Site icon BnBoi.Com

টং লিং – লীলা মজুমদার

টং লিং - লীলা মজুমদার

০১-০৫. এটার নাম পেরিস্তান

যে জায়গাটাতে আমি এখন বসে আছি এটার নাম পেরিস্তান। এ জায়গার কথা আমি ছাড়া এ বাড়ির কেউ জানেও না, এখানে কেউ আসতেও পারে না। ছোটোরা এখানে আসবার রাস্তাই খুঁজে পাবে না, আর বড়োদের পেট আটকে যাবে। কারণ, এক জায়গায় এ বাড়ির দেয়ালের কোনা আর পাশের গুদোমখানার দেয়ালের কোনা একেবারে ঘেঁষটে আছে। আর তার নীচে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সরু অন্ধকার একটা নালা।

ভারি ভালো এ জায়গাটা, আঁকড়ে-মাকড়ে একবার পৌঁছুতে পারলে আর ভাবনা নেই, কেউ দেখতে পায় না। সামনে দিয়ে গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে, আর মাথার বেশ খানিকটা ওপরে ওদের একতলার চাতাল, ওইখানেই ওদের নাটকের রিহার্সাল হচ্ছে এখন। ওদের পায়ের তলায় এই চমৎকার জায়গাটার কথা ওরা কেউ জানেও না। জানলে আর অমন নিশ্চিন্ত মনে হাত-পা নেড়ে নাটক করতে হত না!

সবচেয়ে খারাপ ওদের ওই প্রকাশদা, অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না। ওদিকে ক্লাস ইলেভেনে উঠেও বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, নাকি লট হয়েছেন। লট কী তা আমি ঠিক জানি না, তবে আমার বড়োকাকিমা যে-রকম করে বললেন, মনে হল নিশ্চয় খুব খারাপ কিছু।

ওই প্রকাশদা সাজছে শিশুপাল, আর ওদের ইস্কুলের অঙ্কের স্যার ব্রজেনদা সাজছে শ্রীকৃষ্ণ। ছোটোকাকা শেখাচ্ছেন– এমনি করে হাত বাড়িয়ে অর্ঘ্যথালা ধরে থাকো ব্রজেন, মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকো। ছোটোকাকা যা বলছেন ব্রজেনদা তাই করছে। ওদিকে প্রকাশদাকে পায় কে! বই দেখে দেখে খুব অপমান-টপমান করছে ব্রজেনদাকে। বইতে যেসব কথা নেই সেসবও ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আমি পেছন থেকে বই দেখে যেমনি সেকথা বলেছি, কী রাগ আমার ওপর। আমার আর কী! এখন যতই অপমান করুক ব্রজেনদাকে, ওর অঙ্কের খাতা দেখবে ওই ব্ৰজেনদাই, তখন নাকি এক হাত নিয়ে নেবে। আমার বড়োকাকার ছেলে বিভুদা বলেছে।

বিভুদাও কম যায় না। আমাকে খালি খালি বলে,

–দ্যাখ, আমিই বলে কয়ে জ্যাঠামশাইকে– জ্যাঠামশাই মানে আমার বাবা চিঠি লিখিয়ে তোকে আনিয়েছি, এখন আমাদের এক বাক্স দাড়ি-গোঁফ না দিলে তোকে কিন্তু পার্ট দেওয়া হবে না।

শুনে আমি অবাক! এক বাক্স দাড়ি-গোঁফ আমি কোথায় পাব? বিভুদা কিছুতেই ছাড়ে না, বলে,

পাব না মানে? কলকাতার দোকানে সব পাওয়া যায়, গত বছরের ভূতুড়ে নাটকের জন্যে তো কলকাতা থেকেই হাড়গোড় ভাড়া করে আনা হয়েছিল। এবছর সব ঝগড়াঝাটির ব্যাপার, মোটে চাঁদা ওঠেনি, কলকাতা থেকে কিছু ভাড়া করে আনা যাবে না। ভালো চাস তো এক বাক্স দাড়ি-গোঁফ দে, নইলে ভোঁদার দল আমাদের ওপর এক হাত নেবে, এ আমি কিছুতেই সইব না বলে রাখলাম। দাড়ি-ঘোঁফ দেব না! ওঃ! ওই তালপাতার শরীরে তো তেজ কম না!!

এই বলে বিভুদা আমার ডান ঘাড়ে একটা রদ্দা মারল। মেরে বলল,

–এটাকে আমি মার বলি না, এটা শুধু মারের নমুনা। দাড়ি-গোঁফ না দিলে আসল মার কাকে বলে টের পাবি, বুঝলি চাঁদ!

বলে আমার গাল টেনে রবারের মতো এই অ্যাত্তখানি লম্বা করে দিল! শেষটা আমি এইখানে এই পেরিস্তানে চলে আসতে বাধ্য হলাম।

বিভুদা মনে ভাবে কী? ম্যালেরিয়া হয়ে নাহয় আমার শরীর খারাপই হয়ে গেছে, কিন্তু তাই বলে আমার বন্ধু বিশের তো আর ম্যালেরিয়া হয়নি। আসবে একটু বাদেই বিশে এখানে, হাঙরমুখো নৌকো বেয়ে ওপার থেকে। কী চালাক বিশে! এখানে পার হলে চাতাল থেকে ওরা দেখে নেবে, তাই গঙ্গার পুলের ওধারে পার হয়ে, নদীর কিনারা ঘেঁষে ঘেঁষে নৌকো চালিয়ে এসে ওই নালাটির ভেতর নৌকোসুদু ঢুকে পড়ে। ওখানে দেয়ালের গায়ে এই বড়ো আংটা লাগানো আছে, তাতে নৌকো বেঁধে বিশে এক লাফে নেমে পড়বে। সঙ্গেসঙ্গে গলার মধ্যে মেঘ ডাকার মতো শব্দ করতে করতে সিংহও লাফিয়ে নামবে।

সিংহ হল আমার বন্ধু বিশের কুকুর। কী চেহারা সিংহের, বাবা! দেখলেই লোকের হাত-পা হিম হয়ে যায়। আমি কিন্তু সিংহকে একটুও ভয় পাই না। ওর এত বড়ো কালো থ্যাবড়া নাকের ওপর হাত বুলিয়ে দিই, আর সিংহ ওর বুড়ো আঙুলের মতো ল্যাজ নেড়ে, নেচে-কুঁদে, আমার মুখ চেটে একাকার করে দেয়।

পোড়া হাঁড়ির মতো এত বড়ো সিংহের মুখটা, টকটকে লাল জিভ ঝুলিয়ে রাখে। কুকুরের ল্যাজ কেটে দিলে ওদের ভীষণ তেজ বাড়ে, তাই সিংহের ল্যাজটা বিশে বেশি করে কেটে দিয়েছে, তাতে খুব বেশি তেজ হয়েছে ওর।

আমার বন্ধু বিশের গায়ে কী জোর! এই এতখানি বুকের ছাতি, হাতের পায়ের গুলি ইটের মতো শক্ত। এতটুকু করে চুল ছাঁটা, তাতে নাকি কুস্তি করতে সুবিধে হয়। হাতাওয়ালা গেঞ্জি আর নীল হাফ-প্যান্ট আর সাদা ক্যাম্বিশের জুতো পরে বিশে যখন নৌকো থেকে লাফিয়ে নামে ওকে একটা পালোয়ানের মতো দেখায়! আমি মেজোকাকিমার কাছ থেকে চেয়ে আমসত্ত্ব নিয়ে আসি, বিশে এলে ভাগ করে খাই। সিংহও আমসত্ত্ব খায়।

আমরা তিন জনে চাতালের তলায় সবুজ ঘাসের ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে থাকি, আর গঙ্গার পুলের ওপর দিয়ে চেন ঝুলোতে ঝুলোতে মালগাড়ি যায় টং লিং–টং লিং–টং লিং। পায়ের তলায় তখন কীরকম লাগে যেন। মনে হয় অনেক দূরে কোথাও বিশের সঙ্গে চলে যাই।

বিশের বুকে একটা নীল রঙের কঙ্কালের মুণ্ডু আর তার নীচে দুটো মোটা মোটা মানুষের হাড় ক্রস করে বসানো, এইরকম করে উল্কি দিয়ে আঁকা আছে। দেখে প্রথমটা একটু কীরকম মনে হয়েছিল, ঠিক ভয় না, তবে পেটের ভেতরে প্রজাপতিরা ফড়ফড় করছিল। কিন্তু বিশে বললে,

–যাবি নাকি আমার সঙ্গে সমুদ্রের জাহাজে?

শুনে আমি অবাক। বিশে ডাঁসা পেয়ারাতে এক কামড় দিয়ে বললে,

যাবি তো বল। তোকে আন্দামান ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরে নিয়ে যেতে পারি। সেখানে একটা প্রবালের দ্বীপ আছে, তার মাঝখানে মস্ত একটা নীল উপসাগর, সেইখানেই আমাদের আস্তানা। বাইরে থেকে কিছু বুঝবার জো নেই, পাথরে-আড়াল করা সরু নালার মতো পথটা দিয়ে একবার ঢুকলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। নারকেল গাছ জড়িয়ে লতা উঠেছে, তাতে থোলো থোলো কালো আঙুর ঝুলছে, পেড়ে খেলেই হল। পাথরের গায়ে কমলামধুর চাক, মধু উপচে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, সিংহ পর্যন্ত চেটে খায়। মাথার ওপর লাল-নীল হিরেমন পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। যাবি তো বল।

যেতে তো খুবই ইচ্ছে করে; কিন্তু মা যে আবার আমাকেই বলেন চিঠি ডাকে দিয়ে আসতে, মুশকিলও আছে ঢের। তার ওপর নিমকি ইস্কুল থেকে ফিরেই বলে, দাদা আমার ঘুড়ি জুড়ে দাও; বাবা বলেন, খবরের কাগজ থেকে এটা-ওটা কেটে রাখতে। বিশের সঙ্গে সমুদ্রের জাহাজে চলে যেতে তো ইচ্ছে করেই, কিন্তু তাহলে এসব করবে কে?

যখন জোয়ার আসে, হুড়হুড় করে নালা দিয়ে জল ভেতরে ঢুকে যায়। বিশের নৌকো এই পাড়িটা অবধি ভেসে ওঠে। সেই সময়ই বিশে আসে। ভাটা পড়লে জল কোথায় নেমে যায়, এক হাঁটু কাদা বেরিয়ে পড়ে, বিশের নৌকো ডাঙার ওপর বসে থাকে, বিশে আর বাঘা তখন চোরা ঘরে বিশ্রাম করে, আমিও আস্তে আস্তে দেয়াল আঁকড়ে মাকড়ে উঠে পড়ি। তারপর বাগানের ধার ঘুরে গিয়ে খিড়কি দিয়ে আবার বাড়িতে ঢুকি। ওরা ভাবে বুঝি বাগানের ঘাটে বসে ছিলাম।

ততক্ষণে হয়তো নাটকের রিহার্সাল শেষ হয়ে গেছে। বড়োরা অনেকেই যে-যার বাড়ি চলে গেছে। বিভুদা, ছোটোকাকা, আরো দু-একজন চাতালের বাঁধানো পাড়ে হাঁড়িমুখ করে বসে ভোঁদার দলের ওপর খুব রাগ দেখাচ্ছেন। আমি আস্তে আস্তে একটা কোনায় এসে বসতেই ছোটোকাকা বললেন,

–অত গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ালে তো চলবে না, চাঁদ! টাকা-পয়সার ব্যবস্থা নেই, কারো পার্ট মুখস্থ হয় না, সাজপোশাকের কী হবে তার ঠিক নেই, তার ওপর আজ আবার এই কাণ্ড! অমন চুপ করে থাকলে তো চলবে না, সবাই মিলে না খাটলে শেষটা কি ভোঁদার দলই এ-বছর কাপ পাবে না কি?

আমি বললাম, আমাকে একটা পার্ট দিলে তবে তো করব।

বিভুদা বললে, না, না, ছোটকা, ওকে কিছু বলাটা ঠিক নয়। ও আমাদের সকলের জন্যে দাড়ি-গোঁফ এনে দেবে।

ছোটোকাকা বললেন, দাড়ি-গোঁফ আর চুল বল।

বিভুদা বললে, ও হ্যাঁ, দাড়ি-গোঁফ আর চুল।

০২.

কী ভালো ভালো সব দাড়ি-গোঁফ দেখেছি লোকদের মুখ থেকে ঝুলে আছে, কিন্তু সেসব আমি পাব কোত্থেকে? তা বিভুদা কিছুতেই বোঝে না। ওদের রিহার্সালে গণ্ডগোল হয়, মেজাজ ওদের বিগড়ে থাকে, তার ঝাল ঝাড়ে আমার ওপর! বলে, খুব বেশি দিন আর নেই চাঁদ, দু-বেলা পেট পুজো আর লবাবি করে ঘুরে বেড়ালে চলবে না। কদ্দূর কী করলি ব?

বলে আমার হাতের কনুইয়ের উপরে দু-আঙুল দিয়ে খিমচে ধরে মাংস টানে। উঃ! কী ব্যথা লাগে, জায়গাটা দড়া পাকিয়ে গোল হয়ে ফুলে ওঠে! তারপর বিভুদা আমার ঘাড়ে ধাক্কা দিয়ে বলে, তোর সব চালাকি জানা আছে আমার!! ভালো মানুষ সেজে থেকে আমাকে বকুনি খাওয়াবার যত ফন্দি। যা না, মার কাছে গিয়ে নালিশ কর্না গিয়ে।

বলে, মেয়েদের মতো সরু গলায় বলতে থাকে, ওঁ কাকিমা, পেঁখো না, বিভুদা আঁমাকে খালি খালি মারে, আঁ আঁ আঁ!– ন্যাকা চৈতোন!

ঠ্যালা খেয়ে আমি দেয়ালের ওপর গিয়ে পড়ি। ঠিক সেই সময় ছোটকা এসে পড়েন, বিভুদাকে বলেন,

–বাস্তবিক বিভু, এ-রকম ফ্যাসাদে তো আগে কখনো পড়তে হয়নি। বড়দার কাছ থেকে কিছু আদায় করতে পারিস-না? নইলে সব যে ভেস্তে যায়। ভোঁদারা শুনছি কাপ পেয়ে কী ফিস্টি দেবে তার তালিকা তৈরি করছে, বড়ো বড়ো চাদা মাছের ফ্রাই, মুরগির কাটলেট, রাবড়ির আইসক্রিম। আমাদের কাকেও নাকি বলা হবে না।

বিভুদা বললে, অথচ নালুর পইতেতে সব এসে দিব্যি খেয়ে গেছে! ছোঃ! তা তুমি ভেবো না ছোটকা, চাঁদ সব এনে দেবে বলেছে, মেক-আপের জন্য আমাদের একটা পয়সা লাগবে না। ড্রেসও যে-যার নিজেরটা বাড়ি থেকে আনলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।

ছোটকাও একটু খুশি হয়ে গেলেন।

–যা বলেছিস। নাটক হবে আমাদের পুজোর দালানে, বাঁধানো স্টেজ তো রয়েইছে, মাথার ওপর তারা ফুটফুট করবে, নীচে শতরঞ্জি বিছিয়ে দেবে, পেছনে কতক চেয়ার দেব ক্লাব থেকে এনে। কিন্তু

এই অবধি বলেই ছোটকা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বিভুদা মহা ব্যস্ত।

-কিন্তু কী, ছোটকা? আবার কিন্তু কীসের? পাট সব মুখস্থ হয়ে যাবে দেখো। ছোটো ছোটো পাঁচটা পাট আমার, তাই মুখস্থ করে ফেলেছি। একটু একটু সাজ বদলে এক এক পাটে নামব, কখনো শুধু গোঁফ, কখনো শুধু দাড়ি, কখনো দাড়ি-গোঁফ দুই, কখনো চাঁচাছোলা, কার সাধ্যি চিনে নেয়– এই চাঁদ, দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থাটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেল!

আমি বললাম, তা আমাকে তো দুটো-একটা পাট দিতে পার। নিজে পাঁচটা না করে, আমাকে দুটো নাহয় দিলে। কিচ্ছু ভালো মুখস্থ হয়নি তোমার, পড়া-টড়াও তো সব ভুলে যাও কাকিমা বলেছেন!

ততক্ষণ ওদের দলবল এসে গেছে, ছোটকা চাতালের দিকে চললেন, অমনি বিভুদা আমার উপরে লাফিয়ে পড়ে আমার মুঠো মুঠো চুল ছিঁড়ে, কানের লতি টেনে একাকার করে দিল। উঃ, কী খারাপ ছেলে বিভুদা। আমাকে মেরে-টেরে মুখ মুছে দিব্যি রিহার্সালে চলে গেল।

আমি পেরিস্তানে গেলাম। কথাটা বিশেকে না বললেই নয়। বিশে এর একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না। হয়তো সিংহকে দিয়ে চাটাবে। কুকুরকে কী ভয় পায় বিভুদা! নাকি ছোটোবেলায় ওর খাটে হুলোবেড়াল উঠেছিল, সেই থেকে ও কুকুর দেখলে ভয়ে কাদা হয়ে যায়! একবার সিংহকে যদি দেখে, তবেই ওর হয়ে গেল!

পেরিস্তানের মাথার ওপরটা ঢাকা, ওপরে তাকালে থাম্বার উপরে-বসানো বাড়ির তলাটা দেখা যায়, কিন্তু বাড়ির কোনোখান থেকে এ জায়গা দেখা যায় না!

এখানে দুটো চোরা কুঠরি আছে সেকথা কেউ জানে না। নালা থেকে বাড়ির তলায় ছোটো সিঁড়ি বেয়ে চোরা কুঠরিতে ঢোকা যায় তাও কেউ জানে না। চোরা কুঠরির দেয়ালে পাথরের তাক আছে, পাথরের বেদি আছে, তাতে শোয়া যায়। কেউ সেসবের কথা জানে না। জানে শুধু বিশে আর সিংহ আর আমি। তাকে দু-তিনটে বই রেখেছি, একটা বিস্কুটের টিনে কিছু খাবার রেখেছি। সিংহর কিনা খুব খিদে। আমাদেরও খিদে পায়।

পেরিস্তানের ভেতর দিকটা যেমনি অন্ধকার, বাইরেটা তেমনি আলো, ঢালু হতে হতে নদীতে নেমে গেছে। কত গাছ-গাছলা গজিয়েছে সেখানে, নৌকো করে সামনে দিয়ে গেলেও জায়গাটা তত চোখে পড়ে না। পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকি, কেউ টেরও পায় না।

ভয় খালি ওই রেলের লাইনের খুপরি ঘরটাকে। ওইখানে একটা বিশ্রীমতন লোক থাকে, কী লাল লাল চোখ তার। গাড়ি যাবার সময় একটা সবুজ নিশান নাড়ে আর কোনো কাজ করে না। খুপরি ঘরটা খানিকটা উঁচুতে একটা বাঁকের উপরে। ওর পেছন দিকের জানালাটা খুলে ঝুঁকে দেখলে হয়তো পেরিস্তানের খানিকটা দেখা যেতেও পারে। এই আমার ভয়।

তাহলে আর বিশে আসবে না। লোকের সামনে ও কিছুতেই বেরোয় না। বলে আমাদের দেশের লোকেরা ভালো নয়, ওদের দেশে সব অন্যরকম। ওদের ইস্কুলের বড়ো ছেলেরা কক্ষনো ছোটোদের পেছনে লাগে না। তবে বিশে আজকাল আর স্কুলে যায় না। কেন যাবে? সব ওর শেখা হয়ে গেছে। ওদের দেশের লোকেরা কেউ বই পড়ে পাস করে চাকরি করে না। ওদের দেশে আপিস নেই।

খালি খোলা মাঠ আর গাছপালা আর নদী আর ঘন বন আর একটা পুরোনো আগ্নেয়গিরি আর মাঝখানে খানিকটা সমুদ্র, সেখানে ঢেউ ওঠে না। আর চারদিকে যে-সমুদ্র তার শেষ নেই। তিনতলার সমান ঢেউ দিনরাত শুধু কালো কালো পাথরের উপরে আছড়ে পড়ছে আর চারদিকের জল ফেনিয়ে দুধের মতো সাদা হয়ে উঠছে।

প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, এমনি সময় কানের কাছে কীসের শব্দে চমকে উঠে বসেছি।

ঝুপ করে অমনি টান হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। কেউ না দেখতে পেলে বাঁচি!

ও কাদের চ্যাঁচামেচি? পেরিস্তানে আবার কে চাঁচাচ্ছে?

মাটি আঁকড়ে কাঠ হয়ে পড়ে আছি, নাকে ঘাস ঢুকছে, গালের উপর দিয়ে অনেকগুলো ঠ্যাংওয়ালা কী যেন হাঁটছে, তবু নড়ছি-চড়ছি না, নিশ্বাস চেপে রাখছি।

কানের কাছ দিয়ে কলকল ছলছল করে নদী বয়ে যাচ্ছে, চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি। ওপারের ঘাটে অন্ধকার জমা হচ্ছে। বুক ঢিপঢিপ করছে।

অন্য লোক যদি পেরিস্তানের কথা জেনে ফেলে তবে আর বিশে আসবে না।

বিভুদাদের বিশে কী ঘেন্নাটাই করে। বলে, ব্যাটার শরীরটা তোর চেয়ে তিন ডবল বড়ো, ওর লজ্জা করে না তোর সঙ্গে লাগতে। তুই কিছু ভাবিস না, একদিন হতভাগাকে দেখে নেব!

কী গায়ে জোর বিশের। কী ভীষণ সাহস! বিভুদাকে এতটুকু ভয় পায় না। বুকে গুমগুম করে কিল মেরে বলে, তুই দেখে নিস রে চাঁদ, ওটাকে কেমন মাটির সঙ্গে একেবারে বিছিয়ে দিই। চালাকি করবার জায়গা পায়নি, ছোটো ছেলের সঙ্গে লাগতে আসা! আচ্ছা, আমিও আছি!

দূরে পুলের ওপর দিয়ে আরেকটা মালগাড়ি চলে গেল, টং লিং টং লিং টং লিং। বিশে মাঝে মাঝে চলন্ত গাড়ি থেকে লাফিয়ে ওঠে-নামে।

আস্তে আস্তে মাথা তুলে উঠে বসলাম। কোথাও কিছু নেই। এই জায়গায় কী অন্ধকার! নদীর ওপর মিটমিট করে কত নৌকোতে বাতি জ্বলছে। ওপারের ঘাটের আলোগুলো থামের মতো লম্বা লম্বা ছায়া ফেলছে। চোখ তুলে চেয়ে দেখি, আমার মাথা থেকে খানিকটা উঁচুতে, ছোটো একটা গর্ত দিয়ে একটুখানি আলো আসছে। একটা টাকার মতো ছোটো একটা গোল ফুটো। বিশে একবার ওদের দ্বীপের আগ্নেয়গিরির বেয়ে উঠে, ওপর থেকে ঝুঁকে দেখেছিল অনেক নীচে টগবগ করে গলন্ত পাথর ফুটছে আর ধোঁয়া উঠছে আর গন্ধকের গন্ধ আসছে।

খচমচ করে গিয়ে উঠলাম ফুটোর ধারে। চোখ লাগিয়ে তাকিয়ে দেখে আমি থ। আরে, ও যে আমাদেরই বাড়ির চাতাল! ওইখানেই তো বিভুদাদের রিহার্সাল চলছে। ছোটোকাকা হাত-পা নেড়ে খুব বকাবকি করছেন। সব দেখা যাচ্ছে, সব শোনা যাচ্ছে। ভারি একটা গোল হচ্ছে।

এমনি সময় দালানের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন নলিনজ্যাঠা, প্রকাশদার বাবা। রাগে মুখটা কী দারুণ লাল দেখাচ্ছে। বড়ো বড়ো পা ফেলে গিয়ে পাকড়ে ধরলেন প্রকাশদার কান! বললেন, ওঃ! আবার লাটক হচ্ছে! লজ্জা নেই হতভাগা, জানিস পরীক্ষায় অঙ্কে দশ পেয়েছিস! চল, একবার বাড়ি চল, পাঁচ বচ্ছরের মধ্যে আর তোকে ছাড়া নয়!

বলে দিব্যি তার কান ধরে নিয়ে চললেন!

ছোটোকাকা এতক্ষণে হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন, ও কী, ও যে আমাদের শিশুপাল!

প্রকাশদার বাবা কাঁধ থেকে ছোটকার হাতটা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেলেন।

বাকিরা যে-যেখানে ছিল সেইখানেই বসে পড়ল! আমিও আস্তে আস্তে নেমে এলাম। নেমে এদিকে তাকাতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। হুড়মুড় করে নালাটা দিয়ে জল ঢুকছে। গাছের সমান উঁচু সব ঢেউ উঠছে। ঢেউগুলোর মাথায় ফেনার ঝুঁটি। বাড়িটার তলা থেকে অদ্ভুত একটা গুমগুম শব্দ বেরুচ্ছে। হাওয়া থেকে অমনি গরমটুকু চলে গিয়ে গায়ে লাগল ঠান্ডা।

বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল, নদীটা এই বুঝি হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরে ফেলে। তলাকার সেই সরু নালাটাতে ঘুরে ঘুরে ফেনা হয়ে জল ঢুকছে। আর সে কী গর্জন! তার ওপর দিয়ে যাই কী করে?

বিশেরা দল বেঁধে ঝড়ের রাতে শুশুক মারতে যায়। সমুদ্রের ঢেউয়ের মাথায় এই তাদের নৌকো ওঠে, আবার ঝপাং করে এই তাদের নৌকো পড়ে। নৌকোর কানা ধরে আঁকড়ে থাকতে হয়। নইলে কে কোথায় ছিটকে পড়বে আর তাদের খুঁজেও পাওয়া যাবে না। একবার একটা তিন-হাত লম্বা চিংড়ি, হঠাৎ নাকে এল ঝড়ের গন্ধ। লাফিয়ে উঠে ফিরে দেখি, নালার মুখে ফেনা-জলে হাবুডুবু খাচ্ছে ও কার ছোটো নৌকো? ও তো বিশের নয়। আমার নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এল।

০৩.

ইস্, নৌকোতে একটা লোকও আছে দেখলাম– দু-হাতে প্রাণপণে নৌকো আঁকড়ে রয়েছে, মাঝে মাঝে ঠ্যাং দুটো নৌকো থেকে আলগা হয়ে ভেসে যাচ্ছে। জলে-ডোবা লোকদের মাথায় ডান্ডা মেরে অজ্ঞান করে তারপর চুল ধরে হিড়হিড় করে ডাঙায় তুলতে হয়। কিন্তু কাছেপিঠে ডান্ডাও নেই, আর চুল ধরে হিড়হিড় করে টানতে হলে তো আমাকে সুষ্ঠু জলে নামতে হয়, তখন আমাকে কে তোলে তার ঠিক কী? সাঁতারও জানিনে। সর্দি লাগার ভয়ে আমাকে জলে নামতে দেওয়া হয় না।

বিশেদের দেশের ছেলে-মেয়েরা হাঁটতে শিখেই ঝপাং ঝপাং জলে পড়ে সাঁতার কাটে। বিশে একবার একটা জাহাজডুবির নৌকো বাঁচিয়েছিল। ঝোড়ো সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওই যেখানে আকাশের সঙ্গে সমুদ্র মেশে, ওইখানে সাঁতরে গিয়ে ঠেলে ঠেলে নৌকোটাকে ওদের দ্বীপের সরুপথ দিয়ে মাঝখানকার স্থির জলে এনে ফেলেছিল। নৌকোতে জন কয়েক বণিক ছিল, তারা বিশেকে ধনরত্ন দিতে চেয়েছিল। তারা প্রাণ হাতে করে ধনরত্নের বাক্স বুকে চেপে আরেকটু হলেই সমুদ্রের নীচে তলিয়ে গিয়েছিল আর কী! তা আর বিশেকে কিছু দিতে চাইবে না? কিন্তু বিশে কিচ্ছু নেয়নি।

এবার চেয়ে দেখি নৌকোটা আরও কাছে এসে গেছে, পাথরের সিঁড়ির এবড়োখেবড়ো ধাপের ওপর থেকে হয়তো চেষ্টা করলে চুলের মুঠি ধরাও যায়। আমাকে দেখে লোকটা হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ধরো দড়িটা, নৌকো যেন ভেসে না যায়।

বলে একটা মোটা দড়ি ছুঁড়ে দিল। আমি দড়ি আঁকড়ে চোখ বুজে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়লাম। চোখ খুলে দেখি নৌকো ছেড়ে সে এসে ডাঙায় উঠেছে। আমার হাত থেকে দড়ি নিয়ে দেখতে দেখতে দারুণ এক গিঁট দিয়ে দেয়ালের আংটার সঙ্গে নৌকো বেঁধে ফেলল। বলল, মাঝদরিয়ায় এমনি করে বয়ার সঙ্গে নৌকো বাঁধে।

তারপর কুকুরের মতো গা ঝাড়া দিয়ে জল খসিয়ে বললে, উঃফ, আরেকটু হলে মরেই গিয়েছিলাম। বাপ, কালো মাস্টার জলে ডুবে মলো ভাবতেও হাসি পায়! এই, একটা শুকনো কিছু দিতে পার? কান দুটো যে পাতকো হয়ে গেছে, মোটে কিছু শুনতে পাচ্ছি নে।

দিলাম পকেট থেকে ময়লা রুমালটা। লোকটা একবার সেটাকে নেড়েচেড়ে, নাকে তুলে দু-বার শুকে, অমনি পাকিয়ে পাকিয়ে লম্বা একটা খোঁচা বানিয়ে, নিজের কান থেকে রাশিরাশি জল বের করে ফেলল। তারপর বললে, ওয়া! ওয়া! বেড়ে গন্ধ তো তোমার রোমালে, জিভে যে জল এসে গেল।

বললাম সত্যি কথা। রান্নাঘরে গিয়ে বামুনদিদির কাছ থেকে ওতে করে গরম-ভাজা বেগুনি এনেছিলাম। সে বললে, আহা! আছে নাকি কিছুমিছু? খিদেয় যে পেট জ্বলে গেল।

থাকে আমার কাছে সর্বদাই কিছু-না-কিছু। উঠে একবার চোরাকুঠিতে যেতে হল। সেও চলল আমার সঙ্গে সঙ্গে। মোমবাতির আলোতে ঘর দেখে একেবারে হাঁ!

–ই কী! বাড়ির তলায় আবার লুকোনো ঘর কেন? কী কর এসব ঘরে তোমরা?

বললাম, কিছু করি না, আমি ছাড়া কেউ এঘরের কথা জানেও না। আমিও জানতাম না। নেহাত বিভুদা আমাকে দুকান চেপে শূন্যে তুলে মামাবাড়ি দেখাবে বলে তাড়া করেছিল, তাই। আমি পালাতে গিয়ে খিড়কির বাগান দিয়ে পাঁচিলে চড়ে কেমন করে বাড়ির এপাশে চলে এলাম। তারপর একটা জায়গায় পৌঁছোলাম সেটা একেবারে পাশের গুদোমবাড়ির গা ঘেঁষে গেছে। মাঝখানে এতটুকু কঁক, নীচে আবার জল। সেই ফাঁক দিয়ে গলে খানিকটা কার্নিশের মতো দিয়ে হেঁটে একেবারে এখানে এসে গেলাম।

লোকটা বললে, ওয়াঃ!! বেড়ে জায়গাখানি তো! বাড়িটা কি তোমার নাকি?

বললাম, না, মানে আমার ঠাকুরদাদার ঠাকুরদাদার বাবা বাড়িটা বানিয়েছিলেন। এর একটা ইটও ভালো মানুষের পয়সা দিয়ে কেনা হয়নি, বিভুদা বলেছে।

লোকটা বললে, আহা! শুনলেও কান জুড়োয়। তা, এখানে দুটো দিন একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পারি কি? শত্রুররা বড্ড পেছনে লেগেছে, খালি পেটে ভিজে গায়ে আর কত লড়া যায়?

বিস্কুটের টিন খুলে ওকে ঝুরো নিমকি আর মুড়ির মোয়া খেতে দিলাম। ছোটো বোতলের জলটাও ওকেই দিলাম; বড়োটা রাখলাম, বিশেতে আমাতে আর সিংহতে খাওয়া যাবে। লোকটার পরনে শুধু একটা কালো হাফপ্যান্ট, ভিজে সপসপ করছে। আর একটা হাতওয়ালা গেঞ্জি, গায়ের সঙ্গে লেপটে রয়েছে।

তাকের ওপর থেকে চাদরটা দিলাম। সেইটে পরে প্যান্ট গেঞ্জি নিংড়ে বেদিটার উপর মেলে দিয়ে খেতে বসল। খেতে খেতে বললে, বারে বারে ইদিক-ঊদিক তাকানো কেন?

বললাম, বাইরে যা জলঝড়, ওরা হয়তো এতক্ষণে আমার জন্য খোঁজাখুঁজি লাগিয়ে দিয়েছে। এই জায়গাটা খুঁজে পেলেই তো হয়ে গেল। আমারও একটা লুকোবার জায়গা থাকবে না, বিশেও আর আসবে না!

–বিশে? বিশে আবার কে?

বিশে আমার বন্ধু, হাঙরমুখো নৌকো করে নদীর ওপার থেকে আসে, সঙ্গে থাকে ওর কুকুর, তার নাম সিংহ। এ জায়গাটার নাম পেরিস্তান।

লোকটা ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠল।

–বিশে যদি আবার এসে আমাকে দেখে, তাহলে কী হবে?

–হবে আবার কী? ভালোই হবে, ও তোমার শত্রুরদের মেরে পাট করে দেবে। তোমার কোনো ভয় নেই।

–কিন্তু কিন্তু যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে?

লোকটা তো আচ্ছা ভীতু। বললাম, না না, কিচ্ছু ভয় নেই। আমি ওকে বলে দেব। তা ছাড়া আজ আর ও আসবেও না। এখন আমি চলি, তুমি চুপচাপ বিশ্রাম করো। অন্য লোক আছে জানলে বিশে কখনো আসে না। পরে আমিই আবার আসব।

আঁকড়ে-মাকড়ে উঠে, খিড়কির বাগান ঘুরে রান্নাঘর দিয়ে বাড়িতে ঢুকলাম। কাকিমারা আমাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠলেন, ও ছেলে! তোমাকে খুঁজে খুঁজে না বাড়িসুষ্ঠু হয়রান!! জলঝড়ে কোথায় ছিলে? ইস্, ভিজে চুপ্পুড় হয়ে গেছ যে! বলি, ছিলে কোথায়?

বললাম, কেন, খিড়কির বাগানে। গাছতলা থেকে নদীর ওপরে ঝড় দেখছিলাম।

–গাছতলা থেকে? কেন? নদী তো ঘর থেকেও দেখা যায়।

-তা দেখা যেতে পারে, এ অন্যরকম দেখা।

বড়োকাকিমা বললেন, যাও-না, তোমার বড়োকাকা তোমার অন্যরকম দেখা বার করবেন।

আস্তে আস্তে বললাম, আর ছোটকা? বিভুদা?

–তারা এসব বিষয় কিছু জানেও না, কেয়ারও করে না। তাদের নাটকের সব্বনাশ হয়ে গেছে বলে যে-যার ঘরে গিয়ে শুয়ে আছে। যাও, এখন কাপড় ছাড়ো তো। বড়োকাকাকে বুঝিয়ে বলব এখন। এমনি ভীতু ছেলে যে অমনি মুখ শুকিয়ে গেছে!

শুনে হাসি পেল। ভীতুরা কি টগবগে ফেনাভরা নালার উপর দিয়ে আধ-হাত সরু জায়গা দিয়ে হাঁটতে পারে?

রান্নাঘরের জলচৌকিটার ওপর বসে বললাম, নাটকের কী সব্বনাশ হয়েছে রে, পুঁটিদি?

পুঁটিদি আমার মেজোপিসির মেয়ে, আমার চেয়ে একটু বড়ো। কী ঝগড়াটে, বাবা! পুঁটিদি বললে, ওমা! তাও জান না? প্রকাশদা-না, রোজ রোজ ব্রজেনদাকে যা নয় তাই বলে অপমান করে! এমনিতে বইতে আছে শিশুপাল শ্রীকৃষ্ণকে যাচ্ছেতাই সব কথা বলছে। ও এমনি খারাপ যে তার সঙ্গে আরও সব জুড়ে জুড়ে দেয়। প্রথমটা নাকি ব্রজেনদা অত টের পাননি, খুব রেগেছেন মনে মনে, কিন্তু ভেবেছেন বলুকগে ছাই, একটু পরেই তো বধ হবে, তখন বাছাধন টেরটা পাবে! তারপর কাল হয়েছে কী, দু-জনার পার্ট-লেখা কাগজ অদলবদল হয়ে গেছে! ব্ৰজেনদা দেখেন অর্ধেক কথা মোটেই পার্টে নেই, প্রকাশদা বানিয়ে বলে, এমনি খারাপ! তখন ব্ৰজেনদা–

পুঁটিদি আরও কীসব বলতে যাচ্ছিল, এমনি সময় বড়োকাকিমার সে কী ধমক, যাও, যাও, আর পাকামো করতে হবে না। একটা লুচিও যার গোল হয় না, তার মুখে আবার বড়োদের নিন্দে! যাও এখান থেকে!

পুঁটিদি সত্যি চলে গেল আর আমিও ভিজে জামা ছাড়তে ঘরে গেলাম।

ঘরে ঢুকেই দেখি লাল লাল চোখ করে বিভুদা আমার খাটের উপরে বসে আছে। তখুনি চলে যাচ্ছিলাম, কিন্তু বিভুদা বললে, চাঁদ, শোন।

আস্তে আস্তে গিয়ে খাটের ওপাশে দাঁড়ালাম। বললাম, কী?

রাগে বিভুদা ফেটে পড়ে আর কী!

কী! কী আবার কী? নাটক বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় তা জানিস? প্রকাশদা রোজ পার্টের কথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে ব্রজেনদাদের অপমান করে, সেই রাগে সকালে ব্রজেনদা জ্যাঠামশায়কে বলে এসেছেন যে এখনও সাবধান হবার সময় আছে। ওদিকে ছেলে নাটক করছেন! এদিকে অঙ্কের পরীক্ষায় যে দশ পেয়েছেন জ্যাঠামশাই কি সে খবর রাখেন? আর যাবে কোথায়, আপিস-ফেরত জ্যাঠামশাই রিহার্সালের মাঝখান থেকে প্রকাশদাকে কান ধরে সারাপথ হাঁটিয়ে বাড়ি নিয়ে গেছেন! সঙ্গে যে অফিসান গাড়িটা রয়েছে সে খেয়ালও নেই! দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা নেই, শিশুপাল নেই, এখন কী করে নাটক হবে শুনি?

এই না বলে এক লাফে খাট পেরিয়ে ধরেছে আমার টুটি চেপে!

–দাড়ি-গোঁফ কবে এনে দিচ্ছিস বল হতভাগা! না এনে দিলে তোর পেয়ারের ছবি আঁকার খাতার আমি কী করি দেখিস!

পেটের ভিতরে সিঁটকে গেলাম আমি! সত্যি যদি খাতাটা ছিঁড়ে ফেলে! ওতে আমি জল-মানুষদের ছবি এঁকেছি! বললাম, শিশুপালের পার্টটা ইচ্ছে হলে আমাকে দিতে পার।

শুনে বিভুদা আমার টুটি ছেড়ে দিয়ে হেসেই কুটিপাটি!

–সে কী রে চাঁদ? তুই হবি শিশুপাল! শিশুপাল যে একটা বিরাট যোদ্ধা ছিল। তোর তো এই চেহারা! বেড়ালছানার পার্ট থাকলে তোকে দিতাম! ওসব কথা ভুলে যা, দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা কর। শিশুপালের বিষয় আমরা ভাবব।

আরও হয়তো গাঁট্টা-টাট্টা মারত আমাকে, বলা যায় না, কিন্তু ঠিক সেই সময় ছোটকা এসে আমার খাটের উপরে বসে পড়লেন। বিভুদা হাত নামিয়ে নিল। ছোটকা বললেন, তবে কি শেষটা সত্যি সত্যি ওই ভোঁদার কাছে হার মানতে হবে নাকি? বিকেলে ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে তোর নামে কীসব নিন্দে-টিন্দে করছিল ওরা।

বিভুদা লাফিয়ে উঠল, কী, আমার নামে বলছিল কী শুনি।

না, অত রেগে ওঠবার মতো কিছু নয়। তবে বলছিল যে ওই বিভুটাকে আমরা ঘোড়াই কেয়ার করি, আছে তো শুধু গোঁয়ার্তুমি আর গুন্ডাগিরি কত্তে! ঘটে যে গোবর ছাড়া আর কিছু নেই সে ইস্কুলেই রোজ টের পাওয়া যায়! বটুদাকে নিয়েই যত ভাবনা!

বটুদা মানে ছোটকা। বিভুদা তো রেগে টং!

বেশ তো, তাই যদি হয়, এখন থেকে নাটকের ভাবনা তুমি একাই ভেবো, আমার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসো না। আমার দ্বিতীয় পাণ্ডবের পার্টই আমার পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া আরও চারটে পার্ট রয়েছে। ওই যথেষ্ট!

ছোটকা থাকতে থাকতে ও ঘর থেকে সরে পড়তে ইচ্ছেও করছিল, আবার ওদের কথাবার্তাটা শেষ পর্যন্ত না শুনে যাইই-বা কী করে? যেরকম সব মেজাজ দেখছি, এর পরে যদি মারামারি লেগে যায়, সেও দেখতে পাব না শেষটা!

ছোটকা বললেন, ওরে বিভু, সম্মুখে বিপদ, এখন কি তাতে আমাতে খাঁচাখেচি শোভা পায়? জানিস, ওরা কর্ণার্জুন করছে, কী সব ভালো ভালো ড্রেস আনিয়েছে। ভবেশ রায় নাকি কর্ণ সাজছে।

বিভুদা অবাক!

–কে ভবেশ রায়? সিনেমার ভবেশ রায়? তবে-না লোক ভাড়া করে আনার নিয়ম নেই, মিনি পয়সায় করতে হবে?

–আরে না রে না, ভাড়া করা নয়। ভোঁদাদের পাশের বাড়ির অজানেশবাবু যে ওর মামা হয়। সে-ই আনিয়েছে। পয়সাকড়ি দিতে হবে না। ড্রেসগুলো ওই সস্তায় করিয়ে দিয়েছে। কিন্তু দাড়ি-গোঁফ এখনও পৌঁছোয়নি। বুঝলি বিভু, ওরাও চাচাছোলা মুখে রিহার্সাল কচ্ছে! দুটো

স্পাই লাগিয়েছি, তারাই খবর এনে দিচ্ছে। তুই বরং একটা শিশুপালের খবর কর। উঠি বড়দার সেই মক্কেলের বাড়ি গেলে কিছু চাঁদা পাওয়া যায়। জল তো ধরে গেল। কী রে চাঁদ, যাবি নাকি সঙ্গে?

আর বলতে হল না, পাঁচ মিনিটে শুকনো কাপড় পরে আমি ছোটকার সঙ্গে রওনা।

০৪.

মক্কেলের বাড়ি যেতে হলে পুলের মাথা পার হতে হয়। আড় চোখে একবার বাঁকের ধারে আমাদের বাড়িটাকে দেখে নিলাম। গাছ-গাছলায় ঢাকা পুরোনো তিনতলা বাড়ি, চাঁদের আলোতে নদীর ধারে চুপচাপ পড়ে রয়েছে। চাতালটা একেবারে জলের কিনারা ঘেঁষে এগিয়ে রয়েছে, ওরই নীচে এত ব্যাপার কে বলবে! হাসি পেল।

ছোটকা হঠাৎ বললেন, কী রে, নাটক প্রায় ডোবে আর তোর হাসি পাচ্ছে, চাঁদ?

চোখ তুলে চেয়ে দেখি রেলের লাইনের খুপরি ঘরের সেই লোকটা একটা লাল গামছা কেচে টগরফুলের গাছের উপরে মেলে দিচ্ছে। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই গম্ভীর মুখ করে একদৃষ্টে এমন করে চেয়ে থাকল যে আমার বুকের ভেতর জোরে জোরে হাতুড়ি পিটতে লাগল। কতখানি দেখতে পায় কে জানে।

ছোটকা বললেন, নাও, অমন ঢিমেতেতালা চালে চললে তো হবে না, সমরেশবাবু এক বার তাসের আড্ডায় বসে গেলে আর কোনো দিকে হুঁশ থাকবে না।

সমরেশবাবুর দলের লোকেরা তখনও এসে জোটেনি, তাই আমাদের দেখে তিনি মহা খুশি। তক্তপোশের কোনায় একটা রোগা লোক বসে ছিল, তাকে দিয়ে আমাদের জন্য পান আনিয়ে বললেন, দ্যাখ বটু, পাঁচ টাকার নয়াপয়সা ভাঙানি দিতে পারিস? এই তাস খেলে খেলেই দেউলে হতে হবে দেখছি।

ছোটকা বললেন, সে আমি এক্ষুনি এনে দিচ্ছি দাদা, কিন্তু তার আগে আপনার সঙ্গে একটু পরামর্শ ছিল। ওই পুজোর নাটক প্রতিযোগিতা নিয়ে

সমরেশবাবু লাফিয়ে উঠলেন, আঁ! আবার ওই পুজোর নাটক? ভোঁদারা আমাদের গোটা বাড়িটার একরকম ছাল ছাড়িয়ে নিচ্ছে ওদের স্টেজ সাজাবে বলে! তোমার বউদির গয়না, বেনারসি কাপড় কিচ্ছু বাদ যাচ্ছে না। একে যদি নাটক বলে তবে বর্গির হাঙ্গামা কাকে বলে বাপ?

দু-চোখ কপালে তুলে ছোটকা বললেন, অমনি ওদের হাতে তুলে দিলেন সব? দেখুন দাদা, এক পাড়াতে মানুষ হয়েছি, একরকম বলতে গেলে ও আমার ভাইয়ের মতো, কিন্তু সেদিন ক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে আপনার নামে যেসব কথা বলছিল দাঁড়িয়ে শোনা মুশকিল হচ্ছিল।

সমরেশবাবুর মুখটা অমনি গম্ভীর হয়ে গেল।

কী, বলছিল কী?

–সে আর কানে তুলবেন না দাদা, ওসব লোকদের কথা ধর্তব্যের মধ্যেই নয়।

–তবু শুনিই-না কী বলছিল।

–বলছিল যে ও-রকম ঢের ঢের বড়োলোক দেখেছি, দোকানদারি করে সব এক-একটি চাই হয়েছেন। ঘটে যে শুধু গোবর ছাড়া আর কিছু নেই, সে একবার ওর তাস খেলা দেখলেই বোঝা যায়! আরও কী সব বলছিল। এমনি ছাচোড়! অথচ আপনি ওদেরই সাহায্য করছেন আর আমাদের বাড়ির এতকালের পুরোনো ক্লাবটা যে উঠে যেতে বসেছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপও নেই!

রাগে সমরেশবাবুর ঝোলা ঝোলা গোঁফের ধারগুলো মুখের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। সেগুলোকে বের করে না ফেলেই গুম হয়ে বসে থাকলেন। গিলে ফেললেই তো হয়ে গেল! হঠাৎ সেই রোগা লোকটির দিকে ফিরে চাপা গলায় বললেন, এসব কী শুনছি, নোটো?

নোটো বললে, সব মিছে কথা স্যার। ওই মোটা লোকটার একটা কথাও বিশ্বাস করবেন না। আবার সঙ্গে করে ছোটো ছেলে নিয়ে এসেছে মন গলাবার জন্যে! এবার আমাকে উঠতে হয়, তাহলে চাঁদাটা–

ভীষণ রেগে গেলেন সমরেশবাবু, তক্তপোশে কিল মেরে বললেন, কিচ্ছু দেব না, এক কানাকড়ি চাদা কাকেও দেব না–তুমিও শুনে রাখো বটু– তবে যাদের নাটক সবচেয়ে ভালো হবে তাদের পাঁচশো টাকা বকশিশ দেব।– যাও এখন। বটু, আমার ভাঙানি নয়া পয়সা?

–এই যে আনছি—

বলে এক দৌড়ে ছোটকা কোত্থেকে যেন এই বড়ো এক পুঁটলি নয়া পয়সা এনে দিলেন। আমি তক্তপোশের ধারে রোগা লোকটার পাশে কাঠ হয়ে বসে থাকলাম। কেউ কোনো কথা বলল না।

পথে বেরিয়ে নোটো বললে, দিলেন তো দাদা সব ফেঁসে! আমি অনেকটা পাকিয়ে এনেছিলাম, আজ রাতে কি আপনার না এলেই নয়? ও হ্যাঁ, আপনাদের শিশুপালকে নাকি কান ধরে নিয়ে গেছে?

বোধ হয় ভেবেছিল ছোটকা রেগে যাবেন। ছোটকা কিন্তু হেসে বললেন, এক শিশুপাল গেল, তার বদলে আরও ভালো শিশুপাল আসবে। চুটিয়ে সাজাব স্টেজ, বলবেন গিয়ে ভোঁদাকে। পাঁচশো টাকা যখন সমরেশবাবু দেবে তখন আর ভাবনা কী?

–আহা, ফাস্ট হলে তবে তো!

–ওই একই হল, আমাদের নাটক করা মানেই ফাস্ট হওয়া।

নোটো রেগে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল। আমাদের রাস্তায় ঢুকেই ছোটকা বললেন, একটা ভালো শিশুপাল জোগাড় হয় কী করে তাই ভাবছি। দাদাকে বলে দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থাটা করে ফেল শিগগির।

আমি বললাম, তুমি যে এক্ষুনি বললে পাঁচশো টাকা পাচ্ছ, আর ভাবনা নেই।

–নাঃ, তুই নিতান্ত গাধা দেখছি। আরে শত্ত্বরকে ও-রকম বলতে হয়, তাও জানিস না? ওদেরও টানাটানি যাচ্ছে। গত বছর একসঙ্গে কাজ হয়েছিল, অনেক চাদা উঠেছিল। এবার দু-দল হয়েছে, চাদাও ভাগাভাগি। তার উপর ওদের জিনিসপত্রও কিছু কিছু খোয়া গেছে নাকি শুনছি। কারো এখন মাথা ঠিক নেই। খুব সাবধানে এগুনো দরকার।

খুপরি ঘরের লোকটা দেখলাম একটা লণ্ঠন তুলে চারদিকে চেয়ে দেখছে। লণ্ঠন একদিকে লাল কাচ, অন্যদিকে সবুজ কাচ। অনেক দূর থেকে লণ্ঠনটাকে দেখা যায়, তার চারপাশ দিয়ে আলো বেরুচ্ছে, কিন্তু লণ্ঠনটা নিয়ে বেশি দূর দেখা যায় না।

রাস্তায় বৃষ্টির জল জমা হয়েছে, ছোটকা গিয়ে খুপরি ঘরের উঁচু জায়গাটাতে উঠলেন, আমিও পিছনে পিছনে গেলাম। ওখান থেকে একবার দেখা দরকার।

বুকের ভেতরে হঠাৎ ছাৎ করে উঠল, যদি দেখি কালো মাস্টার জলের ধারে পা ঝুলিয়ে বসে আছে! ছোটকা অমনি হই চই করে একটা কাণ্ড বাধাবেন, এদিকের ঘাট থেকে নৌকো নিয়ে ঘুরে ওখানে গিয়ে উপস্থিত হবেন। ভয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম, তাকাতে ভয় করছিল। আস্তে আস্তে চোখ ঘুরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম, নাঃ, কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না!

রাত্রে নরম নরম আটার লুচি হয়েছিল, তার সঙ্গে ছোলার ডাল, বেগুনভাজা আর ডিমের ডালনা। বড়োকাকিমা কী ভালো পায়েস করেছিলেন! রান্নাঘরের দাওয়াতে রংচঙে আসনে সারি সারি বসে পাত পেড়ে সবাই খেলাম।

আমাদের খাওয়া হলে ওইখানে কাকিমারা সবাই বসলেন, বড়োরা উঠোনের মস্ত গন্ধরাজ গাছের নীচে তক্তপোশের উপর বসে নাটকের কথা বলতে লাগলেন।

ভোঁদার উপরে বড়োকাকা ছাড়া সকলের কী রাগ! বড়োকাকা পান চিবোত চিবোতে খালি খালি বলতে লাগলেন, তোরা যাই বলিসনা কেন, কাপ নেবে ওরাই। ওদের সঙ্গে তোদের তুলনা! ছোঃ! কী কাজের ছেলে ভোঁদা, আমাদের নতুন দোকানঘরের জন্যে দু-গাড়ি সিমেন্ট পাইয়ে দিয়েছে। দিয়েছি একটা মোটা চাদা। অনেক খুঁটিনাটি জিনিস ওদের কেনা বাকি আছে। বলছিল। কোথায় নাকি সাজের জিনিস আনতে লোক পাঠিয়েছিল, তার কোনো পাত্তা নেই। ভারি ভাবনা ওদের। দেখছিলাম রিহার্সাল, চমৎকার প্লে করছে। শিখে নিলে পারিস।

শুনে কাকিমাদের পর্যন্ত পিত্তি জ্বলে গেল। ছোটকা, মেজোকাকা, বড়দা, মেজদা, বিভুদা সব রেগে উঠে গেল। বড়োকাকা আরেকটু চুন দাঁতে লাগিয়ে বললেন, কী হল? বাবুদের বুঝি রাগ হল? তা তোরাও ওদের মতো ভালো হ-না, তোদেরও প্রশংসা করব। তুই যে বড়ো বসে থাকলি, চাঁদ?

বড়োকাকিমা বললেন, ও তো আর নাটক করছে না, ওর উঠে যাবার কী আছে?

–কেন, ওকে বাদ দিয়েছে কেন? ছোটো পার্টও তো আছে।

-বিভু বলছিল ও তেমন পারবে না, তা ছাড়া পাড়ার পাঁচটা ছোটো ছেলেকে বাদ দিয়ে তো আর ওকে নেওয়া যায় না, এরা কী মনে করবে! হাজার হোক ও থাকে কলকাতায়। তবে বাদ দেওয়া হয়েছে সে আবার কেমন কথা? ও তো বটঠাকুরকে বলে সমস্ত দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা করছে। সেও তো একটা বড়ো কাজ।

বড়োকাকা অবাক হয়ে গেলেন।

–দাদা দাড়ি-গোঁফ কিনে দেবে, এ তো ভারি আশ্চর্য! এরা নাটক করছে শুনে তো ওকে আসতেই দিচ্ছিল না। নাকি যত রাজ্যের বখা ছেলেদের আড্ডা হবে, এইসব বলছিল। তা বাপু নাটক না হলেও তো আর বখা ছেলেদের এড়াতে পারবি নে, তারাই যখন ওর খুড়ো, ওর দাদা। কী-বলিস চঁদ?

ততক্ষণে কাকিমারা উঠে পড়েছেন, আর বামুনদিদি কঁসিতে করে গোছ গোছ লুচি আর বেগুনভাজা আর ঘরে-করা সন্দেশ, ভাড়ারঘরের সামনে জালের আলমারিতে সকালের জলখাবারের জন্যে তুলে রেখেছে। আমি তখন উঠে গেলাম।

একতলাতেই আমার ঘর। জানলার সামনে গঙ্গা, খাটে শুয়ে সেইদিকে চেয়ে চেয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হল সে লোকটা তো সেই চাট্টি কুচো নিমকি আর একটা মুড়ির মোয়া ছাড়া আর কিছু খায়নি।

অমনি চট করে উঠে পড়লাম। বাড়ি ততক্ষণে নিঝুম হয়ে গেছে। জালের আলমারি থেকে গোটা কুড়ি লুচি, বেগুনভাজা, সন্দেশ এইসব নিয়ে আমার বয়স্কাউটের থলিতে ভরলাম, জলের বোতলে জল ভরলাম। এ তল্লাটে কেউ নেই যে কিছু বলবে। বামুনঠাকরুনের বাড়ি কাছেই, সে রাত দশটায় চলে যায়, চাকররা সারি সারি দালানে শোয়। সামনে বৈঠকখানা ঘরের পাশে ছোটকার ঘর, তার পাশে বিভুদার ঘর। মাঝখানের দরজা খোলা থাকে, বিভুদার বড্ড ভূতের ভয়! অবিশ্যি বলে নাকি রাতে যদি ছোটকাকে বোঙায় ধরে, তাই খুলে রাখে।

খিড়কির দরজা খুলে গেলাম চলে পেরিস্তানে। পিঠে থলি আর জলের বোতল ঝুলছে, গলায় দড়ি-বাঁধা টর্চ, পেনসিলের মতো ছোটো। ছোটোমামা জন্মদিনে দিয়েছিল।

০৫.

বিশে অন্ধকারকে ভয় পায় না। বলে, ভয় আবার কীসের, কেই-বা আমাকে দেখতে পাচ্ছে অন্ধকারে। ওদের দ্বীপের পথে আলো জ্বলে না। চাঁদ না থাকলে হাজার হাজার তারার আলোতে পথঘাট ফুটফুট করে! ওদের দ্বীপের মাঝখানের স্থির জলে বিরাট বিরাট কচ্ছপ থাকে, তারা রাত্রে জল থেকে ডাঙায় উঠে ঘুমোয়, অন্ধকারে বড়ো বড়ো পাথরের মতো দেখায়।

সমুদ্রের ধারে কালো পাথরের উঁচু পাড়ি, তার ধাপে ধাপে বুনো হাঁসদের বাসা। রাত্রে তাদের সাদা সাদা ছায়ার মতো দেখায়। শীতের শেষে দল বেঁধে তারা উত্তর দিকে উড়ে যায়। সমুদ্রের উপর দিয়ে সমানে উড়ে চলে, ভয়ডর নেই।

কিন্তু খিড়কির পাঁচিল বেয়ে কিছুদূর গেলেই দু-বাড়ির ছায়া মিশে সে যে কী দারুণ অন্ধকার তৈরি করে রেখেছে সে আর কী বলব। তার অনেক নীচে জলের শব্দ। সামনে বেল গাছের পাতা বাতাসে খড়খড় করছে।

চলে গেলাম সেখান দিয়ে পেরিস্তানে। লোকটা কপালে হাত দিয়ে জলের দিকে তাকিয়ে বসেছিল। আমাকে দেখে দারুণ চমকে উঠল। সাহস দিয়ে বললাম, এ যে আমি, তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার জন্য খাবার এনেছি।

সে খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল।

–এনেছ? আঃ, বাঁচালে! সর্বদাই আমার কিছু-না-কিছু খাওয়া চাই। নইলে দুব্বল হয়ে যাই। কই, দাও কী এনেছ।

খেতে খেতে বার দুত্তিন আমার দিকে তাকাল। কিন্তু আমি একটু টর্চটা জ্বালতেই ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠল।

ও কী কর কত্তা, ও যে একেবারে কঁচড়াপাড়ার ওধার থেকে চোখে পড়বে, অন্ধকারে খোলা চোখের মতো জ্বলজ্বল করবে। ও কাজও কোরো না। দু-দিন একটু হাড় ক-খানিকে জিরিয়ে নিই। পৃথিবীতে যে এমন একটা শান্তির জায়গা আছে, এ আমি ভাবতেও পারিনি। চাট্টি ভোগ করে নিই। তারপর আবার সেই কুমির-কুমির খেলায় নামতে হবে তো! এত বড়ো বাড়ি তোমার, আমাকে একটা চাকর করেও তো রেখে নিতে পার। তবে আমি অন্য চাকরদের সঙ্গে শোবটোব না, আমাকে আলাদা ঘর দিতে হবে। এই ঘরেই আমার চলে যাবে, এর বেশি কিছু আমার দরকার নেই।

লোকটার কথা শুনে আমি অবাক! বললাম, এ বাড়িটা মোটেই আমার না। তা ছাড়া তুমি কী কাজ করতে জান যে চাকর রাখব?

লোকটা ততক্ষণে খাওয়া সেরে, নদীর জলে হাত-মুখ ধুয়ে আমার কাছে এসে বসেছে। বললে, চাকরি কত্তে হলে কাজ জানা চাই একথা তোমাকে কে বললে? আমি খুব ভালো আঁকতে পারি। ওই যারা সব বড়ো বড়ো সোনার মেটেল পায় আর খেতাব পায়, আমি তাদের চেয়েও ভালো আঁকতে পারি।

পার তো তুমি সোনার মেডেল পাও না কেন?

–তার অনেক অসুবিধে আছে কত্তা। আমি তো আর কাগজে আঁকি না।

কাগজে আঁক না তো কীসে আঁক?

–সে আছে সব, কত্তা, বলব একদিন।

দূরে গির্জার ঘড়িতে রাত বারোটা বাজল। উঠে দাঁড়ালাম, এখন ঘুমোতে যেতে হয়। লোকটা হঠাৎ ফিরে আমার পা দুটোকে জড়িয়ে ধরে বলল, দাও কত্তা, দুটো পায়ের ধুলো দিয়ে কেতাখ করে দাও। আহা ঠাই দিয়ে, আহার দিয়ে প্রাণটা বাঁচালে গো। নইলে পরের জিনিস ঘাড়ে করে বয়ে বেড়াচ্ছি, আমাকে এমন বন্ধু কোন দেবতা দিত হ্যাঁ!

.

ঘরে ফিরে এসে শুয়ে শুয়ে লোকটার কথাই ভাবতে লাগলাম। কালোমাস্টার আবার একটা নাম নাকি? নিশ্চয় ছদ্মনাম। বিশেটাও এর মধ্যে আর আসেনি, ও লোকটা যদ্দিন থাকবে আর আসবেও না। উঃ, পাঁচিল চড়ে চড়ে পায়ে কী ব্যথা! বাড়িতে আমাদের বুড়ো চাকর পাঁচুদা রোজ আমার পায়ে তেল মালিশ করে দিত; কিন্তু এখন থেকে আর দিতে দেব না। পাঁচুদা আমার খাবার সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকত, মাছের কাঁটা বেছে দিতে চাইত, দেব ভাগিয়ে। যারা বেশি পুতুপুতু করে মানুষ হয়, বিশে তাদের নাড়ুগোপাল বলে।

ওদের দ্বীপে নাকি চাকর নেই। যে-যার নিজের কাজ নিজে করে। আমি আজকাল রোজ আমার গেঞ্জি কেচে স্নানের ঘরের জানলায় মেলে দিই।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি। সকালে ঘুম ভেঙে শুনি রান্নাঘরের দালানে বামুনদিদি মহা রাগমাগ করছে। বাসন মাজে তারিণী, তাকে বলছে, একেবারে বক-নাক্কস গো। রোজ ডুলি খুলে আট-দশখান লুচি খেয়ে নেয়, কিন্তু কাল রাত্তিরে একেবারে এক দিস্তে সাবাড়! ওই বিভুদাদার কপালে অনেক দুঃখু আছে এই আমি বলে দিলাম!

বিভুদাও দালানের ওধারে নিমকাঠি দিয়ে দাঁতন করছিল। কথা শুনে সে তো চটে লাল!

–শুনলে ছোটকা? মোটেই আমি লুচি খাইনি, বামুনদির কথা শোনো একবার! বামুনদিদি ঝনর ঝনর করে বাসন নামাতে নামাতে বলল, না খায়নি। লুচিগুলো কঞ্জুর হয়ে উবে গেছে! কাল দুধের দাঁত পড়তে দেখলুম, আর আজ মুখ থেকে সকাল বেলায় কেমন মিছে কথা বেরুচ্ছে দেখেছ! আজ তোমাকে শুকনো তো দেওয়া হবে দেখো।

দুমদাম করে পা ফেলতে ফেলতে বামুনদিদি লুচি গরম করবে বলে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। বিভুদা গজর গজর করতে লাগল, আমি স্নানের ঘরে গিয়ে ঢুকলাম।

সত্যিই কোথাও একটা ভালো শিশুপাল পাওয়া গেল না। ছোটকা অনেক বলাতে বড়োকাকা প্রকাশদার বাবাকে বোঝাতে গিয়েছিলেন, তা তিনি নাকের উপর দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বড়োকাকিমা বললেন, ওই ব্ৰজেনদাই হল গিয়ে নষ্টের গোড়া, ওকে তোরা পাঁচজনে মিলে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে পারিস নে? ও-ই যখন ভাগিয়ে দিয়েছে, ও-ই আনুক-না একটা শিশুপাল!

বিভুদা হই হই করে ছুটে এল, আঃ মা, তুমিই সব ডোবাবে দেখছি! বাইরের ঘরে ব্রজেনদা ছোটকার সঙ্গে ফর্দ করছেন, কথাগুলো ওঁর কানে গেলেই হয়েছে আর কী?

বড়োকাকিমাও রেগে গেলেন, তুই থাম দিকিনি, আমার উপর আর কর্তৃত্ব করতে হবে না! কেন বলব না সত্যি কথা, এক-শো বার বলব।

বিভুদা প্রায় কেঁদে ফেলে আর কী।

–আঃ, মা, কেন বোঝ না যে শুনতে পেলে ব্রজেনদা যদি রেগেমেগে চলে গিয়ে ভোঁদার দলে যোগ দেয়, তখন কি তুমি শ্রীকৃষ্ণ সাজবে নাকি?

সেখানে যারা ছিল সব্বাই হাসতে লাগল। বড়োকাকিমা রেগেই ছিলেন, চেঁচিয়ে বললেন, তা অত হাসবার কী আছে এতে? পারব না নাকি শ্রীকৃষ্ণ সাজতে তোরা ভেবেছিস! জানিস, ইস্কুলের প্রাইজে আমি আওরঙ্গজেব সেজেছিলাম?ইয়া গোপ এঁকে দিয়েছিল, সে আর কিছুতেই ওঠে না। সে যাক গে, কিন্তু তুই শ্রীকৃষ্ণ সাজিস না কেন রে বিভু?

বিভুদা আমতা আমতা করতে লাগল।

–ইয়ে– না– মানে– আমি দ্বিতীয় পাণ্ডব সাজছি কি না–

–আহা, ভারি তো দ্বিতীয় পাণ্ডব সাজছিস, তিন লাইন তো কথা বলতে হবে। ও পার্টটা চাঁদকে দিয়ে, তুই শ্রীকৃষ্ণ সাজলেই পারিস। তুই যখন হলি, দেশ থেকে আমার ধাই-মা তোকে দেখতে এসেছিল। চেয়ে চেয়ে আর চোখ ফেরাতে পারে না। বললে, আহা, ঠিক যেন নীল পদ্মের কুঁড়ি, তেমনি রং, তেমনি ঢং, মানুষ বলে তো মনে হয় না গো! শ্রীকৃষ্ণ তোকেই মানাবে।

বিভুদা ঢোক গিলে বললে, না, মানে, আমি একটু মানে শ্রীকৃষ্ণ বেশ রোগা ছিলেন কিনা– তা ছাড়া চাঁদের পেটে বালিশ বেঁধে দিলেও ওকে ভীমের মতো দেখাবে না। কী লিকপিকে হাত-পাগুলো দেখেছ! গোলমরিচ খেলে হেঁচকি ওঠে!

বলে বড়োকাকিমার সামনে আমার হাতের গুলি সেইরকম করে টেনে দড়কচা বানিয়ে দিল। আমার ভীষণ রাগ হল, বড়োকাকিমার ওপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, আহা! তুমি তো কুকুর ভয় পাও; পাণ্ডবদের সঙ্গে যে কুকুরটা স্বর্গে গিয়েছিল, তাকে দেখলে তো তুমি ভয়ে পালিয়ে যেতে! আর আমার বন্ধু বিশের মস্ত পোড়া হাঁড়ির মতো মুখওয়ালা কুকুর সিংহকে দেখলে তো তোমার পতন ও মুচ্ছো হয়ে যাবে! তোমার চোখ উলটে যাবে।

আমার সাহস দেখে দারুণ অবাক হয়ে বিভুদার মুখে আর কথা সরে না! তারপর বললে, বিশে? দেখলে মা, এত বারণ করা সত্ত্বেও পাড়ার বখা ছেলেদের সঙ্গে ভাব করেছে! এবার খারাপ কথা বলতে আর বিড়ি ফুঁকতে শিখতে কদ্দিন! জ্যাঠামশাই শুনলে কী বলবেন বলো তো, তোমাদেরই দোষ দেবেন দেখো!

অমনি বড়োকাকিমা চোখ গোল গোল করে খপ করে আমার কাধ ধরে ফেললেন, কোথায় পালাতে চেষ্টা করছিস, চাঁদ? বিভু যা বলল সেসব কি সত্যি? কে ওই বিশেটা? নাম শুনেই মনে হয় একটা গুন্ডা পালোয়ান কেউ। কোথায় ওর সঙ্গে তোর দেখা হল বল শিগগির। পাড়ার যত সব বয়ে-যাওয়া বাজে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা! বিশে নিশ্চয় ফণী মিত্তিরদের বাড়ির কেউ?

আমি তো পালাবার পথ পাই নে। রাগের মাথায় বিশের নাম করে ফেলাটা যে কত বড়ো অন্যায় হয়ে গেছে বুঝতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু থামতে পাচ্ছিলাম না। বিভুদাদের কথায় গা জ্বলে যাচ্ছিল। এদিকে বিভুদাও বার বার বলছে, বল, কে ওই বিশে! ওই ভোঁদাদের দলের কেউ নাকি? ওঃ! তাহলে এবার বোঝা গেল ভোঁদারা আমাদের ভেতরকার সব খবর কোত্থেকে পায়! বিশ্বাসঘাতক! স্পাই! গুপ্তচর! টিকটিকি!

শেষটা আমি রেগে চেঁচিয়ে বললাম, না, না, না, না, বিশে তোমাদের পাড়ার কেউ নয়। এ পাড়ার কেউ ওকে চেনেও না, ও মোটেই বখাটে বয়ে-যাওয়া স্পাইনয়। তবে ওর গায়ে ভীষণ জোর, বিভুদাকে ও এক হাতে পটকে দিতে পারে, ও কাউকে ভয় পায় না, ও ও

বড়োকাকিমা বললেন, আহা! ওরকম কচ্ছিস কেন চাঁদ? ওর সঙ্গে তোর কোথায় দেখা হল? তোর বাবা-মা তোকে আজেবাজে কারো সঙ্গে মিশতে দেন না বলেই বলছি।

আমি আবার চেঁচাতে লাগলাম, মোটেই বিশে আজেবাজে লোক নয়! বিশে কী ভালো! হাঙরমুখো নৌকো চেপে কুকুর নিয়ে আসে!

–কোথায় আসে?

পেরিস্তানে।

কাকিমা আর বিভুদা তো হাঁ! পেরিস্তানে? পেরিস্তান আবার কোন জায়গা।

-হ্যাঁরে, তোর শরীর খারাপ লাগছে না তো রে! গত বছরের আগের বছর যে-রকম ম্যালেরিয়াতে ভুগলি, শরীরটাতে সেই ইস্তক আর কিছু নেই!

আমি বললাম, না, বিশে বলেছে খুব ভালো আমার শরীর, ওসব যত রাজ্যের বাজে বানানো কথা! কিছু হয়নি আমার! পুতুপুতু করা ভারি খারাপ!ও-রকম করলে আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাব বলে রাখলাম!

এই বলে ফস করে বড়োকাকিমার হাত থেকে গলে বেরিয়ে, একেবারে নিজের ঘরে দরজা দড়াম ও ছিটকিনি! কারো কথায় দরজা খুলিনি, গোঁজ হয়ে অনেক বেলা অবধি ঘরে বসে থাকলাম। তারপরে যে-যার নিজের কাজে চলে গেলে, বাইরেটা চুপচাপ হয়ে গেলে, গুটিগুটি বেরিয়ে এসে একটা গোটা পাঁউরুটি আর দুটো বাসি আলুর চপ আর এক ছড়া কলা ডুলি থেকে বের করে এনে আমার ঘরে লুকিয়ে রাখলাম। বিকেলের জলখাবারের আগে খোঁজ হবে না জানতাম।

আমাকে স্নান করে সকলের সঙ্গে খেতে বসতে দেখে বড়োকাকিমা আর বিভুদা যেমনি অবাক হল, তেমনি হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ঠিক জব্দ হয়েছে। আমি বাড়ি ছেড়ে পালালে বাবা আর ওদের কাউকে আস্ত রাখবে না! হয়তো এ-বাড়ি থেকেই তাড়াবে! রাখি পিসিমা বলেছে, ঠাকুরদার ঠাকুরদার বাবার তৈরি এই বাড়িটা নাকি বাবার ভাগে পড়েছে, তাই বাবাকে কেউ চটাতে চায় না। আসলে অবিশ্যি রাখি পিসিমার ছেলে হরিশেরই নাকি বাড়িটা পাওয়া উচিত ছিল, কারণ ও বাবার চেয়েও বয়সে বড়ো আর খুব ভালো মাউথ-অর্গান বাজায়।

যাই হোক, আমি আছি দেখে সবাই যেন নিশ্চিন্ত। এমনকী, বিভুদাকে ছোটকা বললেন, চাঁদকে বলেছিস নাকি?

বিভুদা মাথা নাড়ল। ছোটকা বললেন, দেখ চাঁদ, তুই দ্বিতীয় সৈনিক হবি আর অমরেশকে ওই মৃত সৈনিকের পার্টটা দিচ্ছি। ওটা খুব সহজ, বেশি রিহার্সাল লাগবে না, একবার শুধু কোৎ শব্দ করে পড়ে যেতে হবে, তারপর শিশুপাল বধ হওয়া পর্যন্ত, হাত-পা এলিয়ে পড়ে থাকতে হবে।

বিভুদা বললে, আসলে ওই পার্টটাই তোকে দেবার কথা হয়েছিল, বেশ পালক-দেওয়া শিরস্ত্রাণ পরতে পেতিস। কিন্তু ছোটকা বলছে, তুই স্টেজে শুলে ফুটলাইটের ওপর দিয়ে তোকে দেখাই যাবে না, আর অস্ত্রশস্ত্রগুলোও বড্ড বড়ো।

খেয়ে উঠে কাগজে-লেখা পার্টটা পকেটে নিয়ে আবার ঘরে গিয়ে দোর দিলাম। সবাইকে বললাম ঘুম পাচ্ছে, কেউ যেন বিরক্ত না করে। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে, খিড়কির বাগানের দিকে স্নানের ঘরের দরজা খুলে তিন মিনিটে পেরিস্তানে পৌঁছে গেলাম।

দেখলাম কালোমাস্টারের মেজাজ ঠিক নেই বললে, এই অ্যাত্ত বেলা করে ওইরকম শুকনো খাবার আনলে? কই, আমার মাছ তরকারি ভাত কই? নিজে তো একরাশ গিলে এসেছ!

বললাম, অনেক কষ্টে এনেছি। খেতে হয় এই খাও, নয় তো উপোস করে থাকো, আমি চললাম। আমারও মন ভালো নেই।

বলে যেই উঠে দাঁড়িয়েছি, অমনি সে সটাং মাটিতে শুয়ে পড়ে আমার দু-পা জড়িয়ে ধরে বললে, খ্যামা দাও কত্তা, খিদের চোটে অন্যায় বলেছি! নয়তো দু-ঘা লাগিয়ে দাও, কিচ্ছুটি বলব না! কিন্তু আমাকে ছেড়ে যেয়ো না। আমি আবার বসলাম, আর সে সাপটে-সুপটে পাঁউরুটি, চপ, কলা সব খেয়ে ফেলল। ভেবেছিলাম বিকেলের জন্য কিছু রাখবে, তাও রাখল না। শেষটা বললাম, বিকেলে আমার রিহার্সাল আছে, রাতের আগে আসতে পারব না, তুমি বরং জলখাবারের সময় কুচো নিমকি আর মুড়ির মোয়া খেয়ো।

সে যেন আকাশ থেকে পড়ল।

–ওমা! মুড়ির মো আবার কোত্থেকে আসবে? সে তো আমি টিপিন খেয়েছি, তোমার দেরি দেখে!

পকেট থেকে আমার বাঁদর-বিস্কুটের ঠোঙাটা শেষপর্যন্ত দিতে হল। সে মহা খুশি হয়ে তখুনি দুটো বিস্কুট মুখে পুরে বলল, ওয়াঃ! এর সঙ্গে অমৃতের যে কোনো তপাত নেই, কত্তা! ও হ্যাঁ, রিহার্সালের কথা কী বলছিলে? দেখি পাটাখানা; দিয়ে দোব নাকি এইসা এক মওড়া যে সকলের তাক লেগে যাবে!

বললাম, মওড়া আবার কী?

সে তো অবাক!

–ওমা, নাটক করবে, মওড়া জান না? তালিম গো, তালিম! ওই যাকে বলে রিহার্সাল তাই আর কী।

আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম, ও লোকটাই-বা অত কথা জানল কী করে?

০৬-১০. পুরো আধটি ঘণ্টা ধরে

পুরো আধটি ঘণ্টা ধরে আমাকে দ্বিতীয় সৈনিকের পার্ট শেখাল কালো-মাস্টার। বলল, ওতেও হল না, পাখি-পড়া করিয়ে ছেড়ে দেব কেমন দেখো। বাবা! তোমার থেকে কত বড়ো বড়ো বাহাদুরকে অমনি অমনি তৈরি করে দিয়েছি-না! পরে যখন তাদের পাখনা গজাল তখন আর আমার কথা মনে পড়ে না। সে যাক গে, আজ ওই ছাদাটা দিয়ে তোমাদের মওড়া দেখব। দেখো, কালো-মাস্টারের মান রেখো।

একগাল হেসে আমার দিকে তাকিয়ে সে আরও বললে, কী, হল কী কর্তা? আজ মুখটা অমন গোমড়া কেন? কেউ কিছু বলেছে নাকি? বলল তো তার মুণ্ডুটা ছিঁড়ে নিয়ে আসি।

তখন বলতে হল সব কথা–

–দেখো, আমাকে যা খুশি বলুকগে, তাতে আমার ততটা এসে যায় না। কিন্তু বিশেকে নিয়ে ওরা ওভাবে কথা বললে রাগে আমার গা জ্বলে যায়। বিশের বিষয় ওরা কী জানে যে যা-তা বলবে? তাকে দেখেছে কখনো?

কালো-মাস্টার গম্ভীর হয়ে গেল।

-কেউ দেখল না বিশেকে, শুধু একা তোমার সঙ্গে ভাব? হা গো কত্তা, অপরাধ নিয়ো না, কিন্তু অমন লুকিয়ে-চুরিয়ে সে আসেই-বা কেন? ভালোমানুষরা তো বুক ফুলিয়ে সোজা পথে আসে। শেষটা তোমাকে কোনো বিপদে ফেলে দেবে না তো?

শুনে আমি লাফিয়ে উঠলাম, কী যে বল কালো-মাস্টার! তুমি বিশেকে জান না তাই ও-রকম। বলছ। এ-বাড়ির লোকরা এত খারাপ, তা বিশে ওদের সঙ্গে মিশবে কেন? তা ছাড়া ওই সিংহ-না, ও তো খারাপ লোক দেখলেই তাকে কামড়ে-টামড়ে একাকার করে দেয়। কী করে আমাদের বাড়ির লোকদের সঙ্গে মিশবে শুনি? আমার মা কিংবা আমার ছোটোভাই নিমকি হলে অন্য কথা ছিল।

কালো-মাস্টার আমার আর-একটু কাছে ঘেঁষে বসে বলল, ও, তোমার মা ভাই তাহলে ওকে চেনে? তবে তো কোনো ভাবনা নেই!

–না, ঠিক চেনে না, মানে দেখেনি তো কখনো, চিনবে কোত্থেকে! তবে আমি বললেই বুঝবে বিশে কত ভালো। বিশে একবার একলা একটা ডাকাত ধরেছিল তা জান? ওদের দ্বীপের লোকরা সমুদ্রের তলা থেকে মুক্তো তুলে আনে, সেই মুক্তো একটা ঝুলিতে করে বিশে এখানে বিক্রি করতে এনেছিল। প্রাণে ভয় নেই বিশের, রাত্তির বেলায় অন্ধকার গলি দিয়ে একা যাচ্ছে, অমনি ডাকাত এসে দিয়েছে ঝুলিতে টান! আর যাবে কোথায়, অমনি ঘুরে দাঁড়িয়ে ধরেছে বিশে তাকে! ধরেই পিটিয়ে তাকে আধমরা করে ফেলেছে! তারপর তারই গামছা দিয়ে পাছমোড়া করে বেঁধে তাকে থানার উঠোনে ফেলে দিয়ে চলে গিয়েছিল।

শুনে কালো-মাস্টারের চোখ ছানাবড়া!

–আঁ! অমনি ফেলে দিয়ে গেল? দারোগার কাছে জিম্মে করে দিল না? আবার যে ডাকাতি করবে।

–আরে না না, তাকে নাকে খত দিইয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিল আর কখনো এমন কাজ করবে, করলে ওকে চুলচেরা করে দেওয়া হবে বলে শাসিয়ে রাখল। পাগল নাকি, আর ডাকাতি করে সে! বিশের ওই অসুরের মতো চেহারা দেখেই তার হয়ে গেছে! বিভুদা থেকে থেকে আমাকে ক্যাংলা বলে ডাকে, কিন্তু আমার বন্ধু বিশের সঙ্গে শুধু বিভুদা কেন, ছোটকা বিভুদা বড়দা মেজদা সবাই মিলেও পেরে উঠবে না।

এই বলে উঠে যাচ্ছি এমন সময় কালো-মাস্টার আমার হাতদুটো ধরে বললে, ও কত্তা, ওই শিশুপালের পার্টটা কে করবে বললে না?

–বলব আবার কী? লোকই পাওয়া যাচ্ছে না।

-কেন, তোমার ছোটকা সবাইকে শেখাচ্ছেন, উনি নিজে করেন না কেন?

–আহা, ছোটকা করবেন কী করে? ওঁর যে কিছুই মনে থাকে না, উনি পার্ট মুখস্থ করবেন কী করে? উনি তো রোজ বাজার থেকে ভুলে গিয়ে যা-তা আনেন বলে রাগারাগি হয়। কিছু মনে থাকে না বলেই তো কোনো কাজও করেন না। বড়োকাকা কারবার দেখতে বলেন, তা উনি হিসেব রাখতেও ভুলে গেছেন বলে সেখানে যান না। উনি পার্ট করবেন কী করে?

কালো-মাস্টার তখন বললে, তা হলে তোমার বন্ধু বিশেকে পার্টটা দাও না কেন!

-না না, তাই কখনো হয়?

–কেন, ও বুঝি থিয়েটার কত্তে পারে না?

ভারি বিরক্ত লাগল। এমন বোকার মতো কথা বলে লোকটা! বললাম, তা পারবে না কেন? এসব সামান্য পার্ট করা ওর পক্ষে কিছুই নয়। জানো, ওকে একবার শত্রুরা আর একটু হলেই ধরেছিল, তখন ও শত্রুদের সর্দার সেজে ওদের নাকের সামনে দিয়ে চলে এসেছিল। কেউ টেরও পায়নি! বললাম-না, ও এ বাড়ির লোকদের সঙ্গে মিশবেই না, তা নাটক করবে কী করে?

চলে এলাম আবার নিজের ঘরে। তারপর সেদিনকার রিহার্সালে সে কী ঝগড়াঝাটি! ভোঁদার দলের দু-জন লোক মজা দেখতে এসেছিল নাকি! দিয়েছে বিভুদা তাদের মেরে অপমান করে তাড়িয়ে। এসব অবশ্যি আমার চোখে দেখা নয়। রিহার্সাল শুরু হবে এমনি সময় ছোটকা হন্তদন্ত হয়ে চাতালে এসে বললেন, কই, নগা আর ভোলা আসেনি এখনও?

ব্যস, কারও মুখে আর কথাটি নেই। ছোটকা ব্যস্ত হয়ে ইদিক-উদিক ঘোরাফেরা করতে করতে বলতে লাগলেন, কী মুশকিল! ওরা দুজনেই শিশুপালের পার্ট করেছে, তাই এত খোশামুদি করে কান্তা কেবিনে চা-চপ খাইয়ে রাজি করিয়ে এলাম; ব্যস্, এখন কারো পাত্তা নেই! তুই এক বার নগাদের বাড়িতে যা দিকিনি বিভু, ওর পার্ট একেবারে মুখস্থ হয়ে আছে–যা তো চট করে।

বিভুদা বললে, যা তো আবার কী? দু-জনেই শিশুপাল সাজবে নাকি?

–আহা, তা কেন! এক জন সাজবে শিশুপাল, অন্য জনকে দ্বিতীয় পাণ্ডব করে দেব বলে এসেছি।

বিভুদা তো থ! দ্বিতীয় পাণ্ডব?

—হ্যাঁ, তাতে অত অবাক হবার কী আছে? তোকে তেমন মানাচ্ছিল না, তা ছাড়া তোর তো আরও চারটে পার্ট আছে। আর অন্য দিকেও অনেক কাজ থাকবে, লোকজন আসবে

বিভুদা থমথমে মুখ করে বললে, সেগুলো তো আর ঠিক কথা-বলা পার্ট নয়, শুধু সেজে গুঁজে ঘুরে বেড়ানো আর মাঝে মাঝে যে আজ্ঞে বলা। সে আমার দরকার নেই, আমি চলি।

ছোটকা ভারি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ও আবার কী বিভু? দু-জনকেই পার্ট না দিলে যে কেউই আসবে না। তুই বাড়ির ছেলে তুই এইটুকু ছাড়তে পারবি নে? ওসব পারিসও না তো ভালো!

শুনে বিভুদা রেগেমেগে চলে যায় আর কী! বড়দা মেজদা তখন মাঝখানে পড়ে বললে, আরে, অত রাগারাগির কী আছে রে বিভু? মেরে তো ওদের তাড়িয়েই দিয়েছিস, ওরা তো আর পার্ট কত্তে আসছে না!

ছোটকা শুনে হতভম্ব!

–মেরে তাড়িয়ে দিযেছে! তার মানে? আমি তাদের বলে-কয়ে পাঠালাম, রাত্রে খেয়ে যাবে বললাম, ওদের জন্য পরোটা কাবাব কিনে আনলাম, আর এখন মেরে তাড়িয়ে দিলেই হল কি না! যা, ফিরিয়ে আনগে যা।

বলে আগুনের ভাঁটার মতো চোখ করে কোমরে হাত দিয়ে বিভুদার সামনে গিয়ে ছোটকা দাঁড়ালেন। বাবা! দেখে আমারই কেমন বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। এক বার তাকিয়ে বাড়ির ভিতের গায়ের ফুটোটার দিকেও তাকালাম, কালো-মাস্টার আছে তো ঠিক? বাইরে থেকে কিছু বুঝবার জো নেই।

আরও সব ছিল আশেপাশে। সব নিয়ে একুশটা কথা-বলা পার্ট, তা ছাড়া দাঁড়ানো পার্ট, জনতা– সে এক ব্যাপার! চাতালে তোক ধরে না। অথচ কারো পার্ট মুখস্থ নেই, ড্রেসের কিছু ঠিক নেই, দাড়ি-গোঁফ নেই, আর সবচেয়ে খারাপ হল শিশুপাল নেই। তারপর বিভুদা যদি রেগেমেগে দলবল নিয়ে চলে যায়, তাহলে তো আমার দ্বিতীয় সৈনিক সাজা ওইখানেই হয়ে গেল!

বড়দা, মেজদা, কুটুবাবু, ঘনাদা, ঘনাদার মামা আরও কারা কারা ছিল। তারা সবাই মিলে বললে, আহা, বটু ছাড়ান দাও, ছাড়ান দাও, যা হবার তা হয়ে গেছে, এখন একটু চায়ের ব্যবস্থা করো দিকিনি। ততক্ষণ রিহার্সাল চলুক, তুমি বরং নিজেই শিশুপালের পার্টটা পড়ে দাও-না।

চমকে গেলাম। এ যে একেবারে কালো-মাস্টারের মুখের কথা। ছোটকা আমতা আমতা করে বললেন, না, মানে, আমি কী করে পড়ব, স্টেজ-ম্যানেজার কে হবে তাহলে?

আমি বললাম, কেন, বড়োকাকিমা হবেন। উনি তো সব জানেন।

অমনি বিভুদা পারলে আমাকে মারে আর কী!

–যা যা, তোকে অত ফোঁপরদালালি কত্তে হবে না। দাড়ি-গোঁফের কী ব্যবস্থা করেছিস? ঘাবড়ে চুপসে আমি এতটুকু হয়ে গেলাম। আমাকেই যে আবার দাড়ি-গোঁফ আনতে হবে তা মনে ছিল না। আবার মনে হল কালো-মাস্টার তো সবই শুনছে, তার সামনে আমাকে যা-তা বলবে আর আমি কিছু বলব না! চেঁচিয়ে বললাম, হা হা, বলেছি যখন তখন নিশ্চয়ই এনে দেব কোথাও থেকে।

ছোটকা তো হাঁ। বিভুদা বললে, কোথাও থেকে মানে? দাড়ি-গোঁফ কি গাছে হয় যে তুলে আনলেই হল? জ্যাঠামশাইকে লিখেছিস?

উঠে পড়ে বিভুদাকে বললাম, তুমি তোমার নিজের কাজ করো দেখি! দাড়ি-গোঁফ পেলেই হল তো!

ছোটকা বললেন, আঃ বিভু, কেবল ওর পেছনে লাগা। এখন কালকের মধ্যে একটা শিশুপাল ঠিক না হলে তো নাটক বন্ধ করে দিতে হবে! তুই এক বার নগা ভোলার কাছে গিয়ে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে ফিরিয়ে আনবি কি না বল!

বিভুদা বললে, সে আমি পারব না। এক চড়েই যাদের জিভ বেরিয়ে যায়, তাদের পায়ে আমি ধরতে পারব না।

–তাহলে কী হবে? আমিই একবার চেষ্টা করে দেখব না কি?

বিভুদা দারুণ রেগে গেল, দেখো ছোটকা, যা ইচ্ছে তাই করে করে তোমার বড্ড বাড় বেড়ে গেছে দেখছি। আমার পার্ট যদি অন্য কাউকে দাও, তোমার নাটক কেমন করে হয় দেখব। এক্ষুনি খনা, নন্টু, বাচন, ভুবন, সব্বাইকে নিয়ে ভোঁদার দলে চলে যাবনা! কী রে, তোরা আমার সঙ্গে আছিস তো?

অমনি তারা সবাই চেঁচাতে লাগল, হা ওস্তাদ, আমরা সঙ্গে আছি, আমাদের চপ-কাটলেট খাওয়াও।

ব্ৰজেনদা এবার গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলেন, দেখো, নাটক সত্যি হবে কিনা বলল। রোজ সন্ধ্যেবেলা প্রাইভেট টুইশন বন্ধ রেখে আসব, আর ঝগড়াঝাটি ছাড়া আর কিচ্ছু হবে না যদি, তো থাক গে, আমার কাজ নেই।

ছোটকা ওঁর হাত ধরে বললেন, যাস নে ভাই, পরোটা-কাবাবগুলো না খেয়ে যাস নে।

শেষপর্যন্ত রিহার্সাল শুরু হল। ছোটকা শিশুপালের পার্ট ভুলভাল করে পড়তে লাগলেন। আমি কালো-মাস্টার যেমন শিখিয়ে দিয়েছিল তেমনি করে বলে যেতে লাগলাম। শেষের দিকে বড়োকাকা এসেছিলেন শুনে বললেন, বা! বা! তুই যদি আরও এক গজ লম্বা হতিস তো। তোকেই শিশুপাল করে দিতাম।

ছোটকা বিরক্ত হয়ে বললেন, থামো মেজদা, ঠাট্টার সময় ইয়ার্কি ভালো লাগে না।

০৭.

অনেক রাত্রে কালো-মাস্টারের খাবার নিয়ে গুটিগুটি পেরিস্তানে গেলাম। সে তো ওই খাবার দেখেই রেগে কই! বলে, খিদেয় পেট জ্বলে গেল, আর এই অর্ধেক রাত কাবার করে শুধু ক্ষীর আর পাঁউরুটি আর কলা আনলে! আমার মাংস-ভাত কই?

আমি ভেবেছিলাম দেখা হলেই বুঝি কালো-মাস্টার আমার অভিনয়ের সুখ্যাতি করবে; তা নয়, উলটে আবার রাগ দেখানো হচ্ছে! বললাম, কত কষ্ট করে আনতে হয়, তা তো জান না। ভাত পাব কোথায় শুনি? ডুলি খুলে যা পাই তাই আনি। তাই নিয়ে আবার কত কথা হয়। কত রাগারাগি! তা ছাড়া ভাতের চেয়ে আটা-ময়দা খাওয়া অনেক ভালো।

কালো-মাস্টার মুখের গ্রাস নামিয়ে রেখে বললে, কে বলেছে পাঁউরুটি আটা-ময়দার তৈরি? পষ্ট দেখতে পাচ্ছি শুধু কতকগুলো ফুটো দিয়ে তৈরি। ময়দা দিয়ে কতকগুলো ফুটো একসঙ্গে জুড়ে দিয়েছে, সে কখনো খাওয়া যায়?

বলে আবার চোখের কোণ দিয়ে আমার মুখটা চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। আমি ঘাসের উপর ওর পাশে বসে বললাম, দেখো, একটা কাজ করলেই তো পার। রাত্রে এদিকে কেউ থাকে না, তুমি তোমার নৌকোটা করে আস্তে আস্তে তীরের কাছ দিয়ে দিয়ে গিয়ে কান্তা কেবিন থেকে মাংস-ভাত খাও না কেন? ওদের নিজেদের ছোটো ঘাট আছে। অনেক মাঝি ওখানে এসে, রান্নাঘরের পেছনে জলের ধারে বসে অ্যাও বড়ো বড়ো থালায় করে ভাত খেয়ে যায় দেখেছি। লাল লঙ্কা দিয়ে ভাত মেখে খায়। সামনে নৌকা বাঁধা থাকে–

কালো-মাস্টার হঠাৎ হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরল, আর বোলো না, কত্তা, জিভে জল ঝরতে লেগেছে। কান্তা কেবিনটা কোথায়?

কিন্তু কান্তা কেবিনে যাবার পথে একটা বিপদ আছে। মাঝখানে পড়ে ওই রেলের লাইনের সেই লোকটার খুপরি ঘর। সে যদি একবার টের পায়! টং লিং–টং লিং টং লিং করে লম্বা একটা মালগাড়ি পুল পার হতে লাগল। দেখি লোকটা তার সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে লাল-সবুজ লণ্ঠন তুলে ধরেছে আর বার বার এদিকে তাকাচ্ছে। কিছু দেখা যায় না জানি, তবু খানিকটা সরে বসলাম।

কালো-মাস্টার বললে, বেশি পহা চাইবে না তো? আমার বড় টানাটানি যাচ্ছে এখন। অথচ দেশের বাড়িতে সোনাদানা গড়াগড়ি যায়। এই গোছ গোছ কাঁসার থালা, তার এক-একটারই ওজন হবে আড়াই সের, আর আমি কিনা একটা ছেঁড়া খবরের কাগজের টুকরোতে একটা নোংরা হাতলভাঙা পেয়ালা বসিয়ে, শুকনো পাঁউরুটি চিবুচ্ছি!

এই বলে এক টুকরো পাঁউরুটি ছিঁড়ে ক্ষীরে ডুবিয়ে জবজবে করে নিয়ে মুখে পুরল। কাল হবে একচোট ওই ক্ষীর নিয়ে। নাকি মালপো হবে বলে তুলে রাখা হয়েছে। রোজ বামুনদিদি বিভুদাকে বকাবকি করে, ও আর কদ্দিন সইবে? পাহারা-টাহারা দিয়ে একাকার করবে, তখন খাবার আনাই দায় হবে।

কালো-মাস্টারকে বললাম, পয়সা আমি কিছু তোমাকে দিতে পারি। দুটো পুজোবার্ষিক কেনবার জন্য মা আমাকে পাঁচ টাকা বারো আনা দিয়েছেন, তার খানিকটা তুমি নিতে পার।

সে তো গেল রেগে।

–ওঃ, একটা দুঃখী মানুষকে দু-বেলা দুমুঠো অখাদ্য দিতে বুঝি ভারি কষ্ট হচ্ছে? থাক তবে, আমি উপোস করেই থাকি!– আচ্ছা, ওদের ওই রান্নাঘরের পেছন দিকটা বেশ নির্জন তো? বাবুরা আশা করি সেখানে আসেটাসে না মানে আমাকে ওরা একবার ধরলে তো আর আস্ত রাখবে না!

বললাম, আরে না, না, অত ভয় কীসের? জান, আমার বন্ধু বিশেকে একবার কুমিরে ধরেছিল। তবু বিশে ভয় পায়নি, এমনি করে কুমিরের দুটি চোয়াল ধরে টেনে হাঁ-টাকে বড়ো করে দিয়ে কামড় ছাড়িয়ে চলে এসেছিল।

কালো-মাস্টার বললে, সে কী! মারল না কুমিরটাকে? আবার শেষটা কাকে ধরবে। নরমাংসের আস্বাদ পেয়েছে!

–আহা! কুমিরের কামড়ে আইডিন দিতে হবে না বুঝি? মারবার সময় কোথায়? তা ছাড়া কামড় ছাড়াবার সময় এমনি জোরে চাড় দিতে হয়েছিল যে তাইতেই কুমিরটা একেবারে মরে গেছল।

কালো-মাস্টার বললে, সাহস দাও তো একটা কথা বলি। আচ্ছা ওই আনাড়িটা কে, ওই যে ভজকট করে শিশুপাল করছিল?

–ওই তো আমার ছোটকা, উনি তো শিশুপাল করবেন না।

পারবেই না তো করবে কোত্থেকে! –আচ্ছা তুমি দাড়ি-গোঁফ দিচ্ছ তাহলে? আমি সব শুনেছি।

আমি আর কী করি, চুপ করে জলের দিকে চেয়ে থাকলাম। হাঙররা এলে ওদের গায়ের সবটা জলের নীচে থাকে, কিচ্ছু দেখা যায় না, খালি ওদের তিনকোনা পাখনাটা জলের উপর ভেসে থাকে, আর তাই দেখে মাঝিমাল্লারা সাবধান হয়ে চলাফেরা করে।

কালো-মাস্টার আমাকে একটা ঠেলা দিয়ে বললে, কই, কিছু বলছ না যে? দাড়ি-গোঁফ কোত্থেকে কিনছ?– ও কী, মুখ ঢাকছ কেন, কাঁদছ নাকি?

নাক টেনে বললাম, না, কঁদব কেন? আমি তো বিশের বন্ধু। কিন্তু ওই বিভুদা সারাক্ষণ খালি খালি বলে দাড়ি-গোঁফ এনে দে, দাড়ি-গোঁফের কী ব্যবস্থা কল্পি– আর খুব জোরে মারে। এই দেখো, হাতের গুলি টেনে নীল করে দিয়েছে।

কালো-মাস্টারের মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল, একটা আঙুল দিয়ে আমার ব্যথার উপর হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি হেসে বললাম, ও কিছুনা, ও সেরে যাবে। বিশেদের হাত-পা কেটে গেলে ওরা পাথর দিয়ে গাদাফুলের পাতা ঘেঁচে ব্যথার উপর লাগায়, হাড়ভাঙার ডগা বেটে মাখে, একেবারে সেরে যায়। কিন্তু দাড়ি-গোঁফ আমি কোথায় পাব? কিনতে নাকি অনেক টাকা লাগে। বাবা থিয়েটার ভালোবাসেন না। বাবা তো টাকা দেবেন না। শুনলে হয়তো আমার থিয়েটার করাই বন্ধ করে দেবেন।

কালো-মাস্টার নদীর দিকে তাকিয়ে বললে, দাড়ি-গোঁফ তা ভাড়াও পাওয়া যায়।

পাঁচ টাকায় পাওয়া যাবে? তোমাকে মাংস-ভাত খাবার বারো আনা দিলে আমার কাছে যে পাঁচ টাকা থাকবে তাই দিয়ে কি পাওয়া যাবে?

–বাঃ, পুজোবার্ষিক কিনবে না? কী সুন্দর চকচকে মলাট দেয়া থাকে! কিনবে না? না কিনলে তোমার মা কী বলবেন?

মা কাছে থাকলে তো কোনো ভাবনাই ছিল না, এক্ষুনি দাড়ি-গোঁফের ব্যবস্থা করে দিতেন। পরীক্ষার সময় মা আমাকে অঙ্ক বুঝিয়ে দেন, আর মুরগির স্টু বেঁধে খাওয়ান। ঘরে এলেই কীরকম একটা ভালো গন্ধ পাই।

কালো-মাস্টার বললে, ও কত্তা, মার কথা মনে পড়ে কষ্ট হচ্ছে বুঝি? তা মা কাছে না থাকতে পারে, কালো-মাস্টার তো আছে। পয়সাকড়ির জন্য তুমি ভেব না, আমার যা আছে তাইতেই আমার কিছুদিন হেসেখেলে চলে যাবে!

এই বলে ট্যাক থেকে একটা ছোটো কালো থলি বের করে, তার মুখ খুলে, হাতের তেলোয় এতএত পয়সাকড়ি ঢেলে দেখাল। আমি তো অবাক!

–ও কালো-মাস্টার, এত তুমি কোথায় পেলে? ওই দিয়ে তো তুমি সারাজীবন সুখে থাকতে। পার!

কালো-মাস্টার বললে, দেখো, কাল তোমার পুজোবার্ষিক কিনে ফেলল। তার একটা আমাকে পড়তে দিয়ো, কেমন? এখানে একা একা পড়ে থাকি। বাইরে এসে জলের ধারে পা ডুবিয়ে যে বসে থাকব তারও জো নেই, যদি কেউ দেখে ফেলে!– আচ্ছা রেলের ধারের ওই খুপরিঘরের . গোঁফওয়ালা লোকটাকে দেখেছ?

শুনে আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। কালো-মাস্টার বললে, উঃ, ওর দিকে তাকানো যায় না। কাজকাম নেই, সারাদিন শুধু খাই আর খাই! জান, ব্যাটা মাঝে মাঝে উঠে একটা নিশান নেড়ে দেয়, তা ছাড়া সারাক্ষণ শুধু খাবার তালেই আছে! কাটছে বাটছে রাঁধছে, তারপর খাচ্ছে, বাসন মাজছে, পান খাচ্ছে! ওইসব কত্তে কত্তে আরেক বার খাবার সময় হয়ে যাচ্ছে! কত আর সইব, একদিন তেড়েফুঁড়ে গিয়ে ওর খাবারে যদি ভাগ না বসাই–ও কী কত্তা, মুখটা এমন কচ্ছ কেন? ভয় পেলে নাকি?

ভয়? বিশের বন্ধুর আবার ভয়? বললাম, না না, ভয়, তবে অন্য লোকের খাবার কক্ষনো খেতে হয় না। বলল, তুমি ওর কাছে যাবে না?

কালো-মাস্টার বললে, না, না, কত্তা, কিচ্ছু ভেব না। আমি জানি তুমি কত কষ্ট করে আমাকে এখানে লুকিয়ে রেখেছ, আমার জন্য খাবার আনছ, আমি আছি বলে তোমার বন্ধু বিশে আসতে পাচ্ছে না। আমি নিতান্ত নেমকহারাম নই, কত্তা। আজ অনেক রাত হল গে, যাও, শুয়ে পড়ো! এই আমি কথা দিলাম, তোমার দাড়ি-গোঁফের আর শিশুপালের ব্যবস্থা আমি করে দেব। এখন অনেক রাত, তুমি শোও গে।

আঃ, শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। গুটিগুটি চলে এলাম। পাঁচিল দিয়ে খিড়কি বাগানে, খিড়কি বাগান থেকে জানালা দিয়ে আমার স্নানের ঘরে, সেখান থেকে আমার শোবার ঘরের মধ্যে।

ঘরে ঢুকে জুতোটা খুলে খাটে সবে বসেছি, এমনি সময় মনে হল কে আমার দরজা ঠেলছে! আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। দাঁতে ছোরা কামড়ে ধরে, খোঁচা খোঁচা চুল লাল চোখ, একটা লোক যদি এবার এসে ঘরে ঢোকে?– বিশে হলে কী করত?

খাট থেকে নেমে, ঘরের আলো জ্বেলে, দরজার ছিটকিনি খুলে দিলাম, হুড়মুড় করে ছোটকা আমার ঘরে ঢুকলেন, কী ঘুম রে বাবা তোর! সেই কখন থেকে দরজা ঠেলছি, সাড়াশব্দ দিচ্ছিস নে! জোরে ডাকতে পারছি না, পাছে বিভুকাকড়াবিছে শুনতে পায়। শোন, নাটক করে কাপটা পেতে পারলে, এশহরে আর আমি মুখ দেখাতে পারব না। এটা তো বুঝিস? শোন, একটা কাজ করে দিস তো একটা খুব ভালো জিনিস দেব তোকে।

আমি বললাম, কী ভালো জিনিস?

ছোটকা গেলেন রেগে। চাপা গলায় বললেন, এমনি দেখে মনে হয় বুঝি গাল টিপলে দুধ বেরুবে। অথচ ভেতরে ভেতরে এত বিষয়বুদ্ধি! যা, তোকে দুটো টাকা দেব।

আমি বললাম, দু-টাকা আমি চাইও না, আর তোমার নেইও। তুমি তো বড়োকাকিমার কাছ থেকে এক টাকা চাচ্ছিলে চা খাবার সময়।

ছোটকা বললেন, আচ্ছা, আচ্ছা, তোকে একটা ভালো পেনসিলকাটা দেব। এবার হল তো?

আমি বললাম, কোন পেনসিলকাটাটা? ওই যেটা বিভুদা নেয়নি, সেটাতে তো শিষ ভেঙে যায়।

ছোটকা বললেন, কী মুশকিল! আচ্ছা, তোকে একজোড়া সাদা খরগোশ এনে দোব, আমার বন্ধু জীবনের বাড়ি থেকে। তা হলে হবে তো?

বললাম, ইস্ সত্যি দেবে তো?

–আরে হা! হা! আমার কাজটা করে দে তো আগে।

–বলো, কী কাজ?

–তোর ওই বিশেটিকে রাজি করিয়ে শিশুপালের পাট করাতে হবে। তোর কথায় তো মনে হয় ও সব পারে।

শুনে কাঠ হয়ে গেলাম।

–বিশে তো করবে না ছোটকা।

–আহা, তাকে রাজি করাতে হবে। নইলে কী বলছি? তাকে একবারটি আমার কাছে এনে দিতে পারবি তো? নাকি তাও না?

আমি চুপ করে থাকলাম। ছোটকা উঠে পড়ে বললেন, তবে থাকগে। কাল সবাইকে বলে দিই যে নাটক হবে না।

–ও মা! নাটক না হলে আমি দ্বিতীয় সৈনিক হব কী করে? ব্যস্ত হয়ে বললাম, না, না, ছোটকা, দেখি একবার চেষ্টা করে।

০৮.

সকালে মার কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়ে কী যে ভালো লাগল। মা লিখেছেন পুজোর ক-দিন নিমকিকে নিয়ে এখানে কাটিয়ে যাবেন, বিভুদাদের নাটক দেখবেন। নিমকিও চিঠির কোনা দিয়ে এত বড়ো কাগ এঁকে দিয়েছে। কতদিন নিমকিকে দেখিনি। বিশেকে নিমকির কথা বলেছি; রাত্রে একা উঠতে ভয় পায়, আমাকে সঙ্গে যেতে হয় এসব কথা বলেছি। বিশে বলেছে ওকে সাহসী করতে হবে। নিমকি এখানে এলে বেশ হবে, সাহসী করবার জন্য ওকে পেরিস্তানে নিয়ে যাব। ওই সরু জায়গাটা একবার পার হতে পারলেই ও সাহসী হয়ে যাবে।

কিন্তু মাকে কিছু বলা যাবে না, বড়োরা বড্ড কথা জিজ্ঞেস করে। তা ছাড়া বিশের কথা শুনলে কী বলবেন কে জানে! হয়তো বলবেন, ওকে ওপরে নিয়ে আয়, আমাদের সঙ্গে চা-জলখাবার খাবে।

বিশে চা খায় না। সিংহকে দিলে হয়তো খেত, কিন্তু বিশে দেয় না। মা তো সিংহকে দেখলে ভয় পাবেন। মা কুকুর ভালোবাসেন না, বলেন ওরা নাকি ভারি নোংরা। একবার বাবা একটা কুকুরবাচ্চা এনেছিলেন; আপিসের সায়েব দিয়েছিল ছোট্ট, হলদে রঙের, ঝাঁকড়া চুল, কুতকুতে চোখ, বাবার কোলে চড়ে এসেছিল। মা দেখেই প্রায় মুচ্ছো যাবার জোগাড়! বললেন, এক্ষুনি ফিরিয়ে দিয়ে এসে ওটাকে। কে ওকে খাওয়াবে, চান করাবে, ময়লা পরিষ্কার করবে শুনি? জগুর যা ঘঁচিবাই, আর আমি তো ছোঁবও না– ও কী করছ, কাছে এনো না বলছি– উঃ!

বলে মা হাত-পা এলিয়ে সোফার ওপর পড়েই গেলেন।

কত করে বললাম নিমকি আর বাবা আর আমি ওর দেখাশুনো করব, সে কিছুতেই কিছু হল। শেষটা বাবা সত্যি সত্যি হরেনকাকাদের বাড়িতে কুকুরটাকে দিয়ে এলেন। ইস, ওদের বাড়ি গিয়ে দেখেছি কুকুরটা ওদের হাত-পা চাটে! সিংহ রোজ আমার নাকমুখ চেটে দেয়, আমি একটুও ভয় পাই না।

সকালের জলখাবার খেয়ে যে-যার কাজে গেলে দেখি একটা তেলেভাজাওয়ালা ঝাঁকা নামিয়ে খিড়কি দোরের ধারে বসেছে। পাঁচিলের ওপর দিয়ে এক ঠোঙা কিনলাম, কিছু মুড়ি কিনলাম ওর কাছেই ছিল। লোকটা খুব খুশি, মাথায় আঁকা তুলতে তুলতে বলতে লাগল, খেয়ে দেখো খোকাবাবু, সারাজীবন জিভ চুলকুবে।

খুব ইচ্ছে করছিল তবু একটাও খাইনি, মা বারণ করেন।

পেরিস্তানে গিয়ে দেখি চোরাঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অনেক ধাক্কাধাক্কি করবার পর কালো-মাস্টার বেরিয়ে এসে বলল, কী, লাগিয়েছ কী বলো তো? পাড়া ডেকে এখানে এনে জড়ো করবে নাকি?

তারপর আমার হাতে ঠোঙা দেখে খুশি হয়ে বলল, ও কী, এনেছ কী? আহা, বেঁচে থাকো বাপ, এক-শো বছর পরমাই হোক।

এই বলে পেঁয়াজি, বেগুনি, ফুলুরি একটা করে মুখে পোরে আর একমুঠো মুড়ি খায়। আমার তাই দেখে দেখে জিভের জলে পেট ঢাক!

খেয়েদেয়ে কালো-মাস্টার নালার জলে হাত ধুয়ে আমাকে বললে, দেখবে এসো, কী ব্যবস্থা করেছি।

বলে আমাকে চোরাঘরে নিয়ে গেল।

দেখে আমার মাথাটাথা ঘুরে একাকার। দেখলাম ঘরের মাঝখানকার বেদিটার ওপরে সারি সারি দাড়ি-গোঁফ সাজানো। লম্বা দাড়ি, বেঁটে দাড়ি, খোঁচা দাড়ি, ছুঁচলো দাড়ি, চারকোনা দাড়ি, সোজা দাড়ি, কোঁকড়া দাড়ি, লাল দাড়ি, কালো দাড়ি, সাদা দাড়ি, হলদে দাড়ি, ছাগল-দাড়ি, দোভাগা দাড়ি। আর সে কী গোঁফ! বুরুশ গোঁফ, পাকানো গোঁফ, ঝোলা গোঁফ, শজারু গোঁফ, বেড়াল গোঁফ, মাঝখানে চাচাছোলা দু-ধারে গোঁফ, দু-ধারে চঁচাছোলা মাঝখানে গোঁফ, প্রজাপতি গোঁফ, মশার মতো গোঁফ।

দেখে দেখে আর আমার চোখ ফেরে না! এত গোঁফ দিয়ে যে আমাদের সারাজীবন সুখে কেটে যাবে। গলা দিয়ে আমার কথা। বেরোয় না, শেষটা ভাঙা গলায়। বললাম, কোথায় পেলে কালো মাস্টার? খেতে পাও না, গোঁফ-দাড়ি কোথায় পেলে?

কালো-মাস্টার বললে, আমার। নৌকোর ভেতরটা এই দিয়ে ভরে ছিল যে। জলে ভিজে জাবড়া হয়ে এর সঙ্গে ও এঁটে ছিল, এর রং। গড়িয়ে ওর গায়ে লেগে ছিল। এতদিন ধরে রাত জেগে না ঘুমিয়ে না খেয়ে

আড়চোখে একবার আমার দিকে চেয়ে আবার বলতে লাগল, না ঘুমিয়ে, আধপেটা খেয়ে, জট ছাড়িয়ে, রং ধোলাই করে, তেল মাখিয়ে, পাতা কেটে, কোকড়া আঁচড়িয়ে, তবে সে-না ভোল ফিরিয়েছি। এখন এরকম বলা যেতে পারে এরা আমারই হাতে তৈরি। নেবে এগুলো? তাহলে কিন্তু আমার একটা কথা রাখতে হবে।

দাড়ি-গোঁফের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে দেখতে লাগলাম। আহা, ওই লালচে পাকানো গোঁফ-জোড়াটি দ্বিতীয় সৈনিকের গোঁফই বটে। হাত বাড়িয়ে আস্তে আস্তে ছুঁতে গেলাম, ফোঁস করে উঠল কালো-মাস্টার।

অবাক হয়ে চেয়ে দেখি এই একটু আগে মুড়ির সঙ্গে তেলেভাজা খেয়ে যার মুখ হাসিতে ভরে ছিল এখন তার অন্য রূপ। পিঠ-বাঁকানো বনবেড়ালের সঙ্গে আর তার কোনো তফাত নেই। চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, খবরদার, ওতে হাত দিস নে বলছি। অধম্মের কাজ করে, প্রাণ হাতে করে ওর জন্য আমি বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়ে আছি। ছুঁয়ো না বলছি। আগে বলো আমি যা বলব তাই হবে!

ছুটে পালাতে যাচ্ছি, খপ করে আমার হাতের কবজি ধরে ফেলে কালো-মাস্টার বললে, ওঃ! বিশেষ বন্ধু বুঝি বিপদের সময় পালিয়ে যায়! আমি কোথাকার একটা কালো-মাস্টার আমি প্রাণ তুচ্ছ করে দাড়ি-গোঁফ আগলে আছি, খেতে পাই নে, ভালো একটা বিছানা পাই নে, এই আমি যার চারটে বালিশ আর দুটো বড়ো পাশবালিশ না হলে ঘুম হত না–আর দরকারের সময় তুমি দিব্যি চম্পট দিচ্ছ! বিশে শুনলে কী বলবে শুনি?

ব্যস্ত হয়ে বললাম, ইয়ে– না– চলে তো যাচ্ছিলাম না।

সে বললে, তাও ভালো। তবে শোনো, এই দাড়ি-গোঁফ সব তোমাকে দেব, কিন্তু তার বদলে বিশে সাজবে শিশুপাল।

আমার মুখে কথাটি নেই। কালো-মাস্টার আমার দিকে চেয়ে বললে, কী বলতে চাইছিলে বলেই ফেলল। বিশে থিয়েটার করবে না, এই তো? আহা, তুমিও যেমন! আরে আমিই বিশে হয়ে শিশুপাল সাজব, তাও বুঝলে না?

উঃ, বাঁচা গেল! মনটা হালকা হয়ে গেল।

–কিন্তু

কালো-মাস্টার বললে, এর মধ্যে আবার কিন্তু কী? এতে কার কী অসুবিধেটা হচ্ছে শুনি? আমি এখান থেকে না যাওয়া পর্যন্ত বিশে আসছে না এটা তো ঠিক? কাজেই সে কোন গোলমাল করতে পারবে না। তোমার ছোটকারা তো যেমন করে তোক একটা শিশুপাল পেলেই খুশি! তাহলে আর আপত্তিটা কোথায়? আমার জীবনের আশা শিশুপাল সাজব।

বললাম, কিন্তু তোমার শত্রুরা যদি তোমাকে ধরে ফেলে?

কালো-মাস্টার এত জোরে হো-হো করে হেসে উঠল যে আমার ভয় হতে লাগল ওপর থেকে যদি ওরা শুনে ফেলে! কালো-মাস্টার বললে, কিছু মনে কোরো না, আমি যাকে শিশুপাল সাজাব অন্য লোকে তাকে চিনে ফেলবে এ কথা শুনলেও হাসি পায়। কেউ চিনবে না, বুঝলে। আমি শিশুপাল সাজলে আমি আর আমি থাকবনা, সত্যি করে শিশুপাল হয়ে যাব, এও কি বলে দিতে হবে? জানো মণি পালকে এমন জটায়ু সাজিয়েছিলাম যে অনেকদিন পর্যন্ত তার মুখ থেকে কিচিরমিচির ছাড়া কোনো শব্দ বেরুত না।

বললাম, পারবে তো কালো-মাস্টার? পার্ট দেখলে না, রিহার্সাল করলে না, শেষটা সব ডোবাবে না তো?

তাই শুনে সে হাত-পা ছুঁড়ে তখুনি শিশুপালের পার্ট আগাগোড়া এমন চমৎকার বলে যেতে লাগল যে আর আমার কোনো আপত্তিই থাকল না। শুধু ওকে ওই বিশে বলে চালানোতেই যা মুশকিল। সে বুঝিয়ে বললে, বুঝলে, আগে আমি বিশে সাজব। তারপর ওই বিশে শিশুপাল সাজবে। এতে অসুবিধেটা কোথায় বুঝলাম না।

বললাম, বিশের বুকে মড়া মানুষের খুলির নীচে ক্রশ করা হাড় উল্কি করা আছে।

–তা আছে তো তাতে হয়েছে কী? আমিও সবুজ কালি দিয়ে চমৎকার মড়া মানুষের খুলির নীচে ক্রশ করা হাড় আমার বুকে এঁকে নেব। ওসব বাজে কথা রাখো। এখন বলো বিশে আমার চেয়ে কোন দিক দিয়ে ভালো।

বললাম, ইয়ে, বিশের মুখটা

-কী মুখটা? আমি দাড়ি কামিয়ে পাউডার মেখে নিলেও বিশের মুখটা ভালো? বাজে কথা বোলো না, বলো আর কীসে ভালো।

বললাম, কী লম্বা-চওড়া বিশে, হাতের পায়ের গুল কী শক্ত! সঙ্গে সিংহ থাকে।

কালো-মাস্টার তো অবাক।

–সিংহ থাকে! এই সেদিন-না বললে কুকুর থাকে?

-আহা, ওই একই, কুকুরের নামই সিংহ।

–কুকুরের নাম সিংহ হবে কেন?

–আহা চট কেন, রিহার্সালের সময় সিংহকে বাড়িতে রেখে আসব। আর হাতের পায়ের গুল যে বলছ, কী এমন মন্দ আমার হাতের পায়ের গুল?

এই বলে হাত-পা বেঁকিয়ে মাস্ল ফুলিয়ে আমাকে আবার দেখাতে লাগল। দেখে হাসি পেল, কীসে আর কীসে! বললাম, দেখো, তুমি যাই বলনা কেন–

সে আর অপেক্ষা না করে দাড়ি-গোঁফগুলোকে জড়ো করতে লাগল। দ্বিতীয় সৈনিকের গোঁফে যেই হাত দিয়েছে আমি বললাম, কথায় কথায় রাগ কর কেন? দেখি একবার ছোটকার সঙ্গে কথা বলে।

কালো-মাস্টার ছুটে এসে আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরল। বলল, দাও বাপ, চাট্টি পায়ের ধুলো দিয়ে কেতাত্থ করে দাও।

ঘরে ফিরে এসে ভেবে দেখলাম এতে খুব সুবিধেই হয়ে যায়। শুধু মিথ্যে করে বিশের নামে কালো-মাস্টারকে চালাতে খারাপ লাগছিল। তবে বিশে যে এতে কিছু মনে করবে না এ আমার খুব জানা ছিল। কারণ যদিও বিশে লোকের সামনে বেরোয় না আর আমাদের বাড়ির লোকদের ভারি ঘেন্না করে, তবু সে কথা তো আর এরা কেউ জানে না। ওরা ভাবে বিশে বুঝি এ-পাড়ার কাছাকাছি কোথাকার একটা বখা ছেলে। তবে আর কালো-মাস্টারকে বিশে বলতে ক্ষতি কী? আমি অবিশ্যি ওকে কালো-মাস্টারই বলব, বিশে বলে ডাকতে পারব না কক্ষনো।

দুপুরে খিচুড়ির সঙ্গে সাত-রকমের ভাজা হয়েছিল। খেতে খেতে সবার সামনেই বললাম, দাড়ি-গোঁফের একটা ব্যবস্থা করেছি ছোটকা, আর বিশে শিশুপালের পার্ট করতে রাজি হয়েছে।

তাই-না শুনে যে যার পিঁড়ি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বড়োকাকিমার হাতা থেকে আমার পাতে দুটো বড়ো বড়ো মাছের ডিমের বড়া পড়ে গেল। একা বড়োকাকা আর আমি বসে থাকলাম।

বড়োকাকা খিচুড়ির সঙ্গে কাঁচালঙ্কার কুচিভাজা মাখতে মাখতে বললেন, দাদাকে শেষ পর্যন্ত মত করালি বুঝি? বাবা, আমি বলতে গেলে সে কী রাগ, পারলে থিয়েটার বন্ধ করে দেয়!

আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। ডিমের বড়া গলা দিয়ে নামতে চায় না। ছোটকা বললেন, ও কী, চুপ করে রইলি যে? বিশে কখন আসবে?

–বিশে সকলের সঙ্গে এখন রিহার্সাল করতে চাইছে না। আজ অন্যরা চলে গেলে পরে তোমার আর বিভুদার কাছে পার্ট অভ্যাস করে যাবে বলেছে। পরশু একেবারে সবার সঙ্গে রিহার্সাল করবে।

ছোটকা একগাল হেসে বললেন, আঃ, বাঁচালি চাঁদ! মাথা থেকে একটা এক-শো মন বোঝা নামল। হারে, সে ভালো করবে তো?

–ভালো করবে তো মানে? সে ব্ৰজেনদাকেও শেখাতে পারে। জানো, একবার

বিভুদা হাঁড়িমুখ করে বলল, থাক, এখন আর তার গুণের ব্যাখ্যান কত্তে হবে না। পার্ট দিচ্ছি। ওই তার পক্ষে যথেষ্ট। আর দাড়ি-গোঁফ কখন পাচ্ছি? যদি এর মধ্যে কোনো চালাকি থাকে

ছোটকা এক ধমক দিলেন, ঢের হয়েছে বিভু, নিজের এদিকে দুটো কথা বলতে গেলেই জিভ বেরিয়ে যায় আবার তেড়িবেড়ি!

বিভুদাও বললে, তুমিও থামো দিকিনি! নিজে তো লেখা কাগজ সামনে ধরেও যা খেল। দেখাও—

ছোটকা বললেন, আহা, সে আমার কিছু মনে থাকে না বলে। তা ছাড়া প্রযোজক কবে আবার অভিনয় করে?

বড়োকাকা বললেন, এখন যে-যার জায়গায় বসে খেয়ে নাও দিকিনি। হারে চাঁদ, দাড়ি গোঁফগুলো পাওয়া যাবে কখন? আমাকে আবার সাজ গোছাবার ভার দিয়েছে কিনা!

আমি বললাম, আজ সবাই চলে গেলে বিশে যখন আসবে, ওকে বলে দেব কাল পরশু একদিন সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। ওকে কিন্তু রাত্রে এখানে খেয়ে যেতে বলেছি বড়োকাকা।

ছোটকা বললেন, হ্যাঁ, হা, অবিশ্যি খাবে। আজ আমাদের বড়ো ভালো দিন– পোলাও মাংসের ব্যবস্থা কচ্ছি, দেখ-না।

০৯.

রাতের পোলাও-মাংসের কথা শুনে কালো-মাস্টার সেদিন দুপুরে পাঁউরুটি খেতে আপত্তি করল না। শুধু বললে, হা কত্তা, কাপড়চোপড় নেই, তা মওড়াতে পরব কী?

বললাম, সে একটা ব্যবস্থা করে ফেলব। আমার পাঞ্জাবি পাজামা তোমার হবে না?

সত্যি কথা বলতে কী কালো-মাস্টার মাথায় আমার চেয়ে খুব বেশি লম্বা নয়; রোগা লিকলিকে– ওকে বিশে বলে কী করে যে চালাব তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। ভাগ্যিস বিশেকে কেউ চোখে দেখেনি! এই ছ-ফুট উঁচু ষণ্ডা জোয়ান, হাঁক দিলে গঙ্গার ওপার থেকে শোনা যায়। ওদের দেশে ছোটো ছোটো নানা রকমের আগ্নেয়গিরি আছে, তার এক-একটার চুড়োয় চড়ে ডেকে ডেকে অন্য চুডোর লোকদের সঙ্গে ওরা কথা কয়। দূর থেকে জাহাজ আসছে দেখতে পেলে অমনি জানান দেয়। সেইরকম গলাও বিশের।

টং লিং টং লিং টং লিং করে লম্বা একটা মালগাড়ি পুলের ওপর চড়ল আর সেই গুঁফো লোকটা অমনি সবুজ নিশান হাতে করে এগিয়ে দাঁড়াল। আমিও বাড়ির ছায়াতে আর একটু সেঁদিয়ে গিয়ে অবাক হয়ে বললাম, ও কী কালো-মাস্টার, সবুজ কালি, তুলি-কলম দিয়ে কী করবে? ছবি আঁকবে নাকি?

এই বলে ওর পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম।

ও খুশি হয়ে বলল, ছবিই বটে। জানো কত্তা, সারাজীবন কত যে ছবি এঁকেছি তার ঠিকানা নেই; কত কদাকারকে সুন্দর করেছি, সুন্দরকে করেছি কদাকার! কত বুড়োকে হোকরা বানিয়েছি, ছোকরাকে বুড়ো! কত পালোয়ানকে রোগা বানিয়েছি, রোগাকে পালোয়ান! বিশে হওয়া আমার পক্ষে কী আর অমন শক্ত কথা! এই দেখো, বিশে হওয়ার আমার আর কতটুকু বাকি আছে।

এই বলে আধময়লা গেঞ্জিটাকে খুলে ফেলল। চেয়ে দেখি ওর হাড় জিরজিরে বুকের ওপর সবুজ কালি দিয়ে মড়ার মাথা আঁকা, তার নীচে দুটো হাড় ক্রশ করে বসানো, সে যে মানুষের হাড় সে আর কাউকে বলে দিতে হবে না!

এত ভালো ছবি আঁকে কালো-মাস্টার এ আমি ভাবতেও পারিনি। বললাম, আমার বুকেও ওইরকম এঁকে দাও-না, কালো-মাস্টার!

বলে জামাটা খুলে বসলাম।

কালো-মাস্টার জিভ কেটে বললে, ছি, কী যে বল কত্তা! বিশের বুকে যে উল্কি আঁকা সে কি যার-তার বুকে শোভা পায়? এসো, বরং জোড়া হাঁসের নীচে পদ্মফুল করে দিই।

তাই দিল কালো-মাস্টার। ঠান্ডা ঠান্ডা তুলিকালির টানে কী যে আরাম লাগল! হয়ে গেলে কালো-মাস্টার বললে, দেখো, স্নানের সময় যেন জল না লাগে।

কালো-মাস্টারের যেমন কথা। দু-তিন দিন স্নানই করব না ঠিক করেছি। জামা গায়ে দিয়ে ওপরে যাবার সময়ে ওকে আর এক বার সাবধান করে দিলাম, খুব সাবধান, কালো-মাস্টার, তুমি যে এখানে আছ কেউ যেন টের না পায়। বিশেষ করে খুপরিঘরের ওই লোকটা। জলের ধারে পা ঝুলিয়ে ও-রকম করে বসে থাক কেন? ও তোমাকে একবার দেখতে পেলেই হয়ে গেল। তোমার শিশুপাল সাজা এ আমি বলে দিলাম।

তাই শুনে কালো-মাস্টার একেবারে চোরাকুঠরির ভিতরে গিয়ে বেদিটার উপরে টান হয়ে শুয়ে পড়ল। আমিও আস্তে আস্তে উপরে এসে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লাম। একটু ভাবনাও হচ্ছিল, কী জানি ওই লোকটাকে বিশে বলে চালাতে গিয়ে শেষটা না কোনো ফ্যাসাদে পড়ি। বাবা যদি কোনোরকমে টের পান তাহলেই তো গেছি!

বিকেলে কালো-মাস্টারকে আনাই দেখি এক ব্যাপার! সে কিছুতেই পাঁচিলে চড়ে নালার ওপর দিয়ে যেতে পারল না। খালি নীচের দিকে তাকায় আর ওর মাথা ঘোরে। শেষটা ও-পথ ছেড়ে দিলাম। তা ছাড়া সরু জায়গাটাতে হয়তো ওর পেটটা গলতই না। কারণ এদিকে রোগা হলে কী হবে, ওদিকে এই ক-দিনে দিব্যি এক নাহাপাতিয়া বাগিয়েছে।

অগত্যা সন্ধ্যে লাগলে পর নৌকো বের করে কান্তা কেবিনের একটু আগে গাছগাছড়ায় আড়াল-করা একটা আঘাটায় নামলাম দুজনে। কালো-মাস্টার জলকে বিশ্বাস করে না, নৌকো টেনে ডাঙায় তুলে কারখানার উঁচু পাঁচিলের গা ঘেঁষে ঝোঁপের পেছনে লুকিয়ে রাখল। সেখান থেকে অন্ধকার গলি দিয়ে হেঁটে গেলে আমাদের বাড়িটা বেশি দূরে নয়। গুফো লোকটা রুটি সেঁকছিল, কিছুই লক্ষ করল না।

চাতালে ছোটকা, বিভুদা, ব্রজেনবাবু সবাই ব্যস্ত হয়ে পায়চারি করছেন আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। আমাদের দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তারপর কালো-মাস্টার আলোর নীচে এসে। দাঁড়াতেই মুখে কারো কথা সরে না। ছোটকা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ইয়ে, এই নাকি সেই অসাধারণ বিশে? আশ্চর্য তো। ইয়ে, কী বলে, ও পারবে তো পাট করতে, চাঁদ? নাকি এখনও বল, সব বন্ধ করে দিই।

চেয়ে দেখি কালো-মাস্টারকে ঠিক একটা চোরের মতো দেখাচ্ছে। আমার একটা হাতকাটা খাকি শার্ট আর নীল হাফপ্যান্টের তলা থেকে রোগা-রোগা কালো ঠ্যাং বেরিয়ে রয়েছে, সোজা তাকাচ্ছে না কারো দিকে, সারা গায়ে যেন একটা কেমন ভয় ভয় ভাব, দেখলে পিত্তি জ্বলে যায়। মুখ দেখলে মনে হয় ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। যেন চোরের হদ্দ।

এগিয়ে এসে বললাম, আচ্ছা ছোটকা, রিহার্সালের পর পোলাও-মাংস খাওয়া তো? বিশে, পার্ট বল।

আর বলতে হল না, কালো-মাস্টার চোখের সামনে বদলে গেল। আলোর নীচে এসে আগাগোড়া শিশুপালের পার্ট বলে যেতে লাগল, আর শুধু শিশুপাল কেন, শ্রীকৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির গলা বদলে বদলে সবার পার্ট করে যেতে লাগল্প। শুনে সকলে হাঁ, মুখে কারো কথা সরে না। প্রত্যেকটা পার্ট এত অসম্ভব ভালো করে বলে গেল যে আমি সুষ্ঠু অবাক। বলে তো ছবি আঁকে, অথচ এত ভালো থিয়েটার করে! আশ্চর্য বটে।

কুড়ি মিনিট ধরে ও একাই বলে গেল, তারপর সে অঙ্কটাকে শেষ করে তবে থামল। ছোটকা অন্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ছি ছি, তোমাদের লজ্জাও করে না।

আর-একটু হলেই হয়েছিল আর কী, বিভুদার দল উঠে দাঁড়িয়েছিল পর্যন্ত, এমন সময় কালো মাস্টার হাতজোড় করে বললে, আপনাদের সকলের সঙ্গে নাটক কত্তে পারাটাকেই আমি সৌভাগ্য বলে মনে করি, নইলে আমার এত কাজের মধ্যে আবার নাটক করার সময় কোথায়? তাহলে গোড়া থেকে আবার শুরু হোক, কেমন?

আর কথাটি নেই, অমনি যে-যার জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল, যাদের পার্ট শেখা হয়নি তারাও দেখি হাতে একটু সময় পেলেই মুখস্থ করতে লেগে গেছে। অন্যদিন সব পালাই পালাই করে, আজ রাত এগারোটা বেজে গেল সেদিকে কারো খেয়ালই নেই। তারপর সে কী খাওয়া, অনেকদিন বাদে প্রাণ ভরে কালো-মাস্টার খেয়ে নিল। শেষে আসর ভেঙে গেল, যে-যার বাড়ি গেল, কালো-মাস্টারও মুখে দুটো পান পুরে পথ ধরল।

ছোটকা বার বার বলতে লাগলেন, কাল যেন ছটার মধ্যে আসে– সবাইকে তৈরি করে নিতে হবে তো!

উঃফ! এতক্ষণে আমার বুকের ঢিপঢিপুনি থামল। সে মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেলে বড়োকাকা বললেন, আশ্চর্য! এ-রকম তো আমি ভাবতেও পারিনি! ওকে কোথায় পেলি রে চাঁদ?

আমি তো পালাবার পথ পাই নে। বিভুদা এসে বললে, এসব থিয়েটারি লোকদের সঙ্গে মিশিস কেন রে হতভাগা?

আমি তো অবাক, এ আবার কেমন। কথা! বিপদের সময় উদ্ধার করে দিচ্ছে বলে কোথায় খুশি হবে, না উলটে ধমকানো হচ্ছে! বললাম, হিংসে হচ্ছে। বুঝি? তা ওকে ভালো না লাগে তো চলে যেতে বললেই পার। আমিই তো বলে-কয়ে এনেছি। ও কি সহজে রাজি হয়!

ছোটকা বললেন, তুমি থামো তো বিভু, নিজে মরা সৈনিকের পার্ট করতে পর্যন্ত ভুল কর, তোমার মুখে ওসব কথা শোভা পায় না। বাবা! ভাগ্যিস বিশেকে পাওয়া গেল, তাই ভোঁদার। দলের নাকের তলা থেকে কেমন কাপ ছিনিয়ে আনি দেখো। আর রাত নয়, যা চাঁদ, শুয়ে পড়, কাল আবার আর-একটা দিন আছে তো।

শুলাম বটে, ঘুম আসে না কিছুতেই। কতরকম যে ভাবনা– কালো-মাস্টার ঠিকমতো পৌঁছেছে তো, বিশে বলে ওকে চালাচ্ছি, শেষটা সব ফেঁসে না যায়। যাগে, আর ভেবে কী হবে আর তো কটা দিন। ছোটকা ওকে রোজ রাত্রে খেয়ে যেতে বলেছে, ওর উৎসাহ দেখে কে! আর আশ্চর্য যে অন্য যারা এতদিন ঝিমিয়ে পড়ছিল, তারাও সবাই তড়বড়িয়ে জেগে উঠেছে। আমার তো নিজের পার্ট আগেই মুখস্থ হয়ে গেছিল, এখন অন্য অন্য ছোটো পার্টগুলো সব মুখস্থ করে নিলাম। বলা তো যায় না, লোকের কেমন হঠাৎ হঠাৎ অসুখ করে, মরেও যায় কত লোকে। তখন তো আর ওসব সামান্য কারণে নাটক বন্ধ করে দেওয়া যাবে না!

হঠাৎ মনে হল শিশুপালই যে শুধু পাওয়া গেছে তা তো নয়, দাড়ি-গোঁফেরও একটা ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কী যে আরাম লাগল সে আর কী বলব! আবার সঙ্গেসঙ্গে ভয়ে হাত-পা হিম হয়ে গেল। এই কিছুক্ষণ আগেই নাটক ভেস্তে যাচ্ছিল আর এরই মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল, মায় কালো-মাস্টারের খাওয়ার কথাটা পর্যন্ত। যাবার আগে ছোটকা বড়কার কাছ থেকে পাঁচ টাকা চেয়ে ওর হাতে গুঁজে দিলেন। কালো-মাস্টার একেবারে গলে জল। পরে একলা পেয়ে আমি ওর কানে কানে ব্যস্ত হয়ে বললাম, ও দিয়ে কী হবে কালো-মাস্টার? আবার যেন দোকানে টোকানে যেয়ো না।

সে একগাল হেসে বললে, অত ভয় করলে কি আমাদের চলে কত্তা? তোমার কোনো ভয় নেই, স্যান্ডো আমার জন্য খাবার কিনে এনে দেবে।

–স্যান্ডো! সে আবার কে?

–ওমা, স্যান্ডোকে চেন না? ওই যে গো রেলে কাজ করে, ঝুলো গোঁফ, খুপরিঘরে নিশেন নাড়ে।

–তুমি ওকে চেন নাকি?

–বাঃ, ওকে চিনব না! তুমি তো সারাদিন আমাকে একা ফেলে নিজে মজা মার, আমি সে-সময়টা কী করে কাটাই ভেবেছ কখনো? কথা না বলে কেউ থাকতে পারে? তাই ওর সঙ্গে ভাব করেছি, তাতে অন্যায়টা কী হল শুনি?

আমি বললাম, তাহলে আমাদের লুকোনো ঘরের কথা ওকে জানিয়েছ, পেরিস্তানের কথাও বলেছ?

কালো-মাস্টার যেন আকাশ থেকে পড়ল। আচ্ছা, আমাকে কী ভাব বলো দিকিনি কত্তা? তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ, আমি কখনো অমন কাজ কত্তে পারি? তোমার কোনো ভয় নেই, ওকে বলেছি– আমি কারখানা-বাড়ির পাহারাওয়ালা, দিনরাত আমার ডিউটি থাকে, তাই খাবার কেনবার সময় পাই না। সারাটা জীবন বুদ্ধি ভেজে খেইছি, আর এখন একটা বাইরের লোকের কাছে সব ভেস্তে দোব! আমি সে ছেলে নই!

শুনে আমি অবাক!

–কিন্তু এরই মধ্যে এত কথা হয়ে গেছে?

–আরে শুধু কি তাই? ও আমার জিনিসপত্তর যখন যা দরকার কিনে রাখবে, আমি গিয়ে নিয়ে আসব। এতে ভয়ের কিছু নেই সেটা তো মান?

বললাম, আর তার বদলে তুমি কী করবে?

কালো-মাস্টার বললে, মুখটা অমন ব্যাজার করে কথা কইছ কেন? তার বদলে ওকে বারোটা কার্ড পাইয়ে দোব বলেছি, ওর বন্ধুদের নিয়ে এসে আমাদের থিয়েটার দেখে যাবে। কথা তো এই। তোমাকে কোনো বিপদে ফেলব না, প্রাণ থাকতে কালো-মাস্টার। যাই, ছোটকা বড়কার কাছে বিদেয় নিয়ে পা বাড়াই।

বলে চলে গেল তো কালো-মাস্টার কিন্তু আমার যে কত কথাই মনে হতে লাগল! প্রথম থেকেই কালো-মাস্টারকে বিশে বলে চালানোটা ঠিক হল কিনা ভেবেই পেলাম না। বিশে জানতে পারলে কী বলবে?

দূর থেকে শুনতে পেলাম পুলের ওপর দিয়ে মালগাড়ি যাচ্ছে টং লিং টং লিং টং লিং–। আওয়াজটা ক্রমে দূরে সরে যেতে লাগল আর আমিও কখন ঘুমিয়ে পড়লাম টের পেলাম না।

১০.

মা নিমকিকে নিয়ে আমাদের নাটক দেখতে আসবেন। বাবাও নাকি আসবেন, বড়ো পিসিমা গিয়ে কী সব বুঝিয়ে এসেছেন, তাই নাকি বাবা আমার নাটক করা দেখতে আসবেন। এখন দাড়ি-গোঁফের কথা উঠলেই তো আমি গেছি। পরদিন আমার ভাবনার কথা শুনে কালো-মাস্টার দাড়ি-গোঁফের বাক্সটা লুকিয়ে এনে ছোটকার কাছে জমা করে দিল। বলল, সাবধানে রাখবেন স্যার, এর ওপর মেলা লোকের নজর।

ছোটকা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, সে কী বিশু, এসব কী তবে চাঁদের আনা নয়?

কালো-মাস্টার হেসে বললে, জিনিস চেনেন না তাই ওকথা বলছেন। এসব জিনিস আজকাল হয়ই না, তা ও পাবে কোত্থেকে? না স্যার, এসব আমারই জিনিস। কতকাল ধরে যে এদের তেল মাখিয়ে, আঁচড়ে, কুঁকড়ে, হাত বুলিয়ে, আঠা জুড়ে, ঘুচে কুঁড়ে এইরকম চেহারা বানিয়েছি সে আর কী বলব। এগুলোকে আর এখন নকল চুলদাড়ি বলা চলে না, এগুলোকে মানুষের চুলদাড়ি বলা চলে– একদিক দিয়ে আমারই চুল-দাড়ি-গোঁফ বলতে পারেন। এদের একটা চুল ছিড়লে আমার গায়ে লাগে। আর, হ্যাঁ স্যার, আমার কিন্তু একটা আবেদন ছিল।

ছোটকা বললেন, তা বলেই ফেলোনা, থামলে কেন? কিছু পয়সাকড়ির দরকার বুঝি? শোন চাঁদ, আমার দেরাজের টানাতে

কালো-মাস্টার জিভ কেটে হাতজোড় করে বলল, না, না, ও কী কথা স্যার! আপনার কাছ থেকে আর পহা নিলে আমার যে পাপ হবে। বলছিলাম কী, আমার জীবনে অনেকরকম ঝামেলা আছে কিনা, তা আমার শিশুপাল সাজার কথাটা একটু গোপন রাখবেন স্যার, নইলে শেষটা টানাটানি পড়ে যাবে, হয়তো শেষপর্যন্ত দেখবেন নাটকের দিনেই আমি ফেরারি।

ছোটকার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, তাই কখনো হয়? তাহলে যে আমাদের সব্বনাশ হয়ে যাবে! আমি ভোঁদাদের কর্ণার্জুন রিহার্সাল দেখে এসেছি, বুঝলে, পাশের বাড়ির ঘুলঘুলি দিয়ে। একেবারে রাবিশ! সাজপোশাকের ওপর দিয়ে মেরে দেবে ভেবেছে, কেউ একবর্ণ নাটক কত্তে পারে না, ওই সিনেমা আক্টরটা তো স্রেফ একটি মাকাল ফল! ওদের নাকের ডগা দিয়ে কাপ নিয়ে বেরিয়ে যাব। যারা যারা প্রতিযোগিতায় নামছে সবাইকে কার্ড পাঠাচ্ছি, বিশু, ভোঁদারা এসে দেখে যাক নাটক কাকে বলে! ওদেরও নাকি দাড়ি-গোঁফের কষ্ট।

কালো-মাস্টার বললে, তা আর হবে না? কার সঙ্গে লাগতে এসেছে ভুললে চলবে কেন? আমাকেও বারোটা কার্ড দেবেন স্যার। আর ইয়ে, স্যার, ওরা রিহার্সালে এলে কিন্তু আমি নাটক কত্তে পারব না। প্রাণ হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াই, চারদিকে শত্রুর গিজগিজ করছে, এখানে আসা যাওয়াই একটা ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে

ছোটকা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে শুনলেন, তারপর বলে উঠলেন, ওঃ! এতক্ষণে বুঝেছি, বিশু। তুমি নিশ্চয় কোনো নামকরা কেউ, নাম ভঁড়িয়ে নাটক করছ। পাছে কেউ চিনে ফেলে তাই এত ভাবনা। এবারে বুঝেছি।

কালো-মাস্টার বললে, শুধু চিনে ফেলবে না, স্যার, দড়ি দিয়ে বেঁধে ধরে নিয়ে যাবে, এই আমি বলে রাখলাম।

ছোটকা ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, বিশু, তোমার কোনো ভাবনা নেই। আমি তোমাকে এমনি লুকিয়ে রাখব যে চাঁদ ছাড়া এ বাড়ির কেউ অবধি জানতে পারবে না। দেখো, চাতালের পাশের ঘরটা আমাদের লাইব্রেরি, ওর দরজাও ভোলা হয় না, এমনি সব পড়ুয়া এ-বাড়ির লোকরা। ওর চাবি আমার কাছে থাকে। ওর পাশেই আমার চানের ঘর, মাঝখানে দরজা আছে। তুমি ওই লাইব্রেরি ঘরে থাকবে, আমার চানের ঘরে চানটান করবে, কাকপক্ষী টের পাবে না। রিহার্সালেও কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এবার নিশ্চিন্দি তো?

কালো-মাস্টার বললে, আর আমার খাবার?

ছোটকা বললেন, বাঃ, সে আবার একটা কথা হল নাকি! আমার খাবার আমার ঘরে দিয়ে যেতে বলব, কান্তা কেবিন থেকে চপকাটলেট আনব, দু-জনে ভাগ করে খাব।

এর পর কালো-মাস্টার আর কোনো আপত্তিই করল না। কিন্তু আমার বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল– কোত্থেকে-না আবার কোন নতুন বিপদ হয়! মনে হতে লাগল, এতে কেমন যেন বিশেকে ছোটো করা হচ্ছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কালো-মাস্টারও খুব খুশি, ওকে নিয়ে আর আমাকেও ভাবতে হবে না, আমার পেরিস্তানও নিরাপদ।

কালো-মাস্টার আরও বললে, একটু বেশি রাত করে আসব, স্যার, তা হলে! এই চাতাল দিয়ে ঘুরে আসব, আপনি লাইব্রেরি ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে রেখে শুয়ে পড়বেন।

খাওয়া-দাওয়ার পর টর্চ নিয়ে গেলাম একবার পেরিস্তানে। কালো-মাস্টার আমাকে দেখে চমকে-টমকে একাকার। বললাম, আবার এখানে এলে কেন। থেকে গেলেই পারতে।

কালো-মাস্টার বললে, না কত্তা, এসেছি ভালোই করেছি। নৌকোটাকে তো ঝোঁপের পেছনে ফেলে রাখা যায় না। এখানে রাখাও ঠিক নয়, তাই লুকিয়েছি কারখানা বাড়ির ঘাটের নীচের আড়ালে। তা ছাড়া

–কী তা ছাড়া?

–তা ছাড়া আজ বোধ হয় বিকেলে তোমার সত্যিকার বিশে তার সিংহকে নিয়ে এসে থাকবে।

আমি এমনি চমকে গেলাম যে আর-একটু হলে পড়েই যাচ্ছিলাম। বললাম, অসম্ভব, বিশে আসতেই পারে না!

কালো-মাস্টার কোনো কথা না বলে, আমার হাতের টর্চটা নিয়ে সিঁড়ির ধাপের কাছে মাটির ওপর আলো ফেলল। দেখলাম বড়ো বড়ো থাবার দাগ। সঙ্গে মানুষের জুতোপরা পায়ের ছাপও আছে। বুকের ভেতরটা হিম হয়ে গেল।

–তুমি কোনো জিনিসপত্র এখানে ফেলে রাখনি তো, কালো-মাস্টার?

কালো-মাস্টার বললে, খেপেছ? তাপ্পর তাই দেখে আমার সন্ধান পাক আর কী! আমার থাকবার মধ্যে ছিল তো ওই দাড়ি-গোঁফ, সেও তোমার ছোটকার কাছে সঁপে দিয়েছি। দেখতে পার, তোমার চোরা ঘর খাঁ-খাঁ করছে, তোমার ওই জলের বোতল আর খাবারের টিন ছাড়া কোত্থাও কিচ্ছু নেই। এখানে খুঁজলে কালো-মাস্টারের চিহ্নটুকু পাওয়া যাবে না। তুমি এবার যাও দিকিনি ঘরে, আমিও অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে তোমাদের লাইব্রেরি ঘরে গিয়ে সেঁদোই। ও-রকম কালো মুখ কেন গা? একটু আনন্দ করো, এই দেখো কেমন তোমার পেরিস্তান ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি। আমারই জন্য তোমার বন্ধু বিশে আসে না, সে কি আমি বুঝিনি ভেবেছ? এবার তাকে খবর দাও, সে এসে দেখে যাক পেরিস্তানের এতটুকু ক্ষতি করিনি।

কালো-মাস্টারের দেখি মহাফুর্তি, থাবার দাগ আমাকে একবার দেখিয়েই সে-বিষয় ভুলে গেছে, আমার কিন্তু আত্মাপাখি খাঁচাছাড়া। ও কথাটা বিভুদার কাছে শেখা। খালি মনে হতে লাগল কোথাও একটা গলদ থেকে যাচ্ছে, তাই থেকে এখনও অনেক বিপদের সম্ভাবনা আছে।

উপরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কালো-মাস্টারও ভাটার কাদা ভেঙে নদীর ধার দিয়ে রওনা দিল। ওকে নিয়ে আর আমার কোনো ভাবনাই রইল না। কেবলই বড়ো বড়ো থাবার দাগের কথা মনে হতে লাগল। ও যে সিংহের থাবা হতে পারে না সে আমি জানতাম… তবে কার?

হঠাৎ চমকে উঠে বসলাম। যদি পুলিশের ডালকুত্তোর হয়? যদি কালো-মাস্টারের শত্রুরা ওর পেছনে ডালকুত্তো লাগিয়ে থাকে? আবার শুলাম… তাও তো হবার জো নেই, জলের ওপর দিয়ে শুকে শুকে কুকুর তো আসতে পারে না! আমি জলে নামি না বটে, মা-বাবা বলেন জলে নামলে গায়ে ঠান্ডা লেগে আমার সর্দি হবে, সেই সর্দি বুকে বসে আমার নিউমোনিয়া হবে। কিন্তু বিশেদের ছোটো ছেলেরা হাঁটা শেখার আগেই নাকি সাঁতার শেখে। দেশ জুড়ে গায়ের শিরার মতো সুন্দর সুন্দর সব নদী, তাতে ওরা দিনরাত হেঁটে বেড়ায় পথঘাটের চেয়ে নদীর জলে হাঁটতেই ওদের সুবিধে লাগে। ওদের পেছনে কেউ ডালকুত্তো লাগালেও ওদের ধরতে পারে না। জল পেলেই ওরা জলে নেমে পড়ে, জলের ওপর দিয়ে ডালকুত্তো ওদের গন্ধ পায় না।

শুঁকে শুঁকে কারো খোঁজে ডালকুত্তো পেরিস্তানে আসেনি। পেরিস্তানের গন্ধই আলাদা। ওর শব্দও আলাদা, মানুষের গলার স্বর নেই ওখানে, খালি নদীর কলকল, ছলছল, মাঝে মাঝে দাঁড় বাইবার ছপাত ছপাত, আর দূরে পুলের ওপর থেকে টং লিং টং লিং টং লিং।

এখন আমার ঘর থেকেও শুনতে পেলাম টং লিং টং লিং টং লিং কোনো ভয় নেই, কোনো ভয় নেই।

১১-১২. সত্যি সত্যি নাটক হবে

এতদিনে সবার মনে হতে লাগল যে শেষপর্যন্ত সত্যি সত্যি নাটক হবে। কারো মনে এখন আর কোনো ভাবনা নেই; শিশুপালের মতো শিশুপাল এসেছে, বর্ম-অস্ত্র পরালে কে চিনবে কালো-মাস্টারকে! তার ওপরে যখন সবচেয়ে ভালো কোঁকড়া চুলটা আর পাকানো গোঁফটা পরে সেজেগুঁজে লাইব্রেরি ঘরে রিহার্সালের পর এসে ছোটকার আর আমার সামনে দাঁড়াল, আমরা তো হাঁ! কী-একটা রাজা রাজা ভাব, কে বলবে সত্যিকার শিশুপাল নয়।

সত্যি কথা বলব? স্বয়ং বিশেও যে এর চেয়ে ভালো পার্ট করতে পারত এ আমার এখনও মনে হয় না। এর চেয়ে বেশি আর কী বলতে পারি? আর সে দাড়ি-গোঁফেরও তুলনা হয় না। ছোটকা বললেন, বিশু, আমার চৌত্রিশ বছর বয়স, তার মধ্যে কুড়ি বছর ধরে প্রত্যেক পুজোয় নাটক করেছি, নাটক দেখেছি, কিন্তু দাড়ি-গোঁফের এমন বাহার আমি কল্পনাও করতে পারিনি!

ইস, ছোটকা বেচারা যে এতটা বুড়ো তা আমি জানতাম না। এদিকে ফুর্তির চোটে সক্কলের। পার্ট মুখস্থ হয়ে গেল, ঝগড়াঝাটি বন্ধ হয়ে গেল। এমনকী বিভুদা আমাকে আর একদিনও মারেনি। অবিশ্যি সব সময় কালো-মাস্টার কাছে কাছে থাকত বলেও সেটা হতে পারে।

মহালয়ার দিন সকালে হঠাৎ মা আর নিমকি এসে হাজির। ভালো পড়তে পারুক না পারুক পুজোসংখ্যা দুটোকে দেখে নিমকি যে কী খুশি সে আর কী বলব? তাই শুনে কালো-মাস্টার বললে, তা হলে এবার ছোটকার কাছ থেকে সেই সাদা খরগোশ জোড়াও এনে ওকে দাও। দেখো, আরও কত খুশি হবে।

আরে, সাদা খরগোশের কথা যে ভুলেই গিয়েছিলাম। ছোটকা তখন আহ্লাদে ভরপুর, দুবার বলতে হল না, অমনি চিঠি লিখে দিলেন। সেই চিঠি হাতে করে, আমি নিজে গিয়ে খরগোশ দুটোকে নিয়ে এলাম। বড়োকাকা একটা খাঁচাও কিনে দিলেন। নিমকিটা এমনি বোকা, আমাকে বললে, ইস দাদা, তোমার মতো কেউ নাটক করতে পারে না। কী ভালো খরগোশ রে!

বলে খরগোশের গোঁফে হাত বুলোতে লাগল।

সে যাকগে, অন্যবারের মতো এবারও নাটক হল আমাদের বাড়ির মস্ত পুজোর দালানে। আজকাল আর পুজো-টুজো হয় না সেখানে, তবে ছোটকাদের ক্লাবের নানান ব্যাপার হয়। কী চমৎকার উঁচু স্টেজ বাঁধানো সেখানে। তার দু-পাশে পুজোর জিনিস রাখার ঘর দুটো বেশ আমাদের সাজের ঘর হল।

ড্রেস তো যে-যার নিজেরটা জোগাড় করবে। কালো-মাস্টারের, আমার, বিভুদার আর আমাদের বাড়ির অন্যান্য যারা নাটক করছিল, সক্কলের ড্রেস বড়োকাকা কলকাতার একটা বড়ো দোকান থেকে ভাড়া করে আনলেন। কালো-মাস্টারকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন, সে কিছুতেই গেল না। জিভ কেটে বললে, তাই কখনো হয়? সব যে আমার চেনাজানা, গেলেই হাতে হাতকড়া পড়বে।

বড়োকাকা অবাক হয়ে বললেন, সে কী বিশু, তুমি কি কোনো অন্যায় কাজ করে গা-ঢাকা দিয়ে আছ নাকি? তাহলে তো

বড়োকাকা আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ছোটকা রেগে উঠলেন, বললেন, দেখো মেজদা, যা করেছে করেছে, নাটক শেষ হবার পর তুমিও যা হয় কোরো। এখন যদি টু শব্দটি কর তত ভালো হবে না বলে রাখলাম।

কালো-মাস্টার বললে, কী আর হবে? আমাকে ফাটকে দেবে আর ভোঁদাবাবু কাপ পাবেন। ইনি হয়তো তাই চান।

বড়োকাকা অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, কিন্তু চুরি-টুরি করেনি তো, বিশু?

কালো-মাস্টার বললে, অন্যরা যা ইচ্ছে বলতে পারে, আমি ওকে চুরি বলি না। নিজের জিনিস কেউ কখনো চুরি করে?

বড়োকাকা বললেন, ওই তা হলেই হল, বিশু! এ নিয়ে আর আমি কিছু বলব না।

লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের রিহার্সাল চলতে লাগল। ওদিকে পুজোর সাত দিন আগে থেকেই অন্য যত সব প্রতিযোগিতার দলের নাটক শুরু হয়ে গেল। দশটা ক্লাব নাম লিখিয়েছিল। বড়োকাকা ব্যবস্থা করে এসেছেন, আমাদেরটা হবে সবার শেষে, নবমী পুজোর দিনে। তার আগের দিন ভোঁদারা কর্ণার্জুন করবে।

দল বেঁধে আমরা রোজ নাটক দেখতে যাই, শুধু কালো-মাস্টার যায় না। বলে, হাঃ, আর হাসাবেন না স্যার। সারাটা জীবন দেশের সেরা অভিনেতাদের সঙ্গে কারবার করে এলাম, আর এখন আমাকে রিসড়ে-শেওড়াফুলির বাহাদুরদের দেখাচ্ছেন। সে সময়টুকু বরং দাড়িটাড়িগুলোকে গুছোলে কাজে দেবে। ওগুলো জ্যান্ত জানোয়ারের মতো স্যার, রোজ ওদের চেহারা বদলায়।

গেল না কালো-মাস্টার। আমি তাতে নিশ্চিন্তই হলাম। সকলেই এত খুশি, এমন কী, কালো-মাস্টার নিজেও, আর শুধু আমারই কিনা বার বার মনে হত, ওকে বিশে বলে চালানোটা বোধ হয় ঠিক হল না। অথচ তা না করলে নাটকও হত না, চালিয়ে করিই-বা কী? ও তো আর নিজের নামে অভিনয় করবে না। নিজের কথা কিছু বলতেই চায় না।

বাবা এলেন সপ্তমীর আগের দিন সন্ধ্যেবেলায়। আমরা তেজারতি ক্লাবের কংসবধ দেখে ফিরে এসে দেখি হাঁড়িমুখ করে বাইরের ঘরে বসে আছেন। বড়োকাকাকে দেখেই জ্বলে উঠলেন, তুইও যদি ওদের দলে গিয়ে জুটি শম্ভ, তবে আর ওদের কী বলব। গলার বোতাম লাগাও, চাঁদ!–এসে দেখি বাড়িতে একটা লোক নেই, শূন্য পুরী খাঁ-খাঁ কচ্ছে, বামুনদিদি পর্যন্ত বিকেলে রাঁধাবাড়া সেরে থিয়েটার দেখতে গেছে! বলি, তোদের পাড়ার চোরগুলোরও নিশ্চয় থিয়েটার দেখার শখ আছে, নইলে বাড়ির বেবাক জিনিস পাচার হয়ে যায়নি কেন? তবু ওই খেমো চেহারার চাকরটা ছিল, সে-ই আমাকে চা-টোস্ট খাওয়াল। নইলে পৈতৃক বাড়িতে, পুজোর আগের দিন বাবুরা সব যা অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন!– বিকেলে দুধ খেয়েছিলে, চঁদ?– চাকরটা বলল, রোজই নাকি এইরকম হয়। নাঃ, চঁদটার আর কিছু হবে না বুঝতে পারছি, রোজ কলিভার অয়েলটা খাচ্ছিস তো?–যা ইচ্ছে করোগে তোমরা, তবু দে দয়া করে চাকরটাকে রেখে গেছিলে সেইজন্যে আমি কৃতজ্ঞ। যদিও বেটার চেহারাটা স্রেফ চোরের মতো!

আমরা এ-ওর মুখের দিকে চাইলাম। চাকরটা বলতে যে কালো-মাস্টার ছাড়া আর কেউ নয়, এ আমাদের বুঝতে বাকি রইল না। একটু হাসিও পাচ্ছিল এই ভেবে যে এখন যাকে চোর চোর করছেন, একবার তার শিশুপালের সাজ দেখলে তাক লেগে যাবে না!

এদিকে বাবা এসেই আমার রাতে নাটক দেখা বন্ধ করে দিলেন। পাছে নবমীর দিন আমার নাটক করাও বন্ধ করে দেন, সেই ভয়ে কোনো আপত্তি করলাম না। আমি যাব না শুনে নিমকি খুব খানিকটা কেঁদে নিল। শেষটা মা-ও গেলেন না, নিমকিও গেল না। আমাদের তাই ভোঁদার দলের কর্ণার্জুন দেখা হল না। রাতে ফিরে এসে খেতে বসে ছোটকারা খুব হাসাহাসি করতে লাগলেন। নাকি ভালো দাড়ি-গোঁফ পায়নি, সৈনিকদের সব আঁকা দাড়ি, ঘামে গলে চটচট করছিল। গোড়ায় দাড়ি-গোঁফের নাকি কী ব্যবস্থা হয়েছিল, শেষ মুহূর্তে ঝগড়াঝাটি হয়ে সব ভেস্তে গেছিল। ছোটকা বললেন, সহজে বলতে কী চায় ওরা? বুঝলে বিশু, তবু আঁচে জানলাম সিনেমার ওই ভবেশ রায় যে কর্ণ সাজল– কী ছিরির অভিনয় আর, বলিহারি!– ও-ই শেষ মুহূর্তে কোত্থেকে একটা লোক ধরে এনেছিল, সে-ই সবাইকে সাজিয়েছে। নিয়েওছে নাকি দু-শো টাকা, এখন সে টাকা কোত্থেকে আসে তার ঠিক নেই।

কালো-মাস্টার ব্যস্ত হয়ে বললে, কী নামটা লোকটার বললেন? দু-শো টাকা নিয়েছে? বেশি নিয়েছে। দেওয়া উচিত হয়নি। আমাদের

বাবা চমকে গিয়ে ছোটকাকে বললেন, ও কে বটু? ওই তো আমাকে চা খাওয়াল।

বড়োকাকা বললেন, ও আমাদের বিশু, চাঁদের বন্ধু। শিশুপালের বাবা তার কান ধরে টেনে নিয়ে যাবার পর বটুরা তো কেঁদে ভাসাতে লাগল, তখন চাঁদ গিয়ে ওর বন্ধু বিশুকে ধরে নিয়ে এল। তাই তো আমরা বেঁচে গেলাম।

বাবা বললেন, ও। বলে অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। আমিও অমন ভালো পায়েসটাকে না খেয়েই গুটিগুটি কেটে পড়লাম আমার শোবার ঘরের দিকে। সেখানে নিমকি খরগোশের খাঁচা মাথার কাছে রেখে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। ওর কী মজা! ওর জীবনে কোনো ভাবনা চিন্তা নেই।

সসস

চমকে ফিরে দেখি খিড়কির বাগানে দাঁড়িয়ে কালো-মাস্টার আমাকে জানালা দিয়ে ডাকছে। আস্তে আস্তে গিয়ে বললাম, কী?

কালো-মাস্টার বললে, মাপ দ্যান কত্তা, আমার জন্যে আপনাকে কতই-না ঝঞ্ঝাট পোয়াতে হচ্ছে। আর তো কালকের দিনটি, কাল তোমাদের কাপ পাইয়ে দিয়ে হাওয়া হয়ে যাব, আর বিরক্ত করব না। আর দেখো কত্তা, পরে যদি কেউ কিছু বলে কালো-মাস্টারের নামে, কিছু বিশ্বাস কোরো না। আর তোমার বন্ধু বিশের কাছে আমার হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ো।

কান্না পেতে লাগল, গলার কাছটাতে ব্যথা করতে লাগল। এত সব হাঙ্গামার মধ্যে বিশের কথা মনেও ছিল না। বললাম, ও কালো-মাস্টার, আর গেছিলে পেরিস্তানে? আমি যে যেতে পারি না, নিমকি আমাকে ছাড়েও না, আবার পাঁচিলে চড়তেও ভয় পায়।

কালো-মাস্টার জিভ কেটে বললে, পাগল! বিশের আর সিংহের পায়ের ছাপ দেখেছি, আর কি আমি যাই সেখানে? তার নামে চরে বেড়াচ্ছি। এখন কালকের দিনটা ভালোয় ভালোয় কাটলে বাঁচা যায়। তার একেবারে কঞ্জুর হয়ে যাব, এ এলাকায় কেউ আমার টিকিটি দেখতে পাবে না- ও কী কত্তা, তোমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে নাকি?

চোখ মুছে বললাম,

–ধেৎ! অম্বলটা বড্ড ঝাল ছিল কিনা! কিন্তু ও বিশের আর সিংহের পায়ের ছাপ নয়, কালো-মাস্টার, আর কেউ এসেছিল।

–সে আবার কী, কত্তা? কী করে জানলে তুমি?

আমি খালি বললাম, সে আমি জানি, কালো-মাস্টার। তাদের আসা সম্ভব নয়।

কালো-মাস্টার চলে যাবার অনেকক্ষণ পর মা শুতে এসে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বা রে, এই এক মাসে তুই তো দিব্যি বড়োসড়ো হয়ে উঠেছিস চাঁদ! হাত-পাগুলো কী শক্ত রে বাবা! আর দেখ চাঁদ, তোর বাবা বলছিলেন কি ওই রকম আজেবাজে বয়সে-বড়ো লোকদের সঙ্গে ভাব করিস নে আর, তুই এখনও ছোটো ছেলে–

আমি বললাম, না মা, নিমকি ছোটো ছেলে, আমার এগারো বছর কবে পূর্ণ হয়ে গেছে। বিশেরা– ওই অবধি বলে থেমে গেলাম।

মা বললেন, সেই কথাই তো বলছি, ওই বিশুটির বয়স কম করে ধরলেও ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের কম নয়–।

আমি বললাম, কী যে বল মা, ও তো পঁচিশ বছর ধরে থিয়েটারেই কাজ কচ্ছে, বেশ বুড়ো আছে। তা ছাড়া

মা বললেন, তা ছাড়া কী? থামলি যে বড়ো?

কী আর করি, ও যে বিশে নয়, আমি মিথ্যে করে ওকে বিশে বলে চালাচ্ছি, একথা মাকে কী করে বলি? তাই হাই তুলে বললাম, এখন আমার ঘুম পাচ্ছে, মা।

মা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আলো নিবিয়ে চলে গেলেন। কী যে খারাপ লাগছিল। কালকের দিনটা কেটে গেলেই বাঁচি।

কালকের কথা মনে পড়তেই আবার উঠে বসলাম, কাল আমাদের কাপ পাইয়ে দিয়েই কালো-মাস্টার কঞ্জুর হয়ে যাবে, আর এ-এলাকায় তার টিকিটি দেখা যাবে না।

পরদিন বললামও কালো-মাস্টারকে, তুমি কলকাতায় আমাদের বাড়িতে এসো, কেমন? আমার ডাকটিকিটের খাতা তোমাকে দেখাব।

কালো-মাস্টার জিভ কেটে বললে, কী যে বল কত্তা, তোমার একটা কাণ্ডজ্ঞান নেই। আজ রাতে তোমাদের নাটককে কাপ পাইয়ে দিয়ে বেমালুম ডুব দেব। কোনো ডালকুত্তাও আর আমাকে শুকে শুকে বের করতে পারবে না। ও কী, নাক দিয়ে জল পড়ছে কেন, কত্তা? কেমন তোমার পেরিস্তানে আবার যাবে, সেখানে তোমার বন্ধু বিশে আসবে, সিংহ আসবে– আমি জলের বোতলে আবার জল ভরে রেখেছি; খালি টিনে মুড়ি, ডালমুট, কুচো নিমকি ভরেছি, বিশেদের খেতে দিয়ো; একটা শিশিতে কিছু মুড়ি-ল্যাবেঞ্চশও রেখে এসেছি, খেয়ো তোমরা।

আমি বললাম, সে কী, তুমি আবার গেলে কী করে? নালা টপকাতে তো তোমার ভয় করে, অথচ তোমাকে বিশে বলে চালাচ্ছি! বিশেদের দেশে কী গভীর সমস্ত

থেমে গেলাম। কালো-মাস্টার বললে, বেশ তো, কাল থেকে আমি গায়েব হয়ে যাব, তোমার সাহসী বিশেকে নিয়ে থেকো তুমি। আচ্ছা এতই যদি ভালো তোমার বিশে, তাহলে বাড়ির লোকদের সঙ্গে চেনা করিয়ে দাওনি কেন শুনি?

আমি বললাম, কে ভালো কে খারাপ সে তুমি বুঝবে না। যে-ই তোমাকে ভালো খাবার খাওয়ায় তুমি তো তাকেই ভালো বল। বিশে আমাদের বাড়ির লোকদের ঘেন্না করে বলেছি-না তোমাকে। ভালো খাবারে সে ভোলে না।

আর বেশি কথা হল না। ড্রেস-রিহার্সালের জন্য সব লোকেরা এসে পড়ল। অবিশ্যি ড্রেস-রিহার্সালে বিশে ছাড়া আর কেউ ড্রেস পরল না– ওমা, কাকে আমি বিশে বলছি, কালো-মাস্টারকে সবাই সারাক্ষণ এমন বিশু-বিশু করে যে আমার সুষ্ঠু ভুল হয়ে যাচ্ছে। অথচ কীসে আর কীসে! যাই হোক, দুপুরে শেষ রিহার্সাল হয়ে গেল, তারপর যে-যার সাজপোশাক গুছিয়ে রাখল। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যে বিভুদাও গড়গড় করে পার্ট বলতে লাগল! আর বাবা পর্যন্ত বললেন, তা মন্দ কচ্ছে না বটুরা। সমরেশ কি সত্যিই পাঁচশো টাকা দিচ্ছে নাকি?

বড়োকাকা বললেন, না দিলে তো আমাদের বাবুরা চোখে সর্ষেফুল দেখবেন, কান অবধি সব দেনায় ডুব রয়েছেন! বটুকে কান্তা কেবিনের পথ দিয়ে হাঁটা বন্ধ করতে হয়েছে, ধারে আর ক দিন চালানো যায়!

কালো-মাস্টারও বললে, আপনারা ভাববেন না, স্যার, আমরা মেরে বেরিয়ে যাব। নইলে আমার নাম কা– উঃ! চিমটি কাটছ কেন চাঁদ?

আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললাম, কোথায় চিমটি কাটলাম! চেয়ারের ফাঁকে তোমার ওখানটা চিপকে গিয়েছে বোধ হয়।

পরে বললাম, আচ্ছা, তোমার কি এত দিনেও একটু আক্কেল-বুদ্ধি হল না, আর-একটু হলেই তো সব ফেঁসে যাচ্ছিল। আমি ভুলে যাই যে তুমি সত্যিকার বিশে নও, আর তুমি ভুলতে পার না?

কাছেপিঠে তখন কেউ ছিল না, কালো-মাস্টার চট করে আমাকে একটা প্রণাম ঠুকে বললে, আহা, তাই যেন হয়, স্টেজে উঠে সবাই যেন তাই ভাবে। একটা কথা ছিল, কত্তা, অভয় দাও তো বলি।

বললাম, কী কথা বলো।

সে বললে, কাপ তোমরা পাবে ঠিকই, সমরেশবাবুও তোমার বড়োকাকার হাতে পাঁচ-শো টাকা খুশি হয়ে দিয়ে দেবে। সব হবে, কিন্তু সন্ধ্যেটা নির্বিঘ্নে কাটবে বলে মনে হয় না। তোমার বড়োকাকাকে একটু ডাকো দিকিনি, দুটো দরকারি কথা আছে।

ডাকলাম বড়োকাকাকে, লাইব্রেরি ঘরের একটা ফালি বারান্দা, সেখান থেকে গঙ্গা দেখা যায়, সেইখানে নিরিবিলি গিয়ে আমরা বসলাম। কালো-মাস্টার বললে, স্যার, সন্ধ্যে বেলায় কয়েকটা ষণ্ডা-গোছের ভলেন্টিয়ার রাখবেন, যে-ই গোলমাল করবে তাকেই যেন বাইরে নিয়ে যায়। আর অচেনা অজানা বাজে লোকদের খবরদার ঢুকতে যেন না দেয় আমার অনেক শত্রুর স্যার, নাটক পণ্ড করে দিতে পারলে তারা ছাড়বে না। হ্যাঁ, তবে আমার বন্ধু স্যান্ডোকে বারোটা টিকিট দিয়েছি, তারা বারো জন আসবে। কোনো ভয় নেই স্যার, তাদের কতক কতক বলে রেখেছি, কেউ গোল করলেই তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে বাইরে নিয়ে যাবে কিছু বললেন?

বড়োকাকা বললেন, কাজটা কি খুব ভালো হবে, বিশু? সবাই আমাদের নিমন্ত্রিত অতিথি, একটু যদি গোলমালও করে– এই যেমন কাল বটুরা কতবার শেম শেম বলে চেঁচিয়ে এল ভোঁদাদের অভিনয় দেখতে গিয়ে।

কালো-মাস্টার হেসে ফেলল, ও-রকম গোলমালের কথা বলছি না, স্যার, আজকের অভিনয় দেখে অমন কথা কারো বলতে ইচ্ছেই করবে না। আমি বলছিলাম, আমার শত্তুররা যদি আমার নাটক করা বন্ধ করে দিতে চায়– ধরুন আপনাদের কাছেই যদি মিছে কথা লাগিয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যায়–

বড়োকাকা বললেন, সে আমরা দেব কেন? সবই যখন শুনলাম, তখন বিভুর দলকে ডেকে ওদের ছাতুপেটা করে দেব-না– তোমার কোনো ভয় নেই, বিশু। আরে, চাঁদ দিনরাত তোমাদের সাহসের আর গুন্ডাপনার গল্প করে করে আমাদের কানের পোকা নড়িয়ে দেয়, তুমি এখন ভয় খেলে চলবে কেন? চলো, আর খুব বেশি সময়ও নেই, সাজপোশাক শুরু কত্তে হয়।

কালো-মাস্টার বললে, কিন্তু যদি পুলিশ আসে? ওরা ধরুন পুলিশের কান ভাঙিয়ে তাদের সঙ্গে করে নিয়ে এল? কিংবা নিজেরাই ধরুন পুলিশ সেজে এল? থিয়েটার-করা লোক সব, চেনবার জো থাকবে না!

বড়োকাকা এবার ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, তা হলে কী হবে, বিশু?

কালো-মাস্টার হাসল, আরে, এতটুকুতেই মুষড়ে পড়লেন? আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না, শুধু গেটের ভলেন্টিয়ারদের বলবেন যে অচেনা লোকদের ঢুকতে দেবে না। আমার বন্ধু স্যান্ডোর দল একটা করে গাদাফুল কানে গুঁজে আসবে, তাই দেখে তাদের চিনবে। তা ছাড়া কিন্তু পুলিশ এলেও বাইরে বসিয়ে রাখবে নাটক না ভাঙা পর্যন্ত। তারপর নাটক ভাঙলে পর, আপনাদের কাপ পাওয়ার কথা সবাই শুনলে পর, স্বচ্ছন্দে আমাকে যার খুশি ধরে নিয়ে যেতে। পারে। অবিশ্যি যদি আমার নাগাল পায়।

এই বলে কালো-মাস্টার উঠে পড়ে সাজগোজের ব্যবস্থা করতে গেল।

১২.

আমাদের ওই নাটকের বিষয় বেলুড় বালি থেকে হুগলি উঁচড়ো বদ্যিবাটি পর্যন্ত লোকরা আজও গল্প করে। এমন নাটক কেউ দেখেনি। যেমনি তার সাজসজ্জা, তেমনি অভিনয়ের বাহাদুরি। আজও লোকে বলে সবচেয়ে ভালো অভিনয় করেছিল বিশ্বনাথ বলে লোকটা, যদিও তার সত্যিকার পরিচয় এখন রহস্যে ছড়ানো। সব বলছি।

চমৎকার করে স্টেজ সাজানো, পেছনে গঙ্গার কুলকুল কলকল শব্দও শোনা যাচ্ছে না, পাপা পোঁপো করে এমনি ভালো বাজনা বাজছে। তা আর বাজবে না! দি গ্রেট গ্যাঞ্জেস কত্সার্ট পার্টি যে বড়োকাকিমার মাসতুতো ভাইয়ের নিজের দল।

দেয়ালে সব গাদাফুলের তোড়া ঝোলানো হয়েছিল, তাতে বিভুদাদের দলের পাণ্ডা সুকুমার নিজের হাতে পিচকিরি দিয়ে গোলাপজল ছিটিয়ে দিয়েছিল, চারদিক গন্ধে ভুরভুর করছিল। আমি একবার পর্দা ফাঁক করে উঁকি মেরে দেখি বাবা! শুধু মাথা– গুনগুন করে সব কথা বলছে, মৌচাকের মতো শব্দ হচ্ছে। একটু পেট ব্যথা করতে আরম্ভ করে দিয়েছিল, অতগুলো লোকের সামনে দ্বিতীয় সৈনিক সেজে আমি ধপ করে পড়ে মরি কী করে! ভাবছিলাম ওরই মধ্যে কোথাও স্যান্ডো আর তার বন্ধুরা বারোজন কানে গাদাফুল গুঁজে বসে আছে, বিশের শত্তুররা এতটুকু ট্যা-ফু করলেই তাদের টুটি চেপে ধরবে।

তারপরেই কোথায় একটা ঘণ্টা বাজতে লাগল, আমার তো হাত-পা ঠান্ডা! বারে বারে বিশের মানে কালো-মাস্টারের মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস পেতে চেষ্টা করলাম। তা ওকেও কি চেনবার জো ছিল! আমাদের সবাইকে সাজিয়েছে কলকাতা থেকে আনা সেই কোম্পানির লোকেরা, শুধু কালো-মাস্টার নিজে সেজেছে।

কী চমৎকার দেখাচ্ছিল ওকে! রং মেখে ফর্সা ধবধব করছে, লালচে দাড়ি-গোঁফ চুল পরেছে, যেখানে-সেখানে গয়না জুলজুল করছে, ভুরু দুটোকে সোজা করে টেনে মাঝখানে জুড়ে দিয়েছে, চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে; মাথার ওপর মণিমাণিক্য-দেওয়া পাগড়ি পরে এই এতখানি উঁচু দেখাচ্ছে; গায়ে মখমলের সাজ, হাতে একটা গোলাপ ফুল। সত্যিকার রাজা দেখেছিলাম একবার, কালো কোটপ্যান্ট পরা, সে এর কাছে দাঁড়াতেও পারত না। কানের পেছনে একটু আতর মেখে নিয়ে এক্ষুনি বধ হতে যাবে, বীর আর কাকে বলে!

আমরা যে অভিনয় করছি ভুলে গেলাম। মনে হল সত্যি সত্যি পঞ্চপাণ্ডব এসেছেন, ওই বুঝি শ্রীকৃষ্ণ– তবে শ্রীকৃষ্ণের হাতের গয়নাগুলো বড্ড কেটে বসেছিল, সাজের বাবুরা তাই নিয়ে হাসাহাসি করছিল, কেষ্টঠাকুরের গতর কত! ব্রজেনদা মনে মনে রেগে টং।

শেষ দৃশ্যে শিশুপালের অভিনয় দেখে সবাই কেঁদে ভাসিয়ে দিচ্ছিল, তারই মধ্যে একটা চাপা শোরগোল শোনা গেল– চুপ চুপ শব্দ, খুব নড়াচড়া, কারা যেন বেরিয়েও গেল। সব যখন শেষ হয়ে যাচ্ছে, আমার পর্যন্ত কান্না পাচ্ছে, হঠাৎ অবাক হয়ে দেখি, দু-দিকে চেয়ারের সারি, মাঝখানে যাবার রাস্তা, তারই মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে ভোঁদা চেঁচাচ্ছে আর বড়োকাকা, ছোটকা আরো দশ-বারোজন বড়োরা ওকে ধরে, একরকম ঠেলতে ঠেলতে দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। অন্য লোকেরা সবাই মিলে বলছে সসস, তারই মাঝখানে শিশুপাল মরে গেল, স্ক্রিন পড়ে গেল। আর সে কী আকাশ-ফাটানো হাততালি!

হাততালির মাঝখানে আর-একবার স্ক্রিন উঠল, আর সমরেশবাবু ছুটে এসে, খচমচ করে স্টেজে চড়ে, মাইকের কাছে গিয়ে চিৎকার করে বললেন, শিশুপাল-বধকেই আমরা পাঁচ-শা টাকা পুরস্কার দিলাম, আর শিশুপালকে বিশেষ পুরস্কার দেড় ভরি সুবর্ণপদক।

শিশুপালও ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে, সমরেশবাবু অমনি তাকে বুকে জাপটে ধরেছেন, সঙ্গেসঙ্গে ধন্য ধন্য রব আর আবার স্ক্রিন পড়ে যাওয়া!

এতক্ষণ স্টেজেই এত আনন্দ-কোলাহল হচ্ছিল যে বাইরের কথা কারো মনে ছিল না। এবার চারদিক থেকে কিলবিল করে লোকেরা সব স্টেজে উঠতে লাগল। বড়োকাকা, ছোটকা, ভোঁদা, সেই চিত্রতারকা ভবেশ রায়, আর ওদের দলের আরও কত কে। কী রাগ সবার!

বড়কাকা বললেন, চাঁদ!

শুনে আমি থ! আমরা জিতেছি, কাপ পেয়েছি, তবে এরা এত গম্ভীর কেন! আর শুধু গম্ভীর কী বলছি, ভোঁদারা তো রেগে থরথর করে কাঁপছে।

বড়োকাকা বললেন, দাঁড়াও, কেউ যেয়ো না। ভবেশবাবু, দাড়ি-গোঁফ চিনে নিন। এগুলোই কি আপনাদের? একটু ভেবে বলবেন।

ভবেশ রায় গেল ঘাবড়ে, এর দাড়িতে হাত দেয়, ওর চুল দেখে, মুখটা কাচুমাচু, বললে, না, মানে দাড়ি-গোঁফ কি আর সে রকম চেনা যায়? সব সময়ই ওদের চেহারা বদলায়!

দারুণ চমকে উঠলাম, এ যে কালো-মাস্টারেরই কথা! কিন্তু কালো-মাস্টার কই? এক্ষুনি যেখানে ছিল এখন তো আর সেখানে নেই!

ছোটকা বললেন, বিশে কোথায়, চাঁদ? সে নাকি এদের দাড়ি-গোঁফ চুরি করে পালিয়ে এসেছে?

আমি ভয়ংকর রেগে গেলাম, হাত-পা ছুঁড়ে বললাম, না, না, না, ও কক্ষনো চোর না! বড়োকাকা বললেন, জিনিসই নেয়নি. তো চোর কীসের? আপনাদের দাড়ি-গোঁফ ছাড়িয়ে নিয়ে যান।

ভোঁদা বললে, কিন্তু কিন্তু তাহলে তোমরা কাপ পাও কী করে? ও সাজ তো আমাদের!

সমরেশবাবু বললেন, আহা, কী জ্বালা, সাজের জন্যে তো আর কাপ দেওয়া নয়! অভিনয় কত্তে হয় তো এরাই করেছে। কিন্তু মশায়, ব্যাপারটা একটু খুলে বলুন তো, কিছুই যে বুঝলাম না।

ভোঁদা বললে, কী আবার ব্যাপার? ভবেশ ওকে আনল, বললে আমাদের থিয়েটারের মেকাপম্যান, নাম কালো-মাস্টার, এত ভালো সাজাতে কেউ পারে না; তা সে বেটা একদিন রিহার্সাল দেখেই বলে, আমাকে কর্ণ সাজাও, ভবুবাবু কিছু পারছে না! ব্যস্, ওই ওর এক কথা! এদিকে ভবেশ করছে কর্ণ, যা-তা একটা বললেই তো আর হল না! তখন কালো-মাস্টার করল কী, স্রেফ দাড়ি-গোঁফ নিয়ে কেটে পড়ল। কোম্পানিকে টাকা দেওয়া হয়ে গেছে, আর আমাদের টাকা কোথায় যে আবার দাড়ি-গোঁফ ভাড়া করব? বলুন দেখি, কী অন্যায়! আবার আমাকে হল থেকে ঠেলে বের করে দেওয়া হয়েছে!

কখন বাবাও এসে স্টেজে উঠেছেন আমি দেখিনি। আমার দিকে ফিরে বাজের মতো গলায় বললেন, চাঁদ কোথায় পেলে ওকে? সে যা-ই হোকগে, ওকে এখন ধরা হোক, হাজতে পোরা হোক। কিন্তু কোথায় ওর সঙ্গে আলাপ হল, হতভাগা?

আর কি আমি সেখানে থাকি! এক নিমেষে একেবারে হাওয়া। পেছনে শুনলাম একটা হই-হই ধর-ধর শব্দ, তারপরেই পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে, পাঁচিলে চড়ে সরু ফাঁক দিয়ে গলে, নালা ডিঙিয়ে একেবারে পেরিস্তানে!

বুকটা ঢিপঢিপ করছিল। এমন সময় শুনলাম টং লিং টং লিং–টং লিং করে পুলের ওপর দিয়ে মালগাড়ি যাচ্ছে, স্যান্ডো বেরিয়ে এসে সবুজ নিশান নাড়ছে, আর সঙ্গেসঙ্গে ওরই ঘরের ছাদ থেকে গেঞ্জি-পরা কালো একটা লোক মালগাড়ির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত নাড়তে নাড়তে চলে গেল। উঃ, আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম!

এতক্ষণে খেয়াল হল আমি একা নই, আমার সামনে আমার সমান বয়সের একটা ছেলে আর তার চেয়ে একটু ছোটো একটা মেয়ে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আর একটা পোড়া হাঁড়ির মতো মুখওয়ালা লেজকাটা কুকুর আমার পায়ের গোড়ালি শুকছে।

ছেলেটা বলল, আমরা পাশের গুদোম-বাড়িতে থাকি, ওই নালা পার হয়ে এসেছি। আমার নাম কালো, ও আমার বোন আলো। আর কুকুরটার নাম বাঘা। আমরা মাঝে মাঝে এখানে আসি, ভারি ভালো লাগে এ জায়গাটা– তুমি রাগ করবে না তো?

আমি বললাম, না, মোটেই রাগ করব না, এখন থেকে তোমরা আমার বন্ধু। আমার বড়ো বন্ধুর দরকার। এক্ষুনি আমাকে ধরবার জন্য লোকরা আসবে, তোমরা ভয় পাবে না তো?

তারা বললে, মোটেই না, আমরা তোমার দলে থাকব! তোমাকে সাহায্য করব।

এবার আসুক ওরা, ধরুক আমাকে! একটুও ভয় পাব না। বলব, কালো-মাস্টার চোর নয়, দেখে আসতে পার, সঙ্গে কিছু নেয়নি, সাজের ঘরে গয়না-পোশাক ছেড়ে রেখে গেছে। তার সুবর্ণপদকও নেয়নি, ওটা বিক্রি করে, ভোঁদারা কোম্পানিকে দাড়ি-গোঁফের জন্য যে টাকা দিয়েছিল সেটা পুরিয়ে দাও, ব্যস্, চুকে গেল! হাঁ করে দেখছ কী? তাকে পাচ্ছ না, সে চলে গেছে!

তখন বিভুদা হয়তো বলবে, আর তোর বন্ধু বিশে, সে কোথায়? তার সিংহ কুকুর কোথায়? বলে আমার মাথায় গাঁট্টা মারতে চেষ্টা করবে।

আমিও তখন ওর হাত ধরে মুচকে দিয়ে বলব, তাকেও ধরতে পারবে না। সেও নেই, সিংহও নেই, ছিলও না কোনদিন। আমি তাদের বানিয়েছিলাম। আমার গায়ে জোর ছিল না, আমার বন্ধু ছিল না, ভয় লাগত, একলা লাগত, তাই তাদের বানিয়েছিলাম। এখন আমার গায়ে জোর কত; আমার সত্যিকার বন্ধু হয়েছে, আর বিশেরা আসবে না। আরে, বিশে বলে কেউ আছে নাকি যে তাকে ধরবে? ভেবেও হাসি পাচ্ছে!

Exit mobile version