Site icon BnBoi.Com

মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

০১. প্রথম অধিবেশন

পৃথিবীতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের জনহিতকর প্রতিষ্ঠান এসেছে। বিভিন্ন তাদের উদ্দেশ্য। এক সময় পরোপকার পয়সাওয়ালা লোকেদের ফ্যাশানের অঙ্গ ছিল। মানুষের উপকার করতে হবে। গ্যেটে লিখেছিলেন, To give is the business of the rich. এলিট লিখেছিলেন, one must be poor know the luxury of giving. ইতিহাস খুঁজলে অনেক মজার-মজার প্রতিষ্ঠান কত মজার কারণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল জানা যায়, যেমন পঞ্চদশ শতকের weeks charity। এই প্রতিষ্ঠান বিধর্মীদের পুড়িয়ে মারার জন্যে বিনাপয়সায় কাঠ সরবরাহ করতেন। সপ্তদশ শতকে একটি প্রতিষ্ঠানের পাগলামি ছিল, অত্যন্ত অপ্রচলিত একটি ডেনিশ ভাষায় বাইবেলের একটি উপদেশ মুখস্থ করে সারা বছর যিনি ওই প্রচার করবেন তাকে টাকা দিয়ে উৎসাহিত করা। শেষে এমন একদিন এল যেদিন ভাষা বোঝার মতো আর একটি মানুষও রইল না। যাদের একটি পা তাঁদের জুতো দিয়ে সাহায্য করার জন্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, The Benefit Shoe Foundation. ঘোড়াকে বড়দিনে খানা খাওয়াবার জন্যে এসেছিল, A Horses Christmas Dinner Trust Fund. Hat Research Foundation আন্দোলন শুরু করেছিলেন টুপি ছাড়া যেন মাথা না থাকে। ক্যালিফোর্নিয়ার Point Foundation পাঁচ হাজার ডলার দান করেছিলেন গণিকাঁদের একটি ট্রেড ইউনিয়ন করার জন্য। National Lough Week Foundation, Lollipop Foundation og হলেও আছে। এক অমেরিকাতেই বত্রিশ হাজার ছোট-বড় ফাউন্ডেশান আছে। বাগেহট লিখেছেন, The most melancholy of human reflection, perhaps is that, on the whole it is a question whether the benevolence of mankind dose most harm or good.

কলকাতায় পশুক্লেশ নিবারণী সমিতি ছিল। মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতি ছিল না। পশু মানুষের হাতেই নিগৃহীত হতো বেশি সেই কারণেই পশুপ্রেমী কিছু মানুষের প্রাণ কেঁদেছিল। বর্তমানে মানুষের অবস্থা নিগৃহীত পশুর চেয়েও বেদনাদায়ক। মানুষকে মানুষের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে এই সমিতি কবে স্থাপিত হল জানি না। তবে সমিতির বিভিন্ন অধিবেশনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। ডিজনির পরিকল্পনা ছিল কুকুরদের জন্যে Dalmatian Foundation, কার পরিকল্পনা এই মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতি।

.

প্রথম অধিবেশন

আপনারা আমাকে যে গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন সেই দায়িত্বের আমি উপযুক্ত কিনা জানি না।

অতীতে আমি বিপ্লবী ছিলুম, তখন আমার কাজ ছিল ধ্বংসের। বোমা, বন্দুক, সত্যাগ্রহ। আমার বয়েস হয়েছে। এই বয়েসে মন্ত্রী কিংবা প্রধানমন্ত্রী হওয়াই সাজে। বললেই তো আর সাজা যায় না। গদিতে গদিয়ান হতে হলে দল চাই, বল চাই, ছল চাই। শুনেছি ভালো জন হলে ভালো ছেমোছলা কলা শিখতে হয়। সে যাই হোক, এখন কাজের কথায় আসা যাক। বহুঁকাল আগে এই শহরে সি এস পি সি এ নামে প্রতিষ্ঠান ছিল– ক্যালকাটা সোসাইটি ফর প্রিভেনশান অফ ক্রুয়েলটি টু অ্যানিম্যালস। সেই সোসাইটির এখন কি অবস্থা, কি তাদের কাজ আমি জানি না। সারা শহরের এখানে ওখানে এখনও কিছু পরিত্যক্ত মরচে ধরা লোহার জলপাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। এখন তার আর কোনও ফাংশান নেই। অতীতের স্মৃতি মাত্র। ঘোড়া নেই, ঘোড়ায় টানা ট্রাম নেই। জলধারের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। শহরে এখন যে পশুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি তা হল মানুষ। সেই মানুষের ক্লেশ নিবারণের জন্যে আমাদের প্রস্তাব একটি সমিতি স্থাপন, যার নাম হবে, সি এস পি সি এম, ক্যালকাটা সোসাইটি ফর প্রিভেনশান অফ ক্রয়েলটি টু ম্যান। ক্লেশ নিবারণ করতে হলে জানা দরকার, আমাদের কী কী ক্লেশ, কীসে আমরা ক্লিষ্ট। আমি বসছি, সদস্যরা এইবার একে-একে আলোচনা করুন।

মাননীয় সভাপতি, সমবেত পশুগণ, আপনারা জানেন, জানা না থাকলেও জেনে নিন, সারা পৃথিবীতে মানুষ ছাড়া যে-কোনও পশু সম্পর্কে ভয়ানক চিন্তাভাবনা চলছে। বাঘ, সিংহ, গন্ডার, হাতি, হায়না, কুমির, সাপ, পাখি, গিরগিটি প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্যে বিশ্বসংস্থা, প্রাদেশিক সংস্থা, রাষ্ট্রপুঞ্জ জলের মতো অর্থব্যয় করছেন, আইন তৈরি করছেন, কি না করছেন। এদিকে মানুষের ক্লেশ দিন-দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে কলকাতায়। এই শহরে মোস্ট নেগলেকটেড অ্যানিম্যাল হল মানুষ। যেহেতু আমরা দ্বিপদ সেই হেতু আমরা চতুষ্পদদের সুযোগ সুবিধা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। দিন-দিন আমাদের বঞ্চনা বেড়েই চলেছে। অন্যান্য পশুরা জন্মেই স্বাধীন, আমরা কিন্তু জন্মেই পরাধীন। দেহের দাসত্ব, পরিবারের দাসত্ব, সমাজের নামের দাসত্ব, অর্থনীতির দাসত্ব। সবচেয়ে বড় ক্লেশ হল এই দাসত্ব। সেই কবিতার লাইন কটা আমার এখন মনে আসছে।

স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিয়ে চায় রে
কে বাঁচিয়ে চায়।
দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায়
কে পরিবে পায়।

আমাদের যা খুশি আমরা তা করতে পারব না কেন? বাঘ পারে, সিংহ পারে, কুকুর পারে। আমরা দুর্বল, আমরা ভীতু, আমরা অভ্যাসের দাস। কোড অফ কনডাকটের বাইরে গেলেই ছি ছি পড়ে যাবে–লোকটা নরপশু পশ্বাচার। এইটাই হল ফ্যালাসি নাম্বার ওয়ান। সাইকোলজিক্যালি আমাদের মেরে রাখা হয়েছে। আপনারা ফ্রয়েডের নাম শুনেছেন। সাহসী মানুষ, তিনি চ্যালেঞ্জ করে বলেছিলেন–

Most of what we are conscious of is not real and the most of what is real is not in our consciousness.

এখনও জানা গেল না, হোয়াট ইজ রিয়েলি রিয়েল।

আপনাদের কথা আমি জানি না। আপনাদের সামনে আমি নিজেকেই নিজে অ্যানালিসিস করছি। মনে হয় আমার আয়নাতেই আপনাদের চেহারা দেখতে পাবেন। আমার দুটো ভাব, একটা বায়োফিলিয়া। তার মানে লাভ অফ লাইফ। জীবনকে ভালোবাসা। তার অর্থ কিন্তু জীবে প্রেম নয়। জিভে প্রেম। নিজের জীবনকে ভালোবাসা। আমি বাঁচতে চাই, প্রভুত্ব করতে চাই, ভোগ চাই, সুখ চাই, সম্পত্তি চাই, ভালো খেতে চাই, পরতে চাই, অধিকার করতে চাই। অনায়াসে সব কিছু পেতে চাই। আমি একটা homme machine. এসব ব্যাপারে আমি প্রতিযোগিতা পছন্দ করি না, ভাগাভাগির মধ্যে যেতে চাই না। এই দিক থেকে আমি ডুয়েলিস্ট। আমি আর আমার প্রাচুর্যে ভরা পৃথিবী, এর বাইরে সবাই আমার অপরিচিত। কিন্তু ইয়েস, দেয়ার ইজ এ বিগ বাট। আমি তো আর জায়েন্ট নই যে সব কিছু নিজের ক্ষমতায় দখল করে নেব। তাই আমার দুটো দিক, একটা হল হোমো সেকসুয়ালিস, আর একটা হল হোমো ইকনমিকাস।

ফ্রয়েড সায়েবের মডেল অনুসারে আমার মধ্যে দুটো শক্তি কাজ করছে, একটা হল নিজেকে রক্ষা, সেলফ প্রিজারভেটিভ আর একটা প্রজননেচ্ছু, সেকসুয়্যাল ড্রাইভ। আমার এই দুটো ইচ্ছে প্রতিমুহূর্তে খর্বিত, খণ্ডিত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত। সমাজ এর ওপর চেপে বসে আছে, সংসার এর মধ্যে গোঁজামিল ঢুকিয়ে দিয়েছে। কালচার মনের মধ্যে ঢুকে দুটো শুম্ভ নিশুম্ভ তৈরি করেছে–আচার, অনাচার। আমি অসুস্থ, আমি ক্লান্ত, অন্তর্দ্বন্দ্বে খণ্ড-খণ্ড। কোনটা আচার, কোনটা অনাচার বুঝতে গিয়ে জীবনটাই জেবড়ে গেল। আবার সেই ফ্রয়েড :

Society imposes unnecessary hardships on man which are conducive to worse results rather than the expected better ones.

বায়োফিলিয়া থেকে আমার মধ্যে এখন প্রবল হয়ে উঠেছে নেক্রোফিলিয়া। মৃত্যুকেই আমি এখন ভালোবাসতে শুরু করেছি–মরণ রে উঁহু মম শ্যাম সমান। যে অবস্থায় পড়ে মানুষ মৃত্যুকে ভালোবাসতে শেখে সেই অবস্থায় পরিবর্তন প্রয়োজন। এই অবস্থা যাঁরা তৈরি করেছেন তারা কারা? তাঁরা হলেন এক ধরনের পোচার।

কাজিরাঙা ফরেস্টে যে-সব পোচার গণ্ডার মারে তাদের জন্যে কড়া আইন তৈরি হয়েছে। আমাদের যারা মারছে তাদের জন্যে কে কি অবস্থা নিয়েছেন জানতে চাই। সাপ্রেশান, অপ্রেশান। এসব কি অপরাধ নয়? অবশ্যই অপরাধ। কে সেই অপরাধী? সভ্যতা। সভ্যতাই হল রিয়েল অপরাধী। রিয়েল রিয়্যালটি হল, আমি একটা পশু, আমি দেবদূত নই, দেবতা নই। একটা জীবন, একটা জীব।

জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত আমাকে সভ্য করে তোলার জন্যে কম অত্যাচার হয়েছে! কম মগজ ধোলাই দেওয়া হয়েছে আমাকে একটা ক্রীতদাস করে তোলার জন্যে! আমি যদি বাঘ হতুম, গরিলা কি গণ্ডার হতুম, তাহলে কি আমাকে অত সহজে পোষ মানানো যেত? যেত না। ভয়ের ব্যাটারি চার্জ দিয়ে সার্কাসের রিং মাস্টাররা আমাদের বশে রেখেছেন, একটি মাত্র সত্তাই আমাদের জেগে আছে–হোমো ইকনমিকাস। নো ওয়ার্ক, নো পে। নো সাবমিসান, নো প্রেমোসান।

ছেলেবেলায় মা বলতেন, কথা না শুনলে কিছু পাবি না। বাবা বলতেন, উনিশের নামতা মুখস্ত না দিতে পারলে খাওয়া বন্ধ। মুখে-মুখে তর্ক কোরো না, কান ধরে নিলডাউন করিয়ে রেখে দেব, সেইসব দুঃস্বপ্নের দিনের কথা। বাঁদরটাকে মানুষ করার জন্যে জাঁদরেল একজন শিক্ষক চাই। উঠতে বসতে পিটুনিই হল একমাত্র ওষুধ। এই পিঠের ওপর কত কিছুর স্মৃতি চিহ্ন–জুতো, ঝাটা, লাঠি, বেল্ট দাদুর খড়ম। দুটো কানের দুরকম লেংথ। ডান কানটা পণ্ডিতমশাই টেনে-টেনে বাঁ টার চেয়ে এক ইঞ্চি বেশি লম্বা করে দিয়েছেন। এর থেকে আমি একটা সহজ অঙ্ক পেয়েছি, ব্যাকরণ কৌমুদীর একের চার ভাগ আয়ত্ত করতে কান এক ইঞ্চি লম্বা হয়, পুরোটা আয়ত্ত করতে হলে কানের চেহারা আর মানুষের মতো রাখা যায় না, হাতি কিংবা খরগোশের মতো হয়ে যায়।

ভেবে দেখুন ভাই সব সেই অতীতের কথা। শৈশবে আমাদের কেউ মানুষ বলে মনে করতেন কি? এই দেখুন আমার শৈশব পরিচয়ের একটা লিস্ট তৈরি করেছি, বিভিন্ন পশুর সমন্বয়ে আমার শৈশব–গাধা, গরু, বাঁদর, হনুমান, শূকর, উল্লুক, পাঁঠা, সব মিলিয়ে জানোয়ার। একমাত্র অবতারদেরই একই আধারে এত রূপ কল্পনা করা চলে। প্রেমিকের পক্ষেই প্রেমিকার শরীরে এতরূপ দেখে গান গেয়ে ওঠা চলে–একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে। শৈশবের নামরূপেই আমার রূপ প্রকাশিত। ক্ষণে-ক্ষণে বিভিন্ন পশুর পশ্বাচারে জগৎ প্রমাণিত করেছি ম্যান ইজ এ বাইপেড অ্যানিম্যাল উইদাউট এনি উইংস।

এইবার আসা যাক ব্যবহারিক দিকে। কীভাবে সেই মধুর মানব শৈশবে আমি ব্যবহৃত হয়েছি। কখনও ফুটবলের মতো, কখনও চটি-জুতোর মতো, পাপোশের মতো, তবলার মতো, পাখোয়াজের মতো, আবর্জনার মতো। শরীরের ওপর কোনও স্বাধীনতা ছিল না। যিনি যেভাবে পেরেছেন তিনি সেইভাবে ব্যবহার করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন মানুষ জন্মায় না, আদিতে সবাই অকৃত্রিম পশু। শুধুমাত্র নির্বিচার পেটাই আর ধোলাইয়ের সাহায্যেই মানুষ তৈরি হয়।

পৃথিবীতে এখন বর্ষপালনরীতি চালু হয়েছে। এখন চলছে শিশুবর্ষ। শিশু ক্লেশ নিবারণের, শিশু নির্যাতনের নানা কথা শুনতে পাচ্ছি। যদিও আমি শিশুর পিতা তবু আমি আমার নির্যাতিত শৈশবের জন্যে উপযুক্ত বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানাচ্ছি। সেদিনের সেই নির্যাতিত শিশু আজরে নির্যাতক পিতা, তবু বিচার চাই।

এই সভা আজকের মতো মুলতুবি রইল। ক্লেশের ক্লাসিফিকেশান ও কোডিং-এর জন্যে প্রয়োজন হলে আমাদের একাধিকবার বসতে হবে। যারা ঘুমিয়ে পড়েছেন উঠে বসুন। বাড়ি যান। আজ থেকে প্রত্যেকেই লিখতে থাকুন কার কিসে ক্লেশ!

০২. দ্বিতীয় অধিবেশন

গত সভায় আমাদের মাননীয় বক্তা অনেক আবোল-তাবোল বকেছেন।

বাঙালির স্বভাবই হল, যারা একটু বলতে কইতে পারেন তারা আর মাইক ছাড়তে চান। যদিও এ সভা অ-মাইক। এটাও কিন্তু মনুষ্য ক্লেশের মধ্যে পড়ে। আমরা শুনব না, শুনতে চাইছি না তবু জোর করে শোনাবার চেষ্টা। দেখো আমি কত বড় পণ্ডিত। কত কি জেনে বসে আছি। বক্তারা চিরকালই শ্রোতাদের ক্লেশের কারণ। এর নাম দেওয়া যাক বকর-বকর ক্লেশ।

যিনি নোট নিচ্ছিলেন, সভাপতি নীচু গলায় তাকে বললেন, বাঁদিকে ওপরে লিখুন, বকর বকর ক্লেশ, বড় করে লিখুন, হ্যাঁ, আন্ডার লাইন করুন।

এই বকরমবাজদের মধ্যে পুংলিঙ্গও আছে স্ত্রীলিঙ্গও আছে, সুতরাং বকরমবাজরা হলেন উভলিঙ্গ জীব। ইংরেজিতে এদের বলে–হারমাফ্রোডাইট। এঁরা অফিসে সহকর্মী, যানবাহনে সহযাত্রী, মঞ্চে নেতা, সভাপতি কিংবা প্রধান অতিথি, বেতারে বক্তা, গৃহে শয্যাসঙ্গিনী! একবার দম দিয়ে ছেড়ে দিলেই হল। দম মারো দঅঅম।

সভাপতি ফিসফিস করে বললেন, শেষ লাইনটা বাদ দিন। ও দমটা গ্রামোফোনের দম নয়, যদুর জানি গাঁজার দম।

কথা কম, কাজ বেশি, এদেশে তা সম্ভব হল না। চৈত্র মাসে, গাজনের সন্ন্যাসীরা চড়কের দিন জিভে বাণ ফোঁড়েন, এর নাম হল বাণ-ফেঁড়। উদ্দেশ্যটা কি? বাক্যের উৎসস্থলে বাণ মেরে বাক্যবাণ বন্ধ করা। যে কুকুর বেশি ঘেউঘেউ করে তার মুখে মাজল বেঁধে দেওয়া হয়। যে বাছুর সবসময় বাঁটের দুধ খাওয়ার জন্যে বেশি ছোঁকছোঁক করে তার মুখে জাল বেঁধে দেওয়া হয়। আমি স্বীকার করছি, মানুষের মুখের গঠনটাই বেয়াড়া। থ্যাবড়া। শেয়াল বা কুকুরের মতো ছুঁচোলো নয়। মাজল পরাবার কোনও উপায়ই ঈশ্বর করে রাখেননি। ঠোঁট দুটো গুণছুঁচ দিয়ে সেলাই করে দিলেই বকরম-বকরম বন্ধ হতে পারে! কিন্তু সে তো আর সম্ভব নয়। তবে হ্যাঁ, কঁদুনে খোকার মুখে যেমন চুষি বা সাকার ঢুকিয়ে দেওয়া হয় সেইরকম একটা কিছু যদি চালু করা সম্ভব হতো তাহলে মন্দ হতো না। চুষলেই চাটনি, বেশ নেশা ধরানো চাটনি। এত বড়-বড় চুষি, সি এস পি সি এম ছাপ মারা। যেই মনে হবে লোকটা বড় বিপজ্জনক, ক্লেশদায়ক, সুযোগ পেলেই বকতে আরম্ভ করবে, দাও মুখে চুষি রে।

যেমন ধরুন কোনও মহিলা এসে বললেন, কত্তার জ্বালায় বাড়িতে আর টিকতে পারছি না, চব্বিশ ঘণ্টা বকর-বকর করে পাগল করে দিচ্ছে। সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের এই সংস্থার তৈরি স্পেশ্যাল একটা নিপলস্ তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হল। সঙ্গে এক শিশি চাটনি।

সভাপতি প্রশ্ন করলেন, কীসের চাটনি? আমের না আমড়ার?

মিষ্টি-মিষ্টি চাটনি। এমন চাটনি যার মধ্যে কিছু নেশার উপাদান থাকবে। বকবক করার নেশার চেয়েও জোরালো নেশা। ফরমূলাটা ধরুন এইরকম হবে, কাঁচা আম এক কেজি, চিনি ৫০০ গ্রাম, এক ভরি আফিমের জল, অভাবে পোস্তর খোলাসেদ্ধ জল, বেলশুট চূর্ণ ২০০ গ্রাম। বেল দেওয়ার কারণ, আফিমে একটু কনস্টিপেশন হতে পারে, বেলে সেটা কেটে যাবে। কনস্টিপেশনে বায়ু বেড়ে যায়, বায়ু উর্ধমুখী হলে বকবকানি আরও বেড়ে যেতে পারে।

এখন আম সেদ্ধ করে কাত করে বের করে মিহি মোলায়েম করে হেঁকে ফেলুন। চিনি রস করে মিশিয়ে দিন। সামান্য জিরে গুঁড়ো, অল্প একটু লঙ্কা, আফিমের জল, বেলচূর্ণ দিয়ে বেশ করে ফুটিয়ে নিন। ঠান্ডা হলে শিশিতে ভরে ফেলুন। গায়ে লেবেল মেরে দিন নাম ফরমূলা ১, মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতির মোক্ষম দাওয়াই। বয়স্কদের বকম-বকম, কানের কাছে অনবরত হাঁচি অথবা কাশির মতোই বিরক্তিকর। ফাঁপা চুষিতে এক চামচে ফরমূলা ১ ভরে কত্তাকে চুষতে দিন, গিন্নির মুখে গুঁজে দিন, শ্বশুরের মুখে ঠুসে দিন, শাশুড়ির ঠোঁটে পুরে দিন। অব্যর্থ দাওয়াই! অভ্যাস হয়ে গেলে চুষি একবার ধরে গেলে, কেউ আর বক্তা থাকবেন না, সবাই তখন শ্রোতা।

সভাপতি একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, আফিম পাবেন কোথায়? ইট ইজ ভেরি ডিফিকাল্ট টু প্রোকিউর। এই তো আমার পা ফুলছে বলে কবরেজ বিধান দিয়েছেন, একগুলি করিয়া সরষের অহফিম দুধসহ সেব্য। তার জন্যে কার্ড চাই, আবগারি বিভাগের পারমিট চাই। তা ছাড়া ওই বস্তুটি যৌবন ধরে রাখে, খিদে বাড়ায়, গালে গোলাপি আভা আনে, মানুষকে মৌতাতে রাখে। কিশোর ন্যাচারাল প্রসেসে যুবক হবে। সংসারে প্রবেশ করবে। ধাক্কা আর মার খেতে-খেতে অকালে বুড়িয়ে ঝরাপাতার মতো চেহারা হয়ে যাবে। ডিসপেপসিয়া, ন্যাবা, বুক ধড়ফড়, কন্যাদায়, পুত্রদায়, পিতৃঋণ সব নিয়ে একদিন অকালে বল হরি হরিবোল। ফিনিশ। সেখানে আফিম ইনট্রোডিউস করে জীবনকে মধুর করে তোলা অপরাধ। আমরা তো আর কনস্টিটিউশনের অ্যাগেনস্টে যেতে পারি না। জীবনবিরোধী কার্যকলাপ পরিহার করিয়া চলাই বাঞ্ছনীয়।

কোন কনস্টিটিউশন? ভারতীয় সংবিধানের কথা বলছেন, যে সংবিধানের দুশো বার অ্যামেন্ডমেন্ট হয়েছে, যে সংবিধানে বলেছে, ইকোয়াল অপরচুনিটিস ফর অল, ফ্রিডম অফ স্পিচ, ফ্রিডাম ফ্রম পভার্টি, স্লেভারি, এট অল?

ও নো নো। সে সংবিধান অতি পবিত্র বস্তু, পার্লামেন্ট ছাড়া তাতে হাত দেওয়ার অধিকার কারুর নেই। আমি মিন করেছি আমাদের কনস্টিটিউসান, হিউম্যান সামথিং দেবভোগ্য বস্তু, আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। আমি একটা বিকল্প ব্যবস্থার কথা ভাবছি।

হোয়াট ইজ দ্যাট।

আমরা কালা হয়ে যাওয়ার সাধনা করি। কথায় আছে, ধরো আর মারো আমি পিঠে বেঁধেছি। কুলো, বকো অরে ঝকো আমি কানে দিয়েছি তুলল।

তার মানে আপনি ফাংশানাল ডিজঅর্ডার চাইছেন?

অফকোর্স। ইতিহাসে দেখুন এক-একটা যুগ এসেছে, ডার্ক এজ, গোল্ডেন এজ, রেনেসাঁস, রিভাইভ্যাল অফ রেনেসাঁস, এইভাবে আমরা এসে পড়েছি–এজ অফ ব্রেকডাউনে! রাস্তায় গাড়ি ব্রেকডাউন, পাওয়ার প্ল্যান্ট ব্রেকডাউন, পেট্রল আর ডিজেল সাপ্লাই ব্রেকডাউন, রেলে ব্রেকডাউন, মর‍্যাল ব্রেকডাউন, পারিবারিক শান্তি ব্রেকডাউন, সব সার্ভিস ব্রেকডাউন, হেলথ ব্রেকডাউন, সামাজিক কাঠামো, মানুষ মানুষের সম্পর্ক সব ব্রেকডাউন। ডাউন ডাউন, নিলডাউন। হাম হাম গুঁড়িগুড়ি।

সুর করে বলি, ম্যায় চলি, ম্যায় চলি, হাম হাম হামাগুড়ি।

কিন্তু সভাপতি স্যার, কালা হব বললেই কি হওয়া যায়! শুনেছি বিল্বমঙ্গলবাবু কাম জয় করার জন্যে প্রেমিকার খোঁপা থেকে কাটা খুলে নিয়ে চোখে খোঁচা মেরে অন্ধ হয়ে বলেছিলেন, প্রাণপ্রিয়ে দিলুম বারোটা বাজিয়ে, তুমি কে, কে তোমার, অন্ধের কিবা রাত্রি কিবা দিন, পেঁচিও যা পরিও তাই। তাহলে আমরাও কি স্ব-স্ব পত্নীর বড়ি-খোঁপা থেকে ইস্টিলের কাঁটা খুলে কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট করে এককালে সব বধির হয়ে যাব?

না তার প্রয়োজন নেই, বিল্বমঙ্গলের পরিবর্তে কর্ণমঙ্গল কাব্য আর তেমন মার্কেটে চলবে না। শ্রবণশক্তি ইতিমধ্যেই নয়েজ পলিউশানে কমে আসছে। নেতারা চোঙা ফুঁকে প্রায় আধকালা করেই দিয়েছেন। আর একটু ধৈর্য ধরতে পারলেই ফুল-কালা হয়ে যাব। এর মাঝে আর একপথ আছে–অভ্যাসযোগ। শুনেও শুনব না, দেখেও দেখব না।

রাইট। রকে বসে ছেলে আমার স্যাঙাতদের নিয়ে খুব গুরু-গুরু করে যাচ্ছে। ভীষণ ইরিটেশান হচ্ছে ভেতরে, ক্লেশ, ভীষণ ক্লেশ…।

গুরুর নাম শুনে ক্লেশ?

আজ্ঞে এ গুরু সে গুরু নয়। এই জেনারেশানের কথার ধরন। একদিন কি একটা কথা বললুম, উত্তর দিলে, কি যে বলো, গুরু। অবশ্য তক্ষুনি সামলে নিয়ে সরি বলেছিল, গর্ভধারিণী মাকে একদিন বলে বসল, হায় সখি।

ও, এই ব্যাপার। হ্যাঁ, এখানে অভ্যাসযোগ চলবে। শুনেও শুনবেন না।

যেমন ধরুন মাসের শেষে। সকাল থেকেই স্ত্রী বলছেন, শুনছ, বড় জামাই আসছে কানপুর থেকে, শুনছ বড় জামাই। সকালের চায়ের সময় বড় জামাই, বাথরুমে ঢোকার মুখে বড় জামাই, অফিসে বেরোবার সময় বড় জামাই, লাস্ট বিছানায় শুয়ে মাঝরাতেও বড় জামাই! শেষে তেরিয়া হয়ে বলতেই হল, মানে মুখ ফসে, সরি ফকসে নয় ফসকে বেরিয়ে পড়ল–বিগজামাই আসছে তো আমার বাপের কি! সঙ্গে-সঙ্গে আবিষ্কার করলুম, আমি আর খাটে নেই। মশারি ঝুলে লাল মেঝেতে।

ভুল করেছেন। সকাল থেকে যেমন বধির ছিলেন, তেমনি বধির থাকাই উচিত ছিল। একটা টোটকা শিখে রাখুন, যখনই কোনও ক্লেশদায়ক কথা শুনতে থাকবেন, তখনই মনে গুনগুন করতে থাকবেন, আমি বনফুল গো, আমি বনফুল গো, ছন্দে-ছন্দে দুলি আনন্দে, আমি বন…

 ০৩. তৃতীয় অধিবেশন

সভার কাজ তাহলে শুরু করা যাক, বলে সভাপতি হুঁককু-ককু করে কেশে উঠলেন। সিজন চেঞ্জ। কাশি হয়েছে। সম্পাদকের চটির স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেছে। পেছন থেকে কে চেপে ধরেছিল। ছেঁড়া স্ট্র্যাপে নীচু হয়ে একটা পেপার ওয়েট ঠুকে-কে ড্রয়িং পিন লাগিয়ে টেমপরারি মেরামত করতে করতে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ শুরু করে দিন। টেবিলের তলা থেকে পুরোনো খানকতক চেয়ারের গা বেয়ে। সম্পাদকের সমর্থন সভ্যদের কানে এল।

জুতোয় আবার কি হল?

আর বলেন কেন? ম্যাগনাম সাইজের এক মহিলার পদাঘাতে স্ট্র্যাপ ফটাস। এতটা রাস্তা স্রেফ টানতে-টানতে এসেছি। এখন দেখছি যদি কিছু করা যায়।

ছেড়ে দিন ছেড়ে দিন, ও আপনার কম্ম নয়। যার কাজ তার সাজে। উঠে চেয়ারে বসুন।

দাঁড়ান এক মিনিট, একটা হাতুড়ি পেলে এতক্ষনে হয়ে যেত। গোলাকার পেপারওয়েটে তেমন জোরালো ঠোক্কর লাগাতে পারছি না।

সভাপতি আর-এক পশলা কাশি ছাড়লেন। ছেড়ে বললেন, আজ একটু সকাল-সকাল সভা শেষ করতে হবে। তোমার ওই পাদুকাপর্ব এখন রাখো। রমণী আর চটি দুটি বস্তুই সহজে বশ্যতা স্বীকার করতে চায় না। যত ঠুকবে ততই বিগড়োবে।

কথাটা বড় জব্বর বলেছেন কিন্তু মনুষ্য জীবনের দুটি ক্লেশ, রমণীয় রমণী এবং এই চটি। অপরিহার্য অথচ অবাধ্য। সৃষ্টিরক্ষার জন্যে সব স্পিসিজেরই মেল ফিমেল প্রয়োজন কিন্তু প্রয়োজন ফুরোবার পরও এই যে টেনে-টেনে চলা এর কি কোনও প্রতিকার নেই?

অবশ্যই আছে।

যেমন?

যেমন মাকড়সা। স্ত্রী মাকড়সা প্রয়োজন মিটে গেলেই পুং মাকড়সাকে খেয়ে মুখ মুছে জালের ভেতর গ্যাট হয়ে বসে থাকে। চলে আও কোন আয়েগা আ যাও।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন স্ত্রী মনুষ্য বিশেষ একটি সময়ের পরে পুং মনুষ্যকে কড়মড়িয়ে শেষ করে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হেঁকে বলবে, আ যারে ম্যায়তো কবসে খাড়ী হুঁ। হরি, সিম্পলি হরি। ভাবা যায় না দাদা।

ভাবা যায় না দাদা! সত্যি কথা বললেই হরিবল। মাকড়সা তৎক্ষণাৎ যা করে মহিলা মনুষ্য সেই একই কাজ ধীরে-ধীরে ওভার দি ইয়ার্স সিসটেমেটিক্যালি করে। কেন তুলসীদাস মনে নেই :

দিনকা মোহিনী, রাতকা বাঘিনী,
পলক পলক লহু চোষে।
দুনিয়া সব বাউড়া হোকে
ঘর ঘর বাঘিনি পোষে।

বিশুদ্ধ বাংলায়, যে দিবাভাগে মোহিনীসদৃশী ও নিশাভাগে বাঘিনিতুল্য হইয়া মুহূর্তে মুহূর্তে দেহের শোণিত চুষিয়া খায়, জগতের লোকে উন্মত্ত হইয়া প্রতি গৃহে সেই বাঘিনিকে প্রতিপালন করিতেছে।

সম্পাদক জুতো মেরামতের ব্যর্থ চেষ্টা ছেড়ে মনমরা হয়ে বসেছিলেন, তিনি এইবার সোৎসাহে বললেন, ঠিক বলেছেন। রাতের কথা ছেড়ে দিন, সে অনেক কথা, কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোবে, বলতে হবে, দোষ কারোও নয়গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা, এই দিবাভাগেই দেখুন না, পেছন থেকে চেপে ধরে চটির স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে দিলে। কি করতে পারলুম! নাথিং, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলুম। লাল করমচার মতো দুটি ওষ্ঠ। নাভিদেশ ঘিরে গোল করে বিন্দু বিন্দু চন্দনের ফোঁটা। ফিনফিনে ছাপা শাড়ি। বাতাসে সুগন্ধ। এ্যারম করতে করতে, এ্যারম করতে করতে, নাচতে নাচতে, দুলদুলের ঘোড়ার মতো চলে গেল। গ্রাহ্যই নেই। যেন চটি ছেঁড়ার জন্যেই জন্মেছেন। অথচ…।

সভাপতি হাত তুললেন, থামানোর ইঙ্গিত, স্টপ, স্টপ। এ সম্পাদক শুড রিমেন নন কমিট্যাল। কাগজে চিঠিপত্রের কলমে লেখা থাকে দেখনি, মতামতের জন্যে সম্পাদক দায়ী নহে।

না, আমি থামব না, আমার ভীষণ ফিলিংস এসে গেছে। সম্পাদক হলেও আমি একটা মানুষ তো। ডাউন দি মেমারি লেন আমাকে বছর তিনেক পেছিয়ে যেতে দিন। সেই দিনটা আমি কিছুতেই স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। ডান গালে হাত বোলালে এখনও পেরেকের দাগ।

পেরেকের দাগ!

ইয়েস, পেরেকের দাগ, জুতোর কাটা পেরেক।

নিজের কেরামতি বুঝি? নিজের গালটাকেই স্যান্ডেল ভেবে ঠোকাঠুকি করেছিলেন?

অফকোর্স নট। আই অ্যাম নট দ্যাট ফুল। জনৈকা মাজা সুন্দরী গালে পাদুকাঘাত করেছিলেন।

মানে জুতো মেরেছিলেন?

ইয়েস জুতো।

কে সেই জুতো মারা সুন্দরী, ইওর ওয়াইফ?

প্রোভোকড অর আনপ্রোভোকড? টিজ করেছিলেন? তখন কি আপনি কলেজে পড়তেন?

আমার এখনকার বয়েস দেখলে তাই মনে হয় কি! এই ধরনের বোকা-বোকা কথাও ভয়ঙ্কর ক্লেশের কারণ। এ বোকা শুড রিমেন সাইলেন্ট।

আমি বোকা?

আপনি ইডিয়ট।

আপনি ক্রিস্টালাইজড ইডিয়েট। চরিত্রহীন লম্পট।

লম্পট?

ইয়েস লিচেরাস, ট্রেচারাস, তা না হলে একজন অপরিচিতা মহিলা পৃথিবীতে এত লোক থাকতে আপনাকে হঠাৎ জুতো মারতে যাবে কেন। নিজের স্ত্রী হলে কিছু বলার ছিল না, যে হাত সোহাগ করে, যে হাত পেঁপে, কাঁচকলা দিয়ে মাছের ঝোল রাঁধে, সে হাত জুতোও মারতে পারে, মারার অধিকার আছে, বাট…।

বাট! ইও আর এ ঘৃণ্য স্ত্রৈণ। চটিলেহী নিন-কম-পুপ স্বামী।

হ্যাঁ তাই, তাতেও গৌরব আছে। আপনার মতো পরনারীর পশ্চাদ্ধাবন করে গালে জুতো ইনভাইট করতে চাই না। আই হেট দ্যাট। জুতো মারনেওয়ালা যখন বাড়িতেই আছেন, তখন হোয়াই শুড আই হ্যাংলার মতো গো টু আদারস?

সভাপতি ট্যাপ ট্যাপ করে টেবিলের ওপর বারকয়েক নস্যির ডিবে ঠুকে শব্দ করলেন, অর্ডার অর্ডার। এটা কি হচ্ছে? এভাবে চললে মনুষ্যক্লেশ নিবারণের ক্ষমতা কারুর বাবার সাধ্যে হবে না। ঠাকুরই বলে গেছেন, জগৎ হল একটা আস্ত পেঁয়াজ। খোসা ছাড়িয়েই যাও, শেষে কিস্যু পাবে na। এ দুনিয়া ধোঁকার টাটি!

হু ইজ দ্যাট ঠাকুর? দারুণ বলেছেন।

হে-হে বাবা। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংস। যাক আসল ইসুটাই গুলিয়ে গেল। নো মোর উত্তেজনা। তবে জানা দরকার সম্পাদক কেন জুতো খেয়েছিলেন তিন বছর আগে। মধ্যবয়েসে জুতো, আনইউজুয়াল ব্যাপার। ছাত্রজীবনে হলে কেটা অন্যরকম হতো। জাস্টিফায়েবল ভাইস। হি মাস্ট বি অ্যালাউড টু ডিফেন্ড হিজ ক্যারেকটার। তিনি যে ক্লেশ পেয়েছিলেন, তা কারণে না অকারণে? অকারণে হলে আমাদের প্রসিডিংস-এ নোট করা হবে। গো অন, কনটিনিউ ইন সেলফ ডিফেনস।

হাতিবাগান।

ইয়েস হাতিবাগান।

সময় সন্ধ্যা।

কাল? মিনস ঋতু?

বসন্ত।

আই সি, আই সি।

আই সি, আই সি করে লাফাবার কিছু নেই। কলকাতায় তেমন উতলা বসন্ত আসে না, মানুষ তেমন কাককু নয় যে বসন্ত এলেই খাঁচায় বন্দী থেকেও কুহুকুহু করে উঠবে, তেমন ফ্যারিয়া নয় যে বায়োলজিক্যাল ইমপালসে ভাদ্র হলেই কেউকেউ করবে।

কি বলে রে! মানুষের সারা বছরই তো ভাদ্র।

ইয়েস সারা বছরই ভাদ্র, দ্যাটস টু তবে বসন্ত শুনে আই সি, আই সি করার কি আছে? আমি কি মোগল সম্রাট, না বৃন্দাবনের কেষ্টঠাকুর! আই স্টে নিয়ার হাতিবাগান।

বেশ তো, হাতিবাগানে স্টে করেন বলে সাত খুন মাপ না কি! জানেন দ্যাট ইজ এ বাজার এলাকা। কত নিরীহ মহিলা সেখানে বাজার করতে যান, অ্যান্ড এ ডেনজারাস ক্যারেকটার লাইক ইউ…।

সভাপতি বাধা দিলেন, ব্যাপারটা আবার ঝগড়ার দিকে চলে যাচ্ছে কিন্তু। সম্পাদক ইউ গো অন।

আমি তো যাচ্ছিলুমই।

অ্যান্ড আই ওয়াজ ফলোইং।

আঃ! আবার বাধা।

আচ্ছা চলুন, চলুন।

বাস থেকে নেমে আমি হনহন করে হাঁটছি, ভিড় বাঁচিয়ে-বাঁচিয়ে।

হনহন করে কেন? নর্মাল স্পিডে নয় কেন?

প্রকৃতির ডাকে!

আই সি, শুনলেন সবাই? নিজেই বললেন, প্রকৃতির ডাকে।

ধ্যার মশাই, আচ্ছা বুন্ধু তো! এ প্রকৃতি সে প্রকৃতি নয়। নেচার-নেচার, নেচারস কল। দেশি শব্দটা সভায় বলা যায়!

আই সি।

হ্যাঁ, আই সি, সারাজীবন দেখেই যান, কিছু বুঝে আর দরকার নেই।

আচ্ছা-আচ্ছা তারপর কি হল বলে যান।

হনহন করে হাঁটছি। বড়-বড় পা ফেলে। হঠাৎ কি হল আমার ডানপায়ের ডগাটা সেই মহিলার চটির পেছন দিকটা কুটুস করে চেপে ধরল।

কুট্টুস করে তো কামড়ায় শুনেছি, চেপেও ধরে নাকি! অক্লেশে যততত্র যা তা বিশেষণের প্রয়োগ।

এই লোকটি বড় ইনটারাপশান করেন।

ঠিক বলেছেন! বিরোধী দলের এম এল এ হবার যাবতীয় গুণ এর মধ্যে বর্তমান।

অথবা স্ত্রীজাতির। বুঝলেন, হয় এম এল এ না হয় স্ত্রীলোক দুটোর যে-কোনও একটা হওয়ার চেষ্টা করুন।

চটিতে পা পড়তেই তিনি সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাওয়ার মতো হলেন, কিন্তু পড়লেন না। যদি পড়ে যেতেন তাহলে আমাকে হাত ধরে তুলতে হতো এবং যদি তুলতে হতো তাহলে আমাকে দুহাত ধরেই তুলতে হতো। একহাতে আমি তুলতে পারতুম না কারণ তিনি ছিলেন বেশ ওজনদার টাটকা মহিলা। তাহলে আমি দুহাতেই তুলতুম এবং জনসাধারণ দেখতেন। বলা যায় না হয়তো কোনও চেনা লোক দেখতেন এবং বাড়ি গিয়ে আমার স্ত্রীর কাছে রিপোর্টিং করতেন। তারপর কি হতো, ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয়।

সভাপতি মহাশয়!

বলুন।

এই মনুষ্যটির কথায় একটি জিনিস অতি প্রকট। সেটি হল উদ্বেগ, সেই উদ্বেগের উৎস স্ত্রীজাতি। একটি স্ত্রীলোক পথে যাঁর চটির পেছন দিকটা উনি ডানপায়ে চেপে দাঁড়িয়ে আছেন, দ্বিতীয় স্ত্রীলোক গৃহে যিনি এই মনুষ্যটির গতিবিধির ওপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন। এখন প্রশ্ন হল, বেসিক প্রশ্ন স্বামীরা কি স্ত্রীর কেনা গোলাম? আমরা কি জরুকা গরু?”

একটু ব্যাকরণগত ভুল হল বোধহয়। বলুন আমরা কি জরুকা বুল।

নো-নো, বুল বললে অসহায় অবস্থাটা তদ্রুপ প্রস্ফুটিত হয় না। বুল অনেক বেপরোয়া, অনেক স্বাধীন ও নিঃশঙ্ক। ইংরেজিতেই বলি, বাংলায় বললে অশ্লীলতার দায়ে পড়ে যাব। এ বুল ক্যান চেজ এনি কাউ। বরং বলুন জরুকা বলদ। খাটাসীনা স্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে ভক্ত স্বামী গাইছেন– মা আমায় ঘুরাবি কত চোখ বাঁধা শ্বশুরের বলদের মতো।

শ্বশুরের বলদ আবার এল কোথা হতে? গানে আছে কলুর বলদের মতো।

ওই তো ইংলিশ মিডিয়ামে লেখাপড়া না করার ফল। বাংলা পাঠশালা কি টোলে পড়লে ওই রামপ্রসাদ পর্যন্তই যাওয়া যায়। ইংলিশ ফোক ব্যালাডে ব্যাঞ্জো বাজিয়ে মেয়ে গান গাইছে, মাই ফাদার উইল পারচেজ এ বুল ফর মি লালা টালালা।

আই সি, আই সি।

আবার দেখার মতো কি হল আপনার, বেশ তো চুপচাপ ছিলেন এতক্ষণ।

এতক্ষণে অরিন্দম কহিল বিষাদে, এ ফিউ ডেজ ব্যাক, টেরিফিক দাম্পত্য কলহের সময় আমার স্ত্রী বললেন, বাবা পয়সা খরচ করে একটা ষাঁড় কিনে এনেছেন।

সেকি?

ইয়েস, শি সেড দ্যাট।

বব না লম্বা?

তার মানে?

স্ত্রীর ডেসক্রিপসান, কি জাতীয় স্ত্রী, ববকরা চুল না বড়লোকের বিটি গো লম্বা লম্বা চুল?

বব, না লম্বা, বেঁড়ে, রেগে-রেগে সব চুল উঠিয়ে ফেলেছে, এক সময় অবশ্য এই চুলের ঢল ছিল।

হাই না ফ্ল্যাট?

তার মানে?

হাই হিল না ফ্ল্যাট হিল জুতো?

ও আই সি। এক সময় হাই ছিল, তাতে আমার চেয়ে দু ইঞ্চি হাইট বেড়ে গেল। দুজনে একসঙ্গে বেড়াতে বেরোলে রকের ছেলেরা টন্ট করত, এ ল্যাম্ব, এ ল্যাম্ব। স্ত্রীর ভেড়া হয়ে বাঁচতে চাই না। আমিও হাইট বাড়িয়ে নিলুম, এক ইঞ্চি ওপরে উঠে গেলুম। সঙ্গে-সঙ্গে স্ত্রী আরও হাফ বেড়ে গেলেন। কে হারে, কে জেতে। ভগবান আছেন মশাই। গীতায় বলেছেন, স্ত্রীজাতির অহঙ্কার

মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতি

খর্ব করার জন্যে পুরুষ জাতির সম্ভ্রম রক্ষার্থে সম্ভবামি যুগে যুগে।

এটা আবার গীতায় পেলেন কোথায়?

কতরকম গীতা আছে জানেন কিছু? এই আশার বাণী আছে স্বামী গীতায়। মনে রাখবেন অর্জুন শুধু যোদ্ধা ছিলেন না, সংসারীও ছিলেন, নট ওয়ান ওয়াইফ সেভারেল ওয়াইভস। ন্যাগিং ওয়াইভাস। এক দ্রৌপদীকে সামলাতেই পাঁচ-পাঁচটা স্বামীর হাতে হ্যারিকেন।

সে তো যুধিষ্ঠিরের জন্য। বেচারা আফিং খেয়ে দাবায় বসলেন অ্যান্ড লস্ট হিজ লিমিটেড ওয়াইফ।

যুধিষ্ঠির আফিং খেতেন, হু টোলড ইউ? স্ল্যান্ডার অ্যাগেনস্ট শাস্ত্রস।।

ধীরে যামিনী ধীরে। দুই আর দুইয়ে চার। অত প্রবলেম তবু যুধিষ্ঠির দাবায় বসলেন, কেন বসলেন? ফ্রাসট্রেশান, কেন ফ্রানট্রেশান পেটের গোলমাল, অ্যামিবায়োসিস।

এ তথ্য আবার কোথায় পেলেন?

অ্যাজামপসান। তখন ফিলটারড ওয়াটার, ক্লোরিন এসব ছিল না। পুকুর পানি, সেই পানিতে শত-শত অদৃশ্য প্রাণী অ্যান্ড ক্রনিক আমাশা, ন্যাচারালি দুর্বল, দুর্বল বলেই ধার্মিক, সত্যবাদী। পেটের ব্যামোর সবচেয়ে প্রাচীন ওষুধ আফিং, আফিং মানেই ইমপোটেনসি, অ্যান্ড দ্যাটস হোয়াই দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ। কৃষ্ণের আবির্ভাব, ভীমের গদাযুদ্ধ, অর্জুনের বিষাদযোগ।

সভাপতি সহসা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, সভা আজকের মতো এখানেই পণ্ড হল।

০৪. চতুর্থ অধিবেশন

গত সভা অসম্পূর্ণ থেকে গেছে। আমার একটু তাড়া ছিল। কেন ছিল তাও আমি অকপটে ব্যক্ত করছি। আমার গৃহিনী নাইট শোয় সিনেমা যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন।

কি সিনেমা? বাংলা না হিন্দি, ধর্মীয় না সামাজিক।

সম্পাদক হাসি-হাসি মুখে প্রশ্নকারীর দিকে তাকালেন, হিন্দি সিনেমা অবশ্যই কারণ ওই বস্তুটিই একমাত্র ফরমূলা যাতে প্রেম আছে, সংগীত আছে, আকাশ আছে, বাতাস আছে, জরা আছে, যৌবন আছে, প্রাচুর্য আছে, দরিদ্র আছে, সবার ওপরে আছে অধর্মের পরাজয়, ধর্মের জয়।

কি বই, কোন হল?

বইয়ের নাম ডোন্ট নো, জানি না। হল নয় প্রতিবেশীর বাড়ি, টি.ভি.-র ছবি।

আপনার ভূমিকা?

আমার ভূমিকা বাড়ি পাহারা দেওয়া এবং বেবি সিটিং।

এখনও আপনার বেবি? বিলম্বে বিবাহ অথবা…।

কোনটাই নয়। আমার নাতি, গ্র্যান্ড সান।

কেন, পুত্রবধূ কি উদাসীন?

না, তিনি শশ্রুমাতার অনুগামী। এই একটি ব্যাপারে দুজনের অদ্ভুত মিল। রতনে রতন। চেনে ভাল্লুকে চেনে শাঁকালু।

স্ত্রী এবং পুত্রবধু দুজনকেই কি আপনি ভাল্লুক বলতে চাইছেন?

আজ্ঞে না, দুজনেই রত্ন। স্ত্রী রত্ন। কিন্তু এ সবই হল সভাবহির্ভূত প্রসঙ্গ। সভার কাজে ফিরে আসা যাক।

সম্পাদক, সম্পাদক কোথায়?

এই তো এসে গেছেন। সুদীর্ঘ পরমায়ু।

কি হে বিলম্বের হেতু! তোমার আঙুলে ব্যান্ডেজ কেন? আঙুলহাড়া?

সম্পাদক বসতে-বসতে বললেন, আঙুলহাড়া নয়, আঙুলের খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছি।

সে আবার কি! আলুরই তো খোসা ছাড়ায়, তোমার আঙুলটা আলু না কি হে।

ধরেছেন ঠিক, আলুর খোসাই ছাড়াতে গেসলুম, গিয়ে আঙুলের খোসা ছাড়িয়ে ফেলেছি।

গৃহিনী কি ধর্মঘট করেছেন?

আজ্ঞে না, তিনি হেড মিসট্রেস হয়েছেন।

হাইলি ইন্টারেস্টিং। কারুর স্ত্রী হেড মিসট্রেস হলে তাকে কি আলু ছাড়াতে হয়!

তাহলে খুলে বলি। ব্যাপারটা হল এইরকম। আমার একার রোজগারে সংসার চলে না, আমার স্ত্রী ফরচুনেটলি একটি স্কুলে চাকরি পেয়েছেন। সকালে স্কুল। ভোর সাড়ে পাঁচটায় তিনি বেরিয়ে যান। আমি চা করে দি, ব্রেকফাস্ট বানিয়ে দি। কোলের ছেলেটাকে খাঁচায় ভরে, তার ওপরেরটাকে পাহারায় রেখে বাজারে যাই। ফিরে এসে দ্রুত কুটনো কেটে বাটনা বেটে, দুধ জ্বাল দিয়ে, ডিমের ডালনা ভাত ইত্যাদি রাঁধি। দাড়ি কামাই, দুধ খাওয়াই। মাছের লোভ, কাটতে জানি না। তাই নেমন্তন্ন বাড়িতে চেয়ে-চেয়ে ছ-সাত পিস মাছ খাই। খেয়ে পরের দিন কাত হই। তার পরের দিন অফিসে যাই। দিস ইজ মাই লাইফ।

অ্যান্ড লাইফ ইজ লাইক দ্যাট।

দুঃখ করো না যদু, রাম শ্যাম যদু মধু, টম ডিক হ্যারি সকলের জীবনেই এমনি কিছু কাটা খোঁচা মেরে আছে। লাইফ ইজ নট এ বেড অফ রোজেস। গোলাপের সঙ্গেই কাটা থাকে। গালিব সাহাবকে স্মরণ করুন।

কয়দে হায়াৎ ও বন্দে গম, আসল মে দোনো এক হ্যায়।
মওৎ সে পহলে আদমি, গম মে নেজাৎ পায়ে কিউ।

কিস্যু বোঝা গেল না।

বাংলা করলেই বুঝবেন–জীবনের বন্ধন আর দুঃখবন্ধন, দুটোই এক। মরার আগে দুঃখ থেকে পার পাওয়ার উপায় নেই দাদা, চিতাতেই চরম শান্তি। এই দেখুন আমার দুটো হাত, বাম। হস্ত আর দক্ষিণ হস্ত।

বক্তা জামার আস্তিন গুটিয়ে দুটো হাত সভার সামনে তুলে ধরলেন। এগজিবিট নাম্বার ওয়ান, নাম্বার টু। সকলেই সমস্বরে প্রশ্ন করলেন, হাতে আবার কি হল মশাই, মাশুল না হস্তশুল?

ভালো করে দেখুন, দেখে বলুন, এনি ডিফারেন্স? ইয়েস দেয়ার ইজ এ ডিফারেন্স। বাঁ হাতের চেয়ে ডান হাতটা মোটা।

হ্যাঁ, তাই তো, ঠিকই তো। কেন এমন হল? আপনার বাঁ-হাতের কারবার কি তেমন চলে না, উৎকোচ ইত্যাদি?

দিস ইজ অ্যানাদার স্টোরি। তাহলে শুনুন। নাইনটিন ফিফটিতে আই গট ম্যারেড।

লাভ অর নেগোসিয়েটেড?

বর্ণে না অসবর্ণে?

নর্মাল, নর্মাল। নর্মাল ডেলিভারির মতো নর্মাল ম্যারেজ। কিন্তু আনফরচুনেটলি ছানা কেটে গেল।

সে কি মশাই, বিবাহ কি দুগ্ধ, বাসী হলেই ছানা কেটে যাবে! না হরিণঘাটা, ছানা কেটেই আসবে!

প্রেশার, প্রেশার। প্রেশার কুকারের মতো ভালভ খুললেই তিন-তিনবার সিটি। বউয়ের ঠোঁট ফাঁক হলেই ফ্যাসস, বাড়ি মাত। সবেতেই তেনার অসন্তোষ।

তা অমন প্রেশার কুকারের মতো বউ বিয়ে করলেন কেন?

এ ব্যাপারে এক-এক এক্সপার্টের এক-এক মত। আহা বিয়ের পরেই তো প্রেশার কুকারের মতো হয়ে গেল। শাশুড়ী বলেন, মেয়ে তো আমার অমন ছিল না বাবা, একটু রাগী ছিল, সামান্য বায়না-টায়না করত, কোনও জিনিস মনে না ধরলে ঠুকে-ঠুকে খানিক কেঁদে সারাদিন ঘাড় কাত করে গো হয়ে বসে থাকত, সেইসময় অবশ্য তালে তাল রেখে না চলতে পারলে খামচে-টামচে দিত, কাপডিশ ছুড়ত। তা সে রেগে গেলে কে না অমন করে! খোঁচাখুঁচি করলে মরা বাঘও হালুম করে ওঠে। আর হবে নাই বা কেন, আমার হাই, বাপের হাই, বংশটাই হাই, হাই ফ্যামেলির হাই হই ব্যাপার।

তাহলে দেখছেন, বিবাহের পূর্বে কত কি দেখা উচিত, ফ্যামিলি হিসট্রি, হেরিডিটি, প্রেশার, সুগার, দাঁত চোখ নাক কান ব্লাড ইউরিন সুটাম স্টুল মান্টু এক্সরে ইসিজি।

তার মানে মেডিক্যাল বোর্ড বসানো উচিত।

অফ কোর্স। ব্যাপারটা যখন সারা জীবনের তখন মাল টেস্ট করে নেওয়াই উচিত। এই তো আমার ফার্মে যেসব মাল কেনা হয় সব স্যাম্পেল আগে ল্যাবরেটারিতে টেস্ট করে রিপোর্ট দেখে তারপর কেনা হয়।

থামুন। ওসব টেস্ট-মেস্ট আমাকে দেখবেন না। আমার এক জানা কেমিস্টের কলকাতায় দুটো বাড়ি হয়ে গেল। টু বিগ হাউসেস। সেরেফ সাপ্লায়ারের পয়সায়। একটা করে বড় পাত্তি ছেড়ে দিলেই অচল মাল সচল।

যেমন প্রেমে। প্রেম হল আঁধি। ব্লাইন্ডিং এফেক্ট অফ লাভ। প্রেমিকের চোখে ঘেঁটু ফ্লাওয়ারও লোটাস।

আহা, এনার তো প্রেম নয়, ফিফটিতে প্রেম তো এমন বুবনিক প্লেগের মতো ঘরে-ঘরে, মনে-মনে, জনে-জনে ছড়িয়ে পড়েনি। প্লেগও গলায়, প্রেমও গলায়। প্রেমের ফঁস পরেছি গলে, এখন আড়াই হাত জিভ সামনে পড়েছে ঝুলে।

আই থিংক।

কী থিংক!

আমার মনে হয় হোমিওপ্যাথি ক্যান সলভ দি প্রবলেম।

আমার বউকে আমি বিশাল হোমিওপ্যাথি দেখিয়েছি। এক-এক চোটে সিক্সটি ফোর।

না-না আমি তা বলছি না। হোয়াট আই মিন টু সে, বিয়ের আগেই বিফোর ম্যারেজ, একটা ডোজ…।

সে আবার কি? অসুখ না জেনেই ওষুধ! রাম না জন্মাতেই রামায়ণ!

আহা পুরোটা না শুনেই উত্তেজিত হন কেন! শুনুন প্রকৃত অভিজ্ঞ ডাক্তার মানুষের মুখ দেখেই মাল চিনে ফেলেন। ডক্টর রায়ের কথা মনে নেই। দশ হাত দূর থেকেই রোগ ধরে ফেলতেন। চেম্বারে রুগি ঢুকছে না তো রোগ ঢুকছে। আড়চোখে অ্যানাটমিটা একবার দেখে নিলেন। ইয়েস, লিভার ঝুলে কুঁচকির তলায় লতর-পতর করছে। গলব্লাডার থেবড়ে গেছে কি হার্ট ফানুসের মতো ফুলে উঠেছে, হাড়ে হাড়ে আর্থারাইটিস ঘুণ পোকার মতো কট্টর মটর করছে, ব্রেন একবগগা হয়ে গেছে।

ডক্টর রায়ের মতো ডাক্তার এ-যুগে পাচ্ছেন কোথায়? পেলেও বাবা তারকনাথের মতো অবস্থা। চেম্বারে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হবে, ভোলেবাবা পার লাগাও।

সেই জন্যেই তো হোমিওপ্যাথি। হোমোইয়স মিনস লাইফ। প্যাথস মিনস ফিলিং। তার মানে একাকার অনুভূতি। একজন হোমিওপ্যাথের চোখে মানুষ হল সোরা, যেমন ঋষির চোখে মানুষ হল কামিনী কাঞ্চনের দাস, ব্যবসায়ীর চোখে গলায় চাকু চালাবার মুরগি। পলিটিশিয়ানের চোখে ব্যালট পেপার। সেইরকম সব মানুষই সোরা, না হয়…।

হোয়াট ইজ সোরা? সোরা, গন্ধক আর কাঠ-কয়লা, বাজির মশলা। সোরা মিনস একত্সপ্লোসিভ। তার মানে মানব হল সোরা, মানবী হল গন্ধক, দুয়ে মিলে গানপাউডার।

আজ্ঞে না, সে সোরা নয়। মানুষের নেচার, মানুষের অসুখ কনট্রোল করছে তার হেরিডিটি। বংশানুক্রমে বিষাক্ত রক্ত লক্ষ-লক্ষ রুগি তৈরি করে চলেছে। ফর একজামপল ইওর টাক, রেসপনসিবল সোরা। আমার রাতকানা চোখ, সোরা, সম্পাদকের ব্লাড প্রেশার সোরা, সভাপতির হাঁপানি সেই সোরা।

কি তখন থেকে সোরা-সোরা করছেন, কবরেজ মশাই আমাকে বলেছেন, দেয়ার আর ওনলি থ্রি থিংস, জানবা। তিনটি মাত্র জিনিস, বায়ু পিত্ত আর কফ। মধ্যমা, অনামিকা আর তর্জনি পাশাপাশি নাড়ির ওপর স্থাপন করিয়া কায়মনে অনুভব করো। কোন নাড়ি বেগবান, বায়ুর কি পিত্তের, কি কফের।

ও হল ভৌতিক চিকিৎসা, বার্ধক্যে সান্ত্বনা। হোমিওপ্যাথির রুট চলে গেছে ইতিহাসে, শিল্পে, অলঙ্কার শাস্ত্রে। আমরা পেট থেকে স্ট্রেট নেমে আসছি এক-একটি সিমটমের আকারে। ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা নয়, ঘুমিয়ে আছে অসুখের অঙ্কুর সব মানুষের রক্তে।।

রূপভেদা প্রমাণানি ভাব-লাবণ্য-যোজনম।
সাদৃশ্যম বর্ণিকাভঙ্গম ইতি চিত্রং ষড়ঙ্গকম।

যা বাব্বা! ঘুরে ফিরে সেই সংস্কৃত চলে এল? মানুষ হয়ে জন্মাবার মহা জ্বালা তো। এর চেয়ে আমার বেদান্ত ফার বেটার। এক খুঁয়ে সব উড়িয়ে দিয়েছে। তুমি নেই আমি নেই, কেউ নেই, কেউ নেই। হে মায়া প্রপঞ্চময়, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা।

সভাপতির বোধহয় একটু ঘুম-ঘুম এসে গিয়েছিল, তিনি একটিপ নস্যি নিয়ে বললেন, আপনাদের আলোচনা আমি হাফ শুনেছি, হাফ শুনিনি। এটা মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সভা না আত্মোন্নতি বিধায়িনী সভা? সম্পাদক, সম্পাদক গেলেন কোথায়?

এই তো পাশেই আছি।

তোমাকে আমি বারবার বলছি সকলের চোখের সামনে একটা নোটিশ বোর্ড ঝুলিয়ে দাও, মনুষ্য ক্লেশ চোখে পড়ুক, তা না হলে এই আবোল-তাবোলই চলবে। নাও এখন তোলো, টেনে তোলো।

কাকে তুলব?

আমূর্খ! ডিরেইলড আলোচনাকে টেনে লাইনে তোলো! আমি তুলে দিচ্ছি।

না, আপনি আবার হোমিওপ্যাথিতে চলে যাবেন।

গেলেও সিমিলিরাস সিমিলিরাস কিওরেনটুর, বিষে বিষে বিষক্ষয়। উফ্ কি যে একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে না! ধরুন আমি বিয়ে করব।

এখনও করেননি?

হ্যাঁ-হ্যাঁ সে ভুল আমি অনেক আগেই করে বসে আছি। সাপোজ, সাপোজ আমি বিয়ে করব, এখন কনজারভেটিভ পদ্ধতিতে আমার মেয়ে দেখার কোনও অধিকার নেই। প্রথমে আমার এলডার্সরা দফায়-দফায় যাবেন আসবেন। অনেকটা বাজার করার কায়দা। টিপেটাপে, উলটে-পালটে, দরদস্তুর করে পছন্দ। একবার অবশ্য আমাকে শুনিয়ে-শুনিয়ে বলা হবে, এইবার তাহলে ছেলে একবার মেয়েকে দেখে আসুক অর্থাৎ আমাদের পছন্দটাকে ডিটো মেরে আসুক। এই যে মেয়ে বাছাই হচ্ছে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞদের দিয়ে, মোস্ট আনসায়েন্টিফিক ওয়েতে। ইয়েস, চুল ঠিক আছে, ট্যারা নয়, হাসলে গালে টোল পড়ে না, খুব লম্বাও না, খুব বেঁটেও না, হাতে-পায়ে লোম নেই, পায়ের আঙুল ফঁক। নয়, কপাল উঁচু নয়, চিরুনদাতী নয়, সব ঠিক আছে লেকিন…

এর পরও লেকিন?

ইয়েস লেকিন। নো অ্যাস্ট্রোলজার। ফাঁইনাল দেখা দেখবেন ছেলের পক্ষে একজন হোমিওপ্যাথ। চৌষট্টি হোক, একশো আঠাশ হোক লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন। মেয়ের বাবা নগদের সঙ্গে এই টাকাটা ধরে দেবেন। ওটাই হবে স্টেক মানি। ছেলে হল ঘোড়া, বাজী, বাজী, বাবাজি। হড়কে গেল তো সামান্য টাকাতেই গেল, ধরা পড়ল তো মেয়ের আস্তাবলে সারাজীবন বাঁধা রইল বাহন হয়ে। পক্ষিরাজের পক্ষসাতন। মুখে লাগাম, পিঠে জিন, তার ওপর কন্যা আরোহী, সারাজীবন, টগবগ, বগাবগ।

লেকিন হোমিওপ্যাথি কি দেখবেন, ভেতরটা? জিভ গলা চোখের তলা, কানের ভেতর, নাকে পেনসিল টর্চ ইত্যাদি?

ধুর, ওসব অ্যালোপ্যাথিক অভদ্রতা। হোমিও হল আর্টফ্যাকালটি–ভাবলাবণ্য যোজনম। খাজুরাহোর মূর্তি সাধারণ মানুষের চোখে একরকম, পুরাতত্ত্ববিদের চোখে আর-এক রকম। আমাদের চোখে পাত্র-পাত্রী, সুন্দর, অসুন্দর, বহিরঙ্গ বিচার, অন্তরঙ্গ বিচার হোমিওপ্যাথের হাতে। তিনি হিস্ট্রি নেবেন ছাপার ফর্মে–মানসিক ভাবসমূহ এবং সর্বাঙ্গীন তাবত লক্ষণচয়। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ। মেয়ের বসার ধরন, মুখের ভাব, কপালের ভাঁজ, কানের লতি, নাকের ডগা, চোখের পাতা, চুলের গোড়া, দাঁতের পাটি। এরই মাঝে সার্চিং আইস ঘুরছে চারপাশে, আত্মীয়স্বজন, তাদের চেহারা, কণ্ঠস্বর, হাসির শব্দ, হাসতে গেলে কাশি আসে কিনা। দেওয়ালে পূর্বপুরুষদের ছবি। দেখছেন আর নোট করছেন, বর্তমান থেকে অতীতে, পূর্বপুরুষ, তার পূর্বপুরুষ, পিতা, পিতামহ, বৃদ্ধপিতামহ, বৃদ্ধ প্রপিতামহ, বংশের ডালে-ডালে পাতায়-পাতায় বিচরণ, লক্ষণ সেন, বল্লাল সেন, শেরশাহ, ঔরঙ্গজীব, আকবর, বাবর, মহম্মদ ঘোরী, ভায়া খাইবার পাশ, বোলান পাশ, কাবুল, গজনি, কান্দাহার, ইরান, ইরাক…

সে কি মশাই, আমাদের বউরা সব অতদূর থেকে রোল করতে করতে, রোল করতে করতে এসেছে নাকি?

হ্যাঁ-হ্যাঁ বাব্বা, ইসকো বোলতা হ্যায় এথনোলজি। সামনে পাত্রী, তার দেহলক্ষণ ফুঁড়ে দৃষ্টি চলেছে রক্তের ধারা অনুসরণ করে কচ্ছু বিষের সন্ধানে।

হোয়াট ইজ কচ্ছু? ইজ ইট বিচ্ছু?

বিচ্ছুর চেয়েও সাংঘাতিক হল কচ্ছু, কচ্ছু মিনস…যা লোডশেডিং হয়ে গেল মোশা।

অন্ধকারে সভাপতি হাই তুলিলেন এবং সভা এইখানেই বিপর্যস্ত হইল।

০৫. পঞ্চম অধিবেশন

একটা বাল্য ফিউজ হয়ে গেছে।

দাম কত?

চার-পাঁচ টাকা হবে।

তাহলে আমরা সকলে পঁচিশ পয়সা করে চাঁদা দি।

আবার চাঁদা স্যার! শ্রবণেই ভীতি। দুগগা পুজো থেকে সরস্বতী পর্যন্ত লাগাতার চাঁদা। মুঠোমুঠো চাঁদা। সংসারী মানবের পক্ষে বড়ই ক্লেশের কারণ।

সামান্য পঁচিশ পয়সায় এত ক্লেশ!

আজ্ঞে হ্যাঁ। পঁচিশ পয়সা আমার এক পিঠের বাস ভাড়া। পঁচিশে একটা পাতিলেবু, দুটো সিগারেট, পাঁচটা বিড়ি কিংবা পঞ্চাশ গ্রাম লাল-লাল কঁচা লঙ্কা। লিটল ড্রপস অফ ওয়াটার, লিটল গ্রেনস অফ স্যান্ড।

উঃ কি যন্ত্রণায় যে পড়া গেছে! ছেলেবেলায় পাঠ্যপুস্তকে গোটাকতক কবিতা, সেই কবিতার কোটেশান শুনতে-শুনতে কান পচে গেল। এই এক লিটল ড্রপস আছে আর-একটা আছে জন্মিলে মরিতে হবে, আর-একটা আছে টু আর ইজ হিউম্যান, আর-একটা আছে লোকে যারে বড় বলে, আর-একটা আছে ভাবিতে উচিত ছিল প্রতিজ্ঞা যখন, আর-একটা আছে জীবে দয়া করে যেই জন, আর-একটা আছে…

ওরে কেউ তোরা থামা না ওকে।

এই মশাই স্টপ, একদম চুপ, ক্লেশদায়ক মানুষ।

হবে না। উনি যে একজন প্লিডার। প্লিড করে করে কত মক্কেলকে কত জজ সাহেবকে খতম করে দিলেন। ইহাকে বলে ভার্বাল টর্চার।

সভাপতি মৃদু কেশে বললেন, আমরা শুরু করেছিলাম ফিউজ বা দিয়ে। সেখান থেকে চলে গেছি জীবে দয়াতে। খুব হয়েছে ভাই সকল, একটা আলো না জ্বললেও ক্ষতি হবে না। এখন কাজের কথায় আসা যাক। কাজ না করলে চিত্ত বড়ই ব্যাকুল হয়। দীর্ঘদিন ধরে এই সমিতির অধিবেশন বসছে।

দীর্ঘদিন কোথায় মশাই! চারটে অধিবেশন হয়েছে, আজ হল পঞ্চম।

আমার কাছে দীর্ঘ। বয়স ভেদে সময় স্লো ফাস্ট হয়। শেক্ষপিয়র পড়েছেন আপনারা?

শেক্ষপিয়র নয়, শেকসপিয়র, মোক্ষমূলর নয় ম্যাকমুলার।

ধ্যার মশাই! শেকসপীয়র নয় পিয়ার, শেকসপিয়ার।

আপনি আমার চেয়ে বেশি জানেন? ই আর এ ডিপথং হয়ে অ।

ডিপথং? ডিপথং আবার পেলেন কোথায়?

সভাপতি মৃদু হেসে ঝগড়া থামালেন, আমি শেক্ষপিয়র, শেকসপিয়র, পিয়ার সব উইথড্র করে নিলুম। মনে করুন আমিও পড়িনি আপনারাও পড়েননি।

না, তা কেন? তা মনে করব কেন? আমরা শেকসপিয়ার পড়েছি অনেকে।

আমি বাদ। আমি পড়েছি শেকসপিয়ার। ডেফিনিটলি পড়েছি।

সভাপতি দুহাত তুলে বললেন, কি বিপদেই পড়া গেল!

বিপদ তো আপনি নিজেই তৈরি করলেন। হচ্ছে মনুষ্যক্লেশ, আমদানি করলেন ছাত্রজীবনের ক্লেশ শেকসপিয়ারকে।

শেকসপিয়ার ক্লেশদায়ক? বলেন কি!

ঠিকই বলি, যে-কোনও পাঠ্যবস্তুই মনুষ্যক্লেশের কারণ, যে-কোনও অপাঠ্যই চিত্তবিনোদনের হেতু। যে-কোনও মানুষকে ডেকে জিগ্যেস করুন, কজনের ছাত্রজীবন সুখের ছিল। কজনের মনে আছে শেকসপিয়ার।

আমার রয়েছে–টাইম ট্রাভেলস ইন ডাইভার্স পেসেস উইথ ডাইভার্স পার্সনস। আই উইল টেল ইউ হু টাইম অ্যাম্বলস উইথাল হু টাইম গ্যালপস। বলুন তো কোথায় আছে?

আমি একটু বাইরে থেকে আসছি।

ওই দেখুন, কুইজ কনটেস্ট হচ্ছে ভেবে পালাচ্ছে।

না তা নয়, ছোট বাইরে।

ছোট বাইরে! স্কুলে কলেজে সর্বত্র তুমি এই করে এসেছ। পড়া ধরা শুরু হলেই ছোট বাইরে।

আজ্ঞে না-আ।

আজ্ঞে হ্যাঁ-অ্যা। ছোট বাইরেতে যেতে হয় যান, বলে যান কোথায় আছে।

আপনি বলুন না।

আপনি বলুন না।

সভাপতি নস্যি ডিবে টেবিলে ঠুকে বিবদমান দুই পক্ষকে থামিয়ে দিলেন, শান্তি শান্তি।

হোয়াই শান্তি, আমি একবার বলবই, দুয়ো হেরে গেছে দুয়ো।

হেরে গেছি! বাঃ বেশ মজা। আপনি আবার জিতলেন কখন?

আমি নিউট্রাল। না নেগেটিভ না পজেটিভ, হ্যাঁ-হ্যাঁ বাবা, কমপ্লিটলি নিউট্রাল। হেরেছেন আপনি, গো হারান হেরেছেন। নিউট্রালরা কখনও হারে না। গুম হয়ে বসে থেকে মৃদু-মৃদু হাসে, হারজিতের খেলা তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়।

সভাপতি গলা ছেড়ে বললেন, মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতিটাই এখন দেখছি দারুণ ক্লেশের কারণ হয়ে উঠছে। ক্লেশ তো কমবেই না। উলটে আরও ক্লেশ যোগ করে ছাড়বে। এটাকে তুলে দেওয়া হোক!

না না। তোলা চলবে না। সকলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠলেন।

তুলে দিলে এই সন্ধেবেলাটা আমরা যাব কোথায়? সাত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার মতো ক্লেশদায়ক আর কি আছে? আমাদের বাড়ি…।

বক্তা উঠে দাঁড়িয়ে সকলের দিকে হাসি-হাসি মুখে তাকালেন, আমাদের বাড়ি, সেই হোম হোম সুইট হোম। স্বামী স্ত্রী যেন দুটি খত্তাল। একটি ঘরে আর একটি বাইরে। যতক্ষণ দুজন দুদিকে, অলরাইট, শান্তি। যেই কাছাকাছি স্ট্রাইকিং ডিসটেনসে এল, ঝম ঝম ঝম ঝং। চিনে বাদ্যি শুরু হল। তা সেই পুংখত্তালের আটক থাকার জায়গাটাকে আপনারা উঠিয়ে দেবেন? আমরা এখানে। থাকলে গেরস্তরা তবু একটু শান্তিতে থাকে।

বক্তা বসলেন। সভাপতি বললেন, দ্যাট মিনস এই সমিতি কিছু কাজের হয়েছে।

অফকোর্স হয়েছে। এই তো হোমিওপ্যাথিক কায়দায় সেদিন মেয়ে দেখে এলুম। উঃ, সে এক এক্সপিরিয়েনস মশায়।

কীরকম, কীরকম? সকলে উৎসাহী হয়ে উঠলেন শোনার জন্য।

ভাইপোর বিয়ে। মেয়ে দেখা হচ্ছে। সেদিনে সেই উনি বললেন না, মেয়ে বাজিয়ে নিতে হয়। বাড়িতে বললুম, ব্যাপারটা আমি হ্যাঁন্ডল করব। একটা বউমা আনব তবে বাজিয়ে আনব। সকলেই রাজি, দেখা যাক তোমার কেরামতি। আমার ফ্রেন্ড পঞ্চানন হোমিওপ্যাথি করে। সোস্যাল সার্ভিস নয়, ফিওয়ালা হোমিওপ্যাথ। চল পঞ্চু, দেখি তোমার কেরামতি। স্পাইগিরি করতে হবে। ভাবলক্ষণ দেখে বুঝতে হবে একটি মেয়ের ভেতরে কি আন্ডার কারেন্ট বইছে। জেনেটিক স্ট্রাইকারটা ধরে ফেলতে হবে ওপর থেকে। ছেলের দুই কাকা সেজে, বড়কাকা আর ছোটকাকা…।

হাসালেন মশাই, কাকার আবার বড় কি? কাকা বড় হলেই তো জ্যাঠা হয়ে যায়। বলুন মেজোকাকা, সেজোকাকা।

সেকী! ব্যাপারটা তাহলে তো খুব কেলো হয়ে গেছে মশাই। আমরা তো ছেলের বড়কাকা আর ছোটকাকা বলে মেয়ে দেখে এলাম তিন ঘণ্টা ধরে।

ধরে ফেলবে, ফিশি অ্যাফেয়ার। বড়কাকা হয় না।

কে বলেছে হয় না, ছোট হলে বড়ও হয়। সেই পড়েননি বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।

লাও এ আর-এক পণ্ডিত। আরে মশাই এ বড় সে বড় নয়। বয়েসে বড়।

আপনি মশাই আর-এক মূর্খ। ছোট বয়স বেড়ে-বেড়েই তো বড় বয়স হয়। যেমন ধরুন আমার পিতা। পিতা ছোট ছিলেন, পিতা বড় হতে শুরু করলেন, পইতে হল, আরও বড় হলেন, হতে-হতে আমার পিতা হলেন।

গবেট, ফাশক্লাস গবেট। স্ট্যাটাস, সম্মান, সম্মানের কথা হচ্ছে, হাইট, বয়স, ওজন এসব কোনও ফ্যাকটারই নয়। যে-কোনও ছোটকাকার বয়স পাঁচও হতে পারে বেঁচে থাকলে একশোও হতে পারে। দে আর বরুন লাইক দ্যাট, ছোটকাকা, মেজোকাকা, সেজোকাকা, বড়কাকা, মেজোজ্যাঠা, সেজোজ্যাঠা অ্যান্ড সো অন।

দাঁড়ান, দাঁড়ান ব্যাপারটা কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। কই আমি তো পিতা হয়ে জন্মাইনি। জন্মে তবে পিতা হয়েছি। তবে হ্যাঁ পড়েছি, ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে। তার মানে কাকা হয়ে, জ্যাঠা হয়ে জন্মানো যায় একসেপ্ট পিতা। পিতাস আর মেড নট বরুন। মাথাটা কেমন করছে। আমি সভাপতির সাহায্য চাই। প্লিজ এই ঘোটপাকানো ব্যাপারটা একটু সমঝে দিন।

সভাপতি বললেন, ব্যাপারটা হল রিলেশানের ব্যাপার। একটা ব্ল্যাকবোর্ড থাকলে বোঝানো সহজ হতো। যাক এই কার্ডবোর্ডটায় এঁকে বুঝিয়ে দি। দশটা লোক পাশাপাশি। ধরা যাক তিন নম্বর ব্যক্তি কারুর পিতা। তাহলে কি হল?

আজ্ঞে তিন নম্বর ব্যক্তি তাহলে কারুর পিতা হলেন।

ইয়েস। এ পর্যন্ত তাহলে ক্লিয়ার?

হ্যাঁ ক্লিয়ার।

তাহলে তিন নম্বর ব্যক্তি যার পিতা, দুনম্বর ব্যক্তি তার মেজোজ্যাঠা, প্রথম ব্যক্তি তার বড়জ্যাঠা। এই হল ওপর দিকের রিলেশান। এইবার পিতার নীচের দিকে যারা তারা সব কাকা, ছোটকাকা, নকাকা, রাঙাকাকা।

দাঁড়ান পজিশনটা একটু সরিয়ে নি, ধরা যাক ওই সারির চতুর্থ ব্যক্তি তো আমার পিতা হলেন না, তিনি আমার জ্যাঠা হলেন, কোন জ্যাঠা?

সেজো জ্যাঠা।

পঞ্চম ব্যক্তি কে হলেন?

ন’কাকা।

তার মানে ছোটকাকা উবে গেলেন!

উবে নয়, যার ছোটকাকা হওয়ার কথা ছিল তিনি হয়ে গেলেন বাবা। সম্পর্ক বুঝতে গেলে সারেগামা বুঝতে হবে। এই সারির দশটি লোক হল, বড়, মেজো, সেজো, ছোট, ন, রাঙা, নতুন, গোলাপ ইত্যাদি। এইবার এদের ছেলেপুলে, ডালপালায় নানা সম্পর্ক।

কি আশ্চর্য ভাই, এই প্রথম আবিষ্কার করলুম জন্মেই বাবা হওয়া যায় না তবে জ্যাঠা কি কাকা হওয়া যায়, বাবাস আর মেড নট বরন।

খুব জ্ঞান বেড়েছে মশাই। এদিকে মনুষ্যক্লেশ নিবারণী। মেয়ে দেখা কেমন হল তা আর শোনা হল না।

সভাপতি বক্তাকে মেয়ে দেখার কথা বলতে আদেশ করলেন। বক্তা আবার শুরু করলেন?

আমি ছোটকাকা, পঞ্চু ডাক্তার বড়কাকা। পঞ্চুকে দেখতে-শুনতে বড়-বড়ই লাগে, বেশ ভারিক্কি। মেয়েকে তখনও আসরে ছাড়া হয়নি। মেয়ের বাবা সামনে বসে আলাপসালাপ করছেন। কোলের ওপর নিজের থ্যাসকান উদর, মুখটি গোলাকার, নাকের ডগাটা গণ্ডারের মতো, ঈষৎ লাল। চুল বুরুশের মতো, কালো কুচকুচে। একটা চোখ সামান্য ছোট। হাতের আঙুল পাকার মতো। প্রথম পাবে ছাড়াছাড়া চুল, শূন্য নম্বর পেন্টব্রাশের মতো; সোজা-সোজা হয়ে আছে। কথা বলতে বলতে কলার মতো আঙুল দিয়ে হাঁটুতে বাজনা বাজাচ্ছেন কেটল ড্রামসের মতো। মাঝে-মাঝে হাঁটু নাচাচ্ছেন, ভুরু কোঁচকাচ্ছেন। পঞ্চু ডাক্তার সব লক্ষ্য করছে। আমি দেখছি বুঝছি না কিছুই, একটু অস্বাভাবিক লাগছে এই যা। পঞ্চু দেখছে এবং বুঝছে। পঞ্চ হঠাৎ প্রশ্ন করল, আপনার বাবার সামনের দাঁত দুটো কি ফঁকা ছিল? ভদ্রলোক থতমত খেয়ে বললেন, কেন বলুন তো?

না এমনি।

ভদ্রলোক ঢেউ করে একটা সেঁকুর তুললেন। ডক্টর পঞ্চানন সঙ্গে-সঙ্গে জিগ্যেস করলে, আপনার মায়ের কি অম্বল ছিল? ভদ্রলোক অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ছিল কি! আছে। মা এখনও জীবিত। আর ওই একটাই অসুখ। পঞ্চানন হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে গিয়ে প্রশ্ন করল, আপনার ঠাকুরদা কি শীতকালে কনকনে ঠান্ডা জলে চান করতে ভালোবাসতেন? ভদ্রলোক অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ঠিক বলতে পারব না। পঞ্চানন সঙ্গে-সঙ্গে প্রশ্ন করল, আপনার বাবার ছিল ঠিক উলটো, শীতকালে জল দেখলেই ভয়ে সাত হাত দূরে সরে যেতেন। ভদ্রলোক এইবার বেশ রাগতভাবেই বললেন, এ সব প্রশ্ন কেন? পঞ্চুর উরুতে অদৃশ্য চিমটি কেটে বললুম, ইনি অল্প বিস্তর ডাক্তারি করেন তো, হোমিওপ্যাথি, ভীষণ নামডাক।

ভদ্রলোকের রাগ কমেছে বলে মনে হল না। তিনি বললেন, আপনারা তো মেয়ে দেখতে এসেছেন, রুগি দেখতে আসেননি। সবিনয়ে বললুম, তা ঠিক, তবে কিনা ভালো ডাক্তারের চোখে সবাই রুগি, যেমন, ভালো জ্যোতিষীর চোখে সবই গ্রহ, ভালো ধর্মগুরুর চোখে সবাই পাপী।

পঞ্চানন উৎসাহের চোটে উঠে পড়েছে। দূরে দেওয়ালে একটা অয়েল পেন্টিং ঝুলছিল। রুদ্রাক্ষের মালা পরা তেঁটিয়া এক বৃদ্ধ আসনে বসে আছেন। পঞ্চানন ছবিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে জিগ্যেস করল, পায়ের আঙুলে কড়া ছিল এনার? প্রস্রাবের দোষ ছিল কি? শীতে হাঁপানি হতো? মুদ্রাদোষ ছিল?

ভদ্রলোক আসন ছেড়ে উঠে আমি কিছু করার আগেই ভীমবেগে তেড়ে গিয়ে ডক্টর পঞ্চাননের গালে এক থাপ্পড় ইডিয়েট, আমার গুরুদেবকে নিয়ে রসিকতা! গেট আউট, গেট আউট।

ন্যাজ তুলে দুজনেই রাস্তায়। পঞ্চাননের গাল লাল।

আমি বললুম, পঞ্চানন, তুমি সব ছেড়ে গুরুদেবকে নিয়ে পড়লে কেন? মেয়ে, মেয়ের বাপ, মা, বাপের বাপকে দেখতে পারো, গুরুদেবকে ধরে টানাটানি করে কি পেলে?

পঞ্চা বললে, বেঁচে গেলে। গুরুকে ধরে টানতেই হাই-প্রেশার বেরিয়ে পড়ল। জেনেটিক্যালি ওদের বংশে পাগলের বীজ ঘুরছে।

০৬. ষষ্ঠ অধিবেশন

নিপ ইন দি বাড। হ্যাঁ ভ্রূণেই হত্যা। বিবাহই হল মনুষ্য জাতির নাইনটি পার্সেন্ট ক্লেশের কারণ। ওই হোমিওপ্যাথি দিয়ে কি হবে না, মশাই। একবার জোড় লেগে গেলে সারাটা জীবন ত্রিভঙ্গ -মুরারী হয়ে বয়ে বেড়াতে হবে। বদহজমের দাওয়াই আছে, বদ-বিবাহের কোনও দাওয়াই নেই। বিয়ের আগে পাত্রীপক্ষের চালচলনই আলাদা। মেয়ের আমার তুলনা হয় না মশাই; রূপে তো আর মানুষের হাত নেই কিন্তু গুণ! একেবারে ট্রেইনড জিনিস। যেমন চলন, তেমনি বলন, একেবারে ডোম্যাসটিকেটেড টাইগ্রেস। লেজ ধরে হিড়হিড় করে টানাটানি করলেও ফিকফিক করে হেসে যাবে। একবার যাচাই করে দেখুন। পতিপ্রাণা, সংসারসেবিকা, মৃদুভাষী, কর্মনিপুণা, স্বল্পভোজী, সমুদ্রের মতো হৃদয়, ফোয়ারার মতো দয়ালু, আকাশের মতো উদার। ঠিক যেমনটি আপনি চান তেমনটি।

ও-মশাই! যেই না বিয়ে শেষ হল, ফুলশয্যার খাট থেকে সংসারের চাতালে নেমে এল আর-এক মূর্তি। দুর্গ দখল। আঁচলে বাধা স্বামী, হামভি মেলেটারি তেমভি মেলেটারি। শানবাঁধানো গলা। নাচের পুতুলের মতো হাত-পা নাড়া। তেরছা চাউনি। দুমদুম চলন। নাও শালা এখন ম্যাও সামলাও।

শালা বলছেন কেন?

ও কিছু না, রামকৃষ্ণ বলতেন।

তিনি তো অনেক কিছুই বলতেন। সব ছেড়ে তাঁর শালাটাকেই ধরলেন?

আজ্ঞে হ্যাঁ। বোনটিকে তো সারা জীবনেও ম্যানেজ করতে পারলুম না, শ্যালককে ধরেই টানাটানি করি। লাস্ট টোয়েন্টি ইয়ার্স ব্যাঙ্কশালে প্র্যাকটিশ করছি। লাস্ট ফাঁইভ ইয়ার্সে ফাঁইভ হান্ড্রেড ডিভোর্স কেস ট্যাকল করেছি। ফেড-আপ। আমার কুকুর হতে ইচ্ছে করছে! আমায় দে মা কুত্তা করে, আমার কাজ নেই আর মনুষ্য জীবনে।

আপনার মতে এই ঝামেলা থেকে মুক্তির কী উপায়?

উপায় একটাই। খাও-দাও আর বগল বাজাও। আপনি আর কপনি। খাল কেটে কুমির ঢুকিও না।

মেয়েরা মেয়েদের জগতে থাক, ছেলেরা ছেলেদের জগতে। ইস্ট ইজ ইস্ট, ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট, দি টোয়েন শ্যাল নেভার মিট।

বাঃ-বাঃ। তাহলে সৃষ্টি কি করে রক্ষা হবে? ভগবানের কিংডাম ধরে টানাটানি।

আর্টিফিসিয়ালি হবে। ভেটরিনারি ডাক্তার ডাকা হবে। নো বিবাহ। যার শিল যার নোড়া তারই ভাঙি দাঁতের গোড়া। ওসব চলবে না। মনুষ্যক্লেশ যদি নিবারণ করতে চান ফটাফট বিয়ে বন্ধ করুন। পেট যদি ভালো রাখতে চান তেলেভাজা খাবেন না। স্বাস্থ্য যদি ভালো রাখতে চান যোগব্যায়াম। মন যদি ভালো রাখতে চান উচ্চ চিন্তা। চোখ যদি ভালো রাখতে চান সবুজ। সুখী যদি হতে চান ব্যাচেলার।

বুড়ো বয়সে কে দেখবে?

ও। আপনাদের ধারণা বউ দেখবে। মুখের স্বর্গে বাস করছেন। আগেও দেখেনি এখনও দেখবে না। শঙ্করাচার্য কি লিখেছিলেনকা তব কান্তা কস্তে পুত্র। সেই গানটা আর তেমন কানে আসে না, আগে শোনা যেত, বোম্বে আউট করে দিয়েছে, সেই প্রেয়সী দেবে-এ এ ছড়া অমঙ্গল হবে বলে। দেখেননি স্বামী পটল তুললে মেয়েদের গতর বাড়ে।

ই হি হি। অশ্লীল শব্দ। গতর অত্যন্ত গ্রাইম্য ভাষা গ্রামারে নাই।

কোন পণ্ডিতে কইসে? সংস্কৃত গাত্র শব্দ হইতে গতর আসিয়াছে।

আপনারা বড় ঝগড়া করেন।

আজ্ঞে জীবধর্ম। পাশাপাশি থাকলেই লাঠালাঠি বেঁধে যাবে। দুজন ইংরেজ ক্লাব করে, দুজন স্কচ ব্যাঙ্ক করে, দুজন বাঙালি ঝগড়া করে, দল করে। একেই বলে বাঙালিদের প্রপার্টি। স্বভাব না যায় মলে।

আপনি সিনিক।

তবে শুনুন। দু-বউয়ের টেপ করা কনভারসেশান। আমার এক ক্লায়েন্ট তার বসার ঘরে টেপের ফাঁদ পেতে তার স্ত্রীর কথা ধরেছেন এবং প্রমাণ হিসাবে কোর্টে পেশ করার তালে আছেন।  ভদ্রলোকের স্ত্রীর নাম রমা। রমার বাড়িতে এসেছেন বান্ধবী শ্যামা। এইবার শুনুন।

রমা : বল তোর খবর কি! হঠাৎ এত মুটোতে শুরু করলি কেন? বিয়ের আগে তো শেপ ছিল। দিন-দিন যেন ঢাকের মতো হয়ে যাচ্ছিস।

শ্যামা : ধ্যাস, জীবনে অরুচি ধরে গেল শালা।

রমা : কেন মিঞা, প্রেম করে বিয়ে করলে, ঢাক ঢোল পেটালে, এখন নিজেই ঢোল মেরে গেলে?

শ্যামা : ঠিক হল না। যা ভেবেছিলুম তা পেলুম না। লোকটা বেয়াড়া।

রমা : আগে বুঝিসনি?

শ্যামা : ধ্যার, ফলস পার্সোনালিটি। তখন শ্যামা-শ্যামা করত। ফুল, বেলপাতা, চিনেবাদাম, পার্ক, গঙ্গার ধার, সিনেমা, সব ফলস। ভেবেছিলুম শ্যামা, শ্যামা মা হয়ে বুকে উঠে নাচব, ওরে বাপস, এখন আমাকেই বগলদাবা করে রেখেছে। তাঁ ফোঁ করার উপায় নেই। কি মেজাজ। ভয়ে মরি, যদি ঝেড়েফেড়ে দেয়। বলে প্রেম ইজ প্রেম, সংসার ইজ সংসার, দুটোকে মিকসআপ করে ফেলো না।

রমা : ভেরি স্যাড। আবার একবার লড়ে যাবি তারও উপায় নেই। চেহারাটা একেবারে বেঢপ করে ফেলেছিস।

শ্যামা : শাড়িটা নতুন কিনলি?

রমা : হ্যাঁ।

শ্যামা : রোজ একটা করে কিনিস?

রমা : রোজ না হলেও সাতদিনে একটা দুটো হয়ে যায়।

শ্যামা : এত টাকা পাস কোথা?

রমা : ক্লিন ঝাড়ফুঁক।

শ্যামা : সেটা আবার কি?

রমা : গরু দেখেছিস। সেরেফ দুয়ে যাও।

শ্যামা : তোর গরুর এত দুধ?

রমা : ফুকো দিয়ে বের করি। কায়দা জানতে হয়, ম্যান। বগল দাবা করার টেকনিক আছে। ম্যারেজ ইজ এ কনট্রাকট। মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে কি ছিল জানিস? ছেলেকে মেয়ের বাপের কাছে কথা দিতে হতো, আমি আপনার মেয়েকে রোজ হ্যাম, পর্ক, এগ, বাটার, পরিজ খাওয়াব, বছরে এক ডজন গাউন দেব প্লাস বাহাত্তর পাউন্ড মধু খাওয়াব। নো মামার বাড়ি। চুক্তি করে বউ।

শ্যামা : বের না করলে জোর করে বের করাবি?

রমা : টেকনিক আছে ভাই, টেকনলজির যুগ।

শ্যামা : (দীর্ঘ নিশ্বাসের শব্দ) আমার ভাই, একেবারেই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নেই। স্লেভ হয়ে পড়ে আছি।

রমা : আমার ফুল ফ্রিডাম প্লাস ম্যানিপুলেশন।

শ্যামা : কীরকম?

রমা : প্রথমে প্রেম দিয়ে মাথাটা চিবিয়ে সব সিক্রেট জেনে নিয়েছি। তোর বর মাসে কত রোজগার করে জানিস?

শ্যামা : না রে।

রমা : অনেক মেয়েই জানে না। ওইটাই হল হাজব্যান্ডদের ট্যাকটিকশ। রোজগারটা চেপে রাখবে, বউরা যেন গাঁটকাটা। আমি সেই সিক্রেটটাই আউট করে নিয়েছি। তাহলে প্রথমে গুপ্ত তথ্য আবিষ্কার পরে গামছা নিংড়োনো। ছাড়ো মাল। আঁমাঁর এঁখন পঁকেঁট খাঁলি, কাঁদুনি গাইবার পথ বন্ধ। পয়সা না ছাড়লে সংসার হয় না চাঁদু। বউ বশে থাকে না। ফিনকি হাসি, দুলকি চলন, ঝুমকি মিলন, সব পয়সার খেল। তুমি আমার স্ত্রী গো, শুকনো কথায় চিড়ে ভেজে না মানিক। চরকায় তেল দিতে হয়।

শ্যামা : তুই তো সাংঘাতিক কথা বলছিস রে। সংসার তো রসাতলে যাবে।

রমা : এ সব হল ইমপোরটেড কথা। বিদেশী বুলবুল। তুমি বব চুল চাইবে, ঠোঁটে লিপস্টিক চাইবে, কামানো ভুরু চাইবে, ম্যাঙ্গিকাট ব্লাউজ চাইবে, আর মেজাজটি চাইবে সতী বেহুলার স্বামী অন্তপ্রাণ, তা কি করে হয়, গুরু? আমি ভালোবাসতেও পারি, নাও পারি, আমি সংসার ভাঙতেও পারি, গড়তেও পারি, আমি মা হতেও পারি, ডাইনিও হতে পারি, আমার খুশি। শেকসপিয়র পড়িসনি, ইউ দাউ ম্যারি, ম্যারি এ ফুল। আমি ভাই এক ফুলকে বিয়ে করে বেশ সুখেই আছি।

শ্যামা : আমার যদি সামান্য অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও থাকত! স্বামীর হাততোলা হয়ে দিন কাটাচ্ছি রে, রমা!

রমা : মাঝেমধ্যে পকেট মার না।

শ্যামা : ধরে ফেলে মাইরি।

রমা : ধরে ফেলে মাইরি। কিছুই শিখলি না বিয়ে করে বসলি। আমার কত রকমের সোর্স অফ ইনকাম। বাজারে মারি, রেশনে মারি, মুদিখানায় মারি, স্টেশনারিতে মারি।

শ্যামা : কীভাবে? তুই নিজে বাজার করিস?

রমা : নিজে কেন করব? চুক্তি, এগ্রিমেন্ট, আরেঞ্জমেন্ট। মুদিকে, স্টেশনারকে বলে রেখেছি ডবল বিল করবে। বোকা লোকটা মুখ বুজে মাসের প্রথমে পেমেন্ট করে আসে, আমি পরে গিয়ে আমার হাফ পাওনা বুঝে নিয়ে আসি। হেহে বাবা টেকনিক। বিশ্বাসের জমির ওপর দাঁড়িয়ে বিশ্বাসঘাতকতা। ট্রেচারি দাই নেম ইজ উওম্যান।

কাট। এরপর আর টেপে কিছু নেই। দুই সখীর নিভৃত আলাপন। বন্ধুগণ, এর পরও কি আপনারা চাইবেন জীবনে কোনও আধুনিকা আসুক বধূরূপে? ও নো, নেভার। মেরি ওয়াইভস অফ উইন্ডসর পড়েছেন? স্যার জন ফলসটাফকে ফোর্ড বলছেন : আমার প্রেমের সৌধ আমি কোথায় খাড়া করেছি।

Like a fair house built upon
another mans ground
So that I have lost my edifice by
mistaking the place
where I erected it.

মি লর্ড. টলস্টয় লিখেছিলেন,

Don’t trust a horse in the pasture or a wife in the home!

বিশ্বাস করেছ কি মরেছ, ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কেস। ঘরে-ঘরে নাগিনিরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস। ছাঁদনাতলাই আমাদের বধ্যভূমি। মি লর্ড, দেশের বড়-বড় ওষুধ কোম্পানির উচিত, গর্ভনিরোধক বটিকা নয়, বিবাহ নিরোধ বটিকা, প্রেম নিরোধ বটিকা প্রভৃতি প্রচুর পরিমাণে তৈয়ারি করিয়া পথিপার্শ্বস্থ জলসত্র হইতে একঘটি গঙ্গোদক সহ জনে-জনে পরিবেশন করা। আমার মক্কেলের বিবাহ করিয়া খুব আক্কেল হইয়াছে। বিবাহের পূর্বে তিনি ঘুঘু দেখিয়াছিলেন এবে ফঁদ দেখিতেছেন। ইহা এমন এক আক্কেলদন্ত যাহা আজীবন উঠি-উঠি অবস্থায় থাকিয়া মনুষ্যকুলকে চক্ষে সরিষাফুল দেখাইতে থাকে। মি লর্ড…

কি তখন থেকে মি লর্ড, মি লর্ড করছেন? এখানে কে আপনার লর্ড?

ও আই সি। আমি ভেবেছিলুম কোর্টে দাঁড়িয়ে সওয়াল করছি। এক্সকিউজ মি।

আপনি কি ব্যাচেলার?

আজ্ঞে না।

তবে আপনার এত সাহস এল কোথা থেকে! তখন থেকে নারীবিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন!

মাই প্রফেশান। যখন যার পক্ষে দাঁড়াই তখন তার জন্যেই লড়ে যাই। ডাক্তার, পলিটিশিয়ান, বিজনেসম্যান, ফ্লিমস্টার, পুলিসম্যান এঁদের সাত খুন মাপ। আমার স্ত্রীর অ্যাপ্রুভ্যাল আছে।

শুনুন, শুনুন। বিবাহ বন্ধ করা যাবে না। পতঙ্গ আগুনে ঝাঁপ মারবেই। তা ছাড়া, এটা হল এজ অফ সেক্স। যেদিকেই তাকাও মোহময়ী নারী। সিনেমার পোস্টারে, বিজ্ঞাপনে, রাস্তায় ঘাটে, বাসে-ট্রামে, ঘরে-বাইরে, নাটকে নভেলে মায় মন্দিরে শ্মশানে। এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে! তবে হ্যাঁ, একটা উপায় আছে। কথায় বলে, সাবধানের মার নেই, মারের সাবধান নেই। একটু ডিটেডটিভগিরি করে তারপর মেয়ে ঘরে আনলে মনুষ্যক্লেশ মনে হয় সেভেনটি পার্সেন্ট কমে যাবে। বাবলা গাছে বাঘ বসেছে।

সে আবার কি?

হঠাৎ মনে হল। একটা দৃশ্য, হবু বেয়াই ছদ্মবেশে বাড়ির সামনের রকে বসে-বসে বিড়ি ফুঁকছেন। ফুঁকছেন আর দেখছেন। লোকে ভাবছে। কোথা থেকে পাড়ায় এক নতুন পাগল এসেছে। আসলে পাগল না, বেয়াই। মেয়ে এলোচুলে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। স্বভাবটি কেমন? কার দিকে নজর? কটা ছেলে সকাল থেকে সাইকেল নিয়ে চক্কর মেরে গেল? মেয়ে কখন বেরোয় অ্যাবসেন্সে দুপুরে সিনেমা। বাড়িতে কে ঢুকছে কে বেরোচ্ছে, কতটা হইহই হচ্ছে? এক্সট্রোভার্ট না ইনট্রোভার্ট। ঝগড়ার পরিমাণ। কার গলা কত উঁচু। মেয়ে হারে না মা হারে। ঝগড়ার সময় কি ধরনের ল্যাঙ্গোয়েজ বেরোয়! কতক্ষণ রেডিও চলে? ছুটতে ছুটতে বারান্দায় বেরিয়ে আসে না ধীর পায়ে? রাস্তা দিয়ে পরিচিত কেউ গেলে চিৎকার করে ডাকে কিনা? ফেরিওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করে কি না? ছাদে উঠে লাফায় কিনা? রাস্তার দিকে বেশি থাকে না বাড়ির ভেতর? প্রেমঘটিত কোনও ঝামেলা আছে কিনা? বাড়ি সম্পর্কে পাড়ার লোকের ওপিনিয়ান কি! বাবলাগাছে বাঘ, আই মিন উড বি ফাদার ইন ল বসে উড বি পুত্রবাঘিনীর চালচলন লক্ষ্য করছেন। একটু খাটতে হবে কিন্তু সুফল অনেক। ইনটারেস্টিং ব্যাপার। ম্যারেজ আর ওয়েলডিং সেম ব্যাপার। ধাতুতে-ধাতুতে জোড়াজুড়ি। সমানে-সমান জোড় লাগাতে হবে। দুটো দুরকমের হলেই খুলে পড়ে যাবে। চিড়িক ধরে যাবে। সাপের ছুঁচো গেলা। না পারছে গিলতে, না পারছে ওগরাতে। এই ভাবে, এইভাবেই আমরা মনুষ্যক্লেশ কিছু কমাতে পারি। জনহিতকর কাজের পাঁচনটা তাহলে বলেই ফেলি।

Take a dozen Quakers-be Sure
Theyre Sweet and pink.
Add one discussion program
to make the people think
… Garnish with Compassion just
a touch will do.
And served in deep humility
your philanthropic stew.

০৭. সপ্তম অধিবেশন

ঘরে-ঘরে বউ জাতির অত্যাচার। সেই অত্যাচার সম্পর্কে আমারও কিছু বলার আছে।

হ্যাঁ-হ্যাঁ বলুন-বলুন। আমরা শোনার অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছি। হাটে হাঁড়ি ভাঙুন।

আমার দাম্পত্য জীবনের বয়েস নিয়ারলি টোয়েন্টি ইয়ারস। সেই টোয়েন্টি ইয়ারস আমার হাড়ে দুব্বো গজিয়ে গেছে।

বউটি কেমন?

কত রকমের বউ আছে জানেন?

আজ্ঞে না। রকম-রকম বউ নিয়ে ঘর করার সুযোগ হল কই?

বেশ তা যখন হয়নি তখন শুনে নিন। এক বোকা-বোকা ভালোমানুষ ধরনের। এঁদের ঠোঁট তেমন পাতলা নয়। নীচের ঠোঁট সামান্য ঝুলে থাকে। দাঁত উঁদুরের মতো নয়। নাক তেমন তীক্ষ্ম নয় একটু থ্যাবড়া মতো। গোল-গোল চোখ। গোল-গোল মুখ। চুল মোটা বালামচির মতো। এসরাজের ছড়ে ব্যবহার করা চলে। কপালে বড় টিপ পরেন। সেটা কখনই সেন্টারে প্লেস করতে পারেন না। হয় একটু বাঁয়ে না হয় একটু ভাঁয়ে সরে যায়। যত বয়েস বাড়তে থাকে ততই চর্বিযুক্ত হতে থাকেন। চুলের বহর কমতে কমতে শেষে মাথার টঙে একটি বড়ি খোঁপা। গলার স্বর বীণার মতো নয় ফ্লুটের মতো। শব্দে র-ফলা থাকলে জিভে জড়িয়ে যায়। ঋ-ফলারও সেই অবস্থা। দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ ঠিক মতো উচ্চারণ না হয়ে এইরকম শোনাবে–দাবিড় উতকল বঙ। তুমি হাড় কৃপণ বলতে গিয়ে বললেন–তুমি হাড় কিপটে। এঁদের হাঁটা চলায় ভূমিকম্পের এফেক্ট। সিসমোগ্রাফে ধরা পড়বে। রেগে কথা বললে তানসেন। ঘটি বাটি গেলাস আলমারি কাঁচ ঝিনঝিন করে উঠবে। দু একটা বা ফিউজ হয়ে যেতে পারে। ফ্লোরেসেন্টের স্টার্টার কেঁপে উঠবে। এঁরা চুরি করে স্বামীর ব্যাগ থেকে পয়সা বের করতে গেলে মেঝেতে ঝনঝন করে ছড়িয়ে ফেলবেনই। হিসেবে কঁচা। দরজায় ফেরিওয়ালা ডাকার অভ্যাস। দরদস্তুর করে ছটাকার জিনিস আট টাকায় কিনবেন এবং অম্লানবদনে ছেঁড়া নোট ফেরত নেবেন। বয়েসে বাত হবে। ঘনঘন সর্দির ধাত। এই হল টাইপ ওয়ান।

টাইপ টু। বুদ্ধিমান। পাতলা-পাতলা ছিমছাম চেহারা। পাতলা ঠোঁট, পাতলা নাক। নাকের ডগা ঘামে। চোখ টানা-টানা, রাগী-রাগী। হালকা হরধনু ভুরু। পাতলা চুল। সামান্য কেঁচকানো। বেশ লম্বা সামান্য কটা। একটু খোঁচাখোঁচা চেহারা। কপালের টিপ বিন্দুর আকারে সেন্টারে। এঁদের অভিমানের চেয়ে রাগ বেশি। রাগলে নাকের পাটা ফোলে, ঠোঁট কাঁপতে থাকে থিরথির করে। মন ভালো থাকলে গুনগুন গান। হিন্দি ছবির, বাংলা ছবির, সবই অবশ্য দু-লাইন করে। সময় সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত। এঁদের হাঁটা চলা হালকা পায়ে। প্রসাধন প্রিয়। সপ্তাহে একটা বড় সাবান খরচ করে থাকেন। মাসে দু-শিশি শ্যাম্পু। মাথায় খুসকির উপদ্রব। লিভার কমজুরি। মধ্যবয়েসে হাঁপানি হতে পারে। রাগের অভিব্যক্তি গুম হয়ে থাকা। মিনিমাম সাতদিন স্পিকটি নট। তোষামোদ প্রিয়। পিঠে হাত না বুলোলে রাগ পড়ে না! স্বামীদেরই এগিয়ে যেতে হয়–ওগো রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি। যা হয়ে গেছে এবারের মতো ভাব।

এই হল দুটো এক্সট্রিম টাইপ। এদেরই পারমুটেশান কমবিনেশানে আমাদের দেশের যাবতীয় বউ। সকলেই রাগী। কেউ বদরাগী কেউ আবার নিমরাগী। কেউ রেগে গেলে কেঁদে ফেলেন, কেউ খামচাখামচি করেন, কেউ কাপডিশ, জুতো, ঝ্যাঁটা ছোঁড়েন, কারুর হাঙ্গারস্ট্রাইক শুরু হয়ে যায়, কেউ বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, কেউ বাপের বাড়ি যাব বলে সুটকেস গুছোতে থাকেন। সংসারের স্থির জলে এঁরা হলেন উড়ুক্কু মাছ। দেওয়ালের গায়ে বসে শুড় নাড়া আরশোলাও বলতে পারেন। থেকে-থেকেই সংসারের এ-দেওয়াল ও-দেওয়ালে ফরফর করে উড়ে বেড়ান।

এখন বলুন আপনার বউ কোন প্রজাতির?

আজ্ঞে মিক্সড টাইপ। আপনি যেসব লক্ষণ বললেন তার কিছু কিছু মেলে তবে ইনি রেগে গেলে গান করেন আর খাওয়া বন্ধ হয় না বরং বেশি-বেশি খেতে থাকেন।

হুঁ, এঁরা খুবই সাংঘাতিক ধরনের। কোল্ড অ্যান্ড ক্যালকুলেটিং টাইপ। এঁদের সঙ্গে ঘর করতে পারেন। তারাই যারা মোটাসোটা গাবদাগোবদা একটু ব্লান্ট টাইপের। সামান্য ভুঁড়ি থাকবে, হাতে বড়-বড় খসখসে চুলের মতো লোম। চোখ ঘোলাটে লাল। নাকের ছিদ্রে চুল। ঘুমোলে গাঁকগাঁক করে নাক ডাকে। খেয়ে বাছুরের মতো ঢেঁকুর তোলেন। গুতিয়ে বাসে-ট্রামে ওঠেন। নামার স্টপেজ এলে আর ধৈর্য ধরতে পারেন না, সিট থেকে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সদ্যোজাত ছাগলের মতো চঁট ছুঁড়তে-ছুঁড়তে হুড়মুড় করে নেমে যান। স্নানের পর মাথার চুলে সেরখানেক জল থাকবেই আর সেই অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সরু চিরুনি দিয়ে ফচাক-ফচাক করে সামনে টেনে পেছনে উলটে চুল আঁচড়াবেন। আয়নার কাঁচে তেল জলের ছিটে। স্নানের পর স্ত্রীর শাড়িই দুর্ভাঁজ করে কোমরে ফাঁপা গিট দিয়ে একটু উঁচু করে পরবেন এবং খেতে বসার সময় কাঁধে একটা ভিজে লাল গামছা অবশ্যই থাকবে। হাত ধুয়ে প্রথমে পাছায় ভিজে হাত লেপটাবেন তারপর শাড়ির সামনের দিকে মুছবেন। এঁদের কেউ-কেউ মোটরবাইক চালাবেন। হিন্দি সিনেমা প্রিয় হবেন। তারকাঁদের মধ্যে গব্বরকে ভালো লাগবে, নায়িকাঁদের মধ্যে আমান। আড্ডাবাজ হতে হবে। তাস দাবা চলতে পারে। পরস্ত্রীর দিকে অপাঙ্গ দৃষ্টি। ঘরে লালসুতোর বিড়ি বাইরে সিগারেট। সারি আসনে বসলে পা দুপাশে যতদূর সম্ভব ফাঁক করে থাকবেন। প্যান্টের পকেট থেকে পয়সা বা রুমাল বের করার সময় পাশে যিনি থাকবেন তার কোমরে, ওপরে পাঁজরে ইনভেরিয়েবলি খোঁচা মারবেন। ঘুমের ঘোরে হাত পা ছোঁড়ার অভ্যাস থাকবে। হুড়ুম করে পাশ ফিরবেন। পাশে আর কেউ শুয়ে থাকলে খাট থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা হবে। সস্ত্রীক বেড়াতে বেরোলে শিশুটিকে নিজেই বুকে বহন করবেন। যানবাহনে সবুক-শিশু যাঁর সামনে দাঁড়াবেন তার প্রাণ বের করে দেবেন। শিশুর পায়ে ধুলোকাদা গোবর মাখা, লাল জুতো। সেই জুতো কখনও কপালে, কখনও গালে, কখনও ধবধবে জামার বুকে এসে সিলমোহরের মতো লাগতে থাকবে। বিরক্ত হলেও ভূক্ষেপ করবেন না। যাকে তেল দেওয়ার দরকার তাকে তেল দেবেন এবং কাজ মিটে গেলে তাকে আর চিনতে পারবেন না। বাড়িতে অচেনা কেউ এলেই ফিউরিয়াস হয়ে জিগ্যেস করবেন–কি চাই? বারোয়ারি পুজোর চাঁদা দেওয়ার সময়ে প্রতিবারই একটা করে লাঠালাঠি ফাটাফাটির নায়ক হবেন।

আপনি কি ওইরকম?

আজ্ঞে না। কিছু কিছু মিলছে তবে পুরোটা নয়।

তাহলে তো নির্যাতিত হতেই হবে। আচ্ছা শোনা যাক।

অতীতের ইতিহাস আমি বলতে চাই না। সে যা হওয়ার হয়ে গেছে। একবার আমাকে চুড়ি মেরেছিল।

সে আবার কি?

আমার শ্বশুমাতা আত্মরক্ষার জন্যেই বোধহয় মেয়ের হাতে কিরিকাটা দুটো বালা পরিয়ে দিয়েছিলেন। একবার ঘষে দিলেই বিহারি পোকা।

বিহারি পোকা?

সাঁওতাল পরগনায় বর্ষাকালে সন্ধেবেলা একরকমের পোকা ওড়ে। গায়ের পাশ দিয়ে একবার উড়ে গেলেই হল। ছাল ছিঁড়ে কালো ঘা। আমার বউয়ের বালা দুগাছা সেই মাল। বেশি জোরজার করলেই যাও বলে একবার হাতঝামটা। ব্যাস দাগরাজি। সপ্তাহখানেক ভোগো। সুগার থাকলে ঘা শুকোতে মিনিমাম এক মাস। তার ওপর একা রামে রক্ষে নেই দোসর লক্ষ্মণ। হাতে একটি নোয়া। আছে। মুখটা সামান্য ফঁক ক্ষয়ে ক্ষয়ে ক্ষুরধার। মাথার ওপর দিয়ে একবার হাত ঘোরালেই এক খামচা চুল গন। তার ওপর ব্লাউজে ডেও-ডেও সেফটিফিন। তার ওপর নাকে একটি তিনকোণা পাথরের নাকছাবি। তার ওপর কানে মধ্যযুগের গ্ল্যাডিয়েটারদের ঢালের মতো কানের পাতা চাপা কানপাশা।

এ তো মশাই রণচণ্ডী, খড়গখেটকধারিণী!

আজ্ঞে পরকুপাইন, শজারু গোছের জিনিস। শরীরে লেবেল মেরে দিলেই হয়–হ্যান্ডল উইথ কেয়ার।

এখন এমত একটি বস্তুর আচার আচরণের কয়েকটি নিদর্শন : আমি খেটে খাওয়া মানুষ।

তিনি তো খেটে খাওয়া নারী, আপনার সংসারের যন্ত্রী।

দ্যাটস টু। তবে আমি বেশ খাঁটি। খেটেখুটে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরি। স্বাস্থ্যের নিয়মে বলে সলিড এইট আওয়ারস ঘুম। ভোর পাঁচটায় আমাদের কাজের লোক আসে। খটাখট কড়ার শব্দ। দরজা খুলে দিতে হবে। দুজনেরই কানে শব্দ আসছে। দুজনেই শুনছি। কে ওঠে, কে খুলে দেয়। মশাই, মটকা মেরে পড়ে থাকে। প্রতিদিন তিনশো পঁয়ষট্টি দিন এই শর্মাকেই ঘুমচোখে উঠে টলতে টলতে গিয়ে দরজা খুলতে হয়। আর এমন শয়তান যেই এসে বিছানায় শুই অমনি মোলায়েম গলায় জিগ্যেস করে, কি গো খুলে দিয়ে এলে! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে। এটা ইউনাইটেড নেশানে তুলে ধরার মতো একটা আন্তর্জাতিক ব্যাপার। একেই আমার একটু কুসংস্কার আছে। সকালে আমি কারুর মুখ দেখতে চাই না, দিন ভালো যায় না। সেই আমাকে জোর করে দেখতে বাধ্য করাবে। ওই পাঁচটার সময় সাহস করে আর ঘুমোতে পারি না। ঘুমের সেকেন্ড এডিশান সহজে কাটতে চায় না। ভালো ঘুম হয় না বলে সারাদিনই শরীর খ্যাত খ্যাত করে, হাই ওঠে। এফিসিয়েনসি কমে আসছে বলে জুনিয়াররা টপাটপ প্রোমোশান নিয়ে মাথায় চেপে বসেছে।

এরপর ঝড়বৃষ্টির কাল আসছে, বর্ষা আসছে। সে আর-এক খেলা। সব জানালা খুলে শোয়া হল, মাঝরাতে তেড়ে ঝড়বৃষ্টি এল। আমার এই দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে এমন একটা দিন দেখলাম না যে দিন আমার বউ উঠে জানালা বন্ধ করেছে। মশারি তিমির পেটের মতো ফুলে উঠেছে। হু-হুঁ করে ধুলো ঢুকছে। তিনি শুয়ে আছন কাঠের পুতুলের মতো। এই শর্মাকেই তেড়েফুঁড়ে বেরোতে হবে, সারা বাড়ির যেখানে যত জানালা দুমদাম করে পড়ছে। সব একে-একে জলঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে বন্ধ করতে হবে। যেই ফিরে এসে শোব অমনি সেই মোলায়েম গলাসব বন্ধ করেছ তো?

হ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ।

রান্না ঘরেরটা?

হ্যাঁ সেটাও।

রান্নাঘরের জানলা দেখেছেন? যমেও ছোঁবে না। হাতময় কালি। একদিন রেগে গিয়ে, হ্যাঁ সেটাও বলি, সেই কালি রাত দুটোর সময় সারামুখে মাখিয়ে দিয়েছিলুম। ভোর পাঁচটায় ট্যাক্সি ডেকে বাপের বাড়ি। হাতে হ্যারিকেন। পনেরো দিন পরে পায়ে ধরে নিয়ে এলুম। শ্বশুমাতা উপদেশ দিলেন– পরের বাড়ির মেয়ে নিয়ে গেছ বাবা, অত্যাচার করলে তোমারই নিন্দে হবে। কি বংশের ছেলে তুমি। এ তো বউয়ের মুখে কালি নয় তোমার বংশের মুখে কালি। তুমি দোলের দিনে মাখাও কেউ কিছু বলবে না। অ্যালুমিনিয়াম মাখাও, আলকাতরা মাখাও, গরুরগাড়ির চাকার কালি মাখাও, বচ্ছরকার দিনে কেউ কিছু বলবে না। মজা দেখুন, শ্বশুরবাড়ির কাউন্সিলে আমাদের কেস আনরিপ্রেজেন্টেড। আমাদের পক্ষে কেউ বলার নেই, কেউ শোনার নেই। সেন্টার টেবিলে স্টেনলেস স্টিলের থালা। চারটে ফুলোফুলো বাদামি লুচি। কড়কড়ে আলু ভাজা। দুটো রসগোল্লা। ঢাউস এককাপ চা। সামনে চশমা চোখে সিগারেট মুখে গম্ভীর শ্বশুরমশাই। আর-এক চেয়ারে ষণ্ডামার্কা আধুনিক চেহারার শ্যালক। ঘরের মাঝখানে কাঁচাপাকা চুল ক্ষয়ক্ষয়া শাশুড়ি। দরজার বাইরে পরদা ধরে ম্যাকসিপরা মহা আদুরি শ্যালিকা। লুচি সহযোগে উপদেশ শুনে বউ বগলে বাড়ি। বউয়ে অরুচি!

নাও কাম টু দি পাখা প্রবলেম। খাটের ধারে শোবেন বউ। দেওয়ালের দিকে শোবেন স্বামী। যুক্তি–আমাকে তো ভোরে উঠতে হবে, টুক করে পাশ থেকে খসে পড়ব, তোমার ঘুমের ব্যাঘাত হবে না।

অফিসের ভাত ধরায়। সাত খুন মাপ। কিন্তু আমাকে যে বাথরুমে যেতে হয়।

বাথরুমে যাবে কেন? শোওয়ার আগে বেশ করে জল খেয়ে ঘণ্টাখানেক বসে-বসে মশার কামড় খাও তারপর বাথরুম করে একেবারে ড্রাই হয়ে শুয়ে পড়ো। রাতে বারেবারে উঠতে নেই খোকাবাবু। টানা ঘুমোতে হয়। এক ঘুমে রাত কাবার।

বেশ বাবা তাই হোক। শ্বমাতা বলেছেন স্বামী মানেই স্যাক্রিফাইশ। সন্ন্যাসীও স্বামী, বউয়ের বরও স্বামী।

কিন্তু ম্যাডাম আসল খেল তো শুরু হবে শোওয়ার পর।

মশারির ভেতর তিনি, বাইরে তার ঝুলন্ত পা জোড়া। পাতায়-পাতায় ঘষে ধুলো ঝরাতে ঝরাতেই গোটাকতক মশা ঢুকবে। এরপর তিনি ভেতরে পা টেনে নিতে-নিতেই আরও গোটাকতক। এরপর চুড়িবাদ্য করতে-করতে লটরপটর হাতে মশারি খুঁজতে-গুঁজতে আরও খানকতক। এইবার খোঁপা আলগা করে শয়ন ও হাই উত্তোলন–আলো নেবাও।

হয়ে গেল আমার পড়া। চোখে আলো পড়লে ঘুম হবে না। ঘুম না হলে ভোরে ওঠা যাবে না। দায় আমার। আলো নিবল। একটু উসখুস। দু-চারবার পায়ের পাতায়-পাতায় ঘষাষষি।

উঃ মশা ঢুকেছে। আলো জ্বালো।

আলো জ্বলল।

–নাও মশা মারো।

হাঁটু গেড়ে মশারির আয়তক্ষেত্রের ভেতরে এক বাহু থেকে আর-এক বাহুতে আমার ছোটাছুটি আর দুহাতে তালি। মশা কি অত সহজে মরে! তিনি শুয়ে-শুয়ে নির্দেশ দিতে থাকবেন।

–ওই যে ওই যে, ওই তো ওই কোণে, ওই কোণে। হা-হা উড়ে এদিকে চলে এল। ধ্যাস ল্যাদাডুস। মশা মারতেও শেখোনি, চাকরি করো কি করে!

মশার সঙ্গে গাদি খেলা। শেষে তাঁর দয়া হবে।

–নাও নিবিয়ে দাও, হয়েছে-হয়েছে।

আবার আলো নিবল। ঘুম আসছে-আসছে। গলা শোনা গেল।

–শালা খুব জ্বালাচ্ছে।

–কে?

–মনে হয় একটা পুরুষ মশা।

–কি করে বুঝলে পুরুষ মশা?

–তা না-হলে কানের কাছে এত গুনগুন করে গান গাইবে কেন? কামড়াবি কামড়া। তোমার মতো স্বভাব আর কি! একবার শুরু করলে চাপড় না খাওয়া পর্যন্ত থামতে চাও না।

–বেশ তা না-হয় হল। স্বামী আর মসকুইটো এক শ্রেণীর মাল, তা আমাকে এখন কি করতে হবে?

–মারতে হবে। আলো জ্বালো।

আলো জ্বেলে আবার মশার সঙ্গে এক চক্কর চোর পুলিশ খেলা। আবার শুতে-শুতেই বায়নাক্কা–হে প্রাণনাথ গলা শুকিয়ে গেছে, এক গেলাস জল। মশারির ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে জলের গেলাস নিয়ে আধশোয়া হয়ে আলগোছে ঢকঢক করে জল খেয়ে একটি প্রাণঘাতী শব্দ ছাড়া হল–আঃ। বিছানার বাইরে আমি দাঁড়িয়ে আছি মহারানির খাস ভৃত্য। গেলাসটা নিয়ে রেখে দিতে হবে।

গেলাস রাখতে-না-রাখতেই হুকুম মনে হয় অম্বল হয়ে গেল, দুটি জোয়ান দাও তো গো।

জোয়ান খেয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়া হল। খাট কেঁপে উঠল। ভাবলুম শেষ হল। অতই সহজ!–পাখাটা পুরো করে দাও। বেশ তাই করে দি। বিছানায় এসে শুয়েছি। বেশ ঘুম আসছে। দুচোখ জুড়ে। শুনছ? হ্যাঁ গো শুনছ?

–বল।

–পাখাটা তিন করে দাও, শীত-শীত করছে।

–তুমি করে দাও না!

–আমি শুয়ে পড়েছি। নামতে গেলেই মশা ঢুকে যাবে, পায়ে ধুলো লেগে যাবে।

–আমারও তো তাই হবে।

–তুমি নামার কায়দা জানেনা, তোমার চটি আছে।

বউকে টপকে খাট থেকে নেমে রেগুলেটর ঘুরিয়ে তিনে করে দিলুম। তারপর আবার বউ লঙঘন করে নিজের জায়গায় শুলুম। আবার ঘুম আসছে।

–শুনছ?

–কি হল প্রাণেশ্বরী?

–সুবিধে হল না। ভোলটেজ ড্রপ করেছে। তুমি-আর একবার কষ্ট করে ফুল পয়েন্টে করে দিয়ে এসো, লক্ষ্মীটি।

আবার ঘাড়ের ওপর দিয়ে হুড়মুড় করে মেঝেতে এসে পড়লুম। এবার খুব রেগে গেছি। আর শোওয়া নয়। টুলে বসেই রাতটা কাটিয়ে দিই, জরুকা গোলাম।

–কি হল, শোবে না?

–শুয়ে তো লাভ নেই। আবার ওঠাবে, ভোলটেজ বাড়বে কমবে, ভোলটেজ স্টেবিলাইজার হয়ে বাইরেই বসে থাকি।

–রেগে যাচ্ছ কেন? কত সহজেই তোমরা রেগে যাও। একটুও সহ্য শক্তি নেই। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলে গেছেন তিনটে স–শ ষ স সহ্য কর, সহ্য কর, সহ্য কর তিনবার। নাও চলে এসো। এবার শীত করলে তোমাকে জড়িয়ে ধরে শোব।

মশাই এই হল আমার রাত। দিনের কথা শুনলে আঁতকে উঠবেন।

০৮. অষ্টম অধিবেশন

মনুষ্যক্লেশ নিবারণের নাম করে মেয়েদের খুব কেচ্ছা করা হচ্ছে, লজ্জা করে না আপনাদের? নারী হল শক্তির অংশ, নারী হল জগদ্ধাত্রী। আমরা আছি বলেই তো আপনারা আছেন। কোথায় সেই পামর যে ভোলটেজ স্টেবিলাইজার হয়ে সারারাত পাখার সুইচ-এর তলায় বসে থাকে বলে খুব নাকে কেঁদেছে? কোথায় সেই ভদ্রলোক?

আজ্ঞে আপনাকে দেখে চেয়ারের তলায় লুকিয়েছে।

তাই নাকি! এই যে বেরিয়ে এসো। উঠে এসো। তোমার ছেলেকে যা শোভা পায় তোমায় তা শোভা পায় না। লড়তে হয় সামনা-সামনি লড়ে যাও! আমি কি করি, আর তুমি কি করো এঁদের সামনেই তার বিচার হয়ে যাক। উঠে এসো।

তুঁমি আঁবার তেঁড়েমেড়ে এঁই জঁনসঁমক্ষে এঁলে কেঁন?

ইয়ে হ্যায় ইজ্জত কি সওয়াল। নাকে কেঁদে পার পাবে না। চেপে ধরলেই চিঁচি ছেড়ে দিলেই লম্ফঝম্ফ, তোমাকে আমি হাড়ে-হাড়ে চিনি।

আমি না-হয় আমার দুঃখের কথা একটু সাতকান করেই ফেলেছি তা বলে এই কি একটা ঝগড়া করার জায়গা? নারী হবে ন, নতমুখী, সহিষ্ণু, মৃদুভাষী। নরম-নরম গরম-গরম। রোদে দেওয়া শীতের বিছানায় মতো।

ন্যাকামো রেখে এদিকে উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়াও।

উঃ তোমার এই ল্যাঙ্গোয়েজ, সো ভালগার। ভাবতে পারো, দুর্গা কি মা জগদ্ধাত্রী আরতির সময়, চারদিকে ধূপধুনোর ধোঁয়া, কাঁসর-ঘণ্টার শব্দ, ভক্ত নরনারী গদগদ, হঠাৎ বলে উঠলেন, ন্যাকামি রাখো।

তা কেন?

বাঃ এই বললে তুমি হলে জগদ্ধাত্রী, সিংহবাহিনী। তা ভাষা, চাল-চলনটাও তো সেই রকম হওয়া উচিত।

বাজে না বকে পাশে এসে দাঁড়াও।

আহা যান না মশাই, মিসেস যা বলছেন শুনুন না! তখন তো খুব গিন্নির নামে বলছিলেন, এবার ম্যাও সামলান। আমরা বাবা বলিও না ঝামেলাতেও পড়ি না। আমরা জানি সরকারের বিরুদ্ধে আর স্ত্রীদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানেই সিডিসান। পাচে পড়ে যাব। পুলিসের গায়ে কিল না মেরেই মরতে হয়, মারলে তো কথাই নেই।

আচ্ছা, আপনারা এইবার দেখুন, দুজনের হাইটটা দেখুন। আমার স্বামী আমার চেয়ে প্রায় একহাত লম্বা।

পশ্চিম বাংলায় সাধারণত তাই হয়। বউ মোটা তোক ক্ষতি নেই তবে মাথায়-মাথায় না হলেই ভালো। মাথা ছাড়িয়ে গেলে নাকচ। বউ লম্বা হলে কত্তার অকল্যাণ হয়। লোকে বলে হিড়িম্বা। বউ নয় তো যেন গিলে খেতে আসছে। এই তো বেশ মানিয়েছে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন মনে হচ্ছে যেন–মেড ফর ইচ আদার। দেখুন-দেখুন কি সুন্দর মানিয়েছে, যেন হরগৌরী, যেন দুষ্মন্ত শকুন্তলা, যেন রাম আউর রমা। আমার ঠাম্মা দেখলে নমস্কার করে বলতেন আহা নয়ন সার্থক হেন লক্ষ্মী-জনার্দন।

স্টপ।

বউ বেঁটে, স্বামী লম্বা। যে বাড়িতে বসবাস সেই বাড়িতে সমস্ত দরজা-জানালা সাত থেকে দশ ফুট উঁচুতে। ডিঙ্গি মেরে-মেরে নাগাল পাওয়া যায় না। জানালার গবরেটে উঠে উল্লুকের মতো ঝুলতে ঝুলতে প্রথম-প্রথম ছিটকিটি লাগাতুম। তখন সবে বিয়ে হয়েছে, এমন ঢিপসি হয়ে যাইনি। উনি বললেন, তুমি যখন জানলায় উঠে ওভাবে লচকে লচকে ছিটকিনি লাগাও তখন আমার ভেতর থেকে বোম্বে ছবির একটা হিরো বেরিয়ে আসে। একদিন হঠাৎ, না আমি বলতে পারব না, লজ্জা করছে।

আপনি হেলপ করুন। উনি মুখ ঘুরিয়ে থাকুন। আপনি বলে ফেলুন। মনে করুন এটা আদালত কিংবা চার্চের কনফেশান বক্স। ক্রাইম কবুল করুন।

ক্রাইম আবার কি? স্ত্রীকে ধরে পেটালেও ক্রাইম হয় না, আদর করলেও রেপ হয় না। মনুসংহিতা বলছে।

দ্বিধাকৃত্বাত্মনো দেহমর্ধেন পুরুষোহভবৎ।
অর্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্রভুঃ।।

সৃষ্টির পূর্বে ঈশ্বর আপনাকে দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া এক অংশে পুরুষ, অপরাংশে নারীমূর্তি পরিগ্রহ করিলেন ও সঙ্গত হইলেন। তার মানেটা কি! আমার অর্ধেকটা আমি আর অর্ধেকটা উনি। হাফ প্লাস হাফ ইজ ইকুয়ালটু সেই।

সেইটা কি?

আমি। সেই মহা আমি, যার এত হাঁকডাক হম্বিতম্বি, রাজা প্রজা, বড়বাবু ছোটবাবু, সধবা বিধবা, হিরো ভিলেন, সাধু শয়তান প্রজা ক্যাপিটাল আমি। বউকে পেটানো মানে নিজেকে পেটানো, খামচানো মানে নিজেকে খামচানো, আদর করা মানে নিজেকে আদর করা। ওর ভেতর কে বসে আছে ঘাপটি মেরে? আমি। হাম হায়। বৃহদারণ্যক পড়ুন ও ন বা অরে জায়ায়ৈ জায়া প্রিয়া ভবত্যত্মনস্তু কামায় জায়া প্রিয়া ভবতি। জায়ার ভেতর আত্মস্বরূপিণী দেব বর্তমান। তাই তো জায়া এত প্রিয়। তার মানে কি? কে একটা আমার ভেতরেও রয়েছে ওর ভেতরেও রয়েছে। যেই বলব, কে গো, সে বলবে আমি গো, আবার যেই ও বলবে, কে গো, আমি বলব, আমি গো।

অ্যায়, আমি বলছেন কেন? বলুন সে বলবে। আমি গো।

ওই হল। সেই তো আমি, আমিই তো সে।

বাঃ তুমিটা তাহলে উবে গেল?

না উবে যাবে কেন? কত রকমের বাদ আছে জানেন, দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ। কখনও আমিই সব। আমার জমিজমা, বিষয়সম্পত্তি, নাম ধাম কাম। সব আমার। লীলার সময় আমি তুমি। মিলনে তুমহি হি হি। হি মানে সে বা তিনি। তখন তন্ত্র।

তোমার ওসব মামদোবাজি রাখো। রেখে কবুল করো তুমি কি ধরনের মাল। নিজে করো তো ভালো, যদি না করো সমগ্র নারীজাতির স্বার্থে আমাকেই করতে হবে।

আজ্ঞে হ্যাঁ, চাপে পড়েই বলতে হচ্ছে স্ত্রীরা জন্মায় না তৈরি হয়। এক-এক স্ত্রীর এক এক স্বভাব। সেই স্বভাবের জন্যে দায়ী তাদের স্বামীরা।

এই তো পথে এসো। মনে পড়ে বৎস, বিয়ের আগে পাঁচটি বছর কি তেলান তেলিয়েছিলে আমাকে! পাঁচটায় এসো। মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়ে আছ বাঁকা শ্যাম হয়ে। তিনটের সময় দাঁড়িয়ে থেকো বকুলতলায়। দুপুর রোদে কাগজ মাথায় দিয়ে মরা বকুলতলায় দাঁড়িয়ে আছেন আমার প্রেমিক চিদু। পার্কে বসে চানাচুর খাও, ঝালমুড়ি খাও, চকোলেট খাও, ফুচকা খাও, ভেলপুরি খাও। চলো যাই সিনেমায়, থিয়েটারে জলসায়। কত মিঠিমিঠি হাসি, মিঠিমিঠি বাতেঁ। ভ্যাজোর-ভ্যাজোর এক কথা, তুমি আমার প্রাণ, তুমি আমার সিন্ধু, জাহ্নবী, যমুনা, তুমি আমার লাইট-হাউস, তুমি আমার টর্চের ব্যাটারি, হৃদয়ের ধুকপুকি। তুমি আমার গোলাপখাস, গোলাপি রেউড়ি। দুব্বো ঘাস দিয়ে গায়ে সুড়সুড়ি। মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে, বাঃ বেশ বউটি। চলো তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। তোমার শেষ ট্রাম চলে যাবে। যাকগে, তবু তোমাকে ছেড়ে আসি। প্রয়োজন হয় পয়দলে ফিরব। তোমার জন্যে আমি লাইফ স্যাক্রিফাইস করতে পারি। সেই তুমি আর এই তুমি!

আহা প্রেমে আর রণে একটু ছলাকলা শাস্ত্রসম্মত ব্যাপার। মনে নেই ইংরেজরা মীরজাফরকে মসনদে বসাবার লোভ দেখিয়ে সিরাজের পেছনে বাঁশ দিয়ে কেমন পানাপুকুরে ফেলে দিয়েছিল। সেম কেস। প্রথমে চার করে টোপ ফেলো, মাছ ঘাই মেরে যেই টোপটি গিলল মারো টান।

ও এই তোমার মনের ভাব? ভালোবেসে ল্যাং মারা! তাহলে জেনে রাখো তুমি যদি ঘোড়া হও আমি সেই খোঁড়া।

শুনলেন, শুনলেন আমি নাকি ঘোড়া!

মনে নেই বিয়ের পর বছর খানেক কি করেছিলে? ঘুরতে ফিরতে, শুতে বসতে মাধু মাধু। একবার চিদু বলে ডাক ভাই।

আহা সেইটাই তো আমার প্রেমের প্রথম উল্লাস। প্রথম উল্লাসেই আমার কোমর ভেঙে গেল। বাপস তোমার কি ওজন! উইনডো সিলে উঠে, ছাপা শাড়ি পরে সার্কাস-মোহিনীদের মতো ছিটকিনি লাগাচ্ছিলে। হঠাৎ বেরিয়ে এল সে। সেই বোম্বাই হিরো। তোমাকে মনে হল হেলেন। কোমরটা ধরে শূন্যে তুলে বার্ট ল্যাংকাস্টারের মতো যেই না একপাক ঘুরেছি মট করে একটা শব্দ হল, কোমরটা খুলে গেল। তিনমাস বিছানায়। তখনই বুঝলুম স্ত্রী অতিশয় গুরুভার পদার্থ। তারপর আমি আর অমন প্রেমাস্ফালন দেখিয়েছি! দেখাইনি। তাহলে তুমি কেন খোঁড়া হয়ে গেলে ডার্লিং!

কেন হলুম? বলব সেকথা! তোমার প্রথম উল্লাসের দিনে তোমার স্ত্রীর কি মাথার ওপর হাত তোলার উপায় ছিল? আমার হাত তোলা মানেই তোমার চিত্ত বিক্ষেপ এবং স্থান-কাল-পাত্র ভুলে লণ্ডভণ্ড কাণ্ড। ছিটকিনি হাত না তুলে লাগানো যায়?

সে একটু হতেই পারে। তুমি নারী আমি নর। আমি নারী তুমি নর হলে তুমিও অমন হেদিয়ে পড়তে। তা বলে তুমি আমার সাড়ে তিনশো টাকা দামের ব্রিফকেসের ওপর মড়মড়িয়ে উঠে জানালার ছিটকিনি বন্ধ করবে?

মনে পড়ে, একদিন ইডেনে ঘাস ভিজে ছিল? আমার শাড়িতে দাগ লেগে যাবে বলায় তুমি ব্রিফকেস পেতে দিয়ে মহাদরে বসিয়েছিলে। তখন তো তোমার বুক মোচড় দিয়ে ওঠেনি। বলেছিলে, আমার ব্রিফকেস ধন্য হল। সেই ঈশ্বরী পাটনির নৌকা। মা অন্নপূর্ণার পায়ের স্পর্শে সেঁউতি সোনার হয়ে গেল।

তখন তো তুমি প্রেমিকা ছিলে। প্রেমিকা একটা অন্য রকম ব্যাপার। কল্পনা-কল্পনা রোমানস টোমানস মিলিয়ে ভূতের মতো। আকৃতি আছে শরীর নেই। প্রেমিকা হল পালকের মতো, তুলোর মতো হালকা। স্ত্রী হল পাথর লোড। প্রেমিকার প্রেম ছাড়া কোনও কর্তব্য নেই। স্ত্রীর কত কর্তব্য। স্ত্রী হওয়া মানেই বশ্যতা স্বীকার করা, সাবমিশান। বরফ দেখেছ? বরফ তুষার। চারদিকে পড়ে আছে পেঁজা তুলোর মতো। আবার কুলফি মালাইও দেখেছ। প্রাক-বিবাহিত জীবন সেই তুষারের মতো। কিন্তু যেই তুমি বিয়ে করলে অমনি হয়ে গেলে খাপে ভরা কুলপি মালাই। এক সংসার থেকে এসে আর-এক সংসারের খোলে ঢালাই হওয়া। একটা জিনিস বোঝ না কেন, মেয়েরাই বিয়ের পর সব ছেড়েছুঁড়ে শ্বশুরবাড়ি যায়, ছেলেরা যায় না। নিয়মটা আগে ওলটাও তারপর গালগলা ফুলিয়ে চিৎকার করবে। তুমি হলে লেপ, আমার ইচ্ছে হলে শাটিনের ওয়াড় পরাব, ইচ্ছে হলে মার্কিনের। লেপের কিছু স্বাধীনতা আছে কি?

তার মানে পুরুষ-জাতি স্বার্থপর। সুবিধেবাদি। প্রবঞ্চক। কাজের সময় কাজি, কাজ ফুরোলেই পাজি।

তা বলতে পারো।

সময় তো অনেক এগোল, চারদিকে শিক্ষার প্রসার, বিজ্ঞান মানুষকে সঁদে পাঠাচ্ছে, তোমাদের স্বভাব একটু সংশোধন করে দেখো না! সেই ঘিনঘিনে স্বামী, বউকাঁটকি শাশুড়ি! আর কতকাল চলবে এইভাবে!

তোমাকে সকালে আমি চা তৈরি করে খাওয়াই। একমাত্র লালবাহাদুর শাস্ত্রী ছাড়া আর কোন স্বামী বউকে বেড-টি সাপ্লাই করে এসেছেন শুনি?

কোন বউ তোমার মতো অকর্মণ্যর ফেলে যাওয়া চশমা অফিসে পৌঁছে দিয়ে আসে শুনি?

কোন স্বামী তোমার মতো আয়েশি বেড়ালকে বিছানার শুইয়ে মাঝরাতে জল সাপ্লাই করে শুনি?

কোন বউ অন্য মেয়ের সঙ্গে রপটারপটি করার জন্যে স্বামীর চুলে কলপ লাগিয়ে কলেজি কার্তিক বানিয়ে দেয় শুনি?

কোন স্বামী বউয়ের পাকা চুল তুলে দেয় শুনি?

কোন বউ বকের ভূমিকায় স্বামী-বাঘের গলা থেকে হাঁ করিয়ে মাছের কাটা বের করে দেয় শুনি?

ক্ষান্ত হন, ক্ষান্ত হন। আপনারা দুজন, সত্যিই মেড ফর ইচ আদার। আপনার লিকার, স্ত্রীর ফ্লেভার যেন আসাম-দার্জিলিং ব্লেন্ড।

স্তোত্রপাঠে তরজার সমাপ্তিঃ
যত্র নার্য পূজান্তে নন্দন্তে তত্র দেবতাঃ।
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তাফলাঃ ক্রিয়া।।

যে গৃহে নারীর পূজা সেই গৃহে দেবতার আগমন, যে গৃহে নারীর অসম্মান সেই গৃহে সমস্ত কর্মফল কুফল।

তুমি তাহলে ডাব বলো।

ডাব।

আমি বলি ভাব। ডাব ভাব। চলো হাত ধরাধরি করে বাড়ি যাই।

০৯. নবম অধিবেশন

ক্লেশ পাওয়ার জন্যেই মানুষের জন্ম। জগৎ এক কারাগার।

কে আপনি? হে দার্শনিক?

আপনাকে তো এর আগের কোনও অধিবেশনে দেখিনি। হঠাৎ কোথা থেকে এলেন?

আমি সেই কৃষ্ণ। যে কৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রে অর্জুনের রথের সারথি হয়েছিল। যে কৃষ্ণ গীতা আওড়ে ছিল। যে বই পৃথিবীর মাস্টার পিস। সর্বকালের বেস্ট সেলার। আজ পর্যন্ত কারুর বাপের ক্ষমতা হল না ওই রকম দ্বিতীয় আর-একটি রচনা করার। গীতা বিক্রি করে যে রয়্যালটি বিভিন্নকালের মুদ্রায় পাওয়া গেছে সেই টাকায় অ্যামেরিকা আধখানা কিনে ফেলা যায়।

আপনি কবে ছাড়া পেলেন প্রভু!

কোথা থেকে মাই ডিয়ার স্যার?

উন্মাদ আশ্রম থেকে?

ছাড়া তো পাইনি ভাই। উন্মাদ আশ্রমেই তো রয়েছি। এই সংসারটাই তো সেই বিশাল পাগলাগারদ। আমারই এক খেলার খুঁটি সেই কতকাল আগে লিখে গেছে–হতেছে পাগলের মেলা খেপাতে-খেপিতে মিলে। এই সংগীত আগে কখনও কখনও সকালে তোমাদের বেতার তরঙ্গে প্রচারিত হতো। এখন আর হয় না। এখন তার বদলে এসেছে হামতুম এক কামরেমে বন্ধ হ্যায়, আর চাবি খো যায়। ওই একই ব্যাপার, একই মানে। বিশ্ব কারাগারে কোটি-কোটি পাগল মত্ত মার্তণ্ডের মতো হুটোপাটি করে বেড়াচ্ছে। দূর থেকে আমি যখন দেখি, তখন দেখি…

কতদূর থেকে প্রভু!

পার্সপেকটিভে যখন পৃথিবীকে দেখি, তখন দেখি, মহাশূন্যে একটি গোলক ঘুরছে, তার আষ্টেপৃষ্ঠে পোকার মতো কিলবিল করছে মানুষ। আঁচড়াচ্ছে, কামড়াচ্ছে, খাবলাচ্ছে, খোবলাচ্ছে, উঠছে, পড়ছে, মরছে, জন্মাচ্ছে। আহা কি সুন্দর খেলা।

এ কি বলছেন প্রভু! আপনি তো বলেছিলেন, আমাদের জন্ম নেই মৃত্যু নেই, শুরু নেই, শেষ নেই, আমি নেই, তুমি নেই, শুধু তিনি আছেন, যাঁকে কাটা যায় না, পোড়ানো যায় না, মারা যায় না, শেষ করা যায় না। এখন যে অন্য কথা বলছেন?

ঠিকই বলেছি। তোমরা বুঝতে ভুল করেছ। সেটা হল ভৌতিক অবস্থা। মানুষ মরে ভূত হতো। ভূত সর্বশক্তিমান। ভূতের বিনাশ নেই। কারণ ভূতের দেহ নেই। এই দেহ, এই দেহটাই শালা যত ক্লেশের কারণ।

শালা বলছেন স্যার?

কেন? শালা শব্দ শুনে আঁতকে উঠছ কেন? বহু ভালো জিনিসের সঙ্গে শালা যুক্ত আছে যেমন যজ্ঞশালা, কর্মশালা, ধর্মশালা, পাঠশালা, গোশালা, পাকশালা। শালা বললেই বউয়ের ভাই মনে করছ কেন? দেহ একটা শালা। এবং সেই ভগবান, সেই আল্লা, সেই গড, যিনি এই মনুষ্য দেহের ভাস্কর তিনি একটা বোগাস, ওয়ার্থলেস থার্ডক্লাস কারিগর। যে লোকটা কাঁচ তৈরি করেছিল, তার চেয়েও অপদার্থ। মানুষের উচিত আর দেরি না করে ভগবানের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা। এই ডিফেকটিভ মেকানিজম চলবে না চলবে না।

সভায় একটা গুঞ্জন উঠল। সভাপতি বললেন, আমরা যে কত বড় পাগল তা প্রমাণ করার জন্যেই এই ছত্রধারীর আবির্ভাব। তবে যা বলছে শোনা যেতে পারে। সেই এক কথাই তো বলবে ইট ইজ এ টেল টোলড বাই এন ইডিয়ট সিগনিফাইং নাথিং। সেই ইডিয়েট হলেন ভগবান।

সভাপতির কথা বক্তা বোধহয় শুনে ফেলেছেন। মৃত্যু হেসে বললেন,

ভগবান নয় শয়তান। আমি তার রাইভ্যাল। গীতায় আমি অর্জুনকে সেইজন্যে ক্যাটেগোরিক্যালি বলেছিলুম–মামেকং শরণং ব্রজ। অ্যান্ড হি ডিড দ্যাট। সে তাই করেছিল এবং যুদ্ধ জিতেছিল। ইউ অল নো দ্যাট। এখন অবশ্য অ্যাটম বোমার যুগ। কুরুক্ষেত্র আর হবে না। এক্সপার্টরা বলছেন– হলে বড়জোর বর্ডার ওয়ার হবে। কোলড ওয়ার হবে। যাক ওটা আলাদা ব্যাপার। আসল ব্যাপার হল, এই সৃষ্টি রহস্য অনেকটা গোয়েন্দা কাহিনির মতো। সামওয়ান অফ ইউ বলেছিলেন শেষ নাহি যার শেষ কথা কে বলবে! শেষটা অবশেষে জানা গেছে। রহস্য এখন পরিষ্কার। শয়তানকেই আমরা ভগবান ভেবে বসে আছি। শয়তান তৈরি না করলে মানুষের মতী একটা জীব হতো না। ভগবানকে সাজা দেওয়ার জন্যেই ভগবান মেরে মানুষ তৈরি হয়েছে।

এ কথাটার মানে কি?

মানে খুব সহজ। ভগবান টুকরো-টুকরো হয়ে গেছেন। রোজই হচ্ছেন। প্রতিদিন কোটি কোটি টুকরো হয়ে যাচ্ছেন।

সে আবার কি?

বিশ্বজুড়ে রোজই কয়েক কোটি মানুষ জন্মাচ্ছে। এত মানুষ আসছে কোথা থেকে! সবই ভগবানের টুকরো। ভগবান যত টুকরো হচ্ছেন ততই তার শক্তি কমে যাচ্ছে। এ্যাজ ফর একজাম্পল, গ্রহ ভেঙে উপগ্রহ হয়। উপগ্রহ ভেঙে উল্কা হয়। উল্কা পুড়ে ছাই হয়। মানুষও সেইরকম বিশালের কুঁচো, জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

ভগবান এত টুকরো হচ্ছেন কেন?

শয়তানের কারসাজি। সেই আদম আর ইভের গল্প। লোভের আপেল। আপেলের লোভ। জন্ম মানেই ক্ষয়। প্রজননের ইচ্ছেই হল পাপ। ভগবানের মনে পাপ ঢুকে নারীলোলুপ করে তুলেছে। সেই লালসা থেকেই প্রতি মুহূর্তে মানবশিশু ট্যাঁট্যাঁ করে উঠছে। লালচ বড় বালাই। এক শক্তিমান। ভগবান এখন পিলপিলে ভগবান, কীটাণু কীট। পতঙ্গের মতো আসছেন আর ধেড়িয়ে মরছেন। ভগবান নিজেই চিৎকার করছেন–নো মোর নো মোর।

ভগবান চিৎকার করছেন?

অবশ্যই। বিবেকের কণ্ঠস্বর হল ভগবানের কণ্ঠস্বর। এখনই নয়, দুয়ের বেশি কখনও নয়। ডোন্ট মালটিপ্লাই। পোস্টার হোর্ডিং বিবিধভারতী। কে কার কথা শোনে। শয়তান সাহিত্যে, শয়তান সিনেমায়, নাটকে। শয়তান ক্যাবারেতে, মদে, মাংসে, আহারে, বিহারে। ভগবান সংযম হারিয়ে শয়তানের ফাঁদে।

তাহলে, কি হবে স্যার?

নিয়তি, বৎস নিয়তি। ভগবানের কোনও আকার আকৃতি ছিল না। তিনি ছিলেন, শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত। লালসায় তার একটা মাথা গজালো গোল ফুটবলের মতো। দুটো গোলগোল চোখ। দুটো লগবগে হাত বেরোল। দুটো লিকপিকে ঠ্যাং। একটা বেয়াড়া আকৃতি। অকেজো শরীর। ভেতরে জটিল যন্ত্রপাতি। লিভার, পিলে, ফুসফুস, হৃদয়, মাইলের-পর-মাইল স্নায়ু, জড়ানো পাকানো, টুকরো টুকরো হাড় জুড়ে একটা কাঠামো। একটু বেকায়দায় হলেই খিল খুলে যায়, ভেঙে ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। মাথায় ঘিলু। একটু ধাক্কা লাগলেই ছলকে যায়। একটু চাপ পড়লেই বিগড়ে যায়। এক মাথার মেকানিজমেই ভগবান কাত। খেপে গেলে কারুর কিছু করার নেই। উলঙ্গ হয়ে ঘোরে। টিউমার হলে ভেলোরে ছোটে। তোমরাই বলো পৃথিবীতে আর কোনও প্রাণীর এত দুর্বল, এত সূক্ষ্ম শরীর? খুব লম্ফঝম্প। এ ওকে তড়পাচ্ছে, ও তাকে তড়পাচ্ছে, হঠাৎ ওগো আমার পেট ব্যথা করছে গো বলে দাঁত চিরকুটে ফ্ল্যাট। নিজের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। বোলাও ডাক্তার। ডাক্তারের জ্ঞানও তেমনি। এখানে টেপে ওখানে টেপে। বুকে নল লাগায়। পেটে তবলা বাজায়। জিভ টেনে বের করে। চোখ উলটে দেখে। রায় দেয় পেটে বায়ু, বুকের দিকে ঠেলে উঠছে অম্বল। শেষে দেখা গেল ক্যানসার। ভগবান ফেঁসে গেলেন। ডাক্তার ভগবান ফি পকেটে পুরে সিমলায় বেড়াতে চলে গেলেন।

মানুষকে তাহলে ভগবান বলছেন?

অণু ভগবান। বহুর মধ্যে সেই এক দানা-দানা, কণা-কণা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন। অপলকা, অপটু একটা খোলে ঢুকে আমার নাম জপছে তরস্বরে–হে কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ। কৃষ্ণ কি করবে? ওই খোলে ঢুকেছিস কেন শালা! যে খোল পচে যায়, ধসে যায়। যে খোলের আবরণের কোনও শক্তি নেই। হাড়। হাড়ের ওপর চর্বি, চর্বির ওপর মাংস, মাংসর ওপর নুনছাল, তার ওপর ছাল। ভেতরে ব্যাজ-ব্যাজ করছে রক্ত। শরীরের নীচের দিকে সেপটিক ট্যাঙ্ক। তার আবার ধারণ ক্ষমতা এতই কম, রোজ সকালে সবেগে দুর্গন্ধময় মাল বেরিয়ে আসে। কোনও ভগবানের একবার, কারুর বারবার। থেকে-থেকে জল বিয়োগ। শরীর মানেই মল, মূত্র, কফ, পিত্ত, স্বেদ, শোণিত। ঘর্মাক্ত ভগবানের দুর্গন্ধে অন্য ভগবান তিষ্ঠতে পারে না। গায় ফাঁস-ফাস করে গন্ধ দ্রব্য স্প্রে করে সামাল দিতে হয়। এই যদি ভগবতী তনু হয় তাহলে এই শরীরের সৃষ্টি কর্তাকে কি বলতে ইচ্ছে করে? তোমরাই বলো। মানুষ ভগবানের সৃষ্টি নয়। সৃষ্টি হল শয়তানের। একজন এই রহস্য, এই সিক্রেট ডিজাইনটা ধরতে পেরেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি। সব গুলিয়ে ফেলে একটা পৌরাণিক গল্প ফেঁদে বসল।

সেটা কি?

সেই গল্প। আদম আর সাপ। শয়তানরূপী সাপ বলছে, তুমি বড় নিঃসঙ্গ। কতকাল এইরকম একা-একা থাকবে? তুমি তোমার একটি প্রতিমূর্তি তৈরি করো। তোমার একজন সঙ্গী চাই। ইভের আবির্ভাব। শয়তানের কারসাজি সফল হল। শক্তির বিভাজন। পরা প্রকৃতি, পরা শক্তি। শয়তান আরও একধাপ এগোল। রমণ কর। পরাশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করো! কোন শক্তি? যে শক্তি শয়তানের আপেল খেয়ে চৈতন্যময়ী নয় লাজময়ী। বিশাল শক্তি, বিশাল জলধি আবদ্ধ হতে হতে ছোট-ছোট ডোবায় পরিণত হল। শয়তান চারপাশে মায়া সৃষ্টি করে কাল থেকে কালান্তরে জন্মের চাকায় ঘুরিয়ে মারছে। যার জন্ম আছে তার মৃত্যুও আছে। শয়তান বলছে জন্মেই তুমি পরাভূত, মৃত্যুর দাস। তুমি আমার পরিকল্পনায় ক্রীতদাস। শয়তানের পেপার ওয়েটের তলায় ভগবানের পাতলা কাগজ বিবেকের হাওয়ায় প্রতিটি মনে ফড়ফড় করে উড়ছে। প্রতি মুহূর্তে অনুশোচনা, এ কি করছি, এ কি করে ফেলেছি। এ কি করে বসে আছি। একই দেহে ভগবান আর শয়তান। ত্যাগ ভোগ প্রেম, নিষ্ঠুরতা, সত্য, মিথ্যা, রক্ষক, ভক্ষক, দাতা, প্রবঞ্চক। তোমাদের শহরের তলায় পয়ঃপ্রণালী। খাবার জল, নদৰ্মার নোংরা জল পাশাপাশি বইছে। তোমরা জানো, তাই বলো ম্যান ইজ এ বান্ডল অফ কনট্রাডিকশানস। একই শরীরে হিরো আর ভিলেন। একই ইতিহাসে জয় আর পরাজয়। পালাবার পথ নেই, শান্তি নেই। শুধু ক্ষয়ে যাও, শুধু জ্বলে যাও। চিতা দহতি নির্জীব, চিন্তা দহতি সজীব। চিতা চৈতন্যময়ী।

তবে উপনিষদে যে বলা হয়েছে অমৃতস্য পুত্রা।

ওটা ধারণা মাত্র। সমুদ্র মন্থন করে অমৃত উঠেছিল, শুনেছ তোমরা। দেবতারা যদি দেবতাই হবে, সর্বশক্তিমান হবে, তাহলে অমৃত খেয়ে অমর হতে চাইবে কেন? অমরেও আবার অমরত্বের বাসনা কীসের? আসলে দেবতা একটা ভাওতা, একটা ধাপ্পা। পুরাণজুড়ে দেবতাদের কেচ্ছা। দুর্বলতা, ভীরুতা, কামকতা, তঞ্চকতা। শয়তানের চরিত্র অনেক বলিষ্ঠ। তার লক্ষ অনেক স্পষ্ট। শয়তান হল শক্তি। সে প্রভুত্ব করতে চায়, অধিকার করতে চায়, খর্ব করতে চায়, খর্বিত হতে চায় না। অসীম তার শক্তি। সে যে কত শক্তিমান পৃথিবীই তার প্রমাণ। পৃথিবীর তিনের চার ভাগ জল একের চার ভাগ স্থল। জল মানে অজ্ঞাত এলাকা, রহস্যময় এলাকার পরিধি অনেক-অনেক বেশি। অন্ধকার আলোর চেয়ে শক্তিশালী। পৃথিবী যদি শয়তানের সৃষ্টি না হতো তাহলে দিন রাত্রির এই ভাগাভাগি হতো না। প্রকাশ করে প্রচ্ছন্ন করে দাও। রাতের পাপ দিনের আলোতে স্পষ্ট। প্রাণীজগৎ ঘুমিয়ে পড়ে, জেগে থাকে মানুষ, তার চিন্তা নিয়ে, দেহ নিয়ে, পাপ নিয়ে। ভগবানের সৃষ্টি হলে পৃথিবীর চেহারা অন্য হতো। স্থলভাগ হতো তিনের চার, জলভাগ একের চার। অজানা বলে কিছু থাকত না। ম্যান পোপিং ইন ডার্কনেস। সীমহীন অন্ধকারে মানুষ নিজেকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে। উঃ কি দেই ফেলেছে ভগবানকে! পৃথিবী এক ভয়াবহ জায়গা। মহাশূন্যে ভাসমান এতটুকু একটা ফুটবল। এই তো শরীর! চতুর্দিকে ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া, প্যারাসাইটস। জঠর থেকে মুক্তির সঙ্গে-সঙ্গেই আক্রান্ত। জন্মেই প্রথম সংগ্রাম অসুখের সঙ্গে, তারপর শয়তানের প্ল্যানে তৈরি মানুষের পরিবেশ। বিশাল বিশাল যন্ত্র, ইঞ্জিন, মোটরগাড়ি, অস্ত্র-শস্ত্র, বিমান, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া বাহিনী। সৃষ্টিই স্রষ্টাকে ধ্বংস করতে চাইছে। মানুষের অধিকাংশ সৃষ্টিই সংহার মূর্তি ধারণ করে মানুষের পেছনে তাড়া করেছে। এই প্রক্রিয়াকে আর থামানো যাবে না কারণ শয়তান তাই চায়। নিজেদের কবর নিজেরা খোঁড়। প্রতিপদে তোমরা পরাজিত। প্রতিটি জন্ম সেই পরাজয়ের এক-একটি মেডেল। শয়তান চেয়েছিল সেই নিরাকার নির্গুণ সত্তাকে একটা খোলে ভরতে। খোলাটা কেমন, যন্ত্রণাকাতর ক্ষয়িষ্ণু ষড় রিপুর বাঁধনে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যের দাস। আমি যদি থেকেও থাকে, সে আমি হল দাস আমি–স্লেভ আই। জোনাকি গোবরে পড়েছে। আমি হল দেহের দাস, আমি তারপর জগতের দাস, ডবল দাসত্ব। লোহার বাঁধনে বেঁধেছে সংসার দাসখত লিখে নিয়েছে হায়।

জন্মের ওপর দেবতার কোনও হাত নেই। তিনি সোনার পালঙ্কে আসতে পারেন, ছেঁড়া কাঁথায় এসে চিতপাত হতে পারেন, ফুটপাতেও গড়াগড়ি দিতে পারেন। জন্মের ওপর কোনও কনট্রোল নেই। কামার্ত হয়ে যে যাকে জড়িয়ে ধরবে সেইখানে ভগবান দেহ ধারণ করবেন। তারপর শুরু হবে তার দাসত্ব। সবরকমের নিপীড়ন, উৎপীড়ন। অন্য প্রাণী কত মানুষের মতো এমন জন্মেই দাসত্ব করে না। বাঘ, সিংহ, গণ্ডার। পরাভূত হয়, দাস হয় না। এই হল শয়তানের প্ল্যান। দেহভূত ভগবান রোগ শোক, জুরা ব্যাধি নিয়ে চলেছে-তো-চলেছেই। মরণ রে উঁহু মম শ্যাম সমান। শয়তানের তৈরি আখ মাড়াই কলে দেহী ভগবান ছিবড়ে হচ্ছে। সেই কল চলছে শয়তানের অর্ডারে, মানুষ বা ভগবানের তত্ত্বাবধানে।

স্টেট চায় বশ্যতা। ওসব ডেমোক্রেসি-ফেমোক্রেসি চোখে ধূলো দেওয়ার ব্যাপার। সংঘ, সংগঠন হল কিছুর ওপর কিছুর লাঠি ঘোরানো। এ ওকে চেপে রাখছে, ও তাকে চেপে রাখছে। সংসারে, সমাজে, সেরেস্তায়, রাজদ্বারে সর্বত্রই সেই নিষ্পেষণ। টর্চারের কল চলেছে। হাঁটু মোড়ো, হাত জোড় করে বলো, দাস আমি, প্রভু তুমি, হে মনুষ্যভূত দেবতা তোমার সামনে আমি নতজানু। তুমি যা বলবে তাই বলব। যেমন করে বলাবে তেমন করেই বলব, আমার কোনও স্বাধীনতা নেই। তুমি ভাতে মারতে পারো, তুমি হাতে মারতে পারো। আমি আমার দেহকে ভয় পাই, তোমার নিপীড়নকে ভয় পাই। তোমার প্রসাদে আমার এই অস্তিত্ব!

বক্তা ছাতি বগলে নেমে পড়লেন।

আপনি কে? পরিচয়, পরিচয়?

আমি এক বুদ্ধিজীবী মানুষ। কেরানি। গুডবাই ফ্রেন্ডস।

১০. দশম অধিবেশন

আজকে আমরা কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমাদের এই সভায় এনেছি। আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি। ইনি স্বামী মুগ্ধানন্দ। নমাসে হিমালয়ে থাকেন। তিন মাস ভ্রমণ করেন।

নমস্কার মহারাজ!

জয়স্তু।

ইনি ডক্টর সিদ্ধান্ত। সাইকোলজিস্ট। সারা ভারতে এঁর নাম। বহু পাগলকে সুস্থ করেছেন। বহু খুনিকে সাধু করেছেন। বহু ডিকটেটারকে ডেমোক্র্যাট করে ছেড়েছেন।

নমস্কার।

নমস্কার।

এই ভদ্রলোকের নাম অমল বোস। ইনি ডগট্রেনার। ব্যারাকপুরে কুকুরের স্কুল খুলেছেন। কুকুরকে ইনি মানুষের বাবা বানাতে পারেন।

নমস্কার।

নমস্কার।

ইনি হলেন চৈতন্য মুখোপাধ্যায়। গণিতের শিক্ষক। অঙ্ক কেটে জোড়া লাগান। বহু গাধাকে পিটে-পিটে গরু করেছেন।

নমস্কার।

নমস্কার নমস্কার।

ইনি হলেন নরেশ বেদান্ত। দার্শনিক। জগৎ মিথ্যা ব্রহ্ম সত্য, ব্রহ্ম মিথ্যা জগৎ সত্য, এইসব মারাত্মক-মারাত্মক বিষয় নিয়ে ইনি গবেষণা করেন। পথ চলতে-চলতে গীতার শ্লোক আওড়ান। বেদ-বেদান্ত এঁর কণ্ঠস্থ।

নমস্কার।

শুভায় ভবতু।

এঁর নাম হরিসাধন ভট্টাচার্য। পুরোহিত। ভাটপাড়ায় টোল ছিল। জুটমিলের শব্দে শ্যামনগরে চলে এসেছেন। টোল উঠে গেছে। জীবনে অসংখ্য শ্রাদ্ধ ও বিবাহকর্ম করিয়েছেন। সুপণ্ডিত মানুষ। একটি সংস্কৃত শব্দও ভুল উচ্চারণ করেন না। উপনয়ন ও বিবাহের সময় যজমানকে সংস্কৃত মন্ত্রের অর্থ বলে দেন।

নমস্কার।

কল্যাণ হোক।

ইনি হলেন রামরাম বাটপাড়িয়া। ব্যাবসাদার মানুষ। স্বাধীনতার আগে কোটিপতি ছিলেন। বর্তমানে অবুদপতি।

নমস্কার।

নমস্তে জি।

হাঁ জি।

ইনি হলেন পন্টু হালদার। ফেমাস মাস্তান। হ্যাঁ, মাস্তান বললে ইনি অসন্তুষ্ট হন না, বরং গর্ববোধ করেন। কারণ মাস্তানী এখন জাতে উঠেছে। ভেরি ডিগনিফায়েড প্রফেশান।

নমস্কার।

ঠিক আছে, ঠিক আছে।

ইনি হলেন বটু পাল। নেতা। ছবার এম এল এ হয়েছেন। ট্রেড ইউনিয়ন করেন। এঁর কথায় দেশীয় শিল্পের চাকা চলে, চাকা বন্ধ হয়। ডজনখানেক বন্ধের সফল শিল্পী।

নমস্কার।

সেলাম। শ্রমিক ঐক্য জিন্দাবাদ। চলবে না, চলবে না। ও সরি।

সরি।

ইনি হলেন অ্যাডভোকেট এ. এন. ঘোষ। ইনি দোষীকে নির্দোষী, নির্দোষীকে দোষী প্রমাণ করায় সিদ্ধ।

নমস্কার।

থ্যাঙ্ক ইউ।

এইসব গুণী মানুষকে আজ আমরা এক ছাদের তলায় একসঙ্গে উপস্থিত করেছি একটি মাত্র উদ্দেশ্যে–পথের সন্ধান পাব বলে। মানুষ হয়ে জন্মেছি, যতদিন না মৃত্যু আসছে ততদিন এই জীবন টেনে-টেনে চলতে হবে। আমাদের মৃত্যুর পরও মানুষ আসবে, মানুষ থাকবে। জীবন মানেই ক্লেশ। তবু চেষ্টা ক্লেশহীন জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানো যায় কিনা। শঙ্করাচার্য বলেছেন–যাবৎ জনমং তাবৎ মরণং যাবৎ জননী জঠরে শয়নং ক্ষণপতি সজ্জন সঙ্গতিরেকা ভবতি ভবার্ণবে তরণে নৌকা। এঁরা একে-একে আমাদের পথ বাতলান। গৃহিনীরা জানেন পেঁয়াজ ছাড়াতে গেলেই চোখে জল আসে। বাঁচার উপায়ও জানেন–বটির ডগায় একটি পেঁয়াজ গেঁথে রেখে পেঁয়াজ ছাড়ালে চোখে জল আসে না। সেইরকম ভাণমুক্ত, ক্লেশমুক্ত, জীবনযাপন পদ্ধতি হয়তো এঁদের জানা থাকতে পারে। স্বামী মুগ্ধানন্দ, আপনি আলোকপাত করুন প্রভু।

নারায়ণং নমস্কৃত্য নরষ্ণৈব নরত্তোমম
দেবীং সরস্বতীবৈষ্ণব ততোজয়মুদীরয়েৎ।

আপনারা মনুষ্যক্লেশ নিবারণের চেষ্টা করেছেন। উত্তম কার্য। তবে গোড়াতেই আমার মনে একটি সংশয় জাগছে–কীসের ক্লেশ, কার ক্লেশ। জগৎ একটি মায়া। ব্রহ্মই সত্য। মায়ার পরদার মধ্যে দিয়ে দেখছি বলেই জগৎকে সত্য বলে মনে হচ্ছে। জগৎ বলে কিছু নেই। সবই একটি দীর্ঘস্থায়ী স্বপ্ন মাত্র। সত্য মনে করলেই সত্য, মিথ্যা মনে করলেই মিথ্যা। ক্লেশ মনে করলেই ক্লেশ, অক্লেশ মনে করলেই অক্লেশ। সবই এক বিরাট খেলা। ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছেন–পাঁকে থাকবি পাঁকাল মাছের মতো। গায়ে পাঁক লাগবে না। এ দুনিয়া ধোঁকার টাটি, খাই দাই আর মজা লুটি। তবে হা ব্রহ্মজ্ঞান তো আর সকলের হয় না, হতে পারে না। আমাদের সব মতুয়ার বুদ্ধি। গরু যতক্ষণ হাম্বা হাম্বা করে ততক্ষণে তার মুক্তি নেই। যেই মরল অমনি তার নাড়ি শুকিয়ে একতারার তাঁত হল, অমনি সে তুঁহুঁ-তুঁহুঁ করে বেজে উঠল। চিরমুক্তি। আমি-আমি, হাম্বা-হাম্বা তখনই দাসত্ব। আমি যেই শেষ হল গরুর তখন তুঁহুঁ অবস্থা। তুঁহুঁতেই মুক্তি। সব ছাড়া যায়, আমি ছাড়া যায় না। জগৎকে সত্য ভেবে যারা রোগ শোক জরার দাসত্ব করছেন, প্রতিদিন সংসারে মার খাচ্ছেন তাঁর এই গানটি শুনুন–

ভবে কে বলে কদর্য শ্মশান
পরম পবিত্র চরম যোগের স্থান
পাপী পুণ্যবান মুখ কি বিদ্বান
সমান ভাবে হেলায় সকলি শয়ান।
অন্ধ খঞ্জ বধির গলিত কুষ্ঠধারী
কন্দর্প সমান রূপের দর্পহারী
সজ্জন তস্কর গৃহ বনচারী।
রাজা আর ভিখারী সকলে সমান।
হেথা এলে পরে যায় মায়া সব
রয় না ভবজরার কোনও উপদ্রব।
শ্মশান মাত্র নাম কিন্তু শান্তিধাম
সুখ দুখ শান্তির চির অবস্থান।
ভবে কে বলে কদর্য শ্মশান!

এসেছি, চলে যাব। কিংবা আসিনি যাবও না, ভ্রম মাত্র। তবু ভাবতে দোষ কি আমি অমৃতের সন্তান, আমার জন্ম, নেই মৃত্যু নেই, বন্ধন নেই, জরা নেই, যৌবন নেই। সাত্ত্বিক জীবন যাপনেই শান্তি। জপ ধ্যান, নিরামিষ আহার, সপ্তাহে একদিন উপবাস, সৎসঙ্গ, কামিনী কাঞ্চন ত্যাগ, এই হল ক্লেশমুক্তির উপায়। দিনরাত শুধু সৎচিন্তা, প্রেম।

সভায় ঘনঘন হাততালি।

পেয়ে গেছি। পথ পেয়ে গেছি। নিরামিষ মানে কতটাকা বাঁচল, একবার ভাবুন। ডেলি অ্যাট লিস্ট চার টাকা, মাসে একশো কুড়ি। একদিন উপবাস। আরও গোটা দশেক টাকা। একশো তিরিশ। কামিনী ত্যাগ মানে বউকে বাপের বাড়ি পাঠান, চ্যাঁ ভ্যাঁ সমেত।।

সাইলেন! সাইলেন! ডক্টর সিদ্ধান্ত এবার বলছেন।

লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন। না, শুধু জেন্টলমেন, লেডিজ নেই। আমি বেদ-বেদান্ত ভ্রম মায়া, এসব বুঝি না, বুঝতেও চাই না। আই নো ম্যান, হিজ ওয়ার্ল্ড অ্যানড এনভায়রনমেন্ট। মানুষের বাইরেটা কিছুই নয়, ভেতরটাই সব। কনসাস নয়, সাব কনসাসেই যত গেঁড়াকল। মানুষ হল আইসবার্গ। মনের তিনের চার অংশ ভাসমান বরফের মতো সাবকনসাসে তলিয়ে, একের চার ভেসে যাচ্ছে বাইরে।

এই যে মগ্নচৈতন্য, এটা মানুষের নিজের তৈরি নয়, অন্যের সৃষ্টি। সেই অন্যের সৃষ্টি। সেই অন্যের মধ্যে আছে পিতা মাতা, শিক্ষক, সমাজ, ঘটনা। আজকে আমরা জানতে পেরেছি, ম্যানস হিস্ট্রি ইজ রিটন বাই দি জিনস। রিসার্চ চলছে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাহায্যে কালে আমরা পছন্দমতো মানুষ তৈরি করতে পারব। তখন পৃথিবী হবে প্যারাডাইস। হাক্সলির ব্রেভ নিউ ওয়ার্লর্ড সফল হবে। কিন্তু যতদিন তা না হচ্ছে, ততদিন অপ্রেসান থাকবে, ডিপ্রেসান থাকবে, মেলাঙ্কলি থাকবে, ফ্রাসট্রেসান থাকবে। নিউরোসিস, ইনিউরসিস থাকবে। হোমিসাইড, জেনোসাইড, রেপ থাকবে। ম্যানিয়াক থাকবে। কমপ্লেক্স থাকবে।

মানুষে-মানুষে খাঁচাখাই লেগেই থাকবে, হত্যা থাকবে, আত্মহত্যা থাকবে। নিপীড়ন থাকবে, নিষ্ঠুরতা থাকবে। ঘর ভাঙবে, ঘর গড়বে। কেউ রুখতে পারবে না। বদহজম, অম্বল, টাক, মাথা ধরা সবই থাকবে। আমরাও থাকব। ম্যানহোল খুলে পাক পরিষ্কারের মতো আমরা সাবকনসাস থেকে গাদা বের করার চেষ্টা করব। স্বামীকে স্ত্রী ফিরিয়ে দেব, স্ত্রীকে স্বামী, পিতাকে পুত্র, পুত্রকে পিতা। সৃষ্টির শেষদিন পর্যন্ত এইভাবেই চলতে থাকবে! অ্যালোপ্যাথিক ট্রিটমেন্ট। রোগ চাপা থাকবে, সারবে না। এক ক্লেশ যাবে আর-এক ক্লেশ আসবে। ক্লেশ আর ক্লেশ নিয়েই জীবন। লিবিডো। লিবিডো মানে জীবনীশক্তি, লাইফ ফোর্স। এই বাক্যটি ফ্রয়েড সাহেবের উদ্ভাবন। মানুষ পেতে চায়, ভোগ করতে চায়, উত্তেজনা চায়, উত্তেজনার প্রশমন চায়। দেহে চায়, মনে চায়। চাহিদার পরিতৃপ্তিতে শান্তি, সন্তুষ্টি। অপরিতৃপ্তিতে বিষাদ, ক্রোধ, বিভ্রান্তি। ক্রোধী মানুষ, অসন্তুষ্ট মানুষ, অতৃপ্ত মানুষ সংসারে শান্তি দিতে পারে না, শান্তি পেতে পারে না। ক্লেশমুক্ত হতে হলে নেতি চিন্তা, নেগেটিভ ফিলিংস ছাড়তে হবে। খণ্ডিত বিভক্ত মানুষ না হয়ে অখণ্ড মানুষ হতে হবে। উৎকণ্ঠা ভুলে যেতে হবে। হাত-পা ছড়িয়ে শ্লথ হয়ে বিশ্রাম নিতে শিখতে হবে। ফ্ল্যাট হয়ে শুয়ে পড়ুন। চোখ বোজান। মনে-মনে বলুন, বিশ্রাম, বিশ্রাম চাই। আমার দিন আর রাত উৎকণ্ঠায় ভরা। নেভার মাইন্ড। পনেরো কি তিরিশ মিনিট সময় আমি সব কিছুর বাইরে। তালে-তালে, লয়েলয়ে নিশ্বাস নিতে থাকুন। এরই নাম শবাসনে প্রাণায়াম।

আধুনিক সভ্যতার দান উৎকণ্ঠা, দুর্ভাবনা। দুর্ভাবনার চেয়ে দুরারোগ্য ব্যাধি আর কিছু নেই। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, চিতা দহতি নির্জীব, চিন্তা দহতি সজীব। মুক্তির উপায়, ভয়ে দেখে পেছিয়ে। যেও না, ভয়ের মুখোমুখি হয়ে লড়ে যাও। অ্যাক্ট, অ্যাকসান ইজ দি রেমিডি। ওয়ার্ক অ্যান্ড নো ওরি ইজ দি রেসিপি।

আত্ম সমীক্ষা। নিজেকেই নিজে বিচার করুন। প্রত্যেকের মধ্যেই মাইনাস পয়েন্ট, প্লাস পয়েন্ট আছে। মাঝে-মাঝে নিজের বিবেকের মুখোমুখি দাঁড়ান। নিজের অক্ষমতা, সক্ষমতা, নিজের ভালো দিক, মন্দ দিক সমালোচকের দৃষ্টিতে দেখুন। নিজেকে জানা মানেই নিজেকে সংযত করা, শুদ্ধ করা, সুন্দর করা। প্রতিদিন নিজেকে আবিষ্কার করুন, ভেঙে ফেলে নতুন করে গড়ুন। গ্যেটে বড় সুন্দর কথা বলেছিলেন, আমরা যখন বলি দুনিয়াটা পালটে গেছে, আগের মতো আর নেই তখন ভুলে যাই নিজেও কত পালটে বসে আছি।

আমাদের শাস্ত্রে একটা কথা আছে সুইট লেমন মেন্টালিটি। পাতিলেবু কখনও মিষ্টি হতে পারে না। জীবন একটা টক-মিষ্টি অনুভূতি। কখনও শূন্য, কখনও পূর্ণ। জীবনের পথ কুসুমাস্তীর্ণ হতে পারে না। শুধু গোলাপ নয়, গোলাপ আর কাঁটা। সুমিষ্ট পাতিলেবুর আশায় যাঁরা ঘুরছেন তাদের ক্লেশ কে নিবারণ করবে! সুইট লেমন মেন্টালিটি ছেড়ে পৃথিবীর সব কিছু মেনে নিতে হবে হোল লিভিং উইথ অল ইটস গিফটস, সুইট অ্যান্ড সাওয়ার। পৃথিবীতে আমাদের চাওয়ার শেষ নেই। পাওয়াতে আমাদের চাওয়ার নিবৃত্তি নেই। আমি কিছুই চাই না এই হল ক্লেশ নিবারণের। শেষকথা।

বক্তা বসলেন। চেটাপ্যাট হাততালি।

এইবার বলবেন শ্রীঅমল বোস ডগট্রেনার।

আমি কুকুর চরাই, অবশ্য বিলিতি কুকুর। কুকুর মানুষে বিশেষ তফাত নেই। মানুষের মতো কুকুরের সব আছে কেবল মানুষের ভাষাটাই নেই। ট্রেনিং মেকস এ ম্যান, ট্রেনিং মেকস এ ডগ। শৈশব থেকেই মানুষকে যদি উপযুক্ত কায়দায় শিক্ষা দেওয়া যায় তাহলে মানুষও কুকুরের মতোই বুদ্ধিমান, কর্তব্য পরায়ণ, বিশ্বাসী, বিচক্ষণ ও প্রভুভক্ত হতে পারে। আমরা কুকুরকে বলি ফেথফুল ফ্রেন্ড। কজন মানুষকে বলতে পারি আমার বিশ্বাসী বন্ধু, প্রাণের বন্ধু! কজন মানুষকে বলতে পারি আমার বিশ্বাসী, কর্তব্যপরায়ণ কর্মী! পারি না। তার কারণ মানুষ এখনও পুরোপুরি শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি। মানুষের সংখ্যা অনেক, সেই তুলনায় বিলিতি কুকুরের সংখ্যা অনেক কম। তা ছাড়া কুকুরের শিক্ষিত হওয়ার প্রবণতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। কুকুর রেগে যেতে পারে, খেপে যেতে পারে কিন্তু মানুষের মতো দেখো তো না দেখে বখে যেতে পারে না। কুকুরের কামড়ের ইঞ্জেকশান আছে, অহরহ মানুষের কামড়ের কোনও প্রতিকার নেই।

মানুষ ভাবে বই পড়ে বি এ, এম এ পাশ করলেই মানুষ হওয়া যায়। অত সহজ! একেই তো মানুষের মধ্যে সদগুণের বড়ই অভাব। আলস্য, প্রতিহিংসা, বিশ্বাসঘাতকতা, বেইমানি, পরশ্রীকাতরতা, পরস্ত্রীকাতরতা, হিংসা, দ্বেষ, চুরির প্রবণতা, মুনাফার লোভ, ক্ষমতালিপ্সা, সব মিলিয়ে মানুষ একটা ক্যাডাভেরাস জীব। কুকুর সেই তুলনায় অনেক পারফেক্ট প্রাণী। আমি দেখেছি এক একটা কুকুর সারাজীবন ব্রহ্মচারী থেকে গেছে। সুপ্তিস্থলন নেই, স্বমেহন নেই। বিপরীত লিঙ্গের কুকুর দেখে সামান্য ছটফট করেছে, কুঁই-কুঁই করেছে, কিন্তু প্লেবয় ম্যাগাজিন খুলে মদের গেলাস নিয়ে বসেনি। বেশ্যালয়ে গমন করেনি।

মানুষের মতো ইমপারফেক্ট প্রাণীকে কুকুরের মতো মানুষ করতে হলে কি করতে হবে বুঝতে পারছেন? প্রাণীর পরিতৃপ্তির প্রথম শর্তই হল পেটপুরে খাওয়া, পরিশ্রম আর বিশ্রাম। দুর্ভাগ্যের কথা অধিকাংশ মানুষই অভুক্ত। যাঁরা প্রচুর খান তারা ধনী, শ্রম বিমুখ এবং অসুস্থ। ভারতবর্ষে ভোগের অনেক খরচ। খরচ মানেই উপার্জন। সোজাপথে প্রচুর উপার্জন অসম্ভব। আর সেইখানেই মরালিটির বিসর্জন। মানুষের তিনটি শ্রেণি ইমমরাল রিচ, ডিসকনটেনটেড হ্যাঁগার্ডস, অ্যান্ড মিডলক্লাস মাউস। উচ্ছিষ্ট ভোজন করে, মোসায়েবি করে, কুড়িয়ে বাড়িয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা। গুড়ের নাগরি উলটে যাচ্ছে ভ্যান-ভ্যান করে মাছি বসছে। কুকুর অনেক বলিষ্ঠ প্রাণী। কুকুরকে ট্রেন আপ করা যায়, মাছিকে করা যায় না।

তবু আমাদের চেষ্টা করতে হবে। শৈশব থেকেই মানুষকে ধরতে হবে। মেরে ধরে নয়, কুকুরের কায়দায় ট্রেনিং দিতে হবে। সে কায়দাটা হল, পুরস্কার, তিরস্কার। ভালো কাজে পুরস্কার, খারাপ কাজে তিরস্কার। একটা অবজেক্ট অফ ফিয়ার তৈরি করে রাখতে হবে। কুকুরের বেলায় আমরা হাতের কাছে রাখি পাকান খবরের কাগজ, ফোলডেড নিউজ পেপার। আর্মিতে ব্যাটন, মিডল ইস্টে চাবুক, মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে খেটে লাঠি আর একজন ফাদার ফিগার। প্রহার নয়, প্রহারের ভয়, মাঝে-মাঝে হুঙ্কার। দাঁড়াও, তোমার বাবা আসুক! দেখতে-দেখতে এমন একটা পরিবেশ তৈরি হবে–এইরে বাবা আসছে মনে করেই সব ঠান্ডা। তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রথমেই বাবা তৈরি করতে হবে, বাবার মতো বাবা। শুধু বাড়িতে নয়, সর্বত্রই একটা করে বাবা চাই। রাস্তায় ঘাটে, স্কুলে কলেজে, অফিস কাছারিতে। বাবার অভাবে দেশ উচ্ছন্নে গেল।

অবজেক্ট অফ ফিয়ার তৈরি হলেই শুরু হবে আসল ট্রেনিং। ট্রেনিং এর মূল কথাই হল বশ মানান। জৈনদের সাধনায় অনেক যোগ আছে। তার মধ্যে একটি হল স্থান যোগ। দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা ঘণ্টার-পর-ঘণ্টা। নট নড়নচড়ন। নড়লেই যোগ নষ্ট। তারপর অভ্যাস করো একপায়ে দাঁড়ান। এর নাম ধৈর্য।

কুকুরকে আমরা প্রথমে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসে থাকার ট্রেনিং দি। সিট ডাউন। নড়লে বা ওঠার চেষ্টা করলেই সেই অবজেক্ট অফ ফিয়ার, পাকানো খবরের কাগজ চোখের সামনে আস্ফালন। করে ভয় দেখাই। তারপর আদেশ তামিল করার ট্রেনিং। দূরে একটা বল রেখে বলি নিয়ে আয়। আনলেই উৎসাহ দেওয়ার জন্যে পুরস্কার, এক টুকরো বিস্কুট। বলটা সামনে রেখে বলি, পাহারা দে, কাউকে ছুঁতে দিবি না। সামনে খাবার রেখে বলি, খাবি না।

ওই একই কায়দায় ছেলে মানুষ করতে হবে। নরমগরম ট্রিটমেন্টে চরিত্রে টেম্পার লাগাতে হবে। ইস্পাত আর চরিত্র একই জিনিস। বেশি আদর না, বেশি শাসন না। বশ্যতা স্বীকার করো। আমরা চাই দ্বিতীয় ভাগের সুবোধ বালক, যাহা পায় তাহাই খায়, কদাচ অবাধ্যতা করে না। সংসারের নিয়ম হল প্রথমে দাসত্ব তারপর নেতৃত্ব। দাস থেকেই নেতা। আমাদের সকলের মধ্যেই হিরো ওয়ারশিপের মনোভাব লুকিয়ে আছে। অস্বীকার করে লাভ নেই। পলিটিক্যাল হিরো, ফিল্ম হিরো, স্পোর্টস হিরো, হিরো হলেই হল, শতশত ফ্যান কাতারে কাতারে রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল–যুগযুগ জিও। অফিসে সেরেস্তায় বড় কর্তাদের কি সাংঘাতিক দাপট! কে কার ঝাড়ে বাঁশ কাটে! কার ধনে কে পোদ্দারি করে! কে কাকে ক্ষমতায় বসায়! তবু যে বসে গেল তাকে সবাই মানতে বাধ্য। তিনি তখন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ভাগ্যবিধাতা গড। সরকারি অফিস হলে তিনি তখন সাহেব, স্যার। হায়ারর্কি তখন এইরকম–দাসের দাস, দাসের দাসের দাস, তস্য দাস। সেই গডকে তখন নানাভাবে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা, তেল দিয়ে, ব্যক্তিগত খিদমত খেটে। উঠতে স্যার বসতে স্যার। কলা নিন মূলো নিন। দিন স্যার ইলেকট্রিক বিলটা আপনার তিন মাইল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে জমা দিয়ে আসি। দিস ইজ মাই সেক্রেড টাস্ক। টেলিফোন বিল? ও দ্যাটস এ প্লেজার। বাড়িতে কাজ আছে? সো হোয়াট। আমি তো আছি! ভোর রাতে উঠে শেয়ালদা থেকে আমি মাছ কিনে এনে দেব। একদম ভাববেন না স্যার, নতুনবাজার থেকে ঘাড়ে করে ছানা কিনে এনে দেব। পরিবেশন? নো প্রবলেম। কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে লেগে যাব। যে নিজের বাড়িতে কুটোটি নেড়ে উপকার করে না সে বসের বাড়িতে হাসি-হাসি মুখে গাধার চেয়ে বেশি খাটে। বাড়ির কাজে মুখ ভার করে বলে– আমি একটা ডিগনিফায়েড সার্ভেন্ট ভাই! বড় কত্তার বাড়িতে গ্লোরিফায়েড দাস। এর দুটো কারণ, গড় সন্তুষ্ট হলে প্রসাদ মিলতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, দাসত্বে নিজের ব্যক্তিত্বকে খোঁটা বেঁধে ঠেলে ঠুলে দাঁড় করাতে হয় না। সোজা হয়ে বসার সাধনা করতে হয়, কষ্ট আছে। কুঁজো হয়ে বসা বড় আরামপ্রদ। আত্মবিসর্জনে ঝামেলা কম। প্রসাদ জুটে গেল তা ভালোই, না জুটলেও কোনও ক্ষতি নেই। বঞ্চনা সহজে হজম করা যায়। যুগযুগ ধরে মানুষ তাইতেই অভ্যস্ত। ব্যক্তিত্ব ফলাতে গিয়ে যে সংঘর্ষ তা সহ্য করা শক্ত। টেনসনে ইরিটেসান, অংসাইটি, নার্ভাস ব্রেকডাউন! উঁচতে উঠতে চিতপাত হওয়ার ভয়। জমিতে ফ্ল্যাট হয়ে থাকলে সরীসৃপের আনন্দ! সেই জন্যেই আমাদের প্রবাদ, অতি বড় হোয়য়া না ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি নিচু হোয়য়া না ছাগলে মুড়োবে। ব্যক্তিত্বকে কুঁজো করে, মোসায়েব হয়ে তালে তাল মিলিয়ে দিনগত পাপক্ষয় করে যাও। রামপ্রসাদ গান বেঁধেছিলেন– আমি চাই না মা গো রাজা হতে, রাজা হওয়ার সাধ নাই মা চিতে, দুবেলা যেন মা পাই গো খেতে। আমাদের ধর্মও বলছে, তুমিই সব, আমি তোমার দাস। আমি যন্ত্র তুমি যন্ত্রী, আমি ঘর তুমি ঘরণী, যেমন করাও তেমনি করি, যেমন চালাও তেমনি চলি। বীরভাবের বীরাচারীর শেষে স্ত্রী আচারী হয়ে গাঁজা ভাং খেয়ে শ্মশানে লুটোপুটি। বীরের পতন অনিবার্য। দাসের পতন নেই। মানুষ নিপীড়িত, অত্যাচারিত হতে ভালোবাসে। সুখের চেয়ে যন্ত্রণার আনন্দ অনেক বেশি। ডিকটেটাররা তাই এত ভালো শাসক। গণতন্ত্র সর্বত্রই ফেলিওর। হার্ডি বোধহয় সেইকারণেই বলেছিলেন, ডেমোক্র্যাসি হ্যাঁজ অল দি ভারচুস সেভ ওয়ান ইট ইজ নট অ্যাট অল ডেমক্রেটিক। ইতিহাসে দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর প্রান্তে-প্রান্তে এক ডিকটেটার যায় তো আর-এক ডিকটেটার আসে। অসংখ্য মানুষ অম্লান বদনে তার প্রভুত্ব মেনে নিয়ে বসে থাকে। ডিকটেটারে ডিকটেটারে লড়াই হয়, সাধারণ মানুষ প্রাণ দিতে বাধ্য হয়। নেতারা বসে থাকেন ঠান্ডা ঘরে, জলচৌকিতে। সাধারণ মানুষ বোমা, পটকা, ছোরাছুরি নিয়ে অলিতে-গলিতে মারামারি করে মরে। একদল বলে, অমুক যুগযুগ জিও, আর-একদল বলে তমুক যুগযুগ জিও। অমুকে তমুকে বিশেষ ফারাক নেই। একই মুদ্রার এ পিঠ আর ও পিঠ। দুজনেই এক গেলাসের ইয়ার। একই হোটেলে একই টেবিলে মুখোমুখি বসে রাইট আর লেফট। সুগারকোটেড বুলি, মিথ্যা প্রতিশ্রুতি, স্বপ্নের জাল বুনে বুনে জনতাকে হাতে রাখা। বল রয়েছে মাঠে খেলোয়াড়দের পায়ে। গ্যালারিতে ফ্যানরা উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। খেলার প্রতিযোগিতা মাঠ ছেড়ে গ্যালারিতে, গ্যালারি থেকে রাস্তায়, রাস্তা থেকে স্টেশানে, সেখান থেকে পাড়ায়, ভাঙচুর, গুলি, লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, মৃত্যু। যা নিয়ে কাণ্ড, যাদের নিয়ে কাণ্ড, তারা প্রোফেসনাল। তাদের কাছে খেলা উপলক্ষই, টাকাটাই সব। তারা যখন নরম বিছানার গরম ঘুমে, ভরা পেটের স্বপ্নে তখন অসহায় মানুষ স্টেশান প্ল্যাটফর্মে, পিঠে লাঠি, চোখে কাঁদানে গ্যাসের জল। রাত তিনটের সময় ছোঁড়াখোঁড়া বিরিঞ্চিবাবু শহর থেকে ফিরছেন সেরেস্তায় খাতা ঠেলে।

.

এই জীবনেরও কত মোহ। মৃত্যু তাড়া করলে ন্যাজ তুলে ছুটে পালায়। এই হল ফাউন্ডেশন অফ স্টেট। নেতারা জানেন এই প্রতিযোগিতার, এই উত্তেজনায় জনমানসিকতাকে ম্যানিপুলেট করেই বারেবারে ক্ষমতায় ফিরে আসতে হবে, উত্তেজনায় আগুনে শুকনো কাঠ গুঁজে খুঁজে আখের গুছোতে হবে। অসুস্থ উত্তেজনায় মানুষকে মাতিয়ে রেখে, মানুষকে শিবিরে-শিবিরে বিভক্ত যুদ্ধমান করে রাখতে হবে। দেয়ার ইজ নাথিং লাইক ওয়ার। ওরা লড়ে মরুক আমরা ইতিমধ্যে কোমরের কাপড়টা খুলে নি। অত্যাচারী রোমান সম্রাট কালিগুলা থেকে শুরু করে এই আশির ডেমোক্র্যাট, সকলেরই এক স্ট্রাটেজি। আমি হিরো তোমরা আমাকে ওয়ারশিপ করো। আমি আসনে বসি। তারপর এই নাও তোমাদের ব্রেড, ওয়াইন, ওয়াইফ, মেয়েছেলে, থিয়েটার সিনেমা সেক্স, এরিনায় রক্তাক্ত গ্ল্যাডিয়েটার, রথের দৌড়, ঘোড়দৌড়, মাঠে ফুটবল, রাস্তায় মিছিল, শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন, কে জি বি, সি আই এ, পুলিশ, সিক্রেট পুলিশ, লকআপ, থার্ড ডিগ্রি, রেপ, মার্ডার, ছিনতাই, ক্যাবারে। পঙ্ককুণ্ড তৈরি করে ফুটে থাকি পদ্মফুলের মতো।

এই যখন অবস্থা, অবস্থা যখন কিছুতেই পালাটাবে না, ক্ষমতায় যখন ভ্যাকুয়াম থাকবে না, তখন শৈশব থেকেই সকলকে কুকুরের মতো ট্রেনিং দিয়ে ওবিডিয়েন্ট করো, ওয়াচফুল করো, অ্যালার্ট করো। ভালো প্রভু হয় না, ভালো দাস হয়। ইতিহাস বলছে। নেচারের বিরুদ্ধে না যাওয়াই ভালো। ভালো কুকুর প্রভুর বড় পেয়ারের, বড় আদরের।

এবার আপনাদের সামনে আসছেন গণিতের শিক্ষক।

হ্যাঁ, আমি একজন শিক্ষক। ম্যাথেমেটিক্স আমার বিষয়, আমার ভালোবাসা। জীবনে এক গণিতে বিশেষ তফাত নেই। হিসেব করে খরচ, হিসেব করে প্রয়োগ, হিসেব করে পা ফেলা, হিসেব করে কথা বলা, হিসেবেই সুখ, বেহিসেবেই দুঃখ। গাণিতিক বুদ্ধির অভাবেই মানুষের যত ক্লেশ। শুধু কাব্য, শুধু সাহিত্যে, শুধু ভাবালুতায় মানুষের যত দুর্ভোগ। ইমোশান, সেন্টিমেন্ট হল গর্দভের লক্ষণ। মানুষকে হতে হবে কুল, ক্যালকুলেটিং। পৃথিবীটা কি? গিভ অ্যান্ড টেক। এক হাতে নেবে, এক হাতে দেবে। ডেবিট আর ক্রেডিট। বুক কিপিং। অঙ্কে মোটা মাথা হলেই ঠকে মরতে হবে। পৃথিবীর মানুষকে দু-ভাগে ভাগ করতে হবে, একদল ঠকায় আর একদল ঠকে। একদল মারে আর একদল মরে।

অঙ্কে কঁচা হলে মানুষ প্রেমে পড়ে। প্রেম হল ন্যাবার মতো। দৃষ্টি হলুদ, জগৎ হলুদ নিজে হলুদ, যা দেখেছি সব হলুদ। দুই আর দুয়ে যেমন পাঁচ হয় না, মানুষে মানুষে, মানুষে মানুষীতে তেমনি প্রেম হয় না। প্রেম একটা ফ্যালাসি, একটা কল্পনা, এ ফিউমিং ইম্যাজিনেসান, হ্যাঁলুসিনেসান। যা নেই তাকে সত্য বলে মেনে নেওয়ার নির্বুদ্ধিতা। গণিতে এসবের স্থান নেই। ইট ইজ সো প্র্যাকটিক্যাল। প্রেমে কানা ছেলে পদ্মলোচন হয়, পেঁচি, হয়ে ওঠে ক্লিওপেট্রা। ফাটা কাঁসরের মতো গলাকে মনে হয় বীণানিন্দিত কণ্ঠ। সেই ঘোরে মানুষ বেমক্কা ফাঁদে পড়ে ফেঁসে যায়। প্রেম-প্রেম ভাব হলেই অঙ্ক করো।

রাসেল বলেছিলেন, ছেলেবেলায় তার প্রচণ্ডই দুঃখকষ্ট ছিল। মাঝে-মাঝে মনে হতো আত্মহত্যা করি। সেই আত্মহত্যার প্রবণতা থেকে বাঁচার জন্যে তিনি গণিতের আশ্রয় নিয়েছিলেন। গণিত তাঁকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। কিন্তু দিস গবেট ইউনিভার্স সে কথায় সহজে কান দিতে চায় না। ইউনিভার্সিটিতে, ইউনিভার্সিটিতে বছরের-পর-বছর ধরে কপচে চলেছে শেলির রোমান্টিসিজম, কিটসের আর্ট ফর আর্টস শেক, সুইনবার্নের লাভ, বায়রনের ডিবচারি। পো-ওঁপো ছেলে, ধুমসো ধুমসো মেয়েরা বাপের অন্ন ধ্বংস করে সেই নেশার জগতে বছরের পর বছর জীবন নষ্ট করছে। ও মাই লাভ ও মাই রোমানস্ বলে একজনের হাত ধরে ছজনে টানাটানি। গলায় দড়ি, বিষ, ঘুমের ওষুধ। তারপর বাবু-বিবিরা কলেজের বাইরে এসে শেলিকে সের দরে বেচে দিয়ে মার্চেন্ট অফিসে ঢুকে দুই আর দুয়ে চার করছেন। কলেজে অধ্যাপক হয়ে ঢুকে বছরের-পর-বছর সেই একই বুলি কপচে চলেছেন। সেই এক হ্যাঁমলেট, সেই এক ওথেলো। টুমরো অ্যান্ড টুমরো, ব্রিফ ক্যান্ডল, টু বি নট টু বি। প্রেমপত্র আর লিখতে হল না। নোট লিখে লিখে আঙুল ক্র্যাম্প। লেকচার কপচে কপচে গলা ভাঙা, মাথায় টাক, চোখে চশমা, রক্তে সুগার। এদিকে প্রেমিকা প্রেমপর্বের কোটেশান লাঞ্ছিত প্রেমপত্র পুড়িয়ে শাঁসালো মক্কেলের গলায় ঝুলে পড়ে ইয়া বিশাল এক গিন্নি। মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে অঙ্কে অনেক পাকা। ডেবিট ক্রেডিট ভালো বোঝে। গিভ অ্যান্ড টেকে ওস্তাদ। তারা বলে, ফেলো কড়ি মাখো তেল, আমি কি তোমার পর।

অঙ্কে সেন্টিমেন্টাল প্র্যাকটিকাল হয়। এই বেনিয়ার জগৎকে ভালো করে বুঝতে শেখে। অ্যাভারেজ, রুল অফ থ্রি, ইন্টারেস্ট, টাইম অ্যান্ড মোশান, রিলেটিভ স্পিড, মিকশ্চার, কমপাউন্ড ইন্টারেস্ট না বুঝলে ঝানু হওয়া যায় না। পারমুটেশান কম্বিনেশান জীবনের সর্বক্ষেত্রের এক চরম সত্য। অঙ্কে মাথা ভালো হলে মানুষ বুঝতে শেখে, অলওয়েজ, ওয়ারশিপ দি রাইজিং সান। অঙ্কের ভালো ছাত্র কখনও চুলে কলপ লাগিয়ে বার্ধক্যে যুবক সেজে লম্ফঝম্ফ করতে গিয়ে কোমর ভাঙে না। অঙ্ক হি কেবলম। নমস্কার।

এইবার মস্তান শ্ৰীযুক্ত…

ঠিক আছে ঠিক আছে। আমার বেশি কিছু বলার নেই। আমার হল এক বাত, হাত থাকতে মুখে কেন! ঝামেলা দেখলেই লাশ ফেলে দাও। ও সব সাহিত্য, দর্শন, ধম্ম-ফল্ম বুঝি না শালা, পকেট গরম থাকলে শরীর গরম, মেজাজ শরিফ! কেউ কাউকে অ্যায়সা কিছু দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। আদায়ের অস্ত্র ইস্পাত। পেটের কাছে ফলাটা ধরো, মাল শালা আপসে বেরিয়ে আসবে। কায়দা জানলে কৃপণও দাতা হয়ে যাবে। শাস্ত্র-ফাস্ত্র অনেক শুনেছি মশাই, ক্যাপিটালিজম, মার্কসিজম, সোস্যালিজম, মাছের ডিমপাড়ার মতো লাইব্রেরি-ফাইব্রেরি সব ছোট-বড় বইয়ে ভরে গেল, পড়ে-পড়ে পণ্ডিতদের ডিসপেপসিয়া হয়ে গেল, পৃথিবীর চেহারা, মানুষের চেহারা কিছুই বদলাল না। গরিব সেই গরিব, বড়লোক সেই বড়লোক। রঘু ডাকাতই সেভিয়ার। রবিন হুডই আদর্শ। বেচাল দেখলেই শালা প্যাদাও। দুটো লাশ ফেলে দাও, সব ঠান্ডা। ছুরিটা দাঁতে চেপে লুঙ্গির কষি বাঁধতে-বাঁধতে দাঁত চাপা মুখেই বলো, কোন শুয়োরের বাচ্চা, বাস সব ঠান্ডা। কার ঘাড়ে কটা মাথা! একবার এগিয়ে আসুক তো দেখি। ভয় হল মূলধন, ছুরি হল ম্যাজিক। রাজনীতি, আইন, ভোট, ধর্ম, আদর্শ, নীতি, সব ছুরির কন্ট্রোল। ক্ষমতাই হল ক্লেশ নিবারণের একমাত্র উপায়। সকলের সব সিক্রেট আমার জানা। বেশি ঘাঁটলেই হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব।

এবার শ্রীবাটপাড়িয়া।

জয় শ্রীরামচন্দ্র, পবনসূত হুঁড়মারচন্দ্রজি কী জয়। রামরাজত্ব এসে গেছে বাবুজি। হামার কোনও ক্লেশ নেই। সিরিফ বাত ঔর থোড়িসি অ্যাসিড, সামটাইমস প্রেশার, বিলকুল সব ঠিক। আউর কুছ নেহি। দুনিয়া চল রহে, হামভি চলরহে মজেসে। হামি কুছ সমঝে না। আংরেজি না, বাঙলা না, চুনাও না। হামি সমজে ভাও। সিরিফ এক প্রশ্ন–কেতনা ভাও। এম. এল. একা কেতনা ভাও, এম. পি.কা কেতনা। জুটকা কেতনা ভাও, স্টিলকা কেতনা, দুনিয়ামে একই চিজ হ্যায় ভাও। পিতাজিকা কেতনা মাতাজিকা কিতনা জরুকা কিতনা গরুকা কিতনা। লেলিন কেয়া ভাও, কার্টারকা কেয়া ভাও, খোমেইনিকা কেয়া ভাও। একই চিজ হাম পুছতা, কেতনা ভাও পহেলে বাতাও। দোনো চিজ এক সাথ মিলা কর, কস্টিং করকে বাজারমে ছোড়দে। হোর্ডিং, পাইলিং, লেবেলিং, সেলিং বাস। ইসসে জিয়াদা কুছ নেহি হায়। গঙ্গামে পানি বইবে, শীত আসবে, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত, যানে দো আনে দো। হামারা কেয়া। জনতা যায়েগা তো কংগ্রেস আই আয়েগা, ও জায়েগা তো দোসরা কোই আয়েগা, হামারা কেয়া। হামি জানে, ভাও কেতনা। রুপিয়া চেয়ে বড়িয়া কুছু নেই। হামি আসন কিনতে পারে, এম. এল. এ-এম. পি মেলতে পারে, পুলিশ হামার, নেতা হামার, সরকার হামার, জগৎ হামার, হামি জগৎ শেঠ। লেকিন কেমন কোরে হামি এমন হোয়েচি? ও তো সিক্রেট ভাইসাব। দুনিয়ামে দোনো চিজ হ্যায়, এক খরিদনে কা, এক বিকনে কা। বাই অ্যান্ড সেল অ্যান্ড গো অন মেরিলি। সেল দেম অল। ওয়ার্লর্ড ইজ ফর সেল।

এইবার আমাদের কিছু বলবেন অ্যাডভোকেট।

ইয়েস থ্যাঙ্ক ইউ। একটা কথা আছে চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। বড় খাঁটি কথা। যদি কেউ ধরা পড়ে তখন আছি আমরা। এখন কথা হল আইনের সাহায্যে আমাদের ক্লেশ নিবারণ কতটা সম্ভব। আমরা মানে কারা? যে আমির টাকার জোর নেই সে আমির জন্যে আইনও নেই আদালতও নেই। সে আমি হল বুড়বাক আমি। আইন হয় তো পারচেজ করা যায় না কিন্তু আইনজীবীকে পারচেজ করা যায়। আইন ভীষণ ফ্লেকসিবল, ব্রহ্মের মতো তার শত ব্যাখ্যা। আইনবিদ সহায় হলে অপরাধ বলে কিছু থাকে না। তবে বেআইনি ঘটনা এতই বেড়ে চলেছে যে আইন। দিয়ে আর সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে ক্রিমিন্যাল সাইডে তুলকালাম কাণ্ড চলেছে। ল লেস অবস্থাটাই হয়তো ল হয়ে যাবে। হত্যা আর ক্রাইম বলে স্বীকার না করা যেতে পারে। হত্যা এ ফর্ম অফ ভায়োলেন্ট ডেথ নট পানিশেবল। অ্যানিহিলেসান। আমেরিকান ভাষায়, চাক হিম আউট। ইরেজ হিম। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, জাস্ট মিউচ্যুয়াল ট্রান্সফার অফ প্রপার্টির্স। যার আছে ভুরিভুরি তার কাছে থেকে কিছু আদায় করে নেওয়া। জমিজমা সংক্রান্ত মামলা সিভিল সাইডে থাকতেও পারে, না থাকলেও ক্ষতি নেই। দখল আর জবরদখল পাশাপাশি চলছে। আমাদের পারিবারিক অশান্তি ক্রমশই বাড়ছে।

বিগ্যামি অ্যাডালটারি শব্দ দুটো এখনও জ্বালাচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো আর জ্বালাবে না। ডিভোর্সের মামলাও খুব আসছে। কালে ওটাকেও আমরা তিনবার তালাক, তালাক, তালাক বলে চটপট স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা করে দিতে পারব। পারমিসিভ সোসাইটিতে সামান্যতম বাধাও যাতে না থাকে সেই চেষ্টাই আমাদের করা উচিত। শেষ কথা বলং, বলং বাহুবলং। আইন দিয়ে অ্যামপুট করা যায়, ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা যায়, উঁকিলের চিঠি দিয়ে ভয় দেখানো যায়, লাভ কি হয় বলা শক্ত। মামলা করে ডিক্রি পাওয়া যায়, ভাড়াটে উচ্ছেদ করতে হলে সেই দিশি দাওয়াই দিতে হয়। ডিগ্রি থাকলে আজকাল চাকরি হয় না, মুরুব্বি ধরতে হয়। লিটিগেশান ইজ এ লেংদি প্রসেস। মামলা যখন ফয়সালা হয় উভয় পক্ষই কাত। বাঘের লড়াইয়ে শৃগাল লাভবান। আমেন।

আমি দার্শনিক। আমার কথা হল পড়ে নয়, দেখে শিখুন। যত দেখবেন তত শিখবেন। কি শিখবেন? এখানে ধনী দরিদ্র হয়, দরিদ্র ধনী হয়, সৎ অসৎ হয়, অসৎ সম্মান পায়। এক আসে, আর-এক যায়। যৌবন বার্ধক্যে ঢলে পড়ে! সুখে থাকলেও মৃত্যু, দুঃখে থাকলেও মৃত্যু। সাকারে বিশ্বাসী হবেন কি নিরাকারে বিশ্বাসী হবেন যার-যার নিজের অভিরুচি, তবে একটা কিছু ধরা চাই। গুরু ধরুন, চেলা ধরুন, মতবাদ ধরুন, ফুটবল ধরুন, ক্রিকেট ধরুন, রেস ধরুন, ফাটকা ধরুন, যা হয় কিছু একটা ধরার চেষ্টায়, ধরি ধরি করি ধরতে না পারি, জীবন শেষ। খেল খতম, পয়সা হজম।

রাজনীতিবিদ আপনি কিছু বলুন।

আমার একটাই কথা, আমাকে ভোট দিন। আপনারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। ভোটের অধিকার পেয়েছেন, সে অধিকার হারাবেন না। আমি যখন যে দলেই থাকি না কেন আমাকে ভোট দিন। টাকাকড়ি, ধনদৌলত চাইছি না, চাইছি একটা ভোট। আপনারা আমাকে ভোট দিলে আমি সুখী হব। বিবেকানন্দ বলে গেছেন, জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। আমি একটা জীব, পলিটিক্যাল জীব, সেই জীবে দয়া মানে ঈশ্বরের সেবা, পরকালের কাজ। রাজনীতিতে বিশ্বাস হারালেও ঈশ্বরে বিশ্বাস হারাবেন না। ঈশ্বর কখনও কারুর কিছু করছেন কি? আমরা মনে করি তিনিই সব করছেন, তিনি সব করতে পারেন, তিনি নির্ধনকে ধনী করতে পারেন, অপুত্রককে পুত্রক, অসফলকে সফল। একজন রাজনীতিকও তাই। ইলেকশনের পর তাঁকে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায়। না। ধরা যায় না। তিনি কি করেন, তিনি কি করবেন, তিনি কি করতে পারেন কেউ জানে না। অতএব ভোট দিয়ে সেই ঈশ্বরতুল্য রাজনীতিবিদের সেবা করুন। সেবা পরমধর্ম। ফ্লোরেন নাইটিঙ্গে ল, হেলেন কেলার, মাদার টেরেসা সেবা ধর্মের জন্যে জগতে বিখ্যাত! আপনারাও সেবা করুন। পরশ্রীকাতর বলে বাঙালির বড় দুর্নাম। সেই দুর্নাম কাটাতে হবে। আমি যদি মন্ত্রী হই, বাড়ি করি, গাড়ি করি, টাকা করি, আমার আত্মীয় স্বজন চামচাঁদের অবস্থার উন্নতি করি তাতে আপনারা দুঃখ করবেন কেন, ঈর্ষা করবেন কেন, খুশি হবেন, সুখী হবেন, আমাদের গর্ব বলে লাফাতে থাকবেন, বলবেন, আহা আরও বড় হোক, আরও বোলবোলা হোক। বাঙালির উন্নতি হোক। আগেকার দিনের জমিদারদের কথা ভাবুন। নিরন্ন প্রজারা পড়ি কি মরি করে নজরানা দিয়ে যেত? জমিদারদের বাড়ির ঝাড়লণ্ঠন দেখে, বিশাল বাড়ি দেখে, চেহারা দেখে, বোলবোলা দেখে, ব্যাভিচার দেখে, অত্যাচার দেখে কি খুশিই না হতো! সেই খুশির ভাবটা আবার ফিরিয়ে আনুন।

ত্যাগই জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। তুলসীদাস বলেছেন সব ছাড়ো সব পাওএ। সব ছাড়লেই সব পাওয়া যায়। রাজনীতি অতি নোংরা জিনিস। সেই নরকে আপনাদের ভোট নিক্ষেপ করে আমাদের নরকবাসকে দীর্ঘ করুন। আপনাদের স্বার্থে আমরা নরকে যেতে প্রস্তুত আছি। নরক ভরতি থাকলে আপনাদের আর সেখানে স্থান দেওয়ার জায়গা থাকবে না, তখন স্বর্গের পথ অটোমেটিক্যালি খোলা থাকবে। আমরা মস্তান নিয়ে, রক্তাক্ত রাজনীতি নিয়ে, দলাদলি, দল ভাঙাভাঙি নিয়ে, কালোয়ার, কালোবাজারি, ব্যাবসাদার, মুনাফাখোর নিয়ে নরক গুলজার করে বসে থাকি। সমাজে বেশ্যালয় রাখা হয় যাতে লম্পটরা যার-তার হাত ধরে টানাটানি না করতে পারে। বারনারী সামাজিক স্বাস্থ্য রক্ষা করে চলেছে। রাজনীতিও তাই। রাজনীতির ম্যানহোলে আমরা পাঁক জমা করে আপনাদের পবিত্র রেখেছি। আপনারা ত্যাগে, তিতীক্ষায়, ধৈর্যে, উদারতায়, দারিদ্র্যে, সততায়, উদাসীনতায় সংসার ধর্ম পালন করে মহাপ্রস্থানের পথে চলে যান। বাজে ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। শুধু ভোটের সময় ভোট দিয়ে পবিত্র নাগরিক দায়িত্ব পালন করুন। আপনারা সকলেই দায়িত্বশীল নাগরিক হয়ে উঠুন। একটা কথা জেনে রাখুন, আমরা যত অসৎ হব আপনারা রিলেটিভলি ততই সৎ হয়ে উঠবেন। আর একটা কথা, আপনারা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী হতে পারেন। খুবই স্বাভাবিক, ফ্রিডাম অফ স্পিচ, ওপিনিয়ান, আইডিয়া, সংবিধানের মূল কথা। সেই কারণে আমি আপনাদের সুবিধের জন্যে অনবরতই দল পালটে-পালটে সর্বদলীয় চেহারা পেয়েছি। আমাকে ভোট দেওয়া মানেই সব দলকেই ভোট দেওয়া। আচ্ছা আপনারা সুখে থাকুন। আমরা দুঃখেই থাকি। গলায় বিষ ধারণ করে নীলকণ্ঠ। আনইজি লাইজ দি হেড দ্যাট ওয়্যারস দি ক্রাউন।

সভা শেষ। সভাপতি উঠলেন। চা এসেছে। সমিতির পয়সা কম, সঙ্গে ডগ বিস্কুট। সভাপতি বললেন, মনুষ্যক্লেশ নিবারণী সমিতির আপাতত আর কোনও অধিবেশন হবে না। আমার ধারণা ক্লেশ নিবারণ করা সম্ভব নয়। ক্লেশ না থাকলে অক্লেশ মধুর হয় না। অন্ধকার আছে বলেই আলো, অসৎ আছে বলেই সৎ-এর কদর, রোগ আছে বলেই আরোগ্য সুখের। ক্লেশ আছে বলেই ধর্ম আছে, বিশ্বাস আছে, বন্ধুত্ব আছে, আদৰ্শ আছে, সাধনা আছে, সমাজ আছে, সংসার আছে। ক্লেশ মোচনের চেষ্টাটাই ক্লেশদায়ক। অস্কার ওয়াইলড বলেছিলেন? Philanthropy seems to have become simply
the refuge of people who wish to annoy their
fellow creatures.

Exit mobile version