হেমাঙ্গ লজ্জিত হয়ে বলে, আমি কখনও কো-এড়ুকেশনে পড়িনি, ছেলেবেলা থেকেই মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা বা বন্ধুত্ব রেস্ট্রিকটেড ছিল। বাবার ধারণা, বেশি মেলামেশা করলে নারীজাতির ওপর ছেলেদের শ্রদ্ধা কমে যায়।
রশ্মি অবাক হয়ে বলে, এ তো প্ৰায় মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা!
হয়তো আপনি ঠিকই বলছেন। কিন্তু অভ্যাসটা মজ্জাগত হয়ে গেছে।
রশ্মি খিলখিল করে ছেলেমানুষের মতো হেসে বলে, বেচারা!
এই বেচারা শব্দটাই বুঝি আর এক পা এগিয়ে আসা।
রশ্মি বলল, আচ্ছা, নার শ্রদ্ধাই বা কেন করতে হবে বলুন তো! শ্রদ্ধার চেয়ে অনেক বেশি দরকার বন্ধুত্ব, ভালবাসা। তাই নয়?
আপনি এসব বিষয়ে আমার চেয়ে বেশিই জানবেন। উন্নত সমাজব্যবস্থা দেখেছেন। আমরা তো কূপমণ্ডূক। কীই বা জানি!
রশ্মি তার চশমা, দুল ইত্যাদির একটা বিলিক তুলে অন্ধকার টাক্সিতে তার দিকে ঘুরে তাকাল, এটা কি বিনয়। নাকি একটু হুল?
কী যে বলেন! আমার পরিবারটা বেশ রক্ষণশীল। আমরা অ্যাডাল্ট হওয়ার পরও আমাদের ওপর খবরদারি বজায় রাখা হয়। আমি এখনও একটা পারিবারিক শাসনব্যবস্থার মধ্যে আছি। অনভিপ্ৰেত কোনও কাজ করলে তার জন্য জবাবদিহি করতে হয়। স্বাধীনতা একদম নেই।
রশ্মি একটা দুঃখের শ্বাস ফেলে বলে, বুঝতে পেরেছি। আপনি সেই পরিবারে মানুষ যেখানে এখনও বর্ণাশ্রম মানা হয়; মারেজকে বরদান্ত করা হয় না, এঁটোকাঁটা বিচার করা হয়, বউদের ঘোমটা দিতে হয়, এটসেটরা, এটসেটরা।
অনেকটা তাই।
আপনি বোধ হয় বাড়ির পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করবেন!
বিয়ে করলে তো! ওই একটা ব্যাপারে এখনও ফ্যামিলি প্রেসারকে ঠেকিয়ে রাখা গেছে।
কিন্তু একদিন ভালমানুষের মতো টোপর পরে তো একটা অচেনা মেয়ের গলাতেই মালা দিতে হবে!
রশ্মির হাসিতে খুব সঙ্কুচিত হয়ে হেমাঙ্গ বলল, ব্যাপার কি জানেন? আমার অভিভাবকরা আমার ভিতরে নারীজাতির মুক্তি মুম্বু শ্ৰদ্ধার সঞ্চার করে দিয়েছেন যে, কোনও নারীকে বিয়ে করার কথাই আমি ভাবতে পারি না। অতিরিক্ত শ্ৰদ্ধার ফলই হবে।
রশ্মি ভীষণ হাসছিল। মুখে রুমাল অবধি চাপা দিতে হল তাকে। তারপর বলল, আপনি কিন্তু খুব বিচ্ছু। মুখে ভালমানুষীর ভাব, কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুষ্ট আছেন।
হেমাঙ্গ এ মেয়েটার সঙ্গে অনেকক্ষণ ধরে মেশামোশি করছে, সুতরাং তার সঙ্কোচটা খানিকটা কেটেও গেছে। সে খুব সাহস করে বলল, আমার মতো প্রবলেম তো আপনার নেই। আপনি তো ইচ্ছে করলে ঘর-সংসার করতে পারেন।
রশ্মি মিষ্টি করেই বোধ হয় হাসল, অন্ধকারে ভাল বোঝা গেল না। তারপর বলল, মেয়েদের বুঝি ঘর-সংসার করা ছাড়া আর কিছু করার নেই? ঘর-সংসার ঘর-সংসার শুনে শুনে পাগল হওয়ার জোগাড়।
রাগ করলেন নাকি?
না, রাগ করলে বুঝতেই পারতেন। শুনুন, ছেলেদের বিয়ে করা আর মেয়েদের বিয়ে করা কিন্তু এক ব্যাপার নয়। ছেলেদের বিয়ে করা অনেকটা আনন্দের ব্যাপার, একটু ভারমুক্ত হওয়ার ব্যাপার। কারণ তাকে দেখাশোনা করার একজন আসছে। কিন্তু মেয়েদের বিয়ে করা মানেই হচ্ছে ভয়, উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা। নিজের পরিবার ছাড়তে হবে, সন্তানধারণ থেকে আরও অনেক কিছুর দায়দায়িত্ব নিতে হবে। এবং তার পরে সংসার ছাড়া তার আর কিছু করার থাকবে না।
হেমাঙ্গ অত্যন্ত সমবেদনার সঙ্গে বলল, ঠিক কথা। মেয়েদের বড়ই কষ্ট।
রশ্মি ফের তার দিকে চেয়ে বলল, মুখটা ভাল দেখতে পাচ্ছি না। খুব সম্ভব এটাও একটা বিচ্ছুমি, তাই না?
বিশ্বাস করুন, বাস্তবিকই মেয়েদের কষ্টটা আমি বুঝতে পারি।
রশ্মি সবেগে ডাইনে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, কোনও পুরুষই কখনও মেয়েদের সত্যিকারের কষ্ট বুঝতে পারে না। সিমপ্যাথাইজার হতে পারে, বন্ধু হতে পারে, কিন্তু মেয়েদের আসল সমস্যাটা শুধু মেয়েরাই টের পায়। আপনি কিছুতেই সেটা বুঝতে পারবেন না।
হেমাঙ্গ মৃদু স্বরে বলে, ছেলেদের প্রবলেম কি মেয়েরা বুঝতে পারে?
খুব পারে। ছেলেরা হল ডমিনেটিং, ইগোয়িস্ট আর কেয়ারলেস।
হেমাঙ্গ খুব র বলল, আমারও তাই মনে হয়।
আপনি খুব বিচ্ছু। এমন ভাব করছেন যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানেন না। মনে মনে হাসছেন তো!
হেমাঙ্গ কাচুমাচু হয়ে বলে, না, না, মোটেই হাসছি না। ইদানীং দেখছি মেয়েতে আর ছেলেতে একটা কেমন যেন আকচাআকচি শুরু হয়েছে, অনেকটা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের মতো। খুব লেখালেখিও হচ্ছে কাগজে।
রশ্মি খুব হাসছিল, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল বুঝি? না মশাই, জীবনটা ফুটবল নয় মোটেই।
ট্যাক্সি হাজরায় ঢোকার পর রশ্মি বলল, মোটে তো সন্ধে। আসুন, এক কাপ কফি খেয়ে যান।
হেমাঙ্গর এর প্রতিবাদে কিছু বলার ছিল না। সে ট্যাক্সি ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ল। তারপর রশ্মি রায়দের বাড়িখানা দেখে তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইল। ফটক, ফটকের ওপাশে অনেকটা লন, ফুলের বাগান, আর চারদিকে সবুজের সমারোহের মধ্যে তিনতলা বনেদী একখানা প্রকাও বাড়ি। না, তাদের বাড়ির চেয়ে বড় নয় ঠিকই, কিন্তু তবু বেশ বড়।
বাড়ির ভিতরটাও দেখবার মতো। মেহগনি, আবলুস বা বাৰ্মা সেগুনের সেকেলে মজবুত সব চেয়ার-টেবিলআলমারি-বুককেস। বিশাল বৈঠকখানার এক কোণে একটা মস্ত পিয়ানো অবধি রয়েছে। পেল্লায় বড়লোক, সন্দেহ নেই।
হেমাঙ্গ খুব উজবুকের মতো বলল, আপনি বোধ হয় রোজ গাড়ি করে শিয়ালদায় গিয়ে ট্রেন ধরেন, না?
রশ্মি একটু অবাক হয়ে বলে, কি করে বুঝলেন?
হাত গুনতে জানি যে!