নিস্তব্ধতা। লেদু নিরুত্তর।
জু পেরিয়ে ট্যাক্সি পোলে ওঠার জন্যে গিয়ার বদলাচ্ছে। হিরণ বেশ স্পষ্ট ভাষায় এতক্ষণ পরে শেষ করল বাক্যটি, নাকি, তোর আরও কিছু বলার আছে?
এ যাবৎ বাড়িতে হিরণকে একান্তে ডেকে লেদু যা জানিয়েছে এবং যে বিষয়ে জ্ঞাত হওয়ার বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশ করার সাহস চিনুর এখনও হয়নি, তা হল, একটা কার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। রঞ্জন ও সুমিতা, প্রথমে সে বলেছিল হাসপাতালে, পরে স্বীকার করেছে, মারা গেছে। সানফ্রান্সিসকো থেকে ভাইস কনসাল ফোন করে শুধু এটুকু জানিয়েছেন। আর কোনও খবর নেই। ওরা আবার ফোন করবে বলেছে।
কিন্তু, গাড়িতে আর কেউ ছিল কি? ওদের ছেলে দুটো জীয়ন আর অঞ্জন, বা, বা, নন্দিন? হিরণ এখন সেই দিকে ইঙ্গিত করছে।
বললাম তো তোমাকে, ড্রাইভারের পাশের সিট থেকে পিছন ফিরে, প্রথমে চোখ নামিয়ে, তারপর উইন্ডস্ক্রিনের ভেতর দিয়ে ভিক্টোরিয়ার আবছা গম্বুজের দিকে ঘাড় শক্ত করে থেকে লেদু বলল, আমি এর বেশি কিছু জানি না।
সল্টলেকে পৌঁছে লেদুদের বাড়ি থেকে প্রথমেই মার্সেদে একটা আর্জেন্ট কল বুক করল হিরণ। রিসিভার রাখতে না রাখতে সঙ্গে সঙ্গে ফোন বেজে উঠল। এত তাড়াতাড়ি! না, তা নয়।
হ্যালো, থ্রি সেভেন টু সিক্স ডাবল ওয়ান?
ইয়েস। ইয়েস।
আ পি পি কল ফ্রম ইউ. এস. এ. ফর মিঃ হিরণ চ্যাটার্জি।
স্পিকিং প্লিজ।
প্লিজ, হোল্ড অন।
সেই পি-পি-পি-পি। অতলান্তিকের হু-হু হাওয়া। হাহাকার জটিল স্থান ও কালের দুস্তর ব্যবধানের।
ম্পিক হিয়ার প্লিজ।
হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো…
উত্তর নেই।
স্পিক হিয়ার প্লিজ। ইউ আর অন দ্য লাইন।
হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো
সাড়া নেই।
শুধু হাওয়ার হাহাকার। আছাড়।
প্লিজ হোল্ড অন। আই অ্যাম ট্রায়িং টু কানেক্ট।
হ্যালো…হ্যালো… পি-পি-পি-পি।
হঠাৎ, সময়ের সোঁ-সোঁ সাঁতরে, পৃথিবীর তিনভাগ জলের ওপার থেকে ভেসে এল নন্দিনের তীক্ষ্ণ চিৎকার, এবং, তাও মাত্র একটিবার।
হ্যালো, বাবা? পি-পি-পি-পি।
হ্যালো, কে নন্দিন? কথা বল!
উত্তর নেই।
হ্যাঁ। যা ভাবতে পারে না বলে ভাবতে চায়নি হিরণ, তবে তাই। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পার হওয়ার সময় বেশ প্রাঞ্জলভাবেই তো বলেছিল লেদু, যখন হিরণ জানতে চেয়েছিল, রঞ্জন-সুমিতার মৃত্যু ছাড়া তার আরও কিছু বলার আছে কি না, যে, ওই তো বললাম তোমাকে। অর্থাৎ, যথেষ্ট বলেছি, আর কী বলব? এখন যা বোঝার বুঝে নাও হে ভ্রংশবৃদ্ধি, শেষ পর্যন্ত তোমার সর্বনাশ হলই, তমি আর ঠেকাতে পারলে না! ঘাড় শক্ত রেখে সে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে, যখন সে ওইনা-বলা কথাগুলো বলে। উইন্ডস্ক্রিনের ওপারে আদিম বৃষ্টিধারায় গা ধুয়ে তখন ঘোর অন্ধকারে ভেসে উঠছিল ভিক্টোরিয়ার সাদা গম্বুজ।
অ্যাক্সিডেন্টে মরলে মানুষ নাকি প্রেত হয়? হ্যাঁ, নিঃসন্দেহেনন্দিনের প্রেতাত্মাই ও-ভাবে কে বাবা? বলে চিৎকার করে উঠেছে, যা প্রকৃত প্রস্তাবে ছিল স্থান ও সময়ের শতশৃঙ্খল ভেঙে পড়ার খান খান শব্দ। আহা, একবারের বেশি সে পারেনি।
তার, নন্দিনের, প্রেতকণ্ঠ আরও কিছু বলবে কিনা শোনার জন্যে সে রিসিভারটা কানে চেপে রাখে। ভূমিকম্পের সময় যেমন মানুষ বুঝতে পারে না যে সে কাঁপছে না মাটি তাকে কাঁপাচ্ছে, সে-ভাবে, এখন তার সর্বাঙ্গ ঠকঠক করে কাঁপছে, বাহ্যত মেঝের ওপর সে অবশবর্তী হাই ফ্রিকোয়েন্সি অণু-লাফে লাফিয়েই চলেছে একটানা—এমনাবস্থাতে সে রিসিভারটি আঁকড়ে আছে অথবা রিসিভারটিই তাকে, তা নির্ণয় করা অসম্ভব।
ওই, অনেক স্তব্ধতা ভেঙে আবার ভেসে আসছে সময়ের সোঁ-সোঁ পেরিয়ে সেই সঙ্কেত-শব্দ পি-পি-পি-পি।
নিঃসন্দেহেনন্দিনের প্রেতকণ্ঠ আরও কিছু বলতে চায়। বাঁ-কান থেকে দ্রুত তুলে ডান কানে সে রিসিভারটি চেপে ধরে থাকে। তার হাতের কাঁপুনি সে যত থামাতে চেষ্টা করে তত বেড়ে যায়।
হ্যালো, বাবা।
কে, নন্দিন?
পি-পি-পি-পি…
হ্যালো, কে নন্দিন। কথা বল কথা বল রে।
হ্যাঁ, আমি নন্দিন।
তুই বেঁচে আছিস?
বাবা, তুমি শুনতে পাচ্ছ?”
খুব ভাল শুনতে পাচ্ছি। তুই কথা বল। বলে যা। কী হয়েছে?
শোনো বাবা। সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার হয়েছে। ছোট কাকা, কাকিমা আর জীয়ন স্পট ডেড। কার অ্যাক্সিডেন্ট। কাল রাত ১০টার সময়। এখান থেকে ৩০ মাইল দূরে। মডেরা শহরের মুখে। বাবা, শুনতে পাচ্ছ?
ওঃ। ইউ ফুল, হিরণ চিৎকার করে উঠল, তুই বলে যা। অঞ্জন কোথায়?
আমরা ওদের সঙ্গে যাইনি। বাড়িতে ছিলাম। ওরা এল-এ থেকে ফিরছিল। পিছন থেকে একটা পিক-আপ ভ্যান ধাক্কা মারে। ড্রাইভার ড্রাঙ্ক ছিল।
অঞ্জনকে ডাক।
ও ঘুমচ্ছে।
ওকে ডাক! হিরণ এবার সেই ভাবে চিৎকার করে ওঠে যা ফোন-বিনাই অতলান্তিক পেরিয়ে পৌঁছতে চায় নন্দিনের কাছে।
হিরণ জানতে চায়, বেঁচে আছে কিনা অঞ্জন। প্রমাণ চায়।
অঞ্জন এসে বোবা গলায় আঁ-আঁ-আঁ করল কয়েকবার। তারপর কোনওমতে জেঠু, প্লিজ, কাম হিয়ার, অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল বলে নন্দিনের হাতে ফোন তুলে দিল।
বাবা, তুমি আমাদের অবস্থা বুঝতে পারছ?
হ্যালো, ক্যালকাটা, ডু ইউ ওয়ান্ট টু কন্টিনিউ?
ইয়েস প্লিজ। আই ডু। প্লিজ, ডোন্ট ডিসকানেক্ট…
তুমি আমাদের অবস্থা বুঝতে পারছ বাবা! আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। এরপর ওদের বডি আসবে। এখানে আমরা শুধু দুজন। আমরা কী করব বাবা? বাবা, আমরা কী করব?