লাঠি-লণ্ঠন নিয়ে সেই পালানোর পর দু’দিন বাদে বাগনানের বাসের আড্ডায় তিনটে ছ্যাঁচোড়ের সঙ্গে আলাপ। কথায় কথায় অনেক কথা বেরিয়ে পড়ল। তাদের ব্যাবসাপত্র খারাপ নয়, চুরি, ছিনতাই আর ছোটখাটো ডাকাতি করে তাদের ভালই চলে। অনেক বলে কয়ে ভিড়ে পড়লাম তাদের সঙ্গে। তারা আমাকে প্রাণের ভয় দেখিয়ে, বিস্তর শাসিয়ে সাবধান করে দিল, বেগরবাঁই করলে জান যাবে।
বাগনান বাজারে এক দুপুরে বসে আছি, ছোট্ট একটা খুকি তার বাচ্চা ঝিয়ের সঙ্গে দোকানের সওদা করতে এসেছে। ছ্যাঁচোড়দের একজন কদম বলল, ওই খুকিটা হল হোমিয়ো ডাক্তার কালীপদ ঘোষের ছোট মেয়ে, কানে একজোড়া সোনার বেলফুল দেখা যাচ্ছে। দেখবে নাকি হে উপল ভদ্র?
ওরা কেন যে আমার নামের সঙ্গে ভদ্র কথাটা জুড়ে নিয়েছে তা ওরাই জানে। প্রস্তাব শুনে আমার হাত-পা ঝিমঝিম করছিল। আসলে আমার সব কাজে বাগড়া দেওয়ার জন্য একজন সং আছে। সে আমার বিবেকবুড়ো। যখন-তখন এসে ঘ্যানর ঘ্যানর করে রাজ্যের হিতকথা ফেঁদে বসে। তাকে না পারি তাড়াতে, না পারি এড়াতে।
ছ্যাঁচোড়দের অন্য একজন হাজু আমাকে জোর একটা চিমটি দিয়ে বলল, দু’দিন ধরে খাওয়াচ্ছি তোমাকে, সে কি এমনি? যাও কাজে লেগে পড়ো। ধরা পড়ে মার খাও তো সেও এ লাইনের একটা শিক্ষা। মারধর বিস্তর খেতে হবে। বাবুয়ানি কীসের?
সত্যিই তো। আমার যে মাঝে মাঝে এক পাগলাটে খিদে পায়। সেই সব খিদের কথা ভেবে বড় ভয় পাই। কাজে না নামলে কেউ খেতে দেবে কেন? উঠে পড়লাম।
জানা আছে, কালীপদ ঘোষের মেয়ে, কাজেই একটা সুবিধে। অ্যালুমিনিয়ামের তোবড়ানো বাটিতে খানিকটা বনস্পতি কিনে মেয়েটা রাস্তায় পা দিতেই গিয়ে বললাম, ও খুকি, কালীপদদার কাণ্ডখানা কী বলো তো! পেট ব্যথার একটা ওষুধ কবে থেকে করে দিতে বলছি।
খুকি কিছু অবাক হয়ে বলল, বাবা তো খড়গপুরে গেছে।
খুশি হয়ে বলি, আমাকে চিনতে পারছ তো? আমি রামকাকা, লেভেল ক্রসিং-এর ধারে রঘুদের বাড়ি থাকি। চেনো?
খুকি মাথা নাড়ল দ্বিধাভরে। চেনে।
আমি বললাম, তোমার বাবা কয়েকটা জিনিস চেয়ে রেখেছিল আমার কাছে, দেব দিচ্ছি করে আর দেওয়া হয়নি। মহীনের দোকানে রেখে দিয়েছি, নিয়ে যাবে এসো।
বলে বাজারের ভিতর দিয়ে তাকে ডেকে নিয়ে যাই। ঝি মেয়েটা দুনিয়া কিছু বেশি চেনে, সে হঠাৎ বলে উঠল, ও বিন্তি যাসনে, এ লোকটা ভাল না।
ভীষণ রেগে গিয়ে তাকে এক ধমক মারলাম, মারব এক থাপ্পড় বদমাশ ছোটলোক কোথাকার! এই সেদিনও কালীপদদা বলছিল বটে, বাচ্চা একটা ঝি রেখেছে সেটা চোর। তোর কথাই বলছিল তবে।
ঝি মেয়েটা ভয় খেয়ে চুপ করে গেল। মাথাটা আমার বরাবরই পরিষ্কার। মতলব ভালই খেলে। খানিকটা ভয়ে, খানিকটা বিশ্বাসে খুকিটা এল আমার সঙ্গে, ঝি মেয়েটাও। বাজারের দোকানঘরের পিছু দিকটায় একটা গলি মতন। মুদির দোকান থেকে একটা ঠোঙায় কিছু ত্রিফলা কিনে এনে খুকির হাতে দিয়ে বললাম, এইটে বাবাকে দিয়ে আমার কথা বোলো, তা হলেই হবে। সবই বলা আছে।
মেয়েটা ঘাড় নাড়ল, ঠোঙা হাতে আমাকে অবাক হয়ে দেখছিল। পিছু ফিরতেই আমি ফের ডেকে বললাম, ও বিন্তি, তোমার বাপ-মায়ের কি আক্কেল নেই! ওইটুকু মেয়ের কানে সোনার দুল পরিয়ে বাড়ির বার করেছে! এসো, এসো, ওটা খুলে ঠোঙায় ভরে নাও। কে কোথায় গুন্ডা বদমাশ দেখবে, দু’ থাপ্পড় দিয়ে কেড়ে নেবে। কালও ছিনতাই হয়েছে এখানে।
মেয়েটা কাঠ হয়ে আছে। ঝি মেয়েটা ঝেঁঝে উঠল, কেন খুলবে, অ্যাঁ? চালাকির আর জায়গা পাওনি?
তাকে ফের একটা ধমক মারলাম। কিন্তু বিন্তিও দুল খুলতে রাজি নয়। মাথা নেড়ে বলল, না, খুলব না। সদ্য কান বিঁধিয়েছি, দুল খুললে ছ্যাঁদা বুজে যাবে।
কথাটা আমারও যুক্তিযুক্ত মনে হল। এ অবস্থায় ওর কান থেকে দুল খুলি কী করে?
ছ্যাঁচোড়দের তিন নম্বর হল পৈলেন। সে কম কথা আর বেশি কাজের মানুষ। আমি যখন খুকিটিকে তার ঝি সমেত চলে যেতে অনুমতি দিয়ে দিয়েছি, ওরাও চলে যাচ্ছে, ঠিক সে সময়ে। পৈলেন এসে গলির মুখটা আটকে দাঁড়াল। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, রোগা কিন্তু পাকানো শক্ত চেহারা। কলাকৌশলের ধার দিয়েও গেল না। ঝি মেয়েটাকে একখানা পেল্লায় ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে বলল, চেঁচালে গলায় পা দিয়ে মেরে ফেলব।
সেই দৃশ্য দেখে বিন্তি থর থর করে কাঁপে, কথা সরে না। এক-একটা প্যাঁচ ঘুরিয়ে পৈলেন পুট পুট করে দুটো বেলকুঁড়ি তার কান থেকে খুলে বলল, বাড়ি যাও, কাউকে কিছু বললে কিন্তু মেরে ফেলব।
রেল স্টেশনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পৈলেন আমাকে বলল, সব জায়গায় কি আর কৌশল করতে আছে রে আহাম্মক? গায়ের জোর ফলালে যেখানে বেশি কাজ হয়, সেখানে অত পেঁচিয়ে কাজ করবি কেন?
হক কথা।
বেলকুঁড়ি দুটো বেচে যে পয়সা পাওয়া গেল তার হিস্যা ওরা আমাকে দিল না, আমার আহাম্মকিতেই তো ব্যাপারটা নষ্ট হচ্ছিল প্রায়।
এক দিন পাঁশকুড়া-হাওড়া ডাউন লোকালে তক্তে তক্কে চারমূর্তি উঠেছি। শনিবার সন্ধে, ভিড় বেশি নেই। এক কামরায় একজোড়া বুড়োবুড়ি উঠেছে। বুড়ির গায়ে গয়নার বন্যা। ইদানীং কারও হাতে মোটা বালা সমেত ছ’গাছা করে বারোগাছা চুড়ি, গলায় মটরদানা হার বা কানে ঝাপটা দেখিনি। আঙুলে অন্তত পাঁচ আনি সোনার দুটো আংটি। বুড়োর হাতে ঘড়ি, পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম, হাতে রুপো-বানো লাঠি। এ যেন চোর-ছ্যাচোড়দের কাছে নেমন্তন্নের চিঠি দিয়ে বেরোনো।