Site icon BnBoi.Com

হিরোসিমা, মাই লাভ – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

হিরোসিমা, মাই লাভ - সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

 ০১. সাবমেরিন লেদু

[আমার আর সব রচনাই আত্মজৈবনিক। শুধু এই একটি ছাড়া। মৃত মানুষদের নিয়ে লিখতে গিয়ে এই প্রথম আমাকে একটি কাল্পনিক উপন্যাস লিখতে হল। কেননা, আমি দেখলাম, মৃতের গল্প কোনও জীবিত মানুষের পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। তা যদি হত, তাহলে জীবিতের ত্বক মৃতের চামড়া গ্রহণ করত। কিন্তু, না, জীবিতের শোক মৃত গ্রহণ করে না। আমরা এ-দিক থেকে বড় পরাধীনভাবে বেঁচে আছি। তাই, এই প্রথম আমার একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক উপন্যাস, যার সব চরিত্র কল্পনাপ্রসূত। এমন কি, নায়ক হিরণের সঙ্গেও আমার কোনও মিল নেই। এই প্রথম এ-রকম। আমার আর সবই গঙ্গার কবিতা। শুধু এইটে যমুনার।]

 

০১. সাবমেরিন লেদু

ঠিক ঘুম ভাঙার আগে স্বপ্নের শেষটা ছিল চিনু তাকে নাড়া দিয়ে ডাকছে। অথচ, জেগে উঠে হিরণ দেখল, চিনু পাশে শুয়ে নেই।

বাইরে অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। তারা তখনও জেগে, হিরণের মনে পড়ল, যখন-এ বছরের প্রথম মেঘ-ডাকাডাকি শুরু হল হঠাৎ, ঝোড়ো হাওয়ায় ছাদের দরজার খোলা-বন্ধের ঘনঘন আওয়াজ থামাতে চিনু উঠে গিয়েছিল পাশ থেকে, আর সে নেমে আসার আগেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল হিরণ।

ছাদের দরজার চাবি সব ফ্ল্যাটেই আছে একটা করে। কে কখন খুলে রেখে গেছে তা জানার উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত কোন ফ্ল্যাট বন্ধ করতে উঠবে, তা নির্ভর করে একটা দরজা ঝড়ে আছড়াচ্ছে—সারারাত আছড়াচ্ছে এটা উপেক্ষা করা তথা এই টেনশন, বুকে-করাঘাত বা ওই হাহাকার সহ্য করার ক্ষমতা কোন ফ্ল্যাটের কতখানি, তার ওপর। অবশ্য, এও অস্বীকার করা যায় না যে ছতলার টপ-ফ্লোরের দুটি ফ্ল্যাটের যে-কোনও একটির ওপরেই নৈতিকত এ দায়িত্ব বর্তায়, এবং প্রায় মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করে মুখোমুখি ১২ নং থেকে কোনওরূপ প্রতিক্রিয়া না দেখা দিলেও, শেষ পর্যন্ত, চিনু জানে, সে কিন্তু হার মেনেছিল রতিক্লান্ত হিরণের প্রতি অসীম মমতাবশতই। বয়স বাহান্ন পেরল, আহা, রোগা মানুষটা এ-বয়সে যেন বড্ড নেতিয়ে পড়ে। নয়-নয় করেও চিন্ময়ী প্রায় বছর দশেকের ছোট।

ঝড়-বাদল উপেক্ষা করে চিনু তাই ছাদে উঠেছিল।

এখন, এই মাঝরাতে ধড়মড়িয়ে জেগে, চিনু-নেই-এমন বিছানায় একা উঠে বসে, হিরণের প্রথমেই মনে হল, অ্যাঁ, চিনু কি তবে সেই তখন থেকে আর ফেরেনি নাকি?

শোবার ঘর থেকে ডাইনিং স্পেসে বেরিয়ে এ-পর্যন্ত-অবিচলিত সে আলো জ্বালে। সঙ্গে সঙ্গে চোখের পলকে তার শরীরময় ছড়িয়ে পড়ে ভয়, ট্রেলে আগুন, তার সকল স্নায়ু-শিরা, বস্তুত তার মাথার চুল ও লোম–এ-সবও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে সে টের পায়। কেননা, ঠিক যা ভেবেছিল, আবার যা ভাবতে চায়নি বলে শেষ পর্যন্ত পেরেও ওঠেনি ভাবতে, সে দেখল, ফ্ল্যাটের সদর দরজা দুহাট করে খোলা। এই দরজার এখন আর বন্ধ হওয়া নেই। এখন এ শুধুই হা-হা করছে খোলা। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু এখন হাওয়া নেই। ছাদের দরজাতেও সেই খোলা-বন্ধ, কই, আর নেই তো।

দুজন লোক—দুজনই মনে হয় তার— যারা ছাদে লুকিয়ে ছিল সেই সন্ধে থেকে… চিনু ছাদে পা রাখা মাত্র তার মুখ চেপে ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে… ও মাগো, চিনু সেই থেকে ছাদের অন্ধকারে চিৎ হয়ে পড়ে? জীবিত বা মৃত, এই আকাশ-ভাঙা বৃষ্টি তার ওপর ঝরে পড়ছে সেই তখন থেকে, যখন, যে-সময় জুড়ে, তারই সপ্ৰেম উপহার নাকডাকা কৃতঘ্ন ঘুমে সে ঘুমিয়ে–এই দৃশ্য কল্পনা করতে গিয়ে হিরণের ঝুলপির পাশ দিয়ে স্বেদধারা নেমে আসে দরদরিয়ে, আর, ঠিক তখনই তিনতলার ল্যান্ডিং-এ সে চেনা মনুষ্যকণ্ঠ শুনতে পেল।

কে লেদু? হিরণ জানতে চাইল।

হ্যাঁ-হ্যাঁ। উত্তরে চিনুর গলা শোনা গেল, লেদু এসেছে।

চিনুর স্বর আকণ্ঠ ও উন্মুল… ভয়ার্ত। তবু তা শুনে স্বস্তি বোধ করে হিরণ। পায়ের নিচের মাটির ছোঁয়া পায়।

হিরণদের ফ্ল্যাটবাড়ি। একতলায় কোলাপসিবল গেটে তালা। একদা, গেটের পাশে, ভেতর দিকে, বারোটি ফ্ল্যাটের জন্য ছিল ফ্ল্যাটপিছু একটি করে বেল। পিয়ানোর রিডের মতো সারবন্দী কালো ডেকোলাম-টপ বোর্ডের ওপর সাদা সুইচগুলো, টিপলেই টুংটাং। পাড়ার ছেলেরা গেটের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বেল বাজিয়ে মাঝে-মধ্যে পালাত। গৃহিণীদের দিবানিদ্রায় ব্যাঘাত। সে অমন হয়ে থাকে। তারপর একদিন অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মধুবাবুর ফ্ল্যাটে, তখন দুপুর রাত, বেল বেজে উঠল। ওঁর বাড়িতে আবার হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। প্রথম তিন কলি না বেজে যার থামবার নাম নেই। পাঁচতলা থেকে শীতের মধ্যরাতে চাদরে মাথামুড়ি দিয়ে নেমে মধুবাবু দেখলেন, কোথায় কে, সব ভোঁ-ভাঁ।

মধুবাবু শাসকপন্থী শরিকি রাজনীতি করেন, স্থানীয় কাউন্সিলর। ছাদের সিঁড়িতে পাড়ার লুম্পেনদের প্রেম, কন্ট্রাসেপটিভ রাবার—সব দেখেছেন। কেন এ-সব, তাও জানেন। স্বাধীনতার পর যাদের জন্ম, তাদের সামনে যাহোক একটা জাতীয় আদর্শ, একটা মধুর স্বপ্ন যদি ওরা তুলে ধরতে পারত। যেমনটা করেছিল রাশিয়া-চীন! বিপত্নীক মধুবাবু বছরখানেক হল জেলা কমিটির কমরেড লীলা ঘোষকে পূর্বপক্ষের দুই ছেলে-মেয়ের মা হিসেবে ঘরে এনেছেন, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নবজন্ম— তিনি কি বোঝেন না, মধ্যমাঘের রাতদুপুরে এই জন্মদিনের শুভেচ্ছা—পরপর দুদিন—এ কার উদ্দেশ্যে এবং কারা এসব করছে। নিঃসন্দেহে, কংগ্রেসি মাস্তানদের কাজ।

পরদিনই বেল-বোর্ডটি তুলে নেওয়া হয়। এ-সব অবশ্য হিরণরা আসার আগের কথা। এখন নিচে থেকে ডাকাডাকি করতে হয়, রাতবিরেতে কেউ এলে। নিচে নেমে গিয়ে গেট খুলে দিতে হয়। চিনু তাই নিচে নেমে গিয়েছিল।

ওরা ওপরে উঠে আসছে। প্রথমে লেদু, পরে চিনু। পাখিও নয়, কেননা পাখি তো তবু ডানা থেকে জল ঝাড়ে–বোঝা যায়, গাছের ফল কি একটা শস্যের দানা যে-ভাবে ভেজে, ভিজে যায়, সেইরকম অচেতন, নিপ, আত্মরক্ষাহীনভাবে লেদু কে জানে কঘণ্টা ধরে এমন একটানা ভিজেছে যে, এখন তাকে দেখে তার ফ্যাকাশে-নীল কোঁচকানো মনুষ্য-চামড়াটা হ্যাঙারে টাঙিয়ে দেওয়ার কথাই প্রথমত মনে পড়ে। শেষ কটা সিঁড়ি উঠতে গিয়ে সে দু-দুবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মানুষ নয়, তাকে দেখে হিরণের মনে হল, তাড়া খাওয়া জন্তুই এমন বোধবুদ্ধিহীনভাবে এগিয়ে আসে। যখন, সে এগচ্ছে না পিছচ্ছে, নাকি, সেই সর্বনাশাকেন্দ্রের দিকেই চলে যাচ্ছে যেখান থেকে তার পলায়ন, সে ব্যাপারে তার কোনও হুঁশ থাকে না। যখন শুধু ছোটা। আর হুমড়ি খেয়ে পড়া। নাজানি রাস্তায় আরও কতবার এ-ভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে বেচারা! পড়তে পড়তেও উঠে দাঁড়িয়েছে।

এসো এসো, তোমরা ঘরে এসো, বলে তাদের আগেই ঢুকে পড়ে বসার ঘরের মেঝেয় হাত-পা ছড়িয়ে বসে পড়ল লেদু। তাকে ঘিরে বৃত্তাকারে একটি জলাসন তৈরি হতে থাকে।

হ্যাঁ, যে-কোনও সর্বনাশের কথাই সে এখন বলবে। এবং সে যা বলবে শোনামাত্র তা সত্য হয়ে যাবে ও তা মেনেও নিতে হবে। কারণ, ঠিক যা ঘটেছে, সে দাঁড় করাবে সেই অনস্বীকার্যের সামনে। তবে যাই ঘটে থাকুক, যাই বলুক সে, আসল কথা হল, সে-সর্বনাশের সঙ্গে সে বা চিনু সরাসরি কতখানি জড়িত। আর, তাদের দুজনের যে কিছু হয়নি এতো দেখাই যাচ্ছে। লেদুর পক্ষে এমন কথা জানাবার আর সম্ভাবনা নেই যে, ওগো কাকা, ওগো কাকিমা, তোমাদের দুজনের বা দুজনের একজনের এই সর্বনাশ হয়েছে। হ্যাঁ, সুযোগ সে পেয়েছিল বটে একবার। যখন হিরণের কাঁধের মস্ত টিউমারটির ব্যাপারে সে গিয়েছিল পার্ক সার্কাসে বায়োপসি-রিপোর্ট আনতে আর সে ফেরার আগেই হিরণ বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল বাঁশদ্ৰোনিতে, ভাগ্নীর ওখানে। লেদু মোটরবাইক চালিয়ে এ-বাড়ি সে-বাড়ি করে শেষমেশ চেতলা থেকে সেই যার নাম বাঁশদ্ৰোনিতে তাকে খুঁজে বের করে ও হাসতে-হাসতে এন-এ-এফ বা নাথিং অ্যাবনর্মাল ফাউন্ড রিপোর্টটি তার হাতে তুলে দেয়। ভগ্নদূত সেই একবারই চান্স পেয়েছিল যখন সে বলতে পারত, ওগো কাকা, তোমার সর্বনাশ হয়ে গেছে। অমন সুযোগ জীবনে একবারই আসে। আর সে সুযোগ সে হারিয়েছে। চিরতরে।

অতএব, এ প্রলয়-পয়োধি রাতে এমন আর কী ঘটে থাকতে পারে যা তাকে আর চিনুকে জানাতে সে এ-ভাবে ছুটে এসেছে তা ভাবতে গিয়ে হিরণ কোথাও থই পেল না। তাই সে ধরে নিল, তাহলে এমন কিছু ঘটেছে যাতে লেদুই প্রত্যক্ষভাবে ইনভলভড়। সর্বনাশ হয়ে গেছে তারই।

বৌদি কেমন আছে? সে জানতে চাইল।

অর্থাৎ লেদুর মা।

ততক্ষণে একটা বড়সড় গামছা এনে লেদুর মাথা মুছিয়ে দিচ্ছে চিনু। গামছার ভেতর থেকে লেদু জানাল (তার মুণ্ডু দেখা যায় না) ন-কাকা, একটা টে-টেলিফোন এসেছে মার্সেদ থেকে। ওখানে একটা কিছু হয়েছে। মার্সেদ? সে তো ম্যাপে-নেই-তবু-আছে, ক্যালিফোর্নিয়ার এমন এক স্মল-টাউন— হাজার হাজার… প্রায় চার হাজার মাইল দূরে প্রশান্ত মহালমুদ্রের ধারে বোধ ও বুদ্ধির বাইরে শ্বেত জনবসতি এক—তার কাছে যা শুধু স্প্যানিশ শব্দ একটি, যা এসেছে মার্সি বা ক্ষমা থেকে, যা রঞ্জনের বৌ সুমিতা তাকে জানাল এই তো সেদিন, কমাস আগে, দীঘার ফরেস্ট বাংলোয় দোতলার বিমুগ্ধ বারান্দায় বসে।

চার মাসও পুরো হয়নি। ফেব্রুয়ারিতে মার্সেদ থেকে এবার সুমিতা এসেছিল একাই, তার ছোটভাই রবির বিয়েতে। তারপর কদিনের জন্যে ওরা দীঘা গিয়েছিল। চিনু ছিল, লেদু আর তার বৌ শর্মি ছিল। সঙ্গে ছিল ওদের চার বছরের বিছুটা যে সুমিত্তার রিস্টওয়াচটা ওখানে বাংলোর ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল, নইলে পচে যাবে বলে। দুটো দিন, আহা কী মাতিয়েই রেখেছিল ছেলেটা। একতলার বাগান থেকে ছেলেটাকে দোতলায় সুমিতার কাছে পাঠানো হয়েছিল “সোনাদিদার কাছ থেকে, যাও, লাপিয়ের-এর সিটি অফ জয় বইটা চেয়ে আনো” এই বলে। ব্যাটা ঠিক ঠিক বলেছিল। এবং দুহাতে বুকে ধরে সিঁড়ি ভেঙে বইটা নিয়েও এসেছিল।

নন্দিন, বেশ ভাল আছেনদা, খুব অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছে। পড়াশোনা খুব ভাল করছে। বারবার জানাত সুমিতা। দশ-পনের মিনিট অন্তর নিজের থেকেই বলত বারবার। কেউ জানতে চাক বা না চাক।

একটা কিছু?

হিরণ এই প্রথম টের পেল দিকচিহ্নহীন জলরাশির ওপর সবে মাথা তুলেছে একটি চঞ্চল টেলিস্কোপ-চক্ষু, সমুদ্রের গভীরে একটি স্থির সাবমেরিন দাঁড়িয়ে আছে।

রঞ্জন, সুমিতা, তাদের দুই ছেলে জীয়ন আর অঞ্জন এবং…এবং…হ্যাঁ, তাদের একমাত্র সন্তান নন্দিন এদের কারও একজনের ভীষণ একটা কিছু হয়েছে। তবু, হয়ত, না নিশ্চয়ই এদের কারও মৃত্যু-সংবাদ লেদুর কাছে নেই। না, নন্দিনের তো নয়ই। ভাইনয়, ভ্রাতৃবধু নয়, ভ্রাতুস্পুত্র নয়, শুধু তাদের আত্মজার কথা ভেবে এতক্ষণের মধ্যে এই প্রথম সে চিন্ময়ীকে খোঁজে ও তার মুখের ভাষা পড়তে তার মুখের দিকে তাকায়।

সে দেখল, লেদুর মাথা-মোছা থামিয়ে, গামছাটা বুকের কাছেদুহাতে দুমড়ে ধরে চিনু দাঁড়িয়ে। তার পিঠ দেওয়ালে।

চোখের তারা ছাড়া তার সব কাঁপছে।

 ০২. হো, যারা ধোঁকে হ্যায়…

হিরণের হাতের আঙুলগুলো লম্বা-লম্বা। আঙুল কেন, তার তালুর গোটা গড়নটাই কেমন যেন অমানবিক ঢঙে লম্বাটে। চামড়া দিয়ে ঢাকা তাই, যৎকিঞ্চিৎ মেদমাংসও রয়েছে, পাঠোদ্ধারের আশায় রয়েছে বিবিধ হস্তরেখা। নইলে বলা যেত, কঙ্কালের হাত। সমস্ত স্কেলিটনের হাত লম্বাটে।

হাতে সানের মাউন্ট তার বরাবরই চাপা। বস্তুত, একটা গহুরই সেখানে। সূর্য-রেখাটিও ভেঙে চুরমার। আর… লাইফ-লাইনের কথা ধরলে সে তো কবেই মরে-হেজে গেছে বলতে হয়, এতই হাস্যকর ছোট্ট সেটা, ধর্তব্যের মধ্যে নয়, এবং, অমনটা বললে সম্পূর্ণ মিথ্যেও বলা হয় না। জীবন জুড়ে বেঁচে থাকতে, থাকতে, থাকতে, থাকতে কে যে কবে, কখন, টুক করে কোথায় মরে পড়ে আছে, সে গায়েব লাশের সন্ধান জীবদ্দশায় আর পাওয়া যায় না।

আশপাশে অনেকেই তো এভাবে মরণোত্তর বেঁচে আছে। অনেকে কেন, অধিকাংশ। একদিন ছিল, যখন মনে হত, ব্যতিক্রমহীনভাবে প্রায় সকলেই। একদিন, যখন তার বয়স ২৫-২৬, মনে হত তার, সে আপাদমাথা বিশ্বাসও করত যখন এমনটা ভাবত, যা প্রায় টায়ে-টায়ে দেখতে পেত বললেও অংশত ঠিক বলা হবে, যে, এত লাশ তার মৃত অস্তিত্বের চারিধারে, শুধু এই একটা শহরে! অফিসে যাও— লাশ সহকর্মী, কারখানার খোলা গেটে বিড়ি ফুঁকছে লাশ শ্রমিক, বাড়িতে লাশ-ভ্রাতা, লাশ-পিতা, লাশ-মাতা, কোনওদিন একগাড়ি লাশ-যাত্রী নিয়ে চলেছে ৯ নং ডাবলডেকার, কেবিনে লাশ-ড্রাইভার, অনাদি কেবিনের ছোট্ট টেবিলে মুখোমুখি লাশ-দম্পতি, সামনে গরম মোগলাই, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাড়ি চেপে বেরিয়ে আসছেন লাশ-ভাইস চ্যান্সেলর, কফি হাউসে লাশ-কবি, লাশ-সাংবাদিক, লাশ-মেয়র, লাশ-মন্ত্রী মায় হাইকোর্টে বিচারাসনে লাশ-বিচারপতি… কিন্ডারগার্টেনেও কলহাস্যমুখর লাশ-শিশুর দল এমনকি! তখন, সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য লাশ মনে হত তাদের, এ মরা শহরে যারা তখন প্রেম করত। প্রবল বর্ষার মধ্যে, ময়দানের বাসসাপে, পিছনে ভিক্টোরিয়া, রঙিন চীনা ছাতার নিচে এক বাঙালি লায়লা-মজনুকে দেখে মনে পড়ে, আজ থেকে ২৫/২৬ বছর আগে একদিন, কোনও একদিন, তার অবিকল তাই মনে হয়েছিল।

পরে এম. এস এবং এফ. আর. সি. এস হলে কী হবে, তার ছোটভাই রঞ্জন ছিল আদতে একটি ইন্টারমিডিয়েট, যে কিনা প্রথম টি, এস. এলিয়ট পড়েছিল বিলেতে গিয়ে! হিরণই তাকে বইটি পড়তে বাধ্য করে। এখান থেকে এক কপি ওয়েস্ট ল্যান্ড কিনে সে তার তঙ্কালীন চেলসির ঠিকানায় তাকে পাঠায়। সেই টি, এস, যার অমর প্রেমগীতিতে ছিল—

A crowd flowed over London Bridge, so many
I had not thought Death had undone, so many

তো, হিরণের হাতে আয়ু-রেখা একরকম না থাকার মধ্যে। ভাগ্য বলতেও তার হাতে কিছু নেই, নেই কোনও রেখাটেখা। সানলাইন বা যশোরেখা, সে তো কবে ভেঙে চুরমার। যশ নেই, আয়ু নেই, ভাগ্য নেই। একটি প্রখর বিদেশ-রেখা তবু, কেন যে, তার তালুর নিচে থেকে অমন অমোঘভাবে রিং-ফিঙ্গারের দিকে উঠে গেছে! সেই ছোটবেলা থেকে যখন যতবারই হাত পেতেছে, এমনকি মা-র সঙ্গে কাশীর হরিশ্চন্দ্র ঘাটে বাল্যকালের প্রসিদ্ধ ভৃগুমুনিও, অন্যান্য বিষয়ে মতান্তরে মাথা নাড়লেও তার হাতের ওই চচ্চড়ে বিদেশ-রেখাটির প্রবল অস্তিত্ব সম্পর্কে তিনিও সংশয় প্রকাশ করেননি। ম্যাপে নীল সমুদ্র-ছবির ওপর একটি বল বাণিজ্য-রেখা যেন, যার ওপর একটি নিশ্চল পালতোলা অর্ণব-পোতই শুধু যা এখনও দেখা দেয়নি।

ছেলেবেলা থেকে হাত পাততে পাততে তাই, একটা ধারণা তার কখনও না মরে, অজান্তে হঠাৎ লাশ না হয়ে গিয়ে, না-গায়েব বেঁচে ছিলই যে আর কিছু না হোক, বিদেশ সে যাচ্ছেই। কীভাবে, তা জানে না। কোনও পরিকল্পনা নেই। তেমন কোনও লাইনও সে ধরে নেই। তবু সে যাচ্ছে।

এ নয় যে জ্যোতিষে তার খুব বিশ্বাস। আদৌ তা নয়। তবু সেই কবে থেকে একটাই কথা শুনতে শুনতে শুনতে শুনতে শুনতে সে, ঠিক বিশ্বাস নয়, ভাবতে কেমন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে হয়ত একটা সুযোগ আসবে। এলে, সে যাবে।

কলেজে ঢুকে ফোর্থ ইয়ার পড়তে না-পড়তেই বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে ডানা মেলা শুরু হল। না, ডানা মেলা বললে ঠিক বলা হয় না। বেশ ভুল বলা হয়ে যায়। বলা উচিত, পাল তোলা। কেননা, তখন তো সবাই জাহাজেই যেত।

সবার আগে গেল বাদল। বাদলের সঙ্গে হিরণ পড়ছে সেই ক্লাস-টু থেকে, টাউন স্কুলে। ১৯৫২-য় শেষ ম্যাট্রিকুলেশনে সে আর বাদল দুজনেই পাস করল সেকেন্ড ডিভিশনে। তার হওয়ার কথা ছিল ফার্স্ট ডিভিশন আর বাদলের মেরেকেটে থার্ড। বাদল পেল থার্ড ডিভিশন থেকে ২১৭ নম্বর বেশি, আর সে পেল ফার্স্ট ডিভিশনের থেকে ৫ নম্বর কম। মুড়ি-মিছরির দর এক হয়ে গেল। নম্বরের দিক থেকে কান ঘেঁষে, প্রেসিডেন্সিতে ঢুকল আর্টস নিয়ে। বাংলা বৈ অনার্স পেল না। বাদল নিল কমার্স। খোলা গেট দিয়ে গটগট করে অনার্স-সহ ঢুকে গেল সুরেন্দ্রনাথে। সেই থেকে জন্ম বাদলের প্রতি তার অবিশ্বাসের। সে বাদলকে সন্দেহের চোখে দেখা শুরু করল।

তারপর, ফোর্থ ইয়ারে তারা তখন। কলেজ স্ট্রিটে তখন রোজ দুপুরে তেলেঙ্গানার বিলম্বিত ঢেউ আছড়ে পড়ে। রোজ বিপ্লব! ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়। তৎকালীন দাপক (এখন গ্রেস) সিনেমার দুপাশের দোকানগুলো থেকে রোজ দুপুরে, কলেজ পালিয়ে, জলের ট্যাঙ্কগুলো নামিয়ে এনে ব্যারিকেড তৈরি করা, সঙ্গে কলুটোলার গলি থেকে টেনে-আনা ঠেলা দু-চারটে। পুলিস তেড়ে এলে কমরেড সীতা মুখার্জি তীক্ষ্ণ চিৎকার করে হুকুম দিতেন, কমরেডস্, রেজিস্ট করুন। কদিন ধরে পাত্তা নেই বাদলের। পাশে নেই। গোলদিঘির জনসভায় গুরুতর আহত হয়েছিল কমরেড লতিকা মিত্র। লতিকার ডান হাত পুলিস পাকিয়ে ভেঙে দিয়েছিল। মেডিকেল কলেজের এমার্জেন্সিতে ঢুকে, তখন সন্ধেবেলা, সেকালের প্রবাদপ্রতিম অর্থোপেডিক্স ডাঃ পঞ্চানন চক্রবর্তী, কী হয়েছে মা তোমার, দেখি-দেখি বলে ফুলে-ঢোল কমরেড মিত্রর ফর্সা হাতখানা কব্জির কাছে তাঁর লোমশ পাঞ্জা দিয়ে চেপে ধরে প্রবল জোরে মারলেন এক হ্যাঁচকা টান, কটাং করে ভয়াবহ শব্দ এক, কমরেড লতিকা চিৎকার করে উঠল বাবা গো বলে আর ডাক্তার চক্রবর্তী বললেন, যান, সেট হয়ে গেছে বোনটা। ইউ আর কিওর্ড।

এমার্জেন্সিতে ডিউটি ছিল টেকো তপনের। সে বছরেই তপন আর রঞ্জন বেলুড় বিদ্যামন্দির থেকে ইন্টারমিডিয়েট করে মেডিকেলে ঢুকেছে। মেডিকেল কলেজের গেটে, হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে, তপনই তাকে প্রথম জানায়, হিরুদা, শুনেছ, বাদলদা কাল ওয়েস্ট জার্মানি চলে গেছে?

ডানা-মেলার, না তো, পালতোলার সেই শুরু।

কিন্তু, বাদল! ওয়েস্ট জার্মানি! শুনে কী ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিল সে।

বলতে বলতেই তপনের বাস এসে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি ২নম্বর দোতলারফুটবোর্ডে লাফিয়ে উঠে, চলন্ত বাস থেকে হাত নেড়ে তপন চেঁচিয়ে বলেছিল, “রঞ্জনের কাছে সব শুনে নিও।

ওয়েলিংটনের দিকে শীত-কুয়াশার জন্য বেশিক্ষণ বাসটা দেখা যায়নি। যতক্ষণ যায়, তারপরেও বহু সময় সেদিকে তাকিয়ে ছিল হিরণ।

ছিপছিপে, মিষ্টি ও মাকুন্দ, মেয়েদের চেয়েও সুন্দর, গোটা স্কুলজীবন জুড়ে, আহা, কী অকথিত প্রেমেই যে সে পড়েছিল বাদলের। উত্তরা সিনেমায়, ক্লাস টেনে পড়তে, টেস্ট পরীক্ষা ও ম্যাট্রিকুলেশনের মাঝখানের সময়টা সিনেমার নেশায় পেয়ে বসে হিরণকে। সঙ্গে থাকত, সব সময়, ক্লাস নাইনের ছোটভাই রঞ্জন। বাদল বসত মাঝখানটিতে। কত ছবিই না তারা দেখেছে একসঙ্গে। মনে পড়ে ঝামাপুকুরের কীর্তি সিনেমায় (এখন জহর) প্রথম দেখা বাজি। সরমায়ে কাহে, ঘাবড়ায়ে কাহে, বা, সি. আই. ডি-র যাত্তা কাঁহা হ্যায় দিওয়ানে, কাকুর লিপে গীতা দত্তর কিন্নরীকণ্ঠ, ও. পি. নাইয়ারের সুর— যার মধ্যে ছিল, তেরা দিলমে ফিফটি, মেরা দিলমে ফিফটি-জমানা হত্যায় পুরা…ইত্যাদি। একটা গান খুব গাইত বাদল। হো, যারা ধোঁকে হ্যায়, ধোঁকে হ্যায় পিছলে জমিন/বাবুজি ধীরে চলনা/পেয়ারমে জারা সামহালনা.. এটা কোন ছবির কিছুতেই মনে পড়ে না আজ। মনে পড়ে গীতা দত্ত অনুকরণে কী অবিকল লচক-সহযোগেই না সে যাতা-কে যাত্তা আর সামালনা-কে সামহালনা করতে পারত।

স্কুলে পড়তে শ্রীতে কবি দেখতে দেখতে, বসন যখন ঢলে পড়ল মৃত্যুতে, তার মাথার কাছে প্রদীপটা শেষবার কেঁপে উঠে দপ্ করে নিভে গেল, তখন সেই বিপুল ট্র্যাজেডিতে কী উন্মথিত না হয়েছিল তারা তিনজনে একসঙ্গে, সে, বাদল আর রঞ্জন। বাদল তার ঘাড়ে মাথা রেখে বলেছিল, কীরে, কিছু বলবি? মানে, ইজন্ট ইট সুপার্ব?

মায়, একসঙ্গে ঘাটশিলা গিয়েছিল। তারা তিনমূর্তি।

সেই বাদল এই মুহূর্তে জার্মানিতে। সত্যি, এর চেয়ে রহস্যময় বুঝি আর কিছু হয় না। অন্তর্ধান ছাড়া একে আর কী বলা যায়, নেতাজির পরে। এ অপার রহস্যের বিস্তৃত বিবরণ সে আর রঞ্জনের কাছে বাড়ি ফিরে কী শুনবে।

পরে বুঝেছে, লাইনে থাকলে, সেও তখন চলে যেতে পারত। তার হাতের আজন্ম-অটুট বিদেশ-রেখাটি তখনই মাহাত্ম্য পেতে পারত এবং অনেক সহজেই। যুদ্ধোত্তর পূর্ব ইউরোপে তখন নারী-শিশু আর বালক-বালিকার ভিড়-পৃথিবীর সর্বত্র থেকে পশ্চিম জার্মানিতে ইমপোর্ট হচ্ছে সক্ষম ও সাবালক যুবকের পাল, বিশেষ করে ওয়েস্ট জার্মানিতে যেতে ভিসাটিসার বালাই তখন একদমই ছিল না। পরে জেনেছিল, বাদল আসলে ওখানে একটি পাঊরুটির কারখানায় ময়দার বস্তা তোলার কাজ পেয়েছে।

তুলুক বস্তা। তবু তো বিদেশ! স্টুটগার্ড। জার্মানি। ওক, বিচ, এলম, বার্চ। ব্ল্যাক ফরেস্ট। নদীর নাম রাইন। চারিদিকে ফুটফুটে সাদা দেবদেবী। ঝকঝকে রাস্তা। ঝকঝকে বাড়ি। বাড়ির চারচালায়, ফুটপাথের ধারে ধারে, গাছের পাতায় কোথায় নয়—নীল বরফ।

মেম। মেম মানেও সেই বরফ-ব্লু দিয়ে মাজা সাদা-সাদা পা, ঊরু পর্যন্ত উন্মুক্ত। সে সময় কলকাতায় ৬০ ভাগ লোক ধুতি পরত। তাই শুনে তার প্রথমেই মনে হয়েছিল, বাদল এখন সেই দেশে যে-দেশে পুরুষরা পা ঢেকে রাখে এবং মেয়েরা তা খুলে দেখায়।

সেই শুরু। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়-পর্বে ঢোকার আগে, পরে আশপাশ থেকে আরও অন্তর্ধান শুরু হল। ততদিন অবশ্য যাওয়া বেশ টাফ হয়েছে, ভিসা তো লাগেই, লাগেজব-ভাউচার… তবুযাওয়ার যেন বিরাম নেই। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কেউ গেল কানাডায়, কেউ আমেরিকায়। অধিকাংশ ব্রিটেনে।

তা বলে, এম. বি. বি. এসের রেজাল্ট বেরনোমাত্র রেজিস্ট্রেশন হওয়ার আগে, রঞ্জন তাকে এসে বলবে, নদা, আমি বিলেত যাব, তুই কিছু টাকা স্ট্যান্ড করতে পারবি?–এ জন্যে হিরণ মোটই প্রস্তুত ছিল না।

 ০৩. হ্যাঁ, আমি নন্দিন

লেদু একটা ট্যাক্সি এনেছিল। এক বস্ত্রে চিন্ময়ী আর হিরণ বেরিয়ে পড়ল। যে গামছাটা দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিচ্ছিল চিনু, সেটা সেই থেকে ওর কাঁধেই থেকে গেছে। কী না ভেবে যে লেদু সেটা শক্ত করে কোমরে বেঁধে নেয়!

২৭ এপ্রিল। রাত এখন ১টা হবে। তার মানে মার্সেদে এখন, আজই, বেলা ১টা কি দেড়টা। ওরা কমবেশি ১২ ঘণ্টা পিছিয়ে। উত্তরায়ণ-দক্ষিণায়নের জন্যে আধঘণ্টা এদিক-ওদিক হয়। মার্সেদের সময়ের হাড়হদ্দ হিরণের জানা। নন্দিনকে শেষ ফোন করল এই তো সেদিন, ১২ এপ্রিল। ভবানীপুরে চিনুর দাদার বাড়িতে গিয়ে সন্ধেবেলা কল বুক করে টোকেন নম্বর হাতে বসে থাকা। সময় দেওয়া হয়েছিল এখানকার রাত ৯টা। উপলব্ধিতে পাওয়া মুশকিল, তবু ওখানে তখন, সেদিনই কমবেশি সকাল ৯টা হতে বাধ্য।

এ-বছর ফেব্রুয়ারির গোড়ায়, সুমিতা ফিরে গেল। এয়ারপোর্টের মাইক্রোফোন-সিস্টেমে ফ্লাইট নং থ্রি-ও-থ্রির প্যাসেঞ্জারদের ডাকছে এমন সময় ভ্রাতবধর হ্যান্ডব্যাগে, আর সবাইকেলকিয়ে, টুক করে একটা ছোট্ট বাক্স ফেলে দিয়েছিল হিরণ।

আংটি একটা। অপরাধীর হাসি হেসে বলেছিল, জন্মদিনে নন্দিনকে দিও।

প্যাসেঞ্জার্স অফ ফ্লাইট নাম্বার থ্রি-ও-থ্রি আর বিয়িং রিকোয়েস্টেড টু রিপোর্ট ফর চেকিং ইমিডিয়েটলি এই মাইক্রোফোন-ঘোষণার নিচে আন্ডারলাইন টানার মতো ঘোষণাটির সঙ্গে সঙ্গে ট্রলি ঠেলে এগিয়ে যেতে যেতে সুমিতা বলে যায়, “বাবা, আর কত কী দেবেন মেয়েকে। বিয়ের তত্ত্ব পাঠাচ্ছেন যে… বলে সেট্রলির ওপর ঢাউস স্কাইব্যাগ দুটির দিকে সহাস্য ইঙ্গিত করে, যার মধ্যে সত্যিই প্রায় সবই নন্দিনের জিনিস। জামাকাপড়ের কথা বাদ দিলেও, আমসত্ত্ব থেকে সন্দেশ, মাউথ ফ্রেশনার হিসেবে ভাজামৌরি থেকে বই-রেকর্ড-ক্যাসেট—কী যে নেই ওতে। শুধু একটা ক্যাসেটের কথাই ধরা যাক। সুচিত্রা মিত্রের বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি। সে আর নন্দিন দুজনে গত বইমেলায় দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে গানটি শুনেছিল। না ক্যাসেট, না রেকর্ড—কোথাও গানটি পাওয়া গেল না। অথচ, শুনেছে। বইমেলায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে গানটি আগাগোড়া শুনেছিল নন্দিন। দাঁড় করিয়ে রেখেছিল হিরণকেও। গান শেষ হলে একটি কথা না বলে, কী অপূর্ব, না বাবা?— চোখে তাকিয়ে ছিল হিরণের দিকে। তাই, খোঁজ, খোঁজ। নন্দিনের জন্য সুমিতার হাতে পাঠাতে হবে ক্যাসেটটা। একটা পুরো দিন লেগেছিল একলা চল রে নামে আসোর্টেড ক্যাসেটে গানটি আছে এই তথ্য সংগ্রহ করতে ও ক্যাসেটটি কিনতে। খুব ছোটবেলায়, বছর-দেড়েকের তখন নন্দিন। নন্দিন তো নয়, তখন শুধু নিনি। তখনও নামকরণ হয়নি। বেবি ফুডের খুব ক্রাইসিস চলছে, অথচ বাড়িতে আছে আর কচামচ– আজকের দিনটা কোনওমতে চলবে। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে, আর যার হাতেই দেখেছে ফুডের টিন— দাদা, কোথায় পেলেন?জানতে চেয়ে দোকানের নাম শুনেই সেখানে ছুটে গেছে তা সে বাগরি হোক, রাধাবাজার হোক, বড়বাজার হোক— লিটারালি ছুটতে ছুটতেই গেছে, এবং কোথাও পায়নি। শেষ সংবাদসূত্র ধরে মনোহর কাটরার পানবাজার বলে একটি বাড়ির বিশাল ছাদে সিঁড়ি-উপসিঁড়ি ধরে শেষ পর্যন্ত অকুস্থলে পৌঁছে তা বেশ কয়েকশো পানের ঝুড়ির একপ্রান্তে একটি টেবিল-চেয়ার ও পাশে গুনে দেখে ঠিক পঞ্চাশটা ল্যাকটোজেন–কৌটো (তখনও বিল কাটা শুরু হয়নি), সে শেষ থেকে লাইনের লোকগণনা শুরু করে ও সাতচল্লিশ পেয়েই দৌড়ে লাইন দিতে যেতে-যেতেই আরও তিনজন দাঁড়িয়ে যায়। ওঃ, ক্যাসেট-জোগাড়ের মতো সে এমনি আর একটা সারাদিন নন্দিনের, না-না, নিনির জন্যে কেটেছিল বটে।

সেদিন বেহালায় গিয়ে বন্ধু সত্যেনের বৌ-এর কাছ থেকে একদিনের মতো ফুড ধার করে বহুরাত্রে বাড়ি ফিরেছিল। এবার তো তবু দিনের শেষে পেয়ে গিয়েছিল ক্যাসেটটা।

শ্যালক কল্যাণের বাড়িতে, নন্দিনের প্রথম বিদেশি জন্মদিনে রাত সাড়ে নটায় কানেকশন পাওয়া গেল। হ্যালো, টোকেন এস-এক্স টেন, উই আর ট্রায়িং দ্য ইউ, এস. এ. লাইন, প্লিজ, হোল্ড অন… পিপ-পিপ-পিপ-পিপ… হ্যালো নদা… পিপ-পিপ-পিপ-পিপ তারপর বোধহয় তো অ্যাটল্যান্টিকেরই হাওয়া ঢুকে পড়ল লাইনে। শুধু সাঁই সাঁই শব্দ।  

হ্যালো, নদা, হ্যাঁ, এখন এখানে সকাল ৯টা নন্দিন একটু আগে উঠেছে। চা করছে। হ্যাপি বার্থ ডে ফ্রম ড্যাড বলে প্রথমেই আপনার আংটিটা দিয়েছি। হ্যাল্লো…হা শুনতে পাচ্ছেন… খুব পছন্দ! তবে রিং ফিঙ্গারে হয়নি। একটু ছোট হয়েছে। মোটা হয়ে গেছে তো বেশ। আচ্ছা, পাথরটা কি চুনী? কৌটোর ডালা খুলে একদম কেঁদেই দিল। কিছু শুনতে পাচ্ছেন?

না, কী শুনব?

এটা একটা কার্ড। মাউথ-পিসের কাছে ধরে আছি। খুললেই হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ-এর সুর বাজে। শুনতে পাচ্ছেন না? ওর এক কালো বন্ধু, নাম ক্লারা, দিয়েছে। ষোলটা কার্ড পেয়েছে। ওর কলেজের বন্ধুরা এখুনি এসে পড়বে। সারাদিনের জন্যে নিয়ে যাবে। মারিপোজে বলে একটা সুন্দর শহরে ওরা যাবে। লাঞ্চ করবে। আমরা সন্ধেবেলা ওকে নিয়ে বেরোব। নিন, মেয়ের সঙ্গে কথা বলুন…

নন্দিন ডালা খুলে কেন কেঁদে ফেলেছিল তা শুধহিরণেরই জানারকথা। ডালার লাল ভেলভেটের ওপর একটা ছোট সাদা কাগজ পিন দিয়ে আটকে দিয়েছিল সে, যাতে মেয়ের নাম নেই, শুধু লেখা: সোনার চেয়ে দামিকে। অন্য ডালায় আংটির সোনা! পড়েই ও কেঁদেছে নিশ্চয়। ভাষা কাঁদিয়েছে। কেঁদেছে, কাঁদুক। কাঁদাবার জন্যই তো লেখা। কাঁদা ভাল রে নন্দিন। অস্তিত্বের স্নান হয়।

মিনিটে ৩০ টাকা। শ্যালক কল্যাণ তিন আঙুল দেখিয়েছে। মানে তিন মিনিট হয়ে গেল। সবাই কথা বলবে।

হিরণ, কীরে কেমন আছিস? জানতে চাওয়া মাত্র অতলান্তিকের ওপার থেকে অস্তিত্বের স্নানশব্দ! সে নে মায়ের সঙ্গে কথা বল বলে তাড়াতাড়ি রিসিভারটা চিনুর হাতে তুলে দেয়। চিন হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফোনের ওপর। কীরে নন্দিন, কেমন আছিস, নন্দিন…নন্দিন…কীরে কাঁদছিস কেন এ ছাড়া সে কিছু বলতেই পারছেনা দেখে, একরকম কেড়ে নিয়েই সে রিসিভারটা শ্যালকের হাতে তুলে দেয়।

 

বেকার রোড দিয়ে তোড় বৃষ্টির মধ্যে ট্যাক্সি চলেছে পা টিপে। ওয়াইপার কাজ করছে না। কোমরের গামছা খুলে ফেলে লেদু মাঝে মাঝে কাচ মুছে দিচ্ছে।

তাহলে লেদু, এত বলে ভবানীভবন থেকে ন্যাশনাল লাইব্রেরি পর্যন্ত আর কিছু না বলে, তারপর হিরণ জানতে চাইল, তাহলে লেদু তুই আমাকে যা বলেছিস সেটাই কী সব?

নিস্তব্ধতা। লেদু নিরুত্তর।

জু পেরিয়ে ট্যাক্সি পোলে ওঠার জন্যে গিয়ার বদলাচ্ছে। হিরণ বেশ স্পষ্ট ভাষায় এতক্ষণ পরে শেষ করল বাক্যটি, নাকি, তোর আরও কিছু বলার আছে?

এ যাবৎ বাড়িতে হিরণকে একান্তে ডেকে লেদু যা জানিয়েছে এবং যে বিষয়ে জ্ঞাত হওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করার সাহস চিনুর এখনও হয়নি, তা হল, একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। রঞ্জন ও সুমিতা, প্রথমে সে বলেছিল হাসপাতালে, পরে স্বীকার করেছে, মারা গেছে। সানফ্রান্সিসকো থেকে ভাইস কনসাল ফোন করে শুধু এটুকু জানিয়েছেন। আর কোনও খবর নেই। ওরা আবার ফোন করবে বলেছে।

কিন্তু, গাড়িতে আর কেউ ছিল কি? ওদের ছেলে দুটো জীয়ন আর অঞ্জন, বা, বা, নন্দিন? হিরণ এখন সেই দিকে ইঙ্গিত করছে।

বললাম তো তোমাকে, ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে পিছন ফিরে, প্রথমে চোখ নামিয়ে, তারপর উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে ভিক্টোরিয়ার আবছা গম্বুজের দিকে ঘাড় শক্ত করে থেকে লেদু বলল, আমি এর বেশি কিছু জানি না।

সল্টলেকে পৌঁছে লেদুদের বাড়ি থেকে প্রথমেই মার্সেদে একটা আর্জেন্ট কল বুক করল হিরণ। রিসিভার রাখতে না রাখতে সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে উঠল। এত তাড়াতাড়ি! না, তা নয়।

হ্যালো, থ্রি সেভেন টু সিক্স ডাবল ওয়ান?

ইয়েস। ইয়েস।

আ পি পি কল ফ্রম ইউ. এস. এ. ফর মিঃ হিরণ চ্যাটার্জি।

স্পিকিং প্লিজ।

প্লিজ, হোল্ড অন।

সেই পি-পি-পি-পি। অতলান্তিকের হু-হু হাওয়া। হাহাকার জটিল স্থান ও কালের দুস্তর ব্যবধানের।

ম্পিক হিয়ার প্লিজ।

হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো…

উত্তর নেই।

স্পিক হিয়ার প্লিজ। ইউ আর অন দ্য লাইন।

হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো

সাড়া নেই।

শুধু হাওয়ার হাহাকার। আছাড়।

প্লিজ হোল্ড অন। আই অ্যাম ট্রায়িং টু কানেক্ট।

হ্যালো…হ্যালো… পি-পি-পি-পি।

হঠাৎ, সময়ের সোঁ-সোঁ সাঁতরে, পৃথিবীর তিনভাগ জলের ওপার থেকে ভেসে এল নন্দিনের তীক্ষ্ণ চিৎকার, এবং, তাও মাত্র একটিবার।

হ্যালো, বাবা? পি-পি-পি-পি।

হ্যালো, কে নন্দিন? কথা বল!

উত্তর নেই।

হ্যাঁ। যা ভাবতে পারে না বলে ভাবতে চায়নি হিরণ, তবে তাই। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পার হওয়ার সময় বেশ প্রাঞ্জলভাবেই তো বলেছিল লেদু, যখন হিরণ জানতে চেয়েছিল, রঞ্জন-সুমিতার মৃত্যু ছাড়া তার আরও কিছু বলার আছে কি না, যে, ওই তো বললাম তোমাকে। অর্থাৎ, যথেষ্ট বলেছি, আর কী বলব? এখন যা বোঝার বুঝে নাও হে ভ্রংশবৃদ্ধি, শেষ পর্যন্ত তোমার সর্বনাশ হলই, তমি আর ঠেকাতে পারলে না! ঘাড় শক্ত রেখে সে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে, যখন সে ওইনা-বলা কথাগুলো বলে। উইন্ডস্ক্রিনের ওপারে আদিম বৃষ্টিধারায় গা ধুয়ে তখন ঘোর অন্ধকারে ভেসে উঠছিল ভিক্টোরিয়ার সাদা গম্বুজ।

অ্যাক্সিডেন্টে মরলে মানুষ নাকি প্রেত হয়? হ্যাঁ, নিঃসন্দেহেনন্দিনের প্রেতাত্মাই ও-ভাবে কে বাবা? বলে চিৎকার করে উঠেছে, যা প্রকৃত প্রস্তাবে ছিল স্থান ও সময়ের শতশৃঙ্খল ভেঙে পড়ার খান খান শব্দ। আহা, একবারের বেশি সে পারেনি।

 

তার, নন্দিনের, প্রেতকণ্ঠ আরও কিছু বলবে কিনা শোনার জন্যে সে রিসিভারটা কানে চেপে রাখে। ভূমিকম্পের সময় যেমন মানুষ বুঝতে পারে না যে সে কাঁপছে না মাটি তাকে কাঁপাচ্ছে, সে-ভাবে, এখন তার সর্বাঙ্গ ঠকঠক করে কাঁপছে, বাহ্যত মেঝের ওপর সে অবশবর্তী হাই ফ্রিকোয়েন্সি অণু-লাফে লাফিয়েই চলেছে একটানা—এমনাবস্থাতে সে রিসিভারটি আঁকড়ে আছে অথবা রিসিভারটিই তাকে, তা নির্ণয় করা অসম্ভব।

ওই, অনেক স্তব্ধতা ভেঙে আবার ভেসে আসছে সময়ের সোঁ-সোঁ পেরিয়ে সেই সঙ্কেত-শব্দ পি-পি-পি-পি।

নিঃসন্দেহেনন্দিনের প্রেতকণ্ঠ আরও কিছু বলতে চায়। বাঁ-কান থেকে দ্রুত তুলে ডান কানে সে রিসিভারটি চেপে ধরে থাকে। তার হাতের কাঁপুনি সে যত থামাতে চেষ্টা করে তত বেড়ে যায়।

হ্যালো, বাবা।

কে, নন্দিন?

পি-পি-পি-পি…

হ্যালো, কে নন্দিন। কথা বল কথা বল রে।

হ্যাঁ, আমি নন্দিন।

তুই বেঁচে আছিস?

বাবা, তুমি শুনতে পাচ্ছ?”

খুব ভাল শুনতে পাচ্ছি। তুই কথা বল। বলে যা। কী হয়েছে?

শোনো বাবা। সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হয়েছে। ছোট কাকা, কাকিমা আর জীয়ন স্পট ডেড। কার অ্যাক্সিডেন্ট। কাল রাত ১০টার সময়। এখান থেকে ৩০ মাইল দূরে। মডেরা শহরের মুখে। বাবা, শুনতে পাচ্ছ?

ওঃ। ইউ ফুল, হিরণ চিৎকার করে উঠল, তুই বলে যা। অঞ্জন কোথায়?

আমরা ওদের সঙ্গে যাইনি। বাড়িতে ছিলাম। ওরা এল-এ থেকে ফিরছিল। পিছন থেকে একটা পিক-আপ ভ্যান ধাক্কা মারে। ড্রাইভার ড্রাঙ্ক ছিল।

অঞ্জনকে ডাক।

ও ঘুমচ্ছে।

ওকে ডাক! হিরণ এবার সেই ভাবে চিৎকার করে ওঠে যা ফোন-বিনাই অতলান্তিক পেরিয়ে পৌঁছতে চায় নন্দিনের কাছে।

হিরণ জানতে চায়, বেঁচে আছে কিনা অঞ্জন। প্রমাণ চায়।

অঞ্জন এসে বোবা গলায় আঁ-আঁ-আঁ করল কয়েকবার। তারপর কোনওমতে জেঠু, প্লিজ, কাম হিয়ার, অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল বলে নন্দিনের হাতে ফোন তুলে দিল।

বাবা, তুমি আমাদের অবস্থা বুঝতে পারছ?

হ্যালো, ক্যালকাটা, ডু ইউ ওয়ান্ট টু কন্টিনিউ?

ইয়েস প্লিজ। আই ডু। প্লিজ, ডোন্ট ডিসকানেক্ট…

তুমি আমাদের অবস্থা বুঝতে পারছ বাবা! আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। এরপর ওদের বডি আসবে। এখানে আমরা শুধু দুজন। আমরা কী করব বাবা? বাবা, আমরা কী করব?

লাইন কেটে গেল।

তোরা সাবধানে থাক। ভালভাবে থাক। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি যাচ্ছি। সম্ভব হলে নেকস্ট ফ্লাইটেই। তোরা, ততক্ষণ, বেঁচে থাক।

হিরণ তখনও বলে যাচ্ছে।

০৪. ব্যাপারটা খুনও হতে পারে

পরদিন ২৮ এপ্রিল হিরণ এয়ারপোর্ট পৌঁছল বিকেল সওয়া ৫টার সময়। ফ্লাইট ৬টা ১০-এ। লাউঞ্জ থেকে সে দেখতে পেল, এয়ার লাইন্স-এর কাউন্টার ফাঁকা। প্যাসেঞ্জাররা ইমিগ্রেশন এনক্লোজারে চেকিং-এর জন্যে ঢুকে গেছে। লেদু এখনও আসেনি।

বিকেল ৪টের সময় ভিসা হল। তার এবং লেদুর। কনসুলেট থেকে ফোনে সে খবর চিনুকে জানিয়ে ব্রেবোর্ন রোড থেকে পাসপোর্ট তুলে সে ভি. আই. পি ধরে সোজা এসেছে এয়ারপোর্টে। লেদু আগাগোড়া সঙ্গে ছিল। সল্টলেকে নেমে গেল, বাড়ি হয়ে আসবে বলে।

হিরণের কাঁধে চিরপুরাতন ঝোলা ব্যাগ, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। পরনে রঙচটা জিনস্। সে দেখল, এই মাত্র ঘণ্টাখানেকের মধ্যে চিনু জড়ো করেছে অনেককেই। চিনুর দিদি, ভায়রাভাই, সস্ত্রীক শ্যালক কল্যাণ, ভূপেশবাবু ও তাঁর স্ত্রী… বোন বকু আর তার ছেলে তোপসে মায়, তাদের অফিস থেকে রাখাল সেন— এসেছে অনেকেই। সকলের মুখে-চোখে লেখা একটাই কথা:তুমি পেরেছ!

মাত্র ৬ ঘণ্টা। ১১টা থেকে ৫টা। এ কঘণ্টা জেদি, গুণটানা ক্রমাগত চেষ্টায় হিরণ পাসপোর্ট এবং ভিসা দুটোই জোগাড় করতে পেরেছে। শুধু তার একার নয়। তার এবং লেদুর। অবশ্য লেদুর পাসপোর্ট ছিল। জোগাড় করতে পেরেছে না বলে ছিনিয়ে আনতে পেরেছে বলাই ঠিক। শেষ মুহূর্তে আটকে যাচ্ছিল এন-ও-ডি নামে একটা রাবার স্ট্যাম্পের জন্যে। সেটা পাওয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন। সকলের চোখের সামনে সোজা পাসপোর্ট অফিসারের ঘরে সে এত অবসন্ন ও ধুকতে ধুকতে ঢুকে পড়ে, যে কেউ বাধা দেওয়ার কথা ভাবেনি। আমেরিকান এক্সপ্রেসের জয়ন্ত সেন সকাল থেকে গাড়ি নিয়ে তার সঙ্গে। সে ধরে ধরে তাকে নিয়ে গিয়েছিল ভিতরে। সত্যি, সে, শেষ পর্যন্ত পেরেছে। টানা ৬ ঘণ্টায় যতগুলো মিনিট, যতগুলো মহুর্ত, তার প্রতিটি অব্যর্থভাবে ব্যবহারের পুরস্কার হিসেবে তার ঝোলা ব্যাগের মধ্যে রয়েছে শুধু তার নয়, লেদুরও, সাতরাজার ধন দুই মানিক পাসপোর্ট আর ভিসা!

চিনু তার জন্যে হাতে করে একটা ছোট সুটকেস এনেছে। তাতে আছে, টুথপেস্ট ব্রাশ ইত্যাদি—একটা প্যান্ট ও দুটো জামা, সে জানাল, একটা চিরুনি আর দূটো রুমালও আছে সুটকেসে, সে বলল, হিরণ যেন প্লেনে উঠেই চুলটা ঠিকমতো আঁচড়ে নেয় ও মুখটুখ ধুয়ে নেয় টয়লেটে গিয়ে, সে মনে করিয়ে দেয়। পৌঁছেই যেন ফোন করে। চিনু যে ২২ হাজার টাকা লেদুর হাতে পাঠিয়েছিল, তা থেকে যা বেঁচেছিল, মুঠো করে হিরণ চিনুর হাতে তুলে দেয়।

কত আছে?

হাজার দুই-আড়াই হবে, জানি না। হিরণ বলল, কিন্তু, ওটা তুমি দিদিকে এখন ফেরত দিও। তোমার দরকার হবে। আমি কবে ফিরতে পারব ঠিক নেই। এসে যা হয় করব।

ওর দিদিমীনা দশ হাজার দিয়েছে।

অফিস?

ও, অফিস।

সে আমি দেখবখন। রাখাল বলল, একটা অ্যাপ্লিকেশন ওখান থেকে পাঠিয়ে দিও।

মাইনে?

সে বলতে হবে না। আমি বৌদিকে দিয়ে যাব।

আমার সই? রেভেনিউ…

সব দেখব আমি। তুমি যাও, এখুনি চেকিং-এ ঢুকে পড়।

লেদু?

সে এলেই পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি যাও—চিনু বলল। সবাই একরকম ঠেলেই তাকে সিকিউরিটি এলাকায় ঢুকিয়ে দিল। যেতে যেতে সে একবার পিছন ফিরে তাকায়। ওই যে, লেদু এসে পড়েছে।

অঞ্জনের আঁ-আঁ-আঁ, বা নন্দিনের শেষ কথা বাবা, আমরা এখন কী করব, শুনে হিরণ বলতে হবে তাই বলেছিল বটে যে, তোরা সাবধানে থাক, আমি যাচ্ছি যত তাড়াতাড়ি পারি, খুব সম্ভব পরের ফ্লাইটেই—কিন্তু রিসিভার নামিয়ে রেখেই সে বুঝেছিল, পরের ফ্লাইটে কেন, সে যেতেই পারবে না। নন্দিন গেছে গত বছরেই, সে জানে, একপিঠের ভাড়াই ১১ হাজারের মতো, সঙ্গে ৫০০ ডলার নিতে হয়, সেও প্রায় ৭ হাজার। ফেরার কথা না ভাবলেও, শুধু গিয়ে পৌঁছনোটাই হাজার কুড়ির ধাক্কা। ২০ হাজার ভারতীয় টাকার তবু একটা বাস্তবতা আছে। সেটা, এ-হেন ভূমিকম্পে জড়ো হতেও পারে। সে ধাক্কা হয়ত-বা সামাল দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু পাসপোর্ট? ভিসা? এ জিনিস এত তাড়াতাড়ি হওয়ার নয়, হতে পারে না। পুলিস রিপোর্ট পেতেই তো মাসখানেক। পেতে কালঘাম ছুটে যায়। আর ভিসা? নন্দিনের সময় দেখেছেতো। সুচের ভেতর দিয়ে উট যাওয়া আর আমেরিকান ভিসা পাওয়া অনেকটাই এক ব্যাপার। যিশুর কৃপা ছাড়া তা কোনও বাঙালি ভগবানের কাজ নয়।

ফুরনে পাড়ার ট্যাক্সি ভাড়া নিয়ে কাল রাতে বেরিয়েছিল লেদু। কথা হয়েছিল, ঘঘারাঘুরির শেষে ড্রাইভার বিবেচনা করে যা চাইবে তাই তাকে দেওয়া হবে। ট্যাক্সিতে, অনর্গল বৃষ্টির মধ্যে, কলকাতার আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিতে দিতে রাত ভোর হয়ে গেল। ভোরবেলা ঘুম থেকে তুলে টালিগঞ্জে সুমিতার বড়মামা ভূপেশবাবুকে খবর দেওয়ার পর বার্তাবহ হিসেবে তার কাজ শেষ হল।

বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। আকাশে পাইপলাইনের উপ-কক খুলে গেছে যেন। হুড়হুড় করে একভাবে জল পড়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে শেষ রাত থেকে শুরু হয়েছে সো-সোঁ হাওয়া। পুরো সাইক্লোনের আবহাওয়া।

ভূপেশবাবুর ড্রয়িংরুমে দক্ষিণ দরজার ওই ভারী পর্দাটা তুলেই সুমিতা প্রথম বেরয় ও হাত তুলে সবাইকে নমস্কার করে, আজ থেকে ১৮ বছর আগে যখন রঞ্জন আমেরিকা থেকে তাকে দেখতে আসে। সেটা ছিল ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সঙ্গে ছিল হিরণ, চিন আর বোন বকু। ওই এখন-নিশ্চল পর্দাটা দুদিকে ঠেলেই ঘরে প্রবেশ করেছিল চওড়া কাঁধ, লম্বাপানা সুমিতার দুর্গামূর্তি, তাকে সেই প্রথম দেখে চালচিত্রহারা একটি প্রতিমার কথাই মনে হয়েছিল হিরণের। কিন্তু, মেয়ে দেখার পর বেরিয়ে এসে রঞ্জন ইংরেজিতে তাকে বলে, আচ্ছা, নদা, ওরা মেয়ের যে ফোটোটা পাঠিয়েছিল, তোর কি মনে হয় সেটা কি খুব রিসেন্টলি তোলা?

অর্থাৎ, সেই তন্বী, শ্যামা, শিখরদর্শনা এখানে কোথায়। এত মোটালো কবে। অর্থাৎ, আমি একে বিয়ে করব না।

মানুষমাত্রই যে প্রয়াস করে থাকে ও করে বারংবার ব্যর্থ হয়, এবং তবু তা করে যায় পর্দা তুলে সুমিতার সেই প্রথম আবির্ভাবের মুহূর্তটিকে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছিল হিরণ, এমন সময় ওঃ-হো-হো একবার মাত্র বলে সেই থেকে নিস্ফূপ ভূপেশবাবু এই প্রথম কথা বললেন, হিরণ, আমার মনে হয় তোমার ওখানে যাওয়া উচিত। ইউ শুড গো।

কিন্তু, মামাবাবু–

কথা দেওয়ার আগেরিটায়ার্ড ভদ্রলোক বোধহয় ভেবে দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আই উইল স্ট্যান্ড ফর দ্য প্যাসেজ-মানি। তুমি অঞ্জন, জীয়ন আর তোমার মেয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াও।

হিরণের চোখ থেকে বৃষ্টির জল তখনও শুকোয়নি। জামা-গেঞ্জি খুলে নিংড়ে সে পাখার হাওয়ায় শুকোতে দিয়েছে। মামিমা মনে করিয়ে দিলেন, কফিটা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।

টাকার প্রশ্ন নয় মামাবাবু। বৃষ্টির ছাট চোখ থেকে হাত দিয়ে মুছতে মুছতে হিরণ বলল, সে আমি জানি হয়ত হয়ে যাবে। কিন্তু পাসপোর্ট ও ভিসা? এ-সব কিছুই তো আমার নেই!

ভূপেশবাবু চুপ করে গেলেন। সুমিতার মামা তাকে পছন্দ করেন খুবই, হিরণ জানে, তাকে স্নেহ করেন। সফদরজং হাসপাতালে ইন্টার্নি তখন সুমিতা। দিদির বাড়িতে থেকে পড়াশোনা। বাম, মারা, প্রিয়তমা ভাগ্নীকে তিনিই আনিয়েছিলেন সদর দিল্লি থেকে— নট ভেরি রিসেন্ট ফোটোগ্রাফ-এর অজুহাতে রঞ্জন যাকে এককথায় বাতিল করে দেয়। সেই অনিচ্ছক ঘোড়াকে লাগাম ধরে, পেছন চাপড়ে জল পর্যন্ত টেনে এনেছিল এই হিরণই— এটা তিনি কৃতজ্ঞচিত্তেই মনে রেখেছেন।

কাল মধ্যরাত থেকে এই অতি-নাটক শুরু হয়েছে।

বাইরে বৃষ্টি পড়ে চলেছে বিরতিহীন একটানা–তার ওপর এই সাইক্লোনের আবহাওয়া। এর শেষ কোথায়?

যখন, যেখান থেকে সম্ভব, হিরণ এর মধ্যে বারছয়েক টেলিফোন করেছে সল্টলেকে। তাদের বুক-করা কল ওরা রেসপন্ড করেছে। এছাড়া ওরা আরও দুবার ফোন করেছে। মার্সেদ থেকে ফোন করেছিলেন ডাঃ অরোরা নামে এক পাঞ্জাবি প্রতিবেশী। জানা গেছে, শুধু রঞ্জন-সুমিতা নয়, গাড়িতে পিছনের সিটে হয়ত ঘুমিয়েই পড়েছিল ৭ বছরের জীয়ন— সেও মারা গেছে, যদিও ভূপেশবাবুকে সে আর জীয়নের কথা বলেনি। ডাঃ গ্রেওয়াল আরও জানিয়েছেন, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ব্যাপারটা খুনও হতে পারে। অঞ্জন আর নন্দিনকে উনি তাঁর বাড়িতে এনে রেখেছেন। অঞ্জনকে একটা ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে। খুন শোনার পর সে বারবার অ্যাক্সিডেন্ট-স্পটে ছুটে বেরিয়ে যেতে চাইছে। তার মাথায় এখন প্রতিহিংসা ছাড়া কিছু নেই।

ভূপেশবাবু পাইপ ধরিয়েছেন পরনে সুমিতার দেওয়া বিদেশি স্লিপিংসুট। অনেকক্ষণ কথা বলেননি। হিরণ বলল, তাহলে উঠি মামাবাবু?

নো। ভূপেশবাবু উঠে দাঁড়ালেন, তুমি বোস। কী বলছ তুমি হিরণ! তোমার ছোটভাই, কত ভালবাসত সে তোমাকে, আমি তো জানি। আমি, আমি তো গেছি স্টেটসে। ওদের ওখানে থেকেছি। সুমিতা, রঞ্জন দুজনেই খালি নদ-নদা করত। আর কারও কথা তো বলত না। কতবার তোমাকে যেতে বলেছে বল তো? নন্দিনের সঙ্গে তোমার টিকিটও পাঠিয়েছিল। পাঠায়নি? তুমি গেলে না।

দেখুন, মামাবাবু, পারলে আমি নিশ্চয়ই যেতাম। যদি যেতে দিত। এ কি বলতে হত আমাকে। আমার মেয়ে নন্দিন ওখানে রয়েছে, আমার নাবালক ভাইপো— কিন্তু, আমাকে যেতে দিচ্ছে কে?

না হিরণ। অঞ্জন নয়, নন্দিনও নয়। তোমার ভাই! আমি রঞ্জনের কথা বলছি। বিদেশবিভুইয়ে তার অন্ত্যেষ্টি হবে, তার আত্মীয়স্বজন কেউ থাকবে না? ওখানকার লোকে জানাবে এ লোকটা হা ঘরে, এ পৃথিবীতে এর কেউ নেই, কেউ ছিল না! নিবে-যাওয়া পাইপ টেবিলে বিচারপতির হাতুড়ির মতো ঠুকতে ঠুকতে উনি বলে গেলেন, দিস ইজ নট হাউ ইট শুড বী। একি একটা কুকুর-বেড়াল মরেছে নাকি, যে টান মেরে ওরা ভাগাড়ে ফেলে দেবে? নো-ননা,ইউ মাস্ট বী দেয়ার হিরণ। ইফ নট ফর এনিথিং এলস, ফর দ্য ডেড সোলস অনার। ইউ মাস্ট অ্যাটেন্ড দেয়ার ফিউনারাল। আমি বড্ড বুড়ো হয়ে গেছি। নইলে আমি যেতাম। ইয়েস, টু আপহোল্ড দ্য অনার অব দা ডেড! বাট ইউ ক্যান। কান্ট ইউ? ইউ। মাস্ট। গো।

অনেকক্ষণ একটানা কথা বলে ভূপেশবাবু হাঁফাতে লাগলেন। প্রথমবারের কফি ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। মামীমা দ্বিতীয়বার কফি আনলে হিরণ চুপচাপ কফি খেতে লাগল। ক্যালিফোর্নিয়ার বে-এরিয়ার সবচেয়ে নামকরা সার্জন ডাঃ রঞ্জন চ্যাটার্জির এ পৃথিবীতে কেউ নেই! ভারতবর্ষের থেকে তার ফিউনারাল অ্যাটেন্ড করতে কেউ এল না? কুকুর…… ভাগাড়……. মুখ তুলে সে হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল, আরে, বৃষ্টি হঠাৎ থেমে আসছে। সেই জোলো হাওয়াও আর নেই তো। একই সঙ্গে সে টের পেল, তার চোয়াল শক্ত হয়ে আটকে রয়েছে, তার মধ্যে জন্ম নিচ্ছে, সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত দিক থেকে তার অস্তিত্ব জুড়ে নেমে আসছে এক অজানা আত্মপ্রত্যয়, তার সারা জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্যে যার দৃষ্টান্ত নেই। কখনও ছিল না।

হ্যাঁ, আমি যাচ্ছি। যদিও তুই, রঞ্জু, বিদেশে বেঁচে ছিলিস নদা ছাড়া একা-একাই, এতগুলো বছর, কিন্তু মৃত্যুর পর তোকে একা থাকতে দেব না। তোর মৃতদেহের পাশে আমাকে গিয়ে দাঁড়াতেই হবে। সে তুই আমার জন্য যত টাফ কাজই রেখে গিয়ে থাকিস। আমি যাব। আমি গিয়ে দাঁড়াব। আমার ভাই-এর মৃতদেহের পাশে। কেউ, কোনও কিছুই এ অধিকার থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে পারে না। পারবে না।

উঠে গিয়ে সে সল্ট লেকে ডায়াল করল। আশ্চর্য, এক চান্সেই পেয়ে গেল। একটা নতুন খবর দিল চিন। সানফ্রান্সিসকো থেকে ভাইস-কনসাল আবার ফোন করেছিলেন। পাসপোর্ট অফিস ও কলকাতার আমেরিকান কনসালকে টেলেক্স পাঠানো হয়েছে। ডাঃ চ্যাটার্জির ফিউনারালে তার ফ্যামিলির কেউ যদি আসেন সব রকমে অন এমার্জেন্সি বেসিস মোস্ট সিমপ্যাথেটিক অ্যান্ড সিনসিয়ার সাহায্য করতে বলা হয়েছে। শুনে, হিরণ এতক্ষণে যেন একটা আশার আলো দেখতে পেল। তাহলে সে চেষ্টা করতে পারে। সে যেতে পারে।

তুমি ব্যাঙ্ক খুললেই আমাদের ফিক্সডটা ভাঙিয়ে ফেল। যা পার জোগাড় কর। কিন্তু ফিক্সে তো মাত্র দশ। আঃ! তার গলা ধরে গেছে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে, যা বলছি কর না। যা পার জোগাড় কর। যতটা পার, যেখান থেকে পার। যেভাবে পার। গয়না বাঁধা দাও। অন্তত পনের জোগাড় করে রাখ। আমি যখন যেখানে বলব, লেদুর হাতে পাঠিয়ে দেবে। আমি মার্সেদ যাচ্ছি। সম্ভব হলে আজই। লেদুকে দাও।

লেদু বলল, ন কাকা, আমার পাসপোর্ট আছে। আমিও যাব। তুমি আমার জন্যেও চেষ্টা কর। আমি হাজার তিরিশ পর্যন্ত পারব।

সুমিতার বড়মামাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে করতে, যেন সঙ্কল্প, হিরণ বলল, ঠিক আছে মামাবাবু। আমি যাচ্ছি। আর….চোখে চোখ রেখে, আজই।

সে ট্যাক্সি নিয়ে ছুটল জয়ন্তর কাছে। জয়ন্ত সেন আমেরিকান এক্সপ্রেসে আছে। সে ঢের সাহায্য করতে পারবে। সে বন্ধু।

০৫. ডাকোটা থেকে জাম্বো জেট-এ

ডাকোটায়, অ্যালুমিনিয়ামের বেঞ্চিতে বসে, কোমরে বেঁধে ক্যাম্বিসের বেল্ট, হিরণ একবার জোড়হাট গিয়েছিল। সেট লিগ্যাসিও লেদুর নেই। তবে, এয়ার ইন্ডিয়ার দোতলা জাম্বো জেট, শ দুয়েক নাকি প্যাসেঞ্জারই যাচ্ছে, এ-সম্পর্কে কোনওরকম পূর্ব-ধারণা তাদের দুজনের কারোরই ছিল না। দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত, হাতে অমন এক জবরদস্ত বিদেশ-রেখা থাকা সত্ত্বেও, গত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে সহাস্যে হিরণ শুধু সি-অফই করে যাচ্ছিল। রান-ওয়ে ধরে ধীর ও গম্ভীরগতিতে, যেন কোথাও যাবার নেই এমনভাবে চলে সেই শান্ত, অননুমেয় ইউ টার্ন, তারপর যা ভাবতেও পারা যায়নি, সহসা স্পিড বাড়িয়ে ধোঁয়া এবং গর্জনের মধ্যে শেষ পদাঘাতে মাটি কাঁপিয়ে কেউ নীল আকাশে মিলিয়ে গেছে তীর হয়ে, কেউ ঢুকে গেছে মেঘের মধ্যে মেঘ হয়ে, যেদিন যা। গত সেপ্টেম্বরে নন্দিন ঢুকে গেল শরতের সাদা মেঘের মধ্যে। মেঘই হয়ে গেল। তখন সন্ধেবেলা, ফেব্রুয়ারির শীতের বিকেল, সেদিন আকাশ ঝকঝকে নীল, যেদিন, যখন, সুমিতা শেষবারের মতো মিলিয়ে গেল নীলিমা ও নৈরাজ্যে।

গত ২৬ বছরে শুধু রঞ্জনকেই সি-অফ করেছে তা বারপনের তো হবেই। প্রথমবার অবশ্য হাওড়া স্টেশনে, জাহাজ ছিল বোম্বে থেকে তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় ওরা চার বন্ধু, চুনী, অরুণেশ, বিষ্ণু আর রঞ্জন। বগির গায়ে টাঙানো লালু শালু: হরি সিং, ট্রাভেল এজেন্ট। এক গাড়ি লোক বিদেশ যাচ্ছে শুধু কলকাতা থেকেই। ওদের মধ্যে অরুণেশ আর রঞ্জন ফিরে এসেছিল একসঙ্গে, ৫/৬ বছরের মধ্যে। দুজনেরই তখন এফ-আর-সি-এস করা হয়ে গেছে।

রঞ্জন ফিরে গেল মাস দুই পরে। অরুণেশ গেল না।

আমার দাদা হবার কথা ছিল গাইনি। রঞ্জনই বলল, তোের আঙুল বেঁটে, তোর আঙুল বেঁটে, পদবী ধাড়া, ধাড়া; তুই অর্থোপিডিক্স কর। এবার পুজোর আগে অলিম্পিয়ায় দেখা, খুব মালটাল খেয়ে অরুণেশ একা বসে ছিল। মদ খেলে বড় বাক্যের মধ্যে অধীন ক্লজগুলো ও দুবার করে বলে, এক প্রিন্সিপালটি ছাড়া, এটা সে আগেও দেখেছে।

রঞ্জনরা এখন কোথায় দাদা? সে জানতে চায়।

মাস দুই আগের কথা, তখনও ওরা বহালতবিয়তে বেঁচে, হিরণ তাই বলেছিল, মার্সেদে। বলে মাসে কোথায় ওকে বোঝায়। আরও মদ খেয়ে অরুণেশ বলেছিল, আমার দাদা রোজগার, আনঅফিসিয়ালি বলছি আপনাকে, আনঅফিসিয়ালি বলছি, এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে, এ মাস থেকে ১০ হাজার ক্রশ করেছে।

মাসিক না দৈনিক? হিরণ ভেবে দেখল, কলকাতার বিখ্যাত অর্থোপিডিক্স সার্জন নিঃসন্দেহে দিনমজুরির কথাই বলেছে।

অথচ, অরুণেশ তার সত্যিই খুব বাঁটকুলে আর থ্যাবড়া আঙুলগুলোর দিকে অনেকক্ষণ সস্নেহে তাকিয়ে থেকে বোধহয় রঞ্জনের কথাই ভাবছিল, অথচ, দেখুন দাদা, আমি ধাড়া। আমি ধাড়া। আর রঞ্জন পড়ে আছে ধাড়ধাড়া মার্সেদপুরে। মার্সেদপুরে। তাই না? হাঃহাঃহাঃ। এবার প্রিন্সিপাল ক্লজটিতেও সে দ্বৈততা দেয়, হাঃ-হাঃ-হাঃ।

এই সেটেলাইট প্যাড থেকে মেঝেয় পদাঘাত করে, আমাকে লঞ্চ করতে আমার সাবপোস্টমাস্টার বাপের, বাপের, খরচা হয়েছিল কত জানেন দাদা? কত জানেন দাদা সাড়ে ৭০০ টাকা। জাহাজে বিস্কুট খেয়ে থাকতাম। বিস্কুট খেয়ে থাকতাম। রঞ্জনের কত লেগেছিল দাদা?

রঞ্জনের সেকালেই হাজার চারেক লেগেছিল। অরুণেশের মাত্র ৭৫০? রঞ্জন একটা স্যুট করিয়েছিল বটে মহম্মদালি থেকে হাজারখানেক তো হিরণই দিয়েছিল অফিস কো-অপারেটিভ থেকে ধার করে। তা, অরুণেশ কি ইজের পরে গিয়েছিল?

গত বছর নন্দিনীকে সি-অফ করতে যাওয়াটাও এ জীবনে ভোলার নয়। ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬। ফ্লাইট নং জিরো-জিরো-থ্রি। রাত ৯ টা। আত্মীয়-স্বজন সব ঝেটিয়ে এসেছে এয়ারপোর্টে। বিশেষ করে নন্দিনের মামার বাড়ির লোক। এয়ার ইন্ডিয়ার মূল ফ্লাইট বোম্বে থেকে। কাল সন্ধেবেলা। বোম্বে, লন্ডন, নিউইয়র্ক। সেখান থেকে ইন্টার্নাল ফ্লাইটে ক্যালিফোর্নিয়া। বেশ জটিল ভ্রমণ-সূচি। যাচ্ছে, একা। অবশ্য, এয়ার ইন্ডিয়া দায়িত্ব নিয়েছে। নিউইয়র্কে প্লেন ধরিয়ে দেবে বলেছে।

৮টার সময় চেকিং-এ ডাকল। ৮টার সময় সবাই ভেতরে চলে গেল। থেকে গেল শুধু হিরণ, আর লেদু। লেদু বলল, প্লেন উড়ে যাওয়া পর্যন্ত দেখে যাবে।

ভাগ্যিস ছিল। বোম্বে নিয়ে যাবার জন্যে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর প্লেনটা, প্রথমে বলতে লাগল, লেট। তারপর রাত ১২টা নাগাদ নন্দিন সুটকেস-বোঝাই ট্রলি ঠেলে সিকিউরিটি-বেড়া পেরিয়ে হাজির। বলল, বাবা, প্লেন আসবে কাল ভোরে। আমাদের আজ এয়ারপোর্ট হোটেলে রাখবে। যান্ত্রিক গোলযোগ। বলে হাসল।

আমাদের? ওর পাশের ভদ্রমহিলা বললেন, নমস্কার। আমি সূলতা সরকার। আমিও সানফ্রান্সিসকো যাচ্ছি। খুব ভাল লেগেছে আপনার মেয়েকে। আমি ওকে নিয়ে যাব। হোটেলে আজকের রাতটা দুজনে একসঙ্গে থাকব। আপনি চিন্তা করবেন না। বাড়ি চলে যান।

লেদু আর হিরণ সারারাত এয়ারপোর্টে থেকে গেল। লেদুর মোটর সাইকেল আছে। কোথা থেকে একটা রাম কিনে আনল। সেটা শেষ করতে বার-কয়েক টয়লেটে যেতে যেতেই রাত কেটে গেল।

যান্ত্রিক গোলযোগ বলে যে মেয়ে অমন সাহসী হাসি হাসতে পারে, পরদিন ভোরে সে অমন কাণ্ড করবে তা কে ভাবতে পেরেছিল।

১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬। ভোরবেলা। হাওয়া জোরে বইছে। একটু জোলো, অন্তত শীত-শীত লাগছে বেশ। হিরণ আর লেদু শুধু ওরা দুজন তিনতলায় এয়ারপোর্টের দিকে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। প্যাসেঞ্জারদের জন্য ঢাকা করিডর দু-ভাঁজে ঢালু হয়ে নেমে গেছে প্লেনের প্রায় দরজা পর্যন্ত। প্যাসেঞ্জাররা প্লেনে উঠছে। প্লেন প্রায় দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।

প্রথম ভাঁজের মুখে আগে সুলতা তারপর নন্দিনকে দেখা গেল। দু-হাতে দুটো মস্ত সুটকেস, বাঁক নিয়েই সে বাঁ-দিকে মুখ তুলে তাকায় এবং ছাদের আলসেয় হিরণ আর লেদুকে দেখতে পায়! বারান্দায় শুধু তারা দুজন। একজন বেঁটে, একজন লম্বা। ভুল হবার কথা নয়। করিডরের দ্বিতীয় ভাঁজের মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে নন্দিন সেই অপ্রত্যাশিত কাণ্ডটা ঘটায়।

সে সুটকেস দুটি ধীরে নামিয়ে রাখল। আহা, অত ভারি আর যা রোগা মেয়ে। অত বোঝা আর টানতে পারছে না বেচারা, হিরণ ভেবেছিল। কেন যে অত জিনিস দিতে গেল চিনু। কিন্তু, তা নয়। সেজন্য নয়।

তারপর, হঠাৎ, একেবারে অপ্রত্যাশিত, নীলিমা থেকে বজ্রাঘাতের মতো, বলা নেই, কওয়া নেই, দুদিকে দুই সুটকেস, মধ্যিখানে নন্দিন, করিডরের কাচের দেওয়ালে মাথা রাখল।

ঢাকা করিডর। স্বচ্ছ টানেলের মতো। খোলা থাকলেও শোনা যেত না। বেশ, অনেকটা দূরে। চোখের জল দেখা যেত না। তবু, হিরণ, বুঝল,নন্দিন কাঁদছে।

সে এক সত্যিই, বড় অসহ্য ছবি। ছবিই তো। শব্দ নেই, স্পর্শ নেই— ঢালু করিডর দিয়ে প্যাসেঞ্জাররা দ্রুত নেমে যাচ্ছে, শুধু নন্দিন একা দাঁড়িয়ে। কেঁদে চলেছে। চলচ্চিত্র যখন মুখর হয়নি, সেই সাইলেন্ট যুগের একটি লঙ-শট যেন। নিচে সাব-টাইটেল:বাবা, কী অপরাধ করেছিলাম যে এ-ভাবে যেতে দিচ্ছ: বাধা দিচ্ছ না?

সুলতা সরকার ফিরে এসে ওর পিঠে হাত রেখেছেন।

ঐ যে, সুটকেস তুলে নিচ্ছে নন্দিন। প্লেনে ওঠার সিঁড়ির নিচের দিকটা করিডর আড়াল করেছে। ওপরের অংশ পুরোটা দেখা যায়। কারুকে বিদায় দেবার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে নেই, তবু অনেকেই হাত নেড়ে প্লেনে ঢুকল। শেষ দুই যাত্রী ছিল সুলতা আর নন্দিন। সুলতা তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন। কিন্তু, করিডরের বাকি পথ বা সিঁড়ি থেকে নন্দিন একবার ফিরেও তাকাল না।

প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

পিছুটানের তুলনায়, সামনে থেকে টানটা সব সময়েই বেশি শক্তিশালী, ভাগ্যিস। নইলে, হিরণ যা ভয় করেছিল, ফিরে না আসে মেয়েটা। বা, সে নিজেই হাত নাড়ানোর বিদায়-ভঙ্গিমা পাল্টে না বলে ওঠে, যেতে হবে না। চলে আয়! মৃতের তুলনায় যে-জীবিত, তার বেঁচে থাকা অনেক বেশি ইমপর্টান্ট, ভাগ্যিস। নইলে তো মৃতের জন্য পিছনের জন্য, বিলাপ করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত।

তবে জীবন জুড়ে বিদায়-নাটকের সেরা দৃশ্য তবু এটা নয়। সেটা দেখা দিয়েছিল ক্লারা আর কুমুদকে বিদায় দেবার সময়। গ্রিস থেকে এসে, এখানে বিয়ে করে; ওরা বায় ল্যান্ড গ্রিসে ফিরে যাচ্ছে। স্থান:হাওড়া স্টেশন। ট্রেন ছাড়ার পূর্ব-মুহূর্তে শ্বেতাঙ্গিনী বন্ধুপত্নী জানালার কাছে তাকে ডেকে এনে বলল, হিরণ, তুমি তো আচ্ছা লোক। আমাদের বিয়ের পার্টিতে সামওয়ান ওয়জ মেকিং পাসেস অ্যাট ইওর ওয়াইফ অল দা হোয়াইল, আর তুমি এমন ড্রাঙ্ক হয়ে গেলে যে তা নোটিসই করলে না।

এ-সব যৌবনকালের দৃশ্য। তখন বছর খানেকও হয়নি তাদের বিয়ে হয়েছে। শুনে ভর্তি চায়ের খুরি মাটিতে আছড়ে ফেলে হিরণ ছুটে চলেছে ট্রেনের সঙ্গে আর বলে চলেছে কে, কে, তুমি নাম বলে যাও ক্লারা, প্লিজ, যে কোন শালা আর জানালায় অপসৃয়মাণ জাস্ট-ম্যারেড ক্লারা হাসতে হাসতে তখন আঙুল তুলে তার অট্টহাস্যমুখর বরকে দেখাচ্ছে… অবশ্যই ঠাট্টা। বিদায়দৃশ্যগুলির মধ্যে ত এটাই, সবাইকে ছাপিয়ে, সবচেয়ে কাছের জিনিস হয়ে আছে।

 ০৬. এখানে এনো না কোনও ঋণ…

২৯ এপ্রিল।

বাবা? কিচেনে ট্র্যাশ-ক্লোজেটের ওপর ঝুড়িতে আপেল আছে কয়েকটা। বড় দেখে একটা এনে রাখবে?

সকালবেলা। বাথরুমে শাওয়ারের শব্দ। নন্দিন স্নান করে নিচ্ছে। সাড়ে ৭টায় ইয়াস আন্টি তার দুই ছেলে নিয়ে আসবে। তাদের স্কুলে এবং নন্দিনকে কলেজে নিয়ে যাবে। এ-ঘরে যেদিকে তাকাও, অনেকগুলো ছোট-বড় কোয়ার্টজ ঘডি; দেওয়ালে তো বটেই, আলমারিতে, ড্রয়ারে, ডিশওয়াশারে, ওয়াশিং মেশিনে, টয়লেটে, মায় স্টিলের ডট পেনেও—সর্বত্র একটা-না-একটা ঘড়ি সাঁটা। হঠাৎ দেখলে মনে হবে নিশ্চল আমেরিকান আরশোলা সব। শুধু শুড় দুটো নড়ছে। হুশ করলেই এখুনি পালাবে।

তারই একটিতে চোখ রেখে আমি একটু চেঁচিয়ে বললাম, ৭টা ২৫ এখন।

–শ্‌-শ্‌-শ্‌স। আস্তে, বাবা। আই অ্যাভ টোল্ড ইউ দ্যাট অলরেডি। নন্দিন আবার দরজা একটু ফাঁক করে বলল, এখানে কেউ চেঁচিয়ে কথা বলে না বাবা।

আমরা পৌঁছেছি কাল রাত নটা নাগাদ। তাড়াতাড়ি একটু কিছু খাইয়ে দিয়ে, বাড়িটাও ভাল করে না দেখিয়ে, দুজনকে নিজের ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে, কাল অধিক রাত পর্যন্ত নন্দিন আমাদের দুজনকে আমেরিকান সহবত সম্বন্ধে অনেক তালিম দিয়েছে, যে-সব উপদেশের অধিকাংশের শুরু এখানে কেউ দিয়ে। যেমন,

এখানে ভদ্রলোকরা কেউ সিগারেট খায় না। বিশেষ করে পুরুষরা কেউ খেলে এরা গার্ডেনারফার্ডেনার ভাবে। বুঝলে বাবা? বিশেষ করে ব্ল্যাকরা খেলে। তোমরা পিছনে সুইমিং পুলে গিয়ে খেয়ে আসবে।

এখানে কেউ সবার সামনে হাঁচে না। খুব অভদ্রতা। আর অন্য কেউ যদি হেঁচে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে বলবে গড় ব্লেস ইউ। বুঝলে বাবা?

তারপর ধরো, কেউ ছোটকাকা-কাকিমার ব্যাপারে সমবেদনা জানাল তোমাকে, সঙ্গে সঙ্গে বলবে আই অ্যাপ্রিসিয়েট, বুঝলে বাবা?,থ্যাঙ্ক ইউ বোল না, গ্রেটফুল এখানে কেউ বলে না, কাউকে প্রাণে বাঁচালেও। চাকর ভাববে। বুঝলে বাবা?

আর খবর্দার, ফোনে বা সাক্ষাতে কাউকে মিঃ বা মিসেস বলবে না। বলবে, হাই জনি। বা, হাই কিটি। যার যা নাম। বুঝলে বাবা? তা সে যত বুড়ো-বুড়ি বা ছোঁড়াছুঁড়িই হোক।

কাল রবিবার। কাল সকাল থেকেই অনেক মোনার আসবে। তাদের সঙ্গে ঠিকমত কথা বলবে, নইলে, কী ইম্প্রেশন হবে তাদের ছোটকাকার ফ্যামিলি সম্বন্ধে, বল তো?

এতগুলো ব্যাপার একসঙ্গে পয়লা রাতে না বুঝতে পারলেও একটা ব্যাপার বুঝতে অসুবিধে হয় ন! ৷ এক বছর বলার চান্স পায়নি। চুটিয়ে বাবা বলে নিচ্ছে নন্দিন। কারণে, অকারণে।

লেদুনন্দিনের থেকে বছর ছয়েকের বড়। কিন্তু নন্দিনের সঙ্গে ওর ব্যবহার সমবয়সীর। বিধবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়েছে। বাবার ব্যবসা কন্ট্রাক্টরি করে। লেদু বলল, থাম তো তুই। আর শেখাতে হবে না। এখন এক গ্লাস জল দে দেখি।

ঘরের মধ্যে ওর প্রায় দ্বিগুণ উঁচু একটা ফ্রিজ খুলল নন্দিন। ফুট জুস আর কোল্ড ড্রিঙ্কে ঠাসা। পেপসি কোলার একটা জ্যারিকেন বের করে সে টেবিলের ওপর এনে রাখে। এক গ্লাস গড়িয়ে লেদুর সামনে রেখে গম্ভীরভাবে বলে, এখানে কেউ জল খায় না। মিনারেল ওয়াটার খায়। জল চাইলে, গাঁইয়া ভাববে। ভূত ভাববে। সে দাদার টাকে একটা আদুরে চাঁটি মেরে বলে, বুঝলে লেদধুস!

তাই নাকি! জল খায় না, শুধু পেপসি আর সেভেন আপ? চোখ বড় বড় করে লেদু ওর দিকে সপ্রশংস চোখে তাকিয়ে। আমি বুঝতে পেরেছি, আসলে লেদু এসেছে আমেরিকায় তার স্বপ্নের দেশে। তাদের বড়লোকী দেখতে। প্লেনে ওঠার পর থেকেই তার হাবভাব বদলাতে শুরু করেছে। প্লেনে চিজ-মাখন-প্যাস্ট্রি যখন যা দিয়েছে ছোটখাটো প্যাকেজে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখেছে আর উচ্ছ্বসিতভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলে গেছে, দ্যাখো, দ্যাখো খাঁটি ডেনিস প্যাস্ট্রিজেনিভার মাখন—একটু টেস্ট করে দ্যাখোনকাকা! হুইস্কির ছোট্ট উপহার-বোতলগুলো চেয়ে নিয়েছে। বারবার। প্লেন যত এগিয়েছে, তত তার উত্তেজনা বেড়েছে। এয়ার ইন্ডিয়ায়, সে যখন গীত গাতা চল দেখার জন্য সামনের দিকে ভাল সিটে উঠে গেল, তখনও কিছু বলিনি আমি। ভেবেছিলাম, আহা, বয়স কম, প্রথম জেট প্লেন, প্রথম আমেরিকা—এমনটা তো হবেই কিছুটা। তবু, টোকিও থেকে জাপান এয়ারলাইন্সে উঠে সে যখন ডিনারের পর সিটে লাগানোইয়ারফোনে ছয়-চ্যানেলের গান শুনবে বলে আড়াই ডলার পে করতে যাচ্ছে, তখন তাকে মনে না করিয়ে দিয়ে পারিনি, শুনবে শুনুক, কিন্তু সে যেন ভুলে না যায় যে সে বা তারা কী জন্যে, কী উপলক্ষে কোথায় যাচ্ছে। তখনকার মতো গান শুনল না বটে লেদু, কিন্তু লাঞ্চের পর বেভার্লি হিল কপ-টু দেখবে বলে সামনের ব্লকে সোজা চলে গেল। আমাকে না বলে। কপ-ওয়ান তার কলকাতায় দেখা। সেই টোকিও এয়ারপোর্টে যা এককাপ কফি আড়াই ডলার দাম দিয়ে, তারপর বা আগে আমি একদিন দুরাত্রি জল ছাড়া কিছু খাইনি। খেতে পারিনি। পাশে বসে কেউ যদি খচর-কচর করে চিবিয়ে যায়, একটু অশ্লীল বা জান্তব আমার লাগারই কথা। প্লেনে লেদু আগাগোড়া তাই করে গেছে। কপ-টু দেখতে দেখতে সোৎসাহে উঠে এসে লেদু যখন বলল, নকাকা, ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইন ক্রশ করছে। ঘড়ি মেলাও, ঘড়ি মেলাও… শোক অথবা ঘুমের আচ্ছন্নতা থেকে জেগে উঠে, জল ছেড়ে অনেক দূর ডাঙার ভিতরে চলে আসা শামুকের মতো খোল থেকে বিষাদমাখা মুণ্ডু বের করে আমি তাকে না বলে পারিনি, লেদু, তুই কি শোকের টিকিট কেটে ডগমগপুরে যাচ্ছিস..

সত্যি কে বলবে এই সেই লেদু, কঘণ্টা আগেও যে ওভাবে হামাগুড়ি দিয়ে আমাদের ফ্ল্যাটে উঠে এসেছিল! লেদু বলল, আরে, শোক-ফোকের ব্যাপার নয়। এটা ইন্টারন্যাশনাল ডেট লাইন! একটা দিন হারিয়ে যাচ্ছে তোমার সারা জীবন থেকে… বলে সে অপ্রস্তুতভাবে কেন এমন হয় তা বোঝাতে বোঝাতে সিকোর মস্ত ঘড়ি দেখে নিজেরটার কাঁটা ঘোরাতে লাগল। এক্কেবারে ভুল। ডেটলাইন ব্যাপারে হাস্যকর তার ধারণা। এ বিষয়ে কিছু জানা না থাকলেও আমি বুঝতে পারলাম। যেমন বুঝতে পারলাম, সার্ভেন্টিসের মূল বইটি পড়া না থাকলেও, বিবেকবান দ্বিধাগ্রস্ত ডন কুইকজোটের সঙ্গে আসলে চলছে মাঠো, নির্বোধ অথচ প্র্যাগম্যাটিক এক সাঙ্কো পাঞ্জা। পারলে, একটা চড় কষাতাম তখন লেদুর গালে।

গত এপ্রিলে হায়ার সেকেন্ডারি দিয়ে নন্দিন আমেরিকা বেড়াতে যায়। আমার আর নন্দিনের টিকিট এসেছিল। চিনুর আসেনি বলে আমি যাইনি। ওখানে ৮ মাসে টেথ গ্রেড পাস করে, মাস দুই হল সে নিউট্রিশন মেজর নিয়ে মার্সে কাউন্টি কলেজে ঢুকেছে। রঞ্জনের ইচ্ছে ছিল নন্দিন ডায়াটিসিয়ান হয়ে ওর অলিভ মেডিকেল সেন্টারে ঢোকে।

অঞ্জন পাবলিক স্কুলে পড়ে। স্কুল যায় সকাল ৭টায়। সে পড়ছে টেন্থ গ্রেডে। যাওয়ার আগে দরজায় টোকা মেরে বাংলায়, নন্দিন তোমার সাতটার সোময় হয়েছে বলে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। অর্থাৎ, তার কলেজ যাওয়ার সময়।

আজই প্রথম ও স্কুলে আর আমি কলেজে যাচ্ছি বাবা। গত সপ্তাহেও কাকিমা ডেকে তুলেছিল। বাথরুমের দরজা বন্ধ করার আগে দাঁত মাজতে মাজতে নন্দিন আমাকে জানাল।

সত্যি, মস্ত ঘরখানা নন্দিনের। উঁচুতে, তিন দেওয়াল জুড়ে ক্লোজেট। একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো। বহুদিন ব্যবহার হয়নি বোঝা যায়। বেকার দাঁড়িয়ে থেকে থেকেই বুঝি পা চারটি অমন বেঁকে গেছে। বিশাল ডালার ওপর নন্দিনের বইপত্র থেকে কালার এবং হোয়াট নট। এমনকি, একটি হেয়ার-কন্ডিশনার। ড্রায়ার ও ওয়াশিং মেশিনও এ-ঘরেই। এত বড় ঘরে জানালার ধারে মাত্র একটা ছোট্ট সিঙ্গল বেড দেখে লেদু আমরা শোব কোথায় জানতে চাওয়া মাত্র কেন, এইখানে বলে ছুটে গিয়ে চার-পাঁচজনে বসার সোফাটার নিচে একটা রড ধরে টানতে টানতে, সোফা গদিটদি সাজিয়ে, মায় চাদর-ব্ল্যাঙ্কেট-বালিশ সব পেতে মিনিট দুয়েকের মধ্যে নন্দিন একা-একাই সেটাকে পরিণত করেছিল একটি আকর্ষণীয় ডাবল বেডে। লেদু এখনও সেখানেই ঘুমুচ্ছে।

মেয়ের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের পরিচয় কাল থেকে অনবরতই পাচ্ছি। বুঝছি যে, সেনন্দিন আর নেই যার এক-একটি হাই তুলতে লাগত ৩০ সেকেন্ড। ঘড়ি দেখে তবু বললাম, কীরে, পারবি তো? এখন ৭টা ২৫।

পারতেই হবে বাবা। কালো জিনসের স্কার্ট আর কালো সিফনের ফ্রিল-দেওয়া জামা পরে বাথরুম থেকে বেরিয়ে নন্দিন বলল, সাড়ে সাতটা মানে এখানে সাতটা ঊনত্রিশ, সাতটা একত্রিশ কখনওই নয়। সাত ঊনত্রিশে ওই চায়না বেরি গাছটার নিচে আমাকে দাঁড়াতে হবে।

এর মধ্যে পারবি?

আন্টি ড্রাইভওয়ের ওই দিক দিয়ে ঢুকবে আর এই দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। মাঝখানে একবার শুধু আমার জন্যে দরজা খুলবে। পারতেই হবে বাবা।

রাস্তার দিকে বিশাল গ্লাস প্যানেল। দুদিকে নস্যি-রঙের প্রগাঢ় পর্দা টানা। পর্দা দুদিকে সরে যাওয়ার পর গ্লোব সিনেমার প্যানোরামিক স্ক্রিনে যেমন, জানালার কাচে এখন ফুটে রয়েছে একটি মূলত সবুজ, রোদ ঝলমলে চলচ্ছবি। দূরে, বেয়ারক্রিক খালের (নন্দিন বলেছে নদী) ওপর সেতুর এপারে সাদা রঙের কাঠের গেট পর্যন্ত দেখা যায়। সেখান থেকে শুরু হোয়াইট গেট ড্রাইভের। দু লেনের লম্বা রাস্তা জুড়ে সাদা ফুলে ভরা এখনও নাম-না-জানা বিদেশি গাছের সারি দুধারে। মাঝে মাঝে একটা গাড়ি বাঁক নিচ্ছে, ব্রিজ থেকে নেমে এই দিকে ছুটে নিঃশব্দে আসছে। বাড়ি সাউন্ড প্রুফ। ড্রাইভারের সিটে নারী-পুরুষ যেই বসে থাক, তখন থেকে দেখছি সকলেই এই বাড়িটার দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে। লাল কস্টিউম পরে স্বর্ণকেশী শ্বেতাঙ্গিনী এক জগ করতে করতে বাড়ির সামনে দিয়ে ছুটে গেল, শুধু সে কেন, তার সঙ্গী পোলকা-ডট গ্রেট-ডেনটাও, ছোটা অব্যাহত রেখে, এদিকে কয়েকবার ভীতভাবে তাকায়। যেন সেও জানে মাত্র ৪ দিন আগে কী ভীষণ ভূমিকম্পে ভেঙে গেছে এই বাড়িটা, যদিও আপাতদৃষ্টিতে অটুট দাঁড়িয়েও রয়েছে।

এই সেই হোয়াইট গ্রেট ড্রাইভ, ২৮৫৬ নং। ক্যালিফোর্নিয়া-৯৫৩৪০। গত ১২ বছরে এই ঠিকানায় কত চিঠি, কত কার্ড যে পাঠিয়েছি তার হিসেব নেই। এক বছরে সপ্তাহে দুটো করে নন্দিনের কাছেই শখানেক চিঠি এসেছে। এই সেই ২৮৫৬ হোয়াইট গেট, যে ঠিকানায় সুমিতাকে পাঠানো হারমোনিয়ামটা, হায়, শেষ পর্যন্ত পৌঁছল না।

পোল থেকে একটা গাড়ি নামতে দেখেই ওই আসছে বলে ব্যাগ কাঁধে তুলে নিয়ে, আপেলহাতে নন্দিন ছুটতে শুরু করল, আমি ফোন করব তোমাকে। কলেজ থেকে।

হাই আন্টি, হাই আঙ্কল বলতে বলতে সে ছুটে কিচেন পেরোচ্ছে, আমি শুনতে পেলাম। ছন্দা-অমিয় তাহলে উঠে পড়েছে। আমার এবার বাইরে বেরনো উচিত। কাল রাতে ওদের সঙ্গে আলাপ ছাড়া বিশেষ কোনও কথা হয়নি। ওরাই তাড়াতাড়ি শুতে বলেছিল।

গাড়ির কাচ খুলে নন্দিন হাত নাড়ল। হাত নাড়ল ইয়াসও। ওই যে ওদের ছেলেমেয়েরাও হাত নাড়ছে। গাড়িটা হোয়াইট গেটের মুখে বাঁক নেওয়ার আগে পর্যন্ত আমি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম। বোধহয় ক্যাডিল্যাক।

 ০৭. আল কাপিতান

৩০ এপ্রিল

প্রকৃতি শূন্যতা সহ্য করে না।

যা ভেবেছিল, ভুল। এখানে জীবন এসে দাঁড়িয়েছে। মৃত্যু তাকে জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে। অনভিপ্রেত অতিথি মাত্র চারদিন যেতে না-যেতেই বলছে, তবে উঠি রে।

কিচেন-সংলগ্ন টেবিলে অমিয় আর ছন্দা বসে আছে। সামনে একটা প্যাড। হোল্ডারে গুচ্ছের ডট পেন। আর, আজকের খবরের কাগজ অনেকগুলো। ছন্দা চা খাচ্ছিল। আন্ডারলাইন করার বদলে, বেঢপ মোটা মার্কার কলম দিয়ে একটা সম্পূর্ণ প্যারাগ্রাফের লাইনগুলোর ওপর স্বচ্ছ হলুদ কালি বোলাচ্ছিল অমিয়। ওরা আমার দরজা খোলার শব্দের দিকে মুখ তুলে তাকায়।

মর্নিংনদা, ছন্দার গলার সুরে আত্মীয়তা, ঘুম হয়েছিল?

ঠিক আছে। আমি বলি।

বসুন। চা করি আপনার জন্যে। এক কাপ জল কুকিং রেঞ্জের একটা বাক্সের মধ্যে রেখে সে কাচের ডালাটা তুলে দেয়। দূটো-তিনটে বোতাম টিপে। ভেতরে আলো জ্বলে ওঠে। ফুটন্ত জলসুদ্ধ কাপ বের করে এনে তাতে টি-ব্যাগ, সুগার আর শুকনো দুধ-কিউব মিশিয়ে চা পরিবেশন করতে তার এক মিনিটের বেশি সময় লাগে না।

এগুলো মাইক্রোওয়েভ ওভেন। এক কাপ জল ২০ সেকেন্ড। বলতে বলতে ছায়া ঘনিয়ে এল ছন্দার মুখে, সুমি আগুনকে ভয় করত খুব। রান্নাবান্না সব মাইক্রোওয়েভেই করত।

অমিয় ওয়েস্ট কোস্ট স্টার নামে একটি কাগজ আমার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে দেয়। প্রথম পাতার ডান দিকের সেকেন্ড লিডটা কালো সাইন পেনে চৌকো করে বর্ডার দেওয়া।

তিন কলমের হেডিং: টারলক বয় প্লিডস ইন্নোসেন্স। ছেলেটির নাম জন পার্ল। বয়স ১৯। তার এক কলম ছবি।

টারলক? চেনা-চেনা লাগছে। অ্যাঁ-হ্যাঁ, মনে পড়ল, এইটারলকশহর ছিল জন আপডাইকের কাপল উপন্যাসের চরিত্রদের লীলাক্ষেত্র। সেটা তাহলে ধারেকাছেই? টারলকের সেই জোড়ায়জোড়ায় ইদুর-দম্পতি, এর গোড়ালি ওর পায়ে বাঁধা— তাদের খাড়া-ল্যাজ ইঁদুর-দৌড়। ইঁদুর বৌ-দের অনবরত বিছানা-বদল। সব নাম ভুলে গেছি, তবু বেশ কিছু লোক, যাদের সঙ্গে দেখা হলেই চিনতে পারব, এমন কিছু মানুষের কাছাকাছি কোথাও আমি, এই বিভুই-এ, এমনটা ভেবে একটু স্বস্তি বোধ করছি দেখি।

জন পার্ল বিধবার একমাত্র ছেলে। বাড়ি টারলকে। ড্রপ-আউট বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে। সে বেকার ভাতা পায়। সান্টা মারিয়া থেকে সে একটা খালি পিক-আপ ভ্যান নিয়ে যাচ্ছিল স্টকটনের দিকে, ফ্রি-ওয়ে হান্ড্রেড থার্টির ৩নং লেন ধরে না, গাড়িটা তার নয়। তার বন্ধু স্যাম পিয়ার্সনের। হ্যাঁ, সে কিছুটা মদ খেয়েছিল। কিন্তু সে তো দুপুরবেলায়। অনেক আগে। হা, স্পিডলিমিট ছাড়িয়ে সে গাড়ি চালিয়েছিল কিছুক্ষণ। একসময় ছিল ৯০ মাইলে, ৬০-এর লেনে। বোধহয় রাডারে ধরা পড়ে যায়। ট্রাফিক-পেট্রল তাকে তাড়া করে। পুলিস বলেছে, না? তাড়া করেনি! পিছনে জোর আলো ফেলে অনেকক্ষণ ধরে তবে কারা আসছিল? তার তাই মনে হয়েছিল, এনিওয়ে। যে, পুলিস! তখন রাত? ১০টা হবে। মডেরা শহর থেকে বেরোবার মুখে শোল্ডার থেকে নেমে এল একটা নীল রঙের লিঙ্কন। সে তখন পুলিসের ভয়ে প্রাণপণে চালাচ্ছে। সে ভাবতেই পারেনি যে গাড়িটা ওভাবে নামবে। গাড়িটার পেছনে সে সোজা ধাক্কা মারে। উইথ মাই আইজ ক্লোজড। তাকে অবাক করে গাড়িটা মুহূর্তে দপ্ করে জ্বলে ওঠে। তারপর…

ছন্দা বলল, চা খান নদী। এগুলো পেস্তোশিয়া। সল্টেড পেস্তা। আর এগুলোকে এরা বলে ককি। আমেরিকান বিস্কুট। অনেকটা আমাদের লেড়ো বিস্কুটের মতো, তাই না? বলে কী মনে করে সে একটু হেসেই বলে, আমি দর্জিপাড়ার মেয়ে। আপনারা তো বেনেটোলার?সুমিতা ছিল আমার… চোখের জল লুকোতে সে মুখ লুকোয়, লোকে বলত, অনসূয়া-প্রিয়ংবদা।

টেবিলে ইন্ডিয়া ওয়েস্ট ইন্ডিয়া অ্যাব্রড, নেভাদা পোস্ট আর মর্নিং স্টার। সবই আশপাশের কাগজ। সবাই ফলো-আপ ছেপেছে কিছু না-কিছু।

টি ভি-র টেনথ-চ্যানেলে থার্টি মিনিটস-এ পুরোটা দেখিয়েছে। ছন্দা জানাল, অঞ্জনের ইন্টারভিউ নিয়েছে। আপনার মেয়েকেও দেখিয়েছে।

গত তিনদিনের খবরের কাটিং ওই বোর্ডটায় ছন্দা টেলিফোনের পাশে বোর্ডটা দেখায়। বোর্ড পিন দিয়ে আটকানো খবরগুলির মধ্যে একটি চার কলমব্যাপী গাড়ির ভস্মীভূত কঙ্কাল! আমি শিউরে উঠি।

অবিচুয়ারি বোর্ডের পাশ থেকে শুরু কিচেনের। কিচেনের গোটা পূর্ব দিক জুড়ে লম্বা গ্লাসপ্যানেল। সুমিতা এখানে দাঁড়িয়ে পূর্বাস্য হয়ে রান্না করত।

…বাবা, আজ কি ওখানে রথ?

…না, রথ তো কাল রে।

…কাকিমা বলল আজ!

…ও-হ্যাঁ, তোদের হিসেবে তাই তো হবে।

.. আমরা এখন রাইস-ক্রিসপি, মানে ঠিক মুড়ি নয়, ধরো চালভাজা— চালভাজা দিয়ে বেগুনি আর পাঁপড় খাব। কাকিমা ভাজছে। ছোটকাকা বলল, তোর বাপকে ডাক। ডেকে বল।

তাই ফোন করলাম।

কুকিং রেঞ্জের গ্লাস-প্যানেল দিয়ে বাড়ির পিছনে বিঘে চারেকের মাঠ পেরিয়ে সিয়েরা নেভেদা পর্বতমালা পর্যন্ত দেখা যায়। দেখা যায় আল কাপিতান। রেড ইন্ডিয়ানরা থাকত মূলত ওখানে, ওই ইওসেমিটি উপত্যকায়। ওখানেই সেই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু, ৪০০০ ফুটের সাদা-ধূসর ওয়ান-পিস গ্রানাইটের খাড়া পাহাড়: আল কাপিতান। কাপিতান ছিল বিখ্যাত রেড-ইন্ডিয়ান ডাকাত। জানো বাবা? সে যখন ঘোড়া ছুটিয়ে যেত, ঘোড়ার ওপর তাকে দেখা যেত না। শুধু দেখা যেত তার মাথার পালকের মুকুট আর হাতের বর্শা। জানো বাবা, ওই কাপিতান আসছে বলে এখানে ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়ায়।

শরতের ছেঁড়া মেঘ ছাড়া কিছু মানায় না এমন নীল আকাশের দিকে মাঠের বেড়া ডিঙিয়ে বন পেরিয়ে, আল কাপিতান পর্যন্ত সুমিতার চোখের ভেতর দিয়ে আমি দেখবার চেষ্টা করি। সুমিতা নিশ্চয় দেখত। রান্না করতে করতে। মাঝে মাঝে। মুখ তুললেই: আল কাপিতান!

কাপল-এর নায়কের নাম মনে পড়ে গেছে। পিয়েতনাম মনে না পড়ে যাবে কোথায়, চেনা মানুষ! পিয়েতের প্রেমিকার নাম ছিল জর্জি। তাই কী?

টারলক এখান থেকে কতদূর?

টারলক? সে তো খুব কাছে। ৩০ মাইল। কেন, চেনেন বুঝি কাউকে?

অমিয় উঠে গিয়েছিল ডোরবেল শুনে। হাউসক্লিনিং লেডি এসেছে। হাই মারিয়া: অমিয়। শুনলাম, পোটুরিকান। ভ্যাকুয়াম ক্লিনার বের করে সে লিভিং রুমের ভেলভেট কার্পেট ঝাঁট দিতে শুরু করেছে দেখতে পাই।

অ্যাঁ-হ্যাঁ। পিয়েত কী যেন ইঞ্জিনিয়ার বোধহয়। এ নিয়ে আরও কৌতূহল চাপা দিতে আমি মার্কার পেন দিয়ে শোল্ডার শব্দটার ওপর হলুদ বুলাতে বুলাতে তাড়াতাড়ি প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা, শোল্ডার ব্যাপারটা কী?…

ইউ নো, অমিয় এতক্ষণে নড়ে-চড়ে চেয়ার টানল, দেঁয়ার আর সিক্স লেনস্‌ অন দ্য ফ্রিওঁয়ে। দিঁস হাইওয়ে অঁর ফ্রি-ওঁয়ে অ্যাজ উই প্রেফার টু কঁল ইট, রানস দ্য এনটাঁয়ার ইউনাইটেঁড স্টেটস, ইভন্ থ্রু দ্যঁ ডেঁজার্টস অফ আঁরিজোনা, গ্রু দ্য গ্রাঁন্ড ক্যানিয়ন। দিঁস ইজ দ্যঁ প্রিন্সিপাল আঁর্টারি দ্যাঁট কিপস ম্যারিকান ব্লাড অন দ্যঁ মুভ। আপ অ্যান্ড ডাউন-ও-কেঁ? লাইক দিঁস—সে প্যাডে ছবি আঁকতে শুরু করে, শোল্ডার হল এই ফ্রি-ওঁয়েতে গাড়ি পার্ক করার জায়গা। মাঝে মাঝে, একশো-দেড়শো মাইল অন্তর ওগুলো থাকে। এদিকে তিনটে রাস্তা, ওদিকে তিনটে রাস্তা মাঝখানে শোল্ডার। দুহাতের তালু জড়ো করে, ডাইনে ও বাঁয়ে দুদিকে দুলিয়ে, তারপর জোড়া তালু টেবিলের ওপর সশব্দে ঠকে সে ব্যাপারটা বিশদ করে।

রাত দশটায় ওরা গাড়ি পার্ক করল? যখন বাড়ি থেকে মাত্র ৩০ মাইল দূরে?

অ্যাঁট লিঁস্ট, দ্যাঁট ইঁজ দ্যঁ স্টোরি দ্যাঁট সান-অফ-আ বিচ জন পার্ল ওয়ান্ট টু সেঁএল…

আনুনাসিকতা-সহ দিব্যি একটা ক্যালিফোর্নিয়ান অ্যাকসেন্ট রপ্ত করেছে অমিয়, আমি লক্ষ্য করলাম, অথচ, বাংলা বলার সময় সেটা একদম আসে না ভাগ্যিস। তাহলে, নিঃসন্দেহে, ভূত মনে হত।

রি-রি-রি-রি-রি-রি। ফোন। নন্দিন?

এখানে রিসিভার লম্বালম্বি ভাবে হুকে ঝোলে। কিড়িং-কিড়িং শব্দে বেয়ারা ডাকা নয়। এর স্বর সবল ঝিঝি পোকার। প্রেস-বাটন ডায়াল। রিসিভারের সঙ্গে থাকে ৩০/৪০ গজ তার। রিসিভার নিয়ে ছন্দা লিভিং রুমে চলে গেল। ফিরে এসে বলল, না আপনার ফোন।

হিরণদা, আমি ফ্রিমন্ট থেকে বলছি।

আপনি?

আমি রঞ্জনদার ছোট ভাইয়ের মতো। আমাকে তুমি বলুন। আমার নাম ধূর্জটি পালিত। সাহেবরা সংক্ষেপে বলে ধুজ (হাসি)। স্বর পাল্টে, যাক। দেখুন, যা হওয়ার তা তো হয়ে গেছে। হ্যালো…

আমি শুনতে পাচ্ছি। আপনি বলুন।

দেখুন দাদা। কথা বলার মতো অবস্থা আপনার নয়। আমি জানি। এমন মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি… এ তো আমরা কখনও শুনিনি। আই ওয়াজ দ্য লাস্ট ম্যান টু সি দেম অফ। ফ্রম এল-এ। কেন যে, ডি-ট্যুর করে ওরা ফ্রিকো গেল। কী জন্যে? ইটস্ রিয়েলি আ মিষ্ট্রি টু মি। যাক, আপনি এসে গেছেন। জানতাম, কেউ এলে আপনিই আসবেন। আপনিই তো নদা?

হ্যাঁ, আমিই ন’দা।

আপনার কথা সবসময় বলত। হি ওয়জ সো ভেরি প্রাউড অফ ইউ। বাট…মাই ব্রাদার ইজ আ গিফটেড রাইটার। একটু ড্রিঙ্ক করলেই শুরু করত। আমরা হাসাহাসি করতাম। এই রে, আবার নদা শুরু হল।

আর কারও কথা বলত না?

না! আর আপনাদের বাবার কথা।

তাই নাকি? জানতাম না তো।

ও ইয়েস। দ্যাটস ফর শিওর। তারপর যেন গোপন খবর, যেন কাছে ডেকে, ধূর্জটি কানে কানে বলল, হি ইউজড নট টু হোল্ড আ ভেরি হাই ওপিনিয়ন অ্যাবাউট দ্য রেস্ট অফ ইওর ফ্যামিলি, ইউ ননা।

আমি তা জানি। কিন্তু, ফ্ল্যাটার্ড হওয়ার বদলে, এখানে কারও মুখে সে-কথা শুনে খুবই কুৎসিত লাগল। ভীষণ খারাপ লাগল লোকটাকে। রিসিভারের ওপর আমার মুঠো শক্ত হয়ে চেপে বসে যাচ্ছে।

দেখুন, কী বলব, সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। তবে একটা কথা বলি। স্বর নামিয়ে, ওই যে ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা পরিত্রাতার ভূমিকায় প্রথম দিন থেকে নিজেদের কাজকর্ম ছেড়ে ওখানে গেড়ে বসেছেন, ইউ মাস্ট হ্যাভ ওয়ান্ডার্ড— হোয়াই?

কী দিক দেখে বলুন তো?

শুনতে পাচ্ছে নাকি? দেখলাম, অমিয় আর ছন্দা জ্বলন্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। বোধহয় ভুল করলাম। টেলিফোন নিয়ে আমি চলে গেলাম পাশের ঘরে।

এই… টাকাকড়ি, গয়নাগাটি, দরকারি কাগজপত্র সবই তো ছড়িয়ে। ধূর্জটি বলে চলেছে, আই হ্যাভ ইনফর্মেশনস যে ওরা অঞ্জনকে নিয়ে ব্যাঙ্কে ভল্ট দেখতে গিয়েছিল। ছেলে মাইনর, হাউ কুড দে মেকআ প্রিপসটারাস মুভ লাইক দ্যাট! আপনি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিত ছিল। হাউয়েভার, কিপ অল দ্য রুম আন্ডার লক অ্যান্ড কি। নো বড়ি শুড হ্যাভ এনি অ্যাকসেস টু দ্য কম্পিউটার রুম ইন পার্টিকুলার। ওখানেই সব আছে আমি জানি। উইল আছে। রঞ্জনদা ইউজড টু ট্রাস্ট মি আ লট। ফিউনারাল কবে করছেন?

ফিউনারাল?

হা। আপনার জন্যেই তো সাসপেন্ডেড হয়ে আছে। কিচেনে ফিরে গিয়ে আমি মাউথ পিসে হাত চাপা না দিয়েই জানতে চাই, ফিউনারাল কবে ছন্দা?

আঁই নিড, অ্যাঁট লিস্ট টু-টু-থ্রি ডেঁজ টাইম অমিয় গর্জন করে উঠল, সেঁফ ডিসট্যান্সে বসে খালি ফোন আর কৈফিয়ত। আঁস্ক হিম, হোয়ার ইজন্ট হি হিয়ার— দিস ইজ দ্য ফোর্থ ডে–নট আ সিঙ্গল সোল ইজ অ্যারাউন্ড আজ ইয়েট। হাঃ!

আস্তে, আস্তে ছন্দা বলল।

হোঁয়াট ফর? হোঁয়ায় দা হেল!

ধূর্জটি বলল, আচ্ছা দাদা, আমি আবার ফোন করব। জেনে নেব। মিন হোয়াইল কিপ আ ভিজিল অন মিঃ উইচ অ্যান্ড মিসেস উইচেস। বায়।

খুব সহজভাবে হেসে অথচ আমার চোখের তারায় তার চোখের তারা আটকে ছন্দা যেন কিছু নয়, এমনভাবে জানতে চাইল, কী বলছিল ধুজ?

ফিউনারাল কবে জানতে চাইছিল।

ছন্দা-অমিয় মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। আমাকে বোঝবার চেষ্টা করছে। বুঝছে মনে হল, আমি তাদের মধ্যে পড়ি না, যাদের বলা হয় ওপেন-বুক।

ও, আচ্ছা। তাহলে এই ব্যাপার। বীরিভড়-টার্নড় টুরিস্ট ভাইপোর সঙ্গে দুদিন দুরাত্রি লুডোর খোলে ছক্কার মতো ঝাঁকুনি খেতে খেতে আমি উড়ে এসেছি। আমি জানতাম, মার্সেদে গিয়ে আমাকে পড়তেই হবে। সে ছয়-পাঁচ, তিন-দুই, পাঞ্জা বা পোয়া, যা হয়েই পড়ি। ছেলেটা আর মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে তাদের জেঠকে আর বাবাকে। তারপর ভাই হিসেবে, ভাসুর হিসেবে চোখের জলে ভাসতে ভাসতে ওদের শেষকৃত্য করা— এর বেশি কিছু কৃত্য আমার ধারণায় ছিল না। কিন্তু, এখন দেখছি, আরও একটা লাশ পড়েছে। এবং, তা হল ওদের বিষয়সম্পত্তি, টাকাকড়ির লাশ—–ডানা মেলে শকুনের পাল উড়ে আসছে সেদিকেই—এরা কি সেই লাশের ওপর বসে?

আচ্ছা, এদের বিষয়-সম্পত্তি কত হবে?

সম্পত্তির কথা পরে। অমিয় বলল, দুদিন ধরে বডি সিটি করোনারের অফিসে পড়ে আছে। আসুন, আগে ওদের সৎকারের ব্যবস্থা করি।

অবশ্য, সকার আর কীসের হবে। বডি বলতে তো কিছু নেই। মুখ চোখ বিকৃত করে ছন্দা বলল, শুধু তাল-তাল মাংস। ডেন্টিস বডি আইডেনটিফাই করেছে। সুমি-র তিনটে দাঁত বাঁধানো ছিল। সেটা ছিটকে পড়েছিল। আর আপনার মেয়ের বডি কার্ড।

বডি কার্ড?

হ্যাঁ। ওতে ছবি থাকে। নাম-ধাম থাকে। ড্যাশ বোর্ডে ছিল। ওই গাড়িতেই নন্দিন ড্রাইভিং শিখছিল কিনা। ওগুলো পোড়ে না। ওই জন্যেই তো ভাইস-কনসাল আপনাদের প্রথমে জানিয়েছিলেন নন্দিনও…. কাগজেও প্রথম দিন তাই বেরিয়েছিল। আমরা তো তাই জেনেই এসেছিলাম। যে শুধু অঞ্জন বেঁচে আছে।

ডিং-ডং, ডিংডং, ডিংডং। ডোর-বেল।

প্রথম মোর্নার। থ্রি-পিস ডাভ-গ্রে স্যুট। গ্যাবার্ডিন। হাতে প্রচুর খাবার। সেই প্রথম আর শেষ রোগা আমেরিকান। নাম বলল, হ্যারি। গভীরভাবে মর্মাহত। আবার আসব বলে চলে গেল।

আমরা ওদের মৃতদেহ দেখিনি। প্যাডে হিজিবিজি দাগ কাটতে কাটতে মাথা নিচু করে ছন্দা বলে গেল, দেহ বলতে কিছু ছিল না। এবং ওদের শরীরের সবটাই যে করোনারের কাছে আছে, তাও না বলতে বলতে হাল্কা মেহেদি-রঙা ববড় চুল তার মুখ ঢেকে দেয়, গয়নার বাক্স যেটা গাড়িতে ছিল, তার চারদিকে জমে ছিল তাল-তাল মাংস, যেন সূর্যের তাপে পুড়ে অমন পাথরের মতো শক্ত হয়ে গেছে। আমাদের তো…. আমাদের তো ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে মাংস ছাড়াতে হয়েছিল। গয়নাগুলোর, আশ্চর্য, কিছুই হয়নি।

ছন্দার ধারণা, গয়নার বাক্সের চারদিকে জমে থাকা যে তাল-তাল মাংসপিণ্ড, তা ছিল সুমিতার। তার মতে, নিজের মাংস ঢেলে সে সম্পূর্ণ ধ্বংসের হাত থেকে সেগুলোকে রক্ষা করে গেছে। এ বছর ফেব্রুয়ারি দীঘা যাওয়ার সময় বাসস্ট্যান্ডেমাথা থেকে একটা হেয়ার-পিন পড়ে গেল সুমিতার। খোঁজ, খোঁজ। সুমিতা একটা এঁটো শালপাতার নিচে থেকে সেটা কুড়িয়ে পেল, তবে পরের বাসে উঠল। আবার টিকিট কাটতে হল।

আর একটা জিনিস মিরাকিলাসলি সেভড় হয়েছে ছন্দা জানাল, কী বলুন তো?

মাইনাস আট-দশ পাওয়ারের সোনালি সেল-ফ্রেমের চশমার মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে চোখের কোণ মুছল সে। ঠিক পরমুহূর্তে, মুখে এনে জীবনের উদ্ভাস, বলল, যাবতীয় ফোন-নম্বর আর ঠিকানা লেখা রঞ্জনদার ডায়েরিটা। ওটাও গাড়িতে ছিল। সত্যি, কী করে যে ওটা বাঁচল। পুরো একটা দিন আমরা হাত গুটিয়ে বসে। কিছু করতে পারছি না। একটা ঠিকানা নেই, কিছু নেই। পুলিস ভাগ্যিস দিয়ে গেল। নইলে তো কাউকে কনট্যাক্টই করতে পারতাম না। ছন্দা গর্বের সঙ্গে বলে যায়, দেখবেন, কত লোক আসবে ফিউনারালে। কত ভালবাসত সবাই রঞ্জনদাকে। অ্যাজ আ সার্জন, হি ওয়াজ অ্যাট দা টপ। বলতে বলতে চশমা খুলে সে রুমাল বের করে।

৫ থেকে ১০ মিনিট অন্তর মোর্নাররা আসতে থাকে। হাতে রাংতা দিয়ে মোড়া কাগজের থালায় খাবার, বা, ঝুড়িতে ফল। ফুলের দোকান থেকে খেপে খেপে ফ্লাওয়ার-স্ট্যান্ড বা ফ্লাওয়ারবাস্কেট আসছে। সঙ্গে কার্ড। একজন স্নিগ্ধ, আত্মকর্মক্ষম, দুচার ডায়ালগের অভিনেতাকে বদলিহিসেবে সহসা ট্র্যাজেডির হিরো-চরিত্রে নামালে সে যতটা পারে, ততটা আপ্রাণভাবে করমর্দন করতে করতে আমি সমানে আই অ্যাপ্রিসিয়েট বলে যাচ্ছি। গ্রেগ লুইস নামে এক কালো দৈত্য এসে, কী যেন করে, সমানে ডাঃ চ্যাটার্জির প্রশংসা করে যাচ্ছে, তারপর সে যখন ইট উইল টেক আ লঙ লঙ তাইম তু…তু…ফরগেত আ পার্সন লাইক হিম বলছে, দেখি তার সাদা চোখে জল আমি অভিভূত হয়ে তার দুহাত জড়িয়ে আই অ্যাম গ্রেটফুল টু ইউ যেই না বলেছি, মনে হল, দারুণ রেগেই যেন সে চিৎকার করে উঠল, নো নিড! আমি তার হাত চমকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুপা পিছিয়ে আসি। তা নয়, ছন্দা আমাকে পরে বোঝাল, আসলে ও বলতে চেয়েছে, ইংরেজরা যেমন বলে, নিড নট মেনশন। তবে, ওর গলাটা ওইরকম রাগী। মেঘের হুঙ্কারের মতন। আমি ভেবেছিলাম, ও বলছে, তোমার কৃতজ্ঞতার আমি পুটকি মারি। ছন্দা বলল, শুধু ডায়ালেক্ট নয়,

এদের ভাষা একদম আলাদা।

সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় শোক প্রকাশ করে গেলেন পাশের বাড়ির মিসেস স্টেইনসন। ভদ্রমহিলা রোগা, একা বিধবা, ৫০, ছেলে থাকে লাস ভেগাসে। ছাই রঙের গোড়ালি পর্যন্ত স্কার্ট পরে শুধু তিনি হেঁটে এসেছিলেন। দুঃখ জানাতে এসে, শুধু তাঁরই দেখলাম, ওই নামের শব্দটির আদৌ দরকার হয় না। মাই পার্স ইজ ইওর্স তিনি মাথা নিচু করে শুধু এইমাত্র আমাকে জানালেন।

দুটোর সময় নন্দিন ফিরে এল। ততক্ষণে ডাইনিং রুম ফল আর খাবারে বোঝাই। লিভিং রুমে রঞ্জন, সুমিতা আর জীয়নের ছবি রেখেছে ছন্দা। সমস্ত ফুল সেখানে রাখা হচ্ছে।

যাওয়ার সময় ঝি মারিয়া অনেকক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। কী ব্যাপার। অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করছি, এমন সময় সে বলল, আমার চোখ থেকে চোখ না সরিয়ে, স্ট্রেঞ্জ! ব্যাপার কী!

ইউ লুক একজ্যাক্তলি লাইক ইওর নেফিউ। ওনলি দিফারেন্স, হি ইজ মাচ মোর স্ত্রং। সে বলে গেল।

অর্থাৎ, অঞ্জন। আমি তা জানি। ছোটটাকে দেখতে হয়েছিল ওর বাপের মতো।

সকালে সেই যে বেরিয়েছে অঞ্জন, আর দেখা নেই। একটা ফোনও করেনি। ওর সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

৩০ এপ্রিল।

৩টের সময় জেফ কোনিগ ফোন করল। ৩টে বলতে দুপুর নয়, কারণ, এরা বলেছে সন্ধ্যা হবে রাত ৮টায়।

জেফ রঞ্জনের অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বিস্তর শোকপ্রকাশ করে সে জানতে চাইল, আমরা খরচাপত্র চালাচ্ছি কী করে। আমি বললাম, আমাদের সঙ্গে হাজারখানেক ডলার আছে। আর বাড়িতে তো প্রচুর খাবার-দাবার। জেফ বলল, ফিউনারালের বিষয়ে আমি কী ভেবেছি। শুধু ফিউনারালেই ১০ হাজার ডলারের মতো খরচ হতে পারে। একটু ইতস্তত করে সে বলল, আমি যদি তাকে টেম্পােরারি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ করি, তাহলে ডাঃ চ্যাটার্জির এস্টেট থেকে সে আপাতত সব বিল মেটাতে পারবে। এটা অবশ্য একটা খুবই টেম্পােরারি অ্যারেঞ্জমেন্ট, ও বলল, আগামী তিন বছরের জন্য এস্টেটের অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং ছেলের গার্জেন কোর্ট থেকে যতদিন না হচ্ছে শুধু সেই কদিনের জন্য। দিস ইজ নো বাইন্ডিং, ও বলল। ওকে, এ বিষয়ে একটু পরে জানাচ্ছি বলে ফোন রেখে, আমি ছন্দা আর অমিয়র পরামর্শ চাইলাম। এখন আমার মুশকিল একটাই, কে বিশ্বাসযোগ্য, বা কারা? আসার আগে জানতাম, আমার কাজ একটাই এবং তা হল—এখানে এসে-পড়া। তারপর চিৎপাত ভেসে-থাকা, শোক-সাগরে। ভেসে-যাওয়া। কিন্তু, ওই চিত্রকল্পের সূত্র ধরে বলা যায়, তীরে এত ঢেউ, ঢেউয়ের পরমুহূর্তে ঢেউ যে, কাল থেকে আমি হাঁটু জলেও নামতে পারিনি।

ওরা রাজি হল। মনে হল, বেশ খুশি, ওদের কাছে আমার এই প্রথম আত্মসমর্পণে।

ওদের দুজনের মধ্যে কথা বলে ছন্দা, অমিয় স্ত্রীর ইঙ্গিত না-পাওয়া পর্যন্ত চুপ করে থাকে।

ছন্দা অমিয়কে বলল, তাহলে ফিউনারাল পরশুই হয়ে যাক। তুমি জেফকে ডাক।

অমিয় জেফকে ফোনে ধরলে আমি বললাম, তাহলে কাগজপত্র আনো, আমি সই করে দিচ্ছি।

জেফ যা বলল, তা শুনে এ-দেশে এসে এই প্রথম আমি অবাক হলাম। বা, আমেরিকা জিনিসটা কী, তার প্রথম স্বাদ পেলাম, এভাবেও বলা যায়। জেফ বলল, আজ রবিবার। কাল সকাল থেকেই আমি যেন সমস্ত বিল তার অফিসে পাঠাই। সে কাল সকালে কোর্ট বসলেই, জাজকে একটা স্টেটমেন্ট দেবে যে ডাঃ চ্যাটার্জির নিয়ারেস্ট রিলেশান তার দাদা তাকে টেম্পােরারি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর নিয়োগ করেছেন।

আমার মুখের কথাতেই হবে?

সেটাই যথেষ্ট। এখানে কেউ মিথ্যে কথা বলে না।

শুনে ছন্দা বলল, তা ঠিক। কিন্তু এখানে কেউ কারুকে বিশ্বাসও করে না।

কাদের দেশে এসেছি, জানবার ইচ্ছে হওয়া স্বাভাবিক। আমি বললাম, আর-একটু বলুন।

 

না, আমি খারাপভাবে কথাটা বললাম না। তবে, খুব একটা ভালও নয় হয়ত ব্যাপারটা। ছন্দা হাই তুলে বলল, আসলে, এদের কারুকে বিশ্বাস করার দরকারই হয় না। কারণ এদের আত্মবিশ্বাস আছে।

জেফ বলছিল, এখানে কেউ মিথ্যে কথা বলে না।

বলবে কোত্থেকে, মিথ্যে কথা তো বলে মানুষ। কারণ, মিথ্যে বলতে বুদ্ধি লাগে। এখন, একটা বাঘ এসে যদি বলে আমি মিথ্যে বলি না, আমি বলি, হালুম, আপনি কি খুব ইমপ্রেসড় হবেন? সেটাকে তার সততা বলবেন? অনেস্টলি, দে হ্যাভ হার্ডলি এনি চয়েজ ইন দা ম্যাটার। সে হঠাৎ উঠে পড়ে বলল, চলুন বাড়িটা দেখবেন। আগে বাইরেটা দেখি চলুন। তারপর ভেতরটা দেখবেন। তুমি থাক।

ফিউনারাল কবে হবে?

পরশু। ও হ্যাঁ, তুমি জেফকে বল, সে অমিয়র দিকে ঘাড় বাঁকায়, সমস্ত অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে।

বেশ একটা রানী রানী ভাব ছন্দার আত্মপ্রত্যয়ে। চোখ ছাইরঙা। চুলের রঙ বাদামি। হংসিনী গ্রীবা।

সামনে দিয়ে বেরুলে দীর্ঘ ড্রাইভওয়ের দুপাশে সবুজ ছাঁটা ঘাসের লন। অনেকগুলো অজানা গাছ। এটা মেহগিনি যেতে যেতে ছন্দা একটার গায়ে হাত রাখে। আমরা বাড়ির পিছনের বিশাল কোর্ট ইয়ার্ডের দিকে গেলাম। যেতে যেতে দেখলাম পথের ধারে তিনটে নুড়ির মতো অনুল্লেখযোগ্যভাবে তিনখানা গাড়ি পড়ে আছে। এটা ক্যাডিলাক, ওটা মার্সেডিজ, এটা কামপারা, যেতে যেতে ছন্দা হাত রাখে গাড়িগুলোর গায়ে। লিঙ্কন কন্টিনেন্টালটা তো গেছে। বিশাল গাড়ি ছিল, নীল রঙের। সুমি ওটাই বেশি চালাত। দামি বলে, শুধু টার্বো পোর্সাটা আছে গ্যারেজে।

আহা, রঞ্জনদা বারদুয়েকও চাপেনি।

এখন ৭টা। খাঁটি বিকেলবেলা। হাওয়ার জোর বাড়ছে। বসন্তের আবহাওয়া। যেতে যেতে ঙ্কিলারগুলো নিজের থেকে খুলে গিয়ে, মাঠময় বৃত্তাকারে জল ছড়াতে লেগেছে।

আমরা মাঠের ধারে সাদা রঙ করা কাঠের বেড়া পর্যন্ত গেলাম। ছন্দা বলল, ওই যে বনটা দেখছেন ওটাও চ্যাটার্জির্দার। অ্যামন্ড আর ওয়ালনাটের পর পর দুটো অৰ্চাৰ্ড। মাইল তিনেক লম্বা হবে।

আমরা সুইমিং পুলে গেলাম। ৭২ ফিট লম্বা। মার্সেদে এত বড় সুইমিং পুল আর কারও নেই। একে বলে জাকুসি। মাঝখানের দেওয়াল দিয়ে ভাগ করা ছোট অংশটায় গরম জল। ধোঁয়া ওড়ে। হট স্প্রিং আর কী। বাকিটা কনকনে ঠাণ্ডা। পরপর দুটোয় স্নান করে উঠলে ক্লান্তি বলে কিছু আর থাকে না। মার্সেদে জাকুসি আর কারও নেই। গার্ডেনারের নাম আমোস। সে পুলের জুল তুলে ফেলেছে। আমি দেখলাম পুলের ধারে কাঁটা চামচ আর একটা শুকনো কোয়ার্টার প্লেট পড়ে আছে। একটা প্রকাণ্ড সোনা ব্যাঙ পাশেই সোফায় বসে আছে এখনও না লাফ দিয়ে।

অঞ্জন ফিরেছে। ছন্দা বাড়ির পিছন দিকে একটা প্রকাণ্ড আলো-জ্বলা ঘর দেখিয়ে বলল, ওই ঘরটা ছিল সুমি আর রঞ্জনদার। এখন অঞ্জন থাকে।

ঘরের ভেতর থেকে বাজনার শব্দ। জ্যাজ। সো জেঠ। ইউ আর হিয়ার…কাল সন্ধেবেলা সেই একটাই কথা হয়েছিল অঞ্জনের সঙ্গে। তারপর ও বেরিয়ে গেল বন্ধুদের সঙ্গে। আজ সকাল থেকে দেখা পাইনি। কী করছে ছেলেটা। কোথায় যাচ্ছে। আজ ওর সঙ্গে কথা বলব। ওকে আটকাব। রঞ্জন নেই। সুমি নেই। আমি আছি। আমি ওর গার্জেন। ওর দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে।

সূর্য নেভাদা পর্বতমালার পিছনে অস্ত গেছে। আমার অজান্তে কখন যে সব অন্ধকার হয়ে গেল! মাঠের ধারে ধারে, কোর্ট-ইয়ার্ড, ড্রাইভওয়ে, সামনেরলন সর্বত্র বাতিস্তম্ভগুলি জ্বলে উঠেছে। ফেরার পথে দেখলাম জীয়নের একটা খেলনা মোটরগাড়ি মার্সেডিজের বনেটের ওপর। দূরে, আল কাপিতান।

অন্ধকারেও দেখা যায়। ছন্দা বলল, সাদা তো।

 ০৮. হিরোসিমা, মাই লাভ

১ মে।

কাল ফিউনারাল। জেফ সত্যিই কামাল করেছে। কলকাতায় ওদের কোনও আমেরিকান সমস্যার কথা উঠলে রঞ্জন সুমিতাকে বলত, ও নিয়ে ভেবো না। জেফ জানে। ও ঠিক ম্যানেজ করবে। সুমিতা বিশ্বাসও করত। তা, সে খুব ভুল করত না।

আজ গোটা বে-এরিয়ার এবং এখানকার সমস্ত কাগজে ফিউনারালের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়ে গেছে। সকলকে যোগ দিতে অনুরোধ করা হয়েছে অঞ্জনের নামে। জেফ আমার নাম দিতে চেয়েছিল। আমি বারণ করি। ফিউনারালের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে আইভার্স অ্যান্ড অ্যালকর্ন ফিউনারাল হোম। আজ ১টার সময় ফিউনারাল সার্ভিস হবে মে-ফেয়ার গ্রাউন্ডের কাউন্টি হলে। সেখানে তিনটি ক্যাসকেটের মধ্যে থাকবে তিনটি কফিন। ডাঃ চ্যাটার্জি ও মিসেস চ্যাটার্জির জন্য জেফ ৭৫০ ডলার দামি দুটি ক্যাসকেট কিনতে বলেছে, যা ওদের মর্যাদার উপযুক্ত। জীয়নের জন্য ৩২৫ ডলারের ক্যাসকেট। সাক্ৰামেন্টো থেকে রামকৃষ্ণ মিশনের অনাথানন্দ স্তোত্রপাঠ করতে আসছেন। খ্রিস্টীয় মতেও কিছুটা হবে। পাদ্রী আসবেন। স্কুলের মেয়েরা শোকগীতি গাইবে।

অতিথিদের রাত্রিবাসের জন্য একটা মোটেল পুরোটা ভাড়া করা হয়েছে। ২০টা ঘর। “কাছেদূরে বেকার্সফিল্ড, ওকল্যান্ড, ফ্রেজনো, হেওয়ার্ড, বার্কেলে, হ্যামেট, সানহোজে, সানফ্রান্সিসকো, ডেভিস, মারিপোজে, মডেরা—সর্বত্র থেকে ওদের বন্ধু ও গুণগ্রাহীরা কাল থেকেই আসতে শুরু করেছে। ডেভিস থেকে আসছেন ডাঃ গ্রেওয়াল এবং তাঁর স্ত্রী সুজানা। উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সিয়াটল থেকে রঞ্জনের বেলুড়ের বন্ধু চুনী ফোন করেছিল। সেই হরি সিং ট্রাভেল এজেন্ট যেচারমূর্তিকে থার্ড ক্লাসে তুলে ১৯৬১-তে বিলেত পাঠায়, তাদের একজন। বিলেতে ১০ বছর একসঙ্গে ছিল, শীতে দুজনে একটা কালো ওভারকোট ভাগাভাগি করে পরেছে, চুনী বলল, সে আসছে। ইস্ট কোস্ট থেকেও একটি দম্পতি আসছে। দেবেন ব্যানার্জি ও তাঁর স্ত্রী অমিয়া। এরা আটলান্টা থেকে প্লেন ধরেছে বলে ওদের মেয়ে একটু আগে আমাকে জানিয়েছে। গত দুদিনে ইন্টারস্টেট ফোন বেজেছে বার কুড়ি। সবাই ফিউনারালে আসতে পারা বা না-পারার কথা জানাচ্ছে। খাবারে আর ফুলে দুটি ঘর ভরে গেছে।

 

ফ্রিমন্ট থেকে এসেছে ধূর্জটি পালিত। বিকেল ৪টের সময় ৭০ মাইল দূরে মডেস্টো শহরের ক্রিমেশান হোমে ইলেকট্রিক চুল্লিতে শবদাহ। রাতে এ বাড়ির আউট-ইয়ার্ডে শ্মশানবন্ধুদের একটি বুফে-টাইপ ডিনারে নিমন্ত্রণ। এত কিছু ব্যবস্থা সে, জেফ, একা করেছে। এ ছাড়া কামপারাটা আমি যাতে ব্যবহার করতে পারি, সে জন্যে সুবিবেচক সে একজন ড্রাইভার নিয়োগ করেছে। মুভমেন্ট ব্যাপারে কারও ওপর নির্ভর করা আমার পক্ষে উচিত হবে না, ছন্দারা ফিউনারালের পরদিন চলে যাচ্ছে। তাছাড়া, অ্যাজ ইট গোজ হিয়ার, ইউ নো, ইফ ইউ ডু নট পজেস ইওর ওন কার, ইউ আর নট নেসেসারিলি অ্যান আন-আমেরিকান জেফ রসিকতা করে বলল, বাট ইউ সার্টেনলি আর অ্যান আন-ক্যালিফোর্নিয়ান।

এহ বাহ্য, অঞ্জনকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মল-এর বিখ্যাত দোকান পারভিন্স থেকে একদিনের মধ্যে কালকের দিনের জন্য একটা কালো স্যুট করিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু অঞ্জন আমাকে ধরাছোঁয়া দিচ্ছে না। পাত্তা দিচ্ছে না একদম। অলমোস্টইগনোর করছে। ডাকলে সাড়া দিচ্ছে, নইলে কথা বলছে না। ও আমাকে বরাবরই পছন্দ করে না। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখনও সেই পোর্ট অফিসেই চাকরি করছ? ঠেসটা হল, অর্থাৎ কিনা, সেই গরিবই আছ? এত দূর স্পর্ধা! আমি ওকে অনেক চিঠি দিয়েছি, উত্তর দেয়নি। কলকাতায় এলে অনেক ভালবাসার চেষ্টা করেছি, উপহার দিয়েছি, কিন্তু সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেনি। বাবার গরিব আত্মীয়দের ও পছন্দ করে না। এবং অপছন্দ বা ঘৃণা করার চেয়ে যা বেশি, ওর মনে তাদের সম্পর্কে কোনও কৌতূহল নেই। জিজ্ঞাসা নেই।

ও নন্দিনের সঙ্গেও আগাগোড়া খুবই খারাপ ব্যবহার করেছে। নন্দিন আমাকে লিখত। তুমি কেন এসেছো? এই ছিল ওর মুখের বুলি।

আমি জানি, এর জন্যে দায়ী রঞ্জন। সে দেশ ও আত্মীয়দের তথা দেশজ কোনও কিছুকেই ছেলেদের শ্রদ্ধা করতে শেখায়নি। আমরা যা গরিব ছিলাম না! বাক্যটিকে ভূরিভোজনের পর ভাজামৌরি হিসেবে ব্যবহার করতে করতে, শুধু দারিদ্র্য নয়, ও ছেলেদের ওর দেশের দরিদ্রদের ঘৃণা করতে শিখিয়ে গেছে। নিজের হঠকারিতাকে জাস্টিফাই করার জন্যে ওকে এটা করতে হয়েছে, আমি ভাল করেই জানি যে, যারা দেশে আছে তারা ভাল নেই। সুখে নেই। কারণ, তারা গরিব। আমরা সুখে আছি। আমরা ভাল আছি। কারণ, আমরা বিদেশে থাকতে বাধ্য হলেও, বড়লোক। দেশের গরিবের চেয়ে বিদেশের বড়লোক ভাল।

কাল সন্ধেবেলা সুইমিং পুল থেকে ফিরে দেখলাম ও সুমিতা-রঞ্জনের বেডরুমে দরজা বন্ধ করে মিউজিক সিস্টেম চালিয়ে জ্যাজ শুনছে। ওর ফোন এলে ঘরে কানেকশান দিতে বলছে। ছন্দা বলল এখন ডাকলে খেপে যাবে। আমি তবু ডাকতে যাচ্ছিলাম, লেদু বলল, না-, নকাকা, এখন ডেকো না। আমি ওর হাত ছাড়িয়ে উঠতে যাচ্ছি, ছন্দা বলল, ওর সঙ্গে বন্ধু ন্যান্সি রয়েছে। ও ঘরের কাঠের মেঝে থেকে পদাঘাতের দপদপ শব্দ ভেসে আসে। ওরা ব্রেক-ড্যান্স করছে।

কাল রাতে তো ও আমাকে সবার সামনে অপমানই করল। রাত ২টো পর্যন্ত টিভি দেখল। আমরা বসে ফিউনারালের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বলছি। ও একটা কথাও বলছে না। যেন, এটা আর কারও বাবার ফিউনারাল। ওঠার সময় পা দিয়ে টিভি সুইচটা অফ করল।

দিস ইজ নট ডান অঞ্জন। এই প্রথম আমি ওকে বাধা দিই।

হোয়াট ইজ নট ডান আঙ্কল?ও যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং ঘাড় পুরোটা ঘোরায় না। লক্ষ্য করি জেঠ বলে না, এবং আঙ্কল শব্দটি স্বাধীন সিলেবলে কেটে যে-ভাবে তাতে বিদ্রুপের নুন ছড়াল, আমি তার জ্বালা অনুভব করি।

পা দিয়ে সুইচ কেউ নেবায় না।

মাই ড্যাড উড নট হ্যাভ ডেয়ার্ড টু টেল মি দ্যাট। বলে ও ঘরে চলে গেল।

অঞ্জন! ইউ শুট নট স্পিক দ্যাট ওয়ে টু ইওর এল্ডার্স ওকে শুনিয়ে বলল বটে ছন্দা, কিন্তু অমিয় মনে হল খুশিই হয়েছে। আমাদের মধ্যে একটা খটাখটি লাগুক, ও মনে হয় এটাই চায়। রাতে লেদু শুচ্ছে অঞ্জনের আগেকার ঘরে। একদম পাশেই। কাল নন্দিনের ঘরে দরজা বন্ধ করে ফিসফাস করে লেদু জানাল, ও সারারাত জেগে থাকেনকাকা। লেট নাইট থ্রি-এক্স ফিল্ম দ্যাখে ওর টিভিতে। টেলিফোন করে সারারাত।

তুমি ওর সঙ্গে ওভাবে কথা বোলো না। লেদু ভীতভাবে বলল।

থাম তুই। আমি চিৎকার করে বললাম, তুই ম্যাদা মারতে এসেছিস, মেরে যা। আমেরিকা বেড়াতে এসেছিস, বেড়িয়ে যা। আমাকে আমার কর্তব্য করতে হবে। আমি ওর জ্যাঠামশাই। ওর বাবা আমার ছোট ভাই। আমি ওর বাপের দাদা।

আধঘণ্টা পরে ন্যান্সি আর অঞ্জন বেরল। মেয়েটা অঞ্জনের চেয়ে ঢ্যাঙা, বয়েসে বড় তো বটেই।

গ্যারেজ খোলার শব্দ।

ওরা পোসাটা নিয়ে বেরচ্ছে। ঘণ্টায় ১৫০ মাইল স্পিড। মেয়েটা গাড়ি চালায়। অঞ্জন ছমাস পরে লাইসেন্স পাবে। তখন ১৬ হবে। মেজর হবে আঠারোয়।

রাতে ঝুপঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হল। আমি নন্দিনকে বললাম, একটা ক্যাসেট চালাতে। নিজের ছোট্ট রেকর্ডারে নন্দিন অজয় চক্রবর্তীর একটা ক্যাসেট খুব লো ভলিউমে চালিয়ে দিল। দিয়ে শুয়ে পড়ল। ওঃ হো, কী না ভেবে যে…

অজয় চক্রবর্তীর রাগাশ্রয়ী গান।

ক্যাসেটটা আমিই গতবার সুমিতার হ্যান্ডব্যাগেপুরে দিই। মূলত জ্ঞান ঘোষের গান। গৌড়সারঙ্গ। ভালই গেয়েছেন অজয় চক্রবর্তী। কিন্তু জ্ঞানবাবুর কণ্ঠের সেই গ্রেন ও বন্দিশ, সেটা বরং কিছুটা ছিল সুমিতার অবিস্মরণীয় হাস্কি গলায়, যখন, যেদিন, চিনুর সঙ্গে মানকুণ্ডুতে তার কোনও এক বন্ধুর বাড়ি থেকে ঘুরে এসে, ঘরে ঢুকে নতুন পোর্টেবল স্কেল-চেঞ্জিং হার্মোনিয়মটির মুখোমুখি হয়ে সহসা, বিপুল বেপরোয়া আগ্রহে সেভাবে যন্ত্রটির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল সে যেভাবে অগ্রসর হয়েছিল কদিন আগেই দীঘায় সমুদ্র-ঢেউ কেটে কেটে অকুতোভয়ে, যদিও সেক্ষেত্রে আমার হাত ছিল তার হাত ধরে চেপে— আর এবার, এখন, হায়, হার্মোনিয়মের দিকে প্রহরী-হারা সে কত একা! বেলো-টেলো ঝপাঝপ খুলে, স্টপার টেনে ও বন্ধ করে, আবার খুলে, আপার-লোয়ার চেম্বার সর্বত্র সরগমে ভরিয়ে–সহসা সে গেয়ে উঠেছিল:

এই কাননে, ছড়িয়ে গেলাম,
মোর জীবনের করুণ কাহিনী…

বাইরে বৃষ্টি বাড়ছে। আহা, অজয় চক্রবর্তীও বড্ডই ভাল গেয়েছেন। কিন্তু কোথায় সেই বন্দিশ, সেই গ্রেন, সেই জ্ঞানবাবু-ভাবাবেগে-ভরা হাস্কি নারীকণ্ঠ।

আমি শুনতে লাগলাম:

হায়, মালতী বিতান-তলে
দ্যাখো পড়ে আছে ঝরে
মোর বেদনার নীরব রাগিণী।

বাইরে মাঠে সারারাত আলো জ্বলে। বৃষ্টি-কাঠির আলোর ঝাঁটা, ঝাঁট দিয়ে যাচ্ছে সারা মাঠ। মেপল, রেড উড, চায়না বেরি—এক পাইন ছাড়া আউট-ইয়ার্ডের সব কটি গাছই আমার অচেনা— সোঁ সোঁ হাওয়া, সব কটা স্টপার ও বেলো খুলে, তাদের আপার ও লোয়ার চেম্বারে ধরে, শাশ্বত রাত্রির বুকে তারা বাজিয়ে চলেছে অন্য এক অপার্থিব, অমানবিক সুর! এখন তারা গাইছে: গোলাপ জানে, বকুল জানে মঞ্জরী আর মুকুল জানে মোর গগনে কোন ফাগুনে হেসেছিল কোন সে চাঁদিনী…

মার্সেদে এসে এই প্রথম আমি, নিঃশব্দে, কাঁদতে লাগলাম।

প্লেন থেকে বোম পড়ছে হিরোসিমায়। লিটল বয়। এপিসেন্টার থেকে উঠে তেজস্ক্রিয় মেঘের ছাতা ঢেকে ফেলছে আকাশ। আকাশ থেকে কালোয়-কালো হিমশীতল ভস্মবৃষ্টি ধীরে নেমে আসছে।

শত শত সৌরতাপময় অগ্নিবলয় থেকে ছেলে-কোলে ছুটে বেরিয়ে আসছে সুমিতা। জীয়নের চোখ পিটপিট করছে। সুমিতার বাঁ চোখ কোটর থেকে গড়িয়ে পড়ে চিবুকের কাছে ঝুলে আছে। মাড়ি থেকে রক্ত পড়ছে গলগল করে।

প্রথমে কয়েকজন নৃত্যরত হিজড়ে—তারপর রঞ্জন বেরিয়ে এল ওই অগ্নিপরিধির ভিতর থেকে। রঞ্জনের হাতে রক্তাক্ত গ্লাভস, হাতে উদ্যত সিরিঞ্জ, সুমি, তোমার কিছু হয়নি তো, জীয়ন বেঁচে আছে তো, সে জানতে চাইছে, অথচ, আমি দেখছি, তার মাথার খুলির ওপরের অংশটাই নেই–ফুটন্ত লাভা রঙের সেরিব্রাম ফুলে-ফেঁপে গজগজ করছে। আর, হায়, সে তা এখনও জানে না।

সুমিতা কিছু বলার জন্যে মুখ ফেরালে দেখি একটা ঝটপটে জ্যান্ত শিঙি মাছ, সে দাঁতে কামড়ে আছে।

তার মাড়ি থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে।

ঠিক এই সময় রঞ্জন আমাকে দেখতে পায়। দেখে, তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন? সাপের দুখণ্ড চেরা জিভে চিৎকার করে ওঠে সে। তার মাথার খুলি উড়ে গেছে, চোখের মণি বনবন করে ঘুরছে, আমাকে মূলসুষ্ঠু উপড়ে তুলে ফেলবে, এমন অবধারিতভাবে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলে যেতে থাকে,

তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন…

তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন…

তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন…

প্রবল কাঁপুনির মধ্যে ভয়াবহ ভয়ে শতসূর্য তাপের মধ্যে জেগে উঠে আমি, পরমুহূর্তেই, ঠিক তার উল্টো, শীতলতমতার মধ্যে জমে যাই।

বাইরে এখনও বৃষ্টি। কনকনে ঠাণ্ডা। করিডরে তাই সেন্ট্রাল এয়ার কন্ডিশনিং-এর রেগুলেটার কেউ কমাতে গিয়ে ভুল করে চরমে ঠেলে দিয়েছে। নিশ্চিত ছোঁড়াটার কাণ্ড।

হু-হু হিমঠাণ্ডা হাওয়া আসছে, আমার বিছানার পাশেই, মেঝের আউটলেট থেকে।

কার্পেট টেনে আমি ঝাঁঝরির মুখটা বন্ধ করে দিই।

 ০৯. ডাউন উইথ আমেরিকা! ডাউন! ডাউন!

১১ মে শনিবার শ্রাদ্ধ হবে। নিয়মমাফিক ৯ তারিখ। কলকাতা থেকে সেইরকমই বলেছিল। শনিবার ছুটির দিনে এগিয়ে দিতে হয়েছে।

শ্রাদ্ধ হবে এখান থেকে ৯০ মাইল দূরে লিভারমোরের ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে। ছন্দারা বাড়ি চলে গেছে। শ্রাদ্ধের যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছে অমিয় আর ছন্দা। ওরা কাছাকাছি থাকে। অবশ্য এখানে দূর বলে কিছু নেই। যে-কোনও কাজের ব্যাপারে ফোন তুললেই ও-দিক থেকে মিষ্টি স্মিত স্বর:মে আই হেল্প ইউ?

অঞ্জন যথাসম্ভব অশেীচ পালন করছে। মাংস খাচ্ছে না। চালচলনে ও চেহারায় ২৪/২৫ বছরের যুবকের মতো হলেও, আসলে তো ১৫ প্লাস, গোঁফ-দাড়ি যথাকালে ছাড়া গজাতে চায়নি। দাড়ি রাখার তাই প্রশ্ন ওঠেনি। পৈতে ছাড়া শ্রাদ্ধ হয় না বলে সে আমার থেকে এক দণ্ডি পৈতে নিয়েছে। এবং চাবি লাগিয়ে গলায় তা পরেও আছে। তবে জামা ও হাওয়াই চপ্পল পরছে।

ফিউনারাল সার্ভিসের দিন কাউন্ট হল শোকার্থীতে ভরে গিয়েছিল। গোটা মার্সে ফেয়ারগ্রাউন্ড গাড়িতে ভর্তি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এখানে গ্যারেজ নেই এবং বাড়ি প্রতি অন্তত দুটি করে গাড়ি সামনের লনে খালি দেশলাই বাক্সের মতো অবহেলায় পড়ে থাকে। তাছাড়া, আমি শুনেছি, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলে কিছু, এক টেলিফোনে-ট্যাক্সি ছাড়া, অন্তত ক্যালিফোর্নিয়ার স্মল টাউন গুলিতে থাকে না। অবশ্য, মার্সেদ ছাড়া কোনও শহর আমি এখনও দেখিনি।

কাউন্টি হলে মঞ্চের সামনে, মেঝের ওপর ট্রলিতে তিনটি ক্যাসকেট, দুদিকে রঞ্জন ও সুমিতা, মাঝখানে জীয়ন। জীয়নের ক্যাসকেটটি অপেক্ষাকৃত ছোট, তার ওপর ওর খেলনা এল এম জি যা থেকে একদিন সেকেন্ডে একশত জলবুলেট বেরুত ঝাঁকে ঝাঁকে। রঞ্জন ও সুমিতাকে চিহ্নিত করার জন্যে ওদের ক্যাসকেটের ওপর ছন্দা রঞ্জনের বাবুমশাই ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি এবং সুমিতার প্রিয়তম শাড়ি নীল জমির ওপর রুপালি বুটিদার বেনারসী বিছিয়ে দিয়েছে।

এর সবটাই ছন্দার কল্পনা। দেখে আমার বিশ্বাস হল, সত্যিই ওরা ছিল অনসূয়া-প্রিয়ংবদা। অথচ ফ্রিমন্ট থেকে ফোন করে পূজ বলল…

অন্যদিকে, ছন্দা আমাকে ধূজ সম্পর্কে যে কথা বলেছে, তাতে ধূর্জটিকে তো নরাধমই বলতে হয়। ২৭ এপ্রিল ভোরবেলা কাগজ দেখেই ছন্দা ধূর্জটিকে ফোন করেছিল: তোমরা তো একঘণ্টার ফ্লাইটে থাক। তোমরা কি যাচ্ছ? তার তখন হাত-পা কাঁপছে, ধূর্জটি ছিল না। বৌ বলল, ভাই, ওর কারখানায় এখন যে রেটে লে-অফ হচ্ছে… ও তো যেতেই পারবে না। তখন অমিয় ফোন করে বসকে বলল, যা ভাল বোঝেন করবেন। আমি যাচ্ছি। ছন্দা কাজ করে রিয়েল এস্টেট কেনাবেচার অফিসে। সে অফিসে খবর দেয় মার্সেদে পৌঁছে, তবে ওরা একবস্ত্রে গাড়ি নিয়ে বেরয়। বিকেলবেলা মার্সেদ পৌঁছে শুনল, ভোরের প্লেনে মার্সেদ পৌঁছে মিঃ অ্যান্ড মিসেস ধূজ সাড়ে তিনটের ফ্লাইটে ফিরে গেছে। অঞ্জন তখন রেড্ডি দের বাড়িতে দরজা-বন্ধ বন্দী। নন্দিন বাড়ির চাবি ওদের দিয়েছিল। সারা বাড়ি তছনছ করে, বিশেষ করে কম্পিউটার রুমে, ওরা কী খুঁজেছিল? কী পেয়েছে? কী নিয়ে গেছে? ওরা কে? কবার দেখা হয়েছে ওদের রঞ্জনদাদের সঙ্গে? কতদিনের আলাপ? এই সব প্রশ্ন ক্রুদ্ধা ফণিনীর মতো ছন্দা আমার সামনে রাখতে থাকে। এখানে সবচেয়ে কঠিন কাজ আমার একটাই। কাকে বিশ্বাস করব আর কাকে করব না। সমগ্র ফিউনারাল সার্ভিসটা ছিল মোট দশ মিনিটের অনুষ্ঠান। শেষে কালো স্যুট পরে ভারতীয় দর্শন কিন্তু আত্মায় আমেরিকান (বার্মিংহাম ট্রিবিউনের ইন্টারভিউতে অঞ্জন তাই বলেছিল—এত সাবালক! )—একপোঁচ কম সাদা, বয়স মাইনাস-১৬, মার্সেদ ড্রাগন ফুটবল ক্লাবের সফলতম স্কোরার যখন মঞ্চ থেকে মাত্র একটি বাক্যের ধন্যবাদ জানাল, তখন ভাগ্যিস দুফোঁটা জল এসে আমাকে বলে গেল তুমি চক্ষুষ্মন…নইলে তো নিজেকে অন্ধ ভাবতাম! আমি তৃপ্ত হলাম এই ভেবে যে, আমার উপদেশ মতো মাত্র একটি বাক্যই সে বলেছে, নয়ত, আমি তাকে বলেছিলাম, দুটি সেনটেন্স বলতে গেলে তুমি হয়ত কেঁদে ফেলবে এবং সেটা তোমার বাবার সম্মানের পক্ষে উপযুক্ত হবে না। লোকে তোমাকে দুর্বল ভাববে। হ্যাঁ, এই প্রথম অঞ্জন আমার একটা কথা শুনেছে বটে। তবে এখানেও দেখলাম সে তার স্বেচ্ছাচার ঈষভাবে প্রয়োগ করল। ও বলল, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন, প্লিজ অ্যাকসেপ্ট মোস্ট সিনসিয়ার থ্যাঙ্কস অন বিহাফ অফ মাইসেলফ অ্যান্ড মাই ফ্যামিলি। আমি বলেছিলাম ফ্যামিলির আগে চ্যাটার্জি শব্দটি রাখতে।

অনুষ্ঠান ১০ মিনিটের। কিন্তু রীতিমাফিক করমর্দন চলল প্রায় একঘণ্টা ধরে। শোকার্থীদের অধিকাংশই সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে এসে পাশাপাশি আমাদের দুজনের হাত পরপর ধরে প্রায় ফিসফিসিয়ে কিছু না-কিছু সন্তপ্ত মোনোসিলেবিল উচ্চারণ করে গেলেন। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম: শোক বলতে এরা বোঝে স্তব্ধতা। পিয়ানোর সুরে কিন্ডারগার্টেনের স্বর্গচ্যুতা পরীশিশুরা যে শোকগান গেয়ে চলেছে তাও যেন রাগিণী নীরবতায়।

লক্ষ্য করলাম শোকজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে অনেকেই যখন হাত-নাড়া দিয়ে অঞ্জনকে বললেন, হাউ একজ্যাক্টলি ইউ লুক লাইক ইওর আঙ্কল..অঞ্জন রীতিমত অস্বস্তি বোধ করছে। বস্তুত, তার জুতো ঘষার শব্দ আমি দুএকবার শুনতে পেলাম।

মডেস্টো ক্রিমেশান হোমে পাশাপাশি তিনটি বিদ্যুৎ-চিতার মধ্যে তিনখণ্ড বিশাল পাঊরুটি, সেঁকা হবে বলে, কত ব্যঞ্জনাবিহীনভাবে ঢুকে গেল।

বাবা-মা-ভাই পুড়িয়ে, গায়ে মেখে চিতার ছাই, অঞ্জন সে-রাতে মুভি দেখতে গেল।

নইলে নাকি, বন্ধুরা ওকে উইক ভাববে!

হতভাগা!

আর, এই যদি হয় আমেরিকার নব-প্রজন্মের সবল ছেলেরা, তবে তারা গোল্লায় যাক।

 ১০. প্রসঙ্গ কমলালেবু

৫ মে।

সকালে উঠে দেখলাম এক বাক্স কমলালেবু থেকে একসঙ্গে ৪টি বা ৫টি লেবু নিয়ে অঞ্জন মাঠে লোফালুফি খেলা খেলছে। মাটিতে পড়ে একটু ঘেঁতো হয়ে যাচ্ছে যেগুলো, সেগুলো কখনও হাই-কিক, কখনও ব্যাক-ভলি করে দূরে ছুঁড়ে দিচ্ছে।

হেই, হোয়াট আর ডুয়িং? খেলা না থামিয়ে মুখ ঊর্ধ্বপানে রেখে সে ঠিক আমাকে নয়, উদাসীন চাপা গলায় ছোট্ট করে যেন নিজেকেই জবাব দিল, জাগলিং! আমাকে উত্তর দিলে তো আরও চেঁচিয়ে বলত।

উন্মাদ নয় তো ছেলেটা!

আমার মনে পড়ে গেল অনেকদিন আগের কথা। তখনওর চার বছর বয়স হবে। ওরা দিনদুই আগে এসেছে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে রেডিওটারনব ঘোরাতে যেতেই সেটা আলমারির পাল্লার মতো দুদিকে দুখণ্ডে খুলে গেল। খোঁজ! ছোট্ট ফ্ল্যাট আমাদের। এর মধ্যে কোথায় লুকোল ছেলেটা।

অঞ্জনকে পাওয়া গেল খাটের নিচে, এককোণে। লেজ গুটিয়ে যেন অপরাধী কুকুর ছানাটা!

আমি উবু হয়ে বসে জানতে চেয়েছিলাম, হেই, হোয়ায় ডিড ইউ ডু দ্যাট।

খাটের নিচের কোনায় আরও গুটিয়ে-সুটিয়ে বসে সে চিল্কার করেদুবার প্রত্যুত্তর দিয়েছিল।

বিকজ আই কুড ডু ইট!

বিকজ আই কুড ডু ইট!

তারপর বছরের পর বছর ধরে ঘটনাটা অফিসে, আড্ডায় যাকে পেয়েছি তাকে বলেছি।

প্রশ্ন: ভাঙলে কে?

উত্তর: কারণ, আমি বাংতে পারি।

ভাবা যায়!

চার বছরের আমেরিকা-বর্ন বাচ্চার মুখে এ-হেন ভ্যালু-জাজমেন্ট অফিসে, আড্ডায় যে যখন শুনেছে, সে-ই হা-হা, হো-হো, হিহি বা ঠোঁট মুচড়ে না হেসে পারেনি— যার যা। বিশেষত কবছর আগেই নকশালবাড়ি আন্দোলন হয়ে গেছে।

মাঠে পূর্ব-সীমানায় কাঠের সাদা বেড়ার ওপর কটি রঙিন চড়ুই বসে। বোধহয় লাভ বার্ড। এরা নাকি শবযাত্রার কফিনের ওপর বসতে ভালবাসে। এদের পছন্দ স্তব্ধতা। বা শোক। বেড়ার ওপারে ঈশ্বরের অ্যামন্ড ওয়ালনাট অরণ্য পেরিয়ে দূরে, বহুদূরে চতুর্ভুজ পিরামিডের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একখণ্ডের গ্রানাইট—– আল কাপিতান। এখন কাপিতানের মাথায় ঘন কালো মেঘ। নিশ্চয়ই খুব বৃষ্টি হচ্ছে ওখানে। এত সাদা, এমন ঝকঝকে তো কোনওদিন দেখিনি। সবুজ ছাঁটা ঘাসের মাঠ জুড়ে, ঘুরে ঘুরে এখন সাত-আটটা কমলা নিয়ে জাগলিং করছে অঞ্জন। খুলে-যাওয়া স্পিঙ্কলার থেকে সবেগে উঠে এসে তোড় জল-ফোয়ারা ওর আউট-সাইড, বিস্তৃত, উন্মুক্ত বক্ষপটে আছড়ে পড়ছে। সে কথা ওর মনে নেই।

ওর মুখ আকাশের দিকে।
খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে
বিরাট শিশু
আনমনে,
নিরজনে, প্রভু নিরজনে…

 ১১. বেজে ওঠে স্খলিত ঘুঙুর

৬ মে

ভয় পেতে পেতে এখানে এতটুকু হয়ে গেছি।

গার্ডেনার আমোস বড় ভাল মানুষ, বড় গরিব মানুষ। সংসারে তার কেউ নেই। রঞ্জন তার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে (মার্সেদে এমন কাণ্ড সেই প্রথম) এ অঞ্চলে বিখ্যাত হয়। সেই থেকে গত ১০ বছর ধরে আমোস এ-বাড়িতে থেকে গেছে। এতগুলো বছরেও দুর্বলতা তার সবটা যায়নি। তাকে অবজার্ভেশনে রাখার জন্যেই রঞ্জন তাকে বাড়ির কাজে লাগায়। লোকটা ২০ বছর বাঁচলে আমার একটা বিশ্বরেকর্ড হবে— সে আমাকে লিখেছিল।

আমোস এখন আমার ড্রাইভার। কাজে-কর্মে বেরুতে হলে কামপারাটা নিয়ে বেরোই। তবে বাইরে কাজ বেশি থাকে না। টেলিফোনই যথেষ্ট। এখানে টেলিফোনে রেকর্ডেড মেসেজ থাকে। মিঃ বা মিসেস অমুক সন্ধে ৭টার সময় বাড়ি ফিরবেন আশা করা যায়। ইতিমধ্যে তাঁকে এই এই নাম্বারে যোগাযোগ করা যেতে পারে।

ফিউনারালে যারা এসেছিল, সকলেই তাদের ওখানে দুএকদিন ঘুরে আসার আমন্ত্রণ জানাল। সানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি পেরিয়ে আমেরিকার স্বর্ণমত্তিকায় পা রাখা মাত্র, হাবেভাবে লেদু নিজেকে স্বর্গের সিটিজেন মনে করতে থাকে। হা, সে তার স্বর্গেই পৌঁছে গেছে— তবে এসেছে ধান ভানতে। ব্যানার্জি-দম্পতির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সে আটলান্টা চলে গেছে। সেখান থেকে ফোন করে কুশল জানিয়েছে। বলেছে, শ্রাদ্ধে আসতে খুব চেষ্টা করবে। তবে ব্যানার্জিদার বন্ধু নিউইয়র্ক থেকে তাকে নিমন্ত্রণ করেছে, ডাঃ রঞ্জন চ্যাটার্জির ভাইপোকে তারা নায়াগ্রা না দেখিয়ে কিছুতেই ছাড়বে না। আমি সঙ্কীর্ণমনা। আহা, বাচ্চা ছেলে, এসেছে যখন, দেশটা দেখে যাক এমনটা ভেবে কিছুতেই তাকে স্নেহধন্য করতে পারছিনা। এদিকে ছন্দারা চলে যাবার পর বাড়িতে আমাকে অধিকাংশ সময় একা থাকতে হয়। আমোস থাকে মাঠে বা সুইমিং পুলে।

সারা বাড়ি নীল ভেলভেট কার্পেটে মোড়া। মায় বাথরুমও। গতকাল দুপুরে কমোড থেকে উঠতে গিয়ে দুফোঁটা পেচ্ছাপ বাইরে পড়ে গেল। যদিও কমোডের চারদিকে আর এক প্রস্থ তোয়ালে পাতা আছে এমনতর দুর্ঘটনার কথা ভেবেই— তবু সেই মৃত্যুমুখর জনহীন বাড়ির টয়লেটে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল রঞ্জন টের পেয়েছে। আর সে যেন বলছে, ছিঃ, নদা! জানি, ব্যাপারটা পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক। তবু ভয় পাবার দায় তো মনেরই, শরীরের নয়। আমি টয়লেট থেকে দ্রুত ছুটন্ত, উলঙ্গ বেরিয়ে এলাম। মন বলল, সেদিন তো বাথটাবের পর্দা টানতে ভুলে গিয়েছিলে বলে কার্পেট-টার্পেট ভিজে একসা, কই, সেদিন তো এমনটা শোনোনি। হা মনে পড়ে অনেক কথাই। কামপারাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে মনে পড়ে শেষের দিকে ফোন করলে কীরে, নদা, কবে আসছিস?ভাবখানা, নন্দিনের সঙ্গে টিকিট পাঠালাম, এলি না। কিন্তু, বাপু হে, এখন তো কান এখানে, মাথা আর কতদিন দূরে থাকবে? কবে টিকিট পাঠাব বল, কখন আসতে পারবি, আর হ্যাঁ, শোন ড্রাইভিংটা শিখে আয়। তোকে কামপারাটা দিয়ে দেব। —মনে পড়ে।

কিন্তু, আজ দুপুরে যা ঘটল, তাকে যেন শুনলাম কিছুতেই বলতে পারি না।

শ্রদ্ধ-ব্যাপারে সাক্ৰামেন্টোর অনাথানন্দজির সঙ্গে কথা বলছি।

হঠাৎ কোথা থেকে সেই ইন্টারন্যাশনাল কলের পি-পি-পি-পি-পি, পৃথিবীর তিনভাগ জলের ওপর দিয়ে উড়ে আসা সোঁ-সোঁ হাওয়া।

নারীকণ্ঠ: কেমন আছেন?

আমি: তুমি কে?

অনাথানন্দ: আমি স্বামী অনাথানন্দ।

আমি: আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?

অনাথানন্দ: আমি খুব ভাল শুনতে পাচ্ছি। যদি তিল-কাঞ্চন শ্রাদ্ধ করেন, তাহলে—

নারীকণ্ঠ: আপনি ভাল আছেন আঁ? আর ইউ ও-কে?

আমি:আপনি কোনও মেয়ের গলা শুনতে পাচ্ছেন?

অনাথানন্দ : না তো।

আমি: তাহলে ক্রশ কানেকশান—

অনাথানন্দ: এখানে ক্রশ হয় না। হ্যাঁ, যদি তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ করেন—

নারীকণ্ঠ: হ্যাল্লো–হ্যাল্লো–হ্যাল্লো–

টেলিফোন হুকে টাঙিয়ে আমি ছুটে বেরিয়ে পড়লাম মাঠে। কেউ কোথাও নেই। সাইলেন্ট ফিল্মে যেমন, কী স্তব্ধ বৃষ্টিপাত হচ্ছে সারা মাঠ জুড়ে! মাঠের মধ্যে সাদা-ছোট বাদামি ঘোড়াটা ঢুকে পড়ল কী করে?

মুখ ঘাসে ডোবানো, মাঝে মাঝে ভিজে পরিতৃপ্ত ল্যাজ তুলে সে নিজের পেট, কোমর ও পিঠ আদর করছে। চিরস্তব্ধ, শব্দসুরহীন বৃষ্টির ঝাপ্টা এসে তাকে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে।

সব জল তুলে ফেলে আমোস সুইমিং পুলের মধ্যে দাঁড়িয়ে।

ডীড ইউ সি সামথিং? সে সোজাসুজি জানতে চাইল।

শান্ত ঘাড় নেড়ে আমি জানালাম, না।

ডীড ইউ হিয়ার সামথিং?

আমি কী স্বীকার করব, আমি এইমাত্র ফোনে অবিকল সুমিতার গলা শুনেছি, যদিও তা ছিল ঈষৎ মৃত? না। না! আমাকে উইক ভাববে। পাছে লোকে উইক ভাবে, সে-জন্যে ঐটুকু ছেলে কী না করছে। মা পুড়িয়ে, বাবা পুড়িয়ে, ভাই পুড়িয়ে ছাই-মাখা মুখে সে যাচ্ছে নাইট-শোতে পর্নো দেখতে।

হেসে বললাম, ও নো। নাথিং। অ্যাবসোলিউটলি নাথিং।

ওকে। বলে সে পুলের গা ধুতে শুরু করল। নিচে, নীলাভ জল-তলানির মধ্যে স্বচ্ছ দেখা যায়। একটা মস্ত ইন্টারভেনাস ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ জলতলে পড়ে আছে। আমাদের কালবোস টাইপের একটা নিশ্চল মাছ সেটা শুঁকছে।

রবারের নয় তো, মাছটা?

৬ মে।

নন্দিন রোজ কলেজ যাচ্ছে। অঞ্জন যায় না। ও, একবারও কাঁদেনি। জেফ ফোনে বলছিল, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। শ্রাদ্ধের পর দেখানো হবে ঠিক হয়েছে।

নন্দিনের কাছে জানতে চাইলাম, কীরে, তোর কী ইচ্ছে? সে খুব আগ্রহভরে বলল, আমি থাকব বাবা। পড়াশোনা শেষ করব। জেফ বলল, তাতে কোনও অসুবিধে নেই। ওর সোস্যাল সিকিউরিটি ইনসিওরেন্স করা আছে। সোস্যাল সিকিউরিটির কাজ হল, যদি কারও জীবনে ছন্দপতন হয়, সেই ছন্দে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া নন্দিনের নিউট্রিশনে মেজর হওয়া পর্যন্ত কাভার করা আছে। ও ততদিন কলেজ ক্যাম্পাসে থেকে পড়তে পারবে।

কলকাতা থেকে এসেছিলাম একটা নর্থ স্টার পরে। দেড় বছরে একবারও ব্রাশ করিনি। আমেরিকায় এসে কদিনেই জুতোটা ঝকঝকে হয়ে গেছে। এমন কি, সোলেও ময়লা নেই একটুও।

 ১২. দ্য গোল্ড রাশ

৭ মে।

এখানে সবই পার্সেন্টেজ। বা দালালি।

সারাদিনে চার-পাঁচটা টেলিফোন আসে শুধু উকিলদের কাছ থেকে। সকলে পরিচয় দিয়ে প্রথমেই বলে, নমস্কার। আপনার একটাও পয়সা লাগবে না। আমি লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল কোম্পানির বিরুদ্ধে ১০ মিলিয়ন ডলারের কেস করব। আমার কাছে খবর আছে, ওই ব্যাচের গাড়িগুলো ছিল ডিফেক্টিভ। এর গ্যাসোলিন ট্যাঙ্ক ছিল পিছন দিকে। টোকিওর এক অ্যাকসিডেন্টে ১০ মিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দেবার পর ওরা মডেল বদলায়। ট্যাঙ্ক সামনে আনে। কিন্তু আপনার ভাইকে কি ওরা সতর্ক করেছিল? ৫ মিলিয়ন আপনাদের। ৫ আমার। নমস্কার। আমি ক্যাম্ফ অ্যান্ড ক্লিভারের বিরুদ্ধে কেস করব। যারা জন পার্ল ফ্রি-ওয়ে ধরে গাড়ি ড্রাইভ করছে জেনেও তাকে অতটা মদ সার্ভ করেছিল। নমস্কার। আমি স্যাম পিয়ার্সনের বিরুদ্ধে কেস করব, যে ওর মতো হেবোকে তার গাড়ি দিয়েছিল। টু মিলিয়ন ডলার্স। ভেসে-ওঠা এইসব ইয়াঙ্কি ডুডলদের আমি জেফ-এর নাম্বার জানিয়ে দিই।

ডলার! ডলার! ডলার! টিভির সমস্ত অনুষ্ঠানে সুসজ্জিত লালমুখো বাঁদরের এই একটাই চিৎকার, আর ল্যাজ-আস্ফালন। এক কুৎসিত লোলচৰ্মা বুড়িকে নিয়ে বিখ্যাত ৩০ মিনিট-এ সারাক্ষণ দেখাল। কী? না, সে ১০ মিলিয়ন ডলার লটারিতে পেয়েছে! ১৬ নং চ্যানেলে একটি হিট প্রোগ্রামের নাম হল, হিয়ার কামস দা চাম্প! ফেক রেসলিং দেখায়। মনে হয় যেন সত্যি কুস্তি হচ্ছে, তা নয়। এরা রেফারির বাঁশি কেড়ে নেয়। পরস্পরকে শেষ পর্যন্ত চেয়ার, বেঞ্চি, খুঁটি যা পায় তাই তুলে মারে। ঘাড় মটকে ঘুরিয়ে দেয়। কটাং করে শব্দ হয়। বলা বাহুল্য, ঘাড়গুলো তখন রবারের,তবে বোঝা যায় না। কাল সন্ধেবেলা হল কী, একজন চারমণি রেসলার বাঁ-দিক থেকে ঢুকল। তার পরনে কাস্তে-হাতুড়ি-তারাসহ লাল পতাকা দিয়ে তৈরি ল্যাঙট। অর্থাৎ, সে রাশিয়া! ভাবলাম, ছিঃ, এরা এত ইতর। ওমা, পরমূহুর্তে ছিপছিপে আমেরিকান কুস্তিগীর স্টার্স অ্যান্ড স্টিপস্-সহ আমেরিকান পতাকার ল্যাঙট পরে মঞ্চে হাজির। বুঝলাম:আজকের বিষয় রাশিয়া ভার্সাস আমেরিকা। এই বর্বর ভাঁড়ামো কেন? উত্তর একটাহ: ফান! বস্তুত, পর্দায় সমবেত দর্শকরা হেসে হাঃ হাঃ। আজকের বিজেতা পুরস্কার পাবেন—-টিংটং–পর্দায় ভেসে ওঠে গাড়ি, উড়ন্ত এরোপ্লেন (ট্রিপ টু হনলুলু) ইত্যাদি ইত্যাদি। অ্যান্ড–এইট্টি থাউজান্ড ডালার!

জেফ আমাকে বলেছে, হ্যাঁ, তুমি গার্জেন হতেই পার। তোমার ক্লেমই সবার আগে বা, একমাত্র। তবে, তোমাকে আমেরিকান সিটিজেন হতে হবে। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে সিটিজেন ছাড়া কেউ মাইনরের গার্জেন হতে পারে না। হুইচ মিনস্ ইউ হ্যাভ টু ড্রপ ইওর ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ। আই উইশ ইউ ডু দ্যাট ফর ইওর নেফিউজ শেক। সে আরও জানাল, আমেরিকায় অবৈতনিকনয় কিছুই। গার্জেন এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দুই-ই তুমি হতে পার এবং এজন্যে প্রপার্টির আয়ের মোট ২৫% তুমি পাবে। এবং আমার ধারণা ডাঃ চ্যাটার্জির এস্টেটের দাম ১২ মিলিয়নের কম হবে না। অর্থাৎ, সেই ডলার! ১২ মিলিয়ন মানে কত। ১ কোটি ২০ লক্ষ ডলার! ! তাকে ১৪ দিয়ে গুণ করে ১২% সুদ কষলে কাকেশ্বর কুচকুচের সেই সাত-দুগুণে-কত-হয় তা জানা যেতে পারে। কিন্তু, সেটাও আমার কাছে হবে একটা সংখ্যা মাত্র। আমি বড় পরাধীনভাবে টাকাকানা। জন্মান্ধ। এর অন্যথা হওয়ার নয়। পরপর দুদিন দুপুরবেলা ১২ চ্যানেলে একটা প্রোগ্রাম। দেখলাম। দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে।

মারিপোজের এক ভদ্রমহিলার মেয়ে কাউন্টি স্কুলের স্কুল-লিভিং সার্টিফিকেট পেয়ে গেছে, এদিকে সে এক লাইন ইংরেজি লিখতে পারে না। দেশ-বিদেশ-ইতিহাস-ভূগোল কিছুই সে জানে না। সে শুধু জানে আমেরিকা। আমেরিকা পৃথিবীর সেরা দেশ। আর কেউ নেই।

কিছু নেই। জানিবার মতো আর কিছু নাই আমেরিকা ছাড়া! ভদ্রমহিলা ২০ মিলিয়ন ডলারের কেস করেছেন স্কুলের বিরুদ্ধে। তাঁর মেয়ের স্কুল-জীবনের ১২টা বছরের ১৩টা বাজাবার জন্যে।

পুরো কোর্ট-সিন দুদিন ধরে দেখাল। বিবাদিপক্ষের কৌঁসুলি আমেরিকার শিক্ষা-ব্যবস্থার যার নাম প্যান্টুল খুলে ছেড়ে দিলেন। তিনি দেখালেন, কীভাবে ইহুদিরা আমেরিকার মিডিয়াগুলো, টাকা, রাজনীতি এবং শিক্ষাকে কন্ট্রোল করছে। সমস্ত বড় কাগজ ওয়াশিংটন পোস্ট, টাইম, নিউজউইক, নিউ ইয়র্ক টাইমস সব… সব জু-দের কন্ট্রোলে! জুইশ ডিফেন্স লিগ, জুইশ ডিফেন্স

কংগ্রেস, সাইমন সেন্টার— এই সব হাই-প্রোফাইল ইহুদি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করছে খ্রিস্টান আমেরিকাকে! ভদ্রমহিলার কৌঁসুলি ব্রায়ান ব্রথ নামে একইহুদি গডফাদারের বিরুদ্ধে খুব বিষোদ্গার করলেন। না জানি, তিনি কে। জুডাসের প্রেতাত্মা বিরচিত এই নতুন শিক্ষা-নীতি আমেরিকার নব প্রজন্মকে একটি পুরোপুরি হোবো এবং মোরোন জেনারেশনে পরিণত করে, নিতে চলেছে ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসা, উপসংহারে তিনি জানালেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের কৌঁসুলি ও শিক্ষা দপ্তর তাঁদের সওয়াল ও সাক্ষ্যে যেভাবে আমেরিকার নতুন শিক্ষানীতিকে ডিফেন্ড করলেন, তা শুনেই আমি বিশেষত তাজ্জব। বলা হল, হোমোসেপিয়ান মানুষ যখন হাত তুলে পায়ের ওপর দাঁড়াল, যখন হাত দুটি জানতে চাইল, আমি এবার কী করব সেই তখন থেকে মানুষের মাথার দিগন্ত খুলে যাওয়ার শুরু। তার আগে পর্যন্ত অন্যান্য চতুষ্পদের সঙ্গে মানুষের তো কোনও তফাতই ছিল না। কালক্রমে লাভ দাই নেবার থেকে তথাকথিত রেনেশাঁ-সহ, কম্যুনিজম-প্রমুখ বিবিধ সামাজিক মূল্যবোধে আক্রান্ত হতে থাকে মানুষের মাথা। এভাবে মানুষ আবার সেই চতুষ্পদের যুগেই ফিরে যাচ্ছে। সে হাতদুটি পুনরায় মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে।

আমেরিকার নতুন বিপ্লবী শিক্ষানীতি চাইছে নতুন করে আবার মানুষকে দুটি হাত দেওয়ার জন্যে। যাতে, মানুষের মাথা নতুন করে সৃষ্টিশীল হয়। এবং, ফের মানুষ একটা নতুন দিগন্তের মুখোমুখি হয়। এই জন্যেই প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে দেওয়া হয়েছে একটি করে পার্সোনাল কম্পিউটার। যা মনে রাখবে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, ওই কম্পিউটার মানুষের আর-একটি মাথা। যা-কিছু সৃজনশীল নয়, যা-কিছু নন-এসেন্সিয়াল, সেগুলো মনে রাখার দায়িত্ব তার! মানুষের মনোমন্দির থাকবে লেপাপোঁছা। খোলা থাকবে দরজা। যাতে নব নব সৃজনশীলতা সেখানে প্রবেশ করে ও আসন গ্রহণ করতে বাধা না পায়। দুদিন ধরে শুনে আমি ভাবলাম, মোটে দুটো। আমাদের রাবণের ছিল দশটা মাথা। কী হল শেষ পর্যন্ত? লঙ্কাকাণ্ড!

ছন্দার বর অমিয় লিভারডোরে ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রধান হোতা, ওই মন্দির প্রসঙ্গে সে আমাকে বলেছিল এ-আর কী দেখছেন। কটা টাকা। আমেরিকার মোস্ট এক্সপেনসিভ টেম্পল হল সান্টা আনাতে। ৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ওরা ওখানে চার্চ তৈরি করেছে। যিশু আসবেন বলে।

আমি বলেছিলাম, কিন্তু আমার ধারণা ঈশ্বর যদি আসেন তো আসবেন আমাদের ভাঙা মন্দিরে।

 

রোজ সন্ধেবেলা ১৯-চ্যানেলে যে কুইজ প্রোগ্রামটা হয় তার নাম:ইউ ক্যান ডু।

মঞ্চের পেছনে টাঙানো থাকে বিশাল কারুকার্যময় অক্ষরমালা দিয়ে তৈরি একটি বাক্য। শুরুতে অক্ষরগুলো থাকে ওল্টানো। অক্ষর দিয়ে তৈরি প্রতিটি শব্দের মধ্যে, যে-কোনও লিখিত বাক্যে যেমন, ফাঁক থাকে। কাল ছিল ৪২টি অক্ষর দিয়ে তৈরি ১১টি শব্দ। বলতে হবে ওখানে পুরো বাক্যটি কী।

তারপর দেখানো হল প্রায় আলিবাবার রত্নগুহা এক: এত প্রাইজ! এরপর নিলাম চলতে থাকে। সারা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসা ভাগ্যান্বেষীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ জন দর-হাঁকিয়ে যখন মঞ্চে উঠল, ততক্ষণে সাত মিলিয়ন ডলার জমা পড়ে গেছে। এবার তারা এক-একটি অক্ষর বলে অজানা বাক্যটি সম্পূর্ণ করতে প্রয়াসী হয়।

প্রথম একজন হাসতে হাসতে আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ে: আই উড কল ফর অ্যান N.

উন্মত্ত জাজের সঙ্গে ভাঙা-নৃত্যের রতিপটিয়সীদের মধ্যে একজন এগিয়ে গিয়ে শেষের অক্ষরটি উল্টে দেয়। বিপুল হর্ষধৃনি। দেখা গেল সেখানে একটি N ছিল। বহুবর্ণ আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে তা থেকে।

আর-একজন সহাস্যে বলল: আই নিড আ T. দেখা গেল T-ও রয়েছে। চিৎকার। নাচ সমানে চলেছে।

ইলেকট্রনিক ঘড়িতে টিক-টক, টিক-টক… সময় ৩০ সেকেন্ড। কারও মোট তিনবার না মিললে সে মঞ্চ থেকে নেমে আসবে। অর্থাৎ, পয়সা হজম।

আই নিড আ F.

নোও?

এ-ভাবে আধঘণ্টার মধ্যে, বাঁ-দিকে ON E শেষের দিকে ROB–R এবং একেবারে শেষে TAN পর্যন্ত তৈরি হতে না হতেই, অসমাপ্ত শব্দের বাকি অক্ষরগুলো মনে মনে বসিয়ে এবং ৪২টি অক্ষর আঙুলে গুনে, উঠে দাঁড়িয়ে একজন গড়গড় করে বলে গেল

ONCE UPON A TIME THERE LIVED A ROBBER NAMED AL CAPITAN.এ-ভাবে, বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্যে, আল কাপিতান মুহূর্ত মধ্যে একজনকে রাজা ও নজনকে ফকির করে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে মিলিয়ে গেল।

পলকের জন্য দেখা গেল তার পাখি-পালকের উষ্ণীষ এবং উদ্যত বর্শা। তাকে এরা কেউ কখনও দেখতে পায়নি। পেল না।

 ১৩. হ্যারি, জেফ, মারিয়া ও লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল

৮ মে।

মারিয়া পৃথুলা, ছোটখাটো, দুধ-সাদা, ঘাডের বদলে গর্দান, মাথায় গোলাপিরুমাল, গায়ে সাদা অ্যাপ্রন। লাল পাতলা ঠোঁট। তাকে জিপসি-জিপসি দেখতে। মারিয়া নাকি ছাগল পোষে। ছোটবেলায় জীয়ন-অঞ্জন দুজনেই ওর ছাগলের দুধ খেয়েছে। রোজ সকালে একটা ফোর্ড গাড়িতে চেপে ছাগল আসত। সামনে দুয়ে দিত। এখন মারিয়া আসে ফিয়াটে। অঞ্জন ওকে এখনও গোট উওম্যান বলে।

আমি মারিয়ার কাছে জানতে চাইলাম, এখন বুঝি বরফ পড়ে না।

এ-রকম আবহাওয়ায় না। মারিয়া বলল, তবে পরপর কয়েকদিন ধরে আকাশ খুব পরিষ্কার আর নীল থাকলে পড়তে পারে। আবহাওয়াও ড্রাই থাকা দরকার।

কিচেনের জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি। বেলা ১০টা হবে। এখনও কুয়াশা কাটেনি। তবে শুকনো হাওয়া বইতে শুরু হয়েছে। মাঠের উত্তর দিকের গমক্ষেতে একটা ট্রাক্টর কুয়াশার মধ্যে ফুটে রয়েছে। বহুদূরে, শুনেছি ৭০/৮০ মাইল দূরে, কুয়াশা ছাড়িয়ে কাপিনের চূড়া দেখা যায়। একটা হলুদ আলোর রশ্মি কোথা থেকে উঠে এসে পর্বতচূড়ায় লাগল। কিছুক্ষণ থাকল। তারপর রঙ বদল করতে করতে শেষ পর্যন্ত কালো হয়ে ভারি রহস্যময়ভাবে কুয়াশার মধ্যে ঢুকে গেল।

৮ মে।

শ্রাদ্ধ ১১ মে। কার্ড এসে গেছে। ওপরে আমি নিজের হাতে বাংলায় লিখে দিয়েছিলাম। ছাপা হয়েছে। পোস্ট করার জন্য সমস্ত কার্ড জেফের অফিসে দিয়ে এলাম।

জেফ কোনিগ অনেক খবর দিল। ডক্টর চ্যাটার্জির অলিভ অ্যাভিনিউ-এর মেডিক্যাল সেন্টার সে বন্ধ করে দিয়েছে। দুটি মেয়ে কাজ করত, ছাড়িয়ে দিয়েছে। ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলোর কাছে ক্লেম-পিটিশন দেওয়া হয়েছে। চারজন উকিল চারটি কমপেনশেসন কেস করেছে। জন পার্লের নামে পুলিস সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের মামলা এনেছে। কাল কেস উঠবে।

এদিকে শ্রাদ্ধের আয়োজন সম্পূর্ণ, সে বলল। সানফ্রান্সিসকোয় দা হিমালয়া রেস্তোরাঁকে ১৫০টি ভারতীয় এবং ওলিয়েন্ডারকে ৫০টি বিদেশি লাঞ্চ লিভারমোর টেম্পলে পাঠাতে বলা হয়েছে।

৮ মে।

দুপুরবেলাটা বড় একা লাগে। গান-টান শুনি। টিভি দেখি। মাঠে গিয়ে বসে থাকি। মাঠের মাঝখানে গিয়ে বসলে সবচেয়ে নিরাপদ লাগে। মনে হয়, আর যাই হোক, আকাশ তো ভেঙে পড়বে না! ওদিককার ঘরগুলোয় যাইনা। লিভিং রুমেও যাই না। ওখানে একটা ছৌ-মুখোশ আছে। দুর্গার মুখ! তার গর্জন তেল মেশানো হলুদ পালিশ অন্ধকারে দেখা যায়। চোখ দুটো, আলো পড়লে ঠিকরায়। আমি নন্দিনের ঘর ছেড়ে কোথাও যাই না। টেলিফোন এ-ঘরে এনে রেখেছি।

আজ দুপুরবেলা নন্দিনের ঘরের পর্দা সরাতে প্রথমেই লেটার বক্সটি চোখে পড়ল। লন পেরিয়ে সাইডওয়াকের ধারে লোহার খুঁটির ওপর পোঁতা একটা কাঠের বাক্স। পোস্টম্যান এসে তার পাশে গাড়ি রাখছে। দেখলাম, ড্রাইভারের সিট থেকে না নেমে সে শুধু দরজা খুলেই বাক্সে চিঠি দেওয়া-নেওয়া করতে পারে। আমি আজ দুটি চিঠি ওখানে রেখেছি। বাক্সর দরজা বন্ধ করে দিয়ে লাল হাতলটা সে তুলে দিয়ে গেল। মানে, অন্তত একটি চিঠি এসেছে।

প্রথম দু-চারদিন কত চিঠি, বইপত্র আসত। কত দ্রুত কমে এল! গত দুদিনে তো কিছুই আসেনি। সবাই জেনে যাচ্ছে। আমি রোজ ছোটকাকার ডাকবাক্স থেকে চিঠি আনি। এটা আমার কাজ। ছোটকাকার অনেক চিঠি আসে। বইপত্র আসে। বেশ ভারি হয়। কিন্তু, তোমাদের একটি চিঠি থাকলে একটুও ভারি লাগে না। প্রথম দিকে নন্দিন লিখেছিল।

বাক্স খুলে দেখি, কল্যাণ লিখেছে। তার বক্তব্য: ফোনে আমি যা বলেছি, শুনে তার মনে হয়েছে, একজন বিশ্বাসযোগ্য লোকাল গার্জেন ঠিক করেনন্দিনকে এবং সম্ভব হলে, মাসখানেকের জন্যে হলেও, অঞ্জনকে নিয়ে আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসা উচিত। অঞ্জন আমেরিকাতেই পড়াশোনা করবে। তার শেকড় ওপড়াননা মোটেই উচিত হবে না। কোনও প্রলোভনেই তুমি যেন ওখানে থেকে যেও না বাক্যটির নিচে লাল কালি বুলিয়ে কল্যাণ আন্ডারলাইন করে দিয়েছে। চিনু নন্দিনকে লিখেছে কান্না দিয়ে। ওরে, তোকে আর কিছু হতে হবে না। কিছু করতে হবে না। তুই আমার বুকে ফিরে আয়। ইত্যাদি।

দুপুরবেলা। শহরতলির এই দামি আবাসন-এলাকায় কেউ কোথাও নেই। কুকুর নেই এমন রাস্তা ভাবা যায়! কিন্তু, পথিক নেই, তবু পথ? এখানে শত শত মাইল ড্রাইভ করে গেলেও একজন পথিক চোখে পড়ে না। পথ এখানে পথে পড়ে থাকে।

সবুজ ডাকবাক্স। গায়ে লেখা ২৮৫৬। এই সেই ২৮৫৬ হোয়াইট গেট ড্রাইভ। পথের ধারে অচেনা বৃক্ষরাজির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি আকাশপাতাল ভাবতে থাকি। এই সেই ২৮৫৬ হোয়াইট গেট, ক্যা–৯৫৩৪০, যেখানে চিঠিতে-কার্ডে সপ্তাহে দুটো করে ধরলেও গত এক বছরে শুধু নন্দিনের জন্যে শতাধিক চিঠি এসে পড়েছে এই বাক্সে। আর, এইভাবে তরুণ সুদর্শন সাহেব পোস্টম্যান গাড়ি চেপে এসে ড্রাইভারের সিটে বসে সযত্নে চিঠিগুলি একে একে রেখে হাতল তুলে দিয়ে গেছে। বাড়ি থাকলে, নন্দিন এসেছে ছুটতে ছুটতে। ওই সেই বাড়ি, হাজার হাজার মাইল দূরে যার অস্তিত্বের কথা আমি মুহূর্তের জন্যও কখনও অস্বীকার করতে পারিনি, যদিও তা ছিল কালপুরুষের পায়ের কাছে বশংবদ লুব্ধকের চেয়েও ঢের অবাস্তব, কেননা, লুব্ধককে তো চোখে দেখা যায়।

বিদেশ নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখেছি কত-না। আশ্চর্য যে, প্রত্যেকটির পটভূমি ছিল আমেরিকা। রঞ্জন তো ইংল্যান্ডেও ছিল, কানাডার সাসকাচুয়ান আর এডমন্টনে ছিল ছমাস করে— কই, এদের কখনও দেখিনি তো স্বপ্নে! তা ছাড়া, ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ…এরাও রয়েছে। পৃথিবীর কোথায় যে রয়েছে, থেকে গেছে রিও-ডি-জেনেরো! হয়ত ব্রাজিলে। যেন মৃত্যুর মতো এরা সব। মানো বা না মাননা, মনে রাখো বা ভুলে যাও, যা তোমার খুশি। সে তুমি যেখানে থাক, যে চুলোয়, এরা আছে। দূরে… কিন্তু আছে। অপেক্ষা করছে। একদিন তুমি সেখানে যাবে বলে।

বস্তুত, বিদেশ শব্দটির মধ্যে একটা কাছে আয় ডাক আছেই। বিদেশি জিনিসের প্রতি আমাদের অদম্য আকর্ষণের কথাই ভাবা যাক না কেন। সেই যে একবার রঞ্জন আমার জন্যে এনেছিল একটা পালকের মতো হালকা গ্যাস লাইটার— তখন এখানে লাইটার বলতে লম্ফ, কেরোসিনে জ্বলে যার বোতাম টিপলেই জ্বলে উঠত দপ করে আগুন এবং আগুন না নেভা পর্যন্ত বিখ্যাত সব সোনাটা থেকে রেকর্ড করা সাতটি সুরের একটা-না-একটা বেজে যেত। বেজেই চলত! একটির সুর নাকি ছিল মোৎসার্টের দ্য ম্যারেজ অফ ফিগারো থেকে?

তো, সেই কবে ১৯৭২ সালে রঞ্জন আমেরিকা যাওয়ার পর থেকে স্বপ্নে আমি বহুবার আমেরিকা গেছি। কিন্তু সে তো এই মার্সেদ নয়, এই বাড়ি নয়, এই রাস্তা নয়। বরাবরই আমি এ-দেশে এসেছি বিনা পাসপোর্টে ও বিনা ভিসায়। আর, পালতোলা জেলে-ডিঙিতে। আর, সে অভিযাত্রায় প্রধান আকর্ষণ ছিল কী? না, ভয় পৌঁছনো কোনওমতে। কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়া। আর, পুলিসকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকা। আর, রঞ্জনকে খোঁজা। যেজন্যে ডক এরিয়া থেকে খুব বেশি দূরে কখনও যেতে পারিনি। ধরা পড়ার ভয়ে।

ডাকবাক্সর ধারে দাঁড়িয়ে আমার স্পষ্ট মনে পড়ল, অন্তত একবার আমি রঞ্জনকে খুঁজে পাই। পশ্চিম উপকূলের দক্ষিণতম বিন্দুর কোনও এক শহরে সেদিন ভোরবেলা সাইক্লোনের আবহাওয়া। ঝোড়ো হাওয়া আর উড়ন্ত বৃষ্টিকণার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি অবশেষে রঞ্জনকে খুঁজে পাই একটা হতদরিদ্র অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের ঝুলন্ত চারতলায়, মাটি থেকে যার তিনটি তলা গেছে। ভেঙে, এবং, রঞ্জনের তখনও তা জানা নেই! কী ভয়ঙ্কর! রঞ্জনের ঘরে ঢুকে দেখি, মেঝেয় পাতা অনেকগুলো বিছানা। কেউ নেই। রঞ্জন একা শতরঞ্চি-সহ নিজের বিছানা গোটাচ্ছে। আমাকে দেখে সে দারুণ রেগে গেল। আমার দিকে অভিযোগের তর্জনী তুলে বলল, এই সাইক্লোন আসছে কাঁথির সাইক্লোন-আই থেকে! আমি লক্ষ্য করলাম, স্বপ্নের সেই দরিদ্র আমেরিকা, সেই বাস্তুহারা রঞ্জন, সেই ভিজে মৃত্যু-আবহাওয়া, আজকের ঝকঝকে দুপুরের তুলনায় আমার কাছে

অনেক বেশি সত্য হয়ে আছে।

এই সব সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় দেখি একটি বিশাল পিক আপ ভ্যান হোয়াইট গেট থেকে এদিকে ৬০/৭০ মাইল বেগে ছুটে আসছে। রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়েছিলাম। আমি তাড়াতাড়ি সাইডওয়াকের ওপর উঠে দাঁড়াই। তারপর কী ভেবে আরও পিছিয়ে লনের ঘাসের ওপর গিয়ে দাঁড়াই।

গাড়ি না বলে দোতলা বাড়িই বলা উচিত। কলকাতার এল নাইনের মতন। হাব-ভাবে মনে হয়েছিল বেরিয়ে যাবে, তা না, গাড়িটা হঠাৎ আমার উল্টোদিকে সশব্দে দাঁড়াল। দেখলাম, সিঁড়ি নামিয়ে ড্রাইভারের কেবিন থেকে একজন লাল আমেরিকান নামছে। রাস্তার ওপার থেকে হাত তুলে সে যখন বলল, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড আমি সত্যিই আঁতকে উঠেছিলাম।

এখানে ভয় পেতে পেতে আমি এতটুকু হয়ে গেছি। ভয় একটাই: রঞ্জন-সুমিতা আমাকে এভাবে উড়িয়ে এনেছে, সে কি আমাকে ধৃংস করবে বলে? কী ওদের ইচ্ছে? অপঘাতে মৃত প্রেতাত্মা, যার নাকি মাটির মায়া সহজে যায় না, আর এখনও তো শ্রাদ্ধও হয়নি…

আকাশ ভেঙে পড়ে না। তাই মাঝে মাঝে মাঠে গিয়ে বসি। তখন সাহস পাই। তখন ওদের শুনিয়ে মনে মনে বলি, আমি সব বাজি রেখে ২০ হাজার টাকা ধার রেখে এভাবে ছুটে এলাম, সবটাই কি আমার মেয়ের জন্যে? তোমাদের ছেলের জন্য নয়? তোমাদের ফিউনারালে থাকব বলে নয়? তোমাদের মৃত আত্মার সম্মানের জন্য নয়?

একটি প্রশ্নেরও আমি উত্তর পাই না।

লোকটা রাস্তা পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। পরনে লাল শর্টস, গায়ের সাদা গেঞ্জির ওপর লেখা: ডু নট কাম ইন মাই ওয়ে!

সে আবার বলল, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড। মাই নেমে ইজ হ্যারি কেলার।

আমি কিলারই শুনলাম। এবং শুনে সাদা হয়ে গেল আমার মুখ। লোকটা তাও দেখল। বলল, কে ই এল এল ই আর। নট কিলার।

আমার বৌ কারা ডক্টর চ্যাটার্জির মেডিকেল সেন্টারে নার্স ছিল। হি ওয়জ আ ব্রেভ ম্যান। আ গ্রেট ডক্টর।

সে আর তার বৌ এবং মেয়ে ন্যান্সি শ্রাদ্ধে যেতে চায়। কারণ, এখানে ছিল না বলে ফিউনারালে যেতে পারেনি। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে চায়।

লোকটা এ দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদ বলতে লোকটা খুবই রোগা।

রোগা আমেরিকান… আমার মনে পড়ল, প্রথম মোর্নার হিসেবে সবার আগে বাড়িতে এসেছিল এই হ্যারি না?

মাই ডটার ন্যান্সি অ্যান্ড জন আর গুড ফ্রেন্ডস।

জন বলতে অঞ্জন। সাহেবরা ওকে জন বলে ডাকে।

৮ মে।

বিকেলবেলা। ছোট্ট এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। হোয়াইট গেট ড্রাইভ জুড়ে যতদূর দেখা যায় বৃষ্টি শেষের কনে-দেখা-আলো।

রাস্তার দুধারে একই জাতের তরু-বীথিকা। তাতে কাঠগোলাপের মতো সাদা সাদা ফুল।

সারা পথ জুড়ে সেই দুপুর থেকে এখনও কোনও পথিকের দেখা নেই। হাওয়া নেই। শুধু মাঝে মাঝে গাড়ি গেছে নিঃশব্দে।

একটু আগে সুন্দর তামার ঘটে রঞ্জন, সুমিতা, আর জীয়নের অ্যাসেস দিয়ে গেছে।

সারা রাস্তায়, পথের মাঝামাঝি একটা ঝকঝকে নীল অটোমোবাইল দাঁড়িয়ে।

লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল?

 ১৪. রঞ্জনের সঙ্গে কথাবার্তা

৯ মে।

কীরে নদা, সেই এলি তাহলে?

……

খুব ভাল লাগছে। ব, কেমন দেখছিস আমার ঘরবাড়ি?

ঠিকই আছে।

ঠিক আছে কীরে। ওই যেখানে পাহাড়ের শুরু, ওই পর্যন্ত সবটা আমার।

আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি।

সে কীরে। এ কথা বলার স্পর্ধা তোর হয় কী করে। নে একটা কমলা লেবু খা।

না।

আরে, খা না!

না।

না?… এই যে ঘড়িটা পরে আছি, এটার দাম কত জানিস?

ন্‌না তো।

এগুলো জেনিভার পেজেঘড়ি। গত ৫ বছরে এরা এই মডেলটা মাত্র ১৭৫টা তৈরি করেছে। আমি পরে আছি ১৫৫ নং ঘড়িটা। দ্যাখ, নম্বর লেখা আছে। এর দাম কত জানিস? ১৯ হাজার ১শো ৬০ ডলার। রাফলি ১৪ দিয়ে গুণ কর। লাখ তিনেক টাকা হবে আর কী। আমার আর একটা পেজে আছে। হোয়াইট গোল্ডের। ডায়মন্ড সেট করা। ৮০ হাজার ডলার দাম। ওটা আছে এল-এ-র ফাইডেলিটি ব্যাঙ্কের ভল্টে ডু ইউ নো হাউ মাচ রিয়েল এস্টেট আই ওন— ওয়ার্দি অফ হাউ মেনি ডলার্স। হাউ মাচ ইন ক্যাশ? টেন মিলিয়ন, টুয়েন্টি, থার্টি-ট্রাই টু গেস…

আমি জানি না।

ও-কে। ইয়া। বাট দে আর দেয়ার। ওয়েল, ইউ কান্ট পসিবলি ডিসপিউট দেম। ক্যান ইউ? ইউ ক্যান নট আউট দা থিস দ্যাট একজিস্ট, দো দে আর বিয়ন্ড ইউ। ও-কে? তোর ফ্ল্যাট কত বড়?

সাড়ে ছ-শো।

কিনতে পেরেছিস?”

না।

ব্যাঙ্কে কত?

আমার এখন বিশ হাজার টাকার মতো ধার।

আমি টিকিট পাঠালাম। এলি না! আই শ্যাল বায় ইউ দা রিটার্ন প্যাসেজ এনিওয়ে।

আমার জুতোর ঘরে ঢুকেছিলি?

হ্যাঁ।

ক-জোড়া জুতো ওখানে জানিস। জানিস না। ৮০ জোড়া। তোর?

আমার এক জোড়া জুতো।

মোজা এক জোড়া?

হ্যাঁ।

এই যে জামাটা পরে আছি, ম্যানুফ্যাকচারারের নাম জানিস?

না।

গুচে। বছরে ৫০০ শার্ট বানায়। এর যে ইজিপসিয়ান কটন, এরা নিজেরা তৈরি করে। আমার বাড়িতে যা জিনিসপত্র আছে— সোলার প্ল্যান্ট, নিজের জেনারেটর যা ওই উইন্ডমিল তৈরি করে—৭২ ফিটের সুইমিং পুল—একে বলে জাকুসি। এতে পর পর দুটো ডুব মারলে, একটা ঠাণ্ডা আর একটা গরম—লোকে বাপের নাম ভুলে যায়, বুঝলি? তুই আমার লিভিংরুমে যা কিছু দেখলি এভরি বিট অফ ইট ইজ ফ্রম ক্যাশমিয়ের। অলটুগেদার বাড়িটার দাম কত জানিস? কিনেছিলাম দেড় মিলিয়নে। মানে দুকোটি আর কি। কিন্তু এখন? কতটা জমি, তোর ধারণা? বাহান্ন বিঘে। তুই আবার হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ আ ম্যান রিকোয়ার গল্পটা শোনাবি না তো? হ্যাঃ, হ্যাঃ, হ্যাঃ।

কিন্তু, আমি তো ঠিক তাই শোনাব। আমি তো দেখছি তুই একটা কয়েদী?

ডোন্ট বি সিলি।

হ্যাঁ। অ্যান্ড ফর ইওর হোল লাইফ টার্ম অ্যাট দ্যাট।

কী রকম?

দ্যাখ যখন এয়ারপোর্টের বেড়ার ওপার থেকে দুটো স্বাস্থ্যবান ছেলে আর ঝকঝকে বৌ-এর কনুই ধরে এগিয়ে আসতিস… প্রথমবার এসে কী বলেছিলি মনে আছে?

কী বলেছিলাম বল তো? এত রোগা আর ইমাসিয়েটেড, কীরে, তোরা কি খেতে পাস না?

রাইট। এখন এখানে তোকে দেখেও তাই মনে হচ্ছে। অবশ্য, এভরিবডি নোজ হিয়ার দ্যাট ইউ আর আ রাইটার। কাজেই, তোর মতো চেহারাটাও কোয়ালিটেটিভলি চলে যাবে। হ্যাঁ, লাইফটার্মের ব্যাপারটা কী বলছিলি বল তো?

কী বলছিলাম…আ-হা, এয়ারপোর্টে তোদের দেখে দেশে ও-রকম মনে হত। মনে হত স্বর্গ থেকে আসছিস। ভাবতাম, কেন ফিরবি তোরা এই হতভাগা দেশে, এই পৃথিবীতে?

আর এসে কী দেখছিস?

দ্যাখ, আগে যদি আসতাম, আমি ঢের হয়েছে এখন চল তো বলে বোঁচকা-কুঁচকি তুলে তোদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতাম। হ্যাঁ, সম্ভব হলে ঘাড় ধরে। তোরা টাকার গাছ পুঁতেছিস বটে একটা। কিন্তু, তার চারদিকে জেলখানার দেওয়াল। ইয়েস, ইউ আর সার্ভিং লাইফ। ফর শিওর!

অ্যাই…স্টপ দ্যাট বুলশিট।

নো আই অ্যাম টেলিং ইউ হোয়াট ইউ রিয়েলি আর। দ্য ট্রুথ!

তুই তোর মেয়ের ফিউচারের জন্যে, বৌদির জন্যে কী করেছিস? ইউ ইরেসপনসিবল প্যারাসাইট! মেয়েটার ভবিষ্যতের ভার পর্যন্ত আমার হাতে তুলে দিলি!

আমি জানতাম না। ভেবেছিলাম তোরা একটা-কিছু। ইউ হ্যাভ অ্যাচিভড সামথিং। এসে দেখছি, এই বাড়িঘর, গাড়ি, অৰ্চাৰ্ড, সুইমিং পুল…এ তো বনে ফিরে যাওয়া একটা হাতির নাদা, কাঁচা কয়লার উনুন থেকে উড়ন্ত ধোঁয়ার চেয়েও বেশি ধোঁয়া বেরচ্ছে এ-থেকে। ইউ রিয়েলি হ্যাভ অ্যাচিভড নাথিং।

রিয়েলি?

হ্যাঁ। অন্তত একবার আমার কথা মন দিয়ে শোন। শুধু নিজের সংসারের শ্রীবৃদ্ধি করা কোনও অ্যাচিভমেন্ট নয়। এর বাইরে অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে যা আমাদের প্রত্যেকের সত্ত্বা-আমাদের প্রত্যেকের সেলফ জানে। সে কথা ভুলে মেরে দিয়ে শুধু নিজের সংসারের বেঁচে থাকাকে নিজের বেঁচে-থাকা ভাবা… সংসার ছেড়ে, বৌকে ছেড়ে, ছেলেকে ছেড়ে তুই চলে যেতে পারিস। মানুষ যায়। কিন্তু নিজেকে ছেড়ে তুই কোথায় যাবি?

তোর মেয়ের বিয়ে দিবি কী করে? টাকা পাবি কোথায়? ওখানে তো ডাওরি লাগে?

ওহ। ইউ ইনকরিজিবুল হামবাগ। ইউ ভেইন! ইউ ফুল! তা যদি লাগে, শি উইল প্রস্টিটিউট হারসেলফ, কালেক্ট দা মানি অ্যান্ড প্রেজেন্ট দা ডাওরি টু হার হাজবন্ড। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?

আমি ডাক্তার। আমি মানুষ বাঁচাই। হোয়াট ডু ইউ ডু?

আ। ফর ওয়ন্স ডোন্ট বি আ হিপোক্রিট। সত্যি করে বল তো, তুই ডাক্তার, না, ব্যবসাদার? ডাক্তারের গাইডিং ফোর্স তো দুটো। এক, জ্ঞান। দুই, রোগীকে সারিয়ে তোলা। এর মধ্যে ব্যবসা আসে কোথা থেকে রে? কেন ওই অৰ্চাৰ্ড, গোল্ড মাইনের অর্ধেকটা কিনেছিস কেন, কেন ১৪টা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিয়েছিস?তই ছেলের জন্যে কত রেখে গেছিস?দশমিলিয়ন, কড়ি মিলিয়ন? তোদের শোবার ঘরে নিউ ওয়েভার্স জাজ বাজিয়ে, ইউ নো হোয়াট…তোদের বিছানায়। হ্যামলেট মাকে বলেছিল, এখনও তোমার বিছানা থেকে বাবার বীর্য শুকোয়নি তুমি এর মধ্যে কাকার সঙ্গে ওই বিছানায় শুলে? ফ্রেয়লটি, দাই নেম ইজ… এ তো সেই বৃত্তান্ত। তারা এর নাম ছেলেকে এডুকেশন দিচ্ছিলিস? এ তো আমেরিকান জন্তু একটা। আরন্ট ইউ অ্যাশেমড় অফ আ সন লাইব দ্যাট—স্বীকার কর হতভাগা। যে ব্যর্থ যদি কেউ হয়ে থাকে, সে তুই। আমি নয়। তুই! তুই!

ন’দা! আমি তোকে চিরকাল আমার অলটার-ইগো ভেবেছি। আমি যখন ডাক্তারি পড়তাম, তখন আমার বাক্স থেকে হাড়, মাথার খুলি এ-সব তুই চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলি। মার্কাস স্কোয়্যারের বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে তোদের অতি আধুনিকা বলে বই-এর দোকানে কবিতার বইএর পেপার ওয়েট হিসেবে এগুলো ব্যবহার করেছিলি। আমি কত রাগ করেছিলাম, মনে আছে?

একদিন লুকিয়ে তোর শার্ট পরে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। তুই জামাটা আমার গা থেকে খুলে নিয়েছিলি। সেদিন আমি মার্কাস স্কোয়্যারে গিয়েছিলাম গেঞ্জি পরে।

আমাদের তো ক্লাস ফোর অবধি খালিশা। নটি বয় পেলাম ফাইভে উঠে। প্রথম মোজা পরে মেডিকেল কলেজে যাই।

ক্লাস ফোর অবধি খালি পা। ঠিকই। কিন্তু আমাদের সেজন্যে কোনও অভাববোধ ছিল কী?

না… তা…তখন…।

দেয়ার ইউ আর! এই অভাববোধের অভাব— এ যতদিন বেঁচে থাকবে মানুষের মনে— যতদিন, যাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে–যতদিন শিশু বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে—ততদিন সে তার কাছ থেকে এটা শিখবেই—ততদিন অ্যাচিভমেন্ট বলতে সে অন্য জিনিস ভাববে। আর, তুই যা করেছিস, তাকে মনে হবে এলিফ্যান্ট-শিট!

ব্লেসেড ইজ দা পুওর ইন স্পিরিট?

ব্রেসেড ইজ দা চাইল্ড ইন স্পিরিট!

তোকে টি. এস. এলিয়টের একটা বই পাঠিয়েছিলাম। পাতা উল্টে দেখেছিলিস?

না। সময় পাইনি।

আহা, অন্তত দ্য বেরিয়াল অফ দা ডেড-এর এই কটা লাইনও যদি, যদি তুই পড়তিস, যাতে ছিল…

Unreal City
Under the brown fog of winter dawn
A crowd flowed over London Bridge.
So many
I had not thought
Death had undone so many…

তুই একবার পাতা উল্টেও দেখলি না বইটার?

অথচ, আমি পাঠিয়েছিলাম! তাহলে তো তুই তখনই জানতে পারতিস সেই সব জিনিসের কথা যাদের অস্তিত্ব আছে। যাদের অস্বীকার করা যায় না। যারা তোর মনোযোগ দাবি করে।

কী অ-ব্যর্থভাবে মরে গেলাম না রে ন’দা?

আমাদের বেনেটোলার বাড়ির গোলবারান্দা থেকে আমরা কাগজের প্লেন ছাড়তাম, তোর মনে পড়ে?

হ্যাঁ। আমারটা আগে মুখ থুবড়ে পড়ত।

আচ্ছা, আমি কেন এভাবে বেঘোরে মারা গেলাম, তুই জানিস?

বল্‌ না। আমি অশিক্ষিত। এলিয়ট পড়িনি। তুই বল আমাকে।

আমি এতক্ষণ তো সেই কথাই বললাম।

এলিয়ট পড়িনি, তাই। না রে, নদা?

দ্যাখ, মৃত্যু হল আমি বেঁচেছিলাম এই মুখোশটার খসে পড়া। এ ছাড়া কিছু তো নয়। মুখোশটাকে তুই মুখ ভাবতে গেলি কেন রে রুনু?

জীয়ন মরে গেল কেন?

ওইটুকুন ছেলে। ওর অপরাধ কী?

জানি না।

আই হ্যাভ আ হাঞ্চ। ওকে অবিকল আমার মতো দেখতে হয়েছিল। হয়ত তাই। রাইট?

আমি জানি না।

আর সুমিতা

আমি জানি না।

সহমরণে যাবে বলে নিশ্চয় নয়? বল না! আই হ্যাভ আ হাঞ্চ।

হোয়াট হ্যাপেন্ড অ্যাট দীঘা?

আমি জানি না।

সুমিতা আমাকে সানফ্রান্সিসকো নিয়ে যাচ্ছিল কেন? বলল, চল না, হেভি সারপ্রাইজ দেব তোমাকে। নইলে তো আমরা ৯১ নং ফ্রি-ওয়ে ধরে ফিরতাম। তুই জানিস কেন?

আমি জানি না।

 ১৫. এসকাইলাসের মৃত্যু ও অন্যান্য

১০ মে।

আজকের ডাকে রঞ্জনের একটা চিঠি এসেছে। জবৃলপুর থেকে ছোড়দির লেখা। ভাই রুনু ছোড়দি লিখেছে, ১৯৩৮ সালের ২১ এপ্রিল শেষরাতে তোর জন্ম। সেদিন দারুণ ঝড়বৃষ্টি। বেলার দিকে হৃষীকেশ থেকে এতোয়ারি বাবা আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। হুলুস্থুল কাণ্ড। কদিন থেকেও গেলেন সেবারে। তোর কুষ্ঠি তৈরি করে দিলেন। বলে গিয়েছিলেন, এই ছেলের ৭ মাসে, ১৭ বছরে আর ৪৯ বছরে মৃত্যুযোগ আছে। ৪৯ পেরুলে এ জাতক রাজা হবে। ৭ মাসে কাচকামিনীদের বাড়ির পুকুর থেকে তোকে প্রায় মতই ভোলা হয়। সবাই তাই ভেবেছিল। ঠিক ১৭ বছর বয়সে হয়েছিল সাঙ্ঘাতিক পেরিটোনাইটিস। অপারেশনের পর ওই অসুখ হলে তখন কেউ বাঁচত না। এ বছর ২১ এপ্রিল তোর ৪৯ পূর্ণ হয়ে গেল। যাঃ তাহলে তুই বেঁচেই গেলি শেষ পর্যন্ত। প্রার্থনা করি, আমাদের স্বর্গীয় পরমারাধ্য কুলগুরুর কথার বাকিটাও ফলুক। তুই রাজা হ।

আমি জ্যোতিষে বিশ্বাস করি না। তবে, এই একটি ক্ষেত্রে দুর্বলতা হয়। ইচ্ছে হয় ভাবি যে, ওর জন্মমুহূর্তটি হয়ত অব্যর্থভাবে বলা যায়নি, তাই ৫ দিন এদিক-ওদিক…এমন ভাবনার শৌখিনতাকে প্রশ্রয় দিতে মন চায়, যদিও, আমি জানি, অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু, তার কোনও যথাস্থান নেই, নেই কোনও যথাসময়, সে-আবহাওয়ার কোনও পূর্বাভাস থাকতে পারে না। অন্তত মৃত যারা তাদের কাছে তো নয়ই। দুর্ঘটনায় যারা মারা যায়, তারা দেশে মরে না। বিদেশেও মরে না। তারা রাত ৯টায় মরে না, বা ভোর ৬টায় মরে না। পৃথিবীর দেশ-বিদেশ বা পৃথিবীর সময় তাদের পক্ষে প্রযোজ্য হয় না।

গ্রিক নাট্যকার এসকাইলাস জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন। তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, অমুক তারিখ থেকে অমুক তারিখের মধ্যে মাথায় আঘাত লেগে তাঁর মৃত্যু হবে। এসকাইলাস দিকচিহ্নহীন প্রান্তরে গিয়ে বসে রইলেন। সেখানেই কদিন আহার-নিদ্রা। হয়ত মৈথুন। আকাশ থেকে তো কিছু পড়বেনা, এক আকাশ ছাড়া! দুর্নিরীক্ষ উঁচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল একটা ঈগল, কচ্ছপের খোল ঠোঁটে নিয়ে। সেটা মাথায় এসে পড়ল। অত বড় নাট্যকারের তাতেই মৃত্যু হয়। আকাশ ব্যাপারে এ নিশ্চিন্ত যদিও এমনকি, পারস্যের সেই নিরক্ষর উপজাতি-প্রধানেরও ছিল না, তুমি পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কাকে ভয় করো বিজেতা আলেকজান্ডারের এই প্রশ্নের উত্তরে অভিপ্রেত আলেকজান্ডার না বলে যে বলেছিল, আকাশ!

সত্যি, কার মাথায় কখন আকাশ ভেঙে পড়বে এবং কোথায় আর কীভাবে, আগে থেকে তা টের পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। জুতো পালিশ করতে করতে বা চুম্বন, কখন যে মারা যায়নি মানুষ! মন্দিরে-টয়লেটে কোথায় নয় যে। রোমের সম্রাট ক্লদিয়াসের দরবারে সম্রাটের কানে শব্দ ও নাকে গন্ধ যেতে পারে এই ভয়ে বাতকর্ম চেপে রাখতে রাখতে এক বিদূষকের বায়ু-চাপে হার্ট-স্ট্রোক হয়। দুহাতে বুক চেপে সে রাজসভায় লুটিয়ে পড়ে।

চুড়ান্ত অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয়েছিল বটে বাদলের বড় পিসেমশায়ের। তিনি ছিলেন বামার লরির বিলেত-ফেরত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। বেনেটোলার বাড়িটা বাদলের বাবা জলের দামে কিনে ফেললে, একদিন দেখতে এসে, সেদিন মহাঅষ্টমী, বুঝেছ উপেন, এই সিঁড়িটা বেশি দিন থাকবে না, এটা তাড়াতাড়ি সারিয়ে নিও এই না বলে বেড়াবার ছড়ি দিয়ে যেই একটা খোঁচা দিয়েছেন সিঁড়িতে, অমনি হুড়মুড় করে সেটা কিনা তাঁর মাথাতেই ভেঙে পড়ল! তাই বলছিলাম, অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু, এর কোনও জাত নেই। স্থান নেই। সময় নেই।

১ মে রাতের স্বপ্নে, গায়ে অ্যাপ্রন ও রক্তাক্ত গ্লাভস হাতে সিরিঞ্জ আমার দিকে তুলে ধরে রঞ্জন প্রশ্ন করেছিল, তুই আমাকে আগে বলিসনি কেন?

শিল্প-সাহিত্যে, কবিতায়, সময় কেমন এগিয়ে-পিছিয়ে যায়, কত অবলীলভাবে। সেখানে আগে থেকে জানা যায় কত কিছু। গীতার মূর্তিমান, জীবিত যুযুত্সবা: কত সহজে কুরুক্ষেত্রে আগে থেকে মরে পড়ে থাকে। অপরাহ্নে খুন হবে সান্তিয়াগো নাসার, তার রক্ত ক্রনিক অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড-এর পাতায় মধ্যাহ্নেই ঘাতকের ছুরি থেকে ঝরতে থাকে। জীবনেও এমনটা হয়। হয়ে থাকে। কিন্তু, আগে থেকে কিছুই বোঝা যায় না। কেন যে।

দীঘা, ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭। ২৬ এপ্রিল তখনও প্রায় তিন মাস দূরে। সেই অনাগত ২৬ এপ্রিলের ক্যালিফোর্নিয়ার রাত-উপকূলে জেগে উঠে নীল প্যাসিফিক ও পীতাভ দক্ষিণ চীন সমুদ্র পেরিয়ে, সরু মলাক্কা প্রণালীর মধ্যে দিয়ে চলে এসে, ভারত মহাসাগরও পিছনে ফেলে, বঙ্গোপসাগরের ঘোলা জলে যখন ঘাই মারল খুনে-খরশান সেই নীল ঢেউ, হাঁটু-জলে লাইফ বেল্টের ওপর সুমিতা তখন শুয়ে আছে। সুমিতা সাঁতার জানে না। তাই আমি আর লেদু আছি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। সে এসে প্রথমে তাকে উল্টে জলের মধ্যে ফেলে দিলে। এমন বিজাতীয় অর্বাচীন ঢেউ, যাতে এত নীলাভা, এত বড় ঢেউ, এখানে, তীরের এত কাছে আর এই শীতশেষের শুরুতে— দীঘার বেলাভূমিতে এ ছিল প্রায় কল্পনাতীত। আমরা দেখলাম, এক অ-দেখা নীল জলপ্রবাহের মধ্যে সে চিৎহয়ে শুয়ে। তা, এমন ঢেউ একটি বই তো না, সরে যেতে কসেকেন্ড দুই, চার, পাঁচ… আর কত। আমি তাই কাছে যাওয়ার চেষ্টা করিনি। জানি, জল ভেঙে কাছে পৌঁছবার ঢের আগেই ও উঠে দাঁড়াল বলে। কিন্তু, এ কি অবিশ্বাস্য! সুমিতা ওঠবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করার আগেই উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে কোনাকুনিভাবে একবার এবং দক্ষিণ-পূর্বদিক থেকে কোনাকুনিভাবে আর একবার, দু-দুবার ফিরে এসে সে ওকে জলের নিচে চিৎ করে শুইয়ে রাখল। তারপর আর এল না।

এতক্ষণে আমি ওর পাশে চলে গেছি। সম্পূর্ণ সরে যাওয়ার আগে স্বচ্ছ-নীল সেই বিদেশি অপর-জলের মধ্যে আমি স্পষ্ট দেখলাম, মৃত্যুর পর যে হিমাভা ওর মুখে ছড়িয়ে থাকার কথা, তা এখনই ওখানে লেগে আছে। আজ যদি আমি বলি, গীতা বা ক্রনিক-এ যেমন, ২৬ এপ্রিল মার্সেদে ওর মৃত্যুর তিন মাস আগে আমি ওকে দীঘায় মৃত দেখেছি, তাহলে আমি একটুও মিথ্যে বলবনা।

তবু কেন যে বুঝতে পারিনি। কেন যে আগে বলে দিইনি, ওগো জীবন, তুমি সাবধান। তুমি মরে গেছ।

কেন যে।

মার্সেদের দিকে সোজা সড়ক ফ্রি-ওয়ে নাইনটি ওয়ান ছেড়ে কেন সে ১১৩ ধরে সানফ্রান্সিসকোর দিকে ওভাবে বেঁকে গেল, তা শুধু আমি জানি। আর জানত সে। সারপ্রাইজ দেবে বলে সে রঞ্জনকে কিছু বলেনি।

দীঘা থেকে ফেরার পথে, বাসে খুবই ক্যাজুয়ালি সুমিতা আমার কাছে জানতে চেয়েছিল, আচ্ছানদা, স্কেল-চেঞ্জিং হারমোনিয়ামগুলো কি আজকাল পাওয়া যায়, ওই যে-গুলো পোর্টেবল? একসময় ডোয়ার্কিন খুব এক্সপোর্ট করত। কী কিউট, না?

যাওয়ার আগের দিন দুপুরবেলা মানকুণ্ডু থেকে ঘেমে-নেয়ে একসা হয়ে ফিরে, বিছানার ওপর, দরজা খুলেই, নতুন, এক্সপোর্ট-কোয়ালিটি, পোর্টেবল হারমোনিয়ামটি দেখতে পেয়ে সে কী উন্মাদনা তার মুখে-চোখে! মন্ত্রচালিতেরমতো হেঁটে গিয়ে, একেবারে কোলেটোলে তুলে নিয়ে সেটা, স্টপারগুলো খুলে ও বন্ধ করে, কী ক্ষিপ্রতায় সে সরগমে ভরিয়ে তুলল তার ঊর্ধ্ব ও অধঃ চেম্বার যখন জ্ঞান ঘোষের গ্রেন ও বন্দিশ পেরিয়ে এসে ঝরে পড়তে লাগল তার হাস্কি গলা থেকে: গোলাপ জানে, বকুল জানে
মঞ্জরী আর মুকুল জানে
মোর গগনে কোন ফাগুনে
হেসেছিল কোন সে রাগিণী…

এত আগ্রহ! এ কি নয় নিদ্রাতুরার যাই বলে নিশিডাকে সাড়া দিয়ে ওঠা। আমার তখনই ভীষণ অমঙ্গলময় মনে হয়েছিল।

ফিরে যাওয়ার সময় সব গেল। শুধু হারমোনিয়ামটি গেল না। ওজনে শুধু ওটাই বেশি হয়ে গেল?বিশাল স্কাইব্যাগ ফেলে যাবে, তবু হারমোনিয়ামটি সে ছেড়ে যাবে না কিছুতে। আমি কথা দিলাম, যত তাড়াতাড়ি পারি পাঠিয়ে দেব।

সব গেল। আনক্যারেড লাগেজ হিসেবে গেল না শুধু হারমোনিয়ামটি। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল কেন। স্কাইব্যাগ রেখে, হারমোনিয়ামটা ওকে কেন যে তখনই নিয়ে যেতে দিইনি। তাহলে তো, ২৫ এপ্রিলের ভোররাতে, ৯১ নং ফ্রি-ওয়ে ছেড়ে ১১৩ নং ধরে ওভাবে

সহসা বেঁকে সানফ্রান্সিসকোর দিকে সে স্বামীপুত্রকে টেনে নিয়ে যেত না।

কেন না, এ শুধু গোলাপ জানে, আর বকুল জানে, আমি জানি আর সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স জানে যে, সেই আনক্যারেড হতমানিনী হারমোনিয়ামটি সানফ্রান্সিসকো বিমানবন্দরের এয়ারকার্গোর অন্ধকার গুমঘর থেকে প্রেতিনীর হাতছানি দিয়ে তখন ওকে ডাকছিল।

 

১০ মে।

কাল লিভারমোরে শ্রাদ্ধ। লেদু ফিরে এসেছে।

কত খড়কুটোই যে এই অটুট ধ্বংসস্তুপ থেকে তুলে এনে সে আমাকে মাঝে মাঝে দেখায়। কাল কোথা থেকে পেয়ে একটা ছোট্ট, খুব গরিব কার্ড এনে দেখাল। তাতে লেখা: ডাঃ রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়, সুচরিতে। জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই। গ্রহণ করুন। চিন্ময়ী রায়চৌধুরি। ৭ আগস্ট। ১৯৬৭

তখনও বিয়ে হয়নি আমাদের। কার্ড হাতে পেয়ে বুঝলাম, এটা আসলে ছিল রঞ্জনের কাছে চিনুর একটা নোটিস। যে, আমি আছি। আমি আসছি।

কার্ডটা উল্টে দেখি, পিছনে রঞ্জনের হাতে লেখা: ভাই নদা, আমার…

ব্যস এইটুকু। আর কিছু লেখেনি। ২০ বছর পরে মার্সেদে ওদের বাড়িতে বসে আমি, ভাই নদা আমার উচ্চশিক্ষার্থে এ মহাশ্মশান যাত্রার শেষ কোথায় এভাবে বাক্যটি সম্পূর্ণ করছি দেখি।

১০ মে।

হাইওয়ে ট্রাফিক ট্রেলের ডিউটি অফিসার সার্জেন্ট ববি স্টিলম্যান এসেছিল কালো পোশাকে শোকপ্রকাশ করতে। বয়স হবে ২৪/২৫, দেখতে সিলভেস্টার স্ট্যালোনের মতো। মাথায় বালি রঙের পাতলা চুল যা কপালের দুপাশ থেকে ধনুকাকারে বেঁকে এই বয়সেই পিছন পর্যন্ত ঝরে গেছে। দেখে মনে হয়, শিগ্‌গিরই সবটায় টাক পড়ে যাবে। বৌ বলে যার পরিচয় দিল সেও রীতিমতো ঢ্যাঙা, শরীরে-স্বাস্থ্যে তাকে একটি মেয়ে-রোবো বললেই হয়।

ববি বলল, অ্যাক্সিডেন্ট রিপোর্ট পাওয়া গেছে। গাড়ি চালাচ্ছিল সুমিতা। গোলাকার লাল মাথাভর্তি কালো কালো তিল চুলকে সে আমাকে নানাদিক থেকে সান্ত্বনা দেয়। যেমন, যাক, ছেলেটা তো বেঁচে গেছে। তোমার মেয়ের তো যাওয়ার কথা ছিল ওদের সঙ্গে, তাইনা? ইত্যাদি। কুকুতে নীল চোখ থেকে স্টিল ফ্রেমের শৌখিন প্যাশনে খুলে এই ববিই আমাকে শেষ পর্যন্ত ভৌত-বিজ্ঞানের এক পরমাশ্চর্য খবর জানাল। যেভাবে মুহূর্তে দপ্ করে জ্বলে উঠেছিল, সে বলল, তাতে গাড়ির ভেতরে অক্সিজেন ২ থেকে ৩ সেকেন্ডের মধ্যে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হওয়ার কথা। এদিক থেকে মৃতরা দগ্ধযন্ত্রণা ভোগ করেনি বললেই হয়। তার আগেই অক্সিজেনের অভাবে তারা মরে গেছে।

ইট ওয়জ মিয়ারলি দ্য কর্পসসেস দ্যাট দা ফায়ার কুড বার্ন– সে এভাবে আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে।

বিদায় দিতে গিয়ে দরজা বন্ধ না করে আমি অপসৃয়মাণ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওরা এসেছিল একটা লম্বাটে কালো পুরনো মডেল ভ্যান গাড়িতে চেপে। অবিকল হিন্দুসকার সমিতির গাড়ি।

১০ মে।

২৮৫৬ হোয়াইট গেট ড্রাইভে যখন ঢুকি, মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বাড়ির প্রবেশদ্বারে উৎকীর্ণ রয়েছে ৩৫ শতাব্দী আগেকার সেই ফলক, যাতে লেখা:

মৃত্যুর ডানা তাকেই স্পর্শ করুক
যে নিদ্রাভঙ্গ করবে এই প্রবলপ্রতাপ ফারাও-এর
যিনি এখানে শুয়ে আছেন
অনন্তকালের জন্য…

যা লেখা ছিল টুটানখামেনের সমাধিমন্দিরের প্রধান ফটকের ওপর। ভয় হয়, শৃগাল-দেবতা আনুবিস এ-বাড়ির মধ্যে কোথাও হাঁটু পেতে বসে আছেন।

 ১৬. নিরস্ত্রের যুদ্ধে যাই, শস্ত্র হয় মন

১৬ মে।

আমাদের তিনজনের ফেরার টিকিট কাটা হয়ে গেছে। কনফার্মেশন হলে কাল ১৭ মে আমি আর নন্দিন দেশে ফিরে যাচ্ছি। আজ বিকেলের বাসে আমরা সানফ্রান্সিসকো যাব। লেদু কদিন থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সে ডিজনিল্যান্ড, হলিউড, লাস ভেগাস এ–সব দেখে-টেখে যাবে। লস এঞ্জেলেসে সে থাকবে বেভার্লি হিলস্-এ। পৃথিবীর সবচেয়ে পন্ জায়গা। এক স্কোয়্যার ইঞ্চি জমির দাম কত জানো? প্রশ্নোত্তরে সে জানায়, ২০০০ ডলার!

১১ মে, শনিবার সকালে লিভারমোর মন্দিরে রঞ্জন, সুমিতা আর জীয়নের শ্রাদ্ধ হল। শ্রাদ্ধ করালেন মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রবিচন্দ্রন আয়ার। ওদের তিনজনের ছবির সামনে তামার পাত্রে অ্যাসেস, কুশাসন, কুশের আংটি থেকে কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। ছন্দা, এমনকি, প্লাস্টিকের আম্রপল্লবও টাঙিয়ে দিয়েছিল।

১০০০ ডলার তাকে দিতে হবে এই শর্তে অঞ্জন ন্যাড়া হয়েছে। শ্রাদ্ধের সময় চোদ্দ না হলেও, নবদ্বীপের টিকিধারী বোষ্টম ঈশ্বর ভোলানাথ দেবশর্মন থেকে সাত পুরুষের নাম সে বলল। শ্রাদ্ধে রঞ্জনের ধুতি-পাঞ্জাবি আর চটি পরে আমাকে যেতে হয়। ছন্দার নির্দেশমতো শ্ৰাদ্ধান্তে চটি থেকে পা খুলে আমি অঞ্জনের সামনে দাঁড়াই। সে পায়ে হাত দিয়ে আমাকে নমস্কার করল না। উল্টে হোমের ধোঁয়ায় রক্তাভ চোখ তুলে বলল, আস্ক জেফ কোনিগ টু পে মি ওয়ন থাউজান্ড ডলার্স টো-মোরো।

জেফ দাঁড়িয়েছিল পাশেই। সে হাসতে হাসতে তখুনি তাকে একটা চেক লিখে দেয়।

লাঞ্চের প্লেট হাতে জেফ আমাকে একান্তে ডেকে বলল, আজ রাতে মার্সেদের বাড়িতে মিটিং। আমার লিস্ট অনুযায়ী সে রঞ্জনের বন্ধদের আজকের মিটিংয়ে আসতে বলেছে। আজ রাতটা হোটেলে কাটিয়ে ওরা সকালে যে যার জায়গায় ফিরে যাবে। আজ রাতেই ওর গার্জেন এবং সম্পত্তির অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ঠিক করতে হবে। এই বিশাল সম্পত্তি, আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ডেও যাবিশাল, এভাবে বেওয়ারিশ পড়ে থাকতে দেওয়া আর উচিত হবেনা। সোমবার কোর্ট খুললেই পিটিশন করতে হবে।

নট দ্যাট, আই অ্যাম পুশিং। জেফ বলল, তুমি আমাকে গার্জেন করতে পার। ডাঃ চ্যাটার্জি কনসিডার্ড মি ট্রাস্ট-ওয়ার্দি ফর দা লাস্ট টেন ইয়ার্স।

আমি বললাম, ধন্যবাদ জেফ। তুমি অনেক করেছ। আমাদের চ্যাটার্জি-পরিবারকৃতজ্ঞ তোমার কাছে। কিন্তু গার্জেন আমি ঠিক করে রেখেছি।

শুধু জেফ কেন, অনেকেই আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে একই কথা বলল। সবাই জেনে গেছে যে, আমি ফিরে যাচ্ছি। বেশ কয়েকজন রেকমেন্ড করল ধূর্জটি পালিতকে। ধূর্জটি মিটিং-এ আসছে রীতিমতো একটি লবি নিয়ে। প্রায় সকলেই এই পিতৃমাতৃহারা অনাথের দ্বিতীয় পিতামাতা হতে আগ্রহী। শুধু ছন্দা আর অমিয় কিছু বলল না।

ফেরার পথে জেফ-এর গাড়িতে আমি আর অঞ্জন। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে বলে আর কারুকে গাড়িতে উঠতে দিইনি।

অঞ্জন বাংলায় বলল, বলো।

আজ তোমার গার্জেন ঠিক হবে।

আমি জানি।

তোমার কাকে পছন্দ।

আই লাইক হ্যারি কেলার।

ন্যান্সির বাবা?

হ্যাঁ মাইল পাঁচেক চুপ করে থেকে আমি বললাম, বাট আই ডু নট লাইক হিম।

হু আর ইউ?

ইন দ্যাট কেস, আমি অ্যাম নট লিভিং ইউ. এস. এ। আমি তোমার গার্জেন হয়ে থাকব।

তুমি তোমার মেয়ের জন্যে এসেছ। মেয়েকে নিয়ে যাও। আমি যদি একা থাকতাম, তুমি কি আসতে?

আমি আমার ভাই-এর, ভ্রাতৃবধূর এবং ভাইপোর ফিউনারালে এসেছি।

আমি ইন্ডিয়ান গার্জেন বালোবাসি না। ও আবার বাংলায় বলল। তারপর বলল, আই হেট ইন্ডিয়ান বেগার্স।

একটা চড় মারার জন্যে আমার হাত উঠে গিয়েছিল। তখন যে মারিনি এটা ওর বরাত।

রাতের মিটিং-এ আমি রঞ্জনের বেলুড় রামকৃষ্ণ মিশনের বন্ধু চুনীলাল রায়ের নাম প্রস্তাব করলাম। হ্যারিকেমিটিং-এ ডাকিইনি। চুনী বৌ সুজিকে ফোন করে তার অনুমতি নিল। তারপর আমার হাত দুটো ধরে বলল, দাদা, এত বড় গুরুভার…

তুমি ছাড়া আমি ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম, রুনুর ছেলেকে আর কার হাতে তুলে দিয়ে যাব চুনী? তুমিই বলো, কাকে।

মিটিং-এর পর রঞ্জনের সেলার খোলা হল। নিজে মদ খেত না। কিন্তু পৃথিবীর সেরা পানীয় ওখানে থরে থরে সাজিয়ে রেখে গেছে। চুনী ওখান থেকে গ্লেন ফিডডিশের একটা বড় বোতল নামাল।

অনেক রাত অবধি রঞ্জন-সুমিতাকে নিয়ে মজার মজার গল্প হল। সবাই কিছু না কিছু বলল। চুনী বলল, লন্ডনে থাকতে, বুঝলেন দাদা,সুজিকে ভালবাসতাম আমরা দুজনেই। সুজি অনেকদিন মন ঠিক করতে পারেনি। দুজনের সঙ্গেই ডেট করত। তারপর একদিন বিকেল বেলা, সাইকেল নিয়ে আমরা তিনজনে একটা নদীর ধারে বেড়াতে গেছি। ফাগুন মাস। বুঝলেন দাদা। যতদূর দুচোখ যায় শুধু চেরি, চেরি, চেরি… শুধু চেরির ক্ষেত। বুঝলেন দাদা। কেউ কোত্থাও নেই। আমি আর সুজি একটা উত্নাই বেয়ে তরতরিয়ে অনেকটা নেমে গেছি, এমন সময় সেই ফাঁকা মাঠে, সেই বিশাল চেরি-ক্ষেতের মাঝখানে, বেশ চেঁচিয়ে, বুঝলেন দাদা, সুজি আমাকে প্রপোজ করল। ব্যস, আর কথা নেই। সাইকেলের মুখ ঘুরিয়ে চড়াই ভেঙে উঠে এসে আমি রঞ্জনকে বললাম, তখন দারুণ হাঁফাচ্ছি, সুজিঃ, সুজিঃ, সুজিঃ, আমাকে প্রপোহোজ করেছে। কীঃ বহলব, তুই বহল। একটু জেলাস হয়নি। বুঝলেন দাদা। হি হ্যাড আ লার্জ হার্ট–মাচ মাচ লার্জার দ্যান মাইন…

চুনী খুব তাড়াতাড়ি ড্রাঙ্ক হয়ে পড়ল।

বাড়ির পিছনের মাঠে যাওয়ার দরজা দিয়ে বেরিয়ে সবাই যখন একে একে গাড়িতে উঠল, তখন রাত কত তা জানি না। এখানে এসে এই প্রথম আমি মদ খেয়েছি। বেশ নেশা হয়েছে আমার। আমি মাঠের শেষে সাদা কাঠের বেড়া পর্যন্ত হেঁটে গেলাম। আজ বেশ শীত। হিম পড়ছে। আল কাপিতানের পিছনে আজ পূর্ণিমার চাঁদ। গোটা সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা ঝকঝক করছে।

তারপর একখণ্ড ঘন কালো মেঘ এসে চাঁদের প্রায় সবটা ঢেকে দিল। সরে যেতে সময় নিল অনেকক্ষণ।

শোওয়ার আগে নন্দিন আমাকে বলল, এক হাজার ডলার নিয়ে অঞ্জন রিনো নেভাদায় গেছে। এখনও ফেরেনি।

সেখানে কী হয়?

সে একটা ছোটখাটো লাস ভেগাসের মতো। সমুদ্রের ধারে। সেখানে সারারাত জুয়ো খেলা হয়।

কত দূর এখান থেকে?

তা একশো মাইল তো হবেই।

ফিরবে কী করে?

বন্ধুদের সঙ্গে পোর্সাটা নিয়ে গেছে। পোর্সাতে এক ঘণ্টার ড্রাইভ। বন্ধুদের সঙ্গে ফিরবে। যেন এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছু হয় না। এমনভাবে নন্দিন বলল, ন্যান্সি ভাল ড্রাইভ করে।

১৬ মে।

ভোর রাতে রাস্তার দিকের গ্লাস প্যানেলে টোকা।

নন্দিন, ওপেন দা গ্যারাজ।

ওই, অঞ্জন এসেছে। নন্দিন ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল, আজকাল এইরকম রাত করে বাড়ি ফিরত। আমি গ্যারাজ খুলে দিতাম। কাকিমা সব জানত। ছোটকাকাকে বলতে বারণ করেছিল। বলতে বলতে সে সুইচ বোর্ডের একটা বোতাম টেপে। ঘড়ঘড় করে বাইরে গ্যারাজের শাটার ওঠার শব্দ।

দরজা খুলে আমি করিডোরের মুখে গিয়ে দাঁড়াই।

অঞ্জন?

কী। বলো।

কোথায় গিয়েছিলে?

রিনো নেভাদা।

কেন?

গ্যাম্বলিং। হোয়াই?

তোমার সঙ্গে কথা আছে। বসো এখানে।

হোয়াই?

তুমি জুয়ো খেলতে গেলে, টাকা কোথায় পেলে?

বাবার পেজে ঘড়ি উল্টে ও বলল, আমরা তোমাদের মতো গরিব নই।

আমার নেশা না কমে ভীষণভাবে বেড়ে গেছে। মাথা টলে যাচ্ছে মাঝে মাঝে।

শোনো। তোমার বাবার ক্লাসমেট চুনীলাল রায় তোমার গার্জেন হয়েছেন।

চলে যাচ্ছিল। নিজের ঘরের দরজা পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। আমার কথা শুনে ফিরে এল।

আমার মুখে প্রায় মুখ ঘষে জানতে চাইল, অ্যান্ড হু আর ইউ টু ডিসাইড দ্যাট?

আমি তোমার ন্যাচারাল গার্জেন। বিয়িং নিয়ারেস্ট কিন টু ইওর ফাদার।

আই হ্যাভ নো রিলেশানস ইন ইন্ডিয়া। নাইদার ড় আই নিড অ্যান ইন্ডিয়ান গার্জেন, মাটিতে পদাঘাত করে ও বলল, আই হেট ইন্ডিয়ানস। আই হেট বেগার্স।

বাট ইওর পেরেন্টস ওয়্যার ইন্ডিয়ানস।

দ্যাটস হোয়াই আই হেট দেম অলসো। আই হেট মাইসেলফ বিকজ আই হ্যাভ অ্যান ইন্ডিয়ান বডি। দিস ইন্ডিয়ান শিট! বলে নিজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কাঁপিয়ে ও একটা বাতকর্মের শব্দ করে।

আমার পা দুটো ঠকঠক করে কাঁপতে শুরু করেছে। শেকড় থেকে গাছের পাতায় যেভাবে মাটির রস উঠে আসে, সেভাবে পায়ের পাতা থেকে লক্ষ লক্ষ কোষের সঙ্কোচন ও প্রসারণ পদ্ধতিতে আমার মাথায় রাগ উঠে আসছে। দশতলা থেকে লাফাবার আগে আত্মহত্যাকামী যেভাবে না-না, আমি লাফাবনা ভাবতে ভাবতে তবু লাফায়, সেভাবে ওর গালে একটা সপাটে চড় মারব বলে… চেঁচামেচি শুনে লেদু ওর ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ওর খুনি চোখমুখ দেখে

নন্দিন এই সময় বলে ওঠে, বাবা, তুমি চলে এসো।

শাট আপ, ইউ বিচ!–অঞ্জন।

মাথার মধ্যে এক মুহূর্তের লোডশেডিং। আলো জ্বলে উঠলে দেখলাম, আমার শক্তিসর্বস্ব দিয়ে ওর গালে আমি একটা থাপ্পড় মেরেছি।

টাচ মি ওয়ন্স এগেন, অ্যান্ড ইউ ডাই।

নন্দিন চিৎকার করে ছুটে এল আমাদের মাঝখানে। কিন্তু ততক্ষণে ওর গালে আর-একটা থাপ্পড় আমার মারা হয়ে গেছে।

সর তুই, ভাগ! ওকে ঠেলে মাটিতে ফেলে দিয়ে শুয়োরের বাচ্চাকে আমি আজ দেখে নেব বলতে বলতে চুলের মুঠি ধরে আমি ওকে কাছে টেনে আনি। মেঝে থেকে রঞ্জনের চটি খুলে আমি ওকে পেটাতে থাকি। বাঞ্চেৎ ছেলে! মারা আমি থামাতে পারি না, বাপ-মাকে পুড়িয়ে এসে শালা তুমি পার্টিতে যাও? আমি অনেক সহ্য করেছি—আজ তোর বাঁদরামি আমি ঘোচাব…

মারতে মারতে আমি ওকে মাঠে নিয়ে যাই। মারা আমি থামাতে পারি না। যত মারি, মারার প্রবণতা তত বেড়ে যায়।

 

১৬ মে।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জেফ-এর ফোন।

অঞ্জন কোথায়?

বাড়ি নেই।

তুমি করেছ কী। ক্যালিফোর্নিয়ার আইনে মাইনরকে মারা গুরুতর অপরাধ। এখানে মাইনরকে বাড়িতে একা রেখে গেলে শাস্তি হয়। এভরি মাইনর হিয়ার, হু ইজ অ্যান আমেরিকান সিটিজেন, তার টু গার্ডিয়ান হল ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা। সরি টু সে, তোমাকে কিছুদিন মার্সে কাউন্টি জেলে থেকে যেতে হতে পারে।

এ আমি কী করলাম। রঞ্জনের বন্ধুরা সকলেই মার্সেদ ছেড়ে চলে গেছে এক চুনী ছাড়া। ছন্দাঅমিয়ও নেই। এখন কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারে না।

মাথার চুল দুহাতে টেনে ধরে আমি মেঝের ওপর বসে পড়ি। কাল সোমবার ১৭ মে সকাল ১০টায় আমাদের কোর্টে গিয়ে পিটিশন দেওয়ার কথা। লিভিং রুমে উকিল এসে কাগজপত্র ঠিকঠাক করছে।

সকাল ১০টায় পুলিস আমাকে কোর্টে হাজির করল।

রবিবার সারাদিন অঞ্জন বাড়িতে এল না। শুনলাম হ্যারিদের বাড়িতে আছে। সে ফোনে আমাকে যাচ্ছেতাই গালাগালি করল। পুলিস আমাকে ঠিক অ্যারেস্ট করল না। তবে প্রচুর থমকে গেল। সোমবার সকাল ১০টায় জাজের সঙ্গে মার্সের্স কোর্টে দেখা করতে বলে গেল।

জাজ ওয়াল্টার গার্ডনার রঞ্জনের টেনিস কোর্টের বন্ধু। আদালত কক্ষে নয়, তিনি আমার সঙ্গে দেখা করলেন তাঁর চেম্বারে। আমার সঙ্গে গেল জেফ, আমার উকিল জন ব্রিড আর চুনী। লেদু ভয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে।

একজন বিচারপতি যে এত সুপুরুষ, সজ্জন, মৃদুভাষী আর স্বর্ণকেশ হতে পারেন, এটা ছিল কল্পনাতীত। দেখতেও রোগা ছিপছিপে প্রেমিক-পুরুষের মতন। একটা ডাভ-গ্রে থ্রি-পিস স্যুট পরে উনি কফি খাচ্ছিলেন। আমাদের জন্যে কফি আনতে বললেন। কেউ আমাকে বলেনি, উনি কিছু বলার আগেই আমি মাথা নিচু করে নিজের থেকে ক্ষমা চাই। বিচারপতি স্মিতচক্ষে হেসে বললেন, আই অ্যাপ্রিসিয়েট ইওর কনসার্ন ফর ইওর নেফিউ। এত দুরে এভাবে, আত্মীয়স্বজনের মধ্যে তো শুধু তুমিই এসেছ। অ্যান্ড আই নো হোয়াই। তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি তবে আমার মনে হয় গার্জেন ঠিক করে দিয়ে তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরে যাও। ফিউনারাল এক্সপেন্স থেকে তোমাদের তিনজনের টিকিট কেটে দেওয়ার নির্দেশ আমি দিচ্ছি। কোনও শাস্তি আমি তোমাকে দিচ্ছি না। তুমি কোনও দোষ করোনি।

বেলা বারোটার মধ্যে গার্জেন-অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে চুনী শপথ নিল। সে কিছুদিন এখানে থাকবে। দেনা-পাওনা মিটিয়ে সে অঞ্জনকে এখন তার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখবে। ওর মতে, সবার আগে দরকার অঞ্জনকে একজন ভাল সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো, ও আমাকে বলল।

১৭. দূরবীনের উল্টোদিক

এই দেখুন, সানফ্রান্সিসকো!

সানফ্রান্সিসকোর ডাক নাম ফ্রিসকো। মার্সেদ থেকে পাক্কা ১২০ মাইল। গতকাল সন্ধে সাড়ে ৮টা নাগাদ গ্রে-লাইন বাসে আমি, লেদু তার নন্দিন ফ্রিসকো এসে পৌঁছেছি। টার্মিনালে ছন্দাদের বন্ধু মহীতোষ সান্যাল দাঁড়িয়েছিল। হাতে চ্যাটার্জি লেখা পোস্টার।

জ্যাপান এয়ারলাইন্স হংকং পর্যন্ত ওকে টিকিরি কনফার্ম করেছে। হংকং থেকে আপনাদের এয়ার ইন্ডিয়া ধরতে হবে। শ্বেতকেতুর (লেদুর ভাল নাম) টিকিটের পনের দিন এক্সটেনশান হয়েছে। কাল সকাল আটটায় এয়ার লাইন্সের বাস আসবে। এত খবর একসঙ্গে দিয়ে মহীতোষ জানাল, সব ব্যবস্থা ছন্দাদিই করেছেন।

গতকাল ৬টা নাগাদ যখন বাস ছাড়ল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মডেস্টো থেকে ওকল্যান্ড পর্যন্ত ঘণ্টাখানেক বেশ আলো ছিল। টানা ফ্রিসকো পর্যন্ত এক্সপ্রেস হাইওয়ে বাস, ওকল্যান্ড পেরিয়ে, একটা ছোটখাটো স্ন্যাক বারের সামনে একবার যা মিনিট পাঁচেক দাঁড়াল। আমরা বাস থেকে নামিনি। এয়ার-কন্ডিশানড বাসের নস্যি-রঙা কাচের মধ্যে দিয়ে একটা সাদা গির্জার পিছনে পাঁচ মিনিট ধরে জীবনের শ্রেষ্ঠ সূর্যাস্ত দেখলাম। দেখলাম, গির্জা-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে নীল পপিফুলের ক্ষেত। তার মধ্যে দিয়ে বাসের দিকে হন্তদন্ত, দ্রুত এগিয়ে আসছেন কালো জোব্বা পরা পুরোহিত। তাঁকে ভনভন করে হেঁকে ধরেছে একরাশ প্রজাপতি। বিরক্ত হাত নেড়ে প্রজাপতি তাড়াতে তাড়াতে তিনি ছুটতে শুরু করলেন। তাঁর গলায় দুলছে ক্ৰশ। ঠিক মাথার পিছনে বৃত্তাকার সূর্য।

ফ্রিসকোর আগে একের-পর-এক সমুদ্র-সেতু পেরতে পেরতে ব্রিজের নিচে প্যাসিফিকের নীল জল ক্রমে কালো হয়ে এল। যেতে যেতে, যেন যুগান্ত পেরিয়ে, একটা সামান্য ঘটনা আমার মনে পড়ে গেল। মানুষের কী যে মনে থাকে। আর কী যে সে ভুলে যায়!

ঠিক কোন বছর মনে নেই, ১৪/১৫ বছর আগে তো হবেই। কোনও এক নবমীর দিন, খুব ভোরবেলায় সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে বিবেকানন্দ পার্কের বাসস্টপে আমি এল নাইনের জন্যে একা দাঁড়িয়ে। আগের দিন বন্ধু অজিত হালদারের বাড়িতে এত মাতাল হয়ে পড়ি যে, রাতে থেকে যেতে হয়। ভোরের প্রথম বাসে বাড়ি ফিরব।

সারারাত খুব ঝড়বৃষ্টি। হঠাৎ দেখি, ভিজে ফুটপাথ ধরে একটা শালিক-ছানা আমার দিকে হেঁটে আসছে।

হয় ডানা ভেঙেছে, নয়ত, আহারে, এখনও উড়তে শেখেনি। আমি তাড়াতাড়ি সেটাকে হাতে তুলে নিতে-না-নিতে বাসও এসে পড়ে এবং আমি বাসে উঠে পড়ি।

টিকিট? আমার তালুর ওপর ভিজে পাখিটার দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে কন্ডাক্টর বলল, এটাকে নিয়ে উঠেছেন কেন?

তার সমর্থন পাব এমনটাই নিশ্চিত জেনে আমি বললাম, দেখুন, এটা ঝড়ে রাস্তায়…

অ্যানিম্যাল নিয়ে বাসে ওঠার নিয়ম নেই। আপনি নেমে যান।

কিন্তু দেখুন, কাচুমাচু হয়ে আমি বলি, এটা অ্যানিম্যাল না। পাখির ছানা একটা। ঝড়ে…

আপনি নেক্সট স্টপে নেমে যান! বলে আমাকে স্তম্ভিত করে সে ঘণ্টা মারে। বিদীর্ণ, বিস্ফারিত চোখে আমি যাত্রীদের দিকে তাকাই। ভোরের প্রথম বাসে দুধের ডিপোর মেয়ে, কারখানার প্রথম শিফটের শ্রমিক, বাজারের ফড়ে-যাত্রী বলতে কজন বা। বোধহয় তখন নকশাল আমল বলেই কেউ আমার সমর্থনে একটা কথাও বলল না। আমি একবার ভাবলাম, সে কি আমাকে এ কথা বলছে, না, আমার উচ্ছন্ন চেহারা, আমার শ্যাবি ধুতি-পাঞ্জাবিকে?নাকি, পোর্ট কমিশনারের মোহরমারা কেরানিকে সে চিনে ফেলেছে? পাঞ্জাবির কোঁচকানো প্রান্ত হাত দিয়ে মসৃণ করতে করতে আমি আবার বলি, দেখুন, এ এখনও উড়তে শেখেনি।

বাস রসা রোড স্টপে দাঁড়াল।

কফি হাউসে, আমার মুখে গল্পটা এই পর্যন্ত শুনে তরুণ কবি দেবপ্রসাদ সহাস্যে জানতে চেয়েছিল, তখন আপনি কী করলেন? নিশ্চয়ই উড়িয়ে দিলেন পাখিটা?

সানফ্রান্সিসকো ঢোকার আগে শেষ সমুদ্র-সেতু সান মাটি ও ব্রিজের নিচে কালো জলস্রোত আমাকে প্রশ্ন করে, তুমি কার জন্যে এভাবে উন্মাদের মতো ছুটে এসেছ? তোমার মেয়ে না ভাইপো?যদি তোমার মেয়ে এখানে না থাকত…

পাখির ছানাটাকে জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ার আগে (ফুটপাথের ওপর মুখ থুবড়ে পড়েছিল) সে আঁচড়ে দিয়েছিল আমার হাতের তালু। অঞ্জনের প্রখরতর প্রশ্ন এখন তার বাঘ-নখে আমার সারা বুক আঁচড়ে রক্ত ঝরায়।

 

৭টায় ভোর। মুখটুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি, সক্কালবেলায় একটা মেশিন চালিয়ে দিয়ে তার ওপর উঠে মহীতোষ মর্নিং ওয়াক করছে। পায়ের নিচে দিয়ে দ্রুত সরে যাচ্ছে একটা লোহার রাস্তা। সে একটা হ্যান্ডেল ধরে, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, তার ওপর দৌড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেখে মহীতোষ মেশিন বন্ধ করল। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে গ্লাস-প্যানেল থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়ে বলল, ওই দেখুন, সানফ্রান্সিসকো!

ওই দেখুন, গোল্ডেন গেট ব্রিজ, মহীতোষ তখনও হাঁফাচ্ছে, ওই যে বনটা দেখেছেন ওটা গোল্ডেন গেট পার্ক। ও-দিকে ফিশারমেন্স হোয়াফ। সুন্দর জায়গা। জ্যাপান টাউন। চায়না টাউন। ঘিরাডেল্লি স্কোয়্যার। ওই যে ক্রুকেড স্ট্রিট। একের পর এক রঙিন পিকচার পোস্টকার্ড ফেলতে থাকে সে, ওই যে দূরে, সমুদ্রের মধ্যে আলকাট্রজ দ্বীপ। একসময় ডাকসাইটে বন্দীরা থাকত। এখন ট্যুরিস্ট স্পট। মহীতোষ অনুযোগ করল, আপনারা তো থাকলেন না। শ্বেতকেতুকে সব দেখিয়ে দেব।

যেন ওগুলো সব দেখা হয়ে গেল, লেদু ল্যাজ নাড়িয়ে বলে রাখে, আমাকে লাস ভেগাস দেখাতে হবে কাকু!

ওই দেখুন, সানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্ট। ওই যে ট্রান্স আমেরিকান পিরামিড বিল্ডিং। রাতে দেখলে ইনক্রেডি মনে হবে।

মহীতোষের বাড়ি এক ছোটখাটো পাহাড়ের ওপর। এখান থেকে আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল পাহাড় ও সমুদ্র দিয়ে ঘেরা ফ্রিসকোকে সত্যিই স্বর্গের রাজধানীর মতন দেখায়। পৃথিবীর তিনভাগ জল এসে তার পা ধুইয়ে দিচ্ছে। নিচে, রৌদ্রস্নাতদূর বিমানবন্দরে, আমাদের বেনেটোলার বাড়ির গোল বারান্দা থেকে ছাড়া একটা কাগজের প্লেন ভাসতে ভাসতে ঘুরে-ঘুরে নামছে।

মানুষের কখন যে কী মনে পড়ে যায়। কেন যে! আমি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা মহীতোষ, আল কাপিতান এখান থেকে দেখা যায় না?

আল কাপিতান? সে তো অনেক দূর! কেন ওদের বাড়ি থেকে দেখেননি? ওখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। ইনফ্যাক্ট, ট্যুরিস্ট গাইডে মার্সেদের নামই তো আপনার গেটওয়ে টু আল কাপিতান।

না, মানে, তোমার এখান থেকে… আহা। পাওয়ারফুল বায়নাকুলার দিয়ে এখান থেকেও দেখা যায়। আমার আছেও একটা, মহীতোষ বলল, দেখবেন?

মহীতোষ আমাকে দোতলার ব্যালকনিতে নিয়ে গেল। আমার হাতে একটা ফুট দেড়েক লম্বা বায়নাকুলার ধরিয়ে দিয়ে বলল, ওই দিকে খুঁজুন। দেখতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ। ওই যে। আজ বরফ পড়েছে নাকি!

বরফ? হ্যাঁ, তা পড়তে পারে। আপনি কিন্তু তাড়াতাড়ি নিচে আসবেন। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি। বাস আসতেও দেরি নেই।

ক্যালিফোর্নিয়ার গোটা পূর্ব সীমানা জুড়ে রেড ইন্ডিয়ান ঈশ্বরের নিজের হাতে তোলা উঁচু পাঁচিল: সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা। তার মাঝখানে আল কাপিতান। একখণ্ড সাদা গ্রানাইট দিয়ে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু সমাধিফলক। এখান থেকে শুধু তার সমতল চূড়াটি দেখা যায়। আজ, এই প্রথম কাপিতানের মাথায় বরফ।

কিন্তু… আমি কি ভুল দেখলাম? বরফে-ঢাকা আল কাপিতানের মাথায় আমি পলকের জন্য একবার দেখতে পেলাম একটি কালো হারমোনিয়াম। পর মুহূর্তে, অনন্ত শুভ্রতার ঢাল বেয়ে, উল্টে-পাল্টে সেটা নিচের দিকে গড়িয়ে এল। মাত্র একবার আমি স্পষ্ট দেখলাম। তারপর আর দেখা গেল না।

আমি কিদূরবীনের ভুল দিকটা দিয়ে দেখছিলাম?

 

বাবা, বাস এসে গেছে। কী করছ তুমি! শিগগির নেমে এসো।

আসুক বাস। জিনিসপত্র বলতে তো সঙ্গে কিছু নেই। শুধু উঠে পড়া। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে নামতে নামতে আমি ভাবলাম, না, দূরবীন নয়। এ আমার চোখেরই ভুল। তৃষিত মানুষ মরীচিকা দেখে। আমি দেখেছি সমাধি ফলকের মাথায় সুরযন্ত্র। এ হতেই পারে।

Exit mobile version