Site icon BnBoi.Com

পথহারা – লুৎফর রহমান

পথহারা - লুৎফর রহমান

০১-০৫. হরিদয়াল ঠাকুর

প্রথম পরিচ্ছেদ

হরিদয়াল ঠাকুর তাঁর স্ত্রী একটা শিশু-কন্যাকে লইয়া গঙ্গার ঘাটে স্নানে আসিয়াছিলেন। অসংখ্য লোকের ভিড়–কে কার খোঁজ রাখে।

স্নান শেষে হরিদয়ালের স্ত্রী কন্যা বুকে করিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। ঠাকুর কিছু জলযোগ করিয়া ঘাটে জল খাইতে গিয়াছেন, এমন সময় শান্তা কাঁদিয়া চিৎকার করয়া উঠিলেন–“আমার খুকি কই?”।

ঘাটে ঘটি ফেলিয়া ঠাকুর ফিরিয়া আসিলেন। যাহা দেখিলেন তাহাতে মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। কই তাঁহার খুকি? সেই হাসিমাখা সুন্দর খুকি–যাহাকে কোলে করিয়া একঘণ্টা আগে তিনি আদর করিয়াছেন–সে কোথায় গেল! শান্তা কহিলেন–তাঁহার একটু তন্দ্রা আসিয়াছিল–সহসা একখানা কঠিন হস্তের স্পর্শ তিনি অনুভব করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলিয়া দেখিলেন তাঁহার খুকি নাই। তখনও বুকেতে শিশুর মুখের ক্ষীরধার লাগিয়াছিল। জননী আকুল আর্তনাদে গঙ্গার ঘাট কাঁপাইয়া তুলিলেন। কে কাহার কথা শুনে–সকলেই স্নানে ও ধর্মকর্মে ব্যস্ত।

বুকের বেদনা কণ্ঠ ভাঙ্গিয়া বাহির হইতে ছিল। সমস্ত দৃশ্যটা তাহার কাছে সহসা বিষাদে ভরিয়া উঠিল। যে প্রকৃতি এই মাত্র তাঁহার মাতৃ-হৃদয়ে আনন্দ ও হাসির ধারা বহাইয়া দিতেছিল, সহসা একি তাহার মৌন মলিন বদন।

কী ভীষণ বেদনা! মাতৃহৃদয়ের অসীম জ্বালা কে বুঝিবে তখন? জনকতক লোক শুষ্ক সহানুভূতি ও কৌতূহল লইয়া শান্তার উপর বিরক্তি প্রকাশ করিয়া জ্ঞানেরও অধিক স্নেহের পরিচয় দিতেছিল।

সহসা একটি টুপিপরা যুবক জনতা হইতে মাথা ঠেলিয়া বলিয়া উঠিল, “কী বাছা! কী হয়েছে?”

পথের লোক স্নান শেষ করিয়া সেখানে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়াছিল, অপবিত্র হইবে ভয়ে তাহারা সরিয়া গেল। যুবক সেদিকে আদৌ লক্ষ্য না করিয়া আবার জিজ্ঞাসা করিল–“কী মা, কী হইয়াছে?”

শান্তা কাঁদিয়া বলিয়া উঠিলেন–বাবা! সর্বনাশ হইয়াছে। গুণ্ডায় আমার মেয়েকে চুরি করিয়া লইয়া গিয়াছে। ওগো আমার কী হবে? কেন গঙ্গার ঘাটে পুণ্যি করতে এসিছিলাম!” বলে শান্তা মূৰ্ছিতা হইয়া পড়িলেন।

যুবক ব্রাহ্মণকে সেই স্থানে দাঁড়াইয়া থাকিতে বলিয়া ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হইয়া গেলেন।

সেবক-সমিতির ছেলেদের সহিত মোয়াজ্জেম বেড়াইতে আসিয়াছিল। সে এই হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখিয়া অত্যন্ত বেদনা অনুভব করিল। সেবক-সমিতির নেতা হেমেন্দ্র তাহার –বন্ধু। হেমেন্দ্র লাঠি হাতে করিয়া চতুর্দিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। এমন সময় মোয়াজ্জেম যাইয়া কহিল–“হেমেন্দ্র, সর্বনাশ হইয়াছে। শান্তা নাম্নী এক ব্রাহ্মণ মহিলার মেয়ে চুরি হইয়া গিয়াছে।”

ভাবিবার সময় ছিল না। তড়িত বার্তার মতো ছেলেদের সাহায্যে এই আকস্মিক দুর্ঘটনার সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত হইয়া পড়িল। প্রায় পঞ্চাশজন কলেজের ছাত্র ঘাটে পথে যাত্রীদের মধ্যে কোনো বিপদ হয় এই ভয়ে সর্বত্র পাহারা দিতেছিল।

ছেলেদের আশ্বাস বাক্যে শান্তার বুকে বল আসিল। হরিদয়াল ও শান্তা মনে করিলেন শীঘ্রই তাঁহারা তাহাদের শিশুকে ফিরাইয়া পাইবেন।

সমস্ত দিন অতিবাহিত হইল। কোনোও খবর পাওয়া গেল না। সন্ধ্যার আঁধারের সঙ্গে সঙ্গে শান্তার হৃদয়ে পুনরায় আঁধার ও বেদনায় ভরিয়া উঠিল। ধীরে ধীরে যাত্রীদের ভিড়ও কম হইয়া আসিল। আপনাদের ক্ষুদ্র ছোট কথা লইয়া চলিয়া যাইতে লাগিল।

আজই সন্ধ্যায় তাঁহারা বাড়ি ফিরিয়া যাইবেন, ইহাই সকাল বেলা শান্তা স্বামীর সহিত ঠিক করিয়াছিলেন। কিন্তু একি বজ্রাঘাত! যাহা স্বপ্নেও তিনি কখনো ভাবেন নাই তাহাই আজ তাহার ভাগ্যে ঘটিল। দেবতাকে তিনি কি এইরূপে পূজা করিতে আসিয়াছিলেন? ইহাই কি সেবার ফল?

সারা বছরের ছোট-বড় ভুল মুছিতে তিনি স্বামীর সহিত মন্দাকিনী-নীরে অবগাহন করিতে আসিয়াছিলেন। এমন করিয়া তাহার বুকের মানিক হারাইয়া যাইবে–যদি তিনি। জানিতেন, তাহা হইলে কখনো গঙ্গাস্নানে আসিতেন না।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দশ বছর পরেকার কথা। হুগলীর মুসলমান-বোর্ডিং-গৃহের যে পার্শ্বে গঙ্গা সেইদিকের একটি স্তম্ভে বসিয়া দুই বন্ধু হাসিয়া হাসিয়া খুন হইতেছিলেন।

সমস্ত রাত্রি মোয়াজ্জেম হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে শহর ঘুরিল–কিন্তু কোনো ফল হইল না।

বোর্ডিং-গৃহের এই দিককার দৃশ্য অতি চমৎকার। নদীর ভিতর হইতে সারি সারি স্তম্ভ শ্ৰেণী, সুরক্ষিত দীর্ঘ প্রাচীরের উপর প্রাচীর। যখন দৈনন্দিন জোয়ার আসিয়া এই প্রাচীর পাদমূলে আছড়াইয়া পড়ে, তখন স্তম্ভের উপর দাঁড়াইয়া মনে হয় সমুদ্রকে জয় করিবার জন্যই তাহার বুকের উপর দাঁড়াইয়া আছি। যখন রাত্রিকালে গগনে চন্দ্রোদয় হয় তখন সেই নৈশ শোভাই বা কী সুন্দর! সংসার-তাপক্লিষ্ট মানুষ পিনিসে চড়িয়া যখন সেই চন্দ্রকরোজ্জ্বল গঙ্গার বুকের উপর দিয়ে ভাসিতে ভাসিতে যায়, তখন মনে হয়–এই পাপ ও নীচতা ভরা সংসার ছাড়িয়া অনির্বচনীয় আধ্যাত্মিক আনন্দে গঙ্গার শীতল বুকে সাঁতরাইতে সাঁতরাইতে অনন্তের সন্ধানে আকাশ ও সমুদ্রের যেখানে মিলন সেই দূর-অতি নির্জন গম্ভীর ভাবময় প্রান্তে চলিয়া যাই।

দুই বন্ধু হাসিয়া কথা কহিতেছিলেন। প্রত্যেক স্তম্ভের মাথার উপর দুইজন বা তিনজন করিয়া বালক বসিয়া আছেন। ছাত্রেরা নিত্যই এখানে বসিয়া থাকেন। কেহ কেহ বা দুই। প্রাচীরের মধ্যস্থিত ভূমিতে খেলা করেন। যুবক-হৃদয়ে সে কী উল্লাস ও আনন্দ! কেহবা সুপারিন্টেণ্ডেটের ভয়ে চাপা গলায় গান করেন–

“আজ এ নিশিথে
কারে মজাইতে”–ইত্যাদি।

বন্ধু দুইটির বাড়ি নদীয়ায়। যে হুগলীর বোর্ডিং-গৃহের কথা আমরা বলিতেছি এখানে প্রথমে কলেজ, মাদ্রাসা ও স্কুলের ছাত্র একসঙ্গে থাকিত।

একজনের নাম আবু মহম্মদ আবদার রাহমান। তিনি মাদ্রাসার পাঠ শেষ করিয়া ইংরেজি পড়িতেছিলেন। যথাসময়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া আই-এ ক্লাশে ভর্তি হইয়াছেন। অন্য যুবকের নাম আহমদ হাছান। ইনি বি-এ ক্লাশে পড়েন। দুইজনের একস্থানে বাড়ি বলিয়া অত্যন্ত বন্ধুত্ব।

সম্প্রতি আহমদ হাছানের পিতা পুত্রের নিকট পত্র লিখিয়াছেন। বন্ধুকে সেই পত্রখানি পড়াইয়া শুনান হইবে। তাহার বিবাহের কথা লেখা, তাই বন্ধুদ্বয়ের মধ্যে এত হাসাহাসি চলিতেছিল। পত্রে লেখা ছিল–

বাবা!

আমরা এখন বুড়ো হয়েছি, এ বয়সে পুত্রবধূর মুখ দেখা সকল বাপ-মায়ের সাধ। বিশেষত, তোমার মা এ বিষয়ে জেদ করিতেছেন, আর তিনি আজমপুরের মৌলবী এমদাদ। আলী সাহেবের কনিষ্ঠা কন্যা পছন্দ করিয়া কথা দিয়াছেন। তোমার আত্মীয়-স্বজন সকলেই মেয়ে দেখিয়া এক বাক্যে বলিতেছেন–মেয়ে রূপেগুণে খুব ভালো, এ কাজ করিতেই হইবে। আশা করি, তোমার অমত হইবে না।

তোমার চিরশুভাকাক্ষী

–পিতা।

আবু হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“কেমন, বিবাহের নামে প্রাণটা নাচিয়া উঠিতেছে তো? আশা করি, অতীতে কথা ভুলিয়া যাইবে।”

শেষ কথাটিতে যে গুপ্ত উপহাস ছিল তাহা হাছান বুঝিতে পারিয়া কহিল–“বন্ধু কী করি, বুঝিতে পারি ইহা অত্যন্ত অন্যায়। কিন্তু ইহাতে কি আমার দোষ আছে? যখনই জানালা খুলি তখনই দেখি সেই মেয়েটি আমার দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া থাকে।”

আবু বলিলেন–“তুমি সে দিকে না চাহিলেই পার। পাপের পথে যে টানিয়া লইতে চায় তাহাকে মিত্র না ভাবিয়া শত্রু মনে করা উচিত।”

হাছান কহিল–“পাপ তাহা কেমন করিয়া বুঝি? একটি মেয়ে তাহার আত্মার স্বভাবে বৃত্তিবশে একটি যুবকের প্রতি আসক্ত হইতেছে, তাহাতে কি অপরাধ?”

“অপরাধ নাই! সে হিন্দু মেয়ে, সংসারের জটিলতা ও বিপদ সম্বন্ধে সে কিছুমাত্র জানে না। তাহাকে উৎসাহিত করা তোমার কিছু মাত্র কর্তব্য নহে।”

“তোমার আত্মার প্রেমের পার্শ্বটা একেবারে মরিয়া গিয়াছে। আমি তো একজন যুবক। আমারই কামরার পার্শ্বে একটি যুবতী বালিকা নিত্য নির্জনে তাহার কোমল ও দারুণ আকাক্ষাপূর্ণ আঁখি দুইটি আমার দিকে নিক্ষেপ করিয়া থাকিবে, আর আমি নিশ্চল হইয়া পড়িয়া থাকিব। তোমাকে যদি এই অবস্থায় পড়িতে হইত তাহা হইলে বুঝিতাম কতখানি বীরত্ব। আমার মনে হয় মেয়েটির পিতা জজকোর্টের উকিল। এমন রূপ আমি কখনো দেখি নাই। কী করি ভাই, পড়াশুনা সব মাটি হইল।

“তুমি ঐ কামনা পরিত্যাগ কর।”

“ইচ্ছা করিলেও উহা অসম্ভব হইয়া পড়িয়াছে। জানি না, কী প্রকারে তাহার দৃষ্টি আমাকে একেবারে পাগল করিয়াছে। সে অত্যন্ত সরলা, নচেৎ ধীরে ধীরে সে নিজেকে এই কণ্টকময় পথে তুলিয়া ধরিত না। মনে কর যদি, তাহার বাড়ির কেহ জানিতে পারে–তাহাদের মেয়ে বোর্ডিংগৃহের এক যুবকের প্রতি আসক্ত হইয়াছে, তাহা হইলে হয়তো তাহারা তাহাকে জীবন্ত পুড়াইয়া মারিবে।

“তুমি ভালো করিয়া খুলিয়া বল! কেমন করিয়া এই হিন্দু বালিকার সহিত তোমার প্রেম হইল?”

হাছান কহিল–“শোন বলিতেছি। রোজার মাসে একদিন কামরায় আর কেহ ছিল না। আমি জানালা খুলিয়া পাশের বাড়ির দিকে চাহিয়া আছি, এমন সময় সহসা একখানি ঘুড়ি আসিয়া আমাদের জানালায় বাঁধিয়া গেল। দেখিলাম এক কিশোরী ঐ বাড়ির ছাদ হইতে অপর পার্শ্বে জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল; সে হাঁপাইতেছিল। বুঝিলাম; সে ছাদের উপর ঘুড়ি উড়াইতেছিল। হঠাৎ সূতা কাটিয়া ঘুড়িখান নিচে পড়িয়া আমারই জানালায় বাঁধিয়া গেল। সে মনে করিয়াছিল তাহাদেরই বাড়ির জানালায় ঘুড়ি পড়িয়াছে। তুমি তো দেখিয়ায় দুই জানালা খুব নিকটে। অপরিচিতা যুবতাঁকে দেখিয়া একটু সঙ্কোচের সহিত জানালা ঠেলিয়া দিলাম। সে অত্যন্ত আশা করিয়াছিল; অনুভবে বুঝিলাম সে উহা ধরিবার জন্য হাত বাড়াইয়া দিল। সে পুনঃপুনঃ হাত বাড়াইয়া দিতেছিল। তাহার নিষ্ফল ব্যর্থ চেষ্টা দেখিয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছিলাম। কিছুক্ষণ পরে সে একখানা লাঠি লইয়া আসিল; কিন্তু লাঠিতে কোনো সুবিধা হইল না। আমি একটু দুঃখিত হইতেছিলাম। আমারি হাতের কাছে একটা জিনিস পড়িয়া আছে, যাহার জন্য একটা বালিকা এক ঘণ্টা ধরিয়া বিষম কষ্ট করিয়াও কিছু করিতে পারিতেছে না। মনে ভাবিলাম, এরূপ সঙ্কোচের মূল্য কী? হাত বাড়াইয়া ঘুড়িখানি তুলিয়া দিলে তো আমার জাতি যাইবে না। জানালা খুলিয়া কহিলাম, ‘যদি আপত্তি না থাকে, আমিই ঘুড়িখানি আপনার হাতে দিতেছি।’ বালিকা কৃতজ্ঞতার সহিত মাথা নাড়িল। মৌনতা অবলম্বন করিল।

ঘুড়িখানি লইয়া যখন সে ফিরিয়া গেল, তখন তাহার আঁখির দিকে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়াছিলাম। দেখিলাম, তাহাতে যেন কত কৃতজ্ঞতা, কত দুঃখ! শিরায় শিরায় একটা অনির্বচনীয় স্পন্দন অনুভব করিলাম। পরমুহূর্তেই অত্যন্ত লজ্জিত ও অনুতপ্ত ভাবিলাম, একি! রোজার মাসে রোজা করিয়া মুসলমানের হৃদয়ে পরস্ত্রীর রূপ দেখিয়া চাঞ্চল্য! কী ঘৃণা! কী লজ্জা! তাড়াতাড়ি ওজু করিয়া কোরান পাঠ করিতে বসিলাম। কিন্তু কী বলিব, হৃদয়ে ঘুরিয়া ঘুরিয়া বালিকার কৃতজ্ঞতাভরা করুণ দৃষ্টি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল। বিরক্ত হইয়া গঙ্গার ঘাটে আসিলাম। গঙ্গার অনির্বচনীয় শোভা দেখিলাম। সীমাহীন বিস্তারে মন গম্ভীর ও ভাবময় হইয়া উঠিল। তরঙ্গের প্রতি আস্ফালনে দেখিতে পাইলাম বালিকার কৃতজ্ঞতাভরা সে করুণ আঁখির দৃষ্টি। পুনরায় ঈশ্বরকে ডাকিবার জন্য মসজিদে আসিলাম। তোমরা নামাজ পড়িলে, আমি নামাজ না পড়িয়াই এক মনে এক প্রান্তে বসিয়া আল্লাহকে ডাকিতেছিলাম। পরস্ত্রীর রূপ লইয়া আত্মার একি ঢালাঢলি। কী ঘৃণা! কী লজ্জা! ধীরে ধীরে হৃদয়ে শান্তি আসিল। অতঃপর কামরার ফিরিয়া আসিলাম।”

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

ইচ্ছা করে যুবকটির সহিত যাইয়া গল্প করি। তার মূর্তিখানি যেন কার্তিকের মতো। যত দেখি ততই আমার দেখিতে ইচ্ছা করে। এতে দোষ কী? আমার মনে তো কোনো পাপ নাই। আমি এক বিধবা, তাতে সে ভিন্ন জাতি। হৃদয়ের মধ্যেই পাপ। আমার হৃদয়ে তো কোনো পাপ নাই। যাই, দূর হইতে একবার দেখিয়া আসি। সন্ধ্যাকালে নিতুই দেখি সে যেন আমার প্রতীক্ষায় বসিয়া থাকে। সেখানে কেউ নাই এখন।

এমন সময় দাসী কমলা আসিয়া সংবাদ দিল, মা তাহাকে ডাকিতেছেন। মায়ের নামে বালিকা শিহরিয়া উঠিল। সে বুঝিল, মা যেমন রোজই তাহাকে সামান্য সামান্য কারণে বকেন, আজও তাহাই করিবেন!

বালিকা কিছু জিজ্ঞাসা না করিয়া ভাড়ার ঘরের কাছে যাইয়া দেখিল তাহারই বয়সের আর একটি মেয়ে দাঁড়াইয়া আছে। সর্বাঙ্গ অলঙ্কারে মোড়া। ক্রোধ ও ঘৃণায় তাহার চক্ষু। দুটি জ্বলিতেছিল।

যদুনাথ বাবুর প্রতিপত্তি হুগলীর সকলেই জানিত। একমাত্র কন্যা ললিতাকে রাখিয়া যখন তাহার ছেলে বয়সের স্ত্রী কলেরায় প্রাণ ত্যাগ করেন, তখন উকিল বাবুর প্রাণ ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল।

বহুবার বহুলোক তাঁহাকে পুনর্বার বিবাহ করিতে বলিয়াছিলেন। তিনি বহু বৎসর ধরিয়া অস্বীকার করেন। জীবনের এই শেষ বেলা যখন ললিতা বিধবা হইয়া বাপের বাড়ি আসিল, তখন উকিলবাবু একটি মেয়ের বয়স কাঁচা বালিকাকে সধবা করিয়া গৃহে আনিলেন।

উঠিতে বসিতে বিবাহের দুমাস পরেই ললিতা ও তাহার নূতন মায়ে দ্বন্দ্ব আরম্ভ হইল।

ললিতা যেন এই নবীনার কাছে একটা বাজে লোক বলিয়া পরিগণিতা হইল। সারা জীবনের অনুগ্রহপ্রার্থিনী ললিতা উঠিতে বসিতে নিগৃহতা হইতে লাগিল।

সে কী করিয়াছে? ঈশ্বর কেন তাহাকে অকালে বিধবা করিয়া তাহার জীবনটাকে এমন আবর্জনা বিশেষ করিয়া তুলিলেন! সবই তাহার বাপের অথচ সে এই দু’দিনেই একবারে পর হইয়া গিয়াছে। কোথা হইতে সে যেন উড়িয়া আসিয়া পরের অনুগ্রহের ভিখারি হইয়াছে! সে আর এখন জোর করিয়া বলিতে পারে না, “এ জায়গাটুকু আমার।”

সেদিন উকিল বাবু অফিসে কাজ সারিয়া বাসায় আসিলেন, তখন গৃহিণী ও বিধবা মেয়ে কলহে ব্যস্ত। গৃহিণী তাড়াতাড়ি ঘোমটা টানিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলেন। উকিল বাবুর ইচ্ছা ছিল সারাদিনের অবসাদ ও পরিশ্রমের পর গৃহিণীর কাঁচা মুখ দেখিয়া মনটাকে আবার সরস করিয়া লইবেন।

কিন্তু আনন্দের আহ্বানের পরিবর্তে শুনিলেন গৃহিণী কাঁদিয়া কাঁদিয়া কহিতেছেন, “ওগো আর এত জ্বালা সয় না! হয় আমাকে নিয়ে থাক, না হয় তোমার মেয়েকে নিয়ে থাক।”

ক্রোধে উকিল বাবুর শরীর জ্বলিয়া গেল। তিনি ললিতাকে অজস্র গালি দিতে দিতে কহিলেন, “স্বামীকে খেয়ে বাপকে খেতে এসেছে; পরের মেয়েকে এনেছি, তার সঙ্গে রাতদিন এ কি প্রকার ব্যবহার!”

ললিতার বুকে শেলের মতো কথাগুলি বাজিল। ইচ্ছা করিতেছিল সে কোথাও চলিয়া যায়। সে আর তাহার বাপের সুখের কাটা হইয়া থাকিবে না। কিন্তু কোথায় সে যাইবে! ভগবানের এই বিশাল রাজ্যে তার এতটুকুও মাথা রাখিবার স্থান নাই। তার পর একদিন তাহার জ্বর হইয়াছিল। সমস্ত রাত্রি সে জ্বরের ঘোরে তাহার মৃত মায়ের কথা বলিয়াছিল। প্রত্যুষে ঝঙ্কার দিয়া তাহার নূতন মাতা বলিলেন–“পুরোনো মা যদি এত মিষ্টি হয় তবে শ্মশানে গিয়ে বসে থাক না কেন? মা কি কাহারো মরে না! আমরা কি এতই পর? এত পর যদি হই তবে উকিল বাবু আমাকে বিয়ে কল্লেন কেন?”

বিবাহের সময় ললিতার অনেক গহনা ছিল। একদিন ললিতা দেখিল সেগুলি তাহার মায়ের ভগ্নির গায়ে উঠিয়াছে। ললিতা বলিল, “গহনা গায়ে দিবার শক্তি নাই বলে কি ওগুলির উপর আমার কোনো স্বত্ব নাই?” নূতন মা বলিলেন–“এখনো তোমার এত গহনার সাধ! যদি গহনার সাধ এত হয় তবে আর বিধবার ব্রত পালন কেন? শাড়ি পর, গহনা গায়ে দাও, চুলে তেল মাখ, আর একটি মানুষ খুঁজে নিও, মন ঠাণ্ডা হবে!”

কতকাল আগে ললিতার স্বামী মরিয়া গিয়াছেন। মাঝে মাঝে তার এই মৃত স্বামীর বিরুদ্ধে মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিত। সে মরিয়া গিয়াছে, কিন্তু আর একটি লোককে জীবন্ত করিয়া রাখিবার তার কি অধিকার ছিল! মানুষ কি স্নেহ ভালবাসা ব্যতীত বাঁচিতে পারে! স্নেহের এক রত্তিও তাহার প্রাণকে কখনও শীতল করে নাই। মনে পড়িত তাহার মৃত মায়ের মুখোনি। আহা! এ জীবনে আর ললিতাকে কেহ ডাকিয়াও একটা কথা কহিবে না। এ সংসারে আর তাহার কাজ কী? এত অবহেলা ও বেদনার মধ্যে সে কেমন করিয়া বাঁচে?

সেদিন অকস্মাৎ একটি যুবকের অযাচিত ভদ্রতায় কি যেন স্বর্গীয় এক স্নেহের স্পর্শ। সে হৃদয়ে তাহার অন্তরে অনুভব করিল। এমন মধুর করিয়া আর তো তাহাকে কেহ কখনো। সম্বোধন করে নাই। ললিতার ইচ্ছা করে হৃদয় যখন একটি অজানিত বেদনায় ভরিয়া উঠে, রৌদ্রতাপদগ্ধ পৃথিবী যখন বেদনাভরা মধ্যাহ্নে আর্তনাদ করে, তখন একটিবার এই যুবকের পানে তাকাইয়া আসে। সেই মুখে যেন কত স্নেহ তাহাতে কত সহানুভূতি! ইহার অধিক সে ভাবিত না।

শুধু কল্পনা নয়–সত্য সত্য যখন তীব্র যাতনায় প্রাণ তাহার বাহির হইতে চাহিত, সে ধীরে অতি ধীরে জানালার কাছে আসিয়া দাঁড়াইত।

তখন সন্ধ্যাকাল, বোর্ডিং-ঘরে কেহ ছিল না। হাছান চেয়ারে বসিয়া ললিতার জানালার দিকে চাহিয়াছিল। সে প্রায়ই দেখিত এ মেয়েটির মুখে একটা বেদনার ছায়া টানা। অন্তরে সহানুভূতি অনুভব করিলেও কখনও কথা কহিত না। একটি অবিবাহিত যুবকের পক্ষে এই প্রকার আলাপ করা অন্যায় হইতে পারে। সমাজের কাছে অন্তত ইহা জঘন্য বলিয়া সহজেই অনুমিত হইবে। তা ছাড়া স্বাভাবিক সঙ্কোচে তাহার জিহ্বা আড়ষ্ট হইয়া উঠিত।

হাছান চাহিয়া দেখিল, ধীরে ধীরে ললিতা তাহার দিকেই আসিতেছে। সেই ঘুড়ি ধরিয়া দেওয়া ব্যাপার আজ ছয় মাসের কথা। কোনো কথা কাহারো মধ্যে না হইলেও হাছানের প্রাণে যেন এত দিনে একটা স্নেহ ও বন্ধুত্বের ভাব জাগিয়া উঠিয়াছে। ললিতা যেন তাহার পরিচিত শত বন্ধুদের মধ্যে একজন।

সহসা হাছানের ইচ্ছা হইল সঙ্কোচ ফেলিয়া একবার সে জিজ্ঞাসা করে, “আপনি। কেমন আছেন?”

ললিতা ধীরে ধীরে আসিয়া জানালার পার্শ্বে দাঁড়াইল।

হাছান কথা বলিতে পারিতেছিল না, তাই অতিকষ্টে অত্যন্ত বিনীতভাবে ভয়ে ভয়ে সে জিজ্ঞাসা করিল,–“আপনি কেমন আছেন?”

ললিতার চোখ জলে ভরিয়া উঠিল। সে কহিল, “ভগবান আপনার মঙ্গল করুন, আপনি তবু জিজ্ঞাসা করিলেন। কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করে না আমি কেমন থাকি।”

“প্রায়ই দেখি আপনার চোখে-মুখে একটা বিষাদের ছায়া। আপনার এ বালিকা বয়স!”“যাতনায় জীবন আমার ভরা। এ সংসারে এমন কেহ নাই, আমার দুঃখ বুঝেন!”

“কেন, কীসের আপনার দুঃখ? আপনি পিতার বাড়িতেই থাকেন ইহার কারণ কী? আপনার স্বামী কোথায় থাকেন?”

বালিকা কাঁদিয়া ফেলিল। কাঁদিয়া কাঁদিয়া সে কহিল–তাহার স্বামী নাই। বালিকা বয়সে সে বিধবা হইয়াছে। সারাজীবন তাহাকে দুঃখে ও বেদনায় কাটাইয়া দিতে হইবে। এ সংসারে এতটুকু তাহার জন্য স্নেহ নাই। এ সংসারে একটি মানুষ নাই, ডাকিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করে–সে কেমন আছে।

হাছানের প্রাণ ব্যথায় ভরিয়া গেল; তাহার এই অপরিচিতা বন্ধুর এত দুঃখ! কথা না। বলিলেও আবু আজ বুঝিল অজানিত অবস্থায় কতখানি শ্রদ্ধা, সহানুভূতি দিয়া সে এই সুবর্ণ প্রতিমাকে আত্মার অজ্ঞাতে পূজা করিয়া আসিয়াছে। আত্মার গভীর প্রদেশে আজ যেন কে কঠিন আঘাতে জিজ্ঞাসা করিতেছে “হাছান! তুমি একটা অসহায় আত্মাকে কি বাঁচাইতে পারো না?” কিন্তু কেমন করিয়া?

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

পরদিন সন্ধ্যাকালে হাছান ললিতার নিকট হইতে একখানি দীর্ঘ পত্র পাইল। পত্রের প্রতিছত্রে একটা অসহায় আত্মার করুণ আর্তনাদ গুমরিয়া গুমরিয়া উঠিতেছিল। বিপুল আগ্রহে নির্জনে হাছান পড়িয়া দেখিল :

“কী বলিয়া সম্বোধন করিব বুঝিতেছি না। এই অবহেলা-ভরা সংসারে আমার প্রাণ বাঁচিতেছে না। বিমাতার দারুণ বাক্যবাণ, পিতার নির্মম অবহেলা, সংসারের দারুণ রুদ্রতা আমাকে বলিতেছে তুমি চলিয়া যাও-জানি না কি কারণে, আপনাকে এত নিভৃতে কথা বলিতে প্রলুব্ধ হইতেছি। আপনি আমার কি করিতে পারেন? তবুও ইচ্ছা এই নিদারুণ সংসারের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিবার পূর্বে আপনাকে আমার প্রাণের কথা বলিয়া যাই। এই জ্বালাময় সংসারের মাঝে একটা সহানুভূতিময় মানুষের কাছে যদি থাকিতে পারিতাম, তাহা হইলে আর এ কঠিন সংকল্প করিতাম না। কিন্তু কে আছে আমার এ। সংসারে?” তাহার পর সংসারের শত কথা। তাও এক এক করিয়া সব কথা পড়িল।

শেষে যাহা পড়িল তাহাতে তাহার আত্মা শিহরিয়া উঠিল। অবহেলা ও নির্মম আঘাতে ললিতা আত্মহত্যা করিবে?

কেন? এত বড় দীর্ঘ তাহার দেহ। এই বাইশ বৎসর ধরিয়া সে কত বড় মানুষের গ্রন্থ। পড়িয়াছে। সে কি একটা অসহায় আত্মার কিছুই করিতে পারে না। হাছান মনে মনে বলিয়া উঠিল–এই বালিকাকে রক্ষা করিতে হইবে। এই কার্যের জন্য তাহাকে যে ক্ষতি, যে বেদনা, যে কষ্ট সহ্য করিতে হয় সে করিবে। নচেৎ সে মিথ্যা, মিথ্যা তার শিক্ষা ও জীবন, মিথ্যা তার ধর্ম।

হাছান কাগজ লইয়া পত্র লিখিতে বসিল। সে লিখিল :

শ্রদ্ধেয়া ভগিনী, আপনার পত্র পড়িয়া গভীর বেদনা অনুভব করিলাম আমি আপনার কী উপকার করিতে পারি বুঝিতেছি না। তবুও ঈশ্বরের নামে আজ প্রতিজ্ঞা করিলাম, আপনার জন্য যাহা করিতে হয় করিব। আপনি বিশ্বাস করুন, আজি হইতে আমি আপনার ভাই হইলাম। অন্তরে যখন বেদনা অনুভব করিবেন তখন একটা নীরব হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহের চিন্তা করিবেন। আত্মহত্যা করিবার ঘৃণিত প্রবৃত্তি দূর হইবে। বাহিরের লজ্জা ও সঙ্কোচ আমাকে কর্তব্য-পথচ্যুত করিতে পারিবে না। এই প্রতিজ্ঞার জন্য হয়তো ভবিষ্যতে আমার বিপদ হইতে পারে। কিন্তু তজ্জন্য আপনি দুঃখিত হইবেন না। আপনার অকৃত্রিম সহৃদয়তায় আমি মনে মনে বিপুল গৌরব অনুভব করিতেছি।

হাছানের মনে যে পাপটুকু ছিল তাহা সেই দিনই বেশ করিয়া ধুইয়া গেল।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

”আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে কি তুমি ঘৃণা কর? আমি কুৎসিত হইতে পারি কিন্তু আমার অর্থ আছে। অনেক লোক আমাকে খুব ভয় করে। বল, তুমি কি আমাকে ঘৃণা কর!”

হুগলীর পাড়া-বিশেষের এক প্রকোষ্ঠে এক যুবতী এক বাবুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া, যুবতীর নিখুঁত সৌন্দর্য সমস্ত ঘরখানি আলোকময় করিয়া তুলিয়াছিল।

বাবু যুবতীর করুণা ভিক্ষা করিতেছিলেন। তাঁহার চোখে সোনার চশমা, পরনে। মূল্যবান পোশাক।

তখন রাত্রি দশটা। রাস্তায় জন-কোলাহল ছিল না। শান্তস্বরে যুবতী কহিল–“বাবু, আপনার ন্যায় ভদ্রলোকের কি আমাদের ন্যায় ইতর লোকের করুণা ভিক্ষা ভালো? ঘরে আপনার সতী স্ত্রী আছেন। আমাদের এই পাপ স্থানের স্পর্শে আপনার দেহ অপবিত্র করিবেন না। আপনার দেবী প্রতিমা সত্য স্ত্রীর অভিশাপে আমাদের নরকেও স্থান হইবে না। দয়া করে ক্ষমা করুন। আমি আপনার পায়ে ধরি।”

শহরের হতভাগিনীদের মধ্যে মোহিনী পতিতার মেয়ে, তেমন সুন্দর এমন আর কেউ নয়। মোহিনীর বয়স ষাটের কাছাকাছি। ৫ খানি বাড়ি তার। বাড়ি ভাড়ার আয় মাসিক ৩০০.০০ টাকার কম নহে। তাহা ছাড়া নগদ ৮০,০০০.০০ টাকা ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ছিল। তাহার একমাত্র মেয়ে সুরী।

সুরী আদৌ তাহার মায়ের কথা শুনে না। একটি বাবু এই সুরীর জন্য পাগল হইয়াছেন। মোহিনী তার কন্যাকে বহুবার অনুরোধ করিয়াছে, কিছুতেই কিছু হয় নাই। কতবার এই বাবুটি ভিখারির মতো সুরীর গৃহপার্শ্বে দিনরাত্রি দাঁড়াইয়া থাকিত তার হিসাব নাই।

আজ প্রকোষ্ঠের মধ্যে সুরী এই বাবুটিকে নানা প্রকার অনুরোধে ব্যস্ত করিয়া তুলিতেছিল।

মেয়ের এই অস্বাভাবিক ব্যবহারে মোহিনী বিস্মিত হইলে সে বাহিরে কিছু বলিত না। অতি নম্রতাবশে মাঝে মাঝে সুরীকে কি যেন কহিতে যাইত, কিন্তু পারিত না। বারবিলাসিনীর কন্যার পক্ষে পুরুষ মানুষের প্রতি অবহেলা দারুণ অধর্ম। মোহিনী সুরীকে পাপ-পথে লইবার জন্য ভগবানের কাছে বহু পাঠা মানত করিয়াছে। মদনমোহনের সম্মুখে গালায় বস্ত্র লইয়া সে কত কাঁদিয়াছে। কিন্তু তবুও দেবতা সদয় হন নাই।

সুরী পতিতা রমণীর সন্তান, কিন্তু তবুও, তাহার ভিতরে একটা অস্বাভাবিকত্ব পরিলক্ষিত হইত, যাহা হতভাগিনীদের জীবনে একেবারেই নূতন, একেবারেই বিস্ময় উৎপাদক। বহুদিন সে তাহার মাকে দেখিয়াছে–কত পুরুষকে লইয়া নৃত্য ও গান করিতে। সে অনেক দিনের কথা। তাহার মায়ের এই জঘন্য রুচির পরিচয় যখনই সে পাইত তখনই তাহার বালিকা হৃদয় বেদনা ও ঘৃণায় ভরিয়া উঠিত।

সে কখনও মাতার সহিত দুই তিন দিন কথা কহিত না। মোহিনী কন্যার বিরক্তি বুঝিতে পারিয়া শেষ বয়সে সকল রকম আনন্দ পরিত্যাগ করিয়াছিল।

মোহিনী ইচ্ছা করিয়া তাহার কন্যাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছিল। সুরীর পড়িবার ঘর কত বইয়ে ভরা। বই পুস্তকের মধ্যে সে সর্বদা ডুবিয়া থাকিত। কিন্তু হইলে কি হয়, সে। যে বেশ্যার মেয়ে। বাবুদের আনন্দ বর্ধন করাই যে তাহার জীবনের কাজ। তাই পূর্ব পরিচিত বাবুটি আসিয়া প্রায়ই তাহার কর্তব্য স্মরণ করাইয়া দিতেন। আজও তিনি তাহাকে পথে আনিবার জন্য নানা রকম কথায় ফাঁদ পাতিতেছিলেন। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া সুরী বলিল–“মহাশয়, আপনার কতখানি ভুল হইতেছে তাহা আপনি বুঝিতেছেন না। আমার ন্যায় অস্পৃশ্যার সংসর্গে এসে নিজেকে এত হীন কাজে আপনার একটুও লজ্জাবোধ। হইতেছে না? আপনার এই ভালবাসার কোনো মূল্যই নাই। পাপের ভিতর আপনি সান্ত্বনা। খোঁজেন কেমন করিয়া? একটা মিথ্যা ভুলে আপনার মতিভ্রম ঘটিয়াছে। রূপ বলিয়া কোনো কিছু পদার্থ আছে কিনা সন্দেহ। আপনার স্ত্রীর সহিত আমার তুলনা করুন, কীসে আমি তার চেয়ে বড়? তিনি পবিত্র, আমি অপবিত্র, সেই জন্য? তাঁর প্রেম সংযত, আমাদের ভালবাসা উদ্দাম, তার ভালবাসা স্বর্গীয় এবং বিশ্বাসে ভরা, আমাদের প্রেম অস্থির ও বিশ্বাসহীনতায় কলঙ্কিত। তিনি আপনার সুখ ও দুঃখের সহচরী, আর আমরা মধুলুব্ধ ভ্রমরের ন্যায় আপনার সম্পদের চাটুকার। ক্ষমা করুন মহাশয়। এই পাপ হতে ফিরিয়া পড়ুন সতীর বুকে ছুরি হানিবেন না।” কথায় কথায় রাত্রি ১২টা হইয়া গেল। সকলেই ঘুমাইয়া গিয়াছে। মোহিনী আপনার প্রকোষ্ঠে নিদ্রাভিভূতা। শুধু সুরীর ঘরে আলো জ্বলিতেছিল। বাবু বলিলেন, যাদের জাতি নাই, তাদের মুখে এমন উপদেশ শোভা পায় না। আমার স্ত্রীর নাম করিও না। তাহাকে আমি অত্যন্ত ঘৃণা করি; তার রূপ থাকিলেও আমি তাহাকে ঘৃণা করি। আমি তোমাকে ভালবাসি। আমার প্রতি দয়া প্রকাশ কর। বিপুল অর্থের বিনিময়ে আমি তোমার কৃপাভিক্ষা করি।”

সুরী কহিল–“আপনি আপনার স্ত্রীকে ঘৃণা করেন? একথা বলিতে আপনার লজ্জা হল। সত্য কথা বলিতে কী? আপনার বর্তমান অবস্থা যদি তিনি জেনে থাকেন, তা হলে। আপনার তাঁহাকে ঘৃণা করবার তো কোনো অধিকার থাকিবেই না। পারন্তু আপনিই অধিক করিয়া তাহার কাছে ঘৃণার পাত্র হইবেন। আপনার ঘৃণা কি কারণহীন?”

বাবু বলিলেন–“কারণহীন নয়। সে অত্যন্ত অসভ্য।”

সুরী হাসিয়া বলিল–“তাই বুঝি আপনি অসভ্য স্ত্রীকে রাখিয়া অপেক্ষাকৃত সভ্য রমণীর কাছে আসিয়াছেন? আপনার স্ত্রী অসভ্য, তিনি আপনার ভালবাসা লাভের অযোগ্য! আর আমি যোগ্য! আমি অধিক সভ্য! আমার কৌলীন্য-গৌরব বেশি?”

বাবু ধৈর্যশূন্য হইয়া বলিলেন,–“সুরী, অত বিরক্তিকর কথা বলিয়া সময় নষ্ট করিতেছ কেন? এসব বাচালতা পরিত্যাগ কর। ধর্মকথার স্থান ইহা নহে। আমি তোমাকে ভালবাসি। নিষ্ঠুরের মতো তুমি আমার সহিত ব্যবহার করিও না।”

সুরী কহিল–“ইহা ধর্ম-মন্দির নয় স্বীকার করিলাম। কিন্তু মহাশয়! স্মরণ করিবেন ইহা প্রেমেরও স্থান নহে। এখানে দিবারাত্র বাসনায় আগুন জ্বলে। আপনি মনে করিতেছেন আপনার প্রস্তাবে আমি আত্মহারা হইব, তাহা কখনও নহে! যে স্বামী স্ত্রীকে ভালবাসে না সে আমাদের মতো রমণীকে ভালবাসিবে? আপনাকে আমি বিশ্বাস করি না। আপনি অন্ধ হইয়া গিয়াছেন। কিন্তু যখন জ্ঞান হইবে তখন আঘাতে পদাঘাতে দূরে নিক্ষেপ করিবেন; কিংবা যখন আপনার জ্ঞান হইবে তখন আপনি পথের ভিখারি। আমাদের দয়ায় অনেক মানুষ পথের ভিখারি হইয়াছেন। আপনি ফিরিয়া যান। এখানে সুখ নাই। কেবল বাসনার আগুন। কেবল একটা বিরাট ভুলের মধ্যে আপনি চৈতন্যশূন্য হইয়াছেন।

বাবু বলিলেন–“আমি চৈতন্যশূন্য হই নাই। আমার জ্ঞান আছে। জ্ঞান যার নাই সে কখনও এমন করিয়া কাহাকেও ভালবাসিতে পারে না। আমি নিজের সম্পত্তি তোমায় দান করিব।”

সুরী হো হো করিয়া হাসিয়া বলিল–“মহাশয়! এই আপনার জ্ঞান? জিজ্ঞাসা করি, এ সম্পত্তি কার? ইহা কি আপনার নিজের অর্জিত? না, আপনার পিতা পিতামহের? যদি আপনার অর্জিত ধন না হয়, তাহা হইলে পরের দেওয়া দানকে এমন করিয়া পথে ফেলিয়া দিবার আপনার কি অধিকার আছে? এই বিরাট সম্পত্তি আমার ন্যায় অপাত্রে দান না করিয়া, কোনো সকার্যে ব্যয় করুন।”

বাবু বলিলেন–“শয়তানের কাছে আমি নিজেকে বিক্রয় করিতে রাজি আছি। সত্য করিয়া বলিতেছি তোমার মুখে এসব বাজে কথা শোভা পায় না। ভালো কথা বলিয়া দয়া করিয়া আমাকে সুখী কর।”

সুরী আবার কহিল–“আপনার স্ত্রীর সহিত যদি কোনো অপরিচিত লোক এই প্রকার প্রেমালাপ করে, তবে আপনার কি মনে হয়?”

বাবু কহিলে–“স্ত্রীকে তাহা হইলে আমি হত্যা করিব।”

“কেন?”

আমার সম্মুখে, আমার স্ত্রী পরপুরুষের সহিত প্রেমাভিনয় করিবে, আর আমি তাহা দেখিব?

সুরী বলিল–“আর আপনি আপনার স্ত্রীর সম্মুখে পর-রমণীকে লইয়া যে প্রেমাভিনয় করিতেছেন। ইহাতে তিনি কী ভাবিতে পারেন?”

বাবু বলিলেন–“কিছু না।”

সুরী বলিল–“আপনার মাতাকে চরিত্রহীনা বলে জানেন আর তারই উদরে আপনার জন্ম হইয়া থাকে, তা হলে আপনি কী করবেন?

বাবু কোনো কথা না বলিয়া সে স্থান পরিত্যাগ করিয়া গেলেন।

০৬-১০. ঢাকা জেলার এক দ্বিতল গৃহে

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

ঢাকা জেলার এক দ্বিতল গৃহে এক বিংশতি বর্ষীয় যুবক তাহার ভাবির সহিত রহস্য করিতেছিল।

সদাগর এবাদত আলী ঢাকা জেলার শ্রেষ্ঠ সদাগর। পুত্র এবাদ আলী বি. এ. পাস করিয়া জাপানে শিল্প শিক্ষা করিতে গিয়াছেন। ছোট ভাই এরশাদ স্কুলে পড়ে। এবাদত আলী আজ দুই বৎসর হইল পুত্রকে জাপানে পাঠাইয়াছেন। সদাশয় এবাদত অতিশয় অমায়িক ভদ্রলোক। পুত্রবধূ কুলসুম বাড়িতেই থাকেন। এরশাদের এখনও বিবাহ হয় নাই। সে স্কুলে পড়ে।

এরশাদ প্রাতঃকালে উপর-তলায় তাহার ভাবির ঘরে নাস্তা করিতে গিয়াছিল। খাইতে খাইতে এরশাদ ভাবিকে কহিল–“ভাবি, বড় ভাইয়ের আর আসবার দেরি কত? এই দুই বছর গিয়াছেন। বড় ভাই কেমন লোক ভাবি আপনার কষ্টের কোনো ধার তিনি ধারেন না।”

কুলসুম কহিলেন–“তোর তা দিয়ে দরকার কী? স্বামী ছাড়া হয়ে থাকলে বৌয়ের কষ্ট হয় কি না, যখন বিয়ে করবি বৌকে জিজ্ঞাসা করিস। এখন তার কী?”

“না ভাবি! রাগেন কেন? আমি কি আর মিথ্যে কথা বলছি।”

দেবরের রহস্য বুঝতে পেরে এরশাদের ভাবি বলিলেন–“সেটা কি আর মিছে কথা! কষ্ট? দারুণ কষ্ট। যখন বিয়ে করবে তখন যেন বৌয়ের কষ্ট বুঝতে ভুল না। স্বামী ছাড়া হয়ে থাকলে মেয়ে মানুষের যে কষ্ট হয় সেটা কি আর ঢাকবার কথা। দেখো তোমার বৌ যেন ১৫ দিনও তোমার অদেখা হয়ে না থাকে। নইলে সে লুকিয়ে লুকিয়ে কাদবে। লোকে জিজ্ঞেস করলে বলবে চোখে ধোয়া লেগেছে।”

“ভাবি আব্বা তো আমার বিয়ে দেবার নামও করেন না। তুমি তবে দেখ, মা কী বলেন? কুড়ি বছর তো কম বয়স নয়! রাত্রে ভাবি, বড় লজ্জার কথা। কী বলবো আপনাকে! মন কেমন করে। কাকে বলি, কিছু ভাল লাগে না। রাগে আমার গা জলে যায়। সকলেই মেয়েদের বিয়ের জন্য ব্যস্ত, আমরা যেন কেউ নয়।”

“তোমার পড়াশুনা খুব হবে! রাতদিন বৌয়ের ভাবনা ভাবে, না বইয়ের ভাবনা ভাবে? মাকে বলবো, এরশাদের আর পড়াশুনা হবে না একটা ফুটফুটে দেখে বিয়ে দাও। কেন আর বুড়ো বয়সে প্রাইভেট মাস্টারের তাড়না।”

“ভাবি! আপনার পায়ে পড়ি, অমন করে বলবেন না। ওতে বড় লজ্জা পাব, একটু ভালো করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলবেন। আচ্ছা ভাবি, আপনি যে ফুটফুটে একটা মেয়ের কথা বললেন, সে কি আপনার মতই সুন্দরী হবে?”

মেয়েমানুষ যেমন প্রকৃতির হউক না কেন, নিজের রূপের প্রশংসা শুনলে মনে মনে সে একটু আনন্দ অনুভব না করে পারে না। কুলসুম মনের ভাব গোপন করিয়া একটু উৎসাহিত হইয়া জিজ্ঞেস করিলেন–“কেন, তোমার ভাবি কি বড় সুন্দর?”

“কী বলেন ভাবি? আপনার মতো সুন্দরী মেয়ে ঢাকা শহরে নাই।”

কুলসুম দেবরের কাছে মনে মনে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ হইয়া গেলেন। এমন করিয়া তাহার সৌন্দর্যের তারিফ এর আগে আর কেউ করে নাই। তাঁর স্বামীও কখনও তাহাকে মুখ ফুটিয়া বলেন নাই। ”কুলসুম! তুমি কত সুন্দর তুমি কত মধুর।”

চাঞ্চল্য ও ভালবাসার প্রকাশ কখনও তাঁর মুখে দেখা যেতো না। হাসির একটা রেখাও তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিত না। সম্পূর্ণ কাজের ও সংসারী লোক বলতে যা বুঝায় তাই তিনি। প্রতিদিন অন্ধকারে দুইজনের দেখাশুনা–তাড়াতাড়ি হয়তো একটা ব্যস্ততা ভরা প্রণয়-সম্ভাষণ, তার পর সব শেষ! কেবল কাজ।

আজ এই দুই বৎসর যে সব চিঠি আসিয়াছে তাহাতে কেবল কঠিন পাথরের কুচির মতো কতকগুলি কথা সাজান। কোথাও একটু গন্ধ নাই। সবগুলিতেই লেখা থাকে–কাজের ভিড়ে পত্র লেখবার সময় হয় না। আব্বাকে আর আম্মাকে আমার সেলাম জানাইও। এখনো অনেক কাজ শিখিতে বাকি আছে। বাড়িতে থাকবে, আমাকে না বলে কোথাও যেও না–আর কিছু নহে।

এরশাদ আবার কহিল–“ভাবি, আপনার মতো সুন্দরী মেয়ে আমি কখনও দেখি নাই।”

কুলসুম কহিলেন–“থাম থাম ও ছোট মিঞা, আমার চেয়েও ভালো বৌ পাবে!”

“ভাবি, আপনার চুলগুলি জমাট বাঁধা মেঘের মতো। ইচ্ছা করে চুলের দিকে চেয়ে থাকি। আপনার মুখোনি দেখলে মনে হয় চাঁদের কথা।”

কুলসুম লজ্জিত হইতেছিলেন বটে কিন্তু মনে মনে অনিচ্ছা সত্ত্বেও খুশি হইয়া উঠিতেছিলেন। তিনি বিরক্তির ভান করিয়া কহিলেন–“ঠাট্টা করো না। ভাবি বলে কি এত ঠাট্টা ভালো!”

এরশাদ কহিল–“ঠাট্টা! এসব ঠাট্টা। যদি মিছে কথা বলে থাকি তবে জিভ যেন আমার খসে পড়ে।”

.

সপ্তম পরিচ্ছেদ

এবাদ বড় লোকের ছেলে। টাকার অভাব নাই। জাপানের হুইট, হং স্ট্রীটে তাঁর বাসা। একটা ক্ষুদ্র সাজান কামরা।তার এ দূর জাপনে আসার আদৌ ইচ্ছা ছিল না। প্রথম প্রথম তাঁহার মন আদৌ টিকিত না। Tannery শিখিতে সেখানে গিয়াছিলেন। কাজ অনেক শেখা হইয়াছে। বন্ধুবান্ধব তার অনেক জুটিয়াছে। পুরুষ মেয়ে দু-ই।

পৌষ মাস। সন্ধ্যাবেলা র‍্যাপার গায়ে দিয়ে তিনি নিজের ছোট কামরায় বসিয়া আছেন, এমন সময় শুনিলেন, কে যেন তার দরজায় মৃদু মৃদু আঘাত করিতেছে। তাড়াতাড়ি দরজা খুরিয়া ফেলিলেন, একজন যুবতী জাপানি মহিলা তাহাকে নমস্কার করিলেন। যুবতীর পরনে মূল্যবান পোশাক। কোনো উচ্চ-বংশের কন্যা ভাবিয়া এবাদ ব্যস্তসমস্ত হইয়া সম্ভ্রমের সহিত তাহাকে একটা চেয়ারে উপবেশন করিতে বলিলেন। যুবতী বাক্য ব্যয় না করিয়া চেয়ারে উপবেশন কিরলেন।

অতঃপর কয়েক মিনিট উভয়ের মধ্যে, কোনো কথা হইল না। কি বলিয়া কি কথা আরম্ভ করিতে হইবে এবাদ বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না। অধিক্ষণ নীরবে বসিয়া থাক অসঙ্গত বিবেচনা করিয়া, এবাদ অত্যন্ত ভদ্রতা ও নম্রতা জানাইয়া যুবতাঁকে বলিলেন–“মহাশয়া! এই দীনের পর্ণকুটীরেতে আসিয়া অধীনকে অত্যন্ত সম্মানিত করিয়াছেন। আপনার এই আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?”।

যুবতী ধীরভাবে কহিলেন–“হ্যাঁ, পারেন। নিকটেই আমার বাড়ি। আপনি আমাকে চিনলেও আমি আপনাকে চিনি।”

এবাদ আরও বিনীতভাবে কহিলেন–“আপনাকে আমি জানি না, সে জন্য আমি দুঃখিত। আপনি আমাকে জানেন শুনিয়া যার-পর-নাই আনন্দলাভ করিলাম অতঃপর আপনার আগমনের কারণ জানিতে পারিলে আরও আনন্দ লাভ করিব।”

যুবতী কহিলেন, “আপনার মিস্ ফিনির সহিত পরিচয় আছে কি?”

“হ্যাঁ আছে, তিনি আমার একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু।”

“তাহার অত্যন্ত অসুখ। তাঁহার বাঁচিবার আর আশা নাই। একবার তিনি আপনাকে দেখিতে চান।”

এবাদ অত্যন্ত দুঃখিত হইয়া কহিলেন–“বটে! মিস্ ফিনির অসুখ! এই সংবাদটি দিয়া আপনি আমাকে অত্যন্ত বাধিত করিলেন। অনুগ্রহ পূর্বক আমার সঙ্গে একটু যাবেন কি?”

“হ্যা! সেই উদ্দেশেই আমি এখানে আসিয়াছি। বাহিরে গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে। আপনি সতুর বেশ পরিধান করিয়া লউন। আমি বাহিরে অপেক্ষা করিতেছি।”

এই স্থানে মিস ফিনির একটু পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। সিঙ্গাপুর হইতে আসিবার সময় এই মেয়েটির সহিত এবাদের পরিচয় হয়। তিনি জাপানের এক প্রসিদ্ধ ডাক্তারের কন্যা। এই কুমারীর সাহয্যে মিস্টার এবাদের বাসা ঠিক হইয়াছিল। নূতন দেশে আসিয়া প্রথম যে অসুবধা ঘটিয়া থাকে, তার মীমাংসা মিস্ ফিনিই করিয়া দিয়াছিলেন। দিনে দিনে উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্ব জমিয়া উঠিল। মিস্ ফিনি ইউরোপীয়ান পোশাক পরিধান করিতেন।স্বর্ণবর্ণ উজ্জ্বল কেশগুচ্ছ, কোমল গণ্ডের রক্ত বিভা তাঁহাকে এবাদের চোখে বেশ সুন্দর করিয়াই দেখাইয়াছিল।

যে সুন্দরী মহিলা মিস্ ফিনির পীড়ার সংবাদ আনিয়াছিলেন তাঁহার পোশাকও ইউরোপীয়ান ধরনের। ঢেউ তোলা গাউন। শুভ্র মুখের উপর লাল রুমালখানি তাহাকে অভিনব করিয়া তুলিয়াছিল।

উভয়েই গাড়িতে যাইয়া বসিলেন। এবাদ তাহার বন্ধু মিস্ ফিনির পীড়ার কথা ভাবিতেছিলেন।

গাড়ির মধ্যে সুন্দরী অপর পার্শ্বে না বসিয়া মিস্টার এবাদের পার্শ্বেই বসিলেন। এবাদ বিস্মিত হইলেও কিছু বলিতে পরিলে না।

সুন্দরী যেন এবাদের মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন–“মহাশয় বিস্মিত হইবেন। আপনাকে দূরে রাখিয়া আমি নিজের মতো বসিয়া আরাম করিতে চাহি না। ইহাতে কোনো লজ্জা অনুভব করিবেন না।”

এবাদ বিস্মিত হইয়া ভাবিলেন–“কী জানি, হইতে পারে–জাপানের ইহাও একটা ভদ্রতার নিয়ম হইতে পারে।”

এবাদ অজ্ঞতার ভান করিয়া কহিলেন–“মহাশয়া! ক্ষমা করিবেন। জাপানি সভ্যতার সকল অংশের সহিত এখনও আমি পরিচিত হই নাই। আপনার সহিত আমার পরিচয় হইল। আশা করি, এ বন্ধুত্ব এক দিনের হইবে না। এতদিন আপনার সহিত আমার পরিচয় হয় নাই, তজ্জন্য আমি যথেষ্ট দুঃখিত। মিস্ ফিনির কাছে একদিনেও আপনার কথা শুনি নাই। আমার দুর্ভাগ্য বলিতে হইবে।”

এবাদ লক্ষ্য করিলেন যুবতীর আঁখি ক্রমশ সহজ দৃষ্টি হারাইল। সে যেন একটা অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে যুবতীর দিকে আকর্ষিত হইতেছে।

যুবতী কহিলেন–“জাপানি সুন্দরীরা মন হরণ করিতে পারে কিনা? তাদের সৌন্দর্য আপনার চোখে কেমন দেখায়?”

এবাদ কি উত্তর দিবেন ভাবিয়া পাইতেছিলেন না। দৃষ্টি অবনত করিয়া তিনি কহিলেন–“জাপানি মহিলারা বেশ সুন্দরী। তাহাদিগকে দেখলে মনে খুব তৃপ্তি জন্মে।”

যুবতী আবার কহিল–“বটে! আমাদের দেশের সুন্দরীকে দেখলে আপনার তৃপ্তি জন্মে। আচ্ছা, তাহাদিগকে আপনার ভালবাসতে ইচ্ছা হয়?”

এবাদ কি উত্তর দিবেন ভাবিয়া পাইতেছিলেন না। পাছে অদ্রার পরিচয় দেওয়া হয় এই ভয়ে তিনি কহিলেন–“নিশ্চয়ই আমি জাপানি মহিলাদের সৌন্দর্যকে প্রশংসা না করিয়া পারি না। তাহার দেখিতে চমৎকার!”

যুবতী সহসা এবাদের মুখের কাছে মুখ লইয়া কহিলেন–“আপনার সৌন্দর্য জ্ঞান আছে। ইউরোপীয়ান মহিলারা আমাদের দেশের মহিলাদের কাছে সৌন্দর্য হিসাবে কত ছোট তা আপনি বেশ বুঝিতে পারেন?”

এবাদের চরিত্র কোনো কালে কলুষিত নহে। তিনি কোনোও দিন তাহার মনে কোনো তরল ভাবের প্রশ্রয় দেন নাই। পাপের বিরুদ্ধে হৃদয়ে তাঁর কোনোও দারুণ ঘৃণাও ছিল না তবে ইচ্ছা করিয়া পাপে প্রবৃত্ত হইতেন না।

এই দূর জাপানে আসিয়া তিনি কোনো দিন রমণীর কথা চিন্তা করেন নাই। রমণীর সৌন্দর্য তাঁহাকে কল্পনাময় করিতে পারিত না। তিনি একটা কলের মতো। মন্দই হোক আর ভালোই হোক কোনোও প্রকার চিন্তা তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারিত না। তার ও চিন্তার অংশটা একেবারে মৃত।

.

অষ্টম পরিচ্ছেদ

মিস্ ফিনি উচ্চবংশদ্ভুতা। যে দিন সিঙ্গাপুর হইতে বাড়ি আসিতেছিল সেইদিন সে দেখিল একটা ভারতবর্ষীয় যুবক জাপানে যাইতেছেন। মিস্ ফিনির চোখে এমন সুন্দর যুবক আর কখনও পড়ে নাই। জাপানের অসংখ্য নাসিকা শূন্য পুরুষগুলোর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়া সে ভুলিয়া গিয়াছিল। সভ্য দেশ ফ্রান্সে বহুদিন ছিল বলিয়া বোধ হয় তার মনের এই পরিবর্তন। সর্বদা মি. এবাদের সঙ্গে মিশিলেও জাপানি লজ্জাহীনতা লইয়া অপেক্ষাকৃত সভ্য ফিনি কখনও এবাদের কাছে তাহার প্রাণের দারুণ তৃষ্ণার কথা মুখ ফুটিয়া বলে নাই। সাধারণ জাপানি নাচগৃহে, সমুদ্রপার্শ্বস্থ রাস্তায়, রাজধানীর সাধারণ উদ্যানে মিস্ ফিনি বহুবার এবাদের সহিত বেড়াইয়াছে। কিন্তু কখনও সে বলে নাই।–“মিস্টার এবাদ, আমি আপনাকে ভালবাসি।” মিস ফিনি যদি তাহার এই আকাঙ্ক্ষার কথা এবাদকে বলিত তাহা হইলে সম্ভবত তাহার প্রস্তাব ব্যর্থ হইত না। কতদিন সন্ধ্যার ঈষৎ আঁধারে সমুদ্র পার্শ্বে দাঁড়াইয়া সে ইচ্ছা করিয়া তাহার মদিরাসক্ত রক্তবর্ণ ওষ্ঠ দু’খানি এবাদের কাছে ধরিয়া বলিয়াছে–ঐ সমুদ্রের নীলজল কত উল্লাস ও আনন্দ ভরা। কিন্তু একটি বারও ভয়েই হউক বা সঙ্কোচেই হউক মি. এবাদ তার অতি সুন্দর মুখোনি একটুখানি বাড়াইয়া দিয়া একটা দারুণ তৃষিত হৃদয়ের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন নাই।

একদিন জাহাজে চড়িয়া সমুদ্র-বিহারের জন্য সে এবাদকে লইয়া বাহির হইয়াছিল। জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়াইয়া সে এবাদের সহিত কত রহস্য করিয়াছে, হেলিয়া হাসিয়া সে কত রকমে এবাদকে তাহার অকৃত্রিম ভালবাসার পরিচয় দিতে চাহিয়াছে। কিন্তু মূর্খ এবাদ তাহার কিছুই বুঝে নাই।

একবার নাচগৃহে এবাদকে লইয়া ফিনি কত চাপা হাস্যে জানাইতে চেষ্টা করিয়াছে–সে তাহার সোহাগের বস্তু। কিন্তু মুখ ভারতবাসী মোটেই বুঝিতে পারে নাই–জাপানি রমণীর রূপসুধা ভারতবাসীর পক্ষে অনধিগম্য নহে।

একদিন ফিনির পিতা বাড়িতে ছিলেন না। সে সন্ধ্যাকালে গল্প করিতে এবাদের ঘরে আসিয়া বলে–“মি. এবাদ, আজ আপনাকে নিমন্ত্রণ করতে চাই। বাবা বাড়িতে নাই, আপনার ইচ্ছা কি?” মিস্টার এবাদ বলিলেন–মুসলমানেরা জাপানিদের হাতে খায় না। তাতে তাদের ধর্ম নষ্ট হয়। অতএব ক্ষমা করবেন।”

ফিনির মাঝে মাঝে সন্দেহ হইত হয়তো এই ভারতবাসী নিতান্ত বোকা। কিন্তু এই সান্ত্বনা তাহাকে শান্ত করিতে পারিল না। যেমন করিয়া হউক এই যুবককে আপনার করা চাই।

এবাদের উন্নত ললাট, দীর্ঘ দেহ, স্বর্ণবর্ণের কেশদাম এবং নীল বিস্তৃত আঁখি মিস ফিনিকে দিনে দিনে একেবারে পাগল করিয়া তুলিতেছিল।

শহরের ”হায়ার্টলঙ্গ” পল্লীতে মিস্ ”হেনা হন” একজন বিখ্যাত নাচনওয়ালী, কুমারী মহলে তার যথেষ্ট প্রতিপত্তি ছিল।

বৎসরে যেদিন জাপানি মেয়েরা জোনাকী পোক ধরে ভালো স্বামী পাবার জন্য। ”ককং” দেবতার কাছে বলি দেয়, সেই দিন নাচওয়ালী হেনা হনের বাড়িতে শহরের কুমারীদের ভিড়।

সেটা যে একটা সাধারণ নাচওয়ালীর ঘর একথা সেদিন ভদ্র ও অভদ্র ঘরের কোনো কুমারীই মনে করে না। চুপে চুপে হেনা হনকে বলে আসতে হয় কেন যুবকেরে দেখে কোনো যুবতীর মন চুরি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে একটু বেশি করে টাকা খরচ করলে কুমারীকে আর তার প্রণয়ীর জন্য চিন্তান্বিত হতে হয় না। শিকার ধরবার জন্য হেনা হনকে যদি প্রাণ দিতে হয় তাও সে দিতে পারে–জাপানি কুমারী-মহলের বিশ্বাস এই প্রকার।

ধীরে ধীরে গাড়িখানি একবাড়ির সামনে এসে দাঁড়াইল। যুবতী এবাদের হাত ধরে। বললেন, “নেমে পড়ুন।”

এবাদ কথা বলিল না। সে শুধু দেখলো এটা মিস্ ফিনির বাড়ি নয়!

একটা দীর্ঘ অন্ধকারময় সিঁড়ি! তার পর একটা খোলা হল। তার পর আবার একটা দীর্ঘ আঁধার ভরা পথ। তার পর একটা সিঁড়ি। সিঁড়ির দুইধারে ফুলের মতো স্তবকের মতো কতকগুলি মেয়ে! তাদের হাসি বাঁধশূন্য। হাসিয়া হাসিয়া এ ওর গায়ে বরফের জলের মতো গলিয়া কুটি কুটি হইতেছিল। আঁখিতে বিস্মৃতির আনন্দময় হিম-কণা আর মাদকতা ভরা হিল্লোল। সমস্ত সংসারটাকে উড়িয়ে নিয়ে আকাশ দিয়ে তার চলছিল। ফুলবাগানে এলিয়ে পড়া লতার মতো সুখের আবেগমাখা বাতাসের মাঝে তারা খেলছিল।

এবাদ চাহিয়া দেখিল, কথা কহিল না।

তার পর আর একটি ঘর, সাদা ফরাস পাতা। জাপানি মেয়েরা ধধবে আলোর মাঝে গা এলিয়া মানুষের মন চুরি করবার ফন্দিতে ব্যস্ত ছিল। তারপর একটা ঘর। সেখানে কেই নাই। দূর হতে বীণার ঝঙ্কার মানুষের তরল মনকে আরও তরল করে সুন্দরীদের আলতা পরা পায়ের তলে ফেলিয়া যাইতেছিল।

এবাদ কথা বলিল না। তার পর আর একখানা ঘর। বাজারের পাশেই খোলা জানালা দিয়ে শহরের জাপানি জনতা দেখা যাচ্ছিল।

ঘরখানি ফুল আর পাতায় ভরা, কৃত্রিম ঝরনা আর গোলাপ পুষ্পে সাজান। কয়েকখানি আসন আর দুইখানা কাউচ। যুবতী তার একখানিতে এবাদকে বসিতে বললেন–এবাদ হ্যাঁট রেখে একখানা চেয়ারে বসে জনতার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এবাদকে বন্দি করিয়া হেনা হন ঘর বন্ধ করিয়া বাহিরে চলিয়া গেলেন। ধীরে ধীরে গভীর নিবিড় আঁধারে ঘরখানি ভরিয়া উঠিল।

.

নবম পরিচ্ছেদ

রাত্রি ন’টার সময় একটি যুবক এসে সুরীকে জিজ্ঞাসা করিল–“আপনি কেমন আছেন?”

সুরী চেয়ারে বসে একখানা পত্রিকা পড়িতেছিল–কভার খুলিয়া সে পড়িয়া দেখিল একটা কবিতা। বারে বারে সে পড়িল–

ধরণীর একপ্রান্তে আছে সে দাঁড়ায়ে
ওষ্ঠে হাসি রক্ত দীপ্তি, কটাক্ষে মাখায়ে,
আছিল সে একদিন কোমল মধুর
মাতৃত্ব মহিমা আর গন্ধে ভরপুর।
বিধাতার হাসি নিয়ে একদা ঊষায়
জন্মেছিল মার কোলে মৌন বরষায়।
ফিরে এস, ফিরে এস, হে সুন্দর! হে মধু!
বিকাইতে পথে পথে জন্মেছিলে তুমি শুধু?
উঠিবে না? চাহিবে না? গাহিবে না গান?
আঁধারেই রয়ে যাবে? জানিব না প্রাণ?
এ জনম মিছে বলল, হে মাতঃ পাষাণী
বিধাতার একরূপে দিলে এত গ্লানি?
ছুঁড়ে ফেল দূর কর, ভোগের বাঁধন,

হলাহলে ভরে দিলে সারাটা জীবন?
ছোট বড় সব সুখ জীবনের মাঝে।
বিস্মৃতি হারায়ে ফেলে আপনার মাঝে
দৃষ্টি যবে ভেঙ্গে যাবে, আসিবে মরণ
শেষ হবে সব খেলা সকল স্বপন।
উঠিবে কি ডাকি বল সেই শেষ দিন
স্মরণে একটু সুখ, ওরে দীনহীন!
আসিবে কি স্মৃতিপথে একটু ভাসিয়া!
জীবনের গত লঘু-সুখ হাসি-ছায়া
মদিরা অলস চোখে, হে দুঃখিনী বালা
তুলিয়াছ দীন প্রাণে সীমাহীন জ্বালা।
মূর্খতা আঁধার আর অধীনতা ভার
রমণীরে করিয়াছে পাষাণী অসাড়।

সুরীর কণ্ঠস্বর বাধিয়া আসিতেছিল। একটা অজানা গভীর ব্যথা তাহার কণ্ঠ ফাটিয়া বাহির হইতেছিল। এমন সময় একটি যুবক জিজ্ঞাসা করিল–“আপনি কেমন আছেন?”

সুরী কি কহিতেছিল–এমন সময় মোহিনী সুরীর প্রকোষ্ঠের সম্মুখ দিয়ে চলে গেল। সুরী কথা বলিল না। অতঃপর সে দেখিল–একটি অষ্টাদশবর্ষীয় যুবক তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে। সুরীর অঙ্গ দিয়া একটি স্পন্দন বহিয়া গেল। যুবকের দিকে চাহিয়া সে বলিল–“আপনি কী চান? আপনি জানেন, এ কাঁদের বাড়ি?”

যুবক কথা বলিল না। সে মৌন হইয়া দাঁড়াইয়া থাকিল।

সুরী আবার কহিল–“আপনার এই দিব্য মূর্তি! দেবতার মহিমা ও গৌরব আপনার দেহ দিয়ে ফুটে বেরুচ্ছে, আর আপনার এই প্রবৃত্তি! কোনো পিতা-মাতার বুকে আগুন জ্বালবার জন্য আপনি এসেছেন?”

যুবক কথা বলিল না।

সুরী আবার কহিল–“সারা জীবনটা মরুভূমি করে তুলবার ব্যবস্থা কে দিয়েছে? কোনো পিশাচ সে? এই স্বর্গীয় জীবনের প্রতি আপনার একটু মায়া নাই। এই পথে যে হাঁটে তার জীবনে অপরিসীম দুঃখ। সারাজীবন আপনার বুকের ভিতর আগুন জ্বলবে। যান যান, ফিরে যান। নিজে অস্পৃশ্য বলে ভগবানের ও মানুষের কাছে আপনাকে অস্পৃশ্য করতে চাই না। আপনি ছেলে মানুষ, কিছু বোঝেন না। মা-বাপের বুকে ছুরি দেবেন না। মা-বাপ আপনার কাছ থেকে অনেকখানি আশা করে। যুবকের আঁখিতে ঈশ্বরের জ্যোতি প্রতিভাত হতে থাকে। আপনি সে আলোককে শয়তানের আঁধার দিয়ে ঢেকে ফেলবেন না। এখানে সুখ নাই। আপনার ভিতরে এর পরে যে পাপের আগুন জ্বলে উঠবে, তা সমস্ত সাগরের জল দিয়ে নিভাতে পারবেন না।”

যুবক ভাবিতেছিল, সে কথা কহিতে পারিতেছিল না। চরণ তাহার উঠিতে ছিল না।

সুরী আবার কহিল–“যুবক, কে তোমাকে এই পথের পথিক করিয়াছে? তাহাকে যাইয়া হত্যা কর। সে তোমার সারা জীবনের শত্রু।”

যুবক সহসা কাঁদিয়া ফেলিল। সে বলিল–“আপনি কে তা জানি না। আমার জ্ঞানলাভ হইয়াছে, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি চলিলাম।” আমি প্রতিজ্ঞা করিলাম–কোনো নরপিশাচ আমাকে আর পথভ্রষ্ট করিতে পারিবে না। আমি কে তাহা বলিব না। –আপনি আমার যে উপকার করিলেন, তজ্জন্য ভগবানের কাছে সারাজীবন আপনার মঙ্গল প্রার্থনা করবো।”

যুবক দ্রুতপদে সে স্থান পরিত্যাগ করিল। বহুলোকের উপদেশ সে পাইয়াছে। কিন্তু কিছু সে গ্রাহ্য করে নাই। আজ যেন কে তার ভিতরে একটা ভীষণ তেজ সৃষ্টি করিয়া দিল। সে রাস্তায় যাইয়া এই অস্পৃশ্য বালিকার উদ্দেশ্যে শতবার নমস্কার করিল।

.

দশম পরিচ্ছেদ

শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন প্রভাত। দিবালোকে দৃষ্টি চলিতেছিল না। জীবনের আড়ষ্টতা ও অন্ধকার বিশ্বজোড়া মৌন কুহেলির পার্শ্বে স্পষ্ট হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছিল–এই বিস্তীর্ণ ধরা–কত মানুষ! কোথায়–কত মানুষ কল্পনা ও দুঃখ লইয়া পড়িয়া আছে। পাপ ও বেদনার ভিতর কত মানুষ সান্ত্বনা খুঁজিতেছে।

সুরীর মায়ের বড় অসুখ। সে আর বাঁচিবে না। ডাক্তার বলিয়া গিয়াছেন, তাহার মাকে হাসপাতালে পাঠানো আবশ্যক; বাড়িতে তার উপযুক্ত সেবা হইতেছে না। টাকার জোরে ডাক্তার বাবু, সুরী ও সুরীর মাকে চিরকালই তার মস্ত মুরুব্বী বলিয়া মনে করিতেন।

মোহিনী আকুল চিৎকারে সুরীকে ডাকিল–“মা! কই তুমি।”

সুরীর চোখে জল! দৌড়াইয়া সে মায়ের কাছে যাইয়া উপস্থিত হইল। যাতনায় মোহিনীর কণ্ঠ শুকাইয়া আসিতেছিল। বেদনাতুর কণ্ঠে মোহিনী কহিল, “মা, আর সহ্য হয় না। অসীম জ্বালা। গত জীবনের এত সুখ একটুও আজ আমাকে সান্ত্বনা প্রদান করতে পারছে না। অনেক টাকা সঞ্চয় করেছি–অনন্ত সুখে সারা জীবনকে উজ্জ্বল করে রাখতে চেষ্টা করেছি। আজ–সে সব কোথায় গেল? লক্ষ যুবকের মূর্তি লক্ষ শয়তানের মতো আজ আমার সামনে ভেসে আসছে। ভগবান কি আছেন?”

মোহিনী আকুল আবেগে আবার জিজ্ঞাসা করিল–“সত্যি কি ভগবান আছে?”

সুরী দৃড়কণ্ঠে কহিল–“হ্যাঁ আছেন।”

মোহিনীর চোখে জল। সে আবার কহিতে লাগিল। ”সুরী! আট বছরের সময় বিধবা হয়েছিলাম। যখন ষোল বছর আমার বয়স তখন চোখের সম্মুখে দেখতে পেতাম–সমস্ত সংসারটায় আগুন ধরে উঠেছে। সেই আগুন নিবাতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। ওঃ তারপর দীর্ঘ এক বিস্মৃতির যুগ কামনার আগুন যখন মুহূর্তের জন্য শান্ত হতো–ধরণীর রক্ত যখন একটু হিম হয়ে আসতো–তখন কী দারুণ মানসিক জ্বালা আমাকে পুড়িয়ে ছাই করে দিতো। বিস্মৃতির মোহিনী শক্তিকে ফিরিয়ে আনবার জন্য সুরা পান করতাম। মানবীয় সমস্ত কোমল বৃত্তিকে বলি দিবার জন্য কেবল পান করতাম সুরা। আর ফিরে যাবার জো ছিল না। আর অনুতাপ করার সময় ছিল না। সুরী, আমরা তো মানুষ, শিরায় কি রক্ত নাই? আলো ও গন্ধে ভরা পৃথিবীর বুকে ভাই-বোন একই জায়গায় বেড়ে উঠে মুহূর্তের ভুলে মেয়েমানুষকে জীবন সন্ধ্যা পর্যন্ত, অনন্তের জন্য কেন নরক বরণ করে নিতে হয়? এরা এত নিগৃহিতা কেন? এদের ফিরে যাবার আর পথ থাকে না কেন? সমস্ত সংসার এদের সামনে একটা অভেদ্য পাথরের দেওয়াল টেনে দেয় কেন? মানুষ কি পিচ্ছিল খেয়ে পড়ে না? তাই বলে কি চিরকাল তাকে কাদায় পড়ে থাকতে হবে? লম্পট, দস্যু মাতাল ভাইকে লোকে যত্ন করে তুলে নেয়, একদিনের ভুলের জন্য বোনের মাথায় তারা পাথর ছুঁড়ে মারে। সুরী, বল মা–জীবনের এই সীমাহীন পাপের জন্য কি আমি দায়ী?”

মোহিনী আবার কি বলিতে যাইতেছিল–কিন্তু একটা ভীষণ ব্যথায় সে দুমড়াইয়া পড়িল।

সুরী তাড়াতাড়ি আর এক দাগ ঔষধ মাতাকে খাওয়াইল।

মোহিনী একটু শান্ত হইয়া আবার কহিতে লাগিল–“ভগবান আমার চিন্তা নিয়ে কাজ করবেন না। যখন আমার বয়স ত্রিশ তখন সাংঘাতিক একটা আঘাত পেয়িছিলাম–সেই সময় একটা যুবককে আমি ভালবেসেছিলাম। তার মূর্তিখানি মনে হলে এখনও আমার প্রাণ স্পন্দিত হয়ে ওঠে। তার অতর্শনে প্রাণ আমার জ্বলে যেতো। জানি না, পথের রমণী হয়ে কেন তাকে ভালবাসতে গিয়েছিলাম। সুরী আমাদেরও তো প্রাণ আছে–খালি কাঠাম নিয়ে। শূন্যকে আঁকড়িয়ে ধরে কেউ বাঁচতে পারে না। আমি তো তাই পারি নাই। পরের জিনিসকে চুরি করতে গিয়েছিলাম।

তারপর কয়েকমাসের জন্য তার সঙ্গে দেখা হয় নাই। তাকে না দেখতে পেয়ে জীবনে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। জানতাম, তার বাড়ি গঙ্গার অপর পারে। একদিনে ঘোর অন্ধকার-প্রাণের জ্বালায় বেরিয়ে গঙ্গার বুকে ঝাঁপ দিলাম। বাঞ্ছিতকে পাবার জন্য অসীম বল এসেছিল। বিপুল বলে গঙ্গ পার হয়ে ওপারে গিয়ে উঠলাম। তার প্রকাণ্ড বাড়ি খুঁজে বের করে অনেক কষ্টে বাবুর কাছে যেয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বললাম”দাসীকে আর পায়ে রাখেন না কেন? পথের রমণী বলে কি ঘৃণা করেবেন?” তার পর এক সিংহীর মতো রমণী এসে অমার ঘার আর চুল ধরে বের করে দিয়ে বলেন, “পরের জিনিসের উপর তোমার এত লোভ? লজ্জা করে না?”

দারুণ লজ্জা ও ঘৃণায় ফিরে এলাম বুক ভেঙ্গে গেল। তারপর এক কাজ করেছিলাম। তা অতি ভয়ানক। সে পাপের জন্য ভগবানের কাছে আমাকে অনন্ত শাস্তি ভোগ করতে হবে।

মোহিনীর চোখ ফাটিয়া জল আসিল। আবেগে তার বুক ভাঙ্গিয়া যাইতেছিল।

মোহিনী চাপ দুর্দমনীয় উচ্ছ্বাসে আবার কহিল–“প্রাণের জ্বালা জুড়াইবার জন্য এক কাজ করেছিলাম। এরূপ পৈচাশিক কাজ আমার ছাড়া আর কেউ করতে পারে না। একটা যুবতাঁকে পথের ভিখারিণী করেছিলাম। তার অভিশাপ পলে পলে নরকের মাঝে লক্ষ সাপ হয়ে আমাকে কামড়াবে।

একদিন গঙ্গার ঘাটে যুবতী শুয়েছিল–জানি না-কি জাতি, তার বুকের শিশুকে চুরি করেছিলাম। মনে করেছিলাম, কাছে একটা শিশু পেলে প্রাণের জ্বালা কমবে। বেঁচে থাকবার সুবিধা হবে।

সুরী! সুরী! তোমাকে মা বলতে আমার সাহস হয় না। তোমার কাছে আমি অমার্জনীয় পাপ করেছি। তুমিই সেই মেয়ে। তুমি আমার গর্ভে জন্ম লও নই। তুমি ফুলের মতো পবিত্র ছিলে! তুমি দেবতার গানের মতো স্বর্গীয় ছিলে।”

সুরী লাফাইয়া উঠিল। ”আমি তোমার মেয়ে নই, আমার বাপ-মা থেকে তুমি চুরি করে এখানে এনেছ?”–বলিয়া সুরী মূৰ্ছিতা হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল।

১১-১৫. ইমাম বাড়ির হাসপাতালের খাতা

একাদশ পরিচ্ছেদ

”১৮–” সালের ইমাম বাড়ির হাসপাতালের খাতা খুলে দেখতে দেখতে পাওয়া যাবে একটি কলেজের ছেলের নাম।

আবু মহম্মদ আবদার রহমানের নিউমোনিয়া হয়েছিলো, চিকিৎসার জন্য কলেজ থেকে তাকে হাসপাতালে পাঠান হয়েছিল। এক মাস কেটে গেছে। একটু ভালো হয়েছে। হাসপাতালে যে দিকে মেয়েমহল তাহারই অতি নিকটে অবদার রহমানের সিট। হাসান সেখানে প্রায়ই আসেন। বন্ধুর নীরব-হাসপাতালের দিনগুলি সরস করবার জন্য হাছান বই, খবরের কাগজ প্রত্যহ দুই-তিন ঘণ্টা করে আবুর শিয়রে বসে পড়েন।

বন্ধু এত পরিশ্রম ও যত্ন লইলেও তার দিনগুলি বড় বিরক্তিকর হইয়া উঠিয়াছিল। সম্প্রতি আজ কয়েকদিন হল একটা জোছনার মতো ফুটফুটে সুন্দরী মেয়ে তাহারই পাশের কামরায় এসে বাস করিতেছেন। যুবতাঁকে দেখলে খুব বড় ঘরের মেয়ে বলেই বোধ হয়। তাহার মায়ের হাত পচে গিয়েছিল। কারণ কি তা আবু জানতে পারেন নি। মায়ের শিয়রে একখানা চেয়ার পেতে মেয়েটি রাতদিন বসিয়া থাকে। একটুও তার মুখে বিরক্তির ভাহার নাই।

যুবতী অসাধারণ সুন্দরী। রানীর মতো তাহার সর্বাঙ্গ মহিমা ও সম্পদে ঘেরা। রাতদিন সে মায়ের শিয়রে বসিয়া মাতৃভক্তির পরিচয় দিতেছিল। আবুর মনে ধীরে ধীরে এই মেয়েটির প্রতি একটা শ্রদ্ধার ভাব জাগিয়া উঠিল।

মাঝে মাঝে দুই তিন ঘণ্টা একযোগে বসিয়া থাকিয়া যখন সে ক্লান্ত হইয়া পড়ে তখন চেয়ারখানি টানিয়া বারান্দার রেলিঙ্গের ধারে বসিয়া বই পড়ে। আবুর মনে কৌতূহল উপস্থিত হইল। এমন সুন্দরী মেয়ে লেখাপড়াও জানে, অথচ কোনো পুরুষ মানুষ সঙ্গে নাই। একদিন সন্ধ্যাবেলা আবু ধীরে ধীরে লাঠিতে ভর দিয়ে রেলিঙ্গের পার্শ্বে যাইয়া দাঁড়াইলেন। মেয়েটিকে কি বলিয়া কি জিজ্ঞাসা করিবেন বুঝিতেছিলেন না। অনেক ভাবিয়া জিহ্বার আড়ষ্টতা অতি কষ্টে দূর করিয়া আবু ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলেন ”আপনি ওখানা কী বই পড়ছেন?”

যুবতী সম্ভ্রমের সহিত উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল ”একখানা কোনো কাজের বই নয়। গল্পের বই মাত্র।”

আবু যুবতীর ভদ্রতায় অত্যন্ত মুগ্ধ হইয়া গেলেন। তিনি মধুর স্বরে বলিলেন ”গল্পের বই তো বাজে বই নয়। ভালো গল্পের বই চরিত্রগঠনে বিশেষ সহায়তা করে। মানবচরিত্রের বিপুল জ্ঞান জন্মে। সংসারের, মানব সমাজের ও মনের অনেক খবর গল্পের বইয়ের ভিতর দিয়ে লাভ করা যায়।”

যুবতী কহিলেন–“তা ঠিক–অনেক দৃষ্টি লাভ হয়।”

আবু পরিচয়ের একটু সুবিধা পেয়ে বললেন–“ইনি আপনার কে?”

সুরী কি বলিবে। তাহার সর্বাঙ্গ দিয়া বিদ্যুতের একটা প্রবাহ বহিয়া গেল। মুহূর্তের মধ্যে সুরী ভাবিয়া লইল–সব কথা আপাতত গোপন করিতে হইবে।

সুরী ধীর ভাবে বলিল, “উনি আমার মা।” সুরী মুহূর্তের মধ্যে ভাবিয়া লইল ভদ্রলোক কি কি কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। উচ্চমনা মানুষের সহিত মেশা সুরীর ভাগ্যে কখনও ঘটে নাই। সেও মানুষ। যদি এই সুযোগে একটা ভদ্রলোকের সহিত বা একটা উন্নত আত্মার সহিত সে একটু পরিচয় করিতে পারে তাহাও তাহার পক্ষে লাভ। সমস্ত পৃথিবীর কাছে সে ঘৃণার পাত্র। এই যুবকই যদি জানিতে পারেন তিনি একজন পতিতার সহিত কথা বলিতেছেন, তাহা হইলে লজ্জায় ঘৃণায় তিনি সরিয়া যাইবেন।

সুরী বলিয়া গেল–“এই রুগ্ন মহিলা তাহার মা, এ সংসারে তাদের কেউ নাই। বড় বিপদে তারা পড়েছে। যারা ছিল সবাই মরে গেছে, এক মা ছাড়া তার আর কেউ নাই।”

আবু হৃদয়ে অত্যন্ত দুঃখ অনুভব করিলেন। সহানুভূতিতে তার প্রাণ ভরিয়া উঠিল। সমস্ত রাত্রি সে একা মায়ের শিয়রে জেগে থাকে, কেউ তাকে একটু অবসর দিবার নাই। আবুর ইচ্ছা হইতেছিল এই রুগ্ন দেহেই সে যুবতীর মায়ের সেবায় একটু পরিশ্রম করে।

যুবতী আবুর মনের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিলেন–“আপনি হয়তো আমার কষ্টের কথা ভেবে দুঃখিত হচ্ছেন। আমি একটুও কষ্ট অনুভব করি না। আপনি যদি আমার ভাই হতেন তবে আমি একা আপনাদের দুই জনের সেবা করতে বিরক্ত হতাম না।”

আবু যুবতীর এই অযাচিত স্নেহপূর্ণ হৃদয়ের পরিচয় পাইয়া একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেলেন। ভাবিলেন, ঐরূপ দেব-বালিকার সন্ধান তিনি জীবনে কখনও পান নাই।

ক্রমে আর এক মাস কাটিয়া গেল। আবু সহিত সুরীর একটা অপার্থিব সম্বন্ধ জন্মিয়া গেল। প্রথম প্রথম আবু একটু লজ্জা অনুভব করিতেন। কিন্তু তাহার পর একটা প্রগাঢ় মমতার বলে আবু দু’টি নিঃসহায় ভদ্রলোককে অত্যন্ত আপনার জানিয়া ফেলিলেন।

আবুর স্বাস্থ্য ফিরিয়া আসিল। মোহিনীর অবস্থা ক্রমে অত্যন্ত শোচনীয় হইতে লাগিল। তার পর একদিন প্রাতঃকালে আবু হাসপাতাল ছাড়িয়া গেলেন।

হাসপাতাল একটা বিরক্তিকর স্থান হইলেও আবু এই দুই মাসের অবস্থানে এই বিশ্রী স্থানকেও অত্যন্ত ভালবাসিয়া ফেলিয়াছিলেন। আসিবার সময় সুরী তাহার জলে ভরা আঁখি অবনত করিয়া বলিয়াছিল–“আপনাকে ভাইয়ের মতো ভালবেসে ফেলেছি। আমাদের। খবর নিতে ভুলবেন না। আমাদের বাড়ি ৮নং … বাগানে।”

.

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

আজমপুরে আবু মহম্মদ আবদার রহমান তাহাদের পুরানো ছোট দালানের রকের উপর বসিয়া কাগজ পড়িতেছিলেন। বৈকাল বেলার শীতল বাতাস থাকিয়া থাকিয়া প্রবাহিত হইতেছিল। আবুর ছোট বোন আসিয়া বলিল–ভাইজান, চাচি আপনার সঙ্গে কি কথা বলতে চান। তিনি মায়ের কাছে অপেক্ষা কচ্ছেন।”

গ্রাম্য সম্পর্কে এমদাদ আলী মিঞার স্ত্রী আবদার রহমানের চাচি। বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নয়। তা ছাড়া দূর দেশ হইলে সামান্য সম্পর্কেও যেমন ঘনিষ্ঠতা হয়, গ্রামে আবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠতা বলিয়া কেউ কাকেও স্বীকার করে না। কেউ কাকেও ঘনিষ্ঠ পরিচয় দিতেও ইচ্ছা করে না।

আবু বুঝিতে পারিয়াছিলেন–তাঁর চাচি কি জন্য তার কাছে আসিয়াছেন। তিনি এমদাদ আলী সাহেবের স্ত্রীর নিকট যাইয়া সালাম করিয়া কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন।

এমদাদ মিঞার স্ত্রী দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বল্লেন–“বাবা! ঘরে যার সেয়ানা মেয়ে, তার কাছে কুশল জিজ্ঞাসা করো না! বুকের রক্ত ভাবতে ভাবতে পানি হয়ে গেল।”

আবু দুঃখপূর্ণ স্বরে বলিলেন–“তা ঠিক চাচি! আমার যতদূর সাধ্য তা আমি কচ্ছি এবং করবো।”

এমদাদ মিঞার স্ত্রী জলে চক্ষু ভারিয়া আবুকে আর্শীবাদ করিয়া বলিলেন–“তোরা তো পর নস বাবা। আমার মেয়েও যা, তোর বোনও তাই।”

আবু জিজ্ঞাসা করিলেন–“সম্প্রতি হাছানের বাপের সঙ্গে আর কোনো কথা হয়েছে কি?”

এম-স্ত্রী-তিনি তো অনেক দিন থেকেই আশা দিয়ে আসছেন। তত্রাচ ভরসা পাই না। মেয়ে ক্রমশ বেড়ে উঠছে, চিন্তায় রাত্রে ঘুম হয় না। তুমি বাবা প্রাণপণে একটু চেষ্টা করো। যেন দু’কূল না হারাই।

আবু–আমেনা-লেখাপড়া জানে, কোরান পড়তে পারে, ফারসিও সে বেশ বুঝে। বাংলা-ইংরেজিও তার বাপের কাছে পড়েছে। মেয়ে আপনার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। যারা মেয়েকে উপযুক্ত না করে ভালো বর খোঁজে তারা যার পর নাই অন্যায় করে। মেয়ে যার সঙ্গে সারাজীবন বসবাস করবে, তাকে একটু ভালো করেই পরীক্ষা করে, শিক্ষিত লোক বিয়ে করে। যা-তা একটা মেয়েকে একটা শিক্ষিত লোকের গলায় বেঁধে দিয়ে তার সারাজীবনের অভিশাপের পাত্র হওয়া ঠিক নয়। রান্না-সংসার ছাড়া আরও একটা সংসার আছে, সেটা আমাদের গ্রামের লোক বুঝে না, এটা বড় অন্যায় কথা।

এমদাদ মিঞার স্ত্রী আবুর মুখের দিকে তাকাইয়াছিলেন। তিনি সার জীবনের অভিশাপ–আর একটি জগৎ ইত্যাদি কথা বুঝতে না পারিয়া বলিলেন, “বাবা তোরা কত কি বই পড়েছিস–তোরা কত কথা জানিস–তুই যদি চেষ্টা করিস তা হলে তোর বোনের বিয়ে হতে দেরি হবে না। আমেনা লেখাপড়া জানে বাবা! তোরা ছাড়া আর তোর চাচির কেউ নাই। মৌলবী সাহেবের কথা ছেড়ে দাও। মেয়ের কথা বলে বলেন–আল্লাহ মানুষের সুখ-দুঃখের কথা সর্বদা চিন্তা কচ্ছেন। খোদার হাতে সব সঁপে দাও। তুমি আমি চিন্তা করে কী করবো।” কথা তো ঠিক-তাই বলে কি চিন্তা ছেড়ে বসে থাকা যায়।

আবু–তা তো ঠিক চাচি-আচ্ছা আপনি অত চিন্তা করবেন না। আমেনাকে আমি নিজের বোনের মতোই জানি। আমার দ্বারা যা হয় করবো।

এমদাদ–স্ত্রী–আচ্ছা তুমি মধুপুর কবে যাবে।

আবু ডাক্তার বলেছেন যত শীঘ্র সম্ভব যাওয়া আবশ্যক। এবার তো আর বাঁচবার আশা ছিল না।

এমদাদ মিঞার স্ত্রীর চক্ষু জলসিক্ত হইয়া উঠিল।

আবু–মাকে একবার দেখতে এলাম, নইলে ঐ পথ দিয়েই চলে যেতাম। দুই একদিনের মধ্যেই আমি যাত্রা করবো।

এম-স্ত্রী-আচ্ছা, তোমার যাওয়ার আগিই একবার হাছানের সঙ্গে দেখা করে গেলে ভালো হয় না। মুধুপুর গেলে৩/৪ মাসের মধ্যে তো তুমি ফিরে আসতে পারবে না।

আবু–আপনি ব্যস্ত হবেন না। প্রাণপণে আমি চেষ্টা করবো।

এমন সময় বাহির হইতে পিয়ন আসিয়া “সাহেব বাড়ি আছেন?” বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিল। আবু এমদাদ মিঞার স্ত্রীকে পুনরায় ছালাম করিয়া বহিরে আসিলেন।

পিয়নের নিকট হইতে একখানি চিঠি গ্রহণ করিয়া আবদার রহমান দেখিলেন, পত্রখানি বন্ধু আহমদ হাছান লিখিয়াছেন।

চেয়ারখানি টানিয়া লাইয়া আৰু পড়িলেন। পত্রে লেখা আছে : ‘প্রিয় বন্ধু, অনেকদিন বাড়ি গিয়াছ। কোনো সংবাদ না পাইযা দুঃখিত আছি। সত্বর কুশল-কথা লিখিয়া চিন্তা দূর করিবা। পরীক্ষা শেষ হইয়া গিয়াছে। ভালোই লিখিয়াছি। খোদার ফজলে পরীক্ষায় কৃতকার্য হইব, কোনো সন্দেহ নাই। তোমার মধুপুরে যাইবার দেরি কত? অনর্থক বাড়ি যাইয়া বসিয়া থাকা অপেক্ষা ইচ্ছা করিয়াছি তোমার সঙ্গে মধুপুরে যাইব!

ইহাতে দুইটি সুবিধা বুঝিতেছি। প্রথম আমার দেশ দেখা হইবে, দ্বিতীয় তোমাকে একটু সেবা করিবার সুবিধা পাইব। আমি প্রস্তুত রহিলাম। তুমি কোনো দিন আসিবে জানিতে পারিলেই আমি ঠিকঠাক থাকিতে পারি।”

বন্ধু হাছানের সহানুভূতি ও প্রেমপূর্ণ পত্র পাইয়া আবদার রহমান যার পর নাই আহলাদিত হইলেন।

কালবিলম্ব না করিয়া পর দিন প্রাতঃকালেই তিনি টেলিগ্রাম করিয়া দিলেন ”আমি অদ্যই সন্ধ্যাকালে রওনা হইতেছি।”

.

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

হাওড়ার স্টেশন লোকে লোকারণ্য। মধুপুরের ট্রেনে রাত্রি আটটার সময় ছাড়ে। সেদিন জ্যোৎস্নায় সমস্ত জগৎ প্লাবিত। পূর্ব হইতেই দুইটি সেকেন্ড ক্লাস সিট রিজার্ভ করা হইয়াছিল। সঙ্গে একটি মাত্র চাকর।

হাছানের তামাক টানিবার অভ্যাস ছিল। দিনরাত্রি সমানভাবে চলিত। আবু তামাক পান কিছুই স্পর্শ করিতেন না, বন্ধুর বিরক্তি উৎপাদনের ভয়ে হাছান জানালার পার্শ্বে যাইয়া অনবরত ধূমপান আরম্ভ করিলেন।

গাড়ি যখন আসানসোলে পৌঁছিল তখন একটা বাঙালি প্রৌঢ়া পাগলী গাড়ির দরজায় ধাক্কা দিতে লাগিল। তাহার চেহারা দেখিয়া মনে হয় সে কোনো উচ্চ বংশের মেয়ে ছিল। তাহার আঁখিতে যেন একটা উদাস ও গভীর দৃষ্টি মাখান। সে আসিয়া অত্যন্ত দৃঢ়স্বরে দরজা। খুলিতে বলিল। হাছান তামাকের নল হাতে করিয়া ঘুমাইয়া গিয়াছিলেন। সে গাড়িতে আর কোনোও আরোহী নাই। সুতরাং বাধা দিবার কেহ ছিল না। আবু যন্ত্রচালিতের মতো অগ্র পশ্চাৎ না ভাবিয়া দরজা খুলিয়া দিল।

পাগল যে রূপ করে এই প্রৌঢ়া রমণী সেরূপ বিশেষ কিছু করিল না। গাড়ির ভিতর প্রবেশ করিয়াই সে বললে, “বাবা। আমি পাগল, সময়ে সময়ে আমার মাথা ঠিক হয়।”

আবু জিজ্ঞাসা করিলেন–“তোমার বাড়ি?”

পাগলী কহিল–“নদীয়া।”

আবু অত্যন্ত বিস্মিত হইয়া কহিলেন–“নদীয়ায়?”

পাগলী ধীরভাবে কহিল–“হ্যাঁ, নদীয়ায়।”

পাগলী ভীতিহীন মনে জিজ্ঞাসা করিল–“তোমার বাড়ি?”

আবু বিরক্তি প্রকাশ না করিয়াই উত্তর দিলেন ”নদীয়া, আজমপুরে!”

পাগলী অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া কহিল–“আজমপুরের হরিঠাকুরকে চেন? তার বৌকে চেন?”

আবু কহিলেন ”হ্যাঁ চিনি, নাম তার শান্তা; তার মেয়ে নদীর ঘাটে হরিয়ে গিয়েছিলো। তিনি যখন বাড়ি ফিরে এলেন তখন থেকে আর কেউ তাঁকে কথা বলতে বা হাসতে দেখে নি। একদিন তিনি বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে গেলেন! আর সন্ধান হল না। তখন তাঁর যুবতী বয়স। এখনো তাঁর কথা মনে হলে আমাদের দুঃখ হয়। আমাদের অনেকখানি শ্রদ্ধার পাত্র তিনি ছিলেন।”

প্রৌঢ়া বলিল–“আমি সেই!”

বর্ষাকালে মাঠের মাঝে কোনো বালকের মাথার কাছে বজ্রনিনাদ হইলে সে যেমন চমকিত হয়, আবু তেমন চমকিত হইলেন। এই সেই হরিদয়লের বৌ। আবুর সর্বাঙ্গ দিয়া একটা স্পন্দন ছুটিয়া গেল। এই চলন্ত গাড়ির মাঝে কত বছর আগেকার সেই বৌটি, কতকাল ব্যাপী হাজার বিচিত্রতার দাগ নিয়ে, আপ তারই সম্মুখে উপস্থিত। কী বিস্ময়! কী আশ্চর্য!

আবু তাড়াতাড়ি বেঞ্চ ছাড়িয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। তার পর তিনি বিছানা হইতে কম্বল টানিয়া মাটিতে বিছাইয়া রমণীকে বসিতে অনুরোধ করিলেন। রমণী কম্বল সরাইয়া রাখিয়া কহিল–“আর সম্মান চাহি না।”

আবু কথা বলিতে পারিতেছিলেন না। শুধু ভাবিতেছিলেন,এত বছর পর হরি ঠাকুরের বৌয়ের তার সঙ্গে এই চলন্ত গাড়ির ভিতর দেখা হইবার কারণ কি? আর এক কথা–সে তো পাগল। এত শৃঙখলা মতো সে কেমন করিয়া কথা কহিতে পারিতেছে?

রমণী বলিলেন–“আজ বহু বৎসর তোমার সন্ধানে আছি–তুমি আমার মেয়ের খবর জান। বল আমার মেয়ে কোথায়?”

আবু ভীত হইয়া পড়িলেন–হরিদয়ালের মেয়ের সঙ্গে তার কী সম্বন্ধ? তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আজ বহু বৎসর রমণী ঘুরিতেছে–তারই বা অর্থ কী?

আবু একটু ভীতির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন–“আমি আপনার মেয়ের সংবাদ জানিলাম কেমন করিয়া?” আবু বিস্ময়ে পুনরায় ভাবিলেন–এক গ্রামের লোক, হরিদয়াল ঠাকুরের স্ত্রী আজ এত দীন ও মলিন বেশে তার সম্মুখে। কোনো কালে শান্তার সঙ্গে সামনাসামনি তার দেখাশুনা বা পরিচয় না থাকিলেও দুঃখে ও সহানুভূতিতে আবুর মন ভরিয়া উঠিতেছিল।

আবু অত্যন্ত বিনীত শ্রদ্ধার কণ্ঠে বলিলেন–“আমি আপনার মেয়ের সংবাদ জানি কেমন করিয়া, দয়া করে বলুন।”

রমণী বলিলেন–“শোন–যেদিন হুগলী থেকে বাড়ি ফিরে যাই সেদিন মনে হচ্ছিল–সংসারে ধর্ম নাই। সংসারের সকল লোকগুলোকে নাপিশাচ বলে মনে হচ্ছিল–ভাবছিলাম মিথ্যা ধর্ম-মিথ্যা ঈশ্বর-মিথ্যা দেবতা-মিথ্যা পূজা!

একটা ভীষণ যাতনায় আমার গলা বন্ধ হয়ে আসছিল–চোখে আমার জল ছিল না। একখানি ছোরা হাতে করে সংসারে সব মানুষগুলোকে খুন করার দারুণ বাসনা হচ্ছিল। ভাবছিলাম যাবৎ একটা মানুষ এ জগতের অত্যাচার ভোগ করে তাবৎ মানুষ কেন উপাসনা করে? এ পূজাগুলিই বা কী? আমাকে এমনি করে পাগল করে ভগবানের কি সুখ হয়েছিল? এটা কি পরীক্ষা? রাক্ষসী আমি; এ পরীক্ষার কোনো মূল্য বুঝি না। এ জগতে এত দুঃখ ও বেদনা কেন? জগৎ যদি সৃষ্টি না হতো তা হলে কে এত দুঃখ ভোগ করতো, কোথায়ও মানুষ স্বর্ণসিংহাসনে বসে স্বর্গসুখ অনুভব করছে,কোথায় মানুষ দুঃখ ও বেদনায় চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

আমি সেদিন কী যাতনা ভোগ করছিলাম তা কয়েকজন যুবক ছাড়া আর কেউ তো জিজ্ঞাসা করলে না! চন্দ্রসূর্য তেমনি করে উঠেছিল। মানুষের সমাজ তেমনি করে বয়ে যাচ্ছিল। সমস্ত সংসারটা সেদিন পাপ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষেপে উঠলো না কেন? মানুষ কি উপাসনা করে! সে জ্বালার মীমাংসা কোথায় ছিল? চোখের সামনে আমার সোনার শিশুকে চুরি করে নিলে! তখন আকাশ থেকে বজঘাত হল না! কিন্তু আমার শিশুর হাসি,তার সুষমা অমার বুকের কোণায় বেঁধে ছিল। কোনো পাষণ্ড আমায় এমনি করে শ্মশানে বসবার আদেশ দিয়ে গেল?

মানুষ অন্যায় ও পাপ করে। তাদের বুক কাঁপে না, তাদের হাত অবশ হয়ে যায় না। আরও বিচিত্র এই অন্যায় ও পাপের বিরুদ্ধে না দাঁড়িয়ে মানুষ উপাসনা করে। এরই বা অর্থ কী?

বাড়ি এলেম, কিন্তু কী বিস্ময়? শাশুড়ি এলেন আমাকে মারতে। আমারই অমনোযোগিতায় খুকি হারিয়ে গিয়েছে–এই তিনি বল্লেন। আমি হাসি সংবরণ করতে পারলাম না। আমার হাসি দেখে শাশুড়ী আমাকে ঝাঁটা দিয়ে মারলেন। তিনি বললেন–হৃদয়হীনা রাক্ষসী! বুকে তোমার কিছুমাত্র মায়া নেই।”

এতক্ষণে রমণী ‘ভগবান’ বলিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।

তার পর আবার বলিতে আরম্ভ করিলেন–“স্বামী হরিদয়াল বুঝেছিলেন আমার সেই হাসির অর্থ কী? দেখতে পেলাম আমার হাসি দেখে তিনি কেঁপে উঠলেন। মায়ের সামনে তিনি কোনো কথা বলতে সাহস করলেন না। তাঁর কথা মনে হলে আমি পাগলী হয়েছি তবুও আমার বুক ফেটে যায়! বালিকা বয়সের স্বামী তিনি আমার। যেদিন বিবাহ হয়, সেদিন প্রাণের শত আশা-আকাক্ষার সিংহাসন গড়ে তাকে সেখানে বসিয়েছিলেন। কোথায় আমার হরি? কয়েকদিন তার সঙ্গে স্বপ্নের ঘর বেঁধেছিলাম। জীবনটা পথে পথে কেটে গেল।

শাশুড়ীর সঙ্গে সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যে আমি সকলেরই শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলেছিলাম, শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন না কেবল তারা। আমার দিকে চাইতেই তিনি কেঁদে ফেলতেন। পাছে কেউ দেখে তাকে দুর্বল বলে নিন্দা করে; এই ভয়ে তিনে তাড়াতাড়ি আমার সম্মুখ হতে সরে যেতেন।

বলতে ভুলেছি, বাড়ি আসাবার দুদিন পর থেকে শাশুড়ী আমার শোবার জন্য স্বতন্ত্র ঘর করে দিলেন। সকলে বললে, আমি পাপী না হলে এমন বজ্রাঘাত আমার মাথার উপর পড়ে? শাশুড়ী বল্লেন, প্রায়শ্চিত্ত না করে তার বিছানার ত্রিসীমানায় আমি না যাই। আমার নিশ্বাসে অমঙ্গল আছে। আমি রাক্ষসী। আমি পূর্বজন্মে ডাইনী ছিলাম। নইলে দিনে-দুপুরে কোলের মেয়েকে হারিয়ে ফেলি? সেদিন আমি কাউকে গ্রাহ্য না করে খুব করে হেসেছিলাম।

নিশীথে একাকী নিঃসঙ্গ হয়ে শুয়ে আছি। দুপুর-রাতে দেখতে পেলাম শিয়রে দাঁড়িয়ে স্বামী কাঁদছেন। একটা দ্বিতীয় রকমের যাতনায় মন আমার অস্থির হয়ে উঠেছিল–সংসারের একি অত্যাচার? অধর্ম, মূর্খতা আর অন্যায়-মুরুব্বী এবং ধর্মের সাজে এত মানুষকে পশু করে তুলেছে। মানুষের জন্য এত দুঃখ রচনা করছে।

মনে হল এই পাপে ভরা সংসারে আর থেকে কাজ নাই। কয়েকদিনের ভেতর দেখতে পেলাম, স্বামীও যেন কেমন হয়ে গেছে। যে আসে সেই বলে এই ডাইনীকে ঘরে রেখে ভালো হবে না। একে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দাও। মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে একেও গঙ্গার ঘাটে রেখে আসতে পার না। যদি ভালো চাও তবে বৌয়ের সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ ত্যাগ কর।

মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো! স্ত্রীলোকের মনের উপর এত অত্যাচার! সমস্ত সংসারটা যেন একটা অগ্নিময় নরক বলে আমার বোধ হল। বেশ বুঝলাম সংসারে ধর্মের নাম গন্ধ নাই। সব মানুষই শয়তানের উপাসনা করে।

মাথা ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠলো। মানসিক অবস্থা ক্রমে অতি ভয়ানক হল। একটি মানুষও সহানুভূতি জানাতে থাকলো না। স্বামী মানুষের কথায় অত্মশক্তি বজায় রাখতে পারলেন না। সেই ধর্মহীন পশুগুলোর কথায় আমার আত্মা নূতন চিন্তা ও বিদ্রোহে অতি ভীষণ হয়ে উঠলো।

আমি পাগল হয়ে একদিন বেরিয়ে পড়লাম। আমি ঠিক পাগল হয়েছিলাম না। সকলে আমাকে নূতন রকমের দেখে পাগল বলতে আরম্ভ করলে। পাগল মানি কী? যার চিন্তা ও ভাবের সহিত সংসারের দশজলে সহিত মিল খায় না, সেই তো সমাজে পাগল বলে পরিচিত হয়।

একটা নূতন রকমের ভাবে ও উত্তেজনায় আমি উদ্ভ্রান্ত হয়ে উঠলাম।

পাপ সংসার হতে একটা অসীম বেদনায়, একটা প্রচণ্ড আশাতে, একটা নূতন শক্তির উত্তেজনায় যাকে পাই তাকেই গালি দিয়ে–চোখে একটা ভীষণ ও রুদ্রভাব মেলে বেরিয়ে পড়লাম।

.

চুতুর্দশ পরিচ্ছেদ

”তখন দুপুর বেলা–মাঠ ধু-ধু করছিল। প্রখর সূর্যতাপে মাঠের ভিতর মরুর অভিনয় হচ্ছিল। আমি হন হন করে সেই পথ দিয়ে চলতে লাগলাম।

ধীরে ধীরে স্বামীর বাড়িখানি দূরে মিশে গেল। কোনো মায়া হচ্ছিল না। আমার অকৃত্রিম স্বামী প্রেম দারুণ ঘৃণায় পরিণত হয়েছিলো। হায়, মানুষের মন কী বিচিত্র! এত প্রেম দুদিনেই ছাই হয়ে গেল।

তারা মনে করেছিলো–আমি ফিরে যাব। কিন্তু ফিরলাম না। মানুষের সোজা পথ ফেলে বন অতিক্রম করতে করতে ঘুরে ঘুরে দ্রুতপদে চলতে আরম্ভ করালাম কোনো ভয় হল না।

দিন চলে গেল! ক্রমে বনে বনে অন্ধকার জমাট বেঁধে উঠতে লাগল। ক্ষুধা ছিল না। মনে হচ্ছিল, ক্ষুধা হতে আমি মুক্ত হয়েছি। আর কোনোকালে ক্ষুধা হবে না। জঙ্গলের মধ্যে পাতা বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত কোন পথে কেটে গেল।

সকাল বেলায় উঠে দেখি গাছের আগায় পাখিরা সব গান গাচ্ছে। মনে আনন্দ হল–একটা বিচিত্র ধরনের পাখি দেখে তাকে পেতে ইচ্ছা হল। অমনি পাখি ধরবার জন্য গাছের আগায় উঠে পড়লাম। আমি পূর্বে কখনো গাছে উঠি নি–তাতে কোনো অসুবিধা বোধ করলাম না।

নিষ্ঠুর পাখি আমার দেহকে অবহেলা করে, অথবা মানুষের মূল্যহীন পরিবর্তনশীল প্রেমকে ভয় করে উড়ে গেল। গাছের শীর্ষে দাঁড়িয়ে দেখলাম সীমাহীন উদার আকাশ, কতদূর আকাশ ও পৃথিবী একসঙ্গে মিশেছে! শ্যামল মাঠ। উত্তর-পশ্চিম দিকে একটা ছোট নদী বয়ে যাচ্ছিল। একটা ছোট গ্রাম তার পার্শ্বে অর একটা দেবতার মন্দির।

গাছ থেকে নেমে সেই দিকে চল্লাম। একটা বড় মাঠ হতে হলো। হাঁটতে হাঁটতে বেলা অনেক হয়ে গেল। গত দিন সন্ধ্যাকালে একটু ক্লান্তি অনুভব করেছিলাম, আজ সে ক্লান্তি নাই। আবার দ্বিগুণ উৎসাহ ফিরে আসিয়াছে।

গ্রামে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিল–সেইটাই মন্দির। মন্দিরের সামনে যেয়ে দাঁড়াতেই পূজারী বামন আমার দিকে একটা তীব্র কটাক্ষ নিক্ষেপ করলেন। যাঁরা দেবতার সামনে বসেছিলেন তারা দেবতার চিন্তা ছেড়ে, আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আমার চিন্তা আরম্ভ করলেন। আমি সব বুঝতে পাচ্ছিলাম।

পূজা হতে আরও দু’ঘণ্টা লাগল। ব্রাহ্মণ মন্ত্র পাঠ করতে অনেকবার এদিক ওদিক চাইবার ভানে আমার রূপ দেখছিলেন। আমি তা বুঝে মনে মনে হাসছিলাম।

পূজা শেষ হল, ধর্ম-জনতা ভেঙ্গে আমার চারিপাশে নূতন জনতার সৃষ্টি হল–আমি অবাক হয়ে তাদের বিচিত্র ধর্মভক্তির কথা ভাবতে লাগলাম।

একজন জিজ্ঞাসা করলে, সুন্দরী! তোমার নাম?

আমি কহিলাম—”আমি কী তোমার ঘরের বৌ? সুন্দরী বলে আমাকে সম্বোধন করবার তোমার কী অধিকার আছে?”

আর একজন একটু বিরক্ত হইয়া একটু দয়ার সহিত জিজ্ঞাসা করলে, বাছা তোমার বাড়ি?

আমি কহিলাম-বাড়ি আমার বাংলাদেশে। সে আবার জিজ্ঞাসা করিল–“জাতি? আমি বিরক্ত হইয়া বলিলাম কী জাতি? তা দিয়ে তোমার কী? আমার সঙ্গে তোমার বিয়ে?”

সকলেই হেসে উঠলো–একজন বললে ”তোমার বাবা কী জাতি ছিল?”

আমি কহিলাম “মানুষের জাতি কী? ঈশ্বর আছেন, মানুষ আছে। অমনুষের পিতা ঈশ্বর। আমি কোনো জাতির ধার ধারি না।“ ব্রাহ্মণ আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিলেন, ‘মেয়েটিকে এত বিরক্ত করেছো কেন? পাগল মানুষ নিয়ে পূজার বাড়িতে রহস্য করা পাপ! যাও সকলে বাড়ি যাও।’

জনতা ভেঙ্গে গেল। তার পর ব্রাহ্মণ আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন–’বাছা, এই পূজার ঘরের সামনে বসে থাক। কারুর সঙ্গে কথা বলো না। মায়ের প্রসাদ এলে খেতে পাবে।

ব্রাহ্মণের অনুগ্রহে মুগ্ধ হলাম। মুহূর্তের মধ্যে যেন সংসারকে আপনার বলে মনে হল। আমি পূজা দালানের রকে বসে পড়লাম।

.

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

”কয়েক দিন সেখানে কেটে গেল। ব্রাহ্মণের স্নেহে মাথার গোলামাল অনেকটা কমে গেল।

একদিন নিশীথকালে শুয়ে আছি, দেখলাম–ধীরে দরজা খুলে যাচ্ছে। বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইলাম। সম্মুখে পূজারী ব্রাহ্মণ। কিছু কথা না বলে চুপ করে পরে থাকলাম। ভাবলাম ব্রাহ্মণের কোনো কাজ আছে।

কী আশ্চর্য! ব্রাহ্মণ ধীরে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো, তার পর যা দেখলাম তাতে মাথাটা আবার কেমন হয়ে যেতে লাগল, সহসা সংসারের উপর দারুণ ঘৃণা জমে এলো, বাঘিনীর মতো লাফিয়ে উঠে বললাম, ব্রাহ্মণ এ কি?”

সে যেন সহসা কেমন হয়ে উঠলেন। মাথা তার নুয়ে পড়লো! সে কাঁপতে কাঁপতে বল্লে–‘আমি ব্রাহ্মণ, দেবতার অংশ! আমাকে সন্তুষ্টি করলে পুণ্যি হবে। আমার বিরুদ্ধে কাজ করবার তোমার অধিকার নাই।’

সিংহিনীর মতো বললাম—’তুমি চণ্ডাল, ব্রাহ্মণ বলে যে তোমাকে স্বীকার করে সেও চণ্ডাল।’

ব্রাহ্মণ মৃদুভাবে উত্তর দিলো–’ব্রাহ্মণের কাজে সমালোচনা করতে যাবার তোমার কি ক্ষমতা আছে? আমি ব্রাহ্মণ! তুমি আমাকে ভক্তি করবে। আমার পাপ আমার কাছে। তোমাকে শুধু মানতে হবে আমাকে। শুধু আমাকে সেবা করবে।’

আমি কহিলাম—’কোন গর্দভ তোমাকে এ জ্ঞান শিখিয়েছে? এরি নাম ব্রাহ্মণত্ব! ব্রাহ্মণ কাকে বলে তা তুমি জান? পৈতা দিলেই ব্রাহ্মণ হয় না! যারা তোমাকে ব্রাহ্মণ বলে মানে, তারা ধর্ম না করে অধর্ম করে।’

ব্রাহ্মণ দৃঢ়স্বরে বলিল-‘বটে! আমি ব্রাহ্মণ নই! দেবতাকে অসন্তুষ্ট করে তুমি বেঁচে যাবে? এখনও বলছি আমাকে সন্তুষ্ট করো।’ এই কথা বলেই সে দুই হাত তুলিয়া আমার দিকে অগ্রসর হল? আমি প্রচণ্ড পদাঘাতে তাকে দূরে ফেলে দিলাম। তার মাথা ভেঙ্গে গেল।

ব্রাহ্মণ ক্রোধে কাঁপিতেছিল। সে হাত তুলে বললে—’দেখ মাগি, তুই কে তা আমি জানি, আমার সঙ্গে চালাকি! প্রতিজ্ঞা করলাম কাল রাতে মুসলমানের দ্বারা তোর জাতি নষ্ট করে ছাড়বো।’

আমি বলিলাম, তুমি ব্রাহ্মণ। তোমার অভিশাপে ফুলের বাগান শ্মশান হয়। আমাকে অভিশাপে ভস্ম করে দাও। মুসলমানকে ডাকা কেন?

 ১৬-২০. সে সমস্ত দিন

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

সে সমস্ত দিন আমাকে তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছিল। একটু জলও আমায় খেতে দেয়

নাই। ক্ষুধায় তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছিল। সন্ধ্যাকালে অবসন্ন হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

অনেক রাতে দরজার সামনে কীসের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলাম দরজা খুলে যাচ্ছে! এক অতি বলিষ্ঠ ভীষণকায় মানুষ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে, ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল।

লোকটা মোটা গলায় বললে-‘ঠাকুর, দরজা একেবারে বন্ধ করবেন না! চাবি ফেলে যান। যা করাবার আমি করবো। আপনি এখান থকে চলে যান। নইলে কিছু হবে না।’

বাহির হইতে গম্ভীর আওয়াজে কে বললে, “আচ্ছা।’

লোকটি তাহার দৈত্যির মতো চেহারা নিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু এ কি? সেই ভীষণকায় দৈত্য দেবতার মতো বললে, ‘মা উঠে পড়, উঠে পড়। তোমাকে বাঁচাতে এসেছি। ব্রাহ্মণ অতি ভীষণ লোক, ফাঁকি দিয়ে বাঁচাতে এসেছি। খবরদার! পাগলামি করিস না। চুপে চুপে বেরিয়ে পড়।’

আমি কথা না বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম।

সেই লোকটি আর দেরি করল না। বহিরে এসে সে আমাকে বললে, ‘আমার সঙ্গে আয়।’ এই কথা বলেই সে মাঠের দিকে রওনা হল, আমি তার পেছনে পেছনে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম।

গভীর নিশা, চারিদিক অন্ধকার। লোকটা বললে, তুই আমাকে তো চিনিস না। কোনো ভয় নাই। আমার বাড়ি এক ক্রোশ দূরে। এই রাত কালেই আমার বাড়ি ছেড়ে আরও তিন ক্রোশ পথ যেতে হবে; নইলে উপায় নেই। আমার বোনের বাড়ি লাহিড়ীপাড়া। সেখানে তোকে রেখে তোর সোয়ামীকে খবর দেবো।

আমি কহিলাম, ‘সোয়ামীর ঘর যে কোনো কারণেই হোক ছাড়লে আর সেখানে যাওয়া ঠিক নয়। ঘরে যদি আগুন লাগলে বাড়ির ভিতর পুড়ে মরা ভালো, তবুও বাড়ি ছেড়ে বেরোনা ঠিক নয়। তাতে স্বামী সতীত্ব সম্বন্ধে অবিশ্বাস করতে পারেন। আমার মাথা একটু খারাপ হয়েছে, পাগল হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছি, স্বামীর ঘরে আর আমার যাওয়া। হবে না।’

লোকটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, আচ্ছা, খোদা যা করেন, তাই হবে। আমি একজন লেঠেল, শয়তান ব্রাহ্মণ মনে করেছিলো আমি লেঠেল এবং মুসলমান, যে কোনো পাপ আমি করতে পারি। তোর সর্বনাশ করাবার জন্য আমাকে টাকা দিয়েছে। দশটা টাকার কথা বলেই ঘৃণার সঙ্গে মাঠের মধ্যে টাকাগুলি সে ফেলে দিয়ে বললে—’হারামি টাকা মুসলমান শূকরের গোস্ত মনে করে। চাইনে অমন শয়তানি টাকা! ব্রাহ্মণ মনে করেছিলো সামান্য দশটা টাকার লোভে আমি যে কোনো পাপ করতে পারবো। আমার ধর্ম কী? তা সে জানে না! আমাদের মহারাজ মোহাম্মদের মহিমা কে বুঝে? মুসলমান কি? তা। সেই কাফের কি করে জানবে?’

আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভক্তির সহিত বলিলাম–’সর্দার, তুমি আমার পুত্র, তুমি আমার পিতা, তুমি দেবতা; এই কথা বলে আমি সর্দারের পদধূলি গ্রহণ করলাম।‘

সর্দার বাধা দিয়ে বললে, ‘মা তোমার সালামের দরকার নাই। আমি যে তোমাকে বাঁচাতে পেরেছি এ জন্য খোদার কাছে হাজার শোকর।’

আনন্দে ভক্তিতে আমার চোখে জল আসল। ইচ্ছা হল সর্দারকে দেবতা বলে পূজা করি। তার পা দুখানি বারে বারে চুম্বন করি।

প্রভাত হতে একটু দেরি ছিল। আমরা এক নদীর ধারে এসে দাঁড়ালাম! দেরি করবার সময় ছিল না। গন্তব্যপথ আর এক ক্রোশ দূরে। কাছে কোনো নৌকা ছিল না। নদীটি বিশেষ বড় নয়! সর্দার বললে, ‘যেমন করে তোক আমাদের নদী পার হতেই হবে। কোনো নৌকাও তো দেখতে পাচ্ছি না।’

আমি বললাম, ‘ছোট নদী যখন, আমি সাঁতার দিয়েই পার হতে পারবো।’ ভালো করে কাপড় এঁটে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সর্দার আমার কাছে কাছেই রইল। ভয় পাছে আমি ডুবে যাই।

দুমিনিটের ভিতর পার হয়ে আবার একটা মাঠ পার হতে আরম্ভ করলাম। মাঠ পার হতে প্রায় এক ঘণ্টা লাগলো। গ্রামের দক্ষিণ পার্শ্বে একটা বাড়িতে আমরা উপস্থিত হলাম। চারখানি ঘর! সর্দার দেরি না করে বোনকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন।

সর্দারের বোন দেখতে খুব কালো, সে অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। সর্দার তার বোনের ভাব বুঝতে পেরে বললে, ‘বুবু তুমি বিস্মিত হয়ো না। ইনি হচ্ছেন আমার মা। দক্ষিণদোয়ারী ঘরখানি ছেড়ে দাও। উনি হিন্দু, উহার পাক আলাদা হবে। দেখো যেন। মার কোনো কষ্ট না হয়। আমার আর দেরি করবার যো নাই, আপাত এ দুটাকা নাও।‘

সর্দারের বোন টাকা নিলো না। সে বললে, ‘সে কি কথা? উনি তোমার মেয়ে তা হলে আমারও মেয়ে। আমাদের কোনোও অভাব নাই, আমরা একটা লোককে সারা বছর বসিয়ে খাওয়াতে পারি।’

সর্দার বললে, ‘আচ্ছা, আমার আর সময় নাই। আমি আবার কাল আসবো। দেখো যেন মায়ের কোনো কষ্ট না হয়।’

কথা বলে সর্দার আমার দিকে একবার আশ্বাস ও স্নেহভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গেল।

সর্দারের বোন আমাকে যত্ন করে বসতে দিল। ভিজে কাপড় দেখে তাদের বাড়ির কাঁচা জোলার তৈরি একখানা মোটা কাপড় এনে দিলে, আমি তাই দিয়ে কাপড় ছাড়লাম।

.

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

‘এক মাস কেটে গেল। সর্দার প্রায়ই আমাকে দেখে যেতো, আমার কোনো কষ্ট ছিলো। একদিন বিকাল বেলা সর্দার মুখখানা ভার করে বলে, ‘মা’ বড় বিপদ উপস্থিত!’ আমি বলিলাম—’কী বিপদ সর্দার?’

সর্দার। সেই কাফের ব্রাহ্মণ জমিদারের কাঁচারীতে নালিশ করেছে। নায়েব তার শিষ্য।

আমি নাকি একটা হিন্দুর মেয়েকে বের করে কোথায় সরিয়ে রেখেছি। দেখেছো ব্রাহ্মণের ধর্ম? বেটা মনে করেছে কাঁচারীতে আমাকে অপমান করবে। তা হবে না। যদি তাই হয় তবে ব্রাহ্মণের জান নেবো। নায়েবের ঘাড়েও মাথা থাকবে না। এতে যদি আমার। ফাঁসি হয় তাতেও আমি রাজি আছি। তবুও এই হারামজাদা জাল দেবতাকে আমি দেখবো।

আমার মাথা যেন কেমন হয়ে এলো। আমি কহিলাম, ‘সংসারে ধর্ম নাই। অধার্মিক বেঁচে থাকে। তাদেরই প্রতিপত্তি বেশি। অধর্মের বিরুদ্ধে কেই দাঁড়ায় না। শয়তাকে সবাই সম্মান করে। ধর্ম নাই! হৃদয় পবিত্র না করেই অন্যায়ের মধ্যে ডুবে থেকে মানুষ উপাসনা করে, আর স্বর্গে যেতে চায়। কী আশ্চর্য!

সর্দার বল্লে, কোনো শালাকে ভয় করি নে। যদি বামুনের কথা নায়েব বিশ্বাস করে। তা হলে তার ভালো হবে না। এই বলে সর্দার সেদিন কার মতো চলে গেল। এর। কয়েকদিন পরে সংবাদ পেলাম সর্দারকে নায়েব মশাই বেঁধে রেখেছে। মনটা বড় খারাপ। হয়ে উঠলো। ক্ষমতার এই ঘৃণিত অপব্যবহার দেখে হাড়ে হাড়ে জ্বলে গেলাম। মাথার ভিতর বন বন করতে লাগল।

আমি পাগল হয়ে জমিদারের কাঁচারির দিকে ছুটে চলোম। যে আমাকে এমন করে উপকার করেছে, তাকে আমারই জন্য এত লজ্জা ও অপমান ভোগ করতে হবে এ আমার। সহ্য হল না।

যেয়ে যা দেখলাম তাতে আমার মন কেঁপে উঠল। নায়েব একটা লম্বা ফুরশি হুঁকোর নল মুখে দিয়ে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে বসেছিল সামনে সর্দার! হাত বাঁধা। মাথা নত করে সে দাঁড়িয়েছিল।

আমাকে দেখেই ব্ৰহ্মণ! লাফিয়ে উঠে বললে, এই সে মেয়ে, একেই ও বের করে এনেছে। হিন্দু পরিবারের জাতি নাশ! এর একটা বিহিত–ব্যবস্থা হওয়া আবশ্যক।

আমি কহিলাম–ব্রাহ্মণ! নিজের পাপ ও বদমায়েশী ঢাকবার জন্য এই নীচ ষড়যন্ত্র কেন?’

নায়েব বিরক্ত হইয়া কহিল–“সাবধানে কথা বল। উনি আমাদের দেশের গুরু। তুমিও কম বদমায়েশ নও।”

আমি কহিলাম–নায়েব! তুমি আমাকে কি মনে করো? প্রজার টাকা চুরি করে সুখলিপসু বোকা জমিদার বাবুদিগকে ফাঁকি দিয়ে খুঁড়ি মোটা করে আমাকে বদমায়েশ বলছো।

নায়েব বলল–“দেখতে পাচ্ছি মেয়েটা সর্দারের পিরিতে পাগল হয়ে গিয়েছে। জাত তো আর ফিরে পাবে না।”

আমি হো-হো করে হেসে উঠে বললাম,–“ঠিক! ঠিক! কি ধর্ম! কি ব্রাহ্মণত্ব। আর কি তোমার শাস্ত্রজ্ঞান! তোমাদের অধার্মিক লম্পটের আর চোরের জাতি যাবে না আর আমার জাতি যাবে! এমন সমাজের সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ নাই।

নায়েব কি জানি কি কারণে একটু অনুগ্রহপ্রবণ হয়ে পড়লো।

বরকান্দাজ কুকুরগুলো লাঠি হাতে নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে, নায়েবের হুকুমের আশায় দাঁড়িয়েছিলো। নায়েব হেঁকে বললে–“রামা,সর্দারকে ছেড়ে দাও।

রামা বলল–“হুজুর ওর বিচার হল না? বাহির হইতে একজন চাপ–স্বরে বললে–শিকার তো মিলেছে! আর বিচারের দরকার কী?’

নায়েব আমার দিকে তাকিয়ে রুক্ষস্বরে বললে–“মুসলমানের বাড়িতে যেয়ে আর জাতি নষ্ট করো না। আমার বাসায় যাও।”

অতঃপর ব্রাহ্মণ নায়েবের দিকে তাকিয়ে বলল–“তোমার ওখানে থাকার জায়গা আছে তো? না হয় মেয়েটি আমার ওখানে গেলেও পারে।

একটা স্ত্রী লোককে নিয়ে ব্রাহ্মণ শিষ্যের ভিতর এই দ্বন্দ্ব দেখে আমি হাস্য সংবরণ করতে পারলাম না। কী বদান্যতা! কী অভিনয়!

মাথা আমার কেমন হয়ে উঠলো! হেসে হেসে খুন হয়ে আমি মাঠের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করালাম। দুই-একজন বরকান্দাজ ধরবার জন্য আমার পিছনে পিছনে এসেছিলো কিন্তু খানিক এলেই আমার উম্মাদনাপূর্ণ অঙ্গভঙ্গি দেখে অবাক হয়ে তারা ফিরে গেল।”

.

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

চারিদিন হেঁটে সাজাহানপুর স্টীমার স্টেশন ঘাটে এসেছি। একটা যুবক সেখানকার বাবু। স্টেশনে এসেই একটা আশ্চর্য কাণ্ড দেখলাম। ঢাকার এক বাঙাল অসময়ে টিকিট চেয়েছিল। বাবু ঘরের মধ্যেই মুখ ধুচ্ছিলেন। সমস্ত রাত ঘুমিয়ে ঘুমিয় বাবুর মাথা বোধ হয় খুব গরম হয়ে উঠেছিল। নিষ্ঠীবন ভরা মুখে জল বেচারার মাথায় ফেলে দিয়ে বললেন–“টিকস চাইছো, বাপ্পা?’।

মাথা যেন কেমন হয়ে উঠলো। ইচ্ছা হল ছোটলোকটাকে কান ধরে ঠিক করে দেই। পথ-ঘাটে মানুষের নির্মমতা দেখে দেখে ক্রমেই আমি বেশি করে পাগল হচ্ছিলাম। সমস্ত জাতিটার ভিতর, পল্লীতে, শহরে রাস্তায়, গলিতে, স্টীমারে, গাড়িতে মানুষের একি নীচতা ও মানুষ্যত্বের অবমাননা। প্রাণ ভেঙ্গে বের হল–ভাবলাম, কাজ নাই এ সংসারে।

ভাবলাম পাগল হয়ে সারা জীবন ঘুরে বেড়াব। ঘৃণিত ভণ্ড পিশাচদের সঙ্গে আর আমার কোনো সম্বন্ধ নাই। একটা যুক্তির আস্বাদ পেয়ে হো-হো করে হেসে উঠলাম।

আমার হাসি শুনে কতকগুলি লোক এসে আমার চতুর্দিকে দাঁড়াল, আমি আরও হাসতে আরম্ভ করলাম। তার সকলেই বললে, আমি পাগল।

ক্রমে যাত্রী এসে জমা হল। আমার পয়সা ছিল না। মনে করলাম কত জায়গা পড়ে থাকে, একজন ভিখারির ভারে জাহাজ ডোবো-ডোবো হবে না। জাহাজে উঠতে যাচ্ছিলাম, কেরানি টিকিট দেখতে চাইলো। আমি বললাম, ‘টিকিট নাই পয়সা নাই।’ কেরানি হেসে বললে, আচ্ছা বিনা টিকিটে যদি যেতে চাও তা হলে সবার পরে যাবে, অপেক্ষা করো।’ সকলেই স্টীমারে উঠে গেল। চট্টগ্রামের খালাসীগুলি সিঁড়ি টানতে আরম্ভ করলো। কেরানিকে বললাম–“বাবু যেতে দাও আমাকে। জাহাজে অনেক জায়গা পড়ে আছে। আমার কাছ থেকে কোম্পানি পয়সা আদায় না করলে তো তার কিছু ক্ষতি হবে না।’

কেরানি তাড়াতাড়ি আমাকে তার কামরার ভিতর যেতে বললে। আমি টিকিটের আশায় টিকিট-ঘরে প্রবেশ করিলাম।

জাহাজ ছাড়-ছাড় হল বাবুকে মিনতি করে বললাম, বাবু, আমি পাগল মানুষ যেতে দাও আমাকে। জাহাজে অনেক মানুষ যাচ্ছে। একজন বিনা টিকিটে গেলে কারো কোনো ক্ষতি হবে না।

বাবুব হেসে বললে, “আজ আমার কছেই থাকো। রূপ তোমার ঢের আছে। কাল টিকিট ও নূতন কাপড় দিয়ে তোমাকে পাঠিয়ে দেবো। হ্যাঁ তুমি কোথায় যাবে?’

আমি হো হো করে হেসে উঠলাম, মাথা আমার কেমন খারাপ হয়ে উঠলো। আমি বললাম–’সাগরে যাবো।‘

এইকথা বলেই আমি ক্ষিপ্রগতিতে তার কামরা থেকে বেরিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। সকলে তীর থেকে ‘ধরো ধরো একটি মেয়ে মারা পড়লো। মেয়েটি পাগল বুঝি’ এই সব কথা বলে চিৎকার করতে লাগলো। আমি নদীর বুকে লাফিয়ে পড়লাম।

.

ভাসতে ভাসতে এক মাঠের কূলে এসে উপস্থিত হলাম। প্রকাণ্ড মাঠ, ইচ্ছা হল সমুদ্রের মতো এই নদীকে সামনে করে মরুর মতো বালির মাঠে সীমাহীনতায় ছবি দেখে,এই নিবিড় নির্জনতার ভিতর পড়ে থাকি।

কিন্তু এ কি! এখানেও মানুষ! একটা ধীবর-কন্যা মাছ ধরছিল। একটা মেয়ে তার। পাশে বসে খেলা করছিল।

এগিয়ে যেতে দেখতে পেলাম মেয়েটির হাত বাড়িয়ে আমার কোলে আসবার জন্য মা! মা! করছে। জানি না কেন? মায়ের স্নেহে প্রাণ ভরে উঠলো। ইচ্ছা হল মানুষের ভিতর একটা কুঁড়েঘর বেঁধে আমার হরিঠাকুর আর এই মেয়েটিকে নিয়ে আবার সোনার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু হায়! অনেক দিন আগেই সে স্বপ্নে আমার আগুন ধরে গিয়েছিল।

ধীবর বধূ মাছ ধরা ফেলে ছুটে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে–“তুমি কে বোন।‘

আমি বললাম—’আমি তোমারই জাতি আমার একটি মেয়ে ছিল। কোথায় হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। মাঝগাঙ্গে নৌকা ডুবে আমার আর আর সঙ্গীরা কোথায় ভেসে গিয়েছে, তা জানি না। ভাসতে ভাসতে এখানে উঠে পড়েছি।‘

ধীবর-বধূ কাদ কাঁদ হয়ে বললে–“আহা! এমন বজ্রঘাত তোমার মাথার উপর পড়েছে। কবে তোমার মেয়েটি হারিয়েছিল? আমি বললাম–সে অনেক তথা প্রজাপতি নিয়ে সে খেলা করছিল, আমি অমনোযোগী হয়ে আপন মনে কাজ করছিলাম–মেয়ে আমার প্রজাপতি ধরাবার জন্য দৌড়াতে দৌড়াতে কোথায় চলে গেছে তার ঠিকানা নেই।‘

ধীবর-বধূ জাল ফেলিয়া কাঁদিয়া ফেলিল। বলিল–একে এই শোক তার উপরে নৌকা ডুবে সকলকেই হারালে। কোথায় তোমার বাড়ি তাও তুমি জান না। মেয়েমানুষ যখন তুমি কেমন করেই বা জানবে!

মনে মনে একটু হাসিয়া গম্ভীরভাবে বলিলাম-হ্যাঁ সতী যারা তাদের পক্ষে স্বামীর নাম, বাপের নাম, জেলার নাম এসব জানা বেহায়ামি, তা আমি জানি; নইলে আমি জেনে রাখতাম।

ধীবর বধূ বলিল–আহা তোমার এত দুঃখ! তোমাই এই রূপ, এই বয়স–তোমার মাথায় এমন বিপদ! কী করা যায় বোন? ভগবান আমাদিগকে যেভাবে রাখেন তাই ভালো। তুমি ধীবরের মেয়ে, আমিও ধীবরের মেয়ে। আমার মেয়েটি ছাড়া আর কেউ নাই। স্বামী আমার বহুদিন মারা গেছে, এই সংসারে একাকী নিঃসঙ্গ জীবন আমি অতিবাহিত করি। আজ হতে তুমি আমার বোন হও। দুটি দুঃখিনী স্ত্রীলোক একসঙ্গে থাকবো। দু’জনের দুঃখ এক করে সমানভাবে ভাগ করে নেবো, দু’জনের মনই হালকা হয়ে যাবে। চল আজ হতে তুমি আমার বোন। লোকে জিজ্ঞাসা করলে বলবো তুমি আমার কোনো দুরসম্পর্কীয়া বোন।

আমি কহিলাম–’বেশ, আর ঐ সোনার মেয়েটির মা দুজনেই হবো! দুজনেই ওকে মাতৃস্নেহে ভরে ফেলবো।

ধীবর বধু বলিল–আজ হতে ও মেয়ে তোমারই। ভগবানের নাম করে বলছি, আজ হতে ওর মা তুমি।

আমি কহিলাম–“তুমি তো আমাকে বসিয়ে খাওয়াতে পারবে না। কেমন করে জীবিকা নির্বাহ হবে?

‘কেন ধীবরের মেয়ের আবার ভাবনা কী? আমরা তো আর বামন কায়েত বা মুসলমানের মেয়ে নই, যে পেটের দায়ে মরবো। মিথ্যা মানের ভড়ং করে পরদা টানিয়ে পাপ করতে বাধ্য হবো! আমরা ধীবরের মেয়ে, পেটের ভাবনা ভাবতে হবে না। জাল বুনে মাছ ধরে আমরা দশটা লোককে পোষাতে পারি। ভদ্রলোকের বৌ-কি ঘরের কোণে ভাতের জ্বালায় কুকুরের মতো ঝাটা লাথি খেয়ে কেঁদে মরুক। আমরা দুই বোনে জাল বুনবো–মাছ ধরবো, সুখে কাল কাটিয়ে দেবো। তা ছাড়া তুমি দুই দশ দিনকাজ না করলেও কিছু বয়ে যাবে না। আমি এত দুঃখিনী নই। মাথা যেন আমার কেমন হয়ে এসেছিল। পরক্ষণেই মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাবটা দূর হয়ে গেল। আমি বললাম–যখন খুব ছোট ছিলাম তখনই ঠাকুর দিদির কাছে বসে জাল বুনোনা শিখেছিলাম। বিয়ে হবার পর থেকেই আর কোনো কালে জালে হাত দিই নি। সব বোধহয় ভুলে গেছি। আমাকে জাল বুনোনো শিখিয়ে দিতে হবে। মাছ ধরার কৌশলগুলি আমাকে বলে দিতে হবে।

ধীবর বধূ বিস্মিত হয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। আমি একটু ভীত হলাম।

কে কহিল–“আচ্ছা সব ঠিকঠাক হবে। তুমি তোমার মেয়েকে কোলে নাও। আমি আমার জালখানা আর মাছের ঝাঁকা কাঁখে নেই।”

সেই মাঠ পার হয়ে আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা লোকালয়ে আসিলাম। একখানা ঘর আর একখানা রান্নাঘর। আমাদেরকে দেখে পাড়ার কয়েকটা মেয়ে এসে ধীবর-বধূকে জিজ্ঞাসা করেলে, ‘এ মেয়েটি কে?’ সে বললে ‘আমার দিদি। আমাকে দেখতে এসেছে। আর যাবে না, এখানেই থাকবে।’

.

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

কয়েক মাসের ভিতর আমি জাল বোনা আর মাছ ধরতে বেশ পটু হলাম। তুমি হয়তো বিস্মিত হতে পার, আমি কেমন করে ধর্ম বিসর্জন করে জেলেনী হয়ে পড়লাম। ধর্ম আমার ‘মনের ভিতর ছিল। আমার ধর্ম আমার কাছেই ছিল। কেউ তো কেড়ে নিতে পারে নি। আমার বিশ্বাস ধর্ম অপবিত্রতা আর পাপে নষ্ট হয়; কারোর জল খেলে ধর্ম নষ্ট হয় না। যে আমাকে ভালবাসে, যার কাছে আমার উপকার পাই তাকে ঘৃণা করলেই আমার জাতি যায়।

মাঠ থেকে আর ডোবা থেকে আমরা মাছ ধরাতাম আর বাজারে বিক্রয় করতাম! কোনো দিন আমার এই নূতন বোনটির সহিত ঝগড়া হয় নাই। যে পয়সা উপায় করতাম সব জেলে-বধূকে দিতাম। তার মেয়েটির নাম রেখেছিলাম ‘আলতা’।

আলতা তার আপন মাকে ভুলে আমাকেই বেশি ভালবাসতে আরম্ভ করলে। আমার তাকে কোলে করতে কোনো ঘৃণা হতো না। নিজেকে আমি বেশ করে ভুলে তাকে আঁকড়ে বরতে শিখেছিলাম।

সব ভেদ নষ্ট হয়ে গেল। দুই জনের খাটুনীর ফলে আমাদের প্রচুর আয় হতে লাগলো। কোনো কষ্ট ছিল না।

সাত বছর আমার এখানে কাটে। তার পর একটা ঘটনা ঘটেছিলো যাতে আমার মাথা আবার খারাপ হয়ে উঠলো।

গ্রামে কয়েকটা ছোঁকড়া যুবক আমাদের উপর বিশেষ অনুগ্রহ দেখাতে আরম্ভ করলে। হাটের ভিতর মাছ নিয়ে এলে তারা আমার মুখপানে চেয়ে চেয়ে থাকত।

এর পর দিনে-দুপুরে কত পুরুষ আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে আরম্ভ করলে। বিধাতার সংসারে যেন একটুকু নিরাপদ স্থান নাই।

একটা যুবক–তার নাম রমেন্দ্র বোস। অনর্থক একদিন সে আমাকে মামি বলে ডাকলে। বিরক্ত হলেও আমি তার উপর একটু স্নেহপ্রাণ হয়ে উঠলাম। আলতার মা একদিন আমায় বললে, দিদি, এই যুবকটি বোসেদের বাড়ির ছেলে। কিছু বলবার যো নাই। তুমি সাবধানে থেকো, ওর মামি বলাকে বিশ্বাস করো না। মামি বলতে সে একদিন তোমার বুকে ছুরি বসাতে পারে।

আমি আলতার মাকে তার সতর্কতার জন্য খুব আশীর্বাদ করে বললাম ”দিদি, সে সম্বন্ধে তুই কিছু ভয় করিস না। মেয়ে মানুষ যদি তার সতীত্বের জন্য একবার মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তা হলে কেউ তাকে কুপথে নিতে পারে না।”

মাথার কাছে একখানা বঁটি রেখে আমরা শুয়ে থাকতাম। একদিন দুপুর রাতে শুয়ে আছি সহসা শুনতে পেলাম কে যেন বেড়া কাটছে। ব্যাপারখানা ভালো করে বুঝবার জন্য ধীরে ধীরে আলতার মাকে তুলে বেড়ায় ছিদ্র দিয়ে দেখতে পেলাম সাতজন যুবক, তাদের পাণ্ডা আমার ভাগিনা রমেন্দ্র বোস।

রমেন্দ্র বোস ধনীর সন্তান। সে এই রাত্রে তার এয়ার-বন্ধুকে নিয়ে কেন এসেছে তা আমার বুঝতে বাকি রইল না।

আলতার মা ভয়ে কাঁপছিল আমি তাকে সাহস দিয়ে বলল–“কোনো ভয় নাই।” ধীরে বেড়ায় পাশ খুলে গেল। স্বচ্ছ আঁধারে দেখতে পেলাম রমেন্দ্র আমার দিকে এলো। আর একটি যুবক তার পরেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে আলতার মায়ের দিকে গেল। তার পর যা দেখলেম তাতে আর মুহূর্ত মাত্র বিলম্ব না করে রমেন্দ্রের ঘাড়ে বঁটি দিয়ে এক প্রচণ্ড আঘাত করিলাম।

প্রচণ্ড আঘাত ব্যর্থ হল না। রমেন্দ্রের মাথা দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

‘বাপরে মলুম’ বলে অন্য যুবকটি কুকুরের মতো বেগে কাটা পথ দিয়ে পালাল; সঙ্গে সঙ্গে অন্য যুবকটি ভীত হয়ে কে কোথায় কোনো পথ দিয়ে পালিয়ে গেল।

আলতার মা ভয়ে চাপা গলা কেঁদে উঠলো।আমি বললাম–“তুমি ভীত হয়ো না। যত বিপদ সব আমার ঘাড়ে।”

তাড়াতাড়ি আলো জ্বলে দেখলাম রমেন্দ্রনাথ বিচ্ছিন্ন মাথা বেড়ার পাশে পড়ে আছে। কী বিকট চাহনী! সমস্ত ঘর রক্তময়! গায়ে রক্ত লেগে গিয়েছিল। দুইজনে বাহির হয়ে গা ধুয়ে এলাম। আলতার মা কাঁদছিলো।

.

বিংশ পরিচ্ছেদ

সকাল বেলা বাড়ি লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। আমি কিছুমাত্র ভীত না হয়ে বল্লাম–সতীর সর্বনাশ করতে এলে এমনি করে শাস্তি ভোগ করতে হয়। রমেন্দ্রকে আমি খুন করেছি। কিছুক্ষণের মধ্যে চৌকিদার, জমাদার, দারোগা ও রমেন্দ্রের বৃদ্ধ বাপ এসে শান্তভাবে হাজির হল।

আমি সকলের কাছে স্বীকার করলাম আমি খুন করেছি। সকলে অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।

আলতার মা তখনও কাঁদতেছিল। রমেন্দ্রের বৃদ্ধ পিতা চোখে একটুও জল দেখলাম। ঘৃণায়, লজ্জায় তার মুখ কালি হয়ে গিয়েছিল।

বৃদ্ধ আমার দিকে চেয়ে বললো–’বেশ করেছ মা। আমাদের দেশে এখনও যে এমন বীর রমণী আছে তাতে আমি সুখী হচ্ছি। পুত্র-শোকের দারুণ আঘাতের মধ্যে তোমাকে আমি আশীর্বাদ করছি।’

দারোগা কিন্তু তার শান্তভাব বেশিক্ষণ বজায় রাখল না। সে এবং তার বন্ধু চৌকিদার ও সিপাই আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে আরম্ভ করলে। ক্রোধে আমার সর্বশরীর জ্বলে গেল, মাথা আমার কেমন হয়ে উঠলো। আমি দারোগাকে লক্ষ্য করে বল্লাম-দেখ দারোগা! দুঃখিত ও উৎপীড়িতের সেবার জন্যই তুমি নিযুক্ত হয়েছ। অসৎ উপায়ে অর্থ উপায়ের জন্য তোমার গালি দিবার কোনো ক্ষমতা নাই! দারোগা আমার মুখের উপর লাথি নিয়ে এলো। তার দেশওয়ালী কুকুরগুলো আমাকে পৈশাচিক ভাষায় সম্বোধন করতে আরম্ভ করলো। দারোগাকে কহিলাম–’দারোগা! তোমার মতো নরপিশাচকে সরকার কেন নিযুক্ত করেছেন? সকল কর্মচারী অপেক্ষা তোমাদের অধিক মনুষ্যত্ব আবশ্যক! আর এই কুকুর সিপইগুলিকেই বা সত্য ও ন্যায়ের রক্ষকরূপে কেন নিযুক্ত করা হয়েছে। আমার প্রতি এই দুর্ব্যবহার উপস্থিত নিরীহ ধীবরেরা দেখছিলো। তারা আমার কথায় অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে পড়লো।

দারোগা আর সিপাইগুলি তাদেরকে ধমক দিলে। ফলে একজন মোটা সোটা পালোয়ান ধীবর দারোগার মাথার উপর লাফাইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে সিপাইগুলিও আক্রান্ত হল। বাড়িখানা শন্তি ও বিচারের স্থান না হয়ে, মারামরি ও সোরগোলের আড্ডায় পরিণত হলো। দারোগার নাক ভেঙ্গে রক্ত বেরোতে লাগলো। তাড়াতাড়ি একখানা মাদুর পেতে দারোগার মাথায় জল ঢালতে লাগলাম। প্রায় এক ঘণ্টা অতীত হবার পর দারোগা চৌকিদারকে ডেকে ঘোড়া আনতে বললে। ইতোমধ্যে অন্যান্য ধীবরেরা আপন আপন বাড়িতে চলে গিয়েছিল। দারোগা যাবার সময় বললেন, তোমাদের কোনো ভয় নাই, আমি শালাগুলোকে একবার দেখাবো!’ চারজন লোক রমেন্দ্রর শবদেহকে ঘাড়ে করে দারোগার পিছনে পিছনে চললে।

দুদিন পরেই শুনতে পেলাম এক শত সিপাই বন্দুক আর তলোয়ার নিয়ে গ্রাম ঘেরাও করেছে। আলতার মা আবার কাঁদতে আরম্ভ করলো। আমি হাসিয়া কহিলাম–“খুন করলাম আমি। সিপাই এসেছে সেদিন যারা তাদের কাজে বাধা দিয়েছিলো তাহাদের ধরতে। তুমি কাঁদ কেন?”

ধীবরেরা দমিবার পাত্র নয়। তারা বন্দুকের গুলিকে রোধ করবার জন্য কাপড়-কাচা পাট আর কুঠার দা চবক্‌, কেহ-বা সড়কি নিয়ে সিপাইদের সম্মুখীন হল। তার পর ভীষণ লড়াই বেঁধে গেল। সে ভীষণ লড়াইয়ের কথা কী বলবো! কী ভয়ানক রক্তারক্তি!

ভয়ানক চিৎকার! কী ভীষণ আর্তনাদ! সন্ধ্যা পর্যন্ত লড়াই হল। সন্ধ্যার নিবিড় আঁধারের সঙ্গে সঙ্গে লড়াই থেমে গেল।

সিপাইরা রাত্রির জন্য কোথায় গেল জানি না, পরদিন সকাল বেলা দেখতে পেলাম সমস্ত গ্রামখানি শূন্য। একটা প্রাণী সেখানে নাই। গ্রামের সমস্ত লোক ঘরবাড়ি খালি করে। কোথায় চলে গেছে।

২১-২৫. হাকিমের সম্মুখে হাজির

একবিংশ পরিচ্ছেদ

যথা সময়ে আমাদেরকে হাকিমের সম্মুখে হাজির হতে হল। ষোলজন ধীবর ধরা পড়েছিল। আমি আর আলতার মা খুনের আসামি, আর ধীবরেরা দাঙ্গা-হাঙ্গামার আসামি। যারা ধরা পড়েছিল তাদের অনেককে দু’তিন মাস ধরে সরকারি হাসপাতালে থাকতে হয়েছিলো। গুলিতে কারো মুখ ছিঁড়ে গিয়েছিলো। তলোয়ারের আঘাতে কাহারো হাত ছিল না। মুর্খের দল ডাক্তারকে এক হাজার টাকা করে ঘুষ দিয়েছিলো। ডাক্তার মুখে বলেছিলো তার রিপোর্টের উপরেই মোকদ্দমা চলবে। মূর্খ ধীবরেরা তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে এক নয়, দুই নয়–হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছিলো।

সেদিন জজের কাছারীতে শত শত মানুষ জমেছিলো। আমি আর আলতার মা একটা উকিলও নিযুক্ত করেছিলাম না। কত উকিল এসে বললে, মোকদ্দমা আমার হাতে দাও, খালাস পাবে।

উকিলকে বিশ্বাস করবার কোনো দরকার ছিল না। ভাবলাম খাঁটি সত্য কথা জজের কাছে বলবো–তাতে যা হয় তাই হবে। আলতার মা আর সেই ৬ জন আসামি জোড়হাত হয়ে হাকিমের দিকে চেয়ে কেবলই কাঁদছিলো। ধীবর আসামিদের জন্য কলকাতা থেকে দুইজন উকিল গিয়েছিলো। তাদের ফি দৈনিক ৫০০ টাকা করে। দারোগা, উকিল, সিপাই, চৌকিদার এসে উপস্থিত হলো।

তারপর বিচার হল। দারোগা বাবু বললেন, ‘আলতার মার বাড়িতে উপস্থিত হতেই ধীবরেরা এসে আমাকে আক্রমণ করলে। আমরা আসামিদিগকে নিরস্ত করতে যেয়ে অনুনয় করে বললাম–আমরা কারও ক্ষতি করতে আসি নি। তারা কিন্তু বিশ্বাস করলে না। বললে, যে গ্রামে দারোগা আসে সে গ্রামের সবার ভাগ্যেই জেল থাকে, বিশেষ করে এটা যখন খুনি ব্যাপারে তখন সবাইকে কালাপানিতে যেতে হবে। আমরা অনুচরেরা। আমার সঙ্গে সঙ্গে প্রহৃত হল। গভর্ণমেন্টের কাজে বাধা পেয়ে আমরা পুলিশ সাহেবকে সব কথা জানালাম, ফলে বহুসংখ্যক অস্ত্রধারী সিপাই নিয়ে পরের দিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত। হই। ভীষণ দাঙ্গা হল। সরকারকে গ্রাহ্য করা দূরে থাক, তারা সরকারকে মানি না বলে নিশান উড়িয়ে দিলো। পুলিশ সাহেব তাদেরকে ধরতে গিয়েছিলেন! তিনি সাংঘাতিকরূপে। আহত হয়ে ফিরে আসেন, একথা কোর্ট জানেন। বহু কষ্টে এই ষোল জনকে ধরা হয়েছে। মাদারিপুরের ঘাটে, সুন্দরবনে, কাশীর মালোপাড়ায়, কলিকাতায় ক্ষুদিরামের হোটেলে যে কয়েকজন ধরা গিয়াছে তারাই আসল আসামি। চারিজনের আইনমতে ফাঁসি হওয়া উচিত, বাকি ১২ জনের নির্বাসনদণ্ড দেওয়া হউক। পরিশেষে ইহাও আমার বক্তব্য যে, এই আসামি স্ত্রীলোক দুটি রাজকর্মচারীকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। আসামি হলেও তারা সরকারের নিকটে যথেষ্ট পুরস্কার দাবি করতে পারে।

দারোগার উক্তি শুনিয়া আলতার মা এতক্ষণে চোখ মুছিয়া ফেলিল। আমার মনে কোনো প্রকার ভাব উপস্থিত হয়েছিল না, শুধু বিচিত্র ব্যাপার দেখছিলাম সরকারি উকিল দাঁড়িয়ে একই কথা বললেন। দারোগার কথা সমর্থন করতে গিয়ে তিনি বললেন, এই স্ত্রীলোক দুটির শুধু মুক্তি দেওয়া উচিত নহে, ইহারা যেমন বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে, তাতে এদের সরকার হতে যথেষ্ট পুরস্কার দেওয়া আবশ্যক। সতী রমণীর মর্যাদা আইনেরও উপরে। তাহাদের সম্মান রাজদরবারে অধিক রক্ষিত হওয়া আবশ্যক। আমাদের কোনো উকিল ছিল না। যা বলতে হবে তা নিজেই আমি বলবো স্থির করেছিলাম। অন্য আসামিদের বড় বড় উকিল উঠে বললেন;

দারোগা যা বললেন তা সবই মিথ্যা। সাক্ষাতে সে সব প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। দারোগা প্রথমেই হারাণ মাঝির বাড়িতে যেয়ে তার সধবা মেয়েকে বিনা কারণে ললেন, ‘তুমি এই মোকদ্দমা কিছু জান?’ নিমু নারায়ণ ও রামচরণ তার প্রমাণ দিয়েছে। হারাণের মেয়ে যখন কেঁদে বললে যে, সে কিছু জানে না, দারোগা বাবু তখন ক্রোধান্ধ হয়ে তার সিপাইদের হুকুম দিলেন এই মাগীকে ধর। সিপাইরা মুক্তস্থানে তাকে অর্ধ-উলঙ্গ করে অপদস্থ করে। বৃদ্ধ বাপ এই শোচনীয় দৃশ্য দেখে দারোগার কাছে করুণা ভিক্ষা করে। দারোগা তাকে এমন প্রচণ্ড আঘাত করেছিলো যে, সেই আক্রমণ করতে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়; অথচ দারোগা বাবু সাক্ষী বলে গেল–এই বৃদ্ধই পুলিশ সাহেবকে আক্রমণ করতে গিয়েছিল। পুলিশ সাহেবকে রক্ষা করতে যেয়ে এক সিপাই এর মাথায় আঘাত করে এবং তার ফলেই সে মারা গেছে। ধীবরদের রক্ত-মাংসের শরীর। তাদের উপর এত অত্যাচার করলে এমন অঘটন যে সংঘটিত হবে তা দারোগা বাবুর মতো বিচক্ষণ রাজকর্মচারীর জানা উচিত ছিলো। আসীম আলতার মা আর তার বোনের বাড়িতে না এসো, দারোগাবাবু প্রথমেই হারাণ,মাঝির বাড়িতে গিয়েছিলেন, এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। এই দারোগাবাবু কার্য হতে জানা যায়, তিনি সরকারি কার্য করতে একেবারে অপারগ। তিনি প্রজার মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু কার্যত এই অনাসৃষ্টির কারণ একমাত্র তিনি। গভর্ণমেন্টের কর্তব্য এখন এই ব্যক্তিকে কার্য হতে অবসর দেওয়া।

দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অভিযুক্ত হওয়া স্ত্রীলোক দুইটির এবং দারোগার। শাস্তি হওয়া আবশ্যক। স্ত্রী আসামিদ্বয়ের যে চরিত্র ভালো একথা আমরা বিশ্বাস করিতে পারি না। সাক্ষীরা বলেছে দারোগার সহিত আলতার মার অবৈধ প্রণয় ছিল। সকল দাঙ্গার কারণ রমেন্দ্রের হত্যা। রমেন্দ্রের সহিত আলতার মায়ের বোনের প্রণয় ছিল। আলতার মা বোনের উপর ঈর্ষাপরবশ হইয়া জমিদার-পুত্র রমেন্দ্রকে হত্যা করেছে।

হাকিম অতঃপর আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন–“তুমি কী জান?’

আমি কহিলাম–দারোগা বাবুর সহিত আমাদের কোনো কালে পরিচয় নাই। তদারকের পূর্বে তিনি অন্য কোনো বাড়িতে গিয়েছিলেন কি না আমি জানি না। রামেরে হত্যা আমার দ্বারাই সংঘটিত হয়েছে। আত্মরক্ষার জন্য বাধা দিতে গিয়েই এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়! আমার প্রতি দুর্ব্যবহার করায়, আমার বাড়িতেই ধীবরেরা দারোগা বাবুকে আক্রমণ করে।

আর কোনো জেরা মন্তব্যের প্রয়োজন হল না। জজ সাহেব রায় দিলেন। দাঙ্গা অভিযুক্ত ৪ জন মূল আসামির শুক্র বার বেলা ১২-৪ মিনিটের সময় ফাঁসি হইবে। বাকি ১২ জন আসমির ৫০০ টাকা জরিমানা। পরিশেষে জজ সাহেব আমাদের কথা উল্লেখ করে বললেন–এই স্ত্রীলোক দুটির বীরত্বে, সতীত্বে কোট খুব আনন্দ প্রকাশ করিতেছে। তাহারা সত্য কথা বলিয়াছে, উহাদিগকে মুক্তি দেওয়া হউক।

পরে বিচারে দারোগার দুই মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল। রায় প্রকাশ হইবার পরকোর্টের ভিতরে ভিতরে ও বাহিরে হই হই শব্দ আরম্ভ হল। আমরা কাঠগড়া থেকে মুক্ত হয়ে বাহির হয়ে এসে দাঁড়াতেই হাজার হাজার লোক আমাদের চুতুর্দিকে এসে দাঁড়াল।

আমরা ক্রমে ক্রমে জনতা ঠেলে সরে এলাম। জনতা পার হয়ে একটু দূরে এলে আলতার মা আমার হাত ধরে বললে—’দিদি, তুই সব বিপদের মূল। তুই যদি আমাদের গ্রামে না আসতিস, তোকে যদি বড়িতে স্থান না দিতাম তাহলে আজ আমাদের গ্রাম উজার হতো না।’

কি জানি কেন–মন দুঃখে ভরে গেল। মাথাটা যেন কেমন হয়ে উঠলো।

.

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

”বাড়িতে ক্রমেই ভয়ানক জ্বর আরম্ভ হল। আলতার মা ক্রমশ আমার উপর কী কারণে জানি না বিরক্ত হয়ে উঠলো! আমাকে দেখলেই সে যেন শিউরে উঠতো! আলতা যদি মা মা বলে আমার কাছে আসতো তার আপন মা জোর করে আমার কাছ থেকে টেনে নিয়ে যেত।

সংসারের বিচিত্রতা দেখে মন ও মাথা দুই-ই আবার খারপ হয়ে উঠলো। ভাবলাম, জ্বরটা একটু কম পড়লেই এস্থান থেকে পালাবো। কিন্তু আলতার কথা ভেবে মনটা যেন কেমন হয়ে গেল। কতকালের সেই হারান স্মৃতি আগুনের মতো মনের মধ্যে জ্বলে উঠলো। ভাবলাম কোথায়, আমার মেয়ে কোথা? সে কার ঘরে এখন? সে কি জানে তার মা কে? হায়রে কপাল? আমার বুকের ধন যে চুরি রে নিলে? কে আমাকে এমন করে ভিখারিনী করলে? ভগবান, তুমি কি আছ। তোমার কাজ নাকি মঙ্গলময়। আমার বুকের আগুন জ্বেলে তুমি তোমার কি মহান উদ্দেশ্য করছ। সে কার মাকে মা বলে মনকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছে।

এর পর দুদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। তৃতীয় দিনে জ্বরটা ছেড়ে গেল। রাত্রি যখন দ্বিপ্রহর তখন আকাশে মেঘ উঠেছিলা। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল একটু একটু বৃষ্টি আরম্ভ হল! সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বাতাস দেখা দিল। আমি ভগবানকে স্মরণ করে কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লাম। সেই বৃষ্টি ঝড়ের ভিতর অতি-ভীত মনে আমি অগ্রসর হচ্ছিলাম। সমস্ত রাত্রি হেঁটে হেঁটে কাটিয়ে দিলাম। সকাল বেলা এক রেলস্টেশনে এসে উপস্থিত হলাম। ১০ টা টাকা সঙ্গে ছিল, কলকাতার টিকিট করলাম। রাত্রি বারটার সময় কলকাতয় এলাম। পর দিন সকাল বেলা হাওড়ার রেল পথ ধরে অগ্রসর হতে আরম্ভ করলাম। প্রায় তিন মাস হেঁটে আমি নাগপুরে যাই। শুনেছিলাম বিন্ধ্যপর্বতে অনেক সিদ্ধ সাধু-সন্নাসী থাকেন। এবারে আমি তাদের সন্ধানে বেরিয়েছিলাম। শুনেছিলাম, সিদ্ধ পুরুষেরা সব বলতে পারেন। নাগপুর হতে আর তিন মাস হেঁটে আমি বিন্ধ্যপর্বতে উপস্থিত হই। আর্যাবর্তের দক্ষিণ সীমায় বিন্ধ্যাচল। কী বিরাট পাহাড় বিন্ধ্যাচল! সমস্ত বিশ্ব ছেড়ে জনমানবশূন্য হিংস্র জন্তু সমাকীর্ণ পাহাড়ের মধ্যে একেবারে চলোম। যখন দূর হতে বিন্ধ্যপাদদেশ অবলোকন করলাম তখন সন্ধ্যা প্রায় সমাগত। প্রাণ এক অনির্বচনীয়ভাবে ভরে উঠলো। প্রাণে ভয় ছিল না, সুতরাং একটা বিরাট শান্তি যে আমার মধ্যে দেখা দিবে তদ্বিষয়ে সন্দেহ কি! পশ্চিম গগনের হৈমকর এসে পাহাড়ের মাথায় প্রভাত হচ্ছিল। যখন পাহাড়ের পাদদেশে এসে উপস্থিত হলাম, তখন দেখতে পেলাম একটা স্রোতম্বিনী পাহাড়ের বুক ভেঙ্গে বের হচ্ছে। দুই পার্শ্বে কী ভীষণ জঙ্গল? বড় বড় গাছ আকাশকে চুম্বন করবার জন্য মুখ বাড়িয়ে আছে। দেখতে পেলাম হাজার হাজর বানর। হঠাৎ পিছন থেকে কি যেন একটা অদ্ভুত জীব ভীষণ চীৎকার করে উঠলো একটা বিকট ভয়ানক আনন্দে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম। নিস্তব্ধ বনভূমি কাপিয়ে আমার হাসি হো হো করে হেসে উঠলো। ইচ্ছা হল সমস্ত পাহাড়ের উপর উড়ে উড়ে বেড়াই! বিরাট গভীর নিস্তব্ধ দেশের মহারানী হই। শৈলের উপর শৈল সমুদ্রের তীরের মতো তরঙ্গায়িত হয়ে উঠেছিল। ইচ্ছা হচ্ছিল এই বিশাল মাটির তরঙ্গের শীর্ষ হতে এক লম্ফে শূন্যকে উপহাস করে গভীর নিম্নভূমিতে লাফিয়ে পড়ি। কী বিরাট দৃশ্য! কী ভয়ানক!

সন্ধ্যার অন্ধকারের সঙ্গে পাহাড় আরও গম্ভীর ভাবময় হয়ে উঠলো। মনে হল সংসারে আমি একা। এ সংসারে আর কেউ নাই। ভগবানের বিশাল ভীমরূপ আমার সম্মুখ। আমার অস্তিত্ব বাতাসের সঙ্গে মিশে গেল। মনে হল বুকখানি কেটে ফেলি। আত্মা আমার মুক্ত হোক। আকাশে-বাতাসে ব্যোম-সমুদ্রে, উর্ধ্ব হইতে নিম্নে, নিম্ন হইতে উর্ধ্বে জোছনার অর্ধ আলোতে খেলে বেড়াই। ভেঙ্গে ফেলি দেহের কারাগার। মনে হল মৃগের সঙ্গে খেলে বেড়াই। নীল লতা-পাতা দিয়ে শয্যা রচনা করি। হিংস্র শার্দূল ভল্লুকের মুখে ননী তুলে দি।তারা আমার পায়ের কাছে শুয়ে পড়ুক। মনে হল জরা মৃত্যু দূর হোক। মানুষ কামনা বাসনা হতে মুক্ত হোক। সমস্ত বিশ্বসংসারটা পাহাড় হয়ে উঠুক। মানুষ স্বভাবের শিশু হয়ে লতাপাতার সঙ্গে মিশে থাকে। বিশ্বের সমস্ত গ্রন্থ সাগরে ডুবে যাক; শুধু তিনটি কথা বেঁচে থাক–ঈশ্বর; ন্যায় ও সত্য। সকল উপাসনা, সকল ধর্ম উঠে যাক, শুধু থাকুক ঈশ্বর ন্যায় ও সত্য।

সেই স্রোতস্বিনী-উপকূলে সমস্ত রাত্রি পঁড়িয়ে কেটে গেলো। তার পর অনবরত সাতদিন আমি পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরি। বনের ফল খেতাম ও ঝরনার জল পান করতাম। সাতদিন পর আমার মনস্কামনা সিদ্ধ হল। একস্থানে দেখলাম একজন ফকির চোখ বুজে পশ্চিম দিকে মাথা নিচু করে পড়ে আছেন। হরি হরি! সে কী অপূর্ব মূর্তি! সমস্ত বনভূমি যেন আলোকিত হয়ে উঠেছিলো।

তিনদিন আমার এই ফকিরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে কেটে গেল। চতুর্থ দিনে ফকির আমার দিকে ফিরে চাইলেন। আমি দুই হাত দিয়ে তাকে নমস্কার করলাম। ফকির কোনো কথা জিজ্ঞাসা না করেই বললেন–“কি বেটী! মেয়ে খুঁজতে এসেছি। ওখানে শুয়ে থাক মেয়ের সন্ধান পাবি।”

জানি না, কি কারণে ঘুমে চোখ ভেঙ্গে এল। আমি সেই স্থানে অবিলম্বে ঘুমিয়ে পড়লাম। তার পর প্রগাঢ় গভীর নিদ্রা। দেখতে পেলাম একটা বিরাট মাঠ, সেই মাঠের মাঝে তুমি দাঁড়ায়ে আছ। আমার মেয়ে তোমার বুকের উপর মাথা রেখে হাসছে।

আবু চমকিত হইয়া লাফাইয়া উঠিল বিস্মিত বিমূঢ় হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমি!

রমণী কহিলো–হ্যাঁ তুমি! যখন ঘুম ভেঙ্গে গেল তখন স্বর্ণকিরণ পাহাড়ের উপর একটা অপূর্ব মহিমা ছড়িয়ে দিয়েছিলো।

প্রভাতে ফকির হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মেয়ের সন্ধান পেয়েছে?”

আমি কহিলাম, হ্যাঁ, পেয়েছি ঠাকুর। ফকির বললেন, “তবে আর দেরি করো না। যাও, ঐ যুবকই তোমার মেয়ের জীবন-স্বামী।”

আমি আর দেরি করলাম না। ফকিরকে নমস্কার করে যাত্রা করলাম।

আজ পাঁচ বছর ভারতের সব নগর ঘুরেছি–কোথাও তোমার সন্ধান পাই নাই। আজ বৈকাল বেলা হাওড়ার স্টেশনে আমি ঘুরছিলাম। তোমাকে দেখতে পেয়ে আমার সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে উঠেছিল। সমস্ত পৃথিবীটা আমার চোখের সামনে ঘুরে উঠলো।চলন্ত গাড়িতে আমি অনায়াসে লাফিয়ে উঠতে পেরেছি। এখন বল, আমার মেয়ে কোথায়?

আবু অত্যন্ত বিনীত হয়ে বললেন, “আমি যে সে যুবক তা কী করে জানলেন”

রমণী কহিলেন, “আমি নিজের চোখে তোমাকে দেখেছি। বল আমার মেয়ে কোথায়? একটি বার তাকে দেখতে চাই। সেই সোনার প্রতিমাকে একবার শুধু দেখতে চাই।”

আবু কহিলেন–“আপনার স্বপ্নের সহিত সত্যের কোনো সম্বন্ধ নাই। যদি আপনার মেয়ের কোনো সন্ধান জানতাম ত্ম হলে আমি স্বেচ্ছায় আপনার খোঁজ নিয়ে নিজকে কৃতার্থ করতাম আপনার দুঃখে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে”।

রমণী উত্তেজিত হইয়া করিলেন, “তুমি আমার কন্যার জীবন-স্বামী। তুমি স্বামী হয়ে স্ত্রীর খবর জান না! বল–আমার মেয়ে কোথায়?

আবু আবার বলিলেন–“আমার এখনও বিবাহ হয় নাই। তা ছাড়া আপনি হিন্দু। আপনার কন্যার সহিত আমার বিবাহ অসম্ভব কথা!”

রমণী বলিলেন–“তুমি বলতে চাও–তুমি মুসলমান, হিন্দুর মেয়েকে বিবাহ করলে তোমার জাতি যায়?”

আবু বলিলেন, “তাহা বলিতেছি না। শুধু প্রথা নাই।”

“কীসের প্রথা? যেখানে মনুষ্যত্ব আছে সেখানেই আত্মাকে বিক্রয় করা যায়। হিন্দু এক ছাড়া দুই ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে না। বাঙালি হিন্দু গ্রিকের মতো অন্ধ পৌত্তলিক নহে, ইহারা খাঁটি মুসলমান। ইহারা মোহাম্মদের মহা-মনুষ্যত্বকে অস্বীকার করে না। বল আমার মেয়ে কোথায়?”

আবু আবার বিনীতভাবে কহিলেন, “সত্য করিয়া বলিতেছি, আপনার মেয়ের সংবাদ আমি। বিন্দুবিসর্গ জানি না। আমি এমন নরপিশাচ নহি। আপনার মাতৃহৃদয়ের দুঃখ আমি পুরাপুরি অনুভব করছি, সত্যি করে বলছি আমি কিছু জানি না।”

রমণী হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিয়া কহিল–“মিথ্যা! সংসারকে বিশ্বাস নাই–এখানে কেবল অধর্ম ও পাপ।”

মুহূর্তের মধ্যে বাধা দিবার অনেক পূর্বে রমণী চলন্ত ট্রেন হইতে অন্ধাকরে মাঠের মধ্যে লাফাইয়া পড়িল।

.

এয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

কানাই নগরের নিমু শেখ কতকাল হতে যে জিরা, গোলমরিচ, কেরোসিন তেল, লাল সুতা পুতুল, মেয়েদের মাথার কাঁটা বেচে বেড়ায় তার ঠিকানা নাই। সরলা, আমলা, যুঁই নিহার, লতা, নাসিফা, জামিলা খাতুন বাল্যকালে আধা-বয়সী-নিমু অর্থাৎ নৈমুদ্দীনকে গ্রামকে গ্রামে মাথায় পসরা নিয়ে ঘুরতে দেখেছে। তাদের প্রত্যেকের কত দূরে দূরে বিয়ে হয়েছে, কারো। বা দুই চারিটি ছেলে আজুও তারা দেখে সেই আধা-বয়সী নিমু তাদের শ্বশুরবাড়ির কাছ দিয়েও চিৎকার করে বলে–“চাই জিরে, গোলমরিচ? চাই মাথার কাঁটা?”

কেউ তাকে দেখে লজ্জা করে না। যারা তার সামনে নেংটা শিশু হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে তারা আজ পাঁচ ছেলের মা হলেও নৈমুদ্দীনকে দেখে লজ্জা করে না। মেয়েদের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি-সবখানেই নিমুর জন্য অন্দরমহল অবারিত দ্বার। শিবু দাসের বউ তার বিধবা কন্যা রমার খবর দুই ক্রোশ দূর হতে নিমুর দ্বারা সংগ্রহ করে। সেদিন রমার ভাসুর তাকে লাঠি দিয়ে মেরেছিল। রমা নিমুর কাছে গোপনে সব কথা বলেছে। নৈমুদ্দীন যথা সময়ে সে কথা শিবুর বৌকে বলে তার আঁখিজল ফেলবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।

নিহার রামরতন দত্তের মেয়ে ছোট কালে না নিমু শেখকে ঠাকুর দাদা বলে ডাকতে। আজও তেমনি করে নিমুকে সে দেখা পেলেই দাদা বলে আলাপ করে। পাঁচ বছর আগে যখন ঢাকঢোল পিটে ফজরপুরে বাবুদের বড় ছেলে নিহারকে বিয়ে করতে আসে, সেদিন নৈমুদ্দীন নিহারকে নাতনীর প্রাপ্য কত ঠাট্টাই না করেছিল। নিহার তার কথা শুনে হেসে খুন হয়েছিল।

আর আজকাল যখন আগুনের ডালি বিধবা নিহার নিমু শেখের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়, তখন নিমু শেখের মুখে কথা সরে না। রহস্য সে ভুলে যায়। অতি কষ্টে সে আঁখিজল সংবরণ করে। বিবাহের এক মাস পরেই নিহার বিধবা হয়ে ভায়েদের ও ভ্রাতৃবধূরে কৃপার পাত্র হয়ে বাড়ি ফিরে ছিলো।

রমার মা বার্তাবাহক নিমুকে দিয়ে শুক্রবার মেয়ের কাছে খবর পাঠিয়েছিলো, শ্বশুরবাড়িতে আর তাকে অত লাথি খেয়ে থাকতে হবে না। শনিবারেই তার মা তাকে নিয়ে আসবে।

নৈমুদ্দীন যেখানেই যাক, যেখানেই থাক, সে এই দুটি মেয়ের কথা ভুলতে পারত না যত রাতেই সে শুতে যাক, শোবার আগে সে একবার ভাবতো–আহা, এই দুটি মেয়ের কেউ নেই! নৈমুদ্দীনের চোখ জলে ভরে উঠতো। সে ভেবে উঠতে পারতো না কেমন করে সে এদের দুঃখ কষ্ট দূর করতে পারে? সে যে বড় দরিদ্র, তা ছাড়া উপার তো কিছু ছিল

হিন্দুদের এ জঘন্য বাধ্যতামূলবক বৈধব্য ব্রত সে সামান্য অজ্ঞান লোক হইয়াও ঘৃণা না করিয়া থাকিতে পারিত না।

.

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

কাটিহারের মুনসেফ শ্যামাচরণ মিত্রের নাম সকলেই জানেন। তখন পূজার সময় তিনি বাড়ি আসিয়াছিলেন। বিজয়ার পরদিন তার বড় ছেলে হরিচরণ বসন্ত রোগে প্রাণ ত্যাগ করিল। হরিচরণ ওকালতী পাস করিয়া বাড়িতে ছিলেন। দুই এক মাসের মধ্যেই তিনি বহরমপুরে কাজে যোগ দিবেন, এইরূপ বন্দোবস্ত হইয়াছিল। কিন্তু হায়, বিধাতার ইচ্ছা অন্যরূপ! কে বুঝিয়াছিল বিজয়ার দিন যেদিন বঙ্গের সর্বত্র হিন্দুর ঘরে আনন্দ-কোলাহল শ্যামাচরণের ঘরে এমন বজ্রাঘাত হইবে।

মুনসেফ বাবুর স্ত্রী সৌদামিনী শ্রেষ্ঠা সুন্দরী, বয়স পঁয়ত্রিশ হইলেও অতীব সৌন্দর্য তাঁহার মধ্যে যথেষ্ট ছিল।

বিবাহের অনেক দিন পরে হরিচরণের জন্ম হয়। সৌদামিনী প্রাণ অপেক্ষা তাঁহার একমাত্র পুত্রকে স্নেহ করিতেন।

গ্রামের মধ্যে সাধ্বী ধার্মিকা রমণী বলিয়া তাহার নাম ছিল। নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু মুসলমান তাঁহাকে মা বলিয়া ডাকিত। সৌদামিনীর নিন্দা কোনো মুসলমান কৃষক শুনিতে পারিত না। গ্রামে যদি কাহারো কোনো অসুখ হইত সৌদামিনী তাহার ঔষধ-পত্রের ব্যবস্থা নিজেই করিতেন। নিজ ব্যয় তিনি পাল্কিতে চড়িয়া রোগীকে দেখিয়া আসিতেন!

হারান শেখের ছেলে পড়িতে পারে না। হারনি শেখ আলির বাবুদের বাড়িতে সৌদামিনীকে ধরিল, অমনি তাহার পুত্রের পড়ার ব্যবস্থা হইয়া গেল।

নিতাই ঠাকুর তাঁর মেয়েকে নিয়ে ভারি বিপদে পড়িয়াছেন। বিবাহের ভার নিলেন সৌদামিনী যত খরচ সব তার!

এ হেন ধার্মিক রমণী সৌদামিনীর মাথায় এই সময় এমন বজ্রাঘাত হইল! মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক।

কেঁদে কেঁদে তিনি কয়দিন একেবারে অনাহারে ছিলেন। তার পর বহু চেষ্টার পর বহু অনুরোধের পর জল স্পর্শ করেন। এই সাংঘাতিক বিপদ শুধু তাহাকেই কাঁদায় নাই, যে শুনিয়াছিল সেই কাঁদিয়াছিল। আহা, সতীর কপালে এই ছিল।

মুনসেফ হরিচরণ ছিলেন অত্যন্ত গোঁড়া হিন্দু। পাশ্চাত্য শিক্ষাকে তিনি নিতান্ত ঘৃণার চোখে দেখতেন। মুসলমানদের প্রতি স্ত্রীর অন্যায় টান দেখিয়া তিনি হাড়ে হাড়ে চটিতেন। কতবার তিনি স্ত্রীকে নিষেধ করিয়াছিলেন, কিন্তু কোনো ফল হয় নাই। ভিতরে তার কি ছিল তা কেউ জানে না। বাহিরে তিনি মুসলমানের ছায়া মাড়িয়ে স্নান করিতে দ্বিধা বোধ করিতেন না। একটা গ্রামের ছেলে একদিন তাহাকে মুরগির মাংস খাইতে দেখিয়াছিল–এই কথা সে বন্ধু মহলে একদিন প্রচার করে। তাঁর পিতা এই কথা শুনিয়া একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলিয়া উঠেন। এত বড় একটা ধার্মিক লোকের বিরুদ্ধে এই পৈশাচিক অপবাদ শুনিয়া, পিতা পুত্রের মাথায় পায়ের খরম দিয়া এরূপ ভীষণ আঘাত করেন যে তার মাথা কাটিয়া যায়। ফলে বেচারাকে ছয় মাস হাসপাতালে থাকিতে হইয়াছিল।

মুনসেফ বসিয়া তামাক খাইতেছেন, এমন সময় গ্রামেরএকজন মুসলমান ভদ্রলোক তাহার সঙ্গে দেখা করিতে আসিয়া ফরাসে বসিয়া পড়িলেন। অমনি সুসেফ বাবু ‘রাম রামবলিয়া হুঁকো ফেলিয়া দিলেন। ভদ্রলোক লজ্জিত ও মর্মাহত হইয়া বলিলেন, বাবু তা হলে আসি,আপনার খাবার বেলা হয়েছে, দেরি করলে অসুখ হতে পারে।

মুনসেফ বাবু বুড়ো ভদ্রলোকের অসঙ্কোচে নাম ধরিয়া বলিলেন–“আচ্ছা, তা হলে এসো।”

রাতদিন তিনি সৌদিমিনীর কাছে হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা করিতেন। ইদানীং তিনি স্ত্রীর হাতে খাওয়া পর্যন্ত ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। অফিস হতে আসিয়াই একবার তিনি স্নান করিয়া শুচি হইতেন।

স্ত্রীর হাতে না খেলেও তিনি সৌদামিনীর জন্য পাগল ছিলেন। সৌদামিনীর নিজের পক্ষে নানা বিরক্তির কারণ থাকিলেও স্বামীর ভালবাসায় তিনি সব কথা ভুলে যেতেন। প্রতিদিন মুনসেফ বাবু পূজার পর টিকিতে ফুল বাঁধিয়া তাড়াতাড়ি স্ত্রীর ঘরে আসিয়া কৃষ্ণ ঠাকুরের মতো সৌদামিনীর পায়ের কাছে গড়াইয়া পড়িতেন! সৌদিমিনী লাফাইয়া উঠিয়া বলিতেন, একি?–এ কি? আমার যে নরকেও স্থান হবে না।

ধার্মিক শ্যামাচরণ বলিতেন–তুমি দুর্গা! আমি তোমার মধ্যে জগদ্ধাত্রীর রূপ দেখতে পাচ্ছি। তোমাকে আমি মা বলে পূজা করবো!

এমনভাবে তাঁহাদের জীবন কাটিতেছিল, হঠাৎ একদিন তাঁহাদের একমাত্র পুত্র। হরিচরণ মৃত্যুমুখে পতিত হইল।

শোকে শ্যামাচরণ ও সৌদামিনী একেবারে মুহ্যমান হইয়া পড়িলেন। শ্যামাচরণ ছয় মাসের ছুটি লইলেন।

শোক প্রশমিত করিবার জন্য শ্যামাচরণের স্ত্রী তীর্থভ্রমণে গমন করিলেন। উভয়েরই ইচ্ছা কিছুকাল কাশীতে বাস করিয়া শ্রীক্ষেত্র হইয়ো বাড়ি ফিরেন।

ছয়মাস অতীত হইয়া গিয়াছে। পুত্রশোক অনেকটা প্রশমিত হইয়াছে। বিশেষ করিয়া ভগবান আবার তাদের প্রতি কৃপা প্রকাশ করিয়াছেন। সৌদামিনী বহু বৎসর পরে আবার অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছেন।

সংসার আবার শত সুষমা লইয়া তাঁহাদের সম্মুখে প্রতিভাত হইতেছিল। ফুলের গন্ধ আবার ফরিয়া আসিয়াছিল জোছনার আলো আবার তাঁহাদের কাছে মধুর হইয়া উঠিয়াছিল।

একদিন জোছনার আলোয় জগৎ অভিনব সাজে সজ্জিত হইয়াছে। বাড়ির সম্মুখে নানাবিধ কুসুম ফুটিয়াছিল। নীল লতা আর ছোট ছোট ফুলের গাছ সেদিন শ্যামাচরণের বহিবাটীখানিকে একখানি নন্দপুরী করিয়া তুলিয়াছিল। এমন সময় শ্যামাচরণ তাহার স্ত্রীকে লইয়া সেখানে উপনীত হইলেন।

শ্যামল দুর্বার উপর দাঁড়াইয়া আলো ও গানে ভরা প্রকৃতির মধ্যে সৌদামিনী শ্যামাচরণের বুকের উপর মাথা রাখিয়া বলিলেন–এ সংসারে যদি স্বামী-স্ত্রীর মধুর মিলন

থাকিত, তবে মানুষ বাচিত না। তুমি আমাকে কত ভালবাস, আমি তোমাকে কত ভালবাসি। সকল দুঃখ, সকল বেদনা তোমার মুখের দিকে তাকাইলে ভুলিয়া যাই। .

শ্যামাচরণ স্ত্রীর মুখে চুম্বন করিয়া তাহাকে বুকে আরও একটু চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন–প্রিয়ে, স্ত্রী-পুরুষের মিলন না থাকিলে এই দুঃখ কষ্টভরা সংসারে কেহ বাঁচিতে পারিত না, ইহা সত্য। যেদিন প্রথম তোমকে বিবাহ কর সেই দিন হইতেই কী মধুর স্বপ্ন রচনা করিয়াছি। তোমার সৌন্দর্য, তোমার মাধুরী তোমার রক্ত ওষ্ঠের মৃদু কম্পন, প্রতি প্রভাতে নূতন মোহ সৃষ্টি করে! সকল বেদনা, সকল দুঃখ ভূলিয়া ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়া বলি ‘প্রভু! মানুষকে তুমি কী মহাদান দিয়াছ। সমস্ত সংসার ভুলিতে পারি, কিন্তু সৌদামিনীকে ভুলিতে পারি না। তুমি আমার জীবনের শক্তি, ধর্মে তুমি আমার ভক্তি, বিচারকার্যে তুমি আমার বৃদ্ধি, আমি তোমার কাছে শত রকমে ঋণী, তুমি আমার মহারানী।

সোদামিনী কহিলেন–প্রিয়তম, আমি তোমার দাসী। আমাকে অত প্রশংসা করিয়া লজ্জিত করছ কেন?

নিকটস্থ পাথরের বেদীর উপর বসিয়া শ্যামাচরণ সৌদামিনীর হাত ধরিয়া কহিলেন–বেশ, তুমি দাসী, আর আমি দাসীর দাস।

সৌদামিনী কহিলেন–তোমার সহিত কথায় পিরবার যো নাই। এই বলিয়া তিনি শ্যামাচাণের মুখে এক চুম্বন দান করিলেন।

স্বামী-স্ত্রী অতঃপর অনেক কথা হইল।

অবশেষে শ্যামাচরণ কহিলেন–ছুটি ফুরাইয়া গিয়াছে। সোমবারেই রওনা হওয়া আবশ্যক। আমি ময়মনসিংহে বদলি হইয়াছি। সুতরাং গোয়ালন্দ দিয়া যাইতে হইবে।

.

পঞ্চবিংশ পরিচ্ছেদ

পাঠককে এইবার জাপানে যাইতে হইবে।

বেনা তাহার স্বামীর জীর্ণ দেহখানির উপর হাত রাখিয়া কহিল–প্রিয় লেমান, তোমার চিকিৎসায় তো সর্বস্বান্ত হইয়া গিয়াছি, হাতে তো আর কিছুই নাই। ছেলেগুলি তো রাত্রিতে কিছু খায় নাই। যদি প্রাণ দিয়ে তোমাকে রক্ষা করিতে পারিতাম তাহাতেও আমার আপত্তি ছিল না। তোমার রক্তশূন্য মুখ আর আমি দেখিতে পারি না। ছেলেগুলিকে কেমন করিয়া বাচাই। এ মাসের বেতন দশ ফ্রাঙ্ক আগেই নেওয়া হয়ে গিয়েছে। মিস্ ফিনিকে আবার কী বলা যায়।

লেমান কী হল সাবিত্রী প্রতিম বধূর স্বাস্থ্যের রক্ত-ভরা চিবুকে হাত দিয়ে কহিল প্রিয়তমে, ভগবান যদি আমার মরণ দিতেন তাহা হইলে অধিক সুখী হইতাম। আর তোমাকে কষ্ট দিতে পারি না। তোমার এই বয়স এই সৌন্দর্য আমার স্পর্শে থাকিয়া অকালে শুকাইয়া যাইবে। আমি নরাধাম, তোমার জীবনকে বিষময় করিয়া তুলিয়াছি। ভগবান। আমাকে ক্ষমা কর।

বেনা স্বামীর পা ধরিয়া কহিল–আমার প্রাণাধিক! অমন কথা মুখে আনিও না। আমি কি কুলটা রমনী! জাপানী রমণী অনায়াসে স্বামীর জন্য প্রাণ দিতে পারে, তথাচ সে প্রলোভনে মুগ্ধ হইবার পাত্রী নহে। প্রিয়-লেমান, তুমি সারা জীব এই অবস্থায় বাঁচিয়া থাকে। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তোমার সেবা করিব।

লেমান কহিল–দেবতার কাছে প্রার্থনা করি, পরজন্মে তুমি মহারানী হয়ে জন্ম গ্রহণ করো।

বেনা কহিল-প্রিয় লেমান, পরজন্মে আমি যদি মহারানী হই, তবে দেবতা যেন তোমাকে রাজা করেন। পরজন্মে ইহা অপেক্ষাও যদি কষ্টের জীবন হয়, তবে যেন তোমাকেই স্বামীরূপে পাই। আমি অর্থ চাহি না; সম্পদ চাহি না, সম্মান চাহি না, চাই তোমাকে।

মিস্ ফিনির পিতা টকিও শহরের একজন সম্রান্ত ব্যক্তি। তাহারই বাড়ির অদূরে এক দরিদ্র দম্পতির মধ্যে উল্লিখিত রকমের কথা হইতেছিল।

লেমান অতি দরিদ্রের সন্তান। যুবক বয়সে কুমারী বেনার ভালবাসা লাভ করিয়াছিল। শহরের এক গলিতে এই দরিদ্র দম্পতি বিবাহের পর মর্তেস্বর্গ রচনা করিয়াছিল। সে আজ দশ বছরের কথা।

আজ দুই বৎসর হইল লেমান কাল যক্ষ্মা-ব্যাধির কবলে পড়িয়া তলে তিলে ধ্বংসের পথে চলিয়াছে।

লেমান সমস্ত দিন পরিশ্রম করিয়া যাহা পাইত তাহাতে তাহাদের বেশ চলিত মাসে। শেষে হাতে দুই দশ ফ্রাঙ্ক জমিতেও ছিল। তাদের কোনো কষ্ট ছিল না।

কয়েক বছরের মধ্যে তিনটি ছেলে-মেয়ে হয়েছিল, তথাচ অনটন হয় নাই। বড় ছেলেটি তার বাপের ইট টানায় সাহায্য করিয়া সামান্য দুই এক পয়সা উপায় করিতে পারিত। দুই বছর হইতে লেমান ব্যাধির যন্ত্রণায় কোনো কাজ করিতে পারে না। ঘরে যা কিছু ছিল সব শেষ হইয়া গিয়াছে।

দারুণ সাংসারিক কষ্টে বেনা মিস্ ফিনির সহচরী হইয়াছিল। কাজ,–স্নানের সময় ফিনির গা পরিস্কার করিয়া দেওয়া, চুল বাঁধিয়া দেওয়া, কাপড় পরায় সাহায্য করা, মুখে পমেটাম লাগান, জুতা পরিস্কার করা, স্নানের সময় কাপড় ধরিয়া রাখা ইত্যাদি। বেনার মাসিক বেতন ১০ ফ্রাঙ্ক।

জুলাই মাসেরবেতন ১০ ফ্রাঙ্ক জুন মাসেই সে লইয়া ডাক্তারকে দিয়াছে। কিন্তু ব্যাধির উপশম হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাইতেছে না। ছেলেরা কি খাইবে, কিছু নাই।

লেমান বেনার হাত ধরিয়া কহিল–প্রিয়তমে, তুমি আর কি করিবে? ছেলেপিলের ক্ষুধার যন্ত্রণা তো আর দেখা যায় না। বড় ছেলে একখানা রিক গাড়ি টানিবার উপযোগী হয় নাই, তা হলে সে তো কিছু কিছু উপায় করিতে পারিত!

বেনা কহিল–আমার প্রিয় লেমান, আচ্ছা আমি আর একবার মিস্ ফিনির কাছে যাই। যদি অগ্রিম আরও কিছু পাওয়া যায়।

লেমান তাহার কম্পিত রক্তহীন হাতখানি বেনার চিবুকে রাখিয়া কহিল–না না, আমার প্রিয় বেনা! দরিদ্র বলিয়া কি ক্রমে ক্রমে নীচাশয় হইতে হইবে? মিস্ ফিনিরে তোমার উপর বিরক্ত হইবেন। আমাদিগকে কত ঘৃণার চক্ষে দেখিবেন।

বেণা কহিল–প্রিয় লেমান, আমি তোমার জন্য হাজার অপমান হাজার লজ্জা মাথায় তুলিয়া লইতে পারি; কুমারী ফিনির হৃদয় উন্নত। তিনি আমাদের দুঃখ কাহিনী শুনিলে নিশ্চয় ব্যথিত হইবেন। ধনীর একটু কৃপায় বহু দারিদ্রের প্রাণ রক্ষা হয়।

লেমান বলিল–এখন থাক প্রিয়তমে, এই দারুণ লজ্জা ও অপমান আমি সহিতে। পারিতেছি না। . বেনা–প্রিয় লেমান তোমার রোগজীর্ণ শরীরে মানসিক কষ্ট খারাপ ফল প্রসব করিতে পারে। আচ্ছা, আমি বাহির হইতে আসি। অনেক কথা বলিয়াছি। একটু বিশ্রাম কর।

লেমান শত তালি দেওয়া অথচ পরিষ্কার উপাধানের উপর মাথা রাখিয়া চক্ষু মুদ্রিত করিল।

বিবাহের দিন বেনা তাহার বাল্যবন্ধুর নিকট একখানি ফুল উপহার পাইয়াছিল সেইখানি বাঁধা দেবার জন্য সে গোপনে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল।

ঘর হইতে বাহির হইবার সময় সে নীরবে চোখের জল মুছিয়া কহিল–দেবতা আমার প্রিয় লেমানকে ভালো করো।

২৬-৩০. জবনহাটী গ্রামের এক বুড়ি

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ

যশোর জেলার মাগুরা মহকুমার অধীন জবনহাটী গ্রামের এক বুড়ি আর তার সেয়ানা মেয়ে তাদের স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে মেজের উপর বসেছিল।

মা তার মেয়েকে বলিল–মা ফেলী! তিন জায়গায় তোর নিকে দিলাম। তিন জনই তোকে তাড়িয়ে দিল। নাড়ী কাটায় দুই আনা চারি আনার বেশি কেউ তো দিতে চায় না। কেমন করে চলে?

ফেলী। সেই কালেই তো বলেছিলাম, পরের ছেলেকে বিশ্বাস নাই। তুই কেন নিকে দিলি?

“নিকে না দিয়ে কি করি মা, কি খাব? নিজে না হয় মরে গেলাম, তুই কি করে বাঁচবি? আর তোর তো রক্তমাংসের শরীর, এই বয়স। কী করে তোকে ঘরে পুষে রাখি বল দেখি।“

“আচ্ছা, মা, নিকে যখন করতে আসে, তখন তারা কত ভালবাসা জানায়। এক মাস যেতে যেতেই রাতদিন মারতে থাকে। মেয়েমানুষের এত দুর্গতি কেন? যদি পুরুষমানুষ হতাম তাহলে তো এই অপমান, এত লজ্জা সহ্য করতে হতো না। কি করে ধর্ম রক্ষা করা যায়?”

“মা কি বলবো। পৃথিবীতে ধর্ম নাই। যার গায়ে জোর সেই সম্পদশালী, সেই ধার্মিক। আমরা দরিদ্র লোক, পরনে কাপড় নাই, ভাত নাই, ধর্মও নাই। আয় আমরা বিষ খেয়ে মরি। ধীরে ধীরে একটু একটু করে মরার চেয়ে আয় একবারে মরে যাই।”

“মা, মরা কথাটা বলতে যত সোজা কাজে তত সোজা নয়। আর তা ছাড়া বিষ খেলে মরলে পরকালে তার আর জায়গা হয় না।”

আজ তিন দিন খাওয়া হয় না। মিঞাদের বাড়িতে মিঞার যায়ের মৃত্যু উপলক্ষে ফাতেহা হইতেছিল। ফেলীর মা যুবতী কন্যা ফেলীকে লইয়া খানাবাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইল। ক্ষুধায় তারা পথ চলিতে পারিতেছিল না। বড় দুঃখে, বড় বেদনায় চরণ তাহাদের ভাঙ্গিয়া পড়িতেছিল।

খানাবাড়িতে অসংখ্য মানুষ। কত মূল্যবান, কত বিচিত্র পোশাকে তাদের দেহ সজ্জিত। আলবোলার গন্ধে ধূমে মজলিসে ধূমায়িত। থাকে থাকে, পানের খিলি। যুবকের উচ্চ হাসি, আর বুদ্ধদেব চিন্তাপূর্ণ সংসারজ্ঞানে সভাগৃহ কম্পিত।

মৌলবীরা তর্ক করতেছিল–দাড়ি রাখা সুন্নত। অতএব যাহারা দাড়ী রাখে না তাহারা কাফের, কি না?

এমন সময় শততালিযুক্ত কাপড়-পরা ফেলীকে লইয়া ফেলীর মা সেখানে উপস্থিত হইল। আত্মার মঙ্গলই যখন উৎসবের মূল কারণ, দরিদ্র ও দুঃখীর আশীর্বাদেই যখন পূণ্য, তখন আজি এই সহস্র মুদ্রা আয়ের মধ্যে ফেলীর মায়ের জন্যে কি একটি টাকাও জুটিবে না! একটি টাকাতে যে তাদের দশ দিন চলে। আহা! একটি টাকা তাহাদের কাছে কত মূল্যবান! ফেলীর মা ভাবিতেছে–এমন বিজ্ঞ বিজ্ঞ মৌলবী বসিয়া আছেন ইহারা কি এই সামান্য কথা বুঝিতেছেন না? নিশ্চয় তাঁহারা এই কথার আলোচনা করিতেছেন।

সে আরও ভাবতেছিল–এই সব সম্পদশালী মানুষকে খাওয়াইলে কি লাভ হয়? আমাদের মতো দারিদ্র মানুষকে যদি এই অর্থে ও বস্ত্র দেওয়া হয় তবে আমরা মৃত্যু হইতে বাঁচিতে পারি। আহা! এই সামান্য কথা কি কেউ বুঝবে না? অন্নের জন্য আমরা একটু একটু করিয়া মরিতেছি, আর এইসব মানুষ যাহাদের এখানে আহার করিয়া কোনো লাভ হইবে না, কাহাদের দাবি অধিক? কে খাইলে অধিক পূণ্য লাভ হইবে?

বলিয়াছি ফেলী যুবতী। বক্ষে তাহার ছেঁড়া কাপড়, অনেক টানাটানি করিয়া পরিয়াছে। ফেলী ভালোরূপে তাহার লজ্জা রক্ষা করিতে পারিতেছিল না। তার মলিন বসনের সব জায়গাই যে জীর্ণ। টানিলেই যে ছিঁড়িয়া যায়। মা ও মেয়ে মজলিসের সম্মুখে যাইয়া হাত পাতিয়া দাঁড়াইল।

মজলিসের দৃষ্টি সেদিকে পড়িতে না পড়িতেই একজন বলিয়া উঠিলেন–ছিঃ ছিঃ, বেহায়া স্ত্রীলোক! একেবারে উলঙ্গ!

আর একজন বলিলেন–আরে তাড়াও, তাড়াও, বেহায়া পর্দাহীন ছোট লোক। একেবারে উলঙ্গ হয়ে সামনে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। এ শয়তান দৃশ্যে ধর্ম রক্ষা হয় না।

তৃতীয় ব্যক্তি বলিলেন–এইসব লোকই সমাজে ব্যভিচার স্রোত বহাইয়া দেয়। এদের তাড়িয়ে দাও।

এক চাকর আসিয়া ফেলীর মাকে রুক্ষস্বরে বলিল,–বেহায়া বেটী! সম্মুখ থেকে দূর হ’। ছোটলোক কোথাকার!

ফেলী বলিল–আমরা কয়েকদিন খাই নাই। চাকরটি বলিল–হারামজাদি, বাজারে যেয়ে পয়সা উপায় কর। ভদ্রলোকের জাত মারতে এসেছি। সকলেরই ওজু নষ্ট করুলি!

ফেলীর মা আবার বলিল–কিছু ভিক্ষা চাই। চাকরটি বিলম্ব না করিয়া ঘাড় ধরিয়া তাহাকে এক প্রচণ্ড আঘাত করিল।

ফেলী বলিল–মা, চল যাই, ফিরে যাই। আমরা দাই। দাই, ছোট লোকের কোথাও স্থান নেই।

.

সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ

রাত্রি তখন তিনটা। সহসা তিনটা মেয়ে তিনখানা থালা লইয়া এদের ঘরে প্রবেশ করিল।

এই গভীর রাতে আকাশ হইতে তিনটি সুরবালা তিনখানি অমৃত থালা লইয়া এবাদের সম্মুখে উপস্থিত। প্রত্যেক থালায় নানাবিধ মিষ্টান্ন, সঙ্গে তিনটি কাঁচের গ্লাসে স্বর্গীয় গন্ধামোদিত সরবৎ।

একটি বৃদ্ধা নারী একটা তীব্র আলোকবিশিষ্ট প্রদীপ রাখিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরখানি গন্ধে ও আলোতে ভরিয়া উঠিল।

কামরার ভিতরে ঘরে–টেবিলের উপর মিষ্টান্ন রাখিয়া প্রথম সুন্দরী এবাদের মুখে জল ছিটাইয়া দিয়া কহিল–জামাই শ্রেষ্ঠ! মুখ ধোও।

সন্ধ্যা হইতে একাকী জনমানবহীন প্রকোষ্ঠে বসিয়া থাকিতে এবাদের ঘুম। পাইতেছিল। এবাদ চিন্তার কোনো ধার ধারে না। পার্শ্বের চৌকিতে সে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়াছিল।

মুখ দেওয়া হইলে তিনখানি মিষ্টান্ন থালা এবাদের সম্মুখে রাখা হইল। এবাদ নির্বিকারচিত্তে সেগুলি গলাধঃকরণ করিতে লাগিল।

প্রকোষ্ঠ কার্পেট মোড়া। অতঃপর কার্পেটজড়িত মেঝের উপর তালে তালে পা ফেলিয়া বিচিত্র ভঙ্গিতে এ উহার গায়ে হেলিয়া সুরবালার নর্তন আরম্ভ করিল।

এবাদের মুখে কথা নাই। তিনি নয়ন ভরিয়া দেখিতে লাগিলেন। যুবতীরা গান ধরিল। এস, এস, বিদেশী দেবতা, তুমি আমাদের মহারানী ফিনির প্রাণ কেড়ে নিয়েছ। মিস্ ফিনি আজ গলায় ফুলের মালা পরবে না! মিস্ ফিনি কুয়াশাময় মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়েছিলেন।

সহসা তার মাথার উপর একরাশ ফুলের বাহার ঝরে পড়েছে। রানী ফিনি আজ তাঁর প্রিয়কে নিয়ে চাঁদের আলোতে খেলা করবেন।

এবাদ একটি কথাও বলিতেছিল না। সমস্ত জীবন সে আর এমন উন্মাদনা কখনও অনুভব করে নাই। একখানি সম্পদ ভরা দেহের কল্পনায় সে সহসা উদ্বেল হইয়া উঠিল। সে সকল কথা ভুলিয়া গেল! কে সে, তাহার বাড়ি কোথায়? কেন তাহার এই বর্তমান অবস্থা? কিছুই তাহার খেয়াল আসিল না।

ওঃ! যে মিস ফিনি তাঁহার অপূর্ব যৌবনমাধুরী লইয়া তাহার আশে-পাশে কত ঘুরিয়া বেড়াইয়াছেন, আজ সেই ফুলরানী মিস্ ফিনির সহিত তাহার বিবাহ! এবাদ ভাবিল, মিস ফিনিকে লইয়া সে চিরজীবী বন্দি থাকিতে পারে না! অন্ধ অন্তর যেন আজ তাহার খুলিয়া গেল। তাহার জীবনের একটা পাশ এতকাল একেবারে ঘুমাইয়াছিল।

আজ যেন তার নূপুর শিজ্ঞনে সমস্ত লুপ্ত আকাঙ্ক্ষা বাধাহীন উত্তেজনায় তাহার শিরায় শিরায় নাচিয়া উঠিল।

মৌন, ভাবহীন কল্পনাহীন এবাদ মধুর হাসি হাসিয়া সেবিকা ও নাচওয়ালী সুন্দরীর দিকে তাকাইয়া কহিল–সুন্দরী, আর এক পেয়ালা শরবত। সেবিকা স্বর্ণাধারে আরও খানিক লালরক্ত ঢালিয়া দিল।

এবাদ তাহা পান করিল। আহা! সংসার কী মধুর! এখানে দুঃখ নাই, বেদনা নাই–কেবল আনন্দ! কেবল সুখ। এবাদ আরও ভাবিল–পৃথিবীর এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত। পর্যন্ত কেবল ফুলের বাগান। অনন্ত সুন্দরী তাহাদের নগ্ন সৌন্দর্যমুক্ত করিয়া হাসিয়া খেলিয়া বেড়াইতেছে। যে এই আনন্দ ও সৌন্দর্য ভোগ করে না সে নিতান্তই অপদার্থ। এবাদ ছোখ পুঁজিয়া দেখিল রমণীরা কুসুমের মালা রচিয়া এ উহার গায়ে হানিতেছে। তাহাদের হাসিতে সুধা ঝরিয়া পড়িতেছে। ওহে! কে এমন নরাধম আছে যে, এইসব সুন্দরীদের পায়ের তলে সুখের আবেশে আপনাকে চূর্ণ করিয়া দেয় না?

কীসের মনুষ্যত্ব? কীসের ঈশ্বর? রমণীই ঈশ্বর!!

আহা, রমণীর চুলগুলি কী সুন্দর! কী মাদকতাভরা! উহা অনুভব করিবার বলিবার নহে। এক একটা চুলের জন্য এক একটা রাজত্ব দেওয়া যাইতে পারে। রমণী বেলীর তীব্র মধুর বিষ কী মহাআবেগে সমস্ত আত্মাটাকে গ্রাস করিয়া ফেলে। রমণীর মুখোনিতে ধরার তাবৎ মধু-মাখান। ওষ্ঠের বঙ্কিম হাসি কামানের গোলা অপেক্ষা ভয়ঙ্করী। নিতম্বে তার আত্মার জীবন-রস তরঙ্গায়িত হইতে থাকে। পা দিয়া সে সমস্ত সংসারটা চূর্ণ করিয়া দিতে পারে। যখন সে সংসার বুকে বিচরণ করিতে থাকে তখন মাটি অসীম পুলকে কাঁপিয়া উঠে। তাহার তীব্র কটাক্ষে পৃথিবীর গতি সৃষ্টি হইয়াছে। তাহার মাদকতা ভরা রামধনুর মতো সমস্ত আলো-বাতাসে রঙ ফলায়। রমণী রানী! রমণী মহারানী!

এবাদ চোখ খুলিয়া চাহিল দেখিল মিস্ ফিনি মহারানীর বেশে তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান। সারা বিশ্বের সৌন্দর্য সংগ্রহ করিয়া মিস ফিনির চারু মোহিনী মূর্তি নির্মিত। পরণে রক্তবস্ত্র। এবাদের বুকের ভিতর কামনার আগুন দাউ দাউ করিয়া জ্বলিয়া উঠিল। স্বর্গের শ্রেষ্ঠ ও সুখ ও সৌন্দর্য পরী-মূর্তি গ্রহণ করিয়া তাহার সম্মুখে উপস্থিত।

বৃদ্ধ পুরোহিত মিস্ ফিনিকে এক রৌপ্যনির্মিত আসনে বসাইলেন। অতঃপর পুরোহিতের নির্দেশমতো নর্তকী বালিকারা এবাদের পোশাক খুলিয়া ফেলিল।

কোনো সময়ে পুরোহিত তাহার পবিত্র পুস্তক ও মন্ত্রপুত দণ্ড লইয়া তাহাদের বিবাহ কার্য সুসম্পন্ন করিতে আসিয়াছেন এবাদ তাহা জানে না। তাহার হৃদয় আনন্দে চিত্তে নাচিয়া উঠিল। কোনো পুণ্য কার্যপ্রভাবে এবাদের আজ এত সুখ? স্বর্গ যেন আপন ইচ্ছায় তাহার মাথার উপর ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। গর্বে ও উল্লাসে এবাদের মন ভরিয়া উঠিল।

এবাদ তাড়াতাড়ি পুরোহিতের পদধূলি লইয়া কহিল–আজ্ঞা করুন! কী করিতে হইবে?

পুরোহিত আশীর্বাদ করিয়া কহিলেন–মিস ফিনির জন্য উপযুক্ত পাত্র হইয়াছে। বৎস, তোমাকে প্রথমত স্নান করিয়া দেবতার পায়ে আপনাকে উৎসর্গ করিতে হইবে। এবাদ ইতস্তত করিতেছিল। সে যে মুসলমান, দেবতার পায়ে সে নিজেকে উৎসর্গ করিবে?

এমন সময় মিস্ ফিনি কহিলেন–প্রয়তম আর দেরি কেন? দূরাগত বাঁশির সুরের ন্যায় এবাদের কানে সে স্বর প্রবেশ করিল। কীসের ধর্ম?

এবাদ তাড়াতাড়ি তাহার আসন্ন প্রিয়তমার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করিরয়া নর্তকীদিগকে ইঙ্গিত করিল।

পার্শ্বের বেদির উপর বসাইয়া অতঃপর তাহারা এবাদকে স্নান করাইল। তিনটা অপ্সরার কোমল হস্তের মধুর স্পর্শে এবাদ ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমানের সকল কথা ভূলিয়া গেল।

তারপর বিবাহ। পুরোহিত পবিত্র জল’ এবাদের মাথার উপর ছিটাইয়া দিলেন। অসংখ্য দেবদেবীকে সাক্ষ্য করিয়া মন্ত্র পাঠ করাইয়া পুরোহিত মিস্ ফিনিকে মিস্টার এবাদের সহিত বাঁধিয়া দিলেন।

বাসরঘরে ফুলশয্যা রচনা করিয়া নর্তকীত্রয় দম্পতিযুগলকে দুর্বা দিয়া আশীর্বাদ করিল। অতঃপর তাহারা দেবতার নামে গান করিতে করিতে দরজা বন্ধ করিয়া বাহির হইয়া পড়িল।

.

অষ্টবিংশ পরিচ্ছেদ

মধুপুরে যাইয়াই রহমানের, শরীর আবার খারাপ হইয়া পড়িল। মি. আবু রহমানের মায়ের কাছে তার করিয়া দিলেন–বন্ধু রহমানের অসুখ বাড়িয়াছে। সত্বর কয়েকজন আপনার লোক লইয়া এখানে আসা চাই।

তিনদিন পরেই মৌলবী এমদাদ আলী সাহেব তাঁহার স্ত্রী ও কন্যা, আবদুর রহমানের মাতা ও ভগ্নি আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

ডাক্তার বলিলেন–কোনো আকস্মিক মানসিক উত্তেজনায় ব্যাধি ফিরিয়া আসিয়াছে। আবদুর রহমানের মাতা দিবারাত্র ক্রন্দন করিতে আরম্ভ করিলেন।

এমদাদ মিঞার কন্যা আমেনা এবং রহমানের ভগ্নি হামিদার উপর সেবার ভার পড়িল। এমদাদ মিঞার স্ত্রী পথ্যের ও আহারের ভার লইলেন। রোগীর তত্ত্বাবধান আবু সাইদ প্রাণপণে করিতে লাগিলেন।

গাড়ির ভিতর কী কাণ্ড হইয়া গিয়াছে তাহা রহমান কাহাকেও জানায় নাই। সেই ঘটনার পর কয়েকদিন রহমান কাহারো সহিত কথা বলে নাই। চিন্তায় তাহার রাত্রিতে ঘুম পর্যন্ত হইত না। আবু সাইদ একবার কারণ জিজ্ঞাসা করায় রহমান বলিয়াছিল, “মন খারাপ হইয়া উঠিয়াছে। কারণ বুঝিতে পারিতেছি না।”

প্রায় একমাস অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। ডাক্তারের ঔষধে এবং তিনটি প্রাণী অক্লান্ত সেবায় রহমান এবার সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করিল।

এই বিপদের সুযোগে আবুর সহিত এমদাদ মিঞার কন্যার যথেষ্ট পরিচয় হইয়া গিয়াছে। মাথার উপর বিপদ লইয়া আমেনার পানে একবারও আবু অন্যভাবে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে পারে নাই। যখন সেবার পরিশ্রম করিয়া গেল, তখন সহসা একদিন আমেনার মনে হইল–এই একমাস ধরিয়া সে আবুর সহিত কী আশ্চর্য রকমে মিশিয়াছে। লজ্জায় সঙ্কোচে তাহার মন ও মুখ লাল হইয়া উঠিল। যে দিন সে রহমানের কঠিন ব্যাধির সংবাদ শুনিতে পায় সেদিন তাহার বালি-হৃদয়ে একটা গভীর বেদনা জাগিয়া উঠিয়াছিল। সেইদিন আমেনা বুঝিয়াছিল, আপন ভাই না হইলেও সে রহমানকে কতখানি ভালবাসে ও শ্রদ্ধা করে। রহমানকে সেবা করিবার একটা লিপ্সা তাহার প্রাণের মধ্যে জাগিয়া উঠে। সুতরাং রহমানের মাতার সামান্য অনুরোধেই নিজের মায়ের সহিত বিপুল উৎসাহে সে মধুপুরে চলিয়া আসিয়াছে। কিন্তু আজ যখন সকল বিপদ কাটিয়া গেল, তখন সে তার গত মাসের সমস্ত ঘটনা, সমস্ত কথার সমালোচনা আরম্ভ করিল।

অস্তগমনোমুখ সূর্যের সমালোচনা আরম্ভ করিল।

অন্তগমনোম্মুখ সূর্যের রক্তরাগ তাহার পেলব গণ্ডে পড়িয়া এক অভিনব দৃশ্য সৃষ্টি করিয়াছিল। রাকের থাকের ঈষৎ ঠেস দিয়া সে ইত্ৰময় এটঠফ-এর ছবির দিকে তাকাইয়াছিল। এক বর্ণও সে বুঝিতেছিল না।

মনে মনে সে প্রশ্ন করিল,–“সেদিন এত ঘণ্টা করিয়া কেন এখানে আসিলাম? রহমান ভাইয়ের মা হয়তো মনে করিতেছিল, মিস্টার আবুর করুণা ভিক্ষা করিতেই, এখানে আমার আসিয়াছি? সে মানুষ, আমি মানুষী, তাহার করুণা কেন আমি ভিক্ষা করিতে যাইব? আমি কী একটা মর্যাদা নাই। তাহার পা ধরিয়া বলিতে হইবে কী, দয়া করিয়া আমায় গ্রহণ কর। ছিঃ ছিঃ ছিঃ কি ঘৃণা! মিস্টার আবু কি মনে করিতেছেন? তিনি হয়তো কত ঘৃণার . সহিত ভাবিতেছেন, আমেনা সেবার ভানে আমার করুণা ভিক্ষা করিতে আসিয়াছে।”

তারপর এই দীর্ঘ একমাস কত ভাবে কত রকমে সে আবু সাহেবের সঙ্গে মিশিয়াছে। সেদিন কামরার ভিতর ঈষৎ অন্ধকারে ডাক্তারের ঔষধটা তাড়াতাড়ি ধরিতে গিয়া সে মিস্টার আবুর গায়ে উপর যাইয়া পড়িয়াছিল। তখন তাহার মনে কিছুমাত্র সঙ্কোচ বা লজ্জাবোধ হয় নাই। কিন্তু আজ যখন সেই ভয়ানক দৃশ্যটি তাহার চোখের সামনে আসিয়া উঠিল। তখন সে দারুণ আত্মগ্লানিতে একেবারে মুহ্যমান হইয়া পড়িল। আমেনা ভাবিল–ছিঃ ছিঃ ছিঃ! এমন করিয়া নিজেকে ছোট করিয়া ফেলিয়াছে! মিস্টার আবু কী মনে করিয়াছিলেন? তিনি হয়তো ভাবিয়াছেন–এই বেহায়া মেয়েটি কেমন করিয়া উঠিতে বসিতে আমার মনোযোগ আকর্ষণ করিতে ব্যস্ত। আমেনার ধৃষ্টতা অসহ্য।

আমেনার সহসা ইচ্ছা হইল, সে তার দেহটাকে মাথা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলে। একটা দুর্জয় উত্তেজনায় সে বহিখানি মেঝের উপর ফেলিয়া দিল।

তারপর একদিন আবু সারাদিন পরিশ্রম করিয়া যখন রহমানকে বাতাস করিতেছিল তখন আমেনা তাহার অস্বাভাবিক ভদ্রতা বশে বলিয়া উঠিয়াছিল–“মিস্টার আবু, সেবাকার্যে স্ত্রীলোকের দাবিই অধিক। আপনি আর কষ্ট করিবেন না।” মিস্টার আবু বলিয়াছিলেন–“আমার কোনো কষ্ট হইতেছে না।”

প্রত্যুত্তরে আমেনা বলিয়াছিলেন–“মিস্টার আপনাকে অমন করিয়া বাতাস করিতে দিয়া আমি নিজে কিছুতেই বসিয়া থাকিতে পারিব না। উহাতে আমার অধিক কষ্ট হইবে।”

আমেনা আজ এতদিন পরে ভাবিতেছিল–ছিঃ ছিঃ! হয়তো মিস্টার আবু সে-সময়ে মনে মনে কতই না হাসিয়াছিলেন!

ব্যথায় বুক চাপিয়া ধরিয়া আমেনা বলিয়া উঠিল–খোদা!

আমেনা কঠিনভাবে প্রতিজ্ঞা করিয়া ফেলিল–আজ হইতে আর মিস্টার আবুর সম্মুখে যাইবে না; তাহার সম্মুখে সে আর কথা কহিবে না। এই সময়ে একজন দরজার ফাঁক দিয়া

আমেনার উজ্জ্বল মুখোনি দেখিয়া বলিয়া উঠিল–“কী সুন্দর!” সে আবু সাইদ।

.

ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ

জামালপুরের এক ঘড়ির দোকানে ঘড়িওয়ালা লোহারামের সঙ্গে তাহার বন্ধু রমাকান্তের কথা হইতেছিল।

রমাকান্ত লোহারামের হাত হইতে ঘড়িটা লইয়া বলিল–আরে, এটার স্প্রিং নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ছয় টাকা দেবে বলেছে?

লোহারাম বলিল–ঘড়িটে বেশ। মাত্র স্পিংটা ভাঙ্গা। বলেছে, পাঁচ টাকা দিবে। ঘড়ির কথা ফেলে রাখ। শুনলাম, বাজারে একটা মেয়ে এসেছে। সে নাকি ভারি সুন্দরী। চল, আজ দুপুর বেলা মেয়েটাকে দেখে আসি।

“আরে, এ কাজ! মালিক বলেছে, তার আজই কলকাতা যেতে হবে। নইলে তার ৫০০ টাকা ক্ষতি হবে। এই ঘড়িটার জন্যে সে তো দু’দিন বসে আছে তার খরব রাখন?”

“আরে ফেলে রাখ! মনের সুখের চেয়ে তার ৫০০ টাকা বড় নয়।”

“বেশ তো তোমার ধর্ম! এক ব্যক্তির ৫০০ টাকার ক্ষতি, আর তোমার বাজারে যেয়ে মদ খাওয়া, আর অশ্লীল আমোদে মত্ত হওয়া! এই না ভদ্র লোককে সকাল বেলা বললে–দুপুরেই ঘড়ি ঠিক হয়ে যাবে। বেচারা কত অনুনয়-বিনয় করে বলে গেল। তুমি কী রকমের লোক বল তো লোহারাম?”

লোহারাম হাসিয়া কহিল–“আরে মনটা বড় খারাপ হয়েছে। মন যাতে ভালো হয়। তার চেষ্টা করা আবশ্যক! যখন সে আশা করে দুপুর বেলা ঘড়িটি নিতে আসবে তখন দেখবে আমাদের দোকান বন্ধ। হা করে খানিক তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে ঘড়ি ফেলে থুয়েই সে বাড়ি ফিরে যাবে। অন্তত ছয় মাসের মধ্যে সে আর ফিরবে না। আমিও ইত্যবসরে অর্ধের দামে কোনো গ্রাহকের কাছে বেচে ফেলবো।”

”যখন ছ’মাস পরে আবার সে ঘড়ির তাগাদায় আসবে?”

“বলবো, সবাই ঠিক হয়েছিল বাবু! সেইবারেই আর দু’ঘণ্টা দেরি করলেই ঘড়ি নিয়ে যেতে পারতেন। একেবারে ছয় মাস আপনার দেখা নাই। কী বলবো, হঠাৎ পরশু দিন ধা করে স্পিংটা কেটে গেল। যে সে-স্প্রিং দিয়ে আর এবার হবে না। ভাল স্প্রিং আনতে কলকাতা চিঠি পাঠিয়েছি।”

“আর সে বুঝি তোমার স্প্রিং আর ঘড়ির জন্য শহরে বসে বসে দশ দিন কাটিয়ে দেবে?”“সে কি করবে তা জানি!”

“কী করবে”।

“সে, তোমার সব-কথা বেদবাক্য বলে মেনে নেবে। বলবে, লোহারাম বাবু, কাজের ভিড়ে, আর ঘড়ির আশায় শহরে বসে থাকতে পাচ্ছি না। আপনি দয়া করে ভি.পি.-তে বাড়ির ঠিকানায় ঘড়িটি পাঠিয়ে দেবেন।”

“বেশ বটে, তোমার জ্ঞান।” লোহারাম একটু হাসিয়া বলিল, একটু জ্ঞান ট্যান না থাকলে কি সংসারে বেঁচে থাকা যায় ভাই! এ-কালে ধর্ম ধর্ম করলে কি আর চলে? দেখিয়ে দাও তো একটা ধার্মিক লোক!” এমন সময় ঘড়িতে ১১টা বাজিল। লোহারাম হাতের কাজ ফেলে রেখে রমাকান্তকে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিতে বললে–তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে চলো, একবার ঘুরে আসা যাক। যতদিন বেঁচে থাকি ভাই, একটু আরাম করে নেওয়া যাক। সংসারে কে ক’দিন সুখ করে যেতে পারি তাই সঙ্গে যাবে। করে মরে যাব! রোগ-শয্যায় শুয়ে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মানুষ রসগোল্লা খেতে চায়, তা জানত?”

রমাকান্ত বলিল–“লোহারাম বাবু, আচ্ছা ক’ বৎসর বাড়ি যান না? বাড়িতে খরচ টরচ পাঠিয়ে থাকেন তো? আপনার কেদির চলে কি করে?”

লোহরাম শয়তানের মতো সহজভাবে বলিলন–“কাদম্বিনীর কথা বলছ? সে আর টাকা পয়সা কি করবে? সাত বছর বাড়ি থেকে আসছি। এর মধ্যে নিজেই খরচ কুলিয়ে উঠতে পারি না। ফুর্তির প্রাণ ভাই! কী করি বল?”

ধরণীতে যদি কোনো বিপদ থাকে তবে সে পতিতাদের আড্ডা। চাঞ্চলচিত্ত ক্ষুদ্রমতি যুবকগণ এই পৈশাচিক নরককে স্বর্গের সোপান মনে করে। একটা অতি পৈশাচিক ও ভয়ানক আনন্দ এই স্থানের আলো-বাতাসকে ভরিয়া রাখে চাঁদের জ্যোতির্মণ্ডলের মতো প্রত্যেক পতিতার অঙ্গ ঘিরিয়া একটা পৈশাচিক মহিমা বিরাজ করে। কুলবধূদের সতীত্ব গৌরব ভরা মুখের সম্মুখে মানুষের মাথা শ্রদ্ধা ও ভয়ে নত হয়। পতিতাদের দৃষ্টি মানুষের মনে একটা জঘন্য বেদনাময় লালসা সৃষ্টি করে।

লোহারাম ও রমাকান্ত তাম্বুল রাগরঞ্জিত অধরে জামালপুরের পতিতাদের আড্ডায় যাইয়া উপনীত হইল। কলঙ্কিনীরা হাসিয়া হাসিয়া রূপের ঢালি লইয়া নামজাদা মহাজন লোহারামের নিকট যাইয়া উপনীত হইল। অহে, সমস্ত পৃথিবী বিনিময়ে মানুষ যে সম্মানকে টানিয়া রাখে ইহারা হাসিয়া হাসিয়া তাহাই সর্বসাধারণের কাছে বিক্রয় করে। কী ভয়ানক কথা।

.

ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

যথাসময়ে আবু সাইদ ও আবদুর রহমান বাড়ি আসিয়াছেন। তার পর রহমান বন্ধুকে বাড়ি লইয়া গিয়াছেন।

আবু বলিলেন–“ভাই, যেদিন থেকে আমেনাকে দেখেছি সেই দিন হতেই মনটা যেন আমার কেমন হয়ে গিয়েছে। যেমন দেখতে, তেমনি তার গুণ। আমেনাকে স্ত্রীরূপে পেলে আমি খুশি হবো।”

রহমান বলিল–“আর বেশি দেরি হবে না, শীঘ্রই তাকে তুমি পাবে।” ঠিক এই সময় আর এক জায়গায় আমেনা আর তার মায়ের কথা হইতেছিল।

আমেনা বলিল–“মা, শুনতে পেলাম আমাকে নাকি আবুর সহিত বিয়ে দেবার জন্য খুব চেষ্টা করছো?”

মা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন–“তোর কপাল কি তত বড় হবে আমেনা?”

“কেন আমি কি একটা পশু?”

মা বিস্মিত হইয়া বলিলেন–“কি বলিস মা? তোর কথা, তো বুঝতে পারছি না?”

আমেনা কহিল–“বলছি ছাই। বলি আমরা গরিব মানুষ, গরিবের মতো থাকাই ভালো।

“আবু সাঈদ বড় ঘরের ছেলে। তার উপর সে শীঘ্রই পুলিশ সাহেব হবে। আমরা কি বিনা কারণে এত পরিশ্রম করছি। মা-বাপের মন বুঝি না তো! যদি খোদা তোকে কোনো দিন ‘মা’ করে, তাহলে বুঝতে পারবি মেয়ের জন্য মার প্রাণ কেমন করে।”

আমেনা আমি কী কথা বলছি আর আপনি কী কথা বলছেন! আমি বলছি–আমরা গরিব মানুষ। আমি খুব বড় দরের লোকের সঙ্গে ওঠা-বসা করি নাই। তার মতো শিক্ষিত যুবকের সঙ্গে ওঠা-বসা করতে আমি পারবো না।

“সে খুব ভালো লোক।”

“ভালো লোক মানে সে আমাকে ঘৃণা করে। ভালবাসার বর্ষা দু’দিনেই কেটে গিয়ে যখন সরল ও সহজ জীবনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হবে তখন সে আমাকে ঘৃণা করবে।”

“তোর কথা কিছুই বুঝি না!”

“এত সহজ করে বলছি তাও আপনি বুঝেন না যে যেমন তার তেমনি থাকা চাই, নইলে মিল হয় না।”

‘আমরা মিল চাই না। তোরা সুখে থাকলেই আমরা সুখী হবো।”

“স্ত্রীর মা-বাপকে ও আত্মীয়-স্বজনকে বাদ দিয়ে কোনো যুবক কোনো স্ত্রীলোককে ভালবাসতে পারে না।”

“ছেলে খুব ভালো। এরূপ ছেলের সঙ্গে বিয়ে হওয়া ভাগ্যের কথা।”

আমেনা যাহা বলিতে চায় তাহা তাহার মা আদৌ বুঝিতেছিলেন না। আমেনা কয়েক দিন ধরিয়া যতই ভাবিতেছিল, ততই তার মন বিদ্রোহী হইয়া উঠিতেছিল। কেন তাহাকে এতটা হীন করিয়া বিবাহ দেওয়া হইতেছে? মিস্টার আবুর কাছে কেন সে এত কৃপার পাত্রী হইতে যাইবে? সে ছোট–সে দরিদ্র। দরিদ্র ও ছোটর ঘরে যাওয়াই তার পক্ষে শ্রেয়। বড়লোকের সহিত দরিদ্রেরা উঠা-বসা, আর মূখের পক্ষে জ্ঞানী সঙ্গস্পৃহা অত্যন্ত বিপজ্জনক। কেন পিতা-মাতা এই সত্য কথা বুঝিতেছেন না। সারাটা জীবন একটা অপমান ও বেদনার ভার লইয়া তাহাকে শ্বশুরের ঘর করিতে হইবে। একটু অপেক্ষাকৃত বেশি সুখের জন্য দুইখানা বেশি গয়নার খাতিরে কেন সে এত আত্মমর্যাদা–জ্ঞানশূন্য হয়ে নিজেকে দীর্ঘ অপমানের পথে দাঁড় করে দেবে। সুখ কি গয়নায়? সুখ সম্মানে; সুখ প্রেমে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! পেটের ছেলেগুলিও তো তাকে বাপের কৃপার পাত্র বলে মনে করবে। ছোট ঘরের মেয়ে বলে বাইরে ঘৃণা না করলেও অন্তর তাদের বেশ করে অনুভব করবে, তাদের মা খুব ছোট।

রহমান হাসিয়া বলিলেন–“বলি, অকস্মাৎ এত আগ্রহ বেড়ে উঠলো! এর মানে কি ভাই?” মি, আবু বলিলেন–“জানি না কেন। একদিন বৈকালবেলা মধুপুরে দরজার ফাঁক দিয়ে তার মুখখানা দেখেছিলাম। কেন যেন এক অপূর্ব মাধুরী তখন তার মুখে জড়িয়ে উঠেছিল। মনে হল, এমন মধুর মুখ জীবনেও কখনও দেখি নাই। সেই দিন হতে মনের ভিতর একটা তীব্র বেদনা জাগ্রত শুরু হয়েছে। সব সময়েই কি যেন ভাবি! খাবার সময় কি দিয়ে ভাত খাই ঠিক থাকে না।”

রহমান কহিলেন–“আমেনার কপাল আর তোমার অনুগ্রহ! এই বিবাহে এমদাদ মিয়া আর তার স্ত্রী তোমার কাছে চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবে। আমিও অল্প কৃতজ্ঞ হবো না।”

“বটে! তোমার স্বার্থ আছে নাকি?”“এই বিবাহের কর্তা আমি। তোমার সঙ্গে তাকে বিবাহ দিবার প্রধান পাণ্ডা আমি।”

“আমার ভালবাসা না থাকলেও, তোমার খাতিরে তাকে বিবাহ করতাম। বন্ধুর কাছে বন্ধুর মর্যাদা খুব বেশি।”

রহমান বলিলেন–“আমার কপাল!” এমন সময় পিয়ন কাগজ দিয়ে গেল। কাগজ খুলিয়াই একস্থানে রহমানের নজর পড়িল। বিস্ময়াবিষ্ট ও ভীত হইয়া রহমান বলিয়া উঠিল–“সর্বনাশ! এ কি দারুণ সংবাদ!”

রহমানের হাত হইতে আবু কাগজ লইয়া পড়িয়া দেখিলেন :

গতকাল্য মুনসেফ শ্রীযুক্ত বাবু শ্যামচরণ মিত্র তাঁহার স্ত্রীকে লইয়া কর্মস্থানে যাইতেছিলেন! ভয়ঙ্কর বৃষ্টি হইতেছিল। বাতাসও অল্প বহিতেছিল না। বর্ষার জল নদীর কোণায় কোণায় ভরা, শ্যামচরণ বাবু তাহার স্ত্রী লইয়া স্টীমারে উঠিতেছিলেন, এমন সময় দুইজন মুটে সেই পথ দিয়ে নামিতে থাকে। তাড়াতাড়িতে মুনসেফ বাবুর গায়ে ধাক্কা লাগে। তিনি জলের মধ্যে পড়িয়া যাইতেছিলেন। তাঁহার স্ত্রী তাঁহাকে রক্ষা করিতে যাইয়া নিজেই জলের মধ্যে পড়িয়া যান। অন্য সংবাদ–স্টীমারের খালাসীগুলি নাকি সিঁড়ি টান দিয়াছিল। সংবাদ যাই হোক, ব্যাপারটা যেন অত্যন্ত সাংঘাতিক তদ্বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। পরন্তু গোয়ল ও চাঁদপুরের স্টীমার ঘাটের মজুরিগুলি ও কর্মচারীরা যে বিদেশী ভদ্রলোকের উপর অত্যন্ত অত্যাচার করে তদ্বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। উপরিবন কর্মচারীরা ইহার প্রতিবিধানও করেন না। শুনা যায়, মজুর-মুটেরা কর্মচারীদিগকে রীতিমত ঘুষ প্রদান করে এবং কর্মচারীরাও মোটবাহকদিগকে স্নেহের চোখে দেখেন। এই শোচনীয় ঘটনার জন্য কে দায়ী? স্টীমারের খালাসীরাও যাত্রীদের উপর কম অত্যাচার করে না। কাহাকেও কিছু বলিবার যো নাই। প্রত্যেকেই নিজেকে এক একজন রাজা মনে করে। প্রয়োজন হইলে তাহারা যে কোনো বিদেশী লোককে হত্যা পর্যন্ত করিতে পারে।

ঘটনা আরও ভয়ানক বিচিত্র যে, এই রমণীকে রক্ষা করিবার জন্য কেহ অগ্রসর হয় নাই। মুনসেফ বাবু সিঁড়ির উপর দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া শুধু কাঁদিতে থাকেন।

আবু বলিলেন–“ভয়ানক কথা! অত্যন্ত ভয়ানক!

“দেশের লোকগুলি কী পিশাচ! কাহারো পানে কেউ তাকায় না। এ উহার মাথা ভাঙ্গিয়া খায়। কীসের ধর্ম, কীসের মনুষ্যত্ব!”

৩১-৩৫. আর তো সহ্য হয় না

একবিংশ পরিচ্ছেদ

ফেলী বলিল–“মা, আর তো সহ্য হয় না। চল যাই। থানায় যেয়ে দারোগাকে চারি আনা ঘুষ দিয়ে নাম লিখিয়ে নেই গিয়ে!”

ফেলীর মা। চল আমিও নাম লেখাবো। আমাদের কোথায়ও স্থান নেই। আজ চারিদিন যাবৎ প্রতিবেশীর নিকট হইতে ফেলীর মা আর ফেলী ভাতের মাড় চেয়ে চেয়ে খাচ্ছে। হায়! মানুষের কি এত দুঃখ! এত দারিদ্র্য, এত ঘৃণা, এত অবমাননার ভিতর। মানুষ কি করে ধর্ম রক্ষা করে! মানুষে মুখে বলে পবিত্র হও, ধর্ম কর, কার্যত সে সদাই মানুষকে অধর্ম করিতে বাধ্য করে।

একখানা ভাঙ্গা ঘর, একখানা থালা, স্বামীর থালা, স্বামীর কালের একখানা পাটা তার পুরানো বদনাটা বিক্রি করে, ফেলীর মায়ের হাতে সাত টাকা হল।

দু’খানা নূতন কাপড়; একখানা আয়না, একখানা চিরুণী, এক শিশি সুগন্ধ তৈল, আর এক কৌটা মাজন তারা গ্রাম্য হাটের দিন কিনিয়া আনিল। মা-মেয়ে ঠিক করিল, ইহাতেই তাদের পাপের মূলধন হইবে!

আঁধার তখনও অল্প অল্প ছিল, মা ও মেয়ে এমনি সময় ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া পড়িল। বুক তাদের কাঁপিল না, বরং একটা মুক্তির আনন্দ অনেক দিন পরে তাহাদেরকে মাতাইয়া তুলিল।

সারাদিন হাঁটিয়া তাহারা ঝিনাইদহ মহকুমায় আসিয়া উপস্থিত হইল। পথের অনেক লোক ফেলীর মুখের দিকে অনেকবার চাহিয়াছিল। এর আগে তার মলিন মুখের দিকে

একবারও কেউ ফিরিয়া তাকায় নাই। আজ মুখে গৌরব! কত রূপ! কত আলো।

রাত্রিতে তারা এক হোটেলে রইল। মায়ে-ঝিয়ে হোটেল-স্বামীর কারণহীন অনুগ্রহে খাবার সময় সকলের চেয়ে বেশি ব্যঞ্জন পাইয়াছিল। সকাল বেলা হোটেল-স্বামী সকলের। নিকট হইতে পয়সা গ্রহণ করিল, কেবল লইল না ফেলী আর তার মায়ের নিকট হইতে।

তারা দেশ ছাড়িয়া নদের জেলা চুয়াডাঙ্গা মহুকুমায় যাইবে। একখানা ফেরত গাড়ির ভাড়া ঠিক হইল এক টাকা। গাড়োয়ান আগ্রহের সঙ্গে হেসে ফেলী আর তার মাকে গাড়িতে তুলে নিল। তখন বেলা আটটা।

গাড়ির ভিতর ফেলীকে তার মা বলিল–“ফুলরানী! ব্যাটাকে পান তৈরি করে দে।”

গাড়োয়ান আনন্দাতিশয্যে বলিল–“থাক; থাক।”

পথের মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করেছিল, গাড়ি কোথায় যাবে? গাড়োয়ান অত্যন্ত আহ্লাদের সহিত বলিতেছিল, “বৌ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে।”

নামাইবার সময় ভাড়া তো লাগিলই না, অধিকন্তু গাড়োয়ান ফুলরানীকে একখানা চাটুকদার শাড়ী আর একটি টাকা দিয়ে বললে,–“মনে রেখ। মাঝে মাঝে এসে দেখা। করলে যেন জায়গা পাই।” ফুলরানী মধুর হাসিয়া বলিল–“জীবনে তোমাকে কখনও ভুলব না। তোমাকে দেখা অবধি মন আমার কেমন হারিয়ে গিয়েছে।” গাড়োয়ান তার। মাথাটা ফুলরানীর পায়ের কাছে রেখে খালি হাতে বাড়ি চলে গেল। এই হতভাগাই আজ পাঁচ টাকা জলে ফেলে না দিয়ে পাঁচটি পয়সাও কি ভিক্ষাস্বরূপ দু’দিন তাহাদেরকে দিতে পারে নাই?

.

দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

“ওটা কী ভেসে যায় রে?”

নবা বলিল–“তাই তো রে, ওটা কী?”

বিহারী নৌকাখানি একটু এগিয়ে নিয়ে বললে–“একখানা কাপড়। চিলুঘাটের ন্যাকড়া বুঝি?”

“না না, ভালো করে দেখ দেখি। চুলের গোছা দেখা যাচ্ছে।”“চল, একটু এগিয়ে দেখে আসি।”

নৌকাখানি এগিয়ে নিয়ে বিহারী আর নবা দেখতে পেলে একটা আধবয়সী স্ত্রীলোক ভেসে যাচ্ছে।

মানুষ যেমন প্রকৃতিরই হোক না কেন, সে একেবারে চোখের সামনে কাউকে মরে যেতে দেখতে পারে না। উভয়ে ধরাধরি করে মাতৃল্পে দেহটি নৌকার উপর টেনে উঠিয়ে, ফেললো।

বিহারী, চিৎকার করে বলে উঠলো,–“আরে জ্যান্তো মেয়ে মানুষ। নৌকা বেয়ে দে একেবারে বাড়ির ঘাটে।”

।তার পরে তীরবেগে নৌকা বেয়ে দিতে তারা ভিতর বাড়ির ঘাটে এসে পৌঁছল।

বিহারী তার দিদিকে ডেকে তাড়াতাড়ি সৌদামিনীর অসাড় দেহ ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে ফেললো। পেটের ভিতর জল যেয়ে পেট ফুলে উঠেছিলো। বিহারী পেট থেকে জল বের করে দিল। বিহারীর বোন সৌদামিনীর গায়ে সেঁক দেওয়া আরম্ভ করলো।

সারাদিন পরে বৈকাল বেলা সৌদামিনী চোখ খুলে চেয়ে দেখে, সে এক ধীবরের বাড়িতে শুয়ে আছে।

বিহারীর বোন বললে–“কে গো তুমি নদী দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলে? বিহারী ও নবা তোমাকে জল থেকে তুলে এনেছে। কী জাত তুমি?”

সৌদামিনী অতিকষ্টে কহিল–“আমি এখানে কেন? মুনসেফ বাবু কই?” বলিতেই তাহার মনে হইল সেত গোয়ালন্দ স্টীমারঘাটে তার স্বামীর কাছ থেকে পড়ে গিয়েছিলো।

সৌদামিণীয় চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল।

বিহারীর বোন আবার জিজ্ঞাসা করিল–“তোমরা কী জাত? আমাদের জাতি যায় নাই তো?”

সৌদামিনী কহিল, “না, তোমার জাতি যাইবার সম্ভাবনা নাই আমি ভালো জাত।”

বিহারীর বোন একখানা ঘেঁড়া কাপড় আনিয়া কহিল–“এই খানা পরো।”

সৌদামিনী অতি কষ্টে বিছানা হইতে উঠিয়া কাপড় বদলাইল। সে ভাবিতেছিল–ভগবান এ কি করলে?

স্বামীর প্রেম সম্বন্ধে তাহার দৃঢ় আস্থা ছিল। কিছুক্ষণ পরই সে সকলকে কহিল–সে এক বড় লোকের ঘরণী। স্টীমার থেকে জলের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। স্বামী এতক্ষণে তার সন্ধানে বেরিয়েছেন এবং নিশ্চয়ই তিনি অতিশীঘ্র এখানে উপস্থিত হবেন।

বিহারীর বোন বলিল–“হিন্দুর বৌ তুমি, তোমার তো জাতি গিয়াছে। হিন্দুর মেয়ের কোনো বিপদ হলে জাত থাকে না, তা বুঝি জান না?”

সৌদামিনী বুকের ভিতর একটা দীর্ঘ তীক্ষ্ম শলার মতো কি যেন প্রবেশ করিল। বাহিরে তিনি বলিলেন–“ওসব কোনো কথা নয়, তার স্বামী নিশ্চয়ই তার সন্ধানে বেরিয়েছেন।”

আরও বললেন–“তারা যে কষ্ট স্বীকার করেছে তার জন্য তারা যথেষ্ট পুরস্কার পাবে।”

বিহারী, নবা ও বিহারীর বোন পুরস্কারের নাম শুনিয়া আনন্দিত হইয়া উঠিল এবং তৎক্ষণাৎ বিহারী চিড়ার সন্ধানে বাহির হইল।

শীঘ্র শীঘ্র গ্রামময় রাষ্ট্র হইল, নদী দিয়ে একটি বৌ ভেসে যাচ্ছিল, বিহারী আর নবা তাকে তুলে বাড়ি এনেছে।

বর্ষীয়সী রমণীরা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললে–“আহা বউটির জাত গেল, তবে আর বেঁচে থেকে লাভ কি?”

একমাস অতীত হইয়া গিয়াছে তবুও কেউ সৌদামিনীর সন্ধানে এলো না একমাস পরে সৌদামিনী একটা কাল সন্দেহ বুকে নিয়ে একখানা পত্র লিখিল। পত্রখানি এই :

তারিখ … প্রিয়,

কি লিখবো! চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। আমি নদীর উপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছিলাম। দুইজন ধীবর আমাকে তুলে এনেছিলো! আমি বর্তমানে এখানে আছি। তুমি পত্র পাঠমাত্র এসে আমাকে নিয়ে যাবে। পথের পানে চেয়ে রইলাম।

দাসী সৌদামিনী এক সপ্তাহ পর উত্তর এলো–

প্রিয় সৌদামিনী!

তোমার পত্র পেয়েছি। হাজার দুঃখ হলেও তোমাকে আর আনবার যো নাই। ১০টি টাকা পাঠাইলাম। আরও অনেক পাঠাইব। সেখানে ঘর বেঁধে নিও। সমাজের ভয়ে আমার সেখানে যাবার যো নাই।

ইতি–

শ্যামচরণ।

পত্র পড়ে সৌদামিনী মূৰ্ছিতা হয়ে পড়ে গেল। এত ভালবাসার এই পরিণাম! সমাজের ভয়ে শ্যামচরণ তার এত বছরের স্ত্রীকে অবাধে ফেলে দিলেন। আপন স্ত্রীর প্রতি এত অবিশ্বাস! স্ত্রী তবে কেমন করিয়া পুরুষকে বিশ্বাস করে? স্ত্রীলোকের কী আত্মা নাই? স্ত্রীলোকেরই জাতি যায়? পুরুষের কী জাতি নাই? একটা আত্মার জন্য, একটা সত্যের জন্য সমস্ত বিশ্বসংসারের সহিত সগ্রাম বাঁধালে কি ক্ষতি? বালা দুগাছি বিক্রি করে সৌদামিনী ধীরদেবরকে ও বিহারীর বোনকে ২০ টাকা দিল। বাকি এক মাসের খাবার খরচ করে কয়েকখানি কাপড়ে ব্যয় হয়ে গেল। সৌদামিনীর কষ্টের অবধি রহিল না। ছোট লোক পয়সার চাকর। সৌদামিনী একেবারে পথের ভিক্ষারিণী হলেন। যার মান-মর্যাদা কিছুই এর পরে রইল না। যাকে ধরে তার এত সম্মান সেই যে তাকে তার বিপদের সুযোগ নিয়ে পথে ফেলে দিচ্ছে। এই কি ধর্ম?

তার কি হয়েছে? কেন তাকে ফিরে নেওয়া যাবে না সহায়-সম্পত্তিহীন হয়ে স্ত্রীলোকের পক্ষে ছোটলোকদের মধ্যে কেমন করে কাল কাটান যায়? গত জীবনের এত ভালবাসা, এত প্রেমের প্রতিজ্ঞা মুহূর্তের মধ্যে উড়ে গেল। একটা মানুষের জন্য, একটা সত্যের জন্য মানুষ যারা তারা সমাজ তো দুরের কথা, নিজের জীবন দান করতে আনন্দ বোধ করে। নারীর উপর স্বামীর একি অত্যাচার! ইহাই কি ধর্ম। ইহারি নাম কি জাতিরক্ষা। এই পৈশাচিক ধর্মই কি এতকাল সে পালন করে এসেছে। ধর্মের নামে একি অত্যাচার?

সৌদামিনীর ইচ্ছা হইল, সমস্ত দেবতাগুলোকে তিনি পৃথিবী ছাড়া করেন। সমস্ত হিন্দু সমাজকে তিনি সাগর-জলে ডুবিয়ে মারেন।

তিনি কেমন করে এখানে থাকবেন। এই সব ছোটলোকদের প্রতি তাঁর বিশ্বাস কী? হায়! এমনি করে বিধাতা তার কপালে আগুন ধরিয়ে দিলেন। কোথায় তার পুত্র হরিচরণ? সে হয়তো তার মাকে এমনি করে ফেলে দিত না। সে সংসার ছাড়তো, সে ধর্ম পরিত্যাগ করতো, কিন্তু তার মাকে সে ফেলতো না। সৌদামিনী হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন। তিনি কোনো দিন ভাবতে পারেন নাই, তাঁর স্বামী তাঁর পুত্রের তুলনায় এত ছোট। তিনি চিরকালই ভেবে এসেছেন যে, পুত্রকে তিনি পরিত্যাগ করতে পারেন কিন্তু তার পতি দেবতাকে তিনি কখনও পরিত্যাগ করতে পারেন না।

.

ত্রয়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

লোহারামের স্ত্রী কাদম্বিনীর কাপড় একেবারে ছিঁড়ে গিয়েছে। সাত বছর সে ক্ষুদ-কুঁড়ো খেয়ে বেঁচে আছে। বাড়ির গিন্নীর পনেরখানা কাপড়। চাকরে আর দুই জোড়া কিনে নিয়ে গেল!

বাড়ির কাজেই রাধাগোবিন্দের বাড়ি। রাধাগোবিন্দ গ্রাম্য সম্পর্কে লোহারামের ভাই, সুতরাং কাদাম্বিনীর দেবর। রাধা প্রায়ই কাদম্বিনীর সঙ্গে আলাপ করতো। অনেকবার সে কাদম্বিনীকে কাপড় কিনে দিতে চেয়েছে। কাদম্বিনী গম্ভীরভাবে রাধার অযাচিত দান প্রত্যাখ্যান করেছে।

আজ সন্ধ্যাবেলা রাধা কাদম্বিনীর ঘরে তামাক টানতে টানতে এসে উপস্থিত হল। ঘরে প্রদীপ নাই। তেল থাকলে আলো জ্বলতো।

রাধা অন্ধকারে কাহাকেও না দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল–“দিদি, বা আছ গা?”

কাদম্বিনী অন্ধকারের ভিতর হইলে বলিল–“এই যে এখানে বস আছি।”

বেদনায় দারিদ্রে কাদম্বিনীর আর মনের জোর নাই। এই দুঃখ ও অভাবের শেষ কোথায়?

কাদম্বিনী একখানি ছেঁড়া ছালা পেতে দিয়ে বললে, “বসো রাধা।”

রাধা তামাক টানিতে টানিতে আবার বলিল–“এমনি করে আর কদিন চলবে দিদি?”

কাদম্বিনী মুদৃ আর্দ্র কণ্ঠে বলিল–“কি করবো। ভগবান কপালে যা লিখেছিল তাই হচ্ছে। কে আছে আমার এ সংসারে?”

রাধা বলিল–“দিদি, অমন কথা বলো না। আমি কি তোমার পর?”

রাধা যে তার কোনো কালের কেউ নয়–কাদম্বিনী তাহা বিলক্ষণ জানিত। তত্রাচ বললে–“না না তুমি পর এমন কথা বলবো কেন?”

“তবে যে আমি কোনো কিছু দিলে তুমি লও না?” কাদম্বিনী কথা বলিল না।

রাধা আবার বলিল–“ও পাড়ার নিমাই ঘোষের ছেলে জামালপুরে গিয়েছিলো। সে যা দেখে এসেছে তা লোকের কাছে বলবার যোগ নাই রাম! রাম!”

কাদম্বিনী আগ্রহান্বিত স্বরে কহিল, “কি খবর রাধা? তার কোনো অমঙ্গল হয়েছে কি?”

রাধা কহিল–“অমঙ্গল! কীসের অমঙ্গল? তুমি যেমন বোকা দিদি! সে ওদিকে নবাবি চলা চেলে তোমার কথা ভুলে মদ আর গাঁজা, আর নিত্য নূতন মেয়ে মানুষ নিয়ে সুখভোগ করছে, আর তুমি উঠতে-বসতে তার নাম করছে!”

কে যেন কাদম্বিনীর গায়ে জ্বলন্ত মশাল ছুঁইয়ে দিল। অন্ধকারে কাদম্বিনীর মুখোনি সহসা অতিমাত্রায় বিস্ময় ও ক্রোধে লাল হয়ে উঠলো।

কাদম্বিনী আবার কহিল–“নিমাই ঘোষের ছেলে নিজের চোখে দেখে এসেছে?”

সে মিথ্যা আর বলবে কেন? তার কি এতে কোনো স্বার্থ আছে?

সমস্ত রাত্রি কাদম্বিনী ঘুমাইল না।

তার এই সতীত্বের, এই অপেক্ষার এই পরিণাম!

পরদিন হাট থেকে রাধা আট সের চাল, এক জোড়া কাপড় এক বোতল তেল আনিয়া কাদিম্বনীর কাছে পাঠাইয়া দিল। কাদম্বিনী তাহা লইতে আজ অস্বীকার করিল না।

নিমু শেখের শালা মহিউদ্দিন। ছোটকালে তার নাম ছিল মদো। সে গরু রাখত আর পাড়ায়। পাড়ায় তামাকে খেয়ে বেড়াতো।’

কলকাতা থেকে সেবারে এলাম প্রচারকমণ্ডলীর এক মৌলানা এসেছিলেন। এক বিরাট সভা হয়েছিল। দু’দিনের পথ থেকে মানুষ চাল-চিড়ে বেঁধে বক্তৃতাশুনতে এসেছিল।

মদো সেদিন তার মুনিব-বাড়ি গেল না। গরুগুলি মরার গেল বলে কয়েকবার তার মুনিব চীৎকার করতে করতে ডাকতে এলেন; মদো প্রত্যেক বারেই বলিল–তার ভয়ানক মাথা ধরেছে। বিছানা হতে তার ওঠবার যো নাই।

মুনিবের চীকার যখন আর শোনা গেল না তখন সে তার মার কাছ থেকে একটুখানি তেল নিয়ে; মিঞাদের পুকুর থেকে ডুব দিয়ে দুটি পান্তা খেয়ে তুলে–থোওয়া কাপড়খানা পরে, ক্ষারেকাঁচা একপাট্টাটা মাজায় বেঁধে, সাজানো গামছাটা কাঁধে ফেলে চুপে চুপে মৌলানা সাহেবের বক্তৃতা শুনতে চলে গেল। মদো বা মধু দেখলো কত হাজার হাজার লোক। তার রাখাল হৃদয়ে যেন এক অপূর্ব ভাব সে উপস্থিত হল। সে ধুলা ঝেড়ে এক জায়গায় বসে বক্তৃতা শুনতে আরম্ভ করলো। মৌলানা সাহেব কত কথা বললেন। মধুর চোখে কখনো জল এলো, কখনো ক্রোধ তার চোখ রক্তবর্ণ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারলে সে সামান্য জাতি নয়। তার পূর্বপুরুষগণ জগতের বড় বড় লোক ছিলেন। তার মনে প্রশ্ন হল, সে তবে কেন এত ছোট, এত ঘৃণিত?

মৌলানা বললেন–“মানুষকে মরতে হবে। টাকা-কড়ি-ধন-সম্পত্তি কিছুই মানুষকে বড় করে না। বড় করে শুধু বিদ্যায়, আর যার চরিত্র বড় সেই বড়। পদবীতে লোক বড় হয় না। যে কোনো মুসলমান শ্রেষ্ঠ হতে পারে। খোদা কারো মাথায় বড় ছোট বলে ছাপ মেরে দেন নাই। যে বড় চেষ্টা করে সেই বড় হয়!”

মধুর মনে প্রশ্ন হল, সে কেন বড় ও শ্রেষ্ঠ হয় না?

মৌলানা বললেন ”যে মুসলমান বিদ্যা লাভ করে না সে মুসলমান নয়। প্রত্যেক মুসলমানকে বিদ্যা লাভ করতে হবে। মূর্খের উপাসনার কোনো মূল্য নাই! জ্ঞান লাভ করা মুসলমান ধর্মের এক শ্রেষ্ঠ নির্দেশ!”

মধু ভাবিল, সে মুসলমান নয়। যতদিন না সে বিদ্যালাভ করতে পারে ততদিন সে কাফের।

মৌলানা আবার বললেন–খোদাকে ভরসা করে মানুষ যা ইচ্ছা করে তাই হতে পারে।

মধুর প্রাণের ভিতর আগুন জ্বলে গেল। সে সভার মধ্যেই নীরবে প্রতিজ্ঞা করলে, সে যত দিন না লেখাপড়া শিখে একজন মুন্সী হতে পারে ততদিন সে মুসলমান নয়। বাড়ি ফিরে এসে পরদিন অতি প্রত্যুষেই বিছানা থেকে উঠে একেবারে সে শহরে চলে গেল। একখানা প্রথম ভাগ আর একখানা আরবি বই কিনে বাড়ি ফিলে এলো।

আজ দশ বৎসর পরিশ্রম করে মধুর মনস্কাম সিদ্ধ হয়েছে। সে এখন মুন্সী মহিউদ্দিন।

বাঙালা ও আরবি ভাষায় মহিউদ্দীনের যথেষ্ট দখল জন্মেছে। কেউ তাকে তুমি বলে কথা বলতে সাহস পায় না। ভিতরে তার শক্তি জেগেছে, সে একজন খাঁটি মুসলমান হয়েছে। খোদার জন্য সে যে কোনো কাজ করতে পারে। সে কোনো মানুষকে ভয় করে না। খোদা ছাড়া আর কেউ তার প্রভু নয়। ইদানীং ইংরেজি ভাষায় তার ব্যুৎপত্তি জন্মেছে। সে এখন একজন খাঁটি ভদ্রলোক যথার্থ একজন মুসলমান। সে অত্যান্ত বিনয়ী, মান বাড়ানোর জন্য সে বিনয়ী নয়। ভিতরটাই তার বড় হয়ে গিয়েছে। তাকে সম্মান ও নমস্কার করতে প্রত্যেক হৃদয়বান মনে আহ্লাদ হয়। সে একজন চাষার ছেলে এ কথা সে ঢাকে না। সে বলে এতেই তার বেশি গৌরব, এতেই তার বেশি মনুষ্যত্ব।

ভগ্নিপতি নইম শেখের বাড়ি আজ মহিউদ্দিন এসেছেন। ছোটকালের মধুকে দেখে নইমের মনে গৌরব জন্মেছে। তবুও সে আর তাকে মধু বলে ডাকতে সাহস করছে না।

মহিউদ্দিন তার চাষা ভগ্নিপতির মানসিক অবস্থার কথা বুঝতে পেরে বললেন ”আমি সেই মধুই আছি। আমার জন্য কোনো সম্মানের আবশ্যক নাই।”

নইম তার সরল চাষা-প্রাণের অন্তঃস্থল হতে আশীর্বাদ করে বললে,–“খোদা তোমাকে বেহেশত নছিব করে। তুমি আমাদের গৌরব।”

মহিউদ্দিন বললেন–“তোমরাও আমার গৌরব।”

.

চতুত্রিংশ পরিচ্ছেদ

সরযু বা সুরীর মা, আবদার রহমান যে দিন হাসপাতাল ছেড়ে চলে আসে তার দু’দিন পরেই মুত্যুমুখে পতিত হয়।

সরযু মোহিনীর মৃত্যুর একমাস পরে কলিকাতা চলে আসে। সংসারের সমস্ত সুখ সে বিসর্জন করলে।

সুরীর অর্থের অনটন ছিল না। কিন্তু এত টাকা দিয়া সে কী করবে? নিজের আদৃষ্ট এবং সংসারের দুঃখ ও বিচিত্রতা ভেবে সে ইচ্ছা করলে সারাজীবন পীড়িতের সেবায় কাটাইয়া দিবে। কত লক্ষ লক্ষ রমণী দুঃখে, বেদনায়, অভাবে ও বিপদে পড়িয়া পথে দাঁড়ায়। তাহাদের আর ফিরিবার পথ থাকে না। কত পবিত্র ও সৌন্দর্যের ফুল অকালে শুকাইয়া ঝরিয়া পড়ে। কেহ তাহাদের খোঁজ রাখে না। জীবনে একবার একটা ভুল করিলে তাহার আর অনুতাপ করিবার উপায় নাই। কি অসীম দুঃখ বেদনা কি ভীষণ পাপে লক্ষ লক্ষ রমণীর বুকে চিতা জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাদের একটু সরে দড়াবার পথ নেই। কত বড় বড় ঘরের কত সাধ্বী সংসারের অবহেলা ও ঘূর্ণাবর্তে পড়িয়া ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক পথে এসে দাঁড়ান। তাহাদের আঁখিজলের খবর কেউ রাখে না। তাদের বেদনা জগৎকে জানাবার কোনো উপায় নেই। একে দারুণ লজ্জা তার উপর মানুষের ঘৃণা ও অবহেলায় তারা নিবিড় আঁধারের মধ্যেই আত্মগোপন করে।

সরযু ক্যামবেলে ভর্তি হইয়াছে। মানব-সেবার পক্ষে ঔষধের জ্ঞান থাকা আবশ্যক।

যত মেয়ে-ছাত্রী ছিল, তাদের মধ্যে সরযুই সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্রী। তাহার অনুধাবনশক্তি দেখিয়া কলেজের সকলেই চমৎকৃত। সে প্রতি পরীক্ষায় সুবর্ণ-মেডেল ও বৃত্তি লাভ করে। সমস্ত বৃত্তি সে, আতুর অনাথিনী রমণীগণকে বিলাইয়া দেয়। রমণী হইয়া সে রমণীর দুঃখ ভালো করিয়া বুঝিয়াছিল।

কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীটের মোড়ে সে একটা ছোট দোতলা বাড়ি লইল।

ভাড়া চল্লিশ টাকা। প্রতিদিন নিজের গাড়িতে চড়িয়া সে স্কুলে যায়। হুগলীর সম্পত্তি হইতে তাহার মাসিক আয় ৩০০ টাকা। এই তিনশত টাকাতেই তার বেশ চলতে লাগলো।

কখনও সে ব্রাহ্ম-মহিলাদের মতো, কখনও মেয়েদের মতো পোশাক পরে।

চাকরের মধ্যে একজন পশ্চিমদেশীয় দারোয়ান। বেতন তার দশ টাকা আর খাই খচর। একজন দাসী, তার বেতন পাঁচ টাকা।

একটু স্পর্শে, একটুখানি ভুলে যে ধর্ম নষ্ট হয়, সেই হিন্দু ধর্মের উপর সে আস্থা হারিয়েছিল। কেহ যেন তাই বলিয়া মনে না করেন সরযুর কোনো ধর্ম ছিল না। জীবন তার অত্যন্ত পবিত্র। সর্বদুঃখহর ঈশ্বরের কারুণ্য ও সর্বনিয়ামক শক্তির উপর তার গম্ভীর বিশ্বাস। মানুষের কাছে কোনো ধর্মের লোক সে, জানাইবার প্রয়োজন হইলে সে কহিত, আমি ব্রাহ্ম। সরযু বুঝিয়াছিল, জগতের কুসংস্কার ও মিথ্যার মাথায় পদাঘাত করিতে বিশ্বের সকল। মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্র পুত প্রেমের শৃঙ্খলে বাধিতে ইসলামই পথ। পারিপার্শ্বিক অবস্থার ভিতরে সে মুখ ফুটিয়া সে কথা প্রকাশ করিতে ভয় পাইত। সে দেখিল, এসলামের অণুকরণের নব গঠিত ব্রাহ্ম ধর্ম ও কুসংস্কার ও ভুলের প্রধান শত্রু। ইহাদিগকে অবাধে মুসলমান বলা যাইতে পারে যদি ও তারা লজ্জা ও ব্যক্তিত্বের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখিবার খাতিরে মুসলমান নাম গ্রহণ করে না। মহাত্মা রামমোহন রায়ের সময় যদি বঙ্গদেশের। মুসলমানের অবস্থা ভালো থাকিত। তবে চিন্তাশীল, উন্নত হিন্দু সম্প্রদায় ব্রাহ্মধর্ম বলিয়া এসলামের নূতন শাখা বাহির করিতেন না।

সরযুর জীবন কী সুখময়! তার কামনা নাই, বাসনা নাই, মানুষের কল্যাণে বাসনা নিয়েই তার জীবন। তার জীবন কত পবিত্র, কত মধুর!

বাড়িতে পড়ে পড়ে তার বাংলা সাহিত্যে বেশ জ্ঞান জন্মেছিল। আরবি শব্দ বাঙ্গালায় পড়ায় সুবিধাজনক নয় দেখিয়া, সে অল্পদিনের মধ্যে দুই তিন খানা ইংরেজি বই পড়িয়া লইল।

কোনো পুরুষ লোকের সহিত সে আলাপ করিত না। স্ত্রীলোকের স্বাধীনতা আবশ্যক জানিলেও সে স্বাধীনতার অর্থ পুরুষের সহিত মেলামেশা মনে করিত না। পুরুষকে সে। সাধ্যমত দূরে রাখিত। সামনাসামনি হইয়া কখনও সে পুরুষের সহিত কথা বলিত না।

কঠিন পরিশ্রমের ফলে সরযু প্রশংসার সহিত দুই বৎসর অধ্যয়ন করিল, আর এক বৎসর পরেই সে উপাধি লাভ করিবে।

এই পরিশ্রম ও ঔদাসীন্যের ভিতর সে একটা লোকের কথা অত্যন্ত আগ্রহের সহিত ভাবিত। সে যে কলিকাতা আসিয়া এবং ক্যাম্বোল ভর্তি হইয়াছে তাহা যথাসময়ে সে মিস্টার আবদুর রহমানের কাছে লিখিয়াছে। আবদুর রহমানের গভীর শ্রদ্ধাপূর্ণ চিঠি সরযুর মনে একটা মধুর পরিত্রতায় পূর্ণ দাগ ফেলিত।

এই দীর্ঘ দুই বৎসরের মধ্যে অনেকবার মিস্টার রহমানের সহিত সরযুর দেখা হইয়াছে। মিস্টার রহমানকে সে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে।

রহমান সেদিন ও সরযুর হাতের একখানা চিঠি পাইয়াছে। পত্রের প্রতি পঙক্তি সরযুর দেবীভাবের পরিচয় দিতেছে। আবদুর রহমান এমন আশ্চর্য দেবীপ্রতিমা রমণী আর কোথাও দেখে নাই। সে তাহাকে একজন অকৃত্রিম বন্ধু মনে করে। সরযুর ন্যায় মহিলার সহিত আলাপ করিয়া সে গৌরব অনুভব করে। সরযুর জীবন ও সাধনার প্রতি আবদুর রহমানের মনে একটা আশ্চর্য সহানুভূতি জাগিয়া উঠিয়াছে।

সেদিন আব্দুর রহমান সরযুর পত্রে জানিতে পারিয়াছে, সরযু একটা আশ্রম খুলিতে চাহে। সেখানে সহায়-সম্পত্তিহীন রমণীরা নিম্নশিক্ষা করিবে। সরযু, বহু টাকা ও সম্পত্তি এই কার্যে উৎসর্গ করিতে চাহে। সমস্ত জীবন কুমারী থাকিয়া সে তার এই উদ্দেশ্যে কর্মে পরিণত করিতে চেষ্টা করিবে। দেশের স্ত্রীলোকের দুঃখ, পাপ ও সহায়হীনতা তাহাকে দারুণভাবে আঘাত করিয়াছে। এই জন্যই সে ক্যাম্বেলে ভর্তি হইয়াছে।

আবদুর রহমানের সহিত সরযু এই বিষয় লইয়া একবার পরামর্শ করতে চাহে।

ফেরত ডাকে রহমান সরযুকে শত ধন্যবাদ দিয়া পত্র লিখিয়া দিল–শীঘ্র সে একবার তাহার সহিত দেখা করিবে।

কে যেন অতি অস্ফুটস্বরে সেই সময় রহমানের মনের ভিতর বলিয়া গেল, “আহা! সরযু যদি মুসলমান হইক।” রহমান চমকিত হইয়া বলিয়া উঠিল–ছি!

রহমান তখনও অবিবাহিত।

.

পঞ্চত্রিংশ পরিচ্ছেদ

সন্ধ্যাবেলা বকুল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে রমা নিহারের মতো হাত ধরে বললে–“নিহারা! দিদি! বল, তোর মন কি বলে?

“মনে দিন রাত হুহু করে আগুণ জ্বলে। কী করব, তুই বল? আর তো উপায় নাই, অত্যাচারী সমাজ আমাদের বিধবার হৃদয়ে আগুন জ্বেলে দিয়ে বেঁচে থাকবে না? মুসলমানদের কেমন সুন্দর ব্যবস্থা। কোনো নারীর স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ করা হয় না। হিন্দুদের ভিতর পুরুষ একশটা বিবাহ করতে পারে, আর মেয়েরা সারাজীবন আগুনকে বুকের ভিতর পুষে রাখবে। কি ধর্ম! কি অবিচার!”

রমা শূদ্রের মেয়ে। নিহার কায়স্থের মেয়ে। তত্রাচ এদের মধ্যে বাল্যকাল হতে অত্যন্ত ভালবাসা। একজনের ব্যথা অন্যজন প্রাণপণে বুঝিতে চেষ্টা করে। বাল্যকাল হতে তারা। এক জায়গায় খেলা করে, তাহার পর একই সময় তাহারা বিধবা হয়, উভয়ের মানসিক অবস্থা! একই প্রকার ভয়ানক, সুতরাং প্রতিদিন তাহাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্বন্ধ আরও গাঢ় হইয়া উঠিতেছিল।

রমা নিহারের গলা ধরিয়া বলিল–“দিদি, কী করে একটা দীর্ঘ জীবন কাটাবো? প্রাণ যে ফেটে বেরোয়! কেউ আমাদের দুঃখ বুঝে না। আয়, আমরা বিষ খেয়ে মরে যাই।”

“মরতে পারলেও এ জ্বালা জুড়োতো কিন্তু নিজ হাতে কেমন করে নিজের প্রাণ বের করে দেবো?”

“তা তো ঠিক। আমরা মরি না কেন? পোড়া ব্যাধি আমাদেরকে কি চেনে না!”

“আচ্ছা আয়, ঠাকুরের কাছে পাঁঠা মানত করি। ঠাকুরকে বলি–ঠাকুর আমাদেরকে তোমার শীতল ক্রোড়ে আশ্রয় দাও। আমরা দুইবোন জোড়া পাঁঠা দেবো।”

“মরে গেলে কেমন করে ঠাকুরকে পাঠা দেবো?”।

রমা চিন্তা করিয়া বলিল, “তা তো ঠিক, কিন্তু আর যে সহ্য হয় না। অধর্ম ও পাপ করতে পারবো না আমরা, কিন্তু এ আগুন কি করে নিভাবো?”

“দেখো আমাদের আত্মীয়-স্বজন কেউ আমাদের দুঃখের কথা ভাবে না। কেউ আমাদের বেদনার কথা জানে না। সংসারের কাজ চলে যায়। কে খোঁজ রাখে, কার মনের ভিতর কী চিতা জ্বলেছে! সাধু ও জ্ঞানী যারা তারা স্ত্রীলোককে ঘৃণা করেই নাকি এত বড়!”

নিহারের চোখে অশ্রু গড়াইয়া পড়িতে ছিল। গাছের পাতাগুলি বেদনায় কেঁপে কেঁপে উঠছিলো।

রমা নিহারকে সান্ত্বনা দিয়া বলিল, “দিদি, ভগবান ব্যথিতের বন্ধু, তার উপর আস্থা থাকা আবশ্যক। আমরা যদি মুসলমান হতাম, তাহলে এ নরকের আগুনে পুড়ে মরতে। হতো না। মুসলমানদের হৃদয়ে আছে, তারা দুঃখীর দুঃখ বুঝে; উপাসনা করতে জানে। মৌলভী সাহেবের বিধবা মেয়ে জমিলার সেদিন এক ডেপুটির সঙ্গে বিয়ে হল। জমিলা। দেখা হলেই বলে, তার মৃতস্বামীর স্মৃতি সে মুছে ফেলে নাই। ডেপুটি তার মৃত স্বামীর নতুন মূর্তি পরিগ্রহ করে তাকে ভালবাসে। সে ডেপুটির কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ সে জমিলার এত বড় শোককে একটু লাঘব করতে এগিয়েছে। এরূপ স্বামী পেলে কে দ্বিতীয় বার বিবাহ করতে লজ্জা বোধ করে? মায়ের এক সন্তান মরে গেলে সে তার দ্বিতীয় পুত্রকে টেনে নিয়ে শোক ভুলতে চায়। তাতে কি তার মাতৃত্বের মহিমা কমে যায়?”

নিহার বলিল–“আয় আমরা দুজনেই মুসলমান হই। মুসলমান ধর্ম খুব ভালো ধর্ম। শুনেছিস তো, মৌলবীরা কত সত্য কথা বলে।”

“কি করে মুসলমান হবো?”

“তাহলে খুব ভালো হয়, কেমন?”

‘হ্যাঁ তা ঠিক। বেশ ভালো যুক্তি বটে। মুসলমানদের মধ্যে খুব ভালো ব্যবস্থা আছে। কিন্তু কি করে কি করবো?”

“সে ভার আমি নিচ্ছি। নইমুদ্দিনের দাদা আমাকে আর তোকে খুব ভালবাসে। তাকে সব কথা বলবো। সে কলকাতা ইসলাম মিশনে খরব দেবে। সেখান থেকে মৌলবী এসে আমাদিগকে মুসলমান করে ভালো বিয়ে দেবে। সবার মাঝে নইম দাদা বলবে দুটি হিন্দু রমণী স্বেচ্ছায় মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করতে চায়। কারো বাধা দেবার ক্ষমতা থাকবে না?”

দু’জনে ঠিক করলো নইম দাদা আশ্রয় গ্রহণ করা কর্তব্য।

৩৬-৪০. মসজিদের ভিতর লোকে লোকারণ্য

ষড়ত্রিংশ পরিচ্ছেদ

মসজিদের ভিতর লোকে লোকারণ্য। মিস্টার আবু হাছানের আজ এমদাদ মিঞার সর্বগুণালঙ্কৃতা কন্যা আমেনার সহিত বিবাহ।

আবদার রহমান বরের কাছেই বসিয়াছিলেন।

এক বিপদ উপস্থিত হইয়াছে মৌলবী এমদাদ সাহেব ও তাহার স্ত্রী আমেনাকে কবুল’ বলাইতে পারিতেছেন না। কত রকমের বুঝান হইতেছে। জাতি যাইবার ভয় দেখান হইতেছে কিছুতেই আমেনা বলিবে না–“বিবাহের রাজি আছি।”

পাড়াগাঁয়ের মেয়েদের মতো লজ্জা ও শরমে সে নিজের গলায় নিজে ছুরি দিয়া ভদ্রতার পরিচয় দিতেছিল না সে রানীর মতো নিজের দাবি বুঝিয়া লইবার জন্য কঠিনভাবে বলিতেছিল ”একে বিবাহ করিতে আমি রাজী নহি।”

সভার লোক আমেনার প্রতিজ্ঞা শুনিয়া একেবারে অবাক। তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল এমন ভয়ানক মেয়ে তারা কখনো দেখে নাই। হবে না কেন, লেখাপড়া শিখিলেই মেয়ের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মা-বাপকে পর্যন্ত গ্রাহ্য করে না।

সভাস্থ সকল লোক চিন্তাযুক্ত! হাছানের পিতা রাগিয়া আগুন হইতে ছিলেন।

আবদার রহমান হাছানের কানের কাছে মুখ লইয়া বলিল, “বেশ মেয়ে! পল্লীগ্রামের হাবা মেয়ে বিবাহ করা অপেক্ষা এইরূপ মেয়ে বিবাহ করাই ভালো। তার ভিতরে সে একটা মানসিক বল আছে তা বুঝতে পাচ্ছ বোধ হয়। পরের কথায় সহজে দমিতা হবার পাত্রী সে নয়। তার নিজের বিশ্বাস ও চিন্তার উপর একটা ভয়ানক শ্রদ্ধা আছে। এরূপ মেয়ে বিবাহ করেই সুখ।”

হাছান মৃদু হাসিয়া বলিলেন, “অপমানের কোনো কারণ আছে কি?”

“কিছু না! চুপ করে বসে থাক আর খাও। আমার প্রাণ থাকতে তোমার অপমান হবে, এ বিশ্বাস তুমি কর?”

আবু যাহাই বলুন ব্যাপার অত্যান্ত শোচনীয় হইয়া পড়িল। দুপুরবেলা তারা মসজিদে এসেছেন। মৌলভী পবিত্র হইয়া হাছানের পার্শ্বে কোরআন

শরীফ হাতে লইয়া বসিয়াছিলেন। গহনা-পত্র আগেই দেওয়া হইয়াছে। শুধু আমেনার সম্মতির জন্য সকলে বসিয়া আছেন। এক ঘণ্টার মধ্যে কাজ শেষ হইবার কথা।

প্রায় সন্ধ্যা হইয়া গেল। আমেনা কঠিনভাবে বলিতেছে, মিস্টার হাছানকে সে বিবাহ করিবে না।

আমেনা মলিন বসনে নিজের ঘরে মাটির উপর বসিয়াছিল। চুলে তার তেল নাই। একখানা গহনা সে পরে নাই।

পিতা কাঁদিয়া মেয়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “মা, আমার জাতি যে যাবে। তোমার যে এত অমত আছে একথা তোমার মাও তা কোনোদিন বলেন নাই।”

আমেনা রুদ্ধকণ্ঠে বলিল, “আব্বা! অনেক আগেই আমি মাকে বলেছিলাম, এই, বিবাহে আমার বিপদ হবে।”

পিতা বলিলেন, “তোর কী বিপদ হবে? আমার যা সামান্য সম্পত্তি আছে। তাতে তোর সারাজীবন বসে খেলেও ফুরাবে না। তুই কার কি ধার ধারিস?”

আমেনা বলিল, “আব্বা, ভাতের জন্যই কি লোকে কন্যার বিবাহ দেয়? বাপের কি কন্যার জন্য ভাত-কাপড়ের অনটন হয়? আপনি কি আমার মঙ্গল চান না।”

আমেনার পিতা আমেনাকে অত্যান্ত ভালবাসিতেন। কিন্তু সে ভালবাসার অর্থ কি কন্যার মঙ্গল চিন্তা নহে?

মৌলবী এমদাদ আলী সাহেব তার কথা কহিতে পারিলেন না। মুখ ঢাকিয়া দারুণ। মানসিক যন্ত্রণায় ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন।

অনেক রাত্রি হয়ে গেল। আমেনা তেমনি কঠিন হয়ে বসে রইল।

সকাল বেলা উপাসনা করা শেষ করিয়া সকলে আবার মসজিদে আসিয়া বসিলেন। আর দূরে থাকা যুক্তিসঙ্গত নয় ভাবিয়া আবদুর রহমান একবার আমেনার সহিত দেখা করিতে গেলেন।

পূর্বেই বলা হইয়াছে; সম্পর্কে আমেনা আবদুর রহমানের চাচাত বোন।

আমেনা একা একা বসে পড়ছিলো। আবুকে দেখে সে চোখের জল মুছিয়া বলিল, “ছোট ভাই আপনি ও আমার বিরুদ্ধে?”

আবু অত্যন্ত বিস্মৃত হইয়া বলিল, “কেন হয়েছে কি?”

“আপনি জানেন না?”

“জানি বই কি। দু’নি থেকে তুমি এতগুলি লোককে কষ্ট দিচ্ছে।”

“সে দোষ কি আমার?”

“তোমার নয় তো কার?”

“আপনার, আমার পিতারও আমার মায়ের।”

“কেমন করে?”

“আপনারা আমার সুখ-দুঃখে বুঝতে পাচ্ছেন না।”

“তুমি বলতে চাও, তোমার সুখ-দুঃখের কথা তুমি নিজেই চিন্তা করো।”

“আর কেউ করে না।”

“এত লেখাপড়া শিখে তুমি, এত বড় অকৃতজ্ঞের মত কথা বলছো?”

আমেনা নরম হইয়া পড়িল। অনেকক্ষণ হাত রগড়াইয়া আমেনা বলিল, “এ বিবাহে সুবিধা হবে না।”

“কেন? কোনোদিক দিয়ে?”

“আমার মন এগোয় না। কিছুতেই এগোচ্ছে না।”

“তুমি কি মিস্টার হাছানকে ঘৃণা কর?”

”না, কখনো না। কখনো না। আমি তাকে শ্রদ্ধা করি।”

“তবে তোমার এ কি ব্যবহার?”

“তিনি আমাকে বিবাহ করে সুখী হবেন না। আমি তার চেয়ে অনেক হীন। যেচে সেধে আমি কাহারো সহিত বিয়ে পুষতে চাই না।”

“কে বললে তোমাকে বিয়ে করে সুখী হবে না? তুমি জান না, সে তোমাকে অত্যন্ত ভালবেসে ফেলেছে ইহা সাময়িক নহে। তার মনের এই ভাব চিরকাল থাকবে। তুমি তার চেয়ে হীন? মিথ্যা কথা। রূপ-গুণে তুমি তার সম্পূর্ণ উপযুক্ত। তার সঙ্গে মিশতে তোমার কোনো সঙ্কোচ আবশ্যক নাই। ভয়ে ভয়ে তোমাকে কাল কাটতে হবে না। তোমার স্বাধীনতা নষ্ট হবে না। যেচে-সেধে কেউ তোমাকে বিয়ে দিচ্ছে না। বরং কারই আগ্রহ বেশি। মানের ঘোরে যদি কেউ আগে বিয়ের প্রস্তাব না করে তবে বিয়ে কী করে হবে? আমরা আগে প্রস্তাব করেছি বলে কি আমাদের মান গিয়েছে? আমাদের মেয়ে তুমি। চির জীবনের মতো তোমাকে একটা অগৌরবের মধ্যে ফেলে দেবো এই যদি তোমার বিশ্বাস হয় তবে সেটা মিথ্যা ধারণা।”

০ ০ ০ ০

বেলা ১২টার সময় আবদুর রহমান ফিরে এসে বললেন, মেয়ের মতে ১২ হাজার টাকার কাবিন হোক। আর কোনো কথা নেই।

কেহ আপত্তি তুলিলেন না।

অবিলম্বে সুখ ও দুঃখের ভবিষ্যৎ লইয়া দুটি অপরিচিত আত্মার আচ্ছেদ্য বন্ধন হয়ে গেল!

বিবাহের পরের দিনই তার এলো মিস্টার হাছান ডেপুটি সুপারিন্টেন্ডেন্ট অব পুলিশ হয়েছেন। কাজ শিক্ষার জন্য তাকে এক সপ্তাহের মধ্যে ট্রেনিং-এ যোগ দিতে হবে।

.

সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ

অন্নদা পতিতা, তার ঘরের মধ্যে সে বিহারীর কাঁধের উপর হাত রাখিয়া বলিল, “দেখতে কেমন?”

বিহারী ঘাড় নাড়িয়া বলিল, “কী বলেন? দেখতে যেন কাঁচা হলুদ। আগুনের দলা। ঠিক যেন দুর্গা ঠাকুরুণ।”

বিহারী ধীরব মানুষ। পতিতাদের গহনা ও কাপড়ের চটক দেখিয়া মনে করিত, তারা এক একজন মহারানী। সুতরাং সে ভয়ে তাহাদের সহিত খুব সম্ভমের সহিত কথা বলিত।

অন্নদা বলিল, “তাহলে পঞ্চাশ টাকাতেই স্বীকার?”

“আমার যেন বড় অধর্ম হবে।”

“তুই তো আর কচ্ছিস না। তুই গরিব মানুষ, একটা ভদ্র লোককে বাড়ির ভিতর স্থান দেওয়া কি তোর পক্ষে সম্ভব? তার আর ভদ্রলোকদের কোপনজরেও তুই পড়তে পারিস। কাজ তো এত ঝঞ্ছট দিয়ে! আমার ঘাড়ে পার করে দে। তোর কিছু অধর্ম হবে না। যা করবার আমিই করবো।”

“পঞ্চাশ টাকায় আমি পারবো না।”

“কেন?”

“সাজো বছরে তোমার বাড়িতে সে দালান তুলে দেবে। শহরের সব বাবু তোমার গোলাম হয়ে যাবে।”

উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করিয়া অন্নদা উৎসাহে আবার প্রস্তাব করিল ”আচ্ছা তাহলে মোট একশত টাকা নিবি?”

বিহারী কোনো কালে একশত টাকার মুখ দেখে নাই। একেবারে হাতের উপর সে এতগুলি টাকা দেখতে পাবে। সুতরাং সে আর বেশি আপত্তি করতে সাহস করিল না!

বিহারী বলিল, “রাজি হতে পারি, কিন্তু সে যে পোষ মানবে, তা তো মনে হয় না। শেষকালে তুমি আমার কাছে টাকা ফেরত চাবে তা কিন্তু হবে না।”

অন্নদা বলিল, “সে যা করতে হয় আমি করবো টাকা একবার দিয়ে আবার ফিরে চাবো? তেমন অধার্মিক আমি নই। কত সাবিত্রী দেখেছি? অন্নদার জঁকো হাতে পড়ে সব পাখির মতো পোষ মেনেছে!”

বিহারী বলিল–“তাতো ঠিক তোমাকে কি আমি জানি না। কিন্তু দেখো ধর্ম খেয়ো না!”

“সে সন্দেহ করো না।”

“কেমন করে কি করবো?”

বাড়িতে যেয়ে বলল–“আমরা গরীব মানুষ, এখানে থেকে আপনার কষ্ট হচ্ছে। এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আপনার থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে। বাবুর স্ত্রী খুব ভালো লোক। আপনার কথা শুনে কত কাঁদলেন। বাবুর স্ত্রী আপনার সকল সুবিধা করে দেবেন। তাঁর অনেক মেয়ে আছে। অনেক ঘর আছে। আপনাকে এত ঘর ছেড়ে দেবেন।”

“কবে আনতে লোক পাঠাবেন?”“কাল দুপুর রাত্রে। তুই সব ঠিক করে রাখবি।”

অন্নদা পঞ্চাশ টাকা গনিয়া বিহারীর হাতের উপর দিল। সঙ্গে আর এক জোড়া ধোয়া কাপড় দিয়ে বললে–“এখন পঞ্চাশ টাকা দিলাম। বাকি টাকা কাল রাত্রে দেবো।”

আনন্দে বিহারী উদ্বেল হইয়া গেল। জীবনে তার এমন সৌভাগ্য ঘটে নাই। অন্নদাকে নমস্কার করিয়া বিহারী বিদায় হইল।

সে মাসে মোটেই টাকা আসে নি। জেলেদের ভাঙ্গা ঘরের মধ্যে বসে সৌদামিনী ভাবছিল ভগবান এমনি করে জীবনকে শ্মশানে পরিণত করলো!

কাপড় একেবারে ফেটে গিয়েছে। ঘরে মাত্র সকাল বেলার জন্য দুমুঠো চাল আছে।

আর এক নূতন কথা। কোনো কোনো ইতর রমণী হেসে হেসে কানাকানি করে বলছিল–বিহারী এই মাগীরে নিয়ে……

সৌদামিনীর লজ্জায় ঘৃণায় ইচ্ছা করিতেছিল–প্রাণ তার বেড়িয়ে যাক। সে তার নিজের শরীর নিজে ছিঁড়ে ফেলে। হায়! ধর্মে কেন বলে আত্মহত্যা কর মহাপাপ? তাতে

অনন্তকাল নাকি নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হবে?

অতিদুঃখে সে অভিশাপ দিয়ে শ্যামাচরণ লক্ষ্য করে বললে–“এই তোমার প্রেম? এই তোমার হিন্দু ধর্ম? এই ধর্মের তোমরা বড়াই করো? জীবনের অতি আপনার সতী অর্ধাঙ্গিনীক ফেলে দিয়ে ধর্ম রক্ষা করো।”

এমন সময় বিহারী পিছন হইতে ডাকিয়া কহিল–“কি কথা একটা?”

সৌদামিনী কহিলেন–“কি কথা বিহারী?”

“আপনার বড় কষ্ট হচ্ছে তা আমি বুঝতে পারি। বিশেষ করে আমাদের মতো। ছোটলোকের বাড়িতে ভদ্রলোকের পক্ষে থাকা অসম্ভব।”

“আমি আর এখন ভদ্রলোক নহি বিহারী! এখন আমি অত্যন্ত ছোট। তোমরা যে আমাকে একটু জায়গা দিয়েছ এতেই আমি কৃতজ্ঞ ইচ্ছা করেছিলাম তোমাদিগকে ভালো করে পুরস্কার দেবো, কিন্তু তাহলো না। বিহারী এর পরে আমার কি হবে তা বুঝতে পারি না। কাল আমি রানী ছিলাম, আজ পথের ভিখারিণীর চেয়ে নিকৃষ্ট!”

“আপনি অত বিচলিত হবেন না। আপনার একটা কূল করেছি।”

“সৌদামিনী আগ্রহের সহিত বলিল, “কি কূল করছো বিহারী?”

“এক ভদ্রলোকের বাড়িতে আপনার থাকবার বন্দোবস্ত হয়েছে। বাবুর স্ত্রী খুব ভদ্রলোক। আপনার কথা শুনে কতো কাদলেন। বাবুর স্ত্রী আপনার সকল সুবিধা করে দেবেন। তার অনেক মেয়ে আছে অনেক ঘর আছে। আপনাকে এক ঘর ছেড়ে দিবেন।”

সৌদামিনী কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল–“বিহারী তুমি কি স্বপ্নে দেখছো, ভালো করে বলো। কে এমন দেবী আছেন। তুমি কি সত্য কথা বলছো?”

“আমি খুব সত্য বলছি। এরপরে আর আপনার কষ্ট হবে না। ভগবান আপনার দুঃখ, মোচন করেছেন।”

“করে যাবো সেখানে?”

“আজই!”

সৌদামিনী অত্যন্ত বিস্ময়ে বলিয়া উঠিল–“আজই!”

“হ্যাঁ আজই!”

সৌদামিনী পাল্কি হইতে যখন অনুদার বাড়ির উঠানে নামিল তখন পাল্কির দুই পাশে সাতটি যুবতী মেয়ে। সকলেরই সাজ-সজ্জা খুব চমৎকার।

সৌদামিনী অত্যন্ত সঙ্কোচের সহিত জিজ্ঞাসা করিল–“তিনি কই?”

একজন প্রৌঢ়া অত্যান্ত আগ্রহের সহিত মেয়েগুলিকে ঠেলিয়া সৌদামিনীর হাত জড়াইয়া ধরিল। সৌদামিনী রমণীর পদধূলি গ্রহণ করিল।

অত্যন্ত স্নেহ ও ভালবাসা দেখাইয়া অন্নদা সৌদামিনীকে এক সজ্জিত ঘরে লইয়া বসাইল। যুবতীদের মধ্যে কেহ তাহাকে বাতাস করিতে লাগিল, কেহ বসিবার আসন ঠিক করে দিল, কেহ জলখাবারের বন্দোবস্ত করিল।

ঘরের ভিতর একখানা মুল্যবান কৌচ, দুইখানা চেয়ার, একখানা ইজিচেয়ার; একটা বড় আয়না, আর অনেক কুৎসিত ছবি!

অন্নদা কৌচের উপর সৌদামিনীকে বসাইয়া নিজে তাহার পার্শ্বে বসিয়া হাজার মমতা

ও ভালবাসার পরিচয় দিতে লাগিল।

অন্নদা কহিল–“আপনাকে এই ঘর একেবারে দিলাম। এখানে উঠবেন বসবেন, মোট কথা, এ ঘর আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হল।”

অন্নদা এই সময় শৈল বলিয়া কাহাকে যেন ডাকিল। শৈল অনতিবিলম্বে এক থালা, খাবার আর গ্লাসে করিয়া লইয়া আসিল।

সৌদামিনীর খাবার ইচ্ছা না থাকিলেও অন্নদার অনুরোধে সে খাইতে বসিল। তার পর গ্লাসটা হাতে নিয়ে সৌদামিনী বললে–“এটা কী জিঞ্জার? এত বন্দোবস্ত কেন? সাদা জলেই আমার তৃপ্তি হয়!”

অন্নদা শৈলকে আরও দুই গ্লাস জিঞ্জার লাল আনিতে বলিল। পিপাসিতা সৌদামিনী পর পর চারি গ্লাস জিঞ্জার পান করিল। তারপর দেহ যেন অবশ হয়ে এলো। চোখ অজ্ঞাতসারে মুদিত হয়ে গেল। সৌদামিনী ধীরে ধীরে বিছানার উপর ঘুমাইয়া পড়িল।

অতি উৎকৃষ্ট বিলাতি সুরা সৌদামিনীর সারা শরীরে অতি সুখের চৈতন্য-অপহারক শক্তি ছড়াইয়া দিয়াছিল।

প্রভাতের অরুণ কিরণ খোলা জানালা দিয়ে সৌদামিনীর গায়ের উপর যেয়ে পড়ছিল। চোখ খুলতেই তার সর্বনাশের দৃশ্য সে দেখতে পেল।

নিমেষের মধ্যে তার মাথায় প্রলয়ের আগুন জ্বলে উঠল। লাফ দিয়ে মেজে পড়ে সে এক পদাঘাতে দরজা ভেঙ্গে ফেলে। যখন সে মনের ভিতর একটা অতি প্রচণ্ড প্রলয় নিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালো, তখন তার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। সে তখন একেবারে পাগল।

.

অষ্টাত্রিংশ পরিচ্ছেদ

মাসের পর মা আনন্দে মধুর স্বপ্নে কেটে যাচ্ছিল।

ঘরের মধ্যে মিটি মিটি আলো জ্বলছিল। ফিনি মিস্টার এবাদকে গভীর প্রণয়ের আবেগে কত ভালবাসা জানাইতে ছিল। জীবনের চরম সুখে-বিশ্ব-সংসার ভুত-ভবিষ্যৎ ভুলে এবাদ ফিনির প্রেমে আপনারা সীমাহীন বাসনা ও মাদকতার আগুন নিয়ে এবাদ ফিনির জন্য একেবারে পাগল হয়ে গিয়েছেন।

আজ কত বছর বাড়ি ছাড়া, তার যে, বাড়িতে এক স্ত্রী ছিল তা কি তার মনে আছে? স্বপ্নের মতোও সে কথা এবাদের মনে হয় না। এক বছর হলো বাড়িতে সে মোটেই পত্র লেখে না।

তখন রাত্রি তিনটা। আগের দিন বৈকাল বেলা ফিনি এবাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ইচ্ছা থাকলেও সে যেতে পারে নাই।

ফিনি এবাদের মুখের কাছে মুখ লইয়া কহিল, “আমার প্রিয় ভারতবর্ষের বন্ধু! তোমাকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্তে থাকতে পারি না। কিন্তু দিবারাত্র এখানে থাকলেও পিতা সন্দেহ করতে পারেন।”

এবাদ গম্ভীর আবেগে বলিল–“প্রিয়ে, আমারও তোমারি মতো অবস্থা। যতক্ষণ তুমি এখানে থাক না ততক্ষণ আমি পাগলের মতো পথের পানে চেয়ে থাকি।”

“আমি এক যুক্তি ঠিক করেছি।”

“কী যুক্তি?”

“তুমি একেবারে আমাদের বাড়িতে চলো।”

“যদি তোমার পিতা জানতে পারেন?”

“আমি তোমাকে আমাদের আঁধার ঘরে রেখে দেবো। আঁধার ঘর প্রত্যেক বাড়িতে থাকে। সেখানে কেউ থাকে না, না কেউ যায় না। নীরব আঁধার নিয়ে সেই কামরাটির মধ্যে মাটির নীচে আমরা থাকব। চাবী আমার কাছেই থাকে।”

“সেখানে আমরা আহার, জল কে দেবে?”

“আমার প্রিয় বিশ্বসী ভৃত্য বেলা।”

“ওকে কি বিশ্বাস করতে পারা যায়?”

“বেলা অত্যন্ত বিশ্বাসী ভৃত্য। তাকে প্রাণ দিতে বললে সে প্রাণ দেবে।”

“বেশ যুক্তি রাতদিন তখন তোমার সঙ্গসুখ উপভোগ করতে পারবো কিন্তু কেন যে আমার একটু ভয় হচ্ছে।”

“সেটা তোমার মনের দুর্বলতা ছাড়া আর কিছু নয়। আমাদের সেই নিষ্কলঙ্ক নির্বাত সুখ-সমুদ্রে কোনোও প্রকার দুশ্চিন্তার স্থান হওয়া উচিত নহে।”

“কেমন করে সেখানে যাবো?” বাহিরের দিকে এক গুপ্তদ্বার আছে। সেই পথ দিয়ে গভীর রাতে তোমাকে নিয়ে যাবো।”

এমন সময় বাহির হইতে দরজায় যা পড়লো। ফিনি বিছানা হইতে উঠিয়া কাপড় পড়িয়া কহিল–“ওহে প্রিয়! বেলা এসেছে!”

কয়েক মিনিট বাহিরে দাঁড়াইয়া থাকিয়া বেলা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মিস্টার এবাদ ও ফিনিকে নমস্কার করিল।

ফিনি বেলাকে জিজ্ঞাসা করিল–“পিনাস ঠিক হয়েছে?”

বেলা আর একটা নমস্কার করিয়া কহিল, “হয়েছে।”

সেদিন ফিনি এবাদকে লইয়া সাগর-ভ্রমণে বাহির হইবে। পূর্বদিনেই একখানা পিনাস ঠিক করিতে বেলাকে সে বলিয়া দিয়াছিল। বেলা তাহার কত্রীর আজ্ঞা পালন করিয়া অতি প্রত্যুষেই সংবাদ দিতে আসিয়াছে।

বেলা অত্যান্ত বিশ্বাসী তাহা আগেই বলা হয়েছে। তার কত্রী–ফিনির কাছে সে অত্যান্ত ঋণী। শোকে-দুঃখে সে সর্বদা ফিনির সাহায্য পায়। ফিনির যতই দোষ থাকুক না কেন, সে সর্বদা তার কত্রীর দোষ সকলের নিকট হইতে গোপন করিয়া রাখিত এবং শহরময় সে প্রচার করিয়া বেড়াইত যে, তাহার কত্রী মিস ফিনির মতো মেয়ে সারা শহরে নাই।

বেলা তার কত্রী ও মিস্টার এবাদকে স্নান করাইয়া দিয়া প্রাতঃভোজনের বন্দোবস্ত করিতে লাগিল।

|||||||||| অতঃপর আহারাদি করিয়া অতি প্রত্যষেই মিস ফিনি, তাহার বিশ্বাসী ভৃত্য বেলা এবং এবাদকে লইয়া সাগরাভিমুখে যাত্রা করিল।

প্রায় আধ ঘণ্টার ভিতর গাড়ি সাগর উপকূলে উপস্থিত হইল।

প্রকাণ্ড পিনাসে চড়িয়া এবাদ মিস ফিনির সহিত সমুদ্রবিহারে বাহির হইলেন। পিনাসে তিনটা কামরা। বেলা পিছন দিককার কামায় যাইয়া দরজা বন্ধ করিল। এবাদ তার প্রিয় ফিনিকে লইয়া সম্মুখের প্রকোষ্ঠে উপবেশন করিলেন।

সমুদ্রের ঢেউগুলি পিনাসে আছাড় খাইয়া পড়িতেছিল ফিনি এবাদের বাহু ধরিয়া তাহার কোমল পেলব দেহ এবাদের গায়ের উপর এলাইয়া দিল। এবাদ ফিনির লাল কুসুম কোমল গণ্ডে চুম্বন করিতে লাগিল।

ফিনি কহিল–“প্রিয় বন্ধু আমরা কত সুখি। দেবতা প্রসন্ন ছিলেন তাই তোমাকে পাইয়াছি। সেবারে যখন তোমারে সহিত সমুদ্রে-বিহারে হইয়াছিলাম তখন একটুও ভারি নাই যে, আমাদের এত সুখের দিন আসিবে। তোমার দিকে চাহিয়া চাহিয়া আমি প্রেমের আগুনে মরিয়া যাইতাম, কিন্তু, তুমি কিছুই বুঝিতে পারিতে না।”

এবাদ কহিল–“প্রিয় ফিনি, তোমার ভিতর যে এত প্রেম ছিল তাহা আমি ভাবিতে পারি নাই। তখন ভাবতাম; তুমি আমার সাধারণ শ্রেণীর একজন বন্ধু! কে জানিত, তুমি আমাকে এত ভালবাস।”

প্রখর রৌদ্রে ঢাকা শহর মরুভূমির মতো ঝাঁ ঝাঁ করছিল। কুলসুম–তার নিজের কামরায় বসে সীমাহীন আকাশের পানে তাকিয়েছিল। বাহিরের উষ্ণ বাতাস তাহার শরীরে উষ্ণ দীর্ঘ নিশ্বাসের মতো আগুনের হাল্কা ছড়িয়ে দিচ্ছিলো।

কি দারুণ বেদনা তাহার কোমল বুকখানিকে পিষ্ট করে দিতেছিলো। সে আজ দশ বৎসরের কথা, কত আঁখি জলে সে স্বামীকে বিদান দিয়েছিলো। আর কতকাল সে এমনি করে দারুণ বেদনা নিয়ে কাল কাটাবে। কুলসুম ভাবিতেছিল–“এত বছর কি পড়িতে লাগে? একখানা চিঠি কি লিখিতে নিয়ে কাল কাটাবে। কুলসুম ভাবিতেছিল–“এত বছর কি পড়িতে লাগে? একখানা চিঠিও কী লিখতে নাই? একটা প্রাণীকে এমনি করে হত্যা করে বিদেশে পড়ে থাকা কি ধর্ম? এমন শিল্প-শিক্ষার কী ফল? অর্থ যদি এর উদ্দেশ্যে হয় তবে সে অর্থ আমি চাই না। ভিখারিণী হয়ে স্বামীকে নিয়ে ভিক্ষা করে খাবো। এত অর্থ, এত গহনা, এত রূপ দিয়ে আমার কি লাভ? সামান্য দরিদ্র কৃষক রমণীও ভাগ্য যে আমার চেয়ে অনেক ভালো। কেন এখানে আব্বা আমার বিয়ে দিয়েছিলেন? একটা নির্মম হৃদয়হীন মানুষের অত্যচার সইতে?” বাহিরে পৃথিবী লতা, পাতা ও আলো-বাতাস পুড়িয়া ছাই হইতেছিল। কুলসুমের মুখোনিতেও তেমনি আগুন ধরে উঠলো।

দারুণ বেদনায় বালিশটাকে বুকে লইয়া সে বিছানার উপর শুইয়া পড়িল। চোখ দিয়া অজস্রধারে জল পড়িতে লাগিল।

সেদিন তার শ্বশুর বাড়িতে ছিলেন না। তার শ্বাশুড়ী দুপুর বেলায় আপন কামরায় ঘুমিয়েছিলেন। একে বৃদ্ধাবস্থা, তাহার উপর প্রায় এক বৎসর বড় ছেলের কোনো চিঠি না পাইয়া তাহার শরীর ক্রমশ শোচনীয় হইতেছিল। দিনের বেলা দুপুরে একটু ন্দ্রিা ছাড়া আর কোনো সময়ে তার দ্ৰিা হয় না। সারা রাত্রি বসিয়া কাটাইয়া দেন।

পেছন হইতে এবাদ তার ভাবিকে ডাকিল–“ভাবি!”

এত দুঃখ ও বেদনার ভিতর কুলসুম তাহার ছোট দেবরের নানা রহস্য কথা বলিয়া অনেকটা শান্তি পাইত। দেবর এবাদ তাহার সহিত রহস্য করিলেও সে তাহাকে খুব শ্রদ্ধা করিত।

মানুষ যখন আপনাকে অত্যন্ত অসহায় মনে করে তখন সে সামান্য শত্রুতা মার্জার শিশুকে ভালবাসিয়া ও সান্ত্বনা পাইতে চায়। আপন ভাইয়ের সহিত যাহার অত্যান্ত শত্রুতা হয়, সে পথের অপরিচিত লোককে ভালবাসিয়া সুখ পাইতে চায়। যে মাতাল সন্তান মরিয়া গিয়াছে সে পরের ছেলেকে আগ্রহে বুকের সহিত জড়াইয়া ধরে। মানুষ একটা আকর্ষণ ব্যতীত বাচিতে পারে না। সে আকর্ষণ আপনার জন্যই হউক বা পর হউক, মানুষ হোক বা কর্ম হোক, একটা কিছু হইবেই। আত্মার এই অংশ কখনও শূন্য থাকে না।

অত্যন্ত বেদনায়, জীবনের এই কঠিন শূন্যতায় কুলসুম, তাহার দেবর এবাদকে অত্যন্ত ভালবাসে। এবাদের আহারের বন্দোবস্ত কুলসুম নিজেই করে, নিজ হাতে সে তাহাকে খাওয়ায়, নিজেই পার্শ্বের কামরায় তার শয্যা রচনা করিয়া চুপেচুপে শ্বশুরের অগোচরে ভীত এবাদকে তামাক সাজিয়া দেয়।

এবাদকে দেখিয়া কুলসুম অনেকটা সোয়ান্তি অনুভব করিল। কুলসুম অত্যন্ত স্নেহের স্বরে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া কহিল–“এবাদ! ভাই আমার, আয়!”

এবাদ তাহার ভাবির পায়ের কাছে আসিয়া শুইয়া পড়িল। এবাদের মুখ স্বেদসিক্ত। কুলসুম অত্যন্ত স্নেহে এবাদের মুখোনি আঁচল দিয়া মুছাইয়া দিলেন।

ভাবি আর দেবরে অনেক কথা হইল। কেবল স্নেহ আর শ্রদ্ধাতে।

এবাদের মুখে একটা ফোট হইয়াছিল। কুলসুম হাত দিয়া সেটা টিপিয়া দিলেন, হাতের চাপে এবাদের উজ্জ্বল রক্তময় মুখোনি আরও রক্তময় হইয়া উঠিল।

.

উনচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

তখন সন্ধ্যা। দিবালোক ধীরে ধীরে সরিষা যাইতেছিল। পল্লীপথের নির্জনতা মশার গুঞ্জনধ্বনিতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া উঠিতেছিল। সেই নির্জন পথের নির্জন কালিমার ভিতর দিয়া রমা ও নিহার নইমুদ্দিন শেখের বাড়িতে যাইতেছে।

গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার ভালবাসার পাত্র-চির পরিচিত সরল ধর্মভীরু নইমুদ্দিন শেখ তখন উপসনা শেষ করিয়া তামাক খাইতেছিল।

বেশি দূরে তার বাড়ি নয়। মাঝে একখানা পতিত জমি, তার পর কয়েকখানা বাড়ি, তার পর একটা গ্রাম্য ছোট রাস্তা, দু’পাশে তার সুপারী গাছ, তারপর ঘোষদের বাড়ি। দুঃখিনী বিধবার ভাঙ্গা একখানা ঘর, আর বেদনা-ভরা একখানা উঠান পার হয়ে রমা আর তার বন্ধু নিহার নইম শেখের বাড়ির উপস্থিত হলো।

বৈকাল বেলা রমা আর নিহার তাদের মায়ের কাছে তাদের পুরানো আত্মীয় না হলেও আত্মীয় ঠাকুরদার নইমুদ্দীন শেখের বাড়িতে যাবে বলে প্রস্তাব করেছিল। কোনো মা তাতে আপত্তি তুলেন নাই।

নইম আর নাতনী রমা আর নিহারকে দেখে হুঁকো ধুয়ে চীৎকার করে বললে, “ওগো, নাতনীরা এসেছেন। কই, এদিকে এসে বসতে দাও”–বলিয়া গৃহিণীর জন্য অপেক্ষা করিবার সময় তার সহিল না। নিজেই সে একখানা ছালা এনে নিহারকে বসতে দিলো।

তার পর কতো স্নেহের কথা এই সেদিন রমা-নিহার নইমের চোখের সামনে ছোট কচি খুকী ছিল। আজ তারা সেয়ানা, তারই সামনে তাদের বিয়ে হয়েছিল, তারই সামনে…। নইম কহিতে পারিল না। গলার স্বর তাহার আর্দ্র হইয়া উঠিল।

তারপর আরও কত কথা হইল। অনেক কথার পর নিহার বলিল,–“একটা কথা।”

নইম কহিল–“দিদি?”

“খুব গোপন কথা।”

“যদি ঘৃণাক্ষরে কেউ জানতে পারে তা হলে সর্বনাশ হবে।”

নইম আরও একটু এগিয়ে এসে বললে–“কী কথা বোন। কেউ শুনবে না, তুমি আস্তে আস্তে বল। আমাকে তোরা আপন ঠাকুর দাদা মনে করবি। তোদের দুঃখে; তোদের ব্যথার কথা মনে হলে সেদিন আমার খাওয়া হয় না। রাত্রে ঘুম আসে না। মুখে কি বলবো ভাই? খোদা জানে। আহা! তোরা যদি হিন্দুর ঘরে ন. জন্মিতিস তাহলে তোদের জীবন এমন শ্মশান হতো না। কী করতে পারি; কী ক্ষমতা আছে আমার? খোদার কাছে মোনাজাত করি–এদৃশ্য যেন আর আমার দেখতে না হয়।”

নিহার বলিল–“সত্যিই বলবো, কিছু মনে করবে না তো? তুমি আমাদের দাদা হও বলেই বলতে সাহস পাচ্ছি, নইলে বলতে পাত্তেম না।”

“বলো কোনো ভয় নেই। তোমাদের প্রত্যেক কথা আগ্রহের সাথে শুনবো।”

“দাদা, তুমি আমাদেরকে অত্যন্ত ভালবাস তাই বলতে সাহস পাচ্ছি। যদি অন্যায় হয় তবে প্রতিজ্ঞা করো কারো কাছে এ কথা প্রকাশ করবে না।”

মহিউদ্দিন রংপুরের এক পল্লীগ্রামে একটা মাদ্রাসা খুলেছেন। সেখানকার বড় মৌলবী তিনি। নিকটস্থ আট-দশ গ্রামের লোক তাহাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করে। …

গ্রামে কোনো মারামারি হয়েছে, মহিউদ্দিন তাহা মিটমাট করিয়া দেন। কাহারো বিবাহ তিনি যাইয়া সমস্ত বন্দোবস্ত করেন। কেহ, পীড়িত হইয়াছে, তিনি যাইয়া চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেন, কাহারো আত্মীয়ের মৃত্যু হইয়াছে, মহিউদ্দিন যাইয়া তাহার অন্ত্যেষ্ট্রিক্রিয়া সমাধা। করেন। মাদ্রাসা ছাড়া বাহিরের লোক এইসব কাজে তাঁহাকে বহু অর্থ দিয়া শ্রদ্ধা প্রকাশ করে।

প্রাতকালে তিনি তাঁহার ছাত্র কছিমুদ্দিনকে পড়াইতেছিলেন। কছিমুদ্দিনও নদিয়ার মানুষ। অর্থ ব্যয় করিয়া পড়িবার সাধ্য নাই বলিয়া সে তার দেশী মৌলবী মহিউদ্দিনের কাছে আজ তিন বৎসর যাবত পড়ে। শুধু কাজ করিয়া আহার করিয়াই তার দিন যায় না।

মহিউদ্দিন জ্ঞানলাভেচ্ছু কছিমকে প্রত্যহ নূতন নূতন জ্ঞান দান করেন। একই পড়া এক মাস পড়াইয়া মহিউদ্দিন নিজের কাজ-কর্মের সুবিধা করিয়া লন না এবং তিন বৎসর কছিম ইংরেজি, বাংলা, আরবি ও উর্দু ভাষায় বিশেষ জ্ঞান লাভ করিয়াছে। ইংরেজি বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর ছেলেদের সহিত ইংরেজিতে সে কথা বলিতে পারে। খবরের কাগজও সে বেশ পড়িতে পারে এবং মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখিবার ইচ্ছা পোষণ করে। কোরানের পঠিত অংশের অর্থ বেশি বলিতে পারে। প্রতিবেশী দিল্লী পাঞ্চাবের মুসলমানের ঘরের খবর লাভের জন্য সে উর্দু পড়ে। অন্য কোনো উদ্দেশ্যের জন্য নয়। উর্দু ভাষায় কথা বলিয়া সে ভদ্রলোক হইবার কল্পনা পোষণ করে না। সে চাকরি করিবার উদ্দেশ্যে লেখাপড়া শিখিতেছে না। বাড়িতে তার অনেক জমি আছে তাতে ধান, গোল আলু ও আখ যথেষ্ট পরিমাণে হয়। সমাজে যাহাতে নিতান্ত অশিক্ষিত লোকের মতো কাল না কাটাইতে হয় এইজন্য সে অধ্যায়ন করিতেছে। দুনিয়ায় মূর্খের মতো বাচিয়া থাকাই বিপজ্জনক। লেখাপড়া শিখিয়া সে কৃষকের কাজ করিয়া খাইবে, সংসারে। কাজ করিয়া অর্থ উপায়ে। করিবে তত্ৰাচ সে একটা অপদার্থ মুখ হইয়া থাকিবে না। ইহাই তাহার ইচ্ছা। শিক্ষিত মানুষ যে কাজই করুক তাহাতে তার গৌরব। তাতেই তার মান ও প্রসার হয়। ধীরে ধীরে তার অহঙ্কারহীন আত্মশক্তি জাগিয়া উঠিতেছে।

পিয়ন আসিয়া মৌলবী সাহেবকে একখানা পত্র দিয়া গেল। পত্রখানি মৌলবী সাহেবের ভগ্নিপতি নইমুদ্দীন লিখিয়াছে অনেকদিন তিনি তাহার দরিদ্র ভগ্নি ও ভগ্নিপতির সংবাদ পান না, তজ্জন্য তিনি দুঃখিত ছিলেন। আগ্রহের সহিত চিঠি খুলিয়া দেখিলেন তাতে লেখা আছে :

দোয়াবরেষু–অনেকদিন হইল তোমার সংবাদ না পাইয়া যার পরনাই দুঃখিত আছি। একটি কথা বলিতেছি, খুব চিন্তা করিয়া যাহা ভালো বিবেচনা কর ফেরত ডাকে লিখিবে। আমি অত্যন্ত চিন্তাযুক্ত, আছি। কী করিব কিছুই বুঝিতেছে না। তুমি জ্ঞানী সুতরাং তোমার কাছে বিহিত মীমংসা হইবে, সন্দেহ নাই।

চক্রবর্তী কন্যা নিহার দীনবন্ধু দাসের কন্য রমাকে তুমি চিনতে পার। বিধর্মী হইলেও বাল্যকাল হইতেই এই দুইটি বালিকার উপর আমার প্রগাঢ় স্নেহ।

আমি মুখ মানুষ হইলেও ইহাদের জন্য আমি অত্যন্ত বেদনা, অনুভব করি। তুমি জান। না বোধ হয়, ইহারা খুব বাল্যকালে স্বামীহারা হইয়াছে।

পরকথা, সেদিন সন্ধ্যাবেলা, নিহার ও রমা আমার কাছে এক অতি গোপন কথা বলিয়া গিয়াছে। সংসারের সাধারণ মানুষ তাহাদের দুঃখ ও কথার গুরুত্ব অনুভব না করিলেও প্রত্যেক হৃদয়বান তাহাদের জন্য প্রভূত বেদনা অনুভব করিবে। অত্যন্ত ও ভয় ও সঙ্কোচের সহিত তাহারা একথা বলিয়াছে, আমার সাহায্যে তাহারা মুসলমান ধর্ম গ্রহণ।

করিয়া দুইজন চরিত্রবান মুসলমান যুবকের সহিত বিবাহিতা হইতে চায়। বলিতে কী, তাহাদের এই সৎসাহসে হৃদয়ে আনন্দ অনুভব করিয়াছিলাম ও করিতেছি। ইসলাম যদি এই দুইটি আত্মাকে শান্তি ও মুক্তি দিতে পারে তবে অত্যন্ত ভালো কথা। কিন্তু আমরা দ্বারা এই গুরুতর কার্য কি করে সম্ভব? একে হিন্দুদের শক্তি বেশি, তা ছাড়া দুইজন যুবতী স্ত্রীলোক লইয়া কথা, তুমি কী যুক্তি দিতে চাও, সত্ত্বর লিখিবা!

মহিউদ্দিন পত্র পড়িয়া একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিলেন। চিঠিখানি আমরা আমাদের ভাষায় লিখিলাম। বস্তুত ঠিক এরূপ ভাষায় পত্র লেখা হইয়াছিল না।

সেদিন মহিউদ্দিন মাদ্রাসায় পেলেন না। সমস্ত দিন তিনি চিন্তা করিলেন, তাহার পর সন্ধ্যাকালে তিনি একখানি পত্র লিখতে বসিলেন–তাহাতে শুধু লিখিলেন–ভাই সাহেব! পত্র পাইয়া যার পরনাই ব্যথিত হইলাম। আপনি মেয়ে দু’টিকে খুব সাবধানতার সঙ্গে এখানে লইয়া আসিবেন, তার পর যাহা করিতে হয় আমি করিব। এই দুইটি অসহায় প্রাণীর জন্য আমি করুণাময় আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করি।

সারাদিন মহিউদ্দিন চিন্তা করিলেন–মানুষের অত্যাচারে পড়িয়া মানুষ এমন করিয়া কেন জর্জরিত হয়? দেশের কুসংস্কার ও সামাজিক অত্যাচারে প্রপীড়িত কত হাজার হাজার রমণী এমনি করিয়া আঁখিজলে সারাজীবন কাটাইয়া দেয় তাদের কে খবর রাখে? সকল জায়গায় অত্যাচার চলে, মানুষের মনের উপর অত্যাচার চলে না। মানুষের খোদার দেওয়া স্বভাবের বিরুদ্ধে কেন মানুষ একটা কঠিন লৌহ দেওয়াল তুলিয়া দিয়া এত অত্যাচার ও অবিচারকে প্রশ্রয় দেয়!

সামান্য দীন অবস্থা হইতে অনেক দুঃখ বেদনার সহিত সংগ্রাম করিয়া মহিউদ্দিন বড় হইয়াছিলেন, সুতরাং অনেকখানি দৃষ্টি তাহার লাভ হইয়াছিল। মানুষের দুঃখের প্রতি তাহার মনুষ্যত্ব ভয়ানক রকমে সাড়া দিয়া উঠিত।

তিনি আরও ভাবিলেন–মৌলবীরা যদি চেষ্টা করেন তবে বহু মানুষকে দুঃখের হাত হইতে তাহারা উদ্ধার করিতে পারেন। বহু মানুষ ইসলামের গতিতে আসিয়া নির্বাণ লাভ করিতে পারে। যে বেশি অন্ধ ও মূক তাহার জন্য বেশি বেদনা অনুভূত হওয়া আবশ্যক। গায়ে যার শক্তি আছে সে নিজের স্থান নিজে করিয়া লইতে পারে; পরের সাহায্য তার দরকার হয় না। ইসলাম অর্থ কী? মানুষকে শান্তি দেওয়া, বিশ্বমানবকে দুঃখ হইতে সুখের পথে লইয়া যাওয়া। কুসংস্কার, অত্যাচার ও অন্ধকার মাথায় পদাঘাত করা শুধু ভাবহীন উপাসনা ও উপবাসে ইসলামে মুক্তির খবর নাই।

তাহার মনে হইল, এ-দুটি দুর্বলা নিঃসহায় আত্মাকে যদি সে বাঁচাইতে পারে তবে সে আল্লাহর নিকট অনেকখানি মর্যাদা পাইতে। মহিউদ্দিন ঠিক করলেন সমাজের নিকট ছোট হইবার ভয় থাকিলেও তিনি নিহারকে বিবাহ করিয়া একটা অন্ধ ধর্মহীন ব্যথিত মানুষকে জীবন দান করিবেন। তাহার শিষ্য কছিমুদ্দিনও অবিবাহিত ছিল।

মহিউদ্দিন আবার ভাবিলেন–দেশের জাতির মাথায় কি পৈশাচিক অত্যাচারের ভার চাপান হইয়াছে। শক্তি ও ভারহীন হইয়া তাহারা তাহাদের আত্মার স্বাভাবিক দাবীর কথা ভুলিয়া পরাধীন পশু হইয়া আঁধারে কাঁদিয়া কাঁদিয়া কাল কাটাইতেছে। সারা রমণী জাতিটা দারুণ অপমানে আত্মহীন কৃপার পাত্র হইয়া বাচিতে চেষ্টা করিতেছে মাত্র।

.

চত্বরিংশ পরিচ্ছেদ

মাথার তেল ফুরিয়ে গিয়েছিলো–কাদম্বিনী রাধাকে তেল এনে দিতে বললে।

কাদম্বিনী আবার বলিল–দাঁতে তার বড় ব্যথা। একটু মাজন না পেয়ে সে বড় কষ্ট পাচ্ছে। রাতে তার ঘুম হয় না।

সেইদিনই বিকাল বেলা রাধা নিজে পছন্দ করে একজোড়া পাছাপেড়ে বাহারের শাড়ি কিনিয়া আনিয়া দিল। তাতে দোষ কী? কাদম্বিনী কী বিধবা যে সে চুল বাঁধবে না? দাঁতে মাজন লাগাবে না? রাধা এ কথা তাকে প্রায়ই মনে করে দিত। কাদম্বিনীর দুঃখ অনেককটা উপশমিত হইয়া পড়িয়াছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে রাধার কাছে অত্যান্ত শক্তিহীন হইয়া পড়িল কেন? তেমনি করিয়া রাধার সহিত আর কথা বলতে আজকাল সে সাহস পায় না। কেন? স্বর তাহার শক্তিহীন ও স্ত্র।

রাধার সম্মুখে সে একেবারে দিনে দিনে ব্যক্তিত্বহীন হইয়া পড়িল। সে কি রাধার স্ত্রী? স্ত্রী কাহাকে বলে? স্বামীর সহিত স্ত্রীর সম্বন্ধ কি স্ত্রীলোকেরা সম্মান রক্ষা, তাদের সাংসারিক সুখ-দুঃখের উপশম করাই তো স্বামীর কাজ, তাই জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয়, কাদম্বিনী কি রাধার স্ত্রী?

মিথ্যা কথা! রাধা তাহাকে সমবেদনা জানায় মাত্র! সে আর কেউ নয়।

০ ০ ০ ০

কাদিম্বনী যখন ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন একদিন দারুণ উপদংশ রোগগ্রস্ত হয়ে লোহারাম খালি হাতে বাড়ি এসে উপস্থিত।

তার এই ভয়ানক অবস্থার সময় সে তার ব্যথিতা, বিস্মৃতা, অবহেলিতা স্ত্রী কাছে ফিরে এসেছে। সংসারে তো অনেক পথ ছিল। আর কোনো পথ তাহার আজ মনে পড়ে নাই কেন?

যেদিন কাদম্বিনী বুঝিল, সে অন্তঃসত্ত্বা সেদিন তার লজ্জা হইল না। স্বামীর উপর একটা ভয়ানক ক্রোধও ঘৃণার আগুন তাহার বুকের মধ্যে জ্বলিয়া উঠিল।

উপদংশ–রোগগ্রস্ত হয়ে নিজের পত্নীর কাছে লোহারামের ফিরিয়া আসিতে লজ্জা হয় নাই, আর কাদম্বিনীরই কী এত লজ্জা?

উপদংশ রোগের অর্থ কাদম্বিনী বেশ বুঝে। লোহারাম লক্ষ্য করিল। তাহার অতিনা, চরিত্রবতী স্ত্রীর অতীত সলজ্জা ভাব সেই কথা ও হাসির ভিতর দিয়া একটা অন্তনিহিত অনুরাগের ছায়া আর নাই।

উপদংশের কী ভীষণ জ্বালা তাহা যাহার হইয়াছে সেই বোধ হয় বেশি করিয়া জানে। দারুন যন্ত্রণায় লোহারাম আত্মহত্যা করিতে যাইত, কাদম্বিনী নানা প্রকারে সান্ত্বনা দিয়া তাহাকে নিরস্ত্র করিত।

অন্তরের ভিতর দারুণ ঘৃণা পোষণ করিয়া কাদম্বিনী লোহরামের সেবা করিত। লোহরামের শরীর কিছু ভালো হইলে সে দেখিল, তাহার স্ত্রী কাদম্বিনীর রোগ আরম্ভ হইয়াছে। পাপীর সংস্রবে আসিয়া কাদম্বিনীর মাথায় নূতন বিপদ আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু তাহাতে তাহার কিছুমাত্র সহানুভূতি হইল না।

সেদিন সন্ধ্যাকালে পাড়ার লোক হাটে গিয়াছিল। লোহারাম স্ত্রীকে সম্মুখে আসিতে বলিল। রোগযন্ত্রণায় কাদম্বিনী নড়িতে পারিতেছিল না, তত্রাচ সে লোহারামের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। কাদম্বিনী তখন আট মাস। লোকে তখন বেশ করিয়া কানাকানি আরম্ভ করিয়াছে। কাদম্বিনী কিছুমাত্র গ্রাহ্য করে নাই।

লোহারাম কহিল–“এ সব কী কানাকানি আরম্ভ হইয়াছে? প্রমাণও তো যথেষ্ট পাচ্ছি, অর্থটা কি বল।”

কাদম্বিনী তাহার সকল যন্ত্রণা তখনকার মতো ভুলিয়া গেল। দারুণ উত্তেজনায় কঠিন স্বরে কাদম্বিনী বলিল–“তুমি হয়তো আমার পেটে ছেলে হবার কথা বলিতেছ?”

লোহারাম বলিল”হ্যাঁ, ব্যাপারখানা কী?”

“ব্যাপার কিছুই নহে। রাধা আমার স্বামী! তাহারি সহবাসে আমি অন্তঃসত্তা হইয়াছি।”

একটা জ্বলন্ত অগ্নিময় স্পর্শে লোহার বুকটা অকস্মাৎ ছ্যাৎকরিয়া উঠিল। সে অত্যন্ত ঘৃণার, সহিত বলিল–“রাধা তোমার স্বামী। আর আমি? কবে সে তোমাকে বিবাহ করিয়াছিল?”

কাদম্বিনী বলিল”কোনোও কালে মন্ত্র উচ্চারণ না করিলেও সে আমার অভাব দূর করিয়াছে, ভালবাসিয়াছে ও স্নেহ করিয়াছে। দুটি না বোঝা মন্ত্রের দোহাই দিয়ে তোমার মতো লম্পট আমার জীবনকে শ্মশান করে রাখবে, ইহা কোনো শাস্ত্র অনুমোদন করে না আর স্বামীই যদি হও তবে এর জন্যে দায়ী কে? এ পাপ ও কলঙ্কের কারণ তুমি। তুমি নরপিশাচা স্বামীর মূর্তিতে তুমি আমার বুকে ছুরি দিয়েছ।”

বাঘের মতো লোহারাম কাদম্বিনীর ঘাড়ের উপর যাইয়া পড়িল। যদি আইনের ভয় না থাকিত তাহা হইলে লোহারাম তদ্দণ্ডে কাদম্বিনীকে হত্যা করিত। লোহারাম কাদম্বিনীর চুল মুড়িয়া দিল। তাহার পরিধনের বস্ত্র কাড়িয়া লইয়া তাহাকে বাড়ির বাহির করিয়া দিল।

সেই রাত্রে গৃহ হইতে তাড়িত হইয়া কাদম্বিনী রাধার করুণা ভিক্ষা করিয়াছিল। নরপিশাচ রাধা কহিল ”ভদ্রলোকের মাথায় যদি কলঙ্ক চাপাও তাহা হইলে আমি তোমাকে জেলে দিতে ছাড়িব না”।

বতাহা আঁধারে নদীর কূলে অসহায় গৃহ হইতে তাড়িতা কাদম্বিনীর মৌন আত্মাটি কেমন করে নিজের কাছে কাঁদছিল–সে খবর রাখতে সকলেই লজ্জাবোধ করে বোধ হয়?

৪১-৪৫. নিভৃত কুটীরে ফিনি

একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

নিভৃত কুটীরে ফিনি এবাদের পার্শ্বে বসিয়াছিল। অসীম আবেগে তাহার প্রণয়ীর মুখে সে চুম্বনের উপর চুম্বন প্রদান করিতেছিল।

সেই আঁধার প্রকোষ্ঠের এক কোণে একটা ম্লান প্রদীপ তাহাদের নির্জন প্রণয়ভরা চাঞ্চল্যকে আরও চঞ্চল করিয়া তুলিতেছিল। বহুমূল্যে একখানি, তদুপরি প্রায় দেড়হস্ত। পরিমিত মোটা গদি কামগন্ধভরা হৃদয়ে বাসনা ও কামনা জাগাইতে অত্যন্ত অনুকূল। অসীম সুখে এবাদ সেই দুগ্ধফেননিভ উপর আপনাকে ছাড়িয়া দিয়াছিল।

সহসা দরজায় আঘাত পড়িল। ফিনির সকল ও উল্লাস, কামনা ও আনন্দ একটা অতি শীতল বিরাট বরফ্যুপের চাপে যেন চৈতন্যহীন হইয়া গেল। অথবা জগতের একটা অতি মধুর সুষমা-ধরার সহিত যদি কাহারো ওষ্ঠের স্পর্শ হইতে থাকে আর ঠিক সেই সময়

পৃথিবীটা পায়ের তল হইতে সহসা সরিষা গিয়া একটা ভীষণ আগুনের সীমাহীন পথে। তাহাকে ফেলিয়া দেয় তখন তাহার মানসিক অবস্থা যেমন হয়, ফিনিরও তেমনি হইল। ওষ্ঠ তাহার নীলবর্ণ হইয়া গেল–ধমনীর প্রবাহ সহসা নিথর হইয়া গেল। তাহার চোখ দুটি সহসা মাথার মধ্যে বসিয়া গেল।

আর একটা প্রচণ্ড আঘাত! এবাদ একটা যন্ত্রণাব্যঞ্জক চিৎকার করিয়া কহিল–“ফিনি, মিস, ফিনি! এই দূরবেশ আসিয়া রমণীর মোহে অবশেষে প্রাণ হারাইতে হইল!”

আর একটা প্রচণ্ড আঘাতে ভিতর দিককার অর্গল ভাঙ্গিয়া গেল।

ফিনির পিতা দেখিলেন তার যুবতী কন্যা ফিনি এক যুবকের পার্শ্বে নিশ্চল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া আছে।

০ ০ ০

বেলা লেমানের শীর্ণ হাতখানি চুম্বন করিয়া কহিল,–“আমার প্রিয় লেমান সতীর সর্বশ্রেষ্ঠ গৌরবের পথ মুক্ত করিয়া দাও। যেদিন তোমাকে ভালবাসিয়াছিলাম, সেইদিন এদিন ও আত্মা তোমার সেবার নিযোগ করিয়াছি। দশ হাজার টাকায় তোমার উত্তম চিকিৎসা হইবে। তোমার সকল রোগ সারিয়া যাইবে। ছেলেগুলির কষ্ট থাকিবে না। পশুর মতো বাঁচিয়া লাভ কী? এই দেহ তোমার সেবায় উৎসর্গ করিবার এমন সুযোগ কোনো সতীর ভাগ্যে ঘটে না।”

লেমান হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল–প্রিয়তমে, কী ভয়ানক বলিতেছ! আমি তোমার এই ভয়ানক আত্মোৎসর্গ সহ্য করতে পারিব না। আমি আরও বেদনা সহ্য করিতে রাজি আছি।”

“না প্রিয় লেমান, অনুমতি দাও–আমাকে চরম সুখে সুখী হইতে দাও। এতকাল কি তোমার বৃথা সেবা করিলাম? আমাকে এই দান দিতে তুমি ইতস্তত করিতেছ? ইহাতে আমার কত সুখ তা তুমি বুঝিতেছ না?” প্রায় তিনঘণ্টা ধরিয়া বাদানুবাদ হইল। লেমন কাঁদিতেছিল।

ছেলেগুলি বিছানার উপর তাদের পবিত্র ও শুভ্র ফুলের পাপড়ীর মতো ওষ্ঠগুলি মুক্ত করিয়া শুইয়াছিল। দেবী বেলা এক এক করিয়া সন্তানের মুখে চুম্বন দান করিল। আঁখিতে তাহার জল নাই। একটি অসীম পুলক তাহার চোখেমুখে প্রতিভাত হচ্ছিল।

বেলা আবার তাহার স্বামীর হাত ধরিয়া কহিল–“সখে! ছেলেগুলি যখন জিজ্ঞাসা করিবে, মা কই? বলিও তোমাদের মা, বেড়াতে গিয়াছে, শীঘ্রই আসিবে।”

লেমানের শীতল ওষ্ঠে বেলা আর একটা চুম্বন মুদ্রিত করিয়া দেবতাদের হাতে স্বামীকে উৎসর্গ করিয়া পেছনের দিকে চাহিতে চাহিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।

লোহার শৃঙ্খলে বাধা হাত-পা বদ্ধ। রাত্রি বারটার সময় মাটির ভিতর কোমর পর্যন্ত পুঁতিয়া পাথর দিয়া তাহাকে চূর্ণ করা হইবে। ভদ্রলোকের বাড়িতে একজন বিদেশীর এই কাণ্ড করিবার সাহস! অতি গোপনে রাত্রি ৩টার সময় এই ভয়ানক কাণ্ড সংঘটিত হইবে।

ফিনির সম্মুখে এবাদের মাথা চুর্ণ করা হইবে। সে দাঁড়াইয়া দেখিবে, পিতার অনুমতি লইয়া কাহারো সহিত প্রেম করিলে সে প্রেমিকের কি দশা হয়।

মুক্তির আর কোনো আশা নাই। অনুতাপে আর কোনো ফল নাই। নিজ কৃত অপরাধের ফল এবাদকে মাথায় করিয়া লইতে হইবে। কেউ তাহাকে রক্ষা করিবে না। কী সাংঘাতিক!

রাত্রি ১২ টার আর বেশি দেরি নাই। আবাদ সেই নিভৃত গুহায় একাকী ঘড়ির দিকে চাহিয়া, সেকেণ্ডের কাটাটি হনহন করিয়া ঘুরিয়া আসিতেছে, দেখিতেছিল। এ কি আর স্ত্রীর প্রতি অত্যাচার ও বিশ্বাসঘাতকতার প্রায়শ্চিত্ত?

এবাদ তখন ভাবিতেছিল, যদি একবার সে তার স্ত্রী দেখা পাইত তাহা হইলে জীবনের এই শেষ মুহূর্তে সে তার পায়ে ধরিয়া ক্ষমা চাইয়া লইত।

টং টং করিয়া গাড়িতে ১২টা বাজিল, সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্ধকার নিভৃত গুহার লৌহদরজা অতি সহজে খুলিয়া গেল।

সেই অন্ধকারের ভিতর এবাদ দেখিল, যেন একটা মানুষ প্রবেশ করিল। এ কি ঘাতক?

ভয়ে এবাদ চীৎকার করিতে যাইতেছিল হঠাৎ একটা নারীর কোমল স্পর্শে এবাদ চমকিত হইয়া উঠিল। যে আর্তস্বরে অতি ধীরে জিজ্ঞাসা করিল–“কে?”।

বেলা কহিল–“ভয় নেই, এই কাপড় পরুন। আপনাকে মুক্তি দিতে আসিয়াছি। আপনার কাপড় আমাকে দিন। আমি মিস্টার এবাদ হইয়া এখানে বসিয়া থাকিব। এই শান্তি আমি লইব। দেরি করবেন না। রাস্তায় অন্ধকারে গাড়ি দাঁড়াইয়া আছে।”

সহসা এবাদ একটা প্রচণ্ড মানসিক বিবর্তনের আঘাতে পড়িয়া যাইতেছিল। এ কী স্বপ্ন! জাপানে কি এমন রমণী সম্ভব?

কিন্তু তাহার ভাবিবার সময় ছিল না। সে বেলার সহিত কাপড় বদলাইয়া লইল। তারপর বেলার পুরুষ পোষাক-পরা দেবীমূর্তির সম্মুখে সেই নিবিড় আঁধারে একটা অজানিত স্বর্গীয় ভাবাবেগে মাথা অবনত করে সে বাহির হইয়া পড়িল। একটা পুরুষ দরজায় দাঁড়াইয়াছিল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে অতি সন্তর্পণে অন্ধকারের ভিতর দিয়া বেলার পোষাক-পরা মিস্টার এবাদ রাস্তায় যাইয়া অপেক্ষমান গাড়িতে উঠিয়া বসিল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি নক্ষত্রবেগে সাগরকূলে জাহাজঘাটে ছুটিল। রাত্রি তিনটার সময় ভারতীয় মেলে মিস্টার এবাদ জাপান ছাড়িয়া দেশ অভিমুখে যাত্রা করিল।

ঠিক সেই সময় মিস্টার, এবাদের পোষাকে আবক্ষ প্রোথিতে মাথায় পাথরের উপর পাথর পড়িতেছিল। চিৎকার নাই, চাঞ্চল্য নাই,–নিশ্চল পাথরের মতো আঘাতের উপর আঘাত সে সহ্য করিতেছিল।

দরিদ্র স্বামীর রোগমুক্তির জন্য সতীসাদ্বী বেলা ১০,০০০ টাকার পরিবর্তে আপনাকে চূর্ণ করিয়া ফেলিল।

পরদিন উষাকালে মিস ফিনি দশ হাজার টাকা নিয়ে যখন লেমানের কাছে উপস্থিত হল তখন লোমন বিছানার উপর নিশ্বাসহীন জড় পদার্থের মতো পড়েছিল। ফিনি লেমানের মৃতদেহ ঠেলিয়া দেখিল তাহার বুকের সঙ্গে দলা করা একটা জামা, সেটা বেলার!

.

দ্বিত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

কলিকাতা ট্রেটি বাজার চর্বির দোকানের সম্মুখে একটা অসামান্য রূপবতী মেয়ে হাউ হাউ করে কাঁদছিলো।

রমণীটি কে? অনেক মুটে মুজুর ছোটলোক যুবতীর চারি পার্শ্বে দণ্ডায়মান। অনেক ভদ্রলোক সেই পথ দিয়া যাচ্ছিলেন। লোকে কি বলবে, এই ভয়ে তাহারা যুবতীর দিকে একবার মাত্র নজর করে আপন কাজে চলে যাচ্ছিলেন। গঙ্গার-উত্তর ধারের একজন খুঁড়িওয়ালা লোক সাত হাত হুঁকোর নল টানিতে টানিতে অত্যন্ত ঘৃণার সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “বাড়ি কোথায় মাগী?”

“বাড়ি আমার ঢাকা।”

“যার সঙ্গে বের হয়ে এসেছিল, সে তোকে ফেলে বুঝি পালিয়েছে?”

কুলসুম আবার হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। সে স্বরে আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িবার উপক্রম হইতেছিল। সকাল বেলা গাড়ি হইতে নামিয়া জনতার মধ্যে সে এবাদকে হারাইয়া ফেলিয়াছে। সারাদিন হাঁটিয়া হাঁটিয়াও সে এবাদের সন্ধান পায় নাই। সন্ধ্যাকালে সে কলুটালা, দিয়া ড্যামজেনলেন দিয়া ট্রেটি বাজার যাইয়া অত্যন্ত দুঃখে অসীম, বেদনায় আত্মকৃত পাপের অনুতাপে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিতেছিল।

ছেলেমানুষ এবাদ যৌবনের উদ্দাম বাসনায় মুগ্ধ হয়ে তার ভাবিকে নিয়ে কলিকাতার বুকের উপর এসে যখন দাঁড়ালো, তখন সহসা ক্লান্তিভরা পথের মাঝে অতি ভীষণ অনুতাপ এসে তার কবি বুকখানা জড়িয়ে ধরলো। সে তখন বুঝতে পারলো, কী ভীষণ কাজ সে করেছে। সমস্ত বিশ্ব তাকে মৌন ভাষায় বলেছে, ওরে নরপিশাচ, ওরে শয়তান, কী করেছিস। . সে ভয়ে ভাবিকে রাস্তার ভিতর ফেলে ফেরৎ গাড়িতে ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করিল। সে একটুও ভাবলো না, তার ভাবির কি হবে! মুহূর্তের ভুলের ফলে হাসতে হাসতে সে তার ভাবির অতি সুন্দর, অতি পবিত্র, অতি মহান দীর্ঘ জীবনের উপর একটা দীর্ঘ শ্মশান রচনা করা গেল। ওহো! উদ্ধার নাই, পথ নাই, ফিরবার উপায় নাই–একটুখানি দাঁড়াবার জায়গা নাই, সে কি পুরুষ? হাজার পাপে যার দোষ হয় না, যে জীবন ভরে ব্যভিচার করে, বৃদ্ধকালে সে দেশপূজ্য মহাপুরুষ হতে পারে!

অসীম জ্বালায় কুলসুম কাঁদছিলো। তার পদ্মের মতো পা ছিটে রক্ত বেরুচ্ছিলো, কিন্তু তবুও তো কেউ তাকে একটু বসতে দিতে পারে না। কারণ তার তখন জাতি গিয়েছে, সে অস্পৃশ্য, তার সঙ্গে মানুষ কথা বলতে লজ্জা করে।

একজন দয়াদ্ৰহৃদয় মুসলমান ভদ্রলোক বললেন, “আমি তোমাকে টাকা দিতে রাজি আছি। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।”

কুলসুম কাঁদিয়া বলিল,–“আমায় কেটে টুকরো টুকরো করে জ্বালিয়ে ছাই করে দেবে! কোথায় গেলেন।“

ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। একটা পথহারা অসহায় রমণীর সহিত কথা না বলিয়া সকলে ঈশ্বর উপাসনায় মন দিলেন। ছোটলোকেরা অশ্লীল ভাষায় বলাবলি করিতেছিল–মাগীর যেমন কামড়।

০ ০ ০ ০

এমন সময় একটা যুবতী আসিয়া কুলসুমের হাত ধরিয়া কহিল–“আয় বোন, আমার সঙ্গে আয়-ভয় কী তোর?” সে ছখিনা পতিতা।

কুলসুম মাথা নত করে তার পেছনে পেছনে চলে গেল।

.

ত্ৰিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

লেডি ডাক্তার সরযুবালা গাড়িতে চড়ে হ্যারিসন রোড দিয়ে যাচ্ছিলেন। সহসা তাহার দৃষ্টিপথে একটি রমণী পড়িল। একটি বৃহৎ দালানের রকে বসে রমণী একটি শিশুর মুখে বটের পাতার সাহায্যে দুধ দিচ্ছিল। সরযুর বুকখানি ধড়াস করিয়া উঠিল। রমণীর মাথার চুল উঠে গিয়েছিলো, সর্বাঙ্গে ঘা। পরণে অতি মলিন ছিন্ন বসন। শাঁ শাঁ করে শীতল বাতাসে এসে শিশুটিকে কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে তুলছিলো। রমণী তার সেই হেঁড়ে কাপড় দিয়ে শিশুকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিল। জীর্ণ বসনের সকল জায়ঘায় ছেঁড়া। যে দিক সে ধলতে যাচ্ছিল, সেই দিকই ছিঁড়িয়া যাইতেছিল। সরযু কোচোয়ানকে গাড়ি থামাইতে বলিলেন।

কোচোয়ান গাড়ি থামাইলে; গাড়ি সেখানেই রাখিতে বলিয়া সরযু রমণীর দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।

একটা ছোট হাঁড়িতে একটু দুধ। কোথা হতে যে সেই দুধটুকু পেয়েছিলো তা জানি। সহসা হাঁড়িটা বাতাসের আঘাতে নিচ পড়িয়া ভাঙ্গিয়া গেল। শিশু একটু দুধের আশায় তখনও হা করিয়াছিল। সরযু রমণীর সম্মুখে যাইয়া অতি মধুর স্বরে বলিলেন–“তোমার কোনো পাড়ায় বাড়ি, মা?”

কাদম্বিনী একটা মেমসাহেবকে তাহার সম্মুখে উপস্থিত দেখিয়া ভয়ে পলায়ন করিতে যাইতেছিল। পরক্ষণেই সরযুর মুখের অমৃতমাখা বাণী শুনিয়া, কৃতজ্ঞতায় একেবারে চোখের জল ফেলিয়া বলিল,–“আমার বাড়ি নাই মা। আমি ভিখারিনী, মুক্ত আকাশ আমার ঘর, শৃগাল কুকুর আমার আত্মীয়!”

সরযু বলিলেন–“ভয় নাই মা! আমি তোমার আত্মীয়! বল, তোমার বাড়ি কোথায়? এ শোচনীয় অবস্থা তোমার কেন?”

কাদম্বিনী হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া বলিল, “আমার সঙ্গে বেশি কথা বলিবে না। আপনার সম্মান হানি হইতে পারে। আমি পাপীয়সী-পাপ করেছিলেম। স্বামী আমাকে পথে বার করে দিয়েছেন। আমি অস্পৃশ্যা, আমার ছায়ায় আসলে আপনার পাপ হবে। এই শিশুটি আমার পাপের সাক্ষি আমার কেউ নাই, আমায় কেউ নাই। জ্বালায়, যন্ত্রণায় আমাকে পথে পড়ে মরতে হবে।”

সরযু বলিলেন–“আমি পত্নীকে ভালবাসি, আমি নিজেই পাপী–আমি নিজেই অস্পশ্যা। আমার সঙ্গে যেতে রাজি আছ! তোমার চিকিৎসা হবে। তোমার সুখ ফিরে আসবে। বল, যেতে রাজি আছ। আমি তোমার জননী হলাম।”

কাদম্বিনী শিশুকে ফেলিয়া সরযুর পা জুড়াইয়া ধরিয়া কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল,–“তুমি আমার জননী। তোমার বুকখানি মাতার স্নেহে ভরপুর।”

সরযু দূরে কোচোয়ানকে গাড়ি আনতে বলিলেন।

.

চতুশ্চত্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

জ্যৈষ্ঠ মাস। প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি বহিতেছিল। রানীগঞ্জের পুলিশ সাহেব মিস্টার হাছান কামরায় বসে অফিসের খাতা দেখছিলেন আর পার্শ্বে চেয়ারে উপবিষ্টা স্ত্রী আমেনার সহিত কথা বলছিলেন। তখন রাত্রি নয়টা। বাহিরে প্রলয়ের ভয়ে সকল মানুষ রাস্তা-ঘাট ছেড়ে যে যার মতো আশ্রয় গ্রহণ করেছে।

মিস্টার হাছান বলিলেন,–“প্রিয় আমেনা তোমার এমন ভাব কেন? সকল সময়ই তোমার মুখ ভার। এতে আমার অত্যন্ত কষ্ট হয়। বিবাহিতা জীবন পুস্তকেই শুধু পড়েছি বড় সুখের। শুনিয়াছি, প্রেমিকা ধারায় স্বর্গ রচনা করেন! তাদের প্রেম মুনি-ঋষির জিনিস। পুস্তকেই পড়িয়াছি, জীবনে তাহার সন্ধান পাই না কেন!”

আমেনা কথা বলিলে না।

মিস্টার হাছান আবার কহিতে লাগিলেন,–“যখন কলেজে পড়িতাম তখন কবিদের রঙ্গিন কল্পনা বাস্তবে পরিণত করিবার বাসনা ছিল। কিন্তু একজনের ইচ্ছায় কী তা সম্ভব! তুমি এমন করিয়া দূরে দূরে থাকিলে আমাদের জীবন কত বিষময় হবে, তা কি তুমি বুঝতে পার না? কি তোমার বেদনা, আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি তুমি খুলে বল, আমি তার জন্য ক্ষমা চাহিব–আমি তার প্রতিবিধান করবো। খাওয়া একদিনও ভালো হয় না। চাকরানীর যা ইচ্ছে তাই রান্না করে রাখে। তুমি যদি একটু দয়া করে দেখ, তাহলে তো কোনো দোষ হয় না। তুমিও তা খাবে। আর দয়া করে যদি আমাকে স্বামী বলে মানো। তাহলে আমিও তো খাবো। এতে কি অপমান বিবেচনা করো? কাজে কি অপমান আছে? অপমান হয় পাপে ও নীচতায়। কাপড়, জিনিসপত্রের কিছুরই ঠিক থাকে না। যেখানে সেখানে জিনিসপত্র পড়ে থাকে। প্রত্যহ একখানা রুমাল বাজার থেকে আসে, অথচ একখানাও ঠিক থাকে না। এসব কে দেখবে, বল? আমার কি আপন আর কেউ আছে? কত শিশি গন্ধতেল সেফের উপর সাজানো। তুমি স্পর্শ করবে না। বিধবার বেশে মলিন কাপড়ে রুক্ষ কেশে কাল কাটাও। চোর ডাকাতকে জব্দ করতে পারি কিন্তু বিদ্রোহী আত্মাকে আমি দমন করদে পারি না। তোমার এমন ভাব কেন? এ বেদনা আমার কাছে অসহ্য হয়ে পড়েছে। জীবনে কিছুমাত্র সুখ নাই।”

আমেনা কথা কহিলেন না। বিবাহের পর ছয় মাস সুখে কাটিয়াছিল। তারপর আমেনা নিত্য নূতন কল্পিত অপমান ও উপহাসে কাল্পনিক দীনতা ও হীনতায় নিজেকে স্বতন্ত্র করিয়া রাখে। সে সব সময়ই মনে করে, সে ছোট-তার স্বামী তাকে মনে মনে ঘৃণা করেন। শথ চেষ্টাতেও সে তার মর্যাদা বাড়াইতে পারে না। বিধাতা তাকে ছোট করিয়াছেন, মিস্টার হাছানের স্তুতিবাক্যে সে বড় হইতে পারে না। সে তাতে আরও বিরক্ত হয়। সে দিনে দিনে আপনাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও হাছানের পার্শ্ব হইতে সরাইয়া লইতে চেষ্টা করিতেছিল। হাছান তাহার দিকে হাসিলে সে মনে করে, এ তীব্র উপহাস কেন? যদি হাছান স্ত্রীকে নমস্কার করেন, আমেনা ভাবে তাহার হীন ব্যক্তিত্বকে আরও হীন করিয়া ফেলা হইল। সারাদিন সে চিন্তা করে। প্রতি কাজে সে নিজেকে অপমানিত মনে করে। চাকরাণীরা হাসিতে থাকিলে

আমেনা মনে করে, তাহারি হীনতা লইয়া তাহারা কানাকানি করতেছে।

যদি বেশি মূল্যের কাপড় আনিয়া দেওয়া হয় আমেনা বিরক্তির সহিত ভাবে আমার হীনতাকে ঢাকিবার জন্য বাহিরের আঁকজমকপূর্ণ পোশাকের ব্যবস্থা হইতেছে। আমি ছোট তাই দামী পোশাক পরিয়া মর্যাদা বাড়াইয়া তুলিতে হইবে। যদি কাছে আসিয়া রসিবার জন্য হাছান ডাকেন, আমেনা ভাবে–আমাকে না ডাকিয়া আমার কাছে আসিলেই তো হয়। যদি হাছান তাহার বিছানায় যাইয়া বসেন, আমেনা মনে করে–যেন অতিথি! একটু আলাপ করিয়া তাহাকে আনন্দ দেওয়া হইতেছে মাত্র।

রান্না যদি বেলা হয়ে যায়, আমেনা মনে করে সে ছোট ঘরের মেয়ে বলে তার প্রতি এই অবহেলা। ঘৃণায় সে চাকরানীদের সহিত কথা বলে না। সে সর্বদা মনে সন্দেহ করে–চাকরানীরা মনে করে, সাহেবের বউ ছোট। আমেনা তাহাদেরকে কোনো আদেশ দিতে ভয় ও সঙ্কোচ অনুভব করে।

বাহির হইতে কে যেন দরজায় আঘাত করিল। এই ঝড়ের মধ্যে কে পুলিশ সুপারিন্টেণ্ডেন্টের ঘরে, আঘাত করিতে সাহস করে? ঝড়ের শব্দকে উপেক্ষা করিয়া সে শব্দ মিস্টার হাছানকে বিস্মিত করিল।

মিস্টার হাছান রিভলভারটি ঠিক করিয়া দরজার কাঠে উপস্থিত হইয়া ধীরে ধীরে দরজা খুলিয়া দিলেন।

অতি ক্ষিগ্রবেগে একটি রমণীমূর্তি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। এ কি? এ যে ললিতা!

সর্বাঙ্গ তার সিক্ত। সে কাঁদিতেছিল। অত্যন্ত শ্রদ্ধায়, অতি পুরাতন উদ্বেলিত স্নেহ-স্মৃতিতে মিস্টার হাছান ভাই এর মতো অত্যন্ত বিস্ময়ে অত্যন্ত আবেগে ললিতাকে জড়াইয়া ধরিলেন।

আমেনা এই পৈশাচিক দৃশ্য দেখিল। তার চোখের সম্মুখে স্ত্রীর প্রতি এই অবমাননা! অত্যন্ত ঘৃণায় অত্যন্ত লজ্জায় একটা মূৰ্ছাকে অতি কষ্টে সংবরণ করিয়া আমেনা অন্ধকারে নিজের বিছানায় আসিয়া শুইয়া পড়িল।

মিস্টার হাছান স্ত্রীর দিকে ফিরিয়া বলিলেন, “আমেনা বিবি! ইনি তোমার একজন। বোন! শীঘ্র একখানা শাল আনিয়া দাও।” কিন্তু আমেনা তখন সেখানে ছিল না।

হাছান নিজেই কাপড় আনিয়া ললিতাকে পরিতে দিলেন।

হাছান, বলিলেন–“ললিতা, তোমাকে দেখে আমার কত আনন্দ হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। সেদিন যে পত্র লিখছো তাতে তো কিছুই লেখা নাই! ভালো করিয়া সকল কথা খুলিয়া বল।” প্রথম দর্শনের উদ্বেল আনন্দ সহসা ললিতার মুখে অদৃশ্য হইল।

ললিতা বলিলেন—”আমার জীবন অত্যন্ত অসহনীয় হয়ে পড়েছিলো। আমার চোখের সামনে সারা সংসারটা মরুময় হয়ে উঠেছিলো আত্মা সেখানে প্রতিধ্বনি পায় না সেখানে কারো বেঁচে থাকা কঠিন। সে পিতাই হোক, আর মাতাই হোক। স্নেহ-মায়া ছাড়া জগতে কে বেঁচে থাকতে পারে? আমার জন্য একটু শান্তিও ছিল না। অসহায় আত্মার চারদিকে দিবারাত্র আগুন জ্বলতো। তাই আপনার কাছে এসেছিল অন্নের জন্য নয়ম, সহানুভূতি ও স্নেহের জন্য।”

হাছান চেয়ারে বসিয়াছিলেন। সহসা চেয়ার ছাড়িয়া হাছান অত্যন্ত স্নেহে ললিতার হাত ধরিয়া বলিলেন–“তোমার এই বিশ্বাসকে আমি প্রাণের আবেগ নিয়ে সার্থক করতে চেষ্টা করবো। আজ হতে আবার আমি তোমাকে নূতন করিয়া মানিয়া লইলাম।”

ললিতা বলিলেন–“আজ হতে আবার আমাকে নূতন করিয়া মানিয়া লইতে হইবে কেন? আমি আপনার কে, এ কথা হুগলীর বোর্ডিং ঘরেই তো আপনি আমাকে বলেছেন।”

গভীর স্নেহে হাছান বলিলেন–“ক্ষমা কর ললিতা। তুমি আমার চিরজীবনের বোন। কিন্তু তোমার যে আজ হতে জাতি গেল?”

ললিতা ঘৃণায় সহিত বলিলেন, “আমার জাতি গেল? কী ভয়ানক কথা! এমন কথা বললে যে পাপ হয়। আপনার স্পর্শে এসে আমার জাতি যাবে? আপনি ব্রাহ্মণের চেয়ে অনেক বড়। বিধাতা কাহারো কপালে ব্রাহ্মণের ছাপ মারিয়া দেয় নাই। আমার বিশ্বাস আমার কাছে। আমার জাতি যাইবে ও কথা যদি কেউ বলে, তাহা হইলে বুঝিবে সে আমার মনুষ্যত্বের প্রতি ঘোর অবমাননা করিল। পাপীকে ঘৃণা করা নিতান্ত অযৌক্তিক না বলেও পূণ্যবানকে যে ঘৃণা করিবে, বিধাতার বজ তাহাকে অস্তিত্বহীন করিয়া দিবে। স্বাতন্ত্রের দ্বারা জাতিকে বাঁচাতে চেষ্টা না করিয়া মনুষ্যত্বের পাথর দিয়া জাতির জীবন গঠন করিতে হইবে। আমি ঐ সব মানি না। বিশ্বাসে মানুষের মুক্তি নাই, মুক্তি কর্মে। কমেই মানুষের মহত্ত্ব। মহত্ত্বের প্রাণ মানুষের সেবায়, আর্তের রক্ষায়, পতিতের উদ্বারে গভীর সহানুভূতিও বেদনাবোধ, ঘৃণায় নহে।”

আমেনার দৃঢ় বিশ্বাস হইল, এই মেয়েটি নরপিশাচ হাছানের প্রণয়িনী। দিবারাত্র ললিতার সহিত গল্প করে। মানুষ যেখানে প্রাণের প্রতিধ্বনি পায় সেখানেই সে যায়; কেহ তাহাকে বাধা দিতে পারে না। যে বাধা দিতে চায় সে ভুল করে।

ললিতার কিছুমাত্র সঙ্কোচ নাই। হাছান বৈকাল বেলায় বাড়ি আসিলেই সে তার স্বাভাবিক স্নেহে অনুপ্রাণিত হইয়া হাছানকে বাতাস করে। তাহার খাইবার বন্দোবস্ত সে-ই করে। তাহাদের আসার পরদিন হইতে মিস্টার হাছানের আহারের পরিবর্তন হইয়াছে। সে সব জিনিসে অনভ্যাসবশত বা সংস্কারফলে ললিতার ঘৃণা উপস্থিত হইতে পারে, সে-সব দ্রব্য তিনি সেই দিন হইতে পরিত্যাগ করিলেন।

দারুণ ঘৃণায় একটি দীর্ঘ ভুল বুকে লইয়া আমেনা একদিন বাপের বাড়ি চলিয়া গেলেন। মিস্টার হাছান আমেনার হাত জড়াইয়া ধরিয়া তাহার অপরাধ প্রকাশ করিতে বলিলেন। আমেনা কোনো কথা বলিলেন না। সারা জীবন আর তিনি হাছানের কাছে ফিরিয়া আসেন নাই।

দুটি অতি দুঃখী আত্মার সঙ্গে সারা জীবন কাটিয়া গেল। যদি তাদের পরিচয় না হইতো, তা হলে বোধহয় তারা কেউ বাচিত না।

জিজ্ঞাসা করি–বিবাহ জিনিসটা কী? বিবাহ কি সহানুভূতির আদান প্রদান নহে?

ললিতা শেষ জীবনে মহাপুরুষ মোহাম্মদের মহামানবতাকে বিশ্বাস করে ছিলেন। সারাজীবন হাছান ললিতার বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন।

.

পঞ্চচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

স্টীমারের উপর রমা ও নিহার বসেছিল। নইম শেখের সঙ্গে পালিয়ে তারা রাইপুরে যাচ্ছে।

এমন সময় টিকিট কালেক্টর এসে টিকিট চাইলে। তখন নইম শেখ নিচে গিয়েছিল। রমা কহিল–“টিকিটি তাদের কাছে নাই।”

‘টিকিটওয়ালা জিজ্ঞাসা করিল–“কোথায় যাবে তোমরা?”

একটু ভীত হইয়া রমা কহিল–“তাতো জানি না!”

বাবু একটু সন্দিগ্ধ হইয়া উঁচু গলায় জিজ্ঞাসা করিল–কোথায় যাবে জান না। কী জাতি তোমরা?”

নিহারকে দেখাইয়া রমা বলিল–“উনি ব্রাহ্মণ, আমি শূদ্র।”

বাবু আরও বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল–“তোমাদের সঙ্গে কে?”

রমা ইতস্তত করিতে লাগিল। বাবু সন্দিগ্ধ হইয়া আরও উঁচু গলায় বলিল–“তোমাদের সঙ্গে কে যাচ্ছে বল।”

রমা বলিল–“নইমুদ্দীন শেখ!”

বিস্ময়ে বাবু আবার বলিল–“নইশ শেখ! তোমরা হিন্দু একজন বামুনের মেয়ে, আর একজন শূদ্র। যাচ্ছো কোথায় জান না! যে নিয়ে যাচ্ছে সে মুসলমান!”

চিৎকার করিয়া বাবু ডাকিল–“পুলিশ পুলিশ!”

অবিলম্বে দুইজন সিপাহী এসে সেখানে উপস্থিত হল। মূর্তি তাদের অতি ভয়ানক। অন্তর তাহাদের কত কাল তা কে জানে।

অনেক লোক রমা ও নিহারের চারিদিকে দাঁড়াইয়া গেল। এমন সময় নইমুদ্দীন এসে সেখানে উপস্থিত। সিপাই রাহেন কহিল–“শালা, দুই দুইটি মেয়েকে বের করে নিয়ে পালাচ্ছে!”

নইমুদ্দীন থতমত খাইয়া গেল। কে কি উত্তর দিবে, বুঝিতেছিল না। রমা ও নিহার কাদিতেছিল। অবিলম্বে একখানা কাপড়ে নইমের হাত বাঁধা হয়ে গেল।

কমলাপুরের সাব-ইন্সপেক্টর সুরেন বাবু রাগে জ্বলে গেলেন। মুসলমানেরা এত বড় স্পর্ধা! তিনি হুকুম দিলেন, “গারদ-ঘরে শালার দাড়ি ধরে একেবারে হাড় ভেঙ্গে দাও। বিচারে, যা হয় হবে! চাকরির পরোয়া সে করে না।“

সুরেন নিজ ব্যয়ে রমা ও নিহারের বাড়িতে তার করে দিলেন। জাতি যাবার ভয়ে তারা কেউ এলেন না! বাড়ি হতে যে মেয়ে বেরিয়ে যায়, তার সন্ধান নেওয়া ঘোর অপমানের কথা, তা সুরেন বাবু ভুলে গিয়েছিলেন।

শ্রীঘ্র রমা ও নিহারকে সাক্ষী, করে নইমুদ্দীনকে সুরেন বাবু চালান দিলেন।

হাকিমের সম্মুখে রমা ও নিহার বলিল, “তারা স্ব-ইচ্ছায় নইমুদ্দীনকে সঙ্গে যাচ্ছে। তাতে কাহারো বাধা দিবার ক্ষমতা নাই।” হাকিম পরদিন নইমদ্দীনকে মুক্তি দিলেন। আইনে তাকে বাধা দিবার ক্ষমতা ছিল না। রাত্রিতে গারদ–ঘরে রমা ও নিহারের সকল গৌরব ও সকল মর্যাদা চুরি হয়ে গিয়েছিল।

নইমুদ্দীনের চোখের সম্মুখে এই ভয়ানক অত্যাচার হয়ে গেল। হিন্দু হলেও তারা যে নইমুদ্দীনের নাতিনী! একটা অতি ভয়ানক মানসিক বেদনাময়, পুলিশের ভীষণ প্রহারে ও অপমানে নইমুদ্দীনের সেই দিন মনের অবস্থা অত্যান্ত খারাপ ছিল।

সে ক্ষিপ্ত শৃগালের মতো নদীর কূল দিয়ে রমা ও নিহারকে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। অমাবস্যার রাত্রি। বনপথে গভীর নিবিড় আঁধার। তারা স্টীমারঘাটে যাচ্ছিল। হঠাৎ নইমুদ্দীনের মাথায় এক প্রচণ্ড আঘাত পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে দুইটি বলবান হিন্দু যুবক রমা ও নিহারের হাত ধরে আঁধারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

৪৬-৪৮. সরযু তার বাসার প্রকোষ্ঠে

ষত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

সরযু তার বাসার প্রকোষ্ঠে বসেছিলেন। মিস্টার আবদুর রহমান তাঁর সম্মুখে। সরযু বলিলেন–“মিস্টার রহমান, আপনাকে আমার সঙ্গে রাণাঘাটে যেতে হবে।”

মিস্টার রহমান বলিলেন,-বেশ, আপনার অনুরোধ আমি পালন করবো। কিন্তু কোথায় থাকবো?” ..

“কোথাও থাকতে হবে না। আমার সঙ্গেই যাবেন।”

“লোক কিছু বলবে না তো?”

“লোকের কথাকে আপনি ভয় করেন? আপনার যদি মনের জোর না থাকে, তবে আপনি হিন্দুর পোশাকে যাবেন।”

“আচ্ছা।”

“আমার শুধু রোগী দেখা নয়, বিশেষ কোনো উদ্দেশ্যে আছে।”

“কী উদ্দেশ্যে।”

“সেখানে গেলেই বুঝতে পারবেন।”

“যে রমণীকে সেদিন পথ থেকে তুলে এনেছি, তার শরীর খুব ভালো হয়েছে। তার মেয়েটি দেখতে কার্তিকের মতো। মা ও মেয়ে উভয়ের লেখা পড়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছি।”

“সেই রমণী না হয় চিরজীবন আপনার আশ্রমে থাকলো, কিন্তু এই বালিকার কী হবে?”

“তাকে ভালো করে লেখাপড়া শিখিয়ে, পাঁচশত টাকা যৌতুক দিলে অনেক বর পাওয়া যাবে। রমণীর নাম কাদম্বিনী, বাড়ি তার যশোরে ছিল! আপনাকে বোধ হয় বলেছি।”

“হ্যাঁ,! বলেছেন আপনাকে এই মহৎ কার্যের জন্য কতখানি শ্রদ্ধা করবো তা বুঝতে পারছি। আপনি দেবী। আপনি যে পথ দিয়ে যান সে পথের বাতাস ও ধুলা পবিত্র হয়ে যায়।

সরযু মুখ নত করে বললেন,–“আপনি আমাকে লজ্জিত করেছেন।”

মিস্টার রহমান সরযুর লজ্জানত মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন স্বর্গীয় আভা তার মুখে ফুটে উঠছে।. আহা তিনি যদি মুসলমান হতেই মিস্টার রহমান পরক্ষনেই নিজেকে ধিক্কার দিয়ে মনে মনে বললে, “ছিঃ সে কি কথা!”

সরযু আবার বললেন–“এই আশ্রয়ে আমি আমার সমস্ত সম্পত্তি উইল করবে। যে সব স্ত্রীলোক বিপদে পড়ে সংসার হতে তাড়িত ও ঘটনাক্রমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথে দাঁড়াবে। তাদেরকে আমি এখানে স্থান দেবো। অবিবাহিতা রমণীর বিবাহের জন্য স্বতন্ত্র টাকার উইল করবো। সঙ্গে সঙ্গে একটা শিল্প বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। শিল্পের মধ্যে সেলাই শিক্ষাই বেশি হবে। তা ছাড়া কাঠের কাজও শিখাবো!”

“স্ত্রীলোককে কাঠের কাজ শিখাবেন!”।

“তাতে দোষ কি! মিস্টার রহমান? স্ত্রীলোকের গায়ে জোর নাই? আমার ইচ্ছা তাদের সমস্ত শক্তিকে জাগাইয়া দেওয়া। অনিচ্ছায় যেন তাদেরকে পাপ না করতে হয়। সারাজীবন যাতে তাদেরকে পিশাচ হয়ে না থাকতে হয়। বিধাতার রাজ্যে কেউ সারাজীবন পাপকে জড়িয়ে থাকতে পারে না। উচ্চ বংশের রমণী যারা, তাদেরকে আমি নিজে চিকিৎসা বিদ্যা শেখবো! দেশে অসংখ্য ধাত্রী আবশ্যক!

“শ্রদ্ধায় আপনার সম্মুখে আমার মাথা নত হয়ে আসছে। আমার ইচ্ছা সরাজীবন আপনার কাছে থেকে আপনার এই কাজে সাহায্য করি।”

“ভগবান কি সে সুবিধা করে দেবেন? আপনার ন্যায় দৃষ্টিসম্পন্ন একজন ব্যক্তির সাহায্য পেলে আমি দ্বিগুণ শক্তিতে কাজ করতে পারি।”

রহমান বলিলেন–“আপনার এ গভীর বেদনার মূল কী? কি করে এই বিরাট সহানুভূতি আপনার হৃদয়ে জাগলো? আমি আপনাকে নমস্কার করি।”

সরযুর চোখ অকস্মাৎ জল দেখা দিল। স্বর তাঁর ভারি হয়ে উঠলো। রুমাল দিয়ে অতি কষ্টে চোখের জল সরিয়ে বললেন—”আপনি কি তা শুনবেন? পরে বলবো।”

রাণাঘাটের বহু লোক ফুলারানীর প্রেমে পড়িয়া সর্বস্বান্ত হয়েছেন। কালীপ্রসন্ন নিজের স্ত্রীকে ফেলে থুয়ে রাত দিন ফুলরানীর দরজার পরে থাকে। সেখানেই সে খায়, সেখানেই।

সে শোয়। লোকে বুঝাইতে চাইলে সে বলে, ফুলরানীকে সে ভুলতে পারে না–তাতে তার অধম হবে।

কুৎসিৎ রোগে ফুলরানী আজ কয় মাস ধরে কষ্ট পাচ্ছে। কোনো চিকিৎসায় ফল হয় না দিন রাত্রি অপরিসীম কষ্ট।

ফুলীর মা কলকাতা যেয়ে শুনে এসেছি। লেডী ডাক্তার সরযু এই সমস্ত চিকিৎসায় খুব পারদর্শী। অসংখ্য টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিলো। ১০০ টাকা ভিজিটে এবার ডাক্তার সরযু ফুলরানীকে দেখতে আসছেন।

রাত্রি আটটার সময় সেভেন-আপে রাণাঘাটে সরযু গাড়ি থেকে নামলেন। বিশেষ কোনো কারণে মিস্টার রহমান আসতে পারেন নাই। অবিলম্বে একখানা গাড়ি ঠিক করে তিনি ফুলানীর বাসা অভিমুখে যাত্রা করলেন। ষ্টেশনে ফুলরানীর চাকর রাধা এসেছিল।

দ্বিতল বাড়ি। উপর তলার প্রকোষ্ঠে একখানা বহুমূল্য পালঙ্কের উপর ফুলরানী শুয়েছিল। নিকটেই একখানা চেয়ারে ফুলীর মা বসেছিল। দরজায় কালীপ্রসন্ন দাঁড়িয়ে।

ফুলীর মা ডাক্তারকে দেখে চেয়ার ছেড়ে উঠে তাহার হাত ধরে যানাক্লিষ্ট ফুলরানীর বিছানার পার্শ্বে নিয়ে গেল।

কালীপ্রসন্ন তখনও দাঁড়িয়ে। ফুলরানীর মা বিরক্ত হয়ে বললে ”আজ যাও বাপু! রাতদিন এমনি করে বিরক্ত করলে কি করে চলে? দেখতে পাচ্ছো তো, ফুলীর কত অসুখ!”

ফুলরানী যাতনায় অস্থির হয়ে চিৎকার করছিলো। কলিকাতার ডাক্তারকে দেখে সে বিছানায় উঠিয়া সরযুর হাঁটু জড়াইয়া ধরিয়া কহিল,–“মা গো, আর সহ্য হয় না। একটু বিষ দিন বিষ। খেয়ে প্রাণত্যাগ করবো। আর পারি না!”

সরযু শান্তস্বরে বলিলেন, “তোমার ব্যথা এখনই সেরে যাবে। আমি ঔষধ দিচ্ছি।” সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটু ঔষধ খাইয়া দিলেন।

প্রায় আধ ঘণ্ডার মধ্যে যাতনা কমে গেল। ফুলীর মা সরযুর পা জড়াইয়া ধরিয়া বললে, “আমাদেরকে রক্ষা করুন, আপনার ভালো হবে। আমরা পতিতা, সকলেই আমাদেরকে ঘৃণা করে। টাকা খরচ করিলেও কেউ ঘৃণা করে আমাদেরকে ভালো ঔষধ দেয় না। এ যাবৎ কেউ আমাদের বাড়িতে আসে নাই। আপনি দেবী, তাই আপনার এই দয়া।”

সরযু বলিলেন, আমি ডাক্তার মানুষ, ঘৃণা করলে ব্যবসা চলে না। বিশেষ করে এইসব চিকিৎসা আমি করে থাকি।”

সরযু আর একবার ঔষধ খাওয়াইয়া দিলেন।”

আর একঘণ্টা কেটে গেল। ফুলীর সকল বেদনা যেন কি যাদুমন্ত্রে অকস্মাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেলঃ ফুলরানী কৃতজ্ঞতায় মাটিতে নামিয়া সরযুর পা জড়াইয়া ধরিয়া বললে”মা আপনি দেবী! আপনার ঔষধ অমৃত।”

রাধা চৌকাঠের উপর বসে ঝিমুচ্ছিলো।

সরযু বললেন–“একেবারে নিরাময় লাভ করতে হলে তুমি আর কখনও কোনো পুরুষের স্পর্শে আসতে পারবে না।”

ফুলী হাত জোড় করিয়া বলিল–“আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আপনার কাছে। আপনি আমার জননী। আপনি দেবী। আর আমি পাপ করবো না। যখন দারুণ দুঃখে এই পাপ পথ অবলম্বন করি, তখন খোদার কাছে প্রতিজ্ঞা করি, ‘খোদার দুঃখ ঘুচলেই তোমার পথে ফিরে আসবো।’ অনেক অর্থ হয়েছে। তবুও এই প্রলোভন হতে মুক্ত হতে পারি না। আমাদের কি খোদা নাই? আমরা কি শৃগাল-কুকুর অপেক্ষাও অধর্ম? কিন্তু কোথায় যাবো? যে সমস্ত নরপিশাচ আমাকে অনুগ্রহ করে, তাহারা আমাকে স্থান পরিত্যাগ করতে দেখলে শত্রু হয়ে দাঁড়াবে। মাগো, আমাকে রক্ষা করুন। এই পাপ-পথে আর আমি থাকবো না একটু স্থান কোথাও পেলে, এই বৈভব-এই সম্পত্তি ফেলে শাক খেয়ে থাকবো। মৌলবীদের কাছে পরলোকের কথা শুনেছি কি ভয়ানক, কত পৈশাচিক, আমাদের জীবন। কিন্তু ইচ্ছা করে আমি এই পথে এসে দাঁড়াই নি। সংসার আমাদিগকে এখানে তাড়িয়ে দিয়েছে। ক্ষুধার জ্বালায়, অবহেলায় আমরা এখানে এসেছি। কুকুর অপেক্ষা ঘৃণিত ছিলাম। এক্ষনে আমি রানী হয়েছি, কত ভদ্র ও বড়লোক আমার চরণ লাভ করিবার জন্য ব্যস্ত।”

সাতদিন পরে ফুলী তার মাকে ফেলে মাথা মুড়ে সাদা কাপড় পরে সরযুর আশ্রমে যেয়ে উপস্থিত হয়েছিলো। সরযুও তাঁকে জনননীর স্নেহে জড়িয়ে ধরেছিলেন। পাঠকের মনে আছে, মহিউদ্দীনের এক শিষ্য ছিল। এই যুবক প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে পড়ার খরচ সগ্রহের জন্য কলিকাতার রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।

দেশের লোক মিস্টার রহমানের পরামর্শে সে সাহাষের জন্য সরযু ডাক্তারের সহিত দেখা করে সরযু এই যুবকের সহিত সগদ ৫০০ টাকা ও ৫০০ টাকার গহনা দিয়ে ফুলরানীকে বিবাহ দেন। সেই টাকায় মহিউদ্দিনের শিষ্য, বি. এ. পাস করেছিলেন।

… জিলায় এই দম্পত্তির সন্তান-সন্ততি এখনও বেঁচে আছেন, তাঁরা এখন দেশের মধ্যে সম্রান্ত ব্যক্তি।

.

সপ্তচত্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

অতি প্রত্যুষে ফুলে-ভরা ছোট বাগানের দিকে তাকিয়ে সরযু গত জীবনের কথা ভাবছিলেন। তাঁর মনে হচ্ছিল মিস্টার রহমান তার কাজে সহানুভূতি দেখাবার উপযুক্ত লোক। বহু ভদ্রলোকের সহিত তাঁর আলাপ হয়েছে, কিন্তু এমন ভদ্রলোক তিনি কখনও দেখেন নাই প্রাণের এক কোণে সরযু দেখতে পেলেন–মিস্টার রহমান যেন একগাছা তিনি কখনও দেখেন নাই প্রাণের এক কোণে সরযু দেখতে পেলেন মিস্টার রহমান যেন একগাছা ফুলের মালা হাতে করে তাকে ডাকছেন।

সরযুর লাল মুখ রক্তে ভরে উঠলো। অজ্ঞাতসারে সেই নির্জন কামরায় সে মুখ নত করে ফেললে।

মিস্টার রহমান যদি তাঁকে বিয়ে করেন, তাহলে তাঁর কাজের কি কোনো বাধা হবে? মিস্টার রহমান কি তার সঙ্গী হবেন?

বস্তুত রহমান শ্রদ্ধা ও সহানুভূতিতে সরযু তার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। ধীরে ধীরে তার আত্মবিশ্বাস করতে প্রলুব্ধ হচ্ছিল। মিস্টার রহমানকে সারাজীবন সঙ্গে পেলে সে রমণী জাতির স্বাধীনতা ও মর্যাদার জন্য কিছু করতে পারে। একা শত বাধার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এই বিরাট কাজ কী সে করে উঠতে পারবে! _ মিস্টার রহমান ছাড়া আর কোনোও সঙ্গী পাওয়া কি তার পক্ষে সম্ভব হবে? বাহিরের চাকচিক্যের অন্তরালে সে যে অত্যন্ত ছোট। বিধাতা তাকে ছোট করে রেখেছেন। মিস্টার রহমানের মনুষ্যত্বের প্রতি শ্রদ্ধা আছে। তিনি সমাজ ও অসত্যকে ভয় করবার লোক নন।

তিনি একটা সঙ্গী পেতে চান কেন? তার কর্মের সাহায্যের জন্য! তাঁর জীবনব্যপী সংগ্রামে ভরসা দিবার জন্য একটা লোক তিনি চান।

.

অষ্টচত্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

যেখানে কলিকাতা বড় লাইব্রেরি, তারই অনতিদুরে দু’টি যুবতী এক জায়গায় বসে পান বিক্রি করে। নীচ জঘন্য স্ত্রীলোকদের মতো তাদের মুখে কথায় চটুলতা ছিল না। ক্রেতার কোনো রসিকতায় তারা উত্তর দিত না।

ভাগ্যের কী মর্ম বিদারক পরিহাস! যে রমা ও নিহার এককালে স্বর্গের পূণ্য নিয়ে বাতাস ও মাটিকে তাদের দেহ ও চরণের স্পর্শ দিয়ে পবিত্র করেছে, আজ দেশের মূর্খতা, অবিচার ও হৃদয়হীনতার ফলে তারা কোথায়? ইহা ভাবিতেও আমাদের চোখ দিয়া জল পড়ে। অশ্লীল ও জঘন্য কথা–এসব না ভাবলেও চলবে না।

উভয়ে তারা এক জায়গায় বসে। সারাদিন বড় বড় জ্ঞানী লোকের কাছে তারা পান বিক্রয় করে। ক্রেতার মুখের দিকে চেয়ে তারা কখনও কথা বলে না। শহরের এক জঘন্য পল্লীতে এক ক্ষুদ্র খাপরার কামরায় তারা বাস করে। একই সঙ্গে তারা খায়। দুঃখে হোক বা প্রেমে হোক তাদের এখন জাতি বিচার নাই।

সেদিন পান বিক্রি করে তাদের দুইজনের আড়াই টাকা লাভ হয়েছিল। এইরূপে তারা পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলো। জঘন্য পল্লীতে থাকলেও তাদের কাছে কোনো বদমায়েসের স্থান হতো না। ভিতরে একটা অস্বাভাবিক উচ্চ প্রবৃত্তি সেই জঘন্য স্থানেও তাদের আত্মার উপরে বসেছিলো।

অনেকদিন থেকে একটা বদমায়েস বক্তা নিহার পানওয়ালীর কাছে প্রেম ভিক্ষা করছিলো। গায়ে তার যেন অসাধারণ শক্তি। দেখতে যমের মতো। নিহার অত্যন্ত ঘৃণায় বলেছিলো, পান বিক্রি করলেও সে শহরের সাধারণ পানওয়ালী নহে। বদমায়েস রাস্তার মধ্যে নিহার ও রমাকে অতি পৈশাচিক ভাষায় বলেছিল–“আমার বাসনা আমি পূর্ণ করবোই করবো। বাজারের পতিতার আবার এত বড়াই কেন?”

সেদিন সন্ধ্যাবেলা নিহার বাসায় ফিরে এসে রান্নার আয়োজন করিতেছিল। রমা পার্শ্বে বসে মাছ ধুইছিল। এমন সময় ও বদমায়েস যুবকটি এসে বললে, “নিহার, আমার কথা তোকে শুনতে হবে। আমি পাঁচ টাকার জায়গায় দশ টাকা দিতে রাজি আছি।”

রাত যখন দশটা তখন সহসা দরজায় আঘাত পড়লো। নিহার রমার কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে বললে–“দাখানা, ঠিক করে ধর রমা। আমার কাছে বঁটি আছে।”

নিহার জিজ্ঞাসা করিল, “কে?” অতি রুক্ষ্ম ও পৈশাচিক ভাষায় উত্তরে শোনা গেল, “দরজা খোল মাগী। জানিস না আমি কে! যদি দরজা না খুলবি, আমরা ঘর ভেঙ্গে ভিতরে আসবো। আমি একজন নহি। আমরা দশজন এসেছি।”

একটা ভয়ানক শক্তি রমা ও নিহারের ভিতর জেগে উঠলো। রমণীর স্বাভাবিক ভীরুতার পরিবর্তে একটা রুদ্র ভাব রমা ও নিহারকে মুহূর্তের মধ্যে মাতাল করে ফেললো। নিহার রমার কানে কানে ফিস্ ফিস্ করে আবার বললে–“রমা, হাতের বল যেন ঠিক থাকে।”

নিহার ধীরে ধীরে দরজা খুলে বললে–“এস! ঘরের মধ্যে এস!”

তার পর সেই অন্ধকারে ছোট ঘরে দশ মিনিটের মধ্যে দশটি লোকের মাথা দেহ ছাড়া হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। পুলিশের অপমান ও সাধারণের উপহাসকে ভয় করে সেই রাত্রেই রমা ও নিহার নদীতে যেয়ে আত্মহত্যা করে।

পরদিন দুপুর বেলা নদীর তীরে শতদলপুর থানায় এক চৌকিদার এজাহার দিচ্ছিলো–“কালীবাড়ির ঘাটে দুইটি স্ত্রীলোকের লাশ পাওয়া গিয়াছে। একের আঁচল অন্যের আঁচলের সঙ্গে বাঁধা।”

পুলিশ তদন্ত করে রিপোর্ট দিলেন ‘বেওয়ারিশ।’

Exit mobile version