Site icon BnBoi.Com

মরুস্বর্গ – আবুল বাশার

মরুস্বর্গ - আবুল বাশার

০১-২. মরুভূমির আকাশে

উৎসর্গ : কলা-সমালোচক সন্দীপ সরকার শ্রদ্ধাভাজনেষু
প্রথম প্রকাশ– জানুয়ারি ১৯৯১

.

পটভূমিকা প্রসঙ্গে

পুরাণ-মিশ্রিত এই কাহিনীর পটভূমি খ্রিস্টের জন্মের সহস্রাধিক বৎসর আগের প্রাচীন পৃথিবী–পৃথিবীর এক নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। এই ভূখণ্ডের আকৃতি বাঁকা চাঁদের মত। উত্তরে তার কৃষ্ণসাগর, দক্ষিণে আরব মরুভূমি। পূর্বে পারস্য, পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর–পারস্য উপসাগর থেকে অর্ধবৃত্তাকার এই ভূমি মিশরের লোহিত সাগরের কিনারা ছাড়িয়ে গেছে।

আরব মরুভূমির বুকে তিনটি প্রধান ধর্মের জন্ম–যিশুর ধর্ম, মুসার ধর্ম এবং হজরত মুহম্মদের ধর্ম। বর্ণিত মরুভূমি থেকে ধর্মগোষ্ঠীগুলি অর্ধবৃত্তাকার জমির কোলে আশ্রয় পেয়েছিল এবং সেখান থেকে পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভূভাগে ছিল কৃষি জীবন নির্ভর বহু দেবদেবীর নানান বিচিত্র ধর্ম। প্রাচীন বাইবেলে পশুপালক মরুযাযাবর গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে কৃষিজীবী মানুষদের ধর্ম ও জীবনগত এক নিরন্তর দ্বন্দ্বের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। বর্তমান কাহিনীতে এই দ্বন্দ্বকে মূর্তিমান ঈশ্বর এবং মূর্তিহীন ঈশ্বরের দ্বন্দ্ব রূপে কল্পনা করা হয়েছে। কল্পনাকে মরুভূমির প্রধান তিনটি ধর্মই সমর্থন করে।

পুরনো বাইবেলেই রয়েছে ভাষাগত বিভেদের কথা। কাহিনীতে বিশেষ উপাদান রূপে ভাষার সমস্যাটিকে লোটা নামের একটি কাল্পনিক চরিত্রের সাহায্যে উপস্থিত করা হয়েছে। ধর্ম এবং ভাষার সমস্যা উপন্যাসের সৃষ্টি নয়, ধর্মশাস্ত্রীরাই এই দ্বন্দ্বের রূপকার। জীবন আশ্রয় না পেলে ধর্ম বাঁচে না–মরুভূমিতে এই সত্য আবিষ্কৃত হয়। নিরন্তর এক অর্থহীন যুদ্ধের হাত থেকে জীবন পরিত্রাণ খুঁজেছে মাটির কাছে। লোটা আশ্রয় চেয়েছিল, উপন্যাসের এটিই প্রধান আকাঙ্ক্ষা। ধর্ম এবং ভাষা সভ্যতার বাহন হলেও, এই দুইটি জৈবনিক উপাদান শুধু আজকার ভারতবর্ষেই নয় প্রাচীন দুনিয়াতেও মানুষকে বিচ্ছিন্ন, দগ্ধ এবং যুদ্ধলিপ্ত করেছে। লোটা তারই নিদর্শন। এ কাহিনী। তাই মরুভূমির পটকে নির্বাচন করে শস্যশ্যামল ভূমিক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হয়েছে।

লোটার উটপূজা কোন কল্পনা নয়। হজরত মুহম্মদ নারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, তোমরা খোদাকে সিজদা (প্রণাম) করবে। যদি খোদা ব্যতীত কারুকে সিজদা করতে চাও, স্বামীদের কর-কুত্রাপি উটকে সিজদা কর না–বোঝা যায় উটপৃজা ঐতিহাসিক সত্য। বিভিন্ন পুঁথিতে এবং লোককথায় উটপূজা আর উটের দেবতা বা নবীর কথা বর্ণিত। এভাবে বিচিত্র উৎস থেকে, এই কাহিনীর গড়ন গড়বার জন্য অজস্র (যেমন উটের পিঠে যৌনাচার ইত্যাদি) উপকথা, কিংবদন্তী বা লোককল্পনার বিবিধ উপাদান জড়ো করা হয়েছে, যা কল্পনামাত্র নয়, তা ইতিহাসও বটে–উটের পিঠে যৌনবিহারের কথা মুসলমানদের হাদিসে অবধি উল্লিখিত রয়েছে। অতএব লোটাই শুধু নয়–সাদইদ, নোয়া প্রমুখ চরিত্রগুলি কিংবদন্তী আশ্রিত হলেও সমস্তটাই সেই প্রাচীন নগর-সভ্যতার বিলুপ্ত ইতিহাসের সাক্ষ্য। সাদইদ স্বর্গ গড়তে চেয়েছিল সেদিনের নির্মিত নগরগুলির নির্মাণ আর ভাস্কর্যের বাস্তব সৌন্দর্য দেখে–নগরগুলিই তার স্বর্গ কল্পনার ভিত্তি। বাইবেল এবং কোরানে সাদইদকে নিন্দা করা হয়েছে, এবং সাদইদের জন্য অশ্রুপাতও শাস্ত্রসম্মত। এছাড়া কৃষির দেবদেবীদের কথা, সূর্যদেবতার বিবরণ একই প্রকারে প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি, যা গুহাচিত্র, প্রাচীরচিত্র ইত্যাদি থেকে উৎকীর্ণ হয়েছে বিভিন্ন গ্রন্থে—এ-কাহিনী সেইসব গ্রন্থের প্রণেতা এবং পুরাতত্ত্ববিদদের কাছে ঋণী। ঋণী সেইসব গ্রন্থের অঙ্কিত চিত্রগুলির শিল্পীদের কাছে, সংগ্রাহক বিজ্ঞানীদের নিকট। তাছাড়া সাধারণ প্রচলিত বিভিন্ন গ্রন্থও এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে–সব গ্রন্থের নামোল্লেখ সম্ভব নয়। প্রধান যে গ্রন্থটিকে অবলম্বন করা হয়েছে, তার প্রণেতা লরেন্স টুম্‌স্‌।

শ্রদ্ধেয়কলা-সমালোচকসন্দীপ সরকার অজস্র চিত্র এবং ভাষ্যের সাহায্যে এই কাহিনী নির্মাণে আমাকে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন। তাঁর সহযোগিতা ছাড়া এই উপন্যাস অসম্ভব ছিল।

–লেখক

.

রিত্র ও স্থান পরিচিতি

ইহুদ–মুসাপন্থী এক অখ্যাত নবী।

সাদইদ–সেনাধিপতি।

লোটা–সাদইদের প্রধান সেনা।

হেরা–নিনিভে নগরীর নির্মাতা ভাস্কর।

আক্কাদ–দামাস্কাস ও মেসোপটেমিয়ার বণিক।

নমরু-মিশরের ভূপতি; মিশর-নগরী আমারনার পুরোহিত।

আবীরুদ–নমরুর পুত্র; রিবিকার প্রেমিক।

হিতেন–হিটাইট বা হিত্তীয় জাতির রাজা।

আব্রাহাম–প্রাচীন নবী।

নোহ–নৌ-নির্মাতা নবী । অপর উচ্চারণ নোয়া।

লোট–আব্রাহামের বন্ধু।

মিশাল–নৌকারিগর।

দিনার–রহস্যময় মরু-কিশোর ।

ফেরাউন–মিশরের রাজা।

মোসি–মুসা বা মজেস।

আমন–সূর্যদেবতা।

যবহ–ঈশ্বর। অন্য উচ্চারণ ইয়াহো।

ইস্তার–কৃষির দেবী।

মসীহ–ত্রাতা।

সারগন–রাজচক্রবর্তী, যিনি সাধারণ অবস্থা থেকে রাজা হয়েছিলেন।

জিব্রিল–দেবদূত।

আজরাইল–যম। জিগুরাত-স্বর্গ ।

নিনিভে–আসিরিয়ার নগরী।

কনান–প্যালেস্টাইন।

রিবিকা–নায়িকা।

রুহা–হাতকাটা দেবদাসী।

নিশিমা–দেবদাসী।

নিনিভা–হেরার দ্বিতীয় পত্নী।

.

০১.

সমস্ত রাত্রি মরুভূমির আকাশে নিশান-মাসের চতুর্দশীর চাঁদটির দিকে চেয়ে ছিল সুন্দরী রিবিকা। নিশান-মাসটি যে মুক্তির মাস সেকথা স্বপ্নদশী ইহুদ বারবার বলেছিলেন। এই মাসে নিস্তার-পর্ব পালন করছিল তারা। অথচ তাদের একমাত্র আশ্রয় এলিফেনটাইন দুর্গটি জ্বালিয়ে দিলে মিশরীয়রা। হাতির দাঁতের কারুকাজ করা মন্দিরটি ধ্বংস করল। হায় দেবী ইস্তার তোমাতে আমাতে আর কোনই বিশেষ পার্থক্য নেই।

চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়ের তলার ভেজা বালি পাথর আর জল মুঠো করে চেপে ধরল রূপবতী রিবিকা। রিবিকার গায়ে কাপড় নেই। পরনের কাপড়খানিও মরুদসুর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে। আকাশের নীল নদীর জলের মত উজ্জ্বল চাঁদ নগ্ন রূপসীকে দেখছে, কিন্তু নির্বাক। আকাশের ওই ক্রীতদাসী চন্দ্রমা কী বলবে তাকে? রূপ আছে কিন্তু নরদেবতা ফেরাউনের পিরামিডের আকাশ ছেড়ে কোথাও চলে যাওয়ার সাধ্য নেই। যেন সে পিরামিডের চুড়োর সঙ্গে গাঁথা। নরদেবতা সপ্তম ফেরাউন তাকে আটকে রেখেছে। তার বন্দিত্ব আর রিবিকার বন্দিত্ব নীল নদীর আকাশের মত সীমাহীন অথচ তা যেন-বা একটি পিরামিডের চূড়ার চারপাশে বন্দী।

একটি হায়েনা এসে মরুকূপটির উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়েছে। ভয়ে রিবিকার হৃদয় কেঁপে উঠল। মানুষ নাকি হৃদয় দিয়ে চিন্তা করে–একথাই বলেন নরোত্তম ইহুদ। সেকথা যদি সত্য হয়, তাহলে এখন সেই হৃদয় স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে। পায়ের তলায় জল পাথর আর বালি ফের মুঠো ভরে আঁকড়ে ধরে বিনিদ্র রিবিকা। তারপর সে কূপটির তলা থেকে সেই ভেজা ভারী পাথর মিশ্রিত বালি উপরের দিকে ছুঁড়ে মারে। এই মরুকূপের ভিতর সে মরুদস্যুর হাত থেকে কোন প্রকারে প্রাণে বেঁচে আত্মগোপন করতে পেরেছে। উপরে দীর্ঘক্ষণ তাদের দলটির সঙ্গে দস্যুদলের লড়াই হয়েছিল সন্ধ্যার মুখে।

কেউ রক্ষা পায়নি। সকলকে হত্যা করেছে ডাকাতরা। কেবল সে লড়াই বাধার পর উটের পিঠ থেকে নেমে পালাতে শুরু করে। ঊর্ধ্বশ্বাসে মরুভূমির ভিতর দিকহারার মত ছুটতে শুরু করে। একজন ডাকাত তার পিছু পিছু তেড়ে এসে তার গায়ের পোশাক টেনে ছিঁড়ে দেয়। পরনের পোশাক ধরে টানাটানি করার সময় রিবিকা হতভাগ্য দেবী ইস্তারের নাম ধরে কঁকিয়ে কেঁদে ফেলেছিল। দস্যুটি তাকে কিছুতেই ছাড়ত না-সহসা কোথা থেকে একটি বর্শা এসে কামোন্মত্ত ডাকাতটিকে পিছন থেকে বিদ্ধ করে। লোকটি রিবিকার পরনের পোশাক ছেড়ে মরুভূমির বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে যায়।

আবার পালাতে থাকে দেবী ইস্তারের মত নগ্ন এবং রূপসী রিবিকা। কতদূর সে ছুটে এসেছে বুঝতে পারে না। যেন নীল নদীর পশ্চিম তীরে সূর্যদেবতা সামাশ ডুবে যাচ্ছেন, মরুপথ অতিক্রম করতে করতে বুঝতে পারে মাত্র–অথচ কোথায় সেই নীল নদী পড়ে রইল পিছনে। তার শস্য রাঙানো দেহতীরের বসতি ভেঙে দিল মানবদেবতা ফেরাউন–যে কিনা দুই-তৃতীয়াংশ দেবতা এবং মাত্র একাংশ মানুষ। ফেরাউনদের শবাধারলিপি সে পড়েছে। তাতে স্পষ্ট করে লেখা ছিল, চিরকাল তারা লিখে আসছে :

‘আমি কাউকে কখনও কাঁদাইনি,
আমি কাউকে কখনও কষ্ট দিইনি,
আমি পশুদের কখনও আঘাত দিইনি।
আমি কাউকে কখনও মৃত্যুদণ্ড দিইনি ।।‘

মরুপথে দিগ্বিদিক ছুটতে ছুটতে রিবিকা কতবার সেই শবাধারলিপি মনে মনে পাঠ করেছে আর দেবী ইস্তারের নাম ধরে কেঁদেছে।

বালির আঘাতে রিবিকার পা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, ফোস্কা পড়েছে। সে ছুটতে ছুটতে বালির ঢিবির পাশে পড়ে গিয়েছিল, শ্ৰমশ্রান্ত সে–তার হৃদয় আর চলছিল না। হৃদয় চিন্তা করতে পারছিল না। আস্কিলনের রাজকুমার ওয়িডিয়া হৃদয় দিয়ে চিন্তা করতেন। নরদেবতা ফেরাউন সেই হৃদয় দিয়েই চিন্তা করেছে। এমনকি পুণ্যশ্লোক ইহুদ অবধি হৃদয়ের সংকেতে কথা বলেন। কারণ এই সকল দিব্যজ্ঞানী মহাত্মাদের হৃদয় সত্যের পালক দিয়ে ওজন করেছেন ঈশ্বর–তাঁরা প্রত্যেকেই সত্যের এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। অথচ রিবিকা জানে না, পালকের মত হালকা আর কোমল তার হৃদয় ভেঙে পড়বে কিনা! তার হৃদয় আজ কোন্ সংকেত বহন করছে। সূর্যদেব সামাশ মরুভূমির বুকে অস্ত গিয়েছেন, চাঁদের বেগুনি আলো পড়েছে বালিতে, যা ক্রমে রূপার গলিত বিভায় উজ্জ্বল হবে, হৃদয় মাত্র এইটুকু চিন্তা করতে পারে।

কেমন এক আচ্ছন্নতার ভিতর, ক্লান্ত অবসাদের ভিতর রিবিকার সময় কেটেছে । চারিদিকে চাঁদের আলোর ঘোর। সন্ধ্যা অতিক্রান্ত হলে চোখ মেলে রিবিকা। চাঁদ কোন দেবী কিনা জানে না সে, তবে ক্রীতদাসী যে সন্দেহ নেই। ইহুদের হৃদয় কি তবে সত্য বলেনি? কোথায় মুক্তি! মরুভূমির বালিতেই রিবিকা মুখ গুঁজড়ে পড়ে আছে।

ক্রীতদাসী চাঁদ জানে মাত্র তিনটি ভেড়ার লোমের বিনিময়ে রিবিকা দামাস্কাসের এক মরুবণিকের কাছে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। অথচ সুন্দরী কনান তার মাতৃভূমি। পবিত্র দেশ কনান। আব্রাহামের মধুদুগ্ধপ্রবাহিণী স্বপ্নের দেশ, মহাপিত নোহের পিতৃভূমি। একজন বণিক, যার ছিল মদ আর লোমের ব্যবসা–রিবিকাকে তিনটি মেষের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়ে ফোরাত নদীর তীরভূমির দিকে চলে গিয়েছিল। সেই পূর্বদেশের দেবী ছিলেন ইস্তার। আকাশের দেবতা সূর্য,নাম তার সামাশ। অথচ সেই মেষপালক বণিকটি ক্ষুদে ব্যবসায়ী এবং চতুর–তাকে কন্যারূপে গ্রহণ করে, দাসীরূপে ব্যবহার করেছিল।

লোকটির নাম ছিল আক্কাদ। তার নবী ছিলেন সালেহ। সালেহ উটের নবী। পুণ্যশ্লোক ইহুদের মতই কি তিনিও মরু আরাবার নবী? নিশ্চয়ই তাই। ফোরাতের তীরে আক্কাদের ছিল ছোট একটি গোষ্ঠী।

সবচেয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আক্কাদীয় গোষ্ঠী। মাত্র গুটিকতক তাঁবুর তলে তারা বাস করত।

কিন্তু এসব ভেবে তো কোন লাভ নেই। আক্কাদ অবশ্য ইট দিয়ে গেঁথে জমরুদ পাথর গেড়ে একটি সুন্দর ইমারত গড়েছিল–তার ছিল সাদা সাদা উট আর উষ্ট্রী। আর ছিল নানা রঙের মেষ। মদের দোকান ছিল।

চাঁদের আলোয় হঠাৎ খেয়াল হল, ঠিক পায়ের কাছেই একটি অর্ধমৃত কূপ। নিচে নেমে বালি সরাতে পারলে জল পাওয়া যাবে। তৃষ্ণার পীড়নে বুক ফেটে যাচ্ছে। আর দেরি না করে রিবিকা গড়াতে গড়াতে কৃপের তলায় নেমে আসে। ক্লান্ত হাতে বালি সরাতে সরাতে মরু-দস্যুটির কামানো থুতনি আর ঝোলা গোঁফ মনে পড়ছিল। তাকে দেখাচ্ছিল আক্কাদের সাদা আর গায়ে হলুদ মুতমাথা গাধাটার মত বোকা। নিশ্চয়ই পাহাড়ী ডাকাত। একটা হিত্তীয় বাঁদর। একেবারে গোঁয়ার হাটুস। হিটাইট বা হিত্তীয় জাতিকে মনে মনে হাটুস বলে গালি পাড়তে পাড়তে বালি খুঁড়ে চলল রিবিকা। আঙুলে জলের ছোঁয়া লাগা-মাত্র সে শিউরে উঠল। যেন-বা ফেরাউনের দৈবী হৃদয় পালক আর ঐশ্বর্যময় জীবনের মত তাকে ছুঁয়েছে। উপরে চাঁদের আলোর হালকা হাওয়া বইছে। দূরের অরণ্যে কোথাও পাতাগুলি নড়ে উঠল। এই সময় মরুভূমির পশুরা বালির উপর খেলা করে। উপর থেকে হাওয়ার একটা গোলা বয়ে এসে কূপের ভিতরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেই বাতাসে পশুর গায়ের রমণ করা গন্ধ।

নিঃশ্বাস টেনে কেমন বিপন্ন হয় রিবিকা। জলপান করতে করতে ভাবে, ঈশ্বরের রমণকৃত সুঘ্রাত শ্বাস দিয়ে মানুষের জন্ম। এই জল, এই জ্যোৎস্না, এই বায়ু, উপরের বন্যঘ্রাণ, মাতাল মরুভূমি, রক্তঝরা মৃত্যুশীতল বালকা–অবধিহারা তার বিস্তার–অথচ সে এক ভাগ্যতাড়িত ক্রীতদাসী কিনা মুক্তির কথা ভাবছে–যে কিনা দেবী ইস্তারের মত নগ্নিকা। কী তুচ্ছ এই জীবন!

উপরে কৃপের কিনারে ভয়ংকর সেই লম্বাটে মৃত্যুবৎ জঘন্য-দর্শন মুখটা ঝুঁকে আসে। হিংস্র আর ধূর্ত মরু-হায়েনাটা কিছুতেই যাবার নয়। রিবিকা জলের ভিতর হাত নেড়ে খলবল শব্দ করে, খুব দ্রুত এবং সবেগে হাত নাড়ে। ক্রমাগত হাতের আন্দোলনে জলের চাপা অদ্ভুত শব্দে হায়েনাটা দূরে কান পাতে এবং মরুভূমির আকাশে তাকায়। জলের শব্দ থেমে যেতেই আবার ঝুঁকে আসে। রিবিকা অতর্কিতে পাথর মেশানো বালি ছুঁড়ে মারে। ভেজা দলা পাকানো বালি গিয়ে লাগে হায়েনার জ্বলন্ত চোখে। পশুটা অন্ধের মত চিৎকার করে ওঠে। হিংসার বিদ্যুৎ গলা থেকে খেঁকিয়ে বার হয়। গায়ে মোচড় মেরে পালিয়ে যায় পশুটা।

অতঃপর কুপের তলার জলে রিবিকার হাতে আন্দোলিত জল মাত্রই যে-শব্দ ওঠে, তাতেই ভয় পায় হায়েনাটা। সমস্ত রাত্রি এভাবে কূপটা জেগে থাকে। জল, মানুষ, চাঁদ আর হায়েনা ছাড়াও নাঙা দেবী ইস্তার জাগেন।

কাল ভোরে কী হবে, কোথায় যাবে রিবিকা কিছুই জানে না। সেকথা ভাববার মত মনের অবস্থাও তার নয়। সে কেবল এই রাতটুকু কোনভাবে পার করতে চায়।

নীল নদীর দক্ষিণ প্রান্তে এলিফেনটাইন (ঐরাবত দুর্গ)। দুর্গটি ধ্বংস হয়ে গেল। ইহুদের জনগোষ্ঠী নিরাশ্রয় হল। তার আগে পর পর সাত বছর নীল নদীতে জলোচ্ছ্বাস হল না। দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। স্বাভাবিকের চেয়ে মাত্র পাঁচ ফুট নিচে দিয়ে জল বইলেই নীল নদীর অববাহিকা অঞ্চলে ফসল জন্মানো যায় না। মাটি শুকিয়ে ওঠে। পর পর সাত বছরের খাদ্যাভাবে প্রচুর মানুষ মারা গেছে। ইহুদের যাযাবর গোষ্ঠীর পশুরা মরেছে। মিশরে ইহুদের লোকবল অতি সামান্য। অথচ সামান্য এই জনগোষ্ঠীর জন্যই ইহুদের স্নেহ অসামান্য। তিনি চান পারস্য উপসাগরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণ থেকে লোহিত সাগরের কিনারা পর্যন্ত বিস্তৃত হাজার মাইলের চন্দ্রকলাকৃতি অর্ধবৃত্তাকার ভূভাগের আধিপত্য। তাঁর ধর্মের বিস্তার। এবং তিনি আব্রাহামের বায়োগোষ্ঠীর একতা যাতে হয়, সেই ইতিহাস সৃষ্টি করতে চান। তাঁর বারোটি গোষ্ঠী চন্দ্রকলাকৃতি ভূভাগে ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের তিনি খুঁজছেন।

ইহুদ কবেই (ঐরাবত) এলিফেনটাইন ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। দুর্গের চারপাশ ঘিরে গড়ে ওঠা রিবিকাদের বস্তীগুলিকে তিনি এক পরম মমতাবশত ত্যাগ করে যাননি। তাঁর সংকল্প ছিল মোসির উল্লিখিত নিশান-মাস অর্থাৎ মুক্তির মাসেই যাত্রা করবেন কানের দিকে। ঠিক এই মাসেই মাত্র ৮০ জন উৎকৃষ্ট উম্মত পরিবার সঙ্গে করে মোসি এই মিশর ছেড়ে গিয়েছিলেন একদা অতীতে। কিন্তু একদিন (১২০০-৫২৫ খ্রিঃ-পূর্বাব্দের কোন এক সময়) ইতিহাসের চাকা অতীতবৃত্তে ঘুরে যেতে লাগল পিছনে, ঘুরেই গিয়েছে বলা যায়। মিশরীয়রা মোসির আগের যুগের মত বিভিন্ন স্থান থেকে ইহুদের ধর্মের লোকজনকে কিনে। এনে, জোর করে ধরে এনে ক্রীতদাস ব্যবস্থার নতুন করে পত্তন করেছে এই মিশরের বুকে। দক্ষিণ-পূর্বের অসুর জাতি মিশর আক্রমণ করেছে অতীতের মত।

অবশ্য মোসি তো মাত্র ৮০ জন উম্মত পরিবারকে কনানের দিকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। পরে সেই টানে আরো কতজন বিভিন্ন স্থানে মুক্তি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু দাসত্বের শৃঙ্খল বারবার পায়ে পরেছে তারা। কেবল একটুখানি মুক্তির স্বাদ তাদের রক্তে মিশেছিল সেই কবে। সেই স্বাদ আবার তারা ভুলে যেতে বসেছে। যাযাবর জাতি স্বাধীন চৈতন্যে ঘোর, ফের মাটির টানে তার রক্ত উষ্ণ হয়, ক্রীতদাসত্বে মজে। হানাদার হিসেবে তার বদনাম যত, মুক্তি-পিপাসু এবং ভূমিবশ্য হিসেবেও তার রক্তের গড়নের দাম আছে। ইহুদ এসব বলেন।

এলিফেনটাইন (ঐরাবত) কতবার ধ্বংস হয়েছে। দুর্গের মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করেছে ক্রীতদাসেরা। বিশেষত মেসোপটেমিয়ার আব্রাহামী দাসেরা চেয়েছে মন্দিরটি পুনরায় নির্মাণ করে সাজাতে এবং দুর্গের প্রাচীর খাড়া করতে। অতঃপর দেবী ইস্তারকে মন্দিরের সর্বোচ্চ ধাপে প্রতিষ্ঠা দেবার চেষ্টা করেছে। তারা। এমনকি তারা মন্দিরের গায়ে খোদিত করেছে মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন অনুশাসনলিপি। মানবাধিকারের জ্বলন্ত উক্তি।

‘অত্যাচারী তার পাপের ভারা টানতে পারে না। তার স্পর্ধাচিহ্ন পিরামিডের চুড়ার মত আকাশম্পৰ্শী হলেও সে ডোবে।‘

এই লিপি হুবহু সুমেরীয় লিপির অনুকৃতি নয়। তার সঙ্গে আধুনিক মেজাজ এবং মিশরীয় উপমা ব্যবহৃত হয়েছে। সেদিকে আঙুল তুলে ইহুদ বলেছেন–এই লিপি ইতিহাসজড়িত। কিন্তু মিশরের রাজা এতে ক্ষুব্ধ হতে পারেন। প্রাচীন অনুশাসন অবিকৃত রাখাই বিধেয়। তোমরা এভাবে প্রকাশ্য উক্তির নকশা না আঁকলেই পারে। তাছাড়া দেবী ইস্তারকে এভাবে গহনা পরিয়ে জীবিত করার মানে নেই। এ দেবী নগ্ন ছিলেন। এসব কুসংস্কার।

ইহুদেরও দেবীর উপর রাগ। কিন্তু তিনি খুব বুদ্ধিমান। সব কথাই খুব নরম সুরে বলেন। তিনি জানেন পর পর সাত বছর দুর্ভিক্ষ হলে মানুষ কৃষির দেবী, উর্বরতার বিগ্রহ ইস্তারকেই ডাকবে। নগ্ন হলেও ডাকবে । ইহুদের বোঝা উচিত, কেন, কীভাবে দেবী নগ্ন হয়েছিলেন!

রিবিকার চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসছিল। সে তখন জলের তলায় হাত চালিয়ে দিয়ে শব্দ করল। জলের শব্দে হায়েনাটা আবার সরে গেল। যেন মৃত্যুর ছায়া সরে গেল চকিতে।

তার মনের ভিতর জেগে উঠল তিনটি লোম-ছাঁটা ভেড়ার করুণ নেড়া ছবি। একজন কনানীয় চাষী রিবিকাকে বিক্রি করছে। মেষের লোম স্থূপীকৃত করেছে একজন যাযাবর মেষপালক বণিক। মদের কারবারী। লোকটির হাতে ধরা লোমকাটার যন্ত্র। খুরপি চকচক করছে। আক্কাদের গাধাগুলির পিঠে ছিল চামড়ার থলে ভর্তি মদ আর শুঁটকি মাছ। সেবছর মরুভূমির হাহাকার করা শীত ছিল কনানের গ্রামগুলিতে–সে যে কী ভয়ংকর দুর্দশা!

মরুভূমিতে শীত সব বছর সমান পড়ে না। এই শীতকে চাষীরা যমের চেয়ে ভয় পায়। মেষপালক যাযাবর আব্রাহামীদের সেকারণে রেয়াত করতে বাধ্য হয় তারা। যাযাবরী তাঁবুগুলির সঙ্গে সেই সময় সদ্ভাব হয়। ভেড়ার নোম আর যাযাবরীদের হাতে বোনা লোমের পোশাক চাষী তার শস্যের বিনিময়ে কেনে। ঘটনা এমনও রয়েছে যে,একটি গরিব চাষী পরিবার শুধুমাত্র নোম পাওয়ার জন্য যাযাবরীদের চাষের জমিতে বসবাসের সুযোগ দিয়েছে। চাষবাস এবং অন্যান্য কাজের সুযোগ দিয়েছে। দ্রাক্ষাচাষ এবং মদ তৈরি শিখিয়েছে।

নগরের লোকেরা আব্রাহামীদের কেন যে বেদে বলে উপহাস করে? অমার্জিত অসভ্য বলে কটুক্তি করে? খুরপি-অলা আক্কাদের চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বালিকা রিবিকার দুই চোখ ম্লান হয়ে আসছিল। দুই চোখ তার বারবার ভিজে উঠছিল। ঠাকমার মুখে রাজা সারগনের গল্প শুনেছে । তিনি ছিলেন রাজচক্রবর্তী। এই আক্কাদের পূর্বপুরুষ তিনি। ফোরাত আর হিদ্দেকল নদীর তীরে ছিল তাঁর রাজপ্রাসাদ ‘জিগুরাত’ সে এক স্বপ্নবেষ্টিত পৃথিবী। আজ আর নেই। কেন নেই, সে এক অভিশাপের কথা। সে কাহিনী শুনলে মন খারাপ করে।

মানুষ রাজত্ব গড়ে, ফের রাজত্ব হারায়। আব্রাহামীদের বদনাম ঘোচে না–এরা মরু আরাবার হানাদার গোষ্ঠী। এরা বেদে। এরা নিরন্ন। দিদিমা সুর করে বলতেন :

‘আব্রাহামী হানাদার মাথা নিচু করে না,
সারগন মরে তবু সারগন মরে না ॥
নলখাগড়ার ঝুড়িতে সারগন ভাসে রে;
পীচ-আঁটা ঢাকনার ঝুড়িতে–
জর্দন নদীতে, ফোরাতের কূলেতে,
ভিস্তির কোলেতে সারগন হাসে রে ॥
তার জাত আরাবার, কাঁচাখেকো হানাদার–
বেঁচে থাকে তাঁবুতে, ঘরবাড়ি জোটে না,
যখন সে মরে যায়, কাঁচা খায় হায়েনা ॥
কবর তো জোটে না, তিন হাত জমিটুকু
তাও সে পায় না, এমনই হাহাকার–
হানাদার হানাদার, জর্দন নদীতে ফোরাতের কূলেতে ॥’

কোথায় ফোরাত আর কোথায় জর্দন! সারগন কতদূর পূর্বে পশ্চিমে উত্তরে দক্ষিণে সাম্রাজ্য গড়েছিল–সবই নিশ্চিহ্ন হয়েছে। পরে তারই জাত মিশরের ফেরাউনের হাতে বন্দী হল। সবই কপাল! এই আহাদী আক্কাদ তাকে আজ পশুলোমের বিনিময়ে মদ আর শুঁটকি মাছের বিনিময়ে খরিদ করছে বালিকা সে, তার বাধা দেবার কোনই ক্ষমতা নেই। তাকে বেচে নানী এই চাষী পরিবার। মরুভূমির শীতের হাত থেকে বাঁচবে। একটি পারিবারিক উষ্ণতার বিনিময়ে রিবিকা মধুদুগ্ধপ্রবাহিণী পবিত্র জন্মভূমি ছেড়ে কোথায় ভেসে যাবে।

আক্কাদ লোম কাটতে কাটতে হাতের খুরপি থামিয়ে ঘাড় তুলে বলল–ফোরাতের পানি তো খাওনি বাছা! দেখবে কী মিঠে! ফোরাতের হাওয়া খুব ভাল। আমার বাড়ির নাম হাওয়ামহল। খালি বসন্তের হাওয়া বয়। মরুভূমির ঠাণ্ডা পোঁছয় না। খুব তাড়াতাড়ি তুমি যুবতী হতে পারবে।

–আমি যাব না ঠাকমা! আমি কি আক্কাদের ভেড়ার চেয়ে দেখতে খারাপ!

–না বাছা! কিছুতেই না! তুমি যে খুবই সুন্দরী মাগো!

–তবে এভাবে বেচে দিচ্ছ কেন?

–তোমার ভাগ্য মা! আক্কাদের তোমাকেই চোখে ধরল কিনা! এই দ্যাখো, উনি আমাকে একখানা কুর্তা দিয়েছেন। তোমার কাকাদের লোমের জোব্বা দিয়েছেন। তোমার কাকীদের গরম বসন দিয়েছেন। সবই তোমার জন্য মা! জমিতে ভাল ফসল হলে তাই বেচে একটা উট কিনে তোমায় আনতে যাবে তোমার ছোটকাকা। ততদিনে তুমি আর কতটুকু বড় হতে পারবে–যদি বৃষ্টির দেবতা চোখ তুলে চান–সামনের সন তুমি ফিরে আসবে।

–তুমি যে বল, পূর্বদেশে যারা গেছে, তারা আর ফেরেনি!

–তারা তো যুদ্ধে মরেছে। তাছাড়া মিশরের রাজা ধরে নিয়ে গেছে। বিহিস্তুনের ডাকাতেও মেরেছে ওদের। তা ফের কারুকে ভান হ্রদে পুঁতে দিয়েছে। তুমি যাবে নিনিভে নগরী পার হয়ে, ফোরাত কি হিদ্দেকলের ধারে–সেখানে উটকণ্ঠী নৌকা ভাসছে মা। ভয় পেও না। মহপিতা পুণ্যশ্লোক নোহ তোমার সঙ্গে রইলেন!

সমস্ত ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে পড়ছিল রিবিকার। আক্কাদ সেদিন তিনটি ভেড়ার লোম কেটে তূপীকৃত করেছিল, এবং রিবিকাকে পেয়ে লোমসুদ্ধ তিনটি ভেড়াই দিয়ে দিয়েছিল কনানীয় দরিদ্র পরিবারটিকে।

লোমছাড়ানো হতকরুণ একটি মেষ যেমন, রিবিকা নিজেও তাই–ভাগ্যের কথা মনে হলে, বারবার তার তিনটি ভেড়ার ছবি মনে পড়ে। আক্কাদ তাকে যত সস্তায় কিনেছিল তত কম দামে বেচেনি, চড়া দাম নিয়েছিল মিশরীয় এক বণিকের কাছে। আসলে আক্কাদ তাকে চড়া দরে বেচে দেবার জন্যই যে। কিনেছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু কেনার সময় দেবী ইস্তারের নামে, কৃষিদেবতা। বালদেবের নামে দিব্যি গেলেছিল, সে রিবিকাকে কন্যার মত দেখবে এবং বেচে দেবে না। বলেছিল-উটের গা ছুঁয়ে কসম খাই মা!

মিশরীয় সেই বণিক পুরনো নগরী আমারনার লোক ছিল। লোকটি সূর্যদেবতা আটনের জন্য রচিত সূর্যস্তোত্র আওড়াত। এর নাম ছিল নমরু। মিশরের সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু সম্প্রদায়ের লোক। সংখ্যালঘু আক্কাদ করত উটের পূজা। নমরু করত সূর্যস্তব। ভাবতে অবাক লাগে, এরা দুজনই এমন ধর্ম পালন করত, যার কোন মিলই নেই। সেদিক দিয়ে দেখলে আক্কাদ ছিল বিদ্রোহী আর কোণঠাসা, একটেরে লোক। ইহুদের আবার এই দুই ধর্মসম্প্রদায়ের উপর সহানুভূতি লক্ষ্য করা গেছে। রিবিকা যখন যেখানে থেকেছে সেই ধর্মই পালন করেছে। তবে দেবী ইস্তারের মত এত স্পষ্ট কেউই নয়, অন্তত রিবিকার তাই মনে হয়েছে। এই দেবী যেন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা (সেকালে সেখানে অন্ন বলতে যব গম ইত্যাদি বোঝাত), কোমল, ভীরু আর নগ্ন। নবান্নের দেবী। অন্নপূর্ণাই বল আর লক্ষ্মীই বল, এত অসহায় কেউ নয়, এত পূর্ণশ্রীও কেউ না।

টুকরো টুকরো ভাবে কত ছবিই না মনে পড়ে! পূর্বদেশের নবান্নের রাত, যে-রাতে আক্কাদ তাকে প্রথম সম্ভোগ করেছিল উটের পিঠে শুইয়ে । কন্যা হয়েছিল উপপত্নী। তখন রিবিকার বুকে কেবলই কুঁড়ি ফুটেছে। স্তনবৃন্তে মর্দন করা লোকটার মেটে সাপের মত আঙুল সিরসির করছিল; ঘৃণায় আর ভয় মেশানো কামার্ধ দেহে রিবিকা কেঁদেছিল–তার যোনি-প্রদেশ রক্তাক্ত করেছিল গর্দভ-লিঙ্গ পশুটা। সে বারংবার রিবিকাকে বুঝিয়েছিল, উটের পিটে যৌন আস্বাদন করলে পুণ্য হয়, এ জিনিস সুন্নৎ। নবী সালেহ তাতে খুশী হন।

উটের কুঁজটা নবী সালেহর কবর। এখানে তিনি শুয়ে আছেন। এই অনুমান পূর্বদেশগুলির সকলেই বিশ্বাস করত। কেন করবে না? সালেহ ছিলেন মরু আরাবার আমোরাইট বা আমেলেক জাতির লোক, আব্রাহামের বংশের মানু নোহের পুত্র সামেরের গোত্রভুক্ত, তথাপি উট-উপাসক। নিশ্চয়ই বারো গোষ্ঠীর এক গোষ্ঠী এরা। নবান্নের রাতে আক্কাদের লোকজন উটকে মাল্যে পুষ্পে সুর্মা তিলকে সাজাত, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে দিত। এই রাতে তারাও দেবী ইস্তারের সামনে যৌনাচার করত। এই রাতে সমূহ গ্রাম নগরী সেজে উঠত। গ্রামে এবং নগরে সর্বত্র উৎসব চলত। চাষী জীবনে উটের প্রভাব তেমন ছিল না, কিন্তু যৌনাচারের রাতে কোন কোন চাষীপুত্র উটকে ব্যবহার করত তার আন্দোলিত পৃষ্ঠভূমিতে যৌনবিহারের জন্য।

দুটি ধর্ম–নির্দিষ্ট এই রাত্রিতে মিলিত হত। নবান্নের রাতেই আক্কাদ রিবিকাকে উটের পিঠে জোর করে তুলে নিয়েছিল। সেই সময় আক্কাদের চোখদুটি দপ দপ করে জ্বলছিল। আক্কাদের চোখে হীরা পর্বতের নীল সুমা। মোসি যে পর্বতে ঈশ্বর যবহের প্রত্যাদেশ পেয়েছিলেন, সীনয় উপদ্বীপের হীরা পর্বতটি, অতএব সীনয় পর্বতেরই সংলগ্ন অথবা সীনয়েরই অন্য নাম হেরোর বা হীরা। অথবা হীরা কোন গুহা মাত্র। যাইহোক, হীরার পবিত্র সুর্মা চাষীদের চোখেও সেই রাতে জ্বল জ্বল করছিল পশুচর্বির মশালের আলোয়। আলোর ফোয়ারা উঠছিল আকাশের দিকে। মিলনের এমন রাত পৃথিবীতে কমই আসে।

নবান্ন আর দোলের রাত একই রাত। আকাশে পূর্ণিমা। উদ্ভাসিত আলোয় প্লাবন বইছে চরাচরে। দেবী ইস্তার অলংকৃতা। ঢোল বাজছে বাতাসে। উট সুসজ্জিত। সবার পরনে বেগুনি রঙের পোশাক। মরুসরষের পাঁপড়ি আর বোঁটায় রাঙানো–বোঁটা বেগুনি, পাপড়ি হলুদ। রঙে ছোপানো হয় সেদ্ধ করার পর। রিবিকার গায়ে কাঁচুলি–দুই-তিনটি স্তরে পাতলা কাপড়ে ঢাকা বক্ষবন্ধনী)–আর কোন পোশাক নেই। মধ্যরাত্রিতে গায়ে সামান্য সুতো রাখাও নিষেধ। ধর্মের নিষেধ। দেবী ইস্তার ক্ষুণ্ণ হবেন। আক্কাদীয়রাও সেকথা বিশ্বাস করে। কাঁচুলি পরা বিদেশী নাগরিক প্রভাব । চাষীরা অনেকে কাঁচুলি পরলে ঠাট্টা এবং ঈষৎ কটুক্তি করত।

আক্কাদের মা তাড়া দিচ্ছিল–যাও বাছা! আক্কাদ উটের পিঠে অপেক্ষা করছে। বুকে ওইরকম লাগাম পরেছ, লজ্জা হয় না? এত শউরেপনা ভাল না!

কথাটার ইঙ্গিত বালিকা রিবিকা বুঝতে পারছিল না। ঢেলে সেই কখন কাঠি পড়ে গিয়েছে। দেবী ইস্তার শেষ রাতে পাতালে নামবেন। যমালয়ে প্রবেশ করবেন তিনি। যমের বাড়ি পাতালে,এই হল লোকবিশ্বাস। মাটি ও বৃষ্টির দেবতা তামুজদেব মাঠ থেকে হলুদ শস্য কেটে নেবার পর পাতালে চলে যান। যমালয়ে যাত্রা করেন। মাঠ শূন্য। একটি দানাও সেখানে পড়ে নেই। আকাশ মেঘহীন। মরুভূমির শীত সামান্য হালকা হয়েছে। দোল রাত্রি এসেছে। নবান্ন হয়েছে প্রথমে একবার। যখন ফসল উঠেছিল। এবার হচ্ছে দ্বিতীয়বার। এটাই বড় উৎসব। এই উৎসবটি হয় বীজ গমের পায়েস দিয়ে, দেবীকে খাইয়ে, তেভাগ দিয়ে, পাঠানো হয় তামুজদেবকে উদ্ধার করতে। তামুজদেব পাতাল থেকে ফিরে না এলে আকাশে মেঘ জমবে না। আঁর প্রিয়তমা দেবী ইস্তার ছাড়া তাঁকে বাঁচিয়ে তুলে যমালয় থেকে ফিরিয়ে আনার কেউ নেই। দেবীকে সাত সাতটি তোরণ অতিক্রম করে যমালয়ে পাতালে শেষ স্তরে পৌঁছতে হবে।

প্রত্যেকটি তোরণ অতিক্রম করার সময় দেবীর হাত থেকে তাঁর দৈবশক্তির প্রতীকগুলি একটি একটি করে কেড়ে নেওয়া হয়। প্রত্যেক তোরণে একটি করে প্রতীক তিনি হারিয়ে ফেলেন। সাতটি স্তরে পেঁচানো পোশাক, প্রত্যেকটি খণ্ড খুলে পড়ে প্রতিটি তোরণের কাছে। যম তাঁর বস্ত্রহরণ করেন। দেবীমূর্তির দিকে চেয়ে ছিল রিবিকা। বুকে তার কেবলই কুঁড়ি ধরেছে। বারবার সে আনমনা হয়ে যাচ্ছিল।

পুরোহিত এবার চতুর্থ খণ্ড পোশাকটি খুলে ফেলছেন দেবীর গা থেকে। চতুর্থ প্রতীক একটি নৌকা, সেটি হাত থেকে নামিয়ে রাখলেন। এই সময় বিষয় শিঙা বেজে উঠল। মৃত্যুর স্বর যেন ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। রাঙা রাত্রি যে বিষাদে ভরে যায়, অন্তত রিবিকা বালিকা হলেও বুঝতে পারে। এই যে নৌকার, প্রতীক–এটা নোহের চিহ্ন। নৌকার পুচ্ছটাতে ফের উটের মুখ আর গলা। তা ছাড়া উটের বিগ্রহও আছে।

এই সময় খানিকটা গোলমাল বাধে। প্রতীক নামাতে গিয়ে পুরুত নাকি ভুল করেছেন। চতুর্থবার নামবে উটের চিহ্ন। ষষ্ঠবারে নামবে নৌকা এবং অবশেষে বৃষমূর্তি। বৃমূর্তি হল চাষীর চিহ্ন। দেবী ষষ্ঠ তোরণ পর্যন্ত মহাপিতা নোহের নৌকায় করে যেতে পারেন। সপ্তম তোরণে গিয়ে বৃষের পিঠ থেকে পড়ে যান। অতঃপর নগ্ন দেবী ভাসতে ভাসতে গিয়ে রানী এরেসকীগালের কাছে উপস্থিত হন। এই কাহিনী ইস্তার পুরাণে লিখিত আছে। পুরোহিত সেই পুরাণ পাঠ করে চলেছেন মন্ত্রস্বরে। বস্ত্রহরণ করছেন যম। এই অনুষ্ঠানে পুরাণ-পাঠ আবশ্যিক।

মণ্ডপের সামনে থেকে নড়তে এতটুকু ইচ্ছে নেই রিবিকার। অথচ আক্কাদের মা বারবার ডেকে পাঠাচ্ছে। কেন যে এভাবে ডাকছে এবং বারংবার আক্কাদ উঠের পিঠে ওঠাতে চাইছে বোঝা যায় না। উঠের পিঠে ওঠা মানে যে একজন কুমারীর পক্ষে খুব মারাত্মক, রিবিকা শুনেছে–কিন্তু দোলের এই রাত্রি তার কাছে কোনই আনন্দ বহন করে না। প্রথমে বুঝতে না পারলেও ক্রমশ রিবিকার মনে হচ্ছিল, তার বিপদ হবে।

দেবী ইস্তারও কুমারী। তামুজদেব তাঁর প্রেমের উপাস্য পুরুষ। তাঁর সঙ্গে অবৈধ মিলনে আকাশে মেঘ জমে, মাটি উর্বর হয়। মাটির সঙ্গে চাষীর হলের সম্পর্ক, বলপ্রয়োগের সম্পর্ক। যে দেবী তামুজকে উদ্ধার করেন, তাঁরই যৌন-প্রহারে দেবী দুঃখ এবং আনন্দ পান। পুরাণের মস্বরে সেকথা আছে। দুঃখ আর আনন্দ মেশানো দোলরাত্রি বিষাদে আচ্ছন্ন হয় এই মুহূর্তে।

দেবীর তরফে আর্তস্বর পুরুতের গলায় ধ্বনিত হয় :

‘আমাকে ছেড়ে দাও, যাতে আমি যে-দেশে গিয়ে কেউ ফেরে না, সেখানে যেতে পারার সান্ত্বনা পাই, জানি সে দেশ বিষণ্ণতার, সে দেশ অন্ধকারের। (ইয়োব ১০ : ২০-২১)।

এই পূর্ণিমা রাতে বস্ত্রহৃতা দেবীর বিসর্জন। আর্তস্বরে সমস্ত গ্রাম আর আলোকোজ্জ্বল নগরীগুলি মথিত হচ্ছে। একই সঙ্গে চুড়ান্ত দুঃখ আর আনন্দ পাওয়ার অনুভূতি রিবিকার হয়নি। তার জীবনে অবৈধ কোন প্রেমও নেই। সে জানে আক্কাদের উটের কুঁজটা নবী সালেহের কবরভূমি। যে নবী মাটিতে ঠাঁই পাননি মৃত্যুর পর। সমগ্রজীবন মরু আরাবার পথে পথে, ফোরাতের তীরে তীরে। তাড়িত হয়ে ফিরেছেন। শুধু তৃষ্ণার জল দিয়েছে মরুবাহক উট। উটই ছিল তাঁর দেবতা। সালেহের জীবনও ইস্তারের মত। দুঃখের রূপ তো একই। অসহায় যে তার একই কষ্ট। দেবী প্রতীক হারিয়ে অন্ধকার পাতালে প্রবেশ করেন, সালেহ ঘুরে মরেন মরুভূমির উষর পথে পথে।

প্রতি বছরই দোলরাত্রির দেবী-অর্চনায় উটের প্রতীক নামানোর সময় পুরুতে পুরুতে গোলযোগ বাধে। পুরোহিতরা অবস্থাপন্ন এবং প্রচুর জমির দখলদার। তারা সালেহের উপাস্যদের পছন্দ করে না। এরা যেহেতু মরু আরাবার যাযাবর জাতি, হানাদার–তাই ঘৃণ্য। এদের বাস্তু নেই, নির্দিষ্ট কোন বাসভূমি নেই, এরা তাঁবুতে থাকে। জোর করে পূর্বদেশীয়দের শস্যভূমিতে ছাগল মেষ উট নিয়ে ঢুকে পড়ে–জবরদখল করে জমি। এই অতীতে বহুবার ঘটেছে। পরে এরা বাস্তু পেয়েছে কিন্তু কখনই নিজস্ব ভূখণ্ড পায়নি, জবরদখল করাই এদের নিয়তি। এদের ইতিহাস দীর্ঘ। এরা যখনই নিজস্ব বাসভূমির জন্য কোন এক স্থানে তাঁবু স্থাপন করেছে, গ্রাম ও নগরের মানুষরা ক্ষুব্ধ হয়েছে।

অথচ দিনে দিনে এরা চাষীজীবনের সঙ্গে খুব একটা দূরত্বও রাখতে চায়নি। বরং মিশে যেতে চেয়েছে। তাদের যাযাবরী অনেক প্রথাকানুন ত্যাগ করে, কোথাও বালদেব, কোথাও দেবী ইস্তারের উপাসনা শুরু করেছে। চাষবাস শিখে স্থিতু হয়েছে। শুধুমাত্র মাংসভুক এই শ্রেণীর মানুষ তাদের কাঁচাখেকো বদনাম ঘোচানোর জন্য চাষীদের ঘরে বৈবাহিক সম্বন্ধ গজার চেষ্টা করেছে। কিন্তু চাষীরা আপন ঘরের গৌরীদান করতে হামেশা কুণ্ঠা প্রকাশ করে। বরং যাযাবর মেয়েদের ঘরে বউ করার পর চোর বলে খোটা দেয়। আসল বউ নয়, উপপত্নী।

রিবিকার মা ছিল কনানীয় পরিবারে দ্বিতীয় শ্রেণীর বউ। অর্থাৎ রক্ষিতার চেয়ে সামান্য উন্নত। উপপত্নী মাত্র। রিবিকার বাবা রূপে মুগ্ধ হয়ে পরিবারের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তাঁর থেকে মেয়েটিকে ঘরে তুলেছিল। পরে কালাজ্বরে বউটি মারা যায়। উপপত্নীর মেয়ে বলে বাতৃ আর জমিতে রিবিকার কোন আইনগত অধিকার ছিল না।

আক্কাদ ওকে পশুলোমর বিনিময়ে খরিদ করল। একজন যাযাবর বণিক চাইছে–পরিবার তেমন কোন আপত্তিই করল না। কেনই বা করবে!

রিবিকার মায়ের মুখের ভাষা ছিল অন্যধারা। পরিবারের পাঁচজন নাকি বুঝতেই পারত না। কে জানে কী ছিল–মাকে তো রিবিকার তেমন মনেই নেই। ভাষাভেদ মানুষকে বিভিন্ন করে, খাদ্যাভ্যাস আলাদা করে দেয়–সর্বোপরি ধর্ম কখনই এক হতে দেয় না। অথচ রিবিকার বাবা ছিল মহাপিতা নোহের বংশধর। নোহ কি যাযাবর ছিলেন না? নোহকে কেন যে সবাই চাষী মনে করে? চাষী বটে, জেলেও বটে, মিস্ত্রীও বটে। তিনি নৌকার কারিগর, চাষের উদগাতা, বীজ ও জীবের পালক। অথচ তিনিও মহাপুরুষ পুণ্যশ্লোক আব্রাহামেরই পূর্বপুরুষ।

তা সত্ত্বেও বিভেদ কম নয়। আব্রাহামীরা একদা যখন বাবিলনের পতনের পর ঈশ্বর যবহের অভিশাপে ভাষাভেদ হল বারোটি গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে গেল মরুনগরী আর গ্রামগুলি এবং মরুছাউনিগুলিতে, নোহ তাঁর নৌকায় সকল গোষ্ঠীর বীজ ও জীবকে স্থান দিয়েছিলেন-তিনি ভাষাভেদ গণ্য করেননি–যাযাবর কি চাষী, ভেদাভেদ করেননি।

রিবিকার বাবা যদি মাকে পত্নীরূপে বিবাহ করতেন, তাহলে বোধহয় রিবিকা এভাবে বিচ্ছিন্ন হত না। আক্কাদ মরুবণিক যাযাবর সালেহর কউম। ঠাকুমা একবার ভেবেও দেখলেন না কার হাতে পড়ছে মেয়েটি! যেখানে যাচ্ছে। সেখানকার অবস্থা কীরকম। তিনটি মেষ আর মেয়ে কি সমান? কনানীয়দের গণিতের ভাষা কি এই ধারা? মন্দিরের দেবীর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকা আপন মনে ফুঁপিয়ে উঠল। চতুর্থ প্রস্থ কাপড় খণ্ড খুলে ফেলেছে। পুরোহিত।

উটের চিহ্ন নিয়ে বিবাদ। আসলে আক্কাদীয়দের কেউ চায় না। মন্দিরে উটের ঠাই দিতে গভীর কুঠা-পুরোহিতরা চরম অসন্তোষে প্রতি বছর দোলের রাতে বিবাদ বাধায়। তারা চায় আক্কাদীয়দের উচ্ছেদ করতে। কিন্তু আক্কাদ অনেক চাষী পরিবারের লোম, মদ আর শুঁটকি মাছ দাদন দিয়ে মাথা খরিদ করে রেখেছে। আক্কাদের এই উন্নতি পুরোহিতরা সহ্য করতে পারে না।

সালেহ মরুপথে ঘুরে মরেছেন। উটের মাংস আর তৃষ্ণার জল দিয়ে তাঁর বাহক মানুষের জীবন রক্ষা করেছে–তাঁর দলকে নিয়ে ঘুরেছেন তিনি উষর মরু, নীল বনানী, সবুজ উপত্যকার চন্দ্রকলাকৃতি পথে। তাঁর পূর্বপুরুষ আব্রাহামের মত তাঁরও চোখে ছিল একটি পবিত্র দেশের স্বপ্ন, মধুদুগ্ধপ্রবাহিনী দেশের মেঘমেদুর ছায়ায় তিনি আশ্রয় এবং সমাধির স্বপ্ন দেখেছিলেন।

সালেহ পাননি। উটের কুঁজই তাঁর সমাধিক্ষেত্র। মন্দিরের সামনে থেকে রিবিকাকে আক্কাদের ভগিনী এসে জোর করে হাত ধরে টানল। আক্কাদের উটের কাছে এনে রেখে গেল। ইস্তার পুরাণে উট-উপাস্যদের বিধর্মী এবং বিদেশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে দেবী তাঁদেরও বাঁ হাতে গমশীর্ষ উপচার নেন। দেবী হতভাগ্যদের অমোচন করেন। অসভ্য জাতিরা সংযত থাকলে দেবী প্রসন্ন থাকেন। দেবী গমশীর্ষ চান–উট-উপাসক যেন নিজের জমি থেকে সেই ফসল উৎপাদন করে।

কিন্তু সালেহর যেখানে মরবার মত সাড়ে তিনহাত জমিই ছিল না–সেক্ষেত্রে তাঁর সংখ্যালঘু গোত্রটি জমি কোথায় পাবে–গমই বা ফলাবে কোথায়?

রিবিকাকে মন্দিরের চৌহদ্দির অনেক দূরে দাঁড়িয়ে দেবী ইস্তারের অর্চনা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছিল, এমন সময় আক্কাদ-ভগিনী সেবা তাকে টেনে নিয়ে এল।

বলল–ওভাবে হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছ? পোশাক-খোয়ানো নাঙা দেবী নিজেই তো বাঁচে না, তোমায় কি রাখবে গা? নবী সালেহর আশ্রয়ই আসল। পাতালে গিয়ে ভাসেন যে-দেবী, ইজ্জৎ যার নিজেরই নেই, তা ফের গমের শীষ! কথায় বলে কিসে আর কিসে–তামা আর সীসে! কোথায় সালেহ আর কোথায় ইস্তার। এসো তেতা, দাদা সেই কখন থেকে সেজে বসে আছেন ভোলায়।

উটের পিঠে দোলা চাপানো হয়েছে। সেবা বলে ভোলা। ঠেলা দিয়ে সেবা রিবিকাকে উটের পিঠে তুলে দিতেই উটটা চলতে শুরু করল।

মৃত্যবৎ জঘন্য-দর্শন কুৎসিত লম্বা মুখাকৃতি হায়েনাটা ফের ফিরে এসেছে। কূপের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রিবিকাকে দেখছে। সঙ্গে সঙ্গে রিবিকা সতর্ক হয়। জলের তলায় সজোরে হাত এবং আঙুল নেড়ে জলকে সরব আর হিংস্র করে তোলে। জলের যেমন সুন্দর ধ্বনি আছে, ফোরাত আর হিদ্দেকলের নদীতে সুর আছে, আছে জর্দনে আর নীল নদীতে সংগীতের ধ্বনিমালা, পার্বত্য নদীগুলির গান আছে ঝিরিঝিরি, তেমনি সেই জলেই রয়েছে হিংসা। ভয়াবহ প্লাবনে সেই হিংসারই ছবি ভেসে ওঠে।

কূপের জল মায়াবী। রিবিকার প্রাণরক্ষা করেছে। ফের সেই জলকে হিংস্র করে তুলে তাই হয়েছে তার অস্ত্র। হিংসা দিয়ে হিংসা দমন করা একটা শিক্ষা বটে। কিন্তু একে দমন না বলে, বলা উচিত–হিংসা ঢাল এবং হিংসাই তরবারি। শুধু আত্মরক্ষার জন্য ইহুদের ঈশ্বর এই হিংসার পক্ষপাতী। কোমল আর মৃদু এই হিংসা আজকার এই জলের মত সত্য। একজন ক্রীতদাসের হিংসা এরকমই নরম আর মায়াবী হতে বাধ্য।

যবহের হিংসা কোমল আর মায়াবী। সীনয় পাহাড়ে তাঁর আত্মা রয়েছে। তিনি জ্বলে ওঠেন কিন্তু কখনও দাবানল ঘটান না। চোখে এই দৃশ্য দেখা যায়। হঠাৎ আকাশের তলা আর পাহাড়ের চূড়া রক্তিম হয়ে ওঠে। আগুন লাগে আকাশের গায়ে। অথচ আকাশ থেকে গন্ধক বৃষ্টি হয় না, মানুষ পুড়ে মরে না। যবহের পবিত্র চোখ থেকে আগুনের সংকেত বার হয়। যবহ পবিত্র নাম। মনে মনে তাঁকে ডাকতে হয়। তিনি বাবিলের স্বর্গ (জিগুরাত)-এর পতন হলে পিতা আব্রাহামকে ডেকে নিয়েছিলেন। মহাত্মা মোসিকে তিনি মিশর থেকে উদ্ধার করেন। যবহ এক রহস্যময় ঈশ্বর। তাঁর সংকেত আছে। জ্বলে ওঠা আছে, হিংসা আছে কোমল আর মৃদু। যবহ, কে? যবহ কেমন?

ইহুদ বলেন, তাঁকে দেখা যায় না। তিনি অদৃশ্য। তিনি সংকেতকারী। তাঁর উদ্দেশে নিশানমাসে ঢেরা-চিহ্ন আঁকতে হয় ঘরের দেওয়ালে। এই চিহকরণের ক্রিয়াপথ হল নিস্তার বা স্বস্তিকা। যারা চিহ্ন আঁকে তারা যবহের লোক। বান্দা। যবহের দাস কখনও ফেরাউনের দাস হতে পারে না। যবহ বলেন–আমি কে। এই প্রশ্ন করো না। আমি যা আমি তাই। আমার চিহ্ন যারা আঁকে তাদের আমি রক্ষা করি। বন্যা এবং খরার হাত থেকে নিস্তারীদের বাঁচাই। শিলা ও গন্ধক বৃষ্টি তাদের মাথার উপর হতে দিই না । উত্তরের পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে ফেলে তাদের হত্যা করি না। মরুভূমির তপ্ত হাওয়া ছড়িয়ে বালিঝড় দিয়ে ফসল এবং প্রাণ নষ্ট করি না। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত করি না আমার উপাস্যদের। মরুদস্যুর আক্রমণ থেকে তাদের রক্ষা করি। আমি তোমাদের মুক্ত করি।

কিন্তু মহাপ্লাবনের কথা মনে আছে? আমি শুধুমাত্র নোহ এবং তার নিজের লোকেদের ত্রাণ করেছিলাম। কিস্তি (নৌকা) বানানোর বুদ্ধি আমি নোহকে দিয়েছিলাম। আমি বুদ্ধি এবং জ্ঞান দান করি। তোমার শত্রুদের জন্য বন্যা, খরা, ভূমিকম্প, মরুলু, গন্ধক বৃষ্টি ঘটাই। ফেরাউনের ধ্বংসের জন্য এইসব দুর্যোগ সৃষ্টি করি। ভয় পেও না–কারণ নোহ ভয় পায়নি। নিস্তার-পর্বে ঢেরা-চিহ্ন আঁকো–আমাকে স্মরণ করো। তোমাদের গুণ-চিহ্নিত গৃহ আমি রক্ষা করব। আমি গন্ধক বৃষ্টির হাত থেকে আব্রাহামকে বাঁচিয়েছিলাম। বন্যার হাত থেকে নোহকে রক্ষা করেছি। আমি মোসিকে চূণ অবস্থায় তার মায়ের পেটে লালন করেছি। এমন ব্যবস্থা করেছিলাম যে, ফেরাউন বুঝতে পারেনি মোসির মা গর্ভবতী। গর্ভাবস্থার সমস্ত লক্ষণ আমি গোপন রেখেছিলাম। সেই স্ত্রীলোকের তলপেট এমনভাবে নির্মিত ছিল যে, মোসি যে রয়েছে তা বোঝার উপায় ছিল না। পেট ফোলেনি, স্বাভাবিক ছিল। নিয়মের এই বৈকল্য আমার ইচ্ছাধীন। নইলে সেই সময় ফেরাউনের নির্দেশ ছিল মোসির উম্মতদের যত স্ত্রীলোক গর্ভবতী হয়েছে, তাদের হত্যা করা হোক। আমি গোপন করতে পারি এবং প্রকাশ করতেও পারি। আমি ওই শিশুকে আগুনের ভিতর বাঁচিয়ে রেখেছিলাম।

যখন ফেরাউনের সেপাই শিশুহত্যার জন্য প্রবেশ করল, আমি উনুনের ভিতর মোসিকে ঠেলে দিলাম। আগুন তখন নিবে গিয়েছিল। আমারই নির্দেশে আগুন নেবে এবং প্রজ্বলিত হয়। পাহাড়ে যে আগুন জ্বলে ওঠে–এ-সবই সেই সংকেত মাত্র। সেপাই সর্বত্র শিশু মোসিকে খুঁজেছে তন্নতন্ন করে, পায়নি। আমি তাকে উনুনের ভিতর রেখেছিলাম। উনুনে যে শিশু থাকতে পারে একথা শিশুর মা অবধি বিশ্বাস করেনি। কারণ আমিই তাকে গড়িয়ে দিই।

রিবিকা, তোমার মত সুন্দরী তন্বীকে আমিই কুপের ভিতর গড়িয়ে ফেলেছি, তোমাকে আমি কূপের অন্তরালে গোপন করেছি। জলকে হিংস্র করে তোলার বুদ্ধি আমিই তোমাকে দিয়েছি।

মোসি যখন তার দলবল নিয়ে লাল দরিয়া (লোহিত সাগর) পার হচ্ছেন তিনি তাঁর হাতের লাঠিকে ইশারা করেন, উত্তাল জলের উপর আঘাত করতেই জল দু’ভাগ হয়ে পথ সৃষ্টি হয়। সেই পথের উপর একখানা পাথর পড়ে ছিল, যবহ মোসিকে নির্দেশ করেন, আঘাত করো। মোসি তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে পাথরের উপর আঘাত করেন, পাথর দু’ভাগ হয়। যবহ মোসিকে এই লাঠি দান করেছেন। এই লাঠি দিয়ে তিনি মেষ চরান। মেষ যেমন লাঠির নির্দেশে একমুখে প্রবাহিত হয়, যবহ তাঁর উপাস্যদের সেইভাবে একত্রিত করেন, একাভিমুখী করেন।

ইহুদের হাতেও অনুরূপ একখানি লাঠি আছে। তিনি সেটি মাথার উপর ঘুরিয়ে বলেছিলেন–পাথর দু’ভাগ হলে দেখা গেল একটি ঘাস ফড়িং একটি ঘাস মুখে করে সমুদ্রের তলায় পাথরের ভিতর বেঁচে আছে। যবহ তাঁকে ঘাস যোগাচ্ছেন। এইভাবে তিনি গোপন করতে পারেন। রক্ষা করতে পারেন।

অথচ এলিফেনটাইনের ঢেরা-চিহ্নিত সমস্ত গৃহ এবং দুর্গটি মিশরীয়রা বেছে বেছে জ্বালিয়ে দিয়েছে। যবহ প্রেরিত মৃত্যুদূত ইহুদীদের রক্ষা করেনি। স্বপ্নদর্শী ইহুদ বলেছিলেন–সাত বছর দুর্ভিক্ষ হয়েছে, সাত বছর নীল নদীতে জলোচ্ছ্বাস। হল না–এ-সবই যবহের নির্দেশ–মিশরীয়রা দুর্বল হয়েছে এবার আমরা। কনানের দিকে চলে যেতে পারব। তাই সবাই চিহ্ন এঁকেছিল। নিস্তার পর্ব পালন করছিল। এই সময় অগ্নিসংযোগ করল মিশরীয়রা বাইরের শত্রু আক্রমণ করল ফের মিশরকে। লুঠ, হত্যা, ধর্ষণ চলতে লাগল। সবই কি যবহের নির্দেশ? আগুনের হাত থেকে মোসি বেঁচেছিলেন কিন্তু রিবিকাদের। কত প্রাণ চলে গেল! যবহ তাঁর বান্দাদের এমন শাস্তি দিলেন কেন?

রিবিকা কূপের তলায় আর্তনাদ করে উঠল–ঘাসফড়িঙের মুখে ঘাস জোগাও জানি, কিন্তু আমার বস্ত্র কেড়ে নাও। দেবী ইস্তার তো নাঙা থাকে। মহাত্মা ইহুদ!

যদি আমরা ঢেরা না আঁকতাম, আমাদের অনেকগুলি গৃহ বেঁচে যেত। চলার পথে মোসিকে যবহ যে লীলা প্রত্যক্ষ করালেন ওই পাথর দু’ভাগ করে, তার মহিমা যাই হোক, দেবী যে নগ্ন থাকে, এ তো মিথ্যা নয়। নগ্নতাই এখন বাস্তব, ধর্ষণের ফলে ছিন্ন রক্তাক্ত যৌনাঙ্গ বাস্তব, দু’পা বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়া বাস্তব, পথের উপর বিচ্ছিন্ন মস্তক, ওপড়ানো চোখ বাস্তব, উটের পিঠে চড়িয়ে বালিকাকে যৌনপ্রহারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলানো বাস্তব–মনে পড়ে। সবই মনে পড়ে। এবং উপরে প্রহরারত মৃত্যু অবাস্তব নয়।

আক্কাদ বলল–রিবিকা! আজ দোলের রাত! আমি যৌন-বিহারের জন্য পাঁচটি উট চাষার ছেলেদের ভাড়া দিয়েছি। উটের দোলনে রতিমোচন আনন্দদায়ক। একজন বুড়োলোকও এই রাতে বালিকাদের দিয়ে গা লেহন করায়। ওই দ্যাখো…

একটি চালার নিচে দৃশ্যটি দেখা গেল। এক বৃদ্ধকে দুটি নগ্ন নারী চাঁদের ছায়ায় লেহন করে চলেছে। সমস্ত বুক এবং যাবৎ অঙ্গ লালায় মথিত হচ্ছে। বুকের পাঁজর দ্রুত প্রকম্পিত হচ্ছে কামনাতাড়িত বাতাসে। শিঙা বেজে উঠল মন্দির চাতালে। বৃদ্ধের মুখ দিয়ে রক্ত উথলে এসে গলা ভিজে যাচ্ছে। বুড়োটি রোগগ্রস্ত। এই রোগ ছোঁয়াচে–অথচ দুটি তরুণী বধূ তাকে লেহন করছে। মৃত্যু এবং যৌনতা এত ঘনিষ্ঠ যে সহ্য হয় না। কাম এবং পুনর্জীবন তো ইস্তারের উপাসনা মাত্র। ফসলের জন্ম আর মৃত্যু আর জন্মই জীবন।

আঙুল তুলে দেখিয়ে আক্কাদ রিবিকাকে বলল–এসো! রিবিকা বলল–তুমি আমার পিতা। ক্ষমা করো!

আক্কাদ বলল–তুমি আমার কেনা। ক্রীত যা তাই হল দাসী। তোমাতে আমার অধিকার। পালক পিতা পালিতাকে এমনি কেনে না। কুঁজের এদিকে মাথা রাখো।

কবরের দিকে মাথা রেখে রিবিক মৃত্যু আর যৌনতার মাঝখানে ছটফট করে ক্রমাগত একটি অন্ধকার স্রোতে তলিয়ে যেতে লাগল। যেন ইস্তার চলেছেন পাতালে।

.

০২.

মরু-হায়েনাটার গায়ে ভোরবেলার সূর্যের আলো এসে যখন লাগল, সে তখন অরণ্যের দিকে চলে গেল। কূপ থেকে উঠে এল রিবিকা। সূর্যদেব আটনের দিকে জলভরা দুই চোখ মেলে চাইলে সে। আমারনার বণিক নমরুর স্তোত্রোচ্চারণ মনে পড়ছিল তার।

‘দুনিয়ার সকল কিছুর একমাত্র স্রষ্টা তুমি,
যা কিছুর অস্তিত্ব চোখে পড়ে এবং পড়ে না,
সমস্তই একা তুমি সৃষ্টি করেছ;
তোমার চোখের ভিতর থেকে যাবৎ মানুষ
বেরিয়ে এসেছে। তোমার মুখ থেকে
দেবতাগণ অস্তিত্ব লাভ করেছেন;
দেবতাদের মধ্যে তুমিই রাজা ॥”

[মিশরীয় প্রাচীন কবিতা]

মহাপৃথিবীর আকাশে তুমি কোথাও সামাশ, কোথাও-বা তুমি আটন অথবা আমন। তুমিই আমেন। ঈশ্বর। অথচ তোমার এই আকাশ অবধিহারা–সবখানে তুমি রয়েছ। রিবিকা বিড়বিড় করে বলল–নারীর কতটুকু লজ্জা পাওয়া উচিত হে দেবতা! মরুপথ দিয়ে রথ এবং অশ্ব পূর্বে পশ্চিমে ছোটাছুটি করছে–কখনও-বা নেমে আসছে উত্তরের পর্বতগাত্র বেয়ে। কারা এরা? কাউকে আমি চিনি না। কে শত্র কে মিত্র আমি জানি না। শুধু জানি আমার লজ্জায় পৃথিবী লজ্জা পায় না–পৃথিবী মানে ওই আকাশ, ওই পাহাড়, সমুদ্র, লাল দরিয়া, নীল নদী, আকাশচুম্বী পিরামিড, অথবা আলোকোজ্জ্বল নিনিভে নগরী, বাবিলের স্বর্গের সিঁড়ি, কেউ লজ্জিত হয় না–ম্লান হয় না দেবতা সামাশ। হা আমীন, হা আমীন, যুদ্ধশেষে যে জেতে, যুদ্ধের পাওনা এই নারী তার হয়। আমি কারো নই, আমার মূল্য মাত্র তিনটি পশুলোমের সমান।

আমারনার সূর্যমন্দিরে আমি ছিলাম সকাউৎসর্গীকৃত নারী। হা দেবতা, তুমিই আমার বর। তামুজদেব নয়, তুমি। দেবদাসী রিবিকাকে কে তোমার দাসী করেছিল মনে আছে? একজন সম্পত্তিশালী পুরুত! নমরু নামেমাত্র বণিক–আসলে সে ভূপতি। ঘরে অনেকগুলি বউ। আমি ছিলাম তোমার ভোগ্যা–হে দেবতা! অথচ তোমার নামমাত্র। মন্দিরে রেখে নমরুই আমাকে ভোগ করত। মানুষ দেবতার নামে যা দেয়, তা আসলে নিজেরই জন্য দখলে রাখে। দেবতার ছুতা না দিলে ক্রীতদাসী হালাল হয় না–অধিকারেও থাকে না। নারী ‘তাহলীল’ হয় আমনদেবের মন্দিরে, শুদ্ধ হয়। আক্কাদের এটো মাল দেবতাকে দিয়ে শুদ্ধ করিয়ে নিয়েছিল নমরু।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম আলো-ঝরানো সূর্যের দিকে ফের চোখ তুলল রিবিকা। মরুপথ অশ্বের ক্ষুরের উৎক্ষিপ্ত ধূলায় একটা সমাচ্ছন্ন মেঘের মত পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। তারই আড়াল ধরে অরণ্যের দিকে এগিয়ে চলেছে রিবিকা। তার আর চলবার শক্তি নাই। অথচ তার থেমে পড়ার মত কোন ছায়া সে দেখতে পাচ্ছে না। এইভাবে একলা পথ হেঁটেছিলেন মহাপিতা আব্রাহাম।

চন্দ্রকলাকৃতি ভূখণ্ডের উত্তর-পূর্ব দিকের অসুর জাতি অতীতে পুনঃ পুনঃ যে বীভৎস আক্রমণ করে মিশর থেকে ইহুদের পূর্বযুগের মোসির উম্মতদের টেনে এনে তাদের নগরগুলিতে বন্দী করেছিল–সে এক ভয়াবহ আতঙ্কের ইতিহাস; আজও সেই ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে। অসুররা কতবার যে মিশর আক্রমণ করেছে তার সঠিক হিসেব করা হয়নি। এরা পার্বত্য হিত্তীয়দের মতই। দুর্ধর্ষ। মিশরও কম যায়নি। প্রতি-আক্রমণ চালিয়েছে। কিন্তু মোসির মত ইহুদও শান্তি চান। তাঁর অভিযাত্রা অবশিষ্টদের নিয়ে, যারা অসুরদের হাতে এখনও বন্দী এবং যারা আজও মিশরের ক্রীতদাস মাত্র। মোসির অসম্পূর্ণ কাজ তিনি সম্পন্ন করতে চান। তিনিও আব্রাহামের মত দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত থেকে অর্ধগোলাকৃতি পথে দক্ষিণ-পশ্চিম কিনারা পর্যন্ত পরিভ্রমণ করেন।

এই পথে কাঠের তৈরি তেতলা সাঁজোয়া গাড়ি গেছে। বন্দীদের বহন করে নিয়ে গেছে অসুররা। নিনিভে নগরীর দিকে চলে গেছে সৈন্যবাহিনী, রথ আর পদাতিক। অশ্ববাহিনীর পদচিহ্ন পড়েছে পথে। এই দৃশ্য কত পুরনো, যুগযুগান্তর একই দৃশ্যের অবতারণা করছে নগরনির্মাতা মানুষ–কেন করছে। কিছুই বোঝা যায় না।

রিবিকা পথের দিকে চেয়ে আঁতকে উঠল। তার হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেল।

সারি সারি খুঁটা পোঁতা–মানুষের মুণ্ডুহীন ধড় এবং কোথাও শুধুমাত্র গুচ্ছবাঁধা ছিন্ন মুণ্ড ঝুলছে। রক্ত টুপিয়ে পড়ছে বালির উপর লাশ পচে গলে পড়ছে, মরুশকুন আর শৃগাল খুঁটিগুলিকে ঘিরে গোল বৃত্ত রচনা করেছে, রিবিকা শৃগালগুলিকে হায়েনা ভেবে শিউরে ওঠে। পশুদের জিহ্বা লাল আর রক্তমাখা। শকুনের চঞ্চতে মানুষের হাড় আর পচা মাংস ধরা। সবই যেন মরুপথের চিরন্তন। দৃশ্য। এ-দৃশ্য কিন্তু রিবিকা এই প্রথম দেখল। অসুররা চিরদিন এভাবেই পথ অলংকৃত করে মৃতদেহ সাজিয়ে। অধিকাংশই পুরুষদেহ। আক্রান্ত জাতির পুরুষ। ধ্বংস করা একটা যুদ্ধনীতি। পুরুষকে শেকল পরিয়ে সাঁজোয়ায় তোলা বীরত্বের নমুনা। বন্দী করে কৃষিজমিতে চাষে জোড়া, পাথর কাটার কাজে নিয়োগ করা সবই যুদ্ধের উদ্দেশ্য। সুন্দরী মেয়েদের পুরুষহীন করা এবং ধর্ষণ করা এক ধরনের বিক্রম। মেয়েরাও শ্রমিক হয় দ্রাক্ষাক্ষেত্রগুলিতে।

কচি খেজুর রসের মত, নবীন সান্ধ্য রসের মত কৃষককন্যার গায়ের গন্ধ অসুরদের মুগ্ধ করে। যৌনতার এই মৌতাত তাদের সংগীতকে মাদকতায় পূর্ণ করেছে। মিশরীয়দের মত এরা ফুলের ঘ্রাণের উপমা প্রয়োগ করে না। ফোরাতের তীরেও একই ধরনের গান গাইত কিছু শ্রেণীর লোক। একটি খুঁটায় ঝোলানো নারীদেহ দেখে রিবিকার সেই গানের সুর মনে পড়ে। ভয়ে আর ত্রাসে সেই সুর পাখির ডানার মত মনের ভিতর ঝাঁপটায়-হৃদয়কে আঘাত করে।

রিবিকার দিকে পশুরা হিংস্র হলুদ চোখ মেলে তাকায়। রিবিকা ভয়ে অরণ্যের দিকে ছুটতে শুরু করে। ইহুদ কোথায় সে জানে না। খুটা পোঁতা পথ কতদূর গেছে সে জানে না। ইহুদকে সাঁজোয়ায় করে অসুররা তুলে নিয়ে গেছে কিনা তাও সে জানে না। ইহুদ চলেছিলেন পায়ে হেঁটে। তাঁর দল সামনে এগিয়ে গিয়েছিল। রিবিকা হাঁটতে পারছিল না বলে দয়ালু ইহুদ তাকে উটের পিঠে চড়িয়ে দিয়েছিলেন। তারপর উটের পিঠে ছিল আরো কিছু রমণী–তারাও আর নেই। উটের সঙ্গে পায়ে হাঁটা লোকেরাও নিশ্চিহ্ন, নিশ্চয়ই। তারা খুঁটায় ঝুলছে অথবা বালির উপরে শুয়ে আছে, বেঁচে নেই। হতে পারে অসুররা নয়, হিত্তীয়রা মেরে ফেলেছে।

এমন অরণ্যও এই প্রথম দেখছে রিবিকা। সমুদ্রের ভেসে আসা স্বল্প মেঘ এই অরণ্য রচনা করেছে। ক্ষুদ্র অরণ্য। দূর থেকে সমুদ্রের তান ভেসে আসছে। বৃক্ষপত্রের মর্মরধ্বনিও বেজে চলেছে। দেবদারুগাছ, ঝাউ আর শালসেগুনের গাছ, তাল খেজুর বীথি আছে, পাশেই রয়েছে দ্রাক্ষাকুঞ্জ। ফলবতী দ্রাক্ষা মৌমাছির পুঞ্জে গুঞ্জিত। একটি কৃষ্ণবর্ণ গাছের ছায়ায় আশ্রয় পায় রিবিকা। চারিদিক সৌরভে মুগ্ধ, আবিষ্ট। রক্তাক্ত নৃশংস মৃত মুণ্ডমালিকা-সজ্জিত পথ ছেড়ে এসেছে সে। রথ, অশ্ব, বর্শা, সাঁজোয়া, মরুকূপ, হায়েনা, শৃগাল শকুন–সেই ত্রাস এখানে নেই। দূরে রয়েছে মৌন সুদৃশ্য পাহাড়। অদ্ভুত স্তব্ধতা জমাট বেঁধে সৌরভ আর গুঞ্জনে ফুরিত করছে এক অপার সংগীত।

হঠাৎ রিবিকার চোখে পড়ল একটি বাচ্চা মেষ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কালো কুঞ্চিত কেশ সারা গায়ে, কিন্তু ছোট ঘোট। মেষটির বয়স খুবই কম। মরুযাত্রীরা ফেলে চলে গেছে। মরুদস্যুরা ওকে নেয়নি। রিবিকার অত্যন্ত মায়া হল। সে ওকে ধরবার জন্য হাত বাড়াল–আ মসীহ! বলে দু’হাত সামনে প্রসারিত করল রিবিকা।

হাতের নাগাল থেকে খানিক দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রাণীটি। মনে হল একে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে সে। এই প্রাণীই তার নগ্নতাকে আড়াল করতে পারে।

এক দেবদাসীকে ভালবেসেছিল এক মিশরীয় যুবক। নমরুর জোয়ান পুত্র আবীরুদ। আবীরুদ রোজ মন্দিরের চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। সূর্যমন্দিরের সামনের একটি গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে থাকত সারা দুপুর। রাত্রে আসত চুপিচুপি। বলত–আমি তোমাকে দু হাত রাঙানোর প্রচুর মেহেদি পাতা দিতে পারি, ঠোঁট রাঙানোর জন্য দিতে পারি সুগন্ধি পাতা আর পা রাঙাবার প্রসাধন–সব দিতে পারি এবং দামাস্কাসের পাথরের মালা এবং আমাদের প্রসিদ্ধ আতর। আমার জন্য তুমি কি দুয়ার খুলবে না? আমি তোমার জন্য অশ্ব আর। সুর্মা প্রস্তুত রেখেছি। নীল নদীর উপর চাঁদ ঝুলে আছে–এসো আমরা সম্বন্ধ পাতাই। তুমি আমার বোন। এসো বিয়ে করি।

মুখে ছেলেটির এ ছাড়া কোন কথাই ছিল না। যেন মরু-দোয়েল। ক্রমাগত শিস দিয়েই চলেছে। মরু-চাতকের মতই ছিল আবীরুদের পিপাসা। পাখির সেই ডাকে মন খারাপ করত। পিরামিডের নিঃসঙ্গ চূড়াকে আর্তস্বরে প্রদক্ষিণ করত পাখিটি।

এই পাখিটিই যেন আবীরুদ। অথচ আবীরুদের সঙ্গে আপন বোন দীনার বিবাহ স্থির ছিল। ভূসম্পত্তি রক্ষা করতে হলে আপন বোনকে বিয়ে করাই বুদ্ধির কাজ। নমরু যখন জানতে পারল তার ছেলে তারই রক্ষিতা দেবদাসী রিবিকার। প্রেমে আসক্ত হতে চলেছে, তার হৃদয়ে পিরামিড ভেঙে পড়ল।

মিশরীয়রা উট পছন্দ করে না। কিন্তু অশ্বে তাদের অশেষ ভক্তি। কারণ যুদ্ধপ্রিয় হিত্তীয়রা অশ্বশিক্ষা জানে–অশ্ব সবচেয়ে দ্রুতগামী এবং শক্তিশালী পশু। উট শ্লথগতি এবং বিকটদর্শন। একজন মিশরীয় যুবক যখন তার। প্রেয়সীকে অশ্বের কথা বলে, তখন সে তার আভিজাত্য আর আধুনিক মনের পরিচয় দেয়। রিবিকা ছিল উট-পূজকের রক্ষিতা এবং দেবী ইস্তারের মত দুর্ভাগা। ফলে তার সূর্যমন্দিরে আশ্রয় হয়েছিল। তার প্রতি একজন ভূপতি। সূর্যপুরোহিত আসক্ত হতে পারে, কিন্তু সে তার ছেলের সঙ্গে সেই ‘সদকা’ নারীর বিবাহ কস্মিনকালেও দিতে পারে না।

তথাপি একদিন রাত্রে আমারনার মন্দির থেকে রিবিকা আবীরুদের সঙ্গে ঐরাবত মন্দির (এলিফেনটাইন) দুর্গের এলাকায় অশ্বধাবিত হল। রাত্রির উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত নদী নীল। তারই কিনারা ধরে ছুটে চলল অশ্ব। বসন্তের দীপ্র হাওয়ায় রিবিকার মাথার চুল উল্লসিত আবেগে কম্পিত হল ছন্দে ছন্দে। সে আবীরুদকে পিছন থেকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে অশ্বের তীব্র বেগ সামাল দিচ্ছিল–এই তার অনিঃশেষ স্মৃতি, উষ্ণ আর উতল।

যখন মিশর আক্রান্ত হল, ইহুদের উম্মতরা নিস্তার-পর্ব পালন করল, নিশান-মাস এল–আগুন লাগল সিবিকাদের ঘরে ঘরে–আবীরুদ নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। একটি বর্শা এসে তাকে বিদ্ধ করে মাটিতে ফেলে দিল। সেই বর্শা ছুঁড়েছিল মিশরীয় বণিক পুরোহিত নমরু। অসুররা আবীরুদকে মারেনি। পিতার হাতে পুত্রের জীবননাশা হয়েছিল। নমরু থুৎকার দিয়ে বলেছিল–এ মাগী বেশ্যা। দেবতা আমন তোকে ঘৃণা করে। ইহুদ ছাড়া তোকে নেবার কেউ নেই।

আবীরুদের সঙ্গে খুব স্বল্প সময় রিবিকা একটি তাঁবুতে বাস করেছিল। এই জীবন যাপনের কোন মানে হয় না। আবীরুদ তাকে কোনদিনই ঘরে তুলতে পারত না। নমরু এই সম্পর্ক স্বীকার করবে কেন? মরু-যাযাবরের মত আবীরুদ তাঁবুতে দিন কাটাত-সঙ্গে সুন্দরী রিবিকা। এলিফেনটাইনের (ঐরাবত মন্দিরের) অধিবাসীরা তাদের সন্দেহের চোখে দেখত। এই জীবন কোনদিই মিশরের মাটিতে প্রতিষ্ঠা পাবে এমন সম্ভাবনা ছিল না। তবু সেই তাঁবুর জীবনে আকাশে মরু-চাতকের করুণ স্বর কখনও থামেনি।

লোকে আবীরুদকে ঠাট্টা করে বলত–অমন সুন্দর প্রাসাদ ছেড়ে ছেলেটা ওই পূর্বদেশী একটা ইস্তারীকে নিয়ে পড়ে আছে! দেবদাসীকে ঘরে তোলার সাধ্য তো নেই। আমনের বউকে গৃহ দিতে নেই, সে মন্দিরের সরকারী মাল । ছোঁড়াটা দু’দিন মধু লুটছে। আসলে ঘেন্নাপিত্ত থাকলে আমারনা থেকে পালিয়ে আসে-সঙ্গে একটা উটমুখী মেয়ে। হায়, একেই বলে ভ্যাগাবন্ডী! জীবনে হুতোশ লাগলে কে ঠেকায়!

ফেরাউনদের শবাধারলিপিতে খোদিত ছিল :

‘আমি কাউকে কখনও কাঁদাইনি,
কাউকে কষ্ট দিইনি। কখনও কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিইনি।’

মিশর রিবিকাকে কেবলই কাঁদিয়েছে। আবীরুদকে মেরেছে। চন্দ্রালোকিত রাত্রিতে অশ্বারোহণের উদ্দাম চঞ্চল বেগবতী স্মৃতিই রিবিকার দহ্মানো জীবনকে আরো দন্ধেছে। জীবনের কোথাও সে আশ্বাস পায়নি জন্মাবধি। তার দেহে। খেজুর রসের নবীন স্বাদু ঘ্রাণ মিশরীয় আতরে মজ্জিত হয়েছে মাত্র–সেই সজ্জা, সেই রাতের গভীর উত্তেজক যাত্রা তাকে কাঁদায়।

ইহুদ তার পিঠে হাত রেখে মন্দ্রস্বরে বলেছিলেন–একটি মেষশাবক তোমায় পথ দেখাবে রিবিকা। সেই তোমার নিয়তি। কারণ মাসি সেই বাচ্চা মেযেদের ভালবাসতেন।

রিবিকা আবার ভেড়ার বাচ্চাটির দিকে হাত বাড়াল। তার হাসি পাচ্ছিল স্বপ্নদর্শী ইহুদ অদ্ভুত কথা বলেন। তাঁর পয়গম্বরী রহস্যময়। তিনি স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা একটি পবিত্র দেশের কথা বলেন। মর্তের এক অমরাবতী সেই কনান। মধু আর দুধ বইছে তার মাটিতে, উপত্যকায় স্বর্ণশস্যে ম ম করছে হাওয়া।

এই সংগীতময় অরণ্যের মর্মর ব্যঞ্জিত সুঘ্রাত হাওয়া এসে রিবিকার নগ্ন ত্বকে স্পর্শ দিচ্ছিল। সমস্ত রাত্রির জাগরণের ক্লান্তি দু চোখে ঘুমের আবেশ এনে দিয়েছিল, সে আর চোখ তুলে চাইতে পারছিল না। তথাপি সে জোর করে দু চোখ প্রসারিত করল। ভেড়ার বাচ্চাটিকে ধরবার জন্য ছুটে গেল। বাচ্চাটি অরণ্যের ভিতর ছুটে যেতে লাগল।

রিবিকা অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করেছিল। সে আর ভেড়াটিকে দেখতে পেল না। স্বপ্নদশী ইহুদের কথা কি সত্য? তাই যদি হবে তাহলে এই অরণ্যে পথ কোথায়? সে তো পথ হারিয়ে ফেলেছে। এ অরণ্য আর যাই। হোক নিরাপদ নয়। মনে হচ্ছিল হিংস্র জন্তু রয়েছে, ডাকাতদল থাকতে পারে। যে-নারীর জীবনের দাম মাত্র তিনটি ভেড়ার লোমের ওজনের সমান–তাকে একটি মেষশাবক পথ দেখাবে কী করে? ইহুদ তাঁর ধর্মের প্রতীক মেষের কথা বলেছেন। মেষশিশু মানে সেই মসীহ, সীনয় পাহাড়ে যাঁর ঈশ্বরের সঙ্গে কথা হয়েছিল। মুসা, মোসি, মসীহ।

হঠাৎ শিঙার আওয়াজ কানে এল রিবিকার। সে উৎকর্ণ হয়ে উঠল । আবোরা প্রবেশ করল ভিতরে। চোখে পড়ল তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি ভূমিক্ষেত্রে লোজন রয়েছে, তারা সৈনিকের পোশাক পরা এবং বিচিত্র রঙের বলিষ্ঠ অশ্ব চিৎকার করছে। রিবিকা ভয় পেয়ে পিছনে ফিরল এবং দ্রুত দৌড়তে লাগল। মেষশাবককে নিকটে আকর্ষণ করে। বস্ত্রখণ্ড তুলে নেয়। তার বুকে প্রজাপতির ডানা মৃদু স্পন্দনে যেরকম তার শ্বাসপ্রশ্বাস যেন সেই ছন্দে স্পন্দিত। কিন্তু তবু সে এই জীবনকে বিশ্বাস করতে পারে না।

প্রজাপতি দুটি তার বুক থেকে উড়ে পালাবার ক্ষমতা রাখে না। ক্রমে মৃত্যুই স্বাভাবিক। মধুর লোভে যে এই দুটি প্রাণ এসেছিল তা সে বুঝতে পারে উপরে চোখ তুলে। বিরাট কালো মধুচক্র। যেন মেঘ। ক্ষুদ্র পিরামিড উল্টো করে। ঝোলানো, যেন ঝুলন্ত শিলা। টুপিয়ে পড়া মধু মৃত্যুসোমরস। কী বোকা রে তোরা! নারীর বুকের এই পুষ্পফুল্লতা মায়াবী, এ যে পুষ্পভ্রম মাত্র! যদি আক্কাদ। কখনও নারীর বুকে চন্দ্রোদয় দেখত অথবা পুষ্পকলিকার বিকাশ লক্ষ্য করবার প্রতিভা পেত! একজন মরুবণিক তা পারে না। তার তো মদ আর শুঁটকির কারবার। মরুর রঙ ধূসর। দামাস্কাস থেকে ফোরাতের তীরে বাসা বেঁধেছিল ঐশ্বর্যের লোভে কারবার ফলাবার জন্য। বোকা চাষীদের ঠকিয়ে মুনাফা করার জন্য। তার চোখে মেয়েমানুষ খরিদা সম্পত্তি, যুদ্ধে পরিত্যক্ত মাল। সে কখনও মিশরের শৃঙ্গার রসের কবিতা পড়েনি।

‘নারী তুমি মেষপশমের মত হালকা
তোমার দাম নেই, ওজন নেই–
তবু তোমাকে ফুলের বিনিময়ে খরিদ করা যায় না।
মরুশীতে উষ্ণপশম দিতে পারিনি প্রিয়া–
আতর আর সুর্মা তাই বৃথা গেছে। আমার তো
ফুলের বাজার–খদ্দের আসে না ।।’

ভূপতির ছেলে আবীরুদের মেজাজ আতর আর সুর্মার মেজাজ। কিন্তু প্রিয়ার জন্য শীতের পশম কেনার সামর্থ্যও তার ছিল না। তাঁবুর জীবনে পশুর লোম যোগাড় করা সমস্যা, কিন্তু সেই দুঃখকে সে সস্তা আতরে আর সুর্মায় এবং ফুলে ভরিয়ে তুলেছিল। অন্তত তার মুখের কবিতায় তার দারিদ্র্য আর বাদশাহীপনা। একাকার হয়ে যেত। বস্ত্রখণ্ড গায়ে জড়াতে জড়াতে সেই কবিতার সুর কানে ভেসে আসছিল স্মৃতির ধুনে। বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল রিবিকা।

হঠাৎ তার চোখ চলে যায় সামনের দেবদারু গাছটির দিকে। আড়া থেকে একখানি পা বেরিয়ে এসেছে। সৈনিকের জুতা পরিহিত এই পা সে ‘মশরের মাটিতে দেখেছে। শরীরের তুলনায় এই পা সরু হয়, পাতা একটু বেশি লম্বা এবং ভারী, কিন্তু পাতার তুলনায় পায়ের উপর অংশ মিহি, অসুন্দর পা। এই পা মরুভূমিতে দ্রুত ছুটতে পারে। কিন্তু চোখ দুটি হয় ভেতরে ঈষৎ ঢোকানো, দয়ার্দ্র। সেই চোখ সুদূরাভিসারী। মুখ খুব সুন্দর এবং মায়াময়। ঠিক ঠাকুমার বিবরণ অনুযায়ী সারগনের পা। রাজচক্রবর্তী সারগন। বাদশা সারগন। মনে পড়ল, সারগন মরে, তবু সারগন মরে না।

লোকটি সামনে এসে দাঁড়াল। হাতে ওর ক্ষুদ্র বর্শা। পিছনে একটা দীর্ঘদেহী। তুষারধবল অশ্ব। মনে হচ্ছে সাদা আগুন দাউদাউ করছে। লাগাম ধরা রয়েছে বাঁ হাতের আঙুলে। পিঠের দু’পাশে ঝুলন্ত রেকাব, পিঠে গদি আঁটা। অশ্বের মুখ ঈষৎ ফেনশুভ্র। লোকটি শৌখিন।

এ অশ্ব হিত্তীয় অশ্ব। লোকটির পা দুখানি দেখে বোঝা যায় মানুষটি অসুর নয়। কিন্তু মুহূর্তে আসুরিক ঘটনা ঘটে যায়। ক্ষুদ্র বর্শাটা নিক্ষিপ্ত হয় নিরীহ ভেড়াটির গায়ে এবং মায়াভরা শিশুমেষ মাটিতে গেঁথে গিয়ে পিছনের দু পা শূন্যে উঠে যায়, ছটফট করে, এত চকিতে ঘটে যে,ভেড়ার বাচ্চাটি মরবার আগে কাঁদবার সময় পায় না। তার হৃদক্রিয়া রুদ্ধ হয় নিমেষে। সে তাকে লজ্জার হাত থেকে রক্ষা করে গেল, কিন্তু প্রাণ দিতে বাধ্য হল।

লোকটি বলল–আমি বিনিময়ে বিশ্বাসী। কাপড় দিয়েছি, ভেড়ার মাংস আমার। আশা করি দুঃখ পাওনি। অবশ্য এতটুকু মাংস কাকে দেব? আমার শিবিরে এখন আটাশজন সৈন্য কসরত করছে।

একটু থেমে লোকটি বলল–তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে।

বলেই লোকটি বর্শায় গাঁথা মেষটিকে কাঁধে তুলল। তারপর রিবিকার খুব কাছে এসে দাঁড়াল-তোমাকে তাই বলে হত্যা করব ভেবো না। যারা তোমাকে এবং তোমার ভেড়াটিকে ছেড়ে গেছে, হয়. মরেছে, নতুবা পালিয়েছে, তাদের সরদার হয় সৎ পুরুত,নয় কপট মসীহ (নবী)। কারণ সৎ পুরুত ভীতু হয়, কপট মসীহ হয় কাপুরুষ। মসীহর হাতে লাঠি থাকে বটে, কিন্তু পথের বাঘ বা হায়েনা থোড়াও ডরায় না। যুদ্ধই জীবন-যুদ্ধ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। শিরোপা, পদাধিকার, সৌধ, একটি ছোট পাহাড়। সোনাদানা তো বটেই, খাদ্য পানীয় সুরা। এমনকী তোমার মত সুন্দরীদের। শৌর্য থাকলে পথের উপরই সব পড়ে থাকে। দেবতাদের ধন্যবাদ, এই জীবন যেন কখনও শেষ না হয়। ভাগ্যিস অসুররা মিশর আক্রমণ করেছিল! এসো!

বলে লোকটি ক্লিবিকার বুকের দিকে হাত বাড়াল। ঈষৎ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল–তুমি আমার ভাষা বুঝতে পারছ না?

রিবিকা বলল–সব কথা পারিনি। তবে আমি অনেক ভাষা জানি। ভাষা বুঝে আমার লাভ নেই। আমাকে ছেড়ে দাও। আমার বাঁচার ইচ্ছে নেই। আমাকে ছোঁবে না। হাত সরাও।

সাদইদ বলল–খাওয়া-দাওয়ার পর তোমার ফের বাঁচতে ইচ্ছে করবে। একদণ্ড দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখেই তার বিশ্বাস স্থির হল যে ওরা দস্যুও হতে পারে, ফের দুর্ধর্ষ সৈনিকও বটে। এটা তাদের গোপন শিবির। অশ্ব এবং অস্ত্রচালনা, শিক্ষা করছে। এদের হাতে পড়লে তার আর নিস্তার নেই।

রিবিকা দিগভ্রান্তের মত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। তারপর এমন এক স্থানে এসে পড়ল যে,মনে হল এদিকে ওরা আর আসবে না। ওদের অশ্বধ্বনি আর শোনা যাচ্ছে না। ওদের দৃপ্ত গলার স্বরও অরণ্যের আড়ালে ঢাকা পড়েছে।

এবার রিবিকা আছাড় খেয়ে দেবদারুর তলায় পড়ে গেল দু চোখ শীতল ক্লাসের ছোঁয়ায় ক্লান্তিতে ক্ষুধায় বুজে এল। গাছে সুরেলা পাখি ডাকছিল। বাতাসে বিচিত্র বর্ণের প্রজাপতি উড়ছিল। কিছুই আর চেয়ে দেখতে পারছিল না রিবিকা। গাছের ডালে প্রকাণ্ড মধুচক্র ছিল–চক্রটি এত বড় যে, রিবিকা যদি দেখত হলে পুলকিত এবং ভীতও বোধকরি হতৃত্ব। তার নগ্ন বুকের উপত্যকায় মধুচক্র থেকে মধু টুপিয়ে পড়ল। স্তন ফোঁটায় ফোঁটায় ভিজে যেতে লাগল। সেই মধুর পতনে তার শরীর মৃদু মৃদু কেঁপে উঠছিল।

ঠিক এই সময় দুটি উজ্জ্বল রঙের, সেই রঙও অসাধারণ, প্রজাপতির জগতে এমন রঙদার ছবি খুব বিরল, সেরকম দুটি প্রজাপতি এল। এতবড় প্রজাপতিও সাধারণ নয়। মসীহ যদি এ প্রজাপতি পাঠিয়ে থাকেন, তবে এই নির্জন অরণ্যই সেকথা টের পেল। বুকের উপর, যেন দুটি রাঙা কুসুমের উপর বসছে এভাবে, সন্তর্পণে মধুলোভী প্রজাপতি, দুই সম তরঙ্গের প্রাণ চুপচাপ বসে পড়ল। প্রাচীন এ অরণ্য, বৃক্ষও নবীন নয়, বাতাস যে কবেকার সমুদ্রবিধৌত হয়ে আসছে কে জানে–এ নারী দেবী ইস্তারের মত দুঃখী আর বিষাদমথিত–এর মাথায় নীল ফিতে বাঁধা, যা নীল নদীর স্মৃতিবাসিত চিহ্নস্বরূপ, চোখ দুটি গভীর কালো পিরামিডের ছায়া ফেলেছে, যে সমস্ত রাত্রি মৃত্যুর সঙ্গে জলের হিংসা জাগিয়ে যুঝেছে, যে একদা উটের পিঠে কবরে মাথা রেখে পুরুষের দ্বারা যৌন-প্রহৃত হয়েছিল, যার আসক্তি নীল নদীর কিনারা ধরে ছুটে গিয়েছিল একদা নির্জন জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্রিতে, যার বিবাহ হয়েছিল সূর্যদেব আমনের সঙ্গে, যার ঘর জ্বলে গিয়েছে ভস্মরূপে, মিশরীয়দের পুঞ্জীভূত ঘৃণা, পূর্বদেশের অবহেলা, কনানের ভাগ্যহত স্মৃতিই যার সম্বল, তাকে ফুলের মত সুন্দর দেখে দুটি কোমল বহুলরঙরঞ্জিত প্রজাপতি অধিকার করল–চন্দ্রকলাকৃতি ভূখণ্ডের ইতিহাসে এই তুচ্ছ দৃশ্যটি অবলোকন করেছিল যে, তার নাম সাদইদ। সে দেখেছিল নারীর নগ্নতাকে অলংকৃত করেছে দুটি ডানা-ছড়ানো রঙিন প্রজাপতি।

ভেড়ার বাচ্চাটি ঘুমন্ত রিবিকার কাছে এসে দাঁড়ায়। তার হাঁটুর উপর মুখ বাড়িয়ে শোঁকে। ভেড়ার গরম নিঃশ্বাসে ঘুমন্ত রিবিকা চোখ মেলে। প্রথমে সে ভয় পায়, আর্তনাদ করতে গিয়ে ভেড়াটিকে দেখে থেমে যায়, পুলকিত হয়।

বলে—’আ মসীহ, তুমি এসেছো!’ মুখ দিয়ে কথা বার হতে না হতে সে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ে। ভেড়াটির পিঠে যত্ন করে ভাঁজ করা খুব মসৃণ কাপড়–সৈনিকের শরীরের বস্ত্রখণ্ড। শরীরে পেচিয়ে মসীহদের মত করে পরা যায়। ডান হাত উন্মুক্ত থাকবে, বাঁ কাঁধের উপর ফেলে দিলে পিঠে কোমর ছাড়িয়ে জানু অবধি ঝুলবে। সৈনিকরা কেউ কেউ বিশ্রামের সময় এই পোশাক পরে।

প্রথমে আহ্লাদিত হয়ে উঠলেও, রিবিকা ক্রমশ ভীত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তার মুখ শুকিয়ে ওঠে। সে ভেড়াটির দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে সাহস পায় না। তার মনে হয় সে ফাঁদে পড়ে গিয়েছে। মেয়েরা আদিকাল থেকেই ভয় বা সংকোচ পাওয়ামাত্র চকিতে আপন বুকের দিকে তাকায়। যেদিন সে শরীরের উর্বভাগে কাপড় পরত না, সেদিনও সে চোখ আপন বুকের দিকে মেলেছে। মেয়েরা কখনওবা নরম পতঙ্গকেও ভয় পায়। হোক সে প্রজাপতি। যেন তার বুকে প্রাচীন আকাশের ইন্দ্রধুন ডানা মেলেছে। সূর্যদেবতা সামাশ আকাশে এই রঙ ছড়িয়ে দিতে পারেন। বৃষ্টির পর আকাশে তিনি ধনুকের সংকেত মেলে মানুষের জীবন-সংগ্রামের ছবি আঁকেন।

রিবিকা আপন স্তনযুগলের বর্ণপ্রলেপে ভয় পায়। আর্তস্বরে বলে ওঠে-মা গো!

মা আর দেবী ইস্তার এক্ষেত্রে একাকার। কোমল প্রজাপতি কিন্তু উড়ে পালাতে পারে না। মধুতে পাখা প্রলিপ্ত হয়েছে। দূর থেকে দেখলে সুশোভিত কাঁচুলির মত দৃশ্য হয়। এই প্রকৃতি শীতল, সালংকারা, বর্ণবিভাসিত। এই কি তবে মধুদুগ্ধের দেশসীমা! দৈবনির্দেশিত এই দৃশ্যে ভয় এবং আহাদ মিশে রিবিকাকে ক্রমে আশ্বস্ত করে! আবীরুদের হাতের আঙুলের চেয়ে কোমল এই ডানা আবীরুদের অঙ্গুরীয় বিভার মত রঞ্জিত। কী বিস্ময়! কী বিস্ময়!

রিবিকার কণ্ঠে আদরের ভেজা নরম স্বর নিরর্থক বেজে ওঠে। সে জানে না। এই দৃশ্যের কোন দর্শক আছে কিনা।

রিবিকার চোখে কৃতজ্ঞতার অরুণালোক খেলা করতে থাকে। তার গ্রীবায় প্রজাপতির রঙ লেগেছে; অস্তগামী সূর্যালোক যেমন নীল নদীতে ছায়া ফেলে মন্দিরগাত্রে ভেসে ওঠে, তেমনি এক ছবি। রিবিকা মনে করে জীবন অলীক নয়, রহস্যময় ঈশ্বরের দান–দেবী ইস্তার কাপড় না পেলেও মানুষ পায়। মসীহর সংকেতে ঘাসফড়িঙের বাঁচা, প্রজাপতির উড়ে আসা।

–এমন কেন হল? নিজের কাছেই এই প্রশ্নের বিস্ময় শেষ হয় না। সে বেশ! ছোঁব না। তুমি নিজে থেকেই ঘোড়ায় উঠে বসো। তুমি সুন্দরী না হলে, আমি সৈন্যশিবিরে ছেড়ে দিতাম। তাছাড়া সামান্য প্রজাপতি তোমার ইজ্জৎ রেখেছে, ক্ষুদ্র জীবেরা আমার শিক্ষক। আমি নরম প্রাণীদের ভালবাসি। আমার কথা তুমি বুঝবে না! আমি মসীহ (নবী) হলে এই কথাই তোমার আশ্চর্য লাগত। তোমার সরদারের নাম কী?

ঈষৎ বিস্ময়াপন্ন গলায় রিবিকা প্রায় অস্ফুটে বলল–ইহুদ। মহাত্মা ইহুদ।

সাদইদ ঘোড়র কাছে ফিরে এসে গদিতে হাত বুলাতে বুলাতে বলল–ও! সেটা একটা লাঠিধারী বটে! যাক গে! এখন যা বলছি শোন, আমার নষ্ট করার। মত সময় নেই। অসুররা যে-কোন সময় হামলা করতে পারে।

সহসা সাদইদের কাঁধে ধরা বর্শার বাঁটের দিকে চোখ পড়ে রিবিকার। বাঁটের কারুকৃতি অদ্ভুত। ডানামেলা প্রজাপতি কাঠে কোঁদা হয়েছে। শত দুঃখের মধ্যেও রিবিকার চোখে বিস্ময় ঝলসে ওঠে। লোকটি শৌখিন মাত্র নয়, কেমন যেন অন্যরকম। চোখ দুটি দয়াপূর্ণ এবং উদাসীন। গভীরও বটে। রিবিকা তথাপি রাগতস্বরে বলল–একজন সামান্য সৈনিকের কাছে দয়াই যথেষ্ট। মসীহর নামে ঠাট্টা করার স্পর্ধা তোমার মত নিষ্ঠুরের শোভা পায় বইকি। তুমি নিশ্চয়ই জানো লাঠি ঘোরালেই কেউ মোড়ল হয় না। তবে বর্শা ছুঁড়তে পারলেই ডাকাত হওয়া যায়।

তাই নাকি! সাদইদ তরুণীর মুখের দিকে সকৌতুকে চাইল। ক্ষণকাল চুপ। করে থেকে বলল–তুমি যে আমারনার দেবদাসীদের মত কথা বলছ দেখছি। তোমার পরিচয় জানতে পারি?

–তুমি দেবদাসীর ঘরে গেছ কখনও? পাল্টা প্রশ্ন করে রিবিকা।

–সে অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি। দেবদাসীর চেয়ে সুন্দর মেয়ের আমার অভাব নেই।

–তবে আমায় ছেড়ে দাও। তোমার তো অনেক আছে।

–অনেক আছে বলেই তোমাকে আমার দরকার। যার আছে সেই তো রাখতে পারে!

–কিছুই থাকে না সেপাই। নানভী (নিনিভে) নগরীও ধ্বংস হবে! আর তোমার নরম ক্ষুদ্র প্রাণী শখের প্রজাপতিও বেঁচে নেই। আমার মত মেয়ের স্তনে মধু পড়লে তা বিষ হয়ে যায়, অত নরম প্রাণ কি বাঁচতে পারে! এই দ্যাখো … কিছুই থাকে না! যা দেখছ সব!

বলে অশ্বের কাছে এগিয়ে এসে রিবিকা গায়ের কাপড় দু হাতে সরিয়ে পিঠে মেলে দু হাত দু পাশে প্রসারিত করে দিলনাও দেখে নাও। আমি আমনের (সূর্যদেব) বউ, আমার তো কোন লজ্জা নেই! হায়েনাও আমাকে খেতে পারে না। সাত বছরের দুর্ভিক্ষেও আমি মরিনি। নাঙা মেয়ের চুলে নীল ফিতে বাঁধা–তাই দেখে কবিতা লিখবে এমন মানুষ নোহের সন্তানরা জন্ম দিতে পারে না। আর তোমার মত সৈনিক জীবনেও কাঁদতে জানে না। নাও, দ্যাখো, দ্যাখো!

সাদইদ যা গাছের আড়াল থেকে চুরি করে দেখছিল কিছুক্ষণ আগে, তা অতি নিকটে উদ্ভাসিত হতে দেখল। এমন রূপ সে কখনই দেখেনি। সে কোন প্রকার জাদু বিশ্বাস করে না। স্বপ্নদর্শীরা জলের উপর তেল ফেলে মানুষের ভাগ্য গণনা করে, পশুর মেটের আকৃতি, তেলের আকার দেখে ভাগ্য বলা তার কাছে হেঁয়ালি এবং অসত্য। কোন প্রকার নবীগিরি বা নবুয়তী সে পছন্দ করে না। কারুকে মাথার উপর লাঠি ঘোরাতে দেখলে পাগলা কুকুর লেলিয়ে দিয়ে আনন্দ পায়। সে যে-কোন প্রকারের গ্রাম্যতাকে ঘৃণা করে। দেবদাসীর প্রতি তার কণামাত্র আগ্রহ নেই। সে যুদ্ধের অর্জনকে সম্মানজনক ভাবে, নিনিভের ঐশ্বর্য আলো উদ্ভাসন তাকে লুব্ধ এবং ঈর্ষাতুর করে। তথাপি তার আজ মনে হল, এই। মেয়েটিকে সে পথে পেয়েছে, যুদ্ধ করতে হয়নি এ তার ভাগ্য।

রিবিকার বুকের দিক থেকে সে চোখ ফেরাতে পারছিল না। তার কুসুকুলিকার মত রাঙা আঙুল স্তনের প্রলিপ্ত প্রজাপতির ডানাকে ছুঁয়ে তুলে ফেলে উড়িয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা করে–এই মুহূর্তে। এই মনোভাব কোন মসীহ বা ঈশ্বর জানতে পারে না। মানুষ সে অর্থে দেবতার চেয়ে দুর্গম।

রিবিকা সাদইদকে ভুল বুঝল। মনে হল, চোখে যতই দয়া থাক, এ নিশ্চয়ই এমন নির্জনতায় সম্ভোগ না করে ছাড়বে না। মসীহ যদি সহায় থাকেন, সম্ভোগের পর ছেড়ে দেবে। তখন সে মরুপথে কেঁদে বেড়াবে, তাই বেশ । তবু নিস্তার পাবে। মহাত্মা ইহুদকে সে কি পাবে না খুঁজে? সাদইদের গালে চড় মেরে বলল–অনেক দেখেছ, দেবদাসী দ্যাখোনি, না? কোন পুরুষের হৃদয়ে যুদ্ধের যুগে সত্য নেই সরদার। পুরুষ যে কখনও সত্য সৃষ্টি করেছে, ঈশ্বরের প্রত্যাদেশে করেছে, তেমন দুএকজন ছাড়া আমার কে আছে? নাও, যা করবার করো। তুমি আমার মেষশিশুকে মেরেছ! প্রাণের উপর খুব মায়া তাই না, প্রজাপতির বন্ধু!

বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দুহাতে মুখ ঢেকে সাদইদের পায়ের কাছে মাটির উপর বসে পড়ল রিবিকা। কান্নার চাপে তার বুক ভেঙে যেতে লাগল। শরীর কাঁপতে লাগল।

সাদইদ কিছুক্ষণ হতভম্বের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখে ধীরে ধীরে কান্না থেমে গেল রিবিকার। কান্নাভেজা দুহাত চোখের উপর থেকে সরিয়ে কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাদইদকে দেখল। তারপর গায়ের কাপড় সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

এবার সাদইদ খুশি হয়ে উঠল অকারণ। বলল–ওঠো! আমি লাগাম ধরে হেঁটে যাব।

রিবিকা প্রথমে সাদইদের প্রস্তাব ঠিক শুনছে কিনা বুঝতে পারছিল না। হাসি মুখে খুব নরম করে সাদইদ বলল–উঠবে না? জিজ্ঞাসা করেই সে তার আঙুলে লেগে থাকা প্রজাপতির পাখার আসান লক্ষ্য করছিল। কিছুই থাকে না। একটি নগরী আঙুলের এই রেণুর মত শেষ হয়। তাই কি? কিন্তু আমি কখনই একথা মানতে পারি না। মনে মনে বলল সাদইদ।

রেকাবে পা রেখে বহুকষ্টে রিবিকা ঝুলে ঝুলে বেয়ে বেয়ে ঘোড়ার পিঠে। উঠল। সামনে লাগাম ধরে এগিয়ে চলল সাদইদ। অনেকক্ষণ দু’পক্ষই নীরব।

হঠাৎ সাদইদ মিশরীয় সেই কবিতা আউড়ে উঠল আপন মনে :

‘আমার ফুলের বাজার, তাই খদ্দের আসে না।
আমার নেই পশম, যা দিয়ে তোমায় রক্ষা করি,
ওহে প্রিয়া! মরুশীতে একটি বৃদ্ধ উট
আমার সঙ্গী! আতর আর সুর্মা কী হবে!
শুধু পশমের জন্য, আঙুর বাগিচার জন্য,
সবুজ উপত্যকার জন্য এ জীবন–আব্রাহাম!’

চমকে ওঠে রিবিকা! সে চুপিচুপি বুকের কাপড় সরিয়ে দেখে দুটি প্রজাপতিই স্পন্দনহীন। এ-স্থল ছুঁয়েছে ওই লোকটি!

কবিতার সুর সহসা সাদইদের গলায়।

সাদইদ বলল–তোমার এই ভেড়ার বাচ্চাটা যদি আমাদের শিবিরে না ঢুকে পড়ত, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হত না। ভেড়াটাকে দেখেই মনে হল, রাস্তায় নিশ্চয়ই কোন কাফেলা (মরুযাত্রীদল) যাচ্ছে। আমার সৈন্যরা যে যেমন পারল এদিক-ওদিক ছড়িয়ে গেল ঘোড়া নিয়ে, মরুভূমির মধ্যে। আমি একা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে আসছিলাম। তোমাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখে কী যে হল বলতে পারব না–কোলের বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিলাম, ওর পিঠে চাপিয়ে দিলাম আমার ঘাড়ের কাপড়। ওকে এভাবে বর্শায় গেঁথে মারার আমার বিন্দুমাত্র উৎসাহ ছিল না।

–তবে মারলে কেন? উদ্বেগের সঙ্গে বলল রিবিকা।

সাদইদ বলল–হিত্তীয় সৈনিকদের সম্বন্ধে তোমার কোন ধারণা নেই। ওরা ক্ষ্যাপা কুত্তার মত মরুভূমি তোলপাড় করে যখন কিছুই পাবে না–জুমা পাহাড়ের ওদিকে ঘোড়া হাঁকিয়ে চলে গিয়ে মদ খেয়ে দেবদাসীদের মন্দিরে পড়ে থাকবে দুদিন। যুদ্ধ যত ঘোরতর হয় দেবদাসীদের উপর ততই নির্যাতন বাড়ে। যুদ্ধের আধেক শক্তিই দেবদাসী। বিশেষ করে আমারনার মেয়েদের উপর বেশি লোভ।

–কেন?

–তারা সুন্দরী আর ওদের হাত-পা মোলায়েম। মিশর সুখী দেশ। চাষী ঘরে যারা মাঠে কাজ করে তারা গেঁয়ো হয় ঠিকই, হাত-পা শক্ত হয়, কিন্তু শহুরে দেবদাসীরা কামকলায় পটু আর লেখাপড়াও কিছুটা জানে, গান জানে। ওখানকার অভিজাতরা দেবদাসীদের যত্নে রাখে। একটা রাষ্ট্র কতটা ভাল তা বোঝার উপায় হচ্ছে দেবদাসী। যেখানে কবিতা-চৰ্চার চেয়ে কামকলার চর্চা বেশি হয়, জানবে সেটা ঐশ্বর্যশালী দেশ। কবিতা হল উটচালকের জিনিস, তারা তো চুটকিলা গায়, ঠুংরি জাতীয় গান করে।

–তুমি কী করো! সকৌতুকে জানতে চায় রিবিকা!

–আমি? বলে স্নান হেসে পিছনে ফিরে চাইল সাদইদ। তারপর সামনে চোখ মেলে চলতে চলতে বলল–আমি কী করি একটু পরেই বুঝতে পারবে। অকৃতজ্ঞতা হল যুদ্ধের শর্ত? তোমার ভেড়ার ওপর আমার কোনই কৃতজ্ঞতা ছিল না। থাকলে হত্যা করতাম না। আমি শিবিরে গিয়ে কোন কথাই বলব না, শুধু ভেড়াটা ছুঁড়ে দেব। একটা ভেড়া আর তোমার মত সুন্দরীকে পেলে ওরা চুড়ান্ত উৎসাহ পাবে। আমি ওদের পরিচালক। ওরা মরুভূমি ছুঁড়ে খালি হাতে ফিরেছে। ব্যর্থতার জ্বালায় জ্বলছে। আমি ওদের প্রশমিত করব। ওদের বোঝাতে হবে, রেগে উঠলেই হয় না, চোখ খুব তীক্ষ্ণ আর মাথাটা ঠাণ্ডাও। দরকার।

–তুমি আমাকেও ভেড়াটার সঙ্গে হত্যা করলে না কেন? অশ্বপৃষ্ঠে হাহাকার করে উঠল রিবিকা।

–মানুষ যে যুদ্ধে জেতে কেন জেতে, তলার ইতিহাস খুব কটু। একজন মহাপরিচালকের পক্ষে খারাপ দেখালেও তাকেও কতকগুলো ছোট কাজ করতে হয়। ভেড়া বওয়াটা নিশ্চয় খুব মর্যাদার কাজ নয়। তবু কেন বইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ।

–আমাকে ক্ষমা করুন। বলতে বলতে রিবিকার মাথা ঘুরে উঠল। সে ঘোড়ার গা খামচে ধরল।

সাদই বলে যেতে লাগল–তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তোমাকে যে মন্দিরটা দেওয়া হবে, তা খুবই পরিচ্ছন্ন আর আধুনিক। সূর্যমন্দিরই পাবে তুমি । সূর্য যতদূর আলো ছড়ায় একজন সৈনিক আকাঙ্ক্ষা করে সে ততদূরই পৌঁছবে। কিন্তু সারগনও তা পারেননি। কিন্তু সূর্যের বর পেয়েছে দেবদাসী–সবখানে তার দেশ। মহাপিতা নোহের কাহিনী সবদেশে আছে, দেবদাসীর কাহিনীও মানুষের যুদ্ধের সঙ্গে জড়ানো–সর্বত্র আছে। মন্দিরে তোমাকে পাহারা দেবে সমর্থ একজন গামছাবালা। তোমার কাছে আসবে রাষ্ট্রনায়ক, মন্ত্রী। সত্যি বলতে কি তোমার জন্য মোতায়েন হবে গামছাবালা-এরা দালাল চরিত্র নয়। প্রহরী বলতে পারো। মিলনের আগে এবং পরে সেই গামছাবালা তোমার ও তেনার নানারকম সেবা করবে। লাঠিধারী যেমন পদবী, গামছাবালাও তাই।

শুনতে শুনতে রিবিকা অশ্বপৃষ্ঠ থেকে মাটিতে খসে পড়ল। ক্ষুধায় এমনিতেই এত কাহিল ছিল যে, গা কাঁপছিল; তার কম্পিত হৃদয়ও আর চিন্তা করতে পারছিল না। পড়ে যাওয়ার শব্দে পিছনে ফিরে তাকাল সাদইদ। দেখল মেয়েটি মূৰ্ছা গিয়েছে। তার বুকের উপর থেকে কাপড় সম্পূর্ণ সরে গিয়েছে। একটি প্রজাপতিও আর জীবিত নেই। ভোরের এই অরণ্য আড়াল দেওয়া টুকরো টুকরো আকাশে প্রজাপতির রেণু মাখিয়েছে কে!

সে আপন মনে লজ্জা পেল, গামছাবালা যে পদবী সে যে দালাল নয়, একন নির্যাতিতার সামনে এসব এমন করে বিবৃত করা ঠিক হয়নি। মেয়েটিকে নিয়ে এখন সত্যিই সে কী করবে! মেয়েটি তো জানে না এই পুরুষটি আসলে কে–কী তার ভাগ্যের পরিচয়। গামছাবালা কথাটি কি আর সাধে সাধে মুখে আসে!

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সাদইদ। মহাপরিচালক কথাটাও কি কম পরিহাস্য! মর্যাদা! নিরীহ অসহায় নারীর কাছে মর্যাদার কথা! সামান্য একজন ভাড়াটে সৈনিক! যারা মিশর থেকে, আসিরীয় ভূখণ্ড থেকে, বাবিলন থেকে গুপ্তপথে, চোরাপথে পালিয়ে আসা সৈনিক, তারাই তার সহচর। একত্র দল গড়েছে–সেই দল ভাড়া খাটে, তারই পরিচালক সে। যুদ্ধ শেষ হলে কিংবা আসিরীয় নগরী নিনিভে ধ্বংস হলে তাদের আর কোনই দাম থাকবে না। যুদ্ধ থাক, কিন্তু নগরী যেন ধ্বংস না হয়। একটা বড় নগরী ধ্বংস হওয়ার পর কিছুকাল যুদ্ধ থেমে থাকে। বিজয়ী জাতি ভাড়াটে সেনাদের নিজের রাষ্ট্রে বন্দী করে আবার । স্বপ্নের পাহাড়, ক্ষুদ্র অরণ্য, মরূদ্যান, মন্দির, দেবদাসী–সব কেড়ে নেয়। যুদ্ধ থামলে আবার তাকে পার্বত্য নগরীর মধ্যে হিত্তীয় রাষ্ট্রের সৈন্যশিবিরে,নতুবা কোথাও ঠাঁই নিতে হবে।

অথচ কনান তার দেশ। মহামতি হিত্তীয় রাজা হিতেন তাকে এই যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার সময় খানিকটা স্বাধীনতা দিয়েছেন মাত্র। সে নিজের উদ্যোগে সৈন্যদল গড়েছে। তথাপি হিতেনের যুদ্ধবিদ্যা সাদইদের অধিগত হয়েছে হিতেনের বদান্যতায়–ফলে হিতেনের কাছে তার আনুগত্য প্রবল।

হিতেন সাদইদকে একটি ছোট পাহাড়, কিছু মন্দির এবং শিবির স্থাপনের জন্য এই সামান্য অরণ্য দিয়েছেন। এখানে ছোট একটি দ্রাক্ষাকুঞ্জ আর দুটি কূপ এবং ক্ষুদ্রাকৃতি মরূদ্যানের বিস্তার আছে। দ্রাক্ষাকুঞ্জের কাজ করে আহত সৈনিকরা–বিশ্রামের জন্য তাঁবু খাটায়। পাহাড় এখান থেকে পঞ্চাশযাট মাইল দূরে অবস্থিত। সেখানেই রয়েছে নতুন মন্দিরগুলি। হিটাইটরা (হিত্তীয়) অশ্ব চালনাতেই কেবল পারঙ্গম, তাই নয়, এরা মাটির ইট, বালির তাপে শক্ত করে নিয়ে বাড়ি তৈরি করতেও পারে। সেই গৃহগুলি পাথর এবং ইটের প্রস্তুত। ঠিক সেইভাবেই তারা মন্দির গড়েছে।

এইসব মন্দিরগৃহ উপাসনার জন্য তৈরি নয়। সৈনিকরা এখানে দেবদাসীদের হাতে মদ্যপান এবং রাত্রিবাস করার জন্য আসে; আক্রান্ত জাতির সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে দেবদাসী করা হয়। তারা অধিকাংশই পুরুষহীন। তাদের পুরুষরা হয় যুদ্ধে নিহত, নতুবা জেল খাটছে অথবা পঙ্গু। যুদ্ধে ক্রমাগত পুরুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার ফলে দেবদাসীদের সংখ্যা দিনে দিনে অসম্ভব বেড়ে গিয়েছে।

একটি নগরীর শ্রীবৃদ্ধি মানে দেবদাসীর সংখ্যা-বৃদ্ধি। দেবতা সামাশের জয়জয়কার। নারীকে পুরুষহীন না করতে পারলে সৈনিকদের জন্য দেবদাসী সরবরাহ করা যাবে না। দেবদাসী না থাকলে সৈনিকরা যুদ্ধ করবে না। দেবদাসীর সংখ্যা বাড়লে মন্দিরের সংখ্যা বাড়বে, সঙ্গে সঙ্গে গামছবালার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাবে। পরাধীন রাষ্ট্রের পুরুষদের জন্য গামছা কাঁধে করা চাকরি নির্দিষ্ট। হয় সে দ্রাক্ষার মদ বানাবে, নয় গামছা কাঁধে ফেলে টুলের উপর বসে থাকবে দেবদাসীর মন্দিরের দরজার কাছে। আবোবদনে এইধারা বসে থাকাই হল সভ্যতার চিহ্ন। যে দেবদাসীর সৌন্দর্য যত বেশি তার গামছাবালার চাকচিক্যও তত বেশি।

সংজ্ঞাহীন রিবিকার মুখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে জীবনে এই প্রথম সাদইদের মনে হল, দেবদাসীদের পাড়ায় এই মেয়েটির খুব কদর হবে। কিন্তু এই মেয়েটিকে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তুলতে সাদইদ বুকের মধ্যে কেমন একধারা কষ্ট অনুভব করছিল।

ঠিক সে জানে না, এই কষ্টটাই বা কিসের! এমন তো কখনও হয়নি। যার পুরুষ নেই, তার তো ঈশ্বর আছেন! গামছাবালা এবং পুরুত আছে। সর্বোপরি সৈনিকদের আদর-সম্ভাষণ তো রয়েছেই। সাদইদ কূপ থেকে মাথার টুপিতে করে জল বহে এনে রিবিকার মুখে প্রক্ষেপ করতে করতে ভাবল–আমি না হয় দেবদাসীর ঈশ্বরকে অথবা যে কোন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না–তা বলে আমনদেব সূর্য তো মিথ্যে হয় না। সে প্রতিদিন আকাশে আসে। ঈশ্বর যবহ পাহাড়ে বসে চোখ রাঙায়। দেবতার আশীর্বাদে একজন প্রথম শ্রেণীর দেবদাসী কত সমাদৃত হয়। নগর রাষ্ট্র ধ্বংস হয়, তেমন রূপসী দেবদাসী ধ্বংস হয় না। একটি নগর শেষ হলে আর-একটি নগর জেগে ওঠে। বিজয়ী রাষ্ট্র-পুরুষ সবচেয়ে সুন্দরীকে অশ্বে তুলে নিয়ে চলে যায়।

মেয়েটিকে বলতে হবে–সে যেন কোন সৈনিকের প্রেমে না পড়ে। তার নিজের দাম বোঝা উচিত। সৈনিক আজ আছে কাল নেই। আজ রাতে যে সৈনিক এই মেয়েটির পাশে শুয়ে রাত কাটালোকাল ভোরেই তার মৃত্যু হতে পারে। অসুররা যে কখন কার প্রাণ নেবে বলা তো যায় না। ভাড়াটে সৈনিকের দেশ নেই, রাষ্ট্র নেই, জীবনের স্থায়িত্ব নেই। তার চুক্তিরও কোন দাম নেই। আজ সে মিশরের পক্ষে, কালই সে অসুরদের তরফে। একটি ছোট পাহাড় দেখে একটি নগরীর কল্পনা করা কী বোকামি! সাদইদ তার পাহাড়টির দিকে গাছপালার ফাঁক দিয়ে একবার চাইল। তারপর আবার রিবিকার জলসিক্ত মৃদু কম্পিত মুখের রেখার দিকে চাইল। এই মেয়েটি তাকে প্রজাপতির বন্ধু বলে ঠাট্টা করেছে। অত্যন্ত উর্বর-মস্তিষ্ক না হলে, অমন বাক্য মুখে আসত না। যার রূপ প্রখর আর মিন্ধ এবং বুদ্ধি প্রখরতর,তাকে দেবী ভাবলে অন্যায় হয় না । দেবী যে আকাশে থাকে না, সাদইদের এ হল গভীর বিশ্বাস!

একজন দেবী কখনও এত স্পষ্ট নয়, যা প্রত্যক্ষ তাই সত্য। যা বোঝা যায়, তাই সত্য এবং সুন্দর। প্রজাপতি এই সুন্দরীকে অধিকার অকারণ করেনি। সাদইদ দেখল, রিবিকার চোখের পাতা ঘন-ঘন নড়ে উঠছে। সে চেতনা ফিরে পাচ্ছে।

০৩-৪. সাদইদের দিকে চোখ মেলে

সাদইদের দিকে চোখ মেলে চাইল রিবিকা। তার বুকের কাপড় সরে গেছে। লোকটি তার দিকে গভীর আগ্রহে চেয়ে আছে। হঠাৎ কী খেয়াল হওয়াতে সাদইদ রিবিকার বুকের কাপড় সাবধানে তুলে রিবিকাকে ঢেকে দেয়। রিবিকা পুরুষের এই আচরণ ভাবতে পারে না। নারী যখন সংজ্ঞাহীন, পুরুষ তখনও নারীকে গমন করে। মিশরে সমকামী পুরুষের অভাব ছিল না। পুরুষ এমনকি মৃতাকেও গমন করে। নারীর এসব সুযোগ নেই। দেবতা আমন নারীকে এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছেন। ফলে সে সুন্দর হয়েছে।

সাদইদ বলে উঠল–ভয় পেও না প্রজাপতি!… খুব নরম করে বলল, তা আহ্বানের সুরে। কেন যে এমন করে বলল, হৃদয়ের এই চিন্তার ব্যাখ্যা সাদইদের জানা ছিল না। ঠিক তখনই হৃদয়াবেগের প্রবল চাপে রিবিকা সভ্যতার সেই নারী যে লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে ফেলল।

একটা কথা ভেবে রিবিকার কান্না থেমে যায়। অজ্ঞান অবস্থায়, দেবী ইস্তারের মত যখন সে পাতালে ভাসছিল, খুব একা, খুবই অসহায়, যখন সে তার পুরুষকে পাগলের মত অন্ধকার স্রোতে খুঁজছে, তখন এই সৈনিকটা তাকে গমন করেনি তো!

–কী হল? প্রশ্ন করল সাদইদ।

রিবিকা জবাব না দিয়ে উঠে বসে অন্ধকার স্রোতের কোন ক্ষীণ স্মৃতি শরীরে স্পষ্ট লেগে আছে কিনা মনে মনে বুঝে নিল। শরীর কাহিল, কিন্তু অজ্ঞানতার ক্রমাগত নিমজ্জন তাকে অসহায় করেছে, পীড়ন করেনি-বুঝতে পেরে ফের দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলল । রিবিকা আপন বুকের দিকে কাপড়ের আড়ালে চক্ষু সঞ্চালিত করে টের পেল মৃত পতঙ্গ অক্ষত। তার কান্না আরো বেড়ে গেল।

সাদইদ বলল–নিনিভে নগরী তোমার চেয়ে সুন্দরী নিশ্চয়। মনে রেখো সেখানের সিংদুয়ারে বৃষমূর্তি আছে বৃষের মুখ মানুষের মত। স্কন্ধ বৃষ, চোখ মানুষের। সেই চোখে তোমার জন্য কোন কান্নার জল জমে নেই–তা আগুন জ্বালায়। বৃষবক্ষ যাকে বলি, তা নির্মম। ওঠো, আমার সঙ্গে তোমাকে যেতে হবে।

কথার শেষ অংশে গলা কঠোর করে তুলল সাদইদ।

গাছপালার ফাঁক দিয়ে জুমা পাহাড়ের দিকে আবার চাইল সাদইদ।

বলল–তোমাকে মধু আর রুটি দিতে পারি। দেখে মনে হচ্ছে তুমি অনেক দিন কিছু খাওনি। চলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তোমাকে শিবিরে নিয়ে যাই।

রিবিকা ঘোড়ার পিঠে ফের উঠে বসেছিল। অত্যন্ত ম্লান গলায় বলল–খিদেয় ধোঁকাচ্ছি, দেহে বল নাই। এই অবস্থায় যা খুশি করতে পারো। তবে দোহাই, আমাকে শিবিরে দিও না। তোমার সৈনিকরা আমাকে ছিঁড়ে খাবে। হায়েনার হাত থেকে মসীহ আমায় রক্ষা করেছেন, একটা মেষশিশুর কাছ থেকে তুমি একজন প্রজাপতির বন্ধু, কিছুই কি শিখবে না?

–অ। তুমি দেখছি ভারী চালাক। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীদের কাছে থেকে কতকিছুই শেখার আছে। হ্যাঁ, আমি একথা বিশ্বাস করি। আমার কাছে ব্যাপারগুলি খুবই স্পষ্ট। অবশ্য ক্ষুদ্র কেন, বৃহৎ প্রাণী যারা, তারাও আমাদের শেখায়। উট, অশ্ব, কুকুর। এরা কেউ ভগবান নয়। এরা লাঠিধারীদের মত ইশারাবাদীও নয়, ভণ্ডও নয়। কিছু মনে করো না। পিতা নোহ ছাড়া আমার কোন মসীহর উপর আস্থা নেই।

বলতে বলতে একটি দেবদারু গাছের ছায়ায় ফের দাঁড়িয়ে পড়ল সাদইদ।

বলল–এখানে একলা তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে। তুমি নিচে নেমে এসো। আমার ভয় হচ্ছে, তোমাকে সৈনিকরা দেখলে কিছুতেই ছাড়তে চাইবে না।

–দোহাই!

আর্তনাদ করে উঠল রিবিকা। বলল–আমি তোমার কবিতার তারিফ করি সারগন। পিতা নোহের সন্তান তুমি–আমায় বাঁচাও।

–আমি সারগন নই প্রজাপতি। আমাকে এত সম্মান দেখানোর কিছু নেই। আমি শুধু প্রজাপতি দু’টির’আচরণে মুগ্ধ আর অবাক হয়েছি। জানি মধুর। লোভেই তারা তোমার কাছে এসেছিল। কিন্তু তারপর ঘটনাটা অন্যরকম। হয়েছে। ওরা বিভ্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সেটা খুব দুর্লভ ব্যাপার। ঠিক তোমাকে বোঝাতে পারব না। হৃদয় উর্বর হলে, আমি এ নিয়ে দু ছত্র লিখতাম। পাথরের গায়ে কুঁদে রাখলে সেটা বাবিলের অনুশাসনলিপির চেয়ে মূল্যবান হত। ধন্যবাদ! তুমি আমার কবিতার তারিফ করেছ!

ধন্যবাদ জানিয়ে সাদইদ বলল–এবার তাহলে তোমাকে নামতে হয়।

রিবিকা বলল–আমার নামবার ক্ষমতা নেই সারগন। আমি আর পারছি না।…বলতে বলতে রিবিকার চোখ দুটি খিদেয় আর ক্লান্তিতে মুদে এল।

দুটি হাত অখের দিকে প্রসারিত করে সাদইদ বলল-তোমার সঙ্গে অদ্ভুত দু’টি প্রজাপতির সংযোগ ঘটেছে। যাই হোক, এই দৃশ্যের খাতিরে আমি তোমাকে খাদ্য আর পানীয় দেব। এবং চাইব না যে তোমাকে ধর্ষণ করে মেরে অসুরদের খুটায় টাঙিয়ে দিক সৈন্যরা। অসুর কে নয় বল? যুদ্ধ যতদিন আছে একটা রঙিন প্রজাপতির পক্ষধ্বনি কারো কানে যাবে না। আমি নিশ্চিত, প্রকৃত নোহের সন্তান ছাড়া এই ধুন শুনতে পায় না। আমি ঠিক যোগ্য নই। চুটকিলা গেয়ে যুদ্ধ থামানো যায় না। দরকারই বা কী! যুদ্ধ থামলে আমার জায়গা কোথায়! এসো! নেমে পড়ো।

গাছের ছায়ায় নামিয়ে রেখে সাদইদ অশ্বারোহণ করল, রিবিকার চোখে অদ্ভুত আকুতি ফুটে উঠল। খিদে আর তেষ্টায় সে বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল। মুহূর্ত কতক চলে যায়। দ্রুতই ফিরে আসে সাদইদ। দ্রাক্ষাকুঞ্জ থেকে মধু আর রুটি সংগ্রহ করে ফিরেছে। হত্যা করা মেষটাকে সৈনিকদের ভিতর ছুঁড়ে দিয়ে এসেছে।

রিবিকা যখন গোগ্রাসে খেতে শুরু করল, সুন্দর মায়া এসে সাদইদের চোখ দু’টিকে ঘিরে ছায়া ফেলে দাঁড়াল।

সাদইদ বলল–তোমার জন্য জল, মধু আর রুটি। শীতে আর গ্রীষ্মে উপযুক্ত পোশাক। যদি পর্যাপ্ত এইসব পাও, কী করবে তুমি? মিশরীয় অভিজাত নারীদের মত তুমিও কামকলার চর্চা করবে। তখন আমার মত যাযাবরের কবিতা ভাল লাগবে না। আমার কতরকম ভাবনা, কোনটারই মাথামুড়ো নেই। কখনও বলি প্রজাপতি, কখনও বলি যুদ্ধ। দিশেহারা একটা ভাব। যার দেশ নেই, গ্রাম কিংবা নিজস্ব নগরী নেই। অশ্ব আর অস্ত্রবিদ্যা কী কাজে লাগল! রাজা হিতেনের অনুগৃহীত। তোমাকে যে খেতে দিলাম–মাগনা নয়। রাজাকে তুষ্ট করলে…যাক গে!

খেতে খেতে রিবিকা থেমে পড়ে দু’চোখ সামান্য কুঞ্চিত করে সাদইদের মুখের ভাষা পড়বার চেষ্টা করে। কেমন সন্দেহ হয়। মনে হয়, এই লোকটাও তাকে বিক্রি করে দেবে। পুরুষ মাত্রই বিক্রেতা এবং ক্রেতা। প্রত্যেকেই বণিক। তবে লোকটির ভাব খুব দুরূহ সন্দেহ নেই। নিজেকে সে দিশেহারা বলছে। নারীর শরীরে কাদা, বালি লাগে, তেমনি ফুলের পাপড়িও লেগে থাকে। সবই সমান। তুচ্ছ প্রজাপতি দেখে মুগ্ধ যে হয়, সে পাগল। লোকটা যখন প্রজাপতিকেও শিক্ষক বলে ঘোষণা করেছে, বোঝা যায়, পাগলামিটাও তবে আস্ত। আবীরুদ এইরকমই ছিল। প্রাসাদ ছেড়ে সে তাঁবুর তলে থাকতে চেয়েছিল।

ভাবতে ভাবতে আবার খেতে শুরু করল রিবিকা। খাওয়া শেষ হলে ঢকঢক করে জলপান করতে করতে থেমে পড়ল সে। বলল–হায় আমন! তোমাকে তো একবারও বললাম না! মাফ করো আমাকে। তোমারও তো খিদে পেয়েছিল!

ক্ষীণ হেসে সাদইদ বললবলেছিলাম না! খেতে পেলে আবার তোমার বাঁচতে ইচ্ছে করবে। ক্ষুধার্ত মেয়েকে বলাৎকার করা কাপুরুষতা। সমকামিতার চেয়ে নোংরা জিনিস। আমি যদি সারগন হতাম, আমার নাগরিক অনুশাসনে একথা লিখতাম। অবশ্য সারগনেরই মত আমার জন্মমুহূর্তেই মা আমাকে ত্যাগ করেছিলেন। হয় আমি জারজ ছিলাম। কোন সৈনিক আমার পিতা ছিলেন, যার কোন উদ্দেশ ছিল নানতুবা মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। আমার মাকে তোমাদের ঈশ্বর হত্যা করেছিলেন। নইলে নবজাতক সাদইদ কেন ঝুড়িতে করে জলে ভেসে যাবে।

একটু থেমে সাদইদ বলল–একজন ভিস্তি–ভিস্তি বোঝো তো! দ্রাক্ষাকুঞ্জের মালি। তিনি কে? তিনি এক ক্রীতদাস। বস্তুত তিনিই আমার পিতা-আসল বাপটি কে জানিনে। এইরকম দিশেহারা নিরাশ্রয় জন্ম আমার। সারগনেরই মত। কিন্তু আমি সারগন নই। বারংবার একটা মিথ্যা কথা বলছ। কেন?

বলতে বলতে সাদইদের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। আরো খানিক জল আশ্লেষে পান করে রিবিকা বলল–একজন দেবদাসীকে ক্ষমা কর! আমার কথার কি কোন দাম আছে!

সাদইদ রিবিকার স্বীকারোক্তি শুনে অবাক হয়। মুখে আর কোন কথা বলে না। ক্ষমা চেয়ে সুন্দরী রিবিকা ঘাড় নিচু করে অনেকক্ষণ বসে থাকল। তার অধোভঙ্গিমার মুখোনির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে কবিপ্রাণ সাদইদের মনে হল, মেয়েটিকে সে কুমারী ভেবেছিল। একটি দেবদাসীকে চিনতে না পারা তার অক্ষমতা। মেয়েটির মাথার নীল ফিতেটিকে দেখে তার আশ্চর্য লাগছিল।

সাদইদ বলল-দেবদাসী না থাকলে আমাদের যুদ্ধ থেমে যেত। তোমরা। আছো বলেই আমরা আছি প্রজাপতি!

–তোমার একথার প্রতিবাদ করার সাহস একজন দেবদাসীর নেই। তুমি সৈনিক। মুখে যা আসে বলতে পারো। তবে একথা একজন বুড়োর মুখে ভাল শোনায়। আমি প্রজাপতি নই। আমার নাম রিবিকা। আমার মত মেয়েকে প্রজাপতি বলে ঠাট্টা না করলেই পারতে সারগন!

রিবিকার ঈষৎ অভিমানভরা কণ্ঠস্বর শুনে সাদইদ হা-হা করে হেসে ফেলে বলল–আবার সারগন!

রিবিকা আবার লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। বলল–অন্য কোন সৈনিক হলে এমন করে সারগন বলে ডাকলে খুশি হত! তুমি তেমন নও। তোমার নাম ধরে তো ডাকতে পারি না।

সাদইদ বলল–শোন আমনের বউ! তোমাদের মুখে তারিফ শুনতে সৈনিকরা ভালবাসে, কারণ তাতেও এক ধরনের নেশা হয়। মদের চেয়ে সে নেশা খর। একজন সৈন্যকে গেজিয়ে দিতে তোমরা ওস্তাদ। বিশেষত একজন ভাড়াটে সেপাই দেবদাসীর মুখে ছাড়া প্রশংসা কোথায় পাবে! আমি অধিনায়ক, কিন্তু কখনও কোন সেপাইয়ের প্রশংসা করিনি। কেন করব?

বলতে বলতে গাছের শেকড়ে বসে থাকা সাদইদ উঠে দাঁড়ায়। তারপর তার ফেনশুভ্র ঘোড়াটির কাছে সরে এসে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়িয়ে লাগাম আঁকড়ে ধরে। পরম মমতায় ঘোড়ার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলে–তারিফ কখনওই করব না। এরা প্রত্যেকে সারগন হওয়ার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু কখনও ঐক্যবদ্ধ হয় না। লুঠের মাল নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করে। একজন সুন্দরী দেবদাসীর উপর অধিকার বলবৎ করতে সহযোদ্ধার বুকে চাকু বসায়। মন্দিরে গিয়ে কে আগে কার কাছে কোন্ সুন্দরীর কাছে যাবে তার প্রতিযোগিতা করে। কী বলব, এদের ঐক্য নেই। এরা কখনও কোন একটা সুন্দর নগর নির্মাণের কথা ভাবতে পারে না। ক্রীতদাস ছিল, চোরাপথে পালিয়ে এসেছে, মন খুব ছোট। বিচিত্র মুখের ভাষা। কারো সঙ্গে কারো মিল নেই।

একটু থেমে সাদইদ বলল–আমি নিজে প্রচুর মেহনত করে ওদের জন্য একটা তাঁবুর মিশ্রভাষা তৈরি করেছি। তাঁবুতে থাকে, কথা চালাচালির একটা মাধ্যম তো লাগে। সেই ভাষা তো কতকগুলো নকশা হলেই চলে না। মুখে একটা নকশার বর্ণনা করতে অনেক সময় লাগে। লিপি তৈরি হয়েছে, ভাষাও সহজ হয়েছে। লিপি দরকার। আমি নকশা নয়, লিপিভিত্তিক একটা বর্ণমালা প্রস্তুত করেছি-বলতে পারো, এটা আমার কোন কৃতিত্বই নয়। ফিনিশীয়রা লিপির ভাষার উদগাতা। উগাতা বোঝো তো! এই ভাষা তৈরি একটা জাতির ক্ষমতা। কল্পনা করার ক্ষমতা। লিপি হল লিখিত রূপ। অঙ্কিত রূপ নয়। সেটি হওয়ার ফলে ভাষাগুলিকে মেশানো সহজ হয়েছে। সে কাজটা কঠিন নয়। তা, সেই কাজ করে আমি প্রমাণ করেছি, বাবিলের গল্পটা ঠিক নয়। মানুষ ভাষার। দূরত্ব ঘোচাতে পারে। তা সত্ত্বেও এরা সত্যকে চিনতে চায় না।

একনাগাড়ে কথা বলার পর দম নেবার জন্য দণ্ডভর থামে সাদইদ। ঘোড়ার কাছ থেকে দ্রুত সরে এসে জলের পাত্রটা রিবিকার হাত থেকে ছোঁ মেরে ঠোঁটে তুলে নিয়ে ঢকঢক করে জল গেলে। তারপর সেটি মাটিতে ফেলে দিয়ে বলে–চলল, ওঠা যাক। তুমি দেবদাসী, তোমার পক্ষে বোঝা কতটা সম্ভব আমি জানি না। ঈশ্বর যবহ বা ধরা যাক আকাশের দেবতারা মানুষের মধ্যে। ভাষাভেদ ঘটিয়েছেন। কারণ মানুষ জিগুরাত তৈরি করে। জিগুরাত বা স্বর্গ যাই বল, মানুষের হাতে গড়া। তাই না? তা আকাশের ঈশ্বর মনে করলেন, স্বর্গের সিঁড়ি বানিয়ে তুলে মানুষ তেনাদের আক্রমণ করতে চাইছে, কী স্পর্ধা! ব্যস হয়ে গেল! অমনি তেনারা জিগুরাত ধ্বংস করেই ক্ষান্ত হলেন না, মানুষকে আলাদা করে দিলেন। কীভাবে? না, ভাষা আলাদা হল। এক এক গোষ্ঠীর এক এক ভাষা। গল্পটার ছিরি আছে বলতে হবে! সরদার ইহুদ নিশ্চয়ই তোমাকে এই গল্পটা হাজারবার বলেছেন!

–হ্যাঁ! সলজ্জ মুখ তুলে মাথা নাড়ল রিবিকা।

সঙ্গে সঙ্গে সজোরে উচ্চস্বরে হো-হো করে হেসে উঠল সাদইদ। পাগল ছাড়া এভাবে হাসে না। মনে হল, এই হাসি যেন আকাশের দেবতাদেরই বিদ্রূপ করছে।

ইসিতে তার স্বর ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল, হাসি না থামিয়েই সে কথা বলে যেতে লাগল আর কোন সোল্লাসে ঘোড়ার পিঠ চাপড়ে উঠতে থাকল, বলল–তুমি মিশরী মেয়ে, তুমি বুঝবে! রাজা ফেরাউন তো নিজেই তিনভাগ দেবতা, একভাগ, মাত্র মানুষ। দেবতা আর মানুষে এই ভাগাভাগিটা হাস্যকর। হয় তুমি পুরোপুরি দেবতা হও, নতুবা পুরোটাই মানুষ হও। এমনকি তুমি। লাঠিধারীদের মত জাদুকরও হবে না। দেবতাদের স্বভাব সব সময় কুপিত থাকে। তারা যদি সত্যিই কোথাও থাকে, তবে তাদের বোঝা উচিত, মানুষ প্রচণ্ড ক্ষমতাধর। মৃত্যুর পরও মানুষের একটা ছায়া থেকে যায়। যাক গে! আমার কথা তুমি বুঝবে না।

রিবিকা বলল–মানুষ ভাষা তৈরি করতে পারে একথা বিশ্বাস করা কঠিন সারগন! ভাষা ঈশ্বরের দান। মুখের ভিতর জিভ নেড়ে নেড়ে মানুষ শব্দ করতে পারে মাত্র, ভাষা তো অন্য জিনিস। ঈশ্বর না চাইলে মানুষ নতুন কোন ভাষা সৃষ্টি করতেই পারে না। তুমি ধ্বংস হবে সারগন! ঈশ্বরই ভাষাভেদ ঘটিয়েছেন। তুমি সৈনিকদের জন্য ভাষা তৈরি করলে কেন?

সাদইদ ম্লান হেসে বলল–জুমা পাহাড়ের ওদিকে আমরা এখন চলে যাব রিবিকা। পাহাড়ের নাম জুমা অথবা জুম । আমার ভাষার নাম জুমপাহাড়ী অরমিক ভাষা। এই ভাষা তোমাকেও শিখতে হবে। দেবদাসীরা, ওখানে গিয়ে দেখবে–জুমপাহাড়ীতে কথা বলছে। একটা অত্যন্ত নির্দোষ সহজ মিষ্টি ভাষা। ভয় নেই। আমি কোন দেবতাকে অপমান করার জন্য এই ভাষা তৈরি করিনি। বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলে একটা মিশ্রভাষা গড়ে না নিয়ে উপায় ছিল না। চলো, যাওয়া যাক।

উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে রিবিকা বলল–কোন অহংকার দেবতারা সহ্য করেন সারগন। নইলে সাত বছর মিশরে বৃষ্টিপাত নেই, জলোচ্ছ্বাস নেই–এমন কেন হবে! যারা ঘরে ঘরে নিস্তার-চিহ্ন, গুণচিহ্ন আঁকল, তারাই পুড়েছে। মহাত্মা ইহুদ, কোথায় রয়েছেন কেউ জানে না। আমি এই অরণ্যে বসে তাঁর জন্য অপেক্ষা করব। তোমার তৈরি ভাষায় কথা বলার আগে আমার যেন মৃত্যু হয়। হায় দেবী! মাগো!

বলতে বলতে দু’হাতে চোখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ল রিবিকা। সাদইদ পরম আশ্চর্য হল। কোন সৈনিক অথবা দেবদাসী কখনও এমন করেনি। সাদইদের কৃত্রিম ভাষায় কথা বলাতে তাদের কোনওই আপত্তি নেই। বিভিন্ন স্থান থেকে তারা এসেছে। তাদের নিজেদের গোষ্ঠীভাষা ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু সংযোগের ভাষা জুমপাহাড়ী। তারা বাধ্য এই কৃত্রিম মনুষ্য-উদ্ভাবিত ভাষায় কথা বলতে। কেন না সেখানে এমনও দু একজন রয়েছে, যারা ভাষাগত কারণেই একা হয়ে পড়ে। একটা লোক শুধু তার নিজের ভাষাটিই জানে, সে কী করবে!

ভাষার সমস্যা বিকট। একজন শ্বেতাঙ্গিনী মিশরী দেবদাসীর কাছে কনানী সেনা ভাষার কারণে প্রত্যাখ্যাত হয়ে গোলমাল বাধায়। আমারনার মেয়ে উর নগরীর প্রায় লুপ্ত ভাষা যখন একজন বলে, বুঝতে পারে না। ঈশ্বরের ভাষা না কি লুপ্ত হয় না। কিন্তু দামাস্কাসের কোন এক মরুজাতির এমন এক ভাষায় লোটা নামে একজন দুর্ধর্ষ সৈনিক আপন মনে কথা বলে যে, সাদইদ স্বয়ং হতবাক হয়ে শোনে বুঝতে পারে না। লোটার ভাষা জুমাপ্রদেশে সবচেয়ে নিঃসঙ্গ ভাষা। লোটা যদি কালই মরে যায়,জুমার চারপাশে সেই ভাষাটিও আর শোনা যাবে না। মরুভূমির জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রিতে চাঁদের দিকে চেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে দুবোধ্য ভাষায় সম্ভবত সে তার ভাগ্যকে অভিসম্পাত দেয়কী করুণ আর আদ্রব্যাকুল তার ভাষা! ভাষা দুর্বোধ্য, দুর্বোধ্যই নয়, অবোধ্য বলাই সঠিক, সে কাঁদে। মনে হয়, মানুষ নয়, অবলুপ্ত হওয়ার ভয়ে ভাষাটাই যেন কাঁদছে!

ভাষা দিয়ে ঈশ্বর মানুষকে বিচ্ছিন্ন করলেন। নোটাকে দেখলে মর্মান্তিক ঘটনাটির সেই যে একমাত্র বিষণ্ণ সাক্ষী, সেকথা গুরুতর আঘাত হয়ে হৃদয়ে বাজতে থাকে। লোটার ভাষাই শুধু আলাদা এবং একলা নয়। তার পূজাবিধিও আলাদা। জুমাতে একমাত্র উট-উপাসক সে। ভাষা এবং পূজা যদি এত স্বতন্ত্র হয়–তার ভাগ্যে অপার ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই বতায় না। অমিতসাহসী, বীর্যশালী এমন সৈনিক হয় না। সে মরে গেলে সাদইদের অপূরণীয় ক্ষতি হবে।

সাদইদ সকরুণ চোখে রিবিকার দিকে চাইল। তারপর একটা ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলল। লোটাকে সবাই খাটো চোখে দেখে। কবে সেই বাবিলের জিগুরাত, দর্পিত স্বর্গ মাটিতে ভেঙে পড়ল, কোন সেই অতীতের কথা। কিন্তু ভাষার ভিতর রইল তার শাপলাগা স্মৃতি। ঈশ্বর যেখানে একবার নাক গলাবেন, যুগ যুগ ধরে তারই প্রহার চলতে থাকবে।

দেবদাসী নিশিমা খুব দাম্ভিক মেয়ে। দরজার বাইরে লোটাকে ঠেলে ফেলে দিলে, শালা উটমুখো, বেদে! ভাষার মা বাপ নেই। আমার ইয়ে-ধোয়া জল খাস রে সালেহর বাচ্চা! ওরে গামছাবালা সারগনের ছাঁ–লিয়ে যা, মড়াটাকে পিরামিডের খাঁচায় শুইয়ে দে আয়। ওরে গামছাবালা! ভাতারের শালীর পো, আয় দুদু খা আর গা মোছা আমার! পিদিম জ্বেলে দ্যাখ মড়াটা দুয়োর আগলে ভনভন করে যাচ্ছে রে! কী ভাষার ছিরি! উটের খুরো, উটন্যাজা! শালা আমায় চাট মেরেছে রে! ফেলে দে বালির উপর।

এই তীব্র অপমান কোন সৈনিকই হজম করতে পারে না! তার মজ্জা থেতলে গেছে যেন। শরীরে ভাষার বিষ ঢুকে গেছে। সে পলাতক সেনা। ঘর হারানো, শ্রীপুত্রকন্যাহারা এক দলিত ক্ৰী দাস। আরাবা মরুর কোন্ দিগন্তে তার ভাষাগোষ্ঠী হারিয়ে গেছে। সে এ। এবং এ কারণে এত গোঁড়া যে, সে তার ভাষা এবং উট-উপাসনা কোনটি ছাড়তে রাজি নয়। সে সেই রাতে গামছাবালাদের দ্বারা প্রহৃত হয়ে সাইদের কাছে ছুটে এল। ইচ্ছে করলে সমস্ত মন্দির সে একাই রক্তাক্ত করে পিষে দিতে পারত। কিন্তু তাতে সমস্যা মিটত না। কামনাতাড়িত, নারীসঙ্গহারা, অপমানিত লোটা সাদইদের সামনে গুহার ভিতর নিজেকে একটি পাথরের উপর আছড়ে ফেলল।

নিকষ পাষাণের মত বলিষ্ঠ অন্ধকারসদৃশ ঘর্মাক্ত পিঠে আলো পড়েছে। এই ক্ষুদ্র পাহাড়টির অধীশ্বর সাদইদ। চর্বির মশালের আলো পাহাড়ের অভ্যন্তর উদ্ভাসিত করেছে আলো-ছায়ায়। পাহাড়টির একটি অংশ মন্দিরের মত করে কেটে কেটে বানানো হয়েছে সাদইদের গৃহ। পাহাড়ের চুড়োটা দূর থেকে দেখতে পিরামিডের মত স্পর্ধিত। পাহাড়কে ঘিরে তাঁবুর সংসার এবং কিছু কিছু ইটপাথরে তৈরি দেবদাসী মন্দির আর আছে দ্রাক্ষাকৃঞ্জ। এ অঞ্চল নগরও নয়, গ্রামও নয়।

তাঁবুতে পুরুষরা থাকে। মন্দিরে থাকে দেবদাসী। সৈনিকদের জন্য এ ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা জরুরি নয়। রাজা হিতেন আসলে সৈন্যাবাস এবং দুর্গ। স্থাপনের জন্য সাদইদকে ওই পাহাড় এবং দ্রাক্ষাকুঞ্জ দান করেছেন। যে-কোন সময় কেড়ে নিতে পারেন। পলাতক সৈন্যরা তাঁবুর তলায় থাকে, মন্দিরে রাত্রিবাস করে। বস্তুত এদের কোন সংসার নেই। সাদইদ এদের জন্য কখনও কোন গ্রাম বা নগর নির্মাণ করতে পারবে না। এদের দিতে পারবে না সংসার করার সুখ। যদি কখনও নিনিভে নগরী ধ্বংস হয়, তখনই যুদ্ধ থামবে। সাদইদ মনে মনে অদ্ভুত একটি স্বপ্ন দেখে। সে এই সৈনিকদের আর দেবদাসীদের সঙ্গে করে কনান প্রদেশে একদিন ঢুকে যাবে।

তার প্রবর্তিত জুমপাহাড়ী ভাষা যুদ্ধকালীন ভাষা, ভয় হয় যুদ্ধ থামলে এই ভাষাটিরও মৃত্যু হবে। কিন্তু কানে ঢুকে যেতে পারলে ভাষাটি মরবে না। সৈনিদের মুখে এই ভাষা বাঁচবে, সৈনিকরা সংসার পেলে এবং দেবদাসীদের কৃষিক্ষেত্রে নিয়োগ করতে পারলে জুমপাহাড়ী মানুষের ঐক্যের ভাষা হিসেবে টিকে যাবে। দেবদাসীর সন্তানরা সংখ্যায় কম নয়।

আলো এসে পড়ল পিঠের উপর। পাথরের উপর মুখ রেখে কুঁজো হয়ে পড়ে থাকা লোটা ফুঁপিয়ে উঠল। তার শরীর অপমানে থরথর করে কাঁপতে থাকল গমকে গমকে। এই বিচ্ছিন্ন মানুষটিকে যে কোথায় রাখবে সাদইদ,ভেবে পেল না। ধর্মে একা, ভাষায় একক। এই বিচ্ছিন্নতা কেন? লোটার কী ভবিষ্যৎ? মানুষের হৃদয়ে এর কোন আশ্রয় নেই কেন?

নোটার পিঠের ঘর্মাক্ত-পিছল আলো চকচক করছে। লোটা বলছে–আমার। কে আছে? বউ নেই, সন্তান নেই।

অস্পষ্টভাবে লোটার আর্তচাপা গোঙানির ভাষা বোঝার চেষ্টা করে সাদইদ। তার কেবলই মনে হয়, লোটা বলছে, কে আছে তার–তার বউ, তার সন্তান?

যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার কি কোন আক্রোশ পুঞ্জীভূত হয়েছে হৃদয়ে? হঠাৎ সাদইদের মনে হল, লোটা যেন বলছে–যুদ্ধই যখন জীবন, তবে যুদ্ধই আমার। নিয়তি, তিনি আমায় গ্রহণ করুন! কতকাল আমি নারী-সঙ্গ করিনি। মানুষ কি এভাবে বাঁচতে পারে? দেবদাসীর এত দাম বাড়িয়ে দিয়েছে এই যুদ্ধ? আর আমি, আমার ধর্ম এবং ভাষাকে দেবদাসীর পায়ে উৎসর্গ করব? আমি ভুলে যাব আমার সর্বস্ব? আমি আমার স্ত্রীপুত্রের সঙ্গে যে ভাষায় কথা বলেছি, যে ধর্ম পালন করেছি, সব ত্যাগ করব একটি গণিকার কাছে? এমন পতিত অবস্থা কেন হল আমার?

সাদইদের কাছে লোটা এক সুতীব্র সমস্যা। লোটা তার কোন কিছুই ছাড়তে চায় না। জুমপাহাড়ী ভাষা সে মুখে উচ্চারণ করবে না। বোধহয় এই ভাষার অক্ষরগুলি নিয়ে তার আপত্তি আছে। কারণ অক্ষরগুলি ফিনিশীয় বর্ণমালা ছাড়া কিছু নয়, দু’একটি এদিক-ওদিকের মিশেল রয়েছে মাত্র। কিছু ইস্তারী চিহ্ন আর নকশা আছে, আছে মিশরীয় দু’একটি অপভ্রংশ। সব মিলিয়ে এ তার কাছে উৎকট মনে হয়েছে হয়ত। সে মনে করে তার নিজের ভাষা নিদোষ আর পবিত্র। দেবভাষা তার। সে কেন সেই ভাষা ত্যাগ করবে?

অতএব সীমাহারা নিঃসঙ্গতাই তার সঙ্গী! সবচেয়ে বড় সমস্যা তার ধর্ম। সৈন্যশিবিরে দেবতা আমন বা সামাশই যথেষ্ট অথবা দেবী ইস্তার কিংবা বালদেব। কারো মনে উঁকি দেয় ঈশ্বর যবহ। তারা মেষের মূর্তি কাছে রাখে। কিন্তু তাদের কেউ তেমন ঘৃণা করে না। কেবল নোটার বেলা যত বিপত্তি। সে

উটের বিগ্রহ সামনে রেখে বসে থাকে।

লোটার ধর্ম পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়ে যাবে, এই ভয়ে লোটা তীব্র এক বিষাদে রক্তাক্ত হয়েছে। তার একাকিত্ব যেন পিরামিডের চূড়ার মত অলৌকিক। লোটার জন্য দেবদাসী রিবিকা কি সুলভ্য হতে পারে না? নাকি এই নারীকে রাজা হিতেনের হারেমে উৎসর্গ করবে সাদই? হিতেনের হারেম সুন্দরীদের এক বিপুল সমাবেশ মাত্র। সেখানকার প্রহরীরা খোঁজা সম্প্রদায়। শোনা যায়, সেই হারেম সমকামী নারীতে পরিপূর্ণ। সমকামী নারীদের রতিমোচনের প্রদর্শনী রাজা হিতেনের প্রসিদ্ধ বিলাস। রাজা হিতেন কাম ও রতির দেবতা হবার বাসনা করেন। তিনি নাকি আপন শরীরে রতি আর কামকে একত্র ধারণ করার কথা ভাবেন।

একদিকে লোটা, অন্যদিকে হিতেনকার জন্য রিবিকাকে সাদইদ নির্বাচন করবে?

বেদনাপূর্ণ দৃষ্টিতে সাদইদ রিবিকাকে দেখতে থাকে। সাদইদের এই দৃষ্টিপাত, চোখের ভাষাবিভঙ্গ, চাহনির কারুণ্য কোন প্রকারেই উপলব্ধি করতে পারে না রিবিকা।

সাদইদ সহসা রিবিকাকে অশ্বপৃষ্ঠে তুলে নিয়ে কেমন এক ক্ষিপ্ত আক্রোশে দুবার বেগে মরুভূমির বুকে অশ্ব ছুটিয়ে দেয়। হতচকিত বিহ্বল হয়ে পড়ে রিবিকা। সাদইদ আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে থাকে–একটি প্রজাপতি জীবনের পক্ষে যথেষ্ট নয়। কিছুতেই নয়। মহাপিতা নোহ, তুমি আমাকে এভাবে বিভ্রান্ত করছ কেন? আমি কোন বীজ অথবা কোন জীবকাররা সুরক্ষা জানি না। আমি ত্রাতা নই। জীবনের অর্থ এই মরুভূমির বুকে আমি হারিয়ে ফেলেছি। এখানে যুদ্ধ আর নারীর তৃষ্ণা ছাড়া আর কিছু নেই। সুন্দরী নিনিভে, তার আলো, রক্তে তোলপাড় করে। কেন এভাবে ছুটছি আমি? কোথায় চলেছি? আমার ফুলের আর আতরের বাজার। অথচ পশম সংগ্রহের সামর্থ্য নেই। কেন আমি স্বপ্ন দেখি তবে? কেন দেখি? মেয়েটি আমাকে সারগন বলেছে, অথচ আমি তো সামান্য ভাড়াটে সৈনিক। মরুভূমির লুটের রসদ জোগাড় করা আমার কাজ। আমার দৃষ্টি কেন তুচ্ছ রঙিন দু’টি পতঙ্গের উপর নিবদ্ধ হয়? কী আছে হৃদয়ের ভিতর? পিরামিডের চেয়ে, বাবিলের জিগুরাতের চেয়ে হৃদয় কি বিস্ময়কর?

তার দিয়ে ঘেরা এবং ইট দিয়ে কোমর পর্যন্ত খাড়া করা প্রাচীরের আড়ালে শবির। তারগুলি তেমন মিহি নয়, ধাতু ঘষে ঘষে সরু করা। অসুররা অনেক সময় শিবির আক্রমণ করে তাবৎ সৈন্যবাহিনী মুহূর্তে নিঃশেষ করে দেয়। বশেষত ভাড়াটে সৈনিকদের উপর অসুরদের ক্রোধ সীমাহীন। তাই গাছপালা ঘেরা, ইটের প্রাচীর এবং প্রাচীরের উপর ধাতুর মোটা তারের বেড়া, বস্তুত শিক দিয়ে বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে বানানো বেড়া–সহসা আক্রান্ত হলে সৈন্যরা পালিয়ে যাওয়ার কিছুটা সময় পায়। হৃদয়ের কথা ভাবতে ভাবতে শিবিরের দিকে মুহূর্তে চোখ চলে যায় সাইদের। অশ্ব তীব্র বেগে ছুটে যাচ্ছিল, হঠাৎ শিবিরে ঢুকে পড়ল।

গাছপালার ভিতর কতকগুলি তাঁবুর ছাউনি ছাড়া অন্য কোন গৃহ নেই। অশ নিয়ে প্রাচীরের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। অত্যন্ত ছোট একটি শিঙা, যা তার গলায় ঝোলে, সেটি ফুকে উঠল সে। সেই শব্দে একটি তাঁবু থেকে প্রথমে একজন, পরে অন্যান্য তাঁবু থেকে দু’একজন বেরিয়ে এসে দাঁড়াল। শিঙার সুরের ভিতর কোন ব্যস্ততার সুর ছিল না, খুব শান্ত স্বরে ডাকা–তাই তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে আসা সৈনিকদের চোখে-মুখে তেমন কোন উদ্বেগের চিহ্নই দেখা যায় না।

সাদইদ রিবিকার সমস্ত মুখমণ্ডল এবং শরীর কাপড়খানির দ্বারা ঘোমটার মত করে তুলে ঢেকে দিয়ে বলল–তুমি চুপ করে থেকো, কথা বলবে না।

রিবিকা বুঝল, সাদইদ তাকে গোপন করতে চাইছে। তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেবার পর কী মনে করে সাদইদ পথ থেকে এদিকেই ফের ছুটে এল । একটি তাঁবুর থেকে একজন মাত্র সৈনিকই তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। জুম পাহাড়ের দিকে অশ্ব ধেয়ে যেতে গিয়ে ফিরে এসেছে সাদইদ। এখানে রয়েছে আটাশজন নব্য সৈনিক–এরা পালিয়ে এসেছে বিভিন্ন নগরী থেকে, দু’একজন জুটেছে মরুপথ থেকে। প্রত্যেকেই ছিল পদাতিক। এদের অশ্ব চালনার কোনওই অভিজ্ঞতা নেই।

সৈনিকটি কাছে এগিয়ে আসতেই সাদইদ বলল–একজনকে পথের উপর পাওয়া গেছে সমের মিঞা, তুমি সকলকে বলে দাও। আমি আহত এই বেচারিকে নিয়ে পাহাড়ে চলে যাচ্ছি। এর চিকিৎসা দরকার। আমার ফিরতে কোন কারণে দেরি হলে লোটাকে পাঠিয়ে দেব। আর শোন, রাজা হিতেনের সঙ্গে দেখা করা জরুরি, আমি চলে যেতে পারি। অযথা কেউ যেন মরুযাত্রীদের আক্রমণ না করে। অসুররা মরুযাত্রীর বেশ ধরে যাচ্ছে, আসলে প্রত্যেকটা কাফেলাই এখন সন্দেহজনক–তারা মরুযাত্রী না-ও হতে পারে। সৈনিক হতে পারে। না বুঝে আক্রমণ করতে গিয়ে, ফল উল্টো হতে পারে। তোমরা নতুন, শিবির ধ্বংস করে চলে যাবে অসুররা। সাবধানে থাকবে।

সৈনিকটা মাথা নেড়ে সাদইদের কথায় সায় দিয়ে ফিরে যাচ্ছিল, সহসা সাদইদ বলে উঠল–মনে রেখো সমেরু, একজন সৈনিক আমার কাছে আমার এই সাদা ঘোড়াটার মতই দামী। অযথা কোন প্রাণের বাজে খরচ পিতা নোহ পছন্দ করেন না। রাজা হিতেনের কাছে একশ’টি সুন্দরী দেবদাসীর মূল্য যরকম, আমার কাছে ক্ষুদ্র একজন সৈন্য তারও চেয়ে শতগুণ মূল্যবান। আমি তোমাদের শপথ করে বলতে পারি, কখনও যদি একটি গ্রামও আমি অধিকার রুরি, তোমাদের মত সৈনিকদের আমি সেখানে সংসার গড়বার ব্যবস্থা করব।

সাদইদের কথায় পিছনে ফিরে দাঁড়িয়েছিল সমেরু। স্মিত হেসে বলল–প্রাণে বাঁচলে তবে তো সংসার! একখানা তাঁবু, দু’মুঠো খাদ্য আর আমার মা। আমি আর কিছুই চাই না মহামতি। একটা নদীর ধারে ছোট একখানা তাঁবু ফেলবার অধিকার আর মাকে ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখি। আপনি আমার জন্য তাই করুন। আমি কোন দেবদাসীর মন্দিরে যেতে চাই নে। মহাত্মা উঁহুদের ধর্মই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তিনি মানুষের পাপ আর পুণ্যের সীমানা নর্ধারণ করতে পারেন। আমার মনে হচ্ছে, জুম পাহাড়ের ওদিকে তাঁকে কোথাও আমি দেখেছি। আমার বাঁচালতা ক্ষমা করবেন, আমি ছেলেমানুষ, মামার বিয়ে হয়নি, মা-ই আমার চোখে একমাত্র সবচেয়ে সার্থক নারী, আমি সেই মাকে হারিয়েছি, আমার আর চাইবার কিছু নেই।

কথা শেষ করেই সমেরু দ্রুত পায়ে তাঁবুর দিকে ছুটে গেল।

সমেরু নামে এই কিশোরটির মুখমণ্ডল অত্যন্ত নরম। হাত-পা সুন্দরী দেবদাসীদের মত অতিমাত্রায় কোমল। গোঁফের রেখা অবধি ঠিকমতন ওঠেনি। চোখ দুটি এত মায়াবী যে,মরূদ্যানের স্বচ্ছ জল যেন ভরে আছে বলে মনে হয়, শান্ত সেই চোখে স্থির তার হৃদয়, যেন ছায়ায় মোড়ানো একটি হ্রদ। সে তার মা ছাড়া অন্য কোন নারীর কথা চিন্তা করতে চায় না।

যুদ্ধেরও একটি অলিখিত, লিপিহীন পঞ্জিকা প্রণয়ন করতে হয়েছে নাইদকে–কিন্তু সেই পঞ্জিকার পৃষ্ঠায় আজ একটি অভূতপূর্ব তথ্য সন্নিবেশিত হল। মা-ই একমাত্র নারী। সমেরু জোরের সঙ্গে বলল, মহাত্মা ইহুদের ধর্মই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম। তিনি পাপ আর পুণ্যের সীমানা নির্ধারণ করেন। কথাটা শুনেই মনে হল, ছেলেটি এই বাক্যটি মুখস্থ করেছে। নারী সম্পর্কে তার বক্তব্যও অজি। মা ছাড়া আর যেন কোন নারীই হয় না। সে তার মাকে নিয়ে নদীর ধারের তাঁবুতে বাস করতে চায়। সে দেবদাসীর মন্দিরকে ভয় পায় বলে মনে চল। ভাবতে ভাবতে সাদইদের এক তীব্র কৌতূহল হতে থাকল।

অশটি মন্থর বেগে অগ্রসর হচ্ছিল। মাথার কাপড় নামিয়ে ফেলে রিবিকা বলল–আমি পারলাম না! হায় দেবী!

–কী পারলে না রিবিকা!

–ওই ছেলেটাকে মুখের পর্দা সরিয়ে কেন দেখলাম না! ও নিশ্চয়ই মহাত্মা ইহুদকে দেখেছে! আমি প্রশ্ন করতে পারতাম! তাছাড়া ওর মুখটা আমার চিনে রাখা উচিত ছিল। যে কিশোর মা ছাড়া কিছু জানে না, তাকে কেন আপনি নষ্ট করছেন সারগন! দোহাই! আপনি ওকে রক্ষা করুন!

রিবিকা আর্তস্বরে ককিয়ে উঠল। সাদইদ লক্ষ্য করছিল, প্রথমাবধি এই মেয়েটি তাকে ‘আপনি-তুমি’ করছে, যখন যা মুখে আসছে। কখনও তাকে ভাবছে সামান্য সৈনিক, কখনও ভাবছে মহামতি সারগন। মাথারও কিছু ‘বেগড়বাঁই’ আছে সন্দেহ নেই। সহসা একটা কিসের ঝোঁকে বেমক্কা সাদইদ ঈষৎ আক্রমণাত্মক ঢঙে পেশ করল–সমেরুকে তোমার পছন্দ হয়? ওকে তুমি চাও বুঝি? চোখে দেখলে তোমার শরীরে তেষ্টা পেত নিশ্চয়ই। ঠিক আছে, একদিন দেখা হবে অবশ্য।

–না! না! ভয়ে কেমন আর্ত চাপাস্বর ফুটে ওঠে রিবিকার গলায়।

–না কেন! ও-ও তো সৈন্যমাত্র। কেবল তুমি তোমার মন্দিরটা পরিচ্ছন্ন রাখবে। দ্যাখো, ও হল জোয়ান ছেলে, দেহে প্রচণ্ড জোর–ওকে সমস্ত বুদ্ধি দিয়ে আমি তৈরি করব । ও যেভাবে মা মা করছে, সেটা পাগলামি! ওকে যদি আমি একটি মাত্র রূপের কথা বলি–যেমন ধরো, নারীর বুকের চন্দ্রোদয় সে দেখেনি, সেটা যদি বলি–কেমন হতে পারে! ভেবে দ্যাখো, দুটি প্রজাপতি তোমাকে অধিকার করেছিল! কেন করেছিল! পতঙ্গ নির্বোধ বটে, কিন্তু ফুল ছাড়া সে বসে না । পতঙ্গ মানে এই দুটি প্রজাপতির কথা আমি বলছি। তারা ফুল ছাড়া বসে না। অথচ তারা তোমায় অধিকার করেছিল। মা সুন্দর। কিন্তু এই দৃশ্যটা নিশ্চয়ই তার জানা নেই। বলা দরকার, জীবনে আরো কিছু আছে, জানতে হলে তোমার মত দেবদাসীর কাছেই যেতে হয়।

অশ্ব কিছুটা গতি বাড়িয়েছে। টিপে টিপে ঠোঁটের তলায় একটি একটি শব্দ উচ্চারণ করে চলেছিল সাদইদ। কথা না কি মন্ত্র বোঝা যায় না। লোকটা কবি সন্দেহ নেই। তবে ভয়ানক যোদ্ধা এবং গভীর চিন্তানায়কও বটে। তার অভিসন্ধিরও সীমা নেই।

সহসা সাদইদ বলে ফেলল–তোমার রূপের আড়ালে খুব উত্তেজক সুরা আছে আমনের বউ। সেটা ছেলেটাকে ধরাতে হবে। নইলে ছেলেটা ফের কোথাও ভেগে যেতে পারে।

শুনতে শুনতে সভয়ে শিউরে উঠল রিবিকা। সমেরু এক অদ্ভুত কিশোর নিশ্চয়। কণ্ঠস্বর পাখির মতন সুরেলা। তাকে সে দেখেনি। সারগন তাকে ঢেকে রেখেছিল। অবশ্যই তাকে নিয়ে এই অশ্বারোহী সৈনিকটির নানান মতলব মাথায় আসছে । পতঙ্গ-অধিকৃত নারী যদি সমেরুকে নষ্ট করবার জন্য ব্যবহৃত হয়–তবে এই সৈনিকটির কবিত্ব সর্বনাশা। এই লোকটি নিশ্চয়ই তার কবিত্বকে যুদ্ধের কাজে ব্যবহার করে–একে বিশ্বাস করা পাপ। ভাবতে ভাবতে দম পায় না রিবিকা।

রিবিকা এইরূপ ভাবছিল বটে, কিন্তু যুদ্ধের কতকগুলি নিজস্ব নীতি আছে। মানুষের জমি দখলের দাঙ্গাগুলি একরোখা ঘটনা, সেখানে কোন উচ্চাশা থাকে না। এ অবধি মানুষের মনে পাপ জন্মায় না। বাঁচার জন্য মানুষ হয় হানাদার। কিন্তু যুদ্ধ অন্য জিনিস। মানুষ যখন থেকে নগর গড়তে শিখল, তখন থেকে। হানাহানি মাত্রই যুদ্ধ নয় বোঝা গেল। গ্রাম এবং অন্য নগরীগুলিকে শুষে শুষে এনে একটি উপত্যকাকে সাজিয়ে ভোলা, যেন একটি শোভিত স্বপ্ন, তার খিলান, গম্বুজ, সিঁড়ি ও প্রাচীর-দম্ভ আর ঔদ্ধত্যের ভাস্কর্য, তিনতলা সাঁজোয়া গাড়িটি মানুষের শস্ত্র আর ক্রীতদাসে পূর্ণ হয়ে মরুপথ যখন অতিক্রম করে তখনই বোঝা যায় যুদ্ধ হল মানুষের সর্বাত্মক বিভীষিকা।

সামান্য একজন দেবদাসী নীল নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে কতদিন একথা ভেবেছে। আজ সে জীবনের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতার ভিতর প্রবেশ করছিল। জীবনে সে কখনও বা চকিতে অনুভব করার চেষ্টা করেছে যে নারীর বক্ষাকাশে এক নিবিড় চন্দ্রোদয় হয়, আবীরুদ তার কবিতায় একদা একথা বলেছিল, সে কথায় রোমাঞ্চ ছিল–কিন্তু প্রজাপতি যখন তাকে অধিকার করল, পৃথিবীর সকল মসীহ এবং আকাশের দেবতাদের সমূহ প্রার্থনা যেন তখন তারই জন্য। কেন্দ্রীভূত হয়েছে, এ বিস্ময় শেষ হতে না হতেই সাদইদ তাকে বলেছে, তার রূপের আড়ালে রয়েছে মদ। এ সৌন্দর্য যুদ্ধেরই উদ্দীপনা মাত্র। বহুদর্শী এ জীবন তার। অভিজ্ঞতাও নানা-বিভঙ্গিত। আক্কাদের হাতের আঙুল ছিল মোটা, মেটে সাপের মত। সাদইদের আঙুল পুষ্পকলিকার ন্যায়, কিন্তু সে আঙুল নখরে। শাণিত একথা বিস্মৃত হলে চলে না।

সাদইদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল–একজন এহেন কিশোরকে সৈন্যরা উত্ত্যক্ত করে। কী বলব তোমায় রিবিকা। মেয়েছেলে সস্তা হলেও, যুদ্ধের নিয়ম হল, সৈনিকের কাছে তাদের একটু আক্ৰা করে রাখতে হয়। যত দেবদাসী দরকার আমার মন্দিরে,ততটা সরবরাহ নেই। হিতেন বলেন, একটু কম করেই রাখো। ফলে হয়েছে কি, একটা মন্দিরেই দশজন সৈনিকের লাইন পড়ে যায়। ফের প্রধান সৈন্যদের আলাদা ব্যবস্থা-জনপ্রতি একজন দেবদাসী দিতে হয়। ভেবে দ্যাখো, কী অবস্থা! একখানা মন্দির, একজন দেবদাসী আর একজনই সেনাপতি। সমস্ত ব্যাপারেই অভাব তৈরি হয়। মেয়েছেলে সস্তা কিন্তু দেবদাসী আক্রা–এই কৃত্রিম অভাব বজায় না থাকলে যুদ্ধ থেমে যাবে। এর একটা কুফল হচ্ছে, সমেরুর মত কিশোরদের সৈন্যরা খোবলাবে। পুরুষ যখন পুরুষকে প্রেম নিবেদন করছে, জানবে সেটা সমকামী শিবির।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অশ্বের গতিবেগ আরো কিঞ্চিৎ বাড়িয়ে দিয়ে সাদইদ বলল–আমি সৈন্যদের শেখাই। না–কোন ধর্মপুরাণ পাঠ করতে শেখাই না। শেখাই শস্ত্র ক্ষেপণ করা। অশ্ব চালনা। অর্থের পিঠে চড়ে ছুটতে ছুটতে বশ ছুঁড়ে লক্ষ্য ভেদ করা। লক্ষ্য করেছি, সমেক দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকলে কোন কোন সেনা লক্ষ্যভেদ করতে ব্যর্থ হয়। আমি আজ তিনদিন এই সবই করেছি। তোমাকে এসব কথা শোনাতে আমার ভালই লাগছে–কেননা তুমি মিশরী দেবদাসী।

.

আবার থামল সাদইদ। তারপর বলল–সমেরু সামনে থাকলে নষ্টমজ্জার সেপাই দৃষ্টি-বিভ্রান্ত হয়ে কাত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যায়। তখন অন্যরা হো হো করে হাসে। এটাও এক ধরনের উদ্দীপনা এবং শিক্ষাও বটে। সমেরু সামনে থাকলেও লক্ষ্যভেদ করতে হবে–যাতে চাঁদমারী বিদ্ধ হয়। ভয় হচ্ছে সমেরুকে না সৈন্যরা নিজেদের ভিতর লুফালুফি করে মেরে ফেলে!

ফের অশ্বের গতি সামান্য পড়ে এল। এমনকি হঠাৎ থেমেই পড়ল সাদইদ। সমেরুর দুর্ভাগ্যের কথা রিবিকা বিমূঢ় হয়ে শুনছিল। এই বিবরণ বিশ্বাস করতে তার বুক কেঁপে যাচ্ছিল। সমেরু তবে শিবির ছেড়ে পালাতে চাইবে না কেন? যুদ্ধের এই নির্লজ্জতা ক্ষমাহীন। একজন রূপবান নিদোষ কিশোর-রিবিকা তাকে কল্পনার চোখে দেখতে থাকে। সৈন্যরা তাকে কামনা করে পরস্পরের মধ্যে কামড়াকামড়ি বাধিয়েছে–এ দৃশ্য রিবিকার কল্পনায় আসতে চায় না। সমেরু সামনে আছে বলে সৈন্যের বর্শা লক্ষ্যবিন্দু বিদ্ধ করতে পারছে না। ছেলেটা তবে কী করে বাঁচবে! মনে হল, সমেরু তার চেয়েও হতভাগ্য, যে তার মা ছাড়া অন্য কারুকে জানে না। কোন কিশোরের মনের এমন সরল স্বপ্নকে নষ্ট করছে মানুষ, এই অশ্বচালক কবি হয়েও কী করে সইছে এইসব! এ বান্দার পতন অনিবার্য! মনে পড়ল ইহুদ কতদিন সদোম আর ঘোমরা শহর দুটির ধ্বংসের কথা বলেছেন! লোট, লোটের বউ, জিব্রিল আর আব্রাহামের কাহিনী।

উক্ত নগর দু’টি সমকামিতায় ভরে গিয়েছিল। যবহ জিব্রিলকে নগর দু’টিকে ধ্বংস করার জন্য পাঠালেন। পিতা আব্রাহামের সঙ্গে সীনয় পাহাড়ে তাঁর বন্ধু ঈশ্বর যবহের কথা হত। যবহ বললেন,–ওহে আব্রাহাম, শোন আমার বাতাবাহক (পয়গম্বর)! আমার গায়েবী আওয়াজ শোন! অদৃশ্য বার্তা শোন! আমি নগর দুটি ধ্বংস করব! ওখানে আর কোন ভাল মানুষ অবশিষ্ট নেই।

আব্রাহম বললেন–না বন্ধু যবহ! আমার ঈশ্বর! আপনি একবার অন্তত পরীক্ষা করে দেখুন, সেখানে অন্তত ৫০ জন ভাল মানুষ পাওয়া যাবে। লোট আমার বন্ধু–সে অত্যন্ত ভাল লোক। আরো ভাল লোক আছে। আমি বিশ্বাস করি না সমস্ত মানুষ খারাপ হয়ে গিয়েছে।

জিব্রিল একদিন অতঃপর আব্রাহামকে সঙ্গে করে লোটের বাড়ি আতিথ্য গ্রহণ করলেন। তখন নগরীর লোকেরা লোটের বাড়ি আক্রমণ করে। তারা জিব্রিল এবং আব্রাহামকে সমকামী সন্দেহ করে–ভাবে এরা দুজন অপূর্ব মানুষ! লোট নগরবাসীদের বোঝাতে পারে না এই দুজন সমকামী নয়–এরা আলাদা। জিব্রিল খেপে গিয়ে নগরের লোকেদের অন্ধ করে দেন। লোট পরিবারকে খিড়কি পথে নিষ্ক্রান্ত করেন জিব্রিল। আব্রাহাম অতঃপর লোট এবং লোটের বউকে সঙ্গে করে পাহাড়ের দিকে ছুটতে শুরু করেন।

জিব্রিল বলেন, তোমরা কেউ পিছনে ফিরে চাইবে না। শাপ লাগবে। পালাও। পালাও।

হঠাৎ তীব্র এক আওয়াজ হয় পিছনের দিকে। লোটের স্ত্রী ভুল করে পিছনে চেয়ে ফেলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নুনের অনড় মূর্তিতে পরিণত হন। সীনয় পাহাড়ের আগুন থেকে গন্ধক বৃষ্টি শুরু হয়। ঈশ্বর লোটের বউকে অবধি গ্রাস করেন। বউ পিছনে চেয়ে দেখে ভুল করেন–এত পাপগ্রস্ত নগরীর দিকে দৃকপাত করাও ভয়াবহ। ইহুদ বলেছেন, সমকামিতা কোন বিদ্যা নয়। কলাও নয়। পাপ। নগর নির্মাণ করা স্পর্ধা মাত্র।

রিবিকা ভাবল, ইহুদের প্রতিটি কথা সত্য। তিনি স্বয়ং সত্য। সমেরু তাকে দেখেছে।

–সমেরুর সঙ্গে আমার দেখা হবে বললে! ও নিশ্চয়ই মহাত্মার ঠিকানা জানে! জিজ্ঞাসা করে রিবিকা।

ঘোড়া থেমে পড়েছে। সামনের দিকে অদ্ভুত চোখে চেয়ে আছে সাদইদ। সদ্য হত্যাকাণ্ড হয়ে গেছে পথের উপর। একটি সুদীর্ঘ উদ্বাস্তু প্রবাহ উল্টো দিকে চলেছিল বলে মনে হচ্ছে। আসিরিয়ার দিক থেকে যাচ্ছিল সিদন টায়ার মাগিদ্য উপদ্বীপগুলির দিকে–সবই রাস্তায় খতম হয়ে গিয়েছে। এ প্রবাহ নতুনই শুরু হয়েছে। ক্রমশ নিনিভের পতন আসন্ন হয়ে উঠছে । নিনিভের উপর চারিদিকের আক্রমণ শুরু হয়েছে।

ঘোড়া থেকে নেমে পড়ে সাদইদ। ঘোড়াটি রিবিকাকে পিঠে করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এমন দৃশ্য অশ্বটির কত চেনা। দেবদাসীকে যেভাবে মানুষ চারিদিক থেকে খোবলায়, রূপসী নগরীকেও সেই ধারা ঠুকরে চলে। যারা খতম হল, তারা সবাই ভাস্কর আর মিস্ত্রী। দুঃখ হয় এরাই নিনিভের নির্মাতা। যারা গড়ে তুলেছিল, তাদেরই আজ কোন আশ্রয় নেই। ওদের অস্ত্র হল নানা ধরনের চিকণ কাজের হাতিয়ার। থলেয় মুখ আঁটা অবস্থায় তাদেরই মৃতদেহের পাশে পড়ে রয়েছে।

সবাই মৃত। বোঝা যায় অসুররা মারেনি। সাদইদের মতই কোন ভাড়াটে দল মেরে গিয়েছে। এরা বেঁচে থাকলে আরো কত নগর নির্মাণ করতে পারত। হঠাৎ মৃত্যুস্তূপের ভিতর একটি শিশুর কান্না উচ্চকিত হয়।

.

০৪.

দুপুরে মরুভূমির উত্তাপ বেড়েছে। প্রকাশ্য দিনের বিপুল ক্ষমাহীন আলোয় মৃতদেহগুলি পড়ে আছে। খুব ভোরের দিকেই হয়ত খুন হয়ে গিয়েছে। ভাড়াটে সৈনিকরাই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। মরুযাত্রীরা ছিল সকলেই পায়ে হাঁটা মানুষ, সম্পূর্ণ নিরস্তু। অসুররা হত্যা করলে খুঁটায় টাঙিয়ে দিত মৃতদেহ। মুণ্ডু ছিন্ন করত । ঘাতকরা যখন তা করেনি, বুকে কেবল বশ বিদ্ধ করেছে, বোঝা যায় এরা কারা। মৃতদের সঙ্গে কোন গৃহপালিত পশুদল ছিল না, শস্যও ছিল না তেমন। মিস্ত্রী আর পাথরকাটিয়ে শ্রমিক এবং কিছু ভাস্কর পরিবার নিনিভে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল প্রাণের ভয়ে। অত্যন্ত লোভী, ভয়ানক বোকা আর স্বার্থপর নির্দয় কোন সৈন্যদল এই-ধারা নিরীহ মানুষদের হত্যা করে ফেলে গেছে।

সামান্য দু’চার রত্তি কানের সোনা আর কাপড়ের পুঁটুলি বাঁধা যবের দু’চার কুনকে ছাতুর লোভেই মানুষ মানুষকে হত্যা করতে পারে–যুদ্ধ আর নগর-সভ্যতা মানুষের জন্য এমনই পরিণাম রচনা করেছে। মরবার আগে এরা ভয়ে চেঁচাতেও পারেনি। শিশুটি কিন্তু আশ্চর্যভাবে জীবিত। মৃতা মায়ের চন্দ্রোদিত নগ্ন বুকে মুখ ঠেকিয়ে স্তন্যপানের চেষ্টা করছে। হঠাৎ কেন যেন সাদইদের মনে হল, দুধের বদলে শিশুর মুখে রক্ত উঠে আসবে।

দ্রুত হাত বাড়ায় সাদইদ। শিশুটাকে বুকে তুলে নেয়। ভাড়াটে সৈনিক মানেই খুব দয়ালু এমন ভাববার তেমন যোগ্য কারণ নেই। বরং তারা খাদ্যাভাবে, বস্ত্রাভাবে এইভাবে দুস্যুবৃত্তি পোষণ করে। সাদইদ ভাবছিল, কোথাও মানুষ সম্পর্কে আশার আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এই শিশুটিকে নিয়ে এখন সে কী করবে? গলায় শিশুটির একটি ঝকঝকে রূপার লকেট ঝুলছে। মৃতদেহের ভিতর পা ফেলতে বরাবরই সাদইদের খারাপ লাগে।

সমস্ত দৃশ্যটি চেয়ে চেয়ে প্রায় নিষ্পলক দেখছিল দেবতাদের দেহের মত শুভ্র অশ্বটি। মৃতদেহের তূপ দেখলেই ঘোড়াটা এভাবে স্থির হয়ে দাঁড়ায়–পুরনো নক্ষত্রের মত চোখ মেলে চেয়ে থাকে।

পায়ে পায়ে ঘোড়ার কাছে এগিয়ে এল সাদইদ। শিশুটিকে রিবিকার দিকে তুলে ধরে বললনাও। যুদ্ধের পাওনা। আজ আমার ভাগ্যটা খুব প্রসন্ন দেখছি । বিনে যুদ্ধে একটা আশ্চর্য নারী এবং অত্যাশ্চর্য শিশু উপহার পেলাম। শিশুটি মেয়ে নাকি ছেলে–ওহো ছেলেই বটে–তা বেশ। ওর গলায় এই লকেটটা ঝুলছিল। দাঁড়াও দেখি লকেটের খোপে কী রয়েছে!

মুখটা খুলতেই চোখে পড়ল খুদে খুদে লিপি-লকেটটা ছিনিয়ে নেবার আগে শিশুকে বিষ আর মধু দাও–ইতি হেরা। নিনিভের ভাস্কর হেরা–এ তারই পুত্র। সেই পরিচয় লিপিবদ্ধ রয়েছে।

–কী লেখা আছে সারগন?

সাদইদ খোপ বন্ধ করে শিশুর গলায় লকেটটা অত্যন্ত গম্ভীর মুখে ঝুলিয়ে দেয়। কথা বলে না। ধীরে ধীরে ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে বসে। অশ্ব হাঁকিয়ে দেয়।

–বললে না কী লেখা আছে?

লকেটের ঢাকনা দু’টি প্রজাপতির পাখনার মত। অশ্ব থেকে সাদইদ সহসা নেমে পড়ে বলে–রিবিকা তুমি পিছনে বসে আমাকে দুহাতে ধরে থাকবে–পুত্রটিকে আমায় দাও–তুমি সামলাতে পারবে না।

সেইভাবে বিন্যস্ত হল দৃশ্য। অশ্ব ধাবিত হল। চোখের সামনে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে জুম পাহাড়। চলতে চলতে সাদইদ রিবিকার প্রশ্নের জবাব দেয়। তারপর বলে–এই লকেটটা হেরার নিজের হাতের তৈরি। অথবা তারই নির্দেশে কোন মণিকার বানিয়ে দিয়েছে। ওই শব্যুপে এই শিশুর পিত্তা পড়ে রইল কিনা জানি নে। অথচ আমি এই শিশুকে মধু দিতে পারি, কিন্তু বিষ দিতে পারি না রিবিকা!

শিশুটিকে কোলে তুলে নেবার সময় সাদইদের বারবারই মনে হচ্ছিল আরো একটি শিশুর কথা। তার মা তাকে প্রসব করা মাত্র জিব্রিল মাকে হত্যা করে। সে ভেসে যেতে থাকে ঝুড়িতে। যে দ্বীপে তার জন্ম সেই দ্বীপ নাকি সমুদ্রের তলায় তারপর তলিয়ে যায়। কুফর দ্বীপে তার জন্ম–সে দ্বীপ আর নেই। তাকে তার ভিস্তি পিতা কাফেরের পুত্র বলে ডাকত। কুফর এক অভিশপ্ত দ্বীপ। এই শিশুটি তারই মত কাফের নিশ্চয়। কোন স্বপ্নদর্শী এই শিশুকে দেখলে হয়ত বলতে পারতেন, এ বেচারি ঈশ্বর বিশ্বাস করবে না, আকাশের দেবতাদের অবজ্ঞা করবে, নবীদের করবে উপহাস। কেননা এর জন্ম আর শৈশব মৃতদের তূপে এসে ঠেকেছে, এতদূর হতভাগ্য শিশু কোথাওই তার আস্থা এবং বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না–বরং সে নিজেকেই ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলে। সে তার নিজেরই মত করে একটি একটি আকাশ, সূর্য, চন্দ্র এবং অজস্র তারকাপুঞ্জ আর পাহাড় বন নদী সৃষ্টি করে আপন মনে। তার কেবলই মনে হয় এই আকাশ, বন, নদী, সমুদ্র কোন দেবতার সৃষ্টি নয়–এরা সূর্যের মত আপনাতে আপনি পূর্ণ–এদের কোন নির্মাতা নেই। মানুষও জন্মের পর নিজেকে বানায় নিজেকে সে খাদ্য দেয়, বস্ত্র দেয়, গৃহ দেয়–সে নিজেই তবে জীব-দেবতা।

জন্ম মৃত্যু অপরিজ্ঞাত, জীবনও রহস্যময়। চাঁদ, সূর্য, তারকার যেমন আকাশ রয়েছে, মানুষের রয়েছে জীবন। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সূর্য-চন্দ্র, তেমনি মানুষও ভাসছে জীবনভর। একটি ঝুড়িতে করে শিশুর ভেসে যাওয়া কি কম কথা!

একবার পাহাড়, একবার আকাশ দেখল সাদইদ। দূরে সমুদ্র গর্জন করছে। সাদইদ শিশুর মুখের দিকে চেয়ে থেকে ভাবল, শিশুটা এখনও ভেসেই রয়েছে, তার রয়েছে মনের আকাশ–তার রয়েছে চন্দ্র-সূর্য, সমুদ্র, অরণ্য, পাহাড়, নদী এবং পিরামিড আর জিগুরাত–তাছাড়া রয়েছে অজস্র অহিংস পশুপাখি। সে ভাসছে।

এই শিশু যতদিন জীবন না পায় ততদিন ভাসে। যতদিন ভাসে ততদিন জীবন পায় না। জীবন মানে শ্রম, নির্মাণ, প্রতিষ্ঠা। জীবন মানে সুরক্ষা। নিজেকে বাঁচানো, খাদ্য বস্ত্র গৃহ এইসব দেওয়া, নিজেকেই দেওয়া–মানুষ যখন দেবতাদের আক্রোশ থেকে, ফোঁসানি থেকে, চোখ রাঙানি থেকে, ক্রোধ এবং অভিশাপ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারে–তখনই তার সার্থকতা। এই সার্থকতার নাম জীবন। জীব এবং বীজকে রক্ষা করার নাম জীবন। মহাপিতা নোহ ছিলেন জীবনের দেবতা। নবী ছিলেন। মানুষ আসলে জীব-দেবতা।

শিশুর মুখপানে চেয়ে থাকতে থাকতে সাদইদের মনে হচ্ছিল, জীবন-দেবতাই যেন তার কোলে হাত-পা নেড়ে খেলা করছে।

শিশুর সঙ্গে হঠাৎ সে কথা বলে উঠল–শোন সারগন, দুষ্টুমি করো না। আমায় কিছু বলতে দাও।

সহসা এমন উক্তি শুনে আশ্চর্য হয় রিবিকা। সে সাইদের মনের থই পায় না। একদা সে আবীরুদের সঙ্গে অশ্বারোহণ করেছিল। পাশে প্রবাহিত নীল নদী। আজ সম্মুখে পাহাড়, নীল আকাশের গায়ে হেলানো, দূরে সমুদ্রের সংগীত ভাসছে। এ তার জীবনের দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা। সে সাদইদকে পিছন থেকে দু’হাতে আলিঙ্গন করে রয়েছে। পাশ দিয়ে মুখটা ঠেলে সে শিশুকে দেখবার চেষ্টা করছে। শিশু সাদইদের মুখে হাত বাড়িয়ে ঠোঁট আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করছে, কথা বলতে দিচ্ছে না।

বেলা পড়ে আসছে। পাহাড়-চূড়ায় আলো রাঙা হয়ে উঠছে। সাদইদ কথা বলে শিশুর সঙ্গে–। দ্যাখো ভাই, তোমার লকেটটা ভারী সুন্দর! প্রজাপতির দুটি ডানা যেভাবে পিঠের উপর খাড়া হয়ে জুড়ে যায়–এ ঠিক তাই। একটি প্রজাপতিকে বাঁচানো তেমন সহজ নয়, শিশুকে বাঁচানোও সমান শক্ত। পতঙ্গের। ডানায় যেমন ইন্দ্রধনু খেলে ওঠে, এটা সূর্যের বিষ–আর তোমার হাসিটাও তাই। নারীর বুকে চাঁদের বিম্ব, তোমার মুখে সূর্যের বিষ–তাহলে আকাশ থেকে। স্বর্গও নামতে পারে এখানে। দেবতাদের ক্ষুণ্ণ করব না শিশু-সারগন, তুমি বোঝে। সব কিছুর ছায়া থাকে হেরার পুত্র। তোমার দেহে নোহের ছায়া পড়বে, তুমি একটি জাহাজ বানাবে, তুমি পিরামিড গড়বে। তুমিই স্বৰ্গকে নামিয়ে আনবে মাটিতে।

বলতে বলতে সাদইদ শিশুকে আবেগে আহ্লাদে চুম্বন দিতে থাকে। শিশু হেসে ওঠে। সেই হাসির দোলায় যেন সাদইদ নিজেই আত্মহারা হয়ে আকুল হাসিতে স্ফূরিত হয়। রিবিকাও হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে ভাবে, এ কোন অশ্বারোহণ তার!

তবু ভয় করে তার। বিশ্বাস হয় না। অশ্বারোহী পুরুষটি শিশুর জন্য বরাদ্দ করছে একটি স্বর্গের, যা আকাশ থেকে মরুতে বিম্বিত হবে!

কীভাবে মরুতে স্বর্গ বিম্বিত হয় রিবিকা ভাবতে পারে না। হৃদয় কীভাবে এইসব চিন্তা করে তার জানা নেই। তবে সাদইদের কথা শুনতে শুনতে কেবলই তার মনে হচ্ছিল, পিরামিডের শবাধারলিপির কথাগুলি, যে সম্রাট অথবা অভিজাত মানুষটি শবাধারে শুয়ে চিরনিদ্রায় অভিভূত এবং নির্বাক সে কি

ঘোষণা করছে সে কখনও কারুকে আঘাত করেনি, কাউকে কাঁদায়নি, এমনকি একটা পশুকেও সে যাতনা দেয়নি–এভাবে আদর্শ মানুষ ঘুমিয়ে থাকে।

অথচ ওই কথাগুলি যে প্রতারণা, তা প্রমাণিত হয়েছে। জীবন একরকম। বাণী অন্যরকম। মানুষ দেবতা হওয়ার লোভে অমন বাণী রচনা করে। অশ্বারোহী পুরুষটি পতঙ্গের দাম দেয় অথচ সে মেষ-শিশুকে হত্যা করে। পতঙ্গের পক্ষধ্বনি শুনতে পায় অথচ নিনিভের মনুষ্য-আর্তনাদ তাকে বিচলিত করে না–শবস্তূপ থেকে জীব প্রাণ খুঁটে তুলে আনে অথচ সমেরুর মত কিশোরকে সে প্রবল যাতনার ভিতর নিক্ষেপ করে। আক্কাদই শুধু প্রতারক নয়, একজন ফেরাউন সম্রাটও ক্রীতদাসীর গর্ভ তল্লাশ করে শিশুহত্যার পরোয়ানা জারি করে। কতকাল মানুষ এইরকম দু’মুখো জীব–এক মুখে অহিংসা, অন্য মুখে যুদ্ধের শিঙা ফুঁকে চলেছে। শিশুর গলায় লকেট দেখে যে অভিভূত, সে আদৌতে একটি ক্ষুদ্র শিঙা লটকে রেখেছে গলায়।

–তুমি আমার শিশুমেষকে হত্যা করেছ সারগন–ক্ষমা করব না কখনও! আমার জন্য একটি সূর্যমন্দিরই যথেষ্ট। তাই দাও। তোমার কাছে যাচনা করার কিছু নেই।

আপন মনে বলে যেতে থাকে রিবিকা। কতকগুলি তাঁবুক্ষেত্র তারা অতিক্রম করে আসে। তারপর দেখতে পায় সার সার মন্দির। মন্দিরগুলি সব এক। ধরনের নয়। আকাশে আলো নরম হয়েছে। অশ্বের গতি অনেকক্ষণ খুবই মন্থর। শিশুকে পাওয়ার পর ঘোড়া যেন আর চলতেই চাইছে না। পাহাড় ক্রমশ আরো নিকটবর্তী হয়ে এল। দিনের আলোতেই দেখা গেল পাহাড়ের মাথায় রূপালি চাঁদ উদ্ভাসিত। মন্দিরের সিঁড়িতে দেবদাসীরা বুকের কাপড় ফেলে দিয়ে বসে আছে। সুগন্ধি পাতা চিবিয়ে চলেছে। পেয়ালা থেকে গড়িয়ে খাচ্ছে দ্রাক্ষাসব। পথের উপর মদপাত্র সাজিয়ে বসেছে মানুষ।

মাটির কাঁচা ইট মরুবালিতে শুকানো হয়েছে। তাই দ্বারা নির্মিত হয়েছে মন্দির। তাঁবুর আকৃতির এই ঘরগুলি খড়ো। যবের গমের বিচালি ছাওয়া। কোথাও পাথরের লেশমাত্র নেই। অবশ্য দু’একটি মন্দিরে কিছু তফাত রয়েছে। তাঁবু বলতে যেগুলি গোলাকার তাঁবু, মন্দির সেই আকৃতিবিশিষ্ট হওয়ার পর চুড়ো তুলেছে গোলার মত। দু’একটি মন্দির সহসা রাজকীয়। সম্পূর্ণ পাথর কেটে তৈরি, তা পিরামিড-সদৃশ।

রিবিকা বুঝতে পারছিল পরিচ্ছন্ন মন্দির বলতে কী বোঝাচ্ছিল সাদইদ। তাকে দেওয়া হবে পিরামিড মাকা কোন একটা মন্দির। সন্ধ্যার মুখে মন্দির প্রাঙ্গণে ঢোল আর বীণা বেজে উঠল। মরুভূমির একধরনের বুনো তীব্র গন্ধ ফুলের মালা কব্জিতে জড়িয়ে বেঁধে জুম পাহাড়ী সৈন্যরা তাঁবু থেকে নির্গত হতে লাগল। মুখে মদের ঝাঁঝালো গন্ধ, গায়ে আতর ছিটিয়েছে। পোশাক পরেছে মসীহদের মত। কিন্তু এমনভাবে তা পেঁচানো হয়েছে পরনে এবং গায়ে যে, একখানি পায়ের থাই অবধি চোখে পড়ছে। চোখে ঢুলু ঢুলু চাউনি আচ্ছন্নতা পীড়িত, ঈষৎ তির্যক । গোঁফ জুমরে মদের প্রলেপ দিয়েছে, চোখে কেউ কেউ সুমা পরেছে। আতরে মদে মাখামাখি বাতাস রূপালি চাঁদে হল্লা তুলে ছুঁয়ে নামছে মাটিতে। অত্যন্ত কম বয়েসী পাঁচটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে একটি ছোট মন্দিরের সামনে। পাথরের পাটাতন পাতা বদ্বার ঠাই, একে বলা হয় দীঘল কেদারা। এখানে বিশ-পঁচিশজন সেপাই মাথা নিচু করে বসে রয়েছে।

মাথা নিচু করে বসে থাকার কারণ যে সাদইদ, ক্রমে বুঝতে পারে রিবিকা। কচি মেয়েগুলি দাঁত বার করে হাসছে। বুকের জামা খুলে একটি কুঁড়ি দেখিয়ে জামার তলে ঢুকিয়ে রাখছে একটি পাজি মেয়ে। ক্রমাগত এই-ধারা করছে।

সাদইদ ঘোড়া নিয়ে গিয়ে ওখানে থেমে গেল। সুন্দরী রিবিকার দিকে সবাই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। কচি সেই পাজি মেয়েটি রিবিকাকে বুকটা দেখিয়ে জিভ ভেংচে বলল–নতুন নাগরী বুঝি! তা বেশ। ক’খানা ভেড়া দিয়ে খরিদ করল তোকে!

সাদইদ ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নেমে শিশুটাকে রিবিকার কোলে ছুঁড়েই দিল একপ্রকার। তারপর সটান কচিটার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললকনানী ভাষাটা তো বেশ মজবুত করে বলতে পারো কিন্তু এইসব আদিখ্যেতা কেন? সহবত বোঝো না?

বলেই গালে একটা চটাস করে চড় মারল সাদইদ। তারপর ধমক দিয়ে উঠল–বেয়াদব! শরীর সামলে রাখো!

–আ বাপ! তিন ভেড়ার খরিদানা মাগী আমি, তুমি মিনসে হলে বতাই হবা নাকি ভিস্তির পো? জানি তুমি লোকটা অতি মন্দ নও, শুদু হিতেনের পেটোয়া বটো। আমায় একবার হারেমে দাও দিকিনি, ঘুরে আসি! আঙুর চটকালে মদ, মাগী চটকালে বদ–তা বুঝি জানো না!

বলেই সাদইদকে জিভ বার করে ভেংচে উঠল পাজিটা। সাদইদ রেগে গিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতেই মেয়েটি পড়ে গিয়ে কেঁদে ফেলল ভয়ে।

একজন গামছাবালা সাদইদের কাছে এগিয়ে এসে বলল–হুঁজুর! ঘাট মাফ করবেন! ওটার মাথা খারাপ! খালি বকবে,যতই কেন বলুন! আসলে যুদ্ধে ওর বাপ-মা দুটিই খতম হয়েছে। পরে এক মদঅলা শুঁটকিঅলা ওকে তিন ভেড়ার। বদলি কিনে আনে, সেই গল্পটা ও করে! কী করে শুঁটকিঅলা-উটবালাকে ও নিজেই ওদের উঠানে ডেকে নিয়ে গেল। একটাই কেচ্চা কেবলই আউড়াবে। ওর কাকারা ওকে বেচে দিয়েছে! ওর দুখখু একটাই–ও কেন নিজেই ব্যাপারীকে ডেকে নিয়ে গেল! বিশদ করে বলা ওর স্বভাব। মাথাটা গেছে। হুজুর! মারলেও শুনবে না। আপনি চলে যান। আমি ওকে দেখছি!

গামছাবালা ঘাড় থেকে গামছা নামিয়ে হাতের মুঠোয় ধরে কপাল অবধি তুলে নাচিয়ে অভিবাদন জানালো সাদইদকে। সাদইদ সহসা ঘাড় নিচু করে ঘোড়ার লাগাম ধরে সামনে এগিয়ে চলল।

সেই যে সাদইদ ঘাড় নামালো, পথের উপর থেকে আর চোখ তুলল না। পাহাড়টা মনে হচ্ছিল খুব কাছে, কিন্তু মোটেই তত নিকটে নয়। সুদীর্ঘ সময় সাদইদ পথ হেঁটে এল। সন্ধ্যা ঘনাল। রিবিকা একটি কচি মেয়ের ভিতর তার অতীতকে এক ঝলকে প্রত্যক্ষ করল। হুবহু একই জীবন। তিনটি ভেড়া অবধি সঠিক। কচিটা যে নিজেই বণিকটিকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল না-বুঝে পথ থেকে, এই বেদনা তার কিছুতেই শেষ হতে চাইছে না।

কেউ আসার পথে প্রশ্ন তোলেনি বটে, তেমন খুব আশ্চর্যও হয়নি রিবিকাকে দেখে। কারণ তারা নিজেদের কাহিনীতেই অশেষ বিস্ময় সংগ্রহ করেছে। হঠাৎ এই অশ্ব যেন একটি উটের অবয়ব লাভ করে। কিছুতেই রিবিকা ভাবতে পারে না, এ উট নয়, ঘোড়া। দীর্ঘদেহী, সুউচ্চ ঘোড়াটা অতঃপর উট হয়ে যায়। লাগাম ধরা মানুষটিকে মনে হয় ফরাতের উটচালক। হঠাৎ চোখে পড়ে আর এক আশ্চর্য ছবি। বালির ঢিবির উপর বসে রয়েছে একটি একহাত কাটা ভয়ানক। রূপসী মহিলা, ফুলের মত বুক খুলে সে একটি কালো কেঁদো বাচ্চাকে স্তন্যদান করছে। দু’হাত তফাতে ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি লোক। ঘাড়ে গামছা, কিন্তু হাতে একখানা লাঠি। কে ওরকম দাঁড়িয়ে রয়েছে? ও যে চেনা চেনা কেউ।

মহিলার কাটা হাতটা স্তন্যদান করায় ক্রমাগত লাফাচ্ছে এক অনির্বচনীয় পুলকে আর বিষাদে। স্বর্ণালী সূর্য টলটল করছে। রূপালি চাঁদ অন্য গগনে ফটফটিয়ে হাহাকার করছে। কাটা হাতের প্রত্যেকটি কম্পন যেন কিছু একটা ধরতে চায়। চামড়ার ক্রমপ্রসারণ ও সংকোচন যেন কাটা নগ্ন হাতটির হৃদয়। অথবা ফুসফুস। যা কিনা বাতাস পাচ্ছে না। দম আটকে আসতে থাকে রিবিকার।

মন্দির ছেড়ে এখানে কী করছে মা, শিশু আর গামছাবালা চেনা চেনা লোকটি? বোধহয় এদিকে কোথাও এসেছিল, সন্ধ্যায় ফিরে যাওয়ার কথা, ফিরতে পারেনি।

ফর্সা কাটা হাত, কিন্তু কাঁধের পাশে ঝুলন্ত, কনুই-হীন, কনুইয়ের উপর অবধি কিছুদূর যুদ্ধের কোপে উধাও, কাটা অংশটি কালো আর অদ্ভুত দলা দলা কদর্য কোষযুক্ত, যেন-বা ফুসফুস। কালো ফুসফুস। বারবারই মনে হয় রিবিকার। সে ভয়ে শিউরে উঠে মুখে আর্ত শব্দ করে ফেলে। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে। সেই শব্দে সচকিত হয় রুহা। স্তন ঢেকে ফেলে কাপড়ে। সন্তানকে স্তনচ্যুত করে কাঁধে ফেলে উঠে দাঁড়ায়। লাঠিধারী গামছাবালা কিন্তু নড়ে না। যেন মূর্তি।

পশ্চিম আকাশে রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ডের আলো ক্রমশ ম্লান। অন্য দিগন্ত ক্রমে ব্যাপ্ত করে সাদা রূপার গলিত বিভা। তাই মহাঘোর এই বালুকাবিস্তীর্ণ পটভূমি-সম্মুখে খাড়া ভীষণ পাহাড়। পাহাড়ের পায়ের তলায় মসীহ ইহুদ মূর্তিবৎ স্থির। কাঁধে গামছা, হাতে জাদুকীর্ণ লাঠি একাভিমুখিতার প্রতীক এই দণ্ড। গামছাখানি তার আত্মার অপমান। অবধারিতা একারণে যে, অপমান চন্দ্রকলাকৃতি বঙ্কিমা প্রসারিত ভূখণ্ডের সমান। কোথাও লুকোবার ঠাঁই নেই। যবহ দেখছেন, তাঁর বান্দা কী অসীম বেদনায় অপমানে নির্বাক।

রুহা অশ্ব দেখে ছুটে আসে। সাদইদের প্রতীক্ষায় সে অস্থির হয়েছে। একদণ্ড থামে না। ককিয়ে ওঠে–আমার সেপাইকে দেখলেন হুজুর! খোঁজ পেয়েছেন! কোথায় আছে? কবে আসবে?

সাদইদ থেমে পড়েছে। মনে হচ্ছে এ দৃশ্য নতুন নয়। এই প্রতীক্ষা পুরনো হয়ে গিয়েছে। এই প্রশ্ন ধারহীন। এই বিড়ম্বনা সোয়াস্তিশূন্য। সাদইদ খাদে নামানো ঈষৎ ভেজা গলায় যতদূর সংক্ষিপ্ত সম্ভব জবাব করে–আসবে!

–কবে?

এতক্ষণে মুখ তোলে সাদইদ। হঠাৎ কড়া উত্তর–তোমাদের সমস্ত জবাব সামান্য ভাড়াটে সৈনিক দিতে পারে না রুহা!

–তুমি দেবে না তো কে দেবে তবে? ভিস্তির পোলা হয়ে আমার নাগরকে তুমিই কেড়ে খেয়েছ বদমাশ! নতুবা লুকিয়ে রেখেছ। দাও। ফিরিয়ে দাও। সাদইদ ফের মুখ অবনত করেছিল। ফের তুলল। বলল–আসবে রুহা!

–কবে!

–আমি স্বপ্নদর্শী নই। মসীহ নই। আমি নক্ষত্রবিজ্ঞান জানি না।

–তুমি পিঁপড়ের ভাষা বুঝতে পারো। পিঁপড়ের গতিবিধি দেখে কখন বৃষ্টি হবে বলতে পারো। তবে কেন বলতে পারবে না আমার সেপাইয়ের খবর? তুমি ওকে নিনিভের দিকে পাঠিয়েছ। একদল সেনা তো ফিরল না! কেন ফিরল না? কী হল ওর? লোটাই বা কবে ফিরবে?

–ফিরে আসবে নিশ্চয়।

–দেখা হয়েছে বল তাহলে?

–যা হয়েছে! এবার পথ ছাড়ো!

–কখন আসবে!

–কাল।

–রোজই তো বল কাল। আসে না কেন? আমার শিশু যে কাঁদে!

–মধু খেতে দাও।

–আমার বুকে কি গরল আছে বলছ?

–আমি সেকথা বলিনি রুহা। সামনে মরুভূমিতে শীত আসছে–আমি সেপাইদের বলেছি মৃতদেহ থেকে কাপড় সংগ্রহ করতে। এখানে নদী নেই! শস্যক্ষেত্র নেই। এমনকি সমুদ্রের গর্জন শোনা যায় মাত্র, সমুদ্র উত্তাল হয়–কিন্তু বাতাস লাট খেয়ে কিনারা ছুঁয়ে সমুদ্রের ভিতর ঘুরে চলে যায়–কেবল একটা নির্দিষ্ট সময়ে সামান্য মেঘ উড়ে আসে। তখন সমুদ্র বাতাস খুলে দেয়। এই ঊষর জীবন কেবল যুদ্ধে খরচ হয় রুহা। মৃতদের পরিত্যক্ত খাদ্য বস্ত্রে জীবন বাঁচে। এ এক ধরনের চুরি। লুঠ নয়। পরাক্রম নয়। তোমার সেপাই আসবে একদিন প্রচুর বস্ত্র আর খাদ্য নিয়ে। সমুদ্র সর্বক্ষণ হাওয়া দেবে সেই জীবন তো আমরা পাইনি।

–আমি কী করব মা গো!

বলে উধ্বাকাশে মুখ তুলে রুহা আর্তনাদ করে উঠল।

আকাশে চন্দ্রকিরণ ঘনীভূত হচ্ছে, সূর্যালোক আর নেই। রুহা চাঁদের আলোর দিকে চেয়ে কেঁদে উঠল–আমার এই কাটা হাতটাকে কে আর ভালবাসবে! কেউ তো রইল না!

এবার অনড় মূর্তিটা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। রিবিকা ইহুদকে ধীরে ধীরে চিনতে পারে! একজন মসীহের এই পরিণাম অভাবিত। বোঝা যায় সাদইদ তাঁকে জীবনের একেবারে তলায় ঠেলে দিয়েছে। তাঁর এই-ধারা ঘাড় নিচু করে থাকা অবিচল মূর্তি প্রকৃতই এক সুতীব্র অপমানের দীনতম দশা–যার পর আর কিছু নেই।

সমুদ্র রয়েছে এখানে, কিন্তু সমুদ্র কিছুই দেয় না–বায়ু অথবা মেঘ। এ এক আশ্চর্য জমি। তেমনি জীবন এখানে রুদ্ধ হয়নি, কিন্তু তার কোন রূপ বা আকার নেই, একটা পিণ্ডবৎ পড়ে আছে, গর্ভনাশের ফলে মানবী যেমন পিণ্ড প্রসব। করে। এ উপমা রিবিকার মনে আসে কেন সে বুঝতে পারে না। সে আমারনায় থাকার সময় ওইধারা পিণ্ড প্রসব করেছিল। আবীরুদ তখন তার কাছে আসতে শুরু করেছে। সেই সময় তার তলপেট নড়ছে, নমরুর বাচ্চা ধরেছে সে। সে এক মর্মান্তিক অনুভূতি। গা সিরসির করে। পায়ের তালু সিরসির করে। মাথা ঘুরে ওঠে রিবিকার। সে শিশুসহ বালির উপর খসে পড়ে যায়।

তারপর সে যখন চেতনা ফিরে পায় দেখে অদ্ভুত একটি জায়গায় সে শুয়ে আছে। চোখ মেলেছে সে। প্রজ্বলন্ত চাঁদ টইটই করছে আকাশে। দু’একটি তারকা ভাসছে। বাতাস আসছে হু-হুঁ করে। অথচ চারপাশ পাষাণে মোড়া। ছাদবিহীন এ এক আশ্চর্য ঘর। জ্যোৎস্না আর হাওয়ায় যেন আকাশে ভাসমান। পাশে শায়িত শিশু। কেউ কোথাও নেই। এ তবে রক্ষঃপুরীর মত কোন স্থান।

মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার সময় সে কি ‘বাবা’ বলে কোন আর্তনাদ করেছিল? তার গলায় কি কোন স্বর ফুটে ওঠেনি? জীবনই যেন তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে দিয়েছে। কান্না তার গলায় দলা হয়ে জমে উঠেছিল। সে মহাত্মা ইহুদকে ডেকে উঠতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল ডাক শুনে মহাত্মা ইহুদ লজ্জা পাবেন। সমস্ত অপমানের শেষ দশায় পৌঁছেও কেন এই লজ্জা অবশিষ্ট থাকে–ভাবলে চরম অবাক হতে হয়। ভাবতে ভাবতে রিবিকা ঘুমে তলিয়ে যায়।

খুব ভোরে তিনতলা সুউচ্চ একটি সাঁজোয়া গাড়ি এসে দাঁড়ায় পাহাড়টির কাছে। তিনতলা পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে লাশ। চারটি অশ্ব টেনে এনেছে। অশ্বের গায়ে ঘাম, চোখগুলি তীব্রভাবে হলুদ–সবই কালো ঘোড়া। চারটি ঘোড়াই বুঝি মৃত্যুর ফেরেস্তা–আজরাইল।

সাঁজোয়ার পিছু পিছু ছুটে আসছে উন্মত্ত রোরুদ্যমান প্রবল জনস্রোত–জুমপাহাড়ী স্ত্রী-পুরুষ। মহাশক্তিমান লোটা এই সাঁজোয়া ভর্তি করে এনেছে সৈনিকের লাশ–এর মধ্যে কারা যে সাদইদের সেনা,স্থির করতে পারেনি। সে মনে করেছে, এরই ভিতর থেকে দেবদাসীরা তার আপন পুরুষটিকে চিনে নিতে পারবে। তাছাড়া শিশুরা তার জনককে চিনবে । এই ভয়াবহ দৃশ্যটি কেন রচনা করল লোটা,সাদইদ বুঝতে পারে না। অস্থির কান্নায় আকাশ উতলা হয়ে উঠল।

সেই আর্তরব কানে পৌঁছতেই রিবিকা ভয়ে শিশুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে। গবাক্ষপথে সে চেয়ে দেখে দৃশ্য। কান্না যেন সমুদ্রের মত বিহ্বল। দেবদাসী আর। শিশুর আর্তনাদ। যাদের আত্মীয়-বিয়োগ হয়েছে সেই পুরুষাও কেঁদে ওঠে। সবাই তো আর এখানে নিঃসঙ্গ ছিল না। কারো ভাই কারো পিতা বিনষ্ট হয়েছে–তারা কাঁদছে। দেবদাসী, যারা কিনা রুহার মত ভালবাসা করেছে, তাদের কান্নাই সবচেয়ে উচ্চকিত। মথিত এ কান্না যেন মরু লু-এর মত দিগন্তপ্লাবী প্রহার।

সমস্ত বেগ এসে সাদইদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পাষাণবিধৌত জলরাশি যেভাবে সমুদ্র পাঠাতে থাকে এবং টেনে নেয়–ফের পাঠায় কান্নার তরঙ্গ সেইরূপ। জলপাহাড়ের মত ডুবে যেতে থাকে সাদইদ। সে যেন সমুদ্রের তলা থেকে কথা বলতে থাকে।–এমন কেন করলে লোটা?

সাঁজোয়া থেকে লোটা লাশ নামায় কাঁধে করে, একাকী। কেউ কিন্তু হাত লাগাচ্ছে না বলে তার কোন বিকার নেই। সে সাঁজোয়ার পিছু পিছু লাগামের দড়ি সাঁজোয়ায় বেঁধে টেনে এনেছে চারটি উট। সে সকলকে বলছে–দেখে নাও। কার কোনটা পুরুষ। কে বাপ, কে সন্তান, কেইবা পুত্র! যারা বিচ্ছেদ চাওনি, তারা দেখে নাও। আমি কিন্তু উটের পিঠে তুলে দেব!

নোটার ভাষা এখানে কেউ বোঝে না। বোঝে একমাত্র রিবিকা। কিন্তু রিবিকা সেকথা বুঝতে পারে না। লোটার ভাষা খুব পুরনো  যে-ভাষায় একমাত্র আক্কাদের মা, সেবার মা কথা বলত। এ ভাষা শুনে রিবিকা কতকাল পর অসম্ভব চমকে উঠল। শিশুর লকেটটা ধরেছিল সে হাতের মুঠোয়। ঘর থেকে বেরিয়ে সে সাদইদের কাঁধের নিচে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল কখন,তার নিজেরই। অজান্তে।

সাদইদ মন্দ্রস্বরে বলে উঠল–তোমার মুখের ভাষা আমরা কেউ জানিনে লোটা! তোমার ব্যাকুলতা আমরা বুঝব না। কেবল তোমার ইঙ্গিত আমরা বুঝতে পারি!

লোটার আর্তনাদে, মন্ত্রজব্দ সমুদ্র যেভাবে স্তব্ধ হয়, তরঙ্গ হয় জমাট, এ ঠিক তাই, সেভাবে কান্না থেমেছে। সেই নিস্তব্ধতার ভিতর একটি কণ্ঠস্বর ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছে, সে লোটার দিগন্তবিদীর্ণ স্বর। সাদইদ আপন মনে বলে উঠল–তোমার ভাষা ঈশ্বরের মত। আমরা তো বুঝতে পারি না।

–আমি বুঝতে পেরেছি সারগন! বুঝতে পেরেছি!

বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা। আশ্চর্য হয়ে চমকে সাদইদ পাশে দাঁড়ানো রিবিকার মুখের দিকে চাইল। বিস্ময়-পীড়িত অভিভূত স্বরে বলল–তুমি জানো! তবে বলে দাও এদের!

রিবিকা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, যেতে লাগল আমার দেবতা একমাত্র দেবতা, যিনি জীবন এবং মৃত্যুকে বহন করেন। আমার ভাষা একমাত্র ভাৰা, যা। নবী সালেহ বলতেন। আমার উটগুলি সেই দেবভাষা ছাড়া কিছুই জানে না। আমি আজ প্রমাণ করতে চলেছি, আমার ভাষা আর ধর্ম অনশ্বর। চিরন্তন। এর ক্ষয় নেই। প্রতিটি মৃতদেহ আমার উট বহন করে নিয়ে যাবে দূর দিগন্তের দিকে ফেলে রেখে আসবে দেহ। আসলে নবী সালেহ যেখানে রয়েছেন, সেখানে লুকিয়ে ফেলবে উট,এই মৃতদেহগুলি। তোমরা আমার ভাষা বোঝে না। আমিও বুঝি না তোমাদের। যদি জানতে মৃত্যুকে বহন করার দেবতা একমাত্র উট! জীবনকে বইবার ক্ষমতা একমাত্র তারই। আমার ব্যাকুলতা যদি

বুক চাপড়ে চাপড়ে আর্তনাদ করতে থাকে লোটা। মৃতদেহ কাঁধে করে নামাতে থাকে, উটের পিঠে তুলে দিতে থাকে।

জুমপাহাড়ী ভাষায় অনুবাদ করে দিতে গিয়ে থেমে পড়ে সাদইদ। উট শব নিয়ে দিগন্তের দিকে রওনা হয়। রুহা তার প্রিয়তম মৃত্যুকে চিনতে পেরে আগলে বসে পড়ে। মৃতদেহ ছাড়তে চায় না। তার কোলের বাচ্চাটা মৃত পুরুষের বুকে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে পড়তে চায়। সৈনিকপুরুষটি শিশুকে আদর দিয়েছে অনন্ত, সেকথা শিশু ভোলেনি। কেন তবে চোখ মেলছে না লোকটা? হাত বাড়াচ্ছে না কেঁদোটার দিকে?

রিবিকা আর সহ্য করতে পারল না। তার কণ্ঠস্বর বুজে এল। সাদইদ অসহিষ্ণুর মত বলল–থাক আর বলতে হবে না। লোটার উন্মাদনা প্রশমিত হবে না। ও কপাল চাপড়াবে। আপন বুকে কিল-ঘুষি ছুঁড়বে–এই ওর রোগ!

রিবিকা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। গুহায়িত ছাদবিহীন গৃহে শিশুকে বুকে করে ফিরে এসে লকেটটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আকাশে মুখ তুলে সজোরে বিলাপ করে উঠল–হায় দেবী! মা গো!

লকেটটাকে এখন স্পর্শ করতেও তার ভয় করছিল। শিশুর মুখে ঈশ্বরের মত হাসি নিঃশব্দে ঝরছে। যেন দেবতা আমন শিশুর মুখমণ্ডলকে উদ্ভাসিত করে রেখেছেন। রিবিকা সেদিকে চেয়ে দেখতে দেখতে ডুকরে ডুকরে উঠতে থাকল।

বাইরে মৃতদেহকে চেনার উপায় সহজ ছিল না। কারো দেহ স্বাভাবিক নেই। কারো চোখ দুটি ঝলসে দিয়ে মুখকে বিকৃত করে দেওয়া হয়েছে। কারো মুখেরই আধখানা কেটে নামিয়ে দেওয়া। কারো দেহ আছে, মুণ্ডু সাঁজোয়ায় তোলা। হয়নি। কারো মুখ সহজ নয়। তথাপি কিছু কিছু আশ্চর্য ঘটনা ঘটছিল। বহুকাল বাদে একজন তার স্বামীকে মৃতদেহের ভিতর আবিষ্কার করতে পেরে সহসা ভয়ানক আর্তনাদ করে উঠল।

উটের পিঠে তোলার আগে মৃতকে নগ্ন করা হচ্ছিল। কাপড় খুলে নিয়ে একদিকে জড়ো করে রাখছিল লোটা। ওগুলি জলে সেদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে শিবিরে বিলি করা হবে। এই সাঁজোয়ায় একেবারেই অচেনা পুরুষ কম নেই। কিছু নারীও মরেছে, অল্প শিশুও। সকলকে নগ্ন করে অন্তিম প্রস্থানে পাঠানো হচ্ছে। হঠাৎ একজন, নাম সুব্বা, ভয়ানক খেপে গিয়ে লোটাকে আক্রমণ করল! ঝাঁপিয়ে পড়ল লোটার উপর। কী হয়েছে? না, সুব্বা তার হারিয়ে যাওয়া কিশোর ভাইকে মৃতদেহের ভূপে আবিষ্কার করতে পেরেছে। আক্রান্ত লোটা আক্রমণ মুহূর্তে প্রতিহত করে হো-হো করে পাগলের মত উচ্চহাস্য করে উঠল।

সাদইদ ভাবল, কেন সে নোটাকে পাঠালো সৈনিকদের না-ফেরার খোঁজ নিতে? লোটা বহুদিন নিঃসঙ্গতা রোগে ভয়ানক হয়ে উঠেছিল। কীভাবে সে সাঁজোয়া ভর্তি করেছে, কেউ জানে না।

গবাক্ষে চোখ রাখে রিবিকা। শব বোঝাই উট চলেছে দূর দিগন্তের দিকে। লোটার নির্দেশই যথেষ্ট। মৃতদেহ নিয়ে ছুটে যাচ্ছে ঊর্ধ্বশ্বাসে। শক্ত আংটা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে শব।

একে একে সমস্ত দেহ বহে নিয়ে গেল উটেরা। কোথায় ফেলে দিয়ে এল কেউ জানে না। এইভাবে নবী সালেহর মৃতদেহ উট বহে নিয়ে গিয়ে শূন্য পিঠে ফিরে এসেছিল। খালি পিঠে, প্রকাণ্ড গলা ভয়ানক দোলাতে দোলাতে ফিরছে। দিগন্ত থেকে উটেরা। কুঁজগুলি কবর। পায়ের আঘাতে বালিও উড়ছে। সমস্ত শরীর মৃত্যুর পর উটের ভিতর আশ্রয় পায়। একথা জোরে জোরে চিৎকার করে বলছে লোটা।

লোটা বলছে–হা নবী! সমস্ত যুদ্ধ ওই কুঁজে থেমে যায়। যুদ্ধের অবশেষকে তুমিই বহন করো পিতা!

সূর্য মাথার উপর দীপ্যমান। কখন সে মধ্য আকাশে উঠে গেছে কারো খেয়াল নেই। কান্নার মন্থন পারাবার-প্রমাণ উত্তাল। মরুর বুক ঝড়ের মত হু-হুঁ করছে।

সূর্য চলে গেল দিগন্তে। শেষ দেহটি রুহার পুরুষটির উত্তোলিত হল। উট ক্লান্ত পায়ে অগ্রসর হল। রুহার হাত থেকে মৃতদেহ ছিনিয়ে নিয়ে লোটা উটের পিঠে বেঁধে দিল।

দিগন্তের কাছাকাছি চলে যেতেই রুহা বুকফাটা আর্তনাদ করে উটের দিকে ছুটে চলল। তার কেঁদোকে সে বালির উপর ফেলে রেখে ছুটল। কী আশ্চর্য! কেউ তাকে ধরবার চেষ্টাও করল না। হঠাৎ দেখা গেল ইহুদ দিগন্তের দিকে ছুটতে শুরু করলেন। উটকে আর দেখা যাচ্ছে না।

সহসা লোটা কী যেন চিৎকার করে বলল। কেউ বুঝল না। রিবিকা শুনতে পেল–আপনি যাবেন না মশায়! উট কোথায় যায় কেউ জানে না। মরুভূমির পাহাড়ের ওদিকে কোথায় যে যায়…ও মশায় যাবেন না।

তারপর স্বয়ং লোটা তীব্র বেগে দৌড়তে লাগল দিগন্তের দিকে। দেখতে দেখতে লোটা ইহুদকে অতিক্রম করে গেল। উট কোনদিকে ছুটেছে কেউ জানে না। সাদইদ শুভ্র অশ্বের পৃষ্ঠে লাফিয়ে উঠে অশ্ব ছুটিয়ে দিল, যখন একজন বলে উঠল–রুহা বাঁচবে না। ওকে আমনদেব ডেকেছেন!

অতঃপর সীমাহীন মরুর বুকে আর এক যুদ্ধ শুরু হল! মরুবাঘের মত লোটা পাগলিনী রুহার বেদনাকাতর দেহে ঝাঁপ দিল। মৃতদেহ পিঠে করে দাঁড়িয়ে রয়েছে উট। রুহা কঁকিয়ে উঠল–আমায় ছেড়ে দাও।

একটি পাহাড়গুহার ভিতর টেনে আনার চেষ্টা করছে একটি পুরুষ একটি নারীকে। দুজন দুজনের ভাষা বোঝে না। লোটার বিদ্বেষ আরো ভয়াবহ। পাহাড় নারীকণ্ঠে তীব্র আর্তনাদ করে ওঠে। অশ্বারোহী সাদইদ সেই কান্না শুনতে পায়–কিন্তু কোথায় রুহা বুঝতে পারে না। ইহুদ তখনও পৌঁছতে পারেননি।

অত্যন্ত ছোট পাহাড় এটি। সাদইদ অশ্বকে দ্রুত পাহাড়ের চারপাশ প্রদক্ষিণ করে আনে। দেখতে পায় ওদের। লাফিয়ে নামে। ছুটে এসে ক্ষুধার্ত বাঘের মুখ থেকে শিকার কেড়ে নেয়। ইহুদ ততক্ষণে পৌঁছে গেছেন।

সাদইদ প্রবল বলপ্রয়োগ করে লোটার গালে চপেটাঘাত করে। এই সময় উটটা খাদের কাছে গিয়ে গা ঝাড়া দিতেই আংটা ছিঁড়ে মৃতদেহ খাদে পড়ে যায়। পাহাড়ের নিচে খাদটা ভরে এসেছে। শবের গন্ধে চারিদিক ভারী হয়ে রয়েছে। দেরি না করে সাদইদ রুহাকে অশ্বের পিঠে তুলে নেয়। অশ্ব ছুটে আসে জুম পাহাড়ের মন্দিরের দিকে। অপমানিত লোটা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইহুদ এসে লোটার কাঁধে হাত রাখেন…

.

রাত্রি গম্ভীর হয়েছে। লোটা আর রুহার ঘটনা কী ঘটল রিবিকা জানে না। সে সাদইদকে জিজ্ঞাসা করতেও সাহস পাচ্ছে না। উটের শব বহনের দৃশ্য তার মনে এক নিরাশ্রয় ভয় সৃষ্টি করেছে। সাদইদ এখন রিবিকার চোখের সামনে চুপচাপ থুতনিতে হাত রেখে একটি বেদীর মত উচ্চ পাথরের আসনে বসে আছে। চাঁদের আলো সারা ঘরকে ভরিয়ে দিয়েছে সাদা পুষ্পের মত। শিশু ঘুমন্ত। সাদইদ একবারও রিবিকার মুখের দিকে মুখ তুলে চাইছে না। সামনে। বসে আছে অন্যমনস্ক–কী এক গভীর চিন্তায় মগ্ন বলে মনে হচ্ছে!

হঠাৎ বাইরে ঘোড়ার একটা চিৎকার শোনা যায়। একটু পরেই লোটা এসে ঢোকে। সাইদের সামনে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে বলে আমায় ক্ষমা করুন সারগন! আমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।… বলেই লোটা শিশুর মত উচ্চ গলায় কাঁদতে লাগল। পিঠে হাত রাখল সাদইদ। সস্নেহে বলল–আমি তোমার দুঃখ বুঝি না লোটা! তুমি চুপ করো, শিশু জেগে যাবে। জানি, বলপ্রয়োগে কখনও কারো হৃদয় পাওয়া যায় না। রুহা যাকে ভালবাসত সে তো। শেষ হয়ে গেল। তুমি তার চরম দুঃখের মুহূর্তে কেন ওরকম করলে! এ। তোমার ঠিক হয়নি। তুমি ব্রাত্য–তোমার ভাষা, ধর্ম আলাদা। তোমার জন্য কোন দেবদাসীর ব্যবস্থা আমি করে উঠতে পারিনি। তাই বলে তুমি রুহার উপর। বলপ্রয়োগ করবে? আমাকে দেখে তুমি শিখতে পারো না? আমার সব আছে মনে করো! অথচ কী আছে আমার? কোন দেবদাসীর প্রতি আমার কোনই। আগ্রহ নেই। আমিও তোমারই মত নিঃসঙ্গ। যদি তুমি বুঝতে!

কথাগুলি সে অনুভবে সমস্তই বুঝতে পেরেছিল বটে, তাই তার কান্না থেমে গেল। কী মনে করে উঠে দাঁড়িয়ে রিবিকাকে দেখিয়ে ভয়ানক লোভার্ত চোখে লোটা বলল–ওই তো তোমার সব আছে। শিশু আর নারী! তোমার কপাল তো রাজচক্রবর্তীর কপাল! বন্ধু, আমি লোভ করছিনে। তবে আমি কোথাও চলে যেতে চাই। যুদ্ধ আছে, অথচ নারী নেই, এই অবাস্তব জীবন কত আর বইব! রুহার কাছে তবু আমি ক্ষমা চাইব! আমার ভাগ্যে একটা হাতকাটা মেয়েও জুটল না। আমি খুব ছোট জাত, আমার ভাষা বেদেজনের ভাষা–ঠিক আছে!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে চলে যায় লোটা। যাবার সময় চোখে বিদ্যুৎ ঝলসে তালে–তীব্র কামাগ্নি! মনে হল, রিবিকা পুড়ে যাবে।

রিবিকা সমস্তই বুঝে ফেলেছিল। সাদইদ রিবিকার দিকে দৃষ্টি ফেরালো না। বলল–আমার ভয় হচ্ছে রিবিকা! লোটা যদি আত্মহত্যা করে! ভেবে দ্যাখ লোটা কি সাহসী! ওর জন্যই আমরা বেঁচে আছি। আচ্ছা! তুমি একটা কথা শুনবে! না থাক!

বলে আবার চুপচাপ বসে থাকল সাদইদ। সাদইদের উপর সহসা রিবিকার কেমন মায়া হচ্ছিল! কাছে এগিয়ে যায় রিবিকা।

–আপনি আমাকে সব কথা বলতে পারেন! আমি শুনব!

রিবিকা সাদইদের ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে প্রায় নিজেরই অজ্ঞাতে বলে ফেলে।

–যদি ধরো লোটা আত্মহত্যা করে! আমার তো কেউ নেই। লোটাই একমাত্র বন্ধু! অথচ ও আমার তৈরি ভাষা নিল না । ও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইছে। ও বলে, একদিন সে উটের পিঠে চড়ে বৃষ্টির ভিতর দিয়ে ঝাঁপসা হয়ে দিগন্তে মিলিয়ে যাবে। ভাবতে পারিনে রুহার মত একটা সাধারণ মেয়ের ওপর।

সে পাহাড়ের ওদিকে…কী বলব…খুব খারাপ সেই দৃশ্য!

বলতে বলতে আবার থেমে পড়ে সাদইদ। আবার বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।

–আচ্ছা! লোটা এতক্ষণ তোমায় দেখিয়ে কী বলছিল, কোন মন্দ কথা বুঝি! তুমি কিছু মনে করো না!

ফের চুপ করে থাকে সাদইদ।

–আপনার কষ্ট কিসের! যুদ্ধই তো আপনার সর্বস্ব! নারীকে জোর করলে অন্যায় তো হয় না। দেবদাসীদের ঠাঁই দিয়েছেন তাই অনেক।

বলল রিবিকা।

সাদইদ বলল–কারো জন্য দয়া নয় রিবিকা। আমি ভাড়াটে সেনা! আগেই বলেছি, তোমার চেয়ে ভাগ্য আমার উর্বর নয়। শুধু অস্তিত্বের জন্যই সব, শুধু বাঁচা–আর কিছু নয়–কে আমায় চালিয়ে নিয়ে ফিরছে জানিনে। আজ সমস্ত দিন মনটা বিষণ্ণ হয়ে থেকেছে–কেন আমি মেষ-শিশুকে হত্যা করেছি! প্রতিনিয়ত যুদ্ধ দেখে দেখে হৃদয় নষ্ট হয়ে গেছে। আমি তো শৈরীর মানুষ। জন্মের আগে থেকে যুদ্ধ আমাকে নিয়তির মত অনুসরণ করেছে। অথচ আমার শিক্ষা সম্পূর্ণ হল না! একটি পতঙ্গ যা জানে আমি তা জানি না। একটি কুকুর কখনও বিশ্বাস ভঙ্গ করে না। প্রভুর জন্য প্রাণ অবধি ত্যাগ করে! সূর্যদেবতা সামাশের চেয়ে একটি শিশু অধিক পবিত্র। আমি তোমার বুকে ইন্দ্রধনুর রঙ। আর আলো দেখেছি রিবিকা!

বলতে বলতে স্বর যেন গলার ভিতর নিবে আসে সাদইদের।

–তোমার কেউ নেই?

–আমার জন্মের কথা আগেই বলেছি!

–মহাত্মা ইহুদকে এভাবে হীন কাজে নিয়োগ করলে কেন? উনি আমার পিতা।

–কে তিনি?

–যাঁর হাতে লাঠি রয়েছে!

যুদ্ধই তাঁকে নিয়োগ করেছে বিবিকা!

–এ তোমার চালাকি! তোমার সৈন্য ওঁকে বেঁধে এনেছে। আমাদের তামাম দলটাকে হত্যা করেছে।

–যুদ্ধ যে তাই করে আমনের বউ!

–তোমার শিশুবিলাসকে আমি ঘৃণা করি সারগন! শিশুকে স্পর্শ করার অধিকার তোমার নেই।

রিবিকা সাদইদের কাছ থেকে সরে চলে এসে হেরার পুত্রকে কোলে তুলে নিয়ে দুই চোখ মুদে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করতে থাকে।

সাদইদ সেই দৃশ্য দেখে ভাবে–এই ছবি একটি স্বর্গের ছায়া। তখনই একটি উট এসে গবাক্ষপথে গলা বাড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। গায়ে ওর শব বহনের ঘ্রাণ।

রিবিকা সুতীব্র ভয়ে শিশুকে বুকে সজোরে চেপে ধরে চিৎকার করে ওঠে। সাদইদ দ্রুত আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে গবাক্ষের কাছে সরে আসে। তারপর ত্বরিতে গবাক্ষের ঝাঁপ ফেলে দেয়।

বাইরে চলে আসে একাকী সাদইদ। তার মনে হয়, একটি প্রস্তাব উত্থাপন। করতে গিয়ে সে থেমে গেল কেন? লোটার ভাষা বোঝে রিবিকা। এই যুক্তিই যথেষ্ট। লোটাকে নিঃসঙ্গতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে রিবিকাই।

কিন্তু কেবলই তার চোখের উপর ভাসছে প্রজাপতি–অধিকৃত এক কোমল সৌন্দর্য। কী অপার সেই রূপ! পতঙ্গ যার সুরক্ষার দাবি করে তার জন্য কী করতে পারে একজন ভাড়াটে সৈনিক? কিছুই কি পারে না? মধু আর বিষ–ভাস্কর হেরা জগৎকে প্রশ্ন করেছে কী দেবে মানুষ শিশুর মুখে!

উটটা চলে যাচ্ছে জ্যোৎস্নার প্লাবনে ক্রমশ। কালো অষের পিঠে চড়ে একলা মরুর উপর অকারণ ছুটে বেড়াচ্ছে লোটা। এ যেন তার একলার উৎসব। লোটা মুখে স্ফূর্তির তীব্র চাপা এক-ধারা শব্দ করছে। এ তার কান্নাও হতে পারে!

হঠাৎ কখন পাশে এসে চুপটি করে দাঁড়িয়েছে রিবিকা। সাদইদ ঘাড় ঘুরিয়ে মায়াবতী রূপসী দেবদাসীকে দেখল। রিবিকার মাথার কাপড় বাতাসের ধাক্কায় কাঁধে খসে পড়ল। চাঁদের পানে মুখ তুলল রিবিকা। তার চোখের কোণে গড়ানো অশ্রু নিচের পাতার তলে বিন্দুবৎ জমেছে। চাঁদের আলো ঠিকরে এসে পড়ছে সেই বিন্দুর উপর।

জ্যোৎস্নায় এত মোহ, এত তীব্র ভাললাগা থাকে সাদইদ জানত না। সে ভাবল, এই নারী কেন চিরকাল থাকে না এই চন্দ্রকলাকৃতির দেশে! সে কেন ফুরিয়ে যায়?

ভাষা থাকে, ধর্ম থাকে, দেবতারা আকাশে থেকে যান, এমনকি পিরামিড ধ্বংস হয় না। এই নারী কেন এমন থাকে না চিরকাল? রিবিকা তুমি থাকবে–বলে হাত বাড়াতে গিয়ে থেমে গেল সাদইদ। দেখল, উটটা দিগন্তে হারিয়ে যাচ্ছে, কালো ঘোড়া লাফাচ্ছে!

০৫-৬. লোটার কেবলই মনে হচ্ছিল

লোটার কেবলই মনে হচ্ছিল তার সমস্ত গা পচে যাবে। শব বহনের সময় মানুষের মৃতদেহ থেকে গলিত রক্ত সারা দেহে লিপ্ত হয়েছে, দেহ থেকে একটা বীভৎস গন্ধ কিছুতেই নড়তে চাইছে না। একথা সে কাকে বলবে? কালো ঘোড়া ছুটিয়ে সমস্ত রাত সে জ্যোৎস্নায় মরুভূমি তোলপাড় করেছে। কিন্তু এভাবে তো বাঁচা যায় না।

সকালবেলায় রুহার মৃত্যু-সংবাদ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। রুহার মৃত মুখে গাঁজলা উঠছে। রুহা ভোররাতের কোন এক সময় বিষ গিলেছে। মরবার সময় সে অন্য দেবদাসীদের বলে গেছে–সে ছিল চাষীর মেয়ে। দেবী ইস্তার যেমন দুঃখী, সেও তাই। মরে যেতে তার বাধে না। আবার সে পৃথিবীতে আসবে। সঙ্গে থাকবে তামুজদেব। তামুজকে যুদ্ধের গহ্বর থেকে সে উদ্ধার করে ফিরে আসবে। সে আর দেবদাসীর জীবন নয়, চাষীকন্যার মত দুঃখে তাপে বেঁচে থাকবে। হাজার একটা লোক তাকে ছিঁড়ে খাবে দেবী ইস্তার তা চান না, তাই সে চলে যাচ্ছে।

খোড়ো মন্দিরের সিঁড়ির তলায় তক্তার উপর শোয়ানো হয়েছে তাকে। তার চোখ তুলে তাকানোর সাধ্য নেই। গা খিঁচুনি দিচ্ছে প্রবল ধাক্কায়। তার পা দু’টি তক্তার উপর স্থির রাখা যাচ্ছে না–মাথা পড়ে যাচ্ছে তক্তা ছাড়িয়ে। মাথা একজন, অন্যজন পা দু’খানি ধরে আছে চেপে। এই দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখছে লোটা। রুহার মুখে যাতে বাতাস লাগে, সেজন্য লোকজনের ভিড় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। লোটা স্পষ্ট সব দেখতে পাচ্ছে। তার গায়ে গরম জল ঢালছে। এক কানা বুড়ি। এই বুড়ি ছাড়া কেউ লোটাকে স্পর্শ করে না। বুড়ি বোবা বলে তার ভাষার বালাই নেই। তাছাড়া বুড়ি তার নিজের ধর্ম কী বলতে পারে না। তার কাপড়ের আঁচলে বাঁধা থাকে গুটিকতক কুমীরের প্রতীক। তাই হয়ত তার দেবতা।

বুড়ি গরম জল ঢেলে ঢেলে পাথরের খোয়া দিয়ে নোটার গায়ের রক্ত ঘষে তুলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। কানা বুড়ি এক চোখে ঝাঁপসা দেখতে পায়। লোটা কড়াইতে করে মৃতদের পরিত্যক্ত কাপড়-চোপড় সেদ্ধ করে চলেছে। জ্বালানি ঠেলে দিচ্ছে আর লাঠি দিয়ে কড়াইয়ের সেদ্ধ হতে থাকা বাষ্পময় বস্ত্রগুলি গুতোচ্ছে। মাঝে মাঝে গরম জল গায়ে পড়ার সময় লোটা সামান্য চেঁচিয়ে উঠছে। সে দেখছে চোখের সামনে রুহার মৃত্যু।

খিঁচুনি দিতে দিতে এক সময় রুহার দেহ স্থির হয়ে গেল। লোটা তখন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। সাদইদ লোটার সামনে এসে দাঁড়াল চুপচাপ। অনেকক্ষণ কোন কথাই বলল না । লোটা রক্তাক্ত চোখ তুলে সাদইদকে একবার। দেখল। তার বুকে কান্না জমাট বেঁধে গেল–সে আর কাঁদতে পারল না।

লোটা জানত এখন তাকে কী করতে হবে। ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। একটা উট টেনে আনল মৃতদেহের কাছে। সবাই সরে দাঁড়াল একটু তফাতে। মৃতদেহ স্পর্শ করা মাত্র লোটার তাবৎ দেহ থরথর করে কেঁপে উঠল।

লোটা অদ্ভুত একটা আর্তনাদ করে উঠল। তার ভাষা তো কেউ বোঝে না। বারবার সে সাদইদের দিকে চোখ তুলে কী যেন প্রশ্ন করছিল। সাদইদ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত করল রিবিকাকে আনা দরকার। ঘোড়া ছুটিয়ে গিয়ে সাদইদ রিবিকাকে পাহাড় থেকে তুলে আনল।

লোটা তখনও আর্তনাদ করে চলেছে। রিবিকা দুই চোখ বিস্ফারিত করে শুনতে পেল–ছায়া। ছায়া থাকবে তো! রুহার ছায়া কি থাকবে না কোথাও?

কথা বলতে গিয়ে রিবিকার গলা কান্নায় বুজে এল। সকলে তার মুখের দিকে প্রশ্নাতুর চোখে চেয়ে আছে। রিবিকা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল–ছায়া। ও বেচারি রুহার ছায়ার কথা বলছে!

এখানকার কিছু মানুষ রিবিকার কথা বুঝতে পারল। রিবিকা বিচিত্র ভাষা জানে। কখনও সে আমারনার ভাষা, কখনও হিদ্দেকলের ভাষা, কখনও কনানী ভাষায় বলল-ছায়া কি থাকে না কোথাও!

পুরোহিত রুহার শেষ স্নান করিয়ে দিল। তারপর বলল–ছায়া তো থাকেই । থাকবে না কেন? কিন্তু কোথায় থাকে সে কি আর দেখা যায়। জ্ঞানী মানুষ দেখতে পান মাত্র। তুমি তো পাপ করেছ লোটা। সরে দাঁড়াও!

পুরোহিত আর লোটাকে রুহার দেহ স্পর্শ করতে দিল না। সাদইদ লোটাকেই মৃতদেহ উটের পিঠে তোলার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। পুরোহিত সেই নির্দেশ বাতিল করে দিয়ে বলল–মানুষ মৃতাকেও গমন করে জানবেন। লোটা শবানুগমন করতে পাবে না।

রুহাকে পিঠে করে উট চলতে শুরু করল দিগন্তের দিকে। পুরোহিত প্রবল ঘৃণায় লোকটাকে বলল–ভাষা তো শিখলে না! আমি কতদিন তোমায় যুদ্ধের জরুরি ভাষা, তাঁবুর ভাষা শেখাতে চাইলাম। গা করলে না। নিজ ধর্মে তুমি একটা পাষণ্ড! সালেহর মত তোমারও কোথাও ঠাঁই নেই বাপু! চলো হে, শব এখন যাত্রা করুক, রোদ চড়া হয়ে যাচ্ছে! একটা উটই তোমার নিয়তি, ওই বিকট পশুটাই একদিন তোমাকে দিগন্তে পৌঁছে দেবে–ভাবনা কিসের!

যাত্রা যখন সবে শুরু হয়েছে, সকলে নড়েচড়ে চলতে শুরু করেছে, মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য, এ যে যুদ্ধে বিনাশ হওয়া নয়, তাই এর শবানুগমন আছে, উট একলা দিগন্তে নিয়ে যাবে না, মানুষও শবের পিছনে পিছনে যাবে মৃত্যুর খাদ অবধি–মানুষ সবে চলতে শুরু করেছে, সবার শেষে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ইহুদ। তিনি লোটার কাছে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে নিঃশব্দে কাঁধে হাত রাখলেন।

লোটা আশ্চর্য হল। মানুষটি তার চরম উন্মত্ত অবস্থায় কাঁধে হাত রেখেছিলেন, চরম দুর্দশার মুহূর্তে এবং এখন শোক আর ব্যর্থতার, অপমানের। শেষহীন সংকটকালেএগিয়ে এসে দ্বিতীয়বার হাত রাখলেন। এ কেমন মানুষ!

চাপা সুরে এই প্রথম ইহুদ কথা বললেন–তোমার ভাষায় যে কথা বলে সেই তোমার আপনজন লোটা। দুঃখ করো না। যবহ তোমায় বিচ্ছিন্ন করেছেন।

লোটা ইহুদের কথা বুঝতে পারল না বটে, কিন্তু মনে মনে কী যেন এক আশ্বাস অনুভব করল।

উট তখন বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে।

লোটাকে ইহুদও ছেড়ে গেলেন। শবানুগামী দলটি ক্রমশ দূরবর্তী দৃশ্যে মিলিয়ে যেতে থাকে। লোটার কালো ঘোড়াটি কাছে এসে পাশে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায়। এই প্রবল শক্তিমান নিবার্ক প্রাণীটিই তার একান্ত আশ্রয়। লোটার চোখ যবহের চোখের মত জ্বলতে থাকে। ইহুদের ভাষা সে বোঝেনি, কিন্তু কেমন এক ধারা আশ্বাস পেয়েছে, অবশ্য একজন গামছাবালার আশ্বাসেরই বা কী দাম! বেচারি এরপর অন্য দেবদাসীর তাঁবেদারি করবে। ইহুদের কোলে রুহার কালো বাচ্চাটা খেলা করছিল। একজন কোন দেবদাসীর কাছে বাচ্চাটা জমা হবে। যারা বৃদ্ধা, তারাই অবৈধ পিতৃমাতৃহীন শিশুদের আগলায়।

লোটা সাদইদকেও চলে যেতে দেখল পাহাড়ের দিকে–সুন্দরী ওই মেয়েটিকে ঘোড়ার উপর কোলের কাছে বসিয়ে নিয়ে রাজার হালে সাদইদ হেলেদুলে যাচ্ছে–এই দৃশ্য অসহ্য! নোটার কাঁধে তামাম যুদ্ধের ভার। অথচ সকলের জন্য রয়েছে নারী আর শিশু। লোটার কেউ নেই। আছে কেবল অপমান। রুহা আত্মহত্যা করেছে ঘৃণায়। পূর্বদেশে চাষীদের সঙ্গে উটবালাদের দাঙ্গা দীর্ঘকালের ঘটনা। চাষীরা উট উপাসকদের সহ্য করে না। যাযাবর বেদে বলে উপহাস করে। যারা থিতু জীবন পেয়েছে, তারা ভেসে বেড়ানোদের কেনই বা সইবে! হানাদার বলে প্রবল ঘৃণায় চোখ কোঁচকায়। সবই লোটা জানে।

অথচ সবই ভগবানের ইচ্ছে। বাবিলের জিগুরাত ঈশ্বর ধ্বংস করে দিলেন। মানুষের স্পর্ধা আকাশের দেবতাদের ভাল লাগল না। মানুষ স্বর্গের সিঁড়ি বানিয়ে দেবতাদের আক্রমণ করতে চেয়েছিল। দেবতাদের অন্তত তাই ধারণা। স্বর্গ ধ্বংস হল–এই শাস্তিই যথেষ্ট ছিল। ক্রুদ্ধ দেবতারা কিন্তু আক্রোশবশত মানুষকেই বিচ্ছিন্ন করে দিলেন! ভাষা আলাদা হয়ে গেল।

লোটা ভাবল, তার নিজের ভাষাটি ঈশ্বরের দান। ঈশ্বরই লোটার বিচ্ছিন্নতা চেয়েছেন। না চাইলে এই ভাষা তিনি যোগাচ্ছেন কোথা থেকে! ভাষা ত্যাগ করলে মানুষের আর রইল কী? সাদইদ তার ভাষাই কেড়ে নিতে চাইছে। ভাষা চলে গেলে ধর্মও আর আস্ত থাকবে না। সাদইদ তাকে কিছুই দেয়নি। বরং কেড়ে নিতে চাইছে। অথচ বারংবার আশ্বাস দিয়ে চলেছে, নিনিভে ধ্বংস হলে যুদ্ধের যা পাওনা লুঠ করে নিতে পারা যাবে, তাই হবে জীবনের পক্ষে যথেষ্ট। অতঃপর তারা কানের দিকে ঢুকে যাবে। সেইসব লুঠ করা পশু, খাদ্য, বস্ত্র, অলংকারাদি নিয়ে কনানে ঢুকতে পারলে জীবনটা অন্যরকম হতে পারে। আসলে কী হতে পারে কেউ জানে না। রাজা হিতেন সমস্তই কেড়ে নিতে পারে।

এই যুদ্ধে জীবন তো কোথাও আস্ত নেই। সর্বত্র ধ্বংসলীলা চলেছে। চাষীর খেতখামার জ্বালিয়ে দিয়েছে সর্বত্র। পশু বধ করে চলে গেছে অসুররা। চাষীরা যেসব রাষ্ট্রে খাল কেটে চাষ করার নতুন প্রণালী আবিষ্কার করেছে, তারাও গৃহছাড়া–খালগুলি বুজিয়ে দিয়ে গেছে যে যেমন পেরেছে–শুধু অসুর নয়, সর্বাত্মক এই যুদ্ধে সকলেই যেন সকলের শত্রু হয়ে গেছে।

সবচেয়ে দুঃখজনক, আঙুর কুঞ্জগুলি তছনছ করেছে এই যুদ্ধ। মানুষ মদ অবধি তৈরি করে খেতে পারছে না। মদ না পেলে সৈনিক লড়বে কী করে?

ভাবতে ভাবতে লোটার আকণ্ঠ তৃষ্ণা জেগে ওঠে। মদ আর শুঁটকির চাট তার রক্তের অধিকার, রক্তের উষ্ণতা এ ছাড়া হয় না। শীত আসার আগেই যদি নিনিভে ধ্বংস না হয়, তবে এই শিবির প্রাণীশূন্য হয়ে যাবে। সাদইদ কাপড়, মদ, খাদ্য কোনটাই পর্যাপ্ত জোগাড় করতে পারবে না। গ্রামগুলিতে দুর্ভিক্ষ, মহামারী–তন্দুর বিড়! একখানা রুমালটি আর চারখও ভেড়ার মাংস নিয়ে একটা পরিবারে হানাহানি অবধি হয়ে যাচ্ছে।

জীবনটা এখন অন্ধ কেঁচোর মত–কোনদিকে চলেছে বোঝা যায় না। যেদিকে অত্যধিক আঘাত পাবে মনে করে, সেদিক থেকে গা টেনে ভয়ে অন্যদিকে ছোটে। কিন্তু কোথায়, জানার উপায় নেই। চলেছে মাত্র। দিকহীন, অন্ধ এক যাত্রার নাম যুদ্ধ। ক্রীতদাস যারা, কেন ক্রীতদাস তা যেমন তারা জানে না, যুদ্ধ কেন, কিসের যুদ্ধ সে জানে না। ইহুদও কি জানেন এই যাত্রার অবধি? যাদের তিনি সঙ্গে করে এনেছিলেন মিশর থেকে, তারা কোথায়? সবই মরুভূমিতে হারিয়ে ফেলেছেন। লোকটা নিতান্তই বোকা! তাঁর অনুসরণকারী নেই। পশুদল নেই। অথচ লাঠিখানা হাতছাড়া করছেন না। সৈনিকরা তাঁকে বেঁধে এনে দেবদাসীর মন্দিরের সামনে টুল পেতে বসতে দিয়েছে। সাদইদ এই বেচারির সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। কেনই বা না হবে? লাঠিধারীদের এই যুদ্ধের সময় কত বেশেই না দেখা যায়। আসলে এসব লোক, আপনি বাঁচলে বাপের নাম করে, মোদ্দা হল বাঁচা-মাথাটা এখানে জড়ে দিয়েছে। তা, লোকটা বোকা, কিন্তু ভদ্র। কেঁচোবৎ নড়াচড়া করছে। কাঁধে হাত রাখলে মন্দ লাগে না। তবে গা কেমন সিরসির করে।

ভাবতে ভাবতে লোটার বুক হু-হুঁ করে উঠল। কোথায় চলেছি? কেন যুদ্ধ করছি! শীতে বাঁচব কিনা জানি না। সাঁজোয়া ভর্তি করে লাশ বহে এনে পোশাক ছিনতাই করছি–জীবনের এই তলানি এত উষর যে, সেখানে একটা নারী অবধি পাওয়া যায় না! কারুকে ছুঁয়ে ফেললে সে আত্মহত্যা করে! এই অন্ধ জীবন আর আমি চাই না, হা নবী!

লোটা আকাশে মুখ তুলে সুতীব্র চিৎকার করে উঠল। জেহাদী এই কণ্ঠস্বর যুদ্ধের আর্তনাদ। মানুষ যখন শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন এভাবে চিৎকার করে। এই আর্তনাদ মনে হয়, তামাম চন্দ্রকলাকৃতি বাঁকা ভূখণ্ডকে মথিত করছে। আকাশ থেকে চোখ নামালো লোটা। দূরপথে চোখে পড়ল এক পুরোহিত একা ছুটছে রুহাকে বহে নিয়ে যাওয়া উটের শবযাত্রীর পশ্চাতে, সে পিছিয়ে পড়েছে। এই পুরুত টোলে বসে সাদইদের জুমপাহাড়ী অরমিক সমন্বয়ী ভাষা শেখানোর ওস্তাদি করে। শালা পা নাচায় আর উচ্চারণ করে ইয়াহো! ইয়াহো! হা খোদা! যখন লোটা টোলের বাইরে দেবদারুর তলায় বসে থাকে-ওই পুরুত বাঁকা তলচোখে যেন ব্যঙ্গ করে। একে খুন করে ফেলতে ইচ্ছে হল লোটার।

লোটা ফের আর্তনাদ করে উঠল। এ গর্জন তার নাভিতে মোচড় দিয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছিল। লোটা হাহাকার করে উঠল–এই মুহূর্তেও তার ভাষা কেউ বুঝতে পারছে না।

নোটার আর্তনাদে সাদইদের পাহাড় অবধি কেঁপে উঠল! গা কেঁপে উঠল। রিবিকা ব্যাকুল স্বরে বলে উঠল–লোটা কেন অমন করছে! ও কি মরে যাবে!

আবার আর্তনাদ ভেসে এল-সলেহও … …ও ও… পি. ই ই তা… আ… আ… আ…

রিবিকা আপাদমস্তক শিহরিত হয়। তার শরীর কণ্টকিত হয়ে ওঠে।

অগ্নিদগ্ধ গ্রাম। দুর্ভিক্ষ-কবলিত উৎসন্ন জনপদ। মারী-পীড়িত লোকশূন্য গৃহ। খুঁটায় ঝুলন্ত মৃতদেহ। শেয়াল-কুকুরে-শকুনে টানাটানি করা মৃত্যু। নগরীর একটি ধ্বস্ত দেওয়াল আগুনে পুড়ে কালো হয়েছে। মুহূর্তে চোখের উপর দিয়ে। ছবির মত ভেসে যায় সাদইদের। এ যেন সেই আর্তনাদ, যার নগর কিংবা গ্রাম বলে কিছু নেই–সর্বত্র এই প্রাণফাটা চিৎকার উঠছে! কিন্তু এ আর্তনাদ এখন লোটারই একান্ত হৃদয় থেকে নিংড়ে বার হচ্ছে। তার মুখ বন্ধ করার উপায় সাদইদ নির্ণয় করতে পারছে না।

সাদইদ অশ্বপৃষ্ঠ থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে চাইল। দিগন্তে ওরা পৌঁছে গেছে। ছোট পাহাড়টির মাথায় রয়েছে বালদেবের মন্দির। সেখান থেকে প্রকাণ্ড একটি ঘণ্টাধ্বনি কান পাতলে এই নির্জন দুপুরে শোনা যেতে পারে। সেখানে রয়েছে পবিত্র শিলা আর পবিত্র বৃক্ষ। পুংশক্তি আর স্ত্রীশক্তির প্রতীক। এ স্থান গ্রাম নয়, নগরও নয়। অথচ দেবতা ছোট পাহাড়টির শীর্ষস্থান কখন কীভাবে দখল করে বসেছেন সাদইদ জানতেই পারেনি। শুধু তাই নয়, সূর্য মন্দিরগুলির সামনে গাছের বদলে খুঁটি পুঁতে রেখেছে দেবদাসীরা। এর নাম ‘আসেরা’।

এরা দেবদাসী বটে, কিন্তু কেউই চাষী জীবনকে ভুলতে পারে না। দেবী ইস্তার অথবা বালদেবকে স্মরণ করে। আসেরা তারই প্রমাণ। এরা কেউ ছিল বাবিলে, আসিরিয়ায় অথবা মিশরেকীভাবে ভাসিয়ে এনেছে যুদ্ধ! নিনিভের অবরোধ। মিশরের দুর্ভিক্ষ। কিন্তু এদের বেশির ভাগ এরা অরমিক ভাষাটি মান্য করল, তাঁবুর ভাষা দ্রুত শিখল–কেবল উট-উপাসক বেদেটি মাথা নোয়াল না। তার কারণ, মিশরীয়, মোসোপটেমিয়া, হিটাইট আর কনানী হিব্রসদৃশ সমন্বয়ী ভাষাটি কীলকাকৃতি নকশার ভাষা নয়। অথচ এ ভাষা মরুভূমিরই ভাষা। এ কথা লোটা বুঝতেই চাইল না। সে ভয় পেয়ে গেল। নকশা থেকে লিপিতে এ ভাষার পরিণতি ঘটেছে, একথা লোটা সহ্য করল না। তার ভাষা কত পুরনো। ধর্মও পুরনো।

লোটা কি প্রাচীন আমালেক জাতির লোক? প্যালেস্টাইনের মরু অঞ্চলে এর পূর্বপুরুষরা বাস করত? বারো গোষ্ঠীর কোন এক গোষ্ঠীই কি তার গোষ্ঠী? কী যে তার অতীত ইতিহাস, জানা যায় না। এমন হতে পারে, তার গোত্রের নাম। হয়ত ‘আসের’ । সে যে চাষবাস মোটেও জানে না, তা বোঝা যায়।

তবে লোটা যে ইউসুফ’ গোত্র নয়,তা ঠিক। কারণ বারো গোষ্ঠীরা আব্রাহামী আমোরাইট। মোসি ছিলেন ইউসুফ গোষ্ঠীর লোক হয়ত। কী ছিলেন বোঝা ভার। বারো গোষ্ঠীর নামগুলি চমৎকার। রুবেন, সিমিওন, লেবি, যিহুদা, দান, নপ্তালি, গাদ, আসের, ইষাখর, সবুলুন, ইউসুফ। হতে পারে মোসি ছিলেন যিহুদা গোত্রের মানুষ। কী হতে পারে কেউ জানে না।

লোটার আমালেকরা হয়ত বারো গোষ্ঠীরই কোন গোত্র-উদ্ভূত। কী বিচিত্র। গোত্রধর্মগুলি! কেন যে লোটাকে বোঝানো গেল না, এ ভাষা যেমন চাষীর ভাষা, তেমনি তাঁরুর মাংসখেকোদের ভাষাও বটে। যাযাবরী সংস্কৃতি কী উচাটন!

না পারে গৃহনির্মাণ, না পারে ধাতু বা পাথরের কাজ কিংবা চাষবাস। পুরো এক যাযাবর! এ লোক যুদ্ধ ছাড়া কিছুই পারবে না। পারবে হানা দিতে, লুঠ করতে, ঘর জ্বালাতে, উট দিয়ে শস্যক্ষেত্র তছনছ করে দিতে! এ মেষ প্রকৃতি নয়। উটের মত শূন্যে ভাসমান জীব। খুব অদ্ভুত যে,এখানকার অন্য সৈনিক আর দেবদাসীরা নিজেদের চাষী মনে করে–দুঃখী, কিন্তু তাদের জমিজায়দাদ ছিল একদা–ঐশ্বর্য ছিল! এই গর্ব তাদের সম্বল। ক্রীতদাসত্বেও অনেকে তার চাষীত্বের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে পারেনি। অথচ যখন একজন সৈনিক তার বেদনার্ত গলায় সুর করে বলে :

‘আমার থাকবে এক আঙুর বাগিচা–
এ আমার নিজের কুঞ্জখানি প্রিয়,
বসিতে দিও ঠাঁই বিছায়ে আঁচলখানি তব;
ডুমুর বৃক্ষের তলে, আমার সে নিজস্ব ডুমুর,
কেউ মোরে হানিবে না তীর, বর্শা বা কুড়ল,
নির্ভয় সে জীবন মম, সেই মোর অমরাবতী তীরে
স্বপ্নের কুটীর ॥ [মীখা ৪ : ৪ ]

বোঝা যায় না, এই সৈনিকটি কে? যাযাবর,নাকি চাষী! এ তার কিংবদন্তীর সত্যযুগে নিবিষ্ট দু চোখ মেলে চেয়ে থাকা। সাদইদ জানে, যাযাবর আর চাষী আলাদা থাকেনি চন্দ্রকলার বাঁকা মৃত্তিকায়–অথচ লোটাকে তারা সহ্য করল না।

অথচ নিশিমার মত সামান্য দেবদাসী তাকে কুকুরের মত ধাক্কা দিয়ে দুয়ারের বাইরে ঠেলে ফেলে দিলে। এই দেবদাসীরা আমনের বউ। দেবতা সামাশকে সহ্য করে তারা, গ্রহণ করেছে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের তুলাদণ্ডে মেপে। বালদেব আর আমন বা সামাশ অনেক শক্তিশালী–কিন্তু উট কী কাঙাল একটি জীব! অচ্ছুত ওই জীবটা, মৃতদেহ বহা ছাড়া কোনওই কাজ হয় না। চাষী বৃষভক্ত, তার শস্য বইবার গাড়ি কী উন্নত! দেবী ইস্তার কী লাবণ্যময়ী। হিত্তীয়রা রথ চালায়, আমনভক্তরানী ইবেলসূর্যের ধর্ম সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে গেছেন! রথের যুগ এখন শ্লথগতি ভাসমান উট কী বোকা! গা ঘৃণায় কুঁচকে যায়।

নিশিমারা সম্রাট ফেরাউনের ধাতুবলয় নির্মিত রথের চাকা বালুরাশির ঘর্ষণে আগুন-স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে ধাবিত হতে দেখেছে। কী শৌর্য! এই রথ নিয়ে ফেরাউন মোসিকে লাল দরিয়া অবধি তাড়া করে গেছিল! রাজা হিতেন যখন সুন্দরীদের দেখতে আসে এই জুমপাহাড়ীতে, তখনও আগুন ঝলসায় চাকার আবর্তে। রাজার পায়ে লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে। সাধ হয় তেনার হারেমে গিয়ে থাকতে। রাজা হিতেনের দেহে রতি আর কামের সমান অবস্থা। কেমন সেই হারেম। নিশিমা বলেছে–আমি যাব! কিন্তু কে তাকে নিচ্ছে? ত রূপ তো নিশিমার নেই!

সাদইদ ভাবতে ভাবতে রিবিকার সুন্দর মুখোনির দিকে সকরুণ চোখে দেখল। রিবিকা বলল-লোটার কাছে একবার যাও। ও যে পাগল হয়ে গিয়েছে! রুহার অন্তরে এত ঘৃণা ছিল সারগন!

সাদইদ বলল–হ্যাঁ, রিবিকা! এখানকার দেবদাসীরা কোহিন আর বল-এর গল্প করতে ভালবাসে! আদম আর হবার দুই পুত্র! কোহিন চাষী। এবল মেশপালক, পশু চরায়। ওরা দুজনে ঈশ্বরকে খুশি করার জন্য পাথর দিয়ে দু’টি বেদী তোয়ের করে। কোহিন তার শস্যসবজির উপচার বেদীতে রাখল। এবল রাখল তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ পশুর মাংস। তারপর দুজনই আগুন লাগিয়ে দিল। উদ্দেশ্য ছিল তাদের নৈবেদ্যের আগুনে পোড়া সুগন্ধ দেবতা গ্রহণ করবেন।

রিবিকা বলল-ইহুদের মুখে এ গল্প শুনেছি। এবলের ধোঁয়া আকাশে যবহের দিকে উঠে গেল। কোহিনের ধোঁয়া নিচে নেমে গেল। এই পাল্লাতে মেষপালক জিতেছে।

সাদইদ বলল–না রিবিকা! নিশিমারা কোহিনকেই জেতায়। বুঝতে পারি এই দ্বন্দ্ব যাবার নয়। অনেক দেবদাসী নিরামিষ আহার করে। অথচ মরুভূমির শীতে গা উষ্ণ রাখতে হলে মাংস-রুটিই খেতে হয়। ডুমুর-রুটি সৈন্যরা পছন্দ করে না। দেবদাসীরা কেউ কেউ ঘুচিবায় দেখায়। তবু শেষমেশ সেনাদের ঘরে নিতে আপত্তি দেখি নে! কিন্তু লোটা যে উট-উপাসক। খুব দুভাগ্য! আমরা যাযাবর, কে আর কে নয়-কারো বলার সাধ্য নেই। যুদ্ধ আমাদের এখানে গুতিয়ে এনে জড়ো করেছে। লোটা উটে করে মড়া বইবে–এ যেন একটা পেশা! এভাবে তাকে ঘৃণা করে ঠেলে দেওয়া হল! রুহার মৃত্যুর জন্য এই দুভাগ্য দায়ী। নবী সালেহও তো একটা শস্যসবুজ উপত্যকার স্বপ্ন দেখেছিলেন!

শুনতে শুনতে রিবিকা চমকে উঠল! সহসা তার চোখের সামনে আক্কাদের ভয়ংকর কঠোর মুখ ভেসে উঠল। উটের পিঠে দোলায়িত রমণের ক্ষুব্ধ বিষয় শোকাবহ স্মৃতি হৃদয়ে গুমরে উঠল।

রিবিকা সহসা এক অজ্ঞাত ভয়ে আপনমনে সিটিয়ে উঠল। সে তার অতীত জীবনের ছায়াকে মনের তলায় দেখতে পেয়ে জীবন সম্পর্কে এক অপূর্ব তৃষ্ণা অনুভব করছিল। এ তৃষ্ণা যে কিসের তা সে জানে না। সে আর সাদইদকে বলতে পারল না লোটার কাছে যাও। বরং তার মনে হল, সাদইদ তাকে এই মুহূর্তে যেন ছেড়ে না যায়। হঠাৎ তার মনের এই পরিবর্তন দেখে রিবিকা নিজেই কেমন হয়ে গেল।

বলল–এই দুপুরে আর কোথাও গিয়ে কাজ নেই তোমার। যা হবার তা হয়েই গেছে। আমাদের বাচ্চাটা একা রয়েছে, ঘুম থেকে জেগে উঠলে ভয় পাবে!

সাদইদ রিবিকার কথা শুনে আশ্চর্য হল। মনে হল, এই মেয়েটির মনেও একটা সংসারের ছবি বিরাজ করছে, যে কিনা যুদ্ধকে ভয় পায়–আর লোটা যেন যুদ্ধেরই বিভীষিকা! রুহার মৃত্যুকে যেন রিবিকা গোপন করতে চাইছে!

সাদইদ বলল–লোটা গৃহনির্মাণ, চাষবাস, পাথরকাটার কাজ কিছু নিশ্চয়ই পারবে না। কিন্তু দেশরক্ষার কাজে তার কোন জবাব নেই। অথচ দেখো লোটার নিজেরই কোন দেশ নেই।

রিবিকা এ প্রসঙ্গ আর শুনতে চাইছিল না। বলল–তোমার পাহাড়টা কি ভাল সারগন। আকাশের তলায় এ যেন আশ্চর্য স্বপ্ন!

–তোমার পছন্দ হয়েছে?

–খুউব! তবে আমার পছন্দের কীই-বা দাম!

–কেন?

–কালই তুমি আমায় তাড়িয়ে দেবে! দেবে না?

–কী করে বলব!

সাইদের এই জবাবে বক্তা এবং শ্রোতা দুজনই অবাক হয়। রিবিকা প্রথম থেকেই শুনছে সাদইদের প্রচুর সুন্দরী রয়েছে, অথচ নিজের বলতে তারা তার কেউ নয়-বাই মন্দিরের মাল। যুদ্ধের পড়ে-পাওয়া মজুত দ্রব্য। সাদইদ প্রকৃতপক্ষে লোটারই মত একা। কিন্তু লোটার মত বিচ্ছিন্ন নয়, বঞ্চিতও নয়। কাকে তবে সে ভালবাসে? একজন দেবদাসীর কী হবে–সেকথার জবাব তার জানা নেই–একথা বিশ্বাস করতে হবে! পরম আশ্চর্য হয়ে ঘাড় ফেরাল রিবিকা! সাদইদের চোখের দিকে তবু সে চাইতে পারল না।

সাদই অবাক হয়ে রিবিকাকেই অপলক দেখছিল। কী এমন ঘটল যে,এমন কথা তার মুখ থেকে বার হল! দেবদাসীর কী হবে কাল–এ যে বাতুল অতি নগণ্য প্রশ্ন! একজন দেবদাসী সূর্যমন্দিরের রক্ষিতা যুদ্ধের জ্বালানি–সৈনিকের দ্রাক্ষারস!

দিগন্ত থেকে এক ঝলক বাতাস এসে অশ্বের গায়ে লাগে। রিবিকার গাত্রাবরণ খসে পড়ে, সোনার মত শরীর, মায়াপুষ্পময় বক্ষস্থল, যা বর্ণবহুল। প্রজাপতির পুষ্পভ্রম ঘটায়, মরুর বুকে এক আশ্চর্য শীতলতা, কোন দামেই এ ঠিক খরিদ হবার নয়, এ যেন সৌন্দর্যের সকল আধারকে উপচে ফেলে!

আকাশে দীপ্যমান দেবতা সামাশ। দূরবর্তী মরুপ্রাঙ্গণে আর্ত তৃষ্ণার্ত লোটার। নিরাকুল চিৎকার চকিত হয় মাঝে মাঝে! দিগন্তে মানুষের সারিবদ্ধ ছায়া, সামনে শববাহক উট, জীবন চারিদিকে ধু-ধু করছে। ঘোট পাহাড় থেকে খোমশের (বালদেব) পূজার ঘণ্টা বিষয় বাতাসে অস্পষ্ট ভেসে আসে। এমন আবহের ভিতর জীবনের এক অবধিহারা বিস্ময় প্রজাপতির পাখার তরঙ্গের মত কাঁপতে থাকে–রিবিকার চোখ দুটি যেন ছায়াচ্ছন্ন রঙিন সবুজ হ্রদ–দুটি চোখ কাঁপে–পাতা কাঁপে, জল ভরে ওঠে।

ধরা গলায় রিবিকা সহসা বলে–পিরামিডের আকাশে চাঁদটা উঠত সারগন। মনে হত, ওই আকাশ আর চুড়ো ছেড়ে কোথাও সে যেতে পারবে না।

–তারপর?

–এখানে এসে দেখলাম, পাহাড়ের মাথায় চাঁদটা এসে পৌঁছেছে। এবার ফের মনে হল, চাঁদটা আর কোথাও যেতে পারবে না। পাহাড় ছেড়ে পালাবার সাধ্যই তার নেই। নীল নদীর আকাশে এই চাঁদটা অস্ত গিয়েছিল সারগন!

বলতে বলতে উচ্চকিত স্বরে কেঁপে উঠল রিবিকা। অষের পিঠের একপাশে রিবিকার পা দুখানি ঝুলছিল–তার পিছনে সূর্য সামনে পাহাড়।

–তারপর?

–কে জানত! চীদ আবার ওঠে! আকাশ কত দূর। তার শেষ নেই। এখানে রাত্রি এল! চাঁদ উঠল! আমি তাঁবুর তলে শুয়ে চাঁদ দেখেছি সারগন! কাল আমার কী হবে বলে দাও!

–সে তো গণকের কাজ রিবিকা!

–দেবদাসীর ভাগ্য তুমি জানো না? আমায় তুমি কুড়িয়ে পেয়েছ! কুড়িয়ে পাওয়া জিনিস ফের হারিয়ে গেলে হৃদয় তবু খারাপ করে! করে না? যার কোনই দাম নেই, তা হারালে মন (হৃদয়) খারাপ হওয়া কী যে বাজে ব্যাপার!

–তারপর?

–তবু তুমি আমায় কিনবে কবি? নোহের সন্তান তুমি!

এই হৃদয়বিদারক আকুলতা যেন শেষহীন এক তরঙ্গ–যা লোটার আর্তনাদকে ছাপিয়ে উঠতে চায়। দুটি স্বরই নিরাকুল, নিরাশ্রয়-দুটি বিপরীত আঘাতে বুক ভাঙে। সাদইদের হৃদয় একটি দ্বীপের মত সমুদ্রে একা জলের তরঙ্গায়িত দোলায় বিধৌত হয়–সেই সমুদ্র, যার বাতাস কিনারে এসে সমুদ্রেরই গর্ভে ফিরে যায়–সে তেমনি এক রুদ্ধ সমুদ্রের মত তোলপাড় করতে থাকে।

–নোহের সন্তানের কাছে বেদামী মানুষও দাম চাইতে পারে সারগন। তুমি কবি। তুমি ছাড়া আমায় তো কেউ কিনবে না। মহাত্মা ইহুদ আমার বাবা। তাঁকে একটি ভাল কাজ দাও। অপমান করো না।

–অ!

–কী হল?

–না। কিছু নয়। আমি কবি নই রিবিকা! আমি ভাড়াটে সৈনিক।

–তুমি রাগ করলে? ইহুদকে মহাত্মা বলেছি বলে?

সহসা কড়া গলায় সাদইদ বলল–একজন দেবদাসী খুবই চালাক হয় রিবিকা! বাইরে সে সুন্দর হলেও অন্তরে অনেক ফাঁদ পেতে বসে থাকে। জানি নে তুমি আমার কাছে কী চাইছ? প্রজাপতি দুটি আমার মত ব্যর্থ কবির ভ্রান্তি মাত্র । দ্যাখ, দেবদাসী কী করে একই সঙ্গে এক পুরুষকে লেহন করে, অন্য পুরুষকে দেহ দেয়। যাকে পিতা বলে ডাকে, সে হয়ত তার প্রেমিক!

রিবিকার দুই চোখ দপ করে জ্বলে উঠল মুহূর্তে। তার মনে পড়ে গেল আক্কাদ তাকে কন্যারূপে খরিদ করে দাসীরূপে ব্যবহার করেছিল। যুদ্ধের সময় পুরুষের হৃদয়ে কোন সত্য থাকে না।

রিবিকা অত্যন্ত দৃঢ়স্বরে বলল কার কাছে কী চাইছি সারগন! কিছুই চাই না।! তুমি যা খুশি করতে পারো। তোমার কাছে দয়া চাওয়া যায়। ভদ্রতা আশা করা যায় না। ভাড়াটে সৈন্য বর্বর–সেকথা সবাই জানে! যুদ্ধই যার নেশা–তার কাছে চাইবার কী আছে! আমায় ঘোড়া থেকে নামতে দাও! তুমি হেরার পুত্রকে মধু দিতে চেয়েছ, তাই যথেষ্ট!

বলে রিবিকা গায়ের কাপড় সামলে তুলে নিচে লাফিয়ে পড়ল। তারপর দ্রুত পাহাড়ের দিকে ছুটল। পাহাড়ে ঢুকে এসে দেখল শিশু তখনও ঘুমিয়ে রয়েছে। ঘুমন্ত শিশুকে বারবার চুমু খাচ্ছিল আপন মনে রিবিকা–একসময় তার পিছনে এসে দাঁড়াল সাদইদ। তার আসা টের পেয়ে পিছন ফিরে স্পষ্ট চোখে দেখল সাদইদকে।

সাদইদ হঠাৎ বলে উঠল–যুদ্ধই আমার নিয়তি রিবিকা। তুমি তোমার কাল কী হবে জানতে চেয়েছিলে। রুহার মন্দিরটা খালি হয়ে গেল! সেখানে তুমি কালই

–সারগন!

দুচোখে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা।

–বাইরে ঝড়ের বেগে ছুটে আসছে হিতেনের দৃত। হয়ত এখনই আমায় চলে যেতে হবে! তোমায় খরিদ করার সামর্থ্য আমার নেই বলেই সারগন বাইরে বেরিয়ে চলে গেল! রিবিকা তার পিছু পিছু ছুটে এসে দেখল একটি সোনালী অষের চালক সারা গায়ে কালো পোশাক মোড়ানো, সাদইদের সঙ্গে কথা বলছে। গোল কাগজে পাকানো পত্র পাঠ করল সাদইদ। তারপর তড়াক করে অশ্বে লাফিয়ে উঠে পিছন ফিরে রিবিকাকে দেখে ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেল! অস্বাভাবিক ক্রোধে মুহূর্তে তার মুখ কঠোর হয়ে গেল। সহসাই নেমে এল ঘোড়া থেকে। রিবিকার সামনে এগিয়ে এসে গালে একটা চড় কষিয়ে দিয়ে বলল–কেন ছুটে এলে?…যাও!

এই সময় কালো পোশাক হা-হা করে অট্টহাস্য করে উঠল। তার কালো মুখ সাদা দাঁতে সবুজ একটা ছোপ লাগানো চামড়ায় হাসির চোটে কুঁচকে গেল।

এত জোরে চড়টা মেরেছিল সাদইদ যে,রিবিকার মাথা ঘুরে গেল! সে পড়ে গেল নিচে। আশ দুটি ছুটে গেল দিগন্তের দিকে। ঝাঁপসা চোখে কান্না-প্লাবিত রিবিকা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল পাহাড়ের পায়ের কাছে ছায়ায়, এই অংশে পাহাড়টি বেঁকে সূর্যকে আড়াল করেছে।

দিগন্ত থেকে শবানুগামীরা ফিরে আসছে। ফিরে আসছে শববাহক উট। নিঃসঙ্গ উট, যার দোলানো গলা শূন্যে ভাসে নিরবলম্ব। আর্তনাদ করছে লোটা। তার অশ্ব চিৎকার করে আকাশ মথিত করছে।

রিবিকার গালে সাদইদের পাঁচটি আঙুলের ছাপ স্পষ্ট বসে গেছে। গালে হাত বুলাতে বুলাতে কান্নায় ফোঁপানো রিবিকা চোখ মুদে ফেলে আশ্চর্য হল–সারগন কি তবে তাকে সত্যিই ভালবেসেছে! নাকি অন্য কিছু? সারগন হঠাৎ অত খেপে গেল কেন? কালো দূতটির সামনে তার বেরিয়ে আসায় কী অপরাধ হয়েছে? ওহো! মা গো! ও যে হিতেনের তাঁবেদার! এ যেন আর এক ফেরাউনের সেপাই।

হঠাৎ রিবিকার শিশু কেঁদে ওঠে। রিবিকা সেই কান্না ক্ষীণ সুরে ভেসে আসতে শোনে। দ্রুত ছুটে যায় পাহাড়ের ভিতর।

শিশু রিবিকার গালে স্পষ্ট ছাপ দেখে হাত বাড়ায়। একটু-আধটু অবোধ গলায় কথা বলার চেষ্টা করে। শিশুর কোমল আঙুলের ছোঁয়ায় রিবিকা শিহরিত হয়। সাদইদ শিশুর জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করেছে। পর্যাপ্ত দুধ। মধু,আঙুর। এমনকি নানারকম খেলনা। তার মধ্যে মিশরের কাগজে আপন হাতে বানিয়েছে নৌকা। যার মধ্যভাগ পিরামিডের মত খাড়া হয়ে উঠেছে একটু বেশি।

শিশুকে বলেছে–এই তোমার নৌকা বাবুসোনা! নোহের কিস্তি। এই তোমার ফেরাউনের পিরামিড। সবই তোমায় দিলাম। মানকরোনা! পিরামিড তোমার ঐশ্বর্যের নিশানা। নৌকা তোমার দুঃখের ভার বইবে। জীব আর বীজের প্রতিপালক হবে তুমি। তোমার হাতে যেন মানুষ কখনও দুঃখ না পায়! তুমি কখনও আমার মত শিশুমেষকে হত্যা করবে না। তুমি পিঁপড়ে পাখি পতঙ্গের ভাষা বুঝবে। তুমি হবে নতুন স্বর্গের ভাস্কর।

রিবিকা ককিয়ে উঠল–সারগন যে আমায় কিনতে চাইলে না খোকা! তোর জন্য যে লোকটা ব্যবস্থা করেছে, সে যে কালই আমায় মন্দিরে ঢোকাবে! এই পাহাড়টার মতই মানুষটা কী রহস্যময়! আমি কী বোকা রে!

শিশুকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে অঝোরে অশ্রুপাত করছিল নিঃশব্দে রিবিকা। এমন সময় গবাক্ষপথে একটি রক্তমাখা অদ্ভুত মুখ ভেসে উঠল। কে ওটা? ও কি মানুষ? আঁতকে উঠল রিবিকা।

লোটা হা-হা করে হেসে উঠে বলল–শোন বোন! আমার ভাষা তুমি ছাড়া কেউ বোঝে না! তুমি কুমারী আনাথ। আমি তোমার ভাই বালদেব! ভয় কি? তুমি ছদ্মবেশী বকনাবাছুর! এখন চারিদিক নির্জন। কেউ জানবে না। দুয়ার খুলে দাও । আমি ক্ষুধার্ত! রুটি মাংস চাইনে। তোমাকে চাই। তোমার আমার মিলনে সমুদ্র মেঘ পাঠাবে! এ জীবন অমর নয় রিবিকা! আমি শববাহক। ঘেন্না হয় বুঝি! এসো আমরা দু’জন উঠের পিঠে মিলিত হই!

কনানী পৌরাণিক গল্পের কুৎসিত প্রসঙ্গ বারবার উত্থাপন করছিল লোটা । অপমানে ভয়ে রিবিকার মুখ কালো হয়ে উঠেছিল। স্বয়ং যুদ্ধের বিভীষিকা গবাক্ষ ধরে দাঁড়িয়েছে। ভয় হচ্ছিল সে যদি জোর করে পাহাড়ের ভিতর ঢুকে পড়ে!

লোটা ফের বলে উঠল–আমি পদাতিক নই। আমি সাদইদের অশ্বারোহী এক নম্বর সেনাপতি। আমার গোত্র ছোট হতে পারে, ধর্মে আমি কাঙাল হতে পারি কিন্তু আমার সম্মান আছে রিবিকা! আমি মন্দিরের সামনে যত্রতত্র লাইন দিয়ে দাঁড়াতে পারিনে। আমি নোংরা দেবদাসীর কাছে গিয়ে শরীরে রোগ বাধাতে পারিনে। আমার নবী সালেহ। তিনি পয়গম্বর। তিনি জীবন আর মৃত্যুর অধিপতি। জীবন আর মৃত্যুকে কেউ বহন করে না। তুমি দুয়ার খুলে দাও। যদি অনুমতি করো, আমি ভাল পোশাক পরে আসতে পারি। আমাকে একটিবার অন্তত সারগন বলে ডাকো তুমি। একবার ডাকো!

গবাক্ষের নিচে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে লোটা। যদি পড়ে যায়, দৈবাৎ হাত ফসকে গেলে মাথার খুলি পাষাণে পড়ে থেঁতলে যাবে নির্ঘাত।

মুখাকৃতি কেমন এক মায়াময় লোভে, রক্তের ছিটে দাগে করুণ আর ভয়ংকর দেখায়। ককানো আর্ত ভাষা পাগলের মত।

–ঠিক আছে, ছোট জাত বলে দুয়ার না হয় বন্ধ রাখো। আমি এই পাহাড়তলীর জনপদ রক্ষা করছি বিবিকা! মড়ার গন্ধে তিষ্ঠোতে পারতে না। এখন দুপুরে হালকা লু বইছে। কিন্তু সন্ধ্যার পর শীত পড়তে শুরু করবে। শীত আসন্ন। কত দেবদাসী আর শিশু মহা-শীতে নষ্ট হবে– বাঁচবে না। মড়ার গা থেকে পোশাক খুলে নিয়ে সেদ্ধ করার ছোট কাজটি কেউ করবে না। সালেহ। ছিলেন পবিত্র। তাঁর উম্মত বলে এ কাজ করি। তাই বলে জাত আমার ছোট নয়। তোমরা কেন উটের মত উপকারী প্রাণীকে শব বইবার দায়িত্ব দিয়েছ? শুঁটকি আর মদ বহে বেড়ায় এই জীবটা, কিন্তু প্রকাণ্ড পাথর টানা ছাড়াও সোনাদানাও তো বইতে পারে। পারে না? তোমরা চাষীবাসী, তোমরা মিশরের। দেবদাসী, দেবরাজ সামাশতোমাদেরভগবান। সব ঠিক। কিন্তু আমি তো শুধু পায়ে হাঁটা লাগাম ধরা চুটকিলা গাওয়া উটের চালক যাযাবর নই। আমি সেনাপতি, রিবিকা!

মানুষের দীনহীন এমন আকুলতা কখনও শোনেনি রিবিকা–যুগপৎ মর্যাদাবান অভিমানও দেখেনি কোনদিন। একই সঙ্গে তার আপন ধর্মের প্রতি, ভাষার প্রতি ভালবাসা আর সংকোচ লোটাকে দগ্ধাচ্ছে। লোটা যেন স্বয়ং যুদ্ধের অস্তিত্ব–যাযাবর জাতিগুলির সমষ্টি সত্তার রূপ, ক্রীতদাসের একান্ত-হৃদয় বিদীর্ণ হচ্ছে ক্রমাগত। লোটা কাতরাচ্ছে পথ হারানো মরু যাযাবর পিতা আব্রাহামের মত। অধিকারহারা এমন মানুষটিকে একবার রিবিকার সারগন বলে ডেকে উঠতে মন চায়। পারে না।

ভয় করে। সংকোচ হয়। ঘৃণাও হয়। কেন এই ঘৃণা সে জানে না। সে নিজে দেবদাসী–যুদ্ধের পাপ মোছর রুমাল! জীবনের তলানি মদ, কটু কাদামাখা বালিভরা মরুকূপের জল। নানান পুরুষে লেহিত, এটো ঝুঠো পরিত্যক্ত মদপাত্র, কানাভাঙা, কুকুরে চেটে তোলা শীতার্ড বাটিখুরির ছবি। রক্তমাখা ওই মুখটা, ফাটা জামা ছিঁড়ে গা থেকে ঝুলছে, যুদ্ধের শোণিতে কালো ছোপঅলা শবগন্ধময় পোশাক দেখে, শক্ত চোয়াল, চোখের তলায় মরুভূমির বালি, খোঁচা-খোঁচা দাড়ির ভিতর লু ঝাঁপটানো উষরতা–চোখ করুণ আর রক্ত রাঙানো বদ গোপন ধূর্ততা জড়ানো–এ মূর্তি কী ভয়াল! এ দেখে বুক শুকিয়ে কাঠ হয়।

রিবিকার ঠোঁট থরথর করে কাঁপে। হেরার পুত্রকে বুকে আঁকড়ে ধরে সভয়ে বারবার। চোখ তুলে গবাক্ষে চাইতে গায়ে ঘাম দেয়। সারা মুখমণ্ডল ঘর্মাক্ত হয়ে ওঠে। মানুষের ক্ষুধার্ত কাতর চোখ এত তীব্র আর আকুল হয় করুণাঘন হয়? কী করবে রিবিকা?

–আমার ভাষা কেবল তুমিই বোঝে রিবিকা! এই মরুভূমিতে আর কেউ নেই। মানুষ কথা না বলে থাকতে পারে! বলল দেবী ইস্তার! কতকাল মুখ বুজে থাকব!

রিবিকা পারে না। মনে মনে বলে ওঠে–আমার সারগন যে একজনই লোটা!তাকে পাই না-পাই জীবনের শেষ বাসনা তারই পায়ে অঞ্জলি দিয়েছি। সারগন নিজেও জানে না আমার কী হয়েছে। মন্দিরে আমায় এভাবে ডেঝে না লোটা!

গবাক্ষ আঁকড়ে ধরায় পেশল কঠিন হাত দুখানি ফুলে উঠেছে শক্তির উল্লাসে। কিন্তু হাত ফসকে গেলে লোটা বাঁচবে না। একদিকে রিবিকার শেষ বাসনার সুতীব্র তৃষ্ণা, অন্যদিকে লোটার দুর্ভাগ্যের প্রতি ঘৃণা-মেশানো সহানুভূতি তাকে বিচলিত করে। সে ফুঁপিয়ে ওঠে।

লোটার মুখটা এই কান্নার স্পর্শে অসাধারণ কোমল হয়ে পড়ে। দগ্ধ রক্তাক্ত চোখ নিবে গিয়ে ঘষা নক্ষত্রের সুদূর আলোর মত ম্লান হয়ে ওঠে। ঠোঁটের ভাঁজে সিঞ্চিত হয় অপরাধের ভাষা। লোটা যেন অন্যায় করে ফেলেছে।

হঠাৎ তার মনে হয়, তারই কারণে রুহা আত্মহত্যা করেছে। এবার রিবিকার যদি কিছু হয়! লোটার আঁকড়ানো হাত মুহূর্তে শিথিল হয়ে পড়ে! হাত খসে যায়।

লোটা পাষাণের উপর পতিত হয়। রিবিকা প্রাণফাটা আর্তনাদ করে গবাক্ষর কাছে ছুটে আসে। নিচে চোখ মেলে বোবা হয়ে যায়। পাষাণেই পড়েছে বটে কানি-পরা আব্রাহাম। নড়ছে না। মৃদু ফোঁপানি চকিত হয় রিবিকার কণ্ঠে। কালো ঘোড়া মনিবকে এসে শোঁকে। ধীরে ধীরে নড়ে ওঠে দেহ। মরেনি। হৃদয় স্তব্ধ হয়ে পড়েনি। তবে পায়ে লেগেছে। লেংচে ওঠে লোটা।

ঘোড়ার পিঠে ওঠার আগে করুণ চোখে গবাক্ষর দিকে চায়। লোটা সেই যুদ্ধ, যার অবসান সহজ নয়। পা খোঁড়া হতে পারে, কিন্তু যে পড়ামাত্রই মরে না। কালো ঘোড়া লু-প্রবাহিত ঝাঁঝালো রৌদ্রে, কম্পমান রৌদ্র তরঙ্গে-তরঙ্গে কেঁপে ওঠে ছবির মত। অশ্ব আর অশ্বারোহী–দূরে ভেসে যায়। এবার একা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রিবিকা।

আকাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেষশিশুর মত মেঘ জমতে থাকে। হঠাৎ রিবিকা দেখে ভগবানের বন্ধু মোসি লাঠি হাতে মেযেদের চালিত করছেন–আকাশে মানুষের মত একটা মেঘ দেখা যায়।

রিবিকা মহাত্মা ইহুদের নাম ধরে কেঁদে ওঠে সশব্দে। হঠাৎ তার মনে হয়, এ পাহাড়টি যেন এলিফেনটাইন দুর্গের মত। সে বন্দী। এই শিশু বন্দী। সাদইদ এক নব্য ফেরাউন।

সাদইদ যখন ফিরে এল, রাত্রি তখন যথেষ্ট গম্ভীর হয়েছে। চাঁদ পাহাড়ের উচ্চতা ছাড়িয়ে অনেক উপরে দাঁড়িয়ে। সাদা অশ্ব পাহাড়ের গা চাটছে। তার ফোঁসানি শোনা যায়। বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একা সাদইদ। রিবিকা ঘুমাতে পারেনি।

রিবিকা ফোঁসানি শুনতে পায়। বাইরে বেরিয়ে আসে। বুঝতে পারে সাদইদ ফিরেছে। ভয়ে ভয়ে সে সাদইদের কাছে এগিয়ে আসে। সাদইদ রিবিকাকে ফিরে দেখে না। চাঁদের আলোয় তার মুখ অসম্ভব গম্ভীর। এক-পা এক-পা করে একটি উচ্চ শিলার দিকে এগিয়ে যায় সাদইদ। বসে পড়ে। সামনে পা মেলে দেয়। চওড়া শিলা। পিছনে হাত মেলে দেয়। হাতের উপর ভর দিয়ে পিছনে চিতিয়ে থাকে। চাঁদ দেখে যায় আপন মনে। তার এই নীরবতায় ভয় পায় রিবিকা।

সাদইদ যখন চোখ মুদে বসে থাকে–তখন রিবিকা ভয়ে অপরাধে, দুপুরের দূত আসার সময়ের ঘটনার কথা মনে করে, হঠাৎ বোকার মত পাহাড়ের বাইরে চলে আসার অপরাধ করার কথা ভেবে সাদইদের পায়ের তলায় চুপ করে বসে পড়ে। রিবিকার ছোঁয়ায় চোখ মেলে সাদইদ।

সাদইদের মনে হয় তার পায়ের তলায় একটি মেষ, যাকে সে বশায় গেঁথে ফেলেছিল, সে পড়ে আছে। বুকে তার এক পরমাশ্চর্য মায়া ছলছল করে ওঠে। সে জানে, এই বুক বৃষবক্ষ, নির্মম। তবু কোথাও একটা নদী আছে বিস্তীর্ণ সাদা মরুর তলায়–দেখা যায় না। নদীতীরে অমরাবতী–এক নগরীর কেন্দ্রে গড়ে উঠেছে। স্বর্গের হৃদয়ে এক কক্ষ–যেখানে বিরাজ করছে চির বসন্তের স্ফটিক স্বচ্ছ আলো–সেই আলোয় ঘুমিয়ে রয়েছে এক নারী–দুটি প্রজাপতি তাকে খুঁজছে। এই মোহ কি দূর হবে না কখনও? খুবই ভাবাবেগে হৃদয় যেন বুজে আসে!

রিবিকা হঠাৎ বলে–আমাকে মুক্তি দাও সারগন!

মুহূর্তে সেই নদী যেন সাদইদের পায়ের তলা ছুঁয়েছে–চাঁদ সাক্ষী! সাদইদ সহসা রিবিকাকে দু’হাতে আকর্ষণ করে বুকে টেনে নিয়ে বলে–আমি কিছুতেই আর পারছিনে রিবিকা! তোমাকে আমি কারুর জন্য দিতে পারি না। তুমি আমার যুদ্ধের পড়ে-পাওয়া, কুড়োনো! চাঁদ জানে, আমি কী বলছি!…

.

০৬.

এক গভীর অবসাদ ছাড়া আর কিছুই নেই। রিবিকার শরীরকে শতবার আলিঙ্গন করেও সাদইদের তৃপ্তি হয়নি। এক অব্যক্ত অবসাদে মন ভরে আছে। তার কোমরে ঝুলছে রাজা হিতেনের দেওয়া সন্ধিপত্রের স্বর্ণফলক। এই সন্ধিপত্রে রাজা সাদইদের কল্যাণ কামনা করে লিখেছে–তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সীলমোহর অঙ্কিত স্বর্ণফলকে তোমার স্বাক্ষর চিহ্নিত করেছি, তোমার আমার যুক্ত স্বাক্ষর খোদিত হয়েছে। তোমার সৈন্যবাহিনী আমার অনুগত থাকবে। কেউ কোন সামাজিক অপরাধ করলে তার বিচার-ভার তোমার বটে, কিন্তু আমার পরামর্শ প্রার্থনীয়, তুমি অনুগৃহীত সেনাধিপতি, আমার দানছত্রের অধীন মরু অঞ্চল, পাহাড় ও দ্রাক্ষাকুঞ্জগুলি শোভিত রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা তোমার কাজ। তোমার নিকট কর প্রার্থনা করি না। কেবল যখন আমার সাম্রাজ্যে সুন্দরীদের প্রতিযোগিতা হয় তখন তুমি উৎকৃষ্ট সুন্দরী সরবরাহ করবে। একটি উৎকৃষ্ট সুন্দরীর বিনিময়ে তোমাকে দেওয়া হবে কিছু ডুমুরবৃক্ষ, একটি দ্রাক্ষাবাগিচা এবং নতুন কোন অঞ্চলরেখা, তাতে থাকবে উদ্যান আর শান্ত জলাশয়। তোমার কল্যাণ এবং মঙ্গলসাধনা রাজা হিতেনের কর্তব্য। তুমি নিজে কোন আইন প্রণয়ন করতে পারো না। আমার প্রণীত আইনই তোমার পালনীয় আজ্ঞাস্বরূপ। কারো উপর মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা প্রয়োগ করার অধিকার তোমার নেই। যৌন-পীড়কের শাস্তি মৃত্যু। দেশদ্রোহিতা-হত্যা এবং যৌন অপরাধের জন্য আমার নির্দেশ আছে মৃত্যুদণ্ড। তাছাড়া বাকি অপরাধের দণ্ডগুলি মৃদু ও কোমল। ‘নারী-বিলাস’ পুরুষের সৌন্দর্যচর্চা। নারী তার প্রিয় পুরুষের কাম প্রশমন করে সূক্ষ্ম কলানৈপুণ্যে, ব্ৰীড়ায়, লাস্যে,সংগীতে ও নৃত্যে। নারীর ক্ষমতা স্বর্গীয়। তাকে পদাঘাত ও বলাকার করা পাপ। অত্যন্ত সুদক্ষ, প্রত্যয়বান সৈনিকও যদি কোন সামান্য দেবদাসীর উপর গর্হিত আচরণ করে এবং তা প্রমাণিত হয়, তবে মৃত্যুদণ্ডই হবে সৈনিকটির শাস্তি। মনে রাখবে আমার চর তোমাকে সর্বদা অনুসরণ করে। অথচ তুমি আমার সন্তান মাত্র।

নারীর ক্ষমতা স্বর্গীয় অথচ আমি হিতেনের সন্তান হয়েও চোখের সামনের এই নারীকে উপভোগ করতে পারছিনে। কেবলই এক বিষাদ আমাকে আচ্ছন্ন করছে। ভাবতে ভাবতে বেদনা-জড়ানো চোখের পাতা তুলে রিবিকাকে দেখল সাদইদ। ভোর হয়েছে পাহাড়ের শীর্ষে–শান্ত সাদা সীসার মত উজ্জ্বল।

পাহাড়ের মাথায় সেই এক শান্ত রহস্যময় স্নিগ্ধ প্রত্যুষ। সূর্য ওঠেনি। ঈশ্বরের নিঃশ্বাসে ভরে আছে মরুভূমি।

সাদইদ রিবিকার দিকে চেয়ে বলল-রুহার মৃত্যু এক অভিশাপ রিবিকা! রাজা হিতেন লোটার মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা দিয়েছে। রাজার রথ আসবে। তার সুন্দরী প্রতিযোগিতায় তোমার নাম তালিকাবদ্ধ হয়েছে। এই দণ্ডাজ্ঞা পালন করতে আমি বাধ্য। তোমাকে উপহার দিয়ে আমি যা পাব–দ্যাখো রিবিকা রাজাই তো ঈশ্বর! তার অলক্ষ্য কিছু নেই।

বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাদইদ। সাদইদ ফের বলল–লোটা জানেই না, তার পরমায়ু শেষ হয়ে গিয়েছে। তুমিও জানতে না তোমার ভবিষ্যৎ। গত রাত্রি এক দুঃস্বপ্ন ছিল। কোন নারী বা কোন সৈন্য আমার নয় রিবিকা। এই পাহাড়ও আমার নয়। ইতিহাস সুদীর্ঘ  মানুষ একদিন বিশ্বাস করতেই চাইবে না রাজা ঈশ্বরের মত ক্ষমতাবান ছিল। এই যুদ্ধ শেষ হবে। আমি কী তুচ্ছ দ্যাখো, তোমাকেও রক্ষা করতে পারি না! নারী আর শিশুর রূপ স্বর্গীয় নিশ্চয়ই–যুদ্ধই বারবার তাকে ধ্বংস করেছে। আমার যদি দেশ থাকত তোমাকে আর লোটাকে নিয়ে সেখানে চলে যেতাম। চোখের সামনে লোটার মৃত্যু আর তোমার বিসর্জন দেখে যেতে হবে।

–না। এ হতে পারে না। কিছুতেই হতে পারে না!

বিপন্ন আর্তস্বর রিবিকার কণ্ঠে দলিত হয়ে ওঠে। তার কেবলই মনে হতে লাগল, এই ভোর কেন এল? এই জীবন কেন সে পেয়েছিল! গত রাত্রির মত একটি বিপুল বিস্ময়কর অপার সুখের রাত কেন তার মত হতভাগ্য দেবদাসীর জীবনে আসে! কেন তার হৃদয়কে দুটি নির্মল প্রজাপতি অধিকার করেছিল। শববাহক লোটা কেন এই মরুমর্তে জন্মলাভ করে! রাজাই যদি দেবতা, রাজাই যদি ঈশ্বর, তবে মহাত্মা ইহুদ কেন তাদের মুক্তির কথা বলেছিলেন?–হায় যবহ, হায় ইয়াহো!

–অসম্ভব! এ হতে পারে না। কিছুতেই নয়। আমি যাব না সারগন! ছেড়ে দাও। তুমি যুদ্ধ ছেড়ে দাও! এতটুকু জায়গা কি কোথাও নেই?

কামনাদীর্ণ স্বর উচ্চকিত নিনাদে ফেটে পড়ে পাহাড়ের অভ্যন্তর-সীমায়। যখন দিনের প্রথম সূর্যালোক মরুভূমির বালুকা স্পর্শ করল, লোটার কালো ঘোড়া লাফিয়ে উঠল, লোটা তার পিঠে চড়েছে–একা ভোরে অশ্বারোহণ লোটার এক ধরনের নিঃসঙ্গ খেলা। অশ্ব মাঝে মাঝেই তাকে পিঠ থেকে ফেলে দেয়। ইচ্ছে করেই হুমড়ি খেয়ে বালুতে আচমকা লুটায়। অশ্ব জানে না, এইই লোটার শেষ ঘোড়ায় চড়া। ঘোড়াটি থাকবে। লোটা থাকবে না। একথা অশ্ব যেমন জানে না, নোটাও জানে না।

মরুস্থলীর সকলে জেনেছে যেকথা–ভাষার অভাবে লোটা তা জানতে পারেনি। সে আহ্লাদে নিশ্চিন্তে আপন মনে খেলা করে চলেছে। তার বিশ্বাস। অগাধ। সাদইদ থাকতে তার কোনওই ভয় নেই। মৃত্যুও তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। সাদইদ লোটার চাউনি, চলাফেরা, যুদ্ধযাত্রার প্রতি মুহূর্তে একথা অনুভব করেছে।

লোটার আহ্লাদিত অশ্বক্রীড়া দেখতে দেখতে সাদইদের বুক অসম্ভব বিষাদে। পূর্ণ হয়ে যেতে লাগল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নিস্তব্ধ রিবিকার চোখ ছলছল করে উঠল। মনে পড়ল, কালই বেচারি তার কাছে অদ্ভুত প্রস্তাব করেছিল। একবার অন্তত সারগন বলে ডাকার জন্য আকুল প্রার্থনা জানিয়েছিল। ডাকলে কী ক্ষতি ছিল!

মহাত্মা ইহুদ পাহাড়ের দিকে এই ভোরবেলা পায়ে পায়ে হেঁটে আসছেন। অদ্ভুত দৃপ্ত তাঁর ছুটে আসার ভঙ্গি। মসীহরা যেমন লম্বা পা ফেলে হাঁটেন। তাঁকে দেখে অশ্বপৃষ্ঠ থেকে সহসা স্খলিত লোটা কপালে হাত ঠেকিয়ে সহাস্য অভিবাদন জানাল। সলজ্জ ভঙ্গিতে গা ঝাড়তে লাগল। ইহুদ ইশারায় লোটার অভিবাদন গ্রহণ করলেন। তারপর একদণ্ড সময় নষ্ট না করে সাদইদের সামনে এসে বিনা ভূমিকায় বললেন–লোটা জানে না আজ তার মৃত্যুর দিন। তাকে এ কথা শোনানোর দায়িত্ব কে নেবে? তুমি তার মৃত্যু-সংবাদ বহে এনেছ।

–হ্যাঁ এনেছি।

-সেকথা বলার জন্য কাউকে নির্দেশ দাওনি? তোমার সন্ধিপত্র মাটির ফলকে উৎকীর্ণ করে দেবমন্দিরের সামনে স্থাপন করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না হিতেনের পোলা!

এরকম দৃপ্ত বাঁকা কথায় কী আশ্চর্য আজ সাদইদের মেরুদণ্ড কেঁপে উঠল। হঠাৎই ইহুদ নামের সামান্য সেবক লোকটি, দেবদাসীর অনুগত অত্যন্ত নিম্ন পেশার মানুষটি যেন রাতারাতি বদলে গিয়েছেন। সাদইদ ইহুদকে চিনতে পারছিল না।

–রাজার আইন আমি মানতে বাধ্য ইহুদ!

–কিন্তু আমি ঈশ্বরের আইন ছাড়া কোন আইন মানতে বাধ্য নই সাদইদ! একথাটা তোমাকে বলার আজ বিশেষ প্রয়োজন। রাজার রথকেও আমি ডরাই না। জানি রথ আসবে। কিন্তু লোটার মৃত্যুই কি অনিবার্য। তুমি তাকে ভাষা দিতে পারোনি, ধর্ম দিতে পারোনি–এমনকি একটি নারীও তোমার ছিল না! অথচ সে তোমার জন্য প্রাণ বিপন্ন করেছে কতবার! সেই প্রাণটাই আজ তুমি। কেড়ে নিতে চলেছ! এই যদি তোমার আইন–তবে সেই আইন আমি মানি না। কেউ মানে না।

–এ আমার আইন নয় ইহুদ। রাজার আইন!

–তুমি তার পুত্র!

–না। আমার পিতা একজন ভিস্তি। আমার জন্মের ইতিহাস নেই।

–তবে তুমি এই আইনকে অস্বীকার কর।

আপনি করুন। আমি বাধা দেব না। আপনি আমাকে কেন এভাবে আঘাত করছেন!

সাইদের চোখ ছলছল করে উঠল। ইহুদ কিঞ্চিৎ নরম হয়ে সাদইদের সামনে মেঝেয় বসে পড়লেন।

সসম্ভ্রমে ব্যস্ত হয়ে সাদইদ বলল–ওভাবে মাটিতে বসছেন কেন আপনি! আহা! আপনি ওই শিলাসনে বসুন!

–না থাক!… যেন বিরক্ত হয়ে ঈষৎ ধমকেই উঠলেন ইহুদ! তাঁর চোখ সহসা কেমন এক অনির্বচনীয় দিব্যালোকে যেন ভরে যেতে লাগল। সেই আলো ছড়িয়ে পড়ল রিবিকার মুখে। রিবিকার দ্বাঙ্গ ভাষাতীত এক মহাভাবে মুহূর্তে শিহরিত হয়ে উঠল।

ইহুদের গলা ভারী হয়ে উঠল–আমার এই হাতের লাঠিখানা চিনতে পারিস মা!

ইহুদের কণ্ঠস্বরে অপার্থিব এক জাদু মিশেছিল, রিবিকার সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেল। তার পা দুখানি যেন গেঁথে গেল পায়ের তলার পাষাণের সঙ্গে। কোলের শিশুকে সে বুকের সঙ্গে সপাটে আঁকড়ে ধরেছিল। হঠাৎ তার মনে হল সমস্তই যেন ইহুদ ছিনিয়ে নিতে এসেছেন।

অর্ধস্ফুট স্বরে রিবিকা বলল–পারি বাবা!

–আমাকে তুমি ভুলে গেছ!

–আপনাকেই আমি মরুভূমির বুকে খুঁজেছি বাবা!

ইহুদ এবার ফের ঈষৎ গর্জে উঠলেন–মিথ্যে কথা!… সেই গর্জনে হেরাপুত্র মায়ের বুক থেকে মাথা তুলে শূন্যে চোখ মেলে কী যেন খুঁজে দেখল, পেল না। আবার মায়ের বুকে মাথা রাখল। লজ্জায় রিবিকা চোখ নত করল।

ইহুদ বললেন–তাই যদি না হবে তাহলে আমার অপমান তোমার বুকে বাজল না কেন? তুমি কী করে এই পাহাড়দুর্গে রাত কাটালে! তোমার পাপের বিচার কে করবে! রাজার আইন আছে, সে আইন রাজাকে স্পর্শ করে না।

সাদইদ আর স্থির থাকতে না পেরে বলল–মানুষকে প্রাণে বাঁচানো যদি পাপ হয় তাহলে সে পাপ আমি করেছি! আপনি রিবিকাকে হায়নার মুখে ফেলে রেখে গেছিলেন।

ইহুদ বললেন-তোমার সৈন্য আমাদের আক্রমণ করে। হায়নার চেয়ে তোমার লোভ অনেক কদর্য। আমার হাতে লাঠি দেখেও তোমার সেপাই আমাকে রেয়াত করেনি। তুমি তোমার চোখের সামনে আমাকে দেখেছ কখনও মনে করনি এ অন্যায়!

–আমায় ক্ষমা করুন!

সাদইদের গলা কেঁপে উঠল।

–ইয়াহোর কাছে ক্ষমা চাও সাদইদ! রুহার মৃত্যুর কৈফিয়ত তোমায় দিতে হবে। বন্ধু লোটা তোমার নারী-সৌভাগ্যে পীড়িত হয়ে ঘরের বশে রুহাকে বলাৎকারের চেষ্টা করে। অথচ লোটাকেই তুমি মৃত্যুদণ্ড দিলে! ইয়াহোর বিচার অনেক সূক্ষ্ম সাদইদ! তুমি শাস্তি পাবে!

মাথা নিচু করে ইহুদের কথা শুনতে শুনতে সাদইদ বলল–আজ পর্যন্ত রাজা হিতেনের সঙ্গে আমার কোন সন্ধিপত্রই ছিল না মহাত্মা ইহুদ! একজন সামান্য সৈনিক, ভাড়াটে সৈনিকের সঙ্গে কোন রাজা কখনওই সন্ধিপত্রের চুক্তি করেন না। অতি সম্প্রতি সেই সন্ধিপত্র হয়েছে! কালই আমি সেটা হাতে পেয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, লোটা সম্পর্কে আমার কখনও কোন অভিসন্ধি ছিল না। এই সন্ধিপত্রও রাজার কাছে আমি প্রার্থনা করিনি।

ইহুদ বললেন–তুমি কী করেছ না করেছ সে সম্পর্কে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। এখানকার কারুরই নেই, সেকথা তোমার জানা দরকার। সমস্ত রাত্রি আমরা আলোচনা করেছি। তোমার সন্ধিপত্রের নকল মাটির ফলক আমরা উপড়ে ফেলেছি। তুমি জেনে রাখো, তুমি হিতেনের দাসত্ব করতে পারো, আমরা নই। আমরা নেই তোমার সঙ্গে!

–আমি জানি। হঠাৎ এই সন্ধিপত্র করে রাজা আমাকে দুর্বল করতেই চেয়েছেন।

–সে বুদ্ধি তোমার আছে?

–আমায় এভাবে বলবেন না মহাত্মা ইহুদ!

–আমি মহাত্মা নই সাদইদ। তাই যদি হতাম, তাহলে এত হীন পেশায় নিয়োগ করে তুমি আমায় অপমান করতে না। তবে এই লাঠির কোন ক্ষমতা

আছে কি নেই তুমি এবার প্রমাণ পাবে। লোটাকে মারবার জন্যই চালবাজ রাজা এই সন্ধিফলক সোনায় মুড়িয়ে তোমার হাতে তুলে দিয়েছে! যাতে সারা জীবন তুমি এই মরুভূমিতে ঘুরে মরো! তবে তুমি যা খুশি করতে পারো–আমার কিছু এসে যায় না। মধুদুগ্ধের দেশে আমার পোঁছনো দরকার।

–আপনার স্বপ্ন সফল হোক মহাত্মা ইহুদ!

–তুমি আমাকে ব্যঙ্গ করছ?

ইহুদের এই আকস্মিক আঘাতে সাদইদ বিমূঢ় হয়ে যায় এক মুহূর্ত! সে অতিকষ্টে চোখ তুলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিবিকার মুখের দিকে চায়। এই সেই নারী, যাকে সে নগ্নাবস্থায় বস্ত্র দান করেছিল, ক্ষুধা তৃষ্ণা কাতর মুমূর্ষ দেবদাসী, যাকে সে মধু রুটি আর তৃষ্ণার জল দিয়েছিল–যাকে সে মন্দিরে ঠেলে দিতে পারেনি, যার সীমাহীন রূপ তাকে মুগ্ধ করেছে, লোভী করে তুলেছে, সেই নারী ভেবেছিল সাদইদ বুঝি রাক্রান্ত পুরুষ, তার কাছে সে জানতে চেয়েছিল তার ভবিষ্যৎ! কী পরিহাস জীবনের ওই শিশু অবধি আজ বুঝে ফেলেছে সাদইদ তার নিজেরই ভবিষ্যৎ জানে না।

সাদইদ বলল–একটা সামান্য শিশুকে ব্যঙ্গ করার সাহসও আমার নেই!

বলেই সাদইদ রিবিকার ম্লান চোখ থেকে চোখ নামিয়ে মাথা নিচু করল।

ইহুদ বললেন–তোমার সাহস যথেষ্টই আছে। লোকে তোমায় সারগন বলে ডাকে। আমি স্বপ্নদ্রষ্টা, আমার হাতে মসীহের ‘আঁসা’–এই জাদুদণ্ড! এই মহাবিদ্যার নামে শপথ করে বলছি, তুমি ব্যর্থ হবে! আমি স্বপ্ন দেখেছি, নিনিভের পতন হয়েছে! মারী আর মড়কে ফতুর হয়ে গেছে নগরী! ক্রমাগত এই স্বপ্ন! ক্রমাগত!

বলতে বলতে ইহুদের দুই চোখ কেমন ঘোর হয়ে আসে! যেন তিনি মুহূর্তে স্বপ্নবিষ্ট হয়ে পড়লেন। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে স্থির রইল জুম পাহাড়।

হঠাৎ মন্দ্রস্বর ভেসে উঠল–তুমি ঈশ্বরের ভাষার উপর খোদকারী করেছ সাদ। এই এক পাপ। ক্ষমা নেই।

–নতুবা মানুষ কীভাবে কথা বলত! একটা ভাষা তো লাগে! এইভাবে মানুষ মিলিত হয়!

–এই চেষ্টা হাস্যকর কোমলমতি সাদ। পৃথিবীতে ধর্ম ছাড়া ঐক্য হয় না। তোমার সাহসকে বলিহারি যে, তুমি নিজের মূর্খতা বুঝতে পারো না। ঈশ্বর ভাষার সাহায্যে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেন। ধর্মের সাহায্যে একত্রিত করেন। মসীহের ধর্মে একথার বারংবার উল্লেখ আছে। তুমি ভাষার চর্চা করলে অথচ লোটার মুখে ভাষা যোগাতে পারলে না। কবিতা গেয়ে ধর্মের শক্তিকে খর্ব করা যায় না। ইয়াহহ! ইয়াহো! তাঁর ইচ্ছেয় সব হয়।

মাদইদ নরম সুরে বলল–ক্ষমা করবেন মহাত্মা ইহুদ! আপনার আদর্শের জয় হোক। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা আলাদা। অত্যন্ত অল্প সময়ের জন্য হলেও মানুষ যে একটি ভাষার তলে মিলিত হয়েছিল সেই ইতিহাস ধর্ম এসে মুছে দেবে কিন্তু এই সত্য।

–এ সত্য নয় সাদইদ! লোটাই তার প্রমাণ!

–সে তো ধর্মও ছাড়েনি।

–ছাড়বে। আমি যা পারি তুমি তা পারো না। তোমার ভিতর ঈশ্বরের কোন প্রত্যাদেশ নেই। তুমি অভিজ্ঞতাবাদী। আমি প্রত্যাদেশবাদী, ধার্মিক! আমি জড়ো করি, তুমি জড়ো করার মন্ত্র কখনও পাবে না। চলো মা রিবিকা–আমরা উঠি!

–কোথায় যাব বাবা!

–ইয়াহো যেখানে নিয়ে যেতে চাইছেন! যে লোক লুঠ করে, সে কখনও গুছিয়ে তুলতে পারে না। এখানে থেকো না! সাদইদ এবার একা নিনিভে লুঠ করতে যাবে। একা। একদম একা।…

বলেই ইহুদ হা হা করে হেসে উঠলেন। রিবিকা অত্যন্ত করুণ চোখে সাদইদের দিকে চাইল। শিশুকে গভীরভাবে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরল।

গম্ভীর সুরে ইহুদ বললেন–যার শিশু তাকে ফেরত দাও রিবিকা!

–এ শিশু যে আমার বাবা! একে ফেরত দিতে বলো না!

হাহাকার করে উঠল রিবিকা!

সাদই অত্যন্ত ধরা গলায় ঢোক গিলে বলল–আমি এই শিশু আর নারীকে লুঠ করিনি মহাত্মা ইহুদ! আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। আপনিই তাদের ছিনিয়ে নিচ্ছেন!

অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন ইহুদ। তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগল। বললেন–আমার ধর্ম কখনও ছিনিয়ে নেয় না সাদ। সে-ধর্ম দেয়। রিবিকা আমার কন্যা! ওই শিশু তোমারই রইল। দাও মা, দিয়ে দাও! দেরি করো না। সকলে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে! তুমি লোটার মৃত্যুর কথা ঘোষণা করবে। লোটা শুনবে।

ঘোড়ার পিঠে তখনও খেলা করে চলেছে লোটা। সেদিকে একবার চেয়ে দেখে আর্তনাদ করে উঠল রিবিকা-বাবা তুমি আমায় এমন নির্দেশ দিচ্ছ কেন! আমি কী অন্যায় করেছি!

–এ নির্দেশ আমার নয় রিবিকা। হিতেনের নির্দেশ। রাজার হুকুম!

–আমি পারব না! এ আমি পারব না কিছুতে।

–পারতেই হবে মা! ধৈর্য ধরো। মন শক্ত করো!

ছেলেকে বুকে করে কাঁপতে কাঁপতে রিবিকা মেঝেয় বসে পড়ে, সাদইদের ঠিক পায়ের তলায়। ভয়ে সাদইদ পা টেনে নেয়।

–আমার তো আর কোনওই আশ্রয় রইল না সাদইদ!–সরে যাওয়া সাদইদের পায়ের দিকে চেয়ে বলে উঠল রিবিকা। সাদইদ অনড় পাষাণের মত স্থির।

এই প্রথম সাদইদের নাম ধরে ডাকল রিবিকা। বুকের ভিতরটা সাদইদের কেঁপে উঠল।

–বাদশার বাদশা ইয়াহহ, তিনিই তোমার আশ্রয় রিবিকা। সমস্ত দেবদাসী, তামাম ক্রীতদাস, সকল সৈন্য তাঁরই বান্দা। ফেরাউনের আইন, হিতেনের আইন, অসুরদের আইনের চেয়ে বড় তাঁর আইন । তিনি যা জানেন, আমরা কেউ তা জানি না। নইলে লোটার ভাষা একমাত্র তুমিই কেন জানবে। এ ঘটনা তিনিই ঘটিয়েছেন। তাঁর অভিপ্রায় বোঝা আমার কর্তব্য! লোটার মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞার কথা তুমিই তাকে বলবে।

–পারব না! কিছুতেই পারব না! সাদইদ তুমি আমায় বিষ দাও সারগন! এই শিশুকে তুমি হত্যা কর!

–আজ তোমার বিবাহ রিবিকা!

মহাত্মা ইহুদ যেন আকাশ থেকে বলে উঠলেন। রিবিকার কান্না মুহূর্তে জমাটবদ্ধ পর্বততুষারে আবৃত হল। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা একটি শীর্ণ দীর্ঘ গাছে এসে বসল একটি ভয়ানক কালো মরু-ঈগল। তার ভারে নুয়ে পড়ল বৃক্ষের একটি ডাল। ঈগলের পাখার ঝাঁপটে কেঁপে উঠল মরু-প্রান্তর!!

মহাত্মা ইহুদ বললেন–লোটার মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা ঘোষণা করা নিশ্চয়ই খুব কষ্টের রিবিকা। তার মত সৈনিক শত অশ্বের চেয়ে, শিক্ষিত ঘোড়ার চেয়ে দামী। অথচ ইয়াহো সেই নিষ্ঠুর কাজের জন্য তোমাকেই নির্বাচন করেছেন। কিন্তু সেই নিষ্ঠুরতা সহনীয় করার জন্য সেই লোটাকেই তোমাকে বিবাহ করতে হবে। বিয়ের পর তুমি লোটাকে মৃত্যুর কথা বলবে! সমস্ত শিবির দেখবে নগর নির্মাতা মানুষ, যুদ্ধবাজ রাজারা কীভাবে এই সংসারকে মারছেন। মৃত্যু তো ক্রীতদাসের মুক্তি রিবিকা–তুমি সেই মৃত্যুকে বরণ করো মা গো!

মহাত্মা ইহুদের কণ্ঠস্বর ভাবাবেগে বুজে এল। দাড়ি গোঁফে আচ্ছন্ন মুখে চোখ দুটি সিক্ত হয়ে উঠল।

সাদইদ বলল–তোমার চোখের জল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার রিবিকা! এই শিশু আমার সম্পদ। দাও আমাকে! কখনও ধর্ম বুঝিনি। যে ঈশ্বরকে কখনও দেখিনি, তার অস্তিত্ব কেমন তাও জানি না–তবে কুড়িয়ে পাওয়া আমার ভালবাসার আজ সম্মতি হবে এই আনন্দ একজন সৈনিকের পক্ষে যথেষ্ট রিবিকা। তুমি সম্মত হও। লোটা মৃত্যুর আগে যদি একথা বিশ্বাস করে মরে যে সে পেয়েছিল। সেই শক্তির জোরেই আমি বেঁচে থাকব।

–এই সৌভাগ্য ইয়াহোর দান। তোমার এবং লোটার! যে ঈশ্বরকে তুমি চেনো না, সব তাঁরই অভিপ্রায় মাত্র। চলো রিবিকা।

বলে উঠলেন ইহুদ! রিবিকা তার শিশুকে সাদইদের কোলে অর্পণ করে বলল–আজ আমি দেবতা সূর্যের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হচ্ছি, দেবদাসী হবে কনে! তুমি যাকে আমনের বউ বলে ডাকতে, তার আজ মৃত্যু হল সারগন! দেবদাসীর ভাগ্যকে নিশ্চয়ই তুমি ঈর্ষা করছ! কুড়িয়ে পেয়েছিলে তো তাই এত সহজে ফেলে দিতে পারলে! তোমার লুঠ করা হাত দু’খানি এত দুর্বল সাদইদ!

কালো ঈগল পাখা ঝাঁপটে উঠল। তার পাখায় মরুভূমির শুকনো বালি, পায়ের নখে ধরা ধ্বস্ত নগরী নিনিভের রক্তাক্ত ইঁদুর! রিবিকা দ্রুত পাহাড় ছেড়ে মরুভূমিতে নেমে গেল। মরুকণ্ঠ তৃষ্ণার্ত ঈগল চিৎকার করল।

মরুভূমিতে একা ঘুরে ফেরাই কি তবে নিয়তি। ভিস্তির কোলে যে মানুষ হয়েছে, যার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যাকে মা ত্যাগ করে চলে গেছেন অমরাবতী–যে শিশু পিচ আঁটা ঝুড়িতে ভেসেছে কুফর দ্বীপের কোলে, যে দ্বীপ তলিয়ে গেছে সমুদ্রে, জিব্রিল ছাড়া যার জন্য কেউ অশ্রুপাত করেনি, তার নিয়তি কি আকাশের মত নিঃসঙ্গ? শুভ্র শ্বেত, উল্লসিত অগ্নিশিখার মত প্রখর অশ্বের দিকে চেয়ে ছিল সাদইদ।

আপন হাত দুখানির দিকে চেয়ে ছিল সে। দুমুঠো বালুর মত এ জীবন–যতই আঁকড়ে ধরা যাক, ঝরে পড়ে। এ তো কোন মৃত্তিকা নয়। দেশ নয়। তবু ভাল যে,মহাত্মা ইহুদের আশ্রয়েই চলে গেল রিবিকা। লোটার সঙ্গে তার বিবাহ–এ যে সত্যিই ঘটতে চলেছে ভাবলে চোখের পলক পড়তে চায় না। যাকে সাদইদ ছাড়তে পারছিল না, আপনিই সে চলে গেল ইয়াহোর ইশারায়। মরুমর্তের সেই ঈশ্বর কী মারাত্মক কুশলী! কখন দেয় আর কখন নেয়, সামান্য মানুষ বুঝতেই পারে না।

একজন দীন দেবদাসীর সেবক রাতারাতি হয়ে ওঠেন দিব্যজ্ঞানী মহাত্মা মসীহ। মরুজন্ম কী বিচিত্র! দুখানি হাতে ধরবার মত আর কিছু নেই, শুধু লাগাম ছাড়া! ভাবতে ভাবতে স্বর্ণালী বৈকালিক মরুরৌদ্রে সাদা অশ্বের কাছে নেমে এসে দাঁড়ায় সাদইদ। কোলে তার শিশু। শিশুই হাত বাড়িয়ে লাগাম টেনে ধরে। কী অবাক! হা থোকা! তুমি যদি রিবিকাকে এমন করে আঁকড়ে ধরতে পারতে!

সাদইদ শিশুকে নিয়ে অশ্বে উঠে বসে। হঠাৎ আকাশে শিঙার তুরীয় তীব্র নিনাদ ভেসে ওঠে। মহারাজা হিতেনের রথ আসছে দিগন্তের পারে স্বর্ণবিস্ময় ছড়াতে ছড়াতে। ধাতু বলয়ের ঘর্ষণে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মরুপথকে ফুলঝুরির মত বর্ণালী করেছে কল্পনা করা যায়। তার চোখের সামনে লোটার মরদেহ লটকানো হবে–বর্শাবিদ্ধ করার পর। তক্তার একটি যোগচিহ্নের কাঠামো খাড়া করা হয়েছে মরুভূমির উপর। লোটাকে গাঁথা হবে সেই দৃশ্যে। তার আগে তার বিবাহ সম্পন্ন হবে।

সাদইদ ঘোড়া নিয়ে এসে যোগচিহ্নবৎ তক্তার কাঠামোটির কাছে চুপচাপ দাঁড়ায়। সবচেয়ে নিঃস্ব বঞ্চিত ক্রীতদাসের জন্য, নারীকে পেতে চাওয়ার, ভাষা ও ধর্মের অধিকার চাওয়ার দণ্ড এখানে, বধ্যভূমির মরুচিহ্ন এটি, এখানে আমি কী করছি, ভাববার চেষ্টা করে সাদইদ। কাঠামোর দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে হাত থেমে যায়। বিবাহের পর মৃত্যুর উৎসব। ইয়াহোর ধর্ম কি জীবনের এই নিরাশ্রয় নিষ্ঠুরতার ভিতর উপ্ত হয় উদ্ভিদের মত?

মন্দির আর তাঁবুর এলাকায় এই মরুপ্রান্তরে এই প্রথম একটি বিবাহের মন্ত্র উচ্চারিত হবে। বিবাহ মাত্রই এখানে অতি কল্পনার একটি দৃশ্য। এ জিনিস কখনও হয় না। এখানে যেমন নদী নেই, তেমনি এখানে বিবাহ নেই। সমুদ্র যেমন এখানে বাতাসকে আড়াল করেছে, তেমনি আড়াল করেছে দাম্পত্য। এখানে প্রতিটি শুকনো বালুকণার মধ্যে যুদ্ধের দানা ছড়ানো, বিচ্ছেদ যেন লু। অশ্বের চমকিত দেহের কাঁপুনিতে রয়েছে যুদ্ধের আবেগ। আকাশের শূন্য হাওয়ার ভিতর ঝাঁপটা দিচ্ছে মরু-ঈগল।

তবে বিবাহ কিসের! ভাড়াটে সৈনিকের তাঁবুতে, নকল মন্দিরে, বিবাহ তো হাস্যকর! মন্দিরগুলি না হয়েছে মিশরের পাষাণ-ভাস্কর্যের সমতুল কোন বিপুল নির্মাণ, এখানে না আছে নিনিভে নগরীর ডানাঅলা বৃষের মানুষমুখো দুর্দমনীয় ঐশ্বর্যের মূর্তি কোন–এ যেন হিদ্দেকলের তীরের এঁটেল মাটির দৃঢ়তা নিয়েও দাঁড়াতে পারেনি। সবই আসলে ছায়ামাত্র–এ বসতি জীবনের নকলী প্রচ্ছায়া শুধু। সৈন্য বটে, কিন্তু সকলেই তো পলাতক দাসদাসী। কোন সম্রাট বা রাজা এদের বিশ্বাস করে না। এরা মিশরের পক্ষে ভাড়া খাটছে, যে কোন সময় অসুরদের পক্ষ অবলম্বন করতে পারে–রাজা হিতেন সাদইদকে তার বাহিনী নিয়ে যে কোন শক্তির তরফে যুদ্ধে যোগ দেবার স্বাধীনতা দিয়েছে–এ স্বাধীনতা হিতেনের খেয়ালিপনা মাত্র। আবার সন্ধিপত্র রচনাও সেই রাজারই পাগলামি। এই পাগলামি নিঃসন্দেহে ভয়ানক নিষ্ঠুর। সাদইদ যে অতি ক্ষুদ্র একজন রাজা নয়, দু পাঁচটি গ্রামের অধিকর্তা সামন্তও নয়, ভূস্বামী পুরোহিত নয়–হিতেন সে কথা সন্ধিপত্রে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।

তক্তার কাঠামো ছেড়ে পাথর মেশানো মরুপথ ভাঙতে লাগল সাদইদ। আজ দেবী ইস্তারের জন্মদিন। প্রেমের দেবী ইস্তার। জমিজমার দেবী, বীজের গর্ভস্থানের দেবী, মৃত্তিকার দেবী। আজ বড় শুভদিন। মড়কের দেবী নয়, যুদ্ধের দেবতা নয়, জলের দেবতা কুমীরের জন্মদিন নয়–আজ চাষীদের উৎসবের দিনে রিবিকার বিবাহ, শুকনো মরুস্থলী আজ স্বপ্নবিষ্ট। কিন্তু আজ মৃত্যুরও দিন।

শিঙার আওয়াজ শোনা যায় বাতাসে। এ ধ্বনি-বিভ্রমও হতে পারে। সাদইদ হয়ত সবই ভুল শুনছে। সবই ভুল দেখছে। সামনে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায়। প্রতিটি দাস সৈন্য এবং দেবদাসীর হাত বা শরীর থেকে পাথর ঘষে ঘষে দাসমালিক এবং সম্রাটদের এঁকে দেওয়া উল্কি মুছে ফেলা হচ্ছে, শরীরে রক্তপাত হয়ে যাচ্ছে তবু এই দৃশ্য থামছে না। রক্তপাতের পর ভেষজ দাওয়াই লাগানো হচ্ছে। এই উল্কি মুছে ফেলার অপরাধের দণ্ড হল আঙুল কর্তন।

এক ধরনের অম্নরস উল্কিস্থানে লেপন করে তীক্ষ্ণ পাথর বা ছুরির সাহায্যে চামড়া চেঁছে তোলা হচ্ছে দাসমালিকের ছাপ, নাম-ঠিকানা। মানুষ চিৎকার করে উঠছে যন্ত্রণায় আর আনন্দে। কিশোর-কিশোরীর চোখে জল টুপিয়ে পড়ছে। এ কোন আশ্চর্য ছবি! সৈনিকদের অনেকেই ছিল কৃষক, দাসমালিক তাদের পায়ে দলেছে, বেগার খাঁটিয়েছে, বাধ্যতামূলক কাজে নিয়োগ করেছে–তার নিজের জমি ফেলে কৃষক তার মালিকের জল তোলার কপিকল চালিয়েছে ভোররাত্রি থেকে মধ্যরাত অবধি। তার দেহ ধনুকের মত বেঁকে গেছে। তার জমির গম পুড়ে গেছে মরু লু-তে, গমের শিষ বালির স্তরে ছোপ ধরে শুকিয়ে গেছে, তার সেচের নালা বুজে গেছে ধূলায়, তার কুটিরখানি উড়ে গেছে ঝড়ে, নলখাগড়ার চালা উধাও। একদিন সে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে এসেছে গৃহে, রাজার আমলারা তার বউ আর বাচ্চাদের ফিনিসীয় জাহাজে তুলে দিয়েছে, ফিনিসীয় ধূর্ত বণিকদের দাসব্যবসা কখনও বন্ধ হয়নি–জাহাজ ভেসে গেছে কোথায় কেউ জানে না। যে ফিনিসীয়রা বাইশটি বর্ণ আবিষ্কার করে বর্ণমালা প্রস্তুত করেছে, ভাষাকে করেছে উন্নত, তাদের মূল ব্যবসাই ছিল দাসদাসী কেনাবেচা।

সাদইদ বুঝে পায় না একটা সভ্য জাত কী নিষ্ঠুর হয়! বউ হারিয়ে, সন্তান হারিয়ে সেই কৃষক তবু বাঁচতে পারেনি। তার হাতে উল্কি আঁকা–চাষী বর্ণমালা বোঝে না। দাসমালিকের বাইশী ভাষা আয়ত্ত তিনি উল্কির নকশায় তাঁর নাম ঠিকানা লিখে ছেড়ে দিয়েছেন–মানুষ পালাবে কোথায়! সেই সব-হারানো কৃষক ধরা পড়ে গেছে অতঃপর–আত্মগোপন করেও থাকতে পারেনি। দাসমালিক আর ফেরাউনের চোখের আড়ালে। ফেরাউনের চোখ পিরামিডের মত আকাশ থেকে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয়। ধরা পড়ার পর সেই কৃষক হয়েছে চিরস্থায়ী সৈনিক। তারপর শেষবারের মত পালিয়ে এসেছে হেথায় মরুমর্তে! সাদইদ কখনও জোর করে তাদের দেহের উল্কি মুছে ফেলার নির্দেশ দিতে পারেনি। অথচ ইহুদ নিজে হাতে সেই উন্নত ভাষার ছাপ মুছে দিচ্ছেন। চাষীর মনের উপর চলেছে অতীতের স্মৃতির প্রহার। তার বউকে, সন্তানকে মনে পড়ছে।

চাষী কেঁদে উঠছে আনন্দে। ভয় করছে, আনন্দ হচ্ছে। তার দীর্ণ কান্নায় আর উল্লাসে মথিত হচ্ছে অপরাহু। একদিকে বাঁটা মেহেদিপাত্র মুঠোয় চেপে ধরে বসে আছে সজ্জিত রিবিকা, চোখে সুর্মা, গলায় ঝুলছে বনকুসুমের মালা, বাহুতে জড়ানো পুষ্পবন্ধ, পরনে জড়ানো মেসোপটেমিয়ার রেশমী বসন, সূক্ষ্ম বস্ত্রের আড়ালে তার দেহাবয়ব স্পষ্ট রাঙা। বসনের তলায় কোন পরিধান নেই। তার হাতের উল্কি আগেই তোলা হয়েছে।

সাদইদ ঘোড়া নিয়ে এসে অনেকখানি তফাতে একটি ছায়ানিবিড় বৃক্ষের তলে দাঁড়াল। কেউ তাকে একবার ভাল করে চেয়েও দেখল না। এই প্রথম সাদইদ অদ্ভুতভাবে অনুভব করল, সে এই জনমণ্ডলীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন। এরা তার উপস্থিতির কোন পরোয়া করে না। যেন এরা তাকে কখনও দেখেওনি। সে বড়জোর একজন বহিরাগত পলাতক সৈনিক। তার দিকে কেউ কেউ পরম করুণার চোখে চাইল।

একজন সৈনিক সকৌতুকে বলে উঠল–এসো মুছে নাও! রাজার ছাপটা গা থেকে ছাড়িয়ে ফেলে স্বাধীন হও বাছা! রক্ত কিছুটা ঝরবে বটে, কিন্তু হৃদয়ে তাম পাবে। মরুভূমিতে কতকাল ঘুরে মরছ–একটু আহ্লাদ, একটু মুক্তির কথা ভাবো। কী হে, শুনতে খুব মন্দ লাগে বুঝি?

এক বুড়ি বলল–বাছার কী আর সাধ আহ্লাদ আছে! মহাত্মা পয়গম্বর যে কনের বাবা, তা জানলে কী আর লোটার দোস্ত নিবিকের সাথে ফস্টিনস্টি করে–সেই শরমে দেইড়েই আছে, ঘোড়াটি তেনার বিবশ হয়েছেন গো!

এই কথায় গায়ে টোনা মেরে গালের টোল নাচিয়ে হি হি করে হেসে উঠল দঙ্গলবাঁধা দেবদাসীরা। মরুমর্তে এ এক বিষম মর্মান্তিক দৃশ্য–আহ্বাদে দিশেহারা, দুঃস্বপ্নেভরা এ ছবি, তবু কান্নায় বিষণ্ণ, রক্তপাতে, রঙে উচ্চকিত মধুর। সেই মাধুর্যে কাঁপছে হৃদয়, রাঙা ঠোঁট, ফের মৃত্যুর গন্ধে বাতাস উতলা।

ইয়াহোর ধর্মের প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ইস্তারের জন্মদিনে। এই মরু তার ক্রোড়, তার গর্ভস্থান, ইহুদের দণ্ডখানি তার নির্ভরতা। দণ্ডখানি নেড়ে নেড়ে সকলের সঙ্গে কত কথা বলে চলেছেন ইহুদ। সাদইদের ইচ্ছে হল, সে ভয়ানক আর্তনাদ করে ওঠে।

কিন্তু কী বলে সে আর্তনাদ করবে? কী হবে তার মুখের ভাষা? এখানে যে তার কেউ নেই। কে শুনবে তার কথা! সাদইদ বিড় বিড় করে উঠল–এ ভারী অন্যায় মহাত্মা ইহুদ! বিয়ের নামে, মুক্তির নামে এ আপনি কী করছেন! এই মানুষেরা সকলে লোকটাকে ঘৃণা করত! কোন দেবদাসী ওকে আশ্রয় দেয়নি। তার মৃত্যুর দিনে কিসের আয়োজন করেছেন আপনি! রিবিকাকে এভাবে কাঁদিয়ে তার ভাগ্যকে পরিহাস করছেন কেন? ওগো, তোমরা থামো!

সাদইদের স্বর ফুটল না। চোখ বহে গণ্ডদেশ প্লাবিত করে সাদইদের অশু গড়াতে চাইছিল, সাদইদ জানে এই মরু-বাতাসে সেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ে না, চোখের পাতার আড়ালে কেবল চিক চিক করে সূর্যবিম্বিত বালুকণার মত তীব্র।

অথচ ইয়াহোর ধর্ম এক অবিনাশী উদ্ভিদ! ইয়াহো বলেন–হোক! শুধু হউক’ বলাই যথেষ্ট, সৃষ্টি পুরাণে মরুমর্তে, জীবকুলে এক অমৃত মন্থন শুরু হয়।

মহাত্মা ইহুদ বললেন–আমার কন্যার হৃদয়ের বেদনা জয়ী হোক।

কথাটা শুনে সাদইদ কেঁপে উঠল। সে সহসাই চিৎকার করে উঠল–লোটা! এ হতে পারে না লোটা! তোমার কালো ঘোড়া কোথায়? নিনিভের পতন হয়েছে, এসো আমরা যাত্রা করি। থেকো না, ওভাবে পড়ে থেকো না দোস্ত!

এই মুহূর্তে সাদইদের সাদা অশ্ব এক বেগার্ধ স্বরে হেষাধ্বনি করে ওঠে আকাশে মুখ তুলে। সাদইদের কণ্ঠস্বর চাপা পড়ে যায়–এ মিথ্যা! এ অন্যায় লোটা! যুদ্ধ তোমার নিয়তি, তুমি উঠে এসো!

লোটার দুই চোখ তন্ময় ছিল। সে চেয়ে ছিল তার কনেটির দিকে। সাদইদের মুখে ‘লোটা’ নাম উচ্চারণ শুনে একবার চকিতে চোখ তুলে সাদইদকে দেখে স্মিত হাস্য করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। অশ্বের হেষাধ্বনিতে রিবিকার মুষ্টিবদ্ধ দু’ হাত শিথিল হয়ে খুলে গেল। তৃষ্ণাকুল দুটি চোখ তার, সুর্মার নদীতে ছল ছল করতে লাগল। সে সাদইদের দিকে নয়ন মেলে চাইতে পারল না। তার সাধ হচ্ছিল সে একবার শিশুকে দেখে।

মহাত্মা ইহুদ বললেন–আমার কন্যার হৃদয়ের বেদনা তোমার পাহাড়ের চেয়ে উচ্চ সাদ। পিরামিডের চেয়ে মহৎ। রাজার আইন টলে পড়ে, কিন্তু মেষশিশুর চেয়ে পবিত্র হৃদয় কর্তব্যে বিচলিত হয় না।

রিবিকার বিবাহ ইয়াহোর নির্দেশ মাত্র। বঞ্চিত লোটার জন্য ঈশ্বরের একমাত্র উপহার। সাদ, তুমি পাগল হয়ে গেছ!

সকলে উচ্চহাস্যে বিদ্রূপ করে উঠল। কিসের মাতমে এরা সব বধির হয়েছে, সাদইদ ভেবে পেল না। আবার বলে উঠল–আমরা এখনও চলে যেতে পারি লোটা! রিবিকা তুমি বলে দাও–সব কথা বলে দাও নোটাকে।

রিবিকা শিহরিত হয়ে উঠল। তার প্রাণ বলল, সে বলে দেয়। সে চোখ তুলে কতজনের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চাইল, কোথাও সে কণামাত্র সমর্থন পেল না। সবাই যেন এক পাষাণের মত স্থির, চোখে এক মদির স্বপ্ন জমাট বেঁধে আছে, কিন্তু কোন তরঙ্গ নেই। রিবিকা হতাশায় ভেঙে পড়ল আপন হৃদয়ে। তারপর সে মহাত্মার দিকে চোখ তুলল।

ইহুদ বললেন–আমার ধর্মে কোন প্রতিমাপূজা নেই। আমার ধর্ম দেবতা সামাশ বা আমনের চেয়ে শক্তিশালী। ইয়াহো নিরাকার। তাঁর কোন শরিক নেই। তিনি অদ্বিতীয় ঈশ্বর। বলল, তিনি যা তিনি তাই। তুমি এই কথাগুলি লোটাকে বলিয়ে নাও। এই মন্ত্রই বিবাহের মন্ত্র। এখানকার সমস্ত পুরুষ তোমার মত নারীর স্বপ্ন দেখে। আমি সকলকে সেই স্বপ্নের দিকে নিয়ে চলেছি। তোমরা সকল বিগ্রহ বর্জন কর। ইয়াহো সূর্যকে অবধি নিয়ন্ত্রণ করেন। বাতাস তাঁরই নির্দেশে চলে, মেঘ বৃষ্টি, সমুদ্র নদী তাঁরই ইশারায় আন্দোলিত হয়। বৃক্ষের একটি পাতাও তাঁর ইচ্ছা ছাড়া কাঁপে না।

ঠিক এই উচ্চারিত মন্ত্র রিবিকা বলে উঠবে, তখনই হিতেনের রথকে দুটি ঘোড়ায় টেনে আনল মরুপথ বিদীর্ণ করে তীব্র বেগে। শিঙা নিনাদিত হল।

মহাত্মা ইহুদ রাজার উপস্থিতি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে লোটা আর রিবিকার বিবাহ নিষ্পন্ন করলেন। বিবাহের দৃশ্য দেখতে দেখতে হিতেনের দুই চোখ মহাক্রোধে চকচক করে উঠল। রাজা এসেছে লোটাকে বধ করতে আর সুন্দরী রিবিকাকে রথে তুলে নিতে। এ দৃশ্য তার কাছে অভাবিত, অপমানজনক। সে হুংকার দিয়ে উঠল। বলল–সৈনাধিপতি সাদইদ, এ কী দেখছি আমি! সুন্দরীকে টেনে আনো আমার কাছে! লোটাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে চলো!

একজন সৈনিক বলে উঠল–সাদইদের আধিপত্য আমরা স্বীকার করি না। রাজা হিতেন। তুমি ফিরে যাও।

–এতবড় স্পর্ধার কথা কী করে বলছে লোকটা!

–যে ফেরাউন আমাদের সর্বস্ব ধ্বংস করেছে–আমার জমিজমা, বউ, সন্তান নষ্ট করে দিয়েছে, তারই হয়ে ভাড়া খাটছি আমরা–এই অপমান কত সইব বলতে পারো! তোমার তদারকির পরোয়া করি না রাজা। তুমি ফিরে যাও। ফেরাউন আমার হাতের আঙুল কেটে দিয়েছে, এই দ্যাখো!

দু’ হাত মাথায় তুলে দেখালো সেই সৈনিক।

–অসম্ভব! ওই সুন্দরীকে আমার চাই! বলল রাজা হিতেন।

ইহুদ বললেন–মা রিবিকা, তুমি এবার লোটাকে বলে দাও, রাজা তাকে বধ করতে এসেছে!

রিবিকার ঠোঁট দুটি থরথর করে কেঁপে উঠল। সে কিছুতেই এতবড় মর্মান্তিক কথা উচ্চারণ করতে পারছিল না। তার কেবলই মনে পড়ছিল তার মায়ের ভাষা ছিল লোটারই মত বিচ্ছিন্ন,সকলে তাকে ঘৃণা করত। মা ছিল বাবার উপপত্নী! লোটার মুখটা তেমনই সরল।

ইহুদ এবার রিবিকাকে ধমক দিয়ে উঠলেন। রিবিকার চোখ দুটি এমন অসহায় মুহূর্তে সাদইদকে খুঁজছিল। সে নিজেও অবাক হল, তার চোখ কেন সাদইদকেই খুঁজছে!

হিতেন গর্জন করে উঠল–সাদইদ লোটাকে বাঁধো–আমার হুকুম!

সাদইদ তার সাদা অশ্ব রাজার রথের কাছে হাঁকিয়ে নিয়ে এল। তারপর বলল–আপনার সঙ্গে রয়েছে সারথী আর মাত্র একজন ঢাল ধরা সৈনিক-তাই সম্বল করে এত হাঁকাহাঁকি ঠিক নয় মহারাজা।

রাজা হিতেন উচ্চ হাস্য করে উঠল। বলল–তুমি বড় মূর্খ সাদ। তোমায় সন্ধিফলক মাগনাই দিয়েছি দেখছি।

এই সময় দূরে থেকে প্রখর তূর্যনাদ ভেসে এল। দেখতে না দেখতে সমস্ত তল্লাট রাজা হিতেনের অশ্বারোহী সেনায় ভরে গেল। লোটার কোমরে দড়ি বাঁধা হল শক্ত করে–দুহাত বাঁধা হল। সন্ধ্যার আগের সূর্যালোকে নীল আকাশ রক্তে প্লাবিত। সেই দিকে দু চোখ মেলে লোটা হাঁটতে থাকল বধ্যভূমির দিকে।

রিবিকা লোটার ভাষায় আর্তনাদ করে উঠল–যেও না লোটা, রাজার লোক তোমায় হত্যা করতে নিয়ে যাচ্ছে! মহাত্মা ইহুদ, এ আপনি কী করলেন।

প্রবল কান্নায় ভেঙে পড়ল রিবিকা। দুহাত মুখ ঢেকে মাটির উপর বসে পড়ল। যে ক্রীতদাস সৈন্য দু হাতের আঙুল কেটে দিয়েছে মিশরের দাসমালিক বলেদু হাত তুলে দেখাচ্ছিল সেই সৈনিকটি রিবিকার কাছে এগিয়ে এসে বলল–কেঁদো না বউ! তুমি কাঁদলে মানুষের সংসার কাঁদে!

লোটা আকাশে চোখ মেলে এগিয়ে চলেছে, তার পিছু পিছু সমস্ত মানুষ ধীরে ধীরে দীর্ঘ সারির মিছিলে চলতে শুরু করেছে। সাদইদ সেই প্রবাহের দিকে বিষাদপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়েই রয়েছে। তার করার কিছুই নেই।

লোটা প্রায়ই বলত, যা রিবিকা অনুবাদ করেছিল সেদিন আমি একদিন বৃষ্টি ঝরা ভোরে ঝাঁপসা দিগন্তে উটের পিঠে চড়ে চলে যাব, আর ফিরব না।

কিন্তু এখন তো সন্ধ্যাকাল। সবাই চলে গেছে বধ্যভূমির দিকে। ভয়াবহ আর্তনাদ করে উঠলেন মহাত্মা ইহুদ। ইয়াহো! ইয়াহো। …

তারপর হঠাৎ তিনি স্বয়ং বধ্যভূমির দিকে পাগলের মত ছুটতে শুরু করলেন। রাজার রথ ধীরে ধীরে তাঁর পিছু পিছু এগিয়ে চলল। বাবার পিছনে ছুটে গেছে রিবিকা–তার ছুটে যাওয়ার দিশে ছিল না।

এমন সময় বধ্যভূমির কাছে মিছিল থামলে এই মরুমর্তে এক আশ্চর্য দৃশ্যের ঘটনা দেখা যায়। নোটাকে আঁকড়ে ধরেছে রিবিকা। মহাত্মা ইহুদ বলছেন–এই কান্নার শেষ কি নেই? ঈশ্বর!

লোটার বুকে লুটিয়ে পড়েছে রিবিকা।

সাদা অষের পিঠে হেরার পুত্রকে কোলে করে ছুটে এসেছে সাদইদ। তার মনে হল, সামনের এই ছবিই পৃথিবীর শেষ ছবি। এর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। তার দেখা প্রজাপতি অধিকৃত নারীই লোটার বুকে আরো সুন্দর হয়ে ফুটে উঠেছে। এবং এর পরই পৃথিবীর নৃশংসতম দৃশ্যটি সে দেখবে।

কিন্তু দৃশ্যান্তর হল ইয়াহোর নির্দেশে। কেননা মহাত্মা আকাশে মুখ তুলে ইয়াহোর নামে আতশব্দ করে উঠলেন মুহুর্মুহু ।

দিগন্ত সহসা কালো হয়ে উঠল। মনে হল দিগন্তজুড়ে কী যেন কালো মতন ভেসে আসছে। রাজা হিতেন সুন্দরী রিবিকাকে ধরবার জন্য রথ ছেড়ে নেমে পড়েছিল। সে কেবল সম্মুখে এগিয়ে এসেছে মাত্র দুটি ধাপ ফেলে, এমন সময় দিগন্ত সমাচ্ছন্ন হল! অজস্র ঈগল নিনিভের দিক থেকে উড়ে আসছে।

প্রত্যেকটির পায়ে ধরা ইঁদুর। মাথার আকাশ ভরে গেল মুহূর্তে।

রাজার পায়ের কাছে ঈগল তার শিকার ফেলে দেয়। ইঁদুরের মুখ টুকটুকে লাল। পেট মোটা। ধপ ধপ শব্দে ইঁদুর পড়তে থাকে আকাশ থেকে। মানুষ আর্তনাদ করে ওঠে–মড়ক! মড়ক! মানুষের মড়ক! নিনিভে মানে মড়কের নগরী! সব শেষ হয়ে গিয়েছে।

রাজার দেহ সঙ্গে সঙ্গে হিম হয়ে যায়। সে হাত বাড়িয়েছিল কিন্তু পা আর নড়াতে পারল না। রাজা রথে গিয়ে চড়ল।

মহাত্মা ইহুদ লোটার দড়ি গা থেকে দ্রুতহাতে খুলে দিলেন। লোটা ছাড়া পেয়ে তার কালো অর্থের দিকে দৌড়ে গেল। সমস্ত মরুভূমিতে পা ফেলা যাচ্ছে না। ভয়ে রাজার সৈন্যরা অশ্ব ছুটিয়ে দিয়েছে অন্য দিগন্তের দিকে। পা আর ফেলা যাচ্ছে না কিছুতেই। প্রচুর ইঁদুর দৌড়চ্ছে। লাল মুখ। পেট ফোলা। কোনটির ভুড়ি বেরিয়ে পড়েছে। লোটা লাফিয়ে উঠল কালো ঘোড়ার পিঠে।

তেড়ে গেল রথ লক্ষ্য করে। রাজার বুক ভেদ করে গেল লোটার ছুঁড়ে দেওয়া বর্শা। রাজার দেহ রথ থেকে মাটিতে পড়ে গেল। তারপর এক দণ্ডে কালো অশ্ব কোথায় হারিয়ে গেল দেখা গেল না।

সমস্ত রাত কম-বেশি সকলেই জেগে থাকল লোটার অপেক্ষায়। লোটা এই বুঝি ফিরে আসে। সবাই ভয় করছিল সমস্ত মরুভূমিতে লালমুখো মড়কের ইঁদুর ছড়িয়ে গেছে। জুম পাহাড়ী এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার। মহাত্মা ইহুদ রাত্রির আকাশে আর্তনাদ ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন মাঝে মাঝে ইয়াহো!

মানুষের হৃদয় সেই আর্তনাদে কেঁপে কেঁপে উঠছিল। তারা শেষ রাত্রের লাল চাঁদের আলোয় দিগন্তে চেয়ে ভাবছিল–একটি কালো অশ্ব তারা দেখতে পাবে। সমস্ত রাতের প্রতীক্ষা ব্যর্থ করল লোটা। ফিরে এল না। মহাত্মা ইহুদ ভোরের সূর্যকে লাঠি তুলে শাসন করে বললেন–হ্যাঁ সামাশ! তুমি আবার এসেছ! তোমাকে ইয়াহোর নির্দেশে বারবার আসতে হবে! রানী ইসাবেলা তুমি দেখে যাও, ইয়াহোর হুকুমে শত শত ঈগল উড়ে এসেছে। সূর্য এসেছে। লোটা তাঁরই নির্দেশে হারিয়ে গেল! ইয়াহো চাইলে সে আবার ফিরে আসবে! নতুবা সে আর ফিরবে না। চলো আমরা মধুদুগ্ধের দেশে যাত্রা করি!

রিবিকা এ সময় ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সকালের দিগন্তে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকার মনে হল, কালো ঘোড়া ওই বুঝি দেখা যায়! কিন্তু সে দেখল একটি সাদা অশ্ব দিগন্তে উদ্ভাসিত হয়েছে। সে তখন আরো জোরে কেঁদে উঠল উচ্চকিত সুরে।

এরপর সব প্রবল প্রবাহ এল নানা দিগন্ত থেকে। মহাত্মা প্রস্তুত। বিশাল এক জনসমুদ্র মহাত্মাকে অনুসরণ করবে। সবাই উঠে দাঁড়িয়েছে। সূর্যের কুসুম আলো লাল বালুতে পড়ে জ্বলজ্বল করছে। জুম পাহাড় একা দাঁড়িয়ে আছে। তার ভাষা কেউ আর শুনবে না।

সাদা অশ্ব থেকে ছেলে কোলে করে নেমে এল সাদইদ। তার চোখে সমস্ত রাত্রির জাগরণ। সে লোটাকে খুঁজে ফিরেছে তামাম রাত্রি। সাদইদ মাথা নিচু করে রিবিকার দিকে শিশুকে এগিয়ে ধরে বলল-একে বাঁচিয়ে রেখো রিবিকা। আমি লোটাকে খুঁজতে গেলাম।

জনস্রোত চলতে শুরু করল। রিবিকা হঠাৎ শিশুকে কোলে নেবার সময় লক্ষ্য করল সাদইদের হাতের উল্কি রক্তাক্ত, সদ্য ছুরিতে কেটে ফেলেছে সে। রক্ত ঝরে পড়ছে। সাদইদ চিৎকার করে উঠল

–কেউ তোমরা আমার সঙ্গে যাবে না? অন্তত একজন কেউ? আমার ভাষায় যারা কথা বলেছ, তারা কেউ নেই?

 ০৭-৮. জুম পাহাড়

জুম পাহাড় কোন উত্তর দিল না। আমার সমন্বয়ী অরমিক ভাষায় যারা কথা বলেছ, তারা কেউ নেই। আর্তনাদ করেছিল সাদইদ। তার নিজস্ব পাহাড়ও কোন জবাব দেয়নি। শিশুর গলার লকেটটি সে ঝুলিয়ে রেখেছে সাদা অশ্বের কপালে। এই চিহ্ন ছাড়া জুম পাহাড়ী জীবনের আর কোন অবশেষ নেই। কোন দিগন্তেই লোটার সাক্ষাৎ মেলেনি।

ঈগল উড়ে আসা যত অলৌকিক, তারও চেয়ে রহস্যময় লোটার হারিয়ে যাওয়া। সে যেন পয়গম্বরের মত কোথাও চলে গেছে। মৃত রাজার নাকের কাছে একটি লাল ইঁদুর মরে পড়ে আছে। রাজার নাকের ভিতর ইঁদুরের গা থেকে নেমে চলে গেছে লাল পিঁপড়ের একটা স্রোত। রাজার এই মৃত্যুও অলৌকিক।

প্রজাপতির রেণুর মত তুচ্ছ এ জীবন রাজা! বিড়বিড় করে একলা নিঃসঙ্গ মরু-যাযাবর সাদইদ বলে উঠল। গাছের ডালে বসে থাকা কালো ভয়ংকর ঈগল ছাড়া সেকথা কেউ শুনল না। দিগন্তে মিলিয়ে গেছে মহাত্মা ইহুদের জনতা।

একটা দীর্ঘশ্বাস চাপল সাদইদ। তারপর নিনিভের দিকে অশ্ব হাঁকিয়ে দিল। চলতে চলতে সহসা তার দ্বিতীয় শিক্ষা শিবির, যেখানে সে আটাশ জন সৈন্য রেখে এসেছিল, যেখানে রয়েছে কিশোর সমেরু, মনে পড়ল সেকথা। সেখানে রয়েছে ক্ষুদ্র অরণ্য,সমুদ্রের হাওয়া সেখানে তবু লাগে–এখানেই সে রিবিকাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। শিবিরের ভিতর ঢুকে পড়ল সাদইদ। তাঁবুতে সামুদ্রিক হাওয়া এসে লাগছে। তাঁবু ফটাস ফটাস করে ক্রমাগত শব্দ করছে। যেন কোন ডানাঅলা প্রাণী।

অবাক হওয়ার শক্তিও সাদইদের ফুরিয়ে এসেছিল। সে দুই চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে রইল। কেউ কোথাও নেই। সমস্ত শিবির জনশূন্য। অশ্বগুলিও নেই। দেবদারুর ডালে ঝুলে আছে সমেরুর মৃতদেহ। সাদইদ বুঝল এ আত্মহত্যা নাও হতে পারে। সমেরু একটি তাঁবুর তলে তার মাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছিল। এমন সুন্দর কিশোরের সঙ্গে রিবিকার দেখা হল না। একটি মরুশকুন ডালে বসে সমেরুর গলিত দেহ থেকে মাংস খুবলে চলেছে। শকুনের গলার শব্দে গদগদ স্ফূর্তির চলকানি।

সাদা অশ্বের গায়ে হাত রেখে সাদইদের সমস্ত দেহ থর থর করে কেঁপে উঠল। সে অশ্ব চালনা করল মরুভূমির বুকে। সমস্ত দিনটা মরুভূমির উপর শেষ হয়ে গেল। মানুষের প্রবাহ চারিদিক থেকে ছুটে চলেছে দিগ্বিদিক! সাদইদ সমস্ত রাত্রি অশ্ব চালনা করল, কেবল মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়েছে গাছের তলে।

কয়েক দিন পর কোন এক অপরাহে নিনিভে পৌঁছে গেল সে। মড়কে প্রাণহীন নগরী। রাত্রি আসন্ন, আলো জ্বালাবার কেউ নেই। পথের উপর দিয়ে গান গেছে যাচ্ছে একজন। চওড়া সড়ক, প্রকাণ্ড শহর। লোকটা গাইছে,নাকি আর্তনাদ করছে, বোঝা যায় না।

‘আমার বীণা টাঙানোর দেওয়ালখানা কই?
ওহে সুন্দরী নিনিভে!
পুড়ে গেছে সব, জ্বলে গেছে সর্বস্ব প্রভু!
কোথায় তারকাঁটা পোঁতা দেওয়ালখানি–
আমার বীণাখানি যে ইনিয়ে বিনিয়ে ওঠে,
মহানগরী নিনিভে! নানভী, আমার নানভী!’

বীণার মীড়ে নগরীর শেষ স্তব্ধতা জমাট বাঁধছে! সাদইদ লক্ষ্য করল পথের উপর গাছের নিচে বসে একটি অদ্ভুত ধরনের লোক কী যেন মাটির ফলকের উপর লিখে চলেছে!

‘কাল যে বেঁচে ছিল আজ সে বেঁচে নেই,
একটু আগে যে গান গাইছিল,
সে এখন শোকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।’

[মেসোপটেমিয়ার কবিতা]

–এসব কেন লিখে রাখছ তুমি?

সাদইদ প্রশ্ন করতেই লোকটা চমকে পিছন ফিরে চাইল, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখ দুটি বিষয়, কিন্তু কোমল। কেমন শুকনো করে হেসে বলল-আর কেন! এটাই আমার অভিজ্ঞতা কিনা! মড়কে উচ্ছন্নে গেল, দাগা খেল প্রচুর! সবাই চারিদিক থেকে এসে ধ্বসিয়েই দিলে। তবু মায়া হয়। দু’ ছত্র লিখে রাখলাম–যদি কখনও কেউ পড়ে, ভাববে–আচ্ছা কী ভাববে বল তো!

লোকটার কথার মধ্যে পাগলামির লক্ষণ ছিল। সাদইদ কোন জবাব দিতে পারল না। লোকটা আরো হয়ত কিছু লিখত কিন্তু হাতের খোদাই করার বাটালি ফেলে দিয়ে বলল–নিয়ে যাও, তুমিও নিয়ে যাও। এখনও যা রয়েছে, দু’একটা গ্রাম বসাতে পারবে। গরু! প্রচুর গাভী! ভেড়া! ছাগল! একটু গাঁয়ের দিকে গেলেই এসব পেয়ে যাবে। নেবার লোক নেই। সবাই পালিয়েছে। মড়ককে যদি ভয় না করো, মন্দিরে ঢুকে পড়ো। প্রচুর সোনাদানা। তবে খাবার ছোঁবে না! মারা পড়বে। জল খাবে না। বিষ।

একটু থেমে লোকটা ফের পাগলের মত বলল–আজ এখানকার মানুষকে কেউ নেয় না। তুমি তো সৈনিক। আমায় নিয়ে চলো । আমি তোমার গুলাম হতে চাইছি। একটা নগর কীভাবে গড়ে ওঠে? খরিদা গুলামের মেহনতে! চাষার বেগারিতে। চাচা খাটে বলেই একটা নিনিভে তৈরি হয়। কারিগর পাড়ায় গিয়ে দেখে এসো সবাই ধুকছে। কেউ তাদের নিতে চাইছে না! ক্রীতদাস মানে হল মেহনত। উল্কির দাগা মারা ঘোটলোক! তবু বলছি, আমায় নিয়ে চলো, আমি মরব না। আমার মড়ক হয়নি।

–আপনি অসুস্থ!

–নাহ! আমি অসুস্থ নই। আমাকে রোগ এখনও ধরেনি। কিসের মায়ায় এখনও পড়ে আছি এখানে! আমার যা বলার ছিল এতক্ষণ খোদাই করলাম। চলো। আমি ভয়ে জল অবধি স্পর্শ করিনি। যদি দ্রুত কোথাও নিয়ে না যাও, আমি বাঁচব না। আমাকে বাঁচাও। আমি তোমাকে এই বাটালির মুখ থেকে হাতুড়ি থেকে একটা নগরী উপহার দেব। আমি পারি। যোদ্ধা নই। রাজাও নই। তবু পারি।

বলতে বলতে লোকটি তেষ্টায় জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে লাগল। তার চোখ দুটি ক্লান্ত হয়ে এসেছিল। মুদে আসতে চাইছিল।

সাদইদ ভাস্করের পাশে বসে পড়ে বলল–আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি হেরা! আপনি বিখ্যাত মানুষ।

সাদইদ হেরাকে চিনতে পেরেছে শুনেও হেরার চোখেমুখে তেমন কোন উৎসাহ দেখা গেল না। সাদইদ হঠাৎ মনে পড়ায় অশ্বের কপাল থেকে লকেটটা খুলে এনে হেরার হাতে দিতেই হেরার চোখ মুহূর্তে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল খুশিতে। পর মুহূর্তেই হেরার মুখ ম্লান হয়ে গেল।

হেরা বলল–আমার ছেলে কি বেঁচে আছে? কী দিয়েছ ওর মুখে? বলেই হেরা সাদইদের বুকের কাপড় সজোরে খামচে ধরল।

সাদইদ শান্ত গলায় বলল–আছে। বেঁচে আছে। মধুই দিয়েছি।

–তবে এক্ষুনি আমায় নিয়ে চলো!

বলতে বলতে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেও পারল না হেরা। মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে বলল–জল!

অশ্বের পিঠে হেরাকে উঠিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে ফিরে চলল সাদইদ। পিছন ফিরে একবার নগরীর দিকে চেয়ে দেখে বলল–তোমার একটা দেওয়ালও আর আস্ত নেই। তোমাকে লুঠ করব এমন অবস্থাও তোমার নয়। তবে যা পেলাম, তার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই। সেলাম নিনিভে! সেলাম ডানাঅলা বৃষ!

অনেক দূর আসার পর সন্ধ্যা ঘনালো ঘোরতর। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার নিবিড় রাত্রি । গত রাতে একাকী সাদইদ পথ চলেছিল। কিন্তু আজ অসুস্থ হেরাকে সঙ্গে করে অতিঘোর অন্ধকারে পথ চলার সাহস তার হল না। একটি ক্ষুদ্র মরূদ্যান তার চোখে পড়ল। চারিদিক গভীর নির্জন। এখানে জল রয়েছে। হেরার মুখে জল তুলে দিল সাদইদ। হঠাৎ চোখে পড়ল জলাশয়ের জলে অঞ্জলি পাতার সময় অন্ধকারেই একটি উট তার গলা নামাচ্ছিল–সে সামনেই বসে রয়েছে। সামনের দুপা ভাঁজ করে মাটিতে ভেঙে প্রাণীটি পিছনের অংশ তুলে জলে মুখ নামিয়েছে।

অত্যন্ত তীব্রভাবে লোটার কথা মনে পড়ে গেল। কোথায় গেল মানুষটা, কেনই বা ওভাবে হারিয়ে গেল! ওই প্রাণীটির কথা ভাবলে লোটাকেই শুধু মনে পড়ে না–কত ভাবনার উদয় হয়। মরুভূমির মানুষ তৃষ্ণার সময় এই প্রাণীটিকে হত্যা করে এর শরীর থেকে জলের থলি বার করে নেয়। বাঁচার জন্য এমন নৃশংসতার কথা একজন চাষী ভাবতে পারে না। একে না মারলে জীবন বাঁচে না।

বেঁচে থাকার এই নীতিই যুদ্ধের নীতি । মানুষ পশুর কাছে জীবন ভিক্ষা চেয়েছে হত্যার মাধ্যমে। এ ভিক্ষা নয়, অপর অস্তিত্বকে মুছে দিয়ে নিজেকে টেকানোর নামই যুদ্ধ। মানুষ যখন এভাবে বাঁচার শিক্ষা পায়–অন্য কোন উপায় ভাবতে পারে না, তখন যুদ্ধের নীতি হয়ে ওঠে আক্রমণলুঠ, হত্যা, বিনাশ। এই নীতি মানুষ তৃষ্ণা ও খাদ্যের বেলা যেমন পশুর উপর প্রয়োগ করে, তেমনি মানুষের উপরও প্রয়োগ করে।

এই নিয়মের বাইরে কি কিছু নেই? হিতেনকে হত্যা না করলে কি লোটার বাঁচা হয় না! লোটাকে না মারলে কি হিতেনের বাঁচা অর্থহীন হয়ে যায়। একটি নগর ধ্বংস না হলে কি আর একটি নগর গড়ে ওঠে না। জীবন কি মরুভূমি মাত্র! অঞ্জলিবদ্ধ হাত জলে ছোঁয়ানোর সময় সাদইদ লক্ষ্য করছিল উটটি সমান তালে মুখ নামাচ্ছে জলে।

উটের কোন গৃহ নেই। তাঁবুর পাশে তার নগ্ন আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে ঝিমোতে থাকা কাঠামো–সে শূন্য মরুভূমির উপর দাঁড়িয়ে থাকে একা। লোটা যেভাবে দাঁড়িয়ে থাকত। উটকে মানুষ একটি কুকুর কি অশ্বের মত ভালবাসে না। তাকে ঘর দেয় না। স্নেহ দেয় না। তৃষ্ণার জল নেয়। হত্যা করে। তার পিঠে রতিবিহার করে। উটের কাঠামো শিল্পহীন, অশ্বের মত তার দেহে আকাশ ঝিকিমিকি বিদ্যুৎ নেই।

চাঁদ না হলে রাত্রি পার হওয়া যায় না। দিনে অশ্বারোহণ, রাত্রে বিশ্রামকতকাল এভাবে, আর কতকাল?–অন্ধকারে মুছে যাওয়া আকাশে চোখ তোলে সাদইদ। বহু দূরবর্তী এক নিঃসঙ্গ তারকা জ্বল জ্বল করে–যেন লোটার চোখ। সাদইদের এত কষ্ট হচ্ছিল যে,বুক ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছিল। উটটা মরূদ্যান ছেড়ে অন্ধকার মরুভূমিতে নেমে চলে গেল–যেন একটি কবর ভেসে গেল, মানুষের মৃত্যু-গহ্বরের ভূপ। এই গহ্বরে তলিয়ে গেছে নগরী নিনিভে।

একজন চাষী ফলবান বৃক্ষের কাছে যা শেখে, একজন মরুভূমির যাযাবর তা কখনও শিখতে পারে না। গাছ মাটির তলে ‘আপন হৃদয় দিয়ে চিন্তা করে। নিজেরই জ্ঞানে শেকড় চালিয়ে দেয় রস টেনে নেয় দেহে, পাতার আড়ালে রচনা করে পুষ্প, দিয়ে তৈরি করে রসালো ফল। গাছ কোথাও যায় না। সে চুপচাপ ফুল ও ফল তৈরির ধ্যান করে, শেকড় ক্রমশ প্রসারিত করে। নিঃশব্দে–সে কখনও হুংকার দেয় না, আর্তনাদ করে না অযথা। একজন চাষী তাই কোথাও যেতে চায় না–সে ফোঁটাতে এবং ফলাতে ভালবাসে। অথচ রাজারা, দাসমালিকরা নগর গড়বার জন্য তাদের জমি থেকে উৎখাত করে নিয়ে যায়। কপিকলে জুড়ে দেয়। আর একজন যাযাবরকে পাকড়াও করতে পারলে মিশরের রাজা পিরামিড বানানোর পাথর বহন করিয়ে নেয়–তারা কবরের পাথর টানে উটের পিঠে করে। অথচ লোটা বৃক্ষের মত একটি নারীর ছায়ায় আশ্রয় চাইত।

অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে রিবিকার মুখটা, তার নগ্ন প্রজাপতির ছবি মনে পড়ে গেল। দিনের পর দিন ধূসর দিগন্তহারা মরুভূমি মানুষকে কী দিতে পারে? না কোন শিল্প, কোন বৃক্ষচরিত্রহায় প্রজাপতি!

আবার ভোরবেলা মরুভূমির বুকে নেমে এল হেরা আর সাদইদ। এভাবে ওরা কতদিন চলেছে খেয়াল ছিল না। কিন্তু মরুভূমি আজ আর দৃশ্যহীন নয়। একটি স্থির ছবি যেন অপেক্ষা করছিল তাদের জন্য। প্রায় স্থিরই বলা যায়। গরুবাছুর ছাগছাগী মেষ গাভীর দল অল্প অল্প লেজ নাড়ছিল বৃক্ষগুলির ছায়ার নিচে। বড় গাছটির তলায় মুখ খুঁজড়ে পড়ে আছে শিকড়ের আড়ালে একজন। যেন কোন মসীহ।

মুখটা শিকড়ের ভিতর গোঁজা। এতগুলি পশু নিয়ে লোকটা কোথায় যাচ্ছিল? পরনের কাপড় শতচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চাষীর মতই খালি গা। খুব মেহনত করেছে বোঝা যায়। কিন্তু ওভাবে শুয়ে আছে কেন? নিনিভে থেকেই লোকটা দূরপাল্লার পথে নিশ্চয়ই যাত্রা করেছিল। তারপর ঘুমিয়ে পড়েছে। যেন মসীহ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।

সাদইদ ডাকল–অ্যাই শুনছেন! ওহে, এদিকে একবার দেখুন?

মুখ গোঁজা বেচারি কোনই সাড়া দিল না। এমনকি নড়ল না অবধি। সাদইদ বার কতক ডাকার পর ঘোড়া থেকে নেমে এল। ঠিক তখনই কোথা থেকে ছুটে এল কালো অশ্বটি। দ্রুত পড়ে থাকা মানুষটির গায়ে মুখ রেখে অদ্ভুতভাবে দাঁড়িয়ে রইল। অশ্ব স্থির। যেন সে শ্বাস নিতেও চাইছে না। সাদইদ অশ্বটিকে চেনবামাত্র মুখ গোঁজা লোটার কাছে ছুটে গেল। ঘোড়া সাদইদকেও চিনতে পেরেছিল। গা ধরে মুখটা চোখের উপর টেনে আনল সাদইদ। কষে রক্ত গড়ানো ফর্সা মুখ নির্বাপিত, পীতবর্ণ। ক্ষণকাল আগে রক্তাভায় জুলজুল করছিল, ঠোঁট কালো হয়ে গিয়েছে–দু চোখ মুদিত। লোটা জীবিত নেই। এভাবে অবশেষে এইভাবে দোস্ত!কথাগুলি উচ্চারণ করতে গিয়ে অভিমানী শিশুর মত সাদইদের ঠোঁটদুটি প্রবল আবেগে থর থর করে কেঁপে উঠল।

হেরা বলল–আকছার এমনটা ঘটছে সাদইদ! নিনিভের অভিশাপ আছে, সে পৌঁছতে দেয় না। দ্যাখো, একটু দূরেই তো গ্রাম শুরু হয়েছে! অথচ বেচারি আর যেতে পারল না। কত মানুষ এরকম রাস্তায় পড়ে রইল তার ইয়ত্তা হয় না।

কিন্তু তাই বলে লোটা এভাবে থেমে পড়বে। ও হয়ত মৃত্যুর একদণ্ড আগেও ভেবেছে, রিবিকার কাছে পৌঁছতে পারবে। ওর বিয়ে হয়েছে মাত্র কিছুদিন। আগে। ও রিবিকার জন্য ধর্ম অবধি ত্যাগ করেছিল। এই পশুগুলি সে প্রচণ্ড মেহনত করে জোগাড় করেছে। মৃত্যুর গহ্বর থেকে টেনে এনেছে।

এইসব ভাবতে ভাবতে সাদইদের বুকের ভেতরটা কেমন হু হু করে উঠল। হেরা বোঝে কিনা জানা নেই, যে মানুষ মড়কের ভিতর থেকে পশুদের জোগাড় করে আনে, রাজা হিতেনকে বর্শায় গেঁথে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে ঘোড়া ছোটায় নিনিভের দিকে, তার থেমে পড়া উচিত নয়। এই মুহূর্তে তার জেগে উ পণ্ডদল তাড়িয়ে নিয়ে দিগন্ত পার হয়ে গ্রামে পৌঁছনো দরকার। লালমুখো ইঁদুর যখন দেখা দেয়, তখনই মড়ক লাগে–পশুর দিকে চেয়ে মানুষের কতকিছু জানতে হয়। মানুষের মড়কের সংবাদ বহন করছে লাল ইঁদুর–একথা লোটা নিশ্চয়ই জানত! সে জেনেশুনেই, ইঁদুরের সংকেত পেয়েও, রাজা হিতেন রিবিকাকে ছিনিয়ে না নিয়ে, লোটাকে বধ না করে ফিরে যেতে চাইল, পারল না–সমস্ত সংকেত জানা ছিল–সংকেত পেয়েই লোটা লাফিয়ে চড়ল ঘোড়ায়। ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। এভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল লোটা। লোটা শেষ হয়ে গেল।

–এখান থেকেই তোমাকে শুরু করতে হবে সাদইদ। ঠিক এখান থেকে। চমৎকারভাবে বলে উঠল স্থপতি হেরা–নিনিভের নির্মাতা।

একথা শুনে তামাম প্রত্যঙ্গ বিপুল এক বেগে, হৃদয় এক মহাভাবে আন্দোলিত হতে লাগল সাদইদের। এই মরুমর্ত কী নিঃসীম তৃষ্ণা জাগায়–এ তৃষ্ণা জলে মেটে না। নারী, শিশু এবং শিল্পেও মেটে না–একটি প্রজাপতির ইন্দ্রধনুর রঙেও সেই তৃষ্ণা ছড়ানো থাকে–এই বাঁচা যে কী, কেউ জানে না। লোটা যেভাবে মরে পড়ে রইল, সেই তৃষ্ণার কী রূপ,কোন ভাষায় তা আঁকা যায় না। সে পৌঁছতে চেয়েছে; ফিনিসীয় বর্ণমালায় তার বিবরণ নেই, হাম্বুরাবির অনুশাসনফলকে তার হদিস নেই, আমারনার পত্রাবলীতে তার ঠিকানা মেলে না। উগারীতের সাহিত্যে, মেসোপটেমিয়ার কবিতায় তার কোন চিহ্ন খুঁজে পাবে না কেউ। তবু এখান থেকেই শুরু করতে হবে।

লোটার গায়ে হাত দিল সাদইদ। হিম। খাস স্তব্ধ। সে শিশুর মত মুখ গুজড়ে পড়ে ছিল। যেন সে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কেন এভাবে পড়ে থাকা লোটা? লোটা কোন উত্তর দিল না। এই পশুদল নিয়ে তুমি কী করতে, আমায় বলে দাও। তোমার অশ্ব রইল, যাকে নিয়ে তুমি একলা খেলা করতে। কত অপরাহু কত প্রভাত তুমি একলা খেলা করেছ, আমার বানানো ভাষা তোমাকে স্পর্শ করতে পারেনি। ভাষা পারে না। ভাষার উর্ধ্বে থাকে হৃদয়।

সাদইদ সহসা লক্ষ্য করে কালো অশ্বের কপালে একটি মাটির ফলক। ভাঙাচোরা নকশা আঁচড় কেটে কেটে তৈরি, খুবই পুরাতন নকশা, একজন রাজার ছবি, অনেকটা ফেরাউনের মত, পায়ের তলায় দেবী ইস্তারের নগ্নমূর্তি। এ দেবী রিবিকা ছাড়া কেউ নয়।

অপটু হাতে মৃত্যুর আগে একজন যাযাবর একে রেখে গেল। ফলকে হাত রেখে হেরার দিকে ঈষৎ বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল সাদইদ। হেরা পানসে হেসে বলল–তোমার বন্ধু খুব উচ্চাশী ছিল মনে হচ্ছে। সে সারগন হওয়ার স্বপ্ন দেখত।

–না হেরা। আপনি নোটার অভিপ্রায় বুঝবেন না।

–কেন?

–-ও এঁকেছে ওর স্ত্রীর ছায়া। সে যেন তোটাকে স্বীকার করে। এতগুলো পশু নিয়ে সে ফিরছে, সে রাজা ছাড়া কী? কী আশ্চর্য! কোন দেবদাসী কখনও ওকে সারগন বলে ডাকেনি!

ক্রমাগত লোটার স্মৃতি মরু আকাশের ভাসমান মেঘের পতিত ছায়ার মত দিগন্ত ছুঁয়ে ছুটে আসছিল। কালো ঘোড়ার কপালে ঝোলানো ফলক লোটা পরম আহ্লাদে পথ চলতে চলতে সংগ্রহ করে উৎকীর্ণ করেছে। এ ফলক শিলার মত মসৃণ। সহজে আঁচড় পড়ে। অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সাদইদ হাতে ধরা ফলক ছেড়ে দিয়ে বলল–তাহলে এখান থেকেই শুরু!

হেরা বলল–একজন যাযাবর ঠিক এখান থেকেই শুরু করে কিনা! ফেরাউনের রাজসভায় এমন অনেক যাযাবর মন্ত্রিত্ব করেছে, যার হাতে উটের লাগাম ধরা ছাড়া ধরবার কিছুই ছিল না। লোটা যদি একজন চাষী হত, কখনও মড়কের শহরে পা দিত না। দুঃখিত সাদইদ, একথায় আমি কিন্তু তোমায় কোন ইঙ্গিত করিনি।

অসহায় আর করুণ চোখ দুটি তুলে সাদইদ হেরাকে বলল–তুমি শিল্পী তোমার তো অহংকার থাকবেই। স্ত্রী মরেছে মড়কে, শিশু হারিয়ে গেছে। তথাপি বাঁচালতার কোন কামাই নেই। ইহুদের অহংকার লাঠি, ফেরাউনের পিরামিড, তোমার অহংকার ছেনি, বাটালি। কিন্তু লোটা? ওর ছিল উট। এই কালো ঘোড়াটা ওকে আমি উপহার দিয়েছিলাম। ফলে উটের পূজারী কখনও। মাথা তুলে কথা বলত না। ওর ছিল সাহস–তাই সে মড়ককেও ভয় পায়নি। যাক গে। লোটার ঘোড়াটা এবার তুমি নাও। তোমায় দিচ্ছি।

হেরা কেমন অসহায়ের মত ব্যস্ত সুরে বলে উঠল–না না। ওটা তুমিই নাও । আমার এই সাদাটাই ভাল। বেশ আছি এটার পিঠে!

–ওটা ভাল নিশ্চয়। এটাও খারাপ না। তবে সাদাটা কিঞ্চিৎ বজ্জাত। তোমায় ফেলে দিতে পারে।

–না না। ফেলবে কেন! আমরা তো ধীরে ধীরে যাব। এতগুলো জীবকে তো খেদিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

–সে আমি দেখব’খন তুমি কালোটার পিঠে উঠে পড়।

–না সাদইদ । আমায় বিরক্ত করো না। বলছি তো সাদাটায় বেশ আছি।

–আমি যা দিতে চাইছি, তোমার তাতে আপত্তি কিসের?

কিয়ৎক্ষণ চুপ করে থেকে হেরা বলল-লোটার অশ্ব! ভেবে দ্যাখো, সেটা কী হতে পারে। তা ছাড়া লোটা অসুস্থ ছিল বন্ধু সাদ! মিতে তোমায় গোপন করব না–তোমার মিতবউ মড়কে মরেছে–একটা লাল ইঁদুর কী ভয়ানক। আমায় ওভাবে বারবার তাগাদা দিচ্ছ কেন? একটা অসুস্থ উট-উপাসক ভাড়াটে সেনা–মানে, তুমি ঠিক বুঝবে না, আমি কী বলতে চাইছি! ইঁদুর কী ভয়ানক। তা ছাড়া উট-উপাসক! মানে ঠিক তোমায়…

–অ। ঠিক আছে!

দণ্ডভর দম বন্ধ রেখে সাদইদ দিগন্তের আবছা গ্রামগুলির দিকে চাইল। চেয়েই থাকল। তার চোখ অপ্রতিরোধ্য অশুতে ছলছল করে উঠল। শান্ত গলায় সে বলল ঠিক আছে। এখান থেকেই যখন শুরু করতে চাই! নাও, তুমি সাদাটায় গিয়ে উঠে পড়। আমি লোটার ঘোড়ায় চড়ছি। আমাকে মৃত্যু স্পর্শ করবে না। যদি তাই হত, তাহলে তোমাকে সঙ্গে নিলাম কেন? মড়ক আমাকে ধরবে না স্থপতি!

শেষের বাক্য দুটি সাদইদের গলার খাদে বুজে গেল। ততক্ষণে শ্বেত অশ্বের পানে এগিয়ে গিয়েছে, হেরা শুনতে পেল না।

সাদইদ কালো অষের পিঠে চড়ে হু হু করে কেঁদে ফেলল নিঃশব্দে। তারপর সে তার অনভ্যস্ত গলায় যাযাবরী স্বর নকল করে চিৎকার করে উঠল–হরররররহু! হরররররহ্! হাহা! হিররররর হে! হিরররর ইহ! হো হো! উররররহ্! হট হট হাঃ! হা হা হ্!

কালো অশ্ব পশুদলকে খেদিয়ে নিয়ে চলল। পড়ে রইল লোটার নিষ্প্রাণ দেহ। বৃক্ষের ডালগুলি মরুশকুনের ভিড়ে থিক থিক করছে। চোখগুলি হলুদ রেখার বৃত্তে তালশাঁসের ভিতরের জলের মত টলটলিয়ে উঠছে।

গ্রাম ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। সবুজ গাছপালার নিবিড় ছবি। এই তার জন্মভূমি। সেই জন্ম যেন কিংবদন্তীর মত । পিতা নোহ কখনও এখানে ছিলেন নশ্চয়। মিশরেও ছিলেন তিনি। তিনি রয়েছেন রক্তে আর নিঃশ্বাসে।

সাদইদ মনে মনে বলল–এই জীবগুলি সবই লোটার দান পিতা। এদের তুমি রক্ষা কর। হেরার পুত্র যেন বেঁচে থাকে।

.

০৮.

দ্বিতীয় পর্ব

তারপর বেশ কিছু বছর কেটে গেছে মধুদুগ্ধের দেশে। রিবিকার সঙ্গে সাদইদের দেখা হয়নি। সাদইদ তার জীবন শুরু করেছিল একটি বৃক্ষের মত। একটি ছোট গ্রামে নদীর তীরে ছোট কুটির বেঁধেছিল। চাষীর চোখে ছিল তার প্রতি ঘৃণা আর করুণা। পশুদল নিয়ে সে প্রবেশ করেছে, যাযাবর যেমন প্রবেশ করে। রাত্রির অন্ধকারে হানা দিয়েছিল যেন সে। চাষীরা তার পশুগুলি কেড়ে নিয়ে বলেছিল–যা ভাগ! এ লোক যুদ্ধ বাধাবার জন্য এসেছে নিশ্চয়। শোন ভাই, এখানে ওসব চলবে না।

মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর চাষীদের সাদইদ বলল–পশুগুলি আমি তোমাদের জন্যই কষ্ট করে এনেছি। আমি যুদ্ধ-ফেরত একজন সাধারণ সৈনিক। চাষবাস জানিনে। এই সব গরু আমার কোনই কাজে লাগবে না। তোমরাই রাখো। তবে আমায় তাড়িয়ে দিও না। এ আমার বন্ধু হেরা। নিনিভের লোক। ওর বউ মড়কে মরেছে। শিশুপুত্র হারিয়ে গিয়েছে। বাচ্চাটিকে আমরা খুঁজছি। আমাদের আশ্রয় দাও। মহাত্মা ইহুদের কাছে আমাদের ছেলেটি রয়েছে, ওঁর এক মেয়ের কোলে আমরা তাকে দিয়েছি।

–কোন্ মেয়ে সেকথা বলবে তো! তাঁর কি মেয়ের শেষ আছে? অবিবাহিত ইহুদের চোখে মেয়ে মাত্রই হয় মা, নয় মেয়ে। অতএব সঠিক করে বলতে হবে কার বউ, কার কী, কোথায় থাকে–গ্রামের নাম–সবকিছু বলতে হবে! ইহুদ থাকেন পাহাড়ে–কোন্ পাহাড়ে তাও আমরা দেখিনি। কত শিশুই যে তাঁর দয়ায় বেঁচেছে! তিনি তো মহাপুরুষ! হলফ করে বলতে পারি ওই ছেলে নষ্ট হয়নি। মহাত্মা বহাল রাখেন, নষ্ট করেন না!

একজন মধ্যবয়স্ক চাষী গড়গড় করে বলে যেতে লাগল। একজন বৃদ্ধ তাকে সমর্থন করে বলল–হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক! মড়কের মুখ থেকে তিনি রক্ষা করেন, যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচান। রাজা হিতেনের অতবড় সৈন্যদল তাঁর লাঠির ইশারায় মাটিতে শুয়ে গিয়েছিল, আর ওঠেনি! রাজা মুখে রক্ত তুলে পথের ওপর পড়ে গেল। সেই যে পড়ল, আজও পড়ল, কালও পড়ল। বলি কি, ছেলে নিশ্চয় আছে, নষ্ট হয়নি।

মহীপাল নামে একজন সম্পন্ন কৃষকের গোয়ালে গরুগুলিকে লোকেরা বেঁধে দিল–ভেড়াগুলিকে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিল। তারপর বলল–যাও, ঢুঁড়ে দ্যাখো!

এইভাবে মধুদুগ্ধের দেশ সাদইদ আর হেরাকে অভ্যর্থনা জানায়। হেরা ধৈর্য, রিয়ে বলে ওঠে–শিশুকে আমি আর পাব না সাদ!

–পাবে। নিশ্চয় পাবে। অতবড় একটা নগরের স্থপতি তুমি। একদিনে সই নগরী গড়ে ওঠেনি। তুমি কত ধৈর্যে সেই রূপ তোয়ের করেছ। আগে কিটু ঠাঁই দরকার। তারপর শিশুকে খুঁজব আমরা।

–ঠাঁই তুমি কোথাও পাবে না! তখন সেদিন রাগ করেছিলে, এখন দেখলে তা যাযাবর ভাড়াটে সৈনিকের কোথাও জায়গা নেই। মড়কের নগরী থেকে সেছি বলে এই একটা ভাঙা কুঁড়ের কাছে ফেলে রেখে ওরা দিব্যি চলে গেল! লো ফিরে যাই।

–কোথায় যাব! জীবনভর এই একটা দেশের স্বপ্ন দেখেছি হেরা! সন্যদের বলতাম যদি কখনও একটা গ্রামের অধিকার পাই… থাক সে কথা। এলাম তো যাযাবরের মত। অথচ এ আমার নিজের জন্মস্থান। কেউ আমায় চনে না। আবার আমি মরুভূমিতে ফিরে যাবো! সেই তাঁবুর জীবন, সেই উটের গাম ধরে পথ চলা।

–তাহলে ইহুদের শরণাপন্ন হও। তার ধর্ম গ্রহণ করো।

–অসম্ভব!

–কেন?

–ইহুদের ধর্ম মরুভূমির ধর্ম! মাটি ছাড়া মূর্তি হয় না। ভেবে দ্যাখো!

–হ্যাঁ! সেকথা ঠিক।

–বালি মুঠো করলে মূর্তি তো হবে না!

–না।

–মরুভূমি একঘেয়ে। ধূসর। যতদূর চাও কোন ছবি নেই।

–নেই বটে।

–ইহুদের ধর্মের ঈশ্বর পাহাড়ে থাকেন। তাঁর কোন রূপ নেই। আছে কবল আগুন-ঝরা দুটি চোখ। চোখ দু’টিও দেখা যায় না। কল্পনা করা যায় ত্র। রূপ মানে তো মাটি। মানে গ্রাম + ছবি। ঠিক তোমায় বোঝাতে রছিনে।

–বুঝতে কিছুটা পারা যে না যায়, তা নয়। তবে সেই ইহুদই জিতে গছেন। মূর্তিহীন ঈশ্বরই সব দখল করেছেন–এখন তুমি কী করবে!

–তবু রূপ যে খুব গুরুতর বিষয় হেরা! তা যে একটা প্রজাপতি!

–তোমার কথা আর বোঝা গেল না।

–আমিও ঠিক বুঝি না, বালিতে মূর্তি হয় না কেবল এটুকু তোমায় বলতে পারি। দ্যাখো, রূপ, আকৃতি, জ্যামিতি, একটা ছায়া–এসব আমার চাই। পরমায়ু যখন ফুরায় তখন একটা পিরামিড খাড়া হয়। পাহাড়ের গুহায় আঁক শিকার শিকারী–এ তো ছায়া। নিনিভের গায়ে আঁকা রাজা চলেছে মৃগয়ায়–রাজা থাকল কি গেল সেটা কথা নয়। ছায়াটাই আসল। রূপ তাছাড় কী? তুমি কেন আমার সঙ্গে এসেছ! নিনিভে নেই। কিন্তু তোমার হৃদয়ের ভিতর সেটা দেখতে পাও! পাও না?

–পাই।

–তবে? বল, এমন কেন হয়! আমি কেন দুটি প্রজাপতি আর লোটার করুণ মুখখানা ছাড়া কিছুই দেখতে পাইনে। লোটা হিতেনকে বশবিদ্ধ করে মারে। এইজন্যই মারে যে,রাজা হিতেন তাকে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে বধ করতে চেষ্টা করে। সেই সময় আকাশ ছেয়ে যায় ঈগল পাখিতে-পাখিরা মড়ব সংকেতকারী লাল ইঁদুর নখে ধরে উড়ে আসে, কারণ ইঁদুর তাদের খাদ্য। ভয়ে রাজা তার দলবল নিয়ে পালানোর চেষ্টা করে–ছুটে চলেছে–এমন সময় লোট বশ ছোঁড়ে। এটা একটা অভিজ্ঞতা। তারপর লোটা পশুদল নিয়ে বালি ছেড়ে মাটির দিকে যাচ্ছিল। সে একটা ছবি হতে চাইছিল। আকাশে একটি যুদ্ধ চলছিল ঈগলে আর ইঁদুরে। নিচে ঘটছিল হিতেন আর লোটার যুদ্ধ। তাহলে বল, এখানে ইয়াহোর ইশারা কোথায় ছিল!

হেরা অনেকক্ষণ মুখ বুজে থেকে বলল–তোমার অভিজ্ঞতা স্বাভাবিক কিন্তু কারো কাছে সেটা স্বাভাবিক না-ও হতে পারে। ক্রমাগত যুদ্ধ সমস্ত রূপ আকৃতি, ছবি, জ্যামিতি, তাঁবু, গৃহ সব–সমস্ত ভেঙে দেয়। তামাম কিছু অদৃশ করে দেয়। তাহলে অদৃশ্য একটা জগৎ আছে কোথাও। ইহুদ মনে করেন ইয়াহো সেই জগতে থাকেন। তোমাকেও ভেবে দেখতে হবে এসব কথা লোটা ছিল, লোটা নেই।

সাদইদ হেসে ফেলে বলল–এভাবে আমায় বোঝাতে পারবে না হেরা! য কিছু অদৃশ্য হয় তা মানুষ আবার ফিরিয়ে আনতে পারে। সব ছবি । এবং তা আরো সুন্দর করে আনতে পারে। সব রূপ। সমস্ত।

–হ্যাঁ পারে! পারে বইকি!

বলতে বলতে দূরে কুটিরের আলোর দিকে চাইল হেরা। একটি বউ ছোট মশাল ধরিয়ে আলোর শিখার দিকে উপরে চোখ তুলে চেয়ে আছে। অন্যমনস্ক সুরে হেরা অতঃপর বলল–কিন্তু লোটা আর ফিরবে না!

–সে তো ইয়াহোর ইচ্ছে! সেই ইচ্ছেয় আমার আগ্রহ নেই। কারণ লোটাকে ফেরানোর ক্ষমতা আকাশের খোদারও নেই। রেগে যেও না স্থপতি! যা তিনি ফিরিয়ে দেন না নিয়ে ব্যাখ্যা চলতে পারে কিন্তু সেই ব্যাখ্যায় অদৃশ্য জগৎটা অদৃশ্যই থেকে যায়–আলো পড়ে না সেখানে। সেই অন্ধকার আমি চাই না।

–রেগে তো তুমিই গেছ সাদইদ! তর্ক তুমিই করছ!

–তর্ক তো এক মুখে হয় না। যা আমি সবচেয়ে ঘৃণা করি, সেই অদৃশ্য জগতের কথা তুললে! বরং একটি বীজ থেকে একটি গাছ কীভাবে উঠে আসছে, সেই পর্যবেক্ষণ অনেক সুন্দর। তোমার শিশুকে যেদিন নলখাগড়ার কাগজে তৈরি নৌকা, উপহার দিলাম–সেদিন সে হেসে উঠেছিল। আজও সেই হাসি দেখতে পাই। এর চেয়ে সুন্দর আর কী আছে! এই নৌকা আমার পিতা নোহ বানিয়েছিলেন। জীব এবং বীজের সুরক্ষার জন্য। আমি কাগজের নৌকা বানাতে বানাতে ভেবেছি আসল নৌকা জ্যামিতি মাত্র কাঠের বাহু ছোটবড় করে গাঁথা–এই বুদ্ধি নোহের ছিল।

হেরা বলল–কিন্তু এখন আমার সমস্ত বুদ্ধি লোপ পেয়েছে সাদ। ভয়ংকর রাত। কড়িয়ে শীত পড়বে! বাঁচব তো? দাঁড়াবার মত মাটিও যে পাইনি!

একটু ভেবে হঠাৎ সাদইদ বলে উঠল–একটা উপায় হতে পারে হেরা! চলো ওই বউটার কাছে গিয়ে প্রার্থনা করি! যুদ্ধ নারীকে সবচেয়ে বেশি ক্ষয় করে–কিন্তু চাষীর ঘর–দয়ামায়া থাকতে পারে! একখানা কাঁথা যদি দেয়, রাতটা তাহলে কোনরকমে কাটিয়ে দিতে পারব!

কাঁথা চাইতে গিয়ে আশ্চর্য ঘটনা হয়! বউটি ওদের দেখে স্তম্ভিত হয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর ফিক করে হেসে ফেলে মেঝেয় পড়ে থাকা কাঁথা জড়ানো এক বুড়িকে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে জাগিয়ে তোলে। বৃদ্ধা ঘুম জড়ানো চোখে সাদইদকে দেখে ভয়ানক আশ্চর্য হয়। এ যে সাদইদ! সারগন!

বোবা বুড়ি অদ্ভুত অব্যক্ত আহ্লাদে চাপা স্বর তোলে মুখে। বউ বুঝতে পারে লোক দুটি খারাপ নয়। বুড়ির চেনাজানা ঠাহর হচ্ছে। বুড়ি তার আঁচল খুলে কুমীরের প্রতীকগুলি দেখিয়ে অভিমানের সুরে জিভ ঠেলে ঠেলে একটা শব্দই কেবল বার করতে পারে বহু কষ্টে–লোটা! লোটা!

শিউরে ওঠে সাদইদ।

–তুমি চেন? প্রশ্ন করে হেরা!

অশ্রুরুদ্ধ স্বর চেপে বুড়ির মুখের কাছে মুখ নামিয়ে সাদইদ বলল–লোটা আসবে বুড়ি-মা! একদিন লোটা কি আসবে না! দ্যাখো, কেঁদো না!

কুমীর বুড়ি এ সংসারে কী করে এল? কপাল চাপড়াচ্ছে বোবা ভাষায় করাঘাত করতে করতে! মশালের আলো কাঁপছে! নদী থেকে বাতাস বহে আসছে! বাতাসে আঁশের গন্ধ! বোধহয় কোথাও মাছের জালও অন্ধকার উঠোনে টাঙানো আছে। নইলে গন্ধ এত স্পষ্ট হবে কেন! এ তবে চাষী পুরোপুরি নয়, জেলেও বটে। কুমীর সেই নদী অববাহিকার ত্রাস। দেবতা মাত্র।

কাঁথা ওরা পেল। ভাঙাকুটিরে ফিরে এল। সমস্ত রাত দাঁত কাঁপানো শীত। কাঁথা গায়ে দেওয়া দুটি সুন্দর বলিষ্ঠ গাভী সারারাত শীতে নাদলো আর প্রস্রাব করল ছড়ছড় শব্দে। একই ভাঙা কুটিরে বাঁধা থাকল দুজন মানুষ আর দুটি গরু।

ভোরের দৃশ্য আলাদা। বুড়ি ছুটে এল সাত সকালে। এসেই সে যেমন করে লোটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিত, ঠিক তেমনই ভালবাসায় সাদইদের গায়ে হাত বুলিয়ে চলল। সে যেন যুদ্ধের রক্ত মুছিয়ে দিচ্ছে। লোকে সবাই ভিড় করে এল। বুড়ির আহ্লাদ ধরে না। যুদ্ধের দ্বাত্মক রুদ্রতার আড়ালে বোবা এই বুড়ি পড়ে ছিল! এককোণে। যুদ্ধ তাকে কী করে যেন ধর্তব্যই ভাবেনি। অথচ সে ছিল। এই বউটি তার ছেলের বউ। তাদের সে ফিরে পেয়েছে। কিন্তু তার থাকাটাই বিস্ময়কর!

হেরা বলল–তুমি বুড়িকে মিথ্যে কথা বললে কেন?

–বুড়ি শুনতে পায় না হেরা! ওর কাছে লোটার মৃত্যু নেই! আর এরকম একজন মানুষকে সবাই বিশ্বাস করে। ও না থাকলে জীবনটা শুরু করাই যেত না।

এইভাবে গ্রামে ঠাঁই পেল ওরা। কিন্তু শিশুর সন্ধান তারা পেল না। হেরা একদিন নির্জন দুপুরে ফুঁপিয়ে উঠল নদীর মৃদু কলোলিত স্রোতের দিকে চেয়ে। তার বুকের ভিতর রয়েছে অবলুপ্ত বিধ্বস্ত নগরীর স্মৃতি। সে প্রসিদ্ধ স্থপতি। কিন্তু আজ তার কোন কাজ নেই। গ্রামের কুঁড়েঘরে তাকে থাকতে হয়। অত্যন্ত নিম্নমানের পরিবেশ। স্যাঁতসেতে ঘর। কখনও বৃষ্টিতে মাটি ফুলে ওঠে জোঁকের মত। মরুভূমির তপ্ত হাওয়ায় সেই গৃহ হাহাকার করে কখনও বা। নদীর বন্যায় সেই কুটির তলিয়ে যায়। এখানকার চাষবাস অত্যন্ত পুরনো ধরনের। বীজ ছিটিয়ে তার উপর দিয়ে ছাগল ভেড়ার পাল দৌড় করানোর বুদ্ধিও জানে না–যাতে করে পশুর পায়ের দাপানিতে বীজ পুঁতে গিয়ে তোফা উদ্ভিদ দিতে পারে। কিছুই জানে না। এত খাদ্যাভাব এখানে। আকাশে মুখ তুলে হাহাকার করা আর রাতদিন ঢোল বাজিয়ে বালদেবের মন্দির মাত করা এদের কাজ। চারিদিক থেকে নানান জনপ্রবাহ এসে মিশেছে–কাউকে এরা খেদায় না। নানান দেশে পৌঁছনোর রাজপথগুলি এই দেশের বুকের উপর দিয়ে চলে গেছে। রথ, অশ্ববাহী সেনা, পদাতিক ছুটাছুটি করেছে এই পথে। চাষী তা চেয়ে চেয়ে দেখেছে।

চোখের সামনে সৈন্যরা ঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার খেলা খেলে চলে গেছে–চাষী মুখ বুজে থেকেছে। মিশরের দূতরা এসে লোভ দেখাতোযুদ্ধে চলো, প্রচুর উপহার দেব–মাতব্বর যদি হ্যাঁ করে মাথা নেড়ে দেয়,রাজা করে দেব। চাষী প্রলোভনে ভোলেনি। যুদ্ধ করা নয়, যুদ্ধ দেখা এদের রোমাঞ্চ। যুদ্ধ থামলে এরা বীরের গল্প ফাঁদে–আরে ভাই অমুক সারগনের কথা বোলো না–এমনি হাঁকলে ওই দেওদার তলায় দাঁড়িয়ে যে, লেডুর গর্ভবতী বউটা ছেলে বিইয়ে বসলে! লাও লেঠা!

বলেই বিবরণকতা মাড়ির দাঁত বার করে এমনি নিঃশব্দে হাসলে যে, সেই হাসিটা গাঁময় ছড়িয়ে গেল, যারা দেখেছে তারাও তো আকুল, হেসে অস্থির, যারা মাড়ির বর্ণনা শুনল তারাও নিরাকুল হাসিতে আকাট হয়ে রইল। তারপর দলে দলে শুঁটকি মাছের চাট দিয়ে আঙুর তাল খেজুরের চোলাই মেরে তামাম রাত দেবী ইস্তারের ভাসান শুনল। দেবী কী করে পাতালে যেতে যেতে ক্রমশ নগ্ন হয়ে যাচ্ছে, বস্ত্রহরণের সেই দৃশ্যে মেতে গেল গ্রাম। তখন নদীর জল ফেপে উঠে মরাই তলিয়ে মাটির গোলার তলা ফাঁক করে ডিহি ছুঁয়ে এসে ভাসান শ্রোতাদের পাছার কাপড় ভিজিয়ে দিলে। সবাই তখন চমকে লাফিয়ে উঠে বলল–ওরে বাপ। হায় দেবী–এ যে বান বটে গো!

এরা নদীতে বাঁধ দিতেও জানে না। নালা কেটে জলাশয় তৈরি জানে না। বান হলে পূজা দেয়। বজ্ৰ গজালে পূজা দেয়। মাটি শুকালে জিভ ফুড়ে একটা লগির সঙ্গে শেকল বেঁধে ঝোলে। বলে, লে মাতৃকা রক্ত খা! এ হল এদের দুর্ভিক্ষের শুখা মাটির মাদল বাজানো উৎসব। এই উৎসবে হঠাৎ জড়ো হওয়া কোন বহিরাগতকে দেখলেই হোতা ব্যক্তিটি শুধায়–মশাইয়ের যুদ্ধ জানা আছে নাকি! ভাড়াটে, না আসল! বহিরাগত মিটকি মিটকি হাসছে দেখে বললে–আচ্ছা নিবে নগরে একটা পাঁচিল ছিল শুনেছি। দেখতে কেমন ছিল মশাই! শুনেছি প্রস্থে আপনার কত গুণিতক কত হাত যেন পুরু। তা বেশ! শুনি সেই পাঁচিল নাকি ধ্বসে গেল তিনতলা সাঁজোয়ার ধাক্কায় । মিথ্যা বলব না। দু’ একখানা দেখেছি! এই রাস্তা ধরে গেছে…তিনতলা–সব চোলাই আর দেবদাসী ভর্তি হয়ে চলে গেল! দেখবেন, ঈষৎ রঙ লাগলে বলবেন, কথায় রঙ দেওয়া ঠিক নয়।

–না না। বলুন। বেশ বলছেন আপনি। পাঁচালী শুনেছি তো, তাও এত ভাল লাগে না।

উৎসাহিত দ্রাক্ষাবাগিচার মালী বলল–একথা শুনে ইহুদ বললেন, মেয়েলোক বাড়লে, দেবদাসী বাড়লে, বেশ্যা বাড়লে জানবে–এটা যুদ্ধের লক্ষণ! দ্যাখো আর নাই দ্যাখো, এটা যুদ্ধ। পুরুষ কমে যাচ্ছে, এটা যুদ্ধ! একথা মহাত্মার কাছে কোথায় শুনলাম শুনবেন! গত মাসে ওলাওঠা দেবীর থানে। না ভাই ঈষৎ ভুল হল। শুনলাম ভোমরাতলীর হাজারী থানে। ও গাঁয়ে কুমারী বলি হচ্ছে সেদিন। মহাত্মা এসে ঢাকের কাঠি হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন কুমারী মেরে বৃষ্টি নামে না–ইয়াহোকে ডাকো! তা আমরা ইয়াহোকে ডাকি না এমন নয়। ডাকি। অবসর পেলে ডাকি! বাপঠাকুদ্দা কুমারী বলি দিয়েছে, চারটা দশটা বিয়ে করেছে–আমরাও করছি। পূজা করলে কি আর ইয়াহোকে ডাকা যায় না। খুব যায়। ধম্ম ঠাকুর জানে, এই দিগরে দশটা কুমারী বলি হলে হুড়মুড়িয়ে আকাশে মেঘ জমে যাবে। ফলে সবাই মহাত্মাকে মারতে তেড়ে গেল! ইহুদ আকাশে লাঠি উচিয়ে বললেন, আমি নোটাকে মৃত্যুর মুখ থেকে উদ্ধার করেছি। আমি পারি! মেঘ জমবে। ওই দ্যাখ পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। আকাশের তলায় রুদ্র জিহ্বা নীল রঙ চাটছে। মেঘ জমবে। ইয়াহোকে ডাকো।

তারপর কী বলব ভাই, দুদিন যেতে না যেতেই আকাশ ফেড়ে ঢল নেমে গেল!

হেরা বলল–সবই শুনলাম। কিন্তু আমি নালা কেটে জল ধরে রাখার কথা বলছি। নিনিভের গ্রামগুলিতে এই প্রণালীর চাষাবাদ ছিল। জলকেও বাঁধা যায় মালী। পাথর ফেলে, তক্তা বসিয়ে বন্যা ঠেকানো যায়। এ তোমার ঢাকের কাঠির সঙ্গে হাতের লাঠির তজা নয়। সেটা শ্রম ঢালবার অন্য চেহারা। তা ওহে মালী, সেই কুমারী মেয়েটা তো বেঁচে আছে!

–আজ্ঞে আছে বইকি! যাবেন নাকি দেখতে! বাঁচার পর, মানে বলি তো হল না–সেই থেকে মেয়েটা বোবা হয়ে রয়েছে! দেখতে খুবই খাসা!

–আচ্ছা যাব! কোথায় থাকে!

–ওই আপনার উট-পাড়ায়!

–উট?

–আজ্ঞে!

ক্ষুব্ধ হেরা এই প্রথম কনানের মাটি খামচে তুলল হাতে। তৈরি করল একটি উটের মূর্তি। মরুভূমিতে পায়ে হেঁটে গিয়ে শুকিয়ে আনল। রঙ করল। সাদইদ ঘোড়া নিয়ে কোথায় চলে যায়, অনেক রাতে ফেরে না। উটের মূর্তি দেখে বলল–এটাও তো কাজ হেরা!

হেরা বলল–এটাই একমাত্র কাজ! এটা এক মূর্তিমান দেবতা। যে মেয়েটি বলি হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য উপহার। আমি ভাস্কর নই। কারিগর। অজস্র মূর্তি দিয়ে এই দেশকে ভরে দেব সাদইদ। ইট কাঠ পাথর মাটি–সকল বস্তুকে দেবতা করে না তুললে মূর্তিহীন ঈশ্বর ডরাই না। ইহুদ কোথায় আছে–দেখে নাও, এরপর আত্মপ্রকাশ করে কিনা! আমার শিশুকে আমিই বহাল রাখব, সে নয়! সে কে?…

সাদইদ বলল–আমার এখন কিছু মিস্ত্রী, কারিগর আর শিক্ষিত নালা প্রস্তুতকারক চাষীর দরকার। আমি বিধ্বস্ত নগরী থেকে তাদের তুলে আনতে চাই। বাড়তি ফসল–উদ্বৃত্ত ফসল না হলে তোমায় কাজ দেওয়া যাবে না। আমার চাই প্রচুর খাদ্য। পরিধান। পশম। আতর। সুম। ফুল। প্রচুর প্রজাপতি।

–আমার এই উট–এই যথেষ্ট এখন।

মালী এসে হেরাকে নিয়ে গেল কুমারী মেয়েটির কাছে। হেরা তাকে উট উপহার দিয়ে সম্ভোগ করল। মেয়েটি বাধা দিল না। সম্ভোগ শেষ হলে মেয়েটি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। সেই দৃশ্য দেখতে দেখতে হেরা পাগলের মত ভাঙা ঘরটি ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে চলে এল পথে। মালী তাকে প্রচুর মদ খাইয়ে বলল–আপনি এবার কেঁদে হালকা হোন–আমরা জানি আপনার খুব কষ্ট ।

–কিছুই জানো না তুমি,আহাম্মক! আমাকে ঠকালে কেন? বলেই চড় মারতে গেল হেরা। পারল না। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। পড়ে রইল পথের উপর। মুখ ঘষড়াতে থাকল। বমি করল।

মালী বলল-শালা রসের নাগর। কুত্তা!

হেরা মদ খায়। মূর্তি তৈরি করে। দোকানপাটে সেই মূর্তি দিয়ে আসে। তার মন ভাল থাকে না। তার কষ্ট হয়, বুকের মধ্যে রয়েছে তার নিনিভে নগরী। তার পাগলামি কিন্তু সত্যিই ব্যর্থ হয় না। ইহুদ লক্ষ্য করেন, এইসব মূর্তি নিনিভের বাজারে পাওয়া যেত। দোকানপাটে সেই মূর্তি ছেয়ে গেছে। এই কারিগর কোথা থেকে এল! এ তো নাগরিক-বিদ্যার জিনিস!

লোক দিয়ে সাদইদকে ডেকে পাঠালেন ইহুদ–তোমার সঙ্গে কথা বলার তেমন কোন প্রবৃত্তি আমার নেই সাদইদ। তবু তোমায় ডেকে পাঠাতে হল!. বললেন ইহুদ।

সাদইদ বলল–আপনাকে আমি অনেকদিন ধরে খুঁজছি। আপনার সঙ্গে আমার বোঝাঁপড়ার শেষ হয়নি। আমি কাজের লোক। ধর্ম আপনার জিনিস! কিন্তু সেই ধর্ম যেন সত্য কথা বলে আমি চাইব! লোটাকে আপনি মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়েছেন একথা সত্য নয়। লোটা বাঁচেনি।

–তাহলে তুমিই তাকে হত্যা করেছ।

কথার শুরুতেই পা থেকে বক্ষস্থল অবধি এবং দাঁড়া বরাবর একটা হিম স্রোত বহে গেল সাদইদের। উচ্চাসনে বসে দিব্যতা-মুগ্ধ চোখে কথা বলছেন শান্ত তীব্রখরে ইহুদ। সাদইদ বুঝতে পারল মূর্তিহীন ঈশ্বর তুচ্ছ নয়। তথাপি খানিক ইতস্তত করে সাদইদ বলল-লোটা মারা গিয়েছে, হত্যা তাকে কেউ করেনি। হেরা দেখেছে!

–হেরা তো একজন পাপী মানুষ সাদইদ। মূর্তি বানায়। তা সে বানাক। কিন্তু নাগরিক পাপ যেন কুমারী মেয়েকে না দংশায়। নিভাকে আমি বলির হাত থেকে বাঁচিয়েছি–তাকে সে উটের মূর্তি উপহার দিয়ে বলাৎকার করেছে। বোবা মেয়েকে ধর্ষণ করার শাস্তি কী হতে পারে বিধান দাও হিতেনের পোলা। কী হে ভিত্তি! নিভাকে ডেকে আনো! আমি সমস্ত আঙুল কর্তন করব না। খালি ডান হাতের বুড়া আঙুলটা কেটে দেব। নদীতে বাঁধ বাধলেই হয় না সাদইদ। বাঁধ বাঁধো চরিত্রে! অবশ্য তোমার আর আমার সত্যের ধারণা আলাদা। কিন্তু তোমার ধারণা অনুযায়ী হেরার মৃত্যুই অনিবার্য ছিল।

–এতবড় শাস্তি ওকে দেবেন না মহাত্মা ইহুদ!

–কেন দেব না?

সাদইদ কোন উত্তর দিতে পারল না। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। শিশু কোলে করে দাঁড়িয়ে ছিল রিবিকা,ইহুদের আসনের আড়ালে। লোটার মৃত্যুর কথা সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার জানতে ইচ্ছে করছিল কোথায় কীভাবে লোটা মরেছে। তার চোখের সামনে বারবার লাফিয়ে উঠতে থাকল। দিগন্তাভিসারী এক কৃষ্ণ অষ। তার গলায় আজ আর কোন কান্না এল না। সে অপেক্ষা করেছে দিগন্তের দিকে চেয়ে। কেঁদেছে। কিন্তু কান্না এক সময় নিজেই থেমে গেছে।

আজ মাথা নিচু করে থাকা সাদইদকে দেখে তার অন্তর কেমন মুচড়ে উঠল। একজন সামান্য চাষীর পোশাক পরা এই কি সারগন! মহা অপরাধীর মত দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ইহুদ সহসা কঠোর স্বরে বললেন–ঠিক আছে। দুটি শর্ত তোমায় পালন করতে হবে। প্রথমত হেরা আর মূর্তি বানাবে না। দ্বিতীয়ত নিভাকে সে বিবাহ করবে। যাও! ওহে কে আছে ওকে ওর শিশুকে দিয়ে দাও!

রিবিক এগিয়ে এল সামনে! সাদইদের বলতে ইচ্ছে করল–এই নারীকে আমি চাই মহাত্মা ইহুদ। এর সঙ্গে আমার পাপের সম্বন্ধ!

কিছুই কিন্তু বলতে পারল না সাদইদ। কেবল রিবিকার বিমর্ষ আর গভীর চোখ দুটির দিকে চেয়ে মৃদুস্বরে বলল–কেমন আছে প্রজাপতি!

রিবিকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-জানি না সারগন!

–শোন সাদইদ। লোটাকে আমি বাঁচাইনি। ইয়াহো বাঁচিয়েছিলেন! তোমার কথাই ঠিক। লোটা যদি না ফেরে কখনও, তবু এই সত্য স্থির থাকবে!

বললেন ইহুদ।

রিবিকা বলল-যুদ্ধ থেমেছে। তবু যুদ্ধ থামেনি সারগন। ভয় পেও না!

কালো অষের পিঠে ওরা তিনজন। শিশু, নিভা আর সাদই। এ এক আশ্চর্য অশ্বারোহণ। চকিতে অন্য এক দৃশ্য ভেসে উঠল রিবিকার মনে। সাদা অশ্ব ছিল। সেটি। কিন্তু আজকের অশটি তো কৃষ্ণকায়। মুহূর্তে ম্লান হয়ে আসে চোখ।

ভয় পেও না। যুদ্ধ থামেনি সারগন! আজ সাদইদের মনে হল, লোটা নেই, তবু তার অশ্ব আছে যেমন, তেমনি যুদ্ধও ফুরোয়নি। একদিন যুদ্ধ থামবে মনে হলে জীবনে আর কিছু বুঝি নেই, মনে হত! আজ মনে হচ্ছে, সব আছে তার। কিছুই হারায়নি। শুধু একটি শব্দ–ভয় পেও না। এ কী বিষম শক্তিধর। কুমারী বলি হয় যে দেশে, দেবী থাকেন নাঙা, বাবা মেয়ে ধর্ষিত হয়–সেই। দেশের নারীকণ্ঠে এত জোর থাকে কী করে! যুদ্ধ সব রূপ ভাঙে, আকৃতি ভাঙে, স্বর্গ ধ্বংস করে, ঈগল ওড়ায় আকাশে, যোদ্ধা ঘুমিয়ে পড়ে পথে, আর জাগে না, মরুশকুনের চোখ টলটল করে, সমেরু ঝোলে ডালে, তাঁবু আওয়াজ করে। ফটফটসু বহে, দুর্ভিক্ষ হয়, বান ডাকে, শোকে স্তব্ধ হয় পৃথিবী–তারপরও নারী বলে, ভয় পেও না। সামান্য চাষীকে, অতি তুচ্ছ যাযাবরকে, ভাড়াটে ফেরতা সৈনিককে ডাকে সারগন! সেই এক কোমল নারী ডেকে ওঠে, যাকে দুটি অদ্ভুত বর্ণবহুল ডানা কাঁপানো প্রজাপতি ফুল ভেবে অধিকার করেছিল! এ কী বিস্ময় ব্যাকুল চন্দ্রকলার দেশ। এ মরুমর্ত অশেষ শোকেও গান গায়!

হঠাৎ কতকাল পর আকাশে চোখ তুলে চাইল সাদইদ। মনেই ছিল না, মাথার’পর আকাশ রয়েছে। সেখানে চাঁদ আর নক্ষত্ররাজি ওঠে। তার একদা পাহাড় ছিল, তথায় চাঁদ উঠত। রিবিকা সেই চাঁদের কথা বলেছিল। এই চাঁদ ওই পাহাড় ছেড়ে কোথাও যাবে না। এইরকম মনে হত! আজ আকাশ এমন করে সেজেছে কেন। চাঁদ তার চারপাশে নীল কস্তুরী আভায় জড়িয়েছে এক গোল পুরু বৃত্ত। যেমন নীল তেমনি সাদা। কী দারুণ ছবি! সমস্ত রাতেই চাঁদ একটি তারকা সঙ্গে করে উদিত হয়। সেই তারকাকে চাঁদ ছাড়ে না। আজ অজস্র তারকা চাঁদের চারপাশে ঘিরে বসেছে। চাঁদ যেন কথা বলছে, তারকারা ঝুঁকে পড়ে শুনছে–এইসব তারকা কোথায় ছিল। এভাবে চাঁদের চারিদিকে জুটল কী করে! চাঁদ যেন সভা বসিয়েছে আকাশে।

০৯-১০. ফের সেই তাঁবুরই পৃথিবী

ফের সেই তাঁবুরই পৃথিবী। কনানে এসে তাঁবুরই তলে আশ্রয় পেয়েছিল। সৈনিক আর দেবদাসীরা। গৃহ পায়নি। সাদইদের ভাল লাগল, দেবদাসীর সঙ্গে অনেক সৈনিকের বিয়ে দিয়েছেন ইহুদ। তবে দেবদাসীর সংখ্যা বেশি ছিল না বলে অনেক সৈনিক অবিবাহিতই রয়েছে। সেই অবিবাহিতদের মধ্য থেকে কিছু সৈনিকের বিয়ে ইহুদ দিয়েছেন অনেক আগে আসা যাযাবর পরিবারে–যারা ইয়াহোর উপাসক। তবে সেইসব পূর্ববর্তী যাযাবর পরিবার যারা অত্যন্ত দরিদ্র এবং এখনও যারা তাঁবুরই তলে রয়েছে। তাছাড়া কিছু উট-উপাসক পরিবার ইহুদকে সম্মান করে–তারা সৈনিকদের পাণিগ্রহণে আগ্রহী–কিন্তু লোটার ঘটনা সত্ত্বেও সৈনিকদের ভিতর কেমন একধারা নাক-উঁচু ভাব ।

দেবদাসী, বিয়ের পরও কি দেবদাসী? নইলে অনেক সৈনিকের মধ্যেই কেন এক গোপন চোরা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে! তারা কনানী চাষীর মেয়ের সঙ্গে প্রেমে পড়তে চায়। দু’ একটি ঘটনা ইতিমধ্যে ঘটে গেছে। প্রেম শুধু নয়, বিয়ে অবধি হয়েছে। তারা ভাগ্যবান। মেয়ের বাবা সেই জামাইকে গৃহ নির্মাণের জন্য এক টুকরো জমি দিয়েছে। খড়ের চাল আর মাটির দেওয়াল। তারপরই ঘটনা অন্যরকম হয়েছে। একটি বউ তাঁবুতে, অন্যটি, কম বয়েসী বউটি, রয়েছে কুটিরে। সৈনিকের হয়েছে দু’তরফ। ফলে দেবদাসীর এখন উপোসের কাল এসেছে। খেতে না পেয়ে শুকিয়ে থাকা। কেননা সৈনিক থাকে। কুটিরে–চাষবাসে ঢুকে গেছে। তাঁবু বাতাসে নিঃসঙ্গ ফটফট আওয়াজ করে চলে।

দেবদাসী থাকে একা। চাষীর ছেলেরা আসে। বিয়ে করতে নয়। ভোগ করতে। দু’এক কুনকে গম অথবা বাড়ি থেকে গোপনে নিয়ে আসা বউয়ের পুরনো কাপড়। দানধ্যান দেওয়া-থোয়ার এই হল বহর। এদিকে ঘরের বউটি ভারী মুখরা আর তিড়িঙ্গে–লাফিয়ে ছুটে এসে দেবদাসীর পরনের কাপড় ধরে টানলে—খোল্‌ মাগী কাপড়!

লজ্জায় তখন দেবদাসীর ধরিত্রী দ্বিধা হতে বাকি, মুখ লুকোবার মন্দির-কাণটি সে হারিয়েছে। কাপড় টানাটানির এই দৃশ্য দেখে সাদইদ স্তম্ভিত হয়ে যায়।

ইহুদের সামনে দেবদাসীর বিচার বসল। দেবদাসী বলল–লজ্জা ঢাকবার পরনের দু’প্রস্থ কাপড় দাদাবাবু দিয়েছিল! তারই খোঁটা এত! এই মারে তো সেই মারে! বলি কি এই সোনার অঙ্গে কুষ্ঠ হয় আমার। আমি পাপী! মহাত্মার সামনে বলছি, সামনে শীতে আমি আর বাঁচব না। জুম পাহাড় কী দোষ করেছিল শুনি–এখানে টেনে আনলে কেন? আমারও স্বামী ছিল, ঘর ছিল! তাঁবুর মিনসে কি মিনসে নাকি! কে দেয়, কে থোয়–দেখবার কে আছে! তাঁবুতে ফেলে রেখে চাষার ঘরে চলে গেল। আমি ধম্ম ধুয়ে খাব!

ইহুদ বললেন–সবুরে মেওয়া ফলে মা!

–হ্যাঁ খোবানী জন্মায়! কিন্তু গাছ তো পুঁতবেন!

–ইয়াহো ধর্মের উদ্ভিদ। তিনি তোমায় ছায়া দেবেন।

এই দৃশ্যের সামনে বেশিক্ষণ থাকা যায় না। সাদইদ সরে চলে আসে। তাঁবুর এই পৃথিবীতে ঘুরতে ঘুরতে কত নির্মম ছবি চোখে পড়ে। সাদইদ দেখে এক নিঃসঙ্গ সৈনিককে–একা একটি পাথরের উপর বসে আছে। বয়স বেশি নয়। বেচারি মরুভূমির জাতক–যে কিনা উটের পিঠে প্রসবিত হয়েছিল। চাষী জীবনের সঙ্গে এর কখনওই কোন যোগাযোগ ঘটেনি। নাম দিনার। এ যেন সমেরু আর লোটার মিলিত প্রতিচ্ছায়া। বাপ-মাকে কোথায় হারিয়েছে। সে তার দেহ থেকে হিতেনের উল্কি মুছে ফেলেছে–সেই ক্ষতস্থানে চেয়ে ঘাড় গুঁজে চুপচাপ বসে থাকে।

–একা বসে আছো?

–হ্যাঁ।

আর কোন কথা বলল না। দু’ধরনের সৈনিক। এক যারা চাষী ছিল। জমি থেকে উৎখাত হয়ে ক্রীতদাস হয়। দ্বিতীয় যারা মরুভূমি থেকে ক্রীতদাস হয়ে পিরামিডে কাজ করত। পরে সৈনিক হয়েছে। পদাতিক। যারা চাষী ছিল তারা চাষে ঢুকবার চেষ্টা করছে। কিন্তু যারা পাথর বইত উটের পিঠে বা চাকাঅলা গাড়িতে, তারা চাষীদের চোখে ঘৃণ্য। এদের জন্য এই গ্রামে কোন কাজ নেই।

নতুন জামাতা হয়েছে যে সৈনিক, তার সঙ্গে শ্বশুরের সংলাপ কানে আসে।

–শ্যামাঘাস চেন বাপ? গম আর ঘাসে একাকার।

–চিনতে হবে!

–ওহ্! এখনও চিনতে হবে! কবে চাষবাস করতে মানিক!

এক ঝটকায় কানে এল কথা। শ্বশুর বলল–কত না জমি-জিরাত ছিল। মানিকের! খেজুরের বাগান! খোবানির চাষ। খেজুরের আঁটি যেন পিরামিডের পানা খাড়া হয়ে থাকত! গাইয়ের দুধে গোঁফ চুমরে যেত! আঁটি হত জ্বালানি আর দুধ হত ক্ষীর। একবার ফরাতের পলিতে আটকে গেল পাঁচখানা গাই, সেকি কাণ্ড! বাঁট ঠেকল কাদায়, দুধের ভারে থইথই! কাদায় গড়িয়ে পড়ে দুধ। কালো এটেল আর সাদা দুধ! সেই একটা জীবন ছিল বটে।

–আজ্ঞে!

–তবে মানিক আমার শ্যামাদাস চেনেন না!

–আজ্ঞে বিস্মরণ হয়েছে।

–তা তো হবেই, কতকালের কথা!

–আজ্ঞে!

–ওট্‌ শালা সেপাই! মিছে বলার আর জায়গা পেলে না। আরে যা যা, তাঁবুর ইস্তারীর কাছে যা! শরীরের কী ব্যাধি আছে, কে জানে ঘোড়াখোর! আমার মেয়েকে ভোগাভাগা দিয়ে এখন জমিতে দাগ বসাতে চাও! ওই যে কী বলে নাম, ইয়াহুদ, সেইটেই সব্বেনেশে! মহাত্মা বলে কথা!

এই অপমান হজম হয় না। তাঁবুতে অগত্যা জুমপাহাড়ীর স্ত্রীর কাছে ফেরে সেই লোক। কুটির থেকে নতুন কনে হামলায়। তাঁবুর বউ স্বামীকে পেয়ে বলে–সবুর আর কত করব সেপাই!

সেপাই ডাকটি শুনে মাথা গরম হয়ে যায়। দেবদাসীকে অকথ্য গাল দেয়। পিটিয়ে পাট পাট করে দেয় লোকটি।

দেবদাসী বিধবস্ত বাহু, পিঠ দেখিয়ে বলল–দেখুন সারগন! আপনি বলুন, মুক্তি কবে পাব? হে অদৃশ্য ঈশ্বর, তুমি কি দেখতে পাও না!

লোটার অশে ধাবিত সাদইদ আকাশে চোখ তুলল। আকাশে চাঁদের সভা বসেছে। তারকারা চাঁদের মুখপানে ঝুঁকে আছে। চাঁদ কথা বলছে, তারকারা শুনছে। একটা নীলাভ গোল বৃত্ত। কস্তুরী আভা জড়ানো যেন এক গোল তাঁবুর রাত। আজ প্রচুর বাঁচতে ইচ্ছে করে! কিন্তু বেদনা জাগে গম শিষ আর যব শিষের পার্থক্য বোঝে না বলে একজন সৈনিক যখন অপমানিত হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিশুকে চুম্বন করল সাদইদ। তারপর বলল–ওহে নিভা! ভাল করে আঁকড়ে থাকো পিছনে। পড়ে যেও না!

হেরা তার শিশুকে পেয়ে আহ্লাদে আটখানা। আরো আশ্চর্য নিভাকে দেখে। সাদইদের হাত দুখানি ধরে বললে–এমন কখনও হয় না সাদইদ! কখনওই হয় না। আমি আরো মূর্তি বানাব। পুরনো দেবদেবীদের অনেক ভাব আমার মাথায় এসেছে। এবার নববর্ষে মন্দিরে একেবারে মচ্ছব হবে। দেবদেবীদের অভিনয় করবে মানুষ। লিঙ্গপূজা হবে। কত কি হবে। নিনি আমার সঙ্গে থাকবে। ওর নাম কিন্তু নিভা নয় সাদইদ। ও নিনি। আমার স্বপ্ন।

–এ তোমার পাপের উপার্জন। এ তোমার দণ্ড হেরা। তুমি কখনওই আর মূর্তি বানাতে পারবে না। ইহুদের সঙ্গে শর্ত করে এসেছি। শিশু আর নারীর জন্য তোমায় শিল্পচর্চা ত্যাগ করতে হবে। যদি এই শর্ত অমান্য করো, তোমার আঙুল কর্তন করা হবে।

–অসম্ভব! এ হতে পারে না। হাস্যকর প্রস্তাব। মূর্তি না বানালে আমি খেতে পাব না। বাঁচতে পারব না। মাটি মানেই মূর্তি। মাটি তার রূপ চায়। পাথর তার রূপ চায়। পেত্তল তার রূপ চায়। সোনা চায় অপূর্ব রূপের কান্তি। নগর হল রূপের একটি উচ্চতা। নিনি আমার পাপের উপার্জন নয়। সে আমার অর্জন। একটা রূপের বদলে পেয়েছি। ও আমার বোবা দেবী, ওর সঙ্গে দেহ মিলনে কোন পাপ নেই আমার। আমায় বিরক্ত করো না! নিনিভা! ও নিনি! স্বপ্নের নগরী! হায়!

বলে শিশুকে কোলে করে নিনির হাত ধরে জ্যোৎস্নায় নেমে গেল হেরা। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। তারপর আশ্চর্য হয়ে হেসে ফেলল। হেরাই। পারে জীবনের একটা ভয়ানক সমস্যাকে মুহূর্তে মিটিয়ে ফেলতে।

এই হেরাই অতঃপর যোবা মেয়েটির মুখে ভাষা দিল। নিনি একদিন আশ্চর্য প্রশ্ন শুধালো-সবারই তো কিছু না কিছু রয়েছে। সারগনের কেউ নেই কেন?

হেরা সাদইদকে চোখের ইশারা করে বলল-এবার জবাব দাও!

সঙ্গে সঙ্গে সাদইদের চোখের সামনে ভেসে উঠল দিনারের মুখচ্ছবি। সে ঈষৎ হাসল। বলল–আমার অনেক আছে নিনিভা। তোমরা জানো না! তোমরা নতুন ঘর বাঁধলেনগর ধ্বংস হয়ে গেছে, তোমাদের দেখলে সেকথা মনেই হয় না! আগুন সাক্ষী রেখে বিয়ে করেছ তোমরা ইহুদ ভেবেছিলেন তোমরা বিয়ের সময় তাঁর কাছে যাবে! এ তাঁর ব্যর্থতা!

হেরা বলল–তোমার কি মনে হয় না, যার যা ভাল লাগে সে সেই ধর্ম করবে! পূজাবিধি কতকালের অব্যেস! মূর্তি ছাড়া ধর্ম কী করে হবে! নগর কী করে হবে!

সাদইদ বলল–তোমার সেই এক কথা হেরা। নগর। নগরের সঙ্গে মূর্তির কী সম্বন্ধ!

–সম্বন্ধ আছে সাদইদ। ডানাঅলা বৃষ–নিনিভের ভাস্কর্য! মূর্তি ছাড়া তুমি তোমার শক্তি, সমৃদ্ধি, তোমার শৌর্য–কিছুই প্রকাশ করতে পারো না। মানুষ মূর্তিতে পরিণত না হলে দেবতা হতে পারে না। যেমন মিশরের ফেরাউন। মূর্তি যত বিশাল হবে মানুষও তত দেবতা হয়ে উঠবে। নতুবা দেহটা হবে সিংহের, মাথা হবে মানুষের–অন্তত তুমি তাই হও–আতঙ্কের জনক। তোমার পায়ের তলায় পিঁপড়ের সমান পড়ে থাকবে চাষা। একজন মুটে। একজন কারিগর। একজন ঘরামী।

–তাহলে বলছ, মূর্তিই সব?

–মূর্তিই সব সাদইদ। নগর মানে মূর্তি। বিশাল মূর্তি। বড় বড় রাস্তা। রাস্তার উপর মূর্তি। কোন উচ্চতার উপর মূর্তি। যাতে ভয় আর সম্ভ্রম হয়। উচ্চতা, কেবল উচ্চতা। ক্রমাগত উচ্চতার দিকে ওঠা। পিরামিড একটি সুউচ্চ আকৃতি–একটা জ্যামিতি ছাড়া কিছু নয়। এর কি কোন মানে নেই? নগর। বলতে কতকগুলি সুউচ্চ বিশাল আকৃতিকে বোঝায়। মিনারকে বোঝায়। সৌধ বোঝায়। স্তূপ। জিরাত। স্বর্গ! এইসব বোঝায়।

–কিন্তু স্বর্গ বোঝায় না হেরা!

দু’জনের উত্তেজিত তর্কে নিনিভা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা তার কখনওই ছিল না। বাচ্চাকে সে বুকের সঙ্গে আঁকড়ে ধরেছে সবেগে।

হেরা অবাক হয়ে বলল–স্বর্গ বোঝায় না?

সাদইদের গভীর জবাব–না।

একটু থেমে বলল–বোঝায় না। মধুদুগ্ধের দেশ এটি। সহিষ্ণু। সব ধর্ম এখানে থাকবে। কিন্তু মধু থাকে উচ্চে। মধুচক্র থাকে উপরে। কিন্তু তা টুপিয়ে পড়ে মাটিতে। গাভীর দুধ মাটিতেই ঝরে পড়তে চায়। উপরে থাকে এইজন্য। যে,তা মাটির উপর ঝরবে। উপরে থাকার নিয়মই হচ্ছে নিচে নামার উদ্দেশ্য। মধুদুগ্ধপ্ৰবাহিণী দেশ। মর্তের অমরাবতী। স্বর্গ উপর থেকে নিচে নামবে। তাড়া করে ওঠা নয়।

হেরা বিড়বিড় করে বলে–তাড়া করে ওঠা!

সাদইদ বলল–হ্যাঁ। একটা জ্যামিতির কথা তুমি প্রায়ই বল। তোমার সঙ্গে আমি একমত। তুমি ভাস্কর, স্থপতি, জ্যামিতি মানে যেমন ধরো তিনটে বাহু উপরে খাড়া হয়ে আকাশ ধরতে চায়। ত্রিভুজও তো একটি জ্যামিতি। কিন্তু সেটা আদৌতে কবর। হাত দিয়ে ছুঁতে না পারার ফলে পাথর সাজিয়ে সাজিয়ে বাহু বাড়ানো–এই আকৃতি সম্ভ্রম ঘটায়, কিন্তু একজন চাষীর দুঃখ বাড়িয়ে দেয়, পিঠ নুইয়ে দেয়। আমি বলছি, এভাবে তেড়ে ওঠাকে আমি সুন্দর বলি না। মধু টুপিয়ে মাটিতে পড়ছে, ফল মাটিতে পড়ছে, ফুলের ভারে ডাল নুইয়ে নামছে। হাওয়ায়। যত কিছু সুন্দর তা মাটির দিকে নামতে চায় কেন! সূর্যের আলো, চাঁদের আলো মাটির দিকে নেমে আসছে কেন? ইন্দ্রধনুটা নামতে পারছে না। বলে শান্ত জলের তলায় এসে ভাসছে। মেঘ নামছে বৃষ্টির হাত ধরে মাটিতে! তাহলে স্বর্গ কেন মাটিতে নামবে না! তোমার কী মনে হয়?

হেরা স্তব্ধ হয়ে চুপ করে গেল। নিনি অবাক হয়ে সাদইদের বুকের দিকে চাইল। ওখানে হৃদয় আছে। কিন্তু এতসব কথা হৃদয় চিন্তা করতে পারে । চিন্তার ধকলে এই মানুষটি মরে যাবে না তো! ফের হেরাও তর্ক বাধানোর জন্য। দম ধরেছে। দুটিই পাগল।

হেরা বললনগর না গড়লে তুমি কিছুতেই স্বর্গ গড়তে পারো না। মধু যে মাটিতে টুপিয়ে পড়বে তার জন্য মধুচক্র দরকার। উচ্চতা দরকার। বন্যা যাতে তোমাকে ঘিরে না ধরে। দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধ যেন তোমাকে তেড়ে না মারে। গ্রামগুলির দিকে যদি তুমি নজরদারি করতে চাও, তোমাকে উচ্চতার দিকে যেতেই হবে।

সাদইদ বলল–হ্যাঁ, গ্রামগুলির দিকে নজর রাখা। উপরের দিকে ওঠা এই জন্য যে, যেন আমি নিচের শেষ অবস্থাটা, একেবারে তলার স্তর দেখতে পাই। যেখানে লোটা মুখ গুজড়ে পড়ে রয়েছে!

হেরা চমকে উঠল। অবাক হয়ে সাদইদের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। সাদইদ অতঃপর ম্লান হেসে বলল–মূর্তি আমার চাই। লোটা মুখ খুঁজড়ে মরুভূমির বালিতে পড়ে আছে, তার কাছাকাছি ছড়িয়ে রয়েছে পশুগুলি-মরু আকাশ থেকে নেমে আসছে নখরঅলা ভয়ংকর কালো ঈগল। এই মূর্তিটা আমার চাই হেরা! একজন নিঃসঙ্গ পড়ে থাকা হাঁটু ভেঙে পড়া মানুষ–অথচ নির্দয় আকাশ, মরু ঈগল!

–ও হো হো! অমন করে বলল না সাদইদ–সহ্য হয় না!

ভয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলে হেরা। নিনিভা নরম লাবণ্যময় শ্যামা-উজ্জ্বল মুখ ভয়ে বিস্ময়ে ভরিয়ে তোলে, দুচোখে তার টলটল করে কাঁচা শিশুগম চারার মত আলো। স্নিগ্ধ করুণ চির হরিতের মুগ্ধতা নিনিভাকে কখনও যেন ছেড়ে যাবে না মনে হয়।

–একজন মানুষ ভালবাসে কতকগুলি আকৃতি-নারী তার মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আকৃতি–স্বর্গ মানে চির বসন্তের আলোপগ্ন নারী আর নগ্ন শিশুর চেয়ে সুন্দর কিছু নেই। সেই আলোর মধ্যে নারী আর শিশুরা থাকে। হেরা! আমি আর কিছু চাই না!

–কিন্তু তোমার সেই নারী কোথায় সারগন!–নিনিভা শুধালো।

সেকথার জবাব না দিয়ে সাদইদ বলল-ইয়াহোর স্বর্গে শুধু নারী থাকে। পুরুষ আর নারীর অবিচ্ছিন্ন ক্লান্তিহীন মিলন। সেখানে শিশু নেই। স্বর্গের দেওয়ালে তুমি একেছ একটি স্রোত। গাভী আর বৃষের তুমুল প্রবাহ। সন্ধ্যা হয়ে আসছে-দেবতা আমন আকাশে ডুবুডুবু, যাই যাই করছে। পশুর গলায় ঘণ্টা বাজছে। সেই একটা স্রোত চলেছে তো চলেইছে। ভেবে দ্যাখো হেরা! সেই দলটির মধ্যে তুমি একটা শিশু; সাদা ধপধপে বাছুর দাওনি! আমি তাহলে তোমাকে স্বর্গের সেই দেওয়ালটি ভেঙে ফেলতে বলব।

–তাহলে তোমার শিশু কোথায় সারগন!

সাদইদ সেই জবাব না দিয়ে বলল–ইয়াহোর স্বর্গ–ইহুদের বেহেশ্‌ত অসম্পূর্ণ হেরা! অথচ ইহুদের কিছু কল্পনা আমার মন্দ লাগে না। ওঁর ওপর ইয়াহো যখন ভর করেন, তখন বেচারি স্বর্গের বিবরণ দেন–যেন তিনি স্বর্গের সকল আকৃতি দেখতে পাচ্ছেন? সেই বর্ণনায় কখনও শুনিনি যে,তিনি দেখছেন #কটি উটের পিঠে একটি শিশুর জন্ম হচ্ছে! আমার কথা হেরা তুমি বুঝবে না!

উটের পিঠে জন্ম, উটের পিঠেই মৃত্যু-একঘেয়ে ধূসর মরুপথ–তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে–উটকেই অতঃপর হত্যা করে জলের থলি টেনে বার করে তেষ্টা মেটানো-মরুভূমি এমন মানুষকেও বাঁচিয়ে রাখে। আর যেখানে মানুষ বৃক্ষের স্বভাব পায়–নদী পায়–উপত্যকা পায়–সেখানেও বৃষ্টির জন্য কুমারী বলি দিয়ে রক্তাক্ত নারীদেহ ফসলের মাঠে টেনে নিয়ে ফেরে। একটা কুমারী দেহ, জল্লাদ কেটে ফেলে দিলে তাই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়–কার জমি কুমারীর রক্তের ছোঁয়া পাবে! ফসল ভাল হবে। যুদ্ধের পর নারীর সংখ্যা বাড়ে পুরুষের তুলনায়, কুমারী বলি থাকলে সেটা ফের সমতায় ফিরে আসে। এই কি জীবন?

মানুষ এভাবে কতকগুলি নিয়ম চালু করে। কুমারী বলি রদ করেছেন মহাত্মা ইহুল। কিন্তু বৃষ্টির জন্য দেবদেবীর দেহমিলনের অভিনয় হয় নববর্ষে–সেটা এখনও রদ হয়নি। শুধু একটা লাঠি ঘুরিয়ে তাঁকে সমস্ত কাজ করতে হচ্ছে। হলে আকাশে মাথার উপর লাঠি ঘুরিয়ে তাঁকে চিৎকার করে বলতে হচ্ছে, কুমারী বলি অতি দূর দূরান্তরের দেশের, মহুলা নদীর পারের ঘটনা—হাল আমলে এখানকার পুরুতরা চালু করেছিল–জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য তারা নানারকম পূজা চালু করছে–যার কখনও নামই শোনা যায়নি। আর একবার একটা জিনিস চালু হলে সহজে রদ করা যায় না। নতুন একটা নিনিভে-পূজাও চালু হয়েছে। মড়ক-পূজার নতুন নাম হয়েছে নিনিবে। মারীর দেবী নিনিবে।

অথচ হেরাকে ধন্যবাদ যে, সে তার স্ত্রীর নামই রেখে দিলে নিনিভা। তার সংস্কারে বাধলও না একটু। ভয়ও করল না! আতঙ্ককে ভালবাসার মধ্যে হেরা মজা পায়। লোটার কথায় তার দুচোখ ঢেকে ফেলার ভয় বোধহয় ভয় নয়–কান্না। এই ছবি তার হৃদয়ে ঢুকে গেল। সারাদিন, সারাজীবন হেরা ওই দৃশ্যটা ভুলবে না। ক্রমান্বয়ে সে ভাববে।

বছর চৌদ্দ বয়েস নিনিভার। বলির মুখ থেকে বেঁচেছে সে, তারপর বোবা হয়ে যায়। নিনিভা যদি বোবা না হত, তাহলে হয়ত হেরা তার কাছে ছুটে যেত না। হেরা এরকমই।

সাদা অশ্বটার পিঠে লাফিয়ে উঠল সাদইদ। প্রবল জ্যোৎস্নার ভিতর ছুটতে শুরু করল।

নদীর বাঁধটার কাছে এসে ঘোড়ার পিঠে শান্ত হয়ে দাঁড়াল সাদইদ। জল ফেঁপে উঠে খালে গিয়ে পড়ছে। মাটির উপর পলি জমলে মাটি উর্বর হয়–মেসোপটেমিয়া তার নদীর তীরে এই নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছিল। সেখানকার চাষীদের দক্ষিণ এলাকা থেকে, মারীর বিভীষিকার কবল থেকে টেনে এনেছে সাদইদ–এখানকার লোকেরা ভয়ে শুকিয়ে কাটা হয়ে গিয়েছিল। নদীর এই দূরবর্তী এলাকায় তাদের ঘর বেঁধে দিয়েছে সাদইদ। এরা বাধ বেঁধেছে, খাল কেটেছে। এমন ফসলের রূপ কনান কখনও দেখেনি। শস্য পাবার সময় হয়ে এল। সেই গন্ধ নাকে এসে লাগছে।

জ্যোৎস্নায় চারিদিক নিথর। হঠাৎ দূরে মাঠের ভিতর মশালের আলো চোখে পড়ল। তারপর সমবেত বিচিত্র চিৎকার। ঘোড়া ছোেটালো সাদইদ। কাছাকাছি যেতেই দেখা গেল কতকগুলি লোক মাঠের উপর দিয়ে কী যেন বস্তু দারুণ উল্লাসে মাতলামো করতে করতে টেনে নিয়ে চলেছে, চিল্কারে আকাশ ফাটিয়ে তুলছে। অষের পায়ের শব্দ শুনে লোকগুলি দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর কে একজন চেঁচালো–সারগন! ওরে সারগনের ঘোড়া! চ! ফেলে দে! আর নিয়ে যেতে হবে না। অ্যাই! সর্বনাশ হল! পালা, পালা!

মাঠের উপর মশাল ফেলে দিয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে পালিয়ে গেল। অশ্বের পিঠ থেকে নেমে মাটিতে পড়ে থাকা জ্বলন্ত মশাল তুলে ঝুঁকে পড়ল সেই বস্তুটির উপর। সাদইদ দেখল–নিনিভা! কিন্তু তা কী করে সম্ভব! একটু আগেই তো সাদইদ নিনিভার সঙ্গে কথা বলে এসেছে। মুহূর্তে এ ঘটনা কী করে ঘটে! অবিকল নিনিভার মুখ।

সাদইদ অশ্ব ছুটিয়ে ফিরে আসে। এসে দেখতে পায় নিনিভা হেরার সঙ্গে কথা বলছে। অশ্ব থেকে নেমে এসে বলে-তোমার মত দেখতে এই গ্রামে আর কেউ আছে?

–হ্যাঁ। আমার বোন। দু’বছরের ছোট। আমার আরো পঁচটা বোন আছে। একজন দেখতে আমার মত। কেন?

–ও বলি হয়ে গিয়েছে নিনিভা। ইহুদের ভয়ে রাত্রে কেটেছে।

নিনিভা আর্তনাদ করল–জানতাম! বাবা বোনটাকে বাঁচতে দেবে না। মাঠে ফসল হচ্ছে না বলে বলির জন্য বাবার কাছে পুরুত আমাদের চাইত। হায় গোলাপী, শেষে তুই ..

বোনের নাম ধরে ডুকরাতে থাকল নিনিভা। অশ্ব ছুটিয়ে এসে মাঠের মধ্যে গোলাপীর বলি হওয়া মৃত গলা কাটা দেহ খুঁজে পেল না সাদইদ। হেরা কালো ঘোড়ায় চড়ে সাদইদের পিছু পিছু এসেছিল।

বলল–তোমার কি কষ্ট হচ্ছে সাদইদ? কতকগুলি নিয়ম তুমি বুঝতে চাও না কেন? তিনটে ভেড়ার বদলে হাটে একটা বালিকা খরিদ করা যায়। পশুবলি হলে নারী কেন বলি হবে না? তুমি একটা স্বাভাবিক ঘটনায় এত উত্তেজিত হও! তুমি কি ভাবছ, হাটে কেবল পশুই বিক্রি হবে, মানুষ বিক্রি হবে না? পশু আর মানুষে তফাত করাটা তোমার কবিত্ব হতে পারে, নিয়ম হতে পারে না।

–কিন্তু ইয়াহোর নিয়মটা তাহলে আমাকে বলবে! ইহুদ কেন এই নিয়ম রদ করতে চাইলেন? শোন বলি, মসীহ পশুদের চালনা করেন। চাষী পশুদের খেতে দেয়, বাঁচায়, চালিয়ে নিয়ে ফেরে। তাই মানুষ কখনও পশু হতে পারে না। চালকের বেঁচে থাকা দরকার। লোটার মৃত্যু তাই মেনে নেওয়া যায় না। সে পশুদের চালিত করেছিল। তুমি একটা অন্ধকার সময়ের কথা বলছ–এখন মানুষ হত্যা করা অন্যায়। আমি কিছুতেই তা হতে দেব না। যা আমার কবিতার সমর্থন পাবে না তাকে আমি উচ্ছেদ করতে চাই। কুমারীর রক্ত নয়, জমি উর্বর হয় পলিজলে।

–পলিজল!

–হ্যাঁ, পলিজল! এটা মাটির নিয়ম। সে উর্বর হওয়ার জন্য মানুষের রক্ত প্রত্যাশা করে না। সে চায় মাটিরই প্রলেপ। মাটি আপন নিয়মে কাজ করছে। জল তার আপন নিয়মে পলি বইছে। এই নিয়ম নিরন্তর চলছে। মানুষ এদিকে সে নিয়ম না জেনে নরবলি দিচ্ছে, কুমারীর দেহ কেটে ফেলছে। এদিকে মহাত্মা ইহুদ করলেন কি,মাথার উপর লাঠি ঘুরিয়ে বললেন–লাঠিই শ্রেষ্ঠ! পশুকে শাসন করে। হেদিয়ে মরছেন তিনি। এ করে হয় না হেরা!

–হয়, তা কে বলেছে!

–আমি নিয়ম না জানতে পারি, তাই বলে কুমারী মেয়েটি অকারণ হত্যা হয়ে গেল, তারা মৃতদেহ হিঁচড়ে টানছে মাঠের উপর দিয়ে–হৃদয় যদি তোমার দুঃখ না পায়, তুমি কখনও জল, বৃক্ষ, মাটির কথা বুঝতেও পারবে না–স্বর্গও তৈরি হবে না তোমার হাতে। নোহ নিয়ম জানতেন। তাই কিস্তি তৈরি হল। তিনি জল এবং মাটির কাছেই থাকতে চেয়েছেন। জলের উপর ভাসছেন। কিনারা খুঁজছেন। যিনি নৌকা তৈরি করবেন, তার কিন্তু লাঠি ঘোরানোর সময় হবে না। কারণ নৌকায় তাকে তুলে রাখতে হবে সকল জীব এবং বীজের নমুনা। একটা কালো খর্ব হাবসী কন্যাও যেন আমার স্বর্গে আশ্রয় পায় হেরা! কখনও যেন নিনিভার আর্তনাদ আর শুনতে না হয়!

–কিন্তু নৌকায়, তো সবাই আশ্রয় পায়নি। যারা পাপী তারা ঠাই পায় না। তারা মরে! নোহ তাদেরই নিয়েছিলেন, যারা পুণ্য করেছিল। আমি ইহুদের বক্তৃতায় একথা গত কদিন আগে শুনে এসেছি। তিনি আমায় দেখে বললেন, ওহে কর্মকার–কী ব্যঙ্গ ভাবো–বললেন, আর কী সব বানাচ্ছো এখন বললাম–নোহর কিস্তি মহাত্মা! তা উনি শুধালেন–কার জন্য! কথাটা অত্যন্ত বাকা–একেবারে হৃদয়ে এসে বেঁধে! বললাম, তেমন বাছবিচার করিনি মসীহ! তা উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন। তারপর বললেন–তবে এ নৌকা তোমার তলিয়ে যেতে বাধ্য হেরা! বাকি কথা তোমায় আর বলতে পারব না। সাদইদ!–চুপ করে গেল হেরা!

সাদইদ চেয়েছিল গমের ঝাড়ালো শিষগুলির দিকে। ভাবছিল মধু আর রুটি আর ডুমুর। খোবানী-খেজুর! মানুষ খাবে। মাটি এবার প্রচুর দিয়েছে। গমগাছের গোড়ায় জল জ্যোৎস্নালোকে চিকচিক করছে। সেই ঝিলিমিলি অসম্ভব সুন্দর! চেয়ে থাকলে নিশ্চয় পুণ্য হয়। হঠাৎ পাশে ঘাড় ঘুরিয়ে সাদইদ বলল–লোটা তবে কী পাপ করেছিল হেরা! মরল নে?

হেরা বলল-লোটা তো মরেনি!

–মরেনি?–সাদইদ কাতর স্বরে এক তীব্র আর্তনাদ করে।

–না। ইহুদের উম্মতরা লোটার মৃত্যুর কথা বিশ্বাস করে না। এই মিথ্যা প্রচারের জন্য তোমাকে ঘৃণা করে! পুণ্যবান লোটার কখনও মৃত্যু হতে পারে না। তারা বিশ্বাস করে লোটা একদিন ফিরে আসবে।

–অসম্ভব!

–সে তত তোমার আমার কাছে সাদইদ। ইহুদের উম্মতরা মনে করে, লোটা মরুভূমিতে রয়েছে। নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। ফলে লোটার স্ত্রীর আর কখনও বিয়ে হবে না। রিবিকাকে আমি কখনও দেখিনি। নিশ্চয়ই সে নিনিভার মত বোবা। রিবিকা নিশ্চয়ই দেবীর মত সুন্দর। লোটা ছাড়া তাকে কেউ কখনও স্পর্শ করতে পারবে না। ভেবে দ্যাখো সাদইদ, সামনের ওই কালো ঘোড়াটা কী মিথ্যা হয়ে গেল!

–এসব কথা তোমার মুখে আমি আর শুনতে চাইনে হেরা! তুমি ফিরে যাও! আমার ফিরতে দেরি হবে।

–এখানে কী করবে এখন?

–লোটার জন্য অপেক্ষা করব!

–পাগল! তুমি কী পাগল হয়ে গেলে! যা তুমি বিশ্বাস কর না, তার জন্য কি অপেক্ষা করা যায়!

–একটি মেয়ে কী করে পারে!

–পারে না সাদইদ, পারে না!

পারে, কে বলেছে তোমায়? পারা উচিত নয়।

–উচিত নয়? তবে সে রয়েছে কী করে?

–সে তো আমি বলতে পারব না।

–তবে তুমি কথা বলছ কেন হেরা! কেন বলছ কথা!

প্রায় চিৎকার করে ফেলল সাদইদ। আর্ত সে স্বর গলায় হাহাকার করে উঠল। হেরা নিচু সুরে বলল–নিনিভার বোন মরল এই রাতে। কেন মরল, এতদিন যা জানতাম তা ভুল! কিন্তু রিবিকা যে অপেক্ষা করে রয়েছে একথা ভুল নয় সাদইদ। ভুল হতে পারে না। লোটা ফিরে এসে যুদ্ধ করবে।

–যুদ্ধ!

–হ্যাঁ। ইহুদের সাম্রাজ্য গড়ে উঠবে সেদিন।

–কী বলছ তুমি?

–তুমি ইয়াহোর ধর্ম গ্রহণ করো সাদইদ! তুমি পাপী!

–এ পাপ কিসের হেরা!

–যুদ্ধের! লোটার অপমানের। লোটা ফিরে আসবে সেকথা বিশ্বাস না করার পাপ। তুমি তুচ্ছ একটা মানুষ সাদইদ। কাফের! পাপ করার অধিকার তোমার আছে।

হঠাৎ মনে হল, এ যেন হেরা নয়, ইহুদেরই কণ্ঠস্বর। কালো অশ্বটি মুহূর্তে মিলিয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। একা দাঁড়িয়ে রইল সাদইদ। ক্রমশ তার হৃদয়ে হেরার বলা কথাগুলি চেপে বসতে লাগল। তুমি একটা তুচ্ছ মানুষ। পাপ করার অধিকার তোমার আছে।

নিনিভার কণ্ঠস্বর ভেসে উঠল–সবার কত কিছু আছে। তোমার নেই কেন? তোমার শিশু! তোমার নারী!

–আমার আছে নিনি! আর্তস্বর ফুটে বার হয় সাদইদের কণ্ঠে । তারপর সাদইদ আকাশে চোখ তুলে বলে–আমার পাপ করার অধিকার আছে নিনি! নিশ্চয়ই আছে। দেবদাসী রুহা! তুমি শুনে রাখো, আমি পাপী! আমার কুড়িয়ে পাওয়া নারীতে আমার পাপেরই অধিকার মহাত্মা ইহুদ! এ নারী লোটার নয়।

এই নিথর, জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রকৃতি সাদইদের কথায় বিচলিত হল না! কিছুক্ষণ বাদে একলা কালো ঘোড়াটা ফিরে এল। অনেকদিনই এরকম হয়, সাদইদ সাদা ঘোড়ায় চলেছে সম্মুখে, পিছনে ছুটে আসছে লোটার কৃষ্ণ অশ্ব। অকারণ কালো ঘোড়া অসহায়ের মত, অবাধ্যের মত দৌড়য়। তাকে ফেরানো যায় না।

কালো অশটিকে দেখে ভয়ে সাদইদ একটা বোবা আর্তনাদ করে কেঁদে ফেলে। সাদা ঘোড়ার পিঠে লাফিয়ে উঠে পড়ে। ছুটিয়ে দেয় ক্ষিপ্র বেগে। কালোটি তাকে অনুসরণ করে। সাদইদকে এক আশ্চর্য পাগলামি পেয়ে বসে। এই জ্যোৎস্নায় দেবদেবীর রমণকৃত সুঘ্রাণ হাওয়ায় ছড়ানো। পশুরা ঘুমাতে পারছে না। নদীর জলে সোনালী একটি সিংহী চকচক শব্দে জল পান করছে। জ্যোৎস্নার তীব্র দোলনে জল কাঁপছে সাদা ইস্পাতের ঢালের মত। সিংহীর নধর শরীরে কামনার কাপুনি। অশ্ব ছুটে যায়। রাত্রি বেড়েছে ঢের।

তাঁবুর পৃথিবী চোখে পড়ে। সাদা অশ্ব এসে থামে দিনারের তাবুর সামনে। কালো অশ্ব মুখ তুলে শূন্যে ভেসে বেড়ায় নিরুপায় অর্থহীন। দিনার বেরিয়ে আসে চুপচাপ।

সাদইদ বলে–তুমি কাল রাস্তা তৈরির কাজে নিয়োগ হলে দিনার। কাল আমার সঙ্গে দেখা করো। যাও রিবিকাকে ডেকে দাও।

দিনার প্রথমে সাদইদের প্রস্তাব বুঝতে পারে না। কাজে সে নিয়োজিত হবে কোথায়? আর কেনই বা রিবিকাকে ডেকে দেবে? কাজ এবং ডেকে দেওয়ার মধ্যে সম্পর্ক কোথায়!

দিনার চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বিরক্ত হয়ে সাদইদ বলল–শুনতে পাও না?

একটুখানি কেঁপে উঠল দিনার। তারপর জুমপাহাড়ী ভাষায় দিনার জবাব দিল–আপনার জিভ খসে পড়বে সারগন! কাকে ডাকতে বলছেন আপনি। উনি আমাদের মায়ের মত। সবার মা! আর আমাকে কাজের লোভ দেখাবেন না! আপনি তো ইয়াহোর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। যার কিনা হিতেন রাজার বিরুদ্ধে একটা কথা বলার সাহস নেই, সে বানাবে জিগুরাত! ওই কাজে আমাদের দয়া করে ডাকবেন না। থুঃ! কী ভাষায় কথা বলছি হায় ইয়াহো! যান চলে যান!

দিনার চলে গেল! কালো অশ্ব তীব্র আর্তনাদে আকাশে গলা তুলল। রিবিকার ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল, লোটা যেন এসেছেন! রিবিকা পাগলের মত বাইরে বেরিয়ে চলে আসে। সাদইদ ওকে হাত ধরে অশ্বে টেনে তুলে নেয়। তারপর অশ্ব আর থামে না। রিবিকার ঘোর কাটতে সময় লাগে না।

সাদইদ রিবিকার কানের কাছে মুখ রেখে বলে–বলেছিলে ভয় পেও না!

–আমায় ছেড়ে দাও সাদইদ!

–কেন তুমি বেরিয়ে এলে!

–আমার যে মনে হল, উনি এসেছেন!

–আমি সাদইদ রিবিকা! তোমার সারগন!

–অ। তুমি?

পাগলের মত কথা বলে রিবিকা। তারপর সাদইদের কোলে মূৰ্ছা যায়। অশ্ব কোথায় এসে পৌঁছয়, সাদইদ ছাড়া কেউ জানে না। এক আশ্চর্য উপত্যকায় উঠে এসেছে জ্যোৎআফেননিভ অশ্ব। স্বর্গের আলোয় জ্বলছে তার দেহ।

এমন সুন্দর উপত্যকা সাদইদের স্বপ্নের ভূমি। এ উচ্চস্থান ঝর্নার ধারায় সিক্ত, প্রকৃতিই নিজে সেজে রয়েছে, সমতল থেকে ধীরে ধীরে খাড়া হয়ে পাহাড়ের গা অবধি প্রসারিত হয়েছে এ পাহাড়ে ইয়াহোর অগ্নিচক্ষু আকাশ রক্তাক্ত করে না। এখানে ঝর্নাটি বাতাসে যেন দেবদাসী রিবিকার মাথার নীল ফিতার মত ভাসছে, অনন্ত সুরে বইছে, ফেনাইত হচ্ছে স্ফটিক বুদ্বুদ, নীল আভা-মাখা স্রোতে মিশে আছে কিঞ্চিৎ গেরুয়া পলি। এখানে আপনা-আপনি জন্মেছে দ্রাক্ষাকুঞ্জ, গাছপালাগুলি ঝুলিয়ে রেখেছে ফল ফুল মধুচক্র আর লতানো দোলনা। এখানে কখনও ভূমিকম্প হয় না। পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ে না ভয়ংকর পাগলা পাথর। এখানে গাছের ডালের দুবাহু তোলা ফাঁকে মুখ রেখে বসে থাকে পূর্ণিমা। লাল আলোর ঘোর আর ছায়া-মাখা চাঁদটি ফর্সা হয়ে ওঠে ক্রমশ। চাঁদটা একটা বিশাল মধুচক্রের ঝুলন্ত শিলার পাশে উঁকি দিয়ে ডালের দু’বাহুর উপর ধীরে ধীরে খাড়া হয়।

সেই ছায়া, সেই আলো, সেই শুভ্রতা রিবিকারসংজ্ঞাহারা মুখে এসে লাগে। চুলে এসে ঝর্নার বাতাস সুরের দোলা দিয়ে একটা তরঙ্গ উদ্বেলিত করে। রিবিকার বুকের কাপড় বাতাস যেন আকুল হয়ে অতি সন্তর্পণে খসিয়ে দিয়ে চলে যায়। পাথরে শায়িতা রিবিকা। চোখ মুদিত। হাত দুটির একটি মাথার দিকে এলিয়ে শ্লথ আবেশে পড়ে রয়েছে। অন্য হাতটি পাথর ছাড়িয়ে শূন্যে ঝুলে পড়েছে। নাভিমূলের একটি-দুটি রেখার নিচে কাপড় বিস্রস্ত। একটি পা পাথরের উপর সটান, অন্যটি পাথর গড়িয়ে ঝুলছে। রিবিকা কি পড়ে যাবে?

রিবিকার মাথার কাছে ঝর্না এঁকেবেঁকে চলেছে মেসোপটেমিয়ার খালের মত। যেন সুরই এঁকেবেঁকে গেছে। এই অবস্থায় আকাশের দেবতারা যেন চাঁদের মশাল তুলে রিবিকার মুখ দেখছে। দেবতারা এই রাতে মানবীর গর্ভসঞ্চার করে। তারপর তারা আর আকাশে ফিরে যেতে পারে না। তারা প্রজাপতি হয়ে পৃথিবীতে থেকে যায়।

হঠাৎ সাদইদের ভয় হয়, রিবিকা যদি আর না জেগে ওঠে? লোটার মতই যদি ঘুমিয়ে পড়ে? সাদইদ রিবিকার মাথায় হাত রাখে। রিবিকার দেহ নড়ে ওঠে।

চোখ দুটি পাপড়ির মত খুলে যায়। সভয়ে রিবিকা দ্রুত উঠে বসে। কাপড় তুলে বুকের কাছে জড়ো করে। সাদইদ রিবিকাকে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করার জন্য পাথরের উপর বসবার চেষ্টা করে। রিবিকা পাথর ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে–আমায় হেঁবে না সাদইদ।

–কেন রিবিকা!

–লোটার হৃদয় কষ্ট পাবে।

–লোটা নেই। ও মরে গেছে। লোটা আর ফিরবে না রিবিকা! এখানে কেউ নেই। চারিদিক নির্জন। দ্যাখো সেই চাঁদটা এখানেও এসেছে। এই উপত্যকা ছেড়ে চাঁদ আর কোথাও যাবে না। এখানেই আমাদের স্বর্গ মিবিকা!

–তা হয় না সাদইদ। চাঁদ যেমন মিথ্যা, স্বর্গও সত্য নয়। একমাত্র ইয়াহোর স্বৰ্গই সত্য সারগন। লোটা ফিরে আসবে। সমস্ত মরুভূমিতে সে আমায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। মানুষ আজ জেনেছে, লোটা মরে না। সে মরেছে ভাবলে পাপ হয়। তার জন্য অপেক্ষা করলে মানুষের পরমায়ু বৃদ্ধি পায়। আমি আজও বেঁচে আছি কেন? বলে দাও, কেন বেঁচে আছি! তার সঙ্গে আমার দেখা হবে। ও যে আমার জন্য খাদ্য আর বস্ত্র জোগাড় করতে গেছে সাদইদ।

–আমি তোমায় খাবার আর পোশাক দেব রিবিকা! তুমি তো আমারই ছিলে! মনে আছে জুম পাহাড়ের সেই রাত। সেই সকালবেলা! আমার এই লুঠ করা হাত দুটি দুর্বল নয় রিবিকা!

–লোটার হৃদয় কষ্ট পাবে সাদইদ! তুমি যদি এই নির্জন স্থানে আমার অসম্মান করো–পাপ হবে তোমার! লোটার পত্নীকে কেউ ছুঁতে পারে না। দেবতা পর্যন্ত তার ওপর কু দৃষ্টি ফেলতে পারে না। আমি চিরপবিত্র নারী! ছোবে না আমাকে। স্বর্গ একটা প্রতারণা। তুমি পাপী!

সাদইদ বিষঃ সুরে বলল–তোমার দেহ! আমি যদি প্রজাপতি হতে পারতাম, তুমি আমায় পাপের কথা তুলে এভাবে কষ্ট দিতে না! আমার কষ্টের কি কোন দাম নেই? আমি নোহের সন্তান। কবি আমি। মনে নেই? আমি তোমাকে একটি ফুলের বিনিময়ে খরিদ করতে পারি। পারি না? এই নাও রিবিকা। অন্তত তুমি আমায় ফুলের পাপড়ি দিয়ে স্পর্শ করতে দাও।

হাতে ধরা ফুলটি সাদইদ সামনে এগিয়ে ধরে। বলে–এই ফুল নিশিগন্ধা । সাদা এর কলিকা। এখানে মধু আর শিশির জমেছে রিবিকা। এই রাতে একটি উটের চোখের জল এভাবে ঝরে পড়ে।

–ওভাবে বলল না সাদইদ! আমি আশ্রয়চ্যুত হব । আমার কেউ নেই যে সারগন! এই মাটিতে আমার জন্ম। তিনটি ভেড়ার বদলে আমি এখান থেকে বিক্রি হয়ে গিয়েছিলাম এক বণিকের হাতে। ঠাকুমা বলেছিল আমার কাকারা ফসল ভাল হলে উট নিয়ে যাবে আমায় ফিরিয়ে আনতে। সেই অপেক্ষা করছি কত বছর। ওরা যায়নি ফরাতের বস্তীতে। কেউ নেই। এখানে এলাম। কেউ আমায় চিনল না। দেবদাসীকে কেউ চিনতে চায় না। মনেও রাখে না। তুমি ভুলে যেও সাদইদ। এই স্বর্গ আমার জন্য নয়। স্বৰ্গ কি কখনও নেমে আসে?

–আসে না? তোমার এই দাঁড়িয়ে থাকা কি সত্য নয়? –সাদই অবাক হল, গলায় অদ্ভুত কাতরতা।

–এ অলীক! সাজোয়ার মৃতদেহের ভিতর আমার এই দেহ কি শুয়ে থাকতে পারে না? পারে, খুব পারে! মনে করো, আমি নেই। অদৃশ্য জগৎ আমায় ডেকে নিয়েছে! বলতে বলতে ফুঁপিয়ে উঠল রিবিকা।

এই সময় সাদইদের হাত থেকে নিশিগন্ধার কলিকা স্খলিত হয়ে রিবিকার পায়ের উপর পড়ে যায়। ফুলের স্পর্শে রিবিকার তামাম দেহ রোমাঞ্চিত হয়। মুহূর্তে তার দু’চোখ মুদে আসে। নাকের গোড়া স্ফীত হয়, বুকের ভিতর ঘন মদির খাস যেন ঢুকে যায়। ধীরে ধীরে নারীর দেহ কেঁপে ওঠে ঠোঁটের উপর ঘাম জমে।

সাদইদ রিবিকাকে স্পর্শ করবার জন্য হাত বাড়াতে গিয়ে বসে পড়ে পায়ের কাছে। ফুলের দীর্ঘ কলিকা তুলে নিতে গিয়ে দুটি হাতের তালু প্রসারিত উপুড় করে পায়ের উপর চেপে ধরে। রিবিকা গলায় অদ্ভুত সুখ আর কাতরতার মিশ্র ধ্বনি উচ্চকিত করে। তারপর সে সাদইদের মাথাটা ঈষৎ ঝুঁকে শরীরে চেপে ধরে।

এমন সময় কালো অশ্বের হ্রেষা তীব্র মন্থনে গলার শিরা ছিঁড়ে আকাশে দীর্ণ হয়। পাগলের মত ছুটে আসতে থাকে ঘোড়াটা। কী যে হয় ঘোড়া ফের ফিরে যায় নিচের দিকে। অশ্বের এত আর্তনাদ কখনও শোনা যায়নি।

সাদইদ রিবিকাকে পাথরের উপর শুইয়ে দেয়। জ্যোৎস্না আরো উজ্জ্বল হয়েছে। ডালের দু’বাহুর ফাঁকে ঝুলছে মধুচক্র, মৌমাছির জ্যোৎস্নার মাদকতায় অদ্ভুত নড়াচড়া। চকচক করছে কালো পুঞ্জীভূত দেহগুলি। সাদইদ ভাবল, মধু যেমন সঞ্চিত থাকে মধুচক্রে, এই স্বর্গস্থানে সঞ্চিত থাকবে খাদ্য, পানীয় আর পোশাক। দুর্ভিক্ষে, বন্যায়, অভাবে মানুষ এখানে আশ্রয় পাবে। বন্যার জল নেমে গেলে, বর্ষার জল মাটিতে পড়লে, শীত অথবা গ্রীষ্ম কমে গেলে মানুষ নিচে নামবে।

কিন্তু নোহের নৌকাকে যেমন সেদিন মানুষ বিশ্বাস করতে চায়নি, তার স্বর্গকেও কেউ বিশ্বাস করবে না। এই রিবিকা স্বর্গ বিশ্বাস করে না। তাকে বোঝানো দরকার, স্বর্গ আকাশে থাকে এ ধারণামাত্র। সেই কল্পনা সত্য। কিন্তু এই মর্তে তার বিশ্ব মিথ্যা নয়। নারীর এই রূপ যেমন সত্য, স্বর্গও সত্য। স্বর্গ ছাড়া, হেরার ভাস্কর্য ছাড়া এ নারীর রূপ কোথাও বিম্বিত হতে পারে না।

অশ্ব আর্তনাদ করে উঠল। সাদইদ রিবিকাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে ফেলল। রিবিকা কেঁদে উঠল। দু হাত জড়ো করে প্রার্থনার ভঙ্গিতে বলল–হায় ইয়াহো। এ পাপীকে রক্ষা করো প্রভু!

কালো অশ্ব তীর এবং বর্শাবিদ্ধ হয়েছে। কে তাকে মারছে কেউ জানে না। অশ্ব ছুটে এসে পাগলের মত সাইদের গা ঘেঁষে আছাড় খেয়ে পড়ল, তারপর গা ঝাড়া দিয়ে প্রাণপণে উঠে দাঁড়াল।

সাদইদ বলল–লোটা তুমি এ কী করলে? আমার পাপ তোমার সহ্য হল না!

অশ্ব কান পাতল বাতাসে। মরুভূমি তাকে ডাকল লোটার গলায়–সালেহ-ও-ও-ও, হায় পিতা-আ-আ-আ…

.

১০.

পায়ে বর্শা বিঁধেছে দাবনা বরাবর। ঘাড়ে বিঁধেছে তীর। ছোট বর্শা এবং তীর ছুঁড়েছে শত্রু। এইসব বর্শা এবং তীরে বিষ মাখানো থাকে। অশ্ব কান পাতল বাতাসে। লোটা ডাকছে। আর তো বিলম্ব করা ঠিক নয়। ঘোড়া ছুটতে শুরু করল ।

সাদইদ রিবিকার পায়ের উপর আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। রিবিকার নগ্ন বুকে মুখ রেখে ডুকরে উঠল। গলার স্বর থরথর করে কেঁপে উঠল। ভাঙা অধস্ফুট স্বরে সাদইদ বলল–আমি আর বাঁচব না রিবিকা!

অত্যন্ত অসহায় শোনাল সাদইদের গলা। বিষাদে মায়ায় পূর্ণ, কামনাহত, অথচ নিঃস্ব, বঞ্চিত সে স্বর। আহত অশ্ব তীব্রতম হ্রেষা ছড়াতে ছড়াতে গ্রাম অতিক্রম করে গেল। অশ্বের এই আর্তনাদ যুদ্ধের স্পষ্ট সংকেত।

শিশুর মুখকে নারী অত্যন্ত আদরে যেমন করে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে,রিবিক বক্ষলগ্ন সাইদের মাথাটিকে তেমনি সমাদরে নিবিড়তম আশ্লেষে চেপে ধরল। বলল–আমার ভালবাসার পাপে তোমার স্বর্গ গড়ে উঠুক সারগন। ভয় পেও না! আমার ঈশ্বর কে আজও জানি না। কিন্তু তুমিই আমার দেবশিশু, তুমিই দেবতা! আমি নাঙা দেবী। আমার জন্য তুমি বারবার জন্মাবে এই পৃথিবীতে! বস্ত্র দিয়ে আমার লজ্জা ঢাকবে।

কালো অশ্বের আহত উন্মাদনা সহ্য করা যায় না। কিন্তু সেই চাপে রিবিকার সব অবদমন অনর্গলিত উচ্ছ্বাসে হৃদয়ের রূপান্তর ঘটায়। সে বুঝতে পেরেছে, ইহুদের লোক লোটার অশ্বকে হত্যা করে গেল!

শান্ত এক সমাহিত ধ্যান-মূর্তির মত চাঁদটা স্থির। হাত বাড়ালে তাকে যেন ছোঁয়া যাবে মনে হয়।

সাদইদ বলল–এখানে আর এভাবে বসে থাকা ঠিক নয় রিবিকা!

রিবিকা শুধালো–কোথায় যাব?

–কোথাও আমাদের লুকিয়ে পড়তে হবে।

–চলো তাহলে, আর দেরি করো না!

সাদইদ তার নগ্ন দেবীকে সাদা ঘোড়ায় করে তীব্র বেগে নেমে এল উপত্যকা থেকে। নদীর তীর বরাবর ছুটতে থাকল অখ। রিবিকার মনে পড়ল, এইভাবে সে একদা নীল নদীর কিনারা ধরে চালোকিত নীল রাত্রিতে আমারনা থেকে এলিফেনটাইন দুর্গের দিকে অশ্ব ধাবিত হয়েছিল। জানি না, এবারে ভাগ্যে কী আছে? ভাবল রিবিকা। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

নদীর তীরভূমিতে দুই পারে নতুন বসতি গড়ে উঠেছে। কারিগর, শ্রমিক, পাথর কাটিয়েদের বাসস্থান। আর আছে দু’ চারজন চাষী। সবাই বিদেশী। প্রায় সকলকেই সাদইদ দূর-দূরান্তর থেকে, বিধ্বস্ত নগরী থেকে সংগ্রহ করেছে। একবার ভাবল, এখানেই কোথাও আশ্রয় নেয়।

হঠাৎ সাদইদ আশ্চর্য প্রশ্ন করল–তুমি কী রূপে বাঁচতে চাও রিবিকা!

–মানে? তোমার কথা বুঝলাম না!

–মানে আর কী? অশেষ তোমার রূপ! দেবী-রূপে বাঁচবে, নাকি মানুষ রূপে বাঁচবে। আমি তোমাকে, যা চাইবে তাই করব! হেরা তোমাকে তেমন করেই আকৃতি দেবে!

রিবিকা চুপ করে রইল। সহসা অদ্ভুত একটি মাটির সুউচ্চ মূর্তি চোখে পড়ল। একজন অশ্বারোহী মরুভূমির উপর দিয়ে তীর-বেগে ছুটছে। অবাক করার মত। এই মূর্তিটাই এখন অবধি বৃহৎ। তাতে লেখা আছে–এই রাস্তা স্বর্গের দিকে গেছে! অশ্বারোহীর তীক্ষ্ণ বর্শার গায়ে অক্ষরগুলি আঁকা।

–হেরা তোয়ের করেছে!

–হ্যাঁ রিবিকা! এসো লোটাকে আমরা স্পর্শ করি!

অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে সাদইদ মূর্তিটির তলায় নত হল। মূর্তির গায়ে হাত দেওয়া মাত্র সাদইদের বুক হাহাকার করে উঠল।

–লোটার ঘোড়াটিকে তুমি খুজবে না সাদইদ!

–না রিবিকা। আমি আর পাব না। মরুভূমির ভিতর চলে গেছে। এতক্ষণ বেঁচেও নেই। এই মূর্তিই আমার সম্বল। পরে এটা পাথর দিয়ে নির্মাণ করা হবে । চেয়ে দ্যাখো হুবহু সেই মুখ। সেই দেহ। সেই বলিষ্ঠতা। সেই উল্লাস! হেরার হৃদয় কী স্বচ্ছ!

আবার অশ্বারোহণ করল ওরা। নদীর বহু পথ অতিক্রম করে ঘোড়াসুদ্ধ ওরা ভেলায় চড়ে নদী পার হল। তারপর সাদইদ বলল–সামনে ওই যে। বাড়িগুলো দেখছ, এই গ্রামে আমি জন্মেছি। এখানে আমার কেউ চেনা থাকলেও তাকে যেমন আমি চিনতে পারব না, সেও আমায় পারবে না।

–এখানে কোথায় থাকবে তাহলে? –রিবিকা প্রশ্ন করল।

সাদইদ বলল–এই গ্রামে নিনিভের এক নৌকারিগর থাকে। খুবই বুড়ো হয়েছে। চোখে ভাল করে দেখতেও পায় না। ওর একটা আট-নয় বছরের নাতনি আছে। সংসারে আর কেউ নেই। সবাই যুদ্ধে বিনষ্ট হয়েছে। বুড়োর নাম মিশাল । নাতনির নাম বিদ্যা। এদের কাছে থাকবে তুমি। এদের একখানা উটমুখী নীল নৌকা আছে,ভারী মজবুত। সমুদ্রের উপর পর্যন্ত ঘোরে। বুড়ো আমার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ । মিশাল তোমায় ওই নৌকায় সমুদ্রের ভিতর লুকিয়ে রাখবে!

রিবিকা এই সময় ঈষৎ ফুঁপিয়ে উঠল। রাত্রি তখনও কিছুটা বাকি। হঠাৎ সে সামনে দেখতে পেল সমুদ্র। তার কান্না থেমে গেল। নদী পিছনে পড়ে রইল অনেক দূরে। গ্রামকে তারা অতিক্রম করে এসে সমুদ্র পেয়েছে। নীল নৌকাও চোখে পড়ল কিনারে । মিশাল রিবিকাকে নৌকায় তুলে নিয়ে বলল–সারগন! আমার হিফাজতে রইল, চিন্তা করবেন না।

ফেরার পথে নদী অতিক্রম করার পর অশ্বারোহী সাদইদ কারিগরদের কুটিরের পথ অতিক্রম করছিল। হঠাৎ ইহুদের মন্দ্র কণ্ঠস্বর শুনতে পেল–সেই মহামারী আর ধ্বংসের কথা মনে নেই আপনাদের? নদীর স্রোতের মত মানুষের রক্ত প্রবাহিত হয়েছিল পর্বত গহ্বরে, গিরিখাতে; উচ্চ ও সমতলভূমি আর পাহাড় রঞ্জিত হয়েছিল এমনভাবে, মনে হত যেন লোহিত কম্বল–আমার কাঁধের এই লাল কম্বল লক্ষ্য করুন! শিবিরাগ্নির মত জ্বালানো হয়েছিল পাশ্ববর্তী সমূহ জনপদ, আর খালের টাটকা পানীয় জলকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল জলাভূমিতে। সুন্দর সব ফলের বাগানে ঝটিকার মত গিয়ে প্রবেশ করেছিল সৈন্যবাহিনী, দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল লৌহকুঠারের শব্দ ..একটি শস্যমঞ্জরীও তারা অক্ষত ছেড়ে দেয়নি। তারা কারা? এই সাদইদ সেই এক নির্মম সেনাধিপতি ছাড়া কেইবা ছিল? আপনারা কেন তার মত মানুষকে অনুসরণ করলেন! আপনারা ফিরে যান।

ইহুদ সামান্য থেমে আবার বললেন–সাদই একজন লুণ্ঠনকারী। সে তাবুর পবিত্র নারী রিবিকাকে লুঠ করে নিয়ে গেছে । সেই অভিমানে লোটার অশ্ব ফিরে গেছে মরুভূমিতে । মহাত্মা লোটা সেই অষে চড়ে ফিরে আসবে। একদিন এই ইয়াহোভক্ত ইহুদের ধর্মরাজ্য গড়ে উঠবে। সেই রাজ্যে থাকবে আদর্শ গ্রাম। কখনও উদ্ধত নগর গড়া হবে না। নগর মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে। নিনিভে আমার বাবিল মানুষকে বিচ্ছিন্ন করেছে। জাতিভেদ এবং ভাষাভেদ ঘটিয়েছে। স্বর্গ ঈশ্বরের জিনিস। মানুষ আকাশে সৌধ আর তৃপ বানালেই, সিঁড়ি গড়লেই ঈশ্বরের স্বর্গ হেঁয়া যায় না ভাই। তা কখনও নিচেও নামে না। সব বস্তুর বিম্ব হয়। স্বর্গের হয় না। মর্ত মর্তই। মরুভূমি যেমন গ্রাম নয়। ইয়াহহ যেমন ইস্তার নয়–তেমনি স্বর্গ স্বর্গ-ই–মর্তে সেই ছবি আসে না। মানুষ নগর গড়তে পারে। স্বর্গ পারে না।

আবার থামলেন ইহুদ। তারপর বললেন–সাদইদের স্বর্গের জন্য একখানা পাথর যে পুঁতবে, তার জিভ খসে পড়বে। মহাত্মা লোটার স্ত্রী দেবীর মত পবিত্র। তার উপর বলপ্রয়োগ করলে ইয়াহোর বুক কেঁপে ওঠে। সেই পাপ বহন করার ক্ষমতা এই পৃথিবীর নেই। সাদইদ রিবিকাকে নিয়ে আপন হাতে বানানো স্বর্গে প্রবেশ করবে–তোমরা বাইরেই পড়ে থাকবে বন্ধু! মানুষের হাতে গড়া স্বৰ্গকে কখনও বিশ্বাস করো না। ফেরাউন কখনও প্রজার জন্য পিরামিড গড়েনি। প্রজার লাশ পথের উপর পচেছে, শেয়াল শকুনে টানাটানি করেছে। তোমরা ফিরে যাও!

–কোথায় ফিরে যাব আমরা?–একজন চিৎকার করে বলল।

–যেখানে খুশি যাও। এখানে থেকো না।

ইহুদ কুটির অঙ্গন থেকে বাইরে চলে আসেন। তখন সবে সূর্য উঠছে। চারিদিকে হালকা কুয়াশা। লাঠি হাতে, কম্বল কাঁধে রাস্তার উপর চোখ রেখে এগিয়ে আসছেন তিনি।

সাদইদ লোটার মূর্তির কাছে এসে দেখল, সেটি বিধ্বস্ত। মাথা ওপড়ানো, একটি পা ভাঙা, কোমর নড়বড়ে। হতাশায় অভিভূত চোখে নির্নিমেষে দেখছিল সাদইদ। মনে মনে ভাবল–এ দৃশ্য হেরা সইতে পারবে না!

ইহুদ সাদা অশ্বের কাছে এসে থামলেন! চোখ তুললেন সাদইদের বিমর্ষ চোখে। সাদইদ ইহুদের চোখ থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল–এতক্ষণ আপনার বক্তৃতা শুনছিলাম মহাত্মা ইহুদ! স্বর্গ এই দুনিয়ায় সম্ভব কিনা জানি না। কিন্তু চাষীর পক্ষে প্রচুর ফসল ফলানো সম্ভব। সেই ফসল থেকে উদ্বৃত্ত অংশ একটি শস্যভাণ্ডারে আমি জমা রাখব। যেসব খালকাটা শ্রমিক এখানে এসেছে, তাদের তাড়িয়ে দিয়ে আপনার কী উপকার হবে! দুর্ভিক্ষ হবে, মানু খেতে পাবে না। তখন আকাশে বৃষ্টির দেবতার কাছে দু’হাত তুলে কাদবে আর কুমারী বলি দিয়ে অসহায় নারীর প্রাণনাশ করবে। এই কি আপনি চান?

গম্ভীর গলায় ইহুদ বললেন–আমি কী চাই, তুমি ভাল করেই জানো! কুমারী বলি আমিই রদ করেছি। ফসল বেশি হলেও ওই হত্যাকাণ্ড রদ হত না সাদইদ! তার জন্য এই লাঠির শাসন দরকার ছিল! কিন্তু উদও ফসল তুমি কেন শস্যভাণ্ডারে তুলবে? তুমি কে? তুমি অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে স্বর্গ বানাতে চাও–একথাও আমি সর্বসাধারণকে বলেছি! আজ আমি আর গামছাবালা নই সাদইদ। এই লাল কম্বল দেখে মানুষ বোঝে–এই মানুষটি যুদ্ধের শোক আর বিভীষিকা কাঁধে করে বইছে। মানুষ মরলে তোমার প্রাণ কাঁদে কিনা জানিনে, কিন্তু আমি সইতে পারি না।

সাদইদ বলল–এ কারণেই আপনি মহাত্মা। কিন্তু লোটার এই মূর্তি ভেঙে দিয়ে আপনি মহাত্মার কাজ করেননি। আপনি জানেন, লোটা বেঁচে থাকলে ফিরে আসত। লোটা নেই বলেই তার মূর্তিটা হেরা তৈয়ের করে এই রাস্তার উপর খাড়া করেছে। হেরা প্রচুর পরিশ্রম করেছে, দিনরাত ভেবেছে। লোটার মৃত্যু সে দেখেছে মহাত্মা ইহুদ! আপনি কেন ভেঙে দিলেন?

ইহুদ বললেন দ্যাখো সাদইদ! লোটার মৃত্যু ধারণা মাত্র। তার মৃত্যু হতে পারে না। মহারাজা হিতেনের মত বলশালী রাজচক্রবর্তীকে যে হত্যা করে, তার মৃত্যু নেই। কালো অশ্ব তাকে আনতে গেছে। সে ফিরে এসে রিবিকাকে উদ্ধার করবে। তোমার লাম্পট্যের গহ্বরেই তোমার পতন অনিবার্য সাদইদ। লোটার আর কোন রূপ নেই! ইয়াহো তুলে নিয়েছেন।

একটু হেসে ইহুদ বললেন–কোন মূর্তি দিয়ে মহাত্মা লোটাকে বাঁধা যায় না সাদ। সেই চেষ্টা কখনও করো না! মূর্তি গড়া পাপ।

সাদইদ বলল–মূর্তি দিয়ে চিন্তা করা সহজ মহাত্মা। নকশার ভাষা হল মূর্তির ভাষা। মূর্তি আবার সকল ভাষার চেয়ে শক্তিশালী। আপনি জেনে রাখুন, মানুষ মূর্তি বানাবেই। আকাশের ঈশ্বর মূর্তি বানিয়েছিল, সেগুলি মানুষ। মূর্তি গড়া একা ঈশ্বরের অধিকার নয়। মানুষেরও অধিকার।

–মূর্তি ধ্বংস করাও কিন্তু ইয়াহোর নির্দেশ। কারণ তার নিজের কোন রূপ নেই।

–মরুভূমির ঈশ্বরের কোন রূপ থাকে না মহাত্মা ইহুদ। কারণ সেখানে মাটি নেই। বালু মুঠিতে ধরে ছেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এখন মাটিতে এসেছেন। মূর্তির অধিকার আপনাকে মেনে নিতে হবে।

–তুমি তর্ক করছ সাদইদ! আমি বিতর্ক পছন্দ করি না। মূর্তির আড়ালে রয়েছে ব্যভিচার। যৌনাচার। মানুষ দেবদেবীর অভিনয় করে অবৈধ দেহমিলনের জন্য। বৃষ্টি হওয়া না-হওয়া তার উপলক্ষ। কেননা, এখন সে জেনেছে ইয়াহোর নির্দেশে বৃষ্টি হয়। অথচ সে মন্দির মণ্ডপে নববর্ষের ব্যভিচার ত্যাগ করেনি। তোমার হেরা নগ্ন দেবীর মূর্তি বানায়। এ পাপ। নারীকে উলঙ্গ করা পাপ সাদইদ। নগর নারীকে উলঙ্গ হতে শেখায়। দেবদাসী করে। মন্দির। হল পাপপুরী। যদি মন্দির কখনও পবিত্র হয়ে ওঠে, জানবে পৃথিবী সেদিন নেই। মন্দির মানে রক্তপাত, মন্দির আর মূর্তি মানে কুৎসিত যৌনাচার। তুমি মূর্তির অধিকার ছেড়ে দাও। ইয়াহোর ধর্ম স্বীকার করো। রিবিকা তাহলে তোমার হবে সাদইদ। নতুবা নয়।

ইহুদ আর দাঁড়ালেন না। অনেকটা পথ যখন তিনি অতিক্রম করেছেন, সাদইদ অশ্ব ধাওয়া করে ছুটে এল। ইহুদ থেমে পড়ে ওর দিকে চোখ তুললেন। অশ্ব ছটফট করছে। লাগাম টেনে ঘোড়াকে সামাল দিতে দিতে সাদইদ বলল–লোটা আজ মূর্তি ছাড়া কিছু নয় মহাত্মা ইহুদ! আমার মনের ভিতর সে আছে–তার মূর্তি! তাকে বাইরে না আনলে আমার যেমন নেই, লোটারও মুক্তি নেই। যাকে ভালবেসেছি, তাকে ভেতর থেকে বাইরে আনাই তো আমার ধর্ম । একথা বোঝার জন্য আপনাকে আবার আসতে হবে এই মর্তে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে সুযোগ আপনার নেই। আপনি কখনও তেমন প্রত্যাদেশ পাবেন না। দুঃখিত মহাত্মা ইহুদ! রিবিকা দেবী নয়। সে আমার জীবন যুদ্ধের পাওনা। রিবিকার জন্য আমি বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং প্রকাণ্ড নগরী গড়ে তুলব। আপনি শুনে রাখুন, আপনার লাঠির চেয়ে একটি অসি কিন্তু কম শক্তি ধরে না।

বলেই সাদইদ তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। পিছন থেকে ইহুদ চিৎকার করে বলে ওঠেন–ওহে সারগন! তুমি কিন্তু শুনে রাখো, নোটার এই মূর্তি ভাঙার জন্য আমি কাউকে নির্দেশ দিইনি। আকাশের দেবদূত রাত্রে এসে ভেঙে দিয়ে গেছে।

. ইহুদের জোরে জোরে বলা কথাগুলির কিয়দংশ সাদইদের কানে গিয়েছিল–সে তীব্র বেগবান অশ্বটিকে মোচড় মেরে ঘুরিয়ে মুহূর্তে ছুটে এল ইহুদের সামনে। বলল–কে ভেঙেছে বললেন?

–জিব্রিল!

–অ! আকাশ আর মর্তের ভ্রাম্যমাণ অদৃশ্য দেবদূত! তবে শুনে রাখুন, সেই জিব্রিলই কিন্তু গতরাত্রিতে ব্লিবিকাকে তুলে নিয়েছে আকাশে,আর লোটার ঘোড়াটিকে বর্শা, তীর ছুঁড়ে মেরেছে!

–হতে পারে! আমি অবিশ্বাস করছি না।

মৃদু ঘাড় নেড়ে সাদইদের কথা সমর্থন করলেন ইহুদ। সাদই অবাক হয়ে চমকে উঠল।

ইহুদ বললেন–জিব্রিল যদি সত্যিই তুলে নিয়ে থাকেন, তবে তিনিই এই তাবুর দুনিয়ায় তাকে ফেরত দিয়ে যাবেন। কারণ লোটা আর রিবিকা এই মর্তেই মিলিত হবে। জেনে রেখো সাদইদ, লোটার কামনা ছিল রিবিকার উপর। মরুভূমিতে যে-মিলন ঘটেনি, এই শস্যসবুজ কাননে, যিহুদায়, জেরুজালেমে সেই মিলন ঘটবে। ঘটতে বাধ্য! এর অন্যথা হতে পারে না।

বলতে বলতে আকাশে দু’হাত প্রসারিত করলেন ইহুদ।–হায় ইয়াহো। তোমার বান্দার প্রার্থনা মঞ্জুর কর পিতা! আমার উম্মতদের (মন্ত্রশিষ্য) মোনাজাত (প্রার্থনা) কবুল কর! পিতামাতা আমার নাম রেখেছিলেন ইহুদ! আমাকে সার্থকনামা করে তোলো ঈশ্বর। আমার অনুসরণকারীরা,ইহুদি! তাদের স্বপ্ন যেন বিফল না হয়! পিতা মুসা–তোমার ইহুদ যেন ব্যর্থ না হয়!

শুনতে শুনতে অশ্বারোহী সাদইদের মাথা নিচু হয়ে গেল। তার থুতনি এসে বুকে ঠেকল। মনে হল তার, সে অপরাধী। তার দু চোখে অশ্রুর পীড়া –গলার কাছে দলা পাকানো লোটার কামনা, যা ভালবাসায় করুণ, মরুতৃষ্ণায় ব্যাকুল। বুক তার খা খাঁ করছিল।

সাদইদ মাথা নিচু করেই বলল–আমার মত পাপীর জন্য তোমার ঈশ্বরের কাছে কোন প্রার্থনা নেই মহাত্মা ইহুদ!

কণ্ঠস্বর কাঁপছে। মাথা তুলল সাদইদ। চোখ দুটি প্রত্যাশায় সহসা উজ্জ্বল হয়, মনে হয়, মহাত্মা ইহুদের কাছে সে যেন তার স্বপ্নসাধ ভালবাসা মজুত করেছে, ইহুদের করপুটে, প্রসারিত বাহুতে তার হৃদয় জড়ানো, যেন তাবুর দূরবর্তী মরুদ্বীপের মত হাওয়ায় দুলছে।

ইহুদ গম্ভীরভাবে বললেন–হ্যাঁ আছে! তোমার হৃদয়ে সত্যের আলো পড়ক। প্রার্থনা করি।

বলেই ইহুদ অগ্রসর হতে থাকেন সামনের দিকে। যেতে যেতে বলেন–বাবিলের স্বর্গ ঈশ্বর নিজে হাতে ধ্বংস করেছিলেন। তিনি কখনওইতোমার হাতে ফিরিয়ে দেবেন না! তোমার জুমপাহাড়ী ভাষা যেমন গড়ে উঠতে পারে না, তোমার স্বর্গও গড়ে উঠতে পারে না।

হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছেন ইহুদ। আপন মনে বলে চলেছেন–ঈশ্বর সৃষ্টি করেন গ্রাম। মানুষ তৈরি করে নগর। তাই নগর বারবার ধ্বংস হয়।

সাদইদ বলল–অথচ পিরামিড টিকে থাকে।

ইহুদ সহসা দাঁড়িয়ে পড়ে অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বললেন–ওহে দয়াল সারগন! স্বর্ণ কিন্তু কিছুতেই টেকে না।

বলেই ইহুদ অদ্ভুত বাকা করে অট্টহাসি ছড়িয়ে হাঁটতে থাকলেন।

অশ্ব নিয়ে মাটির উপর সহসা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সাদইদ। সামনে এগিয়ে চলে গেলেন ইহুদ। প্রথমেই সাদইদের এই মুহূর্তে যেকথা মনে হল, তা হল, মানুষের কণ্ঠস্বর কী রহস্যময় হতে পারে!

তারপর তার শরীরে অদ্ভুত ক্রোধ তৈরি হতে লাগল। ক্রোধ যদি আগুন হয়, তাহলে তা এক সময় নিবে গেল। নিবে যাবার পর তার হৃদয় এক চাপা অনুশোচনায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। সে কি তবে সত্যিই পাপ করেছে গত রাতে?

লোটার কামনা কি মরুমর্তে এখনও রিবিকাকে খুঁজছে! মরুভূমি সব সময় সবুজ মাটির দিকে তৃষ্ণার্ত জিভ বার করে চাটতে থাকে জল আর উদ্ভিদ, মরু গিরগিটির ললকানো পাতলা জিভের মত। নারীর শরীরের রূপ আর মায়া যেন মাটিরই গড়ন, ছায়াময় গাছ আর নীল জল এবং জ্যোৎস্না। পুরুষ উটের মত নিরবলম্ব গলা দোলানো জীব। পুরুষ এক বর্শা-বেঁধা কালো অশ্ব যে মরুভূমির দিকে মরবার জন্য তুমুল জ্যোৎস্নায় ছুটে যায়। ভাবতে ভাবতে সাদইদের বুক হাহাকারে মুচড়ে ওঠে।

কী পাপ করেছি আমি! বলে সে আকাশে মুখ তোলে। ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে সাদা ঘোড়া। তাবুর সংসার পাতা গ্রামের প্রান্তসীমায় চলে আসে তার ঘোড়া। কেন চলে আসে, সাদইদ বুঝতে পারে না। সামনে তারবেড়া তোলা হয়েছে কেন? অবাক হয় সে! সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারে–কেন এই ব্যবস্থা!

চাষীদের সঙ্গে তাঁবুঅলাদের সীমানা এভাবে নির্দেশ করেছে মানুষ। চাষীর ক্ষেতে যাতে তাবুর পশুরা হানা না দিতে পারে। পশুদের থানা বসানো হয়েছে। চাষীদের গ্রামের ভিতর। সমস্যা গুরুতর হলে ইহুদের ডাক পড়ে। তিনি বিচার করে দেন। চাষীরা তার বিচার মান্য করে। কারণ তিনি নবী। সবই সত্য। কিন্তু ইহুদের অনুগামী মরুভূমির মানুষ আজও আলাদা হয়ে রইল–একখানা তাবু পর্ণকুটিরে রূপান্তরিত হওয়া কী শক্ত!

তারবেড়া যেন সেই মরুভূমির সৈন্যশিবির। সাদইদ খুব আশ্চর্য হয়–সৈনিকরা এই ভোরে বর্শা ছোঁড়া অভ্যাস আছে; তাহলে কি যুদ্ধ শেষ হয়নি! নাকি চাষীদের ভয়ে অথবা চাষীদের ভয় দেখানোর জন্য এই বর্শাযুদ্ধের খেলা! আচ্ছা, একজন সৈনিক কি কখনও যুদ্ধ ত্যাগ করে না? একজন ভাড়াটে সৈনিক কি কখনও চাষী হয়ে ওঠে না? যে লোকটি একদা চাষীই ছিল সে কেন তার পূর্বের বৃক্ষের স্বভাব ফিরে পায় না? যে ছিল, সে থাকেনি, এ তার শাপলাগা জীবন, কিন্তু মরুভূমি তো আর নেই, সে এসেছে মাটিতে, তু কেন সে শস্ত্র অভ্যাস করছে? হঠাৎ সাদইদের রাত্রির দৃশ্য মনে পড়ল। কালো ঘোড়া বিদ্ধ। হয়ে চিৎকার করছে। বর্শার খেলা কি তবে কোন একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি।

একজন চাষী কাঁধে গামছা ফেলে খাটো লুঙ্গি পরে সামনে পথ ভাঙছে দেখে সাদইদ চোখের ইশারায় তাকে ডাকল। চাষীটি সামনে এসে মাথাটি খুঁকিয়ে সেলাম জানাল সাদইদকে। তারপর বলল–কী দেখছেন রাজা! ওই ভয়েই তো মরছি আমরা। ভেবে দেখুন, কে বেদে, কে নয় বলা যাবে না। কে আগে, কে পরে এই কানে থিতু হয়েছে, তারও সন তারিখ নাই। কতজন পরে এসে ঘর পেয়েছে, জমি পেয়েছে, বুদ্ধি আর গায়ের জোর! তবু মুশকিল আসান হল না। আকাশের মালিকরা, ওই দেবদেবীরা মানুষকে আলাদা করেছে, মুখের কথা। ভেন্ন ভেন্ন–এ প্রত্যয় সবার। কিন্তু ইয়াহুদ বেচারি হামলে মরছে, কী হবে কে জানে! কখনও বলছে, লড়াই ভুলে যেও না, কখনও বলছে অস্তর ধারণ করো না। কিন্তু একজন সেপাই কি অস্তর ছাড়ে!

একটু চুপ করে থেকে তাগড়া, কপাল-কাটা চাষীটা বলল–আপনাকে টিকে থাকতে হলে অস্তর শান দিয়ে রাখতে হবে। মোদ্দা হল, যুদ্ধের মুড়ো ল্যাজা নাই। শ্যাষ নাই রাজা। সেইটে আপনার শুঁটকি বনাম কাকড়া হতে পারে। উট বনাম অশ্ব কি ষণ্ড হতে পারে। পূর্বপুরুষ নোহু বলে গিয়েছেন সক্কল হল জীব। তিনি তোমার ভেলায় শুঁটকি মাছও রাখলেন, কাকড়াও রাখলেন। তাই কিনা!

–হ্যাঁ! তাই তো রেখেছিলেন! সাদইদ মাথা দোলাল।

হঠাৎ কোথা থেকে একজন ছোকরা চাষী ছুটে এসে বলল–আরে বাবা, নোহু অত বোকা ছিলেন না! খেয়েদেয়ে কাজ নেই মরা মাছ তুলতে যাবেন ভেলায়। কিন্তু কাকড়ার জান সহজে যাবার নয়। সেই কথা রাজাকে বলে

প্রথমে যে এসেছে, বয়স্ক চাষী, সে ত্বরিতে জবাব করল–সেই কথাই তো কইছি ভাই রাজাকে। আমরা মশাই, একটু-আধটু কাঁকড়া খাই। দুধও খাই কাঁকড়াও খাই। নোহু যে পদার্থ ভেলায়’ তোলেন নাই, সেই মরা জিনিস ছুঁই না! ওসব হল পূর্বদেশীদের অভিরুচি। আপনিই বলেন, কার গন্ধ খারাপ–যেটা মরা সেইটে, নাকি যেটা তাজা রইল সেইটে! ওরা কি বলে শুনবেন, কাঁকড়া হল, থলচরা, মানে মাটিচরা আর জলচরা–উভয়। সেইটে নাকি দোষ! আর গায়ে খালি খোসা। ওই কাঁকড়া নাকি মরুভূমি থেকে এসেছে! কথার কী মাহাত্ম্য দেখুন! আরে বাবা, মরুভূমি থেকে এসেছে বিছে। যত বিষ, সব এসেছে! পূর্বদেশীদের কাছে আমি সৃষ্টি-পুরাণ শিখব মনে করেছে! যা মুখে আসবে বলবে, ফেরাউনের রাজত্ব পেয়েছে কিনা! তা আপনার অভিরুচি একবার শুনতে পাই রাজা!

সাদইদের সহসা মনে হল, বয়স্ক চাষীটি তাকেও যেন বিদ্রূপ করছে। তবু সে হেসে ফেলে বলল–আমি তো রাজা! সমস্ত দেহে বিষ। কিন্তু জন্মেছিলাম এই মাটিতে। কার জন্য ভাড়া খেটে মরেছি জানি না। কে আমার ঈশ্বর তাও জানা নেই! কী খেয়ে বেঁচে থেকেছি তারও কোন বিচার করিনি কখনও। আমি শুধু একটা বীজ কীভাবে পূতলে সোজা হয়ে মাটি খুঁড়ে উঠবে সেই কথা ভাবি। আমি তোমাদের জন্য উন্নত চাষ কীভাবে সম্ভব, সেই নিয়ম চালু করেছি।

অবরুদ্ধ এক আবেগকে ঠোঁটের আড়ালে চেপে ধরে সাদইদ বলল–সব মানুষ মাটি চায়। মরুভূমি কেউ চায় না। অথচ যুদ্ধটা থাকে মরুভূমির বুকে। এখানে এসে আমি দেখলাম, মাটি কখনও রক্ত চায় না। সে চায় নিজেরই প্রলেপ। পলিজল। মাটির নিয়ম মাটিরই নিজস্ব। সে কারো মুখ চেয়ে বসে নেই। মানুষের রক্তের প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই। সে চেয়ে থাকে নদী আর বিশাল আকাশের দিকে। নোহ তাই আকাশ দেখেছিলেন,আর নদী। সেখানে বন্যার সংকেত ছিল। আমরা যাই খাই না কেন, দুনিয়ার শিশুরা মধু খেতে ভালবাসে। আমি চাই প্রচুর মধু আর দুধ। বাগান গড়ে না উঠলে স্বর্গের পথ। তৈরি হবে না–বিষ না মধু, এবার তোমরাই বল!

দু’জন চাষীই ঘাড় নিচু করে কথা শুনছিল। সাদইদের কথার কিছু তাদের বোধগামী ছিল, কিছু-বা ছিল না।

হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ছোকরা চাষীটা বলল–আপনাকে আমরা বলে রাখছি–ফসল এবার সাধারণ হয় নাই। চাষীর মন ভাল আছে। নববর্ষে দেবীর মণ্ডপে যেন সেপাইরা বিবাদ না বাধায়। আমরা নিজেদের ভিতর যত নষ্টামিই করি, সে আমাদের নিজস্ব রেওয়াজ। ওইদিনে একটু-আধটু মাতলামি হয়, ইয়ে হয়–যার যাকে ভাল লাগে মেয়েপুরুষ–বুঝলেন রাজা–বাপ-ঠাকুদ্দার জিনিস–নইলে মেঘ কী করে আসবে। মেয়েদের আগ্রহই বেশি। তাই বলে একটা সেপাই আমার পরিবারকে ধরে টানবে–এই অনাছিষ্টি সইব না! আপনি রাজা বলে মানি, ইয়াহুদ নবী বলে মানি। কিন্তু আমাদের দরবার উভয়ের কাছে।

বেশ উত্তেজিত হয়ে কথা বলে যাচ্ছিল ছোকরা চাষীটি। সাদইদ আর চিন্তা করতে পারছিল না। তবু সে তার হৃদয়কে সংযত করে মুখে হাসি টেনে এনে বলল–তোমরা এত ভোরে এখানে কেন এসেছিলে!

একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বয়স্ক চাষী বলল–ওই একটু যুদ্ধ দেখা, কসরত দেখা!

ছোকরা হঠাৎ ধমক দিয়ে বয়স্ককে থামিয়ে দেয়–কী দেখি, না দেখি, অত বিবরণের কী আছে। তামাশা আর নাইবা করলে, চলো, উনি রাগ করবেন–হাজার হোক, তেনারই সব শিক্ষা! গত রেতে লোটার ঘোড়া চলে গিয়েছে, তাঁবুতে সবার মুখ পানসে হয়ে রয়েছে–দিনার আজ খেলতেই নামল না! বাসীমুখে মদ খাচ্ছে বেদম–কী যে হয়েছে! চলল, চলো!

ওরা হনহন করে চলে গেল। সাদইদ চাইল তারবেড়ার ওপারে। দেখল, দিনার এক তাঁবু থেকে অন্য তাঁবুর দিকে এগিয়ে চলেছে টলতে টলতে। পা নড়াতে পারছে না। তার দিকে চাইছে পাগলের মত। ভয়ানক সেই চাহনি। হঠাৎ মনে হল, এই দিনারই কালো ঘোড়ার ঘাতক! মূর্তিও কি এই দিনারই ভেঙে দিয়েছে?

এই দিনার, যার জন্ম হয়েছিল উঠের পিঠে–ভাবা যায় না, ছেলেটা কী ভয়ংকর জোয়ান হয়েছে! চেয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ সদইদের মনে করুণার উদ্রেক হয়। এই সেই দিনার যে কিনা উঠের পিঠে মসীহর লাঠির মত এতটুকু পুঁচকে, মাথাটা যেন পুঁটুলি–দাঁড়িয়ে থাকত দিনমান। কাঁদত, চেল্লাত। কেউ ওকে নামিয়ে নিত না। কাঁদতে কাঁদতে এক সময় মিইয়ে গিয়ে থামত। সবাই। ওর মুখের দিকে দূর থেকে চেয়ে থেকে মজা পেত। ও নাকি গুনতে শিখেছে। উট গোনে। মেষ গোনে, ছাগ-ছাগী গোনে। মানুষ গোনে। তার নিজস্ব ভাষায়, যা সবার কাছে দুর্বোধ্য। শিশুদের ভাষা আসলে দুর্বোধ্যই হয়। সেই দুর্বোধ্য ভাষায় দিনার গুনতে পারত এক দুই।

দিনার গুনত মৃত্যু। একটি লাশ এল। দুটি লাশ এল। এভাবে উটের পিঠে মসীহর লাঠির মত দাঁড়িয়ে থাকা শিশুটি মৃত্যুর সংখ্যা নাকি গুনত। মানুষের এইরকম ধারণার . কোন হেতু পাওয়া যায় না। যুদ্ধের মানুষ শিশু সম্বন্ধে যে এধারা অদ্ভুত একটা গল্প চাল করে দেয় অথবা সেটা তারা সত্য মনে। করে–কেন করে তার কোন অর্থ বোঝা যায় না। তবে তাই যদি সত্যিকার ঘটনা হয়, তবে এই দিনারের মধ্যে কী একটা ভয়ংকর বস্তু নিশ্চয় গোপন আছে। যার ফলে সাদইদ তাকে ঘাতক মনে করছে–এইরকম মনে করাও হেতুহীন। অন্যায়। সে হয়ত জানেই না, লোটার ঘোড়া কখন কীভাবে মরুভূমিতে চলে গেছে।

তবে বিস্ময় অন্যত্র রয়েছে। চাষীরা তাঁবুপাড়ায় কালবেলা অনেকে কসরত দেখতে আসে। জালের আড়ালে আটকে থাকা ভাড়াটে সেনারা কী করছে এই তাদের কৌতূহল। ভয় করে। আবার ঘৃণা ও করুণাও করে মনে মনে। এভাবে মরুভূমি শেষ হয় না। মরুর জীবন ফুরায় না। মাটিতে মেশে না জীবন। মাটি আলাদা থাকতে চায়। একটা কুটির আর একটা তাঁবু আলাদাই থেকে যায়। মাটি ভয় করে। করুণা করে। বিদ্বিষ্ট হয়। অথচ দূর থেকে দেখে। একটি বৃক্ষ ছায়ানিবিড় চোখে যেন মরুপ্রান্তরের ঊষর বিকটদর্শন উটের মুখের ফেনার দিকে অপলক চেয়ে রয়েছে। ঠিক যেভাবে রিবিকার চোখ চেয়ে থাকে।

হঠাৎ সাদইদের মনে হল, রিবিকা কখনও তাকে ভালবাসেনি। লোটাকে সে বিয়ে করেছিল, সেটাই হয়ত রিবিকার শেষ স্বপ্ন। তাহলে কি স্বর্গ কখনও তৈরি হবে না! লোটা চিরকাল অদৃশ্য ঈশ্বরের মত মরুভূমিতে বিরাজ করবে? কখনও সে স্বর্গ এই মাটির উপর তৈরি হতে দেবে না?

সাদইদের ঘোড়া ছটফট করে উঠল। সে ছুটতে থাকল দিগ্বিদিক। কী আশ্চর্য! আবার ঘোড়াটি ভুল করে ভাঙা মূর্তিটার কাছে, বিধ্বস্ত লোটার কাছে চলে আসে। ঘোড়ার এমনধারা অবশ পাগলামি থাকে। পথ ভুলে যায় । যেখানে যেতে চায় সেখানে যায় না। সাদইদের রাগ হল, কেন ঘোড়া ভাঙা মূর্তির কাছে টেনে আনল তাকে? মাথা খারাপ হয়ে গেল! ঘোড়ার না তার–সাদইদ বুঝতে পারল না! হঠাৎ-ই সাদইদ অযথা সাদা অশ্বকে প্রহার করতে লাগল। প্রহার করতে করতে দেখল, ঘোড়া মাটির উপর শুয়ে গেছে। সাদইদ ক্রোধে আর প্রবল শূন্যতায় দিশে হারিয়ে ডুকরে উঠল। হঠাৎ মনে হল, এই অবস্থায় কেউ যদি দেখে, কী ভাববে! ঘোড়াকে কখনও সে মারে না।

হঠাৎ-ই চাবুক-ধরা হাতটা, যে চাবুক সে কোমরে বাঁটসুদ্ধ জড়িয়ে রাখে, ব্যবহার করে না, সেইসব, হাত এবং বাঁট সজোরে চেপে ধরল কেউ। অবাক হয়ে সাদইদ দেখল, হেরা একটি গাধার পিঠে চড়ে এসেছে এই ভোরে।

সাদইদ ভেঙে পড়ে বলল–দেখো হেরা! লোটার কী হয়েছে! তুমি ভাল করে দেখো, তোমার কষ্টের মূর্তিটা কেমন করে ভেঙে দিয়ে গেছে।

হেরা বলল–আরে, ওটা তো আমার বুকের মধ্যে আছে! যতবার ভাঙবে ততবার আমি ওটাকে বুকের ভিতর থেকে বাইরে টেনে আনব! তুমি ভেবো না। কিন্তু এই ঘোড়াটা মরে গেলে আমাদের খুবই ক্ষতি হবে! ওকে ছেড়ে দাও। সবচেয়ে দ্রুতগতির এই জীবটি তোমাকে আগলে রেখেছে সাদইদ! দাও, ছেড়ে দাও। পাগলামি করো না, দেখো, ও কীভাবে অসহায়ের মত শুয়ে গিয়েছে!

সাদইদ স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর কিছুক্ষণ কথাই বলতে পারল না। এবং মনে হল, কালো ঘোড়াটির কথা কীভাবে সে হেরার সামনে পেশ করবে!

গাধাটির দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল সাদইদ। হেরা তার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল–কালো ঘোড়াটা শেষে পাগল হয়ে মরুভূমিতে পালিয়ে গিয়েছে। ঘোড়া এভাবে হারিয়ে যেতে পারে। ফের একদিন ফিরে আসবে দেখে নিও!

এবার আর্তনাদ করে উঠল সাদইদ–কী বলছ হেরা! তুমি কী বলতে চাও, রিবিকাকে আমায় ফিরিয়ে দিতে হবে! ঘোড়া কখনও ফিরবে না। ফিরতে পারে না!

সাদইদের কথা হেরা বুঝতে পারে না। ঘোড়ার সঙ্গে রিবিকার কী সম্বন্ধ? তারপর বুদ্ধিমান হেরার হৃদয় সমস্তই অনুভব করতে পারে। তার কাছে আলোকিত হয়ে ওঠে সাদইদের হৃদয়। মাথা নিচু করে হেরা।

–তোমার কথা ফিরিয়ে নাও হেরা!–সাদইদ পাগলের মত বলে।

হেরা কোন কথা না বলে চুপ করে থাকে। সাদইদ সাদা অশ্বটাকে খাড়া করে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে, সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হেরার মনে হয় তার বলার মত কোন কথাই যেন নেই।

হঠাৎ বলে–কারিগররা চলে যেতে চাইছে সাদইদ!

–না। অসম্ভব। যেতে পারে না। কিছুতেই পারে না। আমি বহু কষ্টে ওদের জোগাড় করেছি!

বলেই সাদইদ অশ্ব ছুটিয়ে দেয়। দ্রুত বেগে কারিগর পাড়ায় এসে পথ অবরোধ করে দাঁড়ায়। একা।

চিৎকার করে বলে–তোমরা যেও না। তোমাদের আমি কাজ দেব।

কারিগরদের মধ্যে একজন মাতব্বর বলে ওঠে–ইহুদ চান না আমরা থাকি। আমরা কী করব! কাজও তেমন পেলাম না। একটা নগর গড়ে তোলা সহজ নয় সারগন। আপনি চান ঠিকই, হয়ত একদিন কাজও আমরা পাব। কিন্তু এখানকার পুরনো বাসিন্দারা আমাদের ঠিক সইতে পারে না। আমরা সবাই বউ সঙ্গে আনিনি। কিছু কিছু এনেছি। কিন্তু সবচেয়ে খারাপ লাগছে, চাষার ছেলেদের অত্যাচারে বউরা মাঠে গিয়ে প্রাতঃকাজ করতে পারছে না, ছোকরারা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। তখন ভোর পুইয়ে সাফ হয়নি, একজন চাষার বেটা কচি বউটাকে হামলা করে মাঠে পেড়ে ফেললে! দেখুন! আমরা নিরীহ লোক। আমরা ফরাতের তীরে ভাল সূক্ষ্ম কাপড় বানিয়েছি কত। এরা মোটা কাপড় বোঝে, পাতলা কাপড়ে ইহুদের আপত্তি আছে। ওদিকে কুমোর পাড়ায় গিয়ে দেখে আসুন! টালি বানাতে দিচ্ছে না। ভাঁটার গর্ত বুজিয়ে দিয়েছে। পাথরের উপর গর্ত করে একটা পাত্র বানানো হয় এখানে। কী মোটা কাজ! নিনিভের কুমোররা সূক্ষ্ম কাজ জানে। একটা ঘটির কী নকশা ভেবে দেখুন!

হেরা ততক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিল। ওকে দেখে কারিগররা বলল–উনি আমাদের কতরকম নকশার কথা বলেন! কিন্তু এখানে সেসব সম্ভব নয়। আপনি দেশের উন্নতি করুন, তারপর আমরা আসব!

সাদইদ বলল–কিন্তু যাবে কোথায় তোমরা!

–অন্য কোন রাষ্ট্রে চলে যাব। আপনার সাধ আহ্লাদ আছে, কিন্তু ব্যবস্থা নেই। টালির উপর নকশা করবেন হেরা, কিন্তু আপনার দেওয়াল কোথায়! সূক্ষ্ম কাপড় পরবে, তেমন মানুষ নেই। আমাদের এরা যাযাবর ভাবছে, কিন্তু এদের কোন শিক্ষাদীক্ষা আছে বলে মনে হয় না। তাছাড়া ভাবছে, আমরা উড়ে এসে জুড়ে বসেছি! কতরকম অপমান সইতে হয়। মুখের ভাষা শুনে সেই ভাষার উপর টিটকিরি করার জন্য ছন্দবাঁধা বোল তৈরি করছে। আসলে আমরা কি যাযাবর, হেরা, আপনিই বলুন!

মাতব্বরের কথা শুনতে শুনতে হেরা বলল–আপনারা সাদইদের আন্তরিকতার মূল্য দেবেন আশা করি! দেখুন! আমার চেয়ে কর্মহীন আপনারা কেউ নন। কবে আমার কাজ শুরু করতে পারব কিছুই জানি না। এখানে কাপড়ের সূক্ষ্মতাই যখন বোঝে না, তখন আমার শিল্প কে বুঝবে! তবু রয়েছি, যদি কখনও হয়ে উঠে কিছু!

একজন বলল–এই তো আপনার মাটির ঘোড়াটা গুঁড়িয়ে ভেঙে পড়ল । এখানে জিব্রিলের কোপ পড়েছে হেরা! অবশ্য আপনার ঘোড়াটা খুব বেড়ে হয়েছিল। মাটির হলেই বা হবে না কেন, পাথর হলে আরো দাম্ভিক দেখাত । দর্প জিনিসটা খারাপ। ইয়াহুদের কথা ফেলা যায় না। তাছাড়া এখানে সুতোও পাওয়া মুশকিল! বরং যা আছে তাই থাক। গম দিয়ে বণিকদের কাছে কাপড় কিনে নেবে এখানকার লোকেরা! মোটা কাপড়।

হেরা বলল–সূক্ষ্ম কাপড়ও তো দর্প, অহংকারের জিনিস ভাই! তোমার কথার ভিতর খাদ আছে!

মাতব্বর বলল–দেখুন হেরা, আহত হবেন না। সামান্য মানুষ আমরা । যেখানে ব্যবস্থা ভাল দেখব চলে যাব। নিনিভে আমার দেশ ছিল। ইয়াহহ জিব্রিলকে পাঠিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে। ইয়াহুদ যখন চাইছেন না, আমরা থাকতে পারব না। চলো হে, চলো! বেলা চড়ে যাবে।

চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে কারিগররা, সাদইদ কোন কথাই বলতে পারছে না। ভাবল, হেরা ভাবল নিজের সূক্ষ্মতাটা মানুষ বোঝে, অন্যেরটা ধরতে পারে না। অন্যের জিনিসে সে অহংকার খুঁজে পায়। যা সূক্ষ্মতর, তারই ভাগ্য খারাপ। তার যশ নেই, উপেক্ষা রয়েছে। তাকে মারবার জন্য রয়েছে জিব্রিল। অথচ এখন মুখ বুজে থাকাই ভাল। জিব্রিলই কি ঈগল পাখির মত আকাশে ওড়ে? একটা পাগলা পাথর যখন পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়ছে, তা কি তখন জিব্রিলই ধাক্কা দেয়? কারিগররা যে চলে যাচ্ছে, কে টেনে নিয়ে চলেছে এদের? হেরা ভাবল, ইহুদের ধর্মটা মন্দ নয়! তাকে ঘোরতর অবিশ্বাস করলে কালো ঘোড়ার বদলে পাওয়া যায় একটি বেঁটে ধূসর গাধা-নিনিভের বদলে কনান। হেরা ভাবল, সেও কি তবে চলে যাবে কোথাও–এখানে অর্থহীন আয়ু ক্ষয় করার কি সত্যিই কোন মানে আছে? বাচ্চা এবং নিনিভাকে সে পেয়েছে, এবার রওনা দেওয়া যায়।

এমন সময়, সাদইদের কম্পিত একটা হাত হেরার কাঁধের উপর এসে আশ্রয় পায়। সাদইদের হাতটি যেন হাত নয়। হৃদয়। হৃদয় হেরাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। সাদইদের চোখ চিকচিক করছে। সেদিকে চোখ তুলে হেরা চোখ নামিয়ে নিল। এই সাদইদ তাকে মড়কের মুখ থেকে টেনে এনেছে। নিনিভাকে, শিশুকে উপহার দিয়েছে কুটির বেঁধে দিয়েছে। অথচ লোকটির কেউ নেই। রিবিকা এক মরীচিকা! লোকটি লোটার চেয়েও হতভাগ্য–সবই সামনে রয়েছে, সবই সে স্পর্শ করতে পারে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না। তথাপি আঁকড়ে ধরতে চায় । হেরা তার কাঁধের উপরে এসে পড়া সাদইদের হাতের উপর নিজের একটা হাত তুলে স্পর্শ করল। সাদইদ কেঁপে উঠল।

কারিগররা যখন চলে গেছে হেরা বলল-তবু তোমায় শুরু করতে হবে। সারগন।

অন্যমনস্ক সাদইদ চমকে উঠল। বলল–তোমার জন্য একটি সোনালী অশ্ব দরকার। তুমি, নিনি আর খোকাবাবু সেটায় চড়বে। উদ্বৃত্ত শস্য হবে অনেক। চাষীদের জন্য কাপড় আর তোমার জন্য ঘোড়া। ওরা বুঝল না হেরা! চলে। গেল!

সাদইদের কণ্ঠস্বর ভেঙে পড়তে চাইছিল। ফের কাঁপা কাঁপা গলায় সাদইদ বলল–এখানে পাথরের ফলক বসাও হেরা। তাতে লিখে দাও, এখানে পৃথিবীর প্রথম আক্রমণের নীতি বর্জিত হয়েছে। অতীতের ইতিহাসকে এই পথ ঘৃণা করে। একটা বসন টাঙিয়ে দাও, রক্তাক্ত কাপড় নয়। কোন লোহিত কম্বল নয়। ভয় নয়। একটি প্রজাপতি নির্ভয়ে উড়বে এমন একটা ছবি ভেসে থাক সেই বসনের উপর।

হেরা বলল–ফের আমি লোটার মূর্তি গড়ে তুলব সাদইদ! কিন্তু আক্রমণ ছাড়া বাঁচা যায় না। তোমাকে একটি পুরু প্রাচীর এবং সৈন্যদল গড়ে তুলতে হবে। প্রকৃত রাখতে হবে প্রচুর সাঁজোয়া। প্রচুর অখ। মনে রেখো হিতেন মরেছে। কিন্তু হিত্তীয়দের বিনাশ হয়নি।

হেরার কাঁধ খামচে ধরল সাদইদ।

হেরা বলল–একটা ভারী কথা তোমাকে বলতে চাই। নগর গড়া আর ধ্বংস করা–তারই যোগফল হল সভ্যতা। যারা ধ্বংস করে এবং অধিকার করে তাদের কথা মানুষের মুখের কাহিনীতে থেকে যায়। মানুষ ধ্বংস করে নগর। ঈশ্বর ধ্বংস করেন স্বর্গ।

সাদইদ শুধালো–তাহলে গড়ে কারা?

হেরা বলল–তুমি সেকথা ভাল করেই জানো! নোহের সন্তানরা গড়ে।

–কিন্তু গড়ে তোলে কেন বলতে পারো?

–সেকথা সহজ করে বলা যায় না। বলাই হয়ত যায় না। আমি কেন লোটার অশ্বারোহী মূর্তিটা বানালাম বলতে পারব না। ধ্বংসের ব্যাপারটা বলা যায়। নির্মাণের ব্যাপার বলা খুব মুশকিল। অহংকার?

বলেই হেরা চাপা গলায় অদ্ভুত হেসে উঠল। তারপর বলল–দুটোই কাজ। ধ্বংস করা একটা কাজ। গড়া একটা কাজ। মানুষ কাজ করছে। যার যেমন ভাল লাগছে করছে। তুমি ভেবো না, তুমি গড়ছ বলেই খুব মহৎ। যারা ধ্বংস করছে তারাও সম্মানিত। ঈশ্বর স্বর্গ ধ্বংস করেছেন বলে তাঁর কিন্তু মড়ক হয়নি। যারা রাজা তারা ধ্বংস করে বলেই রাজা। ধ্বংসের জ্ঞান এবং বুদ্ধিকে তুমি উপেক্ষা করতে পারো না। আগে ভাল করে পিষে দাও, কোমর ভেঙে দাও, কপিকলে জুড়ে দাও, তারপর ফলকে লিখে রাখো, আমি একটি পশুকেও আঘাত দিইনি।

সাদইদ বলল–আমি কিন্তু আঘাত দিয়েছি হেরা!

হেরা বলল–সেটা কখনও ফলকে লিখে রাখবে না। একটা মানুষ দুমড়ে ভেঙে পড়ছে, থলি টানতে পারছে না, নুইয়ে পড়ছে, এটা আঁকবে মানুষ যাতে দুমড়ে নুয়ে পড়তে শেখে, ভয় পায়। ক্রমাগত ভয় সৃষ্টি করতে না পারলে তুমি কখনও সারগন হয়ে উঠতে পারো না। জীবন থেকে তুমি কিছুই শেখোনি সাদইদ। রাজা হিতেনের সন্ধিফলক তোমার মনে নেই?

–আমি কিন্তু একটি স্বর্গের কথা বলছি হেরা!

–সেটা ধ্বংস করার জন্য ঈশ্বর আছেন!

–তাহলে আমি কী করব?

–তুমি মরো!

বলেই হেরা সাদা গাধার পিঠে গিয়ে লাফিয়ে উঠল। ছোট ছোট পা দ্রুত ফেলে ফেলে গাধা চলতে শুরু করল। তথাপি সাদইদের নগরনির্মাণের কাজ থামল না। আবার সে কারিগর, কাঠের এবং সুতোর কারিগর, মাটির কুমোর–সকলকে ধরে আনল। বাঁধ বাঁধবার চাষীদের, খাল কাটবার কুশলীদের সংগ্রহ করে আনল। ইহুদ আবার তাদের ভাগিয়ে দিলেন। হেরা কুমোরদের কাছে গিয়ে নকশা দেখায়। কল্পনা দেয়। নকশাদার একটা ভাঁড় রঙ করিয়ে পুড়িয়ে এনে দ্রাক্ষার রস পান করে পথের উপর দাঁড়িয়ে। মাথা পা টলমল করে। বাজে কথা বলতে থাকে–শালা সাদ! স্বপ্নের তোর সর্বনাশ করি রে সারগন! মধু টুপিয়ে পড়ে, দুধ গড়িয়ে যায়! ইয়ের্কি!

এই মত্ত অবস্থা তার কাটে না। সে বুঝতে পারে না এই যন্ত্রণার উপশম। কীভাবে হবে। রাত্রে ঘুম হয় না। বুকের ভিতরের নগরী তাকে স্বপ্নের ভিতর। টেনে নেয়। সে দেখে নগরী দাউদাউ করে পুড়ছে।

বাইরের দাওয়ায় শুয়ে আছে শিশু আর নারী। দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে সে। নারীর কাছে আসে, তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে নিনিভাকে সম্ভোগ করে–ঘরে আসে, মদ খায়। ঘুমানোর চেষ্টা করে। পারে না। ফের মদ খায়। আবার সম্ভোগ করে। বিছানায় শোয়। দুঃস্বপ্ন দেখে। পৃথিবীর সমস্ত মূর্তি ভেঙে পড়ছে। ঘুম চটে যায়। আবার সম্ভোগ করে। আবার মদ খায়। নিনিভা হেরার পায়ের উপর পড়ে গিয়ে বলে–তুমি পাগল হয়ে গেছ! আমি আর পারছি না!

রাত্রি-শেষে নেতিয়ে পড়ে হেরা। ভোর হয়। নিনিভারও ভয়ানক ঘুম এসে পড়েছিল। প্রত্যুষ জেগেছে। কিন্তু নিনিভার দেহ কিছুতেই জাগতে চাইছিল না।

ভোররাত্রির অন্ধকারে দুটি কালো হাত এসে নিনিভার কোলের কাছ থেকে শিশুকে তুলে নয়। ঘুমন্ত শিশুকে একটি গাছের গোড়ায় শুইয়ে দেয়। তারপর একটা ভারী ধরনের পাথর, যা ছুঁড়ে একদা মানুষ পশুকে ঘায়েল করত, তাই দিয়ে ঘুমন্ত শিশুর মাথা থেতলে দেয়। শিশু কেঁদে ওঠারও সময় পায় না। ঘুমের ভিতরই শিশুর মৃত্যু হয়।

মৃত শিশুকে ঘাতক গাছের গোড়ায় বসিয়ে দেয়। ঘাড় কাত হয়ে একদিকে কাণ্ডের উপর পড়ে থাকে। একই রাতে অন্য এক গাছের তলায় একইভাবে বসিয়ে রাখা হয় আরো একটি মৃতদেহ। সেটি এক দেবদাসীর।

সাদইদ ভোরে এসে হেরাকে মারতে মারতে জাগিয়ে তোলে, নইলে হেরা জেগে উঠতে পারত না। এই মার চপেটাঘাত মাত্র। চক্ষু টকটকে লাল। চোখ মেলল হেরা।

তার শিশু নেই। প্রথমে সে এই সংবাদ বুঝতেই পারল না। বারবার তাকে বলা হয়, খোকা নেই হেরা! তোমার শিশুকে কে একটা পাগল, জিব্রিল,মেরে রেখে গাছের তলায় ফেলে চলে গেছে। পাথরঅলা একটা লোক! বুঝতে পারো না, তোমার লকেট-ঝোলানোনা শিশুটি আর নেই। হতে পারে গর্ভবতী বউটাই হয়ত মেরে ফেলেছে। আপন মা তো নয়। সে কি আর মধু খাওয়াবে, গরলই গেলাবে!

১১-১২. সোনালী অশ্বের পিঠে

সোনালী অশ্বের পিঠে চড়ে হেরা সোজা উপত্যকার কালো আঙুরের মত নিবিড় মধুচক্রের কাছে উঠে এল। এতবড় প্রশস্ত পথ নিনিভেও ছিল না। পথের দু’পাশে বাজার-পাট বসতে শুরু করেছে। কনানের সমস্ত পথ সবার জন্য উন্মুক্ত। ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে নানান দেশের সঙ্গে। নগর প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। উচ্চতার দিকে উঠে গেছে পথ, তারপর সিঁড়ি তৈরি হচ্ছে, যেভাবে কল্পনা করা যায় একটি দুধের রাস্তা নক্ষত্র থেকে নেমে এসেছে মাটিতে, আকাশে দুধের রাস্তা দেখা যায়।

একটি তৃপ্তির খাস ফেলে হেরা নিজেকেই বলল, এখানেই অতএব অমরাবতী। সাদইদের কক্ষ। কক্ষের ভিতর নগ্ন নারী। শুধু প্রমাণ করা যে, রিবিকার হুবহু নকল করা হয়েছে এখানে, যাতে দুটি সত্যিকার প্রজাপতি উড়ে এসে রিবিকার বুত্রে উপর বসে। কিন্তু এটা কি আদৌ প্রমাণ করা সম্ভব! যদি তা প্রমাণিত না হয়, তবে বলা যায় না যে এটি মানুষের গড়া স্বর্গ! স্বর্গ প্রমাণ সাপেক্ষ, তা শুধু ঘোষণা-করা কোন ফলকাকীর্ণ লিপি নয়। সাদইদ বলেছে, যদি প্রজাপতি না উড়ে আসে,বুঝতে হবে এই নির্মাণ মিথ্যা। তাহলে সমস্তই ভেঙে ফেলতে হবে। ভাবলেই মনটা কেমন দমে যায়।

হেরা আবার নিজেকে বলল, সব জিনিসের যেমন চুড়ো আছে, তেমনি সৌন্দর্যেরও চুড়ো আছে। সেখানে স্থাপন করতে হবে রিবিকার নগ্নতা। কিন্তু রিবিকাকেই যে কখনও দেখিনি। সাদইদ তাকে লুকিয়ে রেখেছে। নগ্নতা না দেখলে নগ্নতা উৎকীর্ণ হয় না। নগরীটা বুকের মধ্যে আছে, রিবিকা তো বুকের মধ্যে নেই।

সামনের অর্ধসমাপ্ত মাটির নগ্ন নারীমূর্তির দিকে চাইল হেরা। ভাবল, বাকি কাজ পরে হবে। কাজটা দু’চার দিনের নয়। তবে এ মূর্তি তো রিবিকার নয়। এ যে নিনি। কী মুশকিল। শিশু গেল হত্যায়। বউ গেল পালিয়ে। কেন গেল? বোবা মেয়েটিকে সে ভাষা দিয়েছিল। কিন্তু রইল না। পড়শীরা হত্যার দায় চাপাল নিনিভার কাঁধে। ক্রমাগত বলতে থাকল, এই মেয়ে মরুরাক্ষসী! বাচ্চাকে শুষে নিয়েছে। অবিরাম বলতে থাকলে মানুষ না-পালিয়ে কোথায় যাবে!

ভাবতে ভাবতে হেরার তৃপ্তির শ্বাস বেদনার দীর্ঘশ্বাসে বদলে যায়। এই কনানে আমি কেন এসেছিলাম? বউ আর শিশুর টানে,আর এসেছিলাম কাজ পাব বলে। কিন্তু যুদ্ধ মানুষের আকৃতি ভেঙে দেয়, লুপ্ত করে রূপ আর কাঠামো–একটা শ্বাসরুদ্ধকর অদৃশ্য জগৎ তৈরি করে। কিন্তু যুদ্ধ তো থামল না কখনও। মারী মড়ক বন্যা দুর্ভিক্ষ যেমন পালা করে আসে–বন্যা, অতঃপর মড়ক এবং দুর্ভিক্ষ, সেইভাবে হত্যা ধর্ষণ ইত্যাদি, এইসব ক্রিয়া চলতেই থাকে। মানুষ বস্তুত এইরকমই। যা হারাচ্ছে নিয়ত, তাইই সে নিয়ত খুঁজছে।

মাটির মূর্তির দিকে অপলক চেয়ে আজ জীবনের কত কথাই না মনে পড়ে যাচ্ছিল। এমন সময় আকাশমুখী পথ বেয়ে অপরূপ উপত্যকার দিকে এই সন্ধ্যাকালে উঠে আসে সাদা অশ্বারোহী দেবদূতের ক্ষিপ্রবেগ–সাদইদ।

অশ্ব থেকে অবতরণ করতে করতে বলে–আর কতদূর হেরা! স্বপ্নদর্শী ইহুদ বলে বেড়াচ্ছেন রাত্রের আকাশে বৃশ্চিক তারকার উদয় হয়েছে। যুদ্ধ ধ্বংস আর মড়ক অনিবার্য! আমি শুধু ভাবি আকাশে চাঁদ যে সভা বসিয়েছিল সে দৃশ্য। তিনি দেখেননি।

হেরা হেসে উঠে বলল–আমি শুনেছি অন্য এক কথা। যেসব মা বাপ শিশু সন্তানদের যুদ্ধে মরুভূমির বুকে হারিয়ে ফেলেছে এবং যে-শিশু তার মা-বাপ পায়নি আর যে-দেবদাসী স্বামী পেল না, যে-সৈনিক পেল না ঘর–ইয়াহোর স্বর্গে তারা নিশ্চিত সমস্তই ফিরে পাবে এবং মিলিত হবে। এই বক্তৃতা খুবই নতুন। বৈপ্লবিক বলতে পারো।

–তুমি শুনেছ?

–হ্যাঁ, শুনেছি বইকি! তোমায় লুকবো না। আমি গোপনে ভিড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে অনেক বক্তৃতাই উপভোগ করি। ইহুদ তাঁর অন্তর থেকেই বলেন। খুব স্পর্শ করে। কোমলমতি মানুষ তাঁর কথায় কাব্যের চেয়ে অধিক রস পায়। একদিন খোকা চলে যাবার পর ইহুদের বক্তৃতা শুনতে শুনতে মনে হল সব ছেড়ে দিই, ওঁর পায়ে গিয়ে পড়ে যাই। আমার মনের সেই অবস্থার কথা তোমায় বোঝাতে পারব না।

হঠাৎ সাদইদ খুব স্পর্শকাতর স্বরে বলে–আমি তোমায় কিছুই দিতে পারিনি হেরা! কিছুই পারিনি। বরং আমি কেবল তোমার কাছে চেয়েই চলেছি!

হেরা হা হা করে হেসে ফেলে মাটির মূর্তির দিকে চেয়ে বলে উঠল–কোন কিছু পাওয়ার ব্যাপারে একটা চমৎকার পুরনো পন্থা আছে সারগন। পাথরঅলাদের কথাই ধরো!

বলেই হেরা কাহিল করে হাসল। বলল–পাথরঅলাদের কথা মনে এলেই আমার অসম্ভব রোদন আসে। বাচ্চাটাকে মনে পড়ে কিনা। নিনিভাকেও তীব্র মনে পড়ে যায়। কান্না ঠেকানো যায় না। পাথর মেরে পশু শিকার করা নিশ্চয়ই অজ হাস্যকর। পশুপালন যখন করছি, প্রয়োজনের পশুগুলো তো আমাদের ঘরেই রয়েছে। কিন্তু পাথরঅলারা যখন পশুশিকার করে বেড়াত

সাদইদ বলল–শিল্পী মানুষ হলে যা হয় কথা তোমার ভাবাবেগে এলিয়ে পড়ে–এত বিস্তারিত কর যে, মূল ব্যাপারটা ধরতে খুব চিন্তা করতে হয়।

হেরা আবার হাসল। বলল–আমি তো তোমার মত কর্মের মানুষ নই, চিন্তাবিদও নই। সংগঠন যারা করে তাদের চিন্তাও খুব গঠিত হয়–যেমন মহাত্মা ইহুদ–সব হল লাঠির ইশারাগুছিয়ে ভোলা। আমার হয় না।

–-আচ্ছা, কী বলছিলে বলে দাও। তারপর খুব দ্রুত মূর্তিটার কথা ভাবো!

–মূর্তিটাকে আমি তুক করছি সাদইদ!

সাদইদ চমকে উঠল। তুক বলার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তে সাদইদের চোখের উপর প্রাচীন পর্বতগুহা ভেসে উঠল। পুরনো পাথরমারা মানুষ গুহার দেওয়ালে শিকারে যাওয়ার আগে শিকারের ছবিটা আঁকত–এটা তার হৃদয় থেকে, মানে স্বপ্ন থেকে আসত। তারপর আঁকা ছবিটার ওপর তুক করত। তুক করলে বনে গিয়ে সেই আঁকা ছবিটাই সে জ্যান্তরূপে শিকার করতে পারত। ফলে ছবি বা মূর্তি থেকে তার নড়বার উপায় নেই। সাদইদ ভাবল, আমিও কি পারছি? তাহলে হেরাই বা পারবে কেন? কিন্তু সে কাকে তুক করছে?

সাদইদ বলল-খুব কষ্ট হয় হেরা! সবই তুমি হারিয়েছ, কিন্তু তুক করে সেইসব কি ফিরে পাবে? মাটির তৈরি নিনিভাকে রক্তমাংসে ফিরে পাওয়া–

হেরা সঙ্গে সঙ্গে বলল–না সাদ!

–তবে?

–এ তো রিবিকা স্বর্গদর্শী সারগন! আমি তার নগ্নতা দেখিনি। তাকে দেখাও–আমি নিনিভার রূপ থেকে মুক্ত হই! আমি হৃদয়ের শেষ শক্তি দিয়ে ভেবেছি কিন্তু পারিনি। বারবার নিনিভাই চলে আসে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, আমি পারব!

বলতে বলতে হেরার গলা বুজে এল। একটি অঘটন হল। একটি পাগলা পাথর এই ঘোর হতে থাকা সন্ধ্যার হালকা তিমিরে তৃতীয়ার চাঁদের কোমল। কিরণ মেখে পাহাড় থেকে গড়িয়ে পড়তে থাকে। ক্রমাগত পড়ে যেতে থাকে। লাফিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পড়ছে। একদণ্ড থামছে, কি থামছে না। নিচে ছুটছে একটা বিধ্বংসী ক্ষমতার মত। এ ঘটনা এই পাহাড়ে এই প্রথম।

এই প্রথম জীবনে সাদইদ মুখ ফসকে উচ্চারণ করল সুতীব্র হতাশার সুরেহায় ইয়াহো! এমন তো ভাবিনি।

হেরা বলল–হাঁ, আজ কত মরবে কে জানে! খুব সাংঘাতিক এই পতন। চেয়ে থাকলে মনে হয় এই উপত্যকাটাই যেন বসে যাচ্ছে।

সাদইদ সাদা অশ্বে লাফিয়ে উঠে বসে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়। হেরা পিছন থেকে আর্তনাদ করে ওঠে–ওভাবে যেও না সারগন!

তারপর কী ভেবে হেরা একা এই জনশূন্য নির্জনে অট্টহাস্য করে বলে–তুক। তুক করছি ওহে পাথরঅলা! ওহে রুদ্র, তুমি কে? অদৃশ্য, তুমি কে হে! মহাত্মা ইহুদ, আমায় গ্রহণ করুন পিতা! আমি তোমার স্বর্গে যেতে চাই। আমার সংলাপ শুনছে এই উপত্যকা! কেউ শুনছে না। আমিও শুনছি না। হা হা হা হা! হা হা হা!

হাসি শুনে সোনালী অশ্ব হেরার কাছে ঈশ্বরের মত এগিয়ে আসে। অশ্বপৃষ্ঠে চড়ে ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসতে থাকে হেরা। রাস্তার দু’পাশে দোকানপাট আলোয় উজ্জ্বল বীণা বাজিয়ে গান গেয়ে চলেছে এক অন্ধ গায়ক, তার গাইবার বিষয়বস্তুটি ভারী সুন্দর।

‘দুধের রাস্তা রাজা খুবই মধুর
এখানে ডুমুর রুটি, এখানে কেবলই সুর।
তবু তোর পাপের ভারা টানবি আর কতদূর–
এখানে তাঁবুর বাজার, এখানে কেবলই সুর।
এখানে তাঁবুর পাশে চাষীদের কুটির আছে,
এখানে মরুর হাওয়া, পাথরে ফুল ফুটেছে।
সব তোর নিজের গড়া, সবই তোর স্বপ্ন রাজা–
মাটিতে দুধের নদী, মধুর ওই উপত্যকা,
সব তোর আকাশ-ছোঁয়া, সবই তোর মাটির টানে
তবু যে পাপের ভারা ডুবে যায় নদীর বানে।
তুই তো বিম্ব ছায়া, তুই তো লোটার ছায়া–
যে রয় মরুর মাঝে যে হয় আসল কায়া;
সে আছে ঝড়ের মুখে, সে আছে মারীর বুকে
সেই যে আসল রাজা, আসবে কনান দেশে।
তার বিবিকে তুই কেড়েছিস, তুই যে রাজা অসুর–
দুধের রাস্তা রাজা খুবই মধুর।’

একটু থেমে আবার গাইছে :

‘তুই যে হত্যাকারী, শিশুকে তুই মেরেছিস,
তুই যে হত্যাকারী, ঘোড়াকে তুই মেরেছিস–
তবু তোর সুনাম করি, তুই যে শান্ত অধীর
কে জানে কী করেছিস, রিবিকা কোথায় আছে;
এখানে মরুর হাওয়া, পাথরে ফুল ফুটেছে।
এ বীণা আমার বীণা, কেড়ে তুই নিস না জানি–
লোটাই আসল রাজা, রিবিকা আসল রানী।
এই সুর কেবল এ সুর, গেয়ে যাই আপন মনে–
তোর ওই স্বর্গে যেন ইয়াহো পাথর হানে।
নতুবা স্বর্গ তোমার ইয়াহো উঠিয়ে নেবেন,
আকাশে নিজের কাছে, আকাশে নিজের কাছে–
এখানে নদীর হাওয়া, আকাশে চাঁদ উঠেছে।’

হেরা বীণাবাদকের গান শুনতে শুনতে আশ্চর্য বোধ করছিল। সে বুঝতে পারছিল, পাপ কীভাবে জাল ছড়িয়ে চলেছে কনানের সর্বত্র। সাদইদ কোনদিনই এই মাটিতে প্রতিষ্ঠা পাবে না। তার এই স্বর্গকে কেউ বিশ্বাস করে না। তাকে ইহুদ হত্যাকারী এবং লুণ্ঠনকারী ঘোষণা করেছেন। মহাপিতা নোহের নৌকাকে নোহের পুত্র অবধি বিশ্বাস করেনি। পিতার নৌকায় পুত্ৰ উঠতে চায়নি। পুত্র বন্যায় তলিয়ে গেল, তথাপি পিতার নৌকায় উঠে এল না। কিন্তু কেন এমন হয়?

বীণাবাদক জানে, সাদইদ তার বীণা কেড়ে নেবে না। এই বিশ্বাস তার অন্তরের, কিন্তু উপত্যকায় যে স্বর্গ তৈরি হচ্ছে তাতে তার আস্থা নেই। কিন্তু কেন?

সমতলে নেমে আসার আগেই হেরার চোখে পড়ল আকাশের তলায় এক সর্বগ্রাসী আগুন লেগেছে। দ্রুত ঘোড়া ছোটাল হেরা। এই ভয়াবহ দৃশ্যের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। অনেকটা কাল কেটে গেছে এই কনানে আসার পর। প্রতিটি পাথর এখানে গেঁথে ভোলার মেহনত সীমাহীন। পথের প্রতিটি স্তর খাড়া করা মুখের কথা নয়। কতবার শ্রমিক কারিগর মিস্ত্রী, চাষনালার চাষী সব ছেড়ে পালিয়ে গেছে। মাঝপথে নির্মাণের কাজ থেমে পড়েছে। তবে এখানে। আর ভয়াবহ বন্যা কিংবা সাংঘাতিক খরা হয়নি। একটু-আধটু যা হয়েছে, তার সম্পূর্ণ মোকাবিলা করেছে সাদইদ। এখানে বাজার বসেছে, কুটির তৈরি হয়েছে। কিন্তু কুটির আর তাঁবুর লড়াই থামেনি। পূর্বদেশী চাষী বা শ্রমিকের সঙ্গে কনানের বিবাদ, বিদ্বেষ দূর করা যায়নি ইয়াহোর নির্দেশে। কখনও কখনও মনে হয় সমস্ত চেষ্টাই অবান্তর। .

হঠাৎ মনে পড়ল, আজ নববর্ষের দিন! রাত্রি নামল। চাষীর ঘরে ফসল ফলেছে সুপ্রচুর। সাদইদ উদ্বৃত্ত সংগ্রহ করতে গিয়ে বাধা পেয়েছে বিচিত্র ধরনের। ইয়াহোর বান্দারা অনেকেই দিতে চায়নি। সাদইদ তবু হেরাকে উপত্যকা ঘিরে প্রাচীর খাড়া করতে বলেছে। পথ তৈরি হয়েছে। আজ আগুন লাগল কেন?

হেরার চোখের সামনে সব ভস্মীভূত হতে লাগল। তাঁবুর পশুরা পুড়ে গেল। চাষীর ঘর জ্বলল। পথের উপর পড়ে রইল মৃতদেহ। বিদেশী সংখ্যালঘু কুমোরদের বউ,কন্যা ধর্ষিতা হল। ঘটনা কেন ঘটল? দু’জন দেবদাসী খুন হয়ে গেল। দেবদেবীর অভিনয়ের রাত বিষাক্ত বিষাদে ছেয়ে গেল। নিশ্চয়ই কোন সেপাই চাষী ঘরের মেয়েকে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে–এমন একটা বিবরণ শোনা যাবে বাতাসে। কিংবা কুমোরদের কোন ছেলে তাঁর মেয়ের উপর নষ্টামির চেষ্টা করে। বলা হবে,এই ঘটনায় কনানীদের কোনওই ভূমিকা ছিল না। অথবা তাঁবুর বসতি আছে বলেই দাঙ্গা বেধেছে, স্বর্গ না গড়তে চাইলে এমন হত না!

হেরা চোখের সামনে দেখতে পেল আলো-অন্ধকার মেশানো একটা কুটির থেকে কচি একটি মেয়ের হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনছে দিনারের মত একজন কেউ। হাতে ধরেছে ধারালো তৃতীয়ার চন্দ্রাকৃতি গোল অস্ত্র। কিশোরীটি চিৎকার করছে। মেয়েটির মুখের আদল অনেকটা নিনিভার মত। হেরা বুঝতে পারল, নিনিভার বাপের সংসারে অত্যাচার কখনও থামেনি। বাপ বেচারি কী করবে? তার তো করার কিছু নেই। এতগুলি মেয়েকে সে সামলাতে পারছে না। ইয়াহোর ধর্ম গ্রহণ করার পরও, কনানের পুরনো ধর্ম তাকে ছাড়ছে না। কুমারী বলি হয়েছে, আজ নববর্ষে অন্য মেয়েটিকে টানছে এক মরুজাতক সেপাই।

ধর্ষণে উদ্যত দিনারের একটি ছায়া, দিনার কিনা বোঝা যায় না–অশ্বের পায়ের শব্দে চমকে উঠে কিশোরীর গলায় অস্ত্র পেঁচিয়ে দিয়ে অন্ধকারে গা-ঢাকা দিল। কিশোরীর দেহ সামনে পড়ে লাফাচ্ছে, গলা দু’ফাঁক হয়ে গেছে পশুর মত। হেরা অশ্য ধাওয়া করে দিনারকে পেল না। হঠাৎ নারীকণ্ঠের আর্তনাদে তাঁবুতে এসে দেখল নিশিমা খুন হয়ে গিয়েছে, তার মাথার কাছে মড়া আগলে বসে আছে এক বৃদ্ধা, সেই বৃদ্ধাই মাঝে মাঝে ককাচ্ছে ভয়ে। হেরা পাগলের মত ছুটে এল পাহাড়ের দিকে। এখানে নাকি ইহুদ থাকেন।

দেখা গেল, ইহুদ কতকগুলো মানুষকে, যারা অধিকাংশ মরুসৈনিক, নির্দেশ দিচ্ছেন–ছুটে যাও। বন্ধ করো তাণ্ডব।

হেরা বলল–যা হবার তা তো হয়েই গেছে মহাত্মা! সম্ভবত আপনার দিনার এইমাত্র এক কিশোরীকে খুন করে অন্ধকারে ছুটে গেল। এবার থেকে আমরা এক ক্ষমতাশালী সৈন্যদল গড়ে তুলতে বাধ্য হব!

তারপর সবচেয়ে বড় বাঁধটা রাতারাতি কেটে দিল কে, জানা গেল না। খরা এল অতঃপর। দগ্ধানো গ্রামের ভস্ম মরুর হাওয়াআকাশেওড়াতে লাগল। বালি উড়ে এসে খাল বুজে যেতে লাগল। পাথর গড়িয়ে পড়তে থাকল পাহাড় থেকে। উপত্যকার মধুচক্র শুধু মোম হয়ে ঝুলে থাকল হলুদ বর্ণে। রাত্রে গ্রামের ভিতর মৃত্যুর রোল উঠতে লাগল। মরু-হায়েনা হানা দিল রাত্রির গভীরে। শেয়াল ছুটে এসে মড়কলাগা পশুর দেহ ধরে টানাটানি করতে থাকল। নীল সমুদ্র হল ধূসর। মিশালের নৌকা অস্থির হয়ে দুলতে থাকল কেবল। দেবদাসীরা তাঁবু ছেড়ে নেমে এল পথে। চাষার ঘর থেকে মেয়েরা নেমে এল পথে। ভাঙা কুটিরে ফেদে বসল দেহের ব্যবসা। কিন্তু খদ্দের জোটানো দায়।

একদিন একটি মেয়ে হেরার হাত ধরে টানল।–এসো না গো! ঘরে আঙুর গেঁজানো মদ আছে।

হেরা চমকে উঠে দেখল, মাথাটা গেছে–এই কি নিনি! নিনি হেরাকে চিনতে পারল না। ভাঙা পাল্লা বন্ধ করে চিৎ হয়ে বসন আলগা করে দিল। হেরা তাকে সম্ভোগ করতে পারল না। পালিয়ে এল। এবার তার মনে হল, সব মিথ্যা! কোথাও নিশ্চয় পাপ করছে মানুষ, কী পাপ বুঝতে পারছে না।

ক্রমশ সে পাগল হয়ে যেতে বসল। বাতাসে পোড়া গন্ধ কিছুতেই দূর হতে চাইছে না। অধিকাংশ পশু মড়কে ফৌত হয়ে গেছে। তাঁবুর মানুষরা গাছের তলায় বসে আছে। যে লোকটির দুটি বউ–তাঁবুর বউ আর কুটিরের বউ–তার অবস্থা খুবই করুণ। কুটিরের বউ তার কাছে আসতেই চাইছে না। চাষাতে চাষীতে খুনোখুনি হয়ে গেছে। পুঁটকি মাছ আর কাঁকড়ার বিবাদ। হেরার মনে হল, মানুষ কখনওই খুনোখুনি ছাড়া থাকতে চায় না। দাঙ্গা, রক্তপাত, ধর্ষণ, মারী, মড়ক, দুর্ভিক্ষ, খাদ্যাভাব, পথে বসে পড়া তার প্রাগৈতিহাসিক অভ্যাস। যুদ্ধ তার নিয়তি । নগর তৈরি হলেই সেটা সে ধ্বংস করে। সুন্দরী মেয়েকে বলাকার করা, বলি দেওয়া তার কাজ। চিরকাল সে ধ্বংসে আর বলাৎকারে আনন্দ পায়। নির্মাণের আনন্দ দু’এক জনের, ধ্বংসের আনন্দ সবার। নির্মাণের আনন্দ তাকে বোঝাতে হয়, তবে বোঝে–কিন্তু ধ্বংসের আনন্দ বোঝাতে হয় না।

যে যত ক্ষমতাশালী, যে যত সভ্য, সে ততই ধ্বংস ভালবাসে। বিনাশ হল মানুষের প্রবৃত্তি। ঈশ্বর যেমন ধ্বংস করেন, মানুষও তেমনি ধ্বংস করে। দেবদূতরা সুযোগ পেলেই আকাশ থেকে নেমে এসে মানবীর গর্ভসঞ্চার করে। বলাৎকার করার অভ্যাস দেবতারা মানুষকে শেখান। একমাত্র ঈশ্বর যবহ অদৃশ্য, তাঁর বলাৎকারের অভ্যাস নেই, তবে মানুষের হাতে গড়া নির্মাণ দেখলেই তিনি কুপিত হন। ভাষাভেদ করেন। বিচ্ছিন্ন তিনিও করেন। তিনি পাপ দ্বারা মানুষকে শোধন করেন, ধুনুরি যেমন তুলা শোধন করে। নগরগুলি ঈশ্বরের কর্মক্ষেত্র, সেখানে মানুষকে পেঁজানোনা তাঁর কাজ, ধ্বংস করা তাঁর আনন্দ।

কিন্তু নির্মাণ? স্থাপত্য? মূর্তি? হেরা ভাবল, কেন সে নির্মাণ করেছিল? সে কি তবে ধ্বংসের জন্য? একটা পাগলা পাথর যেমন পাহাড় থেকে খসে পড়ে, তেমনি একটা পাথর শিশুর মাথায় মেরে থেঁতলে দেওয়াও কি একটা অদৃশ্য ক্ষমতা? যুদ্ধেরই আর একটা রূপ? দিনার যদি করে থাকে–কেন করছে? সে যুদ্ধের লাশ গুনত ছেলেবেলায় উটের পিঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, একথা বলে সাদইদ। যুদ্ধের ভিতর জন্মালে কি একটা মানুষ পাথর মারতে ভালবাসে? আকৃতি নষ্ট করা, মানুষকে পোড়ানো, মাটিতে পোঁতাও কি একটা দায়িত্ব?

ভাবতে ভাবতে হেরার মাথাটা গোলমাল হয়ে যায়। নিনি আমাকে ডাকল! নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বসন আলগা করল কী কুশ্রীভাবে! নারীর সৌন্দর্যে আছে স্বর্গের আলো, শিশুর নগ্নতা ঈশ্বরের হাসির মত পবিত্র। সাদইদ এসব বলে। হেরা ভাবল, আসলে একটি মেয়েকে তুক করা ছাড়া আর কিছুই হয় না। তার সুন্দর আকৃতি এই বিশ্বে কখনও বজায় থাকে না। নগর ধ্বংস হয়, সেও ধ্বংস হয়। তবে নির্মাণ কেন করে মানুষ? হেরা ভাবল, তুক। রিবিকাকে তুক। করব। আর কিছু নয়। একবার তাকে হৃদয়ে বিম্বিত করাই আসলে সবকিছু। সেটাই তো স্বর্গ।

সাদইদের মনে হল, সমুদ্রে জলের তলায় একটি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। তার তীরে অমরাবতী। বাইরে মাটির উপর আর কখনও স্বর্গ গড়া যাবে না। তার সমুদ্রের জলে ঝাঁপ দিতে ইচ্ছে করছিল। মৃত্যুরও আকাঙ্ক্ষা থাকে। মনে হল, মৃত্যু যেন তাকে চাইছে। মিশালের নৌকা দুলছে। অসম্ভব তীব্র জ্যোৎস্নার এ রাত। চাঁদটা রাসরি এসে পড়েছে ঘুমন্ত রিবিকার মুখে। সাদইদ ভাবল, এই ফাঁকে সে জলে নেমে পড়ে। তারপর মনে হল, রিবিকাকে সে আর বহন করতে পারছে না। এই সীমাহীন রূপের ভিতর মদ নয়, মৃত্যু রয়েছে। এমন কি কখনও কেউ ভাবে? সুন্দরের সামনে দাঁড়ালে কি এরকম হয়? মরে যেতে ইচ্ছে করে?

নারী যে সুন্দর, তার রূপ থেকে স্বর্গের আলো তৈরি হয় শিল্পীর হাতে, এই কল্পনা তার মাথায় না এলে, এই জগতে তার কোনওই দুঃখ ছিল না। একটি প্রজাপতি থেকে এই ভাবনার উদয়। সমুদ্রেই তবে তার বিসর্জন হোক। বাইরে জ্যোৎস্না, জলে, কিনারে জ্যোৎস্না, গাছপালায় শিশিরমাখা জ্যোৎস্না, সবই বিচ্ছেদহীন মনে হচ্ছে। অথচ আজ বাতাসে মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা সমুদ্রের মত গর্জন করছে। সীমানা হারানো মরুভূমি জ্যোৎস্নায় প্লাবিত–সেখানে ছুটে মরছে কালো অশ্ব–এই একটি ছবি। কোথাও নেই। অথচ মনের ভিতর রয়েছে। সাদইদের বুকের ভিতর একটা পাপের উৎস খুলে যায়। সহসা সে রিবিকাকে জাগিয়ে তোলে।

রিবিকার ঘুম জড়ানো, যেভাবে একটা চুল তার গালের উপর জড়ানো, ঈষৎ জেগেছে, নিদ্রাভিভূত সুন্দর, শুভ্ৰপুষ্প কলিকার মত কোমল-একদিকে ভয়াল যুদ্ধ, অন্যদিকে একা এই নারী–এখানে কী কাজ সাদইদের? মহাপিতা নোহ এই নারীকে কেন রক্ষা করেছিলেন?

জড়ানো গলায় রিবিকা বলল–তুমি ঘুমোবে না সাদইদ?

হঠাৎ মন্থর গলায় সাদইদ বলল–ভাড়াটে সৈনিক আর দেবদাসী। এভাবে বাঁচা যায় না রিবিকা!

ঘুম থেকে চমকে মুখ তুলে চাইল রিবিকা। তারপর বলল–তুমি তো সারগন সাদইদ!

তারপরই দু’চোখ মুদল এবং সাদইদের কোলে মুখ গুঁজে দিল রিবিকা।

সাদইদ কণ্ঠস্বর সামান্য কঠোর করে বলল—কিন্তু তুমি ইয়াহোর জন্য আজ উৎসর্গ হয়েছ আমনের বউ। তোমাতে আমার অধিকার নেই।

এবার মুখ তুলে উঠে বসল রিবিকা। সাদইদের গালে কোমল স্পর্শে হাত বুলিয়ে বলল–জীবন কেন এরকম বলতে পারো? যুদ্ধের দুনিয়ায় ঈশ্বরও করুণা করেন না। তুমি বলেছিলে, মানুষ ক্ষমতাধর! সেই ক্ষমতা কি এত ক্ষুদ্র যে, অধিকারের কথা তুলছ? কেন বারবার এমন করো!!

সাদইদ বলল–পাপ আমাকে উতলা করেছে রিবিকা? আমি পারছি না।

–তোমাকে পারতে হবে সাদইদ! আবার গড়ে তুলতে হবে! একদিন বলেছিলাম, তোমার তৈরি ভাষায় কথা বলব না, তোমার স্বর্গকেও আমি বিশ্বাস করিনি। কিন্তু তোমাকে চেয়েছি সারগন!

–কেন চেয়েছ! আমি তোমাকে এতদূর টেনে এনেছি শুধু স্বর্গে পৌঁছব বলে। তা যে অবাস্তব। আজ হয় ইয়াহো, নয় হেরা। একদিন প্রশ্ন ছিল, কার কাছে দেব–রাজা হিতেন, নাকি লোটা। দুজনের কেউ তোমায় পায়নি।

-হেরা কেন?

–তোমার নগ্ন রূপ তার বিষয়।

–আমি যাব না। কিছুতেই যাব না। এই রূপ তো তোমারই সারগন। নমরু, আক্কাদ এরা যে কেউ কখনও আমার এত দাম দেয়নি!

–হেরার চোখে তুমি আরে দামী রিবিকা। সে স্থপতি, সে ভাস্কর!

–কিন্তু তুমি স্বর্গদর্শী সাদ! প্রজাপতি তোমার বন্ধু!

–তাই আমার পাপ! আমি বুঝিনি, মধুতে যখন প্রজাপতি লিপ্ত হয়, সেই ঘটনায় পাপ ছিল! অতি-কল্পনায় পাপ থাকে। স্বর্গের কাঠামো মানুষের পাপের পাঁজর দিয়ে তৈরি। ইহুদ বলেন, গ্রামকে শুষে তবে নগর তৈরি হয়, একটা স্বর্গ হল তারই চুড়া! অতএব তোমাকে ইহুদের কাছেই ফিরে যেতে হবে রিবিকা! আমি তোমাকে বইতে পারছি নে!

হঠাৎ রিবিকার মুখ কালো হয়ে গেল! যেন জ্যোৎস্নার চাঁদের গায়ে মেঘ এসে লেগেছে। ক্রমশ কালো হয়ে আসছে সমুদ্র-ছায়া।

রিবিকা ধীরে ধীরে নৌকার উপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল–তুমি রাজা! এই তোমার অহংকার সাদইদ। গ্রাম বসালে, চাষ-আবাদের নতুন নিয়ম আনলে। স্বর্গ গড়তে চাইছ। যুদ্ধ করেছ। তুমি অধিপতি। আমি সামান্য দেবদাসী। যতবার যাকে খুশি দেওয়া যায়। আমি যুদ্ধের পরিত্যক্ত জিনিস। আমাকে দিয়ে স্বর্গ গড়া যায়, যুদ্ধও করা যায়। দেবী ইস্তার আমাকে নগ্ন করেছে, আমন ভোগ করেছে, ইয়াহো তারই শোধ নিলেন নোটাকে দিয়ে। সবই হল!

–এ-সবই ঘটনা রিবিকা! প্রশ্ন করো না। এভাবে চিন্তা করা পাপ। নারী কখনও এভাবে চিন্তা করে না।

–তবে আমায় যেতে দাও। –বলে রিবিকা সমুদ্রে ঝাঁপ দেবার জন্য এগিয়ে যায়। সাদইদ বলে, স্বর্গ ওদিকে নয় রিবিকা! বলেই সে রিবিকার দেহ হাত ধরে টেনে নেয় নিজের দিকে। তারপর অবাক হয়ে ভাবে, স্বর্গ তবে কোথায়! একটু আগেই তো সে নিজে জ্যোৎস্না-পুলকিত রাত্রির তলায় উত্তাল সমুদ্রের নিচে একটি নদীতীরে অমরাবতীর সেই কক্ষ কল্পনা করছিল।

রিবিকা সাদইদের বাধা ঠেলে সমুদ্রে ঝাঁপ দিতে চায়–তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় সাদইদের বলপ্রয়োগে। সাদইদ অতঃপর রিবিকাকে একপ্রকার জোর করেই সম্ভোগ করতে থাকে। রিবিকা বাধা দিয়েও ঠেকাতে পারে না। অবশেষে রিবিকা মেনে নেয় এবং ভাবে, এই পৃথিবীকে তার আর কোন প্রশ্ন করার নেই। তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। এই বলপ্রয়োগই বীজ। এরই নাম মাটি আর উদ্ভিদ। দেবী ইস্তারের জন্মকথা, তার মৃত্যু, তার প্রেম আর নগ্নতা কখনও শেষ হবে না। সে স্বর্গে গেলেও নগ্নই থাকবে। তবে, এই পুরুষকে যেন সে এইভাবে অন্য কোন জীবনে বুকের ভিতর পায়–ঈশ্বর যেন এই ব্যবস্থা করতে পারেন!

দাঙ্গাবিধ্বস্ত কনান। দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশ। পশুদের মড়ক লেগেছে। বন্যায় বাঁধ ভেঙে ভেসে গেছে শস্যক্ষেত। বন্যার পর মড়ক। তারপর দুর্ভিক্ষ। তীব্র শীত হানা দিল ঘরে ঘরে। শীতেও মানুষ মরতে লাগল। সবচেয়ে বেশি মারা গেল তাঁবুর লোক। আগুন জ্বালবার, রাতে গা গরম করে কোনপ্রকারে বাঁচার তাগিদে তাঁবুর মানুষ চাষী-গেরস্তর আঙিনায় শুকনো কাঠ চুরি করতে এসে ধরা পড়ল। নির্মম বিচারে চোরের হাত কেটে দিল জনগণ। সেই কাটা হাত দেখিয়ে জনে জনে সে বলে বেড়াতে লাগল–সে একজন দামাদ। জামাইবাবু। চার ঘরের বর, দেখে রাখুন, কী হেনস্থা করেছে।

সাদইদ হেরাকে বলল–সমস্ত উদ্বৃত্ত, যা দিয়ে নগর এবং মূর্তি তৈরি হয়, সব বিলি করে দেব। যত মূল্যবান ধাতু, দামী পাথর বাইরে থেকে আনা হয়েছিল, সব বিক্রি করে বস্ত্র কিনে নেব। সবই বিলি করতে হবে।

হেরা বলল–সব হাতে তুলে দেবার পরও দেখবে, কত মানুষ মরে গেছে।

–তবু যতদূর বাঁচাতে পারি। স্বর্গ গড়ার কাজ স্থগিত রেখে দাও হেরা!

হেরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–মহাত্মা ইহুদ বলেছেন, এই বন্যা, দুর্ভিক্ষ, মড়ক, মহাশীত সবই স্বর্গ গড়তে চাওয়ার পাপ । তুমিই মানুষের দুঃখের জন্য দায়ী। এতকাল দেবতার দোষ দেওয়া হত, এবার মানুষ তোমাকে দুষছে! তাছাড়া..

–তাছাড়া কী?

–এত কষ্ট, তবু মানুষ দাঙ্গার পর গুমখুনের ঘটনা ঘটাচ্ছে অবিরাম!

–মহাত্মা ইহুদ কী করছেন হেরা!

–লাঠির শাসন মানুষ শুনছে না সাদইদ। ইহুদ বলছেন, স্বর্গ গড়া বন্ধ হলে তবে মানুষ শাপ এবং পাপমুক্ত হবে।

–স্বর্গ সম্ভব নয় হেরা। তুমি ফিরে যাও।

–আমি ফিরে যাব?

–হ্যাঁ হেরা! আমি তোমায় বিদায় দিচ্ছি!

দামী পাথরগুলি বিক্রি করতে শুরু করল সাদইদ। চোখের সামনে এই দৃশ্য সহ্য করছে পারছিল না হেরা। বণিকরা সব বস্ত্রের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়ে উট এবং অশ্বের পিঠ বোঝাই করে ফিরে যাচ্ছিল। সেই দৃশ্য সমুদ্রের উপর ভাসমান নৌকা থেকে রিবিকাও লক্ষ্য করছিল। সাদইদ একটা উচ্চ শিলাসনে দাঁড়িয়ে খাদ্য আর কাপড় বিলি করছিল। সে দৃশ্য রিবিকার দৃষ্টিসীমার বাইরেই ছিল।

চোখের সামনে দিয়ে বহুকষ্টে সংগৃহীত পাথরগুলি চলে যাচ্ছিল। নির্মাণের কাজে এতবড় আত্মঘাত সহ্য করা হেরার পক্ষে খুবই প্রাণবিদারী ঘটনা। তার সুন্দরের অনুভূতির স্তরে স্তরে আঘাত পড়ছিল বারবার। হঠাৎ সে লক্ষ্য করল, সবচেয়ে উজ্জ্বল পাথরখণ্ড, যা অফুরন্ত বাসন্তী আলো বিকিরণ করে, যা দিয়ে সে অমরাবতীর নির্দিষ্ট কক্ষে চিরবসন্ত বিরাজ করবে এমন স্ফুটিত রঙিন শুভ্রতার সঙ্গে চাপা বাসন্তী আভা ছড়াবে বলে পাথরটি প্রাণান্ত চেষ্টায় জোগাড় করেছিল, সেই পাথরটিও বেচে দিচ্ছে সাদইদ।

দ্রুত ছুটে গিয়ে হেরা বণিকটির সামনে দাঁড়িয়ে সাদইদের দু’হাত চেপে ধরে বলল–দিও না। এভাবে দিও না সাদ। তোমার স্বর্গে তাহলে কখনও প্রজাপতি উড়ে আসবে না।

পাগলের মত ককিয়ে উঠল হেরা। বণিকটি আশ্চর্য হয়ে গেল, কিঞ্চিৎ থতমত করে বলল–পাথরটা দামী নিশ্চয়। দামও আমি দেব। গরম গরম ভাল পোশাক আর খাঁটি মদ আমার কাছে আছে।

হেরা বলল–আপনি অনেককিছুই বোঝাই করেছেন–এই পাথরটা আর চাইবেন না।

বণিকটি বলল–দাম আমি উপযুক্তই দিতাম, আমি উটের পিঠ খালি করে দিয়ে যেতাম। চারদিকে আকাল চলছে, ভেবে দেখুন!

সাদইদ হেরার ভয়ানক অস্থিরতা দেখে বলল–ঠিক আছে সওদাগর, আপনি বরং এখন চলে যান, পরে দেখা যাবে’খন।

–না। পরে নয়। কখনওই নয়। আপনি আসবেন না। চলে যান। একবারে চলে যান!

হেরা যেন আর্তনাদ করে উঠল। বলল–এভাবে আমায় তুমি বাতিল করে দিও না সাদইদ!

এই সময় চোখে পড়ল আর এক দৃশ্য। কাঠের উচ্চ চারপায়ার উপর দাঁড়িয়ে সাদইদের নির্দেশে যে মধ্যবয়স্ক শান্ত মেজাজের স্বাস্থ্যবান কর্মীটি কাপড় এবং গম বিতরণ করছিল তার সামনে সহসা কখন লাঠি হাতে এসে দাঁড়িয়েছেন ইহুদ। লাঠির অগ্রভাগ দিয়ে ঠেলা দিলেন গম মাপার পাত্রটিতে, যে দুঃখী তাঁবুর বাসিন্দা আঁচল পেতেছিল, সে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে আঁচল গুটিয়ে নিল। গমগুলি মাটির উপর পড়ে গেল।

সাদইদ এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বলল–ওকে নিতে দিন মহাত্মা ইহুদ!

–না। পাপের শস্য নেবে না। যে উদ্দেশ্যেতুমি মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছিলে, তার অহংকার আছে, সেই শস্য মুখে ভোলা পাপ সাদইদ। ইয়াহোর বান্দা শুকিয়ে মরবে, তবু নেবে না। মরুভূমিতে আমরা পরীক্ষা দিয়েছি, আজও পরীক্ষা শেষ হয়নি। তুমি যা কেড়ে নিয়েছ, সবই তোমায় ফেরত দিতে হবে। তোমাকে মানুষ বিশ্বাস করে না। তুমি নিজেকে ঈশ্বর মনে কর!

ইহুদ আর দাঁড়ালেন না। যে লোকটি ঘাড়ের বসন সামনে মেলে আঁচল পেতেছিল, সে অতঃপর ইহুদের পিছুপিছু ঘাড় নিচু করে চলে যেতে লাগল। পলকহারা সাদইদ খুব আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইল সেদিকে। দুটি চোখ তার ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে এল। এক সিক্ত বেদনার ছায়া চোখের পাতায় ভার হয়ে বসল। তার মনে হল, সবই বৃথা। এই জীবন আর বহন করা যায় না।

রাত্রির হালকা চন্দ্রকিরণে নিঃসঙ্গ সাদইদ সাদা অখের পিঠে ঘুরে বেড়ায়। দেখতে পায় যে মানুষ ক্ষুধায়, শীতে, মড়কে কাহিল, সে ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ে আছে, তাঁবুতে বা গৃহকোণে কিংবা পথের ধূলায়, কাঁকরমেশানো কালো মাটিতে, সাদা বালিতে-ইয়াহোর নাম ধরে আর্তনাদ করছে। মনে হল, মনের কোন্ মহাবল এদের এমন করেছে! সাদইদের কষ্টের সীমা রইল না।

গভীর রাত্রিতে নৌকায় ফিরে এসে সীমাহীন অপমান তাকে বিদ্ধ করতে থাকল। দামী পাথরটার কথা তার বারবার মনে পড়ছিল। হেরার আকুলতা সে ভুলতে পারছিল না। মনে পড়ছিল, মানুষের পথে পড়ে ধুঁকতে ধুঁকতে ইয়াহোর নাম উচ্চারণ করতে করতে মরে যাওয়ার দৃশ্য। এরা তার কাছে হাত পাতবে না। পাপের শস্য গ্রহণ করবে না। তাকে তারা বিশ্বাস করে না। সে লোটার বউকে হরণ করেছে। মানুষকে সে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য উপত্যকায় স্বর্গের ভিত তৈরি করেছে!

সাদইদ রিবিকার ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে ছিল। এই সৌন্দর্য এক জমাট বধিরতা মাত্র, চেয়ে থাকলে স্বাসরোধ হয়ে যায়। রিবিকা চোখ মেললে এই রাত্রে আর সাদইদ সইতে পারবে না। সৌন্দর্যের সেই ভাষার সামনে সে দাঁড়াতে পারবে না। এমন কেন ভয় করছে,সাদইদ বুঝে পায় না। মনে হল, জীবনেও সে আর রিবিকার চোখদুটির দিকে চাইতে পারবে না। মরুভূমিতে কোনওই সৌন্দর্য ছিল না, কিন্তু এই নারী ছিল। জীবনে এমন কেন ঘটেছিল,সাদইদের জানা নেই। লোটা সাদইদকে বিশ্বাস করত, ভাবত, সাদইদ থাকতে তার কোনওই ভয় নেই, মৃত্যুও লোটাকে স্পর্শ করবে না। অথচ মৃত্যু নোটাকে স্পর্শ করেছে, সাদইদ স্পর্শ করেছে লোটার বউকে!

সাদইদ আর ভাবতে পারছিল না। স্বর্গের জন্য এই নারীর নগ্নতা জরুরি, হেরার সামনে একান্ত এই রূপ খুলে বসা দরকার। সবই সত্য! অথচ আজ আর কোন কিছুই সত্য নয়। রিবিকার গায়ের দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে সাদইদ থেমে পড়ল। তার এত কষ্ট হচ্ছিল যে, বুকের ভিতরে যেন একটি মরুভূমি ঢুকে গিয়ে হাহাকার-করা ‘লু’ প্রবাহিত করছিল।

এইভাবে রাত কেটে যাচ্ছিল। সমুদ্র তোলপাড় করছিল। চাঁদ নিবে গিয়ে সমুদ্র কালো হয়ে আসছিল। চোখের সামনের জল যে জল তা আর মনে হল না। হঠাৎ এ কী! অস্পষ্ট উত্তালতার খাঁজে খাঁজে একটি কালো অশ্ব ছুটে বেড়াচ্ছে কেন? ঢেউগুলি যেন স্থির হয়ে পড়ছে মুহূর্তে, তার আড়ালে কালো ঘোড়া! সেই দৃশ্য ভেঙে আবার একই দৃশ্য তৈরি হচ্ছে।

সাদইদ চাইছিল নিচ্ছিদ্র এক অন্ধকার সমুদ্র যাতে আর দেখতে না হয়। চাঁদ শেষ হলেই যেন সমুদ্র শেষ হবে। বাইরে দূরে গাছপালার দিকে চাইল সে–কালো এলোমেলো ছায়া। অন্ধকারে এইবার সে রিবিকার গায়ে হাত দিয়ে ডাকল–চলো রিবিকা, সময় হয়েছে!

রিবিকা অন্ধকারেই উঠে বসল। নৌকা থেকে নেমে এল ওরা। কোনওই কথা বলল না। সাদইদ ভাবছিল, রিবিকা নিশ্চয়ই কিছু বলবে। নির্বাক অশ্ব অতঃপর অন্ধকারেই অগ্রসর হল। সমুদ্র রইল পিছনে, সামনে গ্রাম, তারপর ক্রমশ নদী এগিয়ে আসতে থাকল। নদী পার হল ওরা। রাত শেষ হয়ে আসছে। মরুভূমি থেকে শীত সরে গেছে। শেষরাতে শীতলতা আছে বাতাসে, আকাশের এককোণে মেঘও জমেছে গ্রামগুলির উপর। অন্ধকার ফিকে হয়েছে, মেঘটার দিকে চোখ পড়ল সাদইদের। রাত এভাবে আরো ফুরিয়ে এল।

রিবিকা তবু কোন কথা বলল না। হঠাৎ একটি কুটিরের সামনে এসে অদ্ভুত একটা গানের কলি শুনে থেমে পড়ল সাদইদ। একটি বৃদ্ধা আপনমনে নিশ্চয়ই বলছে না, কারুকে উদ্দেশ করেই বলছে কোন কাহিনী। ফাঁকে ফাঁকে দু’একটি কলি গেয়ে উঠছে।

সারগন এগিয়ে চলেছে সাদা অশ্বে। পিছনে তেড়ে আসছে মৃত্যুর দেবদূত আজরাইল। সারগন বুঝতেই পারছে না। সারগন বুঝতেই বা পারবে কেন? ইয়াহো যাকে পাঠায়, সেই মরণ, তাকে তো দেখা যায় না। যদি সারগন তার আপন হাতে গড়া স্বর্গে পৌঁছে যেতে পারে, মরণের সাধ্য নেই তাকে ছোঁয়ার। সারগন দ্রুত অশ্ব তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে।

অশ্ব থেকে নেমে পড়ল সাদইদ। শুনতে পেল এবার একটা সুর :

‘সারগন যায় উপত্যকার সড়কে–
মানুষ মরে খিদের জ্বালায় মড়কে।
তবু সারগন থামে না, মধুর দেশে দুধের দেশে;
সারগন যায় সিঁড়ির শেষে উপরে, বাতাসে–
সারগন যায় আকাশে, দুধের পথ, তারার আলোর উপরে,
তার গন্ধ বাতাসে, তার শব্দ আকাশে, শহরে ॥’

সাদইদ কুটিরের সামনে এসে দাঁড়াতেই গান থেমে গেল। বৃদ্ধা কিছুক্ষণ পর ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল। অবাক হয়ে চেয়ে রইল সৈনিকের মত দৃপ্ত বলিষ্ঠ সাদইদের দিকে। সাদইদের আজকের পোশাক ছিল সৈনিকেরই মত।

সাদইদ অভিভূত গলায় বলল–আপনি কে? ওই মেয়েটি কি আপনার? বৃদ্ধা বলল–আমি আর কে বাছা! তোমার দয়ায় আমরা বেঁচে আছি। ওটা আমার মেয়ে। আমি বিধবা। তোমাকে আমি কখনও যে আমার কুঁড়ে ঘরের সামনে দেখতে পাব ভাবিনি। এ যে স্বপ্ন বাবা। দাঁড়াও। তোমার স্বর্গে দেবার। জন্য একটা দানসামগ্রী রেখেছি, ভেবেছিলাম মেয়ের বিয়েতে দেব।

বিধবা ঘর থেকে এক টুকরো ধাতু মুঠোয় করে এনে সাইদের দিকে এগিয়ে ধরল।

বলল–নাও। স্বর্গ গড়ে তোল সারগন। খুব তুচ্ছ, কিন্তু হেলা করো না। আমি দিলাম। আমার আর কিছু নেই।

সাদইদ অশ্বের কাছে ফিরে এল। স্বর্গটিকেই যেন সে হাতের মুঠোয় করে ধরে এনেছে। মুহূর্তে সে তার সমস্ত অবস্থার কথা বিস্মৃত হয়েছিল। রিবিকার হাতটা আপন হাতে তুলে নিয়ে একটি তালুতে ধাতুটুকু অর্পণ করে বলল রাখো রিবিকা!

রিবিকা মুঠোয় চেপে ধরে চোখ মুদে কেঁদে ফেলল। তারপর কথা বলে ফেলল, আর সে চুপ করে থাকতে পারল না।

বলল–আমায় দুর্ভিক্ষের মুখে তাঁবুতে ফেলে দিও না সারগন। আমি বাঁচতে চাই। আমি তোমার। সাদইদ! আমাকে এভাবে কেন নিয়ে যাচ্ছ!

সাদইদ বলল–আমি তোমায় ফেলে দেব না রিবিকা। এ অশ্ব এখন উপরে উঠবে। ইয়াহো নয়। ইহুদ নয়। লোটাও নয় রিবিকা। হেরা! একমাত্র হেরা!

তাঁবুর পথ ছেড়ে অশ্ব উপত্যকার দিকে সবেগে ছুটতে শুরু করল। সাদইদ চিৎকার করে উঠল–হেরা!

রিবিকা ফুঁপিয়ে উঠল পাষাণ-বন্দী উড়ন্ত একটি জোনাকির মত, অশুর মত।

.

১২.

হেরা কেবলই রিবিকার পা দু’খানির দিকে চেয়ে ছিল কতকাল। তার শুধু সাদইদের করুণ অসহায় মুখচ্ছবি মনে পড়ত। কিছুতেই হেরা রিবিকার মুখের দিকে চোখ তুলে চাইতে পারত না। অথচ রিবিকার নগ্ন দেহ এবং মুখের অপরূপতা না দেখলে মূর্তি নির্মাণ করা যায় না। হেরা উপত্যকা নিচে স্বর্গের রাস্তা যেখান থেকে সমতল স্পর্শ করে উপরে উঠে এসেছে ঠিক সেই নিম্নভাগে লোটার অশ্বারোহী প্রস্তরমূর্তি খাড়া করেছে। সমস্ত পথ প্রস্তরশোভিত করেছে। উপত্যকায় সুসজ্জিত করেছে বৃক্ষলতাপুষ্প এবং মধুচক্রের বিন্যাস। স্বর্গের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করেছে ঝর্নার স্রোত এবং শান্ত উদ্যানকে বেষ্টন করেছে ছবির মত স্থির জলাশয়। এখানে চিরবসন্ত বিরাজ করবে, এই তার প্রত্যাশা।

কিন্তু রিবিকাকে পাথরে উৎকীর্ণ করার উপায় তার জানা নেই। তার কেবলই। মনে হত, সে রিবিকাকে তুক করার কথা বলেছিল এজন্য যে, নিনিভার মুখশ্রী তাকে মুক্তি দিচ্ছিল না। আজ নিনিভা নষ্ট হয়ে গেছে। সে তবে রিবিকার মুখের দিকে চাইতে পারে। কিন্তু কিছুতেই সে চোখ তুলতে পারল না।

.

এইভাবে কতকাল কেটে গেছে। সে ছুটে গেছে সাদইদের কাছে। বলতে চেয়েছে–আমি পারব না সাদ। রিবিকার নগ্ন দেহ এবং মুখশ্রী দেখলে আমি নিজেকে সংযত রাখতে পারব না। তোমার স্বপ্ন আমার স্পর্শে নষ্ট হবে । তোমাকে আমি নগর দিয়েছি, স্বর্গ চেও না।

সাদইদ বলেছে–আর কতকাল অপেক্ষা করব হেরা! তোমার প্রজাপতি কি উড়ে এল? আমি তোমাকে সর্বস্ব দিয়েছি, আমাকে আমার স্বর্গ উপহার দাও। মরুভূমিতে ছিলাম, একটি মেয়ের রূপ দেখে আমি একটি শিশুর জন্য স্বর্গের কল্পনা করেছি। আমি চেয়ে আছি, তুমি কবে ডাকবে!

হেরা কোন কথা না বলে তার মূর্তির কাছে ফিরে এসেছে। সে কিছুতেই আর শুরু করতে পারছে না! সে রিবিকার পা দু’খানির দিকে চেয়ে আছে। একদিন এভাবে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ হেরার ছায়া পড়ল জলাশয়ের জলে।

হেরার মাথায় বুদ্ধি খেলে ওঠে। হৃদয়ে আলোড়িত হয় ছায়া। সে একটি উচ্চ পাটাতন খাড়া করে। জলাশয়ের উপর, কিনারে বাঁকিয়ে তৈরি করে একটি গোল অর্ধচন্দ্রকলাকৃতি পাটাতন–যার উপর গিয়ে বসে থাকে সে। রিবিকা জলের তলে হেরার ছায়া দেখতে পায় একটি গাছের ছায়ায় বসে–এখানে থাম উঠেছে গৃহের। মানুষ এখানে আড়াল হতে পারে। অথচ জলাশয়ের পতিত ছায়া দেখা যায়।

রিবিকা একদিন অতঃপর পাটাতনের উপর গিয়ে বসে পড়ে। গায়ের কাপড় ফেলে দিয়ে নগ্ন হয়। ছায়ার উপর চোখ পড়ে হেরার। হেরা তার কাজ শুরু করে। হেরা ভালবেসে ফেলে একটি ছায়া। আর কিছু নয়। রিবিকা, নগ্ন রিবিকা ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলে–সে জীবনভর কোন পুরুষকেই পেল না। সে একটা ছায়ামাত্র। মরুভূমির বুকে সে ছিল। স্বর্গেও সে রয়েছে। অথচ সে মানুষ নয়।

রিবিকা আর্তনাদ করল আমায় যেতে দাও হেরা! আমাকে পাষাণে বন্দী করো না।

হেরা বলল–তুমি ছায়া মাত্র। তোমার কথার জবাব আমার জানা নেই রিবিকা! আমাকে কাজ করতে দাও।

রিবিকা চিৎকার করল–আমি যেতে চাই। আমাকে সারগনের কাছে নিয়ে চল।

–কাজ শেষ হলেই তুমি সারগনকে ফিরে পাবে রিবিকা।

–কবে শেষ হবে?

–আর দেরি নেই।

সাদইদের মনে হল, স্বর্গের সেই কক্ষে রিবিকা রয়েছে। তার কি কষ্ট হয় না?

একদিন সে ঘোড়া ছুটিয়ে উপত্যকায় ছুটে এল।

হেরা বলল–কাজ শেষ হয়ে এসেছে। এবার তুমি স্বর্গে প্রবেশ করবে।

–কবে হেরা?

–কালই সাদইদ। কাল প্রত্যুষে–সূর্যোদয়ের মুহূর্তে । সামান্য কাজ বাকি। কক্ষের নারী স্বর্গের বাইরে অশ্বের হেষা শুনে বাবার মত কেঁদে উঠল। মনে হল, এ যেন লোটার কালো ঘোড়া তাকে ডাকছে। হঠাৎ কেন তার এমন মনে হল সে জানে না। মরুভূমি সত্য ছিল না, এই স্বর্গও সত্য নয়। তার নিজেরই আকৃতি এক মরীচিকা মাত্র। সে বাস্তব নয়। তার বিবাহ বাস্তব ছিল না। সে সমুদ্রে মিশালের নৌকায় লুকিয়ে ছিল সে জীবন অবাস্তবই ছিল। তবে এখানে কেন সে রয়েছে! রিবিকার ইচ্ছে করল, সে বাইরে বেরিয়ে পড়ে।

রিবিকা পারল না। সে তার আপন মূর্তির ওপর মাথা কুটতে লাগল। সে একা। স্বৰ্গ কি মানুষকে এরকম একা করে দেয়? চরম এক নিঃসঙ্গতা ছাড়া তার কিছু নেই।

কিন্তু সেই আগামীর প্রত্যুষ আর এল না। সূর্যোদয় হওয়ার আগেই হেরার কাজ চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল। রাত্রির গভীরে তাঁবুর সৈন্যরা এসে হেরার আঙুল কর্তন করে স্বর্গের মেঝেয় ফেলে রেখে চলে গেল। মেঝেয় সর্বাত্মক আর্তনাদ করে গড়াতে থাকল হেরার দেহ। হেরার এই ভয়াবহ আর্তস্বর রাত্রির আকাশকে বিদীর্ণ করতে থাকল।

রিবিকা ভেবেছিল, সৈন্যরা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু তাকে তারা স্পর্শও করল না। একজন কেবল বলল–পবিত্র নারী অশুচি হয়েছে, ওকে স্পর্শ করা পাপ। ওকে শুদ্ধ করার লোক নেই।

নগর ধ্বংসের কাজ শুরু হল। ইহুদের অত বিশাল সৈন্যবাহিনী কোথা থেকে এল কেউ জানে না। সাদইদের স্বল্পসংখ্যক সেনার উপর সেই রাত্রেই অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাদইদ বুঝতেই পারেনি, ইহুদের ধর্ম কতদূর প্রসারিত হয়েছে। তলে তলে কতবড় সংগঠন গড়েছেন তিনি। আসলে ইহুদের সৈন্য শুধু নয়, সাগর-জাতি কনানকে আক্রমণ করল সেই রাতে। যুদ্ধ বাধল।

মিশালের নৌকায় একলা শুয়ে ছিল সাদইদ। একজন জোয়ান সমুদ্রের কিনারে অশ্বের পিঠ থেকে নামল। দিনারের মত আকৃতি। সে ঝুঁকে পড়ল নৌকার কাছে। দড়ি খুলে দিল। স্বপ্নগ্ৰস্ত গভীর নিদ্রামগ্ন সাদইদ ভেসে গেল।

.

সমুদ্র তার হৃদয়ে পরম সমাদরে সাদইদকে টেনে নিল। নৌকা তাকে তুলল, ফেলল। এই দৃশ্যের তরঙ্গের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল। এই দৃশ্যের কোন সাক্ষী রইল না। চাঁদের কিরণ ঝিলমিল করতে থাকল কেবল।

কনান থেকে আবার একটি প্রবাহ চলেছে জেরুজালেমের দিকে। বন্দর নগরীগুলি অতিক্রম করছে সেই স্রোত। কিছু স্রোত ছড়িয়ে পড়েছে মরুভূমির বুকে। মানুষের এই বিপুল প্রবাহ থামতেই চাইছে না। মহাত্মা ইহুদ এদের পথ-নির্দেশ করছেন।

ইহুদ বললেন–মানুষ আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, তাদের আবার গুছিয়ে তুলতে হবে। জেরুজালেমের বুকে হবে শেষ যুদ্ধ। সেখানেই গড়ে তুলতে হবে ইয়াহোর মন্দির। ঈশ্বর প্রত্যাদেশ করেছেন, সাদইদের স্বর্গ ছিল তাঁরই স্বর্গের মত সুন্দর। তাই ইয়াহো সাদইদের স্বর্গের সমস্ত আকৃতি নিজের কাছে তুলে নিয়েছেন। স্বয়ং সাদইদ কোথায় চলে গেছে কেউ জানে না।

একজন বৃদ্ধা হাহাকার করে কেঁদে বলল–লোটা ছিল সাদইদের বন্ধু!

ইহুদ বললেন–সাদইদ জন্মেছিল এক দ্বীপে। সাদইদ প্রসব হওয়ার পর তার মাকে মৃত্যুর দূত হত্যা করেন, মৃত্যুর দূত মাকে হত্যা করার মুহূর্তে কেঁদে ফেলেছিলেন। সাদইদের মৃত্যু যখন হয়, মৃত্যুর দূত আজরাইল ছাড়া তার কাছে। তখন কেউ ছিল না। এই মৃত্যুর নিঃসঙ্গতা কী ভয়াবহ ছিল ওহে আকাশের মালিক ইয়াহো! আজরাইল কত প্রাণ হত্যা করেছেন, কিন্তু কেঁদেছেন মাত্র দু’বার। সাদইদের জন্মের মুহূর্তে এবং মৃত্যুর সময়। কারণ সে স্বর্গে প্রবেশ করতে পারেনি।

মাঝে মাঝে বিশ্রাম নিয়ে আবার চলতে শুরু করে জনস্রোত। একটি উঠের পিঠে আশ্রয় পেয়েছে রিবিকা। উটের রশি ধরে মাথা নিচু করে চলেছে হেরা।

রিবিকা প্রশ্ন করল–তুমি কেন ওভাবে চলেছ হেরা! কোথায় যাবে?

হেরা বলল–আরো একটি নগর নির্মাণের দিকে চলেছি আমরা! এ পথ স্বর্গের দিকে চলেছে রিবিকা।

রিবিকা পিছন ফিরে চেয়ে সজোরে আতশব্দে চেঁচিয়ে উঠল–কিন্তু সারগন কোথা হেরা! কোথায় তাকে রেখে এলে!

হেরা কোন জবাব দিতে পারল না। ঘাড় নিচু করে এগিয়ে যেতে থাকল। হঠাৎ রিবিকা শুধলো–তোমার যে আঙুল নেই হেরা!

হেরা বলল আমার কিছুই নেই। কিন্তু আমি নিনিভে নির্মাণ করেছিলাম। আমি সাদইদের স্বর্গ গড়েছিলাম। রিবিকা! এই কথা মানুষকে বলবার জন্য আমি তোমার সঙ্গে চলেছি। শুধু এক কষ্ট আর বিস্ময় আমার সম্বল।

–আমার যে কেউ রইল না হেরা!

–আমি রইলাম।

–কিন্তু আমাদের যে কেউ আর চায় না স্থপতি। মহাত্মা ইহুদ আর আমায় চিনতে পারেন না। আমরা যে পাপ করেছি।

হেরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল–পাপ!

শুধু এইটুকু উচ্চারণ করেই পথের উপর দাঁড়িয়ে পড়ল হেরা। বুঝতে পারল রিবিকা আর তাকে ইহুদ হত্যা করতে পারেন। কারণ সাদইদ এখন ইতিহাস। কাহিনী-পরাণ। লোটা অমর। ভাবতে ভাবতে উট থেমে পড়ল।

জনস্রোত সামনে এগিয়ে চলেছে। হেরা আর রিবিকা অন্য এক দিগন্তের দিকে পাড়ি জমাল। আকাশে মেঘ জমল, ঝাঁপসা হয়ে এল দিগন্ত। তারাও কাহিনী হয়ে গেছে। তাদের জীবন আর অস্তিত্ব উদ্বাস্তু এই স্রোতের কাছে অনাবশ্যক। এরা তাদের আর চায় না।

দুটি নরনারী অতঃপর একটি জনশূন্য দিগন্তের দিকে চলেছে। এই উট এক জীবনবাহী জীব। তার রয়েছে এক বীর্যবান পুরুষ আর এক ঋতুমতী নারী।

মরুভূমে আবার একটি স্বর্গ তৈরি হবে। অতএব এখান থেকে ফের শুরু হল হেরা আর রিবিকার অভিযাত্রা।

পিছন থেকে বাতাস যেন বলে উঠল–আমার স্বর্গ আর কতদূর হেরা!

হেরা পিছনে চাইলে, সমুদ্র উত্তাল হয়েছে।

Exit mobile version