কারা মা?
বটতলার ওরা। নিতাইকে এখনই খবর দিতে হবে।
নিতাইদাকে তো দেখলাম কলোনীর মোড় পেরিয়ে কোথায় যাচ্ছে। সঙ্গে কারা সব আছে।
দৌড়ে গিয়ে খবরটা দিয়ে আয় বাবা। কেন যে রোজ আসছে এরা কিছু বুঝতে পারছি না। এক্ষুনি যা।
যাচ্ছি। কিন্তু গিয়ে বলবটা কি?
বলিস বটতলার ওরা তোর বাবাকে খুঁজতে এসেছিল।
তাতেই হবে?
সকলের সামনে বলিস না। আড়ালে ডেকে চুপিচুপি বলিস।
কুয়োতলা থেকে সবই শুনতে পেল বিষ্ণুপদ। গায়ে জল ঢালল না অনেকক্ষণ। ভেজা গায়ে বসে রইল। সব জায়গা থেকে নিজেকে তুলে আনা কি সহজ কাজ?
রামজীবন কিছু পাকিয়ে তুলেছে। বটতলা তো এতকাল ভাল জায়গাই ছিল। শীতলার থান আছে। সবাই বলে জাগ্রত দেবী। একসময়ে এই জায়গার নামই ছিল শীতলাতলা। গায়ের নাম বিষ্টুপুর বললে কেউ কেউ বলে, কোন্ বিপুর গো! শীতলাতলা বিষ্টুপুর?
সেই শীতলাতলায় এখন আড্ডা হয়েছে। খারাপ খারাপ লোক এসে জুটেছে। কাছ ঘেঁষে বাসরাস্তা হওয়ার পর থেকেই অধঃপতন। কঁচাপয়সার কারবার আছে।
পটল ফের সাইকেল ঘুরিয়ে বেরিয়ে গেল।
দাওয়ায় চালের তলায় দাঁড়িয়ে গামছাটা নিংড়ে নেয় বিষ্ণুপদ। মাথা মোছে, গা মোছে। মুছতে মুছতে অনেক কথা ভাবে। চারটে সাইকেল। চারটে আবছা লোক। হেঁড়ে গলা। সেজো বউ ভয় পেয়েছে। রামজীবনের কি কোনও বিপদ।
বৃষ্টিটা ফের চেপে এল। একরকম ভাল। বৃষ্টিতে সব ধুয়ে যাক। যত ভাবনা-চিন্তা, যত পাপ-তাপ সব ধুয়ে যাক।
আজ অনেকটা ভাত বেড়ে এনেছে নয়নতারা। বলল, ভাল ঘানির তেল আছে, একটু ভাতে মেখে খাবে নাকি?
তেল-ভাত বিষ্ণুপদর বেশ পছন্দ। সঙ্গে লঙ্কা আর নুন। বলল, দাও একটু। ভাতটা একটু বেশী মনে হচ্ছে।
খাও। কচুরমুখি সেদ্ধ, বেগুনের ঝোল আর ডাল। এই আছে আজ। হবে এতে? খুব হবে।
খেয়ে উঠে বিষ্ণুপদ একটু ঘুমলো। শরীর কিন্তু খারাপ লাগছে না। শ্বাস ঠিক আছে। নাড়ীও ঠিক আছে। কোথাও কোনও গড়বড় টের পায় না সে। তবু কালঘড়িটা চোখের সামনে ভাসছে। একখানা মোটে ঘর আছে আর। দুটো কাটাই সেদিকে ঘুরছে।
জেগে দেখল, পুলিন ডাক্তার বসে আছে জলচৌকিতে।
হল কি গো বিষ্ণুপদ? কালঘড়ি না কী যেন দেখেছ!
পুলিনের বয়স বিষ্ণুপদর সমানই হবে। বিষ্ণুপদ কথাটা পছন্দ করল না। নয়নতারার কথাটা ফাঁস করা উচিত হয়নি। এরা কেউ তো বুঝতে চাইবে না ব্যাপারটা।
বিষ্ণুপদ একটা হাই তুলে বলে, ডাক্তার কি আর সব সারাতে পারে?
সারাবার মতো কিছু থাকলে সারাতে পারবে না কেন? কিন্তু তোমার সারাবটা কি? রোগটা কোথায়?
বিষ্ণুপদ মাথা নেড়ে বলে, বোগটোগ কিছু নেই। এ হচ্ছে ফুরিয়ে যাওয়া। ঘড়ির দম শেষ হয়, দেখনি?
দম দিলে ফের চলে। বিগড়োলে দম আর নেবে কি?
তুমি কি বিগড়েছ ভাই?
মনে তো হয়। লক্ষণ তো মিলছে না। থাকগে, হাতটা দাও, নাড়ী দেখি।
বিষ্ণুপদ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হাতখানা বাড়াল। পুলিন নাড়ী দেখতে জানে কিনা তাতে ঘোর সন্দেহ আছে বিষ্ণুপদর। এ বিদ্যে সোজা নয়। জানুক না-জানুক, পুলিন ছাড়া তাদের আর সাই বা কে?
হাতখানা রেখে দিয়ে পুলিন বলে, কিছু হয়নি তোমার। নাড়ী দিব্যি টনটনে আছে।
এখনও আছে। নাড়ীটাড়ীতে কিছু বোঝা যাবে না হে।
তবে কিসে বোঝা যাবে? এটা একটা বিজ্ঞান, মানো তো!
তা মানে বিষ্ণুপদ। মানুষ কত কিছু জানে, কত খবর রাখে, কত ওষুধপত্র বের করে ফেলেছে। বিষ্ণুপদ অজান জিনিস সব মানে।
তবে কি জানো পুলিন সব জেনেও কিছু যেন অজান থেকেই যায়। এই দেহ-যন্ত্রটার মধ্যে কত কলকজা বলো তো! কী সাংঘাতিক সব কাণ্ড।
সেসব তো তোমাকে একদিন আমিই বুঝিয়ে দিয়েছিলাম।
সে কথাই তো ভাবি। দেহের মধ্যে কত কী পুরে দিয়েছেন ভগবান।
ওষুধ দিচ্ছি। খেয়ো।
কিসের ওষুধ? অসুখ তো কিছু নেই বললে?
তবু দিচ্ছি। ভাবনাচিন্তা কমবে। ঘুম হবে। খিদে হবে।
সে সব তো হচ্ছেই।
০০২. এয়ারলাইনস্ অফিসের কাছাকাছি
বাসটা এয়ারলাইনস্ অফিসের কাছাকাছি এসেছে বলে টের পাচ্ছিল চয়ন। ঠাসা ভিড়ের মধ্যে সে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে। একটু আগে সে একজনের কজিতে ঘড়ি দেখতে পেয়েছিল। বিকেল পৌনে ছটা। সাড়ে ছটার মধ্যে গোলপার্কের কাছে মোহিনীদের বাড়িতে তার পৌছোনোর কথা। পৌঁছে যাবে বলে আশাও করছিল সে। সবই ঠিক চলছিল। বাস পাওয়া, বাসে ওঠা, পৌনে ছটা–এসব মিলিয়ে মিশিয়ে বিকেলটা ভালয় ভালয় কেটে যাচ্ছিল প্রায়।
কিন্তু হল না। ভ্যাপসা গরমে সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ে চলন্ত ডবলডেকারের নিচের তলায় মানুষের গায়ে সেঁটে থেকেও সে আচমকা চোখের সামনে সেই নির্ভুল কুয়াশা দেখতে পেল। ঘন সাদা কুয়াশা। দুটো সরু রেল লাইন সেই কুয়াশায় উধাও হয়ে গেছে। আবছায়া একটা সিগন্যাল পোস্ট। ঝিক করে সিগন্যাল ডাউন হল। কুয়াশার ভিতরে কিছু দেখা যায় না। শুধু একটা রেলগাড়ির এগিয়ে আসার শব্দ পাওয়া যায়। ঝিক ঝক ঝিক ঝিক।
বা হাতের বুড়ো আঙুলটা আপনা থেকেই কেঁপে কেঁপে ওঠে চয়নের। ঝিক ঝিক ট্রেনের শব্দের সঙ্গে এক তালে।
আঙুলটা কেঁপে উঠতেই আতঙ্কিত চয়ন প্রাণপণে ভিড় কাটিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করতে থাকে। দুর্বল শরীরে সে এক অসম্ভব চেষ্টা। তার চারদিকে মানুষের দেয়ালে ফাটল ধরানোর জন্য যে শক্তির দরকার তা তার এমনিতেই নেই। তার ওপর শরীরে যে কাপন উঠে আসছে সেটা ইতিমধ্যেই তার শরীরের আনাচে কানাচে সতর্কবার্তা পাঠিয়ে দিয়েছে। সমস্ত শরীর হাড়িকাঠে ফেলা বলির পাঠার মতো নিজীব আত্মসমর্পণের দিকে ঢলে পড়ছে।