Site icon BnBoi.Com

তারাবাঈ – সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী

তারাবাঈ - সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী

তারাবাঈ ০১ পরিচ্ছেদ

বিজাপুরের সোলতানের অধীনে কৃষ্ণনগর পরগণার জায়গীরদার সরফরাজ খান নিরুদ্বেগ জায়গীর ভোগ করিতেছিলেন। যুদ্ধকালে সোলতানকে দুই হাজার পদাতিক এবং পাঁচশত অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে সাহায্য করিতে হইত। আর সোলতানের সৈন্যদের রসদের জন্য প্রতি বৎসর পাঁচ শত গো এবং এক হাজার মেষ ও ছাগল প্রদান করিতে হইত। ইহা ছাড়া একটি পয়সাও খেরাজ বা খাজনা স্বরূপ দিতে হইত না। সরফরাজ খান প্রায় ছয়শত সত্তর বর্গ মাইল পরিমিত রাজ্যে সাড়ে দশ লক্ষ প্রজা লইয়া স্বাধীনভাবে বাস করিতেন। শাসন ও বিচারের সমস্ত বন্দোবস্তই তাঁহার নিজের অধীনে ছিল। কেবল মৃত্যুদন্ড দিতে হইলে বিজাপুরের দারোল-এন‌্ছাফের অর্থাৎ হাইকোর্টের কাজী-উল-কোজ্জাত অর্থাৎ প্রধান জজের হুকুম লইতে হইত। মারাঠা দস্যুপতি শিবাজী সরফরাজ খানের সঙ্গে বরাবরই সদ্ব্যবহার করিয়া উভয়ের মধ্যে সদ্‌ভাবের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। কিন্ত সলিমগড়ের মীর্জা ওবায়দুল্লাহ্‌ বেগের সহিত সরফরাজ খান কন্যা আমিনা বানুর বিবাহের অসম্মতি জ্ঞাপন করায়, পরস্পরের মধ্যে যখন মনোমানিল্যের সঞ্চার হইল, সেই সময় ওবায়দুল্লাহ বেগের নিকট হইতে প্রচুর অর্থবল এবং সৈন্যবল লাভ করিয়া শিবাজী সহসা কৃষ্ণগড় আক্রমণ করিয়া বসিলেন।

সরফরাজ খান এই আক্রমণ সম্বন্ধে একেবারেই কিছু অবগত ছিলেন না। সুতরাং সহসা আক্রান্ত হইয়া প্রথমত নিতান্তই অপ্রতিভ এবং উদ্বিগ্ন হইলেন। পরে সত্বরতা সহ প্রস্তুত হইয়া কৃষ্ণগড়ের পার্বত্য দুর্গে আশ্রয় গ্রহণপূর্বক ভীষণভাবে সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলেন। দুর্গ হইতে মধ্যে মধ্যে ধাওয়া করিয়া শিবাজীর বহু সৈন্য হতাহত করিতে লাগিলেন। কিন্তু শিবাজীর সৈন্য-সংখ্যা অনেক বেশি থাকায়, সরফরাজ খান বিশেষ কিছু সুবিধা করিয়া উঠিতে পারিলেন না। দুর্গের রসদ ক্রমে ফুরাইয়া গেল। অথচ বিজাপুর সোলতানের কোনও সৈন্যদল সাহায্যের জন্য আগমন করিল না।

সরফরাজ খান ক্রমশ হতাশ হইয়া পার-পর-নাই ভীষণ হইয়া উঠিলেন। তিনি অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া অপেক্ষা সৈন্যদল ও একমাত্র বীরপুত্র আলী হায়দর খানকে সঙ্গে লইয়া শিবাজীর সৈন্যদলকে ভীষণভাবে, আক্রমণ করিলেন। প্রচন্ড আক্রমণে শিবাজীর সৈন্যদল রণক্ষেত্রে তিষ্ঠিতে না পারিয়া বহুদূরে হটিয়া গেল। শিবাজীর প্রচুর রসদ তোপ-বন্দুক এবং গোলাগুলী সরফরাজ খানের হস্তগত হইল। কিন্তু এই যুদ্ধে তাঁহার একমাত্র বীরপুত্র আলী হায়দর খান যুদ্ধ করিতে করিতে সমক্ষেত্রে পতিত হইলেন। এদিকে শিবাজী আরও মাওয়ালী ও মারাঠা সৈন্যদল সংগ্রহ করিয়া পুনরায় নবীন উদ্যম এবং বিপুল তেজে দুর্গ আক্রমণ করিলেন। আবার ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হইল। দুর্গ-প্রাচীর ভগ্ন করিবার জন্য মারাঠা গোলন্দাজগণ অনবরত এক স্থান লক্ষ্য করিয়া গোলা নিপে করিতে লাগিল। সরফরাজ খান, তাঁহার সেনাপতি মোতামদ খান এবং কন্যা আমিনা বানু দুর্গের প্রচারের উপরে তোপ পাতিয়া শক্রসৈন্য সংহারের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের জ্বলন্ত উৎসাহ এবং উত্তেজনাপূর্ণ সঞ্জীবণী বাণীতে কৃষ্ণগড়ের সৈন্যদলের মধ্যে প্রবল উৎসাহ ও বীরত্বের সঞ্চার হইল। কৃষ্ণগড়ের গোলন্দাজগণের অব্যর্থ লক্ষ্যে শিবাজীর সৈন্যদল যখন ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া পড়িবার উপক্রম হইল, ঠিক সেই সময় একটি শেল আসিয়া বীরপুরুষ সরফরাজ খানের স্কন্ধদেশে পতিত হইল। সেই শেলের দারুণ আঘাতে তাঁহার দেহ একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া উড়িয়া গেল। সৈন্যদলে ভীষণ হাহাকার ধ্বনি উত্থিত হইল। শক্রগণ যাহাতে সরফরাজ খানের নিধনবার্তা অবগত না হইতে পারে, তজ্জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বিত হইল।

গভীর রজনীতে পরামর্শ-সভা আহুত হইল। মোতামদ খান এবং অন্যান্য প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ নিরাশ হইয়া শিবাজীর সহিত সন্ধি করিবার প্রস্তাব করিলেন। সরফরাজ খানের পত্নী হামিদা বানুও সন্ধির প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, কিন্ত বীর্যবতী কুমারী আমিনা বানু বলিলেনঃ “বিধমী ও বেঈমান কাফেরের সহিত সন্ধি অপেক্ষা যুদ্ধ করাই ভালো। আমাদের প্রেরিত দূত বিজাপুরে পৌঁছে থাকলে, নিশ্চয়ই এতদিনে সোলতান-বাহিনী আমাদের সাহায্যের জন্য রওয়ানা হয়েছে। এ সময় হীন শর্তে সন্ধি করলে, পরে পস্তাতে হবে। শিবাজী যেমন, যখন ইচ্ছা সন্ধি উল্লঙ্ঘন করতে দ্বিধাবোধ করেন না, স্বাভাবিক ধর্মভীরুতার জন্য আমাদের পক্ষে সেরূপ করা সম্ভব হবে না। সুতরাং ভবিষ্যতে আমরা শক্তিশালী হলেও এই বেইমান ও অসভ্য কাফেরদিগের অধীনে বহু হীনতা ও নীচতা স্বীকার করতে হবে। সুতরাং কমবখত মারাঠা কাফেরের সঙ্গে যুদ্ধ করাই সর্বতোভাবে সঙ্গত।

“যুদ্ধে যদি জয়লাভ করি, শক্রর নিপাত হবে। আর যদি মৃত্যুমুখে পতিত হই, তাহাও মহাসৌভাগ্যের কারণ হবে। কারণ, মহাপুরুষ হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলেছেন, ‘যুদ্ধ করতে করতে যে মৃত্যু, তাহাই শ্রেষ্ঠ মৃত্যু। এরূপ মৃত্যু মানুষকে বিনা হিসাবে বেহেশতে লয়ে যাবে।’ সুতরাং সকলে যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হউন। আমার বিশ্বাস, চরম বিক্রমে আক্রমণ করলে, শক্রগণ নিশ্চয় পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হবে।”

আমিনা বানুর উৎসাহ এবং যুদ্ধপ্রিয়তা সন্দর্শন করিয়া সকলেই যুদ্ধের জন্য আবার মাতিয়া উঠিলেন। সুতরাং দুর্গবাসী সকলেই প্রাণপণ যত্নে দুর্গ-প্রাচীরের ভগ্নস্থানগুলি রাতারাতি মেরামত করিয়া প্রভাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইলেন। মোতমদ খান এবং কুমারী আমিনা বানু অশ্বারোহণে দুর্গের সর্বত্র পরিভ্রমণ করিয়া সকলকে উৎসাহিত এবং উদ্বোধিত করিতে লাগিলেন। সুর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই কুমারী আমিনা বানু বর্মমন্ডিত অবস্থায় অস্ত্রশস্ত্রে সজিজ্জত হইয়া স্বয়ং সেনাপতির পদ গ্রহণপূর্বক ভীম বিক্রম এবং অটল সঙ্কল্পে গৈরিক প্লাবনের ন্যায় শিবাজীর বাহিনীর উপরে যাইয়া আপতিত হইলেন। ভীষণ প্রতাপে শিবাজীর ব্যূহ বিদীর্ণ হইয়া গেল। আমিনা বানু অনেক দূর পর্যন্ত মাওয়ালী ও মারাঠা সৈন্যের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া দুর্গে ফিরিয়া আসিলেন। শিবাজীর সৈন্যের প্রচুর রসদ-পত্র তোপ-বন্দুক ও গোলাগুলী হস্তগত করিয়া কুমারী আরও বিক্রমশালিনী হইয়া উঠিলেন। মধ্যে মধ্যে দুর্গ হইতে ধাওয়া করিয়া মারাঠাদিগের ভীষণ মার দিতে লাগিলেন। শিবাজীর সৈন্যদল বহু উৎসাহ এবং পুরস্কারের প্রলোভনে উদ্বুদ্ধ এবং প্রলুব্ধ হইয়াও কুমারীর সহিত সম্মুখ-সংগ্রামে ব্যূহ বাঁধিয়া দাঁড়াইতে সমর্থ হইল না।

কুমারী আমিনা বানু যেমন বীর্যশালিনী, তেমনি অসাধারণ রূপবতী ছিলেন। বাল্যকাল হইতে সমর-শাস্ত্রে তাঁহার গভীর অনুরাগ ছিল। অশ্বারোহণে, অস্ত্র-সঞ্চালনে, ব্যূহ-বিন্যাস কৌশলে, তোপ পরিচালনায়, তিনি অসাধারণ দক্ষতা লাভ করিয়াছিলেন। এক্ষণে সমরক্ষেত্রে সাক্ষাৎভাবে তাঁহার বীরত্ব, প্রতাপ, সাহস ও কৌশল দেখিয়া সকলেই বিমোহিত হইল।

শিবাজী এই কুমারীর প্রতাপ ও সাহস দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন। রমণীর রূপলাবণ্যের সহিত এই প্রকার বিস্ময়কর বীর্যশৌর্যের অপূর্ব সমাবেশ দেখিয়া শিবাজী এই রমণীরত্বকে হস্তগত করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিছুদিনের জন্য যুদ্ধ লাভ করিবার জন্য উন্মক্ত হইয়া উঠিলেন। বলে পরাস্ত করিতে না পারিয়া কৌশল ও প্রলোভনে কুমারীকে বন্ধ রাখিয়া সন্ধির প্রস্তাব উত্থাপিত করা হইল। আমিনা বানুর অসাধারণ বীরত্ব ও কৌশলে শিবাজী নিতান্ত মুগ্ধ ও বিস্মিত হইয়াছেন, এইরূপ ভান করিয়া তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করা সঙ্গত নহে বলিয়া প্রকাশ করিলেন। অতঃপর শিবাজী কৃষ্ণগড়ের অধিকারিণী আমিনা বানুর সহিত সন্ধি-বন্ধনে আবদ্ধ হইলেন। তিনি আর কখনও কৃষ্ণগড় আক্রমণ করা দূরে থাকুক, অন্য কেহ আক্রমণ করিলে, তিনি আততায়ীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন।

অতঃপর উভয়পক্ষ হইতে মিত্রতা স্বরূপ উভয় পক্ষকেই বিপুল আড়ম্বরে ভোজ প্রদান করা হইল। ভোজ শেষ হইলে, শিবাজী বহুমূল্য নানাবিধ বিলাস দ্রব্য, করাচী হইতে লুণ্ঠিত একজোড়া হীরকের কঙ্কণ এবং লক্ষ টাকা মূল্যের পারস্যসাগর-জাত একটি মুক্তামালা আমিনা বানুকে উপহার প্রদান করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিবাজীর রূপ-গুণ যশঃবিক্রম প্রভৃতি তিলে তাল করিয়া বর্ণনা করিবার জন্য উপযুক্তরূপে শিক্ষিতা কতিপয় ধূর্ত স্ত্রীলোক দাসী-স্বরূপ প্রেরিত হইল। ইহাদের কর্তব্য ছিল-ক্রমশ শিবাজীর গুণকীর্তন করিয়া আমিনা বানুকে শিবাজীর প্রতি অনুরক্ত ও মুগ্ধ করা।

শিবাজীর উদারতা এবং মহত্ব দেখিয়া সকলেই ধন্য করিতে লাগিল। বীরঙ্গনার প্রতি এই প্রকার সন্মান ও দয়া প্রকাশ করায় দাক্ষিণাত্যের মুসলমানগণও শিবাজীর প্রশংসা কীর্তন করিতে লাগিল। অতঃপর যথাসময়ে বিজাপুরের প্রধানমন্ত্রী এবং যুবরাজ যাইয়া নির্দিষ্ট সময়ে আমিনা বানুকে রাজ্যাভিষিক্ত করিয়া ‘মালেকা’ অর্থাৎ রাণী উপাধি প্রদান করিলেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং মুকুট পরাইয়া দিলেন। যুবরাজ বিজাপুরের হুকুমতের তরফ হইতে একখানি মূল্যবান তরবারি উপহার প্রদান করিলেন। শেখ-উল-ইসলাম জামে মসজিদে যাইয়া আল্লাহ তালার মঙ্গল আশীর্বাদ মালেকা আমিনার জন্য প্রার্থনা করিলেন। শিবাজীও তাঁহাকে অনেক ভেটঘাট প্রদান করিয়া যথেষ্ট সম্বর্ধনা করিলেন। মালেকা আমিনা বানু রাজ্যাভিষেকের পরে বিজাপুরের সোলতানের হুজুরী-নজর স্বরূপ পাঁচটি উৎকৃষ্ট হস্তী, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং ২৫টি বৃহৎ মুক্তা প্রেরণ করিলেন।

তারাবাঈ ০২ পরিচ্ছেদ

শীত ঋতুর অবসান হইয়াছে। মলয় সমীরণের মধুর সঞ্চরণে উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের প্রাণে প্রাণে নব-জীবন এবং নব আনন্দের সঞ্চার হইয়াছে। নবীন পত্র-পল্লবে এবং মঞ্জরী-মৌলী-ভূষণে ভূষিত হইয়া নানা জাতীয় বৃলতা অপরূপ শোভা বিস্তার করিতেছে। অনন্ত আকাশের অনন্ত নীলিমা উজ্জ্বলতর হইয়া আল্লাহতালার অনন্ত মহিমা প্রকাশ করিতেছে! পাখীর কণ্ঠে ললিত ছন্দে নানাবিধ মধুর ও মনোহর কুজন স্ফুরিত হইয়া দিগদিগন্ত মুখরিত এবং পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে। এমন মধুর ও মনোহরি বসন্তকালে শিবাজী দিগদিগন্ত মুখরিত এবং পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে। এমন মধুর মনোহর বসন্তকালে শিজাবী আমিনা বানুকে বিশেষ সম্বর্ধনা পুর্বক রাজধানী রায়গড়ে বিশেষ পরামর্শের জন্য নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন।

মালেকা প্রথমে নিমন্ত্রণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিলেন, নানা প্রকার ওজুহাত দেখাইতে লাগিলেন। অবশেষে বহু সাধ্য-সাধন এবং অনুনয়-বিনয়ে বাধ্য হইয়া জননী হামিনা বানু, দুইশত সিপাহী এবং স্বকীয় সহচরীগণ সহ রায়গড়ে শুভাগমন করিলেন।

শিবাজী বিপুল আড়ম্বর ও ধুমধামে মালেকাকে অভ্যর্থনা করিলেন। ফলত শিবাজী দ্বারা মালেকা আমেনা বানুর আদর-অভ্যর্থনা যতদূর হওয়া সম্ভবপর, তাহার কিছুই ক্রটি হইল না। আমিনা, তাঁহার মাতা এবং সঙ্গীয় লোকজন সকলে। শিবাজীর ভদ্রতা, সৌজন্য ও শিষ্ট ব্যবহারে পরম প্রীতি লাভ করিলেন।

শিবাজী এই সময়ে কৌশলে আমিনা বানুর রূপ-লাবণ্য বিশেষরূপে দর্শন করিয়া যার-পর-নাই লুদ্ধ এবং মুগ্ধ হইয়া পড়িলেন। আমেনা বানুর ভাসা ভাসা পটল-চেরা ভুবন-মোহন-অক্ষিযুগল এবং সর্বাঙ্গম সুঠাম ও সৌন্দর্য দেখিয়া সকলেই প্রশংসা করিতে লাগিল। শিবাজী আলোকসামান্য সুন্দরী, অগ্নিতুল্য তেজস্বিয়নী এবং প্রখর রাজনীতিজ্ঞা, এই রমণীরত্নকে পত্নীরূপে লাভ করিতে পারিলে, সমগ্র ভারতের অধিপতি হইয়া আশাও পোষণ করিতে লাগিলেন। মুসলমান কখনও কাফেরকে কন্যা দান করিতে পারে না, শিবাজী এই চিন্তাতেই অস্থির হইতে লাগিলেন। সুতরাং অসম্ভব কার্যকে সম্ভব করিবার জন্য শিবাজী কাল্পনিক পন্থা উদ্‌ভাবনে ব্যস্ত হইলেন। অনেক চিন্তা করিলেন, কিন্তু কিছুই নির্ধারিত হইল না। মন ক্রমেই মাতিয়া উঠিতে লাগিল। ক্রমেই লালসা বায়ু-প্রাপ্ত বহ্নির ন্যায় অতীব প্রচন্ড হইয়া উঠিল।

শিবাজী মালেকার সৌন্দর্য-সুধার এমনি পিপাসু হইয়াছিলেন যে, ক্রমশ তাঁহার হিতাহিত জ্ঞান ও পরিনামদর্শিতা একেবারেই লোপ পাইল। মালেকাই তাহার ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তাকে আশ্রয় করিয়া ফেলিল। অবশেষে তাঁহার পরামর্শদাতা শুরু রামদাস স্বামীর পরামর্শে, ভানপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া মালেকা বানুর পাণিগ্রহণের জন্য চেষ্টা করিতে বলিলেন। বিবাহ করিবার পরে সুবর্ণ-নির্মিত কৃত্রিম গাভীর গর্ভে প্রবেশ করিয়া প্রসব-দ্বার দিয়া নির্গত হইয়া সেই গরু ব্রাহ্মণদিগকে দান করিলেই প্রায়শ্চিত্ত হইয়া যাইবে। আবার তিনি হিন্দুত্ব লাভ করিতে পারিবেন। রাজা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, মোসলেম-ললনা পাণিপীড়ন করিতে পারেন, রামদাস স্বামী এরূপ ব্যবস্থাও দিলেন।

তারাবাঈ ০৩ পরিচ্ছেদ

চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথি। পূর্ণকলা শশধরের অমল-ধবল জ্যোৎস্না-লহরীতে গগন-ভবন সুখ-তরঙ্গে ভাসিতেছে। কৃষ্ণগড়ের দুর্গ-মধ্যস্থ মনোহর উদ্যানে নানা জাতীয় ফুল ফুটিয়া কৌমুদী-স্নাত হইয়া মৃদু মন্দ পবনে মধুর গন্ধ বিতরণ করিয়া হাসিতেছে, নাচিতেছে এবং খেলিতেছে। সরোবরে জলজ পস্পদাম প্রস্ফুটিত হইয়া মনোহারিণী শোভার সৃষ্টি করিয়াছে। নবপত্রপল্লাবসনে সুখে সমাসীন হইয়া কোকিল ও পাপিয়া সুধামাখা কুজনে অনন্ত শূণ্যবক্ষে যেন কি এক পীযূষ-স্রোত প্রবাহিত করিতেছে! জলে-স্থলে শূন্যে সর্বত্র জ্যোৎস্নার মধুর ও শান্তোজ্জ্বল বিকাশ! মলয়া হওয়ার অবিরাম সুখ-স্পর্শ মৃদু সঞ্চরণ। ফুলে ফুলে হাসির ঢলাঢলি! নীলিম গগন-পটে তারকাবলীর স্নিগ্ধোজ্জ্বল সমাবেশ! এ হেন মধু-যামিনীতে মালেকা আমিনা বানু প্রিয় সহচরী রোকিয়াকে সঙ্গে লইয়া উদ্যান মধ্যস্থ সরোবরে ঘাটে গালিচা পাতিয়া বসিয়া প্রকৃতির চিত্তবিনোদন দৃশ্য উপভোগ করিতেছিলেন। মালেকা এবং রোকিয়া উভয়ে নীরব। কিছুণ পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া রোকিয়া বলিল, “মালেকা! এ মধু-যামিনী এমন করে একেলা ভোগে সুখ কি? হৃদয়-রাজ্যে প্রেমের জ্যোৎস্না না ফুটলে বাইরের জ্যোৎস্নায় কেবল অন্ধকারই বৃদ্ধি করে!”

মালেকাঃ কেন? এই ত তুমি আছ! তোমার সঙ্গেই মধু-যামিনীর জ্যোৎস্না-লহরী পান করছি।

রোকিয়াঃ ঠাট্টা রাখ। দুধের সাধ কি ঘোলে মিটে? এমন ক’রে যৌবন-জীবন যাপন করায় পল কি? বিবাহ করাই সঙ্গত।

মালেকাঃ কথা ত ঠিক্‌! কিন্তু যাকে-তাকে ত আর স্বামীত্বে বরণ করতে পারি না। বীরপুরুষ না হলে, কা’কেও বিবাহ করব না, এই সংকল্পই ত এখন বাধা হয়ে পড়ছে।

রোকিয়াঃ কেন, মোতামদ খান কি উপযুক্ত নন?

মাঃ মোতামদ খান একজন উপযুক্ত সেনাপতি ব্যতীত আর কিছুই নন। তাঁকে বীরপুরুষ বললে অন্যায় হয় না বটে, কিন্তু আমি যে শ্রেণীর বীরপুরুষ চাই, সে শ্রেণীর নহেন। মোতামদ খান যদি বাহুবলে রাজ্য সংস্থাপন করতে পারতেন অথবা কৃষ্ণগড়কে স্বাধীন করতে পারতেন, তা’ হ’লে তাঁকে বীরপুরুষ বলে স্বীকার করতাম।

রোঃ তবে শিবাজী?

মাঃ বটে! শিবাজী সাহসী পুরুষ এবং রাজ্য সংস্থাপনেরও চেষ্টা করছেন। কিন্তু অতি নীচ প্রকৃতি বিশিষ্ট। শিবাজীকে বীরপুরুষ বলা কিছুতেই সঙ্গত নহে, দস্যু বল। বীরপুরুষের মহত্ব ও বীরত্ব তাঁতে নাই। ‘পার্বত্যমূষিক’ উপাধিই তাঁর পক্ষে যথার্থ।

রোঃ কেন, আপনার প্রতি ত খুবই উদার ও সদয় ব্যবহার করেছেন।

মাঃ নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁর ভিতরে তাঁর মৎলব আছে।

মাঃ মৎলব ছাড়া দুনিয়ার কে কি ক’রে থাকে?

মাঃ তা’ বটে! কিন্তু মৎলবের মধ্যেও পার্থক্য আছে। নিজের স্বার্থসিদ্ধিই যার একমাত্র উদ্দেশ্য, সে মৎলব অতীব ঘৃণিত।

রোঃ শিবাজীর মৎলব ঘৃণিত কিসে?

তাঃ তাঁল এই সদয় ও উদার ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাকে লুব্ধ ক’রে বিবাহ করা। কিন্তু তাঁর জানা উচিত যে, মুসলমান কখনও কাফেরকে পাণিদান করতে পারেন না।

রোঃ তিনি ত আপনার জন্য ইসলাম ধর্ম পর্যন্ত অবলম্বন করতে প্রস্তুত আছেন। আপনি বিবাহে স্থির-নিশ্চয় সম্মতি দিলে তিনি পৈতৃক হিন্দু ধর্ম ত্যাগ ক’রে পবিত্র ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করবেন। এতে তাঁকে নানাবিধ অসুবিধা ও কষ্ট ভোগ করতে হবে বটে; কিন্তু তুবও তিনি আপনার জন্য সে সমস্ত সহ্য এবং বহন করতে প্রস্তুত আছেন। প্রেমের এমন আদর্শ এবং প্রেমের জন্য এরূপ স্বার্থত্যাগ নিতান্তই বিরল নহে কি?

মাঃ নিশ্চয়ই। এরূপ ভন্ডামী এবং এরূপ শয়তানী নিশ্চয়ই নিতান্ত বিরল!

রোঃ ভন্ডামী কিরূপ? হায়! একেই বলে ‘যার কি চুরি সেই বলে চোর!’

মাঃ ভন্ডামী না হয়ত, ষন্ডামী ত বটেই। সাত সাতটি স্ত্রী এবং কয়েক গন্ডা উপপত্নী থাকলেও যাঁর আমার জন্য ঘুম হয় না, সে যদি আদর্শ প্রেমিক হয়, তবে আদর্শ লম্পট এবং পিশাচ আর কে?

রোঃ যে ব্যক্তি যাকে তনুমন সমর্পণ করেছে, সে যদি তা’কে না পায়, তা’ হলে তার ঘুম না হওয়াই ত স্বাভাবিক। এ অবস্থায় ত বেচারা শিবাজীর প্রতি দয়া হওয়াই স্বাভাবিক।

মাঃ বটে, বলিস কি? তুই পাগল নাকি! এরূপ লোকের প্রতি যদি দয়া হয়, তা’ হলে, বাম পদাঘাত করবার প্রবৃত্তি হবে আর কা’কে?

রোঃ ছিঃ! ছিঃ! এমন কথা বলা কি সঙ্গত?

মাঃ যে ব্যক্তি নারী লাভের জন্য পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করতে প্রস্তুত তা’র প্রতি ইহা অপেক্ষা সদুক্তি আর কি হ’তে পারে? যদি শিবাজী আজ ধর্মের জন্যই ধর্ম পরিগ্রহ করতেন, তা’ হলে নিশ্চয়ই মুক্তকণ্ঠে তাঁর প্রশংসা কীর্তন করতাম। শিবাজী ইসলাম ধর্ম পরিগ্রহ করলেও কদাপি তাতে স্থিরতর থাকবেন না। কোনও রূপে আমার রাজ্য এবং আমাকে হস্তগত করবার জন্যই ইসলাম গ্রহণের ভাণ করা হচ্ছে। শিবাজী ইসলামের পরম শক্রু। তিনি মসজিদগুলি চূর্ণ এবং তাহা শূকর-রক্তে অপবিত্র ক’রে পরম আনন্দ লাভ করছেন। শিবাজীর ন্যায় নৃশংস দস্যু যদি দমিত না হয়, তা’ হলে ইসলামের সমূহ অমঙ্গল বুঝতে হবে। আমি এহেন অস্পৃশ্য পাষন্ড কাফেরের পাণিগ্রহণ করব, এরূপ আশা করা বাতুলের পক্ষেই শোভা পায়। বরং শিবাজী এবিষয়ে যতই চেষ্টা করবেন, আমার ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা ততই বৃদ্ধি পাবে। আমি প্রাণান্তেও এমন ঘৃণিত দস্যু ও জাহান্নামী কাফেরকে কিছুতেই স্বামীত্বে বরণ করতে স্বীকৃত নহি। এমনকি, এ বিষয়ের আলোচনা করতেও আমি ঘৃণা এবং বিরক্তি বোধ ক’রে থাকি।

 তারাবাঈ ০৪ পরিচ্ছেদ

ঊষা তাহার অরুণিমা-জালের চাঁপা আঙ্গুলের কোমল স্পর্শে ঘন আঁধাররাশিকে তরল করিয়া নিদ্রিত বিশ্ববক্ষে নব চেতনার সঞ্চার করিতেছে। প্রভাতবায়ু কুসুম-গন্ধ হরণ করিয়া মৃদুমন্দ গতিতে স্বাস্থ্য ও স্নিগ্ধতা বিতরণ করিয়া প্রবাহিত হইতেছে। মধুরকণ্ঠে নানা ছন্দে সুললিত তানে বিশ্বপিতার মহিমা কীর্তন করিতেছে। ধীরে ধীরে মৃতবৎ জগৎবক্ষে কেন মনোহর ও মধুরভাবে নবজীবনে আবির্ভাব সূচিত হইতেছে।

এ হেন মধুর প্রভাতকালে অতি প্রত্যুষেই রায়গড়ের রাজপথের পার্শ্বে লোক সমাগম পরিদৃষ্ট হইতেছে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, রায়গড় তখন অতি ক্ষুদ্র শহর।

এই ক্ষুদ্র শহর আজ বিজাপুরের সেনাপতি মহাবীর আফজাল খাঁর অভ্যর্থনাহেতু পরম রমণীয়ভাবে সজ্জিত হইয়াছে। পথের মধ্যে মধ্যে নানাস্থানে বিচিত্র তোরণসমূহ নির্মিত হইয়াছে! পতাকা, পুস্প এবং কদলী বৃক্ষে সমস্ত রাস্তা গোলজার করা হইয়াছে। মহারাষ্ট্রগণ যথাসম্ভব উৎকৃষ্ট বেশ-ভূষার সজ্জিত হইয়া সোৎসুকচিত্তে অপেক্ষা করিতেছে! মহারাষ্ট্র রমণীগণ পুস্পগুচ্ছে কুন্তল সাজাইয়া বিচিত্র ভঙ্গীতে কোঁচা ও কাছা দিয়া শাটী পরিয়া অট্টহ্স্যে এবং কোলাহলের গগণ-পবন মুখরিত করিয়া রাস্তার এক এক স্থানে জটলা পাকাইতেছে। বহু সংখ্যক বালক ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করিতেছে।

এদিকে বাদ্যোদ্যমসহ মহারাষ্ট্রদিগের রাজা শিবাজী সহস্র সংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্যসহ মুসলমান-পোষাকে উৎকৃষ্টরূপে সজ্জিত হইয়া সপারিষদ আসিয়া নগর তোরণের মূলে শ্রেণীবন্ধভাবে দন্ডায়মান হইলেন।

সহসা দূরে একটি তোপ গর্জন করিয়া উঠিল। সেই তোন গর্জনের সঙ্গেই সর্বত্র একটি অস্ফুট কলরব উত্থিত হইল। শিবাজী অশ্বারোহী সৈন্য এবং পারিষদগণকে সঙ্গে লইয়া বেগে অশ্ব ছুটাইলেন। নহবতে নহবতে শাহানার সুরে শানাই বাজিয়া উঠিল। রাস্তার পার্শ্বেই বাটী হইতে শঙ্খধ্বনি হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে শিবাজী, বিজাপুরের সেনাপতি বীরবর আফজাল খাঁকে পরম সমাদরে এবং বিপুল আড়ম্বরে অভ্যর্থনা করিয়া রাজপ্রসাদের দিকে অগ্রসর হইলেন। শিবাজীর সৈন্যগণ পতাকা উড়াইয়া এবং বিগল বাজাইয়া অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। পশ্চাতে আফজাল খাঁ সহস্র সংখ্যক বীর পুরুষগণ বিপুল উৎসাহে নানাবিধ শ্রুতিমধুর বাদ্য বাজাইতে বাজাইতে অগ্রসর হইল। তৎপশ্চাতে বিপুল জনতা ও পদাতিক সৈন্যগণ চলিতে লাগিল। মারাঠা রমণীরা চতুর্দিক হইতে হুলুধ্বনি দিতে লাগিল।

আকাশে সূর্য উঠিয়াছে! তরুণ অরুণের লোহিত কিরণরাগে গগণ-ভুবন মনোমোহন সৌন্দর্যে ভূষিত হইতেছে। কিন্তু বিশ্বলোচন সবিতা-দেবের প্রতি আজ কাহারো দৃষ্টি নাই। যে সমস্ত হিন্দু সূর্যোদয় “জবা কুসুম সঙ্কাশ” প্রভৃতি স্তব আওড়াইয়া প্রত্যহ সূর্যের উপাসনা করিত, তাহাদেরও আজ সেই উপাস্য সূর্য-দেবতার দিকে নজর নাই। আজ সকলের দৃষ্টিই বিজাপুরের বীর সেনানী রূপবান ও তেজীয়ান আফজাল খাঁর প্রতি! আফজাল খাঁ অশ্বারোহণে চলিয়াছেন! তেজীয়ান অশ্ব নৃত্যশীল গতিতে ধীরে ধীরে কি বাঁকা ভঙ্গিমাতেই চলিয়াছে! আফজাল খাঁ রূপের ছটায় এবং বীর্যগরিমায় চারিদিক যেন আলো করিয়া চলিয়াছেন। কিবা কমনীয় কান্তি! কিবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিব্যঞ্জন আয়ত লোচনযুগন! কিবা অঙ্কিত ভ্র! কিবা প্রশস্ত ললাট! কেমন বলিষ্ঠ ও পুষ্ট দেহ! মরি! মরি! কি তেজঃপুঞ্জ মূর্তি! কি বীরত্বব্যঞ্জক গোঁফ। যে দেখিল, সেই মুগ্ধ হইল। রমণীমহলে এই অপরূপ রূপের অস্ফুট স্বরে সমালোচনা উঠিল। সকলেই আফজাল খাঁর কোনও-না-কোনও অঙ্গের প্রশংসা করিতে লাগিল! তাঁহার সঙ্গীয় অশ্বারোহী সৈন্য এবং দেহরগিণেরই বা কি মনোরম গঠন-পারিপাট্য! কি বাঁকা ঠাম?

আফজাল খাঁর বাম পার্শ্বে শিবাজী চলিয়াছেন। শিবাজী মারাঠাদিগের মধ্যে সুশ্রী এবং সাহসী বীরপুরুষ বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। কিন্তু আজ মারাঠারা দেখিল-শিবাজীর শ্রী, চেহারার তেজঃ, গঠন-পারিপাট্য এবং পুষ্টি, আফজাল খাঁর তুলনায় কত নগন্য! চন্দ্রের নিকট তারকা তেমন, পদ্মের নিকট শাপলা যেমন, কর্পূর আলোর নিকট মৃৎপ্রদীপের আলো যেমন, ময়ূরের নিকটে পাতিহংস যেমন, আফজাল খাঁর নিকটে শিবাজীও সেইরূপ প্রতিভাত, হইতেছেন। শিবাজীও বিস্মিত দৃষ্টিতে এক একবার নেত্রকোণে আফজাল খাঁর কমনীয় কান্তি, রমণীয় গঠন এবং তেজঃপুঞ্জ মূর্তি দর্শন করিতেছেন, আর হৃদয়ে ঈর্ষার সর্প দংশনে জ্বলিয়া উঠিতেছেন! হায়! শক্রর এত রূপ! এত বীর্য! একি কখনও সহ্য হয়! তাঁহার স্বজাতীয় মারাঠাদিগের নিকট আজ যে তাঁহার সর্বপ্রকার হীনতাই সূচিত হইতেছে।

যাহা হউক, নগরের দৃশ্য দেখিতে দেখিতে অল্প সময়ের মধ্যেই শিবাজী আফজাল খাঁকে লইয়া রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারে উপনীত হইলেন।

এইখানে শিবাজীর আত্নীয়-স্বজন এবং তাঁহার গুরু রামদাস স্বামী অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আফজাল খাঁর উপস্থিতি মাত্রেই একশত এক তোপ সন্মখস্থ প্রান্তরে গর্জন করিয়া উঠিল! এই তোপ গর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই সহসা এক মহাবিপদের সঞ্চার হইল! শিবাজীর একটি প্রকান্ড হস্তী ভয়ে চঞ্চল হইয়া জনতার মধ্যে বেগে ছুটিতে লাগিল! মাহুত প্রাণপণে হস্তীটাকে থামাইবার চেষ্টা করিয়াও কিছুতেই কৃতকার্য হইতে না পারিয়া ভীষণে প্রহার করিতে লাগিল! ভীষণ ডাঙ্গশের প্রহারে হস্তীটি উন্মত্ত প্রায় হইয়া মাহুতকে সবলে স্কন্ধ দেশ হইতে আকর্ষণপূর্বক পদতলে নিষ্পেষিত করিয়া ফেলিল। ভীষণ পদাঘাতে এবং গুরুভারে মাহুত মুহূর্ত মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হইল।

মাহুতকে নিহত করিয়া আরও উন্মত্ত এবং ভীষণ হইয়া পড়িল। তাহার উন্মত্ততা এবং ভীষণতায় সেই সুসজ্জিত এবং সুশৃঙ্খল অগ্রভাগ একেবারেই বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত হইয়া পড়িল। সর্বত্র ভীতির কোলাহল পড়িয়া গেল। হস্তীর সম্মুখ হইতে সকলেই বেগে পলায়ন করিতে লাগিল। হস্তীটি বেগে ছুটিতে তাহার দক্ষিণ পার্শ্বের এক স্থানে, যেখানে মারাঠা স্ত্রীলোকেরা দাঁড়াইয়া মিছিল দেখিতেছিল, সেই দিকে ধাবিত হইল। স্ত্রীলোকেরা ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিতে লাগিল।

কিন্তু রত্নখচিত কৌষেয়বস্ত্র-সুসজ্জিত রাজকুমারী তারা পলায়ন করিতে যাইয়া মঞ্চে কাপড় আটকাইয়া পড়িয়া গেল। হস্তীটি এমন সময়ে বিকট চীৎকার করিয়া উঠায়, তারার দাসীগণ তারাকে ফেলিয়াই পলায়ন করিল। চতুর্দিকে ভীষণ আতঙ্কজনক উচ্চ কোলাহল উত্থিত হইল! এক পলকের মধ্যে হস্তী তারাকে পদ-বিমর্দিত করিবে! সকলেই হাহাকার করিয়া উঠিল।

শিবাজী-তনয়া তারার কোমল-দেহ-কুসুম কুঞ্জরপদতলে দলিত আর বেশি বিলম্ব নাই। হস্তী এক পা উঠাইয়াছে। সর্বনাশ! সর্বনাশ! সকলেই তারার মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হইয়া গেল।

কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! সহসা কেন হস্তীটি ভীষণ আর্ত-চীৎকার করিয়া উঠিল। সকলেই বিস্ময়বিস্ফোরিত নেত্রে অবাক হইয়া দেখিল যে, উন্মত্ত হস্তীটি কপালে তীর বিদ্ধ হইয়া তারাকে ত্যাগ করিয়া অন্যদিকে ছুটিয়া যাইতেছে। তীর একহস্ত পরিমিত মস্তিস্কের মধ্যে বিদ্ধ হইয়াছিল। সুতরাং হস্তীটি কিয়দ্দুর যাইয়া ভূপতিত হইল। রক্তধারা প্রবাহিত হইয়া জমিন সিক্ত হইয়া গেল। দেখিতে দেখিতে হস্তীটি প্রাণ ত্যাগ করিল!

কে এই আসন্নবিপদ হইতে তারাকে রক্ষা করিল? কে এমন অব্যর্থ লক্ষ্যে ভীষণ তেজে তীর নিক্ষেপ করিয়া এই মহাবিপদের অবসান করিল? কাহার বাহুতে এমন দুর্জন শক্তি যে, হস্তীর মস্তকের মস্তিস্ক পর্যন্ত তীরে বিদ্ধ করিয়াছে?

সকলেই দেখিতে পাইল যে, বীরকুল-চূড়ামণি আফজাল খাঁই মুহুর্ত মধ্যে ধনুকে জ্যা আরোপণ করিয়া সবল ও নিপুণ হস্তের অব্যর্থ লক্ষ্যে রাজকুমারী তারাবাঈকে আকস্মিক মৃত্যুর হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছেন। চতুর্দিকে আফজাল খাঁর নামে জয়ধ্বনি হইতে লাগিল। সকলেই মুক্তকণ্ঠে আফজাল খাঁর সাহস এবং তেজের কথা আলোচনা করিতে লাগিল।

অতঃপর বিচ্ছিন্ন মিছিল আবার সুশৃঙ্খল করা হইল। শ্রেণীবদ্ধ হইয়া সৈনিকগণ তিনবার করিয়া কুর্ণিস করত আফজাল খাঁ এবং তাঁহার প্রভু বিজাপুরের সোলতানের দীর্ঘজীবন উচ্চকণ্ঠে কামনা করিল।

আফজাল খাঁ অশ্ব হইতে অবতরল করিলে সর্বপ্রথমে রামদাস স্বামী ধান্যদূর্বা দ্বারা আফজাল খাঁর মঙ্গলচর্না করিলেন। অতঃপর পুরুষ ও রমণীরা মিলিয়া আফজাল খাঁর শিরে ও সর্বাঙ্গে রাশি রাশি পূস্পবর্ষণ করিতে লাগিল। এত পুস্প বর্ষণ হইতে লাগিল যে, আফজাল খাঁ নিঃশ্বাস রুদ্ধ হইবার উপক্রম হইল। উপদ্রব দেখিয়া রামদাস স্বামী সকলকে ধমক দিলেন। কিন্তু যুবতীদিগের মধ্যে একটি রমণী নিষেধের পরও গোলাপের পাঁপড়ী আফজাল খাঁর মুখে বর্ষন করিতে লাগিল। রামদাস স্বামী তখন বিরক্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কি তারা, কি ক’রছ! তোমার কি হুঁস নাই?” কিন্তু তারা তবুও আর এক মুষ্টি পুস্প বর্ষণ করিয়া ক্ষান্ত হইল তারার ভঙ্গী ও পুস্প বর্ষণ মত্ততা দেখিয়া আফজাল খাঁ ঈষৎ স্মিতহাস্য করিলেন।

অতঃপর পরম যত্নে সুসজ্জিত প্রাসাদ্যভ্যন্তরে আফজাল খাঁকে লইয়া রামদাস স্বামী এবং শিবাজীর পিতা শাহজী তাঁহার সেবায় ও পরিতোষ-বিধানে নিযুক্ত হইলেন। সৈনিক পুরুষদিগকেও যথাযোগ্য বাসস্থান এবং আহার প্রদান করা হইল। আদর-অভ্যর্থনা এবং সন্মান-সম্বর্ধনা পুরামাত্রায় চলিতে লাগিল।

তারাবাঈ ০৫ পরিচ্ছেদ

গভীর রাত্রি। জন-প্রাণীর সাড়াশব্দ নাই। আকাশে কৃষ্ণা পঞ্চমীর চন্দ্র কিরণধারায় সমস্ত পৃথিবীকে পুলকিত করিয়া রাখিয়াছে। নানা জাতীয় নৈশ-কুসুমের গন্ধ বাহিয়া মৃদুমন্দ গতিতে বায়ু বাহিয়া যাইতেছে। এমন সময় রায়গড়ের একটি বৃহৎ উদ্যানমধ্যস্থ ক্ষুদ্র অট্রালিকায় শিবাজী, তাঁহার পিতা শাহজী, শুরু রামদাস স্বামী, বলবন্ত রাও, মালজী প্রভৃতি মারাঠাপ্রধানগণ গুপ্ত পরামর্শের জন্য নিভৃতে সমবেত হইয়াছেন। সকলেই গভীর চিন্তামুক্ত-সকলেই নীরব। এই নৈশ গুপ্ত সভাধিবেশনের কথা আর কেহই অবগত নহে। রাজপুরীর আর কোনও নরনারী এসভার কোনও সংবাদ রাখে না এবং রাখিবারও কোনও প্রয়োজন নাই।

সকলেই নীরবে গৃহতলে সমাসীন। সকলেই গম্ভীর চিন্তায় নির্বিষ্ট। মৌনতা ভঙ্গ করিয়া সহসা শাহজী বলিলেন, “বৎস শিবা! অকারণে রাজ-বিদ্রোহিতা মহাপাপ। আমরা বিজাপুরের সোলতানের অধীনে বেশ আরাম ও স্বচ্ছন্দে দিন গুজরান করছি। রাজ্যের সর্বত্র শান্তি বিশেষ রূপে প্রতিষ্ঠিত। চোর-দস্যুর উৎপাত একেবারেই নাই। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প-কৃষি অসাধারণ উন্নতি লাভ করেছে। জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকলেই তুল্যভাবে শাসিত এবং পালিত হচ্ছে। মুসলমান শাসনে ব্রাহ্মণ শূদ্রের বিচারে কোনও পার্থক্য নাই। উচ্চ রাজকার্যে হিন্দু-মুসলমান সকলেরই সমান অধিকার। তারপর বিজাপুরের সোলতান, শুধু আমাদের রাজাই নহেন; আমাদের প্রভু এবং অন্নদাতা। আমি, যে রাজার একজন অমাত্যের মধ্যে গণ্য, সেই রাজার বিরুদ্ধাচরণ করা পাপ-মহাপাপ! ধর্ম এ পাপ কখনও সইবে না। এতে কেবল ধ্বংস ও অকীর্তিই আনয়ন করবে।

“প্রবলপ্রতাপ সোলতানের বিরুদ্ধাচরণ করা ছেলেমী এবং পাগলামী মাত্র। হঠাৎ আক্রমণ করে তাঁর দু’চারটি দুর্গ এবং দশ-বিশ খানা গ্রাম দখল করেছ বলে, সম্মূখ সমরে তার পরাক্রান্ত বাহিনীকে কোনও রূপে পরাজিত করতে পারবে, ও রূপ কল্পনা তুমি স্বপ্নেও পোশন করো না।

“সোলতান অত্যন্ত সরলচেতা এবং উদার প্রকৃতির লোক। তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং রক্তপাতের পক্ষপাতী নহেন। তাই আমাকে বিনা যুদ্ধে গোলযোগ মিটাবার জন্য পাঠিয়েছেন। বৎস, যদি তোমার পিতার জীবনকে বিপন্ন না করতে-অধিকন্ত নিজেকেও রক্ষা করতে চাও, তা’ হ’লে সোলতানের বশ্যতা স্বীকার করে, রাজভক্ত প্রজারূপে বাস করাই সর্বদা যুক্তিসঙ্গত। তুমি যেসমস্ত দুর্গ অধিকার করেছ, তুমিই তার অধ্যক্ষ নিযুক্ত থাকবে। এ অপেক্ষা মহামাননীয় সোলতানের নিকট আর কি অনুগ্রহ পেতে চাও? ইহা বাস্তবিক লোকাতীত মহানুভবতা। দেবতারাও ইহার অধিক অনুগ্রহ করতে পারে না।

“প্রিয় শিবা! সোলতান আমার বিলম্ব দেখলে নিশ্চয়ই সন্দিগ্ধ হবেন। তুমি সেনাপতি আফজাল খাঁর নিকটে আগামীকল্য বশ্যতা স্বীকার করলেই, সমস্ত অশান্তি ও গোলযোগ মিটে যায়। এ শুভকার্যে আর বিলম্ব করা উচিত নহে। চিন্তা, করে দেখ-সামান্য অবস্থায় সামান্য বংশে জন্মগ্রহণ করে এবং সামান্য লোক হয়ে বিজাপুরের সম্মনিত সামন্তের মধ্যে গণ্য হওয়া ভাল, কি জনসমাজ কুক্কর তুল্য ঘৃণিত দস্যু অভিহিত হয়ে সর্বদা বন-জঙ্গলে উৎকণ্ঠিতভাবে জীবনযাপন করা ভাল।”

পিতার কথায় শিবাজী ক্ষণকাল নীরব রহিলেন। তারপরে বলিলেন, “বাবা! আপনি যা” বললেন, তা’ উচ্চাকাঙ্খাবিহীন হীনচেতা ব্যক্তিদিগের নিকট নিতান্তই যুক্তিসঙ্গত বটে, যশোলোলুপ রাজ-পদাকাঙ্খী ব্যক্তিদিগের পক্ষে এ উপদেশ গ্রাহ্য হতে পারে না। রাজ্য কাহারও পৈতৃক বা বিধি-নির্দিষ্ট নিজস্ব বস্তু নহে। যে বাহুবলে অধিকার করতে পারে, তারই হয়ে যায়। সুতরাং রাজবিদ্রোহিতা কথাটার কোন মূল্য নাই। বিশেষত, ইহা যে কোনও পাপ কার্যের মধ্যে গণ্য, তা’ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না।

“পৃথিবীর রাজপদ যখন সর্বশ্রেষ্ঠ পদ, তখন ছলে-বলে কলে-কৌশলে যে কোনও প্রকারে হউক, তা’ লাভ করাই আমার মতে পরম ধর্ম। যখন আমি সেই ধর্মে দীক্ষিত হয়েছি, তখন আর সোলতানের নিকট বশ্যতা স্বীকার করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

শাহজীঃ বৎস শিবা! তুমি যা’ বললে, তা’ অনেকটা সত্য বটে। কিন্তু তুমি কি বাহুবলে রাজ্য অধিকার করেছ? কিম্বা করতে সমর্থ? তুমি অত্যন্ত ভুল বুঝছ! তুমি যে বৃত্তি অবলম্বন করেছ, তা’ বীরপুরুষ বা রাজকর্মী ব্যক্তির বৃত্তি বলে কদাপি অভিহিত হতে পারে না, পূর্বেই বলেছি, ইহা অতি জঘন্য দস্যুবৃত্তি! দস্যু সকলেরই ঘৃণার পাত্র এবং শূল-দন্ডে বধ্য।

শিবাঃ কিন্তু এই দস্যুবৃত্তি ব্যতীত যখন অন্য কোনও উপায় অভীষ্ট সিদ্ধির সম্ভাবনা নাই, তখন এই দস্যুভাবেই আমাকে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সাধনা করতে হবে। আমি এই কর্তব্য হতে কিছুতেই আর এখন বিচলিত হতে পারি না। আপনি আর বিজাপুরে ফিরে যাবেন না। পর্বত ও অরণ্যসঙ্কুল দুর্গম কঙ্কন প্রদেশের দুর্গে যেয়ে সুখে বাস করুন। আপনার কেহ কেশও স্পর্শ করতে পারবে না। আমি এদিকে ছলে-বলে কলে-কৌশলে যে রূপেই হউক, সোলতানের আধিপত্য নষ্ট করে রাজ্যস্থানের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করব। যদি কোনও বিপদ ঘটে, তা’ আমার প্রতিই ঘটবে। যদি কিছু অধর্ম হয়, তা আমারই হবে। সে জন্য আপনার কোনও চিন্তা নাই। আপনি আমার আর কোনও কার্যেরই আলোচনা করবেন না।

শিবাজীর কথা শুনিয়া একটু রুষ্ট হইয়া রুক্ষ স্বরে বলিলেন, “কি আশ্চর্য, তোমার পাপ কার্য-মহাপাপ কার্যেরও সমালোচনা করতে পারব না। আমি এমন রাজদ্রোহী দস্যু পুত্রের মুখ দেখতেও ইচ্ছা করি না! তোমার যা’ ইচ্ছা, তাই করতে পার, কিন্তু পরিণামে এই ঔদ্ধতা এবং পাপের জন্য তোমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।” এই বলিয়া শাহজী নিতান্ত ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত অবস্থায় সেই নির্ভৃত গৃহ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।

শাহজী নির্ভৃত গৃহ হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেলে, শিবাজী এবং রামদাস স্বামী প্রভৃতি মিলিয়া যে পরামর্শ করিলেন, তাহা যার-পর-নাই ঘৃণিত এবং পাপজনক! আফজাল খাঁকে সহসা আক্রমণ করিয়া বধ করাই তাঁহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য! তাঁহাকে বধ করিতে পারিলে, বিজাপুরাধিপের দক্ষিণ হস্ত ভগ্ন হইবে বলিয়া শিবাজীর দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ আফজাল খাঁর ন্যায় এরূপ তেজীয়ান এবং মহাবীর সেনাপতি লাভ বহু ভাগ্যের কথা। শিবাজী অনেকবার বলিলেন যে, ‘আফজাল খাঁর ন্যায় বীর পুরুষের সাহায্য পাইলে তিনি দশ বৎসরের মধ্যে সমস্ত দাক্ষিণাত্যে জয়পাতাকা’ উড্ডীন করিতে পারেন।’ এহেন আফজাল খাঁকে কোনও রূপ নিহত করিতে পারিলে, তাঁহার উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ যে অনেকটা নিস্পণ্টক হয়, তদ্বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নাই। সুতরাং আফজাল খাঁকে গুপ্তভাবে হত্যা করিবার জন্য আয়োজন চলিতে লাগিল।

তারাবাঈ ০৬ পরিচ্ছেদ

অন্তঃপুরস্থ একটি অট্রালিকার সজ্জিত কক্ষে তারাবাঈ একটি জানালার ধারে বসিয়া গভীর চিন্তাসাগরে নিমগ্ন। তারাবাঈয়ের সখী মঞ্জরীমালা এবং ধাত্রী সারদা উভয়ের গাঢ় নিদ্রায় নিদ্রিত। ছটায় সমস্ত ক আলোকিত করিয়া জাগিয়া জাগিয়া কি যেন চিন্তা করিতেছে। বাতায়ন-পথে হেমস্তের ঈষৎ শীতল সমীরণ ধীর গতিতে প্রবাহিত হইয়া যুবতীর কুঞ্চিত অলকরাজি এবং চেলাঞ্চল লইয়া ক্রীড়া করিতেছে।

যুবতী যেমনি সুন্দর সুঠাম, তেমনি বেশ তেজস্বিনী অথচ মূর্তিবিশিষ্ট। যুবতী শিশিরসিক্ত বালার্কের নব অরুণিমা-রাগ-রঞ্জিত বস্‌রাই গোলাপের ন্যায় মনোহর! অথবা শারদীয় ঊষার ন্যায় চিত্তহারিণী। সমগ্র মহারাষ্ট্রে তারাবাঈয়ের ন্যায় সুন্দরী যুবতী আর একটি আছে কি-না সন্দেহ। তারাবাঈকে দেখিলে, তাহাকে আদৌ মারাঠা-কন্যা বলিয়া বোধ হইত না। মনে হয়ত, যেন কোনও ইরাণী-সুন্দরী মারাঠী পরিচ্ছদে দেহ সাজাইয়া অন্তঃপুর আলো করিয়া বিরাজ করিতেছে। যৌবনসমাগমে তারা বর্ষার নদীর ন্যায়, বসন্তের গোলাপের ন্যায়, শরতের পদ্মে‌র ন্যায়, ঊষার তারকার ন্যায়, পরিপুষ্ট, কমনীয়, লোভনীয় এবং শোভনীয় হইয়াছে! তাহার অন্তরের চন্দ্রদর্শনে নদনদী সমুদ্রের স্থির জল যেমন স্ফীত হইয়া উঠে, তারাবাঈয়ের স্থির অচঞ্চল হৃদয়ও আজ তেমনি অসাধারণ সৌন্দর্যশালী পুরুষত্ব আফজাল খাঁকে দর্শন করিয়া প্রেমানুরাগে অধীর ও আকুল হইয়া উঠিয়াছে। যে মালোজীর সঙ্গে তারার বিবাহের কথা হইয়াছে, যে মালোজীর বীরত্বের কথা শুনিয়া এবং বীর্যপুষ্ট-দেহ-কান্তি এবং রূপশ্রী দেখিয়া তারাবাঈ মুগ্ধ হইয়াছিল, আজ সেই মালজীর শ্রী ও কান্তি তারার কাছে তেমন চিত্তবিনোদন বলিয়া আর প্রতিভাত হইতেছে না। তারা মনে মনে তাহার ইষ্টদেবতা শঙ্করকে ধন্যবাদ দিতে লাগিল যে, মালোজীর সহিত বিবাহের পূর্বেই সে আফজাল খাঁর ন্যায় পুরুষরত্নের দর্শন পাইয়াছে। আশার সহিত দারুণ নিরাশায় তাহার চিত্ত ঝঞ্জানিল-সন্তাড়িত সরসীর ন্যায় উদ্বেলিত হইয়া উঠিয়াছে।

আফজাল খাঁকে দেখিয়া তারা হৃদয়-মন তাঁহার চরণতলে লুটাইয়া পড়িয়াছে। কিন্ত হায়! প্রকাশ্যে তাহা উৎসগ করিবার কোনও উপায় হইবে কি? পিতার শক্রপক্ষীয় সেনাপতির প্রতি অনুরাধ, কি ভয়ানক কথা! কি অসম্ভব ব্যাপার! তারাবাঈ প্রেমোদ্বেল চিত্তকে নানা প্রকারে শান্ত ও সংযমিত করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিল; কিন্তু কৃতকার্যতার অপেক্ষা পরাজয়ের মাত্রাই আরও বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তারা বড়ই বিপদে উজ্জ্বল ও তাঁহার প্রতি প্রেমাশক্তি ততই শত গুণে দৃঢ় বদ্ধমূল হইতে লাগিল। তারার দুই কপোল বহিয়া অশ্রুধারা মুক্তাধারার ন্যায় গড়াইয়া পড়িতে লাগিল।

তারা যতই পাঠান বীরকে ভুলিবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিল, মন ততই বলিতে লাগিল, আহা! তাঁহাকে কি ভোলা যায়! কি চমৎকার মোহিনী মূর্তি! মরি! মরি! কি রূপেরই বাহার! কি কান্তির ছটা! কি তেজঃ! কি সাহস! কি স্ফূর্তি! যেন সাক্ষাৎ কার্তিক। কি লাবেণ্যর জোয়ার! কি ভুবনভুলানো অক্ষিযুগল! এমন নব্য যুবক, এমন সুঠাম ও সুশ্রী তিজস্বী পুরুষ! হায়! উহার চরণে আত্মবলিদানেও যে সুখ! উহার কথা স্মরণ করিতেও যে হৃদয় অমৃতরসে সিক্ত হইয়া যায়।

তারাবাঈ আফজাল খাঁকে ভুলিবার জন্য চেষ্টা করিয়া, আফজাল খাঁর প্রেমোম্মাদনায় আরও উন্মুত্ত হইয়া পড়িল। ধৈর্যের বাঁধ একেবারেই ভাঙ্গিয়া গেল! মনে হইতে লাগিল, কিসে যেন হৃৎপন্ডিটাকে আফজাল খাঁর দিকে সবেগে আকর্ষণ করিতেছে! তাহার শরীরের অণু-পরমাণু যেন শরীর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আফজাল খাঁর প্রতি ছুটিয়া যাইতে চাহিতেছে! কি ভীষণ ব্যাপার! কি অভূর্তপূর্ব ঘটনা! যুবতী বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হইয়া পড়িল! বস্তুতঃ প্রেমের আকর্ষণের নিকট সকল আকর্ষণই পরাস্ত! প্রেমের প্রভাবের নিকট সকল প্রভাবকেই খর্ব হইতে হয়। মানব ক্ষুদ্র জীব! তাহার হৃদয়টি আরও ক্ষুদ্র! কিন্তু এই ক্ষুদ্র হৃদয়-সঞ্জাত প্রেমের ধারা সারা বিশ্বকে ভাসাইয়া দিতে পারে।

এই প্রথম যৌবনের প্রথম প্রেমের উচ্ছ্বসিত আবেগে তারা অধীর ও আকুল হইয়া উঠিল! তারাবাঈ আকুল প্রাণ লইয়া ঘরের বাহির হইয়া পড়িল। এদিকে সেদিকে, প্রাঙ্গণের ধারে, দীঘির পাড়ে চিন্তা-ভারাক্রান্ত চিত্তে ভ্রমণ করিতে লাগিল! আর পুনঃ পুনঃ তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে আফজাল খাঁর অবস্থান অট্রালিকার দিকে দৃকপাত করিতে লাগিল। তারা বেড়াইতেছে কিন্তু হৃদয়ের উদ্বেগ ও কামনার আগুন তাহাকে উন্মত্ত প্রায় করিয়া রাখায় কিছুতেই সাশন্ত পাইতেছে না। তারা ক্রমশ বেড়াইতে বেড়াইতে আপন মনে বাগানের দিকে চলিল। যাইতে যাইতে ক্রমণ বাগানটির রমণীয় সৌধের নিকটবতী হইল। সৌধ দেখিয়া মনে হইল, এই নির্জন সৌধ আফজাল খাঁকে পাইলে সে অশ্রুজলে তাঁহার পদতল অভিষিক্ত করিয়া দিত। কিন্তু হায়! তাহার গগ্ধ অদৃষ্টে এ সুযোগ কখনও জুটিবে কি? এইরূপ চিন্তা করিতে করিতে সেই নির্জন সৌধের যেমনি নিকটবর্তী হইল, অমনি শুনিতে পাইল “আফজাল খাঁকে সেরূপেই হউক, হত্যা করতে হবে। শক্রকে ছলে-বলে-কৌশলে যেকোনও প্রকারে হত্যা করা পরম ধর্ম।”

সহসা বজ্রাঘাত হইলেও তারাবাঈ কখনও এরূপ চমকিত ও আতঙ্কিত হইত না। তারার প্রেমের পাত্র আফজাল খাঁর হত্যার সিদ্ধান্ত শুনিয়া তাহার হৃদয়ের স্পন্দন যেন রুদ্ধ হইয়া গেল! একজন মহা পরাক্রান্ত মতাশালী সেনাপতিকে প্রবৃত্তি এবং ভীষণ হীনতা যে মানুষের মনে স্থান পাইতে পারে, ইহা কিছুতেই সেই সরলা তরলা প্রেমাবিহবলা কুমারীর পক্ষে বুঝিয়া উঠা বা ধারণা করা সজন ছিল না। তাহার পিতা শিবাজী ডাকাতি করেন বটে, কিন্তু এমনি করিয়া ছলনা-পূর্বক যে ঠগীর ন্যায় নির্দোষ ব্যাক্তির প্রাণবধ করিতেও পটু, তাহা জানিতে পারিয়া পিতার প্রতি বিষম ঘৃণা ও অশ্রদ্বার ভাবে হৃদয়ে ব্যথিত হইয়া উঠিল!

এক্ষণে কিরূপে তাহার হৃদয়-আকাশের শরচ্ছন্দ্রমা, জীবন-উদ্যানের রসালবৃক্ষ আফজাল খাঁকে হত্যাকান্ড হইতে রক্ষা করিবে, তচ্ছিন্তায় শিবাজী-নন্দিনী যৎপরোনাস্তি আকুল হইয়া উঠিল। নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়াও তাহার আকাঙ্খিত প্রেম-দেবতা আফজাল খাঁকে দস্যুধর্মী পিতার নিদারুণ ষড়যন্ত্র এবং নৃশংস হত্যাকান্ড বাঁচাইবার জন্য তারাবাঈ ব্যস্ত হইয়া উঠিল।

মানব-হৃদয়ে যখন নবীন প্রেমের সঞ্চার হয়, তখন উহা গিরিগুহা-নির্গত তরঙ্গিণীয় ন্যায় তীব্রবেগে প্রবাহিত হয়। বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া ছুটিতে থাকে। নদীর সম্বন্ধে-

“পর্বত-গৃহ ছাড়ি,
বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে
কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?”

ইহা যেমন সত্য, প্রেমের সম্বন্ধেও তেমনি নীচের কবিতাটি অটুট সত্য।

মানস কন্দর হ’তে যৌবন-ঊষায়,
যে প্রেমের মন্দাকিনী কারো পানে ধায়,
কার সাধ্য তার গতি করে অবরোধ?
রোধিতে যে চায়, সেই নিতান্ত নির্বোধ!
বায়ু জল উল্কা তীর কত ধরে বেগ
তাহার অধিক জান প্রেমের উদ্বেগ!
প্রেমের সমুখে হায়! কঠিন পাষাণ
হ’য়ে যায় সুকোমল ফুলের সমান!
সাগর গোস্পদ হয়, মরু হয় বন,
দুঃখে উপজয় সুখ, মরণে জীবন!
যত দুঃখ যত কেশ যত নির্যাতন,
প্রেম করে সকলেরে সুধা-প্রস্রবণ!
বিষেরে অমৃত করে, আঁধারে আলোক,
নরকেরে স্বর্গ করে বিষাদে পুলক,
আপনারে ভুলে যাওয়া পরের কারণ
ইহাই প্রেমের বটে প্রথম লণ।
দ্বিতীয় লণ শুধু স্মরণ, সেবন
প্রেমাস্পদ হেতু শেষে আনন্দে মরণ!

তারাবাঈ নিঃশব্দ পদ-সঞ্চারে প্রাচীরের গায়ে কান লাগাইয়া রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শিবাজীর সমস্ত পরামর্শ শ্রবণ করিল। আফজাল খাঁকে হত্যা করিবার জন্য ষড়যন্ত্রের সমস্ত মন্ত্রণা শুনিয়া ব্যাকুল চিত্তে চরণে তথা হইতে প্রস্থান করিল।

তারাবাঈ ০৭ পরিচ্ছেদ

তরুণ অরুণের কনক-কিরণ-রাগে চতুর্দিকে আলোকিত হইয়াছে। প্রভাত-পবন-বনভূমির স্বভাবজাত কুসুমগন্ধ বহন করিয়া মৃদুমন্দ সঞ্চরণ করিতেছে। শিশির-সিক্ত পাতায় পাতায় সূর্যের রশ্মি পতিত হইয়া শ্যামলিমার অঙ্গে লালিমার কি অপূর্ব বাহার খুলিয়াছে! নানাজাতীয় বিচিত্র-বর্ণ-বিচিত্র-পক্ষ সুধাকণ্ঠ বিহঙ্গগণ কুজন-লহরীতে বিশাল আরণ্য প্রকৃতিকে মুখরিত এবং পুলকিত করিয়া তুলিয়াছে! এমন সময়ে কৃষ্ণগড় ও রায়গড়ের সীমানাস্থিত অরণ্যে মৃগয়ার জন্য শিবাজী এবং আফজাল খাঁ কতিপয় শিকারী অনুচর, বহুসংখ্যক কুক্কর, বাজপী ও পালিত চিতা বাঘ সহ প্রবেশ করিলেন। পঞ্চাশটি হস্তী শিকারী ও শিকারের সরঞ্জাম বহন করিয়া নিবিড় অরণ্য তোলপাড় করিয়া ক্রমশঃ গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করিল। হস্তিযুগল ভয়ে বিহঙ্গগণ ত্রাসিত হইয়া চতুর্দিকে ছত্রভঙ্গ অবস্থায় উড়িতে লাগিল। মৃগ, কৃষ্ণসার ও অন্যান্য আরণ্যজন্ত চতুর্দিকে ভয়ে ছুটিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। শিকারীগণ কেহ তীর, কে বা বন্দুকের দ্বারা মৃগ শিকার করিতে লাগিল।

শিকার করিতে করিতে ক্রমশঃ আফজাল খাঁ এবং শিবাজী একটি ক্ষুদ্র পাবর্ত-নদীর তটে গভীর বনে উপস্থি হইলেন। এই নিবিড় বনের একটানা শ্যামল-শোভা-দেখিয়া আফজাল খাঁ নিতান্তই বিমোহিত হইলেন। এই বনে সিংহ বাস করিত বলিয়া সাধারণ শিকারীরা প্রায় এ-দিকে পদাপর্ণ করিত না। কিন্তু আফজাল খাঁর সিংহ এবং ব্যাঘ্র শিকারের অপরিমিত কৌতূহল ছিল বলিয়া এই বনে স্বেচ্ছায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বনের নিবিড় প্রদেশে উপস্থিত হইয়া আফজাল খাঁ দুই হস্তে বক্রমুখ ক্ষুদ্রাকৃতি দুইখানি তরবারি ধারণপূর্বক হস্তিপৃষ্ঠ হইতে অবতরণপূর্বক দুইজন অনুচর সহ পদব্রজে বনের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। এই সিংহ-নিবাস বনে প্রবেশ করিতে অনেকেরই অমত ছিল। কিন্তু পাঠান বীর আফজাল খাঁর জ্বলন্ত উৎসাহ এবং দৃঢ়তার নিকট সকলের আপত্তি ও ভীতি প্লাবনের মুখে তৃণগুচ্ছের ন্যায় ভাসিয়া গেল। আফজাল খাঁর পশ্চাতে আরও পাঁচজন বীরপুরুষ তরবারি মাত্র হস্তে ধারণ করিয়া সেই শ্বাপদ-সঙ্কুল ভয়াবহ বনে প্রবেশ করিলেন। শিবাজী এবং তাঁহার অন্যান্য মারাঠা অনুচর এবং আফজাল খাঁর সঙ্গীয় অন্যান্য যোদ্ধা ও শিকারী হস্তিপৃষ্ঠে সেই নিবিড় বনের মধ্যে খাঁ সাহেবের পশ্চাৎ পশ্চাৎ প্রবেশ করিল।

বনের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সকলেই প্রকান্ড শাল, গজারী, দেবদারু, তমাল, তাল প্রভৃতি বৃক্ষ দর্শনে স্তম্ভিত হইলেন। বহুকালের বৃক্ষরাজিতে পরিপূর্ণ হইয়া এই নিবিড় বন যার-পর-নাই গম্ভীর দৃশ ধারণ করিয়াছিল। এই কারণে সূর্যরশ্মি কদাচিৎ প্রবেশ করিত। আফজাল খাঁ অনুচর পঞ্চকসহ সেই নিবিড় বনে সিংহ শিকারের জন্য তরবারি হস্তে ক্রমশঃ ধীরে ধীরে জঙ্গল ভাঙ্গিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। অগ্রসর হইতে হইতে এক ক্ষুদ্র পবর্তমূলে একটি গুহার সম্মুখীন হওয়া মাত্র সহসা দুইটি সিংহ ভীষণ গর্জনে অরণ্যভূমি প্রকম্পিত করিয়া উল্লস্ফপূর্বক আফজাল খাঁর উপর পতিত হইবার উপক্রম করিল। তখন মহাবীর আফজাল খাঁ এবং সহচরগণ মুহুর্ত মধ্যে সাবধান হইয়া দৃঢ়মুষ্টিতে সিংহ লক্ষ্যে তরবারি ধারণ করিলেন। এই সময় বীরবর আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সঙ্গীদের বদনে অপূর্ব দৃঢ়তা এবং বীরত্বের তেজঃ অতি চমৎকাররূপে ফুটিয়া উঠিল। সিংহ আফজাল খাঁর উপরে পতিত হইবার প্রাক্কালে মহাসাহসী আফজাল খাঁ তরবারির প্রচন্ড আঘাতে সিংহের গ্রীবাচ্ছেদন করিয়া লস্ফ প্রদানপূর্বক দূরে সরিয়া দাঁড়াইলেন। সিংহিনীও আফজাল খাঁ সরিয়া যাওয়ার তাঁহার উপরে আপতিত হইতে না পারিয়া মুহুর্তের জন্য স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইল এবং পর মুহুর্তেই লম্ফ প্রদানপূর্বক বিদ্যুদ্বেগে আফজাল খাঁর বাম বাহুর উপরে পতিত হওয়া মাত্রই খাঁ সাহেব দক্ষিণ হস্তের অসির ভীষণ আঘাতে সিংহিনীর মস্তক বিদ্ধ করিয়া ফেলিলেন।

অর্ধহস্ত পরিমিত তরবারির অগ্রভাগ সিংহিনীর মস্তক মধ্যে প্রবেশ করায় সে ভীষণ হুঙ্কার করিয়া দূরে যাইয়া পতিত হইল। আফজাল খাঁ অসির দ্বিতীয় আঘাতে সিংহিনীটিকেও দ্বিখন্ড করিয়া ফেলিলেন। সকলে আফজাল খাঁর সাহস এবং কৌশল দেখিয়া বিস্মিত এবং স্তম্ভিত হইয়া মুক্তকণ্ঠে ‘সাবাস! সাবাস!’ করিতে লাগিল।

আফজাল খাঁর বাম বাহুতে সিংহিনীটা একটু নখর বসাইয়া দিয়াছিল, সেখানে কিঞ্চিৎ চূর্ণ ঔষধ প্রয়োগ করিয়া পট্রি বাঁধিয়া দেওয়া হইল।

সকলে আফজাল খাঁকে বনপ্রবেশে নিরস্ত হইতে বলিলে, তিনি স্মিত হাস্য করিয়া বিপুল উৎসাহে আরও সম্মুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। এদিকে হস্তিপৃষ্ঠে থাকিয়া শিবাজী এবং অন্যান্য বীরপুরুষ ও শিকারীগণ বহু মৃগ, চিতা, বন্য-কুক্কুট, ময়ূর ও অন্যান্য পক্ষী শিকার করিলেন। অতঃপর দ্বিপ্রহর সমাগমে সকলে এক মনোহর উপত্যকায় উপনীত হইয়া আহারের আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন।

এইস্থলে নির্মল ও বিশুদ্ধ জলের একটি ঝরণা হইতে অতি বেগে জলরাশি উঞ্ছগত হইতেছিল। ছায়াযুক্ত প্রকান্ড প্রকান্ড বৃসমূহ বিরাজমান থাকায় চন্দ্রাতাপের কার্য সাধিত হইল। সঙ্গে তাম্বুর অভাব না থাকিলেও তাহা খাটাইবার কোনও প্রয়োজন বোধ হইল না। মারহাট্টা এবং মুসলমানগণ পৃথক পৃথক স্থানে মৃগয়ালব্দ নানা জাতীয় মৃগ ও পক্ষিমাংসের কাবাব, কোফ্‌তা এবং কোরমা প্রস্তুতপূর্বক উদরপূর্তি করিলেন। ঝরণার জল পান করিয়া সকলেই তৃপ্ত হইলেন।

কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিবার পরে সূর্যের তেজঃ কিছু মন্দীভূত হইলে, আফজাল খাঁ এবং শিবাজী দলবল সহ হস্তিপৃষ্ঠে কৃষ্ণগড়ের সীমান্তের দিকে মৃগয়া করিতে করিতে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। সূর্যাস্তের কিঞ্চিৎ পূর্বে এক বনের ভিতর দিয়া যাইবার সময় সহসা একটি প্রকান্ডকায় ভীষণ ব্যাঘ্র একটি উচ্চ ভূখন্ড হইতে লম্ফ প্রদানপূর্বক একেবারেই শিবাজীর উপর পতিত হইল! হঠাৎ ব্যাঘ্রের আক্রমণে শিবাজী যার-পর-নাই আড়ষ্ট এবং হতবুদ্ধি হইয়া হস্তিপৃষ্ঠ হইতে ভূপতিত হইলেন। ব্যাঘ্ররাজ শিবাজীর গ্রীবা ভাঙ্গিয়া রক্তপান করিবার উদ্যোগ করায় চতুর্দিকে একটি ভীতিজনক অস্ফুট রব উত্থিত হইল। শিবাজীর হস্তের তরবারিখানি ভূপতিত হইবার সময়ে দূরে ছিটকাইয়া পড়িয়াছিল। কোষে আর একখানি তরবারি থাকিলেও শিবাজী ভয়ে মূর্চ্ছিত হইয়া আত্মরক্ষার উদযোগ করিতে অসমর্থ ছিলেন।

সকলেই শিবাজীর আসন্নমৃত্যু কল্পনা করিয়া যখন ভীত ও ব্যাকুল হইতেছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে সকলে বিস্ময়-বিস্ফোরিত-নেত্রে দেখিতে পাইল যে, মহা সাহসী আফজাল খাঁ হস্তিপৃষ্ঠ হইতে তরবারি হস্তে বেগে লম্ফ প্রদানপূর্বক ভূমিতলে দন্ডায়মান হইবার পূর্বেই প্রচন্ড আঘাতে ব্যাঘ্ররাজকে দ্বিখন্ড করিয়া মূর্চ্ছিত শিবাজীকে ভূমি হইতে উত্তোলন করিলেন। চতুর্দিকে হইতে হর্ষ-রসাপ্লুত কণ্ঠে “সাবাস! সাবাস!” শব্দ উত্থিত হইল।

আফজাল খাঁর সাহস, কার্যতৎপরতা এবং সত্বরতা দেখিয়া সকলেই অবাক হইয়া গেল! শিবাজী ভক্তিগদ্‌গদ্‌ কণ্ঠে তাঁহার প্রাণদাতা বীরবরকে পুনঃ পুনঃ মুক্ত কণ্ঠে ধন্যবাদ দিতে লাগিলেন। নিজের আসন্ন মৃত্যুর আশঙ্কা জানিয়াও যিনি পরের প্রাণ রক্ষার জন্য ভীষণ ব্যাঘ্রের মুখে লম্ফ প্রদানপূর্বক পতিত হইতে পারেন, তাঁহার বীরত্ব ও পরহিতৈষণার তুলনা কোথায়?

এই ঘটনার পরে আফজাল খাঁর লোকজন আর অগ্রসর না হইয়া রায়গড়ে ফিরিয়া যাইবার জন্য মত প্রকাশ করিলেও, শিবাজী অত্যন্ত আগ্রহতিশয্যে পুনঃ পুনঃ কৃষ্ণগড়ের প্রান্ত পর্যন্ত যাইবার জন্য জেদ ও উৎসাহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তাঁহার উৎসাহে মহাবীর আফজাল খাঁ সাহেব উৎসাহিত হইয়া আরও অগ্রসর হইয়া রাত্রি যাপনের মত প্রকাশ করিলেন, সুতরাং শিকারীর দল আবার অগ্রসর হইতে লাগিল।

বেলাও তখন খুব বেশি ছিল না। খুব দ্রুত গমন করিলেও এক প্রহর রাত্রির পূর্বে কৃষ্ণগড়ের প্রান্ত পর্যন্ত উপস্থিত হইবার কোনই আশা ছিল না। সুতরাং মাহুতেরা হস্তিযুথকে খুব দ্রুত গমনের জন্য বিশেষ তাড়া করিল। কিয়দ্দূর অগ্রসর হইবার পর সকলেই বিস্মিত দৃষ্টিতে দর্শন করিল যে, নিবিড় অরণ্যানীর মধ্য হইতে সহসা সর্বাঙ্গ-বর্মমন্ডিত একজন অশ্বারোহী এক ক্ষুদ্র পর্বতের পার্শ্ব হইতে আফজাল খাঁর সম্মুখীন হইয়া অভিবাদনপূর্বক এখখানি পত্র প্রদান করতঃ পর মুহূর্তেই বিদ্যুদ্বেগে অশ্বচালনা করিয়া সেই নিবিড় বনের অন্তরালে অদৃশ্য হইয়া গেল। আফজাল খাঁ পত্র পাঠ করিয়া তাহাকেও কিছু না বলিয়া অগ্রসর হইতে লাগিলেন। জনৈক পার্শ্বচর পত্রের কথা জিজ্ঞাসা করিলে আফজাল খাঁ বলিলেন যে, পত্রখানি বিজাপুর হইতে আসিয়াছে। সোলতান তাঁহাকে শীঘ্রই রাজধানীতে ফিরিবার জন্য লিখিয়াছেন।

শিবাজী সহসা সেই অশ্বারোহীদের আগমন এবং দ্রুত গমনে কিঞ্চিৎ বিচলিত হইয়া কয়েকজন সৈনিককে তাহার অনুসরণ করিবার জন্য ইঙ্গিত করিলেন। কয়েকজন সৈনিককে কয়েকজন মারাটী অশ্বারোহী সেই অশ্বারোহীর পশ্চাদ্ধবনের উপক্রম করায় আফজাল খাঁ কঠোর দৃঢ়তার সহিত তাহাদিগকে নিবারণ করিয়া বলিলেন যে, অশ্বারোহী বিজাপুর সোলতানের খাস সংবাদবাহক। তাহাকে সন্দেহ করিবার কিছুই নাই। সুতরাং অশ্বারোহীগণ আর তাহার পশ্চাদ্ধাবিত হইল না। কিঞ্চিৎ অগ্রসর হইবার পরে আফজাল খাঁ শিবাজীর পশ্চাতে পড়িবার চেষ্টা করিয়া শিবাজীকে বলিলেন, “এখানের পথ নিতান্তই সঙ্কীর্ণ বিশেষতঃ অন্ধকার হয়ে আসছে, আমার মাহুত ভাল দেখতে পাচ্ছে না, আপনার হাতীটাকে আগে চালান। তা’ হ’লে আমার হাতী তার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাওয়ার সুবিধা পাবে।”

শিবাজী অত্যন্ত সঙ্কুচিত হইয়া বলিলেন, “হায়! তাও কি হায়! আপনাকে পিছে রেখে আমি অগ্রে যাব, তা’ তখনও মনে করবেন না। আমা দ্বারা এরূপ বে-আদবী কখনও হবে না।”

আফজাল খাঁ হস্তী থামাইয়া শিবাজীকে অনেক পীড়াপীড়ি করিলেন; কিন্তু শিবাজী কিছুতেই অগ্রগমনে সম্মত হইলেন না। সুতরাং অগত্যা আফজাল খাঁই পূর্বের ন্যায় অগ্রগামী হইলেন। এক সঙ্কীর্ণ গিরিবর্ত্মের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া আফজাল খাঁ শিবাজীকে আবার অগ্রগমনের জন্য পীড়াপীড়ি করিলেন। শিবাজী পুনরায় অস্বীকৃত হইলেন। আফজাল খাঁ তখন সেইস্থলে হস্তী হইতে অবতরণপূর্বক সঙ্গী সৈন্যদিগকে আহবান করিয়া বলিলেন, “তোমরা কয়েক খন্ড গুরুভার প্রস্তর এই রাস্তার উপর দিয়ে সাবধানে সম্মুখের দিকে গড়িয়ে লয়ে যাও। এই রাস্তায় ঘোড়াডুবি-গর্ত আছে।”

তারাবাঈ ০৮ পরিচ্ছেদ

আফজাল খাঁর আদেশ মাত্রই কতিপয় সৈন্য দুইটি গুরুভার প্রস্তর গড়াইয়া কিয়দ্দূর লইয়া যাইতেই সহসা এক খন্ড প্রস্তর শ্যামল দুর্বাযুক্ত মৃত্তিকা ভেদ করিয়া ভীষণ শব্দে নিন্মে পতিত হইল। এই ভীষণ ও ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা দেখিয়া সকলেই শিহরিয়া উঠিল। আফজাল খাঁর সর্বনাশ সাধনের জন্যই যে, এই ভীষণ ষড়যন্ত্র করা হইয়াছে, তাই বুঝিতে কাহার ও আর বাকি থাকিল না। এই ভীষণ ষড়যন্ত্র লাইয়া বিশেষ আলোচনা হইবার পূর্বেই শিবাজী সহসা এক বংশীধ্বনি করিলেন। সেই বংশীধ্বনির সঙ্গে সঙ্গেই বহুসংখ্যক লুক্কায়িত মাওয়ালী সৈন্য, প্রতি প্রস্তর খন্ড, প্রতিবৃক্ষ ও প্রতি ঝোপের আড়াল হইতে নির্গত আক্রমণ চতুর্দ্দিক হইতে আফজাল খাঁ এবং তাঁহার মুষ্টিমেয় দেহরক্ষী সৈন্যকে ভীষণভাবে আক্রমণ করিল। অগণ্য হস্তী বা মহিষযুথ কর্তৃক আক্রান্ত হইলে সিংহ ভীষণ প্রদীপ্ত হওয়া উঠে, আফজাল খাঁ এবং তৎসঙ্গিগণও সেইরূপ রোষে-দুঃখে প্রোজ্জ্বলিত হুতাশন প্রায় নিতান্ত প্রদীপ্ত হইয়া ভীষণ তেজে উলঙ্গ কৃপাণ করে অরাতি নিধনে প্রমত্ত হইলেন। সন্ধ্যার তরল অন্ধকার তাঁহাদের কাফের-শোণিত-পিপাসু তরবারি বিদ্যুৎ চমন প্রদর্শন করিতে লাগিল। ত্রিশজন মোসলেম প্রায় দুই সহস্র শক্রর বিরুদ্ধে যুঝিতে লাগিল।

এই সঙ্কীর্ণ গিরিবর্ত্মের সম্মুখস্থ মাওয়ালী সৈন্যগণের ভিড় ঠেলিয়া এবং প্রচন্ড প্রহারে তাহাদিগকে তরল পারদের ন্যায় চঞ্চল করিয়া আফজাল খাঁ সেই গিরিপথের মধ্যে প্রবেশ করতঃ আত্মরক্ষা করিবার জন্য বিপুল চেষ্টা ও উদ্যোগ করিলেন।

আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সৈন্যগণ কেহই বর্মপরিহিত ছিলেন না। সুতরাং শরীরের নানাস্থানে গুরুতর আঘাত প্রাপ্ত হইয়া সন্ত্রস্ত সিংহের ন্যায়, পবনাহত পাবকের ন্যায়, উন্মত্ত কুঞ্জরের ন্যায়, আহত ফণীর ন্যায়, সমুদ্রের তরঙ্গের ন্যায়, ভীষণ বাতাবর্তের ন্যায়, নিতান্ত উগ্র এবং একান্ত আত্মবিস্মৃত হইয়া তেজঃদৃপ্ত ও সংহারক হইয়া পড়িলেন! “দীন দীন” রবে ভীষণ গর্জন ও হুঙ্কার করিয়া শক্র বধ করিতে লাগিলেন। ভীষণ ও অসম যুদ্ধে দশজন মোসলেম বীরপুরুষ নিহত হইলেন। মারাঠীদিগের প্রায় অর্ধেক সৈন্য নিহত হইয়া ভূপতিত হইল। তথাপি রণে ভঙ্গ না দিয়া আফজাল খাঁকে নিহত বা বন্দী করিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিল। ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার বিচ্ছিন্ন করিয়া চন্দ্রের জ্যোৎস্নাজাল পৃথিবীকে আলোকিত করিয়া তুলিল। আফজাল খাঁ বিশ্বাসঘাতক ও বেইমান শিবাজীর প্রতি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া প্রতিহিংসা সাধন মানসে, শক্রশ্রেণী ভেদ করিয়া তাঁহার প্রতি অভিদ্রুত হইলেন। কিন্তু আর উপায় নাই দেখিয়া সন্মান রক্ষার্থ মরিয়া হইয়া ভল্ল বিস্তারপূর্বক তেজের সহিত ফিরিয়া দাঁড়াইলেন। বহুসংখ্যক মাওয়ালী ও মারাঠী যোদ্ধা আসিয়া আফজাল খাঁর ভীষণ আক্রমণ হইতে দস্যুপতি শিবাজীকে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহাকে মন্ডলাকারে বেষ্টন করিয়া দাঁড়াইল। আফজাল খাঁকে লক্ষ্য করিয়া সকলেই ভীষণ বেগে বিষাক্ত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিল। কয়েকটি তীর আফজাল খাঁর স্কন্ধে এবং শরীরের নানাস্থানে বিদ্ধ হইলেও, পুরুষসিংহ তৎপ্রতি কিছুমাত্র ভ্রূক্ষেপ না করিয়া দুর্বিসহ পরাক্রমে শক্র হনন করিতে লাগিলেন। দুর্দ্দমতেজঃ প্রভাবে শিবাজীর দেহরী কতিপয় দস্যুযোদ্ধার মস্তক ছেদনপূর্বক শিবাজীর প্রতি মালেকল মউতের জিহবার ন্যায় ভয়াবহ রক্তরঞ্জিত তরবারি প্রসারণ করিয়া ধাবমান হইলেন। কিন্তু সহসা একটি বিষাক্ত তীর তাঁহার পেশানীতে বিদ্ধ হইল। রক্তধারায় মুহূর্তমধ্যে তাঁহার মুখমন্ডল এবং মনোহর শ্মাশ্রুরাশি আপ্লুত হইয়া গেল। যন্ত্রণায় তিনি অধীর ও বিপন্ন হইয়া পড়িলেন। শিবাজী এবং তাঁহার সঙ্গী যোদ্ধাগণ ভীষণভাবে প্রাণপণ করিয়া আফজাল খাঁকে আক্রমণ করিতে লাগিল।

আফজাল খাঁ সেইরূপ জখমী অবস্থাতেও দুর্জয় বাহুবলে কয়েকজন মারাঠী দস্যুকে নিধন করিয়া শিবাজীকে প্রচন্ড তরবারি প্রহার করিত উদ্যত হইলেন। কিন্তু বহু রক্তপাতে ও বিপুল পরিশ্রমে সহসা মূর্চ্ছিত প্রায় হইয়া ভূপতিত হইলেন।

সোলেমান খাঁ নামক জনৈক বীরপুরুষ অগ্রসর হইয়া আফজাল খাঁর দেহ রক্ষায় প্রবৃত্ত হইলেন। আফজাল খাঁকে ভূপতিত দেখিয়া শিবাজী এবং অন্যান্য দস্যুগণ তাঁহার শিরচ্ছেদ মানসে মাংস-লোলুপ শকুনির ন্যায় ছুটিয়া আসিল। সোলেমান খাঁ গুরুতরূপে আহত হইয়া শক্তির চরম বিন্দুতে নির্ভর করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। কিন্তু আর রক্ষা করা অসম্ভব! মোসলেম সৈনিকগণ প্রায় সকলেই নিহত কিংবা গুরুতররূপে আহত হইয়া ভূতলশায়ী। যে দুইজন বাঁচিয়া আছে, তাহারাও বহুদূরে আফজাল খাঁ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। সাংঘাতিকরূপে আহত সোলেমান খাঁ মাথা আর ঠিক রাখিতে পারিতেছেন না! হস্ত শিথিল হইয়া আসিতেছে।

এমন সময় সহসা সমস্ত কোলাহল নিবারণ করিয়া অতি ঘন চটাপট অশ্বপদ ধ্বনি শ্রুত হইল। দেখিতে দেখিতে পঞ্চাবিংশতি মোসলেম বীর পুরুষ বিদ্যুৎ গতিতে ভীষণ তরবারি হস্তে সংহারক বেশে শিবাজীর সৈন্যদলের উপর প্রচন্ড বার্তাবর্ত কিংবা সামুদ্রিক উচ্চড ঊর্মির ন্যায় ছুটিয়া পড়িল। তাহার সকলেই বর্মমন্ডিত ছিল। একজন যুবক বীরপুরুষ ভীষণ তেজে শিবাজীর উপরে আসিয়া পড়িলেন! তরবারির ভীষণ আঘাতে শিবাজীর লৌহ-ঢাল বিদীর্ণ করিয়া তাঁহার মস্তক আহত করিয়া ফেলিল।

শিবাজী ভীষণ চীৎকার করিয়া দ্রুত অশ্ব ধাবন করতঃ প্রাণ রক্ষার্থে জঙ্গলের অভ্যন্তরে পলায়ন করিলেন। অত্যল্প সময় মধ্যেই সমরক্ষেত্র নির্জন হইয়া পড়িল। শীতল জলধারা অনবরতঃ মস্তকে বর্ষণ করায় এবং তস্থানে প্রলেপ দিয়া পাটি বাঁধিয়া দেওয়ায় অল্পণ মধ্যেই আফজাল খাঁর চৈতন্য সঞ্চার হইল। অতঃপর তাঁহাকে এবং আহত মোসলেম সৈন্যদিগকে কোনওরূপে অশ্বপৃষ্ঠে সমারূঢ় করিয়া কৃষ্ণগড়ের কেল্লার দিকে আগন্তুক বীর-পুরুষ অগ্রসর হইবার উপক্রম করিলে, আফজাল খাঁ বলিলেন, “হে বীরপুরুষ! আপনার দয়া ও মহানুভবতা অপরিসীম! আপনার ঋণ অপরিশোধ্য! আপনার সহানুভূতি অতুলনীয়! আপনি মঙ্গলের জন্যই আমাকে কৃষ্ণগড়ের দুর্গে লয়ে যেতে চাচ্ছেন, আমি সেজন্য আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। কিন্তু, হে মিত্রবর! আপনার ন্যায় মহাজন ও বন্ধুজনের পরিচয় প্রদান করলে প্রাণের ভিতরে গভীর শান্তি ও আরাম পাব।”

আগন্তক বীর পুরুষ কিয়ৎকাল নীরবে দন্ডায়মান রহিলেন। অতঃপর বামাকণ্ঠে সকলের বিস্ময় উৎপাদনপূর্বক বলিলেঃ “মহানুভব সেনাপতে! আমার পরিচয় অতি সামান্য। আমি কৃষ্ণগড় দুর্গের জায়গীরদার সরফরাজ খাঁর কন্যা আমিনা বানু। সুদক্ষ গুপ্ত সন্ধানীর নিকট আপনার তত্ত্ব এবং আপনাকে নিহত করার জন্য নৃশংসপ্রকৃতি শিবাজী যে ভীষণ ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তা’ অবগত হয়ে অতীব ব্যস্ততা সহকারে দ্রুত রণসজ্জাপূর্বক বীরপুরুষগণকে সঙ্গে লয়ে আপনার সাহায্যের জন্য এখানে আগমন করেছি।”

আফজাল খাঁ আমিনা বানুর পরিচয় লাভ করিয়া নিতান্ত প্রীত ও আনন্দিত হইয়া পুনঃ পুনঃ আশীর্বাদ করিলেন। অনন্তর আমিনা বানু আফজাল খাঁকে লইয়া দুর্গের দিকে অগ্রসর হইলেন।

 তারাবাঈ ০৯ পরিচ্ছেদ

একটি মনোহর ও প্রশস্ত কক্ষ মধ্যে একটি অনতিউচ্চ পর্যাঙ্কে মহাবীর আফজাল খাঁ শায়িত রহিয়াছেন। একজন হাকিম, দুইজন দাসী এবং স্বয়ং তারাবাঈ প্রাণপণে তাঁহার সেবা শুশ্রূষায় পরিলিপ্ত রহিয়াছেন। গৃহের ছাদের দোদুল্যমান শতবাহুবিশিষ্ট ঝাড় প্রোজ্জ্বলিত হইয়া উজ্জ্বল আলোকে গৃহতল আলোকিত করিয়াছে। ক্রমে রাত্রি বেশি হইলে, হাকিম সাহেব চলিয়া গেলেন। দাসী দুইটিও কান্তরে যাইয়া শয়ন করিল। তখন তারাবাঈ সময় পাইয়া ধীরে ধীরে আফজাল খাঁর ললাটে ও মস্তকে হস্ত বুলাইতে লাগিল। দুইজন দুইজনকে দর্শন করিয়া গভীর প্রেমাবেশে অভিভূত হইতে লাগিলেন। আফজাল খাঁ দেখিলেন, তারা অসাধারণ সুন্দরী। তাহার প্রশস্ত ললাট, আয়ত চক্ষু, উন্নত নাশিকা, আরক্তিম গন্ড, শঙ্খবিনিন্দিত কণ্ঠ সমস্তই চিত্তাবর্ষক এবং মনোহর। তাহার টানাটানি বাঁকা ভুরু আর তাহার নিন্মে সেই ডাগর ও উজ্জ্বল চক্ষুর লাস্যময় বিদ্যুৎ-কটাক্ষে মুনির মনও বিচলিত হইয়া যায়। সুন্দরীর যৌবন-কুসুম মনোহর ভঙ্গিতে বক্ষ-সাগরের বিকাশোন্মুখ সঞ্চার করে। সুন্দরীর বাহু, অধরোষ্ঠ, তালু, অংস, বক্ষ সমস্তই সুবিভক্ত এবং সুবিন্যস্ত। আফজাল খাঁ তারাবাঈ-এই সৌন্দর্য দেখিয়া আশ্চর্যান্বিত হইয়া গেলেন। কৃষ্ণবর্ণ মারাঠীর ঘরে ইরান-তুরানের এই অপরূপ সৌন্দর্য কেমন করিয়া জন্মগ্রহণ করিল! বস্তুতঃ, তারাবাঈ-এর বেশ পরিবর্তন করিয়া, কোনও শাহজাদীর পোশাকে তাহাকে সজ্জিত করিলে কেহই তাহাকে মারাঠী-সুন্দরী বলিয়া অনুধাবন করিতে পারিবে না। আফজাল খাঁ তারাকে যতই দেখিতে লাগিলেন, ততই মুগ্ধ হইতে লাগিলেন। তারার গোলাপের ন্যায় সুন্দর ও কমনীয় হস্তখানি নিজ হস্তে ধীরে ধীরে চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, “তারা! তোমার ঋণ শোধ করা সুকঠিন। তোমার সতর্কতা, বুদ্ধিমত্তা এবং প্রেমেই আমার জীবন রক্ষা হয়েছে। তুমি যদি সেদিন সৈনিকের ছদ্মবেশে সাবধানতাসূচক পত্রখানি না দিতে, তা’ হলে আমি দেহরক্ষী সৈন্যসহ ঘোড়াডুবি-গর্তে পড়ে প্রাণ হারাতাম। তোমার পিতা যে এরূপ নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা এবং ষড়যন্ত্র করবেন, তা’ আমার স্বপ্নের অগোচর ছিল।

“এমন কঠিন পিতার ঔরসে জন্মিলেও তোমার অন্তঃকরণ অতি পবিত্র ও মহৎ। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, তুমি কেমন করে তোমার পিতার এই গভীর ষড়যন্ত্রের বিষয় অবগত হয়েছিলে? আর কি কৌশলেই বা তুমি রায়গড় পরিত্যাগ করে সেই নিবিড় বনরাজিপূর্ণ দুর্গম স্থানের সন্ধান পেলে?

তারাবাঈ ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া বলিলেন, “সেনাপতি! আপনাকে দর্শন করবার পর ত’তেই আমার প্রাণে ধীরে ধীরে আসক্তির তীব্র অনল প্রোজ্জ্বলিত হয়। তারপর আমাকে উন্মত্ত হস্তীর পদতল হ’তে ক্ষিপ্রতা এবং বীরত্ব ও কৌশলের সহিত রক্ষা করায়, আমি আপনার চরণেই আত্ম বিকিয়ে বসি। আমি সেই গভীর রজনীতে বিমনায়মান চিত্তে উদ্যানবাটিকায় বেড়াতে বেড়াতে উদ্যানমধ্যস্থ গৃহের নিকটবর্তী হয়ে বুঝতে পারলাম যে, গভীর নিশীথে সেই গৃহের দ্বার রুদ্ধ করে আমার পিতা, গুরু রামদাস স্বামী, মালোজী প্রমুখ কি যেন পরামর্শ করছেন।

“অতঃপর নিঃশব্দ পদসঞ্চারে সেই গৃহের অবরুদ্ধ জানালা সংলগ্ন হয়ে এই ভীষণ ষড়যন্ত্রের সমস্ত কথাই শুনতে পেলাম। শিকারে যাবার কথা এবং শিকারে লয়ে লয়ে যেয়ে কৃষ্ণগড়ের নিকটবর্তী গিরিসঙ্কটে ঘোড়াডুবি-গর্তের মধ্যে কৌশলে নিক্ষেপপূর্বক প্রাণবধ করবার সমস্ত কথা শ্রবণ করে আমি যার-পর-নাই আকুল ও অস্থির হয়ে উঠি।

“কি করব, কোন উপায়ে আপনাকে রক্ষা করব, একান্ত মনে কেবল তাই অবিরাম কয়েকদিন পর্যন্ত চিন্তা করি। অবশেষে মনে করলাম, গোপনে কোনও রূপে দেখা করে বা পত্র দিয়ে আপনাকে সাবধান করে দিব। এইরূপ চিন্তায় একান্ত উন্মনা হয়ে আমার ধাত্রীমাতাকে সমস্ত কথা খুলে বলে তাঁর চরণ ধারণ করলাম। তিনি আমাকে নিবৃত্ত হবার জন্য অনেক বুঝালাম; কিন্তু তাতে আমি আরও অধীর ও ব্যাকুল হয়ে পড়লাম। আপনার অহিত বা অনিষ্ট হলে আমি যে গলায় ছুরি নিব, তা’ তাঁকে বিশেষ দৃঢ়তার সহিত বললাম। তিনি গোপনে আপনার সহিত সাক্ষাৎ করে আপনাকে সাবধান করে দিবেন বলে যে-দিন স্বীকার করলেন, দুঃখের বিষয় যে সেই দিনই আপনি পিতার সহিত সহসা শিকারে বহির্গত হয় পড়লেন।

“আপনার মৃগয়ায় গমনের পরে আমি ধাত্রীমাতার সাহায্যে আপনার উদ্দেশে জনৈক ভৃত্যকে আমার বহুমূল্য হার প্রদানের অঙ্গীকারে সঙ্গে লয়ে গভীর নিশীথের অন্ধকারে অশ্বারোহণে কৃষ্ণগড়াভিমুখে যাত্রা করি। অনুমানের উপর নির্ভর করে আমার সেই প্রাচীন ভৃত্যটি ইঙ্গিতে একটি পার্বত্য পথ দিয়ে আপনার নিকট উপস্থিত হই। পাছে কেউ ধরে ফেলে, এই ভয়েই চকিতে বিদ্যুৎ-গতিতে পত্র দিয়েই পলায়ন করি এবং অবিলম্বে কৃষ্ণগড়ের রানী মালেকা আমিনা বানুর নিকটে উপস্থিত হই। তিনি যখন আমাদের বাটী গিয়েছিলেন, তখন তাঁর সহিত আমার গভীর প্রণয়ের সঞ্চার হয়। তাঁর নিকটে উপস্থিত হয়ে আপনার পথের বিপদ এবং গুপ্ত সৈন্যের অবস্থানের কথা নিবেদন করে, আপনাকে রক্ষা করবার জন্য বিশেষ অনুরোধ করি।

“সেই সূত্রে তিনি একশত তেজস্বী ও বিক্রান্ত অশ্বারোহী পাঠান সৈন্য লয়ে আমাদের উদ্ধারের জন্য সহসা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরমেশ্বরকে অনন্ত ধন্যবাদ যে, এই হতভাগিনীর চেষ্টা ও উদ্যম, আপনার জীবন রক্ষায় কতকটা সফল হয়েছে। আর কিছু পূর্বে মালেকার সৈন্যদল, ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলে, আপনি এরূপ গুরুতরভাবে জখম হতেন না। যা’ হোক, পরমেশ্বরের ইচ্ছায় এবং হাকিম সাহেবের চেষ্টায় আঘাত প্রায় আরোগ্য হয়ে এসেছে। আর দু’চার দিনের মধ্যেই আপনি সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করবেন।”
আফজাল খাঁ বলিলেন, “বিশ্বস্রষ্টার কৌশল ও মহিমা অপরিসীম! যিনি তোমার পিতার অন্তঃকরণে ভীষণ কুটিলতা ও হিংসার বিষ প্রদান করেছেন, সেই তিনিই আবার তোমার অন্তঃকরণ কোমলতা এবং প্রেমের সুধায় পরিপূর্ণ করেছেন! যিনি পাষাণকে কঠিন ও নীরস করে সৃষ্ট করেছেন, সেই তিনিই পাষাণের বক্ষ ভেদ করে তরল নির্মল জলের ধারা প্রবাহিত করেছেন।

“একই বৃন্তে একই উপাদানে তিনি কুসুম ও কণ্টক সৃষ্টি করেছেন। তাঁর রহস্য, তাঁর মহিমা সকল। বিচিত্র ও কৌশলময়! তিনি কোমল কুসুমের কঠিন ফলের জন্ম দেন। আবার কঠিন ফলের মধ্যেই সুমিষ্ট রস ও সুশীতল স্নিগ্ধ বারি রক্ষা করেন। অনন্ত তাঁর মহিমা! অপরিসীম তাঁর কুদরত! তাঁকে ধন্যবাদ দাও।

“যিনি তোমার হৃদয়ে প্রেমের আগুন জ্বালিয়ে আমাকে রক্ষা করেছেন, যিনি তোমাকে কল্যাণের পথে পরিচালিত এবং তোমার প্রেমতৃষ্ণাকে তৃপ্তি দান করুন, এই প্রার্থনা করি।”

তারাবাঈ বলিলেন, “সেনাপতে! হৃদয়ের আকুল উন্মাদনায় তোমার জন্য গৃহত্যাগ করে আজ অরণ্যে চলে এসেছি। এখন তোমার পূজায় মন্দিরে যদি স্থান দাও, তোমার পূজায় লাগব, আর যদি স্থান না পাই, তবে অকালে জীবনকুসুম শুঙ্ক হয়ে ঝড়ে পড়বে! যেদিন হ’তে তোমাকে দেখেছি, সেইদিন হতেই সব ভুলে তোমাকে মজেছি। সেইদিন হতে তোমার চরণকমলের ধ্যান ব্যতীত দেবাদিদের মহেশ্বর শিবের ধ্যান আর করতে পারি নাই। মহেশ্বরকে যে ফুল ও বিল্বপত্র যুগিয়েছি, তা’ তোমার চরণেদ্দ্যেশেই যুগিয়েছে। সেইদিন হতে তোমার মোহনমূর্তি আমি শয়নে-স্বপনে, নিদ্রা-স্বপনে, নিদ্রা-জাগরণে এক মুহূর্তের জন্যও নিস্মৃত হতে পারি নাই।
“মনকে যত বুঝাতে লাগলাম, মত ততই অবুঝ হয়ে উঠতে লাগল; যতই ধৈর্যধারণ করতে চেষ্টা করলাম ততই অধীর ও উন্মত্ত হয়ে উঠল! চুম্বক যেমন লৌহকে আকর্ষণ করে, তোমার হৃদয় তেমনি আমাকে আকর্ষণ করেছে! এ আকর্ষণে এ সন্মিলনে বাধা দিবার শক্তি কা’রও নাই!

“তুমি বিজাপুর রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। তুমি একজন মস্ত বীর পুরুষ! তোমার সস্মুখে যশঃসন্ধান ও উচ্চপদ নিয়তই তোমাকে প্রলুব্ধ করছে! তুমি আমার জীবন-বসন্তের মলয়ানিল, হৃদয়-আকাশের চূর্ণ চন্দ্রমা এবং ঊষার আকাশে শুকতারা হলেও, আমি তোমার সম্পূর্ণ অযোগ্য। কিন্তু আমার হৃদয়ের ক্ষুদ্র নদী আজ তোমার উদ্দেশে-তোমার প্রেম-পরিপূর্ণ হৃদয়-পারাবার পানেই ছুটে চলেছে।

“তার গতি অবাধ! সে আজ আত্মহারা অবশভাবে ছুটে চলেছে। তার পরিণামে কি হবে, তদ্বিষয়ে সে কিছুমাত্র চিন্তা না করেই তোমাতেই আত্ম বিকিয়ে বসেছে! হে প্রাণেশ্বর! হে স্বামিন! হে আমার জীবন-প্রভাতের হোমন ঊষা! হে জীবনবারিধির কৌস্তভ রতন! এখন তোমার আদর-অনাদরেই এ হতভাগিনীর জীবন-মরণ নির্ভর করে।”

শিবাজী-নন্দিনী আর কিছু বলিতে পারিলেন না। উচ্ছ্বসিত প্রেমাবেগে সন্দেহ এবং আশঙ্কায় তাহার পদ্মপলাশলোচন হইতে তরল মুক্তাধারা নির্গত হইতে লাগিল।

হে রমণী অনিশ্চিত প্রেমের আশায় চিত্তের উন্মাদনায় পিতামাতা আত্মীয়-স্বজনের স্নেহের বন্ধন খন্ডন করিয়া তাহার প্রেমাস্পদের সেবায় উপস্থিত হইয়া পিপাসা পরিতৃপ্তি করিতে পারিতেছে না, তাহার প্রেমাস্পদের নিকটে নিজের অবস্থার বিবরণ খুলিয়া বলিতে যাইয়া শোকাবেগে ক্রন্দন করা নিতান্তই স্বাভাবিক।

আফজাল খাঁ সুন্দরীর প্রেমোচ্ছ্বাস এবং হৃদয়ের অবাক হইয়া গেলেন। মনের ভিতর দ্রবীভূত হইয়া নিতান্ত চাঞ্চল্য অভিভূত এবং প্রেমের ধারায় অভিসিক্ত হইলেন। অন্তরে বাহিরে তখন মহাবীর আফজাল খাঁর তুমুল ঝটিকা প্রবাহিত হইল। প্রাণের পরতে পরতে অনন্ত পুলক শিহরিয়া উঠিতে লাগিল! নব বসন্তের মলয়া হাওয়ার প্রথম চুম্বনে শীত-সঙ্কুচিত কুসুমকলিকাগুলি যেমন শিহরিয়া উঠিয়া ফুটিয়া উঠে, আফজাল খাঁর হৃদয়-মালঞ্চ তেমনি শিহরিয়া উঠিয়া প্রেমের পুস্পে ভরিয়া গেল।

অনন্ত প্রেমের কুসুম-সুষমার মোহিনী আভা, সন্ধাকাশে স্বর্ণমেঘের ন্যায় হৃদয় জুড়িয়া বসিল। হৃদয়ে হৃদয়ে আভা ফুটিল। মরমে মরমে বাণ ছুটিল। তখন আগ্রহ ও ব্যগ্রতায় হৃদয়-কুঞ্জে প্রেমের কোকিল পাপিয়া অবিরাম কুজনে ডাকিতে লাগিল।

আফজাল খাঁ প্রেমাবেশে সেই নির্জন দীপালোক-আলোকিত-কক্ষে শিবাজী-নন্দিনীকে বুকের ভিতরে টানিয়া লইয়া তাহার গোলাপী গন্ডে কয়েকটি চুম্বন দান করিলেন। প্রদীপ-শিখা একটু কাঁপিয়া উঠিল! যুবতীর হৃদয় লজ্জা ও প্রেমে সঙ্কুচিত অথচ সহর্ষ হইয়া উঠিল।

উভয়েই ক্ষণকাল নীরব। উভয়ের বক্ষের স্পন্দন দ্রুত চলিতে লাগিল। উভয়ে উভয়ের গভীর প্রেমালিঙ্গনে আবদ্ধ। মারাঠা রাজকুমারীর নেত্র-কুবলয় হইতে প্রেমের মুক্তধারা বর্ষিত হইয়া পাঠানবীরের বক্ষস্থল বিপ্লাবিত করিতে লাগিল।

তারাবাঈ ১০ পরিচ্ছেদ

বিজাপুরের সোলতানের পক্ষ হইতে পঞ্চদশ সহস্র, পদাতিক, দুই সহস্র অশ্বারোহী, সাতশত গোলন্দাজ সৈন্য কৃষ্ণগড়ে সমাগত হইয়াছে। শিবাজীর বিশ্বাসঘাতকতা এবং নৃশংস ব্যবহারের সংবাদ শ্রবণে ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত হইয়া বিজাপুর দরবার শিবাজীকে সমস্ত দস্যু-সৈন্যসহ ধ্বংস করিতে এই সৈন্যদল প্রেরণ করেন।

আফজাল খাঁ কৃষ্ণগড়ে রাজকীয় বাহিনীর আগমন আশায় অপেক্ষা করিতেছিলেন। যথাসময়ে এই নূতন বাহিনী কৃষ্ণগড়ে সমাগত হইলে, মহাবীর আফজাল খাঁ শিবাজীর সহিত যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হইলেন। শিবাজীর প্রতি নিতান্ত রুষ্ট এবং বিরক্ত হইয়া মালেকা আমেনা বানুও ইসলামের মহাশক্র শিবাজীর ধ্বংস সাধন মানসে মহাবীর আফজাল খাঁর সহিত যোগদান করিলেন।

ক্রমাগত যুদ্ধ চলিতে লাগিল। শিবাজী সন্মুখ-সমরে অক্ষম হইয়া ক্রমাগত পশ্চাদবর্তন করিতে করিতে সহ্যাদ্রি পর্বতের দুর্গম অরণ্য এবং গিরিগহবর পরিপূর্ণ স্থানে যাইয়া আশ্রয় লইলেন। হঠাৎ আক্রমণ, গুপ্ত আক্রমণ এবং নৈশ আক্রমণ এই তিন আক্রমণ দ্বারা মধ্যে মধ্যে মোসলেম বাহিনীকে বিপদাপন্ন এবং চঞ্চল করিতে লাগিলেন। মোসলেম সৈন্য তাহার দস্যুসৈন্যের অনুসরণ করিলে তাহারা ছত্রভঙ্গ হইয়া নিবিড় অরণ্যানী এবং পর্বতের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া ফেরুপালের ন্যায় লুক্কায়িত হইয়া পড়িত। ফলতঃ শিবাজীর মাওয়ালী দস্যুগণ পলায়নে এবং হঠাৎ আক্রমণে যার-পর-নাই অভ্যস্ত হইয়াছিল!

তাহাদের পলায়ন এবং আক্রমণ বস্ততঃই শৃগালের ন্যায় দ্রুত এবং কৌশলপূর্ণ ছিল। ফলতঃ শিবাজীর নামের অর্থ তাঁহার কার্যের সঙ্গে বেশ সার্থক হইয়াছিল। তখনকার দিনে “শিবাজী দরহকিকত শিবাজী আস্ত।” অর্থাৎ শিবাজী কার্যতঃ যথার্থ “শৃগাল,” একথা দাক্ষিণাত্যের সর্বত্রই প্রবাদবাক্যের ন্যায় প্রচলিত হইয়াছিল।

শিবাজীর ধূর্ততা, ছলনা এবং মিথ্যাবাদিতার কিছু ইয়ত্তা ছিল না। স্বাধীন রাজ্য স্থাপনের আকাঙা তাঁহাকে এমনি অধীর ও আকুল করিয়া তুলিয়াছিল যে, তিনি তাঁহার অভীষ্ট সাধন মানসে কোনও প্রকার পাপ ও অন্যায়কে বিন্দুমাত্রও পরওয়া করিতেন না।

খুন, জখম, চৌর্য, প্রবঞ্চনা তাঁহার জীবনের নিত্য কর্তব্যকর্ম মধ্যে পরিগণিত ছিল। এহেন ধূর্ত শিবাজীর সহিত পুনঃ পুনঃ সন্মুখ-সমরে চেষ্টা করিয়াও আফজাল খাঁ কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। তরঙ্গায়িত উচ্চাবাস ভূমি, নিবিড় অরণ্য, পর্বতের অসংখ্য গুহা এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পার্বত্য-নদীর গর্ভ ও উচ্চপাড়ের আশ্রয় গ্রহণ করিয়া শিবাজী মধ্যে মধ্যে ‘রাতহানা’ দিয়া বিজাপুরের সুশিতি বাহিনীকে যার-পর-নাই ত্যক্ত-বিরক্ত করিতে লাগিলেন।

পার্বত্য প্রদেশে দস্যুদলের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া জয়লাভ করা বহু বিলম্ব এবং ক্ষতি সাপেক্ষ দেখিয়া, বীরাঙ্গনা মালেকা আমেনা বানু শিবাজীর জন্মভূমি রায়গড় আক্রমণ করাই ন্যায়সঙ্গত মনে করিলেন। রায়গড় আক্রমণ করিলে, শিবাজী বাধ্য হইয়া সন্মুখ-যুদ্ধ দান করিতে বাধ্য হইবেন বলিয়া, মালেকা আমেনা বানু আফজাল খাঁকে উৎসাহিত করিতে লাগিলেন।

কিন্তু আফজাল খাঁ এই পার্বত্য প্রদেশেই শিবাজীকে হীনবল এবং ধৃত করিবার জন্য নানা প্রকার কায়দা-কৌশল এবং ফন্দী খাটাইতে লাগিলেন। মাওয়ালী ও মারাঠী দস্যুগণ ছদ্মবেশ ধারণ এবং চৌর্যকার্যেও বিলক্ষণ পটু ছিল। রাত্রিতে তাহারা নানা প্রকার পশু, বিশেষতঃ গরু-ঘোড়ার কৃত্রিম বেশে আসিয়া মুসলমান শিবিরের খোঁজ-খবর লইয়া যাইত। পার্বত্য রমণীদিগের রূপ ধারণ করিয়া দিবসে তাহারা নানা প্রকার ফলমূল এবং তরিতরকারীও বিক্রয় করিতে আসিত।

মধ্যে মধ্যে সন্দেহবশে কয়েকজনকে ধৃত করায়, তাহার মারাঠী গুপ্তচর বলিয়া প্রকাশ পাওয়ায় পাহারা আরও কড়াকড়ি করা হইল। মালেকা আমেনা বানু বুঝিতে পারিলেন যে, তাঁহাকে এবং শিবাজী-নন্দিনী তারাবাঈকে কোনও রূপে বন্দী বা নিদ্রিতাবস্থায় চুরি করিয়া লইবার জন্য শিবাজীর দলপতিগণ বিশেষ তদবির করিতেছেন।

মালেকা এবং তারাবাঈ সাবধানতার জন্য অস্ত্র-পাণি হইয়া শয়ন করিতেন। মারাঠীরা যে-কোনওরূপে এই সুন্দরীদ্বয়ের কাহাকেও অপহরণ করিতে সমর্থ হইবে, তাহা কেহ স্বপ্নেও চিন্তা করিলেন না। মোতামদ খান স্বয়ং রাত্রিতে মালেকা এবং তাঁহার শিবিরের প্রহরীদিগের সতর্কতার জন্য বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করিলেন।

কিন্তু মানুষ যখন যে-বিষয়ে অতিরিক্ত সাবধান হয়, অনেক সময় যেমন তাহাতেই অসম্ভাবিতরূপে বিপদ ঘটিয়া থাকে; তেমনি এই সাবধানতার মধ্যেও গুরুতর বিপদ সংঘটিত হইল।

সহসা এক দিন প্রভাতে দেখা গেল যে মালেকার শিবিরে মালেকা নাই। তাঁহার শিবিরের মধ্যে একটি গর্ত রহিয়াছে। অনুসন্ধানে দেখা গেল, তাহা গর্ত নহে সুড়ঙ্গ। অশ্রু বক্র পথে পনর শত হস্ত পরিমিত সুড়ঙ্গ কাটিয়া মালেকাকে গভীর নিশীথে নিদ্রিয়বস্থায় বেহুঁশ করিয়া অপহরণ করিয়াছে।

অতঃপর সেই সুড়ঙ্গ পথে নামিয়া ধীরে ধীরে সকলে এক বনের মধ্যদেশে একখন্ড পরিস্কৃত ভূমি দেখিতে পাইলেন। সেখানে কিছু পূর্বেও লোক ছিল, তাহা বেশ বুঝিতে পারা গেল। সুড়ঙ্গের মাটিগুলি একস্থানে রাশীকৃত না করিয়া ক্রমশঃ নদীর জলে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে।

সুড়ঙ্গের মুখে একটি লতাগুল্মের ঝোপ রহিয়াছে। এমন কৌশলপূর্ণ স্থান যে, দেখিয়াও সহসা কেহ কিছু নির্ধারণ করিতে পারে না।

মালেকা আমেনা বানুকে যে মারাঠীরা অচিন্ত্যভাবে সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গ খনন করিয়া অপহরণ করিয়া লইয়াছে, সে-বিষয়ে কাহারও আর কোনও সন্দেহ রহিল না। মালেকার জন্য মোসলেম শিবিরে ভীষণ হাহাকার পড়িয়া গেল! আফজাল খাঁ যার-পর-নাই শোকার্ত হইয়া পড়িলেন। সৈন্য-সামন্ত সকলেই বিষাদ-সাগরে নিমগ্ন হইল!

তারাবাঈ তাঁহার আশ্রয়দাত্রী এবং পরম হিতৈষিণী মালেকার অপহরণে যার-পর-নাই ক্ষুণ্নমনা এবং বিষাদের বিমলিন হইয়া অশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিলেন।

আমেনা বানুর মাতা শোকে পাগলিনী হইয়া উঠিলেন। পাছে বা ধর্মাধর্ম জ্ঞানশূন্য পাষন্ড কাফেরগণ এই মোসলেম সুন্দরীকে কলঙ্কিত অথবা নিহত করে, ইহা ভাবিয়া সকলেই পেরেশান ও লবেজান হইয়া উঠিলেন।

দরী-গিরি, বন-জঙ্গল, নদ-নালা, সমস্ত তন্ন তন্ন করিয়া অনুসন্ধান করা হইল। মারাঠীদিগকে ভীষণভাবে যত্র তত্র আক্রমণ করিয়া বিপর্যস্ত ও বিধ্বত করতঃ বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা হইল! কিন্তু কোথায়ও কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।

অনেক মারাঠীকে বন্দী করিয়া বিশেষ প্রলোভন এবং প্রাণদণ্ডের ভয় দেখাইয়াও তাহাদের নিকট হইতে কোনও তত্ত্ব পাওয়া গেল না। চতুর্দিকে বহু গুপ্তচর প্রেরণ করিয়াও কোনও সূত্র আবিস্কার করা গেল না। সকলেই যার-পর-নাই নিমর্ষ ও শোকাকুল চিত্তে দিন-যাপন করিতে লাগিলেন।

মহাবীর আফজাল খাঁ এবং বীরবর মোতামদ খান নানা প্রকার নূতন নূতন পন্থা এবং কৌশল অবলম্বন করিয়া মালেকার অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। শিবাজীকে বন্দী করিতে পারিলে, সমস্ত উদ্দেশ্যই সিদ্ধ হইবে বুঝিয়া, শিবাজীকে বন্দী করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিতে লাগলেন।

কিন্তু বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেল যে, শিবাজী তখন আবহক্ষেত্রে উপস্থিত নাই। সেনাপতি আবাজী তখন শিবাজীর প্রতিনিধি যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করিতেছেন। অতঃপর শিবাজীর অবস্থান নিরূপণের জন্য বিশেষ চেষ্টা হইতে লাগিল।

তারাবাঈ ১১ পরিচ্ছেদ

গভীর রজনী। চতুর্দিক নিবিড় অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। পশ্চিমঘাট গিরিগহবরের একটা মনোহর কক্ষ বিশেষরূপে সজ্জিত। এই নির্জন রাজা অশোকের সময় শ্রমণদিগের নির্বাস জন্য নির্মিত হইয়াছিল।

গভীর নির্জনে বাস করিবার উদ্দেশ্যেই এই সমস্ত কৃত্রিম গুহা খোদিত করা হইয়াছিল। মধ্যে মধ্যে তিনি শক্রর অনুসরণ অব্যাহতি এবং যুদ্ধ হইতে বিশ্রাম লাভ করিবার জন্য এই নির্জন গিরিহুহার বাস এবং স্বকীয় ভোগলালসা পরিতৃপ্তি করিতেন।

এইখানেই ভীষণ হত্যা এবং লুণ্ঠনের গুপ্ত পরামর্শ হইত। গভীর বনরাজিপূর্ণ এই দুর্গম পর্বতের পাদমূলে ভীষণ অরণ্যের সম্মুখে একটি পরিখা খোদিত ছিল। লোকে তাহাকে পার্বত্য নদী বলিয়াই মনে করিত।

পরিখার উভয় পার্শ্বে উচ্চ গড়; তাহা নানাজাতীয় বৃলতা বিশেষতঃ বৃহৎ বৃহৎ শাল ও তালবৃক্ষে সমাচ্ছন্ন হইয়া স্বাভাবিক ক্ষুদ্র পর্বতের স্তুপ বলিয়া ভ্রম জন্মাইত! গড়ের উপরে নানা স্থানে বৃরাজির পাদমূলের অন্তরালে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ তোপ সজ্জিত ছিল।

এতদ্ব্যতীত বনের নানা স্থানে অদৃশ্যভাবে তোপ সজ্জা ছিল। বনের মধ্যে মৃত্তিকার নীচে কয়েকটি পাতালপুরী বা গুপ্ত-কক্ষ ছিল। এই সমস্ত পাতাল-গৃহে নানাবিধ যুদ্ধের উপকরণ, লুণ্ঠিত সামগ্রী এবং ধন-ভান্ডার সংস্থাপিত ছিল। এই গোপনীয় গুহাবলীর একটি প্রশস্ত এবং অধিকতর রমণীয় গুহাতে ললনাকুল ললাম-ভূতা এক ষোড়শী রূপসী রূপের ছটায় কক্ষ আলোকিত করিয়া একখানি পালঙ্কোপরি অর্ধহেলিত অবস্থায় অবস্থিত!

রমণীর ঈষৎ কুঞ্চিত সুচিক্কণ ঈষন্নী লাভ কেশকলাপ ললাট এবং গন্ডে পতিত হওয়ায় তাহার মুখখানি শৈবালে ঈষদাচ্ছন্ন প্রভাত-প্রস্ফুটিত কমলের ন্যায় অথবা মেঘ-কিরীট-চন্দ্রমায় ন্যায় শোভা পাইতেছে। সে মুখের ও চক্ষুর ছটায় তেজস্বিতা, দৃঢ়তা এবং পবিত্রতার আভাই কেবল বিকীর্ণ হইতেছে।

গৃহস্থিত প্রদীপের আলোক, রমণীর বিশ্ববিমোহন রূপের ছটায় যেন মলিন বলিয়া প্রতীয়মান হইতেছে। উন্নত বিশাল বক্ষ শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে বাত্যাহতা স্ফীত বা তরঙ্গায়িত পদ্মার ন্যায় ক্ষণে ক্ষণে উন্নত এবং অবনত হইতেছে।

রমণীর নেত্রকুবলয়ের প্রশান্ত এবং স্থির দৃষ্টি হইতে উন্নত চিন্তার ইঙ্গিতই সূচিত হইতেছে। রমণী যুবতী-প্রস্ফুটিত-যৌবনা এবং অসাধারণ সৌন্দর্যশালিনী হইলেও, তাঁহাকে দর্শন করিয়া কাম-গন্ধী প্রেমের উদ্রেক না হইয়া সশ্রদ্ধ ভালোবাসারই সঞ্চার হয়।

রমণী অলৌকিক সুন্দরী। তাহার মুখমন্ডলে তরুণ অরুণের অরুণিমা, নয়নে বর্ষণ-মুক্ত শারদাকাশের নীলিমা, গঠন-বৈচিত্র্যে কাফ-কৌশলের অপূর্ব মহিমা পরিদূশ্যমা! রমণী নির্বাতি সমুদ্রের জলরাশির ন্যায় তরল সৌন্দর্যে ভরপুর হইয়াও অচঞ্চল! সুতরাং, তাঁহাকে দর্শন করিলে আনন্দ এবং শ্রদ্ধারই উদ্রেক হয়। সে সৌন্দর্য-সে লাবণ্য কেবল কবিত্বময়, রসময় এবং আনন্দময়! তাহাতে স্বপ্নের আবেশ এবং মদিরার বিহবলতা নাই, তাহা স্পষ্ট, মুক্ত এবং ব্যক্ত; সুতরাং সহসা তাহাতে মনশ্চাঞ্চল্য ঘটে না।

প্রিয় পাঠক-পাঠিকা! এই গরীয়সী সুষমা-সম্পন্ন মহিমময়ী রমণী আমাদেরই সেই মালেকা আমেনাবানু। রমণী অর্ধশায়িতাবস্থায় বাম হস্ত বাম কপোলে রাখিয়া দক্ষিণ হস্তে “দেওয়ান হাফেজ” ধারণ করিয়া পড়িতেছিলেন।

এমন সময় শিবাজী তথায় আসিয়া একাকী উপস্থিত হইলেন। মালেকা আমেনা তখন অন্যদিকে মুখ ফিরাইয়া বসিলেন। শিবাজী দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া নিকটবতী একখানি সোফাতে উপবেশন করিলেন। ক্ষণকাল নীরবে যাপন করিবার পরে বলিলেন, “মালেকা! মালেকা! আমার প্রাণের মালেকা! একবার তুমি আমার দিকে মুখ ফিরাও। একটিবার মাত্র কথা শুন। আমি তোমার জন্যই উন্মুত্ত হয়েছি। তোমার প্রেমামৃত পানের জন্যই মানস-চকোর চঞ্চল হয়েছে। কিছুতেই তোমাকে পরিণয় পাশে আবদ্ধ করতে স্বীকৃতা করতে না পেরে অবশেষে তোমাকে হরণ করতে বাধ্য হয়েছি।

“তোমাকে বশীভূত করবার জন্যই অপহরণ করে এই নিভৃত নির্জন গিরিগুহায় নিয়ে এসেছি। তোমার প্রেমে প্রমত্ত হয়ে রাজ্য, ধন-সম্পদ নিসর্জন দিয়েছি। তোমাকে লাভ করতে না পারলে, জীবনের আর কোনও প্রয়োজন নাই।

“হে সুন্দরী! হে মানসি! নব-বসন্তের নব-বিকাশোন্মুখ অবস্থায় অভিমান-ভরে তোমার এই প্রেমদাসকে তুচ্ছ করে উভয়ের অকল্যাণ ও অমঙ্গল আনয়ন করো না। বসন্ত এসেছে, তবে সৌরভ-সুধা বিতরণে বিলম্ব কেন?

“হ মানিনী! শিবাজী দস্যু হলেও রাজা, মারাঠী হ’লেও বীর-পুরুষ, কাফের হলেও প্রেমিক এবং মূর্খ হলেও কৃতজ্ঞ। সুতরাং একেবারে তোমার অযোগ্য নহে। তোমার প্রেম-প্রবাহের রসসিক্ত হ’লে, শিবাজী ভারত-সিংহাসনে সমারূঢ় হ’বারও কল্পনা করে।
“হে বীর্যবতী! তোমার বীরত্ব এবং সাহস সহায় হ’লে, এ বাহু আরও বলশালী হবে, এ মস্তিস্কে আরও উচ্চ উচ্চ রাজনৈতিক চিন্তা-স্রোত প্রবাহিত হবে। তাই বলি, মালেকা! তুমি আমার হৃদয়রাজ্যের মালেকা হ’য়ে মালেকা নামের সার্থকতা সম্পাদন কর। নিশ্চয় জানিও, তোমার প্রেমে হতাশ করলে এ জীবন-তরু অকালে শুঙ্ক হবে। এস মালেকা! এস, আমার বক্ষে এস। নতুবা এই বক্ষে শাণিত ছুরিকা বিদ্ধ করে এ বিদগ্ধ জীবনের অভিনয় শেষ কর।

“ক্রমাগত আজ দু’মাস কাল তোমার সাধনা করে মন বড়ই চঞ্চল এবং বিধুর হয়েছে, আর ধৈর্যধারণ অসম্ভব। মনের স্থৈর্য ক্রমশঃ নষ্ট হচ্ছে। এস তুমি! এস, আমার মরুভূমিতুল্য দগ্ধবক্ষে তুমি মিত্রাপ-জ্বালা-নিবারণী মন্দাকিনীর ধারার ন্যায় প্রবাহিত হও।

“এস মালেকা! এস, তা’তে কোন কলঙ্ক নেই। আমি তোমাকে কলঙ্কিনী করব না। আমি তোমাকে রাজ-আড়ম্বরে যথারীতি বিবাহ করব। ভগবান রামদাস স্বামী আমার অনুকূলে। বাহুবল, অর্থবল, বুদ্ধিবল সমস্তই আমার পদতলে।

“মালেকা! একবার তুমি সম্মতি প্রকাশ কর। আজ দীর্ঘ দু’টি মাস ধরে তোমার সাধনা করছি! তোমার রূপবহিৃতে পতঙ্গের ন্যায় আত্মবিসর্জন করতে বসেছি। হায়! তবুও কি তুমি পাষাণী হয়ে থাকবে? মালেকা! আজ সাধনার শেষ দিন!

“আজ যেমন করেই হউক মনের বাসনা পূর্ণ করব। আজ আর তোমার সম্মতি-অসম্মতির অপো করতে পারি না। এস রূপসি! এস, এস, বক্ষে এস!”

এইরূপ উন্মত্ত প্রলাপ বকিতে বকিতে শিবাজী দুই বাহু প্রসার করিয়া মালেকাকে সহসা আবেষ্টন করিয়া অধর-চুম্বনে উদ্যতপ্রায়। রোষেন্মত্তা মালেকা আমেনাবানু সহসা ক্রুদ্ধা ব্যাঘ্রীর ন্যায় ভীষণ বলে উত্থিত হইয়া শিবাজীকে দূরে ঝটকাইয়া ফেলিলেন। দেওয়ালে আহত হইয়া শিবাজী কতলে ঘূর্ণিত হইয়া ভূতলে পতিত হইলেন, উঠিবার উপক্রম করিলেন। কিন্তু শক্তিশালীনী মালেকা সহসা ভীমবলে পদতলে শিবাজীকে চাপিয়া ধরিয়া দৃঢ়মুষ্টিতে শাণিত ছুরিকা বক্ষ-লক্ষে উদ্যত করিয়া বলিলেন, “বল দুরাত্মন। বল জাহান্নামী কাফের! বল কাম-কুক্কুর! পাষন্ড শয়তান। আর কখনও নারী হরণ করবি? পাষন্ড, আজ হ’তে তোর জীবনের পাপভিনয়ের শেষ করব।”

মালেকা ভীষণ ক্রুদ্ধ মূর্তিতে ক্রকুটি-কুটিল আঁখিতে বিকীরণ করিয়া এবং ক্রোধাবেগে কম্পিত হইতে হইতে ভীষণ গর্জন করিয়া শিবাজীকে পদতলে আরও ভীষণভাবে চাপিয়া ধরিলেন। ছুরিকার শাণিত মৃত্যুর করালী জিহবার ন্যায় শিবাজীর চক্ষে প্রতিভাত হইল!

শিবাজী ভীতি-বিহবলচিত্তে রূদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলিলেন, “মালেকা! আমায় মাফ কর। আর না, যথেষ্ট হয়েছে। দোহাই তোমার, প্রাণবধ করো না! আর কখনও পরনারী হরণ করব না! আর কখনও তোমার প্রতি লালসার দৃষ্টিপাত করব না। আজ হ’তে বুঝলাম, মুসলমান রমণী সতী। সতীত্বের এবং ধর্মের সন্মান মুসলমান রমণীর মত আর কোনও জাতীয়রা রমণীর কাছে আদৃত এবং রতি নহে।”

মালেকার তর্জন-গর্জনে এবং শিবাজীর করুণ প্রার্থনায় সমস্ত গিরিগুহা শব্দায়মান হইয়া উঠায়, ভিতরের প্রহরী এবং দাস-দাসীগণ ব্যস্ত হইয়া ছুটিয়া আসিল। তাহার আসিয়া দেখিল যে, মালেকা আমেনাবানু ভীষণ রণরঙ্গিনী মূর্তিতে ভ্রুকুটি-কুটিল নেত্রে শিবাজীকে পদতলে চাপিয়া দন্ডায়মান! একজন দাসী আনন্দ-উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, “ঠিক হয়েছে, মা! এ যে, উগ্রচন্ডী কালী করালী মূর্তি! পদতলে কাম-কুক্কুর শিবাজী! আজ নরাধমের উপযুক্ত প্রতিশোধ হয়েছে। কি বলব, মা! এই নরাধম কাম-কুক্কুরই আমাকে পাপ-লালসায় ভাসিয়ে স্বকীয় ঘৃণিত পাপ-লিপ্সা চরিতার্থ করেছে। আমি এক্ষণে পুরাতন হয়েছি। তাই নূতন রস ভোগের জন্য নবীনা তোমাকে হরণ করে এনেছে। বেশ হয়েছে, মা! পাষন্ডের উপযুক্ত প্রতিশোধ গ্রহণ কর!”

এই বলিয়া দাসী আনন্দে করতালি দিয়া অট্র হাস্যে সমস্ত গুহা প্রতিধ্বনিত করিতে লাগিল। মালেকা ভীষণ গর্জনে, দন্তে দন্ত সংঘর্ষণ করিয়া আবার বলিলেন, “বল নরাধম কুক্কুর! আর কখনও পরনারীর প্রতি কুভাব পোষণ করবি কি-না?” এই বলিয়া মালেকা আমেনাবানু ছুরিকাখানি বক্ষের দিকে আরও বিনত করিলেন।

শিবাজী ভীত এবং আর্তকণ্ঠে বলিলেনঃ “মালেকা! মালেকা! রক্ষা কর! দোহাই তোমার! আজ হইতে তুমি আমার মাতা! তোমার মাতৃ সম্বোধন করছি। রক্ষা কর, মা! সত্যই তুমি দানবদলনী পাপ-তাপ-নাশিনী দুর্গা। এতদ্ব্যতীত নারীতে কখনও এমন তেজঃ ও সাহসের সঞ্চার সম্ভব নহে।

“মা কর, মা! আমায় মা কর! আজ হ’তে তোমাকে পরম পূজনীয়া জননী বলেই পূজা করব। ধন্য সতী! তুমি শত ধন্য! তোমায় ও পবিত্র পদাঘাতেই কাম-বিকারের নেশা আজ হতে ছুটে গেল। কিন্তু মা! এই পাপী সন্তানের বক্ষ হতে পাদপদ্ম অপসারিত কর, মা! আমার শ্বাস রুদ্ধ হয় আসছে!”

প্রহরী ও দাসদাসীগণ মালেকাবানুর ভীষণ প্রলয়ঙ্কারী মূর্তি সন্দর্শনে সকলেই স্তম্ভিত এবং বিস্মিত হইয়া পড়িয়াছিল। এতক্ষণে তাহাদের মোহ ভঙ্গ হওয়ায় সকলেই “একি কান্ড, মা! ছাড় ছাড়! মহারাজার প্রাণ বধ করে না”-বলিয়া সমস্বরে করুণ চীৎকার করিয়া উঠিল।
মালেকা বক্ষ হইতে দণি পদ তুলিয়া লইয়া একটু দূরে সরিয়া দাঁড়াইলেন। শিবাজী উঠিয়া দাঁড়াইয়া আলুলায়িতকেশা মালেকা আমেনাবানুর পাদপদ্মে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিয়া যুক্ত করে বলিলেন, “মা! অধম সন্তানের অপরাধ মার্জনা কর। তোমার পূত পদস্পর্শে আমার দিব্যজ্ঞানের উদয় হয়েছে। আমি মহাপাতকী সন্তান, তুমি পুণ্যবতী সাক্ষাৎ জগন্মতা ভবানী। আমার অপরাধ লইও না। আমার ধর্ম-বুদ্ধি সঞ্চারের জন্যই তুমি ও মায়া-প্রপঞ্চ বিস্তার করেছ।” সকলেই দেখিল, শিবাজীর চক্ষু অশ্রুপ্লুত। সত্যই তাঁহার প্রাণে তীব্র অনুতাপের অগ্নিশিখা প্রজ্জ্বলিত হইয়াছে।

গভীর অন্ধকার ভেদ করিয়া বিশ্বপ্রহলাদিনী ঊষার মৃদু হাস্য যেমন বিশ্ববক্ষে নবজীবনের সঞ্চার করে, তেমনি অদ্যকার এই ভীষণ পাপলিপ্সা এবং কামাসক্তির সূচীভেদ্য অন্ধ তসমা ভেদ করিয়া দিব্যজ্ঞানের কিরণ শিবাজীর কলুষিত অন্তঃকরণে পদ্মের নির্মল সৌন্দর্য এবং বিমল সৌরভ ফুটাইয়া তুলিল। অকস্মাৎ যেন মেঘরাশি বিচ্ছিন্ন করিয়া চন্দ্রমার বিমল জ্যোতিঃ গগনবক্ষে ফুটিয়া উঠিল!

তারাবাঈ ১২ পরিচ্ছেদ

নৈশ-অন্ধকার দূর করিয়া ঊষার শুভ্র আলোক-রেখা পূর্ব-গগণে ফুটিয়া উঠিয়াছে। নানাজাতীয় বিহঙ্গরাজি সুমধুর কুজনে কাননরাজি মুখরিত করিয়া তুলিয়াছে। বিহগকণ্ঠে নানা ছন্দে বিশ্ববিধাতার বন্দনাগীতি গীত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই আফজাল খাঁর শিবিরে ফজরের নামাজের সুধাবর্ষী আজান ধ্বনি ধ্বনিত হইল। যোদ্ধৃগণ শীঘ্র শীঘ্র অজু করিয়া উপাসায় মনোনিবেশ করিলেন।

উপাসনা শেষে মোসলেম শিবিরের প্রধান প্রহরী আসিয়া আফজাল খাঁকে নিবেদন করিলেন যে, শেরমর্দান খান এবং তাঁহার অনুচরগণ কেহই তাম্বুতে নাই। পরে প্রকাশ পাইল, তারাবাঈও তাম্বুতে নাই। তাহার জিনিসপত্র সমস্তই পড়িয়া রহিয়াছে। তখন চতুর্দিকে একটি মহা খোঁজ পড়িয়া গেল! নাই-নাই-নাই ত শেরমর্দান খানের দলের কোনও লোকই নাই! চারিদিকে সবাই খুঁজিতে লাগিল। কিন্তু কোথাও পাওয়া গেল না।

শিবিরে মহা হুলস্থুল পড়িয়া গেল। সুদ গুপ্তচরদিগকে চুতর্দিকে মারাঠী শিবিরে প্রেরণ করা হইল। ক্রমশঃ জানিতে পারা গেল যে, শেরমর্দান খানই তারাবাঈকে বন্দী করিয়া লইয়া গিয়াছে। শেরমর্দান খান এবং তাহার অনুচরগণ কেহই মুসলমান নহে, সকলেই মারাঠী।

তারাবাঈকে হরণ করিয়া লইয়া যাইবার জন্যই তাহারা মুসলমানের বেশে আসিয়া আফজাল খাঁর সৈন্যদল-ভুক্ত হইয়াছিল।

শেরমর্দান-স্বয়ং মালোজী। এই মালোজীর করেই শিবাজী তারাবাঈকে সমর্পণ করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন। মালোজী তারার রূপ-মাধুরী দর্শনে মুগ্ধ হইয়া গিয়াছিলেন। তারাকে মুসলমান শিবির হইতে উদ্ধার করিবার আর কোনও পথ না পাইয়া অবশেষে মালোজী ছদ্মবেশ ধারণ করিয়া আফজাল খাঁর সৈন্যদলে ভর্তি হইয়াছিলেন।

ক্রমশঃ সেনাপতির নিকট কৃতিত্বের পরিচয় প্রদানপূর্বক বিশ্বাসভাজন হইয়াছিলেন। অবশেষে সেনাপতি ইহার দলভুক্ত লোকের উপরেই তারারা শিবির রক্ষার ভার সমর্পণ করিয়াছিলেন। সেই সুযোগে মালোজী ঔষধ প্রয়োগে তারাকে বেহুঁস করিয়া গভীর নিশীথে হরণ করিয়া লইবার সুবিধা পাইয়াছিলেন। মালোজীর চাতুরী এবং কৌশলে সকলেই ধন্য ধন্য করিতে লাগিলেন।

মারাঠীদিগের চাতুর্য এবং ধূর্ততা সম্বন্ধে এতদিন যাহারা অবিশ্বাসী ছিল, আজ তাহারাও মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা কীর্তন করিতে লাগিল। তারাবাঈয়ের অপহরণে আফজাল খাঁ নিতান্তই বিমনায়মনা হইয়া পড়িলেন। মালেকা এবং তারার উদ্ধারের জন্য নানাবিধ পরামর্শ ও প্রচেষ্টা চলিতে লাগিল।

তারাবাঈ ১৩ পরিচ্ছেদ

শিবাজীঃ মা! তুমি সাক্ষাৎ ভবানী। তুমি দয়া করে সন্ধি করে দাও। এ ভীষণ যুদ্ধের শাস্তি হলেই রক্ষা পাই। অসংখ্য লোক এই সমরাগ্নিতে পতঙ্গের ন্যায় ভস্মীভূত হচ্ছে। দেশের কৃষি, বাণিজ্য, শিল্প ক্রমশঃ বিলুপ্ত হচ্ছে। আর কিছুদিন এই সমরানল প্রোজ্জ্বলিত থাকলে, একবারেই উৎসন্ন যাবে।

মালেকাঃ আমি এখনও তোমার বন্দিনী। এই পশ্চিমঘাট গিরি-গুহার নির্জন প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ থেকে কেমন করে প্রস্তাব করতে পারি? আর সন্ধি করবার মত থাকলে, মহামতি আফজাল খাঁর নিকটে সে-প্রস্তাব পেশ করলেই ত হ’তে পারে।

শিবাজীঃ আফজাল খাঁ সন্ধি করবেন, এরূপ ত কিছুতেই মনে হয় না। মারাঠী শক্তিকে সমূলে নিমূল করাই তাঁর উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্য প্রতিপালনের জন্য তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করলে, তিনি প্রাণপণে চেষ্টা করছেন।

মালেকাঃ অপহৃত রাজ্য ও দুর্গ ফিরিয়ে দিলে এবং বিজাপুরের আধিপত্য স্বীকার করলে, তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে ক্ষমা করবেন।

শিবাজীঃ তা’ হ’লে আমার কি লাভ হ’বে? আমার স্বাধীনতা বজায় না থাকলে, সন্ধি করে লাভ কি? যা’তে আমার স্বাধীনতা থাকে, অথচ সন্ধি হয়, তোমাকে সেইরূপ চেষ্টাই করতে হবে।

মালেকাঃ অসম্ভব বলে বোধ হয়। তোমাকে “পুনর্মূষিক” হতেই হবে। বিজাপুর দরবারের কঠোর আদেশ যে, তোমাকে বন্দী বা নিহত করতে হ’বে। এর জন্য অর্থব্যয় ও বলক্ষয় করতে বিজাপুর দরবার কুণ্ঠিত নহে। সোলতান তোমার প্রতি ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছেন।

শিবাজীঃ তবে উপায় কি?

মালেকাঃ উপায়-রাজ্য প্রত্যর্পণ করে ক্ষমা প্রার্থনা করা।

শিবাজীঃ প্রাণান্তেও স্বেচ্ছায় রাজ্য ফিরিয়ে দিতে পারব না।

মালেকাঃ তবে সন্ধির কথা মুখে আনিও না। যথার্থ বীরপুরুষের ন্যায় যুদ্ধার্থ প্রস্তুত হও।

শিবাজীঃ মা! তুমি অন্ততঃ আমার অনুকূল হও।

মালেকাঃ অসম্ভব! তুমি মুসলমানের প্রতি যেরূপ ভীষণ অত্যাচার আরম্ভ করেছ, মসজিদগুলি যেরূপভাবে অপবিত্র করেছ, তা’তে তোমার পক্ষ অবলম্বন করা দূরের কথা, তোমার বিরুদ্ধে দন্ডায়মান না হওয়াই পাপ। আমাকে শিবিরে পৌঁছিয়ে দিবার জন্য কি করছ? যত বিলম্ব হচ্ছে, আফজাল খাঁ এবং মোতামদ খান ততই উন্মত্ত হয়ে যুদ্ধ করছেন। আমাকে ফিরিয়ে পেলে, তাঁরা অনেকটা শান্তি লাভ করবেন।

শিবাজীঃ মা! তোমাকে মা বলেই মেনে নিয়েছি। সাক্ষাৎ ভবানী-মূর্তি বলে পূজাও করছি। অন্ততঃ মা সন্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করবে না, এ আশা করা কি বিড়ম্বনা?

মালেকাঃ নিশ্চয়ই নহে। আমি ত প্রথমে যুদ্ধ করি নাই। তুমি পুনঃ পুনঃ কৃষ্ণগড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমার কত সর্বনাশ করেছ; তা’ একবার ভেবে দেখ।

শিবাজীঃ যত শীঘ্র পারি, পৌঁছিয়ে দিবার জন্য চেষ্টা করব। কিন্তু মা! আমার স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে।

মালেকাঃ আমার তা’তে হাত নাই।

শিবাজীঃ আমি মনে করি যথেষ্ট আছে।

মালেকাঃ সম্বন্ধ পাততে পারলে, রক্ষা পাবার সম্ভাবনা হ’তে পারে। কিন্তু তোমার কি তা’তে মত হবে।?

শিবাজীঃ সে কিরূপ সম্বন্ধ? সে কিরূপ ব্যাপার?

মালেকাঃ কেন? কিছুই কি জান না? তোমার কন্যা তারা যে আফজাল খাঁর রূপে প্রেমোম্মাদিনী। আফজাল খাঁও তার সেবা-শুশূষায় মুগ্ধ হয়েছেন। আফজাল খাঁর করে তারাকে সমর্পণ করে সন্ধি করলে, হয়ত সোলতান তোমার অনুগ্রহ করতে পারেন। কারণ, আফজাল খাঁ সোলতানের একান্ত প্রীতিভাজন।

শিবাজীঃ অসম্ভব! মালোজীকে কন্যা সম্প্রদানে পূর্বেই সম্মতি প্রকাশ করেছি। বাগদত্তা কন্যা কিরূপে আফজাল খাঁর করে সমর্পণ করব।

মালেকাঃ তা’তো বটে! কিন্তু তারা আফজাল খাঁকেই হৃদয়-মন দিয়ে বরণ করেছে, সুতরাং মালোজীর পক্ষে তারা আকাশের ন্যায় অপ্রাপ্য।

শিবাজীঃ আমিও তা’ বুঝেছি, কিন্তু কি করব! যেমন করে হউক মালোজীর করেই সমর্পণ করতে হবে। পরিণাম যা’ হয়, হবে। মালোজী তারার রূপে মুগ্ধ! মালোজী মুসলমান শিবির হ’তে তা’কে হরণ করে লুকিয়ে রেখেছে।

মালেকাঃ আমাকে হরণের সঙ্গে সঙ্গে নাকি? কেমন করে হরণ করলে? সেই সুড়ঙ্গ পথে নাকি?

শিবাজীঃ না, তার অনেক পরে। ছদ্মবেশে শেরমর্দান খাঁ রূপে! তোমাদের শিবিরে অনেক দিব বাস করবার পরে।

মালেকাঃ শেরমর্দান খাঁই তবে মালোজী!

শিবাজীঃ হাঁ।

মালেকাঃ সাবাস বটে! অদ্‌ভুত সাহস এবং ছদ্মবেশ ধারণে অপরিসীম নৈপুণ্য! আমরা কোনও সন্দেহ করতে পারি নাই। বাস্তবিকই মারাঠীরা কি ভীষণ ধূর্ত! তোমাদের অসাধ্য কর্ম কিছু নাই!

শিবাজীঃ প্রেমের দায়ে সকলি সম্ভব।

এই সময়ে মালেকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।

শিবাজীঃ মা! তুমি বুঝি তারাকে খুব ভালবেসেছ?

মালেকাঃ তাঁ, খুবই! নিজের ছোট ভগ্নী এবং সখির মত! তারাকে মালোজী হরণ করেছে এ-সংবাদ শেলসম অন্তঃকরণকে বিদ্ধ করছে। হায় তারা! তারাকে বোধ হয় রায়গড়ে নিয়ে গিয়েছে?

শিবাজীঃ না। তারাকে কোথায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে আমি তা’ ঠিক অবগত নহি। তবে শুনেছি, তার মাতুলালয়ে আছে।

মালেকাঃ এ অপহরণে কোনও ফল হবে না। তারা, আফজাল খাঁ ব্যতীত আর কা’কেও স্বামীত্বে বরণ করবে না। জোর-জবরদস্তি ক’রে কুফল ব্যতীত কোন সুফল হবে না।

শিবাজীঃ তা’ খুবই বুঝছি। কিন্তু মালোজীর করে কন্যা সমর্পণ না করলে, মালোজী বিদ্রোহী হবে। আত্মীয়-স্বজন ক্রুদ্ধ এবং বিরক্ত হবে। মহাসঙ্কট। তারার মৃত্যুই এক্ষণে মঙ্গলজনক। এমন কুলত্যাগিনী কন্যার পিতা হওয়া বিষম পাপের ফল! লোক-সমাজে মুখ দেখাতে ইচ্ছে করে না।

মালেকাঃ তুমি অন্যের কুলের প্রতি হস্ত প্রসারণ করেছিলে, কাজেই তোমার কূলে কলঙ্ক হবেই। প্রত্যেক ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া, প্রত্যেক নিঃশ্বাসের প্রশ্বাস, প্রত্যেক ধ্বনির প্রতিধ্বনি এবং প্রত্যেক দানের প্রতিদান আছে। অনুতাপ বৃথা! এ তোমার স্বকৃত কর্মফল। শিবাজী লজ্জায় অধোবদন হইলেন। একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়া আবার ঠিক হইয়া বসিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, “আফজাল খাঁকে কন্যা দান করলেই বা কি লাভ হবে? তিনি কি আমার পাবলম্বন করে বিজয়পুর দরবারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন?”

মালেকাঃ তা’ নহে। মুসলমান হয়ে তিনি কখনো বিশ্বাসঘাতকা করতে পারেন না। তিনি আদর্শ মুসলমান। তবে তোমার জায়গীর যা’তে বাজেয়াপ্ত না হয়, তার চেষ্টা করতে পারেন।

শিবাজীঃ আফজাল খাঁই আমার প্রধান শক্র। তাঁর মত দক্ষ সেনাপতি না থাকলে বিজয়পুর বাহিনীকে অনেক পূর্বেই পর্যুদস্ত করতে পারতাম!

মালেকাঃ আফজাল খাঁকে কন্যা দান করলে সন্ধি হতে পারে এবং তারার জীবনও রক্ষা পেতে পারে।

শিবাজীঃ দেখা যাক কোথাকার ঘটনা কোথায় যেয়ে দাঁড়ায়! তোমাকে আগামীকালই কৃষ্ণগড়ে পৌঁছিয়ে দিচ্ছি। মা! তুমি আমার বিরুদ্ধাচরণ করবে না, এটাই আমার বিশেষ ভরসা।

তারাবাঈ ১৪ পরিচ্ছেদ

গভীর নিশীথে সুড়ঙ্গপথে বেহুঁশ অবস্থায় তারাবাঈকে হরণ করিয়া লইয়া মালোজী এক পর্বত গুহায় লুকাইয়া রাখিলেন। কিন্তু সেখানে আফজাল খাঁর চরগণ আশু অনুসন্ধান পাইতে পারে বলিয়া পিত্রালয় রায়গড়ে পাঠাইবার কথা হয়। কিন্তু সেখানে রাখিলে পাছে আফজাল খাঁ রায়গড় আক্রমণ করিয়া বসেন, এই ভয়ে শিবাজী তাহাকে মাতুলালয়ে রাখিতে আদেশ করেন। কঙ্কন প্রদেশের বিঠ্‌ঠলপুরের এক গিরি-উপত্যকার তারার মাতুলালয়। স্থানটি নিতান্ত দুর্গম, অথচ প্রাকৃতিক দৃশ্যে নিতান্তই মনোরম। তারার মাতামহ মলহর রাও একজন বড় জোতদার এবং হায়দ্রাবাদ নিজামের তহশীলদার। সুতরাং বিঠঠপুলপুরে তিনি একজন মতা ও প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি। তারাকে এখানে বিশেষ যত্নে গোপনে রাখা হইল। তারার মনের গতি পরিবর্তনের জন্য নানাবিধ অবলম্বন করা হইল। কোনও রূপে একটি সন্ধি স্থাপিত হওয়া মাত্রই মালোজীর সঙ্গে তারার উদ্বাহ-ক্রিয়া সম্পন্ন হইবে, এই আশায় সকলেই উদ্বিগ্ন রহিল।

তারা সহস্র যত্ন এবং আদর পাইলেও কিছুতেই আফজাল খাঁর অতুল গরিমাপূর্ণ সৌন্দর্য এবং প্রেমের মাদকতা ভুলিতে পারিল না। স্বাধীন বনচারী বিহঙ্গকে পিঞ্জারাবদ্ধ করিতে তাহার মানসিক অবস্থা যেরূপ হয়, তারার অবস্থাও তদ্রুপ।

তারার প্রাণের ব্যাকুলতা এবং চাঞ্চল্য দিনের পর দিন বাড়িয়া যাইতে লাগিল। পলায়ন করিবার জন্য নানা চেষ্টা করিয়াও কোনও সুযোগ করিয়া উঠিতে পারিল না।

জীবন, তারার কাছে নিত্যই দুর্বহ বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তারার মনের কথা, প্রাণের ব্যথা, ব্যক্ত করিবার জন্য একটি লোকও নাই। তাহার প্রণয়-দেবতা আফজাল খাঁর কোনও সংবাদ না পাইয়া সে আরও অধীর চঞ্চল হইয়া উঠিল। সে কাহারও সহিত মিশিত না বা কথা কহিত না। মনের অশান্তি ও চাঞ্চল্য হাজার চেষ্টা করিয়াও তারা লুকাইতে পারিত না। তাহার মনের প্রতি অণুপরমাণু তুষানলে যে দগ্ধ হইতে লাগিল।

হায়! সে দুঃখ এবং সে জ্বালা ব্যক্ত করিবার ভাষা নাই। তারার মাতামহী তাহার মানসিক শান্তি বিধানের জন্য অনেক চেষ্টা ও তদ্বির করিলেন। অনেক হোম এবং যজ্ঞ করিলেন। তারার বিত্তরঞ্জনের জন্য গান-বাদ্যের বন্দোবস্ত করিলেন। কিন্তু জলের পিপাসা কি দুগ্ধে নিবারিত হয়? ক্ষুধার পেট কি কখনও কথায় ভরে? তারার কিছুতেই শান্তি হইল না।তারার কিছুতেই শান্তি হইল না।

তারা পুড়িয়া পুড়িয়া ছাই হইতে লাগিল। ক্রমশঃ সুবর্ণ কান্তি বিমলিন হইতে লাগিল। তারার উজ্জ্বল কটাপূর্ণ চক্ষু ক্রমশঃ উদাস ও কাতর-দৃষ্টিপূর্ণ হইয়া উঠিল। কেশ বেশ এবং অঙ্গরাগে তাহার আর কিছুই যত্ন রহিল না। কিছুদিন মধ্যে তারাতে কিছু কিছু উম্মাদের লক্ষণও পরিদৃষ্ট হইতে লাগিল।

বায়ু শান্তির জন্য নানা প্রকার আয়ুর্বেদীয় তৈল এবং ঔষধের ব্যবস্থা হইল। কিন্তু তাহাতে বিশেষ কোনও সুফল পরিদৃষ্ট হইল না। তারার নধর ও পুষ্ট তণু ক্রমশঃ ক্ষীণ ও শ্রীহীন হইতে লাগিল। সকলেই বুঝিল, প্রেমাস্পদ লাভের দারুণ নৈরাশ্যেই তারার শরীর-মন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। তারার মাতামহী অম্বুজা বাঈ তারাকে চক্ষের তারার ন্যায় দেখিতেন। তারার শোচনীয় বিষন্ন অবস্থা অবলোকন করিয়া তিনি যার-পর-নাই মর্ম-পীড়িত হইলেন।

তারাবাঈ ১৫ পরিচ্ছেদ

বিঠ‌্ঠপুরে বিঠঠলজীর একটি মন্দির ছিল। এই বিগ্রহের নামানুসারে গ্রামের নাম বিঠ‌্ঠলপুর হইয়াছিল। বাসন্তী পূর্ণিমার তিথিতে এই বিঠঠলদেবের মন্দিরে কোথা হইতে এক তেজঃপুঞ্জতনু তপ্তাকাঞ্চনকান্তি ললনা-কুল-ললাম ভূতা মহাতেজস্বিনী ভৈরবী আসিয়া উপস্থিত হইলেন।

প্রভাত হইতে হইতেই ভৈরবীর আগমন-সংবাদ সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হইয়া পড়িল। দলে দলে নরনারী কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তে এই নবীনা ভৈরবীকে দেখিবার জন্য সমবেত হইতে লাগিল। ভৈরবী অনেক পীড়িত ব্যক্তিকে ঔষধ দান করিয়া অল্প কয়েক দিনের মধ্যে আরোগ্য করিলেন। ভৈরবীকে রূপে-গুণে-জ্ঞানে আকৃষ্ট হইয়া দলে দলে লোক চতুর্দিক হইতে উপস্থিত হইতে লাগিল।

বিঠ্‌ঠলপুর লোকের হলহলায় সজাগ হইয়া উঠিল। নানাপ্রকার উপহার দ্রব্য, নজর-নেয়াজ এবং মানতের ফল-ফুল, নানাপ্রাকার উপাদেয় ভোজ্য জাত, বস্ত্র এবং মুদ্রায় মন্দির পূর্ণ হইয়া উঠিল। সন্তান লাভ কামনায় নারীদিগের বিপুল জনতা হইতে লাগিল। ভৈরবী এই বিপুল খাদ্যসামগ্রী এবং অর্থরাশি প্রফুল্ল চিত্তে গরীব-দুঃখীদিগকে দান করিতে লাগিলেন।

ভৈরবীর রূপের ছটা, তেজস্বিনী মূর্তি, বিনয়নম্র ব্যবহার, সরল ধর্মোপদেশ এবং রোগ আরোগ্য-শক্তি অবলোকন করিয়া সকলেই বিমুগ্ধ হইতে লাগিল! চতুর্দিকে ভৈরবীর নামে ধন্য ধন্য রব পড়িয়া গেল।

ভৈরবীর প্রশংসায় আকৃষ্ট হইয়া একদিন স্বয়ং তারার মাতামহী অম্বুজা বাঈ তারাকে লইয়া ভৈরবী সন্দর্শনে বিঠ্‌ঠলজীর মন্দিরে উপস্থিত হইলেন। ভৈরবীর অনিন্দ্যসুন্দর কমনীয় মূর্তি এবং মধুর বাক্যালাপে অম্বুজা বাঈ এবং উভয়ের মোহিত হইয়া পড়িলেন। তারার অসুখের কথা উঠিলে ভৈরবী বলিলেন যে, তিনি একরাত্রি তারাকে নির্জনে নিজের কাছে রাখিয়া একটি মন্ত্র জপ করিয়া গভীর রাত্রে হোম করিবেন।

অম্বজা বাঈ আনন্দের সহিত তাহাতে অনুরাগপূর্ণ সম্মতি প্রকাশ করিলেন। অতঃপর নির্দিষ্ট রাত্রে তারাবাঈকে লইয়া ভৈরবী মন্ত্র জপ করিতে লাগিলেন। কিছু রাত্রি পর্যন্ত মন্ত্র জপ করিবার পরে, ভৈরবী তারাকে বলিলেন, “তোমার এ মানসিক বিকার প্রেমের জন্যই সংঘটিত হয়েছে। তুমি নিশ্চয়ই কারও প্রেম-পাশে আবদ্ধ হয়েছে। তিনি কে আমাকে খুলে বল।”

তারাবাঈ ভৈরবীর কথা শুনিয়া লজ্জায় অধোবদন হইল, তাহার গণ্ড রক্তাক্ত হইয়া আবার মলিন হইয়া গেল। তারা নীরবে হতাশের দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল।

ভৈরবী বলিলেন, “আমি গণনায় দেখছি যে, সেই নাগররাজ মুসলমান কুলোদ্‌ভব। তুমি মারাঠী-রাজকুমারী হয়ে কিরূপে মুসলমান নাগরের রূপে মুগ্ধ হলে, ইহা ত নিতান্তই আশ্চর্যের বিষয়! যা হ’বার তা’ ত হয়ে গিয়েছে। এক্ষণে তাতে ভুলে যাবার চেষ্টা করাই সঙ্গত। ভুলবার চেষ্টা করলে, ভুলে যাওয়াটা কঠিন নহে?”

তারা কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বলিলেন “তা’ সম্পূণ অসম্ভব।

ভৈরবীঃ বটে! প্রেম কি এতই গভীর হয়েছে? এত ফাঁসিয়া গেলে ত মুশকিল! জাতি কুল মজাইয়া প্রেম করা ত ভাল নয়।

তারাঃ প্রেম কি জাতি-কুল বুঝিয়া চলে? তটিনী যেমন নিভৃত গিরিকন্দর হ’তে নির্গত হয়ে আপনার মনে আপনার ভাবে পথ কাটিয়ে সাগর-সঙ্গমে প্রবাহিত হয়, প্রেমও তেমনি উদ্দাম গতিতে আপনার মনের পথে ছুটে চলে। নদী যেমন পথে চলতে কা’কেও জিজ্ঞাসা সমুদ্রের সম্মিলন লাভ না করে কিছুতেই ক্ষান্ত হয় না, প্রেমও তেমনি আকাঙ্খিতকে প্রাপ্ত না হয়ে স্থির হতে পারে না।

ভৈরবীঃ তুমি দেখছি, প্রেম-রাজ্যের মস্ত দার্শনিক পন্ডিত হয়ে পড়েছে! তোমার সঙ্গে এটে উঠা কঠিন!

তারাঃ আপনার বিনয় প্রকাশের কায়দা অতি চমৎকার! এই অধীনা এবং অধমাকে আর লজ্জিত করবেন না। আপনার চেহারা দেখে এবং কথা শুনে আমি একরূপ অনির্বচনীয় শান্তি লাভ করেছি। আপনার স্বর যেন কত কালের পরিচিত! আর আপনাকে যেন কতই প্রাণের জন বলে বোধ হচ্ছে! কেন এরূপ হচ্ছে, তা’ ঠিক বুঝতে পারছি না!

ভৈরবীঃ আমিও সত্য সত্যই তোমার জন্য প্রাণের ভিতরে গভীর মমতা বোধ করছি। তোমাকে নিতান্তই আত্মীয়তম, মধুরতম এবং প্রিয়তম বলে বোধ হচ্ছে। এণে আমি তোমার অভীষ্ট সিন্ধ হবার কোনও আনুকূল্য করতে পারলেই কৃতার্থ এবং সুখী হতে পারি।- এই বলিয়া ভৈরবী গভীরভাবে ধ্যানমগ্না হইলেন। দীর্ঘ ধ্যানের পর সহসা ধীরে চুরুম্মিলন পূর্বক প্রভাত-প্রস্ফুটিত গোলাপের ন্যায় স্মিত হাস্যে বলিলেন, “তোমার ভাগ্যাকাশ ঊষালোক আলোকিত দেখে আশ্বস্ত হলাম!-এই বলিয়া ভৈরবী গম্ভীর মূর্তি ধারণ করিলেন।

তারাঃ কি দেখলেন? বিশদরূপে বুঝিয়ে বলুন।

ভৈরবীঃ আর কিছু বুঝিয়ে বলতে হবে না। অভীষ্ট সম্পূর্ণরূপে সিদ্ধ হবে।

তারাঃ এখানে বসেই কি অভীষ্ট সিদ্ধ হবে?

ভৈরবীঃ নিশ্চয়ই না।

তারাঃ তবে কোথায় যেতে হবে?

ভৈরবীঃ তা’ আমি জানি। সমুদ্র-সঙ্গম ব্যতীত গতি আর কোথায়?

তারাঃ কে আমাকে নিয়ে যাবে?

ভৈরবীঃ যে তোমাকে নিতে এসেছে।

তারাঃ আপনি! আপনি!! আপনি আমাকে নিতে এসেছেন! বটে, প্রেমাস্পদের সহিত মিলনের জন্য, কিম্বা দেবতার মন্দিরে বলিদানের জন্য! ভৈরবীর প্রাণ যে অতি কঠোর। আমার জন্য আপনার এত গরজ কি? কে আপনি?

ভৈরবীঃ বেশী কথা বলো না। স্থির হও। আমি কে, এই দেখ।

ভৈরবী এই বলিয়া তাহার বাহুর উপরের অংশে একটি দাগ দেখাইল। এতক্ষণ ইহা বস্ত্রাবৃত ছিল।

তারা এই অস্ত্র লেখা দেখিয়া বিস্মিত এবং আনন্দিত হইল। ভৈরবীর কণ্ঠ আলিঙ্গন করিয়া তারার বক্ষে মুখ লুকাইয়া আনন্দাশ্রু বর্ষণ করিতে লাগিল। ভৈরবী আনন্দোদ্বেলিত চিত্তে তারা পেলবগন্ডে দুইটি গাঢ় চুম্বন করিয়া স্নেহভরে বলিলেন, “আর অশ্রু বর্ষণ করো না। তোমার ক্রন্দনে আমার হৃদয় মথিত হচ্ছে। প্রস্তত হও। নদীর ঘাটেই নৌকা। এখনই এই স্থান ত্যাগ করে নৌকায় আরোহন করতে হবে।”

তারার মুখমন্ডল সহসা মেঘাবরণ মুক্ত শরচ্চন্দ্রের মত সমুজ্জ্বল হইয়া উঠিল! আনন্দোজ্জ্বাসে তারার হৃদয়ের স্তরে স্তরে এবং শোণিতের কণায় কণায় বিদ্যুৎ চমকিতে লাগিল!! নৈরাশ্যের গ্রীস্ম-জ্বালা পরিশুঙ্ক হৃদয়-তটিনীতে আশা ও আনন্দের বর্ষাকালীন জীমূত-ধারা মূষলধারে বর্ষিত হইতে লাগিল। সে বর্ষণে প্রেমের দু’কূল-প্লাবী বান ডাকিয়া যুবতীর হৃদয় তোলপাড় করিয়া দিল। ঝটিকা-সংক্ষুব্ধ-অম্বুধির ন্যায় তাহা চঞ্চল এবং উত্তাল হইয়া উঠিল।

অতি সত্বর ভৈরবীও বেশ পরিবর্তন করিয়া সাধারণ মারাঠী যুবকের ন্যায় সজ্জিত হইলেন। অতঃপর আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি সহ নির্গত হইবার উপক্রম কালে তারা বিঠ্‌ঠলজীর প্রতিমাটি ভূপাতিত করিয়া পদাঘাতে তাহা ভগ্ন করিয়া ফেলিল! ভৈরবী বলিলেন, “তারা! ছি! ছি! এ করলে কেন? প্রতিমার সহিত প্রতিহিংসা কিসের?

তারাঃ প্রতিহিংসার জন্য নহে। মারাঠীদের ভ্রমাপনোদনের জন্য। তাহারা এই মূর্তিকে জাগ্রত এবং জীবিত বলিয়া জানে! আমার সঙ্গে মত দিন এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। আমি এই প্রমাণ করে গেলাম যে, ইহা প্রস্তর ব্যতীত আর কিছুই নহে। এতে তাদের অনেকের ভ্রান্তি দূর হবে।

ভৈরবীঃ দেখছি, তুমি মূর্তিপূজক কাফেরের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেও হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহর ন্যায় প্রতিমা চূর্ণ করতে বিশেষ আনন্দ লাভ করে।

অতঃপর ভৈরবী এবং তারা নিশীথের গভীর অন্ধকারের মধ্যে যথাস্থানে যাইয়া নৌকায় আরোহন করিলেন। সুবাতাস বহিতেছিল। নৌকা পাল-ভরে তীরের মত ছুটিয়া চলিল। পাঠক-পাঠিকা! বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছেন যে, এই ভৈরবী আর কেহ নহে, ভৈরবী আমাদেরই অসাধারণ তেজঃস্বিনী বিচিত্রকর্মা মালেকা আমেনাবানু।

তারাবাঈ ১৬ পরিচ্ছেদ

নৌকা ভরাপালে জোর বাতাসে কল্‌ কল্‌ স্বরে নদীর জলরাশি কাটিয়া তীরের মত বেগে ছুটিল। রাতারাতি নৌকা অনেক দূরে সরিয়া পড়িল। প্রভাত সমাগমে বায়ুর বেগ কিছু মন্দ হইয়া আসিল। দেখিতে দেখিতে বায়ুর প্রবাহ একেবারেই রুদ্ধ হইয়া গেল। সুতরাং মাল্লারা নৌকার পাল নামাইয়া দাঁড় ধরিল। ঝড়ের মত যে নৌকা বায়ুভরে ছুটিয়া যাইতেছিল, এক্ষণে তাহা অপেক্ষাকৃত ধীর মস্থরভাবে যাইতে লাগিল। মালেকা এবং তারা কিছু চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। মাল্লাগিদকে যতদূর সম্ভব দ্রুতগতিতে দাঁড় ফেলিবার জন্য পুনঃ পুনঃ আদেশ করিতে লাগিলেন। মাল্লারা যতদূর সম্ভব তীব্র বেগে দাঁড় ফেলিতে লাগিল।

ক্রমশঃ আঁধার ভেদ করিয়া প্রভাতের অরুণিমাজাল পূর্বগগনে দেখা দিল। বিহঙ্গ-কণ্ঠে বিশ্ব-বিধাতার বিবিধ বন্দনা ললিত-স্বরে গীত হইয়া পৃথিবীকে ঝঙ্কৃত করিয়া তুলিল! স্নিগ্ধ গন্ধসহ মৃদু-মন্দ সঞ্চার কুসুম-গন্ধ বহন করিয়া বিশ্ব-বিধাতার মঙ্গলাশীর্বাদের ন্যায় সবত্র প্রবাহিত হইয়া নব জীবনের সূচনা করিতে লাগিল।

নিশাচর প্রাণীদিগের মনে নৈরাশ্য ও ভীতির সঞ্চার এবং দিবাচরদিগের মনে আনন্দ উৎসাহের স্রোত প্রবাহিত করিতে দেখিতে দেখিতে দিবসের আবির্ভাব হইল। দিবা আবির্ভাবে মালেকা এবং তারা স্ত্রীলোকের পরিচ্ছদ পরিত্যাগ পূর্বক মারাঠী পুরুষের বেশে সজ্জিত হইয়া নৌকার ভিতরে অবস্থান করিতে লাগিলেন। নৌকায় কয়েকজন পাঠান বীরপুরুষ আসিয়াছিল; তাঁহারা বীর-পরিচ্ছদ পরিত্যাগ পূর্বক মারাঠী পুরুষের মাল্লাদিগের সাজে সজ্জিত হইলেন।

নৌকা ভরাপালে তীর বেগে গেলে যেখানে তিন দিনে নিরাপদ স্থানে যাইয়া উপস্থিত হইতে পারত, সেখানে বায়ুর গতি রুদ্ধ হওয়ায় শুধু ক্ষেপনী সাহায্যে চারি দিনে অর্ধপথে যাইয়া উপস্থিত হইল।

এদিকে বিঠঠলপুর হইতে ভৈরবী এবং তারার সহসা অন্তর্ধানে এবং দেবমূর্তির ভগ্নদশা দর্শনে পরদিবস প্রাতঃকালেই এক হুলস্থুল কান্ড পড়িয়া গেল! দেবমূর্তির ভগ্নাবস্থা এবং দারুণ অবমাননা দর্শনে সকলেই মর্মাহত হইল! ভৈরবীর সম্বন্ধে নানাজনে নানা মত প্রকাশ করিতে লাগিল।

কেহ ভৈরবীকে নাস্তিক, কেহ উন্মত্ত বলিতে লাগিল। কিন্তু একটি তীক্ষ্ণবুদ্ধি বৃদ্ধা বলিল যে, এই ভৈরবী বাস্তবিক পক্ষে ভৈরবী নহে। এই ভৈরবী নিশ্চয়ই কোন মুসলমান রমণী। রমণী অসাধারণ এখানে আসিয়াছিল। মারাঠীদের ধূর্ততা এবং কৌশলকে এবার মুসলমান রমণী বেশ টেক্কা দিয়াছে। ধন্য রমণীর সাহস এবং বুকেট পাটা! সমস্ত মারাঠীদের মুখ ভোঁতা করিয়া দিয়াছে! কথা তড়িদ্বেগে সর্বত্রই রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। ঘটনা শুনিয়া সকলেই অবাক হইল! ভগ্নপ্রতিমা সন্দর্শনে সহস্র সহস্র নরনারী সমাগত হইল। ভৈরবী এবং তারার উদ্দেশ্যে সহস্রকণ্ঠে সহস্রকণ্ঠে অজস্র অভিসম্পাদ এবং সহস্র গালাগালি বর্ষিত হইতে লাগিল। কোনও কোনও প্রাচীন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তাহাদের আরাধ্য এই ভগ্নমূর্তির শোকে অশ্রুধারা বহাইতে লাগিল। নবীন-নবীনরাও অনেকে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিল। কেবলমাত্র একটি মারাঠী কুমারী বিস্ময়-বিজড়িত কণ্ঠে বলিল, “ওমা! বিঠ‌্ঠলজী আমাদের কেমন প্রভু! একজন মুসলমান রমণীর সঙ্গে যুদ্ধেই চুরমার হয়ে গিয়েছে। তবে দেখছি, এসব দেবতা-টেবতা কিছুই নয়-সবই মাটী! সবই ভুয়া! সবই মিথ্যা!”

তাহার কথা শুনিয়া সকলেই জিব কাটিয়া বলিল, “সর্বনাশ! সর্বনাশ! হীরা বলে কি! হিন্দুর মেয়ের মুখে একটি সর্বনেশে কথা! ঘোর কলি! ঘোর কলি!! ধর্ম আর থাকে না।” এই বলিয়া হীরার প্রতি সকলেই তর্জন-গর্জন করিতে লাগিল! হীরাবাঈ তাহাতে আরও ত্যক্ত বিরক্ত হইয়া উত্তেজিত কণ্ঠে বলিল, “আমি কি অন্যায় বলছি? যে-দেবতা নিজেকে রাখতে পারে না, সে আমাদিগকে কেমন করে রাখবে, আমাকে বুঝিয়ে দাও। আমি দিব্য দেখতে পাচ্ছি, এটি একটি বড় পাথরের মূর্তি ছাড়া আর কিছুই নয়! উহাতে ভক্তি করা আর লাথি মারা, সমান কথা।” হীরার কথার ধারে সকলেই কিছুই নয়! উহাকে ভক্তি করা আর লাথি মারা, সমান কথা।” হীরার কথার ধারে সকলেই হতভম্ব হইয়া পড়িল। কেহ কেহ হীরার প্রতি রুখিয়া উঠিল। হীরা ক্রুদ্ধ হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেল।

তাহার মাতামহ মলহর রাও নানাস্থানে নানাদিকে অনুসন্ধানী লোক পাঠাইলেন। নানুপুরে মালোজীর নিকট একজন অশ্বারোহীকে অবিলম্বেই পাঠান হইল। মালোজী তখন বিশেষ কার্যের জন্য নানুপুরে অবস্থিতি করিতেছিলেন।

সংবাদ শুনিয়া মালোজী বজ্রাহতের ন্যায় প্রথম স্তম্ভিত হইলে, কিন্তু পর মূহুর্তের পনর জন্য অশ্বারোহী সহ তুঙ্গা নদীর তীর ধরিয়া দুই পর্বতের মধ্যবর্তী ভবানীপুর নামক স্থানে-যেখানে নদী সঙ্কীর্ণ অথচ গভীর প্রবাহে প্রবাহিত হইতেছে, সেই ভবানীপুর লক্ষ্য করিয়া বিদ্যুদ্বেগে ঘোড়া ছুটাইলেন। ঘোড়াগুলি পদাঘাতে প্রস্তর-গাত্রে স্ফুলিঙ্গ ছুটাইয়া এবং পর্বত ও বন-প্রান্তরে পদধ্বনির প্রতিধ্বনি তুলিয়া তীব্রবেগে ছুটিয়া চলিল। তরুশাখাসীন বিহঙ্গাবলী এবং ক্ষেত্রমধ্যস্থ বাবুই পক্ষীর ঝাঁক কেবল চকিতে চঞ্চল হইয়া কোলাহল করিতে করিতে উড়িয়া চলিল। পথিকগণের চক্ষে কেবল মারাঠী সৈন্যদিগের রবিকর-প্রতিফলিত বর্শাফলকগুলি ঝলিতে লাগিল।

তারাবাঈ ১৭ পরিচ্ছেদ

নৌকা চলিয়াছে। একটু বাতাস বহিতেই মাঝি আবার নৌকায় পাল তুলিয়া দিল। সকলেই নিরুদ্বেগচিত্তে নানা প্রকার গালগল্পে মশগুল! ভবানীপুর আর বেশী দূর নহে। ভবানীপুর পার হইলেই নৌকা প্রশস্ত নদীবক্ষে পড়িবে।

মালেকা বলিলেন, “যে-পর্যন্ত ভবানীপুর না ছাড়াও, সে-পর্যন্ত বিশেষ সাবধানে চলবে।” মালেকা নিজে নৌকার ছইয়ের উপর বসিয়া নদীর দক্ষিণ পার্শ্বের যেখানে সেখানে বন ছিল, সেখানে সেখানে নিপুণ দৃষ্টিতে দেখিয়া যাইতে লাগিলেন। ক্রমশঃ সন্ধ্যার প্রাক্কালে নৌকা ভবানীপুরের নিকটবর্তী হইল। নৌকা ভবানীপুর পার হইয়াছে, এমন সময় কতিপয় অশ্বারোহী মারাঠী চীৎকার করিয়া নৌকা থামাইতে বলিল। মালেকার বুঝিতে বাকি রহিল না, ইহারা শত্রু পক্ষেরই লোক। সুতরাং মাঝিকে অপর তীরে নৌকা চালাইতে ইঙ্গিত করিল। নৌকা নদীর অত্যন্ত প্রশস্থ স্থানে আসিয়া পড়িয়াছে। এ অবস্থায় দস্যুদের পক্ষে নৌকা আক্রমণ করা সহজ নহে! নৌকা অপর তীরে দূর দিয়া চলিয়া যাইতেছে দেখিয়া মারাঠীরা ভীষণ চীৎকার করিতে লাগিল। তাহার চীৎকার করিয়া বলিল, “আমরা দস্যু নহি। আমরা কোতয়ালীর লোক। তোমরা কোনও রমণীকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছ কি-না, তা’ই মাত্র আমাদের প্রতি দেখবার হুকুম। আমরা তোমাদের কোনও অনিষ্ট করব না। অল্পক্ষণের জন্য তোমাদের নৌকা থামাও, নতুবা আমরা গুলী চালাব। অনর্থক খুন-জখম হবে।”

মালেকার ইঙ্গিতে মাঝি বলিল, “আচ্ছা, তবে আমরা সম্মুখের বাঁকে থামাচ্ছি। তোমরা অনুসন্ধান করে দেখ।” বাতাস খুব জোরে বহিতেছিল, সুতরাং অল্প সময়ের মধ্যে নৌকা বাঁকে আসিয়া লাগিল। নদীব তখন অন্ধকার আচ্ছন্ন। তবে নির্মেঘ আকাশ বলিয়া দৃষ্টি একেবারে অবরুদ্ধ নহে। মালেকার নৌকার ভিতরে মাত্র একটি ক্ষীণ বাতি মিটিমিটি করিয়া জ্বলিতেছিল। বাহিরে তাহার আলোক প্রায় কিছুই দেখা যাইতেছিল না।

মালেকা সকলকে যাহার যাহা কর্তব্য বেশ করিয়া বুঝাইয়া দিলেন। নৌকার ভিতরে অব্যর্থ-লক্ষ্যে সৈনিকগণ নৌকার পার্শ্বের ছইয়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ছিদ্রের মুখে বন্দুকের নল সংযোগ করিয়া হাঁটু গাড়িয়া বসিল। দ্বাদশ ছিদ্রে দ্বাদশটি বন্দুক সংস্থাপিত হইল। আট জন মাল্লা এবং এক জন মাঝি মাত্র বাহিরে রহিল। তাহারা সকলেই আপন আপন কার্য সম্পাদনে অত্যন্ত পটু।

দস্যুরা দুইটি প্রকান্ড মশাল জ্বালাইয়া নদীর তীরে সারিবন্দী অবস্থায় দন্ডায়মান রহিল।

মাঝি বিনীতভাবে মালোজীকে বলিল, “সর্দার সাহেব! আপনি যে কয় জন ইচ্ছা লোক লইয়া নৌকার ভিতরে এসে দেখে যান। তবে ভিতরে এরূপ স্থানাভাব যে, ৩/৪ জনের অধিক লোকের দাঁড়াবার জায়গা হবে না। জিনিসপত্রে বোঝাই হয়ে রয়েছে।”

মালোজীঃ বেশি লোক নিয়ে দরকার কি? আমি মাত্র দু’জন লোক নিয়ে উঠেছি। তোমাদিগকে মিছামিছি জ্বালাতন করব না।-এই বলিয়া মালোজী তরবারিধারী দুইজন সৈনিকপুরুষ সহ নৌকার সিঁড়িতে পদার্পণ করিলেন। মাল্লারা কয়েকজন আসিয়া মস্তক নত করিয়া বিশেষ শ্রদ্ধাভরে সালাম করিল। মালোজী সৈনিক পুরুষদ্বয় সহ নৌকায় যেমনি উঠা, অমনি তাহাদের ঘাড়ে বজ্রের ন্যায় ভীষণ মুষ্ট্যাঘাত আর সেই সঙ্গে একেবারে দ্বাদশ বন্দুকের এক সঙ্গে আওয়াজ। দ্বাদশটি অশ্বারোহী সৈন্য মুহুর্ত মধ্যে অশ্বপৃষ্ঠ হইতে ভূপতিত হইল। ঘোড়াগুলি ভড়কাইয়া দিদ্বিদিকে উধাও হইয়া পলায়ন করিল। অবশিষ্ট তিনজন অশ্বারোহী প্রাণভয়ে চীৎকার করিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়মান হইবার উপক্রমেই মাল্লাদিগের গুলীর আঘাতে হতজীবন হইয়া ভূপতিত হইল।

এদিকে নৌকায় সমাগত মালোজী, সঙ্গীদ্বয়সহ মুহুর্ত মধ্যে বন্দী হইয়া পড়িলেন। অস্ত্র-শস্ত্র কাড়িয়া লইয়া লৌহশৃঙ্খলে কঠোরভাবে আবদ্ধ করিয়া তিন জনকে নৌকার ডহরে রজ্জুবদ্ধ কুর্মের ন্যায় ফেলিয়া রাখা হইল।

এদিকে তিন চার জন্য মাল্লা তীরে উঠিয়া নিহত মারাঠীদিগের অস্ত্র-শস্ত্রগুলি নৌকায় উঠাইয়া তাহাদের লাশগুলি নদীতে ফেলিয়া দিয়া তাড়াতাড়ি নৌকা ছাড়িয়া দিল।

প্রবল পবনে তখন নৌকা বিজয়ী বীরের মত স্ফীত বক্ষে ছুটিতে লাগিল। এই ঘটনার বর্ণনা করিতে যে-সময় লাগিল, তাহার দশমাংশ সময়ের মধ্যে সমস্ত কার্য সম্পন্ন হইয়া গেল। অতঃপর সকলে করুণাময় খোদাতা’লাকে প্রাণ খুলিয়া ধন্যবাদ দিল।

 তারাবাঈ ১৮ পরিচ্ছেদ

চৈত্র মাসের শেষ। বসন্তের পূর্ণ বিকাশ এবং গ্রীস্মের সমাগমে শিবাজী ক্রমশঃ পরাস্ত হইয়া নিবিড় কাননে আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। তাঁহার সৈন্যদল ছিন্নভিন্ন হইয়া ঝাড়ে জঙ্গলে এবং পাহাড়-পর্বতে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। মালোজী বন্দী হওয়ায় শিবাজী যার-পর-নাই হতাশ এবং বিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। রামদাস স্বামী, আবাজী প্রভৃতি তখন সন্ধি করিবার জন্য শিবাজীকে বিশেষভাবে উপদেশ দিতে লাগিলেন। কিন্তু আফজাল খাঁ শিবাজীকে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করিয়া সন্ধি করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। সন্ধির জন্য পুনঃ পুনঃ আবেদন-নিবেদন এবং প্রার্থনা ও মিনতি চলিতে লাগিল। অবশেষে শিবাজী এক দিন মালেকা আমেনাবানুর চরণে লুণ্ঠিত হইয়া তাঁহার কৃপাভিখারী হইলেন।

মালেকা আমেনাবানু তখন আফজাল খাঁকে বিশেষরূপে অনুরোধ করিলেন। পরামর্শ হইল যে, শিবাজী স্বেচ্ছায় আনন্দ-উল্লাসে তারাবাঈকে রাজেচিত আড়ম্বরে আফজাল খাঁর করে সমর্পণ করিবেন। আর আফজাল খাঁ শিবাজীকে তাঁহার অধিকৃত পরগণা এবং কেল্লাগুলির মাত্র এক চর্তুথাংশ ছাড়িয়া দিবেন। শিবাজী বিজাপুর সোলতানের আধিপত্য ধর্মতঃ এক কার্যতঃ স্বীকার করিবেন।

শিবাজী মুসলমানদের যে-সমস্ত মসজিদ ভগ্ন করিয়াছেন, তাহা সমস্তই যথাযথরূপে প্রস্তত করিয়া দিলেন। শিবাজী রণতরী রাখিতে পারিবেন না। এই সমস্ত শর্ত যথারীতি লিখিয়া বিজাপুর দরবারে প্রেরণ করা হইল। বিজাপুর দরবার একেবারেই শিবাজীর উৎসাদনের পপাতী ছিলেন; কিন্তু আফজাল খাঁর অনুরোধে এই সমস্ত শর্ত স্বীকার করিয়া সন্ধি স্থাপনের জন্য অনুমতি প্রদান করিলেন।

আফজাল খাঁর সহিত তারাবাঈয়ের বিবাহ সম্বন্ধে বিজাপুরের সোলতান প্রথমতঃ আপত্তি তুলিলেন। কিন্তু তারাবাঈ-এর করুণ প্রার্থনা এবং গভীর ব্যাকুলতাপূর্ণ পত্র পাইয়া পরে অনুমোদন করিলেন।

অতঃপর ২১শে চৈত্র শুক্রবার উভয় পরে প্রধান প্রধান সামন্তদিগের সম্মুখে যথারীতি সন্ধিপত্র স্বারিত হইল। শিবাজীর প্রার্থনানুযায়ী মালোজীকে আমেনাবানু বিনা নিষ্ক্রয়ে মুক্তি প্রদান করিলেন। মালেকা বলিলেন, “মালোজী আপনি তারাকে বেহুঁস করে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমি সচেতন এবং সশস্ত্রাবস্থায় আপনাকে বন্দী করেছি। সুতরাং আশা করি, আমাতে কোনও হীনতা দর্শন করবেন না।

মালোজী লজ্জায় অধোবদন হইয়া বলিলেন, “আপনার সাহস যেমন অপরিসীম, দয়াও তেমনি তুলনাহীন! আপনি আমাকে চিরকৃজ্ঞপাশে আবদ্ধ করলেন।” অনন্তর যথাসময়ে বৈশাখী পূর্ণিমাতে বিবাহের দিন নির্ধারিত হইল।

শিবাজী তারাকে লইয়া বাড়ী ফিরিলেন। তারার প্রতি যাহাতে কোনও উৎপড়ীন না হয়, সেজন্য মালেকা শিবাজীকে বিশেষভাবে সাবধান করিয়া দিলেন। তারার প্রতি অন্যায় ব্যবহার হইলে শিবাজীকে যে সকল-হারা হইতে হইবে, তাহা বিশেষরূপে বুঝাইয়া দেওয়া হইল।

 তারাবাঈ ১৯ পরিচ্ছেদ

আজ বৈশাখী শুল্কপরে চর্তুদর্শী। অমল ধবল শশীর মনোহর কৌমুদী জালে গগনমন্ডল ও ভূতল কি সুন্দর ও শোভন দৃশ্য ধারণ করিয়াছে! রায়গড়ে শিবাজীর বাটী আজ বিশেষরূপে ধ্বজপতাকা এবং আলোকমালায় সুসজ্জিত! বিরাট সভামন্ডপে অসংখ্য আলোকের সমাবেশ! রাজবাড়ীর ফটকে ফটকে নহবতে নহবতে মধুর সুরে শাহানা বাজিতেছে! সৈনিকেরা উৎকৃষ্ট বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া নিতান্ত জাঁকজমকের সহিত রাস্তার দুই পার্শ্বে শ্রেণীবদ্ধভাবে দন্ডায়মান রহিয়াছে। বহুসংখ্যক নারী বিচিত্র পরিচ্ছেদ পরিধান করিয়া ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ করিতেছে। ফলতঃ শিবাজীর রাজপুরী আজ উজ্জ্বলিত নাট্যশালার ন্যায় মনোহারিণী শোভা ধারণ করিয়াছে।

একটু রাত্রি হইতেই “বর আসিতেছে, বর আসিতেছে” বলিয়া সর্বত্রই একটা ধুম পড়িয়া গেল। সুর্বণখচিত মনোহর পরিচ্ছদ পরিহিত দুইশত অশ্বারোহী রৌপ্য-নির্মিত বর্শাফলকে রক্তবর্ণ রেশমী পতাকা বিধুনন করিয়া সকলের অগ্রে নমুদার হইল। অতঃপর পঞ্চাশটি হস্তী স্বর্ণাস্তরণে আস্তৃত এবং স্বর্ণমুকুট পরিহিতাবস্থায় অগ্রসর হইল। অতঃপর নানা শ্রেণীর তুরী, ভেরী, বাঁশী, স্বরুদ, রুদ, কুপচাপ, সেতার, সারেঙ্গী, বীণ, রবান, বেহালা প্রভৃতি কোমল সুরের বাদ্যের ঐক্যতান বাজাইতে বাজাইতে বাদ্যকরণ অগ্রসর হইল।

তৎপর খাসগেলাফ, আসাসোটা, অসংখ্য প্রকার ফুলের ঝাড় সহ বাহকগণ অগ্রসর হইল। তৎপর সুবর্ণ তাঞ্জামে চড়িয়া বীরকুঞ্জর, রূপসাগর, বর নাগর আফজাল খাঁ আগমন করিলেন। তাঁহার পশ্চাতে বিজাপুরের কতিপয় অমাত্য সর্দার ও সামস্ত উৎকৃষ্ট অশ্বারোহণে নিতান্ত জাকজমকের সহিত আগমন করিলেন। অতঃপর সোলতানী “তবলখানা,” নানাজাতীয় বিগল, কর্ণাল, ভেরী, দফ, তবল, নাকারা প্রভৃতি নানা প্রকার বাদ্যে শুরু-গম্ভীরভাবে উৎসবের বাজনা বাজাইতে বাজাইতে অগ্রসর হইল।

তৎপর সাধারণ সৈনিক, অন্যান্য লোক এবং রাস্তার জনতা অগ্রসর হইল। ক্রমশঃ বরযাত্রীদল শিবাজীর দীর্ঘ প্রাসাদের সম্মুখে যাইয়া দন্ডায়মান হইলেন। শিবাজী এবং তাঁহার পিতা শাহজী, মালোজী, গুরু রামদাস স্বামী, বলবন্তরাও এবং অন্যান্য কর্মচারীগণ পরম যত্নে সকলকে আদর অভ্যর্থনা এবং সাদর সম্ভাষণে প্রীত এবং সন্তুষ্ট করিয়া যথাযোগ্য আহার ও আবাসস্থান প্রদান করিলেন।

আফজাল খাঁ আনীত নানাপ্রকারের উৎকৃষ্ট মিষ্টান্ন, মোরব্বা, হালুয়া এবং ফলমূল সমস্ত প্রকান্ড প্রকান্ড চুপড়িতে করিয়া অন্তঃপুরে নীত হইল।

আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সঙ্গীয় কতিপয় বিশিষ্ট লোককে প্রাচীর বেষ্টিত একটি উদ্যানবাটিকার মধ্যস্থ সুন্দর গৃহে স্থান দেওয়া হইয়াছিল। শিবাজী সেইখানে আসিয়া আফজাল খাঁ এবং অমাত্যবর্গকে বিশেষভাবে অভ্যর্থনা এবং সম্বর্ধনা করিলেন। শিবাজীর বিনয়নম্র ব্যবহার, মধুর সাদর সম্ভাষণ ও সশ্রদ্ধ যত্নে সকলেই পরশ পরিতোষ লাভ করিলেন।

তারাবাঈ ২০ পরিচ্ছেদ

আজ বৈশাখী পূর্ণিমা। জ্যোৎস্না-জালে জগন্মঙ্গল যেরূপ মনোহারিণী শোভা ধারণ করিয়াছে, রায়গড়ের রাজবাটীও আজ তেমনি আলোক ও পুস্প পতাকা সজ্জায় পূর্বদিন অপোও যেন অধিকতর শোভায় প্রদীপ্ত এবং পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে! সমস্ত দিন ভোজের বিপুল উৎসব অন্তে মগরেবের নামাজের পরে যথারীতি ইসলামী প্রথানুযায়ী উদ্বাহ-ক্রিয়া সম্পন্ন হইল।

অতঃপর জামাতা আফজাল খাঁকে অন্তঃপুরে আনয়নের ব্যবস্থা হইল। অন্তঃপুরের একটি নির্দিষ্ট অট্রালিকায় বাসরের জন্য পূর্ণ হইতেই আরাস্তা করা হইয়াছিল। আফজাল খাঁকে সেই অট্রালিকায় লইয়া বসাইবার কিছু পরেই অন্তঃপুরে ভীষণ আর্তনাদ উত্থিত হইল। সে আর্তনাদ অন্তঃপুরের যে যেখানে ছিল সকলেই চকিত হইয়া শিহরিয়া উঠিল!

“খুন! খুন! তারা খুন হয়েছে!” এই ভীষণ অশনিপাততুল্য শব্দ পুনঃ পুনঃ দ্রুত হইতে লাগিল! শিবাজী এবং আফজাল খাঁ উঠিতে পড়িতে প্রাঙ্গণে ছুটিয়া গেলেন! স্ত্রীলোকদিগের ভিড় ঠেলিয়া সত্যই দেখিতে পাইলেন যে, সালঙ্কারা সুসজ্জিতা তারা বুকে শাণিত-ছুরিকা-বিদ্ধ-অবস্থায় ভূতলে পতিত রহিয়াছে! রক্তে মেদিনী ভাসিয়া যাইতেছে! ছুরিকা তন্মুহুর্তেই বক্ষ হইতে তুলিয়া লওয়া হইল। চিকিৎসার যথারীতি বন্দোবস্ত হইল! কিন্তু হায়! সকলি বৃথা। তীক্ষ্ণধার ছুরিকায় হৃদপিন্ড বিদীর্ণ হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা প্রাণত্যাগ করিল। এই লোমহর্ষনকার নিদারুণ সাংঘাতিক ঘটনার বৃত্তান্ত এই যে, তারাকে যখন নববধূ বেশে সাজাইয়া বাসর ঘরের দিকে লইয়া যাওয়া হইতেছিল, তখন প্রাঙ্গণে অবস্থিত একখানি পালঙ্কির ভিতর হইতে সহসা মালোজী নির্গত হইয়া শাণিত-ছুরিকা তারার বক্ষেবিদ্ধ করিয়া দেন। ছুরি বিদ্ধ করিয়াই মালোজী উর্দ্ধশ্বাসে দরজার দিকে ছুটিয়া যান। দারবান বাধা দিতেই দারবানকেও ছুরি মারিয়া নিজের পথ মুক্ত করেন। কিন্তু অন্তপুরের দ্বার হইতে ছুট পাইলেও বাহিরের দ্বারে সৈনিক-প্রহরী কর্তৃক গ্রেপ্তার হন।

মহা আনন্দের মধ্যে মহাবিষাদের তরঙ্গ উত্থিত হইয়া! পূর্ণিমার শোভা আমাবস্যার অন্ধাকারে ডুবিয়া গেল। আশার কমল নিরাশার পঙ্কে মগ্ন হইল। রায়গড়ে মহা হাহাকার পড়িয়া গেল! তারা শোকে সকলেই আত্মহারা হইল! সেই বিবাহোৎসব দিনের এই নৃশংস হত্যাকান্ডের শোকের বিষয় পাঠক-পাঠিকা অনুমানে বুঝিয়া লউন। আর যদি সহানুভূতি থাকে, তবে এক বিন্দু অশ্রুপাত করুন।

পরদিন প্রত্যুষে মালোজীকে শূলে চড়ান হইল। মুহুর্ত মধ্যে নৈরাশ্য-দিগ্ধ হিংসাপরায়ন আত্মা শূন্যে মিশিয়া গেল। রায়গড়ের বিষাদ ভার আরও বাড়িয়া গেল। কারণ সকলেই বুঝিল যে, মালোজী তারার প্রতি একান্তই আসক্ত এবং অনুরক্ত ছিলেন। কিন্তু তারা তাহাকে একেবারেই চাহিত না। সে আফজাল খাঁর রূপসরোবরেই প্রেমের কমল তুলিতে সাঁতার দিয়াছিল। কিন্তু হায়! হতভাগিনীর আশা পূরণ হইল না। দগ্ধজীবনের অতৃপ্ত আকাঙ্খা এবং প্রেমের আগ্নেয়-পিপাসা লইয়াই জীবন ত্যাগ করিল! প্রেম-সরোবরে ডুবিয়াও এক বিন্দু প্রেমসুধা পানের পূর্বেই তাহার জীবনলীলা শেষ হইল। কি তীব্র বিষাদপূর্ণ ভয়াবহ ঘটনা! শিবাজী কন্যার শোকে নিতান্ত বিমনায়মান এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। আফজাল খাঁর নিকটে গভীর দুঃখ ও করুণ বিলাপ প্রকাশ করিলেন। আফজাল খাঁর চক্ষু হইতে অশ্রুধারা নির্গত হইল।

অনন্তর আফজাল খাঁর সহিত আত্মীয়তা এবং কুটুম্বিতা বজায় রাখিবার জন্য শিবাজী তাঁহার ভগ্নী কামিনীবাঈকে আফজাল খাঁর করে সমর্পণ করিবার প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু আফজাল খাঁ কিছুতেই স্বীকৃত হইলেন না। আফজাল খাঁ তৎপর দিবস প্রাতঃকালে বিজাপুরে কুচ করিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন। শিবাজীও অগত্যা তাহাতে সম্মত হইলেন। পরদিন প্রত্যুষে সেনাপতি সাহেব রাজধানীতে প্রত্যাবর্তন করিবার জন্য প্রস্তুত হইলে, শিবাজী, রামদাস স্বামী প্রভৃতি সকলেই বিদায় দিতে আসিলেন। শিবাজী দুঃখ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “মহাবীর সেনাপতে! আমার আসা পূর্ণ হ’ল না। নৌকা কূলে লেগেও ডুবে গেল। আপনি আমার প্রবল শক্র ছিলেন। আপনি অসাধারণ বীরপুরুষ! আপনি আমার দক্ষিণ হস্ত হলে, দিল্লীর সিংহাসন দখন করাও অসম্ভব ছিল না। আমার আশা পূর্ণ হ’ল না। আপনার সহিত যুদ্ধে কখনও পারব না! আমার রাজ্যলিপ্সা কখনও দমিত হবে না; সে পথের আপনি কণ্টক। যে উপায়ে সে কণ্টক দূর করার জন্য আশা করেছিলাম, তা’ ব্যর্থ হ’ল! সুতরাং এক্ষণে দস্যুবৃত্তি ব্যতীত আর উপায় নাই।”

শিবাজীর কথা শেষ হইতে না হইতেই আফজাল খাঁ ভীষণ চীৎকার করিয়া উঠিলেন। বিস্ময়-বিস্ফারিতনেত্রে সকলে চমকিত এবং ব্যস্ত ভাবে দেখিল-শিবাজী ভীষণ ব্যাঘ্র-নখাকৃতি তীক্ষ্ণধার ছুরিকা আফজাল খাঁর বুকে আমূল বসাইয়া দিয়াছেন। সকলে ভয়ে আর্তনাদ করিয়া উঠিল! আফজাল খাঁর লোকজন প্রস্তুত হইবার পূর্বেই শিবাজী এবং মাওয়ালী সৈন্যগণ মুসলমানগণকে আক্রমণ করিয়া বিপর্যন্ত এবং বিচ্ছিন্ন করিয়া ফেলিল। বহু সম্ভ্রান্ত সৈন্যগণ নিহত হইলেন। হস্তী, অশ্ব, আসাসোটা এবং অন্যান্য সমস্ত মূল্যবান পদার্থই লুণ্ঠিত হইল। বাদ্যকরগণ বাদ্যযন্ত্রাদিসহ ধৃত হইল।

অল্প সংখ্যক লোকই প্রাণ লইয়া বিজাপুরে প্রত্যাবর্তন করিত সমর্থ হইল। শিবাজী অনতিবিলম্বেই আবার নানাস্থানে লুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। আফজাল খাঁ এবং তাঁহার সহকারী যুদ্ধবিশারদ তেজস্বী বীরপুরুষদিগের নিধনে শিবাজী অতিমাত্রায় স্পর্ধিত এবং সাহসী হইয়া উঠিলেন। শিবাজীর ভীষণ ও ভয়াবহ বিশ্বাসঘাতকতা এবং মহাবীর আফজাল খাঁর শোকে মুহ্যমান এবং ক্রোধ ও প্রতিসিংসায় উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন। শিবাজীর এই অমানুষিক হত্যাকান্ড এবং বিশ্বাসঘাতকতায় সমগ্র দক্ষিণ-ভারত চঞ্চল হইয়া উঠিল। যেখানে-সেখানে এই লোমহর্ষক এবং পৈশাচিক হত্যার নিদারুণ কাহিনী একমাত্র আলোচ্য বিষয় হইয়া উঠিল।

শিবাজীর এই নৃশংস হত্যাকান্ড এবং জুগুপ্সিত বিশ্বাসঘাতকতায় দাক্ষিণাত্যের সমস্ত রাজরাজড়াই শিহরিয়া উঠিলেন। সকলেই বুঝিল, শিবাজীর অসাধ্য পাপকর্ম কিছু নাই।

তারাবাঈ ২১ উপসংহার

আফজাল খাঁর হত্যাকান্ডের পরে শিবাজী নানা দুর্গ এবং পরগণা অধিকার করিয়া ক্রমশঃ প্রবল হইয়া উঠিল। অবশেষে বিজাপুরের প্রবল বাহিনীর বিপুল প্রতাপে শিবাজী পুনরায় পর্যুদস্ত এবং নিতান্ত হীনবল হইয়া বিজাপুরের বশ্যতা স্বীকার করেন।

এই যুদ্ধে মোতামদ খান বিশেষ পরাক্রম এবং প্রতিভা প্রদর্শন করায় মালেকা আমেনাবানু তাঁহাকে পরিণয়-পাশে আবদ্ধ করেন।

এই সময়ে দাক্ষিণাত্যে মারাঠীদিগের পুনরভ্যুত্থানের আশা সমূলে নির্মূল হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু অতীব পরিতাপের বিষয় যে, এই সময়ে ভারতেই অদ্ভুতকর্মা তপস্বী সম্রাট মহাপরাক্রান্ত মহাযশঃ বাদশাহ আওরঙ্গজেব সমগ্র ভারতে একচ্ছত্র প্রভুত্বের লালসায় অকারণে গোলকুন্ডা এবং বিজাপুর রাজ্যদ্বয় আক্রমণ করেন। এই দুই রাজ্য পূর্ব হইতে দিল্লীশ্বরদিগের বন্ধুতা সূত্রে আবদ্ধ ছিল এবং শাহজাহানের সময় হইতে উভয় রাজ্য ‘সালামা নজরানা’ দিল্লীর দরবারে পেশ করিতেন। তথাপি আওরঙ্গজেব এই উভয় রাজ্য আক্রমণ করেন।

গোলকুন্ডা এবং বিজাপুর ক্ষুদ্র রাজ্য হইলেও সমৃদ্ধ এবং বলদৃপ্ত ছিল। জ্ঞানচর্চা, শিল্পচর্চা এবং বিজ্ঞানচর্চায় উভয় রাজ্যই বিশেষ খ্যাতি লাভ করিয়াছিল। উভয় রাজ্যের সোলতান, মন্ত্রী এবং সেনাপতিগণ নিতান্ত দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। আওরঙ্গজেবের মহীয়ান চরিত্রে এবং গরীয়সী বীর্যবত্তা ও দূরদর্শিতার শুভ্র-যশে এই উভয়রাজ্য আক্রমণ করাই হইতেছে অদূরদর্শিতা এবং স্বজাতিদ্রোহিতার দুরপনেয় কলঙ্ককালিমা। এই রাজ্যদ্বয় দখল করিবার জন্য তাঁহাকে প্রায় ত্রিশ বৎসরকাল ভীষণ লোকক্ষয়কর যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল। মুসলমান বাদশাহ ও বহু দুর্গ দখল করিয়া স্বাধীন আত্মকলহের সুযোগে শিবাজী অবসর বুঝিয়া বহু পরগণা ও বহু দুর্গ দখল করিয়া স্বাধীন রাজ্য পত্তন করেন। মারাঠীগণ প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠে। অবশেষে আওরঙ্গজেবকে এই মারাঠী শক্তি দমনের জন্য বিশেষ বেগ পাইতে হয়। আওরঙ্গজেব বিজাপুর আক্রমণ না করিলে, শিবাজী আর কখনও মাথা তুলিবার সুবিধা পাইতেন না। বিজাপুরের রাজশক্তিই শিবাজীকে চিরকাল দমন রাখিতে সমর্থ হইত।

তোমার ছবির ধ্যানে, প্রিয়


তোমার ছবির ধ্যানে, প্রিয়,
দৃষ্টি আমার পলক-হারা।
তোমার ঘরে যাওয়ার যে-পথ
পা চলে না সে-পথ ছাড়া।
হায়, দুনিয়ায় সবার চোখে
নিদ্রা নামে দিব্য সুখে,
আমার চোখেই নেই কি গো ঘুম,
দগ্ধ হ’ল নয়ন-তারা॥

Exit mobile version