প্রেম ব্যাপারটাকে পেখম ছোট থেকেই খুব ভয় পায়। ওদের অঞ্চলের ঝিকুদা তো কোন একটা মেয়ের প্রেমে পড়ে পাগলই হয়ে গেল। এখন ঝিকুদাকে দেখা যায় কখনও চক্রবর্তীর চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে, কখনও মামুর ইলেকট্রিকের দোকানের টুলে বা ঘোষ বাইন্ডিং-এর সামনের বারান্দায় একা-একা বসে আছে। কারও সঙ্গে কথা বলে না। কারও দিকে তাকায় না। পেখমের মনে হয় সোনাঝুরির সবাই বোধহয় ঝিকুদার কাছে স্বচ্ছ কাচের তৈরি।
নয়না খুব ডানপিটে ধরনের মেয়ে। ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারে। সাইকেল চালায়। এমনকী, লুকিয়ে সিগারেটও খায়। একদিন তো নয়না গিয়ে ধরেছিল ঝিকুদাকে। বলেছিল, “তুমি এমন ক্যালানের মতো বসে থাকো কেন গো? একটা মেয়ে ছেড়ে গেল বলে? ন্যাকামিটা কি প্র্যাকটিস করে আয়ত্ত করেছ না জন্মগত?”
পেখম পাশেই ছিল নয়নার। ওর তো ভয়ে ঢিপঢিপ করছিল বুক। কী কেলেঙ্কারি করছে মেয়েটা? ও শুনেছে ঝিকুদা নাকি মাঝে মাঝেই মারমুখী হয়ে ওঠে। তাকে এসব কী বলছে নয়না? ঝিকুদা রেগে গিয়ে এবারও যদি কিছু করে?
কিন্তু ঝিকুদা কিছুই করেনি। শুধু পেখমদের দিকে তাকিয়ে হেসেছিল একটু। তারপর ফুড়ুৎ গলায় বলেছিল, “বিলকিস।”
মা নয়নাকে পছন্দ করে না। মা কাকিমাকে পছন্দ করে না। মা কাজুকেও পছন্দ করে না। মা আসলে সেই মানুষদের মধ্যে পড়ে যার মাথা আর চোখ আতসকাচ দিয়ে তৈরি। সব কিছুকে খুঁটিয়ে না দেখলে মায়ের মন ভরে না। আবার দেখার পর তো আরওই ভরে না! পেখম মাকে ভয় পায় বেশ।
কাজু সেই যে এসেছিল সকালবেলা আর পেখমকে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল, সেটা ঠিক লক্ষ করেছিল মা। তাই বাবা কাজুকে পড়ানোর জন্য ঠিক করলেও মায়ের মনঃপূত হয়নি ব্যাপারটা।
বাবাকে বলেছিল, “এটা কি ঠিক হল? এমন উঠতি বয়সের একটা ছেলে! পেখমকে দেখেই তো ওর জিভ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল! নিজের মেয়ের রূপ দেখে বোঝো না যে, ওকে সাবধানে রাখতে হবে? আমি কত শাসনে রাখি। আর তুমি সেখানে খাল কেটে কুমির ঢোকালে!”
বাবা বলেছিল, “তুমি পাগল হয়ে গেলে? ও তো বাড়িতেই পড়াতে আসছে। আর কত ভাল ছেলে লেখাপড়ায়! সক্কলে ওর নাম জানে। তুমি সব কিছুতেই এমন কোরো না তো!”
মা বলেছিল, “ভাল হলেই ভাল। না হলে…”
বাবা শুধু বলেছিল, “না হলে আমি তো আছি।”
সেই কাজুর পড়াতে আসার শুরু। সপ্তাহে তিনদিন করে সন্ধের দিকে আসত ও। ছোট্ট ঘরটার বিছানায় বসত পেখম আর লাগোয়া টেবিলের পাশে চেয়ার নিয়ে বসত কাজু। একমনে পড়াত। মা চা দিয়ে যেত। মুড়ি মেখে দিয়ে যেত। কিন্তু খেয়ালই থাকত না ওর। ও শুধু পড়িয়ে যেত। আর পড়াতে-পড়াতে দেশ-বিদেশের কথা বলত। নানা মানুষের গল্প বলত। বলত যুদ্ধের ইতিহাস। বলত দক্ষিণ মেরুর গল্প। অঙ্ক করাতে গেলে ইউক্লিডের সময়কার গল্পও বলত অনায়াসে। আর পেখম রোজ একটু-একটু করে ডুবে যেত। চারিদিকে গোলাপি তুলোর ভিতর কে যেন ওকে ডুবিয়ে দিত আস্তে আস্তে। এক-একটা পড়ানোর দিন শেষ হলে মনের ভিতরে কেমন একটা কষ্ট হত। মনে হত আবার কবে আসবে কাজু! কেন সপ্তাহে মাত্র তিনদিন আসবে? রোজ এলে ক্ষতি কী? তারপর পড়ানোর সময় হলে তো পেখমের বুকের ভিতরটায় কী যেন একটা হত। একই সঙ্গে ভাল লাগা আর ভয়, কষ্ট আর আনন্দ, বন্ধন আর মুক্তির স্বাদ পেত পেখম।
বাল্বের আলোয় চকচক করত কাজুর মুখ। হাত নেড়ে, চুলে হাত ডুবিয়ে ঠিক করতে-করতে কাজু কত কী যে বলত! পেখম বুঝত দু’ঘণ্টার শেষে কাজুর মুখটুকু ছাড়া আর কিছুই মাথায় ঢোকেনি! এমন করতে-করতে ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজ়াল্ট বেরোল। আর সবাই অবাক হয়ে দেখল পেখম ফেল করতে করতে কোনওমতে পাশ করল!
প্রথম ঝড়টা তুলেছিল মা! এত ভাল ছাত্রী, তার এ কী দশা! এ কেমন করে হল? এই মাস্টার ভাল ছাত্র হতে পারে, কিন্তু পড়াতে পারে না একদম।
রাতে খেতে বসে মা তো চিৎকার করে বলেছিল, “কোথা থেকে ঠাকুরপো একে জোগাড় করে এনেছে! বড় বড় বুলি শুধু! এই পড়ায়? একে তুমি টাকা দিয়ে রেখেছ? কেন রেখেছ? কীসের জন্য? কাল এলে ওকে বিদায় করবে। একদম ধুলোপায়ে বিদেয় করবে। ঠাকুরপো অনেক উপকার করেছে। আর আমার মেয়ের ভবিষ্যতের বারোটা বাজাতে হবে না।”
বাবা রুটির টুকরো ছিঁড়ে চুপ করে বসেছিল। পাশের ঘর থেকে সব শোনা যায়। পেখমের ভয় লাগছিল খুব। ছোটকার নামে মা এসব বলছে! ছোটকা না-হয় নাইট ডিউটিতে গিয়েছে, কিন্তু কাকিমা তো সব শুনতে পাবে!
পেখম একবার বলেছিল, “মা, কাজুদার দোষ নেই। আমিই ফাঁকি দিয়েছি।”
“তুই চুপ কর!” মা ধমক দিয়েছিল খুব, “তোকে বড়দের মধ্যে কথা বলতে বারণ করেছি না?”
বাবা তাকিয়েছিল মায়ের দিকে। তারপর শান্ত গলায় বলেছিল, “তুমি চুপ করো একটু। আর কথা বাড়িয়ো না। ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল আজকে। ও নিজেই বলেছে আর পড়াবে না।”
আর পড়াবে না! নিজে বলেছে! পেখমের মনে হয়েছিল, কেউ বুঝি ওর বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে দিয়েছে! কী বলছে এসব! এমন হয় নাকি? পড়াবে না বললেই হল! হাত কাঁপছিল পেখমের। ঝাপসা লাগছিল সবকিছু। তবু তার মধ্যেও শুনেছিল, মা অনবরত বলে চলেছে, “আমি সব বুঝি। পড়াবে না! সাধু সাজা! আর তুমি সব শুনলে? কিছু বলতে পারলে না? হুঃ, পুলিশ না ছাই! বললে না কেন যে, শুধু কি চা-মুড়ি ধ্বংস করতে আসত!”