Site icon BnBoi.Com

রায়হান – লুৎফর রহমান

রায়হান - লুৎফর রহমান

০১-০৫. ডোবা থেকে এক বদনা পানি

প্রথম পরিচ্ছেদ

মা বলিলেন–“আমেনা, ডোবা থেকে এক বদনা পানি নিয়ে এস তো মা।”

আমেনা বদনা হাতে লইয়া ডোবায় পানি আনিতে গেল এবং কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ফিরিয়া আসিল।

মা বলিলেন–“লক্ষ্মী মেয়ে–চাঁদ মেয়ে। আচ্ছা, ঘর থেকে লবণ আর মরিচ নিয়ে এস দেখি।”

আমেনা দৌড়াইয়া গিয়া ঘর হইতে মরিচ ও লবণ লইয়া আসিল। হাটের দিন খোরশেদ যে মাছ আনিয়াছিল তাহারি কয়েকখানা অবশিষ্ট ছিল। আমেনার মা ঠিক করিলেন বেগুন আর সেই মাছ রান্না হইবে।

ওমেদপুরে মজিদ মিঞার স্ত্রী আজ তিন বৎসর হইল বিধবা হইয়াছেন। মজিদ মিঞা যখন মারা যান তখন তার বিধবা পত্নী নফিসার এক ছেলে আর এক মেয়ে। মেয়ের নাম আমেনা। আমেনার বয়স এখন এগার–বড় লক্ষ্মী। শিক্ষার গুণে মেয়ে মার কথা অমান্য করতে জানে না।

পিতার মৃত্যুকালে খোরশেদের বয়স ছিল পনর। এখন তার বয়স আঠার হইয়াছে। ইংরেজি স্কুলে সেকেন্ড ক্লাসে পড়ে। উনুনে ফুঁ দিয়া নফিসা মেয়েকে আবার কহিলেন–তরকারি কখানা কুটে নাও তো মা!

আমেনা ঘাড় নাড়িয়া বেগুন কুটিতে বসিল। বেগুন কুটিতে কুটিতে আমেনা শিশুর সরলতায় জিজ্ঞাসা করিল–“ভাই কোথায় গিয়েছে, মা?”।

নফিসা বিরক্ত হইয়া কহিলেন–“জালেম, গিয়াছে আবদুল হামিদের কাছে। বইয়ের পড়া কোন্‌খানে তা নাকি তার মনে নাই। আবদুল হামিদের কাছে থেকে পড়া শুনে আসবে। স্কুল তো বাড়ি নয়, মাষ্টার মাও নয়, বোনও নয়। সেখানে তো আর দুরন্তপনা খাটে না। পড়া না করলে মাষ্টার বেত মারেন। সে ভয় তার আছে।”

মা যে পুত্রের উপর বিরক্ত ছিলেন সেটা মিথ্যা নয়। বাড়িতে তার দৌরাত্ম মাঝে মাঝে এত ভয়ানক হইত যে নাফিসাকে সেজন্য চোখের জল ফেলিতে হইত। ছোট বোন আমেনা দিনের মধ্যে অন্তত দুইবার ভাইয়ের হাতে কিল-চড় খাইত।

আমেনা কিল-চড় খাইয়াও ভাইয়ের উপর রাগিত না। খানিক কাঁদিয়া আবার সেই ভাইকে ভাই বলিয়া ডাক দিত। সেই ডাকে নির্ভরশীলতা কানায় কানায় মাখান।

পাড়ার ছেলেরা সেদিন সকালবেলায় ডোবায় বড়শি ফেলিয়া মাছ ধরিয়াছিল। আমেনা তাহা দেখিয়াছিল। যখন দুপুরবেলা, মা শুইয়াছিলেন, তখন সে চুপে-চুপে ভাইয়ের ছিপ লইয়া সেইখানে গেল। ইচ্ছা, সেও মাছ ধরিবে। বড়শিতে যে টোপ গাঁথিতে হয় তা সে জানে না। খালি বড়শি ফেলিয়া প্রায় ১৫ মিনিট অপেক্ষা করিয়াও যখন সে দেখিল মাছ ধরে না তখন সে বিরক্ত হইয়া বড়শি ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিল। বড়শি চুরি করিয়া যে কী বিপদে পড়িতে হইবে তা সে একটুও তখন ভাবে নাই।

ইহারই মধ্যে খোরশেদ আসিয়া উপস্থিত। সন্ধ্যাবেলা, খোরশেদ পড়িতে না বসিয়াই জিজ্ঞাসা করিল–“মা, ভাত হয়েছে?”

নফিসা কহিলেন–“পড়া না করেই ভাত বাবা? খানিক পড়–ইত্যবসরে মায়ে-ঝিয়ে রান্না করে নিয়ে আসি।”

“ভাত কোন্ দুপুরে খেয়েছি, তার পর বিকেলে দুটো মুড়ি ছাড়া আর কিছু খাই নাই। ক্ষুধাপেটে কি পড়া যায়?”

“খেলেই পড়া হয় না। খালি পেটে খুব পড়া হয়।”

“তুমি কচু বোঝ কি না? শাস্ত্রে বলে মেয়ে মানুষের বুদ্ধি নাই–সেটা কি আর মিছে কথা?”

এই কথা বলিয়া খোরশেদ পড়িতে বসিল। মা পুত্রের কথায় উত্তর দিলেন না।

ইংরেজি বইটা খুলিয়া দুই একবার রিডিং পড়িয়া সে দেখিল ইংরেজি বড় সুবিধা বোধ হইতেছে না। বইখানা বিরক্তির সহিত বন্ধ করিয়া সে গ্রামার খুলিয়া বসিল। গ্রামারের পড়া ছিল কারকের অধ্যায়। ক্রিয়া কাহাকে বলে তাই যে বুঝিল না কারকের সে কি বুঝিবে? বিরক্ত হইয়া গ্রামার ফেলিয়া বাংলা পাড়িতে গেল। তাহাও সে অধিকক্ষণ পড়িতে পারিল না।

সহসা তাহার ইচ্ছা হইল, বড়শির ছিপখানা ঠিকমতো আছে কিনা একবার দেখিয়া আসে। অতঃপর ঘর হইতে বাহির হইয়া অন্ধকারে সে ছিপ হাতড়াইতে লাগিল।

ছিপ সেখানে ছিল না। দুপুরে ছিপ লইয়া আমেনা মাছ ধরিতে গিয়াছিল। ফেরত আনিতে তাহার মনে ছিল না।

যথাস্থানে ছিল না দেখিয়া খোরশেদ চিৎকার করিয়া কহিল–“কে আমার ছিপ নিয়েছে রে?” রান্নাঘরে আমেনা তখন বাটনা বাটিতেছিল। ভাইয়ের গলার কঠিন আওয়াজ শুনিয়া সে নোড়া ফেলিয়া মুহূর্তের মধ্যে মাকে না বলিয়াই অন্ধকারে বাহির হইয়া গেল।

পাছ ফিরিয়া নাফিসা ঝাপির ভিতর মসলা খুঁজিতেছিলেন। ফিরিয়া দেখিলেন–মেয়ে বাটনা ফেরিয়া বাহিরে গিয়াছে।

“ও মা-আমেনা” বলিয়া তিনি ডাকিলেন।

আমেনা উত্তর দিল না।

নফিসা আবার ডাকলেন–“আমেনা!”

তবুও আমেনা উত্তর দিল না।

একটু শঙ্কিত হইয়া নফিসা উনুনে ভাত ফেলিয়া বাহিরে আসিলেন।

সহসা ডোবার ধার হইতে আমেনা আর্ত ও ভীতস্বরে চীৎকার করিয়া ডাকিল–মা, মা!

অত্যন্ত ভীত হইলে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেমন চিৎকার করে, আমেনা ভয়ে তেমনি করিয়া চিৎকার করিতেছিল। সেই সময়ে রাস্তা দিয়া রায়হান যাইতেছিলেন। রায়হান চিৎকার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী হয়েছে? কী হয়েছে?

নফিসা প্রদীপ লইয়া বাহিরে দৌড়াইয়া গেলেন এবং দূর হইতেই ব্যগ্র আর্তস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হয়েছে? কী হয়েছে?” ততক্ষণে রায়হান আমেনার স্বর লক্ষ্য করিয়া দৌড়াইয়া ডোবার ধারে আসিয়া ভীত অর্ধ-মূৰ্ছিতা আমেনার সিক্ত-শীতল দেহ কোলে লইয়া নফিসার দিকে আসিতেছিল।

আমেনার বসন সিক্ত। ধীরে ধীরে তাহার নিশ্বাস পড়িতেছিল।

মেঝের উপর পাটি পাতিয়া মা মেয়েকে শোয়াইলেন। রায়হান পার্শ্বে বসিয়া বাতাস করিতে লাগিল। নফিসা আমেনার মুখের কাছে মুখ লইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া ডাকিতে লাগিলেন–“মা আমেনা! মা আমেনা!”

কিয়ৎকাল পরে আমনো চক্ষু মেলিল। রায়হান জিজ্ঞাসা করিল–“কী আমেনা এমন করে চেঁচিয়ে উঠলি যে?”

বালিকা মৃদুস্বরে কহিল, দুপুরবেলা ভাইয়ের ছিপ নিয়ে ডোবায় ফেলে এসেছিলাম। ভাই এখন ‘ছিপ ছিপ’ করে চেঁচিয়ে উঠলো, তাই আনতে গিয়ে দেখলাম একটা সাদা মানুষ বাঁশঝাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে।”

খোরশেদ এতক্ষণ চুপ করিয়া তামাসা দেখিতেছিল। ছিপের সন্ধান পাইয়া সে বিরক্তির সহিত জিজ্ঞাসা করিল–“কিরে পাজি, তুই ছিপ নিয়েছিলি?”

নফিসা রুক্ষস্বরে বলিলেন–“পাজি, নচ্ছার, বের হ বাড়ি থেকে।” শুধু এই বলিয়াই তিনি নিরস্ত হইলেন না। তাহার পিঠে একটা চড় লাগাইয়া দিলেন।”

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

রায়হানের বয়স পঁচিশের বেশি হইবে না। গ্রামের প্রান্তে তার একখানা দোকান। ছোটকালে পয়সার অভাবে ইংরেজি স্কুলে তার পড়া হয় নাই, যদিও জ্ঞানলাভের প্রতি তার বিপুল আগ্রহ ছিল। সেই যে বাল্যে ওস্তাদ সাহেবের পাঠশালায় সে প্রাইমারি পাশ করিয়াছিল, তারপর আর তার কোনো স্কুলে পড়া হয় নাই।

অনেক বৎসর পড়া ছাড়িয়া দিলেও, সে নজরের সম্মুখে যে বাঙালা বইখানা পাইত তাহাই আগ্রহের সঙ্গে পাঠ করিত। আত্মার সন্দেহ দিকটা চাপা পড়ে যাওয়াতে রায়হানের ব্যবহার, কথা ও স্বভাব দিন দিন অধিকতর মার্জিত হইয়া প্রকাশ পাইতেছিল। গ্রামে রাস্তার পার্শ্বে তাহার একখানা দোকান ছিল।

দোকানে চাল, ডাল, চিড়ে, মুড়ি, গুড়, সরিষার তৈল, আরও অনেক রকম জিনিস পাওয়া যাইত। ক্রেতাদের সঙ্গে তার ব্যবহার খুবই মধুর। তার অভ্যাস–একবার ছাড়া দুইবার কোনো জিনিসের দাম না বলা। সে কাহাকেও কোনো জিনিস বাকি দেয় না। প্রথমে ইহার জন্য অনেকে তার উপর অসন্তুষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু সে কাহারও কথা শুনে নাই। এমন কি, গ্রামের অনেক ভদ্রলোক প্রথম প্রথম তার দোকান জোর করিয়া তুলিয়া দিবেন বলিয়াছিলেন, কিন্তু ভাগ্যে গ্রামের নসির মিঞা তার দিকে ছিলেন। নসির মিঞা মসজিদের ভিতর বলিয়া দিয়াছিলেন, গ্রামে দোকান থাকাতে সকলের পক্ষেই লাভ। বাকি লইলে দোকান থাকিবে না। নসির মিঞা গ্রামের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী লোক, অথচ অত্যাচারী নন।

কেউ কেউ সন্দেহ করিয়াছিল যে, সকলের সুবিধা নষ্ট করিয়া নসির নিজের সুবিধা করিয়া লইলেন। কিন্তু তিনি সে ধরনের লোক নন। তার ছেলে একদিন দোকানে বাকি জিনিস আনিতে গিয়াছিল–শুনিতে পাইয়া তিনি ছেলেকে মারিয়াছিলেন এবং ভর্ৎসনা করিয়াছিলেন। ক্রমশ রায়হানের অনেক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী বন্ধু জুটে গেল। আবদুল হামিদ তাদের একজন। ইদানীং কেউ কোনো জিনিস তার দোকান হইতে ধারে লইত না। সকলেই বুঝিয়াছিল ধার করিয়া জিনিস লইলে সেই ছোট দোকানের ছোট প্রাণটি দুই দিনেই বাহির হইয়া যাইবে।

সন্ধ্যাবেলা রাজভাষাখানা একটু পড়িয়া দোকানের দুয়ার বন্ধ করিয়া রায়হান ভাত খাইতে বাড়ি যাইতেছিল। আবদুল হামিদের বাহির-বাড়ির উপর দিয়াই তাহার পথ।

জোছনার আলোকের মধ্যে দাঁড়াইয়া হামিদের বিধবা বোন করিমা একটু বড় পেয়ারা গাছের মাথার দিকে চাহিয়াছিলেন। করিমার বয়স পঁচিশ। বর্ণ উজ্জ্বল গৌর, বৈধব্যের অবহেলায় কিঞ্চিৎ স্লান ও নিষ্প্রভ, তবুও কোনো অপরিচিত মানুষ সে মুখের দিকে যদি চাহিত, সে স্তব্ধ হইয়া যাইত।

রায়হান করিমাকে একাকী বাহির-বাড়ির প্রাঙ্গণে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়া মাথা নত করিয়া চলিয়া যাইতেছিল। করিমা ডাকিয়া কহিলেন,–রায়হান, তুমি বড় লাজুক এবং তার ফলে অভদ্র।”

রায়হান বলিলেন–“আপনি আমার বাল্যবন্ধু হলেও বয়সকে মেনে চলতে হবে।”

“ছিঃ! এরূপ কথা বলা অন্যায়। এস আমাদের বাড়ির ভিতর।” রায়হান করিমার সহিত বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল।

হামিদ তখন পড়িতেছিল। রায়হানকে দেখিয়া সে কহিল, “রায়হান, আমার বাংলা পড়াটা বুঝিয়ে দিয়ে যাও তো।”

করিমার মা হাফিজা সেখানে ছিলেন। পুত্রের ধৃষ্টতার বিরক্ত হইয়া তিনি কহিলেন, “হামিদ, কথা বলতে জান না।” হামিদ অপ্রস্তুত হইয়া চুপ করিয়া রহিল।

মৌলবী সাজেদ আলী রিটায়াড় পুলিশ ইন্সপেক্টর। শেষ বয়সের পুত্র হামিদ আহ্লাদে একটু বেয়াদব হইয়া পড়িয়াছিল।

হাফিজা রায়হানকে বসিতে বলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,–“দোকান কেমন চলছে বাবা?”

রায়হান সে কথার উত্তর না দিয়া কহিল–চাচি, হামিদ আমার এক বয়সের, অমন করে কথা বল্লেও বিশেষ দোষ হবে না।”

হাফিজা বলিলেন–“তুমি হচ্ছ করিমার বয়সের, যদি ও ওর বুয়াকে মানে তাহলে তোমাকেও মানতে হবে। সম্রম করে কথা না বলুক বাড়ির উপর মানুষ এলে বসতেও কি বলতে নেই? সোজাসুজি নাম ধরে নবাবের মতো হুকুম!”

হামিদকে একটু উৎসাহিত করিয়া তুলিবার জন্য রায়হান স্বইচ্ছায় তাহাকে খানিক বাংলা পড়াইয়া দিলেন। ঘরে পড়িয়া রায়হানের বাংলা ভাষার জ্ঞান জন্মিয়াছিল, সুতরাং অনায়াসে দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র হামিদকে পড়াইতে সক্ষম হইলেন।

হাফিজা মেয়েকে বলিলেন–“রায়হানকে কিছু খেতে দাও।” তারপর একটু থামিয়া কহিলেন–“রায়হান, ছোটকালে তুমি এখানেই সারাদিন করিমার সঙ্গে খেলে খেলে কাটিয়ে দিতে।”

রায়হান আপত্তি করিলেন না।

করিমা ছোট একখানা কাঁসার থালায় কতকগুলি মুড়ি, কয়েকটা নারিকেলের নাড় –একটু হালুয়া এবং খানিকটা সর আনিয়া দিল।

মনের একটা দারুণ বেদনা, একটা ছোট চাপা দীর্ঘশ্বাসের আকারে করিমার বুকখানাকে সহসা কাঁপাইয়া গেল। তাহার উজ্জ্বল নীল চক্ষু একটু শিহরিয়া উঠিল। বাহিরে স্নিগ্ধ নীল ও উজ্জ্বল প্রকৃতির পার্শ্বে করিমার পেলব-গৌর দেহখানি স্বপ্নমাধুরী সৃষ্টি করিতেছিল। সে যখন দাঁড়াইল তখন বোধ হইতেছিল একখানা তরল, অতি সুন্দর কনক প্রতিমা জোছনার উপর দাঁড়াইয়া পৃথিবীর ললাটে একটা মাধুরীর টিপ কাটিয়া দিতেছে।

হাত ধুইয়া রায়হান বলিলেন–“চাচি! আবার এখনি আমাকে খেয়ে দোকানে যেতে হবে।”

হাফিজা বলিলেন–“আচ্ছা বাবা! তাহলে যাও।”

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

বৈকালবেলা মৃদু মন্দ বাতাস বহিতেছিল। শেফালিকা গাছের তলায় দাঁড়াইয়া নীল অঞ্চলখানা উড়াইয়া দিয়া আমেনা একখানা শিলার উপর পা রাখিয়া তাহাতে মেহেদীর পাতার রঙ লাগাইতেছিল।

নীল বসনের নিচে রক্তরাঙ্গা কচি কুসুমগুচ্ছের মতো পা দুখানি স্বল্পসুষমা সৃষ্টি করিয়াছিল। সে বুঝিতেছিল না বৈকালবেলায় স্নান প্রকৃতির গায়ে কতখানি গৌরব সে ভরিয়া দিতেছে। কাল কেশগুচ্ছের পাশে তার কিরণময় মুখখানি যেন শ্যামল পল্লব-লতার ভিতরকার একটা লাল গোলাপ বলে ভ্রম হইতেছিল।

রায়হান দূর হইতে দেখিলেন শত সৌন্দর্যে ছোট বালিকা দেহটিকে ভরিয়া সুষমাময়ী আমেনা দাঁড়াইয়া আছে।

নজর পড়িতেই আমেনা একেবারে বিদ্যুৎবেগে বাড়ির ভিতর যাইয়া রান্নাঘরে প্রবেশ করিল।

নফিসা মেয়ের আকস্মিক চাঞ্চল্যে বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কিরে, কী হয়েছে?”

দরজার ওপাশে দাঁড়াইয়া আমেনা চাপা গলায় ফিক ফিক করিয়া হাসিতেছিল।

রায়হান নফিসাকে আদাব করিয়া মাটির উপর বসিয়া পড়িলেন।

নফিসা বিস্ময়ে কহিলেন–“রায়হানকে দেখে এত লজ্জা! শীগগির একখানা পাটি নিয়ে এসে তোমার ভাইকে বসতে দাও।”

রায়হান বলিলেন–“আমেনা হয়তো মনে করেছে আর কেউ।”

কেন অমন করিয়া ছুটিয়া পালাইয়া দরজার ধারে আসিয়া সে দাঁড়াইয়াছে তা আমেনা নিজেই ঠিক করিতে পারিতেছিল না। একটা সহজ ভাব মুখের উপর ফেলিয়া আমেনা রায়হানের সম্মুখে একখানা মাদুর পাতিয়া দিল।

নফিসা মেয়েকে বলিলেন–“তোমার ভাইয়ের পা চুম্বন করো।” একটু থামিয়া অন্যদিকে মুখ করিয়া পুনরায় কহিলেন–“রায়হানের কাছে আমেনা চিরজীবন ঋণী, সেই বিপদের কথা কখনো ভুলবো না। আর একটু হলেই মেয়ে আমার মরে যেতো।”

রায়হান মৃদু হাসিয়া বলিলেন–“থাক্। সালাম-শ্রদ্ধা না হলেও আমি ওকে ভালবাসি।” একটুখানি যে কোনো রকম আঘাত যেমন বেহালার তারে অনেকক্ষণ পর্যন্ত সুরময় হইয়া বহিতে থাকে, রায়হানের মুখের কথাগুলি তেমনি করিয়া আমেনার মনের মধ্যে অনেকক্ষণ ধরিয়া বাজিতে লাগিল। সে ভাবিল, মা ছাড়া আরও একটা মানুষ তাকে ভালবাসে, এ তো, সে জানে না। ভাই তাকে ভালবাসে না, যদিও সে নিজে ভাইকে খুব ভালবাসে।

মুখখানি একটু টানিয়া লইয়া মোহন হাসির আলোয় কপোল ও ওষ্ঠদ্বয় প্রভাময় করিয়া আমেনা কহিল–“আমিও আপনাকে খুব ভালবাসি।”

মা বালিকার সরলতা ভরা কথায় একটু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“তুই তোর রায়হান ভাইকে কেমন করে ভালবাসিস?”

আমেনা কহিল–“কেন মা, আপনাকে যেমন করে ভালবাসি?”

রায়হান হাসিয়া বলিলেন–আমি কি তোমার মা?

আমেনা কহিল-মাইয়ের মতো। ভাইয়ের মতো নয়।

নফিসা ও রায়হান আমেনার কথায় অনেকক্ষণ ধরিয়া হাসিলেন।

ছোট অবগুণ্ঠনের ভিতর ছোট মুখখানি অভিনব বলিয়া বোধ হইতেছিল। মৃদু হাসির ক্ষীণ তরঙ্গ মাঝে মাঝে আমেনাকে আরও নয়ন মোহন করিয়া তুলিতেছিল।

রায়হান বলিলেন–আমেনা, পড়ে থাক?

আমেনা ঘাড় নাড়িয়া বলিল–না।

নফিসা কহিলেন–ও পড়ে না।

রায়হান–কিছুই পড়ে না?

নফিসা–শুধু কোরান পড়েছে। এখন আর কিছু পড়ে না।

রায়হান–তাতে মনে একটু পবিত্রতার ভাব জেগে উঠতে পারে। কিন্তু তাতে মনের অন্ধকার দূর হতে পারে না। মনের অন্ধকার দূর না হলে কোরান পড়া বৃথা।

নফিসা–তুমি ঠিক কথা বলেছ বাবা। জ্ঞানের দ্বারা মনকে চাষ না করতে পারলে ধর্ম পালন হয় না। লোকের সঙ্গে উঠতে বসতে পারা যায় না। শিক্ষিত লোকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বোকা হতে হয়।

রায়হান–তা হলে আমেনাকে একটু একটু পড়াবার ব্যবস্থা করুন না কেন?

নফিসা–তা করা দরকার। কেমন লেকের হাতে পড়ে তার ঠিক নাই। খোদার মরজি হলে আর বেশি দেরিও নাই। লেখাপড়া না শিখলে হয়তো তাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হতে হবে। তুমি ভালো কথা মনে করে দিয়েছ। বাবা! আমেনার আত্মার উন্নতির জন্য কোনো চেষ্টাই হচ্ছে না। ভালো বর খোঁজবার আগে মেয়েকেও ভালো করে তোলা চাই, এ আমি জানি।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া নফিসা আগ্রহের সহিত আবার কহিলেন–“রায়হান, তাহলে তুমিই একটু একটু করে পড়িয়ে যেও।”

রায়হান–আপনার অনুরোধ আমার কাছে আজ্ঞা বলেই মনে হবে। মেয়ের লেখাপড়ার আবশ্যকতা আপনি বুঝেছেন, এটা বড় আশ্চর্য। আমাদের দেশের অধিকাংশ নারী এত কুসংস্কারাচ্ছন্ন যে, তারা মেয়েদের লেখাপড়া শিখাতে মোটেই চান না।

নফিসা–কী বল, ধর্মে নারী-পুরুষ সকলেরই জ্ঞান আহরণ করবার নির্দেশ আছে। যারা মুসলামান ধর্মের কিছু জানে না–তারা নারী কেন, পুরুষকেও জ্ঞান ও আলোক হতে দূরে রাখে। না বুঝে লক্ষ লক্ষ পবিত্র গ্রন্থ পাঠ করলেও কোনো লাভ হয় না। পাপে ভরা

অন্ধকারময় কদর্য আত্মা দিয়ে কোরান পাঠ করলে কোনো লাভ হয় না, এ কথা আমি বুঝি।

রায়হান–বেশ, ক্ষতি স্বীকার করে আমি আজ হতে আমেনাকে পড়াবো। কিন্তু ঠিক যদি তাকে আমার কাছে পড়তে দিলেনই, তবে আজ হতে অন্তত চার বৎসর আমি তাকে জ্ঞান দান করবো।

নফিসা–বেশ। বিয়ের জন্য প্রথম ভাগ ও কতকগুলি ভাঙ্গা হাড়ির মতো অক্ষর তৈরি করতে শিখলেই হবে না। সে প্রথম ভাগ পড়েছে। দ্বিতীয় ভাগও শেষ করেছে। তুমি তাকে এখন ভালো ভালো কথা শিক্ষা দাও, মন যাতে তার উন্নত হয়।

আমেনা মিটমিট করিয়া মুখ ফিরাইয়া হাসিতেছিল। রক্ত ওষ্ঠ দিয়া একটু একটু করিয়া সুধা ঝরিতেছিল।

রায়হান আমেনাকে জিজ্ঞাসা করিলেন–এখন থেকে তুমি আমার কাজ বাড়িয়ে দিলে। রোজ বিকালে পড়তে রাজি আছ?

আমেনা হাসিয়া কহিল–কেন, সকল মানুষ যে সন্ধ্যাবেলা পড়ে?

রায়হান–সন্ধ্যাবেলা তোমার মাকে সাহয্য করতে হবে। একা তিনি অত কাজ করে। উঠতে পারেন না। সংসারের কাজও তোমাকে শিখতে হবে, শুধু বই পড়লে চলবে না।

হাতের কাজ শেখাও মেয়েদরে দরকার। তাছাড়া আমারও সময় হবে না। সন্ধ্যাকালে দোকান ছেড়ে আসতাম। এখন থেকে ঘণ্টাখানেক আগেই আসবো।

আমেনা–আমার পড়তে খুব ইচ্ছা করে। বাংলায় আমি পুঁথি লিখবো।

রায়হান বিস্মিত হইয়া বলিলেন–বটে, তোমার এত বড় কল্পনা! ছোট কালেই যার মনে এই ভাব সে খুব শিক্ষিতা হবেই হবে।

নফিসা বলিলেন–এটা খুব বিস্ময়ের কথা নয়। এমন দিন ছিল, যখন মুসলমান নারী কত বই লিখেছেন। বেশ তো, এরূপ কল্পনা খুব ভালো।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

স্কুলের ছুটির পর হামিদ, খোরশেদ ও রমেশ গ্রাম্য পথ ধরিয়া বাড়ি যাইতেছিল।

তখন বৈকাল বেলার হেমকর গাছের আগাগুলি সোনালি আভায় রাঙ্গা করিয়া তুলিয়াছিল এবং কুল-বধুরা মিত্রদের পুকুর হইতে জল লইয়া যাইতেছিলেন। তাহাদের হাসি ও কথায় পাতা আর গাছে-ঘেরা পুকুরপাড় মুখরিত হইয়া উঠিতেছিল।

স্কুল হইতে বাহির হইবার সময় চানা ও বুটওয়ালার কাছ থেকে খোরশেদ, হামিদ এবং রমেশ তিনজনেই এক পয়সা করে ছোলা ভাজা কিনিয়াছিল। লবণ আর মরিচের গুঁড়া মিশানো ছোলা খাইতে নাকি বেশ লাগে।

হামিদ বলিল–“সদর রাস্তা ছেড়ে এসেছিল। পানির তেষ্টাও খুব লেগেছে; আয় রমেশ, ঘাটে বসে ছোলা খাই।”

রমেশ বলিল–“বেশ! অনেকক্ষণ হতে আমারও জিভ দিয়ে জল ঝরছে।”

রমেশ তাদের সহপাঠী। অতঃপর তিন জনেই পুকুরধারে বসিয়া ছোলা চিবাইতে আরম্ভ করিল। রমেশ একটু দূরে বসিয়া খাইতেছিল। সে যে হিন্দু একথা খোরশেদের মনে ছিল না। খোরশেদ রমেশের দিকে অগ্রসর হইয়া অসঙ্কোচে কহিল–“রমেশ, তোরগুলি কেমন দেখি, এক মুঠ দে আমায়।”

খোরশেদ রমেশের কাপড়ের ভিতর হাত দিতেই রমেশ ঘৃণায় ক্রোধে সব বুট মাটিতে ফেলিয়া দিল।

হামিদ বিরক্ত হইয়া কহিল–“জান না ও হিন্দু। এত বৎসর একসঙ্গে পড়ে আসছ, ভুলে গেছ হিন্দুর আচারের কথা?”

খোরশেদ ততোধিক বিরক্ত হইয়া কহিল–“ফেলে রাখ তোমার আচার! হিন্দুর মুণ্ডুপাত ছাড়া আর কোনো ভালো কাজ নেই।”

মুখের কথা মুখেই রহিল। ক্রোধান্ধ খোরশেদ জুতা খুলিয়া রমেশের মুখে লাগাইয়া দিল।

হামিদ কাপড়ের ঝোলা ফেলিয়া খোরশেদের হাত ধরিয়া কাহিল–“তুমি কি পাগল হলে খোরশেদ? জুতাপেটা করলে কী কেউ জব্দ হয়? তোমার ধর্মের মহিমা কি তুমি এইভাবে প্রচার করবে?”

খোরশেদ কাপিতে কাঁপিতে বলিল–“হিন্দু ঘৃণা করবে মুসলমানকে! সম্পূর্ণ অসম্ভব। মুসলমান হিন্দুকে ঘৃণা করতে পারে।–কী অপমান! ওর কান ধরে আমি জলে চুবাচ্ছি। মুসলমান কি তার গৌরব ভুলে গেছে?”

হামিদ কহিল–“দেখ খোরশেদ, তুমি মুসলমানের মতো কথা বলছে না। মনুষ্যত্বহীন যে, সেই মানুষকে ঘৃণা করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। মানুষকে ঘৃণা করা কি খুব প্রশংসার কথা? যারা হীন তারাই এ করে। মনের উন্নতির মাঝখানটাতে এই অহমিকার পরিচয় লোকে দিয়ে থাকে। হিন্দুরা এই দোষে দোষী। তুমি এতে বিরক্ত না হলে তা’দিগকে কৃপার পাত্র মনে করতে পার। তাকে জুতো মেরে কী লাভ? মুসলমানের মহিমা কি হিন্দুকে জুতো মেরে প্রতিষ্ঠিত হবে?”

খোরশেদ অধিকতর ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল–“রাখ তোমার বক্তৃতা। হিন্দুকে জুতোপেটা করাই উচিত। এমন পাজি ও অভদ্র জাত জগতের কোথাও নাই।” হামিদ পুনঃ নম্রভাবেই কহিল–“ছিঃ, তুমি ক্ষেপেছ। হাজার হলেও তারা আমাদের প্রতিবেশী। হিন্দু আমাদের ভাই। ইসলামের গৌরব রক্ষা করবার জন্য হিন্দুকে দেশছাড়া করতে চাও নাকি? তুমি নিজে নামাজ পড়ে থাক। মহাপুরুষ মোহাম্মদের অন্তত বড় বড় আদর্শগুলি প্রতিপালন করে থাক? খাঁটি মুসলমান মিথ্যা কথা বলতে পারে না। তুমি কি মিথ্যাকে ঘৃণা করে থাক? যথার্থ এসলামের ভক্ত পূর্ণমনুষ্যত্ব লাভের জন্য চেষ্টান্বিত হবে।–তুমি তো করে থাক? তুমি নিজের চরিত্রের মন্দ অংশটুকু ঘৃণা কর। পরের আচার-ব্যবহার নিয়ে মাথাব্যাথা করবার, দরকার কী? আসল কথা, হিন্দু তোমাকে ঘৃণা করে না। তার মনে শক্তি নাই–সে বিবেক ও সত্য অপেক্ষা সমাজকে বেশি ভয় করে। রমেশ ঘাটের মেয়েদের ভয়ে অমন করে আঁৎকে উঠেছে। সে তোমাকে সত্য করে ঘৃণা করে না। ঘৃণা করতে পারে না। কোনো, মুসলমানের কাছে সে কোনো কালে অপমানিতও হয় নাই যে, তোমার উপর আজ শোধ তুলছে। সত্য, মুসলমান হও, জ্ঞানী হও, হিন্দুর কেন, প্রত্যেক হৃদয়বান মানুষের মাথা সম্ভ্রমে তোমার কাছে নত হয়ে পড়বে। লাঠালাঠি করে কোনো ফল হয় না। বুদ্ধি, সৎস্বভাব ও তর্কের দ্বারা মানুষকে জয় করো।”

খোরশেদ কটমট করিয়া হামিদের দিকে চাহিয়া কহিল–“তুমি একটা গরু!”

কয়েক মুহূর্ত নির্বাক থাকিয়া, বই গুছাইয়া আবার তাহারা বাড়ির দিকে চলিল।

হামিদ প্রহৃত সহপাঠীকে সান্ত্বনা দিতেছিল।

খোরশেদ ক্ষুদ্ধ অপমানের বেদনা লইয়া আগে চলিল। এই সময় একটা হিন্দু-মেয়ে পুকুর হইতে কলসি কাঁখে লইয়া পার্শ্বের পথ হইতে খোরশেদের সম্মুখে আসিল। দুটি পথ যেখানে মিলিত হইয়াছে সেটা পুকুরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণা। খোরশেদের গায়ের সঙ্গে কলসির স্পর্শ ঠিক লাগে নাই।

টুপি-পরা খোরশেদকে লক্ষ্য করিয়া বালিকা কহিল–“রাম! মুসলমান ছোঁড়াদের জ্বালায় আর এ-পথ দিয়ে জল নেওয়ার যো নাই।”

একে খোরশেদের মনে তখনও অপমানের রক্ত ক্ষরিত হইতেছিল, তাহার উপর এই দ্বিতীয় আঘাতে সে নিতান্তই ধৈর্যশূন্য হইয়া পড়িল, কহিল–“তুই শ্যামসুন্দরের মেয়ে। ন? মুসলমান ছোঁড়ারা কী এই পথ দিয়ে নূতন গেল! মুসলমানের গায়ে কি গন্ধ! হারামজাদি!”

গিরিবালা কহিল–“কি! ভদ্রলোকের মেয়ের সঙ্গে মুসলামনের ছেলের এত হাইয়ের কথা! ছোটলোক, দূর হ।” এই কথা বলিতে বলিতে গিরিবালা তাহার কলসির জল ঢালিয়া ফেলিল।

খোরশেদ অত্যন্ত অপ্রস্তুত হইয়া প্রচণ্ডবেগে গিরিবালার ঘাড় ধরিল। বাম পা দিয়া একটা ভয়ানক পদাঘাতে পিতলের কলসিটাকে পুকুরের মধ্যে ফেরিয়া দিল। তারপর তাহার চুল ধরিয়া খোরশেদ বালিকার পিঠের উপর মুহুর্মুহু আঘাত করিতে লাগিল।

খোরশেদের চক্ষু দিয়া আগুন বাহির হইতেছিল। এই কাণ্ড অতি অল্প সময়ের মধ্যে ঘটিয়া গেল।

হামিদ দৌড়াইয়া আসিয়া খোরশেদের হাত ধরিয়া কহিল–“খোরশেদ, তুমি পাগল হলে? আজ কি তোমায় ভূতে ধরেছে? সেয়ানা মেয়ের গায়ে হাত দাও! এটা তোমার কি অভদ্রতা নয়!”

খোরশেদ ক্রোধে কহিল–“বটে! আমায় ভুতে ধরেছে? তা ঠিক। কাল ওকে উলঙ্গ হয়ে পথের ধারে বেড়াতে দেখলাম। মেয়েছেলে কি না, সেয়ানা হয়ে ভারি বাহাদুর হয়েছে। ও আমাকে মুচি মোসলমান বলতে একটু দ্বিধা বোধ করলে না। কাফেরের বংশকে পাথর দিয়ে মেরে ফেলা উচিত।”

হামিদ শান্তস্বরে অথচ বিরক্ত হইয়া কহিল–“একই কথা বারে বারে বলা যায় না। ওদের যা আচার পুরুষানুক্রমে চলে এসেছে সেটা ওরা কী করে ভুলবে! যে তাতে রাগে সেই পাগল। তুমি একটু দূর দিয়ে গেলেই পাত্তে। এক হিন্দু অন্য হিন্দুকে ঘৃণা করে তা জান। স্বামী বৌকে ঘৃণা করে। পিতা পুত্রকে ঘৃণা করে। পুরোহিত শিষ্যকে ঘৃণা করে। এক দেশের হিন্দু অন্য দেশের হিন্দুকে ঘৃণা করে। মুসলমান তো দুরের কথা। ঘৃণার দ্বারাই ওরা ওদের স্বতন্ত্র রক্ষা করে আসছে। ওতে যে রাগে সে পাগল।”

পুকুর ঘাটের মেয়েরা তখন কথা বন্ধ করিয়া দিয়াছিল। তাহাদের হাসি তখন থামিয়া গিয়াছিল। বিলম্ব না করিয়া ভয়ে ভয়ে মেয়েরা যার যার মতো বাড়ি ফিরিয়া যাইতে লাগিল।

হামিদ রমেশকে কানে কানে বলিল–“খোরশেদ বুঝি আজ নেশা করেছে। মাঝে মাঝে তার মাথা খারাপ হয়। তুমি এই মেয়েটিকে নিয়ে ওদের বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এস; আমি ওকে নিয়ে বাড়ি যাই।”

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

ওমেদপুরে মৌলবীরা অনেকবার মিলাদ শরিফ পাঠ করিয়াছেন। কিন্তু কেহই তাহার একবর্ণও বুঝিতে পারে নাই। কেবল উর্দু, ফারসি ও আরবি, শ্রোতাদের হৃদয় তাতে কাঁদে নাই–ভক্তি ও রসে মন কাহারো আপুত হয় নাই।

পাড়ার বৌ-ঝি আর মুরব্বী মেয়েদের অনুরোধে রায়হান বাংলা-ভাষায় মিলাদ পাঠ করিবেন। এই কার্যে নফিসা ছিলেন প্রধান উদ্যোগী। সুতারাং তাহারই বাড়িতে উৎসবের ব্যবস্থা হইয়াছে।

জোছনালোকে-স্নাত গ্রামখানি সিগ্ধ সৌন্দর্যে ভরপুর। আলো-বাতাসে মহিমা খেলিয়া বেড়াইতেছিল। মৃদু স্নিগ্ধ সমীর ধীরে বহিতেছিল। শ্যাম গ্রাম্য ছবিখানি শুভ্র বসনে কাহার দিকে যেন তাকাইয়াছিল।

সুন্দরীরা গ্রাম্য নির্জন পথ দিয়া ধীরে ধীরে খোরশেদের বাড়িতে আসিয়া সমবেত হইলেন।

ভাইকে লইয়া কর্মীরাও আসিয়াছিলেন। একখানা ধধবে সাদা কাপড় পরিয়া আভরণহীনা করিমা অন্তঃপুরে নফিসাকে যাইয়া সালাম করিলেন।

রায়হান একখানা পাটির উপর ঘরের বারান্দায় বসিয়াছিলেন। গ্রামের কোনো মেয়ে বা বধূ তাহাকে দেখিয়া লজ্জা বোধ করেন না। সকলেই তার আপনার।

হামিদ রায়হানের পার্শ্বে যাইয়া উপবেশন করিলেন।

পুরুষের ভিতর কেবল হামিদ, রায়হান ও খোরশেদ আজিকার এই উৎসবে যোগদানের অধিকারী হইয়াছিল।

রায়হানের পার্শ্বে রেড়ীর তেলের একটা প্রদীপ জ্বলিতেছিল। আর কোথাও কোনো প্রদীপ ছিল না। উঠানের উপর মেয়েরাই প্রশস্ত ফরাস পাতিলেন। ওজু করিয়া তাঁহারা এক এক স্থানে উপবেশন করিতে লাগিলেন।

পূর্বপার্শ্বে ফুলগাছের আড়ালে জোছনালোকে জোছনার মতোই ফুটফুটে মেয়েটি কে?–হামিদ নিরীক্ষণ করিয়া দেখিলেন–সে আমেনা।

আমেনা এত সুন্দর তা তো হামিদ আগে লক্ষ্য করে নাই? একটা অস্ফুট মৃদু শব্দ হামিদের ওষ্ঠদ্বয় কাঁপাইয়া গেল। তাহার শিরায় শিরায়, তাহার অন্তরের গোপন ঘরে একটা নবীনতার মধুময় ঝিলিক ছুঁইয়া গেল। কিন্তু তৌবা একি? নিঃশব্দে বসিয়া হামিদ রায়হানকে জিজ্ঞাসা করিল–“আর দেরি কি ভাই? আরম্ভ করে দিন।” তাহার পর তাড়াতাড়ি আবার সে জিজ্ঞাসা করিল–“আমাদের আর ওঁদের ভিতরে একটা পরদা হলে ভালো হত না?

রায়হান বলিলেন–“আমাদের মা-বোন ছাড়া তো অপর কেউ নাই।” হামিদ অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিল–“যদি কোনো বাজে লোক এসে পড়ে?” রায়হান বলিলেন–“না, ভিতরে আর কেউ আসবে না।”

মেয়েরা ভক্তিপ্রবণ হৃদয়ে অর্ধ আলো-আঁধারে ফুরাসের উপর বসিয়া গেলেন। তাঁহাদের সম্মুখে একাট মসৃণ ছোট গালিচার উপর বসিয়া রায়হান মহানবীর জীবনী পাঠ আরম্ভ করিলেন।

বামপার্শ্বে একটা উজ্জ্বল আলোক। তাকিয়ার উপর পুস্তক রাখিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিয়া রায়হান একটা আরবি গান গাহিলেন–

“চিন্ময় ওগো, মধু আর প্রেম!
প্রেম-বর্তিকা জ্বাললিয়া দাও।।
রক্ত-লোহিত আত্মার মাঝে
একবার আসি গাহিয়া যাও।
বেদনা-বিধুর মানুষের মনে,
ওগো গেয়ে যাও তুমি গান।।
ভাবুক হৃদয়ে শুষ্ক তাপিত,
প্রভো, তোমার প্রেমের বান;
ওগো, বজ-আঘাতে চূর্ণ হউক,
প্রভো, কালিমা মোদের চিত্তে।।
ফুলে ফুলে হোক গন্ধের মেলা।
প্রভো, তোমার মহিমা বিত্তে।”

গান থামিল। শ্রোতাদের আত্মার শিরায় শিরায় একটা পবিত্র ভাবের ধারা বহিয়া গেল। জগতের সহিত যেন কাহারও কোনো সম্বন্ধ রহিল না। অহঙ্কার ও নীচতা আত্মা হইতে যেন মুহূর্তের জন্য ধুইয়া পুছিয়া গেল।

দূরে এক প্রান্তে করিমা ও আমেনা এ উহার গায়ে হাত দিয়ে বসিয়াছিলেন। দৃষ্টি তাঁহাদের রায়হানের গম্ভীর ভাবময় ললাটের উপর নিবদ্ধ। পলকহীন দৃষ্টি, স্থির চৈতন্য নিথর বপু। এই সামান্য কয়েক মুহূর্তে তাহাদের কাছে মনে হইতেছিল এক যুগ। শত বৎসরের ভিতর দিয়া তাহারা আজ যেন সহসা এক আলোক ও শুদ্ধতার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

রায়হান বলিলেন–আমাদের যেদি ধর্ম সেটি নূতন নহে। যারা বোঝে না তারাই বলে এটা হজরত মোহাম্মদের ধর্ম। ঈশ্বর এক–তিনি মহান-পাপ ও অজ্ঞানতার বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড়াতে হবে–এই চিরন্তন সত্য যুগে যুগে মহাপুরুষেরা প্রচার করেছেন। এইসব মহাপুরুষ, একটা বিরাট বেদনা ও সহানুভূতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মহামানুষ মোহাম্মদ এই মহাপুরুষদের অন্যতম। তিনি সত্যের সংস্কারক মাত্র। ইসলাম নূতন নহে। যাহা সত্য তাহা নূতন নহে–সত্য ছিল, আছে ও থাকবে।

এই মহামানুষ পৃথিবীতে এসেছিলেন মূর্খতা, অন্ধতা ও পাপ হতে মানুষকে রক্ষা করতে। মানুষের দুঃখ তাহার অন্তরকে বাল্যকালেই ভাবপ্রবণ করে তুলেছিল। মানুষের পাপও দুঃখের কারণ মূর্খতা অন্ধতা। এই মূর্খতা ও অন্ধতা দূর করা ইসলামের শ্রেষ্ঠ নির্দেশ। জ্ঞানের সাধনা উপাসনা সমতুল্য। মুখ সহস্র বৎসর উপাসনারত থাকলেও বিশেষ পূণ্য অর্জন করিতে পারে না। অর্থ না বুঝে ভাব-গদগদচিত্তে পবিত্র কোরান মজিদ পাঠ করলেও পূণ্য লাভ হয় না, কোরান পাঠ করতে পারলেই জ্ঞান লাভ হয় না। কোরানের অর্থ বোধ হওয়া চাই এবং সে অর্থ গ্রহণ করার জন্য বিপুল জ্ঞান লাভ আবশ্যক।

বাহুর শক্তি অপেক্ষা, মনের দৃষ্টির মূল্য বেশি। যে পাপ করে এবং নীচতা,লোভ ও বাচালতার দ্বারা আত্মাকে কলঙ্কিত করে সে এই দৃষ্টি লাভ করতে পারে না।

ইসলামে নারীর সম্মান খুব বেশি। নারীকে যে অপমান করে সে পাপী। নারীর শক্তি জাগিয়ে তোলা আবশ্যক। পারাধীনতায় মানুষ পশু হয়। নারীকে স্বাধীনতা না দিলে তাহার মনের নীচতা ও সঙ্কীর্ণতা ঘুচবে না। পুরুষ অপেক্ষা নারীর শিক্ষা বেশি দরকার। শিক্ষিতা নারীর জ্ঞান ও চরিত্রশক্তি জাতিকে অতি অল্প সময়ে শক্তি ও আত্মমর্যদা জ্ঞানসম্পন্ন করে তুলতে পারে।

সমস্ত বিশ্ব হতে নারীকে সারাজীবন এক কারাগারে আবদ্ধ করে রাখবার পুরুষের কী অধিকার আছে। পাপের ভয়ে?–নারী কি নিজের মর্যাদা নিজে বুঝে না? সে কি নিজেকে নিজে রক্ষা করবার চেষ্টা করতে পারে না? সে নিজেকে নিজে প্রতিষ্ঠিত করবার অধিকারী হতে জানে না?

আমাদের মহানবী এসেছিলেন মানুষকে পাপ হতে রক্ষা করতে। যে মানুষ আত্মাকে শুদ্ধ ও পবিত্র করবার চেষ্ট না করে ধর্মকার্যে লিপ্ত হয় সে ভণ্ড। প্রতিদিন পাঁচবার উপাসনা করবার মতো প্রত্যেক মুসলমানকে জ্ঞানলাভের জন্য সর্বদা সজাগ থাকতে হবে। মূখের। উপাসনার কোনো মূল্য নাই।

ফুলের মতো নিজেকে পবিত্র করবার জন্য চেষ্টা করতে হবে। যে তাহা করে না, এবং শুধু এবাদতের দ্বারা স্বর্গে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে, সে ভুল করে।

প্রায় দুই ঘণ্টা ধরিয়া হজরতের জীবন-মহিমা ও বিশেষত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা হইল। অতঃপর উপস্থিত শ্রোতৃবর্গের উপর এলাহীর করুণা ভিক্ষা করিয়া সকলে মোনাজাত করিলেন। তারপর সভা ভঙ্গ হইল। –প্রায় পঞ্চাশজন নারী সমবেত হইয়াছিলেন। প্রত্যেকেই ইচ্ছাপূর্বক চারি আনা করিয়া চাঁদা দিয়াছিলেন। পুরুষ ভদ্রলোকেরাও মেয়েদের স্বাধীনভাবে কথা বলাবলি করিবার সুযোগ দিবার জন্য চাঁদা দিয়াছিলেন। একুনে পঁচিশ টাকা চাঁদা সংগৃহীত হইয়াছিল। এই পঁচিশ টাকা দিয়া পোলাও, গোস্ত ও দধির ব্যবস্থা হইয়াছিল।

মিলাদ অন্তে নফিসা খাতুনের উপদেশ মতো সকলে সারি সারি বসিয়া গেলেন। বৃথা ঝঞ্ঝাট বাড়ানো হইবে ভয়ে মেয়েরা আগেই কিছু পয়সা খরচ করিয়া কলা ও পদ্মের পাতা এবং সোরাই ক্রয় করিয়া আনিয়াছিলেন। শীতল জলে ভর্তি করিয়া সোরাইগুলি মাঝে মাঝে রাখিয়া দেওয়া হইল।

প্রত্যেক পঙক্তিতে বারজন করিয়া বসিলেন। সুতরাং অন্তত চারিজন খাদেম আবশ্যক। রায়হান ও হামিদের উপর পরিবেশন ভার পড়িল। কিন্তু তবুও আরও দুইজন বাকি।

রসনা তখন সকলেই সরস হইয়া উঠিয়াছিল। সরম ও লজ্জায় করিমা ও বালিকা আমেনা বাকি দুইজনের স্থান গ্রহণ করিলেন।

কোনো কারণে আকস্মাৎ হামিদের ললাট স্বেদসিক্ত হইয়া উঠিল। জিহ্বা তাহার শুষ্ক হইয়া গেল। তাহার সহযোগী ঐ সুন্দর হাস্যময়ী লীলামধুর বালিকাটির পানে তাহার ঘৃণিত চিত্ত এমনভাবে লুটাইয়া পড়িতেছে কেন? সহসা নীরবে সে আল্লার নাম লইয়া ভাবিল তাহার চিত্তের এই ভাবপ্রবণতা কি খোদার কাছে ঘৃণিত?–তা বোধ হয় নয়। হউক তাহার চিত্ত এত উন্মনা তাতে কি ক্ষতি?–এটা সম্মান ও শ্রদ্ধা ছাড়া আর কী?

মিলাদ ও তাহার অন্তে রায়হানের বাড়ি যাওয়া হইল না। জমাজমি সংক্রান্ত কোনো কাজে খোরশেদকে সেদিন টাউনে যাইতে হইবে। হামিদকে সঙ্গে লইয়া তাহারা খোরশেদের সহিত শেষ রাত্রিতে গাড়ির জন্য স্টেশনে যাত্রা করিল।

০৬-১০. হিন্দু পাড়ায় শ্যামসুন্দরের বাড়িতে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

হিন্দু পাড়ায় শ্যামসুন্দরের বাড়িতে দুপুররাত্রে পাড়ার সব হিন্দু সমবেত হয়েছেন–পুরুষ নারী উভয়েই। আজ কয়েকদিন হইতে রোজই তারা এমন করেন।

নগেন ঘোষ বলিল–“যাই বল, এবার যে গ্রামে থাকতে পারবো এরূপ মনে হয় না। যে গুজব শুনে আসছি তা একেবারে ভিত্তিশূন্যতা বোধ হয় না। জালালপুরে যে ব্যাপার হয়ে গিয়েছে তার খবর তো সকলেই রাখ। এই আগুন বঙ্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। মোসলমানেরা একেবারে ক্ষেপে গিয়েছে। তারা আর আমাদিগকে রাখবে না। এই বেলা পালিয়ে স্ত্রী-কন্যার সম্মান রক্ষা করা চাই। নইলে কী যে বিপদ হবে তা ঠিক করে বোঝা যাচ্ছে না। আর দেরি করা নয়। সেদিন খোরশেদ যে গিরিবালাকে মেরেছে এটা সামান্য কথা মনে করো না। এর সঙ্গে আরও অনেক কিছু জাত আছে। ওরা সহজে ছাড়বে বলে মনে করো না।এই সামান্য ঘটনা হতে বুঝতে পার তাদের জেদ ও দেমাক কত বেড়ে গিয়েছে। যার যার মতো সরে পড়ো।”

গিরিবালার বাবা শ্যামনসুন্দর বলিলেন–“মেয়েকে মেরেছে তাতে দোষ নাই। এরপর আরও যদি কিছু হয় তা হলে জাত থাকবে না। নতুন গুজবের সত্য-মিথ্যা আমাদের গুপ্তচরদের দ্বারা দেখা যাউক কিছু জানা যায় কিনা। খোরশেদের বাড়িতে একশ লেঠেল এসে লুটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, এইটিই হচ্ছে বড় কথা। ভাই, এতদিনের পর স্ত্রী কন্যাকে হারাতে হল।’ এই বলিয়া শ্যামসুন্দর অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন।

প্রায় পঞ্চাশজন স্ত্রীলোকে সেখানে বসিয়াছিলেন; তারাও অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন।

নগেন ঘোষ বলিলেন–“চুপ চুপ, আস্তে। হরিদয়াল আর ভজহরি ফিরে এলেই বোঝা যাবে আজকার নতুন গুজবের অর্থ কী। সত্য-মিথ্যা টের পাওয়া যাবে। কিন্তু বড় দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি বলি, রমেশও যাক।”

রমেশ বলিল–“কোনোও রকমে তারা যদি বুঝতে পারে, আমি গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়েছি, তা হলে তারা আমায় আস্ত কেটে ফেলবে। তবুও আপনারা যদি বলেন, সকলের মঙ্গলের জন্য আমি প্রাণ দিতে রাজি আছি। কিন্তু এই বেশে আমি যেতে পারবো না।”

রমেশের মা বলিলেন–“বাবা আমাদিগকে রক্ষা করো। তুই ফকিরের বেশ নিয়ে যা।” সকলেই রমেশের মার বুদ্ধির প্রশংসা করিল।

তারপর সকলে মিলিয় রমেশের মাথায় একটা পাগড়ি পরাইয়া দিল। গ্রামের সখের যাত্রার দল ছিল–তাহাদের সাহায্যে বৃদ্ধ ফকিরের কৃত্রিম শুষ্ক শ্মশ্রু সংগ্রহ করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হইল না।

রমেশ মুসলমান ফকির সাজিয়া আল্লাহর নাম না লইয়া হিন্দু মতোই মনে মনে কৃষ্ণ নাম উচ্চারণ করিতে লাগিল। কালবিলম্ব না করিয়া সেই বেশে মিত্রদের পুকুরপাড় দিয়ে সে রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইল। জোছনার আলোক বলিয়া সে একাকী এই দুঃসাহসিক কর্মে লিপ্ত হইবার সাহস সংগ্রহ করিয়াছিল।

ভয় যে তাহার মোটেই হইয়াছিল না তাহা বলিতে পারি না। মনে মনে সে পুনঃ পুনঃ হিন্দু দেবতার নাম লইতেছিল। ভয়, পাছে তাহার চতুরী ধরা পড়ে।

হিন্দুপাড়ায় গুজব উঠিয়াছিল, মুসলমানেরা বহু লাটিয়াল লইয়া হিন্দুদের বাড়ি-ঘর লুঠ করিবে। তাহাদের স্ত্রী-কন্যার সম্মান নষ্ট করা হইবে। ফলে হিন্দু পাড়ার ভদ্র-অভদ্র, যুবক যুবতী, প্রৌঢ়পুরুষ-রমণী এবং বৃদ্ধদের দারুণ আশঙ্কা উপস্থিত হইয়াছিল। এরই গুজবের মূল, ভিন্নদেশে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা।

গিরিবালার বাবা শ্যামসুন্দরের বাড়িতে সমস্ত হিন্দু সমবেত হইয়াছিল। তাহাদের ধারণা কোনো সময়ে মোসলামানেরা আসিয়া তাদের উপর পড়ে তাহার কোনো ঠিকানা নাই। সঠিক সংবাদ জানিবার জন্য রোজই যেমন পাঠান হয় আজও তেমনি গুপ্তচররূপে দুইজন যুবককে মোসলমান পাড়ার অবস্থা জানিবার জন্য পাঠান হইয়াছিল। তাহাদের বিলম্ব হইতেছে দেখিয়া সকলে রমেশকে ছদ্মবেশে পাঠাইলেন। হরদয়াল ও ভজহরি কীভাবে গিয়াছিল তাহা আমরা জানি না। আজ তাহারা একটা নূতন গুজব শুনিয়া বেশি রকম আশঙ্কিত হইয়া পড়িয়াছেন। রমেশ যদি অত ভীত না হইয়া একটু মনের বল সংগ্রহ করিয়া লইত তাহা হইলে তাহার ভাগ্যে এমন দুর্ঘটনা ঘটিত না। এই ভীতিই হইয়াছিল তাহার শত্রু।

রমেশ দেখিল, দূর হইতে দুইজন মুসলমান কৃষক তাহার দিকে আসিতেছে। সে তখন হিন্দুপাড়া ছাড়িয়া একেবারে মুসলমান পাড়ার মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে।

আবদুল করিম এব সেতাবুদ্দীন বন্ধু হেলালের বাড়ি হইতে দাওয়াত খাইয়া গৃহে ফিরিতেছিল। কৃষক হইলেও তাহাদের যথেষ্ট ধর্মভাব বিদ্যমান ছিল এবং ধর্মবিষয়ক অনেক কথাও তাহারা জানিত।

আবদুল করিমের সাংসারিক অবস্থা কিছু দিন হইতে ভালো হইয়া উঠিয়াছে। তার ইচ্ছা একবার সে মক্কাশরীফে ও বায়তুল মোকাদ্দসে যায়। ফকির-দরবেশকে সে খুবই ভক্তি করে।

রাস্তার ধার দিয়া রমেশ যাইতেছিল। তাহার বিপরীত পার্শ্ব দিয়া আবদুল করিমও সেতাবদ্দীন পশ্চাৎ হইয়া আসিতেছিল।

দিনের আলোর মতো জোছনায় আবদুল করিম চোখ তুলিয়া দেখিল একজন মুসলমান দরবেশ আপন মনে চলিয়া যাইতেছেন হাতে তসবীহ।

আবদুল আকস্মাৎ ভক্তিপ্রাণ হৃদয়ে সেতাবদ্দীনকে অপেক্ষা করিতে বলিয়া ছদ্মবেশী

রমেশের সম্মুখে যাইয়া উপস্থিত হইল। দেখিল, সত্যই তিনি একজন দরবেশ। সে

তাড়াতাড়ি রমেশের পদধূলি লইয়া ভক্তি বচনে কহিল, “হুজুর, আপনাকে দেখে নিজকে ধন্য মনে করছি। আমার নসীব আজ বড়ই বুলন্দ।”

অতঃপর সেতাবদ্দীন আসিয়া রমেশের পদচুম্বন করিল।

রমেশ কথা কহিতে পারিতেছিল না।–কৃষ্ণ! একি বিপদ?–মা কালী, দুর্গে! যে ভক্তিলাভ করিবার জন্য মানুষ কত যুগ ধরিয়া সাধনা করে, আজ এই সঙ্কটময় মুহূর্তে সেই ভক্তি লাভ করিয়া রমেশ বড়ই বিপন্ন।

আবদুল কহিল–”হুজুর,দয়া করিয়া আমার গৃহে পদার্পণ করুন। বান্দা আপনার চরণ পূজা করতে পারলে নিজকে অত্যন্ত ভাগ্যবান মনে করবে। হুজুর কোথা হতে আসছেন?”

রমেশ কি কহিবে অথচ একটা উত্তর না দিলেও নয়। সে কহিল, ‘বিসমিল্লা-বোমানা রিম-কাল্লা সালে আলেকুম।”

বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া আবদুল রমেশের শ্বেত শুশ্রুশোভিত মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। এ যে তার বিশ্বাস ও ভক্তির প্রতি একটা ভায়ানক পরিহাস গোছের হইয়া চলিল। সংশয়ে আবদুল জিজ্ঞাসা করিল–“আপনি কোথা হইতে আসছেন?”

রমেশ শক্তির সহিত তসবী টিপিয়া বলিল–“সুবান আল্লা-সুবান আল্লা। আমি দরবেশ-মোক্কা হইতে আসছি। বিসমুল্লা আলেকুম।”

লোকটি কি পাগল! তাই হবে–কিন্তু পাগল হলেও সে আরবি কথা এত ভুল ও বিকৃত করিয়া উচ্চারণ করিবে কেন? পাগল কি গতজীবনে এত সহজ জানা কথাগুলিও বিকৃত করিয়া বলে?

আবদুল বিরক্ত হইয়া কহিল–“দরবেশ বলিয়া কোনো কথা নাই।”

রমেশ ক্রোধে অধীর হইয়া কম্পিত স্বরে বলিল–নেড়ে, কাফের।

ভক্তির বিনিময়ে কিছুই লাভ না করিয়া আবদুলের মনটা কেমন হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার উপর নেড়ে উপাধি লাভ করিয়া সে যুগপৎ বিস্মিত ও স্তম্ভিত হইয়া কহিল–“আপনি কোথাকার ভণ্ড! মুসলমান হয়ে মুসলমানকে নেড়ে বলেন! আপনি মুসলমান নন। আমার সন্দেহ হচ্ছে। এর মধ্যে খুব রহস্য আছে।”

রমেশ –বটে, আমি মুসলমান নই! আমি দরবেশ, মোক্কা শরীফ হইতে আসিয়াছি। পথ ছাড়িয়া দাও। সুবান আল্লা।

আবদুল –আপনি নিশ্বয়ই মুসলমান নন। আমার খুব সন্দেহ হচ্ছে দরবেশ, কথাটি মোক্কা শরীফ হতে আসে না। আসে মক্কাশরীফ হতে। আচ্ছা, বলুন তো, মুসলমানের ধর্মে বিশ্বাস কি? কলেমাগুলি পাঠ করুন দেখি।

বেগতিক দেখিয়া রমেশ থতমত খাইয়া গেল। অনেকক্ষণ হইতে সে প্রবল চেষ্টায় মনের বল ঠিক রাখিয়াছিল। এখন তাহার কণ্ঠ শুকাইয়া উঠিল। আর উপায় নাই।

অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সহিত রমেশ দৌড়াইয়া রাস্তার পার্শ্বে আম্রকাননের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। পলায়মান রমেশের পশ্চাৎ পশ্চাৎ আবদুলও ছুটিল।

সেতাবদ্দীন দাঁড়াইয়া রহিল না।

কিছুদূর দৌড়াইয়া তাহারা রমেশের গলা ধরিয়া ফেলিল। কিন্তু একি? হস্তের আকর্ষণে লোকটির মাথার উপর হইতে কি খসিয়া আসিল! চাঁদের আলোকে সরিয়া আসিয়া আবদুল দেখিল সেটা একটা পরচুলা। কী বিস্ময়!

ঘাড় ধরিয়া দুই একটা নাড়া দিতেই রমেশের শুশ্রু খসিয়া পড়িল। ওমা, এ যে বলাই ঘোষের পুত রমেশ!

অবদুল ও সেতাব রমেশকে খুব করিয়া আপমানসূচক গালি দিল, তা ছাড়া ভয়ানক প্রহারও করিল। আরও কহিল–হিন্দুদের এত বড় স্পর্ধা! মুসলমানের ধর্ম লইয়া এত বড় তামাসা! দরবেশ-ফকির কি ঠাট্টার জিনিস? শুধু রমেশকে নয়, সমস্ত হিন্দুকে এবার জব্দ করবো। ক্রোধে আবদুলের কণ্ঠস্বর রোধ হইয়া আসিতেছিল।

তাহার পর তাহারা রাস্তা ধরিয়া মুসলমান পাড়ার দিকে চলিয়া গেল। রমেশ অত্যন্ত যাতনায় রাস্তার ধারে পড়িয়া রহিল।

রায়হান যখন মিলাদ পাঠ করিতেছিলেন খোরশেদদের বাড়ির পাশে কচুবনের ভিতর দুইটি হিন্দু যুবক নিঃশব্দে বসিয়াছিল। মশা তাহাদিগেকে অত্যন্ত উতলা করিতেছিল। কিন্তু তবুও তাহারা স্থির ও উৎকর্ণ হইয়া অপেক্ষা করিতেছিল।

আহার-শেষে মেয়েরা কথা কহিয়া বাড়ির পথে যখন অগ্রসর হইবার উদ্যোগ করিতেছিলেন তখন হরিদয়াল ও ভজহরি উধ্বশ্বাসে হাঁপাইতে হাঁপাইতে দৌড়াইয়া শ্যামসুন্দরের বাড়িতে আসিয়া মূৰ্ছিত হইয়া পড়িল।

চোখে-মুখে জলের ঝাঁপটা দিয়া সকলে যুবকদ্বয়ের চৈতন্য সম্পাদন করিলেন। তখন একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া হরিদয়াল কহিল–“আর রক্ষা নাই। বহু লাঠিয়াল খোরশেদদের বাড়িতে সমবেত হয়েছে। কানে শুনলাম, আজই রাত্রে তারা হিন্দুপল্লী আক্রমণ করিবে। তাদিগকে বাহির হতে দেখে এসেছি।”

আর কথা নাই–মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া সমস্ত হিন্দু যে যেমন করিয়া পারিল গ্রাম ছাড়িয়া পলায়ন করিল। থাকিল কেবলমাত্র কয়েকজন পুরুষ।

.

সপ্তম পরিচ্ছেদ

স্টেশন হইতে রায়হান যখন ফিরিয়া আসিলেন তখন ফরসা হইয়া গিয়াছে। বিশ্রামের সময় ছিল না। অতঃপর নামাজ পড়িয়া সেলাইয়ের কল লইয়া একটা জামা সেলাই করিলেন।

বেলা যখর নয়টা তখন থানার বড় দারোগা সাহেব কয়েকজন সি: লইয়া তাহার দোকানে আসিয়া উপস্থিত।

হরিবাবু বড় দারোগার বয়স ষাট বছরের কম হইবে না। তিন বৎসর হইল তিনি ওমেদপুর থানায় আসিয়াছেন। এই দীর্ঘ তিন বৎসরে একদিনের জন্যও রায়হানের সহিত তাহার আলাপ হয় নাই।

পুলিশকে সকলে ঘৃণা ও ভয় করিলেও রায়হান পুলিশর লোক দেখিয়া বিশেষ ভীত হইতেন না,। সুযোগ ও সুবিধা হইলে তিনি তাহাদের সহিত বন্ধুরূপে আলাপ করিতেন। দুঃখের বিষয়, এই ভদ্রলোকের সহিত তাহার কোনো পরিচয় হয় নাই।

থানার বড় দারোগাকে সম্মুখে দেখিয়া রায়হান একটু বিস্মিত না হইয়া পারিলেন না। স্মিত মুখে রায়হান দারোগ বাবুকে সম্মুখস্থ চেয়ারে উপবেশন করিতে অনুরোধ করিলেন।

হরিবাবু অত্যন্ত ভদ্রতার সহিত রায়হানকে নমস্কার করিয়া চেয়ারে উপবেশন করিলেন। রায়হান হাতের কাজ বন্ধ করিয়া দারোগা বাবুর আগমনোদ্দেশ্য জিজ্ঞাসা করিলেন।

দোকানের সম্মুখে দেখিতে শয়তানের মতো কয়জন সিপাই দাঁড়াইয়াছিল। রায়হান তাহাদিগকে আসন গ্রহণ করিতে বলিলেন। বাধা দিয়ে হরিবাবু তাহাদিগকে একটু দূরে সরে যাইতে বলিলেন।

অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া হরিবাবু কহিলেন–“দেখুন, রায়হান সাহেব! আমি আমার সন্দেহভঞ্জন করতে এসেছি। আপনার উপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে।”

রায়–আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? আমার উপর আপনার শ্রদ্ধার ভাব জেগেছে কেমন করে? আমার প্রশ্নে কোনো রূঢ়তা নাই জানবেন। আপনার সঙ্গে আমার কোনদিন তো পরিচয় হয় নাই।

হরি–আমরা পুলিশের লোক–কোথায় কে কি করে, সে খবর না রাখলে আমাদের কর্তব্য সম্পাদিত হয় না। না থামিয়াই ভাবাবেগে হরিবাবু কহিতে লাগিলেন–পুলিশের লোকেরা কথা কেউ বিশ্বাস করে না–কিন্তু তবুও আমরা একেবারে পশু নহি। বহুলোক ক্ষমতার অপব্যবহার করে। ভদ্রতা রক্ষা না করে ভদ্র ও অভদ্রের উপর তারা তাদের দুরন্ত ব্যবহারের পরিচয় দেয়। আমাকে তা মনে করবেন না। আমি মনুষ্যত্বকে আদর করতে জানি। দেশের মানুষকে আমি ঘৃণা না করে শ্রদ্ধা করি ও ভালবাসি। আমি তাদের বন্ধু হতে ইচ্ছা করি। যে দুরাত্মা সে নিজের আত্মীয়ই হোক আর বিদেশীই হোক তাকে শাস্তি দেওয়া। কর্তব্য। কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করিয়া হরিবাবু আবার কহিলেন–চিত্তের স্বাধীনতা নষ্ট না করে আপনি ব্যবসা করছেন ইহা খুব ভালো কথা। একটা নিস্তব্ধ থাকিয়া উৎসাহের সহিত পুনঃ কহিলেন আপনি মানুষের মঙ্গল করতে পারলে পশ্চাৎপদ হন না,এ সংবাদ আমি রাখি। দেশের মানুষকে ভালো করা প্রত্যেক গভর্নমেরন্টের কাজ। আপনি তাই করে থাকেন। চাকরি না করেও সরকার ও আমাদের উদ্দেশ্যকে সার্থক করছেন–বড় ভালো কথা। মানুষের দুঃখ দূর করা, তাদের সুখ ও শান্তির ব্যবস্থা করাই আমাদের কাজ। সর্বত্র ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠা করা আমাদের উদ্দেশ্য, আপনারও সেই ব্রত, বড় ভালো–বড় ভালো।

রায়–ক্ষমা করবেন। আপনার অতিরিক্ত প্রশংসায় আমি নিজেকে বিপন্ন মনে করছি। বহু কর্মচারীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। কিন্তু ক্ষমা করবেন আপনার ন্যায় মহানুভব ব্যক্তির সন্ধান কোথায়ও পাই নাই।

হরি-আপনার নিকট কেন এই বেশে এসেছি তার কারণ এখনও বলি নাই। শীঘ্রই গ্রামের সকলকে এখানে ডাকব। কিন্তু তার আগে অপনার মহত্ত্ব ও সত্যপ্রিয়তার উপর নির্ভর করে একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি।

রায়–করুন। যা জানি বলবো। তাতে নিজের ক্ষতিই হোক বা আমার আত্মীয় স্বজনের ক্ষতিই হোক গ্রাহ্য করবো না।

হরি–আমার কাছে খবর গিয়েছে আপনি গ্রামস্থ হিন্দু ভদ্রলোকদের অত্যাচার করতে বদ্ধপরিকর হয়েছেন। শ্যামসুন্দর বাবু থানায় এজাহার দিয়েছেন–রাত্রি তিনটার সময় নাকি আপনি বহু লেঠেল নিয়ে তার বাড়িতে পড়ে রমেশকে প্রহার করেছেন। আপনার ইচ্ছা ছিল সমস্ত হিন্দুপল্লী লুট করা। কিন্তু প্রভাত হয়ে যাওয়াতে সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় নাই। আপনি কিছু মনে করবেন না। আপনার উপর আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা থাকলেও আইন মেনে আমাদিগকে কাজ করতে হয়। বলুন এখন আপনার উত্তর।

রয়হান একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ! যে হিন্দু প্রীতির জন্য রায়হানকে অনেক সময়-অনেক সহধর্মীর কাছে উপহাস লাভ করিতে হইয়াছে, তার ফল এই! এক দেশে বাস করিয়া সে কখনও কোনো কাজে হিন্দুকে বাদ দিতে চায় নাই। বিশেষ করিয়া শ্যামসুন্দর কেমন করিয়া তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনয়ন করিলেন! সে যে তার কাকা। চিরকালই সে তাকে কত শ্রদ্ধায় কাকা বলিয়া ডাকিয়া আসিয়াছে। তার মেয়ে গিরিবালাকে রায়হান কত স্নেহের চোখে দেখে। তবে কি হিন্দু-প্রীতির কোনো মূল্য নাই? তাহার সহধর্মীরা যেমন বলিয়া থাকেন হিন্দুর ভালবাসা শুধু মুখে। মুসলমানকে তাহারা কখনও ভালবাসে না। এসব অভিযোগ কি সত্য?

রায়হান অত্যন্ত বিস্ময়ে কহিলেন–“আমি রাত্রে তিনটার অনেক আগে খোরশেদকে নিয়ে স্টেশনে গিয়েছিলাম।”

“বাস, আর কিছু দরকার নেই”–বলিয়া দারোগা বাবু সিপাই হরিসিংকে ডাক দিলেন।

হরি সিং লগুড়হস্তে উপস্থিত হইয়া ভাবিল রায়হানকে বুঝি বাঁধিবার হুকুম দেওয়া হইবে। সে একবার তাহার রক্ত চক্ষু শোণিত পিপাসু শার্দুলের ন্যায় রায়হানের উপর নিক্ষেপ করিল। কিন্তু দারোগা বাবু হুকুম দিলেন”গ্রামের সকল ভদ্রলোককে এখানে ডেকে আন। কোনো অভদ্রতার পরিচয় দিস না যেন।” হরিসিং সেলাম করিয়া প্রস্থান করিল।

এমন সময় শ্যামসুন্দর ও নগেন ঘোষ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। শ্যামসুন্দরের মাথায় একখানা ভিজা গামছা জড়ান ছিল।

রায়হান সম্ভ্রমে শ্যামসুন্দরকে বসিতে অনুরোধ করিলেন।

দারোগা বাবু রায়হানের আশ্চর্য ব্যবহারে মনে মনে চমৎকৃত হইতেছিলেন। ভাবিলেন, এমন ব্যক্তি তো কখনও দেখি নাই।!

শ্যামসুন্দরের মনে যাহাই থাকুক, অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, তিনি রায়হানের কুশল, জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিলেন না। নগেন ঘোষ চুপ করিয়া রহিল।

অধিক বিলম্ব হইল না। বিরক্ত ও বিস্ময়ে গ্রামের সব ভদ্রলোক আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

রায়হান, দারোগা বাবু ও অন্যান্য ভদ্রলোকদিগকে বসিবার সুবিধা করিয়া দিয়া যৌন হইয়া এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রহিলেন।

আলোচনায় প্রমাণ হইল–যে সময়ের কথা উল্লেখ করিয়া রায়হান ও খোরশেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনয়ন করা হইয়াছে তখন তাহারা স্টেশনে উপস্থিত ছিলেন।

খোরশেদের বাড়িতে গত রাত্রে মিলাদ পাঠ হইয়াছিল। সেখানে যাহারা সমবেত হইয়াছিলেন তাঁহারা অবলা সরলা নারী মাত্র। তাহারা রক্তচক্ষু লাঠিয়াল নহে। তাহাদিগকে ভয় করিয়া গ্রাম ছাড়িয়া কাহারো পলায়ন করিবার দরকার ছিল না।

দারোগাবাবু বুঝিলেন,ব্যাপারের মূলে কিছুই নাই। কিন্তু তাহার মনে প্রশ্ন হইতে লাগিল রমেশের দাঁত ও নাক কে ভাঙ্গিয়া দিয়েছে? মিথ্যা মোকদ্দমা সৃষ্টি করিবার জন্য ইহা কি তার বাপেরই একটা কারসাজি?

দারোগা অনেকক্ষণ অবাক হইয়া থাকিয়া খেলো ঘটনাকে অধিক ফেনাইয়া না তুলিবার ইচ্ছায় রায়হন ও অন্যান্য ভদ্রলোকদের সহিত অমায়িকভাবে করমর্দন করিয়া সেখান হইতে অশ্বপৃষ্টে প্রস্থান করিলেন।

শ্যামসুন্দর মৌন হইয়া বসিয়া থাকিয়া রহিলেন। সকলে মিলিয়া তাহাকে ঘিরিয়া বিদ্রূপ বাণ বর্ষণ করিতে লাগিলেন। হিন্দুরা খেয়ালের বশবর্তী হইয়া মুসলমান

ভদ্রলোকদিগকে অপ্রস্তুত করিবার জঘন্য চেষ্টা কেন করিতেছেন, ইহাও কেহ কেহ প্রশ্ন করিলেন। ক্রমশ তাহাদের স্বর উত্তেজিত ও রুক্ষ্ম হইয়া উঠিল।

ব্যাপার খারাপ হইতে পারে বিবেচনা করিয়া রায়হান শ্যামসুন্দরকে প্রস্থান করিতে ইঙ্গিত করিয়া সকলকে মৃদুভাবে কহিলেন—”বিপদে পড়িলে মানুষ নানা ভুল করে বসে। হিন্দুদের ব্যবহারের আমাদের ক্ষুণ্ণ হওয়া উচিত নয়। গোলযোগ যে এইখানেই শেষ হল, এতে সকলেরই আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। শ্যামসুন্দর বাবু ও অন্যান্য হিন্দুরা এইভাবে শঙ্কিত হবার যথেষ্ট কারণ ছিল।”

রায়হানের নিকট হইতে হরিবাবু স্টেশনে যাইয়া স্টেশন-মাস্টারের নিকট জানিলেন–গত রাত্রি ২টা হইতে সকাল পর্যন্ত রায়হানের সহিত তাহার ব্যবসা সম্বন্ধে আলাপ হইয়াছে। দারোগা হাসিয়া থানায় প্রস্থান করিলেন।

.

অষ্টম পরিচ্ছেদ

গিরিবালাকে প্রহার করিবার পর প্রায় সাতদিন ধরিয়া খোরশেদ স্কুলে যায় নাই। প্রথম তিনদিন বিনা কারণে সে কামাই করিয়াছিল। শেষ পাঁচদিন তাহাকে সাংসারিক কাজে টাউনে কাটাইতে হইয়াছিল।

মনটা একটু ভার করিয়াই সেদিন খোরশেদ ক্লাসের ভিতর বসিয়াছিল।

শিক্ষক যাহা বুঝাইতেছিলেন সেদিকে তাহার আদৌ মন ছিল না এমন সময় হঠাৎ দপ্তরি আসিয়া ক্লাসের শিক্ষক মহাশয়েকে বলিল–“হেড মাস্টার সাহেব খোরশেদ মিঞাকে ডাকছেন।”

গত সাতদিন খোরশেদ স্কুলে আসে নাই। তাহার মন বিনা কারণে আতঙ্কিত হইয়া উঠিল। শিক্ষকের অনুমতি লইয়া সে বাহিরে আসিল।

লাইব্রেরি ঘরে তখন আর কেহ ছিল না, শুধু প্রধান শিক্ষক বিনয় বাবু চেয়ারে বসিয়া একখানা চিঠি লিখিতেছিলেন।

খোরশেদ নিঃশব্দে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া বিনয় বাবুকে আদাব করিল। তিনি কথা কহিলেন না, শুধু একটু মাথা ঝুঁকাইয়া দপ্তরিকে বাহির যাইতে আদেশ দিলেন।

খোরশেদ দুর্দান্ত হইলেও শিক্ষকদের সম্মুখে সর্বদাই সে নম্র ও ভদ্র হইয়া থাকিত। তার ভিতরে যে কতখানি দুর্জয় ভাব নিহিত ছিল একথা কোনো শিক্ষক জানিতেন না।

অত্যন্ত ভয়ে খোরশেদ বিনয় বাবুর আজ্ঞার অপেক্ষা করিয়া মাথা নত করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। বুক তাহার দুরু দুরু করিতেছিল। কোনো দিন তো এমনভাবে হেডমাস্টার মহাশয় তাহাকে ডাকেন নাই। কেহ কি তাহার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনয়ন করিয়াছে? যে একটু ঘটনা হইয়াছিল তাহা তো এক রকম মিটিয়া গিয়াছে।

একটা উদ্বেগশূন্য দীর্ঘনিশ্বাস টনিয়া লইয়া খোরশেদ সোজা হইয়া দাঁড়াইল।

বিনয় বাবু এইবার মাথা তুলিয়া কহিলেন–“খোরশেদ! তোমার বিরুদ্ধে এক গুরুতর অভিযোগ আছে। হয় তোমার স্কুল পরিত্যাগ করতে হবে নইলে অতি কঠিন দণ্ড গ্রহণ করতে হবে।”

খোরশেদ অত্যন্ত বিস্ময়ে ও অত্যন্ত ভয়ে কহিল–“কী গুরুতর অভিযোগ মহাশয়? যদি অপরাধ করে থাকি তবে তার জন্য শাস্তিভোগ করতেই হবে। আমি যে কোনো অপরাধ করেছি এরূপ তো আমার মনে পড়ে না।”

বিনয় বাবু সহানুভূতি বর্জিত কঠিন কণ্ঠে বলিলেন–“তুমি শ্যামসুন্দর বাবুর কন্যা শ্রীমতি গিরিবালাকে মেরেছিলে?”

খোরশেদ তৎক্ষনাৎ কী উত্তর দিতে যাইতেছিল, কিন্তু কী কারণে সে চুপ করিয়া রহিল। প্রধান শিক্ষক মহাশয় আবার বলিলেন–“কেমন এই অভিযোগ সত্য?”

“সত্য।কিন্তু কেন অপমান করেছিলাম তা আপনি জানেন?”

“সে কারণ আমি জানতে চাই না। তুমি যে তাকে মেরেছ–এইটা ঠিক?”

“ঠিক–কিন্তু কারণ আমাকে বলতে হবে। আপনি না শুনলেও আমি বলবো। সে আমাকে অশ্লীল ভাষায় গাল দিয়েছিল কেন? সে তো অনেক দূরেই দাঁড়িয়েছিলো–তবু কেন বল্লে–জল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। জল যে কোনো রকমেই নষ্ট হয় নাই এই কথাই তাকে ভালো করে জানিয়ে দিয়েছিলাম।”

“তোমার ভয়ানক অপরাধ হয়েছে। বিদ্যালয়ের ছেলেদের পক্ষে পথের মাঝে বাজে লোকের সঙ্গে বচসা করা আইন বিরুদ্ধ। তুমি কোন সাহসে অসঙ্কোচে একটা যুবতী মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে সাহস করেছিলে?”

“আমি কথা বলি নি।”

“তুমি কথা বল নাই?”

“সেই আমাকে প্রথমে অতি জঘন্য অপমানজনক কথা বলেছিল।”

“কথাটা কি?”

“এই যেমন মুসলমানেরা আপনাদিগকে গোলাম, উঁটা বা কাফের বলে ঠিক সেই ধরনের কথা।”

“যাক, শুনতে চাই না। তোমাকে গালি দিয়েছিলো–তুমি তার বাবাকে কেন বলে দিলে না?”

“এই মিষ্টিমধুর কথাগুলি হিন্দু ছেলেমেয়েরা তাদের মা-বাবার কাছেই শেখে; সুতরাং তাদের কাছে নালিশ করা আর নিজকে বেশি করে অপদস্থ করা একই কথা। ক্ষমা করবেন, এরূপ উপদেশ আর আমাকে দিবেন না।”

বিনয় বাবু বিরক্ত হইয়া বলিলেন–“তুমি তো বড় পাজি হে। তুমি কোন কালে শুনেছো কোনো হিন্দু তার পুত্র-কন্যাকে এইসব কথা শিখাচ্ছে?”

“পাজি হতে পারি, কিন্তু এটা সত্য কথা!”

“তুমি শ্যামসুন্দর বাবুর মেয়েকে মেরেছিলে–কেমন?”

“মেরেছিলাম। শুধু তাকে নয়, রমেশকেও এ একই কারণে অপমান করেছি।”

“বটে, তোমার এত সাহস?”

“সাহস না হয়ে উপায় কি! হিন্দুর এই রোগের ঔষধ কর্ণ মর্দন ছাড়া আর কিছুই নয়। আজ যে হিন্দু আমায় অপমানসূচক গালি দিতে সঙ্কোচ বোধ করে না–কালই সে বিপদে পড়লে ভগবানের অংশ বা দেবতা বলে আমাকে নমস্কার করবে।”

ক্রোধের মাথায় কথাগুলি বলিয়া ফেলিয়া খোরশেদ থতমত খাইয়া গেল। বিনয় বাবু অগ্নিশর্মা হইয়া “দপ্তরি দপ্তরি” বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিলেন।

দপ্তরি আসিতেই বিনয়বাবু হুকুম দিলেন–“এই ছেলেটিকে কান ধরে বের করে দাও।”

কিন্তু তাহার পূর্বেই দুঃখে ও ভয়ে খোরশেদ লাইব্রেরি পরিত্যাগ করিয়াছিল।

এক ঘণ্টার মধ্যে দপ্তরি সার ক্লাসে নোটিশ দিয়া আসিল–“অদ্য খোরশেদ মিঞার মাথায় স্কুলের ছুটির পর সর্বসমক্ষে গাধার টুপি পরান হইবে।”

.

নবম পরিচ্ছেদ

সেইদিন হইতে কয়েক মাস খোরশেদ স্কুলে যায় না। বাড়িতেই সে থাকে। মাঠের জমি দেখিয়া এবং বাপের কালের প্রজাদের নিকট হইতে খাজনা আদায় করিয়া তার দিনগুলি কাটিয়া যায়।

মিত্রপুকুরের বাঁধানো ঘাটে তখন আঁধার জমিয়া উঠিয়াছিল। ঘাট হইতে সেই অল্প আঁধারকে সরাইয়া ফেলিয়া একটা যুবতী উপরে উঠিলেন।

যুবতী দেখিলেন, ওমা একি? তার সম্মুখে খোরশেদ। খোরশেদ আড়ষ্ঠকণ্ঠে বলিল,–“গিরি, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। অনেক দিন থেকে সুযোগ খুঁজছি, কিন্তু পাই নাই।”

রূপময়ী গিরিবালা দেখিল–সুঠাম সুগোল-দেহ খোরশেদ পোষমানা ব্যাঘের মতো তাহার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। গিরিবালার সে চপলতা আর এখন নাই। সংসারের অনেক কথাই সে ভাবিতে শিখিয়াছে। সে দেখিল–বিনয়াবনত খোরশেদের মুখে একটা তরল মহিমার দীপ্তি ফুটিয়া উঠিয়াছে। দুর্দান্ত খোরশেদ যে কাহাকেও ভয় করে না সে আজ তাহার সম্মুখে বিনয়ে নম্র। কী বিস্ময়!

পুলক ও গৌরবে গিরিবালার মন ভরিয়া উঠিল। সে নম্র-মধুরকণ্ঠে কহিল–“ক্ষমা, কীসের ক্ষমা খোরশেদ? আমি কিছু মনে করি নাই।”

খোরশেদ আবগভরা কণ্ঠে বলিল–“গিরি, তোমার মন এত বড়! তুমি কি দেবী? তুমি আমার মতো নরপিশাচকে এত সহজে ক্ষমা করলে? ওঃ তুমি বড় মহৎ–আমি তোমায়। ভালবাসি।”

জীবনের যে সময় কোনো অজ্ঞাত অনুভূতির লালসায় মানুষের মন অজ্ঞাত সারে উন্মুখ হইয়া থাকে, তখন কেউ যেন এই অতি মধু অথচ ভয়ানক কথাটি কাহাকেও না শুনায়।

গিরির গণ্ড সহসা স্বেদসিক্ত হইয়া গেল। তাহার কাকাল হইতে কলসিটি পড়িয়া একেবারে বেঁকা হইয়া শব্দের সহিত জলের ভিতর পড়িয়া গেল।

দূর হইতে একটি প্রদীপ লইয়া কে একজন ডাকিয়া উঠিলেন–গিরি, এত দেরি হচ্ছে কেন? তোর বাবা যে জলের জন্য বসে আছেন।”

মুহূর্তের মধ্যে গিরি ব্যস্ত হইয়া উঠিল। অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যাকালে সে কাহার সহিত কথা বলিতেছে?

গিরি চিৎকার করিয়া বলিল–“মা,আমায় এগিয়ে নিতে এসেছ! আমি ডরিয়ে মরছিলাম। ভাগ্যে এই ছেলেটা এসে ঘাট থেকে আমায় টেনে তুলেছে।

গিরির মা বিনোদিনী বিস্ময় ও ভয়ে বলিলেন–“মা, এই বাড়ি-এর মধ্যে কি এসেছে?”

বিনোদিনী মেয়ের সম্মুখে আসিয়া দেখিলেন–গিরির কাপড় ভিজে।

“ওমা,কি কথা?”–বলিয়া খোরশেদের দিকে ফিরিয়া বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিলেন কে বাবা তুমি? তুমি কি আমাদের গ্রামের ছেলে?”

একটা দমকা বাতাস আসিয়া বিনোদিনীর হাতের প্রদীপটি নিবিয়া গেল।

খোরশেদ বলিল–“আমি খোরশেদ, গিরি জলের পার্শ্বে সিঁড়ির উপর পড়ে ওমা, ওমা বলে আর্তস্বর চিৎকার কচ্ছিলো–আমি দৌড়ে এসে টেনে তুল্লাম।

বিনোদিনী চোখের জল ফেলিয়া বলিলেন–“বাছা! তুমি খোরশেদ–আহা, আর জন্মে তুমি আমার ছেলে ছিলে! তুমি এ পথ দিয়ে না গেলে যে মেয়ে আমার ডুবে মরে যেত।“

উদ্বেগ,ব্যগ্রতায় বিনোদিনী ভয়ের কারণ জিজ্ঞাসা করিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। এইবার মেয়ের দিকে ফিরিয়া উৎকণ্ঠা-আশঙ্কায় জিজ্ঞাসা করিলেন–“কী হয়েছিল মা?”

গিরি বলিল–“কী যেন আমার পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। একে বারে উপুড় হয়ে পড়ে গড়াতে জলের ভিতর, যেয়ে পড়ছিলাম। গলা আমার বন্ধ হয়ে এসেছিল। ভাগ্যে খোরশেদ বাবু এসেছিলেন।“

খোরশেদ বলিল–“আমি বাবু নই–আমি মিঞা।”

তাহার পর ”আসি” বলিয়া সে পিছন ফিরাইয়া দাঁড়াইল।

বিনোদিনী ব্যস্তভাবে অগ্রসর হইয়া খোরশেদের হাত ধরিয়া কহিলেন : ‘তুমি আজ বাড়ি যেতে পারবে না। এস আমাদের বাড়ি। তোমাকে নিজ হাতে খাওয়াব।”

খোরশেদ আপত্তি তুলিল না। বিনোদিনী অগ্রে, গিরি মধ্যে এবং পশ্চাতে খোরশেদ চলিল।

শ্যামসুন্দর যখন আনুপূৰ্কি ঘটনা শুনিলেন তখন কৃতজ্ঞহৃদয়ে বলিলেন, বাবা খোরশেদ! তুমি আমাদের পর নও। আজ থেকে তোমাকে আমি অধিক করে ভালবাসবো।”

খোরশেদ। আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? আমি কী করেছি?”এর চেয়ে বড় কাজ কে কত্তে পারে?”

তারপর কথায় ও প্রশংসায় ঘণ্টা খানেক কাটিবার পর বিনোদিনী একটা পাকা পেঁপে, দুখানা সন্দেশ এবং খানিক দুধ লইয়া আসিয়া কহিলেন–“মা গিরি, এইগুলি ধর দেখিন, খোরশেদকে দাওয়ায় বসিয়ে নিজ হাতে খাওয়াব। পেঁপেটা বাক্স থেকে ছুরি এনে কেটে দাও। আর জন্মে ও হিন্দু ছিল।”

গিরি, “আনি” বলিয়া পেঁপে ও সন্দেশের ডালা ও দুধ-খানিক গ্রহণ করিল।

আর আপত্তি করিলে লাভ হইবে না ভাবিয়া খোরশেদ কোনো কথা না বলিয়া আসনে বসিয়া পড়িল।

শ্যামসুন্দর অন্ধকারে ঘরের ভিতর তামাক খাইতে লাগিলেন।

বিনোদিনী কহিলেন”তুমি সঙ্কোচ বোধ করো না খোরশেদ। নিজের বাড়ির মতো বসে খাও। এঠো আমি নিজেই পঙ্কিস্কার করবো, তাতে আমায় স্নান করতে হবে না।

.

দশম পরিচ্ছেদ

এই দুঃখ ভরা সংসারে শান্তির আনন্দ কোথায়?–পরের উপকার করিয়া যে দীন ও নিরাশ্রয়কে তাহার হাত ধরিয়া-মূর্খকে জ্ঞানের আলো দিয়াছে।

স্নিগ্ধ রজনীর অঞ্চল উড়াইয়া ধীর সমীরণ করিমার মুখে আসিয়া লাগিতেছিল। করিমা অস্ফুট স্বরে কহিল–“পথহীনকে পথ দেখাইয়া-মূর্খকে জ্ঞান দান করিয়া।”

সে জানে তার জীবন শুষ্ক ও মরুময়। কোথায়ও একটু আনন্দ নাই। পিতা পুনরায় বিবাহ দিবার জন্য তাহাকে তৃতীয় ব্যক্তির দ্বারা অনুরোধ করিয়াছিলেন। করিমা সন্দেহ ও অবিশ্বাসে কিছু বলে নাই।

জীবনের এই শুষ্কতার ভিতর প্রাণের এই ভয়াবহ নির্জনতার প্রতিদান কি শুধু এই পুরাতন সংসারের স্থবির দিনগুলি একই রকম খেলা, কথা ও কাজ?

তার জীবনের উদ্দেশ্য কী? শুধু বাঁচিয়া থাকা। জীবন কি তার শুধু বিড়ম্বনাময়-নিরর্থক!

সেদিন জ্যোছনালোকে সে একটা অতীতের স্বপ্ন দেখিয়াছিল। কিন্তু তাহা ভাবতে সে সাহস পায় নাই। সেই যুবকের প্রশান্ত সৌম্য মূর্তির মধ্যে একটা অতীত স্বর্গ আবেগের বন্যা তাহার মনের উপর দিয়া খেলিয়া গিয়াছিল। নিজের মনে অবাক হইয়া সে বলিয়াছিল ”তওবা”।

একটা কিছু করা চাই। এমনি করিয়া ছেলেখেলার মধ্যে মানুষের মনটাকে কিছুতেই ডুবাইয়া রাখা যায় না। আত্মার স্বভাবজাত অতৃপ্তির সম্মুখে ইন্ধন যোগান চাই। নহিলে সে। বাঁচে না।

করিমা ভাবিল, দুঃখী ও অন্ধ মানুষকে ভালবাসিয়া সে তাত্ত্বিক আনন্দ সংগ্রহ করিবে। মানুষের শিশুকে বুকে লইয়া সে সুখী হইবে।

করিমা আবার ভাবিতেছিল–সেই সে ভিখারির মেয়েটা সেদিন এসেছিল। চারবার তার নিকে হয়েছিল,তবুও সে বিধবা। দ্বিতীয় ও চতুর্থ স্বামী তালাক দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। সে কাল, এই তার অপরাধ। কী করে তার চলবে? মেয়ে মানুষের জন্য সংসারে কাজ আছে? শুধু মানুষের উপর নির্ভর করে কি বেঁচে থাকা যায়? অনেক দিন হইতে সে নিজেকে প্রশ্ন করিয়া আসিতেছে–মেয়ে মানুষকে যদি একটা অর্থকরী কাজ শিখিয়ে দেওয়া যায়–তা হলে সে নিজেই অন্ন সংগ্রহ করবার ক্ষমতা পেতে পারে। এটা সম্ভব কী?

সেই হতভগিনী মেয়েটি সম্বন্ধে আবার তাহার চিন্তা আসিল। আহা, মেয়েটি কাল হলেও তার চেহারায় একটা স্বর্গীয় লালিত্য ফুটে উঠেছে। মাত্র তার বয়স পঁচিশ। মরতে। এখনও বহু বৎসর বাকি। কী করে সে এতকাল বেঁচে থাকবে? খোদার দেওয়া আত্মার প্রতি এত অবহেলা কী সহ্য হয়?

প্রতি শুক্রবারে কত ভিখারিনী এসে দরজায় হাঁক ছাড়ে। কার ঘরেই বা কত চাল পয়সা আছে? এই সহস্র হতভাগিনীদের দুঃখ বেদনার জন্য কে দায়ী? কে তাহাদিগকে এমন করেছে? তারা ছোটলোক–এখানে ওখানে যেতে পারে। ভিক্ষেই হোক আর যাই হোক বাচবার জন্য তারা কিছু চেষ্টা করতে পারে। অসহায় ভালোমানুষের ঘরের মেয়েরা কী করবে? তারা কী করে বাঁচবে? মেয়ে মানুষের জীবন কি দুঃখময়! তা ছাড়া মূল্যহীন জীবনের আদর স্বামীর ঘরেও হয় কি? ন্যায্য দাবি না থাকলে কে কাকে মানে? তাদের জন্য সে কি তার ক্ষুদ্র শক্তি ব্যয় করিয়া কিছু করতে পারে না? সত্য রকমে তাদের জন্য তার। মতো সামান্য নারী কী করতে পারে?

করিমা-আকাশ-পাতাল ভাবিল, কিন্তু কোনো মীমাংসা হইল না।

করিমা আবার ভাবিল–মানুষ লেখা-পড়া না শিখলে পশু হয়–সে কিছু বুঝতে পারে।মেয়ে মানুষের বোঝবার যদি ক্ষমতা থাকতো তা হলে তারা তাদের অবস্থার কথা ভেবে, না কেঁদে থাকতে পারতো না। বাপের যদি একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হয়। পিতা পুত্রের মঙ্গলের জন্য দশ হাজার টাকা ব্যয় করেন। মেয়েকে অন্ধ ও মূর্খ করে বিয়ের নামে তাকে জন্মের মতো তাড়িয়ে দেন। ডেপুটি ইন্সপেক্টর মৌলবী এমদাদ আলীর হঠাৎ মৃত্যুর পর আহা! তার প্রৌঢ়া বৌটির কী দূরবস্থাই না হয়েছিল! এমন ভদ্রঘরের মেয়ে সারা জীবনটা তার দুঃখে দুঃখে কেটে গেছে। আহ্ কি বেদনা–কি যাতনা! এর মীমাংসা কী? সব সময়ে সব অবস্থায়ই দ্বিতীয় বিয়ে সম্ভব? সহসা উফুল্লা হইয়া করিমা বলিয়া উঠিল–দৃষ্টি সম্পন্ন চিন্তাশীল পরোপকারী রায়হানকে এই সব কথা বল্লে সে কি বলে জানা যাবে। আমার মনের এই বেদনার কিছু মূল্য আছে কিনা তার কাছে শুনে দেখলে হয়। সে তো অনেক কথা ভাবে-হৃদয় তার মমতাভরা, এই গুরুতর কথাটা কি তাকে কোনোদিন। আঘাত করে নাই? কিন্তু সহসা করিমা ঈষৎ শিহরিয়া উঠিয়া ভাবিল–কোনো কারণে হয়তো তার সঙ্গে আমার কথা না বলাই ভালো।

পরক্ষণেই লজ্জিত হইয়া করিমা আবার ভাবিল–রায়হান বড় সুন্দর ও মহৎ। আমার প্রাণের ভিতরে তার মহত্ত্বের কথা ঘুরে ঘুরে বেড়াতে চায় সত্য–কিন্তু তার সঙ্গে আমার কথা না বলাই ভালো হবে কেন? বড় কর্তব্যের সামনে মনের এই অতি মূল্যহীন খেয়ালকে স্থান দেওয়া ছেলেমি। ওটা কিছু নয়। নারীর বেদনা ও দৈন্য আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে। দিচ্ছে। একদিকে সে মুখ, অন্যদিকে সে সম্পূর্ণ নিঃসহায়; জীবন তার আবর্জনাবিশেষ। নিঃস্ব, পরাধীন, মূল্য ও শক্তিহীন বিধবা দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করলেও তার অসম্মান ছাড়া সুখ হয় না। নারীর হাতে অর্থ এবং বুকে বল চাই। রুক্ষকেশা শুক্ল বস্ত্রপরিহিতা নিরাভরণা। করিমা আকাশের দিকে চাহিয়া কেবলই চিন্তা করিয়া যাইতেছিল। উজ্জ্বল লোহিত ললাট তার স্বেদ সিক্ত হইয়া উঠিল। কোমল করুণাভরা বিভ্রান্ত দৃষ্টি কাঁপিয়া কাপিয়া উঠিতেছিল। ভাব ও বেদনাবোধে তার রক্ত চিবুক থাকিয়া থাকিয়া স্ফূরিত হইয়া পড়িতেছিল। করিমার মূর্তি খানি কী পবিত্র! কী সুন্দর! কেবল শুভ্রগন্ধ ও সুষমার একখানা উজ্জ্বল মোহন ছবি।

দরজায় ধাক্কা দিয়া এমন সময় খোরশেদ মুখ বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“হামিদ এখানে আছে?”

করিমা উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন–“কে, খোরশেদ নাকি? টাউনে গিয়াছে, তুমি জান না?”

“জানি” বলিয়া খোরশেদ কহিল–“মনে ছিল না।”

খোরশেদ আবার দাঁড়াইয়া থাকিয়াই বলিল–“যাই এখন বুবু!”

করিমা কহিল–“কেন, এত তাড়াতাড়ি কীসের? এসেছ যখন, তখন বসো।”

“চাচি কই?”

”রান্না ঘরে।”

“এখনও ঘরে প্রদীপ দেওয়া হয় নাই যে?”

“কেন, অন্ধকারে বসে থাকলে দোষ কী?”

দোষ নাই–জিজ্ঞাসা করালাম আর কী।”

এমন সময় করিমার ছোট ভাইটি আসিয়া তাহার বুবুকে জড়াইয়া ধরিল। করিমা প্রদীপ জ্বাললেন।

খোরশেদ একখানা চেয়ার টানিয়া উপবেশন করিল। করিমা কহিলেন–“খোরশেদ, তুমি পড়া ছেড়ে দিলে কেন?”

“প্রতিজ্ঞা করেছি, হিন্দুর স্কুলে আর পড়বে না।”

“কেন?”

“হিন্দুর স্পর্শে আসা মুসলমানের পক্ষে পাপ।”

করিমা হাসিয়া কহিল–“বেশ খেয়াল তোমরা মাথায় চেপেছে।”

খোরশেদ কথা কহিল না, অন্যমনস্ক হইয়া বসিয়া রহিল। করিমা বিছানার উপর বসিয়া খোকাকে লইয়া আদর করিতেছিল।

খোরশেদ কম্পিত-কণ্ঠে কহিল–“করিমা তোমার একখানা চিঠি আছে।”

করিমা হাত বাড়াইয়া বিস্ময়ে কহিল–“দেখি, কোথা হতে এসেছে? পিওন তো বিকেল বেলাও এসেছিল।”

খোরশেদ কথা বলিল না। পকেট হইতে একখানা খাম বাহির করিয়া করিমার তুষারশুভ্র হাতের উপর রাখিল এবং মুহূর্তের মধ্যে কাহাকেও কিছু না বলিয়া সে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।

খামের উপরে লেখা ”প্রাণের করিমা” আর কিছু নয়।

করিমার হাতখানি কাঁপিয়া উঠিল। কী বিস্ময়! চিঠিখানি সে দূরে ফেলিয়া দিতে চাহিতেছিল, কিন্তু ভুলও তো হইতে পারে।

ধা করিয়া খামের মুখটা ফাড়িয়া সে যাহা দেখিল তাহাতে তাহার কাছে যেন সমস্ত ধরণীটা অগ্নিময় হইয়া উঠিল। যাহা স্বতীত, যাহা কল্পনায় আসে না–তাহা করিয়া চোখের সম্মুখে দেখিল। তাহাও আবার খোরশেদের নিকট হইতে! ধিক্ তাহার অদৃষ্টকে!

ঘৃণায় চিঠিখানা কুটি কুটি করিয়া পায়ের নিচে দলাইয়া সেগুলি বাহিরে ফেলিয়া দিল। ঘৃণিত সংসার! মানুষের মন কী বিচিত্র!

১১-১৫. ইহার পর এক বৎসর

একাদশ পরিচ্ছেদ

ইহার পর এক বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। পুত্রকে একদিন নফিসা বলিলেন–“বাবা খোরশেদ, হামিদ যখন প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তখন আমেনাকে তার হাতে দেওয়ায় বাধা কী? হামিদের মা বার বার গোপনে আমাকে একথা বলেছেন। হামিদ আমেনাকে বিয়ে করবার জন্য ভারি উৎসুক। তোমার মত না হলে কী করে কী হবে, বল? তুমি তো আর ছোট নও। জাতির গৌরব করে আর কী হবে, বল?”

খোরশেদ। মা, তুমি কী পাগল হলে?হমিদ বি-এ পাশ করলেও তো আমার বোনকে বিয়ে করতে পারে না। লোকের কাছে তাতে আমাদের মাথা হেঁট হবে। চিরকাল আমরা আমাদের বংশ মর্যাদা রেখে এসেছি। আমা হতে তা নষ্ট হলে আমার মনে ভয়ানক দুঃখ হবে। এ কাজে আমার জাত থাকবে না।

নফিসা। এই যে বংশমর্যাদার বড়াই, এটা বাবা কিছু নয়। মাংসহীন শুকনো হাড় নিয়ে টানাটানি করলে কী হবে? তোমার মামু জোনাব মিঞা বংশের বড়াই করে দুই-মেয়েকে হাতি করে রেখেছিলেন। ত্রিশ বছর উতরে গিয়েছিলো তবুও বিয়ে দিলেন না। এটা কি

ভদ্রতা? দেশে কি একটা মানুষও নাই যে তার মেয়ের উপযুক্ত হতে পারে? তাই যদি তিনি মনে করেন তাবে তার এদেশ ছেড়ে অন্য দেশে যাওয়া উচিত ছিল। বাবা! বেশি বড়াই করা ভালো নয়। আল্লার আলমে শুধু আমরাই ভদ্রলোক একথা মনে করো না!

খোর–উপযুক্ত বর না পেলে মেয়েকে কি লোকে ফেলে দেবে? অসভ্য লোকের মধ্যে কি মার্জত রুচি ব্যক্তিরা বাস করতে পারে? পদে পদে তাদিগকে অপদস্ত ও আহত হতে হয়।

নসিফা –তাই বলে কি চিরকাল মেয়েকে বিয়ে না দিয়ে রাখতে হবে? ভদ্রলোক তুমি কাদিগকে মনে কর? পুরোনো লোকের মধ্যে যারা উচ্চশ্রেণীর বংশ বলে দাবি করে তাদের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে বহু নীচতা আছে। আমার মনে হয় তাদের ভদ্রতা তাদের মনের মধ্যে না থেকে কায়দায় যেয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক শিক্ষিত যুবকেরা সেইসব পুরোনো ভদ্রলোকদের চেয়ে বড়।

খোর–কথায় আছে–বাঘের বাচ্চা বাঘ হয় শেয়ালের বাচ্চা শেয়াল। যাই বলেন, হামিদের সঙ্গে আমেনার বিয়ে হতে পারে না। আমার তা হলে মুখ দেখাবার যো থাকবে না। আমি এতে কোনো মত দিতে পারি না। আপনার কোনো বুদ্ধি নাই, কারণ মেয়ে মানুষ আপনি।

নফিসা–হামিদ কোন্ দিক্ দিয়ে মন্দ? সে কি আমেনার ভাই খোশেদের চেয়ে ছোট? তুমি কি তার চেয়ে শিক্ষিত? তুমি কি তা চেয়ে উন্নত ও ভালো লোকের সঙ্গে মিশতে পার?

খোর–হ্যাঁ মা, লেখাপড়া শিখে সে একটু ভদ্র হয়েছে। কত চাষার ছেলে লেখাপড়া শিখে ভদ্র হচ্ছে–আসলে তারা চাষা।

নফিসা–তবে কোথায় আমেনার বিয়ে দিতে চাও? যে ছেলেটার কথা তুমি বলছিলে আমি তাকে পছন্দ কত্তে পাচ্ছিনে।

খোরশেদ-এ-বংশের সঙ্গে সম্বন্ধ করলে আমাদের যে মর্যাদা আছে তার চেয়ে আরো বেড়ে যাবে। ভদ্রলোকেরা আমাকে বেশি করে ডেকে বসাবে। তা ছাড়া আমারও ভালো ঘরে বিয়ে হবে। আশরাফ শ্রেণীতে ভালো রকমে সাবেত হতে পারে। একটু ভালো হসব নসব না করতে পারলে কি আর ভালো হয়!

নফিসা মনে মনে হাসিলেন। ক্ষণেক নিস্তব্ধ থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“ছেলেটির নাম কী?”

খোর–বর্ধমানের করিমপুর নিবাসী মুন্সী নজীর মোহাম্মদ কাজীর পুত্র এনায়েত আলী একটি পাত্র। যেমন রূপ তেমনি গুণ। তার তেজ কী? নজীর সাহেবের গরু, ঘোড়া সারা মাঠে খেয়ে বেড়ায়, কোনো বেটার সাধ্য নাই কিছু বলে। এক চাড়াল-বেটা ছোটলোক, তার গরু দিয়েছিল খোয়াড়ে–লোকটির নাকি খালি মাত্র একখানা ঘর-পরণের কাপড় ছেঁড়া-বিনা চিকিৎসায়, পয়সার অভাবে তার ছেলেটি নাকি মারা গিয়েছিল–মাঠে মাত্র তার তিন বিঘা জমি, তাইতে তার বুকের এত বল–সে দিয়েছিল আবার নজির সাহেবের গরু খোয়াড়ে। তার থোড় ধান নাকি তোমার বেয়াইয়ের ঘোড়াতে পয়মাল করে দিয়েছিল। নজীর সাহেব হাটের মধ্যে তাকে জুতা-পেটা করেছিলেন। সারা বর্ধমান জেলার মধ্যে তাদের সমকক্ষ তোক আর নাই। মানুষকে জুতাপেটা করবার জন্য তাদের একখানা প্রকাণ্ড দালান আছে।

নফিসা–সাত নদী পার সেই দূরদেশে গিয়ে কি আমেনা সেখানে থাকতে পারবে?

খোর–ঐটি হচ্ছে মা তোমার বোকামি। যত দূরদেশ হয় তত কদর বাড়ে। লোকে জিজ্ঞাসা করবে বোনের বিয়ে হয়েছে কোথায়?–আমি বলবো বর্ধমানে। দূরদেশের নাম করতে কেমন গৌরব বোধ হয়, বলুন, দেখি–হুঁগলী, বর্ধমান, বীরভূম, রাজশাহী, ঢাকা। কেমন শোনা যায়! আরো যখন জিজ্ঞাসা করবে–বিয়ে হয়েছে কোন্ বংশে? বলবো বর্ধমানের জমিদার কাজী নজীর মোহাম্মদের পুত্র এনায়েত মিঞার সঙ্গে। অতি উচ্চ বংশ শরীফ খানদান। লোকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকবে।

নাফিসা–এত কোনা-কানাচের সংবাদ কোথা থেকে সংগ্রহ করলে? যেতে তিন দিন লাগে। আমরা গরীব মানুষ–তাদের সঙ্গে আমাদের মিল হবে না। নিজের অবস্থাকে গোপন করে বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়, পরে বিপদ হবে।

খোর–ঘটকের নিকট থেকে সব তথ্য সংগ্রহ করেছি। বিয়ে যদি এক বার দিয়ে ফেলতে পরি–তবে আর ভয় নাই। কে আমাদের প্রকৃত অবস্থার কথা জানতে পারবে? ঘটক শাহাদত মিঞা তাদের কাছে বলেছেন আমরা জমিদার। ঘটক আমাদেরই লোক।

নাফিসা–বড়লোক যখন ছিলাম তখন ছিলাম–এখন আমরা গরিব মানুষ। এসব জাল-জুয়াচুরি দিয়ে কাজ কী বাবা?

খোরশেদ ক্রোধে মাকে নানা অকথা বলিল; মা তার ছোট ঘরের মেয়ে। তাকে বিয়ে করে খোরশেদের বাপের অনেক কলঙ্ক হয়েছিল! ইত্যাদি।

.

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

কয়েক দিন পর খোরশেদ করিমপুরে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কলিকাতা হইতে অল্প দামে কেনা এক স্যুট, পুরানো সাহেবি পোশাক, পরিয়া খোরশেদ নজীর মিঞার বৈঠকখানায় সম্মুখে পায়চারি করিতেছিল। সঙ্গে ছিলেন শাহাদাত মিঞা। এই ভদ্রলোক উপায়ান্তর না দেখিয়া সম্প্রতি কয়েক বৎসর হইতে এই ব্যবসা আরম্ভ করয়াছেন। দুই বৎসর পূর্বে বর্ধমানে কাপড়ের ব্যবসা করিতে আসিয়াছিলেন। সেই উপলক্ষে নজীর মিঞার সঙ্গে তাহার যথেষ্ট বন্ধুত্ব জন্মিয়াছিল বৈঠকখানার সম্মুখে আর কেউ ছিল না। শুধু শাহাদাত আর খোরশেদ।

নজীর মিঞা, খোরশেদ ও পুরাতন বন্ধু শাহাদত মিঞাকে যথেষ্ট সম্ভ্রমের সহিত গ্রহণ করিয়াছিলেন। বস্তুত তাঁহাদেরই আহারের জন্য বাড়ির ভিতর তিনি পোলাও-কালিয়া কোর্মার ব্যবস্থা করিতেছিলেন। এনায়েত আলী সম্বন্ধীর সহিত আলাপ করিতে লজ্জাবোধ করিয়া ঘরের মধ্যে বসিয়াছিল। বয়স তাহার পঁচিশ-মধ্য ইংরেজি স্কুলে নাকি ফাস্ট ক্লাশে পড়ে।

শাহদাত বলিল–“আরে বাপু এসেছি যখন তখন ইনশাআল্লাহ কাজ হাসিল করে যাবোই যাবো।”

খোরশেদ–খোদার মরজি, আর আপনার দোয়া। বোন আমার বড় হয়েছে। বিয়েটা কোনো গতিকে হয়ে গেলেই হয়। তার পর আর ভয় নাই।

শাহদাত–তোমার বুদ্ধি হয়েছে বাবা। সেয়ানা ছেলে, বই থুয়ে কোথায় পালাবে? কোনো রকমে বিয়েটা হলেই কাজ ফতে।

খোরশেদ-জমিদার বলেই বোধ হচ্ছে। বিয়ে যদি হয় তা হল দেশে খুব নাম হবে, তার আর কোনো ভুল নেই। এমন নসর আমার বাপও করে যেতে সক্ষম হন নাই। খোদার কলম কে রদ করবে? তার অনুগ্রহে সব হয়।

শাহদাত–আরে বাবা এত বড় জমিদার আর এ-তল্লাটে নেই, তবে কিনা একটু কৃপণ। অনেক কিছু চার্জ করবে। কিছুতেই পেছপাও হয়ো না। লেখাপড়া শিখে আর কে নাম করতে পারে? ভদ্রলোকদের সহিত কাজ-কর্ম করে যা হয়।

একটু নিস্তব্ধ থাকিয়া শাহাদত পুনরায় বলিল–“বি. এ. পাশ করে যা না হতো এই বিয়ের দ্বারা তোমার তা হবে। সম্মানের চূড়ান্ত। কপাল তোমার। বাবা, তোমার বিয়ের ঘটকালিও আমি করবো।”

খানা তখন প্রস্তুত হইয়াছিল। নজির মিঞা বাহিরে আসিয়া বৈঠকখানায় দস্তরখানা পাতিবার জন্য ভূত্যকে আদেশ দিলেন। খাঞ্চায় খাঞ্চায় আহার সামগ্রী আসিল।

শাহাদাত খোরশেদ যথেষ্ট আদব-কায়দার সহিত জানু ভাঙ্গিয়া উপবেশন করিলেন। ব্যঞ্জনের বহর দেখিয়া খোরশেদ শাহাদত মিঞার গা টিপিয়া কহিল–“একেবারে শরীফ!

নজির হাসিয়া কহিলেন–“শাহাদম মিঞা, সামান্য কিছু প্রস্তুত হয়েছে।” খোরশেদের দিকে চাচিয়া বলিলেন ”বাবা খোশেদ, আপনারা তো বড়লোক। গরিব মানুষের বাড়ির সামান্য নুন-ভাত খেয়ে দেশে যেয়ে বদনাম করবেন না। কাজ যদি হয় তবে গরিবের বাড়ি আপনাদের মতো লোকের পায়ের ধুলো পড়বে। নয় তো এই শেষ।”

খোরশেদ আপনার অনুগ্রহ হলেই হতে পারে।

নজির–আমার এনায়েত যেমন ছেলে তেমন ছেলে এদেশে নেই। কী করি–খরচ পত্র আর কুলিয়ে ওঠে না। বাবার জন্য এ পর্যন্ত আমার পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। বইয়ের খরচ লেগেছে এবার দুশো টাকা।

শাহাদত বলিলেন–তা তো লাগবেই–তিনি বুঝি ফাস্ট ক্লাশ পড়ছেন?

নজির–হ্যাঁ ভাই ফাস্ট ক্লাশে পড়ছে। বড় তেজী ছেলে। সেদিন তর্ক করে সে স্কুলের হেডমাস্টারকে হারিয়ে দিয়েছিল। এ-দেশের কোনো মাস্টার আর তাকে পড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। তাকে কলকাতায় পাঠাতে চাই। কিন্তু একা তো আর খরচ চালাতে পারি নে।

শাহাদাত–আপনি খুব ভালো মতলব এটেছেন। পাড়া গাঁয়ে থাকলে ছেলেপিলে বোকা হয়। কোথায় কলকাতার শহর আর কোথায় পল্লীর মহাকুমার স্কুল। রাজধানীর ছেলেপিলের মনে জোর কত! সেখানে পড়াশুনাই বা হয় কত চমৎকার! মুখে তাদের রাতদিন ইংরেজি লেগেই আছে। তাদের খরচ-পত্র সম্বন্ধে কী ভাবনা? আল্লার রহমে একরকম হয়েই যাবে। কোনো দিন কাজ কি বেঁধে থাকে?

নাজির–আর এক কথা–দেশীয় স্কুলের মাস্টার বেটারা একেবারে জোচ্চোর। ইচ্ছে। করে ছেলেদিগকে ফেল করে দেয়। পাশ যেন তাদের বাবার ঘরের তালুক। উপর ক্লাশে তুলে দিতে যেন ব্যাটাদের পুত্রশোক হয়। খোশা-মোদ না করলে আর কারো পাশ হবার

যো নেই। এনায়েত এমন তেজী ছেলে তবুও বছর বছর তাকে তুলে দেবার জন্য মাস্টারদের খোশামদ করতে হয়েছিল।

খোরশেদভাই সাহেব কত নম্বর পেয়েছিলেন? নজির–ছেলে খুব ভালোই লিখেছিল। ঐ যে বল্লাম, ভালো লিখলে কী হবে?

রাত্রি হইয়া গিয়াছে দেখিয়া সকলে আহারাদি শেষ করিলেন। আহার করাইলেন এনায়েত আলী।

অতঃপর বিবাহের কথা আরম্ভ হইল। নজির মিঞা কহিলেন–“লেখাপড়া জানা। মেয়েরা বড় বেহায়া। আশাকরি, আমার ভাবী পুত্র বধূ এই পড়ার ধার ধারেন না।”

খোরশেদ–“কিছু না, আমার ভগ্নি একেবারে বোকা। দুই পয়সা আর দুই পয়সা কত হয় তা সে জানে না।“

অতঃপর শাহাদাত মিঞা কহিলেন–“বন্ধু! আপনার কাছে কি কোনো কথা ভাড়িয়ে বলা যায়। মেয়ে সম্বন্ধে যা বলেছি তার একবর্ণও মিথ্যা নয়। ভদ্ৰপরিবারে কি লেখাপড়ার চর্চা করে মেয়েদিগকে ব্রাহ্ম-খ্রিস্টান করে তোলা হবে? ছিঃ ছিঃ, তাতে কি ভালো মানুষের ইজ্জত থাকে?”

অতপর বহু কথার পর ঠিক হইল ছেলেকে মাসে-মাসে কন্যাপক্ষকে, বেশি নয়, ১০ টাকা করিয়া পড়ার খরচ দিতে হইবে। গহনা খোরশেদকেই দিতে হইবে। রূপার গনহার আবশ্যকতা নাই–সব কয়খানিই সোনার হইবে।

খোরশেদ তাহাতেই স্বীকৃত হইল। আরও কথা হইল নজির মিঞা, বেশি নয়–২শত বরযাত্রী লইয়া যাইবেন। বাছা বাছা কুটুম্বকে উপঢৌকন ও রেল ভাড়া খোরশেদ দিবে।

বিবাহ সম্বন্ধে আরও আবশ্যক-অনাবশ্যক বহু কথা হইল। সর্বশেষ খোরশেদ গল্পচ্ছলে কহিল–তাহাদের মতো জমিদার তাহাদের দেশে আর কেই নাই। তাহাদের বাড়িতে যে দশজন চাকরানী খাটে, তাহাদের পরনে হামেশা কাজ করবার বেলায়ও দশ বিশ টাকা দামের শাড়ি থাকে।

নজির মিয়া মনে মনে আনন্দ লাভ করিলেন। ভাবিলেন যা-হোক, এতদিন পর একঘর কুটুম্ব পাওয়া গেল। –প্রত্যাবর্তনকালে খোরশেদ কলিকাতা হইতে কতকগুলি চীনা বাসন ও গিল্টি করা গহনা ক্রয় করিয়া আনিল। ভদ্রলোকের বাড়িতে চীনামাটিও কাঁচের বাসন থাকা দরকার, খোরশেদের ধারণা ছিল এই রকম। বিবাহের দিন বরযাত্রীরা সাদা কাঁচের পাত্রগুলি দেখিয়াই খোরশেদের শরীফত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইবে আর কি!

.

এয়োদশ পরিচ্ছেদ

প্রখর সূর্যত্তাপে ধরণী উষ্ণশ্বাস ফেলিতেছিল।

খোরশেদ কয়েকটা ডাব এবং এক বদনা দুধ লইয়া শ্যামসুন্দরের বাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইল। রূপ ও গৌরবে গিরি পথেই দাঁড়াইয়াছিল। সে জল আনিতে যাইতে ছিল। হাতে তাহার স্বর্ণবলয়, বাহুতে অনন্ত, কপালে টিপ।

বাতাস তাহার অঞ্চল উড়াইয়া দিয়াছিল। খোরশেদকে দেখিয়াই সে থমকিয়া দাঁড়াইল শিরায় শিরায় তাহার বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল। কী বিড়ম্বনা!

গিরির সুগঠিত দেহের দিকে খোরশেদ তাকাইল না। সে সোজাসুজি শ্যামসুন্দরের বাড়ির দিকে চলিয়া গেল। সে হয় তো গিরিকে দেখিতে পায় নাই।

গিরি দ্রুতপদে জল আনিতে চলিয়া গেল।

শ্যামসুন্দর খোরশেদকে দেখিয়া কহিলেন–“এই দুপুর রোদে কষ্ট করবার কী দরকার?” খোরশেদ ব্যথভাবে কহিল–“বাড়ির কাজ তো বিশেষ কিছু নেই কাকা! দিদিমণির, আপনার এবং কাকীর জন্যে কচি ডাব এনেছি মাত্র।”

বিনোদিনী খোরশেদকে বসিতে দিয়া, তাহার গায়ে বাতাস করিতে লাগিলেন। খোরশেদ মনে মনে হাসিল।

শ্যামসুন্দর কহিল—”বোনের বিয়ে তো হয়ে গেল। বেশ ভালো ঘরই বটে। সে দেশে ভদ্রলোক বেশি না মোসলমানই বেশি?”

খোরশেদ সহজভাবে উত্তর করিল–“মুসলমান ভদ্রলোকই বেশি।”

বিনোদিনী কহিলেন–“তুমি কবে যাবে বাবা?”

খোরশেদ–এই দুই চার দিনেই যাব। প্রথমে রাচির ট্রেনিং-এ কিছুদিন থাকতে হবে; তারপর কোনো জায়গায় স্থায়ী হবে।

বিনোদিনী–এখন কত করে পাবে?

খোরশেদ–যত দিন ট্রেনিং-এ থাকবে ততদিন বেতন ৫০ টাকা, তারপর থানায় স্থায়ী হলে বেশি।

বিনোদিনী–আর জন্মে তুমি আমার ছেলে ছিলে। তোমাকে দেখতে ঠিক হিন্দুর মতো।

এমন সময় গিরি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করিল। মুখে তার হাসি-চোখে একটা স্নিগ্ধ সন্তোষ। অঞ্চল তাহার খোরশেদের গায়ে লাগিয়া গেল।

খোরশেদ কথা বলিল না।

শ্যামসুন্দর কী কাজে বাহিরে গেলেন। মাতা তনয়াকে বলিলেন–“গিরি! তোমার দাদাকে কিছু জলখাবার দাও।”

খোরশেদ আপত্তি জানইলেও গিরি তাহার হাত ধরিয়া ঘরের মধ্যে লইয়া গেল।

উঠানে এমন সময় একটি মুসলমান ভিখারিনী আসিয়া আল্লা ও মোহাম্মাদের নাম করিয়া ভিক্ষা চাহিলে, কিন্তু তাহার কাথায় কেহ উত্তর দিল না।

নানাবিধ মিষ্টান্ন দিয়া গিরি অনুরোধ করিয়া খোরশেদকে আপ্যায়িত করিল।

জল লইতে বাহিরে আসিয়া গিরি দেখিল ভিখারিনী রান্নাঘরের ডোয়ার উপর ভর দিয়া দাঁড়াইয়া আছে।

গিরির মা চিৎকার করিয়া বলিলেন–“ওমা, মুসলমান ঘর ছুঁয়ে হাঁড়ি বাসন নষ্ট করলে গো! আজ আর খাওয়া হবে না গিরি, মাগীর চুল চেপে ধর। যা, যা, মুসলমানের হাই দেখ।”

ভিখারিনী অপ্রস্তুত হইয়া বাহির হইয়া গেল। গিরি খোরশেদকে ডাকিয়া কহিল–“খোরশেদ, দেখ তো দাদা, ছোট লোকের হাই!”

তখন সন্ধ্যা। খোরশেদ কথা না বলিয়া গিরি ও বিনোদিনীর কাছে বিদায় প্রার্থনা করিল।

গিরি অবাক হইয়া বলিল–“না দাদা, আজ তুমি যেতে পারবে না, আজ থাক, কাল যাবে।”

বিনোদিনী কহিলেন–“ওমা–সেকি কথা! এই এলে, আবার এখনই যাবে? তুমি কি আমাদের পর?

শ্যামসুন্দর বাহির-বাড়ি হইতে গাভীর দড়ি ধরিয়া ভিতরে প্রবেশ করিলেন। তিনিও বিস্মিত হইয়া বলিলেন–“না, না, আজ থাক্। পরের বাড়ি তো নয়।”

অগত্যা চাকরটি বাড়ি ফিরিয়া গেল। খোরশেদের যাওয়া হইল না।

কথায় কথায় রাত্রি তখন এগারটা হইয়া গিয়াছিল।

শ্যামলাল ঘোষপাড়ায় শালিসীতে গিয়াছিলেন। কখন ফিরিয়া আসিবেন ঠিক ছিল না।

গ্রীষ্মতিশয্যে খোরশেদ অনেকক্ষণ ধরিয়া বাহিরে গাছ তলায় বাসিয়াছিল। মুক্তমাঠ হইতে শীতল বাতাস ধীরগতিতে প্রবাহিত হইতেছিল। চন্দ্রালোকে রজনী হাস্যময়ী। জোছনা-বাতাসে বেদনাবিধুর প্রণয় তরল তরঙ্গাকারে উচ্ছলিত। প্রাণময় প্রকৃতির কণ্ঠ হইতে যেন সঙ্গীতধ্বনি শোনা যাইতেছিল।

পেছন হইতে খোরশেদকে চমকিত করিয়া গিরি কহিল–“কী ভাবছ?”

অতঃপর সে খোরশেদের পার্শ্বে বসিয়া পড়িল। গিরির উজ্জ্বল ললাটে শুভ্র জোছনা সুষমা রচনা করিতেছিল। কী কমনীয় মাধুরীমাখা মুখখানি!

খোরশেদ স্তব্ধ বিস্ময়ে গিরির মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

গিরি শান্ত নম্র স্বরে কহিল–“এই মোহিনী প্রকৃতির অনন্ত পুলকের মধ্যে ইচ্ছা হয় বাতাসের উপর খেলিয়া বেড়াই। আর সঙ্গে থাকে আর একজন।”

খোরশেদ–“কে সে?”

“যাকে ভালবাসা যায় সেই প্রাণের দোসর।”

“ঠিক বলেছ। আমিও তাই ভাবছিলাম।”

“বন্ধু ও সাথী বিহনে জীবন বৃথা। এই মাধুরী-মহিমা, এই আলোক বাতাস সবই প্রাণহীন পাথরের স্তূপ।”

“ঠিক গিরি! জীবন আমার দুঃখময়। এ দুঃখের অবসান হবে না।”

“নিশ্চয়ই হবে। দেবতার দয়া হলে তোমার দুঃখের পথে সুখের ফুল ফুটবে।”

“তুমি যা বলছো গিরি, ঠিক বলছো?”

“হ্যাঁ ঠিক বলছি।”

“ছাই, প্রাণের আবেগে কী সব কথা বলে ফেলেছি! তুমি যে আমার দিদি।”

“ছিঃ ও কথা বলো না।”

তাহার পর তাহারা মৌন হইয়া আকাশের দিকে চাহিয়া রহিল। প্রায় এক ঘণ্টা অন্তর মৌনতা ভাঙ্গিয়া জড়িত কণ্ঠ গিরি কহিল–“খোরশেদ, তুমি আমাকে ভালবাস?”

খোরশেদ সহজ স্বরে উত্তর করিল–“হ্যাঁ ভালবাসি।” গিরির সারা অঙ্গ স্পন্দিত হইয়া উঠিল। চক্ষু তাহার মুদ্রিত হইয়া আসিতেছিল।

সে সহসা মূৰ্ছিত হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।

.

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

দুইটি বড় বড় রাস্তা আড়াআড়িভাবে গ্রামখানিকে মাঝখান দিয়া বিভক্ত করিয়া দিয়াছে। গ্রামের ভদ্র শ্রেণীর ইচ্ছা ও উৎসাহেই রাস্তা প্রস্তুত হইয়াছিল। কৃষক ও ভদ্র সকলে মিলিয়া স্বহস্তে গ্রামবাসীদের সুবিধার জন্য সড়কদ্বয় প্রস্তুত করিয়াছিলেন। গ্রামকে প্রদক্ষিণ করিবারও একটা সড়ক ছিল।

দুইটি রাস্তার সঙ্গমস্থলে গ্রাম্য সভাগৃহ। ছোট একখানা চার-চালা ঘর। মাঝখানে পার্টিশন দেওয়া। আগে এই পার্টিশন ছিল না। স্ত্রীলোকেরাও যাহাতে পর্দা রক্ষা করিয়া গ্রাম্য সভায় যোগদান করিতে পারেন–এই উদ্দেশ্যে কয়েক মাস হইতে পার্টিশন বসান হইয়াছে।

করিমা তাঁহার চিন্তার কথা রায়হানকে বলিয়াছিলেন–নারীকে যদি শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে শিল্প শিখান যায় তাহা হইলে তাহার এত দরবস্থা থাকে না।

রায়হানও বহুদিন হইতে নারীর দৈন্য-দুর্দশার কথা ভাবিয়া আসিতে ছিলেন। করিমার নারী হৃদয়ে তাহার নিজের চিন্তার ধ্বনি পাইয়া তিনি খুবই উৎসাহিত হইয়া উঠিলেন এবং ইচ্ছা করিলেন গ্রামস্থ ভ্রমণ্ডলীর সাহায্য লইয়া তিনি এক নারী-শিল্প-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিবেন। সেখানে সর্বশ্রেণীর নারী শিল্প শিক্ষা করিতে পারিবে।

করিমার উপর রায়হানের শ্রদ্ধাভাব জন্মিয়া গেল। করিমা যে সাধারণ নারী নহে, ইহাও তিনি বুঝিলেন। তাহার বিশ্বাস হইল, করিমা ও তিনি একসঙ্গে কাজ করিলে সমবেত চেষ্টায় নারীর মঙ্গল করিতে তাহার খুবই সুবিধা হইবে।

সভা বসিবার পূর্বে রায়হান গ্রামস্থ মুরব্বীদের সঙ্গে দেখা করিয়া তাঁহার ও করিমার অভিপ্রায় জ্ঞাপন করিয়া সহানুভূতি লাভ করিয়াছিলেন।

অদ্য গ্রাম্যসভায় এই বিষয়ের আলোচনা হইবার কথা।

নারী এবং পুরুষদের জন্য উভয় প্রকোষ্ঠেই ঢালা ফরাস পাতা হইয়াছিল। যথাসময়ে সভার কার্য আরম্ভ হইল।

সভাপতি হইলেন হামিদের পিতা সভাপতির আজ্ঞায় রায়হান কহিলেন, “উপস্থিত। মহিলাবৃন্দ এবং দ্ৰ মহোদয়গণ! অদ্যকার সভার উদ্দেশ্য কি তাহা আপনারা অনেকেই জানেন। তথাচ সর্বসাধারণের সুবিধা ও মত জানিবার জন্য আমি কিছু বলিতে চাই। আমাদের দেশের হিন্দু এবং মুসলমান রমণীদের দুর্গতি ভাষায় প্রকাশ করা সুকঠিন।”

“জ্ঞানের দিক দিয়ে যেমন ইহারা দরিদ্র, তেমনি মর্যাদায়ও ইহারা দরিদ্র। অন্ধতা, মূর্খতা, সহায়শূন্যতা ও দারিদ্র্য আমাদের নারীজাতিকে পশু করিয়াছে। নারীর কোনো শিক্ষার আবশ্যকতা নাই–এ কথা যিনি বলেন তাহাকে কয়েকদিন তাহা অপেক্ষা একজন হী প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে বাস করিতে অনুরোধ করি। তিনি বুঝিতে পারিবেন তাহার জীবনে কতখানি অশান্তি উপস্থিত হইয়াছে। নারী নারী বলিয়াই সে আমাদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা পাইবে ইহা যেন কেহ মনে না করেন। নারী যে মানুষ-মানুষ রূপেই সে অধিক। করিয়া আমাদের প্রেম লাভ করিবে। তাহার মনুষ্যত্ব তাহার নারীত্বকে সমুজ্জ্বল করিয়া তুলিবে। মনুষ্যত্ব দূরে ফেলিয়া শুধু নারীত্ব আমাদের মন আকৃষ্ট যেন না করে।

“অশিক্ষিতা নারীর দ্বারা জীবন কোনোকালে সরস হয় না এবং পদে পদে বিড়ম্বনা ভোগ করিতে হয়, সে যত বড় সুন্দরী সম্পদশালিনী হউক না কেন, নারীর কাছে কি আত্মা নাই? নারী হইয়া জন্মিয়াছে বলিয়াই কি বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান-জ্ঞান বঞ্চিত থাকিয়া মনুষ্যত্ব ও ইসলামকে অস্বীকার করিবে? আহা, যাহার মধ্যে জ্ঞান নাই সে যে বড় দীন। যাহার অর্থ নাই সে দরিদ্র নহে–যে জ্ঞানান্ধ তাহার কাছে সহস্র প্রাণহীন স্বর্ণমুদ্রা থাকিলেও সে বড় দরিদ্র, এ কথা আমরা কবে বুঝিব? দেশবিখ্যাত জননায়কের ভগ্নি হইয়া জন্মিয়াছিলেন। বলিয়াই কি তিনি চিরদুঃখিনী-অন্ধ, পরমুখাপেক্ষী ও মর্যাদাশূন্য হইয়া থাকিবেন? এটা অন্যায় ও অত্যাচার। মমতাই রূপ, নারী মমতাহীন, অন্ধ ও দুর্বল,তাহার রূপের কোনো মূল্য নাই। সে সাময়িক বিলাসের পাত্র–তাহাকে শক্তি দেওয়া হউক, তাহাকে রূপময়ী করিয়া তোলা হউক।”

“যে স্বামী বা পিতা স্ত্রীকে বা কন্যাকে অলঙ্কার বা অর্থ দান করিলেন, তিনি কিছুই দিলেন না। স্বামী যদি স্ত্রীকে অলঙ্কারের পরিবর্তে জ্ঞান দান করিতেন তাবে তাহার মূল্য অধিক হইত। জীবনের এত আপনার জন, যাহাকে নয়নে নয়নে রাখতে চাই, সর্বদা যাহার। মঙ্গল কামনা করি, সেই চারু সঙ্গিনীকে সকল দান অপেক্ষা মহৎ দান হইতে দূরে রাখলাম। বন্ধুর পক্ষে ইহা অপেক্ষা নিষ্ঠুরতা আর নাই। প্রিয়তমার জড়দেহ লইয়া টানাটানি করিলাম, কিন্তু তাহার আত্মা আমারই সম্মুখে দুর্গন্ধ কীটময় রহিয়া গেল, তাহা আমি দেখিলাম না। কেননা, আমি তাহাকে ভালবাসি!–আত্মা তাহার আমার সম্মুখে রুধিরাপুত হইল, আমার চক্ষু দিয়া এক ফোঁটা জলও বাহির হইল না। এই মানবজন্ম আর কি আসিবে?”

“যে সব নারী বিধবা হইয়া অপরের গলগ্রহ তাহাদের কষ্টের সীমা থাকে না। নারী যদি হস্তপদের পূর্ণ ব্যবহার শিখে তাহা হইলে তাহাকে আর এত পরমুখাপেক্ষী হইতে হয় না। দেশের, সমাজের, এমন কি স্বামীর কাছে সে সম্মান লাভ করে। নারীকে শিক্ষা দিতে হইবে। তাহাকে স্বাধীনভাবে জীবিকার্জনের পথ দেখাইতে হইবে। দেশের অনেক নারী দুঃখে, দারিদ্র্যে ও বিপদে পড়িয়া পাপ পথে বাহির হয়। তাহাদের অন্ন যদি থাকিত, যদি দুষ্ট শয়তানদের ছলনা বুঝিবার মতো জ্ঞান তাহাদের থাকিত, তাহা হইলে তাহারা পাপের পথে যাইত না। নারী একবার পাপ করিলে তাহাকে সংসার ও সমাজ হইতে বাহির করিয়া দেওয়া হয়। এইসব সমাজতাড়িতা নারী অন্নসংস্থানের পথ না পাইয়া, হৃদয়ের দীনতা লইয়া নিজকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে না। পুরুষের মতো হারান সম্মান ফিরাইয়া আনিবার শক্তি তাহাদের নাই। ফলে তাহারা লম্পট মানুষের বিলাসপুত্তলি হয়। না হইয়াও তাহারা পারে না। এইসব নারীদের যদি কোনো দাঁড়াইবার স্থান থাকিত, তাহা হইলে তাহারা নিজের ও বাংলার বুকে এত আগুন জ্বালাইত না।”

“অসহায় ও নিরাশ্রয় নারীদের জন্য আমরা আমাদের গ্রামে একটি বিদ্যালয় খুলিতে চাহিতেছি। এই কার্যের প্রতি সকলেরই সহানুভূতি আকর্ষিত হইয়াছে–ইহা সুখের কথা।”

অতঃপর পরদার অন্য ধার হইতে করিমা কহিলেন ”সভাপতি এবং উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী! নারীদের দুঃখে যে আপনারা বিচলিত হইয়াছেন ইহা খুবই আশা কথা। গত কয় বৎসর ধরিয়া নারীদের অবস্থার কথা যতই চিন্তা করিয়াছি ততই ব্যথায় অবনত হইয়া পড়িয়াছি। নারী আর সুনামের মহিমায় বাঁচিতে পারিতেছে না। মনে হও তাহাকে অবাধ্য ও বিদ্রোহী হইতে হইবে। সে কাহারও নিকট দয়া পাইতে চায় না। লজ্জহীনার মতো হয়তো তাহাকে ন্যায্য দাবি বুঝিয়া লাইতে হইবে।”

“বঙ্গের নারীর অপরিসীম দুঃখের একমাত্র কারণ অবরোধ প্রথা (পর্দা নহে)। মূর্খতা ও মিথ্যা লজ্জার প্রশংসা। নারী কাঁদিলেও তাহার রূপ ফুটিয়া উঠে–অশ্রুবিন্দুগুলি মুক্তাবিন্দু বলিয়া অনুমিত হয়–এ কথা, এ ভালবাসা আর আমরা শুনিতে চাই না। পেটে আমাদের অন্ন নাই-পরণে বসন নাই–আত্মায় শুভদ্রতা। নাই–চক্ষু আমাদের শরমে মুদ্রিত-নারী নিরাপদ ওয়েটিং রুমে দাঁড়াইয়া বা অন্ধকারে ছুরি দিয়া সতীত্ব রক্ষা করিবে না–সে পুরুষের মতো আলোকে দাঁড়াইয়া সকলের সম্মুখে নীরব ভাষায় বলিবে–আমাদের ব্যক্তিত্বের মর্যাদা আছে। আমরা এত নির্ভরশীল হইতে পারি না। আমরা মাথা হাত ও পায়ের সম্পূর্ণ ব্যবহার চাই।”

“অত্যধিক শরমের প্রশংসায় আমরা মনুষ্যহীন হইয়া পড়িয়াছি। দারুণ বিপদে পড়িয়াও আমরা চিৎকার করিয়া জোর করিয়া দেশের মানুষকে বলিতে পারি না আমাদিগকে রক্ষা কর। দেশে বহু মেয়েচুরির কথা শুনিতে পাই, কিন্তু কই, পুরুষ-ছেলেকে তো কেউ চুরি করিতে সাহস পায় না? ভিতরে যদি তাহাদের শিক্ষার শক্তি থাকিত তাহা হইলে কি তাহাদিগকে প্রাণহীন বস্তুর মতো লুকাইয়া রাখিতে সাহস পাইত? পুরুষের মতো সে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিত। পুরুষ হাজার বার পাপ করিলেও তাহার দোষ হয় না, নারী একবার পাপ করিলে সে ঘৃণিত, লাঞ্ছিত ও সংসার হইতে তাড়িত হয় কেন? সে কি অনুতাপ করিতে জানে না?”

“যে হৃদয় জ্ঞানের আলোক পায় নাই–যেমন সদা নির্ভরশীল, পরমুখাপেক্ষী ও শক্তিহীন সে হৃদয়ই নহে। ইসলাম ক্রীতদাসকে স্বাধীন করিয়া দিয়া পূণ্য অর্জন করে, আর ইসলাম কি নারীকে অন্ধ, শক্তিহীন এবং ক্রীতদাসীর জীবন গ্রহণ করিতে অনুমোদন করিতে পারে?”

একজন জিজ্ঞাসা করিলেন–“নারীদের জন্য যে বিদ্যালয় খোলা হইবে তাহাতে কী কী বিষয় শিক্ষা দেওয়া হইবে?

রায়হান বলিলেন–“শ্রদ্ধেয়া করিমা বিবি মেয়েদের এবং মহিলাদের নৈতিক ও মানসিক উন্নতির জন্য পরিশ্রম করিবেন। শিল্প-শিক্ষয়িত্রী যত দিন না পাওয়া যায় ততদিন আমি নিজে ছাত্রীদিকে সেলাইয়ের কাজ শিক্ষা দিব। আমার দুইশত টাকা মূল্যের দুইটি মেশিন পূর্বেই এই বিদ্যালয়ের জন্য দান করিয়াছি। যত শীঘ্র সম্ভব পুস্তক বাঁধাই শিক্ষা। এবং মিস্ত্রীর কাজ মহিলাদিগকে শিক্ষা দিতে চাই।”

অতঃপর আরও কয়েকজন ভদ্রলোক অনুষ্ঠানকে প্রশংসা করিয়া বক্তৃতা প্রদান করিলেন। শ্রোতামণ্ডলীর চাহনি ও ভাবে ক্রমশ অধিকতর সহানুভূতির চিহ্ন দেখা যাইতে লাগিল।

একজন দাঁড়াইয়া বলিলেন–“মহিলা কেন, ছেলেদের জন্যও শিল্প-বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক।”

রায়হান বলিলেন–“ছেলে বিদ্যা লাভ করিয়া শক্তিমান পুরুষ হইবার যথেষ্ট সুযোগ পায়। সে অরণ্যে প্রবেশ করিয়া শার্দুলকে সমরে আহ্বান করে। নারী দুর্বলতাহাকেই অধিক সুযোগ দেওয়া কর্তব্য।”

সর্বশেষে করিমা বিবির পিতা সভাপতি রূপে কহিলেন–“উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী এবং স্নেহের পুত্র-কন্যাগণ! আজ আমি কী বলব, বুঝিতেছি না। আনন্দে চিত্ত ভরিয়া উঠিয়াছে। যাহা ভাবিতে পারি নাই তাহা আজ প্রত্যক্ষ করিলাম। নবীন পুত্র-কন্যাদের ভিতর মানুষের জন্য যে এমন বেদনা বোধ জন্মিয়াছে ইহা ভাবিয়া আমি পুলকিত হইতেছি। দুঃস্থ সহায়শূন্য রমণীদের জীবন দেখিয়া সত্যসত্যই মনে হয় ইহারা সংসারের আবর্জনা বিশেষ। হস্ত পদ থাকা সত্ত্বেও কে ইহাদিগকে নিজীব জড়পদার্থ করিয়া তুলিয়াচে তাহা বুঝিতে। পারিতেছি না। প্রিয়তম কল্যাণীয় রায়হান মিঞা এবং আমার কন্যা কল্যাণীয়া করিমা ও অন্যান্য বক্তারা যাহা বলিয়াছেন তাহাই আমাকে পুনরায় বলিতে হইবে।”

“আমি জানি, এক ভদ্রলোক একদা মক্কাশরীফ অভিমুখে যাত্রা করিলেন। তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল পূণ্য লাভ করা। তিনি যে দিন উৎসব করিয়া যাত্রা করিলেন ঠিক সেই দিন তাহারি গৃহপার্শ্বে এক বৃদ্ধা অনশনে কাল কাটাতেছিল।”

“দেশের রমণীদের জীবন ভারস্বরূপ এ-কথা খুবই সত্য। কন্যা বলিয়া বাল্যকালে তাহাকে এক পার্শ্বে বসিতে হয়, অল্প খাইতে হয়–জগতের সকল সৌন্দর্য ও জ্ঞান তাহার দৃষ্টির সম্মুখ হইতে সরাইয়া লওয়া হয়। বিবাহের পর অনুন্নত আত্মা লইয়া স্বামীগৃহ হইতে তাহাকে পদে পদে লাঞ্ছিত হইতে হয়। যদি কোনো কারণে সে স্বামীগৃহ হইতে ফিরিয়া আসে তাহা হইলে জীবন অন্ধকারময়। মনে হয়, খুবই ভয়ানক।”

“আর এ কথা–বহু বালিকা দুষ্ট লোকের ষড়যন্ত্রে পতিতাদের হস্তে পড়ে। আহা! অনিচ্ছা সত্ত্বেও কত কুসুম-কলিকা বালিকা পাপের পথে পড়িয়া আছে, কে তার খবর রাখে? এইসব বালিকার ফিরিবার পথ নাই। সমস্ত বিশ্ব তাহাদিগকে দূর করিয়া দেয়–অপমান ও লজ্জা ছাড়া তাহাদের ভাগ্যে আর কিছু থাকে না। এই সব বালিকার বাহুতে যদি শক্তি থাকিত–যদি তাহাদের পুরুষের ন্যায় নিজদিগকে প্রতিষ্ঠিত করিবার ক্ষমতা থাকিত, তাহা হইলে তাহারা সেই সব পৈশাচিক স্থানে বাস করিতে বাধ্য হইত না। স্ত্রীলোকে অনেক সময় স্বামীর গৃহের তাচ্ছিল্য ও লাঞ্ছনার ভয়ানক পরিণামের কথা বলিয়া থাকে। তার কারণ স্ত্রীলোকদের সত্যসত্যই রূপ ছাড়া গর্ব করিবার আর কিছু নাই। একেবারেই তাহার আবর্জনা বিশেষ-পরমুখাপেক্ষী, অত্যন্ত নির্ভরশীল। কে কবে দীনহীন দরিদ্রকে ভালবাসে? কুরূপা নারীও সম্পদশালিনী হইলে তাহাকে সকলেই ভালবাসে।”

“নারীকে যখন পুরুষের সহিত বসবাস করিতে হয় তখন তাহাকে অনেক পরিমাণে পুরুষে সমকক্ষ করিত হইবে, নচেৎ নারীর ভাগ্য ফিরিবে না।”

“পুরুষ সারাজীবন পাপ করিয়া বৃদ্ধকালে দেশমান্য ঋষি হইতে পারেন–আর নারী যদি একটু পথভ্রষ্টই হয় তবেই তাহার সর্বনাশ। বিধাতার দুয়ার তাহার সম্মুখে রুদ্ধ। কী অন্যায়–কী বেদনা! নারী কি মানুষ নহে? পাপী নারীর কথা কেহ আলোচনা করিতেও লজ্জা বোধ করেন। পুরুষ তাহার পাপী লম্পট পিতার চরণধূলি মাথায় লইয়া স্বর্গে যাইবার। ব্যবস্থা করে! কিন্তু অনুতপ্তা পতিতা নারীকে কেহ স্থান দেয় না। এই সব অত্যাচারিত বালিকা ও নারীর জীবনের মূল্য কে দিবে? একটি জীবনের দুঃখের দাম তো সমস্ত বিশ্ব দিলেও শুধবার নয়।”

“আমরা আমাদের নারী-আশ্রমে কী করিতে চাই? আমরা সর্ব প্রথম নারীকে জ্ঞান দিতে চাই। যাহার মধ্যে জ্ঞান আছে সে যে অবস্থায়ই পড়ুক না কেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিবে। বিশ্বের সম্মুখে নিজের মর্যাদাকে সে গড়িয়া তুলিতে সক্ষম হইবে। জ্ঞানী মরিবার নয়–সে মাথা নত করিবার নয়। মনে হয় পুরুষ অপেক্ষা নারীর অধিক শিক্ষা আবশ্যক। শিক্ষিতা মাতৃদলের মহিমায় অতি অল্পসময়ে যে কোনো জাতি উন্নতির চরম সীমায় উপনীত হইতে পারে। বঙ্গদেশের সমস্ত পুরুষের বিদ্যালয় ও কলেজের পুরুষ ছাত্রদের পরিবর্তে যদি মহিলাদিগকে উচ্চ শিক্ষিতা করা যাইত, তবে বাঙালি অতি অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হইতে পারিত। কতকগুলি শব্দ বা অভিধান মানুষ গঠন করে না। ভাবই শক্তির নিঝর। শিক্ষিতা নারী গৃহের কাজ করিতে করিতে সন্তানকে অতি শিশু বয়সেই মহৎ, গরীয়ান ও শক্তিমান করিয়া তুলিতে পারিতেন।”

“বহু রমণী সমাজ-অত্যাচারে গৃহ ছাড়া হয়। জগতের কোথায়ও তাহাদের স্থান হয়। লম্পট ও বদমাইস পুরুষদের জন্য অট্টালিকা।–শিক্ষিত ও বড় লোকের শ্রদ্ধা, উচ্চ আসন এবং উপাসনা মন্দির পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

আহা! নারী বলিয়াই কি নারীকে পশু অপেক্ষা ঘৃণিত অবস্থায় রাখিতে হইবে? আমাদের এই শিল্পাগারে সকল শ্রেণীর ও জতির রমণীদের আশ্রয়স্থল হইবে। তাহাদিগকে শিক্ষার সহিত নানাবিধ শিল্পকার্য শিক্ষা দিয়া আত্মনির্ভরশীল করিয়া দেওয়া হইবে। দর্জির কাজ, মিস্ত্রীর কাজ, পুস্তক বাঁধাই, বস্ত্রবয়ন, আরও বিবেচনা মতো অন্যান্য বিষয় শিক্ষা দেওয়া হইলে তাহাদিকে অসহায় অবস্থায় কাল কাটাইতে হইবে না–পেটের জন্য রূপ বিক্রয় করিতে হইবে না। মূর্খতা, দারিদ্র ও অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা রমণীর জীবন দুঃখময় করিয়া তুলিয়াছে। তাহারা পুরুষের হাতের খেলনা–ইচ্ছা হইলে পুরুষ কাছে স্থান দেয়, অথবা ফেলিয়া দেয়। মানুষের এ-অধোগতি বাস্তবিকই অসহ্য। আমি এই মহাকার্যে আমার বাৎসরিক ১২,০০০ টাকা আয়ের সম্পত্তি দান করিলাম।”

.

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

ইহার পর এক বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে। নৈহাটির সন্নিকট মহেন্দ্র নগরের থানা নদীর ধারে অবস্থিত। রাত্রিকালে থানার বারান্দা হইতে মিলের অসংখ্য প্রদীপশ্রেণী দৃষ্ট হয়।

থানার অধীন গ্রামগুলিতে হিন্দুর সংখ্যাই বেশি। স্থানে স্থানে দুই এক ঘর দরিদ্র মুসলমান পরিবার বাস করে। তাহারা অনিচ্ছায় অনেকটা হিন্দু ভাবাপন্ন।

থানার পার্শ্ব দিয়া পূর্ব-পশ্চিম অভিমুখে একটি প্রকাণ্ড রাস্তা। রাস্তার পার্শ্বেই বাজার। বাজারে হিন্দু-মুসলমান দুই শ্রেণীর লোকই সমাগত হয়। খোরশেদ আজ ছয় মাস হইতে এখানকার দারোগা। বড় দারোগা যিনি তিনিও মুসলমান।

সেদিন শনিবার বৈকাল বেলা খোরশেদ ও বড় দারোগা সাহেব থানার বারন্দায় বসিয়া আলাপ করিতেছিলেন, এমন সময় চারিজন চৌকিদার একটি মৃতদেহ লইয়া তাহাদের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল।

মৃতদেহের মাথায় একটা রক্ত সিক্ত টুপি লাঠির আঘাতে মাথাখানি দুই ভাগ হইয়া গিয়াছিল।

খোরশেদ ভীত ও বিস্ময়ে কুরসি ছাড়িয়া দুই পদ পেছন হাটিয়া কহিল–“কী ভয়ানক!–কে মুসলমানের রক্ত এমনভাবে ফেলতে সাহস করেছে?” তারপর হাঁকিয়া কহিল–“চৌকিদার ব্যাপার কী? বল।”

বড় দারোগা আবুল হোসেন মিঞা বলিলেন–খুবই দুঃখের বিষয়, তবে বিস্মিত হলে চলবে না। সবে দারোগা হয়েছেন, কিছুদিন খুন-জখম দেখে একটু বিস্মিত হবেনই। হৃদয় শক্ত হলে আর এ বিস্ময় থাকবে না।

খোরশেদ। দারোগা সাহেব, মুসলমানের উপর জুলুম দেখলে চিরকালই যেন আঘাত পাই। মুসলমানকে নিষ্পেষিত হতে দেখে মন শক্ত করে রাখব? অসম্ভব।

আবুল হোসেন। মুসলমানের দুর্দশা দেখে মন শক্ত করে রাখতে বলছি না। মুসলমান হয়ে তা কি বলতে পারি? কিন্তু সে যদি অন্যায় কাজ করে–পরের মাথা ভাঙ্গতে গিয়ে নিজের মাথায় আঘাত পায়?

খোরশেদ। মুসলমান অন্যায় করলেও সে মুসলমান। সে যদি চুরি করে তা হলেও আমি ক্রুদ্ধ হই না। সে যদি বিধর্মীকে হত্যা করে তাকে আমি ধন্যবাদ দেই। হিন্দুকে জব্দ করাই মুসলমানের ধর্ম। শয়তান-প্রতিম কলিকাতার মুসলমান গুণ্ডাকে আমি ভালবাসি। হিন্দু ঋষি হলেও আমার শ্রদ্ধালাভ করবে না।

আবুল হোসেন। এ সব আলোচনা এখন থাক। আপনাকে এখনই ঘটনা স্থলে যেতে হবে। চৌকিদার, তোমাদের এজাহার বল।

চৌকিদার ফেলারাম মুচি বলিল–বাবু, হুজুর! এই যে মড়া দেখতে পাচ্ছেন, এ মড়া হচ্ছে আজিজ মিঞার। গত রাত্রে কে বা কারা আজিজকে হত্যা করে গিয়েছে তার ঠিকানা নেই।

মহেন্দ্রনগরের থানা হইতে প্রায় এক মাইল দূরে ঠাকুর জমিদারদের কাছারী। আজিজ তাহাদের এক প্রজা। সে হুগলীতে কিছুদিন পড়িয়া ছিল এবং এবং ইসলাম-প্রচারক মৌলবী হালিমুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে বহু দেশ ঘুরিয়া বহুলোকের সহিত মিশিয়া এবং বহু কথা শুনিয়া বিলক্ষণ জ্ঞান অর্জন করিয়াছিল। সামান্য লোকের পুত্র হইলেও আজিজের আত্মসম্মান জ্ঞান জন্মিয়াছিল। শ্রেষ্ঠ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সদ্ব্যবহার ও স্পর্শে মন উন্নত হইয়া গিয়াছিল।

জমির খাজনা দিবার জন্য আজিজ কাছারীতে নায়েব গণেশ মুখার্জির কাছে গিয়াছিল। নায়েব মহাশয় আলবোলাটা নিতেছিল, তখন অজিজ মিঞা যাইয়া সেখানে উপস্থিত হইল। নয়েব আজিজের বেপরোয়া ভাব দেখিয়া জ্বলিয়া গেল। কারণ আজিজ আভূমি নত হইয়া নায়েবকে সেলাম করিয়া ছিলেন না।

নায়েব সম্মান নষ্ট হইবার ভয়ে অজিজের দিকে চাহিল না। একখানা চেয়ার ছিল। আজিজ কাহারও অনুমতি না লইয়া সেখানে বসিয়া পড়িল।

নায়েব অগ্নিশর্মা হইয়া কহিল–ছোটলোক, নেড়ে!–কাল তোর বাবা কাছারীর মেজে ঝট দিয়ে গেল, আজ তুই সেই কাছারীর কুরসিতে এসে বসেছিস।

আজিজ বলিল–তা ঠিক নায়েব মশায়। কাল তোমার বাবাও দুর্লভ তিলির ভাত বেঁধে আর মাঠে ধান কুড়িয়ে ফিরত। তার বেটা তুমি ও নায়েব হয়ে বড় মানুষ হয়েছ। তুমি না একটু চিটে গুড়ের জন্য বেদনগাছির বাজারে নারকেলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে? বেশি দিনের কথা নয়!

নায়েব ক্রোধে আজিজের কান ধরিয়া মাথায় হস্তস্থিত রুল দিয়া এক প্রচণ্ড আঘাত করিল।

আজিজ মাথার কাপড় জড়াইয়া কাছারিগৃহ পরিত্যাগ করিয়া আসিবার সময় বলিয়া আসিল–কাফের, ইসলামের অর্থ তুমি কী বুঝবে! এ গণ্ডিতে ব্রাহ্মণ-শূদ্র বলে কোনো কথা নেই–আশরাফ-আতরাফ বলে কোনো কিছু নেই-ইসলাম শুধু আত্মাকে চিনে–আত্মার গৌরব-বলে বড়। ইসলাম বড়-ছোট বলে কোনো সার্টিফিকেট কাহারো গলায় বেঁধে দেয় না। চরিত্র, মনুষ্যত্ব ও জ্ঞানের ঐশ্বর্যে সে মহারাজা। যে ইসলামের এ-কথা মানে না সে অন্ধ মানুষের কাছে যত আসনই পাক না কেন, সে হীন। হিন্দু মানুষের মনষ্যত্বকে অবহেলা করতে সঙ্কোচ বোধ করে না। ইসলাম সৌধ মনুষ্যত্বের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। ঊর্ধ্ব দিকে অঙ্গুলি তুলিয়া অধিকতর দৃপ্তকণ্ঠে কহিল–নায়েব, যদি বেঁচে থাকি তোমার একজনের পাপের জন্য সমস্ত হিন্দুসমাজকে ধ্বংস করতে চেষ্টা করব।

আজিজ আর দাঁড়াইতে পাড়িল না। চাঁদর দিয়া মাথায় রক্তস্রোত রুদ্ধ করিয়া কোনো রকমে সে বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইল। তার একই স্ত্রী যুবতী ও সুন্দরী–নাম তার গুল।

গুল স্বামীর কণ্ঠের কাছে মুখ লইয়া কহিল–কী সর্বনাশ! এ দশা কে করিল? তাহার পর উচ্চঃস্বরে চিৎকার করিল। তাহার পর পাগলিনীর ন্যায় এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরিয়া কাহাকেও না পাইয়া স্বামীকে আসিয়া কহিল–কেউ তো বাড়ি নেই। ওগো বসো, আমিই না হয় ডাক্তার আনতে যাই।

আজিজ কহিল–না প্রিয়ে, হাদীস শরীফে আছে স্ত্রীলোকের বাড়ির বের হতে নেই, তা ছাড়া হিন্দু আমাকে মেরেছে–একথা লোকসমাজে জানান অপমানজনক।

সেই রাত্রিতেই আজিজের মৃত্যু হইল। প্রতিবেশী কলিমুদ্দীন, হাফেজ এবং বেদার মৌলবী আসিয়া কহিল–হিন্দুর অত্যাচার অসহ্য হয়ে পড়েছে। খোদার মরজি কালবশে গোলাম বাদশাহ্ হয়েছে। বাদশাহ্ গোলাম হয়েছে। সবুর!

সে রাত্রে বা পর দিন আজিজকে মাটি দিতে কেহ সাহস পাইল না।

আজিজের মুত্যু যে একটু দোষের মৃত্যু!

আজিজের পত্নীর কাছে যাইয়া খোরশেদ যথাসময়ে শুনিল দুপুর রাতে তার স্বামীর মৃতদেহ তার বিছানার পার্শ্বে পড়ে ছিল। সে আর কিছু বলিল না।

চৌকিদার, দফাদার, গ্রামের লোক সকলেই কহিল, তাহারা আর নূতন কিছু জানে না।

খোরশেদ গোপনে চৌকিদারের নিকট হইতে যাহা শুনিল তাহাতে সে একেবার স্তম্ভিত হইয়া গেল। তদারক হইতে ফিরিয়া আসিয়া সে ভারিতেছিল মুসলমান বিশেষ দীনদার লোকের পত্নী যে অসতী হইতে পারে তা এই জানিলাম। এমন কিছু যে সম্ভব তা সে কখনও ইহার পূর্বে ভাবিতে পারে নাই। সে ইচ্ছা করিল রিপোর্টে এইসব কলঙ্কের কথা লিখিয়া উপরিস্থ কর্মচারীকে যা–তা একটা স্বজাতির বিরুদ্ধে মন্তব্য লিখে মাথা হেঁট করিব না; ব্যাপরটা চাপা দিতে হইবে।

তখন দুপুর রাত। খোরশেদের ঘুম হইতেছিল না। সে ভাবিতেছিল, ছিঃ মুসলমানের ঘরেও অসতী স্ত্রীলোক সম্ভব! এখানে তালাক নেকাহ্ সবেরই তো ব্যবস্থা আছে।

তখন থানায় সকলেই সুপ্ত। গ্রামখানি নিথর নিস্তব্ধতায় সাড়াহীন। দুই একটি পাখি আর্তচিৎকারে মৌন বিশ্বের কাছে বেদনা জানাইতেছিল।

সহসা খোরশেদ শুনিল তাহারই জানালা পার্শ্বে রমণীকণ্ঠে মৃদু ভগ্ন স্বরে কে যেন ডাকিতেছে–ছোট বাবু! ছোট বাবু! স্বর বড় করুণ ও বেদনাব্যঞ্জক।

অন্ধকারে তাড়াতাড়ি দরজা খুলিয়া খোরশেদ সহানুভূতি-মাখাস্বরে কহিল–কে কে, ভিতরে এস।

টেবিলের উপরকার মোমের বাতিটি জ্বালাইয়া খোরশেদ বিস্ময়ে দেখিল–একটি মুসলমান যুবতী তাহারই সম্মুখে দণ্ডায়মান। চক্ষু, তার জল সিক্ত। মুখে একটা আশ্চর্য গৌরব ও লালিত্য।

যুবতী খোরশেদের প্রশ্নের বা অনুমতির অপেক্ষায় রহিল না। করুণ ভাষায় সে কহিল–দারোগা সাহেব! মুসলমানই মুসলমানের বেদনা বুঝে। নায়েব আমার স্বামীকে তার কাছারির ভিতর হত্যা করেছে।

খোরশেদের পায়ের কাছে এক থলি টাকা রাখিয়া যুবতী কহিল–এই নিন সে টাকা। সে আর দাঁড়াইল না। খোরশেদকে বিমূঢ় করিয়া দিয়া সে অন্ধকারে মিশিয়া গেল।

১৬-২০. আমেনা যখন দেখিল

ঘোড়শ পরিচ্ছেদ

আমেনা যখন দেখিল সংসারটা তার বিশ্বাস ও কল্পনাকে একেবারেই ছাই করিয়া দিয়াছে তখন সে একেবারে মৌন হইয়া গেল।

শ্বশুরবাড়িতে আমেনার সঙ্গে ছিল মাত্র একখানা কবিতার বই। বাক্সের মধ্যে কাপড়ের নিচে সেখানাকে সে লুকাইয়া রখিয়াছিল। দুপুররাতে মানুষ যখন চেতনাহীন হইয়া পড়িত তখন সে দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া একটা মেটে প্রদীপ জ্বালিয়া করুণ ঝঙ্কারের মধ্যে আপনাকে হারাইয়া ফেলিত। আহা! মানুষের জীবন কী ভয়ানক ও যন্ত্রণাপ্রদ! কেবল আঁখিজল ও বেদনা লইয়া মানুষের জীবন ধারার সৃষ্টি–আমেনা ভাবিত। আমেনা স্বপ্নেও ভাবে নাই তাহাকে এমন করিয়া বিসর্জন দেওয়া হইবে। সীতাকে অরণ্যে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছিল সে কথা আমেনা”সীতার বনবাস’ পড়িয়া জানিয়াছিল। তার ভাই কি তাহাকে সাগরে ফেলিয়া দিয়া মুক্তি লাভ করিলেন? সত্য সত্যই যদি সাগরে ফেলিয়া দেওয়া হইত তাহা হইলে তাহাকে এমন অসম্মানও বেদনার মধ্যে বাচিতে হইত না। আমেনা আপন। মনে এইসব কথা ভাবে।

এমন আশ্চর্য বিবাহ সে কোনোকালে দেখে নাই। সে বুঝিয়াছে তাহার ভাই সত্য সত্যই একটা হৃদয়হীন প্রতারক। সে একটা প্রতারকের ভগ্নি! এ বেদনা-এ অসম্মান তাহাকে মাথা পাতিয়া লইতে হইবেই তো।

বিবাহের পর শ্বশুরবাড়ি আসিয়া যখন গিলিট-করা গহনাগুলির ছলনা ধরা পড়িল তখন বাড়ি সুদ্ধ লোক একেবারে অবাক! কেবল অবাক হইল না তার চাচিশাশুড়ী। শ্বশুর প্রতারণার অপমানে গর্জিয়া পুত্রকে ডাকিয়া কহিল–এই হারামজাদি মাগীকে এখনই তালাক দিয়ে পথে তুলে দাও।

আমেনা বিস্ময়-বেদনা স্তব্ধ হইয়া গেল। অশ্রুহীন দুটি করুণ আঁখি নত করিয়া সে নির্জনে শ্বশুরের পা ধরিয়া স্বরে কহিল–তাহার ভাই ইতর ও ছোটলোক হইলেও সে ভালো হইয়া তাহার শোধ দিবে। তাহার মাথায় যেন বিপুল অসম্মান চাপান না হয়।

দুপুর-রাতে স্বামীর হাত ধরিয়া সে কাঁদিয়া কহিল–স্বামীন! গহনা দিয়া তোমাকে যতটুকু না পূজা করিতাম, প্রেমভরা হৃদয় দিয়া তার চেয়ে ভালো করে তোমায় পূজা করবো।

স্বামী হুঁকায় একটা কড়া দম দিয়া তাহাকে ঘর হইতে সেদিন বাহির করিয়া দিয়াছিল। আহা! সারা রাত্রি বারান্দায় শীতের ভিতর আমেনা দাঁড়াইয়া কাঁদিয়াছিল। স্বামী ঘরের ভিতর হইতে কহিতেছিল–ডাক্তারী পড়তে যাচ্ছি। তোর ভাই যদি ওয়াদা মতো মাসে মাসে টাকা না দেয় তবে আর আশা নাই। জানিস, আমি পিতৃভক্ত। পিতার ক্রোধকে উপেক্ষা করে সামান্য নারীকে ভালবাসতে পারি না।

আমেনা বলিয়াছিল স্ত্রীলোক তো কর্তব্যানুরোধে স্বামীর কথাকে মায়ের কথা অপেক্ষা অধিক মূল্যবান মনে করে।

এনায়েতুল্লা লেপ ফেলিয়া কথার উপর কথা বলার অপরাধে আমেনাকে প্রহার করিয়াছিল।

যাহা হউক, বিবাহের পর খোরশেদ এনায়েতুল্লাকে এক পয়সাও দেয় নাই। জমি বিক্রয় ও স্ত্রীর গহনা বন্ধকের কথা বলিয়া আমেনার শ্বশুর নজির মিঞা পুত্রের কাছে মাসে মাসে ৫০ টাকা করিয়া পাঠাইতেছিল।

পিতার সুপুত্র এনায়েত কলিকাতায় কী করিতেছিল তাহা বলিতে লজ্জা করে। দুঃখ, বেদনা, অপমান, অসম্মানে শ্বশুরবাড়িতে আমেনার প্রায় এক বছর কটিয়া গেল।

বৈশাখ মাসে অনবরত কয়েকদিন ধরিয়া প্রকৃতি বাদল কুক্কটিকা সমাচ্ছন্ন। একখানি পত্র হাতে লইয়া আমেনাকে চমকিত করিয়া সহসা নজির মিঞা পুত্রের ঘরে প্রবেশ করিয়া বধুকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন–“দেখ মেয়েটি! তোমার উপর আমরা বিশেষ অসন্তুষ্ট না। হইলেও, এই জুয়াচুরির প্রতিশোধ নেবার জন্য তোমাকে কষ্ট দিব। আজ হতে তুমি ঐ ঘোড়ার ঘরে থাকবে। ছালা পেতে শোবে। খাপরায় খাবে, হাঁড়িতে পানি ঢেলে মুখ হাত ধোবে। বুঝলে?”

আমেনা মাথা নত করিয়া মৃদুস্বরে অতি দুঃখ কহিল,–“বুঝলাম।”

“শুধু বুঝলে হবে না–আমার কথা বেদের কথা!” আমেনা চোখের জল ঘোমটার আবরণে ঢাকিয়া রাখিয়া মাটির দিকে চাহিয়া কহিল–“আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য। ভাই প্রতারণা করেছেন–জামাইকে আদনা চিজ থালাখানাও দেওয়া হয় নাই। আমাকে মেটে বাসনে খেতে দেবেন তাতেই আমার চলবে।”

“তোমার ধৈর্য-সহিষ্ণুতায় আমার পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। আমার এইসব কথায় তুমি একটুও কাঁদছ না। আমি চাই প্রতিশোধ–তোমার বুকে আগুন জ্বালাতে। আমার কথা ও ব্যবহারে একটুও বেদনা বোধ করো না। এতে যে বেশি করে আমি প্রতিহিংসাপরায়ণ হবো তা তুমি জান?”

“তা জানি না, বুঝতে চেষ্টা করেও বুঝতে পাচ্ছি না।”

“দেখ, তুমি থিয়েটারি কথা সাধারণত বলে থাক। ভালো মানুষের তো এ লক্ষণ নয়? তোমার কথাগুলি পরিষ্কার বাধুনি দেওয়া। আমার সন্দেহ হয়, তুমি বেহায়া। যা তোমরা জবানি দিয়ে তোমার দুর্গতির কথা তোমার ভাই ও মায়ের কাছে লিখবো–আজই লিখবো।”

“আমি নিজের হাতেই এসব কথা লিখে দিতে রাজি আছি।”

নজির বিস্ময়বিমূঢ় হইয়া কহিল–“কী ভয়ানক! হায়, আমার বাপ দাদার জাতি গেল! তুমি কি লেখাপড়া জান? জুয়াচোর শাহাদত না বলে ছিল–মেয়ে লিখতে-পড়তে জানে না–একেবারে শরীফজাদি! এতকাল এ কথা গোপন রেখেছো? এ কথা লোকে শুনলে কী বলবে! বেশ! লেখ। তোমার দুঃখময় কাহিনী নিজ হাতে লিখে দাও, চিঠিখানা আজই তোমার ভায়ের কাছে পাঠাব।

দোয়াত কলম আনা হইল! শ্বশুরের হুকুমে আমেনা কাগজ-কলম লইয়া লিখিল :

বর্ধমান
বখেদমতেষু,
অসংখ্য আদাব জানিবেন। মায়ের ও আপনার কোনো সংবাদ না পাইয়া বড় চিন্তিত আছি। আমি বোধ হয় খুব সুখে আছি৷এই আপনাদের বিশ্বাস।তাই এই দীর্ঘ সময়ে আমার কাছে, একখানা পত্র লেখাও দরকার মনে করেন নি।

সত্য কথা বলিতে কি৷আমি সুখেই আছি! শ্বশুর-শাশুড়ির অসীম দয়া ও মমতায় আমি ভাগ্যবতী। তা হলেও আমার ইচ্ছা করে এখানকার আমার অতি প্রিয়তম আত্মীয়দের সংবাদ আপনারা লয়েন। আমি খুব সুখে আছি, আমার জন্য একটুও চিন্তা করিবেন না।

আপনার ফিদবী।
আমেনা।

পত্রখানি আমেনার হাত হইতে কাড়িয়া লইয়া নজির পড়িয়া দেখিল। উহার প্রতি ছত্র নজিরের প্রতিহিংসাপরায়ণ চিত্তকে আরো জ্বালাময় করিয়া তুলিল। সে কী চায়? সে চায়। তার পুত্রবধুর দুঃখ তাহার আত্মীয়-স্বজনের মনে ও মুখে কালি ফুটাইয়া তোলে এবং এই করিয়া সে তার মনে সান্ত্বনা লাভ করে।

নজির চিঠিখানা শতভাগে ফাড়িয়া ফেলিল। সে ইচ্ছা করিল, সে নিজেই একখানা চিঠি লিখিবে। তাতে থাকিবে আমেনার দুঃখ-দুর্গতির কথা।

সেই দিন হইতে আমেনাকে একখানা পুরোনো সেঁতসেঁতে কোণার ঘরে বাস করিতে দেওয়া হইল। বাপের বাড়ি হইতে সে কোনো বিছানা আনে নাই, সেই কথা জানাইয়া তাহাকে বিছানা দেওয়া হইল একখানা পুরোনো ছালা। আমেনা ভিখারিনী–সে মেয়ে মানুষ।

সেদিন উঠানে বসিয়া দাসীদের সঙ্গে আমেনা মাছ কুটিতেছিল। দাসীদের জন্য এক এক খানা আসন দেওয়া হইয়াছিল, কিন্তু আমেনা খালি মাটিতেই বসিয়া কাজ করিতেছিল।

আমেনার শাশুড়ি তাহাকে বলিলেন–“কুয়া থেকে ঘড়া দশেক পানি তুলে নিয়ে আয়। সেখানে এখন কেউ নাই।”

আমেনা বাক্য ব্যয় না করিয়া ঘড়া লইয়া পানি আনিতে গেল।

দেউড়ীর ধারেই গোয়াল-ঘর। দূরে বাড়ির চাকর মধু গোয়ালঘরে গাই দুটিকে জাব ঠিক করিয়া দিতেছিল।

আমেনা মাথায় ঘোমটা দিয়া খোদাকে ধন্যবাদ দিয়া পানি তুলিতে লাগিল।

এক ঘড়া-দুই-ঘড়া-চার ঘড়া-আমেনা আর পারে না। আঙুল ফাটিয়া তাহার রক্ত বাহির হইয়া পড়িল।

মধু দূর হইতে লক্ষ্য করিতেছিল–এই অবহেলিতা মলিন বসনা বৌটির অবস্থা। কৃষক হইলেও সহানুভূতির আবেগে স্থান কার ও পাত্র বিবেচনা না কারিয়া সে দৌড়াইয়া আসিয়া আমেনার হাত হইতে রশি লইয়া কহিল–ভাবিজান, আপনি সরুন, পানি আমি তুলে দিচ্ছি–এতগুলি চাকরানী থাকতে আপনার এই কষ্ট!

আহা! মধুর একটা সেয়ানা ভগ্নি এই সেদিন অনাদর ও অবহেলায় শ্বশুড় বাড়িতে প্রাণত্যাগ করেছিল।

দেউড়ীর ওধার হইতে কে একজন বলিয়া উঠিল–“আকাশ থেকে বজ্রাঘাত হোক! ওমা, সে কি! ছিঃ! ছিঃ! মধু বৌয়ের হাত ধরে!”

সত্যিই যেন বজ্রাঘাত হইল–আমেনা মূৰ্হিতা হইয়া কাদা ও পানির মধ্যে পড়িয়া গেল। মধু ভীত হইয়া কাহাকেও কিছু না বরিয়া সে স্থান হইতে পলায়ন করিল।

.

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

একটি সুন্দর-আকৃতি দরবেশ কোথা হইতে আজ সাতদিন হইল থানার সম্মুখে আড্ডা লইয়াছেন। দরবেশ কাহারও সঙ্গে কথা বলেন না। খোরশেদ অনেক বার চেষ্টা করিয়াছে। তাঁহার সহিত কথা বলে, কিন্তু বারে বারেই সে বিফল মনোরথ হইয়াছে।

নিশীথকালে একবার কথা বলিতে চেষ্টা করিয়া দেখিবার জন্য খোরশেদ এই সময়ে তাঁহার কাছে আসিয়াছে।

সে সন্তর্পণে দরবেশের সম্মুখে যাইয়া বসিল। ফকির তখন চোখ বুজিয়া তসবি গণিতেছিলেন।

খুব শঙ্কার সহিত খোরশেদ করজোড়ে ফকিরের সম্মুখে বসিয়া থাকিল। একটু একটু বাতাস থাকিয়া থাকিয়া সাধুর অগ্নিকুণ্ডকে দ্যুতিময় করিয়া তুলিতেছিল।

দূরে বারান্দায় একটা সিপাই এদিক ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল।

প্রায় এক ঘণ্টা অতীত হইলে–ফকির ধীরে ধীরে চোখ খুলিয়া দেখিলেন, একটা যুবক তাঁহার সম্মুখে উপবিষ্ট।

খোরশেদ ফকিরের পদধূলি লইয়া কহিল–শাহ্ সাহেব, একটা নিবেদন।

খোরশেদকে অবাক করিয়া ফকির জিজ্ঞাসা করিলেন কি নিবেদন বাবা।

খোরশেদ আহ্লাদিত হইয়া কহিলেন–এই পাপীর সঙ্গে আপনি কথা বল্লেন! এ আপনার অনুগ্রহ।

ফকির আবার জিজ্ঞাসা করিলেন–কী কথা বলতে চাও?

খোরশেদ–বলতে ভয় হয়, অনুমতি দিলে বলতে পারি।

ফকির–আমাকে কি অনুপযুক্ত পাত্র বলে তোমার সন্দেহ হচ্ছে?

খোরশেদ–না, না, ওকথা বলে এ অধমকে লজ্জিত কচ্ছেন কেন?

ফকির–তবে বল।

খোরশেদ-জীবনের কোনো এক সময়ে একটি মেয়েকে আমি ভালবাসি। তাকে আমি পেতে চাই।

ফকির–আমি কী কত্তে পরি? খোরশেদ–আপনি দোয়া করলে আমার মোকসেদ হসিল হতে পারে।

ফকির-ফকিরদের কাজ মানুষকে উন্নত পথে টেনে আনা। প্রেম অপার্থিব জিনিস হলেও ফকিদের কাছে এই সব কাজে সাহয্য চাওয়া কর্তব্য নহে। খোদার কালাম এই সমস্ত কার্যে ব্যবহৃত হওয়া উচিত নয়। যাকে ভালবাসতে এখনও তাকে ভালবাস–কেউ। তোমাকে নিষেধ করছে না। এই উদ্দেশ্যে কোনো অসাধারণ প্রক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করার দরকার নাই।

বিধাতার ইচ্ছা হলে তুমি তোমার বঞ্চিতকে লাভ করবে, নইলে নয়। পর স্ত্রীর রূপলাবণ্যের কথা চিন্তা করিয়া ব্যভিচার দোষে আত্মাকে কলঙ্কিত করিও না। তোমার বাঞ্ছিতা যদি অপরের ভার্যা হয়ে থাকে তবে বিশ্বাস করিও সে তারই পত্নী হবার জন্যে মতে এসেছিল–তোমার জন্য নহে; তুমি ভুল করে পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হয়েছিলে।

খোরশেদ–আমার প্রেমের প্রতিদান হবার কোনো আশা নাই, তবে আমি পর স্ত্রীর প্রতি আসক্ত নহি।

ফকির–কেন, এসলামীয় প্রথামত সামাজিক রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী তাকে লাভ, করিবার জন্য চেষ্টা করতে পার না?

খোরশেদ–তিনি আমাকে ভালবাসেন না ভালবাসবারও কোনো আশা নাই। হৃদয়ে অনুদিন অসীম জ্বালা অনুভব করি।

ফকির–যে তোমাকে ভালবাসে না, জোর করে তার ভালবাসা লাভ করতে যাওয়াও মূর্খতা এবং নিজের পক্ষে অপমানজনক। ব্যর্থ জীবনের বেদনা নিয়ে বাঞ্ছিতাকে দূর হতে সম্রম ও শ্রদ্ধার সহিত নমস্কার করে খোদার পথে নেবে পড়। খোদার পথে অসীম শান্তি পাবে। আত্মা তোমার সম্পদশালী হয়ে উঠবে। জোর করে কাকেও পেতে আশা করো না। তার অগোচরে নিজেকে বিক্রয় কর–ত্যাগে আত্মা তোমার বিরাট ও মহান হয়ে উঠবে।

খোরশেদ–আপনার কথা মেনে নেওয়া শক্ত। বুঝিতেছি না বলেই শক্ত। জোর করে কাকেও ভালবাসতে বাধ্য করা পাপ। আপনি ঠিক বলেছেন।

ফকির–তুমি যার জন্য পাগল তিনি হিন্দু না মুসলমান? খোরশেদ–যদি বলি হিন্দু, তাহা হলে কি আপনি সুখী হবেন?

ফকির–ছিঃ, এমন কথা বলছো! মুসলমান হিন্দু নারীর প্রেমে মুগ্ধ? এ-কথা বলতে লজ্জা হয় না?

খোরশেদ–ক্ষমা করবেন–আমি কোন হিন্দু নারীকে ভালবাসি নাই।

খানিক নীরব থাকিয়া খোরশেদ জিজ্ঞাসা করিল–মহাত্মন! কারো সঙ্গে কথা না বলে এমনভাবে জীবন যাপন করেন কেন?

সাধু বলিলেন–নিজের মহিমায় নিজে বিভোর হয়ে স্বাধীনচিত্তে বিশ্ববক্ষে ঘুরে। বেড়াই। মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ কাটিয়ে সদা স্বাধীন মাথা খোদার সামনে নত করি।

.

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

ক্রমে খোরশেদ উচ্ছল হইয়া পড়িয়াছে। সে সুরা সেবনের নিজের শরীর ও মানুষের উপর অত্যাচার করিয়া দিনগুলি কাটাইয়া দিতেছিল।

সেদিন একটু একটু করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল। খোরশেদের মস্তিক কখনও মদের নেশায় চঞ্চল। ঘোড়ায় তীক্ষ্ণ কষাঘাত করিয়া খোরশেদ সেই বৃষ্টির ভিতর বাহির হইল।

প্রায় দুই ক্রোশ পথ অতিক্রম করিয়া সে এক হিন্দু পল্লীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। বাড়িগুলি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সব বাড়িতেই এক-একটা তুলসী গাছ।

সে একখানা ছোট কুটির সম্মুখে আসিয়া অশ্ব হইতে অবতরণ করিল? কুটিরখানি এক বিধবা স্ত্রীলোকের। দারোগা বাবুকে দেখিয়া সে তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া একেবারে গড় হইয়া প্রণাম করিল।

খোরশেদ জিভ কাটিয়া কহিল–পাপ!–আমি হিন্দু নই। মুসলমান কাহারও সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত গ্রহণ করে না রমণী! ইহাতে খুশি না হয়ে বিরক্ত হলাম।

গ্রামের যিনি প্রধান তাহার হুকুমে একখানা চেয়ার আসিল। সাধারণ লোক, দুইজন সিপাই, তিনজন চৌকিদার এবং বিধবার কয়েকজন হিন্দু প্রতিবেশী খোরশেদকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল।

খোরশেদ রমণীকে জিজ্ঞাসা করিল–কবে তোমার ঘরে চুরি হয়েছে? সে কাঁদিয়া কহিল–বাবা! তুমি ধর্মাবতার! তুমি যদি আমাদিগকে রক্ষা কর, তা না হলে আমরা দরিদ্র প্রজা বাচি না! আমার মেয়ের কপালে যে কি আছে তা কে বলতে পারে? সে অনেক দিনের কথা বাবা! আমার উমাতারার বয়স ষোল বছর। এই ষোল বছর হল কালীর নামে ষাড় ছেড়ে দিয়েছি। আহ! ওরে সর্বনেশেরা! ওরে পোড়ারমুখোরা! কে এমন ভরা-পড়া কাজ কল্লি রে?

খোরশেদ–এখন শাপ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। তুমি কার উপর সন্দেহ করো তাই বলো।

বৃদ্ধা যাদের উপর সন্দেহ করি তাদের নাম করবার যো নাই গো! তা হলে আমার মাথা কাটা যাবে–তুমি যা জান বাবা তাই করো। কোনো হিন্দু আমার ষাড় খায় নাই।

খোরশেদ–বিশ্বাস কী? অনেক হিন্দু আজকাল মুরগি খাওয়া আরম্ভ করেছেন, গরু খেতে আর বাকি কী?

রমণী সহসা ক্রুদ্ধ হইয়া কহিল–কোথাকার দারোগা তুমি?–রাম! রাম!

খোরশেদ কোনো কথা কহিল না। শেষে কহিল–দেখো বুড়ি, আমার বিশ্বাস নিজের ষাঁড় তুমি নিজেই বিক্রয় করেছ। সমাজের চোখে ধুলো দিবার জন্যে তোমার এই কারসাজি। মিথ্যে মোকদ্দমার জন্য তোমাকে ২১১ ধারায় দেওয়া হবে।

রমণী কাঁদিয়া খোরশেদের সম্মুখে ভূমিতে মাথা ঠেকাইয়া কহিল–“দোহাই বাবা! আমাকে রক্ষা কর। আমাকে রক্ষা করবার জন্যেই ভগবান তোমাকে পাঠিয়েছেন। আমি কিছু জানি নে বাবা, আমি কিছু জানি নে। যাক আমার ষাড়, কোনো প্রতিকারে আমার কাজ নেই। শুধু আমাকে রক্ষা কর।”

সিপাই একজনের ইঙ্গিতে, রমণী একজন ধোয়া কাপড়পরা হিন্দুকে লইয়া আঙ্গিনার এক পার্শ্বে গেল।

সিপাই আস্তে অথচ কঠিন উগ্রতায় কহিল–“বেটি, ২০টি টাকার যোগাড় দেখ।”

নাম তার জনার্দন। মুনিবের চাকর জনার্দনের উগ্র চোখের দিকে চাহিয়া স্বজাতির প্রতি সহানুভূতির আশায় হিন্দু ভদ্রলোকটি কহিলেন–“কিছু দয়া হবে না, সিপাই বাবু।”

সিপাই কহিল–“চুপ, দারোগা বাবুকে কিছু নজর না দিলে হচ্ছে না।” এই কথা বলিয়া সে সেখান হইতে সরিয়া গেল।

রমণী ভদ্রলোকটির হাত ধরিয়া কহিল–“তা হলে কি করি বাবু?”

চিন্তা করিয়া সহানুভূতিমাখা স্বরে ভদ্রলোক বলিলেন,–“গহনাপত্র কিছু আছে? কিন্তু কে এখন টাকা দেবে? খানিক নিস্তব্ধ থাকিয়া ভদ্রলোক আবার বলিলেন–যাক, বিপদকালে সবাই তোমাকে ফেল্লেও আমি তা পারব না খুড়ি।”

বৃদ্ধা চোখের জল ফেলিয়া কহিল–“এস জগদ্বন্ধু এস, বাড়ির ভিতর এস। স্বামীর কালের দুইখানা গহনা ছিল–সোনার। দাম দু’শ টাকা হবে। দারোগাকে কয় টাকা দিতে হবে?”

“অন্তত ৩০ টাকা।”

এই সময় খোরশেদ সিপাই-এর এবং সাধারণের উড়ো কথার সাহায্যে বদমাইসদের খোঁজ লইতেছিল।

জগদ্বন্ধু খুড়ির সহিত বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিল।

ঘরের মধ্যে একটা পুরোনো বাক্স, তার নিচে আর একটা বাক্স, তার নিচে একটা পেটরা! একে একে বাক্সগুলি নাবাইয়া রমণী সেই পেটরাটি খুলিয়া ফেলিল। কতকাল সেটা সেখানে ছিল!

একধারে একটা ছোট বাটার ভিতর হইতে সে একছড়া ঝকঝকে হার বাহির করিল। জগদ্বন্ধু আগ্রহে হাত বাড়াইয়া কহিল–“ঐ বালা দুগাছিও বাইরে রাখ!”

বিধবা জগদ্বন্ধুর হাতে হার রাখিয়া অস্পষ্টভাবে বলিল–“এই বালা আর এই হার গড়াতে তোমার খুড়োর দুশো টাকা লেগেছিল। এই হচ্ছে তোমার কাকার স্মৃতিচিহ্ন।” বিধবার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল।

জগদ্বন্ধু শান্তভাবে বলিল–“বিপদের সময় তোমাকে ফেলতে পারি না। খুড়ি, আমিই এই হার আর বালা নিচ্ছি। অন্যলোক হলে ২৫ টাকার বেশি দিতাম না। তোমাকে ৫০ টাকাই দিব।”

জগদ্বন্ধু হার ও বালা হাতে লইয়া কহিল–“খুড়োর কথা বলো না খুড়ি। অমন লোক আর হয় না। ভাগ্যে তোমার জন্য গহনা দুখানা রেখে গিয়েছিলেন–নইলে এ বিপদের সময় কী হতো?”

জগদ্বন্ধু হার ও বালা লইয়া গিয়া বাড়ি হইতে টাকা লইয়া আসিল। সিপাইকে একপার্শ্বে ডাকিয়া আনিয়া হাতে ৫ টাকা দিয়া কহিল,–“এক টাকা আপনার এবং বাকি চার টাকা দারোগা বাবুকে দিবেন।”

সিপাই হাসিয়া জগদ্বন্ধুকে সালাম করিয়া কহিল–“আপনারা কিছু না দিলে আমরা কী করে বাঁচি? আপনারা ভদ্রলোক কিনা! দুই-এক চশমখোর আছে, তাদের হাতে একটা পয়সাও গলে না।”

অতঃপর খোরশেদ সিপাহী তিনজনকে লইয়া সোজাসুজি ঠাকুরবাড়িতে আসিল। গদির উপর চারিজন হিন্দু তাস খেলিতেছিল। খোরশেদ কাহাকেও কিছু না বলিয়া ঘাম সিক্তকলেবরে তাহাদের পার্শ্বে ফরাসের উপর যাইয়া বসিল।

খেলোয়াড়দের একজন তখন তামাক খাইতেছিল। তাড়াতাড়ি সে কাটি ত্যাগ করিয়া কহিল–“দারোগা হলেও কারও ধর্মে হাত দিবার আপনার কোনো অধিকার নাই।”

বিস্মিত হইয়া খোরশেদ বলিল–“নিশ্চয়ই! কে কার ধর্মে হাত দিল?”

“এই তো হুঁকার জল নষ্ট করলেন!”

খোরশেদের অগোচরে একজন ইশারা করিয়া মৃদু চাপা স্বরে কহিল–“দারোগা হলে কী হবে? মুসলমান তো!”

সিপাই জনার্দন তাহা শুনিয়াছিল। ক্রুদ্ধ সর্পের ন্যায় তার বাবুর দিকে চাহিয়া সে কহিল–“শুনেছেন বাবু, হুকুম দেন, বেটার কান ধরে ঠিক করে দিই।”

শরৎ তাস ফেলিয়া সিপাইদের উপর উগ্র হইয়া কহিল–“কি রে বেটা,–পাজি। ভদ্রলোকের মর্যাদা বুঝি না?”

জনার্দন পশুর মতো কহিল–“সাবধান, শূয়ার কা বাচ্চা।”

শরৎ স্বপ্নেও ভাবে নাই, সামান্য একজন ৭ টাকার অশিক্ষিত সিপাই তাহাকে এরূপভাবে সম্বোধন করিবে। অন্তরের অন্তঃস্থল হইতে জনার্দনকে অভিসম্পাত করিয়া সে নির্বাক কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

খোরশেদ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহসা নিষ্ঠুরভাবে কহিল–“জনার্দন, রামচরণ, বলাই! আচ্ছা, তা হলে তোমরা এদের চারজনকেই বেঁধে থানায় নিয়ে এস।”

মেনু চৌকিদার এক পাশে দাঁড়াইয়াছিল। সহসা খোরশেদ তাহার পার্শ্বে লাথি মারিয়া বলিল–“বেটা হারামজাদা! দাঁড়িয়ে আছিস যে-পাকড়ো।”

সিপাই তিনজন এবং মেনু চারজনকেই গ্রেপ্তার করিল।

ব্যাঘ্র খাঁচায় পড়িলে যেমন সে গর্জিয়া উঠে, শরৎ এবং তাহর বন্ধুগণ তেমনি গর্জিয়া কহিল–“দেখ দারোগা, ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখ নাই। পাড়া গাঁয়ের হাবা পেয়েছ, কেমন? আমরাও আইন-কানুন জানি। বলি, আমাদের অপরাধ কী, দারোগা?”

খোরশেদ কহিল–“ষাড় চুরি করবার মজা টের পাবে!”

শরৎ ঘৃণায় মাটির উপর পদাঘাত করিয়া কহিল–“রাম! রাম!”

“হিন্দু হয়ে যাড় জবাই করে খেয়েছ সে কথা না বল্লেও তোমরা যে ষাঁড় অপরের কাছে বিক্রয় করেছ তার প্রমাণ আছে।”

জনার্দন শরতের ঘাড়ে ধাক্কা দিতে দিতে বাইরে আনিল।

তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিয়াছিল। বড় দারোগা থানায় ছিলেন না। খোরশেদ যথাসময়ে গারদঘরে চারিজনকে আটকাইয়া বাহিরে আসিয়া জনার্দনকে একপার্শ্বে ডাকিয়া আনিয়া মৃদুস্বরে কহিল–“শীতের রাত্রি, গোটা তিনেক টাকা আদায় করে খানিক পরেই ছেড়ে দিও, তাতেই শিক্ষা হবে। আমি একটু বাইরে চল্লাম। ঘোড়ায় চড়ে গায়ে ব্যথা হয়েছে, একটু স্টিমুলেন্ট না হলে চলছে না।”

সন্ধ্যার তিনঘণ্টা পরে জনার্দন, রামচরণ ও বলাই আয়েস-আরামের সহিত আহারাদি করিয়া শরৎকে নিঃশব্দে গারদঘর হইতে এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে লইয়া গেল।

জনার্দন কহিল–“দেখ বাবু, তোমাদের মাথার উপর কী বিপদ তা বুঝতে পাচ্ছ তো। সাক্ষী প্রমাণ ঢের আছে। আমরা এক-এক করে খাড়া করবো। দারোগা সাহেবকে প্রত্যেকে কিছু কিছু করে নজর দাও, তাহলে সব মুস্কিল আসান হয়ে যাবে।”

শরৎ–তোমরা আমাদিগকে বোকা পেয়েছ। দারোগার বাবা এলেও টাকা দিচ্ছি নে। মিথ্যা করে ভদ্রলোকদিগকে নাকাল কল্লে কী হয় তা পরে টের পাবে। তোমরা তো গরু, তোমাদিগকে আর কি বলবো। দেশের মানুষ হয়ে দেশের মানুষের বুক চিরে টাকা সংগ্রহ করিস, এর ফল আছে–আজ হোক, কাল হোক মূক-শক্তিহীন দেশের মানুষ একদিন না একদিন অত্যাচারী বিশ্বাসঘাতক রাজকর্মচারীর কাছে এর জবাব চাবেই চাবে। অত্যাচার করে সেরে যাবে কদিন? মহামান্য রাজা কি এ জন্য তোমাদিগকে নিয়োগ করেছেন? তোরা তো দেশের মানুষের চাকর। মুনিব চিরকাল ভৃত্যের অত্যাচার সহ্য করবে না।

রামচরণ শরতের মাথায় একটা প্রচণ্ড ঘুষি লাগাইয়া কহিল, “শালা, তোর হেঁয়ালী ফেলে রাখ। টাকা দিতেই হবে। প্রত্যেকের নিকট হতে ১০০ টাকা করে রাত্রেই চাই।”

বলাই শরতের টুটি ধরিয়া তার গোটা শরীরটা শূন্যে তুলিয়া ফেলিল। বন্ধ মুখের মধ্যে একটা গভীর বেদনাব্যঞ্জক শব্দ কাঁপিয়া উঠিল। শরৎ বেদনায় কাঁদিয়া উঠিল।

এক-এক করিয়া বাকি তিনজনকেও সেখানে আনা হইল। কিল, ঘুসি, লাথি ও অপমানের অত্যাচারে শরৎ এবং তাহার বন্ধুত্রয় শেষকালে স্বীকৃত হইল ৫০ টাকা করিয়া মোট দুইশত টাকা সেই রাত্রেই তাহারা হাজির করিবে, নহিলে তাহারা বুঝিল, চুরির অপরাধে তাহাদের ভাগ্যে জেল অনিবার্য।

বন্ধু তিনজনকে সেখানে রাখিয়া শরৎ টাকা আনিতে গৃহে গমন করিল।

রাত্রি তখন ৩টা। শীতে কয়েদিরা গারদঘরে কাঁপিতেছে, এমন সময় ছোট দারোগা গরম ওভারকোট ও শালে সর্বাঙ্গ জড়াইয়া সেই পথ দিয়া বাসায়া ফিরিতেছিল।

সিপাই তিনজন মনের আনন্দে গঞ্জিকা সেবন করিতেছিল। খোরশেদ রুক্ষস্বরে জিজ্ঞাসা করিল–“বাবুদের ছেড়ে দিয়েছিস? যাবার সময় দুই চার আনা বকশিস্ দিয়ে দিয়েছেন তো।”

জনার্দন সহসা খোরশেদের কানের কাছে আসিয়া চাপা গলায় কহিল–“বাবু দুই চার আনা নয়! দুশো টাকা আদায়ের ব্যবস্থা করেছি। সে কি আর সহজে, ঘায়ের চোটে শালাদের নাক দিয়ে রক্ত বের করে ছেড়েছি। এক জন টাকা আনতে গিয়েছে। বাকি তিনজন গারদঘরে।”

“ওরে শালা!’ বলিয়া খোরশেদ জনার্দনকে লাথি মারিয়া কহিল–“পুলিশে কাজ কর বলে কি পশু হয়েছ? অপরাধটা কি যে তাদের উপর এই অত্যাচার? কী করেছে তারা, যে। এই টাকা? আন্ শালা-চাবি আন এখনি। গারদঘর খুলে ভদ্রলোকদের যেতে দে। ছিঃ! ছিঃ!–এই দারুণ শীতে!”

জনর্দান তাড়াতাড়ি গারদ ঘর খুলিয়া দিল।

.

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

খোতবা পাঠ করিয়া রায়হান কহিলেন–“আমাদের আশ্রমের পূর্ণ সাফল্যের জন্য কয়েকজন যুবককে বাহিরে যাইতে হইবে। সেই চারজন যুবকের চিন্তা নতুন ধরনের হওয়া চাই। চাকরি যারা করে তারাই ভদ্রলোক, বাকি লে ক সব ছোট,–এরূপ যাহারা ভাবে তাদের দ্বারা কাজ হইবে না। তাদের জানা চাই–জ্ঞী মানুষ যদি সামান্য কাজও করেন তাবে তার মর্যাদা কমবে না। আমি চাই সত্যের সেবক–সে নীচাশয় ও সঙ্কীর্ণ হৃদয় হইবে না। সে বিশ্বাস করিবে মানুষের মর্যাদার ভিত্তি মনুষ্যত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত।

আমাদের শিক্ষালয়ে চল্লিশজন মহিলা আশ্রয় পাইয়াছে। করিমা খাতুন কোরান ও বাংলা শিক্ষা দেবার ভার লইয়াছেন। দুইটি সেলাইয়ের কল চলিতেছে। আমি নিজে তাহাদিগকে সেলাই শিখাইয়া থাকি।

আবুল কাসেম মিঞার একটি কন্যা, যুবতী বয়সে তিনটি পুত্রসহ বিধবা হন। তিনটি পুত্রই কলেরা রোগে প্রাণত্যাগ করে। বিমাতার গর্ভজাত ভাইরা তাহাকে সংসার হইতে তাড়াইয়া দেয়। একান্ত নিরাশ্রয় হইয়া অতি দুঃখে বালিকা এক ধনীর গৃহে আশ্রয় ভিক্ষা করে, কিন্তু তাহারাও তাহাকে কোনো কারণে স্থান দেন নাই। অতি দুঃখে, অতি বেদনায় এ কৃষকের ঘরে তাহার কাল কাটিতেছিল, আশ্রম তাহাকে গ্রহণ করিয়াছেন–শীঘ্রই সে। মাসে ত্রিশ টাকা পর্যন্ত উপায় করিতে পারিবেন।

এক হিন্দু জমিদারের পুত্রবধু গঙ্গাস্নানে গিয়াছিলেন। রান্নাঘাটের কতকগুলি বদমাইস ব্রাহ্মণ ভিড়ের ভিতর হইতে তাহাকে নিতান্ত নিরুপায় করিয়া ফেলে। যুবতীর আঁখিজল পাষণ্ডদের হৃদয়ে কৌতুক দিয়াছিল মাত্র। তাহারা যুবতীর সতীত্ব হরণ করে। সে অনেক কথা–তিন বৎসর পরে সে আমাদের আশ্রমের সন্ধান পাইয়া আশ্রয় ভিক্ষা করে। তাহাকে সেলাইয়ের কাজ শিক্ষা দিতেছি। শীঘ্রই সে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করিবার শক্তি লাভ করিবে। কোনো পিশাচের কৃপার পাত্র হইয়া তাহাকে থাকিতে হইবে না। স্বামী তাহাকে গ্রহণ করিবে কি না–এ প্রশ্ন তুলিবার কোনো আবশ্যকতা নাই।

৩বাহার বলিয়া একটি বিংশ বর্ষীয়া কৃষক যুবতী একটি কন্যা লইয়া পথে পথে ঘুরিত। ছয় বৎসর আগে তাহার স্বামী আসামে চলিয়া গিয়াছিল। মেয়েটির না ছিল অন্ন, না ছিল বস্ত্র। দুষ্ট বদমাইসের দৃষ্টি তাহার কাছে নিতান্ত অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছিল। পুরুষ কিন্তু রমণী জাতের এই দীনতা ও ক্ষুধা সহ্য করিবার পরিবর্তে যে কোনো পাপ করিতে পারে। সেই যুবতাঁকে আমরা গ্রহণ করিয়াছি। ইচ্ছা করিয়াছি তাহাকে পুস্তক বাঁধাই শিখাইবাসে বিধাতার রাজ্যে বাঁচিয়া থাকিতে পারিবে।

কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া রায়হান আবার বলিলেন–একজন যুবককে কলিকাতার বয়ন-বিদ্যালয়ে পাঠাইতে চাই। সে ফিরিয়া আসিয়া ছাত্রীদিগকে বস্ত্রবয়ন শিক্ষা দিবে। প্রস্তুত কাপড় আমারাই পরিব। দেশের বহু নরনারী অনাহারে মরিতেছে, তাহাদিগকে আহার দিয়া বাচাইবার জন্য মানবের মঙ্গলকামী সহৃদয় দেশবাসীকে যদি একটু বিলাস পরিত্যাগ করিতে হয় তাহা তাহাদিগকে করিতে হইবে।

বস্ত্রবয়নে কোনো ছাত্রীর সম্মানহানি হইবে না। জোলা বলিয়া এসলামে কোনো স্বতন্ত্র জাতি নাই। একথা যিনি অবিশ্বাস করিবেন তিনি অন্যায় করিবেন। কোনো কর্মই বিশেষ করিয়া কতকগুলি লোকের জন্য হইতে পারে না। বাংলার হিন্দু-মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো জাতির ভিতর এ নিয়ম নাই।

দেশের মানুষ যদি দেশের জিনিসপত্র ব্যবহার করিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তাহা হইলে বহু মানুষকে সাহয্য করা হয়। ভাইকে সাহায্য করা কি ইসলাম গর্হিত কাজ মনে করে? কত টাকা বিদেশে চলিয়া যাইতেছে। এই টাকার মালিক যদি আমরাই হইতাম, তাহা হইলে, আমাদের সমাজ অনেক আগে শক্তিশালী হইয়া উঠিত। অর্ধাশনে ও অনশনে থাকিয়া বিদেশী বিলাস দ্রব্যে আত্মাকে শীর্ণ ও প্রাণহীন করিয়া সুন্দর হইতে চাহিতেছি।

বই বাঁধাই শিখিবার জন্য একজন যুবকের কলিকাতা যাওয়া আবশ্যক। মেয়েদিগকে কাঠের কাজ শিক্ষা দিবার জন্য একজন যুবককে কোনো আর্টিজন স্কুলে পাঠাইব। যা কিছু খরচ লাগিবে,সবই তিনি আশ্রম হইতে পাইবেন। ছাত্রীরা অস্ত্র ব্যবহারে এবং কাঠের কাজে সুদক্ষ হইয়া উঠিলে পুরুষ শিক্ষকের প্রয়োজন হইবে না। মেয়ে-শিক্ষক পাইলে আর কারও সাহায্য চাহিতাম না।

হামিদের পিতা এবং গ্রামস্থ অন্যান্য ভদ্রলোক আগ্রহের সহিত আশ্রমের সম্বন্ধে বক্তৃতা করিলেন।

করিমার শ্বশুর ভিন্ন গ্রাম হইতে সভায় যোগদান করিয়াছিলেন। তিনি ওজস্বীতাময় বক্তৃতা দিয়া সকলকে প্রতিজ্ঞা করাইলেন, আশ্রমকে এক শক্তিশালী কেন্দ্র করিতে তাহারা বদ্ধপরিকর হইবেন। আশ্রমের সঙ্গে সঙ্গে একটা মাইনর স্কুলেও চলিবে। গ্রামের সকল বালিকা-ইতর কি ভদ্র-বিদ্যালয়ে যোগদান করিবে এবং শিল্প করিয়া তাহারা জীবনকে নিরাপদ করিয়া লইবে।

দুইজন যুবক কহিলেন–আমরা আমাদের ভগ্নিদের শিল্প শিক্ষার্থে বিদেশে যাইতে প্রস্তুত আছি। রমণীর দুঃখ অসহনীয়। নারী বিপদে পড়িয়া অনিচ্ছায় পথে দাঁড়ায়। তাহাদিগকে আশ্রয় দিতে হইবেই। পাপী পুরুষকে উদ্ধার করিবার জন্য বহু মানুষ ব্যস্ত, নারী বলিয়াই নারীর সম্মুখে দুর্লঙ্ঘ্য বাধ তুলিয়া ধরা ঠিক নহে।

.

বিংশ পরিচ্ছেদ

দোকানের কাজে ক্রমশ উন্নতি হইতেছিল। অন্যান্য জিনিস বিক্রয়ের সঙ্গে চারজন দর্জি কাজ করিয়াও কুলাইয়া উঠিতে পারে না।

সন্ধ্যার পর রায়হান দোকান ঘরে বসিয়া খবরের কাগজগুলি দেখিতে ছিলেন। এমন সময় সুকুমার আসিল।

রায়হান মৃদু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কবে বাড়ি এলে, সুকুমার?”

সুকুমার উত্তর না দিয়াই রায়হানের পদধূলি গ্রহণ করিবার জন্য মাথা নত করিল। রায়হান যুবকের হাত ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রীতির সহিত কহিলেন–“ভেবেছ তুমি আমার পদধূলি গ্রহণ করতে পারবে। তোমাকে এত ব্যক্তিত্বহীন করে পাপ করাইতে চাই না। অমন করে নিজেকে হারিয়ে ফেলো না। তুমি জান না, ইসলাম কাকেও ব্যক্তিত্বহীন করতে চায় না? নত মাথা অপেক্ষা নত মন জ্ঞানীর চোখে সমধিক প্রিয়। অনন্ত মানুষকে মুক ও বধির করে একা বেঁচে লাভ কী?” সুকুমার। আপনি দেবতা, আমার মাথা আপনা আপনি আপনার পায়ের কাছে নত হয়ে পড়ে।

রায়হান–ঐ কথা বল্লে আমাকে অপমান করা হয়।

সুকুমার-আপনার অনুগ্রহে বেঁচে আছি। আপনাকে সম্মান করব না,কাকে সম্মান করব?

রায়হান–ভুল বুঝেছ! মাসে মাসে ১০টি করে টাকা পাও বলে আমরা কাছে তোমাকে হীন হতে হবে? দানের দ্বারা তোমার মনকে ছোট করতে চাই না। যদি তুমি ভয় কর, তা হলে তোমার স্টাইপেণ্ড আমি বন্ধ করব! ছোটকাল হতে এই হীন বিনয়ের জন্য তোমাকে ভালবাসি নাই। তোমার মৃতদেহ আমি চাই না–আমি চাই তোমার সকল জীবন-ভরা বিকাশ।

সুকুমার বলিল–“আমায় ক্ষমা করুন–শিক্ষা হয়েছে।” তাহার পর চৌকির উপর বিক্ষিপ্ত বইগুলির উপর তাকাইয়া বিস্ময়ে কহিল–“একি দাদা! বাংলায় সকল মাসিক যে আপনার কাছে! আমাদের কলেজ লাইব্রেরিতে মাত্র দুইখানি বাংলা পত্রিকা আসে। আর সব ইংরেজি। বড় কঠিন কিছু বুঝি না। দুই এক পাতা বুঝলেও ধৈর্য ধারণ করে বেশি পড়তে পারি না।”

রায়হান বলিলেন–“বিদেশী ভাষা, সে সব পড়ে মানুষ হওয়া কঠিন কাজ,জ্ঞানী মাত্রেই স্বীকার করবেন। শক্ত বলে বড় সহিত্যকে অবহেল করতে বলছি না। তবে দেশের প্রত্যেক লোককে বিদেশী সাহিত্য আলোচনা করতে হবে এরূপ ব্যবস্থা করা ঠিক নয়।”

সুকুমার কহিল–“যাদের সহিত্য নাই তারা খুব বড় হবে কী করে?”

রায়হান বলিলেন–“কতকগুলি লোক বেদেশী সাহিত্য থেকে রত্ন চয়ন করে জাতীয় শক্তি বৃদ্ধি করবেন। সাহেবেরা ২৪ ঘণ্টা বই পড়ে; তার অর্থ তারা তাদের মাতৃভাষায় আনন্দ লাভ করে।

বাঙালির যদি উন্নত সাহিত্য থাকত তারাও রাস্তা-ঘাটে জ্ঞান আলোচনা করতো। আইন প্রণয়ন ও সংস্কার সাধনের চিন্তা অপেক্ষা দেশী সহিত্য-উন্নতির কথা অধিক করে সরকারের ভাবা উচিত। তা হলে শাসনের উদ্দেশ্য অনেক আগে সিদ্ধ হয়।”

রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“অধ্যাপকেরা যে বক্তৃতা করেন তা তুমি কেমন বোঝ?”

সুকুমার আমার সন্দেহ হয় তাঁরা মুখস্থ করে এসে কথা বলেন–বক্তৃতা কালে তাঁদের অনেকেরই চিত্তের সহজ ভাব থাকে না। পাছে অধ্যাপক লজ্জা পান, এই ভয়ে কোনো কথা জিজ্ঞেস করি না। রায়হান বলিলেন–“মনের সহজ ভাব না থাকলে শ্রোতাকে সন্তুষ্ট করা যায় না। যদি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেন তা হলে ভালো হয়। কথা ভিতর দিয়ে নিজেকে ভালো করে প্রকাশ করা যায়।”

 ২১-২৫. ভিন্ন গ্রাম হইলেও

একবিংশ পরিচ্ছেদ

ভিন্ন গ্রাম হইলেও নিকটেই সুকুমারের বাড়ি। তাদের অবস্থা আগে খুব ভালো ছিল। পুরোনো দালানখানি তার সাক্ষী। প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া সুকুমার যখন অভাবে পড়া ছাড়িয়া দিতে চাহিয়াছিল,তখন রায়হান তাহার মাকে বলিয়াছিলেন–“খরচ আমি দিব।”

সুকুমার রায়হানকে শ্রদ্ধা করে। তার অন্তরের এই পূজা অর্থের জন্য কিছুতেই নয়।

পরের দিন সন্ধ্যাবেলা রায়হান সুকুমারদের বড়ি যাইয়া উপস্থিত হইলেন। ছোট পরিবার–তার মা আর একটা ছোট বোন, নাম সুষমা। সবে তার বিবাহের সূচনা হইয়াছে। সে বুদ্ধিমতি এবং বই পড়িতে পারে।সুষমা নত হইয়া রায়হানকে প্রণাম করিল। রায়হান কহিলেন, “মানুষ হইয়া মানুষের কাছে মাথা অবনত করতে নাই।” ভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে অধিক শ্রদ্ধা দেখান ভালো দেখায় না।”

সুষমা জিভ কাটিয়া বলিল–“আপনাকে শ্রদ্ধা দেখান ভালো দেখায় না!”

রায়হান বলিলেন–“অধিকাংশ স্থলে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর এই শ্রদ্ধা গোপন অসম্মানের সহিত গৃহীত হয়ে থাকে।”

“আচ্ছা, আপনাকে বাইরে শ্রদ্ধা জানাব না। অন্তরে আপনার চরণে নুয়ে পড়তে বাধা নাই।”

“বেশ”–একটু থামিয়া রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“আচ্ছা, যে কথা বলেছিলাম, তার কী হল”?

সুষমা বলিল–“কী কথা?”

“সেই বোন-পাতানোর কথা।”

“খুব রাজি–সত্যই করিমা আমার বোন। আমি তার সঙ্গে একেবারে এ হতে পারি–আহারে-আরে সব বিষয়ে।”

“সেরূপ বোন-পাতানোর কথা বলছি না।”

“তবে কিরূপ?”

“তুমি হিন্দু-হিন্দুই থাকবে। করিমা মুসলমান-মুসলমানই থাকবে। শুধু মনের মিল, আর কিছু নয়।”

“আপনার ভাই কে হবেন?”

“সুকুমারকে ভাই করিলাম।”

সুষমা। খুব ভালোই হবে।কিন্তু সব হিন্দু-মুসলমান কি আপনার কথা শুনবে? আপনি তো প্রত্যেক হিন্দু-মুসলমান পরিবারে, এই হিন্দু-মুসলমান প্রথাকে একটি অপরিহার্য সামাজিক সংস্কার করতে চান।”

“কেউ মানবে না তা জানি! বরং পাগল বলে উপহাসিত হবো। এটা আমার মনের গোপন ভাব এবং তা আমি সর্বসাধারণের কাছে প্রচার করতে যাচ্ছি না। আমি,করিমা, তুমি ও সুকুমার–এই চারজনের সঙ্গে এই প্রথার সম্বন্ধ।”

“যদিও আমি বুঝি এবং আপনার কাছে কিছু কিছু শুনেছি তবুও আপনার এই প্রথা সম্বন্ধে নূতন করে বলুন।”

রায়হান বলিলেন–“দেখ সুষমা, কারো কাছে আমি আমার মত প্রচার করে বেড়াচ্ছি না। যে চিন্তা সহজভাবে খেলার মতো আমার মাথায় আসে তাই বলতে যাচ্ছি।” একটু নিস্তব্ধ থাকিয়া রায়হান হাসিয়া কহিলেন–“সুষমা, চিন্তার কথা শুনতে তোমার খুব উৎসাহ তা জানি!”

“দেখ, আমাদের দুই জাতির ভিতরে সদ্ভাব স্থাপনের পথ এইভাবে তৈরি করলে মন্দ হয় না। হিন্দু বা মুসলমান পরিবারে সন্তান ভূমিষ্ট হবার পর নামকরণের সময় তার জন্য একটা ধর্ম-ভাই বা ধর্ম-বোন ঠিক করতে হবে। উচ্চ-স্তরের দশজনের চেষ্টায় এটাকে সকলে সামজিক রীতি বলে গ্রহণ করতে পারে। হিন্দু বালিকা মুসলমান ধর্ম-বোন গ্রহণ করবে,মুসলমান বালিকা হিন্দু ধর্ম-বোন গ্রহণ করবে। পুরুষদের সম্বন্ধেও একই কথা। তারাও ভিন্ন সমাজ হতে ভাই গ্রহণ করবে। কেউ কারো সঙ্গে ভ্রাতৃত্ব সম্বন্ধ স্থাপন করে মৃত্যু পর্যন্ত এই বন্ধনকে সম্মানের চোখে দেখবে। দুই বিরুদ্ধ জাতির মধ্যে সখ্য স্থাপন অসম্ভব। বিবাহপ্রথা ছাড়া কোনো কালে বিভিন্ন সমাজের মধ্যে প্রণয় হয় নাই–অথচ হিন্দু মুসলমানের প্রণয় না হলে চলবে না। উভয়ের বাঁচবার পথ এই।

ঘরের ভিতর হইতে সুকুমারের মা বলিলেন–“তোমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গল্প করবে?”

রায়হান বারান্দায় যাইয়া উপবেশন করিলেন। সুষমা কহিল–“মা, আমার ইচ্ছে রায়হান ভাইকে খাওয়াই।”

সুষমার মা বলিলেন–“রায়হান যে খায় না?”

রায়হান কুণ্ঠায় কহিলেন–“দেখুন খুড়ি, আমি খাই না বলে আপনারা বোধহয় কষ্ট পান। যদি বুঝতেন মুসলমান হিন্দু বাড়িতে খেলে তার অসম্মান হয়, তাহলে আপনারা কিছু মনে করতেন না।”

সুষমা কহিল–“নগেনের উকিল সাহেবের ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল, সে সপ্তাহে একবার করে তাদের বাড়ি যেয়ে খেতো, আমি জানি, আপনি খাবেন না তাই বলুন।”

“নগেনের কথা বাদ দাও। অনেক হিন্দু অনেক কিছু করে। আমি তা ভালবাসি না। সে যা সে তাই থাক। হিন্দু সে হিন্দুর মতো থাকবে। অনেক হিন্দু কলকাতায় অবৈধ জিনিস কিনে খায়, সে কি ভালো?”

কিছুক্ষণ পরে সুকুমারের মা সুষমাকে সোজাসুজি দূরে যাইতে না বলিয়া বলিলেন–“মা, তোমার দাদার ঘরে যেয়ে একটু পড়ে এসো। এক্ষুনি আবার রান্না করতে যেতে হবে।”

সুষমা উঠিয়া দাঁড়াইয়া রায়হানকে কহিল–“রায়হান ভাই, যাবার সময় না বলে যাবেন না।”

সুষমা চলিয়া গেল তার মা রায়হানকে বলিলেন–“বাবা রায়হান, সুষমার বিয়ে তোমাকেই ঠিক করতে হবে। এই জন্যই তোমাকে ডেকেছি। সুকুমার বিদেশে থাকে। তার কাকারা মেয়ের বিয়ে সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন।”

রায়হান–“সুষুমাকে তো বিয়ে দেওয়াই দরকার।”

“যদু বাবুর ছেলে তো বি-এ পাশ করেছে!”

“নিশি!–সে ছেলে মন্দ নয়! তবে তার মাথায় কতকগুলি পাগলামি ঢুকেছে। সে কোনো গুরুর মন্ত্র নিয়েছে। মাছ-মাংস খায় না। বিয়ে করে তার স্ত্রীকে নাকি ব্রহ্মচারিণী রবে।”

রায়হান হাসিয়া বলিলেন–“পাছে পিপীলিকার ঘাড়ে পা লাগে এই ভয়ে সে গাছের ডালে এক ঘর বেঁধে সেখানেই বাস করে। তার আর এক উদ্দেশ্যে পাখির সরলতা অনুকরণ করা। সে বলে–সংসারের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নাই। সমস্ত বিশ্বের মানুষ অন্ধকারে পড়ে আছে–সে সকলকে তার আলোকে টেনে তুলবে! সারাদিন সে চোখ বুজে বসে থাকে–পাপ পৃথিবীর পানে সে তাকায় না। দুঃখেই ভগবানকে নাকি পাওয়া যায়, এই জন্য সে সেই উচ্চস্থান থেকে মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ে।

বিস্ময়ে সুষমার মা বলিলেন–“নিশির এই অবস্থা হয়েছে? থাক দরকার নাই। আমার ইচ্ছা তুমিই পছন্দ করে সুষমাকে বিয়ে দাও।”

সুষমার বিবাহ ব্যাপার, জমাজমি সংক্রান্ত কতকগুলি পরামর্শ, সুকুমারের ভবিষ্যৎ জীবন সম্বন্ধে কথা কহিয়া রায়হান বাড়ির দিকে চলিলেন।

.

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

রায়হানের বাড়ি হইতে বেশি দূরে নয়, ওমেদপুরের উত্তর পাড়ায় দুঃখিনী মসুর মা বাস করে। চোখ খোলা থাকিলেও সে কিছু দেখিতে পায় না। শুধু অভ্যাসের জোরে গ্রামের পথ দিয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়।

মসুর মা এককালে যুবতী বধু ছিল। তার স্বামীর নাম ছিল তমিজ। ত্রিশ বৎসর বয়সের সময় দুইটি পুত্র ও একটি কন্যা রাখিয়া সে মারা যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর মসুর মা তার দুই বিধবা বোনকে নিজের বাড়িতে লইয়া আসিয়াছিল। তিন বোনের মধ্যে মসুর মা ই বড়। কুড়োনের মাও ছুটু ছিল মেজো এবং সেজো। বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকায় সাহায্য ও সাংসারিক ভরসার আশায় বড় বোনের অনুরোধে ছটুকে এক নয়–দুই নয়–পাঁচ পাঁচটা বিবাহ করিতে হইয়াছিল; কিন্তু একটা স্বামীও টিকিল না।

।কুড়োনের মাও স্বামী গ্রহণ করিয়াছিল কিন্তু সকলগুলিই বিবাহের যথাক্রমে ১ মাস, ৩ মাস এবং এক বৎসর পরে কোথায় গিয়াছিল, তা কেউ বলিতে পারিত না।

মসুর মা পুনরায় আর বিবাহ করে নাই। দুটি ছেলের মুখেই সে তার স্বামীর ছবি দেখিত।

খাবারের অভাব তো তাদের ছিল না। যা দুই বিঘা জমি ছিল তাতেই তাদের চলিত। বাড়িতে দুইটি গাভী ছিল। আমগাছের আম আর বাড়ির গরুর দুধ তাহারা তৃপ্তির সহিত পেট ভরিয়া খাইত।

তাহার পর একদিন দুই দিন করিয়া অনেক বছর কাটিয়া গিয়াছিল। হঠাৎ একদিন কলেরায় দুটি বোন এবং সেয়ানা মেয়েটি মরিয়া গেল। রহিল মসুর মা আর তার দুইটি জোয়ান ছেলে।

শেষ বয়সে একদিন মসুর মা বুছিল সংসারে সে একা। নিঃসহায় দুঃখময় তার জীবন। বুক তার ভাঙ্গিয়া গেল। মসু চরিত্রহীন হইয়া, মায়ের কথা একটুও না ভাবিয়া কোথায় চলিয়া গেল। এক এক বছর পরে ছোট ছেলেটিও দুই দিনের জ্বরে তার বোনদের মত অন্তঃশয্যা গ্রহণ করিল।

বৃদ্ধ বয়সে বেদনা শোকে ক্ৰমে মসুর মার শরীর ভাঙ্গিয়া পড়িল। সে একা–নিঃসঙ্গ। তার জীবন বড় বেদনাভরা হইয়া উঠিল।

ঘরের পার্শ্বে আমগাছতলায় তার অতি প্রিয়তম ছোট ছেলে এবং মেয়ের কবর দুটি পাশাপাশি হইয়া পড়িয়াছিল।

সন্ধ্যা যখন বিশ্বে নামিয়া আসিত, মৃদু অন্ধকারে গ্রামের পথে পথে যখন মশকদল বেদনার গান গাহিত, যখন বাড়ি গোয়ালঘরের সম্মুখে কত বছরের বেদনা-স্মৃতি লইয়া সাজালগুলি জ্বলিয়া উঠিত, দারিদ্র গ্রাম্য লোকগুলি উঠানে বসিয়া কত সুখ-দুঃখের গল্প করিত, তখন মসুর মা অন্ধকারে সেই আমগাছতলায় বসিয়া আর্তক্রন্দনে সন্ধ্যা-গগন মুখরিত করিয়া তুলিত। তখন গ্রামের পথগুলি তার করুণ শোকগাথায় মূৰ্ছিত হইয়া পড়িত।

মসুর মার বাড়ির পার্শ্বে এক ঘর মুসলমান সুদখোর মহাজন পরিবারের বাস। তাহাদের অনেক জমাজমি ছিল। জনহিতকর কার্যে তাহাদের কোনো সহানুভূতি ছিল না। মসুর মা তাহাদের প্রজা।

একদিন তাহাদের বড় মিঞা মসুর মাকে ডাকিয়া লইয়া বলিলেন, “দেখ মসুর মা, তুই এখন একা, এত বড় বাড়িখানি দিয়ে এখন আর কী করবি। আমার প্রাচীরটা একটু বাড়ান দরকার। তোর ভিতরের বন্দোবস্ত জমিগুলিও ছেড়ে দে। একা মানুষ, করিম মোল্লার বাড়িতে যেয়ে থাক, ঘর বাঁধবার যা খরচ লাগে তা আমি দেবো”।

মসুর মা আর কী বলিবে?–সে ভবিয়াছিল জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি আম গাছের তলার দিকে চাহিয়া চাহিয়া কাটাইয়া দেয়, গত জীবনের হাজার স্মৃতি তার বাড়িখানিকে আঁকড়িয়া ধরিয়া আঁখিজলের সহিত সে বেচিয়া খাইবে।

সে দেখিল আঁখিজলের ভিতরেও এতটুকু খোঁজবার অধিকার তার মতো ছোটলোকের নাই। পরের অনুগ্রহে পালিত হওয়াই হবে এখন তার সব দুঃখের প্রতিদান।

বৃদ্ধা আস্তে আস্তে কহিল–“আমার কোনো আপত্তি নাই!” সে কথা বলা ছাড়া তার আর উপায় ছিল না। মসুর মা কয়েকদিনের মধ্যেই করিম মোল্লার বড় ঘরের পাশে একখানা কুঁড়েঘর তুলিয়া লইল। তাহার পর আরও কয়েক বছর কাটিয়া গেল। ক্রমে চোখ দুটি তার নষ্ট হইয়া গেল। বাড়িতে বাড়িতে লাঠি লইয়া ছায়াময় দৃষ্টির সাহায্যে দুইটি অন্নের জন্য সে ঘুড়িয়া বেড়াইত। সাবেক মুনিব বড়মিঞার বাড়িতে সে অনেক সময় যাইত। বড়মিঞার পুত্রবধূ বুড়ির দুঃখ সাধ্যমত দূর করিতে চেষ্টা করিত। পুরোনো কাপড়, মাথার তেল, কখনও পেটে খিদে নাই বলে চুপে চুপে ভাত-তরকারি মসুর মা কানিকে দিত। মাঝে মাঝে মসুর মা মুনিব বাড়ির ইন্দারায় তার কাঁধা ভাঙ্গা মেটে কলসিটা কাকে নিয়ে জল আনিতে যাইত। চঞ্চল হাসিমুখ বৌটি বুড়ির অজ্ঞাতসারে তার কলসিটি নিয়া লুকাইয়া রাখিয়া দিত। অন্ধ বুড়ি উপুড় হইয়া যখন এখানে ওখানে কলস হাতড়াইত, তখন বালিকা হাসিয়া খুন হইত। পাড়ার বৌ-ঝিদের ভুক্তবিশেষ, পোড়া-পচা পান্তা ভাত মসুর মা আগ্রহের সহিত গ্রহণ করিত।

আমকালে যখন তার আম খাইবার সাধ হইত, তখন সে কোনো ভদ্রগৃহে যাইয়া তাহাদের ফেলিয়া দেওয়া ছোবড়াগুলি চুপে চুপে, কুড়াইয়া লইয়া চুষিয়া খাইত। কেউ যদি কোনোদিন পিঠে প্রস্তুত করিত, মসুর মা কোনো রকমে জানিতে পারিলে, সে সেদিন বিনা আহ্বানে তাহাদের পানি তুলিয়া এটা-ওটা করিয়া দিতে চেষ্টা করিত। দয়া করে তারা তার হাতে একখানা পিঠে দেবে, এই আশায় সেদিন তার কোনো জায়গায় আহার হইত না। সেদিন সে সাঁঝের বেলা তার বন্ধু সেই বালিকা-বধূর কাছে যাইয়া দাঁড়াইত। সাঝের মৃদু অন্ধকারে সকলের অগোচরে কানাবুড়ি কি যেন সুদখোর মহাজনের বাড়ি হইতে আঁচলে ঢাকিয়া লইয়া যাইত।

একদিন বর্ষাকালে তার বন্ধু সেই বৌটি তাকে না বলেই বাপের বাড়ি চলিয়া গেল। বুড়ি তার আশায় মাসের পর মাস কাটাইয়া দিয়াছিল কিন্তু আর সে আসিল না।

সুকুমারদের নিকট হইতে রায়হান বাড়িতে আসিয়া সকলের শেষে ভাত খাইতেছিলেন। তাঁর চাচি পার্শ্বে বসিয়া খাওয়াইতেছিলেন। চাচি খাবার মাঝে কহিলেন–“বাবা রায়হান, তোর মা ছোটকালেই মরে গেছেন। মা হলেও আমি, চাচি হলেও আমি। একটা কথা–“।

রায়হান কহিলেন–“কী কথা মা?”

“তোমার ফুপুর মেয়ে সেয়ানা হয়েছে। তার তো বিয়ে না দিলে চলছে না।”

“তা তো ঠিক! সেয়ানা মেয়েকে বিয়ে না দেওয়া ভালো নয়।”

“তোমার ফুপো–মেয়ে ছোট থাকতেই মারা গেছেন। কিছু সম্পত্তি ছিল তাই রক্ষা। ওকে কোথায় বিয়ে দেই? তাদের মুরব্বি তো আমি এবং তোমার বাবা। তোমার বাবা সেখানে গতকাল বেড়াতে গিয়েছিলেন। তোমার ফুপু অনেক কাকুতি-মিনতি করে একটা কথা বলে দিয়েছেন। তার ইচ্ছে হাসিনাকে তোমার সঙ্গে বিয়ে দেন।”

কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া রায়হান কহিলেন–“সে ভালো কথা। তারা যদি এতে ভাবনার মধ্যে পড়ে থাকেন তা হলে আগে বল্লেই তো হতো। অনেক আগেই আমি বিয়ে কত্তাম।”

“বাবা মেয়ে সেয়ানা–অর্থ নাই–গুণ নাই–বিদ্যা নাই, একটা কথাও জিজ্ঞাসা না করে তুমি রাজি হয়ে গেলে। এটা কি তোমার ঠিক কথা, না উপহাস?”

“একটুও উপহাস নয়–মুসলমান ছাড়া অন্য জাতি নয় তো। অশিক্ষিতা মেয়েমানুষের সঙ্গে বাস করা কঠিন হলেও আমার পক্ষে কোনো অসুবিধা হবে না। বয়সকালে মেয়েদের মন কোমল থাকে, সহ্য করে উন্নতি করতে চেষ্টা করলে অতি সহজেই তারা উন্নত হয়। ধৈর্য না থাকলে এবং অসদ্ব্যবহারে, ভালো স্ত্রীলোকও খারাপ হয়ে যায়। নিজের স্ত্রী যে হবে তাকে শিক্ষিতা ও বড় করতে বেশি দিন লাগে না।”

“বড় ঘর নয় বলে তোমার বাবা রাজি হতে নাও পারেন।”

“ঐটা ভয়ানক অন্যায় কথা–মানুষ বড় হবে জ্ঞানে। বিয়ে করে বড় হতে চেষ্টা খেলো মানুষের কাজ। কোনো বড়লোকের সঙ্গে আত্মীয়তা করে নিজের হীনতাকে স্পষ্ট করে তোলা কি ভালো?”

রায়হানের চাচি সন্তুষ্ট হইলেন।

অনেকক্ষণ পরে চাচি বলিলেন–“আজ কদিন মসুর মা আসে না। শুনলাম তার ব্যামো হয়েছে। বেচারা কী খায়! করিমের মা নাকি তাকে খুব জিল্লতি করে।”

রায়হান কথা কহিল না। রাত্রি হইয়া গিয়াছিল বলিয়া সে খাইয়াই তাড়াতাড়ি দোকানঘরে চলিয়া গেল।

দোকানে যাইয়া প্রদীপটা জ্বালিয়া রায়হান একখানি মাসিক লইয়া বসিলেন। থাকিয়া থাকিয়া মনটা যেন বই ছাড়িয়া বাজে চিন্তায় ভরিয়া উঠিতেছিল। বাতি নিভাইয়া রায়হান শুইয়া পড়িলেন। সহজে নিদ্রা না আসাতে জানালা খুলিয়া অন্তহীন মাঠের দিকে তিনি চাহিয়া রহিলেন। কী গম্ভীর নৈশ আকাশ-প্রকৃতির ছায়াময় মূর্তি। রায়হান ভাবিতেছিলেন–আহা, মানুষের কী দুঃখ!

প্রায় দেড় ঘণ্টা হইয়া গেল তবুও রায়হানের ঘুম হইল না। ক্রমাগত এপাশ ওপাশ করিতেছিলেন। তাহার পর সহসা বিছানা হইতে উঠিয়া পড়িলেন। খাটের নিচে একটা। টুকরি ছিল। কতকগুলি চাল, আধসের ডাল, কিছু লবণ, খানিকটা হলুদ, ছোট একটা। শিশিতে খানিক তেল লইয়া হারিকেন হাতে করিয়া রায়হান বাহির হইয়া পড়িলেন।

রায়হান কয়েক মিনিটের ভিতর একটা ছোট কুটিরের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। মৃত্যুর কাল রেখা কুটিরখানির চারিদিকে ঘিরিয়া ছিল।

রায়হার বাহির হইতে ধীরে ধীরে ডাকিলেন–“মসুর মা?”

ভিতর হইতে একটা অনশনক্লিষ্ট দুর্বল স্বর উত্তর দিল।

রায়হান কহিলেন ”দরজা খোল।”

কষ্টে দরজা খুলিয়া মসুর মা বাতির আলোকে অস্পষ্টভাবে দেখিল–রায়হান।

সে জিজ্ঞাসা করিল–“বাবা রায়হান, এত রাত্রে কী মনে করে? আমার তো ঘুম নাই। বাপ। অনেক দিন হল, মিঞাদের ইন্দারায় পানি আনতে গিয়েছিলাম। পাখানা ভেঙ্গে গিয়েছিল। বড় লেগেছিল”।

তাহার পর ব্যস্ত হইয়া আস্তে আস্তে ময়লা কথাখানা পাতিয়া দিয়ে কহিল–“বসো, বাবা, বসো।”

চালের টুকরি মাটির উপর রাখিয়া রায়হান কহিল–“মসুর মা! কিছু চাল এনেছি, এগুলি তুমি নেও”।

“কেন বাবা–কেন বাবা–চালের দরকার কী?” বলিয়া বুড়ি রায়হানের হাতখানি বুকের কাছে টানিয়া লইয়া কাঁদিয়া ফেলিল।

.

এয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

প্রাতঃকালে পিয়ন কাগজ ও অন্যান্য চিঠির সহিত একখানা রেজেষ্ট্রি দিয়া গেল। আগ্রহের সহিত সেখানা খুলিয়া রায়হান পড়িয়া দেখিলেন তাহাতে লেখা আছে–

১৫/৭ সার্কুলার রোড, কলিকাতা।
প্রিয়তম ভ্রাত,
জীবনের গভীর দুঃখের কথা তোমাকে বলতে আমার এতদিন সাহস হয় নাই। চিরকালই ভিতরে ভিতরে একটা বিশ্বাস পোষণ করিয়া আসিয়াছি, তুমি বড় নীরস–আত্মা তোমার স্থবির–শুষ্ক, কঠিন এবং মরুময়। তবুও তোমায় আমি শ্রদ্ধার চোখে দেখি।

বিশ্বাস ও আশা ছাড়া মানুষ বাঁচে না। জীবনে এমন কোন ঘটনা ঘটিতে পারে, যাহাতে মানুষের মন ছিন্নভিন্ন হইয়া যায়। বাহিরে লোকের কাছে তাহা উপহাসের জিনিস। তুমি উপহাস ও তাচ্ছিল্যের ভাবে গ্রহণ করিবে না–এই বিশ্বাসে আমি বলিতেছি, আমার জীবনে এরূপ কোনো ঘটনা ঘটিয়াছে।

সত্যই কি তুমি নীরস? আত্মা তোমার মরুময়? লক্ষ মানুষের প্রচলিত জীবন ধারা, লক্ষ আত্মার পুণ্য মধুকল্পনা ও স্বপ্নকে কি তুমি ঘৃণার চোখে দেখ? তাহা হইলেও আমি আজ তাহা ভুলিয়া যাইব। আজ মানিয়া লইব আমার মতো অনন্ত দুর্বল মানুষের বন্ধু তুমি, ভাই তুমি।

কণ্ঠ আমার শব্দহীন হইয়া উঠিতেছে–লেখনী যেন অবশ হইয়া আসিতেছে, তবুও বলিয়া পারিতেছি না।

আমি কি তা জানি না–ভালো কি মন্দ তাহাও বুঝি না। পড়াশুনা আমার সব মাটি হইয়া যাইতেছে। চতুর্থ বৎসরের বড় বড় বইগুলি লইয়া কলেজে আসা-যাওয়া করি মাত্র। অধ্যাপক যখন বক্তৃতা দেন, তখন তার মুখের পানে শুধু চাহিয়া থাকি।

স্কুলের জীবনে কখনও ভাবি নাই, এমন কিছু সম্ভব। যখন স্কুলের জীবন শেষ হইয়া আসিল তখন জীবনের সম্মুখে এক নূতন পথ খুলিয়া গেল। প্রথমে উপেক্ষা করিয়াছিলাম, এখন দেখিতেছি এই পথ অতি ভয়ানক। সেই পথের শেষ প্রান্তে দেখিয়াছিলাম এক বালিকা মূর্তি–সে আমেনা।

সেই মিলাদ শরিফের দিন জোছনার আলোক অভিনব বেশে দেখিয়াছিলাম সেই বালিকাকে। আমরা শিরায় শিরায় যেন একটা তড়িৎ প্রবাহ ছুটিয়াছিল। আমার শক্তি ও মনের অবহেলা উপেক্ষা করিয়া সে শত ভাবে আমার সম্মুখে দাঁড়াইয়াছিল। তবুও তাহার সম্মুখে তখন আমি শক্তিহীন হইয়া পড়ি নাই মনে করিয়াছিলাম তাহাকে বিবাহ করিব, কিন্তু যে কারণেই হউক তাহা হয় নাই। আমি নিজের কাছে নিজে লজ্জিত ছিলাম। মা ছাড়া কাহারও কাছে জীবনের এই কথা ভালো করিয়া ব্যক্ত করিতে সাহস পাই নাই!

ধীরে ধীরে বালিকা-রানী এই দীর্ঘ চারি বৎসরের চেষ্টায় আমাকে একেবারে মুহ্যমান করিয়া তুলিয়াছে। দেহমন সব শক্তিহীন হইয়া পড়িয়াছে। কোনো আশা নাই–তবুও অহর্নিশি আত্মা আমার অবুঝ শিশুর মতো সেই ছোট বালিকাটির কথাই ভাবে।

মনে মনে তর্ক করিয়াছি–এ সবই ভুল–দেহকে ধ্বংস করা ছাড়া আর কিছু নয়। অনেকবার মনকে বিদ্রোহ করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু সকল মীমাংসা মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে।

একটা মানুষ আমাকে এমন করিয়া শক্তিহীন করিতে পারে, একথা ভাবিতেও আমি মাঝে মাঝে লজ্জিত হই। কারণ খুঁজিয়া পাই না–তবুও ভাবি এটা কী? খোদা জানেন।

নির্জনে যখন থাকি তখন ভাবি–তারই কথা। বাতাসের মাঝে তারই অস্তিত্ব অনুভব করি। জোছনামাখা আকাশের পানে তাকাইয়া ভাবি মিথ্যা আমার জীবন সংসারের আলো-বাতাস আমার কাছে নিরর্থক। বিশ্বের সম্পদ একটা বিরাট আবর্জনাস্তূপ। আমি নিঃসহায়!–শুষ্ক বেদনা লইয়া এই দীর্ঘ জীবনটাকে টানিতে হইবে! সে কতদিন–কত বছর। দুঃখভরা দারুণ ব্যর্থতা।

যদি মানব সমাজ ছাড়িয়া তাহাকে লইয়া সমুদ্রগর্ভে থাকিতে হইত তাহাতেও আমি খুশি হইতাম।

এই জ্বালা কীসে নিবৃত্ত হইবে জানিতে চাই। সংসারের সকল আসক্তি নিবিয়া গিয়াছে। কী বিস্ময়–সেই বালিকাকে তো আর পাইবার আশা নাই, তবুও এ দুঃখ কেন! যে দুঃখের শেষফল শুধু হাহাকার ও বেদনা, সে দুঃখের এত অত্যাচার কেন?

তার রূপ শত গরিমায় মনের পটে ভাসিয়া উঠে। চোখের সম্মুখে সে সদা খেলিয়া বেড়ায়। তার হাসি কী ভয়ানক ও জ্বালাময়!

কয়েকদিন আগে ইচ্ছা হইয়াছিল বর্ধমানে যাইয়া তাহাকে দেখিয়া আসি। কিন্তু কী উপলক্ষ্য করিয়া তাহার সহিত দেখা করিব? আমি তো আর কেউ নই। তার স্বামীর সঙ্গেও আমার দেখাশুনা নাই।

একটা বড় আশ্চর্য কথা–বিবাহের পর আমেনা তো একবারও বাড়িতে আসিল না।

আমেনা–মহারানী আমেনা-দেবী, গরিমাময়ী–যাহার চরণস্পর্শ করিয়া মাটি ধন্য হয়–যাহাকে বিবাহ করিয়া সারা জীবন ভিখারির বেশে দ্বারে দ্বারে ঘুরিলেও ক্ষতি হয় না,–সে কোথায়?

প্রিয়তম ভাই–শক্তি ও সান্ত্বনা চাই–আমাকে পথ দেখাও–তোমার পত্রের জন্য উদগ্রীব হইয়া রইলাম।

.

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

রায়হান চিঠি পড়িয়া একেবারে স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। তাহার ললাট স্বেদসিক্ত হইয়া উঠিল। ধমনীতে উষ্ণ রক্তস্রোত আরও উষ্ণ হইয়া উঠিল।

পত্রখানি বাম হস্তে তুলিয়া লইয়া রায়হান দক্ষিণ হস্ত দিয়া তাহা দুই ভাগ করিয়া ফেলিলেন। তাহার পর ডেস্ক হইতে চিঠির কাগজ বাহির করিয়া লিখিলেন।

১৭/৭
ওমেদপুর

প্রিয় হামিদ! তোমার পত্র পাইয়াছি। জীবনে যে এমন পত্র পড়িতে হইবে ইহা কখনও ভাবি নাই। পরস্ত্রীর রূপ লইয়া ঢলাঢলি করিতে কে তোমাকে শিক্ষা দিয়েছে? তস্করের ন্যায় পর রমণীর কথা ভাবিতে একটুও লজ্জা বোধ হয় না? বস্তুত তোমার পত্রে আমি যারপরনাই দুঃখ পাইয়াছি। ক্রোধ ও ঘৃণা যুগপৎ আমাকে বেড়িয়া ধরিয়াছে। হীন প্রকৃতির লোক ছাড়া এমন গোপন ব্যভিচার করিতে কেউ সাহস পায় না। তুমি আমাকে অত্যন্ত বেদনা দিয়াছ। বিধাতার বিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়ান কী প্রকার মনুষ্যত্ব বুঝিতে ইচ্ছা করে না।

০ ০ ০ ০

ডাকঘরে পত্র দিয়া রায়হান যখন ফিরিয়া আসিলেন তখন দুপুর। তখনও তাহার খাওয়া হয় নাই। চিত্তা তাহার বড় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল, বুকের ভিতর রক্তপ্রবাহ বিক্ষুব্ধ। তরঙ্গের মতো আছাড় খাইয়া পড়িয়াছিল। তীব্র উজ্জ্বল সূর্যকিরণমাথা আকাশের পানে রায়হান চাহিয়া দেখিলেন–আঃ!

পথ ধরিয়া একখানা পাল্কি আসিতেছিল। রায়হান বিস্ময়ে দেখিলেন সঙ্গে কেউ নাই। বাহকদিগকে রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“পাল্কি আসছে কোথা হতে?”

”জে আজ্ঞে–এই স্টেশন থেকে।”

“সঙ্গে কেউ নাই?”

“জে না!”

“কোথায় যাচ্ছ?”

“খোরশেদ মিঞার বাড়ি–তার ভগ্নি বর্ধমান থেকে এলেন। আমরা তো আর পর নই–দোষ কী, কেউ না থাকলে”?

রায়হান বজ্রাহতের ন্যায় সেখানেই দাঁড়াইয়া রহিলেন! পাল্কি চলিয়া গেল।

দোকানে না যাইয়া রাস্তা হতেই বুকের ভিতর একটা দারুণ আশঙ্কা লইয়া রায়হান খোরশেদের বাড়ির দিকে ছুটিলেন।

খানিক পথ চলিয়া শুনিলেন কে যেন আর্তস্বরে কাঁদিতেছে!

বাহকেরা বাহির-বাড়িতে টাকার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল। রায়হান পকেট হইতে তাড়াতাড়ি দেড়টি টাকা দিয়া তাহাদিগকে বিদায় করিয়া দিলেন। তাহার পর একেবারে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিলেন।

সম্মুখে আমেনা–মূর্তিমতী করুণা–রায়হানকে দেখিয়াই সে মূৰ্ছিতা হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।

.

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

বিপুল লাঞ্ছনা ও অসম্মানের স্বামী কর্তৃক বর্জিতা জন্মের মতো আমেনাকে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছে। তার হীন ও অর্থলোভী শ্বশুর পুত্রবধূকে একাকী বিধবার বেশে পথে তুলিয়া দিয়াছিল। খোরশেদের দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ বধূকে লাঞ্ছিতা করিলেই সিদ্ধ হইবে এইরূপ নজির মিঞা ভাবিয়াছিল।

এনায়েত বধূর অপমানে সন্তুষ্টই হইয়াছিল। পিতা পুত্রকে অনেক টাকা ব্যয় করিয়া নূতন এক রূপবতী কন্যার সহিত বিবাহ দিবেন, ইহাও সে শুনিয়াছিল।

আমেনা ইদানিং কথা বলি না। হৃদয়ের সীমাহীন দুঃখ সে সযতে বুকের ভিতর লুকাইয়া রাখিত। যেদিন তাহাকে চরিত্রহীনা বলা হয় সেদিন হইতে সে মৌন হইয়া গিয়াছিল।

বিবাহ জিনিসটাকে স্ত্রীলোকের স্বভাব অনুযায়ী সে বাল্যকলে অনেকখানি রং লাগাইয়া ভাবিত। যখন সংসারে প্রবেশ করিয়া অপরের বধু হইয়া আনন্দ খুঁজিতে সে একটা ব্যাকুল হইয়াছিল, তখন ভাগ্য তাহাকে দিয়াছিল অমৃতের পরিবর্তে বিষ-সুখের পরিবর্তে জ্বালাময় কন্টক এবং সীমাহীন সঙ্কীর্ণতা।

বাড়ি আসিয়া কয়েকদিন অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। খোরশেদ বাড়িতে টাকা পাঠায়, বাড়িতেও আসে না। সে তার ভগ্নির অপমানের কথা শুনিয়া মায়ের কাছে উত্তর লিখিয়াছে–স্বভাবদোষে আমেনা বর্ধমানে টিকিতে পারে নাই।

অতি আপনার জনের মতো সেদিন রায়হান আসিয়া আমেনাকে বলিয়া গিয়াছে–খোদার বিধানকে মাথায় পাতিয়া লইতে হইবে, উহাতেই জীবন ও আত্মার মঙ্গল। উহাকে দুঃখ প্রকাশ করা ভুল।

আমেনা তাহার গুরুর কথায় শান্তিলাভ করিয়াছে। কিন্তু একদিন অতীত জীবনের করুণ চিন্তা আসিয়া তাহাকে ব্যথিত করিয়া তুলিয়াছিল। তাহার আঁখিপল্লব সিক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। যদি তাহার বর্ধমানে বিবাহ না হইত, তাহার জীবনধারা যদি অন্যভাবে বহিত!

রায়হান তার গুরু। কয়েক বছর আগে সে যখন রায়হানের প্রতিভা-মণ্ডিত উজ্জ্বল চক্ষুর সম্মুখে বসিয়া বক্তৃতা শুনিত, তখন তার বালিকা-চিত্ত একটা কথা ভাবিত–যা সে কাহারও কাছে বলিতে সাহস পাইত না।

মায়ের অসীম স্নেহ-রায়হানের গভীর অকৃত্রিম সহানুভূতি তাহাকে আবার হাস্যময়ী করিয়া তুলিয়াছে। সে তার গত অপমানের কথা ভুলিতে পারিয়াছে।

রায়হান যখন তার মাকে সালাম করিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করে–কেমন আছ? আমেনার তখন ইচ্ছা করে রায়হান ভায়ের পায়ের কাছে নত হইয়া বলে আপনার আশীর্বাদে ভালো আছি। তার গুরু রায়হান ছাড়া অমন করিয়া এতকাল পর্যন্ত কেউ জিজ্ঞাসা করে নাই, সে কেমন আছে। এমন সরলতা, এমন সহানুভূতি সে কোথায়ও দেখে নাই। তার গুরুর উপর তার ভক্তি বেশি করিয়া বাড়িয়া উঠে।

একদিন বৈকাল বেলা নাফিসা রায়হানকে ডাকিয়া কহিলেন, বাবা, তোমার। বোনকে একটু কোরান পড়াতে পার? শুধু মতন পড়তে পারলেই হবে না। ব্যাখ্যা ও ভাবসহ কোরানের বাণীগুলি আলোচনা করবে। তার মনের উন্নতি হোক, খোদার উপর সে বেশি করে নির্ভর করতে শিখুক।

রায়হান কহিলেন–আপনার প্রস্তাবে আমি খুশি হলাম। তার মনের উন্নতি যথেষ্ট হয়েছে, আরও হবে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে একটা সেলাইয়ের কল কিনে দিতে চাই। ভদ্রঘরের মেয়েদের জন্য অনেক বিষয় চিন্তা করতে হবে। আর কিছু না হোক উপার্জিত অর্থ দিয়ে দীন-দুঃখীর দুঃখ দূর করা তো যাবে।

“একটা যন্ত্রের দাম দেড়শ টাকার কম নয়। খোরশেদ এক পয়সা দেয় না। ষাট টাকার ধান বিক্রি হয়েছিল, তাই দিয়ে বাজার চলছে।”

‘টাকার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না। শুধু অনুমতি চাই।”

২৬-৩০. সেই রাত্রে মুর্ছা হইতে উঠিয়া

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ

সেই রাত্রে মুর্ছা হইতে উঠিয়া গিরির মনের ভাব সহসা পরিবর্তন হইয়া গেল। চমকিতা গিরি ভাবিল, কাজ ভালো হইতেছে না। ইহার পর হইতে সে খোরশেদের নিকট হইতে নিজেকে একেবারে দূর করিয়া লইল।

কিন্তু ঈশ্বরের ইচ্ছা! কিছুদিনের মধ্যে গিরির জন্য এমন কিছু ঘটিল, যাহাতে তাহার। জীবন খুবই বিচিত্র হইয়া পড়িল এবং তাহার জ্ঞান ও চিন্তা নূতন গতি প্রাপ্ত হইল।

সুখ, উল্লাস ও গর্বের ভিতর সহসা একদিন কলেরার দৌরাত্মে বাপ-মাকে শ্মশানে রাখিয়া আসিয়া গিরি এক পাশে দাঁড়াইয়া কেবল কাঁদিতেছিল আর নিজের অদৃষ্টের কথা ভাবিতেছিল।

বেদনায় তাহার কয়েক দিন কাটিয়া গেল। অতঃপর নিকটেই দূর সম্পর্কীয় এক কাকার বাড়িতে চলিয়া গেল।

দুঃখের বিষয়, কাহারো অনুগ্রহে কোনো কালে বাচিতে হয় নাই। বাল্যকাল হইতে সে বাপ-মায়ের আদর-সোহাগ পাইয়া আসিয়াছে। পরের বাড়িতে পরের মন যোগাইয়া চলা যে কী বিড়ম্বনা তা সে এতদিনে বুঝিতেছিল।

বাপ-মায়ের মৃত্যুকালেই গিরি খুব সেয়ানা হইয়া পড়িয়াছিল এবং যত দিন যাইতেছিল ততই যেন তাহার বিবাহ বয়স উতরিয়া যাইতেছিল। বিবাহ যে হইবে এইরূপ কোনো আশা সে দেখিতেছিল না।

এমন জীবন যে সম্ভব তা গিরি কোনোদিন ভাবে নাই। তাহার জীবনটা বাহির হইতে কোনো স্নেহ-মমতার অভাবে একেবারে নুইয়া পড়িতেছিল। তার সেই কাকার বাড়িতে সে একটা পরের মেয়ে ছাড়া কিছু নয়।

দুঃখ, বেদনা ও জীবনের এই দুরবস্থার মধ্যে গিরি মনে পড়িতে লাগিল খোরশেদের কথা। কত বড় একটা দুর্লঙ্ঘ্য বাধা তাহাদের মধ্যে বিদ্যমান, তাহা সে প্রথমে ভাবে নাই। খোরশেদ যুবক–সে যুবতী। তর্ক, ন্যায় ও বিচার ডিঙ্গাইয়া মন তাহার খোরশেদের কাছে নত হইয়া পড়িয়াছিল।

কিন্তু যখন সে বুঝিতে পারিল, তাই এই প্রণয়ের কোনো মীমাংসা হইবে না, তখন সে খোরশেদকে দূরে দূরে রাখিয়া নিজেকে সামলাইয়া লইল। খোরশেদ ইহাতে কতখানি বেদনা পাইয়াছিল তাহা সে জানে না।

গিরি এখন কেবল ভাবে–এই দুঃখ-বেদনার মাঝে কে বাঁচিতে পারে? খোরশেদের কথা তার মনে পড়ে। মাঝে মাঝে গিরি বলিয়া উঠে

কীসের ধর্ম?–এত অত্যাচার ও অবিচার যে ধর্মে প্রশ্রয় দেয় সে ধর্মকে অবলম্বন করে কে থাকতে পারে?

প্রথম প্রথম সে মুসলমানকে খুব ঘৃণা করিত। খোরশেদকে যে সে মনে স্থান দিয়াছিল মুসলমান রূপে নয়–হিন্দুরূপে। সে যে মুসলমান এ কথা মনে করিতে সে প্রথম প্রথম ভুলিয়া যাইত।

এই দুর্দিনে যখন সে বুঝিল তার বিবাহের কোনো সম্ভাবনাই নাই তখন তার মনে আসিতেছিল খোরশেদের কথা। সে এখন মুসলমানকে শ্রদ্ধার চোখে দেখিতে শিখিয়াছে। প্রেম, মায়া ও মমতাহীন হিন্দুধর্মকে আর সে জড়াইয়া থাকিতে পারিতেছে না। সে তো মানুষ।

খোরশেদ কি সত্যিই তাহাকে ভালবাসে? গিরি নূতন করিয়া ভাবিল–ভালবাসে।

এমনি করিয়া চিন্তায় চিন্তায় দিনগুলি কাটিয়া যাইতেছিল। তার চাচার মেয়েগুলির বিবাহ হইয়া গেল, তাহার হইল না। হইবার সম্ভাবনাও ছিল না। তবে চাচা প্রতিবেশীদের কথার বাণে অনেক সময় বিবাহের জন্য একটু ব্যস্ত হইয়া উঠিতেন। কিন্তু যখন অর্থের কথা ভাবিতে হইত তখন সকল উৎসাহ দমিয়া যাইত। গিরির বিবাহ দিবার তার ইচ্ছা ছিল না তা নয়–অবস্থা এমন হইয়া দাঁড়াইল যে সে ইচ্ছার কোনো মূল্য রহিল না।

চাচি গোপনে স্বামীকে কহিলেন–নিজের ঘাড়ে যখন এতগুলি মেয়ে তখন পরের মেয়ে ঘাড়ে লইবার সময় অগ্র-পশ্চাৎ ভেবে দেখা উচিত ছিল।

সে রাত্রে গিরির ঘুম হইতেছিল না। অনেক রাত্রে চোখ বুজিয়া সে শুনিল-বারান্দার অন্ধকারে চাচা স্ত্রীর সহিত তারই বিষয়ে কী যেন বলিতেছেন। সে উৎকর্ণ হইয়া শুনিল চাচা কহিলেন–“গিরির বিয়ে দেওয়া তো বড় বিপদ হল। তার বাবার কালের যে কয় বিঘা জমি আছে তাই বিক্রি করে ফেলি। তাতে ৭০০ টাকা হবে, বাকি আমরাই দেই।”

চাচি বিরক্তির সহিত কহিল–“গহনার দেড়টি হাজার টাকা কে দেবে?”

“তার মায়ের গহনা তো আছে। আর বেশি কী লাগবে?”

“ও মা!” বলিয়া চাচি বলিল–“সে গহনা না আমার ছোট মেয়ে নিশার গায়ে গিরি পরিয়ে দিয়েছিল? গহনার উপর নিশার মায়া হয়ে যায় নি? কি করে তার গা থেকে সেগুলি খসাবো?”

“নিশা ডবল ডবল গহনা দিয়ে কী করবে?”

“যে জিনিস নিশা অনেক দিন ধরে নিজের জিনিসের মতো করেই পরেছে–তার আর খসান যায় না। জমি বেচে ফেলার কথা বলছো তাই-বা কী করে সম্ভব? ধর গিরির বিয়ে হল–সেই যদি বিধবা হয়ে আমাদের ঘাড়ে ফিরে চাপে তাহলে উপায়?”

গিরি সব শুনিল। সে নড়িল না শুধু নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিল। একাকী ঘরের মাটির উপর একখানা ছিন্ন কাথার উপর সে শুইয়া ছিল। একবার সে জানালা দিয়ে আকাশের পানে তাকাইল। নিশীতে আজ সে তাহার বেদনা স্পষ্টভাবে বুঝিল। কেমন তার এই দুঃখ-বেদনা? মানুষের দুঃখ-বেদনা হয়, সে কয়দিনের জন্য! দুঃখের কি কোনো মীমাংসা নাই? সে আরও দুঃখকে জয় করিয়া সে কি পুরুষের মতো নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারে না? নারী বলিয়া একাকী আপনার মতো সে শুকাইয়া মরিবে? পরের জীবন নয়, শুধু নিজের জীবনকে বাঁচাইয়া রাখিবারও কি তার সামর্থ্য নাই?

গিরি ভাবিল–নিরাশা, বেদনা ও অবহেলার মাঝে সে তার এক মুহূর্তও সেখানে তিষ্ঠিতে পারে না।

গিরি যতই চিন্তা করিতে লাগিল খোরশেদ ততই অভিনব বেশে তার মনের ভিতর দেখা দিতে লাগিল। তার মনে হইল, খোরশেদের প্রতি সে অবিচার করিয়াছে। খোরশেদ মুসলমান–তাতে ক্ষতি কী? খোরশেদ তার অতি আপনারা। এ সংসারের দরদ বুঝিবার কেউ যদি থাকে তবে সে খোরশেদ। তার সমাজতার ধর্ম-কাহারো তার বেদনা বুঝিবার ক্ষমতা নাই।

.

সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ

সেদিন খোরশেদ অফিসেই ছিল। বড় দারোগা আবুল হোসেন মিয়া নিজের সেরেস্তায় বসিয়া ডাইরি লিখিতেছিলেন। এমন সময় একজন হিন্দু আসিয়া বড় দারোগার সম্মুখে দাঁড়াইল।

লোকটির দেহ কাঁপিতেছিল।

তাহার মাথায় একটি চুলও ছিল না। আবুল হোসেন মিয়া লোকটিকে উপবেশন করিতে কহিয়া সমাচার জিজ্ঞাসা করিলেন। সে কহিল, “আমার নাম রমণী। বাড়ি সোনাপুর। গতরাত্রে আমার একটা গহনার বাক্স চুরি গিয়াছে। আমার সর্বস্ব তাতে ছিল।” তাহার পর কাঁদিয়া কহিল–“আমার সর্বনাশ হয়েছে। শুনেছি হুজুর সদাশয় ব্যক্তি। দীন দুঃখীর প্রতি আপনার দয়া আছে। এ গরিবকে হুজুর রক্ষা না করলে আর উপায় নাই। গরিবের মা-বাপ আপনি।”

দারোগা সাহেব কহিলেন–আপনি কাকে সন্দেহ করেন?”

“কাকে সন্দেহ করবো? সে কথা বলতে আমার ভয় হয়।”

“কোনো ভয় নাই। অসঙ্কোচে সব কথা বলুন।”

“বাড়ির কাছে এক ঘর দুর্দান্ত মুসলমান আছে। জানেন তো বাবু, মুসলমানেরা ভয়ানক লোক। তাদের উপরেই আমার সন্দেহ হয়। সেই বেটারা ছাড়া আর কেউ এ কাজ করতে সাহস পায় নাই। দোহাই আপনার! তারা যেন কোনো কিছু শুনতে না পায়, তা হলে অর্থের সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রাণও যাবে।”

বেলা হইয়া গিয়াছিল বলিয়া আবুল হোসেন স্নান করতে চলিয়া গেলেন। যাইবার সময় বলিয়া গেলেন–“পার্শ্বের কামরায় এক বাবু বসে আছেন। সেখানে যেয়ে আপনি আপনার এজাহার দিন, তিনিই তদারকে যাবেন।”

খোরশেদ নবাবি কায়দায় আরাম কেদারায় বসিয়া আলবোলা টানিতেছিল। লোকটি ‘বাবু’ বলিয়া প্রায় এক ঘণ্টা দাঁড়াইয়া থাকিল। খোরশেদ কথা কহিল না। অনেকক্ষণ পরে

ওষ্ঠ ভিজাইয়া বিকৃত কণ্ঠে আবার সে কহিল বাবু।

নল হইতে মুখ তুলিয়া খোরশেদ অবজ্ঞার সহিত বলিল–“বারন্দায় বসে থাক, সুযোগ মতো ডাক দিব। হাতে কত কাজ আছে দেখতে পাও না?” আর কথা না বলিয়া লোকটি ভয়ে বারান্দায় জানালার নিচে বেড়া হেলান দিয়া বসিয়া পড়িল।

খোরশেদ কেদারায় বসিয়া তামাক খাইতেছিল। বড় দারোগা আহারের পর পান চিবাইতে চিবাইতে ঘুমাইয়া গিয়াছেন, তখনও উঠেন নাই। থানার সকলেই আহার করিয়া কেহ নিদ্রিত কেহ গল্প ও হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। খোরশেদ আগেই খাইয়া আসিয়াছিল।

বেলা তখন শেষ। রমণীমোহন তখনও খায় নাই। ক্ষুধা ও মানসিক বেদনায় নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া মাথায় রেশমি চাঁদরখানি পুঁজিয়া দিয়া সে ঝিমাইতেছিল।

সূর্যের ম্লান আলোক-বন্যায় থানা–ঘরের অঙ্গখানি ধৌত হইতেছিল। বেলা শেষের করুণ ছায়া মানুষের মনকে তখন সন্ধ্যাসঙ্গীত শুনাইবার আয়োজন করিতেছিল।

রমণীমোহন হঠাৎ তাহার মাথার একটা শীতল স্পর্শ অনুভব করিল। ছিঃ ছিঃ! কে যেন জানালা দিয়া তাহার মাথায় থুতু ফেলিয়াছে। রাম, রাম, বলিয়া জানালার পার্শ্বে বসিয়া আছে বলিয়া সে নিজের বুদ্ধিকে ধিক্কার দিতে দিতে সরিয়া বসিতেছিল, সহসা। স্কন্ধের উপর খানিকটা আগুন পড়িল। সে বাপরে বলিয়া উচ্চস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল। চীৎকার শুনিয়া বড় দারোগা সাহেব বাসা হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। সিপাইরা ঘটনাস্থলে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“বেটা, কী হয়েছে?

রমণী গ্রামে ভদ্রসন্তান বলিয়াই পরিচিত ছিল। এমন দুর্দশা ও অপমানের মধ্যে সে কখনও পড়ে নাই।

সে বড় দারোগাকে লক্ষ্য করিয়া কহিল–“দারোগা বাবুকে যেন আমার মাথায় থুতু ও হুঁকার জল ফেলিয়া দিয়াছে”।

খোরশেদ আরামে বসিয়া তখনও হুঁকা টানিতেছিল। বড় দারোগার সাড়া পাইয়া সে বাহিরে আসিয়া কহিল–“ওখানে যে একটা মানুষ বসিয়া আছে তা বুঝি নি। অত লক্ষ্য না করিয়া হুঁকার একটু জল ফেলিতে গিয়া টিকা ফেলিয়া দিয়াছিলাম। কাজটা বড় খারাপই হয়েছে।”

আজিজ মিয়া বিরক্ত হইয়া কহিলেন ”আপনি তো সাহেব, বেশ ভদ্রলোক। অফিসিয়াল ওয়ার্ক আপনি এইভাবে করছেন? এজাহার নেওয়া হয়েছে”?

খোরশেদ নিঃসঙ্কোচে রমণীর দিকে একটা রুক্ষ কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া কহিল–“হয়েছে”।

.

অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ

তদারক হইতে রমণীর ঘরণীকে তস্কর সাব্যস্ত করিয়া খোরশেদ অনেক রাত্রে নিস্তব্ধ বাসার প্রবেশপথে দাঁড়াইয়া ঝিকে ডাক দিল। ঝি ত্রস্তভাবে দরজার কাছে আসিয়া মৃদুভীত স্বরে কহিল–“বাবা! একটা মেয়ে আপনার সন্ধানে এসেছেন। তিনি বিশেষ কোনো কথা বল্লেন না। সঙ্গে কেউ ছিল না।”

খোরশেদ অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“কোথায় তিনি?–কোন্ সময়ে এসেছেন? আর কেউ কি জানতে পেরেছেন?

“না–সন্ধ্যার অন্ধকারে তিনি এসেছেন। বেহারারা দরজায় নামিয়ে দিয়ে চলে গেল। পেছন রাস্তা দিয়ে তারা এসছিল। ও বাসার ঝি আর খুকিরা এসেছিল, উনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন না।”

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া চেয়ারে উপবিষ্ট গিরির পাণ্ডু মুখচ্ছবির দিকে খোরশেদ নির্বাক স্থিরনেত্রে অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল।

গিরি উঠিল না–দাঁড়াইল না, কোনো কথা কহিল না। সে শুধু করুণ নেত্রে খোরশেদের দিকে তাকাইয়া রহিল।

খোরশেদ কাপড় খুলিল না। স্বেদবিন্দুগুলি শুভ্র ললাটে শুকাইয়া গেল। ঝি দরজার ধারে অগ্রসর হইতেছিল, খোরশেদ তাহাকে চলিয়া যাইতে কহিল। খোরশেদ জিজ্ঞাসা করিল–“গিরি–কেন আসিয়াছ?”

অকম্পিত স্বরে গভীর আবেগে গিরি কহিল–“তোমার কাছে আসিয়াছি।”

“স্ত্রীলোকের পক্ষে এরূপভাবে পথে বাহির হওয়া ঠিক নয়, তা জান?”

“না।”

“আমার কাছে কেন এসেছ?” গিরির কণ্ঠস্বর অকস্মাৎ রুদ্ধ হইয়া আসিল। সবই কী ভুল!

সে কহিল–“চন্দ্রকরোজ্জ্বল রজনীকে বুকে দাঁড়িয়ে তুমি যা বলেছিলে তা আমার মনে ছিল। সেই পুকুর ঘাটের পরিচয়টুকু তোমাকে জীবনের বড় আপন করে তুলেছিল। এসেছি আপন মানুষের কাছে–তোমার প্রশ্ন অতি নিষ্ঠুর। তুমি বিশ্বাসঘাতক নও তো?”

খোরশেদ বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিল–“সে কী কথা? তুমি কী বলছো?”

“গত জীবনের প্রণয় ও ভালবাসার কথা কি ভুলে গেছ! সংসারে আর আমার আপন। বলতে কেউ নাই। আমার দুঃখ ও বেদনার কোনো খবর তুমি নাও নাই। আমি তোমার কাছে এসেছি!”

“কেন?”

গিরির চক্ষু দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। সে অতি কণ্ঠে কহিল–“আমি তোমাকে ভালবেসেছি–যেমন তুমি আমাকে ভালবেসেছিলে।”

“আমি কখনও তোমাকে ভালবাসি নি!”

মিথ্যা কথা–তুমি আমার কৃপা ভিক্ষা করিছিলে–তুমি আমাকে ভালবেসে পাগল হয়েছিলে–মন তোমার দিকে গড়িয়ে পড়লেও আমি আমাকে রোধ করেছিলাম। আমি হিন্দু, তুমি মুসলমান!”।

“এখন তো তাই আছি–আমি যার জন্যে পাগল হয়েছিলাম সে কথা জীবনে কাকেও বলবো না। তোমাকে ভালবাসি বলেছিলাম, তার অর্থ-প্রতিশোধ।”

আবেগমাখা কণ্ঠে গিরি কহিল–“আমার বাল্যজীবনে হাসি-খেলার মতো তুমি এত বড় ভুলের দাগ কেটে দিয়েছিলে!”

আড়ষ্ঠ কণ্ঠ বাম হস্তে চাপিয়া ধরিয়া গিরি মাটির দিকে নত হইয়া কহিল–“ভগবান! আমার কী হবে” তাহার সমস্ত মুখখানি রক্তহীন কাগজের মতো হইয়া গেল। সম্মুখে প্রদীপের উজ্জ্বল আলোকে খোরশেদ ঠিক তেমনি ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার মানসিক ভাব তলাইয়া দেখিতে গিরি সাহস পাইল না।

খোরশেদ কহিল–কে তোমাকে এখানে আসতে বলেছে?

”আমার বিশ্বাস!”

“তোমার বিশ্বাস তোমাকে ভুল পথে টেনে এনেছে। তোমার সহিত ঠাট্টা ছাড়া আর কিছু করি নাই। গুরুতর ক্ষতি করা ছাড়া আমা: আর কোনো উদ্দেশ্যে ছিল না।” অনেকক্ষণ উভয়েই স্তব্ধ হইয়া রহিল। খোরশেদ সহজ কণ্ঠে কহিল–“তুমি আমাকে ভালবাস?”

“এখন বাসিতেছি। এখন তাতে কোনো ময়লা নাই। আগে ভীত হয়েছিলাম।”

“কারণ?”

“বাপ-মা মরে গেছেন। পরের কৃপার পাত্র হয়ে থাকতে হচ্ছিলো। তুমি তা জান। পরের বাড়ির বেদনা, অসম্মান ও ঔদাসীন্য আমাকে ভেঙ্গে ফেলেছে। তুমি অনেক কথাই জান।”

“জানি।”

নারীর স্বভাব আমাকে জানিয়ে দিয়েছে–“হিন্দু ধর্ম নারীর জন্য নয়। আমি মুসলমান হতে চাই। তুমি আমার আশ্রয় ও অবলম্বন।”

খোরশেদ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“ধর্ম পরিত্যাগ করতে চাও! তোমার সমাজে কু-সংস্কার ঢুকেছে তাই বলে কী তোমার ধর্ম মিথ্যা!”

“তা হলে হিন্দু হয়েই তোমায় আমি মেনে নিলাম?”

“মুসলমানের পক্ষে হিন্দুকে বিবাহ করা লজ্জাজনক। সমাজে আমার স্থান হবে না।”

“বাইরে মুসলমান হলেও ভিতরে ভিতরে হিন্দু থাকবো।”

“সেটা পাপ।”

“তা হলে আমি মুসলমান হব।”

“কোন্ বিশ্বাসে?”

“যে ধর্মে মানুষকে এমন করে হত্যা করবার অবাধ বিধান আছে, সে ধর্মে আমি কিছুতেই থাকতে চাই না। হিন্দুর নির্মম অত্যাচারে শত শত নারী পথে বেরিয়েছে।” গিরি আবেগে কাঁদিয়া কহিল–“ওগো, আমায় রক্ষা করে। হিন্দু ধর্মে মানুষ আর বেঁচে থাকতে পারে না। মুসলমান ধর্মে নতুন কিছু বিধান নাই। হিন্দুর লক্ষ্য ঈশ্বর, মহামানুষ মোহাম্মদের মহামানবতাকে স্বীকার করলে তার ক্ষতি হবে না। হিন্দু যদি মুসলমান হয় তা হলে তার। পতন হবে না।”

খোরশেদ সহজ স্পষ্ট স্বরে কহিল–“গিরি ক্ষমা কর। তোমাকে ঘরে স্থান দিলে আমার কলঙ্ক হবে। তুমি চলে যাও। মুসলমান হলেও তুমি হিন্দু। ছেলেমেয়ে তাদের সঙ্গে সামজ-সম্বন্ধ করতে ঘৃণা বোধ করবে। দেশময় কলঙ্ক হবে। যাও দেরি করো না।”

গিরির বুকের ভিতর কে যেন আগুন জ্বালিয়ে দিল। তাহার ইচ্ছা হইল সে তাহার দেহটাকে কাটিয়া ছিন্ন ভিন্ন করিয়া ফেলে। সে তাহার অবস্থার কথা ভাবিয়া শিহরিয়া উঠিল। তাহার আরও ইচ্ছা হইল, এই পৃথিবীটাকে সে চূর্ণ করিয়া ফেলে। মিথ্যা শাসন, মিথ্যা বিধানকে দলিয়া দেয়।

সহসা গত জীবনের সোনালি স্বপ্নকে ফিরাইয়া আনিয়া সে কহিল–“খোরশেদ! তুমি যদি আমায় ভালবাস, তাহলে পৃথিবী তোমার ও আমার কাছে সুন্দর হয়ে উঠবে। তোমার প্রতারণার কথা ভুলে যাও।”

খোরশেদ নিষ্ঠুরভাবে কহিল–“আমি তোমায় ভালবাসতে পারি না।”

“আমি হিন্দু, তাই ভালবাসতে ভয় পাও? কিন্তু জেনো, আমার ভিতরে এমন কিছু আছে যা সারা ত্রিভুবন খুঁজেও তুমি পাবে না।”

“প্রেমের জন্য যে ধর্ম পরিত্যাগ করতে চায় সে নরাধম। ইসলামের তুমি কি দেখেছ?”

“স্বীকার করি। খোরশেদ ক্ষমা করো। তুমি জানো–কেউ আমার নাই; সংসারের উপর একটা ভার ছাড়া আর কিছু নই। প্রথম জীবনে আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছিলাম–বোধ হয় বিবাহের জন্য নয়। মানুষের স্বভাবকে যে ধর্ম অস্বীকার করে সে ধর্ম ধর্মই নয়! তাই তোমার হাত ধরতে চাই। পর হয়েও কি তোমার কাছে থাকতে পারবো না?”

খোরশেদ কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া কহিল–“যেভাবে তুমি থাকতে চাও, সেটাও আপত্তিজনক। মুসলমান হলেও তোমায় আমি এভাবে আপন বলে স্বীকার করতে পারতাম না। তুমি যাও, তোমাকে যেতে হবে। থানার লোকে জানতে পারলে একটা অসন্তোষ সৃষ্টি হবে। ঊষার অনেক আগে তুমি চলে যাও। আমার চাকরি নষ্ট করো না”।

“যখন এসেছি তখন আর আমি কোথায় যাব? জাতি আমার নাই, জাত থাকলেও অবশ্য কোনো লাভ ছিল না। আবার বলি পরের মতো, বোনের মতো, অতিথি হয়েও কি তোমার কাছে থাকতে পারবো না? পৃথিবীর সব দুয়ারই কি আমার সম্মুখে রুদ্ধ হয়ে যাবে?”

খোরশেদ–“তা তো আপত্তিজনক।”

গিরি আর কিছু কহিল না–বিদায় প্রার্থনা করিল না। মৌন-নির্বাক হইয়া সে বাসা ঘরের উঠান অতিক্রম করিয়া পথে আসিয়া দাঁড়াইল।

.

উনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

রোজার মাসে খোরশেদের উচ্ছলতা অনেকটা কমিয়া গিয়াছে। সে অনেকটা সংযমী হইয়াছে।

।একটা বহুদিনের পুরানো ডাকাত সম্প্রতি রামগড় অঞ্চলে কোনো দুরভিসন্ধিতে গিয়াছে। এই সংবাদ পাইয়া খোরশেদ ছদ্মবেশে ট্রেন চড়িয়াছিল। পায়ে একজোড়া পামসু, পরনে পাজামা গায়ে মলমলের পিরহান, মাথায় একটা কিস্তি টুপি, হাতে বিলেতি ব্যাগ।

তাহাকে একজন পীরসাহেব বলিয়া মনে হইতেছিল। গাড়ির ভিতর অনেকে তাহার সঙ্গলাভের জন্য ব্যস্ত হইল। অনেক যুবক বৃদ্ধ তাহার পদধূলি গ্রহণ করিল।

খোরশেদ গম্ভীরভাবে সকলের কাছে স্বীয় ধর্মের মহিমা কীর্তন করিতেছিল। একজন, খ্রিস্টান সেখানে বসিয়াছিল। সে কহিল–“পীর সাহেব, ধর্ম সম্বন্ধে যাই বলেন, খ্রিস্টান ধর্মের মতো ধর্ম নাই। আপনি এবং আপনার শিষ্যবর্গ অন্ধকারে পড়ে আছেন। আমরা আলোক রাজ্যের সন্ধান পেয়েছি।”

খোরশেদ বিরক্ত হইয়া কহিল–“তুমি অন্ধ। খোদা তোমাকে নরকগামী করবেন।”

একজন ঠাকুর বলিলেন–“হিন্দু ধর্ম, মুসলমান ধর্ম–সবই এক, রাম রহিমে কোনো পার্থক্য নাই।”

খোরশেদ গম্ভীরভাবে কহিল–“কাফের ছাড়া অন্য কেহ এ কথা বলতে সাহস পায়।” রাত্রি ১০টা পর্যন্ত সে যাত্রীদের সহিত পীরের মতো বহু বচসা করিল।

যখন দেরাজপুর স্টেশনে ট্রেন থামিল তখন রাত্রি এগারটা। খোরশেদের গাড়িখানি। তখন প্রায় খালি। সে বিছানা পাতিয়া শুইবার চেষ্টা করিতেছিল। এমন সময় একটা যুবতী পার্শ্ব-প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিল। বাম হস্তে একটা ক্যাশবাক্স, দক্ষিণ হস্তে একটা টিফিন বাক্স লইয়া যুবতীর সঙ্গে একটা বৃদ্ধ উঠিল।

যুবতী কহিল–“কলিকাতা হতে রামগড় একেবারে কম দূর নয়। রোজার সময় আরও বেশি কষ্ট হয়।”

খোরশেদ কৌতূহলপর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“তোমরা কোথায় যাবে?”

বৃদ্ধা কহিল–“আপনার বেশ দেখে মনে হচ্ছে আপনি সংসারবিরাগী পুরুষ। তাড়াতাড়িতে পুরুষের গাড়িতে উঠে পড়েছি। রোজার মাসে আপনার ন্যায় ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হওয়া আমাদের নসিবে ছিল।”

পীর সাহেব কহিলেন–“তোমার মুনিব কোন গাড়িতে আছেন, দেখে উঠিয়ে দিয়ে গেলেই তো ভালো হতো।”

যুবতী নম্রভাবে অথচ লজ্জাহীনার মতো কহিল–“মৌলানা সাহেব, আমাদের কোনো মুনিব নাই। আপনি পবিত্র পুরুষ, আমাদের সঙ্গে কথা বল্লে আপনার পাপ হতে পারে। আমরা পতিতা।”

খোরশেদ বিছানা হইতে উঠিয়া বিস্ময়ে কহিল–“তোমরা পতিতা! মুখে রমজান মাসের মহিমা কীর্তন, এ তো কোনোকালে শুনি নি?”

যুবতী বলিল–“দয়া করে যখন কথা বলেছেন তখন উত্তর করলে খোদার কাছে পাপী হবো না।”

খোরশেদ অধিকতর বিস্ময়ে বাধা দিয়া কহিল–“তোমরা মুসলমান?”

যুবতী কহিল–“হ্যাঁ হুজুর, আমরা মুসলমান।”

খোরশেদ অবাক হইয়া গেল। বক্ষ তার অপরিসীম অকৃত্রিম দুঃখে ভাসিয়া যাইতেছিল। অস্পষ্ট বেদনা-ভরা স্বরে সে বলিয়া উঠিল–“ইসলামের প্রতি এই অবমাননা? ইসলাম তো নারীকে যথেষ্ট সুবিধা দিয়াছে। তবে এ পিপ কেন?”

খোরশেদ আর কোনো কথা কহিল না।

রাত্রি যখন দুইটা তখন বৃদ্ধা ও যুবতী পর দিবসের রোজার জন্য কিছু খাইয়া লইল। খোরশেদ সবই দেখিল।

০ ০ ০ ০

গন্তব্যস্থানে যাইবার আর বেশি দেরি ছিল না। স্টেশন হইতে নামিয়া সোজাসুজি থানায় যাইয়া যাহা করিবার তাহা করিতে হইবে।

খোরশেদ একটা চুরুট ধরাইয়া শেষ রাত্রের আমোদকে আরও বাড়াইয়া তুলিতেছিল, আর ভাবিতেছিল, ইসলামের মধ্যে পতিতা।

সহসা যুবতী জিজ্ঞাসা করিল–“হুজুর, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই। আমার ভুল হতে পারে।”

খোরশেদ কহিল,–“বল।”

যুবতী বলিল–“কয়েক বৎসর আগে রামপুর জেলার মহেন্দ্রনগরের থানায় ঠিক আপনার মতো দেখতে এক দারোগা ছিলেন। তিনি মুসলমানকে বড় ভালবাসতেন। সে বড় দুঃখের কথা। আমি তাকে পিতা বলে জানতাম। আকৃতির এমন আশ্চর্য সাদৃশ্য আর কোথাও দেখি নাই।”

খোরশেদ বলিয়া উঠিল–“আমিই সেই দারোগা।”

যুবতী সহসা আকুল আবেগে উন্মাদিনীর মতো খোরশেদের পা জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া উঠিল।

খোরশেদের মাথার ভিতর সহসা একটা অস্পষ্ট স্মৃতি জাগিয়া উঠিল। সে বিস্মিত সহানুভূতিতে কহিল–“কি কথা, খুলে বল দেখি বাপু।”

যুবতী বলিল, “আমি আজিজ মিঞার বৌ।” খোরশেদ সহসা একটা দারুণ অস্বচ্ছন্দতায় গাড়ির বেড়ার উপর পড়িয়া গেল।

যে রাত্রে আজিজ-পত্নী থানায় খোরশেদের সহিত দেখা করে, জমিদারদের প্ররোচনায় বরকন্দাজদের সাহায্যে সেই রাত্রেই তাহাকে সরাইয়া ফেলা হয়। এই কাজটা গোপনেই সিদ্ধ হইয়াছিল। ফলে জমিদারেরা নিষ্কণ্টক হইতে পারিয়াছিল।

খোরশেদ একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া যুবতাঁকে জিজ্ঞাসা করিল, “তাহলে কী করা যায়?”

যুবতী কহিল–“আপনি আমার পিতা। পিতার সঙ্গে পথের মাঝে দেখা হয়েছে, আর আমি আপনাকে ছাড়বো না। আমাকে রক্ষা করবেন। আমার গত সম্মান ফিরিয়ে দেবেন। তা হলেই আমি মানুষের মাঝে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে সাহস পাবো।”

খোরশেদ আগ্রহে কহিল–“তাহলে আর দেরি করে দরকার নেই তোমার সঙ্গে যে সব জিনিস আছে, এগুলি বাইরে ফেলে দাও। আমি আর টাউনে নামবো না, তোমায় নিয়ে। একেবারে দেশে যাবো। তোমার ভয় নাই, কোনো কথা আমা হতে প্রকাশ হবে না। আমাদের গ্রামে একটা শিল্প-বিদ্যালয় আছে, সেখানে বহু মেয়ে পড়ে এবং কাজ শেখে। তোমার সব খরচ আপাতত আমি বহন করবো। সেখানে কাজ শিখে সংসারে তুমি স্থান। করে নিতে পারবে।”

অসময়ে রায়হান সন্ধ্যাকালে একখানা পাল্কিসহ খোরশেদকে উপস্থিত হইতে দেখিয়া –বিস্মিত না হইয়া পারিলেন না। খোরশেদকে সম্ভাষণ জানাইয়া সহসা একটা কথা মনে করিয়া রায়হান উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন–“খোরশেদ গিরিকে পেয়েছ?”

খোরশেদ স্থিরভাবে কহিল–“না।”

ক্লান্ত খোরশেদ মাটির উপর বসিয়া পড়িয়া কহিল–“রায়হান ভাই, একটু বসতে চাই, কিছু থাকলে এনে দাও; আমাকে এখনই ফিরতে হবে! নইলে ডিসমিস্ হবার সম্ভাবনা।”

ঘরের ভিতরে চেয়ারখানি টানিয়া দিয়া রায়হান বলিলেন–“বল কী? বাড়ি যাবে না? গুরুতর কিছু হয়েছে নাকি? পাল্কির ভেতর ইনি কে? এ তাড়াতাড়ির অর্থ কী?”

খোরশেদ কহিল–“এর জন্য আমি এসেছি। এর কেউ নেই। তোমার স্কুলের ইনি একজন ছাত্রী।”

.

ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

আমেনা রায়হানকে কহিল–“ওস্তাদ সাহেব, এ-সব কী শুনছি?”

রায়াহন–“কোন্ সম্বন্ধে কথা বলছো?”

“আমার বেয়াদবি মাফ করবেন, জীবনে আপনাকে যতটা আপনার মনে করি এমন আর কাউকে মনে করি না। আমার বিশ্বাস আমার মনের কথা আপনাকে বল্লে আপনি আমাকে আরও অধিক করে ভালো জানবেন।”

“নিশ্চয়ই–আমি তোমার ওস্তাদ নই,আমি তোমার শ্রদ্ধেয় বন্ধু। কী কথা? নির্ভয়ে বলো!”

“আমার যেন কেমন বোধ হয়। এতকাল পরে আমি লজ্জাহীন ও ছোট বলিয়া প্রতিপন্ন হব। মনের ভাব ব্যক্ত করতে অনুমতি চাই।”

“তুমি কি কখনো আমার কাছে কোনো কথা বলতে সঙ্কোচ বোধ করেছ? ওস্তাদের কাছে কোনো কথা গোপন রাখতে নাই।”

“একটা অতীত কথা যা অত্যন্ত বেদনাব্যঞ্জক। আপনার নিকট হতে গোপন করে রেখেছি। সে অনেক দিন আগেকার কথা। সে কথা বলতে আমি পারি না। বর্তমানে একটা নূতন কথা এসে জুটেছে তাই বলতে চাই।”

“আচ্ছা, এখনকার যে কথা তাই বল।”

“আমাকে বিবাহ দিবার জন্য মা পীড়াপীড়ি কচ্ছেন। জিজ্ঞাসা করি, কে কে এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন? এই সমস্ত কথা মাকে জিজ্ঞাসা করতে সঙ্কোচ বোধ করি। আপনাকেও জিজ্ঞাসা করতাম না যদি আপনি অন্য কেউ হতেন।”

“আমেনা আমার প্রিয় শিষ্যা! এ কি তুমি অন্যায় মনে কর?”

“আপনি আমার ওস্তাদ। কেমন করে বলবো!”

“করি–খুবই অন্যায় মনে করি,–যিনি এই কার্যে লিপ্ত হবেন তিনি আমার মনের উপর খুবই অত্যাচার করবেন। তিনি অত্যাচারী, আমার কেউ নয়।”

“সে যদি অত্যাচারী হয় তবে সে আমি।”

আমেনার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। মুখ ফিরাইয়া কাপড়ে চোখ ঢাকিয়া আর্তকণ্ঠে সে কহিল–“গুরু গুরু, আমায় ক্ষমা করুন, আমায় অভয় দিন, বলিব কী? আমি যে ছাত্রী, আপনি যে আমার গুরু!”

রায়হান সংযতকণ্ঠে কহিলেন–“বল।”

আমেনা দুই হাত এক সঙ্গে তুলিয়া ঊর্ধ্ব দিকে চাহিয়া বলিল–“এমন কোনো কথা নাই যা ওস্তাদের কাছে বলা যায় না।”

আমেনার চক্ষু ঊর্ধ্ব দিকেই নিবদ্ধ রহিল। হাত দুখানি মাটির উপর নামাইয়া দিয়া সম্মুখদিকে একটু নত হইয়া শীতল রক্তহীন মুখে সে কহিল–ওগো গুরু, ওগো ওস্তাদ! তখনও আমার বিবাহ হয় নাই যখন আপনার পায়ে নিজের সবকিছু সুখ-দুঃখ রেখেছিলাম। একবারও কেউ আমায় জিজ্ঞাসা করলে না। আমার জীবন ও আত্মার গুরু আপনি আমার সুখ ও দুঃখে আপনার অনুভূতি আছে। একবার ভুল হয়েছে, আর যেন না হয়। আমি অবিবাহিতা থাকব।”

মুহূর্তে রায়হানের সম্মুখে একটা নূতন পৃথিবী ভাসিয়া উঠিল। যে কথা আমেনা কোনোকালে প্রকাশ করিতে চাহিয়াছিল না, কথা প্রসঙ্গে তাহা বলিয়া ফেলিয়া সে রায়হানকে স্তব্ধ করিয়া দিল। রায়হান বিচলিত হইয়া পড়িলেন। নিজকে সহজ ও স্বাভাবিক করিয়া রায়হান ধীর সংযত কণ্ঠে বলিলেন,–“প্রিয় আমেনা তুমি ভিতরে ভিতরে এতকিছু করে বসে আছে। তোমার সঙ্গে আমার কি সম্বন্ধ তা জান?”

“জানি, ভালো করে জানতাম ও জানি।”

রায়হানের দুই চক্ষু জলে ভরিয়া উঠিল। আর্দ্র কণ্ঠে রায়হান কহিলেন–“শিশু তুমি, বুঝে নিজেকে এত প্রশ্রয় দিয়েছ। ওস্তাদের প্রতি তোমার শ্রদ্ধা গভীর নহে বুঝলাম। কই, একদিনও তো তুমি আমায় জিজ্ঞাসা করো নাই?”

আমেনা কুণ্ঠায় কহিল–“জিজ্ঞাসা করি নাই”

”এমন কিছু নাই যা গুরুর কাছে জিজ্ঞাসা না করা যায়।”

“আমার অপরাধ হয়েছে?”

রায়হান বলিলন–“হ্যাঁ, তোমার অপরাধ হয়েছে।”

আমার ভুল ও সত্য আপনার কাছে নিবেদন করলাম–আপনার আজ্ঞা মাথায় পেতে নেবো। শাস্তি যদি দিতে হয় দিন।”

“তা হলে তুমি আমার যথার্থ ছাত্রী। হৃদয়ে অসীম আনন্দ লাভ করলাম।“ রায়হান দৃঢ়কণ্ঠে বলিলেন–“আমার আজ্ঞা মাথায় পেতে নেবে?”

আমেনা উঠিয়া দাঁড়াইয়া সহজভাবে কহিল–“আমার গুরু ভক্তি মিথ্যা নহে।”

“ভালো তাহলে তোমায় বিবাহ করতেই হবে। কোনো কথা বলতে পারবে না। কিছু ভাবতে পারবে না।”

“প্রতিজ্ঞা করলাম তাই করবো–কিন্তু একটা কথা; প্রতিবাদ নয়।”

“বল।”

একবার তো বিবাহ হয়েছিল–আর কেন? মা কি আমায় ভার মনে করেছেন? তাহলে আমি আপনার কাছে যাই। জীবন সেবার দ্বারা কাটিয়ে দেব। তাতেই চিত্তে সুখ ও সান্ত্বনা আসবে। বিশ্বে আমার কোথাও শান্তি নাই। আপনি ছাড়া কেউ আমায় চেনে না।

“আবদুল হামিদ শিক্ষিত যুবক। আত্মা তার অন্ধ নহে। সেখানে অত্যাচার ও অসম্মানের কোনো ভয় নাই। সে তোমায় চিনবে–তোমার মনে সেখানে মর্যাদা হবে।”

ওড়নার আঁচল ধরিয়া আমেনা দেয়ালে মক্কা শরীফের ছবির দিকে চাহিয়া বলিল–“আপনার আজ্ঞা এই”?

“হ্যাঁ।”

পায়ের দিকে মুখ করিয়া অনেকক্ষণ নীরব থাকিয়া আমেনা মৃদু স্বরে কহিল”এক মুহূর্তও ভাবতে দেবেন না? আপনার আজ্ঞা যেন আশীর্বাদ রূপে গ্রহণ করতে পারি।”

 ৩১-৩৫. আকাশে মেঘ করিয়াছে

একত্রিংশ পরিচ্ছেদ

আকাশে মেঘ করিয়াছে। নিবিড় ঘনকৃষ্ণ মেঘের স্তর সারা আকাশ ছাইয়া ফেলিয়াছিল।

করিমা ছাদের উপর দাঁড়াইয়া একাকী আকাশের দিকে চাহিয়া মেঘের খেলা দেখিতেছিল। ঝটিকা-প্রবাহ মেঘগুলিকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দিতেছিল।

দিবসের আলো ম্লান হইয়া আসিল। করিমা দেখিল–আকাশের বিরাট গম্ভীর মূর্তি বজ ও বিদ্যুতের লীলা। তার মনে হইল–জীবন যেন কিছু নয়। মানুষের সম্মুখে কি ভয়ানক পরীক্ষা! এই জড়দেহ চূর্ণ হইলে কী ক্ষতি! আত্মা, প্রেম ও মহত্ত্বের সহিত মিলাইয়া দেওয়াই ঠিক।

করিমা মনে মনে নিজকে প্রশ্ন করিল–জীবনের উদ্দেশ্য কী? কোথায় মানুষের শেষ? কোনোদিকে মানুষের গতি?

করিমা ভাবিল–জীবন কি হাহাকারময়? কোথায় মানুষের শান্তি? আকাশে-বাতাসে দুপুরে-নিশীথে কেবল বেদনার প্রতিধ্বনি উঠে।

সে আরও ভাবিল–এই পৃথিবীতে কত অন্তহীন নরনারী! সৃষ্টির প্রথম হইতে অনন্ত মানুষের ধারা বহিয়া চলিয়াছে–অনন্ত যুবক-যুবতী প্রেম ও হাসির আনন্দে বাঁচিয়া থাকে–তার পর তারা চলিয়া যায়।

তার মনে হইল–মানুষের দুঃখ অন্যায় ও অজ্ঞানতায়। করিমা আবার ভাবিল–অন্যায় করিয়া মানুষ কী করিয়া বাঁচে? মানুষে মানুষে পার্থক্য কী? একটা মানুষের বেদনা আর একটা মানুষের মনে সমানভাবে বাজে না কেন?–মানুষের সুখ কোথায়? কেমন করিয়া এই লক্ষ্য মানুষকে সুখী করা যায়?

মানুষ কেন পাপ করে? পাপে মানুষ কেমন করিয়া শান্তি পায়? পরকে আঘাত করে কেমন করিয়া মানুষ কাল কাটায়? কেমন করিয়া সে হাসে? কী বিস্ময়!

কত জননীর বুক ভাঙ্গিয়া অনন্ত শিশু আকাশে বাতাসে মিশিয়া আছে। কত প্রেমিক প্রেমিকা কোনো অনন্তে ভাসিয়া চলিয়া গিয়াছে।

তার মনে হইল–মানুষের সুখ কেবল পুণ্যে ও জ্ঞানে। করিমা আবার ভাবিল–এই ভীম প্রকৃতির মাঝখানে দাঁড়াইয়া মানুষ তার দীনতা বুঝুক। আত্মা তার গোপন কথার সাহিত পরিচিত হউক।

উদ্দাম বাতাস অবগুণ্ঠিতা করিমার চোখে-মুখে আসিয়া লাগিতে ছিল। অসংযত অঞ্চলখানি করিমা গায়ের সঙ্গে আঁটিয়া লইল।

দূর পূর্ব-আকাশের মেঘগুলি হিমশীতল বাতাসের সহিত যুঝিয়া যুঝিয়া সরিয়া যাইতেছিল। এই উদ্দাম ও ভয়াবহ প্রকৃতির চাঞ্চল্য করিমার কানের কাছে কি যেন বলিয়া যায়–কাহার সন্ধান যেন দিয়া যায়। তার মন যেন কেমন হইয়া উঠে। একটা দারুণ সীমাহীন হাহাকার ও বেদনা তার মনকে বিব্রত করিয়া তুলে। সে খানিক কাঁদিতে চায়। মৃত্যুর ভিতর দিয়া সে এক তৃপ্তির রাজ্যে চলিয়া যাইতে ইচ্ছা করে। ঊর্ধ্বে আরো সে চায় মহাকাশে বিদ্যুতের মতো সে ছুটিয়া খেলিয়া বেড়ায়।

সন্ধ্যার ছায়া করিমার চক্ষদ্বয়কে আরও ছায়াময় করিয়া তুলিল। করিমা ছাদ হইতে ধীরে ধীরে নিচে নামিল।

.

সেদিন বাতাসের বিরাম ছিল না। শেষ রাত্রে করিমা বাহিরে উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন মেঘের অন্তরালে তারাগুলি অস্পষ্ট হইয়া জ্বলিতেছিল।

বাতাস সুপ্ত পৃথিবীকে যেন মথিত করিয়া দিতেছিল।

করিমা ধীরে ধীরে ছাদের উপর উঠিল। অমলিন মেঘের ভিতর দিয়া শেষরাত্রের স্নান আলো ফুটিয়া উঠিয়াছিল। অস্পষ্ট আলোস্তরের উপর দিয়া করিমা দূর প্রান্তরেখার দিকে চাহিয়া রহিল।

মেঘগুলি ধীরে ধীরে আবার জমাট বাঁধিতেছিল?

অব্যক্ত বেদনায় করিমার আত্মাখানি কাঁদিতে লাগিল। তার মনে হইতেছিল, কিছু না, এ পৃথিবীর সবই নশ্বর! মন তাহার এই প্রকৃতির উন্মাদনার ভিতর দিয়া কাহার পানে ছুটিতে লাগিল। কোথায় তিনি?

আকাশ হইতে বৃষ্টি ঝরিতেছিল। করিমা ধীরে ধীরে অগ্রসর হইতে লাগিল। বেশি দূর নহে। বাম পার্শ্বে রায়াহনের দোকান।

করিমা দোকান-ঘরের সম্মুখে যাইয়া দাঁড়াইল। পাথরের মূর্তির মতো বৃষ্টি ও বাতাসের মধ্যে প্রায় অর্ধঘণ্টা করিমা দাঁড়াইয়া রহিল।

অস্ফুট মৃদুস্বরে কপালে হাত উঠাইয়া করুণ বেদনায় বলিয়া উঠিল–ওগো প্রিয়তম–তোমায় সালাম! তাহার পর সে ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে ফিরিয়া গেল।

.

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

দিল্লী হইতে একখণ্ড পত্র পাইয়া রায়হান দুঃখ ও বেদানয় একেবারে নুইয়া পড়িলেন। পত্র পড়িয়া রায়হান অরোধ করিতে পারিলেন না।

এখখানা মানি অর্ডারের ফরম ভর্তি করিয়া রায়হান তখনই দিল্লীর ঠিকানায় একখানা দীর্ঘ পত্র লিখিলেন। পত্রখানি এই রূপ।

ওদেমপুর
প্রিয় দিদি,

তোমার পত্র আমাকে স্তম্ভিত করিয়া দিয়াছে। হর্ষ ও বিষাদ চিত্ত গভীরভাবে স্পর্শ। করিয়াছে। যাহা আশা করি নাই, যাহা ভাবিতেও শিহরিয়া উঠি তাহা প্রত্যক্ষ করিলাম।

এই করুণ ও দুঃখ পূর্ণ ঘটনায় কী লিখিব, কী কহিব, কিছুই বুঝিতেছি না।

আমি আসিতেছি–খবর যখন দিয়াছ তখন আর ভয় নাই। প্রথমে যদি আমাকে তোমার সন্ধান জানিবার সুযোগ দিতে তাহা হইলে এত বিভ্রাট ও লাঞ্ছনার মধ্যে পড়িতে না। ব্যথিতের সেবায় শেষ কপর্দক পর্যন্ত ব্যয় করা আমার জীবনের উদ্দেশ্য। জাতি তোমার যায় নাই। যারা তোমার উপর অত্যাচার করিয়াছে–তাহাদের জাতি গিয়াছে। কুড়িটি টাকা পাঠাইলাম।

রায়হান তখনই পত্রখানি হাতে লইয়া ডাকঘরের দিকে গেলেন।

পত্র ডাকে দিয়া ফিরিয়া আসিবার সময় পথে তাহার দেখা হইল নগেন ঘোষের সহিত।

রায়হান সাদরে জিজ্ঞাসা করিলেন–“কি খুড়ো, কোথায় গিয়েছিলেন?

নগেন আগ্রহে বলিলেন–“এই যে বাবা রায়হান, আপনাকেই খুঁজছি–একটি বিশেষ কথা। তিলিপাড়া হয়ে আসছি।”

রায়হান বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন–“কি কথা খুড়ো?” পার্শ্বে ছায়াময় বৃক্ষতলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া নগেন কহিলেন–“তা হলে এই গাছতলায় একটু বসা যাক”।

রায়হান দ্বিরুক্তি না করিয়া নগেনের সহিত গাছের নিচে দূর্বার উপর উপবেশন করিলেন।

অনেকক্ষণ নিস্তদ্ধ থাকিয়ে নগেন কহিলেন–“আপনি সাধারণ মুসলমান নন! গ্রামের মধ্যে আপনি একজন ভদ্রলোক, তাই বলতে সাহস করছি।”

রায়হান বলিলেন–“মুসলমানের আবার সাধারণ অসাধারণ কী? সব মুসলমানই ভাই ভাই। গ্রামের মধ্যে শুধু আমিই কি ভদ্রলোক?”

নগের সঙ্কোচের সহিত কহিল–“আপনি খুব জ্ঞানী”।

রায়াহন বাধা দিয়া বলিলেন–“আমার চেয়ে সংসারে অনেক কিছু বেশি আপনি দেখেছেন। সুতরাং আমার চেয়ে জ্ঞানী আপনি বেশি।”

নগেন হাসিয়া কহিলেন–“কোরবানির আর কদিন বাকি?”

”আর মাত্র তিন দিন।”

“এটা বুঝি আপনাদের খুব বড় পর্ব?”

“পর্ব বলা যায় না। এ-দিন বড় ভয়ানক এবং পবিত্র।”

“কেমন?”

“মহাপুরুষ ইব্রাহিম খোদার জন্য ঐদিনের পুত্রকে কোরবানি করতে আদিষ্ট হইয়াছিলেন।“

নগেন ভীত বিস্ময়ে মাথা উঁচু করিয়া বরিলেন–“বটে,তা হলে তো বড় ভয়ানক কথা।”

রায়হান শান্তভাবে কহিলেন–“হ্যাঁ, খুবই ভয়ানক কথা?”

”খোদার জন্য পুত্রকে কোরবানি করবার অর্থ কি?”

রায়হান বলিলেন–“ন্যায় ও সত্য ছাড়া খোদা আর কিছু নয়। ন্যায়ের জন্য পুত্রকে কেন, নিজকে পর্যন্ত বিশ্বের মহামানুষেরা কোরবানি দিয়ে থাকেন। সব ধর্মেই বলে সত্য ও ন্যায়ের জন্য কষ্ট স্বীকার করাই আত্মার লক্ষ্য। এ কথা জানিয়ে দেবার জন্য খোদা প্রত্যেক মুসলানকে কোরবানি করতে আদেশ দিয়েছেন। কোরবানি মুসলমানের শ্রেষ্ট ধর্ম। পৃথিবীর সকল সভ্য জাতি কার্যত ইসলামের এই আদেশ পালন করে থাকেন। আপনাদের মহাশক্তির সম্মুখে জীব ও পুরোনো কালের নরবলির সহিত ইহার সম্বন্ধ আছে কি?”

“আমি তা জানি নে বাবা। পণ্ডিতেরা জানে।”

“আমি অনেক ঠাকুরকে বলির অর্থ জিজ্ঞাসা করেছি।”

বলির অর্থের কথা আলোচনা না করিয়া নগেন বলিলেন–“আচ্ছা, এই পর্বের আর এক নাম বুঝি বকুরিদ? বরি না কেটে আপনারা গরু কেন কাটেন?”

রায়হান কহিলেন–“গরু জবেহ অথবা কোরবানি করা হয়। গরু কাটা হয় বলতে নাই। বকর আরবি কথা। শব্দটির অর্থ ছাগ নহে।”

নগেন একটু রুষ্ট হইয়া বলিলেন–“গরু কোরবানি করে হিন্দুদের মনে ব্যথা দেবার দরকার কী?”

এই সমস্ত আলোচনার জন্য রায়হান প্রস্তুত ছিলেন না। বিস্ময়ে রায়হান বলিলেন–“আপনারা তো আর কোরবানি করেন না। গো উৎসর্গে যদি পাপ হয়–তবে সে আমাদেরই হয়। গরুর মৃত্যু দেখে বিরক্ত হন! আমরা আপনাদের প্রতিমা দেখে যথেষ্ট বিরক্ত হতে পারি। মুসলমানের বিশ্বাস প্রতিমা পূজায় মানুষের আত্মা দৃষ্টিহীন হয় এবং মৃত্যু লাভ করে। চোখের সামনে মানুষের এই মৃত্যু মুসলমানকে দিবারাত্রি দেখতে হয়। মানুষকে মৃত্যু ও কুসংস্কার হতে বাঁচাবার জন্য মুসলমানের অস্তিত্ব। প্রতিমা পূজায় তার জীবনকে মিথ্যা করে দেওয়া হয়, তবুও সে অধীর-অত্যাচারী হয় না।”

একটু নীরব থাকিয়া রায়হান কঠিন স্বরে কহিলেন–“বড় বড় শহরে গো-হত্যা হয় তাতে কিছু বলা হয় না–পল্লীর নির্জন কুটির পার্শ্বে মুসলমান বাদ্য না বাজিয়ে নীরবে ধর্ম পালন করে তা ভেবে আপনাদের দরকার কী? গরু তো প্রাচীনকালে হিন্দুরাও খেতেন। গরু খাওযা শরীরের দিক দিয়া ক্ষতিজনক কিংবা পার্থিব কোনো স্বার্থসিদ্ধির অন্তরায় এর ভিতরে যদি কিছু সত্য থাকে তবে তাহা ধীরভাবে সকলের মাঝে প্রচার করলেই তো হয়। জোর করে মানুষের দ্বারা কি কোনো কাজ করান যায়?”

বিরক্তির সহিত রায়হান আবার বলিলেন–“কাহারও ধর্মকার্যে বাধা দেওয়া একেবারে অযৌক্তিক। একে অন্যের দাবি স্বীকার করি না বলেই ইংরেজ জাতিকে মধ্যস্থ মানতে হয়েছে।”

নগেন দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–“হুঁ।”

.

ত্রয়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

ঈদের নামাজ পড়িয়া রায়হান মুরব্বীদিগকে যথারীতি সম্মান জানাইয়া যখন আমেনাকে দেখিতে গেলেন, তখন আমেনার সঙ্গে তাহার স্বামী হামিদও রায়হানের পদচুম্বন করিল।

রায়হান বাধা দিয়া হামিদের হাত ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিলেন–“পাগল নাকি? এসব পুরোনো দস্তুর আমি ভালবাসি না।”

হামিদ হাসিয়া বলিলেন–“স্ত্রীর ওস্তাদ। যার কৃপায় এই রহলাভ করেছি তাকে সম্মান জানাব না?”

রায়হান উপবেশন করিয়া বলিলেন–“পদচুম্বন করা জঘন্য ব্যাপার। মানুষের ব্যক্তিত্বের উপর অত্যাচার আমি পছন্দ করি না।”

আমেনা কহিলেন–“মায়ের কাছে যেতে পাল্লাম না। মনে কষ্ট হচ্ছে। হয়তো মা কত ব্যথা পাচ্ছে।”

রায়হান বলিলেন–“এ কোনো কথা নয়। তোমার সুখেই তোমার মার সুখ। তাঁর কি স্বতন্ত্র সুখ আছে? তোমার মা সাধারণ শ্রেণীর স্ত্রীলোক নন। ঈদের দিন মায়ের কাছে না যেয়ে যে স্বামীর সুখ বর্ধন করতে ব্যস্ত আছ এতেই তার সুখ।”

একটা লোক আসিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে সংবাদ দিল–“কোরবানি নিয়ে হিন্দু মুসলমানে দাঙ্গা বেধেছে। আপনারা আসুন।”

সহসা রায়হানের মুখ কাল হইয়া উঠিল। মৃদুস্বরে তিনি কহিলেন–“হিন্দু মুসলমানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমাদের দুই জাতির কী হবে বলতে পারি না।”

হামিদ–হিন্দুর উপর বিশ্বাস আমি হারাচ্ছি। একটা মহাজাতির বিশ্বাস ও দাবিকে উড়িয়ে দেবার কী উৎকট আয়োজন!”

উভয়ে বিলম্ব করা সমীচীন নহে ভাবিয়া তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলাভিমুখে রওয়ানা হইলেন। হামিদ বলিলেন–“হিন্দুদের এই অন্যায় প্রতিবাদের কথা আগে যদি জানা যেতো তা হলে আইনের সাহায্যে তাহাদের দাম্ভিকতা অনেকটা রোধ করা যেতো। কী বিচিত্র! এতদিন তাদের ধর্মভাবের উদ্রেক হয় নাই!”

দূর হইতেই শোরগোল শোনা যাইতেছিল। রায়হান কথা কহিলেন না। দক্ষিণ হস্তে বুকখানি চাপিয়া ধরিয়া দ্রুত চলিতে লাগিলেন।

পল্লীর দক্ষিণপ্রান্তে একটা ছোট মাঠে উত্তেজিত হিন্দু-মুসলমান ভীষণভাবে এ উহাকে আক্রমণ করিতেছিল।

দারুণ উদ্বেগে জনতার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া রায়হান দেখিলন, ভূতলশায়ী একটা মানুষের মাথা দিয়া রক্তধারা ছুটিতেছে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তাহার মানব দুঃখকাতর হৃদয় কাঁদিয়া উঠিল। রায়হান উন্মাদের ন্যায় লোকটিকে বাঁচাইবার জন্য ছুটিলেন। হামিদ দুই হাত দিয়া রায়হানকে বুকের সহিত জড়াইয়া বাধা দিয়া কহিলেন–“এই উত্তেজিত জনসঙ্গের মধ্যে যাবেন না।”

রায়হান বিপুল বলে হামিদকে সরাইয়া ফেলিয়া ভীষণ রক্তবন্যার মধ্যে প্রবেশ করিলেন। আহত মানুষটিকে বুকের মধ্যে লুকাইয়া রায়হান উচ্চেঃস্বরে কহিলেন–“ওগো মুসলমান ভাইগণ! হিন্দু হলেও সে যে আমাদের প্রতিবেশী! আমাদের সুখ-দুঃখের সহচর। আর মেরো না। যদি মারতে হয় আমার মাথায় মার।”

মুসলমানেরা স্তব্ধ হইয়া মুহূর্তের জন্য দমিয়া গেল। সুযোগ পাইয়া সহসা আহত যুবকটি রায়হানের বুকের ভিতর হইতে উঠিয়া দাঁড়াইল।

হাতে তার তীক্ষ্ণধার দীর্ঘ বল্লম-মূর্তি ভয়াবহ। সে তখন জ্ঞানশূন্য হইয়া গিয়াছিল। তাহার চিন্তা করিবার সময় ছিল না। উন্মত্ত অধীর-পিশাচের মতো সে রায়হানের বুকের ভিতর বল্লম চালাইয়া দিল। রায়হান তখন বলিতেছিলেন–“রমেশ, ভয় নাই, তোমায় বাঁচিয়েছি”–আর কিছু বলা হইল না। রায়হান মূৰ্ছিত হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেলেন।

হামিদের মাথায় যদি অকস্মাৎ বজ্রাঘাত হইত তাহা হইলে সে হয়তো তত উদ্বেলিত হইত না, যেমন সে হইল–এই অতি আকস্মিক হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখিয়া।

ক্রোধে-দুঃখে সহসা হামিদের শিরায় শিরায় অসুরের শক্তি খেলিয়া গেল। হামিদ মাতা-পিতা-স্ত্রী-বন্ধু সব কথা ভুলিয়া গেল। ব্যাঘের আস্ফালনে সে কহিল–“যাও সকলে, আর কেন? কোনো হিন্দুর দেহ যেন আজ আর মাথায় না থাকে।” হামিদ নিজ হস্তগুলি চালাইতে আরম্ভ করিল।

রক্ত ও শবদেহে ক্ষুদ্র ময়দানখানি আচ্ছন্ন হইয়া গেল। অতঃপর আহত রায়হানকে হামিদ ও অন্যান্য মুসলমানগণ স্কন্ধে করিয়া অশ্রু বিসর্জন করিতে করিতে প্রত্যাগমন করিলেন। রায়হানের জীবনের কোনো আশা ছিল না। ধীরে ধীরে নিশ্বাস বহিতেছিল মাত্র।

.

চতুত্রিংশ পরিচ্ছেদ

রায়হান তিন দিন পর যখন চৈতন্য লাভ করিলেন তখন তাঁহার পার্শ্বে আমেনা, হামিদ, আমেনার মা নফিসা এবং রায়হানের চাচি। রায়হানের চাচি অশ্রু বিমোচন করিতেছিলেন।

যথাসময়ে ডাক্তার আসিয়াছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে বল্লম হৃদপিণ্ড বা ফুসফুস ভেদ করে নাই। অত্যধিক রক্তস্রাবে রায়হান অত্যন্ত দুর্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন। ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, ১৫ দিনের ভিতর কী হয় ঠিক বলতে পারি না ঈশ্বরের অনুগ্রহ হইলে রোগী বাঁচবে। তবে তিন মাসের ভিতর রোগী বিছানা ছাড়িয়া উঠিতে পারিবে না।

রায়হান চক্ষু মেলিয়া বলিলেন–“একটু গরম দুধ লইয়া আসুন”।

দুধ পান করিয়া অপেক্ষাকৃত সুস্থ হইয়া কহিলেন–“এত চিন্তার কারণ কী? মানুষকে বিপদের ভিতর দিয়াই বেঁচে থাকতে হয়। ব্যস্ত হবেন না।”

অতঃপর হামিদের দিকে মুখ ফিরাইয়া কহিলেন–“একটা কথা বলি। কী কী ঘটনা ঘটেছে একটু বল। রমেশ কি বেঁচে আছে? বেচারা না বুঝে আমাকে আঘাত করেছিল।”

হামিদ রায়হানের আরো পার্শ্বে আসিয়া রুক্ষস্বরে কহিল–“রমেশের কথা জিজ্ঞাসা কচ্ছেন? যে নরপিশাচ আপনার বুকে ছুরি হেনেছিল–সে শয়তানের কথা কেন? তার মতো হতভাগ্য কে আছে? প্রাণের মমতা না করে আপনি তাকে বাঁচালেন–অথচ আপনাকেই সে হত্যা করতে উদ্যত হল! মানুষ যে এত বড় নিমকহারাম থাকতে পারে তা জানতাম না।” একটু থামিয়া হামিদ পুনরায় কহিল–“হিন্দুকে আপনি তত ঘৃণা করেন না–তার ফল হাতে হাতে পেলেন। আমিও হিন্দুকে ঘৃণা করতাম না–কিন্তু এই ঘটনার পর আমার মত একেবারে বদলে গিয়েছে। কী ভয়ানক জাতি হিন্দু। ইহাদের কাহারও স্পর্শে কোনো মুসলমানের আসা উচিত নয়।”

রায়হান দুর্বলকণ্ঠে আবার জিজ্ঞাসা করিলেন–“রমেশ বেঁচে আছে”?

হামিদ রুষ্ট অবজ্ঞায় বলিলেন–“আছে। আপনার উপর আঘাত করেই সে শৃগালের মতো মুখ ঢেকে পলায়ন করে। সমুচিত শিক্ষা দিবার জন্য তাকে ধরতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। ধরতে পারা যায় নাই। শুনেছি, সে সেই দিনই কলিকাতায় পলায়ন করেছে।”

রায়হান–গোলমাল থেমে গিয়েছে তো?

হামিদ দৃপ্ত হইয়া কহিল–“গোলমাল থামবে? প্রত্যেক হিন্দুর মাথা যেদিন কাটা পড়বে সেই দিন গোলমাল থামবে। কী পৈশাচিক ব্যবহার! মুসলমানের উপর কী অন্যায় অত্যাচার! তাহাদিগকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েছি। আরও দিব।”

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া রায়হান মৃদুভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন–“আমার জ্ঞানশূন্য হবার পর গোলমাল কি আরও বেড়েছিল?”

হামিদ বলিলেন–“সেদিন ১৭ জন হিন্দুকে হত্যা করেছি। একজনের ছাড়া আর কারো মৃতদেহ ধরা পড়ে নাই।”

একটা দুর্দম্য বেদনা রায়হানের বুর্কখানাকে কাঁপাইয়া গেল। কোনোপ্রকার মানসিক ক্লান্তি শরীরের পক্ষে হানিজনক ভাবিয়া একটা দীর্ঘশ্বাসে রায়হান তাঁহার সমস্ত বেদানাটুকু বুকের ভিতর হইতে ঠেলিয়া ফেলিতে চেষ্টা করিলেন।

শারীরিক এই অসুস্থতার ভিতর হামিদের এই সহানুভূতিও নিঃস্বার্থ সেবার মূলে রায়হান কেমন করিয়া বলিলেন–হামিদ, তুমি অন্যায় করেছ!

মৌন বেদনায় রায়হান পার্শ্ব ফিরিয়া শুইলেন। . আমেনা ধীরে ধীরে বাতাস করিতেছিল। এমন সময় পাল্কি হইতে অবতরণ করিয়া করিমা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

অভ্যাস মতো রায়হান উপস্থিত অক্ষমতা বিস্মৃত হইয়া উঠিয়া বসিতেছিলেন। করিমা ক্ষিপ্রভাবে রায়হানকে নিরস্ত করিয়া কহিলেন–“আপনার শারীরিক অবস্থার কথা আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন। একটুও নড়বেন না।”

রায়হান লজ্জিত হইয়া বলিলেন–“ক্ষমা করবেন, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।”

অতঃপর আমেনাকে বলিলেন–“থাক বু আর দরকার নেই। তুমি আর কত খাটবে? তোমার শরীর খারাপ হবে। চাচি তো আছেন?”

নফিসা বলিলেন–“তুমি আর সে সব কথা ভেবো না, বাপু। মেয়েমানুষের কষ্ট করাতেই সুখ। সেবাতে তাদের আনন্দ।”

রায়হান অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়ে মৃদুস্বরে কহিলেন–“করিম! কতদিন আমাকে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে? বিদ্যালয়ের সব কাজ সেরে নেওয়া আপনার একার পক্ষে খুবই কঠিন হবে। আমেনা। শুন, সহরবানু তো লেখাপড়ায় খুব উন্নতি করেছে। পড়ার কাজ তাদের হাতে দিয়ে আপনি শুধু সেলাই শিক্ষা দিতে থাকুন। এখানে যে আয় হবে তাতে যদি মেয়েদের বোর্ডিং খরচ না পোষায় তা হলে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। শান্তিপুর থেকে সে ছেলেটি শীঘ্রই কাপড় তৈরি করা শিখে আসবে।”

করিমা ব্যথিত সুরে বলিলেন–“এখন আপনার কোনো কথা না বলাই ভালো। এখন আপনার নিরবচ্ছিন্ন শারীরিক ও মানষিক বিশ্রাম আবশ্যক।”

“এই সমস্ত কথা ভাবিয়াই আমি সুস্থ হব” বলিয়া রায়হান চুপ করিলেন।

.

পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ

দীর্ঘ চার মাস পর বিছানা হইতে উঠিয়া রায়হান হামিদকে যথেষ্ট আশ্বাস দিয়া দিল্লী চলিয়া গিয়াছেন। বলিয়া গিয়াছেন, যত শীঘ্র সম্ভব ফিরিয়া আসিবেন। রায়হানের দিল্লী যাইবার পর নির্জন নদীর ধারে আঁধারে দারোগা সাহেব একদিন হামিদ মিয়াকে বলিতেছেন–“আপনার বাঁচবার আশা নাই।”

হামিদ জড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন–“কোনো আশা নাই দারোগা সাহেব?” হয় দ্বীপান্তর, না হয় ফাঁসি।”

“না, কোনো আশা নাই। আইনের বই খুলে দেখুন। হয় দ্বীপান্তর, না হয় ফাঁসি।”

আঁধারে হামিদের শুষ্ক রক্তহীন মুখখানি দেখা যাইতেছিল না। ভবিষ্যতের বিভীসিকাময় মরণদৃশ্য তাহার বুকখানি স্পন্দিত করিয়া গেল।

ভাব ও করুণাহীন কঠিনতায় অভ্যস্ত দারোগাবাবু কহিলেন–“আপনার উৎসাহে কুড়িজন মানুষ খুন হয়েছে। আপনি নিজে পাঁচ জনকে হত্যা করেছেন। আইনকে অমান্য করতে কেউ পারে না।”

“আমি মুসলমান মুসলমানের উপকার করা কি আপনার কর্তব্য নহে? এই হত্যাকাণ্ডের মূল হিন্দুরা, তারা যদি মুসলমানদিগকে কোরবানি করতে বাধা না দিত তা হলে এ-ঘটনা কখনও ঘটত না।”

“মানুষ হত্যা কোনো রকমে সমর্থন করা যায় না।”

হামিদ স্তব্ধ হইয়া একবার আকাশের দিকে চাহিল। কঠিন ভায়বাহ মৃত্যুকে সে কেমন করিয়া আলিঙ্গন করিবে? মৃত্যু যে এত ভয়ানক তাহা সে কল্পনায়ও আনিতে পারে নাই। কতবার সে মৃত্যুকে উপহাস করিয়াছে। কর্তব্য ও মহত্ত্বের অনুরোধে মরণকে সে মহিমা ভরা বলিয়া সকলের কাছে ঘোষণা করিয়াছে। কিন্তু সে আজ নিজকে নির্দোষ মনে করিয়াও মৃত্যুকে উপহাস করিতে পারিতেছে না। সে বড় বিপন্ন।

সে যদি অপরাধীই হল তবে তাহার মরণে এত চাঞ্চল্য কেন? সে অপরাধকে কী দিয়া ঢাকিবে? দীর্ঘ পার্থিব জীবন অনুতাপ-বেদনার কঠিন আঘাতে সে কত রাঙা হইয়া উঠিবে! জীবনে তার অপরাধের ভার কমিবে কী?

এই আলো ও গানে-ভরা পৃথিবীকে কিনিয়া রাখিবার জন্য সে সব দিবে। সে পথের ফকির হইবে। সে আবার ভাবিল–একটুও কি আশা নাই?

কত সুন্দর এই পৃথিবী! হামিদ কত বইতে পড়িয়াছে–পৃথিবী কিছু নয়–মৃত্যুর ভিতর দিয়া আমরা অনন্ত জীবন লাভ করি। কিন্তু আজ তাহার একি দুরবস্থা।

হামিদকে নিস্তব্ধ দেখিয়া দারোগা সাহেব করিলেন–“একটা পথ আছে। কিন্তু তাহাতে আমার চাকরি না থাকতে পারে।”

একটু উৎসাহিত হইয়া হামিদ নত হইয়া দারোগার পা ছুঁইয়া কহিল–“একজনকে উপকার করতে যেয়ে আপনি না হয় বিপন্নই হবেন। খোদার কাছে আপনার গৌরব হবে।”

দারোগা হামিদকে বাধা দিল না। সোজা ও কঠিন হইয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল।

হামিদের কাতর কথায় একটু হাসিয়া দারোগা কহিল–“শুন, আমি তোমার স্ত্রীর রূপ ও গুণের কথা শুনেছি। তাকে যদি তুমি ত্যাগ করতে পার তাহা হলে নিজেকে বিপন্ন করে তোমাকে বাঁচাতে চেষ্টা করতে পারি।”

৩৬-৪০. কুমারপুর রেলস্টেশনে মেয়েদের ওয়েটিংরুমে

ষট্‌ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

উপরি উক্ত ঘটনার কয়েকদিন পর কুমারপুর রেলস্টেশনে মেয়েদের ওয়েটিংরুমে এক অস্পরীতুল্যা বিংশতি বর্ষীয়া যুবতী দুইখানি পত্র হাতে করিয়া স্নিগ্ধ প্রদীপ আলোকে দাঁড়াইয়াছিলেন।

রক্তলোহিত মুখখানি নত করিয়া যুবতী পত্রখানি পড়িয়া দেখিলেন।

যদি পত্র পড়িয়া সেই স্থানে যুবতী মূৰ্ছিতা হইতেন তাহা হইলে বিস্ময়ের কোনো কারণ থাকিতে পারে না।

এই যুবতী আমেনা। ওয়েটিংরুমের খোলা জানালা দিয়া আমেনা একবার মুক্ত সুন্দর নীলাকাশের পানে তাকাইল। চক্ষু এবং ওষ্ঠ তাহার কাপিয়া উঠল।

পত্র দুইখানি এইরূপ :

প্রথম পত্রে লেখা ছিল—”প্রিয়তম আমেনা! তুমি জান, আমি বর্তমানে অত্যন্ত বিপন্ন। খোদার করুণার উপর বিশ্বাস হারাইয়াছি। জানি না তুমি দুঃখিত হইবে কি সুখী হইবে। আমি জানি, তোমার স্বামীর প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগের কথা। স্বামী ছাড়া সংসারে আর তোমার কেউ নাই। নরাধমের মতো তোমা হেন ভাষা-বিনিময়ে আজ আমি নিজকে রক্ষা করিতে ইচ্ছা করিতেছি। আমি বুঝিতেছি, আমি হীন। তত্রাচ আমি ইহা না করিয়া থাকিতে পারিতেছি না। আমার মতো কাপুরুষ জগতে হয়তো আর কেউ নাই, তবুও আমি ইহা করিতেছি। আমার প্রণয় ও ভালবাসার কথা স্মরণ করিয়া লজ্জায় আমি এতটুকু হইয়া পড়িতেছি।–কত বাধার মুখে রায়হানের মধ্যবর্তিতায় তোমায় পাইয়াছিলাম, তবুও আজ তোমাকে জন্মের মতো পরিত্যাগ করিতে হইতেছে।

“এ কথা প্রকাশ উপযোগী নহে। তাই এই কৌশল অবলম্বন করিয়াছি। আশা করি তোমার মহত্ত্ব আমার এই হীনতাকে স্বীকার করিয়া লইবে। আমার বিশ্বাস, নারী হইলেও মনুষ্যত্বে তুমি আমার চেয়ে বড়।

“মোকদ্দমায় হয় আমার ফাঁসি, না হয় দ্বীপান্তর হইবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

দারোগা সাহেব বলিয়াছেন, কিছুতেই তিনি আমার মুক্তির জন্য সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইতে পারেন না, তবে যদি আমি আমার রূপবতী ও গুণবতী ভার্ষা দয়া করিয়া তাহার জন্য পরিত্যাগ করি তাহা হইলে ভার্ষা-বিনিময়ে তিনি আমার উদ্ধারকল্পে প্রাণপণে চেষ্টা, করিবেন।

“রায়হান ভাই প্রাণপণে চেষ্টা করিলেও তিনি কী সাহায্য করিয়া উঠিতে পারিবেন বুঝিতেছি না।

“আমি তোমাকে ত্যাগ করিয়া নিজকে বিপদমুক্ত ও নিষ্কন্টক করিতে চাই”।

“রাত্রি ১টার ট্রেনে দারোগা সাহেব এবং একজন বৃদ্ধা আসিবেন। দুইটার সময় যে গাড়ি আসে সেই ট্রেনে তুমি সেই মহিলা ও দারোগা সাহেবসহ গাড়িতে উঠিবা।”

“কথাটা তুমি ভালো করিয়া বুঝিয়াছ কিনা বুঝিতেছি না। শোন, এই দারোগা সাহেব তোমাকে বিবাহ করিয়া প্রাণপণে আমাকে বাঁচাইতে চেষ্টা করিবেন। অবশ্য তোমার সহিত তাঁহার বিবাহ খুব সম্মানের সহিত হইবে। তোমার প্রতি কোনো প্রকার অসম্মান বা অত্যাচার দেখান হইবে না।

“শেষ কথা, তুমি যদি এ প্রস্তাবে অসম্মত হও তাহা হইলে দারোগা সাহেব ভায়ানক ক্রুদ্ধ হইবেন। তাহার অত্যাচার ও অবিচারের সম্মুখে তুমি রমণী–সুতরাং তিষ্টিতে পারিবে না। পুরুষ ইচ্ছা করিলে রমণীর মাথায় কলঙ্ক ও অসম্মান চাপাইয়া দিতে পারে।”

“দারোগা সাহেবের মতের বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিবে না। তিনি তোমাকে খুব শ্রদ্ধার সহিত ভালবাসিবেন। তুমি তাহার আদরের ছোট বৌ হইবে। যত শীঘ্র সম্ভব তোমাকে কলিকাতায় লইয়া বিবাহ করিবেন।”

চক্ষু মুছিতে মুছিতে আমেনা দ্বিতীয় পত্রখানি পড়িয়া দেখিল–সে-খানিতে তাহাকে ত্যাগ করা হইয়াছে।

.

সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ

আমেনা ভাবিয়া ঠিক পাইল না, সে কি করিবে, কাহার কাছে সে যাইবে? চরণ যেন তাহার শক্তি থাকিলেও শক্তিহীন। সে ইচ্ছা করিল, মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া অন্ধকারে পলায়ন করে, কিন্তু তারপর সে কোথায় যাইয়া দাঁড়াইবে?

তাহার ইচ্ছা হইল একবার সে চিৎকার করিয়া সকলকে ডাকিয়া বলে তাহার উপর কতবড় অত্যাচার হইতে যাইতেছে। কিন্তু হায়! বড় করিয়া কথা বলিতে সে কোনো দিন অভ্যস্ত নয়। মানুষের কাছে নিজের কথা বলিবার দাবি করা তো দূরের কথা, পরপুরুষের সম্মুখে একাকী কেমন করিয়া যাইবে?

তাহার ইচ্ছা হইল যেমন করিয়া পারে সে কিছুতেই এই অসম্মান সহিবে না।

একবার তাহার মন তাহার স্বামীর উপর অত্যন্ত বিদ্রোহী হইয়া উঠিল। দারোগাকে বিবাহ করিয়া এই কাপুরুষকে পরিত্যাগ করিলে কী ক্ষতি? স্ত্রীর সম্মান রক্ষার জন্য মানুষ প্রাণ দিতে কুণ্ঠিত হয় না, আর এই নরাধম স্ত্রীকে কলঙ্কিত করিয়া স্বীয় প্রাণ রক্ষা করিতে ব্যস্ত!

কিন্তু সবই তো শেষ হইয়া গিয়াছিল।

আমেনা স্তব্ধ হইয়া ওয়েঠিংরুমে বসিয়া রহিল। যথাসময়ে একটার ট্রেন আসিল। আমেনার বুকখানি কাঁপিয়া উঠিল।

আবার আমেনার ইচ্ছা হইল, সে দৌড়াইয়া পলায়ন করে, কিন্তু তার কাপুরুষ স্বামী হয়ত যমদূতের মত দরজার কাছে দাঁড়াইয়াছিল। তা ছাড়া রমণীর স্বামী ছাড়া এ জগতে কে আছে? তার স্বামীই যখন তাহাকে পরিত্যাগ করিতেছেন তখন সে একা কোথায় যাইয়া দাঁড়াইবে? পথ চিনিয়া এবং একাকিনী সে বাড়িই-বা যাইবে কেমন করিয়া? সে তো এখন একেবারেই সহায়শূন্যা। দারোগার কাছে–সে যত বড় নরপিশাচই হউক–একটি আশ্রয় তো পাওয় যাইতেছে। আমেনা ভাবিল-কর্তব্য কি তাহা তাহার বাড়িতে যাইয়া ধীরভাবে ঠিক করা যাইবে?। সে আরও ভাবিল–তাহার নিজের পক্ষে ভয়ানক অসম্মানজনক হইলেও তাহার সহিত দারোগা পথের রমণীর ন্যায় ব্যবহার করিতেছেন না। সে আবার ভাবিল, স্বামী যাহাকে পথের মাঝে পরিত্যাগ করে, তার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার। সহসা দরজার কাছে একটা আঘাত হইল। আমেনা চাহিয়া দেখিল, একটা প্রৌঢ়া রমণী, হাতে তার কতগুলি ফুল। কক্ষে কাপড় দিয়া বাঁধা একটা পোটলা।

কোনো কথা জিজ্ঞাস না করিয়া প্রৌঢ়া আসিয়া আমেনার পদচুম্বন করিল এবং পোটলা খুলিয়া সুন্দরী রমণী ব্যজনী লইয়া আমেনাকে বাতাস দিতে আরম্ভ করিল।

মুহূর্তকাল ব্যজনী দোলাইয়া রমণী কহিল–“দারোগা সাহেব আপনাকে সালাম পাঠিয়েছেন।” অতঃপর পোটলার ভিতর হইতে উত্তম রসনা-তৃপ্তিকর মিষ্টান্ন বাহির করিয়া কহিল–“কিছু জলযোগ করে গাড়ির জন্য প্রস্তুত হন।”

আমেনা কোনো কথা কহিল না।

রমণী আমেনাকে আবার খাইতে অনুরোধ করিল। তাড়াতাড়ি একটা রৌপ্যের গ্লাসে। বাহির হইতে জল আনিয়া আমেনার হাত ধুইয়া দিল।

বিস্মিত ক্রোধ চাপিয়া রাখিয়া আমেনা মৃদুস্বরে কী কহিতে যাইতেছিল। রমণী সে কথা

শুনিয়া তাহার হাতের উপর খানিক মিষ্টান্ন রাখিয়া আমেনার মুখের কাছে ধরিল।

মুহূর্তের মধ্যে আমেনা কী যেন ভাবিয়া লইল। তাহার পর সে সহজভাবে খাইতে বসিল। আহার শেষ করিয়া মনের ভাব চাপিয়া রাখিয়া আমেনা মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিল ”দারোগা সাহেবের বাড়ি কতদূর?”

রমণী কহিল–“এই দুই স্টেশন পর। বেশি নয়।”

গাড়ি আসিলে দ্বিরুক্তি না করিয়া আমেনা ধীর পদবিক্ষেপে গাড়ির ভিতরে যাইয়া উপবেশন করিল।

গাড়িতে উঠিবার পূর্বে অন্ধকারে তাহার চোখ দিযা খানিক জল গড়াইয়া পড়িল, অঞ্চলে তাহা মুছিয়া ফেলিল। তাহার এই দুঃখ ও অসম্মানের কথা একটা লোকের কাছেও সে বলিতে পারে না–সে যে রমণী! কথাগুলি যে লজ্জাজনক!

যথাসময়ে পাল্কি হইতে নামিয়া আমেনা বিস্ময়ে চাহিয়া দেখিল, দেউড়ীতে কলা গাছ এবং মঙ্গলঘট রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে। ঘটের মুখে ফুল ও আম পাতা। দুইজন রমণী সেখানে দাঁড়াইয়াছিল। হাতে তাহাদের ফুলের ডালা।

আমেনাকে খুবই সম্ভ্রমের সহিত নামাইিয়া লওয়া হইল। দারোগার মায়ের মতোই একটি স্ত্রীলোক পাল্কির ভিতর আসিয়া আমেনাকে চুম্বন করিলেন।

অতঃপর আর একজন বলিষ্ঠকায়া যুবতী আমেনাকে কোলে তুলিয়া বাড়ির মধ্যে লইয়া গেল এবং সেখানে তাহাকে মুল্যবান একখানা মখমলমণ্ডিত বিছানায় বসান হইল।

আমেনার ইচ্ছা হইতেছিল, সে চিৎকার করিয়া বলে–ওগো, সে কেউ নয়। প্রাণের দায়ে তাহাকে তার স্বামী দারোগাকে উপহার দিয়াছে–সে দারোগার বিবাহিত পত্নী নহে। ছিঃ ছিঃ! কেমন করিয়া সে এমন লজ্জাজনক কথা সকলের কাছে প্রকাশ করিয়া দিবে! সে দারেগার পত্নী নহে, সে কি তবে পথের রমণী–একজন রক্ষিতা?

আমেনা স্তব্ধ হইয়া চুপ করিয়া রহিল। একটা কথাও তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল। কেহ সন্দেহ করিল না। সকলেই জানে, নূতন বধূ কাথা বলেন না।

নববধূর রূপ দেখিয়া সকলেই মুগ্ধ হইলেন।

মোট কথা আমেনার প্রতি খুবই সম্মান প্রদর্শন করা হইতেছিল। বাড়ির ছেলেরা এবং চাকরানীরা আসিয়া আসিয়া আমোনার পদ চুম্বন করিল। পোলাও-কোর্মা প্রস্তুত ও ছাগ। জবেহের ব্যবস্থা হইল। আমেনার সম্মুখে এই ব্যঙ্গ অভিনয় সমস্ত দিন ধরিয়া চলিল।

সন্ধ্যা-রাত্রে দারোগা সাহেব আমেনার ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলে আমেনা বিছানা ছাড়িয়া গৃহের পার্শ্বে যাইয়া দাঁড়াইল।

দারোগা মৃদুস্বরে অতি সাবধানে কহিল, “ক্ষমা করিবেন–আপনার কোনো ভয় নাই। আপনি আমার স্ত্রী, এই কথা সকলকে বলিয়াছি, সুতরাং আপনি কাহাকেও অন্য কিছু বলিবেন না। আগামীকল্য আমি কর্মস্থানে চলিয়া যাইব, যথাসময়ে সম্মানের সতি অথচ গোপনে আমি আপনাকে বিবাহ করিব। আপনার কোনো ভয় নাই।”

.

অষ্টত্রিংশ পরিচ্ছেদ

দিল্লী হইতে বাড়িতে ফিরিয়া আসিয়া যখন রায়হান হামিদের বাড়িতে আমেনার সহিত দেখা করিতে গেলেন-তখন হামিদ কাঁদিয়া কহিল–আমেনাকে সে কলিকাতায় বিসর্জন দিয়া আসিয়াছে। সে আমেনাকে লইয়া কলিকাতায় বেড়াইতে গিয়াছিল, ভিড়ের মধ্যে আমেনা কোথায় হারাইয়া গিয়াছে।

গভীর দুঃখে রায়হানের কয়দিন কাটিয়া গেল। হামিদ অনেকবার হাসিয়া রায়হানকে বিধির বিধান মানিয়া লইতে বলিয়া গেল, কিন্তু তবুও রায়হান শান্ত হইতে পারিলেন না।

হামিদ যে দিন এই ভয়ানক সংবাদ রায়হানকে দিয়া গেল সেদিন হইতে পঞ্চম দিনে তিনি একখানা বিয়ারিং পত্র পাইলেন। পত্রে যাহা লেখা ছিল তাহা পড়িয়া রায়হান বজাহতের ন্যায় মাটিতে বসিয়া পড়িলেন।

পত্রখানি এইরূপ :

বীরনগর

প্রিয় ভাইজান,

এই পত্র পাইয়া আপনার মনের অবস্থা কেমন হইবে, তাহা বুঝিতেছি না। আপনারা এবং আমার স্বামী কেমন করিয়া আমার অস্তিত্বকে মুছিয়া ফেলিতে সক্ষম হইয়াছেন বুঝিতেছি না।

এই পত্র আপনি পাইবেন কিনা জানি না। কলিকাতা বেড়াইবার ওছিলায় আমার স্বামী আমাকে বাড়ির বাহির করেন। স্বপ্নেও ভাবি নাই, আমার মাথায় এই বজ্রাঘাত হইবে। কুমারপুর রেলস্টেশনে আমার স্বামী আমাকে হত্যা করি। নির্বিঘ্নে বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছেন। সঙ্গে একখানি পত্র পাঠাইলাম। পড়িয়া দেখিবেন আমাকে কীভাবে পরিত্যাগ করা হইয়াছে। আমি এখন বীরনগর দারোগার বাড়িতে দারোগার স্ত্রীরূপে আছি। আমার মনের উপর কি ভয়ানক কষ্ট হইতেছে, খোদাই জানেন! বিবাহের পর হইতে আমার যে কত অসম্মানের বোঝা চাপান হইল তাহার ইয়ত্তা নাই। যদি উদ্ধারে আমার অসম্মান আরও বর্ধিত হয়, তবে উদ্ধারে কাজ নাই। নিজের বেদনা লইয়া নিজেই শুকাইয়া মরিব। এই জন্যই কি আমায় লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন?

স্ত্রীলোকের জীবন কি এতই তুচ্ছ? একটা খেলনার যে মূল্য আছে আমার জীবনের তাহাও নাই। গৃহপালিতপশুর জীবন ছাড়া আমার জীবন আর কী?

ভাইজান! কোথায় আপনি? কোথায় আমার আত্মীয়-স্বজন আমাকে উপহাস করুক–আপনিও কি আমায় উপহাস করিবেন? আমাকে রক্ষা করুন। তাহার পর নিজের কাছে স্থান দিয়া আমার সম্মান রক্ষা করুন। কেউ আমাকে চিনিবে না। ইহার পর হয়তো আমার মূল্য এক পয়সাও হইবে না। লজ্জা এবং পৃথিবীর অবহেলা হয়তো আমার পক্ষে অসহনীয় হইয়া উঠিবে। এই পত্র আমি দারোগা সাহেবের ছোট ছেলের সাহায্যে ডাকে দিতে সক্ষম হইয়াছি।”

পত্র পড়িয়া রায়হান দুই হস্তে বুক চাপিয়া ধরিয়া বেদনায় মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। তাঁহার উন্নত হৃদয় অতি প্রিয়তম ছাত্রীকে লইয়া পৃথিবীর এ কী কৌতুকঃ অসহ্য বেদনায় রায়হানের চক্ষুও বক্ষ অশ্রুধারায় ভিজিয়া গেল। কিন্তু বিলম্ব করিলে চলিবে না। হয়তো কাঁদিবার কোনো সময় নাই।

রায়হান অনেকক্ষণ বসিয়া চিত্তকে সংগত করিয়া কী যেন ভাবিয়া লইলেন–তাহার পর তিনি সহসা কাপড় পড়িয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া রেলস্টেশন অভিমুখে যাত্রা করিলেন।

জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের সাহায্যে রায়হান যখন বীরনগর দারোগা বাড়ি হইতে আমেনাকে উদ্ধার করিলেন তখন তাহার আনন্দের সীমা রহিল না।

দারোগার পরিবারবর্গ ব্যাপার কিছু না বুঝিতে পারিয়া অবাক হইয়া রহিল।

.

ঊনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

আসল কথা কেহ জানিল না। জানিল কেবল আমেনার মা। তিনি আঁখি-জলে রায়হানের হাত জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন–“বাবা, তোমাকে দিবার আমার কিছুই নাই?।

তালাক যখন হইয়াই গিয়াছিল তখন রায়হান সাধারণের অবগতির জন্য জেল হইতে হামিদকে কারণ নির্দেশ না করিয়াই আমেনার জন্য নূতন তালাকপত্র পাঠাইয়া দিতে। অনুরোধ করিয়াছিলেন। হামিদ তাহা করিয়াছিল। ফাঁসি তাহার হয় নাই। দারোগার বিনা চেষ্টাতেই তাহার মাত্র ছয় মাসের জেল হইয়াছিল। ভীরু হামিদ কাহারো আশ্বাস না মানিয়াই স্ত্রীকে গোপনে পরিত্যাগ করিয়াছিল।

তখন বর্ষাশেষের একটু একটু শীত। সবে শিশির পড়িতে আরম্ভ হইয়াছে। ডোবার ভিতর শেওলার পাতায় হিমকণাগুলি ঝ ঝক্ করিতেছিল। ডোবার মাঝখানে শুভ্র দুটি মৃণাল-প্রভাতে পুণ্য হৃদয়ের পবিত্রটুকু লইয়া আপন মনে জড়াইয়াছিল।

রায়হান দূর হইতে দেখিলেন, ঊষার শিশিরে খালি পায়ে শুভ্র বসনে আমেনা জলের শান্ত সৌন্দর্যের পানে অনিমেষে তাকাইয়া আছে।

কী জানি কেন রায়হানের বুকখানি সহসা কাপিয়া উঠিল। একটা করুণ আবেগ নিমিষের জন্য তাহার বিশ্বাসকে রুদ্ধ করিয়া গেল।

রায়হান তাড়াতাড়ি দোকান-ঘরে চলিয়া গেলেন।

দরজা খুলিয়া, ডাস্টার দিয়া টেবিলখানা, আলমারিগুলি চেয়ার দুইখানা, বইয়ের তাকটি পরিষ্কার করিয়া ফেলিলেন।

তাহার মনে আজ সহসা যেন কীসের একটা স্পর্শ লাগিয়াছে। একটা বেদনা ঘুরিয়া ঘুরিয়া তাহার চিত্তকে অধীর করিয়া তুলিতেছিল।

দরজার কাছে চেয়ারখানি টানিয়া লইয়া রায়হান বাহিরের দিকে চাহিয়া মৃদুস্বরে করুণ বেদনায় বলিয়া উঠিলেন–“আমেনাকে কী করা যায়?”

নিত্য মানুষের মঙ্গল খুঁজিয়া রায়হান যতটুকু আত্মপ্রসাদ লাভ হইত আজ তাহা সামান্যই বোধ হইতেছিল।

আমেনাকে রায়হান আজ কয়েক মাস হইল দারোগার বাড়ি হইতে লইয়া আসিয়াছেন। এই কয়মাস তিনি ভিতরে ভিতরে একটু সুখই অনুভব করিয়া আসিতেছিলেন। আজ কিন্তু সে সুখানুভূতি তাঁহার কাছে যথেষ্ট বলিয়া মনে হইতেছিল না।

রায়হান ভাবিলেন–এই স্নেহময়ী বালিকাটি সংসারের কাছে কী অপরাধ করিয়াছে–যার জন্য তার উপর সংসারের এই শাস্তি? নিজে আমেনার কী উপকার করিয়াছেন? কিসের জন্য আমেনা তাহাকে এত শ্রদ্ধা করে?–সে আমেনাকে জ্ঞান দিয়াছে, এই জন্য? যে জ্ঞানে আমেনার কিছুমাত্র সুখ বাড়ে নাই, সে জ্ঞানের মূল্য কী? সেই পুরোনো বিশ্বাস–“বিধাতা বন্ধুকে দুঃখ দান করেন” এ কথা রায়হান বিশ্বাস করতে রাজি নন। দুঃখকে দূর করাই তাঁর জীবনের আনন্দ। সম্মুখে এই ধূমায়িত সুখ ও আনন্দবাঞ্জিতা আমেনাকে ভালবাসিয়া, রায়হান ভাবিতেছিলেন–তার কাছে সকল সুখই হারাম।

রায়হান আবার ভাবিলেন–“দুইবার তাহাকে বিবাহ দেওয়া হইয়াছে। পাড়ার কেউ কেউ আমেনা সম্বন্ধে একটা অপ্রিয় কথা আলোচনা করিয়া তার ভাঙ্গা মর্যাদাটুকুকে আরও খাট করিয়া ফেলিবে না, তারই বা বিশ্বাস কী?”

আমেনা শান্ত মৌন নিষ্পাপ বালিকা, তার হৃদয়ের মর্যাদা রায়হান ছাড়া আর কে জানে! মানুষ তার বিশ্বাস মানিয়া লইবে কী? অবিশ্বাস ও সন্দেহ আমেনার বুকখানাকে কেমন করিয়া রক্তময় করিবে, রায়হান তাহা বুঝিলেন এবং শিহরিয়া উঠিলেন।

এই বয়সে আমেনার আবার বিবাহ হওয়া দরকার। কিন্তু কোথায়? কে তাহাকে বিবাহ করিবে? তাহাকে সন্দেহ করিবার সুযোগ বিধাতা অনেকখানি মানুষকে দিয়াছিলেন। সে আঘাত আমেনা সহ্য করিতে পারিবে কি? কোন অপদার্থ সৌন্দর্যলোলুপ রূপভিখারি আমেনাকে বিবাহ করিতে আসিতে পারে কিন্তু যেখানে স্বামীর স্ত্রীর ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা নাই যেখানে স্ত্রী কি তিষ্টিতে পারে?

কোনো হীন দুর্মতি যদি আমেনাকে বিবাহ করিতে আসে তাহা হইলে আমেনা কতখানি ব্যথিত হইবে? আমেনা কেমন করিয়া এই অত্যাচার সহ্য করিবে?

দোকান-ঘর বন্ধ করিয়া রায়হান বাহির হইয়া পড়িলেন।

বৈঠকখানায় বসিয়া করিমার বাপ কোরানের অর্থ পড়িতেছিলেন?! রায়হানকে দেখিয়া তিনি বলিলেন, “বাবা, তোমার শিল্পবিদ্যালয় হতে আমাকে দুইখানি নূতন চেয়ার তৈরি। করে দিও।”

রায়হান সালাম করিয়া কহিলেন–“চাচাজান, আপনারই তো সব।”

বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়া রায়হান দেখিলেন, করিমা বারান্দায় বসিয়া কলে জামা সেলাই করিতেছেন।

রায়হান আদাব করিয়া কহিলেন, “খুব কর্মী, এক মুহূর্তও নষ্ট হবার যো নাই।”

করিমা বলিলেন,–“সব চাপ আপনার উপর দিয়ে আমি নিজে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকি, এই আপনার ইচ্ছা?”

রায়হান কুণ্ঠায় কহিলেন–“না, না! সে কথা নয়।” করিমার মা সেখানে বসিয়াছিলেন। রায়হান সালাম করিয়া তাহার কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন।

করিমার মা স্নেহমাখা স্বরে রায়হানকে বসিতে বলিলেন। মেয়ে ও রায়হানের পাছে। কথা বলিতে লজ্জা বোধ হয়; তিনি কাজের বাহানায় উঠিয়া গেলেন।

রায়হান বলিলেন–“বুবু, আমেনা তোমার ও আমার স্নেহ ও সহানুভূতি ছাড়া বাঁচবে। এই ব্যথিত বালিকার জন্য তোমার কতখানি বেদনা বোধ হয়, তা আমি জানতে চাই। আমি ইচ্ছা করি, তোমার ও আমার বিশ্বাস এবং ভালবাসায় তার জীবনের বেদনা অনেকটা কমে যাক।”

করিমা দুই ফোঁটা উষ্ণ আঁখিজল আঁচল দিয়া মুছিয়া কহিলেন–“ভাই, আমেনার জন্য প্রাণ আমার চুর্ণ হয়ে গিয়েছে! বল কী করতে পারি?”

রায়হান বলিলেন–“বন্ধুর কথা, বিশ্বাস ও সহানুভূতিতে মানুষের বহু দুঃখ কমে বটে। আমি ইচ্ছা করি, আজ হতে ভালো করে আমরা তার ভার গ্রহণ করি। সব সময়ে তাকে আনন্দ দেই–জীবন তার সরস ও সুখময় হোক।”

করিমা বলিলেন–“নিজের সঙ্গে সঙ্গে রাখবার উপায় নাই, তোমারও একই অবস্থা। অন্তত সকাল বিকালে তার সঙ্গে যেয়ে মিশতে হবে–আমাদের উদ্দেশ্য কী, সে কথা তার এবং সবার কাছে থেকে গোপন থাকবে।”

করিমা হাসিয়া বলিলেন–“আমেনাকে যদি আমাদের বাড়িতে আনি তাতে কী ক্ষতি?”

“না, তা তার পক্ষে খুবই মর্মান্তিক হবে লোকের চোখেও ভালো দেখাবে না।”

করিমা কহিলেন–“তা ঠিক।”

রায়হান কহিলেন–“বুবু, আর একটা কথা–তুমি কারো কাছে আমেনাকে নিয়ে কোনো কথা বলো না। যার যাই ইচ্ছে তাই বলুক, আমেনার হয়ে কারো কাছে কোনো কথা বলবার দরকার নাই।”

করিমা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–“আমারও তাই ইচ্ছে।”

রায়হান কহিলেন–“চাচিকে বলে যদি তাকে দিনের বেলায় স্কুলে যোগ দেওয়াতে পারি, তার চেষ্টা করব।”

করিমা বলিলেন–“কাজে মানুষের অনেক দুঃখ-কষ্ট ঘুচে যায়। দিনের বেলায় তাকে যদি সঙ্গে পাই তা হলে খুব ভালোই হয়। আমার বেহারাদের বলে দিলে তারা আমেনাকে আনা-নেওয়া করবে। তাতে বেশি খরচ হবে না।”

রায়হান বলিলেন–“ভালো যুক্তি, এতে তার কোনো আপত্তি থাকতে পারে না।”

.

চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

বড় চৌচালা একখানা ঘর-মেঝে সান বাঁধা।–এই ঘরে মেয়েরা কাজ করেন। পড়িবার একটা স্বতন্ত্র কামরা আছে। বেলা দুইটা হইতে সেইখানে পড়া আরম্ভ হয়। সে সময় অন্য সব কাজ বন্ধ থাকে।

হেডমিস্ট্রেস কিরণবালার বাসা স্কুলঘর হইতে একটু দূরে–স্কুল-কম্পাউন্ডেরই ভিতর। সম্মুখে মিস্ত্রী-শিক্ষকের বাসা। তিনিও পরিবার লইয়া থাকেন, তিনি ব্রাহ্মণ।

কিরণবালার স্বামী, সখাওত হোসেন, মিস্ত্রী এবং রায়হান ছাড়া কারও স্কুলে প্রবেশ অধিকার নাই।

মেয়েদের বোর্ডিং-ঘর, দুই শিক্ষকের দুইবাসা এবং স্কুল ঘেরিয়া প্রাচীর; ভিতরের দিকে প্রাচীরের গায়ে গায়ে ফুল ও লতা-পাতা উপরে লৌহশিক বসান। গেট বন্ধ করিয়া দিলে কোনো বিপদের সম্ভাবনা থাকে না।

প্রস্তুত জিনিসপত্র সবই রায়হান গ্রহণ করেন–তিনিই বিক্রয় করেন। লাভ ছাড়া প্রত্যেক জিনিসে নির্দিষ্ট দাম বসাইয়া হিসাব করিয়া মোট যে মূল্য হয় তাহা শিল্পবিদ্যালয়ের ফান্ডে জমা দেওয়া হয়। ফলে রায়হানেরও প্রচুর লাভ হইতেছে। স্কুলেরও একটা বাঁধা মাসিক আয় হইয়াছে।

দর্জির কাজ যে সব ছাত্র শিখিয়াছেন তাহাদের মধ্যে সকলের চেয়ে ভালো হইয়াছেন আবুল কাসেম মিঞার পুত্রবধূ। তিনি মাসে এখন চল্লিশ টাকা আয় করিতে পারেন।

রানাঘাটের সেই মেয়েটি মিস্ত্রীর কাজে খুব দক্ষ হইয়া উঠিয়াছেন। লেখাপড়ায়ও তাঁহার বিলক্ষণ আগ্রহ। অবসর সময়ে এবং অনেক রাত্রি পর্যন্ত তিনি লাইব্রেরিতে বসিয়া বই পড়েন। এক ব্রাহ্মণ ডাক্তার চিকিৎসার জন্য আসিয়া তাহাকে দেখিয়া যান। তিনি সম্প্রতি রায়হানের কাছে একখানি আবেগপূর্ণ পত্র লিখিয়াছেন–তিনি তাহাকে বিবাহ করিতে চান।

রায়হান কিংবা করিমাকে দেখিয়া ছাত্রীরা কোনো সঙ্কোচ বোধ করে না। তাহারা যে। কাহারো অনুগ্রহে সেখানে পালিত হইতেছে একথা তাহাদিগকে ভাবিতে হয় না।

আজিজের স্ত্রীর স্বভাব অতি সুন্দর। স্বভাবে সে সকলকে মুগ্ধ করিয়াছে। সকল ছাত্রী। তাহাকে ভালবাসে। সে পুস্তক বাঁধাই এবং সেলাইয়ের কাজ শিখে। বাহির হইতে ব্যবসায়ী দপ্তরী আসিয়া প্রতি শনিবারে বই দিয়া যায় এবং বাঁধা বইগুলি লইয়া যায়। একজন ছাত্রীকে বই বাঁধাই শিখাইতে মাত্র তিন মাস লাগিয়াছিল–সেই ছাত্রীটি এখন সকলকে কাজ শিখাইয়া লইয়াছে।

হিন্দু ছাত্রীরা স্বতন্ত্র খায়, মোসলমান ছাত্রীরাও ভিন্ন খায়।

দিন রাত্রির ব্যস্ততায় কাহারও মনে কোনো কুভাব আসে না। কিরণবালা ছাত্রীদের সহিত পাঁচবার নামাজ পড়েন। প্রাতঃকালে আজিজের স্ত্রী অনেকক্ষণ ধরিয়া কোরান পাঠ করে।

ফুর্তি ও উল্লাসের জন্য প্রতি বৈকালে হেডমিস্ট্রেস সাহেবা ছাত্রীদিগকে লইয়া পুরুষ ছেলেদের মতো নানাবিধ ক্রীড়া করেন। সখাওত মিঞা এবং মিস্ত্রীকে সে সময় বাহিরে যাইতে হয়।

প্রত্যেক ছাত্রীর নামের পূর্বে মাতা শব্দ যোগ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। নাম উচ্চারণ করিবার সময় সঙ্গে সঙ্গে মাতা শব্দটি বলিতে হয়।

কোনো ছাত্রী কোনো অসভ্যতা বা নীচতার পরিচয় দিলে হেডমিস্ট্রেস মিষ্ট কথায় তাহার ত্রুটি বুঝাইয়া দেন। কাহারো সহিত কোনপ্রকার কঠিন ব্যবহার করা হয় না।

ভোগবিলাস অপেক্ষা সংযমের কথাই ছাত্রীদিগকে বেশি বলা হয়। যদিও স্পষ্টভাবে কিছু প্রকাশ করা হয় না, কথায় ও কাজে এমন ব্যবহার করা হয় যাহাতে তাহাদের মন। ভোগ অপেক্ষা সংযমের দিকে বেশি অনুরক্ত হয়। কাহাকেও কঠিনভাবে কিছু বলা হয় না।

 ৪১-৪৪. আমেনা যে নিতান্ত মূহ্যমান

একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

আমেনা যে নিতান্ত মূহ্যমান হইয়া পড়িয়াছিল তাহা নহে। তবুও রায়হানের করুণ হৃদয়। তাহাকে ভুলিতে পারে নাই। আমেনার জন্য তাহার হৃদয়ে সদাই একটা বেদনার ধারা বহিয়া যায়। আমেনার সম্মুখে মন খুলিয়া প্রাণ ভরিয়া হাসিতেও তাঁহার ভয় হয়।

রায়হান মাঝে মাঝে ভাবে, এই দুঃখিনী বালিকাটির জীবনের বেদনা ও অপমানের অবসান কোথায়? তার নিজের সহৃদয়তা ও বেদনাবোধের ভিতর হয়তো কোনো গলদ রহিয়া যাইতেছে।

ঊষার কিরণ সমস্ত মাঠ ও পথকে আলোক ও গৌরবে ভরিয়া দিয়াছিল। নীল আকাশে সে আলোক, গৌরব, উল্লাস ও আনন্দে লক্ষমুখে ছুটিতেছিল।

রায়হানের পিতা দোকান-ঘরে প্রবেশ করিলেন। রায়হান সসম্মানে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–“কী আব্বা? কোনো জরুরি কথা আছে নাকি?”

রায়হানের বাপ দোকানে বড় আসিতেন না। দোকানের সমস্ত কাজ রায়হানই করিতেন। বৃদ্ধ সাংসারিক কাজের কোনো ধার ধারিতেন না। টাকা পয়সার প্রয়োজন। হইলে পুত্রের নিকট হইতে চাহিয়া লইতেন। দুটি খাওয়া, পাঁচবার মসজিদে যাওয়া এবং বৈঠকখানায় শুয়ে থাকাই ছিল তাঁহার কাজ।

সকালবেলা পিতার আকস্মিক উপস্থিতিতে রায়হান একটু বিস্মিত হইলেন।

পিতা বলিলেন–“একটা বিশেষ কথা আছে বাপ। একা একা দোকানে তোমার সঙ্গে আলোচনা করবো।”

বৃদ্ধ চেয়ার টানিয়া লইয়া কহিলেন–“হুঁকোর জল বদলিয়ে একটু তামাক দেও তো বাপ।”

রায়হান আলবোলার জল বদলাইয়া তামাকে টিকা বসাইয়া পিতার সম্মুখে টেবিলের উপর রাখিলেন।

তামাক টানিতে টানিতে কেরোসিন-বাক্সের প্রকাণ্ড গাদার দিকে চাহিয়া পিতা জিজ্ঞাসা করিলেন–“কয় বাক্স তেল আছে?”

রায়হান বলিলেন–“প্রায় দুশো বাক্স।” সুজির বস্তাগুলির দিকে চাহিয়া রায়হান বলিলেন, “সুজি বাবত প্রায় ১ টাকা লোকসান হবে। জানি না, কী করে বস্তার ভিতর বালি ঢুকে সুজিগুলি পয়মাল করে ফেলেছে। ওগুলি একেবারে ফেলে দিতে হবে।”

বৃদ্ধ বলিলেন–“সুজির ভেতরে যে বালি ঢুকেছে একথা কাউকে বলো না; কে তোমার শুনতে আসবে?”

রায়হান কথা না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন।

বৃদ্ধ বলিলেন–“পীর সাহেব এসেছিলেন। তিনি তাঁর কন্যাকে তোমার হাতে দিতে চান। যা স্বপ্নেও ভাবি নাই তাই হতে যাচ্ছে।”

রায়হান জিজ্ঞাসা করিলেন–“কোন্ পীর সাহেব?”

“কুসুমপুরের বড় পীর সাহেব। দেশের মধ্যে যার শ্রেষ্ঠ আসন। আমাদের দেশের কারো সঙ্গে যিনি সম্বন্ধ করেন না। দিন আমি ঠিক করে ফেলেছি। আগামী মাসের দুই তারিখ।”

একটু থামিয়া কহিলেন–“একই মেয়ে, প্রচুর সম্পত্তি লাভ হবারও সম্ভাবনা আছে”। অতঃপর রায়হানকে দোকান বন্ধ করিয়া বাড়ি যাইতে বলিয়া বৃদ্ধ নিষ্ক্রান্ত হইলেন।

এই সম্মান ও সম্পদের সংবাদ রায়হানের ভালো লাগিল না। চেয়ারে বসিয়া রায়হান দুয়ারের পথে আকাশের দিকে চাহিয়া রহিলেন।

আমেনার সম্মুখে এই সম্মান ও সম্পদ মানিয়া লইতে রায়হানের কাছে নিতান্ত বিশ্রী বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। আমেনার তাহার উপর বিশেষ কি দাবি ছিল? কিছু না। তবুও রায়হান সঙ্কোচে, ব্যথায় অস্পষ্ট স্বপ্নস্বরে বলিয়া উঠিলেন–এই নিরপরাধিনী বালিকার দুঃখ-অপমানের সম্মুখে কোনো স্বচ্ছন্দতা গ্রহণ করিতে পারিতেছি না।

.

দ্বিত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

কয়েকদিন চিন্তায়-চিন্তায় কাটিয়া গেল–তবে কি পিতাকে বলিতে হইবে বিবাহের কথা এখন থাক? রায়হান ভাবিলে, পিতা হয়তো তাহাতে অনেকখানি রুষ্ট হইবেন। পিতার জীবনের অনেকখানি আনন্দ হয়তো ইহার মধ্যে নিবন্ধ আছে। সন্তানের কি পিতাকে আনন্দ দেওয়াই জীবনের কর্তব্য নহে?

অকস্মাৎ এত বড় একটা দুর্ঘটনার মধ্যে পড়িতে হইবে রায়হান ইহা ভাবিয়া উঠিতে পারেন নাই। কয়েকদিন ধরিয়া রায়হান বিদ্যালয়ে কিংবা আমেনার কাছেও যান না।

মন তার বড় অবনত হইয়া পড়িয়াছে। একটা কঠিন অস্বস্তি তাহাকে ব্ৰিত করিয়া তুলিয়াছে।

পিতাকে আনন্দ দেওয়া তার কর্তব্য কিন্তু তাই বলিয়া সে তাহার স্বভাব ও আত্মার ধর্মকে অস্বীকার করিতে পারে না–তাতে যে তার মৃত্যু–তার জীবনকে একেবারে মিথ্যা করিয়া দেওয়া। জীবনের স্বপ্ন ও আকর্ষণকে চূর্ণ করিয়া কে কবে বাচিয়া থাকিতে পারে? তার পিতা কি একথা বোঝেন? সে সম্মান-সম্পদ দিয়া কী করিবে?–যদি তাতে তার জীবনের স্বপ্ন আকর্ষণ মাটি হইয়া যায়! আমেনার সম্মুখে সে কোনো স্বচ্ছন্দতা মানিয়া লইতে পারে না–অসম্ভব!

মানুষের দুঃখ বেদনা প্রাণে প্রাণে অনুভব করাতেই তার জীবনের আনন্দ। মানুষের দুঃখের মীমাংসা করাতেই তার জীবনের সার্থকতা। সুখ দিয়া কী করিবে? স্বার্থপর সুখের সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ নাই। মানুষকে ভুলিয়া সে কোনো সুখ চান না। পরের জন্য দাঃখ যদি ভোগ করিতে হয়, যদি তার জীবন কন্টকময় হয় তাতে তার বিরক্তি নাই;–তাতেই তার গৌরব; সেই গৌরবের সন্ধান করাই তার উদ্দেশ্য।

সন্ধ্যার আগে পাইকারদিগকে পঞ্চাশ মণ লবণ মাপিয়া দিয়া রায়হান খোরশেদের বাড়ির দিকে চলিলেন।

দুয়ারে দাঁড়াইয়া ছাচা আঙুল লইয়া আমেনা দাঁড়াইয়াছিল। মা নামাজ পড়িতেছিলেন। রায়হান আগ্রহে জিজ্ঞাসা করিলেন–“আঙুল কী করে ভেঙ্গেছে?”

কথার উত্তর না দিয়া ঘরের বাতি জ্বালিয়া পাটি পাতিয়া আমেনা রায়হানকে বসিতে অনুরোধ করিল।

রায়হান আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, “হাত ছেঁচেছে কেমন করে?”

আমেনা কহিল–“ঢেঁকিতে।”

রায়হান বলিলেন–“একখানা ঘেঁড়া ন্যাকড়া নিয়ে এস; আঙুল বেঁধে পানিপট্টি করে দি, নইলে ব্যথা বাড়বে।”

ততক্ষণে আমেনার মা নামাজ সারিয়া উঠিয়াছেন। তিনি বলিলেন–“বাবা আঙুলটা একেবারে ছেচে গিয়েছে”।

মেয়েকে বলিলেন–“বাক্সের ভিতর ধোয়া ন্যাকড়া আছে, বের করে আন, তোমার ভাইকে দিয়ে বেঁধে লও।”

রায়হান ন্যাকড়া দিয়া আমেনার আঙুলটি বাঁধিয়া পানিপট্টি করিয়া দিলেন। আমেনার মা ঘরের মধ্যে যাইয়া কতকগুলি সূতা লইয়া নাড়াচাড়া করিতে লাগিলেন।

রায়হান বলিলেন–“করিমা বুবুর সঙ্গে আজ কদিন দেখা হয় না। তিনি আজ এসেছিলেন?”

আমেনা কহিল–“সারা বিকেলবেলা তিনি এখানে কাটিয়েছেন।”

“তোমার জামাগুলি নিয়ে এস। কতদূর অগ্রসর হয়েছে দেখি।”

আমেনা তার হাতের ছাটা তৈরি জামাগুলি লইয়া আসিল। রায়হান দেখিলেন সেগুলি চমৎকার হইয়াছে–কোথায়ও একটু গলদ নাই।

রায়হান আমেনার মাকে ডাকিয়া কহিলেন–“চাচিজান, আমেনা চমৎকার জামা তৈরি করেছে। এমন সেলাইয়ের দাম প্রত্যেক জামাতে এক টাকার কম নয়।”

থালায় কতগুলি গুড়ের মুড়কি এবং কয়েকটা নাড় আনিয়া আমেনার মা রায়হানের সম্মুখে রাখিয়া কহিলেন–“আজ কতগুলি মুড়কি তৈরি করেছি–তুমি দুটো মুখে দাও।”

তারপর কহিলেন–“আমেনা যে চমৎকার সেলাই শিখেছে সে তোমারই অনুগ্রহে।”

রায়হান হাসিয়া কহিলেন–“বেশ! আমারই অনুগ্রহে! ঐ কথা বলবার দরকার কী? আমি কি আপনার পর?”

আমেনার মা বলিলেন–“পর নয় বাপ! পুত্রের চেয়েও আপন।”

তসবিহ টিপিতে টিপিতে তিনি আবার বলিলেন–“শুনলাম তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। বড় খুশি হয়েছি। বেশ বিয়ে! শুনলাম মেয়ে দেখতে পরীর মতো–বেশ মানাবে। আমি নিজে সে মেয়েকে দেখেছি।”

রায়হানের কণ্ঠ অকস্মাৎ শুষ্ক হইয়া গেল।

আমেনা সহজ কণ্ঠে কহিল–“সকলের চেয়ে বেশি আনন্দ আমার।”

মায়ের দিকে মুখ ফিরাইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“বিয়ে হবার কদিন বাকি আছে মা?”

মা বলিলেন–“আগামী মাসেই দুই তারিখ।”

আমেনা কহিল–“আমার ইচ্ছে করে বিবাহের দিন ভাবিকে একজোড়া সোনার বালা উপহার দেই। আমার বালাগুলি যে গিল্টি করা–ক্যামিকেল সোনা।”

মা বলিলেন–“আমার সোনার বালা আছে–তাই দিও।”

রায়হান খানিক পানি খাইয়া জড়িত কণ্ঠে কহিল–“তোমার সেই গিল্টি করা বালাই তুমি উপহার দিও–সোনার বালায় কাজ নেই।” তাড়াতাড়ি চাচিকে সালাম করিয়া রায়হান বাহির হইয়া পড়িলেন।

আমেনার কথাগুলি কঠিন বেদনায় রায়হানের বুকের ভিতর বাজিতেছিল। কতখানি দুঃখকে জয় করিয়া আমেনা তাহাকে এই প্রীতির কথা বলিল। রায়হান ভাবিলেন–তিনি ছোট। হয়তো তার বেদনাবোধ ও সহৃদয়তার কোনো মূল্য নাই।

সেই গাছের নিচে–যেখানে তার একদিন দুপুরবেলা নগেন ঘোষের সঙ্গে কথা হইয়াছিল, রায়হান আঁধারে যাইয়া বসিলেন। নীলাকাশে অনন্ত নক্ষত্র দেখা যাইতেছিল। চিন্তাক্লিষ্ট হৃদয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত হইয়া গেল।

সারারাত্রি রায়হান সেখানে বসিয়া কাটাইলেন। পূর্বাকাশ যখন ঈষৎ শুভ্র হইয়া উঠিল তখন তিনি চমকিত হইয়া উঠিয়া বাড়ির দিকে গমন করিলেন।

পিতা তখন বৈঠকখানায় নামাজ পড়িতেছিলেন। রায়হানকে জিজ্ঞাসা করিলেন–রাত্রে কোথায় ছিলে বাপ?

রায়হান কহিলেন–দোকানেই ছিলাম। তারপর পিতার জায়নামাজের কাছে অগ্রসর হইয়া আড়ষ্ট কণ্ঠে বাম হাতে ললাট ঢাকিয়া কহিলেন–“আব্বা! আমি এখন বিয়ে করতে চাই নে। আমায় মাফ করুন!”

পিতা মৃদু হাসিয়া বলিলেন–“পাগল আর কি!”

.

ত্ৰিশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

বিবাহের আয়োজন চলিতেছিল। খাসি কেনা, হলুদ কোটা মেয়েদের আনন্দ-উৎসব পূর্ণমাত্রায় আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল।

মেয়েদের আনন্দ-উৎসবের প্রসঙ্গে রায়হানের হৃদয়ও অধিকতর ক্লিষ্ট হইয়া পড়িতেছিল।

একদিন আমেনা অশ্রুসিক্ত চোখে রায়হানের পায়ের কাছে করুণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল–“গুরু! আমার চরিত্র সম্বন্ধে কেউ সন্দেহ পোষণ করে কি?”

রায়হান দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর করিয়াছিলেন–“না।”

আমেনা আবার বলিয়াছিল–“এখন থেকে আমার জীবনের কোনো মূল্য নাই। সংসারের অবহেলা ও কৃপায় আমাকে বেঁচে থাকতে হবেজিজ্ঞাসা করি, এর জন্য দায়ী কে?”

রায়হান কোনো উত্তর দেন নাই!

আমেনা আবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিল–“মানুষ মানুষকে কী দেখিয়া শ্রদ্ধা করে? মানুষের আদর মানুষের কাছে কীসে হয়?”

রায়হান বলিয়াছিলেন–“মহত্ত্বে, পুণ্যে ও আত্মার নির্মলতায়!”

আমেনা উত্তর করিয়াছিলেন–“আমার কি তাহা নাই?”

রায়হান বলিয়াছিলেন–“আছে।”

আমেনা আবার জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন–“জগৎ কি তাহা বিশ্বাস করে?”

রায়হান বলিয়াছিলেন–“আমি তাহা বিশ্বাস করি।”

আমেনা শান্ত আবেগে কহিয়াছিল–“তা হলে জীবনে আমার কোনো দুঃখ নাই। ছাত্রের কাছে গুরুর বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাই ঢের।”

রায়হানের প্রার্থনার কোনো মূল্য হয় নাই। পিতা পুত্রের কথার উপর কোনো মূল্যই স্থাপন করেন নাই।

বিবাহার আর তিন দিন মাত্র বাকি। মেয়েরা উৎসব করিয়া দুপুর বেলা রায়হানের গায়ে হলুদ দিতেছিল। পিতা উৎসাহে-আনন্দে এদিক-ওদিক ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন।

চাচি পাড়ার স্ত্রীলোকদিগেকে দাবায় বসিয়া পান দিতেছিলেন এবং কন্যার রূপ লাবণ্যের কাহিনী কহিতেছিলেন।

একটা জড় পদার্থের মতো রায়হান মেয়েদের ইচ্ছানুযায়ী এখানে-ওখানে নীত হইতেছিলেন। বিবাহের কালে সকল ছেলেই লাজুক ও মৌন হয়ে থাকে তা সবাই জানে।

রায়হানের মুখ বন্ধ হইয়া গিয়াছিল–সরমে নয়, সীমাহীন বেদনায়। উল্লাস কোলাহল তাহার মনুষ্যত্বের প্রতি একটা উপহাস বলিয়াই তাহার মনে মনে হইতেছিল।

দুপুর বেলায় উৎসব-অবসাদে বৈকালে বাড়িখানি নিস্তব্ধ হইয়া গিয়াছিল। রায়হান একটা মোটা জোলার তৈরি চাঁদর গায়ে দিয়া খালি পায়ে একাকী রাস্তা ধরিয়া চলিলেন। একটা কঠিন দুর্জয় মানসিক তেজ তাহার মুখখানাকে থাকিয়া থাকিযা শক্ত করিয়া তুলিতেছিল।খানিক পথ চলিয়া রায়হান একবার মাঠের দিকে চাহিলেন। অস্পষ্ট দৃঢ়কণ্ঠে রায়হান দূর দিগন্ত পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া কহিলেন–“জীবনকে মিথ্যা করিতে পারি না। পিতার জীবনের একটা অলীক খেয়ালকে না মানিলে যদি তিনি ব্যথিত হন তা হলে কোনো উপায় নাই। আমি আমার পিতাকে সত্যরূপেই গ্রহণ করিতে চাই।”

ক্রমে সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিল। রায়হান রাস্তা ছাড়িয়া পার্শ্বের সরু পথ ধরিয়া খোরশেদদের বাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। একটা বিপুল শান্তি তখন তাহার চোখে মুখে প্রতিভাত হইতেছিল। আমেনা তখন কোরান পাঠ করিতেছিল। আমেনার মা রায়হানকে স্নেহের স্বরে বসিতে অনুরোধ করিলেন।

রায়হান সালাম করিয়া বিনা ভূমিকায় উঠানের উপর দাঁড়াইয়া ধীর প্রশান্ত স্বারে কহিলেন–“চাচিজান! আমেনাকেই বিয়ে করবো”।

আমেনা তখন রায়হানের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল-সহসা সে মাটির উপর বসিয়া পড়িল।

আমেনার মা কথা কহিতে পারিরেন না–তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন।

রায়হান আমেনার অশ্রুসিক্ত হাতখানি হাতে লইয়া কহিলেন–“আমেনা, তুমি সজ্জিতা হও–আজ রাত্রেই আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে–দুজন অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং করিমাকে আমি ডেকে আনি।”

রায়হান বাহির হইয়া গেলেন।

.

চতুশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

চার বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছিল। খোরশেদ এসলামপুরে বদলি হইয়াছে। ইহারি মধ্যে স্থানীয় জমিদারদের বাড়িতে এক কেলেঙ্কারী হইয়া গিয়াছে। জাহানপুরের যোগেন্দ্র বাবুরা। বহুঁকালের বড় লোক এবং লোকে বলে বনিয়াদি বংশ।

যোগেন্দ্র বাবুর সাত মেয়ে-মেয়েদের বিবাহে তিনি সর্বস্বান্ত হইয়াছেন। রূপে মনোহরা হইলেও বিনা অর্থে তাহাদের একজনেরও সদগতি হয় নাই।

একটি মোকদ্দমায় তাহার বহু হাজার টাকা ব্যয় হইয়া গিয়াছিল। তার পরেই হইয়াছিল তাহার ছোট মেয়ের বিবাহ। বিবাহের দিনই জামাই শ্বশুরের দুরবস্থার পরিচয় পাইয়া মুরুব্বীদের আদেশে ঐ যে চলিয়া গিয়াছিলেন, চার বৎসরের ভিতর আর ফেরেন নাই।

যোগেন্দ্রবাবু বৈবাহিকের নীচতা ও সঙ্কীর্ণতার উপর ক্রুদ্ধ হইয়া ভিতরে জ্বলিয়া পুড়িয়া মরিলেও অর্থ দিয়া কিংবা ক্ষমা চাহিয়া জামাইকে ফিরাইয়া আনেন নাই।

কনিষ্ঠা মেয়ে যামিনীর বয়স ১৮ বৎসর। বিবাহের পর সে স্বামীকে একদিনও আদর সোহাগ জানাইতে পারে নাই। জমিদার বাড়ি বলিয়া কেউ কোনো কথা বলিতে সাহস পাইত না। একেবারে অসংযত বাতাসের মতো সর্বত্র সে খেলিয়া বেড়াইত। চাকর, আমলা, নফর কেউ তাহার সরল আলাপ ও হাসি হইতে বঞ্চিত হইত না।

জমিদার বাড়িতে একজন মুসলমান পেয়াদা ছিল। খোরশেদ আসবার পর সহসা একদিন থানায় সংবাদ আসিল, এই পেয়াদাকে জমিদারেরা হত্যা করিয়া নিকটস্থ দিঘিতে ফেলিয়া দিয়াছেন। কারণ কী তাহা অনেকে অনুমান করিতে প্রয়াস পাইল।

খোরশেদ বিশজন সিপাই পঞ্চাশজন চৌকিদার লইয়া দিঘি পরিষ্কার করিতে প্রবৃত্ত হইল। পেয়াদার মা খোরশেদের পা জড়াইয়া ধরিয়া যাহা বলিল তাহাতে জমিদারদের উপর সমস্ত দোষ গড়াইল।

উদ্ধারের পর দেখা গেল, মৃতদেহের শিরায় শিরায় লৌহশলাকা বিদ্ধ করা হইয়াছে। তাহার চোখ তুলিয়া ফেলা হইয়াছিল এবং জিহ্বাও অতি নিষ্ঠুরভাবে কাটিয়া ফেলা হইয়াছিল।

যোগেন্দ্রবাবুর বাড়িতে তদারক হইল এবং ফলে যাহা যাহা ঘটিল তাহাতে যোগেন্দ্রবাবু বিপন্ন হইয়া পড়িলেন।

.

প্রায় বার হাজার টাকা ঘুষ গ্রহণ করিয়াও খোরশেদ মুসলমান পেয়াদার প্রতি হিন্দুদের অত্যাচারের প্রতিশোধ লইতে বদ্ধপরিকর হইল!

জমিদাররাও খোরশেদকে গোপনে হত্যা করিতে ইচ্ছা করিল।

Exit mobile version