Site icon BnBoi.Com

রাবণের দেশে আমি এবং আমরা – হুমায়ূন আহমেদ

রাবণের দেশে আমি এবং আমরা - হুমায়ূন আহমেদ

সিল্কের ঝলমলে লুঙ্গি

রাবণের দেশে আমি এবং আমরা — ভ্রমণকাহিনী — হুমায়ূন আহমেদ

ভূমিকা

এই বইটিকে ভ্রমণকাহিনী বলা যাবে না। ভ্রমণকাহিনী আমি আসলে লিখতে পারি না। বিদেশে ট্রাভেলগ নামে কিছু বই আছে। ভ্রমণের সঙ্গে গল্প মেশান। এই বইটিকে ট্রাভেলগও বলা যাবে না। ভিন দেশে আমাদের আনন্দ-বেদনার কাব্য বলা যেতে পারে। চেষ্টা করেছি তথ্য দিয়ে বইটিকে ভারী না করতে, বাধ্য হয়ে কিছু তথ্য দিতে হয়েছে। তথ্যে ভুল থাকার কথা না, তারপরেও কোনো ভুল কারও চোখে পড়লে আমাকে জানাবেন। পরের সংস্করণে ঠিক করে দেওয়া হবে।

শ্রীলংকা দেখার আমার শখ ছিল। কারণটা বিচিত্র। মহান বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক আর্থার সি ক্লার্ক নিজ দেশ ফেলে সারা জীবন এই দেশে কাটিয়েছেন। একজন লেখকের কাছে নিজ দেশের চেয়ে অন্যদেশ কেন মনে ধরল তা জানার ইচ্ছা ছিল।

হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী

.

০১.

সিল্কের ঝলমলে লুঙ্গি পরা একজন হাস্যমুখী মানুষ। দেখতে আমাদের বাঙালিদের মতো। যখনই হাসছেন তখনই ধবধবে সাদা দাঁত ঝকমকিয়ে উঠছে। ভদ্রলোকের হাতে গোলাপি রঙের ক্যামেরা। তিনি বিপুল উৎসাহে ক্যামেরায় একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিজেও ছবির জন্যে পোজ দিচ্ছেন। তাঁর ক্যামেরায় অন্যরা ছবি তুলে যাচ্ছে।

ঘটনাটা ঘটছে ঢাকা এয়ারপোর্টের (এই এয়ারপোর্টের নাম ঘনঘন বদলাচ্ছে বলে ঢাকা এয়ারপোর্ট বলছি) যাত্রীদের ওয়েটিং লাউঞ্জে, যেখানে শ্রীলংকাগামী যাত্রীরা প্লেনে ওঠার অপেক্ষায় বসে আছেন। যাত্রীদের মধ্যে আছি আমি, দুই পুত্র এবং তাদের মা শাওন। লুঙ্গি পরা মানুষটির কর্মকাণ্ড আগ্রহ নিয়ে দেখছি। আগ্রহে বাধা পড়ল, কারণ হঠাৎ করেই পারিবারিক বিপ্লবের সূচনা হলো। তিন মাস বয়েসী কনিষ্ঠপুত্র নিনিত গলায় মাইক ফিট করে কান্না শুরু করেছে। সে দুধ খাবে। কৌটার দুধ আছে, কিন্তু তার মা দুধ গোলানোর পানি আনতে ভুলে গেছে। বেচারিকে বিব্রত দেখাচ্ছে।

নিনিতের বড় ভাই নিষাদের বয়স সাড়ে তিন বছর। সে তার ছোট ভাইকে কাঁদতে দেখলেই নিজে কাঁদার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। নিষাদ বলল, আমার ক্ষিধে পেয়েছে। আমি এখন কী খাব? বলেই ভাইয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কান্না।

আমার সফরসঙ্গী স্কুলজীবনের বন্ধু সেহেরি এবং তার স্ত্রী নাজমা। তাদের মধ্যে কিছু নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছে। নাজমা ভাবি শান্তমুখে স্বামীকে কঠিন কঠিন কথা বলছেন। সেহেরি গৌতম বুদ্ধের মতো মৌনভাব ধারণ করেছে। পারতপক্ষে সে স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলায় যায় না। বাইপাস অপারেশনের পর তার মধ্যে ভেজিটেবলভাব প্রবল হয়েছে। উচ্চশ্রেণীর কোনো ভেজিটেবলও না, নিম্নশ্রেণীর। যেমন ধুন্দুল।

আমাদের এই হৈচৈ ঝামেলার মধ্যে লুঙ্গি পরা মানুষটি ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এলেন। হাসিমুখে বললেন, আমি আপনাদের ছবি তুলি?

আমি যথেষ্টই বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তখন একজন বললেন, উনি বাংলাদেশে শ্রীলংকার হাইকমিশনার। যারা শ্রীলংকায় যাচ্ছেন তাদের হ্যালো বলতে এসেছেন।

আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এক জীবনে নানান দেশে গিয়েছি। কোনো দেশের হাইকমিশনার বা অ্যামবেসেডারই এয়ারপোর্টে হ্যালো বলতে আসেন নি। ঘটনাটা কী?

সেহেরি বলল, বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সরাসরি বিমান চলাচল আজই প্রথম শুরু তো, এই কারণেই হাইকমিশনার এসেছেন।

নাজমা ভাবি যে-কোনো ঘটনা নেগেটিভ ভাবে দেখার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন। তিনি মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, প্রথম বিমান চলাচল শুরু হয়েছে তার জন্যে হাইকমিশনার আসার দরকার কী? এইগুলা আবার কী ঢং! ছবি তোলাতুলিতে সময় নষ্ট। তার কারণেই তো বিমান ছাড়তে দেরি করছে।

বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সরাসরি বিমান যাত্রার প্রথম ফ্লাইটের যাত্রী আমরা–এই তথ্য আমার জানা ছিল না। শ্রীলংকা ভ্রমণের আইডিয়া শাওনের। সব ব্যবস্থা সে করেছে। আমাকে কিছু জানায় নি, আমি জানতেও চাই নি। আমার কাছে এই মুহূর্তে শ্রীলংকা ভ্রমণ বিভীষিকার মতো। পুত্র নিনিতের বয়স তিন মাস। আমি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বিদেশের মাটিতে পা দেওয়া মাত্র এই ছেলে তার মাকে চিনবে না। সে সারাক্ষণ বানরের বাচ্চার মতো আমার ঘাড়ে ঝুলে থাকবে। ফিডারে করে তাকে দুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে ডায়াপার বদলানোর সর্ব দায়িত্ব আমার। একই ব্যাপার নিষাদের বেলায়ও ঘটেছে। সারাক্ষণ বাবা! বাবা! বাবা ডাক অবশ্যই মধুর, কিন্তু বিদেশের মাটিতে না।

আমরা মিহিন লংকা বিমানে উঠেছি। সেহেরি এবং তার স্ত্রী বসেছেন আমাদের পেছনেই। নাজমা ভাবি ‘মেদভুঁড়ি কী করি’ গ্রুপের সদস্য। সিটে অনেক কষ্টে শরীর আঁটিয়েছেন। এখন বেল্ট বাঁধতে পারছেন না। তার বিরক্তি হঠাৎ তুঙ্গে উঠেছে। তিনি তার স্বামীকে ধমকাচ্ছেন–সিটে বাঁকা হয়ে বসেছ কেন? সোজা হয়ে বসো। পা নাচাচ্ছ কেন? তুমি কি পুলাপান? ওই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছ কেন? সাদা চামড়ার মেয়ে আগে দেখো নাই? জীবনে প্রথম দেখছ?

তিন ঘণ্টার বিমান ভ্রমণে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটল না। শুধু একজন বিমানবালা নাজমা ভাবির কাছে ধমক খেয়ে হকচকিয়ে গেল। বেচারি এসেছিল সেহেরিকে জিজ্ঞেস করতে, লাঞ্চে দুটা চয়েস আছে। নাসি গোড়াং এবং জিরা রাইস। সে কোনটা নিবে?

নাজমা ভাবি শ্রীলংকান বিমানবালাকে খাস বাংলায় বললেন, তারে জিজ্ঞেস করেন কেন? সে কি কিছু জানে? তারে যা দিবেন গবগবায়া খাবে। তার যে ডায়াবেটিস–এটা খাওয়ার সময় মনে থাকে না।

শ্রীলংকার এই বিমানবালার খাঁটি বাংলা বোঝার কোনোই কারণ নেই। ইউনিভার্সল বডি ল্যাংগুয়েজের কারণেই মনে হয় সে বুঝল। দু’ধরনের খাবার এনে নাজমা ভাবির সামনে ধরল। ভাবি ভুরু কুঁচকে বলল, এইগুলা কী? আমাদের দেশের কোনো ফকিরের পোলাও তো এইগুলা খাবে না।

.

বন্দর নায়েকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে দেখি, আমাকে রিসিভ করার জন্যে শ্রীলংকায় বাংলাদেশ মিশনের কনসুলার অফিসার মীর আকরাম এসেছেন। তার হাতে সুন্দর গিফট র‍্যাপে মোড়া উপহার। আমার লজ্জার সীমা রইল না। অ্যাম্বেসির লোকজনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকা উচিত। একজন লেখককে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট এসে সময় নষ্ট করা উচিত না।

আমি হাসিমুখে (নকল হাসি। এভারেস্টবিজয়ী মুসা ইব্রাহিম যে হাসি হেসে ছবি তোলেন।) আকরাম সাহেবের হাত থেকে উপহার নিলাম। ছবি উঠল। আমি এবং শাওন আবার হাসিমুখে একই গিফট নিলাম। আবারও ছবি উঠল। পুত্র নিষাদকে মাঝখানে রেখে তৃতীয়বারের মতো গিফট নেওয়া হলো। নকল হাসির বাজার বসে গেল।

গিফট হাতে নিয়ে আমি হতভম্ব। সেখানে লেখা–হুমায়ুন স্যার এবং শাওন ভাবির বিবাহবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা। পৃথিবীর বেশির ভাগ স্বামীর মতো আজকের দিনটি আমার মনে নেই। এতক্ষণে দুয়ে দুয়ে চার হলো। শাওন কেন এই দিনেই শ্রীলংকা যাওয়ার ব্যবস্থা করল, কেন আমাকে ভ্রমণসংক্রান্ত কিছুই জানায় নি, কেন আমার কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নেয় নি–সব পরিষ্কার। শ্রীলংকায় প্রমোদ ভ্রমণ বিবাহবার্ষিকীতে আমাকে দেওয়া শাওনের উপহার। এখন আমার উচিত তার দিকে প্রেমপূর্ণ নয়নে তাকানো, তা পারছি না। কারণ কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীলংকার বাদরের মতোই আমার গলায় ঝুলে তারস্বরে চিৎকার শুরু করেছে। তার ডায়াপারের ফাঁক দিয়ে হলুদ রঙের সিরাপের মতো কী যেন নামছে। তার বড় ভাই কিছুক্ষণ পরপর আমার শার্টে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলছে, বাবা! আমি এখন কী খাব?

[পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চই কৌতূহল বোধ করছেন, গিফট র‍্যাপে মোড়া উপহারটা কী জানার জন্যে। তাদের কৌতূহল মেটাচ্ছি। উপহার হলো একটা ফটোফ্রেম। ফটোফ্রেমের বিশেষত্ব হচ্ছে ফ্রেম বানানো এলাচির খোসা দিয়ে। গরম মসলার দেশে সব কিছুতে গরম মসলা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।]

আকরাম সাহেব আমাদের জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। (সাড়ে চার শ’ ডলারে চুক্তি। সাত দিন গাড়ি থাকবে আমাদের সঙ্গে।) নয় সিটের বিশাল গাড়ি। গাড়ির চালক সুদর্শন যুবা পুরুষ, নাম ‘দিগায়ু’। আমি চালককে বললাম, তোমার নামের অর্থ কি দীর্ঘ জীবন?

চালক অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি কীভাবে জানলে?

দীর্ঘায়ু থেকে দিগায়ু– এটি আর ব্যাখ্যা করলাম না। আমার নজর সেহেরির দিকে। সে চোখের ইশারায় আমাকে কী যেন বলতে চাচ্ছে। মেয়েদের চোখের ভাষা সহজেই পড়া যায়, পুরুষদেরটা পড়া যায় না। এক পর্যায়ে সেহেরির চোখের ভাষা বুঝতে পারলাম। সে তার স্ত্রীর পাশে বসতে চাচ্ছে না। আলাদা বসতে চাচ্ছে। আমি বললাম, সেহেরি! তুমি ড্রাইভারের পাশে বসো।

নাজমা ভাবি বললেন, এটা কেমন কথা! স্বামী-স্ত্রী বসবে পাশাপাশি, এটাই নিয়ম।

আমি বললাম, প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। এর অর্থ বিদেশে কোনো নিয়ম নেই।

নাজমা ভাবি বললেন, আপনারা তো স্বামী-স্ত্রী ঠিকই পাশাপাশি বসেছেন।

আমি বললাম, আমাদের দুজনের মাঝখানে ডাবল হাইফেনের মতো দুই পুত্র।

নাজমা ভাবি মুখ ভোঁতা করে পরিস্থিতি মেনে নিলেন। আমাদের টিম লিডার শাওনের নির্দেশে গাড়ি চলতে শুরু করল। আমরা যাচ্ছি ‘ডাম্বুলা’। সেখানে কোন হোটেলে উঠব, দর্শনীয় কী দেখব, কিছুই জানি না। টিম লিডার জানেন এটাই যথেষ্ট।

শাওন বলল, ডাম্বুলা যেতে আমাদের লাগবে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। আমরা উঠব পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হোটেলগুলির একটিতে। হোটেলটা ডিজাইন করেছেন পৃথিবীর সেরা আর্কিটেক্টদের একজন, তাঁর নাম জেফরি বাওয়া। হোটেলের নাম হেরিটেন্স কাভালামা। প্রায় বছরই এটি পৃথিবীর সেরা পরিবেশবান্ধব হোটেল হিসেবে ইউনেস্কো পুরস্কার পায়।

কী মনে করে আমি দিগায়ুকে জিজ্ঞেস করলাম, ডাম্বুলা যেতে আমাদের কতক্ষণ লাগবে।

সে বলল, সাত থেকে আট ঘণ্টা।

আমি টিম লিডারের দিকে তাকালাম। টিম লিডার বললেন, আমি সব তথ্য পেয়েছি ইন্টারনেটে। এক্ষুণি তোমাকে দেখাচ্ছি।

সে তার আইফোন নিয়ে টেপাটিপি করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে তার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। সে জানাল তার আইফোন কাজ করছে না।

আমি দিগায়ুকে বললাম, আমরা দীর্ঘ ভ্রমণে রওনা হয়েছি, ধরো কোনো কারণে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল, তখন আমরা কী করব?

দিগায়ু বলল, আমি কোম্পানিকে টেলিফোন করে দিলেই অন্য গাড়ি চলে আসবে। তবে ছোট্ট সমস্যা হয়েছে।

কী সমস্যা?

হাত থেকে পড়ে আমার মোবাইল ফোন নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি বললাম, চমৎকার। ধরা যাক কয়েকটা ইঁদুর এবার।

দিগায়ু বলল, কী বললে বুঝলাম না।

আমি বললাম, বাংলা ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করলাম।

ততক্ষণে আনন্দের বদলে আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার ক্ষুধা পাবে। সঙ্গে শ্রীলংকার কোনো টাকা নেই। এয়ারপোর্টে ডলার ভাঙানো হয় নি, কারণ টিম লিডারের নির্দেশ পাওয়া যায় নি।

আমি দিগায়ুকে বললাম, পথে আমাদের কিছু খেতে হবে। এমন কোনো রেস্টুরেন্ট কি পাওয়া যাবে যেখানে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যায়? আমার সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড আছে। ডলার আছে।

দিগায়ু বলল, সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে চেষ্টা করে দেখব।

প্রতি আধঘণ্টা পরপর দিগায়ু একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাচ্ছে। খোঁজ নেওয়ার জন্যে ছুটে যাচ্ছে এবং মুখ শুকনো করে ফিরে আসছে। আমি প্রমাদ গুনলাম।

অন্ধকার রাস্তা। স্ট্রিট লাইটের ব্যবস্থা নেই। রাস্তাও ভালো না। বাংলাদেশের মফস্বল শহরের রাস্তার মতো খানাখন্দে ভরা। আমরা ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগুচ্ছি। ঝাঁকুনির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভালো। নিনিত ঘুমাচ্ছে। শিশুরা বিচিত্র কারণে ঝাঁকুনি পছন্দ করে।

সেহেরি বলল, আমার ডায়াবেটিস! কিছু না খেলে তো মারা যাব।

আমি বললাম, নিনিতের দুধ আছে। ফিডারে করে বানিয়ে দেই খাও।

সেহেরি হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মৌনভাব ধরল। নাজমা ভাবি বললেন, হুমায়ূন ভাই তো ভুল কিছু বলেন নাই। তুমি রোগী মানুষ। তোমার খাওয়া দরকার। দুধ তোমার জন্যে উপকারী। বাচ্চাদের দুধে ফ্যাটও থাকে কম।

সেহেরি ক্ষিপ্ত গলায় বলল, আমি ফিডারে করে দুধ খাব?

নাজমা ভাবি বললেন, তোমার জন্যে এখন গ্লাস পাব কই? হুমায়ূন ভাই জ্ঞানী মানুষ। তিনি না ভেবে-চিন্তে কিছু বলেন না।

সেহেরি বলল, চুপ করো তো!

নাজমা ভাবি বললেন, চুপ করব কেন? চুপ করার কী আছে? আগে তো জীবন রক্ষা করবে, তারপর অন্য কিছু। তোমাকে ফিডারে দুধ খেতে হবে। আমরা আমরাই তো। কেউ তো আর ঘটনা দেখছে না।

প্রিয় পাঠক, সেহেরি ফিডারে দুধ খেয়েছে কি খায় নি তা পরিষ্কার করছি না। সব তথ্য প্রকাশ করতে নেই। তবে আমাদের রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, গোপন কথাটি রবে না গোপনে।

গভীর রাতে আমরা জেফরি বাওয়ার ডিজাইন করা হোটেলে ঢুকতে শুরু করলাম। মনে হলো সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। একসময় গাড়ি থামল। পাথরের প্রকাণ্ড পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে হোটেল। কেমন যেন ভৌতিক দেখাচ্ছে।

ফাইভস্টার হোটেলের লবি হয় আলোঝলমল। দেখামাত্র চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এখানে লবি বলে কিছু নেই। টেবিলের কোণে দু’টি লুঙ্গি পরা মেয়ে বসে আছে। তাদের সামনে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। আধো আলো এবং অন্ধকার। সব মিলিয়ে অতি রহস্যময় পরিবেশ।

নাজমা ভাবি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই! এই কোন জঙ্গলে এনে আপনি তুললেন? তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই ফল পড়ার মতো গাছ থেকে দুটা বাঁদর পড়ল। নাজমা ভাবি চেঁচিয়ে উঠলেন, এইগুলা কী! এইগুলা কী!

পুত্র নিষাদ বলল, এগুলির নাম মাংকি!

মাংকি দু’টা নিষাদের সামনে এসে দাঁড়াল। মুহূর্তের মধ্যেই নিষাদের হাতের চকলেটের প্যাকেট কেড়ে নিয়ে গাছে উঠে পড়ল।

ভয়ে হোক কিংবা প্রেমবশতই হোক নাজমা ভাবি সেহেরিকে জড়িয়ে ধরে আছেন। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে।

.

অতি দ্রুত আমরা রুমের চাবি পেয়ে গেলাম। রিসিপশনিস্ট মেয়েটি বলল, তোমাদের রুমের একদিকটা পুরোটাই কাচের। স্লাইডিং ডোর। রাতে ঘুমুবার আগে অবশ্যই স্লাইডিং ডোর লক করবে। নয়তো বাঁদর ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র নিয়ে যাবে।

নাজমা ভাবি হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করে বললেন, হুমায়ূন ভাই, আপনি কোথায় এনে তুলেছেন! রাতে বান্দর ঢুকে তো আমাকে খেয়ে ফেলবে।

সেহেরির ঠোঁটের ফাঁকে ক্ষীণ হাসি। বাঁদর তার স্ত্রীকে খেয়ে ফেলছে–এই দৃশ্য কল্পনায় দেখে তার হয়তো ভালো লাগছে।

ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় রুমে ঢুকলাম। শাওন বলল, হোটেল পছন্দ হয়েছে?

আমি বললাম, ভোর হোক, তারপর বলব।

রুমের সামনের বিশাল বারান্দায় সাত-আটটা বাঁদর এসে বসে আছে। গভীর আগ্রহে তারা নতুন অতিথিদের দেখছে। একটিকে দেখলাম দু’পায়ে ভর দিয়ে মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিষাদ তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, Don’t touch me, সে কিছুদিন হলো স্কুলে যাচ্ছে। তার ইংরেজি স্কুল থেকে শেখা।

পাশের রুমে সেহেরি এবং নাজমা ভাবি। নাজমা ভাবির কঠিন গলা শোনা যাচ্ছে। সেহেরির গলা পাওয়া যাচ্ছে না। ঝগড়া হচ্ছে একতরফা।

আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকীর রাত। রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে কিছু একটা করা দরকার। আমি শাওনের দিকে তাকিয়ে বললাম, একটা গান করো তো।

শাওন বলল, এই অবস্থায়?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

নিষাদ বলল, মা গান করবে না। আমি করব। বলেই সে গান ধরল–

আজকের আকাশে অনেক তারা
দিন ছিল সূর্যে ভরা
আজকের জোছনাটা আরও সুন্দর
সন্ধ্যাটা আগুনলাগা।

শাফিন আহমেদের গাওয়া এই গানটা নিষাদ পুরোটা গাইতে পারে। নিষাদ গান করছে, তার মা’র চোখ ছলছল করছে। আহারে, কী সুন্দর দৃশ্য!

.

ভোর হয়েছে।

আমি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে আছি। আমার সামনে বিশাল কান্ডালামা লেক। আকাশ ঘন নীল। সেই নীল গায়ে মেখে কান্ডালামা হ্রদ হয়েছে নীল। কী আনন্দময় অপূর্ব দৃশ্য! আমি মনে মনে বললাম, ‘আজ আমি কোথাও যাব না।’

মধ্যবিত্তের বিদেশ ভ্রমণ হলো চড়কিবাজি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি। দর্শনীয় যা আছে সব দেখে ফেলতে হবে। কোনোকিছু যেন বাদ না পড়ে। এত টাকাপয়সা খরচ করে এসে বিশ্রামে সময় নষ্ট করা কেন?

ইউরোপ-আমেরিকার ট্যুরিস্টদের দেখি ভ্রমণের সঙ্গে তারা যুক্ত করে বিশ্রাম। রোদে শুয়ে থেকে বই পড়ে। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘুম। ঠান্ডা বিয়ারের গ্লাসে চুমুক।

.

আমি সারা দিন আমার ঘরের বারান্দায় বসে কাটাব–এই দুঃসংবাদ শুনে নাজমা ভাবির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি হতাশ গলায় বললেন, আপনি তো সারা দিন নুহাশপল্লীর বাংলোর বারান্দাতে বসে সময় কাটাতে পারেন। এত টাকাপয়সা খরচ করে এখানে তাহলে এসেছেন কেন?

অকাট্য যুক্তি। কিন্তু লেখকশ্রেণী যুক্তির বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। আমি হ্রদের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় বসে রইলাম। আমার সামনে কাগজ-কলম। দেশের বাইরে আমি কখনো লেখালেখি করি না। এই তথ্য জানার পরেও আমি যেখানে গিয়েছি শাওন কাগজ-কলম নিয়ে গেছে। আমার সামনে রেখেছে। শাওনকে খুশি করার জনেই কবিতার কয়েকটি চরণ লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।

আজ দুপুরে হ্রদের নিমন্ত্রণ।
অতিথি আমরা ক’জন।
পুত্র নিষাদ এবং শাওন
শাওনের লেখক স্বামী…

এরপর আর মিলাতে পারছি না। গদ্যলেখক হওয়ার অনেক সুবিধা। মিলানোর চিন্তা নেই। কবিতাটা হয়তো আরও কয়েক লাইন লিখতে পারতাম, তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটল। বাঁদর এসে টেবিল থেকে চশমা নিয়ে পালিয়ে গেল। চশমা ছাড়া আমি কাছের জিনিস দেখতে পাই। দূরের কিছুই দেখি না। এখন উপায় কী হবে! আমার হাহাকার ধ্বনি শুনে শাওন বারান্দায় এসে আমাকে আশ্বস্ত করল। সে আমার আরও দুটি চশমা নিয়ে এসেছে।

এখন অতি বিস্ময়কর একটি ঘটনা বলি। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বারান্দায় গিয়েছি শেষ সিগারেট খেতে। অবাক হয়ে দেখি টেবিলে আমার চশমা। যে বাঁদর চশমা নিয়ে গিয়েছিল সে ফেরত দিয়ে গিয়েছে।

.

পুনশ্চ

কান্ডালাম হোটেলে এক ভোরবেলায় নাশতা খাচ্ছি, বেয়ারা যখন শুনল আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি তখন আনন্দে তার বত্রিশ দাঁত বের হয়ে গেল। তার আনন্দের কারণ বুঝতে না পেরে আমি জানতে চাইলাম, বাংলাদেশী শুনে এত খুশি কেন?

সে বলল, তোমরা খুব ভালো মারামারি করতে পারো।

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তার কাছে শুনলাম, এই হোটেলে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এবং ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম ছিল। তাদের মধ্যে মারামারি লেগে গেল। বাংলাদেশ জিতল। দু’দলের মারামারি থামিয়েছিলেন ক্রিকেটার জাভেদ ওমর।

যেভাবেই হোক দেশ পরিচিতি পাচ্ছে, এটা খারাপ কী!

রাজা কাশ্যপ

০২.

যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগে শ্রীলংকার নৃপতি ছিলেন রাজা কাশ্যপ।

কাশ্যপ ছিলেন মহা ভীতুদের একজন। সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকেন কখন জলদস্যুরা আক্রমণ করে। কখনবা ভারত থেকে সৈন্যবাহিনী এসে তার দেশ দখল করে।

তাঁর আসল ভয় সৎভাই ম্যাগলোনাকে। সে ঘোট পাকাচ্ছে কাশ্যপের রাজত্ব দখলের। প্রজারা আবার ম্যাগলোনার অনুগত, কারণ মহারাজা কাশ্যপ রক্ষিতার গর্ভে জন্মেছেন। অন্যদিকে তার সৎভাইয়ের গায়ে আছে রাজরক্ত। প্রজারা রাজরক্তের ভক্ত হয়ে থাকে।

একজন ভীতু মহারাজা কী করেন? বিশাল সৈন্যবাহিনী হাতের কাছে মজুদ রাখেন। কাশ্যপও তাই করেছেন। তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী। সবাই হাতিতে চড়ে যুদ্ধে পারদর্শী। শ্রীলংকা হাতির দেশ। রাজা কাশ্যপের আছে দশ হাজার হাতির বিশাল বাহিনী।

একজন ভীতু রাজা তার প্রাসাদ এমন এক জায়গায় নির্মাণ করেন, যেখানে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। রাজা কাশ্যপ তা-ই করেছেন। ছয়শত ফুট উঁচু এক পাথর কেটে দুর্ভেদ্য প্রাসাদ বানিয়েছেন। প্রাসাদ অনেকটা মৌচাকের চাকের মতো। এই পাথর ‘সিগিরিয়া রক’ নামে ভুবন বিখ্যাত। সিগিরিয়া রকের আরেক নাম ‘লায়ন রক’। পাথরের এই দুর্গের প্রবেশপথটি একটি বিশাল সিংহমূর্তির মতো। সিংহমূর্তির অনেকখানি এখনো টিকে আছে।

ভীতু রাজারা লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করেন। সেই কারণেই কাশ্যপের বেশিরভাগ সময় কাটে দুর্ভেদ্য পাথরের প্রাসাদে। সেখানে আমোদপ্রমোদের সব ব্যবস্থা আছে। তার রক্ষিতার সংখ্যা পাঁচ শ’র বেশি। তার রক্ষিতা হিসেবে আফ্রিকান মোটা ঠোঁট কোঁকড়ানো চুলের মেয়ে যেমন আছে, চাপা নাক চেরাচক্ষুর চৈনিক তরুণীও আছে।

তাঁর নির্দেশে এই পাঁচ শ’ তরুণীর নগ্ন এবং অর্ধনগ্ন চিত্র আঁকা হয়েছে পাহাড়ের গুহায়। এইসব দেয়ালচিত্রের সামনেই গ্রানাইট পাথরের দেয়াল। গ্রানাইট পাথর ঘষে এমন চকচকে করা হয়েছে যে, সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আয়না। এই আয়নায় দেয়ালচিত্রে আঁকা রক্ষিতাদের ছবি প্রতিফলিত হয়। রাজা কাশ্যপ প্রতি বিকেলে আয়নায় রক্ষিতাদের ছবি দেখে ঠিক করেন আজ রাত কার সাথে কাটাবেন।

পাথরের সুউচ্চ প্রাসাদে কাশ্যপ সুইমিং পুলের ব্যবস্থা করেছেন (আজও টিকে আছে)। সখীদের নিয়ে আনন্দ-স্নানের আয়োজন।

ব্রিটিশ এক ইতিহাসবিদ ভিন্ন কথা বলছেন। তার মতে তরুণীরা সবাই একদিকে যাচ্ছে। কারও কারও হাতে ফুল। তারা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে বৌদ্ধ বিহার পিদুরাগালা, সিগিরিয়া থেকে এক মাইল দূরে। কাজেই তরুণীরা যাচ্ছে বৌদ্ধ বিহারে গৌতম বুদ্ধের মূর্তির কাছে।

ইতিহাসবিদরা মাঝে মাঝে ইতিহাস লিখতে হাস্যকর যুক্তি ব্যবহার করেন। যে গৌতম বুদ্ধ নারীদের সাধনার বিঘ্ন ঘোষণা করেছেন, তার কাছে তরুণীরা যাবে নগ্ন অবস্থায়? শুধু নগ্ন নারীরাই যাবে? পুরুষ যাবে না। কোনো পুরুষের ছবি দেয়ালচিত্রে নেই।

কাশ্যপের দিন আনন্দেই কাটছিল, হঠাৎ খবর পাওয়া গেল সৎভাই হস্তীবাহিনী নিয়ে আক্রমণের জন্যে আসছে। কাশ্যপ তার বিশাল সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলেন। তখনকার রীতি অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালক হিসেবে হাতির পিঠে রাজা কাশ্যপ আছেন সবার সামনে। তাঁকে অনুসরণ করছে তাঁর বাহিনী। এমন সময় দুর্ঘটনা ঘটল। কাশ্যপের হাতি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ স্থির থেকে পেছনে ফিরল।

কাশ্যপের সেনাপতিরা ভাবল, রাজা যুদ্ধ না করে পালাতে চাচ্ছেন। তারা রাজাকে ফেলে নিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। কাশ্যপ অবাক হয়ে দেখলেন যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একা। ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে তিনি মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করলেন। কোমর থেকে ধারালো ছোরা নিয়ে নিজের গলায় বসিয়ে দিলেন।

কাশ্যপের সেই পাথরের প্রাসাদ আজও দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর অতি বিস্ময়কর স্থান হিসেবে।

.

এই মুহূর্তে আমি আমার সফর সঙ্গীদের নিয়ে সিগিরিয়া রক নামে খ্যাত কাশ্যপের প্রাসাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। যেসব পর্যটক দেয়ালচিত্র দেখবে তাদের চার শ’ ফুট উপরে উঠতে হবে।

আমি বললাম, অসম্ভব ব্যাপার। সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে ফুসফুস করেছি দুর্বল। বাইপাস অপারেশনে হার্টের অবস্থা নাজুক। নগ্নবক্ষা তরুণীদের ছবি দেখতে গিয়ে অপঘাতে মরার কোনো মানে হয় না। আমি শাওনকে জানালাম, আমার পক্ষে উপরে ওঠার প্রশ্নই আসে না।

সেহেরি আমার চেয়ে এক কাঠি উপরে। সে উপরে উঠবে কি উঠবে না তা না-বলেই স্ত্রীকে রেখে উল্টাদিকে হাঁটা শুরু করল।

নাজমা ভাবি চেঁচাচ্ছেন, এই, তুমি কাউকে কিছু না বলে যাচ্ছ কোথায়? তোমার কি ভীমরতি হয়েছে?

সেহেরি ফিরেও তাকাল না। স্ত্রীকে উপেক্ষা করার তার অসীম সাহস দেখে আমি মুগ্ধ।

নাজমা ভাবি বললেন, হুমায়ুন ভাই, আপনি একটা বুদ্ধি দেন দেখি আমি কী করব। ডলার খরচ করে একটা জিনিস না দেখে চলে যাব? এটা কি ঠিক হবে?

আমি বললাম, অবশ্যই ঠিক হবে না। আপনি উপরে উঠবেন। গাইডরা ঠেলেঠুলে আপনাকে তুলে ফেলবে।

পরপুরুষ গায়ে হাত দিবে–এটা কেমন কথা?

তাহলে নিজেই সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকুন। শাওন যাচ্ছে। সে আপনাকে সাহায্য করবে।

নাজমা ভাবি রওনা হলেন। আমি দুই পুত্র নিয়ে বিশাল এক পাথরের উপর বসে আছি। জায়গাটা সমভূমি থেকে অনেক উঁচু। দুজনকে নিয়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাসের কাছে যাওয়া সম্ভব না। চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য অপরূপ। দৃশ্যে মন দিতে পারছি না। বারবার একটা সাইনবোর্ডে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। সেখানে ইংরেজিতে লেখা সাবধান বাণী–

ভয়ঙ্কর ভিমরুলের চাকপ্রধান এলাকা
শব্দ করে তাদের বিরক্ত করবে না।
প্রাণ সংহার হতে পারে।

ভিমরুলদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যেই হয়তোবা নিষাদ গলা উঁচিয়ে কাঁদতে লাগল–মার কাছে যাব! মার কাছে যাব! তার বিকট কান্নায় কনিষ্ঠজনের নিদ্রাভঙ্গ হলো। সে ভাইয়ের সঙ্গে তাল দিয়ে কাঁদতে লাগল। দুই ভাইয়ের কান্নায় ভিমরুলদের শান্তি বিনষ্ট হওয়ার কথা। আমি আতঙ্কিত বোধ করছি। বেড়াতে এসে ভিমরুলের হাতে জীবন দেওয়ার অর্থ হয় না।

আমার দুরবস্থা দেখে শ্রীলংকান এক যুবক পুরুষ এগিয়ে এল। জানতে চাইল বাচ্চা কাঁদছে কেন? [এইংরেজিতে প্রশ্ন, শুদ্ধ ইংরেজি। শ্রীলংকায় শিক্ষার হার শতভাগ]।

আমি বললাম, বড়টি কাঁদছে মার কাছে যাওয়ার জন্যে। ছোটটি ভাইয়ের কান্নায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিচ্ছে। এরা কখনোই আলাদা কাঁদে না, একসঙ্গে কাঁদে।

যুবাপুরুষ বলল, এক হাজার রুপির বিনিময়ে আমি তোমার পুত্রকে ঘাড়ে করে তার মা’র কাছে নিয়ে যেতে পারি। শিশুদের কোলে করে দেয়ালচিত্রের কাছে নিয়ে যাওয়াই আমার জীবিকা।

নিষাদ অপরিচিত এই মানুষটির কোলে চড়ে মার কাছে যেতে রাজি হলো। কান্না থামাল।

বড় ভাই কাঁদছে না, কাজেই ছোটটারও কান্না বন্ধ। আমি যুবককে বললাম, তুমি আরেকজনকে খুঁজে বের করো যে ছোটটাকে কোলে নিয়ে উঠবে। আমার কাছে বেবি ক্যারিয়ার আছে। বাচ্চাকে সেখানে বসিয়ে পিঠে বেঁধে নিলেই হবে।

আমি কল্পনায় দেখছি দুই ভাই মার কাছে উপস্থিত। মা তাদের দেখে বিস্ময়ে খাবি খাচ্ছে। দেয়ালচিত্র তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। পরিচিতজনদের বিস্মিত করতে আমার সবসময় ভালো লাগে।

বিস্মিত করার পরিকল্পনা কাজে লাগল না। শেষ মুহূর্তে নিষাদ বলল, সে তার বাবাকে ছাড়া যাবে না। কেউ আমাকে কোলে করে সিঁড়ি বাইছে–এই দৃশ্য কল্পনা করে শিউরে উঠলাম। দুই ভাই কাঁদুক! কী আর করা।

.

সরু পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে সাড়ে চার শ’ ফুট ওঠার রোমাঞ্চকর বর্ণনা শাওনের কাছে শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এত কাছে এসেও দেখা হলো না। বয়স এবং স্বাস্থ্য বাদ সাধল। আনন্দভ্রমণে তিনটি জিনিস লাগে–

অর্থ
বয়স
স্বাস্থ্য

ভ্রমণে বের হওয়ার মতো অর্থবান হতে সাধারণ বাঙালি ছেলের অনেক সময় লাগে। অর্থ যোগাড়ের সামর্থ্য হতে হতে তার বয়স হয়ে যায়, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।

শাওনের কাছ থেকে নাজমা ভাবির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শুনলাম। বেচারি দেড়শ’ ফুট পর্যন্ত নিজে নিজেই উঠলেন। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আমার পক্ষে আর ওঠা সম্ভব না। আমি নেমে যাব।

বললেই নামা যায় না। নামার সিঁড়ি ভিন্ন। তাৎক্ষণিকভাবে তার জন্য দুজন গাইড জোগাড় করা হলো। একজন তাকে সামনে থেকে টানছে। আরেকজন পেছন থেকে ঠেলছে। সাড়ে চার শ’ ফুট ওঠার পর তিনি হতাশ গলায় বললেন,

‘নেংটা মেয়েদের ছবি দেখার জন্য এত কষ্ট করেছি?’ বলেই তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। তাকে নামিয়ে আনতে তিনজন গাইড লাগল। তারা কাঁধে করে উনাকে নামিয়ে ফেলল। গাইডদের কর্মক্ষমতা অসাধারণ।

.

পাঁচ শ’ রক্ষিতার ছবি থেকে মাত্র আঠারোটি টিকে আছে। বাকি ছবি ধ্বংস করেছেন বৌদ্ধভিক্ষুরা। পরাজিত কাশ্যপের বিজয়ী ভ্রাতা সিগিরিয়া রক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপহার হিসেবে দান করেন। তিনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। গৌতম বুদ্ধের বাণী তাঁকে খুব প্রভাবিত করেছে তা মনে হয় না। তিনি কাশ্যপের প্রতিটি কর্মচারী, তার আত্মীয়স্বজন সবাইকে হত্যা করেন। এই হতভাগ্যের দলে কাশ্যপের স্ত্রী-কন্যারাও ছিল। সর্বমোট সংখ্যা এক হাজার।

বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কাশ্যপের সাধের প্রাসাদে বাস করতে আসেন। তারা সেখানকার নির্জনতায় উপাসনার ফাঁকে ফাঁকে দেয়ালচিত্র ধ্বংস করতে থাকেন। বৌদ্ধধর্মে নারীরা সাধনার বাধা। সেখানে নগ্ন নারীমূর্তির ছবির সামনে উপাসনা অর্থহীন হবেই।

একই ঘটনা রোমের সিসটিন চাপালে ঘটেছিল। গির্জার দেয়ালচিত্র এঁকেছিলেন পৃথিবীর মহান শিল্পীদের একজন–মাইকেল এঞ্জেলো। সেখানে নগ্ন নারীর ছবি। পোপের নির্দেশে সব নগ্ন নারীকে কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়। অনেক বছর পরে কাপড়ের রঙ সরিয়ে অপূর্ব নারীমূর্তি বের করা হয়।

সিগিরিয়া রকের ফ্রেসকো আমি দেখতে পাই নি, সিসটিন চ্যাপেলের বিখ্যাত ফ্রেসকো দেখেছি।

এখন রাজা কাশ্যপ বিষয়ে কিছু বলি। তাঁর বাবা ছিলেন অনুরাধাপুরের নৃপতি। নাম ধাতুসেন। তিনি শুধু যে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন তা-না, মনেপ্রাণে গৌতম বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রজাহিতকর অসংখ্য কাজ তিনি করেছেন। সাধারণ মানুষের হাসপাতাল তো বানিয়েছেনই, পঙ্গুদের জন্যেও একটা হাসপাতাল বানিয়েছেন। অনুরাধাপুরের মানুষদের জলকষ্ট নিবারণের জন্যে তিনি বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বিশাল প্রকল্প শেষ করেন। এই পানি সেচকার্যে ব্যবহার করে অনুরাধাপুর হয়ে উঠল সুজলা-সুফলা। ঐতিহাসিক মাহাওয়ানসা (Mahawansa) বলেছেন, ধাতুসেনের সুকৃতি লিখতে পাতার পর পাতা লাগবে, তারপরেও লিখে শেষ করা যাবে না।

তাঁর পুত্র কাশ্যপ পিতাকে বন্দি করে সিংহাসন দখল করলেন। পিতার উপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করলেন তাঁর লুকানো সম্পত্তির জন্যে। একসময় ধাতুসেন বললেন, চলো তোমাকে আমার সম্পত্তি দেখাচ্ছি। তিনি তাকে নিয়ে গেলেন তার তৈরি জলাধারের কাছে। বললেন, ওই দেখো আমার সম্পত্তি।

কাশ্যপ পিতাকে বললেন, আপনি যেন সারা জীবন আপনার লুকানো সম্পত্তি দেখতে পারেন সেই ব্যবস্থা করছি। তিনি লেকের দিকে মুখ ফিরিয়ে পিতাকে জীবন্তু দেয়ালের সঙ্গে প্লাস্টার করে ফেললেন। ধাতুসেন চব্বিশ ঘণ্টা বেঁচেছিলেন।

মোঘল আমলেও এ প্রনের ঘটনা ঘটেছিল। সম্রাট শাহজাহানকে বন্দি করেছেন তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেব। শাহজাহানের দিন কাটছে তার নিজের সৃষ্টি তাজমহলের দিকে তাকিয়ে। শাহজাহান ভাগ্যবান, তাঁর পুত্র পিতাকে দেয়ালে প্লাস্টার করে ফেলে নি।

ভাইয়ের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে কাশ্যপের হাতি হঠাৎ কেন পিছু ফিরল তার ব্যাখ্যা হলো হাতিরা জলাভূমিতে চোরাবালির অস্তিত্ব বুঝতে পারে। হাতির সামনে চোরাবালি পড়েছিল বলেই সে দিক পরিবর্তন করে। এখানে আমার ছোট্ট প্রশ্ন আছে। হাতি চোরাবালির অস্তিত্ব টের পেয়ে পেছনে ফিরে–এই তথ্য কি হাতিটা কাউকে বলে গেছে?

সিগিরিয়া রক একসময় বনেজঙ্গলে ঢাকা পড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। দুজন ব্রিটিশ পর্যটক ১৮৫৩ সালে এর অস্তিত্ব খুঁজে পান। এরপর থেকে প্রতিবছর শত শত পর্যটক এখানে আসেন। মুগ্ধ হয়ে দেখেন যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগের অপূর্ব স্থাপত্য

.

পুনশ্চ

দেয়ালচিত্রগুলিতে তিনটি রঙ ব্যবহার করা হয়–লাল, হলুদ এবং সবুজ। একটি মাত্র ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কালো ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো ছবিতে নীল রঙ নেই। এটি চিত্র বিশেষজ্ঞদের বিস্মিত করেছে। কারণ অজন্তার গুহাচিত্র একই সময়ে আঁকা। সেখানে নীল রঙ ব্যবহার করা হয়েছে।

সিগিরিয়া রকে আঁকা ফ্রেসকো বিষয়ে কিছু কথা। দেয়াল তৈরি হওয়ার পর রঙতুলি দিয়ে ফ্রেসকো আঁকা হয় না। দেয়ালে প্লাস্টারের সময় ছবি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। লাইম স্টোনের আস্তরের সঙ্গেই প্রাকৃতিক রঙ মেশানো হয়। এই কারণেই ছবিতে যদি কোনো ভুল থাকে সেই ভুল শুধরানো যায় না।

সিগিরিয়া রকের দেয়ালচিত্রে বড় কিছু ভুল এই কারণেই থেকে গেছে। যেমন এক তরুণীর দু’টা হাতের বদলে তিনটা হাত। একটা হাত তার বুকের ভেতর থেকে বের হয়েছে।

পাঁচটা আঙুলের বদলে কিছু তরুণীর হাতে দুটা আঙুল। একজনের হাতে ছয়টা আঙুল দৃশ্যমান।

দেয়ালচিত্রগুলো একজন শিল্পী এঁকেছেন, নাকি অনেকের পরিশ্রমের ফসল– তা জানা যায় নি। শিল্পী হারিয়ে গেছেন, তার শিল্পকর্ম সাড়ে তিন হাজার বছর পরেও মানুষকে মুগ্ধ করছে। সেইসব শিল্পী কত না ভাগ্যবান!

ভরা পূর্ণিমা

০৩.

ভরা পূর্ণিমা। জোছনার ফিনকি ফুটেছে। জানালা ভেঙে যশোধরার শোবার ঘরের খাটে জোছনা ঢুকে পড়েছে। তরুণী যশোধরা পুত্র রাহুলকে নিয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। পাশেই তার রূপবান তরুণ স্বামী। স্বামী হঠাৎ জেগে উঠলেন। অপূর্ব জোছনা দেখে তার হৃদয় আবেগে মথিত হলো। সর্ব রূপের আঁধার যে ঈশ্বর তার সন্ধানের জন্যে তিনি ব্যাকুল হলেন। স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে গৃহত্যাগের সংকল্প নিয়ে বিছানায় বসলেন। ঘুমের ঘোরে স্ত্রী যশোধরা তাঁর গায়ে হাত রাখলেন। তিনি সাবধানে সেই হাত সরিয়ে রেখে যখন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গেলেন তখন পুত্র অব্যক্ত স্বরে ডেকে উঠল, বাবা! তিনি চমকে উঠলেন, কিন্তু সংকল্পচ্যুত হলেন না। গৃহত্যাগ করলেন।

প্রাচীন সেই ভারতে তখন থালা হাতে অনেক ভিক্ষুক পথে পথে ঘুরত। তারা মুখে খাবার চাইত না। গৃহস্থের দিকে থালা বাড়িয়ে দিত।

যশোধরার স্বামী এই কাজটিই করলেন। থালা হাতে মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরতে লাগলেন।

মানুষটিকে সারা পৃথিবী চেনে। তিনি গৌতম বুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় হুবহু এই ঘটনাটা আছে, কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কবিতায় স্বামী যখন স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে ঈশ্বরের সন্ধানে গৃহত্যাগ করছেন। তখন ঈশ্বর আক্ষেপের সুরে বলছেন–

দেবতা নিঃশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, ‘হায়
আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়?’

আমরা এখন আছি গৌতম বুদ্ধের দেশে। যেখানেই চোখ যায় সেখানেই গৌতম বুদ্ধের ধ্যানী মূর্তি। একেকটি ছ’তলা সাততলা দালানের সমান। প্রতিটি পাহাড়ের চূড়ায় মূর্তি। প্রকাণ্ড সব স্তূপা। স্তূপা নির্মিত হয় বুদ্ধের ব্যবহৃত জিনিসপত্র লুকিয়ে রাখার জন্যে।

ক্যান্ডিতে আছে গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দাঁত। নাজমা ভাবি গৌতম বুদ্ধের দাঁত দেখার জন্যে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার একটাই কথা, ডলার খরচ করে এসেছি গৌতম বুদ্ধের দাঁত না দেখে ফিরে যাব? এটা কেমন কথা!

আমার কথা হচ্ছে, দাঁত শরীরের একটি মৃত অংশ। অন্য একজন মানুষের দাঁতের সঙ্গে এই পবিত্র দাঁতের কোনো পার্থক্য থাকার কথা না।

নাজমা ভাবি রাগী গলায় বললেন, এটা কী বললেন! আপনার দাঁত আর উনার দাঁত একই?

আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, অবশ্যই না। দাঁত থেকে DNA টেস্টের মাধ্যমে যদি জিন স্ট্রাকচার বের করা যায় তাহলে দেখা যাবে দুজনের জিন-গঠন ভিন্ন। চলুন দাঁত দেখতে যাব।

আমি রাজি হলাম, কিন্তু আমার মনের খুঁতখুঁতানি দূর হলো না। খুঁতখুঁতানি প্রধান কারণ, ভূপর্যটক এবং মহান পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি লংকার কলম্বোর একটি বৌদ্ধ বিহারের সম্মানিত শিক্ষক ছিলেন। আঠারো মাস সেখানে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা আমার জীবন যাত্রা গ্রন্থে লিখে গেছেন।

এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে গৌতম বুদ্ধের দাঁত প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, এই দাঁত বুড়ো আঙুলের মতো মোটা। লম্বায় প্রায় দুই ইঞ্চি। এটা মানুষের দাঁত হতে পারে না। মূল দাঁত পর্তুগীজ জলদস্যুরা পুড়িয়ে ফেলে। তারা নকল একটি দাঁত দান করে।

আমরা গৌতম বুদ্ধের দাঁত দেখতে যাচ্ছি–এই খবরে পূত্র নিষাদ অত্যন্ত উল্লসিত হলো। তার উল্লাসের কারণ ধরতে পারলাম না। গৌতম বুদ্ধের বিশাল বিশাল মূর্তি দেখে সে এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে কি না কে জানে!

আমি তাকে বললাম, বাবা তুমি গৌতম বুদ্ধের দাঁত দেখতে চাচ্ছ কেন?

নিষাদ বলল, সে তার ভাই নিনিতের জন্যে সেখান থেকে দাঁত কিনে ভাইয়ের মুখে লাগিয়ে দেবে। দাঁতের অভাবে তার ভাই চকলেট খেতে পারছে না–এই জন্যে তার খারাপ লাগে।

শেষ পর্যন্ত দাঁত দেখা হলো না। কারণ ড্রাইভার দিগায়ু বলল, বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়া এই দাঁত সর্বসম্মুখে বের করা হয় না। আজ সেই বিশেষ দিন না।

গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দাঁত দর্শনার্থীরা সবসময় দেখতে পারে। দিগায়ুর মিথ্যা ভাষণে আমার ভূমিকা আছে। গৌতম বুদ্ধের দেখা পাওয়া মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাঁর দাঁত দেখার কিছু নেই। যে মঠে গৌতম বুদ্ধের দাঁত আছে, সেখানে তাঁর মাথার চুলও সংরক্ষিত আছে। এই চুল উপহার হিসেবে বাংলাদেশ দিয়েছে শ্রীলংকাকে। বাংলাদেশে গৌতম বুদ্ধের চুল কীভাবে এসেছে সেটা বলা যেতে পারে।

বুদ্ধ এসোসিয়েসনের প্রধান অজিত রঞ্জন বড়ুয়া বলেন, তিব্বতের এক সাধু (শাক্য ভিক্ষু) পবিত্র চুল বাংলাদেশে আনেন ১৯৩০ সালে। আরেক সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের ভন্তে শ্রমন (বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রধান) গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে রেঙ্গুন থেকে কিছু চুল নিয়ে আসেন।

গৌতম বুদ্ধের চুল বাংলাদেশ থেকে উপহার হিসেবে যাওয়ার অনেক আগেই শ্রীলংকায় এসেছিল। প্রাচীন পলি গ্রন্থ জাতক কথায় বলা হয়েছে ভারতবর্ষের দুই ব্যবসায়ী গৌতম বুদ্ধের একগোছা চুল নিয়ে শ্রীলংকায় আসেন। তাদের একজনের নাম থাপাসু (Thapassu}, অন্যজনের নাম ভালুকা (Bhalluka)। চুল থাকতেও শ্রীলংকা আবার বাংলাদেশ থেকে কেন চুল নিল জানি না।

সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম দ্রুত প্রসার লাভ করে। দলে দলে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে থাকেন। এতে শঙ্কিত হয়ে শংকরাচার্য সুন্দর একটা প্যাঁচ খেলেন। তিনি ঘোষণা করেন, গৌতম বুদ্ধ হিন্দুদের অষ্টম অবতার। তিনি হিন্দু সনাতন ধর্মেরই একজন। কাজেই তার কৃপালাভের জন্যে বৌদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের প্রবল স্রোত বাধাগ্রস্ত হলো।

শেষ খেলা খেললেন রাজা অজাতশত্রু। বিচিত্র কোনো কারণে তিনি বৌদ্ধধর্মালম্বীদের উপর ক্ষেপে গেলেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করলেন। ঘোষণা করলেন, গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের দেখামাত্রই হত্যা করা হবে।

প্রাণভয়ে ভীত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পালিয়ে পাহাড়-পর্বতের দিকে চলে গেলেন। আজও পাহাড়-পর্বতেই এই ধর্মের মানুষের ঘনত্ব বেশি। সমতলে নেই।

.

এই সময়ে পৃথিবীজুড়েই বৌদ্ধধর্মের প্রতি প্রবল আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। পত্রপত্রিকায় প্রায়ই খবর আসছে হলিউডের অমুক তারকা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছেন। তাদের আগ্রহের মূল কারণ এই ধর্মে ঈশ্বর নেই। সোজা-সাপটা ঈশ্বর নেই বলাটা ঠিক হচ্ছে কি না তাও বুঝতে পারছি না। কারণ এক ভক্ত গৌতম বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, গুরুজি, ঈশ্বর কি নেই?

বুদ্ধ বললেন, ঈশ্বর নেই এমন কথা কি আমি বলেছি?

ভক্ত মহা আনন্দিত। কারণ সে মনেপ্রাণে একজন ঈশ্বর চাইছে। ভক্ত বলল, গুরুজি, তাহলে কি ঈশ্বর আছে?

বুদ্ধ বললেন, ঈশ্বর আছেন এমন কথা কি আমি বলেছি?

গৌতম বুদ্ধের নিজের মধ্যে সংশয় ছিল–এমন কথা কি বলা যায়? তিনি ঈশ্বরের কথা বলেন নি, নির্বাণের কথা বলেছেন। কিন্তু নির্বাণ আসলে কী তা কখনো পরিষ্কার করে বলেন নি। একবার বললেন, জ্বলন্ত শিখাকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়াই নির্বাণ। তার কথা হলো, মানুষকে চারটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতেই হবে।

শোক
ব্যাধি
জরা
মৃত্যু

মানুষ বারবার পৃথিবীতে জন্মাবে (জন্মান্তরবাদ)। কীটপতঙ্গ হিসেবে, পশু হিসেবে, মানুষ হিসেবে। তার সুকীর্তির কারণে একটা সময় আসবে যখন আর তাকে পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে না। এটাই নির্বাণ।

আমার কাছে বারবার পৃথিবীতে ফিরে এসে শোক, ব্যাধি, জরা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়। শোকের সঙ্গে থাকবে আনন্দ, জোছনাপ্লাবিত রজনী, প্রিয় সখার কোমল করস্পর্শ। যে নির্বাণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় সেই নির্বাণ আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না। আমি গৌতম বুদ্ধের যুক্তিই তাঁকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘যে ঈশ্বর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তার বিষয়ে কি বলা যাবে?’

কমিউনিস্টদের আধুনিক কমিউনের শুরুটা গৌতম বুদ্ধ করে গেছেন। তাঁর কমিউনের নাম সংঘ (সংঘং শরণং গচ্ছামি)। সেখানে সবার খাবার একত্রে রান্না করা হতো। সংঘে নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ভিক্ষুরা ভোরবেলা শূন্য থালা হাতে বের হতেন। সারা দিন ভিক্ষা করে যা পাওয়া যেত তা-ই রান্না হতো। সবাই মিলে তা-ই খেতেন। সংঘে নারীদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ।

গৌতম বুদ্ধের খালা প্রজাপতি গৌতমী ছিলেন এক অর্থে গৌতম বুদ্ধের মা। তিনিই গৌতম বুদ্ধকে লালনপালন করেছিলেন। এই মহিলা বহু কষ্টে, পায়ে হেঁটে বহু পথ অতিক্রম করে তাঁর পালকপুত্রের কাছে এলেন। সংঘে যোগ দিবেন। বাকি জীবন সংঘে কাটাবেন।

গৌতম বুদ্ধ বললেন, না। সংঘে নারী নিষিদ্ধ।

একবার না, পরপর তিনবার তিনি এই বাক্য উচ্চারণ করলেন।

কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন প্রজাপতি। গৌতম বুদ্ধের সার্বক্ষণিক সঙ্গী আনন্দ তখন বুদ্ধের কাছে কাতর আবেদন করলেন। তিনি যুক্তি দিলেন নারীরাও তো আলোকপ্রাপ্তির সুযোগ পেতে পারে। নারীদের বাদ দেওয়া মানে মানবজাতির অর্ধেককে বাদ দেওয়া।

গৌতম বুদ্ধ অনিচ্ছার সঙ্গে রাজি হলেন। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন।

শর্ত হচ্ছে, নারীভিক্ষুরা যত উচ্চবর্ণের হোক তাদের পদমর্যাদা হবে সব পুরুষ ভিক্ষুর নিচে। যখনই নারীর সামনে কোনো পুরুষ ভিক্ষু দাঁড়াবে তখনই ভিক্ষুনীকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাতে হবে।

আনন্দ একবার জানতে চাইলেন, নারীদের প্রতি তাহলে আমরা কী আচরণ করব?

বুদ্ধ বললেন, তুমি তাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। তাহলেই কী আচরণ করবে সেই প্রশ্ন উঠবে না।

গৌতম বুদ্ধ নারীদের সাধনার বিঘ্ন মনে করতেন। স্বামী বিবেকানন্দও তা-ই করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনে নারী নিষিদ্ধ ছিল। এখনো আছে। আমার খুবই অবাক লাগে, এই দুই মহাপুরুষ কী করে নারীর গর্ভে জন্মেও নারীদের সাধনার বাধা হিসেবে চিহ্নিত করলেন!

বুদ্ধ বলছেন, সকল প্রাণী সুখী হোক! শক্তিশালী কী দুর্বল, উচ্চ মধ্য বা নিচু গোত্রের, ক্ষুদ্র বা বৃহৎ, দৃশ্য বা অদৃশ্য, কাছের বা দূরের, জীবিত বা জন্ম প্রত্যাশী সকলেই সুখী হোক।

সর্বজীবে কি আমরা আসলেই দয়া করতে পারি? একটা কেউটে সাপ আমাকে ছোবল দিতে আসছে, আমি কি তাকে দয়া করব? তার ছোবল খাব? তাকে মারব না!

কলেরা, টাইফয়েড, সিফিলিসের ভয়ঙ্কর জীবাণুরাও তো জীব। তাদের প্রতি দয়া করতে হলে পেনিসিলিন ব্যবহার করা যাবে না। তাও কি সম্ভব!

নিয়তির পরিহাস হচ্ছে, যে দেশে অহিংস যুদ্ধের জয়জয়কার, চারদিকে তাঁর ধ্যানী মূর্তি, সেখানেই জন্মেছে কঠিনতম হিংসা। আত্মঘাতী বোমা হামলার শুরু শ্রীলংকায়। টাইগার প্রভাকরণের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ তরুণ-তরুণী শরীরে বোমা বেঁধে নিজেকে উড়িয়ে দিচ্ছে।

গৌতম বুদ্ধের একটি বাণী আমার খুব পছন্দের। তিনি ভক্তদের বলছেন, আমার কথা হলো নদী পার হওয়ার ভেলা। একবার নদী পার হওয়ার পর ভেলা মাথায় নিয়ে বেড়ানোর কিছু নেই।

এই ধর্মের আরেকটি বিষয় আমাকে আলোড়িত করে, পূর্ণচন্দ্রের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা।

আষাঢ়ি পূর্ণিমা : গৌতম বুদ্ধের গৃহত্যাগ।

বৈশাখী পূর্ণিমা : বুদ্ধের মহাজ্ঞান লাভ।

শারদীয় পূর্ণিমা : কঠিন চিবরদান অনুষ্ঠান।

ভাদ্র পূর্ণিমা (মধু পূর্ণিমা) :কঠিন তপস্যার সময় বানররা গৌতম বুদ্ধকে মধু পান করিয়েছে বলে মধু পূর্ণিমা।

আশ্বিনী পূর্ণিমা : বুদ্ধ তার চুল কেটে আকাশে উড়িয়েছিলেন। এই পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা আকাশে ফানুস উড়ায়।

মাঘি পূর্ণিমা : এই দিনে বুদ্ধ ঘোষণা করেন, আর তিনমাস পর তাঁর মহাপ্রয়াণ হবে।

ফাল্গুনী পূর্ণিমা : এই তিথিতে বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে যান। বাবা-মার সঙ্গে শেষবার দেখা করার জন্যে।

গৌতম বুদ্ধের জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে হয়েছিল। কাকতালীয় হলেও দু’বারই আকাশে ছিল পূর্ণচন্দ্র।*

* অভিনেতা এবং আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ‘বৌদ্ধধর্ম ও পূর্ণিমা’ বিষয়ে আমাকে অনেক সঠিক তথ্যের সঙ্গে একটি ভুল তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, পৌষ পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ শ্রীলংকা গিয়েছিলেন। তথ্যটা ভুল। ধর্মপ্রচারের জন্যে গৌতম বুদ্ধ কখনো শ্রীলংকা আসেন নি।

.

পুনশ্চ

বৈরাগ্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কহিল গভীর রাত্রে সংসারে বিরাগী
“গৃহ তেয়াগিব আজি ইষ্টদেব লাগি।
কে আমারে ভুলাইয়া রেখেছে এখানে?”
দেবতা কহিলা, “আমি।”–শুনিল না কানে।
সুপ্তিমগ্ন শিশুটিরে আঁকড়িয়া বুকে
প্রেয়সী শয্যার প্রান্তে ঘুমাইছে সুখে।
কহিল, “কে তোরা ওরে মায়ার ছলনা?”
দেবতা কহিলা, “আমি।”–কেহ শুনিল না।
ডাকিল শয়ন ছাড়ি, “তুমি কোথা প্রভু?”
দেবতা কহিলা, “হেথা।”–শুনিল না তবু।
স্বপনে কাঁদিল শিশু জননীরে টানি–
দেবতা কহিল, “ফির।” শুনিল না বাণী।
দেবতা নিশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, “হায়!
আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়?”

সরাসরি গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে, নাম ‘ব্রাহ্মণ’। এখানে সত্যকাম গিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নেওয়ার জন্যে। গৌতম তাকে ফিরিয়ে দেন। সত্যকাম মা’কে বলেন,

কহো গো জননী, মোর পিতার কী নাম,
কী বংশে জনম। গিয়াছিনু দীক্ষাতরে
গৌতমের কাছে, গুরু কহিলেন মোরে–
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যা লাভে। মাতঃ কী গোত্র আমার?
শুনি কথা, মৃদুকণ্ঠে অবনত মুখে
কহিলা জননী, যৌবনে দারিদ্রদুখে
বহু পরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে;
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে,
গোত্র তব নাহি জানি তাত।’

কৌতূহলী পাঠক পুরো কবিতাটি পড়তে পারেন।

রবীন্দ্রনাথ গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন। তিনি এই ধর্ম প্রচারককে শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে বিবেচনা করেছেন।

কিং সোলায়মান

০৪.

কিং সোলায়মান এবং শেবার রানীর গল্প তো সবাই জানেন। আরেকবার বলি। জানা বিষয় নতুন করে জানায় আনন্দ আছে। অনেকটা শোনা গান আবার শোনার মতো।

কিং সোলায়মান সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শেবার রানী বিলকিস।

রানী রাজদরবারে ঢুকলেন। সোলায়মানের সিংহাসন অনেকটা দূরে। রানীকে কিছুদূর হেঁটে যেতে হবে। রানী ক্ষণিকের জন্যে বিভ্রান্ত হলেন। মেঝে স্ফটিক দিয়ে এমন করে বানানো যে রানীর মনে হলো পানি। তাকে যেতে হবে পানির উপর দিয়ে। নিজের অজান্তেই তিনি তাঁর গায়ের কাপড় খানিকটা উঁচুতে তুললেন, যাতে পানি লেগে ভিজে না যায়।

সিংহাসন থেকে সোলায়মান অবাক হয়ে দেখলেন, এই পৃথিবীর অতি রূপবতী এক তরুণীর পাভর্তি পশুদের মতো লোম। সোলায়মান রাজবৈদ্যকে এই রোগের ওষুধ দিতে বললেন। রাজবৈদ্যের ওষুধে রানীর লোম সমস্যা দূর হলো। কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হয়ে তিনি সোলায়মানকে বিয়ে করলেন। (মিথ হচ্ছে– সোলায়মান তাঁর পোষা জ্বিনদের কাছ থেকে রানী বিলকিসের ওষুধ নিয়েছিলেন।)

সোলায়মান নবপরিণীতা স্ত্রীকে খুশি করার ব্যবস্থা করলেন। দুটা জাহাজ পাঠালেন রত্নের দেশে। দেশের নাম শ্রীলংকা।

শ্রীলংকাকে বলা হয় পৃথিবীর রত্নভাণ্ডার। ব্লু শেফায়ার বা নীলার মতো দামি পাথরে এই দেশ পূর্ণ। সবচেয়ে বেশি রত্ন যেখানে পাওয়া যায় তার নাম রত্নপুরা বা রত্নের নগর। চীনা ভাষায় দ্বীপটির নাম রত্নদ্বীপ। Star of India নাম দিয়ে যে অপূর্ব নীলা পাথরটি নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে প্রদর্শিত হচ্ছে সেটা নীলা পাথর। পাথরটির নাম রাখা উচিত ছিল Star of Srilanka, ব্রিটিশ রাজমুকুটে চার শ ক্যারেটের যে নীলা পাথরটি আছে সেটাও শ্রীলংকার।

পদ্মরাগ মণি (নীলা পাথরের আরেক সংস্করণ। রঙ কমলা ও গোলাপির মিশ্রণ) শুধুমাত্র শ্রীলংকাতেই পাওয়া যায়। অন্য কোথাও না।

নীলা ছাড়াও আরও যেসব পাথর শ্রীলংকায় পাওয়া যায় তা হলো রুবি, একুয়া মেরিন, টোপাজ, গার্নেট, মুনস্টোন এমেথিস্ট, ক্যাটস আই।

মুর পর্যটক ইবনে বতুতা শ্রীলংকায় এসেছিলেন। তিনি তার ভ্রমণবৃত্তান্তে মুরগির ডিমের চেয়েও বড় রুবি দিয়ে হাতির মাথা সাজানো হতো বলে উল্লেখ করেছেন।

চায়নিজ পর্যটক ফা হিয়েন শ্রীলংকায় একটি রুবি দেখেছিলেন, যা মানুষের বাহুর মতো লম্বা এবং এক বিঘৎ চওড়া। রুবিটি দেখে তার মনে হয়েছে যেন পাথরটিতে আগুন জ্বলছে।

মার্কোপলোও মনে হয় এই রুবিটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

রত্ন আহরণের পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ। নদীর কাদাবালি মেশানো পানি এবং নদীর তলদেশের মাটি ঝুড়িতে নেওয়া হয়। ঝুড়ির নিচটা চালনির মতো। এই ঝুড়ি পানিতে ধুয়ে ধুয়ে কাদামাটি এবং ময়লা দূর করা হয়। ভাগ্য ভালো হলে রত্ন পাওয়া যায়।

আমি মনে করি, বাংলাদেশের শংখ নদীতে এইভাবে রত্নের অনুসন্ধান করা যেতে পারে। শংখ নদী পাহাড়-পর্বত কেটে সমুদ্রের দিকে আছে। পাহাড়-পর্বতে আটকে থাকা মণিমুক্তা শংখ নদী বেয়ে নিচে নামার কথা।

আমাদের পাশের দেশ বার্মা যদি রুবিতে ভর্তি থাকে, আমরা দোষ করেছি কী? বার্মার মাটি, শ্রীলংকার মাটি আমাদের দেশের মতোই পলিঘটিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো শ্রীলংকার চেয়ে উঁচু। বাংলাদেশে যে রত্নের অনুসন্ধান করা যেতে পারে তা মনে হয় কারও মাথায় আসে নি।

.

শ্রীলংকার মণিমুক্তা সম্পর্কে বিতং করে লেখার একটি ব্যক্তিগত কারণ আছে। আমার একসময়ের শখ ছিল রত্ন সংগ্রহ করা। পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছি রত্ন কেনার চেষ্টা করেছি। কখনো পেরেছি, কখনো অর্থের অভাবে পারি নি। আমার সংগ্রহের রক্তে শ্রীলংকার দুর্লভ পদ্মরাগ মণি আছে।

আমার পাথর সংগ্রহের নেশা যখন তুঙ্গে তখন দুটি দেশে খুব যেতে ইচ্ছা করত–একটি শ্রীলংকা, অন্যটি বার্মা। বার্মায় পাওয়া যায় খাঁটি রুবি। রুবি, নীলা এবং পদ্মরাগ মণির মতোই দামি। দুটি দেশের কোনোটাইতেই যাওয়া হয় নি। কারণ বার্মায় সামরিক জান্তা। আসল মগের মুল্লুক। আর শ্রীলংকায় চলছে গৃহযুদ্ধ।

দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, শ্রীলংকায় যখন এসেছি তখন আমার রত্ন সংগ্রহু রোগ সেরে গেছে। অল্প বয়সে ছেলেমেয়েরা স্ট্যাম্প কালেক্ট করে খাতা ভরিয়ে ফেলে। একসময় তাদের এই ব্যাধি সেরে যায়। খাতাও হারিয়ে যায়। কয়েন কালেক্টারদের একই অবস্থা। অনেক ঝামেলা করে সংগ্রহ করা মুদ্রা একসময় যেখানে সেখানে পড়ে থাকে।

আমি রত্ন সংগ্রহ করছি ত্রিশ বছর ধরে। সবই বাক্সবন্দি। কাউকে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করতে চাইলে বাক্স খুলি।

আজ আমি শ্রীলংকার রাস্তায়। কিছুদূর পরপরই Gems-এর দোকান। একবারও দোকানে ঢুকতে ইচ্ছা করল না।

শাওন বলল, রত্নের দেশে এসে রত্ন কিনবে না?

আমি বললাম,’ আনা রাজুলুন মিসকিন।’

শাওন বলল, এর মানে কী?

আমি বললাম, এর অর্থ আমি একজন মিসকিন। মিসকিনের রত্নরোগ সাজে না। কাজেই রত্ন কেনা হবে না।

শাওন বলল, আমি টাকা দিচ্ছি। তুমি তোমার পছন্দের একটা রত্ন কিনে আনো।

আমি রত্নের দোকানে ঢুকলাম না। কাঠের মূর্তির দোকানে ঢুকে একটি বুদ্ধ মূর্তি কিনলাম।

নাজমা ভাবি মহা রিক্ত হলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, এত দাম দিয়ে বুদ্ধের মূর্তি কিনেছেন। আপনি কি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করবেন?

আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। শ্রীলংকায় হাঁ-সূচক মাথা নাড়ার অর্থ না। ভাবি তা বুঝলেন না। তিনি স্বামীর কাছে নালিশ করলেন, হুমায়ূন ভাই বৌদ্ধ ধর্ম নিবেন। ছিঃ ছিঃ কী কাণ্ড। লেখক হলেই যা ইচ্ছা তা করা যায়?

আমি নাজমা ভাবির সঙ্গে ঝামেলায় গেলাম না, গৌতম বুদ্ধের মতো মৌনভাব ধারণ করলাম।

রাতে ঘুমাতে যাব হঠাৎ দেখি আমার বালিশের উপর চমৎকার একটি মুন স্টোন। চন্দ্রের আলোর মতো হালকা আলো বের হচ্ছে। মুন স্টোনের সঙ্গে একটি চিঠি। শাওন লিখেছে–

“তুমি বদলে যাচ্ছ কেন?
একসময় পাগলের মতো gems খুঁজে বেড়াতে। আজ ফিরেও তাকাচ্ছ না। বদলে যাওয়া হুমায়ুন আহমেদ আমি দেখতে চাই না। আমি চাই তুমি কখনো বদলাবে না।”

আমি শাওনকে বললাম, চলো দুজন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের পাশ থেকে ঘুরে আসি।

শাওন বলল, নিষাদ নিনিত?

ওরা ঘুমাচ্ছে। নাজমা ভাবিকে বলো ওদের দিকে নজর রাখতে। বেশিক্ষণ তো আর বাইরে থাকব না। বেশি হলে পনেরো মিনিট।

নাজমা ভাবি সব শুনে বললেন, পুলাপানের ক্যাঁও ম্যাঁও আমার ভালো লাগে না। এরা দুজন একসঙ্গে কাঁদে। আমি পারব না।

বলেই তিনি নিজের ঘরে ঢুকে বেশ শব্দ করে দরজা বন্ধ করলেন।

শাওন বলল, প্রথম রাতে গান শুনতে চেয়েছিলে। এখন কি গাইব?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

শাওন গাইছে। আমি দুই পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে তার গান শুনছি

“মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে
ফিরেছ কি ফির নাই, বুঝিব কেমনে।”

.

পুনশ্চ

শ্রীলংকার সবচেয়ে সুন্দর বুদ্ধমূর্তির নাম ‘আউকানা’। তের মিটার উঁচু গৌতম বুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। এই নামের অর্থ সূর্যখাদক (Devourer of the Sun.), অনুরাধাপুরের নৃপতি ধাতুসেনার নির্দেশে এটি বানানো হয়। এই মূর্তিটি সবচেয়ে সুন্দর দেখায় সূর্যোদয়ের মুহূর্তে।

বুদ্ধের মূর্তির বসার ভঙ্গি এবং হাতের মুদ্রার অর্থ আছে। এ থেকে বলে দেওয়া যায় তিনি জেগে আছেন না সমাধিতে চলে গেছেন। আমার কাঠের কেনা মূর্তিটির ভঙ্গি জাগ্রত।

মূর্তিবিষয়ক শেষ কথাটা বলি। পুত্র নিষাদ দেশে ফিরে সবাইকে বলছে, আমরা শ্রীলংকার আল্লাকে কিনে এনেছি।

শ্রীলংকান তামিল ছাত্র

০৫.

নর্থ ডেকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে Ph.D, করতে গিয়ে একজন শ্রীলংকান তামিল ছাত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। সেও Ph.D. করতে এসেছে। তার নাম রত্ন সভাপতি সুরিয়া কুমারণ। আমেরিকানরা এই নাম ছোট করে ডাকে সুরি। আমিও ডাকি সুরি।

সুরি অতি ভদ্ৰ অতি লাজুক ছেলে। ভাত না খেলে তার পেট ভরে না বলে আমার এখানে মাঝে মাঝে ভাত খেতে আসে।

আমি তাকে বললাম, বিয়ে করে বউ নিয়ে আসো। প্রবাস জীবন তখন সহনীয় হবে। সে বলল, আমার পক্ষে বিয়ে করা এখন কঠিন। আমার বাবা-মা দরিদ্র। বিয়ে করলে তাদের ছেড়ে আমাকে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হবে। আমার রোজগারের টাকা শ্বশুর-শাশুড়ির হাতে তুলে দিতে হবে।

আমি বললাম, সব ছেলেকেই কি বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হয়।

সুরি বলল, হ্যাঁ। এটাই আমাদের দেশের নিয়ম।

আমি বললাম, বাংলাদেশেও যে কিছু ছেলে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠে না, তা-না। তাদেরকে বলা হয় ঘরজামাই। ঘরজামাইদের আমরা ছোট চোখে দেখি। তাদেরকে অমেরুদণ্ডী প্রাণী ভাবা হয়।

শ্রীলংকার অনেক পারিবারিক গল্প আমি সুরির কাছে শুনেছি। এখন মনে পড়ছে না।

আমেরিকার প্রবাস জীবনে আমি একটা উপন্যাস শুরু করি। উপন্যাসটি প্রকাশ করি দেশে ফিরে। নাম– সবাই গেছে বনে। এই উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয় রত্ন সভাপতি সুরিয়া কুমারণের নামে।

শ্রীলংকায় যাওয়ার পর থেকেই আমার এই বন্ধুটির কথা মনে পড়ছিল। শাওনকে বলতেই সে ইন্টারনেট খুলে বসে গেল। ফেসবুক থেকে বের করে ফেলবে। বের করতে পারল না।

সুরি বলেছিল, আমার রূপবতী একটি মেয়ে বিয়ে করার শখ, কিন্তু আমাদের দেশে রূপবতী মেয়ে নেই।

সুরির কথা সত্যি বলেই মনে হচ্ছে। রাস্তাঘাটে যেসব তরুণী দেখছি তাদের চেহারায় আকর্ষণীয় কিছু নেই। এরা কেউ সাজগোজও মনে হয় করে না। ঝলমলে পোশাকের বদলে মলিন পোশাক পরে বের হয়েছে। সবাই কেমন মন খারাপ করে হাঁটছে। কিংবা কে জানে এদের মুখের গঠনই বিষণ্ণ!

শ্রীলংকার প্রিয় বাহন মোটরসাইকেল। ওরা বলে ভটভটিয়া। ছেলেমেয়ে সবাই ভটভটিয়া চালায়।

রাস্তায় পাশের বাড়িঘরের বাগানে যেসব ফল হয় তা টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়, কেউ যদি কেনে। প্রতিটি বাড়ির সামনেই একটা টেবিল। ফলের মধ্যে আছে–কলা, তামা রঙের ডাব এবং আম। আমের গন্ধ চমৎকার, তবে আমাদের দেশের আমের মতো মিষ্টি না।

টেবিলে ছোট ছোট কাপড়ের পুঁটলি পেতে অনেককেই বসে থাকতে দেখেছি। পুঁটলিতে আছে আধা কেজি করে লাল চাল। দরিদ্র মানুষ ঘরে ফেরার সময় এক পুঁটলি চাল কিনে নিয়ে যাচ্ছে।

গ্রাম্য কিছু বাজার দেখলাম। আমাদের দেশের গ্রামের বাজারের মতোই। তবে প্রচুর শুঁটকি মাছের দোকান দেখলাম। লোকজন কিছু কিনুক না-কিনুক শুঁটকি মাছ কিনছে।

নারকেল শ্রীলংকানদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত। নারকেল তেল ছাড়া তারা কোনো খাবার রান্না করে না। কারিতে নারকেল তেল ছাড়াও গুঁড়া শুঁটকি মাছ ব্যবহার করা হয়। এই গুঁড়া শুঁটকিকে তারা মসলার অংশ হিসেবে দেখে। আরব্য রজনীতে নারকেল তেলে রান্না করা খাবারের বর্ণনা আছে। যেখানে এইসব খাবার কুৎসিত এবং অপকারী বলা হয়েছে।

শ্রীলংকান পদ্ধতিতে নারকেল তেলে রান্না করা ভাজি এবং ডিমের কারি খেয়েছি। আমার কাছে যথেষ্টই সুস্বাদু মনে হয়েছে। তবে এরা রান্নায় প্রচুর গরম মসলা এবং লাল মরিচ ব্যবহার করে। গরম মসলার দেশে এই মসলা বেশি ব্যবহার হবেই। গরম মসলা এবং মরিচ আরও কম হলে আমাদের রুচির সঙ্গে মিলত। শ্রীলংকার ডিমের কারির একটি রেসিপি দিয়ে দিলাম। রান্নাবান্নায় আগ্রহী পাঠক-পাঠিকারা রান্না করে খেয়ে দেখতে পারেন।

শ্রীলংকায় যেসব গরম মসলার চাষ হয় তার একটা তালিকা দিচ্ছি। চায়ের পরেই শ্রীলংকার রপ্তানিযোগ্য পণ্যের নাম গরম মসলা। পর্যটক ফা হিয়েন, মার্কোপোলো এবং ইবনে বতুতা সবাই জাহাজ ভর্তি করে শ্রীলংকার মসলা পৃথিবীর নানা দেশে রপ্তানির উল্লেখ করেছেন।

গরম মসলা

সেফরন (জাফরান), গ্যাম্বুজ, কিউমিন সিড (জিরা), দিলসিড, কার্ডামন (এলাচি), গোলমরিচ, ফিনেল সীড, সরিষা, দারুচিনি, কোরিয়েভার (ধনিয়া), লবঙ্গ, নিটমেগ।

আমার প্রকাশক বন্ধু আলমগীর রহমানের জন্যে উপহার হিসেবে শ্রীলংকার সব মসলার একটি করে প্যাকেট নিয়ে এসেছিলাম। তিনি রান্নাবান্নায় উৎসাহী। তাঁর প্রকাশনা থেকে চমৎকার কিছু রান্নার বইও বের হয়েছে। আমার ধারণা ছিল উপহার পেয়ে তিনি খুশি হবেন, উল্টা বিরক্ত হয়ে বললেন, সব মসলা বাংলাদেশে পাওয়া যায়। আপনি শ্রীলংকা থেকে আনবেন মুখোশ, গরম মসলা কেন!

মসলার সব প্যাকেট আমার ঘরে পড়ে আছে। তিনি ফেরত দিয়ে গেছেন।

ডিমের সালুন
(Bittara Vanjanaya)

এই রান্না ডিমের কারি খেয়ে বাবুর্চির কাছ থেকে রেসিপি নিয়েছি।

উপকরণঃ

ছয়টি ভালোমতো সিদ্ধ করা ডিম।
দু’চামচ মাখন।
একটি কাঁচামরিচ, ছোট ছোট করে কাটা।
তিনটি ছোট পাতাওয়ালা পেঁয়াজ কুচি কুচি করে কাটা।
তিনটি রসুনের কোয়া, কুচি কুচি করে কাটা।
এক ইঞ্চি লম্বা দারুচিনি।
দুই টেবিল-চামচ বাটা রসুন
এক টেবিল-চামচ গুঁড়া ব্ল্যাক পিপার।
এক টেবিল-চামচ লালমরিচের গুড়া।
কয়েকটি কারি লিফ।
এক চা-চামচ হলুদ গুঁড়া।
দেড় কাপ ঘন নারকেলের দুধ।
দেড় কাপ সয়া দুধ (না পাওয়া গেলে পানি)।
এক টেবিল-চামচ লেবুর রস।

রন্ধন প্রণালিঃ

মাটির হাঁড়িতে মাখন গলাতে হবে। সয়াসস, লেবুর রস এবং নারকেলের দুধ ছাড়া বাকি সব উপকরণ দুই মিনিট Stir Fry করতে হবে। নারকেলের দুধ, সয়াসস এবং লেবুর রস দিয়ে বলক বের না হওয়া পর্যন্ত জ্বাল দিতে হবে। এর মধ্যে সিদ্ধ ডিম দিয়ে দিলেই রান্না শেষ।

প্রিয় পাঠক, শ্রীলংকার Cuisine বিশ্বসভায় স্থান করে নিতে পারে নি। দেশি পদ্ধতিতে নতুন আলু দিয়ে আমাদের ডিমের ঝোল অমৃত।

.

পুনশ্চ

এই অধ্যায়ে প্রিয় নাজমা ভাবি বিষয়ে কিছু লেখা হয় নি বলে অধ্যায়টা অসম্পূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। কাজেই তাঁর খাদ্যাভাস বিষয়ে দুটি কথা। আমরা সাত দিন শ্রীলংকায় থেকেছি। সাত দিনে চৌদ্দটি মেজর মিল খাওয়া হয়েছে। প্রতিবারই তিনি নিজের জন্যে চিকেন কারি অর্ডার দিয়েছেন। এটা বিশেষ কোনো ব্যাপার না। ফার্মের স্বাস্থ্যবান চিকেন কারও পছন্দের খাবার হতেই পারে। বিশেষ ব্যাপারটা হচ্ছে প্রতিবারই তিনি বলেছেন, আপনারা সবাই ভালো ভালো খাবার খাচ্ছেন আর আমার জন্যে চিকেন কারি।

শাওন মনে করিয়ে দিল যে প্রত্যেকেই তার নিজের খাবার নিজে অর্ডার করেছে।

ভাবি বিরক্ত হয়ে বললেন, এটা কোনো কথা না। পরেরবার আমি চিংড়ি মাছ খাব।

পরেরবারও তিনি চিকেন কারি অর্ডার দিলেন। বাটিভর্তি মাংস দেখে ক্ষুব্ধ গলায় বললেন, আবার চিকেন কারি? আপনারা কি আমাকে মানুষ বলে গণ্য করেন না!

জেফরি বাওয়া

০৬.

আমরা বেনটোটায় এসেছি। হোটেলের নাম সেরেনডিপ। বলাই বাহুল্য, এই হোটেলের ডিজাইনও জেফরি বাওয়া করেছেন। সব সফরের থিম থাকে। আমাদের সফরের থিম হচ্ছে ‘জেফরি বাওয়া’।

খুব কাছেই জেফরি বাওয়ার বসতবাড়ি। এটা এখন মিউজিয়াম। দর্শকরা টিকিট কেটে মিউজিয়াম দেখবেন, ছবি তুলবেন। জেফরি বাওয়া নব্বই বছর বয়সে দু’হাজার তিন সালে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি এই বাড়িতেই থাকতেন। দর্শনার্থীরা তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে পারত। তাঁর বইয়ে অটোগ্রাফ নিতে পারত।

তিনি নেই কিন্তু তার বসতবাড়িতে দর্শনার্থীদের ভিড় কমে নি, বরং বেড়েছে। শাওন ক্যামেরা নিয়ে তার ভাবগুরুর বাড়ি দেখতে গিয়েছে। সঙ্গে পুত্র নিষাদ। আমি ছোটটিকে নিয়ে সমুদ্রতীরে বসে আছি।

পাঠকদের অনেকেই হয়তো জানেন, পৃথিবীতে দু’ধরনের সমুদ্র সৈকত আছে। একটা সাধারণ–যেমন, কক্সবাজার সৈকত। অন্যটির নাম সোনালি সৈকত (Golden beach), যার বালি সোনালি।

আমরা সোনালি সৈকতে আছি। আমাদের উপর নারকেল গাছের সারি। প্রতিটি ডাব বা নারকেলের বর্ণ তামার মতো। সোনালি সৈকতের সঙ্গে এই তামা রঙ চমৎকার মানিয়েছে।

আমাদের সঙ্গে প্রচুর সাদা চামড়ার টুরিস্ট। মেয়েগুলোর গায়ে বিকিনি। এরা সূর্যস্নান করছে।

আমি এবং পুত্র নিনিত করছি ছায়াস্নান। আমরা বসে আছি নারকেল গাছের ছায়ায়। পুত্র নিনিত জেগেছে। খুব হাত-পা নাড়ছে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ একতরফা গল্প করলাম। যেমন

আমি : সমুদ্র কেমন লাগছে বাবা?

নিনিতঃ পা দিয়ে ঝাঁকি। অর্থ সম্ভবত আমি তো সমুদ্রে নামি নি। কী করে বলব!

আমি : গায়ে রোদ চিড়বিড় করছে না তো?

নিনিত : কুঁ ওয়া।

আমি : ছায়াতে বসে মজা পাচ্ছ?

নিনিত : অয়

[সিলেটি ভাষায় বলল, হ্যাঁ। বেশিরভাগ সময় সে চাইনিজদের মতো কিচমিচ শব্দ করে। এই প্রথম সিলেটি ভাষা।]

আমাদের কথাবার্তায় সাদা চামড়ার এক বুড়ি ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এল। এই বুড়ির গায়েও বিকিনি। থলথলে শরীরে বিকিনি যে কী কুৎসিত দেখায় তা মনে হয় এই বুড়িকে কেউ বলে নি।

বুড়ি বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি কি এই শিশুটির একটি ছবি তুলতে পারি?

বেশিরভাগ পিতা-মাতাই বলত, অবশ্যই তুলতে পারো। আমি বললাম, ছবি তুলতে চাচ্ছ কেন?

বুড়ি বলল, আমার বড় ছেলের একটি ছেলে হয়েছে, দেখতে অবিকল এই শিশুটির মতো। আমি এই গল্পটা তাকে বললে সে বিশ্বাস করবে না। ছবি দেখালে বিশ্বাস করবে।

ছবি তোলো।

ছবি তোলা হলো। একটি ছবি আমাকে তুলতে হলো। সেখানে বুড়ি নিনিতকে কোলে নিয়ে নকল হাসি হাসল।

আমি বললাম, শ্রীলংকা কেমন লাগছে?

বুড়ি বলল, আমি তো শ্রীলংকা দেখতে আসি নি। আমি এখানকার রোদ গায়ে মাখতে এসেছি। আমার দেশ ফিনল্যান্ডে। সেখানকার তাপ এখন শূন্যের ৩০ ডিগ্রি নিচে।

আমি বললাম, তোমার দেশ ফিনল্যান্ড আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম। সুইডেন থেকে জাহাজে করে।

বুড়ি অবাক হয়ে বলল, ফিনল্যান্ড কেন গিয়েছিলে?

আমার স্ত্রী এবং পুত্রকে বরফের দেশ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি যেমন রোদ দেখে আনন্দে আত্মহারা, তারাও বরফ দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল।

বুড়ি বলল, তুমি কী করো জানতে পারি।

আমি বললাম, আমি কিছুই করি না। আমাকে বেকার বলা যেতে পারে।

বুড়ি : তুমি কোনো কাজ করো না?

আমি : না।

বুড়ি নিজের জায়গায় ফিরে হাত-পা রোদে মেলে সিগারেট ফুঁকতে শুরু করেছে। আমি পুত্রের সঙ্গে কথোপকথনে মন দিয়েছি। আমি যা-ই বলছি সে তার উত্তরে কুঁ জাতীয় শব্দ করছে। সে এই মুহূর্তে কী ভাবছে, চারপাশের জগতটা তার কেমন লাগছে যদি জানা যেত!

সেহেরি এসে বলল আমার পাশে। তার হাতে আমের জুস (এই দ্বীপে সারা বছর আম হয়।) সেহেরির চোখমুখ উজ্জ্বল। আমি বললাম, ভাবি কোথায়?

সেহেরির মুখ আরও হাসি হাসি হয়ে গেল। সে বলল, নাজমা গেছে স্যুটকেসের তালা কিনতে।

আমি বললাম, তোমাকে খুব আনন্দিত দেখাচ্ছে। তালা কেনার সঙ্গে তোমার আনন্দের সম্পর্ক কী?

সেহেরি বলল, সে প্রতিটি দোকানে ঢুকবে। দোকানের সব তালা পরীক্ষা করবে। শেষে কিনবে না। আবারও প্রথম দোকান থেকে তালা দেখা শুরু করবে। দুপুরে খাওয়ার আগে সে ফিরবে না। আমি এইজন্যেই আনন্দিত।

সেহেরি লম্বা সৈকত চেয়ারে শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকিয়ে ঘুমুতে শুরু করল। সে ঘুমাচ্ছে; তার পাশে গ্লাসভর্তি আমের জুস। সেখানে মাছি ভনভন করছে। সেহেরির নাক ডাকার শব্দে তারা খানিকটা বিভ্রান্ত। সেহেরির নাক ডাকা মাঝে মাঝে সমে এসে হঠাৎ নতুন উদ্যমে বিকট শব্দে শুরু হয়। তখন মাছির ঝাঁক পালিয়ে যায়। সেহেরি একটু ঠান্ডা হলে ভয়ে ভয়ে ফিরে আসে। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে।

আমার হাতে বই। বইটার নাম Outlines of Ceylon History, বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১১ সালে। লেখকের নাম Donald Obeyesekere. যথেষ্টই আনন্দ নিয়ে বইটি পড়ছি। এই বই পড়েই জানলাম কবি মিল্টন শ্রীলংকা নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন–

Embassies from regions far remote,
From India and the golden chersonese,
And from utmost India iste, Taprobane.

এখানে laprobane হলো শ্রীলংকা। শ্রীলংকার আদি নাম Taprobane.

শ্রীলংকায় প্রথম বসতি স্থাপন করেন Wijeya (বিজয়)। তিনি তার দলবল নিয়ে কোত্থেকে এসেছিলেন শুনলে পাঠক চমকে উঠবেন। তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে (Bengal). তার মা’র নাম শচিদেবী। শচিদেবী সেই সময়কার বাংলার রাজার বড় মেয়ে।

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই বিজয় সিংহকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতার প্রথম দু’টি চরণ–

“আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লংকা করিয়া জয়
সিংহল নামে রেখে গেছে তার শৌর্যের পরিচয়।”

কবিতার দুটি চরণ আমাকে দিয়েছেন সাংবাদিক বন্ধু সালেহ চৌধুরী। তিনি যে-কোনো কবিতা একবার পড়লে বাকি জীবন মনে রাখতে পারেন, তবে নিকট মানুষজনের নাম মনে রাখতে পারেন না। তার নাতি-নাতনিদের কার কী নাম এই নিয়ে মাঝে মাঝেই তাকে বিভ্রান্ত হতে দেখা যায়

বিজয় সিংহ বিষয়ে একটি কুৎসিত জনশ্রুতি আমাকে বললেন আর্কিটেক্ট নাট্যকার ও নির্মাতা শাকুর মজিদ। তিনি বললেন, বিজয় সিংহের কোনো পিতা নেই। তার পিতা হলো মা শচিদেবীর পোষা সিংহ। মানুষ এবং সিংহের মিলনে বিজয় সিংহের জন্ম হয়। যে কারণে তার আচার-আচরণ ছিল সিংহের মতো।

এরকম কোনো তথ্য আমি পাই নি। বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে আমি জেনেছি, বিজয় সিংহ তার দলবল নিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় শ্রীলংকায় পৌঁছেন। নারকেল খেয়ে কোনোরকমে তাদের জীবন রক্ষা হয়।

বিজয় সিংহ সিংহের মতো কোনো সাহসও দেখান নি। স্থানীয় নৃপতিকে দলবলসহ নিমন্ত্রণ করে কাপুরুষের মতো সবাইকে হত্যা করেছেন।

.

প্রাচীন শ্রীলংকা রাবণের দেশ বলে আমরা জানি। রাবণ রামপত্নী সীতাকে হরণ করেছিলেন। অনেক ঝামেলা করে লংকায় অগ্নিকাণ্ড করে সীতাকে উদ্ধার করা হয়।

আসলেই কি এমন কিছু ঘটেছিল? নাকি পুরোটাই গল্পগাথা? বলা কঠিন। শ্রীলংকার লিখিত ইতিহাস শুরু হয় বিজয় সিংহ থেকে। তার আগের ঘটনা মানুষের কল্পনা, জনশ্রুতি, মিথ এবং গল্পগাথা।

পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ণের আমার জীবনযাত্রা বই থেকে উদ্ধৃত করছি–

সকালবেলা আমরা সীতা এলিয়া দেখতে গেলাম। লংকা যখন রাবণের দ্বীপ তখন তার রাজধানী আর হরণ করে আনা সীতাকে রাখার একটা স্থান নিশ্চয়ই থাকবে। বাবু মথুরাপ্রাসাদ স্থানটির নির্জনতা আর রমণীয়তা–পাশে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছতায়া ছোট নদী আর পাহাড়ের গায়ে ফুলে লাল অশোক গাছগুলো দেখে বললেন, ‘ঠিক, এটাই মহারানী জানকীর অশোকবন।’ বড় শ্রদ্ধাভরে তিনি অশোকের পাতা নিজের কাছে রাখলেন। আমি পাশের পাহাড়ের ঘাসের নিচে দেড় দু’ফুট মোটা কালো মাটি দেখিয়ে বললাম, ‘আর এই দেখুন সোনার লংকার দহন’।

লংকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম, ‘রাবণের কাহিনীর সত্যতা ব্যাপারে আমি দিব্যি গালতে রাজি নই।

তবে যদি কিছু থেকে থাকে, তো এই’।

সীতাকে সত্যি যদি অপহরণ করে লংকায় আনা হয় তাহলে তার নামে কিছু জায়গার নাম লংকায় থাকার কথা। তা কিন্তু আছে। যেমন, সীতা টালাওয়া (সীতাভূমি), সীতাএলা (সীতার নদী, রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন এই জায়গায় এসেছিলেন।), সীতাকুণ্ড (সীতার দিঘি)।

বাল্মীকির রামায়ণ এবং কল্পপুরাণ দুটি গ্রন্থই শ্রীলংকাকে বিশাল মহাদেশ বলে উল্লেখ করেছে, তা কিন্তু না। এই দুই গ্রন্থের সঙ্গে শ্রীলংকার আয়তন মেলানো যায় না। তবে বলা হয়ে থাকে শ্রীলংকার বড় অংশই সমুদ্রে তলিয়ে গেছে। আগে মালদ্বীপও শ্রীলংকার সঙ্গে যুক্ত ছিল।

রাবণ-সীতার রহস্য কোনো একদিন দূর হয়ে যাবে এই আশায় রইলাম।

ইতিহাস চিন্তায় বিঘ্ন ঘটল। নিনিত জেগে উঠেছে। সে দুধ খাবে। একই সঙ্গে তার কান্না থামানো এবং তার জন্য দুধ বানানো দুরূহ কর্ম। ফিনল্যান্ডের মহিলা এগিয়ে এলেন। আমি তার কোলে নিনিতকে দিয়ে নিনিতের জন্যে দুধ বানাতে বানাতে বললাম, তুমি আমার বাচ্চাটির এত ছবি তুললে। এখন তার কান্না সামলাচ্ছ। একবারও তো জিজ্ঞেস করলে না, বাচ্চাটির নাম কী?

মহিলা বিব্রত গলায় বললেন এর নাম কী?

আমি বললাম, এর নাম নিনিত। নামের অর্থ Grace of God.

অবাক হয়ে দেখলাম মহিলাটির মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, এর নাম নিনিত?

আমি বললাম, হ্যাঁ। ততক্ষণ নিনিতের মুখে দুধের ফিডার দেওয়া হয়েছে। সে কান্না থামিয়েছে। ফিনল্যান্ডের মহিলা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন।

এমন কি হতে পারে যে তার নাতিটির নামও নিনিত! রহস্যময় প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে নানান খেলা খেলে। এখানেও কোনো খেলা খেলছে!

আমি মহিলাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। সব রহস্য ভাঙতে হয় না।

.

পুনশ্চ-১

শাওন গুরুগৃহ দর্শন করে ফিরেছে। তার চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল। জেফরি বাওয়া যে চামড়ার চেয়ারে বসতেন, সেখানে সে নিষাদকে বসিয়ে ছবি তুলেছে। লাইব্রেরি থেকে জেফরি বাওয়ার একগাদা বই কিনেছে। সে হাত নেড়ে নেড়ে বসতবাড়িটা কতটা যে সুন্দর এবং কেন সুন্দর তা বুঝানোর চেষ্টা করছে।

আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি এরকম অভিনয় করলাম। একবার ভাবলাম শাওনকে বলি, তোমার এই গুরু কিন্তু চিরকুমার এবং সমকামী। তারপর ভাবলাম দরকার কী এই প্রসঙ্গের! কথায় আছে–

“যদ্যপি আমার গুরু বেশ্যাবাড়ি যায়
তদ্যপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।”

গুরু বলে কথা।

.

পুনশ্চ-২

জেফরি বাওয়া

কলম্বো শহরে ১৯১৯ সনে জন্মগ্রহণ করেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন (১৯৩৮-১৯৪১)। লন্ডনে আইন পড়েন, ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেন। আইন ব্যবসা শুরু করেন। হাতে কিছু টাকাপয়সা আসতেই লুনুগঙ্গায় তিনি পরিত্যক্ত একটি রাবার বাগান কিনে নেন। রাবার বাগানে ঘরবাড়ি তুলতে থাকেন নিজের মতো করে। এই হলো তার আর্কিটেক্ট জীবনের শুরু। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, স্থাপত্যবিদ্যায় তাঁর কোনো পুঁথিগত পড়াশোনা নেই।

তাঁকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এশিয়ান আর্কিটেক্ট বলা হয়ে থাকে। তিনি Sustainable architecture শুরু করার অনেক পরে স্থাপত্যবিদ্যায় Sustainable architecture এর ধারণা আসে। বাওয়ার ডিজাইনের বিশেষত্ব হচ্ছে, ভেতর এবং বাহিরকে মিলিয়ে দেওয়া। বাসস্থানকে প্রকৃতির অংশ করে নেওয়া। মারা যান ২০০৩ সালে, নিজের ডিজাইন করা স্বর্গচারণ লুনুগঙ্গায়।

হোটেল রুমের বারান্দায়

০৭.

সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আমি হোটেল রুমের বারান্দায় বসে আছি। বারান্দা থেকে সুইমিংপুল, নারকেল গাছের মাথা, মাখার ফাঁকে সমুদ্র দেখা যায়। রুমসার্ভিসে চায়ের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। চা এখনো আসে নি। দুই পুত্রই সারা দিনের পরিশ্রমের পর ঘুমুচ্ছে। সহজে তাদের ঘুম ভাঙবে এরকম মনে হয় না।

সেহেরি এবং নাজমা ভাবিকে হাত ধরাধরি করে সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখলাম। মনে হয় সমুদ্রের দিকে যাচ্ছেন। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর যত বৈরী সম্পর্কই থাকুক বিদেশে তা প্রকাশ করা হয় না। বিদেশে ‘সখী ধরো ধরো’ অবস্থা থাকে।

চা এসেছে। শাওন টি-পট থেকে চা ঢালছে। আমি সিগারেট ধরালাম। শাওন আড়চোখে দেখল, কিছু বলল না। দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে আমার উপরি পাওনা হলো বিনা বাধায় সিগারেট ফোঁকা। শাওন রাগারাগি করে ভ্রমণের আনন্দ নষ্ট করতে চায় না। সারা জীবন দেশের বাইরে থাকতে পারলে মন্দ হতো না। পায়ের উপর পা তুলে সিগারেট টানা।

শাওন বলল, আমি ছোট্ট একটা ভুল করেছি। ভুল শোধরাতে চাচ্ছি।

কী ভুল?

পুরো টুর প্রোগ্রাম আমার করা।

এটা ভুল হবে কেন?

তোমার নিজেরও তো কোথাও যেতে ইচ্ছা করতে পারে। এখনো সময় আছে, বলো, বিশেষ কোথাও কি যেতে চাও?

আমি চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে বললাম, চাই।

কোথায় যেতে চাও?

লেনামা মাউনটেন।

সেটা কোথায়?

পূর্ব শ্রীলংকায়। জায়গাটার নাম পানামা পাটু। ঘন জঙ্গলে ঢাকা একটা জায়গা। জঙ্গলভর্তি বন্য হাতি আর লিওপার্ড।

ওখানে কেন যেতে চাচ্ছ?

ঘটনা আছে।

ঘটনা আগে বলো। আমি ইন্টারনেটে বসি। ড্রাইভার দিগায়ুর সঙ্গে কথা বলে দেখি কীভাবে যাওয়া যায়।

আমি আয়োজন করে ঘটনা বলা শুরু করলাম। শাওন চোখ বড় বড় করে শুনছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে সে যথেষ্টই আনন্দ পাচ্ছে।

জে আর টুলকিনের নাম শুনেছ?

না।

হবিটের নাম শুনেছ?

না।

হবিট হচ্ছে জে আর টলকিনের উপন্যাসের চরিত্র। এরা সম্পূর্ণ আলাদা মানবশ্রেণী। তিন ফুট উঁচু। এদের নিজস্ব ভাষা আছে, সংস্কৃতি আছে। দেখতেও মানুষের মতো। ‘লর্ড অব দ্য রিং’ ছবিটা তো দেখেছ?

হ্যাঁ। একসঙ্গে তো দেখলাম।

সেখানে হবিট আছে। মনে পড়েছে?

হ্যাঁ মনে পড়েছে। শ্রীলংকার জঙ্গলের সঙ্গে হবিটের কী সম্পর্ক?

আমি সাবধানে আরেকটা সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, হবিট কোনো কাল্পনিক বিষয় না। নৃতত্ত্ববিদরা এখন মনে করছেন পৃথিবীতে একসময় সত্যি হবিট ছিল।

বলো কী?

ইন্দোনেশিয়ার লিয়াং বুয়া গুহায় খর্বাকৃতি মানুষের কিছু কংকাল পাওয়া গেছে। নৃতত্ত্ববিদদের মাথার চুল ছেঁড়ার অবস্থা। এদের বলা হয় ‘Ebu-gogo’। নৃতত্ত্ববিদরা এদের নাম দিয়েছেন Homo floresienis. হোমারের মহাকাব্য ইলিয়ডে এক জাতির কথা বলা হয়েছে, যারা সবাই বামুন। এ যুদ্ধে পারদর্শী।

শাওন মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, জ্ঞান না ফলিয়ে মূল ঘটনা বলো।

আমি বললাম, মূল ঘটনা বুঝতে হলে জ্ঞান ফলাতেই হবে। গ্রীক দার্শনিক প্লিনি (Pliny) আড়াই ফুট চার ইঞ্চি লম্বা মানবজাতির কথা লিখে গেছেন। তারা থাকত এশিয়া মাইনর, ভারতবর্ষ এবং নীলনদের আশপাশে।

শাওন বলল, তুমি বরং আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে শ্রীলংকার বেটে মানবজাতির কথা বলো।

আমি অতি আগ্রহে আরেকটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম, শ্রীলংকার এই মানবগোষ্ঠীর নাম নিতেয়ু (Nittaewo)। এদের মূল বাস ছিল পানামা পাটুতে। বাস করত পাহাড়ের গুহায়। এদের কথা প্রথম বলে গহিন জঙ্গলের জংলি মানুষেরা। জংলিদের নাম ভাস (Mass)। ভাসরা নিতেয়ুদের অত্যাচারে তটস্থ থাকত। নিতেয়ুরা ভাসদের শুধু যে খাবার চুরি করত তাই না, সুযোগ পেলেই জংলি মেয়েদের ধর্ষণ করত।

নিতেয়ুরা পাখির মতো কিচিরমিচির করে নিজেদের মধ্যে কথা বলত। ভাসরা তাদের কিছু কিছু কথা বুঝতে পারত। নিতেয়ুরা সাহসী ছিল, তবে কুকুর এবং বন্য মহিষ ভয় পেত।

ভাসরা এক পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে কুকুর এবং তীর-ধনুক নিয়ে এদের আক্রমণ করে। নিতেয়ুরা যুদ্ধে হেরে গিয়ে গুহায় আশ্রয় নেয়। তারা তাদের শিশুদের দু’হাতে উঁচু করে ধরে এদের জীবন রক্ষার আবেদন করে। ভাসরা কোনো কথাই শোনে নি। গুহার মুখে তিন রাত তিন দিন আগুন জ্বালিয়ে সবাইকে হত্যা করে।

শাওন বলল, ঘটনা কতদিন আগের?

বেশি দিন না, মাত্র দু’শ বছর আগে।

অদ্ভুত তো! এত কিছু জানলে কোথায়?

আমি ভারিক্কি ভাব নিয়ে বললাম, প্রদীপ এ জয়তুঙ্গা নামের এক স্কলার এদের উপর থিসিস করেছেন। থিসিসের নাম The Hobbits of Srilanka, An analy sis of the legend.

ড্রাইভারকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে। আমরা পানামা পাটু যেতে চাই শুনে সে চোখ তুলে বলল, সেটা তো ভয়াবহ জঙ্গল। পুরো জঙ্গল ঘেরা আছে হাই টেনশান ইলেকট্রিক তার দিয়ে, যাতে বন্য হাতি বের হতে না পারে। তোমরা সেখানে যেতে চাও কোন দুঃখে? সেখানে তো থাকার মতো কোনো রেস্টহাউসও নেই।

আমি দিগায়ুর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমরা সেখানে যাব না। আরামদায়ক ফাইভস্টার হোটেলের বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখে সময় কাটাব। কারণ আমরা সভ্য মানুষ।

.

পুনশ্চ

সমুদ্র দর্শন করে সেহেরি এবং নাজমা ভাবি ফিরেছেন। নাজমা ভাবি ভয়ানক উত্তেজিত, কারণ তিনি তার হ্যান্ডব্যাগ হারিয়ে ফেলেছেন। হ্যান্ডব্যাগে পাসপোর্ট এবং ডলার। নাজমা ভাবিকে মনে হচ্ছে এক্ষুণি তার হার্ট অ্যাটাক হবে।

আমি বললাম, আপনারা কি হোটেলের রেস্টুরেন্টে চা-নাস্তা খেয়েছেন? সেখানে ব্যাগ ফেলে আসতে পারেন। নাজমা ভাবি উল্কার মতো রেস্টুরেন্টের দিকে ছুটে গেলেন।

সেহেরি হাসিমুখে বলল, খুঁজে মরুক। একটা শিক্ষা হোক।

শাওন বলল, বিদেশে পার্সপোর্ট, ডলার হারানো তো ভয়ংকর ব্যাপার। সেহেরি ভাই, আপনি এত নিশ্চিন্ত কেন?

সেহেরি মুচকি হেসে বলল, ব্যাগ আমি লুকিয়ে রেখেছি। উচিত শিক্ষা।

অনুরাধাপুর মৃত নগরী

০৮.

আমরা অনুরাধাপুর মৃত নগরীর গেটে দাঁড়িয়ে আছি। শাওনকে অত্যন্ত বিব্রত এবং লজ্জিত দেখাচ্ছে। সে যতটা বিব্রত, নাজমা ভাবি ততটাই আনন্দিত। ঘটনা হলো–

অনুরাধাপুর মৃত নগরীতে ঢুকতে চড়া দামে টিকিট কাটতে হয়। সার্কদেশের নাগরিকরা পাসপোর্টে দেখালে অর্ধেক দামে টিকিট পায়। শাওন আমাদের পাসপোর্ট আনতে ভুলে গেছে। নাজমা ভাবি তার এবং সেহেরির পাসপোর্ট এনেছেন। তারা অর্ধেক দামে টিকিট কাটতে পারবেন। আমাদের দিতে হবে ডাবল দাম।

নাজমা ভাবি আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে নিজের মনে গজগজ করছেন, দেশ বিদেশ ঘুরলেই হয় না। নিয়মকানুন জানা লাগে। বিদেশের মাটিতে পাসপোর্টে হলো কলিজার মতো। কলিজা সবসময় সঙ্গে থাকা লাগে। কলিজা হোটেলে ফেলে আসতে হয় না।

ড্রাইভার দিগায়ু অনেক চেষ্টা করল সার্ক টিকিটে আমাদের ঢোকাতে। শেষমেষ সন্দেহজনক চেহারার একজনকে নিয়ে এল। সে গলা নামিয়ে বলল, বিনা টিকিটেই সে সবাইকে ঢুকিয়ে দেবে। বিনিময়ে সে সার্ক দেশের হিসেবে টাকা নেবে।

সেহেরি আনন্দিত গলায় বলল, প্রবলেম সলভড। আমরা তোমাকে এখন টাকা দেব না। সব দেখা শেষ হওয়ার পর টাকা পাবে।

ঐ লোক বলল, অসুবিধা নেই।

আমি অবাক হয়ে মেহেদিরঙে রাঙানো ধবধবে সাদা দাড়ির সুফি সাধকদের চেহারার সেহেরির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি বললাম, সেহেরি, এই লোক ঘুষ খেতে চাচ্ছে। আমি তাকে ঘুষ দেব?

সেহেরি বলল, যে টাকাটা আমরা খরচ করতাম, সেই টাকাই তো তাকে দিচ্ছি। আমাদের দিক থেকে আমরা ক্লিয়ার। আমি শাওনের দিকে তাকালাম, সে কিছু বলছে না। এর অর্থ সেহেরির যুক্তি সে মেনে নিচ্ছে। আমি বললাম, টাকা বাঁচানোর জন্যে ভুল যুক্তিতে আমি যাব না। লোকটা তার দেশকে ফাঁকি দিতে চাচ্ছে, সেই সুযোগ তাকে দেব না। আমি একজন লেখক। একজন লেখক কখনো এ ধরনের কাজ করেন না।

টিকিট কাটা হলো। আমি একজন গাইড নিলাম। তাকে দু’হাজার টাকা দিতে হবে। সে মৃত নগরীর সব বিষয় আমাদের বোঝাবে। গাইড কতটুকু জানে তা বোঝার জন্যে আমি বললাম, সংঘমিত্রা কে?

গাইড বলল, ভারত সম্রাট অশোকের একমাত্র মেয়ে। তিনি অনুরাধাপুর এসেছিলেন।

মহেন্দ্র কে?

ইনি সম্রাট অশোকের একমাত্র পুত্র। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্যে ইনিও অনুরাধাপুর এসেছিলেন।

বোঝা গেল গাইড ভালোই জানে। আমি বললাম, তুমি নিজ থেকে বকবক করবে না। তোমাকে আমরা কেউ যখন কিছু জিজ্ঞেস করব তখনই জবাব দেবে।

গাইড না-সূচক মাথা নাড়ল, এর অর্থ হ্যাঁ।

বিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির লাভায় ঢাকা পড়ে সমৃদ্ধশালী পম্পেই নগরী মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছিল। অনুরাধাপুর মৃত নগরী হয়েছে কালের লাভায় চাপা পড়ে।

অসংখ্য টুরিস্ট বিস্ময় নিয়ে মৃত নগরী দেখছে। সব দলের সঙ্গেই একজন গাইড। গাইডরা মুখস্থ পড়া বলার মতো করে অনুরাধাপুরের ইতিহাস বলছে।

আমি ট্যুরিস্টদের তিন ভাগ করে ফেললাম–

১. এদের হাতে ভিডিও ক্যামেরা। তারা যা দেখছে, ভিডিও ক্যামেরায় তুলে ফেলছে। ভিডিও ক্যামেরা মাঝে মাঝে ধরছে গাইডের মুখে। এই দলে জাপানি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বেশি। ওদের নিজেদের ভিডিও করার আগ্রহ নেই বললেই হয়।

২. এদের হাতে ছোট স্টিল ক্যামেরা। এরাও যা দেখছে তার ছবি তুলছে। নিজেরা দর্শনীয় জায়গার সামনে দাঁড়িয়ে ছবির জন্যে পোজ দিচ্ছে। বেশির ভাগই ইউরোপের। মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধ বৃদ্ধা।

৩. তৃতীয় দলের হাতে কোনো ক্যামেরা নেই। বয়স অল্প। এরা ক্যামেরার চোখ দিয়ে কিছু দেখছে না। এরা এসেছে জোড়ায় জোড়ায়। হাঁটছে একজন আরেকজনের কোমর জড়িয়ে। বেশির ভাগ আমেরিকান। বয়স অল্প। গাইডের কথার প্রতি এদের কোনো মনোযোগ নেই। এদের কাছাকাছি গেলে তীব্র গাঁজার গন্ধ পাওয়া যায়।

আমি দলবল নিয়ে একটা প্রাসাদের পর আরেকটা প্রাসাদে যাচ্ছি। কী বিপুল ঐশ্বর্য এবং সৌন্দর্য নিয়ে এইসব প্রাসাদ দাঁড়িয়ে ছিল। আজ ধ্বংসস্তূপ।

পুত্র নিষাদ অবাক হয়ে বলল, বাবা! আমরা ভাঙাবাড়ি দেখছি কেন?

নাজমা ভাবি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হুমায়ুন ভাইয়ের এই ছেলেটা ট্যালেন্ট। ঠিকই বুঝেছে ভাঙা ঘরবাড়ি দেখার কিছু নাই। এখন পর্যন্ত হাতি দেখলাম না। ভাঙা দালানকোঠার মধ্যে ঘুরছি। সাপে কাটে কি না কে জানে! ভাঙা দালানকোঠা সাপের আখড়া। ডলার খরচ করে এসে সাপের কামড় খাওয়ার কোনো মানে হয়?

ভাবি একা আমাদের সঙ্গে ঘুরছেন। সেহেরি গাড়ি থেকে নামে নি। তার পক্ষে নাকি মাইলের পর মাইল হাঁটা সম্ভব না।

শাওন মহা উৎসাহে ছবি তুলে বেড়াচ্ছে। তার বুকে বেবি ক্যারিয়ারে পুত্র নিনিত ঝুলছে। তার বড়ভাই কাঁদছে না দেখে নিনিতও চুপচাপ। চোখ বড় বড় করে ধ্বংসস্তূপ দেখছে।

আমি নাজমা ভাবিকে বললাম, চলুন, আপনার কিছু ডলার উসুলের ব্যবস্থা করি। বোধিবৃক্ষ দেখে আসি।

নাজমা ভাবি বললেন, বোধিবৃক্ষ আবার কী?

যে বৃক্ষের নিচে সাধনা করে গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন।

সেটা কি এই দেশে?

না। তবে অশোককন্যা সংঘমিত্রা তার একটা ডাল এনে অনুরাধাপুরে লাগিয়েছিলেন। এই গাছটিকেও পবিত্র গণ্য করা হয়। অনেকেই এই গাছের কাছে আসেন পুণ্য লাভের আশায়।

আমরা মুসলমান। আমরা কেন পুণ্য পাব?

তা হয়তো পাবেন না, তারপরেও ভুবনবিখ্যাত একটা বৃক্ষ দেখার আনন্দ তো পাবেন।

বোধিবৃক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে নাজমা ভাবি বললেন, এটা তো একটা বটগাছ। বটগাছ তো কত দেখেছি।

আমি বললাম, বটগাছ না। এটা অশ্বত্থগাছ। ভাবি বললেন, অশ্বত্থ গাছও তো দেখেছি।

আমি বললাম, শ্রীলংকার অশ্বত্থগাছ তো দেখেন নি। বাংলাদেশে কত হাতি দেখেছেন, তারপরেও শ্রীলংকার হাতি দেখার জন্যে আপনি অস্থির।

ভাবি বললেন, হুমায়ুন ভাই, আপনি আমাকে ভোলাচ্ছেন। আপনার মতলব আমি টের পাচ্ছি। আপনি আমাকে হাতি দেখতে দিবেন না। তা হবে না। আমি কিন্তু হাতি দেখব। শ্রীলংকায় এসে হাতি না দেখে গেলে আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারব না।

.

অনুরাধাপুরের ইতিহাস লিখে পাঠকদের বিরক্ত করছি কি না বুঝতে পারছি না। ভ্রমণকাহিনীর লেখকরা অনেকটা ট্যুরিস্ট গাইডের মতো। গাইডরা টুরিস্টদের সুন্দর সুন্দর জায়গায় নিয়ে বকরবকর করতে থাকে। ভ্রমণকাহিনীর লেখকরা পাঠকদের সুন্দর সুন্দর জায়গায় নিয়ে লেখার মাধ্যমে বকরবকর করতে থাকেন। গাইডদের সঙ্গে তাদের তফাত হচ্ছে গাইডদের ধমক দিয়ে থামানো যায়, লেখকদের যায় না

প্রিয় পাঠক! বেশি বিরক্ত করব না। অনুরাধাপুরের ইতিহাসের মজার অংশটা (আমার কাছে) খুবই অল্প কথায় বলব।

অনুরাধা নামটা শুনলেই মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ের ছবি মনে আসে। অনুরাধা আসলে একজন অত্যন্ত বলশালী পুরুষের নাম। তার নামে যে নগরের প্রতিষ্ঠা তা-ই হচ্ছে অনুরাধাপুর। চব্বিশ শতাব্দী বছর আগের প্রতিষ্ঠিত এই নগরী দর্শনার্থীদের এখনো বিমুগ্ধ করে যাচ্ছে। আমরা অবাক হয়ে ভাবছি, মানুষ তখনো এত ক্ষমতাধর ছিল!

মৃত নগরী দেখার একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। নগরীর কোনো নির্জন অংশ বেছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতে হয়। তখন হঠাৎ মৃত নগরী জীবন ফিরে পায়। যে ধ্যান করছে তার কানে জীবন্ত নগরীর নানা শব্দ, বাদ্য-বাজনা ভেসে আসে। আমি তা-ই করলাম। নির্জন একটা জায়গায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি, তখন এক ইউরোপীয় টুরিস্ট এগিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বলল, Any problem man? আমাকে ধ্যানভঙ্গ করে তাকাতে হলো। মৃত নগরীকে জীবিত করা গেল না।

গাইড ব্যস্ত হয়ে পড়ল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শুয়ে থাকা বুদ্ধ দেখানোর জন্যে।

বুদ্ধমূর্তি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তারপরেও গেলাম দেখতে।

গাইড বলল, অনুরাধাপুরে গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দাঁত ছিল। এখন আছে ক্যান্ডিতে।

আমি বললাম, তোমাকে তো প্রশ্ন না করলে চুপ করে থাকতে বলেছি। কথা বলছ কেন?

গাইড বলল, না বললে তুমি তো জানতে না এখানে উনার পবিত্র দাঁত ছিল।

আমি বললাম, দাঁত যিনি নিয়ে এসেছিলেন আমি তার নাম জানি। তুমি কি জানো?

না। উনার নাম কী?

আমি বলা শুরু করলাম। পাঠক নিশ্চয়ই ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, “হুঁ বুঝলাম। জ্ঞান ফলানো শুরু হয়েছে।” আমি জ্ঞান ফলানোর জন্যে কিছু বলছি না। গাইডের কাছে জ্ঞান ফলানোর কিছু নেই। আমার লক্ষ্য শাওন। পৃথিবীর সব স্বামীর মতো আমিও স্ত্রীকে মুগ্ধ করতে ভালোবাসি। এই সুযোগ তেমন হয় না। আজ হয়েছে। শাওন ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এসেছে আমার গল্প শুনতে।

আমি ভাব নিয়ে বললাম, যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ৫৪০ বছর আগে বুদ্ধকে দাহ করা হয়। আগুন থেকে তাঁর একটি দাঁত এবং কলার বোন রক্ষা পায়। কলিঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান উড়িষ্যার রাজা এই দুটি সংগ্রহ করেন এবং গভীর যত্নে রক্ষা করতে থাকেন। কলিঙ্গের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন পাশের এক নৃপতি। যুদ্ধে হেরে গেলে দাঁত এবং কলার বোন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বলে তিনি তাঁর কন্যা রানী ওয়ালিয়াম কুমারীকে তীর্থযাত্রী সাজিয়ে শ্রীলংকায় পাঠিয়ে দেন। রানী ওয়ালিয়াম কুমারীর ছিল মাথাভর্তি লম্বা চুল। তিনি সেই চুলের ভেতর দাঁত এবং কলার বোন লুকিয়ে শ্রীলংকায় চলে আসেন। অনুরাধাপুরের নৃপতি তখন রাজা শ্রীমেঘাওয়ানা। তাঁকে এই দুই পবিত্র বস্তু দেওয়া হয়। এই হলো ঘটনা।

শাওন বলল, কলিঙ্গের রাজা কি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন?

আমি বললাম, হ্যাঁ।

শাওন মুগ্ধকণ্ঠে বলল, তুমি এত পড়াশোনা কখন করলে? আই এ্যাম ইমপ্রেসড।

আমি তৃপ্তির হাসি হাসলাম। যাক, অনুরাধাপুরে আসা সার্থক হয়েছে।

.

পুনশ্চ

অনুরাধাপুরের প্রায় একশ’ ছবি শাওন তার ডিজিটাল ক্যামেরায় তুলেছে। মৃত নগরীর আর্কিটেকচারাল বিউটি তাকে বিমোহিত করেছে। সে অনেক খাটাখাটনি করে ফ্রেম করে যখনই ছবি তুলতে যায়, তখনই নাজমা ভাবি ফ্রেমে ঢুকে পড়ে মিষ্টি হাসি হেসে পোজ দেন। একবার শাওন বলল, ভাবি আপনি বাঁ-দিক দিয়ে ঢুকবেন না। বাঁ-দিকের এই পিলারটা আমার ফ্রেমের শেষ অংশ।

নাজমা ভাবি বললেন, আচ্ছা ঢুকব না। শাওন ফ্রেম করে যেই ছবি তুলতে গেছে, নাজমা ভাবি ডানদিক থেকে টুকে মিষ্টি হাসি হেসেছেন।

শাওনের তোলা একশ’ ছবির আশিটিতে নাজমা ভাবি আছেন। শাওন এখন চেষ্টা করছে ফটোশপের মাধ্যমে ভাবিকে মুছে ফেলতে। একটা ছবিতে কিছু সাফল্য এসেছে। ভাবির শরীর মুছে গেছে, শুধু মুখটা পিলারের মাথায় আটকে আছে। মুখ দূর করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অনুরাধাপুরের একটা পিলার সবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ছবি হিসেবে চমৎকার।

আদম’স পিক

০৯.

বেনটোটা থেকে আমরা যাব নিগাম্বু। কলম্বো হয়ে যেতে হবে। কলম্বোর কাছেই রত্নপুরা। রত্নাপুরাতে আছে রত্নগিরি বা রত্নের পাহাড়। পাহাড় খুঁড়লেই মণিমুক্তা। কলম্বো যাওয়ার পর রত্নপাহাড় দেখা যায়। এই রত্নগিরিই বিখ্যাত আদম’স পিক। অনেক উঁচু পাহাড়। উপরে ওঠা অসম্ভব ব্যাপার। পাহাড়ের নিচে ঘুরাফিরা করে নিগাম্বু চলে যাওয়া। সঙ্গে গাড়ি আছে, সমস্যা কিছু নেই।

আদম’স পিক সম্পর্কে কিছু বলা যাক। সাত হাজার তিন শ’ আটান্ন ফুট উঁচু পাহাড়। এর চূড়ায় একটি পদচিহ্ন।

মুসলমানরা দাবি করেন এই পদচিহ্ন হযরত আদমের। বেহেশত থেকে নির্বাসিত হয়ে তিনি এসেছেন শ্রীলংকায়।

খ্রিষ্টানদেরও এই দাবি। তাদের মতে শ্রীলংকাই হলো স্বর্গভূমি (Eden)। খ্রিষ্টানদের একটি দল অবশ্য বলে এটি সেইন্ট পিটারের পায়ের ছাপ।

বৌদ্ধদের দাবি এটি গৌতম বুদ্ধের বাঁ পায়ের ছাপ। তিনি পৃথিবী থেকে শেষবারের মতো চলে যাওয়ার সময় বাঁ পা রাখেন এখানে, ডান পা রাখেন ব্যাংককের সারাবুড়ি প্রদেশে। সেখানে পাথরের ওপর ডান পায়ের একটি ছাপ আছে।

হিন্দুদের দাবি এই পায়ের ছাপ শিবের। পাহাড়ের নিচে একটি প্রাচীন শিবমন্দিরও আছে।

প্রধান ধর্মগুলির মধ্যে ইহুদি ছাড়া বাকি সবাই পদচিহ্নের দাবিদার। ইহুদিরা যদি বলত এটি মোসেসের (মুসা আলায়েস সালাম) পায়ের ছাপ, তাহলে সর্বকলা সম্পন্ন হতো।

আমার নিজের ধারণা, এটা কোনো মানুষের পায়ের ছাপই না। প্রাকৃতিক কারণে শিলা ক্ষয়ে পায়ের পাতার আকৃতি নিয়েছে। কিংবা মানুষই পাথর খুদে এই জিনিস বানিয়েছে।

আমার এই ধারণার কারণ পায়ের পাতা পাঁচ ফুট লম্বা। দৈত্যের পায়ের পাতা এত বড় হতে পারে, মানুষের না।

ধার্মিক সেহেরি বলল, আদি মানুষ ৬০ ফুট লম্বা ছিল। তাদের পায়ের পাতা তো পাঁচ ফুট লম্বা হবেই।

আমার যুক্তি, এক মিলিয়ন বছর আগে মানুষের দৈর্ঘ্য আমাদের মতোই ছিল। গুহাচিত্রে আঁকা ছবিগুলিই তার প্রমাণ। গুহাচিত্রে শিকারি মানুষ বাইসন, হাতি, হরিণ তাড়া করছে। ছবিতে আঁকা হাতি বা বাইসনের দৈর্ঘ্য এবং মানুষের দৈর্ঘ্যের অনুপাত এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করে।

বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা জানি প্রাচীন মানুষ ছিল ক্ষীণায়ু এবং খর্বাকৃতির। পুষ্টির অভাব, চিকিৎসার অভাব, যুদ্ধ, মহামারী–সব মিলিয়ে মানুষের গড় আয়ু ছিল পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে।

বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ আজ দীর্ঘায়ু। লম্বাতেও মানুষ বাড়ছে। চীন এবং জাপান হলো উজ্জ্বল উদাহরণ। চীনের যুবকরা তো লম্বায় এখন আমেরিকানদের ধরে ফেলছে।

.

কলম্বোর দিকে যাত্রা শুরুর আগে আগে আমি বললাম, শ্রীলংকায় এসে ট্রেনে চড়া হয় নি। বেনটোটা থেকে ট্রেনে কলম্বো গেলে কেমন হয়? দিগায়ু গাড়ি নিয়ে আগে আগে চলে গেল।

সেহেরি বাদ সাধল। সে বলল, ট্রেন প্লাটফরম থেকে উঁচুতে থাকে। ট্রেনের সিঁড়ি সরু। তোমার ভাবি উঠতে পারবে না।

আমি বললাম, দুজন ভাবিকে নিচ থেকে ঠেলবে, আমি তাকে উপর থেকে টানব। টানা এবং ঠেলা খেয়ে সিঁড়ি বাওয়া তো ভাবির অভ্যাস আছেই।

নাজমা ভাবি বললেন, আপনার সব কথা আমি শুনব। শুধু যদি আপনি হাতি দেখাবার ব্যবস্থা করে দেন।

শাওন বলল, ভাবি, ওকে এসব কিছু বলে লাভ নেই। ট্যুর প্রোগ্রাম আমি করেছি। নিগাম্বু থেকে আমরা যাব পিনাওয়ালায়। সেখানে আছে হাতির বাচ্চার এতিমখানা। যে সব হাতির বাচ্চার মা মারা গেছে কিংবা হারিয়ে গেছে তাদের এই হস্তী এতিমখানায় রাখা হয়। তাদের খাওয়ার দৃশ্য, স্নানের দৃশ্য অসাধারণ।

নাজমা ভাবির চোখ চকচক করছে। মনে হয় তিনি কল্পনায় হস্তীস্নান দৃশ্য দেখছেন।

চার কামরার ছোট্ট ট্রেন। কামরাগুলির অবস্থা শোচনীয়। মন খারাপ করে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন চলতে শুরু করামাত্র মন ভালো হয়ে গেল। সমুদ্র ঘেঁসে ট্রেনের লাইন। শান্ত নীল সমুদ্র, সমুদ্রের পাড়ে জেলেপল্লী। দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। সমুদ্র বদলাচ্ছে না। অনেকদিন ট্রেনে এমন আনন্দভ্রমণ হয় নি।

একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ট্রেনের টিকিট ব্রিটিশ আমলের ট্রেনের টিকিটের মতো। এক ইঞ্চি বাই দুই ইঞ্চি হার্ডবোর্ডে ছাপানো। টিকিটের রঙ বলে দিচ্ছে কোন ক্লাস। হলুদ রঙ হলে থার্ড ক্লাস, নীল হলে সেকেন্ড ক্লাস। আমি কলেজে পড়া পর্যন্ত এই টিকিটের চল আমাদের দেশে দেখেছি।

চমৎকার রেলস্টেশনের ছবি দেখে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না। শ্রীলংকার স্টেশনগুলির দীন দশা। এই স্টেশন হোটেল সেরেনডিয়া তাদের প্রচারের জন্যে করে দিয়েছে।

কলম্বোয় পৌঁছে টিম লিডার শাওন ম্যাডাম আমাদের এক ঘণ্টা সময় দিলেন। এই এক ঘণ্টার মধ্যে দুপুরের খাওয়া শেষ করতে হবে। কারোর কেনাকাটার কিছু থাকলে এর মধ্যেই সারতে হবে। আমি কলম্বোর একটা বইয়ের দোকানে ঢুকলাম। বইয়ের সংগ্রহ ভালো। বেছে বেছে বই কিনতে হয়। বই বাছাবাছি করতে অনেক সময় চলে গেল। এখন আদম’স পিকের দিকে রওনা হলে হোটেলে পৌঁছতে রাত দুটা বেজে যাবে। কাজেই আদম’স পিক বাদ দিয়ে হোটেলের দিকে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।

নাজমা ভাবি বললেন, এটা হুমায়ুন ভাইয়ের একটা সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র। আমরা যাতে বাবা আদমের কাছে যেতে না পারি তার জন্যে বইয়ের দোকানে দেরি করেছেন। বিরাট সোয়াব থেকে বঞ্চিত হলাম।

আমি মৌনভাব ধারণ করলাম। গৌতম বুদ্ধের দেশে ঘনঘন মৌনভাব ধারণ করতে হয়।

.

আমাদের হোটেলের নাম ক্লাব ডলফিন হোটেল। ফাইভস্টার হোটেল। নিগাম্বুতে এটিই সবচেয়ে সুন্দর হোটেল। এদের মতো বড় সুইমিং পুল সার্কভুক্ত কোনো দেশে নেই। রাত আটটায় হোটেলে পৌঁছলাম। হোটেলের লবি দেখে মন ভালো হয়ে গেল। ছেলেমানুষের মতো হাততালি দিয়ে বলতে ইচ্ছা করল, কী সুন্দর! কী সুন্দর!

হোটেলে রুম না নিয়ে আমরা একটা ভিলা নিয়েছি। ভিলায় সবাই থাকব। সমুদ্র দেখব। আলাদা কিছু খেতে ইচ্ছা করলে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা। প্রতিটি ভিলার জন্যে আলাদা অ্যাটেনডেন্ট।

জিনিসপত্র সব নামানো হয়েছে। শাওন গিয়েছে চেক ইন কাউন্টারে। সেখানে তাকে বলা হলো, তোমার নামে কোনো বুকিং নেই।

শাওন বলল, নিশ্চয়ই তোমাদের কোনো ভুল হয়েছে।

মাডাম, ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

শাওন বলল, এই হোটেলের ম্যানেজমেন্ট অফিস কলম্বোয়। আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। যার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তার নাম জোসেফ। তার মাধ্যমে আমরা একটা ভিলা নিয়েছি।

ম্যাডাম, আপনার কথা ঠিক আছে। আমাদের হেড অফিস কলম্বো এবং জোসেফ হেড অফিসেই কাজ করেন। কিন্তু ক্রিসমাসের কারণে আজ আমরা ওভার বুকড।

শাওন বলল, আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের খুব বড় একজন লেখক আছেন। আপনারা তার কথা বিবেচনা করবেন না?

হোটেল ম্যানেজমেন্টের সবাই একসঙ্গে সেহেরির দিকে তাকাল। সেহেরি উদাস ভঙ্গিতে মেহেদি রঞ্জিত দাড়িতে আঙুল বুলাচ্ছে। তাকে দেখাচ্ছে বেঁটে টলস্টয়ের মতো।

বেটে টলস্টয় দেখিয়েও লাভ হলো না। জিনিসপত্র তুলে আমরা অন্য হোটেলের সন্ধানে বের হলাম। শুরু হলো ক্লান্তিকর অনুসন্ধান পর্ব।

বিভিন্ন হোটেলের সামনে গাড়ি থামছে। আমরা গাড়িতে বসে আছি। ড্রাইভার দিগায়ুর সঙ্গে চিন্তিত মুখে শাওন নামছে। আর চিন্তিত মুখ করে ফিরছে।

এ রকম চলতেই থাকল, আমরা হোটেলের পর হোটেল দেখতেই থাকলাম। ক্রিসমাস সিজন। সব হোটেল ওভার বুকড। নাজমা ভাবি বললেন, হুমায়ূন ভাই, যদি হোটেল না পাওয়া যায় তখন কী হবে?

আমি বললাম, গাড়ি তো আছে। আমরা গাড়িতে থাকব।

বাথরুম করব কোথায়?

গাড়িতেই করবেন। তারপর নাকে রুমাল চাপা দিয়ে রাতটা পার করবেন।

নাজমা ভাবি বললেন, আপনার সঙ্গে কোনো বিষয়ে কথা বলাই উচিত না।

আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, কথা সত্য।

রাত বারোটায় প্যারাডাইস বিচ হোটেলের লবি থেকে শাওন ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে এসে বলল, “পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে?” সে যখন আর্কিটেকচারে ব্যাচেলর ডিগ্রি পেয়েছিল তখনো মনে হয় এত অনিন্দিত হয় নি।

হোটেলে রুম পাওয়ার পেছনে ইউরোপের প্রবল তুষারপাতের বড় ভূমিকা আছে। সুইডিস এক পরিবার চারটি রুম বুক করেছিলেল। তুষারপাতের কারণে তাদের ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় তারা হোটেল বুকিং ক্যানসেল করেছে। ঘটনা ঘটেছে শাওনের হোটেল লবিতে পা দেওয়ার পাঁচ মিনিট আগে। হোটেলের লবি ম্যানেজার শাওনকে বলল, তুমি অত্যন্ত ভাগ্যবতী মেয়ে। সুইডিস পরিবার বুকিং ক্যানসেল না করলে তুমি কোথাও থাকার জায়গা পেতে না।

শাওন হাসতে হাসতে বলল, আমি না, আমার স্বামী ভাগাৰান। সে কখনো কোথাও কোনো বিপদে পড়ে না।

.

অন্যদের কথা জানি না। আমি এই হোটেলে খুবই আনন্দে ছিলাম। দু’দিন দু’রাত কাটিয়েছি–দুটি বই পড়ে শেষ করেছি। একটি জনাথন লাইওনস-এর লেখা The House of Wisdom, অন্যটার নাম Between Eternities, লেখক Ashuin Desai. দুটিই চমৎকার বই।

নিগাম্বু এলাকাটা কক্সবাজারের মতো। অসংখ্য স্যুভেনিয়ারের দোকান। দাম নিয়ে মুলামুলি জায়েজ। গায়ে গা লাগা ভিড়।

.

আমার শ্রীলংকা ভ্রমণ এই হোটেলেই ইতি। এখান থেকে ঢাকার দিকে রওনা হব। বিদেশ যাত্রা শেষে দেশে ফেরার সময় সবসময় আমি আনন্দিত থাকি। আমার মনে হয়, দেশ মা আমাকে অনেক দিন না দেখে মন খারাপ করে আছে। অভিমানী মার মন খারাপ ভাব দূর করতে হবে। তাড়াতাড়ি দেশের মাটিতে পা দিতে হবে।

আমার জন্যে শ্রীলংকা ভ্রমণ ছিল আনন্দময় অভিজ্ঞতী। ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যে শাওনকে ধন্যবাদ। নাজমা ভাবির নানান কর্মকাণ্ডে আনন্দ পেয়েছি। তাকেও ধন্যবাদ। তিনি অবশ্যি শেষ পর্যন্ত হাতির বাচ্চাদের স্নান দেখতে পান নি। আমি তাঁকে কথা দিয়েছি, আরেকবার তাঁকে নিয়ে শুধুমাত্র হাতি দেখার জন্যেই আসব। যেখানেই হাতি সেখানেই আমরা।

ধলবাদ শ্রীলংকার সহজ-সরল মানুষদের। প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। প্রকৃতি মানুষের ধন্যবাদের ধার ধারে না। তারপরেও পৃথিবীতেই যিনি স্বর্গচারণ বানিয়েছেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মহান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক কেন নিজ দেশ ফেলে সারা জীবন শ্রীলংকায় কাটিয়েছেন–তা এই দেশে পা না দিলে বুঝতে পারতাম না।

আমার কথা ফুরাল
নটে গাছটি মুড়াল
কেন যে নটে মুড়ালি ….
ইত্যাদি।

.

পুনশ্চ

শ্রীলংকার একটি লোককাহিনী দিয়ে দিলাম। অনুবাদ করেছেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া। প্রকাশ করেছে সাহিত্য প্রকাশ।

.

বোকা রাজার গল্প

রাস্তা দিয়ে চলেছে বোকা রাজা, পেছনে পেছনে ঘোড়াটা। ভারি সুন্দর সাদা ঘোড়া। যেমন পছন্দ করত তেমনি ভালোও বাসত রাজা সেই ঘোড়াটাকে। রাজার ছিল এক বন্ধু। ভারি পণ্ডিত সেই বন্ধুটি, আর তেমনি বুদ্ধিমান। রাজ্যের যত লোক সবাই পণ্ডিতের কথা শুনত, তাকে ভালোবাসত ও সমীহ করত। আর এ জন্যই রাজার যত রাগ। রাজা চায় রাজ্যের সবাই তার কথা শুনুক। সে রাজা। কিন্তু প্রজারা শোনে কি না পণ্ডিতের কথা, পণ্ডিতের প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ। হাটেঘাটে সবখানে শুধু পণ্ডিতের গুণগান।

রাজা এবার তেতে উঠল। অনেক খেটেখুটে মাথা থেকে একটু বুদ্ধি বের করল।

রাজা হুকুম দিল, পণ্ডিত, সবাই বলে তুমি খুব বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত। তা মানলাম। এবার আমার সাদা ঘোড়াটাকে কথা বলা শেখাও। তবেই বুঝব তুমি কত বড় পণ্ডিত। যদি পার তো মিলবে বকশিশ, না পার তো হয়ে যাবে হাপিস। ধড় থেকে মাথা একেবারে আলাদা।

পণ্ডিত বাড়ি ফিরল। মাথা নুয়ে পড়েছে, মন খারাপ, মুখে হাসির ছিটেফোঁটাও নেই।

দেখে মেয়ে শুধোয়, বাবা। মন খারাপ কেন? কী হয়েছে?

পণ্ডিত বলল, উপায় আর কী, রাজা যা বলেছে, সারা জীবনেও তা আমি করে উঠতে পারব না। শুধু এই জীবনে কেন, সাত জীবনেও কেউ তা পারবে না।

মেয়ে আবার শুধোয়, কী করতে বলেছে তোমায়?

পণ্ডিত তখন মেয়েকে সব কথা বলল। বলে নিঃশ্বাস ছাড়ল লম্বা।

শুনে মেয়ে বলল, দুকখু করো না বাবা। কালই যাও রাজার কাছে। গিয়ে বলো, হ্যাঁ, আপনার ঘোড়াকে কথা বলা শেখাতে তো পারি। কিন্তু ঘোড়া তো মানুষ নয়, তাই সময় লাগবে অনেক দিন। অন্তত সাত বছরের জন্য ঘোড়াটা আমাকে দিন। তাহলে তাকে কথা বলা শেখাতে শুরু করতে পারি।

কী বলছিস তুই মা! সাত বছরেই বা কী করে শেখাব? সাত বছর পর রাজা আমাকে মেরে শেষ করে দেবে।

বাবা, সাত বছর দীর্ঘ সময়। আর কেই বা বলতে পারে এরই মধ্যে কী ঘটে যাবে! হয়তো রাজার সিংহাসনও উলতে যেতে পারে! নয়তো রাজাই যেতে পারে এই পৃথিবী ছেড়ে!

মেয়ের কথা পছন্দ হলো পণ্ডিতের। খেল দেল। ভালো ঘুম হলো রাতে। সকালে উঠে আস্তে আস্তে চলল রাজবাড়ির দিকে। পথের পাশে ফোটা ভুঁইচাঁপা ফুল দেখে তার ভালো লাগল। তার পাশ দিয়ে একটা খঞ্জনা পাখি ছুটে গেল লেজ দুলিয়ে। তাকেও ভালো লাগল। তারপর পণ্ডিত রাজবাড়িতে গিয়ে পৌঁছাল। দরবার তখনো বসে নি। পণ্ডিত অপেক্ষা করতে থাকল।

রাজা এল রাজদরবারে। মন্ত্রী, সেনাপতি, কোটাল সবাই উঠে রাজার নামে জয়ধ্বনি দিল। শুকপাখি বলে উঠল, পণ্ডিত এসেছে।

পণ্ডিত বলল, হ্যাঁ, আমি এসেছি মহারাজ। আমি আপনার ঘোড়াকে কথা বলা শেখাতে রাজি। কিন্তু এজন্য আমাকে সাত বছর সময় দিতে হবে।

রাজা হাসতে হাসতে বলল, দিলাম। নিয়ে যাও ঘোড়া। মনে রেখ, নয়তো যাবে গর্দান।

পণ্ডিত ঘোড়াটিকে নানা কাজে খাটায়। ঘোড়ার কল্যাণে তার অবস্থা ভালো হয়ে গেল। আর পণ্ডিতের বুদ্ধিমতী মেয়ের কথাই ঠিক। সাত বছর শেষ না হতেই বোকা রাজার সিংহাসন গেল উলটে। আর ঘোড়াটাও মরার আগ পর্যন্ত পণ্ডিতের কাছে ছিল, পণ্ডিতকে ধনী করে না দিলেও খাওয়া-পরার অভাব রাখে নি।

Exit mobile version