Site icon BnBoi.Com

সম্রাট – হুমায়ূন আহমেদ

সম্রাট - হুমায়ূন আহমেদ

জুলিয়াস নিশো

জুলিয়াস নিশো একটি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন দেখলেন। যেন তিনি বিশাল একটা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। ফাঁকা মাঠ। চারদিক ধু-ধু করছে। প্রচণ্ড শীত। হিমেল বাতাস বইছে। তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না, খুব অবাক হচ্ছেন। তিনি কোথায় এসে পড়লেন? হঠাৎ দূরে ঝনঝন করে শব্দ হল। তিনি শব্দ লক্ষ করে এগুচ্ছেন। তাঁর একটু ভয়ভয় করছে। তিনি বেশ কবার বললেন, কে ওখানে? কেউ সাড়া দিল না, তবে একজন-কেউ শব্দ করে হেসে উঠল।

কে ওখানে?

সম্রাট নিশো, আপনি এই নগরীতে কী করছেন?

তুমি কে?

আমি কেউ না। আমি আপনার এক জন বন্ধু।

তোমাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?

দেখতে পাচ্ছেন না, কারণ আপনার চোখ বাঁধা।

নিশো লক্ষ করলেন, তাই তো, তাঁর চোখ বাঁধা! তখন তাঁর মনে হল—এটা স্বপ্ন। এটা সত্যি নয়।

সম্রাট জুলিয়াস নিশো।

বল।

আপনি পালিয়ে যান। এক্ষুনি আপনাকে হত্যা করা হবে। ঘাতকরা আসছে। তাদের পায়ের শব্দ কি আপনি পাচ্ছেন না?

পাচ্ছি।

তাহলে পালাচ্ছেন না কেন?

জুলিয়াস নিশো পালাবার চেষ্টা করলেন। পারলেন না। তাঁর পা লোহার শিকলে বাঁধা। পালাবার কোন পথ নেই। জুলিয়াস নিশো স্বপ্নের মধ্যেই চেচিয়ে উঠলেন—আমার পায়ের শিকল কেটে দাও। দয়া করে আমার পায়ের শিকল কেটে দাও। তাঁর ঘুম ভেঙে গেল। ঘড়ি দেখলেন রাত দুটো দশ। চারদিকে গভীর নিশুতি। ঝিঝির ডাক ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই।

ঘামে তাঁর শরীর ভিজে গেছে। তৃষ্ণায় বুক শুকিয়ে কাঠ। স্বপ্নের ঘোর তাঁর এখনো কাটে নি। এরকম ভয়াবহ একটি স্বপ্ন হঠাৎ করে কেন দেখলেন? কী কারণ থাকতে পারে? তিনি ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। মনে-মনে বললেন আমার মন বিক্ষিপ্ত এবং খুব সম্ভব আমি কোনো কারণে অসহায় বোধ করছি। সেই কারণেই আমার অবচেতন মন এরকম একটি ভয়াবহ স্বপ্ন আমাকে দেখিয়েছে।

তিনি বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। পানি খাওয়া দরকার। পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। অথচ জানালার পাশ থেকে সরে আসতে ইচ্ছা করছে না। বাইরে কী চমৎকার তারারা আকাশ! তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে এই আকাশের কোনো মিল নেই। জুলিয়াস নিশো আবার একটি নিঃশ্বাস ফেললেন, আর ঠিক তখন দরজায় নক হল, মৃদুনক। যেন কেউ খুব আলতো করে দরজায় হাত রেখেছে।

কে? মিস্টার জুলিয়াস নিশো? হ্যাঁ।

দরজা খুলুন। আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। রাত-দুপুরে?

হ্যাঁ। আপনার পরিচয় জানতে পারি? দরজা খুলুন।

তিনি দরজা খুললেন। যে-লোকটিকে তিনি দেখলেন, তার গায়ে সামরিক পোশক। কাঁধের ব্যাজে দুটি আড়াআড়ি বর্শা। জুলিয়াস নিশোলোকটির পদবী ঠিক বুঝতে পারলেন না। জায়ার সেনাবাহিনীর চিহ্ন তিনি এখন ঠিক বুঝতে পারেন না।

আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আমি অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু কোনো উপায় নেই। আপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে।

কোথায়?

আমি জানি না, কোথায়।

জুলিয়াস নিশো ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। রাত আড়াইটায় সেনাবাহিনীর এক জন অফিসার তাঁর মতো এক জন অসুস্থ বৃদ্ধের ঘুম ভাঙিয়ে বলবেআপনাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে? এবং তিনি জানতে পারবেন না, কোথায়? জুলিয়াস নিশা হালকা গলায় বললেন, কোথায় যেতে হবে?

আমি জানি না মিঃ নিশো।

জানলেও তুমি বলতে না। তুমি করে বলছি, কিছু মনে করছ না তো?

আমি কিছুই মনে করি নি।

সঙ্গে ব্যবহারিক জিনিসপত্র নেব?

কিছুই নেবার প্রয়োজন নেই, শুধু আপনার ওষুধগুলি নিয়ে নিন।

জুলিয়াস নিশো মৃদু স্বরে বললেন, যে-মেয়েটি আমার দেখাশোনা করে, তার কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই। আমার মনে হয় আমি আর ফিরে আসব না। মনে হচ্ছে, এটা ওয়ান ওয়ে জার্নি।

মিঃ নিশো, কারো কাছ থেকে বিদায় নেবার মতো সময় আমাদের নেই।

মেয়েটিকে আমি নিজ কন্যার মতো দেখেছি।

লোকটির মুখের একটি পেশিও বদলাল না। জুলিয়াস নিশো মনে-মনে তার প্রশংসা করলেন। লোকটি ভালো সৈনিক।

আমি যদি ওর জন্যে কোন উপহার রেখে যাই, সেটা কি ওর হাতে পৌঁছবে?

নিশ্চয় পৌঁছবে।

তুমি কথা দিচ্ছ?

হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি। যা করবার তাড়াতাড়ি করুন।

তিনি একটি খামে কয়েকটি নোট ভরলেনখামের ওপর গোটাগোটা করে লিখলেন—ক্যারি, যা ছিল, তোমাকে দিয়ে যাচ্ছি। এটাকায় তুমি তোমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সুইজারল্যান্ড থেকে ঘুরে এসো। আমার বন্দিজীবনের শেষ কটি দিন তোমার ভালবাসায় সুস্থ হয়েছিল। পরম করুণাময় ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।

নোটটি তাঁর পছন্দ হল না। তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন না। কাজেই ঈশ্বর শব্দটি ব্যবহার করা ঠিক হয় নি।

অফিসারটি বলল, দেরি হচ্ছে। আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।

জুলিয়াস নিশো বললেন, তোমার নাম জানতে পারি?

আমার নাম জানার প্রয়োজন আছে কি? আছে। একটি পশু অন্য একটি পশুকে নাম ধরে ডাকে না। কিন্তু এক জন মানুষ অন্য একটি মানুষকে নাম ধরে ডাকতে চায়।

আমার নাম মার্কটল।

মাৰ্কটল, এই খামটি তুমি মেয়েটিকে দেবে। এখানে কিছু ইউএস ডলার আছে। এবং তুমি আমার হয়ে মেয়েটির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করবে। চল, এখন যাওয়া যাক।

আপনি গরম কিছু পরে নিন, বাইরে প্রচণ্ড শীত।

ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁদের প্রায় সত্তর গজের মত হাঁটতে হল। কনকনে শীতের বাতাস বইছে। চিল ফেক্টার অনেকখানি নেমে গেছে বোধহয়। কান জমে যাচ্ছে প্রায়। তাঁর কষ্ট হতে লাগল। বয়স হয়েছে। এই বয়সে কষ্ট সহ্য হয় না। বাইরে কোন আলো জ্বলছিল না। চারদিক ঘুঘুটে অন্ধকার। তবু তিনি বুঝতে পারলেন, প্রচুর মিলিটারির আমদানি হয়েছে। মিলিটারি আগেও ছিল, তবে এখন অনেক বেশি। তারা চলাফেরা করছে নিঃশব্দে, তবু টের পাওয়া যাচ্ছে।

মাঠের মতো ফাঁকা জায়গায় একটি আর্মি ট্রান্সপোর্ট হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে। হেলিকপ্টারের লেজের দিকে একটা লাল বাতি জ্বলছে-নিভছে। একচক্ষু দৈত্যের মতো লাগছে হেলিকপ্টারটিকে। নিশো হেলিকপ্টারটির কাছে এসে দাঁড়াতেই তার প্রপেলার ঘুরতে শুরু করল। নিশো অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, এই মাঠটিকেই তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন। অবশ্যি স্বপ্নের মাঠ আরো বিশাল ছিল। এবং এরকম অন্ধকার ছিল না। চাপা এক ধরনের আলো ছিল, যা শুধু স্বপ্নদৃশ্যেই দেখা যায়।  মার্কটল হাত ধরে জুলিয়াস নিশোকে উঠতে সাহায্য করল। নিশো আন্তরিক ভঙ্গিতেই বললেন, ধন্যবাদ, তুমিও কি যাচ্ছ আমার সঙ্গে?

না, আমি যাচ্ছি না। আপনার উপহার আমি যথাসময়ে মেয়েটিকে পৌঁছে দেব। শুভ যাত্রা।

যাত্ৰা কি সত্যি শুভ?

মাৰ্কটল কোনো উত্তর দিল না কিন্তু জুলিয়াস নিশোকে অবাক করে দিয়ে সামরিক কায়দায় একটি স্যালুট দিল। এক জন নির্বাসিত মানুষকে বিদেশি সেনাবাহিনীর এক জন অফিসার কি স্যালুট করে? করে না বোধহয়। নিশো মাকটলের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লেন।

হেলিকপ্টারের ভেতর নরম আলো জ্বলছে। অন্ধকার থেকে আসার জন্যেই হয়তো এই আলোতেও সব পরিষ্কার চোখে পড়ছে। বেঁটেমতো এক লোক নিশোকে বসবার জায়গা দেখিয়ে দিল। অত্যন্ত ভদ্র ভঙ্গিতে বলল, আপনার কি ঠাণ্ডা লাগছে?

হ্যাঁ, লাগছে। এই কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিন। এক্ষুনি গরম কফি দেওয়া হবে। তোমাকে ধন্যবাদ।

আপনি তো মাঝে-মাঝে ধূমপান করেন। এই চুরুটটি টেস্ট করে দেখবেন? হাভানা চুরুট।

তোমাকে আবার ধন্যবাদ।

হেলিকপ্টারের ব্লেড ঘুরতে শুরু করেছে। আকাশে উড়বে। দরজা বন্ধ করা হয়েছে। ককপিটের পাইলট বেতারে নিচু গলায় কী-সব বলছে। নিশোর গা-ঘেঁষে বেঁটে লোকটি দাঁড়িয়ে। নিশো মৃদুস্বরে বললেন, তোমরা কি আমাকে জেনারেল ডোফার হাতে তুলে দিচ্ছ?

হ্যাঁ।

কেন, জানতে পারি?

না, পারেন না। কারণ, আমি জানি না। কারণটি আপনার সরকার এবং জায়ার সরকারের জানার কথা। আমার জানার কথা নয়। আমার দায়িত্ব হচ্ছে আপনাকে ফোর্টনকে পৌঁছে দেওয়া।

জেনারেল ডোফা এখন কোথায় আছেন?

আলজেরিয়াতেই আছেন। দ্বিপাক্ষিক একটি চুক্তির ব্যাপারে তিনি এসেছেন। আজকের খবরের কাগজেই তো আছে। আপনাকে কি খবরের কাগজ দেওয়া হয় না?

না।

আমি আপনাকে খবরের কাগজ দিতে পারি। আমাদের এখানে দি আলজিরিয়া মর্নিং আছে। দেব?

না, দরকার নেই। কিছু জানতে ইচ্ছে করছে না।

জুলিয়াস নিশোকে কফি দেওয়ার পরপরই হেলিকপ্টার আকাশে উড়ল। নিশো কফিতে চুমুক দিয়ে চারদিক দেখতে লাগলেন। ভেতরটা বেশ বড়। তিনি এবং বেটে। লোকটা ছাড়া আরো তিন জন সৈন্য আছে। তারা আটোমেটিক সাব-মেশিনগান হাতে পেছনের দিকে বসে আছে। চোখে চোখ পড়তেই তারা চোখ নামিয়ে নিল।

নিশো ওদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ষাট বছর বয়সের এক জন অথর্ব বৃদ্ধের জন্যে এত সতর্কতার প্রয়োজন কী? হালকা গলায় বললেন, তোমরা তোমাদের অস্ত্রশস্ত্র নামিয়ে রেখে কফি খাও। আমি পাব না। হেলিকপ্টার থেকে পালাবার কৌশল আমার জানা নেই।

সৈন্য তিন জন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বেঁটে অফিসারটি বলল, মিঃ জুলিয়াস নিশো, আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে শ্রদ্ধা করি। আমি আপনার এক জন বিশেষ ভক্ত। কিন্তু……..

তিনি হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিয়ে সোহেলি ভাষায় ছোট্ট একটা কবিতা আবৃত্তি করলেন। সঙ্গে-সঙ্গেই তা ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন। কবিতাটির ভাবার্থ হচ্ছে —

হৃদয় যখন হৃদয়কে বুঝতে না পারে তখনি ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়।

অফিসারটি অস্বস্তিতে কপালের ঘাম মুছল। নিশো বললেন, তোমার নাম এখন জানা হয় নি। তুমি আমার নাম জান। আমার অধিকার আছে তোমার নাম জানার।

আপনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। আপনার নাম সবাই জানে। আমি একজন অখ্যাত লেফটেন্যান্ট কর্নেল।

আমি কি এই অখ্যাত লেফটেন্যান্ট কর্নেলের নাম জানতে পারি?

স্যার, আমার নাম পেয়েরেন। হোসেন পেয়েরেন।

পেয়েরেন।

বলুন স্যার।

তুমি কি বলতে পার আমাকে হত্যা করা হবে কি না?

মৃত্যুর কথা একমাত্র ঈশ্বরই বলতে পারেন।

জুলিয়াস নিশো চাপাস্বরে হাসলেন। হাসতে-হাসতে বললেন, ঈশ্বর নিয়ে আমি চিন্তা করি না। আমার চিন্তা মানুষদের নিয়ে।

পেয়েরেন চুপ করে রইল। হেলিকপ্টারের পাইলট একটি সাংকেতিক বার্তা পাঠাল—কালো পাখি তার নীড়ে। এই সংকেতের অর্থ হচ্ছে—সব ঠিকমত এগুচ্ছে।

নিশো চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, বাতি নিভিয়ে দাও। চোখে আলো লাগছে। আমি ঘুমুবার চেষ্টা করব। কে জানে এটাই হয়তো আমার শেষ ঘুম।

বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। ইঞ্জিনের একঘেয়ে হুম্ হুম্ শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। চারদিকে বিপুল অন্ধকার। হেলিকপ্টার উড়ে চলেছে। আফ্রিকার চিরসবুজ অরণ্যের ওপর দিয়ে।

জুলিয়াস নিশে ঘুমুতে চেষ্টা করছেন। কালোসোহেলি আফ্রিকানদের নেতাপ্রবাদপুরুষ জুলিয়াস নিশো। মুকুটহীন সম্রাট।

কিছু কিছু অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ আছে

কিছু কিছু অত্যন্ত বুদ্ধিমান মানুষ আছে, যাদের বোকার মত দেখায়। জেনারেল ডোফা সেরকম এক মানুষ। বিশালবপু বৃষস্কন্ধ ব্যক্তি। সামনের পাটির দাঁত অনেকখানি বের হয়ে আছে। মুখে দাড়ি-গোঁফের চিহ্নও নেই। নিচের ঠোঁট ঘেঁষে একটি গভীর ক্ষতচিহ্ন নেমে গেছে, যার জন্যে জেনারেল ডোফার মুখ সবসময় হাসি-হাসি মনে হয়।

এই লোকটির কাজকর্ম ঘড়ি-ধরা। রাত সাড়ে দশটায় ঘুমুতে যান। ভোর পাঁচটার মধ্যে জেগে ওঠেন। ছটা না-বাজা পর্যন্ত জগিং করেন। এই এক ঘন্টায় দশ থেকে পনের মাইল রাস্তা দৌড়ানোর পর প্রাতঃকালীন স্নান সারেন। সে একটি দর্শনীয় ব্যাপার। ঘোড়া যেভাবে দলাইমলাই করা হয় সেভাবে দুজন মানুষ তাঁকে দলাইমলাই করতে থাকে। এর ফাঁকে ফাঁকে বরফশীতল জল বালতি-বালতি তাঁর মাথায় ঢালা হয়। স্নানের বিশাল পর্বটি সমাধা হয় চেয়ারে বসে। বাথটাব, হট শাওয়ার বা স্টিমবাথজাতীয় আধুনিক স্নানের প্রক্রিয়া এই আফ্রিকান জেনারেলকে মোটও আকর্ষণ করতে পারে নি।

আজ তাঁর রুটিনের ব্যতিক্রম হয়েছে। তিনি সারা রাত এক ফোঁটাও ঘুমোন নি। একটি বিশেষ খবরের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। ভোর পাঁচটা সাতাশ মিনিটে তাঁর এডিসি এসে জানাল, জায়ার হেলিকপ্টার নির্বিঘ্নে ফোটনকে অবতরণ করেছে, এবং পূর্ব পরিকল্পনামত জুলিয়াস নিশোর পরিচয় গোপন আছে। ফোর্টের দু জনমাত্র ব্যক্তি এই পরিচয় জানেন, এক জন ফোর্টের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার অন্যজন কারাধ্যক্ষ মাওয়া। জেনারেল ডোফা শীতল স্বরে বললেন, অন্য কেউ জুলিয়াস নিশোর সংবাদ জানে না, এই সম্পর্কে তুমি কত ভাগ নিশ্চিত?

এক শ ভাগ স্যার। জলিয়াস নিশোকে তাঁর সেলে নেওয়া হয়েছে। সেই সেলের আশেপাশে কারাধ্যক্ষ মাওয়া ছাড়া আর কেউ যেতে পারবে না, এই মর্মে নির্দেশ জারি করা হয়েছে।

সেলটি পাহারা দিচ্ছে কারা?

আপনার নির্দেশমতই ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি রেজিমেন্টের ওপর বন্দির নিরাপত্তার ভার দেওয়া হয়েছে।

জেনারেল ডোফা উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, কৌতূহলী সৈন্যরা বন্দির পরিচয় জানতে আগ্রহী হবে। হবে না?

হয়তো হবে। কিন্তু স্যার, প্রেসিডেন্টের সিকিউরিটি রেজিমেন্টের জোয়ানদের কৌতূহল কম।

তা ঠিক। জুলিয়াস নিশোর শরীর কেমন?

একটু দুর্বল। কিন্তু শরীর ভালোই আছে।

তাঁর খাওয়াদাওয়া, অষুধপত্র-এ সমস্ত ব্যাপারগুলির প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তো?

হয়েছে। আপনার নির্দেশের কথা আমি মাওয়াকে বলেছি।

ভালো। কফি দিতে বল।

ডোফা পরপর দু কাপ কফি খেলেন। জায়ার পররাষ্ট্র দপ্তরের সচিবকে ডেকে পাঠালেন। তিনটি ছোট-ঘোট চিঠি লিখলেন। জায়ারে অবস্থিত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তাঁর একটি জরুরি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করবার নির্দেশ দিলেন। খানিকক্ষণ নীরবে ধূমপান করবার পর এডিসিকে আবার ডেকে পাঠালেন।

তুমি নিশ্চয়ই জান, আজ বেলা ১০টায় জায়ার বেতার থেকে জুলিয়াস নিশোর মৃত্যুসংবাদ প্রচার করা হবে?

জানি স্যার। কিন্তু আজ দশটায় প্রচার করা হবে সেটা জানতাম না।

এগারটায় মোরান্ডা বেতার থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হবে। সেখানেই বলা হবে এই বৰ্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও দার্শনিকের মৃত্যুতে আমি, জেনারেল ডোফা, তিন দিনব্যাপী রাষ্ট্ৰীয় শোক ঘোষণা করেছি। এডিসি কিছু বলল না। তার মুখ ভাবলেশহীন। ডোফা বললেন, বেলা বারটায় একটি হেলিকপ্টার জুলিয়াস নিশোর শবাধার নিয়ে মোরান্ডায় পৌঁছবে, এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে।

সেই শবাধারে কোনো শব থাকবে না?

নিশ্চয় থাকবে। তবে তা জলিয়াস নিশোর নয়। সেই শবাধারের ঢাকনা খোলা হবে না, কাজেই কার শব সেটা নিয়ে কারোর মাথাব্যথা হবার কথা নয়। তুমি কি কিছু বলতে চাও?

না।

তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চাও। বলে ফেল।

স্যার, এতটা ঝামেলার কোন দরকার ছিল কি? সরাসরি জুলিয়াস নিশোর মৃতদেহ নিয়ে গেলেই হত।

না, হত না। জুলিয়াস নিশো কোনো সামান্য ব্যক্তি নন। তাঁর মৃত্যুতে পৃথিবীজুড়েই একটা হৈচৈ হবার কথা। তাতে আমার কিছুই যায়-আসে না। কিন্তু আমি যেটা ভয় পাচ্ছি সেটা হচ্ছে, মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হবার সঙ্গে-সঙ্গে খোদ মোরান্ডাতে একটা গৃহবিপ্লব শুরু হতে পারে।

যদি শুরু হয়, তাহলে কি আপনি দ্বিতীয় বার একটি ঘোষণা দেবেন যে, জুলিয়াস নিশো বেঁচে আছেন?

হ্যাঁ, দেব। কারণ সত্যি-সত্যি গৃহযুদ্ধ শুরু হলে একমাত্ৰ নিশোই তা থামাতে পারবেন।

তার মানে কি এই যে, জুলিয়াস নিশোর মৃত্যুদণ্ড দিতে আপনি ভয় পাচ্ছেন?

হ্যাঁ, পাচ্ছি। জেনারেল ডোফা এই পৃথিবীতে দুটি মানুষকে ভয় পায়। প্রথম জনের নাম জুলিয়াস নিশো।

দ্বিতীয় জন কে?

দ্বিতীয় জনের নাম তোমার না জানলেও চলবে। আমি আবার কফি খাব, তুমি কফি দিতে বল।

সাড়ে ছটা বাজে, আপনার ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে।

তোমাকে কফির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে, সেটা কর। আমি কোনো কথাই দ্বিতীয় বার বলা পছন্দ করি না।

 

ফোর্টনকের যে-সেলটিতে জুলিয়াস নিশোকে রাখা হয়েছে, তার একটি বিশেষ নাম আছে-না-ফেরা ঘর। এ-ঘর থেকে কেউ কখনো ফেরে না। মোরান্ডার খ্যাত। অখ্যাত বহু মানুষ এ-ঘরে ঢুকেছেন, কেউ বেরুতে পারেন নি। জুলিয়াস নিশোর ব্যাপারে একটি ব্যতিক্রম আছে, তিনি দশ বছর আগে এক বার ঢুকেছিলেন। পঞ্চম দিনে গৃহযুদ্ধ বেধে গেল, সপ্তম দিনে জুলিয়াস নিশোকে ঘর থেকে বের করে আনতে হল গৃহযুদ্ধ থামাবার জন্যে। এর মধ্যেই মাউ উপজাতির এক-পঞ্চমাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে। এরা অত্যন্ত সাহসী মানুষ। মোরান্ডা সেনাবাহিনীর ওপর তারা বড় রকমের আঘাত করেই মারা গেল। সেসময় মাউ উপজাতীয়দের মধ্যে বিদ্যুতের মতো যেকথাটি ছড়িয়েছিল, তা হচ্ছে -নিশোর জন্যে একটি প্রাণ দিন। তিনি আবার তা ফিরিয়ে দেবেন। দশ বছর অনেক দীর্ঘ সময়। এই সময়ে অনেক কিছুই বদলে যায়। নিশোও বদলেছেন। সেসময় তাঁর মাথাভর্তি চুল, চোখের দৃষ্টি ছিল তীক্ষ। এখন মাথায় একগাছিও চুল নেই। ভারি চশমা ছাড়া দশ হাত দূরের মানুষটিকে চিনতে পারেন না। তবু কিছু কিছু জিনিস আছে, যা সময়ের সঙ্গে বদলায় না। যেমন স্বভাব। নিশো ঠিক আগের বারের মতোই হাসিমুখে বললেন, সুপ্রভাত, সুপ্ৰভাত।

কারাধ্যক্ষ মাওয়া শুকনো মুখে তাকাল।

তোমার নাম খুব সম্ভব মাওয়া। ঠিক না?

মাওয়া মাথা নাড়ল।

এত বিমর্ষ হয়ে আছ কেন? দশ বছর আগে তোমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। পুরোনো পরিচয়ের সূত্রেও একটু হাস।

মাওয়া হাসির মতো ভঙ্গি করল। নিশো বললেন, তোমারও দেখি বয়স হয়েছে। নিচের পাটির দাঁত পড়ে গেছে। আমার ধারণা, শুধু আমার একারই বয়স হচ্ছে। হা হা হা।

মাওয়া শান্ত স্বরে বলল, আমার দুর্ভাগ্য স্যার, আবার আপনাকে এই অবস্থায় দেখলাম।

নিশো মাওয়ার কথার কোনোরকম গুরুত্ব দিলেন না। সহজভাবেই নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র চাইলেন। শুধুমুখে চাওয়া নয়, লিখিতভাবে চাওয়া। গোটাগোটা অক্ষরে লিখলেন

০ খবরের কাগজ

০ ট্রানজিস্টার রেডিও (মাল্টি ব্যান্ড)

০ লেখার কাগজ

০ চুরুট (ভালো চুরুট)

০ কফি (ইন্সট্যান্ট কফি নয়)

০ জন স্টেইনবেকের সুইট থার্ড ডে উপন্যাস।

০ এ্যারেন পাউলের কালো মানুষদের কবিতা।

মাওয়া বিব্রত ভঙ্গিতে বলল, লেখার কাগজ, চুরুট এবং কফি ছাড়া অন্য কিছুই দেওয়া যাবে না। আপনি স্যার কিছু মনে করবেন না।

আমি কখনো কিছু মনে করি না। বই দুটি কি দেওয়া যাবে?

এই জঙ্গলে বই কোথায় পাব?

ঠিক আছে।

আপনার সেবার জন্যেও কাউকে দেওয়া যাচ্ছে না। একমাত্র আমিই আসব আপনার কাছে। দিনে এক বার আসব।

ভালো, তবে এমন গোমড়া মুখে আসবে না। হাসিমুখে আসবে। আমাদের এমনিতেই অনেক দুঃখ-কষ্ট আছে। এর মধ্যে গোমড়া মুখ দেখতে ইচ্ছা করে না।  যদিও মাওয়া বলেছিল, খবরের কাগজ ট্রানজিস্টার রেডিও এসব কিছুই দেওয়া হবে না, তবুও মাওয়া মধ্যাহ্নকালীন খবরের কিছু আগে একটি ছোট ট্রানজিস্টার নিয়ে নিশোর কাছে গেল—ভয়ার্ত স্বরে বলল, আপনার প্রসঙ্গে একটি খবর প্রচারিত হয়েছে। সকাল এগারটায়। এখনো বোধহয় আবার বলবে। নিশো মুচকি হেসে বললেন, মজার খবর নাকি? মাওয়া কোনো জবাব দিল না।

নিশো মোরান্ডা বেতারের খবর শুনলেন শান্ত ভঙ্গিতে। মাঝেমাঝে চুরুটে টান দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো উত্তেজনা তাঁর আচার-আচরণে প্রকাশ পেল না।

আমরা গভীর দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি—মোরান্ডার প্রিয় মানুষ জুলিয়াস লিম্বানি। নিশো আজ ভোর চার ঘটিকায় আলজেরিয়াতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। জেনারেল ডোফাপরলোকগত জননেতার শোকসন্তপ্ত পরিবারের কাছে এক শোকবাণীতে জানান-জুলিয়াস লিম্বানি নিশোর মৃত্যু শুধু মোরান্ডার নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। জুলিয়াস লিম্বানি নিশোর বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানানোর উদ্দেশে আগামী তিন দিন রাষ্ট্ৰীয় শোকদিবস হিসেবে পালন করা হবে। বিদেশে অবস্থিত মোরান্ডার দূতাবাসগুলিতে এই উপলক্ষে শোক-বই খোলা হয়েছে। রাজধানীর প্রতিটি ভবনে পতাকা অৰ্ধনমিত রাখা হয়েছে।

জুলিয়াস নিশো হালকা স্বরে বললেন, ফোটনকেও কি পতাকা অৰ্ধনমিত? মাওয়া হা-সূচক মাথা নাড়ল। নিশো মাথা নিচু করে হাসলেন।

অল্পবয়সী মেয়েরা সহজেই হতাশ হয়

অনেকক্ষণ ধরে ফোন বাজছে।

ফকনার বসে আছে পাশেই, কিন্তু রিসিভার তুলছে না। কানের পাশে ফোন বাজা একটি বিরক্তিকর ব্যাপার। কিন্তু লোকটি বিরক্ত হচ্ছে না। নির্বিকার ভঙ্গিতে সিগারেট ফুকছে। মাঝেমাঝে ভুরু কোঁচকাচ্ছে, যা থেকে মনে হতে পারে কোনো–একটি বিষয় নিয়ে সে চিন্তিত।

হার্ভি ফকনার হচ্ছে সেই জাতীয় লোক, যাদের বয়স বোঝা যায় না। এর জুলফির সমস্ত চুল পাকা। বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চান্নর মধ্যে হতে পারে। মাঝারি আকৃতির মানুষ। রোদে পোড়া তামাটে গায়ের রঙ। চোখ দুটি অস্বাভাবিক ছোট। বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বলে। সমস্ত মুখাবয়বে একটি ছেলেমানুষি ভাব আছে, তীক্ষ চোখের কারণে যা ্কখনো স্পষ্ট হয় না।

টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। ফকনার রিসিভার এক বার তুলেই নামিয়ে রাখল। যদি ওপক্ষের প্রয়োজন খুব বেশি হয় আবার করবে।

প্রয়োজন বেশ আছে মনে হচ্ছে। আবার টেলিফোন বাজছে। ফকনার সিগারেটে শেষ টান দিয়ে রিসিভার তুলল।

হ্যালো।

হার্ভি ফকনার?

কথা বলছি।

আমি কি আপনার সঙ্গে একটি জরুরি বিষয় নিয়ে আলাপ করতে পারি?

তার আগে আপনার নাম বলুন।

নাম বললে আপনি আমাকে চিনতে পারবেন না।

আমি অপরিচিত কারো সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলি না।

ফকনার নির্বিকার ভঙ্গিতে টেলিফোন নামিয়ে রাখল। এটা প্রায় নিশ্চিত, লোকটি আবার টেলিফোন করবে। প্লাগ খুলে রাখলে কেমন হয়? ফকনার দ্বিতীয় বার সিগারেট ধরিয়ে বাথরুমে ঢুকল। দু দিন শেভ করা হয় নি। গালভর্তি নীলচে দাড়ি। হেমিংওয়ের মতো দাড়ি রাখার একটা পরিকল্পনা ছিল। এখন মনে হচ্ছে সেটা সম্ভব নয়, গাল চুলকাচ্ছে। কিন্তু দাড়িগুলির ওপর একটি মায়া পড়ে গেছে। থাকুক না-হয় কিছুদিন, তারপর দেখা যাবে। ফকনার আয়নায় নিজের ছবির দিকে তাকাল। লোকটিকে চেনা যাচ্ছে না, যেন অপরিচিত কেউ।

টেলিফোন আবার বাজতে শুরু করেছে। বাজুক। তার এমন কোনো ঘনিষ্ঠ মানুষ নেই, যারা এরকম সাত-সকালে ব্যাকুল হয়ে টেলিফোন করবে। ফকনার মনেমনে বলল, আই হ্যাপেন্ড টু বি এ লোনলি ম্যান। কার কবিতা যেন এটা? এ্যান্থনি স্কীলম্যান?

মনে পড়ছে না। স্মৃতিশক্তি আগের মতো নেই। বাথরুমের বেসিনে গত রাতের অভুক্ত খাবারসুদ্ধ প্লেট পড়ে আছে। দূষিত একটা গন্ধ চারদিকে। মেঝেতে তিনটি বিয়ারের খালি ক্যান। লোনলি ম্যান হবার অনেক রকম ঝামেলা।

হেল্পিং হ্যান্ডজাতীয় কাউকে পাওয়া গেলে মন্দ হত না। ঘর পরিষ্কার করে রাখত। বললেই পারকুলেটর চালু করে কফি বানিয়ে আনত। কফির কথা মনে হতেই তার কফির তৃষ্ণা হল। ক্ৰীম, সুগারবিহীন র-কফি। ব্রাজিলিয়ান বিস্ থেকে টাটকা তৈরি, যার গন্ধেই স্নায়ু সতেজ হয়ে ওঠে।

টেলিফোন এখনও বাজছে। ফকনার বিরক্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল—

হ্যালো।

আমি লিজা, লিজা ব্রাউন।

ফকনার চিনতে পারল না। মেয়েদের নাম তার মনে থাকে না।

তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না?

চিনতে পারব না কেন? কেমন আছ লিজা?

তাহলে এমন রাগীরাগী গলায় কথা বলছ কেন?

সকালবেলা ঘুম ভাঙলে আমার খুব মেজাজ খারাপ থাকে তো, তাই।

রাতে খুব ড্রিংক করেছ, তাই না?

খুব না, তিন ক্যান বিয়ার। তিন ক্যান বিয়ার খেলে একটা মৌমাছির নেশা হয়, কিন্তু আমি মৌমাছি না।

তুমি সবসময় এমন মজার-মজার কথা বল কেন?

মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসির শব্দটা চেনা। সি থেকে মেয়েটিকে চেনা যাচ্ছে। নর্থ অ্যাভিন্যুর পিজা পার্লারের মেয়ে। হাসি-রোগ আছে। মেয়েটির। অকারণে আসবে এবং বকবক করবে।

গত সপ্তাহে পিজা এনে দিয়ে গিয়েছিল। অন্যদের মতো প্যাকেট নামিয়ে রেখেই চলে যায় নি। হাসিমুখে বলেছে, পিজা ছাড়া তুমি কিছু খাও না? প্রায়ই তোমাকে পিজা পালারে দেখি। তুমি নিশ্চয়ই ইটালিয়ান নও?

না, ইটালিয়ান নই। পিজাও খুব পছন্দ করি না। সস্তা বলে খাই। আমি একজন দরিদ্র ব্যক্তি।

তোমার ঘর এত নোরা কেন?

ফকনার হেসে ফেলল।

হাসছ কেন? নোংরা ঘর আমার ভালো লাগে না। গা জ্বলে।

আমি মানুষটি খুব পরিষ্কার, কাজেই আমার ঘর নোংরা। যে-সব মানুষের ঘরদুয়ার খুব পরিস্কার, তারা মানুষ হিসেবে নোংরা।

কই, আমি তো মানুষ হিসেবে ভালোই। কিন্তু আমার ঘর তো খুব পরিষ্কার, ঝকঝকে।

আমার থিওরি শুধু ছেলেদের জন্যেই। মেয়েদের জন্যে নয়। মেয়েদের বেলায় উল্টোটা।

তুমি তো খুব চালাক মানুষ।

ফকনার মেয়েটির চেহারা মনে করতে চেষ্টা করল। চেহারা মনে পড়ছে না। তার মানে মনে রাখার মতো চেহারা নয়। সুন্দরী মেয়েদের চেহারা মনে থাকে। এই মেয়েটিকে নিয়ে সে কি কখনো বাইরে খেতে গিয়েছে? মনে হয় গিয়েছে। কারণ সে। কথা বলছে অত্যন্ত পরিচিত ভঙ্গিতে। ফকনার মনে করতে চেষ্টা করল লিজা ব্রাউন নামের কাউকে নিয়ে সে ডেটিং-এ গিয়েছে কি না।

হ্যালো, তুমি কথা বলছ না কেন?

কী বলব?

পিজার অর্ডার দিলে দুপুরবেলা নিয়ে আসতে পারি। আনব?

আনতে পার। তার মানে, তোমার খুব-একটা ইচ্ছা নেই।

ইচ্ছা থাকবে না কেন, ইচ্ছা আছে। সুন্দরী মেয়েদের সামনে বসিয়ে পিজা খেতে আমার ভালোই লাগে।

আমি সুন্দরী, তোমাকে কে বলল?

আমার কাছে পৃথিবীর সব মেয়েকেই সুন্দরী মনে হয়। সবাইকে মনে হয় হেলেন অব ট্রয়।

তুমি এত মজার কথা বল কেন?

আমি মানুষটি মোটেই মজার নই, সেজন্যেই বোধহয়। আচ্ছা শোন, আমি কি কখনো তোমাকে নিয়ে বাইরে খেতেটেতে গিয়েছি?

লিজা ব্রাউন অবাক হয়ে বলল, তোমার মনে নেই?

না।

তার মানে, তুমি অসংখ্য মেয়েকে নিয়ে ডেটিং-এ গেছ?

ফকনার কিছু বলল না। লিজা ব্রাউন বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি আসব দুপুরে।

ফকনার টেলিফোন নামিয়ে বাথরুমে ঢোকামাত্র কলিংবেল বাজল। কলিংবেলের শব্দ থেকে যে এসেছে তার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। যেমন, অল্পবয়েসী মেয়েরা খুব ঘন-ঘন বেল বাজাবে। বৃদ্ধরা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বেশ টিপে ধরে থাকবে, সেই সঙ্গে কড়া নাড়বে। কিন্তু এখন যে বাজাচ্ছে, তার সম্পর্কে কোনো ধারণা করা যাচ্ছে না। ফকনার দরজা খুলল। নীল স্যুট-পরা লম্বা একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বীমা কোম্পানির এজেন্টদের মতো ছিমছাম একটা ব্রীফকেস। লোকটি মেয়েলি গলায় বলল, ভেতরে আসতে পারি?

আসুন।

আমিই কিছুক্ষণ আগে আপনাকে টেলিফোন করেছিলাম। আমার নাম জন হপার।

বসুন। কি ব্যাপার, বলুন।

আমার কিছুক্ষণ সময় লাগবে।

আপনাকে দশ মিনিট সময় দেওয়া হল।

আধ ঘন্টা দিন।

ঠিক আছে, আধ ঘন্টা। কফি?

হ্যাঁ, কফি খেতে পারি।

জন হপার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারদিক দেখতে লাগল, যেন ঘরের অবস্থা থেকে এর বাসিন্দা সম্পর্কে একটা ধারণা করতে চায়।

ফকনার কফির পেয়ালা হাতে করে তার সামনে এসে বসল। ভারি গলায় বলল, হ্যাঁ, এবার বলুন।

আপনি নিশ্চয়ই জেনারেল ডোফাকে চেনেন?

হ্যাঁ, ভালো পরিচয় আছে। আমি তার একটি কমান্ডো গ্রুপকে ট্রেনিং দিয়েছিলাম। গ্রুপের নাম ছিল প্যান্থার।

জুলিয়াস নিশোর সঙ্গে কি আপনার কখনো দেখা হয়েছিল?

না। রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে আমার কোনো উৎসাহ নেই।

জেনারেল ডোফার সঙ্গে কি আপনার কোনোযোগাযোগ আছে?

না। আমি হচ্ছি ভাড়াটে সৈন্য। যে টাকা দেবে তার হয়ে আমি কাজ করব। কাজ শেষ হলে চলে আসব। ডোফার কমান্ডো ইউনিট তৈরি হবার পর চলে এসেছি। আর কোনোযোগাযোগ হয় নি।

আপনি কি গতকালের খবরের কাগজ পড়েছেন?

না, খবরের কাগজ আমি পড়ি না। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে, সে সম্পর্কে আমার কোন উৎসাহ নেই।

তাহলে জুলিয়াস নিশোর মৃত্যুসংবাদ আপনি জানেন না?

তা জানি। টিভি নিউজ দেখেছি। সিবিএস ভালো কভারেজ দিয়েছে।

জুলিয়াস নিশোর মৃত্যু কি আপনার কাছে খুব রহস্যময় মনে হয় না?

দেখুন মিঃ হপার, মৃত্যুর মধ্যে কোনো রহস্য নেই। আপনি কী বলতে চান খোলাখুলি বলুন। আমি স্পষ্ট কথা ভালবাসি।

আপনি কি সাউথ আফ্রিকায় একটি মিশন পরিচালনা করতে পারবেন?

সেটা নির্ভর করে কী পরিমাণ টাকা পাওয়া যাবে তার ওপর এবং মিশনটি কী ধরনের তার ওপর।

জুলিয়াস নিশোকে ফোর্টনক থেকে বের করে আনা।

মৃত একজন মানুষকে বের করে আনার প্রয়োজনটি ধরতে পারলাম না।

জুলিয়াস নিশো বেঁচে আছেন।

ফকনার সিগারেট ধরিয়ে দীর্ঘ টান দিয়ে শুকনো গলায় বলল, মিঃ হপার, আপনি কে?

আমি সিআইএ-র সঙ্গে আছি।

আমার সঙ্গে কী ধরনের কথা বলার দায়িত আপনাকে দেওয়া হয়েছে?

মিশন সম্পর্কে যদি আপনি উৎসাহী হন, তাহলে আপনাকে শিকাগোতে নিয়ে যাবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

কখন যেতে চান?

আমরা এখনি রওনা হতে পারি।

যাবেন কিসে?

আমি সেনাবাহিনীর একটি বিমান নিয়ে এসেছি। একটা টু-সীটার।

আপনি নিজেই চালাবেন?

হ্যাঁ। আমি একজন বৈমানিক। এক সময় বিমানবাহিনীতে ছিলাম।

বিষয়টি খুব জরুরি মনে হচ্ছে?

খুবই জরুরি।

টাকার ব্যাপারে সিআইএ কৃপণতা করবে না বলে আশা করতে পারি।

টাকা কোনো সমস্যা হবে না বলেই মনে করি। মিঃ ফকনার, আপনি তৈরি হয়ে নিন।

আমি তৈরিই আছি। শুধু একটা নোট লিখে দরজায় রেখে যাব।

 

লিজা ব্রাউন পিজার প্যাকেট নিয়ে এসে দরজায় আটকানো নোটটি পড়ল।

লিজা, তুমি খাবারের প্যাকেটটি দরজার বাইরে রেখে যাও। দেখা হল না বলে দুঃখিত। তারপর বল, তুমি কেমন আছ? ফকনার।

পুনশ্চঃ খাবারের বিল আমি এসে মিটিয়ে দেব।

লিজা ব্রাউন বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটির বয়স খুবই অল্প। সাদামাঠা চেহারা। মাথার চুল ছেলেদের মত কাটা বলেই হয়তো সমস্ত চেহারায় একধরনের মায়াকাড়া ভাব এসেছে। সে কি কিছুটা হতাশ হয়েছে? হয়তো-বা। অল্পবয়সী মেয়েরা সহজেই হতাশ হয়।

ফকনার ক্রমেই বিরক্ত হচ্ছিল

ফকনার ক্রমেই বিরক্ত হচ্ছিল।

তাকে এক ঘন্টার ওপর এন্ট্রি-রুমে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এন্ট্রি-রুমটি ছোট। আলো-বাতাস নেই। বসার জন্যে চামড়ার গদিওয়ালা চেয়ারগুলি নোংরা। সমস্ত মেঝেতে সিগারেটের ছাই। এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের এন্ট্রি রুমের এই অবস্থা কেন? নাকি ইচ্ছা করেই এ-রকম রাখা হয়েছে মনের ওপর চাপ ফেলবার জন্যে।

দেড় ঘন্টার মাথায় তাকে জানানো হল, জেনারেল সিমসন ব্যস্ত, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ডাক পড়বে। তাকে একজন কে এসে এক কাপ কফি দিয়ে গেল। ইন্সট্যান্ট কফি—এমন একটা গন্ধ, নাকে গেলেই বমি-বমি ভাব হয়।

জেনারেল সিমসনের অফিসের দরজা খুলল। অল্পবয়সী একটি তরুণ (সম্ভবত জেনারেলের পিএ) এসে বলল, মিঃ ফকনার, আপনি আসুন। সে ফকনারকে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

প্ৰকাণ্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপাশে যে-ছোটখাটো মানুষটি বসে আছেন, তাঁকে ফকনারের মোটেই পছন্দ হল না। জেনারেল সিমসনের বয়স ষাটের কোঠায়। শরীর অশক্ত। মাথায় একগাছিও চুল নেই। মাথা নিচু করে বসে-থাকা মানুষটিকে দেখেই মনে হয় অনেক ধরনের রোগ-ব্যাধি এঁকে ধরে আছে। পিঙ্গল বর্ণের চোখ। তাকানোর ভঙ্গিতে একধরনের অবহেলা আছে, যা অন্যদের মনে হীনমন্য দেয়। জেনারেল সিমসন ভারি স্বরে বললেন, আপনিই ফকনার। কর্নেল ফকনার?

হ্যাঁ।

বসুন।

ফকনার বসল। সে আশা করেছিল জেনারেল সিমসন উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করবেন। তিনি তা করলেন না, যেন ফকনার একজন ছোট পদের অধস্তন কর্মচারী। তার সঙ্গে বাড়তি সৌজন্য দেখানোর প্রয়োজন নেই।

জেনারেল সিমস কিছুক্ষণের জন্যে একটা ফাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। টেলিফোনে কাকে যেন কী-সব বললেন। এও একধরনের চাল। চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো—তুমি অত্যন্ত নগণ্য ব্যক্তি। বসে থাক চুপচাপ। আমার কাজ শেষ হোক, তারপর দেখা যাবে।

সেনাবাহিনী থেকে আপনাকে ডিসচার্জ করা হয়েছিল?

হ্যাঁ।

কেন?

ফকনার ঠাণ্ডা স্বরে বলল, কেন করা হয়েছিল তা নিশ্চয়ই আপনি জানেন। যেপ্রশ্নের উত্তর জানেন, তার উত্তর আবার শোনাবার কারণ দেখি না।

ফকনার সিগারেট ধরাল। সে তার বিরক্তি চেপে রাখতে পারছিল না। জেনারেল সিমসন বললেন, আমি নন-স্মকার, তামাকের গন্ধ আমার সহ্য হয় না। দয়া করে। সিগারেটটি ফেলে দিন।

আমি বরং পাশের ঘরে গিয়ে সিগারেট শেষ করে আসি। ইতোমধ্যে আপনার যা বলবার ঠিকঠাক করে রাখুন। লম্বা ধরনের আলাপ-পরিচয় আমার পছন্দ নয়।

মিঃ ফকনার, লম্বা আলাপ আমারও পছন্দ নয়। আপনি সিগারেট নিয়েই বসুন। আপনাকে কী জন্যে ডাকা হয়েছে আপনি তা জানেন, আশা করতে পারি।

কিছু জানি।

জুলিয়াস নিশোকে ফোর্টনকে আটকে রাখা হয়েছে। তাঁকে এ-মাসের ২৬ কিংবা ২৭ তারিখে হত্যা করা হবে।

তার আগে নয় কেন?

এ-মাস হচ্ছে জেনারেল ডোফার জন্মমাস। জন্মমাসে আফ্রিকানরা হত্যার মতো বড় অপরাধ করে না, ওদের অনেক রকম কুসংস্কার আছে।

মাস তো শেষ হবে ত্রিশ তারিখে। ২৬/২৭ বলছেন কেন?

চান্দ্রমাসের কথা বলছি। আফ্রিকানরা চান্দ্রমাস মেনে চলে।

আপনি নিশ্চিত যে, ২৬/২৭ তারিখের আগে নিশোকে হত্যা করা হবে না?

নব্বই ভাগ নিশ্চিত। দশ ভাগ আনসারটিনিটি সবসময়ই থাকে। এখন আপনিই বলুন, জুলিয়াস নিশোকে এই সময়ের ভেতর কি উদ্ধার করা সম্ভব?

জগতে অসম্ভব বলে কিছু নেই।

এটা একটা ছেলেমানুষি কথা, পৃথিবীতে অনেক কিছুই অসম্ভব। আমার সঙ্গে ভাবাবেগে তাড়িত হয়ে কোনো কথা বলবেন না। আপনি আমাকে বলুন, এই মিশন গ্রহণ করতে আপনি রাজি আছেন?

ফকনার লোকটিকে পছন্দ করতে শুরু করল। এ কাজের লোক। কথাবার্তার ধরন দেখেই টের পাওয়া যাচ্ছে। এবং এর সঙ্গে কথাবার্তা হওয়া উচিত সরাসরি। কথার মারপ্যাচ না-দেখালেও চলবে।

বলুন, রাজি আছেন?

হ্যাঁ বলবার আগে সব ভালোমতো জানতে চাই।

আপনি সবকিছুই জানবেন। আপনার জন্যে কয়েকটি ফাইল তৈরি করা হয়েছে। এগুলি ভালো করে পড়ন। কাল সকাল নটায় আপনি হা কিংবা না বলবেন।

ঠিক আছে, তা বলব।

অবশ্যি আপনি যা বললেই যে আমরা মিশনটি আপনার হাতে দেব, তেমন। কোনো কথা নেই। আমরা অন্য লোকজনদের সঙ্গেও কথাবার্তা বলছি।

ভালো। বাজার যাচাই করে নেওয়াই ভালো।

কর্নেল ফকনার, আপনাকে একটা কথা বলা……

আমাকে কর্নেল বলবেন না। সেনাবাহিনী আমি অনেক আগে ছেড়ে এসেছি।

মিঃ ফকনার, আমি যে-জিনিসটি বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে……

ফাইলগুলো পড়ার আগে আমি আপনার কোনো কথা শুনতে চাই না।

ঠিক আছে।

আমি এখন তাহলে উঠি।

বেশ। দেখা হবে কাল নটায়।

ফকনার ঘর থেকে বেরুবার আগ মুহূর্তে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল, সিআইএ জুলিয়াস নিশোকে উদ্ধার করতে চাচ্ছে কেন?

উনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।

বিখ্যাত ব্যক্তিদের উদ্ধার করার মতো কোনো মহৎ আদর্শ তাদের আছে বলে আমার জানা নেই।

আমরা জেনারেল ডোফার পতন দেখতে চাই। মোরাভার সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্কের প্রয়োজন আছে।

কী প্রয়োজন?

মোরান্ডায় কপারের এবং মলিবডিনামের খনি আছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ মলিবডিনাম আসে মোরান্ডা থেকে। আমরা চাই না সেই মলিবডিনাম আমাদের হাতছাড়া হয়ে অন্য ব্লকে চলে যাক।

আপনার ধারণা, জুলিয়াস নিশো ক্ষমতায় থাকলে মলিবডিনাম বা কপার ভিন্ন ব্লকে যাবে না?

সম্ভবত না। যদি যায়, তাহলে তাঁকেও সরানো হবে। কাউকে সরানো তেমন কঠিন কিছু নয়।

ফকনার তাকিয়ে রইল। তার বেশ মজা লাগছে। আরেকটি সিগারেট ধরাবার ইচ্ছা। হচ্ছে, কিন্তু ঠিক ভরসাও হচ্ছে না। এবার হয়তো সে চেচিয়ে উঠবে।

সাধারণত আমরা কাঁটা দিয়েই কাঁটা তুলি। এক্ষেত্রে তা সম্ভব হচ্ছে না—কারণ, জেনারেল ডোফার সৈন্যবাহিনী তার খুবই অনুরক্ত যে-কারণে নিতান্ত অনিচ্ছায় আমাদের বাইরের সাহায্য নিতে হচ্ছে। ভালো কি মন্দ, সেটা আপনার দেখার কথা নয়। আপনি দেখবেন আপনাকে যথেষ্ট টাকা দেওয়া হয়েছে কি না।

তাও ঠিক। আমি কি এখন যেতে পারি?

পারেন। এন্ট্রি-রুমে অপেক্ষা করুন, আপনাকে ফাইলপত্র দেওয়া হবে। গুড ডে মিঃ ফকনার।

গুড ডে।

জেনারেল সিমসন নন-স্মোকার, সিগারেটের গন্ধ তাঁর সহ্য হয় না-কথাটা ঠিক নয়। ফকনার চলে যাবার পরপরই তিনি একটি চুরুট ধরালেন।

তাঁর হাতে লাল মলাটের একটি ফাইল। ফকনারের ওপর সিক্রেট সার্ভিসের তৈরি একটি গোপন রিপোর্ট। লাল মলাটের ফাইলের অর্থ হচ্ছে, এ একজন অত্যন্ত বিপজ্জনক ব্যক্তি এবং সিক্রেট সার্ভিস তার ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছে। জেনারেল সিমসন চশমার কাঁচ পরিষ্কার করলেন এবং গভীর মনোযোগর সঙ্গে পড়তে শুরু করলেন–

এস ফকনার জুনিয়র

জন্ম : ১৩ই নভেম্বর, ১৯৩০। সেইন্ট জোসেফ হসপিটাল। ফার্গো নর্থ ডেকোটা।

[বাবা-মার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। এস ফকনার আত্মীয়স্বজন সম্পর্কিত খবরাখবর ফাইল নং কগ ৩০২। ৩১১ লপ ৩৩-এ আছে। মাইক্রো ফিল্ম কোড : BCL 3443026-A2]

০ ব্লাড গ্রুপ : O পজিটিভ RH পজিটিভ।

০ সেনাবাহিনী থেকে ডিসচার্জ করা হয় ১৪ই অক্টোবর, ১৯৬৪। ডিসচার্জের কারণ সম্পর্কিত খবরাখবরের মাইক্রো ফিল্ম কোড : BCL 3443025-A2]

০ সাউথ আফ্রিকায় সিআইএর পক্ষে দুটি মিশন পরিচালনা করেন। মিশন দুটির ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট ফাইল নাম্বার কগ ৩০২/৩১১ বস ৩২-এ আছে। মাইক্রো ফিল্ম কোড : BCL3443027-A2] কোনো রকম রাজনৈতিক মতাদর্শ নেই, তবে কিছু উগ্র বামপন্থী বন্ধুবান্ধব আছে। তাঁর বন্ধুবান্ধবদের ওপর একটি রিপোর্ট ফাইল নাম্বার কগ ৩০২/৩১১ বস ৩৪-এ আছে। মাইক্রো ফিল্ম কোড : BCL3443029A2]

০ মোরান্ডায় জেনারেল ডোফার সৈন্যবাহিনীর একজন টেনার হিসেবে কিছুদিন ছিলেন। এই প্রসঙ্গে কোন পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি হয় নি। সংগৃহীত তথ্যাবলী মাইক্রো ফিল্ম কোড: BCL3443029-A2-তে সংরক্ষিত আছে। তথ্যাবলী খুব নির্ভরযোগ্য নয়।)

০ জুয়া খেলতে পছন্দ করেন। মদ্যপান করেন। মেয়েমানুষ ও অর্থের প্রতি অস্বাভাবিক দুর্বলতা আছে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনযাপন পদ্ধতির ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট মাইক্রো ফিল্ম কোড : BCL3443030-A2-তে সংরক্ষিত আছে।

জেনারেল সিমসনের চুরুট নিভে গিয়েছিল। তিনি অনেকটা সময় নিয়ে চুরুট ধরালেন এবং ফকনার প্রসঙ্গে যে-কটি রিপোর্ট তৈরি আছে তার সব কটি আনতে বললেন। তাঁর পিএ বলল, কফি বা অন্য কিছু কি খাবেন?

তিনি তার উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ফকনারকে কেমন লাগল তোমার?

তাঁর সম্পর্কে আমি জানি। উনি একজন ভয়ানক মানুষ।

জেনারেল সিমসন মৃদু হাসলেন, তার অর্থ ঠিক বোঝা গেল না।

ফকনারকে দুটি ফাইল দেওয়া হয়েছে। ফাইল দুটি যে নিয়ে এসেছে তার বয়স খুবই অল্প। লাজুক স্বভাবের একজন। সে বলল, আপনি যদি চান আমি আপনার সঙ্গে থাকতে পারি।

কেন?

ফাইলের অনেক রেফারেন্স হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন না। সেগুলি বুঝিয়ে দিতে পারি। আমার সমস্তই ভালো করে পড়া আছে।

আমি চেষ্টা করব নিজে নিজে বুঝতে।

ফকনার উঠে দাঁড়াল। তরুণ অফিসারটি অবাক হয়ে বলল, আপনি এখন কোথায় যাচ্ছেন?

কোনো-একটি হোটেলে। সস্তায় হোটেল কোথায় পাওয়া যাবে, আছে আশেপাশে?

আছে। কিন্তু আপনি তো কোনো হোটেলে যেতে পারবেন না।

কেন?

আপনার সঙ্গে যে-দুটি ফাইল আছে, সে-দুটি এই ভবনের বাইরে নেওয়া যাবে না।

তার মানে, আজ রাতে আমাকে এখানে থাকতে হবে?

হ্যাঁ। আপনার কোনো রকম অসুবিধা হবে না। আমাদের গেরুমটি চমৎকার।

আর আমি যদি ফাইল পড়তে না চাই। যদি এই মিশন সম্পর্কে উৎসাহী না হই, তাহলে?

তাহলে আপনি চলে যেতে পারেন। তবে আমার মনে হয় আপনি যাবেন না। কারণ আপনি ইদানীং খুব অর্থকষ্টে আছেন।

ফকনার ক্লান্ত স্বরে বলল, নিয়ে চলুন আপনার গেস্টরুমে। প্রচুর হুইস্কির ব্যবস্থা রাখবেন। মাঝেমাঝে মাতাল হতে আমার ভালো লাগে।

আপনার জন্যে হার্ড ডিংক-এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আপনার যদি বিশেষ ধরনের কোনো হুইস্কির প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকে তবে তা বলতে পারেন, ব্যবস্থা করব।

কারোর প্রতি আমার কোন পক্ষপাতিত্ব নেই। পৃথিবীর সমস্ত মদ এবং সমস্ত নারী আমার কাছে একধরনের মনে হয়।

জুলিয়াস নিশোর ঘুম ভাঙল

জুলিয়াস নিশোর ঘুম ভাঙল ভোর পাঁচটায়। তিনি অবশ্যি তা বুঝতে পারলেন না। তাঁর ঘড়িটি নষ্ট হয়ে গেছে। ঘড়ি ছাড়া এখানে সময় বোঝার অন্য কোনো উপায় নেই। মাথার অনেক ওপরে ছোট্ট একটি ভেন্টিলেটার আছে। সেখান থেকে তেমন কোনো আলো আসে না। এলেও তা ধরা যায় না, কারণ ঘরে দিন-রাত্রি দু শ পাওয়ারের একটি বাতি জ্বলে। তিনি বাতিটি রাতের বেলা নিভিয়ে দেবার জন্যে মাওয়াকে বলেছিলেন। মাওয়াবিনীত ভঙ্গিতে বলেছে, কাল থেকে বাতি রাতের বেলা জ্বলবেনা। কিন্তু ঠিকই জ্বলেছে। একই অনুরোধ দ্বিতীয় বার করতে তাঁর ইচ্ছা হয় নি।

মাওয়াকে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। তিনি যা বলেন, সে তাতেই সঙ্গে-সঙ্গেই রাজি হয় কিন্তু রাজি হওয়া পর্যন্তই। একটা ঘড়ির কথা বলেছিলেন, মাওয়া সঙ্গে-সঙ্গে বলেছে, কাল আসার সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসব। তিনি বলেছিলেন, আজ দেওয়া যায় না?

ঠিক আছে স্যার, নিয়ে আসছি। এক ঘন্টার মধ্যে আসব।

তিনি অপেক্ষা করেছেন। সে আসে নি। মানুষ পশু না। তার চরিত্র এমন হবে কেন? ঘড়ি সে দেবে না, এটা স্পষ্ট করে প্রথম বারেই কি বলে দেওয়া যেত না?

জুলিয়াস নিশো ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন। এখন ঠাণ্ডা লাগছে। সূর্য ওপরে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে তাপ বাড়তে থাকবে। বাতাস থাকবে না। অসহনীয় উত্তাপ। তারপর রাতের বেলা আবার শীত নামতে শুরু করবে। সেই শীতও অসহনীয়। আসলে বয়স হয়েছে, এই বয়সে শরীর অশক্ত হয়ে পড়ে। সামান্য শীতও শরীরের হাড়ে গিয়ে বেঁধে।

নিশো বিছানা থেকে নামলেন। মাওয়াকে ধন্যবাদ দিলেন মনে-মনে, কারণ সে একটি কাজ করেছে। লেখার জন্যে টেবিল-চেয়ার দিয়েছে। সময় কাটানোর জন্যে তিনি একটি লেখায় হাত দিয়েছেন। নাম দিয়েছেন কালো মানুষ: সাদা মানুষ। নামটি প্রথম দিন ভালো লেগেছিল, দ্বিতীয় দিনে লাগে নি। দ্বিতীয় দিনে নাম দিলেন—এক কালো মানুষ। সেই নামও এখন পছন্দ হচ্ছে না। তিনি আজ সেই নাম কেটে লিখলেন কালো মানুষ। ঘোট নামই ভালো। কিন্তু লেখা এগুচ্ছে না। তিনি ভেবে রেখেছেন খুব হালকা ধরনের একটি লেখা লিখবেন। নানান রকম রসিকতার মধ্য দিয়ে কালো মানুষের দুঃখ তুলে আনবেন। কিন্তু লেখা ভারিকি ধরনের হয়ে যাচ্ছে।

নিশো কলম হাতে দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। তাঁর ক্ষুধাবোধ হচ্ছে। মাওয়া কখন আসবে কে জানে। গরম এক কাপ কফি খেলে হত।

মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্ৰণাও হচ্ছে। চোখের সামনে দু শ পাওয়ারের বাল্ব নিয়ে ঘুমানো মুশকিল। আজ আরেক বার অনুরোধ করে দেখলে কেমন হয়?

ফোর্টনকের মাঠে সম্ভবত পিটি হচ্ছে। তালে-তালে হাত-পা ফেলার শব্দ হচ্ছে। এই শব্দগুলি শুনতে ভালো লাগে। তিনি দীর্ঘ সময় মন দিয়ে শব্দগুলি শুনলেন। মনেমনে সৈন্যদের তালে-তালে হাত-পা ফেলার দৃশ্যটি দেখতে চেষ্টা করলেন। সারি বেঁধে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পরনে খাকি হাফপ্যান্ট। গায়ে ধবধবে সাদা গেঞ্জি। সূর্যের আলো এসে পড়েছে তাদের ঘামে-ভেজা চকচকে কালো মুখে। কালো রঙের মতো সুন্দর কি কিছু আছে?

তাঁর মাথার যন্ত্রণা ক্রমেই বাড়ছে। তিনি আবার এসে বিছানায় শুলেন। হাত বাড়িয়ে একটি মোটা বই নিলেন। পড়বার জন্যে মাওয়া দিয়ে গিয়েছে। নিতান্তই বাজে বই। একটি কালো ছেলের প্রেমে পড়েছে সাদা মেয়ে। মেয়েটি ছেলের সঙ্গে পালিয়ে গেছে জঙ্গলে। মেয়ের বাবা তাকে ধরবার জন্যে বিরাট সৈন্যবাহিনী নিয়ে বন ঘিরে ফেলেছে। অসম্ভব সব ব্যাপার। পাতায়পাতায় রগরগে সমস্ত বর্ণনা। মেয়েটি ছেলেটিকে চুমু না-খেয়ে সেকেন্ডও থাকতে পারছে না। এবং চুমু খাবার সময় ছেলেটির হাত চলে যাচ্ছে বিশেষ-বিশেষ জায়গায়।

নিশো দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। এ-জাতীয় বই পড়বার বয়স তাঁর নেই। শারীরিক বর্ণনায় তিনি এখন আর উত্তেজনা বোধ করেন না।

মাওয়া যখন ঘরে ঢুকল, তখন নিশো ঘুমুচ্ছেন। তাঁর গা ঈষৎ উষ্ণ। রাতে ঠাণ্ডা লেগেছে। জ্বরজারি হতে পারে। তালা খোলার শব্দে তিনি জেগে উঠে স্বভাবসুলভ সতেজ গলায় বললেন, মাওয়া, সুপ্ৰভাত।

সুপ্রভাত মিঃ নিশো। রাতে ভালো ঘুম হয়েছে?

এই অবস্থাতে ভালোই বলা চলে। অবিশ্যি শেষরাতের দিকে ঠাণ্ডায় কষ্ট পেয়েছি। আরেকটি গরম কম্বলের ব্যবস্থা করা যাবে?

নিশ্চয়ই যাবে। আমি আজ বিকেলেই নিয়ে আসব।

জুলিয়াস নিশো সামান্য হেসে বললেন, তুমি পলিটিশিয়ানদের মতো কথা বল। অনেক কিছুই নিয়ে আসার কথা বল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই আসে না।

মাওয়া গম্ভীর গলায় বলল, কম্বল বিকেলের মধ্যেই পাবেন।

মাথার ওপরে এই বাতি—এটা কি নিভিয়ে রাখা যায়?

এই বাতি রাত নটার পর থেকে জ্বলবে না।

মাওয়া খাবারের প্যাকেট টেবিলে সাজিয়ে রাখল। ফ্রাঙ্কে কফিও আছে। ভালো কফি। খাবারগুলি যত্ন করে তৈরি করা। সৈন্য বা কয়েদিদের সাধারণ খাবার নয়।

মাওয়া, এই খাবারগুলি কে রান্না করে?

আমার স্ত্রী ও বড় মেয়ে।

চমৎকার রান্না। তাদের আমার ধন্যবাদ দিও।

ধন্যবাদ দেওয়া যাবে না। কারণ, আপনি যে এখানে আছেন, এটা তাদের জানানো যাবে না।

যখন আমি এখানে থাকব না, কিংবা এই পৃথিবীতেই থাকব না, তখন দিও। তাদের বলবে, আমি সারা জীবন খাওয়াদাওয়া নিয়ে কষ্ট করেছি, কিন্তু জীবনের শেষ দিনগুলিতে খুব ভালো খানাপিনা করেছি।

আমি বলব।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মাওয়া ওঠার উপক্রম করল। নিশো বললেন, বাইরের কী খবর? আমার মৃত্যুসংবাদ দেশবাসী কীভাবে নিয়েছে?

আমি জানি না কীভাবে নিয়েছে, বাইরের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। ফোর্টনক শহর থেকে অনেক দূরে।

তা অবশ্যি দূরে। তোমার স্ত্রী, কন্যা? ওরা খবরটা কীভাবে নিয়েছে?

জানি না, মিঃ নিশো। আমি আমার স্ত্রী-কন্যার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করি না। রাজনীতি মেয়েদের বিষয় নয়।

রাজনীতি কোথায়, তুমি কথা বলবে একটি মানুষের মৃত্যু নিয়ে!

আমি কথা কম বলি।

আমরা এমন একটি দেশে বাস করি, যেখানে কথা কম বলাটাই বড় মানবিক গুণ বলে ধরা হয়। অথচ আমি সারা জীবন স্বপ্ন দেখেছি একটি দেশের, যেখানে আমরা সবাই ইচ্ছেমতো বকবক করতে পারব।

মাওয়া আর দাঁড়াল না। নিশো গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। মাওয়া কম্বল নিয়ে এল না। দু শ পাওয়ারের বাতি জ্বলতেই থাকল।

জেনারেল সিমসন

জেনারেল সিমসন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ফকনারের কাছ থেকে পাওয়া এ জবাব তিনি যেন আশা করেন নি। তিনি চশমা খুলে চশমার কাচ পরিষ্কার করলেন। টেবিলে রাখা পানির গ্লাসে ছোট্ট একটি চুমুক দিয় মৃদুস্বরে বললেন, আপনি সত্যিসত্যি মিশনটির ব্যাপারে আগ্রহী নন?

না।

আপনি কি সমস্ত কাগজপত্র ভালোমতো দেখেছেন?

দেখেছি বলেই বলছি, এটা অসম্ভব। ফোর্টনকে আক্রমণ করা মাত্রই জেনারেল ডোফার প্রেসিডেন্ট ব্যাটালিয়ানে খবর পৌঁছবে। এরা হেলিকপ্টার নিয়ে দশ মিনিটের ভেতরে চলে আসতে পারবে। স্থলপথে আসতে ওদের লাগবে খুব বেশি হলে দেড় ঘণ্টা। ওদের রুখতে আমার দরকার পুরোপুরি একটা সৈন্যবাহিনী। আর্টিলারি সাপোর্ট।

জেনারেল সিমসন মৃদুস্বরে বললেন, দেড় ঘণ্টার মধ্যেই যাদি কাজ সেরে আপনারা আকাশে উড়তে পারেন, তাহলে কেমন হয়?

কীভাবে উড়ব?

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তৈরি একটা পুরোনো ধরনের রানওয়ে আছে। সেখানে দেড় ঘন্টার ভেতর একটা বিমান পাঠাতে পারি।

রানওয়ে ফোর্টনক থেকে কত দূরে?

পঞ্চাশ মাইলের কম। সত্তর কিলোমিটার।

সম্ভব নয়। ডোফা নির্বোধ নয়। প্রথমেই সে রানওয়ে দখল করবার জন্যে সৈন্য পাঠাবে।

জেনারেল সিমসন মৃদুস্বরে বললেন, আপনাকে আমি যথেষ্ট সাহসী ভেবেছিলাম।

আমি সাহসী। সাহসী মানেই কিন্তু নির্বোধ নয়। আচ্ছা, আমি উঠি।

একটু বসুন। এক মিনিট।

ফকনার বসল। বিরক্ত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরাল।

সিমসন কিছুই বলছেন না। শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এক মিনিট অপেক্ষা করতে বলার কারণ ধরা যাচ্ছে না।

এক মিনিট হয়ে গেছে মিঃ সিমসন। সিমসন নড়েচড়ে বসলেন। ভারি গলায় বললেন, মিশনটি আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। আপনি না করলে অন্য কাউকে দিয়ে করাতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, আপনি এটি পরিচালনা করুন। আপনার যত রকম সাহায্য-সহযোগিতা দরকার, আপনি সব পাবেন।

আমরা আপনাকে এবং আপনার সঙ্গী-সাথীকে রাতের বেলা ফোর্টনকের পাঁচ মাইলের ভেতর নামিয়ে দেব এবং বেরিয়ে আসবার জন্যে পুরানো রানওয়েতে বিমান থাকবে। যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করা ছাড়াও আপনার প্রাপ্য টাকার পুরোটাই আপনাকে অগ্রিম দেওয়া হবে। টাকার পরিমাণ শুনলে আপনার ভালো লাগবে।

কত টাকা?

এক মিলিয়ন ইউএস ডলার। অনেক টাকা!

এক মিলিয়ন ইউএস ডলার তো আমি একাই নেব। আমার সঙ্গী-সাথীরা কী পাবে?

কজন থাকবে আপনার দলে?

তিন জন অফিসার, পাঁচ জন এনসিও এবং পঞ্চাশ জন কমান্ডো।

এদের জন্যে কত চান আপনি?

দু মিলিয়ন ইউএস ডলার।

আমি রাজি আছি।

আমি যে-তিন জন অফিসার নেব, তাদের একজনের নাম জনাথন। এন্ড্রু জনাথন। সে শিকাগোতে আত্মগোপন করে আছে। আপনারা তাকে খুঁজে বের করবেন এবং আমার কাছে পৌঁছে দেবেন।

সিমসন তাকিয়ে রইলেন, কিছু বললেন না।

আমার দ্বিতীয় অফিসার ইউটার জেলে বন্দি। তাকেও আমার কাছে পৌঁছে দেবেন।

তা কী করে সম্ভব! এক জন কয়েদিকে বের করে আপনার সঙ্গে দেওয়া চলে না। আপনি অদ্ভুত কথা বলছেন!

আমি আমার শর্তগুলির কথা বলছি। তৃতীয় শর্ত হচ্ছে, আমার দলের ট্রেনিংয়ের জন্য প্রথম শ্রেণীর সুযোগ-সুবিধা আছে, এমন একটি জায়গা দরকার। গামাল হাসিম নামে আরো এক জন ব্যবসায়ীকে আমার প্রয়োজন। এবং…..

আপনার সব প্রয়োজনের কথাই আমি শুনতে রাজি আছি কিন্তু সাজাপ্রাপ্ত এক কয়েদিকে এর জন্যে বের করে আনা যায় না।

সিআইএ অনেক কিছু করতে পারে বলে শুনেছি।

আপনি ভুল শুনেছেন।

মোরান্ডায় আমি আমার দলবল নিয়ে এখনি নামতে পারি, যখন আমি জানব ঐ কয়েদি আমর পাশে আছে।

তার নাম কি?

বেন ওয়াটসন।

বেন ওয়াটসন জুনিয়র?

হ্যাঁ।

তার সঙ্গে আপনার পরিচয়ের সূত্রটি কি?

এই প্রশ্ন কি অবান্তর নয় জেনারেল?

হ্যাঁ, অবান্তর। এক জন কয়েদিকে মিশনে পাঠানো আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পক্ষেও সম্ভব নয়।

ফকনার উঠে দাঁড়াল। শীতল স্বরে বলল, আমাকে যেভাবে নিয়ে এসেছেন ঠিক সেভাবে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থাও করবেন, এটা আশা করতে পারি নিশ্চয়ই।

নিশ্চয়ই আশা করতে পারেন।

জেনারেল সিমসন বেল টিপলেন এবং যান্ত্রিক স্বরে বললেন, আপনার সহযোগিতার জন্যে ধন্যবাদ। আপনাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, বিদায়ের সময় জেনারেল সিমসন উঠে দাঁড়ালেন এবং হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। কোমল স্বরে বললেন, ভালো থাকবেন মিঃ ফকনার।

প্লেনে ওঠার আগে-আগে জেনারেল সিমসনের এডিসি তার হাতে একটা মোটা খাম দিয়ে বলল, জেনারেল আপনাকে দিয়েছেন।

কী আছে এর মধ্যে?

আমি জানি না। জেনারেল বলেছেন কাগজপত্রগুলি মন দিয়ে পড়তে।

কাগজপত্র বিশেষ কিছু না। একটি চেক, যেখানে টাকার অঙ্ক লেখা নেই। এবং দু লাইনের একটি নোট।

আমি বেন ওয়াটসনের ব্যাপারে চেষ্টা করছি।

এন্ড্রু জনাথন

এন্ড্রু জনাথন

বয়স : ৪৩।

উচ্চতা : ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি।

ওজন : এক শ পনের পাউন্ড।

চোখ; নীল বর্ণ।

চুল: পিঙ্গল।

জন্মস্থান : ক্যানসাস সিটি।

জনাথন লোকটি ছোটখাটো। ঈগলের মতো তীক্ষ চোখ ছাড়া তার চেহারায় অন্য কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। তাকে দেখলেই মনে হয় অ্যানিমিয়ায় ভুগছে। দুর্বল এবং অসুস্থ একটি ভাব আছে তার মধ্যে। ইদানীং সে ডান পা একটু টেনে-টেনে হাঁটছে। আর্থরাইটিসের প্রথম ইশারা হতে পারে। তাদের পরিবারের আর্থরাইটিসের ইতিহাস আছে।

লোকটি কথা বলে কম। কাজকর্ম বিশেষ কিছু করে না। থাকে ওয়াশিংটনের পশ্চিমের একটা হোটলে। মাসে এক বার সিটি ব্যাঙ্ক থেকে পাঁচ শ ত্রিশ ডলার নিয়ে এসে হোটেলের বিল মেটায়। মাসে দু বার যায় সিঙ্গেলস ক্লাবে,উদ্দেশ্য কোনো মেয়ের সঙ্গ পাওয়া যায় কি না। উদ্দেশ্য সফল হয় না কোনো সময়ই। মেয়েরা তেতাল্লিশ বছরের কোনো মানুষের ব্যাপারে তেমন উৎসাহ বোধ করে না। তার চেয়েও বড় কথা জনাথন নাচ জানে না। কাজেই কোনো মেয়েকে গিয়ে বলতে পারে নাতুমি কি আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ নাচবে?

অবশ্যি তার সময় সেজন্যে যে খুব খারাপ কাটে তা নয়। সমুদ্রের পারে প্রতিদিনই সে বেশ কিছুটা সময় কাটায়। কয়েকটা বিয়ার খায়। কোনো কোনো দিন মুভি দেখে, তারপর ফিরে আসে নিজের ঘরে। প্রতি রাতেই তার ভালো ঘুম হয়। জীবন থেকে অবসর নেওয়া একজন মানুষ, যার জীবনে তেমন কোনো উত্তেজনা নেই। উত্তেজনার প্রয়োজন নেই।

এক দিন দুপুর আড়াইটার দিকে এই লোকটি হঠাৎ গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল। তার সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে হোটেলের বিল মিটিয়ে দিল। হোটেলের মালিক অবাক হয়ে বলল, অসময়ে চলে যাচ্ছেন।

জনাথন হাসল।

আবার আসবেন।

আসব। নিশ্চয় আসব।

জনাথনের গায়ে একটি সামার কোট। মাথায় ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সাদা টুপি। হাতে রেক্সিনের একটি হ্যান্ডব্যাগ। সে হেঁটে-হেঁটে গেল গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশনে। সুটকেস বুক বল নিউ অরলিংটনের ঠিকানায়।

ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে গেল ফ্লাওয়ার শপে। ফুলের দোকানের ছোট্ট মেয়েটিকে বলল, টকটকে লাল রঙের তিন ডজন গোলাপ দিতে পার? সবচেয়ে বড় সাইজ। মেয়েটি হেসে বলল, বিশেষ কোনো উৎসব বুঝি?

হ্যাঁ, খুব বড় উৎসব।

তোড়া বানিয়ে দেব?

দাও।

দাম কিন্তু অনেক পড়বে। এগুলি এসেছে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে।

আমি ক্যাশ পেমেন্ট করব। দামের জন্যে অসুবিধা নেই।

তুমি নিজেই নিয়ে যাবে?

হ্যাঁ, আমি নিজেই নিয়ে যাব। জনাথন কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল, ফুলের সঙ্গে আর কী দেওয়া যায়, বল তো?

কাকে দিচ্ছ?

তা বলা যাবে না।

আমার মনে হয় ফুলগুলিই যথেষ্ট। চমৎকার ফুল! আমাকে কেউ কোনোদিন এতগুলি ফুল একসঙ্গে দেয় নি।

জনাথন চলে গেল ফলের দোকানে। এক ঝুড়ি আপেল কিনল। টকটকে লাল রঙের আপেল। বড় সুন্দর।

ফুল এবং ফলের ঝুড়ি হাতে সে বেলা চারটার দিকে সমুদ্রের পারে উপস্থিত হল। এই জায়গাটি তার খুব ভালো চেনা। গত ছ মাসে প্রতি দিন এক বার করে এসেছে। চষে বেড়িয়েছে চারদিক। এটা কি উদ্দেশ্যমূলক ছিল? হয়তো বা। জনাথনের চোখে-মুখে এখন আর আগের আলস্য নেই। চোখ ঝকঝক করছে। ঈগল পাখির দৃষ্টি। সে এগিয়ে গেল সাউথ পয়েন্ট টার্মিনালে। বেশ কয়েকটি শখের প্রমোদতরী ভিড় করে আছে। সুন্দর-সুন্দর নাম সুইট সিক্সটিন, দি ড্রিম, দি রেড রিবন। এরা সন্ধ্যার আগে-আগে ছেড়ে যাবে। রাত দশটা-এগারটার দিকে ফিরে আসবে।

জনাথন যে-প্ৰমোদতরীটির কাছে এসে দাঁড়াল, তার নাম দি ফার ইস্ট। চমৎকার দোতলা একটি ছিমছাম জলযান। ধবধবে সাদা রঙ। নীল জলের সঙ্গে এত চমৎকার মানিয়েছে।

এখানে কি পল ভিন্তানি আছেন?

কেন? আমার একটু প্রয়োজন ছিল।

কী প্রয়োজন?

আমি তাঁর জন্যে কিছু উপহার নিয়ে এসেছিলাম।

জনাথন তার উপহার দেখাল এবং বিনীত ভঙ্গিতে হাসল। মৃদুস্বরে বলল, একসময় তাঁর কাছ থেকে উপকার পেয়েছিলাম, সেই জন্যে আসা।

উপহার আমার কাছে দাও নিয়ে যাচ্ছি। নাম কী বল। পল ভিন্তানিকে বলব।

আমি একজন অভাজন ব্যক্তি। নাম বললে চিনতে পারবেন না। দেখলে হয়তো চিনতে পারতেন।

না, তুমি যেতে পারবে না। নিরাপত্তার একটা ব্যাপার আছে।

আপনি আমাকে ভালো করে তল্লাশি করে দেখুন।

দেখাদেখির দরকার নেই। দাও, উপহারগুলি দাও। কী নাম বলব?

নাম বলতে হবে না। বলবেন, এক জন দরিদ্র ভক্ত।

লোকটি ফুল এবং আপেল নিয়ে চলে গেল। জনাথন হতাশ মুখে দাঁড়িয়ে রইল নিচে। তার মনে ক্ষীণ আশা, এক্ষুনি তার ডাক পড়বে। এতগুলি চমৎকার ফুল কে দিয়েছে, কী জন্যে দিয়েছে, এটা জানার আগ্রহ সবারই হবে। পল ভিন্তানিরও হওয়া উচিত।

এবং তাই হল, জনাথনকে ভেতরে যেতে বলা হল।

পল ভিন্তানির বয়স ত্রিশের কম, কিন্তু দেখাচ্ছে চল্লিশের মত। তার কোমর জড়িয়ে যে-মেয়েটি বসে আছে, তার বয়স সতেরর বেশি হবে না। এমন একজন রূপসী মেয়েকে দেখতে পাওয়া ভাগ্যের কথা। পল ভিন্তানি প্রচুর মদ্যপানের কারণে চোখ খুলে রাখতে পারছে না। কথা বলল মেয়েটি, এত চমৎকার গোলাপগুলি তুমি পলকে দিয়ে?

জনাথন বিনয়ে মাথা নিচু করে ফেলল।

এত সুন্দর ফুল দিতে হয় প্রেমিকাকে। তোমার বোধহয় প্রেমিকা নেই।

মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে লাগল। সেও মনে হয় নেশাগ্রস্ত।

ভিন্তানি থেমে-থেমে বলল, তোমাকে চিনতে পারছি না।

আমার নাম জনাথন।

জনাথন, ফুলের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। এখন যেতে পার। আর তোমার যদি কোনো আবদার থাকে, পরে এসে বলবে। কিছু-একটা তোমার মনে আছে। বিনা কারণে কেউ ফুল দেয় না। হা-হা-হা।

ভিন্তানি হাতের ইশারা করে জনাথনকে চলে যেতে বলল। জনাথন একটু পিছিয়ে গিয়ে কেবিনের দরজা ভেজিয়ে দিল।

ভিন্তানি, আমাকে তোমার চেনার কথা। আমার নাম এন্ড্রু জনাথন। জার্মানিতে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। আমাকে এত সহজে ভুলে যাওয়া ঠিক না।

ভিন্তানির নেশা কেটে যেতে শুরু করল। মেয়েটি তাকাচ্ছে অবাক হয়ে। সে উঠে দাঁড়াবে কি দাঁড়াবে না ঠিক করে উঠতে পারছে না। জনাথন মেয়েটির দিকে ঠাণ্ডা গলায় বলল, নড়াচড়া করবে না। কোনো রকম সাড়াশব্দও করবে না। আমার সঙ্গে একটি লুগার থারটি সিক্স পিস্তল আছে। পিস্তল চালনায় আমার দক্ষতা তোমার বন্ধু মিঃ ভিন্তানি ভালোই জানেন। তাই না মিঃ ভিন্তানি?

ভিন্তানি শুকনো গলায় বলল, তুমি কী চাও?

তেমন কিছু চাই না। আমি কিছু কোকেন এনেছি তোমার জন্য। এইটি তুমি আমার সামনে খাবে। আমি দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখব। এটা আমার অনেক দিনের শখ।

ভিন্তানির নেশা পুরোপুরি কেটে গেল। তার কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। জনাথন তার সামার কোটের পকেট থেকে পিস্তলটি বের করল। ছোট্ট ছিমছাম একটি জিনিস।

ভিন্তানি টেনে-টেনে বলল, জনাথন, তুমি জীবিত অবস্থায় এখান থেকে বের হতে পারবে না।

তোমার মতো জীবনের প্রতি আমার মোহ নেই। বের হতে না-পারলেও ক্ষতি নেই। খেতে শুরু কর, পিস্তলের গুলি খেয়ে মরার চেয়ে কোকেন খেয়ে মরা ভালো। এতে কষ্ট কম হয় বলে আমার ধারণা।

জনাথন তাকিয়ে আছে হাসিমুখে, যেন কিছুই হয় নি। ভিন্তানি খেতে শুরু করল। তার চোখ ঠিকরে বের হয়ে আসছে। চাপা একটা গোঁ-গোঁ শব্দ আসছে মুখ থেকে।

মেয়েটি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে জনাথনের দিকে। অবিশ্বাস্য এই ঘটনাটি সে নিজের চোখের সামনেই দেখছে, তবু স্বীকার করতে পারছে না।

জনাথন বলল, তোমার মতো এমন রূপসী একটি মেয়ের তো খুব ভালো ছেলেবন্ধু পাওয়ার কথা। এর সঙ্গে লেপ্টে আছ কেন?

মেয়েটি জবাব দিল না। জনাথন বলল, কি নাম তোমার?

এলেনা।

এলেনা, তোমার বন্ধুর হয়ে গেছে, আমার ধারণা। তবু এক জন ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া ভালো।

এলেনা জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল। জনাথন বলল, শুভ সন্ধ্যা, এলেনা।

জনাথন নির্বিঘ্নে নিচে নেমে এল। কেউ তাকে কোনো প্রশ্ন করল না। সে মুখে একটি বিনীত হাসি ফুটিয়ে রাখল।

 

তার খোঁজ পড়ল পঁয়ত্রিশ মিনিট পর। ওয়েস্ট কোস্টের মাফিয়া বস এত্তের বড় ছেলে পল ভিন্তানি মারা গেছে। খবর ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মতো।

এন্ড্রু জনাথন মিলিয়ে গেছে হাওয়ার মতো। এত্তেনা ঠাণ্ডা গলায় বলল, বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে একে আমি চাই। সে এ-শহরেই আছে, এবং সে কোন যাদুমন্ত্র জানে

না।

এত্তেনা মাফিয়াদের ক্ষমতার একটা নমুনা দেখাবার ব্যবস্থা করল। তারা নিজেদের নিজস্ব পদ্ধতিতে শহর থেকে বের হবার সমস্ত পথ সিল করে দিল। মান-সম্মানের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাঘের গুহায় ঢুকে কেউ বাঘের বাচ্চা মেরে যেতে পারে না। বাহাত্তর ঘন্টা পার হয়ে গেল, এন্ড্রু জনাথন ধরা পড়ল না। শিকাগো-মাফিয়াদের একটি প্রধান শাখা থেকে বিপুল সাহায্য এসে উপস্থিত হল। শহরকে বন্ধ করা হবে। চিরুনির মত এলাকাটিতে আঁচড়ানো হবে। একটি মাছিও যেন গলে যেতে না পারে। জনাথন তো এক জন জলজ্যান্ত মানুষ।

শহরকে ঘিরে একটি কাল্পনিক বৃত্ত তৈরি করা হয়েছে। সেই বৃত্ত ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। কিন্তু জনাথনকে পাওয়া যাচ্ছে না।

পঞ্চম দিনে এত্তে একটি টেলিফোন কল পেল। জেনারেল সিমসন লং ডিসট্যান্স কল করেছেন। তাঁদের কথাবার্তা হল এরকম–

সিমসন : আমাকে চিনতে পারছেন তো?

এত্তেনা : পারছি। বয়স হয়েছে, স্মৃতি দুর্বল। কিন্তু আপনাকে চিনতে পারছি।

সিমসন : আপনার পারিবারিক দুঃসংবাদের খবরে খুবই দুঃখিত হলাম।

এত্তেনা : ধন্যবাদ। আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

সিমসন : শুনলাম এন্ড্রু জনাথন এখনো ধরা পড়ে নি।

এত্তেনা : না। তবে ধরা পড়বে। সময় হয়ে এসেছে। আপনি শিকাগো শহরে একটি সুচ ফেলে রাখুন, আমি খুঁজে বের করে দেব। সেই ক্ষমতা আমার আছে। আশা করি স্বীকার করবেন।

সিমসন : আমি একটি বিশেষ কারণে আপনাকে টেলিফোন করেছি।

এত্তো : কারণ ছাড়া আপনাদের মতো মানুষ আমাদের খোঁজ করবেন না, তা জানি। কারণটি বলুন।

সিমসন : এন্ড্রু জনাথনকে আমাদের প্রয়োজন। অত্যন্ত প্রয়োজন।

এত্তেনা : (নীরব) সিমসন : আপনি আপনার দলের সবাইকে উঠিয়ে নেবেন।

এত্তেনা : (নীরব)

সিমসন : এন্ড্রু জনাথনকে জীবিত অবস্থায় আমাদের হাতে তুলে দিতে হবে। আপনার কাছ থেকে এই গ্যারান্টি চাই।

এত্তেনা : তা সম্ভব নয়। সিমসন আপনি বুদ্ধিমান মানুষ বলে জানতাম।

এত্তেনা : (নীরব)।

সিমসন আপনাকে দশ মিনিট সময় দিচ্ছি। দশ মিনিটের মধ্যেই আমাকে জানাবেন। হ্যাঁ কিংবা না।

জেনারেল সিমসন টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। এবং তার এক ঘন্টা পর ফকনারকে টেলিফোনে জানালেন এন্ড্রু জনাথনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাকে আগামী কাল ভোরে পৌঁছে দেওয়া হবে।

খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় নি তো?

না, তেমন হয় নি।

বেন ওয়াটসন জুনিয়রকে কবে পাব?

বলতে পারছি না।

পাব তো?

সিমসন জবাব দিলেন না। টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন।

বেন ওয়াটসনকে ডেকে তোলা হল

রাত দুটো পঁচিশ মিনিটে বেন ওয়াটসনকে ডেকে তোলা হল। কারারক্ষী বলল, জেল ওয়ার্ডেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান, বিশেষ প্রয়োজন। বেন ওয়াটসন গম্ভীর হয়ে রইল, কিছু বলল না।

আপনাকে এক্ষুনি যেতে হবে।

তাঁর সঙ্গে আমার এমন কোনো জরুরি কথা থাকতে পারে না যে আমাকে রাত-দুপুরে তাঁর কাছে যেতে হবে।

আপনাকে যেতে হবে। দয়া করে তর্ক করবেন না।

বেন ওয়াটসন উঠে পড়ল। প্রায় ছ ফুট লম্বা একটি মানুষ। আড়াই শ-তিন শ পাউন্ড ওজন—যে-কারণে তাকে রোগা দেখায়। এর চোখ দুটি বড়-বড় এবং আশ্চর্য রকমের কালো। চোখের দিকে তাকালে এই মানুষটি সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারণা হওয়া খুব স্বাভাবিক। তাকে যারা ঘনিষ্ঠভাবে চেনে, তারা এই ভুল করে না।

মিঃ বেন ওয়াটসন।

হ্যাঁ।

কফি খাবেন?

দুপুর-রাতে আমি কফি খাই না।

লম্বা একটি জার্নি করবেন। গরম কফির কথা সেজন্যেই বলছি।

ওয়াটসন তাকিয়ে রইল।

আপনি রওনা হবেন খুব শিগগিরই।

কোথায়?

মিসিসিপি পেনিটেনশিয়ারি।

কারণ?

আমি কিছু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আদেশে এ-কাজ করছি। স্টেট ডিপার্টমেন্টের কিছু কর্তাব্যক্তি আছেন। এঁদের এক জন আপনার সঙ্গে যাবেন।

আমি এমন একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তা জানা ছিল না।

আমার নিজেরও জানা ছিল না। সিগারেট নিন।

আমি সিগারেট খাই না।

কফি? কফির কথা বলব?

এক বার তো বলেছি, রাত-দুপুরে আমি কফি খাই না।

ওয়ার্ডেন সিগারেট ধরাল। তার চোখ কৌতূহলে চিকমিক করছে।

মিঃ ওয়াটসন।

বলুন।

আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে আর্মার্ড গাড়িতে। মাঝপথে গাড়ি ভেঙে আপনি পালাবেন।

তার মানে?

মানে খুব সহজ, মিঃ ওয়াটসন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট চাচ্ছে আপনি পালিয়ে একটি বিশেষ মানুষের কাছে যাবেন। কাজেই এমন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, যাতে আপনি তা করতে পারেন।

স্টেট ডিপার্টমেন্টের হাতে এতটা ক্ষমতা, আমার জানা ছিল না।

আমার নিজেরো জানা ছিল না মিঃ ওয়াটসন।

বেন চুপ করে রইল। সে কথাবার্তা খুব কম বলে। তার ওপর তার ঘুম পাচ্ছে। ওয়ার্ডেন নিচু গলায় বলল, যে-লোকটির সঙ্গে আপনাকে যোগাযোগ করতে হবে, তার নাম তো জানতে চাইলেন না!

নাম অনুমান করতে পারছি–ফকনার। একমাত্র ফকনারের মাথায়ই এজাতীয় পরিকল্পনা খেলে।

উনি কি আপনার বন্ধু?

আমাদের দুজনারই কোনো বন্ধু নেই। তিনটা বাজছে, এখন কি আমরা রওনা হব?

নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই।

 

পেনিটেনশিয়ারির আর্মার্ড ভেহিকেল ছুটে চলছে হাইওয়ে ফিফটি নাইন দিয়ে। অন্ধকারে বেন ওয়াটসন বসে আছে চুপচাপ। এক জন অল্পবয়স্ক নার্ভাস ধরনের যুবক পরিকল্পনাটি তাকে ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করছে। বেন ওয়াটসনের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না সে কিছু শুনছে। তরুণটি মৃদুস্বরে বলল, আপনি কি আমার কথা বুঝতে পারছেন?

না।

আমি কি আবার গোড়া থেকে বলব?

না। আমার ঘুম পাচ্ছে, আমি এখন ঘুমুব। সময় হলে আমাকে ডেকে তুলবেন। তরুণটি চুপ করে গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বেন ওয়াটসন নাক ডাকাতে লাগল। তরুণটি বিড়বিড় করে নিজের মনে কী যেন বলল। একা-একা বসে থাকতে তার কেমন জানি ভয় করছে। গাড়ির ভেতরটা বড় অন্ধকার। এখান থেকে বাইরে কী হচ্ছে, কিছুই বোঝার উপায় নেই। তার চেয়েও বড় কথা, অদ্ভুত এক মানুষ তার সহযাত্রী, যে দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। তরুণটি খুখুক করে কাশতে লাগল।

টিলার ওপর চমৎকার বাংলো

এ-ধরনের একটি বাড়ি ফকনার আশা করে নি। টিলার ওপর চমৎকার বাংলো। টালির ছাদ। পাইন গাছ দিয়ে ঘেরা বাড়ির সামনে অনেকখানি জায়গায় ফুলের বাগান করা হয়েছে। বিচিত্র বর্ণের কসমস ফুটেছে বাগানে। একটি বগেনভিলিয়া উঠে গেছে টালির ছাদে। তার পাতা নীলচে। সবকিছু মিলিয়ে একটি অদেখা স্বপ্ন।

ঠিকানা ভুল হয় নি তো? ফকনার ঠিকানা যাচাই করবার জন্যে একটি নোটবই খুলল—একটি ছেলে বেরিয়ে এল তখন। ছ-সাত বছর বয়স। অত্যন্ত রুণ। এরকম একটি রুণ শিশুকে এ-বাড়িতে মানায় না। ফকনার বলল, হ্যালো।

ছেলেটি তার দিকে তাকিয়েই ফিক করে হেসে ফেলল। এর মানে এ-বাড়িতে লোজন বিশেষ আসে না। সেকারণেই অচেনা মানুষ দেখে ছেলেটি হাসছে। ফকনার ফুর্তিবাজের ভঙ্গিতে বলল, কেমন আছ তুমি?

ভালো আছি।

এরকম চমৎকার একটি সকালে খারাপ থাকা খুব মুশকিল, তাই না?

হ্যাঁ।

নাম কি তোমার?

রবার্ট।

হ্যালো রবার্ট।

হ্যালো।

আমি কি আসতে পারি তোমাদের বাগানে?

হ্যাঁ, পার।

আমার নাম ফকনার।

ফকনার ভেতরে ঢুকেই হাত বাড়িয়ে দিল—ছেলেটি এগিয়ে দিল তার ছোট্ট হাত।

এখন থেকে আমরা দুজন বন্ধু হলাম, কি বল রবার্ট?

হ্যাঁ, বন্ধু হলাম।

এখন বল, মিঃ রবিনসন তোমার কে হয়?

আমার দাদা।

আমি সেরকমই ভাবছিলাম। রবিনসন কি আছে?

আছে।

কী করছে?

ব্যায়াম করছে।

ফকনার স্বস্তিবোধ করল। ব্যায়াম-ট্যায়াম করছে যখন, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে শরীরের প্রতি নজর আছে।

দাদাকে ডেকে দেব?

আমার এমন কিছু তাড়া নেই। আমি বরং তোমার সঙ্গেই কিছুক্ষণ গল্প করি। এবাড়িতে তোমরা দুজন ছাড়া আর কে থাকে?

আমরা দুজনই শুধু থাকি। তোমার বাবা-মা?

বাবা মারা গেছেন। মার বিয়ে হয়ে গেছে। থ্যাংকস্ গিভিংয়ের সময় আমি মার কাছে যাই।

বাহ, চমৎকার! খুব মজা হয়?

হয়। এবারে ক্রিসমাসে মা আমাদের এখানে আসবে। মার সঙ্গে আসবে পলিন।

পলিন কে?

পলিন আমার সৎ বোন। ভীষণ পাজি।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। আর খুব মিথ্যাবাদী।

বল কী।

হ্যাঁ।

যদি আসে, তাহলে তো বড্ড মুশকিল হবে।

না, হবে না। ও আমার খুব বন্ধু।

আচ্ছা।

পলিন খুব ভালো মেয়ে।

কিন্তু একটু আগে বলেছ, সে পাজি।

পাজি, কিন্তু ভালো মেয়ে। মাঝে-মাঝে পাজিরাও ভালো হয়।

ফকনার শব্দ করে হেসে উঠল। বহুদিন এমন প্রাণ খুলে সে হাসে নি।

হাসি থামতেই চোখে পড়ল, বারান্দায় গম্ভীর মুখে রবিনসন দাঁড়িয়ে আছে। রোগা লম্বা একটি মানুষ। চোখে স্টিল রিমের চশমা। সব চুল পেকে সাদা হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রবীণ শিক্ষক। ক্লাসে ফিলসফি বা সমাজতত্ত্ব পড়ান। ফকনার হাত নাড়ল। রবিনসন তার কোনো উত্তর দিল না। তার মুখ আরো গম্ভীর হয়ে গেল। যেন সে কিছু আশঙ্কা করছে।

কেমন আছ রবিনসন?

ভালো।

তোমার নাতির সঙ্গে কথা বলছিলাম, চমৎকার ছেলে! তোমার নাতি আছে, জানতাম না।

রবিনসন জবাব দিলো না।

এই বাড়িটি নিজের নাকি?

হ্যাঁ। নগদ পয়সায় কিনেছ, না মর্টগেজ্‌ড্‌।

মর্টগেজ্‌ড্‌।

এমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন? মনে হচ্ছে আমাকে দেখে খুশি হও নি।

না, হই নি।

পুরনো দিনের বন্ধুত্বের খাতিরে একট সহজ হতে পার।

তোমার সঙ্গে আমার কখনো বন্ধুত্ব ছিল না।

চশমা নিয়েছ দেখছি!

বয়স হচ্ছে। ইন্দ্রিয় দুর্বল হচ্ছে।

হতাশাগ্রস্তর মতো কথা বলছ রবিনসন।

হতাশাগ্রস্তর মতো না। স্বাভাবিক একজন মানুষের মতই কথা বলছি।

শরীর কিন্তু ভালোই আছে। এবং তুমি হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করবে না, সাদা চুলে তোমাকে চমৎকার দেখাচ্ছে। আইনস্টাইনের মতো লাগছে।

ধন্যবাদ। আমি কি নিরিবিলিতে তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারি?

পার। ব্রেকফাস্ট করে আসি নি। ব্যবস্থা করা যাবে?

যাবে।

ফকনার শিস দিতে লাগল। সে শিসের ভেতর কোনো–একটা গানের সুর বাজাবার চেষ্টা করছে, এবং লক্ষ করছে রবার্টকে। ছেলেটি নিজের মনে কথা বলছে এবং একা-একা হাঁটছে। হাঁটছে দুর্বলভাবে, যেন পায়ে তেমন জোর নেই। পলিও নাকি? ফকনার সিগারেট ধরাল। সিগারেট খুব বেশি খাওয়া হচ্ছে। রবিনসন গিয়েছে। ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করতে। এত সময় লাগাচ্ছে কেন? রাজকীয় কোনো ব্যবস্থা নাকি?

কফির কাপে চুমুক দিয়ে ফকনার হালকা গলায় বলল, এই বাড়ি কত টাকায় মর্টগেজুড়?

ত্ৰিশ হাজার ডলার।

কত বছরে দিতে হবে?

কুড়ি বছর। তোমার রোজগারপাতি কি?

তেমন কিছু না।

কিছু করছ না?

করছি।

বছরে কত আসে?

খুবই সামান্য। বলার মতো কিছু না।

দুঃসময় যাচ্ছে?

রবিনসন জবাব দিল না। ফকনার তার স্বভাবসুলভ সহজ ভঙ্গিতে বলল, আমি তোমার জন্যে একটি চেক নিয়ে এসেছি। এ দিয়ে মর্টগেজের পুরো টাকাটা দেওয়া যাবে এবং কাজ শেষ হলে তুমি সমান পরিমাণ টাকা পাবে। বাকি জীবন হেসে-খেলে চলে যাবার কথা।

রবিনসন চুপ করে রইল।

কাজটা কী, জানতে চাও না?

না। কারণ আমি অবসর নিয়েছি। বাকি যে-কটা দিন বাঁচব, রবার্টের সঙ্গে থাকতে চাই।

বেঁচে থাকার জন্যেও তো টাকার প্রয়োজন। তুমি আমার জন্যে যে-ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করলে, তা দেখে মনে হয় তোমার ঝুড়ি ফুটো হয়ে গেছে।

ফকনার, আমি অবসর নিয়েছি।

মানুষ অবসর নেয় এক বারইযখন মারা যায়। তোমাকে আমার ভীষণ দরকার।

কিন্তু আমার তোমাকে দরকার নেই। আমার দরকার রবার্টকে। ওর কেউ নেই। আমি ওর অভিভাবক।

ফকনার হেসে উঠল।

হাসছ কেন?

তোমার কথা শুনে। তুমি বললে, তুমি তার অভিভাবক। কপর্দকহীন এক জন অভিভাবকের ওর কোনো প্রয়োজন নেই। ওর প্রয়োজন ডলারের। ডলারের মতো বড় অভিভাবক এখনো তৈরি হয় নি।

আমি তোমার সঙ্গে যুক্তিতর্কে যেতে চাচ্ছি না।

চাচ্ছ না, কারণ তোমার কাছে তেমন কোন যুক্তি নেই।

ফকনার, তুমি এখন যেতে পার।

ফকনার উঠল না। নরম গলায় বলল, রবিনসন, আমার অবস্থা তোমার চেয়েও খারাপ। এই মিশনটির ওপর আমার বেঁচে থাকা নির্ভর করছে। প্ল্যানটি তোমাকে করে দিতে হবে। প্লিজ।

অন্য বিষয় নিয়ে কথা বল ফকনার। গান-বাজনায় তোমার কি এখনো আগের উৎসাহ আছে?

ফকনার দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইল। ছোট্ট ছেলেটি দিব্যি নিজের মনে ঘুরছে। বকবক করছে। কী বলছে সে? ফকনারের ইচ্ছা হল ছেলেটির কথা শুনতে।

ফকনার, আমার একটু কাজ আছে।

উঠতে বলছ?

হ্যাঁ।

আমি একটি খসড়া পরিকল্পনা করেছিলাম, সেটা একটু দেখবে?

না। আমি দুঃখিত ফকনার।

ফকনার উঠে দাঁড়াল। ছোট্ট ছেলেটি বলল, চলে যাচ্ছ?

হ্যাঁ, চলে যাচ্ছি।

আর আসবে না?

খুব সম্ভব না।

রবিনসন গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ফকনার বলল, তোমার নাতিটি চমৎকার!

ও ছাড়া আমার কেউ নেই, আমি ছাড়া ওরও কেউ নেই।

ফকনার হাসল। হালকা স্বরে বলল, একমাত্র আমারই কোনো পিছুটান নেই। একেক বার মনে হয়, এরকম একটা পিছুটান থাকলে বোধহয় ভালোই হত। আচ্ছা, চললাম।

রবিনসন দেখল, লম্বা-লম্বা পা ফেলে ফকনার নেমে যাচ্ছে। ক্লান্ত মানুষের হাঁটার ভঙ্গি। হেঁটে যাচ্ছে, কিন্তু এক বারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না। এর সত্যি কোনো পিছুটান নেই। মায়ামমতাও বোধহয় নেই। নাকি আছে?

প্রায় দশ বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল। ব্রাজিলে বড় ধরনের একটা অপারেশন। হাতি ফকনার দলপতি। ঠিক করা হল, আহতদের নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। আহতদের ফেলে আসা হবে। উপায় নেই এ ছাড়া। কিন্তু হার্ভি ফকনার একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। আহত রবিনসনকে পিঠে ঝুলিয়ে একুশ কিলোমিটার দৌড়ে ফিরে এল মূল ঘাঁটিতে।

রবিনসন আজ সারাক্ষণ ভাবছিল, ফকনার পুরোনো ঘটনাটি তুলে তার ওপর চাপ প্রয়োগ করবে। কিন্তু সে তা করে নি।  রবিনসন দেখল, ফকনার বড় রাস্তায় নেমে গেছে। এবং এই দীর্ঘ সময়ে এক বারও পেছন ফেরে নি। আশ্চর্য লোক। রবিনসন উঁচু গলায় ডাকল, ফকনার, ফকনার।

ফকনার ফিরে তাকাল।

তোমার খসড়া পরিকল্পনাটা দেখতে চাই।

ফকনার দাঁড়িয়ে আছে। যেন রবিনসনের কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না।

রবিনসনের হঠাৎ দারুণ মন-খারাপ হল। সে নিশ্চিত জানে, এই মিশন থেকে। সবাই বেঁচে ফিরে আসবে, শুধু সে ফিরবে না। এসব জিনিস টের পাওয়া যায়। মৃত্যু খুবই গোপনে রক্তের সঙ্গে কথা বলে। ফকনার পাহাড়ী ছাগলের মতো তরতর করে উঠে আসছে। রবার্ট অবাক হয়ে দেখছে। এক সময় সে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। শিশুরা মাঝে মাঝে অকারণেই উল্লসিত হয়।

গামাল হাসিম লোকটি স্বল্পভাষী

গামাল হাসিম লোকটি স্বল্পভাষী।

দুর্বল এবং কাহিল এক মানুষ। এই অস্ত্র-ব্যবসায়ীকে দেখে মনে হয় না তিনি কোনো কাজ ঠিকভাবে শেষ করতে পারবেন।

বয়স প্ৰায় সত্তরের কোঠায়। কানে ভালো শুনতে না-পাওয়ার জন্যে ইদানীং তাঁকে হিয়ারিং এইড ব্যবহার করতে হচ্ছে। দুমাস আগে বা চোখে ক্যাটারেক্ট অপারেশন হয়েছে। অপারেশন ঠিকমতো হয় নি, কিংবা কিছু-একটা হয়েছে, যার জন্যে এখন তিনি বাঁ চোখে কিছুই দেখেন না। দু-তিন সপ্তাহ ধরে ডান চোখে অসুবিধা দেখা দিয়েছে, সারাক্ষণই চোখ দিয়ে পানি পড়ে। ডাক্তারের পরামর্শে বেশিরভাগ সময়ই তাঁকে চোখ বন্ধ করে রাখতে হয়।

তাঁর কথাবার্তা অবশ্যি খুবই পরিষ্কার। নিখুত আমেরিকান অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলেন। অস্ত্রের ব্যাপারে তাঁর জ্ঞানও চমৎকার।

ফকনার বলল, আমাকে চিনতে পারছেন তো? আগে এক বার আপনি অস্ত্র দিয়েছিলেন। এগারটি ফরাসি সাব-মেশিনগান আপনার কাছ থেকে কিনেছিলাম। এস এল টুয়েন্টি। আমার নাম ফকনার। হার্ভি ফকনার।

আমার স্মৃতিশক্তি ভাল। এক বার কাউকে দেখলে সাধারণত ভুলি না। এখন বলুন, কী করতে পারি আমি।

পঞ্চাশ জন কমান্ডোর একটি দলকে আপনি অস্ত্র সরবরাহ করবেন।

মিশনটি কী ধরনের?

ছোট মিশন, কিন্তু বড় রকমের বাধার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনা সামনে রেখেই আমাদের তৈরি হতে হবে।

আপনি ঠিক কী চান, পরিষ্কার করে বলুন।

আমার দলকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগে দশ জন কমান্ডো। এরা সবাই নামবে প্যারাশুটের সাহায্যে। এদেরকে সাত দিন টিকে থাকার মতো সাজসজ্জায় সজ্জিত করতে হবে।

বলুন, আমি শুনছি। থামবেন না।

প্রতিটি ভাগে থাকবে দুটি লাইট মেশিনগান, সাতটি রাইফেল এবং একটি অ্যাসল্ট উইপন। গ্রেনেড, পিস্তলও থাকবে সবার সঙ্গেই।

গামাল হাসিম চোখ মিটমিট করে এক বার তাকালেন। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন।

আমাদের অস্ত্রগুলি, যেমন ধরুন A.K-7.62 হলে ভালো হয়।

গামাল হাসিম শীতল গলায় বললেন, A.K-7.62 এবং RPD লাইট মেশিনগান—এ দুয়ের মিলন ভালোই হবে। এদের সবচে বড় সুবিধা হচ্ছে, দুটিতে একই গুলি ব্যবহার করা যায়।

ঠিক আছে, তাই করুন। অ্যামুনিশান কী পরিমাণ চাই?

যাদের কাছে থাকবে A.K-7.62 তারা প্রত্যেকেই দশটি করে ম্যাগজিন পাবে। এ ছাড়াও থাকবে বাড়তি এক শ রাউন্ড গুলি। সেগুলি থাকবে বেনজডালিয়ায় বেন্টে।

বেশ, এবার বলুন RPD লাইট মেশিনগানের জন্যে কী পরিমাণ গুলি চান?

প্রতিটি সাব-মেশিনগানের সঙ্গে পাঁচ রাউন্ডের চারটি কনটেইনার। এ ছাড়া তিন জন কমান্ডো যে পরিমাণ গুলির বেল্ট নিতে পারে, সে-পরিমাণ বেল্ট।

আমার মনে হয় আপনার দলে অন্তত কয়েকটি রকেট লঞ্চার থাকা দরকার।

ঠিকই বলেছেন। তিনটি RPG-2 রকেট লঞ্চার। প্রতিটির সঙ্গে চারটি রকেটের একটি প্যাকেট।

গ্রেনেড কী পরিমাণ চান?

সবার সঙ্গে থাকবে চারটি করে গ্রেনেড। এবং আটচল্লিশ ঘন্টার রসদ। আমেরিকান হেলমেট। আমেরিকান T-10 প্যারাশুট। দেওয়া যাবে?

নিশ্চয়ই দেওয়া যাবে। আমার মনে হয় অন্তত একটি ভারি অস্ত্র আপনাদের থাকা উচিত। যেমন ধরুন, জার্মানির তৈরি PINTER-301. চমৎকার জিনিস! কিংবা ফ্রেঞ্চদের তৈরি ম্যাট মাইন মিলিমিটার।

ভারি কিছুই নেওয়া যাবে না।

এটা ভারি নয়, ওজন বার পাউন্ড। বিপদে কাজে লাগবে। দুটি অন্তত নিন।

ঠিক আছে, দুটি PINTER-301.

আরেকটি মডেল আছে PINTER-308, এর থ্রাস্ট খুব বেশি, তবে ওজনও বেশি।

আপনি 301-ই দিন।

ঠিক আছে।

ফকনার সিগারেট ধরাল মৃদুস্বরে বলল, আপনি ধূমপান করবেন কি?

না।

কোনো রকম পানীয়? ভালো হুইস্কি আছে।

আমি মদ্যপান করি না। আপনার আর কী প্রয়োজন, বলুন।

আমার কিছু কেমিক্যাল উইপন্‌স্‌ দরকার।

কী জাতীয়?

যেমন ধরুন, এমন কোনো বাষ্প, যা অল্প জায়গায় কাজ করে। কর্মক্ষমতা নষ্ট করে দেয় বা ঘুম পাড়িয়ে দেয়।

এনিথল জাতীয় বোমা দেওয়া যাবে।

বোমা ফাটার পর কাজ শুরু হতে কতক্ষণ লাগবে?

পাঁচ থেকে দশ মিনিট।

এত সময় নেই আমার হাতে। আরো দ্রুত কাজ করে, এমন কিছু বলুন।

সে-সব কেমিক্যাল উইপনস্ ভয়াবহ হবে। নার্ভাস সিস্টেমে কাজ করবে। ঘুম পাড়িয়ে দেবে, কিন্তু সে-ঘুম ভাঙবে না। রাজি আছেন?

রাজি আছি। ফকনার বলল, কাগজে লিখে নিলে হত না? আপনার হয়তো মনে থাকবে না।

গামাল হাসিম মৃদুস্বরে বললেন, আমার স্মৃতিশক্তি অত্যন্ত ভালো, আপনি ইচ্ছা করলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। পরীক্ষা করে দেখতে চান?

না। আমি বিশ্বাস করছি।

ফকনার চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানতে লাগল। গামাল হাসিম বললেন, এখন বলুন, কতদিনের ভেতর চান?

দশ দিন।

কী বললেন?

দশ দিন। অস্ত্ৰগুলি আমাদের ব্যবহার করতে হবে। ওদের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে।

দশ দিনে দেওয়া সম্ভব নয়। আমার কোনো গুদামঘর নেই। আমাকে সব জিনিস জোগাড় করতে হয়।

কত দিনের ভেতর দিতে পারবেন?

আমাকে দুমাস সময় দিতে হবে। এর কমে সম্ভব নয়। আমি তো যাদুকর নই মিঃ ফকনার।

ফকনার বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। গামাল হাসিম বললেন, আমি কি উঠতে পারি?

ফকনার বলল, অস্ত্রের জন্যে আপনার যেটাকা পাওনা হবে, আমি তার তিন গুণ টাকা দেব।

তিন গুণ কেন, দশ গুণ দিলেও লাভ হবে না। আমি তো আপনাকে বলেছি মিঃ ফকনার, আমি যাদুকর নই। আমি এখন উঠব।

এক মিনিট দাঁড়ান। আপনি কি জেনারেল সিমসনকে চেনেন?

ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, কিন্তু তাঁকে না-চেনার কোনো কারণ নেই। তাঁকে ভালোই চিনি।

তিনি যদি আপনাকে বলেন, দশ দিনের ভেতর মালামাল পৌঁছে দিতে, আপনি কী করবেন? না বলবেন?

গামাল হাসিম চুপ করে থাকলেন। ফকনার বলল, জেনারেল সিমসন আজ রাতের মধ্যেই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

গামাল হাসিম শীতল স্বরে বললেন, আপনাদের কবে দরকার?

দশ দিনের ভেতর দরকার। আগে বেশ কয়েক বার বলেছি।

ঠিক আছে, পৌঁছানো হবে। তিন গুণ দাম দিতে হবে। পৌঁছানোর খরচ দিতে হবে।

দেওয়া হবে।

সব টাকাই দিতে হবে অগ্রিম।

দেওয়া হবে।

কাল ভোরে কি আপনি একবার আসতে পারবেন?

কটায়?

ভোর ছটায়। অস্ত্রের তালিকাটি সম্পূর্ণ করব। আপনাকে রাশিয়ান ব্যানানা রাইফেলের নমুনা দেখাব।

ঠিক আছে, দেখা হবে ভোর ছটায়।

শুভরাত্রি।

শুভরাত্রি।

পঞ্চাশ জনকে রিক্রুট করার দায়িত্ব

পঞ্চাশ জনকে রিক্রুট করার দায়িত্ব পড়েছে বেন ওয়াটসনের ওপর। ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল—পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে এবং বয়স ত্রিশ থেকে চল্লিশের ভেতর হতে হবে। কিন্তু উৎসাহীদের বয়সের সীমা দেখা গেল সতের থেকে ষাটের মধ্যে এবং অনেকেরই কোন পূর্ব-অভিজ্ঞতা নেই। মাত্র একুশ দিনে এদের তৈরি করাও প্রায় অসম্ভব। জগতের অসম্ভব কাজগুলির প্রতি বেন ওয়াটসনের একটা ঝোঁক আছে।

রিক্রুটমেন্ট শুরু হল সকাল থেকে। একেক জন এসে ঢেকে আর বেন তার দিকে প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো তাকিয়ে থাকে। প্রশ্ন কিছুই নয়। শুধু তাকিয়ে থাকা। যাদের পছন্দ হয়, তাদেরকে নিয়ে যায় মাঠে। সেখানে কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয় এবং ড্রিল হয়। দ্বিতীয় বাছাইপর্বটি হয় সেখানে। সেটিই চূড়ান্ত বাছাই। নমুনা দেয়া যাক।

কী নাম?

রিক ব্রেগার।

বয়স?

তেত্রিশ।

মিশনে কেন যেতে চাও?

টাকার জন্যে।

শুধুই টাকার জন্যে?

হ্যাঁ।

অ্যাটেনশন। লেফট রাইট, লেফট। লেফট রাইট, লেফট। কুইক মার্চ। লেফট, লেফট। লেফট, লেফট। হল্ট। অ্যাবাউট টার্ন। স্ট্যান্ড এট ইজ। শুধুই টাকার জন্যে যেতে চাও?

হ্যাঁ।

টাকার এত প্রয়োজন কেন?

ঘরে ছেলেমেয়ে আছে, স্ত্রী আছে। পছন্দমতো কাজকর্ম পাচ্ছি না। নগদ কিছু টাকা। হলে ভালো হবে।

গুড। কোন সেকশন?

আর্টিলারি। সিলেক্টেড। রাত আটটার মধ্যে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিপোর্ট করবে।

ঠিক আছে, স্যার।

যাবার আগে কন্ট্রাক্ট ফর্ম সই করবে। মারা গেলে টাকা কে পাবে, সে-দলিল দরকার।

ঠিক আছে স্যার।

ওকে, ক্লিয়ার আউট। নেক্সট।

কি জন্যে যেতে চাও?

অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে।

শুধুই অ্যাডভেঞ্চার? হ্যাঁ।

বয়স কত?

একুশ।

হবে না, তুমি যেতে পার। এটা শিশুদের কোনো ব্যাপার নয়।

আমাকে শিশু বলবেন না।

বেন ওয়াটসন প্ৰচণ্ড একটি চড় কমিয়ে দিল। ছেলেটি প্রায় চার ফুট দূরে উল্টে পড়ল। বেন গম্ভীর গলায় বলল, বিদায় হও, কুইক।

তুমি কি আমেরিকান?

না, আমি আমেরিকান নই।

কেন যেতে চাও?

(উত্তর নেই)

কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে?

নেই।

আমরা তো বলে দিয়েছি পূর্ব-অভিজ্ঞতা আছে, এমন সব প্রাণীদেরই আমরা চাই।

আমি দ্রুত শিখতে পারি।

কী করবে টাকা দিয়ে?

ব্যবসা করব।

তুমি যেতে পার। তোমাকে দিয়ে হবে না। তুমি সংসারী মানুষ। সংসারী মানুষ। সাহসী হয় না।

আমি সাহসী।

তা ঠিক। তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি সাহসী। কিন্তু বিপদের সময়। তোমার সাহস থাকবে না। ছেলেমেয়েদের কথা মনে পড়বে। তুমি যেতে পার। নেক্সট।

লেফট রাইট। লেফট রাইট। কুইক মার্চ। ঐ বার্চ গাছ ছুঁয়ে আবার ফিরে এস। কুইক মার্চ। ডাবল। ডাবল। ভেরি গুড। হল্ট। মার্চ এগেইন লং স্টেপ। লং স্টেপ। হল্ট। বয়স কত?

চল্লিশ।

মিশনে যেতে চাও কেন?

টাকার জন্যে।

কী করবে টাকা দিয়ে?

জানি না স্যার। এখনো ভাবি নি।

ঘরে কে আছে?

স্ত্ৰী আছে।

মিশনে তুমি মারা যেতে পার। জান তো?

জানি।

তোমার স্ত্রী তোমাকে ছাড়তে রাজি হবে?

তার সঙ্গে আমার বনিবনা নেই।

অ্যাটেনশন। লেফট রাইট, লেফট রাইট। অ্যাবাউট টার্ন। কুইক মার্চ। ঐ বার্চ গাছ। ছুঁয়ে আবার এস। আমি তোমার দম দেখতে চাই। ওকে, হল্ট। দম ভালোই আছে। আগে – কোথায় ছিলে?

ইউএস ম্যারিন।

তোমার দেশের নাম কি?

মালদ্বীপ।

নাম শুনি নি।

আপনি না শুনলে কিছু যায়-আসে না।

কুইক মার্চ। হল্ট। লেফট রাইট লেফট। লেফট লেফট লেফট। হল্ট। ডবল মার্চ। লেফট লেফট, লেফট। হল্ট।

তোমার কি নাম?

আবদুল জলিল।

মিঃ জলিল, তোমার একেবারেই দম নেই।

আমাকে একটা সুযোগ দিন।

কেন, সুযোগ দেব কেন? টাকার দরকার?

হ্যাঁ।

নিজের জন্যে?

না, নিজের জন্যে নয়।

অ্যাটেনশন। লেফট রাইট লেফট। লেফট রাইট লেফট। হল্ট। তুমি কি সাহসী?

হ্যাঁ।

কী করে বুঝলে?

(নিচুপ)।

কখনো মানুষ খুন করেছ?

না।

খুন করতে পারবে?

(নিচুপ) টাকাটা দিয়ে কী করবে, বলতে চাও না?

না।

ঠিক আছে, তোমাকে রিক্রুট করা হল। সন্ধে আটটার ভেতর রিপোর্ট করবে। যাও।

পঞ্চাশ জনকে নেবার কথা, বাছাই করা হল সত্তর জনকে। বেন ওয়াটসনের ধারণা ট্রেনিংপর্বে কিছু বাদ পড়বে। আঘাতজনিত কারণে চূড়ান্ত পর্যায়ে অনেককে বাদ দিতে হবে। কয়েকটি মৃত্যু ঘটাও বিচিত্র নয়।

সত্তর জন সদস্যের চুক্তিপত্রে সই

রাত আটটা। সত্তর জন সদস্যের চুক্তিপত্রে সই করা হয়ে গেছে। এরা বসে আছে মস্ত একটি হলঘরে। সমস্ত দিনের ধকলে সবাই কিছুটা ক্লান্ত এবং উত্তেজিত। অনিশ্চয়তার একটি ব্যাপার আছে। অনিশ্চয়তা মানুষকে দুর্বল করে দেয়।

হাতি ফকনার ঘরে ঢুকল নটা পনেরয়। এর চেহারায় এমন কিছু আছে, যা দেখলে ভরসা পাওয়া যায়।

হ্যালো, আমি ফকনার, তোমাদের মধ্যে কেউ-কেউ হয়তো আমাকে চেন। কি, চেন না?

কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এক জন রিক্রুট শুধু দাঁত বের করে হাসল। সম্ভবত সে চেনে।

আমি ছোট্ট একটা বক্তৃতা দেব। কারণ, বক্তৃতার ব্যাপারটি আমার পছন্দ নয়। তোমাদেরও সম্ভবত নয়। এটা অলস মানুষদের একটা শখের ব্যাপার।

মৃদু হাসির শব্দ শোনা গেল। নড়েচড়ে বসল অনেকেই।

আগামীকাল সকাল দশটায় আমরা চলে যাব ট্রেনিং-গ্রাউন্ডে। সেই ট্রেনিংগ্রাউন্ডটি কোথায় তা জানার দরকার নেই। যেটা জানা দরকার সেটা হচ্ছে, ট্রেনিং দেবে কে? যিনি ট্রেনিং দেবেন তাঁর নাম এন্ড্রু জনাথন। কমান্ডো ট্রেনিং-এ তাঁর মতো যোগ্য ব্যক্তি দ্বিতীয় কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। তোমরা নিজেরাও তা বুঝতে পারবে। ট্রেনিংয়ের দ্বিতীয় পর্যায় পরিচালনা করবেন রবিনসন। তাঁর ট্রেনিং এড়ু জনাথনের ট্রেনিংয়ের মতো ভয়াবহ হবার কথা নয়।

সবাই নড়েচড়ে বসল।

আমার এরচে বেশি কিছু বলার নেই। তোমাদের কারো কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?

এক জন উঠে দাঁড়াল।

বল, কি জানতে চাও।

মিশনটি সম্পর্কে জানতে চাই।

সে-সম্পর্কে যথাসময়ে জানা যাবে। জানার সময় এখনো হয় নি। আর কিছু?

পারিশ্রমিকের অর্ধেক শুরুতেই দেবার কথা বলা হয়েছিল।

শুরুতেই দেওয়া হবে। যারা ট্রেনিং শেষ করতে পারবে, তাদেরকে পারিশ্রমিকের টাকার অর্ধেক দিয়ে দেওয়া হবে। এখন নয়। আর কিছু বলার আছে?

সবাই চুপ করে রইল।

আজ রাতটা তোমরা নিজেদের মতো কাটাতে পার। এ-শহরে বেশ কিছু সুন্দরী মেয়ে আছে। রাত কাটানোর জন্যে এদের সঙ্গিনী হিসেবে পাবার চেষ্টা করতে পার। কিছুভালোনাইট ক্লাবও আছে। অনেক রকম আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা আছে সেখানে। শুধু একটা জিনিস মনে রাখবে—এখানে রিপোর্ট করতে হবে আগামীকাল সকাল আটটায়।

এক জন উঠে দাঁড়াল। বেশ উঁচু স্বরে বলল, যাদের আমোদ-প্রমোদে যাবার মতো টাকা নেই, তারা কী করবে?

বেন ওয়াটসন শান্ত স্বরে বলল, সবার জন্যে আজ একটি বিশেষ অ্যালাউন্স-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ রাতের জন্যে সবাইকে নগদ দু শ ডলার করে দেওয়া হবে।

প্রচন্ড তালি পড়ল। কয়েক জন একসঙ্গে শিস দিতে শুরু করল।

যে-অস্থিরতা ও উত্তেজনা এতক্ষণ চাপা ছিল তা কেটে যেতে শুরু করেছে। ফকনার মৃদু হাসল। কজন এদের ভেতর থেকে ফিরে আসবে? মনে করা যাক, সব ঘড়ির কাঁটার মতো হবে। ফোর্টনক থেকে বের করে আনা হবে নিশোকে। যথাসময়ে ওদের নেবার জন্যে আসবে ট্রান্সপোর্ট প্লেন। তবুও ক জন ফিরবে? আজ রাতটি কি অনেকের জন্যেই শেষ স্বাধীন রাত নয়? এটা হয়তো তারও শেষ রাত। ফকনার উঠে গিয়ে টেলিফোনের ডায়ার ঘোরাল।

হ্যালো। লিজা ব্রাউন?

কে?

চিনতে পারছ না?

লিজা ইতস্তত করে বলল, ফকনার?

হ্যাঁ, ফকনার। লিজা, পার্লারে কতক্ষণ থাকবে?

রাত এগারটায় বন্ধ হবে।

তুমি কি ডিনার খেয়ে নিয়েছ?

না, কিছুক্ষণের মধ্যেই খাব।

একটা কাজ করলে কেমন হয় লিজা। কোনট-একটা ভালো রেস্টুরেন্টে যদি আমরা ডিনার খাই, তাহলে কেমন হয়?

লিজা কিছু বলল না। ফকনার বলল, আজ আমার জন্মদিন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

লিজা হেসে ফেলল।

হাসছ কেন?

প্রথম যেদিন তুমি আমাকে বাইরে খেতে বললে, সেদিনও বলেছিলে—আজ আমার জন্মদিন।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। অবশ্যি আমি সেদিনই বুঝেছিলাম, এটা মিথ্যা কথা।

বুঝতে পেরেছিলে?

হ্যাঁ। মেয়েরা অনেক জিনিস বুঝতে পারে।

আর কী বুঝতে পেরেছিলে?

বুঝতে পেরেছিলাম, তুমি আমাকে বাইরে খাওয়াতে চাচ্ছ ঠিকই, কিন্তু তোমার হাতে বেশি পয়সা নেই। কাজেই তুমি আমাকে নিয়ে যাবে খুব সস্তা ধরনের কোনো জায়গায়, এবং মেনু দেখে খুব সস্তা কোনো খাবারের অর্ডার দেবে।

তাই দিয়েছিলাম, না?

হা। আজও কি সেরকম হবে?

ফকনার হেসে ফেলল, তোমার বুঝি খুব ভালো রেস্টুরেন্টে খেতে ইচ্ছা করে? হ্যাঁ। আমার ইচ্ছা করে ফারপোতে ডিনার খেতে। সেখানে ডিনারের মাঝখানে অর্কেস্ট্রা বাজারে আমার প্রিয় গান-ব্লু দানিয়ুব।

আর কি?

এই, আর কিছু না।

তুমি তৈরি থাক, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে আসছি।

ফকনার ফারপোতে দুটি সিট রিজার্ভ করল। অর্কেস্ট্রাকে বলল, র দানিয়ুব-এই গানটি বাজাতে হবে। ফ্লাওয়ার শপে টেলিফোন করে বলল, আগামী এক মাস প্রতি দিন দুটি করে লাল গোলাপ লিজা ব্রাউনের নামে পাঠাতে হবে। কে পাঠাচ্ছে, সেসব কিছুই বলা যাবে না। ঠিকানা হচ্ছে ফার্গো পিজা পার্লার নর্থ অ্যাভি। লিজার বাড়ির ঠিকানা জানা থাকলে ভালো হত। ফকনারের ঠিকানা জানা নেই।

ট্রেনিং ক্যাম্প

ট্রেনিং ক্যাম্প।

লরেনকো মারকুইস।

মোজাম্বিক, আফ্রিকা।

১৫ই ডিসেম্বর। মঙ্গলবার।

ভোর ৫-৩০।

বাহাত্তর জন সদস্য খোলা মাঠে অপেক্ষা করছে। সূর্য ওঠার অপেক্ষা। হার্ডি ফকনার তাদের প্রথম কিছু বলবে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনজাতীয় কিছু হয়তো। দলের সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা, তারা নিজেদের মধ্যে চাপাস্বরে কথাবার্তা বলছে। এদের দাঁড় করানো হয়েছে পাঁচটি ভাগে। বার জনের একটি রিজার্ভ দলও আছে।

তারা দাঁড়িয়ে আছে প্ৰকাণ্ড একটি ভোলা মাঠের মাঝামাঝি জায়গায়। মাঠটির চারপাশে ঘনবন। পূর্বদিক থেকে হাড়-কাঁপানো শীতল হাওয়া বইছে। সূর্য উঠে গেছে। বনের আড়ালে থাকায় তার আলো এসে এখনো পৌঁছচ্ছে না।

দলের সবাই নড়েচড়ে উঠল। তাঁবুর ভেতর থেকে হাতি ফকনার বের হয়ে। আসছে। তার মাথায় ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সাদা টুপি। রঙিন একটি হাওয়াই শার্ট। গলায় লাল রঙের স্কার্ফজাতীয় কিছু।

কি, কেমন আছ তোমরা?

কেউ কোনো জবাব দিল না।

শীতের প্রকোপটা মনে হয় একটু বেশি। আফ্রিকা একটি অদ্ভুত জায়গা। দিনের বেলা প্রচন্ড গরম, রাতে শীত, তাই না?

ঠিক বলেছেন স্যার।

আমি সবসময় ঠিকই বলি। এখন কাজের কথায় আসা যাক। তোমাদের ট্রেনিংয়ের দায়িত্বে যে-আছে, তার সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। তার নাম এড়ু জনাথন। জনাথন, একটু এদিকে এস। তোমার হাসিমুখ ওদের দেখিয়ে দাও।

জনাথন এগিয়ে এল। তার মুখ হাসিমুখ নয়।

এই ছোটখাটো মানুষটির নাম এন্ড্রু জনাথন। এর সম্পর্কে আমি কিছু বলব না। তোমরা নিজেরা আজ দিনের মধ্যেই তার সম্পর্কে জানবে। হা-হা-হা। আমার নিজের ট্রেনিংও এই লোকের কাছে। সে ছিল ইউএস ম্যারিনের RSM. এখানে যারা পুরোনো লোক আছে, তারা তাকে চিনবে। আমরা তাকে ডাকতাম ইয়েললা জাগুয়ার।

দলটির মধ্যে চাপা ধরনের কথাবার্তা বাড়তেই থাকল। ফকনার সেদিকে কোন কান না-দিয়ে নিজের মনেই বলতে লাগল, লাঞ্চের আগ পর্যন্ত হবে ড্ৰিল। লাঞ্চের পর অস্ত্রের ট্রেনিং। ঠিক আছে? এখন বাজছে—পাঁচটা চল্লিশ। এই ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ ভোর পাঁচটা চল্লিশে আমি তোমাদের তুলে দিচ্ছি জনাথনের হাতে। যথাসময়ে আমি আবার নিজের হাতে তোমাদের নেব। গুড লাক।

ফকনার এগিয়ে এসে প্রত্যেকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করল, দু-একটা ছোটখাটো প্রশ্নও করল, যেমনকি, চোখ লাল কেন? রাতে ঘুম ভালো হয় নি? বাহ্, তোমার হাত দেখি মেয়েমানুষদের মতো নরম। এত নরম হাতে কি রাইফেল মানায়? তোমার হাতে থাকা উচিত ফুল। কি, ঠিক বললাম না?

ফকনারের সঙ্গে-সঙ্গে বেন ওয়াটসন এবং রবিনসনও মাঠ ছেড়ে গেল। সূর্য উঠে। এসেছে। এন্ড্রু জনাথন শুধু দাঁড়িয়ে আছে। জনাথনের কোমরে একটি লুগার টুয়েন্টিওয়ান পিস্তল। গায়ে গলাকাটা গেঞ্জি। গলায় ফুটবল রেফারিদের বাঁশি। সে বাঁশিতে তীব্র ফুঁ দিয়ে আচমকা সবাইকে চমকে দিল।

অ্যাটেনশন। তোমাদের অনেকেই দেখি দাড়ি-গোঁফ এবং লম্বা-লম্বা চুল। আজ দিনের মধ্যেই এ-সব বাড়তি ঝামেলা থেকে নিজেদের মুক্ত করবে। তোমাদের কারোকারো মুখে একটু বাঁকা হাসি দেখতে পাচ্ছি। কারণ, তোমরা নিজেদের খুব শক্ত মানুষ ভাবছ এবং চোখের সামনে এক জন ছোটখাটো মানুষকে দেখছ। তবে সুখের কথা, তোমরা অনেকেই আমাকে চেন। আগে পরিচয় হয়েছে। যারা চেন না তাদের বলছি, একজন মানুষকে একটি রাইফেলের চেয়েও বড় হবার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমরা কেউ যদি আমার কথার অবাধ্যতা কর, আমি তৎক্ষণাৎ গুলি করে পথের কুকুরের মতো মারব। আমার কোমরে যে-বস্তুটি দেখছ, তার নাম লুগার টুয়েন্টিওয়ান। মানুষের মৃত্যু আমাকে স্পর্শ করে না। তোমাদের চেয়েও অনেক অনেক ভালোমানুষকে আমি চোখের সামনে মরতে দেখেছি। কাজেই আমি যখন বলব, লাফ দাও লাফ দেবে। তোমার সামনে খাদ আছে কি নেই সে-সব দেখবে না। পরিষ্কার হয়েছে?

কেউ কোনো জবাব দিল না।

গুলি করে মারার কথাটা আমার মনে হয় অনেকেই বিশ্বাস করছ না। তোমাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি, এখানে আইন-আদালত বলে কিছু নেই। আমি এড়ু জনাথন-আমিই আইন। আমার এই ছোট পিস্তলটি হচ্ছে আদালত।

সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।

কারোর কিছু বলার আছে?

কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

এস, এখন আমি দেখব, তোমাদের শারীরিক ফিটনেস কোন পর্যায়ে আছে। আমি বাঁশি বাজাবার সঙ্গে-সঙ্গে দশ কদম হাঁটবে, তারপর পঞ্চাশ কদম দৌড়াবে, তারপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়বে। সঙ্গে-সঙ্গে উঠেদাঁড়াবে। দৌড়াবে। আবার শোবে। যতক্ষণ-না আমি থামতে বলব, এটা চলতে থাকবে। শুরু করা যাক।

তীক্ষ্ণ শব্দে হুইসেল বাজল।

সাড়ে ছটার মধ্যে সব এলোমেললা হয়ে যেতে শুরু করল। শুয়ে পড়বার পর উঠতে সময় লাগতে লাগল। পঞ্চাশ কদম দৌড়ে যাবার কথা। অনেকেই অল্প কিছুদূর গিয়েই বসে পড়তে শুরু করল। সবাই ঘামছে। চোখের মণি ছোট হয়ে আসছে। ঠোট গেছে শুকিয়ে।  জনাথন এগিয়ে গেল। কড়া গলায় বলল, এই যে নীলশার্ট, তুমি শুয়ে আছ কেন? উঠে দাঁড়াও

আমার ওঠার ক্ষমতা নেই স্যার।

উঠে দাঁড়াও, নয়তো লাথি বসিয়ে ওঠাব।

স্যার, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

দেখা যাক, সম্ভব কি সম্ভব নয়।

জনাথন অতিদ্রুত দুটি গুলি করল। শুয়ে থাকা নীল শার্ট পরা লোকটির মাথায় চুল ঘেষে গেল একটি, অন্যটি তার চেয়ে এক ইঞ্চি উপরে। সে লাফিয়ে উঠল।

গুড। দৌড়াও, শুয়ে পড়। আবার উঠে দাঁড়াও হাঁট দশ কদম। দৌড়াও।

সকাল আটটার দিকে অনেকেই বমি করতে শুরু করল। দৌড়ানোর ক্ষমতা রইল না অনেকেরই। জনাথন শীতল স্বরে বলল, স্কোয়াড হল্টা নাশতার জন্যে আধ ঘন্টার ব্রেক দেওয়া হল। আধ ঘন্টা পর শুরু হবে ফুট ড্রিল। ডিসমিস। আধ ঘন্টা পর সবাইকে এখানে চাই।

ফুট ড্রিলের ব্যাপারে জনাথনের বরাবরই দুর্বলতা আছে। সে মনে করে, দশ মিনিট ফুট ড্রিল দেখেই বলে দেওয়া যায় কে সত্যিকার সৈনিক, কে নয়। তা ছাড়া ফুট ড্রিল সৈনিকদের হুকুম তামিল করতে শেখায়। এবং একসময় তাদের রক্তে মিশে যায়, যা করতে বলা হবে তা করতে হবে। এর অন্য কোন বিকল্প নেই।

অ্যাটেনশন। স্ট্যান্ড এট ইজ। রাইট টান। স্কোয়াড় মার্চ। লেফট লেফট। লেফট লেফট। হল্ট। লেফট টার্ন স্কোয়াড মার্চ। লেফট লেফট। লেফট লেফট। হল্ট।  আধা ঘন্টা ফুট ড্রিলের পর ছটি দলকে তাদের নিজেদের এনসিওর হাতে ছেড়ে দেওয়া হল। এরা তার নিজের, নিজের দলকে দুপুর বারটা পর্যন্ত ফুট ড্রিল করাবে। জনাথন ঘুরেঘুরে দেখতে লাগল। কাজ ভালোই এগুচ্ছে। মাঝে-মাঝেই অবশ্যি জনাথনের উচ্চকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে, এই যে, তোমার নাম কি?

পিটার স্যার।

শোন পিটার, তোমার বাম হাত যদি ডান পার সঙ্গে সমান ভাবে ওঠানামা নাকরে, তাহলে বাম হাতটি টেনে ছিঁড়ে ফেলব। অবাধ্য হাতের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারছ?

পারছি স্যার।

এই যে তুমি, সাদাগেঞ্জি, ঠিকমতো পা ফেল। তুমি নিশ্চয়ই চাও না তোমার পা টেনে ছিঁড়ে ফেলি? নাকি চাও?

জনাথন আকাশের দিকে তাকাল। রোদের তেজ বাড়তে শুরু করেছে। ঘড়িতে বাজছে মাত্র সাড়ে দশটা। রোদ আরো বাড়বে। সে এনসিওদের ডেকে আনল।

এখন আমরা যাব বনে। গাছপালার ভেতর কীভাবে নিঃশব্দে দ্রুত হাঁটা যায়, সেটা শেখাব। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং। রোজ খানিকক্ষণ এই ট্রেনিং হবে। এখন সবাই দৌড়াও আমার সঙ্গে। স্কোয়াড কুইক মার্চ।

হাঁপাতে-হাঁপাতে দৌড়াতে শুরু করল সবাই। আকাশে গগনে সূর্য। দেখে মনে হচ্ছে ক্লান্ত মানুষগুলো যে-কোনো সময় একে অন্যের ওপর গড়িয়ে পড়বে।

দৌড়াও, দৌড়াও। বড়-বড় স্টেপ ফেল। এতে পরিশ্রম হবে কম। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে থাক। বাই দা লেফট। বাই দা লেফট।

বিকেল চারটায় সবাই এসে দাঁড়াল তাঁবুর সামনে। এন্ড্রু জনাথনের হাতে একটি রাইফেল। তার সামনে একটি টেবিলে একটি সাব-মেশিনগান। এন্ড্রু জনাথন রাইফেল হাতে এগিয়ে এল কয়েক পা। দলের সবাই খানিকটা পিছিয়ে গেল।

যে-রাইফেল তোমাদের দেওয়া হয়েছে, তার নাম কালাসনিকভ অ্যাসন্ট উইপন। সংক্ষেপে AK-7.62. সবাই একে আদর করে ডাকে কলা রাইফেল। তার কারণ, এর ম্যাগজিনগুলি হচ্ছে কলার মতো বাঁকানো। তোমরা তোমাদের স্ত্রীকে যেভাবে চেন, এই রাইফেলটিকে তার চেয়েও ভালোভাবে চিনবে। এর রেঞ্জ কম। কিন্তু দু শ গজ পর্যন্ত এটি অত্যন্ত নিখুঁত। এ দিয়ে একটি-একটি গুলি করা যায় আবার প্রয়োজনে প্রতি মিনিটে দু শ রাউন্ড করেও গুলি করা যায়। এটা হচ্ছে একটা ডিফেনসিভ উইপন।

এখন সবাই মন দিয়ে আমার এই উপদেশ শোন। যারা পুরোনো সৈন্য, তাদের এ উপদেশ জানা আছে, যারা নতুন, তাদের জানা নেই। তবে এ-উপদেশ সবার জন্যেই। এখন থেকে রাইফেলটি থাকবে তোমাদের সঙ্গে-সঙ্গে। বাথরুমে যাও, গোসলখানায় যাও বা ঘুমাতে যাও, রাইফেল থাকবে তোমার সঙ্গে, যতক্ষণ-না এটা তোমাদের একটি বাড়তি হাতের মতো হয়।

তোমরা নিজেদের শরীরের যেমন যত্ন নাও, রাইফেলটিকেও তেমনি যত্ন করবে। এখন তোমাদের দেখাচ্ছি এটা কী করে খুলতে হয় এবং ফিট করতে হয়।

 

রাতের খাওয়া সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে শেষ হয়ে গেল। সাড়ে সাতটায় মেসের হলঘরে জনাথন দেখাল লাইট RPD মেশিনগান।

তোমরা সবাই অস্ত্রটি ভালো করে চিনে রাখ, এর নাম RPD লাইট মেশিনগান। এটিও তৈরি হয়েছে শক্তিশালী একটি দেশে। তবে সেখানে এখন আর এর ব্যবহার নেই। পৃথিবীতে যে-কটি হালকা মেশিনগান আছে এটি হচ্ছে তার মধ্যে একটি। ওজন মাত্ৰ ১৯৩ পাউন্ড। ব্যানানা রাইফেলে যেগুলি ব্যবহার করা হয়, এতেও সেই গুলিই। ব্যবহার হয়। প্রতি মিনিটে এর সাহায্যে দু শ পঞ্চাশ রাউন্ড করে গুলি ছোঁড়া যায়। সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় একটি অস্ত্র, এবং চমৎকার একটি জিনিস। আমাদের যে-পাঁচটি দল আছে, তাদের সঙ্গে দুটি করে থাকবে। অর্থাৎ সর্বমোট দশটি অস্ত্র থাকবে। তবে সবাইকে এই অস্ত্র চালানো শিখতে হবে।

রাত আটটায় মেসঘরের বাতি নিভিয়ে দেওয়া হল। শেষ হল প্রথম দিনের ট্রেনিং।

জুলিয়াস নিশোর শরীর খুব খারাপ

হঠাৎ করে জুলিয়াস নিশোর শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছে। পুরোনো সব অসুখ নতুন করে দেখা দিতে শুরু করেছে। শ্বাসকষ্ট তার একটি। কাল রাতে খুব কষ্ট হল। এত বাতাস পৃথিবীতে, অথচ তিনি তাঁর ফুসফুস ভরাবার জন্যে যথেষ্ট বাতাস যেন পাচ্ছেন। না। আশেপাশে কেউ নেই যে ডেকে বলবেন পাশে এসে বস। হাত রাখ আমার বুকে।

শেষরাতের দিকে তাঁর মনে হল মৃত্যু এগিয়ে আসছে। তিনি মৃত্যুর পদধ্বনি শুনলেন। নিজেকে তিনি সাহসী মানুষ বলেই এতদিন জেনে এসেছেন। কাল সে-ভুল। ভাঙল। কাল মনে হল, তিনি সাহসী নন। মৃত্যুকে সহজভাবে নিতে পারছেন না। ভয় লাগছে। তীব্র ভয়, যা মানুষকে অভিভূত করে দেয়। মাওয়া সকালে খাবার নিয়ে এসে ভীত স্বরে বলল, আপনার শরীর বেশ খারাপ মনে হচ্ছে।

নিশো দুর্বল ভঙ্গিতে হাসলেন।

রাতে ভালো ঘুম হয় নি?

না।

রাতের খাবারও মনে হয় খান নি?

না, খাই নি।

মাওয়া চিন্তিত বোধ করল। এই লোকটিকে বিনা চিকিৎসায় থাকতে দেওয়া যায় না। অথচ ডাক্তার আনা মানেই বাইরের একজনকে জানানো নিশো বেঁচে আছেন।

ভালে কফি এনেছি, খাবেন?

না।

একটু খান, ভালো লাগবে।

মাওয়া কাপে কফি ঢালল। নিশো বললেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হচ্ছে প্রতীক্ষা করা। মনে কর, একটি অচেনা স্টেশনে তুমি অপেক্ষা করছ ট্রেনের জন্যে। ট্রেন আসছে না। কখন আসবে তুমি জান না। নাও আসতে পারে, কিংবা কয়েক মিনিটের মধ্যে এসে পড়তে পারে। কেমন লাগবে তখন মাওয়া?

মাওয়া জবাব দিল না।

আমার ঠিক সে-রকম লাগছে।

কফি নিন।

নিশো কফির পেয়ালা হাতে নিলেন, কিন্তু চুমুক দিলেন না। হালকা গলায় বললেন, অনেক দিন পর কাল রাতে একটা কবিতা লিখলাম। দীর্ঘ কবিতা। কবিতা তোমার কেমন লাগে?

ভালো লাগে না। সাহিত্যে আমার কোনো উৎসাহ নেই।

আমার ইচ্ছা করছে কবিতাটা কাউকে শোনাই। তুমি শুনবে?

মাওয়া জবাব দিল না। চিন্তিত মুখে তাকিয়ে রইল। নিশো হাত বাড়িয়ে কবিতার খাতা নিলেন। মাওয়া লক্ষ করল, খাতা নেবার মতো সামান্য কাজেও তিনি ক্লান্ত হয়েছেন। খাতাটি নেওয়ার সময় তাঁর হাত সামান্য কাঁপছিল।

নিশোভরাট গলায় পড়লেন–

জোছনার ছাদ ভেঙে পাখিরা যাচ্ছে উড়ে যাক বাতাসে, বারুদ গন্ধ থাক অনুভবে।

কবিতাটি দীর্ঘ। সেখানে বারবার বারুদের গন্ধের কথা আছে। মাওয়া কিছুই বুঝল না, বোঝার চেষ্টাও করল না।

কেমন লাগল?

ভালো।

মাওয়া, আমি সম্ভবত একমাত্ৰ কবি, যে কখনো প্রেমের কবিতা লেখে নি। প্রেমের মতো একটি বড় ব্যাপারকে আমি অগ্রাহ্য করেছি।

আপনি শুয়ে থাকুন। বেশি কথা বলাটা ঠিক হবে না।

এখন কেন যেন শুধু প্রেমের কবিতা লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে। কয়েক দিন ধরেই ভাবছি, একটি দীর্ঘ প্রেমের কবিতা লিখব। প্রথম লাইনটিও ভেবে রেখেছি—আমার ভোরের ট্রেন। মা বললেন—ঘুমো, তোকে ডেকে দেব ফজরের আগে। লাইনটি। কেমন?

ভালো।

ছেলেটি শুয়ে থাকবে, কিন্তু ঘুমুতে পারবে না। পাশের বাড়ির কিশোরী মেয়েটির কথা শুধু ভাববে।

আপনি শুয়ে থাকুন, আমি সন্ধ্যাবেলা একবার আসব। চেষ্টা করব একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে।

সেই ডাক্তার এক জন মৃত মানুষকে বসে থাকতে দেখে অবাক হবে না তো?

মাওয়া কিছু বলল না। নিশো বললেন, আমরা খুব-একটা খারাপ সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এক জন জীবিত মানুষকে মৃত বানিয়ে রেখেছি। জেনারেল ডোফা যথেষ্ট বুদ্ধিমান, কিন্তু এই একটি কাঁচা কাজ সে করেছে।

মাওয়া কিয়ে রইল।

ঘটনাটি প্রকাশ হবে। তুমি নিজেই একদিন বলবে। তুমি না-বললেও কেউ-না- কেউ বলবে–বলবে না?

হয়তো বলবে।

একজন মানুষকে মেরে ফেলা এক কথা, কিন্তু একজন জীবিত মানুষকে মৃত বলে ঘোষণা দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।

আপনি বিশ্বাস করুন, আমি সন্ধ্যাবেলা আসব।

আমার মনে হয় না তুমি সন্ধ্যাবেলা আসবে। তুমি হচ্ছ একজন রাজনীতিবিদ, যারা কথা দেয় কিন্তু কথা রাখে না। তুমি অনেক বার বলেছিলে রাতে আমার মুখের ওপর এই বাতিটি জ্বালিয়ে রাখবে না, কিন্তু বাতি ঠিকই জ্বলছে।

মাওয়া ঘর ছেড়ে চলে গেল। সন্ধ্যাবেলা সে ঠিকই এল না, তবে প্রথম বারের মতো মুখের ওপরের বাতি নিভে গেল। অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। ভয়ানক অন্ধকার। নিশোর মনে হল, বাতি থাকলেই যেন ভালো হত।

ট্রেনিংয়ের ধরন পাল্টেছে

ট্রেনিং ক্যাম্প।

লরেনকো মারকুইস।

২৩ ডিসেম্বর। মঙ্গলবার।

মোজাম্বিক, আফ্রিকা।

ট্রেনিংয়ের ধরন পাল্টেছে। এন্ড্রু জনাথনের সঙ্গে যোগ দিয়েছে রবিনসন। তার ট্রেনিং জনাথনের মতো ভয়াবহ নয়। রবিনসন কথা বলে নিচু গলায় এবং হাসিমুখে। কমান্ডোদের জন্যে এটা একটা বড় পাওনা। জনাথনকে তারা ভয় করে। ভালবাসে রবিনসনকে।

মঙ্গলবারের ভোরবেলায় রবিনসন সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। তারা প্রায় চল্লিশ মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। জনাথনের বেলায় তা হত না। এই চল্লিশ মিনিট সে কাটাত ফুট ড্ৰিল করিয়ে।

রবিনসনের চোখে সানগ্লাস। মাথার ধবধবে সাদা চুল বাতাসে উড়ছে। তার হাতে একটা কফির মগ। সে কফিতে চুমুক দিচ্ছে এবং এক জন এক জন করে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। তার মাথায় কোনো পরিকল্পনা আছে নিশ্চয়ই।

কমান্ডোরা, এবার আমরা ট্রেনিংয়ের মূল পর্যায়ে এসে গেছি। তোমরা তোেমাদের সামনে হার্ডবোর্ডের যে-জিনিসগুলি দেখছ, সেগুলি ফোর্টনকের আদলে তৈরি। ফটোগ্রাফ থেকে তৈরি করা হয়েছে। কাজেই মোটামুটি নিখুত বলা চলে। যে-সব জায়গায় সেন্ট্রি থাকে, সে-সব জায়গায় ডামি রাখা হয়েছে। রাস্তা দেখানো হয়েছে চকের গুঁড়ো দিয়ে। যেসব জায়গায় ডাবল লাইন দেখছ, সে-সব রাস্তা একটু উঁচু। ট্রিপল লাইন মানে আরো উঁচু।

লক্ষ করছ নিশ্চয়ই, ফোর্টনক কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। তবে সুখের বিষয়, কাঁটাতারের সঙ্গে কোনো অ্যালার্ম সিস্টেম নেই। কাজেই আমরা সহজেই কাঁটাতার কেটে ভেতরে ঢুকতে পারব। আমাদের হাতে চারটি ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যান আছে। প্রতিটি প্ল্যানই আমরা পরীক্ষা করব। কোন প্ল্যান নেওয়া হবে সেটা ঐ মুহূর্তেই ঠিক করা হবে। হয়তো এমন হতে পারে, সব কটি প্ল্যান বাতিল করে আমাদের নতুন কিছু ভাবতে হবে।……

যেমন ধর, আমরা জানি ফোর্টনকে বর্তমান সৈন্যসংখ্যা তিন শ পঞ্চাশ। গিয়ে দেখলাম রাতারাতি সেখানে এক ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। তখন নিশ্চয়ই আমাদের তৈরি প্ল্যান খাটবে না। কী বল?

স্যার, সেরকম কোনো সম্ভাবনা কি আছে?

থাকবে না কেন? নিশ্চয়ই আছে। কেন, ভয় লাগছে?

কমান্ডোদের মধ্যে বেশ কয়েক জন উঁচু গলায় হেসে উঠল। এমন করাটা জনাথনের সঙ্গে সম্ভব ছিল না।

প্রথম পরিকল্পনাটি এরকম—আমরা দক্ষিণ দিক থেকে আসব—এই যে দেখ, এইদিক থেকে। আট জন সেন্ট্রিকে শেষ করবার দায়িত্ব থাকবে আট জনের। ওপর। কাজটি করতে হবে বেয়োনেটের সাহায্যে, কোনক্রমেই গুলি করা যাবে না। ঠিক একই সময় দুজন চলে যাবে কারারক্ষী মাওয়ার বাসভবনে। মাওয়া থাকে এইখানে—দোতলায়। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি আছে। সিঁড়িতে কোনো দরজা নেই। মাওয়ার বাড়ির সামনে থাকে এক জন সেন্ট্রি। তাকে সামলানোর পর এরা ঢুকবে মাওয়ার ঘরে এবং চাবি নিয়ে দ্রুত চলে আসবে এই জায়গায়। এখানে আছেন জুলিয়াস নিশো। তারা চাবি নিয়ে এখানে এসেই দেখবে, আমি সেলের সামনে অপেক্ষা করছি।

স্যার, যদি চাবি না-পাওয়া যায়?

না-পাওয়া গেলেও কোনো সমস্যা হবে না। আমাদের সঙ্গে তালা ভাঙার যন্ত্র আছে। তবে আমি সেটা ব্যবহার করতে চাই না। এতে অনেক সময় নষ্ট হবে। আমাদের হাতে এত সময় নেই।

এবার আমি তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যারাকেই সব সৈন্যরা থাকবে। খুব সম্ভব ঘুমিয়ে থাকবে। আমাদের পনের জনের একটি দলের ওপর দায়িত্ব থাকবে ব্যারাক সামলানোর।

কিভাবে সামলানো হবে?

ভালোভাবেই সামলাতে হবে। আমরা পেছনে কিছু রেখে যাব না। এখন পর্যন্ত পঁচিশ জন কমান্ডো ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের হাতে আছে আরো পঁচিশ জন। ঠিক না?

জ্বি স্যার।

এই পঁচিশ জনের দশ জন থাকবে রিজার্ভে। এদের দায়িত্ব হচ্ছে নিশোকে ঠিকমত বের করে নিয়ে আসা।

বাকি পনের জনের?

বাকি পনের জনের দায়িত্ব ফোটনকে নয়। তারা সরাসরি চলে যাবে এয়ারপোর্টে। সেটা তারা দখল করবে এবং আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। তাদের দায়িত্বে থাকবে এমন একজন লোক, যার ওপর ভরসা করা চলে। বেন ওয়াটসন। বেন ওয়াটসন হচ্ছে একাই একটি ব্রিগেড। তোমরা যারা তার সঙ্গে কাজ করবে, তারাই সেটা টের পাবে। ফোর্টনকের জন্যে যেমন পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে, এয়ারপোর্টের জন্যে সেরকম কিছু তৈরি করা হয় নি। তার কারণ, বেন ওয়াটসন কোনো রকম প্ল্যানিং-এ বিশ্বাসী নয়। একেক জনের কর্মপদ্ধতি একেক রকম।…….

এখন আমরা এ-জায়গা থেকে পঁচিশ গজ দূরে চলে যাব। সবাইকে আমি কাজ ভাগ করে দেব। আমি দেখাব, কী করে আসতে হবে, কোন দিক দিয়ে আসতে হবে। এবং আমরা চেষ্টা করব, কত কম সময়ে কাজটা শেষ করতে পারি সেটা দেখতে। তোমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের হাতে সময় খুব কম, এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট। এর মধ্যে আমাদের কাজ শেষ করে প্লেনে উঠতে হবে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?

কাঁটাতারের বেড়া কে কাটবে?

রবিনসন হেসে ফেলল এবং হাসতে-হাসতে বলল, আমি। ঐ কাজটি আমি খুব ভালো করতে পারি। এস, এখন শুরু করা যাক। প্রথম প্ল্যানটি আমরা এখন দেখব। স্কোয়াড, অ্যাটেনশন। টু দা লেফট, কুইক মার্চ।

মোরান্ডা

মোরান্ডা।

২৪শে ডিসেম্বর। বুধবার। সকাল ৯টা।

জেনারেল ডোফা গার্ড রেজিমেন্ট পরিদর্শনে এসেছেন। তাঁর মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। তাঁর সঙ্গী-সাথীরা এর কারণ বুঝতে পারছিল না। তারা শঙ্কিত বোধ করছিল।

জেনারেল ডোফা পরিদর্শনের কাজ সারলেন। প্রথাগত বক্তৃতা দিলেন-সৈন্যদের কাজ হচ্ছে দেশের আদর্শকে সামনে রাখা। দেশের প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। পরিদর্শনের শেষে চা-চক্রের ব্যবস্থা ছিল। ডোফা চা-চক্রে রাজি হলেন না। আগের চেয়েও গম্ভীর মুখে প্রেসিডেন্ট হাউসের দিকে রওনা হলেন।

আজ ক্রিসমাস ইভ। ক্রিসমাস ইভের প্রাক্কালে তিনি সবসময়ই একটি ভাষণ দেন। সেই ভাষণ প্রচার হয় বেতার ও টিভিতে। আজকের ভাষণটি তৈরি হয়েছে এবং তাঁর কাছে কপি এসেছে। ভাষণ তাঁর পছন্দ হয় নি। বক্তৃতা-লেখককে কিছু কড়া-কড়া কথা শুনিয়েছিলেন। নতুন একটি ভাষণ তৈরি করে আনার কথা।

নতুন ভাষণটি আগেরটির চেয়েও বাজে হয়েছে। ডোফা ধমকে উঠলেন, এক জিনিসই তো আপনি লিখে এনেছেন। দু-একটা শব্দ এদিক-ওদিক হয়েছে। এর বেশি কিছুই তো করা হয় নি। নতুন কিছু লিখুন।

বক্তৃতা-লেখক বিনীতভাবে বললেন, কি লিখব, যদি একটু বলে দেন।

জুলিয়াস নিশোর কথা তো বক্তৃতায় কিছুই নেই। তাঁর কথা থাকা উচিত। তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে কি কি করা হবে তা বলা দরকার।

কি কি করবেন, স্যার?

সংগ্রহশালা করা যায়। এই জাতীয় কিছু লিখে আনুন, সব কি আমিই বলে দেব নাকি? মাউ উপজাতিদের সম্বন্ধেও কিছু লেখা উচিত। যান, নতুন করে লিখুন। আমার প্রতিটি বক্তৃতায় একই জিনিস থাকে।

বিকেলে তিনি গেলেন প্রেসিডেন্ট রেজিমেন্ট পরিদর্শনে। এটা তাঁর হঠাৎ পরিদর্শন। আগে কিছুই ঠিক করা ছিল না। তাঁর মুখ আগের মতোই গম্ভীর। প্রেসিডেন্ট রেজিমেন্টের জেনারেল র‍্যাবি এর কারণ বুঝতে পারলেন না। কোথাও কোনো ঝামেলা হয়েছে কি? হবার তো কথা নয়। সবকিছু বেশ স্বাভাবিক। প্রেসিডেন্ট কি মাউ উপজাতিদের নিয়ে চিন্তিতঃ চিন্তিত হবার মতো তেমন কোনো কারণ কি সত্যি-সত্যি আছে?

মাউদের কোনো অস্ত্ৰবল নেই। বর্শা এবং তীর-ধনুকের কাল অনেক আগেই শেষ হয়েছে। সাহসের এ-যুগে আর দাম নেই। পরিদর্শনপর্ব ভালোভাবেই শেষ হল। জেনারেল ডোফা সৈন্যদের আনুগত্য ও দেশপ্রেমের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বিশেষ করে প্রেসিডেন্টের রেজিমেন্ট যে পৃথিবীর যে-কোনোে সৈন্যবাহিনীর আদর্শস্থানীয় হতে পারে, সে-কথাও বললেন।

পরিদর্শনশেষে জেনারেল র‍্যাবির সঙ্গে তাঁর একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠক বসল। সেখানেও তিনি গম্ভীর হয়ে রইলেন। সাধারণত এ-জাতীয় বৈঠকগুলিতে তিনি মজার মজার কথা বলে আবহাওয়া হালকা করে রাখেন। আজ সেরকম হচ্ছে না। র‍্যাবি বললেন, স্যার, আপনার শরীর কি ভালো আছে?

শরীর ভালই।

আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।

না, চিন্তিত নই। তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। সেজন্যেই আমার আসা।

স্যার, বলুন। ফোর্টনকে এক শ জন কমান্ডার একটি দল পাঠাতে হবে।

কখন?

আজই।

জেনারেল রাবি কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। ডোফা বললেন, তুমি কি কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?

না স্যার, কিছু জিজ্ঞেস করতে চাই না। এক ঘন্টার মধ্যে হেলিকপ্টারে করে কমান্ডো পাঠানো হবে। ওদের ওপর কি কোন নির্দেশ থাকবে?

না, কোনো নির্দেশ নয়।

আপনি যদি চান আমি ওদের সঙ্গে থাকতে পারি।

না, তুমি রাজধানীতেই থাক।

জেনারেল র‍্যাবি ইতস্তত করে বললেন, ঠিক কি কারণে আপনি এটা চাচ্ছেন তা জানতে পারলে আমি সেভাবে ওদের নির্দেশ দিয়ে দিতাম।

ডোফা দীর্ঘ সময় চুপচাপ থেকে বললেন, তোমাকে বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে। আমি খারাপ ধরনের স্বপ্ন দেখেছি।

কি দেখেছেন স্বপ্নে?

আমার মধ্যে কিছু কুসংস্কার আছে।

সে তো আমাদের সবার মধ্যেই আছে। আইনস্টাইনের মধ্যেও ছিল বলে শুনেছি।

ডোফা থেমে-থেমে বললেন, স্বপ্নটা দেখলাম ভোেররাত্রে। যেন ফোর্টনক থেকে জুলিয়াস নিশো বের হয়ে আসছেন। তাঁর সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মাউ উপজাতীয়। তারা ছুটে আসছে রাজধানীর দিকে। ডোফা কপালের ঘাম মুছলেন।

জুলিয়াস নিশোকে নিয়ে আপনি চিন্তিত, সেকারণেই এ-রকম স্বপ্ন দেখেছেন। অন্য কোনো কারণ নেই। আমি কি স্যার আপনাকে একটি পরামর্শ দিতে পারি?

হ্যাঁ, পার।

নিশোর ব্যাপারটা ঝুলিয়ে রাখবেন না, চুকিয়ে দিন। স্বপ্নের ব্যাপারটাও ভুলে যান।

এ-রকম বাস্তব স্বপ্ন আমি খুব কম দেখেছি। ভোররাত্রের স্বপ্ন, তা ছাড়া এটা আমার জন্মমাস।

আমি স্যার ঠিক এই মুহূর্তে ফোর্টনকে কমান্ডো পাঠানো সমর্থন করি না। কমান্ডো পাঠানো মানেই দৃষ্টি আকর্ষণ করা। আমাদের যা করতে হবে, তা হচ্ছে। কারো দৃষ্টি আকর্ষণ না-করে কাজ সারা। তবে আপনি চাইলে এক ঘন্টার ভেতর আমি এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পাঠাতে পারি। স্যার, পাঠাব?

ডোফা উঠে দাঁড়ালেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন, দরকার নেই।

 

সন্ধ্যায় তিনি একটি চমৎকার ভাষণ দিলেন জাতির উদ্দেশ্যে। সেই ভাষণে জুলিয়াস নিশোর কথা এল

আজ আমি গভীর দুঃখের সাথে স্মরণ করছি প্রয়াত নেতা জুলিয়াস নিশোকে, যাঁর চিন্তায় ও কর্মে জাতির আশা-আকাঙ্খ প্রতিফলিত হয়েছে। যাঁর রচনাবলী আমাকে দিয়েছে নতুন জীবনের সন্ধান। যে-জীবন সুখ ও সমৃদ্ধির, যেজীবন আশা ও আনন্দের।

আমি তাঁর স্মৃতিকে চির জাগরুক রাখার জন্যে জুলিয়াস নিশো সংগ্রহশালা স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছি। তাঁর রচনাবলী যাতে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছতে পারে, সেজন্যে সরকারী পর্যায়ে রচনাবলী প্রকাশের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারের তথ্য ও প্রচার দপ্তরের হাতে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং আমার বিশ্বাস তারা সুষ্ঠুভাবে সেদায়িত্ব পালন করবে।

রাতে গোয়েন্দা দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ব্রিগেডিয়ার সালকের সঙ্গে তিনি দীর্ঘ। সময় কাটালেন। তাদের মধ্যে নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল—

ডোফা : মাউরা কি জুলিয়াস নিশোর মৃত্যুসংবাদ বিশ্বাস করেছে?

নুসালকে : করেছে স্যার। এরা সরল প্রকৃতির মানুষ, সবকিছুই বিশ্বাস করে।

ডোফা : বিশ্বাস যদি করে থাকে, তা হলে এরকম ভয়াবহ একটি গুজব ছড়াল কিভাবে? কেন তাদের ধারণা হল জুলিয়াস নিশো আবার ফিরে আসবেন?

নুসালকে: স্যার, মাউ হচ্ছে একটি কুসংস্কার-আচ্ছন্ন অন্ধকার উপজাতি।

ডোফা : অন্ধকার উপজাতি থোক আর যাই হোক, এরকম একটি গুজবের পেছনে কোনো একটা ভিত্তি তো থাকবে?

নুসালকে : আমি এ নিয়ে প্রচুর খোঁজখবর করেছি এবং এখনো করছি। গুজবের কোন ভিত্তি পাই নি। এটা মুখে-মুখে ছড়িয়েছে। প্রচারটা হয়েছে এভাবে-মাউ জাতির চরম দুর্দিনে জুলিয়াস নিশো ফিরে আসবেন এবং জাতিকে পথ দেখাবেন। সে দিনটি হবে মাউদের চরম সৌভাগ্যের দিন। অনেকটা পথপ্রদর্শকের মতো।

ডোফা : তাই দেখছি। এরা তা গভীরভাবে বিশ্বাস করে?

নুসালকে : জ্বি স্যার, করে।

ডোফা : এই বিশ্বাস ভাঙানোর জন্যে আমাদের কি করা উচিত?

নুসালকে : এই বিশ্বাস ভাঙানোর কোনো রকম চেষ্টা না-করাই উচিত।

ডোফা : কেন?

নুসালকে : যত দিন এই বিশ্বাস থাকবে তত দিন তারা চুপ করে থাকবে। তারা অপেক্ষা করবে জুলিয়াস নিশোর জন্যে।

ডোফা : ভালোই বলেছ। তোমার আইডিয়া আমার পছন্দ হয়েছে।

 

রাত এগারটার দিকে তিনি ফোর্টনকের কারাধ্যক্ষ মাওয়ার সঙ্গে ওয়্যারলেসে কথা বললেন।

কেমন আছ, মাওয়া?

জ্বি স্যার, ভালো। আপনার শরীর কেমন?

আমি ভালেই আছি।

আপনার বক্তৃতা শুনলাম স্যার। চমৎকার।

ধন্যবাদ। তোমাদের ওখানকার সব ঠিক তো?

সব ঠিক আছে।

আমাদের বন্দির খবর কি?

খবর ভালো স্যার। একটু অসুস্থ, তবে তেমন কিছু না।

ডোফা ওয়্যারলেস সেট রেখে দিলেন। সেই রাতেও তাঁর ভালো ঘুম হল না।

মেসঘরে ঢুকে সবাই অবাক হল

ট্রেনিং ক্যাম্প।

লরেনকো মারকুইস।

মোজাম্বিক, আফ্রিকা।

২৪শে ডিসেম্বর। বুধবার।

সন্ধ্যা ৭টা।

মেসঘরে ঢুকে সবাই অবাক হল। বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। টি বোন স্টেক, বেকড পটেটো, লাসানিয়া এবং পর্তুগিজ রেড ওয়াইন। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। শেফ এসে বললটি বোন স্টেক প্রচুর আছে, কারো দরকার হলে তাকে জানালেই হবে। তবে রেড ওয়াইনের সাপ্লাই কম। নিম্নমানের কিছু হোয়াইট ওয়াইন আছে। প্রয়োজনে দেওয়া যেতে পারে।

মেসঘরে রীতিমতো হৈচৈ পড়ে গেল। সাধারণত সাড়ে সাতটার মধ্যে খাবার পর্ব শেষ হয়। আজ আটটা বেজে গেল। তবু কয়েক জনকে ব্যস্ত দেখা গেল।

শেফ এসে বলল, ডিনার শেষ হবার পর হার্ভি ফকনার কিছু বলবেন। সবাইকে থাকতে বলা হয়েছে।

আগামীকাল ক্রিসমাস। সেই উপলক্ষে ছুটি এবং বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা হবে হয়তে। শহরে নিয়ে যাওয়া হবে। আফ্রিকান মেয়েদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর একটা সুযোগ হবে। মন্দ কী?

হার্ভি ফকনার মেসঘরে ঢুকল হাসিমুখে। তার স্বভাবসুলভ অন্তরঙ্গ স্বরে বলল, খাবার পছন্দ হয়েছে?

হয়েছে, হয়েছে।

রেড ওয়াইন কেমন ছিল?

অপূর্বতবে স্যার, পরিমাণ খুবই কম।

আলো জিনিস কমই খেতে হয়। তোমাদের জন্যে একটা জরুরি খবর নিয়ে এসেছি। আমাদের ওড়বার সময় হয়েছে।

মেসঘরে একটি নিস্তব্ধতা নেমে এল। কেউ শ্বাস ফেললেও শোনা যাবে এমন অবস্থা।

আমরা রাত বারটায় এখান থেকে রওনা হব। এয়ারপোর্টের দিকে। পৌঁছতে লাগবে এক ঘন্টা। সেখানে আমাদের জন্যে একটা ট্রান্সপোর্ট বিমান অপেক্ষা করছে। ভোর সাড়ে তিনটায় আমরা পৌঁছে যাব।

কোথায়?

কোথায় যাব এটা বলার সময় এসেছে। আমরা যাচ্ছি মোরান্ডায়।

মেসঘরে একটি মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। হার্ভি কথা বলা শুরু করার সঙ্গে-সঙ্গে গুঞ্জন থেমে গেল।

অনেক বার বলা হয়েছে, তবু আরেক বার বলছি, বিমান থেকে প্যারাশুট দিয়ে জ্যাম্প করবার পর আমাদের হাতে সময় থাকবে এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট। এই সময়ের ভেতর কাজ শেষ করতে না-পারলে মোরান্ডা থেকে জীবিত অবস্থায় কেউ বের হয়ে আসতে পারব না।

মেসঘরে কোনো শব্দ হল না।

একটি কথা আমি সবাইকে মনে রাখতে বলছি। সেটা হচ্ছে, আমাদের বিপক্ষে যেসেনাবাহিনী আছে তা যথেষ্টই শক্তিশালী। জেনারেল ডোফা হচ্ছেন মোরান্ডার প্রধান সামরিক প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট। তিনি একজন প্রথম শ্রেণীর জেনারেল। কারো কিছু বলার আছে?

কেউ কিছু বলল না।

তা হলে যাত্রার প্রস্তুতি নেওয়া যাক। বন্ধরা, শুভ যাত্ৰা। তৈরি হতে শুরু কর।

রবিনসন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে একটি চিঠি লিখল পিটারকে। চিঠিটি তার পছন্দ হল না, সে আবার একটি লিখল। সেটিও পছন্দ হল না। মানসিক উত্তেজনায় এটা হচ্ছে। যা লিখতে ইচ্ছা হচ্ছে তা লেখা হচ্ছে না। সে তৃতীয় চিঠিটি লিখতে শুরু করল।

 

প্রিয় পিটার, তুমি কেমন আছ? আগামী কাল ক্রিসমাস। নিশ্চয়ই তোমার মা এসে গেছেন এবং তোমার দুই বোনটিও এসেছে। আমি কল্পনায় দেখছি তোমরা ক্রিসমাস টি সাজাতে শুরু করছ। আহু, যদি থাকতে পারতাম। খুব ইচ্ছা হচ্ছে ক্রিসমান টি সাজানোর ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য করি। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছা কখনো পূর্ণ হয় না। এই সত্যটি তুমি যত বড় হবে, ততই বুঝবে। তোমাকে একসময় কথা দিয়েছিলাম কখনো তোমাকে ছেড়ে যাব না। কিন্তু একসময় চলে গেলাম। এবং হয়তো আর ফিরব না। যদি এরকম কিছু হয়, দুঃখ করবে না। মানুষের জীবনটাই এরকম। যখন বড় হবে, তখন তোমার মা তোমাকে সব বুঝিয়ে দেবেন কিংবা তুমি নিজেই সব বুঝতে পারবে। আজ আমাকে যতটা হৃদয়হীন মনে হচ্ছে, সে-দিন হয়তো ততটা মনে হবে না। হয়তো খানিকটা ভালো বাসবে। এই জিনিসটির অভাব আমি সারা জীবন অনুভব করেছি। আজকের এই ক্রিসমাস ডের চমৎকার রাতে প্রার্থনা করছি যেন ভালবাসার অভাবে তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে না হয়। চুমু নাও।

রবিনসন

 

রবিনসন চিঠি খামে ভরে ঠিকানা লিখল। এই চিঠি নিজের হাতে পোস্ট করে যেতে হবে। সবচেয়ে কাছের পোস্ট বক্স এখান থেকে প্রায় ছ মাইল। জিপ নিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু রবিনসন ঠিক করল হেঁটেই যাবে। হাতে এখনো প্রচুর সময়। বারটা বাজতে দেরি আছে।

ক্যাম্পের গেটে ফকনার দাঁড়িয়ে চুরুট টানছিল। সে ভুরু কুঁচকে বলল, কোথায় যাচ্ছ?

চিঠি পোস্ট করতে। পিটারকে একটা চিঠি লিখেছি।

পোস্ট করার জন্য তোমাকে যেতে হবে কেন? এখানে রেখে দাও। যথাসময়ে পোস্ট হবে।

এটা আমি নিজেই পোস্ট করতে চাই। আমার ধারণা পিটারের কাছে এটাই হবে আমার শেষ চিঠি।

এরকম মনে হবার কারণ কি?

মৃত্যুর ব্যাপারটি মানুষ আগেই টের পায়।

তুমি শুধু-শুধু ভয় পাম্। তুমি ফিরে আসবে।

রবিনসন কোন কথা বলল না। ফকনার বলল, কাউকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও। একা যে না।

কেন? তোমার কি ধারণা আমি পালিয়ে যাব?

ফকনার তার জবাব দিল না। গম্ভীর মুখে দ্বিতীয় সিগারেটটি ধরাল এবং হাত ইশারা করে বলল, ঐ ওকে সঙ্গে নিয়ে যাও।

বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। রাস্তা গিয়েছে বনের ভেতর দিয়ে। নিৰ্জন রাস্তা শীতল হাওয়া বইছে। রবিনসন মৃদু গলায় বলল, তোমার কি ঠাণ্ডা লাগছে?

তাঁর সঙ্গী বলল, জ্বিনা স্যার।

আমাকে স্যার বলার দরকার নেই। নাম ধরে ডাকবে। তোমার কি নাম?

জলিল।

হাঁটতে ভালোই লাগছে, কি বল জলিল?

জ্বি স্যার।

রবিনসন হঠাৎ করেই তার নাতি প্রসঙ্গে কথা বলতে শুরু করল। সে কেমন একা-একা কথা বলে। একদিন দেখা গেল সে একটা কসমস ফুল তুলে এদিক-সেদিক তাকিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছে। তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করাতে সে বলেছে, খুব সুন্দর তো, তাই খেতে ইচ্ছা করে। রবিনসন রাস্তা কাঁপিয়ে হাসতে লাগল। তার সঙ্গীও হাসল।

একটিই নাতি আপনার? হ্যাঁ। বড় চমৎকার ছেলে।

ইঞ্জিনের হুম-হুম গর্জন

২৫শে ডিসেম্বর। রাত ৩টা

প্লেন উড়ে চলছে।

ইঞ্জিনের হুম-হুম গর্জন ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। কেবিন-লাইট জ্বলছে। কমান্ডোদের দেখা যাচ্ছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকতে। প্রথম দিকে তারা নিজেদের মধ্যে মৃদুস্বরে কথাবার্তা বলছিল। এখন আর বলছে না।

সময় যতই ঘনিয়ে আসেছ উত্তেজনা ততই বাড়ছে। সবার চেহারায় তার ছাপ পড়েছে। একমাত্র নির্বিঘ্নে ঘুমুচ্ছে বেন ওয়াটসন। এই একটি লোকের মধ্যেই কোনো রকম বিকার নেই।

কেবিন-লাইটের পাশেই একটি লাল বাতি জ্বলে উঠল, যার মানে, প্লেনের ক্যাপ্টেন কথা বলতে চান। ফকনার হেডফোন কানে পরে নিল।

হ্যালো, ফকনার বলছি।

আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি স্যার।

তাই নাকি?

কুড়ি মিনিটের মাথায় ড্রপিং জোনে চলে আসব। আপনি সবাইকে তৈরি হতে বলুন।

বাইরের আবহাওয়া কেমন?

খুব ভালো বলা চলে না। শক্ত বাতাস বইছে।

ফকনার ভ্রূ কোঁচকাল। ক্যাপ্টেন বলল, আমি কেবিনের বাতি কমিয়ে দিচ্ছি, যাতে চোখে অন্ধকার সয়ে যায়।

ঠিক আছে।

প্লেনের গতি কমে আসছে। নিচে নেমে এসেছে বেশ খানিকটা। দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। বাইরের প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটায় প্লেন এখন কেঁপেকেঁপে উঠছে। কেবিনের ভেতরটা প্রায় অন্ধকার।

ফকনার গম্ভীর গলায় বলল, অস্ত্ৰ, যন্ত্রপাতি, রসদ এবং প্যারাশুট সবাই পরীক্ষা করে নাও। তোমাদের নিজেদের পরীক্ষা শেষ হলে জনাথন পরীক্ষা করে দেখবে।

বেন ওয়াটসন উঠে বসেছে। সে তাকিয়ে আছে। কেবিনে ঠিক এই মুহূর্তে প্রচণ্ড কৰ্মব্যস্ততা। ফকনার বলল, বাইরে দমকা হাওয়া আছে কাজেই প্যারাশুট খোলার ব্যাপারে খুব সাবধান। মাটির কাছাকাছি না পৌঁছা পর্যন্ত কেউ ফিতা টানবে না, তার আগে ফিতা টানলে বাতাস ভাসিয়ে অনেক দূর নিয়ে যাবে।….

সবার আগে নামবে বেন ওয়াটসন এবং তার দল। তারা নেমে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে না, দ্রুত চলে যাবে এয়ারপোর্টে।

সবার প্রথমে ঝাঁপ দিল ওয়াটসন। ঠাণ্ডা বাতাস বাইরে। নিচের মাটি দ্রুত কাছে এগিয়ে আসছে। আকাশভর্তি তারা। বেন ওয়াটসনের এক বার মনে হল, প্যারাশুট খোলার ফিতা না টানলে কেমন হয়? এটি একটি পুরোন অনুভূতি। প্যারাশুট নিয়ে লাফিয়ে পড়বার পর প্রায় সবারই এটা হয়। অনেকেই শেষ পর্যন্ত ফিতা খুলতে পারে না।

বেন ওয়াটসন মাটিতে নেমেই ঘড়ি দেখল। তিনটা পঞ্চান—পনের মিনিট লেট। তিনটা চল্লিশের ভেতর সবার মাটিতে পা রাখার কথা।

সে তাকাল আকাশের দিকে। একে-একে নামছে সবাই। সে গুনতে চেষ্টা করল—এক, দুই, তিন, চার পাঁচ…..

চারদিকে অন্ধকার

২৫শে ডিসেম্বর। ভোর ৪টা।

চারদিকে অন্ধকার। সূর্য ওঠার এখন এক ঘন্টা দশ মিনিট দেরি। এয়ারপোর্টে পৌঁছতে লাগবে কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট। বেন ওয়াটসন তার দল নিয়ে ছুটতে শুরু করল। তিরিশ কিলোমিটার—এমন কোনো দূরের পথ নয়। তারা ছোটার গতি আরো বাড়িয়ে দিল। কারো মুখেই ক্লান্তির কোন ছাপ নেই। কোন শব্দও উঠছে না।

বেন ওয়াটসনের মনে হল, জনাথন এদের ভালোই ট্রেনিং দিয়েছে। এয়ারপোর্টে পৌঁছে বেন ওয়াটসনের বিস্ময়ের সীমা রইল না। একটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত জায়গা। একতলা একটি দালানে মজুরশ্রেণীর পাঁচ-ছ জন জড়াজড়ি হয়ে ঘুমুচ্ছে। এছাড়া ত্ৰিসীমানায় কেউ নেই। ঘরের দরজা-জানালা ভাঙা ভাঙা জানালায় হু-হু করে হাওয়া খেলছে।

লোকগুলি ঘুম ভেঙে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বেন ওয়াটসন জিজ্ঞেস করল, কেউ ইংরেজি জান?

কোনো উত্তর নেই। ওরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।

কেউ ইংরেজি জান না?

ওরা নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করল। এদের দেখে মনে হয় না কেউ ইংরেজি জানে।

কেউ জানে না?

স্যার, আমি জানি।

তুমি কে? আমি স্যার একজন কন্ট্রাক্টর। এই এয়ারপোর্ট ঠিক করার কন্ট্রাক্ট নিয়েছি।

ভালো করেছ। এখানে কোনো পাহারা থাকে না?

জ্বিনা স্যার, পাহারা থাকবে কেন?

তাও তো কথা। রানওয়ে ঠিক আছে?

আছে স্যার। মোটামুটি আছে। আপনারা কারা?

আমরা কারা তা দিয়ে তোমাদের দরকার নেই। তোমরা গরম পানির ব্যবস্থা করতে পারবে?

পারব স্যার। পানির ব্যবস্থা কর। আর শোন, তোমাদের কেউ এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করবে না। যদি আমরা বুঝতে পারি তোমাদের কোনো মতলব আছে, তা হলে সঙ্গে-সঙ্গে গুলি করা হবে। আমরা মানুষ ভাল নই।

কতটুকু গরম পানি করব স্যার?

আমার কাছে কফি বিস আছে। সবাই মিলে কফি খাব, কাজেই বুঝতে পারছ কতটুকু পানি লাগবে।

জ্বি স্যার।

পানি গরম হবার পরপর তুমি তোমার লোকজন নিয়ে রানওয়ে পরীক্ষা করতে যাবে। একটা ডেকোটা প্লেন নামবে। ঠিকমতোনামতে পারে যাতে, সে-ব্যবস্থা করবে। তোমাদের কাছে কিছু মালমশলা নিশ্চয়ই আছে।

আছে স্যার। গুড, ভেরি গুড।

বেন ওয়াটসন কফির পেয়ালা হাতে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল। তার মুখ ভাবলেশহীন। এয়ারপোর্ট দখল করতে তাকে একটি গুলিও খরচ করতে হয় নি, এটা তাকে মোটও প্রভাবিত করে নি। তাকে দেখে মনে হয়, এরকম হবে তা সে জানত।

শীতের ভোরবেলায় গরম কফি চমৎকার লাগছে। বেন ঘড়ি দেখল। ফোর্টনকে। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

মাওয়া জেগে উঠল

২৫শে ডিসেম্বর। ভোর ৫-১০।

মাওয়া জেগে উঠল প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দে। শব্দ কমে আসতেই সে শুনল একসঙ্গে অনেকগুলি সাব-মেশিনগান থেকে কানে তালা ধরানোর মতো আওয়াজ আসছে। সে-শব্দও থেমে গেল। আলাদা-আলাদাভাবে গুলির শব্দ হতে থাকল। কী হচ্ছে এসব? আবার একটি বিস্ফোরণ। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। মনে হল ফোর্টনকের সবটাই উড়ে গেছে। দরজা-জানালা সব ভেঙে গেছে নাকি? মাওয়া হতভম্ব হয়ে উঠে বসল বিছানায়, ঠিক তখনি বন্ধ দরজা কে যেন লাথি মেরে ভাঙল।

তুমি মাওয়া?

মূর্তির মতো মাথা নাড়ল মাওয়া।

আমরা নিশোকে নিতে এসেছি। তুমি চাবি নিয়ে আমার সঙ্গে এস।

কিসের চাবি?

কোনো বাজে কথা বলবে না। একটি বাজে কথা বলবে গুলি করে এখানেই শেষ করে দেব।

সাব-মেশিনগান থেকে আবার শব্দ আসছে। একটিমাত্র সাব-মেশিনগান। অনবরত ক্যাটক্যাট শব্দ। ভয়াবহ কিছু-একটা হয়ে গেছে।

মাওয়া অনুগত ছেলের মতো চাবির গোছা হাতে নিচে নেমে এল। সিঁড়ির মাথায় দেখা গেল আরেক জনকে দাঁড়িয়ে থাকতে। সেই লোকটি ভারি গলায় বলল, এই কি মাওয়া?

জ্বি স্যার।

ভালো। মাওয়া, আমি ফকনার। তোমাদের সৈন্যবাহিনীর এমন খারাপ অবস্থা, আমার ধারণা ছিল না। একদল গার্লস-গাইডও তো এর চেয়ে ভালো ডিফেন্স দিত। এইসব অপদার্থদের তো লাথি দিয়ে নদীতে ফেলে দেওয়া উচিত।

সূর্য এখনো ওঠে নি। তবু আবছাভাবে সবকিছু দেখা যাচ্ছে। মাওয়া ভালো-মতো চারদিকে তাকানোরও সাহস পাচ্ছে না। কোথাও কোনো শব্দ হচ্ছে না। শুধু ফ্যামিলি কোয়ার্টারগুলি থেকে মেয়েদের চেচিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে। সৈন্যবাহিনীর ব্যারাক মোটামুটিভাবে একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মাওয়া সেলের তালা খুলল। সেলে ঢুকল হার্ভি ফকনার।

সুপ্রভাত জুলিয়াস নিশো।

নিশো কিছু বললেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

আপনি কেমন আছেন?

আমি ভালেই আছি। কিন্তু হচ্ছে কি?

তেমন কিছু না। আমরা আপনাকে নিতে এসেছি।

তোমরা কারা?

আমরা হচ্ছি বুনো হাঁস। আমার মনে হয় না আপনি হাঁটতে পারবেন।

ফকনার ইশারা করতেই এক জন এসে তাঁকে পিঠে তুলে নিল। নিশো মৃদুস্বরে বললেন, অনেক কিছুর পিঠেই চড়েছি, মানুষের পিঠে কখনো চড়ি নি।

ফকনার বলল, আপনাকে অল্প কিছু সময় কষ্ট করতে হবে মিঃ নিশো। ভোর ছটা পঁচিশে আমাদের উদ্ধারকারী প্লেন আসবে। এখানে এমন কিছু কি আছে, যা আপনি সঙ্গে নিতে চান?

না। কয়েকটি প্রেমের কবিতা লিখেছিলাম, সেগুলি আমি মাওয়াকে দিয়ে যেতে চাই।

মাওয়াকে দেওয়া অর্থহীন, ওকে আমি এক্ষুনি মেরে ফেলব।

অসম্ভব। আমার চোখের সামনে কাউকে হত্যা করতে পারবে না।

চোখের আড়ালেই করা হবে।

না না। দয়া কর।

ফকনার হেসে ফেলল।

নিশো চোখ বন্ধ করে উচ্চৈস্বরে বললেন, ঈশ্বর, দয়া কর। বলেই খেয়াল হল—তিনি একজন নাস্তিক। তবু তিনি আবারও ঈশ্বরের নাম নিলেন।

এয়ারপোর্টে সবাই অপেক্ষা করছে

২৫শে ডিসেম্বর। ভোর ৬-২০।

এয়ারপোর্টে সবাই অপেক্ষা করছে। ফকনারের হাতে সিগারেট। তার মুখ হাসি-হাসি। পঞ্চাশ জন মাভোর সবাই আছে। একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। বিশ্বাস হয়েও হতে চায় না। কিন্তু এটা স্বপ্ন নয়-সত্যি। ঐ তো জুলিয়াস নিশো চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে আছেন।

ইঞ্জিনের আওয়াজ আসছে। প্ৰেন এসে পডল বোধহয়। রানওয়ে ভালো নয়, তব প্লেনের নামতে বা উঠতে অসুবিধা হবে না। ডাকোটা প্লেনগুলি ধানখেতেও নেমে পড়তে পারে। ফকনার চেচিয়ে উঠল, স্কোয়াড, অ্যাটেনশন। গেট রেডি।

কমান্ডোদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য জাগল। হ্যাঁ, প্লেন দেখা যাচ্ছে। ডাকোটা প্লেন। ফকনারের নির্দেশে ওয়্যারলেসে প্লেনের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে।

হ্যালো ডাকোটা। বুনো হাঁস কলিং। হ্যালো ডাকোটা, বুনো হাঁস কলিং-ওভার। হ্যালো ডাকোটা।

প্লেনের পাইলটকে শেষ পর্যন্ত ধরা গেল। ফকনার কথা বলবার জন্যে এগিয়ে এল।

গুড মনিং ডাকোটা অ্যান্ড হাপি ক্রিসমাস।

হ্যাপি ক্রিসমাস। কর্নেল ফকনার?

হ্যাঁ।

তোমার জন্যে একটি বড় রকমের দুঃসংবাদ আছে।

বলে ফেল।

আমি তোমাদের নেবার জন্যে নামছি না। কিছুক্ষণ আগেই আমাকে জানানো হয়েছে যে, নিশোকে উদ্ধারের যে-মিশন পাঠানো হয়েছে, তা বাতিল করা হয়েছে।

কেন?

জেনারেল ডোফার সঙ্গে আমেরিকান সরকারের চুক্তি হয়েছে, তারা এখন ডোফাকেই রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে চায়।

ভালো কথা। আমাদের কি হবে?

পাইলট সে-কথার কোনো জবাব দিল না। বিমানটি এয়ারপোর্টের ওপর দুবার চক্কর দিয়ে দক্ষিণ দিকে উড়ে গেল।

সবাই তাকাচ্ছে, কিছু-একটা শুনতে চায় ফকনারের কাছ থেকে। কি বলা যায়? ফকনার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, বন্ধুরা, চমৎকার একটি সকাল।

রবিনসন ভ্রূ কুঁচকে বলল, ব্যাপারটা কি?

ফকনার জবাব দিল না। এক দল থুথু ফেলল। পকেট থেকে সিগারেট বের করল। প্যাকেট বাড়িয়ে দিল রবিনসনের দিকে। রবিনসন বিরক্ত মুখে বলল, আমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি।

ক্যানসারের ভয়ে?

রবিনসন ঠান্ডা গলায় বলল, কেন আজেবাজে কথা বলছ? যা জানতে চাচ্ছি তা বল।

কি জানতে চাচ্ছ? ফকনার সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলল, ব্যাপারটা তুমি যতটুকু জান, আমিও ঠিক ততটুকুই জানি। ওয়্যারলেসে কথাবার্তা যা হয়েছে, তুমি শুনেছ। তার পরেও আমাকে জিজ্ঞেস করবার অর্থ কি? এসব হচ্ছে মেয়েলি স্বভাব।

মেয়েলি স্বভাব থোক বা না-হোক, আমি পরিষ্কারভাবে জানতে চাই-তুমি কি ভাবছ?

এই মুহূর্তে আমি কি ভাবছি, জানতে চাচ্ছ?

হ্যাঁ।

এই মুহূর্তে আমি ভাবছি, এক কাপ গরম কফি পেলে মন্দ হয় না।

রসিকতা করছ?

না, রসিকতা করব কেন? সত্যি-সত্যি কফির পিপাসা বোধ হচ্ছে। সবার জন্য গরম কফির ব্যবস্থা কর। সেই সঙ্গে খাবারদাবার। শীতকালের নেকড়ের মতো ক্ষুধার্ত বোধ করছি।

এর বেশি তোমার কিছু বলার নেই।

আপাতত না।

কফি কি আমরা এই এয়ারপোর্টেই খাব?

মন্দ কি?

এরকম একটা খোলামেলা জায়গায়?

অসুবিধা কি?

দেখ ফকনার, তোমার বুদ্ধির ওপর আমি চিরকাল আস্থা রেখেছি। তবুও বলছি, তোমার কি মনে হয় না জেনারেল ডোফা বিমান থেকে একটা আক্রমণ চালাতে পারে?

মনে হয় না। ডোফার কথাবার্তা বোকার মতো, কিন্তু সে তোমার মতই বুদ্ধিমান। কাঁচা কাজ করবে না। আলাপ-আলোচনায় বসবে।

কিসের আলোচনা?

ডোফা আমাদের সঙ্গে একটা চুক্তিতে আসতে চাইবে বলে আমার ধারণা। সে আমাদের অক্ষত অবস্থায় এ-দেশ থেকে চলে যেতে দেবে, তার বদলে নিশোকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। হরতনের টো আমাদের হাতে।

তাসের কিছু-কিছু খেলায় হরতনের টেক্কা মূল্যহীন।

নিশো মূল্যহীন নয়। সেটা তুমি জান, আমি জানি, জেনারেল ডোফাও জানে। নিশা যতক্ষণ আমাদের হাতে আছে ততক্ষণ ভয় নেই। ব্যাটা বেঁচে আছে তো?

হুঁ।

বাঁচিয়ে রাখ। নিশো হচ্ছে আমাদের বেঁচে থাকার পাসপোর্ট। ওকে ঠিকমত রাখ।

দ্রুত কফির ব্যবস্থা হল। ফকনার কফির মগ হাতে শান্ত গলায় ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিল।

বন্ধুগণ, বুঝতেই পারছ, ক্ষুদ্র একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে। যারা আমাদের এই কাজে লাগিয়েছে, তাদের কাছে আমাদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। আমরা ফাঁদে আটকা পড়ে গেছি। পশুদের জন্য ফাঁদ একটা ভয়াবহ ব্যাপার। এক বার ফাঁদে আটকা পড়লে তারা বেরুতে পারে না।……

সৌভাগ্যক্রমে আমরা পশু নই, মানুষ, এবং বুদ্ধিমান মানুষ। ফাঁদ কেটে বেরিয়ে আসব। আপাতত আমরা যা করব, তা হচ্ছে কভার নেব। যাতে অনুসন্ধানী বিমান আমাদের দেখতে না পায়। কারো কি এই প্রসঙ্গে বলার আছে?

এক জন হাত তুলল। ফকনার বলল, কী বলার আছে?

আমাদের মধ্যে যাদের যাদের বাথরুম পেয়েছে, তারা কি বাথরুমের কাজটা এয়ারপোর্টে সারতে পারি? এদের এখানে ভালো বাথরুম আছে।

সবাই হা-হা করে হেসে উঠল। হাসি আর থামতেই চায় না। ফকনার আরেকটি সিগারেট বের করতে-করতে মনে-মনে বলল, দলটা ভালো। এদের বিশ্বাস করা যায়। এদের উপর ভরসা করা যায়।

বাথরুম সারবার জন্যে দশ মিনিট সময় দেওয়া হল। ডিসমিস।

আফ্রিকার মতো দেশ

কভার নেবার জন্য আফ্রিকার মতো দেশ হয় না। ঘন বনের দেশ। পুরো এক ডিভিশন সৈন্য ছোট্ট বনের মধ্যে লুকিয়ে পড়তে পারে। বিমান থেকে তাদের খোঁজা অসম্ভব। জায়গায়-জায়গায় খানাখন্দ গিরিখাত। আদর্শ কভার।

ফকনারের দল এয়ারপোর্টের উত্তরের বনে ঢুকে পড়ল। দলের কাউকেই তেমন চিন্তিত মনে হল না। অনেকেই পছন্দসই জায়গা বেছে ঘুমুবার আয়োজন করছে। দুজনের একটা দল তাস নিয়ে বসেছে। আলো ভালো মতো ফোটে নি। তাস দেখা যাচ্ছে না। তাতে খেলায় অসুবিধা হচ্ছে না। তাই স্টেকের খেলা। দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে টাকার হিসাব রাখা হচ্ছে। সকলের ইন্দ্ৰিয় তাসে কেন্দ্ৰীভূত।

এরকম পরিস্থিতিতে যে-জাতীয় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাধারণত থাকে, তার কিছুই নেই। সবই কেমন যেন আলগা ধরনের। সবার মধ্যে কেমন টিলালা ভাব। যেন আফ্রিকার বনে তারা সাপ্তাহিক বনভোজনে এসেছে। কারোর চেহারায় উদ্বেগের বিন্দুমাত্র ছাপ নেই। শুধু বেন ওয়াটসনকে খানিকটা ক্লান্ত মনে হচ্ছে।

সে বিশাল এক পিপুল গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসেছে। নিশো আছে তার পাশে। নিশোর হতভম্ব ভাব এখনো কাটে নি। এখন পর্যন্ত তিনি একটি কথাও বলেন নি। কফি দেওয়া হয়েছিল। খান নি, ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁর শরীর খুবই খারাপ লাগছে। কিছুক্ষণ আগে বমি করেছেন। যেভাবে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন, তাতে মনে হচ্ছে মৃত্যু আসন্ন। এখনি হয়তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসবে, কয়েক বার হেঁচকি তুলে সবরকম সমস্যার সমাধান করে দেবেন। এ নিয়েও বেন ওয়াটসনের মাথাব্যথা নেই। সে একটা লম্বা ঘাস দাঁত দিয়ে কাটছে এবং কিছুক্ষণ পরপর কাটা ঘাসের টুকরো থু করে দূরে-দূরে ফেলছে। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, তার মূল প্রচেষ্টা ঘাসের টুকরোটা কত দূরে ফেলা যায়।

নিশো একটা কাতর শব্দ করলেন।

বেন বিরক্ত মুখে বলল, কোঁ-কে করবে না। কোঁ-কে শব্দটা আমার খুবই অপছন্দ।

নিশো বললেন, আনন্দের কোনো শব্দ করতে পারলে খুশি হতাম। তা পারছি না।

যখন পারছ না, তখন চুপ করে থাক।

নিশো হেসে ফেললেন।

বেন কড়া গলায় বলল, হাসছ কেন?

মানুষের হাসি শুনে কেউ বিরক্ত হয় না, তুমি হচ্ছ কেন?

বেন উঠে চলে গেল। নিশো কৌতূহলী হয়ে তাকিয়ে রইলেন। অসম্ভব সাহসী একদল মানুষের সঙ্গে তিনি আছেন। সাহস একটি দুর্লভ জিনিস। সেই দুর্লভ জিনিস এদের আছে। কিন্তু সাহসের সঙ্গে আদর্শের চমৎকার মিলটি এদের হয় নি। যে-কারণে তাদের এই সাহস অর্থহীন। থাকাও যা, না থাকাও।

তিনি জানেন, এরা ভাড়াটে সৈন্য। টাকা যার এরা তার। টাকার বিনিময়ে তাকে উদ্ধার করেছে। টাকার বিনিময়ে বিনা দ্বিধায় ডোফার হাতে তুলে দেবে। অবশ্যি তার জন্যে তিনি যে খুব দুঃখিত তা নয়। যার যা চরিত্র, সে তাই করবে। জীবনের শেষ সময়টা তিনি বিনা ঝামেলায় কাটাতে চেয়েছিলেন, তা সম্ভব হচ্ছে না। কষ্ট এই কারণেই। তিনি চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন, ডোফার সঙ্গে যদি দেখা হয়, তা হলে তিনি কী বলবেন। বলার মতো তেমন কোনো কথা কি সে-সময় খুঁজে পাওয়া যাবে? তার একটি প্রিয় লাইন হচ্ছে—ম্মাঝে-মাঝে জীবিত মানুষের চেয়ে মৃত মানুষের ক্ষমতা অনেক বেশি হয়। এই লাইনটি বলা যায়। তবে না-বলাই ভালো। এই কথাগুলিতে একধরনের অহঙ্কার প্রকাশ পায়। জীবনের শেষভাগে এসে তিনি অহঙ্কারী সাজতে চান না। কারণ তিনি অহঙ্কারী নন। এটাও বোধহয় ঠিক হল না। তিনি অহঙ্কারী। মানুষ হিসেবে তিনি শ্রেষ্ঠ, এই অহঙ্কার তাঁর আছে।

কয়েকটা মাছি তাঁকে বিরক্ত করছে। এটাও বেশ মজার ব্যাপার। মাছিগুলি অন্য কাউকে বিরক্ত করছে না। বারবার উড়ে এসে তাঁর মুখে বসছে। কীটপতঙ্গরা মানুষের মৃত্যুর খবর আগে টের পায়। এরাও হয়তো পেয়ে গেছে। নয়ত বেছে-বেছে তাঁর মুখের ওপরই ভভ করবে কেন?

নিশো দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন। পানির পিপাসা হচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই, যাকে পানির কথা বলা যায়। চেচিয়ে কাউকে ডাকার মত জোর তাঁর ফুসফুসে নেই। তিনি মড়ার মতো পড়ে রইলেন। তাঁর মুখের ওপর মাছি ভভ করছে। কী কুৎসিত দৃশ্য। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে কুৎসিত দৃশ্যের পাশাপাশি একটি চমৎকার দৃশ্যও তাঁর চোখে পড়ল পিপুল গাছের মোটা শিকড়ে একটি পাহাড়ী পাখি। ঝকঝকে সোনালি পাখা। চন্দনের দানার মতো লাল টকটকে ঠোঁট। কী নাম এই পাখির, কে জানে। পাখিটা তাঁকে কৌতূহলী চোখে দেখছে। আহ্, বেঁচে থাকার মধ্যে কত রকম আনন্দ। কত অপ্রত্যাশিত মুহূর্ত।

সম্রাট নিশো।

তিনি পাখির ওপর থেকে দৃষ্টি না-ফিরিয়েই বললেন, আমি শুনছি।

আপনি কেমন বোধ করছেন?

এই মুহূর্তে, চমৎকার বোধ করছি।

শুনলাম কিছুই খান নি।

ইচ্ছা করছে না।

দয়া করে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।

নিশো তাকালেন।

আমার নাম ফকনার।

তুমি এই দলের প্রধান?

হ্যাঁ। আমি জানতে এসেছি আপনার কিছু লাগবে কি না।

কাগজ এবং কলম দিতে পার? পাখিটা দেখার পর চমৎকার একটা ভাব এসেছে। চেষ্টা করব ভাবটা ধরে রাখতে পারি কি না।

কবিতা লিখবেন?

আবেগ ধরে রাখবার জন্যে কবিতা হচ্ছে শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম।

আপনার কি মনে হচ্ছে না, কাব্যচর্চার জন্যে সময়টা উপযোগী নয়?

না, তা মনে হচ্ছে না।

কাগজ-কলমের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না বলে দুঃখিত। আমি অন্য একটি ব্যাপার জানতে এসেছি।

কি ব্যাপার?

এ-দেশের লোকজন কি আপনাকে ভালবাসে?

মনে হয় বাসে।

কি করে বললেন?

আমি ওদের ভালবাসি। ভালবাসা এমন একটি ব্যাপার যে, যাকে ভালবাসা হয় তাকে তা ফেরত দিতে হয়। এখানে বাকি রাখা চলে না। তুমি যখনি কাউকে ভালবাসবে তখনি তা ফেরত দিতে হবে। এবং মজার ব্যাপার কি, জান? অনেক বেশি পরিমাণে ফেরত আসে। তা-ই নিয়ম।

কার নিয়ম?

প্রকৃতির নিয়ম।

নিশো দেখলেন, ফকনার চলে যাচ্ছে। তিনি তাকালেন পাখিটির দিকে। আশ্চর্য, পাখিটা এখনো আছে, উড়ে যায় নি। তিনি মৃদুস্বরে বললেন, এই আয়, কাছে আয়। পাখিটা তখন উড়ে গেল। এই ব্যাপারটাও তাঁর বেশ মজা লাগল। যতক্ষণ পাখিটাকে কাছে আসতে বলেন নি, ততক্ষণ সে কাছেই ছিল। যেই কাছে ডেকেছেন অমনি উড়ে গেছে।

সম্রাট নিশো।

কে?

আমার নাম জনাথন—মিঃ ফকনার আপনার জন্যে কাগজ এবং কলম পাঠিয়েছেন।

ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ।

ফকনার দাঁড়িয়ে আছে

ফকনার দাঁড়িয়ে আছে ওয়্যারলেস সেটের পাশে। ওয়্যারলেস অপারেটর হচ্ছে বেঁটে এ। যার আসল নাম অ্যালবার্ট জিরান। সে মোটই বেঁটে নয়—প্রায় ছ ফুটের মতো লম্বা। তার বেঁটে খেতাবের উৎস রহস্যমণ্ডিত।

বেঁটে এ ওয়্যারলেস সেটের নব ঘোরাচ্ছে। কমুনিকেশন ফ্রিকোয়েন্সির নব ঘোরাচ্ছে, যদি কিছু ধরা পড়ে। কিছুই ধরা পড়ছে না। জেনারেল ডোফা এদের সঙ্গে যোগাযোগর প্রয়োজন এখনো বোধ করেন নি। তবে শিগগিরই হয়তো করবেন। জেনারেল ডোফা চেষ্টা করবেন তাদের ঘিরে ফেলতে। তাঁকে অতি দ্রুত সৈন্য সমাবেশ করতে হবে। প্যারাট্রুপার নামাতে হবে হয়তো। ফোর্টনক এবং এই পরিত্যক্ত এয়ারপোর্ট ছাড়া প্যারাট্রুপার নামাবার জায়গা নেই। গাছপালায় চারদিক ঢাকা।

ওয়্যারলেস সেট বিপ-বিপ করছে। ফকনার বলল, বেঁটে এ, কিছু আসছে?

মনে হচ্ছে। সিগন্যাল ক্লিয়ার না। প্রচুর ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ।

চেষ্টা করে যাও। এফ এম এ দেখবে কিছু পাওয়া যায় কি না?

এল ইশারায় চুপ করতে বলল। সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে। পরিষ্কার সিগন্যাল।

হ্যালো হ্যালো…….ব্রিগেডিয়ার ক্রিন্তা। হ্যালো।

অ্যালবোর্ট জিরান।

মিশন ফোর্টনক? হ্যালো, ফোর্টনক?

ফকনার এগিয়ে এল। ক্লান্ত গলায় বলল, ফকনার কথা বলছি–ব্রিগেডিয়ার ক্ৰিন্তা, সুপ্ৰভাত।

সুপ্রভাত কি না বোঝা যাচ্ছে না।

তোমাদের জন্যে তো সুপ্রভাত বটেই।

ফকনার বিস্মিত ভঙ্গি করল, যেন খুবই অবাক হয়েছে।

আমি যা বলব তুমি তা করবে না?

আমরা কেউ করব না।

বহুবচনে কথা বলছ কেন? তুমি তোমার নিজের কথা বল। যা করতে বলব তা করবে না?

না।

খুবই ভালো কথা। সাধাসাধি আমার পছন্দ না। ভয় দেখিয়ে রাজি করানোতেও আমার বিশ্বাস নেই। আমি সহজ-সরল লোক। যেহেতু তুমি আমার কোনো কাজে আসছ না, কাজেই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখার কোনো যুক্তি দেখছি না।

ফকনার ঠোঁটের সিগারেট খুঁড়ে ফেলে দুপা এগিয়ে খাপ থেকে পিস্তল টেনে বের করল। তার মুখের রেখা একটুও বদলাল না। ঠোঁটের ফাঁকে যে-হাসি লেগে ছিল, সেই হাসি লেগে রইল। পরপর দুবার গুলির শব্দ হল। শব্দ মেলাবার সঙ্গে-সঙ্গেই তার শান্ত গলা শোনা গেল, বেঁটে এল, ডেডবডি সরিয়ে নিয়ে যাও। আর এদের কফি দেওয়ার ব্যবস্থা কর। তোমরা যারা এখনো বেঁচে আছ, তাদের বলছি—কোনো রকম জোরজবরদস্তি নেই। আমার কথা যারা শুনতে চাও না, তাদের শুনতে হবে না। তবে যারা শুনবে তারা ভালোমতো শুনবে এইটুকু আশা করি।

মাওয়া ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল, জেনারেল ডোফাকে কি বলতে হবে?

বলছি। তার আগে কফিপর্ব শেষ হয়ে যাক।

নিশো একদৃষ্টে এদের দিকে তাকিয়ে আছেন। এত দূর থেকে কথাবার্তা তিনি কিছুই শুনতে পান নি। হত্যার দৃশ্যটি শুধু দেখেছেন। এত সহজে, এত শান্ত ভঙ্গিতে মানুষ খুন করা যায়, তা তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। তিনি শব্দ করে বমি করলেন। তাঁর নাড়িতুড়ি যেন উঠে আসতে চাইছে। মনে-মনে বললেন, হে ঈশ্বর, এ কী দেখলাম। তাঁর মনেই রইল না যে তিনি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না। স্বৰ্গ-নরক বিশ্বাস করেন না।

জেনারেল ডোফা বিস্মিত

জেনারেল ডোফা বিস্মিত গলায় বললেন, মাওয়া, তুমি যা বলছ তা কি সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি।

ফকনার মারা পড়েছে?

হ্যাঁ, পড়েছে।

আর নিশো? নিশোর কী অবস্থা?

মারা গেছে স্যার।

তোমার গলা এমন শুকনো শোনাচ্ছে কেন?

আমি আহত। হাঁটুতে গুলি লেগেছে। হাতের আঙুল উড়ে গেছে।

শুনে অত্যন্ত দুঃখিত হলাম। তবে দেশের জন্যে সবাইকে কিছু-না-কিছু ত্যাগ করতে হয়। তুমি কয়েকটা আঙুল ত্যাগ করলে।

জ্বি স্যার।

আমাদের দিকের হতাহতের সংখ্যা কেমন?

অনেক।

তাতে কোন অসুবিধা নেই। নিহতদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা হবে। বিরাট ক্ষতিপূরণ। তাদের সবাইকে জাতীয় বীর ঘোষণা করা হবে।

ইনফ্যানট্রি লেফটেন্যান্ট নুখতা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। সে বীরের মতো যুদ্ধ করেছে।

শুনে সুখী হলাম। শোন, নিশোর মৃতদেহ কি লুকানো হয়েছে?

হ্যাঁ।

ভালো, খুব ভালো। অত্যন্ত আনন্দের সংবাদ। দেশের সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব তোমার জন্যে ব্যবস্থা হবে।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ স্যার। আপনার পক্ষে কি এখানে আসা সম্ভব হবে? সৈন্যরা আপনাকে দেখতে পেলে অত্যন্ত আনন্দিত হবে। তারা বীরের মতো যুদ্ধ করেছে।

আমি আসব। সৈন্যরা আমার সন্তানের মতো। আমি অবশ্যই আসব। সামরিক হেলিকপ্টারে করে আসব।

কখন রওনা হবেন স্যার?

ধর দশ মিনিট। দশ মিনিটের মাথায় রওনা হচ্ছি।

জেনারেল ডোফা রিসিভার নামিয়ে পাশে দাঁড়ানো মিলিটারি এ্যাটাচির চোখে চোখ রেখে হাসলেন। মুহূর্তের মধ্যেই হাসি সামলে নিয়ে মৃদু গলায় বললেন, মাওয়া মিথ্যা কথা বলছে। সাজানো কথা বলছে।

মিলিটারি এ্যাটাচি অবাক হয়ে বলল, আমার কাছে কিন্তু স্যার সাজানো কথা বলে মনে হয় নি।

তোমার বুদ্ধি একটি গরিলার বুদ্ধির চেয়ে খুব বেশি নয় বলেই কিছু বুঝতে পারছ না। ও ধরা পড়েছে ফকনারের হাতে। ব্যাটা যা বলতে বলছে, তাই সে বলছে। বানরের মতো ভীরু একদল মানুষ নিয়ে আমার সৈন্যবাহিনী।

মিলিটারি এ্যাটাচি এক বার ভাবল জিজ্ঞেস করে—স্যার, কি করে বুঝলেন মাওয়া মিথ্যা কথা বলছেন? কিন্তু জিজ্ঞেস করার মতো সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারল না। সে আসলেই ভীরু।

রবিনসন এগিয়ে গেল ফকনারের দিকে

ঘড়িতে বাজছে এগারটা একুশ। রবিনসন এগিয়ে গেল ফকনারের দিকে। নরম গলায় বলল, ফকনার, আমি কি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে পারি?

নিশ্চয়ই পার।

তোমার পরিকল্পনা আমার পছন্দ হয় নি।

জানি। এবং পছন্দ না-হবার কারণও জানি। আমার পরিকল্পনা বেশি সহজ। সহজ বলেই পছন্দ হয় নি। জটিল কিছু হলে তোমার পছন্দ হত।

আমাদের সঙ্গেই আছে।

আমরা তাকে ফেরত চাই।

ভালো কথা, ফেরত দেওয়া হবে। তার পরিবর্তে আমরা কি পাব?

কি চাও?

একটা বিমান, যা আমাদের নিয়ে যাবে। আমরা কোনো রকম ঝামেলা চাই না।

কেন চাও না তা বোঝার মতো বুদ্ধি আমাদের আছে।

তোমরা বিমান পাঠাবে এখানকার এয়ারপোর্টে। আমরা প্রথমে পরীক্ষা করে দেখব সব ঠিক আছে কি না। তোমাদের দিক থেকে দুজনকে আমরা হোস্টেজ হিসেবে সঙ্গে নিয়ে যাব। দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যেমন ধর মিনিস্টার অব ডিফেন্স।

হোস্টেজ নিয়ে যাবার ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।

হোষ্টেজ এই জন্যেই নিতে চাই, যাতে বিমান আকাশে ওঠার পর তোমরা কোনো ঝামেলা না-কর। এয়ার টু এয়ার-মিসাইল তোমাদের আছে বলে শুনেছি।

ঠিকই শুনেছ। তবে কথা কী জান, আমাদের সঙ্গে দরদান করার মতো অবস্থায় তোমরা নেই বলেই মনে হয়।

মিনিস্টার অব ডিফেন্সকে হোস্টেজ হিসেবে দিতে না-চাও, তোমাকে পেলেও চলবে। ব্রিগেডিয়ার মন্দ কি? নিশোকে তোমাদের প্রয়োজন, এইটুকু বুঝতে পারি।

আমাদের যতটা প্রয়োজন বলে তুমি ভাবছ, তত প্ৰয়োজন কিন্তু না। যাই হোক, এই ফ্রিকোয়েন্সিতেই পরে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করব।

কত পরে?

মনে হচ্ছে খুব ব্যস্ত?

হ্যাঁ, কিছুটা।

নিশো কেমন আছে?

এখনো টিকে আছে, বেশিক্ষণ থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে এই মুহূর্তে তাকে দেখে মোটামুটি সুখী বলেই মনে হচ্ছে কবিতা লিখছে সম্ভবত।

ওপাশের কথা বন্ধ হয়ে গেল। ফকনার বেঁটে এলের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, আমি আরেক মগ কফি খাব, ব্যবস্থা কর। জনাথনকে আসতে বল।

জনাথন সঙ্গে-সঙ্গে উঠে এল। ফকনার জনাথনকে আড়ালে নিয়ে গেল। আড়ালের প্রয়োজনীয়তাটা জনাথন ঠিক বুঝতে পারছে না। ফকনার ফিসফাস করবার মতো লোক নয়।

ব্যাপার কি ফকনার?

ব্যাপার খুবই খারাপ। ওদের ভাবভঙ্গি অন্য রকম।

তোমার ধারণা, আমাদের আটকে ফেলতে চাইছে?

তাই।

কি করতে বল?

ফোর্টনকে অফিসারশ্রেণীর কেউ-কেউ নিশ্চয়ই জীবিত আছে?

থাকার তো কথা। কারাপ্রধান মাওয়া জীবিত আছে বলে আমার ধারণা।

জীবিত থাকলে অবশ্যি তাকে আনতে হবে। কত জন তোমার লাগবে? দশ জন।

পনের জন নিয়ে যাওয়া পছন্দমতো পনের জন। এবারকার অপারেশন আগের বারের মতো হবে না। যত দূর সম্ভব ক্ষতি করবার চেষ্টা করবে। ওদের যোগাযোগের কেন্দ্র পুরোপুরি নষ্ট করে দিতে হবে।

তোমার পরিকল্পনাটা কি?

মজার পরিকল্পনা। জেনারেল ডোফাকে বড় ধরনের ধোঁকা দিতে চাই।

আমরা কি এখনি রওনা হয়ে পড়ব?

হ্যাঁ, রওনা হয়ে যাও। কতক্ষণ লাগবে বলে তোমার ধারণা?

ঘন্টা দুই।

তোমাকে এক ঘন্টা সময় দেওয়া হল। এক ঘন্টার ভেতর মাওয়াসহ কমপক্ষে তিন জনকে এখানে চাই। দরকার হলে আরো পাঁচ জন নিয়ে যাও।

তোমার পরিকল্পনাটা কী বল তো শুনি।

এতটা সময় নষ্ট করা কি উচিত হবে? মাত্র এক ঘন্টা সময় তোমাকে দেওয়া হয়েছে। এর দুমিনিট তুমি নষ্ট করে ফেলে।

এক ঘন্টা একুশ মিনিটের মাথায়

এক ঘন্টা একুশ মিনিটের মাথায় কারারক্ষী মাওয়া, এক জন আর্টিলারির ক্যাপ্টেন, দুজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এবং এক জন হাবিলদার মেজরকে নিয়ে জনাথন উপস্থিত হল। মাওয়া জীবিত হলেও গুরুতর আহত। গুলি লেগে তার বাঁ হাতের তিনটি আঙুল উড়ে গেছে। ডান পায়ের উরুতেও গুলি লেগেছে। তাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসতে হয়েছে। বাকি অফিসাররা সুস্থ, তবে তারা বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। চোখে-মুখে দিশাহারার ভাব। অপ্রকৃতস্থ দৃষ্টি। চোখ রক্তবর্ণ।

ফকনার বলল, মাওয়া, কেমন আছ তুমি?

মাওয়া জবাব দিল না। ফকনার বলল, তোমাদের ওপর দিয়ে সামান্য একটু ঝামেলা গিয়েছে বুঝতে পারছি। আমি দুঃখিত। তোমাদের জন্যে কফি হচ্ছে। কফি খাও, ভালো লাগবে। তোমাদের কারোর যদি ধূমপানের অভ্যাস থাকে, তা হলে চুরুট নিতে পার। ভালো চুরুট আছে।

কেউ কোনো উত্তর দিল না। আর্টিলারি ক্যাপ্টেন একদলা থুথু ফেলল।

তোমাদের এখানে আনার উদ্দেশ্যটা ব্যাখ্যা করা দরকার। আমি জেনারেল ডোফাকে বড় রকমের একটা ধোঁকা দিতে চাই। তোমাদের সাহায্য ছাড়া তা সম্ভব হচ্ছে না। তোমরা যা করবে তা হচ্ছে, জেনারেল ডোফার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। আমি যা শিখিয়ে দিই, ওয়্যারলেসে তাই তাকে বলবে। খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলবে। আমি তোমাদের কাছ থেকে প্রথম শ্রেণীর অভিনয় চাই।

বলতে-বলতে ফকনার হাসল। প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করল।

তোমরা যা বলবে তা হচ্ছে….

ফকনারের কথা শেষ হবার আগেই আর্টিলারি ক্যাপ্টেন কঠিন গলায় বলল, তুমি যা বলবে আমরা তাই করব, এরকম মনে করার কোনো কারণ আছে কি?

পছন্দ না-হবার কারণ হচ্ছে, ডোফা কোনো শিশু নয়। তার আচার-আচরণ শিশুর মতো, কথাবার্তা শিশুর মতো, কিন্তু সে শিশু নয়। তুমি তা ভালো করেই জান। সে ধুরন্ধর মানুষ।

ধুরন্ধর মানুষরা মাঝেমাঝে হাস্যকর ভুল করে। করে না?

তা করে। তবে…..

কোনো তবে নয়। এই সুযোগ আমি নিতে চাই।

নিতে চাচ্ছ না, কিন্তু আমার পরামর্শ শোন, একটা বিকল্প ব্যবস্থা রাখ।

কি-রকম বিকল্প ব্যবস্থা?

ধর, ডোফা তোমার পরিকল্পনামতো কাজ করল না। এক দল কমান্ডো বিমান বোঝাই করে পাঠিয়ে দিল। তোমার ফাঁদে সে পা দিল না। যদি তাই করে, তখন আমরা কি করব?

কি করতে চাও?

আগে থেকে তৈরি থাকতে চাই।

বেশ, তৈরি হও। শোন রবিনসন, তোমার মাথার চুল বেশি পেকে গেছে। দড়ি দেখলেই সাপ ভাবছ।

তা ভাবছি। তাতে ক্ষতি তো কিছু নেই। আমি গোটা দলকে দুভাগে ভাগ করে দেব। এক ভাগ থাকবে ফোর্টনকে। অন্য ভাগ নিশোকে নিয়ে গ্রামে লুকিয়ে থাকবে। যদি দেখি ডোফা তোমার ফাঁদে পা দিয়েছে, একটা হেলিকপ্টার নিয়ে নিজেই নেমেছে, তখন আমরা হেলিকপ্টার দখল করে নেব। হেলিকপ্টার নিয়ে পালিয়ে যাব। আর যদি তা না হয়, তা হলে এক দল ওদের মোকাবেলা করবে, অন্য দল নিশোকে নিয়ে আরো ভেতরের দিকে পালিয়ে যাবে। কি, রাজি আছ?

ফকনার জবাব দিল না। একদলা থুথু ফেলল। রবিনসনের পরিকল্পনা তার পছন্দ হচ্ছে না। দল দুটি ভাগে ভাগ করা মানেই ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া।

কি ফকনার কথা বলছ না কেন?

রাজি? হ্যাঁ, রাজি।

গুড। ভেরি গুড। তুমি নিশোকে নিয়ে গ্রামে চলে যাও। এখানকার ব্যাপারটা আমি সামলাব।

আমি যাব?

হ্যাঁ, তুমি যাবে। পরিকল্পনার প্রথম অংশ তুমি করেছ, বাকিটা আমাকে করতে দাও। তুমি ভালো করেই জান, প্ল্যানিং-এর ব্যাপারটা আমি ভালো করি।

এক সময় করতে, এখন কর কি না জানি না।

এখনো করি। সময় নষ্ট করে লাভ নেই, রওনা হয়ে যাও।

দুটি দল যদি কোনো কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, তখন? একটিমাত্র ওয়্যারলেস সেট।

ওয়্যারলেস সেট তোমার সঙ্গেই থাকবে ফকনার। আর আমরা যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি, তা হলে বিচ্ছিন্নভাবেই টিকে থাকার চেষ্টা করব। চেষ্টা চালাতে হবে কত দ্রুত দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া যায়।

ফকনার কিছু বলছে না। বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে যাবার ইচ্ছা খুব একটা নেই।

রবিনসন বলল, সময় নষ্ট করছ ফকনার। রওনা হয়ে যাও।

কত জন সঙ্গে নেব?

সাত জন নাও।

বাকি সব রেখে যাও।

বেশ, তাই হবে।

উসসি নদীতে ডোফা

সময় বারটা পঁচিশ।

দুটি ট্যান্সপোর্ট হেলিকপ্টার ফোর্টনকের ওপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে।

জেনারেল র‍্যাবি নিজেই এসেছে। তাঁর সঙ্গে এক শ সতের জনের একটি সুসজ্জিত কমান্ডো দল। হেলিকপ্টার দুবার নামার মতো ভঙ্গি করেও ওপরে উঠে গেল। র‍্যাবি পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছে না। জেনারেল ডোফার ধারণা যদি সত্যি হয়, তা হলে হেলিকপ্টার নিয়ে নাম হবে একটা বড় ধরনের বোকামি। সরাসরি বাঘের মুখে পড়ে যাওয়া। তার চেয়ে আকাশে থাকা ভালো।

ফোর্টনকের সাঁইত্রিশ মাইল উত্তরে প্যারাট্রুপার নামানো হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা এসে পড়কে। ব্যস্ততার কিছু নেই। জেনারেল র‍্যাবির চোখে ফিল্ড টেলিস্কোপ। ফিল্ড টেলিস্কোপে দেখা যাচ্ছে বিরান জনভূমি। এর মানেও সে বুঝতে পারছে না। র‍্যাবি হেলিকপ্টার-পাইলটের পেছনে বসে ছিল। পাইলটের কাঁধে টোকা দিয়ে বলল, কিছু বুঝতে পারছ?

পাইলট মাথা না ঘুরিয়ে বলল, একটা জিনিসই বুঝতে পারছি। সেটা হচ্ছে, ফোর্টনকে কেউ নেই।

ঘাপটি মেরে বসে আছে হয়তো।

তা থাকতে পারে।

তুমি ফায়ারিং রেঞ্জের বাইরে আছ তো?

তা আছি।

দশ মিনিটের মাথায় প্যারাট্রুপাররা ফোর্টনকে ঢুকল। গ্রাউন্ড থেকে জানানো হল, অল ক্লিয়ার। জেনারেল র‍্যাবিকে নিয়ে হেলিকপ্টার নেমে এল।

জেনারেল র‍্যাবি প্রথম যে-কথাটি বলল, তা হচ্ছে, এ তো দেখি ভয়াবহ অবস্থা! এরা করেছে কী!

ফোর্টনক মোটামুটি একটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। যেখানে-সেখানে মৃতদেহ পড়ে আছে। ফ্যামিলি কোয়ার্টারগুলি থেকে মহিলা এবং শিশুদের কান্ন শোনা যাচ্ছে। জেনারেল র‍্যাবি কঠিন গলায় বলল, ফোর্টনকে কেউ নেই, এ-সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হবার পর আমাকে জানাও, আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।

প্রতিটি ঘর দেখা হয়েছে স্যার।

ভালো কথা। এক শ ভাগ অ্যালার্ট থাকতে হবে। বাঙ্কারগুলিতে পজিশন নাও।

নেওয়া হয়েছে স্যার।

চমৎকার!

ফ্যামিলি কোয়ার্টারে যারা আছে, তাদের নিয়ে এস। তাদের কাছ থেকে শুনি, কী হয়েছে। আর ডেডবডিগুলির একটা ব্যবস্থা কর। কজন মারা গেছে, তাদের লিস্ট তৈরি করতে হবে।

লিস্ট করা হচ্ছে স্যার।

ভেরি গুড। ওয়্যারলেস অপারেটরকে বল—জেনারেল ডোফার সঙ্গে যোগাযোগ করতে, আমি কথা বলব।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

শোন, জেনারেল ডোফার সঙ্গে কথা বলার আগে আমি মাওয়ার স্ত্রী এবং কন্যার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আশা করি তারা সুস্থ আছে।

আমি এক্ষুনি খোঁজ নিচ্ছি স্যার।

প্যারাট্রুপার বাহিনীর কমান্ডার কে?

কর্নেল ফাতা।

সে কোথায়? আমার কাছে কি ইতমধ্যেই তার রিপোর্ট করার কথা নয়?

স্যার, আমি ওঁকে খবর দিচ্ছি।

জেনারেল র‍্যাবি বিরক্তিতে ভ্রূ কোঁচকাল, আর ঠিক তখনি ভয়াবহ বিস্ফোরণ হল। ফোর্টনকের গুদামঘরটি বিস্ফোরণের চাপে কয়েক ফুট শূন্যে উঠে গিয়ে প্রচণ্ড শব্দে গুড়িয়ে পড়ল, আর তার সঙ্গে-সঙ্গে একসাথে গর্জে উঠল বেশ কিছু এলএমজি র‍্যাবি শুধু বলল, কি হচ্ছে? এর বেশি কিছু বলতে পারল না। কারণ, তার কথা শেষ হবার আগেই দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটেছে। মাথার ওপরে বিম-দেওয়া উঁচু ছাদ খুলে আসছে।

প্যারাট্রুপার দলের অধিনায়ক কর্নেল ফাতা ফোর্টনকের সর্বদক্ষিণের বাংকারে বসে অনুসন্ধানী দল কীভাবে পাঠানো হবে তা ঠিকঠাক করছিল। তার মুখে চুরুট। বিস্ফোরণের পরপর সে ঠাণ্ডা গলায় বলল, খুব বড় রকমের বোকামি হয়েছে। খুবই বড় ধরনের বোকামি।

কী বোকামি হয়েছে তা বলার মতো অবসর হল না। তিন ইঞ্চি মর্টারের একটি গোলা এসে পড়ল। নিখুঁত নিশানা, যার থেকে অনুমান করা যায়, বাংকারগুলির পজিশনমতে মটারের গোলা ছোঁড়া হচ্ছে। প্রতিটি বাংকার আক্রান্ত হবে।

পরবর্তী কুড়ি মিনিটে যা ঘটল তার নাম হতবুদ্ধি সৈন্যবাহিনীর রিফ্লেক্স অ্যাকশানজনিত বিশৃঙ্খলা।

ওরা ভেতর থেকে আক্রান্ত হয়েছে, এটা বুঝতে বেশ কিছু সময় নষ্ট হল। বাংকারের নিরাপদ আশ্রয়ে যারা ছিল, তারা ভেতরের দিকে গুলি করবে কি করবে না, সেই সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করে ফেলল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, তারা ক্রল করে আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দুতে যাবে। কিন্তু আক্রমণের কোনো কেন্দ্রবিন্দু ছিল না। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল দূরপাল্লার জন্যে উপযুক্ত। প্রায় হাতাহাতি পর্যায়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি তাদের ছিল না। বিপক্ষ দলের জনবল সম্পর্কেও একটি ভুল ধারণা তৈরি হল, যা মানসিকভাবে তাদের কাবু করে ফেলল।

শুধু হেলিকপ্টার দুটির পাশে দাঁড়ানো দশজনের একটি ইউনিট মাথা ঠাণ্ডা রাখল। মুহূর্তের মধ্যে তারা দুটি লাইট মেশিনগান বসিয়ে ফেলল। যে-ভুলটা সবাই করেছে—পাগলের মত নির্বিচারে গুলিবর্ষণ, তা তারা করল না। কভার নেবার চেষ্টা করতে লাগল।

রবিনসন তার দলের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশকে রেখেছিল হেলিকপ্টার দখলের জন্যে। তারা তা করতে পারল না। হেলিকপ্টার রক্ষীবাহিনী রবিনসনের দলকে কাছ-ঘেঁষতে দিল না। রবিনসনের দল যা করতে পারল তা হচ্ছে, রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে দুটি হেলিকপ্টারের একটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া।

ফোর্টনকের সর্বত্রই আগুন জ্বলছে। রবিনসন হেলিকপ্টার রক্ষীবাহিনীর নজর ঢাকবার জন্যে একটি স্মোক বোম ব্যবহার করেছে। সেই ঘন কালো ধোঁয়ায় চারদিক অন্ধকার। বাইরের বাংকারগুলি থেকে এইচএমজির গুলিবর্ষণের কান-ফাটানো আওয়াজ। তারা গুলি চালাচ্ছে বাইরে। যে-কোনো মুহূর্তে বাইরে থেকে আক্রমণ হবে, এটাই তাদের গুলিবর্ষণের কারণ।

হতভম্ব জেলারেল র‍্যাবি চরর মধ্যে ডোফার সঙ্গে যোগাযোগ করল। ভাঙা-ভাঙা গলায় বলল, বড় রকমের ফাঁদে পড়ে গেছি স্যার।

ডোফা শুকনো গলায় বললেন, কি ব্যাপার?

ফকনারের দল ভেতর থেকে আমাদের আক্রমণ করেছ। আশঙ্কা করছি, বাইরে থেকে অর্থাৎ দক্ষিণ দিক থেকেও আক্রমণ হবে।

এখন কি আক্রমণ বন্ধ?

জ্বি। কিছুক্ষণ আগে গোলাবর্ষণ বন্ধ হয়েছে।

ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কি?

এখনো পুরো রিপোর্ট পাই নি। তবে অবস্থা বেশি ভালো না। বলা যেতে পারে খুবই খারাপ অবস্থা।

তুমি জেনারেল না-হয়ে একটা ছাগল হলে ভালো হত।

আমরা পরিস্থিতির শিকার হয়েছি।

পরিস্থিতি তোমার পশ্চাৎদেশ দিয়ে প্রবেশ করানো হবে।

জেনারেল ডোফা ওয়্যারলেস রিসিভার নামিয়ে দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলেন।

 

র‍্যাবির কাছ থেকে ক্ষয়ক্ষতির পুরো বিবরণ পাওয়ার পরপরই জেনারেল ডোফা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠালেন। তাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলল প্রায় এক ঘন্টা। মার্কিন রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে কেউ খারাপ ব্যবহার করে না। রাষ্ট্রপ্রধানরা তাঁদের বিরাট বিপর্যয়ের সময়ও মাথা ঠাণ্ডা রাখেন। হাসিমুখে কথা বলেন।

জেনারেল ডোফাও তাই খুব ঠাণ্ডা মাথায় হাসিমুখে যে-কথাটি শেষ মুহূর্তে বললেন, তার সরল অর্থ হচ্ছে ঈশ্বর দুটি শয়তান তৈরি করেছেন। দুটির একটি হচ্ছে, যে আদমকে গন্ধম ফল খাইয়েছে—আর অন্যটি হচ্ছে, মার্কিন সরকার।

রাষ্ট্রদূত সেই কথায় প্রাণখুলে হাসল। মধুর স্বরে বলল, আপনি খুবই রসিক। তবে ভয় নেই, আমরা আপনার পেছনে আছি।

ডোফা হাসিমুখে বললেন, শুনে খুব আনন্দ হচ্ছে। তবে সমস্যা কি, জানেন? সমস্যা হচ্ছে, আপনারা একই সঙ্গে দু-তিন জনের পেছনে থাকেন। এই মুহূর্তে হয়তো-বা অন্য একজন জেনারেলের পেছনেও আছেন, আবার কে জানে। হয়তো ফকনারের পেছনেও আছেন।

আপনি খুবই রসিক ব্যক্তি।

ঠিক ধরেছেন, খুবই রসিক।

দুপুরে ডোফা তাঁর স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম করে নদীতে সাঁতার কাটতে গেলেন। তার জন্যে একটি ক্যাবিনেট মিটিং করতে হল। এখন আর কোনো কিছুতেই মন বসছে না।

নদীর পাড়ে টিভি ক্যামেরাম্যান, সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যচিত্রের গাড়ি এবং বেশ কজন পত্রিকার ফটোগ্রাফার দাঁড়িয়ে আছে। আগামীদিনের পত্রিকায় ডোফার সাঁতারের ছবি ছাপা হবে। খবরের ধরন কী হবে, তথ্য মন্ত্রণালয় তাও জানিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে তা লেখা হয়ে গেছে। ফটোকপি করা হচ্ছে। ডোফার অনুমতি পেলেই সাংবাদিকদের হাতে-হাতে দিয়ে দেওয়া হবে।

 

উসসি নদীতে ডোফা

মহামান্য রাষ্ট্রপতি আজ হঠাৎ উসসি নদীতে সাঁতার কাটার জন্যে উপস্থিত হন। জনগণ তাঁদের প্রাণপ্রিয় প্রেসিডেন্টকে তাঁদের মাঝখানে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হন। তাঁরা তুমুল হর্ষধ্বনি দিতে থাকেন। মহামান্য প্রেসিডেন্ট নদীর পারে দণ্ডায়মান জনগণকে তাঁর সঙ্গে সাঁতারের আমন্ত্রণ জানান। এই আহ্বানে তাঁদের আনন্দের বাঁধ ভেঙে যায়। মহামান্য প্রেসিডেন্ট সাঁতার কাটতে-কাটতেই তাঁদের ব্যক্তিগত কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন এবং তাঁদের আশ্বাস দেন যে, অদূর ভবিষ্যতে উসসি নদীতে বাঁধ দেবার ব্যবস্থা সরকার করবে, যাতে প্রলয়ঙ্করী বন্যায় উসসি নদীর দুপাশের মানুষকে আর কষ্ট না-করতে হয়।

 

তথ্যচিত্রের কর্মীরা বড়-বড় রিফ্লেক্টর ফিট করছে। আকাশে মেঘের আনাগোনা। সূর্য বারবার মেঘের আড়ালে চলে যাচ্ছে। ভালো ছবি তোলা খুব সহজ হবে না। টিভি ক্ররা ক্যামেরা নিয়ে নৌকায় উঠে গেছে। অপেক্ষা করছে–কখন মহামান্য রাষ্ট্রপতি নদীতে নামবেন।

ডোফা শেষ মুহূর্তে নদীতে নামার পরিকল্পনা বাতিল করলেন। তবু সবাই নদীর পারে অপেক্ষা করতে লাগল, যদি আবার ফিরে আসেন। কিছুই বলা যায় না, আসতেও ত পারেন।

কবরের শোকগাঁথা

নিশো ক্ষীণস্বরে বললেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি, তা কি জানতে পারি?

ফকনার হাসিমুখে বলল, নিশ্চয়ই জানতে পারেন। এটা কোনো গোপন সংবাদ নয়।

তা হলে বল, কোথায় যাচ্ছি।

জানলে বলতাম। আমি নিজেও জানি না কোথায় যাচ্ছি। উত্তর দিকে যাচ্ছি, এইটুকু বলতে পারি।

তোমার পরিকল্পনা কি?

এই মুহূর্তে কোন পরিকল্পনা নেই। আপনাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা নষ্ট হয়েছে।

ফোর্টনকে তোমার যে-দল ছিল, সবাই কি মারা গেছে?

তাই তো মনে হচ্ছে। ফিরে তো কেউ আসে নি। কেউ-কেউ বেঁচে থাকতেও পারে। বেঁচে থাকলেও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

তুমি ওদের কোনো খোঁজ করবারও চেষ্টা কর নি?

না, করি নি। কারণ এমন কোনো কথা ছিল না। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেছি, তারপর রওনা হয়েছি। ডোফার সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ইচ্ছা নেই।

তোমরা এখন আছ মাত্র সাত জন।

না, আট জন। আপনিও আমাদের সঙ্গে আছেন। দয়া করে চুপ করে থাকলে আমার সুবিধা হয়। কথা বলতে ভালো লাগছে না।

নিশো চুপ করে গেলেন। দলটি অতিদ্রুত চলছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা লকিয়ে ছিল। অন্ধকার হবার পরপর যাত্রা শুরু করেছে। বিরতিহীন যাত্ৰা। এখন প্রায় মধ্যরাত। এর মধ্যে এরা এক মুহুর্তের জন্যেও বিশ্রাম করে নি। নিশোকে এক জন পিঠে তুলে নিয়েছে। সে আছে মাঝখানে। সেও অন্যদের মতোই সমান তালে পা ফেলছে। নিশো এক বার শুধু বললেন, তোমার কষ্ট হচ্ছে?

লোকটি কর্কশ গলায় বলল, তুমি যখন কথা বল, তখনই শুধু কষ্ট হয়। নয়তো হয় না।

নিশো চুপ করে গেলেন। তাঁর প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। ঘুম পাওয়ার ধরনটা অন্য রকম। মনে হয় সমস্ত শরীর ঘুমিয়ে পড়তে চাচ্ছে। তিনি মাঝেমাঝে ঝিমুচ্ছেন। চোখ মেলে রাখতে পারছেন না। আবার ঘুমিয়ে পড়তেও লজ্জা লাগছে।

রাত দেড়টায় ফকনার থামবার হুকুম দিল। এক ঘন্টা বিশ্রামের পর আবার যাত্রা শুরু হবে। জায়গাটা খোলামেলা। চারদিকে গভীর বন। বনের ভেতর পায়ে-চলার রাস্তা আছে। তবে গভীর রাতে কেউ চলাচল করে না। ফকনারের দলের সঙ্গে এখনো কারোর দেখা হয় নি। ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। বাতাসে ঘাসপচা গন্ধ। নিশাচর পাখির ডাক এবং গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। অবশ্য ঝিঝির ডাক সারাক্ষণই আছে। কান সেই শব্দে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে শব্দটা এখন আর কানে আসছে না।

ওয়্যারলেস চালু করা হয়েছে। মাইক্রোওয়েভ কম্যুনিকেশন ফ্রিকোয়েন্সি বদলানো হচ্ছে। কোনো রকম সিগন্যাল ধরা পড়ছে না। ফকনারের ধারণা ছিল, সিগন্যাল আসবে। ডোফা যোগাযোগ করতে চাইবে। এবং তখন হয়তোবা ফকনারের প্রস্তাবে সে রাজি হবে। ডোফা বুদ্ধিমান লোক, রাজি হওয়া ছাড়া তার পথ নেই।

কফি তৈরি হয়েছে। সবাই একসঙ্গে খেতে পারছে না। দুটিমাত্র মগ। দুজন ভাগ্যবান গরম কফিতে চুমুক দিচ্ছে। অন্যরা অপেক্ষা করছে তাদের সুযোগের জন্যে। হাত-পা ছড়িয়ে তারা এমনভাবে শুয়ে আছে যে মনে হচ্ছে আবার উঠে চলার শক্তি নেই। কেউ কেউ মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। ফকনার কফির মগ হাতে নিশোর পাশে গিয়ে দাঁড়াল।

ঘুমুচ্ছেন নাকি?

নিশোর তন্দ্রা ভেঙে গেল। তিনি অবশ্যি কিছু বললেন না।

নিন, আপনার জন্যে কফি এনেছি।

খেতে ইচ্ছা করছে না।

আমরা এক্ষুনি রওনা হব। কফি খেলে আপনার চলতে সুবিধা হবে।

আমি তো আর চলি না, পিঠে শুয়ে থাকি।

পিঠে শুয়ে থাকতেও কষ্ট কম হবে। নিন, কফি নিন।

নিশো কফি নিয়ে এক চুমুক দিয়েই হড়হড় করে বমি করে ফেললেন।

আপনার শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?

বুঝতে পারছি না। বোধশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। কেমন একটা ঘরের মধ্যে আছি।

ফকনার এগিয়ে এসে নিশোর কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠল। গা পুড়ে যাচ্ছে।

আপনার শরীর তো মনে হচ্ছে বেশ খারাপ।

নিশো জবাব দিলেন না। ফকনার বলল, এত প্রচণ্ড জ্বর কি আপনার আগে ছিল?

জানি না, মনে হচ্ছে মরতে বসেছি। তোমরা কি এখনি রওনা হতে চাও?

হ্যাঁ।

আমাকে কি আর আধ ঘন্টা সময় তুমি দিতে পারবে। আমার মনে হচ্ছে আধ ঘন্টার মধ্যে আমার কিছু-একটা হয়ে যাবে। তখন নিশ্চিন্ত মনে তোমরা রওনা হতে পারবে।

ফকনার গম্ভীর গলায় বলল, আপনি যদি পুরোপুরি নিশ্চিত হন, তা হলে আধ ঘন্টা অপেক্ষা করা যেতে পারে। তবে মুশকিল কি জানেন, মৃত্যুর আগে যে-শ্বাসকষ্ট, সেটা শুরু হবার পর সাধারণত দু-তিন ঘন্টা সময় পর লোকজন মারা যায়। আপনার শ্বাসকষ্ট এখনো শুরু হয় নি।

নিশো হেসে ফেললেন। ফকনার বলল, দয়া করে আটচল্লিশ ঘন্টা বেঁচে থাকুন। তা হলেই হবে।

কি হবে?

এর মধ্যেই লোকজন জানতে শুরু করবে-নিশো এখনো বেঁচে আছে। বিরাট একটা চাপ ডোফার ওপর পড়বে। শুরু হবে গৃহযুদ্ধ। জেনারেলদের কেউ-কেউ যেদিকে বাতাস, সেদিকে পাল খাটাবার চেষ্টা করবে। আমরা যখন গ্রামে লুকিয়ে ছিলাম, তখনই গ্রামের বেশিরভাগ লোক জেনে গেছে আপনি বেঁচে আছেন। এইসব খবর দ্রুত ছড়ায়। কে জানে ইতোমধ্যেই হয়তো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।

নিশো কাতর গলায় বললেন, আমার কারণে হাজার-হাজার লোক মারা যাবে, এই দৃশ্য আমি দেখতে রাজি নই। তুমি হয়তো জান না, তোমরা যখন আমাকে বের করে আনলে, তখন থেকেই ঈশ্বরের কাছে আমার মৃত্যু কামনা করছি।

আপনি কিন্তু এক বার বলেছেন ঈশ্বর বিশ্বাস করেন না।

তুমি কর?

আমি ঈশ্বর বা মানুষকোনোটাই বিশ্বাস করি না।

বন্ধুকে বিশ্বাস কর, তাই না?

তা করি।

ফকনার নিজের জন্যে আরেক পেয়ালা কফি এনে নিশোর পাশে বসতে-বসতে বলল, পাখিকে নিয়ে যে-কবিতাটা লিখেছিলেন, ওটা পড়ন। শুনি, কি লিখেছেন।

নিশো জবাব দিলেন না।

ফকনার বলল, পাখি, নারী, ফুল ছাড়া অন্য কিছু নিয়ে কি আপনি কবিতা লিখেছেন? যেমন ধরুন বন্দুক-বন্দুক নিয়ে কখনো লিখেছেন?

হ্যাঁ, লিখেছি। শুনতে চাও?

না, পাখির কবিতাটাই পড়ন। প্রথমে আপনার নিজের ভাষায় পড়বেন, তারপর অনুবাদ করবেন।

নিশো নিজের ভাষায় পড়লেন না। সরাসরি অনুবাদ করলেন। ফকনার আগ্রহ নিয়ে শুনল

সোনালি ডানার একটি চমৎকার পাখি আমার পাশেই বসেছিল।
আমি আনন্দে অভিভূত হয়ে তাকে ছুঁতে গেলাম।
ওম্নি সে উড়ে গেল।
গভীর বিষাদে আমার হৃদয় যখন আপ্লুত হল
ঠিক তখন আমি দেখি পাখির একটি ডানা
পড়ে আছে।
সোনালি এই পাখি যেখানেই যায় সেখানেই তার
কিছু অংশ রেখে যায়।

ফকনার বলল, আপনার কবিতাটি চমৎকার। এখন রওনা হওয়া যাক। আধ ঘন্টা পার হয়েছে। আপনি বেঁচে আছেন। মারা যান নি।

নিশো আবারো হেসে ফেললেন।

আবার যাত্রা শুরু হল। অসম্ভব খারাপ লাগছে তাঁর। বারবারই মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাচ্ছেন। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে, আবার কিছুক্ষণ পর চাঁদের আলো চোখে পড়ছে। গভীর বনে চাঁদের আলো—কী অদ্ভুত দৃশ্য। তার মতো আসছে। এই তার মধ্যেও তাঁর মনে হল তিনি অসীম ভাগ্যবান মৃত্যুর আগে তাঁর প্রিয় জন্মভূমির কিছু মায়াময় দৃশ্য দেখতে পেলেন। জেলখানার অন্ধকূপে শুয়ে থেকে মরতে হল না। যাদের জন্যে এটা সম্ভব হল তাদেরকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু বড়ই ক্লান্তি লাগছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। তাঁর কেবলি মনে হচ্ছে, এক বার ঘুমিয়ে পড়লে তাঁর ঘুম আর ভাঙবে না।

সম্রাট নিশো।

নিশো চোখ মেললেন। ফফকা দিনের আলো চারদিকে। সূর্য অনেক দূর উঠে গেছে। তিনি বিশাল এক পিপুল গাছের নিচে শুয়ে আছেন। তাঁর সামনে ফকনার হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

এখনো মনে হচ্ছে বেঁচে আছেন।

তাই তো দেখছি।

আমরা এখানে পৌঁছেছি অনেক আগেই। আপনি ঘুমুচ্ছিলেন, তাই জাগাই নি। এখন দয়া করে হাতমুখ ধুয়ে কিছু খাবার খান। আপনার জন্যে সুসংবাদ আছে।

কী সুসংবাদ!

জেনারেল ডোফা ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন। অন্য একজন ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন। নতুন জেনারেল ঘোষণা করেছেন যে নিশো বেঁচে আছেন, তাঁকে রাজধানীতে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

কোথায় পেলে খবর?

প্রাথমিক খবর ওয়্যারলেসে পেয়েছি। তবে নতুন জেনারেল বেতার ভাষণ দেবেন। আপনাকে ডেকে তোলার উদ্দেশ্য হচ্ছে বেতার ভাষণটি শোনানো।

নতুন জেনারেলের নাম অ্যামিও। তিনি আবেগপূর্ণ একটি ভাষণ দিলেন, যার মূল বক্তব্য হচ্ছে, মহান নেতা নিশোকে যেসব চক্রান্তকারী জেলখানায় আটকে রেখে তাঁর মৃত্যুসংবাদ প্রচার করেছে বিশেষ সামরিক আদালতে তাদের প্রত্যেকের বিচার হবে। জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতাকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে রাজধানীতে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মহান নেতা আজ দুপুরের মধ্যেই রাজধানীতে পৌঁছবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

ফকনার বলল, আশা করছি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের নিয়ে যাবার জন্যে হেলিকপ্টার আসবে। আমরা আমাদের অবস্থান জানিয়ে দিয়েছি। হেলিকপ্টারে ডাক্তারও আসছেন। আপনি এখন কেমন বোধ করছেন, সেটা বলুন।

ভালো।

মার্কিন সরকারেরও টনক নড়েছে। তারাও যোগাযোগ করেছে। আমাদের নিয়ে যাবার জন্যে একটা সি প্লেন পাঠাচ্ছে।

ফকনার চুরুট ধরাল। আর ঠিক তখনই হেলিকপ্টারের পাখার আওয়াজ পাওয়া গেল। হেলিকপ্টার থেকে ডাক্তার এবং নার্স ছাড়াও দশ জন কমান্ডোর একটি দল নামল। ফকনার চুরুট ফেলে এগিয়ে গেল। কমান্ডো দলের প্রধান উষ্ণ গলায় বলল, আশা করছি আপনি কর্নেল ফকনার।

হ্যাঁ।

ফকনারের আরো কিছু হয়তো বলার ইচ্ছা ছিল। সেই সুযোগ সে পেল না। কমান্ডো দলের সবার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র একসঙ্গে গর্জে উঠল।

সম্রাট নিশো এবং ফকনারের দলের সাত জন প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই মারা গেল। ডাক্তার এবং নার্সকে হত্যা করা হল তার পরপরই।

জেনারেল অ্যামিও নিশোকে রাজধানীতে আনতে চান নি। সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো কোনো পরিকল্পনা তাঁর ছিল না। তা ছাড়া আমেরিকান রাষ্ট্রদূত জেনারেল অ্যামিওকে জানিয়েছেন, মার্কিন সরকার মনে করে যে, এই দেশের জন্যে সামরিক শাসনই উত্তম। নিশোকে এই সময় হাজির করা মানেই রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা। উন্নয়নশীল দেশের জন্যে যা অশুভ।

সন্ধ্যাবেলা সমগ্র বিশ্ববাসী জানল, শেষ মুহূর্তে কুচক্রী ডোফার অনুসারীরা নিশোকে ফোর্টনকে হত্যা করেছে। জেনারেল অ্যামিও বেতার ও টিভি মারফত এই খবর দিতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন। দশ দিনের রাষ্ট্ৰীয় শোক ঘোষণা করা হল। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট গভীর সমবেদনা জানিয়ে বার্তা পাঠালেন।

 

নিশোর নিজের রচনার কিছু অংশই তাঁর কবরের শোকগাঁথায় ব্যবহার করা হয়েছে—

মানুষকে ঘৃণা করার অপরাধে কখনো কাউকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় নি, অথচ মানুষকে ভালবাসার অপরাধে অতীতে অনেককেই হত্যা করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হয়তো হবে।

Exit mobile version