Site icon BnBoi.Com

প্রদোষে প্রাকৃতজন – শওকত আলী

প্রদোষে প্রাকৃতজন - শওকত আলী

০১. চৈত্রের দাবদাহে অশ্বত্থছায়া

০১.

চৈত্রের দাবদাহে অশ্বত্থছায়া বড়ই শ্রান্তিহারক। নতুবা এতো শীঘ ক্লান্তি অপনোদন সম্ভব ছিলো না। দণ্ড দুই আগেও তার দৃষ্টি ছিলো অস্বচ্ছ। দৃশ্যবস্তু বিচিত্র বিভঙ্গে দোলায়িত হচ্ছিলো। কঠিন পথ বারেক মনে হচ্ছিলো সম্মুখে ঢেউয়ের মতো উপরে উঠছে, আবার মনে হচ্ছিলো, ক্রমেই নেমে যাচ্ছে অতলে। পদক্ষেপও তখন স্ববশে ছিলো না। প্রমত্ত মাদকসেবীর মতোই সে টলে টলে যাচ্ছিলো। কখনও বামে, কখনও দক্ষিণে।

সে বড় বিচিত্র অবস্থা। এখন স্মরণ হলে কৌতুক বোধ হয়। অবশ্য তখনও তার কৌতুক বোধ হচ্ছিলো। কৌতুক বোধ হবারই কথা। কারণ প্রথমে তুমি দেখলে বংশবীথিকার বিনত শাখায় একটি বনকপোত। পরক্ষণে সেই ক্ষুদ্রাকার পাখিটি হয়ে গেলো একটি উর্ধলক্ষী মর্কট–মুহূর্তেক পরে সেই মর্কটও আর থাকলো না, নিমিষে হয়ে গেলো একটি বিশুষ্ক বৃক্ষশাখা। চক্ষু কচালিত করলে অতঃপর তুমি আর কিছুই দেখলে না। বংশবীথিকা না, বনকপোত না, মর্কট না–বিশুষ্ক শাখাও না। কী অদ্ভুত কাণ্ড আসলে কিছুই নেই সম্মুখে। শুধুই ক্রোশ ক্রোশ ব্যাপ্ত কুশক্ষেত্র। গ্রাম নেই দিগন্ত রেখায়, বৃক্ষরাজি গোচরে আসে না, প্রান্তরের বিস্তৃতি কেবলই দূর থেকে দূরে প্রসারিত হয়ে যাচ্ছে, আকাশসীমা ধূসরতায় বিলীন।

শ্যামাঙ্গ অশ্বত্থের ছায়ায় শয়ান অবস্থায় নিমীলিত চোখে নিজ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে। সে বোঝে, তার মৃত্যু হওয়াও অসম্ভব ছিলো না। তার সৌভাগ্য যে ঐ সময় দূর থেকে একটি পথিক দল তাকে দেখতে পায়। তার কিছুই স্মরণ নেই, কখন সে ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলো, কখন ছুটে এসেছিলো পথিক দল এবং কীভাবেই বা তারা শুশ্রূষা করে তার জ্ঞান ফিরিয়ে এনেছে।

প্রৌঢ় লোকটি ঐ সময় কাছে এসে জানতে চাইলেন, এখন সুস্থ বোধ করছেন তো?

শ্যামাঙ্গ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায়নি এতোক্ষণ। এবার বললো, আপনারা আমার প্রাণরক্ষা করেছেন–আমি কীভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো জানি না

থাক, থাক, এখন ওসব কথা নয়–আপনি বিশ্রাম নিন, পথিক প্রৌঢ়ের কণ্ঠে প্রগাঢ় মমতা প্রকাশ পায়।

অশ্বত্থের  পাতায় পাতায় চৈত্রের বাতাস শব্দ করে যাচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গ সেই শব্দ শুনতে শুনতে আবার নিমীলিত–চক্ষু হলো। তার মনে হচ্ছিলো, প্রৌঢ় পথিক অহেতুক তার জন্য চিন্তিত হয়ে রয়েছেন। সে এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। একবার ভাবলো, উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো, কী দরকার প্রৌঢ় লোকটিকে অস্থির করে, আরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলেই বা ক্ষতি কি? ততক্ষণে নদীতীর থেকে লোকটি ফিরে আসুক।

প্রৌঢ় পথিক ঐ সময় পুনরায় কাছে এসে উপবেশন করলেন। বললেন, আপনি কি আমাদের সঙ্গী হবেন?

শ্যামাঙ্গ বুঝতে পারে না, কী করবে। কিছু পূর্বে প্রৌঢ়ের আরও একজন সঙ্গী এই প্রশ্ন করেছিলো। তখনও সে কিছু বলতে পারেনি। নৌকাযোগে এরা যাবে দক্ষিণে, বাণপুরের দিকে–আর তাকে যেতে হবে আত্রেয়ী তীরে, রজতপটে। কিছুদূর পর্যন্ত সঙ্গী হওয়া যায়। তারপর তাকে আবার একাকীই পথে নামতে হবে। সে অকপট হলো প্রৌঢ়ের কাছে। বললো, আমার গন্তব্য তো আপনার জানা, আপনিই বলুন, আমার কি কর্তব্য–আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ, আপনি পরামর্শ দিন।

প্রৌঢ়টি কিছু বলতেন হয়তো। কিন্তু ঐ সময়ই প্রেরিত লোকটিকে ছুটতে ছুটতে আসতে দেখা গেলো। সে জানালো যে অনতিবিলম্বে একখানি নৌকা যাত্রা করবে তাদের গন্তব্যের উদ্দেশে।

যারা লম্বমান হয়ে ছিলো অশ্বত্থ তলে, তারা লম্ফ দিয়ে উঠলো এবং যাত্রার জন্য প্রস্তুত হতে আরম্ভ করলো। প্রৌঢ়টিও ঈষৎ চঞ্চল হলেন। তবু তিনি পুনরায় জানতে চাইলেন, আপনি কি যাবেন আমাদের সঙ্গে?

শ্যামাঙ্গ এবারও কোন উত্তর দিতে পারে না।

শেষে নিজেই বললেন প্রৌঢ়, আপনাকে একাকী এভাবে রেখে যেতে প্রাণ চায় না। আর যদি সঙ্গে নিয়ে যাই, তাহলে পরে গৃহে প্রত্যাবর্তনের কালে আপনার অধিকতর কষ্ট হবে, সেও এক চিন্তার বিষয়।

কথাটা ঠিক। সত্যিই যদি পুনর্ভবার স্রোতোবাহী হয়ে দক্ষিণে যেতে হয় তাকে, তাহলে মধ্যপথে তাকে নৌকা থেকে নামতে হবে এবং দীর্ঘতর পথ অতিক্রম করতে হবে পদব্রজেই। ঐ পথ আবার অরণ্য–সঙ্কুল।

শ্যামাঙ্গ যাবে কি যাবে না সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার পূর্বেই পথিক দল অশ্বত্থ তল পরিত্যাগ করলো। এক যুবকের স্কন্ধে দেহভার রেখে ধীর পদক্ষেপে শ্যামাঙ্গও হেঁটে এলো নদীতীর পর্যন্ত। সেখানেও একটি বটবৃক্ষ ছিলো। শ্যামাঙ্গ বটতলে উপবেশন করে চতুর্দিকে চেয়ে দেখলো, ছায়াদায়ী বৃক্ষ একটি নয়, কয়েকটি। তার অনুমান হলো, পুনর্ভবা তীরের অধিবাসীরা সজ্জন। স্থানটি তার ভালো লাগলো। বিশ্রামস্থলটি ভারী মনোরম।

পর পারে একটি ধবল গাভী চরছে–দুটি ছাগ শিশুকে তাড়না করে ছুটছে একটি শ্যামলী বালিকা। নদীর জলস্রোত ভারী ধীর। তীরের নৌকাগুলি ভাসমান কিন্তু স্থির। মনে হয় না, তাদের নিচে জলস্রোত বইছে।

পথিকেরা কাল বিলম্ব না করে নৌকায় আরোহণ করলো। তারা কেন যে অস্থির হয়ে উঠেছিলো বলা দুষ্কর। কেনো নৌকাটি শীঘ্র যাত্রা করবে এমন মনে হচ্ছিলো না।

নৌযানটি বৃহৎ নয়, তবে এই স্বল্প পরিসর নদীতে ওটিকে বৃহৎই দেখাচ্ছিলো। যাত্রী এবং নানাবিধ সামগ্রীতে পূর্ণ হয়ে রয়েছে বলে অনুমান হলো। কারণ যাত্রীদের অনেকেই আচ্ছাদনীর বাইরে বসে আছে। নৌযানটির বহির্দেহে নানান কারুকার্য। ঐ প্রকার কারুকার্য সে আত্রেয়ী তীরে কখনও দেখেনি।

প্রৌঢ় পথিক তখনও নৌকায় আরোহণ করেননি। তার মধ্যে কেমন ইতস্তত একটি ভাব। কি ভাবছিলেন তিনিই জানেন। শেষে কাছে এসে জানতে চাইলেন, আপনি সুস্থ বোধ করছেন তো? ভেবে দেখুন, আমাদের সঙ্গে যাবেন কিনা। আপনি একাকী, তায় এমন অপরিচিত স্থান

শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করলো ঐ সময়, প্রৌঢ়ের চক্ষু দুটিতে বড় মায়া। প্রিয়জনের জন্য আন্তরিক উদ্বেগ ফুটে আছে তার মুখভাবে। সে বললো, অহেতুক উদ্বিগ্ন হচ্ছেন আপনি, আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

ঐ কথার পরও প্রৌঢ় আশ্বস্ত হলেন কি না বোঝা গেলো না। খুব ধীর পদক্ষেপে, অনিশ্চিত ভঙ্গিতে, তিনি নদীর দিকে অগ্রসর হলেন।

প্রৌঢ়ের গমন পথের দিকে দৃষ্টি রেখে শ্যামাঙ্গ ক্ষুদ্র একটি নিঃশ্বাস ফেললো। ঐ মুহূর্তে নিঃসঙ্গ লাগলো নিজেকে। সে উঠে বসলো। এইভাবে শয়ান অবস্থায় সে কতক্ষণ থাকবে? তার এবার ওঠা উচিত। একাকিত্বই তার ভবিতব্য। কখনও তো সে সঙ্গলাভ করতে পারেনি। গুরুদেব তাকে ত্যাগ করেছেন, সতীর্থ বন্ধুরা তার সঙ্গী হয়নি কখনও, আর এ তো মাত্রই দণ্ড দুয়েকের সান্নিধ্য। তবে ভারী সজ্জন এদেশের লোক। বিশেষত প্রৌঢ়টি একেবারেই আপনজনের মতো আচরণ করছিলেন। তার মনে হলো, প্রৌঢ়ের কথা শুনলেই হয়তোবা তার জন্য ছিলো ভালো।

দ্বিতীয় দীর্ঘ নিঃশ্বাসটি নির্গত হওয়া মাত্রই সে নিজেকে ধরে ফেললো। বুঝলো, তার মনের মধ্যে আশ্রয় লাভের একটি বাসনা আবার জেগে উঠতে চাইছে। আসলেই কি তার লতার স্বভাব? সহকার শাখা দেখলেই অবলম্বনের জন্য লোলুপ হয়ে ওঠে? ধিক তোকে, ধিক দুর্বলচিত্ত কাপুরুষ! তোর শিক্ষা হয় না এতো কিছু কাস্ত্রে পরও। ঐ একাকী নদীর বটতলে বসে বসে সে নিজেকে ধিক্কার দিতে আরম্ভ করলো।

কিন্তু তখনও বিস্ময়কর ঘটনাটি ঘটেনি।

সে পশ্চাতের দৃশ্যাবলীতে মনোনিবেশ করেছে তখন। না, নৌকাটির দিকে সে আর দৃষ্টিপাত করবে না। সে দেখছিলো দুটি বালককে। দূরের বৃক্ষতলে দণ্ডগুলি খেলায় তারা মত্ত। ভাবছিলো, বালক দুটিকে ডাকলে কেমন হয়। ঐ সময় দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতেই সে দেখলো, প্রৌঢ় ব্যক্তিটি আবার উঠে আসছেন। এ আবার কি কাণ্ড! লোকটির মস্তিষ্কে কি দোষ আছে? নৌকা ওদিকে প্রস্তুত–আর উনি চলে আসছেন? তার মনে কৌতূহল জাগ্রত হয়।

পশ্চাতে একজন যুবক চিৎকার করে ডাকছে, তবু প্রৌঢ়ের ভ্রূক্ষেপ নেই।

তার মনে হলো, লোকটি বোধ হয় তাকে নিয়ে যাবার জন্য আসছেন। সে মনে মনে কঠিন হলো। না, আর সে পরনির্ভর হতে যাবে না। প্রৌঢ়টি নিকটে এলে সে হাসলো, কি সংবাদ, আবার যে ফিরলেন?

হ্যাঁ ফিরলাম, তোমার ব্যাপারে নিশ্চিত বোধ করতে পারছি না।

এবার শ্যামাঙ্গ উঠে দাঁড়ালো। বললো, দেখুন আপনার বিশ্বাস হয় কিনা–আমি প্রকৃতই এখন একজন সুস্থ ব্যক্তি।

শ্যামাঙ্গকে দেখতে লাগলেন প্রৌঢ়টি। তাঁর দৃষ্টি যেন সরতে চায় না। হঠাৎ জানতে চাইলেন, বৎস, কিছু মনে করো না, তুমি সম্বোধন করছি বলে, সত্যিই কি তুমি আত্রেয়ী তীরের লোক?

এ আবার কি রহস্য! শ্যামাঙ্গ হতচকিত হয়। বলে, এ আপনি কি বলছেন? আপনাকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার কি লাভ?

প্রৌঢ় অপ্রস্তুত হলেন। বললেন, আমার কেমন মনে হচ্ছে তোমাকে একাকী রেখে যাওয়া আমার উচিত নয়। তুমি আমাদের সঙ্গে চলো–দুদিন আমরা তঙ্গন তীরের মেলায় অবস্থান করবো। তারপরই আবার ফিরে আসবো। তোমার মন্দ লাগবে না, এ অঞ্চলের মেলায় নানান উপভোগ্য ও আনন্দদায়ক ক্রিয়াকারে সমাবেশ হয়।

শ্যামাঙ্গ হাসলো, না মহাশয়, সত্বর গৃহে ফেরা আমার বিশেষ প্রয়োজন।

প্রৌঢ় অধোমুখে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার শ্যামাঙ্গের মুখোমুখি হলেন। বললেন, তুমি বিরক্ত হয়ো না বস। একটি কথা জিজ্ঞাসা করি, অর্থ–সামগ্রী কিছু আছে তো তোমার? না হলে কিন্তু পথিমধ্যে বিপদ হতে পারে।

শ্যামাঙ্গের এতোক্ষণে যেন সম্বিৎ হয়, সত্যিই তো, ও চিন্তা তো তার মস্তিষ্কে আসেনি। সে কটিদেশে দুহাত স্পর্শ করে আশ্বস্ত হয়না, কটিবন্ধনে স্থলীটি অক্ষতই আছে। বললো, আমার সঙ্গে কিছু পাথেয় অবশ্যই আছে–কিন্তু আমি কৃতজ্ঞতার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না–আপনি আমার প্রতি এতো স্নেহশীল হয়ে উঠেছেন যে

প্রৌঢ় শ্যামাঙ্গের কৃতজ্ঞতা–ভাষণ সম্পূর্ণ শুনলেন না। বলে উঠলেন, বস, তোমাকে কি বলবো বলো, আমি একজন হতভাগ্য পিতা। আমার একটি বন্ধু পুত্র ছিলো–নিজের পুত্র নেই–ওকেই আমি পুত্রবৎ স্নেহ করতাম, আমার কন্যাটিও ওকে বড় ভালবাসতো, কিন্তু গত বছর এমনই সময়ে দস্যুহস্তে সে–

আর বলতে পারলেন না। বাকরুদ্ধ অবস্থায় থাকলেন কিছুক্ষণ। ক্ষণেক পরে আবার বললেন, আমার কন্যা বিশ্বাস করে না যে সে নেই–সে অপেক্ষা করে আছে, চন্দ্রদাস ফিরে আসবে এবং তার বিবাহ হবে।

প্রসঙ্গটি করুণ। প্রৌঢ় পথিকের আবেগ বিহ্বল ভাব, তাঁর মুখের তুমি সম্বোধন এবং সর্বোপরি শ্যামাঙ্গের জন্য তাঁর উদ্বেগ বিচলিত করে দিলো শ্যামাঙ্গকে। সে কী বলবে ভেবে উঠতে পারছিলো না। বিমূঢ় দৃষ্টিতে সে প্রৌঢ়ের মুখের দিকে চেয়ে রইলো। এই প্রৌঢ়কে কী বলবে সে? তাকে অবলম্বন করে তাঁর ব্যাকুল চিত্ত হয়তো উদ্বেল হয়ে উঠেছে। নিজের কন্যার বেদনা–ভার বহন করতে করতে তাঁর হৃদয় ক্লান্ত, এখন যদি তাঁর আশা হয়ে থাকে যে, বান্ধবহীন স্বজনহীন একাকী পথিক তার বেদনার ভার কিছুটা লাঘব করতে পারবে, তাহলে কি সেটা তার অপরাধ?

ঐ সময় সমস্বরে চিৎকার আরম্ভ হয় নৌকা থেকে। তাতে শ্যামাঙ্গ সচকিত হয়। বলে, আপনার সঙ্গীরা ওদিকে বড় ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

হ্যাঁ, যাই আমি, প্রৌঢ় পশ্চাতে দেখে নিলেন বারেক। তারপর বললেন, বৎস, এটি তুমি রাখো, পথে তোমার প্রয়োজন হতে পারে।

প্রৌঢ় পথিক চলে গেলেন। জয় গঙ্গা মাতা বলে নৌকাটি ভাসলো স্রোতের অনুকূলে। প্রৌঢ় প্রদত্ত বস্ত্রখণ্ডে কুণ্ডলীকৃত বস্তুটি হাতে নিয়ে শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। নৌকাটি দৃশ্যের বাইরে চলে গেলে তার সম্বিৎ ফিরলো। তখন সে কুণ্ডলীকৃত বস্ত্রখণ্ড খুলে দেখলো। অবাক হবার মতোই ব্যাপার। মাত্রই দণ্ড দুতিনের পরিচয়। কিন্তু তবু এই স্বল্প সময়ের মধ্যে তার শুশ্রূষা করেছেন, সাধ্য মতো চেষ্টা করেছেন সুস্থ করে তুলতে–তদুপরি আবার এই দান! দেখলো বস্ত্রখানি উত্তরীয় এবং তারই এক কোণে গ্রন্থিবদ্ধ কয়েকটি মুদ্রা। তার মনে হলো এই দান স্নেহধন্য। সে পরম শ্রদ্ধাভরে দান গ্রহণ করলো।

কি বিচিত্র এই সংসার। কোথাও সে বিতাড়িত হচ্ছে। আবার কোথাও তাকে স্নেহডোরে বাঁধবার জন্য ব্যাকুল বাহু প্রসারিত হয়ে আছে। তার ইচ্ছা হলো প্রৌঢ় পথিকের গ্রামে গিয়ে কন্যাটিকে দেখে আসে একবার। আহা কি আকুল প্রতীক্ষায় দণ্ড পল অনুপল কাটছে বালিকাটির। বালিকা না তরুণী সে কিছুই জানে না। এ কিসের প্রতীক্ষা করছে তরুণীটি–জীবনের না মরণের? শবরীর প্রতীক্ষার কাহিনীটি তার মনে পড়ে। একটি মৃত্যলকে চিত্রটি সে উত্তীর্ণও করেছিলো। কিন্তু হায়, গুরু বসুদেব বুঝতে চাইলেন না।

সে ধীরপদে নদীতীর ধরে অগ্রসর হলো। যে বালক দুটি দণ্ডগুলি নিয়ে খেলছিলো তারা শ্যামাঙ্গকে দেখেও যেন দেখলো না। শ্যামাঙ্গ যখন জানতে চাইলো, বাপু হে, তোমাদের নিবাস কোন গ্রামে? তখন সীমাহীন বিরক্তি নিয়ে তারা শ্যামাঙ্গের আপাদ মস্তক দেখে নিলো। অতঃপর একটি বাক্যও ব্যয় না করে হাত তুলে এমন একটি দিক নির্দেশ করলো যেটি পূর্ব–পশ্চিম, উত্তর–দক্ষিণ, ঊর্ধ্ব–অধঃ সব দিকই হতে পারে।

পথক্রমণ করতে করতে সে অনুভব করলো শরীরে এখনও তার অবসাদ, সর্বাঙ্গে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। সূর্য এখন মুখোমুখি। দেখে মনে হচ্ছে, পশ্চিমাকাশে একখানি উত্তপ্ত তাম্রস্থালী কেউ যেন সংলগ্ন করে রেখেছে।

তার কেবলি মনে হতে লাগলো নীলাম্বর তাকে ভুল পথের সন্ধান দিয়েছে। সে বলেছিলো, পুনর্ভবা তীরের নবগ্রাম হাটে গিয়ে উপনীত হলে তখন আর সমস্যা থাকবে না তোমার। কিন্তু কোথায় সেই নবগ্রাম হাট? সে জানে, নবগ্রাম হাটে আত্রেয়ী তীরের অনেক গো শকট আসে। আত্রেয়ী তীরে একবার পৌঁছাতে পারলে তখন গৃহ গমন তো এক দণ্ডের ব্যাপার।

সে নদীতীর ধরে অনেকখানি পথ অতিক্রম করে। কিন্তু না, কোনো কোলাহল তার কানে আসছে না। পথে লোকই নেই–কোলাহল করবে কে? কিছুক্ষণ অতিক্রান্ত হলে পথিমধ্যে সে একটি তরুণীর সাক্ষাৎ পায়। তরুণীটি একটি গাভীকে তাড়না করে নিয়ে যাচ্ছিলো। তাকে দেখে শ্যামাঙ্গ দাঁড়ালো। ইতস্তত হচ্ছিলো, কিন্তু জিজ্ঞাসা না করেও পারলো না। সে খুবই বিনয়ের সঙ্গে দুহাত জোড় করে যথাবিহিত সম্মান প্রদর্শন করে বললো, ভদ্রে, আমার নমস্কার গ্রহণ করুন। আপনি বলতে পারেন, এই গ্রামের নাম কি?

তরুণীটি অপাঙ্গে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানলো চকিতে, তারপর বললো, মরণ! নাটগীতের আর স্থান পাওনি?

দেখুন, আমি দূরের লোক, এ অঞ্চলের পথঘাট কিছুই চিনি না।

পথের রমণীকে তো ঠিক চিনতে পারেন দেখছি।

ঐ তীক্ষ্ণ মন্তব্যে শ্যামাঙ্গ বুঝতে পারে এ অঞ্চলের রমণীরা ক্ষুরধার জিহ্বার অধিকারিণী। প্রয়োজন নেই বাপু তোমাদের সঙ্গে কথার–তোমাদের খুরে দণ্ডবৎ একশতবার, মনে মনে এই বলে সে পুনরায় সম্মুখের দিকে অগ্রসর হলো।

আরও কিছুক্ষণ হাঁটবার পর অতিশয় ক্লান্তি বোধ হয়। অবশেষে শ্যামাঙ্গ একটি বটবৃক্ষের নিচে মৃত্তিকা বেদীতে প্রথমে উপবিষ্ট ও পরে অর্ধশয়ান হলো। তার সন্দেহ হতে লাগলো, নবগ্রাম হাট নিশ্চয়ই দূরে। নীলাম্বর শূকরপুত্রটা তাকে এভাবে বিপদে ফেলবে, কল্পনাও করা যায় না।

বিল্বগ্রাম থেকে প্রত্যুষেই সে বেরিয়ে এসেছিলো। কেননা গুরু বসুদেব যা করেছেন তারপর সেখানে থাকবার, কি বিলম্বের, কোনই অবকাশ ছিলো না। বিগ্রাম থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার সময় নীলাম্বর বলে দিয়েছিলো–বন্ধু, তুমি পথ ধরে গেলে দুতিন দিন সময় লাগবে, আবার পরিশ্রমও হবে। বরং তুমি প্রান্তরে নেমে যেও–পশ্চিমে পুনর্ভবা তীর, মাত্রই ক্রোশ তিনেক পথ–সেখানে নবগ্রাম হাটে তুমি আত্রেয়ী তীরের শকট পাবে।

সেই কথা শুনে এই অবস্থা তার। প্রাণ চলে যাওয়া বিচিত্র কিছু ছিলো না। সে তো রৌদ্র ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ভূলুণ্ঠিত হয়ে পড়েছিলো। যদি পথিকের দলটি না দেখতে পেতো তাকে–তাহলে ঐভাবে জ্ঞানহারা অবস্থাতেই তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে। যেতো! পরিশেষে তার শরীর ভক্ষ্য হতো শকুন এবং শৃগালের।

নদী এখানে বঙ্কিম। তীরে কিছু লোক দেখা যাচ্ছে। শ্যামাঙ্গ তীর ত্যাগ করে পথে উঠলো। অদূরে একটি বিশাল অশ্বত্থ বৃক্ষ এবং তলে মৃত্তিকাবেদী। বেদী না বলে মণ্ডপ বলাই সঙ্গত–বিস্তৃত চত্বরের মতো একেবারে। শ্যামাঙ্গ সেখানে গিয়ে উপবেশন করলো। তৃষ্ণা বোধ হচ্ছিলো। বারেক ইচ্ছা হলো নদীর জল পান করে আসে। কিন্তু এমন আলস্য তাকে পেয়ে বসলো ঐ মুহূর্তে যে সে উঠলো না। বরং আরও অলস ভঙ্গিতে অর্ধশয়ান হলো।

চৈত্রের অপরাহ্ন বড় ধীর। সূর্য পশ্চিমাকাশে সংলগ্ন, এমন স্থির যে মনে হয় না কখনও নিচে নামবে। স্থানটি নির্জন নয়। অদূরে কয়েকজন গ্রামবাসী কিছু দেখবার জন্য সমবেত হয়েছে বলে মনে হচ্ছে এবং ঐ স্থান থেকেই একেক সময় সোল্লাস চিৎকার ধ্বনি উঠে আসছে। কৌতূহলী হয়ে সে উঠে বসলো। লক্ষ্য করে দেখলো, স্থানটি নিচু এবং জলাশয়। সম্ভবত পুনর্ভবারই একটি মৃত শাখা। ঐখানেই মৎস্য শিকার হচ্ছে।

পুনর্ভবার মূল স্রোত এখানে বঙ্কিম। নদী খাত যেটি সরল, সেইটিই মৃত। এমন ঘটনা সাধারণত দেখা যায় না। তবে নদীর মতিগতি তো রমণীরই মতো, সুতরাং সেটি বোঝাও মানুষের সাধ্য নয়।

নদীতীরের ভূমি ঢেউয়ের মতো–কোথাও উন্নত কোথাও অবনত। বেলাভূমিতে স্থানে স্থানে বদরীকুঞ্জ–এখন বিগতফল এবং নিষ্পত্র। ইতস্তত মনসাকণ্টক ও দীর্ঘ তৃণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝোপ। শঙ্খচিল উড়ছিলো–দূরে টিট্রিহি টিট্রিহি রবে টিট্রিভ পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গের মনে হলো, চরাচর বড় শান্ত। চৈত্রের নদীস্রোত যেমন, তেমনি এ অঞ্চলের জীবনধারাও।

অবশ্য ওদিকে নদীবক্ষে কোলাহল হচ্ছিলো। কিন্তু সেই কোলাহল চরাচরব্যাপী নিঃশব্দতাকে যেন আরও অধিক প্রকট করে তুলছিলো।

সে লক্ষ্য করলো, যারা স্রোতহীন মৃত নদীর জলকে কর্দমাক্ত করে তুলেছে তারা ধীবর নয়, নিতান্তই সাধারণ গ্রামবাসী। তাদের মধ্যে বৃদ্ধ আছে, যুবক আছে, এমনকি বালক–বালিকারাও রয়েছে। ওদের সোল্লাস চিৎকারই থেকে থেকে কানে আসছিলো। এবং ঐ চিৎকারই বুঝিয়ে দিচ্ছিলো যে এই সমবেত মৎস্য শিকার জীবিকার প্রয়োজনে নয়, নিতান্তই আনন্দের কারণে।

সে মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলো। জালপাশ থেকে মৎস্যের উল্লম্ফ পলায়ন, তরুণ ও বালক–বালিকাদের সোল্লাস চিৎকার, নিষিক্ত কৃষ্ণদেহে রৌদ্রের প্রতিফলন–সব একত্রে একটি অসাধারণ দৃশ্য বলে তার মনে হলো। কৌতুক এবং উল্লাস, শক্তি এবং আনন্দ, জল এবং মানবসন্তান–এমন একত্রে আর কখনও তার দৃষ্টিগোচর হয়নি। সে মুগ্ধ নয়নে দেখছিলো এবং তার মনে নানান চিত্র মুদ্রিত হয়ে যাচ্ছিলো।

তার মনে হচ্ছিলো যেন একটি দীর্ঘ চিত্রমালা তার চোখের সম্মুখে গ্রথিত হচ্ছে। ঐ সময়ই আবার গুরু বসুদেবের কথা স্মরণ পথে উদিত হচ্ছিলো। বসুদেব তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেননি। বারবার নিষেধ করেছেন। ঘুরে ফিরে এসে দেখেছেন তার কাজ। স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, দেখো, কোনোভাবেই যেন তোমার ফলকে ব্রাত্য প্রসঙ্গ না থাকে– শাস্ত্রানুশাসন বিচ্যুত হয়ো না।

সে একদিন প্রশ্ন করেছিলো, কেন গুরুদেব, ব্রাত্য মুখচ্ছবিতে অপরাধ কি?

অপরাধ? গুরু বসুদেবের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছিলো। বলেছিলেন, অপরাধের কথা তো বলিনি, বলেছি প্রয়োজনের কথা। মন্দির গাত্রে যে মৃত্তিকাপট থাকবে তাতে পবিত্র ভাবটি থাকা চাই। ম্লেচ্ছ ব্রাত্যের মন্দিরে প্রবেশের অধিকার না থাকলে তাদের প্রসঙ্গ কেমন করে মন্দির গাত্রের মৃত্তিকাপটে উত্তীর্ণ হতে পারে বলো?

শ্যামাঙ্গ বুঝতে পারেনি তখনও। জানতে চেয়েছিলো, গুরুদেব, বুঝতে পারছি না, ব্রাত্যজন অপবিত্র হতে পারে, কিন্তু মৃৎপট, কি শিলাপট–এসব তো আর মানুষ নয়, নিতান্তই মৃত্তিকা অথবা শিলা–এসবের আবার পবিত্র অপবিত্র কি?

বসুদেব ঈষৎ বিরক্ত হয়েছিলেন। বলেছিলেন, মূখের মতো কথা বলো না শ্যামাঙ্গ, মৃত্তিকা ও শিলা তো পৃথিবী পৃষ্ঠের সর্বত্র, কিন্তু দেবতার পীঠস্থান কি সর্বত্র? সকল মৃত্তিকাই কি দেবতা হয়, বলো? সকল শিলাই কি দেবতা?

সে বিভ্রান্ত বোধ করছিলো, সে জানতো, গুরু বসুদেব প্রতিমা নির্মাণশাস্ত্রে সুপণ্ডিত। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রেও যে তার প্রবল অধিকার এ তথ্য তার জানা ছিলো না। তার বুদ্ধি বিভ্রান্ত হচ্ছিলো–কিন্তু হৃদয় বিভ্রান্ত হয়নি। সেখান থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন উঠে আসছিলো। সে নীরব থাকতে পারেনি। বলেছিলো, গুরুদেব, তাহলে দেবতা কী? ভগবান কী? জগত কি দেবসম্ভূত নয়?

এই প্রশ্নে বসুদেব চমকে উঠেছিলেন। সম্ভবত নিদারুণ ব্ৰিত বোধও করেছিলেন। শেষে বলেছিলেন, জটিল তর্ক করো না শ্যামাঙ্গ, দেবতার পীঠস্থান ধর্মসিদ্ধ–তুমি শুধু এইটুকু মনে রাখবে যে ধর্মই সত্য, পরম ব্রহ্মই সত্যব্রহ্মজ্ঞান যার আছে সেই ব্রাহ্মণের নির্দেশই পালনীয়–আর অন্য কিছু সত্য নয়, পালনীয় নয়।

শ্যামাঙ্গের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বসুদেব যা বলেছেন তা তার আদেশ। কিন্তু তবু সে নিজের কথাটি না বলে পারেনি। খুব ধীর কণ্ঠে বিনীতভাবে সে জানিয়েছিলো প্রভু, আমি ইতোমধ্যে মৃঙ্কলকে কিছু মানবী মূর্তি উৎকীর্ণ করেছি।

মানবী মূর্তি? বসুদেবের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে উঠেছিলো মুহূর্তে। বলেছিলেন, দেবপীঠে মানবী মূর্তি কেন থাকবে? এখনই বিনষ্ট করো, কোন পটে–কোন ফলকে তোমার সেই মানবী মূর্তি, দেখি?

শ্যামাঙ্গকে তখন তার রৌদ্রশুষ্ক ফলকগুলি একে একে দেখাতে হয়েছে। রামায়ণ কাহিনীর চিত্রমালা পরিস্ফুটনের দায়িত্ব ছিলো তার। জানকীর বরমাল্য দান, রামের বনগমন, হনুমানের গন্ধমাদন বহন ইত্যাদি নানান প্রসঙ্গ সে মৃৎফলকগুলিতে উত্তীর্ণ করেছিলো। এবং ঐসব ফলকের সঙ্গে সঙ্গে আরও কটি মানবী মূর্তির ফলকও ছিলো। প্রেমিকের কণ্ঠলগ্না ব্যাধ তরুণীর প্রণয়দৃশ্য ছিলো একটি, একটি ছিলো শবর যুবতীর প্রতীক্ষার দৃশ্য আর ছিলো মাতৃময়ী ধীবর রমণীর সন্তানকে স্তন্য দানের দৃশ্য।

বসুদেব দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। বলেন, এ কী করেছো তুমি? এসব কেন করেছো? দেব মন্দিরের সঙ্গে এসবের প্রসঙ্গ কোথায়?

শ্যামাঙ্গ সবিনয়ে বোঝাতে চেয়েছে, প্রভু, শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে ছিলেন সেই প্রসঙ্গেই আমার শবর যুবতীর কথা মনে হয়েছে–আর ধীবর মাতা গোদাবরী তীরের। বনবাসের দৃশ্যে অরণ্যচারী ব্যাধ যুবক–যুবতীর প্রণয় কি একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক হবে?

না, বসুদেব কঠিন কণ্ঠে বলে উঠেছেন, এ হয় না, প্রাসঙ্গিকতার ব্যাপারটি তুমি ছলনাক্রমে আনছো। এ কেমন মুখাবয়ব, এ কেমন মুখভাব বলো? এ মানবিক লালিত্যে কি প্রয়োজন? কেন তোমার ফলকচিত্রে কেবল নমনীয় পেলব রেখা? কেন এই বৃত্তাকার ভঙ্গি? ঋজুতা কোথায়, দৃঢ়তা কাঠিন্য কোথায়? ওষ্ঠ কেন এমন বিলোল হবে? এ হয়নি সব ভুল হয়েছে তোমার। শ্রীরামচন্দ্রের কি এই মুখাবয়ব হয় কখনও? জানকী আর যক্ষিণী মূর্তিতে যে কোনো পার্থক্য নেই। এসবে কাজ হবে না–বিনষ্ট করো এসব।

ঐ কঠিন রুক্ষ নির্দেশ যেন এখনও বক্ষের নিচে এসে আঘাত করে। শ্যামাঙ্গ স্মরণ করে শিহরিত হলো।

ঐ সময় কাতর আর্তনাদ করে উঠেছিলো শ্যামাঙ্গ। আকুল প্রার্থনার মতো করে বলেছিলো, গুরুদেব, এসব মূর্তিতে যে আমার আবেগ স্পন্দিত হয়েছে, রক্ত ধারার ছন্দ যে এদের রেখায় বিধৃত হয়ে রয়েছে। দেখুন আপনি, এই ব্যাধ তরুণ–তরুণীর মুখভাবে সঙ্গীত মর্মরিত হচ্ছে কি না?

বসুদেব প্রায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন–কেন যে হঠাৎ অমন আচরণ করলেন, শ্যামাঙ্গ এখনও কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবে না। বসুদেব বলে উঠেছিলেন, মূর্খ, তুমি শ্যামাঙ্গ, একেবারেই মহামূর্খ। তোমার স্মরণে থাকা উচিত যে এসব নির্মিত হচ্ছে তোমার পিতৃধনে নয়। এসব নির্মাণের বিপুল ব্যয়ভার বহন করছেন কায়স্থ কুলতিলক মহাসামন্ত সুধীমিত্র। সুতরাং তার আদেশ–নির্দেশই তোমাকে মান্য করতে হবে। তুমি আদেশের দাস মাত্র–তাঁর আদেশ পালনের জন্যই তোমাকে অর্থ দেওয়া হচ্ছে–প্রতিমা নির্মাণশাস্ত্র ব্যাখ্যার জন্য নয়।

ঐ সময় সুধীমিত্রের আশ্রিত উদ্ধব দত্ত এসে দাঁড়িয়েছিলো কাছে, কাজ ছেড়ে উঠে এসেছিলো সতীর্থ নীলাম্বর। নীলাম্বরই তাকে সরিয়ে আনে বসুদেবের সম্মুখ থেকে।

সরিয়ে এনে বলে, কাজটা তুমি ভালো করোনি বন্ধু।

শ্যামাঙ্গ তখনও ক্ষুব্ধ। জানায়, কিন্তু আমার অপরাধ কোথায়? গুরুদেব সেটা তো আমাকে বলছেন না–কেবলই ধর্মের কথা আর শাস্ত্রের কথা বলছেন।

শ্যামাঙ্গ ঐ বিতর্কের কথা জীবনে ভুলবে না। তার সাধ এবং আশা সে জলাঞ্জলি দিয়ে এসেছে সুধীমিত্রের ঐ মন্দিরেই। না, আর সে শিল্প রচনায় যাবে না।

ঐ গুরুদেবই তাকে সংবাদ পাঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুধীমিত্রের বিল্বগ্রামে। বলেছিলেন, মৃত্যলকের কাজ আর কেউ করে না–মহাসামন্ত সুধীমিত্র সম্মত হয়েছেন, তাঁর নির্মিত মন্দিরে মৃঙ্কলকও থাকবে। তুমি এ সুযোগ হারিও না। সুযোগ পেয়ে সে ধন্য মনে করেছিলো নিজেকে। আশা ছিলো তার, সমস্ত শিক্ষা ও সাধনার ফলকে নিঃশেষে ঢেলে দেবে ঐ মন্দির গাত্রের মৃৎফলকগুলিতে। দেবপীঠে প্রস্তর প্রতিমার পাশাপাশি শোভা পাবে মৃৎফলকগুলিও। যুগান্তরের মানুষ জানবে আত্রেয়ী তীরবাসী শ্যামাঙ্গ নামক এক মৃৎশিল্পীর হাতের কাজ ঐ সুষমাময়ী শবর কন্যা, ঐ প্রণয়দীপ্ত ব্যাধমিথুন, ঐ মমতাময়ী ধীবর জননী আর রামায়ণ কাহিনীর চিত্রময় ফলকমালা। জনক নন্দিনী যেন বা গৃহেরই বনিতা, লক্ষণ যেন নিজেরই অনুজ, শ্রীরামচন্দ্র একান্তই আপন সুহৃদ। সে দিনের পর দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছিলো। বসুদেব প্রথমে বাধা দেননি। শিষ্যের উপর তার অগাধ বিশ্বাস ছিলো সম্ভবত। কিন্তু তারপর যেন কী হলো–শ্যামাঙ্গের কাজ মনোযোগ দিয়ে দেখতে আরম্ভ করলেন। প্রথম প্রথম তিনি কিছুই বলেননি। তবে এও মনে হচ্ছিলো, শ্যামাঙ্গকে বোধ হয় আর তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। কেউ তার কানে কোনো কথা তুলেছিলো কিনা বলা কঠিন। তবে শ্যামাঙ্গের কাজ দেখবার সময় তাঁর ভ্রূর কুঞ্চন রেখা সর্বদাই জাগরূক থেকেছে। অবশেষে এই ব্রাত্য প্রসঙ্গ নিয়ে ঘটনা।

শ্যামাঙ্গের এখন মনে হয়, যে ঘটনাকে আকস্মিক বলে মনে হচ্ছিলো প্রকৃতপক্ষে তা প্রায় অনিবার্যই ছিলো। প্রশ্নটা তো এসে যাচ্ছিলো দৃষ্টিভঙ্গির। মূর্তি নির্মাণ কেন? শিল্প কেন? এই সব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছিলো গুরুদেবকে এবং তার নিজেকেও। আর প্রশ্নগুলি এমনই যে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। এ ব্যাপারে নীলাম্বরের সঙ্গে তার কথা হয়েছে। নীলাম্বর প্রস্তর–শিল্পী, প্রচলিত প্রতিমালক্ষণশাস্ত্র তার ভালোভাবে অধিগত। ছেদনী দিয়ে কঠিন প্রস্তরে সে অতি সূক্ষ্ম কাজটিও সম্পন্ন করতে পারে। বেশ কয়টি বিষ্ণুমূর্তি সে ইতোমধ্যে নির্মাণ করেছে। সে শ্যামাঙ্গের কথা একেবারেই বুঝতে পারে না। বলে, অহেতুক তুমি গোলযোগ সৃষ্টি করেছে। ভালোভাবে চিন্তা করে দেখো–শিল্প কি? অলঙ্করণ বই তো নয়–যার যা রুচি সেই প্রকারই তো অলঙ্করণ হবে। সেক্ষেত্রে তোমার নাসিকা অনুপ্রবেশ করবে কেন, বলো? গুরুদেব তো ঠিকই বলেছেন। সুধীমিত্র তার মনোমতো বস্তুটিই গ্রহণ করবেন। মনোমতো না হলে সেটা তিনি কেন গ্রহণ করবেন? গুরুদেবকে নিয়োগ করেছেন, এই প্রকাণ্ড কর্মশালা নির্মিত হয়েছে, কত দূর দূর দেশ থেকে বহু অর্থ ব্যয় করে উপাদান সামগ্রী নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রতিদিনই প্রায় বিপুল অর্থ ব্যয়–এ সবের উদ্দেশ্য তো ঐ একটিই–নির্মিত বস্তুটি যেন তাঁর মনোমতো হয়। তাঁর মনোস্তুষ্টি করা ছাড়া গুরুদেবের এক্ষেত্রে আর কী করণীয় থাকতে পারে, বলো?

শ্যামাঙ্গ বিরক্তি বোধ করেছে নীলাম্বরের কথায়। বলেছে, মিত্র নীলাম্বর, তুমি আমার কথা বুঝবে না। যদি বুঝতে, তাহলে মৃত্তিকা নিয়েই কাজ করতে।

নীলাম্বর ঐ কথার পর শ্যামাঙ্গকে পরিত্যাগ করেছে। ঐ কটি দিন ছিলো অশেষ যন্ত্রণার। একটি কথাই বারবার তার মনে আলোড়িত হচ্ছিলো। গুরু বসুদেব কেমন করে বললেন যে তিনি আদেশের দাস? তুমি বলতে কি তিনি তার মতো সকল শিল্পীকে বুঝিয়েছেন? শিল্পী কি ক্রীতদাস? রাজানুগ্রহ ব্যতিরেকে কি শিল্পীর অস্তিত্ব নেই? ধীমান বীটপাল কি রাজাদেশের দাস ছিলেন? প্রথা এবং অনুশাসন ছিন্ন করেন যে শিল্পী তিনি কি ক্রীতদাস হতে পারেন? বসুদেবই তো জানিয়েছেন যে, একদা বরেন্দ্রভূমির মৃৎশিল্পীরা মৃত্যলকে উত্তীর্ণ করেছেন জনজীবনের দৃশ্যমালা। যোগীভিক্ষু, মৃগয়া প্রত্যাগতা ব্যাধরমণী, শৃঙ্গার মগ্ন মানব–মানবী, ঢাল তরবারি হস্তে বীর ধটিকা পরিহিতা বীরাঙ্গনা–এসব দৃশ্যে উত্তীর্ণ মৃৎফলক সোমপুরী মহাবিহারের প্রাচীর গাত্রে এখনও শোভা পাচ্ছে। ঐসব কাজ যে গৌরবের বস্তু–একথাও গুরু বসুদেবই জানিয়েছেন। তাহলে তিনি এখন এমন কথা কেন বলছেন?

সে জানে, বসুদেব যৌবনকালে দরিদ্র জীবনযাপন করতেন। রাজানুগ্রহ লাভের চেষ্টা কখনই করেননি। কখনও তাঁর কেটেছে আত্রেয়ী তীরে, গ্রাম জনপদগুলিতে, কখনও গিয়েছেন রামাবতী পুন্ড্রনগরে, কখনও সোমপুরে। প্রতিমালক্ষণশাস্ত্র তাঁর নখদর্পণে। মৌর্য ও গুপ্ত যুগের প্রতিমা নির্মাণকলা কেমন করে গৌড়ীয় রীতির সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে একাকার হয়ে গেছে–সমস্ত কিছু জানেন তিনি। কী নিষ্ঠা তাঁর, কী সাধনা! চিন্তা করলে বিস্ময় লাগে। অথচ সেই বসুদেবই এখন কী হয়েছেন। তার আচরণ হয়ে উঠেছে দুর্বোধ্য। মহাসামন্ত সুধীমিত্রের আদেশ কি এতোই দুর্লঙ্ঘ্য? তার মনে প্রশ্ন জাগে।

মনে অপরিসীম বেদনার ভার। কাজে মন বসে না। এমনকি সমাপ্তপ্রায় কাজগুলি সম্পন্ন করতেও সে উৎসাহ পাচ্ছিলো না। রৌদ্রশুষ্ক ফলকসমূহ যে অগ্নিদগ্ধ করবে, সে উদ্যমটুকুও তার ঐ সময় ছিলো না।

ঐ সময় একদিন বসুদেব স্বয়ং এলেন এবং কিছু ফলক বেছে বেছে একদিকে পৃথক করে রেখে অবশিষ্টগুলির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন, শ্যামাঙ্গ, এসব অপ্রয়োজনীয় এসব ভেঙে ফেলে নতুন করে প্রস্তুত করো।

একেবারেই অবিশ্বাস্য! বসুদেবের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করা যায় না। তবু শ্যামাঙ্গ জানিয়েছিলো, গুরুদেব, মার্জনা করবেন–এগুলি আমার বহুবর্ষের সাধনার ফল–এগুলি বিনষ্ট করা যাবে না।

বসুদেব কঠিন স্বরে জানতে চেয়েছিলেন, কেন, অদগ্ধ মৃৎফলক বিনষ্ট করা তো কষ্টসাধ্য কাজ নয়।

তা নয়, কিন্তু এ সমস্তই শিল্পকর্ম।

শিল্পকর্ম? বসুদেবের ক্রুদ্ধস্বর চিৎকার হয়ে উঠেছিলো। বলেছিলেন, শিল্পকর্ম কাকে বলে তুমি জানো? এসব যা রচনা করেছো–শুধুই জঞ্জাল, বুঝেছো? এসব জঞ্জাল বিনষ্ট করতে কোনো কষ্টই হয় না।

দেখো, এইভাবে নষ্ট করা যায়, ভালো করে দেখে রাখো। দেখতে দেখতে ক্রুদ্ধ, ক্ষিপ্ত বসুদেব পদাঘাতে মৃৎফলকগুলি ভাঙতে আরম্ভ করে দেন। রক্তিম চক্ষু, উন্মাদ পদতাড়না, তীব্র চিৎকার–সব মিলিয়ে তখন তাকে অন্য এবং অচেনা মানুষ বলে মনে হচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় হয়ে দেখছিলো, কিছু বলতে পারেনি।

শ্যামাঙ্গ পারেনি, কিন্তু বসুদেব পেরেছিলেন। বলেছিলেন, তোমাকে এখানে আর প্রয়োজন নেই–তুমি এবার যেতে পারো। আমি তোমার মঙ্গল চেয়েছিলাম, কিন্তু তোমার স্পর্ধা এবং দুর্বিনয় একেবারেই সীমাহীন–আর আমি তোমার মুখদর্শন করবো না।

এখানে তোমার স্থান হবে না শ্যামাঙ্গ, এক সময় শান্ত স্বরে জানিয়েছেন বসুদেব। বলেছেন, সুধীমিত্র তোমার সমস্ত মৃৎফলক অযোগ্য বলে বিবেচনা করেছেন–আমি অনুরোধ। করেছিলাম, কয়েকটি ফলক যেন গ্রহণ করেন, কিন্তু দেখলাম, কাজ হলো না–তুমি যাও।

শ্যামাঙ্গ কিছুই বলেনি অতঃপর। গুরু বসুদেবকে প্রণাম করে প্রায় রাত্রি শেষে বিল্বগ্রাম থেকে সে বিদায় নিয়েছে।

০২. মৎস্য শিকারের কোলাহল

মৎস্য শিকারের কোলাহল তখনও সমানে হয়ে চলেছে। সূর্য নেমেছে আরও নিচুতে। শ্যামাঙ্গ বারংবার তার মৃৎফলকগুলির কথা ভাবছিলো। জীবন্ত এবং উজ্জ্বল যে চিত্রমালা এখন চোখের সম্মুখে দেখছে–তাই তো সে ধরে রেখেছিলো তার মৃৎফলকগুলির মধ্যে। কিন্তু বসুদেব বুঝলেন না। এখন একটি দিবস অতিক্রান্ত হওয়ার পর তার মনে হচ্ছে গুরু বসুদেবের ঐ আচরণ প্রকৃতই নাটকীয়। ঐ আচরণে কোনো মহত্ত্ব আছে বলে তার মনে হচ্ছে না। চোখের সম্মুখে নতুন চিত্রমালার জীবন্ত বিষয়গুলি যতোই সে দেখছে, ততোই তার গুরুদেবের ওপর করুণা হচ্ছে। গুরু বসুদেব যদি প্রকৃতই শিল্পী হতেন, তাহলে তিনি সুধীমিত্রের নির্দেশ উপেক্ষা করতেন এবং যা তিনি শিষ্যদের বলেছেন তা–ই নিজের জীবনে পালন করতেন। তিনি সে চেষ্টা আদৌ কখনও করেছেন কি না তাই এখন সন্দেহের বিষয়। তিনি কি শিষ্যের পক্ষ নিয়ে সুধীমিত্রের বিরোধিতা করেছেন? করেননি। তাহলে তাঁর ঐ ক্ষিপ্ত উন্মাদ আচরণের কোনো তাৎপর্যই থাকে না। তুমি অন্তরে সৎ থাকবে, মহান থাকবে, কিন্তু বাইরে কিছুই বলবে না, এভাবে কি শিল্পী জীবনযাপন করতে পারে?

হঠাৎ সমস্বরে চিৎকার উঠতেই শ্যামাঙ্গ দৃষ্টি প্রসারিত করলো। দেখলো, একখানি চতুষ্কোণ জালে একটি মধ্যমাকার রোহিত মৎস্য লম্ফঝম্প করছে এবং দুতিনটি কিশোর ছুটে যাচ্ছে ঐ জালের দিকে। কিন্তু লাভ হলো না। করায়ত্ত হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে রোহিতটি সজোর লম্ফ দিলো। এবং সবাইকে হতাশ করে নিমেষে পতিত হলো জলে।

দৃশ্যটি শ্যামাঙ্গ উপভোগ করলো, এবং অপেক্ষা করতে লাগলো, দেখা যাক, ঐ জালধারীর ভাগ্য পরবর্তী প্রচেষ্টায় কী এনে দেয়।

আর ঠিক ঐ সময় তার কানে এলো হাস্যমুখরা দুই রমণী কণ্ঠের আলাপ। একজন বলছে, চুপ চুপ দগ্ধমুখি, তোর লজ্জা ভয় বলতে কি কিছুই নেই একেবারে?

কেন লো? আমি কি তোর মতো ভর্তাতাড়িতা যে আমার লজ্জা থাকবে?

বৃক্ষতলের বেদী যথেষ্ট উঁচু, সম্মুখের ভূমি নিম্নগামী এবং ঐ নিম্নভূমি থেকেই উঠে আসছিলো দুই সখী এবং তাদের আলাপ।

শ্যামাঙ্গ উঠে বসতেই মুখোমুখি হলো। দেখলো, দুটি শ্যামবর্ণা যুবতী পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছে। সম্মুখে হঠাৎ অপরিচিত যুবাপুরুষ দেখে ঈষৎ বা অপ্রতিভ।

লক্ষ্য করে শ্যামাঙ্গ, দুজনেই ঈষৎমেদা এবং শ্রোণীভারানতা। তবে আবার দুজনকেই ঈষৎ চঞ্চলও মনে হয়। হয়তো নবীন যৌবনের কারণে দুজনেরই কৃষ্ণ অক্ষিপক্ষ্মে কৌতুক ও কৌতূহল। শ্যামাঙ্গ মৃদু হাস্যে বললো, আমি ভিন্নদেশী পথিক, এই গ্রামের নাম কি, বলবেন?

তরুণী দুটি কিঞ্চিৎ ইতস্তত করে। তারপর ধীরপদে কাছে আসে। জানায়, গ্রামের নাম উজুবট, গ্রামপতি বিপ্রদাস–এবং ঐ যে দেখা যায়–হাত তুলে দেখায় একজন, ঐখানে আমাদের গ্রাম। শ্যামাঙ্গ দেখে, দূরে আম্রবীথি এবং তার ওপারে একটি মন্দিরের ধ্বজা দেখা যাচ্ছে। তরুণীটি জানায়, ঐ মন্দিরের কাছে গ্রামপতির গৃহ।

তরুণী দুটি তৎক্ষণাৎ চলে গেলো না–একটি সহজ, কৌতূহলী এবং আগ্রহী ভঙ্গি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শ্যামাঙ্গের মনে হলো, এ অঞ্চলের নারীরা সম্ভবত অধিকতর শিথিলশাসনা। সে কারণেই অহেতুক লজ্জা বা সঙ্কোচ দেখছে না তরুণী দুটির আচরণে। বরং সহজেই তারা কৌতূহল প্রকাশ করছে। দুজনেই নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। যেমন, পথিক কি পূর্বে এদিকে আসেননি? আপনার নিবাস কোথায়? রজতপট গ্রাম শুনেছি অনেক দূর–আপনি কি পদব্রজে যাবেন? আচ্ছা, আত্রেয়ী নদী কি আরও প্রশস্তা?

প্রশ্নগুলির প্রত্যেকটিরই উত্তর দিতে হলো শ্যামাঙ্গকে। ইতোমধ্যে একটি বৃদ্ধা এসে উপস্থিত হয়েছে। সেও আলাপে যোগ দিলো। বৃদ্ধার রসনা প্রখর, তদুপরি সে সুরসিকা। ফলে তরুণী দুটির স্বভাবত সংকোচও আর থাকলো না। যখন বৃদ্ধা জানতে চাইলো, পথিক এই নবীন যৌবনে বিবাগী কেন–এই বয়স তো প্রব্রজ্যার নয়? তখন সকৌতুকে শ্যামাঙ্গের মুখপানে দৃষ্টি রাখলো তরুণী দুটি।

আর সে জন্যই বৃদ্ধার কথার উত্তর দেবার পূর্বে দুমুহূর্ত ভাবতে হলো শ্যামাঙ্গকে। সে বুঝলো, বৃদ্ধা তার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ নিয়ে রসিকতা করতে চাইছে। বললো, আয়ি, আপনার মতো কেউ যদি থাকতো, তাহলে কি এই অধম দেশে দেশে ভ্রমণ করে বেড়ায়?

বৃদ্ধা হাসিতে ভেঙে পড়ে। মেয়ে দুটিকে বলে, দেখ লো, পথিক কি চতুর–আমাকে সম্বোধন করলেও বক্তব্য কিন্তু তোদেরই শোনাচ্ছে। তোরা সাবধান হ।

বৃদ্ধার ঐ সরস কটাক্ষের উত্তরে, যে অধিকতর শ্যামা, সে বললো, আয়ি, আমাদের তো লোক আছে, তোমারই নেই–তুমি বরং ভেবে দেখতে পারো।

ঐ সময় নদীকূল থেকে একটি বালকের চিৎকার শোনা গেলো, তার মাছ কে একজন ছিনিয়ে নিচ্ছে। ঐ গোহারি শুনে বৃদ্ধা দাঁড়ালো না। যাবার সময় বলে গেলো, ওলো তোরা পথিককে ছাড়িস নে–আমি আসছি।

আয়ি সুরসিকা, শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে।

আমরাও দেখি, কি কি মাছ ধরা পড়লো।

শ্যামাঙ্গের মন্তব্যের উত্তর না দিয়ে তরুণী দুটি নদীতীর অভিমুখে অগ্রসর হলো। শ্যামাঙ্গ পেছন থেকে ডেকে বললো, বৃহৎ রোহিত ধরা পড়লে নিমন্ত্রণ যেন পাই, দেখবেন।

শ্যামাঙ্গের ঐ কথায় দুজনই ঘুরে দাঁড়ায়। দুজনেরই অক্ষিতারকা নৃত্যপর হয়, পথিক কি ব্রাহ্মণ?

কে ব্রাহ্মণ? আমি? শ্যামাঙ্গ অবাক হয়।

নাহলে রোহিত ভোজনের জন্য এরূপ উদগ্র বাসনা কেন?

শ্যামাঙ্গ প্রায় মুগ্ধ হয়ে গেলো। শ্যামা তরুণীটি বড়ই বুদ্ধিমতী। সে সহজ স্বরে বললো, পথিকের আর দোষ কি বলুন, পুনর্ভবা তীরের রন্ধন নৈপুণ্যের খ্যাতি কে না জানে, তদুপরি নবাম্র আর সজিনাদণ্ডিকার ঋতু এখন–এ সময় ব্রাহ্মণাব্রাহ্মণ নির্বিশেষে সকল রসনারই উদগ্র হওয়ার কথা, আশা করি আপনাদের অজানা নয় সে কথা।

তা নয়, উজ্জ্বলতরা তরুণীটি জানায়, কিন্তু এও মনে রাখবেন, এতদঞ্চলে ঝালের ব্যবহার বেশি। ঝালতপ্ত ব্যঞ্জন ভোজনের অভ্যাস কি আছে পথিকের?

শ্যামাঙ্গ হাসে। মনে মনে বলে, ঝালের কেমন ব্যবহার তা বাপু বিলক্ষণ অনুভব করছি। প্রকাশ্যে বলে, এ অধম ব্রাহ্মণও নয়, শিশুও নয়, যে ননীছানাভুক হবো, আপনারা নিমন্ত্রণ করে দেখুন একবার।

আচ্ছা সে দেখা যাবে, বলে মেয়ে দুটি অতঃপর বিদায় নেয়।

শ্যামাঙ্গ এবার বেদী থেকে নেমে দাঁড়ায়। দেহের ক্লান্তি এবং অবসাদ সত্যিই এবার অনেকখানি দূর হয়েছে। সে দেখে, মৃত নদীর কর্দমাক্ত জলাশয় থেকে সিক্ত বস্ত্রে একে একে মৎস্য শিকারীরা উঠে আসছে। প্রত্যেকের কটিবন্ধনীতে মৎস্যমালা বিলগ্ন। বৃহদাকৃতির মৎস্য প্রায় কারও ভাগ্যেই জোটেনি।

তারা একে একে কৌতূহলভরে বৃক্ষতলে এসে দাঁড়ায়। কারও হাতে ক্ষুদ্রাকৃতি জালিকা। কারও হাতে লৌহাগ্র কোঞ্চ, কারও হাতে বংশখণ্ডিকা নির্মিত পলই। সকলেই শ্যামাঙ্গ সম্পর্কে জানতে চায়। ক্রমে তারা একযোগে ঘিরে দাঁড়ালো। আর তাতে অদ্ভুত একটি অনুভূতি হলো শ্যামাঙ্গের। জলের, মৃত্তিকার, আমিষের সম্মিলিত একটি গন্ধ তাকে আচ্ছন্ন করে দিলো। একবার ক্ষণিকের জন্য মনে হলো, সে যেন অন্য মানুষ। সমাগত লোকেরা নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। কেউ কেউ নাম পরিচয় জানতে চায়। সে আত্রেয়ী তীরের মানুষ জানতে পেরে কয়েকজনের আগ্রহ কিঞ্চিৎ অধিক হলো। অত দূরের মানুষ এ অঞ্চলে অহরহ আসে না। যাদের আত্মীয়স্বজন ঐ দূরদেশে থাকে, তারা নানাবিধ কুশলাদি জানার প্রত্যাশী। যেমন, মহাশয় কি নীলাঞ্জন গ্রামের দিবোনাথকে চেনেন? আপনার গ্রাম থেকে মালঞ্চি গ্রাম কত দূর? আত্রেয়ী তীরের কুম্ভকারেরা কি আর মৃৎপাত্র নির্মাণ করে না? এই প্রকার একের পর এক প্রশ্ন। শ্যামাঙ্গ কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে, কোনোটির পারে না। ওরাই জানালো, আত্রেয়ী করতোয়া সংগম এখান থেকে বিশ ক্রোশাধিক পথ। এ গ্রামের হাটে কদাচিৎ আসে আত্রেয়ী তীরের মানুষ। আপনি বরং নবগ্রাম হাটে যান, একজন পরামর্শ দিলো, ওখানে প্রায় নিয়মিতই আত্রেয়ী তীরের বহু শকট আসে।

নবগ্রাম হাটের নাম শুনে শ্যামাঙ্গ আগ্রহী হয়। সুহৃদ নীলাম্বর নবগ্রাম হাটের কথা বারংবার বলে দিয়েছে। সে জানতে চাইলো, নবগ্রাম কি এ স্থান থেকে অধিক দূর?

না না, দূর কেন হবে? জলসিক্ত প্রৌঢ় লোকটি জানালো। বললো, এই ক্রোশ তিনেক পথ হবে।

ক্রোশ তিনেক। শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণে। তার অনুমান ছিলো, নবগ্রামে যদিবা সে নাও এসে থাকে তাহলে অন্তত পার্শ্ববর্তী কোনো গ্রামে এসেছে–উজুবট নবগ্রাম হাটেরই নিকটবর্তী কোনো স্থান হবে। কিন্তু এখন? সে পশ্চিমাকাশে চাইলো–সূর্যাস্তের আর দণ্ডাধিককাল দেরী–যদি যেতে হয়, তাহলে এখনই তার যাত্রারম্ভ করা উচিত। পথিমধ্যে হয়তো রাত্রি হবে–কিন্তু উপায় তো কিছু নেই, তিন ক্রোশ পথ সহজ ব্যাপার নয়।

সে চঞ্চল হয়ে ওঠে। পাদুকা যুগল পরিধান করে, উত্তরীয় খানি স্কন্ধে রাখে এবং তার যথাসর্বস্ব পুটুলিটি হাতে তোলে।

তাকে ঐভাবে উদ্যোগী হতে দেখে প্রৌঢ়টি বললো, মহাশয় তিন ক্রোশ পথ কম নয়, আপনি অচেনা মানুষ, এই সন্ধ্যা সমাগমে যাত্রা না করলেই ভালো।

শ্যামাঙ্গ সম্মুখে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেয়—হ্যাঁ, সন্ধ্যার আর সত্যিই দেরি নেই। কৌতূহলী গ্রামবাসীরা কৌতূহল নিবৃত্ত করে চলে যাচ্ছে। প্রৌঢ় লোকটিও চলে গেলো। আশ্চর্য ব্যাপার! তাকে সন্ধ্যা সমাগমে যাত্রা করতে নিষেধ করলো প্রৌঢ় লোকটি, অথচ তার রাত্রিযাপনের কি ব্যবস্থা হবে, সে সম্পর্কে কিছুই বললো না। তার অনুমান হয়, বোধ হয় তাকে আবার বিপদে পড়তে হবে।

ঐ সময় তার প্রৌঢ় পথিকের কথা মনে পড়ে। মনে মনে তুলনা করে, দণ্ড কয় আগে তার ভালো–মন্দ নিয়ে এক প্রৌঢ়ের দুশ্চিন্তার অন্ত ছিলো না–আর এখন অন্য এক প্রৌঢ় তার সমস্যার কথা জেনেও কিছু করার চেষ্টা করলো না। সে উঠে দাঁড়ায়, আপাতত যাত্রারম্ভ করাই বিধেয়। পথিমধ্যে যদি তেমন বোঝে, তাহলে পথিপার্শ্বেরই কোনো গ্রামে হয় আশ্রয় প্রার্থনা করবে।

কিন্তু প্রথম পদক্ষেপণের মুহূর্তেই তাকে থামতে হলো। শুনলো, পথিক মনে হচ্ছে যাত্রারম্ভ করলেন?

তরুণী দুটি কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লক্ষ্য করেনি। সে ঘুরে দাঁড়ালো। এবং মৃদু হাস্যে বললো, হ্যাঁ ভাবছি, নবগ্রাম পর্যন্ত চলে যাই।

তার কথায় দুজনের মুখেই ঈষৎ উদ্বেগের ছায়া দেখা গেলো। একজন বললো, নবগ্রাম তো অতি নিকটে, তাই না?

হ্যাঁ, এক প্রৌঢ় তো তাই বললেন, মাত্রই তিন ক্রোশ।

হ্যাঁ, মাত্র তিন ক্রোশ, উজ্জ্বলতরা তরুণীটির চোখে মুখে কপট কৌতুক দেখা গেলো ঐ সময়। বললো, এই তিন ক্রোশ পথ সূর্যাস্তের মধ্যে অতিক্রম করতে আপনার অসুবিধা হবে না তাই না?

না, তা নয়, শ্যামাঙ্গ স্বীকার করে, পথিমধ্যে রাত্রি অবশ্যই হবে।

তাহলে? দুজনের কণ্ঠ থেকে একসঙ্গে শব্দটি উচ্চারিত হয়।

তাহলে কী, শ্যামাঙ্গ জানতে চায়, পথ দুর্গম? পথিমধ্যে অরণ্য আছে? ব্যাঘ ভল্লুক আক্রমণ করে?

স্বল্প শ্যামা তরুণীটি জানায়, শুনুন মহাশয়, ও কাজও করবেন না। পথিমধ্যে অরণ্য আছে তা ঠিক এবং অরণ্যের ব্যাঘ্র ভল্লুকের আক্রমণের ভয়ও আছে। তবে সর্বাপেক্ষা ভয়ের কারণ অরণ্য সংলগ্ন গ্রামগুলি–ঐ গ্রামগুলিতে দস্যু তস্করের বাস। যাত্রা করতে চাইলে ভেবে–চিন্তে তবে যাত্রা করুন।

শ্যামাঙ্গকে এবার ভাবতে হয়। তার কটিদেশে গ্রন্থিবদ্ধ স্থলীতে যা আছে তার মূল্য খুব বেশি না হলেও একেবারে তুচ্ছ নয়। উপরন্তু প্রৌঢ় পথিক আবার কিছু মুদ্রা তাকে দান করেছেন। এ তো মহাবিপদ। সে মনে মনে কিছুটা আতঙ্ক বোধই করে। কিন্তু প্রকাশ্যে সে হাসে, বলে, কিন্তু আমার যাত্রা করা ছাড়া আর কি উপায় আছে বলুন? এখানে আমাকে কে থাকতে দেবে?

ঐ কথায় দুই তরুণীই নিষ্প্রভ হয়ে যায়। বোঝা যায় তারা দারুণ বিব্রত বোধ করছে। উত্তরে তারা কিছুই বলে না এবং এমন ভাব করে, যেন তাদের ব্যস্ততা আছে এবং অচিরাৎ তাদের গৃহে ফেরা প্রয়োজন।

আচ্ছা, এখানে কোনো মন্দির নেই? শ্যামাঙ্গ জানতে চায়।

হ্যাঁ আছে, কেন থাকবে না, একজন হাত তুলে দেখায়, ঐ যে দেখুন, মন্দিরের ধ্বজা উড়ছে।

শ্যামাঙ্গ সেদিকে লক্ষ্য করেনি তা নয়। সে পূর্বেই দেখেছে চক্রলাঞ্ছিত গৈরিক ধ্বজা চৈত্রের বাতাসে সতেজে উড্ডীন। সে বলে, কিন্তু ও তো বিষ্ণুমন্দির, সম্ভবত ব্রাহ্মণদের নিবাস ওখানে, নিকটে কোনো শিবমন্দির নেই?

পথিক কি শিবভক্ত? আবার কৌতুক ফোটে শ্যামাঙ্গী তরুণীটির স্বরে।

না, শ্যামাঙ্গ জানায়।

তাহলে কী?

এবার উজ্জ্বলবর্ণা মেয়েটির চোখে হাসি দেখা গেলো। বললো, ব্রাহ্মণ নয়, শিবভক্ত নয়, তাহলে কী?

কেন ব্রাহ্মণ ও শিবভক্ত ব্যতীত কি অন্য কিছু হওয়া যায় না?

যাবে না কেন? শ্যামাঙ্গী মেয়েটি উত্তর দিলো। বললো, শিবভক্ত না হয়ে যখন কোনো অপরিচিত আগন্তুক শিব মন্দিরের আশ্রয় সন্ধান করে, তখন তার পরিচয় জানতে চাওয়া গ্রামবাসীর কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।

শ্যামাঙ্গ ততক্ষণে বুঝে নিয়েছে, এই তরুণীটির বুদ্ধি যেমন প্রখর বাকপটুতাও তেমনই অসাধারণ। তার বাক্যালাপ সে উপভোগ করতে লাগলো। বললো, জানা ছিলো না যে, পুরুষ নয়, নারীরাই পুনর্ভবা তীরে কোট্টপালের দায়িত্ব পালন করে।

তরুণীটি অপ্রতিভ হয় না। বলে, যদি তাই–ই হয়, তাহলে কি দোষ আছে কিছু?

না, না, দোষ কেন থাকবে? শ্যামাঙ্গ জানায়, আমার এখন মনে হচ্ছে, নবগ্রাম যাত্রা করাই বোধ হয় উত্তম ছিলো।

কেন? হঠাৎ একথা মনে হচ্ছে কেন? মেয়ে দুটি হতচকিত বোধ করে।

মনে হচ্ছে এজন্য যে শুনেছি, কামরূপ প্রভৃতি পূর্বদেশে রমণীরাই সমাজে সর্বেসর্বা। সেখানে পুরুষেরা কেউ বলীবর্দ, কেউ ছাগ, কেউবা কুক্কুর–এখন চিন্তা হচ্ছে, পুনর্ভবা তীরেও সেই রীতির প্রচলন হয়েছে কিনা, যদি হয়ে থাকে, তাহলে কি এই দীন অভাজন পুনরায় গৃহের মুখ দেখতে পাবে?

শ্যামাঙ্গের ঐ কথায় দুই তরুণীই হেসে উঠলো।

ললিত প্রেক্ষণা রমণীর আননে সকৌতুক হাস্য পরিহাস যে বিচিত্র ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করতে পারে তা শ্যামাঙ্গের অজানা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে সম্মুখের তরুণী দুটির হাস্যাননে কোনো প্রকার ইন্দ্রজালই সে সৃষ্টি হতে দেখলো না। যা দেখলো তা নিতান্তই সহজ কৌতুক–এবং তাতে তার মন হয়ে উঠলো ভারমুক্ত। কোনো প্রকার দুশ্চিন্তা বা মানসিক পীড়ন ঐ সময় তার অনুভূতিতে আর রইলো না।

শ্যামাঙ্গ নগরবাসী রাজপাদোপজীবী অথবা সামন্তপ্রভু গৃহের যুবকপুত্রদের মতো লীলারঙে কুশলী নয়। হলে সে এই কৌতুকহাস্যকে দীর্ঘায়ত করতে সচেষ্ট হতো। এবং হাস্যালাপের সূত্র ধরে প্রণয়াসক্তি প্রকাশের চেষ্টা করতো। তাই কৌতুকের ভাবটি সে বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারলো না। কারণ ওদিকে দিবা অবসান প্রায়–এবং তরুণী দুটি ঈষৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। তদুপরি তার নিজেরও একটি রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

সে কখনও বামে কখনও দক্ষিণে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিলো। যদি কোনো বয়স্ক পুরুষ গোচরে আসে।

শ্যামাঙ্গনা তরুণীটি তা লক্ষ্য করে থাকবে। বললো, পথিক কি কাউকে সন্ধান করছেন?

হ্যাঁ, আপনাদের গ্রামে দেখছি পুরুষের সংখ্যা নিতান্তই স্বল্প।

কেন, তাতে কি ভয় হচ্ছে? মেয়েটির স্বরে কৌতুক ঘোচে না। কপট আশ্বাস দেয় সে। বলে, আপনার ভয়ের কারণ নেই, বলীবর্দ, ছাগ অথবা কুক্কুর কোনোটারই আমাদের প্রয়োজন নেই।

আহা যদি হতো! শ্যামাঙ্গ যেন দীর্ঘশ্বাস মোচন করে।

হলে কি ভাল হতো? মেয়েটির চোখে ঈষৎ বিস্ময় ফোটে, এই না বললেন যে আপনার ভয় হচ্ছে–আবার এখনই হায়–হুতাশ কেন?

শ্যামাঙ্গ আক্ষেপ করে বলে, হায় যদি আপনাদের প্রয়োজন হতো, তাহলে বলীবর্দরূপে হোক, কি ছাগরূপে,–রাত্রিযাপনের একটা ভালো ব্যবস্থা নিশ্চয়ই আমার জন্য করতেন আপনারা।

তরুণী দুটি আবার বিব্রত বোধ করতে আরম্ভ করে। তাদের মুখ দেখে শ্যামাঙ্গ বোঝে, পথিককে তারা যে গৃহে আমন্ত্রণ জানাতে পারছে না, এই জন্যই তাদের মুখে ঐ বিব্ৰত ভাব। সে তখন জানতে চাইলো, আচ্ছা, আমি যদি ঐ মন্দিরে গিয়ে রাত্রিযাপনের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করি, তাহলে কেমন হয়?

না, স্বল্প–শ্যামা উত্তরে জানায়, আপনি বরং আমাদের গ্রামে যান–আমার পিতা শুকদেব, মাতুল দীনদাস। গ্রামে গিয়ে এঁদের সন্ধান করবেন এবং নিজ পরিচয় দিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করবেন।

ক্ষণেক চিন্তা করে হঠাৎ মেয়েটি জানতে চাইলো, আম্রপট্টলী গ্রাম কি চেনেন আপনি? আত্রেয়ী তীরের আম্রপট্টলী?

কেন, ঐ গ্রামে কে আছে আপনার? শ্যামাঙ্গ কৌতূহলী হয়। আম্রপট্টলী গ্রাম সে বিলক্ষণ চেনে–সেখানে তার মাতুলালয়। বললো, আমার গ্রাম রজতপট, আম্রপট্টলী থেকে দূরত্ব পাঁচ ক্রোশের মতো।

শ্যামাঙ্গের কথায় যেন উৎসাহ বোধ করে মেয়েটি। বললো, আম্রপট্টলীতে আমার ননদের শ্বশুরালয়। আমার পিতাকে বলবেন যে অনন্তদাসকে আপনি চেনেন। আমার ননদের নাম ব্রজতারা, মোহনদাস তার স্বামী, অনন্তদাসের পুত্র। আমার নাম মায়া, মায়াবতী–বলবেন যে আমার নাম আপনি জানেন।

ব্যাপারটি বেশ জটিল। মায়াবতীর ননদ ব্রজতারা, তার স্বামী মোহনদাস, মোহনদাসের পিতার নাম আবার অনন্তদাস–নিবাস আম্রপট্টলী গ্রাম–অতি দীর্ঘ একটি তালিকা। শুধু এইটুকুই নয়–একটি সম্পূর্ণ কাহিনী নির্মাণ করতে হবে তাকে এখন এবং সর্বক্ষণ সেটি মনে রাখতে হবে। তারপরও রয়েছে মায়াবতীর স্বামীর নাম, শ্বশুরের নাম, তাদের গ্রামের নাম–সম্পূর্ণ ব্যাপারটি আয়ত্তে রাখা সহজ ব্যাপার নয়। মায়াবতীর পরামর্শ গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না তার কাছে। বললো, আতিথ্য লাভের জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিতে হবে? এই কি নিয়ম নাকি এদেশে?

ঐ প্রশ্নে মায়াবতী গম্ভীর হয়ে উঠলো। বোধ হয় কিঞ্চিৎ আহত হলো সে। তার সঙ্গিনীও যে খুব প্রসন্ন হয়েছে এমন মনে হলো না। মায়াবতী সঙ্গিনীকে ডেকে বললো, আয় লীলা, আমরা যাই, বেলা গেলো।

তাহলে এ হলো মায়া, শুকদেবের কন্যা, আর ঐটি হলো লীলা, সম্ভবত লীলাময়ী অথবা লীলাবতী। শ্যামাঙ্গের নাম দুটি মধুর বোধ হলো। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, মায়াবতীদের গৃহেই সে আতিথ্য প্রার্থনা করবে।

অদূরে মেয়ে দুটি উচ্চ আলপথের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। লীলাবতীর কেশভার বিপুল। নদীতীরের বাতাসে তার শিথিল কবরী বিস্রস্ত হওয়ায় বারবার তাকে দুহাত তুলে কবরী বন্ধন করতে হচ্ছিলো। আর ঐ সময়ই শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে লীলাবতীর দেহসৌষ্ঠব অনিন্দ্য। সে একটি অপরূপ যক্ষিণী মূর্তি দেখেছিলো সোমপুর মহাবিহারে। লীলাকে দেখে কৃষ্ণপ্রস্তরে নির্মিত পীবরস্তনী, বিপুলজঘনা, সুকেশী যক্ষিণী মূর্তিটি বারবার তার মানস চক্ষে স্পষ্ট হয়ে উঠলো। এবং নিজ বক্ষের অনেক গোপনে কোথায় যেন সে বারবার শিহরিত হতে লাগলো।

মায়াবতী পিত্রালয়ে থাকে এবং সে যে বিবাহিতা তা বোঝা গেলো। কিন্তু লীলাবতী? তার সংবাদ তো জানা গেলো না কিছুই, সে কি সত্যিই স্বামী পরিত্যক্তা?

০৩. বরেন্দ্রভূমির এ অঞ্চল

বরেন্দ্রভূমির এ অঞ্চলটি বৎসরে একবার মাত্র শস্যময় হয়ে ওঠে। ধানক্ষেত্রগুলিতে হল স্পর্শ এখনও ঘটেনি। খরায় বরীন্দ্রের মৃত্তিকা লৌহপ্রায়, তৃণখণ্ডও গোচরে আসে না। চারণভূমি সম্ভবত দূরে কোথাও। সন্ধ্যাগমে তখন গৃহপালিত গবাদি সদলে গৃহে ফিরছে, তাদের খুরোৎক্ষিপ্ত ধূলিরাশি পশ্চিমাকাশে একটি ধূসর গৈরিক আবরণ বিস্তৃত করে দিয়েছে। ঐ সময় আবার খেয়ালী একটি রাখাল বালক বংশীতে শেষবারের মতো তার সুরটি বাজিয়ে নিচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গের মন ঐ সুর শুনে উদাস হয়ে উঠলো।

দূরে ঘণ্টাধ্বনি হচ্ছিলো। শ্যামাঙ্গ বুঝলো, যেদিকে মন্দিরের ধ্বজা দেখা যাচ্ছে সম্ভবত সেদিকে ব্রাহ্মণদের বাস। গবাদি পশুর দল ঐ দিকেই চলেছে। শ্যামাঙ্গ বাম দিকের পথ ধরলো। পথ সংকীর্ণ, কখনও আম্রকাননের মধ্য দিয়ে, কখনও বা বেনুবীথিকার মধ্য দিয়ে। কিছু দূর অগ্রসর হতেই দেখলো কয়েকটি কুটির, ভয়ানক জীর্ণ দশা কুটিরগুলির। শ্যামাঙ্গ অনুমান করে, সম্ভবত এখানে ডোম শ্রেণীর বাস। এক প্রৌঢ়াকে দেখা গেলো সন্ধ্যার ম্লান আলোতেও চাঙাড়ি নির্মাণে ব্যস্ত। নিকটেই কর্দমাক্ত নালিকায় শূকর পাল। একটি উলঙ্গ বালক কুটিরের বাইরে দাঁড়িয়ে মা মা ডাকে কেঁদে যাচ্ছে। শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করলো, বালকটির পঞ্জরাস্থিগুলি ভারী প্রকট। নিকটে গেলে নির্ভুলভাবে গণনা করা যাবে।

অধিক দূর যেতে হলো না। ডোমপল্লী অতিক্রম করে সামান্য অগ্রসর হয়েছে–ঐ সময় দেখলো একটি সপ্তপর্ণ বৃক্ষের নিচে দুই প্রৌঢ় দাঁড়িয়ে আছেন। কাছে গেলে তারাই জানতে চাইলেন, মহাশয়ের নিবাস কি আত্রেয়ী তীরে?

শ্যামাঙ্গ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক, আপাতত দুশ্চিন্তামুক্ত হওয়া গেলো। সে বুঝলো, মায়াবতী যথার্থই মায়াবতী। বয়োজ্যেষ্ঠ প্রৌঢ়টি বললেন, আমার কন্যা মায়াবতী আপনার আগমনের কথা আমাকে জানিয়েছে। আপনি নাকি মন্দিরে আর গ্রামপতির গৃহে আশ্রয় সন্ধান করছিলেন?

শ্যামাঙ্গ শুকদেবকে আভূমি বিনত হয়ে প্রণাম জানায়। সৌম্যকান্তি এই বৃদ্ধটিকে দেখে তার খুব ভালো লাগছে। দৃষ্টিমাত্র মনোহরণ করতে পারে এমন লোক শুকদেব। পার্শ্ববর্তী প্রৌঢ়টিকে দেখিয়ে বললেন, ইনি আমার পরমাত্মীয়, মায়াবতীর মাতুল দীনদাস নিবাস নিকটবর্তী গ্রাম উদয়পুর––বর্তমানে আমার গৃহে কিছুদিন অবস্থান করছেন।

বিনয়ে বিগলিত হওয়ার অবস্থা শ্যামাঙ্গের। কিছুক্ষণ পূর্বে সে পুনর্ভবা তীরবাসীর শীতল নিস্পৃহতা দেখে মনে মনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলো, এখন সে মনে মনে লজ্জিত হলো। পথিককে যে এমন সম্মান দেখানো যেতে পারে, তার জানা ছিলো না।

পথক্রমণে আলাপ হচ্ছিলো। পিতৃপরিচয়, কি হেতু এই দূর–যাত্রা, পরিবারে কে কে বর্তমান, এইসব প্রসঙ্গ এবং সেই সঙ্গে আত্রেয়ী তীরের শস্য পরিস্থিতি, বস্ত্র–তৈজসাদির মূল্য, রাজপাদোপজীবীদের আচরণ–এই সকল বিষয়েও তারা নানান কথা জানতে চাইলেন।

সাংসারিক বিষয়াদি শ্যামাঙ্গের সম্যক জানা নেই। তবে যা সে জ্ঞাত ছিলো, জানালো। যেমন, তণ্ডুল বর্তমানে অধিক সুলভ নয়, গোধূম কদাচিৎ পাওয়া যায়–বস্ত্রাদি ক্রমেই মহার্ঘ হয়ে উঠছে, তৈজসাদির জন্য দক্ষিণের নৌযানগুলি আর আত্রেয়ী করতোয়া সঙ্গম পর্যন্ত আসছে না, রাজপুরুষদের হাতে প্রায়ই মানুষ অহেতুক লাঞ্ছিত হয়–এই সকল সংবাদ সে প্রৌঢ় দুটিকে জানাতে পারলো।

জলযোগ আগমন মাত্রই হয়েছে–সুতরাং তার ক্ষুধা ছিলো না। এবং ক্লান্তিও না। প্রায় সমগ্র অর্ধদিবস সে তো বিশ্রাম করেই কাটিয়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিরা তাকে ঘিরে ছিলো। তাদের সান্নিধ্য শ্যামাঙ্গের ভালো লাগছিলো না। সে মনে মনে এমন সমবয়সী যুবাপুরুষ খুঁজছিলো, যাদের সান্নিধ্যে সে সহজ হাসি এবং আনন্দের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে পারে। সে ভাবছিলো, কখন গৃহের বাইরে যাবে, সে ঘুরে ফিরে জিজ্ঞাসা করছিলো, নিকটে শিবমন্দির আছে কি না, ধর্মক্রিয়াদি তাহলে কোথায় সম্পন্ন হয়? ব্রাহ্মণপল্লীতে কি নাট্টমন্দির আছে? কায়স্থপল্লী কতদূর? এ স্থানের কায়স্থরা কি যথার্থই কায়স্থ, নাকি ভূম্যাধিকারী মাত্র?

তার প্রশ্নের উত্তর কেউ কেউ দিচ্ছিলো। সমবেত লোকদের মধ্যে তরুণ বয়স্ক কয়েকজন ছিলো, তবে তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের উপস্থিতির কারণে অধিক আগ্রহ প্রকাশ করতে পারছিলো না। প্রৌঢ় ও বৃদ্ধরা স্থানটিকে মুখরিত করে রেখেছেন। তারা প্রত্যেকে যত না শুনছিলেন তদপেক্ষা বলছিলেন বেশি। একজন তার ভাগিনেয়ীর কথা বললে অন্যজন তাঁর পাটল রঙের গাভীটির কথা আরম্ভ করে দেন। ওদিকে একজন আবার তাঁর দৌহিত্রটি কেমন চতুর হয়ে উঠেছে সেই সংবাদ জানাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

দুজন একজন করে আরও প্রতিবেশীর আগমন ঘটেছে ততক্ষণে। দূরদেশী পথিকের সাক্ষাৎ অহরহ ঘটে না। তদুপরি শোনা গেছে যে পথিক যেমন প্রাজ্ঞ তেমনি সুরসিক। ফলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন আরম্ভ হয়ে গেলো এক সময়। যেমন, পথিক যে গ্রাম থেকে আসছেন, সে গ্রামে দ্রব্যসামগ্রী সুলভ, না মহার্ঘ? রাজপুরুষের ব্যবহার কেমন? পথিক কি লক্ষ্মণাবতীর সংবাদ জানেন? মহাসামন্ত হরি সেনের অনুচরেরা নাকি হাটের বিপণীকারদের কাছ থেকে কর আদায় করছে? মহাসামন্ত যজ্ঞদত্ত কি সত্যই বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী?

এসব প্রশ্নের উত্তর শ্যামাঙ্গ কেমন করে দেবে? সে নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করলো। তার সৌভাগ্য যে বৃদ্ধেরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরাই ঐ প্রশ্নগুলির সূত্রে নানান প্রসঙ্গের অবতারণা করে ফেললেন। ফল হলো এই যে শ্যামাঙ্গকে আর কেউ কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে পারলো না।

শ্যামাঙ্গ কতক শুনছিলো, কতক শুনছিলো না। কিন্তু এক সময় তাকে মনোযোগী হতে হলো। আলোচনা হচ্ছিলো সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের সম্পর্কে। সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের নাকি অধিক সংখ্যায় আগমন ঘটছে এ অঞ্চলে। দীনদাস তার কাছে জানতে চাইলেন, আপনাদের অঞ্চলেও কি ভিক্ষুদের আগমন ঘটেছে?

অবাক হয় শ্যামাঙ্গ। বলে, কেন এ অঞ্চলে কি ভিক্ষু নেই?

আছে, দীনদাস জানান, তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য ছিলো, দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে। ছিলো দুজন, এখন তারা সংখ্যায় পাঁচজন।

শ্যামাঙ্গ ঠিক বুঝতে পারে না। বিশ ক্রোশ কি দুরতিক্রম্য দূরত্ব? না হলে এখানে এমন ভিন্ন পরিস্থিতি কেন? নিজ গ্রাম রজতপটে কোনো মন্দির নেই, কিন্তু ভিক্ষুরা তো ঠিকই আছে–ক্রমে হয়তো সংখ্যা বৃদ্ধিও হয়েছে তাদের। আম্রপট্টলীর সংবাদও তার জানা আছে–সেখানেও ভিক্ষুদের সংখ্যা কম নয়–বিল্বমূল গ্রামেও তো সে দেখে এলো ভিক্ষুদের। ভিক্ষুরা এমন কি গুরুত্ব ধারণ করে যে তাদের সংখ্যার হ্রাস–বৃদ্ধি আলোচনার বস্তু হয়ে উঠবে?

সে বললো, আমাদের অঞ্চলে সর্বত্রই ভিক্ষুরা আছে, বহুকাল ধরেই আছে, তাদের সংখ্যা নিয়ে কখনও কোনো সমস্যা হয়েছে এমন শুনিনি।

দীনদাস হাসেন। বলেন, তাহলে বলতে হবে, আপনাদের অঞ্চলে ব্রাহ্মণাদি কুলীনের সংখ্যা কম, নাকি রাজপাদোপজীবীরা যথেষ্ট শক্তিমান নয়?

শ্যামাঙ্গ প্রশ্নটির তাৎপর্য বুঝলো। আত্রেয়ী তীরে ব্রাহ্মণ কায়স্থাদি কুলীনের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়–এবং রাজপাদোপজীবীরাও বিলক্ষণ সেখানে উপস্থিত। তবে ভিক্ষু, শ্ৰমণ বা যোগীদের ব্যাপারে তাদের মারমুখী হতে কখনও দেখা যায় না। কে জানে, এ অঞ্চলে হয়তো এখনও প্রাচীনকালের বিধি–বিধানই অনুসরণ করা হয়ে থাকে। মাতামহের কাছে সে শুনেছিলো, এক সময় নাকি ভিক্ষুদের গ্রামে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিলো, কোনো গৃহস্থ–দ্বারে এলে তাদের দূর দূর করে তাড়না করা হতো।

সে জানায়, আজ্ঞে না, আপনার অনুমান ঠিক নয়। আত্রেয়ী তীরেও ব্রাহ্মণ কায়স্থ আছে এবং রাজপুরুষেরাও আছে। মনে হয়, ভিক্ষু নিগ্রহে তারা আর যথেষ্ট উৎসাহী নয়। হলে, আমি সে সংবাদ পেতাম।

মুহূর্তেক পর সে আবার বললো, এ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে আপনাদের এ অঞ্চলে ভিক্ষুর সংখ্যা মাত্রই পাঁচজন।

অহেতুক তোমরা ভিক্ষুদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে অস্থির হচ্ছো, মায়াবতীর পিতা শুকদেব বলেন, ভিক্ষুরা তো এদেশী, তোমরা কি পশ্চিম দেশাগত যবন জাতীয়দের কেউ দেখেছো?

ঐ কথায় সকলে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পথিক কি দেখেছেন? পথিক নিশ্চয়ই যবন জাতীয়দের কথা জানেন, উনি নিশ্চয়ই কিছু বলবেন–এই প্রকার গুঞ্জন উঠলো। শ্যামাঙ্গ শুনেছে যে পশ্চিম দেশ থেকে যবন জাতীয় অশ্ব ব্যবসায়ীরা মধ্যে মধ্যে এসে থাকে। কিন্তু সে কখনও তাদের দেখেনি। সে বললো, আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না, আমি তাদের দেখিনি।

তার কথায় সকলেই হতাশ হয়। তবে দীনদাস হলেন না। তিনি একটি যুবাপুরুষের দিকে ইঙ্গিত করলেন, গৌরদাস, তুমি তো যবনদের দেখেছো, তাই না?

আজ্ঞে হ্যাঁ, গোকুল হাটে তারা এসেছিলো। অধিকক্ষণ থাকেনি, অপরাহ্নে এসে সন্ধ্যা সমাগমে তারা আবার চলে গিয়েছিলো, বড় অদ্ভুত জাতি।

গোকুল হাট উজুবট থেকে তিন ক্রোশ দূরবর্তী। সাধারণত গো–মহিষাদি পশু ক্রয় বিক্রয়ের জন্য সেখানে বহু দূরাগত ক্রেতা–বিক্রেতার সমাগম হয়। সকলেই উৎকর্ণ হয়ে উঠলো গৌরদাসের অভিজ্ঞতার বিবরণ শোনার জন্য।

কিন্তু শোনা হলো না। তার পূর্বেই অন্তঃপুরের আহ্বান এসে গেলো। একটি বালক এসে জানালো, আহারের আসন দেওয়া হয়েছে, রাত্রি কম হয়নি, মাতামহী পথিককে নিয়ে অন্তঃপুরে যেতে বলেছেন।

সবাইকে উঠতে হলো। প্রতিবেশীরা বিদায় নিলো একে একে। শ্যামাঙ্গের মনে কিন্তু ভিক্ষুদের সংখ্যাবৃদ্ধির প্রশ্নটি তখনও রয়েই গেছে। কেন এরা ভিক্ষুদের সংখ্যাবৃদ্ধিতে এতো চিন্তিত? এই সংখ্যাবৃদ্ধির কি কোনো তাৎপর্য আছে? না হলে দীনদাস কেন ঐ প্রসঙ্গ তুললেন? আর যবন জাতি? এরাই বা কেন এদেশে আসছে? তার মনে একের পর এক প্রশ্নগুলি আসতে লাগলো।

আহারে মনোনিবেশ করতে পারলো না। অথচ আয়োজন ছিলো ভালো। মৎস্যের ব্যঞ্জনই তিন প্রকার, ভর্জিত ইল্লিশখণ্ড, সন্তলিত চিতলপেটিকা এবং নবাম্রসহযোগে মৌরলা। অলাবুসহ মুগও ছিলো সঙ্গে। দেখা গেলো, একটি মাত্র পাত্রে মাংস–ব্যঞ্জন। তবে তার প্রায়–রক্তিম তৈলাক্ত রূপ রসনাকে ব্যাকুল করার জন্য যথেষ্ট। এতদতিরিক্ত দধি খণ্ড–মিষ্টান্ন ইত্যাদি তো ছিলোই।

দ্বারান্তরাল থেকে গৃহিণী অবলোকন করছিলেন। তরুণ পথিকটিকে দর্শনমাত্রই তাঁর পুত্রশোক উদ্বেল হয়ে উঠেছে। গত বৎসর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রটি দস্যুহস্তে নিহত হয়েছে। তার সঙ্গে পথিকের মুখাবয়বে অদ্ভুত সাদৃশ্য। তিনি বস্ত্রাঞ্চলে নয়নজল মুছেছেন বার দুই। শ্যামাঙ্গকে অমনোযোগী দেখে মায়াবতীকে ইঙ্গিত করলেন। সে বলে উঠলো, ভ্রাতঃ কিছুই যে নিচ্ছেন না, গৃহের জন্য কি চিন্তা হচ্ছে?

ঐ কথার পর আহারে মনোযোগী হতে হলো। তবে প্রশ্নটি না তুলে পারলো না শ্যামাঙ্গ। দীনদাসের মুখপানে দৃষ্টি রেখে জানতে চাইলো, ভিক্ষুদের সংখ্যা বৃদ্ধির কি কোনো তাৎপর্য আছে বলে বোধ হয় আপনার?

দীনদাস তখন মুখ গহ্বরে মৎস্যপেটিকার তৈলাক্ত অংশটি নিয়ে ওষ্ঠদ্বয় সংবদ্ধ করে দক্ষিণ হস্তে কণ্টক গুচ্ছ টানতে ব্যস্ত। তিনি ঐ অবস্থাতেই মস্তক হেলন করলেন। তবে ঐ পর্যন্তই, তাকে আর বলতে হলো না। শুকদেব জানালেন, নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না–তবে বাল্যকাল থেকে শুনে আসছি, কাষায় বস্ত্রধারী মুণ্ডিতমস্তক ঐ ভিক্ষুরা নানাবিধ দুষ্কর্মের আকর। তারা এক সময় রাজদ্রোহী ছিলো, এ কারণে গৌড়াধিপতি ও তাঁর অনুচর রাজপুরুষেরা তাদের সমূলে উৎপাটিত করেন তাদের মন্দিরগুলিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এবং ঐ প্রজ্বলিত অগ্নিতে পুরোহিতদের নিক্ষেপ করা হয়। এতোকাল পরে যখন আবার তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটছে, তখন সেটি একেবারেই তাৎপর্যবিহীন হতে পারে, বলুন?

বৌদ্ধ প্রসঙ্গটি শ্যামাঙ্গেরও কিঞ্চিৎ জানা আছে। সে জানে, সমগ্ৰ গৌড়বঙ্গে বৌদ্ধ নিগ্রহের ঘটনাটি ঘটে, কিন্তু সে তো প্রায় শতাধিক বর্ষ পূর্বের কথা। দুর্বল, বিতাড়িত এবং প্রায় নিশ্চিহ্ন কাষায় বস্ত্রধারী ভিক্ষুদের এখন এমন কি শক্তি সঞ্চয় হয়েছে যে তারা মাণ্ডলিক ও সামন্ত মহাসামন্তদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে? সে বুঝে উঠতে পারে না।

দীনদাস, তুমি কি পশ্চিম দেশাগত যবনদের দেখোনি? হঠাৎ শুকদেব শ্যালককে প্রশ্ন করেন।

হ্যাঁ, দেখেছি, অত্যন্ত নিকট থেকে দেখেছি–সে বড় আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। আপনি দেখেছেন ধর্ম প্রচারকদের, কিন্তু আমি দেখেছি বণিকদের। আচ্ছা, আপনি কি ওদের উপাসনা করতে দেখেছেন? দীনদাস জানতে চান।

না তো? শুকদেব কৌতূহলী হলেন। বললেন, তুমি কোথায় দেখলে, বলোনি তো?

গোকুল হাটেই আমি দেখেছি–আমার সঙ্গে গৌরদাস ছিলো। বলতে বলতে দীনদাস দধি ভাণ্ডটি কাছে টেনে নিলেন। অতঃপর পুনরায় বলতে আরম্ভ করলেন, সে এক বিরল অভিজ্ঞতা, এবং অভিনব দৃশ্য। গোকুল হাটে ওরা সেদিন তিনটি অশ্ব নিয়ে আসে–অশ্বারোহণেই তারা এসেছিলো। তাদের অশ্বগুলি দেখবার মতো। আহা! যেমন তাদের উচ্চতা, তেমনি তাদের দেহসৌষ্ঠব, মুগ্ধ হয়ে যেতে হয় একেবারে।

বণিক দলটি ছিল ক্ষুদ্র, সংখ্যায় তারা মাত্রই চারিজন। দ্বিপ্রহরের পরে তারা হাটে উপনীত হয়। বলাই বাহুল্য, তাদের অশ্ব ক্রয় করার মতো লোক গোকুল হাটে ছিলো না। সম্ভবত ক্ষুধার্ত হয়ে উঠেছিলো তারা। তাই অপরাহ্নের শেষে তারা বিশ্রাম এবং আহারের আয়োজন করে। একজন প্রথমে একখানি বস্ত্র বিস্তৃত করে। তার মধ্যস্থলে রাখা হয় খাদ্যবস্তুগুলি, খণ্ড–মিষ্টান্ন এবং কদলী। অতঃপর একে একে তারা হস্তমুখ প্রক্ষালন সম্পন্ন করে। ঐ প্রক্ষালন ক্রিয়াও সম্ভবত তাদের উপাসনার অঙ্গ। কারণ হস্তমুখ প্রক্ষালনের সময় তারা মন্ত্রপাঠ করছিলো, নিঃশব্দে।

হঠাৎ মনে হয়, গৃহদ্বারে কেউ যেন এসে দাঁড়িয়েছে। সে উৎকর্ণ হলো। কটিবন্ধে হস্তস্পর্শ করলো, চোর দস্যু নয় তো?

কিন্তু ক্ষণকাল পরই তার মনে হলো কেউ যেন তাকে ডাকছে। শুনতে পেলো, ভ্রাতঃ আপনি কি নিদ্রাগত?

স্পষ্ট এবং পরিচিত নারী কণ্ঠস্বর। মায়াবতীর কথা স্মরণ হয়। এবং স্মরণ মাত্রই তার মনে এবং দেহে বিচিত্র একটি ভাবের জাগরণ ঘটে। ভাবে, তবে কি পুনর্ভবা তীরের রমণীরা সত্যিই শিথিলশাসনা? এবং স্বাধীন ভর্ত্তৃকা?

সে দ্বার অর্গলমোচন করে দাঁড়ায়–আর মুহূর্তের মধ্যে দুটি রমণীর ছায়ামূর্তি অন্ধকার কুটিরে প্রবেশ করে।

এ ঘটনায় উল্লসিত না হয়ে ঈষৎ শঙ্কিত হয় সে। এই দূর ভিন্ন দেশে অপরিচিতা নারী কি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে কে জানে। সে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালো। আর তাতেই যেন অস্ফুট অথচ ক্ষুব্ধ স্বর শোনা গেলো। একজন বলছে, চল এখন যাই, উনি হয়তো বিরক্তি বোধ করছেন।

তার কথার উত্তরে মৃদু ভৎর্সনা উচ্চারিত হয়। মায়াবতী বলে, আহ্ চুপ কর তো তুই–আমার ভ্রাতাকে যদি আমি কিছু বলতে চাই, তাতে তিনি বিরক্ত কেন হতে যাবেন–এতদূর এসে ফিরে যাবো?

দুই সখীর মধ্যে ঐ প্রকার বাদানুবাদ আরম্ভ হলে শ্যামাঙ্গ আশ্বস্ত বোধ করে। তার স্বরে কৌতুকস্পর্শ পাওয়া যায়। সে বললো, কি সংবাদ মায়াবতী, রাত্রির এই মাধ্যমে হঠাৎ কি প্রয়োজন?

মায়াবতী বারেক ইতস্তত বোধ করে। তারপর বলে, ভ্রাতঃ আমাদের কিছু কথা আছে, সেই কারণে আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি–অপরাধ নেবেন না–আপনি তো প্রভাতেই স্বগ্রামাভিমুখে যাত্রা করবেন–সময় হবে না বলেই রাতের এই মধ্যযামে আসতে হলো।

মায়াবতী ক্রমে সহজ হয়ে ওঠে এবং বলতে থাকে, আপনার যাত্রাপথেই আম্রপট্টলী গ্রাম পড়বে। আপনি যদি সেখানে দণ্ড পরিমাণ কাল অবস্থান করে ললিতদাসের পুত্র অভিমন্যু দাসের সংবাদ নেন তো বড় উপকার হয়। বৎসরাধিক কাল হয় সে স্ত্রীকে পিত্রালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে–কিন্তু তারপর আর কোনো সংবাদের আদান–প্রদান নেই। বলবেন, তার স্ত্রী লীলাবতী ভারি উদ্বিগ্না। সে যেন সত্বর একবার উজুবটে আসে।

শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝে নেয় এবং কৌতুক বোধ করে। বলে, এই প্রকার কাজে আমার দক্ষতা কিরূপ তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। তবে একটা কথা—

কি কথা? লীলাবতীর আগ্রহী স্বর শোনা যায়।

আপনি বলুন, যদি সুসংবাদ প্রেরণ করতে পারি, তাহলে আমার জন্য কী পুরস্কার আছে?

না, কৌতুক নয় ভ্রাতঃ, মায়াবতী জানায়। বলে, সখী লীলাবতী সত্যিই উদ্বিগ্না। তার পিতা দীর্ঘদিন রোগশয্যায় শায়ী।

মায়াবতীর স্বরে বিলক্ষণ আকুলতা ছিলো। শ্যামাঙ্গ সেটা উপলব্ধি করে বলে, আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, অভিমন্যু দাসের সন্ধান আমি অবশ্যই করবো।

ক্ষণেক পরে সে পুনরায় জানতে চাইলো, তার পূর্বে আমার জানা প্রয়োজন, অভিমন্যু দাস স্বগ্রামে অবস্থান করছেন কিনা। তিনি অন্য কোথাও চলে গেলে তাঁর সন্ধান করা কঠিন হবে।

না, সে সংবাদ এখানে আমরা পাইনি, মায়াবতী জানায়, অতঃপর বলে, তবু আপনি সন্ধান করে দেখবেন–যদি কোথাও গমন করে থাকেন, তাহলে সে সংবাদটিও তো আমাদের জানা প্রয়োজন।

অবশ্যই, শ্যামাঙ্গকে স্বীকার করতে হয়। বলে, আম্রপট্টলীতে নিজের প্রয়োজনেই আমাকে যেতে হবে, যদি অভিমন্যু দাসের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয় তাহলে তাকে আমি উজুবটে নিয়ে আসতে পারবো বলে আশা করি–কারণ আমার মাতুলালয় ঐ গ্রামেই।

ঐ আলাপের ক্ষণকাল পরই মায়াবতী এবং তার সখী চলে গেলো, যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো, তেমনি নিঃশব্দেই।

আরও কি অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটবে? শ্যামাঙ্গ নিজের কাছে প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ শয্যায় বসে রইলো। বাইরে কদলীপত্রে বায়ু তাড়নার শব্দ তখনও হয়ে চলেছে–এবং দীর্ঘক্ষণ অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যখন আর কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো না, তখন, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শ্যামাঙ্গ দাস শয্যায় শয়ান হলো। এবার সে নিদ্রা যাবে।

০৪. যোগমায়ার শোক আজ

যোগমায়ার শোক আজ পুনরায় জেগে উঠেছিলো। পথিকের মুখপানে একবার দৃষ্টিপাত করেই তার বক্ষে তুমুল আলোড়ন উপস্থিত হয়। মানুষে মানুষে কি এমনই সাদৃশ্য থাকে?

সেই থেকে যে কতোবার গোপনে অশ্রু মোচন করেছেন গণনা করা যাবে না। আজ চন্দ্রদাস জীবিত থাকলে কি সংসার তার এমন হতশ্রী হয়? একটি পুত্রবধূ গৃহে আনতেন তিনি। মনোহরদাসের কন্যাটির কথা স্মরণ হলে প্রাণ তার ব্যাকুল হয়ে ওঠে। হায় ভগবান, কি কুক্ষণেই না চন্দ্রদাসকে তিনি মেলায় যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। যাত্রার প্রাক্কালে বারে বারেই সে বলছিলো, মা, চিন্তার কোনো কারণ নেই। দুই পক্ষকাল এমন কিছু দীর্ঘ সময় নয়। আমি বস্ত্রগুলি বিক্রয় করে মাত্র কয়েকদিন অবস্থান করবো, লক্ষ্মণাবতী পর্যন্ত যদি যাই, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা, পক্ষকালের অধিক বিলম্ব হতে পারে।

কী মায়াময় কথা তার! বলেছিলো, মা তোমার বড় পরিশ্রম হয়–আমি ফিরে এলে তোমরা পুত্রবধূ ঘরে এনো। আহা! ঐ কথা কটি বলবার সময় ঈষৎ লজ্জা হয়েছিলো বাছার। তারপর বলেছিলো,–পিতাকে বলো, চৈত্রের পূর্বেই যেন গৃহ সংস্কারের কার্যাদি সম্পন্ন করে ফেলেন। আর শোনো, কৃষ্ণা গাভীটি বৃদ্ধা হয়ে পড়েছে, যদি সন্ধান পাওয়া যায়, তাহলে ভালো একটি দুগ্ধদা গাভী ক্রয় করো। পিতাকে বলো, তিনি যেন কায়স্থ পল্লীর লোকদের সঙ্গে বিবাদে না যান। পথিমধ্যে আমি মাতুলালয়ে যাবো, মাতুলকে বলবো, তিনি যেন এখানে এসে কিছুদিন অবস্থান করেন।

নানান প্রয়োজন অপ্রয়োজনের কথা বলছিলো সে। বড় দায়িত্ববান পুরুষ হয়ে উঠেছিলো বাছা–অথচ কি বা বয়স তার! তবু দেহটি হয়ে উঠেছিলো বলিষ্ঠ এবং মনটি মায়াময়। গৃহাঙ্গন ত্যাগের মুহূর্তে ভগিনীর অশ্রু ভারাক্রান্ত মুখ দেখে তার বেণীটি মুষ্টিবদ্ধ করে বলেছিলো, অরে বান্দরি, তুইও কাঁদছিস? এ যাত্রা আমার শ্মশান যাত্রা নাকি?

হায়, কে জানতো ঐ যাত্রাই তার শ্মশান যাত্রা হয়ে উঠবে!

প্রতিটি কথা তাঁর স্মরণ হচ্ছিলো। শয্যাগ্রহণের পরও তার চক্ষে ঘুম আসেনি। নীরবে অশ্রু মোচন করছিলেন। মায়াবতী পাশে নিদ্রামগ্না। হতভাগিনীর কথা ভেবেও তার দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো। দীর্ঘদিন জামাতা বসন্তদাস এখানে আসে না, কোথায় যে গেছে, কেউ জানে না। শুধু জানা গেছে যে, সে নাকি বাণিজ্যে গেছে। এ দিকে মায়াবতী যেমন চঞ্চলা, কী হয় বলা যায় না।

অকস্মাৎ তাঁর সম্বিৎ হলো যে শয্যায় মায়াবতী নেই। তাঁর মনে কোথায় যেন শঙ্কা দুলে ওঠে–এতো রাতে মায়াবতী শয্যায় নেই কেন? তিনি উঠলেন। কাউকে না ডেকে কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে বাইরে এলেন। অঙ্গন অতিক্রম করে বহির্বাটির দিকে শ্রবণ পাতলেন। এবং যা আশঙ্কা করছিলেন, অস্পষ্টভাবে, তা–ই ঘটেছে বলে তার সন্দেহ হলো। পথিককে দেখে মায়াবতীর চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেছিলেন তিনি। এখন বুঝলেন, কেন ঐরূপ চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো কন্যাটি। মায়াবতীর স্বামী সন্দর্শন মাত্র একবারই হয়েছে। আজ সপ্তম মাস অতিক্রান্ত হতে যাচ্ছে, কিন্তু বসন্তদাসের কোনো সন্ধান নেই। এদিকে পথিক যুবাপুরুষ, তায় সুন্দরকান্তি। না জানি কী আছে তার মনে। নিজের কন্যাটিকে তো চেনেন–এমন চঞ্চল স্বভাব কেন যে ওর হলো, ভেবে পান না। তার পিতাই অত্যধিক স্নেহ দিয়ে কন্যার মস্তকটি চর্বণ করেছেন। অবশেষে তিনি পুনরায় কান পাতলেন। শুনতে পেলেন সত্যিই বহির্বাটির কক্ষ থেকে মায়াবতীর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে।

ক্রোধ হলো তাঁর। মায়াবতী আর কিশোরী বালিকাটি নেই। কৈশোরে সে বড় জ্বালাতন করেছে। আহীর পল্লীর তরুণটিকে নিয়ে সে যা আরম্ভ করেছিলো তাতে কলঙ্ক রটতে বিলম্ব হতো না। সৌভাগ্য যে ভ্রাতা দীনদাস ঐ সময়ই বিবাহের সম্বন্ধটি এনেছিলেন। দূরের সম্বন্ধ, কিন্তু তখন আর বিলম্ব করতে সাহস হয়নি। সানন্দেই বিবাহে সম্মতি দান করেছেন।

আর জামাতাটিও যে কী, যোগমায়া বুঝতে পারেন না। নবীন যুবক–এই সময়ে তার স্ত্রী সান্নিধ্যের আকর্ষণটিই প্রধান হওয়া উচিত। কিন্তু দেখো, মূর্খ দেশে দেশে বাণিজ্য করে বেড়াচ্ছে। এদিকে বিবাহের পর মায়াবতীর চাঞ্চল্য আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, মুখরা হয়েছে আরও অধিক। কিছু বলেন না তিনি। কিন্তু তাই বলে এতো দূর! রাত্রির মধ্যযামে অপরিচিত যুবাপুরুষের কক্ষে প্রবেশ করবে!

যোগমায়া কন্যার আচরণে ক্রুদ্ধা যেমন হলেন, তেমনি আবার ব্যথিতও হলেন।

কিন্তু তৎক্ষণাৎ কিছু করতে গেলেন না। ত্বরিত কিছু করেন না তিনি–সে স্বভাবই তাঁর নয়। বরং অপেক্ষা করলেন। অনতিবিলম্বে লীলাবতীসহ কন্যাকে পথিকের কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হতে দেখলেন। লীলাবতীকে দেখে তাঁর স্বস্তির নিঃশ্বাস নির্গত হলো। যাক, মেয়ে তাহলে অঘটন কিছু ঘটায়নি।

তখনও কিন্তু মৃদুস্বরে উভয় সখীর মধ্যে বাদানুবাদ চলেছে। মায়াবতী বারবার বলছিলো, অন্যায় তো কিছু করিনি। একজনকে একটি সংবাদ নিতে বলার মধ্যে অন্যায়টা কোথায় হলো? মানুষের সংবাদ মানুষের নেওয়া কর্তব্য।

তুই যেভাবে দেখিস, অন্যে তো বিষয়টা সেভাবে না–ও দেখতে পারে। আমি স্বামী পরিত্যক্তা বলে যদি তাঁর করুণা হয়, তাহলে সেটা কি আমার জন্য লজ্জার বিষয় নয়? বল তুই?

রাখ তোর লজ্জা, ওটা শতবার ধৌত করে জলপান কর গিয়ে। যে লোকের সঙ্গে তোর জীবনে দ্বিতীয় বার সাক্ষাতের সম্ভাবনা নেই, তার কাছে আবার লজ্জা কি রে কুকুরি?

না সখী, এ তোর অন্যায় হয়েছে, লীলাবতী বুঝতে চায় না। বলে, আমাকে সঙ্গে নিয়ে ঐকথা তোর বলতে যাওয়া উচিত হয়নি।

ঐকথা না বলতে যাবো তো আর কোন কথা বলতে যাবো? মায়াবতী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বলে, অরে পামরি, তুই কি ভেবেছিলি আমি তোকে নিয়ে পথিকের সঙ্গে মিলনের জন্য অভিসারে যাবো? আর পথিকের সান্নিধ্যে গেলে প্রণয়লীলা অনুষ্ঠিত হবে?

না, তা নয়, লীলাবতীর স্বর তখনও আহত। বলে, সে কথা ভাবিনি, দূর দেশের পথিক, তার কতো অভিজ্ঞতা, কতো কাহিনী, ঐ সবই কিছু শুনবো বলে আশা করেছিলাম

এই পর্যন্ত উভয়ের কথা হয়েছে, ঐ সময় যোগমায়া ডাকলেন, মায়াবতী, এদিকে আয়।

দুজনই চমকিত হলো, কিঞ্চিৎ ভীতও। কিন্তু যোগমায়া কিছু বললেন না। শুধু আদেশ করলেন, লীলাবতী গৃহে যাও, রাত্রি গম্ভীর হয়েছে।

লীলাবতী চলে গেলে কন্যার কাছে জানতে চাইলেন, পথিক কি অভিমন্যু দাসের পরিচিত?

না, কিন্তু আম্রপট্টলীতে তাঁর মাতুলালয়।

যোগমায়া আরও কিছু বলতেন, কিন্তু কে জানে কেন, ঐ প্রসঙ্গে আর গেলেন না। শুধু বললেন, ঐ কথা বলবার জন্য পথিকের কক্ষে যাওয়া তোমার উচিত হয়নি। তোমার মাতুলকে বললেই পারতে, তিনিই বলতেন।

পরদিবস প্রত্যুষে শ্যামাঙ্গ প্রস্তুত, যাত্রা করবে। জলযোগ ইতোমধ্যে সমাপন হয়েছে। আহার্যাদি প্রস্তুত করেছেন মায়াবতীর মাতা অন্ধকার থাকতেই। গতরাতে সঙ্কোচবশ অতিথির সম্মুখবর্তী হননি, আজ হলেন। বললেন, বৎস, তোমার সমাদর হলো না, দুদিন থেকে গেলে পারতে।

ঐ কথা কটি শ্রবণমাত্র কী যেন ঘটে যায় শ্যামাঙ্গের মনে। মহিলার মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করলে অজানা এক চাঞ্চল্য অনুভব করে সে। কেমন মনে হয়, ঐ চক্ষু দুটি কোথায় যেন সে দেখেছে–ঐ কণ্ঠস্বরটিও তার চেনা, যেন বহুকাল পর সে ঐ স্বর। শুনতে পাচ্ছে। সে কিছু বলতে পারে না। মায়াবতী মায়ের পাশে ছিলো। সেও বললো, দুদিন থেকে গেলে কী এমন ক্ষতি হবে আপনার?

ঐ কথার পরও শ্যামাঙ্গের মুখে বাক্য নিঃসরণ হয় না। সে জানে, তার জানানো উচিত, গৃহে প্রত্যাবর্তন তার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়–নতুবা মাতৃস্নেহধারায় অভিষিক্ত হওয়ার এই অমূল্য সুযোগ সে ছাড়তো না, অল্প সময়ে সে যা পেয়েছে তা তার চিরদিন মনে থাকবে। এ পথে সে যতোবার আসবে, ততোবারই ও মাতৃপদে প্রণামের সুযোগ সে গ্রহণ করবে–এই সব বাক্য তার মনে আসছিলো। তবে এও আবার উপলব্ধি হচ্ছিলো যে ঐ প্রকার বাক্য শোনাবে নিতান্তই আনুষ্ঠানিক এবং কৃত্রিম। তাই সে নীরবে কালক্ষেপণ করে। কোন কথাটি যে বলবে, কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না।

একেবারে শেষ মুহূর্তটিতেও তার মুখে কথা আসে না। কেবলই মনে হয়, মায়ের কাছে সন্তানের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কি সাজে? সে আভূমি নত হয়ে যায় এবং যোগমায়ার পদধূলি গ্রহণ করে।

আর ঐ পবিত্র মুহূর্তটিতেই ঈষৎ কম্পিত মাতৃস্নেহের পুণ্য স্পর্শ অনুভব করে সে তার শিরোদেশে। উদ্গত অশ্রুরোধ চেষ্টায় কাতর মায়ের মুখভাবটি দেখবার মতো যথেষ্ট সাহসী সে হতে পারে না। তার কেবলি মনে হতে থাকে যে, আর যদি সে বিলম্ব করে তাহলে সে ভেঙে পড়বে এবং ঐ মাতৃপদকমল দুটি জড়িয়ে ধরে সমস্ত জীবনকালের মাতৃস্নেহের তৃষ্ণা সে মিটিয়ে নেবে। তাই সে অত্যন্ত দ্রুত, প্রায় সজোরে নিজেকে বিচ্ছিন্ন। করার মতই, গৃহদ্বার থেকে ছুটে পথে বেরিয়ে আসে এবং যথাসম্ভব দ্রুত পদচালনা করতে থাকে। না, বড় মায়া পশ্চাতে। পুনর্ভবা তীরের মাতৃময়ী নারীর স্নেহ স্পর্শ তাকে যেন উদ্বাহু হয়ে ডাকছে। বাল্যকালে সে মাকে হারিয়েছে, সেই অবিকল মাকে সে আবার দেখতে পাবে–এ যে কল্পনাও করা যায় না। অনেকখানি পথ অতিক্রম করার পর সে পশ্চাতে মুখ ফেরালো। এবং তখনও দেখতে পেলো, তারই গমন পথে দৃষ্টি প্রসারিত করে অনিমেষ নয়নে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে দুই নারী। একজন মাতা, অন্যজন ভগিনী। দুজনার স্নেহোদ্বেল চোখে মঙ্গল কামনার উদ্ভাস। শ্যামাঙ্গকে মুহূর্তেক দাঁড়াতে হলো– আর তাতে চিত্রটি তার অন্তরে চিরকালের জন্য মুদ্রিত হয়ে গেলো। দূরযাত্রায় নিষ্ক্রান্ত ভ্রাতা ও পুত্রকে এইভাবেই চিরকাল মাতা ও ভগিনীরা বিদায় জানিয়েছে। তার মনে পড়লো, ঠিক এই চিত্রটিই সে সোমপুর বিহারে প্রাচীর গাত্রের মৃঙ্কলকে উত্তীর্ণ দেখেছে। দ্বারদেশে দুই নারী দাঁড়িয়ে রয়েছে, দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ। সে তখন বোঝেনি, শিল্পী কোন বিষয় ঐ ফলকে উৎকীর্ণ করেছেন–এখন বুঝলো, মনে মনে সেই প্রাচীন শিল্পীকে সে প্রণাম জানালো।

গ্রাম এখনও কর্মচঞ্চল হয়ে ওঠেনি। সূর্যোদয়ের এখনও কিছু দেরি, বাতাসে ঈষৎ শৈত্যভাব। কোথাও কোথাও গবাদি পশু গোশালা থেকে নিষ্ক্রান্ত হচ্ছে পেছনে কিশোর রক্ষপাল।

পথের দুধারে আম্রবৃক্ষ, নবাম্রভারে কোনো কোনো শাখা আভূমি বিনত। পনসবৃক্ষের কাণ্ডগুলি ফলপিণ্ডে আকীর্ণ। কিছুদূর অগ্রসর হয়ে সে গ্রাম সংলগ্ন কাননে প্রবেশ করলো। মনে হলো, কুসুমিত মধুক বৃক্ষবীথির সুগন্ধ তাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। মধুপ গুঞ্জরণের ধ্বনিও শ্রবণে এলো। একটি কুক্কুরকে ভূমিনত মস্তকে ইতস্তত ভ্রমণ করতে দেখে সে অবাক হয়। কুক্কুরও কি মধুক পুষ্প ভক্ষণ করে? কিন্তু অচিরেই সন্দেহ নিরসন হয়। ওটি কুক্কুর নয়–নিতান্তই শৃগাল। সে ভূমি থেকে লোষ্ট্ৰখণ্ড হাতে নিয়ে শৃগাল লক্ষ্য করে নিক্ষেপ করে।

আর তখনই একটি হাসির শব্দ তাকে সচকিত করে দেয়। পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করতেই দেখে, লীলাবতী অঞ্চল মুখলগ্ন করে দাঁড়িয়ে আছে। সে বিব্রত বোধ করে–লোষ্ট্র নিক্ষেপের ঐ বালসুলভ কাণ্ডটি না করলেও পারতো। লীলাবতী নিশ্চয়ই তাকে বালকের মতো চপল–স্বভাব বলে ধারণা করছে। চোখে চোখ পড়লে তাকে হাসতে হলো। বললো, এতো প্রত্যুষে এখানে আপনি?

আমার মেষ শাবকটির সন্ধানে এসেছি, লীলাবতী জানায়। বলে, আর বলবেন না, এই মাতৃহীন শাবকটি বড় জ্বালাতন করে–তা আপনি কি যাত্রা করলেন?

হ্যাঁ, আজ বহুদিন আমি গৃহত্যাগী, গৃহে প্রয়োজনীয় কর্মাদি রয়েছে।

বিগত রাত্রির কথা স্মরণ হওয়ায় শ্যামাঙ্গ পুনরায় বলে, আপনি চিন্তা করবেন না, আমি আম্রপট্টলীতে নিশ্চয়ই যাবো।

তার ঐ কথায় কী ছিলো ঈশ্বর জানেন, লীলাবতীর হাস্যালোকিত আননে যেন ছায়া পড়ে একটি–কুঞ্চিত হতে দেখা গেলো তার ভ্রূযুগল। মুখের ঐ ভাব গোপন না করেই সে বললো, গত রাত্রির কথা স্মরণ রেখেছেন সে জন্য আমি কৃতজ্ঞ, কিন্তু একটা কথা জানবেন, গত রাতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহাতিশয্য ছিলো মায়াবতীর, আমার নয়, যা শুনেছেন, ঐসব কথাও আমার নয়।

আপনার নয়? শ্যামাঙ্গ হতচকিত বোধ করে–এ কী কথা শুনছে সে পুনর্ভবা তীরের। প্রোষিতভর্তৃকা এই যুবতীর মুখে?

আমাকে দেখলে কি মনে হয় আমি বিরহ কাতরা?

শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণনা করে, সত্যিই তো, প্রোষিতভর্তৃকা বিরহ কাতরা রমণীর বেশবাস ও আচরণ কি এই প্রকার হয় কখনও?

সে প্রশ্ন না করে পারে না। বলে, আপনার স্বামীকে কিছুই জানাবার নেই আপনার?

না, আমার নিজের কিছুই জানাবার নেই। লীলাবতী বলে, শুধু জানাবেন, আমার পিতা রুগ্ন হয়ে পড়েছেন, তিনি জামাতাকে একবার দেখতে চান।

শ্যামাঙ্গের প্রত্যয় হয় না। লীলাবতীর কথার অর্থ সম্যক বোঝা তার পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সে ভালো করে দেখে, সোমপুরের মঞ্জুশ্রী মন্দিরে দেখা পীবরস্তনী যক্ষিণী মূর্তিটি যেন সে দেখতে পাচ্ছে চোখের সম্মুখে। হ্যাঁ, ঐ প্রস্তর মূর্তিটির মতোই ঋজু শান্ত এবং কঠিন। সে মুখপানে চেয়ে বিভ্রান্ত বোধ করে। কিছু বলতে পারে না। যত্নে আঁকা, সীমান্তের ঐ উজ্জ্বল সিন্দুর রেখাটি তাহলে কেন? যদি সে স্বামীর জন্য উদ্বিগ্না না হবে?

লীলাবতী অপ্রতিভ হয় না। পথিকের ঐ প্রকার বিমূঢ় দৃষ্টি তাকে বিন্দুমাত্রও বিচলিত করে না। সে স্থির দৃষ্টিতে শ্যামাঙ্গের মুখপানে চেয়ে থাকে। শ্যামাঙ্গকে তখন বলতে হয়, আমি পথিক মাত্র, পারিবারিক জটিল বিষয়াদি আমার জানবার কথা নয়। কিন্তু তবু বলছি, কোনো বার্তা থাকলে আপনি অসংকোচে আমাকে বলতে পারেন, আমি যথাস্থানে তা পৌঁছে দেবো।

লীলাবতীর ভাবান্তর হয় না ঐ কথার পরও। তখন শ্যামাঙ্গ আবার বলে, আপনার সংকোচের কোনো কারণ নেই, এ আমার নিজের দায়–যে গ্রামে রাত্রিযাপন করেছি, অন্ন গ্রহণ করেছি, সেই গ্রামের লোকের সামান্যতম উপকারে আসতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করবো।

শ্যামাঙ্গের কথায় অকৃত্রিমতা ছিলো। আর সেই জন্যই সম্ভবত লীলাবতীর দৃঢ়সংবদ্ধ ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির রেখা খেলে গেলো। বললো, অহেতুক এতো কথা বলছেন, এই মূখা গ্রাম্য রমণী আপনার ভাষা কিছুই বুঝছে না, আপনি নির্দ্বিধায় যাত্রা করুন–প্রেরণ করার মতো সত্যিই আমার নিজের কোনো বার্তা নেই।

শ্যামাঙ্গকে সপ্রতিভ হতে হয়। বলে, আপনার রোষ দেখছি গভীর–বোঝা যাচ্ছে, হতভাগ্য অভিমন্যু দাসের জন্য ভবিষ্যতে মহাদুর্বিপাক অপেক্ষা করছে।

কেন, এমন কথা কেন বলছেন?

কুপিতা স্ত্রী ভয়ঙ্কর বস্তু, শ্যামাঙ্গ জানায়।

ও, তাহলে ঐ কারণেই আপনি গৃহে প্রত্যাগমনের জন্য অস্থির? লীলাবতীর স্বরে পুনরায় কৌতুক ধ্বনিত হয়।

আমি কোন ছার, দেবাদিদেব মহাদেব পর্যন্ত তটস্থ থাকেন।

শিব ঠাকুরের ঐ ভয় কিন্তু কপট ভয়, লীলাবতী স্মরণ করিয়ে দেয়।

কপট ভয়? শ্যামাঙ্গ বলে, সম্মার্জনী হস্তে দেবীর চামুণ্ডা মূর্তি কল্পনা করুন তো!

দেবীর মূর্তি যাই হোক, শিব তো জানেন, মানভঞ্জনের কলাকৌশল কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়। শিবের পথ অনুসরণ করুন–গৃহলক্ষ্মীর পদসেবা কেমন করে করতে হয়। জানেন তো?

না, তা তো অধমের জানা নেই, মুখে নির্বোধের ভাব আনে শ্যামাঙ্গ।

তাহলে তো দেখছি, আপনার ললাটে সম্মার্জনী প্রায় অবধারিত।

উপায় কি! শ্যামাঙ্গ কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, অনুশীলনীর জন্যও তো পদযুগল প্রয়োজন–তা কোথায় পাবো?

কেন, গৃহলক্ষ্মী কি গৃহে নেই আপনার? লীলাবতী বিস্ময় মানে।

যে লক্ষ্মী অধিষ্ঠিতাই হলেন না গৃহে, তাঁকে গৃহলক্ষ্মী কেমন করে বলি।

লীলাবতীর কৌতুক অন্তর্হিত হয়। সে ভেবে পায় না, এই সুপুরুষ কান্তিমান যুবক কেন এখনও অবিবাহিত। সে অধিকতর কৌতূহলী হলো। বললো, আত্রেয়ী তীরের গ্রামগুলিতে রমণী যথার্থই কি মহার্ঘ?।

শ্যামাঙ্গ দেখছিলো, সূর্যোদয় হয়েছে তার বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, এই বাক্য ব্যয় অহেতুক। প্রত্যুষের এই বিজন কানন পথে লীলাবতীর মতো যুবতী রমণী যতোই আকর্ষণীয়া হোক, চৈত্র দ্বিপ্রহরের মার্তণ্ড প্রতাপ তার চেয়েও অধিক সর্বগ্রাসী। সে বললো, ভদ্রে, অনুমতি করুন, যাত্রারম্ভ করি–বিলম্ব হলে পথে কষ্ট হবে, আমি আবার আসবো, তখন কথা হবে।

লীলাবতী গম্ভীর হয়। কিন্তু সরে যায় না। শুধু বলে, বিদায়কালে মিথ্যা ভাষণ করতে নেই।

মিথ্যা ভাষণ? শ্যামাঙ্গের এবার বিলক্ষণ উন্মা হয়। বলে, কোথায় দেখলেন যে আমি মিথ্যা ভাষণ করেছি?

মিথ্যা নয়? বলুন, কোন প্রয়োজনে আবার আপনি এ পথে আসবেন?

লীলাবতীর দুচোখে এবং কণ্ঠস্বরে বিচিত্র একটি ভাব তখন জেগে উঠেছে। দেখে শ্যামাঙ্গের মনে হলো, সম্মুখের এই যুবতী রমণী অহেতুক তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে নেই। যদি আরও বিলম্ব করে, তাহলে অন্য কিছু একটা ঘটে যাবে।

সে বললো, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করতে চান না, কিন্তু আমার কথা শুনে রাখুন, যাত্রাকালে আমি মিথ্যা ভাষণ করবো না। আমার গুরু বসুদেব বিল্বমূল গ্রামে রয়েছেন–তাঁর সঙ্গে আমার বাদানুবাদ হলেও তাঁর কাছে আমাকে যেতেই হবে আর দ্বিতীয় কথাটি এই যে, আমি বাল্যকাল থেকে মাতৃহীন, আপনাদের গ্রামে আমার মাকে খুঁজে পেয়েছি, কথাটা মায়াবতী জানে না, তার জননীও জানেন না। ওই মাতমুখ দর্শনের জন্য আপনাদের গ্রামে সত্যিই আমি আবার আসবো।

লীলাবতীর মুখের কুঞ্চিত ভ্রূ সরল হয়, ওষ্ঠের কোণে হাসির রেখাটি দেখা যায়। বলে, চপল স্বভাব বালিকার মতো অনেক কথা বলে ফেলেছি, মনে কিছু নেবেন না–তবে যদি কখনও এ পথে আসেন, তাহলে সেই ভবিষ্যতের জন্য উজুবট গ্রাম পূর্বাহেই আপনাকে স্বাগত জানিয়ে রাখলো, আপনি নিশ্চয়ই আসবেন।

লীলাবতী চলে গেলে, পথ অতিক্রম করতে করতে শ্যামাঙ্গের মনে নানান চিন্তার উদয় হয়। সমস্তই লীলাবতী প্রসঙ্গ। বারবার মনে হলো, ঐ যুবতী দুর্বোধ্য বিস্ময়ের প্রতিমূর্তি। বারবার তার ঐ শ্লোকটির কথা মনে হলো, যাতে বলা হয়েছে যে, দেবতারাও স্ত্রী চরিত্র বিষয়ে অজ্ঞ। তার অনুমান হলো সম্ভবত লীলাবতীর মতো নারীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো বলেই শ্লোককার শ্লোকটি রচনা করেছেন।

লীলাবতী গৃহে প্রত্যাগমনকালে নিজেকেই ধিক্কার দিচ্ছিলো। বলছিলো, ছি ছি দগ্ধমুখি, তোর লজ্জা হলো না, এতো কথা বলতে গেলি কেন? তুই না গতকালের ধারণা নিরসন করতে এসেছিলি? এ যে গতকালের চাইতেও অধিক হয়ে গেলোতোর যে অনেক কিছু জেনে গেলো লোকটা। ছি ছি

তার মেষ শাবকটিকে ঐ সময় সে দেখলো, দূরে একটি গোধুম ক্ষেত্রে বিচরণে ব্যস্ত। তার ইচ্ছে হলো না যে, শাবকটিকে গিয়ে ধরে। বরং তার মনে হলো, পিতা হয়তো এতোক্ষণে জেগে উঠে চিৎকার আরম্ভ করে দিয়েছেন। সে দ্রুতপদে গৃহাভিমুখী হলো। পথিমধ্যে হঠাৎ এক কোকিল চিৎকার করে উঠলে সে গালি দিলো, দগ্ধমুখ, তোর মরণ হয় না! মধুক বৃক্ষ তলে দেখলো, একটি প্রকাণ্ড প্রজাপতি উড়ে এসে তার উচ্চ করবীতে বসতে চাইছে–সে ছি ছি করে উঠলো পুনরায়–ধিক তোকে, আমার কাছে কেন, চক্ষুর মস্তকটি কি ভক্ষণ করে বসে আছিস? অন্ধ কোথাকার, যে লোকটি আত্রেয়ী তীরাভিমুখে চলেছে, তাকে দেখতে পাসনি?

গৃহে উপনীত হয়ে দেখে, পিতা সত্যিই জাগরিত হয়েছেন, তবে চিৎকার করছেন। সে অবাক হলো। কক্ষমধ্যে প্রবেশ করে দেখে, একটি লোক পিতার শয্যাপার্শ্বে বসে আছেন এবং পিতা তাকে নিজ দুর্দশার কথা বলে যাচ্ছেন।

সে বাধা দিলো না, এটা আজকাল অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অপরিচয়–পরিচয় নির্বিশেষে পিতা এই কাজটি আজকাল করেন।

আগন্তুক শ্মশ্রুধারী, প্রৌঢ়। তাঁর হাতের যষ্টিটি বঙ্কিম, সম্ভবত হেমতালের। গ্রীবায় প্রস্তরখণ্ডাবলীর মালা, পরিধেয় অত্যন্ত অপরিষ্কার, কাছে গেলে এক প্রকার দুর্গন্ধ ঘ্রাণে আসে। লীলাবতী ভাবছিলো, লোকটিকে বিদায় করে দেয়। কিন্তু হঠাৎ শুনলো, লোকটি ডাকছে, মা লীলা, এদিকে এসো।

নিকটে গেলে পিতা বললেন, ইনি তোমার মাতুল, যোগব্রত নিয়েছেন–সংসারে থাকেন না, এঁকে প্রণাম করো।

লীলা প্রণাম করলে বললেন, ভ্রাতঃ, একে স্বামীগৃহে পাঠিয়ে দাও–অনেক দিন তো রইলো তোমার কাছে। হরকান্ত পরমকুটুম্বের পরামর্শ শুনে কিছু বললেন না। লীলা গৃহকর্ম দেখবার জন্য বাইরে গেলো।

যোগী সিদ্ধপা এক সময় পুনরায় বললেন, ভ্রাতঃ, দিনকাল ভালো নয়–যুবতী মেয়েরা ক্রমেই অরক্ষণীয়া হয়ে পড়ছে–তোমার সৌভাগ্য যে রাজপুরুষদের দৃষ্টি তোমার কন্যাটির উপর পড়েনি।

আগন্তুক হরকান্তকে পূর্বদেশের, পশ্চিমদেশের, দক্ষিণদেশের নানান কথা জানালেন। যেমন পূর্বদেশে পুনরায় সদ্ধর্মীদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে–পশ্চিমে রাষ্ট্রবিপ্লব সমুপস্থিত, ভয়ানক যবন জাতি শনৈঃ শনৈঃ পূর্বে অগ্রসর হচ্ছে–কখন কী হয়, বলা যায় না। এমত শোনা যায় যে, এই যবন রাজ মূর্তিমান যম একেবারে। খর্বদেহ, কিন্তু বাহু দুটি যেন ভূমিস্পর্শ করে। শ্মশুকেশ উভয়ই ঘন, চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ–এবং যখন নিজ ভাষায় ইয়া। আলী বলে হুঙ্কার দেয়, তখন মানুষের হৃৎকম্প উপস্থিত হয়। হাতের অস্ত্র ত্যাগ করে সৈনিক পুরুষেরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করে।

যোগী সিদ্ধপা দক্ষিণদেশের কথা বিশেষ বলতে চাইলেন না। শুধু বললেন, ভ্রাতা হরকান্ত–তোমাকে কি বলবো–মাতা বসুমতী পাপের ভার দীর্ঘকাল বহন করতে পারেন না। যা অবশ্যম্ভাবী, তাই হবে। পরম ভট্টারক মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের মুষ্টির বাইরে চলে গেছে পরিস্থিতি–কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। তার পতন কেবল সময়ের প্রশ্ন।

হরকান্ত যোগী সিদ্ধপাকে দেখছিলেন। শুশ্রুমণ্ডিত মুখাবয়ব হলেও চক্ষু দুটি স্মরণ করতে পারেন। একদা ক্ষেত্রজীবী গৃহস্থ ছিলো এই যোগী পুরুষ। একমাত্র সন্তান পুত্রটিকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। পুত্রটি কায়স্থ পল্লীতে খেলতে যেতো–এবং ঐ সময়ই কায়স্থ পল্লীর বালকেরা তাকে বর্ষায় স্ফীত পুনর্ভবার প্রবল স্রোতে নিক্ষেপ করে।

ঐ ঘটনায় দীননাথ উন্মাদপ্রায় হয়ে যায়, স্ত্রী কমলা উন্মাদিনী হয়ে পুনর্ভবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে–নাহ, সেই ঘটনা স্মরণ করতেও প্রাণ শিহরিত হয়। হরকান্তের রুগ্ন দেহে সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি এতোকাল পর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলো। তার অস্থিরতা বৃদ্ধি পেলো। শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট আরম্ভ হলো।

সিদ্ধপা নিজ ভগিনীপতিটির অবস্থা লক্ষ্য করছিলেন। বড় অসহায় অবস্থা এখন হরকান্তের। যদি তার মতো মুক্ত পুরুষ হতে পারতো তাহলে বেঁচে যেতো। কিন্তু তার যে আবার একটি কন্যা রয়েছে। সংসার তাকে ছাড়ে না, সে বেচারার উপায় কি? যদি সমস্ত কিছু ত্যাগ করে একবার বেরিয়ে আসতে পারতো হরকান্ত, তাহলে আর রোগ শোকে সে এমন বিকল হতো না।

সিদ্ধপা এক দিবস অবস্থান করলেন হরকান্তের গৃহে। এখান থেকে তিনি প্রথমে দক্ষিণে তারপর পূর্বে যাবেন। হ্যাঁ, অবশ্যই তিনি আম্রপট্টলী গ্রামে যাবেন এবং জামাতার সন্ধান করবেন–তবে একটা কথা–সিদ্ধপা ভগিনীপতিকে পরামর্শ দেন, যদি সংবাদ পাওয়া যায় যে অভিমন্যু দাস স্বগ্রামেই অবস্থান করছে, তাহলে আর অপেক্ষায় না থেকে লীলাবতীকে সেখানে প্রেরণ করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত।

লীলা দ্বারান্তরাল থেকে মাতুলের উপদেশ শুনে মন্তব্য করলো,  মাতুল বললেই হলো, আসুক দেখি, কে আসছে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য?

তার সেই অপমান কেমন করে ভুলবে! কুসুম শয্যার রাত্রে লোকটা তার মুখ দুহাতের অঞ্জলিতে নিয়ে কেবলি বলছিলো, আমার বিশ্বাস হয় না–আমার বিশ্বাস হয় না।

অতি মৃদুস্বরে সে জানতে চেয়েছিলো, কি বিশ্বাস হয় না আপনার?

উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে মুখপানে চেয়েছিলো অভিমন্যু–আর বলেছিলো, বিবাহে বিশ্বাস হয় না, নারীতে বিশ্বাস হয় না, তোমাকে বিশ্বাস হয় না।

নববধূ স্বামীর মুখপানে চেয়ে ওষ্ঠদংশন করে মাত্র–অবগুণ্ঠন যেমন ছিলো তেমনি থেকে যায়। তার কিছুই করার থাকে না। ঐ লোকটি, যাকে সে মাত্রই এক দিবসকাল পূর্ব থেকে জেনেছে স্বামী বলে, সে তার মুখপানে কী দেখে ঈশ্বর জানেন। অভিমন্যু কি উন্মাদ? লীলাবতীর সন্দেহ হয়। বাইরে তখনও সম্পর্কিত আত্মীয়া রমণী ও বালিকারা কলহাস্যে মত্ত, আকাশে হেমন্তের জ্যোৎস্না। লীলাবতীর দুই চক্ষু অশ্রুময় হতে আরম্ভ করে। অভিমন্যু যখন তার কঞ্জুলিকার গ্রন্থিমোচন করতে যায় তখন সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকিত হয়ে বলে–না। যখন অভিমন্যু আলিঙ্গনের জন্য ব্যগ্র দুবাহু প্রসারিত করতে চায়, তখনও সে না বলে। এবং শেষে যখন নীবিবন্ধ স্পর্শ করে অভিমন্যু, তখন লীলাবতী চিৎকার করে ওঠে।

কেন, কেন? বিভ্রান্ত বিহ্বল দৃষ্টি এবং স্খলিত কণ্ঠস্বর অভিমন্যুর। সে তখনও জানতে চায়, তাহলে আমার অনুমান সত্য–বলো? প্রথমে সেই ব্রাহ্মণ কিশোরটি, তাই না? সেই উপবীতধারী তরুণ গৌরোজ্জ্বল ব্রাহ্মণ বালক তাই না? অতঃপর পিতার প্রভুপুত্রটি তাই না? নাকি প্রতিবেশী কেউ?

লীলার আর সন্দেহ থাকে না। বদ্ধ এক উন্মাদের হাতে তুলে দিয়েছেন তাকে তার পিতা। এর চেয়ে যে মরণ ছিলো ভালো। সে স্বামীর প্রলাপ শুনছিলো এবং প্রতি প্রশ্নের উত্তরে বলছিলো–হা, হ্যাঁ, হ্যাঁ। যতোবার প্রশ্ন ততোবার হ্যাঁ। অভিমন্যু দাস হা হতোস্মি, আমার ভাগ্যে এই ছিলো, বলে শয্যায় পতিত হয়। ঐভাবেই তার অতিক্রান্ত হয়ে যায় কুসুম শয্যার রাত্রিটি।

লীলা আবিষ্কার করেছে, পরে। অদ্ভুত এক জটিল মানসিক অবস্থা অভিমন্যু দাসের। তার একটি কিশোরী ভগিনী ছিলো। সেই ভগিনীটি ছিলো এক ব্রাহ্মণ কিশোরের খেলার সঙ্গীতাকে একদিন এক কায়স্থ যুবক অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে সে ফিরে আসে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনও করে। এক প্রৌঢ়ের তৃতীয়পক্ষের স্ত্রী হয়ে সে ভগিনীটি এখন তিন সন্তানের জননী।

কারও কোনো ক্ষতি হয়নি, শুধু অভিমন্যুর এই মানসিক জটিলতাটুকু ছাড়া।

তুমি গবাক্ষ পাশে কেন দাঁড়িয়েছিলে, বলল, কি দেখছিলে? পুষ্পবতীর স্বামী ভীমনাথকে? তোমার তাকে ভালো লাগে? তার সান্নিধ্যে যেতে চাও? সত্যি করে বলো, তুমি যা চাও, তাই হবে।

লীলাবতী দ্বার রুদ্ধ করে, গবাক্ষ রুদ্ধ করে, নিজেকে অন্ধকারে গোপন রাখে–তবু উন্মাদের সন্দেহ। একেকদিন শরীর নিরাভরণ করে কখনও স্তনে অঙ্গুলি নির্দেশ করতো, এটি কে প্রথম মর্দন করেছে বলো, সেই ব্রাহ্মণ কিশোর, নাকি কোনো কায়স্থ লম্পট, নাকি তোমার প্রতিবেশীদের কেউ? কখনও আবার উরুদেশে হাত রেখে জানতে চাইতো, লীলা, এখানে কেন নখরাঘাতের চিহ্ন নেই? সেই ব্রাহ্মণ কিশোর কি নখর রাখতো না?

অবশেষে লীলাবতী পিতৃগৃহে এলো। এবং সেই যে এলো তারপর বৎসরাধিককাল হতে চললো। অভিমন্যুর কোনো সংবাদ নেই।

লীলাবতী মাতুলের সব কথাই শুনেছে। রাষ্ট্রবিপ্লব সম্পর্কে তার ধারণা নেই, যুদ্ধ কাকে বলে তাও সে কল্পনা করতে পারে না। তবে আসন্ন কোনো বিপদের আশঙ্কা যে তার মাতুল করছে, সেটা সে বুঝতে পারে এবং সে জন্য তার যে স্বামীগৃহে অবস্থান করা উচিত, সেটা বুঝতেও তার অসুবিধা হয় না। কিন্তু এইখানেই তার বিদ্রোহ। প্রলয় যখন হবে তখন কে বাচবে, কে মরবে, তার কোনো স্থিরতা নেই। বাচবো বলে কৌশল অবলম্বন করলেই যে বাঁচা যাবে, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? সুতরাং ও চেষ্টা কেন? সে স্থির করে, পিতৃগৃহ ত্যাগ করে সে কোথাও যাবে না।

০৫. শ্যামাঙ্গ নবগ্রাম হাটে

শ্যামাঙ্গ নবগ্রাম হাটে যখন উপনীত হলো তখন চৈত্রের প্রখর পশ্চিমা বাতাস এবং রৌদ্রতাপ তাকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে। বেলা তখন দ্বিপ্রহর। হাটের মধ্যস্থলে প্রাচীন একটি বটবৃক্ষ এবং বৃক্ষতলে বিপণী। সে ছায়াতলে ক্ষণেক বসলো। অদূরে দীর্ঘিকা–কাকচক্ষু স্বচ্ছ জল তাকে স্নিগ্ধ আহ্বান করতে থাকলে সে তীরে নেমে যেতে বাধ্য হলো।

জল অতিশয় শীতল, হস্তমুখ প্রক্ষালন শেষে আকণ্ঠ জলপান করে সে বৃক্ষতলে আবার এসে বসলো। অবাক লাগছিলো তার, হাট এমন পরিত্যক্ত মনে হচ্ছে কেন? নাকি আজ হাটবার নয়? সে বামে দক্ষিণে দৃষ্টিপাত করে। জনসমাগম নেই, গো–মহিষের শকটাদি থাকার কথা–একখানি শকটও তার দৃষ্টিপথে আসে না।

ঐ সময় বৃক্ষতলের বিপণীকার, ব্যবসায়ের আশায়, নাকি নিতান্তই সৌজন্যবশে, বলা কঠিন, অতীব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কাছে এসে বসলো এবং জানতে চাইলো, মহাশয় কি দূরে যাবেন?

শ্যামাঙ্গ প্রীত বোধ করে বিপণীকারের ঐ স্নিগ্ধ সম্বোধনে। সে তার গন্তব্যের কথা জানায়। তারপর জানতে চায়, বিপণীতে আহার্য বস্তু কী আছে। শ্যামাঙ্গের ক্লান্ত মুখ দেখে বিপণীকার দ্রুত হস্তে একটি পদ্মপত্র এগিয়ে দিয়ে বলে, আপনি বসুন, আমি ফলাহারের ব্যবস্থা করছি।

ফলাহারটি সত্যিই উপাদেয়। সুগন্ধী এবং কোমল চিপিটক, প্রগাঢ় দধি, তৎসহ খণ্ড–মিষ্টান্ন এবং স্ফীতাঙ্গ, প্রায় বর্তুলাকার, হরিদ্রাভ কদলী। পরম পরিতোষের সঙ্গে আহার সমাপ্ত করে আচমন শেষে যখন বিপণীকারের কুশাসনটি বিস্তৃত করেছে, বাসনা, ক্ষণকালের জন্য লম্বমান হবে–ঐ সময়ই বিপণীকার বিশ্রম্ভালাপের জন্য কাছে এসে বসলো। হাতে করে নিয়ে এসেছে পর্ণ ও গুবাক।

শয়ন আর হলো না। শ্যামাঙ্গ উঠে বসলো। বুঝলো, লোকটি আলাপপ্রিয়। বিপণীকার জানতে চাইলো, নিশ্চয়ই অনেক দূর থেকে আসছেন?

হ্যাঁ, বিল্বমূল গ্রাম থেকে আসছি, বিল্বমূল গ্রাম কি এই স্থান থেকে অধিক দূর?

বিপণীকার হাসে, মহাশয়ের দূরত্ব জ্ঞান দেখছি প্রখর।

কেন? শ্যামাঙ্গ ঈষৎ বিব্রত বোধ করে।

বিল্বমূল কি এখানে? বিপণীকার জানায় এই নবগ্রাম হাটে বিল্বমূল গ্রামের বণিকেরা আসে–ওখানে নাকি একটি মন্দির নির্মিত হচ্ছে–ঐ বণিকেরাই বলে, শকট বাহনে গেলে বিল্বমূল এক দিন এক রাত্রির পথ।

আচ্ছা, হঠাৎ বিপণীকারের কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হয়। নিম্নস্বরে, প্রায় অস্ফুটে, বলে, আপনি পিপ্পলী হাটের সংবাদ কিছু জানেন? কিছু শুনেছেন?

না তো, শ্যামাঙ্গ মস্তক হেলন করে। বলে, না, তেমন কোনো সংবাদ আমার কাছে আসেনি। আমি কোনো সংবাদ জানি না–আপনি কিছু শুনেছেন?

না, আমিও কিছু শুনিনি, বিপণীকার জানায়, তবে আমার সন্দেহ হচ্ছে ওখানে কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। উঠুন, একটি দৃশ্য দেখাবো আপনাকে–এই বলে সে শ্যামাঙ্গের হাত ধরে তার বিপণীর পশ্চাতে নিয়ে গেলো এবং বটমূলের অন্তরাল থেকে দেখালো, ঐ দেখুন।

শ্যামাঙ্গ লক্ষ্য করে। দেখবার মতোই একখানি দৃশ্য বটে। অদূরেই অতিথিশালা এবং কূপ, কয়েকটি আম্রবৃক্ষও রয়েছে ইতস্তত। সমস্ত স্থানব্যাপী বিপুল সংখ্যক লোকের সমাগম–কেউ বসে, কেউ অর্ধ–শয়ান, কেউ, কৌতুক–ক্রীড়ায় রত। কয়েকজন শস্ত্রধারী পুরুষকে দেখে মনে হয় তারা প্রহরায় রয়েছে। প্রায় সকলের পরিধানেই বীরটিকা, হস্তে শূল, কটিদেশে কোষবদ্ধ তরবারি। অল্প কিছু দূরে নবীন একটি অশ্বত্থতলে আরও একটি দল। বোঝা যায় তারা ধানুকী। ধনুকগুলি বৃক্ষকাণ্ডে একত্রে রক্ষিত, ক্ষুদ্র শরাসন ও তৃণীরগুলি বৃক্ষ শাখায় লগ্ন অবস্থায় দুলছে।

দৃশ্যটি দেখে শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে, কোনো সামন্তপতি নিশ্চয়ই।

না, তবে মনে হয়, প্রকৃত রাজপাদোপজীবী কেউ–নতুবা এমন কেন হবে বলুন? ঐ যে, ধ্বজা আর পতাকা, দেখতে পাচ্ছেন?

কিন্তু এখন কোথাও যুদ্ধ হচ্ছে এমন তো শুনিনি, শ্যামাঙ্গ মন্তব্য করে। বলে, তবে কি দস্যু দমনের জন্য এই অভিযান?

হ্যাঁ, কী যে বলেন, বিপণীকারের কণ্ঠস্বরে বিদ্রূপ ধ্বনিত হয়। বলে, এরা করবে দস্যুদমন! কাক কি স্বজাতির মাংস ভক্ষণ করে? বলুন?

ক্ষণকাল পরে বিপণীকার নিম্নস্বরে জানায়, একজন বলছিলো এরা নাকি পিপ্পলী হাটে যাচ্ছে সেখানে নাকি চণ্ডালেরা দ্রোহ উত্থাপন করেছে। কথাটা আমার বিশ্বাস হয়নি, তাই আপনার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, আপনি কিছু জানেন কিনা। অবিশ্বাস্য মনে হয়েছে সংবাদটা, কেন জানেন? দ্রোহকারী নাকি পুরুষ নয়, চণ্ডালদের রমণীরা এ কাণ্ডটি ঘটিয়েছে–এ কি বিশ্বাস করা যায়? আপনিই বলুন?

শ্যামাঙ্গের মস্তিষ্কে উত্তেজনাকর সংবাদ প্রবেশ করতে চায় না। সে বুঝতে পারছে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কারণেই এখানে হাট বসেনি। সেই কারণেই গো–মহিষের শকটাদিও আসেনি। এখন সে কীভাবে স্বগ্রাম অভিমুখে যাত্রা করবে, সেটাই সমস্যা। সে বললো, হাটে কি কেউ আসেনি? দূরের বণিকেরা?

বিপণীকার হাসে, মহাশয় অবোধের মতো প্রশ্ন করছেন। এরা গতকাল কয়েকটি শকটের দ্রব্যসামগ্রী লুণ্ঠন করেছে–তারপর আর কে আসবে হাটে, বলুন? সবাই প্রাণ নিয়ে পলায়ন করেছে। আপনাকে পদব্রজেই যেতে হবে–তবে বিল্বমূলেই প্রত্যাগমন করা বোধ হয় আপনার জন্য মঙ্গল। শোনা যাচ্ছে, এদের পশ্চাতে আরও একটি বাহিনী আসছে, পথিমধ্যে আপনি তাদেরও সাক্ষাৎ পেয়ে যেতে পারেন। এরা তো মানুষ নয়, কখন কি করে কিছুই স্থির নয়।

বিপণীকারের ভ্রূতে কুঞ্চনরেখা। সেখানে কখনও বিরক্তি প্রতিফলিত হচ্ছে, কখনও ঘৃণা। বললো, এদের আসবপানের আগ্রহ দেখলে অবাক হয়ে যাবেন। মনে হবে না যে এরা জলপান করতে জানে। ডোমপল্লীর কাছাকাছি প্রয়োজনেও কেউ যেতে পারছে না। বৃদ্ধ, যুবক এবং শিশুরা নিকটস্থ বনে আশ্রয় নিয়েছে। ঐ অতিথিশালার নিকটে গেলে আর চক্ষু মেলে রাখতে পারবেন না। শূকরপুত্রদের ঐ সমস্ত আচরণ চক্ষু মেলে দেখা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। দলপতিটি সর্বক্ষণ রক্তনেত্র। গতকাল থেকে দুটি যুবতী ডোমনী নির্বস্ত্র হয়ে তার অঙ্গ সংবাহন করে চলেছে–আর গবাক্ষ পথে সাধারণ সৈন্যরা ঐ দৃশ্য উল্লাস ভরে চেয়ে চেয়ে দেখছে, একেবারেই নরকের কীট!

বিপণীকার উত্তেজিত হয়ে উঠলো বর্ণনা করতে করতে। ক্ষুব্ধস্বরে এক সময় বললো, এই পাপাচার কি সহ্য করা যায়, বলুন? আপনি কি কদাচ শুনেছেন যে রাজপুরুষেরা এইরূপ কদাচারে নিমজ্জিত থাকে?

শ্যামাঙ্গ উত্তেজিত হয় না। শুধু সে কেন, অনেকেই শুনেছে, রাজপুরুষদের বিলাসী আচরণের নানান কাহিনী। রাজপুরুষ কিংবা তাদের অনুচরদের এইরূপই তো এখন আচরণ। তার মনে পড়ে, লক্ষ্মণাবতীর এক শিল্পী রাজপুরুষদের বহু প্রকার কাহিনী বর্ণনা করেছিলো। সামন্ত ও মহাসামন্তেরা নাকি রাজকার্য ব্যপদেশে রাজধানীতে গমন করলে নগর নটিনীর গৃহে অষ্টপ্রহর যাপন করে এবং কদাচ জলপান করে না।

শ্যামাঙ্গের ঐ সময় বৎস রাজা উদয়নের কাহিনীটি স্মরণ হয়। রমণী সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে বলে প্রজাদের রাজদর্শনের সুযোগটুকু পর্যন্ত তিনি দিতেন না। গবাক্ষপথে একটি পদাঙ্গুলি শুধু উত্তোলন করতেন আর তাই দর্শন করে প্রজাদের তুষ্ট থাকতে হতো। শ্যামাঙ্গ বিপণীকারের কাছে কাহিনীটি বললো না। শুধু ক্ষুদ্র মন্তব্য করলো, পিপ্পলী গ্রামের অধিবাসীদের দেখছি ঘোর বিপদ সমাসন্ন। ক্ষণকাল পর সে আবার বললো, আপনারাও যে নিরাপদ, এমন কথা কিন্তু চিন্তা করবেন না।

মহাশয় কি আমাকে নির্বোধ ভাবছেন? বিপণীকার বললো, আমি দুইবার এ স্থান ত্যাগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু শূকরপুত্ররা দুইবারই পথরোধ করে দাঁড়িয়েছে। আমাকে দেখলেই বলে, তোমার ভয় নেই, তুমি নির্ভয়ে থাকো। কিন্তু আমি জানি, ডোমপল্লীর রমণী এবং মধুকাসবের আকর্ষণ কিঞ্চিৎ শিথিল হলেই তারা গৃহস্থ পল্লীতে প্রবেশ করবে এবং তখনই হবে আমার বিপদ।

শ্যামাঙ্গ নিজেও বুঝছিলো যথাশীঘ্র তার নবগ্রাম ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু কোন পথে যাবে তাই সে স্থির করতে পারছিলো না। বললো, আমি কোন পথে যাবো, বলতে পারেন?

এই পর্যন্ত বলতে পারলো সে। ঠিক ঐ সময় দুজন সৈনিক পুরুষ নিকটে এসে দাঁড়ালো।

একজন কৃষ্ণবর্ণ, খর্ব কিন্তু স্ফীতকায়। অন্যজন গৌর, দীর্ঘ এবং কিঞ্চিৎ বয়স্ক।

ওহে, একজন বিপণীকারকে সম্বোধন করে বলে, লোকটিকে নতুন দেখছি যেন?

বিপণীকার শঙ্কিত দৃষ্টিতে বারেক শ্যামাঙ্গের দিকে তাকায়। তারপর বলে, মহাশয়, প্রভু, ইনি পথিক, আত্রেয়ী তীরের অধিবাসী।

দীর্ঘদেহ সৈনিক পুরুষ শ্যামাঙ্গের দিকে রোষকষায়িত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, কি হে, কি পরিচয় তোমার?

মহাশয়, শ্যামাঙ্গ সবিনয়ে জানায়, অধমের নাম শ্যামাঙ্গ, হেমাঙ্গদাস আমার পিতা, আমরা মৃৎশিল্পী, আত্রেয়ী তীরের রজতপীঠ গ্রামে আমার নিবাস।

অ, তুমি তাহলে কুম্ভকার পুত্র, বেশ ভালো কথা–খর্বকায় সৈনিক পুরুষটির কৌতুক প্রকাশ পায়। বলে, তা কুম্ভকার পুত্রের হঠাৎ পরদেশ গমন কেন?

শ্যামাঙ্গকে তখন কারণ ব্যাখ্যা করতে হয়। তার কথা শুনে দুজনের মুখেই অবিশ্বাসের হাসি দেখা যায়। একজন কপট কৌতুকে বলে উঠে, ভালো ভালো–অতি চমৎকার তোমার উদ্ভাবন, বসুদেব তাহলে মূর্তি নির্মাণ পরিত্যাগ করে কুম্ভকার বৃত্তি অবলম্বন করেছেন। অতি উত্তম কল্পনা তোমার। এখন সুবোধ বালকের মতো চলো। দেখি, আমরা তোমার প্রকৃত পরিচয়টি উদ্ধার করতে পারি কি না।

এ প্রায় অবিশ্বাস্য কাণ্ড। শ্যামাঙ্গ হতচকিত হয়ে যায়। সে কি চোর না দস্যু? এভাবে বন্দী করবে? সে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করে। বলে, মহাশয়রা বিশ্বাস করুন, মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আমার কোনো লাভ নেই।

হ্যাঁ, বৎস, আমরা বালক নই–সবই বুঝতে পারি। শুধু বুঝতে পারি না, কিছু কিছু কাজও করতে পারি–পিতৃনাম বিস্মরণ মানুষের কি প্রকারে হয় জানো?

বিদ্রূপটি স্থূল এবং অপমানজনক। কিন্তু শ্যামাঙ্গ উত্তেজিত হয় না, নিজ মস্তিষ্ক শান্ত রাখে। সে বুঝতে পারছিলো, এ সব সাধারণ সৈনিকের কাছে ক্রোধ প্রকাশ করা প্রকাণ্ড মূর্খতা। সে ভাবছিলো, বরং দলপতির কাছে নিয়ে যাক আমাকে, উধ্বর্তন রাজপুরুষেরা নিশ্চয়ই আমার কথা বুঝবেন। সে জানতে চাইলো, মহাশয়রা কি আমাকে বন্দীশালায় নিয়ে যাচ্ছেন?

না বৎস, একজন হাসলো। বললো, শ্বশুরালয়ে নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে। কথাটি বলে দারুণ হাসিতে ফেটে পড়লো দুজনে।

কিন্তু অবাক কাণ্ড এই যে, তারা অতিথিশালার দিকে, যেখানে সৈন্যদলটি বিশ্রামরত ছিলো, সেদিকে নিয়ে গেলো না। হাটের আরেক প্রান্তে একটি বটবৃক্ষের অন্তরালে দাঁড়ালো। তারপর অকস্মাৎ রোষকষায়িত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রুদ্ধস্বরে বললো, অরে সদ্ধর্মী কীট, তোর গুপ্তচর বৃত্তির কি পরিণতি হয় এখনই দেখতে পাবি। এখনও সময় আছে, বল, কি হেতু তোর এই হাটে আগমন? পিপ্পলী হাটে তোরাই কি মহাসামন্ত হরিসেনের পরিজনদের উপর আক্রমণ করিসনি? তোরাই কি মূল দ্রোহকারী নোস?

শ্যামাঙ্গ এবার অনুমান করতে পারে যে পিপ্পলী হাটে কোনো গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সৈনিক পুরুষ দুটির অভিযোগের উত্তরে কী বলবে, সে ভেবে উঠতে পারে না। অসহায়ভাবে একবার বামে একবার দক্ষিণে তাকায়। এবং ঐ তাকাবার সময় দূর থেকে বিপণীকারকে দেখতে পায়। দেখে, বিপণীকার বারবার নিজ কটিদেশ স্পর্শ করে একটি মুদ্রা দেখিয়ে ইঙ্গিত করছে। সে বুঝে নিলো, কিছু উৎকোচ দিলে হয়তো সে। নিষ্কৃতি পেতে পারে। চকিতে তার মস্তিষ্কে নতুন বুদ্ধি খেললো। খুবই কাতর স্বরে সে জানালো, মহাশয়রা, বিশ্বাস করুন, আমি বৌদ্ধ নই, আমার চতুর্দশ পুরুষ কেউ সদ্ধর্মী ছিলো না। আমার প্রকৃত পরিচয় আপনাদের কাছে বলছি–কিছুই গোপন করবো না। তার আগে অনুমতি দিন, ঐ বিপণীকারের কাছে আমার কিছু অর্থ গচ্ছিত আছে, সে অর্থ। নিয়ে আসি।

ঐ কথায় কাজ হয়। দুজনেই উৎসাহী হয়ে ওঠে। একজন বলে, নিজ অর্থ অন্যের কাছে কেউ রাখে? তুই দেখছি, একটি উৎকৃষ্ট গর্দভ। যা, তোর কি গচ্ছিত আছে, নিয়ে আয়।

শ্যামাঙ্গ দ্রুত বিপণীর অভ্যন্তরে ছুটে গেলো। এবং অন্তরালে অবস্থান করে ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই নিজ কটিবদ্ধ স্থলী থেকে অর্ধাংশ ভূমিতে রেখে অন্য অর্ধাংশ স্থলীসুদ্ধ হাতে নিয়ে সৈনিক পুরুষদের কাছে এসে দাঁড়ালো। বললো, এবার চলুন মহাশয়রা।

কয়েকপদ অগ্রসর হতে না হতেই একজন জানতে চাইলো, তোমার স্থলীতে কি পরিমাণ অর্থ হে?

অতীব সামান্য মহাশয়।

কত?

তা দুই কুড়ি মুদ্রা হতে পারে।

শ্যামাঙ্গের উত্তরে কিছু বুঝলো কিনা বোঝা গেলো না। তবে কয়েকপদ অগ্রসর। হয়েই তারা আবার দাঁড়ালো। একজন এবার বললো, তোমার কিন্তু প্রাণসংশয় হতে পারে, আমাদের প্রভুর ক্রোধ চণ্ডালের মতো।

শ্যামাঙ্গ এবার আরও বিনয় প্রদর্শন করে। বলে, মহাশয় আমি আপনাদের দাস বই অন্য কিছু নই–আপনারা রাজপাদোপজীবী–আপনাদের অসীম ক্ষমতার বলে আমার মতো দীনহীন দাসের জীবন রক্ষা পাবে। আপনারা দয়া করুন, প্রভু!

তাহলে আমরা যে প্রভু তা তোরা স্বীকার করিস?

হ্যাঁ মহাশয়। শুধু আমি কেন, আমার চতুর্দশ পুরুষ স্বীকার করে।

প্রমাণ? প্রমাণ দেখাও

প্রভু এই যে আমি মস্তক নত করে বলছি, এই কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?

না, দক্ষিণা কোথায়? জানিস না, প্রভুকে প্রণামের সঙ্গে দক্ষিণা দিতে হয়?

স্পষ্ট কথা। শ্যামাঙ্গ ঐ কথার পর ভূমিতে উপবেশন করে। তারপর স্থলীর মুদ্রাগুলি ভূমিতে রেখে দুই ভাগ করে। শেষে এক ভাগ একজনের হস্তে তুলে দিয়ে বলে, মহাশয়, আমার যা ছিলো, তার অধিকাংশই আমি দক্ষিণা স্বরূপ দিচ্ছি, আপনারা দয়া করে গ্রহণ করুন।

আর ঐ অর্ধাংশ? খর্বকায় সৈনিক পুরুষের কণ্ঠস্বরে নিদারুণ অসন্তোষ।

মহাশয়, শ্যামাঙ্গ মিনতি জানায়, এ সামান্য অর্থের বড়ই প্রয়োজন, আমার গৃহে পুত্রকন্যা রয়েছে।

আর মূর্খ, একজন প্রবল উম্মাভরে বলে, স্বয়ং জীবিত থাকলে তবে না পিতৃনাম! অন্য সৈনিকটির রসবোধ প্রচুর। সে বলে, জালিকের গল্পটি জানা আছে তোর?

শ্যামাঙ্গ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকালে সৈনিকটি বলে, তবে শোন–একদা এক জালিক মৎস্য শিকারে নির্গত হয়ে রাত্রির প্রথম যামেই গৃহে প্রত্যাবর্তন করে। এদিকে তার প্রত্যাবর্তনের কথা পরদিবস দ্বিপ্রহরে। জালিক পত্নী কারণ জিজ্ঞাসা করলে সে জানায় যে অন্যের জলাশয়ে মৎস্য শিকার করার অপরাধে তাকে অর্থদণ্ড দিয়ে চলে আসতে হয়েছে। এ দুঃসংবাদ শুনে জালিক গৃহিণী অতিশয় কুপিতা হয়ে বলে, অর্থ দিয়েছে। ভালো–কিন্তু দণ্ডটি দিতে গেলে কেন?

গল্পটি অতিশয় অশ্লীল। শ্যামাঙ্গ বুঝেও না বোঝার ভান করলে সৈনিক পুরুষটি আবার। ব্যাখ্যা করে বলে, গৃহিণীকে এই জালিকের গল্পটি বুঝিয়ে বলিস এবং জানাস যে অর্থ গিয়েছে, কিন্তু দণ্ডটি তোর অক্ষতই আছে, তাহলেই দেখবি গৃহিণীর আর কোনো ক্ষোভ নেই।

ঐ কথার পর সৈনিক পুরুষ দুজন শ্যামাঙ্গের হাতের স্থলীটি নিয়ে চলে গেলো। আর তৎক্ষণাৎ শ্যামাঙ্গ বিপণীকারের নিকট প্রত্যাগত হয়ে সেখানে রেখে যাওয়া মুদ্রা কটি নিয়ে অতিদ্রুত নবগ্রাম হাট ত্যাগ করলো। তার তখন আর দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই। যে পথে এসেছিলো সেই পথেই সে ফিরে চললো। সে জানে না, গৃহে প্রত্যাগমন তার আশু সম্ভব হবে কি না।

পুনর্ভবা, আত্রেয়ী, করতোয়ার উভয় তীরের বিস্তীর্ণ ভূ–ভাগের জনপদগুলির তখন প্রায় এরূপই অবস্থা। গৌড়বঙ্গের রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে মহামহিম পরম ভট্টারক শ্রী লক্ষ্মণ সেন দেব সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। রাজসভায় উমাপতি, ধোয়ী এবং জয়দেবের কাব্যগীতির সুললিত মূৰ্ছনায় সভাস্থল বিমুগ্ধ। জয়দেবের কৃষ্ণলীলার বর্ণনা শ্রবণে সভাসদবর্গ তুরীয়ানন্দে বিহ্বল, ধোয়ীর পবনদূতের বর্ণনায় কামকলানিপুণা রমণীকুলের উল্লেখে স্রোতৃবর্গ অহো অহো উল্লসিত স্বর উচ্চারণ করে উঠছেন। স্মার্ত পণ্ডিতের ভাগবত বিশ্লেষণে মুহুর্মুহু। প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সাধু সাধু রব। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সন্দেহ করা হচ্ছে, যবন কেন্দ্রগুলিতে। কেন তাদের যাতায়াত, গূঢ় পুরুষেরা বিচিত্র সংবাদ আনছে। তথাপি প্রজাকুল সুখী। ব্রাহ্মণ সুখী, কায়স্থ সুখী, বৈশ্য সুখী। কেবল ব্রাত্য শূদ্রদের গৃহে অন্ন নেই, দেহে বস্ত্র নেই, মস্তকোপরি গৃহের আচ্ছাদন থাকে না। আজ যদি গ্রামপতি বসবাসের স্থান দিলেন, তো কালই বললেন, দূর হ, দূর হ, পামরের দল।

তা সকলের সুখ সম্পাদন কি মানুষের পক্ষে সম্ভব? ভগবান যাকে শূদ্র জন্ম দিয়েছেন পূর্ব জন্মের পাপের নিমিত্ত, সেখানে মানুষ কী করতে পারে? ভবিতব্য খণ্ডাবে মানুষের কি এতোই সাধ্য?

০৬. উজুবট গ্রামে ঐ সময়ে

উজুবট গ্রামে ঐ সময়ে একদা মায়াবতীর স্বামী বসন্তদাসের আগমন ঘটলো। শোনা যায়, সে পূর্বদেশ অঞ্চলে বাণিজ্য যাত্রায় গিয়েছিলো। তবে নিজ গ্রামে প্রত্যাবর্তন না করে, কেন শ্বশুরালয়ে তার আগমন ঘটলো সেই রহস্য উদ্ধার করা গেলো না। বিশেষত দীনদাস ঘটনাটি সহজভাবে মানতে পারলেন না।

মায়াবতী অতিশয় উফুল্লা, যোগমায়াও জামাতার শ্রীমুখদর্শনে তুষ্টা। শুকদেব জামাতাকে আপ্যায়নের জন্য এতো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন যে তাঁর মনে ভিন্ন প্রশ্নের উদয় আর হলো না। কিন্তু দীনদাসের মনে চিন্তাটি থেকেই গেলো। তিনি স্বল্প বিচলিতও বোধ করলেন, যখন একদা দেখলেন যে, চারজন সদ্ধর্মী ভিক্ষু জামাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গেলো। ভিক্ষুরা অবশ্য বিলম্ব করেনি, সামান্য কিছুক্ষণ অবস্থান করেই বিদায় নিয়েছে। কিন্তু তবু দীনদাস উদ্বিগ্ন রইলেন।

একাকী শুধু দীনদাস নয়। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ আরও দুএকজন হিতাকাক্ষী ব্যক্তি ভিক্ষুদের সংবাদ নিতে আসেন। কেউ কেউ অনুসন্ধান পর্যন্ত করে যান, সত্যি সত্যি। ভিক্ষুরা বিদায় নিয়েছে কিনা। ইতোমধ্যে শোনা যায়, দূরস্থিত জনপদগুলিতে পর্যন্ত মানুষকে নাকি সন্ত্রস্ত এবং আতঙ্কিত দিনযাপন করতে হচ্ছে। এখন সদ্ধর্মী ভিক্ষু দেখলেই মানুষ প্রমাদ গণনা করে।

ঘটনাটি এইরূপ:

সামন্ত হরিসেন তাঁর অঞ্চলের হাটগুলিতে কর ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তাঁর উদ্দেশ্য মহত্ত্ব ছিলো–একটি মন্দির নির্মাণের বাসনা তার। প্রথমতঃ বৃহৎ বণিকদের উপরই এই কর আরোপিত হয়। কিন্তু সামন্ত প্রভুর দাস এবং কৃপাভোগীদের উৎসাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমে এমন অবস্থার সৃষ্টি হলো যে ক্ষুদ্র বণিকদেরও আর নিষ্কৃতি রইলো না। তারা ক্ষুদ্রবিত্ত বণিকদের নিকট থেকেও কর গ্রহণ করতে লাগলো। কর অনাদায়ে সমূল পণ্য আত্মসাৎ, অহেতুক শাস্তি প্রদান, সামান্য কারণে লাঞ্ছনা গঞ্জনা–এই সকল ঘটতে আরম্ভ করলো। ফলে ক্রেতা–বিক্রেতা উভয় পক্ষেই সৃষ্টি হলো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার।

ঐ সময়ই অকস্মাৎ ঘটনাটি ঘটে।

ঘটনা সামান্য, কিন্তু ঐ সামান্য ঘটনাই একটি প্রচণ্ড, নিষ্ঠুর এবং ব্যাপক বিপর্যয় ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। সমিধ প্রস্তুত থাকলে ক্ষুদ্র একটি স্ফুলিঙ্গই যে দাবানল সৃষ্টি করতে পারে, এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে?

হাটের একপ্রান্তে কর্মকারদের বিপণী। কর্মশালার অদূরে ডোম ও চণ্ডাল শ্রেণীর রমণীরা তাদের হস্তনির্মিত পণ্যাদি–যেমন চাঙাড়ি, খুচি ডুলা, টুকরি এইসব বিক্রয় করে। কয়েকটি ডোমনী যুবতী পিপ্পলী হাট অঞ্চলে বিশেষ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিলো। এতে উগ্র–ক্ষত্রিয় হরিসেনের প্রধান অনুচর বজ্রসেনের ডোমনীদের উপর বিশেষ ক্রোধ ছিলো। ঐ দিন বজ্ৰসেন তার সহচরদ্বয় সমভিব্যহারে হাটে সদম্ভে বিচরণ করছিলো। ঐ প্রকার বিচরণকালে হঠাৎ তারা লক্ষ্য করে যে দুজন সদ্ধর্মী ভিক্ষু ডোম যুবতীদের সঙ্গে হাস্যালাপে রত। দুটি যুবতী, বিশেষ করে কলহাস্যে এমনই বেপথু হচ্ছিলো যে তাদের উর্ধাঙ্গের বসন বারবার বিস্রস্ত হয়ে পড়ছিলো। সে দৃশ্যে বজ্রসেন কি দেখেছিলো ঈশ্বর জানেন, সে হুঙ্কার দিয়ে অগ্রসর হয় এবং ডোমনীদের কাছে গিয়ে তাদের পণ্যের মূল্য জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু ডোমনীদের তখনও উল্লাসঘোর কাটেনি, অঙ্গে হাস্য তখনও তরঙ্গায়িত হচ্ছে এবং কোনোদিকেই তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। সম্ভবত বজ্রসেনের কথা তারা শুনতেও পায়নি। ঐ সময় ক্ষুব্ধ বজ্রসেন চিৎকার করে বলে ওঠে, ওরে পামরি, হট্টকর দিয়েছিস?

অধিক আর কি! ডোমনীটি যুবতী, তায় রূপসী এবং সর্ববিষয়ে পারঙ্গমা। ঊর্ধ্বাঙ্গের বস্ত্রাঞ্চল কটিলগ্ন ও দুহাতের পিত্তল বলয় চমকিত করে বলে ওঠে, কিসের কর, আমরা কেন হট্টকর দিতে যাবো?

তুই কেন শূকরপুত্রী, তোর পিতা দেবে।

অ–অ, বজ্রসেনের দিকে ঐ সময় অন্য ডোমনীরা কটিদেশে বস্ত্রাঞ্চল বন্ধন করে এগিয়ে আসে। একজন ডেকে বলে, হ্যাঁ লো কুসুম, কি বলে ঐ দগ্ধমুখ মর্কট!

কুসুম তার স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় বলে ওঠে, অরে ছিনাল পুত্র, আমরা যে তোর পিতার কর্মস্থলের দ্বারদেশ থেকে তোকে টেনে এনে জগৎ দেখাবার সময় কর দিয়ে এসেছি, সে সংবাদ কি তোর মা তোকে জানায়নি?

বজ্রসেনের ব্রহ্মতালু পূর্ব থেকেই দাহ্য হয়ে উঠেছিলো, ডোমনীর ঐ কথায় সেখানে যেন অগ্নিসংযোগ হলো। সে এক লম্ফে কি বললি, কি বললি এই কথা উচ্চারণ করে। এবং সজোর মুষ্টিতে কেশ আকর্ষণ করে কুসুম ডোমনীকে ভূমিতে নিক্ষেপ করে।

অন্য ডোমনী ও ডোমেরাও ঘটনাস্থলে ইতোমধ্যে এগিয়ে আসে। কর্মকার বিপণীগুলিতে ঠকঠক ঠনঠন শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। সকলেই বিস্ফারিত নয়নে দেখতে থাকে, অতঃপর কী ঘটে। ভিক্ষু চেতনানন্দ ঐ সময় নিকটস্থ হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন। আবেদন জানান, মহাশয়, স্ত্রীদেহে ক্ষত্রিয়ের আঘাত শোভা পায় না, আপনি ক্রোধ সংবরণ করুন। ভিক্ষুর ঐ কথায় হিতে বিপরীত হয়। বজ্ৰসেন তার কোষবদ্ধ অসি নিষ্কোষিত করে ভিক্ষু চেতনানন্দের স্কন্ধে আঘাত করে বসে। তাতে আহত চেতনানন্দ আর্তনাদ করে ভূমিতে পপাত হন। ঐ দৃশ্য সমবেত জনতাকে স্তব্ধ করে দেয় মুহূর্তের জন্য। কিন্তু মুহূর্ত মাত্র, তারপরই কে একজন চিৎকার করে ওঠে, ধর শ্যালককে

অতঃপর যা ঘটতে থাকে তার বর্ণনা দেওয়া মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। ভয়ানক উত্তেজিত এবং উৎক্ষিপ্ত মানুষ মার মার ধর ধর রব করতে থাকে। অচিরাৎ বজ্রসেনের দেহ ডোমনীরা ছিন্নভিন্ন করে দেয়–কেননা ধারালো অস্ত্র তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই ছিলো–ঐ অস্ত্রই তাদের পণ্য উৎপাদনের প্রধান অবলম্বন। বজ্রসেনের সহচরদ্বয় পলায়নের চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না–সমবেত জনতার মুষ্টি, পদ এবং কর্মকারদের হস্তলীর আঘাতে দুজনেরই দেহ কিমাকার মাংসপিণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে যায়।

পিপ্পলী হাটে সংঘটিত ঐ ঘটনার সময় হরিসেন গৃহে ছিলেন না। বয়স্য ও সুহৃদ দুই গ্রামপতিকে সঙ্গে নিয়ে মৃগয়ায় গিয়েছিলেন। মৃগয়াক্ষেত্রেই তিনি সংবাদটি পান। তারপর আর বিলম্ব করেননি, যথাসম্ভব দ্রুত প্রত্যাবর্তন করেন। পথিমধ্যে গ্রামপতি ও সামন্তদের যাকে পেয়েছেন তাকেই সঙ্গে নিয়েছেন। ঘটনাটি ঘটেছিলো দেববারে–তিনি পিপ্পলী হাটে তার বাহিনী নিয়ে উপনীত হলেন বুধবারে। দুদিন বিলম্ব হয় তাঁর লোক সংগ্রহের কারণে। প্রায় দ্বিশতাধিক শস্ত্রধারী যোদ্ধার দল যখন হাটে উপস্থিত হলো তখন নিকটের গ্রামগুলি হয়ে গেলো জনশূন্য!

হরিসেন প্রথমেই বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সন্ধান করেন। ভিক্ষু চেতনানন্দ তখন মৃতপ্রায় সহচর শুদ্ধানন্দ তাঁর শুশ্রূষা করছেন। অন্য ভিক্ষুরা কোথায়, কেউ জানে না। যুবক ডোমেরা পূর্বেই গভীর বনভূমিতে পলায়ন করেছে। ডোম পল্লীতে কেবল বৃদ্ধ, শিশু এবং রমণী। কিন্তু হরিসেন তখন দারুণ ক্রোধে ভয়ানক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন। তিনি যা। করলেন, তার তুলনা হয় না। সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী কোনো মানুষের পক্ষে ঐ কাজের কল্পনা করাও অসম্ভব।

কুসুম ডোমনীকে ধরে এনে সর্বসমক্ষে দাঁড় করানো হলো এবং ঘোষণা করা হলো এই স্বৈরিণী সকল বিরোধের মূল, দেহের যে অংশের কারণে এই স্বৈরিণী পুরুষ সমাজে বিরোধ এবং লোভের বীজ বপন করে, শরীরের যে অংশ যথার্থই নরকের দ্বার, সেই অংশটি আমরা প্রজ্বলিত করে দেবো।

ঘোষণাটি সামন্ত হরিসেনের। ঘোষক কেবল বাক্যগুলি সচিৎকার উচ্চারণ করে গেলো। এবং তারপর সর্বসমক্ষে কুসুমকে নির্বস্ত্রা করে তার যোনিদেশে একটি উত্তপ্ত লৌহদণ্ড প্রবেশ করিয়ে দেয়া হলো। মৃত্যুর পূর্বেকার চিৎকার, বাঁচবার জন্য আকুলি বিকুলি, ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ–সবই কুসুম করছিলো। কিন্তু সবই তখন দেখাচ্ছিলো জীবনের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন পুত্তলীর হস্তপদ সঞ্চালনের মতো। শস্ত্রধারী সৈনিকদের দৃষ্টি হয়ে উঠেছিলো ভারী নিস্পৃহ। একজন অন্যজনের কানে এমনও মন্তব্য করেছে যে, দেখেছো, স্ত্রীলোকটির দেহে এখনও কিরূপ শক্তি?

ঐ সময় ধূম উদগীরিত হচ্ছিলো প্রবল। বাতাসে ছিলো দগ্ধ মাংস ও ভস্মীভূত কেশের গন্ধ। সূর্য ঐ সময় আবার পূর্বাকাশে একখানি পাটলর্ণের মেঘে তার সিন্দুর বর্ণটি লেপে দেয়। হরিগেনের জয়ধ্বনি দিতে আরম্ভ করে তার পদলেহী অনুচরেরা।

হরিসেন দেখছি প্রকৃতই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছেন!

এ মন্তব্যটি অন্য এক শস্ত্রধারী পুরুষের। ওদিকে নতুন ঘোষণা হচ্ছিলো তখন। কুসুম ডোমনীর গর্ভজাত শিশুপুত্র দুটি জারজ–পাপের সন্তান, অতএব তাদের বিনষ্ট করা হবে।

পরের দৃশ্যটিও সমবেত শস্ত্রধারী সৈনিকেরা অবলোকন করে। প্রায় প্রত্যেকের চক্ষুই রক্তবর্ণ, অত্যধিক মাদক সেবনের কারণেই সম্ভবত পদক্ষেপও অসংবৃত। তারা যা দেখছিলো তা যে মানব সম্পর্কিত কিছু–এই বোধ তখন অনেকেরই ছিলো না।

কিন্তু তথাপি কোথায় কী যেন ঘটে। ঐ জনসমষ্টির মধ্যভাগে, হয়তো গভীর কোনো তলদেশ থেকে, যেখানে দৃষ্টি ঢলে না সেইরূপ কোনো স্থান থেকে কেউ কেউ নয়ন মেলে দেখে দৃশ্যটি। আর খড়গাঘাতে দ্বিখণ্ডিত শিশুর রক্তাক্ত শব, কুণ্ডলীকৃত ধূম, অগ্নির লেলিহান শিখা এবং আকাশের পাটল মেঘে ডগডগে সিন্দুর বর্ণটি, সমস্ত একত্রিত হয়ে অদৃশ্য কোনো বন্ধন যেন ছিদ্র করে দেয়। আর তাতেই রুদ্ধবাক জনতা যেন অস্পষ্ট ভাষা পায়। একজন আর একজনকে প্রশ্ন করে, কেন? কেন? কেন?

কিন্তু ঐ প্রশ্নের উত্তরদাতা কেউ ছিলো না সেখানে।

ইতোমধ্যে মুমূর্ষ ভিক্ষু চেতনানন্দকে টেনে আনা হয়েছে। তাঁর সম্পর্কে ঘোষক জানিয়েছেন–ধর্মবিরোধী অনাচারী এই পামরদের একটিই শাস্তি যা আমাদের পিতৃপুরুষদের কাল থেকে দেওয়া হচ্ছে। দেখো, তোমরা গ্রামবাসি!

গ্রামবাসীরা তখন দূরে। বনের বৃক্ষান্তরাল থেকে ঐ জনসমাগমটি দেখছিলো কেউ কেউ, কিন্তু প্রকৃত কী ঘটছে, তা বোঝা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সুতরাং তারা দেখতে পায়নি যে ভিক্ষু চেতনানন্দকে প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়েছে।

নরমাংস দগ্ধ হলে তার গন্ধ অসহ্য বোধ হয়। শস্ত্রধারী সৈন্য দলটি স্থান ত্যাগ করে একে একে দূরে গিয়ে দাঁড়াতে আরম্ভ করে। কেন, কেন, প্রশ্ন তখনও ছিলো। বিষ্ণুদাস মিত্র হরিসেনের অন্যতম মন্ত্রণাদাতা। তার দৃষ্টিতে সৈন্যদলের চঞ্চল আচরণ বিসদৃশ মনে হয়। সে হরিসেনের কাছে তার সন্দেহের কথাটি ব্যক্ত করে। ওদিকে তখন শুদ্ধানন্দকে সভামঞ্চে আনয়ন করা হয়েছে। ঘোষক ঘোষণা করে দিয়েছে যে, এই পামর যদি সমবেত সামন্তদের পাদুকা লেহন করে, তবে একে প্রাণ ভিক্ষা দেওয়া হবে।

ঐ কথার যে কী অর্থ, শুদ্ধানন্দের চেতনায় তার কোনো ছায়াপাতই ঘটছিলো না। সে বিমূঢ় পশুর মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার আচরণ হাস্যকর মনে হচ্ছিলো। ঐ সময় কে যে চিৎকার করে ওঠে বোঝা যায় না। শুধু চিৎকারটি শোনা যায়–ওর কি দোষ? ওর কি অপরাধ? এবং তাতেই সভামঞ্চের লোকেরা পরস্পরের মুখপানে চায়। এই মুহূর্তে কে একজন ভিক্ষু শুদ্ধানন্দের পশ্চাদ্দেশে সজোরে পদাঘাত করে। শুদ্ধানন্দ পতিত হন জনসমষ্টির মধ্যে। এমন মনে হচ্ছিলো যে লোকটিকে ক্ষিপ্ত জনতা ছিন্নভিন্ন। করে দেবে। কিন্তু তা হয় না। বরং দুজন লোক শুদ্ধানন্দকে তুলে দাঁড় করায়। একজন বলে, যা, শীঘ পলায়ন কর।

ঐ সময় সভামঞ্চ থেকে দুজন ঘাতক নেমে আসে, কিন্তু শুদ্ধানন্দকে আর নাগালে পাওয়া যায় না।

শুদ্ধানন্দকে দুটি শস্ত্রধারী তরুণ টানতে টানতে পথে এনে দাঁড় করায়। তারপর বলে, এ পথে আর কখনও আসবেন না–এবার যান, পলায়ন করুন।

ঘটনাটির সমাপ্তি কেন ঐভাবে হয়েছিলো সে রহস্য ব্যাখ্যা করা দুষ্কর। সম্ভবত তার প্রয়োজন ছিলো না। যাদের প্রয়োজন ছিলো, তারা পূর্বে অথবা পরে ঐ বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেছে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। রহস্যটি কি? না সমবেত জনতা এবং দলপতির ইচ্ছার পার্থক্য। দলপতি যা চায়, জনতা তা চায় না। সেনাপতি যা চায়, সৈন্যদল। তা চায় না, গ্রামপতি যা চায়, গ্রামবাসী তা চায় না–ব্যাপারটি এইমত। এবং ঐ কারণেই ভিক্ষু শুদ্ধানন্দের প্রাণ রক্ষা পায়।

তবে প্রাণরক্ষা পাওয়ার ঘটনাটি প্রধান হয়ে উঠতে পারেনি। প্রাণনাশের ঘটনাটিই প্রধান হয়ে উঠেছিলো। এবং সেও হয়েছিলো সামন্ত হরিসেনের পরিকল্পনা মতোই। তিনিও চেয়েছিলেন, এমন শাস্তি দেবেন ব্রাত্য চণ্ডাল–ডোমদের, যেন তারা কোনোদিন। সামন্ত প্রভুর বিরোধিতা করার কথা স্বপ্নেও চিন্তা না করতে পারে।

বলা কঠিন, শুদ্ধানন্দ ঘটনাটির কী বর্ণনা দিয়েছিলেন, কিংবা আদৌ কোনো বর্ণনা দিয়েছিলেন কিনা। কিন্তু লোকমুখে ঘটনাটির নানা প্রকার বর্ণনা প্রচারিত হতে আরম্ভ করে। এবং ঐ সকল বর্ণনায় ত্রাস, উল্লাস, হতাশা, বিভীষিকা, সমবেদনা ইত্যাদি নানা প্রকার মানবিক প্রতিক্রিয়া মিশ্রিত হয়ে যায়। গ্রামপতি সামন্তপতি, এবং হরিসেনের অনুচরবর্গ ব্যাপারটির যথার্থ নিষ্পত্তি হয়েছে মনে করলেও সাধারণ গ্রামবাসী যারা, ক্ষেত্রকর, কুম্ভকার, কর্মকার, তন্তুবায়, অর্থাৎ প্রাকৃতজন, তাদের মনে স্বস্তির সঞ্চার হয় না। প্রত্যেকেই আশঙ্কা করতে থাকে–এই বুঝি ঘটনাটির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। রাজপুরুষ দর্শনমাত্র তারা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তে লাগলো। অবস্থা এমন হলো যে, ভিক্ষু যোগীদের সঙ্গে তারা বাক্যালাপ পর্যন্ত বন্ধ রাখে। ডোম–চণ্ডালদের তারা গৃহকাজে আর ডাকে না। দিবারাত্র সন্ত্রাস, অস্বস্তি এবং দুশ্চিন্তা পিপ্পলী হাটের নিকটবর্তী গ্রামগুলিকে করে রাখলো। নীরব, নিষ্ক্রিয় এবং অন্ধকার।

উজুবট দূরের গ্রাম। কিন্তু পিপ্পলী হাটের ঐ ভয়ঙ্কর ঘটনাটির বিবরণ এই গ্রামেও এসে পৌঁছেছিলো। ব্রাহ্মণ সোমজিৎ উপাধ্যায় যদিও বোঝাচ্ছিলেন যে কাহিনীটি অলীক, যা শোনা গেছে তা দুষ্টজনের প্রচার মাত্র, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। তার ক্ষেত্রকর ভূমি কর্ষণে যায় না, গাভীগুলির যত্ন করে না রক্ষপাল কিলোর দুটি, গৃহদাসী বালিকা দুটি সেই যে গিয়েছে, আগমনের কোনো লক্ষণ নেই।

সোমজিৎকে অগত্যা আসতে হলো ক্ষেত্রকর পল্লীতে, শুকদেবের কাছে। বললেন, তোমরা অকারণ ভীত হয়েছে, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি অলীক–হরিসেন কিঞ্চিৎ উগ্র হলেও তিনি প্রাণনাশের কাজ কদাপি করবেন না।

কিন্তু গ্রামের লোক উপাধ্যায় মহাশয়কে বলে, প্রভু, হরিসেনকে বলুন, তিনি যেন আমাদের উপর নিপীড়ন না করেন।

সোমজিৎ ঐ প্রার্থনা শ্রবণ করেন শুধু। করণীয় কিছু আছে বলে তার মনে হয় না। তিনি বোঝেন, তার কথা কেউ শুনবে না, তবু তিনি চেষ্টা ত্যাগ করলেন না।

হরিসেনের কাছে গেলে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে উপাধ্যায় মহাশয়ের পরামর্শ শুনলে তাঁকে সমূহ ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হবে। বললেন, ওদের অনাহারে রাখুন, দেখবেন, ওরা বিনয়ী এবং শ্রমশীল দুই–ই হয়েছে, সুতরাং ওদের অনাহারে রাখুন।

কিন্তু ওরাও তো মানুষ!

হরিসেন হা হা স্বরে হেসে ওঠেন। বলেন, উপাধ্যায় মহাশয়, আপনি ওসব বুঝবেন না।

ওরা যদি কর্ম সম্পাদন না করতে চায়, তাহলে উপায় কি হবে, চিন্তা করেছেন? সোমজিৎ প্রশ্ন করেন।

হ্যাঁ, করেছি, কিছুই হবে না, আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না–এক সময় বাধ্য হয়ে ওরা আত্মসমর্পণ করবে।

কিন্তু ওদের যদি সহ্যের সীমা অতিক্রম করে? ওরাও তো মানুষ!

পুনরায় উচ্চরোলে হাস্য করেন সামন্ত হরিসেন। বলেন, কী যে বলেন উপাধ্যায় মহাশয়–ওরা মানুষ হলেও আপনার আমার মতো নয়। ভগবান ওদের জন্য কর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। ভাগবতের কর্মযোগ ও কর্মফলের ব্যাপারটি তো আপনি ভালো জানেন। এই মানবজন্মে ওরা শূদ্র–ঐ কাজ করার মধ্যেই ওদের মানবজন্মের সার্থকতা। কাজ না করা ওদের জন্য বিপথগামিতা এবং ধর্মবিরুদ্ধ–আপনি তা সমর্থন করবেন?

সোমজিৎ উপাধ্যায় হরিসেনের গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হলেন। তাঁর আশঙ্কা হতে লাগলো একটি অশুভ পরিণাম ঘনিয়ে আসছে। রাজপুরুষেরা কিছু করছে কিনা তিনি জানেন না, সামন্তপতি ও গ্রামপতিরা একেবারেই উদাসীন। কর্মজীবী মানুষেরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে না পারলে যে সকলেরই সমূহ ক্ষতি সেটা কেউই বুঝতে চাইছে না। এই প্রকার অবস্থা যদি চলতেই থাকে, তাহলে সামাজিক উপপ্লব অবশ্যম্ভাবী–মাৎস্যন্যায় কেউ রোধ করতে পারবে না। তিনি ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অসহায় বোধ করতে লাগলেন।

বসন্তদাসের আগমন হয় পিপ্পলী হাটের ঘটনাটির অব্যবহিত পরে। জামাতার আগমনে শুকদেবের পারিবারিক জীবন আনন্দে উৎফুল্ল হলো বটে কিন্তু তার মনের নিগূঢ়ে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছিলো, তা কাটলো না–বরং প্রবলতর হলো। বিশেষত দীনদাস, মায়াবতীর মাতুল, বসন্তদাসের মুখভাব ফিরে ফিরে লক্ষ্য করতে লাগলেন। একটি দুশ্চিন্তা তার মনে শলাকার মতো বিদ্ধ হয়ে রইলো। সেটি হলো, জামাতা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে তার সাক্ষাতের ব্যাপারটি সম্পর্কে একটি বাক্যও কখনও উচ্চারণ করছে না। তিনি বুঝতে পারেন না, তবে কি বসন্তদাস কোন গূঢ়কর্মের সঙ্গে যুক্ত? আর তাই সে জানতে দিতে চায় না বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সঙ্গে তার কি প্রকার সম্পর্ক হয়েছে?

দিন দুই পরে যখন সন্ধ্যাকালে দেখলেন বসন্তদাস নদীতীরে কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে গভীর আলাপে মগ্ন তখন আর নীরব থাকতে পারলেন না। ঘটনাটি শুকদেবের গোচরে আনলেন। শুকদেব শুনলেন। শুনে মৃদু হাসলেন, কিছু বললেন না। দীনদাস ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, আপনি ব্যাপারটি সহজ বলে মনে করছেন কিন্তু আমার সন্দেহ, ব্যাপারটি সহজ নয়। জামাতা যদি বিপদে পড়ে, তাহলে কী হবে চিন্তা করেছেন?

শুকদেব তখন শ্যালকের মুখপানে দৃষ্টি রেখে একটি ক্ষুদ্র শ্বাস মোচন করে বলেন, আমি ভবিতব্য মানি দীনদাস–যদি ভাগ্যে তোমার অশুভ কিছু লিপিবদ্ধ থাকে, তাহলে কি তুমি তা পরিহার করতে পারবে? পারবে না, সুতরাং দুশ্চিন্তা করে কি হবে! রাজার পাপে রাজ্য নাশ–এ প্রবাদটি তো জানো। রাজার পাপ রাজা একাকী বহন করেন না–তার পাপ প্রজাপুঞ্জেও বর্তায়। যদি ঐ পাপের দায় তোমার বিধিলিপি হয়ে থাকে, তাহলে কি তুমি তা খণ্ডন করতে পারবে? নিশ্চয়ই পারবে না। আমাদের জামাতাটি তো আর বালক নয়–মঙ্গলামঙ্গল জ্ঞান তার নিশ্চয়ই হয়েছে। তুমি অথবা আমি কিছু বললেও সে শুনবে না।

না ভ্রাতঃ, এভাবে নির্বিকার থাকা সমীচীন নয়–দীনদাস তাঁর উদ্বেগের কারণ ব্যাখ্যা করেন। বলেন, জলধর দত্ত এবং কায়স্থ পল্লীর লোকেরা যেখানে আপনার প্রতি শত্রুভাবাপন্ন সেখানে আপনার নিস্পৃহ এবং নীরব থাকা উচিত নয়। জামাতাকে বলবেন, যেন সে। বৌদ্ধ ভিক্ষু ও যোগীদের সঙ্গ পরিহার করে।

উত্তম, বলবো, শুকদেব পুনরায় একটি শ্বাস মোচন করে জানালেন।

 ০৭. প্রথম রাত্রে মায়াবতীর লজ্জা

প্রথম রাত্রে মায়াবতীর লজ্জা হচ্ছিলো।

বিবাহের পর মাসাধিককাল তার স্বামীগৃহে অতিবাহিত করেছে। স্বামীসঙ্গে প্রথম কদিন তার ভয় হতো–বিশেষত দেহ মিলনের ব্যাপারটা তাকে রীতিমতো পীড়িত করতো। পুরুষ মানুষ যে ঐ একটি বিষয় বই অন্য কিছু চায় না, এটা বুঝতে পেরে সে তখন মনে মনে কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু অল্প কদিন পরই সে অনুভব করে যে স্বামী তার কাছে আরও কিছু চায়। কিন্তু সেটা যে কি বস্তু তা সে বুঝে উঠতে পারে না, ঐ সময় সে কখনই পারেনি। তারপর বসন্তদাস হঠাৎ বাণিজ্য যাত্রা করে। শুরু হয় তার বিরহযাপন। স্বামীসঙ্গহীনা না হলে স্বামী যে কি বস্তু তা কোনো নারীর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। সে নিজেও প্রথমদিকে বোঝেনি। বুঝলো গত সাত/আট মাসে। সাত/আট মাস পর আবার তার স্বামীসঙ্গ।

তবু প্রথমদিন তার লজ্জা কাটছিলো না। শুধু লজ্জা নয়, সেই সঙ্গে সে আবার প্রবল আকর্ষণও অনুভব করছিলো। তদুপরি ছিলো একটি দুর্বহ কষ্ট, প্রণয়ভারের কষ্ট।

সুতরাং ঐ প্রকার নানাভাবে মিশ্রিত বিচিত্র একটি মানসিক অবস্থা নিয়ে সে শয্যাপার্শ্বে দাঁড়িয়ে ছিলো।

প্রকোষ্ঠে ধূপ জ্বলছিলো–দীপাধারে প্রদীপ শিখাঁটি ছিলো উজ্জ্বল–শয্যা কোমল এবং দুগ্ধফেননিভ। উপাধান স্কীদের–তাতে আবার সুচারু সূচিকর্ম–একটি লতিকা, দুটি পত্র, একটি কলিকা–এইরূপ চিত্রণ। ওদিকে বক্ষের কঙুলি স্বেদসিক্ত হয়ে যাচ্ছিলো। একেকবার মনে হচ্ছিলো, গবাক্ষ উন্মুক্ত করে।

কিন্তু রাত্রি তখনও গম্ভীর হয়নি একথা স্মরণ হওয়ায় তাকে বিরত থাকতে হয়েছে। সে জানে, কৌতূহলী রমণীরা বাইরে অপেক্ষা করে আছে। গবাক্ষ অর্গলমুক্ত করলেই তারা একত্রে হেসে উঠবে।

ঐভাবে স্বেদাপ্লুত হতে থাকলে কুঙ্কুমবিন্দু এবং চন্দনতিলকের কি দশা দাঁড়াবে ভেবে তার কান্না পাচ্ছিলো। কেন যে দহ্মাননা লীলাবতী তাকে এমন করে সাজিয়ে দিলো? তাম্বুল রাগে ওষ্ঠ রঞ্জিত করবার জন্য তাকে দুতিনবার তাম্বুল চর্বণ করতে হয়েছে। শেষ তাম্বুলটিতে আবার মৃগনাভিচূর্ণ প্রযুক্ত ছিলো। সে বুঝছিলো, অতিমাত্রায় স্বেদাক্ত হওয়ার কারণ ঐটিই। বারেক সে মনে মনে প্রগল্ভা হচ্ছিলো, বারেক আবার লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছিলো।

তার মনে হচ্ছিলো, প্রকোষ্ঠের বাইরে যায়। কেননা এমন রীতির কথা তো সে কখনও শোনেনি। পিতৃগৃহে কন্যা শয়নগৃহে অপেক্ষা করবে স্বামীর জন্য, এমন কি হয়? লোকটা মায়াবতাঁকে জানিয়ে গেলো, আমি এখনই আসছি–কিন্তু তার সেই এখন কি এতোক্ষণেও হয়নি?

বসন্তদাস শয়নগৃহে বেশ বিলম্বে আসে। কক্ষে প্রবেশ করেই স্ত্রীকে ঐভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেও তার পশ্চাতে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে কৌতুকে ঈষৎ হাসে। তারপর মায়াবতীর স্কন্ধদেশ স্পর্শ করে ডাকে, হলুদ পক্ষিটি আমার!

মায়াবতী অপ্রস্তুত, এ কী সম্ভাষণ–ছি! পূর্বদেশ অঞ্চল থেকে কি এই আচরণ শিক্ষা করে এসেছে? ক্ষণকাল পরে কানের কাছে উষ্ণ শ্বাস পড়ে এবং শোনে, হলা পিয় সহি!

মায়াবতী ওষ্ঠ দংশন করে, না, এই নির্বোধের সম্ভাষণে সে সাড়া দেবে না।

কিন্তু নির্বোধ নিরস্ত হয় না। সে সম্মুখে এসে দাঁড়ায় এবং অবগুণ্ঠন উন্মোচন করতে চায়। তখন তার অক্ষিপক্ষ্ম আপনা থেকেই নির্মীলিত হয়ে এসেছে–আর ঐ মুহূর্তটিতে বসন্তদাস গভীর স্বরে ডাকে, মায়া, আমার মায়াময়ী!

ঐ ডাকে মায়াবতীর অন্তরাত্মা আমূল কম্পিত হয়। শরীরের ভার যেন পদযুগল আর ধারণ করতে পারে না। তার চক্ষুরুন্মীলন হয়, কিন্তু দৃষ্টি বিনতই থেকে যায়।

আমার মুখপানে চাও মায়াবতী!

প্রণয়ীর প্রার্থনা যেন। অনুশীলনসিদ্ধ একেবারে কুশলী প্রণয়ী! না জানি কতত রমণীর মানভঞ্জনে এই একই বাক্য প্রয়োগ করে এসেছে। মায়াবতী মনের ভেতরে কোথায় যেন ক্ষীণ একটি কণ্টক দংশন অনুভব করে। স্বেদ তখন আর বিন্দুতে থেমে নেই, একেবারে স্রোতধারা হয়ে নেমে আসছে। সে পুনরায় মুখ নত করে।

এই যদি তোমার আচরণ হবে, তাহলে কি কারণে এই কবরী–বন্ধন, বলো? কেন এই কুরুবক আর শিরিষ, কেন এই পট্টবস্ত্র? কি প্রয়োজনে কণ্ঠে এই স্বর্ণমালা, সুদৃশ্য এই কথুলিই বা কেন? কুঙ্কুম চন্দন এবং অলক্তক কোন কাজে লাগবে, বলো?

অতিশয় নীচ! মায়াবতী তখন মনে মনে বলছে, অতিশয় নীচ এই ব্যক্তি যে প্রণয় সম্ভাষণকালেও কলহ করতে চায়।

স্ত্রীকে নিরুত্তর দেখে বসন্তদাস তাকে বাহুপাশে আবদ্ধ করে। বলে, জানো আমি কি করবো এই কবরীবন্ধনের?

ছি ছি–এ কি নারী পীড়ক! একেবারে অকৃত্রিম দস্যু হয়ে এসেছে পূর্বদেশে বাণিজ্য করে সে বারেক ভাবে, বাহুপাশ ছিন্ন করে ছুটে পলায়ন করে।

জানো, এই কুঙ্কুম চন্দনের কি হবে?

মা গো! এ বড়ই দুঃশীল–এই নাগরস্বভাব কিভাবে হলো এর–এ তো এমন ছিলো। তবে কি অন্য কোনো ব্যক্তির বাহুপাশে আবদ্ধা সে? মায়াবতী এবার প্রাণপণে দেহ সঞ্চালিত করে, যদি পাশমুক্ত হওয়া যায়।

আর এই সুদৃশ্য কণ্ডুলিটির কি দশা হবে, ভেবেছো একবার?

মরণ দশা! ছি ছি, এমন ওষ্ঠকর্তিতও হয় মানুষ! সে কুঞ্চিত করে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিপাত করে স্বামীর দিকে।

বসন্তদাসের কিন্তু বিকার নেই। সে তখনও হাসছে। বললো, কুপিতা রমণী কিন্তু অধিকতর রমণীয়া–সে কথা জানো তো? কথাটি বলে সে তাম্বুল পাত্র থেকে দুটি গ্রন্থিবদ্ধ তাম্বুল একত্রে হাতে নিয়ে বললো, শ্বশুরালয়ে আসব পানের ব্যবস্থা থাকে না কেন বলতে পারো? অতো মধুক বৃক্ষ দিয়ে তোমরা কি করো?

এবার আর সহ্য হলো না। মায়াবতী ঈষদুচ্চকণ্ঠে শ্লেষ ঢেলে উত্তর করলো, আসব পানের যদি এতোই আগ্রহ, তাহলে নটিগৃহে গেলেই হতো, এখানে আগমনের তো প্রয়োজন ছিলো না।

বসন্তদাস তখনও হাসে। ততক্ষণে সে তাম্বুল চর্বণ করেছে এবং চর্বণজনিত কারণে স্বেদাক্ত হতে আরম্ভ করেছে। ঐ অবস্থাতেই সে বলে, হ্যাঁ, সে স্থানে গেলেও হতো, কিন্তু সেখানে কি মায়াবতী পাওয়া যায়, এমন মায়াবতী কি আর কোথাও আছে, বলো?

অতঃপর বসন্তদাস যা আরম্ভ করলো সে বর্ণনা বাৎসায়ন বিস্তৃত এবং অনুপুঙ্খ দিয়েছেন। তার পুনর্বৰ্ণনা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়।

০৮. মৃগনাভিচূর্ণ রাগোত্তেজনা

মৃগনাভিচূর্ণ রাগোত্তেজনা প্রগাঢ়তর করতে পারে এবং শোনা যায়, ক্ষেত্র বিশেষে রাগমোচন বিলম্বিতও করে থাকে। কিন্তু তারও শেষ আছে। এক সময় ক্লান্ত দুই শরীরের স্বেদে শয্যা যখন সিক্তপ্রায়, তখন মায়াবতীর শরীরে যেন তার সমস্ত বিরহকালের ঘুম এসে নামলো, তারপর আর কিছু সে জানে না।

রাত্রির শেষ যামে যখন জাগলো, তখন দেখে, দ্বার অর্গলমুক্ত এবং বসন্তদাস শয্যায় নেই। বাইরে তখনও ঘোর অন্ধকার। বন্য কুক্কুট সবে দুটি একটি ডাকছে। প্রথমে মনে হলো, শারীরিক প্রয়োজনে হয়তো বসন্তদাসকে বাইরে যেতে হয়েছে। কিন্তু সম্ভাব্য সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পরও যখন সে এলো না, তখন মায়াবতীর চিন্তা হতে লাগলো, মানুষটা গেলো কোথায়? জননীকে ডাকবে কিনা এ চিন্তায় যখন সে দ্বিধান্বিতা, তখনই দেখলো, সন্তর্পণে বসন্তদাস কক্ষে প্রবেশ করছে।

কোথায় যাওয়া হয়েছিলো? সে জিজ্ঞাসা করে।

ঐ প্রশ্নে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মায়াবতাঁকে দেখে বসন্তদাস। তারপর বলে, বাইরে।

স্বামীর ঐ সংক্ষিপ্ত উত্তর মায়াবতাঁকে বিমূঢ় করে দেয়। শুধু উত্তরের সংক্ষিপ্ততাই নয়। দেখে স্বামীর মুখে বিচিত্র গম্ভীর একটি ভাব–যা পূর্বে সে কখনও দেখেনি। দীপে তখনও তৈল ছিলো। সে স্বামীর মুখপানে বারবার দৃষ্টিপাত করছিলো। রাত্রিকালের আলিঙ্গনাবদ্ধ স্বামী রাত্রি বিগত হলেই কেমন করে অচেনা হয়ে যায় সে ভেবে পাচ্ছিলো না। শুধু একটি কথা ঐ মুহূর্তে তার স্মরণ হলো। কথাটি বিবাহ রাত্রে মালিনী আয়ী বলেছিলো। বলেছিলো, দেখিস লো, পুরুষ বড় চঞ্চলমতি হয়–অঞ্চলে বেঁধে রাখিস, যেন পলায়ন না করতে পারে।

স্বামীর একেকদিনের ঐ প্রকার রহস্যময় অন্তর্ধান এবং আবির্ভাব তাকে স্বস্তিবিহীন করে তুললো। একদা যখন রাত্রির প্রথম যামেই বসন্তদাস চলে গেলো এবং সারা রাত্রি ফিরলো না–তখন মায়াবতী ভেঙে একেবারে লুটিয়ে পড়লো। সমস্ত রাত্রি সে কাঁদলো। কিন্তু তখনও সে বাইরে কারও কাছে ব্যাপারটা প্রকাশ করেনি। সারারাতের রোদনে তার মুখে মলিন প্রচ্ছায়া দেখা দিয়েছিলো। জননী উদ্বিগ্ন স্বরে জিজ্ঞাসা করলে সে সত্য গোপন করে বললো, শরীর অসুস্থ বোধ হচ্ছে মা, অন্য কিছু নয়। এবং ঐ সময়ই পিতা শুকদেব একদা জানালেন, বৎসে, জামাতাকে বলল সে যেন ভিক্ষু ও যোগীদের সান্নিধ্য পরিহার করে। এমনিতে তো কায়স্থ পল্লীর লোকেরা আমার প্রতি বিরূপ এবং বিদ্বষ্ট। এখন ভিক্ষুদের সঙ্গে তার সৌহার্দ্যের কথা যদি কেউ সামন্তপতির গোচরে আনে, তাহলে আমাদের সবাইকে বিপদে পড়তে হবে।

মায়াবতী সেদিন শয্যায় দুবাহু দিয়ে স্বামীর কণ্ঠ জড়িয়ে ধরে রাখলো। মুহূর্তের জন্য নিদ্রা গেলো না এবং বাহুবন্ধনও শিথিল করলো না। বসন্তদাস নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলে সে বাহুবন্ধন আরও দৃঢ় করলো। বললো, আমি তোমাকে যেতে দেবো না। মধ্যরাতে তুমি কোথায় যাও? ভয়ে আমার প্রাণ কাঁপে–পিপ্পলী হাটের ঘটনাটির কথা তুমি জানো–তবু

বসন্তদাস যুবতী পত্নীর শরীরে সস্নেহ হাত বুলায়। বলে, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। মায়াবতী, আমি কোনো পাপকর্মে লিপ্ত নই–তোমার পিতা আর মাতুলকে বলল, আমি যা করছি, সকলের মঙ্গলের জন্যই করছি।

কী কাজ করো তুমি? মায়াবতী জানতে চায়।

সে কথা এখন নয়, সময় হলে তোমাকে বলবো।

মায়াবতী মরমে মরে যায়। তার দেহসৌষ্ঠব, তার সৌন্দর্য, তার যৌবন–কোনো কিছুই স্বামীকে ধরে রাখতে পারছে না। তার দুচোখে এক অচেনা রহস্য। যখন বাইরে দৃষ্টিপাত করে, তখন মনে হয়, যেন দিগন্ত অতিক্রম করে যাচ্ছে তার দৃষ্টি। যখন ভ্রূকুঞ্চিত করে, তখন মনে হয় না যে ঐ জ্বরেখা আর কখনও সরল হবে।

সে সখী লীলাবতীকে জানায় ব্যাপারটা। বলে, সখী, আমার বড় ভয় করে।

লীলাবতী হাসে। বলে, ভয়ের কিছু নেই, তোর পুরুষ বোধ হয় কোনো কারণে চিন্তাগ্রস্ত–তুই জেনে নে, কী চিন্তা করে ও।

মায়াবতী ঐ রাত্রে স্বামীকে বিশেষ অস্থির দেখলো। বারে বারে সে বাইরে যাচ্ছে। স্বামীর ঐভাব দেখে এক সময় সে স্বামীর দুই পা জড়িয়ে ধরে। বলে, তোমাকে বলতে হবে, তুমি কেন চঞ্চল হয়েছে, কেন তুমি চিন্তাগ্রস্ত আর অস্থির?

বসন্তদাসের বিরক্তি লাগে প্রথমে। তারপর, পদযুগলে স্ত্রীর কোমল বক্ষস্পর্শ, অশ্রুসজল নয়ন এবং বাহু দুটির সজোর আকর্ষণ তাকে কিঞ্চিৎ বিহ্বল করে দেয়। স্ত্রীকে সে দুহাতে তুলে এনে শয্যায় বসায়। তারপর তাকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে বলে, মায়া, তুমি আমার গোপন কথা জানতে চাও–কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমার গোপন কোনো কথা নেই। পিপ্পলী হাটে যে ঘটনা ঘটেছে, সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে আশঙ্কা করি। আমি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে বাধা দেবার চেষ্টা করছি। কীভাবে, সে প্রশ্ন করো না। শুধু আমাকে তুমি বিশ্বাস করো। সম্মুখের কাল বড় ভয়াবহ। আসন্ন ঐ দুর্যোগের কালে অবিশ্বাস ও সন্দেহের অনুপ্রবেশ ঘটলেই আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো। বিশ্বাস আর ভালবাসায় আমাদের সংহত এবং দৃঢ় হতে হবে।

মায়াবতীর দেহ শিথিল হয়ে আসে। সে বসন্তদাসের কথা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারে। বক্ষের ভেতরে ভয় থর থর করতেই থাকে। তারপর স্বামীর মুখের ঐ দুটি কথা তার মনে মুদ্রিত হয়ে যায়। বিশ্বাস এবং ভালবাসা! আহা কী সুন্দর কথা! মায়াবতীর চিন্তা ক্রমে সহজ হয়ে আসে। বিশ্বাস করি বলেই তো ভালবাসি–আর যদি ভালবাসতে পারলাম, তাহলেই তো আর কোনো ভয় নেই আমার, আমি তখন মুক্ত, নিঃসংকোচ এবং দায়হীন।

বসন্তদাস জানে যে তার আচরণ অনেকের কাছেই বিসদৃশ ঠেকছে। মায়াবতীর মাতুল দীনদাস বুদ্ধিমান লোক। তিনি প্রায় ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন কয়েকদিন। গ্রামের অন্যান্য লোকেদের কৌতূহলের ব্যাপারটাও তার অগোচর নয়। পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি যেভাবে ত্রাস, এবং আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে, তাতে বৌদ্ধ ভিক্ষু দর্শন মাত্র যে তারা অস্থির হয়ে উঠবে, এতে আর আশ্চর্য কি! সে জানে, ভিক্ষুদের সঙ্গে তার সংস্রব কেউই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারছে না। কিন্তু তার নিজেরও উপায় নেই।

মিত্রানন্দের লোক বারবার আসছে। প্রত্যেকবারেই তাদের ঐ এক কথা। আর সহ্য হয় না, তোমরা গ্রামবাসীদের জানিয়ে দাও, আমরা যবন জাতিকে ডেকে আনতে চাই। প্রতিবার ওরা আসছে প্রস্তাব নিয়ে, আর প্রতিবারই বসন্তদাস তাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে। বলছে, এখনও সময় হয়নি, মিত্রানন্দকে বলো, সময় হলে আমিই সংবাদ দেবো।

মিত্রানন্দের লোকেদের সঙ্গে তাকে দীর্ঘ আলাপে বসতে হচ্ছে। বোঝাতে হচ্ছে, যবন জাতি বহিরাগত–তারা এলে তুমি আমি কেউ থাকবো না। আর জেনো, তারা শুধু রাজ্য জয়ই করছে না–ধর্মকে পর্যন্ত জয় করে নিচ্ছে। এ বড় চিন্তার কথা–এমতাবস্থায় আমাদের চিন্তা করা উচিত, আমরা কী করবো। এক সন্ত্রাসের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য যদি আমরা আরেক সন্ত্রাসের মধ্যে নিপতিত হই, তাহলে সেটা কোনো কাজের কথা নয়।

বসন্তদাসের কথায় ভিক্ষুরা নীরব থাকে। শুধু অপলক চক্ষুর স্থির দৃষ্টি মেলে রাখে বসন্তদাসের মুখের উপর। বসন্ত অনুমান করে তার যুক্তি শ্রোতারা গ্রহণ করছে না–কিন্তু তবু সে হতোদ্যম হয় না। যতোদিন পারে, ভিক্ষুদের উদ্দেশ্যসিদ্ধি বিলম্বিত করতেই হবে। এ বিষয়ে সে আশাবাদী। কারণ মিত্ৰানন্দ তার সুহৃদ বন্ধু এবং সে বসন্তকে বিশ্বাস করে।

প্রতিদিন অপরাহ্নে সে নদীতটে ভ্রমণ করে। কখন যে ভিক্ষুরা আসবে তার স্থিরতা নেই। তাই তাকে নদীতটে আসতে হয়। তার চপল স্বভাব এখনও আছে। বালক ও কিশোরদের সঙ্গে সে একেকদিন ক্রীড়ায় মত্ত হয়। দণ্ডগুলি ক্রীড়ায় তার পারদর্শিতার কথা ইতোমধ্যে গ্রামের কিশোর ও বালকদের মধ্যে প্রচারিত হয়ে গেছে। সুতরাং সে নদীতটে এলে বালকদের মধ্যে উল্লাস দেখা যায়।

আজ সে নদীতটে এসে দেখলো বালকেরা বিমর্ষ মুখে বসে আছে। কি সংবাদ? সে সন্ধান নিয়ে জানলো যে দ্বিপ্রহরে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেছে। ঘটনাটি সামান্য, কিন্তু মানুষের অনুদারতা এবং ক্রোধ সামান্য ঘটনাকেই প্রকাণ্ড করে তুলতে পারে।

ঘটনাটি হাস্যকরও কিঞ্চিৎ। দ্বিপ্রহরে অভিরাম উপাধ্যায় স্নানে এসেছিলেন। তাঁর অবয়ব শীর্ণাকার, এবং মস্তকে একটি সুন্দর ইলুপ্তি বিরাজমান। তাঁর তৈলসিক্ত ইলুপ্তিটি কখনও কখনও দর্পণের কাজ করে। তিনি যখন নদীজলে নেমে প্রথম ডুবটি দিয়ে সূর্যস্তব আরম্ভ করেছেন, শ্লোকের প্রথম চরণটি উচ্চারিত হয়েছে–কি–হয়নি–ওঁ জবাকুসুম সঙ্কাশং পর্যন্ত বলেছেন মাত্র, ঐ মুহূর্তে বালকদের দণ্ডপ্রহৃত গুলিটি তীরবেগে ছুটে এসে তাঁর। মস্তকের ইন্দ্রলুপ্তিটিতে আঘাত করে। আঘাতটি তীব্র হওয়ায় ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং রক্তপাত হয়। উপাধ্যায় মহাশয় কুপিত হন, উপবীত হস্তে ধারণ করে বালকটি এবং তার চতুর্দশ। পুরুষকে অভিসম্পাত করেন। তাতেও তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয় না, বালকটিকে তিনি ধরে নিয়ে যান নিজ গৃহে। সেখানে তাকে যথেচ্ছ প্রহার করা হয়। ঘটনার সেখানেই সমাপ্তি হয়নি, শোনা যাচ্ছে, বালকটির পিতাকে ব্রাহ্মণরক্তপাতের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

বসন্তদাস মলিনমুখ বালকদের কোনোরূপ সান্ত্বনা দিতে পারে না। কারণ বিষয়টি অতিশয় স্পর্শকাতর। সে বহিরাগত, তার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ঘটলেই ব্যাপারটি ভিন্ন আকার ধারণ করবে। সে বালকদের সঙ্গ ত্যাগ করে ভাসমান নৌকাগুলির দিকে অগ্রসর হলো।

বসন্তদাস বলিষ্ঠ, তায় যুবাপুরুষ। পুনর্ভবা তীরের উচ্চ ভূমিতে সে দাঁড়িয়ে ছিলো। তার উন্নতদেহের প্রতিচ্ছায়া নদীবক্ষে এসে পড়েছিলো। পুনর্ভবার স্রোতে জল এখন গৈরিক বর্ণ। উত্তরদেশে সম্ভবত কোথাও বৃষ্টি হয়ে থাকবে–তাই জলের ঐ রূপ। ঐ গৈরিকবর্ণের জল এখন কিছুদিন ক্রমান্বয়ে আসতেই থাকবে।

নদীতীরে একত্রে একটি ক্ষুদ্র নৌবীথি ভাসমান। নৌকাগুলিতে নানান পণ্যসম্ভার। সম্ভবত এরা এখানে রাত্রিযাপন করবে। রাত্রিকালে দস্যুর ভয়, তাই এই ব্যবস্থা। বসন্তদাসের হাসি পায়, মানুষ বড়ই সহজ সরল। পথে দস্যু যা হস্তগত করে সে আর কতটুকু! পক্ষান্তরে যুগ যুগ ধরে নিজ নিজ গৃহেই অপহৃত হয়ে চলেছে তারা। গ্রামপতি নেয়, রাজপুরুষেরা নেয়, ব্রাহ্মণেরা নেয়, কায়স্থেরা নেয়–কে তাদের শ্রমলব্ধ উপার্জনের অংশ নেয় না? আশ্চর্যের বিষয়, এই চিন্তাটুকু মানুষ করতে চায় না।

সে ঐ সময় শুনলো, নৌকার এক বণিক ডাকছে, মহাশয় কি এই গ্রামবাসী?

কেন? কি প্রয়োজন? বসন্তদাস ঘুরে দাঁড়ায়।

না, জানতে চাইছিলাম। বণিকটি ইতস্তত করে বলে, এই নদীতীর নিরাপদ তো? দস্যুবৃত্তি হয় না তো?

বসন্তদাস হাসে। বলে, আপনি বড় কৌতুকের কথা বললেন, আমি এই গ্রামবাসী আর আমাকেই জিজ্ঞাসা করছেন, আমি দস্যুবৃত্তি করি কি না?

না না, আমি তা বলিনি, লোকটি অতিশয় বিব্রত বোধ করে। আপনারা এখানে নির্ভয়, বসন্তদাস তাদের আশ্বাস দেয়। বলে, এ গ্রামে কোনো দস্যু নেই–তবে আপনারা কি অধিক দূর যাবেন?

না মহাশয়, আমরা নবগ্রাম হাটে যাবো। পথিমধ্যে শুনলাম ওদিকে নাকি রাজার সৈন্যদের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে–কি ঘটনা, এখনও কিছুই বুঝতে পারছি না, আপনি কি কোনো সংবাদ জানেন?

নিকটবর্তী নবগ্রামেও কি কোনো ঘটনা ঘটেছে? বসন্তদাস স্মরণ করার চেষ্টা করে।, এমন কোনো ঘটনার কথা সে শোনেনি। তার একবার মনে হলো, পিপ্পলী হাটের ঘটনাটি বর্ণনা করে। কিন্তু পরক্ষণে চিন্তা করে, কি প্রয়োজন অহেতুক নিরীহ লোককে চিন্তাগ্রস্ত করে? সে বলে, আপনারা নির্ভয়ে থাকুন এখানে সকলই নিরাপদ।

নিরাপদ হলেই ভালো, আমরা ক্ষুদ্র ব্যক্তি, সামান্য কিছু উপার্জন করতে পারলেই গৃহের সন্তান গৃহে ফিরে যেতে চাই–আপনি আমাদের নিশ্চিন্ত করলেন, আপনাকে ধন্যবাদ।

লোকটি হয় ভয়াতুর নতুবা বাঁচাল। হয় ভয়, নয় তোষণ। এছাড়া কি মানুষের স্বাভাবিক আচরণ হতে পারে না? বসন্তদাস বিরক্ত হয় লোকটির অতিমাত্রায় শিষ্ট আচরণ দেখে। তার মনে হয়, এ তো দাসের আচরণ? কতোকাল মানুষ কেবলি দাসত্ব করে যাবে? মনুষ্যজন্মের অর্থই কি দাসত্ব? ভয় আর সন্ত্রাস কি চিরকাল মানুষকে দাস করে রাখবে? এরা কি বারেকের জন্যেও সংঘবদ্ধ হতে পারে না? বোঝে না কি যে সংঘবদ্ধ বাহুবল কি বিপুল ও প্রচণ্ড শক্তি ধারণ করতে পারে?

বারবার প্রশ্নটি তার মনে আলোড়িত হতে থাকে।

সন্ধ্যা সমাগত প্রায়। দূরে বেণুধ্বনি শোনা যায়। বসন্তদাসের নিজ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ হয়। পূর্বদেশের গ্রামগুলিতে সে ভ্রমণ করেছে বন্ধু মিত্রানন্দের সঙ্গে, প্রাচীন পুন্ড্রনগরীতেও সে গিয়েছিলো–সর্বত্রই তার এক অভিজ্ঞতা। রাজশক্তি প্রজাপীড়ন ছাড়া অন্য কাজে কোথাও ব্যবহৃত হয় না। এই রাজশক্তি যে প্রকৃতপক্ষে দুর্বল, এ সত্য কেউ স্বীকার করে না। তারা শুধু মহারাজ লক্ষ্মণ সেন দেবের হস্তীবাহিনী, অশ্ববাহিনী এবং পদাতিকের সংখ্যাটি দেখতে পায়, আর কিছু দেখতে পায় না।

ঐ সময় সে একটি বালককে দ্রুত ছুটে আসতে দেখলো। বালকটি দ্রুত নিকটে এসে জানালো, আপনি এখানে? ওদিকে আপনার সন্ধান করা হচ্ছে।

কেন? বসন্তদাস অবাক হয়।

সামন্ত হরিসেনের গৃহ থেকে দুজন প্রহরী এসেছে–তারা আপনাকে সামন্ত গৃহে নিয়ে যেতে চায়।

বসন্তদাস চমকিত হলো। কিন্তু বালকটিকে সে বুঝতে দিলো না। বললো, তুমি গৃহে যাও, আমার সঙ্গে যে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছে এ কথাটি প্রকাশ করো না।

অতঃপর বসন্তদাস? নিজেকে প্রশ্ন করে সে। ঘনায়মান অন্ধকার, নদীর ছলোচ্ছল স্রোতধারা এবং নক্ষত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করে সে কয়েকবার এবং নিজেকে বলে, এইবার তাহলে তোমাকে জীবনের সম্মুখীন হতে হচ্ছে–তুমি না সংঘর্ষ চাইতে না?

তুমি না হিংসা প্রতিহিংসা উভয়ের নিবৃত্তি চেয়েছিলে? বলেছিলে, যবন জাতিকে আমন্ত্রণ জানানো অনুচিত–এখন তুমি কী করবে?

অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিলো। বসন্তদাস স্থির করলো, আপাতত সে পুনর্ভবার পরপারে আশ্রয় নেবে। না, হরিসেনের সঙ্গে সাক্ষাতের কোনো বাসনা তার নেই। ঐ সময় আকাশের নক্ষত্রমালায় সে প্রিয়তমা পত্নী মায়াবতীর মুখখানি দেখতে চাইলো, কিন্তু দেখলো, শুধু মায়াবতী নয়–আরও একটি মানবীর মুখ সে দেখতে পাচ্ছে। সে বুঝলো, বালগ্রামের মন্দিরদাসী কৃষ্ণাকে বিস্মৃত হওয়া অতো সহজ নয়।

৯. নবগ্রাম হাট থেকে শ্যামাঙ্গ

নবগ্রাম হাট থেকে শ্যামাঙ্গ ঊর্ধ্বশ্বাসেই পলায়ন করেছিলো। নিশ্চয়ই পলায়ন সেটা। তোমার নিজের অনিচ্ছায়, ভীত হয়ে, লাঞ্ছিত হয়ে, দ্রুত স্থান ত্যাগ করাকে আর কি বলা যায়? নিশ্চয়ই তাকে পলায়ন বলতে হবে। শ্যামাঙ্গ পথ ভুল করে। ঐ সময় তার দিগ্বিদিক জ্ঞান থাকবার কথা নয় এবং ছিলোও না। সে পশ্চিমাভিমুখে অগ্রসর হয়। পথ ছিলো বনভূমির মধ্য দিয়ে। ঐ বনভূমিরই মধ্যে এক পল্লীতে রাত্রিবাস করে সে তার যথাসর্বস্ব হারায়। শুনেছিলো সে যে বনভূমির পল্লীগুলিতে দস্যুদের বাস। তবু ঈশ্বরের কাছে সে কৃতজ্ঞ যে দস্যুরা তার প্রাণ হরণ করেনি। করতে পারতো–সাধারণত করাই নিয়ম–কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, তার ক্ষেত্রে ঐ ব্যতিক্রমটি ঘটেছে।

কপর্দকহীন অবস্থায় সে বনভূমিও অতিক্রম করে। দেখে যে রাত্রিকালই বরং ভ্রমণের জন্য অধিকতর নিরাপদ। ব্যাঘের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু বরাহ ভল্লুক ইত্যাদির সঙ্গে কয়েকবারই তার সাক্ষাৎ লাভ ঘটেছে। দেখেছে, মানুষের চাইতে পশু সত্যিই কম বিপজ্জনক।

যে বর্ধিষ্ণু গ্রামটিতে প্রথম এবং সাদর আপ্যায়ন পায় তার নাম কুসুম্বী। সেখানে সে কয়েকদিন অবস্থান করে। গৃহস্থ ছিলেন কুম্ভকার–সুতরাং দরিদ্র হলেও কর্মের বিনিময়ে তারা তাকে উত্তম আশ্রয় দেয়।

সে তখন অনন্যোপায়। তাকে কিছু উপার্জন করতে হবে। তারপর তাকে আবার গৃহে প্রত্যাগমনের চেষ্টা করতে হবে। তার এখন মনে হয়, গুরু বসুদেব সম্ভবত এই সকল পরিস্থিতির জন্য শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করেছেন। তার হাসি পায় নিজের অবস্থা দেখে। আসলেই সে মূর্খ। যে শক্তি সমগ্র সংসারে বিস্তৃত, সেই শক্তির প্রতিকূলে সে যেতে চেয়েছে কোন সাহসে? তার শক্তি কোথায় যে সুধীমিত্রের মতো সামন্তপতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাবে? ধর্ম আছে, শাস্ত্র আছে, সংস্কার আছে–সে নিজ ইচ্ছায় চলতে চাইলেই হলো? নীচ দস্যুর কাছে যে কৃপার পাত্র–তার আবার শিল্পী হবার সাধ?

কুসুম্বীতে অধিকাংশই ক্ষেত্ৰকর। এখানে ভূমি প্রায়শঃ সমতল এবং নদীতীরবর্তী বলে বৎসরের অধিকাংশ সময় থাকে আর্দ্র ও উর্বরা। গৃহস্থরা ধনশালী না হলেও প্রায় সকলেই সম্পন্ন। সুতরাং শ্যামাঙ্গকে অবাঞ্ছিত জ্ঞান করে না কেউ। তদুপরি সে কর্মবিমুখ নয়–কুম্ভকারের কাজগুলি সে যত্নসহকারেই নিষ্পন্ন করে। মনোহরদাস বৃদ্ধ হয়েছেন, সকল কাজ তাকে দিয়ে হয় না। ওদিকে আবার তার পুত্রটি রত্নবিশেষ। বুদ্ধিতে বাতুলপ্রায়–এবং শ্রমকাতর। অথচ এই সময়ই কুম্ভকারদের উপার্জনের কাল, দূরে–অদূরে মেলা হচ্ছে, তৈজসাদি যতো অধিক নির্মিত হবে ততোই উপার্জন বৃদ্ধি পাবে। মনোহরদাস চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। এমন সময় শ্যামাঙ্গকে পেয়েছেন তিনি। তাঁর আশা, শ্যামাঙ্গ যদি তার কাছে থাকে, তাহলে এ বৎসর ভালো উপার্জন করবেন। তাই তিনি শ্যামাঙ্গকে স্নেহ প্রদর্শন করতে কখনও কার্পণ্য বোধ করেন না। কিন্তু শ্যামাঙ্গের আচরণ লক্ষ্য করে মনে তার শঙ্কা জাগে। মনে হয় তরুণটি অত্যধিক রহস্যময়। একেকদিন দিগন্ত পানে এমন উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে যে ডাকলেও উত্তর পাওয়া যায় না। কিংবা বালখিল্য পুত্তলি নির্মাণের সময় এমন অভিনিবেশসহকারে সে কাজ করে, যে না দেখলে বিশ্বাস হবার কথা নয়। মনোহরদাস অবাক হন, একটিমাত্র পুত্তলি গঠনেই সে দণ্ডাধিককাল ব্যয় করে। তবে হ্যাঁ–যা করে সে, তার তুলনা হয় না। মৎস্য হোক, গোয়ালিনী হোক, মৃৎশকট হোক, পক্ষী হোক–বড় সুন্দর পুত্তলিগুলি।

শ্যামাঙ্গ যেদিন কর্ম থেকে অবকাশ প্রার্থনা করলো সেদিন মনোহরদাস বিলক্ষণ উদ্বিগ্ন হলেন। বারবার জানতে চাইলেন–বৎস, আমরা জানি তোমাকে স্বদেশে প্রত্যাগমন করতে হবে–কিন্তু তবু এখানে কি তোমার কোনো সমস্যা হয়েছে, বলো?

না না, এ আপনি কি বলছেন, শ্যামাঙ্গ বৃদ্ধকে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করে। বলে, আপনার কৃপায় আমার জীবন রক্ষা পেয়েছে, সে কথা কি বিস্মৃত হওয়া সহজ, আপনিই বলুন?

সে বৃদ্ধকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে অন্যকিছু নয়–সে পার্শ্ববর্তী গ্রাম উজুবটে যাবে–সেখানে তার বন্ধু আছে কয়েকজন। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা তার অতীব প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। সাক্ষাৎ করেই পুনরায় চলে আসবো, শ্যামাঙ্গ বৃদ্ধকে জানায়। বলে, আপনি নিশ্চিত থাকুন, আমার দ্বারা আপনার কোনোরূপ ক্ষতি আমি হতে দেবো না।

হ্যাঁ, উজুবটেই যাবে সে। দুজন যোগীর সঙ্গে অতি সম্প্রতি তার সাক্ষাৎ হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন পশ্চিমদেশাগত–সে উজুবট যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। সঙ্গী যোগীটি প্রকৃতই যোগী, সকল ব্যাপারেই তার সীমাহীন অনাসক্তি। সঙ্গীর উজুবট গ্রামে যাবার আগ্রহ দমন করে রেখেছে সে অদ্ভুত কৌশলে। এতকাল বলে এসেছে উজুবট বহুদূর। সে এখন সে কথা বলতে পারে না, কেননা আগন্তক যোগী স্থানীয় ভাষা বিলক্ষণ বুঝতে শিখেছে। সে এখন বলে, উজুবটের গ্রামপতি এবং তার অনুচরেরা ভয়ানক যোগীদ্বেষী, একবার যদি আয়ত্তের মধ্যে পায়, তাহলে আর রক্ষা নেই।

শ্যামাঙ্গের সঙ্গে পরিচিত হওয়ায় যোগীটি প্রথম বুঝতে পারে যে, তার সঙ্গীটি তার সঙ্গে এতকাল চাতুরী করে এসেছে। সে শ্যামাঙ্গকে ক্রমান্বয়ে অনুরোধ করতে থাকে। জানায়, উজুবটে তার একজন গুরু অবস্থান করছেন–তাঁর কাছে একটি সংবাদ অবশ্যই উপস্থিত করতে হবে–ইতোমধ্যেই অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে তার।

শ্যামাঙ্গের মনেও একটি বাসনা ছিলো। তার বিপদগ্রস্ত অনিশ্চিত অবস্থায় বাসনাটি প্রবল হতে পারেনি–বলা যায়, সুপ্ত অবস্থাতেই বিরাজ করছিলো। কিন্তু যেই তার অবস্থা কিঞ্চিৎ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে, অমনি সে উজুবট গ্রাম সম্পর্কে সংবাদাদি সংগ্রহ করতে আরম্ভ করে দিলো। ঐ সময়ই সে নিজের মনের একটি দিক আবিষ্কার করে স্তম্ভিত হয়ে যায়। তার ধারণা ছিলো মায়াবতীর মাতাকে দেখবার জন্যই সে উজুবট যাবে। তার মাতৃময়ী মূর্তিটি তার মনে বারবার আসছিলো। এই প্রকার যখন তার মানসিক অবস্থা, ঐ সময়, একদিন মনোহরদাস একটি পুত্তলি তার হাতে এনে দিলেন। জানতে চাইলেন, এইটি কি তোমার গঠন?

কেন, কি হয়েছে? শ্যামাঙ্গ ঈষৎ শঙ্কা বোধ করে, কারণ মনোহরদাসের মুখ অতিশয় গম্ভীর ঐ সময়।

মনোহরদাস জানায়, এ কি গোয়ালিনী মূর্তি হয়েছে, তুমিই বলো?

শ্যামাঙ্গ তখন মনোযোগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। এবং চকিতেই বিমূঢ় হয়ে যায়। এ কে? এ কার মূর্তি? ক্ষুদ্র পুত্তলি–কিন্তু ভঙ্গিটি অবিকল ধরা পড়েছে–রমণীর গমনভঙ্গি ওটি–দৃষ্টি দূরে নিবদ্ধ, গ্রীবাটি ঈষৎ বঙ্কিম, দক্ষিণপদ সম্মুখে প্রসারিত। রমণীটিকে এবং নিজ মনের একটি দিক একত্রে আবিষ্কার করে সে মরমে মরে গেলো। ছি ছি–এ কোন চিত্র তার অন্তরে মুদ্রিত হয়ে রয়েছে চিরকালের জন্য? এ তো অবিকল লীলাবতী, উজুবট গ্রামের লীলাবতী!

সে মনোহরদাসকে জিজ্ঞাসা করে, তাহলে কি পুত্তলিগুলি বিনষ্ট করতে হবে?

না, তা নয়, চিন্তিত মুখে বলেন মনোহরদাস, পুত্তলি অত্যন্ত সুন্দর হয়েছে, আমার চিন্তা হচ্ছে, এই পুত্তলি অধিক সংখ্যায় বিক্রয় হবে কিনা–ক্রেতারা তো গোয়ালিনী চাইবে তোমার কাছে–এ কি গোয়ালিনী? যদি গোয়ালিনী না হয়, তাহলে বলো, এর নাম কি দেবে? মালিনী?

নাম? শ্যামাঙ্গ এই দিকটি কখনই চিন্তা করেনি। সে বললো, নাম যে কুলসূচক হতেই হবে, এমন কি কোনো বিধান আছে? নাম তো ব্যক্তির পরিচায়ক চিহ্ন মাত্র। যে কোনো নাম দিলেই হয়।

বলল, কি নাম দেবে? মনোহরদাস আগ্রহভরে শ্যামাঙ্গের মুখপানে চান।

শ্যামাঙ্গের মনে তখন একটি নামই উচ্চারিত হচ্ছে। বললো, ওর নাম দিন লীলাবতী!

লীলাবতী! মনোহরদাস ক্ষণেক চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, উত্তম–তাই হোক, এই নতুন পুত্তলির নাম হোক লীলাবতী।

শ্যামাঙ্গ মনোহরদাসকে সন্তুষ্ট করলো বটে, কিন্তু নিজ বিবেকের নিকট সে অপরাধ বোধ করতে লাগলো। নিজ মনের এ কি রূপ দেখছে সে? কখন লীলাবতী এমনভাবে তার মানস লোকে স্থান করে নিয়েছে, সে জানতেও পারেনি। শোণিত ধারার প্রবাহ কি মানুষ জানতে পারে? লীলাবতী কি তাহলে তার শোণিত ধারার মধ্যে মিশে গিয়েছে? সে কি মিশেছে তার শ্বাসে–নিঃশ্বাসে? তার স্বপ্নে? কল্পনায়?

ছি ছি, এ কী হলো? ধিক তোকে শ্যামাঙ্গ? শতবার ধিক তোকে–বিশ্বাসঘাতক কোথাকার!

নিজেকে শ্যামাঙ্গ ধিক্কার দেয়। হ্যাঁ বিশ্বাসঘাতকতাই তো সে করেছে। লীলাবতীর কাছে সে না প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছে যে তার স্বামী অভিমন্যু দাসকে এনে দেবে? আর সে নিজেই কিনা হয়ে পড়লো আসক্ত? ছি ছি, ছি ছি, শ্যামাঙ্গ বিবেক দংশনে অস্থির হয়ে ওঠে।

কিন্তু এসবই বালির বাঁধ–ক্ষণে থাকে, ক্ষণে থাকে না। বরং ঐ প্রকার বিবেক দংশন তার আবেগকে অধিকতর উদ্দীপ্ত করে তুললো। যোগীটির পীড়াপীড়ি উপলক্ষ মাত্র–এমনকি মায়াবতীর মাকে প্রণাম করার ইচ্ছাটিও উপলক্ষ বই অন্য কিছু নয়। সে যোগীটির সঙ্গে উজুবটের দিকে যাত্রা করলো।

পথে দুজনায় নানা প্রসঙ্গ নিয়ে আলাপ। উজুবট গ্রামে কোনো সিদ্ধা বা যোগী আছে। এমন সংবাদ শ্যামাঙ্গ পূর্বে কখনও পায়নি। শুনলো, ঐ গ্রামে যোগী গুরু সিদ্ধপা অবস্থান করছেন। সিদ্ধপা অসাধারণ শক্তিমান যোগী–যোগবলে তিনি অসাধ্য সাধন করতে পারেন। চক্ষুর নিমেষে তিনি ত্রিভুবন ভ্রমণ করেন, সর্প–মারী–ভয় তাকে দেখে শতহস্তেন দূরাৎ পলায়ন করে–আরও আশ্চর্য, আকাশচারী দেবগণ পর্যন্ত অনুমতি ব্যতিরেকে তার উপর দিয়ে গমনাগমন করতে পারেন না–তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান মহাদেবের অত্যন্ত প্রিয় ভক্ত।

নির্জন পথের সঙ্গী দীর্ঘ পথক্ৰমণকালে স্বভাবতই বন্ধু হয়। তদুপরি যাত্রা যদি হয় পদব্রজে, তাহলে তো কথাই নেই–শয়ন গৃহের বিশ্রম্ভালাপের বিবরণ পর্যন্ত পরস্পরের নিকট অজানা থাকে না। যোগীটি নিজ গুরুর প্রশস্তি আরম্ভ করে। এবং ঐ প্রসঙ্গেই নানান বিষয় এসে যায়। যেমন পশ্চিম দেশে মাৎস্যন্যায় আরম্ভ হয়ে গেছে। এক যবন দলপতি রাজপুরুষদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে–রাজা কোথায়, কেউ জানে না। এই যবন জাতি অশ্বারোহণে অত্যন্ত দ্রুতগতি–আর অস্ত্রচালনায় যন্ত্রবৎ। হিংস্রতায় একেকজন যমের অনুচর। তাদের রক্তপিপাসা কিছুতেই নিবৃত্ত হয় না এবং নরমুণ্ড দিয়ে তারা গেণ্ডয়া খেলে থাকে।

শ্যামাঙ্গ এই যবন জাতি সম্পর্কে শুনেছিলো শুকদেব ও দীনদাসের কাছে। শুনেছিলো এদের মধ্যে একশ্রেণী আছে যারা সজ্জন এবং বিনয়ী। সে বললো, কিন্তু আমি তো শুনেছি যবনেরা ভদ্র, বিনয়ী এবং সজ্জন, তারা কি সত্যিই নিষ্ঠুর?

যোগীটি ঐ কথায় হাসে। বলে, আপনাকে কি বলবো, স্বচক্ষে দৃষ্ট ঘটনাকে তো আর মিথ্যা বলতে পারবো না–মহানন্দা তীরবর্তী দুইখানি গ্রাম তারা ধূলিতে মিশিয়ে দিয়েছে। আপনাদের প্রত্যয় হয়তো হবে না, কিন্তু অপেক্ষা করুন, স্বচক্ষেই দেখবেন ওরা এদেশেও আসছে।

সে কি? শ্যামাঙ্গ অবাক হয়ে যায়। মুখে বাক্য নিঃসৃত হয় না পক্ষ দুই আগে শুকদেব যে বলেছিলেন কোনো ঘটনাই কার্যকারণ ব্যতিরেকে ঘটে না–তাহলে যবন জাতির আগমনের এইটিই কি তাৎপর্য? সে বলে, আপনি কি প্রকৃত সংবাদ জানেন যে যবনেরা পুনর্ভবার পূর্বতীরেও আসছে?

যোগী ঐ কথার উত্তরে সহসা কিছু বলে না। পরে জানায়, বন্ধু শ্যামাঙ্গ, যদি চক্ষু উন্মীলিত রাখো, তাহলেই বুঝতে পারবে, পরিস্থিতি কিরূপ ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। এদেশে সদ্ধর্মী ভিক্ষুদের উপর অত্যাচার ও লাঞ্ছনা আমরা আবাল্য দেখে আসছি উপরন্তু এখন আরম্ভ হয়েছে প্রজাপুঞ্জের উপর অত্যাচার। রাজশক্তি প্রজাপুঞ্জকে রক্ষা তো করেই না, বরং রাজশক্তির অত্যাচার এবং নিগ্রহে প্রজাপুঞ্জের প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। বহিরাগত যবন জাতি বিভিন্ন স্থানে এখন কেন্দ্র স্থাপন করেছে–সদ্ধর্মী ভিক্ষুরা প্রতিদিন তাদের দুঃখের কথা নিবেদন করছে ঐ সকল কেন্দ্রে। আর প্রতিদিনই তারা অগ্রসর হয়ে আসছে। তুমি শুনলে অবাক হবে যে তোমাদের এই অঞ্চল থেকেও একজন ভিক্ষু ঐরূপ একটি তুর্কি কেন্দ্রে গিয়েছে।

বিশ্বাসঘাতক, শ্যামাঙ্গ ক্রুদ্ধ মন্তব্য করে।

বন্ধু উত্তেজিত হয়ো না, সকল কর্মের নিজস্ব যৌক্তিকতা থাকে–ঐ ভিক্ষুটিও সম্ভবত তার কর্মের যৌক্তিকতা দেখাতে পারবে। শুনতে পেয়েছি তনকূলের তুর্কি কেন্দ্র থেকে এই পক্ষকালের মধ্যেই একটি অশ্বারোহী দল উজুবট গ্রাম অভিমুখে আগমন করবে।

কেন, সেখানে কি হয়েছে? শ্যামাঙ্গ উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়।

জানি না, যোগীটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করে। বলে, আমি এই সংবাদটিই গুরু সিদ্ধপার কাছে জানাতে চাই।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অবশেষে উজুবটে প্রবেশ করে শ্যামাঙ্গ। সঙ্গে যোগীটি থাকায় পথিমধ্যে সকলেই তাদের প্রতি তির্যক দৃষ্টিপাত করছিলো। কিন্তু শ্যামাঙ্গের সেদিকে মনোযোগ ছিলো না। সে মনে মনে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। দ্রুত পদক্ষেপে সে অগ্রসর হচ্ছিল। মনে কেবল একটি চিন্তা, কখন শুকদেবের গৃহে সে উপনীত হবে।

 ১০. শুকদেবের গৃহ নীরব

শুকদেবের গৃহ নীরব। বেলা দ্বিপ্রহর, কিন্তু জনমানব কোথাও আছে বলে মনে হয় না। সে ক্ষণেক স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে। তাতে বিচিত্র একটি ভাব তার উপলব্ধি হয়। মনে হয়, নীরব পল্লীটিতে বিষাদ এবং হতাশা পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে। তার কাছে পরিবেশটি অদ্ভুত এবং দুর্বোধ্য লাগে। সে একটি রাখাল বালককে ডাকলো। বালকটি সংবাদ দিতেই শুকদেব বাইরে এলেন। ক্ষণেক পর দীনদাসকেও দেখা গেলো। যোগীটিকে দেখে দীনদাস বিরক্ত হয়েছেন বলে মনে হলো। বললেন, যোগী মহাশয় কি এই গ্রামেই অবস্থান করবেন?

শ্যামাঙ্গ অবাক হয়। দীনদাসের ব্যবহার তো পূর্বে কখনও রূঢ় দেখেনি সে? এই অল্প কদিনে এমন কী ঘটলো যে

মহাশয়, শুকদেব জানান, আপনি বরং অন্য পল্লীতে যান, আমরা এই পল্লীবাসীরা, বর্তমানে বিপদগ্রস্ত আছি।

দুজনের কেউই শ্যামাঙ্গকে কিছু বলেন না।

শ্যামাঙ্গ বিমূঢ় এবং হতবাক। এমন আচরণ কেন করলেন এঁরা? কী বিপদ এঁদের যে বহিরাগত একজন সংসার ত্যাগী যোগীপুরুষকে পর্যন্ত সহ্য করতে পারেন না? শ্যামাঙ্গ অধিক বাক্য ব্যয় আর করলো না। যোগীগুরু সিদ্ধপাকে কোথায় পাওয়া যাবে–শুধু এই সন্ধানটুকু সে প্রৌঢ় দুজনের কাছে জানতে চাইলো।

দীনদাস সম্মুখে হাত তুলে নির্দেশ করলেন, ঐ যে, ঐ গৃহে যাও।

শ্যামাঙ্গের বিস্ময়ের অবধি থাকে না। ঐ গৃহ তো লীলাবতীদের। ঐ গৃহে যে একজন সিদ্ধ যোগী থাকেন–এ সংবাদ তো কেউ তাকে পূর্বে দেয়নি।

সঙ্গী যোগীটি নির্দিষ্ট গৃহাভিমুখে অগ্রসর হলো। শ্যামাঙ্গকে শুধু বললো, আমি গুরুদেবের কাছে যাই।

দীনদাস জানতে চাইলেন, এই লোকটি লীলাবতীর মাতুলের কাছে কেন এসেছে, জানো?

শ্যামাঙ্গ বুঝতে পারে, লীলাবতীর মাতুলই তাহলে যোগী সিদ্ধপা। বলে, না আমাকে সে কিছু বলেনি, শুধু জানি, সে সিদ্ধপার শিষ্য এবং তার নিবাস পশ্চিমে।

যোগমায়া সম্মুখে এলে শ্যামাঙ্গ তাকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে। সে লক্ষ্য করে, মাতার মুখখানি বিষাদময়।

সে জানতে চাইলো, মাতঃ, মায়াবতাঁকে যে দেখছি না।

ঐ কথায় যোগমায়ার রুদ্ধ আবেগ উদ্বেল হয়ে উঠলো। বললেন, হতভাগিনী বাইরে আসবে না বৎস, তার বড় দুর্ভাগ্য এখন।

অতঃপর যোগমায়াই বললেন–খণ্ডে খণ্ডে, ইতস্তত, পূর্বাপর সঙ্গতিবিহীন, তবু তিনি বললেন, আর তিনি বললেন বলেই শ্যামাঙ্গ ঘটনাগুলি জানতে পারলো।

বৎস, বড় দুর্ভাগ্য আমাদের, জামাতার সন্ধানে প্রতিদিন সামন্ত হরিসেনের গৃহ থেকে দুজন করে লোক আসছে–জামাতা গৃহত্যাগ করেছে–কবে ফিরবে, কিছুই বলা যায় না। এদিকে আবার বালকদের খেলাধুলার সময় দণ্ডগুলির একটি গুলি মস্তকে লেগে এক জ্ঞানার্থী ব্রাহ্মণের রক্তপাত ঘটায় ভয়ানক একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এ স্থানে এ পল্লীতে ভিক্ষু আর যোগীদের সন্ধান করছে গূঢ়পুরুষেরা–কী অঘটন ঘটবে ভবিষ্যতে, কে জানে–আমরা সম্মুখে অন্ধকার দেখছি, তুমি বৎস, বড় দুর্দিনে এলে।

আমার জন্য চিন্তা করবেন না মাতঃ, শ্যামাঙ্গ জানায়, দুর্দিন সুদিন উভয়ই আমার কাছে একরূপ।

লীলাবতী গৃহদ্বার থেকে যোগীটিকে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিলো। মাতুল শিষ্যকে দেখে প্রীত হলেন। অতঃপর দুজনে একটি কক্ষে প্রবেশ করে দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন। লীলাবতীর কৌতূহল হয়েছিলো সামান্য–হয়তো সে ঐ দুজনের আলাপ শুনবার চেষ্টাও করতো–কিন্তু ঐ সময়ই সে মায়াবতীদের গৃহদ্বারে শ্যামাঙ্গকে দেখতে পায়। প্রথম দৃষ্টিতেই সে বিচিত্র একটি স্পন্দন অনুভব করে নিজ রক্তধারায়। ফলে তার ক্রোধ হয়। নিজের উপর, না শ্যামাঙ্গের উপর তা অবশ্য সে স্থির জানে না। কিন্তু ইচ্ছা হয়, একবার লোকটির সম্মুখে গিয়ে দাঁড়াতে। সে জানে, শ্যামাঙ্গের সম্মুখীন হওয়ার আর তার প্রয়োজন নেই। কারণ আম্রপট্টলীর যে সংবাদ জানবার জন্য শ্যামাঙ্গকে তার প্রয়োজন ছিলো, সেই সংবাদ তো তার মাতুল এনে দিয়েছেন। অভিমন্যু দাস আম্রপট্টলীতে নেই, সে সামন্ত হরিসেনের সেনাদলে যোগ দিয়েছে। সুতরাং কোন যুক্তিতে সে এখন শ্যামাঙ্গের সম্মুখীন হবে? লীলাবতী বার দুই শ্যামাঙ্গকে দূর থেকে দেখলো। আর দুইবারই তার মনে হলো, লোকটা প্রতারক, ভণ্ড এবং কাপুরুষ।

লীলাবতী মায়াবতীদের গৃহে এলো অপরাহ্নে। তখনও মায়াবতী ভূমিতে শয়ান। লীলাবতীকে দেখে বললো, আয় এখানে উপবেশন কর।

লীলাবতীর ক্রোড়ে মাথাটি রেখে মায়াবতী কান্নায় ভেঙে পড়লো। বললো, সখী, এ আমার কি হলো?

লীলাবতী সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পায় না। স্বামীর সুখে বড় সোহাগিনী হয়েছিলো মায়াবতী। সেই স্বামী তার হারাবার উপক্রম হয়েছে। এই অবস্থায় সান্ত্বনা বাক্য উচ্চারণ করার কি কোনো অর্থ হয়?

সে বলতে পারে, সখী দুশ্চিন্তা করিস না, তোর স্বামী অবশ্যই ফিরে আসবে–কিন্তু কথাটা কি সত্যি হবে? কে না জানে, বসন্তদাস ভিক্ষুদলের লোক। তাকে সন্ধান করে ফিরছে হরিসেনের লোকেরা। এ অঞ্চলে কোথাও দেখতে পেলেই ওরা বসন্তদাসকে বন্দী করবে। আর একবার ওদের হাতে বন্দী হলে কোনো লোক অক্ষত দেহে ফিরে এসেছে, এমন সংবাদ কারও জানা নেই।

লীলাবতী সখীর মাথায় হাত রাখে। তার রুক্ষ কেশদামে অঙ্গুলি চালনা করে পরম মমতা ভরে। তার মনে হয়, জীবন তাহলে এইরূপই–খণ্ডিত, বিকৃত, প্রতারণাময় এবং হিংস্র। সুখী সংসার বলে জগতে কিছু আছে বলে তার মনে হয় না। সংসারে সুখনীড় রচনা করবার কথা তার, কিন্তু ঘটনা এমন ঘটলো যে, সংসারই তাকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিলো–অথচ তার কোনো অপরাধ ছিলো না। আর সখী মায়াবতী! কদিন পূর্বেও যে ছিলো সংসারবৃন্তে প্রস্ফুটিত কুসুমটি, আজ দেখো, তার কী অবস্থা, সে কেমন ধূলিতে লুণ্ঠিত হচ্ছে–তারও কোনো অপরাধ নেই, তাহলে?

সে বললো, সখী, কাঁদিস না–জীবন বিরূপ হয়ে উঠেছে বলে কি তুই তাকে পরিত্যাগ করবি? বরং ওঠ তুই, আয় আমরা শেষ অবধি দেখি, জীবন আমাদের জন্য কিছু দান করতে পারে কি না।

কথা দুটি সে বললো এই জন্য যে এ ছাড়া তার বলবার কিছু ছিলো না। নিজের অতীত বর্তমান সে একত্রে দেখতে পাচ্ছিলো। এক অদৃশ্য বিধানের নিগড়ে আবদ্ধ সবাই। কেবলি ভয়, কেবলি নিষেধ, কেবলই হতাশা। পিতৃগৃহে দেখছে, স্বামীগৃহে দেখছে, মাতুলালয়ে দেখছে–সর্বক্ষেত্রেই জীবন পিষ্ট, সঙ্কুচিত এবং বিবর্ণ। আশা করার কিছুই নেই কারও—কেননা আশা কখনই ফলবতী হয় না। সুতরাং কেবলই চেষ্টা, কোনো প্রকারে যেন বেঁচে থাকা যায়–জীবনের ধর্মে পারা যায় না, সহজ স্বাভাবিকতায় পারা যায় না, কিন্তু তবু বাঁচতে হবে–কৌশলে হোক, ছলনা করে হোক, আত্মপ্রতারণা করে হোক। এমন ক্লান্তিকর দীর্ঘ প্রক্রিয়ার নামই কি তাহলে জীবন? সে চিন্তা করে কূল পায় না।

সন্ধ্যাকালে নদীতীরে শ্যামাঙ্গ লীলাবতীর সাক্ষাৎ লাভ করলো। লীলাবতী তার মেষ শাবকটি নিয়ে গৃহে ফিরছিলো। বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে শ্যামাঙ্গ ডাকলো, লীলাবতী!

লীলাবতী ঐ ডাক শুনে স্থির হলো মুহূর্তেক, পরক্ষণেই আবার সে সম্মুখপানে অগ্রসর হয়ে চললো। শ্যামাঙ্গের ডাক সে উপেক্ষা করতে চায় বলে মনে হলো। শ্যামাঙ্গ আবার ডাকলো, লীলা–আমি আপনার সঙ্গে দুটি কথা বলতে চাই।

লীলা এবার দাঁড়ায়–এটিও বৃক্ষতল, এবং নিবিড় ছায়া এখানে।

আমি দুঃখিত লীলা, আম্রপট্টলী গ্রামে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

কেন? লীলাবতী কুণ্ঠাবনত পুরুষটির মুখ পানে চায়।

পথিমধ্যে দস্যু আক্রান্ত হয়ে আমি সর্বস্ব হারিয়েছি।

আহা! দুঃখের কথা! লীলা ক্ষুদ্র মন্তব্য করে।

আপনি বিদ্রূপ করতে পারেন, কিন্তু আমি যা বলছি, তার কণামাত্র মিথ্যা নয়।

আর কি কোনো কথা আছে সত্যবাদী পুরুষটির? লীলাবতীর কণ্ঠস্বর এবার গম্ভীর এবং অবিচলিত। জানায়, আমার কাজ আছে, গৃহে আজ অতিথি।

লীলা পদক্ষেপণ করলে শ্যামাঙ্গ বলে, আপনি কোন কারণে আমার উপর রুষ্ট হয়েছেন জানি না, তবে একটি কথা আপনাকে জানানো প্রয়োজন বোধ করি–আমি আপনাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা অবশ্যই পালন করবো।

লীলা আপন মনে যেন হাসে। অতঃপর জানায়, উত্তম কথা, আপনার ভবিষ্যৎ চেষ্টার জন্য পূর্বাহেই ধন্যবাদ। তবে জেনে রাখুন, যার সন্ধানে আপনি যাবেন, তিনি এখন সেখানে নেই–তিনি সামন্ত হরিসেনের বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন–কি, পারবেন সেখান থেকে তাঁকে আনতে?

শ্যামাঙ্গের বুঝতে কষ্ট হয় না, কেন এই ক্ষোভ। লীলাবতীর শ্লেষতীক্ষ কথা তাকে বিলক্ষণ বিদ্ধ করলে সেও লীলাবতীকে জানায়–তাহলে তো আপনি এখন রাজপুরুষের গৃহিণী–আমাদের ভক্তি ও ভয় উভয়ই আপনার প্রাপ্য।

হ্যাঁ, আপনার দেখছি বুঝবার ক্ষমতাটি তীক্ষ্ণ–এখন থেকে বুঝে কাজ করবেন।

সে না হয় করবো, শ্যামাঙ্গ যেন সম্মত হয়। তারপর বলে, কিন্তু একটা কথা কি শুনেছেন?

না বললে কেমন করে শুনবো?

তাহলে শুনুন, অতি শীঘ্রই দুর্ধর্ষ এবং হিংস্র যবন জাতি এদেশে আসছে, ওরা এলে কিন্তু রাজপুরুষদের সত্যি সত্যিই যুদ্ধ করতে হবে–সে বড় কঠিন কাজ হবে তখন।

লীলাবতীর স্বরে আর বিদ্রূপ ধ্বনিত হয় না। সে ধীর পদে কাছে এগিয়ে আসে। বলে, এ সংবাদ আপনি কোথায় পেলেন? সত্যি সত্যিই কি যবন জাতি এদেশে আসবে?

সত্যি-মিথ্যা জানি না, শ্যামাঙ্গ জানায়, আপনাদের গৃহে যে যযাগীটি অতিথি, সে–ই সংবাদটি নিয়ে এসেছে।

এদিকে আবার কুম্ভকার রুহিদাসের পুত্রটিকে নিয়ে যে কাণ্ডটি ঘটেছে তাতে সকলেরই ভয়–সেই পিপ্পলী হাটের মতো কিছু ঘটে না যায়–লীলাবতী চিন্তিত স্বরে জানায়।

শ্যামাঙ্গ দেখলো, এখন লীলাবতী আর চপল নয়, তার স্বরে এখন বিদ্রূপ নেই, ক্রোধ নেই। সে বললো, সাবধানে থাকবেন–প্রয়োজন বোধ করলে এ গ্রাম ত্যাগ করুন– অহেতুক লাঞ্ছিত হওয়ার কোনো অর্থ হয় না।

এ গ্রাম ত্যাগ করে কোথায় যাবো বলুন? শ্যামাঙ্গ দেখে, লীলাবতী তার মুখপানে চেয়ে আছে।

শ্যামাঙ্গ মুখখানি দেখলো, চোখ দুটি দেখলো, কেশপাশ দেখলো, তার মুখে তখন আর বাক্য নিঃসৃত হয় না।

কই, বলুন? কোথায় যাবো এই গ্রাম ত্যাগ করে?

শ্যামাঙ্গের যেন সম্বিৎ ফেরে লীলাবতীর কথায়। মুহূর্তের জন্য সে বিভ্রান্ত হয়েছিলো। বললো, যেখানে হোক, চলে যান–এ গ্রাম নিরাপদ থাকবে না।

আপনি দেখছি আমার জন্য বিশেষ উদ্বিগ্ন হয়েছেন?

শ্যামাঙ্গ সচকিত হয়। এ কথাও কি বিদ্রূপ? সে বুঝতে পারে না। বলে, আপনার রোষ কি এখনও যায়নি?

না, যায়নি, লীলাবতী উত্তরে জানায়। বলে, আপনার উপদেশের কোনো অর্থ হয়–সমস্ত গ্রাম বিপন্ন হলে আমি কোথায় যাবো, কার সঙ্গে যাবো? আর বিপদ কি শুধু বহিরাগত যবনদের কারণে? কেন, সামন্তপতিদের উপদ্রব নেই? তারা আক্রমণ করে না? বরং আপনাকে বলি, আপনি নিজে সাবধান হন, যে কোনো দিন হরিসেনের অনুচররা এ গ্রামে আসতে পারে–

কথা কটি বলে লীলা চলে গেলো। বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শ্যামাঙ্গ।

তার কিছু বলবার নেই, করণীয়ও কিছু নেই। সে যথার্থই কি কাপুরুষ? সমূহ বিপর্যয় আসন্ন উপলব্ধি করেও সে কেবলমাত্র কটি বাক্য ব্যয় ব্যতীত আর কিছুই করতে পারে না? ধিক তোর এই নিবীর্য অস্তিত্বে–তুই কিছুই করতে পারিস না। সন্ধ্যাকালের নির্জন পথে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে ধিক্কার দিতে আরম্ভ করে।

বহির্বাটির কক্ষটিতে শ্যামাঙ্গের শয়নের স্থান হয়েছে। শ্যামাঙ্গ আহারাদির পর শয্যাগ্রহণ করলো। সমস্ত পল্লী অস্বাভাবিক নীরব। মধ্যে মধ্যে কয়েকটি পথকুক্কুর রোদন করে উঠছে। ঐ শব্দ অদ্ভুত লাগে–অজানা ভয় শিহরিত হয় মনে। কে জানে, কোন দুর্যোগ সমান্ন? বাহিরে শুকদেব ও দীনদাসের কথা শ্রবণে আসছিলো। এক সময় ঐ মৃদু আলাপও গেলো নীরব হয়ে। শ্যামাঙ্গ উপাধান দুহাতে আকর্ষণ করে শয়ন করলো এবং তার ক্লান্ত শরীর অচিরেই নিদ্রাভিভূত হয়ে গেল।

বিপর্যয় আরম্ভ হলো মধ্যরাতে। প্রথমে কিছুই বোঝা যায়নি। দূরে রুহিদাসের গৃহ থেকে যখন চিৎকার ওঠে–তখনও শ্যামাঙ্গ নিদ্রামগ্ন। ক্রমে পল্লীবাসীরা দ্রুতপদে বনভূমি লক্ষ্য করে পলায়ন আরম্ভ করলো। দুটি একটি গৃহে যখন অগ্নিসংযোগ আরম্ভ হয়েছে তখনও শ্যামাঙ্গের নিদ্রাভঙ্গ হয়নি। অকস্মাৎ সে অনুভব করে, কেউ তার কক্ষদ্বারে সজোরে করাঘাত করছে। সে জেগে উঠে বসলে মুহূর্তেক পরই চিৎকার এবং আর্তনাদ শুনতে পায়। দ্বার অর্গলমুক্ত করতেই লীলাবতী কক্ষে প্রবেশ করে। রুদ্ধশ্বাসে বলে, শীঘ্র পলায়ন করুন, বিলম্ব হলে প্রাণ হারাবেন।

শ্যামাঙ্গ বাইরে এসে বললো, মায়াবতীরা কোথায়?

লীলাবতী তার হাত ধরে জানায়, তারা বনভূমির দিকে গেছে, আপনি আসুন আমার সঙ্গে, কথা বলবেন না।

এদিকে ততক্ষণে সমগ্র পল্লীটি জ্বলে উঠেছে। কাদের এই কাজ, কিছুই বোঝ যাচ্ছিলো না। দূরে তরবারি হস্তে বীর ধটিকা পরিধানে কিছু লোককে দেখে অনুমান করা গেলো, এরা আর যাই হোক, দস্যু নয়। দুজনে অগ্রসর হতে গেলেই বাধা পায়, সম্মুখে একটি বৃদ্ধকে প্রহার করা হচ্ছে। শ্যামাঙ্গ প্রমাদ গণনা করে–আজ তবে এখানেই ইহলীলা সাঙ্গ করতে হবে। লীলাকে বলে, তুমি অগ্রে যাও–আমি তোমার পশ্চাতে আসছি। লীলা সজোরে শ্যামাঙ্গের বাহু ধরে রাখে। বলে, ওভাবে পারবেন না, পশ্চাতে যাই চলুন।

পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করতেই দেখা গেলো, লীলাবতীদের গৃহ জ্বলছে।

না এদিকে না, সম্মুখেই চলুন, লীলা ধাবিত হলো।

অন্ধকার, ধূম, অগ্নিশিখা এবং আক্রমণকারীদের সোল্লাস চিৎকার। ঐ যে পলায়– ধর ধর–বলে দুজন শ্যামাঙ্গের পশ্চাতে অনুসরণ করে। লীলাবতীর সাধ্য কি যে বলশালী সৈনিকদের পশ্চাতে ফেলবে। তারা লীলাকে ধরতে উদ্যত হওয়া মাত্র শ্যামাঙ্গ একখানি প্রজ্বলিত বংশদণ্ড দুহাতে তুলে নিলো। ওদিকে দুজনের হাতেই রক্তাক্ত তরবারি। ঐ তরবারি দুখানির বিরুদ্ধে বংশদণ্ডটি আর এমন কি অস্ত্র! লীলা, তুমি চলে যাও–শ্যামাঙ্গ চিৎকার করে। কিন্তু ঐ চিৎকার লীলাবতীর শ্রবণে যায় কি না অনুমান করা কঠিন। সৈন্য দুটি তখন ভয়ানক হাসি হাসছে। শেষ আঘাত একেবারেই আসন্ন। শ্যামাঙ্গ প্রস্তুত হলো–জীবন, তোমাকে বিদায়!

কিন্তু ঐ মুহূর্তেই আবার ধাবমান অশ্বের খুরধ্বনিও শোনা গেলো। ধূম এবং অগ্নিশিখার প্রক্ষিপ্ত প্রতিফলনে দ্রুতগতি ছায়ার মতো অশ্বারোহীদের আগমন নির্গমন দেখা যেতে লাগলো। এই অশ্বারোহীদের কারও হাতে উন্মুক্ত তরবারি, কারও হাতে সুদীর্ঘ শূলদণ্ড, কারও হাতের দীর্ঘদণ্ডে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা। এরাই কি পল্লীটিকে ভস্মীভূত করতে চায়? দীর্ঘদেহ, শ্মশ্রুময় মুখমণ্ডল, মস্তকে উষ্ণীষ–না, কোনো সন্দেহ নেই–এরাই সেই যবন দল। শ্যামাঙ্গ নিশ্চিত হয়।

সৈন্য দুটি যেমন, তেমনি শ্যামাঙ্গও বিমূঢ় দৃষ্টিতে ইতস্তত ধাবমান অশ্বারোহীদের দেখছিলো। ঐ সময় একজনকে সম্মুখে অগ্রসর হতে দেখে সৈন্যরা ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করলো। এবং তারপরও ওদের পশ্চাতে একজন অশ্বারোহীকে ধাবমান হতে দেখা গেলো।

লীলা তার হাত ধরে আকর্ষণ করে, চলুন, মূখের মতো দাঁড়াবেন না।

কিন্তু বারেবারেই দাঁড়াতে হলো দুজনকে। দেখলো, তরবারির আঘাতে বালকের ছিন্নমুণ্ড কেমন ভূমিতে গড়িয়ে পড়ে, শূলাঘাতে বৃদ্ধ কিভাবে দুহাত ঊর্ধ্বে তুলে মরণ চিৎকার কণ্ঠ থেকে নির্গত করে, ধাবমান অশ্বের পদাঘাতে রমণী মস্তক কিভাবে চূর্ণিত হয়। সমস্তই দেখলো দুজনে। এবং ঐসব দৃশ্য দেখতে দেখতে বনভূমির প্রান্তে উপনীত হলো তারা। সেখান থেকেই লীলাবতী চিৎকার করে পিতাকে ডাকতে লাগলো। সে তখন উন্মাদিনীপ্রায়–পিতার সন্ধান করছে, মাতুলের সন্ধান করছে, সখী মায়াবতীর সন্ধান করছে। সে জানে না, কে আছে, আর কে নেই। শ্যামাঙ্গ তখনও প্রজ্বলিত, লুণ্ঠিত, বিধ্বস্ত পল্লীটির দিকে চেয়ে আছে। তার মনে কেবলই প্রশ্ন, এরা কারা? একই স্থানে আঘাত হানে, একই গৃহে অগ্নি দেয়, একই পল্লীর মানুষকে হত্যা করে–অথচ দুটি ভিন্ন দল–এদের মধ্যে কি সত্যিই কোনো পার্থক্য আছে?

বরেন্দ্রভূমির জনপদগুলিতে তখন ঐভাবেই প্রাণ বধ হচ্ছে, গৃহ লুণ্ঠিত হচ্ছে, পল্লী প্রজ্বলিত হচ্ছে। রাজধানী লক্ষ্মণাবতীতে পরম ভট্টারক মহারাজ শ্রীমৎ লক্ষ্মণ সেন দেব সিংহাসনে সগৌরবে আসীন হলেও তাঁর মহাসামন্ত ও সামন্তবর্গ প্রজাপালনের কোনো কাজ করে না। বরঞ্চ তারা বিলাসব্যসন ও প্রজাপীড়নে অধিক মত্ত। ওদিকে যবন জাতির হাতে মহাকালের ডমরুতে অনাহত ধ্বনি বেজে উঠেছে। কেউ জানে না, ভবিষ্যতে কী আছে। বড় ধূসর ঐ প্রদোষকাল!

.

[পরের পর্ব – দুষ্কালের দিবানিশি]

Exit mobile version