বাইরে আসতে পেরেছে। তার ডানদিকে মাঠ, যেটা প্লট করে বিক্রি হয়ে গেছে কিন্তু এখনও বাড়ি ওঠেনি। মাঠের মধ্যে আগাছার ঝোপগুলো চাপড়া চাপড়া অন্ধকার হয়ে রয়েছে। মাঠের ওপাশে অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িতে আলো জ্বলছে।

একটা কাতর আর্তনাদ, আর ঝোপের আন্দোলনের শব্দ। সে থমকে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল, ‘কে?’ কাতরানি আর শব্দ থেমে গেল। সেই সময় তার মনে হল দুটো লোক অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সে চারধারে তাকিয়ে পাঁচিলের গা ঘেঁষে মাটিতে পোঁতা একটা দু—হাত লম্বা খোঁটা দেখতে পেল।

মাঠ থেকে একজন ছুটে আসছিল। তার চিৎকার শুনে সে বুঝতে পেরেছিল মেয়ে।

‘বাঁচাও বাঁচাও—।’ তারপরই হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মেয়েটির পিছনে ছিল একজন, সেও ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।

শুধু এইটুকু ঘটনা। কিন্তু তার মাথায় কেন যে রক্ত উঠে এল, রাহুল গত চারদিনে বার কয়েক তার কারণ খুঁজেছে, পায়নি। বাঁশের খোঁটাটা ধরে ষোলো ইঞ্চি বাইসেপসের বাহু টান দিতেই, বৃষ্টিভেজা নরম জমি থেকে সেটা উঠে আসে। যে লোকদুটো এগিয়ে আসছিল তারা হঠাৎই ঘুরে গিয়ে ছুটে পালায়।

সে মাঠের মধ্যে ছুটে গেছিল। লোকটা তখন সবেমাত্র উঠে দাঁড়িয়েছে। চাপা গলায় বলেছিল, ‘এক পা এগিয়েছিস কী চাকু চালিয়ে দোব।’ এই শুনেই সে বাঁশের খোঁটাটা বসিয়েছিল লোকটার মাথায়। এরপরও লোকটা দৌড়েছিল অন্তত তিরিশ গজ। তারপর চিৎকার করে পড়ে গেল। আর কী এক অন্ধ আবেগে সে লোকটার মাথায় পর পর ক্ষ্যাপার মতো আঘাত করে গেছিল। তারপরই সংবিৎ ফিরে পেয়ে সে নিথর দেহটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আবছা আলো, ঝিরঝিরে বৃষ্টি, স্তব্ধ নির্জন চরাচর আর একটা মানুষের উপুড় হয়ে থাকা। দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। সে বুঝতে পেরেছিল, ওটা একটা মৃতদেহ।

তখনই মাথার মধ্যে কে যেন ফিসফিস করে বলে উঠল: রাহুল তুমি খুনি! এখন তুমি পালাও। তারপরই সে দৌড়ল।

জানালা দিয়ে একফালি রোদ এসে পড়েছে। রাহুল হাত বাড়িয়ে তরল সোনার মতো রোদ তালুতে সংগ্রহ করল। হাতটা ঘুরিয়ে ধরতেই সোনায় মাখামাখি হয়ে গেল। হাতটা মেলে রেখে সে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল।

‘এত দেরি করলে বাপু আমরা কিন্তু অন্য লোক দেখব।’

চমকে হাত সরিয়ে নিল রাহুল। জানালার উলটোদিকে সামনের বাড়ির বারান্দা। সেখানে দাঁড়িয়ে ঠিকে ঝি আর বাড়ির গিন্নি। বুকে ভর দিয়ে সরীসৃপের মতো পিছলে রাহুল পেছনে সরতেই দেওয়ালে পা ঠেকে গেল। সে ওদের দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু ওখান থেকে ওরা কি তাকে দেখতে পাচ্ছে?

বোধহয় না। ঘরটা বেশ অন্ধকার। তবু জানালাটা একসময় বন্ধ করে দিতে হবে। রাহুল অপেক্ষা করতে লাগল। কিছু পরেই বারান্দাটা ফাঁকা হয়ে গেল। কাকে যেন দাঁত মাজার জন্য তাড়া দিচ্ছে। ওদের বড়ো মেয়েটির সঙ্গে রীণার ভালোই আলাপ আছে। নাম মায়া, বছর ষোলো—সতেরো বয়স। আসা—যাওয়া করে।

রাহুল উপুড় হয়ে পড়ে রইল মেঝেয় থুতনি ঠেকিয়ে। এই ছোটোঘরের দেওয়ালের পরেই পাশের ফ্ল্যাট। চিনেমাটির বাসন ভাঙার শব্দ হল। ওপরের ঘরে কেউ চলাফেরা করছে। রাস্তায় একদল কচি গলা চিৎকার করল। সবথেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে একটা কাকের কণ্ঠস্বর। প্রচুর শব্দ একসঙ্গে নানান কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আলাদা করে এক—একটা শব্দ বেছে নিতে গেলে বহুক্ষণ মন দিতে হয়। সে সময় কার আছে?

পা দিয়ে ভাঙা তোরঙ্গে রাহুল ধাক্কা দিল। ফাঁপা শব্দ হল। সে জানে এ শব্দটা কেউ শুনতে পাবে না। শোনার জন্য কেউ কান পেতে নেই। তার জন্য কেউ কি ওত পেতে বসে আছে? কলকাতার লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে আলাদা করে তাকে খুঁজে বার করবে পুলিশ! গোয়েন্দারা কি ওত পেতে আছে? এখানে প্রতিদিন কি তারা খোঁজ করতে আসবে, নিশ্চয় না। নজর রাখবে, কিন্তু কাল রাতে কি তারা দেখেছে এ বাড়িতে তাকে ঢুকতে? নিশ্চয় না, তা হলে এতক্ষণে ওরা নিশ্চয় এসে পড়ত।

রাহুল তোরঙ্গে আবার ধাক্কা দিল। এই শব্দটা তাকে ভরসা দিচ্ছে। অনেক কিছুর অধিকার তা হলে এখনও অটুট রয়েছে! অধিকারগুলো কী, তা অবশ্য নির্ধারণ করতে হবে। আপাতত বোঝা যাচ্ছে দিনের বেলাটা নিরাপদ।

জানালার কার্নিশ ধরে একটা বিড়াল হেঁটে গেল। একবার ঘাড় ফিরিয়েছিল, সম্ভবত বন্ধ থাকা জানালাটা হঠাৎ খোলা দেখে। তবে ভ্রূক্ষেপ না করেই চলে গেল। তার মজা লাগল। অপেক্ষায় রইল কখন আবার ও ফিরে আসে। এইভাবেই সে অপেক্ষা করত যখন সুধাংশুকে চিফ অ্যাকাউন্টেন্টের ঘরে যাবার জন্য বেয়ারা ডাকতে আসত। বলির পাঁঠার মতো সুধাংশু যেত। আর ডিপার্টমেন্টের তারা কয়েকজন মুখ লুকিয়ে হেসে অপেক্ষায় থাকত ওর ফিরে আসাটা দেখার জন্য। মত্ত ষাঁড়ের মতো সুধাংশু ছুটে আসত, ‘অসম্ভব, সন অফ এ বিচ, চাকরি ছেড়ে দোব।’

রাহুল ডান পা—টা পাশের দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছিল। পায়ে শক্ত কিছু একটা ঠেকতেই উঠে বসল। একটা হাতুড়ি। এই ফ্ল্যাটে প্রথম আসার দিন ঠেলাগাড়ি থেকে পড়ে গিয়ে টেবলের পায়াটা খুলে যায়। গৌতমের চাকর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছিল। ওর কাছ থেকে সে হাতুড়িটা চেয়ে নিয়েছিল। ফেরত দিতে ভুলে গেছে, ওরাও চেয়ে নিতে ভুলে গেছে। এত তুচ্ছ জিনিসটা!

হাতুড়িটা রাখতে গিয়ে রাহুলের কী খেয়াল হল নিজের মাথায় সেটা বার কতক ঠুকল। ব্যথা লাগে, অথচ আরামও বোধ হল। রেখে দিল। বেড়ালটা আর ফিরছে না। আর তখনই তার মনে হল পাশের ঘরে কেউ যেন চলাফেরা করছে। কেউ যেন হঠাৎ গলা টিপে ধরল তার। অসহায়ের মতো আত্মরক্ষার জন্যই যেন সে হাতুড়িটা শক্ত করে চেপে, কাঠ হয়ে বসে রইল। উৎকর্ণ হয়ে থাকল, কোনো শব্দ নেই। বোধহয় ভুল হয়েছে। হামাগুড়ি দিয়ে দরজার পাল্লার জোড়ে চোখ রাখল।

জোড়ের মাঝে পোস্টকার্ড গলে যায় এমন ফাঁক। সেখানে ভ্রূ লাগিয়ে তাকালে শোবার ঘরের এক—চতুর্থাংশ দেখা যায়। এই অংশটির মধ্যে পড়ে টেবলের বাঁ ধার, খাটের উপরের দিক অর্থাৎ যেখানে বালিশগুলো রয়েছে, দেওয়ালের সাদা অংশ যেটুকুতে ছবি, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি নেই, ইজিচেয়ারের দুই হাঁটু, আর মাঝে মাঝে দরজার পর্দা, যখন হাওয়ায় নৌকোর পালের মতো ফুলে ওঠে।

ঘরে কেউ রয়েছে। রাহুল কতকগুলো ব্যাপার এখন বুঝতে পারে। কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে কি না, কেউ কাছেপিঠে রয়েছে কি না, নড়াচড়া কতটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, চলাফেরার শব্দে কীসের ইঙ্গিত ইত্যাদি।

ওর মনে হল ঘরে কেউ রয়েছে। কে থাকতে পারে? নিশ্বাস বন্ধ করে শব্দ শোনার চেষ্টা করল। তারপরই মনে হল, এত মনোযোগ দিয়ে মানুষটাকে আবিষ্কারের কী দরকার, এ তো রতন! এইভাবেই তো শব্দ হয় তার ঝাঁট দেবার। হাঁটুর কাছে কাপড় গুটিয়ে উবু হয়ে বসে। মসৃণ মেঝেয় সাবধানে ফুলঝাঁটা টানে। কারণ রাহুল বিছানায়, সরকারিভাবে তখনও তার ঘুম ভাঙেনি। ঝাঁট দেবার ছপছপ শব্দটা সে পছন্দ করে না মোটেই।

রাহুলকে ভয় করে রতন, ভালোও বাসে। বরং রীণাকে যেন সে কিছুটা অপছন্দ করে। হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তোলায় রীণা একদিন আপত্তি করেছিল। রীণাও বিশেষ পছন্দ করে না ওকে। রোজই রাহুলের কাছে ওর সম্পর্কে কিছু—না—কিছু বলত। বুড়ো মানুষ, নিড়বিড়ে, এক মিনিটের কাজ দশ মিনিট লাগায় ইত্যাদি শুনে শুনেও রাহুল দ্বিতীয় কোনো লোক নিয়োগের জন্য ব্যস্ত হয়নি।

না হওয়ার কারণ রতনের বয়স, আনুগত্যবোধ এবং পিতৃসুলভ চালচলন। ওর বয়স ষাট—পঁয়ষট্টির মধ্যে। বরখাস্ত করলে কোথাও কাজ পাবে না, ফলে সে তটস্থ হয়ে থাকে এবং প্রাণপণে হুকুম তামিলের চেষ্টা করে অথচ বয়সোচিত কারণেই সে এই সংসারের কর্তা—গিন্নির সাংসারিক বুদ্ধিশুদ্ধির অভাবগুলি বিরক্তি প্রকাশ করে শুধরে দেয়।

শেষোক্ত ব্যাপারটি রাহুলের ভালোই লাগে। বারো বছর বয়সে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতে যেত টালা পার্কে। ফিরত ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণিতে, ভাড়া ফাঁকি দিয়ে। একদিন মুখোমুখি হয়ে গেল কন্ডাক্টরের। ট্রাম তখন জোরে চলেছে। এক বৃদ্ধ হাত চেপে তাকে আগলে ধরলেন,—’অ্যাঁ পালানো হচ্ছে, নামতে গেলে যে পড়ে মরবে সে খেয়ালও কি নেই? চুপটি করে দাঁড়াও।’

গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, যাতে রাহুলের মনে হল কন্ডাক্টর ভাড়া চাইলে এই বুড়ো তার ভাড়া দিয়ে দেবে। কন্ডাক্টর চেয়েছিল। বৃদ্ধ ভাড়া দেয়নি, হেসে বলেছিল, ‘এই বয়সেই ফাঁকি দিতে শিখছে। বড়ো হলে যে পকেট মারবে!’ ট্রাম দাঁড়াতেই রাহুল লাফিয়ে নেমে পড়ে। রাগে, অপমানে কানের ডগা জ্বালা করছিল।

তাদের সঙ্গে খেলতে যেত জ্যোতি নামে একটি ছেলে। চলন্ত ট্রাম থেকে নামায় ওস্তাদ ছিল। কন্ডাক্টরের তাড়া খেয়ে একদিন সে ডান পা—টা ভাড়া হিসাবে চাকার তলায় দিয়ে দেয়। রাহুলের মনে হয়েছিল সেই বুড়োটা থাকলে জ্যোতি খোঁড়া হত না।

তার মাঝে মাঝে মনে হত রতনই সেই বুড়োটা।

মসৃণ মেঝের ওপর চেয়ার সরাবার শব্দ হল। রাহুলের মনে পড়ল, এইভাবেই রীণা তাকে বিছানা ত্যাগের শেষ সংকেত জানাত। একদিনের কথা তার মনে পড়ল—

.

‘আটটা বাজতে চলল বিছানা তুলবে কখন?’ বলতে বলতে রীণা আয়নার কাছে মুখটা এগিয়ে এনে, সাবধানে টিপ পরল। বুক, কোমর, পাছা এবং মুখটাকে ঘুরিয়ে— ফিরিয়ে নানান ভঙ্গিতে দেখল।

‘অত করে যে দেখছ, দেখবে তো সেই বুড়োটা! সেজন্য সাজাগোজার কী দরকার? বুকের কাপড়টা একটু সরিয়ে দিয়ো আর পাছাটা সুইং করিয়ে হেঁটো, তা হলেই কাজ হবে।’ এই ধরনের কথা রীণার গা—সওয়া হয়ে গেছে। শুধু চট করে একবার দেখল রতন ঘরে আছে কি না।

‘নাও, ওঠো খুব হয়েছে। ওই বুড়োটার জন্যেই অ্যাসিসটেন্ট হেডমিস্ট্রেস হয়েছি, মনে থাকে যেন।’

‘এবং হেডমিস্ট্রেসও হবে।’

রীণা গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেল। বুড়োটা অর্থাৎ সনৎপ্রসাদ কুমার যার বড়োবাজারে ঝাড়ামশলার দোকান, দেশে জমিজমা, পুকুর, দু—খানা ফ্ল্যাট বাড়ি, একটি স্ত্রী, আটটি ছেলেমেয়ে, মা—র নামে একটি স্কুল, বৃন্দাবনে বাবার নামে ধর্মশালা। কোষ্ঠকাঠিন্যের অস্বস্তি, সন্তানাদি মানুষ না হওয়ার দুঃখ এবং যুবক থাকার ইচ্ছা প্রভৃতি আছে—তিনি রীণাকে স্নেহের চোখে দেখেন।

রাহুলের ধারণা, বুড়োটাকে যৌন ক্ষমতা হারাবার ভয় পেয়ে বসেছে, তাই রীণার সান্নিধ্যে চাঙ্গা হতে চায় এবং নিশ্চয় রীণা এজন্য তাকে সচেতনভাবে সাহায্য করে। একবার এসে ঘণ্টা দুয়েক ছিল, তার মধ্যে চারবার অন্তত উল্লেখ করেছিল, ‘আপনাদের ছেলেপুলে হয়নি কেন? অ্যাঁ?’ রাহুল মুচকি হেসে প্রসঙ্গটার পাশ কাটাতে চেয়েছিল কিন্তু বুড়োটা জোঁকের মতো লেগেছিল।

‘আমার বে—র প্রথম তিন বছরেই তিন ছেলে। আমার বড়ো ছেলের দু—বছরে দুটি। বড়ো মেয়ের চার বছরে তিনটি। প্রথমদিকেই তো ছেলেপুলে হওয়া ভালো। তবে আপনারা শিক্ষিত, আজকাল আবার কত ওষুধবিসুদ বেরিয়েছে। কিন্তু বেশি বয়সে বাপ হলে ছেলেকে মানুষ করে তুলতে তুলতেই দেখবেন বুড়ো হয়ে গেছেন। আর অল্পবয়সে হলে, বয়স যখন পঞ্চাশ তখনই ছেলে রোজগার শুরু করে দেবে। ব্যস, বসে বসে তখন বুড়ো—বুড়িতে শুধু খাও আর ঘুমোও। এই দেখুন না উনসত্তর চলছে, দেখে বুঝতে পারবেন? কোনো টেনশান নেই, ছেলেরাই সব দেখাশোনা করছে।’

সনৎকুমারের মতে এই হল সংসার—ধর্মের সার কথা। আর দু—ঘণ্টা ধরে এই আলোচনাটা রীণার সঙ্গেই হয়েছিল। রাহুল খাটের এককোণে কাত হয়ে শুয়ে বাসি খবরের কাগজটা তখন পড়ার ভান করছিল। পাঁচ বছর চাকরি করে রীণা কীভাবে অ্যাসিসটেন্ট হেডমিস্ট্রেস হল, রাহুল সেটা জানার দরকার বোধ করেনি বা জানতে ইচ্ছা হয়নি। শুধু এক—আধবার মনে হয়েছিল যাদের ন্যায্য দাবি ডিঙিয়ে ও ওপরে উঠল, তারা মনে মনে ওর সম্পর্কে কী ভাবে!

কিন্তু রীণার ভাবনা, সনৎকুমার কীসে সন্তুষ্ট হয়। ফাউন্ডার—প্রেসিডেন্টের প্রত্যেকটা কথাতেই সে সায় দিল। ‘কত সামান্য থেকে আজ এইখানে উঠেছি,’ সেই কাহিনি শুনতে শুনতে নানাভাবে বিস্মিত হয়ে বুড়োকে খুশি করল। সেই রাতেই রীণা পিল খেতে প্রথম অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিল। রাগে আপাদমস্তক জ্বালা করে উঠলেও রাহুল ওর ইচ্ছায় আপত্তি করেনি, তর্কও নয়। কিন্তু তিন মাস পরও কোনো ফল না ফলায়, সে ডাক্তারের কাছে হাজির হয়েছিল।

.

‘কতক্ষণ লাগে একটা ঘর ঝাঁট দিতে? ভাত নামিয়ে নাও তাড়াতাড়ি।’

রাহুল দরজার জোড়ে চোখ রাখল। রীণা স্নান করে এসেছে, ভিজে কাপড়গুলো হাতে। বারান্দায় নিজেই মেলবে। রতন তা হলে বাজার থেকে ফিরে ঝাঁট দিচ্ছিল। এবার রান্নাঘরে যাবে। রীণা জোড়ের ফাঁক থেকে সরে গেছে। বালিশগুলো থাবড়ে ফুলিয়ে রাখতে রাখতে রতন বিছানা গোছগাছ করছে। রীণা ঘরে ঢোকামাত্র চুপ করল। এখন রীণা স্কুলে যাবার সাজ করবে। সাধারণত এই সময় আমি থাকি বাথরুমে, রাহুল জোড়ে চোখ রেখে ভাবল, তখন শায়া আর ব্রেসিয়ারটা বদলে নেয়। এটা কোনোদিন দেখা হয়নি।

রতন বেরিয়ে যেতেই রীণা খাটে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ঠিক মুখোমুখি। জোড়ের ফাঁক দিয়ে রাহুল সম্পূর্ণভাবে দেখতে পাচ্ছে তাকে। আট—ন ফুট দূরে মাত্র। স্থির দৃষ্টিতে এইদিকেই তাকিয়ে। রাহুল বুঝতে পারছে না এখন ও কী ভাবছে।

উদবেগ, রাহুলের তাই মনে হচ্ছে, আবার মনে হচ্ছে ভয় কিংবা উত্তেজনা। দুই ভ্রূর মাঝে ফুলে উঠেছে চামড়া। নিশ্বাসটা গাঢ় হচ্ছে, দ্রুত হচ্ছে। কণ্ঠনালি ওঠানামা করল ঢোঁক গেলায় আর ঠোঁট দুটি যেভাবে ফাঁক হয়ে রয়েছে তাতে মনে হয় ভিতরে প্রবল আলোড়ন ঘটছে। জানালা বন্ধ করতে সরে গেল রীণা। আবার এল। ঘরের দরজা বন্ধ করে খিল এঁটে এগিয়ে আসতেই জোড়ের ফাঁক ঢেকে গেল।

শিকল খোলার সময় লোহায় লোহায় ঘষার একটা শব্দ শুনল রাহুল। দরজার কাছ থেকে সে এক পা পিছিয়ে গেল। সন্তর্পণে পাল্লাদুটো খুলে রীণা দাঁড়িয়ে। কড়িকাঠের কাছে ঘুলঘুলি দিয়ে আলো আসছে। ফলে ওর টিকালো নাক, কানের ডগা, বাম বাহু, চুলের কিয়দংশ বেশ স্পষ্টই দেখা যায়।

‘তুমি বাথরুমে যাবে না?’

রীণা এমনভাবে বলল যেন রাহুল অন্য জগতের লোক। প্রাকৃতিক ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন ওর দরকার হয় কিনা, সে—সম্পর্কে যথেষ্টভাবে নিশ্চিত নয়।

‘কেন যাব না?’

‘কীভাবে যাবে?’

রাহুল চিন্তিত হল। ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দা। ও পাশের বাড়ির তিনটে জানালা থেকে দেখা যায়। তবে বারান্দার পাঁচিলটা কোমর সমান উঁচু। হামা দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু রতন?

‘ঠিক চলে যাব তুমি বরং রতনকে দোকানে পাঠাও।’

রীণা দরজা বন্ধ করে দিতেই রাহুলের প্রথমে মনে হল, তার স্বাধীনতার একটা বিরাট ভাগ থেকে এখন সে বঞ্চিত। নিজের দেহ বা তার প্রাকৃতিক যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে চিন্তামুক্ত থাকার স্বাধীনতা আর তার নেই।

এখন থেকে বাথরুমে যাবার দরকার হলে তাকে রীণার মুখাপেক্ষী হতে হবে। ঘরের জানালা বন্ধ করে, রতনকে বাইরে পাঠিয়ে, ওপাশের বাড়ির জানালায় কেউ আছে কি না দেখে রীণা তাকে সংকেত জানালে তবে সে বাথরুমে যেতে পারবে। যদি রীণা না থাকে এবং তখন যদি বেরোবার দরকার হয়? রাহুল তা ভাবতে গিয়ে ধীরে ধীরে রেগে উঠতে শুরু করল। তার মনে হল, আত্মরক্ষার জন্য এ কোন দশায় পৌঁছালাম!

দরজা খুলে রীণা চাপা স্বরে ডাকল। উঁকি দিয়ে রাহুল দেখল, বারান্দার তারে ভিজে কাপড়টা মেলে দিয়ে অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে কিন্তু সবটা ঢাকেনি। ঘর থেকেই হামাগুড়ি দিয়ে সে বারান্দায় বেরোল। সেই সময় একবার মুখটা ঘুরিয়ে রীণা তার দিকে তাকিয়েছিল। চতুষ্পদ প্রাণীর দিকে প্রবল কৌতূহলে শিশুরা হয়তো এভাবে তাকায়। রাহুল সেই মুহূর্তে নিজেকে কুকুর ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারল না। তাড়া খাওয়া, দু—পায়ের ফাঁকে লেজ ঢোকানো এবং করুণাপ্রার্থী! নিজেকে ধিক্কার দিয়েই সে বাথরুমে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করার আগে শুনল রীণা বলছে, ‘রতন কিন্তু দশ মিনিটের মধ্যেই এসে যাবে।’

রাহুলের মনে হল, এই আটত্রিশ বছরের জীবনে কখনো কোনো ইতর প্রাণীর সঙ্গে নিজেকে তুলনা করিনি। মেধা, বুদ্ধি, মহত্ত্ব, করুণা, ভালোবাসা, এমনকী ক্রোধ, আমার অধিগত বা জন্মগত কোনো গুণাবলি দেখবার কোনো সুযোগই এই চার দেওয়ালের মধ্যে নেই। আমি এখন ইচ্ছা করলেই কথা বলতে পারি না একমাত্র নিজের সঙ্গে ছাড়া। না গান, না হাসি। খাওয়া, মল—মূত্রত্যাগ এবং ঘুম ছাড়া আর কিছু করার নেই। অবশ্য বইপড়া, লেখা বা ঠোঙা তৈরির মতো কোনো কাজ করতে পারি। কিন্তু এগুলি আমার দেহকে বাঁচিয়ে রাখতে কোনো সাহায্যই করবে না। আমি পালিয়েছি শুধুই বাঁচার তাগিদে, আমার বিদ্যাবুদ্ধির নির্দেশ ছাড়াই ইতর প্রাণীর মতো। যেভাবে একটা সৈনিক পরিখা থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে মেশিনগানের প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই শত্রুর দিকে ধেয়ে যায় বীরত্ব দেখাতে নয়, এ ছাড়া তার বাঁচার আর অন্য উপায় নেই বলেই। সেইভাবেই পালিয়েছিলাম। জৈব অস্তিত্ব রক্ষার সহজাত প্রেরণায় এবং অসাড় মস্তিষ্কে। একে এখনও অস্বীকার করতে পারি না, এজন্য আমি নিজেকে কাপুরুষও ভাবতে পারছি না।

কিন্তু কুকুরের কথা ভাবছি। এই প্রাণীটি হয়তো—বা সাহসী, কর্তব্যনিষ্ঠ কিন্তু নিকৃষ্ট চরিত্র বোঝাবার জন্য একটা বিশেষণ। কুকুরের কয়েকটি বিশেষত্ব এখন আমাতে যে বর্তেছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অপরিচিত কেউ এলে আমি চিৎকার করতে পারব না, আগে দরজা খুলে যেমন বলেছি, ‘আরে পরিমল! অনেকদিন পর…ভেতরে আয়’—এখন আর বলা সম্ভব নয়।

কিংবা অপর একটা কুকুর দেখে তাকে কামড়াবার জন্য ছুটে যেতে পারব না যেমন গৌতমবাবুর ফ্ল্যাটে গিয়ে গরবাচভের গ্লাসনস্ত বা মারাদোনাই গ্রেটেস্ট, তাই নিয়ে তর্ক করতাম।…কুকুরদের বিবাহিত স্ত্রী থাকে না, কিন্তু আমার আছে। ফলে সুবিধাটা এই যে, কোনো কুকুরীর সহচর হওয়ার জন্য আর পাঁচটা কুকুরের সঙ্গে কামড়াকামড়ি করতে হয় না।

রাহুলের মনে হল, শুধু এই ব্যাপারেই আমি কুকুর নই। রীণাকে শুইয়ে তার বুকের উপর উঠতে পারি (কখনো বাধা দেয়নি)। এই স্বাধীনতাটুকু এখনও দখলে আছে। শ্রম, বিশ্রাম, আনন্দ, সুখ এইসবের জন্য এই চার দেওয়ালের মধ্যে এবার থেকে রীণার দেহখানা সম্বল করা ছাড়া আর তার কিছু নেই।

ভাবতে ভাবতে রাহুলের মনে পড়ল গত পাঁচদিনে সে স্ত্রীলোক বিষয়ে বিন্দুমাত্রও চিন্তা করেনি। কী করে বাঁচব, কী করলে ধরা পড়ব না, শুধু এই ভাবনাতেই সে আচ্ছন্ন ছিল। আর যেইমাত্র এই ঘরের নিরাপত্তাটা পেল আর অমনি তার মন ব্যালান্স হারাতে শুরু করেছে। এটা হওয়া উচিত নয়। এখন সে বিপদের মধ্যগগনে। সামান্য অসাবধান হলে ধরা পড়ে যেতে পারে।

নিজেকে সংহত করতে, অনুভূতিগুলোকে প্রখর করতে গভীর কোনো বিষয়ের ভাবনার মধ্যে ঢুকতে পারলে ভালো হয়। রাহুলের মনে হল, আদিম মানব আর আমার মধ্যে নৈকট্য কতটা সে বিষয়ে তো ভেবে দেখা যেতে পারে!

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকনমিকস অনার্স পাওয়া ইউনাইটেড কেমিক্যালসের অ্যাসিসট্যান্ট পাবলিক রিলেশনস ম্যানেজার এবং পাঁচ হাজার বছর আগের মানুষ কিংবা কুকুর এই শিরোনামে সন্দর্ভ রচনার কথা যদি ভাবা যায়, তা হলে কেমন হয়!

.

একটা চিনেমাটির প্লেটে চারখণ্ড টোস্ট আর এক গ্লাস চা, রীণা দরজার একটা পাল্লা খুলে মেঝেয় রেখেই আবার দরজা বন্ধ করে দিল। রাহুল শিকল তুলে দেওয়ার শব্দ শুনতে পেল। গোগ্রাসে টোস্টগুলো শেষ করে তারিয়ে তারিয়ে চা—টুকু খেল। দেখে নিয়েছিল আজকের খবরের কাগজটা খাটের উপর। দেখে একবার ইচ্ছে হয়েছিল জানতে কলকাতায় কোথাও নারী ধর্ষণ হয়েছে কি না আর ভিভ রিচার্ডস ছিয়াশি নট—আউট ছিল, শেষ পর্যন্ত কত করল! জন্মাষ্টমী আজ। রীণার স্কুল নিশ্চয় বন্ধ। সারাক্ষণ বাড়িতে থাকলে ভালোই। কোনো কিছুর দরকার হলেই ডেকে বলা যাবে। কিন্তু কীভাবে ডাকব? রাহুল বিভ্রান্ত বোধ করল। এত তুচ্ছ অথচ বিপজ্জনক একটা সমস্যার আবির্ভাব ঘটতে পারে তা ধারণা করতে পারেনি। গলা থেকে কোনো স্বর বার করা যাবে না। কুকুর অন্তত কুঁইকুঁইও করতে পারে। দরজায় টোকা দেওয়া যায়। কিন্তু রতন যদি ঘরে থাকে আর শুনতে পায়!

রাহুল ভেবে দেখল, প্রথমেই এই সমস্যাটা মেটানো দরকার। তার কাছে এখন সবথেকে জরুরি বিষয়, রীণাকে ডেকে প্রয়োজন জানাবার উপায় আবিষ্কার করা। কিন্তু শূন্য চিনেমাটির প্লেট আর গ্লাসটা চোখের পক্ষে পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে। প্রোডাকশান ম্যানেজার কৃষ্ণমূর্তির বাড়ির বারান্দায় এইরকম প্লেট, অবশ্য কলাইয়ের, সে দেখেছে। আলসেশিয়ানটা সেখানেই বাঁধা। প্লেটটা তার পাশে থাকে আর একটা বাটিতে জল। রাহুলের মনে হল, জল তেষ্টা পেলে সে কী করবে! ঘরের কুঁজোটা এনে রাখা ছাড়া উপায় নেই। রোজ তাতে জল ভরার কাজটা রীণাকেই করতে হবে।

ঘরের বাইরে রীণার ক্রুদ্ধ স্বর শোনা যাচ্ছে। জোড়ের ফাঁকে চোখ রেখে সে দেখতে পেল না। নখ দিয়ে দরজা আঁচড়াতে লাগল যদি শুনতে পায়। রীণা ঘরে ঢুকল, পিছনে রতন। রাহুল আঁচড়কাটা বন্ধ করল।

‘পই পই করে বলেছিলুম গোলমাল হতে পারে, কাপড়গুলো এনে রাখ, এনে রাখ। এখন আমি এই ময়লা শাড়ি পরে থাকব? একটা বুড়ো ভূত কোথাকার। কথা বললে শোন না কেন? অন্য কোনো বাড়িতে এমন কর্তামি করলে দূর করে দিত।’

রতনের জবাব শোনা গেল না। এখন ওর মুখ দেখা যাচ্ছে না, সেটা ভালোই। যন্ত্রণাকাতর বৃদ্ধমুখ অত্যন্ত কষ্টদায়ক।

‘দাঁড়িয়ে থেকে আর কাজ বাড়িয়ো না, ওদিকে ভাতের তলা ধরে গেল হয়তো! তবে এই বলে রাখছি এবার যদি কথামতো কাজ না কর, তা হলে অন্য জায়গায় কাজ খুঁজে নিতে হবে।’

রাহুল চিন্তায় পড়ল। রতন কোথাও যাবে না বা ওর কোথাও যাবার জায়গা নেই। কিন্তু বলা যায় না, যেসব ভাইপোর কথা প্রায়ই বলত, হাতে করে মানুষ করেছি, এখন ভালো রোজগার করে, যারা প্রায়ই নাকি বলে, ‘কাকা আমাদের কাছে এসে থাক, দরকার কী বুড়ো বয়সে কষ্ট করে’—তাদের কেউ এসে যদি রতনকে এখন নিয়ে যায় তা হলে নতুন একটা লোক রাখতেই হবে। নিশ্চয় কোনো মেয়েমানুষ এবং রীণার অনুপস্থিতিতে কৌতূহলবশতই হয়তো একদিন, এ ঘরটা বন্ধ থাকে কেন জানতে শিকল খুলে উঁকি দিতে পারে।

ব্যাপারটা রীণাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। রতনের সঙ্গে কোনোরকম খারাপ ব্যবহার করা তার চলবে না। ওর অনাবশ্যক কোনো কৌতূহল নেই, অন্তত এ ঘরটা সম্পর্কে নেই। নিজের মতো করে কাজগুলো করতে দিলেই ও খুশি থাকে। তাই দেওয়া হোক, রীণা যেন কর্তৃত্ব ফলাবার চেষ্টা না করে। এখন এই সংসারে বা এই ফ্ল্যাটে কোনো রকমের পরিবর্তন ঘটানো চলবে না, পুলিশ নিশ্চয় এখনও ওয়াচ রাখছে।

রতন ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। রীণা ঘরেই আছে তবে দেখা যাচ্ছে না। রাহুল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। এখন তার কিছু করার নেই। জানালার খোলা পাল্লাটা দিয়ে আলো আসছে বটে, কিন্তু হাওয়া নেই। ওটা বন্ধ করলে আলো এবং হাওয়াহীন এই ঘরে কয়েক ঘণ্টার বেশি বাঁচা যাবে না। সুতরাং ঝুঁকি নিয়ে পাল্লাটা খুলে রাখতেই হবে। উপায় নেই। যারা মুক্ত সংসারে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদেরও তো ঝুঁকি নিতে হয়। যেমন রীণা। একটা খুনিকে ঘরে লুকিয়ে রাখার রিসক, হোক না স্বামী,…নিয়েছে তো! পুলিশ ঠিক কী কী প্রশ্ন করেছিল সেটা জেনে নিতে হবে। এখন পর্যন্ত নার্ভ শান্ত রেখেছে, হাউমাউ করে কান্না জোড়েনি বা প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুরু করেনি। আচরণে, কথায় অচঞ্চল শান্ত ভাবটা বজায় রাখা সহজ ব্যাপার নয়! তার শ্রদ্ধা জাগল রীণার প্রতি।

কিন্তু ভ্যাপসা গরমটা ক্রমশই অসহনীয় লাগছে। ওঘরে পাখা ঘুরছে। পুরোনো কিছু খবরের কাগজ একধারে ছড়ানো। তারই একটা ভাঁজ করে নিজেকে সে হাওয়া দিতে শুরু করল। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই বিরক্ত লাগায় কাগজটা ছুড়ে ফেলল। এতে গরমবোধ যেন আরও বাড়ল। বাইরে হাওয়া আছে কি না লক্ষ করার জন্য জানালা দিয়ে তাকাল। ছাতের পাঁচিলে মেলে দেওয়া একটা শাড়ির প্রান্ত ঝুলছে ঠিক জানালা বরাবর। হাওয়া নেই তাই দুলছে না।

সে ভাবতে চেষ্টা করল শাড়িটা কার? অনুর না তার দিদি তনুর? এই শাড়িটা পরেই, যতদূর মনে পড়ে, অনু কয়েকবার তাদের ফ্ল্যাটে এসেছে আবার তনুকেও এটা পরে ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। তনু কয়েকবার এসেছে, অতি লাজুক, রান্নাঘর আর ছাদের বাইরে গেলে দিশাহারা হয়। ঠিক বিপরীত প্রকৃতির অনু। দিনে বারদুয়েক তো এই ফ্ল্যাটে সকালে বা সন্ধ্যায় আসবেই।

রাহুলরা প্রথম যখন এখানে এল অনু তখনই ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। এক ছুটির দুপুরে ও রীণাকে শুনিয়েছিল সীতাংশুকে তার কতখানি ভালো লাগে আর সীতাংশুও প্রতি চিঠিতে সেই কথাই জানিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটা চিঠি সে রীণাকে পড়িয়েও ছিল।

‘এইটুকু মেয়ের সঙ্গে এইসব নিয়ে কথা বলো কেন?’ রাহুল ভর্ৎসনা করেছিল।

‘ওইটুকু মেয়ে!…সীতাংশু ওকে কত পর্নো লিটারেচার পড়িয়েছে জানো?’

‘জেনে দরকার নেই…সীতাংশুটা কে?’

‘মোড়ের ব্যানার্জি মেডিকোর ছেলে। দাদার স্কুটারে চেপে মাঝে মাঝে এখান দিয়ে যায়। পয়সা আছে। অনুর দুখ্যু, সোনার বেনে না হয়ে যদি সে বামুনের ঘরে জন্মাত! একদিন জিজ্ঞেস করল, ‘বউদি আপনাদের বিয়েতে জাত নিয়ে আপত্তি ওঠেনি?’ আর একবার জানতে চেয়েছিল, ‘যদি আপত্তি উঠত তা হলে কী করতেন?’

রাহুলের মনে পড়ল একটা দৃশ্য। মাস তিনেক আগে দেখা। লুকিয়ে সীতাংশুর সঙ্গে ছবি তোলাতে যাবে বলে অনু রবিবার বিকেলে এসেছিল রীণার একটা ছাপা পলিয়েস্টার শাড়ি পরতে আর চুল বাঁধতে। সেই সময় রাহুল অফিসের এক ক্লায়েন্টকে লাঞ্চ খাইয়ে, আড্ডা দিয়ে ফেরে। ওর আসাটা অনু টের পায়নি। ঘরে ঢুকতে গিয়ে রাহুলকে থমকে পড়তে হয়। অনু দু—হাত তুলে স্লিভলেস ব্লাউজের পিঠের হুক লাগাচ্ছে। পরনে শায়া। তাকে দেখেই কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে, পিছন ফিরে অনু ড্রেসিং টেবলের উপর কুঁকড়ে ঝুঁকে পড়ল, রাহুল দ্রুত সরে যায়। রীণা তখন রান্নাঘরে পুডিং তৈরিতে ব্যস্ত।

দৃশ্যটা—কুঁজো হওয়া একটা সতেরো—আঠারো বছরের ডাঁটো দেহ, ব্লাউজ ও শায়ার মাঝে কোমর বেড় দিয়ে বাদামি রেশমের মতো মসৃণ কোমল ত্বক, নিতম্বের উপর আধময়লা সাদা শায়ার মাঝ দিয়ে একটা ভাঁজ—সে বহুদিনই মনে মনে চোখের সামনে পুঙ্খানুপুঙ্খ ফুটিয়ে তুলেছে। যতই দিন গেছে বরং সে যেন এর সঙ্গে আরও কিছু যুক্ত করেছে নিজের অজান্তেই।

প্রায়শই সে দেখে, অনু পিছন ফিরে ঝুঁকে পড়ছে না, শুধু চোখের পাতা নামিয়ে থরথর কাঁপছে বা যখন সে হঠাৎ দরজায় এসে দাঁড়াল তখনও ব্লাউজটা অনুর গায়ে দেওয়াই হয়নি। সে আরও আবিষ্কার করেছিল, এইরকম ভাবনায় রীণা তখন আর রান্নাঘরে নয়, স্কুলের কাজে আটকে পড়ে বাড়ি ফিরতে দেরি করছে। পরে রাহুল এই ধরনের দৃশ্য রচনার জন্য একটা কারণ খুঁজে পায়। সে ভেবেছিল, অনু নিশ্চয় রীণাকে তার অপ্রতিভ হওয়ার খবরটা জানাবে আর রীণা তাকে সেটা বলবে একটু সন্দিগ্ধ গলায়। কিন্তু রীণা কিছুই তাকে বলেনি অর্থাৎ অনু এটা চেপে গেছে।

এসব কল্পনা রুচিবিগর্হিত, অন্তত আমার পক্ষে শোভা পায় না, এইভাবে রাহুল বহুবার নিজেকে ধমকেছে, ভয়ও দেখিয়েছে, বিকৃত চিন্তা করতে করতে কখন কী করে ফেলবে আর মানইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে। তবুও সে লক্ষ করেছে, অবৈধ অশ্লীল ছবি ফোটাবার মানসিক যন্ত্রটি তার আয়ত্তাধীন নয়। এই অক্ষমতা তাকে বার বার নিজের উপর রাগিয়ে তুলেছে।

কে যেন শাড়িটা তুলে নিল। কে তুলল দেখার জন্য রাহুল বুক চেপে জানালার দিকে এগোতে গিয়ে থমকে পড়ল। পুরুষের গলা শোনা যাচ্ছে ভিতর থেকে। দরজায় চোখ রাখল। ঘরে কেউ নেই। রীণা দালানে কথা বলছে কার সঙ্গে? পুলিশ? রাহুল মুহূর্তে বিদ্যুৎপৃষ্ট মৃতদেহের মতো কঠিন হয়ে গেল। মাত্র শ্রবণ ক্ষমতার দ্বারা এখন সে জীবিত। পুরুষ কণ্ঠটি নির্দিষ্ট মাত্রায় ধীর লয়ে কর্তব্য সম্পাদনের পেশাদারি ভঙ্গিতে নয়, লঘু কখনো বা দ্রুত, কণ্ঠে পূর্ণমাত্রায় বন্ধুত্বের প্রকাশ।

রাহুল ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করল। এখন সে দেখছে ঘরের মধ্যে ধূম্রবর্ণ আলো, অনুভব করছে দেহের ধাবমান রক্ত, স্বেদবিন্দুতে পিছল গাত্রত্বক এবং মুখের মধ্যে অম্ল স্বাদ। কার কণ্ঠস্বর, এ তথ্য জানার কৌতূহল তার হচ্ছে না। একবার শুধু সে ভাবল, মিথ্যেই ভয় পেয়েছিলাম।

পাশের ঘরেই এবার কথা হচ্ছে। রাহুল দেখতে পেল না রীণাকে। তার বদলে একটি যুবককে দেখল যাকে সে আগে এই পাড়াতেই দেখেছে বলে মনে হল। থুতনি কর্কশ, গালে দু—একটি মরা ব্রণের গর্ত, ছিপছিপে, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, লঘু ছেলেমানুষি ওর দাঁড়াবার ভঙ্গিতে। ভালো দরজির হাতে তৈরি ট্রাউজার্স। এই কি তবে অনুর সীতাংশু? তা ছাড়া আর কে হতে পারে! কিংবা রীণার বাপের বাড়ির কেউ?

‘আমি তো দাঁড়িয়েছিলুম দোকানের সামনে’, ছেলেটি উত্তেজিত স্বরে বলল। ‘দূর থেকে পুলিশের গাড়িটা আসছে, সার্চ লাইটের আলো। আমাদের গলি থেকেই তো বোমাটা ছুড়ল।’

‘ওভাবে তখন দাঁড়িয়ে থাকে?’ রীণার আদুরে ধমক রাহুল শুনল।

‘দাঁড়াব না তো কী করব, সব বাড়ির ছাদে, বারান্দায় লোক, তা ছাড়া রাস্তার সব আলো নেভানো, সব বাড়িরও। সে যে কী অন্ধকার কী বলব, একটা হাতিও যদি তখন হেঁটে যায় তো কেউ দেখতে পেত না। আর পুলিশের গাড়িগুলো বুনো শুয়োরের মতো ঘোঁত ঘোঁত করে ছুটে যাচ্ছে আর আসছে। বোমাটা পড়তেই দাদা শব্দ শুনে আমার হাত ধরে এমন টানল যে বেটাল হয়ে পড়ে গেলুম আর সেই মুহূর্তে গুলিটা এসে দেওয়ালে লাগল। যেখানে দাঁড়িয়েছিলুম তার এক ইঞ্চি কী দু—ইঞ্চি দূরে।’

‘ইসস’ রীণা শিউরে উঠল শব্দ করে, ‘কী ছেলে বল তো! যদি দাঁড়িয়ে থাকতে তা হলে কী হত?’

ছেলেটি তাচ্ছিল্য দেখাতে ট্রাউজার্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পা—দুটো ফাঁক করে দাঁড়াল।

রাহুল আন্দাজ করল রীণা এখন ড্রেসিং টেবলটার সামনে দাঁড়িয়ে। কী করছে ওখানে? চিরুনি? টিপ? পাউডার? এই সবের কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত? ছেলেটি খাটে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। অর্থাৎ কিছুক্ষণ থাকবে।

‘তোমায় যে চা করে দেব তারও উপায় নেই। চিনি একদম ফুরিয়েছে।’

‘রেশন আনাননি? দোকান তো খোলা দেখলুম।’

‘তাই নাকি!’

রীণাকে দেখা গেল। সবটা নয়, ডান হাঁটু, ডান বাহু ইত্যাদি। ছেলেটির থেকে দু—হাত ব্যবধান। রতনকে ডেকে রেশন কার্ড আর টাকা দিয়ে দোকানে পাঠাল।

ঘামে সপসপ করছে জাঙিয়া। আজ ছ—দিন ধরে সে এটা পরে রয়েছে। জামাটা ছাড়া আর কিছুই শরীর থেকে খোলা হয়নি। এখনি চান করে পরিষ্কার পাজামা পরতে হবে।

ট্রাউজার্সটা খুলে সে সারা শরীরের ঘাম মুছল। দেওয়ালে পিঠ দিতেই ঘামটা শুষে নিল চুনবালি। দু—হাত তুলে মুখোমুখি হয়ে সারা শরীর দিয়ে দেওয়ালটাকে আঁকড়ে ধরল। ও ঘরে কী কথা হচ্ছে শোনার আগ্রহ তার নেই। বাতাসহীন, প্রায়ান্ধকার ভ্যাপসা গন্ধওয়ালা এই ছোট্ট ঘরটা তাকে উদব্যস্ত করে তুলছে। কানের পিছন, ঘাড় এবং কণ্ঠা দিয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। উলঙ্গ হয়ে রাহুল মেঝেয় গড়াগড়ি দিতে থাকল।

আর কথা হচ্ছে না। রাহুল উঠে দরজার জোড়ে চোখ রাখল। ঘরে কেউ নেই। ছেলেটা বোধ হয় চলে গেছে। রতনের ফিরতে অন্তত একঘণ্টা, নখ দিয়ে সে দরজা আঁচড়াতে শুরু করল।

রীণা আসছে না। টোকা দিল। তবুও আসছে না, জোরে ধাক্কা দিল কয়েকবার। হঠাৎ একটা সবুজ রং এগিয়ে এসে কালো হয়ে চোখের সামনে দাঁড়াল। রাহুল পিছিয়ে এল।

দরজাটা খুলেই রীণা অস্ফুট শব্দ করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। রাহুল দ্রুত ট্রাউজার্সটা পরতে পরতে বলল, ‘চান করব। ভীষণ গরম, আমি আর পারছি না…আমি চান করব।’

‘রতন এসে পড়ে যদি!’

রাহুল শুনতে পেল না কথাটা, হামা দিয়ে ততক্ষণে বাথরুমের দিকে যেতে শুরু করেছে। রীণা তার পিছনে পিছনে এল। বাথরুমে ঢুকেই রাহুল বলল, ‘আমার পাজামাটা দাও, শিগগিরি।’

রীণা দ্রুত ঘরে এল। সময় এখন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। রতনই নয় অন্য কেউও এখন এসে পড়তে পারে। লন্ড্রিতে কাচা পাজামাটা রীণার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে রাহুল বাথরুমের দরজা বন্ধ করল। ছোটো মগে বার বার জল ঢালার ধৈর্য এখন তার নেই। ট্রাউজার্স সমেত সে চৌবাচ্চচায় নেমে পড়ল।

মিনিট পাঁচেক পর দরজায় টোকা পড়তে রাহুল চৌবাচ্চচা থেকে উঠল।

‘কে?’

‘আমি, তাড়াতাড়ি নাও।’

‘হ্যাঁ, নিচ্ছি।’

‘প্যান্টটা কী করবে?’

রাহুল প্রথমে বুঝতে পারল না। জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে খেয়াল হল, ভিজে ট্রাউজার্সটা প্রকাশ্যে শুকোতে দিলে রতনের কৌতূহলী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। অবশ্য ছোটো ঘরটায় নিয়ে গিয়ে তোরঙ্গটার উপর মেলে দিলে কোনো সমস্যা দেখা দেবে না। রাহুল এই প্রথম একটা জটিল অসুবিধার পাশ কাটাতে পেরে হালকা বোধ করল।

বাথরুমের ব্র্যাকেটে সাবান, মাজন এবং দাড়ি কামাবার সরঞ্জামগুলোয় তার চোখ পড়তেই সে অবাক হয়ে ভাবল, এগুলো ছাড়াই সে কয়েকটা দিন কাটিয়ে ফেলল কী করে? নিশ্চয় তার মুখে দুর্গন্ধ, শরীরে দুর্গন্ধ। গালে তালু ঘষল। কিন্তু এখন নিজেকে পরিষ্কার করার মতো সময় তার হাতে নেই।

রীণা আবার দরজায় টোকা দিল। রাহুল চৌবাচ্চচার খোলা জলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘হয়ে গেছে। যাচ্ছি।’

ফিরে আসার সময় তার মনে হল, চার হাত—পায়ে চলাটা তো বেশ সহজই। যেন দু—পায়েই হাঁটছি। এটায় যেন শৈশবে ফিরে যাওয়ার মজা রয়েছে। আর একটু বাড়িয়ে ভাবলে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ হওয়ার অভিজ্ঞতা পাওয়া যাচ্ছে। দাঁত মাজা নেই, দাড়ি কামানো নেই, চুল আঁচড়ানো নেই…আছে অতর্কিত ভয়ের আক্রমণ।

বিষণ্ণ, করুণ চোখে রীণা তাকিয়ে দেখছে। ভিজে ট্রাউজার্সটা কাঁধে রেখে হামা দিয়ে যেতে যেতে রাহুল ঘাড় তুলে তাকাল, হাসল। জীবনটাকে নিছকই মুক্ত রাখার জন্য চার—পেয়ে হওয়া, এতে দুঃখ পাবার কী আছে! শোবার ঘরে পাখা ঘুরছে। রাহুল হাওয়ার নীচে বসল।

‘রতন ফেরার আগেই আমাকে চাট্টি ভাত দিয়ো।’

‘এখনও তো কিছু রান্নাই হয়নি।’

‘এই ছেলেটাই কি অনুর সীতাংশু?’

‘হ্যাঁ।’

‘এসেছিল কেন?’

‘যদি অনুর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়! অনুও তো সকালে একবার ঘুরে গেছে। শোবার ঘরে ঢোকেনি বলে তুমি জানতে পারোনি।’

‘তুমি কি বেরোবে এখন?’

‘হ্যাঁ, স্কুলে যাব।’

‘আজ জন্মাষ্টমী…।’

‘বন্ধ থাকলেও, গার্জিয়ান কমিটির সঙ্গে বসতে হবে। ওদের কিছু কমপ্লেন আর সাজেশানস—।’

‘কিন্তু আমার সঙ্গে যে তোমার একবার বসা দরকার। কেন, কীজন্য, কীভাবে…তোমার কি জানতে ইচ্ছে করছে না? পুলিশের কাছ থেকে, খবরের কাগজ থেকে, লোকজনের মুখ থেকে নিশ্চয় অনেক কিছু শুনেছ। কিন্তু আসল লোকটির কাছ থেকে কি—’

‘যা শুনেছি সেটাই যথেষ্ট।…আমি ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি। আর কিছু শোনার নেই।’

রাহুল লক্ষ করল রীণার চোখমুখ কঠিন হয়ে উঠল। বেশ বোঝা যাচ্ছে, ও এখন তার কথা বিশ্বাস করবে না। ধরেই যেন রেখেছে, রাহুল বানিয়ে বানিয়ে একটা গল্প ফাঁদবে।

‘ঘরটা পরিষ্কার করা দরকার আর কুঁজোটা।’

‘রতন রোজ জল ভরে। কুঁজোটা দেখতে না পেলে জিজ্ঞাসা করবে।’

‘বলবে ভেঙে গেল, ফেলে দিয়েছি।…আমার খাওয়া—দাওয়ার ব্যবস্থাটা ভাবতে হবে। বাথরুমে যাওয়ার দরকার হলে…’ রাহুল তাকিয়ে রইল রীণার মুখের দিকে।

‘আজ স্কুলে না গেলেই নয়?’

‘হ্যাঁ, যেতেই হবে।’

রাহুলের এখন বলতে ইচ্ছে করছে, তার থেকেও জরুরি আমার জন্য তোমার আজ এখানে থাকা। বদলে তার মুখ থেকে আবেদনের মতো বেরিয়ে এল, ‘নাইবা গেলে। কী আর এমন গুরুতর কথা—।’

রীণার মুখে বিরক্তি জমে উঠেছে দেখে সে থেমে গেল।

‘তোমার ঘরটা পরিষ্কার করে দি।’ রীণা ঝাঁটা আনতে ঘরের বাইরে গেল।

তোমার ঘর! রাহুল ভাবল, তা হলে তার একটা আলাদা অস্তিত্ব তৈরি হল। দু—জনের মধ্যে ব্যবধান মনে মনে হয়তো এসে গেছে। সে ডাবল বেড খাটের দিকে তাকাল। মাথার বালিশদুটো আর পাশাপাশি নেই, এখন একটার উপর আর একটা। রীণা আলমারি থেকে বেডকভার বার করে তাকে দিয়েছে। বিছানায় পাতা প্লেইন সবুজটা দেয়নি, বালিশটাও দেয়নি। দেখতে না পেয়ে যদি রতন প্রশ্ন করে, বালিশ—বেডকভার গেল কোথায়?

এখন প্রতি পদে তাদের ভাবতে হচ্ছে রতন যেন কিছু সন্দেহ না করে। রতনের চোখে যেন না পড়ে।

রীণার ঝাঁট দেওয়া এক মিনিটেই শেষ। মেঝেয় জায়গা কোথায় যে ঝাঁটা বুলোবে। সে বালতিতে জল আর ন্যাতা নিয়ে এল। দু—তিনবার মুছল।

‘ঘরের প্রায় সব জিনিসগুলো ফেলে দেওয়া দরকার। কোনোটাই কাজে লাগে না অথচ রেখে দেওয়া হয়েছে।’ রাহুল বিরক্ত স্বরে বলল।

‘এসব তুমিই রেখেছ। তোরঙ্গটা কী দরকার ছিল রাখার। তুমিই বললে পুরোনো বই, ম্যাগাজিন ওর মধ্যে রেখে দাও। কিন্তু ওই বই—ম্যাগাজিনগুলোই বা রাখার কী দরকার? কেউ তো একবারও উলটেও দেখল না এতদিনে।… এসবই উঞ্ছ মানসিকতা।’ রীণার গলার স্বর উচ্চচগ্রামে উঠেছে। সভয়ে রাহুল হাতটা বাতাসে থাবড়ে থাবড়ে তাকে গলা নামাতে ইশারা করল।

জানালায় পর্দা ঝুলছে। অন্য বাড়ি থেকে দেখা যাবে না ঘরের মধ্যেটা। ট্রানজিস্টারটা কোথায়? টিভি কেনার পর রেডিয়ো আর শোনাই হয় না। ব্যাটারিও নিশ্চয় নিঃশেষ। তারা দু—জন কথা বলার সময় ট্রানজিস্টারটা চালিয়ে দিলে একটা ভয় থেকে রেহাই মিলবে।

‘আজই ট্রানজিস্টারের ব্যাটারি আনিয়ো, আর ধূপ।’

‘ধূপ কীজন্য?’

‘ঘরে বিশ্রী ভ্যাপসা একটা গন্ধ। ধূপ জ্বালালে তবু কিছুটা কমবে।’

‘ধূপের গন্ধ আর ধোঁয়া দরজার ফাঁক দিয়ে যখন এঘরে আসবে আর রতন ধরে নেবে নিশ্চয় আগুন—টাগুন ধরে গেছে আর তাই ভেবে তাড়াতাড়ি দরজা ঠেলে যখন ঢুকবে তখন তো ভূত দেখার মতো চিৎকার শুরু করবে।’

রাহুল অপ্রতিভ হয়ে প্রসঙ্গটা ঘোরাবার জন্য বলল, ‘ন্যাপথলিন কিনে এনো, গন্ধ হবে পোকামাকড়ও পালাবে।’

‘তুমি কি ওই ঘরে পাকাপোক্তভাবে বাস করার কথা ভাবছ নাকি!’ রীণা জিজ্ঞাসা করল না, শুধু সারাজীবনে যত বিস্ময় সে সঞ্চয় করেছে, সেগুলো একসঙ্গে প্রকাশ করল তার গলা দিয়ে।

রাহুল জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল। কারণ সে নিজেও এখন পর্যন্ত জানে না, সে কী করবে। শুধু জানে, তাকে বাঁচতে হবে।

‘এভাবে কতদিন লুকিয়ে থাকবে?’

‘যতদিন সম্ভব…যতদিন—’

সদর দরজার কলিং বেল বেজে উঠল। কথা অসমাপ্ত রেখে, রাহুল ছিটকে তার কুঠুরিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করল, ভিতর থেকে খিল বা ছিটকিনি নেই। সে দরজায় পিঠ দিয়ে পা ছড়িয়ে বসল।

খবরের কাগজে যা কিছু বেরিয়েছে রাহুল তা পড়েছে। মেয়েটার বাড়ি রানাঘাটে। রোজই কলকাতায় আসত ‘দেহ বিক্রয় করে’ রোজগারের জন্য। বয়স পঁচিশ। নাম ছবি। তাকে নিয়ে রাত আটটা নাগাদ জনা চারেক লোককে অন্ধকার মাঠের দিকে হেঁটে যেতে দেখা গেছিল বলে এক স্থানীয় চা—ওয়ালা জানায়। ওই মাঠে লোকগুলি ছবিকে পরপর ধর্ষণ করার পর তাকে গলা টিপে মারে। ছবির দেহে অলংকার বা তার হাতব্যাগে টাকা পাওয়া যায়নি। মনে হয় গহনা বা টাকার জন্যই তাকে খুন করা হয়েছে। ধর্ষণকারীদের মধ্যে একজনকে মৃত অবস্থায় কাছেই পাওয়া যায়।

তাকে বাঁশ দিয়ে মাথায় মেরে খুন করা হয়। পুলিশের অনুমান এই খুন গহনা বা টাকার ভাগ নিয়ে বিবাদেরই ফল। নিহত ব্যক্তির নাম শ্যামল, সে ঘটনাস্থলের আধমাইল দূরের শীতলাতলার বাসিন্দা। তার নামে কয়েকটি ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের মামলা আছে। আততায়ীরা কেউ ধরা পড়েনি, তবে পুলিশ জোর তল্লাশ চালাচ্ছে। তাদের ধরার মতো সূত্র পুলিশ পেয়েছে।

রাহুলকে ভাবিয়েছে ওই ‘ধরার মতো সূত্র’ কথাটা। সে কিছু কি ফেলে এসেছে মাঠে? কলম, রুমাল, ঘড়ি, জুতো, মানিব্যাগ, কাপড়ের টুকরো, মাথার চুল?…হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ? হ্যাঁ বাঁশের খোঁটাটায় হাতের ছাপ থাকতে পারে, কিন্তু তারপরই তো জোরে বৃষ্টি নেমেছিল। হাতের বা পায়ের ছাপটাপ কি আর তাতে ধুয়ে যায়নি? তা ছাড়া কিছুই তো সে ফেলে আসেনি?

চা—ওয়ালাটা কি শুনছে, কি দেখেছে? ওই লোকটাই ‘সূত্র’ হতে পারে। রাহুল বুঝতে পারছে না, লোকটা তাকে চেনে কি না। অনেক লোকই শর্টকাট করার জন্য মাঠের পথটা ধরে। চা—ওয়ালা সবাইকে কি চিনে রেখেছে? সেও তো ভালো করে মুখটা কখনো দেখেনি, কখনো ওর দোকান থেকে চাও খায়নি। ওর কাছ থেকে পুলিশ কি জানতে পারবে?

আরও দুটো লোক ছিল যারা ছুটে পালায়। তাদের কেউ ধরা পড়েনি। শ্যামলের মতো লোকের সঙ্গী যখন নিশ্চয় ওরাও ডাকাতি—ছিনতাই করে। ওরা দু—জন ছবিকে খুন করেনি, কেননা ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে ছবির চিৎকার করার সময় ওরা দূরে ছিল। ছবির কাছে ছিল শ্যামল, সেই গলা টিপেছে। অন্য দু—জন তখন ছুটে পালাবার সময় জানতও না শ্যামল ছবিকে খুন করছে এবং সে নিজেও দ্বিতীয় এক আততায়ীর হাতে খুন হতে চলেছে। লোকদুটো তাকে দেখেছে। হয়তো শ্যামলের মতো ওরাও আধ মাইলের মধ্যেই বাস করে। ওরা তাকে দেখলে চিনতে পারবে কি না সে বিষয়ে রাহুলের সন্দেহ আছে। আলো যথেষ্টই কম ছিল। কিন্তু শ্যামলের খুনি যে তারা দু—জন নয়, এই কথাটা বলার জন্য ওরা কি পুলিশের কাছে যাবে?

মোটেই নয়। এরা হার্ডকোর ক্রিমিনাল। একটা সেক্সবেচুনি মফস্সলের গরিব মেয়েকে ঠকাবে এবং লুঠও করবে স্থির করেই তাকে ওরা এনেছিল। মেয়েটা চেঁচাতে এবং তার এসে পড়াতেই গলাটা টিপে দিয়েছে। সে এসে পড়েছিল বলেই রাহুলের বিশ্বাস, ছবি মরল। না হলে… তা হলেও বোধ হয় মরত। এদেরই হাতে কিংবা এইডসে কিংবা… এত রকমে মরা যায় যে রাহুল এই নিয়ে আর ভাবতে চায় না।

তবে ছবির টাকা—গহনার ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে… এটা মনে পড়লেই রাহুলের হো হো করে হেসে ওঠার ইচ্ছে হয়। সোনাদানা গায়ে দিয়ে রানাঘাট থেকে কেউ কি এই ব্যবসা করতে আসে? আর ‘বিবাদ’ যে হয়েছে এটাই বা পুলিশ বুঝল কী করে! সোজা ব্যাপারটাকে জটিল করে না তুলতে পারলে বোধ হয়, বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া যায় না।

কিন্তু সূত্র ধরে পুলিশ এই ফ্ল্যাটে এসেছিল, রীণার সঙ্গে কথা বলে গেছে। ওরা জানল কী করে? কী কথাবার্তা হয়েছে, রীণা তা বলতে চায়নি। স্কুল থেকে ফিরলে ওকে চেপে ধরতে হবে। কথা বলার সুযোগ রতন জেগে থাকা পর্যন্ত পাওয়া যাবে না। রতন না থাকলে এই কুঠুরিতে অন্ধকারে বসে তাকে ভেপসে মরতে হত না। এখন তা হলে সে শোবার ঘরে পাখার হাওয়ার নীচে হাত—পা ছড়িয়ে খাটে শুয়ে থাকতে পারত।

রতনটাকে কি বিদায় করা যায় না?

চিন্তাটা আসা মাত্র সে কুঁকড়ে গেল। এতকাল ধরে যে করুণা, মায়া সে এই বৃদ্ধটি সম্পর্কে পোষণ করে এসেছে সেটা কখন যেন নিজের স্বার্থের, দৈহিক নিরাপত্তার প্রশ্নে উবে গেছে। রাহুল অপ্রতিভ বোধ করল নিজের কাছেই। মহৎ, সৎ অনুভবগুলো দেখছি এই একটা জিনিসের কাছে জব্দ—নিজের প্রাণ নিয়ে যখন প্রশ্নটা ওঠে। অস্বাভাবিক কিছু নয়, পৃথিবীর সব মানুষের কাছে এটাই রক্ষা করার তালিকায় এক নম্বরে।

রীণা স্কুল থেকে ফিরল ক—টার সময় রাহুল সেটা তার হাতঘড়ি থেকে বুঝতে পারল না। দম না দেওয়ায় ঘড়িটা বন্ধ। তবে সামনের বাড়ির ঝিয়ের গলা থেকে আন্দাজ করল চারটে বেজে গেছে। স্কুলের মিটিং ছিল এগারোটায়। এতক্ষণ ধরে কি গার্জেনরা বসে থেকেছে!

রাহুল কুঁজো থেকে গ্লাসে জল গড়িয়ে খেল। বসবাসের জন্য ঘরের এটাই নতুন উপকরণ। একটা চিনেমাটির প্লেট অবশ্য রয়েছে কিন্তু ওটা বার করে দিতে হবে। রীণা ভাত খেতে বসে রতনকে বাথরুমে পাঠিয়েছিল, সাবানজলে ভিজিয়ে রাখা বালিশের ওয়াড়গুলো কাচতে। ডাইনিং স্পেশ অর্থাৎ দালান থেকে শোবার ঘরের দরজায় ভাতের প্লেট, তাতে ডাল—তরকারি—মাছ ঢেলে একটা অদ্ভুত খাদ্য বানিয়ে, রীণার পৌঁছতে দশ সেকেন্ডও লাগেনি।

শিকল খুলে দরজার পাল্লা ফাঁক করে, প্লেটটা মেঝেয় রেখে ঠেলে দিয়েছিল। কোনো কথা না বলে দ্রুত দরজা বন্ধ করে শিকলটা আবার তুলে দেয়। রাহুল খুব তৃপ্তিভরে প্লেটটা শেষ করেছিল। ঘোঁট পাকানো খাদ্য খেতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি।

রীণা খাটে বালিশে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে। স্কুলের শাড়িটা বদলায়নি। একদৃষ্টে সে ছোটো ঘরের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে কী ভাবছে। রতন বাইরে থেকে কী জিজ্ঞাসা করল, রীণা মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘টেবিলেই থাক, দরকারি জিনিস। তুমি হাত দিয়ো না।’ তারপর কী ভেবে উঠে ঘরের বাইরে গেল আর ফিরে এল খবরের কাগজে মোড়া দড়িবাঁধা একটা প্যাকেট হাতে। সেটা ছোটো টেবিলের উপর রেখে লেখার প্যাড আর কলম নিয়ে খাটে উপুড় হয়ে লিখতে শুরু করল।

জোড়ের ফাঁক দিয়ে রাহুলের মনে হল সে যেন থিয়েটার দেখছে। রীণা জানে সে এই ঘরে যা কিছু করুক বা বলুক, সবসময়ই তার একজন দর্শক আছে। হোক না স্বামী, আড়াল থেকে কেউ সদাসর্বদা লক্ষ করতে থাকলে সেও আড়ষ্ট হয়ে যাবে। এক ধরনের নজরবন্দি দশার মধ্যে থাকতে থাকতে ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। রাহুল এটা অনুভব করতে পারলেও, নিরুপায়।

যদি রতন না থাকত, তা হলে কত স্বচ্ছন্দে রীণা এই দরজাটা খুলে রেখে তার কাজকর্ম করতে পারত! রতনকে বিদায় করা দরকার।

একটা চিঠি লিখল রীণা। কাগজটা ভাঁজ করে সে ঘরের বাইরে গেল। রতনের সঙ্গে কথা বলছে। কী চিঠি? কাকে চিঠি?

‘চা আমি করে নিচ্ছি। তুমি আগে এটা দিয়ে এসো।’

মিনিট পাঁচেক পর সদর দরজা খোলার ও বন্ধের শব্দ হল। গ্লাসে চা নিয়ে রীণা ঘরে ঢুকল। শিকল খুলল।

‘জানালার পর্দা।’

‘টেনে দিয়েছি।’

রাহুল বেরিয়ে এসে চায়ের গ্লাস নিল। খাটে বসল। রীণা নিজের চায়ের কাপ নিয়ে এসে প্যাকেটটা খুলছে।

পাউরুটি, বিস্কুটের প্যাকেট, জেলির শিশি! রাহুল জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।

‘সবসময় তো খাবারদাবার দিতে পারব না… এগুলোই তখন খেয়ো।’

‘ভালোই করেছ।’

‘হাতে করে আসার সময় ভয় করছিল।’ শাড়ি খুলতে খুলতে রীণা পিছন ফিরে দাঁড়াল।

‘ভয়! কীজন্য?’ রাহুল বিস্কুটের প্যাকেট ছিঁড়ে একটা বার করল।

‘পুলিশের ওয়াচ তো নিশ্চয় আছে। হাতে এত খাবার নিয়ে যেতে দেখে সন্দেহ করতে পারে।’

‘এসব জিনিস তো সব পরিবারেই প্রায় দরকার হয়, এতে সন্দেহ করার কী আছে!’

‘কিছুই নেই, কিন্তু এখন আমাকে সর্ব ব্যাপারে ভয়ে ভয়ে থাকতে হচ্ছে। চলাফেরা, কথা বলা, কেনাকাটাতেও পর্যন্ত। নতুন কুঁজো কিনতে দিতে পারিনি, যদি কেউ মনে করে হঠাৎ এখনই কিনা পুরোনোটা ভাঙল! তোমার দুটো প্যান্ট লন্ড্রিতে রয়েছে, আনতে পারছি না।… অদ্ভুত একটা কমপ্লেক্স তৈরি হচ্ছে, কিছুই আর স্বাভাবিকভাবে করতে পারছি না। বাইরে বেরোতেই মনে হয়, কেউ যেন লক্ষ করছে, ফলো করছে।’

শাড়ি পরা হয়ে গেছে। রাহুল দ্বিতীয় বিস্কুট দাঁতে ভাঙল। প্যাকেটটা রীণার দিকে বাড়িয়ে ধরল। একটা তুলে নিয়ে সে কাপে চুমুক দিয়ে রাহুলের পাশে বসল। দু—জনে কিছুক্ষণ নিজেদের চিন্তায় ডুবে গেল।

‘রতনকে কোথায় পাঠালে!’

‘নন্দিতার কাছে। আজ এগারো দিন স্কুলে আসছে না, পা ভেঙে পড়ে আছে। কিন্তু সেজন্য নয়… পরশুর আগের দিন খবর পাঠিয়েছিল, ওর হাতে কাজের লোক আছে, অল্পবয়সি, বিবাহিতা, দেশ থেকে সবে এসেছে। পাঠিয়ে দেবে কিনা জানতে চেয়েছে।’

‘কী লিখলে!’ রাহুল উৎকণ্ঠিত হয়ে জানতে চাইল। ‘রতনটা খুব অসুবিধে করছে।’

রীণা একটু অবাক হয়েই বলল, ‘রতনকে ছাড়াতে বললে তুমিই তো আপত্তি করতে… ‘যাক বুড়ো মানুষ, এই বয়সে যাবে কোথায়, কে ওকে কাজ দেবে’ এইসব বলে তো আমাকে বোঝাতে! এখন বলছ অসুবিধা করছে?’

‘হ্যাঁ বোঝাতাম। তখন অবস্থাটা অন্যরকম ছিল।’

‘কার অবস্থা? আমার, এই সংসারের…না রতনের?’

‘আমার অসুবিধেটা কি একটা গুরুত্ব পাবার মতো ব্যাপার নয়?’

‘কিন্তু এখন রতনকে নিয়ে আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না, আর এটাও আমার কাছে এখন খুব দরকারি ব্যাপার, কেননা আমাকেই এখন সবকিছু টানতে হবে। পাড়া—প্রতিবেশী, স্কুলের কলিগরা ছাড়া পুলিশও আছে। সবাই এখন আমায় এড়িয়ে চলছে। অনু… যে দিনে দু—বার অন্তত আসত, সে পর্যন্ত গত চারদিনে একবার এসেছে, তাও লুকিয়ে, তাও সীতাংশুর সঙ্গে দেখা করতে। এই যখন অবস্থা, হঠাৎ কাজের লোককে ছাড়িয়ে দিলে—’

‘কেউ সেটা অত তলিয়ে দেখতে যাবে না।’

‘যাবে কি যাবে না তা আমি জানি না, তুমিও জান না। ঘরে বসে থাকা এক জিনিস আর বাইরে সবকিছু ফেস করা আর এক জিনিস।’

‘বাইরেটা যে কী জিনিস তা আমি তোমার থেকে ভালোই জানি।’

‘হ্যাঁ জান। বাইরে গিয়ে কী ফেস করেছ, তা তো আর লোকের কাছে বলার মতো নয়।’

‘কী করেছি বাইরে?’

‘রেপ… মার্ডার। এর থেকে নোংরা, জঘন্য আর কিছু মানুষে করতে পারে?’

রীণা উঠে দাঁড়িয়েছে। চাহনিতে আগুন। দু—চোখের মণি ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। নাকের পাটা ফোলা। ঠোঁটদুটো ঘৃণায় অবজ্ঞায় দোমড়ানো। দেহটা শান্ত হয়ে ঈষৎ ঝোঁকানো।

রাহুল থম হয়ে শুধু স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘আমি রেপ করিনি…মেয়েটাকে স্পর্শ পর্যন্ত করিনি।’ ধীরে ধীরে দাঁত চেপে সে বলল। খুন করার কথাটা বলতে গিয়েও বলল না।

‘সাফাই গেয়ো না।’ রীণা চাপা গলায় ধমকে উঠল। ‘তুমি আমাকেও জড়িয়েছ তোমার পাপের সঙ্গে।’

‘তোমাকে জড়িয়েছি!’

‘একটা মার্ডারারকে সেল্টার দিলে আইন কি বউ বলে আমাকে ছেড়ে দেবে?’

রাহুল অবুঝ অবোধ শিশুর মতো রীণার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। যাকে দেখছে সে অন্য এক রীণা। একে সে চিনতে পারছে না।

‘নন্দিতাকে জানিয়ে দিলাম কাজের লোকের এখন দরকার নেই।’

রাহুল উঠে দাঁড়াল। শূন্য দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে ধীর পায়ে সে নিজের কুঠুরিতে ঢুকে গেল। দরজা বন্ধ করল।

একটু পরেই দরজার একটা পাল্লা ফাঁক হল। কাগজের প্যাকেট মেঝেয় নামিয়ে রেখে রীণা দরজা বন্ধ করল।

অনেকক্ষণ পর রাহুল পাল্লার জোড়ে চোখ রেখে দেখল বিছানায় উপুড় হয়ে রীণা, বোধ হয় কাঁদছে। সে বুঝতে পারছে, ওর মানসিক যন্ত্রণা। যে অবস্থার মধ্যে পড়েছে সেটা তারই তৈরি। রীণার সহ্যশক্তি যে এতখানি, রাহুল এখন তা অনুভব করছে। ভয় শুধু তো তার একারই নয়, রীণাকেও ভাগ নিতে হয়েছে। চাপের মধ্যে পড়েও বুদ্ধি হারায়নি। খুঁটিনাটি সাবধানতার দিকে হুঁশ রেখেছে। সবথেকে বড়ো কথা, তাকে সহ্য করছে। রেপ, মার্ডার… এইসব সত্ত্বেও তার প্রতি মমত্ববোধটা হারায়নি। ওর কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

মাঝরাতে রাহুল কুঠুরি থেকে বেরোল। বাথরুমে যাবে। অন্ধকার শোবার ঘরের মধ্য দিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছে তখন রীণা চাপা স্বরে বলে উঠল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’

‘বাথরুমে।…তুমি ঘুমোওনি?’

‘দাঁড়াও।’ রাহুলের প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে রীণা খাট থেকে নেমে এল। টর্চের আলো পড়ল মেঝেয়।

‘আমি আগে দেখি রতনকে। তারপর যেয়ো।’

সন্তর্পণে, সময় নিয়ে রীণা খিল নামাল। টর্চ জ্বেলে ডাইনিং—দালানটা দেখে এসে বলল, ‘যাও…বাঁদিক দিয়ে।’

বুড়ো মানুষটা কাত হয়ে হাঁটুমুড়ে অঘোরে। মুখ হাঁ হয়ে রয়েছে। কণ্ঠার আর পাঁজরের হাড়গুলো প্রকট। রাহুল তার পাশ দিয়ে পা টিপে বাথরুমের দরজায় পৌঁছাতেই রীণা টর্চ নিভিয়ে ফেলল।

রাহুল যখন বেরিয়ে এল রীণা তখনও দালানে দাঁড়িয়ে। টর্চ জ্বেলে পথ দেখাল। আসার সময় থমকে, রাহুল বারান্দার পাঁচিল থেকে ঝুঁকে দু—ধারে তাকিয়েছিল। রীণা মুখে শব্দ করে উঠতেই তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসে। দরজা বন্ধ করে রীণা খিল এঁটে দিল।

‘রাত্তিরে অনেকেরই ঘুম হয় না, জানালা কি বারান্দায় দাঁড়ায়।’ রীণা চাপা গলায় বলল।

‘তুমিও ঘুমোওনি।’ রাহুল মৃদু শান্তস্বরে, অন্ধকার মূর্তির মতো রীণাকে লক্ষ করে বলল। ‘আমার জন্য তোমায় ভাবতে হবে না, শুয়ে পড়ো…মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ঘুম এসে যাবে।’

‘না।’ রীণা খাটে উঠল। বালিশটা সামান্য সরিয়ে শোবার উদ্যোগ করে বলল, ‘যাও, শুয়ে পড়ো তুমি।’

‘যাচ্ছি।’ কিন্তু রাহুল বসেই রইল। রীণা বিছানায় ছড়িয়ে দিল দেহভার। কিছুক্ষণ তারা কথা বলল না।

রাহুল ঝুঁকে বাঁ কনুইয়ে ভর দেখে রীণার মুখের কাছে মুখ আনল। ‘তুমি খুব ক্লান্ত।’

রীণা চুপ। রাহুল ডান হাতের তালু ওর কপালে রাখল।

‘ঘুমোবার চেষ্টা কর।’ রাহুলের তালু অত্যন্ত কোমলভাবে রীণার কপাল থেকে গালে, চিবুকে, নাকে, ঠোঁটে মন্থর গতিতে সঞ্চরণ করতে লাগল। রীণা প্রত্যাখ্যান করছে না, তালুটা গলা বেয়ে কাঁধের প্রান্তে পৌঁছল। রীণা ব্লাউজ খুলে রাত্রে শোয়।

‘থাক।’ একসময় রাহুলের হাতটা চেপে ধরল রীণা। ‘এবার শুতে যাও।’

‘আর একটু।…তোমার ভালো লাগবে। তুমি অত্যন্ত টেনসড হয়ে রয়েছ, এবার আলগা হও। নার্ভগুলো এলিয়ে পড়ুক।’

রীণা প্রতিবাদ জানাল না। শুধু মুখ থেকে একটা ক্ষীণ শব্দ বেরিয়ে এল। রাহুলের মনে হল, তার কথাগুলোকে সমর্থন করেই যেন রীণার দেহটা শিথিল হয়ে আসছে। বহুদিন, বহু মাস হয়ে গেল এমন যত্নে সে রীণার শরীরে হাত দেয়নি। এত মায়া, মমতা নিয়ে ওর বুকে হাত বুলোয়নি।

রাহুল ঝুঁকে রীণার কপালে ঠোঁট রাখল। তারপর চোখের উপর এবং ওষ্ঠে। ধীরে ধীরে সে বিছানায় রীণার পাশে নিজেকে বিছিয়ে দিল। চুম্বনকে ক্রমশ গাঢ় এবং তীব্র করে তুলল।

‘এবার যাও।’ রীণার স্বরে দুশ্চিন্তার আভাস। ‘বহুদিন এত ভালো লাগেনি তোমাকে চুমু খেয়ে।…তোমার কষ্ট, তোমার দুঃখ,…বেদনা অনুভব না করলে বোধ হয় এই ভালো লাগাটা পেতাম না।’ রাহুল কথাগুলো বলল রীণার অনাবৃত বুকের মাঝে মুখ চেপে রেখে। তার মনে হল রীণার হৃৎস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল।

‘রীণা আমি এভাবে বন্দি হতাম না, চার দেওয়ালের ওই কুঠুরিটায় আমি ঢুকতাম না, যদি মেয়েটার চিৎকার শুনে থমকে না দাঁড়াতাম। আমি তো অগ্রাহ্য করে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে যা হচ্ছে হোক গে আমার কী, এমন একটা ভাব করে নাও তো দাঁড়াতে পারতাম। কিন্তু দাঁড়ালাম কেন?’

রীণার শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়ে আসছে। যেন দম বন্ধ রেখে অপেক্ষায় থাকবে উত্তর শোনার জন্য। রাহুল মুখ তুলে বলল, ‘আমি শুধু এইটাই ভেবেছি এই ক—দিন ধরে। উত্তর পাইনি।…মানুষ বিপদে এগিয়ে যায় কেন? তুমি কি এর উত্তর জান?’

‘না।’ ক্ষীণস্বরে জবাব এল। রাহুল জানে এই শব্দটি ছাড়া রীণার পক্ষে আর কিছু বলা সম্ভব হবে না।

‘বহু লোক অন্যকে বিপদের মধ্যে দেখে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে চলে যায়, কেন যায় জান?’

‘না।’

‘আমাদের সম্পর্কটা আগের মতো রাখা সম্ভব হবে কি?’

রীণা নিরুত্তর রইল। রাহুল হঠাৎই তীব্র একটা আবেগে আচ্ছন্ন হতে শুরু করল। সে রীণার দুই ঠোঁট মুখের মধ্যে ভরে দাঁত দিয়ে চাপ দিল। তারপর নিজেকে টেনে রীণার দেহের উপর তুলল।

‘না, না…অসম্ভব।’

‘কেন অসম্ভব?’ রাহুল প্রশ্নের মতো স্বরে দাবি জানাল। বহুদিন পর সে কামনার প্রবল সাড়া দেহে পেয়েছে। এটা সে নষ্ট হতে দেবে না। এখন খুবই অনিশ্চিত তার ভবিষ্যৎ। কে জানে এটাই হয়তো তার শেষবার!

‘রাহুল না, সম্ভব নয়…আমি পিল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি। কিছু হয়ে গেলে আর মুখ দেখাতে পারব না।’

এরপরই রাহুল এমন একটা কথা বলে ফেলল যেটা বলার জন্য সে পর মুহূর্তেই অনুতাপ করেছে।

‘কিছু হবে না তোমার। অনেক আগেই ডাক্তার দিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়েছি, আমার কখনো সন্তান হবে না।’

রীণার চাপা আর্তনাদটা রাহুলের মুখের উপর এমন জোরে আঘাত করল যে তার মুখ অসাড় হয়ে গেল।

‘লুকিয়ে রেখেছিলে! কিন্তু আমি যে চাই… একটা অন্তত।’ রীণার বুকভাঙা স্বরে রাহুল যেন ছবির শেষবারের চিৎকারটার রেশ শুনতে পেল। ধীরে ধীরে সে বুকের উপর থেকে নেমে এল।

দু—হাতে রীণা মুখ ঢেকেছে। অন্ধকার ঘর। রাহুলের মুখ দেখবে না বলে কিংবা তার নিজের মুখ না দেখানোর জন্য বা শোকের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি এটাই। রাহুল ভাবল, খবরটা কেন ওকে জানাতে গেলাম? এটা কী এমন জরুরি, অবশ্য দরকারি ব্যাপার যে আজ রাতেই…ধৈর্য, সংযম, অপেক্ষা কি করা যেত না? শরীরের তাড়নায় যুক্তি, বুদ্ধি হারানো এমন অন্ধত্ব তাকে পেয়ে বসল কেন? তা হলে ওই লোকগুলোর সঙ্গে তার তফাত কোথায়?

খাট থেকে নেমে রাহুল নিজের কুঠুরিতে ফিরে এল। নিজহাতে দরজা বন্ধ করল। পা ছড়িয়ে বসে প্রথমেই তার মনে হল, বাঁশের খোঁটা হাতে নিয়ে কেউ একজন এবার তার দিকে এগিয়ে আসবে। কবে আসবে তা সে জানে না।

বেডকভারটা টেনে আনার জন্য সে হাত বাড়াতেই হাতুড়িটা হাতে ঠেকল।

রতনের দাঁতে যন্ত্রণা হয়। দাঁতটা তুলে ফেলে দিতেই হবে। রীণা বলেছিল, টাকা দিচ্ছি ডাক্তারের কাছে গিয়ে তুলিয়ে ফেল। রতনের আপত্তি টাকা খরচ করায়। সে জানতে পেরেছে, ঠিকে ঝি কমলের মা একই যন্ত্রণায় ভুগছে এবং ডেন্টাল হসপিটালে গিয়ে দাঁত তুলিয়ে আসবে। রতন অতঃপর কমলের মা—র সঙ্গে ব্যবস্থা করে ফেলে, সেও ওর সঙ্গে যাবে দাঁত তোলাতে।

এসব কথা রাহুল জানল যখন রীণা রাত্রে তাকে বলল, ‘রতন কাল সকালেই দাঁত তোলাতে যাবে। ফিরবে কখন ঠিক নেই, হয়তো দুপুরে আসবে।’

‘তা হলে কে ওকে দরজা খুলে দেবে? তুমি তো সাড়ে ন—টায় বেরোবে!’

‘বাইরে তালা দিয়ে চাবিটা অনুর কাছে রেখে যাব, রতন এসে চেয়ে নেবে।’

সকালে ঘুম ভাঙতেই রাহুলের প্রথমেই মনে হল, রতন আছে না বেরিয়ে গেছে? অন্যান্য দিনেও রতন বেরোয় দুধ আনতে। তারপর বাজারে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসে। আজ রতন টানা অনেকক্ষণ বাইরে থাকবে। হাসপাতালটা কাছে নয় আর বিনি পয়সায় চিকিৎসা করাতে হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। রাহুল ধরে নিল, দুপুর পর্যন্ত সে এই ফ্ল্যাটে স্বাধীনভাবে থাকছে।

দরজা খুলে রীণা বলল, ‘রতন দাঁত তোলাতে চলে গেছে। বাথরুমে যেতে পার।’

রাহুল শোবার ঘরের দরজা থেকে হামা দিয়ে বাথরুমে গেল। এইভাবে যাওয়াটা এখন তার স্বাভাবিক হয়ে গেছে। রীণাও আর তাকে লক্ষ করে না তবে ওই সময়টায় সে পাশের বাড়ির দিকে চোখ রাখে, তারপর হাত নেড়ে তাকে এগোবার জন্য ইশারা করে। ততক্ষণ রাহুল মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে রীণার দিকে। শুধু এই সময়টুকু সে নিজেকে একটু অন্যরকম ভাবে। করুণাপ্রার্থী একটা অসহায় জন্তু, রীণা তার মনিব।

স্বামী—স্ত্রী সম্পর্কটা এই সময়টুকুতে আর থাকে না। তার লেখাপড়া, ব্যায়াম করা, শিক্ষা, রুচি, কান্তি, বিত্ত সব নিশ্চিহ্ন হয়ে সে একটা চতুষ্পদ ছাড়া নিজেকে আর কিছু মনে করতে পারে না।

রীণা সেদিন রাত্রের পর থেকে নিস্পৃহ, আচরণে আবেগবর্জিত কর্তব্যে যথাযথ। রাহুল খবরের কাগজ চোখের সামনে রেখে কান রাখল দালানে। রীণা রান্নাঘরে আর দালানে কাজের জন্য চলাফেরা করছে, মাঝে একবার ঘরেও এল। কলকাতার সকাল তার নিজস্ব শব্দ তৈরি করে যাচ্ছে। সূর্যের আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে প্রতিদিনের মতো অভ্যস্ত জায়গায় পড়েছে।

রাহুলের চোখ ঘরের চারদিকটা ঘুরে এল। ঘরটা একই রকম রয়েছে এখনও। অধিকাংশ আসবাব তার পছন্দেই কেনা। রীণা চেয়েছিল রাবার—ফোম গদির খাট। শিরদাঁড়ার নানান ব্যাধির ভয় দেখিয়ে সে তুলোর গদি আর তোশকের খাট কেনে। প্রত্যেকটা আসবাবই তার জীবনের পটভূমির এক—একটা অংশ। একদিন আর তা থাকবে না। রীণা একার রোজগারে হয়তো চালাতে পারবে না। তখন কি টিভি, রেডিয়ো, খাট, ফ্রিজ বিক্রি করে দেবে?

রীণা স্নান করে ভাত খেল, স্কুলে যাবার জন্য শাড়ি পরল। থালা হাতে ঘরে ঢুকে বলল, ‘তোমার ভাত এই টেবলে রেখে যাচ্ছি, রতন আসার আগেই তোমার ঘরে তুলে নিয়ে যেয়ো।…চাবিটা অনুর কাছে দিয়ে যাচ্ছি।’

রাহুল কাগজে চোখ রেখে মাথা নাড়িয়ে একটা শব্দ করল। সে জানে রীণা কথাটা বলেই ঘুরে দরজার দিকে এগিয়ে গেছে। তার মাথা নাড়া দেখার জন্য সময় দিতে ইচ্ছুক নয়।

রীণা চলে যাবার পর আধঘণ্টা কি তারও বেশি সময় কেটে গেছে, হিসেবটা রাহুল আর করার দরকারবোধ করেনি। এখন তার কাছে সময়ের কোনো দাম বা দরকার নেই। সে পাখার গতি বাড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে। তন্দ্রা মাঝে মাঝে চেতনাকে ঢেকে দিচ্ছে। তবু জেগে থাকার চেষ্টা করছে। রতন এসে যেন তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় না দেখে ফেলে।

হঠাৎ তার মনে হল সদর দরজায় তালা খোলার শব্দ হল। স্প্রিংয়ের মতো বিছানায় উঠে বসল। শোবার ঘরের দরজাটা খোলাই। দরজায় খিল আঁটার শব্দ শুনতে তার ভুল হল না। সে দু—লাফে কুঠুরিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। জোড়ের ফাঁকে চোখ রেখে সে অপেক্ষা করতে লাগল। এত তাড়াতাড়ি রতন ফিরে এল!

ঘরে ঢুকল অনু। প্রথমেই তাকাল ঘুরন্ত পাখার দিকে। হাসল। রাহুল খুবই অবাক হয়ে যায় ওকে দেখে। কেউ চাবি গচ্ছিত রেখে গেলেই কি তালা খুলে তার ঘরে এভাবে আসা উচিত! কিন্তু পাখার দিকে হাসাটা দেখেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। নিশ্চয় মনে মনে প্রশ্ন তুলবে, কেন ঘুরছিল, কে হাওয়া খাচ্ছিল, সে তা হলে গেল কোথায়? ওই দরজা বন্ধ ঘরটায় কী?

অনু পাখার সুইচ বন্ধ করে, পা টিপে জানালার কাছে গেল। পর্দা সরিয়ে বাইরে দু—ধারে, উপরে সন্তর্পণে নজর বোলাল। তারপর শাড়ির আঁচল বার করে কয়েকবার নাড়ল। দু—পা পিছিয়ে এসে অনু দাঁতে আঙুল চেপে জানালার দিকে তাকিয়ে কী ভাবতে লাগল। রাহুল দেখল মেয়েটির গৌরবর্ণ মুখ লাল হয়ে উঠেছে, কপালে ঘাম ফুটেছে, আর দু—চোখে জ্বলজ্বলে অস্বাভাবিক চাহনি।

অনু ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কী ব্যাপার? আঁচল নেড়ে কী করল! কাউকে ইশারা? সংকেত জানাল?…উদ্দেশ্য? অনু কি চলে গেল, নাকি ফিরে আসবে! পাখাটা বন্ধ করার সময় ও কী ভেবেছিল?

আবার খিল তোলার শব্দ। অনু বেরিয়ে যাচ্ছে তা হলে। রাহুল দরজাটা ফাঁক করল আর সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিল। চাপা গলায় কে কথা বলল।

সীতাংশু ঢুকল, পিছনে অনু। উত্তেজনায় টসটসে দু—জনের মুখ। কথা না বলে ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ পর ওরা হাসল।

‘তুমি এমনভাবে দোকানে ঢুকলে, মুখ দেখে মনে হচ্ছিল কী যেন ঘটেছে!’

‘চাকরটা দুপুরের মধ্যেই ফিরবে, তাই ছুটতে ছুটতে গেছি।’

‘দাদা কিন্তু ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই দোকানে আসবে…কর্মচারীদের হাতে দোকান ফেলে বেরিয়েছি শুনলে ভীষণ রেগে যাবে।’

‘যাবে তো যাবে। আমার জন্য বকুনি খেতে পারবে না?’

সীতাংশু একগাল হাসল। অনুকে বুকে টেনে নিয়ে চুমু খেতে গিয়ে জানালার দিকে তাকাল।

‘বাইরে থেকে দেখা যায়।’

‘পর্দা টানা আছে তো।’

‘তা হলেও…বন্ধ করে দি।’ সীতাংশু আর অনু জোড়ের ফাঁক থেকে সরে গেল। দুই ধাপে ঘর অন্ধকার হল। দরজা দিয়ে যতটা আলো আসা উচিত, আসছে না, রীণার টাঙানো শাড়িতে বাধা পেয়ে। ওদের আর রাহুল দেখতে পাচ্ছে না।

‘কেউ এসে পড়বে না তো?’

‘দরজায় খিল দেওয়া।’

‘তবু যদি কেউ এসে পড়ে!’ সীতাংশুর গলা।

‘তুমি বড্ড ভিতু।’ অনুর মিষ্টি ধমক।

কিছুক্ষণ পর সীতাংশুর গলা, ‘ভাত না খেয়েই স্কুলে গেছে।’

‘পাখাটাও নেভাতে ভুলে গেছিল।’

‘মাথার ঠিক নেই… এই বয়সে একা থাকা! বউদির কোমর—বুক—পেট দেখেছ কী দারুণ না?’

‘তোমার ছাড়া আমি আর কারোর দেখি না।’

কথা আর হচ্ছে না। রাহুলের চোখের পাতা দরজার কাঠে ঠেকে গেল। উপরে—নীচে জোড়ের নানান জায়গা থেকে সে দেখার চেষ্টা করল। দেখতে পাচ্ছে না দু—জনকে।

‘আমি অত বড়ো করে লিখি আর তুমি অতটুকু করে উত্তর দাও কেন?’ সীতাংশুর অনুযোগ।

‘আমাদের কি তোমাদের মতো অত বড়ো বাড়ি যে নিরিবিলিতে লেখার জায়গা পাব?’

আবার কথা বন্ধ হল। রাহুল আর দেখার চেষ্টা করল না। এখন তার শিরার মধ্য দিয়ে তরল আগুন শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। থরথরিয়ে হাঁটু কেঁপে উঠতেই সে উবু হয়ে বসে পড়ল। দু—হাতে ঊরু জড়িয়ে হাঁটু চেপে তার যন্ত্রণাটাকে দমিয়ে নিল।

‘না, খাটে নয়…বউদি এসে ঠিক বুঝতে পারবে।’

‘কী করে পারবে?’

‘বিছানায় পুরুষ মানুষ শুলে গন্ধ লেগে যায়।’

‘সব বাজে কথা।’

‘হ্যাঁ গো, পুরুষের গায়ের আলাদা গন্ধ আছে?’

‘তা হলে মেঝেয়…’

‘কিছু হবে না তো?…তা হলে কিন্তু গলায় দড়ি দিতে হবে।’

রাহুল বুঝতে পারল না ঘড়ঘড়ে চাপা স্বরে সীতাংশু কী বলল। সে শুনল শুধু অনুর গলা, ‘মহা শয়তান তুমি, আগে থাকতে ভেবে পকেটে করেই নিয়ে এসেছ…আগে বলো আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসবে না।’

‘না, বাসব না।’

‘গা ছুঁয়ে দিব্যি কর।’

‘কাউকে ভালোবাসব না, কোনোদিন নয়।’

‘যদি আমাদের বিয়ে না হয়?’

‘কেন হবে না! জাতটাত নিয়ে এখন আর কেউ অত আপত্তি করে না। আর যদি করে…বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে বিয়ে করব। তোমার জন্য কষ্ট স্বীকার করতে—।’

সীতাংশুর কথা শেষ হল না কেন? রাহুল জোড়ের ফাঁকে চোখ রেখে ওদের খুঁজতে লাগল। খাটের ওধারে মেঝেয় দু—জোড়া পা সে দেখতে পেল। পায়ের অবস্থান, নড়াচড়া দেখে সে জানতে পারছে দু—জনে কী করছে।

রাহুল হাঁটু গেড়ে মেঝেয় কপাল ঠেকিয়ে। সে সহ্য করতে পারছে না শোবার ঘরের ঘটনাটা। তার মনে হল, অনু যা করছে, সীতাংশু যা করছে, কিছুই এমন অন্যায় নয় যে তাকে দরজা খুলে বেরিয়ে ওদের ভয় পাওয়াতে হবে। তার অসহ্য লাগছে, এটা চোখের উপর ঘটছে কেন? এটা কি তার জন্য শাস্তি? বেচারারা জানে না, একজন তাদের দেখতে পাচ্ছে! এটা যদি ওরা জানতে পারে তা হলে কী মানসিক অবস্থার মধ্যে পড়বে? ভয়ে সিঁটিয়ে থাকবে ছেলেমেয়েদুটো!

ওদের কি ভয় দেখাব?

রাহুল এটা ভেবেই মেঝেয় মাথা ঠুকল। তার মন নোংরা হয়ে গেছে। ভয় দেখানোর মতো নীচ কাজ করার কথা সে ভাবতে পারল কী করে! বেশ তো আছে ওরা নিজেদের মতো ভালোবেসে। ওষুধের দোকানের মালিকের ছেলে, পাড়ার অর্ধশিক্ষিত মেয়ে। বিয়ে হতে পারে, নাও পারে! কিন্তু ওদের জীবনে এই মুহূর্তগুলো…রাহুলের মনে পড়ছে, তার জীবনেও এমন ধরনের মুহূর্ত বিয়ের আগে এসেছিল। কিন্তু তাই নিয়ে সে আর ভাবতে চায় না।

আবার সে দরজার ফাঁকে চোখ রাখল। সীতাংশুর গলা দু—হাতে জড়িয়ে ওর বুকে মাথা রেখে অনু কাঁদছে। সুখের কান্না?

‘আমি এবার যাই, দোকান ফেলে রেখে এসেছি।’

বুকে মুখ ঘষে অনু চোখের জল মুছল।

‘তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।’

রাহুলের মনে হল, পৃথিবীটা একই রয়ে গেছে শকুন্তলা, সীতার আমল থেকে।

‘আমারও কেউ নেই তুমি ছাড়া।’

‘বিয়ের কথাটা বাড়িতে তাড়াতাড়ি তুলো।’

‘তুলব।’

‘রাজি না হলে, আলাদা হয়ে যাবে তো?’

‘যাব।…এইবার যাই, দাদা আসার আগেই—’।

সীতাংশু বুক থেকে অনুকে সরিয়ে দিল। রাহুল হাসতে শুরু করল। ছেলেটা পারবে না, মেয়েটাও ছাড়বে না।

এবার ওরা বিদায় হোক এই ফ্ল্যাট থেকে।

‘আমি কিন্তু বিষ খাব যদি তোমাকে না পাই।’

‘না অনু তোমাকে মরতে দেব না, তাহলে আমিও—’

সীতাংশুর মুখ চেপে ধরল অনু। তারপর কামনাভরা তীব্র চুম্বন করতে করতে দু—জনে খাটের উপর পড়ল।

রাহুল চোখ সরিয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তার ছোটো জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।

একসময় ওরা দু—জন চলে গেল। একসময় রাহুল ঘর থেকে বেরিয়ে ভাত খেয়ে নিল। রতন ফিরে এল। রীণা ফিরল জ্বর নিয়ে। খাটে শুয়ে সে রতনের কাছ থেকে জেনে নিল হাসপাতালের ডাক্তার কী কী বলেছে। রতন প্রেসক্রিপসান দেখাল। ওষুধগুলো খেয়ে সাতদিন পর যেতে বলেছে, সবগুলো দাঁতই তুলে ফেলতে হবে।

রীণাকে ‘অনু—সীতাংশু’ ব্যাপারটা রাহুল বলল না। রীণা আলো নিভিয়ে শুয়ে রইল সারা সন্ধ্যাটা। রতন জানতে চাইল খাবে কি না।

‘তুমি এখানে ঢাকা দিয়ে রেখে যাও। রাতে খিদে পেলে খাব।’

রীণা খায়নি। রাতে শোবার ঘরের দরজায় সে খিল দিয়ে এখন শোয়। আজ কোনোক্রমে উঠে খিল দিল। রাহুল তখন কুঠুরি থেকে বেরোল।

‘কী হয়েছে?’ উদবিগ্ন হয়ে রাহুল জিজ্ঞাসা করল।

‘দুপুর থেকেই গা গরম লাগছিল। শরীরটা জ্বরজ্বর লাগছে…ক্রমশই যেন বাড়ছে। খুব ক্লান্ত—।’

‘থার্মোমিটার তো আর কেনা হয়নি?’

‘না।’

রীণার কপালে তালু রেখে রাহুল উদবেগবোধ করল। জ্বর অন্তত একশো দুই—তিন। ভাইরাস ইনফেকশনই বোধ হয়।

‘গায়ে ব্যথা?’

‘হ্যাঁ…ভীষণ।’

‘খাবে কিছু?’

‘না…খাবারটা তোমার জন্য, খেয়ে নাও।’

দুধ, সেঁকা পাউরুটি আর একটা বাটিতে পাতলা ডাল। রাহুল গোগ্রাসে খেয়ে নিল। এখন তার একটা কথাই মনে হচ্ছে, জ্বর বাড়লে রীণার খাওয়া—দাওয়া বন্ধ হবে। রতন নিশ্চয় তখন ওকে ডাল—ভাত—মাছ রেঁধে দেবে না। তখন কে তাকে লুকিয়ে ভাত বা রুটি খাওয়াবে!

‘কাল রতনকে দিয়ে ক্রোসিন বা নোভালজিন আনিয়ে খেয়ে নিয়ো।…আর দু—প্যাকেট বিস্কিট। একটা থার্মোমিটারও কিনতে দিয়ো।’

রাহুল তার কথার কোনো সাড়া না পেয়ে রীণার কপালে আবার তালু রাখল। বেহুঁশের মতো চিত হয়ে। শ্বাস—প্রশ্বাস খুবই ধীর। তার মনে হল, এখন মাথায় আইসব্যাগ দিলে জ্বর নামবে। কিন্তু ফ্রিজ থেকে বরফ বার করে, ব্যাগে ভরে কে মাথায় ধরবে? কাল সকালের আগে কিছু করা যাবে না। কিন্তু সকালেই বা করবে কে? রতনের নিশ্চয়ই ধারণা নেই এক্ষেত্রে কী করা দরকার। বড়োজোর হয়তো কপালে জলপটি দেবার কথা ভাবতে পারে। রীণা ওকে দিয়ে আইসব্যাগটি আলমারি থেকে বার করিয়ে, কী করতে হবে যদি বলে দেয়!

সে আলমারি খুলল। কাজ এগিয়ে রাখার জন্য টর্চ জ্বেলে কাপড়ের স্তূপ সরিয়ে আইসব্যাগটা বার করে টেবলে, চোখে পড়ার মতো জায়গায় রাখল। খাটে শোবে কি না, তাই নিয়ে সে দ্বিধায় পড়ল। যদিও ঘুমের মধ্যে সে নড়াচড়া করে না, তবু অসুস্থ মানুষের পাশে শুলে বীজাণু সংক্রমিত হতে পারে। দু—জনেই শুয়ে পড়লে ব্যাপারটা তখন বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে যাবে।

রাহুল মেঝেয় শুয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল দরজা ধাক্কানোর শব্দে। প্রথমে সে বিরক্ত হয়ে দরজার দিকে তাকাল। তারপরই উঠে দাঁড়াল বুকের মধ্যে বরফ নিয়ে।

‘বউদি দরজা খুলুন… অ বউদি।’ রতনের উৎকণ্ঠিত চিৎকারের সঙ্গে দরজায় অধৈর্য করাঘাতও চলেছে।

রাহুল খাটে শোওয়া রীণার দিকে তাকাল। চোখ মেলে দিশাহারার মতো তাকাচ্ছে। ওঠার ক্ষমতা নেই। রাহুল বাইরে রতনকে আশ্বস্ত করার জন্য মেঝেয় রাখা থালা—বাটিতে পা দিয়ে ধাক্কা দিল। এতে কাজ হল। করাঘাত বন্ধ করে গলা নামিয়ে রতন বলল, ‘বউদি দেখে পা ফেলুন।’

রীণাকে দু—হাতে প্রায় হিঁচড়ে রাহুল খাট থেকে নামাল। শাড়ি খুলে কোমর থেকে ঝুলছে। চুল আলুথালু। তাকে টেনে নিয়ে সে দরজার কাছে দাঁড় করাল। খিলটা ধীরে ধীরে তুলে, টলে পড়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় থাকা রীণার একটা হাত খিলের উপর রেখেই রাহুল ছুটে কুঠুরিতে এসে দরজা বন্ধ করল।

সে একই সঙ্গে রীণার এবং খিলটা খুলে পড়ে যাওয়ার শব্দ পেল।

‘দেখছ কাণ্ড! এমন বেহুঁশ জ্বর নিয়ে উঠে আসা…আর খিল দিয়ো না দরজায়।…উঠতে পারবে?’

জোড়ের ফাঁকে চোখ দিয়ে রাহুল বাকিটা দেখল। বুড়ো রতন দু—হাতে রীণাকে বগলের নীচ থেকে জড়িয়ে টেনে দাঁড় করাল। শাড়িটা খুলে পড়ে গেল। ব্লাউজের দুটো হুক খুলে গেছে। হাত বাড়িয়ে কোনোক্রমে রীণা খাট পর্যন্ত পৌঁছে খাটে উপুড় হয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ বেরোচ্ছে। দুটো পা ধরে রতন রীণাকে খাটে তুলে শুইয়ে দিল। মাথার নীচে বালিশ রাখল। ব্লাউজের হুক লাগাবার জন্য ঝুঁকে পড়ল এবং চেষ্টা করতে করতে সফল হল। শাড়িটা যথাসম্ভব বিছিয়ে দিল গলা থেকে গোড়ালি পর্যন্ত। এত কিছু করার সময়, রাহুল লক্ষ করল, রতনের মুখে মমতা আর স্নেহ টলটল করছিল।

এইবার সমস্যায় পড়ল রতন। এখন সে কী করবে? রাহুল ভাবল, আমি হলে কী করব? প্রথম কাজ দৌড়ে ডাক্তার ডেকে আনা। রতনের হাতে টাকা নেই। রীণার হাতব্যাগে পঞ্চাশ—ষাট টাকা থাকেই। রতন নিশ্চয় তা জানে।… আর নয়তো কাউকে ডেকে আনা।

চিন্তিত মুখে ঘর থেকে রতন বেরিয়ে গেল। সদর দরজা খোলার শব্দ হল। রতন যাচ্ছে কোথায়? উপরের গৌতমবাবুর কাছে? রাহুল অপেক্ষা করতে লাগল। শোবার ঘরে দীর্ঘশ্বাসের মতো কাতর শব্দে রীণা বুঝিয়ে দিচ্ছে সে এখন যন্ত্রণার মধ্যে রয়েছে।

রতন ফিরল, সঙ্গে অনু। কপালে, গলায় তালু ছুঁইয়ে অনু বলল, ‘এ যে অনেক জ্বর!…ডাক্তার ডাকতে হবে।’

‘আমি তো কিছু জানি না। কোথায় ডাক্তার পাব…তুমি একটু ডেকে আনবে?’

‘দাঁড়াও, সীতাংশুকে বলছি। ওদের দোকানে ডাক্তার বসে।’

অনু বেরিয়ে গেল। রতন দাঁড়িয়ে রইল রীণার মাথার কাছে। বেচারার এখন কিছু করার নেই। শুধু উৎকণ্ঠাভরে বার বার জিজ্ঞাসা করে যাচ্ছে, ‘খুব কষ্ট হচ্ছে বউদি?…কোথায়, মাথায়? টিপে দেব?…জল খাবে?’

রতন গ্লাসে জল এনে, রীণার ঘাড়ের নীচে বাহু দিয়ে তুলে খাওয়াবার চেষ্টা করল। খেল কিনা, রাহুল তা বুঝতে পারল না। রীণার মাথায় কপালে রতন হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

মিনিট কুড়ির মধ্যেই ডাক্তার আর সীতাংশুকে নিয়ে অনু ফিরে এল। চারজন লোকের ভিড়ে রাহুল দেখতে পারছে না ডাক্তার কী পরীক্ষা করছে। স্টেথিস্কোপটার দুটো নল কানে লাগাল এই পর্যন্ত সে দেখেছে। আর দেখেছে সবাই উৎকণ্ঠিত চোখে ডাক্তারের মুখ লক্ষ করছে।

‘ব্লাড টেস্ট করতে হবে…তুমি দুর্গাবাবুকে বলো এখুনি এসে ব্লাড নিয়ে যাক। দোকানে চলো, প্রেসক্রিপশন লিখে দোব। রেগুলার টেম্পারেচার নিতে হবে… আইসব্যাগ তো রয়েছে দেখছি, মাথায় বরফ দেবার ব্যবস্থা কর।’

‘কী মনে হল?’ সীতাংশু জিজ্ঞাসা করল।

‘ব্লাড রিপোর্ট না পেলে বলা শক্ত।…এনার আছেন কে?’ পেশাদারি গলায় ডাক্তার প্রশ্ন করল।

‘আপাতত কেউ নেই, শুধু এই কাজের লোকটি ছাড়া।’

ডাক্তার ভ্রূ কুঁচকে রতনের দিকে তাকাল। ‘আত্মীয়স্বজন কেউ নেই?’

সীতাংশু তাকাল অনুর দিকে। অনু রতনের দিকে।

‘আমি তো কিছু জানি না, কাউকে কখনো আসতে দেখিনি। তবে ইস্কুল থেকে মাঝে মাঝে দু—একজন আসতেন।’ রতন বিব্রত অসহায় মুখে তাকিয়ে রইল।

‘ইনি তো বিবাহিত, হাজব্যান্ড কোথায়?’

‘বাইরে আছেন…সে অনেক কথা, পরে আপনাকে বলব। চলুন।’ সীতাংশু প্রসঙ্গটা চাপা দিতে দরজার দিকে এগোল।

‘নিকটজন কারোর এখন কাছে থাকা দরকার।’

তিনজন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রতন চুপ করে দাঁড়িয়ে, কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। অনু ফিরে এল।

‘আইসব্যাগে বরফ ভরে দিচ্ছি তুমি ততক্ষণ মাথায় ধরো, আমি ওষুধের দোকান থেকে ঘুরে আসছি। আর বউদি একবার আমায় বলেছিল ওর ছোটোবেলার এক বন্ধু ওরই সঙ্গে স্কুলে পড়ায় সে হয়তো বউদির বাপের বাড়ির ঠিকানা জানে। তুমি কি ওর নামটা জান?’

‘না।’

‘আচ্ছা আমি গিয়ে খুঁজে বার করে নেব।’

নন্দিতা পা ভেঙে বাড়িতে রয়েছে, রাহুল মনে মনে বলল, অনু ওকে স্কুলে পাবে না, আর পেয়েও কি কোনো লাভ হবে? রীণার বাপের বাড়ির কেই বা এখন আসবে? বাবা মৃত, মাকে নিয়ে ছোটোভাই চণ্ডীগড়ে, ছোটোবোন বিয়ে করে আছে সল্ট লেকে। নন্দিতা কারোর ঠিকানাই দিতে পারবে না, শুধু বিডন স্ট্রিটে বাপের বাড়িরটির ছাড়া।

নিকটজন বলতে একমাত্র আমি, রাহুল দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ভেবে চলল, সীতাংশুর কথামতো ‘বাইরে’ আছি। অথচ রীণার থেকে এখন হাত দশেকও দূরে নই। থেকেও নেই। কোথাও এখন আমি নেই অথচ আমি বেঁচে আছি! এইরকম অবস্থায় কোনো লোক কখনো কি পড়েছে? চোখের সামনে বউ অসুখে মরবে আর স্বামী খুব কাছের থেকে হাত গুটিয়ে বসে সেটা দেখবে!

ভয়ে। প্রাণের ভয়ে। কী অসম্ভব মূল্যবান এই প্রাণভয় ব্যাপারটি। রাহুল চোখ বুজল বুকের বাঁদিকে হাত রেখে। হৃৎস্পন্দনটা অনুভব করতে পারল না। কবজির কাছে দুটো আঙুল টিপে ধরল।…পাওয়া গেছে। এটা যদি বন্ধ হয়!…এই যদিটাই হল ভয়।

তাকে বাথরুমে যেতে হবে। তলপেটটা ফুলে ভারী হয়ে উঠেছে। কাল রাতের পর এখনও সে পেচ্ছাপ করেনি। অন্তত বারো ঘণ্টা তো বটেই। পায়খানায়ও যাওয়া দরকার। কাল রাতে দুধ—পাউরুটির পর পেটে কিছু পড়েনি। রাহুল আকুল হয়ে শোবার ঘরের মধ্যে চোখ রাখল।

রতন আইসব্যাগ ধরে আছে রীণার মাথায়। মাঝে মাঝে তোয়ালে দিয়ে মুখ থেকে জল মুছিয়ে দিচ্ছে। এই বুড়োটা কি এখন কিছুক্ষণের জন্য ফ্ল্যাটের বাইরে যাবে না? রাহুলের মনে হল এই কুঠুরিটায় নিশ্চয় কোনো নর্দমা আছে। থাকা উচিত।

বন্ধ জানলার দিকের দেওয়ালে সে মেঝের কাছে হাতড়াতে শুরু করল। একটা গর্ত যদি হাতে ঠেকে। তিনবার, চারবার সে দেওয়ালের নীচের দিকটা আঙুল দিয়ে খুঁজল। নেই। ক্রমশ সে রেগে উঠতে লাগল। অদ্ভুত বাড়ি বানিয়েছে। ঘর তৈরি করেছ অথচ নর্দমা রাখনি? গবেট, গাধা, উল্লুক। তার মনে হল, এই দিকের নয়। হয়তো অন্যদিকের দেওয়ালে নর্দমাটা আছে। কিন্তু জিনিসপত্রের স্তূপে দু—দিকের দেওয়াল চাপা। সে শব্দ না করে জিনিসগুলো সরিয়ে জানলার দিকে আনতে লাগল। ভ্যাপসা গন্ধটা বদ্ধ ঘরে আরও ঝাঁঝালো হয়ে উঠল। কয়েকটা পোকা তার হাত বেয়ে সরসর করে উঠে আসতেই সে হাত ঝাড়ল। তোরঙ্গে হাত লেগে শব্দ হওয়া মাত্র সে চট করে জোড়ের ফাঁক দিয়ে তাকাল। রতন একইভাবে রীণার মাথায় আইসব্যাগ ধরে মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। শব্দটা শুনতে পায়নি।

রাহুল আঙুল দিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে মেঝের সংযোগের জায়গাগুলো আঁচড়ে যেতে লাগল। গর্ত এদিকেও নেই। ঘরের কোথাও নেই।

তা হলে? প্রশ্নটা নিজেকে করেই রাহুল ট্রাউজার্সের চেন টানল।

ধীরে ধীরে তলপেট থেকে টনটনানিটা নেমে যাচ্ছে। রাহুল চোখ বুজে চমৎকার একটা আরাম উপভোগ করে যেতে লাগল। ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে লাগছে। কোণের দিকে মেঝেয় জমে থাকবে। ওর ওপর ছেঁড়া তোশকটার তুলো ফেলে দিলে তো ব্লটিংয়ের মতো শুষে নেবে। মনে হওয়া মাত্র রাহুল দাঁত দিয়ে তোশকের কাপড় ছিঁড়ে তুলো বার করে মেঝেয় ছুড়ে ছুড়ে ফেলল। অন্ধকারে সে বুঝতে পারছে না তুলোগুলো ঠিক জায়গায় পড়ল কি না।

শোবার ঘরে লোক এসেছে। রাহুল চোখ রাখল। অনুর সঙ্গে একটি লোক। পিছন ফিরে খাটে বসে লোকটি রীণার হাত টেনে নিল। রক্ত নিতে এসেছে। পরীক্ষা করে কীসের বীজাণু পাবে? রাহুল ভাবতে লাগল, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ডায়বিটিস, যক্ষ্মা, ক্যানসার…আর কী হতে পারে? এনসেফেলাইটিস, এইডস? না এইডস নয়, কোথা থেকে এই রোগ পাবে? তার তো নেই। অন্য কারোর কাছ থেকে রীণা কি পেতে পারে? কিন্তু ও স্বামীর প্রতি খুবই বিশ্বস্ত। এ ব্যাপারে সন্দেহের উপরে।

ছোট্ট হাতব্যাগে লোকটা তার সরঞ্জামগুলো ভরে উঠে পড়ল, তাকে এগিয়ে দিয়ে অনু ফিরে এল।

‘তোমার কাছে টাকাপয়সা আছে তো? না, না, এসব খরচের জন্য বলছি না সীতাংশুদের দোকানে প্যাথোলজিরও কাজ হয়, ওষুধেরও পয়সা লাগবে না। ডাক্তারবাবুর ফি—ও দিয়ে দেবে। বলছি দোকানবাজারের খরচের কথা।’

‘বাজার যা আছে আজ চলে যাবে। দোকানের আর কী কেনার আছে।’ রতন কিন্তু কিন্তু স্বরে বলল।

‘দরকার হলে বলো…আর শোন, আমাদের ঘরের কাউকে বলতে যেয়ো না যে বউদির অসুখ করেছে, আমি ডাক্তার ডেকে এনেছি।’

‘না না, সে আমি বলব না। আর বউদির ব্যাগ তো ওই পড়ে রয়েছে, ওতেই টাকা থাকে।…দিদিমণি ডাক্তার কী অসুখ বললেন?’

‘এখনও বলেননি। রক্ত পরীক্ষার পর বলবেন। আমি আজ বউদির স্কুলে একবার যাব। ওর কে বন্ধু আছে তাকে জিজ্ঞেস করব ওর বাপের বাড়ির কারোর ঠিকানা জানে কি না। আর এই ক্যাপসুলগুলো রইল। তুমি পারবে না, আমি এসে খাইয়ে যাব। থার্মোমিটারটা…দাঁড়াও জ্বরটা দেখি।’

রাহুল উৎকর্ণ হয়ে উঠল। জ্বর কত? আজ নয়তো কাল সকালের মধ্যে রীণা উঠে চলার ক্ষমতা পাবে কি? তা না হলে বিরাট বিপদের মধ্যে সে পড়ে যাবে। পায়খানা দু—দিন চেপে রাখা যাবে কিন্তু তারপর?…না খেয়ে আরও বেশিদিন থাকা যায়। যতীন দাস কতদিন অনশনের পর মারা গেলেন। দু—মাস? তারও বেশি? আমি দু—সপ্তাহ তো থাকতে পারবই।…জল তেষ্টা পেলে সে কী করবে? কুঁজোয় অবশ্য ধরা আছে কিন্তু তাতে কতবার আর খাওয়া যাবে! তারপর?

মাথাটা ঘুলিয়ে যাচ্ছে রাহুলের। দেহটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য একসঙ্গে এতরকম সমস্যার সামনে যে তাকে পড়তে হবে, কখনো সে ভাবতেও পারেনি। তার বিদ্যাবুদ্ধি, শিক্ষা, রুচি সবকিছু নস্যাৎ করে দিয়েছে কতকগুলো জৈব দাবি, যেগুলোকে সে চিন্তার যোগ্য বলেই কোনোদিন মনে করেনি।

‘একশো পাঁচ!…বাবা! কাগজ কলম দাও, ডাক্তারবাবু লিখে রাখতে বলেছেন।’

রাহুলের কাছে তাপের পরিমাণটা চিন্তিত হবার মতো ঠেকল, কিন্তু তার পেটের অস্বস্তিটাই তাকে অন্য ধরনের চিন্তায় ঠেলে দিল। দু—দিন চেপে রাখা নয়, আর দু—ঘণ্টাও সে পায়খানা চেপে থাকতে পারবে না।

.

তিনদিন, না পাঁচদিন, না পাঁচ বছর রাহুল মিনিটের, ঘণ্টার, দিনের হিসাব হারিয়ে ফেলেছে, কুঠুরিটা মল আর মূত্রের দুর্গন্ধে ভরা। ক্ষুধা জিনিসটা যে কী, সেই বোধ এখন আর তার নেই। জল ফুরিয়ে গেছে গত রাত্রে।

ওরা রীণাকে নিয়ে গেছে নার্সিং হোমে। যতটুকু সে বুঝেছে, কাছাকাছিই সীতাংশুর চেনা একটা নার্সিং হোমে ওকে ভরতি করানো হয়েছে।

‘রতন তোমার কোনো চিন্তা নেই। নার্সিং হোমের মালিক আমাদের খুব চেনা, টাকার কথা উনি সেরে উঠুন, পরে হবে। খুব কঠিন অসুখ, মাথায় রক্ত উঠে জমে গেছে। দিনরাত বউদিকে নজরে রাখতে হবে।’ সীতাংশু বলেছিল।

‘কেন আমি কি পারতুম না।’ ক্ষুব্ধ স্বরে রতন বলে।

‘পারতে না কেন, তবে ওদের ওখানে যেভাবে হবে তা তো এখানে হবে না। তুমি যখন খুশি যেয়ো, কেমন?’

প্রায় অজ্ঞান রীণাকে ধরাধরি করে সবাই যখন নীচে নিয়ে গেল তখন রাহুল ভেবেছিল—এইবার, এইবার ছুটে গিয়ে চৌবাচ্চচায় মুখ দিয়ে চোঁ চোঁ করে জল খেয়ে আসবে। কিন্তু ভয়ে কুঠুরি থেকে বেরোতে পারেনি। যদি হুট করে কেউ এসে পড়ে? ভয়, ধরা পড়ার ভয়। শুধু এই একটা ব্যাপারই তাকে স্বাভাবিক মানুষের জীবন থেকে সরিয়ে পশুর জীবনে নামিয়ে দিয়েছে।

কয়েকবার বমি করেছিল রাহুল। তারপর আর তাও হয় না। পেটে কিছু থাকলে তো হবে। হিক্কার মতো হয়েছিল, টকটকে লালা থু থু করে ফেলে। সে আশা করেছিল রীণাকে নার্সিং হোমে পাঠালেও শোবার ঘরটা খোলাই থাকবে। কিন্তু রতন তা রাখেনি। দিনের বেলাতেও এই পাড়ায় চুরি হয়েছে, এটা রীণাই ওকে বার বার হুঁশিয়ার করে বলেছে। তারই ফল হল, যতক্ষণ সে ফ্ল্যাটে থাকে শোবার ঘরের দরজা খোলা রাখলেও নার্সিং হোমে যাবার জন্য যখনই বেরোয় ঘরের দরজাটা বন্ধ করে শিকল তুলে তালা দিয়ে যায়। রাত্রেও শিকল তুলে দিয়ে দালানে ঘুমোয়। তখন রাহুল শোবার ঘরে বেরিয়ে আসে।

প্রথমবার সে উন্মাদের মতো সারা ঘরে খাদ্য খুঁজেছিল, পায়নি। নতুন কুঁজোটায় সামান্য তলানি জল ছিল, সেইটুকুই পায়। অদ্ভুত চোখে সে ঘরের আসবাবগুলোর দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল খাট, বিছানা, আলমারি, টেবল, টিভি, আয়না, রেডিয়ো, বই, জামাকাপড় এগুলো যদি ভাত, রুটি, ডাল, তরকারি আর খাবার জল হয়ে যেত! সে হিসাব করার চেষ্টা করেছিল, মাথার বালিশটা পাউরুটি হয়ে গেলে সে কতদিন চালাতে পারবে। মনে মনে পাউরুটির মতো স্লাইস করে তার মনে হয়েছে দিনে আট স্লাইস করে সতেরো দিন চালাতে পারবে। সেই সঙ্গে আর একটা ব্যাপারও মনে হয়েছে—তার মাথা খারাপ হয়ে আসছে।

অন্ধকার কুঠুরিতে মাড়িয়ে ফেলেছিল নিজেরই মল। তুলো দিয়ে ঘষে ঘষে পায়ের আঙুলের ফাঁক থেকে সেগুলো পরিষ্কার করলেও দুর্গন্ধ যায়নি। বার বার সে হাত শুঁকেছে, পায়ের কাছে মুখ নিয়ে গেছে। বাসি মলের গন্ধ সারাক্ষণ যেন তার নাকের চারপাশ ঘিরে ভনভন করছে। সে অতিষ্ঠ হয়ে বন্ধ দরজাটা বালিশ দিয়ে পিটিয়েছে।

অবশেষে সুযোগ এল। শোবার ঘরে রতন কী যেন খুঁজতে শুরু করল। রাহুল তখন জানলাটা সামান্য ফাঁক করে সকালের রোদের অপেক্ষা করছিল। নটা—সাড়ে নটার আগে সেই তরল সোনা এই ঘরে গড়ায় না। সে ফাঁক দিয়ে দেখেছে রতন খাটের নীচে, আলমারির পিছনে কী যেন খুঁজছে।

হঠাৎই কুঠুরির দরজাটা খুলে গেল। রতনের প্রথমে ঠাওর হয়নি, চোখের মাত্র দু—হাত দূরে, এত কাছে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের অবয়বটিকে। তার চেতনায় দৃশ্যটা ছবি পাঠাতে দেরি করল। রাহুলই প্রথম অসাড় ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে, কিছু একটা অবলম্বন চেয়ে হাতটা পাশে বাড়াতেই হাতুড়ির বাঁটটা মুঠোয় পেল। চিন্তার ঢেউ ওঠার আগেই সে তুলে নিল সেটা।

খাটে পা ঝুলিয়ে রাহুল নির্নিমেষে রতনের মুখের দিকে তাকিয়ে। মুখটায় কোনো হেরফের নেই। যন্ত্রণার ছাপ বা বিকৃতি কিছুই নেই। রোজ সকালে ঘুম ভাঙিয়ে চা দেবার সময় যেমন থাকত, মুখটা প্রায় সেইরকমই। একটু ব্যস্ততা যেন। উনুনে দুধ চাপিয়ে এসেছে এমন একটা ভাব। এ ছাড়া রতন খুব স্বাভাবিকভাবেই মেঝেয় শুয়ে আছে।

হাতুড়িটা খাটের উপর পড়ে। রাহুল সেটা তুলে চোখের সামনে ধরে কৌতূহলী চোখে দেখতে লাগল। সে আশ্চর্যবোধ করল একটা কথা ভেবে, বাঁশের খোঁটার থেকে এটা কত ছোটো অথচ এটারই ক্ষমতা কত বেশি! মাত্র একটা ঘা দিতেই…।

রাহুল হুঁশিয়ার হয়ে রতনকে পাশ কাটিয়ে শোবার ঘরের দরজার দিকে এগোল। দালানে এসে পায়ের দিকে তাকাল। না, রক্ত মাড়ায়নি। এইবার তাকে পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন হতে হবে। সবার আগে জল খেতে হবে।

ফ্রিজ থেকে বোতল বার করে মুখে দিতে গিয়ে রাহুল থমকে গেল। তার অভ্যাস গ্লাসে ঢেলে খাওয়ার। সে গ্লাসে জল ঢেলে ধীরে পান করল। ঝুড়িতে শুকনো টোম্যাটো, শশা। ডেকচিতে দুধে সর পড়েছে। সে হাসল। এখন নয়, আগে বাথরুমে যাওয়া। অনেকক্ষণ ধরে সাবান ঘষবে, দাড়ি কামাবে, শ্যাম্পু করবে, আফটার শ্যেভ গালে লাগাবে। লন্ড্রি থেকে আনা ট্রাউজার্স, শার্ট পরবে। এখন তার অনেক কাজ।

প্রায় দেড়ঘণ্টা পর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে দরজায় তালা দেবার পর চাবিটা পকেটে রেখে রাহুল থরথর করে কেঁপে উঠল। পৃথিবীটা যে এত বড়ো, এই বোধটা সে এখন পাচ্ছে। রতনই তাকে বাঁচিয়ে দিল।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সে মাথাটা তুলে, সামনে চোখ রেখে হাঁটতে শুরু করল। এখন সে যাবে রীণাকে দেখতে। নার্সিং হোমটার নাম সে জানে না, তবে সে জানে বাসস্টপ থেকে মিনিট তিনেক বড়ো রাস্তা ধরে হেঁটে বাঁদিকে একটা রাস্তায়।

কেউ কি তার দিকে তাকিয়ে দেখছে? অবাক হয়ে যাচ্ছে? দেখুক। কানাকানি, ফিসফিস হবেই তাকে দেখে। হোক। কেউ তার কাছে এগিয়ে এসে কথা বলবে না। পাড়ায় কারোর সঙ্গে তার আলাপ নেই। এখন নার্সিং হোমের ভিজিটিং আওয়ার্স নয়। সে ওদের কাছে অপরিচিত। নিশ্চয় দারোয়ান কিংবা নার্স জানতে চাইবে, ‘আপনি কে?’ বলব, ‘আমি আপনাদের পেশেন্ট রীণা মিত্রর স্বামী।’ সন্দেহের চোখে তাকাবে কি? ওরা কি জানে সে এখানকারই একটা মাঠে, এক বর্ষার রাতে…’দেখুন, আমি বেটাইমে এসেছি জানি, কিন্তু নিরুপায়…আমাকে এখনই থানায় যেতে হবে, আমার চাকর খুন হয়েছে। আততায়ীকে আমি চিনি, সেটাই থানায় গিয়ে বলব।…আমি একবার স্ত্রীকে দেখতে চাই, প্লিইজ…।’

একা কথা বলতে বলতে, স্বচ্ছন্দে স্বাভাবিকভাবে রাহুল হেঁটে যেতে লাগল।

পুবের জানালা

এক

দ্বিতীয়বার সে বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। হাঁটার মধ্যে এমন একটা ভাব বজায় রাখল যেন সে খুবই প্রত্যয়ী, তার মধ্যে কোনো উদবেগ বা ব্যস্ততা নেই। কারও দৃষ্টি আকর্ষিত হতে পারে এমন পদক্ষেপ একবারও করেনি। শুধু তার চোখ দুটি অস্বাভাবিক তীক্ষ্ন এবং কৌতূহলী। কিন্তু রাস্তার আলোয় তার চোখ খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল না। তার কাঁধে ঝুলছে একটা নীল আর কালো নকশাকাটা কাপড়ের ঝুলি। পরনে হালকা সবুজ পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা। পায়ে কোলাপুরি। এসব আজই কেনা। কিন্তু তার গালের দাড়ি তিন মাসের। আজকের দিনটির কথা ভেবেই সে দাড়ি রাখতে শুরু করেছিল। বাড়িতে ঢোকার আগে পাড়ার লোক অন্তত যাতে চিনতে না পারে।

দু—পাল্লার লোহার ফটকটা হাট করে খোলা। সাধারণত একটা পাল্লা বন্ধ থাকে। মোটর ঢোকার বা বেরোবার সময় দুটো পাল্লাই খোলা হয়। কোনো মোটর কি এখন ঢুকেছে বা বেরিয়েছে? মোটর তো আছে শুধু তার দাদা গোপেন্দ্রর। কোনো ট্যাক্সি তো ভিতরে ঢুকবে না। এই নিয়ম বাবার আমল থেকে চলে আসছে, কিন্তু গত ষোলো বছরে সেটা কী টিকে আছে?

রাস্তার আলোটা ফটকের পাশ দিয়ে বেরিয়ে—যাওয়া শিবু বর্ধন লেনের মুখেই সনৎদার বাড়ির দেওয়ালে আঁটা। ওই আলোতেই গলির মুখ আর ছাব্বিশ নম্বর সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ফটক ছাড়িয়ে আরও তিরিশ মিটার রাস্তা আলোকিত। রাস্তার এক প্রান্ত গিয়ে পড়েছে গৌরচরণ ঘোষ লেনে। এই দুই রাস্তার মোড়ে একটি পার্ক। এই পার্কে বাল্যে সে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলেছে। পরে খেলেছে ভলিবল। পার্কের দক্ষিণে একটা ব্যায়ামের আখড়া, সেখানে আছে হনুমানজির মূর্তি, পাথরে তৈরি দু—হাত লম্বা। সবাই তাই বলে হনুমানজি পার্ক। পার্কের রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে বেঞ্চ পাতা। কিছুক্ষণ আগে সে পার্কের মাঝামাঝি অন্ধকার জায়গায় একটা খালি বেঞ্চে বসেছিল।

অত্যন্ত ক্লান্ত সে। সকাল দশটায় জেলের ফটকের বাইরে পা দিয়েই তার মনে হয়েছিল, আজ সে লম্বা একটা হাঁটা হাঁটবে। হাঁটতে সে ভালোবাসে। যদিও তার মোটরবাইক ছিল, কিন্তু খুব তাড়া না থাকলে বাড়ি থেকে এক বা দেড় মাইল হেঁটেই চলে যেত। আজ সে হেঁটেছে। আলিপুর থেকে উত্তরে সোজা রেসকোর্স হয়ে পশ্চিমে গেছে। গঙ্গার ধার দিয়ে আবার উত্তরে ইডেন গার্ডেনস। গাছের ছায়ায় ঘাসের উপর চিত হয়ে সে ভেবেছে। তার গত ষোলো বছরকে নয়, ভেবেছে কয়েক ঘণ্টা পর কী ঘটতে পারে সেই কথা। তাকে নিয়ে যাবার জন্য কেউ আসেনি জেল—ফটকে। সে দু—সপ্তাহ আগে বিবিকে চিঠি দিয়েছিল তার খালাসের তারিখ জানিয়ে। ‘বিবি’ তার বউ জাহ্নবীর ডাকনাম।

বিবি গত চার বছর একবারও দেখা করতে আসেনি। সেজন্য তার কোনো দুঃখ, ক্ষোভ বা মর্মবেদনা হয়নি। তার ধারণা সে অনেক বদলে গেছে মানসিকভাবে। এখন সে বুঝতে পারে অন্য মানুষের অনুভবকে, এখন সে ধৈর্য ধরতে, সহ্য করতে এবং আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। কিন্তু এর কোনোটাই পরীক্ষিত হয়নি। এবার হবে।

কীভাবে তাকে ওরা গ্রহণ করবে? তার মেয়ে গুলু, তখন ছিল চার বছরের। এখন সে কুড়ি। তার ছেলে গোরা, তখন ছিল দু—বছরের, এখন সে আঠারো, দুজনকে সে ষোলো বছর চোখে দেখেনি। পুরোপুরি আসা বন্ধ করার আগে বিবি যখন এক—দেড় মাস অন্তর দেখা করতে আসত, তখন সে একবার বলেছিল, ‘গুলু আর গোরার ভালো নাম কিছু রেখেছ?’ বিবি বলেছিল, ‘এখনও কিছু রাখিনি।’ ‘আমি কী রাখব?’ খুব সন্তর্পণে সে বিবির কাছে অনুমতি চেয়েছিল। পরে বুঝেছিল সে ভয় পাচ্ছে, যদি প্রত্যাখ্যাত হয়! নামকরণের অধিকারটা এখনও তার দখলে আছে কি না সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেনি। এক ধরনের কাঠিন্য আর জেদ বিবির মৃদু স্বভাবের আড়ালে প্রচ্ছন্ন থাকে। নিমেষে সেটা কখন যে প্রকাশ্যে আসবে তা কেউ জানে না। বিবি বলেছিল, ‘ছেলেমেয়ের নাম রাখবে, তুমি!’ বিবির চোখ থেকে সে চোখ সরিয়ে নিয়েছিল। অদ্ভুত একটা ঝাঁঝ ছিল বিবির বিস্ময়ের মধ্যে। ‘ওদের একবার আনবে? দেখব।’ কর্কশস্বরে উত্তর পেয়েছিল, ‘না’।

এবার বিবির সামনে গিয়ে তাকে দাঁড়াতে হবে। ইডেন গার্ডেনস থেকে হনুমানজি পার্ক, তার মধ্যে সে নতুন পাঞ্জাবি, গেঞ্জি, পাজামা, চটি এবং ঝুলিটা কিনেছে। একটা চিনা খাবারের দোকানে পেট ভরে চাওমিয়েন আর চিংড়ি মাছ ভাজা খেয়েছে। দোকানের টয়লেটে হাত ধোবার সময় আয়নায় চুল আঁচড়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল। তার মনে হয়েছিল, দাড়িটা রেখে ঠিক কাজই করেছে, তাকে চেনা যাচ্ছে না। তাকে রাশভারি দেখাচ্ছে। তামাটে চামড়ার সঙ্গে কটা চোখ, ঘন ভুরু। কানের উপর, জুলফিতে আর চওড়া চোয়ালের নীচে পাকা চুলের সাদা ছোপ—ধরা কালো দাড়ি তার মুখটাকে বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিকের মতো গম্ভীর করে দিয়েছে। কিন্তু সে নিজেকে হাসিখুশি, উৎফুল্ল একটা সহজ মানুষ হিসাবে সমাজে, বাড়িতে, ছেলেমেয়েদের এবং বিবির কাছে ফিরে আসতে চায়।

চোখ দুটিকে উজ্জ্বল দেখতে চেয়ে সে মণিদুটিকে স্ফীত করেছিল। কপালে তখন তিনটে ভাঁজ পড়ে, আয়নার কাছে মুখ এগিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তাকায়। তার মনে হয়েছিল আগের সেই ঝকঝকে ব্যাপারটা যেন আর নেই। দুশ্চিন্তায় স্তিমিত দুটো চোখ যা তার কাছে নতুন, এরপর সে বুকটা সামনে ঠেলে টানটান হয়ে দাঁড়ায়। ছ—ফুট দু—ইঞ্চি, বিরাশি কেজি ছিল ষোলো বছর আগে। এখনও তাই আছে বলেই তার মনে হয়। ওজনটা হয়তো একটু বেড়েছে, পেটটা একটু উঁচু হয়ে উঠেছে। তা হোক, সে ঝুঁকে পড়েনি বয়সের ভারে। গৌরবর্ণ টকটকে গায়ের রঙ আর নেই। সেজন্য তার মনে কষ্ট নেই। পঞ্চাশের কাছাকাছি হতে যাচ্ছে বয়স। জীবনের একটা এলাকা ছেড়ে দিয়ে আর একটা জমিতে পা রাখতে চলেছে, সেখানে গায়ের রঙ দিয়ে সে কিছু লাভ করবে না।

হনুমানজি পার্কে বেঞ্চে বসে থাকার সময় তার মনে হয়েছিল, এখানকার কিছুই বদলায়নি। বাড়িগুলো একই চেহারায় রয়ে গেছে। অবশ্য ষোলো বছরে বদলাবেই বা কীভাবে। চল্লিশ বছর আগেও সে বাড়িগুলোকে এই রকমটিই দেখেছিল। হয়তো কোনোটার গায়ে কলি পড়েনি, দেওয়ালে অশ্বত্থ বা বটের চারা, জানালার পাল্লা কবজা থেকে ঝুলে গেছে, বারান্দায় পার্টিশান হয়েছে, সদর দরজার চৌকাঠটা আর একটু ক্ষয়ে গেছে, কিন্তু এগুলোকে বদল বলা যায় কী? ঘেঁষাঘেঁষি বাড়িগুলোর কাঠামো তো একই রয়ে গেছে। ছাব্বিশ নম্বর সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিট—এর বাড়িটাকে সে একটু আগেই বাইরে থেকে দেখে এল, একই রয়েছে। তবে লোহার ফটকে মরচে, পাঁচিলের খসে পড়া পলেস্তারা, ফটক থেকে ভিতরে ঢোকার ইট বাঁধানো পথটায় ঢেলা ইট, গর্ত আর ছেঁড়া কাগজ দেখে মনে হয়েছিল বাড়ির মানুষগুলো আগের শৃঙ্খলার মধ্যে আর নেই।

পার্কের বেঞ্চে সে একাই বসেছিল। এক প্রৌঢ় এসে তার পাশে বসে। সে কিনারের দিকে সরে যায়। আড়চোখে তাকিয়ে সে চেষ্টা করে লোকটিকে চেনার । দেখা মুখ কিন্তু সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটের নয়। কিন্তু লোকটি তাকে চিনে ফেলতে পারে কি? পাজামা, পাঞ্জাবি আর বিশেষ করে দাড়িটা কি যথেষ্ট ছদ্মবেশ নয়? দাড়িটা সে রেখেই দেবে তবে বিবি বোধহয় পছন্দ করবে না। ছোটোবেলায় চন্দননগরে মামার বাড়িতে যাত্রায় দেখেছিল, এক অত্যাচারী নবাবকে গ্রাম থেকে এক সুন্দরী গৃহবধূকে হরণ করে নিয়ে যেতে। নবাবের ছিল দাড়ি। সেই থেকে বিবির কাছে দাড়ি আর লাম্পট্য এক হয়ে গেছে।

নিজের অজান্তেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল। দাড়িটা তাকে কাটতেই হবে। সে তখন পাশে মুখ ফিরিয়ে দেখতে পায় লোকটি তার দিকে তাকিয়ে। বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল। তার মনে হয় লোকটি তাকে চেনার চেষ্টা করলে হয়তো চিনতে পারবে। এই পার্কেই ফুটবল খেলার সময় সে ঘুসি মেরে দাঁত ভেঙে দিয়েছিল পাশের পাড়ার বস্তির একটি ছেলের। রক্তাক্ত মুখে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটি তার বাবাকে ডেকে আনে। এই লোকটিই সেই বাবা। হন্তদন্ত হয়ে লোকটি প্রায় ছুটে এসে তাকে চড় মারার জন্য হাত তুলেও মারেনি। না মারার কারণ সে পরে বুঝতে পেরেছিল। তার মুখ চোখ আর গায়ের রঙ লোকটাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ছেলেটা বড়ো ঘরের। ‘কোথায় তোর বাড়ি?’ শুধু এইটুকু জানতে চেয়েছিল। সে বলেছিল, ‘দত্তবাড়ি। আমার বাবা অমিয় দত্ত। এর জন্য ডাক্তার ওষুধের খরচ আমার বাবা দিয়ে দেবে।’ লোকটা চিৎকার করে বড়োলোকদের গাল দিতে দিতে তখন ছেলেকে নিয়ে চলে যায়। পরের দিন রাত্রে বাবা তাকে ডেকে বলেছিল, ‘রঘু, তোর একটা ঘুসির দাম চুকোতে চল্লিশ টাকা খসে গেল। আর ঘুঁসোঘুসি করিসনি বাবা।’ বাবা প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছিল।

এই সেই লোক। কিন্তু ঘটনাটা কম করে পঁয়ত্রিশ বছর আগের, তার মধ্যে সে লোকটিকে একবারও দেখেনি। হয়তো লোকটি তাকে দেখেছে, বহুবারই। ছ—ফুট দু—ইঞ্চি, টকটকে রঙ, কটা চোখ, চওড়া কাঁধ, এসব কি সহজে ভুলে যাওয়া যায়! লোকটি একটি বিড়ি ধরিয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসল। চিনতে পারেনি, জায়গাটা অন্ধকারও। এবারে উঠে পড়া যাক।

রঘু, যার পোশাকি নাম রাঘবেন্দ্র, তখন হনুমানজি পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে। সে পার্কের ফটক দিয়ে না বেরিয়ে রেলিংয়ে যেখানে একটা শিক উপড়ে মানুষ গলে যাওয়ার জন্য ফোকর করা, সেখান থেকে বেরোল। পার্কের ফটকে ফুচকা আর উনুনের উপর পিতলের থালায় রাখা ঘুগনি বিক্রি হচ্ছে। চল্লিশ বছর আগেও সে এদের দেখেছে তবে তখন অন্য লোক বিক্রি করত। যদুপতি একটা টিনের বাক্স নিয়ে ফটকের পাশে বিকেলে বসত। তার মধ্যে গোল দুটো ডিব্বায় থাকত শুকনো ঘুগনি আর ঘন ঝোলের আলুর দম। চাপড়া চিংড়ির চপ আর কাগজের মতো পাতলা মামলেটও তার কাছে পাওয়া যেত। যদুপতির কালো চুল সে আধ—পাকা হয়ে যেতে দেখেছে। অন্তত পঁচিশ বছর ধরে সে এই পাড়ার ঘুগনিওয়ালা ছিল। সন্ধ্যার পর টহল শুরু করত। ছাব্বিশ নম্বরের ফটকের কাছ থেকে মুখটা বেঁকিয়ে যদুপতি ‘ঘউগ….নিইই’ বলে হাঁক দিলেই সে তার প্রাইভেট টিউটর উমাপদবাবুর মুখের দিকে তাকাত। তিনি তখন মাথা হেলিয়ে বলতেন, ‘দেরি কোরো না।’ সে তখন ছুটে বেরিয়ে আসত ফটকে আর ফিরে যেত চার পাতা ঘুগনি হাতে নিয়ে। দুটো পাতা উমাপদবাবুর জন্য। একদিন দেশের বাড়ি থেকে খবর এল, একমাত্র ছেলে সাপের কামড়ে মারা গেছে। তিনি সেই যে দেশে গেলেন আর ফিরে আসেননি।

ধরদের রকে একটা স্টেশনারি দোকান হয়েছে। প্রথমবার সামনে দিয়ে যাবার সময় এটা সে লক্ষ করেনি। বড়োজোর আড়াই হাত চওড়া, দু—হাত লম্বা। দোকানি একটি সুশ্রী যুবক। সামনে একটা কাচের শো—কেস, তার উপর সার দিয়ে কাচের জার। নানান রঙের প্যাকেট দেওয়ালে আর দোকানের সামনে ঝোলানো। নড়াচড়ার জন্য দু—হাত জায়গাও নেই। একটা টুলের উপর বসে বা দাঁড়িয়ে এই পঁচিশ—ছাব্বিশ বছরের ছেলেটি দিনে কত ঘণ্টা কাটায়! আট? দশ? সে জেলে গেছিল বত্রিশ বছরে। সেখানে হাঁটা চলা দৌড়বার জায়গার অভাব ছিল না। ছেলেটি এই দু—হাত জায়গায় নির্বাসিত থাকবে কত বছর? দোকানের উলটো দিকের বাড়ির দরজায় সালোয়ার—কামিজ পরা একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। হয়তো অকারণেই।

রাস্তায় লোক চলাচল কম। যারা সামনে দিয়ে আসছে,তাদের কাছ থেকে না—চেনা আলতো একটা চাহনি ছাড়া আর কিছু সে পেল না। হাতঘড়িতে সে সময় দেখল সাড়ে আটটা। এখন বিবি গোরা গুলুরা কী করতে পারে? হারমোনিয়ামের মতো দেখতে একটা টিভি সেট সে কিনেছিল। তখন টিভি রঙিন হয়নি। জেলে সে রঙিন দেখেছে। বিবি এতদিনে নিশ্চয়ই পুরনো সাদা—কালোটা বাতিল করে রঙিন কিনেছে। ওরা এখন কি টিভি দেখছে? কিন্তু বিবি কি দেখতে দেবে? এখন তো পড়াশুনোর সময়। পড়ার ব্যাপারে বিবি খুব সিরিয়াস। ফিজিক্সে অনার্স নিয়ে বি এসসি। পরীক্ষার মধ্যেই ওর বাবার স্ট্রোক না হলে ফার্স্ট ক্লাস হয়তো পেত। বাবা সামলে উঠেই মা—মরা মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে এক মাসের মধ্যে বিয়ে দিলেন। দেওয়াটা উচিত কী অনুচিত হয়েছে, তাই নিয়ে সে বিবিকে একবার জিজ্ঞাসাও করেছিল, ‘আমার মতো এক অর্ডিনারি বিএ—র সঙ্গে তোমার বিয়ে হওয়াটা উচিত হয়নি।’ বিবি নিরাসক্ত গলায় বলেছিল, ‘তাহলে কার সঙ্গে বিয়ে হলে উচিত হত?’ সে চট করে বিবিকে জবাব দিতে পারেনি। শুধু বলেছিল,’তুমি আমার থেকে অনেক বেশি রিফাইনড, শিক্ষিত।’ বিবির ভ্রূ কুঁচকে উঠেছিল শুনে। ওই কোঁচকানোর অর্থটা সে কোনোদিনই ধরতে পারেনি, এখনও নয়।

ছাব্বিশ নম্বরের ফটকের সামনে দ্বিতীয় বার পৌঁছে সে আগের মতো ফিরল না। বেঁকে যাওয়া সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিট ধরে আরও এগিয়ে গেল। একশো মিটার গেলে একটা ভাঙা শিব মন্দির, তারপর আশুর তেলেভাজার দোকান। আর একটু এগোলে কচুবাগান বস্তি, নারান পণ্ডিতের পাঠশালা, তারক স্যাকরার দোকান, রেশন দোকান, চুল কাটার দোকান।

নতুন কিছুই চোখে পড়ল না, শুধু পুরোনোগুলো আরও পুরোনো হয়েছে। শিবুর দোকান বন্ধ রয়েছে, অথচ বিকেল থেকেই ভিড় লেগে যেত মোচার চপের জন্য। শিবু কি মরে গেছে! নারান পণ্ডিতের পাঠশালা ঘরে কারা ড্রাম আর অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে হিন্দি ফিল্মের গান চর্চা করছে, তার মধ্যে মেয়ের গলাও সে পেল। সন্ধের পর হয়তো ভাড়া নেয় ঘরটা। গান শোনার জন্য দরজায় ভিড়। স্যাকরার দোকানের মাঝামাঝি লোহার গরাদ দিয়ে ঘরটা দু—ভাগ করা। আগে এটা ছিল না। গরাদের ওপারে মাথা নীচু করে হাতুড়িতে ঠুকঠাক করে যাচ্ছে একজন। তারক স্যাকরার ছেলে বলাই, তার সঙ্গে স্কুলে পড়েছে। আশ্চর্য, এত বড়ো টাক—এর মধ্যে ওর হল কী করে! বলাই তাকে নিশ্চয়ই চিনতে পারবে।

সে দ্রুত পা চালাল। শুভ্রা সেলুনে গেঞ্জি গায়ে, লুঙ্গি পরা একজনকে দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছে অল্পবয়সি ছেলে। প্রৌঢ় মালিক বাইরের রকে চেয়ারে পা তুলে বসে। এখানে কখনো সে চুল কাটেনি দাড়ি কামায়নি। লোকটা তাকে চেনে না। সেলুনের উলটোদিকের বাড়ির জানালার নীচে কালী মহাদেব আর কৃষ্ণ—নানা রঙ দিয়ে দেওয়ালে আঁকা। লোকের পেচ্ছাপ করা বন্ধের অব্যর্থ দাওয়াই! হলুদ রঙের মোটর গাড়ির সাইজের একটা আবর্জনা ভরা লোহার বাক্স রাস্তায় বসানো। তার পাশের ঢাকনা খোলা। সেখান থেকে উপচে রাস্তায় পড়ে আছে আবর্জনা। আঁশটে বাসি গন্ধ ঠেলে তার আর এগোবার ইচ্ছে হল না।

সবই তো একই রকম রয়ে গেছে। এক ধরনের ভরসা সে এবার অনুভব করল। চোখে, নাকে, কানে তো অভ্যস্ত জিনিসগুলোই পৌঁছল। তাহলে কি সে তার আগের জায়গাতেই ফিরে এসেছে? ছাব্বিশ নম্বর বাড়িও একই রকম হয়েছে? হয়তো রয়েছে। তার ষোলো বছর না থাকায় কতটকু বদলাতে পারে? গুলু গোরা বড়ো হয়ে উঠেছে, তাদের দেখলে সে চিনতে পারবে না। বিবি একদিনও আলিপুরে ওদের নিয়ে যায়নি। ওদের কাছে বাবা অপরিচিত মানুষ।

পাঁচ বছরের দাম্পত্য জীবনে বিবির সঙ্গেও কি তার পরিচয় হয়েছে! দিদির শ্বশুরবাড়ি চন্দননগরে, বিবির মামার বাড়ির পাড়ায়। সাহেবদের মতো গায়ের রঙওয়ালা, লম্বা—চওড়া ভাইয়ের জন্য মানানসই মেয়ে খোঁজার দায় দিদিই নিয়েছিল। জাহ্নবী তারই আবিষ্কার। সুন্দরী হওয়ার জন্যই ডাকনাম ‘বিবি’। টকটকে না হলেও গৌরাঙ্গী। টানা চোখ, কালো মণি। পাশাপাশি দাঁড়ালে বিবির মাথা তার কানের নীচে পৌঁছয়, সাড়ে পাঁচ ফুটের মতো লম্বা আর যে দেহ—গড়ন পাওয়ার জন্য মেয়েরা ব্যায়াম করে, খাওয়ার বাধ্যবাধকতা মেনে চলে, বিবি তার কিছু না করেই তেমন একটি দেহ পেয়েছে। দিদি বলেছিল, ‘মেয়ের গড়ন—পেটন যেমন, তেমনই মেঘের মতো চুল!’ কোমর ছাড়ানো ঘন চুল। মাথাটা হেলিয়ে বিবি যখন চিরুনি দিয়ে আঁচড়াতো তখন সে তাকিয়ে থাকত। একদিন সে বলেছিল, ‘এ তো দেখছি চুলের ঝরনা! মেয়েরা কেন যে চুল কেটে ছোটো করে!’ চিরুনি থামিয়ে ও বলেছিল, ‘আমার তো কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে।’ সে জবাব দিয়েছিল, ‘আমাদের বাড়িতে মেয়েরা চুল কাটে না।’ বিবির ভ্রূ কুঁচকে উঠেছিল কথাটা শুনে।

তাদের দুজনের জীবন যেন দুটি স্তরে বসানো। কেউ কারও মনের গতিবিধির খবর জানে না। জানার জন্য বিবির তরফ থেকে কখনো আগ্রহ প্রকাশ পায়নি। ওর সঙ্গে কোনোদিনই তার পরিচয় হয়নি। ওকে কখনো সে নগ্ন দেখেনি, বিছানাতেও নয়। রুটিনমাফিক সম্পর্কের বাইরে বিবি কখনো যায়নি।

ছাব্বিশ নম্বরের ফটক থেকে সে ভিতরে ঢুকতে গিয়ে থমকে পড়ল। ধুতি আর শার্ট পরা একটি লোক বেরিয়ে আসছে। কে হতে পারে? ধুতির বহর দেখে মনে হচ্ছে কোনো চাকর। দুলাল নয়। এত দিনে তার বয়স সত্তরের কাছাকাছি হওয়ার কথা। কিন্তু এর চলন অল্পবয়সিদের মতো। লোকটি তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একবার তাকাল মাত্র। সে একে আগে দেখনি।

পথের ডান দিকে বাড়ি, বাঁ দিকে পাঁচিল। পথটা সোজা গেছে বাগানে। কিন্তু তার আগেই ডান দিকে ঘুরে পথটা পৌঁছেছে বিরাট সদর দরজায়। বাগান অর্থে চারটে টেনিস কোর্ট হওয়ার মতো ঘাসের জমি। তার পুব দিকের পাঁচিল ঘেঁষে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। কামিনী, টগর আর শিউলির গাছ ছিল, কিন্তু সেগুলো কেটে ফেলতে হয়েছে তার স্টিল ফার্নিচারের কারখানা বসাবার জন্য।

সদর দরজার মাথায় আলোটা জ্বলছে। তাতে বাগানের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। প্রায় এক কাঠা জমিতে অ্যাসবেসটসের চালার কারখানাটি তিনটি ঘর নিয়ে। কাজ এখন হচ্ছে না কিন্তু একটি ঘরের দরজা খোলা, আলো জ্বলছে। ভিতরে থেকে কথার শব্দ আসছে। মিস্ত্রিরা এখনও বাড়ি যায়নি।

সদর খোলা। একতলায় সব সময় চাকর থাকে কিন্তু এখন নেই। দরজা দিয়ে ঢুকেই একটা বড়ো ঘর। সেখানে কাঠের গোলাকার একটা বড়ো টেবিল, বেঞ্চ আর তিনটে চেয়ার। এটা বৈঠকখানা নয়, সম্মান দেবার মতো নয় এমন লোকেদের সঙ্গে দেখা করার ঘর। এই ঘরের ডানদিকে ভিতরের উঠোনে যাবার দরজা, তার পাশেই দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। ঘরের বাঁ দিকে বৈঠকখানা। ভিতরে উঠোন ঘিরে নীচু দালান, তার পাশে পাশে দুটো রান্না ঘর, কল—পায়খানা, কাজের লোকেদের থাকার ঘর।

অদ্ভুতভাবে নিঃশব্দ বাড়িটা। সে ভাবল এটা কি তার জন্যই? আজ সে খালাস পেয়ে বাড়ি ফিরবে এটা নিশ্চয় দাদা, বউদি, ছেলেমেয়েরা, বিবিকে লেখা তার চিঠি মারফত জেনে গেছে। কিংবা বিবি কাউকেই জানায়নি। দেখা করতে যাওয়া বন্ধ করার পর সে আটটা চিঠি দিয়েছিল। প্রথম দুটোর দায়সারা উত্তর পাওয়ার পর আর জবাব পায়নি। বিবি বাড়ির লোকেদের সম্পর্কে একটি কথাও লেখেনি। শুধু, ‘আমরা সবাই ভালো আছি। আশা করি তুমিও ভালো আছ।’

একতলার ভিতর থেকে কাপড় কাচার অস্পষ্ট শব্দ আসছে। কান পেতে দোতলার পিছন মহলে তার দাদা গোপেন্দ্রর ঘর থেকে হিন্দি সংলাপ ক্ষীণভাবে শুনতে পেল। বোধহয় টিভি—তে সিরিয়াল হচ্ছে। সদর ঘরের উপরেই বড়ো, মাঝারি আর একটা ছোটো—তিনটি ঘর আর চওড়া একটা দালান নিয়ে তার মহল। দুটো ঘরের সঙ্গে জুড়ে বাইরের বাগানের দিকে জাফরি—কাটা রেলিংয়ের টানা বারান্দা। সদর দিয়ে ঢোকার সময় বারান্দায় সে আলো দেখেনি।

সিঁড়ি দিয়ে সে দোতলায় উঠে এল। শেষ ধাপের পর একটা চৌকো জায়গা। সামনের দরজাটা তাদের, ডান দিকেরটা দাদার। সিঁড়ির দেওয়ালে কয়েক ধাপ অন্তর চারটে নিগর্স—চিত্র, সোনালি ফ্রেমে বাঁধানো। ফ্রেমের রঙ কালো হয়ে গেছে, কাচে ময়লা জমে ছবিগুলো অস্পষ্ট। এগুলো পরিষ্কার রাখার দায়টা যৌথ, কেননা সিঁড়িটা সবাই ব্যবহার করে। পরিষ্কার করার কাজটা সে দুলালকে দিয়ে করাত। ছবিগুলো নোংরা হয়ে রয়েছে, সে ধরে নিল দুলাল আর এই বাড়িতে নেই।

সামনের দরজাটা বন্ধ। সন্তর্পণে দরজার কড়া ধরে সে ঠুকঠুক শব্দ করল। ভিতরের প্রথম ঘরটাই ছিল বাবা—মার। তারপর তার আর বিবির, এখন সম্ভবত শুধুই বিবির। ওর কান খুব সজাগ। যদি ঘরে থাকে তাহলে এই ঠুকঠাক শব্দটুকুই শুনতে পাবে। জানে আজ সে ছাড়া পাচ্ছে সুতরাং বিবি প্রতীক্ষা করছে। তবে গত চারবছর যে তার সঙ্গে দেখা করেনি, চিঠিরও উত্তর দেয়নি, তার প্রতীক্ষাটা স্বামীর সঙ্গে ষোলোবছর পর মিলনের আশায় উচাটন মন, অধীরা বিরহিণীর মতো যে হবে না, এটা সে জানে। মনের গভীরে ভয় মেশানো একটা অস্বস্তি সে বোধ করল।

বিবি প্রতীক্ষা করছে একটা বোঝাপড়ার জন্য এবং সে জানে রাঘবেন্দ্র দত্তর বৈধ স্ত্রী, দুই ছেলেমেয়ের মা বোঝাপড়ার জন্য প্রতীক্ষা করতেই পারে।

দুই

ভিতর থেকে পায়ের শব্দ দরজা পর্যন্ত এল। তার মনে হল দরজার আই—হোল দিয়ে কেউ তাকে দেখছে। বিবি না অন্য কেউ? সে মুখ নামিয়ে অপেক্ষায় রইল।

দরজার দুটো পাল্লা ফাঁক করে যে দাঁড়িয়ে, তাকে সে কখনো দেখেনি। মাঝবয়সি এক স্ত্রীলোক। সিঁদুর নেই, থানকাপড়ে ঘোমটা দেওয়া উজ্জ্বল শ্যাম মুখ। চোখে সন্দিগ্ধ কৌতূহল।

‘কাকে চাই?’ নীচু গলায় প্রশ্ন করল।

‘বাড়িতে কেউ নেই?’ সে পালটা প্রশ্ন করল।

‘সবাই কাল চন্দননগর গেছে, আপনি?’

‘আমার নাম রাঘবেন্দ্র দত্ত।’ তার নাম শুনে প্রতিক্রিয়া কী হয় দেখার জন্য সে মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

প্রত্যাশিত চেনা নাম শুনলে যা হয় মুখে সেটাই ফুটে উঠল। সেইসঙ্গে একটা স্বস্তিও। বোধহয় তার জন্যই অপেক্ষা করছিল। দরজার পাল্লা দুটো পুরো খুলে দিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। সে ভিতরের চওড়া শ্বেত পাথরের দালানে পা রাখল।

ষোলো বছর পর নিজের আবাসে। বুকের মধ্যে একটা মোচড় দিল। এখন সে সত্যি সত্যিই তাহলে মুক্ত। এই মুহূর্তটার জন্য সে কতবছর যে অপেক্ষা করেছে। তার সারা শরীরের লোমকূপ থেকে উৎকণ্ঠা, প্রত্যাশা, উদবেগ আর হতাশা যে অবসাদ তৈরি করেছিল, তা যেন বাষ্প হয়ে বেরিয়ে তার চোখদুটোকে সজল করে দিচ্ছে। এবার সে নিজের জায়গায় ফিরে এসেছে। কিন্তু বিবির চন্দননগরে যাওয়াটা কি খুবই জরুরি ছিল?

‘আপনি দুপুরে আসবেন তাই ভাত করে রেখেছিলুম।’

এ কে? দিনরাতের কাজের লোক? নিশ্চয় নিঃসন্তান, অনাথা বিধবা এবং ভদ্র গেরস্ত বাড়িরই, না হলে বিবি রাখত না। এর হাতে সংসার ছেড়ে দিয়ে চলেও যেত না। বিবির খুব কাছের লোক!

‘দুপুরে আসব কে বলল?’

‘বউদি বলেছিলেন।’

‘কোথা থেকে আসব বলেছে?’

মুখে থতমত ভাব। নিশ্চয়ই জানে সে জেল খেটে আসছে, নিশ্চয়ই জানে কেন সে জেলে গেছিল। সে মুখ থেকে চোখ সরিয়ে বাঁয়ে প্রথম ঘরের দিকে তাকল। এই ঘরটার নাম কত্তার ঘর। বাড়ির কর্তারা, তার ঠাকুরদা দ্বারিক দত্ত, বাবা অমিয় দত্ত এই ঘরে বাস করেছে, মারাও গেছে। ঠাকুরদাকে সে দেখেনি। দরজায় ফিকে হলুদ জমিতে হালকা খয়েরি চাকার মতো ছাপ দেওয়া পরদা। পুকুরের জলে ঢিল ফেললে চক্রাকার তরঙ্গ যেমন বাড়তে বাড়তে পাড়ের দিকে যায়, সেই রকম। দরজার দু—পাশে দুটো জানালারও একই কাপড়ের পরদা। দালানের দুটো টিউব আলোই জ্বলছে। এই উজ্জ্বলতার মধ্যে চক্রাকার তরঙ্গগুলো যেন জীবন্ত হয়ে তার বুকের মধ্যে আর একটা তরঙ্গ তুলল। তার মনে হল সব কিছুই ঠিক আছে, চিন্তার কিছু নেই। তার নিজের জায়গা তাকে আগের মতোই গ্রহণ করবে।

দালানের ডান দিকে কাঠের ফ্রেমে তিন রঙের ঘষা কাচ বসানো টানা লম্বা জানালা। আটটা ছোটো ছোটা পাল্লা। খুললেই নীচে উঠোন, উলটোদিকে একইরকম কাচ বসানো দাদার দালান। রোদ যখন পশ্চিম থেকে আসে, এই দালানটা তখন রঙিন হয়ে যায়। সে আবার বিকেলের দালানকে ফিরে পাবে।

‘চন্দননগর কেন গেল?’

‘বউদির ভাইঝির মুখে ভাত।….আপনার ভাত তোলা আছে, গরম করে দোব?’

‘পরে। জানলাগুলো বন্ধ কেন?’

‘বউদি বলে গেছেন।’

‘তোমার নাম কী?’

‘অরুণা।’

‘কতদিন এখানে আছে?’

‘দু—বছর।’

‘আগে কোথায় ছিলে?’ কথাটা বলে সে এগিয়ে গেল। পরদাটা সরিয়ে ঘরের ভিতরে তাকাল। আলো নেবানো, সে ডান হাত দিয়ে দরজার পাশের দেওয়ালে তৃতীয় সুইচটা খুঁজে নিয়ে টিপল। হুবহু সেই ষোলো বছর আগের ঘর। পুবের দেওয়ালে বাবা—মার ছবি একই জায়গায়। মেহগনির খাটটা নড়াতে কম করে চারজন জোয়ানের দরকার। ওটাও একই জায়গায়। তবে একটু—আধটু অন্যরকম এতদিনে যে হবে, এটা সে ধরেই রেখেছে। বেডকভারেও হলুদ—খয়েরি। তার নীচে দুটো মাথার বালিশ। নিশ্চয় বিবি আর গুলুর। আয়না লাগানো আলমারিটা বাঁ দিকে উত্তরের দেওয়ালে সরানো হয়েছে আর সেই জায়গায় একটা কাঠের টেবিল। তার উপর কয়েকটা বই, টেবল ল্যাম্প, প্রচুর খাতা, কাঠের গ্লাসে রঙিন পেনসিল ও কলম আর একটা হাতল—ছাড়া চেয়ার। এগুলো নতুন। টিভি সেটটা এই ঘরেই ছিল, সেটাই শুধু নেই।

‘আগে কোথায় ছিলে?’ সে অরুণার মুখের দিকে তাকাল।

ঘোমটা বাড়িয়ে দিয়ে অরুণা বলল, ‘বাপের বাড়ি। আগে কোথাও কাজ করিনি।’

সে কাঁধ থেকে থলিটা নামিয়ে সেটা বিছানার উপর ছুড়ে দিয়ে পাঞ্জাবির বোতাম খুলতে শুরু করল।

‘আপনি ভাত খাবেন তো?’

‘আগে চান করব।’

সে বিছানায় বসল। শিমুল তুলোর চার ইঞ্চি পুরু গদির উপর দুটো তোশক। তার সারা দেহ কয়েক সেকেন্ড থরথর করেই স্তিমিত হয়ে এল। দু—হাতের চেটো বিছানায় আলতো বোলাতে বোলাতে সে হাসল। তার পরিচিত আরাম এবার সে পেল, এবার থেকে পাবে। চেটো দুটো সে দুই গালে চেপে ধরে দেখল, দরজা থেকে অরুণার কৌতূহলী নজর।

‘খুব অবাক লাগছে?’

অপ্রতিভ হয়ে অরুণা মুখটা পাশে ফেরাল। সে দেখল, যাই যাই করেও তারুণ্য ওর ঠোঁটে চিবুকে আর চোখে এখনও হালকাভাবে লেগে আছে। রাতে এই বাড়িতে আমরা দুজনেই শুধু থাকব, এমন একটা পরিস্থিতি রেখে দিয়ে বিবি ছেলেমেয়ে নিয়ে চন্দননগর চলে গেল কেন? এটা কি ইচ্ছে করে? সে অরুণার দিকে সোজা তাকাল।

‘বাড়িতে তুমি একা, আর কোনো লোক নেই?’

‘বাইরের কাজের জন্য হেমন্ত আছে, নীচে থাকে। ওকে ডেকে দোব?’

‘থাক।’

বাইরের বারান্দার দরজাটা খোলা। সে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এখনও কারখানা ঘরে আলো জ্বলছে। জরুরি বড়ো অর্ডার থাকলে সারারাত সে কাজ করিয়েছে। নিজেও মিস্ত্রিদের সঙ্গে রাত জেগেছে। কিন্তু এখন কারখানাটা কে চালাচ্ছে, কে দেখাশোনা করে? বিবি? চালাবার মতো যোগ্যতা ওর আছে। বিবি খুব শক্ত আর হিসেবি, অলস নয়। ব্যবসাটা বড়ো নয়, তাহলেও চালাতে গেলে বিশ্বাসী লোক দরকার, অর্ডার ধরার জন্য নানান জায়গায় যেতে হয়। পার্টির কাছে থেকে টাকা আদায় একটা বড়ো সমস্যা।

এবার থেকে সে আগের মতো নিজেই কাজকারবার দেখবে। সে উত্তর থেকে দক্ষিণে বাগানের উপর দিয়ে চোখ বোলাল। পিছনের বাড়িগুলোর জানালায় আলো জ্বলছে। বাঁ দিকে শিবু বর্ধন লেনের সেই বাড়িটার জানালায় পরদা সরানো। বারান্দা থেকে সে চিঠি তুলে ইশারা করত সনতের বোন মিতাকে। পরে জেনেছিল ওর ভালো নাম সুমিতা। মিতা তখন ক্লাস সেভেনে, সে টুয়েলভে। একদিন মিতা বেদম মার খেল তার মায়ের হাতে। ওকে এলাহবাদে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হল। কিছুদিন সে খুব মনমরা হয়েছিল, তারপর মিতাকে ভুলে গেল। কম বয়সে এই রকমই হয়, ক্ষীণ হাসি ফুটল তার চোখে।

ভালোই হয়েছে। দুজনের পক্ষেই ভালো। মিতা কোনোভাবেই বিবির ধারে—কাছে আসে না। সে বারান্দা থেকে ফিরে এসে টেবিলটার পাশে দাঁড়াল। একনজরেই সে বুঝল, পড়াশুনোর জন্য এটা ব্যবহৃত হয়। বইগুলো ফিজিক্সের। বিবি কেন যে এমএসসি পড়তে রাজি হল না, সেটা আজও তার কাছে রহস্য। বাবাও অনুরোধ করে বলেছিল, ‘আমাদের বাড়িতে এমএ তো দূরের কথা, গ্র্যাজুয়েট বউ—ঝিও নেই। ছোটো বউমা তুমি পড়তে চাইলে পড়ো।’ বিবি মুখ নামিয়ে বলেছিল, ‘দেখি।’

বিবি দেখেনি। বাবা মারা গেলেন। বিবিকে সে বলেছিল, ‘বাবার ইচ্ছেটা পূরণ করো।’ একই জবাব তাকেও দিয়েছিল। একটা খাতা তুলে মলাট দেখেই বুঝল, উচ্চচ মাধ্যমিক পরীক্ষার উত্তরপত্র। প্রায় ষাট—সত্তরটা খাতা। এগুলো এখানে কেন? বিবি স্কুলে বা কলেজে পড়াচ্ছে নাকি! সে দরজায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা অরুণার দিকে তাকাল।

‘বউদি স্কুলে পড়ায়?’

‘কলেজে পড়ান।’

‘কতদিন পড়াচ্ছে?’

‘বলতে পারব না, আমি তো এসে তক দেখছি পড়াচ্ছেন।’

বিবি তাহলে এর মধ্যেই এম এসসি পাশ করেছে! আশ্চর্য, খবরটা তাকে জানায়নি! আরও কত কী সংসারে ঘটে গেছে কে জানে! বাড়িতে ঢুকে এই প্রথম সে একটা নাড়া খেল। তার মনে হল, বিবি ইচ্ছে করেই যেন স্বামী আর শ্বশুরকে অগ্রাহ্য করেছিল, আর সেটা বুঝিয়ে দিতেই ওদের অনুপস্থিতিটাকে কাজে লাগিয়েছে।

কিন্তু ব্যাপারটাকে সে এভাবেই বা দেখছে কেন? সংসারের প্রধান, একমাত্র পুরুষটি না থাকায় অবশ্যই স্ত্রী একা হয়ে পড়েছিল আর মানুষের সঙ্গ পাওয়ার জন্য তাকে তো বাড়ির বাইরে যেতে হবেই। এ বাড়িতে বড়ো জায়ের সঙ্গে বিবির ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তার বউদি বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় ছাড়া ব্রেসিয়ার পরে না।

কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য বিবি আবার পড়াশুনো শুরু করল তাতে অস্বাভাবিক কিছু খোঁজার মানে হয় না। কিন্তু চাকরি নিল কেন, টাকাপয়সার অভাবে? জেলে থাকার সময়, মামলা চালাবার খরচের জন্য সে তার যাবতীয় স্থাবর—অস্থাবর সম্পত্তি দেখাশোনার আর বিক্রি করার, পোস্ট অফিসের সার্টিফিকেট ভাঙানোর আর ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার অধিকার সই করে বিবিকে দিয়েছিল উকিলের দেওয়া স্ট্যাম্প পেপারে। ব্যাঙ্কের নগদ টাকা, ব্যবসা আর গোকুলানন্দের চাষের যে জমিজায়গা, তার থেকে কত খরচ হয়েছে তিন বছর ধরে মামলা চালাতে? স্বামীর জন্য বিবি কি এমনই নিঃস্ব হয়ে গেল যে, তাকে চাকরি করতে হচ্ছে!

‘বউদির কলেজ কোথায়?’

‘বালিগঞ্জে।’

‘আমি এখন চান করব।’

সে ঝুলি থেকে খয়েরি ট্রাউজার্স আর সবুজ—সাদা ডোরাকাটা হাওয়াই শার্টটা বার করল। দরজিকে দিয়ে মাস ছয়েক আগে তৈরি করানো। তার অন্যান্য পোশাক, তোয়ালে, সাবান, আয়না, যা কিছু ছিল বিলিয়ে দিয়ে এসেছে। বিবি একটা পুরো—হাতা সোয়েটার বছর দশেক আগে কিনে দিয়েছিল। সেটার দশা দেখে কেউ নিতে চাইল না। জেলে রোজগার থেকে যা জমেছিল তার থেকে এত বছর ধরে খরচ—খরচা বাদ দিয়ে জেলার তাকে দিয়েছে সাতাশশো তেরো টাকা। আজ প্রায় চারশো খরচ হল। কত বছর পর সে এতটাকা অন্য লোকের হাতে দিল।

কাগজে মোড়া নোটগুলো বিছানার উপর রেখে সে বলল, ‘তোয়ালে আছে?’

‘কলঘরে নতুন তোয়ালে দেওয়া আছে।’

প্রত্যেকের জন্য আলাদা তোয়ালে, আলাদা চিরুনি এই বাড়ির নিয়ম। কলঘরের দরজার সামনে তোয়ালেগুলো দড়িতে ঝোলানো থাকে। চান করতে যাবার সময় যে যার নিজেরটা নিয়ে যায়, বেরিয়ে এসে আবার ঝুলিয়ে দেয়। প্রত্যেকটার আলাদা রঙ আর নকশা, ভুল হবার উপায় নেই।

‘তোয়ালে দিতে কে বলল, বউদি?’ কথাটা বলেই সে উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকাল।

‘হ্যাঁ’। একটা হালকা বাতাস খেলে গেল তার বুকের মধ্যে। তার দরকারের দিকে বিবি সজাগ থাকবে, এটা তো স্বাভাবিকই। তাকে পাঞ্জাবি খুলতে দেখে অরুণা দরজা থেকে সরে দালানে গিয়ে দাঁড়াল।

দালানটা চওড়া। কত্তার ঘর, তারপর মেজো ঘর। এই দুটো ঘরের মাঝে দেওয়াল ঘেঁষে খাওয়ার টেবল। জন্মে থেকেই সে শ্বেত পাথর বসানো টেবলটা আর কাঠের ছ—টা চেয়ারকে দেখে এসেছে। টেবলে রাখা জিনিসগুলো আগে সে দেখেনি, শুধু টেলিফোনটা ছাড়া। আগের ভারী কালো রঙের বদলে এটা জলপাই রঙের হালকা। টেবলের পাশেই ফ্রিজ। সাদার বদলে এটা টোমাটো রং—এর। তার অনুপস্থিতিতে কেনা। টুলের উপর রাখা জলের ফিলটারটাও নতুন। পিতলের ফুলদানিটা মোরাদাবাদি। তাতে আধ শুকনো রজনীগন্ধার কয়েকটা ছড়। প্লাস্টিকের ছোটো ধামায় চারটে সিঙ্গাপুরি কলা, খোসা কালো হয়ে উঠেছে। কাচের দুটো নুনের কৌটো, উপুড় করা চারটে স্টিলের গ্লাস আর নিকেলের ফোল্ডিং ফ্রেমের মধ্যে পোস্টকার্ড মাপের দুটি শিশুর রঙিন ছবি।

কলঘরে যাওয়ার সময় সে টেবলের পাশে থমকে ছবি দুটোর দিকে তাকাল। বছর দশেকের একটি মেয়ে, মাথায় কুঁচি করে ঘোমটার মতো বাঁধা ওড়না, ফুলের মুকুট, কপালে চন্দনের ফোঁটা, চোখে পুরু কাজল। সামনে থেকে তোলা ছবি, নাকটা হুবহু বিবির মতোই সরু, লম্বা। বোধহয় নাচের কোনো অনুষ্ঠানের পর সাজঘরে তোলা ছবি। মেয়েটি গুলু নিশ্চয়। এত ভারী মেক আপে বোঝা যাচ্ছে না মুখটা কেমন। হাসির জন্য ঠোঁট দুটি খোলা, নীচের একটা দাঁত নেই। অন্য ছবিটি অবশ্যই গোরার। ট্রাই সাইকেলে বসে, প্যাডেলে চটি—পরা পা, হাফ প্যান্ট, গোল—গলার গেঞ্জিতে ছাপছোপ দেওয়া, বাগানে তোলা ছবি। মুখটা সে ছবির কাছে নিয়ে গেল। তার মনে হল, শিশুটির চোখের মণির রঙ তার মতোই কটা, কান দুটি দীর্ঘ, চোয়াল সামান্য চওড়া। ভ্রূকুটি করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। দুজনে এখন কত বড়ো হয়েছে? গুলুর বয়স এখন কুড়ি, গোরার আঠারো। সে মুখ ঘুরিয়ে পাশে তাকাল। অরুণা তাকে লক্ষ করছে। ‘দাদামণি আর দিদিমণির ছবি।’ অরুণা পরিচয় দিল ছবি দুটোর।

‘জানি’।

সে দ্রুত পায়ে কলঘরের দিকে এগোল। দালানের শেষ প্রান্তের ঘরটাকে বলা হয় ছোটো ঘর। তার ডান পাশের সরু পথ দিয়ে যেতে হয় কলঘরে আর পায়খানায়। দড়িতে ঝুলছে তিনটি শুকনো রঙিন তোয়ালে। সে তিনটিতেই নাক ঠেকিয়ে গন্ধ নিল। বিবির গায়ের গন্ধ কোনটিতে সে বুঝে উঠতে পারল না। ও চান করে বেরিয়ে আসার পর কলঘরটা ভরে থাকত যুঁইয়ের গন্ধে। এই গন্ধের সাবান ছাড়া মাখে না। তোয়ালেতেও গন্ধটা লেগে থাকত। কাল চন্দননগর গেছে চান করে, আজ গন্ধ থাকার কথা নয়।

কলঘরে নিকেলের রডে ঝুলছে একটা সাদা তোয়ালে, তাতে আনকোরা গন্ধ। সাবানদানিতে সাদা নতুন সাবানের নীচে আধ খাওয়া একটা গোলাপি সাবান। সে শাওয়ারের কলটা ঘুরিয়েই বন্ধ করে দিল। পাজামাটা শুকনো রাখা দরকার, এটা পরেই কলঘর থেকে তাকে বেরোতে হবে। চান করে পরার মতো কিছু অরুণা রাখেনি। বিবি কি ভুলে গেছিল একটা পাজামা রেখে দেবার কথা বলতে! কিন্তু তার পুরনো জামা প্যান্ট, জুতো কি এখনও পরার মতো অবস্থায় আছে?

মাথার উপর থেকে বৃষ্টির মতো জল ঝরে পড়ছে। সে চোখ বন্ধ করল। কানের পাশ দিয়ে জলধারা গড়িয়ে নামছে। কাঁধ, বাহু, বুক যেন শুষে নিচ্ছে খরা জমির মতো। মুখ তুলে সে জলের আঘাত চোখে, কপালে, গালে নিতে লাগল। রাত্রে নিয়মিত সে চান করত চুল না ভিজিয়ে। সারারাত পাখার তলায় ভেজা চুলে শুলে তার সর্দি হয়। হয়তো কাল তার সর্দি হবে।

কলটা বন্ধ করে সে নতুন সাদা সাবানটা তুলে দিয়ে শুঁকল। ল্যাভেন্ডারের গন্ধ। সেটা রেখে দিয়ে গোলাপিটা শুঁকল। জুঁই, এটা বিবি মাখে। একটু ইতস্তত করে সে গোলাপি সাবানটা গলায় ঘষল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে অনুভব করার চেষ্টা করল, কিছু একটা তার মধ্যে ঘটে কি না। কিন্তু কিছুই ঘটতে শুরু করল না।

সাবানটা বুকে পেটে ঘষতে ঘষতে তার মনে পড়ল, সেদিনও তার দেহের কোষগুলো প্রবল সুখে ফেটে পড়েনি, আবেশে ঝিমিয়েও যায়নি। মনের মধ্যে শুধু একটা জ্বালা বোধ করেছিল। ষোলো বছর আগে এগারোই জুন শুক্রবার রাতে সে মেজোঘর থেকে এসেছিল কত্তার ঘরে। খাটে চতুর্থ জনের জন্য জায়গা হত না, তাই ছেলেমেয়ে নিয়ে বিবি এই ঘরে শোয়।

‘আজ থাক।’

‘বিবি প্লিজ।’ পাজামাটা খুলতে খুলতে সে বলেছিল।

‘কালকে বরং—’

‘কাল সকালে গোকুলানন্দে যাচ্ছি, রোববার বিকেলে ফিরব।’

‘ফিরে এসে বরং—’

‘না।’

অধৈর্য রুক্ষ স্বরটা বিবিকে বুঝিয়ে দিয়েছিল প্রত্যাখ্যান করলে আরও রূঢ়তা আসবে।

‘ওদের ঘুম যেন না ভাঙে।’

এ বাড়িতে তার জন্য বিবির ওটাই শেষ কথা। দু—হাতে অনিচ্ছুক ঊরুদুটো সরিয়ে তাকে নিজের জন্য জায়গা করতে হয়েছিল। আজও মনে আছে, তখন ঘুষি মেরে বিবির মুখটা থেঁতলে দিতে পলকের জন্য একবার ইচ্ছে করেছিল। প্রচণ্ড রাগ চেপে সে হিংস্রভাবে নিজের বিরাশি কেজি ওজন আছড়ে ছিল ওর নরম শরীরে। ওর ঠোঁট চাপা মুখ থেকে সে একটা শব্দ বার করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়, বিবি টুঁ শব্দটি করেনি। অন্ধকারের মধ্যেই সে ওর চোখের মণিদুটোকে পাথরের মতো কঠিন নিষ্পন্দ হয়ে থাকতে দেখেছিল। নিজের উপর অহেতুক একটা রাগ আর জ্বালা নিয়ে সে মেজোঘরে ফিরে আসে। ব্যাপারটা ধর্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়, শেষ রাত পর্যন্ত জেগে থেকে এই চিন্তাটা যতই তার মাথায় ধুঁইয়েছে, ততই সে গ্লানিতে আচ্ছন্ন হয়েছে। বিবি তাকে কখনোই বোঝার চেষ্টা করেনি, তাকে দয়া দেয়নি।

কিন্তু তার অপরাধটা কী? একজন স্বাভাবিক, সক্ষম স্বামী যা করে থাকে, সেইটুকুই সে করতে চেয়েছে। তা হলে এই বিরোধিতা কেন? ওর ইচ্ছা—অনিচ্ছার সামনে কী হাত জোড় করে দাঁড়াতে হবে? সে স্ত্রীকে ভালোবাসে, সুন্দরী, শিক্ষিত বিবির জন্য তার অহংকারও আছে। তবু কেন তাকে অপছন্দ করে, যেটা এক—এক সময় ঘৃণার মতো মনে হয়। বিবি এখনও কী ষোলো বছর আগের মতোই রয়ে গেছে?

চটকানো সাবানটা মুঠোর আঙুলের ফাঁক দিয়ে কাদার মতো বেরিয়ে আসতেই তার হুঁশ ফিরল। শুকিয়ে যাওয়া ফেনায় সারা গা চিটচিট করছে। শাওয়ারের কল খুলে দিয়ে সে চোখ বন্ধ করে হাসল, কাল তার সর্দি হবেই।

অরুণা টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে। দালানের পাখাটা ঘুরছে। গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে তাকে আসতে দেখে সে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘তোয়ালেটা দিন।’

‘দড়িতে তো জায়গা নেই আর।’

‘আর একটা দড়ি আছে।’

আর একটা দড়ি সে দেখেছে। তাতে একটা গামছা ঝুলছে, নিশ্চয় সেটা অরুণার। কাজের লোকের গামছা আর তোয়ালে একই দড়িতে থাকবে না, এটাই এ বাড়ির রীতি। তাহলে শুকনো তোয়ালেগুলো সরিয়ে তার তোয়ালের জন্য জায়গা বার করে দিতে পারে। অরুণা সেটা করার কথা ভাবল না কেন? আমাকে কি নীচু চোখে দেখছে? বিবির কাছ থেকে ও কতটা শুনেছে আমার সম্পর্কে?

তোয়ালেটা রেখে এসে অরুণা বলল, ‘চিরুনি দোব?’

‘এখন না, চুলটা আগে শুকোক। তুমি পাখাটা আর একটু বাড়িয়ে দাও আর খাওয়ার জল দাও।’

রেগুলেটারটা এক ঘর বাড়িয়ে অরুণা তার দিকে তাকাল।

‘আরও এক ঘর দাও।’

মুখ তুলে ঘূর্ণির বৃদ্ধিটা দেখতে দেখতে তার খেয়াল হল পাখাটা নতুন। ছোটো ছোটো অনেক বদলই ঘটে গেছে।

‘আপনাকে একটা গেঞ্জি দোব?’

অবাক হয়ে সে তাকাল। ‘গেঞ্জি আছে নাকি?’

‘দাদামণির আছে।’

‘গোরার!’ আরও অবাক সে। গোরা কত বড়ো হয়েছে? ‘আনো তো।’

অরুণা মেজোঘরের বন্ধ দরজায় পেতলের হুড়কোটা খুলে ভিতরে গেল, গোরা তাহলে এই ঘরেই থাকে। অরুণা গেঞ্জি এনে হাতে দিতেই সে চোখের সামনে ঝুলিয়ে অবিশ্বাসভরে তাকিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘এটা গোরার তো? ….. এত বড়ো হয়ে গেছে!’

গেঞ্জিটা পরে সে গভীর তৃপ্তির হাসি হাসল। আমার চেহারাটাই পেয়েছে, আঠারো বছরে আমি এত বড়োই ছিলাম। সে ঘরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াল।

‘আপনার ভাত গরম করে আনি?’

‘কী রান্না হয়েছে?’

‘মসুর ডাল, আলু—পটলের ডালনা আর মাংস।’

মসুর ডাল তার প্রিয়, এটা অরুণার জানার কথা নয়। নিশ্চয় বিবি বলে দিয়েছে। ডালের সঙ্গে ভাজা না থাকলে সে খেতে পারে না। মসুর ডালের সঙ্গে তার পছন্দ করলা ভাজা।

‘ভাজা করোনি?’

‘করলা ভেজেছি।’

‘বউদি বলে দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

তার চোখ ক্ষণেকের জন্য উজ্জ্বল হল। আসল জায়গায় বদল ঘটেনি। বিবি ভোলেনি তার পছন্দের ব্যাপারটা। একটা আবেগ তার বুক থেকে উঠে আসছে। সে ঢোঁক গিলে সেটাকে নামিয়ে দেবার চেষ্টা করল।

অরুণা একতলায় নেমে গেছে। জামা, ট্রাউজার্স আর নোটগুলো আবার ঝুলিতে ভরে সে একপাশে সরিয়ে রাখল। কাপড়চোপড়গুলো সে আর পরবে না ঠিক করেই রেখেছে। কাউকে দিয়ে দেবে, কিন্তু কাকে? তার মাপের লোক কে আর আছে? গোরা! পাগল নাকি, জেলের গন্ধ লাগা জিনিস নিজের ছেলেকে! বিছানায় টান টান হয়ে শুয়ে সে চোখ বন্ধ করল। বহু বহু বছর পর এমন একটা আরামের উপর সে শরীর রাখল। তার চেতনা থেকে অতীত ধীরে ধীরে এবার মুছে যাবে। একটা নতুন মানুষ হয়ে তার জীবন শুরু হবে আজ থেকেই।

অরুণার রান্নার হাত ভালো। সে প্রায় জাবর কাটার মতো অনেক সময় নিয়ে চিবিয়ে যাচ্ছে এক—একটা গ্রাস। টেবিলের অপর ধারে অরুণা দাঁড়িয়ে, সারা বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। দাদার টিভি বন্ধ। ও বাড়িতে দুই মেয়ে, নিশ্চয়ই এত দিনে তাদের বিয়ে হয়ে গেছে, তাহলে এখন লোক মাত্র দু জন। ওরা দশটায় শুয়ে পড়ে। এখন কটা বাজে?

সে মুখ তুলে দেওয়ালঘড়িটা দেখার জন্য তাকাল। এতক্ষণ সে লক্ষ করেনি, পেন্ডুলাম ঝোলানো সাদা ডায়ালের ঘড়ির জায়গায় একটা সোনালি ফ্রেমের গোলাকার ঘড়ি রয়েছে। ডায়ালটা ফিকে গোলাপি, তিনটে কাঁটা সোনালি। রাত্রে ঘুম না এলে সে দালানের ঘড়ির টকটক শব্দ শুনতে পেত। প্রতি ঘণ্টায় আর আধ—ঘণ্টায় ঘড়িটা বাজত। হপ্তার দম সে নিজের হাতে দিত।

‘আগের ঘড়িটার কী হল?’

‘জানি না। আমি এসে তো এই ঘড়িটাই দেখছি।’

‘তুমি রাতে শোও কোথায়?’

‘বউদির ঘরে, মেঝেয়।’

‘বউদির ঘর’ শব্দটা তার কানে বাজল। এটা তার কাছে নতুন। ‘কত্তার ঘর’ কথাটা হয়তো কেউই আর বলে না। গুলু আর গোরার জন্য এই বাড়ির কতটা অতীত বাকি রইল।

‘আমি আজ আসব, এটা আর কে জানে?’

‘হেমন্ত জানে।’

‘ও বাড়ির কেউ?’

‘বউদি বলতে বারণ করেছে।’

‘দালানের জানালা তুমি বন্ধ করে রেখেছ?’

‘বউদি আজ বন্ধ করে রাখতে বলেছে।’

‘আমি কেন জেলে গেছিলাম, জানো?’

সে অরুণার মুখের দিকে তাকাল। বিবি ওকে কী বলেছে, সেটা জেনে রাখা দরকার। বাড়ির আর পাড়ার লোকেরা, আত্মীয়স্বজনেরা কী শুনেছে বা জেনেছে তা সে জানে না। না জানলেও সে অনুমান করতে পারে। শুধু তো খুন নয়, তার সঙ্গে ছিল—।

‘আপনাকে কতকগুলো লোক খুন করতে এসেছিল। আপানি আটকাতে গিয়ে তাদের একজনকে মেরে ফেলেন।’

বিবি যতটা সম্ভব করেছে। ব্যাপারটাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য এর থেকে ভালো গল্প আর কী হতে পারে! সে মেরে ফেলেছে, খুন করেনি, সে অপরাধ করতে বাধ্য হয়েছে—এই কথা কি বিবি ছেলেমেয়েদেরও বলেছে?

‘আপনাকে কী আরও মাংস দোব?’

‘না। রান্না ভালো হয়েছে।’

‘ঝাল ঠিক হয়েছে? বউদি বলেছিল আপনি বেশি ঝাল খান।’

সে মাথা হেলিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’

‘টক দই এনে রেখেছি।’

নিশ্চয় বিবি ওকে বলে গেছে। ওই বাড়িতে একমাত্র সে—ই মিষ্টি পছন্দ করে না। বাবার ডায়াবিটিস ছিল, তবু প্রতি রাতে চারটে সন্দেশ না খেলে তার ভালো ঘুম হত না। নিজের খাওয়ার ব্যাপারে বিবি কড়াভাবে নিয়ম মেনে চলে। এখনও হয়তো রাতে শোয়ার আগে এক গ্লাস দুধ খায়। এটা ওর ছোটোবেলার অভ্যাস।

ফ্রিজ থেকে অরুণা দইয়ের ভাঁড় বার করে চামচ দিয়ে দই কেটে পিরিচে রাখছে। সে আড়চোখে অরুণার হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মাথার মধ্যে হঠাৎ একটা কম্পন অনুভব করল। হুবহু সেই আঙুল। মোটা, বেঁটে আর ভোঁতামাথার আঙুল। সেইরকম ভাবেই চৌকো সাদা নখগুলো ছাড়িয়ে আঙুলের মাথা বেরিয়ে রয়েছে। দুটো মানুষের আঙুল হুবহু এক হয় কী করে!

আমি কী এখনও তাহলে ভুলে যেতে পারিনি।

‘থাক।’ সে চেয়ার থেকে উঠে পড়ল। ‘আজ আর দই খাব না। শরীরটা ভালো লাগছে না।’

অরুণাকে অনুরোধের সুযোগ না দিয়ে সে দ্রুত বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল। সাবানে হাত ধুতে ধুতে বলল, ‘তুমি শোবে কোথায়?’

‘বউদির ঘরে।’

‘কোথায়?’

অরুণা মৃদুস্বরে বলায় সে স্পষ্ট শুনতে পায়নি। মুখ তুলে সামনের ছোটো আয়নাটায় সে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। দালানের অর্ধেক আর টেবিলটা দেখা যাচ্ছে। অরুণা বাসন তুলছে। সে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘ কোথায় শোবে বললে?’

অরুণা তার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকাল। ‘কেন বউদির ঘরে, রোজ যেমন শুই।’

‘সেকি, এক ঘরে দুজন?’

‘তা কেন, আপনি আপনার ঘরে শোবেন, বিছানা তো করাই আছে।’

অরুণা ডানহাতের তর্জনি তুলে ছোটোঘরের বন্ধ দরজাটা দেখাল।

একটা চিৎকার তার গলা পর্যন্ত উঠে এসে থমকে গেল। সে বলতে চাইল, ‘বেরিয়ে যাও, বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে। কোথায় আমি শোব, সেটা আমিই ঠিক করব। তুমি একটা ঝি, কাজের লোক। আর এই পরিবারের কর্তা আমি!’

‘ছোটোঘরে শোব, সেটা কে তোমায় বলল?’

‘বউদি।’

একহাতে বেসিনটা সে ধরে না নিলে টলে যেত। এই মেয়েমানুষটা তার মনিবের নির্দেশমাত্র পালন করছে। এর সামনে রাগ, ক্ষোভ চিৎকার মানে নিজেকেই সাধারণ স্তরে নামিয়ে আনা।

‘তুমি এখন নীচে খেতে যাবে?’

‘হ্যাঁ। ছোটোঘর খোলাই আছে।’

অরুণা নীচে চলে গেল। বিবি তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে, এটা সে একবারও ভাবেনি। ভাবা উচিত ছিল। চার বছর তার সঙ্গে দেখা করতে যায়নি, একটা চিঠিরও উত্তর দেয়নি, জেলের ফটকেও তাকে নিয়ে যাবার জন্য কেউ ছিল না। এগুলোই তো জানিয়ে দিয়েছে তাকে উপড়ে ফেলেছে এরা মন থেকে। এই বাড়িতে একটা মাছি আর সে কি একই ধরনের মনোযোগ পাবে? বুকের কাছে মাথা নামিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে রূঢ় ধাক্কাটা সামলে চেয়ারে এসে বসল।

তার মনে হচ্ছে সে যেন আবার অধিকার হারাল। মায়ের সঙ্গে ছেলেমেয়েরাও তাকে বোধহয় পরিত্যাগ করবে। এখন আর সে বাবা নয়, স্বামী নয়, কিছুই নয় এই বাড়িতে। সে এই বারান্দায় হাঁটবে, সবার সঙ্গে কথা বলবে, টেবিলে বসে খাবে, টিভি দেখবে, বাড়ির বাইরে যাবে, প্রতিটি কাজ স্বাভাবিক মানুষের মতো করবে অথচ সে কিছুই নয়।

কী ভয়ংকরভাবে বিবি তাকে শাস্তি দিল। ও বোধহয় আজকের দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। ইচ্ছে করেই সবাইকে নিয়ে চন্দননগরে গেছে, যাতে তার নির্দয়তার আঘাতে ভেঙে পড়া একটা মানুষকে না দেখতে হয়। তার প্রতিভূ হয়ে অরুণা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে এই বাড়িতে তার জায়গা কোথায়।

আপাতত অ—দরকারি কিন্তু ভবিষ্যতে দরকার হতে পারে, এমন সব জিনিস রাখার জায়গা এই ছোটোঘর। একটা উঁচু কাঠের র‌্যাকে ছেঁড়া বই, খবরের কাগজ; ইলেকট্রিকের, কর্পোরেশন ট্যাক্সের, টেলিফোনের বিল, পুরনো জুতো, গ্রামোফোন রেকর্ড; ভাঙা আয়না, চেয়ার, শ্বেত পাথরের টুকরো এমনকী বাটনা বাটার শিল পর্যন্ত এই ঘরে ছিল। একটা ছোটো তক্তপোশে গোটানো থাকত শতরঞ্চি মোড়া তোশক। পুবে আর দক্ষিণে দুটো ছোটো জানালা, অন্য দুটো ঘরের মতো এর লাগোয়া কোনো বারান্দা নেই। আগে ছোটো একটা ছাদ ছিল, তার ঠাকুরদার সময়ে ছোটোঘরটা তৈরি হয়। বাড়ির সর্বত্র কাঠের কড়িবরগা, এই ঘরের লোহার।

সে ছোটোঘরের ভেজানো দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। ভেজানো দরজাটা খুলে ঢুকলেই সে আর একটা জগতে পৌঁছে যাবে। জেল সে জানে। যাবজ্জীবন কারাবাসের দণ্ডাজ্ঞা নিয়ে জেলে ঢুকলেও সেখানে একটা প্রতিশ্রুতি ছিল, একদিন সে মুক্তি পাবে। কিন্তু এই ছোটোঘরটাকে সে জানে না। সে জানে না কীসের সম্ভাবনা এখানে রয়েছে। তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। খুনের মামালায় আসামি, ধর্ষণের মামলায় আসামি, আমি রাঘবেন্দ্র নারায়ণ দত্ত, আমার আর কিছুই করার নেই। এবার আমি নিজেকে বিলোপ করার দণ্ড মাথা পেতে নিচ্ছি।

আমি এখনও বুঝতে পারছি না আমি কে! সে চোখ বন্ধ করে ছোটোঘরের দরজায় হাত রাখল।

তিন

সে ঘুমের মধ্যে অস্বস্তিভাবে নড়াচড়া করল। পাখা ঘুরছে তবু সে ঘেমে উঠল। একবার ঘুম ভেঙে উঠেও বসে। নতুন বিছানার চাদরের গন্ধ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে শরীরে ঢুকে পাকাপাকিভাবে যদি রয়ে যায়, এমন একটা ধারণা তাকে কিছুক্ষণ বিব্রত করে রেখেছিল। মুখে ঘাড়ে জল দেবার জন্য বেসিনে যাওয়ার ইচ্ছাটা দমন করে সে আবার শুয়ে পড়ে। এই ঘরে কোনোদিনই সে রাত কাটায়নি। নতুন কলি করা হয়েছে, চুনের গন্ধ এখনও মিলিয়ে যায়নি।

চোখ বন্ধ করে বুকের উপর দু—হাত রেখে সে ঘুমোবার চেষ্টা করে। তখন আবছাভাবে মনে পড়ে শ্রীগোপালের কথাটা : ‘যদি ঘুম না আসে, তাহলে মদ খেলে আসবে।’ ‘তোকে কে বলল?’ ‘বাবাকে দেখেছি ঘুম না এলে খায়।’ ‘নন্দকাকা মদ খায়।’ ‘ঘরের তাকে কাগজে মোড়া বোতল লুকিয়ে রাখা আছে। আলো জ্বেলে প্রথমে দেখে নেয় আমি ঘুমিয়েছি কি না। আমি তখন মটকা মেরে থাকি।’ ‘তুই খেয়েছিস কখনো?’ ‘খেয়েছি। তুই খাবি?’ ‘খেলে মাতাল হয়, বাবা পিঠের চামড়া তুলে দেবে।’ ‘একটু খেলে কিচ্ছু হয় না। এলাচ দিয়ে পান খাবি, কেউ মুখে গন্ধও পাবে না। খাবি তো আমাদের ঘরে আয়।’ দুপুরে একতলায় নন্দকাকার ঘরে, কালমেঘ রস খাওয়ার মতো সে ঢক করে জীবনে প্রথমবার নির্জলা মদ খেয়েছিল। চোখ বুজে সে উগরে আসতে চাওয়া তরল জিনিসটাকে নীচের দিকে নামাতে ধস্তাধস্তি করেছিল নিজের সঙ্গে। চোখ খুলে সে শ্রীগোপালের লম্বা মুখ আর বেরিয়ে থাকা লম্বা দুটো উপরের দাঁতের দিকে তাকিয়ে ছলছল স্বরে বলেছিল, ‘ঘোড়ামুখো, তুই আমাকে নষ্ট করলি!’ সে ছুটে দোতলায় এসে ছোটোঘরের দরজা বন্ধ করে তক্তপোশে শুয়ে ছিল।

তখন সে ক্লাস এইটে, শ্রীগোপাল ক্লাস সিক্সে। তারা সমবয়সি ছিল। তাদের কাচ আর আয়নার ব্যবসা, গোকুলানন্দর জমি—জায়গা নন্দকাকাই দেখাশোনা করত। মা—মরা শ্রীগোপালকে মেদিনীপুরের গ্রাম থেকে নিয়ে যখন এল তখন তার বয়স দশ। ফেল করে করে শ্রীগোপাল কুড়ি বছর বয়সে মাধ্যমিক পাস করল, তার দু—মাস পর পঁয়তাল্লিশ বছর দত্তদের সেবা করে নন্দকাকা মারা গেল আলসারে ভুগে। মারা যাবার এক হপ্তা আগে নন্দকাকা দোতলায় উঠে এসেছিল বাবার সঙ্গে দেখা করতে। ‘বড়োবাবু, শ্রীগোপালকে একটু দেখবেন। আমি মরে গেলে ও অনাথ হয়ে যাবে। ‘ ‘একথা বলছ কেন নন্দ? রঘু আর শ্রীগোপালকে আমি আলাদা করে দেখি না তো। তুমি নিশ্চিন্ত থাক, ওর দায়দায়িত্ব আমি নিচ্ছি।’ শ্রীগোপাল চেয়েছিল কলেজে ভরতি হতে। বাবাকে সেকথা সাহস করে বলতে পারেনি। তাকে ধরেছিল, ‘রোঘো, তুই বল। তুই বললে জ্যাঠামশাই শুনবেন।’ বাবা শোনেননি। ‘শ্রীগোপালের পড়াশুনোর মাথা নেই, মিছিমিছি বছরগুলো নষ্ট হবে। তার থেকে বরং রোজগারের চেষ্টা এখন থেকেই করুক। ওকে গোকুলানন্দে রাখব। ওর যা বিদ্যে তাতে চাকরিবাকরি হবে না, বরং চাষবাসের লাইনে যাক, এতে পয়সা আছে।’ সে শ্রীগোপালকে সেই কথাই জানিয়েছিল। তখন কীরকম থমথমে হয়ে গেছিল ওর মুখ। বড়ো বড়ো দুটো দাঁতে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে হতাশা আর ক্ষোভ দমন করে বলেছিল, ‘তোকে আর আমাকে নাকি আলাদা করে দেখেন না? তুই কলেজে পড়বি আর আমি ধানচাষ করব। এই হচ্ছে বড়োলোকদের চরিত্র। ঠিক আছে তাই করব।’ তখন সে শ্রীগোপালকে কী বলেছিল? তিরিশ বছর আগে…না আরও কম, আঠাশ বছর। কী বলেছিলাম? মনে পড়ছে না….মনে পড়ছে না….আমার স্মৃতিশক্তি কমে গেছে….কিন্তু আমার সব কথা মনে পড়ার আর কি কোনো দরকার আছে?

ধীরে ধীরে তার অবসাদভরা চেতনা ক্ষীণ হয়ে ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি জায়গায় তাকে রেখে নিল। একসময় তার মনে হল, বাইরের দালানে কারা হাঁটচলা করছে, কথা বলছে। তার ইচ্ছে হল উঠে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ায়। দাঁড়াবার জন্য অস্থির হয়ে বিছানায় এপাশ ওপাশ করে সে আবার ঘুমের মধ্যে ঢুকে গেল। পুবের খোলা জানলা দিয়ে বিছানায় রোদ এসে তার ঘুম ভাঙাতে সে চোখ খুলে প্রথমেই দেখল সিলিংয়ে ঝোলানো রঙচটা পাখাটাকে। অবাক হয়ে সে বুঝতে চেষ্টা করল, এখন সে কোথায়? পাখাটা রাতে ঘুরছিল, এখন থেমে রয়েছে।

সে ঘরের চারিদিকে চোখ বোলাল। যে ছোটোঘরটাকে সে চিনত, সেটা ছিল অন্যরকম। কাঠের র‌্যাকটা রঙিন বিবর্ণ একটা পরদা ঝুলিয়ে আড়াল করা। যে সিঙ্গল খাটে সে শুয়ে রয়েছে সেটাও নতুন। প্লাস্টিকের চাদরে ঢাকা কাঠের একটা ছোটো টেবল, তার ওপর হাতঘড়িটা, প্লাস্টিকের জাগ, কাচের গ্লাস আর একটা কাঠের চেয়ার। এর বেশি আর কিছু তার চোখে পড়ল না। সে উঠে বসে হাতঘড়িটা তুলে নিয়ে সময় দেখল। আটটা—পঞ্চাশ। ঘরটা আগের মতো হতশ্রী নয় কিন্তু কীরকম যেন খেলো, দায়সারা আর যত্ন—বঞ্চিত। খাটের কাঠ খুবই সস্তার। সে চাদরটা তুলে দেখল তোশকটা নতুন এবং পাতলা।

দালানে কারা কথা বলছে? কান পেতে সে শোনার চেষ্টা করল। মেয়ে গলায় কে বলল, ‘চায়ে চিনি নিতে বারণ করেছি অরুণাদি, তবু দিয়েছে।’ অরুণার উত্তরটা সে শুনতে পেল না। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। গোরার গেঞ্জিটা তার গায়ে। চুল আঁচড়ানো দরকার কিন্তু চিরুনি নেই, দাঁত মাজার ব্রাশও নেই। ব্রাশটা রেখে দেওয়া উচিত ছিল। দু—হাতের আঙুল চুলে ঢুকিয়ে পিছনে চিরুনির মতো চালাল। দরজার কাছে এসে একটু ইতস্তত করে পাল্লাদুটো সে ভিতরদিকে টানল।

ওরা একসঙ্গে মুখ ফিরিয়ে তাকাল তার দিকে। ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই ওরা জেনে গেছে, সে কালরাতে এসেছে, তাই চমকাল না। টেবলের তিনদিকে তিনটি চেয়ারে বসে ওরা তার দিকে সোজা তাকিয়ে রয়েছে। বড়ো চেহারার যে ছেলেটি, যার চোখ একবার কুঁচকে উঠল, সে নিশ্চয় গোরা। যে মেয়েটি মুখ পিছনে ঘুরিয়ে দেখছে, চোখদুটো বড়ো হয়ে উঠেছে, সে নিশ্চয় গুলু। দুজনের মাঝে বসে রয়েছে বিবি। সে ডানদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখছে। তিনজনের চাহনিতে একটাই মিল। চোখগুলো যেন, প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন লেনসের দূরবিন দিয়ে তার মুখের ভাব ধরার জন্য গভীর অনুসন্ধানী। তার চোখের, ঠোঁটের প্রতিটি কোষ, তন্তু, শিরা, শ্বাসপ্রশ্বাস পর্যবেক্ষণ করছে প্রবল কৌতূহলে । তার কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক মনে হল। ষোলো বছর এরা তাকে দেখেনি, সেও দেখেনি এদের।

কৌতূহলটা পনেরো—কুড়ি সেকেন্ড পর্যন্ত প্রখর থেকে ধীরে ধীরে নিবে এল। গুলু মুখ ফেরাল তার মায়ের দিকে। গোরা মুখ নামাল চায়ের কাপে। বিবিই শুধু তাকিয়ে রইল তার দিকে। ওর চোখেই অপরিচয়ের ছাপটা নেই। মুখ নামিয়ে চাপাস্বরে সে কিছু বলতেই গুলু তার মায়ের বাঁদিকে খালি চেয়ারটায় উঠে এল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। এটা বিবির না—বলা নির্দেশ—ওই চেয়ারটায়ই তাকে এখন বসতে হবে।

সে হাসার চেষ্টা করল। আর শুধু বিবিই সেই হাসিটা দেখল। সে আশা করল, পালটা এক চিলতে হাসি বিবির চোখে ফুটে উঠবে। তার বদলে বিবি মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে গুলুর পরিত্যক্ত চেয়ারটা দেখাল। বসার আগে সে তিনজনের মুখের উপর চোখ বুলিয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং।’ শুধু গুলু অস্ফুটে বলল, ‘মর্নিং।’

‘চন্দননগর থেকে কখন তোমরা ফিরলে?’ জিজ্ঞাসাটা বিবিকে।

‘আধঘণ্টা আগে। তোমাকে চা দেবে?’

‘হ্যাঁ।’

ঘুম ভাঙার পর বিছানাতেই সে এক কাপ চা খায়। বিবির সেটা নিশ্চয় মনে আছে। এতে আপত্তি ছিল ওর: ‘দাঁত না মেজে কিছু খাওয়া আনহাইজিনিক।’ সে বলেছিল, ‘গোলি মারো তোমার হাইজিনকে, বেড—টি দাঁত মেজে খেলে সেটা আর বেড—টি হয় না।’ বিবি আর একদিনও দাঁত মাজার কথা তোলেনি।

আজও তুলল না। তাহলে কি ও বদলায়নি কিংবা ভীষণভাবে বদলেছে বলেই ব্যাপারটা গ্রাহ্যে আনল না?

‘দাঁত মাজার ব্রাশ, পেস্ট কিছুই আমার নেই। কাউকে দিয়ে আনানো যাবে কি?’

‘কেন যাবে না!’ ছেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ডাক তো হেমন্তকে।’

গোরা দ্রুত উঠে গিয়ে দালানের জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে হেমন্তকে ডাকল। ওর ডাকার স্বরটা কেমন যেন, উৎকণ্ঠিত, জরুরি, তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি করতে চাওয়ার মতো। কী নিষ্পত্তি করতে চায়? বাবাকে প্রথম দেখার টাল যে সামলাতে পারছে না সেটা বোঝাই যাচ্ছে ওর ভাবভঙ্গিতে। নিজেকে খাড়া রাখতে চাইছে। বাবাকে গ্রাহ্য করবে কী করবে না এখনও তা ঠিক করে উঠতে পারেনি। গোরার পুরো চেহারাটা এই প্রথম সে দেখল। আঠারো বছরের, কিন্তু একটা ব্যাটাছেলের মতোই বটে! সে স্নেহভরা তারিফ নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকল।

‘এক্সকিউজ মি।’ অস্ফুটে সবার উদ্দেশে কথাটা বলে গোরা মেজোঘরে ঢুকে গেল। বাবার দিকে সে একবারও তাকাল না।

স্বাভাবিকই। সে মনে মনে বলল, বলতে গেলে এই প্রথম বাবাকে দেখছে, জড়তা তো থাকবেই। ধীরে ধীরে আলাপ হবে। নতুন করে বিবির সঙ্গেও সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, এখনও তো তার সঙ্গে বাইরের লোকের মতোই ব্যবহার করা হচ্ছে।

অরুণা চা দিয়ে বলল, ‘কিছু খাবেন, মাখন—পাউরুটি?’

‘না।’ সে বিবির দিকে তাকাল, খাওয়ার কথাটা ওরই তো তোলা উচিত ছিল।

‘চন্দননগর থেকে কখন বেরিয়েছ? কার মেয়ের ভাত, সুবোধের?’ সুবোধ ওর ছোটোভাই, তার বিয়ের সময় ক্লাস ফোর—এ পড়ত।

‘সাতটার ব্যান্ডেল লোকাল ধরে এলাম। হ্যাঁ, সুবোধের মেয়ের ভাত।’ সহজ স্বচ্ছন্দ বলার ধরন। বিজ্ঞানের ছাত্রী, কলেজে পড়ায়, যতটুকু প্রশ্ন ততটুকুই উত্তর। সে বিবির মুখের দিকে এখন ভালো করে তাকাল। মুখটা সামান্য ভারী হওয়া ছাড়া আর কিছুই বদলায়নি। থুতনির নীচেটা একটু ফুলে রয়েছে, চর্বি। গলাটা আর লম্বা দেখাচ্ছে না। বাহুদুটো অন্তত দু—তিন ইঞ্চি মোটা হয়েছে। গায়ের রঙও আর আগের মতো ফরসা নেই। কানে সেই পুরোনো হিরের—তার চোখ নিথর হয়ে গেল। বিবি চুল কেটে ফেলেছে।

সে মুখ নামিয়ে টেবিলে চোখ রাখল। সে টের পাচ্ছে গুলু একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। বিবির চুল, ঘাড় আর কাঁধের উপর ছড়ানো, পিঠে ব্রেসিয়ারের দু—পাশে চর্বি উপচে উঠেছে। কাজটা বোধহয় ইচ্ছে করেই করেছে। ওর দীর্ঘ চুল তার ভালো লাগত বিবি সেটা জানে। তাকে আঘাত দেবার জন্য যদি চুল কেটে থাকে, তাহলে বিবি খুব সফল নয়। গত রাতে ছোটোঘরের দিকে তোলা অরুণার আঙুলই তাকে চুরমার করে দিয়েছে। তারপর আর কোনোকিছুই তাকে যন্ত্রণা দিতে পারবে বলে তার মনে হচ্ছে না।

‘তোমার ভালো নাম আমি জানি না।’

‘জনা।’

‘বেশ নাম। কে রেখেছে, মা?’

‘হ্যাঁ।’

‘গোরার ভালো নাম কী?’

‘গোরা!’ গুলু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। ‘গোরা কে?’

‘উনি রণোর কথা বলছেন। ওর ভালো নাম রণব্রত।’ বিবি তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেবার সময় ভ্রূ কোঁচকাল। তার মনে হল, বিবির চাহনিতে ঔদ্ধত্য আর বিরাগ। যেন বলতে চায়, এরা আমারই ছেলেমেয়ে, এদের আমিই মানুষ করেছি, আমার দেওয়া নামেই এরা পরিচিত হবে। রাঘবেন্দ্র নারায়ণ দত্তর দেওয়া নাম এরা বহন করবে না।

‘জনাকে আমরা জনা বলেই ডাকি, ওর ডাকনাম এটাই।’

সে আবার মুখ নামিয়ে ফ্যাকাশে হাসি হাসল। বিবি নামটা ওর বাপের বাড়ির দেওয়া। যদি তার দেওয়া হত, তাহলে বিবি নিশ্চয় বদলে নিত ।

দালানের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে সেই লোকটি, কাল রাতে যে ফটকের কাছে তার পাশ দিয়ে চলে গেছিল। বছর পঁয়ত্রিশ বয়স, গোল মুখটা বোকামিতে ভরা, তেল চকচকে ব্যাকব্রাশ চুল, হাফশার্টের হাতার তলায় একটা বড়ো মাদুলি।

‘বউদি, ডেকেছেন?’

‘এত দেরি হল কেন আসতে? ডেকেছি তো অনেকক্ষণ।’ বিবি চেয়ার থেকে উঠল। ‘দোকানে যেতে হবে, তাড়াতাড়ি কয়েকটা জিনিস এনে দাও।’ ব্যস্তভাবে সে ঘরে ঢুকে তার ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এল।

‘কী আনতে হবে?’

‘টুথব্রাশ, পেস্ট তো বাড়িতেই রয়েছে, একটা চিরুনি চাই। আর তো এখন কিছুর দরকার হচ্ছে না।’

বিবি তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল। এই প্রথম আজ বিবির গম্ভীর মুখ থেকে সে টেনশন আর ব্যক্তিত্ব সরে যেতে দেখল। স্বাভাবিক, সহজ হাসিভরা বিবি একটা দুর্লভ প্রাপ্তি।

‘একটা সেফটি রেজারও দরকার।’

ডান হাতটা নিজের থেকেই তার গালে উঠে এল। বিবি দাড়ি পছন্দ করে না। ‘দাড়িটা আমি রাখব।’

সে যা দেখবে আশা করেছে তাই হল। বিবির ভ্রূ কুঁচকে রইল তিন—চার সেকেন্ড, চাহনিটা ক্রমশ জটিল হয়ে উঠল। বিবি বুদ্ধিমতী, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে তার বিরুদ্ধে এটা প্রতিরোধের জন্যই বলা। আবার সেই পুরোনো রাঘবেন্দ্র নারায়ণ। কিন্তু কতদিন সে বিবিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? এক সময় তো নুয়ে পড়তে হবেই। বিষয় সম্পত্তি অর্থ সবই তো সে লিখে দিয়েছে। এই বাড়িতে দাদা—বউদিরা ছাড়া বোধহয় সবই নতুন হয়ে গেছে। পুরোনোর সঙ্গে বিবির সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টাটা কেন, এতে ওর কী লাভ হবে?’

‘দাড়ি থাকলে চট করে মানুষকে চেনা যায় না। আমার বোধহয় আপাতত সেটাই দরকার।’

‘হ্যাঁ, সেটাই দরকার।’

বিবি মুখ নামিয়ে মৃদুস্বরে কথাটা বলে ব্যাগ থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বার করে হেমন্তর হাতে দিল। ‘একটা দাঁতমাজার ব্রাশ আর একটা ছেলেদের চিরুনি আনবে।’

বিবি ব্যাগটা ঘরে রেখে ফিরে আসতেই সে বলল, ‘আমার জামাকাপড়গুলোর কিছু এখনও আছে কি?’

‘থাকা কি সম্ভব?’

‘তা বটে! এই দ্যাখো, গোরার গেঞ্জি পরে আছি। কিছু কাপড়—চোপড় তো কিনতেই হবে।’ সে সচেতন থেকেই ‘গোরা’ নামটা উচ্চচারণ করল, এই নাম তারই দেওয়া। ‘রণো’ সে স্বীকার করবে না। বিবির নিশ্চয় কান এড়ায়নি ‘গোরা’ শব্দটা। বুদ্ধিমতী, তাই মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া ফোটাল না।

‘আমি কিনে এনে দেব।’

‘তুমি কি আমার মাপ জানো?’

‘রণোকে সঙ্গে নিয়ে যাব।’

বিবি আবার হাসল। এই হাসিতে তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য নষ্ট হল না। সে হৃদয়ের গভীরে তৃপ্তি বোধ করল, গোরা আর সে সমান—সমান। গোরার বয়সে তার বাপও অমন চেহারার ছিল। সে চেয়ার থেকে উঠে বলল, ‘আমার ঘরে একটা আয়না নেই।’ সে মেনে নিল ছোটোঘর তারই ঘর। ‘একটা আলনাও দরকার। পাখাটা বন্ধ হয়ে গেছে।’

‘লোডশেডিং।’ বিবি বলল।

‘পাওয়ার কাট।’ গুলু বলল।

‘একই ব্যাপার জন্য।’ প্রায় ধমকের মতোই শোনাল বিবির স্বর।

গুলু ঢোঁক গিলল। মেয়েটার মুখ মায়ের মতো হলেও স্বভাবে বোধহয় ততটা মিল নেই। দালানের দুই প্রান্তের জানলাগুলো খোলা, শুধু টেবিলের সামনে মাঝেরটা বন্ধ। দাদার দিক থেকে দেখা যাবে না টেবিলে বসা লোকেদের। এটা নিশ্চয় বিবির তাকে আড়ালে রাখার চেষ্টা।

‘তুমি কী পড়ছ এখন?’

‘ফার্স্ট ইয়ার, সায়ান্স।’

‘কোথায়?’

‘যাদবপুরে।’

‘আজ কলেজে যাবে না?’

‘যাব, সাড়ে এগারোটায় ক্লাস।’ গুলু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে পড়ল।

‘জনা, বাথরুমে যাবে তো এখুনি যাও।’

‘তুমি কলেজে পড়াচ্ছ শুনলাম, এমএসসি—টা কবে পাশ করলে? আজ তোমার কলেজ নেই?’

নিছকই কৌতূহল মেটাতে প্রশ্ন করা। কিন্তু বিবি সহজভাবে সেটা নিল না। গুলু ঘরে ঢুকে যাবার পর সে বিরস স্বরে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ পড়াচ্ছি, বসে খাবার মতো অত টাকা কোথায়? সবই তো শেষ হয়ে গেছে।’

কেন শেষ হয়ে গেছে বিবি তা আর বলল না। আন্দাজে ওর অনুক্ত কথাটা ধরে নিয়ে সে অনুতপ্ত গলায় বলল, ‘আমার জন্যই।’

বিবি নীরব রইল। সে আড়চোখে ওর মুখের দিকে তাকাল। মুখটা কঠিন। হয়তো মনে মনে বলছে, সংসারটাকে মানে মর্যাদায় ডুবিয়ে, টাকাপয়সায় নিঃস্ব করে দিয়ে এখন অনুশোচনা করার কোনো মানে হয় না।

‘আমি কিন্তু তোমাকে খরচ করতে বারণ করেছিলাম। সুপ্রিম কোর্টে যেতে মানা করেছিলাম। জলের মতো টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা আমি বুঝতাম।’

‘এই বোঝার কোনো মূল্য নাই। তুমি এটা কি বোঝনি, স্বামীর জন্য স্ত্রী শেষচেষ্টা করবেই। এমন একটা অবস্থা এসেছিল যে, গোকুলানন্দর জমিজায়গা সম্পত্তি বিক্রি করার কথাও ভাবতে হয়েছিল। আমার কাকা বাধা না দিলে হয়তো বিক্রিই করে ফেলতাম। তার বদলে স্টিল ফার্নিচারের কারখানাটা লিজ দিলাম একজন গুজরাটিকে।’

‘লিজ!’ সে চমকে সোজা হয়ে বসল। ‘আর. ডি. এন্টারপ্রাইজ লিজ দিয়েছ?’

‘একত্রিশ বছরের জন্য।’ বিবি চকিতে তার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘ওটা চালাবার মতো কেউ তো আমার নেই। মিছিমিছি পড়েই থাকত।’

‘কারখানাটা তাহলে এখন আর আমাদের নয়?’

‘না।’

‘আমার দাদার কাছ থেকে তো টাকা চাইতে পারতে।’

‘তোমার দাদাকে তুমি ভালোই চেনো। একবারও খোঁজ নেননি, পাশে এসে দাঁড়াননি। এমন লোকের কাছে টাকার জন্য হাত পাতার প্রবৃত্তি হয়নি।’

সে মুখ ফিরিয়ে বন্ধ জানলার দিকে তাকাল। হাত পঁচিশেক দূরে দাদা থাকে, কিন্তু মানসিকভাবে তাদের মধ্যে ব্যবধান পঁচিশ হাজার মাইলের। বিবি টাকা না চেয়ে হয়তো ঠিক কাজই করেছে। গুলু ঘর থেকে বেরিয়ে তার মায়ের পিছন দিয়ে কলঘরে যাবার সময় বাবার দিকে তাকাল। তার মনে হল ক্ষীণ একটা হাসি যেন গুলুর চোখে নড়ে উঠল।

‘জনা চুল ভিজিও না, কাল রাতে অনেক বার কেশেছ।’ বিবি মৃদু স্বরে বলল। ওর কড়া নির্দেশগুলো মুখ থেকে বেরিয়ে আসে চাপা স্বরে।

‘তুমি কলেজ যাবে না?’

‘না।’

কেন যাবে না, সে কথা জিজ্ঞাসা করার সাহস তার হল না। গোরা সেই যে মেজোঘরে ঢুকেছে, আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। হেমন্ত ফিরে এসেছে। টুথব্রাশের লম্বা বাক্সটা আর চিরুনির সঙ্গে কিছু খুচরো আর কয়েকটা নোট বিবির সামনে টেবিলে রাখল।

‘ঠিক আছে তুমি যাও আর অরুণাকে ডেকে দিয়ো।’

হেমন্ত চলে যাবার আগে কৌতূহলী চোখে তার দিকে তাকাল। বিবি তা লক্ষ করল। ‘শোনো, তোমাকে ও বাড়ির কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করেছে?’

‘না তো!’

‘কাল রাতে দই এনেছ, সকালে গন্ধ হয়ে গেছে। জিনিস দেখে কিনবে।’

হেমন্ত মাথা নেড়ে চলে যেতেই সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কত দিন কাজ করছে?’

‘দু মাস।’

‘দুলালের খবর কী?’

‘ছাড়িয়ে দিয়েছি। বড়ো বেশি গল্প করে, তা ছাড়া বয়সও হয়ে গেছিল।’

সে এবার আর চমকে সোজা হল না, ‘গল্প’ মানে তার সম্পর্কে গল্প। ও বাড়ির লোক, পাড়ার লোক, তাদের সামনে দিয়ে বিবিকে হাঁটতে হয়। তাদের চাহনি, ফিসফাস কথাবার্তা ওর মতো আত্মমর্যাদা সচেতনের পক্ষে সহ্য করা কঠিন তো বটেই।

ফোন বেজে উঠল। সে হাত বাড়িয়ে রিসিভারটা তুলতে গিয়ে হাত টেনে নিল। বিবি তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে, ডান হাতটা বাড়িয়ে। সে রিসিভার তুলে দিল বিবির বাড়ানো হাতে।

‘মিসেস দত্ত বলছি….ওহহ বলো…আচ্ছা ডেকে দিচ্ছি।’ রিসিভারটা টেবিলে রেখে বিবি ডাকল, ‘রণো, তোর ফোন।’

গোরার পরনে জিনস, খালি গা। রিসিভারটা তোলার সময় সে বাবার দিকে একবার তাকাল। ‘হ্যালো, কে? ….কখন যেতে হবে? …ফিরতে রাত হয়ে যাবে?…. আচ্ছা ঠিক আছে।’

বিবি জিজ্ঞাসু চোখে গোরার দিকে তাকাল।

‘সুজিতের ঠাকুমা পড়ে গিয়ে কোমরের হাড় ভেঙেছেন। কৃষ্ণনগর থেকে ওঁকে আনতে হবে। ঠিক এগারোটায় ও গাড়ি নিয়ে আসবে।’

‘তুই কেন?’

‘গাড়িতে তোলা—নামানো, …সুজিতকে তো দেখেছ, ওদের বাড়ির লোকেদের চেহারাও ওর মতো।’

‘কী রোগা ছেলেটা! এক—এক ফ্যামিলির এক—এক রকম গড়ন হয়। …তুই ফিরবি কখন?’

‘বলল তো আটটার মধ্যেই কলকাতায় ফিরতে পারব। ওর কাকার বন্ধুর নার্সিংহোম মৌলালিতে। সেখানে ভরতি করাবে।’

অরুণা দালানে এসেছে। বিবি ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘রণো বেরোবে, রান্না হয়েছে?’

‘ভাত হয়ে গেছে, ডাল এবার নামাবো।’

‘নামিয়ে মাছের ঝাল চটপট করে দাও। তারপর দাদাবাবুর রুটি সেঁকে দিয়ে দাও।’ বিবি টেবিলে পড়ে—থাকা টুথব্রাশের বাক্সটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘দাঁতটা মেজে নাও।’

এতক্ষণ সে যেন বাইরের লোক হয়ে বসে ছিল। বিবি ‘দাঁতটা মেজে নাও’ বলে ওকে যেন সুযোগ দিল পরিবারের ভিতরে আসতে। যে কৃতজ্ঞ হাতে বাক্সটা থেকে সবুজ রঙের ব্রাশ বার করল।

‘বেসিনের ওপর ব্র্যাকেটে পেস্ট রয়েছে।’

কাল রাতেই সে দেখেছে ব্র্যাকেটে তিনটে টুথব্রাশ রয়েছে একটা গ্লাসে, পেস্টের আধ—গোটানো একটা টিউব, হাত ধোওয়ার সাবান, রিংয়ে ঝোলানো হাত মোছার ছোটো তোয়ালে আর সেফটি রেজারের বাক্স। তখন দেখে খেয়াল করেনি বাক্সটা কার জন্য হতে পারে। গোরা যখন ফোনে কথা বলছিল সে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। গোরা দাড়ি কামায়। আঠারো বছরের ছেলে দাড়ি কামাতেই পারে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, তবুও সে অবাক হয়ে গেছিল। কুড়ি—একুশ বয়স পর্যন্ত সে দাড়ি কামিয়েছে লুকিয়ে। যৌবন দেখা দেওয়ার, ব্যাটাচ্ছেলে হয়ে ওঠার চিহ্নগুলো ফোটার জন্য লজ্জা পেত। গোরার বুকে লোম, তবে তার মতো এত ঘন হয়ে ওঠেনি। বাইসেপস, ডেল্টয়েড, ট্রাইসেপস যেন ছেনি দিয়ে কেটে তৈরি করা। নিশ্চয় ব্যায়াম করে। জিনসটা এঁটে বসেছে, ভারী গোল সুগঠিত পাছার উপর। চোখ রাখলেই মনে হবে ওর গায়ে ভীষণ জোর।

নতুন ব্রাশের খোঁচায় মাড়িতে জ্বালা করে। সে সন্তর্পণে ব্রাশ ঘষতে ঘষতে দেখল দালানটা নির্জন হয়ে গেল। গুলু কলঘরে, বিবি আর গোরা তাদের ঘরে। কেউ তার সঙ্গে কথা বলার জন্য নেই। হঠাৎই সে অসহায় বোধ করল। তাকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে না উঠলেও অন্তত কাছাকাছি থাকবে, কথা বলবে। দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর বউ, ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে আসা একটা লোক, যে অপরাধই করে থাকুন না, এমন পরিত্যক্ত বোধ করবে কেন? বিবি তার সম্পর্কে ষোলো বছর ধরে ছেলেমেয়েদের কী বুঝিয়েছে? খারাপ চরিত্রের, সে ঘৃণার যোগ্য, পরিবারটাকে নষ্ট করেছে, একে বর্জন করো! মানসম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ার জন্য এবার কি ওরা শাস্তি দেবে?

ব্রাশটা কলের জলে ধুয়ে সে গ্লাসে রাখতে গিয়ে থমকে গেল। তিনটে ব্রাশের সঙ্গে বিবি কি চতুর্থ ব্রাশটা মেনে নেবে? ওর চোখে সে বিরাগ, বিরক্তি মাঝে মাঝে ঝিকিয়ে উঠতে দেখেছে। আয়না আর আলনার দরকার শুনে বিবি কোনো কথা বলেনি। বালবটায় একটা শেড দরকার, না থাকলে চোখে লাগে। কিন্তু চাইলে কি বিবি কিনে দেবে? তার কাছে টাকা আছে, সে আয়না, আলনা বা শেড নিজে কিনে আনতে পারে। কিন্তু বিবি কি এখন তার বাইরে যাওয়া পছন্দ করবে! কিন্তু কতদিন সকলের দৃষ্টি থেকে বিবি তাকে সরিয়ে রাখতে পারবে? একটা জেলখানা থেকে বেরিয়ে কি আর একটা জেলখানায় সে ঢুকল? এই বাড়িতে কর্তৃত্ব, দাপট আর ইচ্ছাকে ব্যবহার করার যে স্বাভাবিক অধিকার তার ছিল—সংসারের উপর, মানুষের উপর, বিবির উপর—সবই তার হাত থেকে এইভাবে যে চলে যাবে, কখনো সে দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারত না।

‘দাদাবাবু আপনার খাবার।’

সে চমকে ঘুরে দাঁড়ল। টুথব্রাশটা হাতে নিয়ে কখন সে নিজের অজান্তেই ছোটোঘরে ফিরে এসেছে! ফ্যাল ফ্যাল করে অরুণার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী খাবার?’

‘গোলমরিচ দিয়ে পাউরুটি মাখন আর চা। বউদি বললেন, আপনি যদি ঘরে বসে খেতে চান তো খেতে পারেন।’

বিবি তাকে আরও বিচ্ছিন্ন করে দিতে চায়। সবার মতো, সবার সঙ্গে দালানে বসে সে খাক এটা বিবি চাইছে না। ছেলেমেয়েরা তাকে দেখুক সেটাও তার ইচ্ছে নয়। ওর ইচ্ছেতেই তাকে চলতে হবে! হঠাৎই তার মাথা গরম হয়ে উঠল।

‘ডিম নেই?’ তার তীব্র স্বর অরুণার শান্ত চোখকে ব্যস্ত করে দিল।

‘আছে, সেদ্ধ করে দোবো?’

‘দাও, কলা আছে?’

‘নেই, শেষ হয়ে গেছে।’

‘ফ্রিজে জেলির শিশি দেখলাম, জলের বোতলও রয়েছে। শিশিটা আর একটা বোতল দিয়ে যাও, এই প্লাস্টিকের জাগটা নিয়ে যাও।’ সে আঙুল তুলে জাগটা দেখাল। কাল রাতে অনেকটা এইভাবেই অরুণার আঙুল উঠেছিল। ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, ভাবতে পারেনি লোকটা আচমকা এমন রুক্ষভাবে কথা বলবে। নিশ্চয় বিবির কাছে এখনই লাগাবে।

খাবারের প্লেটটা রেখে জলের জাগটা তুলে নিয়ে অরুণা যখন বেরিয়ে যাচ্ছে সে বলল, ‘বরাবরাই আমি দুটো ডিম সকালে খাই, বউদি সেটা জানে। আর আমার সব খাবারদাবার এই ঘরে দিয়ে যাবে।’

মাথা হেলিয়ে অরুণা চলে গেল। সে চায়ের কাপটা তুলে চুমুক দিয়েই বুঝল, অনেক কিছু পরিবর্তন ঘটে গেলেও বিবির দামি গন্ধওয়ালা দার্জিলিং চা খাওয়ার অভ্যাসটা বদলায়নি। বাইরে বাগানে মোটর ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যেতেই সে দ্রুত পুবের জানালায় এসে দাঁড়াল। একটা মাতাদোর ভ্যানে স্টিলের শিট এসেছে। সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। ভ্যানের পিছনের ডালা খুলে দুটো লোক শিটগুলোকে টেনে টেনে মাটিতে ফেলেছে। কর্কশ ঝনঝন শব্দ তার কানে ধাক্কা দিতেই সে জানালা বন্ধ করে দিল। অন্যের কারখানার দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো যুক্তি নেই।

‘ডিম সেদ্ধ আর জেলি, জলের বোতল দিয়ে যাচ্ছি।’ অরুণা তার মুখের দিকে একবারও না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

বাইরে ফোন বাজছে। গোরার গলা শোনা গেল, ‘মা, তোমার ফোন।’

বিবি ফোনে গলা চড়িয়ে কথা বলে না। ঘর থেকে শোনা যাবে না ওর কথা। অরুণা ঠান্ডা জলের বোতল নিয়ে এল।

‘কলঘর কি খালি রয়েছে?’

‘বউদি বোধহয় যাবেন, জিজ্ঞেস করে আসি।’

‘কে খাচ্ছে এখন, গোরা?’

অরুণা বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কে খাচ্ছে?’

ওকে ব্যাপারটা বোঝাবার চেষ্টা না করে সে বলল, ‘দাদামণি খাচ্ছে কি?’

‘হ্যাঁ, সঙ্গে দিদিমণিও বসেছে।’

সে পাউরুটির স্লাইস তুলে নিয়ে চেয়ারে বসল। ঠান্ডা রুটি চিবোতে তার ভালো লাগে না। আধখাওয়া টুকরোটা হাতে ধরে সে চোখ বন্ধ করল।

‘বউদি বললেন ঠিক সাড়ে এগারোটায় বাথরুমে যাবেন।’

সে মাথা নাড়ল। কাজের লোকও এ বাড়িতে কলঘরকে বাথরুম বলছে। বদলের ছাপ মুখের কথাতেও!

দুপুরে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। শরীরটা ঝরঝরে হালকা রাখতে পেট ভরে ভাত খায়নি। কাল রাতে বেশি খেয়ে ফেলায় ঘুম ভালো হয়নি। গোরা আর গুলুর বেরিয়ে যাওয়ার পর বিবিও বেরিয়ে গেল। বলেছিল কলেজে যাবে না। আগে বিবির বেরোনোর দরকার হত না, হলেও একা বেরোতো না। চন্দননগরে যতবার গেছে সঙ্গে সে—ও গেছে। শেষবার গেছে ওর বাবার বাৎসরিকে। ফিরে আসার পর বিবি ক্ষুব্ধ স্বরে বলেছিল, ‘তুমি কি ভাব আমি একা যেতে পারি না? তিন বছর আমি চন্দননগর থেকে যাদবপুর যাতায়াত করেছি, একা। এভাবে পাহারা দিয়ে কেউ সঙ্গে গেলে বিশ্রী লাগে।’ ‘আমাদের বাড়ির বউয়েরা একা ট্রেনে যাচ্ছে, লোকে শুনলে বলবে কী? তা ছাড়া স্বামী সঙ্গে থাকলে বিশ্রী লাগবে কেন?’ ‘সব ব্যাপারেই স্বামীকে সঙ্গে থাকতে হবে কেন? আমাকে কি তোমাদের বাড়ির অশিক্ষিত জবুথবু মেয়েদের মতো মনে করো নাকি?’ তার রেগে ওঠা উচিত ছিল। বাড়ি বা বংশ নিয়ে কোনো হেয় কথা সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু বিবির কথাটা সত্যের থেকে বেশি দূরে নয়। সে কথা কাটাকাটিতে না গিয়ে বলেছিল, ‘বাবা গাড়িটা বিক্রি করে না দিলে এসব প্রবলেম দেখা দিত না, তুমি একাই ড্রাইভারকে নিয়ে চলে যেতে পারতে। তোমাকে তো বলেছিলাম মোটরবাইকে নিয়ে যাব, রাজি হলে না।’ ‘কোমর জড়িয়ে ধরে যাওয়া!’ বিবি শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল।

সেই অবাক চোখ এখন আর বিবির নেই। এখন আর কারুর অনুমতির জন্য ওকে অপেক্ষা করতে হয় না। হয়তো এবার থেকে তাকেই অনুমতি নিয়ে চলাফেরা করতে হবে, হাতও পাততে হবে। হাজার দুয়েক টাকার আয়ু কতদিন আর? টাকা রোজগারের কথা তাকে ভাবতে হবে, চেষ্টা করতে হবে, লোকের সামনে যেতে হবে।

সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল টেলিফোনের শব্দে। দশ—বারো বার বাজতেই সে খাট থেকে উঠে পড়ল। কেউ নেই যখন, অরুণারই ফোন ধরার কথা। নিশ্চয় অরুণা নেই। সে দরজার কাছে পৌঁছবার আগেই বাজা থেমে গেল।

দালানে কেউ নেই, মাত্র দুটো জানালা খোলা। সূর্য এখন পশ্চিমে, তাই রঙিন কাচগুলো উজ্জ্বল হয়ে দালানকে বাহারি করে তুলেছে। সে অবাক হয়ে প্রায়ান্ধকারের মাঝে চেয়ারে বসে পড়ল। কত্তার ঘরের, মেজোঘরের দরজার হুড়কো টানা। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। সে একা, তার সঙ্গী শুধু বাল্যকালের বিকেলের দালান। সে স্কুল থেকে ফিরেছে, মা নীচের রান্নাঘরে, বাবা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় চেয়ারে বসেছে। স্কুলের ব্যাগ পিঠে, দরজা ঠেলে সে দালানে পা দিয়েই থমকে দাঁড়াত। বড়োজোর আধ মিনিট …তিরিশ সেকেন্ড বিশাল সময়, ওইটুকুর মধ্যেই একটা মানুষকে মেরে ফেলা যায়, …ওইটুকু সময়েই একটা মেয়েমানুষকে শুইয়ে তার শাড়ি টেনে খুলে ফেলা যায়,… ওইটুকু সময়ের মধ্যেই একটা মানুষের ধ্বংস ঘটে যায়…।

সে নির্জন দালানে স্তিমিত হয়ে বসে রইল। বর্তমান থেকে সরে যাওয়ার কোনো উপায় আর তার নেই। স্মৃতি, সে ভেবেছিল কমে গেছে। এই একটা জিনিস চেষ্টা করলেও তার হ্রাস—বৃদ্ধি ঘটানো যায় না। যত পিছিয়ে যাবে ততই খুঁটিনাটিগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মিতাকে তাদের অন্ধকার বাইরের ঘরে দেয়ালে চেপে ধরে সারা শরীর দিয়ে পিষে চুমু খাওয়ার সময় ওর মুখে পেঁয়াজের গন্ধ পায়। মিতাকে সে ঝালমুড়ি খেতে দেখেছিল হনুমান পার্কে। বহুদিন ঝালমুড়ি খাইনি, ঘুগনি খাইনি…টেলিফোন বেজে উঠল। দ্বিধা না করে সে রিসিভার তুলে নিল।

‘হ্যালো।’

‘কে বলছেন আপনি?’ নারীকণ্ঠ, একটু ভারী স্বর, বয়স্ক, মার্জিত উচ্চচারণ।

ফোন ধরেই কথার আগে নিজের পরিচয় দাখিল করতে হবে, এতে মনে হয় যেন তাকে দাবিয়ে দেওয়া হল। কর্কশ স্বরে সে বলল, ‘রাঘবেন্দ্র দত্ত। আপনার কাকে চাই?’

‘জাহ্নবীকে চাই, আছে কি?’

‘বেরিয়েছে। কিছু জানাবার থাকলে বলতে পারেন, আমি ওর স্বামী।’

‘স্বামী!’ মহিলা যেন ছ্যাঁকা খেলেন, ‘আপনি ওর স্বামী?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, বিবাহিত বৈধ স্বামী!’

‘জাহ্নবী আবার কবে বিয়ে করল? ওকে তো ডিভোর্সি বলেই জানি, সেই কথাই তো আমাদের বলেছে।’

‘আপনি কে বলছেন?’

‘আমি ওর কলিগ, রমা ঘোষ।’

ফোন সে রেখে দিল। এই কথোপকথন নিশ্চয় বিবি জানবে। সে কোনো মিথ্যা কথা বলেনি। কিন্তু বিবি নিজেকে কেন ডিভোর্সি বলে বাইরে জাহির করল! এতে ওর কোনো সুবিধা হয়েছে কি? ‘আবার কবে বিয়ে করল?’ বিয়ে করার বয়স ওর এখনও রয়েছে, পুরুষদের উত্তেজিত করার মতো উপাদানভরা ওর শরীর। বিবি তাকে ডিভোর্স করতে পারত, হয়তো ছেলেমেয়ের কথা ভেবেই করেনি।

‘অমিয়ার মা, অমিয়ার মা, ওপরে এসো তো একবার।’

বউদির গলা বোধহয়, ঝিকে ডাকছে। সে উঠে জানালার পাশে গিয়ে একটা চোখ দিয়ে তাকাল। বউদি তাদের খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। সে সরে গেল।

মেজোঘরের দরজার সামনে সে দাঁড়াল। গোরা জন্মাবার পর, বিছানার জায়গা কমে যাওয়ায় সে এই ঘরে একা শুতো। ঘরটা এখন কীরকম রয়েছে, সেটা দেখার প্রবল ইচ্ছায় দরজার হুড়কোটা টেনে সে একটা পাল্লা খুলল। বারান্দার দিকের দরজা আর জানালাটা খোলা রয়েছে, ঘরে যথেষ্ট আলো। তার মনে হল, সে যেন অন্য একটা জগতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘরের চারদিকে সে চোখ বোলাল।

দেয়ালে সাঁটা রঙিন পোস্টারে ফুটবলার, ক্রিকেটার, আর গিটার হাতে মাইকের সামনে যেসব বিদেশি মুখ, তাদের একজনকেও সে চেনে না। কয়েকটি পোস্টারে বুক, কোমর, পাছা দেখাবার জন্য উৎকট ভঙ্গিতে মেয়েরা। এইসব ছবি বিবি নিশ্চয়ই দেখেছে, তবুও রাখতে দিয়েছে! এই ঘরেই রয়েছে টিভি সেট। এটা বাইরের দালানে থাকা উচিত ছিল, সবাই তাহলে দেখতে পেত। বিছানার উপর টেপরেকর্ডার আর একটা ইংরেজি ম্যাগাজিন। তার মলাটে একজোড়া মেয়ে—পুরুষ, বোধহয় ফিল্মের। পুরনো কাঠের র‌্যাকটায় গোটা চল্লিশ অডিও ক্যাসেট আর কিছু বই। ওয়ার্ডরোবটা যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে। পাল্লাটা টানতেই খুলে গেল। হ্যাঙারে ঝুলছে ট্রাউজার্স আর নানা রঙের টি—শার্ট। তলার তাকে বাতিল পুরনো ট্রাউজার্স, জামা। তার নীচে ড্রয়ার। সেটা টেনে আধখানা বার করেই সে চমকে উঠল। একটা হুইস্কির পাঁইট, তার অর্ধেক খালি।

পিছন থেকে হঠাৎ কেউ যেন তার মাথায় ডান্ডা বসিয়ে দিল। থরথর করছে শরীরের ভিতরটা, চোখে কয়েক মুহূর্তের জন্য অন্ধকার নেমে এল। বোতলটা কেঁপে উঠল তার হাতে। সেটা রেখে দিয়ে ড্রয়ারটা ঠেলে বন্ধ করে কিছুক্ষণ সে দাঁড়িয়ে থাকল। অসাড় হয়ে গেছে তার স্নায়ু।

গোরা তাহলে গোল্লায় গেছে! কী করে এটা সম্ভব হল? বিবির মতো মানুষের হাতে লালিত হয়ে তার নিজেরই ছেলের এমন দশা হল কী করে? ও কি অন্ধ হয়ে গেছে? ও কি একবারও এই ঘরে আসেনি, উঁকি দিয়েও দেখেনি? তার মদ খাওয়ায় বিবির প্রবল আপত্তি ছিল আর আজ নিজের ছেলের ঘরেই মদের বোতল, দেয়ালে নোংরা ছবি। নিশ্চয়ই জানে। বিবি জেনেশুনে ছেলেকে নষ্ট হতে দিচ্ছে!’

ঘরে ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে সে দুটো হাত আড়াআড়ি কপালের উপর রাখল। ঘুম থেকে উঠে যে তাজা ভাবটা বোধ করেছিল সেটা উবে গেছে। আবার তার ক্লান্তি লাগছে। তার একমাত্র বংশধর নষ্ট হয়ে গেছে এটা মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। গোরা কাদের সঙ্গে মেশে, কারা ওর বন্ধু, টাকা পায় কোত্থেকে? বিবি কি কোনো খবর রাখেনি? ষোলোটা বছর সে বাড়িতে থাকলে এটা ঘটতে পারত না। মাথার উপর বাবা আছে, এই অনুভূতিটাই তো ছেলেমেয়েদের রক্ষাকবচ। শ্রীগোপাল তাকে একঢোঁক মদ খাইয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তার পরের সাত বছর সে একফোঁটাও জিভে ছোঁয়ায়নি। বাবা দালানে বসে রেডিয়ো শুনত, তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে গন্ধ পেতই। মাস্টারমশায়ের কাছে পড়তে হত দাদার সঙ্গে, সুতরাং মদ খাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না!

গোকুলানন্দেই সে টাকা দিয়ে মদ আনিয়ে শ্রীগোপালের ঘরে বসে প্রথমবার খায়, রাতে ওর বিছানাতেই ঘুমোয়, সোমবার সকালে মোটরবাইকে কলকাতায় ফিরে আসে। বাড়িতে ঢোকার আগে সে এলাচ লবঙ্গ দিয়ে মিঠে পাতার পান খেয়েছিল। তখন তাদের দুজনেরই বিয়ে হয়নি। রাত্রে শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘রোঘো, মেয়েমানুষ আনব? খালপাড়ে পাওয়া যায়!’ ‘না’। ‘না কেনরে, বড়োলোকের ছেলে না তুই?’ শ্রীগোপাল তার দাঁত দুটো বার করে নাক দিয়ে হাসির মতো শব্দ করেছিল। ‘বাবার কাছে শুনেছি তোর ঠাকুরদার গরাণহাটায় কেপ্ট ছিল, তুইও একটা রাখ না। তোর বংশের সামন্ততান্ত্রিক ধারাটা তাহলে বজায় থাকবে।’ অ্যালকোহল তার মাথার কোষগুলোতে সবেমাত্র চেপে ধরেছে, দৃষ্টি তখনও ঝাপসা হতে আরম্ভ করেনি, সে অবাক হয়েছিল ‘সামন্ততান্ত্রিক’ শব্দটায় নয়, শ্রীগোপালের উচ্চচারণে। এমন একটা খটমট বানানের শব্দ মদ খেয়ে স্পষ্ট উচ্চচারণ করতে পারবে সে ভাবেনি।’ বলার অভ্যাস আছে বলেই পেরেছে। একদিন ও বলেছিল ‘আমি সোশালিস্ট’ নির্ভুল উচ্চচারণে। ‘ঘোড়ামুখো, রাখতে হলে তোর বউকে কেপ্ট রাখব, আগে তুই বিয়েটা কর তো।’ শ্রীগোপাল তাই শুনে বলেছিল, ‘পনেরোটা টাকা দে, খালপাড়টা ঘুরে আসি।’ সে টাকা দিয়েছিল। শ্রীগোপাল তার জীবনের প্রথম বন্ধু।

গোরাও কি কোনো ‘শ্রীগোপাল’ পেয়েছে? ওর সঙ্গে কী সে একবার কথা বলবে? কিন্তু কী কথা বলবে? ছেলেটাকে মনে হল না নম্র, বিনীত ধরনের। যদি মুখের উপর বলে ‘আপনি কে?’

বাইরে দালানের দরজা খোলার শব্দ হল। অরুণা এসেছে। দরজায় বাইরে থেকে তালা দিয়ে গেছিল। টেবিলে পড়ে থাকা এঁটো থালা—বাটি তুলে নেবার জন্য এলে বলতে হবে ‘এ বাড়িতে দরজায় তালা দিয়ে কেউ বেরোয় না, কাজের লোকেরা তো নয়ই।’ অরুণার জন্য সে অপেক্ষায় রইল।

‘বাবা, আপনি কি চা খাবেন?’

মাথার মধ্যে কথাগুলো তৎক্ষণাৎ বসল না। তবে সে মুখটা ফেরাল। দরজায় গুলু দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে সে উঠে বসল। নিজের অজান্তেই সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো একটা হাত বাড়িয়ে দিল, ‘গুলু’!

গুলু পায়ে পায়ে এসে তার সামনে দাঁড়াল। ওর বাঁ হাতটা নিজের হাত তুলে মেয়ের মুখের দিকে সে নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল। অপ্রতিভ গুলু মুখ নামিয়ে নিয়েছে। এখন তার হাতের মধ্যে একটা টলটলে দিঘি। তার সারা শরীরের কম্পনের আঘাতে ছোটো ছোটো তরঙ্গ উঠছে। তিরতির করে সেই তরঙ্গ তার করপুটে ভেঙে পড়ছে। ওর নরম আঙুলগুলো নিজের মুঠোয় চেপে থেকে সে নাকের পাশে সুড়সুড়ি অনুভব করল। চোখ দিয়ে জল নামছে তো নামুক। সেই চার বছরের গুলু, মাঝরাত্রে বিছানায় উঠে বসে কান্না জুড়ত। কেন কে জানে, বোধহয় কৃমির জন্য। কিছুতেই কান্না থামত না। বিরক্ত বিবি চড় কষালে আরও জোরে কেঁদে উঠত। তখন সে মেয়েকে নিয়ে দালানে পায়চারি করত। পিঠে চাপড় দিতে দিতে কত রকমের কথা বলত গুলুর কান্না থামাতে।

এখন ঝাপসা চোখে সে কুড়ি বছরের গুলুর মুখের দিকে তাকিয়ে ঘড়ঘড়ে স্বরে একটা শব্দ বার করল, ‘মা।’

এবার গুলু কি অনেক কথা বলবে না তার বাবার কান্না থামাতে!’

‘চা খাবেন?’

কী স্নিগ্ধ, মিষ্টি স্বর। বিবির গলার সঙ্গে কোনো মিল নেই। ওর ঠাকুমার এমন স্বর ছিল। ‘তুই এখন আমার সামনে বোস।’

গুলু খাটের উপর তার পাশে বসামাত্র সে ওর দু—কাঁধ ধরে বুকের উপর টেনে নিল: ‘আমার গুলু….আমার মেয়ে…আমার মেয়ে, তোর বাবাকে মাপ করে দে….আমি সবার সঙ্গে অন্যায় করেছি…গুলু আমি তোদের ক্ষতি করেছি…।’

‘আপনি অমন করছেন কেন, শান্ত হয়ে বসুন।’

‘আমাকে ‘আপনি’ বলছিস কেন, আমাদের বাড়িতে বাবাকে ‘তুমি’ বলে। তুই কি এই বাড়ির মেয়ে নোস?’

‘আমি চা করে আনি। অরুণাদি তার ভাইয়ের বাড়ি গেছে, সন্ধের মধ্যেই আসবে। আমি ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়ে বেরিয়েছিলাম।’

ঘর থেকে গুলু চলে যাওয়ার পরই সে বিছানায় ভেঙে পড়ল। বালিশটা মুখের উপর চেপে সে হিক্কা তোলার মতো শব্দ করল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে শান্ত হয়ে সে উঠে বসল। পুবের জানলা দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দেখা দেয়। বিকেল শেষের স্তিমিত আলো পুরোনো দেওয়ালগুলোয় সন্ধ্যার ছায়া ফুটিয়েছে। তারে ভিজে কাপড় নাচিয়ে নাচিয়ে ঝোলাচ্ছে একটি স্ত্রীলোক। সিঁড়ি দিয়ে একটি বালক দুড়মুড়িয়ে নেমে গেল। চড়াই পাখিদের কিচিরমিচির কৃষ্ণচূড়া গাছে। দূরে কোথাও পটকা ফাটার আওয়াজ হল।

চা আর চারখানা বিস্কিট নিয়ে এল গুলু।

‘মা কোথায় গেছে?’

‘বলতে পারব না। মনে হয় সল্টলেকে অপূর্ব মামার ফ্ল্যাটে গেছে। ওঁর ম্যালেরিয়া হয়েছে শুনেছি।’

‘কে অপূর্ব মামা?’

গুলু একটু অবাক হল যেন। ‘অপূর্ব মামাকে জান না! মা—র ছোটোবেলার বন্ধু, চন্দননগরে একই পাড়ায় বাড়ি ছিল, ওরা একই সঙ্গে যাদবপুরে পড়েছে, তবে মা—র থেকে দু—বছরের সিনিয়ার।’

‘না, আমি এর কথা বিবির কাছে কখনো শুনিনি। বেশি কথা তো বলত না। পড়াশুনোর কথা তো একদমই নয়।’

‘অপূর্বমামা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলেন। ফুলব্রাইট ফেলোশিপে রচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করেছেন, সাত—আট বছর আমেরিকায় ছিলেন। এখন আছেন সায়ান্স কলেজে।’

গুলুর চোখেমুখে কেমন যেন উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠল কথাগুলো বলার সময়, কথার সুরে শ্রদ্ধা আর সমীহ। এই উজ্জ্বলতা বাবার কথা বলার সময় কখনোই ফুটবে না। তার ভিতরটা ধসে পড়ছে। ক্ষীণভাবে হঠাৎই তার মনে হল, এই অপূর্বর সঙ্গে বিবির কোন ধরনের একটা সম্পর্ক বোধ হয় আছে।

‘উনি এ বাড়িতে আসেন না?’

‘কেন আসবেন না? অপূর্ব মামার কাছে পড়েই তো মা এমএসসি পাশ করল, মাকে কলেজে ঢুকিয়ে দিলেন তো উনিই।’

‘অপূর্বমামা বিয়ে করেছেন?’

গুলু থতমত হল। প্রশ্নটা এই মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত।

‘হ্যাঁ।’

‘তাঁকে দেখেছিস? তোর মায়ের মতো সুন্দরী?’

‘মোটামুটি, তবে মায়ের মতো নয়। অপূর্বমামার বউ ডাক্তার, গায়নোকোলজিস্ট। ….একি, বিস্কুটগুলো পড়ে রইল কেন?’

‘বিস্কুট খেতে আমার ভালো লাগে না। তুই বরং খা।’

‘আমারও ভালো লাগে না।’

‘আচ্ছা গুলু, আমি এতকাল না থাকার জন্য তোর মনে কি কষ্ট হত? এখন তুই কি খুশি হয়েছিস?’

গুলুর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ‘কষ্ট তো হতই। তোমার চেহারাটা আমি মনে করে রেখে দিয়েছিলাম। কী সুন্দর দেখতে ছিলে। চার বছর বয়সে দেখেছি, ভুলে যাবার কথা নয়। রণোর অবশ্য একদমই মনে নেই। একবার তুমি মোটরবাইকে সামনে বসিয়ে আমাকে পরেশনাথ মন্দির দেখাতে নিয়ে গেছিলে, তাও মনে আছে।’

‘সেদিন পেছনে একজন বসে ছিল, কে বল তো?’

‘মনে নেই।’

‘শিবু বর্ধন লেনে থাকে সন্তু, আমার স্কুলের বন্ধু। ও মানিকতলা যাবে বলে চড়েছিল। সনতের সঙ্গে একবার দেখা করব।’

‘কেন? মা কিন্তু কারুর সঙ্গে দেখা করাটা পছন্দ করবে না।’

সে স্থির চোখে গুলুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মার পছন্দ—অপছন্দ সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, এই ধারণা মেয়েটার হল কী করে! স্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী স্বামী চলবে, সেটা এ বাড়ির ধারা নয়।

‘তুই মাকে ভয় পাস?’

‘ভয় পাব কেন!’

‘মা অপছন্দ করবে, এটা জানলি কী করে?’

গুলুর মুখ ম্লান হয়ে গেল। চোখ নামিয়ে ইতস্তত করে শুকনো হাসল। ‘আমি জানি। অ্যালবাম থেকে তোমার সব ছবি খুলে নিয়ে টুকরো টুকরো করে পুড়িয়ে দিয়েছে আমাদের সামনে। পরশুদিন বলল, তোমাদের বাবা আসছে, কেউ কিন্তু যেচে একটি কথাও বলবে না, বাইরের কাউকেও কথা বলতে দেবে না।’

‘আর কিছু বলেছে?’

‘আর কী বলবে।’ গুলু এমনভাবে তাকাল যেন এরপরও আর কিছু বলার থাকে কি?

বাইরের আলো আরও কমে এসেছে। ঘরের আলো জ্বলতে যাচ্ছিল গুলু, সে বারণ করল। ‘থাক, আলোটা চোখে লাগে।…হ্যাঁ রে, গোরা লেখাপড়া করে?’

‘এবার হায়ার সেকেন্ডারি দিয়েছে।’

‘বোধ হয় পাশ করবে না।’

গুল চুপ করে রইল।

‘তোর মা ওকে খুব ভালোবাসে।’

গুলু অস্ফুটে কী যেন বলল।

‘গোরার বন্ধুবান্ধব কারা, জানিস? কেমন ধরনের তারা?’

‘ওর নানা রকমের বন্ধু, তবে অ্যাকাডেমিক দিক থেকে কেউ তেমন ভালো নয়। বাড়িতে যারা আসে তাদের কথাবার্তা ব্যবহার তো ভালোই। খুব হইচই করে, ক্যাসেটে পপ গান শোনে…বাইরে কে কেমন তা জানি না।’

‘তোর মা গোরাকে পড়তে বসায় না, শাসন—টাসন করে না?’

‘ও মাকে খুব একটা গ্রাহ্য করে না। ছোটো থেকেই কেমন যেন একগুঁয়ে, জেদি, রাফ। মা বলে তোমার জন্যই নাকি গোরা এমন হয়ে গেছে।’

‘আমার জন্য!’ সে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। ‘কেন, কীভাবে? আমি কী করলাম!’

‘জানি না। …মা আমাদের বলত, ডাকাতদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে একজনকে মেরে ফেলেছিলে, তাই জেলে গেছ। একদিন গোরা মাকে জিজ্ঞেস করেছিল, রেপ মানে কী? তখন ও ক্লাস ফোর—এ পড়ে। বিকেলে হনুমান পার্কে খেলতে গিয়ে কী নিয়ে যেন ঝগড়া হয়, তখন কেউ ওকে বলে, তোর বাবাতো…।’

ঘরে এখন আঁধার। গুলু কথাটা সম্পূর্ণ করল না। বড়ো হয়েছে, বাবাকে লজ্জায় ফেলতে চাইল না, নিজেরও লজ্জা করবে। ওর মুখটা এখন কেমন দেখাচ্ছে, সেটা দেখার ইচ্ছে তার হল, কিন্তু আলো জ্বেলে নয়।

কোর্ট বলেছে, তোদের বাবা শুধু মার্ডারারই নয় রেপিস্টও। কিন্তু রেপ আমি করিনি। অনেকবার কোর্টে এই কথা বলেছি, আজও কথাটা তোকে বলছি। গুলু তুই বড়ো হয়েছিস, লেখাপড়া করছিস, তোর বিচারবুদ্ধি তৈরি হচ্ছে, পাঁচটা অশিক্ষিত লোকের মতো তোর বিবেচনা—বোধ নয়। গোকুলানন্দর দারোগা আর শ্রীগোপালের বউ সড় করে…।’ কথাগুলো সে বলল মনে মনে।

গুলু ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। ওর মুখটা আর দেখা হল না। গুলুও কি তাহলে বিশ্বাস করে, কোর্ট ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিল!

চার

শুধু বাড়িটা নয়, সারা উত্তর কলকাতা, পশ্চিমবাংলা, ভারতবর্ষ এখন ঘুমের মধ্যে। পৃথিবীর নানান জায়গা এখন কর্মব্যস্ত, কোথাও বা স্টেডিয়ামে খেলা, ডিস্কো থেকে হই—হুল্লোড়, কোথাও বা শীর্ষ সম্মেলন কী গুলিগোলা চলছে। ছাব্বিশ নম্বর সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাড়িটা এখন অন্ধকার, ঘুমন্ত। কিন্তু একটা ঘরে আলো জ্বলছে। সে জেগে রয়েছে, টেবিলে তার খাবার থালা দিয়ে ঢাকা।

সে তার ঘর থেকেই জেনেছে কখন অরুণা, কখন বিবি, কখন গোরা ফিরল। খাওয়ার টেবিলে বিবির সঙ্গে গুলুর কথাবার্তার টুকরো তার কানে এসেছে।

‘কেমন আছেন দেখলে?’

‘জ্বর নেমে এসেছে। ওর বউই দেখেছে। তবে বড়ো ধরনের কিছু নয়, একটা গাইনির পক্ষে যতটা সামাল দেওয়া…..কলকাতাটা যে কী হয়ে উঠেছে, হেন কুচ্ছিত রোগ নেই যে হচ্ছে না। আমরা ছোটোবেলায় শুনেছি ম্যালেরিয়া নাকি শুধু গ্রামেই হয়!’

গোরা ফিরল। দরজা খুলে দিল বিবি।

‘এত রাত হল যে!’

‘কত আর, এগারোটা।…খাবার রেখেছ নাকি? আমি সুজিতদের বাড়িতে খেয়ে এসেছি। রোজ সেই একঘেঁয়ে রান্না আর খাবার, ধ্যাৎ…..তুমি তো অনেক কিছু রাঁধতে জান, তাহলে পরীক্ষার চোতা অ্যানসার পেপারগুলো না দেখে রান্নাঘরে যাও না কেন?’

এরপর দড়াম করে মেজোঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ।

এই শব্দটাই তাকে বলে দিল গোরা যথেষ্টভাবে প্রকৃতিস্থ নেই। এখন তার বিবির মুখটা দেখতে ইচ্ছে করছে। বলতে ইচ্ছে করছে, তোমারই হাতে মানুষ হয়েছে গোরা। তুমি ভালো করেই জানো, এখন ও কোথায় পৌঁছেছে। বাবা রেপ করে জেলে গেছে বলেই ওর মানসিক সর্বনাশ ঘটে গেছে, এই মিথ্যা ধারণাটা ছড়িয়ে কোনো লাভ নেই, ছেলেমেয়েরা তৈরি হয় মায়ের হাতে, বাবার হাতে নয়। আর এই ছেলে তুমিই তৈরি করেছ!

সে উত্তেজিতভাবে ঘরে পায়চারি করতে করতে একসময় থামল। এভাবে একা ঝগড়া চালিয়ে কোনো লাভ নেই। বরং মুখোমুখি সে বিবির সঙ্গে কথা বলবে। এখন ঘুম আসবে না। মাথাটা ঠান্ডা হোক আগে। পরদার কাপড়ে ঢাকা র‌্যাকটার সামনে দাঁড়িয়ে কাপড়টা সে তুলতেই দেখল, তার চোখের সামনে গাদা হয়ে রয়েছে বাল্যকালের গ্রামোফোন রেকর্ড, পাঁজি, বাড়ির ট্যাক্সের, ইলেকট্রিকের, সর্বজনীন দুর্গোপুজোর বিল, বাজারের হিসেবের খাতা, স্কুলের ছেঁড়া বই, গীতা। উপরের তাকে একটা ছাতার বাঁট দেখা যাচ্ছে, তার পাশে একটা সাপের চামড়ার হাতব্যাগ। ব্যাগটাকে সে চিনল, বিবিকে কিনে দিয়েছিল চর্মশিল্পের মেলায়। হাত তুলে ব্যাগটা টেনে নামাতেই ধুলো পড়ল তার মুখে। ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝেড়ে ব্যাগটা পরদার কাপড়ে মুছল।

চামড়াটা সাপের বলেই বিবি আপত্তি করেছিল। ‘এটাকে দেখেই তো গা শিরশির করছে, বরং অন্য একটা, ওই সাদাটা নাও।’ আঙুল দিয়ে বিবি একটা ব্যাগ দেখিয়েছিল। ‘আরে বাবা, এটা সাড়ে চারশো টাকার ব্যাগ, কোনটে তা হলে নেওয়া উচিত?’ বিবি বলেছিল, ‘শুধু দাম দিয়েই কি জিনিসের ভালোমন্দ বিচার হয়! রুচি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে।’ বলার সময় ওর চোখের কোণ কুঁচকে গেছল। সে বুঝতে পেরেছিল বিবি কী বলতে চেয়েছে। সে তখন বলেছিল, ‘চেহারা দিয়ে বিচার করলে আমিও তো ওই সাদা ব্যাগ, কম দামি কিন্তু বগলে নিয়ে ঘোরা যায়।’ বিবির মুখ রাগে থমথম করে ওঠায় তার হাসি পেয়েছিল। সে দুটো ব্যাগই কিনেছিল।

ব্যাগের টেপা বোতামটা খোলার সময় ‘কট’ শব্দ হল। ভিতরে কয়েকটা পুরনো কাগজের টুকরো, খবরের কাগজ থেকে কাঁচি দিয়ে কাটা। একটা টুকরো তুলে তাকিয়ে সে যেন সাপের ছোবল খেল। এক কলাম তিন লাইন হেডিংয়ে: বাল্যবন্ধুকে খুন, বন্ধুর স্ত্রীকে ধর্ষণ। শব্দগুলো বুলেটের মতো তার মাথায় আঘাত করল। তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল গুঁড়িয়ে যাওয়া খুলিটার টুকরোগুলো জড়ো করতে।

‘নিজস্ব সংবাদদাতা : খালেদনগর, ১৫ জুন—গত শনিবার রাতে খালেদনগর থানার গোকুলানন্দ গ্রামে বাল্যবন্ধু শ্রীগোপাল বিশ্বাসকে দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করে তার স্ত্রী পারুলবালাকে ধর্ষণ করার দায়ে পুলিশ রাঘবেন্দ্রনারায়ণ দত্তকে গ্রেপ্তার করেছে। আসামীর জামিনের আবেদন অগ্রাহ্য করে মহকুমা আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে ১৪ দিন পুলিশ হাজতে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। পারুলবালাকে ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়।’

তার নামের নীচে কালির দাগ, নিশ্চয় বিবির করা। খবরের কাগজ থেকে কেটে রেখেছে বিবিই, সে না হলে এ কাজ এ বাড়িতে কে করবে! কেন কেটে রেখেছিল, ছেলেমেয়েদের দেখাবে বলে? কিন্তু ওরা তো একদিন জানবেই, জেনে গেছেও। কিন্তু সবটা জানে কী?

খবরের দ্বিতীয় প্যারায় সে চোখ রাখল—’রসপুর মৌজার অন্তর্গত কলকাতাবাসী সম্পন্ন রায়ত রাঘবেন্দ্রর জমিজমা ও সম্পত্তির দেখাশোনার কাজ করতেন শ্রীগোপাল। তিনি স্থানীয় কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এক সময় রাঘবেন্দ্রর বহু বিঘা জমি আন্দোলনকারী কৃষকরা দখল করে নেবার চেষ্টা করেছিল। তাঁর সন্দেহ হয়, আন্দোলনকারীদের পিছনে শ্রীগোপালের মদত আছে। শনিবার সন্ধ্যায় এই নিয়ে তার সঙ্গে শ্রীগোপালের কথা কাটাকাটি ও বচসা হয়। এরপরই রাঘবেন্দ্র দা নিয়ে শ্রীগোপালকে আঘাত করে। পারুলবালা স্বামীকে রক্ষার জন্য ছুটে এলে রাঘবেন্দ্র তাকে ঘরের মধ্যে টেনে এনে ধর্ষণ করে। গোকুলানন্দ গ্রামে সেদিন রাত্রে যাত্রাপালা হবে বলে আসরের তোড়জোড় চলছিল। পারুলবালার চিৎকার শুনে যাত্রার উদ্যোক্তা গ্রামের লোকরা ছুটে এসে রাঘবেন্দ্রনারায়ণকে ধরে ফেলে, তখন তিনি মদের নেশায় আচ্ছন্ন ছিলেন।’

হ্যাঁ, তখন তার নেশা হয়েছিল, কিন্তু আচ্ছন্ন সে ছিল না। সেদিন শনিবার সকাল দশটায় সে গোকুলানন্দে পৌঁছেছিল। রথতলার মোড়ে বাসরাস্তার দু—ধারে বাজার তখন জমজমাট। আনাজ বিক্রির একটা মাঝারি পাইকারি হাট প্রতি শনিবার এখানে বসে। স্তূপাকার কুমড়ো, ঝুড়িভরা বেগুন, পটল, কাঁচালংকা, ঢ্যাঁড়স তার সঙ্গে রবারের জুতো, চুটি, তেলেভাজা, রেডিমেড পোশাক, লুঙ্গির পশরা আর ক্রেতাদের ভিড় রাস্তাটাকে সরু করে দিয়েছে। এরই মধ্যে দিয়ে মোটরবাইক চালিয়ে যাওয়ার সময় সামনে থেকে একটা ট্রাক এসে পড়ে। সে বাইকটা দ্রুত সরাতে গিয়ে কাঁধে একটা গোরুর গাড়ির জোয়ালের খোঁচা খায়। জায়গাটা চিনচিন করে ওঠে।

রথতলা থেকে আধমাইল এগিয়ে বাঁ দিকে নেমে গেলে গোকুলানন্দে যাবার মাটির রাস্তা। হাঁটাপথে দশ মিনিট। রাস্তাটা খালপাড় ধরে গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে ভাতারিয়া, রাইহাটা হয়ে সখিবাড়ি। খালপাড় দিয়ে যাবার সময় বরাবরই সে বাইকটা মন্থর করে। সাত—আটটা টালির চালের দরমার ঘরে বেশ্যারা থাকে। শনিবার হাটের দিনেই এদের বড়ো রোজগার। সস্তার রঙিন সিল্কের শাড়ি, ছোটোখাটো চেহারা হলে ফ্রক পড়ে, মুখে রঙ মেখে এরা সকাল দশটা থেকেই নিজেদের বিজ্ঞাপন শুরু করে। খদ্দের আসবে দুপুর থেকে। এদের দেখতে তার মজাই লাগে। মোটরবাইকে চড়া লোক মানেই পয়সাওয়ালা, যদি খদ্দের হয়। এই আশায় ওরা যেভাবে চোখ বড়ো করে তাকায়, সেটা দেখার জন্যই সে মন্থর হয়। এরা বিবির নখের যুগ্যি নয় বটে। কিন্তু এরা তার বাসনার জানালাগুলো খুলে দেয়, যেটা তার বউ পারে না।

সেদিনও সে মন্থর হয়ে তাকিয়েছিল। একজনকে দেখে তার কেন যেন মনে হল, অনেকটা শ্রীগোপালের বউয়ের মতো!

খামারবাড়িতে পৌঁছবার আগেই পিছন থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে পারুলকে দেখতে পায়, রাস্তা দিয়ে জারিকেন হাতে ঝুলিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পারুলের বয়স যখন তেরো—চোদ্দো সেই সময়ই ওকে সে প্রথম দেখেছে। তাদের বাসনমাজা ঠিকে ঝি কার্তিকের মা—র ছোটোমেয়ে, থাকত কচুবাগান বস্তিতে। বহু পরে বউদির কাছে সে শুনেছে নন্দকাকা নাকি ওর ঘরে প্রায়ই যেত। শ্রীগোপাল তা জানত নিশ্চয়। ঘরে বসেই নির্ভুল খবর সংগ্রহে বউদির দক্ষতার কথা বাড়ির সবাই জানে। পারুল মা—র সঙ্গে আসত কাজে সাহায্য করার জন্য। মাঝেমধ্যে তখন তার চোখে পড়েছে হাইজাম্পারদের মতো লম্বা দুটো পা, শীর্ণ দেহ, দুটো বিনুনি, মাজা গায়ের রঙ আর বড়ো চোখ। তাকে দেখলেই চোখ নামিয়ে নিত। তখন সে ক্লাস টেন—এ পড়ত, মিতার সঙ্গে প্রণয় চলছে। একতলার ঘরে শ্রীগোপাল থাকত দুলালের সঙ্গে। ঘরের সামনেই উঠোন, যেখানে বসে কার্তিকের মা বাসন মাজত মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে। শ্রীগোপালের বয়স তখন উনিশ, তার প্রথমবার মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে। ঘরে বসে দুপুরে লেখাপড়া চর্চা করে। সেই সময়ই একদিন দোতলার জানালা থেকে তার চোখে পড়েছিল ঘর থেকে শ্রীগোপাল চোখের ইশারায় কার্তিকের বোনের সঙ্গে ভাবের আদানপ্রদান চালাচ্ছে। সেই দিনই সে শ্রীগোপালকে বলেছিল, ‘কদ্দূর এগোলি’? ‘দারুণ মেয়ে মাইরি।’ ‘নাম কী রে?’ ‘পারুল’। ‘দেখিস ধরা পড়ে যাসনি।’ সামনের লম্বা দাঁত দুটো বার করে শ্রীগোপাল হেসেছিল, ‘ধরা অতই সোজা যেন!’

পোষাচ্ছে না বলে বছরখানেক পর কার্তিকের মা কাজ ছেড়ে দেয়। এরপর শ্রীগোপাল পাড়ার বাইরে সন্ধ্যাবেলার পারুলের সঙ্গে দেখা করত, এইটুকু মাত্র সে জানে। এই প্রসঙ্গে নিয়ে শ্রীগোপালের সঙ্গে কথা বলাকে মর্যাদার পক্ষে যথেষ্ট নয় বলে সে মনে করত। তার সঙ্গে পারুলের মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হয়েছে। পাড়ার বস্তিবাসী ঝিয়ের মেয়ে, সুতরাং কথা বলার প্রশ্নই নেই। হয়তো সে পরিচিতের ফিকে হাসি হেসে থাকবে, তখন পারুলের বড়ো বড়ো চোখ মুহূর্তের জন্য উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখে সে মজাই হয়তো পেয়েছে। একদিন সে হনুমান পার্কের ফটকে যদুপতির কাছে ঘুগনি কেনার সময় একটি মেয়ের সঙ্গে পারুলকে শাড়ি পরে যেতে দেখেছিল। শালপাতার টুকরো দিয়ে খানিকটা ঘুগনি তুলে মুখে দিতে দিতে সে আড়চোখে দেখেছিল, পারুলকে আরও লম্বা, আরও রোগা লাগছে শাড়ি পরার জন্য। আর দেখেছিল পারুলের মুখ সোজা সামনের দিকে, কিন্তু চোখদুটো ডানদিকে ঘুরিয়ে নজর তার মুখে রেখে কথা বলতে বলতে পাশ দিয়ে চলে গেল। খানিকটা গিয়েই ওরা দুজন ফিরে এল যদুপতির কাছে। ‘এক আনা—এক আনা করে দু—জায়গায় ঘুগনি দাও তো।’ সে সেখান থেকে তখন সরে গেছিল।

এখন খালপাড় দিয়ে সেই পারুলই হাতে একটা প্লাস্টিকের জারিকেন নিয়ে চলেছে। অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে ওর চেহারাটা। তিন বছর আগে যখন সে এসেছিল, তখন দেখা সেই রোগা মেয়ের চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না ওর শরীরে। তিল তিল করে কবে যে ও ভরাট হয়ে উঠল তা সে জানে না। তিন বছর আগে শ্রীগোপাল এসে যখন বলল, ‘রোঘো, বিয়ে করে ফেললুম মেয়েটাকে, একদিন গোকুলানন্দে আয় বউভাত খাওয়াব।’ তখন সে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘কাকে, পারুলকে?’ ‘তবে না তো কাকে? বউদি, আপনি তো এখনও একবারও যাননি গোকুলানন্দে, এবার একদিন রঘুর সঙ্গে আসুন।’ বিবি হেসে ‘যাব’ বলেছিল। পরে বিবি জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘পারুল কে? মনে হল তুমি যেন চেনো।’ ‘চিনি বলতে মেয়েটার মা আমাদের ঠিকে ঝি ছিল, মায়ের সঙ্গে ও আসত, এই পর্যন্ত। শ্রীগোপাল তখন থেকেই প্রেম চালিয়েছে। সিড়িঙ্গে একটা মেয়ে, ড্যাবাড্যাবা চোখ, এইটুকু শুধু মনে আছে।’ কার্তিকের মা—র সঙ্গে নন্দকাকার সম্পর্কের কথাটা সে আর বলেনি।

গোকুলানন্দর বাড়িটা ষাট সত্তর বছরের, চুন—সুরকির গাঁথনিতে তৈরি। জমিজমার সঙ্গে বাড়িটাও তার ঠাকুরদা কিনেছিল গায়েনদের কাছ থেকে। পলেস্তরা খসে পড়েছে, জানলার কাঠের গরাদ ভাঙা, পাল্লার কাঠ ক্ষয়ে যাওয়ায় দরজা বন্ধ করলেও বৃষ্টির ছাট কি কনকনে বাতাস ঘরে ঢোকে। ঘরের মেঝের সান চটে যাওয়ায় ঝাঁট দিলেই ধুলোর মতো সুরকি উঠে আসে।

বছরে দু—তিনবারের বেশি কেউ না আসায়, বাড়িটাকে সংস্কার করার গরজ কেউ দেখায়নি। তার আগে দত্তবাড়ির কেউ এখানে রাত কাটায়নি। শ্রীগোপাল দু—তিনবার বলেছিল বাড়িটা সারাইয়ের জন্য। ‘হাজার দশেক ঢাললেই নতুন হয়ে যাবে।’ কিন্তু হচ্ছে—হবে করে সেও মাসের পর মাস পার করে দিয়েছে।

বিবি একবার বলেছিল, ‘বাড়িটা সারিয়ে নিলেই তো হয়।’ সে বলেছিল, ‘সারাতে গেলে তো রোজ আমাকে কলকাতা থেকে গিয়ে কাজ দেখতে হবে। শ্রীগোপালকে ভার দিলে ও বেটা তো অর্ধেক টাকা আগে নিজের পকেটে পুরবে। দেখ না, প্রত্যেকবারই একটা—না—একটা অজুহাত দিয়ে টাকা কম দিচ্ছে, হয় বর্ষা হয়নি বলে বীজতলার চারা নষ্ট হয়েছে; নয়তো কালবোশেখিতে ধানের মোহর ঝরে গেছে কী পোকা লেগে ধান নষ্ট হয়েছে। বাঁশ, নারকোল বেচে দিয়ে কত টাকা যে মেরেছে, তার হিসেব করা যাবে না। ওকে ছোটোবেলা থেকেই জানি তো!’

গ্রাম থেকে খানিকটা বাইরে একটা পুকুর, দুটো ফলের বাগান আর একটা বিঘে চারেকের সবজি খেত পেরিয়ে তাদের বাড়িটা। নিকটতম প্রতিবেশী কম করে চারশো মিটার দূরের শরৎ বসাক। টাকাওয়ালা লোক। পাটের ব্যবসায়ী, একটা ট্রাক আছে, তেজারত করে। একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে, জমি কিনে একতলা নতুন বাড়ি করে বছরখানেক হল বাস করছে। শরৎ বসাক ছাড়া গোকুলানন্দর আর কারুর সঙ্গে তার আলাপ নেই।

বাড়ির একতলায় একটি বড়ো ঘর আর সেপটিক ট্যাঙ্কের পায়খানা, তার উপরে দোতলায়ও একটি ছোটো ঘর আর সেই মাপেরই ছাদ। পায়খানাটা শ্রীগোপাল ব্যবহার করে। বাড়ির লাগোয়া একটা ইঁদারা। নীচের ঘরে ধানের বস্তা, খড়, সার, চাষের জন্য দরকারি সরঞ্জাম রাখা হয়। এরই পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সরু দু—হাত চওড়া সিঁড়ি। সিঁড়ির মাথায় বাঁদিকে ঘর, ডানদিকে ছাদ। ঘরটা তালা দেওয়া থাকে, চাবি থাকে শ্রীগোপালের কাছে।

তার ঠাকুরদা দ্বারিক দত্ত বেলজিয়াম থেকে নানা ধরনের কাচ, ঝাড়বাতি আর আয়না আমদানি করে পূর্ব ভারতে একচেটিয়া ব্যবসা শুরু করে বিশ শতকের প্রথম দিকে। গোকুলানন্দে চাষের জমি, ফলের বাগান, পুকুর সব মিলিয়ে নব্বই বিঘের সম্পত্তি আর বাড়িটা তার আমলেই হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তার কাচ আমদানির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। যুদ্ধ থামার পর হাঁপানির রোগী আটাত্তর বছরের বৃদ্ধের পক্ষে আবার নতুন করে ব্যবসা পাতার মানসিক ও দৈহিক সার্মথ্য আর ছিল না।

দ্বারিকের একমাত্র ছেলে অমিয় বাবার বিষয়সম্পত্তি ও ব্যাঙ্কের পাসবই দেখে স্থির করে, যে বিশ্রামটা বাবার নেওয়া উচিত ছিল, সেটাই সে নেবে বাবার তরফে। চারটে ওষুধ কোম্পানির হোলসেল ডিলার হয়ে অমিয় বাগরি মার্কেটে ঘর নিয়ে বড়োছেলে গোপেন্দ্রনারায়ণকে বসিয়ে দিল ব্যবসায়। আর নিজে ব্যস্ত রইল তার ক্লাব মোহনবাগানকে নিয়ে। ধবধবে ধুতি—পাঞ্জাবিতে শোভিত হয়ে, হুডখোলা অস্টিনে চড়ে অমিয় নিয়মিত বিকেলে ময়দানে যেত, ক্লাব লনের বেঞ্চে বসে বনেদি লোকেদের সঙ্গে গল্প করত। হাজার হাজার টাকা চাওয়া মাত্র ক্লাবকে দিয়েছে এবং কখনো ফেরত চায়নি, কার্যনির্বাহী সমিতিতেও সদস্য হয়েছে।

তার বিষয়—আশয় দেখার ভার ছিল নন্দলাল বিশ্বাসের ওপর। এই ব্যাপারে তার দুই ছেলের থেকেও সে বেশি ভরসা করত তার পুরোনো বিশ্বস্ত লোকটিকে। বেঁচে থাকতেই অমিয় তার বিষয়সম্পত্তি গোপেন্দ্র ও রাঘবেন্দ্রকে ভাগ করে দিয়ে যায়। ওষুধের ডিলারশিপ, বসতবাড়ির সামনের অংশ, ভবানীপুর ও দর্জিপাড়ার বাড়ি পায় বড়োছেলে। বসতবাড়ির পিছনের অংশ ও বাগানের জমি আর গোকুলানন্দর জমিজমা পায় ছোটোছেলে। একমাত্র মেয়ে সরযূর বিয়েতে অমিয় দেড় লাখ টাকা খরচ করেছে, যৌতুকের মধ্যে ছিল গ্রে স্ট্রিটের বাড়িটা আর ডাক্তার জামাইয়ের চেম্বার সাজিয়ে দেওয়া। অমিয় উইল করে যায়, ক্যাশ সার্টিফিকেটে আর নগদে প্রায় চার লক্ষ টাকা তার দুই ছেলের মধ্যে ভাগ হবে আর স্ত্রী রাধারানীকে দেয় পঞ্চাশ হাজার টাকা। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পঞ্চাশ হাজার থেকে যে টাকা রয়ে যাবে, তা সমানভাবে পাবে দুই পুত্রবধূ। এই টাকা রাধারানীর খরচের দরকার হয়নি, ফলে সুদে—আসলে যা দাঁড়িয়েছিল, তার অর্ধেক প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা বিবি পায়।

অমিয় তার ছোটোছেলেকে বলেছিল, ‘রঘু, তোকে গ্রামের জমিজমা দিলাম বলে মনে দুঃখ পাসনি তো? পুরনো ভাড়াটের বাড়ি থেকে কোনো লাভ হয় না। ডিলারশিপের কারবারটা গোপুই গড়ে তুলেছে, ন্যায্যত এটা ওরই পাওয়া উচিত।…. তোর স্বাস্থ্য আছে, খাটবার ক্ষমতা আছে, তুই কেন বসা কাজ করবি? চাষবাস ভালোভাবে করতে পারলে তাতে অনেক পয়সা, মাটি হল সোনা! কেমিক্যালস দিয়ে, ট্রাক্টর দিয়ে, সয়েল টেস্ট করে, উন্নত বীজ দিয়ে যেভাবে ইউরোপ আমেরিকায় হয়, সেইভাবে এগ্রিকালচারাল ফার্ম কর, এর ভবিষ্যৎ আছে। ফিশারিজ কর, পোলট্রি কর, ডেয়ারি কর… যদি তোর উদ্যোগ থাকে, বড়ো হবার স্বপ্ন থাকে…আমি তোকে জমি আর কিছু টাকা শুধু দিয়ে গেলাম—এবার তুই যা করার কর।’

বাবার কথা সে মন দিয়ে শুনে বলেছিল, ‘আমি দুঃখ পেয়েছি এমন ধারণা তোমার হল কী করে? তুমি তো আমায় সেরা জিনিসই দিয়েছ! গ্রাম তো আমার ভালোই লাগে।’ কিন্তু সে চাষ করতে গ্রামে যায়নি, তখন তার সদ্য বিয়ে হয়েছে। বউকে কলকাতায় রেখে গোকুলানন্দে গিয়ে বাস না করে বাড়ির বাগানের জমিতে স্টিলের অফিস—সরঞ্জাম তৈরির কারখানা খোলে। তবে বছরে দু—তিনবার সে গোকুলানন্দে যেত, যদি বিশেষ দরকার পড়ত। যুক্তফ্রন্ট আমলে চাষিরা যখন জমি দখলের লড়াই শুরু করে, বড়ো বড়ো রায়তদের সঙ্গে তখন শ্রীগোপাল ছুটে এসেছিল কলকাতায়।

‘রোঘো, তোর জমি আর বোধহয় বাঁচানো যাবে না। রাইহাটায় চাটুজ্যেদের জমিতে চারটে লাশ পড়েছে, আটকাতে পারেনি, জমিতে লালঝান্ডা পুঁতে দিয়েছে। কালোসোনায় দু—বার ধান কাটতে এসেছিল, মল্লিকরা কলকাতা থেকে গুন্ডা আর বন্দুক এনে হটিয়েছে, দুটো লাশ পড়েছে, জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে। শয়ে শয়ে মানুষ, বড়োজোর দু—তিন দিন আটকাতে পারব, তারপর?’

‘আমার তো আর দুশো কিংবা তিনশো বিঘে নয়, তাহলে আমার জমি নেবে কেন?

‘বারো বছর আগে কংগ্রেস সরকার ভূমিসংস্কার করে পঁচাত্তর বিঘের যে সিলিং বেঁধে দিয়েছিল, তার থেকে তো তোর চোদ্দ—পনেরো বিঘে বেশি রয়েছে। বাড়তি সেই জমিতো আজও চাষিরা পায়নি। এখন যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমল, এবার তো আর ছাড়ানছুড়িন নেই।’

‘তুই তো একটা কৃষক নেতা, কিছু একটা ব্যবস্থা কর।’

‘আমি! …তুই বলিস কী?’ শ্রীগোপালের দাঁতদুটো আরও বেরিয়ে আসে। ‘আমার লাশ পড়ুক, তুই কি চাস?’ ওর অবাক চাহনি ঘিরে রেখেছিল ভয়। উপরের ঠোঁট ধীরে ধীরে নেমে এসেছিল বেরিয়ে থাকা দাঁতদুটোর উপর। ‘জমির মালিক অথচ জমিতে কখনো যাস না। আমি শালা ওখানে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মুখে রক্ত তুলে চাষ করাবো আর ধান বেচার, পুকর—আমবাগান জমা দেওয়ার টাকা বাড়ি বয়ে তোকে দিয়ে যাব, কি না দুটো টাকা আর থাকার একটা ঘর তোরা আমাকে দিচ্ছিস বলে?…যা, এবার গোকুলানন্দে গিয়ে জমি সামলা। …এই যে ছুটে এসে খবর দিলুম, এটা করাও আমার উচিত হয়নি।’

তাদের কথা হচ্ছিল বৈঠকখানার সামনে সদর ঘরে। শ্রীগোপাল চেয়ারে হেলান দিয়ে মুখ উপরে তুলে চোখ বন্ধ করে গভীর চিন্তায় ডুবে গেছিল আর সে চুলের মধ্যে আঙুল চালাচ্ছিল ওর মুখের দিকে তাকিয়ে।

‘আমি কি তাহলে গোকুলানন্দে যাব?’

‘একদম নয়…তোর সেফটির দায়িত্ব আমি নিতে পারব না।’

‘তাহলে?…জমি কি হাতছাড়া হয়ে যাবে?’

‘বাবা সারাজীবনটাই তোদের জন্য দিয়ে গেল…কী পেল?

আমাকে দয়া করে তোরা রাখলি, খেতে পরতে দিলি, স্কুলেও পড়ালি, কিন্তু কলেজে পড়তে দিলি না।’ আপনমনে শ্রীগোপাল বিড়বিড় করেছিল।

‘পড়াশুনো তোর লাইন নয় বলেই বাবা পড়ায়নি।’

‘তোর লাইনও কি ছিল? পড়ে কী হয়েছিস তুই? চেহারা দেখিয়ে, বাইক ফটফটিয়ে চলা ছাড়া আর কী পেয়েছিস?’

সে মাথা নীচু করে শ্রীগোপালের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে রাখে। দুজনের কেউ অনেকক্ষণ কথা বলেনি।

‘একটা যাহোক ব্যবস্থা কর…তুই—ই পারবি।’ টেবিলে ঝুঁকে একটা হাত বাড়িয়ে সে শ্রীগোপালের হাত ছোঁয়ার চেষ্টা করে। হাতটার দিকে অদ্ভুতভাবে তার লম্বা মুখটা কুঁচকিয়ে সে তাকিয়ে ছিল।

‘তুই—ই আমাকে করাপ্ট করবি।’ কথাটা বলেই শ্রীগোপাল চেয়ার থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পড়ে। আর একটি কথাও না বলে দ্রুত পায়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সে ওর পিছনে নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ফটক পর্যন্ত ছুটে গেছিল। শ্রীগোপাল পিছু ফিরে তাকায়নি, হনহনিয়ে কচুবাগান বস্তির দিকে সে চলে গেল। তখন একবার মনে পড়েছিল, কয়েক বছর আগে বলা কথাটা : ‘ঘোড়ামুখো তুই আমাকে নষ্ট করলি!’

তার জমির এক শতক পরিমাণও বেদখল হয়নি। কেন যে হয়নি সেটা জানার চেষ্টা সে করেনি। যদি ও বলে ‘রোঘো তোর জন্যই করাপ্ট হলাম।’ তাহলে কোনোদিন সে আর আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। তবে সে লক্ষ করেছে শ্রীগোপাল কেমন যেন বদলে গেছে। তাকে হেয় করে অপমান করে কথা বলার প্রবণতাটার সঙ্গে বেড়েছে মদ খাওয়াও। একবার শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘টাকা রোজগারের অনেক রাস্তা আছে রে রোঘো, ফিকিরটা শুধু জানতে হয়।’ ‘কীরকম ফিকির?’ ‘পলিটিক্স’, শ্রীগোপাল তেরছা চোখে তাকিয়ে বলেছিল ‘ভাবছি এবার ওটাই করব। …টাকা না থাকলে জীবনে কিছুই থাকে না, সুখ শান্তি, মানমর্যাদা, দাপট কিছুই জোটে না। বাপ—ঠাকুরদা পলিটিক্স বলতে যা বুঝত, ইংরেজ তাড়ানো, সে জিনিস নয়। এখন গরিবি তাড়ানোর পলিটিক্সে ঢুকতে হবে।’ আর একবার বলেছিল, ‘সততার কোনো দাম নেই রে রোঘো।’ ‘হঠাৎ এ কথা?’ ‘এমনিই বললুম। দুখিরাম গায়েনের পুকুরে কে ফলিডল ঢেলে মাছ মেরে দিয়েছে। ওর ধারণা আমিই এটা করেছি। …ওর দেড় বিঘের পুকুর জমা নিতে চেয়েছিলুম, দেয়নি, তাই রাগ মেটাতে আমি নাকি ওর মাছ মেরেছি। এখন বলছে পুকুরটা দেবে, ব্যাটা ভয় পেয়ে গেছে।’ শ্রীগোপালের বলার ধরন আর মুখ দেখে তখন তার মনে হয় কাজটা সম্ভবত ওরই করা, কিন্তু এ নিয়ে সে প্রশ্ন তোলেনি। কী জানি, কথায় কথায় যদি বলে বসে, ‘বেশ করেছি ফলিডল ঢেলেছি।’ তাহলে ওর অধঃপতনের জন্য নিজেকে ছাড়া আর কাকে সে দায়ী করবে?

.

ব্যাগটার মধ্যে আরও কয়েকটা কাগজের কাটিং রয়েছে। আর একটা তুলতে গিয়ে সে হাত টেনে নিল। সাপের গর্তে হাত ঢোকাতে যাচ্ছিল! বুকের ভিতরটা অবশ হয়ে যাচ্ছে, দ্রুত হয়েছে হৃদস্পন্দন। বিবি এগুলো কেটে রেখে দিয়েছে তাকে পড়াবার জন্য? ব্যাগটা এই ঘরে রেখেছি কি সেই উদ্দেশ্যেই, যাতে কৌতূহলবশে তুলে নিয়ে সে খোলে। তাকে আবার মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য?

তখন প্রত্যেকটা খবরের কাগজেই নিশ্চয় এইরকম রিপোর্টই বেরিয়েছে। তার চেনাশোনা, আধচেনা, একদমই অচেনা লক্ষ লক্ষ লোক পড়েছে। ‘পারুলবালা স্বামীকে রক্ষার জন্য ছুটে এলে রাঘবেন্দ্র তাকে ঘরের মধ্যে টেনে এনে ধর্ষণ করে।’ কী মারাত্মক একটা বাক্য। লক্ষ লক্ষ চোখের সামনে তাকে কুৎসিত নোংরা মানুষ করে দিয়েছে। ভাগ্যিস বাবা—মা তখন বেঁচে ছিল না।

কিন্তু এখন কি সবাই ঘটনাটা ভুলে গেছে? স্মৃতি নাকি ধূসর হয়ে যায়! ষোলো বছরে কি ধূসর হতে পারে? কালের প্রলেপে নাকি স্মৃতি ঢাকা পড়ে, মুছে যায়? কতটা সময়কে ‘কাল’ ধরা হয়? ষোলো বছর কী একটা ‘কাল’ হতে পারে? হয়তো তাকে সবাই ভুলে গেছে। কিন্তু ঘটনাটাকে তারা মনে রাখবেই। এখনও কাগজে এইরকম খবর বেরোয়, সেগুলো চোখে পড়লেই হয়তো তারা বলেছে, ‘দত্তদের রঘুও এইরকম ব্যাপার করে জেলে রয়েছে। যাবজ্জীবন …ফাঁসিও হতে পারত, তাই হওয়া উচিত এইসব বজ্জাতদের।’

ব্যাপারটা কীভাবে যে ঘুরে গেল! গোকুলানন্দ থানার দারোগা বিজয় ঘোষ তাকে সেই রাতেই থানায় বসে বলেছিল, ‘পঞ্চাশ হাজার টাকার কমে বাঁচাতে পারব না। সাক্ষী প্রমাণ সব ম্যানেজ হয়ে যাবে, ‘বেকসুর খালাস করিয়ে দোব।’ আরে মশাই বড়োলোক আপনি, এই ক—টা টাকা তো হাতের ময়লা। উঁচুঘরের লোক, মানসম্মানের কথা ভাববেন তো?’

সদর থানায় হাজতে বিবি তার সঙ্গে দেখা করে। চিন্তায় আর অনিদ্রায় বসে যাওয়া চোখ দুটো তার দিকে পৃথিবীর যাবতীয় ধিক্কার আর ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। সে কোনো কথা বলতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল, মানমর্যাদা তার নয়, বিবিরই, ধুলোয় গড়াগড়ি দিচ্ছে। চাপা হিসহিসে স্বরে বিবি বলেছিল, ‘কোনো অজুহাত আমাকে দিয়ো না। কোনো কথা শোনার ইচ্ছে আমার নেই…তবে মামলা চালিয়ে যাব, তোমার যা বলার উকিলকেই বলো, আমাকে বলে কোনো লাভ নেই।’

বিবিকে সে বলতে পারেনি, দারোগাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে আমায় বাঁচাও। বললে বিবি হয়তো টাকা দেবার ব্যবস্থা করত। তার স্বামী নির্দোষ, ষড়যন্ত্র করে একটা বউ রাঘবেন্দ্রনারায়ণকে ফাঁসাবার জন্য মিথ্যা রেপ চার্জ এনেছিল, এটা সবাইকে জানানোর সুযোগ বিবি ছাড়ত না। ওর সব যন্ত্রণার উৎস ছিল এই একটি শব্দে—রেপ। কিন্তু খুনের অভিযোগটা? বিজয় ঘোষ বলেছিল, ‘বেকসুর খালাস করিয়ে দোব।’

এখন শুধু লজ্জা। গুলু, গোরা এদের সামনে রোজ তাকে মুখ দেখাতে হবে। মেয়েটা কথা বলবে মায়ের আড়ালে। মুখভাব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করবে। কিন্তু সে জানে, গুলুর মনের গভীরে কখনোই স্থির স্বচ্ছ উজ্জ্বল হয়ে তার বাবার ছবি থাকবে না। গোরা তাকে উপেক্ষা করে যাবে। বিবিও। কে এই অপূর্বমামা? গুলু বলল মা—র ছোটোবেলার বন্ধু, একই পাড়ায় বাড়ি, একই সঙ্গে পড়েছে। নিশ্চয়ই একসঙ্গে ওর ট্রেনে রোজ কলকাতায় যেত। একটি তরুণ একটি তরুণী…ওদের মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি? …বিবি ডিভোর্সি বলে নিজেকে চালাচ্ছে, কেন? এই অপূর্ব বিবিকে লেখাপড়া শুরু করিয়েছে অথচ বাবার অনুরোধ ও রাখেনি।

তার মাথার মধ্যে দপদপ করে উঠল। গত তিন—চার বছর হল তার মাথায় মাঝে মাঝে একটা যন্ত্রণা হয়। কপালের দু—ধারে হাতুড়ির মতো ঘা পড়ে। তখন সে ধাক্কাগুলোকে সহনীয় করার জন্য মাথায় ঘের দিয়ে শক্ত করে কাপড় কি দড়ি বেঁধে রাখে। সে বুঝতে পারছে মাথায় এবার যন্ত্রণাটা আসছে। সে একটা কাপড়ের টুকরো খুঁজল, ঘরের কোথাও দেখতে না পেয়ে গায়ের গেঞ্জিটা খুলে কপালে জড়িয়ে একটা গিঁট দিল। গোরার গেঞ্জি! ও যদি জানতে পারে তাহলে কী বলবে, ‘আমাদের সবার মাথায় একটা করে গেঞ্জি বেঁধে দাও।’

র‌্যাকে যথাস্থানে ব্যাগটা রেখে, আলো নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ল। এবার যন্ত্রণা আসবে তার মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যেও।

পাঁচ

ছাদের উত্তর—পূর্ব কোণ থেকে সনৎদের দোতলার দুটো ঘর দেখা যায়। একটার দুটো জানালাই খোলা কিন্তু ঘর অন্ধকার, অন্যটার দুটো জানলায় পরদা ঝোলানো, ঘরে আলো জ্বলছে। পরদার উপরের দিকে ইঞ্চি দুয়েক ফাঁক, সেখান দিয়ে ঘরের একটা চিলতে অংশ সে দেখতে পাচ্ছে। একটা স্টিলের আলমারির অর্ধেক, তার পাশে একটা খাটের পায়ের দিক। লুঙ্গিপরা কেউ একজন শুয়ে রয়েছে। পা দুটো নাড়াচ্ছে। খাটে পা ঝুলিয়ে বসে রোগা এক স্ত্রীলোক, বাঁদিকে তাকিয়ে। একে সে কখনো দেখেনি। এই ঘরটা যদি সনতের হয়, পা দুটোর মালিক যদি সনৎ হয়, ওর যদি বিয়ে হয়ে থাকে, তাহলে এই স্ত্রীলোকটি নিশ্চয়ই ওর বউ। ওরা দুজন টিভি সেটের দিকে তাকিয়ে।

সনৎ ক্লাস নাইনে পড়ার সময় একদিন তাকে স্কুলের টিফিনের সময় বলেছিল, ‘বিবেকানন্দের মতো সন্ন্যাসী হব।’ ‘কেন হবি?’ ‘স্বামীজির মতো সারা ভারত ঘুরব, বক্তৃতা দোব, লিখব, দেশের অন্ধকার দূর করব, অস্পৃশ্যতা ঘোচাব।’ ‘তুই একা একা পারবি?’ ‘কেন পারব না!’ ‘স্বামীজি ধর্মের বই, ফিলজফির বই পড়েছিলেন, সংস্কৃত জানতেন।’ ‘সংস্কৃত না জানলেও চলবে, বেদ গীতা বাংলাতেও পাওয়া যায়।’ ‘স্বামীজি বিয়ে করেননি।’ ‘আমিও করব না।’ সনৎকে তারা বলত খ্যাপাটে।

দুলাল বাড়ি থেকে তাদের দুই ভাইয়ের জন্য টিফিন নিয়ে যেত। স্কুলের উঠোনের একধারে দাঁড়িয়ে তারা খেত। ডিমসেদ্ধ, কলা বা অন্য কোনো ফল, মাখন লাগানো পাঁউরুটি, দুটো সন্দেশ, এক গ্লাস দুধ। কোনো কোনো দিন ডিমের বদলে থাকত ঘুগনি বা আলুমরিচ। একদিন তার চোখে পড়ে দূর থেকে সনৎ তাদের খাওয়া লক্ষ করছে। ওকে কখনো টিফিনের সময় কিছু খেতে সে দেখেনি। তার মনে হল সনৎ ক্ষুধার্ত। সে টিফিন কেরিয়ারের বাটি হাতে ওর দিকে এগিয়ে যায়। ‘আমার খেতে ইচ্ছে করছে না, একদম খিদে নেই, তুই ডিম আর রুটি দুটো তুলে নে।’ সনৎ তুলে নিয়েছিল। ফিরে আসতেই দাদা বলেছিল, ‘দেবার কি দরকার ছিল, এবার থেকে রোজ দাঁড়িয়ে থাকবে। তুই দিবি?’ দাদা ভুল বলেনি,সনৎ টিফিনের সময় তার সামনে ঘোরাঘুরি করত। রোজ না হলেও প্রায়দিনই সে বাটি হাতে এগিয়ে গেছে। মিতার দাদা সনৎ, এটাই ছিল খাদ্য সরবরাহের প্রধান প্রেরণা। তা ছাড়া গোগ্রাসে খাওয়াটা দেখতেও তার ভালো লাগত।

সনৎকে সে একবার কুড়িটা টাকা ধার দিয়েছিল পোস্টাল অর্ডার কেনার জন্য। কোথায় যেন চাকরির দরখাস্তের সঙ্গে পাঠাবে। টাকাটা শোধ করেনি, সেও ফেরত চায়নি, সনৎ জানত মিতার সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। জেনেও না জানার ভান করে থাকত। কিন্তু মিতার মা ছিল অন্য ধরনের, অতি বাস্তববাদী, ঠোঁটকাটা। একদিন, যখন সে ক্লাস টুয়েলভে, মিতার মা তাকে ধরল সিঁড়িতে। লাফিয়ে লাফিয়ে সে উঠছিল দোতলায়। তখন একতলার রান্নাঘরের দরজা থেকে গম্ভীর চাপা গলায় ডাক শুনল, ‘রঘু শোনো।’ শুনেই তার বুক ধড়াস করে উঠেছিল। ‘আর তুমি এ বাড়িতে এসো না।’ সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছিল। ‘মিতার সঙ্গে মেলামেশা আজ থেকে তোমাকে বন্ধ করতে হবে, নইলে তোমার কোনো ক্ষতি না হলেও ওর হবে। একদিন ওর বিয়ে হবে তো।’ তখন সে বলে ফেলেছিল, ‘আমি যদি বিয়ে করি।’ ‘না। তুমি বাচ্চচাছেলে, কী বলছ তুমি জান না। তোমাদের বাড়ি কেমন, তা আমি জানি। তোমরা ধনী, তোমাদের বড়োলোক আত্মীয়স্বজন, জাতেও আলাদা, আমাদের সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না। মিতাকে আজ থেকেই ভুলে যাও। এখন তোমাদের কম বয়স, ভুলে যেতে অসুবিধে হবে না।’

সত্যি কথাই বলেছিল মিতার মা। ভুলে যেতে তাদের অসুবিধা হয়নি। স্কুল যাবার পথে চিঠির আদান—প্রদান শুরু হয়। দুজনে ছাদ থেকে কখনো বা বারান্দা থেকে ইশারায় কথা বলত। সেটা ওর মা—র চোখে পড়ে। তারপরই মারধোর করে ওকে এলাহবাদ পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মিতা ফিরেছিল গ্র্যাজুয়েট হয়ে। সে ওর ফেরাটা একদমই লক্ষ করেনি। একদিন ওদের ছাদে বাঁশ—ত্রিপল বাঁধতে দেখে সে দুলালকে কারণ জিজ্ঞাসা করে শুনেছিল, ‘ও বাড়ির মিতার বিয়ে। নেমন্তন্ন করে গেছে কত্তামশাইকে, যাবে তো?’ সে উত্তর দেয়নি। শুধু একঝলক মনে পড়েছিল মিতার মুখের পেঁয়াজের গন্ধটা। বিয়েতে বাবাকেই যেতে হয়েছিল কেননা নতুন বউকে নিয়ে সেই সন্ধ্যায় সে নান্দীকারের ‘তিন পয়সার পালা’ দেখতে যায়।

লুঙ্গিপরা লোকটা উঠে বসল। স্ত্রীলোকটি খাট থেকে উঠে গেল বোধ হয় ঘরের বাইরে। লোকটার খালি গা, মাথার চাঁদিতে চুল ফাঁকা, মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাল। এ কি, এই লোকটাই তো সন্তু, সনৎ! কাঁধটা সরু, বুকটা চাপা, পেটে বড়ো একটা ভুঁড়ি, মাথায় টাক পড়েছে, তার হাসি পেল। এ কি চেহারা করেছে! সে কলেজে ঢোকার পর থেকেই বা মিতার এলাহাবাদ চলে যাবার পর থেকেই সনতের সঙ্গে দেখা—সাক্ষাৎ কমতে শুরু করে। কদাচিৎ পথে দেখা হলে দুজনেই ফিকে হেসে মাথা হেলিয়েছে। বলেছিল, স্বামী বিবেকানন্দ হবে, দেশের অন্ধকার দূর করবে, বিয়ে করবে না। কথাগুলো মনে করিয়ে দেবার জন্য একবার ওর সঙ্গে দেখা করলে কেমন হয়। নিশ্চয় আঁতকে উঠবে তাকে দেখেই। রেপ কেসে জেলখাটা খুনির থেকেও, এরা বেশি বিপজ্জনক। কিন্তু সনতের বাড়িতে গিয়ে সে রেপ করবেটা কাকে? ওর রুগণ, পাটকাঠির মতো হাতওয়ালা বউকে?

এবারের হাসিটা তার মুখে ছড়িয়ে গেল। দেখা করতে যেতে হবে একদিন। পিছনে একটা শব্দ হল। চমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল ছাদের দরজায় গুলু দাঁড়িয়ে।

‘কী ব্যাপার?’

‘কিছু না, দেখতে এলাম।’

‘কী দেখতে, পালিয়ে গেছি কিনা?’

‘কাউকে বলে বেরোওনি তো, মা তাই বলল খুঁজে দেখতে।’

‘তুই এখন কী করছিস? গল্প করার ইচ্ছে হচ্ছে রে, আমার অনেক কিছু মনে পড়ছে।’

‘আমি পড়ছি এখন…যাই।’ খাপছাড়াভাবে গুলু চলে গেল।

গুলু ভালোই জানে মা পছন্দ করবে না বাবার সঙ্গে কথা বলা। বিবি চায় না সে ঘরের বা বাইরের লোকের সঙ্গে কথা বলে, বা বাড়ির বাইরে যায়। তাহলে সারা দিনরাত, হপ্তার, মাসের, বছরের পর বছর সে করবে কী, কীভাবে সময় কাটাবে? রাত্রে ছাদে এলেও তার খোঁজ করা হবে! এটা কি জেলখানা?

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখল দাদার দরজা দিয়ে ওদের ঝি বেরোচ্ছে, দরজা বন্ধ করতে গিয়েও বউদি শিবানী পাল্লাটা আবার খুলল।

‘বউদি কেমন আছ?’ হঠাৎই কথাগুলো তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল। সামনাসামনি হয়ে এত বছরের চেনা মানুষের সঙ্গে কথা না বলা মানে নিজেকে আসামি করে রেখে দেওয়া।

‘ভালো আছি, তুমি কেমন আছে? ফিরেছ যে সেটা আমি পরের দিনই জেনেছি। দাড়ি দেখে ভাবলুম এই কাবুলিওয়ালাটা ছাদ থেকে নামছে কেন? বুকটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল…ভেতরে এসো।’

শিবানীর সঙ্গে সে বসার ঘরে এল। ঘরটাকে নতুন করে তার মনে পড়ল। দাদার অংশে শেষ এসেছিল সে বাবার শ্রাদ্ধের সময়। এই উপলক্ষে দুটো অংশ একাকার হয়ে গেছিল আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে। এই ঘরে বসেই সে দাদার সঙ্গে শ্রাদ্ধের জন্য খরচ—খরচার খসড়া করেছিল। কুড়ি বছর হল কি? …বোধহয় উনিশ। সোফাটা একই জায়গায়, শুধু ঢাকনার কাপড়টার রঙ বদলেছে। দেয়ালে বাবা—মার ছবি একই জায়গায়। ছবিতে শুকনো মালা ঝুলছে, সাদা চন্দনের ফোঁটা। বিবির ঘরের দুটো ছবিতে এসব নেই।

‘দাদা কোথায়, দোকানে? ভালো আছে?’

‘তেমন আর ভালো আছে কোথায়! ওনার ব্লাডপ্রেশার তো ছিলই, এখন আবার ঘাড়ের কাছে একটা ব্যথা শুরু হয়েছে। ডাক্তার বলছে স্পন্ডালিসিস না কি যেন হয়েছে। …তুমি চা খাবে?’

‘না।’

‘ছাদে গেছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাইরে বেরোওনি?’

সে সজাগ হয়ে উঠল। প্রশ্নটার উত্তর বউদিকে আরও অস্বস্তিকর প্রশ্নের সুযোগ এনে দিতে পারে।

‘বেরিয়েছিলাম। এদিক—ওদিক হাঁটলাম। সবই তো দেখছি একইরকম রয়েছে, তোমাদের এই ঘরটার মতো।’

‘একই রকম। কী বলছ ঠাকুরপো? এই আমাকেই দ্যাখো না, আরও মুটিয়ে যাইনি? তোমার দাদা অ্যাম্বাসাডার বিক্রি করে মারুতি কিনেছে, এটাও বদল। অপু—নুপুর বিয়ে হয়ে গেছে, ওরা না থাকায় আমার আর তো হাতে কিছু কাজই নেই…এসব কি বদল নয়? …একটু বোসো, আজ ক্ষীরের পুলি বানিয়েছি।’ শিবানী উঠে দাঁড়াল, ‘দুটো চেখে যাও।’

সে চুপ থেকে সম্মতি জানাল। শিবানীর ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে তার মনে হল সত্যিই বদল ঘটেছে, নইলে তাকে ডেকে ঘরে বসিয়ে বউদি ক্ষীরের পুলি খাওয়াচ্ছে, স্বপ্নেও কি ভাবা যেত! আর একটা ব্যাপারও লক্ষ করার মতো, তার গত ষোলো বছর নিয়ে কোনো কৌতূহল দেখায়নি। এটাই তাকে সহজ করে দিচ্ছে।

চারটে পুলি আর একটা চামচ আকাশি নীল লতাপাতার ছাপ তোলা বোন—চায়নার প্লেটে, অন্য হাতে কাচের গ্লাসে জল নিয়ে শিবানী ফিরে এল। এইরকম প্লেট কুড়ি বাইশ বছর আগে তাদের বাড়িতে সে দেখেছে। বাবা কিনে দিয়েছিল বড়ো বউকে। আজও রয়ে গেছে। বউদি খুব যত্নে রাখে জিনিসপত্র। পুলিগুলোর আকার সরু ঢ্যাঁড়শের মতো। সে চামচ দিয়ে কেটে একটুকরো মুখে দিয়ে চোখ বুঁজল।

‘কেমন হয়েছে?’

চোখ খুলে দেখল বউদির উদবিগ্ন দৃষ্টি। ‘কাজ খুঁজছ? একটা মিষ্টির দোকান করো। কলকাতার কোন দোকান এত ভালো করতে পারবে না।’

‘মেয়েরাও বলে, মা—র হাতের মিষ্টি খেলে দোকানের মিষ্টি আর খেতে ইচ্ছে করে না।’

‘দোকান যদি না করো তো বই লেখো, মিষ্টান্ন রন্ধন প্রণালী।’

‘ওরে বাবা, বইফই লিখব কী, মেয়েকে চিঠি লিখতেই কলম ভেঙে যায়।’ শিবানী খিলখিল করে হেসে উঠল। বহু বছর পর সে হাসির শব্দ শুনল। অবাক হয়ে সে বউদির মুখের দিকে তাকাল।

‘বই লিখতে পারবে তোমার বউ, তবে রান্নার বই পারবে না।’

‘বিবি তো ভালোই রাঁধে।’

‘কোনোদিন তো রান্নাঘরে ঢুকতে দেখলুম না। খালি তো হটর হটর করে বাইরে বেরোনো।’

‘একা মেয়েমানুষ, দুটো বাচ্চচা, না বেরোলে চলবে কেন?’

‘একবারও বিবি আমাদের কাছে এসে দাঁড়ায়নি। তোমার দাদা দুঃখু বলে বলেছিলেন, বউমা যদি একবার এসে বলত তাহলে যত টাকা লাগে আমি খরচ করতুম, বাড়ির বউকে ছোটাছুটি করতে হত না। হাজার হোক রঘু আমার মায়ের পেটের ভাই।’

‘ওর কথা ছেড়ে দাও বউদি। জানই তো আমাদের বাড়ির অনেক ব্যাপার বিবি ঠিক বোঝে না। ও অন্য কালচারে মানুষ হয়েছে।’

‘তা হবে। তবে ওর বাপের বাড়ির লোকেরা দুঃসময়ে কিন্তু খুব করেছে। মামলা তো ওরাই চালাল, টাকা অবশ্যই তোমারই, তা হোক গতর খাটানোর ব্যাপার তো আছে! তারপর বিবিকে আবার পড়াশুনো করানো।’

তার মুখে হয়তো খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা জিজ্ঞাসা ভেসে উঠে থাকবে। বউদির চোখে সেটা ধরা পড়ল। ‘বাপের বাড়ির পাড়ার কে বন্ধু, সেই তো রোজ এসে পড়াত। কেন, তুমি জান না?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, জানব না কেন…অপূর্ব, আমার বিয়ের দিনই ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। খুব ভালো ছেলে, পড়াশুনোয় দারুণ, আমেরিকা থেকে ডক্টরেট করে এসেছে, ওর বউ তো ডাক্তার গাইনি।’ একটানা সে বলে গেল। উসকে ওঠার আগেই বউদিকে নিবিয়ে দেবার জন্য না বলে তার উপায় ছিল না।

‘আলাপ ছিল নাকি!’ বউদি চোখদুটো ছোটো করে তাকাল। ‘তুমি থাকতে ওকে এ বাড়িতে তো কখনো আসতে দেখিনি।’

‘দেখবে কী করে। তখন তো অপূর্ব আমেরিকায়।’

‘অ।’

‘আর কী খবরটবর…বলো।’ অন্য প্রসঙ্গে আসার জন্য সে বউদির কথার ধাঁচ বদলাতে চায়। বিবিকে দু—চক্ষে দেখতে পারে না। কিন্তু সেটা কখনো কখনো গোপনও করে না।

‘খবর আর কী…ভালো কথা, মিতাকে মনে আছে তোমার? শিবু বর্ধন লেনের সেই মেয়েটি, এখন বাপের বাড়িতেই রয়েছে। স্বামী ওকে নেয় না, আর একটা বিয়ে করেছে, খুব বাজে লোক…মিতা আলাদা থাকে মাকে নিয়ে।’

‘মিতা করে কী?’

‘চাকরি করে কোথায় যেন। সনৎ তো মাকে দেখে না, মা—ছেলের ঝগড়া তো লেগেই আছে।’

খালি প্লেটটা টেবলে রেখে সে জলের গ্লাস তুলে নিল। মিতাকে স্বামী নেয় না কেন? হালকা একটা দুঃখ তাকে ছুঁয়ে গেল। এই মিতা তার জন্যই মায়ের হাতে বেদম মার খেয়েছিল! ওকে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে, তাকে কীভাবে মনে রেখেছে সেটা জানার বাসনা তাকে গ্রাস করেছে। পেঁয়াজের ক্ষীণ একটা গন্ধ তার মনে ভেসে এল। বিবেকানন্দ হবার স্বপ্ন দেখা সনৎ এখন মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে!

‘বউদি, এখন উঠি, দাদার আসতে তো দেরি হবে, পরে দেখা করব। আবার পুলি করলে খবর দিয়ো।’

‘ওরে বাবা, তোমার ঘরে খবর দিতে যাবে কে, তার থেকে তুমিই বরং খবর নিয়ে যেয়ো। আমার ঘরে মিষ্টি খেয়েছ এই খবর বিবির কানে গেলে দ্যাখো ও তোমায় কী বলে।’

‘কী বলবে?’ হঠাৎই এক ঝলক রক্ত তার মস্তিষ্কের কোষগুলোয় ঢুকে পড়ল। ‘আমার বাড়ির কর্তা আমি। যেখানে খুশি আমি যেতে পারি, পারি না কি?’

‘দুলাল মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে গল্প করত। পুরোনো লোক, বয়সও হয়েছিল, তাই বলে সেজন্য বিবি ওকে তাড়িয়ে দেবে? অত বছরের পুরনো চাকর কলকাতা শহরে ক—টা লোকের বাড়িতে আছে?’

‘তোমার কি মনে হচ্ছে বিবি আমাকে তাড়িয়ে দেবে?’ বলে সে হাসল। তার সঙ্গে যোগ দিল শিবানীও। আর তখনই বুঝতে পারল, কথাটা বলে নিজের অসহায় অনিশ্চিত অবস্থানটাকে সে প্রকট করে দিল।

‘বিষয়—সম্পত্তি সব ওর নামে লিখে দিয়ে ঠাকুরপো তুমি যে কী ভুল করেছ! অবশ্য মামলার খরচ চালাবার জন্য তা না করে তোমার উপায়ও ছিল না। এখন তো একটা টাকার জন্যও বউয়ের কাছে তোমার হাত পাততে হবে।”

অদ্ভুত দৃষ্টিতে সে বউদির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মুখে কোনো জটিলতা নেই। বউদি জানে এখন সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে।

‘আমি আসি।’

দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। খাওয়ার টেবলে কয়েকটা খাতা, বিবি কলম হাতে ঝুঁকে রয়েছে। তার মনে হল দরজা বন্ধের শব্দে বিবির পিঠ আড়ষ্ট হয়ে গেল। মুখ ঘুরিয়ে তাকাল না। বোধহয় তার জন্যই অপেক্ষা করছে, নয়তো ঘরে বসেই খাতা দেখতে পারত। শোবার ঘরে টেবল ল্যাম্প জ্বালিয়ে গুলু পড়ছে। গোরার ঘর থেকে টিভি চলার আওয়াজটা কানে এসে ধাক্কা দিল। বিবির পাশ দিয়ে সে গোরার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। খাটের উপর গোরা পা ছড়িয়ে শুয়ে, দেয়ালে ঠেস দেওয়া দুটো বালিশে মাথা রেখে, সামনে টিভি সেট। হিন্দি সিনেমার গানের সঙ্গে একদল মেয়ে নাচছে। দরজায় তাকে দেখে গোরা চোখ সরিয়ে তার দিকে তাকাল।

‘সাউন্ডটা একটু কমাও। মা কাজ করছে, দিদি পড়ছে, ওদের ডিসটার্ব হচ্ছে।’

গোরা সেটের উপর চোখ ফিরিয়ে নিল। তার মধ্যে নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে সে বলল, ‘কী হল?’

‘কারুর ডিসটার্ব হচ্ছে না।’ গোরার চোখ সেট থেকে সরল না।

‘জানলে কী করে হচ্ছে না? এত জোরে চালালে পড়াশুনো করা যায় না।’

‘জোরে চলছে না। ওরা কেউ বলেনি ডিসটার্বড হচ্ছে।’ গোরা এবারও তার দিকে তাকাল না।

তার মাথার মধ্যে ঝনঝন করে উঠল। এতটা ঔদ্ধত্য গোরা দেখাবে সে আশা করেনি। তার ইচ্ছে করল সেটটা বন্ধ করে দিয়ে ওর গালে একটা চড় বসাতে। সে আড়চোখে বিবির দিকে তাকাল। বিবি মুখ তুলে তাকে দেখছে, চোখ বিব্রত।’

‘ওরা বলেনি তো কী হয়েছে, আমি বলছি। গম্ভীর এবং ঝাঁঝালো গলায় সে বলল। গোরা ভ্রূকুটি করে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে শান্ত গলায় বলল, ‘যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাবেন। আমায় আর ডিসটার্ব করবেন না।’

সরাসরি এই প্রথম গোরা তাকে প্রত্যাখান করল। মাথা নীচু করে সে চোখদুটো বন্ধ করল।

‘তুমি ঘরে যাও।’ বিবি খাতার উপর আবার ঝুঁকে পড়ল।

সে বিবির পাশে এসে ওর কলমধরা হাতটা মুঠোয় চেপে ধরে মুখ নামিয়ে চাপা স্বরে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে…বাড়িতে এসব কী হচ্ছে? …তুমি নিজের কানে শুনলে, দেখলে, তবু একটা কথাও ওকে বললে না! বাপকে অপমান করছে ছেলে, এ বাড়িতে এই প্রথম।’

বিবি হাত ছাড়াবার চেষ্টা করল না। চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এ বাড়িতে আর কারুর কি আগে যাবজ্জীবন হয়েছিল?’

হাত ধরা মুঠোটা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এল। নিজের হাত থেকে বিবি মুঠোটা নামিয়ে দিল সন্তর্পণে। ‘ঘরে যাও।’

পায়ে পায়ে সে ছোটো ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। আলো জ্বালল না। ‘ঘরে যাও’! সেটা কি এই ঘর! অন্ধকারে দাঁড়িয়ে নিজেকে ধসে পড়তে না দেওয়ার জন্য সে দেয়ালে একটা ঘুঁষি বসাল, তারপর চেয়ারে বসল, দুই হাতের মধ্যে মাথাটা ধরে ঝুঁকে পড়ল।

‘তুমি কি ওর বাড়িতে এখন গেছলে?’ দরজার কাছে থেকে মৃদু গলায় বিবি বলল। সে উত্তর দিল না। বিবি ঘরে ঢুকল।

‘আমাকে একটু একা থাকতে দাও।’

‘আগে কথাটার জবাব দাও।’

‘কী জবাব দেব! তুমি তো জেনে শুনেই প্রশ্নটা করেছ। …হ্যাঁ গেছলাম তাতে হয়েছেটা কী?’ সে রুক্ষভাবে চেয়ারে ঘুরে বসল।

‘কী বলল তোমার বউদি আমার সম্পর্কে?’ অন্ধকারের মাঝে বিবি দাঁড়িয়ে। স্বরে উত্তাপ নেই।

‘অনেক কথা বলল, অনেক অনেক…. হয়েছে!’

‘হয়নি। আমি জানতে চাই কী বলল?’ বিবির স্বরে এবার ক্ষীণভাবে অধৈর্যতা প্রকাশ পেল।

‘তুমি দুলালকে তাড়িয়েছ, কেন!’

‘শুধু এই কথা বলল? …বলেনি আমি তোমার টাকা, বিষয়—সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছি?’

‘হাতিয়ে নিয়েছ বলেনি, সব লিখে দেওয়াটা ভুল হয়েছে বলেছে।’

‘এই বাড়িটা এখনও তোমার নামেই আছে। …কারখানা অবশ্য লিজ দিয়েছি, গোকুলানন্দর কিছু জমি বিক্রিও করেছি, কিন্তু বাকি জমি তোমারই আছে। সেখান থেকে চাষ করিয়ে যা পাই তাই দিয়ে সারা বছরের সংসার খরচ চালাতে হয়, ও টাকা সংসারের।’

‘ব্যাংকের টাকা? সার্টিফিকেটগুলো?’

‘কিছু আছে, তবে ওতে কাউকে হাত দিতে দেব না। জনা আর রণোর ভবিষ্যতের কথা আমাকেই ভাবতে হত।’

‘তাহলে একটা টাকার জন্যেও তো এখন তোমার কাছে হাত পাততে হবে।’

সে উত্তর পেল না।

‘বাড়ি আমার! কথাটার কোন মানে হয়? খিদে পেলে বাড়ির ইট চিবিয়ে খাব? বাড়ির জানালা দরজা কি আমার পরনের কাপড় দিতে পারবে?’

‘বিক্রি করে দাও।’

‘তার মানে!’ সে অবাক হয়ে তীক্ষ্ন চোখে বিবির মুখ দেখার চেষ্টা করল। ‘বিক্রি? বাপ—ঠাকুরদার বাড়ি বিক্রি করব? তুমি বাইরের থেকে এ বাড়িতে এসেছ তাই এমন কথা উচ্চচারণ করতে পারলে।’

‘তাহলে রোজগার করো।’

সে চুপ করে রইল। অতি সাধারণ গ্র্যাজুয়েট, বয়সও হয়ে গেছে, তার উপর জেলখাটা, কোথায় সে চাকরি পাবে? বিবি এতসব জেনেও রোজগারের কথাটা ইচ্ছে করেই বলল তাকে, তার দুর্দশাটা বুঝিয়ে দিতে। বড়ো মর্মান্তিকভাবে সে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে।

দালানে ফোন বেজে উঠল। কেউ রিসিভার তুলল। ‘মা তোমার ফোন…অপূর্ব মামা।’ দরজার কাছে এসে গুলু জানিয়ে দিল।

সে কান পাতল, দালান থেকে বিবির গলা শোনা যাচ্ছে। ‘…তিনটে টিকিট? রণো বোধহয় যাবে না, ও ক্ল্যাসিকাল গান একদমই পছন্দ করে না…গায়ত্রী সময় করে উঠতে পারবে তো, চেম্বারে তো ভিড় লেগেই আছে…না না, যতই সারুক…এয়ার কন্ডিশনড হল—এ তোমায় এখন বসতে হবে না, ভীমসেন আরও বহুবার কলকাতায় আসবেন, তখন শুনে নিয়ো…আমি না থাকলেও অরুণা কি জনা তো থাকবে, ওরাই রেখে দেবে। তুমি বরং দুটোই পাঠিয়ো, মিছিমিছি কেন একটা টিকিট নষ্ট হবে। …বাড়ি ফেরার ট্যাক্সি পাওয়াটাই তখন মুশকিলে ফেলে, তুমি থাকলে লিফট পাওয়া যেত…তোমার বউয়ের গাড়িতে চাপা মানেই ‘পেট্রলের দাম কী ভীষণ বেড়েছে’ সেই গপ্পো সারা পথ শুনতে হবে, রক্ষে করো…বুধ কী শুক্রবার ব্রিটিশ কাউন্সিলে যাব, তার আগে তোমাকে জানিয়ে দেব। …হ্যাঁ, হ্যাঁ, আচ্ছা…।’ বিবির স্বর হঠাৎ অস্পষ্ট হয়ে হেসে উঠল। সে আর ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না।

বিবির কথা বলা শেষ হয়ে গেছে কি? সে চেয়ার থেকে উঠে দরজার কাছে এল। বিবির বাঁ কানে রিসিভার, মুখটা সামান্য নামিয়ে চোখে হাসি। ডান হাতে ধরা কলমটা অন্যমনস্কের মতো টেবলে আলতো করে ঠুকছে। একটু আগেই স্বামীর সঙ্গে যেরকম কঠিনভাবে কথা বলেছিল, তার ছিটেফোঁটাও ওর বসার শিথিল ভঙ্গিতে নেই। বিবি যেন এখন অন্য জগতে। কথা বলতে বলতে বিবি একবার ছোটো ঘরের দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে চাপা গলায় দ্রুত কয়েকটা কথা বলে নিয়ে রিসিভারটা রেখে দিল।

‘কিছু বলবে?’

‘কার সঙ্গে কথা বলছিলে?’ সে এগিয়ে গেল বিবির যতটা সম্ভব কাছাকাছি। দুটো ঘরে দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে। গুলু যতই পড়ুক, গোরা যত জোরেই টিভি চালাক, দালানে বাবা—মায়ের মধ্যে কথাবার্তায় ওরা উৎসুক কান পাতবেই।

‘তা জানার কি খুব দরকার আছে তোমার?’

‘হ্যাঁ আছে।….এই অপূর্ব লোকটা কে?’

বিবির মুখের উপর রাগ ভেসে উঠেই বিরক্তির চাপে ডুবে গেল। ‘আমার বন্ধু…ছোটোবেলার বন্ধু।’

খাতাগুলো গুছিয়ে নিতে লাগল বিবি। তার ভঙ্গিতে ফুটে উঠেছে, ‘যথেষ্ট উত্তর দিয়েছি’—র মতো ভাব।

‘কখনো তো শুনিনি এর কথা!’

‘কার, অপূর্বর? …না শুনে থাকলে এখন শুনে নাও।’

‘তুমি কিন্তু এখনও বিবাহিতা।’

‘কী বলতে চাও?’ বিবির চোখ কঠিন হয়ে উঠল, চোয়ালের পেশী চেপে বসল। ‘যা বলার স্পষ্ট করে বলো, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা আমি সহ্য করতে পারি না।’

‘তুমি আমাকেও সহ্য করতে পারছ না…বোধহয় প্রথম থেকেই পারনি…কারণটা কী অপূর্ব?’ সে অতি ধীরে ধীরে প্রায় অস্পষ্ট স্বরে কথাগুলো বলল। খুব মন দিয়ে শুনলে তাতে বেদনার আভাস পাওয়া যাবে।

‘তোমার এইসব কথার আমি কোনো জবাব দেব না…দিতে বাধ্যও নই। একটা কথা মনে রেখ, জীবনের সেরা সময়ে ষোলোটা বছর লজ্জা, ঘেন্না আর যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়ে কাটাতে বাধ্য হয়েছি, আমাকে বাধ্য করেছ তুমি। তোমার কোনো নৈতিক অধিকার নেই…।’ বিবি চুপ করে গেল। তার মনে হল, কথাগুলো দীর্ঘ সময় ধরে তিল তিল করে বিবির মনের মধ্যে জমেছে, নয়তো এত দ্রুত মুখ থেকে বেরোতে পারত না।

সে বিবির কথাগুলোকে ন্যায্য মনে করল। সাতাশ বছর বয়স থেকে ও একা। সে জবাব দিতে পারল না। সে জানে তার অপরাধটা নিছকই ব্যক্তিগত। সে যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুসেনা খতম করার মতো বা অত্যাচারী শাসককে হত্যা করার মতো বা স্ত্রী—পুত্র—কন্যাকে বাঁচাতে ডাকাত মারার মতো কাজ করেনি। তার কাজের সঙ্গে কারুরই স্বার্থ বা হিত জড়িয়ে নেই। তার কৃতকর্মের জন্য যে প্রতিক্রিয়াগুলো ঘটবে তার ফল তাকেই ভোগ করতে হবে। সে জানে, এটা তাকে মেনে নিতেই হবে। কিন্তু যুক্তির কথা আর একটা পুরুষমানুষের অন্তর, আবেগ, অনুভূতি, ব্যক্তিত্ব নাও মিলতে পারে। প্রত্যেকেরই মনের নিজস্ব চলন আছে। এভাবে বউকে হারাতে হবে সে কখনো ভাবেনি। কিন্তু বিবি হারিয়ে গেছে। ওর মনে তার জন্য এক মিলিমিটারও জায়গা নেই। দয়া ছাড়া আর কিছু ওর দেবার নেই।

‘বিবি, ন্যায়—অন্যায়ের প্রশ্ন তুললে, আমার কিছুই বলার নেই। কিন্তু আমি এসে দেখছি এই সংসারের সবাই অস্বাভাবিক, আমি আপন করে পেতে চেয়ে কাউকেই পাচ্ছি না। আমি খারাপ লোক, তাই বলে ছেলে কেন অপমান করবে? তুমি সেটা চুপ করে দেখে গেলে। বাবাকে শ্রদ্ধা করতে বলছি না কিন্তু একটা বয়স্ক লোকের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয় সেটা সে শিখল না কেন?…আমি কি এর উত্তর তোমার কাছে দাবি করতে পারি? আমাকে ঘেন্না করতে শিখিয়ে তুমি ওদের ক্ষতি করেছ।’

এমন একটা প্রশ্নের জন্য বিবি তৈরি নেই বলে তার মনে হল। নয়তো মুখ নামিয়ে হাতের খাতাগুলো জড়ো করে টেবলে ঠুকে ঠুকে গোছানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ত না।

‘তুমি ওদের মন বিষিয়ে দিয়েছ আমার বিরুদ্ধে।’

‘আমাকে কিছুই করতে হয়নি। ওরা বড়ো হয়েছে, ওদের বাইরে বেরোতে হয়।’ বিবির মুখ তুলে তার চোখের দিকে তাকাল। ওর দৃষ্টিতে একই সঙ্গে অসহায়তা আর মর্মবেদনা সে দেখতে পেল।

‘ওদের বিচারবোধ গড়ে উঠেছে, ওরা অনেক কিছু শুনেছে, ওরা অস্বাভাবিক হয়ে উঠলে তার জন্য কে দায়ী?’

উত্তর দাবি করার ভঙ্গি নয়, বিবি যেন বিবৃতি দিল। বিবৃতিটা তার কাছে অপ্রত্যাশিত নয়। ‘মা বলে তোমার জন্যই রণো এমন হয়ে গেছে।’ গুলুকে সে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিল, ‘তোর বাবাকে মাপ করে দে…তোদের ক্ষতি করেছি।’ সে গোরাকে যদি বুকে টেনে নিয়ে মাপ চায় তা হলে কী গোরা বলবে, ‘তুমি এতকাল না থাকার জন্য কষ্ট তো হতোই।’

খাতাগুলো নিয়ে বিবি ঘরে চলে গেল। অরুণা ট্রেতে রাতের খাবার নিয়ে এসেছে একতলা থেকে। টেবলে ঢাকা দেওয়া বড়ো বড়ো বাটিগুলো রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার খাবার এখন আনব?’

‘আর একটু পরে।’

ঘরে যাবার সময় সে রণোর ঘরের খোলা দরজা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেল বাগানের দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রণো সিগারেট খাচ্ছে। নিজের ঘরে ফিরে সে বিছানায় শুয়ে পড়ল এবং এতক্ষণে অনুভব করল দেয়ালে ঘুঁষি মারাটা উচিত হয়নি..আঙুলের গাঁটে যন্ত্রণা হচ্ছে।

ছয়

স্কুল থেকে ফেরার সময় প্রায় প্রতিদিনই সে অন্নদা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে হয় আট আনার দই নয়তো একটা রাতাবি সন্দেশ কিনত। অন্নদার এই দুটি তল্লাটের নামকরা জিনিস। যারা মিষ্টির সমঝদার, দূর থেকে এসেও মাঝে মাঝে তারা বাক্সভরা রাতাবি কিনে নিয়ে যায়।

দোকানটার গড়ন একই রয়ে গেছে। ঘোষদা যেখানে বাবু হয়ে বসত, এখন সেখানে সেইভাবেই বসে আছে এক ছোকরা। সামনে দইয়ের দুটো আধখালি সরা। তার বাঁ দিকে কাচের আলমারিতে কয়েকটা সন্দেশের থালা। সাদামাটা একই দই—সন্দেশের দোকান। আলমারির পিছনেই মেঝেয় বসে দুটো বিশাল বারকোশে দুজন লোক সন্দেশের দুটো তাল মাখছে, লেচি কাটছে, হাতে পাকাচ্ছে, ছাঁচে চেপে আতা কী শাঁখ কী তালশাঁস বানিয়ে থালায় সাজিয়ে রাখছে। থালাটা চলে যাচ্ছে আলমারিতে, সেখান থেকে ফিরে আসছে খালি থালা। লোক দুটোর পিছনে ছোটো একটা তক্তপোশে বসে থাকত ঘোষদার বাবা। দিনে কতবার যে থালা চালাচালি হয় তার হিসেব একমাত্র জানে তক্তপোশে বসা লোকটি, যার কনুইয়ের নীচে একটা ময়লা কাঠের ক্যাশবাক্স। তার পিছনে একটা ছোট্ট ঘরে ভিয়েন। তক্তপোশে বসেই তৈরি হওয়া থেকে বিক্রি পর্যন্ত সবটাই লক্ষ রাখা যায়।

অন্নদার সামনে সে মিনিট তিনেক দাঁড়িয়ে শুধু দোকানটাকে দেখল। আলমারিতে নরম আর কড়া দু—রকম পাকের সন্দেশই থালায় রয়েছে। সে সেখল কড়াপাকের রাতাবি রয়েছে মাত্র কয়েকটা। তার দরকার দু—বাক্সে অন্তত চল্লিশটা। একটা বাক্স সনতের, অন্যটার মিতার জন্য।

‘রাতাবি কত করে?’

‘এক টাকা আর দেড় টাকা।’ দই কেটে ভাঁড়ে তুলে দিতে দিতে ছোকরা বলল। চোখ তুলে তাকাবারও ফুরসত তার নেই।

‘কখনকার তৈরি?’

‘বিকেলের।’

‘থালায় তো কয়েকটা মাত্র।’

‘আপনার কত চাই?’

‘দেড় টাকার চল্লিশটা, দুটো বাক্সে।’

ছোকরা দুটো কার্ডবোর্ডে ভাঁজ করে বাক্স বানিয়ে আলমারির পিছনে ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘দেড় টাকার চল্লিশটা, দু—বাক্সে।’

সে একটু পাশে সরে অন্য খদ্দেরদের জন্য জায়গা করে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তক্তপোশে আধ ময়লা ধুতি আর গেঞ্জি পরা একজন বসে। মুখে বসন্তের দাগ, চোখে পুরু লেন্সের চশমা। ক্যাশবাক্সের উপর একটা কাঁসার থালা, একটা ছুরি দিয়ে পেস্তা কুচোচ্ছে। সে ঘোষদাকে চিনতে পারল।

‘ঘোষদা ভালো আছেন?’

লোকটি মুখ তুলে ভুরু আর নাক কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, ‘অনেকদিন পর দেখছি, তুমি ভালো আছ? দাড়ি কবে রাখলে?’

‘ভালো আছি। দাড়িটা এই তিন—চারমাস।’

ঘোষদা আবার মাথা নামিয়ে কাজে মন দিল। একটা হালকা ভাব তাকে এখন জড়িয়ে ধরল। ঘোষদা তাকে চিনতে পেরেছে দাড়ি থাকা সত্ত্বেও। এই লোকটার কাছে এখনও সে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরা ছেলেটা হয়েই রয়েছে। দই নেবার পর প্রতিবারই বায়না করত, ‘আর একটু ঘোষদা।’ তরুণ বয়সি দোকানি চামচটা দিয়ে অতি সামান্য একটা চাকলা তুলে ভাঁড়ে ঝাঁকিয়ে ফেলে দিয়ে বলত, ‘পালা এ বার।’

বাক্স দুটো ঝুলিতে ভরে সে গৌরচরণ ঘোষ লেন ধরে ফিরে এল সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। হনুমান পার্কের ফটকে ঘুগনি আর ফুচকার সামনে ভিড়। এতটা পথ সে এল, কেউ তার দিকে ভালো করে তাকালও না। প্রেসের সিসে চুরি করেছিল বলে তাদের পাড়ার একটা লোক তিনমাস জেল খেটেছিল। একদিন একটা লোক রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, তাকে দেখিয়ে সনৎ বলেছিল, ‘ওই দ্যাখ নাড়ু চাটুজ্জে যাচ্ছে, সিসে চুরি করেছিল।’ ‘কবে?’ ‘অনেকদিন আগে, একবছর হবে!’ ‘তুই, জানলি কী করে?’ ‘কেন! সবাই তো জানে!’ সে যাবজ্জীবন খেটে বেরিয়ে এসেছে, কেউ তাকে চেনেই না! পাড়ায় এখন এত ভিড়, এত অচেনা লোক!

ধরেদের রকের স্টেশনারি দোকানের ছেলেটি এক বুড়িকে দু—তিনটে চিরুনি দেখাচ্ছে, একটি বউ বুড়ির পাশে, হাতে প্লাস্টিকের দুটো টিফিন বাক্সের কোনটে নেবে ঠিক করতে পারছে না। সামনের বাড়ির সালোয়ার—কামিজ পরা মেয়েটি স্টিলের গ্লাসে জল নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে দোকানের ছেলেটির সামনে এল। ছেলেটি ব্যস্ত দুজন খদ্দের পেয়ে, মেয়েটি গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে রইল। হেমন্ত বোধহয় এই দোকান থেকেই তার জন্য চিরুনি আর টুথ ব্রাশ কিনেছে।

সে ছাব্বিশ নম্বরের ফটকের সামনে এসে দু—ধারে তাকাল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। বিকেলে মেঘ দেখেছিল। তখন ঠান্ডা বাতাসও কয়েক মিনিট বয়ে ছিল। রাতে জোরে যদি নামে তা হলে সে ছাদে গিয়ে ভিজবে। দূর থেকে থলি হাতে হেমন্তকে সে আসতে দেখল।

‘তুমি রঘু না?’

সে চমকে ঘুরে দাঁড়াল। সেই বুড়ি, যে চিরুনি কিনছিল। কিন্তু একে তো সে চিনতে পারছে না!

‘তুমি তো জেলে গেছলে, কদ্দিন ছিলে?’

‘ষোলো বছর।’

‘ষো—লো—ব—ছ—র!…আমার নাতিটাকে পুলিশ তুলে নিয়ে সাতদিন রেখেছিল, এমন মার মেরেছিল যে চারমাস শয্যাশায়ী ছিল, ডান পা—টা খোঁড়াই হয়ে গেল, আজও ভালো করে হাঁটতে পারে না।’

‘কী করেছিল আপনার নাতি?’

‘নকশাল করত। তবু ভালো গুলিটুলি করে মেরে দেয়নি।…মাধ্যমিকটাও যদি পাশ করত। বাপের তো কোনো নজর ছিল না সংসারের দিকে, তখন তো বাড়িতেও থাকত না ওই নকশালদের ভয়ে।’

‘আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না।’

‘এই শবু বর্ধন লেনের ভেতর দিকে থাকি, তোমাকে তো ছোটোবেলা থেকে আমি দেখেছি। আমার ছেলে দিলীপকে তো তুমি চেনো!’

‘ও হো, আপনি দিলীপদার মা।..দিলীপদা কী করছে এখন?’

‘সে তো ছ—বছর হল মারা গেছে, ক্যানসারে।’

সে অপ্রতিভ হয়ে পড়ল। ইতিমধ্যে কেউ যে মারা যেতে পারে, সেটা তার মনে কখনো আসেনি। এ বার থেকে খেয়ালে রাখতে হবে। হেমন্ত দাঁড়িয়ে তাদের দুজনকে দেখে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। বৃষ্টির ফোঁটা আর পড়ছে না।

দিলীপের সঙ্গে তার কখনো আলাপ হয়নি। দিলীপদা কম্যুনিস্ট পার্টি করত। এক সন্ধ্যায় দেখেছিল, ছোটো একটা মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। সে তখন মোটর বাইকে ফিরছিল, মিছিল দেখে দাঁড়িয়ে যায়। অযথাই দিলীপদা তার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে স্লোগান দেয় : ‘ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ব্যর্থ করো…ব্যর্থ করো…ব্যর্থ করো।’ হঠাৎ যে কেন তার সামনেই ওর স্লোগান দেবার ইচ্ছে হল, সেটা কোনোদিনই সে বুঝে উঠতে পারেনি।

‘বাবুল তো ওরই ছেলে, যে খোঁড়া হয়ে গেছে।’

‘বাবুল করছে কী?’

‘কী আর করবে, ইস্কুলের পাশ তো হল না, একটা রোলের দোকান দিয়েছিল, চলল না। একজনকে ধরে জুতোর দোকানে একটা কাজ জুটিয়ে দিলুম। বলব কী বাবা, সেখানে এমন ধর্মঘট লাগল যে, দোকান সেই যে বন্ধ হল, আজও খুলল না। ওর মা বাগনানে একটা ইস্কুলে পড়ায়, তাতেই সংসার চলে। হ্যাঁ বাবা, তোমার তো অনেক চেনাজানা আছে। দ্যাখো না আমার নাতিটার জন্য…কত লোককে তো বললুম!’

সে প্রায় হতভম্ব হয়ে গেল বুড়ির কথা শুনে, ছুঁচ ফোটার মতো কষ্ট বোধ করল। এইমাত্রই শুনল ষোলো বছর সে জেলে ছিল, আর তার কাছেই নাতির জন্য কাজ যোগাড় করে দিতে বলছে! সে কোনোক্রমে বলল, ‘আমি কী করে কাজ দেব!’

‘কেন তোমার বাড়িতে যে ইস্টিলের আলমারি টেবিল তৈরি হয়, ওখানে বলে ঢুকিয়ে দাও না।’

‘ওটা আমার ব্যবসা নয়, আমি ওর মালিক নই।’

‘তোমার বাড়ির মধ্যেই তো, তুমি বললে ফেলতে পারবে না।’

বুড়ি তার হাত চেপে ধরল। অদ্ভুত একটা সিরসিরানি তার হাত বেয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। বুড়ি তার সম্পর্কে কতটুকু শুনেছে কে জানে, কিন্তু একটা মানুষ অন্তত ধরে নিয়েছে সে কিছু উপকার করতে পারে। বুকের মধ্যে কী যেন একটা কেঁপে উঠছে, দয়া, মমতা কিছু একটা হবে। কিংবা নিজের উপর আস্থা।

‘আচ্ছা আমি দেখব, কোথাও যদি কিছু করা যায়।’

‘দেখবে বাবা?…বড়ো কষ্টে আছে ছেলেটা, বয়স হয়ে গেছে, রোজগার নেই…।’ বুড়ির মুখের চামড়া গুটিয়ে ভাঁজ পড়েছে, চোখের রঙ ঘোলাটে, কষের দাঁত পড়ে গিয়ে গাল দুটো বসা। ‘তাহলে কবে তোমার কাছে বাবলুকে পাঠাব?’

‘না না পাঠাতে হবে না, আমিই দরকার হলে খবর দেব। আপনার বাড়ি তো আমি চিনি।’

‘চেনো? এই শিবু বর্ধন লেনে যাকে জিজ্ঞেস করবে বাবুলদের বাড়ি কোথায়, দেখিয়ে দেবে।’

‘আচ্ছা মাসিমা, আমার কাজ রয়েছে, আমি এবার যাব।’ সে হাতটা ছাড়িয়ে নিল বুড়ির মুঠো থেকে।

‘বাবা দেখবে তো? ছেলেটা দিন দিন কীরকম মনমরা হয়ে যাচ্ছে…।’

আর শোনার জন্য সে দাঁড়াল না। হন হন করে সে ফটক দিয়ে ঢুকে পড়ল। বাগান পর্যন্ত গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখল বুড়ি চলে যাচ্ছে। তাকেও ওই গলিতেই সনতের বাড়ি যেতে হবে, বুড়িকে এগিয়ে যাবার সময় দিতে সে দাঁড়িয়ে রইল। …দিলীপদা বাড়িতে থাকত না, ছেলেটাকে চোখের সামনে রাখেনি…বউ বাগনানে…। সেজন্যই কি বাবুলের লেখাপড়া হল না? …বিবির চোখের সামনেই তো গোরা থাকত, তা হলে এমন হল কেন? কিশোর বাবুল রাজনীতির কিছু বুঝত কী?

শিবু বর্ধন লেনে বস্তিতে কিছু নকশাল ছেলে ঘাঁটি করেছে এটা সে শুনেছিল। পিস্তল হাতে সাদা পোশাকের পুলিশকে দুপুরে গলিতে ঢুকতেও দেখেছে। ঘরের বারান্দা থেকে দেখেছে বাড়ি বাড়ি জানালায়, ছাদে উঁকি দিচ্ছে বাড়ির মেয়েরা। তখন দু—তিনটে বোমা ফাটার শব্দও পেয়েছে। এইরকম পুলিশি হানায় হয়তো বাবুলকে তুলে নিয়ে গেছে। …দিলীপদা ছেলের দিকে নজর দিলে বাবুল আজ কী হতে পারত? আর যাই হোক, গোরা হত না।

বুড়ি আরও একটু এগিয়ে যাক। সে ফটকের কাছে এসে দাঁড়াল। বুড়ি কিন্তু একবারও জানতে চাইল না কেন কীজন্য সে জেল খেটে এল। নিশ্চয়ই জানে, তবুও কৌতূহল নেই। সাঁইত্রিশ কি আটত্রিশ বছরের নাতি মনমরা, প্রায় পঙ্গু…ঠাকুমার প্রাণ! এইরকম একটা প্রাণ কি বিবি পেতে পারত না?

সে ফটক ছেড়ে এগিয়ে শিবু বর্ধন লেনে উঁকি দিল। বুড়িকে দেখা গেল না। সনৎদের একতলায় বৃষ্টির অনুমানেই জানলাগুলো বন্ধ। সে দ্রুত গিয়ে জানালার পাশ দিয়ে একগজ চওড়া সিমেন্ট বাঁধানো গলিটায় ঢুকল। প্রথম দরজাটা সনৎদের, পরেরটা বঙ্কু পাইনদের।

দরজাটা খোলা রয়েছে। ঢুকেই সামনে রান্নাঘরটা। এরই দরজা থেকে মিতার মা ডেকেছিল, ‘রঘু শোনো।’ কী গম্ভীর গলায়। এখন রান্নাঘরের দরজায় শিকল তোলা। ডানদিকের ঘরের দরজাটা বন্ধ। বাঁদিকে সিঁড়ি সে দোতলার বারান্দায় উঠে এল।

‘সন্তু আছিস নাকি?’ কত বছর পর সে এইভাবে ডাকল? সন্তু তখন ঘর থেকে বলত, ‘আছি রে, আয়।’

আদুড়—গা বছর দশেকের একটা রোগা ছেলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। পাজামা—পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝুলি, দাড়ি, কটা চোখ আর ছ—ফুটের উপর লম্বা ভারী চেহারা, সব মিলিয়ে ছেলেটা হতভম্ব।

‘সনৎ আছে?’

কথা না বলে ছেলেটা ঘরে ঢুকে গেল। বারান্দাটা আগের মতো ছিমছাম নেই। একধারে নোংরা লাগা পুরোনো চটি আর জুতো, তার পাশে রেলিংয়ে গোঁজা রয়েছে ঘর মোছার ন্যাতা, তারে ঝোলানো প্যান্ট, জাঙ্গিয়া, গেঞ্জিগুলো ময়লা, ছেঁড়া। গামছাটারও সেই দশা। বারান্দার শেষ প্রান্তে বোধহয় রান্নাঘর। ওখানে একটা গ্যাসের সিলিন্ডার রাখা।

‘কে?’ খালি গায়, লুঙ্গির কষি আঁটতে আঁটতে বেরিয়ে এল সনৎ। তার পিছনে ছেলেটা আর ফ্রক পরা এক কিশোরী। ‘কাকে চাই?’ বলেই সে চিনতে পেরে কপালে ভাঁজ ফেলল। ‘রঘু!’

সে যা ভেবেছিল, সেটা ঘটল না, আঁতকে ওঠেনি তাকে দেখে।

‘অবাক হয়ে যাচ্ছিস তো?’

‘তা একটু হচ্ছি…ব্যাপার কী?’

‘এসে ডিস্টার্ব করলাম না তো?’

‘যোগব্যায়াম কচ্ছিলুম…শিরদাঁড়াটায় একটা রেগুলার যন্ত্রণা হয়… তোর ফেরার খবর পেয়েছিলুম ঠিকই…বসবি?’

‘একটু বসি।’

সনৎও তার ফেরার কথা জানে। পাড়ায় তা হলে তো সবাই জেনে গেছে। বলল, ‘একটু অবাক হচ্ছি’, আসলে যথেষ্টই হয়েছে। তারা দুজনে আলাদা কলেজে পড়েছে, আর তখন থেকেই তো তাদের বন্ধুত্বের ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছল। আবার এত বছর পর একেবারে দোতলায় আচমকা তাকে দেখতে পেয়ে বোধহয় অস্বস্তিতে পড়ল।

সনৎ তাকে নিয়ে বসাল, শোবার ঘরে নয়, ছোটো একটা ঘরে। আলনায় রাখা পোশাক, ছোট্ট টেবলটায় রাখা বইপত্র থেকে বোঝা যায়, এ ঘরে ছেলে আর মেয়ে থাকে। দরজার ঠিক পিঠ করে রাখা ঘরের একমাত্র স্টিলের ফোল্ডিং চেয়ারটা দেখিয়ে সনৎ ‘বোস’ বলে নিজে বসল খাটে।

বসার পর ঝুলি থেকে সে রাতাবির একটা প্যাকেট বার করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির দিকে বাড়াতেই সে নিয়ে নিল।

‘আরে আরে, এসব কী…না না, দিতে হবে না…বাবু ওটা নিয়ো না।’ সনৎ যেভাবে আঁতকে উঠল তাতে সে একটা ধাক্কা খেল। ছেলের হাত থেকে বাক্সটা ছিনিয়ে নিয়ে সনৎ এগিয়ে ধরল তার দিকে। তার আসাটা পছন্দ করেনি বোধহয়।

‘আরে অন্নদার রাতাবি, আজ বিকেলের তৈরি!’

‘হোক, তুই এটা রেখে দে।’

টিফিন খাওয়ার সময় দূর থেকে সনতের চাহনিটাকে সে এখন ওর চোখে খুঁজল। আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখল সেই চাহনিটা রয়েছে ওর ছেলের চোখে। এখন সনতের চোখে গৃহস্থের সামাজিক বিপন্নতা। একটা খারাপ অপরাধী তার ঘরে এসে বসেছে। সে রেগে উঠবে নাকি মজা পাবে, ঠিক করে উঠতে না পেরে বাক্সটা হাত থেকে নিয়ে টেবলে রাখল।

বোধহয় সনৎ বুঝতে পেরেছে, দৃষ্টিকটু রকমের ভদ্রতার অভাব সে ঘটিয়েছে তাই ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘চা খাবি?’

‘খাব।’ ইচ্ছে নেই তবু বলল। সনৎ নিশ্চয় আশা করেছিল সে ‘না’ বলবে, তা হলে তাড়াতাড়ি তাকে বিদেয় করার সুযোগ পেত। কিন্তু তার ক্ষীণ একটা ইচ্ছে জেগেছে একটা পরিবারের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাতে।

‘বাবু, মাকে বল তো চা করতে।’

‘এক কাপ?’

‘না, দু—কাপ।’ ছেলে বেরিয়ে যেতেই সনৎ বলল, ‘তুই তো বেশ মোটা হয়েছিস, হলি কী করে? জেলে পাথর টাথর ভাঙতে হত না?’

‘না।’

‘আচ্ছা, তুই তো চোদ্দো বছরের বেশিই রইলি, কিন্তু আমি তো জানি যাবজ্জীবন মানে চোদ্দো বছর।’

‘যাবজ্জীবন মানে যাবজ্জীবনই। একটা লোক কতদিন বাঁচবে, সেটা তো আগাম বলা যায় না। তাই যাবজ্জীবন কথাটা ব্যবহার করা হয়। তবে কমপক্ষে চোদ্দো বছর কেটে যাবার পর অথরিটি রিভিউ করে দেখে লাইফারের আচার—আচরণ কেমন ছিল, ডিসিপ্লিন নিয়মকানুন ভেঙেছে কি না। সব কিছু ওদের মনোমতো হলে চোদ্দো বছর পরই ছেড়ে দেয়। তা ছাড়াও নানারকম ব্যাপারেও রেমিশন পাওয়া যায়।’

‘তাহলে তোর ষোলো বছর হল কেন?’

‘ওদের মনোমতো আমি হতে পারিনি।’ সে হাসল সনতের চোখে কৌতূহল জ্বলে উঠতে দেখে। সে বুঝল আরও বহু প্রশ্ন তাকে করবে।

‘কেন মনোমতো হতে পারিসনি?’

‘নানান রকম করাপশন, টাকা চুরি, ঘুষ, খাওয়াদাওয়া যা দেবার কথা দিত না, দাবি করলে নানা ছুতোয় মারধোর চালাত…এইসব নিয়ে প্রতিবাদ করেছিলাম, ক—জনকে সঙ্গে নিয়ে হাঙ্গার স্ট্রাইকও, তার ফলও পেলাম।’

এসব কথা বলতে তার ভালো লাগছে না। সে ভুলে যেতে চায় তার কারাবাসের জীবনটাকে, জীবনের কালো অধ্যায়টাকে। তবুও মাঝে মাঝে এক—একটা দেখে যাওয়া ঘটনা ফুলকির মতো ছিটকে ওঠে, জ্বালা ধরায়।

‘হ্যাঁরে রঘু,’ সনৎ দরজার দিকে চট করে তাকিয়ে নিয়ে ঝুঁকে চাপা গলায় বলল, ‘পারুল তো তোদের বাড়িতে বাসন মাজত!…ওর মা—র কাছে তো শ্রীগোপালের বাবা রেগুলার যেত!’

সে উত্তর না দিয়ে সনতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কী বলতে চায় ও! চোখ দুটো ছোটো করে, ঠোঁট টিপে সনৎ একটা রহস্যকে গোপন রাখতে চাওয়ার চেষ্টা দেখাচ্ছে। সে জানে সনৎ কী ইঙ্গিত করতে চায়।

‘শুনেছিলাম নন্দ কাকা যেত।’

সনৎ আবার চট করে দরজার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘পারুল হচ্ছে ওরই মেয়ে, সেটা জানিস?’

‘রোঘো আমি যা পাপ করেছি তার কোনো প্রায়শ্চিত্ত নেই…নিজের গলা নিজেই টিপে মরে যেতে ইচ্ছে করে।’

‘না, জানি না, তোকে কে বলল?’ ঠান্ডা গলায় সে জানতে চাইল।

‘হেঃ, এ তো সবাই জানে। দুজনের মুখের গড়নটা মনে করে দ্যাখ!’

‘তুই মনে করে দেখেছিস?’

‘ধ্যাৎ ধ্যাৎ, একটা প্রসের মেয়ের মুখ…’

‘কী আজেবাজে চিন্তা করছিস শ্রীগোপাল, তোকে নেশায় ধরেছে….আর খাসনি।’ ‘নেশা হনি আমার রণো, আমি এখন আরও খাব।’

‘ওর মুখটা কিন্তু ভালোই দেখতে ছিল।’

‘সেইজন্যই তুই…’ সনৎ বাক্যটা শেষ না করে চোখদুটোকে হাসাতে শুরু করল।

চা নিয়ে এল মেয়েটি, সুঙ্গে দুটো বিস্কিট। ‘তোমার নাম কী মা?’

‘পৌলমী।’

‘বাঃ বেশ নাম। সন্তু, মেয়ের মুখ তোর মতোই হয়েছে।’

সনৎ চুপ করে রইল। বিস্বাদ চা, দুটো চুমুক দিয়ে কাপটা টেবলে রেখে একটা বিস্কিট তুলে নিল। ‘মাসিমাকে দেখছি না যে, কেমন আছেন?’

‘মা নীচে আছে, ভালোই আছে।’ একটু থেমে সনৎ বলল, ‘নীচে মিতাও থাকে।’

‘তাই নাকি!’

‘স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে…আর বলিস না, মাকে নিয়ে হয়েছে যত ঝামেলা। পোস্টাপিসের কেরানি, কত আর মাইনে পাই, নিজের সংসার দেখব না বোনকে দেখব? তবু ভালো, একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ পেয়ে গিয়ে আমার ঘাড় থেকে নেমেছে।’ অনিচ্ছাভরে সনৎ খবরগুলো দিল।

‘তোর শিরদাঁড়ার ব্যথাটা যোগব্যায়াম করে কমেছে?’

‘অনেকটা।’ সনৎ কনুই ভেঙে ডান হাত ঘুরিয়ে পিঠে ঠেকাল।

‘তাহলে তোর ব্যায়ামে আর ব্যাঘাত ঘটাব না।’ সে উঠে দাঁড়াল। ‘তোর বউয়ের সঙ্গে পরিচয় হল না। …পরে একদিন আসব।’

সে ঘর থেকে বেরিয়েই দেখল, ছাদ থেকে সেদিন রাতে যাকে দেখেছিল, সেই স্ত্রীলোকটি দরজার পাশ থেকে ছিটকে শোবার ঘরে ঢুকে গেল। নিশ্চয়ই দরজা দিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করছিল। ধর্ষণকারীর মতো উত্তেজক জিনিস দেখার লোভ বেচারা সামলাতে পারেনি।

‘তুই মা—র সঙ্গে দেখা করবি নাকি?’

‘এলাম যখন দেখেই যাই।’

‘যা। আমার নামে এককাঁড়ি নিন্দে শুনবি।’ সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে সনৎ বলল, ‘ওরা নিজেরাই আলাদা হয়ে গেছে, আর লোকের কাছে বলে বেড়ায় আমি নাকি মা—বোনকে ভিন্ন করে দিয়েছি। তুই তো আমার মাকে হাড়ে হাড়ে জানিস।’

সনতের গলায় উৎকণ্ঠা। তার কৈফিয়তটা বিশ্বাস করল কি না সেটা জানার জন্য উদবেগ নিয়ে তাকিয়ে। ‘হাড়ে হাড়ে জানিস’ বলে পুরোনো কথা মনে পড়িয়ে দিতে চাইল? এতে কি তার মনটা তিক্ত, বিরোধী হয়ে উঠবে বলে ও আশা করে? জেলখাটা লোকের কাছে নিজেকে সুসন্তান বোঝাবার জন্য এই চেষ্টা কেন! সনতের মনের মধ্যে অপরাধ—বোধের গ্লানি যেন রয়ে গেছে, যাবজ্জীবন এটা থাকবে। বিবেকানন্দ হবার বাসনার কথাটা এখন আর নিশ্চয় ওর মনে নেই।

একতলায় নেমে এসে মিতাদের বন্ধ দরজার সামনে সে প্রায় এক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল। টেবলে সন্দেশের বাক্সটা রেখে এসেছে, সেটা ফেরত দেবার জন্য যদি সনৎ ডাকে! তারপর সে দরজায় খুট খুট টোকা দিল গাঁট দিয়ে। চারবার টোকার পর ভিতর থেকে সাড়া এল, ‘কে?’

মনে হল মাসিমার গলা। ‘দরজা খুলে একবার দেখুন না।’

দরজার দুটো পাল্লা আধ হাত ফাঁক হল। মাসিমাই দাঁড়িয়ে। চশমা নিয়েছে, শরীর একটু ঝরেছে, সে হাসল। ‘চিনতে পারছেন মাসিমা? বলুন তো কে?’

‘রঘুদা!’

সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে শুধু বলল, ‘মিতা!’

‘দাড়িটাড়ি রাখলেও চিনতে ঠিকই পেরেছি।’

‘আমি পারিনি।’ কথাটা কুণ্ঠিত স্বরে বললেও মিতার ঝকঝকে চোখ তাকে স্বস্তি দিল।

‘ভেতরে এসো…মা দ্যাখো, কে এসেছে।’

‘কে রে?’ ঘর থেকে বেরিয়ে এল এক প্রৌঢ়া; স্থূল বপু, থান কাপড় ছাড়া আর সবই একরকম রয়ে গেছে। চাহনি বলে দিল চিনতে পারেনি।

‘চিনতে পারছ না?’

‘না তো…ওমমা, এ তো রঘু!’

সে প্রণাম করল। কত বছর পর? শেষবার বাবাকে খাটে তোলার আগে? …দাদাকে বিজয়ার দিনে? মাসিমাকে শেষ কবে দেখেছে মনে পড়ছে না। আজকের মিতার মতোই দেখতে ছিল। ঝুলি থেকে সন্দেশের বাক্সটা বার করে মিতার দিকে এগিয়ে ধরল।

‘অন্নদার!…অনেক দিন ওদের গুজিয়া খাইনি…এনেছ নাকি?’ বাক্সটা হাতে নিল মিতা।

‘রাতাবি।…গুজিয়ার কথাটা মনে ছিল না।’

‘তুমি আমাকে গুজিয়া খাওয়াতে।’ মিতার ঠোঁট ছড়িয়ে পড়ল। ছড়ানো ঠোঁটের ধাক্কায় পঁচিশ—তিরিশ বছর যে কীভাবে ধসে পড়ে সে অবাক হয়ে দেখল।

‘ঘরে নিয়ে বসা, দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?’

‘রঘু শোনো…আর তুমি এ বাড়িতে এসো না…’ বছর, বয়স, ঘটনা, মানুষকে কীভাবে পালটে দেয়! ‘তোমাদের কম বয়স, ভুলে যেতে অসুবিধে হবে না।’ ভুলে কে গেছে? জীবনের প্রথম ঘটনাগুলো ভোলা যায় না। এ বাড়িতেই তার প্রথম চুমু, প্রথম অপমান।

দুটো সিঙ্গল খাট ঘরের দু—ধারে। পরিষ্কার দুটো সাদা—সবুজ মোটা ডোরাকাটা বেডকভার, তার উপর একটা খবরের কাগজ, বোধহয় মিতা পড়ছিল। দেয়াল—তাকগুলো পরদা দিয়ে ঢাকা। জানলাগুলো খুলে পরদা নামিয়ে দেওয়া, পাখা ঘুরছে। ঘরে আসবাব বলতে একটা ছোটো টেবল আর চেয়ার, ট্রানজিস্টর রেডিয়ো, কিছু বইয়ের একটাকে মনে হল অভিধান, ছোটো একটা ঘড়ি, দু—তিনটে ফাইল, টেবল ল্যাম্প। অনেকটা বিবির ঘরের মতোই, তবে কমদামি। আলনাটা দাঁড়িয়ে আছে শাড়ি ব্লাউজ, ছাতা, হাতব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে।

‘এই খাটটায় বোসো, ওটা মায়ের।’ মিতা বাক্সের রাবারব্যান্ড খুলতে খুলতে বলল, ‘মা—র একটু ছোঁয়াছুঁয়ির ব্যাপার আছে।’

সে মিতার মুখ থেকে পা পর্যন্ত চোখ নামাল। কালো পাড়ে জরির পটি, বেলের পানা রঙের জমি। শাড়িটা ওর শ্যামলা গায়ের রঙকে খুলে দিয়েছে। বাহু, ঘাড়, কবজি, গলা ডৌল বজায় রেখেছে। বিবিরই বয়সি, তবে তার মতো কোমরের নীচে চর্বি জমেনি। মিতা বদলেছে কী বদলায়নি তা সে জানে না। বস্তুত সম্পূর্ণ একটা নতুন মানুষকেই সে দেখছে। বহুকাল আগে কিছুদিনের জন্য তারা প্রেমিক—প্রেমিকা ছিল, এই পর্যন্তই। কিন্তু সেই সম্পর্কটাকে এখন টেনে আনা যায় না। সেও তো এদের কাছে নতুনই। মিতার মুখটা খোলামেলা, চোখদুটোয় অস্পষ্টতা নেই, শক্ত চোয়ালে স্বনির্ভরতা, কথা ঝরঝরে। একটু আগেই বোধহয় অফিস থেকে ফিরেছে, ক্লান্তি মুখে লেগে।

বাক্সটা খুলে চোখদুটো বড়ো করে মিতা একটা সন্দেশ তুলে মুখে দিল। ‘ভীষণ খিদে পেয়েছে…নাও ধরো।’ বাক্সটা তার মুখের কাছে ধরল।

‘আমি ছুঁলে মাসিমাকে দেবে কী করে?’

মিতা চট করে ঘরের বাইরে তাকাল। ‘মা এখন চায়ের জল বসাতে গেছে…তুলে নাও। মা—র এই ব্যাপারটা আমি সহ্য করতে পারি না, খিটিমিটি লাগে।’

সে একটা সন্দেশ তুলে নিল। বাক্সটা হাতে নিয়ে মিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সে এখানে এল কোন সুবাদে? ছেলের বন্ধু? মেয়ের বন্ধু? প্রতিবেশী? এরা নিশ্চয় জানে গত ষোলো বছর সে কোথায় ছিল, কিন্তু কৌতূহলের কোনো ছিটেফোঁটা আভাসও দেয়নি। দুজনেই যেন খুশি হয়েছে সে আসায়। এরা নিঃসঙ্গ বোধহয়।

‘ওমলেট খাবে?’ জলের গ্লাস এগিয়ে মিতা বলল।

‘না। ডিমে অ্যালার্জি।’ মিথ্যে বলল, ডিম তার প্রিয় খাদ্য।

‘তা হলে?’ বিপন্ন দেখাল মিতাকে। ‘কী দিই বলো তো?’

‘গরম রুটি আর বেগুন ভাজা হবে, সঙ্গে কাঁচালংকা?’

‘হবে। বেগুন আছে, কাঁচালংকা আছে কি না দেখি।’ মিতা দ্রুত বেরিয়ে গেল।

ফরমাস করে রান্না করিয়ে খাওয়া, শেষ কবে? মাকে সে প্রায়ই বলত ‘নারকোল ছোলা দিয়ে মোচার সেই ঘণ্টাটা!’ ‘কাল বাজার থেকে মোচা আনতে বলব।’ ইলিশের মাথা দিয়ে তেঁতুলের টক করলে না কেন?’ ‘এবার ইলিশ এলে করে দেব।’ আর কাউকে কী তারপর খাওয়ার ইচ্ছের কথা সে বলেছে?

মিতা ফিরে এল। ‘কাঁচালংকা আছে।’

‘থাকুক, তুমি বসো তো! মনে হচ্ছে, একটু আগেই অফিস থেকে ফিরেছ?’

‘কোথায় অফিস জানো, তারাতলা! কম দূর, দু—বার বাসে চড়তে হয়!’

দু—হাত ছড়িয়ে সে পিছনে হেলে বসল, মিতা বসেছে চেয়ারটা টেনে তার থেকে চার হাত দূরে। কীসের অফিস, সেখানে কী কাজ করতে হয়, এমন সব প্রশ্ন করার ইচ্ছে হলেও সে করল না। যদি পালটা জিজ্ঞাসা শুরু করে! মিতা দেখেছে শ্রীগোপালকে, এলাহাবাদ যাবার আগে ফ্রক পরা পারুলকেও। ষোলো বছর আগে মিতা শ্বশুরবাড়িতে, হয়তো খবরের কাগজে পড়ে থাকবে।

‘অফিস আর বাড়ি, আর কিছু নয়?’ কথা শুরু করার জন্য নতুন করে দুই সদ্য পরিচিত আর কী বলতে পারে?

‘আবার কী? যাতায়াতেই প্রাণ বেরিয়ে যায়। বাড়ি ফিরে ধপাস করে বিছানায় পড়া, তারপর স্নান। রেডিয়োটা খুলি, গল্পের বই হাতে পেলে পড়ি…ভারী কিছু মাথায় ঢোকাতে ইচ্ছে করে না। এক একসময় ইচ্ছে করে ছবি আঁকি। এলাহাবাদে গান শিখেছিলাম কিন্তু একা একা কি গান গাওয়া যায়?’

‘সিনেমা দেখতে পার। একটা টিভি সেট কিনে ফেল।’

‘ভাবছি। একটা সাদাকালো ছোটো সেট দু—হাজার দুই—আড়াই পড়বে। মা—র তাহলে চেঁচামেচি করাটা বন্ধ হবে।’

‘চেঁচামেচি! কার সঙ্গে?’

‘ওপরে দাদার সঙ্গে। আর বোলো না, তুচ্ছ জলকল, ছাদ নিয়ে প্রায়ই দুজনের লেগে যায়। আমি আসার পর থেকেই এই ঝঞ্ঝাটের শুরু। দাদা পছন্দ করেনি এখানে এসে থাকি। আসলে বাড়ির শেয়ার দিতে হবে, এটাতেই আপত্তি। দাদার ধারণা, তার অনুগ্রহে আমি এ বাড়িতে রয়েছি। বলেই দিয়েছে, অংশ দাবি করলে কোর্টে যাও। …যাক গে এসব কথা।’

এসব কথা শুনতে তারও ভালো লাগছে না। সে এসেছে মিতাকে দেখতে, কৌতূহল মেটাতে। দু—কাপ চা হাতে মাসিমা এল। ‘একেবারে খালি পেটে খাবে, মিতা চানাচুরের শিশিটা বার কর।’

তাকের পরদা সরিয়ে একটা পেটমোটা শিশি মিতা নিয়ে এল। খবরের কাগজটার উপর কিছুটা ঢেলে নিজে একমুঠো তুলে নিয়ে বলল, ‘এই একটা শখ আমার, কিনে এনে রেখে দিই আর মাঝে মাঝে খাই।’

‘তোমার শখের খাওয়া ছিল তো এন্তার পেঁয়াজ দিয়ে ঝালমুড়ি।’ সে মনে করিয়ে দিল ইচ্ছে করেই। মিতার স্মৃতিতে তার ছবি কতটা ঝাপসা হয়েছে সেটা সে জানতে চায়।

‘তোমার মনে আছে!’

মিতার চোখ ঝকঝক করে উঠল বাচ্চচা মেয়ের মতো। সে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে খুঁজল সেখানে আরও কিছু দেখতে পাওয়া যায় কি না। অনাবিল সারল্য, মজা পাওয়া…লাজুক একটা ছায়া ভেসে গেল না। ও যদি ভুলে গিয়ে থাকে তা হলে সে হাঁফ ছাড়বে। এখন দুজনেরই বয়স হয়েছে।

‘টেবিলে ফাইল দেখছি, অফিসের নাকি?’

মিতা টেবলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘মাঝে মাঝে গল্প লেখার চেষ্টা করি। সময় কাটাতে হবে তো।’

‘ছাপা হয়েছে? আমি তো পড়াটড়ার ব্যাপারে…’ কথাটা শেষ না করে শুধু হাসল।

‘তিন—চারটে ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে ছিলাম, একটাও ছাপা হয়নি।’

মিতাও হাসল। হাসিতে তিক্ততা নেই। ‘কাঁচা লেখা, বুঝতে পারি। তবুও পাঠিয়েছিলাম।’

‘একটা পড়াবে?’

‘ওরে বাবা! পড়বে আর হাসবে, আর মনে মনে বলবে কী অপরিণত, ছেলেমানুষি লেখা। দরকার নেই পড়িয়ে। কোথাও আর এখন পাঠাইও না।’

‘আচ্ছা আমাকে দেখে তুমি অবাক হওনি?’

‘হইনি মানে? এখনও হচ্ছি। গলগল করে কথা বলতে, আর এখন টিপে টিপে একটা দুটো করে মুখ থেকে বেরোচ্ছে।’

‘আমি ঠিক এইরকম অবাক হওয়ার কথা বলছি না। হঠাৎ এতদিন পর এলাম কেন, এটা তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না।’

‘করছে, বলো কেন এসেছ?’

‘ভীষণভাবে তোমাকে দেখার ইচ্ছে হল বলে।’ বলে ফেলেই তার মনে হল, বলাটা ঠিক হয়নি। কথাটার অনেক রকম অর্থ করা যায়। ‘আসলে আমার পুরোনো দিনের আর এখনকার দিনের মধ্যে একটা বিরাট গর্ত রয়ে গেছে, সেটা ভরাট করার চেষ্টা করছি। কে কীরকম হয়ে গেছে সেটা দেখতে চাই।’

‘দেখে বুঝতে পারবে? আমাকে তো দেখছ, বলো তো আমি কী রকম হয়েছি? বাইরের চেহারা অনেক বদলে গেছে, সেটা নিশ্চয় ভরাট করার কাজে লাগবে না।’

সে মুখ নামিয়ে মিতার পায়ের কাছে মেঝেয় চোখ রাখল। কী বলবে? এলাহাবাদে গিয়ে কতদিন পর্যন্ত আমাকে মনে রেখেছিলে? …বিবি চার বছর আমার সঙ্গে দেখা করতে যায়নি, শেষ ছ—টা চিঠির উত্তর দেয়নি, বিবি আমার বউ!…শ্রীগোপাল বেঁচে থাকলে কী বলতো ‘রোঘো তোর জন্য করাপ্ট হয়ে গেলুম।’ …আমি কেন গুলুকে জড়িয়ে ধরে ক্ষমা চাইলাম? …সন্দেশের বাক্সটা নিতে চাইল না, টিফিনের সময় আমার খাবারের ভাগ নিয়েছে…দিলীপদা যদি ছেলের কথা ভেবে…

‘কই বলো?’

‘কী বলব ভেবে পাচ্ছি না, এই তো কিছুক্ষণ মাত্র তোমায় দেখছি। তুমি কী ছিলে সেটাই জানি না, তোমার বদল হওয়াটা আমি ধরতে পারছি না, পারবও না।’

‘আমি কী ছিলাম সেটা তুমি জান না?’ প্রশ্ন করলেও সেটা অবাক হয়ে।

সে মাথা নাড়ল যেন গভীর ভাবনার মধ্যে ডুবে থেকে। যা মনে পড়ছে সেটা শুধু পেঁয়াজের গন্ধ।

দুটো ছোটো থালায় রুটি, বেগুনভাজা নিয়ে মাসিমা এল। একটা থালা দিল মিতাকে, তাতে কাঁচালংকা নেই।

‘আসার পর থেকেই দেখছি আপনি রান্নাঘরে, বসুন।’

মিতা গম্ভীর হয়ে গরম বেগুনভাজা আঙুল দিয়ে খোঁচানোয় ব্যস্ত। এতে তাড়াতাড়ি জুড়োয়। সে, গরমই খেতে চায়।

‘বসার আর ফুরসত কোথায় বাবা, একা হাতেই তো সব করতে হয়। ঘরমোছা, বাসনমাজার ঝি একটা আছে, দোকানবাজার তো আমাকেই করতে হয়, রান্নাবান্নাও। ….তোমার ছেলেমেয়েরা তো সব বড়ো হয়ে গেছে, করছে কী? পড়ছে?’

‘হ্যাঁ।’ রুটির ছেঁড়া টুকরোয় বেগুনভাজা তুলে মুখে দিল।

‘শিক্ষিত বউ, ছেলেমেয়েদের পড়াশুনো তো হবেই। ওপরে যাবে নাকি?’

‘গিয়েছিলাম।’

‘আমাদের কথা কিছু বলল?’

‘না।’ কাঁচালংকা দাঁতে কাটল।

‘সন্তুর বন্ধু ছিলে, তখন তুমি খুব আসতে।’

সে চট করে মিতার মুখের দিকে তাকাল। মুখটা নামিয়েই রয়েছে। তার মনে হল, কিছু একটা ভাবছে।

‘মিতার বিয়েতে তুমি আসনি।’

সে চুপ করে রইল। লংকাটায় ঝাল আছে। মিতা মুখ তুলে তাকে দেখে বলল, ‘খুব ঝাল?’

‘ঠিক আছে।’

‘মেয়েটার কী যে ভাগ্য… তাড়াহুড়ো করে বাপ এমন জায়গায় বিয়ে দিল, খোঁজখবরও ভালো করে নেওয়া হয়নি। …সবাই বলে খোরপোষের মামলা করতে। সন্তুই করতে দেয়নি। কাগজে খবর বেরোবে, চতুর্দিকে ঢিঢিক্কার পড়ে যাবে…তোমার কী মনে হয়?’

‘যদি কেস তেমন থাকে, তা হলে করা উচিত।’

‘আমিও তাই বলি। ছেলেটা আবার বিয়ে করেছে, আগে থেকেই নাকি মেয়েটার সঙ্গে ভাবসাব ছিল।’

‘বিয়েটা করা উচিত হয়নি।’ দুজনেই অবাক চোখে তার দিকে তাকাল। মাসিমা কিছু বলে ওঠার আগেই সে যোগ করল, ‘দুজনেরই।’

পাওয়ার কাট। অন্ধকার ঘরে মাসিমা বিরক্ত স্বরে বলল, ‘এই এক জ্বালা, কবে যে শেষ হবে কে জানে।’

মিতা উঠে গিয়ে তাক থেকে মোমবাতি—দেশলাই এনে জ্বালল। পাখাটা মন্থর হতে হতে শেষ চক্কর দিচ্ছে। সিলিংয়ে শকুন ওড়ার ছায়া ঘুরছে। গোকুলানন্দে সে শকুনকে মরা গোরুর পেটের উপর বসে মাংস ছিঁড়তে দেখেছে। কাগজে তো তারও খবর বেরিয়েছিল, খোরপোষ চাওয়ার থেকেও বড়ো খবর। কিন্তু সবই তো এখন স্বাভাবিক।

‘হাত ধোব।’

‘এসো।’ মোমবাতি হাতে মিতার পিছনে সে কলঘরে এল। এটা তার চেনা জায়গা। সিঁড়ির পাশে টিনের পাল্লা দেওয়া ঘেরা জায়গাটা চৌবাচ্চচা। মেঝেয় সম্প্রতি সিমেন্ট করা হয়েছে। দড়িতে গামছা ঝুলছে।

‘হাতে তেল লেগে, সাবান দাও।’

কাঠের র‌্যাক থেকে সাবানদানিটা মিতা তার হাতে দিল। ক্ষয়ে প্রায় শেষ হয়ে যাওয়া গোলাপি সাবানে জুঁইয়ের গন্ধ।

‘কী শুঁকছ?’ মিতার এক হাতে জলভরা মগ। জল ঢালার জন্য তার কাছ ঘেঁষে নীচু হল। ওর গায়ে বাসি ঘামের টক গন্ধ, বিবির গায়ে কখনো সে ঘামের গন্ধ পায়নি।

‘গন্ধটা বেশ লাগে।’

‘ও কথা বললে কেন, বিয়ে করা উচিত হয়নি?’

‘তোমাকে বলিনি, তোমার স্বামীর জন্য বলা।’ হাত ধুয়ে হাত দুটো ঝাড়ছিল, মিতা আঁচল এগিয়ে ধরল। হাত মুছে আঁচলটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা পুরুষ না হয়ে এ ক্ষেত্রে যদি মেয়ে হত, তা হলে কী করত?’

‘মানে?’

‘মানে কিছুই নয়, এমনিই মনে হল। তোমার স্বামীর মতো—মেয়েটা তার স্বামীকে ত্যাগ করে তার লাভারকে বিয়ে করতে পারত কি?’

‘মেয়েদের অনেক অসুবিধে।’

‘কেমন?’ সে তীক্ষ্ন নজর রাখল মিতার মুখে। কিছু বলার জন্য ঠোঁট দুটো নড়ে উঠলেও কথা বেরোল না। কোনো আবেগকে যেন দমিয়ে রাখার চেষ্টায় ওর চোখ ছলছল করে উঠল। কৈশোরের ছেলেমানুষি আবার ফিরিয়ে আনার জন্য সে ইঙ্গিত দিচ্ছে, মিতার এমন ধারণা হলেও হতে পারে! কষ্টকর, নিঃসঙ্গ, একঘেঁয়ে বর্তমান অনেক সময় বুদ্ধিকে ঘোলাটে করে দেয়।

চড়বড় শব্দ করে বৃষ্টি নামল। এবার তাকে বাড়ি ফিরতে হবে। সে নিজেকে কথা দিয়েছে, বৃষ্টিতে ভিজবে ছাদে দাঁড়িয়ে। মিতা তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ভালোই করেছে, তা হলেই কথা বেড়ে গিয়ে সময় খরচ হবে।

‘তাড়া আছে আমার, বৃষ্টিটা যদি জাঁকিয়ে নামে, তাহলে ফিরতে পারব না।’

‘কতদূরে বাড়ি যে ফিরতে পারবে না? ছাতা আছে।’

সে ব্যস্ত হয়ে ঘরে এসে শূন্য ঝুলিটা কাঁধে তুলে নিল। ‘মাসিমা আমার তাড়া আছে, একজনের আসার কথা…আর একদিন আসব, মিতা চলি।’

মিতার মুখ দেখে বুঝল, ‘একজনের আসার কথাটা বিশ্বাস করেনি। তার এই হঠাৎ ফেরার তাড়া ওকে অপ্রতিভ করে দিয়েছে। নিশ্চয় তার এই আচমকা আসা আর বেমানান বিদায় নেওয়ার কারণ খুঁজতে অনেক রাত পর্যন্ত হাতড়াবে…বিবিও অনেক রাত পর্যন্ত জেগে তার অসুবিধেগুলোকে হয়তো নাড়াচাড়া করেছে।

মোমবাতি আর ছাতা হাতে মিতা সদর দরজা পর্যন্ত এল। ‘আজ আমার ভিজতে ইচ্ছে করছে, ছাতার দরকার নেই।’

‘সত্যি দরকার নেই?’

‘সত্যিই নেই।’ হয়তো মিতা চায়, ছাতা ফেরত দিতে সে আবার আসুক। তার বলতে ইচ্ছে করল, ‘একটু এগিয়ে দেবে?’

জমাট অন্ধকার আর বৃষ্টিধারায় তৈরি চাদরে ধাক্কা দিয়ে মিতার হাতে ধরা মোমবাতির আলো ফিরে এল। তাদের বাগানের পাঁচিলটা দেখা যাচ্ছে না। কেউ একজন ছুটে গেল ছপছপ শব্দ তুলে। আগে জল জমত শিবু বর্ধন লেনে, এখনও হয়তো জমে। চটি জোড়া খুলে সে থলিতে ভরল।

‘বহু বছর পর তুমি এলে রঘুদা।’ মিতার স্বর গভীর, অস্পষ্ট।

সে বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকারে নেমে পড়ল। সিমেন্ট বাঁধানো গলি, গর্ত বা ঢিবি নেই তবে পেরেক বা মাছের কাটা পড়ে থাকতে পারে। আলতো করে পা ফেলে সে এগোল। শিবু বর্ধন লেনে পা দেবার আগে সে পিছন ফিরে তাকাল। হাতের তালুতে মোমবাতির শিখা আড়াল করে মিতা মাথা হেলিয়ে তাকে দেখার চেষ্টা করছে। অযথা চেষ্টা, তাকে দেখা যাবে না।

খালি পায়ে সে ছুটে ছাব্বিশ নম্বরের ফটকে পৌঁছল। চোখটা সইয়ে নিয়ে আবার এক ছুটে পৌঁছল সদর দরজায়। এইটুকু ছুটেই সে হাঁফিয়ে পড়েছে। থলি দিয়ে মুখের জল মুছে সে দরজা ঠেলতেই সেটা খুলে গেল। ভিতরে ঘন অন্ধকার। শুধু উঠোনে যাবার দরজাটা আধখোলা, সেখান দিয়ে দেখা যাচ্ছে রান্নাঘরের হারিকেনের আলো। একটা অস্ফুট চমকে ওঠার শব্দ। দ্রুত পায়ে কেউ সিঁড়ির দিকে চলে গেল। উঠোনের দরজা দিয়ে একজন নিঃসাড়ে প্রায় পিছলে ঢুকে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল। পাল্লা দুটো পুরো বন্ধ হয়নি। ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেল রান্নাঘরে ঢুকল অরুণা।

অন্ধকারে কী করছিল অরুণা! কে উঠে গেল দোতলায়! থলি থেকে চটি বার করে মেঝেয় ফেলল। পা গলিয়ে বুঝতে পারল, ভেজেনি। চেনা সিঁড়ি। দোতলায় উঠে দরজা ঠেলতেই খুলে গেল। এমার্জেন্সি লাইট জ্বালিয়ে বিবি খাতা দেখছে। এই সময় দালানে বসে ওর কাজ করা মানেই তার জন্য অপেক্ষা করা। ঘরে চিমনি লাগানো পিতলের কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালিয়ে গুলু পড়ছে।

‘আমার আগে কেউ কি নীচের থেকে এল?’ গলা নামিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ, রণো…কেন?’

‘কিছু না।’ সে একবার গোরার ঘরের দিকে তাকাল। দরজা আধ—ভেজানো, ঘর অন্ধকার।

‘কোথায় গেছলে তুমি?’ শান্ত গলা, কৌতূহল নেই।

‘সনতের কাছে।’

‘এত লোক থাকতে ওর কাছে! কী দরকার পাড়ার লোকের বাড়িতে যাওয়ার।’ কথার ভঙ্গিটা পরামর্শ দেওয়ার মতো।

‘তাতে কী হয়েছে?’

‘মুখরোচক কথাবার্তা আবার শুরু হবে, এই যা!’

‘হয় হবে।’ সে ছোটো ঘরের দিকে এগোল।

‘শোনো।’ এবার গলায় কর্তৃত্বের দাপট, নীচু স্বরে। সে ফিরে তাকাল। ‘তুমি কোনো দিন কি আমার ফোন ধরেছিলে?’

‘একদিন, হ্যাঁ…বেজে যাচ্ছিল, ধরার কেউ ছিল না, তাতে হয়েছে কী?’

সে বিবির মুখ কঠিন হতে দেখল। আন্দাজ করতে পারল কেন দপ করে উঠল চোয়ালের পেশি। ‘তোমায় কী জিজ্ঞাসা করেছিল?’

‘আমি কে…কে কথা বলছি।’

‘কী বললে তুমি?’ বিবি সোজা হয়ে বসল।

‘বললাম জাহ্নবীর স্বামী বলছি।’ বলেই সে কাঠ হয়ে গেল বিবির মুখটা দেখে।

থম হয়ে গেছে। তিক্ত চাহনির মধ্য দিয়ে ও কী বলে চলেছে! কলমটাকে মুঠোয় গুঁড়িয়ে ফেলার চেষ্টাটা কেন? ডিভোর্সি পরিচয় দিয়ে বিবি কী সুবিধে পায়?…কোনো পুরুষের সঙ্গে যদি ওকে দেখা যায়, তা হলে কেউই সেটা দোষের মনে করবে না! ডিভোর্সির স্বাধীনতা আছে প্রেমিক সংগ্রহের। এই সুবিধাটাই কি সে বানচাল করে দিয়েছে! বিবিকে কি কলিগদের ফিসফাস শুনতে হয়েছে।… নিশ্চয় সেই রমা ঘোষ বলেছে, ‘রাঘবেন্দ্র দত্ত লোকটা কে বলো তো?’ ‘কে রাঘবেন্দ্র?’ ‘ওই যে ফোনে বলল তোমার বৈধ স্বামী।’ আমার আগের স্বামী, এখনও তোমায় ভুলতে পারছে না, এখনও মনে করে আমি ওর স্ত্রী…।’ ‘তোমার বাড়িতে ফোন ধরল যে, তোমার কাছেই থাকে নাকি?’ ‘মাথা খারাপ হয়ে গেছে, তাই কিছুদিন হল বাড়িতে রেখেছি। কী করব, বেচারার কেউ নেই।’

‘তোমার সঙ্গে দু—একটা কথা আছে।’ বিবি তার মুখের দিকে নিথর চোখ রেখে স্থির স্বরে বলল।

‘আমারও একটা বলার কথা আছে, ঘরে আসবে?’ সে ইঙ্গিত করল ছোটো ঘরের দিকে। বিবি উঠে দাঁড়াল।

দালান থেকে আলোটা দরজা দিয়ে যতটকু এসেছে, তাতে ঘরটাকে প্রায়ান্ধকার বলা যায়। খাটের দিকটা অন্ধকার, সে খাটে বসল। টেবল আর চেয়ারে ক্ষীণ আলো পড়েছে, বিবিকে চেয়ারে বসতে হল। সে বিবির মুখটা দেখতে চায়।

‘অরুণা মানুষটা কেমন?’

‘হঠাৎ এ কথা কেন?’ ভ্রূ কুঁচকে উঠল বিবির।

‘দরকার আছে। কোথা থেকে ওকে পেয়েছ, ওর অতীত সম্পর্কে কী জান?’

‘বুঝতে পারছি না হঠাৎ এই সব প্রশ্ন কেন! আমাদের কলেজের এক ক্লার্ক ওকে দিয়েছে। সোনারপুরে ওদেরই পাড়ার মেয়ে। বিধবা, গরিব, দাদার সংসারে থাকত। আমার কাছে দু—বছর রয়েছে, হাতটান নেই, পরিষ্কার—পরিচ্ছন্ন, যতটা সম্ভব মার্জিত কথাবার্তা, চালচলন…কারুর কোনো কমপ্লেন নেই ওর সম্পর্কে।’

সে চুপ করে রইল। একটা বিশ্রী কথা, নিজের সন্তান সম্পর্কে, বলতে তার সংকোচ হচ্ছে। বিবির প্রতিক্রিয়াটা কেমন হবে অনুমান করতে পারছে না। অরুণার উপর যে ওর প্রচুর আস্থা, সেটা একটু আগেই কথার মধ্যে ধরা পড়ল। গোরা সম্পর্কে কোনো কথাই কানে নেবে না, তার কথা বিশ্বাসই করবে না।

‘অরুণা কিছু করেছে কি?’ এবার বিবির স্বরে উৎকণ্ঠা ধরা পড়ল।

‘সদর দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই অন্ধকারে মনে হল কারা যেন রয়েছে। পায়ের শব্দে বুঝলাম একজন ছুটে উপরে উঠে গেল, আর একজন তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে চলে গেল।…উপরে যে উঠে এসেছে সে গোরা।’

চাপা মন্থর স্বরে বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে ম্লান আলোতেই সে দেখতে পেল বিবির মুখ থেকে রক্ত সরে গেল, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যেতে লাগল সারা মুখ। চামড়ার সঙ্গে ভিজে গেঞ্জিটা সেঁটে রয়েছে, পাঞ্জাবিটা সপসপে। পাজামার তলা জলে ভারী। এগুলো খোলার দরকারটা এখন তার কাছে বড়ো কথা নয়।…গোরা এখন বিপদে।

‘কী বলছ তুমি! ঠিক দেখেছ তো?…অরুণা আর রণো!…ওর ছেলে থাকলে সে তো রণোর বয়সিই হত!’

‘অরুণার যৌবন এখন ফুরিয়ে যায়নি।’

‘না ফুরোক, …তুমি যে ঠিক দেখেছ সেটা বিশ্বাস করব কীভাবে?…যেকোনো কারণেই হোক ওরা দুজন ওই সময় ওখানে অ্যাকসিডেন্টালি এসে গেছিল, এটাও তো হতে পারে?’

‘তা হতে পারে, কিন্তু তা হলে দুজনের ছুটে পালাবার তো কোনো দরকার ছিল না!’

বিবি মুখ নামিয়ে চিন্তায় ডুবে যাচ্ছে, দুশ্চিন্তায়। ডুবন্ত লোক বাঁচার চেষ্টায় হাঁসফাঁস করে উঠবেই, এক্ষেত্রে সেটা ছেলের চরিত্রকে পরিচ্ছন্ন মনে করার চেষ্টা। বিবি তা করবে, করতেই হবে। বিবি জানে না গোরার বয়সে তার বাবা কেমন ছিল। অকালে পূর্ণবয়স্কের শরীর, অথচ সেটাকে বাগ মানাবার মতো মনের গড়ন না থাকলে এইরকমই হয়। এটা হবেই। বাবার আকারটাই শুধু নই প্রবৃত্তিটাও গোরা পেয়েছে। মিতাকে তার মা সরিয়ে না দিলে ব্যাপারটা কতদূর গড়াত?…কে জানে!

‘তুমি ওকে কিছু বোলো না, তবে অরুণাকে এখুনি ছাড়িয়ে দাও। সামনে থেকে সরে গেলে গোরা দু—দিনেই ভুলে যাবে।…এখন কম বয়স, ভুলে যেতে অসুবিধে হবে না।’

মিতার মা ‘অসুবিধে হবে না’—ই বলেছিল। সে নিশ্চিত গোরা মনে রাখবে না কিন্তু মনে করে রাখবে বাবাকে, তার ভয় পেয়ে পালিয়ে যাওয়া একটা মুহূর্তের সাক্ষীকে। গোরা ডিস্টার্বড থাকবে। একই বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে তারা দুজন,রোজই একবার অন্তত মুখোমুখি হবে, কেউ কথা বলবে না। চোখে চোখ পড়লেই একজন চোখ সরিয়ে নেবে।

‘এখুনি ছাড়ালে কাজের এমন একটা লোক পাব কোথায়?…অনেক চেষ্টায় পাওয়া।’

‘তাই বলে তুমি…!’ সে অবাক হয়ে বিবির বিরক্ত মুখের দিকে তাকাল।

‘তুমি অন্ধকারে যে কি দেখেছ…শুধু ওরা ছুটে পালাল, এটার উপর ভরসা করে কি কাউকে অ্যাকিউজ করা যায়?’

‘আপনি দেখলেন আসামি কাটারিটা আপনার স্বামীর ঘাড়ে বসাল…তারপর কী করল, ছুটে পালিয়ে গেল?’

‘না।’

‘তা হলে তখন কী করল আসামি?’

‘আমার দিকে এগিয়ে এল।’

‘গোরা একটা লোককে অন্ধকারের মধ্যে সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে অন্তত ‘কে’ বলে এগিয়ে যাবে তো?

‘হয়তো ভয় পেয়ে গিয়ে থাকবে।’

বিবি মানতে চাইছে না, চাইবেও না। উলটে তার সম্পর্কেই বিরক্ত হয়ে উঠছে। হয়তো বলবে উদ্দেশ্য নিয়ে গোরার চরিত্রে কালি ছিটোচ্ছি। কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে আমার? একটাই তো, ছেলেকে বাপের মতো হতে না দেওয়া।

‘তুমি আসার পর থেকেই সবাইকে জ্বালিয়ে যাচ্ছ।’ চেয়ার থেকে ঝাঁকি দিয়ে বিবি উঠে দাঁড়াল। ‘এখানে তোমার আর থাকা উচিত নয়।’

ঘর থেকে বিবি প্রায় ছিটকেই বেরিয়ে গেল। দালানের দরজা খোলার শব্দে সে বুঝল নীচে যাচ্ছে। সম্ভবত রান্নাঘরে, অরুণার সঙ্গে কথা বলতে। সে ভিজে পাঞ্জাবিটা খুলতে খুলতে বেরিয়ে এল তোয়ালের জন্য। গোরার ঘরের দরজা ভেজানো। তার মনে হল, এখানে থাকলে সে নিজেই নিজেকে কুরে কুরে ফোঁপরা করে দেবে।

বিদ্যুৎ ফিরে এসেছে । খাওয়া শেষ করে খালি থালা আর বাটির সামনে সে বসে আছে অনেকক্ষণ। খেতে খেতেই সে লক্ষ করেছিল অরুণা দরজার কাছে দু—বার এসে ফিরে গেছে। দাদার টিভি—তে শেষ অনুষ্ঠান হচ্ছে বোধহয়, নয়তো সারা বাড়ি নীরব। এগারোটার মধ্যে বিবি শুয়ে পড়ে, ছেলেমেয়েদেরও অভ্যাসটা করিয়েছে। এঁটো বাসন নীচে নামিয়ে দিয়ে তবেই অরুণা শোয়। আজ সে দেরি করে খেয়েছে।

হাত ধোয়ার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল দালানে অরুণা দাঁড়িয়ে। কপালের কিনার পর্যন্ত ঘোমটা, সর্বাঙ্গ কাপড়ে ঢাকা, শুধু টেবিলে রাখা ডান হাতের আঙুলগুলো দেখা যাচ্ছে। তাকে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল, কিছু একটা বলতে চায়। কী বলবে, আমি নির্দোষ, তাড়িয়ে দিলে আমার আর কোথাও জায়গা হবে না!

ঘরে ফিরে জলের গ্লাস তুলে নিয়েছে, পিছন থেকে অরুণা বলল, ‘দাদাবাবু আপনি বউদিকে বলেছেন আমাকে ছাড়িয়ে দিতে?’

‘হ্যাঁ।’ গ্লাস মুখে তুলল। অরুণার স্বরটা অপরাধীর মতো নয়।

‘বউদি আমাকে ছাড়াতে পারবে না!’

‘কেন?’

জবাব দিল না। সে তাকিয়ে রইল ওর মুখের দিকে। থালার উপর বাটি রাখা, এবার থালাটা তুলে নিলে ওর চলে যাবার কথা। কিন্তু যাচ্ছে না। আরও কিছু বলতে চায়। ‘কেন পারবে না?’

‘সে আমি বলব না, তবে বলছি পারবে না।’

‘তুমি গোরাকে নষ্ট করছ, এটা তার বাপ—মা সহ্য করবে না।’

‘আপনারা নিজের ছেলেকে খুব ভালো মনে করেন, না?’ বলার সঙ্গে সঙ্গে অরুণা ঘোমটা ফেলে কাঁধ থেকে আঁচল সরাল। ‘দেখুন।’

অরুণা যেখানে আঙুল রেখেছে সে সেখানে তাকাল। বাঁ কানের নীচে সরু গর্ত তাতে রক্ত জমে। বোধহয় দাঁত বসানোর দাগ। বাঁ গালে, গলায় কালো ছোপ। ‘ব্লাউজ খুলে দেখাব?’

‘নাহ।…এসব কী?’ সে স্পষ্টতই আর্তনাদ করল।

‘আপনার ছেলের কাজ। লোডশেডিং হতেই ঘাপটি দিয়ে ছিল সিঁড়ির কাছে অন্ধকারে। আমি ওপরে যাচ্ছিলুম, তখন ধরল…।’ অরুণা ফুঁপিয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিল। ‘আগেও দু—তিনবার চেষ্টা করেছে, বউদিকে বলতে লজ্জা করেছিল…এইটুকু ছেলে…।’

‘কাঁধের এই ইনজুরিটা কী করে হল?’ সদর হাসপাতালে এমার্জেন্সির মেডিক্যাল অফিসার জিজ্ঞাসা করেছিল। তখন সে পুরো উলঙ্গ হয়ে আউটডোরের পাশের ঘরে কাপড়ে ঘেরা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে। সিলিং থেকে ঝুলছে একটা বালব, একটা খাট, টেবিলে কিছু শিশি, দেওয়ালে মহাদেবের ছবি দেওয়া ক্যালেন্ডার। তার সামনে মেডিক্যাল পরীক্ষার সাক্ষী হিসাবে ছিল হাসপাতালের অল্পবয়সি এক জমাদার, গোকুলানন্দ থানার কনস্টেবল, আর ফরসা, রুগণ, লম্বা এক সিস্টার, যার বয়স পনেরো থেকে পঁয়তাল্লিশ হতে পারে। সিস্টারের চোখ তার উলঙ্গ শরীরটা আর সবার সঙ্গেই দেখছিল। লজ্জায় সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিজেকে তখন একটা গুয়েপোকা ছাড়া আর কিছু মনে হয়নি।

‘শনিবার সকালে রথতলায় একটা গোরুর গাড়ির জোয়ালের সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল।’

ডাক্তার টর্চ জ্বেলে কাঁধ পরীক্ষা করতে মুখটা কাছে আনে। তখন সে মনে মনে বলেছিল, ‘যেন ভুল না করে…ইনজুরিটা ধরতে পারে যেন।’ ডাক্তারের ভাবলেশ মুখের দিকে সে আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। ‘এটা জোয়ালের ধাক্কাতেই’, কথাটা সে আর একবার বলেছিল।

‘আপনার ছেলেই এই সব করেছে।’ অরুণা আবার বলল, ঘোমটা মাথায় তুলে দিয়ে। ‘আমাকে ছাড়িয়ে দেবেন?…তা হলে আমিও অনেক কিছু দেখেছি, যাবার আগে সবাইকে বলে যাব।’ অরুণার চোখ দপ করে উঠল, উদ্ধত ভঙ্গিতে চিবুক তুলল। ঠান্ডা নম্র মানুষটার এ কী পরিবর্তন!

‘কী বলে যাবে?’

‘বউদিকে জিজ্ঞেস করবেন।’ থালা তুলে নিয়ে অরুণা বেরিয়ে যাবার সময় শেষ কথা বলল, ‘জোঁকের মুখে দেবার নুন আমার কাছে আছে, বউদি সেটা জানে।’

জরাগ্রস্তের মতো সে দাঁড়িয়ে। বিবি কী জানে? অরুণা তাকে প্রায় ধমকেই গেল। একটা ঝি তাকে চোখ রাঙিয়ে বলে গেল, তাকে ছাড়ানো যাবে না। বিবি কী জানে এই বাড়িতে এটাই প্রথম…ব্ল্যাক—মেইলিং!… ‘অনেক কিছু দেখেছি’, কী দেখেছে?…’এখানে আর তোমার থাকা উচিত নয়।’ বোধহয় উচিত নয়। কোথায় যাব…গোকুলানন্দে?

পরদিন সকালে দালানে ওরা তিনজন খাচ্ছে। অরুণা পট থেকে চা ছেঁকে কাপে ঢালছে। সে গিয়ে বিবির পাশে বসল। এখানে এই সময় তার বসার কথা নয়। সবাই অবাক হয়ে তাকাল তার দিকে। অরুণা ইঞ্চিখানেক ঘোমটা বাড়িয়ে দিয়ে মৃদু গলায় বলল, ‘আপনার খাবার এখানে দোব?’

‘দাও।’

ওরা মুখ নামিয়ে খাওয়ায় ব্যস্ত হল। সে প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে খবরের কাগজটা তুলে নিল। অরুণা তার সামনে চায়ের কাপ রাখল। কাগজের প্রথম পাতায় চোখ বোলাতে বোলাতে আড়চোখে সে ছেলের দিকে তাকাল। কড়া করে সেঁকা পাঁউরুটির টুকরোর অর্ধেকটা মুখে ঢুকিয়ে দাঁতে কামড়ে চোখ বুজে চিবোচ্ছে! বাঁ হাতে ধরা ছাড়ানো কলায় কামড় দিয়ে আবার চোখ বুজল, চোখ খুলে সামনে তাকাল, মুখটা ফুলে উঠেছে। সামনে, টেবিলের অপর প্রান্তে অরুণা। গোরার চোখে তৃপ্তি, পা দুটো নাড়াচ্ছে। গালের পেশি দপদপাচ্ছে ডাঙায় তোলা মাছের কানকোর মতো।

একটা আঁশটে গন্ধে ঘিনঘিন করে উঠল তার ভিতরটা। সে কাগজের ওপাশ দিয়ে গুলুর দিকে তাকাল। একদৃষ্টে টেবিলে চোখ রেখে কাপে ছোটো চুমুক দিল। মেয়েটা কম খায়, হয়তো ছিপছিপে থাকার জন্য। ওকে বলা দরকার এতে শরীরের জোর কমে যায়, কিন্তু কে বলবে? বিবি উসখুস করছে।

‘ভেবে দেখলাম আমি গোকুলানন্দে গিয়েই থাকব।’ ঘোষণার মতো কথাটা সে বলল হাতের কাগজ নামিয়ে।

চকিতে সবাই তাকাল তার দিকে। সবার চোখে অবাক ধরবে এটা সে জানে। সে ঘাড় কাত করে বিবিকে বলল, ‘ডিসিশানটায় কোনো ভুল আছে?’

‘না। আমিও তাই ভাবছিলাম।’

‘ভাবছিলে!’

‘হ্যাঁ, এখানে তুমি অ্যাডজাস্ট করতে পারছ না আমাদের সঙ্গে।’

‘হ্যাঁ ঠিক, …তুমিই তো এ বাড়ির সব, আমি একটা ফালতু…তাই ঠিক করলাম।’ সে আবার চোখ বোলাল টেবিলের তিন পাশে। ‘এ বাড়িতে কোনো কিছুতেই স্টেপ নেবার অধিকার আমার নেই…মার্ডারার, রেপিস্ট…কে গ্রাহ্য করবে, কোনো সম্মান নেই। কাজে লোককে বরখাস্ত করার মতো জোরও আমার নেই।’

সে অরুণার মুখের দিকে তাকল। ‘ঘাড় ধরে একবস্ত্রে বার করে দিতাম, কিন্তু আমি তা পারব না।…তুমি অনেক কথা নাকি সবাইকে বলে যাবে, তাতে আমার বংশের সম্মান থাকবে না। সুতরাং…’

‘থাক আর বলতে হবে না।’ বিবি তাকে থামিয়ে দিল। ‘তুমি গোকুলানন্দে গিয়েই থাকো। হেমন্তকে পাঠাচ্ছি, তোমার থাকার বন্দোবস্ত করে আসতে। তোমার কোনো অসুবিধা, মনে হয় না হবে…পারুল আছে, সে তোমায় দেখবে।’

নামটা মাথায় থিতু হবার পরই সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে উঠল, ‘কে দেখবে?’

‘যাকে তুমি বিধবা করেছ।…যাকে দেখার দায়িত্ব আমিই নিয়েছি। পারুলই এখন গোকুলানন্দর সব কিছু দেখছে। …হেমন্তকে কালই পাঠাব।’

সাত

রথতলার মোড়ে সে বাস থেকে যখন নামল, বিকেল তখন শুরু হয়েছে। ষোলো বছর পর। বোধহয় গত রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। পিচ রাস্তার বাইরের মাটি ভিজে, বহু জায়গায় কাদা। বিকেলে বাজার বসত, আজও বসেছে। তবে কেনাবেচা এখনও জমেনি। সেই একই আনাজপাতি, রাস্তায় বসা দোকানগুলোয় একই জিনিস।

কিন্তু রথতলার অনেক বদলও ঘটে গেছে। রাস্তার দু—ধারে ব্যারাকের মতো টানা লম্বা পাকা দোতলা বাড়ি উঠেছে। একটা বাড়িতে ব্যাঙ্কের সাইনবোর্ড, তলায় টিভি সেট, টেপরেকর্ডার বিক্রির দোকান, তার পাশে গানের ক্যাসেটের। …বড়ো একটা ওষুধের দোকান, স্টেশনারি দোকানটা রঙবেরঙের জিনিসে ভরা। এর উলটোদিকে পাশাপাশি দুটো দোকানে শাড়ি আর রেডিমেড পোশাকের লম্বা কাউন্টারে লোক দাঁড়িয়ে। হিন্দি পপ গানের ক্যাসেট বাজছে…শস্য আর আনাজ বীজের…মিষ্টির দোকান ‘মুখোরুচি’, …কাঠের খাট, লক্ষ্মীর আসন, ড্রেসিং টেবিল…ফিনান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, পান—সিগারেটের দোকানে সফট ড্রিঙ্কসের বাক্স…নতুন সাইকেল, জুতো…সরকারি মৎস্য, কৃষি বিভাগ, তার পাশে নতুন ডাকঘর, উপরে টেলিফোনের তার, একটা বাড়ির দোতলায় ঢালাইয়ের কাজ চলছে…সে দেখতে দেখতে হেঁটে চলল।

রথতলা আর প্রায় চেনাই যায় না। দোকানগুলোর ভিতরে ফ্লুরোসেন্ট আলো দিনের বেলাতেও জ্বলছে। কাচে আলো লেগে দোকানগুলো ঝকঝকে। বিবি বলেছিল, ‘চিনে যেতে পারবে? সঙ্গে হেমন্ত যাক। সে হেসেছিল, ‘এতবার গেছি।’ রথতলা বদলেছে ঠিকই, কিন্তু না চেনার মতো নয়। রাস্তা ধরে আধ মাইল এগোলে বাঁ দিকে গোকুলানন্দের খালপাড়। রাস্তা নেমে গেছে। রাস্তার ধারেই সেই টালির চালের বাড়িগুলো, বাইকে যাবার সময় সে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখত বেশ্যাদের।

বাস, ট্রাক, অটো রিকশা তার সঙ্গে গোরুর গাড়ির, সাইকেল আর ভ্যান রিকশা, নিশ্চিন্তে রাস্তা দিয়ে হাঁটা যায় না। সে রাস্তা থেকে নেমে মাটির উপর দিয়ে হেঁটে চলল। এত লোক, দোকান, যানবাহন, কেউ তার দিকে তাকাচ্ছে না। এতে সে অবাক হল না। পাজামা, পাঞ্জাবি, দাড়ি কাঁধে ঝুলি থাকলেই যে দ্রষ্টব্য হয়ে যাবে কিংবা কটা চোখ, ছ—ফুটের উপর লম্বা, তামাটে হয়ে যাওয়া গায়ের রঙ হলেই যে সবাই তাকাবে, এমনটা সে আশা করছে না। রথতলা প্রতিদিনই নানান রকমের মানুষ দেখায় অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

থানাটা রথতলার মোড় থেকে উত্তরে খালেদনগরের দিকে চলে যাওয়া রাস্তার উপরে। ওইদিকেই হাইস্কুল আর থানা। একবার তার মনে হল, পিছিয়ে গিয়ে থানাটা দেখে আসবে কী না! চারটে সিঁড়ি ভেঙে টালির চালের খোলা দালান, তার পিছনে একটা বড়ো ঘর। সেখানে বসে দারোগা। ওই ঘরের পিছনেই হাজতঘর। সেখানে তাকে দুটো রাত কাটাতে হয়েছিল ষোলো বছর আগে। পরদিন ছিল রবিবার। সোমবার কোর্টে হাজির করে তাকে খালেদনগর সদর থানায় নিয়ে রাখা হয়। দারোগা বিজয় ঘোষ রবিবারই বলেছিল ‘পঞ্চাশ হাজার টাকার কমে বাঁচাতে পারব না।’

বিজয় ঘোষ নিশ্চয় এখন আর এই থানায় নেই। সজল নামের সেই কনস্টেবলটাও নিশ্চয় নেই, যে তার কোমরে মোটা দড়ি বেঁধে, ভ্যান রিকশায় বসিয়ে সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। এতদিনে নিশ্চয় বদলি হয়ে গেছে, প্রোমোশন পেয়েছে। বিজয় ঘোষ বলেছিল, ‘বউটা আপনার এগেনস্টে রেপিংয়ের চার্জ এনেছে…পরীক্ষার জন্য আপনাদের দুজনকে হাসপাতালে পাঠাব।’ এই রাস্তা দিয়েই ভ্যান রিকশাটা গেছিল সদর হাসপাতালে। তার পিছনেই বাবু হয়ে অন্যদিকে মুখ করে বসেছিল পারুল! পথচারীরা অবাক চোখে দেখছিল।

খালপাড়ের টালির চালের ঘরগুলো একইভাবে রয়েছে। তার মনে হল দু—তিনটে ঘর বোধহয় বেড়েছে, জানালায় আগে পরদা দেখেছে বলে মনে পড়ল না। দুটো অ্যান্টেনা তাকে অবাক করল। এদের রোজগার তা হলে টিভি সেট কেনার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। শ্রীগোপাল খালপাড়ের ঘরে আসত পনেরো টাকা নিয়ে!

চাষখেতের জমিতেই তিনটে একতলা ছোটো পাকা বাড়ি। বারান্দায়, জানালায় গ্রিল। রাস্তা থেকে বিদ্যুতের তার গেছে। স্থানীয় লোকই করেছে, হয়তো রিটায়ার্ড। তার মনে পড়ল শরৎ বসাকের বাড়িটা। এই একমাত্র লোক যার সঙ্গে এখানে তার পরিচয় হয়েছিল। এখন তাকে দেখে লোকটা দরজা বন্ধ করে দেবে, নাকি আগের মতোই চা খাওয়াবে? দেখা করে পরীক্ষা করতে হবে। বোকাসোকা দেখতে হলেও চালাক লোক, নয়তো ব্যবসা করে পয়সা করল কী করে?

খালপাড় থেকে গ্রামের দিকে যাওয়া রাস্তাটায় মাটি পড়েছে, চওড়া হয়েছে। একটা মোটরগাড়ি চলে যেতে পারে। এইখানেই সে ষোলো বছর আগে, পিছন থেকে পারুলকে দেখেছিল খালি পায়ে, জারিকেন হাতে নিয়ে হেঁটে যেতে। সে কলকাতা থেকে আসছিল মোটর বাইকে। শব্দ শুনে পারুল রাস্তার ধারে সরে গিয়ে পিছনে তাকায়। সে বাইকটাকে ওর পাশে এনে বলেছিল, ‘যাচ্ছ কোথায়?’ পারুল দাঁড়িয়ে যায়। ‘কেরোসিন আনতে একজনের বাড়ি থেকে।’ ‘কত দূরে? …উঠে পড়ো, পৌঁছে দিচ্ছ।’ পারুল গম্ভীর হয়ে বলেছিল, ‘না’। ‘না কেন? বাইকে তো মেয়েরাও চড়ে!’ বাবুর সঙ্গে ঝিয়ের মেয়ে চড়ে না।’ পারুল হনহন করে হাঁটতে শুরু করে দেয়। সে বাইকটাকে ওর পাশে পাশে চালিয়ে বলেছিল, ‘এখন তুমি ঝিয়ের মেয়ে নও, শ্রীগোপালের বউ, শ্রীগোপাল আমার ছেলেবেলার বন্ধু, বন্ধুর বউ…উঠে পড়ো।’

পারুল থমকে দাঁড়ায়, চোখ কুঁচকে কিছু একটা ভেবে নিয়ে সে বাইকের পিছনে উঠে বসে। ‘ঠিক করে উঠে বসো। শাড়িটা হাঁটুর মধ্যে গুঁজে দাও…বাঁ হাতে জারিকেনটা নাও আর ডান হাতে আমার কোমর ধরো।’ পারুল কোমর ধরেনি। সে ইচ্ছে করেই বাইকটা এমন গতিতে ছেড়ে দিল যে পারুলের পড়ে যাবার মতো অবস্থা হয়, সামলাতে গিয়ে সে তার কাঁধটা আঁকড়ে ধরে। ‘কাঁধে একটা খোঁচা খেয়েছি একটু আগে, জ্বালা করছে।’ পারুল তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নেয়। ‘রাস্তাটা খারাপ, ঝাঁকুনিতে পড়ে যেতে পারো…ডান হাত দিয়ে ধরতে বললাম।’ ‘আমাকে নামিয়ে দিন। আর একটুখানি, হেঁটে চলে যাব।’ সে বাইক থামায়নি, পারুলেরও নামা হয়নি। ওর কাঁধ তার পিঠে চাপ দিচ্ছে, রাস্তার বড়ো বড়ো গর্ত পাশ কাটিয়ে যেতে বাইককে এঁকেবেঁকে চালাতে হচ্ছিল। ‘এভাবে চালালে আমি কিন্তু পড়ে যাব।’ সে বাইক থামিয়ে মুখ পিছনে ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘অনেক দূর এসেছি, আর কতটা?’ তাকে অবাক করে দিয়ে পারুল বলেছিল, ‘অনেকক্ষণ ছাড়িয়ে এসেছি।’ ‘বলোনি তো!’ ছোটোবেলায় আমার খুব ইচ্ছে করত চড়তে, আজ শখটা মিটিয়ে নিলুম।’ বলেই হেসে উঠল। ‘এবার ফেরান, দেরি হয়ে গেছে। ঘরে বাচ্চচা রয়েছে।’ ‘শ্রীগোপাল কোথায়? তুমি কেন কেরোসিন আনতে এতটা হেঁটে যাবে, ও কি করছে?’ ‘সকালেই বেরিয়েছে…কাল থেকে ঘরে তেল নেই, চলুন।’

বাইক ঘুরিয়ে নিয়ে আবার সে ফিরে এসেছিল মাটির রাস্তারই কাছাকাছি। একটা বাবলা গাছের পাশ দিয়ে নেমে গেছে পায়ে চলা পথ। কতকগুলো খড়ের বাড়ি। বাইক থামিয়ে সে বলেছিল, ‘কেরোসিন নিতে এখানে?’ পারুল বলেছিল, ‘এটা দোকানদারের বাড়ি, দোকানের তেল সব বাড়িতেই, ব্ল্যাকে বিক্রি করে। আপনাকে আর আসতে হবে না।’ জারিকেন হাতে পারুল সেই সরু পথটা দিয়ে হেঁটে চলে গেল। পিছন থেকে সে ওর দিকে তাকিয়েছিল। …এই সেই রোগা, লম্বা, হাইজাম্পারদের মতো দুটো পা—ওয়ালা পারুল, কার্তিকের মা—র মেয়ে! তাকে দেখলেই তখন চোখ নামিয়ে নিত। এখন ওকে দেখে কে বিশ্বাস করবে! শ্রীগোপাল বলল, ‘রোঘো, বিয়ে করে ফেললুম মেয়েটাকে।’ তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল ‘কাকে, পারুলকে?’ বিবিকে সে বলেছিল, ‘সিঁড়িঙ্গে একটা মেয়ে, ড্যাবড্যাবে চোখ।’

কেন যে পারুলের হেঁটে চলে যাওয়ার দিকে সে তাকিয়ে থেকেছিল, আজ ষোলো বছর পরেও তা বুঝতে পারছে না। …কোনো অশ্লীল ইচ্ছে জেগেছিল? …তার কোনো অভাব, অপূর্ণতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল?…একটা রুগণ, অপুষ্ট গাছকে হঠাৎ একদিন ফুলে ভরে যেতে দেখার চমক কি সেই তাকানোটাকে তৈরি করেছিল?

উনিশ বছর আগে শ্রীগোপাল বলেছিল ‘রোঘো বিয়ে করে ফেললুম…গোকুলানন্দে আয়, বউভাত খাওয়াব।’ সে আগাম না জানিয়ে খেতে গেছিল পরের রবিবারে। মোটর সাইকেলের পাশের ব্যাগে ছিল উপহার, শ্রীগোপালের জন্য টেরিলিনের প্যান্ট পরা শার্টের কাপড়, বড়ো এক বোতল হুইস্কি। পারুলের জন্য মুর্শিদাবাদী সিল্কের শাড়ি, ব্লাউজ পিস, আর নকল চুনীকে ঘিরে নকল মুক্তো বসানো একটা সোনার আংটি। বিবিকে সে বলেছিল, ‘শ্রী গোপাল যেভাবে আমাদের জমিজমা বাঁচিয়েছে, তাতে পাঁচ হাজার টাকার উপহার দেওয়া উচিত।’

‘ঘোড়ামুখো তোর বউভাত খেতে এলুম রে।’ উঠোনে মোটরবাইকে বসেই সে চেঁচিয়েছিল। খড়ের চালার ঘর থেকে শ্রীগোপাল খালি গায়ে প্রায় ছুটে বেরিয়ে আসে। ‘আরে রোঘো!’ আনন্দে শ্রীগোপালের সামনের চারটে দাঁত বেরিয়ে পড়েছিল। ‘বউকে রান্না চড়াতে বল।’ খামার বাড়িটা প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে। বাইকটা একতলার খামারঘরে রেখে ব্যাগ থেকে জিনিসগুলো বার করে হাতে নিয়ে হেঁটে আসতে আসতে দেখল পারুল দাওয়ায় মাদুর পাতছে। ওকে সেই হনুমান পার্কে ঘুগনি কিনতে দেখার পর এই প্রথম দেখা, একইরকম রোগা, লম্বা রয়ে গেছে। তার দিকে পারুল তাকাল, সেই ড্যাবড্যাবে চোখ।

বোতলটা দেখেই শ্রীগোপাল হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলেছিল, ‘কী জিনিস এনেছিস রে! অনেকদিন বিলিতি খাইনি। আজ মুরগি খাওয়াব তোকে।’ পারুল দাওয়ায় দাঁড়িয়ে দেখছিল, তার কাছে গিয়ে সে শাড়ির বাক্সটা হাতে দিয়ে আংটির কৌটোটা খুলে সামনে ধরল, ‘পছন্দ হয়?’ পারুল মাথায় ঘোমটা তুলে ছোট্ট করে মাথা হেলায়। ‘হাতটা দাও, পরিয়ে দিই।’ সে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়, পারুল আঁচলের নীচে হাত লুকিয়ে ফেলে শ্রীগোপালের দিকে তাকায়। বোতলের ছিপির প্যাঁচ মুচড়ে খোলায় ব্যস্ত শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘পরিয়ে দিচ্ছি পরে নাও, রোঘোর ছোঁয়া লাগলে কী গায়ে ফোস্কা পড়বে?…উপহার এটা।’

পারুল বাঁ হাত বাড়িয়ে দিল। ওর তালুটা মুঠোয় ধরতেই তার মনে হল, হাতটা যেন কেঁপে উঠল। মুখের দিকে তাকাতেই পারুল চোখ নামিয়ে নিল। আংটিটা অনামিকায় খাপ খেয়েছে। পারুল হাতটা টেনে নিচ্ছিল সে চে পে ধরে বলল, ‘দেখি একটু কেমন লাগছে…বাহ, চমৎকার দেখাচ্ছে…শ্রীগোপাল দ্যাখ তো।’ পারুলের হাতটা সে তুলে ধরল। ‘বিউটিফুল…সোনার জিনিস…দুটো গ্লাস দাও তো, চট করে একটু খেয়ে নিশিদার বাড়ি যাই, ওর মুরগির টেস্ট ভালো।’ ‘তুই এই সকালে এখন মদ খাবি?’ ‘সকাল বলছিস কিরে রোঘো, দশটা তো কখন বেজে গেছে।’ পারুল দুটো কাচের ক্লাস আনে, শ্রীগোপাল একটায় প্রায় সিকি গ্লাস ঢেলে, অন্যটায় ঢালতে যাচ্ছে তখন সে গ্লাসটা তুলে নিয়ে বলল, ‘থাক, এখনও আমার সকাল চলছে।’ ‘তা হলে চলুক তোর সকাল। বড়োলোকের ছেলে, শরীরের দিকে নজর তো থাকবেই।’

শ্রীগোপাল এক ঢোঁকে প্রায় অর্ধেকটা নামিয়ে দিয়ে চোখ বুজল। মুখটা দু—তিনবার দুমড়ে গিয়ে ক্রমশ থমথমে হয়ে গেল, কপাল ভিজে ভিজে দেখাচ্ছে। চোখ খুলে হাঁফাল দু—তিনবার। সে দেখল পারুল উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে। ‘ভালো জিনিস জল দিয়ে নষ্ট করতে নেই, খেলে নিট খাওয়া উচিত, বাবা তাই খেত। জানো পারুল, রোঘোকে আমিই প্রথম মদ চাখিয়েছি। তখন ও ক্লাস এইটে, আমি সিক্সে। ও খেয়ে বলেছিল আমি ওকে নষ্ট করলুম।’ শ্রীগোপাল হাসতে শুরু করে। ‘আমরা কীরকম বন্ধু জান?’ দ্বিতীয় ঢোঁকে বাকি মদটুকু শেষ করে শ্রীগোপাল পারুলের দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করে বলে ‘আমাদের বিয়ের আগে, এই ঘরে বসে একদিন বললুম তোর ঠাকুরদার কেপ্ট ছিল, তুইও একটা রাখ। তাতে ও কী বলল জান, তুই বিয়ে কর তোর বউকে কেপ্ট রাখব। …এবার যাই।’ শ্রীগোপাল সোজাভাবে হেঁটে মুরগি আনতে চলে গেল।

তখন নোংরা একটা লজ্জায় তার মাথা ঝুঁকে পড়েছিল। সেই সময় পারুলের মুখ দেখার মতো সাহস তার ছিল না। শ্রীগোপাল যে এতটা মাথামোটা এর আগে কখনো তার মনে হয়নি। চতুর, ধূর্ত, যেকোনো খারাপ কাজ অবলীলায় করতে পারে, এটাই তার জানা ছিল। হয়তো রসিকতা ভেবেই কথাটা বলেছে, কিন্তু বুঝল না কী বিশ্রী চেহারায় পারুলের সামনে তাকে দাঁড় করাল। কোনোদিনই সে আর ওর কাছে পরিচ্ছন্ন একটা মানুষ বলে গণ্য হবে না।

‘মামলেট করে দোব, খাবেন?’ আচমকা পারুলের স্বাভাবিক গলা শুনে সে তাড়াতাড়ি বলে ফেলে ‘খাব’। ‘চান করবেন?’ ‘হ্যাঁ করব, আমার ঘরের চাবিটা দাও। …কোথায় চাবি আছে জান তো?’ পারুল জবাব না দিয়ে ঘর থেকে চাবি এনে দেয়। সে ছুটেই প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরের খামারবাড়িতে পৌঁছয়। দোতলার বন্ধ ঘরের তালা খুলে ভ্যাপসা বাসি গন্ধটা কাটাতে সে পুবের জানালাটা খোলে। জানালা থেকে দেখতে পেল দাওয়ার একধারে রান্নার জায়গায় বসে পারুল তখন উনুনে কাঠ দিচ্ছে। তার মনে হল পারুলের চোখ উনুনের দিকে নয়, জানালার দিকে।

পারুল একটা মোটা ওমলেট কাঁসার থালায় তাকে দোতলার ঘরে দিয়ে গেছিল। ‘আমাদের ভাত কিন্তু মোটা চালের।’ ‘জানি, আগেও খেয়ে গেছি।’ ‘খেতে কিন্তু দেরি হবে, মুরগি নিয়ে কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। …পেটে পড়েছে তো।’ ‘দেরি করবে না, বোতলটা তো এখানে। …শেষ করতে হবে তো? শুধু মুরগির ঝোল আর ভাত আর কিছু রেঁধো না।’ কথা বলতে বলতে সে অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তবে একবার ভেবেছিল, একটা কোনো কৈফিয়ত দিলে ভালো হয়, যেমন শ্রীগোপাল যে তোমাকেই বিয়ে করবে সেটা জানলে অমন কথা বলতাম না বা এই ধরনের কিছু। কিন্তু পারুলের স্বাভাবিক স্বচ্ছন্দ তার অস্বস্তি কাটিয়ে দেয়।

সন্ধ্যায় কলকাতা রওনা হবার জন্য সে মোটরবাইকটা যখন খামারঘর থেকে ঠেলে বার করছে তখন শ্রীগোপাল এসে দাঁড়ায়। ‘নেশাটা হঠাৎ এমনভাবে ধরে নিল যে তোর সঙ্গে বসে খাওয়াটাও হল না। পারুল তোকে ঠিকমত খাইয়েছে তো?’ ‘খুব ভালো মুরগিটা রেঁধেছে।’ ‘যাক…তুই যে সত্যি সত্যিই আসবি ভাবিনি, বউদিকে একদিন আনিস কিন্তু। ঝিয়ের মেয়ে বলে পারুলের একটা কমপ্লেক্স আছে, সেটা তা হলে কেটে যাবে।’ ‘আনব…তুই এখন শুয়ে থাক, বড্ড খেয়েছিস খালি পেটে।’ ‘হুইস্কি অনেকদিন খাইনিরে, দিশিই জোটে এখানে…রাস্তাটা খারাপ, দেখে চালাস।’ সে বাইকে স্টার্ট দিল। ‘রোঘো একটা সত্যি কথা বলবি?’ শ্রীগোপাল তার কাঁধে হাত রাখল। গলার স্বর জটিল সমস্যায় ভরা। ঝুঁকে মুখটা কাছে এনে বলল, ‘ঠিক করে বল তো, আমার আর পারুলের মুখের মিল আছে কি না? ঠিক বলবি।’ শুনেই ধড়াস করে উঠেছিল তার বুক। শ্রীগোপাল কি কিছু শুনেছে? ‘কই, কোনো মিল তো আমার চোখে পড়েনি!’ তার মনে হল, শ্রীগোপাল ভয়ংকর একটা গর্ত ডিঙোবার চেষ্টা করছে। ‘চোখ, নাক, ঠোঁট, কপাল? ওর দাঁত আমার মতো নয় কিন্তু চোখ কুঁচকোলে, হাসলে?…কোনো মিলই নেই? তুই তো আমাদের দুজনকে কবে থেকে দেখছিস, কখনো মনে হয়নি?’ ‘একবারও নয়…ছাড় এবার যাব। নেশা এখনও তোকে ধরে আছে, আবোলতাবোল বকছিস।’ মোটরবাইকের হেডলাইটটা সে জ্বালল। উঠোনে দাঁড়িয়ে পারুল। আলোর তীব্রতায় চোখ বন্ধ করে কয়েক পা সরে গেল। ‘আর একটা কথা, জাস্ট ওয়ান ওয়ার্ড…বাবাকে তো জন্ম থেকেই দেখেছিস, পারুলের মুখের সঙ্গে…’ সে ধাক্কা দিয়ে শ্রীগোপালকে ঠেলে সরিয়ে বাইক চালিয়ে দিয়েছিল। ‘পারুল চললাম…ওকে শুইয়ে দাও, বাজে বকছে।’ ‘আবার আসবেন।’ উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় পড়ার সময় সে শুনতে পায় শ্রীগোপালের চিৎকার ‘রোঘো, দেখে চালাস।’

এর তিন বছর পর সে এসেছিল সেই জুন মাসের শনিবারে। রথতলার কাঁধে জোয়ালের ধাক্কা লেগেছিল, পারুলকে পিছন থেকে দেখেছিল রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে, ওকে বাইকের পিছনে তুলে নিয়েছিল। পারুল বলেছিল, ‘ছোটোবেলায় খুব ইচ্ছে করত চড়তে, আজ শখটা মিটিয়ে নিলুম।’ কলেজে ভরতি হতেই বাবা মোটরবাইক কিনে দেয়, পারুলের শখ কি তখনই জন্ম নেয়? না হলে কচুবাগানে বস্তির মেয়ে ছোটোবেলায় আর কাকে বাইক চালাতে দেখেছে? পাড়ায় আর তো কারুর ছিল না!

ওই তিন বছরে সে অনেকবারই গোকুলানন্দে এসেছে, কয়েক ঘণ্টা থেকে ফিরে গেছে। তখন পারুলকেও দেখেছে, কিন্তু ও যে ‘সিড়িঙ্গে’ থেকে ধীরে ধীরে অন্য একটা কমনীয় শরীর পেতে শুরু করেছে, এটা তার নজরে আসেনি, হয়তো চারপাশের ফাঁকা জমি, খেত, আকাশ, গাছপালার পটভূমিতে দূর থেকে দেখলে মানুষের অন্য চেহারাটা ধরে পড়ে। কিংবা হয়তো গত রাতে বিবির কাছ থেকে পাওয়া উদাসীন অবহেলায় ভরা সম্পর্ক রক্ষা, যেটা ধর্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়, যেটা তাকে গ্লানি আর রাগ ছাড়া আর কিছু দেয়নি।’ …সেটাই কি তাকে প্ররোচিত করেছিল পারুলকে একটু বেশি আকর্ষণীয় করে ভাবতে?…বিবির চোখের স্থির হয়ে থাকা দুটো মণি তার মনের মধ্যে হয়তো তখনও তাকিয়ে রয়েছিল। সেই নিষ্পন্দ চাহনিটাকে ঢেকে দেবার জন্যই কি সে এমন কারও খোঁজ করছিল, যার বড়ো বড়ো চোখ কথায় ভরে থাকবে?

পারুল কেরোসিন তেল নিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত সে বাবলা গাছটার পাশে অপেক্ষা করেছে। ‘একি আপনি এখনও রয়েছেন!’ পারুল অবাক হওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু চেষ্টাটা দেখাবার জন্য হেসেও ছিল। ‘তেল পেলে?’ ‘হ্যাঁ।’ পারুল হাঁটতে শুরু করল। সে বাইকে স্টার্ট দিল। ওর পাশে বাইকটাকে এনে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘ওটা দাও…দাও বলছি।’ প্রায় কেড়ে নিয়েই জারিকেনটাকে সে পেট্রল ট্যাঙ্কের ওপর রেখে হুকুমের সুরে বলে ‘উঠে পড়ো।’ পারুল তখন একবার মাত্র তার বড়ো বড়ো চোখের পূর্ণ চাহনি তার চোখে রেখেছিল। কী কথা ছিল ওই চাহনিতে? তার মনের মধ্যে একঝলক ঠান্ডা হাওয়া খেলে গেছিল। রাতের গ্লানি যতটুকু ছিল সেটা বেরিয়ে গিয়ে সে মুহূর্তে হালকা হয়ে উঠেছিল।

পারুল বাইকের পিছনে উঠে বসে। ‘এটা এবার কোলে নিয়ে একহাতে ধরে থাকো।’ অন্য হাতটা কীভাবে রাখবে সেটা আর সে বলেনি। পারুলের ডান হাত আলতো ভাবে তার কোমরে বেড় দিল। ডান দিকে তাদের বাড়ি যাবার রাস্তা, সে বাঁ দিকে বাইক ঘোরাল। পারুল অস্ফুটে কিছু একটা বলল। সেই গর্ভভরা ভাঙা রাস্তায় গতি বাড়াতেই পারুলের হাতের বেড় শক্ত হয়ে কোমর আঁকড়ে ধরল। রাস্তা দিয়ে অল্পস্বল্প লোক চলেছে, তারা কৌতূহলে তাকাচ্ছে। গ্রামের রাস্তায় এমন দৃশ্য সাইকেলে দেখলেও, মোটরবাইকের পিছনে মেয়েমানুষ তারা দেখেনি।

‘এবার ফিরুন, ঘরে ছেলেটা একা রয়েছে।’ সাত—আট মাস আগে পারুলের একটা ছেলে হয়েছে। ‘একা রয়েছে?’ ‘একটা বুড়িকে রেখেছি, বাসন মাজে, ছেলে দ্যাখে। …আর নয় ফিরুন।’ ‘শখ মিটে গেল?’ পারুল উত্তর দেয়নি। সে বাইক ঘোরাল। বাঁ দিকে একটা পুকুর আর বিশাল একটা অশ্বত্থ গাছ। ডান দিকে আমন ফসলের জন্য জমিতে লাঙল দিচ্ছিল এক চাষি। ‘এই জায়গাটার নাম কী?’ ‘বোধহয় রাইহাটা…আমি কখনো এতদূর আসিনি।’

রাস্তা থেকে একটা পুকুর, আমবাগান আর বাঁশবাগান, আর একটা বড়ো সবজি খেত পেরিয়ে শ্রীগোপালের খড়ের চালের ঘর, উঠোন, খামারবাড়িটা। দোতলায় পুবের জানালা দিয়ে উঠোন, খড়ের ঘরটা, সরু রাস্তার খানিকটা দেখা যায়, আমগাছ আর বাঁশ, তারপর আর কিছু দেখতে দেয় না। তার ভালো লাগে জানালাটায় দাঁড়াতে। কলকাতায় চোখ আটকে যায় একশো—দেড়শো মিটার পর্যন্ত দৃষ্টি গিয়েই। ফিকে হয়ে যাওয়া রঙ, নোংরা কালো রাস্তা, দুর্গন্ধ, পলেস্তারা ভাঙা দেওয়াল, রঙচটা দরজা জানালা, অবিরাম শব্দ, আঁস্তাকুড়,…কেমন যেন অবসন্ন করে দেয় চেতনা। এই জানালা থেকে সবুজ গাছের পাতা আর আকাশ দেখতে তার ক্লান্তি আসে না। বিশাল বিশাল আমগাছগুলোর অর্ধেকই তার বাবার আমলে নন্দকাকা বসিয়ে ছিল, ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলি, বোম্বাই। বাকিগুলো আগেই ছিল। অন্তত দশ মিটার দূরত্বে এক—একটা গাছ, গাছতলা পরিষ্কার, পুকুরের দিকে একটু ফাঁকা জমি, ছোটোবেলায় স্কুলের সহপাঠীদের এনে পিকনিক করে গেছে ওখানে।

উঠোনে নেমে পড়ে পারুল। ষাট—বাষট্টি বছরের, মাথায় চুল ছেলেদের মতো করে কাটা, শীর্ণ ছোটোখাটো চেহারার এক বুড়ি পারুলের ছেলেকে কোলে নিয়ে দাওয়ায় বসে ছিল। ‘এত দেরি করলে বউ।’ পারুল জারিকেনটা দাওয়ায় রেখে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। একটা বছর ছয়—সাতেকের মেয়ে, খালি গা, নোংরা চুল, নাকের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে বাইকটাকে ম্যাজিক দেখার মতো অবাক হয়ে দেখছে। ‘মামি, তুমি এটায় চড়ে এলে?’

‘মলম—টলম কিছু আছে, কাঁধটা জ্বালা করছে।’ পারুল ঘর থেকে একটা দোমড়ানো টিউব এনে বলল, ‘অনেক দিনের, টিপেটুপে বেরোয় কিনা দেখুন!’ প্রায় নিঃশেষিত টিউবটা দেখে সে বলেছিল, ‘কাজ চালাবার মতো বোধহয় পাওয়া যাবে… তুমি লাগিয়ে দেবে?’ বুড়ির হাতে ছেলেকে দিয়ে পারুল বলল, ‘খুলুন।’ সে পাঞ্জাবি, গেঞ্জি খুলে পিছন ফিরে দাঁড়ায়। টিউব থেকে পারুল আঙুলের ডগায় সামান্যই মলম পেল। ‘ইসস গত্তো হয়ে গেছে… গরম জলে ধুয়ে দোব? রক্ত জমে গেছে।’ ‘দরকার নেই, এমনিই লাগিয়ে দাও।’ পারুলের আঙুল কাঁধ থেকে কানের নীচে আলতোভাবে অনেকটা জায়গা নিয়ে ঘেরাফেরা করেছিল। ‘আপনার তিলটা আর বাড়েনি তো!’ ‘কোথায় তিল!’ ‘এই তো’ পারুল তার ডান বগলের পিছনে আঙুল ঠেকাল, ‘মানুষ বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে তিলও তো বড়ো হয়!’ ‘তুমি আগে এটা দেখছ?’ পারুল উত্তর দেয়নি।’ আংটিটা তোমায় পরতে দেখি না তো।’ ‘এখানে পরে কাকে দেখাব?’ দেখাবার মতো কে আছে?’ ‘কেন শ্রীগোপাল তো আছে।’ পারুল উত্তর দেয়নি। …আপনি কিছু খাবেন?’ ‘একেবারে ভাত খেয়ে ঘুম দেব… শুধু ঝোল—ভাল, রাতেও কিন্তু খাব।’

সে বাইকের সাইড ব্যাগ থেকে সন্দেশের বাক্স আর খবরের কাগজ মোড়া হুইস্কির বোতল বার করল। ‘এটা তোমার আর এটা শ্রীগোপালের, তবে এটা এখন আমার কাছে থাকবে।’ বাক্সের গায়ে ছাপা নামটা পড়ে পারুল খুশি হয়ে বলেছিল, ‘অন্নদার মিষ্টি!’ বাক্স খুলে একটা গুজিয়া মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, ‘এ হল বুলি, বুড়ির নাতনি। মা নেই, বাপ আবার বিয়ে করেছে, দিদিমার সঙ্গে আমার এখানেই থাকে। একেবারে হাবাগবা, কোনো বোধবুদ্ধি নেই।’ ‘বয়স বাড়লেই বুদ্ধি বাড়বে, ও তো পিঠের তিল নয়। …আমি ওপরে যাচ্ছি। শ্রীগোপাল গেছে কোথায়?’ ‘ব্যবসার কাজে। ভোরেই খবর পেল দশ হাজার টাকার মাল পুলিশে ধরেছে, তাই ছুটেছে।’ সে অবাক হয়েই বলল, ‘দ—শ—হা—জা—র! তাহলে শ্রীগোপাল তো এখন বড়োলোক। ‘হ্যাঁ, রাতে ঘুমোতে পারে না।’

শ্রীগোপালের কাছ থেকেই সে মাসছয়েক আগে শুনেছিল, চোরাচালানের কারবারে নেমেছে। বিদেশ থেকে বাংলাদেশে যেসব রেডিমেড পোশাক সাহায্য বাবদ পাঠানো হয়েছে, সেগুলোই সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসছে ভারতে। কলকাতায় চৌরঙ্গির ফুটপাথে সে দেখেছে স্তূপ হয়ে রয়েছে ফুলপ্যান্ট, গুদামে পচা অবিক্রিত সিন্থেটিক কাপড়ের আনকোরা জিনিস। পঁয়ত্রিশ—চল্লিশ টাকায় এত ভালো ভালো প্যান্ট বিক্রি হতে দেখে সে তাজ্জব হয়ে গেছিল।

‘চান করব। পরার মতো কিছু দিতে পার, শ্রীগোপালের লুঙ্গিটুঙ্গি যদি থাকে—’। ‘মলমটা মিছিমিছিই লাগালেন জলে তো ধুয়ে যাবে।’ পারুলের গলায় নরম বকুনি ছিল। ‘আর একবার নয় লাগিয়ে দিয়ো।’ পারুল ঘর থেকে একটা পাট করা সবুজ তাঁতের শাড়ি এনে বলল, ‘লুঙ্গি পরতে হবে না, বাসি নোংরা হয়ে আছে।’ শাড়িটায় বাক্সে তুলে রাখার গন্ধ। ‘তোমার শাড়ি পরতে হবে?’ ‘অন্যের বউয়ের শাড়ি পরতে হবে বলে কি লজ্জা করছে?’ ‘তা একটু করছে।’

ইঁদারা থেকে বালতিতে জল তুলে মাথায় ঢালার সময় তার মনে হয়েছিল, এমন হালকা কথাবার্তা বিবির সঙ্গে কখনো বলার সুযোগ তার হয়নি, তার সঙ্গে কেউ বলেওনি। পারুল তাকে সূক্ষ্মভাবে আশকারা না দিলে সে বোধহয় এমন ঠাট্টা—তামাশার স্তরে নিজেকে নিয়ে আসতে পারত না। এজন্য বিবি কি কৃতিত্ব দাবি করতে পারে না? কাল রাতে ওর মুখে ঘুষি মারতে ইচ্ছে করেছিল… ‘ওদের ঘুম যেন না ভাঙে’ শ্রীনাথই বলেছিল, ‘তোর বউয়ের খুব পার্সোনালিটি আছে, গ্র্যাভিটি নিয়ে চলে।’ কে যেন পিছনে দাঁড়িয়ে। মাথায় জল ঢালা বন্ধ রেখে সে পিছনে তাকায়। বুলি দাঁড়িয়ে। ‘কি চাই এখানে?’ ‘মামি বলল, তোমার পাজামাটা এখানেই রেখে যেয়ো, কেচে দেবে।’ ‘আচ্ছা, এখন পালা।’

ঘরে আয়না নেই, তাহলে সে দেখত শাড়ি কোমরে জড়িয়ে তাকে কেমন দেখাচ্ছে, জীবনে এই প্রথম। তাও এমন একজনের, যাকে দেখে বছর পনেরো আগেও সে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে! বাড়ি থেকে চিরুনি আনার কথাটা মনে ছিল না। সে জানালায় এসে শ্রীগোপালের ঘরের দাওয়ার দিকে তাকাল। পারুল থালা থেকে কাটা আনাজ তেলের কড়াইয়ে ঢালছে মুখটা পাশে ঘুরিয়ে রেখে। তার মনে হল পারুলের চোখ যেন জানালার দিকে। পাঞ্জাবিটা গায়ে দিয়ে নীচে নেমে এসে সে চিরুনি চাইল। পারুল চিরুনি দেওয়ার সময় বলে, ‘এখন কিন্তু আমি রান্নার হাতে মলম লাগাতে পারব না।’ সে জানে পারুলকে বললেই মলম লাগিয়ে দেবে তবে দু—বার অনুরোধ করার পর। উঠোনের একদিকে মাচায় দুটো কুমড়ো ঝুলছে। ‘কুমড়ো গাছ তুমি করেছ নাকি?’ ‘তা নয়তো কে করবে?’ এটা কী গাছ লাগিয়েছ, কাঁঠাল?’ ‘হ্যাঁ, দিন দশেক আগে। আমার খুব ভালো লাগে খাজা কাঁঠাল, মুড়ি দিয়ে খেয়েছেন?’ ‘খেয়েছি দারুণ…, হোক, এসে খেয়ে যাব।’

দাওয়ার পা ঝুলিয়ে বসে সে বলল, ‘শ্রীগোপাল চাষবাস ঠিকমতো দেখে তো? নাকি নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত?’ চাষ তো বলতে গেলে অনেকটা আমিই দেখি।’ ‘তুমি!’ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল পারুলের মুখের চাপা গর্ব আর চোখের অস্ফুট হাসির দিকে। ‘না পারার কী আছে, আমাকে তো আর জমিতে নেমে কাজ করতে হয় না। ফুরোনে কাজ, ঠিকমতো কাজটা হচ্ছে কি না তদারকি করা। সার—টার কিনে আনা, সেচের জলের ব্যবস্থা, টেসকো দেওয়া সেসব ও করে। বাগান, পুকুর জমা দেওয়ার কথাবার্তাও আমি শুনে শুনে শিখে গেছি। তবে ছেলেটা হবার পর জমির দিকে আর তেমন যেতে পারি না। …সাহস করে এগোলে সবই করা যায়।’ তার কানে ‘সাহস করে এগোলে’ ফাঁকা কথা মনে হল না।

শ্রীগোপাল দুপুরেও ফেরেনি। সে একাই ভাত খেয়ে ঘরে ফিরল। জানালা দিয়ে চোখে পড়ল তার পাজামাটা, পারুল দড়িতে মেলে দিচ্ছে। তক্তপোশে পাতলা তোশকের উপর হ্যান্ডলুমের বেডকভার, শক্ত একটা বালিশ। সে শোওয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। পশ্চিম থেকে বিকেল শেষের রোদ—বৃষ্টি ধোওয়া গাছের পাতাগুলোকে ঝলসানো সবুজ করে তুলেছিল। ভিজে মাটি আর ঝোপঝাড় থেকে একটা গন্ধ তার ঘুম ভাঙা মস্তিষ্কের কোষগুলো সতেজতায় ভরিয়ে দেওয়ার কাজ শুরু করেছে। দু—হাত তুলে হাতের আঙুলের ডগা ধীরে ধীরে সে পায়ের পাতায় ঠেকাবার চেষ্টা করল হাঁটু না ভেঙে। সফল হতেই সে আমেজ বোধ করল। পিঠ, কোমর, বাহু, ঊরুর ভারী পেশিগুলোতে টান পড়ার ব্যায়াম কয়েক মিনিট করার পর ধীরে ধীরে একটা চমৎকার হালকা প্রফুল্লতা তার শরীর আর মন ছেয়ে এল। একেই বলে স্বাস্থ্য। এই সময় তার চোখে পড়ল কাঠের ছোটো টেবিলে রাখা কাগজে মোড়া বোতলটা। শ্রীগোপাল এতক্ষণে এসে গেছে কি? সে জানালায় দাঁড়াল। বৃষ্টি নামতেই কাপড়চোপড়গুলো দড়ি থেকে বোধ হয় তুলে রেখেছিল পারুল, এখন সেগুলো মেলছে। দুপুরে নিশ্চয় ঘুমোয়নি। উঠোনে হালকা হলুদ রোদের আভার মাধ্যে সে অন্য এক পারুলকে দেখল, যে বৃষ্টিভেজা এই বিকেল, মাটির গন্ধ, গাছের সবুজ, মেঘলা আকাশের আর প্রবল নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে সূর্যকিরণের মতো একাকার। তার শরীরে রোমাঞ্চ লাগল।

বুলি রঙিন ফ্রক পরেছে, তাকে ডেকে পারুল কিছু বলল। মেয়েটা ছুটে আসছে, সিঁড়িতে পায়ের ধুপধুপ শব্দ হল, ‘মামি বলল তুমি চা খাবে?’ ‘খাব।’ …চট করে বড়ো একটা জায়গায় খাবার জল আর একটা গ্লাস আগে নিয়ে আয়।’ ‘বড়ো জায়গা… কলসীতে?’ সে হেসে ফেলে বলেছিল, ‘হ্যাঁ।’ সে বোতলে জড়ানো কাগজ মুঠোয় দুমড়ে ঘরের একধারে ফেলে দিয়ে ছিপির প্যাঁচ এক মোচড়ে খুলে মদের গন্ধ শুঁকতে নাকের কাছে ধরল। তার ভালো লাগল। টুলটা ছাদে নিয়ে গিয়ে ওখানে বসে খেলে কেমন হয়? সে ছাদে এসে দেখল বহু বছরের আবর্জনা, গাছের শুকনো পাতা, কাগজ, গাছের ডালের টুকরো আর ধুলো, বৃষ্টির জলে লেপটে রয়েছে। এতবার এসেছে অথচ ছাদটাকে কখনো সে নজরই করেনি। ছাদটা পরিষ্কার রাখার দায় শ্রীগোপালের, কিছুই দেখে না।

মাথায় কাচের গ্লাস বসানো একটা স্টিলের জাগ দু—হাতে আঁকড়ে বুলি এল। জাগটা ঝকঝকে, এখনও গায়ে টিকিট সাঁটা, আজই বোধহয় প্রথম ব্যবহার হচ্ছে। মেয়েটা দাঁড়িয়ে তার জল খাওয়া দেখল। ‘মামা এসেছে?’ ‘না।’ ‘মামি কী করছে?’ ‘কাপড় পরছে।’ ‘চা আনতে পারবি?’ একটু ভেবে বলল, ‘না।’ ‘তুই এবার যা।’ অনেকদিন আগে এই জানালা থেকে চেঁচিয়ে শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘গ্লাস দিয়ে যাও।’ পারুল দুটো স্টিলের গ্লাস নিয়ে আসে। হতাশ স্বরে শ্রীগোপাল বলে ‘কি বুদ্ধি! এই গ্লাসে কেউ মদ খায় না, জল খায়। কাচের গ্লাস আনো।’ পারুল কাচের গ্লাস পাঠিয়েছে, ও তাহলে জানে সে এখন কী খাবে। নাকি তাকে খুঁচিয়ে দিল খাবার জন্য!

বোতল থেকে সে গ্লাসে হুইস্কি ঢেলে অল্প জল মিশিয়ে চুমুক দিল। কড়া হয়ে গেছে। আর একটু জল দেবে কি না ভাবল, ইতস্তত করে জল দিল না। সে তাড়াতাড়ি গ্লাস শেষ করে আবার ঢালল, অল্প জল দিল, এবারও তাড়াতাড়ি শেষ করে খাটে বসল। সে টের পাচ্ছিল তার ভিতরে কিছু একটা ঘটে চলেছে। একটা অস্থিরতা বুক থেকে নীচে নেমে যাচ্ছে, চোখ ঝাঁ ঝাঁ করছে। তাড়াতাড়ি নেশা হবে বলে শ্রীগোপাল এইভাবে খায়। সে কী তাহলে শ্রীগোপাল হয়ে গেল…ঘোড়ামুখো…করাপ্ট। সে জাগটা মুখে তুলে ঢকঢক করে জল খেয়ে খাটে বসল। মুখ ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে তাকাল। ঘোলাটে আকাশ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। শান্তভাবে আকাশটা অপেক্ষা করছে দিনের মৃত্যুর। রাতে হয়তো বৃষ্টি নামবে। সে চমকে দরজার দিকে তাকাল, পারুল!

ওর মুখের দিকে তাকিয়েই তার চোখ স্থির হয়ে গেছিল। প্রকৃতির মধ্য থেকে যেন বেরিয়ে এসেছে এই পারুল। দু—পাট করে টানটান আঁচড়ানো চুলের মাঝখানে সরু সিঁথিতে সিঁদুর, আলতো একটা খোঁপা ঘাড়ের উপর, কপালের ঠিক মাঝে বড়ো একটা লাল রঙের টিপ, পরনে সেই মুর্শিদাবাদী সিল্কের চওড়া পাড় সোনালি বুটি দেওয়া লাল শাড়ি, ওই কাপড়েরই ব্লাউজ, মুখটা তেলতেলে, খুব সূক্ষ্ম কাজল। পারুল সেজেছে। এক হাতে পিরিচে ঢাকা চায়ের কাপ, অন্য হাতে তার পাজামাটা। ‘শুরু করে দিয়েছেন….চা খাবেন না?’ সে শুধু স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছিল। উত্তরে ছাদের দরজা দিয়ে দুর্বলভাবে আলো আসছে, পুবের জানালার চৌকো এক খণ্ড ঘোলাটে আলো, পারুল সামনের টেবিলে চায়ের কাপ রাখতে এগিয়ে এল। হালকা একটা মিষ্টি গন্ধ ওর শরীর থেকে সে পেল। কাপটা বাঁ হাতে তুলে তার দিকে এগিয়ে ধরে পারুল বলেছিল, ‘কষ্ট করে করলুম আর….।’

সে তাকিয়েছিল পারুলের আঙুলে আংটিটার দিকে। ‘সত্যিই চমৎকার দেখাচ্ছে।’ ‘কী চমৎকার?’ সে কাপটা হাতে নিয়ে টেবিলে রেখে পারুলের বাঁ হাত তুলে নিল। মাথা ঝুঁকিয়ে আংটির উপর আলতো চুম্বন করল। পারুল হাতটা টেনে নিয়ে দু—পা পিছিয়ে যেতেই সে উঠে দাঁড়াল। ঘরে এখনও যা আলো রয়েছে তাতে সে দেখতে পাচ্ছে পারুলের চোখ। বড়ো বড়ো চোখ দুটোয় ভয় নেই, বকুনি নেই। ‘তোমার সব শখ কি মিটেছে…পারুল?’ সে উত্তর পেল না। তখনই সে দু—হাতে কাঁধ ধরে পারুলকে বুকে টেনে নিয়ে ছিল। একটা কোমল ‘নাহহ’ ছাড়া আর কোনো প্রতিরোধ সে পেল না। উন্মাদের মতো সে চুম্বন করেছিল, পিষে দিচ্ছিল ওষ্ঠপুট। পাতলা সিল্কের উপর দিয়ে ছোটাছুটি করা তার করতল অনুভব করছিল পারুলের শরীর ধকধক করছে তার মোটরবাইকের ইঞ্জিনের মতো গরম, ঊর্ধ্বশ্বাসে বেরোবার জন্য প্রস্তুত। তার কাঁধে বসে যাচ্ছে পারুলের আঙুল, জ্বালা করছে জায়গাটা, এই সুখের অনুভূতিটা সে চেয়েছে বিবির কাছে…

শিক্ষা, রুচি, পার্সোনালিটি….ঝিয়ের মেয়ে, শ্রীগোপালের বউ…চুলোয় যাক…পারুলকে টেনে তক্তপোশের উপর ফেলে দিয়ে সে ওর বুকের উপর নিজেকে নামিয়ে দিয়েছিল। ‘ছাড়ুন’, ‘না’, ‘ছাড়ুন বলছি’, ‘না’। সে টের পাচ্ছিল তার দেহের নীচে শক্ত শরীরটা আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে যাচ্ছে, দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ঊরুর পেশি। ‘আমায় দেখে মুখ ঘুরিয়ে চলে যেতেন’, ফিসফিস করে পারুল বলেছিল ‘…মনে আছে?’ ‘আছে…সে ছিল অন্য মেয়ে।’ এরপরই সে টান দিয়ে শাড়িটা পারুলের ঊরুর উপরে তুলে দেয়।

‘মামি…’ ছিটকে দুজনে উঠে দাঁড়ায়। আঁধার ঢুকে পড়েছে ঘরে। দরজায় একটা ছায়া, বাইরে পাখিদের অবিশ্রান্ত কিচিরমিচির। ‘কি চাই তোর?’ পারুল ভাঙা গলায় ধমক দিয়েছিল দরজায় দাঁড়ানো বাচ্চচা মেয়েটাকে। ‘মামা এয়েচে, তোমার ডাকচে।’

তার মুখ তখন পুবের জানালাটার দিকে ঘুরে যায়। উঠোন থেকে চিৎকার করছে শ্রীগোপাল, ‘পারুল…পারুল।’

আট

‘তারপর আসামি আপনার দিকে এগিয়ে এসে কী করল?’

‘আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে ঘরের খাটে নিয়ে ফেলল।’

‘আপনি বাধা দেননি?…চেঁচাননি?’

‘ডান হাতটা আটকা ছিল বগলের নীচে, বাঁ হাতে কোনোরকমে ওর ডান কাঁধটা খামচে ধরি। …গলা দিয়ে তখন স্বর বেরোচ্ছিল না।’

‘খামচে ধরা ছাড়া আর কী করেছিলেন বাধা দেবার জন্য?’

‘ও তখন আমার বাঁ হাতটা মুচড়ে ধরে।’

‘হাসপাতালে মেডিক্যাল পরীক্ষার সময় ডাক্তারকে সে কথা বলেছিলেন?’

‘হ্যাঁ।’

ডাক্তারকে সে বলেছিল ‘এটা জোয়ালের ধাক্কাতেই।’ ডাক্তার টর্চ জ্বেলে মন দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন…ডাক্তারবাবু আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, রিপোর্টে লিখেছিলেন ইনজুরিটা ভারী কিছুর ধাক্কা লাগার জন্য। উকিল আর পুলিশের শেখানো কথা পারুল কোর্টে দাঁড়িয়ে অম্লানবদনে বলেছিল। সে তখন স্তম্ভিত হয়ে দেখছিল শুধু আর—একটা পারুলকে, যাকে সে কোনোদিনই দেখেনি।

এইখানেই সে মোটরবাইকে বসে বলেছিল ‘উঠে পড়ো।’ খালপাড় থেকে খামারবাড়ির লালমাটি ফেলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে সে দেখল বাঁশ আর আমবাগানটা একইরকম রয়েছে। পুকুরে কতকগুলো হাঁস, ঘাটলায় বসে ছিপ হাতে একটি লোক, তার পিছনে দাঁড়িয়ে হাফপ্যান্ট পরা শার্ট গায়ে রুগণ একটি ছেলে। তাকে দেখতে পেয়েছে ছেলেটা, পুকুরের ধার দিয়ে এগিয়ে আসছে। ছেলেটা ল্যাংচাচ্ছে বোধহয় পোলিয়ো।

‘কাকে খুঁজছেন?’

‘পারুল বিশ্বাসকে।’

‘কলকাতা থেকে আসচেন…মালিকের লোক?’

‘হ্যাঁ।’

‘এখানে থাকবেন বলে?’

‘হ্যাঁ। তুমি চেনো পারুল বিশ্বাসকে?’

‘আমার মা হয়…এই রাস্তা ধরে সোজা গেলেই আমাদের ঘর। …মা বলেছিল একজন কলকাতা থেকে আসবে, এখানে থাকবে।’

ছেলেটার মুখ দেখেই তার আন্দাজ করা উচিত ছিল। শ্রীগোপালের মতোই লম্বাটে, সামনের দুটো দাঁতও হয়েছে বাবার মতো। চোখদুটোয় সারল্য, কম বুদ্ধির ছাপ, কথা বলতে চায় লোকের সঙ্গে। বাঁ পা শুকিয়ে লাঠির মতো সরু। সে খুব ধীরে হাঁটতে শুরু করল, ছেলেটা তার সঙ্গ নিয়েছে।

‘লোকটা কীরকম দেখতে সে কথা মা বলেনি?’

‘বলেচে খুব লম্বা চওড়া, সাহেবদের মতো রঙ আর কটা চোখ।’

‘নাম বলেছে?’

‘না। …আপনার নাম কী?’

প্রশ্নটাকে গ্রাহ্যে না এনে বলল, ‘আমায় দেখে চিনতে পেরেছ?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোমার নাম কী?’

‘শ্রীমন্ত…মন্তা।’ ছেলেটা মুখ তুলে তাকাল। দাঁত দুটো বেরিয়ে এসেছে। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনে তাকাল। এখন বিকেলের মাঝামাঝি, আকাশের আলোয় এখনও টান পড়েনি। খামারবাড়ির দোতলার জানালাটা দেখা যাচ্ছে। একটা কাঁঠাল গাছ, তার পিছনে খড়ে—ছাওয়া একটা ঘর। ঘরের পিছনে ঢালু একটা নীচু খড়ের চালা, ঢুকতে গেলে কুঁজো হতে হবে। নিশ্চয়ই গোয়াল।

‘পুকুরে হাঁস দেখলাম, কার?’

‘আমাদের, এগারোটা ছিল, এখন ন—টা। শ্যালে দুটো নিয়েছে।’

‘তুমি স্কুলে পড়ো?’

‘পড়ি…অঘোরনাথ প্রাথমিক বিদ্যালয়, কেলাস ফোর। বড়ো ইস্কুল সেই রথতলায় থানার পিছনে, আমার এই পা নিয়ে অতদূর যাব কী করে…এখানে ইস্কুল খুলতেই ভরতি হয়েছি।’ ছেলেটা হাসল। সরল বোকামিভরা হাসি। ওর বয়স এখন প্রায় সতেরো।

মন্তার উচ্চচারণে কলকাতার ছাপ, বোধহয় মায়ের সঙ্গেই সময়টা বেশি কাটে। পায়ের জন্য খেলাধুলা সম্ভব নয়, বন্ধুবান্ধব নিশ্চয় বেশি নেই। আমবাগানের পাশেই সবজির জমি, সেই জমির অর্ধেকটায় ধান লাগানো হয়েছে। ধানের মাথাগুলো সতেজ স্থির। চোখ জুড়ানো সবুজ। অথচ এখানে ছিল সরষে খেত, কলার বাগান, বেগুন, মুলো, টোমাটোর চাষও হত। পারুল চাষ বদলে দিয়েছে।

কাঁঠাল গাছটার বয়স সে জানে। ষোলো বছর দু মাস দশ দিন। একটা কালো গোরু গাছতলায়। দাওয়ায় পা ঝুলিয়ে বসে দুটি লোক পরনে রঙিন বুশশার্ট, ধুতি। পিছন ফিরে দাওয়ায় ওঠার সিঁড়ির ধাপে বসে এক স্ত্রীলোক, তিনজনে কথা বলছে।

‘মা।’ মন্তা চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই দ্যাখো।’

স্ত্রীলোকটি মুখ ফিরিয়েই পিঠের উপর কাপড় টেনে দিয়ে উঠে দাঁড়াল, মাথায় তুলে দিল ঘোমটা। সে থমকে পড়ল অবাক চোখে। এই কি পারুল…এ কী চেহারা হয়েছে! একেই বোধহয় বলে দশাসই। গলায় ঘাড়ে চর্বি, মুখটা বড়ো দেখাচ্ছে, আঁচলে ঢাকা থাকলেও বোঝা যায় স্তনদুটো ঝুলে রয়েছে, কোমরের পরিধি দ্বিগুণ, দুটো হাত মসৃণ গোল, তলপেটে একটা ঢিবি। পরনে লাল ব্লাউজ, তুঁতে রঙের শাড়ি।

তার দিকে একপালক তাকিয়েই পারুল ঘরের মধ্যে চলে গেল। যাওয়াটা ওর দেহের ওজনের সঙ্গে একদমই খাপ খেল না, গতি আগের মতোই দ্রুত রয়ে গেছে। লোক দুটি তার দিকে তাকিয়ে। দেখে মনে হল চাষবাস করে, বয়স কম। পারুল ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ‘মস্তা এই নে চাবি, দোতলার ঘরটা খুলে দিয়ায়। …রাতে ভাত দিয়ে আসবে। টেবিলে হারিকেন দেশলাই আছে, কলসিতে জল ভরা আছে।’ শেষের কথাগুলো তাকে উদ্দেশ করে বলা। গলাটা একটু খরখরে এবং ভারী।

পারুল তার অবাক চাহনিটা নিশ্চয় লক্ষ করেছে, তাই মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। শরীরটা যে আগের মতো নেই, সেটা নিশ্চয় জানে। এজন্যই কি মুখ লুকোতে চাইছে, নাকি কোর্টে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলার জন্য কিংবা স্বামীর খুনির প্রতি ঘৃণায়? সে মন্তার পিছনে খামারবাড়ির দিকে এগোল। একতলার বড়ো ঘরের কাঠের দরজাটা নেই, সেই জায়গায় বাঁশ আর চ্যাটাইয়ের একটা ঝাঁপ হেলান দিয়ে রাখা। মোটরবাইকটা এই ঘরে রাখা ছিল। এখনও রয়েছে কি? সে ঝাপের ফাঁক দিয়ে ভিতরে তাকাল। উত্তর দিকের দেওয়াল ভাঙা, জানালাটাও নেই। ঘরের অর্ধেকটা খড়ে বোঝাই, ধানের কয়েকটা বস্তা, ধান ঝাড়াইয়ের কাঠের পাটা…বাইকটা সে দেখতে পেল না।

‘এখানে একটা মোটরবাইক ছিল না?’

মন্তার চোখ বড়ো হয়ে উঠল, ‘ভটভটিয়াটা?…সে তো চোরেরা ওই জানালা ভেঙে খুলে নিয়ে গেছে…দুটো চাকা, আলোটা, বসার সিটটা। …ওটা কার ছিল জানেন?’

‘না।’

তারা দোতলায় পৌঁছে গেছে। মন্তা তালা খুলছে, সে ডান দিকে ছাদের দিকে তাকাল। ছাদটা পরিষ্কার করা হয়েছে। মন্তা ঘরে ঢুকে বলল, ‘আজ সকালে মা পরিষ্কার করিয়েছে বুলিদিকে দিয়ে।’

বুলিদি! নামটা তার কানে ঘটাং করে উঠল। এই দরজাটায় দাঁড়িয়ে মেয়েটা ‘মামি’ বলে ডেকে উঠেছিল। ছ—সাত বছরের রোগা কালো মেয়ে। না ডাকলে কী ঘটে যেত! সেই তক্তপোশ, টেবিল, ছোটো টুল সবই রয়েছে। টেবিলের উপর রাখা একটা ছোটো সুটকেশ, হেমন্তর হাত দিয়ে পাঠানো। সে এগিয়ে গিয়ে পুবের জানালাটার ছিটকিনি তুলে পাল্লা দুটোয় ধাক্কা দিল।

দাওয়ায় লোকদুটো বসে, সিঁড়ির ধাপে পারুল। জানালায় সে দাঁড়াতেই পারুল কথা বলতে বলতেই শাড়িটা কাঁধের উপর টেনে বিছিয়ে দিল। সে সরে এল জানালা থেকে।

‘বুলিদি কে?’

‘আমাদের কাজ করে। গোরু—হাঁস দেখে, মা—র সঙ্গে বাজারে যায়, কাপড় কেচে দেয়…খুব গরিব, আরও একটা বাড়িতে কাজ করে।’

‘বিয়ে হয়ে গেছে?’

‘কব্বে। দুটো ছেলে আছে, ওর বর ওকে ফেলে চলে গেছে কোথায়।’

বুলির বয়স এখন তেইশ—চব্বিশ হবে। নতুন কলসির ওপরে মাটির সরা, তার উপরে কাচের গ্লাস। তোশক, চাদর, বালিশ নতুন, হ্যরিকেনটাও।

‘এসব কিনল কে?’

‘কলকাতা থেকে হেমন্ত বলে একটা লোক পরশু এসেছিল। রথতলা থেকে ভ্যানরিকশায় করে কিনে এনেচে। …আপনি এখানে কতদিন থাকবেন?’ মন্তা টুলের উপর বসল। ওর মুখের দিকে সে চোখ কুঁচকে তাকাল। প্রশ্নটা সে নিজেকেও করেছে এই ঘরে পা রেখেই।

‘বলতে পারছি না…হয়তো সারাজীবন।’

‘সারাজীবন!’ মন্তা অবিশ্বাস করতেই পারে। কলকাতা থেকে একটা লোক এখানে কেন সারাজীবন কাটাতে আসবে? ‘কী করবেন?’

প্রশ্নটা বাসে আসার সময় তার মনেও উঠেছিল। তখন মনে পড়েছিল বাবার কথাগুলো, ‘তোর স্বাস্থ্য আছে, খাটবার ক্ষমতা আছে, তুই কেন বসা কাজ করবি? চাষবাস ভালোভাবে করতে পারলে তাতে অনেক পয়সা, মাটি হল সোনা। ….আমি তোকে জমি আর কিছু টাকা দিয়ে গেলাম এবার তুই যা করার কর।’ বাবা তখন জানত না তার ষোলোটা বছর কীভাবে নষ্ট হবে, সে সর্বস্বান্ত হবে।

‘ভাবতে হবে কী করা যায়। …তুমিই বল তো কী করা যায়?’

মন্তার মুখে অপ্রতিভ লজ্জা ফুটে উঠল। ‘আমি কী জানি।’

‘আচ্ছা, চাষ করলে কেমন হয়?’

‘চাষ! আপনি কী করে চাষ করবেন, আপনি কি চাষি?’

‘লোক দিয়ে করাব, যেমন তোমার মা করায়।’

‘মা—র তো জমি আছে, আপনার জমি কোথায়?’

তার কথা বলতে আর ভালো লাগছে না। ক্লান্তি এবার তার শরীর থেকে মনের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। পারুল কীভাবে তার এখানে থাকাটাকে গ্রহণ করবে সেটাই তাকে আন্দাজের গর্তে ফেলে দিয়েছে। এখনও পর্যন্ত আগেকার পরিচয়ের কোনো ঝলক ওর কথায় আচরণে ফুটে ওঠেনি, তাকে বন্ধুভাবে নেয়নি। শত্রুভাবে কতটা নিয়েছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। পাঞ্জাবিটা খুলে সে সুটকেসের উপর রাখল। এখন চা পেলে ভালো লাগত। মন্তাকে কি বলবে? সে বিছানায় আলতো করে নিজেকে শুইয়ে নিয়ে চোখ বুজল।

‘মন্তা, তুমি আমার নাম জান না। আমাদের তো রোজ দেখা হবে, কী বলে তা হলে আমায় ডাকবে?’

মন্তা সমস্যায় পড়ে গেল। সম্ভবত ওর জীবনের প্রথম জটিল সমস্যা। সে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করল। বহু বছর পর এটা তার প্রথম মজা পাওয়ার হাসি। ‘আমাকে একটু চা খাওয়াবে।’

ঘর থেকে মন্তা বেরিয়ে যাবার পর সে চোখ খুলল। জানালা দিয়ে দেখল সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সে ঝুলি থেকে চার ব্যাটারির নতুন টর্চটা বার করে টেবিলে রেখে, বিছানায় ফিরে এসে আবার চোখ বন্ধ করল। বিবি বলেছিল, ‘পারুল আছে, সে তোমায় দেখবে…যাকে তুমি বিধবা করেছ….পারুলই এখন গোকুলানন্দর সব কিছু দেখছে।’

বিবি ভেবেচিন্তে ইচ্ছে করেই তাকে শাস্তিটা দিল। পারুলের মুঠোর মধ্যে তাকে তুলে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর সূক্ষ্ম কাজ ওর দ্বারাই সম্ভব। ‘খাওয়াপরার জন্য তোমাকে ভাবতে হবে না। আমাদের জমিজমার টাকা পারুলই আদায় করে, হিসেব রাখে। খরচখরচা বাদ দিয়ে যা থাকে আমাকে দিয়ে যায়। খুব সৎ মেয়ে। এবার থেকে অন্য খরচের মধ্যে তোমার খরচটাও ধরবে। তোমার যা দরকার ওর কাছ থেকে চেয়ে নেবে। তোমার খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা পারুলই করবে…আমি ওকে চিঠি লিখে দিচ্ছি।’

অনেকদূর পর্যন্ত ভেবে রেখে দিয়েছে বিবি, হয়তো জেল থেকে তার বাড়িতে পৌঁছনোর আগেই ছকে রেখেছিল। ছাব্বিশ নম্বর থেকে তাকে যুক্তিগ্রাহ্য উপায়ে তাড়ানোর বা কেউ প্রশ্ন করলে একটা স্বাভাবিক কারণ দেখানোর রাস্তাও খুলে রেখেছে… ‘গ্রামে এগ্রিকালচারাল ফার্ম করবেন বলে গেছেন।’ কেন যে সে নিজে থেকেই কথাটা বলল ‘ভেবে দেখলাম, আমি গোকুলানন্দে গিয়েই থাকব’, তা হলে বিবির ইচ্ছেটা এত তাড়াতাড়ি পূরণ হত না। পারুল গোকুলানন্দে বসবাস করছে এটা যদি সে ঘুণাক্ষরেও জানত! কী বোকামি, না জেনে কী ভুল সে করে বসল কথাটা বলে। এখন তাকে পারুলের হাত—তোলা হয়ে থাকতে হবে!

‘অসম্ভব। গোকুলানন্দে থাকতে পারি কিন্তু পারুলের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক থাকবে না…আর জমিজমা এবার থেকে আমি নিজে দেখব।’ বিবি শান্ত গলায় ধীরে ধীরে বলেছিল, ‘তা কী করে হয়? এত বছর ধরে পারুল দেখাশোনা করছে, নিয়মিত টাকা দিয়ে যাচ্ছে, পুরো কর্তৃত্ব আমিই ওকে দিয়েছি। এখন কী যুক্তিতে আমি তা কেড়ে নেব?…বাচ্চচা নিয়ে অসহায় একটা মেয়ে বিধবা হল…,’ বিবি তার মুখের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে ছিল, ‘তাকে তো আমায় দেখতে হবে।’ ‘কীজন্য তোমায় দেখতে হবে?’ ‘বিবেক…তার জন্য।’ বিবি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই গুলু, গোরা, অরুণার দৃষ্টি তার উপর এসে পড়ে। ‘যেতে হয় যেয়ো, ইচ্ছে না হলে যেয়ো না। …তবে জমিজমার উপর অধিকার পেতে হলে তোমাকে কোর্টে যেতে হবে।’ বিবি ঠান্ডা গলায় কথাটা বলে নিজের ঘরে চলে গেছিল।

তার অবস্থাটা যে কোথায় পৌঁছেছে সে তা ভাবতে পারেনি। নিজের সম্পত্তি ফিরে পাবার জন্য কোর্টের দরজায় যেতে বলল তার নিজের স্ত্রী! এর থেকে কতটা বেশি অপমান পারুল করতে পারবে? কে বলতে পারে, গোকুলানন্দে তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে? হয়তো পারুলের বিবেক ষোলো বছর ধরে আর বেঁচে নেই। চব্বিশ ঘণ্টা পরই সে বলেছিল, ‘গোকুলানন্দেই যাব।’

‘জেঠু, আপনার চা। হারিকেনটা জ্বালেননি?’

বিছানা থেকে উঠে টর্চটা তুলে নিয়ে জ্বালতেই দু—হাতে একটা কাচের গ্লাস ধরে মন্তা সাবধানে পঙ্গু পা ফেলে ঘরে ঢুকল। তাড়াতাড়ি গ্লাসটা ওর হাত থেকে নিয়ে বলল, ‘তুমি কেন এই গরম গ্লাস হাতে সিঁড়ি ভাঙতে গেলে?’

‘মা এই পর্যন্ত দিয়ে গেল।’ মন্তা দরজার দিকে মুখ ফেরাল। সে অনুমান করল গ্লাস নিয়ে দরজা পর্যন্ত ছেলেকে পৌঁছে দিয়েই পারুল নীচে নেমে গেছে। চায়ে চুমুক দিয়ে বিশ্রী একটা স্বাদ সে পেল। খুব কমদামি, নয়তো খুব বাসি চা দিয়ে তৈরি, না হলে পারুল ভালোই তো চা বানাত। সে গ্লাসটা রেখে হারিকেন জ্বালাল।

‘জেঠু’ বলতে কে বলে দিল?’

‘মা।’

শ্রীগোপাল তার থেকে বয়সে কিছু বড়ো ছিল, এটা তো পারুল জানে, তা হলে জেঠু কেন! ‘আমার চা কিংবা খাবার তুমি এভাবে আনবে না। হয় আমি নীচে গিয়ে নিয়ে আসব, নয়তো তোমার মা যেন ঘরে এসে দিয়ে যায়।’

কয়েক সেকেন্ড থেমে বলল, ‘…আমি যখন ঘরে থাকব না। বলতে পারবে?’

‘হ্যাঁ। আমি এখন যাই। মা বলে দিল যখন কিছুর দরকার হবে জানালা দিয়ে চেঁচিয়ে ‘মন্তা’ বলে ডাকতে।’

এখন থেকে এই ঘরটাই তার সংসার, বাসস্থান। যেভাবে ঘরটা রয়েছে এখন সেইভাবেই থাক, কাল সকালে বরং সুটকেস খুলে কাপড়চোপড় বার করবে, টাঙাবার জন্য একটা দড়ি দরকার। প্রায় দু—হাজার টাকা হাতে রয়েছে, কিছু কেনার দরকার আছে কিনা সেটা দু—তিনদিন না কাটলে বোঝা যাবে না। তবে রথতলায় চা—পাতার খোঁজে তাকে যেতে হবেই।

‘জেঠু…জেঠু।’ মন্তা চেঁচাচ্ছে নীচের থেকে। সে জানালায় গিয়ে দাঁড়াল। ‘মুড়ি খাবেন, তেলমাখা মুড়ি…লংকা পেঁয়াজ দিয়ে?’

‘খাব।’

ঝুলি থেকে কাগজে মোড়া হাওয়াই চটিটা বার করে সে পায়ে গলাল। পারুল উপরে মুড়ি দিতে এলে, এই নিরালা ঘরে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও, একটা দমবন্ধ করা অস্বস্তি তৈরি হবে। নির্জনে সে পারুলের চোখের দিকে তাকাতে চায় না।

দাওয়ায় বসে পারুল মুড়ি মাখছে তেল দিয়ে। মন্তা পেঁয়াজ ছাড়াচ্ছে। উনুনে হাঁড়ি বসানো, ভাতের গন্ধ ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে ছড়িয়ে পড়েছে উঠোনে। গোয়ালের পাশে হাঁসের ঘর থেকে একবার ‘প্যাঁক প্যাঁক’ ডাক উঠল। সে উঠোনে অন্ধকারের মাঝে দাঁড়িয়ে। আকাশ পাতলা মেঘের একটা জায়গা সামান্য উজ্জ্বল। ওখানে চাঁদ। আমবাগান, বাঁশঝাড়, ধানখেত একাকার একটা ছায়ার মতো । জোলো বাতাসে বৃষ্টির গুঁড়ো। সে দূরে হারিকেনের দোলা দেখতে পেল, কেউ একজন চলেছে। কতকগুলো ধাপ পেরিয়ে জীবন তাকে এই উঠোনের মাঝে দাঁড় করিয়েছে? সব কিছুর জন্য কি সে একাই দায়ী? ওই যে স্ত্রীলোকটি দাওয়ায় বসে, ছাব্বিশ সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটে যে স্ত্রীলোকটি পরীক্ষার খাতা দেখছে বা টেলিফোনে কথা বলছে, এই যে ছেলেটি, তার বাবা…।

‘কে, কে ওখানে?’ পারুল হারিকেন তুলে ধরেছে। সে এগিয়ে গেল। পারুলের চোখে ভয়।

‘আমি। মুড়ি খেতে এলাম।’

‘এভাবে কেউ দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারে?’ পারুলের স্বরে অনুযোগের ধমক। মন্তা হাসছে। বাবার মতো দাঁত বেরিয়ে এসেছে।

‘মা—র ভূতে ভয় করে…অপঘাতে মরলে মানুষ ভূত হয়, এখানে বাবার ভূত আছে।’

‘চুপ কর!’ তীক্ষ্ন গলায় পারুল ধমকে উঠল। যে অস্বস্তিতে পড়তে না চেয়ে সে দোতলা থেকে নেমে এসেছে, সেটাই এখন তার আর পারুলের মাঝে তৈরি হয়ে গেল। বিবি কি এটাই চেয়েছে?

একটা অ্যালুমিনিয়ামের ছোটো গামলায় পেঁয়াজ, লংকা আর তেলমাখা মুড়ি তুলে ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে পারুল চাপা স্বরে বলল, ‘দিয়ায়।’

মন্তা উঠে দাঁড়াবার আগেই সে গামলাটা তুলে নিল। ছোটো ছোটো লালচে মুড়ি। সঙ্গে আস্ত পেঁয়াজ, কাঁচালংকা। সে নাকের কাছে গামলাটা তুলে গন্ধ শুঁকল। আপনা থেকেই সে ‘আহহ’ বলে উঠল। একগাল মুড়ি মুখে দিয়ে পেঁয়াজ কামড়াল, দাঁতে লংকা কাটল। মা আর ছেলে তার দিকে তাকিয়ে।

‘লংকাটায় বেশ ঝাল, বাড়ির গাছের নাকি?’ জিজ্ঞাসাটা মন্তাকে উদ্দেশ করে, জবাব দিল পারুল, ‘হ্যাঁ,…মন্তা পড়া আছে না? বই নিয়ে বসবি কখন?’ কথাটা বলে পারুল ভাতের হাঁড়িতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সে পায়ে পায়ে সরে গেল অপ্রতিভ হয়ে। মুড়ি দোতলায় ঘরে বসে খাওয়া যায় কিংবা উঠোনে পায়চারি করতে করতে। সে অন্ধকার রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। একটু দূরে শরৎ বসাকের বাড়ি। ঠিক কোন বরাবর তাকালে বাড়ির আলো চোখে পড়বে বুঝতে পারছে না। সে আর একটু এগোল।

‘জেঠু, অন্ধকারে যাবেন না।’ মন্তার চিৎকার তার কানে এল। ‘মা বলছে সাপখোপ আছে।’

সে এগোল না। সাপের কামড়ে মরা মানে অপঘাতে মরা। শ্রীগোপালের সঙ্গে তা হলে সেও ভূত হয়ে এখানে রয়ে যাবে। ভূত ভূতকে দায়ের কোপ বসায় না, একসঙ্গে তাকায় তাদের কোনো অসুবিধে হবার কথা নয়। …সেদিনও কথা ছিল না যে সে পারুলকে জড়িয়ে ধরবে, চুমু খাবে, তাকে বিছানায় শুইয়ে দেবে…কথা ছিল না শ্রীগোপালের দশ হাজার টাকার মাল পুলিশে ধরবে, সেই মাল দু—হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে তার মাথায় রক্ত চড়ে যাবে, সারা দিন অভুক্ত থাকবে। তবু ঘটে গেল!

মন্তা আসছে। ওকে চলতে দেখলে কষ্ট হয়। ওর জন্য পারুলের নিশ্চয় দুর্ভাবনা রয়েছে। বিবিরও কি নেই গোরাকে নিয়ে!

‘আপনি ফিরে আসুন জেঠু, অন্ধকারে যাবেন না আর।’

‘না, যাব না। আচ্ছা মন্তা, শরৎ বসাকের বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় বলো তো? অন্ধকারে ঠাওর হচ্ছে না।’

‘ওই তো, ওই দিকটায়’ মন্তা হাত তুলে দেখাল। ‘বসাকদের বাড়ির সবাই তো মরে গেছে!’

‘সবাই মরে গেছে, মানে!’

‘একদিন রাত্তিরে ছেলেমেয়ে বউয়ের গায়ে তোশক জড়িয়ে কেরোসিন ঢেলে লোকটা আগুন ধরিয়ে দিয়ে, নিজেও গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেশলাই জ্বেলে দেয়…কেউ বাঁচেনি।’

‘কেন? সবাইকে মেরে নিজে মরল! কারণ কী?’ খবরটা তাকে অসাড় করে দিচ্ছে। এই একজনের সঙ্গেই এখানে তার পরিচয় হয়েছিল। দুটো না তিনটে ছোটো ছেলেমেয়েকে তখন সে দেখেছে। বাবা জ্যান্ত তাদের পুড়িয়ে মেরে দিল, এ কি বিশ্বাস করা যায়!

‘আমি জানি না। পুলিশ এল, কত লোককে জিজ্ঞাসা করল।’

‘বাড়িতে কে আছে এখন?’

‘তালা দেওয়া, ওদিকে কেউ যায় না। …এবার চলুন। কথা না শুনলে মা রেগে যায়।’

‘তোমার মা খুব রাগী?’

‘ভীষণ।’

শরৎ বসাকের খবর শুনে তার মনে অস্থিরতা শুরু হয়েছে। আত্মহত্যা তাকে বিমর্ষ করে দেয়, আর এটা তো নিরীহ কয়েকজনকে হত্যা করে! সে এখন কোনো কিছুতেই আর আগ্রহ বোধ করছে না। প্রায় অর্ধেক মুড়ি শেষ হয়েছে, বাকিটুকু খেতে তার ইচ্ছা করল না। ফিরে আসার সময় সে অন্ধকারে মুড়িগুলো রাস্তার পাশে ফেলে দিল মন্তার নজর এড়িয়ে।

খালি গামলাটা দাওয়ার উপর রাখার সময় সে জিজ্ঞাসা করল মন্তাকে, ‘ভাত নিতে কখন আসব?’

‘রান্না আমার প্রায় হয়ে গেছে…আমরা তাড়াতাড়ি শুই।’ পারুল উত্তর দেয়।

.

স্টেশনারি দোকানে বড়ো বড়ো কোম্পানির প্যাকেটের চা পাওয়া যাবে, কিন্তু এইসব চা তার ভালো লাগে না। খুচরো লুজ চা বিক্রি হয় এমন দোকান সে খুঁজতে শুরু করল। গন্ধ আর লিকার এই দুটোর জন্য দু—রকম চা এক—একজন দোকানদার এত ভালো মেশাতে পারে! বাবা নিজে গিয়ে মজুমদারমশায়ের দোকান থেকে মেশানো চা কিনে আনত দু পাউন্ড করে, মাসে দু—বার। বাবা মোটরেই বসে থাকত, গলায় কণ্ঠি, ফতুয়া পরা মজুমদারমশাই চায়ের ঠোঙাটা গাড়িতে দিয়ে যেত নিজে, নমস্কার করত। বাবা বলত, ‘লোকটা অদ্ভুত ব্লেন্ড করে, একসময় চা—বাগানে কাজ করত।’

কাঠের ফার্নিচারের দোকানের বাইরে টুলে বসা লোকটাকে দেখে তার মালিক বলেই মনে হল। সে এগিয়ে গেল। ‘এখানে চা—পাতার দোকান আছে?’

‘চা—পাতার?…ওই সামনে যে সারের দোকানটা দেখছেন, ওর পিছনেই পাবেন।’

‘ধন্যবাদ।’

রাস্তা পার হয়ে হার্ডওয়্যার দোকান, তার পাশে সারের দোকান, একটা সরু গলি, ঢুকে প্রথম দোকানটাই ‘চা ঘর’। পাঁচ—ছ’টা লালরঙের টিন তাতে সাদা বড়ো অক্ষরে প্রত্যেকটায় ‘চা’ লেখা। দোকানি একজন খদ্দেরের জন্য চা ওজন করছে। সে দাঁড়িয়ে থাকল। পাশের ‘বিভূতি ফার্টিলাইজারস’ সাইনবোর্ডের দোকানের সামনে সাইকেল হাতে ধুতি আর হাতা গোটানো সাদা শার্ট পরা এক বছর—চল্লিশের লোক রাস্তা থেকে চেঁচিয়ে কথা বলছে। তার কান ওই দিকেই গেল।

‘কি বলছেন আপনি! বোরো আই আর ছত্রিশ এখন অবসোলিট হয়ে যাচ্ছে। এখন সুপারফাস্ট ধান পি এন আর এসে গেছে। আমি তো এবার পাঁচ বিঘেতে পি এন আর তিনশো একাশি লাগিয়েছি।’ দোকানের ভিতর থেকে একজন কী যেন বলল। হাতে সাইকেল ধরা লোকটি প্যাডেলে একটা পা রেখে হেসে বলল, ‘তিন মাসে বিঘেতে তেইশ মণ ফলনও পেয়েছে, আমি কুড়ি মণ পাব আশা করছি। …দেখাই যাক না।’

‘আপনাকে কী দোব?’ চশমাপরা, গোলগাল, নম্রভাষী চা—দোকানি জিজ্ঞাসা করছে।

‘দার্জিলিং বড়ো পাতা, হবে?’

‘বড়ো পাতা নেই, ফ্যানিংস আছে, নব্বুই টাকা কেজি।’

‘হাফ কেজি দিন।’ সে একটু অবাক হল, রথতলায় এখন নব্বুই টাকার চা পাওয়া যায় শুনে।

‘না দাদা, ঢ্যাঁড়শ, বেগুন নয়, এবার খালধারের জমিতে কপি লাগাব, …ইস্কুল করব, চাষও দেখব অত সময় কোথা! চলি বটুকদা।’ সাইকেল হাতে ধরে লোকটি হেঁটে চলে গেল।

‘এই যে আপনার চা।’

চায়ের ঠোঙায় প্যাকেটটা ঝুলিতে ফেলে সে সাইকেলওয়ালার খোঁজে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এধার ওধার তাকাল। লোকটাকে তার দরকার। বোধহয় স্কুলমাস্টার, নিজে চাষ করায়, খোঁজখবর রাখে, এক্সপেরিমেন্ট করার সাহস আছে। লোকটিকে না পেয়ে সে স্টেশনারি দোকানে ঢুকল। দু প্যাকেট বিস্কিট, এক শিশি জ্যাম, একটা লুডোর পর একঠোঙা টফি কিনল। দরমার চালায় সারসার হাফপ্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, ব্লাউজ, সায়ার দোকান। একটা ছাপছোপ মারা গোল—গলা গেঞ্জি ঝুলছে দেখে তার মন্তার কথা মনে পড়ল। ওর থেকে বছর দেড়েকের বড়ো গোরা। এই গেঞ্জিটা পরতে গেলে গোরার মাথাটাও গলবে না, মন্তার গায়ে ফিট করে যাবে। ছেলেটার শরীর বাড়েনি, বোধহয় অপুষ্টির জন্য। কিন্তু পারুল এমন দশাসই হয়ে গেল কী করে! সে গেঞ্জিটার সঙ্গে একটা হাফপ্যান্টও কিনল।

লোকটাকে সে দেখতে পেল সাইকেল নিয়ে ফলওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে। অনেকগুলো মুসম্বি লেবু থলিতে ভরে সেটা সাইকেলের হাতলে ঝোলাচ্ছে।

‘যদি কিছু না মনে করেন, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?’

দাড়িওয়ালা, কটা চোখের, দীর্ঘদেহী, অপরিচিত একজনের এহেন হঠাৎ প্রশ্নে লোকটি অবাক। ‘বলুন!’

‘একটু আগে বিভূতি ফাটিলাইজারসে আপনার কথা কানে আসছিল।’

‘আপনি তো চা কিনছিলেন।’

‘আমার নিজের খুব চাষের ইচ্ছে, অল্প কিছু জমি আছে কিন্তু চাষবাস সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। আপনার কথা শুনে মনে হল, আপনি অনেক জানেন, নিজে চাষ করান।’

‘হ্যাঁ, বিঘে পনেরো আছে।’

‘আপনি আমায় সাহায্য করবেন পরামর্শ দিয়ে?’

সে নিজেই বুঝতে পারল তার চোখে, গলার স্বরে আবেদনের মতো কিছু একটা ফুটে উঠেছে। লোকটির মুখ ভারিক্কি হয়ে উঠল। ‘আপনি থাকেন কোথায়?’

‘গোকুলানন্দে।’ বলেই সে সিঁটিয়ে উঠল। এবার অনিবার্য প্রশ্নটা হবে, ‘আপনার নাম?’

‘আপনার নাম, কোন বাড়ি?’

‘দত্তদের বাড়ি, কলকাতায় থাকি।’

লোকটির ভ্রূ কুঁচকে উঠল, ‘পারুল নামে একজন মেয়েছেলে যে বাড়িতে থাকে?…খুন হয়েছিল যে বাড়িতে?’

‘হ্যাঁ। …আমার নাম রাঘবেন্দ্র দত্ত।’

লোকটি মনে করার চেষ্টা করছে। ওর মুখ দেখেই বোঝা যায়, নামটা স্মৃতিকে ঘিরে ওর মাথার মধ্যে ঘুরছে, ভিতরে ঢোকার জন্য একটা ছিদ্র খুঁজছে। নিশ্চয় তাকে আগে কখনো দেখেনি, নামটা হয়তো শুনে থাকবে। রাঘবেন্দ্র লোকটা কে নিশ্চয় পরে জানতে পারবে।

‘আমিই সেই খুনিটা…গোকুলানন্দে থাকব বলে এসেছি।’

লোকটির ঠোঁট ফাঁক হয়ে গেল। তবে দু চোখে ভূত দেখার মতো কিছু না ঘটলেও যথেষ্ট অবাক হয়েছে। এভাবে, ‘আমিই সেই খুনিটা’, পৃথিবীতে ক—টা লোকের শোনার ভাগ্য হয়েছে? ‘আপনিই!’

লোকটি নিজেকে সামলে নিয়েছে। এখন কৌতূহলী হবে। ‘এবার আপনি আমার সম্পর্কে খুব একটা হীন ধারণা করবেন তো?’

‘না, তা করব না। আপনি রিহ্যাবিলেটেড হতে চান, আপনি ক্রিমিন্যাল নন। নিশ্চয় আপনাকে সাহায্য করব।’ লোকটি হাসল। সেই হাসিতে তার বুকের মধ্যে সোঁসোঁ বাতাস বইতে শুরু করল, মেঘ জমে উঠল, বুকের মধ্যে টপটপ বৃষ্টি ঝরে পড়ল, বুকের পাষাণ ভারটা গলে যেতে লাগল।

‘আমি থাকি রাইহাটায়, এই রথতলা মাধ্যমিক স্কুলে ইতিহাস পড়াই… আমার নাম শক্তিপদ হালদার। …আপনার তো এখন বিঘে তিরিশেক ধানজমি রয়েছে।’

‘জানলেন কী করে!’

‘আপনার স্ত্রী যখন জমি বিক্রি করলেন তখন আমি পাঁচ বিঘে কিনেছিলুম। …আপনি যদি লোক দিয়ে নিজে চাষ করান আর হাইব্রিড বীজ, পেস্টিসাইড, রাসায়নিক সারে টাকা খরচ করেন, তাহলে অনেক বেশি রিটার্ন পাবেন। …বাড়ির দিকে যাবেন তো? আমিও যাব। …আপনার ওই পারুল তো চাষিকে লিজ দিয়ে চাষ করায়। অশিক্ষিত চাষি, জমিতে তেমন টাকাও ঢালতে পারে না, ফলনও বেশি হয় না।’ শক্তিপদ কথা বলতে বলতে হাঁটছে, সাইকেলের এধারে সে।

হঠাৎই নিজের মধ্যে এখন একটা প্রবল জোর সে অনুভব করতে শুরু করেছে। কী একটা দপদপ করছে তার শিরা—উপশিরায়। মাথাটা হালকা লাগছে, হাত—পায়ের খিল খুলে যাচ্ছে। অনেক কিছু করা যায়, সে করতে পারে। …’তুই কেন বসা কাজ করবি… স্বাস্থ্য আছে, খাটবার ক্ষমতা আছে’, নিশ্চয়ই আছে। …’সাহস করে এগোলে সবই করা যায়।’ যায়। কিন্তু ভুল জায়গায় সাহস করে এগিয়ে ছিলাম পারুল!

‘আপনি যেকোনো ছুটির দিন আমার বাড়িতে আসুন, কথা হবে। আজ একটু তাড়া আছে। শক্তি মাস্টারের বাড়ি বললে রাইহাটায় যে—কেউই দেখিয়ে দেবে। …আমি চলি।’

শক্তি মাস্টার সাইকেলে উঠে পড়ল। খানিকটা এগিয়ে গেছে তখন সে অস্ফুটে বলল, ‘আসুন, আমি যাব।’

বাড়ি ফিরে দেখল উঠোনে রোগা এক তরুণী। গায়ের রঙ কালো, ময়লা নীল ছেঁড়া শাড়ির ফাঁক দিয়ে সায়া দেখা যাচ্ছে, চোয়ালের হাড় প্রকট। মুখটি মিষ্টি। হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে ওদের ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কাঁঠাল গাছের নীচে গোরুটা খোঁটায় বাঁধা।

‘তুমিই বুলি, তাই না?’

মেয়েটি লাজুক হাসল। হাসিটা ঝকঝকে দেখাল সাজানো সাদা দাঁতের জন্য। বুলির দুটো বাচ্চচা, স্বামী পরিত্যক্তা, দুটো বাড়িতে কাজ করে, বয়স তেইশ—চব্বিশ…. ওর ভবিষ্যৎ কী? যদি ও দোতলার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ‘মামি’ না বলত তাহলে? তাহলে পারুল আর একটা ‘শখ’ না মেটার অতৃপ্তিতে সেদিন তিক্ত কটু আচরণ করত না সারাদিনের ধকলে ক্লান্ত, নেশায় চুরচুর শ্রীগোপালের সঙ্গে।

ঘর থেকে মন্তা বেরিয়ে এসেছে দাওয়ায়। সে ঝুলি থেকে লুডো, গেঞ্জি ও প্যান্টের প্যাকেট আর টফির ঠোঙাটা বার করল। ‘এগুলো তোমার।’ জিনিসগুলো সে বাড়িয়ে ধরল। মন্তা প্রথমেই নিল লুডোর বোর্ডটা। ছকের ঘরগুলো তাকে এত খুশি করেছে যে কথা বলতে পারছে না। সে লক্ষ করল বুলি তাকিয়ে রয়েছে। ঝুলি থেকে বিস্কুটের একটা প্যাকেট বার করে সে এগিয়ে গেল। ‘তোমার।’ বুলি দ্বিধা না দেখিয়ে হাত বাড়িয়ে নিল।

‘মন্তা, তোমার গেঞ্জি আর প্যান্টটা পরে দ্যাখোতো ফিট করে কিনা, না হলে দোকানি বলেছে বদলে দেবে। …তোমার মা কোথায়?’ চায়ের প্যাকেট হাতে নিয়ে সে ঘরের দিকে তাকাল। রথতলায় যাবার সময় সে দেখে গেছে পারুল ঘরে ছিল।

‘মা ঝোড়ো মণ্ডলের বাড়ি গেছে, খড় নিয়েছিল এখনও টাকা দেয়নি। এখুনি আসবে।’

‘চায়ের প্যাকেটটা রেখে দাও, মাকে দিয়ো। যাও এগুলো পরে এসো।’

মন্তা ঘরের মধ্যে চলে গেল। সে দাওয়ায় বসল। বুলি হাঁসগুলোকে বাঁশের বেড়ার দু—হাত উঁচু খুপরিতে ঢুকিয়ে একহাত চওড়া খোপের মুখটা পাটা দিয়ে বন্ধ করে ভারী একটা গাছের ডালের টুকরো টেনে আনল।

‘এখন ক—টা ডিম দিচ্ছে?’ প্রশ্ন করল বুলিকে।

ঘরের ভিতর থেকে মন্তা চেঁচিয়ে বলল, ‘আজ দিয়েছে তিনটে। কাল দুটো দিয়েছিল।’ মন্তা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, কোমরে মুঠো করে প্যান্টটা ধরা। গেঞ্জিটা বুক—কাঁধ ঠিকই হয়েছে, শুধু ঝুলটা একটু বেশি।

‘বাহ, চমৎকার দেখাচ্ছে… কাল পরে স্কুলে যেয়ো। প্যান্টের কোমরটা বড়ো হয়েছে, না?’

‘দড়ি দিয়ে বেঁধে নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’ পঙ্গু পায়ের দিকে মন্তা হেলে রয়েছে। মুখ নীচু করে কাঁধ—বুক বারবার দেখছে।

‘টফিগুলো একবারেই যেন শেষ কোর না। ঠোঙাটা আনো, বুলিকে একটা দিই।’

মন্তা ঠোঙা আনল। সে একটা টফি হাতে নিতেই মন্তা বলল, ‘জেঠু, এগুলোকে টফি বলে?’

‘হ্যাঁ… বুলি এদিকে এসো।’ দুটো টফি তুলে নিয়ে ঠোঙাটা সে মন্তাকে ফিরিয়ে দিল।

‘আপনি খাবেন না?’

‘না, বড়োরা খায় না…বুলি এ দুটো তোমার ছেলেদের।’

সে উঠে দাঁড়াল। বুলিকে দেখে তার মনে হল কিছু যেন বলতে চায়। ‘আর একটা টফি চাই?’

বুলি লজ্জা পেল। ‘না, …একটা কথা বলব?’

‘বলো।’

‘কলকাতায় তো আপনার অনেক চেনাজানা আছে, কারও বাড়িতে একটা কাজ ঠিক করে দিতে পারেন?

তার মনে পড়ল দিলীপদার মা—র কথাটা, ‘বাবা দেখবে তো? ছেলেটা দিনদিন কীরকম মনমরা হয়ে যাচ্ছে।’ বুড়ির নাতির জন্য কাজ কোনোদিনই সে খুঁজে দেখার সুযোগ আর পাবে না, বুলির জন্যও নয়। কিন্তু সেকথা বললে এই আধপেটা থাকা দুই বাচ্চচার মা বিশ্বাস করবে কি? বুলি তাকে হৃদয়বান মনে করেছে বিস্কিট আর টফি পেয়ে। তার মুখের দিকে বুলির তাকিয়ে থাকাটায় সে অস্বস্তি পেতে শুরু করল।

‘কলকাতায় তো ছেলে সমেত কাউকে কাজে রাখবে না।’

‘ওদের এখানে দাদার বাড়িতে রেখে যাব, মাসে মাসে টাকা পাঠাব।’

‘আচ্ছা, খোঁজ পেলে বলব। …মন্তা, মা এলে নতুন পাতা দিয়ে এক গেলাস চা করে দিতে বোলো।’ এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকা যাবে না। এবার থেকে বুলিকে এড়িয়ে চলতে হবে। সে বাড়ির দিকে পা বাড়াল।

‘জেঠু, আপনি আমার সঙ্গে খেলবেন?’

‘মা—র সঙ্গে খেলো।’ সে পিছনে না তাকিয়েই বলল। দোতলায় এসে জানালাটা খুলে দেখতে পেল, লুডো পেতে মন্তা একাই খেলছে। সে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।

আধঘণ্টা পরে সে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেয়ে উঠে বসল। কে হতে পারে? কিছুক্ষণ আগে সে পারুলের গলা শুনেছে। চা করে কাউকে দিয়ে পাঠিয়েছে!

‘কে?’

‘আমি মন্তা।’ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে, ঘরে ঢোকেনি।

‘কি ব্যাপার, ঘরে এসো।’

মন্তার খালি গা, পরনে পুরোনো প্যান্টটা। হাতে লুডো, গেঞ্জির প্যাকেট আর টফির ঠোঙা। সে শুধু তাকিয়ে রইল।

‘মা বলল এগুলো ফিরিয়ে দিতে।’ মৃদু স্বরে মন্তা বলল। চোখ দুটো নামানো।

‘কেন?’

‘জানি না। …নিয়েছি বলে মা মারল।’

একটা আগুন দপ করে জ্বলে উঠল তার মাথার মধ্যে। প্রায় লাফিয়েই বিছানা থেকে নামল, চমকে ওঠা মন্তা তাড়াতাড়ি সরে যেতে গিয়ে টলে পড়ল। সে ভ্রুক্ষেপ না করে সিঁড়ি দিয়ে দুড়দাড় করে নেমে গেল। তার মাথার মধ্যে এখন উত্তপ্ত ধোঁয়া, তার যাবতীয় বোধ পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। …অপমান! একটা বাচ্চচা ছেলেকে দেওয়া তার স্নেহ পারুল পায়ে চটকে দিল… কেন, কেন?

উনুনে একটা বাটিতে গরম জল ফুটছে। পারুল উবু হয়ে বসে। কাচের গ্লাসে দুধ—চিনি, ঠোঙাটা থেকে একটা টিনের কৌটোয় চা ঢেলে রাখছে। বুলিকে সে দেখতে পেল না।

‘আমি মন্তাকে দিয়েছি। তোমার এত সাহস যে ওগুলো ফেরত পাঠিয়েছ?

পারুল অচঞ্চল, মুখে বিরক্তি। ‘কোনো কিছু আমার ছেলেকে দেবেন না।’

‘দিলে কী হয়েছে?’ সে চিৎকার করল।

‘অত কৈফিয়ত আমি দিতে পারব না। আমার ছেলেকে আমি নিতে দোব না।’ পারুলের স্বরে পালটা উত্তেজনা নেই। সাঁড়াশি দিয়ে বাটিটা নামিয়ে এক চামচ চা গরম জলে দিয়ে একটা রেকাবি ঢাকা দিল। ধীরে ধীরে কাজগুলো করল।

এগুলো ওর স্পর্ধা দেখানো! উপেক্ষা করা!

‘তুমি জান আমি কে?’

পারুল মুখ তুলে তাকাল, চোখে বিস্ময়।

‘এই সব কিছুর মালিক আমি…সব কিছুর, জমিজায়গা, বাড়ি সব কিছুর।’

‘আমারও?’

‘হ্যাঁ তোমারও। যতদিন আমার জায়গায় থাকবে ততদিন। …তুমি আমার আশ্রিত, তোমাকে দয়া করে, এখানে থাকতে দেওয়া হয়েছে। আমাকে অপমান করার কোনো অধিকার তোমার নেই।’

‘যান যান।’ পারুল উঠে দাঁড়াল তার দশাসই দেহ নিয়ে। কচুবাগান বস্তির স্বর তার গলায়। ‘অধিকার দেখাচ্ছেন, অধিকার! কে আমার অধিকারীমশাই এলো রে অধিকার ফলাতে! এখানে আমায় রেখেছে বউদিমণি। আজ বিশ বছর এখানে বাস কচ্ছি। বউদিমণির দয়ায় তো আপনি এখানে থাকতে এসেছেন। বাড়িতে তো জায়গা জোটেনি, সব খবর আমি রাখি, আমাকে আবার দয়া দেখাচ্ছে! ফুটুনি অন্য জায়গায় মারবেন। সারা রসপুর মৌজার লোক পারুল বিশ্বাসকে চেনে খুন—হওয়ার বউ বলে। উনি এয়েচেন কিনা আমার মালিক হতে!’

একটানা কর্কশ স্বরে পারুল কথাগুলো বলে ঝপ করে বসে পড়ল। তার বড়ো বড়ো চোখ থেকে আগুন ঝরছে, বুক ওঠানামা করছে। বাটি থেকে গ্লাসে চায়ের লিকার ঢালতে লাগল। সে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে পারুলের মুখের দিকে। হাত—পা কাঁপছে, ক্রোধে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে সে। চোখের সামনে যা কিছু ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে শুরু হয়েছে। দুটো রগ দপদপ করছে। …শ্রীগোপালেরও এমন হয়েছিল।

.

‘রোঘো, আজ থানার লোকগুলো এত অপমান করল যে মাথা খারাপ হয়ে গেছে, অথচ মাসে মাসে ওরা আমার কাছ থেকে টাকা খায়। …বরুণ এই তল্লাটের উঠতি নেতা, পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছিল, দিইনি। এখন পুলিশ দিয়ে শোধ নিচ্ছে, আমার ব্যাবসা লাটে তোলাতে চায়। আমি যখন রাজনীতি করি বরুণ তখন হাফপ্যান্ট পরে, থানা এখন ওর কথায় ওঠে বসে।’ কথাগুলো বলে শ্রীগোপাল দেয়ালে ঠেস দিয়ে গুম হয়ে বসে ছিল। দোতলার ঘরের বিছানায়। কোলে দু—হাতে ধরা প্রায় পূর্ণ মদের বোতলটা।

পারুল নেমে গেছে নীচে, তার সঙ্গে বুলি। ঘর ছিল অন্ধকার। তারা সারা শরীরে লেগে ছিল পারুলের স্পর্শ। একতলা থেকে ‘পারুল, পারুল’ চিৎকার করতে করতে শ্রীগোপাল যখন উঠে আসছিল, তখন একটা ভয় তার কলজেটা চেপে ধরে। শ্রীগোপাল কি কোনো সন্দেহ করবে?সে কাঁটা হয়ে ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল।

‘হারিকেনটা জ্বালিসনি কেন?’

‘এই জ্বালছি।’

সে টর্চ জ্বালল, তারপর হরিকেন। শ্রীগোপালের চোখ পড়ল বোতলে। ‘খুলেছিস?’ ‘সবে একটু খেয়েছি।’ শ্রীগোপাল ছিনিয়ে নেবার মতো করে বোতলটা তুলে নিয়ে খাটে বসল। গ্লাসটা সে এগিয়ে দেয়। ‘রাখ, লাগবে না।’ সারাদিন খাসনি, একটু কিছু পেটে দে।’ কথাটা বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছিল, ঠিকমত বললে পালিয়ে গেছিল। শ্রীগোপালকে তার করুণার পাত্র মনে হচ্ছিল। বোকাটা জানে না, একটু আগেই এই ঘরে বউ ওর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।

ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সে চাপা গলায় ডেকেছিল ‘পারুল, পারুল।’ দাওয়ায় ছেলে কোলে বসেছিল বুড়ি, তার পাশে বুলি। ঘর থেকে বেরিয়ে এল পারুল। সিল্কের শাড়িটা বদলে আটপৌরে শাড়ি পরে নিয়েছে। কপালে টিপটা নেই। হাতের আঙুল খালি। চোখে চাপা উৎকণ্ঠা। পারুলও ভয় পেয়ে গেছে।

‘কিছু খেতে দাও ওকে, আছে কিছু?’ আপনা থেকেই তার স্বর ফিসফিসে হয়ে যায়।

‘ডালবাটা আছে, বড়া করে দোব লংকা দিয়ে?’ পারুলও গলা নামিয়ে বলেছিল।

তারা পরস্পরের চোখের দিকে চোখ রেখে নিথর দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দুজনেই কী কথা তখন বলতে চেয়েছিল? তখনই কি বিদ্বেষ আর ঘৃণা জন্ম নিচ্ছিল? দুজনে প্রায় একই সঙ্গে দোতলায় পুবের জানালার দিকে হঠাৎই তাকায়। তার মনে হয়েছিল, একটা মানুষের ছায়া যেন জানালায় দাঁড়িয়ে। পারুলেরও কি তাই মনে হয়েছিল?

‘ধরুন’।

চায়ের গরম গ্লাস রেকাবির উপর রেখে পারুল তার সামনে দাঁড়িয়ে। মাথায় ঘোমটা, মুখ স্বাভাবিক। একটু আগে যে বিশ্রী ভঙ্গিতে কর্কশস্বরে চিৎকার করেছিল, তার কোনো চিহ্ন ওর স্থূল দেহে লেগে নেই।

তার মাথার মধ্যে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল সেটা নিবে এসেছে। শুধু ধিকিধিকি করছে একটা কথা, ‘বউদিমণির দয়ায় তো আপনি এখানে থাকতে এসেছেন।’ কথাটা সত্যি। রেকাবিটা হাতে নিয়ে সে যাওয়ার জন্য ঘুরতেই চোখ চলে গেল দোতলার জানালায়। মন্তার ভীত মুখ ভাঙা গরাদের ফাঁকে। সে পিছনে তাকিয়ে দেখল, পারুলের চোখও জানালার দিকে।

‘দোতলায় উঠে এসে সে মন্তাকে বলল, ‘ওগুলো রেখে যাও।’

‘আপনি রাগ করেচেন?’

‘না।’

নয়

সেই রাতে একটা ভয়ঙ্কর কিন্তু সত্যি স্বপ্ন সে ঘুমের মধ্যে দেখল।

দোতলার ঘরে তারা তিনজন। একটা থালায় কয়েকটা ডালের বড়া। শ্রীগোপাল চোখের পাতা খুলে রাখার চেষ্টা করছে। সে আর পারুল একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে শ্রীগোপালের মুখের দিকে।

‘বড়ো অন্ধকার লাগছে রে রোঘো, হারিকেনটা জ্বালা।’

সে হাত বাডিয়ে পলতেটা উসকে দিল।

‘রোঘো, আমি তোকে অনেক ঠকিয়েছি। …তুই কি জানিস আমবাগান জাম দিয়ে,পুকুর জমা দিয়ে যে টাকা পেয়েছি তার সবটা তোকে দিইনি। বাঁশ বিক্রির সব টাকা দিইনি… তুই কি তা জানিস?’

‘জানি।’ সে পারুলের দিকে তাকাল। পাথরের মতো ওর চোখ। চোখের পিছনে কী ঘটে চলেছে তা বোঝা যাচ্ছে না। হারিকেনের শিখা লালচে হয়ে এসেছে, বোধহয় তেল কমে গেছে। শ্রীগোপাল ঝুঁকে পড়ছে ক্রমশ।

‘জানিস? তা হলে চোর বলে এতদিন আমাকে ধরিসনি কেন? … আমি জানি কেন ধরিসনি। তুই জানিস আমি করাপ্ট হয়েছি তোর জন্য, তোর জমি রক্ষার জন্য ওদের ভুল বুঝিয়েছি, বিট্রে করেছি। আমার সঙ্গে তুইও নষ্ট হয়ে গেলি। তোর নষ্ট বিবেকের সুযোগটা আমি নিয়েছি। … আমি আজ তোর এখানে শোব, শুতে দিবি?’

‘হ্যাঁ।’

‘পারুল সম্পর্কে আমার কে হয় জানিস? ওর সঙ্গে শুয়ে আমি পাপ করেছি। সেই পাপের ফল আজ আমি পেয়েছি। আমার দশ হাজার টাকার মাল সিজ করে নিল।’

পারুলের ভ্রূ কুঁচকে রয়েছে। শ্রীগোপাল কী বলবে সেটা যেন ও জানে। মুখ নীচু করে দুটো আঙুলে চেখের পাতা টিপে ধরল।

‘বাবার ফোটো আমার কাছে আছে। পারুল আর আমার ফোটোও আছে। পাশাপাশি তিনটে ছবি রেখে আমি দেখেছি… এক মুখ…তুই হাসছিস, পাগল ভাবছিস? … পারুলের মা জানত পারুলের বাপ কে, কিন্তু কিছু বলেনি, আমার সঙ্গে পারুলের বিয়েতে আপত্তি করল না। … বিয়ের খবর শুনে দুলালদা আমাকে বলেছিল, ‘পারুলের বাপ তোর বাবা,বোনকে বিয়ে করলি?’ রেঘো, তখন ছেলেটা ওর পেটে এসে গেছে, আমার আর কিছু করার ছিল না।’

‘কী করে যে মাথায় এই সব ঢুকল।’ ফিসফিস করল পারুল।

‘কে আবার ঢোকাবে…ভগবান ঢুকিয়ে দিয়েছে। … জীবনের বড়ো ভুল কী করেছি জানিস?’ শ্রীগোপাল সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করতে করতে তাকাল তার দিকে। ‘ছেলের জম্মো দিয়ে। … ওর ঠাকুদ্দা আর দাদামশাই একই লোক, একথা একদিন তো জানবে, তখন কী বলবে আমায়? … রেঘো আমার ভয় করে।’

‘কি আজেবাজে বকছিস। শুয়ে পড় তুই।’ সে ছোট্ট ধমক দিল। ‘পারুল তুমি ঘরে চলে যাও।’

‘না না, থাকুক আমার সামনে। … পারুল আজ তোর মোটরবাইকে চেপেছে, তোর কোমর জড়িয়ে পিঠে বুক ঠেকিয়েছে, পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছে … সবই কানে এসেছে। কিরে রোঘো, কেমন লাগছিল বল তো?’

ফ্যাকাশে হয়ে গেছিল তার মুখ। শ্রীগোপাল মুখ তুলে ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে। মুখে হালকা হাসি। পারুলের চোখে কোনো ভাব নেই। কথাগুলোর প্রতিবাদ করা যায় না। সে বাইকে ওঠার জন্য কয়েকবার পারুলকে বলার পর উঠেছিল। না উঠলেই পারত। শখ ছিল মিটিয়ে নিল, এটা কি একটা কারণ? শখেরও বেশি আরও কিছু ছিল।

‘বাইকে চেপেছি তো কী হয়েছে?’ পারুল মৃদু একটা রোখা স্বরে বলল।

‘কী হয়েছে!’ শ্রীগোপাল সটান সোজা হয়ে বসল। তার চোখের চাউনি বদলে গেল। নেশাগ্রস্তের চিহ্নমাত্র নেই, তার বদলে ধূর্তামি ঝিলিক দিল।

‘হয়েছে কী তাতে? আমার পিছনে বসলে কি কোমর জড়িয়ে ধরলেই পারুল খারাপ হয়ে গেল? … তোর মাথার এখন ঠিক নেই, শুবি তো শুয়ে পড়।’ সে একটা বড়া তুলে মুখে দিল তার নার্ভাস হওয়া গোপন করতে। কত স্বাভাবিক রয়েছে সেটা প্রকাশ করার জন্য সে অলস নিশ্চিন্তভরে চিবোতে লাগল।

‘কিছু হয়নি? … তোর মনের মধ্যে নোংরা ঢোকেনি? ও তোর মনে খারাপ চিন্তা এনে দেয়নি? … এই মেয়েছেলেটা জানত ওর বাপ কে, জেনেশুনেই আমাকে ট্র্যাপে ফেলেছিল। বিয়ের আগে এই ঘরেই ও আমার সঙ্গে রাত কাটিয়ে গেছে, তুই কি তা জানিস? ওর মা পাঠিয়ে দিয়েছিল, নইলে ওই খ্যাংরাকাঠির মতো মেয়েকে কে বিয়ে করত … আমাকে বলল, পেটে বাচ্চচা এসেছে, এখুনি বিয়ে করো… ‘

বড়ার থালাটা উড়ে এসে শ্রীগোপালের মুখে পড়ল। পারুল উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে স্ফুলিঙ্গ, প্রচণ্ড রাগ দেহটাকে ফুলিয়ে দিয়েছে। থরথর কাঁপছে যেন কিছুর ভর হয়েছে। অস্ফুটে ‘তবে রে’ বলেই টেবিল থেকে চার ব্যাটারির টর্চটা তুলে শ্রীগোপালের দিকে ঝুঁকল। থালাটা মুখে জোরে আঘাত করেনি। শ্রীগোপাল আচমকা আক্রমণে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে ছিল কয়েকটা সেকেন্ড। টর্চটা তার মাথায় নেমে আসার আগেই সে হাতটা তোলে। হাতের উপর পড়ল টর্চের ভারী দিকটা। সে খপ করে পারুলের চুল মুঠিতে ধরে টান দিয়ে মাথাটা বিছানায় চেপে ধরল।

এত দ্রুত ব্যাপারটা ঘটে যায় যে সে কিছু করে উঠতে পারেনি। সম্বিৎ ফিরতেই চুল থেকে মুঠোটা ছাড়িয়ে নিতে সে শ্রীগোপালের হাত ধরে টানল। শক্ত করে ধরা মুঠো ছাড়াতে পারল না। পারুলের মুখ যন্ত্রণায় বিকৃত, চোখ বন্ধ,ঠোঁট ফাঁক হয়ে দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। শ্রীগোপালের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছে, ফুলে উঠেছে গলার শিরা, সারা মুখ ভয়ঙ্কর কোন ইচ্ছায় দুমড়ে যাচ্ছে, চোখের কোণে লাল ছোপ। সে দেখল শ্রীগোপালের চেহারা নেওয়া একটা হিংস্র পশুকে।

‘ওকে আমি খুন করব…আমাকে মারতে হাত তুলেছে, এত সাহস! … মেরে ফেলব আজ।’

সে ঘুষি মারল শ্রীগোপালোর বাহুতে একবার, দু—বার। মুঠো আলগা হতেই পারুল ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা ছাড়িয়ে নিল। কিছু চুল শ্রীগোপালের আঙুলে লেগে। পারুল উঠে দাঁড়াল। ‘আজ আমিই তোকে খুন করব।’ পারুল ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে, দুড়দুড় করে নীচে নেমে গেল।

‘আমাকে মারলি রোঘো!’ শ্রীগোপাল অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যেতে গিয়ে খাটের কোনায় ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। হাঁটু চেপে ধরে ‘শাললা’ বলে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রীগোপাল খাটে একটা কিল মেরে বেরিয়ে গেল। সে তখন পুবের জানালায় এসে দাঁড়ায়। অন্ধকার উঠোন। দাওয়ার এক ধারে পলতে নামানো হারিকেন জ্বলছে। কয়েক মিটার পর্যন্ত দেখা যায়, তারপরই আবছা থেকে ঘন অন্ধকার।

ঘরের ভিতর থেকে পারুল ছুটে বেরিয়ে এল, হাতে একটা লম্বা কাটারি। পিঠের ওপর ছড়ানো চুল, শাড়ির আঁচল লুটোচ্ছে, হারিকেন পিছনে থাকায় মুখ অন্ধকার। দাওয়া থেকে নেমে পারুল ছুটে এল খামার বাড়ির দিকে। ও তাহলে সত্যি সত্যিই ‘খুন করব’ বলেছে, সে দেখল অন্ধকারের মধ্য থেকে শ্রীগোপাল এগিয়ে গেল, হাতে একটা লম্বা লাঠির মতন কিছু। সে জলদি টর্চটা বিছানা থেকে তুলে জানালা দিয়ে উঠোনে আলো ফেলল। মুখের উপর তীব্র রশ্মি পড়তেই পারুল চোখ বুজল আর তখনই শ্রীগোপলের হাতে ধরা বাঁশের খোঁটাটা পড়ল কাটারির উপর। টর্চ নিবিয়ে সে ছুটেছিল সিঁড়ির দিকে। যখন উঠোনে পৌঁছল তখন পারুল মাটিতে চিৎ হয়ে শ্রীগোপাল। তার ডান হাত হাঁটুতে চেপে বুকের ওপর ঘোড়সওয়ারের মতো বসে, এক হাতে পারুলের বাঁ হাতটা মুচড়ে ধরে রয়েছে, অন্য হাতে গলা টিপে। ঘড়ঘড়ে দমবন্ধ আওয়াজ পারুলের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে। পা দুটো মাটিতে দাপাচ্ছে। কুঁজো হয়ে শ্রীগোপাল মুখটা পারুলের মুখের কাছে রেখে ‘ইঁ ইঁ ইঁ’ শব্দ করে চাপ দিয়ে যাচ্ছে। তখন তার মনে হয়েছিল, পারুল মরে যাচ্ছে।

কাটারিটা তার পায়ে ঠেকল, সে তুলে নিল।

.

‘না, না, না!’

সে উঠে বসল বিছানায়। মাথা নীচু করে বিছানায় কিছুক্ষণ বসে থেকে চোখ খুলল। জানালায় তাকিয়ে ময়লা কাপড়ের পরদার মতো আকাশ দেখতে পেল। আর একটু পরেই ভোর হবে। যে ভয় করে এসেছে সেটাই ঘটল, সে এই স্বপ্নটা দেখল।

যদি না বিকেলে পারুল আর সে মুখোমুখি হত, প্রচণ্ড রাগে চোখের সামনের সব কিছু তার দৃষ্টি থেকে যদি মুছে যেত তাহলে সে বোধহয় স্বপ্ন দেখত না। সব কিছু মোছেনি… ষোলো বছর আগে দোতলার ঘরে শ্রীগোপালের সামনে ক্রোধে ফুলে ওঠা পারুলকে সে দাওয়ায় দেখতে পেয়েছিল। …’অধিকার দেখাচ্ছেন, অধিকার!’ কদাচিৎ দেখা যায় স্ত্রীলোকের এই রূপ, সৌন্দর্য! পলকের জন্য তার মনে ভেসে উঠেছিল মহিষাসুরের দিকে তাকানো দুর্গার চোখ।

দু—হাতে সে মাথা চেপে ধরল। সেই যন্ত্রণাটা আবার শুরু হয়েছে। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে সে দড়ির আলনার কাছে পৌঁছে পাঞ্জাবিটা নিল। সেটা পাকিয়ে শক্ত করে মাথায় বেঁধে সে শুয়ে পড়ল। পারুল তাকে কি ঘেন্না করে, কেন? সেদিন শ্রীগোপাল ওকে মেরেই ফেলত, সে বাঁচিয়েছে। অথচ কোর্টে পারুল একদম উলটো কথা বলল। যা শেখানো হয়েছিল তাই বলেছে। কেন রাজি হল বলতে? ও কি আমাকে সাজা দিতে চেয়েছিল! যাবজ্জীবন সাজা তো জেলে ঢোকার আগেই সে পেয়েছে।

ওর জন্যই হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে তাকে চারটে লোকের সামনে উলঙ্গ হতে হয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন ছিল মেয়ে। শরীরের যে জিনিসটা সে নিজে আর বাচ্চচা বয়সে মা ছাড়া আর কেউ স্পর্শ করেনি, বিবি তো নয়ই, ডাক্তার সেটাকে যখন আঙুলে তুলে দেখছিল তখন সে চোখ বন্ধ করে মৃত্যু কামনা করেছিল। তার শরীরে খোঁজা হয়েছিল বাধা দেওয়ার ধস্তাধস্তির চিহ্ন, তার পাজামা থেকে পাছার কাপড়ের টুকরো ডাক্তার কেটে নিয়েছিল ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য। সেই জায়গাটা তখন পাঞ্জাবি দিয়ে ঢেকে না নিলে তাকে পাগল বলে ভাবা যেত। … জীবনে সেই হেনস্থা, অপমান, লজ্জা কী করে ভুলবে! এই সবই পারুল দিয়েছে। সেদিন যদি ওকে বাঁচাবার জন্য সে শ্রীগোপালের মাথায়…।

কিছুক্ষণ পরেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।

.

শক্তি মাস্টার বলেছিল যেকোনো ছুটির দিন তার বাড়িতে যেতে, রাইহাটায় যে—কেউই তার বাড়ি দেখিয়ে দেবে। রাইহাটা প্রায় আড়াই মাইল। পতে ভ্যান রিকশায় উঠে পড়া যায়, যদি বসার জায়গা থাকে। সে রবিবার সকাল ন—টা নাগাদ বেরোল। হেঁটেই যাবে। বেরোবার সময় পারুলকে সে দেখতে পেল না।

খালপাড়ের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই গ্রাম শেষ। তারপর একরের পর একর জুড়ে বিশাল ধানখেত। হাই টেনশান বিদ্যুতের মোটা মোটা তার লোহার থামে ভর করে খেতের উপর দিয়ে বহুদূর চলে গেছে। বৃষ্টির জলে কোমর ডুবিয়ে রয়েছে সবুজ ধান গাছ। আর মাস তিনেক পরই সোনালি রঙে ভরে যাবে মাঠ। খেত একজনের নয়। কারুর আট বিঘে, কারুর দু বিঘে করে জমি এর মধ্যে রয়েছে। বহুদিন আগে সে শ্রীগোপালকে বলেছিল, ‘এর মধ্যে থেকে নিজের জমিটা চিনে নেয় কি করে বল তো?’ শ্রীগোপাল বলেছিল, ‘একশোটা বাচ্চচার মধ্যে নিজের বাচ্চচাটাকে মা ঠিক চিনে নেয় যেভাবে।’ তার তিরিশ বিঘে ধানজমি এক লপ্তে নয়, তিন জায়গায় ছড়িয়ে আছে। কোথায় কত বিঘে রয়েছে সে জানে, কিন্তু দেখিয়ে দিতে বললে দেখাতে পারবে না,পারবে পারুল।

জনমজুর দিয়ে, ছড়ানো তিরিশ বিঘে জমিতে নিজে দাঁড়িয়ে চাষ করানো একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই লিজে চাষ করায় পারুল। এই কয়েক সপ্তাহে যে যতটুকু দেখেছে তাতে মনে হয়েছে পারুলের প্রতিপত্তি আছে চাষিদের কাছে। অল্পবয়সি তিনটে ভাই মিলে চাষ করে, ‘পারুল বউদির জমি’। এরা করে কুড়ি বিঘে, আর একটি লোক করে দশ বিঘে। বাড়ির কাছে পুকুরের ধারে পাঁচ বিঘেটায় সবজির বদলে ধান চাষ শুরু করেছে পারুল। বাড়ির লাগোয়া বলে এটা নিজেই লোক দিয়ে চাষ করাচ্ছে। ‘সাহস করে এগোলে সবই পারা যায়।’

পারুলের সাহস আছে আর আছে অদ্ভুত একটা মন। কোর্টে দাঁড়িয়ে পারুল তার দিকে আঙুল তুলে বলেছিল, ‘এই লোকটাই।’ সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেছিল। সে ভেবেছিল, এতবড়ো মিথ্যা কথাটা বলতে ওর গলা কাঁপবে, চোখের দিকে তাকাতে পারবে না। কিছুই হল না। ওর শরীরে শ্রীগোপালের দেওয়া আঘাতগুলোই ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছিল বলে কোর্টে বিশ্বাস করে।…একদিন পরে পারুল রেপিংয়ের চার্জ এনেছিল। ওই একদিন তাকে সময় দিয়েছিল দারোগা বিজয় ঘোষ, পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য। পারুল কি ওই টাকার ভাগ পেত?… বিশ্বাস হয় না, টাকার জন্য পারুলের লোভ নেই।

রাইহাটা গ্রামটা বড়ো নয়। দুটি লোক রাস্তায় কথা বলছিল। তাদেরই একজন বলে দিল, ‘ওই তেঁতুল গাছটার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা, সেটা দিয়ে তিরিশ গজ গেলেই ডানদিকে শক্তি মাস্টারের বাড়ি।’ একমানুষ উঁচু পাঁচিলের একধারে দরজাটা খোলাই রয়েছে। ভিতরে ঢুকতেই মাটির একটা বড়ো উঠোন। একধারে উঁচু রকের সঙ্গে পরপর টিনের চালের তিনটে ঘর। দুটোয় তালা ঝুলছে। আর একধারে টালির চালের নীচে গাদাকরা খড়। তার পাশে গোয়াল। ভিতর বাড়িতে ঢোকার দরজাটাও খোলা। সে দরজায় উঁকি দিয়ে দুটো মরাই, একটা জবা গাছ আর তুলসী মঞ্চ ছাড়া আর কিছু দেখতে পেল না।

‘শক্তিবাবু আছেন নাকি?’ বেশ জোরেই সে ডাকল। বছর দশেকের একটি ছেলে ভিতর থেকে এল। ‘শক্তিবাবু আছেন?’

‘আছেন। আপনার নাম?’

‘বলো রাঘবেন্দ্র দত্ত।’

ছেলেটি চলে যাবার দু মিনিটের মধ্যেই পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে শক্তি মাস্টার বেরিয়ে এল। ‘চলুন, বারঘরে গিয়ে বসি।’

তালা খোলা ঘরটায় তক্তপোশ, তার উপর মাদুর, দুটো হাতলওয়ালা জীর্ণ কাঠের চেয়ার, দেয়ালে ইলেকট্রিক বালব আর গণেশের ছবি দেওয়া বাংলা ক্যালেন্ডার ছাড়া ঘরে আর কিছু নেই।

‘এই দশ মিনিট আগে কিছু লোকজন এসেছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে। …এবার তো মেয়েরা পঞ্চায়েতে দাঁড়াবে।’ শক্তি মাস্টার একটা চেয়ারে বসল। তার সামনে তক্তপোশে সে। পঞ্চায়েত শব্দটা তার কানে প্রায় নতুন ঠেকল। ষোলো বছর আগে শুনেছে কিনা তার মনে পড়ছে না। গ্রামের চালচালন অনেক বদলে গেছে। ‘গোকুলানন্দ গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে পারুল বিশ্বাসকে ভোটে দাঁড়াতে বলুন না।… শক্ত মেয়েছেলে, ও পারবে।’

সে অবাক হল, অস্বস্তিও বোধ করল। নির্বাচন, ভোট মানেই তো রাজনীতি। পারুল রাজনীতির ধার ধারে বলো তো মনে হয় না, রাজনীতি করত শ্রীগোপাল।

‘পারুলকে বরং আপনারা কেউ বলুন, আমি বললে কানে তুলবে না… তার কারণ।’ সে থেমে গেল। শক্তি মাস্টার তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল কারণটা বুঝে নিয়ে।

‘বলুন, কী সাহায্য করতে পারি?’

সে ফাঁপরে পড়ল। পারুলের সঙ্গে তার ঝগড়ার পরই সে বুঝে গেছে, চাষ করব বললেই তার পক্ষে জমিতে কিছু করা সম্ভব নয়। বিবি আর পারুল, কেউই তাকে জমি ফিরিয়ে দেবে না। ফিরে পেতে গেলে যে জনবল আর অর্থবল থাকা দরকার তা তার নেই। কিন্তু এসব কথা তো শক্তিমাস্টারকে এখন বলা যায় না। তবু সে এসেছে সেদিনের ওই কথাটার টানে… ‘আপনি রিহ্যাবিলেটেড হতে চান, আপনি ক্রিমিন্যাল নন’, শোনার পরই তার বুক হালকা হয়ে গেছিল।

‘পারুল মেয়েছেলে, লিজ দিয়ে চাষ করানো ছাড়া ওর উপায় ছিল না। কিন্তু আমি যদি গোকুলানন্দে থেকে নিজেই লোক দিয়ে চাষ করি?’

‘পারবেন না। হঠাৎ চাষ করব বলে বাইরে থেকে এসে চাষ করা যায় না, একদম ডুবে যাবেন। অভিজ্ঞতা বলে একটা জিনিস আছে, আমার জন্ম কর্ম সবই এই গ্রামে। আমি মানুষদের জানি, জমি চিনি, প্রাকৃতিক ব্যাপার—স্যাপার বুঝি। বহু বছর গ্রামে বাস করে পারুল অভিজ্ঞ হয়েছে। আপনি আরও কিছুদিন বাস করুন, ধীরে ধীরে বুঝতে পারবেন।’ শক্তিমাস্টার ক্লাসের ছাত্রদের বুঝিয়ে বলার মতো থেমে থেমে ভারী গলায় বলল।

‘আমি যদি অল্প জমিতে, ধরুন আমার বাড়ির লাগোয়াই প্রায়, যে পাঁচ বিঘেটা রয়েছে, তাতে যদি সবজি বা ফলের চাষ করি?’

‘করুন না! জলে না নামলে সাঁতার শেখা যায় না, আপনি ছোটো জমিতে সবজি দিয়েই শুরু করুন। লোকসান হলে অল্পের উপর দিয়েই যাবে কিন্তু অভিজ্ঞতাটা কাজে লাগবে।… আপনি কিছুটা জমিতে কলাগাছ লাগিয়ে দেখুন। কাঁটালি কলা কাঁদিতে পাবেন দেড়শোর মতন, ধরুন বারো ডজনই। যদি পাঁচ টাকা করে ডজন বেচেন, তাহলে একটা কাঁটালির কাঁদি থেকে পাবেন ষাট টাকা। আপনি যদি দুশো গাছ লাগান, তাহলে সব গাছ না বাঁচলেও, দশ হাজার টাকা আশা করতে পারেন। …. না না ওটা আপনি লাভ করছেন না। গাছ লাগানো আর বিক্রির মধ্যে একটা বড়ো খরচ আছে, অর্ধেক বাদ দিতে হবে। …যদি দুশো না পারেন একশো গাছ লাগান, হিসেব করে দেখুন কত পেতে পারেন।

সে একটা বিদঘুটে সমস্যায় পড়ল। মনে মনে একটা বিয়োগ, গুণ, ভাগের চেষ্টা করে, হাল ছেড়ে, সে শুধু হাসল।

‘আপনি টমেটো লাগান। … ফরাসি হাইব্রিড রেড স্টার বীজ এসেছে। খুব ভালো ফলন, চট করে রোগে ধরে না। … পেঁপেও লাগাতে পারেন। বিদেশি হাইব্রিড অনেক রকমের বীজ আসছে, লংকা, ঢ্যাঁড়স, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধা কপি। চাষের পদ্ধতি যতটুকু জানি আপনাকে বলে দোব, জমির ধান উঠলেই নভেম্বর কি ডিসেম্বর থেকে যাতে নামতে পারেন সেজন্য আপনি আগে তৈরি হয়ে নিন। আপনার জমির মাটি পরীক্ষা করাতে হবে, কোন মাটিতে কী সার লাগবে, তাতে কোন ফসল ভালো হবে। এটা সবার আগে জানা দরকার। এইসব না জেনেই তো ফসল বুনে মার খায়।’

শুনতে শুনতে তার মনে হল, চাষবাস অন্য একটা জগৎ নয়। এই জগতের মতোই এতে সাধনার দরকার হয়, অধ্যবসায় লাগে। একটা গাছ একটা প্রার। তাকে লালন করে বড়ো করতে হয়। এতে থ্রিল আছে। কেউ যেন গোরার মতো না হয়, মন্তার মতো না হয় সেজন্য সারাক্ষণ নজরে রাখতে হয়। ষোলো বছর তার যা করে ওঠা হয়নি, এবার সে তা পুরিয়ে নিতে পারে সবজি মানুষ করে। গোকুলানন্দকে বরাবরই অবহেলা করে, অন্যলোকের হাতে তুলে রেখে, আজ তাকে এক অপরিচিত লোকের সামনে বসে কিনা জিজ্ঞাসা করতে হচ্ছে ‘যদি সবজি চাষ করি?’

উঠোন থেকে একটি লোক ডাকল, ‘সেজদা আছেন?’ শক্তিমাস্টার ঝুঁকে দরজা দিয়ে দেখল। ‘নেপু নাকি, ভেতরে আয়।’ সে ঘড়ি দেখল। ‘আমি উঠি এবার।’ তার সঙ্গে শক্তিমাস্টারও উঠল। ‘অতদূর থেকে আজ প্রথম আমার এখানে এলেন, একটু মিষ্টিমুখ না করিয়ে কিন্তু ছাড়ব না… এক মিনিট।’ তাকে হতভম্ব করে শক্তিমাস্টার ভিতর—বাড়ির দিকে হনহন করে চলে গেল। নেপু নামের লোকটি ঘরে এসে বসল। বোধহয় প্রতিবেশী আত্মীয়।

অপরিচিত লোক, বারবার তার দিকে তাকাচ্ছে, সে অস্বস্তি বোধ করে ঘরের বাইরে এল। আকাশ পরিষ্কার, মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। রোদের তাপে মাটির উপরের স্তর শুকোচ্ছে। মেটে গন্ধটা তার ভালোই লাগছে, পাঁচিলের ধারে দুটো টগর গাছের নীচে অজস্র সাদা ফুল ছড়িয়ে রয়েছে। তার মনে পড়ে গেল সূর্য গাঙ্গুলি স্ট্রিটের বাগানেও টগর গাছ ছিল। কারখানার জন্য ঘর তুলতে গিয়ে সেটা কেটে ফেলতে হয়। …সেই কারখানা আজ অন্য লোকের। মামলার খরচ তুলতে বিবি লিজ দিয়ে দিয়েছে। এখানে পারুলও তাই করেছে, তবে জমি যেকোনো সময় ফিরিয়ে নিতে পারবে। … পাঁচ বিঘের জমিটা যদি তাকে ছেড়ে দেয় পারুল!

শক্তি মাস্টার ভালো কথাই বলল, অভিজ্ঞতা চাই। ‘আরও কিছুদিন বাস করুন’, …সে করবে। ঝড়বৃষ্টি, পোকামাকড়ের সর্বনাশ থেকে দু—হাতে আগলে ধান, সবজি মানুষ করবে। বাচ্চচা থেকে বড়ো করে তুলবে। যে সন্তানদের দেখে বাবার মনে গভীর শান্তি ছড়িয়ে যায় তেমন সন্তান সে খেতে তৈরি করবে… পাগলের মতোই এবার থেকে সে ভাববে। পাগলরা মান—সম্মান অধিকার নিয়ে মাথা ঘামায় না। সে পারুলকে বোঝাবে, দরকার হলে বিবির কাছে যাবে…হাতজোড় করতে হয় যদি করবে। বাকি জীবনটা দোতলার ঘরে দিনরাত বন্দির মতো কাটিয়ে যেতে হবে ভাবলেই বুকের ভিতরটা হিম হয়ে যায়।… যাবজ্জীবন থেকে আর একটা যাবজ্জীবনে, পারুলকে চোখের সামনে রেখে বেঁচে থাকা!

‘একি উঠোনে ঘুরছেন যে, ঘরে চলুন।’ শক্তিমাস্টারের এক হাতে চিনেমাটির প্লেট অন্য হাতে জলের গ্লাস। প্লেটে চারটি নারকেল নাড়ু, দুটো ক্ষীরের সন্দেশ। ‘সব বাড়ির তৈরি।’

‘আমি কিন্তু…’ বলে সে সন্দেশ দুটো একসঙ্গে মুখে ঢোকাল, নাড়ু চারটে পকেটে পুরল। শক্তি মাস্টার হাসল। জল খেয়ে সে ‘এখন আসি, আবার আসব’ বলে সদর দরজার দিকে পা বাড়াল।

‘রঘুবাবু আপনি কিন্তু পারবেন।’

সে থমকে ফিরে দাঁড়াল। ‘কী করে বুঝলেন?’

‘যে লোক আমিই সেই খুনিটা’ পরিষ্কার গলায়, চোখে চোখ রেখে বলতে পারে, তার মনের জোর আছে, সাহসও আছে। সে পারবে।’

হায়রে সাহস! পারুল আর তার বউদিমণি, একজন রণমূর্তি ধরে, অন্যজন মার্জিতভাবে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই পৃথিবীতে তার জায়গা কোথায়। ছাব্বিশ নম্বর বাড়ির ছোট ঘরে প্রথম দিন ঢোকার সময় দরজায় হাত রেখে নিজেকে সে বলেছিল ‘এখনও বুঝতে পারছি না আমি কে!’

.

দাওয়ায় একা মন্তা। দেয়ালে ঠেশ দিয়ে পা ছড়িয়ে, হতে কাঁচি, একটা রঙিন ম্যাগাজিন থেকে ছবি কাটছে। পাশে গঁদের শিশি। ওর মা কোথায়? বেরোবার সময় সে পারুলকে দেখতে পায়নি। উনুনের দিকে সে তাকাল। একটা থালায় তার দুপুরের ভাত, দুটো বাটি, তার উপর উপুড় করা একটা থালা, নিবানো উনুনের উপর রাখা।

‘করছ কী?’

মন্তা ম্যাগাজিনটা তুলে দেখাল। সিনেমার। একটি মেয়ে যথাসম্ভব বুক খুলে চটুল চোখে এমনভাবে বসে যাতে উরুদুটো থেকে খাটো স্কার্ট উঠে যায়। সে অবাক হতে গিয়েও হল না। মন্তার সতেরো বছর বয়স, মেয়েদের শরীর দেখার ইচ্ছা ওকে তাড়া করতেই পারে।

‘পেলে কোথায়? মা দেখলে কী বলবে?’

প্রশ্ন দুটো এড়িয়ে গিয়ে মন্তা শুধু হাসল। সামনের দাঁত দুটো বেরিয়ে এল, হাসিটা ঠিক বোকার মতো নয়। পারুল তা হলে ঘরে নেই। সে পকেট থেকে নাড়ু চারটে বার করে বাড়িয়ে ধরতেই মন্তা ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে নিয়ে বলল ‘কে দিল?’

‘এখানে আমার এক বন্ধু আছে, সে দিল। …মা কোথায়?’

‘কলকাতা গেছে।’ মন্তা একটা নাড়ু মুখে দিয়ে চিবোতে শুরু করল।

শুনেই তার মনে হল, বিবির কাছে গেছে। নিশ্চয় নালিশ জানিয়ে বউদিমণির নির্দেশ চাইবে। নিশ্চয় বলবে, ‘আমি মালিক সব কিছুর, জমি জায়গা বাড়ির ‘সব কিছুর মালিক’ বলে চে�চিয়েছি। শুনে বিবির মুখে তৃপ্তির হাসি খেলে যাবে। হয়তো জিজ্ঞাসা করবে, ‘কি বলেছে? …তুমি আমার আশ্রিত? …দয়া করে থাকতে দেওয়া হয়েছে? বলতে দাও, যত পারে চেঁচাক।’

‘কলকাতায় কোথায় গেছে?’

‘জেঠিমার কাছে।’

‘তুমি জেঠিমাকে দেখেছ?’

‘খুব ছোটোবেলায়… এখানে একবার এসেছিল। খুব সুন্দর দেখতে।’

‘মা ফিরবে কখন?’

‘বলেছে বিকেলে ফিরবে, সকালে রান্না করে রেখে গেছে …লুডোটা রেখে দিয়েছেন এখনও?’

‘হ্যাঁ। তুমি কি ঘর পাহারা দিচ্ছ?’

‘মা বলে গেছে ঘর ফেলে রেখে কোথাও যেন না যাই। বুলিদি কাজ করতে আসবে, ও যা চোর একটা! গাছ থেকে কাঁটাল চুরি করেছিল! লোকের বাড়ি থেকে চাল চুরি করে, বাসন চুরি করে…খুব খারাপ হয়ে গেছে।’

‘তাই নাকি, খুব খারাপ?’ চোখ বড়ো করে সে হালকা সুরে বলল, ‘কতটা খারাপ?’

মন্তার মুখ বয়স্কদের মতো গম্ভীর হয়ে গেল। গলাটা নামিয়ে বলল, ‘খালপারের মেয়েগুলো যা করে বুলিদিও তাই করে… একদম খারাপ হয়ে গেছে। মা তো সেজন্য ওকে ওপরে যেতে দেয় না।’

তার গালে কেউ যেন ঠাস করে একটা চড় মারল। মুখটা জ্বালা করে উঠল। পারুল তার সম্পর্কে এতটা নীচু ধারণা করে! উনুনের উপর থেকে ভাতের থালাটা তুলে নিয়ে সে খামার বাড়ির দিকে এগোল।

‘জেঠু, গেঞ্জিটা এখনও আছে?’

সে জবাব দিল না। মন্তাকে তার বিশ্রী লাগছে।

বিকেলে সে পারুলের গলা শুনতে পেল। বুলিকে ধমকাচ্ছে।

‘কাজ ছেড়ে দে, তোকে আর করতে হবে না… অনেক লোক পাওয়া যাবে। …এখনও ঝাঁট দেওয়া, হাঁসগুলোকে তোলা কিছুই হল না।’

সে জানালায় উঁকি দিয়ে দেখল পারুল গরম জলের বাটি উনুন থেকে নামাচ্ছে, বুলি উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। জানালা থেকে সে সরে গেল।

‘বল চা হয়ে গেছে।’

রোজকার মতোই বুলি জানালার নীচে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে চেঁচাল ‘মামাবাবু চা হয়ে গেছে।’ বুলিকে দিয়ে উপরে চা পাঠানো যায় কিন্তু কেন পাঠায় না তার কারণটা সে মন্তার কাছে জেনেছে, বুলি ‘একদম খারাপ হয়ে গেছে।’

নেমে এসে চায়ের গ্লাসটা নেবার সময় পারুল তাকে বলল, ‘বউদিমণি একটা চিঠি দিয়েছে আপনাকে।’

সাদা খাম আঠা দিয়ে বন্ধ। খামে লেখা ‘শ্রীরাঘবেন্দ্রনারায়ণ দত্ত।’ চিঠিটা পারুলের সামনে খুলে পড়া ঠিক হবে না ভেবে সে দোতলায় উঠে এল। সে নিশ্চিত, পারুল তার বিরুদ্ধে কিছু বলেছে আর চিঠিটা সেই সম্পর্কেই।

তার অনুমানটা ঠিকই। লেটার হেড—এ সবুজ কালিতে বিবির নাম উপরে ছাপা, ‘শ্রীমতী জাহ্নবী দত্ত,’ নীচে বাড়ির ঠিকানা। মোটা ভারী ঝকমকে কাগজ।

বিবি চিঠিতে বরাবরই তাকে সম্বোধন করত ‘রঘু’, এই চিঠিতেও তাই। তাদের বাড়ির মেয়ে—বউদের মধ্যে বিবিই প্রথম ‘শ্রীচরণেষুর’ রীতিটা ভেঙেছে। বিবির হাতের লেখা মুক্তোর মতো, কোনো কাটাকুটি নেই।

‘পারুল যা বলল তার সবটা বিশ্বাস করছি না, কিছু নিশ্চয়ই বাড়িয়েছে। একটা কথা তোমার বোঝা দরকার, গোকুলানন্দে থাকতে হলে ওকে চটিয়ো না। পারুল শুধুই আশ্রিত নয়, তারও কিছু বেশি। সেটা তুমি জান। ওর সঙ্গে মানিয়ে চলার চেষ্টা কোরো। ওখানকার জমিজমা ওর হাতেই থাকবে। ওখানকার সব কিছুর মালিক তুমি, এই ধরনের কথা, ওকে না বলাই ভালো। এতে নিজের সম্মান বাড়ে না। বিবি।’ শুধুই ‘বিবি’। তার আগে ‘ইতি’ নেই, তারিখ নেই। এটা চিঠি না অধস্তনকে নির্দেশ দেওয়া একটা সরকারি ফাইলের নোট!

চিঠিটা দু—বার পড়ে সে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। পরিষ্কার নীল। কিন্তু তার মনে মেঘের আনাগোনা। একটা কথা সে বুঝেছে, বিবি তাকে সন্ধি করে থাকতে বলছে। …পারুলই সর্বময়ী হয়ে থাকবে… তার ইচ্ছা—অনিচ্ছা পূরণে বিবির কোনো মাথাব্যথা নেই, বরং যে ইঙ্গিত শেষ বাক্যটিতে দিয়েছে সেটাই মারাত্মক। পারুল তাকে সম্মান না—ও দেখাতে পারে!… অপমান করবে?

খালি গ্লাস হাতে সে নীচে নেমে এল। গ্লাসটা দাওয়ার উপর রেখে সে ডাকল, ‘পারুল।’

ঘর থেকে পারুল বেরিয়ে এল বিস্ময় চোখে নিয়ে। সে বিবির চিঠিটা এগিয়ে ধরে বলল, ‘পড়ো’।

ভ্রূ কোঁচকাল পারুল, ‘আপনার চিঠি, আমি পড়ব কেন?’

‘এ চিঠি পড়া যায়, তোমারও পড়া দরকার।’

চিঠিটা হাতে নিয়ে পারুল ঘরে ঢুকে গেল, সে দাওয়ার সিঁড়িতে বসল। পারুল ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। বিবির চিঠিতে শক্ত বানান নেই হাতের লেখাও পরিষ্কার, সুতরাং ছোট্ট চিঠিটা পড়ে ফেলতে ওর বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু লাগছে। সে মুখ ফিরিয়ে ঘরের ভিতর তাকাল। পারুল খাটের উপর বসে, হাতের চিঠির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।

‘মুড়ি লাগবে নাকি গো?’ মাথায় ছোটো একটা বস্তা নিয়ে এক প্রৌঢ়া ঘরের সামনে এসে বলল। ‘না’। পারুল ঘর থেকে জানিয়ে দিল।

‘মামি, আমি চললুম।’ বুলি ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলেই উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে চলে গেল। ঘর থেকে বেরিয়ে এল পারুল।

‘আমি কিন্তু একটা কথাও বাড়িয়ে বলিনি, তবু বউদিমণি লিখল কেন, ‘বাড়িয়ে বলেছি’।

‘কেউ যদি কাউকে দোষী প্রমাণ করতে চায় তখন তার বিরুদ্ধে বাড়িয়েই বলে থাকে। বিবি সেটাই হয়তো ধরে নিয়েছে।’

‘আমি তো আপনাকে দোষী করার মতো কিছু বলিনি।’ পারুলের গলায় ক্ষীণ একটা গ্লানির ভাব তার কানে ধরা পড়ল।

সে পারুলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে বয়সের ছাপ পড়েছে, শরীরে এখনও যৌবনের শেষ রশ্মিটুকু থাকার কথা, কিন্তু রাত্রি নেমে আসছে। পঙ্গু একটা ছেলেকে নিয়ে গ্রামের নির্জন কিনারে একা ষোলো বছর ধরে বাস করা তরুণী বিধবার পক্ষে সহজ কথা নয়। উদবেগ ওকে কঠোর করে দিয়েছে, ঢেকে দিয়েছে রুক্ষ আবরণে। তবু ওর মধ্যে কোথাও একটা নরম জায়গা আছে, যেখানে ঘা দিলে ব্যথা পায়। ‘আমি তো আপনাকে দোষী করার মতো কিছু বলিনি, একটা কথাও বাড়িয়ে বলিনি।’ হয়তো বলেনি। কিন্তু কোর্টে আঙুল তুলে বলেছিল ‘এই লোকটাই।’ পারুল কি ভুলে গেছে?

‘তুমি কী বলেছ জানি না। কিন্তু আমি তো জানি, কী আমি বলেছি। … আমার তখন মাথার ঠিক ছিল না। ভালমনেই আমি মন্তার জন্য ওগুলো কিনেছিলাম, খুবই সামান্য জিনিস। কিন্তু তুমি যে ফিরিয়ে দেবে আমি তা ভাবতে পারিনি।’ সে উঠে দাঁড়াল। পারুল মুখ নীচু করে রয়েছে। ‘একটা লোকের সঙ্গে রথতলায় সেদিন আলাপ হয়েছিল। আজ তার বাড়িতে গেছিলাম, শক্তিপদ হালদার।’

‘শক্তি মাস্টার! কী জন্য?’

‘লোকটা স্কুলে পড়ায়, চাষবাসও করে, গ্রামে যে এমন বিচক্ষণ মানুষ পাব ভাবতে পারিনি। ওর কাছ থেকে কিছু জেনেটেনে নিয়ে নিজেই এই পাঁচ বিঘে জমিটায় সবজির চাষ করব ঠিক করেছি।’

‘আপনি করবেন!’ পারুলের মুখে ক্ষীণ হাসি ফুটল।’ আপনি চাষের কিছু জানেন?’

‘তুমিও কি কিছু জানতে? জলে না নামলে কি কেউ সাঁতার শিখতে পারে?’

‘কী সবজি করবেন?’

‘টমেটো নয়তো কলা কিংবা কপি … ফুলকপি, মুলো, বেগুন।’

‘আমি ওই জমিতে ধান দিয়েছি, অন্য কিছু করতে দোব না।’ পারুলের হালকা হয়ে আসা কথার ভঙ্গি হঠাৎই কঠিন হয়ে গেল।’ মটর আর সরষে বুনে আমি লোকসান খেয়েছি। … সাঁতার শিখতে গিয়ে ডুবেও যায় মানুষ, তখন তো নিমিত্তের ভাগি হব আমিই! বউদিমণিকে কী বলব লোকসান হলে?’

পারুল সন্ধি করতে রাজি নয়। এখন আর কথা বলে লাভ হবে না। সে কয়েক পা এগিয়ে ফিরে দাঁড়াল। ‘শক্তি মাস্টার বলল, পঞ্চায়েত নির্বাচন আসছে, এবার মেয়েদের পঞ্চায়েত মেম্বার করা হবে, তুমি যদি ভোটে দাঁড়াও…।’

পারুল উঠে ঘরের ভিতর চলে গেল। ‘ভোট—ফোটে আমি দাঁড়াতে পারব না।’

দশ

আচমকাই বিকেলে হাজির হল হেমন্ত। একটা বাজারের বড়ো থলি ভরা জিনিস পারুলের দাওয়ায় নামিয়ে ডাকল, ‘পারুলদি।’

ওর গলার আওয়াজে প্রায় একই সঙ্গে গোয়ালের পাশে মানকচুর গোড়া শাবল দিয়ে খোঁড়ায় ব্যস্ত পারুল উঠে দাঁড়াল আর সে গিয়ে দাঁড়াল জানালায়। হেমন্তকে দেখে সে অবাক হল। হঠাৎ এখানে কেন এল? দুজনের কথা সে শুনতে পাচ্ছে না। মন্তার ছিপ আর একটা খালুই নিয়ে পুকুরে সারা দুপুর কাটিয়ে একটু আগেই সে ফিরেছে।

ইদানীং, সে দুপুরে মাছ ধরার ছুতোর সময় কাটায়। পুঁটি, খলসে, ট্যাংরার থেকে বড়ো মাছ এই ছিপে ওঠে না। চড়া রোদে আচ্ছাদনহীন জায়গায় বেশিক্ষণ বসা যায় না তাই তার বসার জায়গা ঘাটলার গায়ে নিম গাছটার নীচে। বুলি এখানে এঁটো বাসন মাজে, পাতের ভাত খাবার জন্য মাছগুলো ঘাটলায় আসে। স্বচ্ছ জলের নীচে ওদের ঘোরাঘুরি উপর থেকেও দেখা যায়। আর দেখা যায় আমবাগানটা। বড়ো বড়ো গুঁড়ির ফাঁক দিয়ে দূরে শরৎ বসাকের বাড়িটা, আরও দূরে খালপারের রাস্তার একটুখানি। দু—চারটে মানুষ, ভ্যান রিকশা, সাইকেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা যায়। শালিক, কাক আর ঘুঘু ছাড়া আর কোনো পাখির ডাক সে চেনে না। মাঝে মাঝে হঠাৎই বুলবুলি এসে যায়। পাখি চিনতে, পাখির ডাক চিনতে তার ইচ্ছে করে। তুলসীপাতার মতো গন্ধওয়ালা কমলা—সাদা ফুলের ঝোপ পুকুরের পাড়ে, বাড়িতে ইঁদারার ধারে, খামার ঘরটার পাশে। সে এই ফুলের নাম জানে না। কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও লজ্জা করে। ধীরে ধীরে জেনে নেবে পাখিদের, ফুলেদের, মাছেদের, শাকপাতার নাম। ধান, মাটি, সার, বীজ, পোকামাকড় সম্পর্কে কিছুই সে জানে না। থিয়োরেম প্রব্লেমের মতো, সন—তারিখের কি পদ্যের অনেক নাম, অনেক ধরন, এদের মধ্যে অনেক রকমের সম্পর্ক, আলাদা চালচলন, এগুলো স্কুলে বইয়ের মতো মুখস্থ করা যায় না। এগুলো শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো শরীরের নিয়মের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হয়। এজন্য সময় লাগবে… ‘আপনি আগে তৈরি হয়ে নিন।’

তৈরি হবার জন্য সব কিছু থেকে মনকে গুটিয়ে এনে একটা জায়গায় জমা করতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাৎনাটার দিকে তাকিয়ে থেকে তার মনে হয়েছে এটা একটা ভালো পদ্ধতি। সকালে ইস্টদেবতার নাম চোখ বুজে জপ করত মা কাঠের মালা বুড়ো আঙুল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। তখন মা—র মুখ দেখে তার মনে হত জগৎ—সংসার থেকে আলাদা হয়ে শুধু কোনো একটা জায়গায় যেন নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছে। … গুরুদেবের কাছে মন্ত্র নেওয়ার কথা জীবনে সে ভাবেনি, এখনও ভাবে না। সে এখন গভীরভাবে ফাৎনাটার দিকে তাকিয়ে থাকে, কখন ওটা ঠকঠক কেঁপে ওঠে, কখন সাদা কাঠিটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই ডুব দেয়।

আজ একটা চিংড়ির বাচ্চচা আর চারটে পুঁটি পেয়েছে। দেখে হয়তো মন্তা তার সামনেই হাসতে শুরু করবে। পারুল হাসে না। ও এমন একটা ভাব দেখায় যে, একটা কিছু নিয়ে তো লোকটাকে থাকতে হবে, এই নিয়েই থাকুক। সে যে ক—টা মাছ পায়, রাত্রে ঝাল বা ঝোলের বাটিতে ঠিক সেগুলোই তার কাছে ফিরে আসে। এই নিয়ে সে কোনো কথা বলে না। হয়তো পারুল বলে বসবে, ‘আপনার ধরা মাছ আমরা খাব কেন?’

পারুল মাটি খুঁড়ে মান কচুর গোড়া তুলছিল। তার পাশে উবু হয়ে বুলি পাতাগুলো ছিঁড়ে ডাঁটা জমাচ্ছে। সে ছিপ আর খালুইটা দাওয়ায় রেখে শুধু চেঁচিয়ে বলল, ‘ছিপটা রইল।’ এর মিনিট দশেক পরই হেমন্ত এল। কথা বলতে বলতে হেমন্ত থলিটা থেকে দুটো সাদা বাক্স বার করল। দেখেই সে বুঝল ওতে মিষ্টি রয়েছে। ব্যাপার কী? হেমন্ত একটা বাক্স পারুলের হাতে দিতেই ওর মুখে হাসি আর বিগলিত ভাব ফুটে উঠল। হেমন্ত অন্য বাক্সটা নিয়ে এবার খামার বাড়ির দিকে আসছে। সে অপেক্ষা শুরু করল একগ্লাস জল হাতে নিয়ে।

‘দাদাবাবু।’ দরজায় দাঁড়িয়ে হেমন্ত। সে তাকাল। ‘বউদিমণি পাঠিয়ে দিলেন … দাদামণি পাশ করেছে।’

হেমন্তর গালভরা হাসিটা চুপসে গেল দাড়িওয়ালা লোকটার চাহনি দেখে। ‘এতে কী আছে?’

‘সন্দেশ … অন্নদার।’

‘সেতো বাক্সর গায়ে লেখা থেকেই বুঝেছি। ছোটোবেলায় মিষ্টি খেতাম তারপর ছেড়ে দিয়েছি,তোমার বউদিমণি তো সেটা জানে।… ওটা নিয়ে যাও, বরং তুমিই খেয়ে নাও, বউদিমণি জানতে পারবে না।’

‘আপনার জন্য আনা … নিয়ে যাব!’ হেমন্ত মুশকিলে পড়ে গেছে। কলকাতায় ফিরে বলবে কী, সেটাই বোধহয় এখন ও ভাবছে।’

‘তোমার কাজ তুমি করেছ, কেউ যদি না নেয়—তুমি কী করতে পার।’

‘সন্দেশটা খুব ভালো ছিল, বউদিমণি আনন্দ করে পাঠিয়ে দিলেন, একটা অন্তত মুখে দেবেন তো!’

‘একটাও না। … এই নিয়ে আর কথা বোল না। তুমি কি সন্দেশ দিতেই কলকাতা থেকে এসেছ?’

হেমন্তর বলার ভঙ্গি চাকরবাকরের মতো নয়, আত্মীয়তার ছোঁয়া ওর কথায় লেগে আছে। ছেলের পাশের খবরে বাবা কিছুমাত্র উচ্ছ্বসিত না হওয়ায় ও যেন মর্মাহত। রূঢ় হওয়ার জন্য নিজেকে এবার তার দোষী মনে হচ্ছে। ‘ঘরে এসো, বাক্সটা টেবিলে রাখ।’

দমে যাওয়া হেমন্তর মুখ সতেজ হয়ে উঠল। ‘দাদামণি বন্ধুদের নিয়ে কাল পিকনিক করতে আসবে, তাই আমি এলুম সব ব্যবস্থা করে রাখতে।’ হেমন্ত বাক্সটা টেবিলে রাখল।

‘এখানে পিকনিক করবে? … ক—জন আসবে?’ স্কুলে পড়ার সময় সে—ও পিকনিক করে গেছে ক্লাসের ছেলেদের নিয়ে।

‘আমবাগানে রান্নাবান্না হবে। ওখানে তো আগেও হয়েছে। … আমিও অবশ্য দেখিনি। অরুণাদি বলল, বউদিমণি বন্ধুদের নিয়ে এসে পিকনিক করেছেন।’

বন্ধু! বিবির বন্ধু তো অপূর্ব! সঙ্গে আর কারা ছিল? গুলু, গোরা থাকবে, কিন্তু অপূর্বর বউ কি ছিল? অরুণা? … ‘আমিও অনেক কিছু দেখেছি, যাবার আগে সবাইকে বলে যাব।’ অরুণা এখানে কি কিছু দেখেছিল?

‘হাঁড়ি—কড়া বাসনপত্তর সবইতো পারুলদির ঘরে তোলা আছে। কয়লার উনুনটা আছে এই নীচের ঘরে। পারুলদি মুরগির জোগাড় করে দেবে, আমি রথতলা থেকে বিকালে কয়লা কিনে বাজার করে আনব। কলকাতা থেকে বাসমতি চাল, ব্যাসন, মুগের ডাল, গুঁড়ো দুধ, চা, কাগজের গেলাসও এনেছি, মাত্র ছ—সাতজন তো আসবে।’

হাত তুলে সে হেমন্তকে থামাল। ‘তাহলে তোমার তো এখন অনেক কাজ।’

‘কাজ তো সকালে। উনুন ধরিয়ে রান্নার তোড়জোড়… আমিই রাঁধব।’

বুলির ডাক নীচের থেকে শোনা গেল, ‘মামাবাবু, চা হয়ে গেছে।’

‘চলো, নীচে যাই। … রাতে থাকবে কোথায়?’

‘দাওয়াতেই রাতটা কাটিয়ে দেব।’

তারা দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। স্টিলের গ্লাসে পারুল চামচ নাড়ছে। নাড়া শেষ হতেই সে হাত বাড়াল নেবার জন্য।

‘আপনার নয় … হেমন্ত চা নাও।’

‘দাদাবাবুকে আগ দাও।’ হেমন্ত দাঁড়িয়ে রইল।

এইবার সে লক্ষ করল চিনেমাটির কাপে পারুল লিকার ঢালছে। হঠাৎ তাকে খাতির! চাকরের সামনে মনিবকে গ্লাসে চা দেওয়া যায় না বলে? ডিস সমেত কাপটা নেবার সময় সে পারুলের মুখে চোখ রাখল। নির্বিকারমুখ পারুল শুধু বাঁ হাতে ঘোমটাটা বাড়িয়ে দিল।

সকালে নীচে সে দেখল খাবার ঘরের দরজার ঝাঁপটা সরানো। এখানে আসার পর একদিনও সে ঘরটার ভিতরে ঢোকেনি। ঝাঁপের ফাঁক দিয়ে প্রথম দিন যতটুকু দেখেছিল তাই—ই রয়েছে। তবে তখন সে দেখেনি, মেঝেয় ঝাঁটা আর এক কোণে ধানের বস্তার পাশে পড়ে থাকা তার মোটর বাইকের কঙ্কালটাকে। ভাঙা দেওয়াল, জানালার ফোকর,আঁটি বাঁধা খড় ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। বাইকটা কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বিবি বিক্রি করে দিতে পারত! মাডগার্ড, হ্যান্ডল, আর এঞ্জিনটা চোরেরা কেন যে রেখে গেল! বাইকে শেষবারের মতো চেপেছিল পারুলকে পিছনে বসিয়ে, ভাবলে এখন অবাক লাগে।

পারুল আজ একটু ব্যস্ত। একটা পুরনো বেডকভার আর লম্বা কাপড়ের পাড়ের ফালি বুলির হাতে দিয়ে বলল, ‘ছুট্টে হেমন্তকে দিয়ে আয় আর বেলার মা—র কাছ থেকে আমার নাম করে কয়লা ভাঙার হাতুড়িটা এনে কয়লাগুলো ভেঙে দে। তারপর বাটনা বাটা আছে… আজ তুই এখানে খাবি।’

সে দাঁড়িয়ে আছে চায়ের জন্য। চায়ের জল এখনও বসানো হয়নি। পারুল কৈফিয়তের সুরে বলল, ‘সকালে মুরগির জন্য গেছলুম নিশি মণ্ডলের বাড়ি … কেটে,ছাড়িয়ে আনতে দেরি হল; আমি আর হেমন্ত দুজনে মিলে উনুনটা বাগানে নিয়ে গেলুম,… গাছে কাক—শালিক রয়েছে, মাথার ওপর একটা কিছু ঢাকা না দিয়ে কি রান্না করা যায়? চাদরটা বার করে দিলুম … এখুনি চা হয়ে যাবে, একটু বসুন।’

পায়ে পায়ে সে উঠোন থেকে রাস্তার দিকে এগোল। আমবাগানের মাঝামাঝি সব থেকে বড়ো গাছটার নীচে রান্নার বাসনগুলো, তার সঙ্গে বড়ো একটা তোলা উনুন, কয়লার চাঙড়, কয়েকটা ঠোঙ্গা, কৌটো আর তেলের বোতল। চাদরটা হেমন্তর হাতে দিয়ে বুলি চলে যাচ্ছে বোধহয় হাতুড়ির খোঁজে। মন্তা জট পাকানো পাড়ের ফালি টেনে টেনে খুলছে। আজকের সকালটা খুব চমৎকার। ভাদ্রমাস পড়ে গেছে। ঝকঝকে রোদ, মেঘ নেই আকাশে, পুকুরের জলে ছায়া পড়েছে বাঁশঝাড়ের, খালপারের রাস্তা থেকে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, আকাশে চিল, গা জুড়োনো বাতাস। আধবোজা হয়ে এল তার চোখ।

‘চা হয়ে গেছে।’

সে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখল পারুল এগিয়ে আসছে তার দিকে, হাতে একটা জারিকেন। ধ্বক করে উঠল তার বুক। মুহূর্তের জন্য একটা অশুভ ছায়া তার মনে ভেসে উঠল। পারুলের হাতে ওই জিনিসটা কেন?

‘স্যাঁতানো ঘুঁটে কি ওমনি ওমনি ধরবে কেরোসিন না দিলে!… আপনার চা ঢাকা দিয়ে রেখে এসেছি।’ পারুল তার পাশ দিয়ে আমবাগানের দিকে এগিয়ে গেল। ওকে পিছন থেকে দেখতে দেখতে আর একবার তার বুক কেঁপে উঠল। উঠোনে দাঁড়িয়েই চা খেয়ে সে উপরে উঠে এল। হঠাৎই কেমন যেন অস্থিরতা বোধ করছে। ব্লাড প্রেশার শুরু হল কিনা কে জানে! তাজা বোধ করছে অথচ একটা পুরোনো স্মৃতি তাকে অবসাদে ভরিয়ে দিল কয়েক মিনিটেই। সে বিছানায় শুয়ে পড়ল।

একসময় সে মোটর এঞ্জিনের শব্দ পেল। কিছু উত্তেজিত পুরুষ কণ্ঠস্বর ক্ষীণভাবে তার কানে পৌঁছল। ওরা এসে গেছে। ওরা আজকের দিনটা উপভোগ করবে, ওদের মধ্যে গোরাও আছে। তার ইচ্ছে করল ছেলেকে পলকের জন্য হলেও একবার দেখতে। সে বিছানা ছেড়ে জানালায় এসে দাঁড়াল।

আমবাগানের খানিকটা জানালা থেকে দেখা যায়, বাকিটা বাঁশঝাড়ের আড়ালে। সেই আড়ালে—পড়া অংশেই রান্না হচ্ছে। সে অনেকক্ষণ চোখ পেতে রইল যদি একজনকেও দেখা যায়, কিন্তু কাউকেই দেখতে না পেয়ে নীচে নেমে এল। উঠোন পেরিয়ে যাবার সময় দেখল পারুল রান্না করছে। কোমরে জলভরা কলসি আর এক হাতে জলের বালতি নিয়ে বুলি চলেছে আমবাগানের দিকে। সে আর না এগিয়ে একটা খেজুর গাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল।

টেপরেকর্ডারে রক সংগীতের সুর বাজছে। মন্তা উবু হয়ে রেকর্ডারটার পাশে বসে। ঘাসের উপর পাতা বেডকভারে একটি ছেলে চিৎ হয়ে শুয়ে, আর একজন পা ছড়িয়ে বসে। জিনস আর কালো গেঞ্জি পরা লম্বা চওড়া গৌরবর্ণের একটি ছেলে, চোখে সানগ্লাস, একাই শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে দুমড়ে মুচড়ে নেচে চলেছে। দেখামাত্রই সে গোরাকে চিনতে পারল। অতবড়ো শরীর আর কার হবে! এই নাচকে কী বলে … টুইস্ট? শ্যেক? নাকি অন্য কিছু।

গোরা একটু একটু করে সরে গিয়ে আচমকা বুলির পথ জুড়ে নাচতে লাগল। কলসি আর বালতির ভারে বেঁকে যাওয়া বুলি তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ওকে পাক দিয়ে গোরা ঘুরছে। বেডকভার ছেড়ে দাঁড়িয়ে উঠে ছেলে দুটি এবার তালি বাজাতে শুরু করল।

দু—তিনবার পাক দিয়ে হঠাৎ নাচ থামিয়ে গোরা সিঁটিয়ে থাকা বুলির হাত থেকে বালতিটা টেনে নিল, কলসিটা নেবার জন্য অন্য হাত বাড়াতেই এবার বুলি পিছিয়ে গেল। বাবুদের ছেলে জল বইছে এটা দেখা বোধহয় ওর কাছে লজ্জার ব্যাপার। কলসির বদলে বুলির কাঁধ ধরে প্রায় ঠেলে নিয়েই গোরা রান্নার কাছে এগিয়ে গেল। জলের বালতিটা রেখে হেমন্তর সঙ্গে দুটো কথা বলে গোরা ফিরে গেল বেডকভারের দিকে। মন্তা হাসছে বুলির দিকে তাকিয়ে। ওরা তিনজনও হাসছে। ওরা আমোদ করতে এসেছে।

মোটরের হর্ন সে শুনতে পেল। আর একটা গাড়ি। গাড়িটা বাঁশঝড়ের আড়ালে থেমেছে বলে সে দেখতে পাচ্ছে না। ওরা তিনজন হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল। সে নবাগতদের দেখার আশায় উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে রইল। আরও চারজন, তাদের দুজন খুব খাটো হাফ প্যান্ট, আর ছাপমারা গেঞ্জি পরা, কার্ডবোর্ডের দুটো পেটি বয়ে এনে বেডকভারের উপর রাখল। এতদূর থেকেও সে চিনতে পারল পেটিদুটো বিয়ারের। ওরা আমোদ করতে এসেছে।

সে ফিরে এল। উঠোন দিয়ে যাওয়ার সময় পারুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শরীরটা ভালো নেই। আজ আর কিছু খাব না।’ নিজের ঘরে এসে প্রথমেই সে জানালাটা বন্ধ করে দিল। ওদের কারুরই এদিকে আসার দরকার পড়বে না। গোরা এসে তার বাবার সঙ্গে দেখা করবে এমন সম্ভাবনাকে আমল দেবার প্রশ্নই ওঠে না।

সত্যিই তার শরীর অবসন্নতায় ভরে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারছে তার ভিতরে কীরকম একটা ভয় নিঃসাড়ে ঢুকে এসেছে, সম্ভবত জারিকেন হাতে পারুলকে দেখেই কিংবা গোরার নাচের সঙ্গে। আজ সে একটা সুন্দর সম্পর্ক বোধ করেছিল প্রকৃতির সঙ্গে, এখন আর তা করছে না। যোগাযোগ করার পথগুলো এক—এক সময় মনে হয়েছে এত বেশি দীর্ঘ যে, সারাজীবন শুধু হেঁটেই যেতে হবে। হাঁটতে তার ভালো লাগে, যদি জানে শেষ পর্যন্ত একটা বিশ্রামের জায়গা পাওয়া যাবে। গোকুলানন্দে এসে পর্যন্ত সে হেঁটেই চলেছে। কিন্তু শ্রীগোপালের মতো কখনোই সে মাঝপথে বলবে না পাপ করেছি, করাপ্ট হয়েছি। সে কিছুই বলতে চায় না। গাছ, জল, আকাশ, বাতাস, মাছ, পোকামাকড়ের মতো কথা না বলে থাকতে পারলে সে কখনোই বলত না ‘উঠে পড়ো, পৌঁছে দিচ্ছি।’ … পৌঁছলাম। কিন্তু কোথায়?

পাতলা একটা ঘুমের আস্তরণের আড়লে জগতের সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে সে ব্যর্থ হচ্ছিল। নানান ধরনের শব্দ বাইরে থেকে জীর্ণ জানালা দরজা দেয়াল ভেদ করে তার চেতনায় ঢুকে পড়েছে আর সে সেগুলোকে আলাদা আলাদা করে কথায় রূপান্তরিত করে গেছে। একটা কথারও অর্থ সে ধরতে পারেনি। অস্বস্তিতে এপাশ ওপাশ করে একসময় তার মনে হল, সিঁড়িতে কার যেন উঠে আসার পায়ের শব্দ সে শুনল। কার শব্দ হতে পারে? এখানে কারুরই তো আসার সম্ভাবনা নেই! তবু মনে হল ঠিকই শুনেছে। বিছানায় সে উঠে বসল। খোলা দরজা দিয়ে আসা আলোয় ঘড়িটা টেবিল থেকে তুলে সময় দেখল… আড়াইটে!

বিছানা থেকে নেমে কলসি থেকে কাচের গ্লাসে জল গড়াল। চোখে জল দেবার জন্য গ্লাসটা নিয়ে ছাদের দিকে যেতে গিয়েই একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখে সে থমকে পড়ল। পাঁচিলবিহীন ছাদের উত্তরদিকের কিনারে মন্তা উপুড় হয়ে, তার বুক পর্যন্ত প্রায় কার্নিসের বাইরে। ও নীচের দিকে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। সর্বনাশ, ও তো পড়ে যাবে! তার মনে হল, চেঁচিয়ে উঠলেই মন্তা চমকে যাবে তাইতে বিপদ ঘটে যেতে পারে।

সে পা টিপে ঘটে যেতে পারে।

সে পা টিপে মন্তার কাছে পৌঁছেই খপ করে ওর জামার কলারটা ধরে পিছন দিকে টান দিল। মন্তার রোগা দেহটা ছাদের ভিতরে হিঁচড়ে চলে এল। ভীত চোখে ও চিৎ হয়ে শুয়ে, মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে।

‘কী করছিস? এখুনি তো পড়ে যেতিস… কী দেখছিলি ওভাবে?’

মন্তা ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘কিছু না।’

‘কিছু না?’ সে ধমকে উঠল। ‘কিছু নয়তো, ওভাবে প্রাণ হাতে নিয়ে কেউ ঝুঁকে পড়ে?… বল কী দেখছিলি?’ সে কান ধরল মন্তার।

‘বল শিগগিরই… তোর মা কোথায়?’

‘ঘরে, শুয়ে আছে।

‘চল তোর মা—র কাছে।’

‘না।’ মন্তা ধাতস্থ হয়েছে। ওর চোখে বোকামিটা ফিরে এসেছে কিন্তু তা ছাড়াও আরও কী যেন ঝিলিক দিচ্ছে। কান থেকে সে হাত নামাল। দ্রুত ছাদের কিনারে গিয়ে নীচে তাকাল। ঝোপ, ঝাড়, ভাঙা ইট ছাড়া আর কিছু নেই। মুখ ফিরিয়ে মন্তার দিকে তাকাতেই দেখল, ওর সামনের দাঁতদুটো বেরিয়ে রয়েছে… হাসছে।

‘নীচের ঘরে বুলিদি।’

‘কী হয়েছে তাতে?’

‘ওর সঙ্গে দুটো ছেলেও।’

‘কী বললি?’ তার গলা দিয়ে অস্পষ্টভাবে কথাটা বেরোল। ‘দুটো ছেলে!’

‘হ্যাঁ জেঠু। দেয়ালের ভাঙা জায়গাটা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটুখানি… বুলদি শুয়ে আছে।’

‘কী বললি… কোন দুটো ছেলে?’ সে চাপা গলায় বলল, ‘কোন দুটো?’

‘বেঁটে মতন রোগাপানা হাফপ্যান্ট পরা আর সেই বড়ো ছেলেটা…’ মন্তা ভয়ে থেমে গেল একটা বিশাল হাঁ—করা মুখ দেখে।

‘ওহ গোরাআআ।’ আকাশের দিকে মুখ তুলে সে কাতরে উঠল।

জলের গ্লাস হাতে নিয়েই সে ঘূর্ণিঝড়ের মতো সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। খামার ঘরের ঝাঁপটা দরজার ফাঁকা জায়গায় দাঁড় করানো। সে একটানে ঝাঁপটা সরিয়ে নিয়ে ভিতরে তাকাল।

বুলি চিৎ হয়ে খড়ের উপর। তার দুই হাঁটু উঁচু হয়ে, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ দুটি শীর্ণ ঊরু দু—পাশে ছড়ানো। ঢেকে রয়েছে চওড়া একটা কালো গেঞ্জি পরা পিঠ, জিনসটা হাঁটু পর্যন্ত নামানো, ধবধবে দুটি বিশাল পাছা। একধারে দাঁড়িয়ে হাফ প্যান্ট পরা বেঁটে একটি ছেলে।

দুই কি তিন সেকেন্ড, সে ছুটে গিয়ে গোরার চুল মুঠোয় ধরে হ্যাঁচকা টান দিল, যেভাবে একটু আগে মন্তাকে টেনেছিল। গোরার মুখ উঠে গেল উপর দিকে। কয়েকটা মুহূর্তের জন্য দু—জোড়া চোখ পরস্পর জড়িয়ে রইল, তারপরই গোরা লাফিয়ে উঠে জিনসটা কোমরে টেনে তুলেই একটা ঘুষি চালাল। খট করে শব্দ হল চোয়ালে। সে দেয়ালে ছিটকে পড়ল। দরজার কাছ থেকে মন্তা ছুটে পালাল চিৎকার করতে করতে, ”মা, মা, জেঠুকে মারছে… মা জেঠুকে ছেলেটা মারছে… শিগগির এসো।’

রাগে অন্ধ হয়ে যাওয়া গোরা আবার ঘুঁষি চালাল। সে উঠতে যাচ্ছিল, মাথায় আঘাতটা লাগতেই আবার পড়ে গেল।

‘ব্লাডি রেপিস্ট!’

মেঝেয় মাথা চেপে বসে পড়া দেহটার পিঠে গোরা জুতো পরা পায়ের লাথি মারল। সে দেয়ালে ঢলে পড়ল। মনে মনে বলল, ‘এটাই পাওনা ছিল।’ দু—হাতে তার চুল ধরে গোরা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, ‘মেয়েটাকে টাকা দিয়েছি, তোমার মতো ফ্রি পাবার চেষ্টা করিনি, আন্ডারস্ট্যান্ড?… ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?’ কথাটার সঙ্গেই সে থুথু দিল তার মুখে।

সে স্থির দৃষ্টিতে গোরার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার মনে হচ্ছে এখন যেন তার নিজের চোখেই শ্রীগোপালের চোখ বসানো রয়েছে, ‘তুই আমাকে মারলি রোঘো!’ মুখের মধ্যে সে নোনতা স্বাদ পাচ্ছে।’

‘আমি রেপ করিনি রে।’ ফিসফিস করে সে বলল।

‘করিনি রে।’ গোরা ভেঙচিয়ে উঠল। ‘সারা বংশের নাম ডুবিয়েছ…. কেন, কেন,কেন আমরা সবাই সাফার করব, কেন?’ উন্মাদের মতো চাহনি গোরার। ‘মেরেই ফেলব আজ।’

‘রনো, থাক এবার …লেটস পুশ অফ।’ হাফপ্যান্ট—পরা এতক্ষণে কথা বলল।

‘যেতে হয় শালা তুই যা, আমি এই লোকটাকে শেষ করে যাব।’

‘আর একবার হাত তুলেছিস কি তোর লাশ এখানে পড়বে হারামজাদা!’

চমকে উঠে সারা ঘর ঘুরে তাকাল। শাড়ি গাছ—কোমর করা পারুল দরজায় দাঁড়িয়ে। উত্তেজনায় ওঠানামা করছে বিশাল বুক, ধকধক করছে চোখ, দু—হাতে তুলে রয়েছে শাবলটা। আপনা থেকেই গোরা এক পা পিছিয়ে গেল।

‘গেট আউট, গেট আউট।’ গোরা চিৎকার করে উঠল।

‘গেট আউট?… কার গায়ে তুই হাত তুলেছিস জানিস?’

‘আমি জানি। যে তোমাকে রেপ করে—’ গোরা কথাটা শেষ করার আগেই শাবলটা তার গলার পাশ দিয়ে বিদ্যুতগতিতে গিয়ে দেয়ালে আঘাত করল। রক্ত সরে গেল গোরার মুখ থেকে। পারুল শাবলটা আবার দু—হাতে তুলে ধরেছে। গলা লক্ষ করেই যে শাবলটা চালানো হয়েছিল সেটা গোরা বুঝে গেছে। আর বুঝে গেছে দ্বিতীয়বার এই মেয়েছেলেটা ফসকাবে না।

‘পারুল বিশ্বেস কী জিনিস আজ তোকে বুঝিয়ে ছাড়ব। আর একটা খুন হবে এ বাড়িতে।’

‘না, পারুল, না।’ সে উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত মেলে পারুলের সামনে দাঁড়াল। ‘গোরা বেরিয়ে যা, নইলে ও খুন করে দেবে।’

পারুলের মুখের দিকে জ্বলন্ত চোখে একবার তাকিয়ে গোরা দ্রুত বেরিয়ে গেল, তার পিছনে হাফপ্যান্ট—পরা। ঘরে শুধু তারা দুজন, দরজার কাছে মন্তা। বুলি নিঃসাড়ে কখন যে বেরিয়ে গেছে, কেউ লক্ষ করেনি। শাবলটা সে পারুলের হাত থেকে তুলে নিল।

কাঁধ ঝুলে পড়েছে পারুলের, অবসন্নের মতো ধুঁকছে। একবার চোখ তুলে তাকাল তার মুখের দিকে। করুণ চাহনিতে পারুল কী বলতে চাইছে, সে যেন বুঝতে পারছে। তার মুখে ক্ষীণ একটা হাসি ফুটে উঠতে দেখে পারুলের চোখে পলকের জন্য আলো ফুটে উঠল।

‘ঘরে গিয়ে এখন শুয়ে থাক।’ পারুলের পিঠে হাত রেখে সে থাবড়াল। ষোলো বছর ধরে পারুল পরিশ্রম করেছে। ওর এখন বিশ্রাম চাই।

.

অন্ধকার ঘরে সে জানালায় দাঁড়িয়ে।

বাইরের চরাচর গাঢ় অন্ধকরে একাকার। বাতাস বইছে কি বইছে না, সে বুঝতে পারছে না। ঘুমের মধ্যেও পাখিরা ডেকে ওঠে, সে এখনও কোনো ডাক শুনতে পায়নি। গোরুটা আজ গভীর ঘুমে নিশ্চয়, যেমন হাঁসগুলোও। প্রকাণ্ড নৈঃশব্দ্য জানালায় ঝুঁকে রয়েছে। সে দু—হাতে শক্ত মুঠিতে জানালার গরাদ ধরে দাঁড়াল। বুকের মধ্যে শব্দহীন একটা প্রতিরোধ ঘনিয়ে উঠছে। মাছগুলো পুকুরের তলায় জলের চাপ সহ্য করে যেমন, এখন নিথর তেমনই সে এই নীরবতার চাপ গ্রহণ করছে। সে তার বাল্য, কৈশোর, যৌবনের স্মৃতির চাপ আত্মস্থ করবে। ধপে ধাপে সে শৈশবে ফিরে যেতে পারে, খুবই সুখের সফর হবে সেটা, কিন্তু ভবিষ্যতের দিকে হাঁটাটা? স্মৃতিতে ভরা একটা বিরাট বোঁচকা মাথায় নিয়ে হাঁটা!

সে তীক্ষ্ন নজরে দূরের দাওয়ার দিকে তাকাল। কেউ কি ওখানে বসে রয়েছে! থাকার কথা, আজ পারুলও জেগে থাকবে। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে নিশ্চয়ই ওখানে বসবে। টর্চটা জ্বেলে একবার দেখবে কি?… মুখের উপর টর্চের আলো পড়েছিল বলেই পারুল চোখ বন্ধ করে ফেলে আর শ্রীগোপাল তখনই ওর হাতের কাটারিতে…

দাওয়ায় কেউ কি বসে? এত অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। সে একটা হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ করে দিয়েছিল। স্পন্দন বন্ধ মানেই কি নৈঃশব্দ্য! বড়ো মূল্যবান শব্দ এই ধকধকানিটা, সে একটা মূল্যবান শব্দ বন্ধ করার জন্য দায়ী। একমাত্র পারুলই জানে, কেন সে দায়ী। আজ কি পারুল ঋণ শোধ করল? ওর চোখে বোধহয় সেই কথাই ছিল। ও কি ঋণমুক্ত হল?… হওয়া যায় কি, যাবজ্জীবন থেকে কখনো বেরিয়ে আসা যায় কি?

জানালার বাইরে অন্ধকার আর নৈঃশব্দ্য। দাওয়ায় এসে একজন বসবে। পারুলের চোখে পলকের জন্য তখন একটা আলো ফুটে উঠেছিল। সেই আলোটাই কি বিরাট হয়ে গিয়ে বলবে, ‘আপনিই সব কিছুর মালিক’!

সে জানালায় দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ন নজরে তাকিয়ে রইল।

Exit mobile version