কণকলতা বলে, ‘আমি আছি, হুজুর, আপনেরে ভাইর্যা দিমু। আপনেরো ভইর্যা দেওনের লিগা আমি বইস্যা আছি।’
আমি বলি, ‘আমি হয়তো বাঁচবো না।‘
কণকলতা হাহাকার করে ওঠে, ‘তাইলে আমিও বাচুম না, হুজুর। ‘
আমি বলি, ‘সন্ধ্যার পর চ’লে এসো, তাঁতের শাড়ি প’রে।’
কণকলতা বলে, ‘হেই কতা কি আমি ভোলতে পারি, হুজুর? আপনার বিবি কণকলতা আসনের লিগা পাগল অইয়া রইছে।‘
আমি একটু পান করি, সাদ বাদ গানটা বাজিয়ে শুনি।
শোনার সময় আমি মহাশূন্যতা দেখতে পাই, হঠাৎ লাথি মেরে প্লেয়ারটাকে উল্টে ফেলে দিই, গানটা ছাছ্যাছা ক’রে বন্ধ হয়; একটি বালকের জন্যে, অজস্র পাখির রঙ ও সুরের জন্যে আমার কষ্ট হয়, আমার কাঁদতে ইচ্ছে করে। আমি কাঁদতে পারি না, কী ক’রে কাঁদতে হয় আমি ভুলে গেছি।
ওই মঠটি কি এখনো ওখানে আছে, ওটি সত্যিই চুরমার হয়েছে তো?
আমি মোঃ আবু লাদেনকে ডেকে জিজ্ঞেস করি, ‘মোঃ আবু লাদেন, মঠটি সত্যিই চুরমার হয়েছে তো? না কি ওটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, অহন অইডার একটা ইডও নাই, সব কিছু ধুলা অইয়া গেছে।‘
আমি বলি, ‘তাহলে ওখানে কী আছে?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘কিছু নাই, হুজুর, সব খালি, রাহমানির রাহিম আল্লার আশমান ছাড়া আর কিছু নাই।’
আমি বলি, ‘আশমান চুরমার হয়ে যায় নি তো?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘কি যে কন, হুজুর, আশমান চুরমার অইব ক্যান?’
আমি বলি, ‘হতে পারে না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, অইহানে তা আমরা বোমা মারি নাই; আর আল্লার আশমান চুরমার অইতে পারে না।’
আমি বলি, ‘তাহলে কোথায় মেরেছো?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, আপনে ত দ্যাকছেনই, মডে মারছি, কতগুলি বমা আর গ্রেনাইড মারল হেরা।‘
আমি বলি, ‘মঠটি সত্যিই চুরমার হয়েছে?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, গুরা অইয়া গ্যাছে।’
আমি বলি, ‘তুমি গিয়ে একটু দেখো তো মঠটি ওখানে আছে কি না?’
মোঃ আবু লাদেন তাজ্জব হয়, এতোটা তাজ্জব সে জীবনে কখনো হয় নি; সে তার দুটি ভোতা চোখ মেলে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আমি বলি, ‘তুমি যাও, গিয়ে দেখো মঠটি আছে কি না? চুরমার হয়েছে কি না? ধবংস হয়ে কি না? গিয়ে আমাকে কল করো।’
মোঃ আবু লাদেন ছুটে যায়, কিছুক্ষণ পরই মোবাইলে শুনি, ‘হুজুর, এইহানে অহন কোনো মড নাই, জিহাদিরা একটা মছিদ তোলছে, আলহামদুলিল্লা।‘
আমি বলি, ‘খেয়াল রেখে ওখানে যেনো মাটির নিচ থেকে কোনো মঠ মাথা তুলে না। ওঠে, দিনরাত পাহারা দিও।’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, মাডির তল থিকা কি মড ওটতে পারে?’
আমি বলি, ‘পারে না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, পারে না; খালি রাহমানির রাহিম চাইলে পারে। ‘
আমি বলি, ‘মোঃ আবু লাদেন, তুমি ঠিক জানো যে মাটির নিচ থেকে কোনো মঠ উঠতে পারে না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘হুজুর, আমরা পাহারা দিতে আছি, আপনে একটুও চিন্তা কইরেন না, আমরা খাড়া আছি, আমুন কোনো মন্ড ওটলে ওডনের সোমাই চুরমার কইর্যা হলাম, আলহামদুলিল্লা!’
আমি বলি, ‘দ্যাখো তো অন্য কোনো দিকে কোনো মঠ উঠছে কি না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, কোনো দিকই ওটছে না।’
আমি বলি, ‘দ্যাখো তো, অনেক দূরে একটি বালক মঠের দিকে তাকিয়ে আছে কি না? মঠ না দেখে সে কাঁদছে কি না?’
মোঃ আবু লাদেন বলে, ‘না, হুজুর, দূরে কোনো পোলাপান নাই; যে-দুই চাইরজন আছে, তারা কাছেই আছে, হাসাহসি করতেছে।’
আমি বলি, ‘তুমি দূরের রাস্তায় গিয়ে দ্যাখো কোনো বালক একলা দাঁড়িয়ে আছে কি না? সেখান থেকে আমাকে কল করো।’
কিছুক্ষণ পর মোঃ আবু লাদেন কল করে, ‘হুজুর, রাস্তায় কোনো পোলা নাই, তয় দূরে মালাউন বাড়ির একটা মাইয়া এই দিকে চাইয়া রইছে। তারে ধইর্যা লইয়া আহুম নি, হুজুর?’
আমি বলি, ‘না; তুমি গিয়ে সালাত আদায় করো।’
একটু ঘুম এসেছিলো হয়তো, একটা মধুর স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলাম।
স্বপ্নের বদলে আমি বিভীষিকা দেখতে শুরু করি।–ধারাবাহিক, পথে পথে বিভীষিকা, দেখি আমি আগুন লাগিয়ে চলছি গ্রামের পর গ্রামে, সেই আগুন নরকের আগুনের থেকেও প্ৰচণ্ড, শহরের পর শহরে, সমস্ত ধানখেতে, পাটখেতে, সরষেখেতে, শিউলিগাছে আগুন জ্বলছে, গন্ধরাজে আগুন জ্বলিছে; ছুটে চলছে আমার জামাঈ জিহাদে ইছলামের জিহাদিরা; তারা দখলের পর দখল করছে, চুরমার করছে, কতল করছে, আওয়াজ তুলছে আকাশ দীর্ণজীৰ্ণ করে; টেনে এনে ছহবতের পর ছহবত করে চলছে ঘরে, আঙ্গিনায়, রাস্তায়, মাঠে, ইস্কুলের পথে; আমি আর জামাঈ জিহাদিরা আগুন লাগাচ্ছি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিদ্যালয়ে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে, লাল সূর্যের পতাকায়, গেয়ে চলছি। পাক সার জমিন সাদ বাদ, আর গাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নদী শুকিয়ে যাচ্ছে, পুকুরে মাছ মরে ভেসে উঠছে, নারীরা মৃত সন্তান প্রসব করছে, আকাশ থেকে আগুন ঝরে পড়ছে, পাখিরা লুটিয়ে পড়েছে; রক্তে ভিজে উঠছে মাটি, পুকুরে পানির বদলে রক্ত, নদীতে রক্তের ঢেউ, আকাশ থেকে রক্তবৃষ্টি হচ্ছে, গাভীদের ওল্যান থেকে রক্ত ঝরছে; কবিতা থেকে রক্ত করছে, সব নর্তকী খোঁড়া হয়ে যাচ্ছে, চিত্রকরের আঙুলে কুষ্টরোগ দেখা দিচ্ছে।
আমি দেখি আমার দেশ জেনায়–জেনায়–জেনায়–মূৰ্ছিতা হয়ে রাস্তার পাশে প’ড়ে আছে।