Site icon BnBoi.Com

মেঘের ওপর বাড়ি – হুমায়ূন আহমেদ

মেঘের ওপর বাড়ি - হুমায়ূন আহমেদ

আমি মারা গেছি, নাকি মারা যাচ্ছি

আমি মারা গেছি, নাকি মারা যাচ্ছি—এখনো বুঝতে পারছি না। মনে হয়, মারা গেছি। মৃত অবস্থা থেকে অলৌকিকভাবে যারা বেঁচে ওঠে, তাদের মৃত্যু-অভিজ্ঞতা হয়। এর নাম এনডিই (নিয়ার ডেথ এক্সপিরিয়েন্স)। বাংলায় মৃত্যু-অভিজ্ঞতা। তারা সবাই দেখে, লম্বা এক সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে তারা যাচ্ছে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় চোখধাঁধানো আলো। এই আলোর চুম্বকের মতো আকর্ষণী ক্ষমতা। কঠিন আকর্ষণে অন্ধের মতো আলোর দিকে এগিয়ে যেতে হয়।

আমি কোনো সুড়ঙ্গ দেখছি না। সুড়ঙ্গের মাথায় আলোও না। তবে নিজেকে দেখতে পাচ্ছি। জীবিত অবস্থায় কোনো মানুষেরই (আয়নার সামনে ছাড়া) নিজেকে দেখার উপায় নেই। আমি যেহেতু নিজেকে দেখছি, কাজেই ধরে নিতে পারি, আমি মারা গেছি। নিজেকে দেখে আমার মায়া লাগছে। হাসপাতালের কেবিনে ডান দিকে পাশ ফিরে আমি শুয়ে আছি। নাকে অক্সিজেনের নল। বাঁ হাতে ক্যানোলা লাগানো। ক্যানোলা দিয়ে রক্তের শিরায় স্যালাইন যাচ্ছে। স্যালাইনের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক। নাভির নিচে একটা ফুটো করা হয়েছে। কেন করেছে, কে জানে।

মোবাইল ফোনের শব্দ হচ্ছে। আমি যেদিক ফিরে শুয়ে আছি, শব্দটা আসছে তার উল্টো দিক থেকে। রুবিনার মোবাইল ফোন। আমি মাথা না ঘুরিয়েই রুবিনাকে দেখলাম। রোগীর অ্যাটেনডেন্টের ডিভানে সে শুয়ে আছে। ডিভানটা ছোট। তার একটা পা বিছানার বাইরে। অন্য পা গোটানো। বেচারি বালিশ ছাড়া ঘুমাচ্ছে।

রুবিনা ঘুমের মধ্যেই বলল, কে?

ওপাশ থেকে বলল, আমি জুঁই। ভাইয়া কেমন আছে?

ভালো আছে। তোমার ভাইয়া ভালো।

ভাইয়া কি ঘুমাচ্ছে?

ঘুমাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে। রাখি, কেমন? আই লাভ ইউ।

রুবিনা টেলিফোন হাতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে বলল, প্রতিবার রাত তিনটায় টেলিফোন। দিনে কী করিস? ফাক ইউ বিচ!

রুবিনার টেলিফোনের কথাবার্তা শুনে কয়েকটা জিনিস স্পষ্ট হলো। মৃত মানুষ টেলিফোনের ওপাশ থেকে যে কথা বলে, তার কথা স্পষ্ট শুনতে পায়। কেউ মনে মনে কোনো কথা বললে তা-ও শুনতে পায়। এ জন্যই ‘ফাক ইউ বিচ’ এত পরিষ্কার শুনেছি।

এত রাতে জুঁই নামের কে টেলিফোন করল? চিনতে পারছি না তো!

নতুন পরিবেশে নিজেকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করছি। জীবিত অবস্থায় আমার চারপাশের পৃথিবী যেমন ছিল, এখন তেমন নেই। কিছু গুণগত পরিবর্তন হয়েছে। আলো অনেক কোমল হয়ে গেছে। লেন্সে হালকা জেলি লাগিয়ে ছবি তুললে ছবি যেমন কোমল দেখায়, তেমন। রুবিনা যে ডিভানে শুয়ে আছে, তার কিনারা কোমল। ইংরেজিতে সহজ করে বলি—নো শার্প এজেস।

টুপ করে শব্দ হলো। রুবিনার হাতে ধরা মোবাইল ফোন মেঝেতে পড়ে গেছে। যেখানে পড়েছে, তার কাছেই রাশি বিচারের একটা বই। বইয়ের নাম সাল সাইন লেখিকা লিন্ডা গুডম্যান। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পা দুলিয়ে দুলিয়ে রুবিনা এই বই পড়ছিল এবং বলছিল, আশ্চর্য, সব মিলে যাচ্ছে। কী লিখেছে পড়ে শোনাব?

আমি বললাম, না।

আমার বুকে তখন প্রচণ্ড চাপ। নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে। দুটা কান বন্ধ। প্লেন অনেক ওপরে উঠলে কান যেমন বন্ধ হয়, তেমন। আমি ঘন ঘন সেঁক গিলে কানের তবদা ভাব কাটানোর চেষ্টা করছি, এই সময় রাশিফলের কথা শুনতে ইচ্ছে করে না।

আমার না’ কোনো কাজে দিল না। রুবিনা পড়তে শুরু করল, ‘লিব্রানস লাভ পিপল, বাট দে হেইট লার্জ ক্রাউড়। এই শুনছ?

শুনছি।

আমরা মানুষ পছন্দ করলেও জনতা পছন্দ করি না। আরও শোনো, লিব্রা ইজ অল লাভ অ্যান্ড বিউটি অ্যান্ড সুইটনেস অ্যান্ড লাইট। পড়তে পড়তে রুবিনা সিগারেট ধরাল। এমনিতেই নিঃশ্বাস নিতে পারছি না, তার ওপর সিগারেটের কটু গন্ধ। আমি ক্লান্ত গলায় বললাম, সিগারেট ফেলো।

রুবিনা বলল, দুটা টান দিয়ে ফেলে দেব।

টয়লেটে চলে যাও, টয়লেটে দরজা বন্ধ করে সিগারেট টানো।

রুবিনা বই হাতে টয়লেটে ঢুকে গেল। আমি বললাম, দরজাটা বন্ধ করো, প্লিজ।

রুবিনা বলল, পারব না।

কিছুক্ষণ পর তার হাসির শব্দ শুনলাম। রাশিফলের বইয়ে এমন কী লেখা থাকতে পারে যে সে খিলখিল শব্দ করে হাসছে! টয়লেট থেকে সিগারেটের দুর্গন্ধ আসছে, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফিনাইলের গন্ধ। টয়লেটের বেসিনের একটা কল নষ্ট, সারাক্ষণ টিপটিপ করে পানি পড়ে। পানি পড়ার শব্দটা আগে কঠিনভাবে কানে লাগত। মনে হতো, নখ দিয়ে কেউ ব্ল্যাকবোর্ডে আঁচড়াচ্ছে।

এখন অবস্থা ভিন্ন। বেসিনের কল দিয়ে পানি পড়ছে, আমি তার শব্দ পাচ্ছি। শব্দটা আমাকে পীড়িত করছে না, বরং শুনতে ভালো লাগছে। যেন পানির ফোঁটা পড়ার শব্দটায় লুকানো গল্প আছে। গল্পটা কী ভাবতেই মনে পড়ল। গল্পটার নাম ‘ফুড়ুৎ’। পানির ফোঁটা পড়ছে আর ফুড়ুৎ শব্দ হচ্ছে। খুব ছোটবেলায় বাবা গল্প করছেন, আমি তার সামনে দুই হাঁটু গেড়ে কুকুরের মতো বসে আছি। মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছি–

এক দেশে ছিল হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি পাখি। পাখির যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে রাজা বললেন, ‘সব পাখি জালে বন্দী করো। প্রকাণ্ড জাল বানাও।’ রাজার হুকুমে প্রকাণ্ড জাল বানানো হলো। জাল দিয়ে সব পাখি আটকে ফেলা হলো। জালের এক কোনায় একটা ছিদ্র ছিল, এটা কেউ লক্ষ করেনি। ছিদ্র দিয়ে একটা হলুদ পাখি ফুড়ুৎ করে বের হয়ে গেল।

এই বলে বাবা গল্প থামাতেই আমি বললাম, তারপর?

বাবা বললেন, ফুড়ুৎ।

আমি বললাম, ফুড়ুৎ কী?

বাবা বললেন, ফুড়ুৎ করে আরেকটা পাখি চলে গেছে।

আমি বললাম, তারপর?

বাবা বললেন, ফুড়ুৎ।

তারপর কী?

ফুড়ৎ।

আমি বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বললাম, তারপর?

বাবা বললেন, ফুড়ুৎ।

আমি বললাম, সবগুলো পাখি কখন বের হবে?

বাবা বললেন, যেদিন তুই মারা যাবি, সেদিন। তার আগে না।

আমি মারা গেছি।

বাবার কথানুসারে সব পাখি জাল থেকে বের হয়েছে। তবে তাদের ফুড়ুৎ করে ওড়ার শব্দ রেখে গেছে। টয়লেটের কল ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করেই যাচ্ছে। শব্দটা মিষ্টি লাগছে। গাছের পাতা থেকে শিশির পড়ার মতো। আলো যেমন কোমল হয়ে গেছে, শব্দও কোমল হয়েছে। যত সময় যাবে, ততই মনে হয় কোমল হবে।

আলো ও শব্দ—দুটোই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। মৃত মানুষের ইন্দ্রিয় কোথায়? আলো কীভাবে দেখছি? শব্দই বা কীভাবে শুনছি? আমার আলাদা অস্তিত্বও নেই। আমি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছি না। জীবিত অবস্থায় ভূত-প্রেতের ছবি রুবিনার সঙ্গে দেখেছি। হরর ছবি তার খুব পছন্দ। দ্য হুইপ অ্যান্ড দ্য ফ্লেশ, ওমেন, ফ্রাইডে দ্য থারটিনথ—এসব ছবিতে ভূত-প্রেতের আলাদা অস্তিত্ব আছে। তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে। তাদের গায়ে কাপড় থাকে। নগ্ন ভূত-পেত্নী কখনো দেখিনি।

এখন বুঝতে পারছি, এই অংশগুলো ঠিক না। যার কোনো অস্তিত্ব নেই, তার জামাকাপড় পরারও কিছু নেই।

পাশের বিছানায় খচমচ শব্দ হচ্ছে। রুবিনা উঠে বসেছে। চোখ ডলছে। মেঝেতে পড়ে থাকা মোবাইল ফোনসেট উঠিয়ে নিয়ে হাই তুলে কী যেন দেখল। সময় দেখল। বড় করে হাই তুলে ঘুমাতে গিয়েও গেল না; টয়লেটের দিকে রওনা হলো। হাতে সিগারেটের প্যাকেট।

সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছি। প্রথমবার যেমন তীব্র লেগেছিল, এখন তেমন লাগছে না; বরং ভালো লাগছে। রুবিনা নিজের মনে কথা বলছে। তার একা একা কথা বলার বাতিক আছে। সে বলছে, গাধাটার কানে মলা দেওয়া দরকার। গাধার বাচ্চা গাধা। চৌদ্দগুষ্টি গাধা।

রুবিনা বিশেষ কাউকে গাধা বলছে, নাকি নিজের মনে এমনি কথা বলছে? এখন বুঝতে পারছি, রুবিনা গাধা বলছে কাদেরকে। কাদের আমাদের বাসার কেয়ারটেকার। সে সম্ভবত চোর, তবে গাধা না। গাধারা চোর হতে পারে না।

মৃত মানুষ অন্যের মনের কথা ধরতে পারবে, এটা জানা ছিল না। টেলিপ্যাথি নিয়ে অনেক কথা হয়। আমেরিকার এক ইউনিভার্সিটিতে তো টেলিপ্যাথি নিয়ে গবেষণার জন্য আলাদা ডিপার্টমেন্টই আছে। গবেষণার ফলাফল শূন্য। তারা বলতে বাধ্য হয়েছে মানুষের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা নেই। এখন বুঝতে পারছি, টেলিপ্যাথি মৃত্যুর পরের ব্যাপার।

দরজা খুলে একজন নার্স ঢুকেছে। সে চোখমুখ কুঁচকে বলল, কে সিগারেট খাচ্ছে?

বাথরুম থেকে রুবিনা বলল, আমি খাচ্ছি।

কেবিনে সিগারেট খেতে পারবেন না।

কেবিনে তো খাচ্ছি না। টয়লেটে খাচ্ছি।

টয়লেটেও খেতে পারবেন না। সিগারেট খেতে হলে হসপিটালের বাইরে গিয়ে খেতে হবে।

রুবিনা বলল, রাত তিনটা পঁয়তাল্লিশে আমি হাসপাতালের বাইরে কোথায় যাব! গুন্ডারা ধরে নিয়ে গিয়ে আমাকে যদি রেপ করে, তখন উপায় কী হবে?

এই নার্স আজই প্রথম ডিউটিতে এসেছে, রুবিনার কথা বলার ভঙ্গির সঙ্গে সে পরিচিত নয়। নার্স খানিকটা হকচকিয়ে গেল। আমি লাইটার জ্বালানোর শব্দ শুনলাম। পর পর দুটা সিগারেট রুবিনা খায় না। দ্বিতীয় সিগারেট সে ধরাল নার্সকে রাগিয়ে দেওয়ার জন্য। রুবিনা গলা উঁচিয়ে বলল, সিস্টার, এক কাজ করুন, আমার বিরুদ্ধে একটা কমপ্লেইন করে দিন।

নার্স মুখ শক্ত করে আমার বিছানার দিকে এগিয়ে এলো। ক্যানোলা দেখল, স্যালাইনের টিউব নেড়েচেড়ে দেখে হঠাৎ চিৎকার করল, ম্যাডাম, রোগী মনে হয় মারা গেছে।

রুবিনা এই আর্তচিঙ্কারের কোনো জবাব দিল না। নার্স আবার বলল, ম্যাডাম, আসুন। রোগী মনে হয় মারা গেছে।

রুবিনা বলল, মনে হয় মনে হয় বলছেন কেন? ডিউটি ডাক্তারকে ডেকে আনুন। ডাক্তার দেখে বলুক।

নার্স দ্রুত ঘর ছেড়ে বের হতে গিয়ে দরজায় বাড়ি খেল। টয়লেট থেকে রুবিনা বলল, ক্যালাস লেডি! দরজা-জানালা ভেঙে ফেলছে।

আমি কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছি। আমার অবস্থা এখন সবাই জানবে। অন্য রকম উত্তেজনা, অন্য রকম কর্মকাণ্ড শুরু হবে।

রুবিনা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে দেখে মনে মনে অনেকবার বলা একটি বাক্য আবারও বললাম, একজন তরুণী এত সুন্দর হয় কীভাবে!

এই অতি রূপবতীর সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেন বড় মামা হাবিবুর রহমান। মগবাজারে তার একটা ফার্মেসি আছে। ফার্মেসির সঙ্গে মোবাইল ফোনের ব্যবসা। এই ফার্মেসিতে রুবিনা এক সন্ধ্যাবেলায় এসে বলল, কুড়িটা কড়া ঘুমের ওষুধ দিন তো।

বড় মামা বললেন, এতগুলো ঘুমের ওষুধ দিয়ে কী করবেন?

রুবিনা বলল, সুইসাইড করব। কুড়িটায় হবে না?

এতগুলো ঘুমের ওষুধ দিতে পারব না।

একটা দিতে পারবেন? একটা দিন। কুড়িটা ফার্মেসিতে যাব, সবার কাছ থেকে একটা করে কিনব। পরিশ্রম বেশি হবে, কী আর করা? ওয়ার্ক ফর ডেথ। কাজের বিনিময়ে মৃত্যু। আপনি এমন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন কেন? নাকি একটা ঘুমের ওষুধও বিক্রি করবেন না।

বড় মামা একটা ট্যাবলেট দিলেন। রুবিনা ট্যাবলেট মুখে দিয়ে তার সামনেই পানি ছাড়া গিলে ফেলল। ট্যাবলেটের দাম দিয়ে গেল না। রুবিনা পরদিন নিজ থেকেই এল ট্যাবলেটের দাম দিতে।

বড় মামা যেকোনো মানুষের সঙ্গে অতিদ্রুত ঘনিষ্ঠতা করতে পারেন। রুবিনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হতে তাঁর মোটেই সময় লাগল না। মাঝেমধ্যেই

সে মামার ফার্মেসিতে সানগ্লাসে চোখ ঢেকে বসে থাকত।

আমার সঙ্গে রুবিনার মামার ফার্মেসিতেই প্রথম দেখা। প্রথম দেখাতে বুকে ধাক্কার মতো লাগল। কাউন্টারের পেছনে হলুদ পরি বসে আছে। আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। রুবিনা বলল, কী লাগবে, বলুন? তার প্রশ্নে আমার থতোমতো ভাব কাটল না, বরং আরও বাড়ল। আমি গেছি মামার খোঁজে। মামা ফার্মেসিতে নেই। এই হলুদ পরিকে কী বলব? বড় মামার খোঁজে এসেছি? বড় মামা বললে কি এই মেয়েটি চিনবে? নাকি বড় মামার নাম বলব? আমার মাথার ভেতর এতই জট পাকিয়ে গেছে যে কিছুতেই বড় মামার নাম মনে করতে পারলাম না।

রুবিনা বলল, কোনো কাজ ছাড়া ফার্মেসির সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। সুন্দরী মেয়ে দেখলেই তাকিয়ে থাকার কিছু নেই। এই বলে রুবিনা হাই তুলল। হাই তুললে পৃথিবীর সব মানুষকেই কুৎসিত দেখায়। এই মেয়েটির বেলায় মনে হলো, তার হাই তোলাও একটি নান্দনিক দৃশ্য।

এই হলুদ পরির সঙ্গে বড় মামা আমার বিয়ের ব্যবস্থা কীভাবে করলেন, সেটা ভালোমতো জানি না। বিয়ের কথাবার্তা অনেক দূর এগোনোর পর রুবিনার সঙ্গে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। রুবিনা স্যুপে চুমুক দিয়ে ঠোট বাঁকিয়ে ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ স্যুপের বাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, স্যুপে তেলাপোকার গন্ধ পাচ্ছেন?

আমি বললাম, না।

চট করে না বলে ফেললেন? তেলাপোকার গায়ের গন্ধ কেমন, সেটা জানেন?

না।

রুবিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, যদি সত্যি সত্যি আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়, তাহলে তেলাপোকা ধরে তার গায়ের গন্ধ আপনাকে শোকাব।

আচ্ছা।

আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অনেকের সঙ্গেই আমার বিয়ের কথা হয়েছে। কয়েকবার এনগেজমেন্ট পর্যন্ত হয়ে গেছে, কিন্তু বিয়ে হয়নি। আমিও তাদের আংটি ফেরত দিইনি। এখন যে আংটি পরে আছি, সেটা এনগেজমেন্টের আংটি। আংটির পাথরটা হীরার। কত বড় হীরা, দেখেছেন?

হুঁ।

আসল হীরা না। নকল হীরা। আমেরিকান ডায়মন্ড। আশ্চর্য, আপনি তো দেখি তেলাপোকার গন্ধওয়ালা স্যুপ খেয়ে শেষ করে ফেলেছেন। আরেক বাটি খাবেন? আমারটা খেয়ে ফেলুন।

না।

খাবেন না কেন? আমি মুখ দিয়েছি সেই জন্য? আপনার কি মনে হচ্ছে যে, আমার শরীরের জীবাণু আপনার শরীরে ঢুকে যাবে?

আমি চুপ করে রইলাম। রুবিনা বলল, একজন স্বামী তার স্ত্রীকে যখন গ্রহণ করে, তার জীবাণুসহই গ্রহণ করে। আমাকে বিয়ে করতে চাইলে, আমাকে জীবাণুসহই গ্রহণ করতে হবে। রাজি আছেন?

হ্যাঁ, রাজি আছি।

তাহলে আমার মুখ দেওয়া স্যুপটা খেয়ে ফেলুন। পুরোটা খেতে হবে না। কয়েক চামচ খেলেই হবে।

আমি স্যুপের চামচে মুখ দিলাম। হঠাৎ রুবিনার দিকে চোখ পড়তেই দেখি, সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে। এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমরা সাধারণত একজন আরেকজনের দিকে তাকাই না।

এই মুহূর্তে রুবিনা আমার সামনে। তার চোখে সেই পুরোনো অদ্ভুত দৃষ্টি। কিছুটা কৌতূহল, কিছুটা বিস্ময়, অনেকখানি বেদনা। রুবিনা আমার কপালে হাত রাখল। সেই হাত শীতল, না উষ্ণ—বুঝতে পারলাম না। মৃত মানুষের হয়তো বা স্পর্শানুভূতি নেই। ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। মৃত মানুষ যদি দেখতে পারে, যদি শুনতে পারে, তাহলে স্পর্শানুভূতি তার কেন থাকবে না? আমি তো গন্ধও পাচ্ছি। কপালের ওপর রাখা তার হাত থেকে সিগারেটের গন্ধ আসছে।

রুবিনা বিড়বিড় করে বলল, গাধী নার্স। বলে কী, মনে হয় মারা গেছে। মানুষটা আরাম করে ঘুমাচ্ছে। এই নার্সটাকে কাপড় খুলে পাছায় লাথি দিয়ে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়া দরকার।

রুবিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই নার্স ডাক্তার নিয়ে ঢুকল। ডাক্তার আমার নাড়ি ধরল। তাকে তেমন বিচলিত মনে হলো না। সে চোখের পাতা খুলে চোখের মণিতে টর্চ ফেলল। চোখে টর্চ ধরলে আমরা আলো ছাড়া কিছুই দেখি না। কিন্তু আমার দেখতে সমস্যা হচ্ছে না। নার্সের ভীত মুখ দেখছি, রুবিনার কৌতূহলী মুখ দেখছি, ডাক্তারের নির্বিকার মুখ দেখছি।

ডাক্তার আমার বিছানার পাশে বসে ছিল। সে উঠে দাঁড়াল। অ্যাপ্রনের পকেট থেকে স্টেথোস্কোপ বের করে আবার রেখে দিল। খানিকটা ইতস্তত ভঙ্গি করে বলল, ম্যাডাম, পেশেন্ট মারা গেছে।

ডাক্তার মনে হয় রুবিনার কাছ থেকে আর্তচিৎকার আশা করেছিল। সে রকম কিছু না দেখে ডাক্তার বিস্মিত।

রুবিনা সিগারেটের প্যাকেট হাতে নিতে নিতে বলল, আমাকে সিগারেট ধরাতে হবে।

ডাক্তার বলল, ধরান, সিগারেট ধরান। অসুবিধা নেই।

রুবিনা বলল, ওর চোখের পাতাটা বন্ধ করে দিন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

নার্স চোখের পাতা বন্ধ করল না, তবে চাদর দিয়ে আমাকে পুরোপুরি ঢেকে দিল। এতে আমার দেখতে অসুবিধা হচ্ছে না। সবকিছু আগের মতোই দেখছি। এর অর্থ, আমি দেখার জন্য আমার শরীর ব্যবহার করছি না। রুবিনা সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে বলল, টাইম কত দেখুন তো ডাক্তার সাহেব? কখন মারা গেছে, সবাই জানতে চাইবে।

তিনটা ছয়চল্লিশ মিনিট।

রুবিনা বলল, কতক্ষণ আগে মারা গেছে বলে আপনার ধারণা?

ডাক্তার বলল, বেশি আগে না। অল্প আগে।

রুবিনা বলল, এমন কোনো সম্ভাবনা কি আছে, সে চাদর সরিয়ে উঠে বসে পানি খেতে চাইবে?

ডাক্তার-নার্স মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। রুবিনা বলল, আপনারা চলে যান, আমাকে একটু একা থাকতে দিন।

ডাক্তার বলল, ডেডবডি সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করি।

রুবিনা বলল, না।

নার্স বলল, আমরা চলে গেলে আপনি ভয় পাবেন।

রুবিনা বলল, ভয় পাব কেন? জীবিত মানুষকে ভয় পাওয়ার ব্যাপার আছে। মৃত মানুষকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সে যদি জেগে উঠে বলে, এক গ্লাস পানি খাব, আমি খুব স্বাভাবিক গলায় বলব—ঠান্ডা পানি দেব, না নরমাল?

ডাক্তার বলল, আপনার আত্মীয়স্বজন কাউকে খবর দেব?

রুবিনা বলল, খবর আমিই দেব। আপনারা ডেথ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করুন।

ডাক্তার ও নার্স চলে যাওয়ার পর পর রুবিনা আমার মুখের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে দিল। পানির বোতল থেকে পানি খেল। বিরক্ত গলায় বলল, এখনো স্যালাইন যাচ্ছে। এইসব খুলে নাই কেন! গাধা নার্স, গাধা ডাক্তার!

রুবিনা মোবাইল নিয়ে তার বিছানায় আধা শোয়া হয়ে বসেছে। তার হাতে সিগারেটের প্যাকেট। নতুন একটা স্টিক আঙুলের পাশে ধরা। এখনো জ্বালানো হয়নি।

হ্যালো। কাদের কাদের? আমার গলা শুনে বুঝতে পারছ না, আমি কে? খামাখা কে কে করছ। তোমার মোবাইলে তো আমার নাম ওঠার কথা। নাম উঠেছে কিনা দেখো।

ম্যাডাম, উঠেছে।

আমি দুজনের কথাবার্তাই পরিষ্কার শুনছি। কাদেরের গলা শুনে মনে হচ্ছে, তার ঘুম এখনো কাটেনি।

কাদের, মন দিয়ে শুনছ?

জি, ম্যাডাম।

তোমার স্যার মারা গেছেন।

কী সর্বনাশ! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। কখন মারা গেছেন?

কখন মারা গেছেন, এটা ইম্পর্টেন্ট না। মারা গেছেন, এটা ইম্পর্টেন্ট। তুমি গাড়ি পাঠাও, আমি বাসায় ফিরব। হট শাওয়ার নেব।

সবাইকে খবর দিব, ম্যাডাম?

এত রাতে কাউকে খবর দেওয়ার কিছু নেই। সবাই ঘুমাচ্ছে। সকাল সাড়ে আটটার পর খবর দেওয়া শুরু করবে।

জি, আচ্ছা, ম্যাডাম।

সবাই বাসায় আসার জন্য ব্যস্ত হবে। তাদের বলবে, ডেডবড়ি বাসায় নেই।

হাসপাতালে আছে বলব?

না। বলবে কবর হবে তোমার স্যারের বাবার কবরের পাশে। ডেডবড়ি নিয়ে গাড়ি রওনা হয়ে গেছে।

অনেকেই যেতে চাইবে।

যারা যেতে চাইবে, তারা নিজ ব্যবস্থায় যাবে। বুঝেছ?

পলিন আপুকে কি খবর দেব?

পলিন ঘুমাচ্ছে না?

জি।

পলিন খুব স্বাভাবিক মেয়ে না, এটা তুমি জানো।

ঘুম ভাঙিয়ে তাকে দুঃসংবাদ দেওয়ার কী আছে? এ রকম একটা খবর শুনলে সে কী করবে, সেটা তুমিও জানেন না, আমিও জানি না। সকাল নয়টার সময় তুমি রবিকে টেলিফোন করবে। সে নয়টার আগে ওঠে না। ডেডবডি নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়া, দাফনের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তার। আমি এখন আমার মোবাইল অফ করে দিচ্ছি। ড্রাইভার এখনই পাঠাও।

জি, ম্যাডাম।

কাঁদছ নাকি? কাঁদার কিছু নাই। জন্মালে মরতে হয়। তুমি মরবে, আমি মরব। তোমার পুরা গোষ্ঠী মরবে, আমার পুরা গোষ্ঠী মরবে। ঠিক না?

জি, ম্যাডাম।

আমার শোবার ঘরের এসি ছেড়ে ঘরটা ঠান্ডা করে রাখো। বাসায় ফিরে আমি কিছুক্ষণ রেস্ট নেব।

জি, ম্যাডাম।

.

রুবিনা সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে কাপড় বদলাচ্ছে। আমি একজন মৃত মানুষ, তার পরেও আতঙ্কে অস্থির। দরজা লক করা না। যেকোনো সময় যে-কেউ কেবিনে ঢুকতে পারে। আমি চোখ বন্ধ করার চেষ্টা করলাম, চোখ বন্ধ করা গেল না। সব আমার চোখের সামনেই ঘটছে। জীবিত অবস্থায় কোনো কিছু দেখতে না চাইলে চোখ বন্ধ করতাম, এখন তা সম্ভব না? সবকিছুই আমাকে দেখতে হবে?

কেবিনের দরজা খুলে নার্স ঢুকল। বাঁচা গেছে, এর মধ্যে রুবিনার কাপড় বদলানো হয়ে গেছে। ড্রেস বদলানোর কাজটা সে অত্যন্ত দ্রুত করতে পারে।

নার্স বলল, ম্যাডাম আপনি কি চলে যাচ্ছেন?

হুঁ।

ডেডবডি নিয়ে যাবেন না?

রুবিনা বলল, না। আপনারা রেখে দিন।

নার্স হতাশ চোখে তাকাচ্ছে। তাকে হতাশ অবস্থায় রেখে রুবিনা বের হয়ে গেল। আমার বলতে ইচ্ছা করছে, সিস্টার! আমার স্ত্রীর ব্যবহারে আপনি মন খারাপ করবেন না। সে এ রকমই। ডেডবডি সে ফেলে রেখে যাবে না। যথাসময়ে নিয়ে যাবে। সে বাসায় যাচ্ছে। হট শাওয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ এসি রুমে বিশ্রাম করবে। তারপর সব ব্যবস্থা হবে।

আমি বলতে চাচ্ছি, কিন্তু বলতে পারছি না। এটা তো ঠিক না। আমাকে কথা শোনার শক্তি দেওয়া হয়েছে, কথা বলার শক্তি কেন দেওয়া হবে না?

কেবিনে আরও দুজন ঢুকেছে। এরা ওয়ার্ডবয় বা এ রকম কিছু। হাতের ক্যানোলা থেকে নল সরিয়ে, বেড টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় নিচ্ছে, কে জানে। আমি হঠাৎ অস্থির বোধ করলাম, বেডের সঙ্গে সঙ্গে আমিও কি যাব? না কি আমাকে এ ঘরেই থাকতে হবে। আমার আলাদা কোনো শরীর থাকলে, হাত-পা থাকলে আমার ডেডবড়ি যেখানে যাচ্ছে, সেখানে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম। আমার তো শরীর নেই। যা আছে তা খুব সম্ভব চেতনা। চেতনা কি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে? নাকি আমার চেতনা এই ঘরেই সীমাবদ্ধ। এখানে যা হবে, শুধু তা-ই আমি জানব। বাইরের কিছু জানব না, এটা তো ঠিক না! ভেরি আনফেয়ার।

যা ভয় করেছিলাম তা-ই, আমি কেবিন-ঘরে আটকা পড়ে আছি। ওয়ার্ডবয় দুজন ঘর পরিষ্কার করছে। মপ দিয়ে মুছছে। ঘরে স্প্রে করছে। বাথরুম ধুচ্ছে। মৃত্যু কি অশুচি বিষয়? যেখানে কেউ মারা যায়, সেই জায়গা কি অশুচি হয়ে যায়?

ওয়ার্ডবয় দুজন নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। দুজনের গলাই চনমনে। কথা বলেও আনন্দ পাচ্ছে। কথার বিষয়বস্তু হলো, তাদের স্যারের এক ভিডিও মোবাইলে ছাড়া হয়েছে। ভিডিওটা খুব স্পষ্ট নয়, তবে তাদের স্যারকে বোঝা যায়। কিন্তু মেয়েটাকে চেনা যায় না। নার্সের পোশাক পরা মেয়ে। একবারও তার চেহারা দেখা যায়নি।

একজন বলল, ভিডিও ঠিকমতো করতে পারে নাই। প্রথমেই দুজনের চেহারা দেখানো উচিত ছিল। বাকিটা পরে দেখালে চলত।

দ্বিতীয়জন বলল, ক্যামেরাও ঠিকমতো ধরতে পারে নাই। হাত কাঁপছে।

মেয়েটা ভ্যা ভ্যা করে কানছে। কী জন্য, এটা তো বুঝলাম না। প্রথমে তো হাসিখুশি ছিল।

হাসিখুশি বুঝলা কেমনে, মুখ তো দেখ নাই?

হাসির শব্দ শুনলাম না?

মনে হয় প্রথমেও কানছে। মুখ না দেখা গেলে হাসির শব্দ, কান্দনের শব্দ সব এক রকম।

এটা কী বললা?

হ্যাঁ। একবার আমার পুলার কান্দন শুইনা দৌড়ে গিয়া দেখি, সে হাসতেছে।

জটিল কথা বলো তো। হাসি আর কান্দনের শব্দ একই।

তারা মূল আলোচনা থেকে সরে গেছে। হাসি-কান্নার শব্দ অ্যানালাইসিস হচ্ছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার, আমি তাদের স্যারের ভিডিও দেখার জন্য আগ্রহ বোধ করছি। ভিডিও দেখে মেয়েটা হাসছে না কাঁদছে, সেটা জানার চেষ্টা। মৃত্যুর পরও কি যৌনচেতনা থেকে যায়? নিশ্চয়ই থাকে। না থাকলে নোংরা ভিডিও দেখার ইচ্ছে হতো না। কোনো যুক্তিতেই মৃত্যুর পরের যৌনচেতনার বিষয়টা গ্রহণ করা যাচ্ছে না। পুরুষ যুবতী তরুণীর প্রতি শারীরিক আকর্ষণ বোধ করে, তার কারণ প্রকৃতি চায় মানবজাতির অস্তিত্ব টিকে থাকুক, তারা বংশবিস্তার করুক।

একজন মৃত পুরুষ কোনো মৃত তরুণীর প্রতি যৌন আকর্ষণ বোধ করবে না। কারণ, তাদের বংশবিস্তারের কিছু নেই। শরীরই নেই, বংশবিস্তার অনেক পরের ব্যাপার।

ওয়ার্ডবয় দুজন চলে গেছে। আমি কেবিনঘরে আটকা পড়ে আছি। আমার শরীর কোথায় জানি না। রুবিনা কোথায় কী করছে, তা-ও জানি না।

মৃত্যুর পর অতি অচেনা এক জগতে আমি ঢুকে পড়েছি। প্রথম বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গে এর কিছুটা মিল আছে। বিদেশেও বাড়িঘর আছে, মানুষ আছে; কিন্তু সবই কিছুটা আলাদা। ওদের ভাষা আলাদা, নিয়মনীতি আলাদা। রাস্তাঘাট সবই অচেনা।

বিদেশ ভ্রমণে একজন গাইড খুব প্রয়োজন। যে সবকিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে। রাস্তাঘাট চেনাবে। দর্শনীয় জায়গা দেখাবে। পরকালেও আমাদের একজন গাইড দরকার। আমি তো জানতাম, মৃত্যুর সময় মৃত আত্মীয়স্বজনেরা চারদিকে ভিড় করে। তাদের প্রধান চেষ্টা অপরিচিত ভুবনে মৃতের যাত্রা সহজ করে দেওয়া।

আমার সবচেয়ে ছোট ফুফু ক্যানসারে মারা গিয়েছিলেন। তীব্র ব্যথায় দিনরাত পশুর মতো গোঙাতেন। ব্যথা কমানোর কোনো ওষুধপত্র তাঁর জন্য কাজ করছিল না। তার কষ্ট বর্ণনার অতীত। মৃত্যুর ঘণ্টা খানেক আগে হঠাৎ তার সব ব্যথাবেদনা চলে গেল। তাঁর মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। আমি আর বড় মামা তখন তাঁর ঘরে। ফুফু বড় মামার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার চিৎকারে অতিষ্ঠ হয়ে সবাই আমাকে ছেড়ে গিয়েছে, কেউ আমার ঘরে উঁকিও দেয় না। শুধু আপনি দিনের পর দিন আসছেন, ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেছেন, আমার কষ্ট দেখে চোখের পানি ফেলেছেন। আপনার সঙ্গে এই পাগলটা আসছে। পাগলা দৌড় দিয়ে যা, আমার জন্য একটা ললি আইসক্রিম কিনে আন। লাল রঙের আনবি। (ছোট ফুফু আমাকে সব সময় পাগলা ডাকতেন।)।

লাল রঙের ললি আইসক্রিম কিনে এসে দেখি পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষভর্তি ঘর। কে একজন উঁচু স্বরে কালেমা পড়ছেন। ছোট ফুফু বাম কাত হয়ে শুয়ে আছেন। তিনি চোখ বড় বড় করে এদিক-ওদিক দেখছেন। হঠাৎ বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার মতো করে বললেন, আম্মাজি আসছেন। আম্মাজি আমারে নিতে আসছেন।

কালেমা পাঠ বন্ধ হয়ে গেল। সবার দৃষ্টি ফুফুর দিকে। ফুফু একদিকে তাকিয়ে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, আম্মাজি, একা আসছেন? আর কেউ আসে নাই?

ফুফুর মৃত আম্মাজি হয়তো জবাব দিলেন, আমরা সেই জবাব শুনতে পারলাম না। ফুফু বললেন, হ্যাঁ, এখন সবাইরে দেখতেছি। হ্যাঁ আম্মাজি, তাদের সালাম দিতে ভুলে গেছি। আসসালামু আলাইকুম।

হঠাৎ ফুফু আতঙ্কিত গলায় বললেন, আম্মাজি, এই মেয়েটা কে? আমার ভয় লাগতেছে, আমার ভয় লাগতেছে। এটা কে?

বড় মামা বললেন, জোবেদারে কাবা শরিফের দিকে মুখ করে শুয়ায়ে দাও।

সবাই কালেমা পাঠ করো, বলল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।

.

ছোট ফুফুকে নিতে সবাই এসেছিল। তাঁর অপরিচিত একজন মহিলাও এসেছিলেন। আমাকে নিতে কেউ আসেনি। মৃতকে পথ দেখিয়ে নেওয়ার জন্য মনে হয় কেউ আসে না। সবটাই অসুস্থ মানুষের কল্পনা। আমি কেবিনের মেঝেতে তিনটা তেলাপোকা ছাড়া কিছু দেখছি না। একটার গায়ের রং কুৎসিত সাদা। রুবিনা এই তেলাপোকাটা দেখলে লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে পড়ত। তার মতে, এই পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত, সবচেয়ে নোংরা, সবচেয়ে জঘন্য, সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীর নাম তেলাপোকা।

রুবিনার ধারণা, মৃত্যুর পর সে অবশ্যই দোজখে যাবে। তার দোজখে কোনো আগুন থাকবে না। অসংখ্য তেলাপোকা কিলবিল করবে। কিছু তেলাপোকা থাকবে সাদা রঙের। এই তেলাপোকারা তার গা বেয়ে উঠতে থাকবে।

আমি মেঝের তেলাপোকার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ দেখি বারান্দায় চলে এসেছি। লম্বা বারান্দা চোখের সামনে ভাসছে। কেবিন থেকে কী করে বারান্দায় চলে এসেছি, তা জানি না।

বারান্দা ফাঁকা। ওয়াকিটকি হাতে একজন পুলিশ অফিসারকে দেখছি। ইনি হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোচ্ছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, পুলিশ অফিসার কথা বলছেন আমাকে নিয়ে।

ডেডবডি রিলেটিভদের হাতে ট্রান্সফার করা হয়নি তো?

এখনো না।

ডেথ রিপোর্টে আপনারা কী লিখছেন?

ডেড রিপোর্ট এখনো তৈরি হয়নি।

আমি ডেথ রিপোর্টের কপি নিয়ে যাব। ডেডবডির সুরতহাল হবে। আমরা সাসপেক্ট করছি ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে।

বলেন কী? সাসপেক্ট কে?

এখনো জানি না। তদন্ত হচ্ছে।

পুলিশ অফিসার আমার কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়ালেন। কেবিন নম্বর ৩২১। দরজায় আমার নাম লেখা, ড. ইফতেখারুল ইসলাম।

মৃত মানুষেরা নিঃশ্বাস ফেলে না। কারণ, বাতাস থেকে তাদের অক্সিজেন নেওয়ার কিছু নেই। তার পরও নিজের নামের দিকে তাকিয়ে আমি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলার মতো করলাম। আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যার অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। আমি এই পৃথিবীতে ছিলাম, এখন নেই। হাসপাতালের কেবিনের দরজায় নামটা শুধু ঝুলছে।

পৃথিবীতে আমি ঝামেলামুক্ত ছিলাম। মৃত্যুর পর নানা ঝামেলায় জড়াচ্ছি। এখন জানছি, কেউ আমাকে খুন করেছে। সুরতহাল হবে। একজন ডাক্তার নাকে রুমাল চেপে আমার নগ্ন শরীরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন। ডোম কাটাকাটি করবে। পাকস্থলীর খাদ্য কৌটায় বের করে পরীক্ষার জন্য পাঠাবে।

পত্রিকার নিশ্চয়ই নিউজ হবে। পত্রিকাওয়ালারা এই ধরনের খবরের জন্য অপেক্ষা করে থাকে। প্রতিদিন খবরের ফলোআপ ছাপা হয়। পাঁচ থেকে ছয় দিনের মাথায় খবর ছাপা বন্ধ। সবাই সবকিছু ভুলে যায়।

পুলিশ অফিসার কেবিনের দরজা খুলে ঘরে উঁকি দিলেন। চোখমুখ কুঁচকে বললেন, ঘরে সিগারেটের গন্ধ। সিগারেট কে খেত?

পেশেন্টের স্ত্রী। তাকে অনেকবার নিষেধ করা হয়েছিল। মহিলা উগ্র স্বভাবের, কারও কথাই শোনেন না।

তিনি কোথায়?

বলতে পারছি না। ভোরবেলা কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গেছেন।

তার নম্বর কি আছে? আমি কথা বলব।

ডেস্কে নিশ্চয়ই আছে। আসুন, নম্বর বের করে দিচ্ছি।

আমি এই কেবিনে আছি। আপনি টেলিফোন নম্বরটা নিয়ে আসুন। আমাকে এক কাপ ব্ল্যাক কফি দেওয়া কি সম্ভব হবে?

আমি কোনো পুলিশ অফিসারকে কাছ থেকে দেখিনি। আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও পুলিশ সার্ভিসে কেউ নেই। রুবিনার এক চাচাতো ভাই আছে, পুলিশের এআইজি। একবারই তিনি আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আধা ঘন্টার মতো ছিলেন, সেই আধা ঘণ্টা তিনি ক্রমাগত মোবাইল ফোনে কথা বলেছেন। এত বিরক্ত মুখে আমি কাউকে কথা বলতে দেখিনি।

এই পুলিশ অফিসারকেও মনে হলো বিরক্ত। শুধু বিরক্ত না, অধৈর্য। প্রথমে ডিভানের ওপর বসল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ডিভান ছেড়ে বাথরুমের দরজা খুলে উঁকি দিল। সেখান থেকে ফিরে এসে রোগীর বিছানার পাশের টেবিলে রাখা ওষুধের বোতল হাতে নিয়ে শুকতে লাগল।

জিনিস শুকার বাতিক তার মধ্যে প্রবল বলে মনে হচ্ছে। সে সবকিছুই শুকছে। ক্লমেট খুলে সে রুবিনার কিছু পোশাক ঝুলন্ত পেল। পোশাকগুলো শুকল। রোগীর ওষুধের টেবিলের ড্রয়ার অনেক টানাটানি করে খুলল। সেখানে রুবিনার সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার। সে সিগারেটের প্যাকেট শুকল। প্যাকেট খুলে সিগারেট বের করে সিগারেট শুকল। লাইটারটা কয়েকবার জ্বালিয়ে-নিভিয়ে লাইটার শুকল।

অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আমি যখন পিএইচডি করি, তখন লস্কনামের একটা টিভি সিরিয়াল দেখতাম। কলম্বো হলো সিরিয়ালের নায়ক। সে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করে। পিটার ফক নামের একজন অভিনেতা কলম্বো চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অসাধারণ অভিনয়। তারও শুকার বাতিক ছিল। তদন্ত করতে গিয়ে যা দেখতেন, তা-ই কতেন। বেশির ভাগ সময় জিভে লাগিয়েও দেখতেন। একটা দৃশ্যে তিনি সাসপেক্টের বাড়িতে গিয়ে সেন্টের একটা শিশি পেলেন। যথারীতি শুকে দেখলেন। জিভে খানিকটা লাগিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজের জামায় খানিকটা স্প্রে করলেন। শেষ পর্যন্ত এই সেন্টের শিশি আসামিকে ধরতে ভূমিকা রাখল।

বিদেশে পড়াশোনার জটিল সময়টায় কলঙ্কেসিরিয়াল আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দিয়েছে। দেহধারী মানুষের অনেক আনন্দের ব্যবস্থাই পৃথিবীতে আছে। নাটক-সিনেমা-বই-গান-চিত্রকলা-সংগীত-পরকালে এমন ব্যবস্থা কি আছে? বা আসলেই কি আছে? আনন্দ এবং উত্তেজনায় অধীর হয়ে কলম্বোর মতো কোনো সিরিয়াল দেখার ব্যবস্থা কি আছে? মৃতদের সিনেমা দেখার জন্য ছবিঘর আছে? লাইব্রেরি আছে?

.

কফি নিয়ে একজন ওয়ার্ডবয় ঢুকেছে। তার হাতে একটুকরা কাগজ। মনে হয় রুবিনার টেলিফোন নম্বর। পুলিশ অফিসার কফির মগ হাতে নিলেন। যা ভেবেছিলাম, তা-ই। তিনি কফিতে চুমুক দিয়ে নানাভাবে গন্ধ শুকলেন। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে গন্ধ পছন্দ হয়নি। তিনি মগ নামিয়ে রেখে টেলিফোন নম্বর লেখা কাগজটি হাতে নিলেন। নাকের সামনে ধরে কাগজেরও গন্ধ নিলেন। আমি আনন্দিত, কিছুক্ষণের মধ্যেই রুবিনার মিষ্টি গলা শুনতে পাব। মৃত্যুর পরও এই সুবিধাটা হয়েছে—কেউ টেলিফোন করলে দুদিকের কথাই শোনা যায়।

মিসেস রুবিনা কথা বলছেন?

ইয়েস।

কেমন আছেন, ম্যাডাম?

ভালো। হু আর ইউ?

আমার নাম খলিল। খলিলুর রহমান। আমি ইফতেখার স্যারের ডাইরেক্ট ছাত্র। স্যারকে খুব ভালোমতো চিনতাম।

আপনার স্যারকে চিনতেন, ভালো করতেন। এখন আমি ব্যস্ত, টেলিফোন রাখছি।

প্লিজ, ম্যাডাম, প্লিজ। ছাত্রাবস্থায় খুব বিপদে পড়ে আমি স্যারের কাছ থেকে তিন হাজার টাকা ধার করেছিলাম। টাকাটা ফেরত দেওয়া হয় নাই। আপনার কাছে ফেরত দিতে চাচ্ছি।

ফেরত দিতে হবে না। ওকে বাই।

খট শব্দ হলো। রুবিনা টেলিফোন রেখে দিয়েছে। পুলিশ অফিসার খলিল এবার কফির কাপে চুমুক দিল। তিনবার চুমুক, প্রতিবারই তার চোখমুখ কুঁচকে গেল। সে আবারও টেলিফোন করল। আমার ধারণা ছিল, রুবিনা টেলিফোন ধরবে না। টেলিফোন ধরল।

ম্যাডাম, আমি খলিল বলছি। ইফতেখার স্যারের ডাইরেক্ট স্টুডেন্ট।

একটু আগে কথা হয়েছে। আবার কেন টেলিফোন করলেন? স্টুপিড!

ম্যাডাম, রাগ করবেন না। আমার সঙ্গে আপনার কথা বলতেই হবে। আপনার অন্য বিকল্প নাই।

কথা বলতেই হবে কেন?

স্যারের মৃত্যুতে একটি অপঘাত মামলা হতে যাচ্ছে। একটা টেলিফোনে পুলিশকে তার মৃত্যুসংবাদ জানানো হয়েছে এবং বলা হয়েছে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

কে হত্যা করেছে?

এখনো জানি না। আমার ওপর দায়িত্ব পড়েছে তদন্ত করে বের করার।

তদন্ত করুন। আমাকে বিরক্ত করছেন কেন! হাজব্যান্ড মারা গেছে, আমি আপসেট।

ম্যাডাম, আপনাকে তেমন আপসেট মনে হচ্ছে না।

আপসেট দেখাতে হলে আমাকে কী করতে হবে? ভেউ ভেউ করে কাঁদতে হবে?

অতি প্রিয়জনের মৃত্যুতে সবাই দুঃখিত হয়, চোখের পানি ফেলে। কেউ বেশি, কেউ কম। তবে কেউই ডেডবডি হাসপাতালে ফেলে বাড়িতে চলে যায় না।

আপনার কি ধারণা, আমি খুন করে ডেডবডি ফেলে বাসায় লুকিয়ে আছি?

ম্যাডাম, আমার সে রকম ধারণা নয়।

তাহলে টেলিফোন রাখুন, আমাকে বিরক্ত করবেন না।

আচ্ছা ম্যাডাম, টেলিফোন রাখলাম। শোকের সময় বিরক্ত করার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।

খলিল টেলিফোন রেখে আবারও ঠান্ডা কফিতে গুনে গুনে তিনবার চুমুক দিল। তার তিনবার কফির কাপে চুমুক দেওয়া দেখেই বুঝেছি যে আবারও টেলিফোন করবে। কলম্বোর সঙ্গে এই পুলিশ অফিসারের মিল আছে। কলম্বো সাসপেক্টকে অতি বিনীতভাবে বিরক্ত করত। একই প্রশ্ন তিন-চারবার করে লজ্জায় নত হয়ে বলত, ছিঃ ছিঃ, এই প্রশ্ন তো আপনাকে আগেও করেছি। আবার করলাম। আমার আসলে মাথার ঠিক নাই।

হ্যালো, ম্যাডাম, আমি খলিল।

আপনি তো বলেছেন আর বিরক্ত করবেন না। কেন টেলিফোন করলেন?

ছোট একটা প্রশ্ন ছিল, ম্যাডাম। এই প্রশ্নের উত্তর পেলে আর করব না। তবে ময়নাতদন্তের রিপোর্ট খারাপ হলে প্রশ্ন করব।

ময়নাতদন্ত মানে?

সুরতহাল হলো ময়নাতদন্ত। ইংরেজিতে বলে পোস্টমর্টেম। স্যারের ভিসেরা পরীক্ষা করা হবে।

সেটা কখন করা হবে?

আজ দিনের মধ্যেই করা হবে। সেটা কখন, তা তো জানি না। ডাক্তাররা করবেন। এখন ম্যাডাম আপনার প্রশ্নটা কি করব?

হ্যাঁ, করুন এবং আমাকে দয়া করে মুক্তি দিন।

ম্যাডাম, কেবিনে ওষুধপত্র যেখানে রাখা হয়, সেখানে একটা সিগারেটের প্যাকেট আর একটা লাইটার পেয়েছি। সিগারেটের প্যাকেটটা কি আপনার?

হ্যাঁ, আমার।

আর লাইটার? লাইটারটাও কি আপনার?

সিগারেটের প্যাকেট যার লাইটার তারই থাকবে, এটাই তো লজিক্যাল।

ম্যাডাম, অনেক সময় লাইটার অন্যের কাছ থেকে ধার করা হয়।

লাইটারে কি কোনো সমস্যা?

লাইটারে কোনো সমস্যা নয়। সিগারেটের প্যাকেটে সমস্যা।

কী সমস্যা?

আপনার সিগারেটের প্যাকেটে সাতটা সিগারেট ছিল।

এতে কোনো সমস্যা? এমন কোনো আইন কি আছে যে বেজোড় সংখ্যার সিগারেট থাকতে পারবে না, কিংবা প্রাইম নম্বর সংখ্যার সিগারেট থাকতে পারবে না?

ম্যাডাম, এমন কোনো আইন নাই। তবে সাতটা সিগারেটের মধ্যে তিনটা আলাদা। তিনটা সিগারেটের ভেতর গাঁজা ভরা।

বুঝলাম।

গাঁজা ভরা সিগারেট আপনি কোত্থেকে সংগ্রহ করেন, এটা আমার জানা দরকার।

আপনি খাবেন? তিনটা গাঁজার সিগারেট নিয়ে যান।

ম্যাডাম, আমাকে নিয়ে রসিকতা করার প্রয়োজন নাই। আমি তেমন রসিক মানুষও নই। গাঁজার সিগারেট আপনি কোত্থেকে সংগ্রহ করেন, তা আমার জানা প্রয়োজন এই জন্য যে আপনি মাদকের কোন চক্রটির সঙ্গে যুক্ত, তা জানা। গাঁজা ছাড়া অন্য কোনো ড্রাগ কি নেন? ইয়াবা, স্পিড, হেরোইন।

আমি নিজে থেকে আপনাকে কিছুই বলব না। ইউ স্টুপিড! ফাইন্ড ইট আউট।

রুবিনা টেলিফোন লাইন কেটে দিয়েছে। খলিল ঠান্ডা কফির কাপ আবার হাতে নিয়েছে। এবার চুমুক দিল দুবার। এর অর্থ হয়তো রুবিনাকে সে আর টেলিফোন করবে না। খলিলকে আনন্দিত মনে হচ্ছে এবং সে বড় কোনো আনন্দের জন্য অপেক্ষা করছে। বড় আনন্দটা কী হতে পারে?

হঠাৎ করেই তার বড় আনন্দ আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। সে কী ভাবছে, বুঝতে পারছি। তার পরিকল্পনা বুঝতে পারছি। তার মাথার ভেতর বৈদ্যুতিক ঝড় হচ্ছে। মস্তিষ্কের এক অংশ থেকে সীমাহীন সংখ্যার ইলেকট্রন অন্য অংশে যাচ্ছে, আবার ফিরে আসছে। অতি ক্ষুদ্র সব। বৈদ্যুতিক বিভব তৈরি হচ্ছে। ক্ষুদ্র কিন্তু স্পষ্ট। এর অর্থ কী, তা বুঝতে পারছি। ইলেকট্রনের অ্যান্টিমেটরে পজিট্রন তৈরি হচ্ছে, নিমেষেই মিলিয়ে যাচ্ছে। মস্তিষ্ক প্রচুর অক্সিজেন গ্রহণ করে তা জানতাম, সেখানে সামান্য পরিমাণে ওজন (O3) তৈরি হয়, তা জানতাম না।

খলিল কী ভাবছে, তা এখন আমার কাছে স্পষ্ট। বড় যে আনন্দের জন্য সে অপেক্ষা করছে, সেই আনন্দ মৃত্যুবিষয়ক। হত্যাকারীকে সে ফাঁসিতে ঝুলাবে, এই আনন্দ।

এর আগে সে আটটা খুনের মামলা তদন্ত করেছে। এই আটজনের মধ্যে সাতজনের ফাঁসির হুকুম হয়েছে। পাঁচজনের ফাঁসি হয়ে গেছে। দুজনের এখনো হয়নি। তারা ফাঁসির জন্য অপেক্ষা করছে। যে একজনের ফাঁসির হুকুম হয়নি, সে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছে। তার নাম জিলানি।

খলিল নিশ্চিত, জিলানি জোড়া খুনের হোতা। প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে গেছে। এই ভয়ংকর অপরাধী আবারও খুন করবে। খলিল তাকে লক্ষ রাখছে। সে আবারও ধরা খাবে। ফাঁসির হাত থেকে জিলানির মুক্তি নেই।

আমার মৃত্যুর বিষয়টা নিয়ে সে যে আজই তদন্তে নেমেছে, তা নয়। চার দিন আগেই তদন্তে নেমেছে। আমি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই সে লক্ষ রাখছে। খোঁজখবর শুরু করেছে। তার চোখ আনন্দে চকচক করছে, আরও একজনকে সে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারবে। সেই আরেকজনের নাম রুবিনা।

খলিলের মাথার ভেতর ফাঁসির দৃশ্য। রুবিনাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে। জল্লাদ রুবিনার মুখ কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে দিল। রুবিনা বলছে, ‘না, না, না।’ ফাঁসির দৃশ্য দেখার জন্য উপস্থিত জেলার সাহেব হাতের রুমাল ফেলে দিলেন। এটাই সিগন্যাল। রুবিনা ফাঁসিতে ঝুলছে। তার আলতাপরা ফর্সা পা দুলছে।

আশ্চর্য, এখন খলিলের মাথায় কবিতা ঘুরছে। ইংরেজি কবিতা নয়, বাংলা কবিতা। ‘আট বছর আগের একদিন’। প্রথম থেকে নয়, হঠাৎ একেকটা লাইন।

‘কোনোদিন জাগিবে না আর!’

সে এই কবিতাটি ইংরেজি অনুবাদের চেষ্টা করছে। অনুবাদ পছন্দমতো হচ্ছে না বলে সে নিজের ওপর রেগে যাচ্ছে। কোনোদিন জাগিবে না আর’—শি উইল নেভার ওয়েক আপ। লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার’—‘নাও শি ইজ স্লিপিং অন দ্য মর্গ টেব্‌ন্।’

খলিল আমার ছাত্র ছিল। কিন্তু তাকে চিনতে পারছি না। জুঁই নামের যে মেয়েটা রাত তিনটায় টেলিফোন করেছিল, তাকে চিনতে পারিনি। জীবিত অবস্থার কিছু স্মৃতি কি নষ্ট হয়ে গেছে?

লাশকাটা ঘরের পলিথিন বিছানো নোংরা টেবিলে

লাশকাটা ঘরের পলিথিন বিছানো নোংরা টেবিলে আমার শরীর চিৎ হয়ে আছে। গায়ে কোনো কাপড় নেই। টেবিল থেকে ফিনাইলের কঠিন গন্ধ আসছে। ঘরের জানালা আছে। জানালায় হলুদ রঙের পর্দা ঝুলছে। পর্দা নোংরা। সেখানে কিছু বড় বড় নীল রঙের মাছি বসে আছে। মাছিগুলো কিছুক্ষণ বসে থাকে আবার ওড়াউড়ি করে পর্দার ওপর বসে। ঘরের চারটা দেয়ালের একটায় চুনকাম করা হয়েছে। সেখানে কেউ নোংরা কথা লিখেছে। নোংরা কথাটা—এইখানে মরা লাশের পোদ… হয়। যে কথাটা লিখেছে, সে নিজেকে অন্ধকারে রাখতে চাইছে না। মহৎ বাণীর নিচেই সে লিখেছে—ইতি জসিম। তার নিচে মোবাইল ফোনের নম্বর।

ঘরে নিশ্চয়ই অসহনীয় গরম। মুখে রুমাল চেপে দাঁড়ানো ডাক্তার দরদর করে ঘামছে। ডাক্তারের চেহারা সুন্দর। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে সোনালি চশমা। ডাক্তার মাঝে মাঝে মাথা উঁচু করে সিলিংফ্যানের দিকে তাকাচ্ছে। সিলিংফ্যান শব্দ করে ঘুরছে, তবে কোনো বাতাস পাওয়া যাচ্ছে না।

টেবিলের কাছে কাঁচি ও ছুরি হাতে ডোম দাঁড়িয়ে আছে। ডডামের গা খালি। ঘোর কৃষ্ণবর্ণের বেঁটে মানুষ। তার সারা শরীরে ঘন লোম। নির্দেশের অপেক্ষা। ডাক্তার বললেন, পেটটা কেটে শুধু স্টমাক বের করো। ভিসেরা হবে।

ডোম বলল, ফুসফুস-কলিজা নিকালব না?

বললাম তো, শুধু স্টমাক। এত কথা বলো কেন? কাজ শেষ করো। গরমে মারা যাচ্ছি।

ডোম পেট কাটার বদলে, ফ্যানের সুইচ অফ করে দিল। ডাক্তার ক্ষিপ্ত গলায় বলল, ফ্যান বন্ধ করলা কেন?

ফ্যান চললে কাম করতে পারি না।

ইয়ার্কি করো? ফ্যান চললে কাজ করতে পারো না।

ফ্যান চালায়া দিতেছি—কাটাকাটি আফনে করেন। আমি কাটব না। আর আমার সঙ্গে মিজাজ করবেন না। কালু ডোম মিজাজের ধার ধারে না।

কাজ করবে না?

না। যান, ‘রিপোর্ট’ করেন। আমার চাকরি খান। দেখি, আপনে কত বড় চাকরি খানেওয়ালা।

ডোম দরজার দিকে এগোচ্ছে। ডাক্তার ভীত গলায় বলল, ঠিক আছে। ফ্যান বন্ধ করেই কাজ করো। অল্পতে চেতে যাও কেন?

চলন্ত ফ্যান বন্ধ হয়েছে। মাছিরা পর্দা ছেড়ে আমার মুখের চারপাশে ওড়াউড়ি করছে। কখন নামবে বুঝতে পারছে না।

যতই সময় যাচ্ছে, আমার শীত বাড়ছে। শীতে শরীর কাঁপছে না, আমার শরীর বলে কিছু নেই। শীতের অনুভূতি বাড়ছে। একেকবার ঠান্ডা বাতাস আসে, সেই বাতাস কিছুক্ষণ স্থায়ী হয়, তারপর বাতাস হঠাৎ থেমে যায়। শীত মনে হয় এই বাতাস নিয়ে আসছে। ঠান্ডা বাড়ার হার কি এক্সপানশিয়াল? তাহলে একটা সময় আসবে যখন আমরা এক্সপোনেনশিয়াল রেখার কাঁধে চলে আসব। সেই সময় শীত অসহনীয় পর্যায়ে বাড়তে শুরু করবে।

কালু ডোম কাটাকাটি শুরু করেছে। আমার দেখতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু উপায় নেই, দেখতে হচ্ছে। দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর ব্যবস্থা এ জগতে নেই। মাছি যেমন চারদিক দেখতে পায়, আমিও পাচ্ছি।

ডাক্তার চোখ বন্ধ করে জানালার হলুদ পর্দার দিকে তাকিয়ে ছিল, সে হঠাৎ চোখ মেলে একপলকের জন্য শবদেহের দিকে তাকিয়ে ছুটে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। ডাক্তার পেটে হাত দিয়ে লাশকাটা ঘরের বারান্দায় বসে বমি করছে। আহা, বেচারা!

কী যেন হয়েছে। মুহূর্তের জন্য আমার দৃষ্টি অস্পষ্ট হয়ে আবার স্পষ্ট হয়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখি বড় মামার ফার্মেসি। এইমাত্র ফার্মেসি খোলা হয়েছে। বাচ্চা একটা ছেলে মেঝেতে পানি ছিটিয়ে ঝাঁট দিচ্ছে। বড় মামা কাউন্টারে বসে আছেন। তিনি বললেন, পত্রিকা এখনো আসে নাই?

কাজের ছেলেটা বলল, আসলে তো আমাদের সামনেই থাকত। পত্রিকা কি আমি বাড়ি নিয়া যাই?

বড় মামা বললেন, একটা সহজ প্রশ্ন করেছি, সহজ উত্তর দিবি। সব সময় চ্যাটাং চ্যাটাং। যা, তোর চাকরি নট।

কাজের ছেলে বলল, নট হইলে নট। সে ঘর ঝাট দেওয়া শেষ করে বলল, চা আনব?

আন।

দুধ-চা, না রং-চা?

বড় মামা বিরক্ত গলায় বললেন, আমি যে রং-চা খাই তুই জানিস। প্রতিদিন রং-চা এনে দিস। কেন জিজ্ঞেস করলি, রং-চা, না দুধ-চা?

প্রতিদিন রং-চা খাইলেও আইজ দুধ-চা খাওনের ইচ্ছা হইতে পারে, এই জন্য জিগাইছি।

তোর চাকরি নট, বেতন নিয়ে চলে যা।

আপনের চা-টা দিয়া তারপর যাই।

কাজের ছেলে ঘর থেকে বের হওয়ার পরপরই টেলিফোন বাজা শুরু করল। আমি বুঝতে পারছি, কাদের টেলিফোন করেছে। সে আমার মৃত্যুসংবাদ দিতে শুরু করেছে। এটা তার প্রথম টেলিফোন। জীবিত মানুষের কোনো টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা নেই, মৃতদের আছে। সবার আছে কি না জানি না, অন্তত আমার আছে। আমি বড় মামা ও কাদেরের টেলিফোনের কথাবার্তায় মন দিলাম। হতভম্ব বড় মামা বললেন, কখন মারা গেছে?

শেষ রাতে।

ডেডবড়ি কি হাসপাতালে?

জ্বে না। দেশের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে।

কখন রওনা হয়েছে?

সকাল সাতটায়।

আমি কিছুই জানলাম না, ডেডবডি দেশের বাড়িতে রওনা হয়ে গেছে?

রুবিনা কোথায়?

উনি রেস্টে আছেন।

রেস্টে আছেন মানে কী?

শোবারঘরে দরজা বন্ধ করে আছেন।

রুবিনাকে টেলিফোন দাও।

ক্যামনে দিব? দরজা বন্ধ।

দরজা ভাঙ। কুড়াল দিয়ে দরজা কেটে ফেল।

কী বলছেন?

হারামজাদা ঠসা, কানে শুনস না? কুড়াল দিয়ে দরজা কাট।

এই বলেই তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন, প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বুকে হাত দিয়ে কাউন্টারের পেছনে পড়ে গেলেন। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে নিশ্চয়ই। অস্পষ্ট গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। অত্যন্ত বিপজ্জনক অবস্থা। আমি শুধু দেখছি, সাহায্য করতে পারছি না। আমি অবজার্ভার।

কোয়ান্টাম ফিজিকসের ক্লাসে ছাত্রদের অবজার্ভার কী, তা অনেকবার পড়িয়েছি। অবজার্ভার হচ্ছে এমন একজন, যার উপস্থিতি ছাড়া কোনো ঘটনা ঘটবে না। কিংবা ঘটনা ঘটবে কি না, তা অবজার্ভারের ওপর নির্ভর করবে। মনে করো, আকাশে পূর্ণচন্দ্র। চন্দ্রের পাশেই বড় এক খণ্ড মেঘ। কোয়ান্টাম মেকানিকস বলছে, আকাশের চাঁদ একই সঙ্গে মেঘে ঢাকা এবং মেঘমুক্ত। একজন অবজার্ভার যখন চাঁদের দিকে তাকাবে, তখনই শুধু নির্ধারিত হবে চাঁদ মেঘমুক্ত, না মেঘে ঢাকা।

প্রথম দিন যখন এই বক্তৃতা করি, তখন এক ছাত্রী ভয়ে ভয়ে বলল, স্যার, পুরো ব্যাপারটা ভুয়া বলে মনে হচ্ছে। আমি বললাম, কোয়ান্টাম ফিজিকস হচ্ছে সম্ভাবনার জগৎ। সেখানে এই পৃথিবী, গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সিরও ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনা যে একেবারেই নেই, তা নয়।

আমি এখন কোয়ান্টাম মেকানিকসের অবজার্ভার। আশপাশের সব কর্মকাণ্ড সে শুধু দেখবে। কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবে না। বড় মামা মেঝেতে কাত হয়ে পড়ে আছেন। পড়ার সময় কাঠের চেয়ারে বাড়ি খেয়ে তার থুতনি কেটে গেছে। সেখান থেকে রক্ত পড়ছে। এতক্ষণ গোঁ গোঁ শব্দ করছিলেন, এখন সেই শব্দও নেই। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া দরকার। কে নেবে? আমি কোয়ান্টাম মেকানিকসের অবজার্ভার। আমার কাজ শুধু দেখা।

কাজের ছেলেটা ফিরেছে। তার হাতে চায়ের কাপ। বগলে খবরের কাগজ। এই খবরের কাগজ সে কিনে এনেছে। ছেলেটা বড় মামার স্বভাব খুব ভালোমতো জানে। বড় মামা চায়ের কাপে চুমুক না দিয়ে খবরের কাগজ পড়তে পারেন না।

কাউন্টারে চায়ের কাপ ও খবরের কাগজ রেখে সে বলল, গেল কই! বলেই সে ঝাঁটা নিয়ে ফার্মেসির পেছনে চলে গেল। সেখানে ছোট একটা ঘর আছে। মাঝে মাঝে এই ঘরে শুয়ে মামা বিশ্রাম নেন, কাজের ছেলেটা তখন মামার পা টিপে দেয়।

ফার্মেসির পেছনে ঘর ঝাঁট দেওয়া হচ্ছে, তার শব্দ পাচ্ছি। যে ঝাঁট দিচ্ছে, সে এখনো আমার চোখের আড়ালে। চোখের আড়াল’ কথাটা ঠিক হলো না। চোখ নেই, তখন আবার চোখের আড়াল কী?

পুরোনো স্মৃতি কীভাবে কীভাবে যেন থেকে যায়। আমরা এখনো বলি, বাটা দপ করে ফিউজ হয়ে গেল। অতি প্রাচীনকালে প্রদীপ জ্বলত। প্রদীপ নেভার সময় দপ করে শব্দ হতো। সেই ‘দপ’ শব্দ এখনো আমাদের স্মৃতিতে আছে। আমরা বলছি, বাল্বটা দপ করে নিভে গেছে।

জীবিত মানুষের স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে মস্তিষ্কে। একজন মৃতের স্মৃতি কীভাবে সংরক্ষিত হয়? আমার স্মৃতি এখন কোথায় জমা?

কাজের ছেলেটা ঘর ঝাঁট দিয়ে ফিরে এসেছে। সে আবারও বলল, মানুষটা গেল কই? চা ঠান্ডা হইতেছে।

ফার্মেসির পত্রিকা নিয়ে লোক এসেছে। সে বাইরে থেকে পত্রিকা ছুঁড়ে ফেলতেই কাজের ছেলেটি বলল, এত বেলা কইরা কাগজ দিলে আমরার পুষে না। স্যারের সক্কালবেলা কাগজ লাগে। আইজ থাইকা কাগজ বন। নগদ পয়সায় কাগজ খরিদ করব।

মামার কাজের ছেলেটা কাগজ ভাঁজ করে কাউন্টারে রাখতে গেছে, একটু উকি দিলেই সে তার স্যারকে দেখতে পাবে। মনে হচ্ছে, সে উকি দেবে। মামা কি মারা গেছেন? কোয়ান্টাম সূত্রে মামা এখন শ্ৰয়ডিংগারের বিড়াল। একই সঙ্গে জীবিত এবং মৃত। কাজের ছেলে উঁকি দেওয়ামাত্র বিষয়টির মীমাংসা হবে। মামা কোনো একটি রিয়েলিটি গ্রহণ করবেন। হয় মৃত রিয়েলিটি অথবা জীবিত রিয়েলিটি।

কাজের ছেলেটা পত্রিকা ভাঁজ করে রেখে চায়ের কাপ নিয়ে চলে গেল। মনে হয়, চায়ের দোকানে কাপ ফেরত দিতে গেছে।

আচ্ছা, আমি কি আপনা-আপনি মামার শেফা ফার্মেসিতে চলে এসেছি, নাকি কেউ আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে? আমাকে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছে। সেই ‘কেউটা কে? আ ডিভাইন অবজার্ভার—পবিত্র দর্শক; যিনি সবকিছুই দেখেন। মর্গের জানালায় বসে থাকা মাছি দেখেন, শবদেহের নাড়িভুড়ি কাটা দেখেন, আবার শেফা ফার্মেসির মালিকের কুঁকড়ি-মুকড়ি হয়ে পড়ে থাকা দেখেন। শুধু যে দেখেন তা না, অন্যকেও দেখান। আমি এই দৃশ্যটি দেখতে চাইছি না, কিন্তু আমাকে দেখতে হচ্ছে।

ক্লাসের এক বক্তৃতায় বলেছিলাম, একজন মানুষের পক্ষে একই সঙ্গে দুই জায়গায় থাকা সম্ভব নয়, কিন্তু ইলেকট্রন যে থাকতে পারে তা অঙ্কের মাধ্যমে তোমাদের বোঝানো হয়েছে। তোমার শরীরের একটি ইলেকট্রন চাঁদ বা মঙ্গল গ্রহে পাওয়ার সম্ভাবনা কিন্তু আছে। ছাত্রদের একজন শব্দ করে হেসেই নিজেকে সামলে নিয়ে সিরিয়াস হয়ে গেল। আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, আধুনিক পদার্থবিদ্যা দ্রুত ব্ল্যাক ম্যাজিকের দিকে যাচ্ছে। এখন প্যারালাল ওয়ার্ল্ডের কথা বলা হচ্ছে, মাল্টিভার্সের কথা বলা হচ্ছে। তোমার নাম কী?

সে ভীত গলায় বলল, সুমন।

আমি বললাম, সুমন! ঠিক তোমার মতো একজন, তার নামও সুমন, সে এই মুহূর্তে অন্য একটি জগতে আমার মতো দেখতে একজনের দিকে তাকিয়ে আছে। একটাই শুধু প্রভেদ—তুমি এখানে চশমা পরেছ, সেখানে হয়তো তোমার চোখে চশমা নেই। দুইটা রিয়েলিটি—একটায় তোমার চোখ ভালো, অন্যটায় চোখ খারাপ। তোমার অসীম সংখ্যার রিয়েলিটি নিয়ে অসীমসংখ্যক জগৎ বহমান। বিশ্বাস হচ্ছে?

বুঝতে পারছি না, স্যার। মাথা ঘুরাচ্ছে।

আমি কতক্ষণ স্মৃতির ভেতর ঢুকে ছিলাম জানি না। হঠাৎ স্মৃতি থেকে বের হলাম, এখন আর আমি বড় মামার শেফা ফার্মেসিতে নেই। আমাদের গ্রামের বাড়ি কলমাকান্দায়। দূরে কোথাও মাইকিং হচ্ছে। অস্পষ্টভাবে মাইকিংয়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি :

একটি বিশেষ ঘোষণা—কলমাকান্দার কৃতী সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেচর’ ইফতেখার ইসলাম সাহেব ইন্তেকাল ফরমায়েচেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। অদ্য বাদ জোহর তার নামাজে জানাজা ঈদগাঁ মাঠে অনুষ্ঠিত হইবে। আপনারা দলে দলে যোগদান করুন।

একটি বিশেষ ঘোষণা-কলমাকান্দার কৃতী সন্তান…

.

মায়ের কবরের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হচ্ছে। জুম্মঘরের মুয়াজ্জিন কবর খোঁড়া তদারক করছেন। ইনার গলার স্বর মিষ্টি। তিনি হাত নেড়ে নেড়ে কবর খোঁড়া বিষয়ে কথা বলছেন। গোরখোক অবাক হয়ে তার কথা শুনছে। মুয়াজ্জিন বলছেন, কবর দুই প্রকারের হয়। সিন্দুক কবর আর বোগদাদি কবর। তোমরা শুধু পারো সিন্দুক কবর। আফসোস! শোননা, কবরের গভীরতা এমন হবে, যেন মুর্দাকে যখন জিন্দা করা হবে, সে যেন বসতে পারে। মানকের নেকেরের প্রশ্নের জবাব তাকে বসে দিতে হবে, এটাই বিধান। মানকের নেকেরের প্রথম প্রশ্ন কি তুমি জানো?

জে না, হুজুর।

প্রথম প্রশ্ন বড়ই অদ্ভুত। প্রথম প্রশ্ন, ‘তুমি পুরুষ, না নারী?’

বলেন কী! আমি শুনছি, ‘তোমার ধর্ম কী?’ ‘তোমার নবী কে?’

এই সব প্রশ্নও করা হবে। তবে প্রথম প্রশ্ন তুমি পুরুষ, না নারী’। এই প্রশ্ন করার অর্থ কী জানো।

জে, না।

এই প্রশ্ন থেকে বোঝা যায়, মানকের নেকের মৃত ব্যক্তির বিষয়ে কিছুই জানে না।

আচানক হইলাম।

আচানক হওয়ার কিছুই নাই। সব সময় খেয়াল রাখবা, তুমি পুরুষ। মানকের প্রশ্ন করল, তুমি পুরুষ, না নারী। মানকের নেকেরের চেহারাসুরত দেখে তোমার কইলজা গেল শুকায়ে। তুমি ভুলবশত বলো, আমি নারী। তাহলেই ধরা খাইছ। শুরু হইব থানার মাইর।

থানার মাইর কী?

আসামি ধইরা নিয়া পুলিশ থানাত যে মাইর দেয়, তার নাম থানার মাইর।

এই মুয়াজ্জিন সাহেব বড় মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বড় মামা আমাদের বাড়িতে থাকতেন। বাবা তাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। মুয়াজ্জিনের সঙ্গে বড় মামার মাদ্রাসায় পরিচয়। কথায় কথায় বড় মামা তাকে বলেন বুরবাক। মুয়াজ্জিন (তার নাম মুনসি রইস) সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তুমিও বুরবাক। বুরবাক, বুরবাক, বুরবাক।

বড় মামার খবরটা আমি তার বন্ধুকে বলতে পারছি না। জীবিত মানুষের এই ক্ষমতা আছে। মৃতের নেই।

একসঙ্গে অনেকগুলো পাখি ডাকছে। বড় মামা কি মারা গেছেন? বড় মামার মৃত্যুতে প্রচুর পাখি ডাকার কথা। মামা হলেন পক্ষীবন্ধু। তার একটাই নেশা, বনে-জঙ্গলে ফলের গাছ লাগানো। পাখিদের খাওয়ার জন্য ফল। প্রতিবছর বৈশাখ মাসে মিনি ট্রাকভর্তি ফলগাছের চারা নিয়ে তিনি বনে ঢোকেন।

গাজীপুরের শাল বনে তার লাগানো লিচুগাছের পাকা লিচু দেখতে একবার আমি তার সঙ্গে বনে ঢুকেছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও মামা লিচুগাছ বের করতে পারেননি।

বনে-জঙ্গলে ফলের গাছ লাগানো নিয়েও মুনসি রইসের সঙ্গে মামার ঝগড়া। মুনসি রইস বলতেন, ফলের গাছ তুমি লাগাও মানুষের জন্য লাগাব। পশুপাখির খাদ্যের ব্যবস্থা আল্লাহপাক করেন। পিপড়ার কোনো খাদ্যের অভাব হয় না। মানুষের হয়। মানুষকে তিনি জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। বলে মানুষকে নিজের খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়।

মামা বিরক্ত হয়ে বলতেন, সব ফল মানুষ খেয়ে ফেললে পাখিরা কী খাবে? বুরবাক।

তুমিও বুরবাক। পশুবন্ধু সাজছে।

চুপ।

তুমি চুপ।

মাইকের ঘোষণা শুনে থালা হাতে ফকির-মিসকিন আসতে শুরু করেছে। তাদের চোখেমুখে আনন্দ। দুটা গরু জবেহ করা হবে। লাশ দাফনের পর ফকির-মিসকিন খাওয়ানো হবে।

ফকির-মিসকিনদের জন্য একটা গরু, দ্রদের জন্য আরেকটা গরু। যারা গরু খান না তাদের জন্য খাসির মাংস।

আমার মৃত্যুর কারণে যে তিনটি অবোধ প্রাণী মারা যাচ্ছে, তাদের দেখলাম। দুটা গরুই মহানন্দে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে। ছাগলটা কিছু খাচ্ছে না। মৃত্যুর পর এই প্রাণীদের কি আলাদা কোনো জগৎ আছে? তাদের কি আত্মা আছে?

আমার ইচ্ছে করছে গ্রামের বাড়িতে যেতে। অনেক দিন এই বাড়ি দেখি না। বাড়ির পেছনের সবুজ শ্যাওলা ঢাকা পুকুরটা অদ্ভুত। এই পুকুরে প্রকাণ্ড দুটা গজার মাছ আছে। মাঝেমধ্যে গজার মাছ ধরার চেষ্টা চালানো হয়। কখনো ধরা যায় না। অনেকের ধারণা, এই দুটা মাছ না, জিন। মাছের রূপ ধরে পুকুরে বাস করে।

এই পুকুরের আরও রহস্য আছে। হঠাৎ হঠাৎ পুকুর ভর্তি হয়ে যায় পদ্মফুলে। তখন বুঝতে হবে, আমাদের বাড়ির কারও মৃত্যু হবে। ছোট চাচা যখন মারা গেলেন, তখন পদ্মফুলে পুকুর ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। আমার বড় ভাই যখন জামগাছের ডালে দড়ি ঝুলিয়ে ফাঁস নিলেন, তখনো পুকুর ভর্তি ছিল পদ্মফুলে। দাদাজান তখন বেঁচে, তিনি হুকুম দিলেন, সব পদ্ম শিকড় ছিঁড়ে তুলে আন। একটা পদ্মও যেন না থাকে। আমার মৃত্যুতে কি আবার পদ্মফুলে পুকুর ভর্তি হয়েছে? একবার যদি দেখতে পারতাম! খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

ইচ্ছে করলেও বাড়িতে যেতে পারছি না। মৃতের কোনো ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই। অন্যের ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। সেই অন্যটা কে?

.

আমার ডেডবডি আসছে না, এই খবর মনে হয় পৌঁছে গেছে। গোরখোদক এবং মুয়াজ্জেন চলে গেছেন। অনেকেই চলে যাচ্ছে, শুধু ফকির মিসকিনদের দল যাচ্ছে না। তারা হতাশ, কী করবে বুঝতে পারছে না। এদের লিডারশ্রেণীর একজন ক্ষুব্ধ গলায় বলছে, খবর দিয়া আইন্যা কি ফাইজলামি?

লিডারের কথায় সবাইকে সায় দিতে হয়। বাকি ফকির-মিসকিনরা তা-ই করছে। সায় দিচ্ছে। লিডার বলল, আইজ খানা দিবে না মানলাম, কবে দিবে সেটা তো বলা লাগবে।

লিডারের পাশের জন বলল, অবশ্যই অবশ্যই। প্রয়োজনে বাড়ি-ঘর ভাঙচুর হবে। এমন বদদোয়া দিব গুষ্টিমুদ্দা মইরা সাফ হয়ে যাবে।

মহিলা ফকির বলল, ন্যায্য কথা বলেছেন। অতি ন্যায্য।

লিডার বলল, ন্যায্য কি বলেন? এই কথা ন্যায্যের ওপরে দিয়া যায়। কোনো খোঁজখবর না দিয়া আয়োজন যারা করছে তারারে মাইর দেওয়া দরকার।

সমবেত আওয়াজ, অবশ্যই। অবশ্যই।

আয়োজক কারা বোঝা যাচ্ছে না। এর মধ্যে বেশ কিছু গাড়ি ঢাকা থেকে চলে এসেছে। একটা মাইক্রোবাস ভর্তি করে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কলিগ চলে এসেছে। দীর্ঘ পথভ্রমণে তারা ক্লান্ত। ফকির-মিসকিনদের মতোই ক্ষুধার্ত। তারাও ফুডের কী ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছে। তাদেরকেও কিছুটা ক্ষিপ্ত মনে হচ্ছে। ক্ষুধা সব মানুষকে এক কাতারে ফেলে। মৃত্যুর পরের জগতে ক্ষুধা নেই। সেখানে এই কারণেই হয়তো সবাইকে এক কাতারে ফেলা যাবে না।

বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমাদের অঞ্চলের বিখ্যাত ঝুম বৃষ্টি। কিছুক্ষণের মধ্যেই খোঁড়া কবরে পানি জমে গেল। বেশ কিছু ব্যাঙ পানিতে ঝাঁপাঝাপি করে আনন্দ প্রকাশ করছে। অপ্রত্যাশিতভাবেই তাদের জন্য পানির ব্যবস্থা হয়েছে, তাদের আনন্দিত হওয়ারই কথা।

শহরের ঝুম বৃষ্টি আর গ্রামের ঝুম বৃষ্টি আলাদা। শহরে ঝুম বৃষ্টি মানেই দুর্ভোগ। রাস্তায় একহাঁটু পানি। তীব্র যানজট, দূষিত বিষাক্ত পানিতে পা ডুবিয়ে পথচারীর বাড়ি ফেরা। গ্রামের ঝুম বৃষ্টি মানে বিশুদ্ধ আনন্দ।

অনেক দিন আগে বাড়ির পুকুরঘাটে বসে আছি, শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। দীঘির পানিতে বৃষ্টি পড়ছে, বুদ্বুদ উঠছে—দেখে মনে হচ্ছে পুকুরটা আনন্দে খলখল করে হাসছে। বাতাসে গাছের ডালপালা দুলছে, মনে হচ্ছে বৃষ্টির আনন্দে তারা নাচতে শুরু করেছে।

বৃষ্টি শুরু হয়েছিল বিকেলে। আমি ঠিক করলাম, বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত ঘাটে বসে থাকব। বৃষ্টি থামল এশার আজানের পর। তখন এক অদ্ভুত দৃশ্যের সূচনা হলো—হাজার হাজার জোনাক পোকা বের হয়ে এল। তারা সবাই একত্র হয়ে একটা বলের মতো বানাচ্ছে, আবার মুহূর্তের মধ্যে বল ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার বল তৈরি করছে। একসময় তারা আমার চারদিকে ঘুরতে লাগল, সেই ঘুরাও বিচিত্র। কিছুক্ষণ ক্লকওয়াইজ, আবার কিছুক্ষণ অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ। আমার মনে হলো, এই জোনাকিরা আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে, বলতে পারছে না। নিম্নশ্রেণীর কীটপতঙ্গের সঙ্গে আমাদের মানসিক যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা প্রকৃতি রাখেনি।

খ্রিষ্টান ধর্মযাজক লেমেট্রি একবার প্রার্থনা শেষ করে তার লেখার টেবিলে বসে ছিলেন। বেচারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। কারণ, সেদিন সন্ধ্যায় তিনি মহান পদার্থবিদ আইনস্টাইনের ধমক খেয়েছেন। ১৯২৭ সালের কথা। ব্রাসেলসের সলভে কনফারেন্সে এই ধর্মযাজক আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির ওপর একটি রচনা পাঠ করেন। যেহেতু আইনস্টাইন স্বয়ং সেই সভায় উপস্থিত, লেমেট্রির আগ্রহের সীমা ছিল না।

লেমেট্রি তাঁর রচনায় দেখান যে আইনস্টাইনের থিওরি অব রিলেটিভিটির সমাধান দাবি করে মহাবিশ্ব প্ৰসরণশীল। সর্বদিকে তা ছড়িয়ে পড়বে। আইনস্টাইন ধমক দিয়ে বলেন, অঙ্ক দিয়ে সবকিছু বিচার করবে না। অন্ধের মতো অঙ্ক অনুসরণ করলে যে পদার্থবিদ্যা তোমরা বের করবে, তা হলো ঘেন্নাকর (অববামিনে ফিজিক্স)।

লেমেট্রি তার ডায়েরিতে লিখলেন, আমি মানসিকভাবে পুরোপুরি বিপর্যস্ত অবস্থায় লেখার টেবিলে বসে ছিলাম। তখন একটা মশা এসে আমার কানের কাছে গুনগুন করতে লাগল। তার কাজ আমাকে বিরক্ত করা, কিন্তু আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম না। আমার মনে হচ্ছিল, সে আমাকে সান্ত্বনার কথা বলছে। আমি কথাগুলো বুঝতে পারছি না। সে শুধু যে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল তা না, আমাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছিল।

তার দুবছর পরই অ্যাস্ট্রোনোমার হাবল সাহেব মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুরবিন দিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঘোষণা করেন, সব গ্যালাক্সির মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল।

আইনস্টাইন লজ্জিত হয়ে লেমেট্রিকে চিঠি লিখে জানালেন—তোমার থিওরি বিস্ময়করভাবেই সুন্দর। আমার অভিনন্দন।

জীবিত মানুষের জীবনের একটি অংশ কাটে সুন্দরের অনুসন্ধানে। কেউ জোনাক পোকার ঝাঁকের সৌন্দর্য খোঁজে, আবার লেমেট্রির মতো মানুষেরা বিগ ব্যাং থিওরির ভেতর সুন্দর খোঁজে।

পরকালের মানুষেরা নিশ্চয়ই সৌন্দর্য খুঁজবে। কী সৌন্দর্য খুঁজবে?

আমি আমার শবদেহের জন্য খোঁড়া কবর দেখছি, বৃষ্টি দেখছি, দূরের মাইকিংয়ের শব্দ শুনছি। এদের মনে হয় কেউ খবর দেয়নি, ডেডবড়ি আসছে না।

একটি বিশেষ ঘোষণা-কলমাকান্দার কৃতী সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেচর’ ইফতেখার ইসলাম সাহেবের জানাজা…

দিনের আলো দ্রুত নিভে যাচ্ছে। আজও কি রাতে বৃষ্টি থামবে এবং ওই বিশেষ দিনটার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি বের হবে? মনে হচ্ছে তা-ই হবে।

আমি বা আমার চেতনা বা অন্য কিছু

আমি বা আমার চেতনা বা অন্য কিছু এখন দিলু রোডের বাড়িতে, আমার নিজের বাড়ি। এখানে কীভাবে উপস্থিত হয়েছি তা জানি না। আমার অবস্থা স্রোতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার মতো। স্রোত যেদিকে নিয়ে যাবে আমাকে যেতে হবে। নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় কিছু করার নেই। মনে হচ্ছে আমার চিন্তা নিয়ন্ত্রিত।

নিজের বাড়িতে এসে আমি আনন্দে অভিভূত হয়েছি। মনে হচ্ছে কত দীর্ঘ দিবস কত দীর্ঘ রজনীই না আমাকে বাইরে কাটাতে হয়েছে। এখন ফিরে এসেছি। সব আগের মতোই আছে। পলিন তার ঘরে ইন্টারনেটে কী যেন দেখছে। মনে হয় ফেসবুক আপডেট করছে। রুবিনা শাওয়ার ছেড়ে গোসল করছে। সকাল ১০টা বাজে। এই সময় সে একবার শাওয়ার নেয়। শাওয়ার নিয়ে সকালের নাশতা করে। আরেকবার শাওয়ার নেয় রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে আগে।

রান্নাঘরে নতুন একটা কাজের মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি। সে রুবিনার ব্রেকফাস্ট রেডি করছে। এক স্লাইস রুটি, এক গ্লাস মালটার রস, এক কাপ দুধ, একটা সেদ্ধ ডিম। টি-পট ভর্তি হালকা লিকারের চা দেওয়া হবে। রুবিনা নাশতা করার ফাঁকে ফাঁকে চা খাবে। দিনের প্রথম সিগারেটটা অবশ্য শুরুতেই খাবে। মালটার রসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে।

কাদের রান্নাঘরে ঢুকেছে। সে গলা নিচু করে বলল, ড্রয়িংরুমে গেস্ট আছে, এক কাপ কফি দেন। চিনি-দুধ অফ, ব্ল্যাক কফি। চিনি-দুধ ছাড়া এই জিনিস মানুষে ক্যামনে খায় কে জানে!

সালমা বলল, কফি আপনি নিজে বানায়া নিয়া যান। আমার হাত বন্ধ।

কাদের বলল, গেস্ট কে আসছে শুনলে হাতের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। ডিবির ইন্সপেক্টর। ম্যাডামকে অ্যারেস্ট করতে আসছে।

কন কী?

মার্ডার চার্জ। ম্যাডাম আমাদের স্যাররে বিষ খাওয়ায়ে মেরেছে। পত্রিকায় খবর চলে এসেছে।

ও আল্লাহ।

আপনের তো ‘ও আল্লা’ বলার দরকার নাই। ম্যাডাম বলবে ‘ও আল্লা’। যত্ন করে কফি বানায়া দেন, নিয়া যাই।

কফির সঙ্গে আর কিছু দিব? কেক দিব?

শুধু কফি চেয়েছে, শুধু কফি নিয়া যাব। বাড়তি যত্ন করলে সন্দেহ করবে। পুলিশের লোক। আমি নিজেও বিপদের মধ্যে আছি। দুনিয়ার প্রশ্ন করতেছে। আপনি বেঁচে গেছেন। আপনি জয়েন করেছেন স্যারের মৃত্যুর পর। তার পরেও টুকটাক প্রশ্ন আপনারেও করবে। ডিবি পুলিশ নিজের বাপরেও ছাড়ে না। এমন খতরনাক জিনিস।

কাদের কফি নিয়ে অতি বিনীত ভঙ্গিতে ডিবি ইন্সপেক্টর খলিলের সামনে রাখল। খলিল বলল, থ্যাংক য়্যু।

কাদের বিয়ে ভেঙে পড়ে বলল, স্যার, নো মেনশন।

খলিল বলল, বসার ঘরে বেশ কয়েকটা অ্যাসট্রে দেখছি। এখানে কি সিগারেট খাওয়া যায়?

জি, খাওয়া যায়। সিগারেট কি আপনার সঙ্গে আছে না এনে দিব?

সিগারেট সঙ্গে আছে।

স্যার, লাইটার কি আছে?

আছে, থ্যাংক য়্যু।

নো মেনশন, স্যার। ম্যাডাম এখন শাওয়ার নিতেছেন। শাওয়ার নিয়ে ব্রেকফাস্ট করবেন, তারপর আপনার কাছে আসবেন।

কোনো অসুবিধা নেই, আমি অপেক্ষা করব। ম্যাডামের মেয়েটি কি বাসায় আছে?

জি আছে। কী করতেছে জানি না, দেখে আসব?

দেখে আসতে হবে না। আপনি আমার সামনে বসুন। আপনার স্যারকে যে রাতে হাসপাতালে নিয়ে যান, সে রাতের ঘটনাটা আপনার মুখ থেকে শুনি। ঘটনা যা ঘটেছে তা-ই বলবেন। নতুন কিছু যুক্ত করবেন না, আবার কিছু বাদও দেবেন না। বলুন কী ঘটেছিল।

কাদের কী ঘটেছিল বেশ গুছিয়ে বলছে। আমি কাদেরের কথা শুনছি। সে কি ভাবছে তাও বুঝতে পারছি। পুলিশ ইন্সপেক্টর খলিল কী ভাবছেন তা বুঝতে পারছি না। মনে হয়, তিনি কিছু ভাবছেন না। কিংবা যা আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে সে খলিলের ভাবনা আমাকে জানাতে চাচ্ছে না।

কাদের বলছে, স্যার, আমি থাকি একতলায়। রাত আনুমানিক দেড় ঘটিকায় ম্যাডাম আমার ঘরে ধাক্কা দিলেন। আমি দরজা খুলতেই ম্যাডাম বললেন, মেইন রোডে গিয়ে দাঁড়াও। তোমার স্যারের শরীর খারাপ। অ্যাম্বুলেন্স আসতে বলেছি। এর মধ্যে চলে আসার কথা। তুমি অ্যাম্বুলেন্সকে বাসা চিনিয়ে নিয়ে আসবে। ম্যাডামের কথা শুনে আমি দৌড়ে রাস্তায় চলে গেলাম।

খলিল বলল, স্যারের কী হয়েছে জানতে চাইলেন না?

তখন জানতে চাই নাই।

অ্যাম্বুলেন্স আসার পর জানতে চেয়েছেন?

জি না। তখন রুগি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি।

অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিলেন?

জি। অবশ্যই।

খলিল সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ওই রাতে আপনার ম্যাডাম আপনার ঘরে যান নাই। তিনি আপনাকে মোবাইল টেলিফোনে সিগারেট কিংবা গাঁজার পুরিয়া আনতে বলেছেন। আপনি ওই জিনিস নিয়ে ফিরে এসে শোনেন অ্যাম্বুলেন্স এসে আপনার স্যারকে নিয়ে গেছে। আপনি হাসপাতালেও যান নাই।

আমি বুঝতে পারছি কাদের ভয়ে-আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়েছে। পুলিশ ইন্সপেক্টরের প্রতিটি কথাই সত্য। কাদের ভেবে পাচ্ছে না, এই লোক এত কিছু জানল কীভাবে।

খলিল হাই তুলতে তুলতে বলল, সমানে মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছেন। শরীর থেকে চামড়া খুলে ফেলব। কানে ধরে দশবার উঠবস করুন।

খলিলের কথা শুনে আমি অবাক। মিষ্টি গলায় আপনি আপনি করে কানে ধরে উঠবস করতে বলছে।

কাদের সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করল। খলিল বলল, আমি যতক্ষণ এই বাড়িতে থাকব আপনি ততক্ষণ কানে ধরে থাকবেন। আপনার ম্যাডাম যদি কান থেকে হাত নামাতে বলে তার পরেও নামাবেন না।

অবশ্যই। স্যার, বাথরুমে কি যাওয়া যাবে?

যাওয়া যাবে না কেন! কানে ধরে যাবেন।

খলিল আরেকটা সিগারেট ধরাল। সে আনন্দিত এবং উফুল্ল। খলিল চমৎকার প্যাঁচ খেলাচ্ছে। আমি প্রায় নিশ্চিত সে রুবিনাকে প্যাচে ফেলবে। সে প্রস্তুতি নিয়েই এসেছে।

আপনার নাম যেন কী?

কাদের।

এত লম্বা নামে তো ডাকতে পারব না। এখন থেকে আপনার নাম কাদু।

অসুবিধা নাই স্যার।

এখন যান, আপনার ম্যাডামের ব্রেকফাস্ট টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে থাকুন। ম্যাডাম যখন জিজ্ঞেস করবে কানে ধরা কেন, তখন আমার কথা বলবেন। খবরদার কান থেকে হাত নামাবেন না। কান থেকে হাত নামালে আপনাকে ট্যাবলেটের মতো গিলে ফেলব।

কান থেকে হাত নামাব না স্যার। আপনি যখন বলবেন তখন নামাব, তার আগে না।

খলিল ভুল করেছে। রুবিনা সহজ চিজ না। কাদেরকে কানে ধরিয়ে সে রুবিনাকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করছে। রুবিনা ভয় পাওয়া টাইপ মেয়ে। খলিলের সঙ্গে রুবিনার কথোপকথনের জন্য আমি অপেক্ষা করছি। আনন্দময় অপেক্ষা বলা যেতে পারে। কোনো একটা ভালো সিনেমা দেখার আগের মুহূর্তের আনন্দের মতো আনন্দ।

মৃতদেরও তাহলে আনন্দ-বেদনার ব্যাপার আছে। তবে আনন্দ-বেদনার তীব্রতা কম। কাদের কানে ধরে ঘুরছে—দৃশ্যটি মজার লাগছে। জীবিত মানুষ অন্যের বিব্রত অবস্থায় আনন্দ পায়। এ জগতেও তাই।

রুবিনা সিগারেট হাতে ড্রয়িংরুমে বসতে বসতে বলল, সরি, দেরি করলাম। খলিল উঠে দাঁড়াল, বিনীত গলায় বলল, ম্যাডাম, কোনো সমস্যা নেই। কাদের বলে একজন আমাকে কফি দিয়েছে, কফি খাচ্ছিলাম।

খলিল চাচ্ছিল, কাদেরের প্রসঙ্গ ওঠায় রুবিনা তার কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বিষয়ে কিছু বলবে। রুবিনা কিছুই বলল না।

খলিল বলল, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. ইফতেখারুল ইসলাম স্যারের ভিসেরা রিপোর্ট হাতে এসেছে। পাকস্থলীতে টক্সিক বস্তু পাওয়া গেছে। উচ্চমাত্রায় অরগ্যানো ফসফরাস।

রুবিনা সিগারেটে টান দিয়ে বলল, ও আচ্ছা।

খলিল চোখ সরু করে বলল, বিষটা কেউ তাকে খাইয়েছে।

রুবিনা বলল, কিংবা নিজেই খেয়েছে।

খলিল বলল, এই আশঙ্কা অবশ্যই আছে। সে ক্ষেত্রে ভিকটিম ডেথনোট রেখে যাবে। কিংবা মৃত্যুর আগে কাউকে বলে যাবে। আপনাকে কি কিছু বলে গেছেন?

না। তাকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছি। তিন দিন তিন রাত হাসপাতালে ছিল। মাঝে মধ্যে জ্ঞান ফিরেছে। কথাবার্তা বলেছে, কিন্তু বিষ খাওয়া নিয়ে কিছু বলেনি।

খলিল বলল, আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের খাতাপত্র, ডায়েরি এসব পরীক্ষা করে দেখতে চাই।

রুবিনা শক্ত গলায় বলল, কথায় কথায় আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক এই বুলশিট কপচাবেন না। আপনি কখনো তার ছাত্র ছিলেন না। আপনি যেমন আমার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছেন, আমিও আপনার বিষয়ে খোঁজ নিয়েছি। অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্সে আপনি কখনো পড়েননি। আপনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র। অনার্স পর্যন্ত পড়েছেন। অনার্সে থার্ডক্লাস পাওয়ায় আপনার এমএ পড়া হয়নি। আপনি কবিতা লেখার চেষ্টা করেন। অরুণিমা সেন। ছদ্মনামে কিছু অতি অখাদ্য কবিতা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। যা করবেন নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে করবেন। কোনো মেয়ের নামের আড়ালে করবেন না।

খলিল থতমত ভাব কাটাতে কাটাতে বলল, আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি?

রুবিনা বলল, অবশ্যই পারেন। আমি যদি সিগারেট খেতে পারি আপনিও পারেন। ভালো কথা, কাদের কানে ধরে ঘুরছে কেন?

ম্যাডাম, ও আমাকে কিছু মিথ্যা ইনফরমেশন দিয়েছে।

মিথ্যা ইনফরমেশনের শাস্তি যদি কানে ধরা হয়, তাহলে সিগারেট ফেলে আপনারও তো কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত। আপনিও আমাকে মিথ্যা ইনফরমেশন দিয়েছেন। বলেছেন, আপনি আমার স্বামীর ডিরেক্ট স্টুডেন্ট। যা আপনি না।

খলিল বলল, ম্যাডাম, কাদের একটি হত্যাকাণ্ডের সাসপেক্ট। আপনিও সাসপেক্ট। আমি তদন্তকারী অফিসার। মামলার তদন্তের সাহায্যের জন্য আমরা সাসপেক্টদের সঙ্গে কিছু মেন্টাল গেম খেলি। তার সঙ্গে আমি এক ধরনের মেন্টাল গেম খেলছি। কাদেরের মোরালিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন চট করে মিথ্যা বলবে না।

আমি একজন সাসপেক্ট?

জি ম্যাডাম। এ বাড়িতে যারা আছে সবাই সাসপেক্ট। আপনার মেয়ে পলিন, যার বয়স তের বছর, সেও সাসপেক্ট। চালুনি দিয়ে চেলে মূল আসামি বের করা হবে। এই কাজটি আমি ভালো পারি। কবি হিসেবে আমি ব্যর্থ হতে পারি, তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে আমার সুনাম আছে।

রুবিনা বলল, আমি যেহেতু সাসপেক্ট, আপনি নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে মেন্টাল গেম খেলবেন বা খেলা শুরু করেছেন।

ম্যাডাম, আপনার সঙ্গে আমি মেন্টাল গেম এখনো শুরু করিনি। তবে অবশ্যই শুরু করব।

কখন শুরু করবেন?

আপনি অনুমতি দিলে এখনই শুরু করতে পারি। ম্যাডাম, আমি আপনার স্বামীর ডেডবডি নিয়ে এসেছি। বারান্দায় দাঁড়ালেই দেখতে পাবেন পুলিশের গাড়ির পেছনে একটা অ্যাম্বুলেন্স আছে। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর কফিনে ডেডবডি আছে। সুরতহাল যেহেতু শেষ হয়েছে, ডেডবডির কাজ শেষ।

খলিল পকেট থেকে হলুদ খাম বের করল। হলুদ খামের ভেতর সরকারি সিলের কাগজ। খলিল সাহেব কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল, ম্যাডাম, এখানেই সই করে ডেডবডি রিসিভ করুন।

রুবিনা সই করল। খলিল বলল, সুরতহালের ডেডবডি এভাবে হ্যান্ডওভার করা হয় না। নানা ঝামেলার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। আমি দৌড়ঝাঁপ করে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে এসেছি। এটাই আমার মেন্টাল গেম। কাদেরকে আমি অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাব ভেবেছিলাম। ওকে আপাতত রেখে যাচ্ছি। বাসায় ডেডবড়ি, আপনাকে অনেক কাজকর্ম করতে হবে। একজন পুরুষের সাহায্য দরকার।

রুবিনার ঠোঁটের কোনায় ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল। সে মেন্টাল গেমটা পছন্দ করেছে।

ম্যাডাম, অনুমতি দিলে আমি উঠি। আপনার এখন অনেক ঝামেলা। ডেডবডি দ্রুত কবর দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। অতিরিক্তি গরম—ডেডবডি ডিকম্পোজ করা শুরু হয়েছে।

রুবিনা সিগারেট ধরাল। সে বড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে—এ রকম মনে হচ্ছে না। খলিল ডাকল, কাদু কোথায়? কাদু।

রুবিনা বলল, কাদুটা কে?

কাদের অনেক লম্বা নাম তো, এজন্য শর্ট করে কাদু ডাকছি। আপনি যেমন আপনার স্বামীর বন্ধু রবিউলকে রবি ডাকেন অনেকটা সে রকম।

কাদু সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সে এখনো কানে হাত দিয়ে আছে। চোখ লাল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

খলিল বলল, অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে আপনি আপনি করে কথা বলা হয়েছে। এখন থেকে তুমি, তারপর তুই। ঠিক আছে।

কাদের বলল, জি স্যার, ঠিক আছে।

কাদু, কান থেকে হাত নামাও। তোমার এখন প্রচুর কাজ। তোমার স্যারের ডেডবডি নিয়ে এসেছি। কোথায় রাখবে ঠিক করো। প্রচুর বরফ লাগবে। বরফের ব্যবস্থা করো। গ্রামের বাড়িতে ডেডবডি নিতে চাইলে মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করো। চা-পাতা-ফাতা কী কী যেন লাগে। কোনো একটা শেষ বিদায় স্টোরে চলে গেলে সবকিছু পাবে।

রুবিনা বলল, উইল ইউ প্লিজ লিভ আস নাও!

খলিল দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, অবশ্যই ম্যাডাম! এক্ষুনি চলে যাচ্ছি। আমার ধারণা, কেউ টেলিফোন করলে আপনি এখন ধরবেন না। দয়া করে আমারটা ধরবেন। আপনার নিজেকে ক্লিয়ার করার একটা পথ আছে। যদি আপনার স্বামীর লেখা কোনো কাগজ পান। যদি লেখা থাকে আমি স্বেচ্ছায় বিষপান করেছি। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। এ রকম কিছু যদি না পান আপনি উদ্ধার পেতে পারেন। এখন একটা সৎ পরামর্শ দেব।

রুবিনা বলল, কী রকম?

এনায়েত নামে একজন লোক আছে, কারওয়ান বাজারে থাকে। মানুষের সই জাল করার ব্যাপারে তার দক্ষতা অসাধারণ। জাল পাসপোর্ট, জাল দলিলে তার ওপর কেউ নেই। তার টেলিফোন নাম্বার কি দেব?

রুবিনা জবাব দিল না। কঠিন চোখে তাকিয়ে রইল। এই প্রথম আমি খলিল কী চিন্তা করছে তা ধরতে পারলাম। এনায়েত নামের লোকটিও তার ফাদের অংশ। এনায়েত ডিবি পুলিশের লোক। রুবিনা তার কাছে জাল কাগজ তৈরি করতে যাবে এটাই ফাঁদ। কফিন রাখা হয়েছে শোবার ঘরের উত্তরের বারান্দায়। বাড়িতে থমথমে আতঙ্ক। কাদের মাথায় টুপি পরে ফেলেছে। টুপি মাথায় কাদেরকে কখনো দেখিনি। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। টুপির কারণেই হয়তো মুখ লম্বাটে হয়েছে। কাদের কাপভর্তি চালে আগরবাতি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আগরবাতিগুলো হয় ভেজা কিংবা কোনো ভেজাল আছে। একটু জ্বলেই নিভে যাচ্ছে। কাদের ব্যস্ত আগরবাতির তদারকিতে।

সালমা মাথায় ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘরে সময় কাটাচ্ছে। ধোয়া বাসন আরেকবার ধুয়ে ফেলছে। মুখে বিড়বিড় করছে, আল্লাহ রহম করো। দুপুরে এই বাড়িতে রান্না হবে কি না তা বুঝতে পারছে না। মরা-বাড়িতে চুলা জ্বালানোর নিয়ম নেই, তবে বড়লোকের বাড়ির নিয়মকানুন থাকে। আলাদা। দুপুরে ম্যাডাম যদি বলেন, ‘খানা লাগাও, তখন সে কী করবে? কাদেরের কাছে সে পরামর্শ চেয়েছিল। কাদের মুখ ঝামটা দিয়ে বলেছে, আমারে দিক করবেন না। আমার সব বুদ্ধি শেষ। যা করার নিজের বুদ্ধিমতো করেন।

সালমা বলল, রাইস কুকারে চাল দিয়ে রাখি আর ফ্রিজ থেকে ইলিশ মাছ বার করে রাখি। ম্যাডাম খানা দিতে বললে দশ মিনিটের মধ্যে খানা দিতে পারব। রান্না খাসির মাংস আছে, মাইক্রোওভেনে গরম করে দিব। চলবে না?

কাদের বলল, চলবে কি না জানি না। আমি বাঁচি না নিজের যন্ত্রণায়।

কাদের অবশ্যই নিজের যন্ত্রণায় অস্থির। সে পালিয়ে যাওয়ার ধান্ধায় আছে। বাগেরহাটে থাকে তার স্কুলজীবনের বন্ধু শামসুদ্দিন। শামসুদ্দিনের কাঠ চেরাইয়ের কল আছে। তার কাছে মাসখানিক পালিয়ে থাকা যায়। প্রয়োজনে সেখান থেকে ইন্ডিয়া চলে যাওয়া। ডিবি পুলিশের ভাবভঙ্গি তার কাছে মোটই ভালো লাগছে না। এই হারামজাদা অবশ্যই তাকে রিমান্ডে নিয়ে যাবে।

পালিয়ে যেতে হলে তাকে যেতে হবে এক কাপড়ে। ব্যাগ নিয়ে বের হলেই সবাই সন্দেহ করবে। খালি হাতেও যাওয়া যায় না, টাকা-পয়সা দরকার। কাদের তার মানিব্যাগ খুলে টাকা গুনল। এক হাজার টাকার একটা নোট আছে। ভাংতি টাকা আড়াই শয়ের মতো। এত অল্প টাকা নিয়ে রওনা হওয়া ঠিক না। কয়েকটা জরুরি জিনিস কেনা দরকার এই বলে সে কি ম্যাডামের কাছে টাকা চাইবে? ম্যাডাম এখন দুঃখ-ধান্ধায় আছে। এই অবস্থায় কত টাকা যাচ্ছে তা কেউ খেয়াল করে না।

রুবিনা আধঘন্টার ওপর শোবার ঘরের রকিং চেয়ারে বসে আছে। তার হাতে মোবাইল ফোন। আধঘণ্টা আগে সে রবিকে টেলিফোন করেছিল। খলিল ঠিকই বলেছে, রবির আসল নাম রবিউল। রুবিনা ছোট করে ডাকে রবি। রুবিনাকে ছোট করলে হয় রুবি, রবিউল ছোট করলে হয় রবি। রুবি রবিতেও মিল।

প্রথম দুবার কলে রবি ধরেনি। তৃতীয়বারে ধরল।

রুবিনা বলল, এক্ষুনি বাসায় আসো। পুলিশ ওর ডেডবডি বাসায় দিয়ে গেছে। এখন আর আমার মাথা কাজ করছে না। তোমাকে ব্যবস্থা করতে হবে।

রবিউল বলল, তোমার বাসায় আসা সম্ভব না। পত্রিকায় নিউজ হয়েছে জানো? সেখানে আমার নাম আছে। খুবই ফালতু পত্রিকা, কেউ পড়ে—সাতসকাল নাম। হেডিং করেছে—স্ত্রী কর্তৃক অধ্যাপক স্বামী খুন। তোমাকে পড়ে শোনাব?

পড়ে শোনাতে হবে না। পত্রিকা নিয়ে চলে এসো।

বললাম তো আসা সম্ভব না। আবার নিউজ হয়ে যাবে। ডিবি পুলিশও আমাকে সন্দেহ করছে। কিছুক্ষণ আগে ডিবি পুলিশের এক ইন্সপেক্টর টেলিফোন করেছে, নাম খলিল।

তুমি তা হলে আসতে পারছ না?

না। সম্ভব না। তোমাকে বাস্তব বুঝতে হবে। তোমার বাড়ির সামনে নিশ্চয় সাংবাদিক ঘুরঘুর করছে।

আমার বাড়ির সামনে কোনো সাংবাদিক ঘুরঘুর করছে না।

ওরা আড়ালে-আবডালে থাকে। সুযোগমতো উদয় হয়। এদের আমি সুযোগ দেব না।

আচ্ছা, ঠিক আছে।

রুবিনা, সরি।

সরি হওয়ার কিছু নেই।

রুবিনা মোবাইল হাতে রকিং চেয়ারে দুলছে। বেচারিকে দেখে মায়া লাগছে। কেউ তার পাশে নেই, অবশ্য সে চাচ্ছেও না কেউ তার পাশে থাকুক। তার বাবা-মা আমেরিকায় থাকলেও বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন ঢাকায় থাকেন। পুলিশের একজন অ্যাডিশনাল আইজি তার চাচাতো ভাই। রুবিনা কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করছে না।

রকিং চেয়ারের দুলুনি বন্ধ করে রুবিনা ডাকল, কাদের!

কাদের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত হলো। এখন তার হাতে তসবি। সে তসবি ঘোরাচ্ছে, কিন্তু মনে মনে কিছু পড়ছে না। পড়লে আমি বুঝতে পারতাম। কাদেরের কর্মকাণ্ডে আমি মজা পাচ্ছি। মৃত্যুর পরেও মজা পাওয়ার বিষয়টা নষ্ট হচ্ছে না, এটা ভালো।

কাদের! সিগারেট নিয়ে আসো।

এক কার্টুন নিয়ে আসি, ম্যাডাম?

আনো।

সালমা দুই-একটা টুকটাক জিনিস চেয়েছে। চা-পাতা, চিনি, কফি। আনব?

আনো।

দুপুরে কি ঘরে পাক হবে, ম্যাডাম?

পাক হবে না কেন? মানুষের মৃত্যু হয়, ক্ষুধার মৃত্যু হয় না।

কাদের বলল, আপনার আর কিছু লাগবে ম্যাডাম?

একটা পত্রিকা নিয়ে আসতে পারো, সকাল না কী যেন নাম?

সাতসকাল।

হ্যাঁ, সাতসকাল। থাক, পত্রিকা আনতে হবে না।

টাকা দেন, ম্যাডাম। দুই হাজার দিলেই চলবে।

আমার খাটের ডান দিকের ড্রয়ারে টাকা আছে। তাড়াতাড়ি আসবে। আমার সিগারেট শেষ।

ড্রয়ার খুলে কাদের ৫০ হাজার টাকার একটি বান্ডিল পেল। ব্যাংকের সাটা কাগজ নেই, বান্ডিল থেকে কিছু হয়তো খরচ হয়েছে। কাদের বান্ডিল নিয়ে বের হচ্ছে। আমি ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার করছি। আমার চিক্কার রুবিনার কানে গেল না। যাওয়ার কথাও না।

আমি কাদেরের সঙ্গে আছি। কাদের লক্ষ্য করছে না আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন তাকে অনুসরণ করছে। সে ইন্সপেক্টর খলিলের লোক। তাকে রাখা হয়েছে বাড়ির ওপর নজরদারির জন্য। সে মোবাইলে খলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করল।

কাদের রাস্তার পাশের এক চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ানো। চায়ের অর্ডার দিয়েছে। কাদের সিগারেট খায় না। একটা সিগারেটও সে ধরিয়ে খুক খুক করে কাশল। সে ভয়াবহ আনন্দে আছে। মুক্তির আনন্দ।

খুব ইচ্ছে ছিল কাদেরের সঙ্গে সঙ্গে থাকার। সেটা সম্ভব হলো না। আমি এখন পলিনের ঘরে। পলিন তার ফেসবুকে ইংরেজিতে তথ্য দিচ্ছে। তথ্যের বাংলাটা এমন:

আমার সত্ত্বাবার শবদেহ এখন বারান্দায় রাখা আছে। কফিনের ভেতর তিনি আছেন। আমার খারাপ লাগছে। কান্না পাচ্ছে। আমার এই সবাবা আমাকে খুব আদর করতেন। তিনি অত্যন্ত জ্ঞানী ছিলেন। আমাকে বিজ্ঞানের অনেক কিছু বলতেন। তিনি অঙ্ক করে একবার আমাকে দেখিয়েছেন যে ৩ সমান ২ হতে পারে। তিনি কীভাবে করেছিলেন আমার মনে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর কাছে শিখে নিতাম।

রুবিনা রান্নাঘরে, তার হাতে এক হাজার টাকার একটা নোট। রুবিনা সালমাকে বলল, আমাকে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দাও, কাদের দেরি করছে। সিগারেট আনতে পারবে না? ড্রাইভার আসেনি। ড্রাইভার থাকলে তাকে পাঠাতাম।

সিগারেট আনতে পারব আপা। আপনি গেটে দারোয়ানরে বলে দেন। দারোয়ান আটকাবে।

বলে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি এসো। বেনসন অ্যান্ড হেজেস আনবে—লাইট।

জি আচ্ছা। যাব আর আসব।

সালমা তার ব্যাগ নিয়ে বের হলো। আর ফিরল না।

পলিনের ফেসবুকের আপডেট:

আজ আমাদের বাসায় রান্না হয়নি। আমি আর মা অরেঞ্জ জুস এবং দুধ খেয়েছি। আর ডিম সিদ্ধ খেয়েছি। কাদের চাচা আর সালমা খালা বাজার করতে গিয়ে ফিরে আসেননি। মায়ের ধারণা, তারা দুজনেই পালিয়ে গেছে।

.

সন্ধ্যাবেলা ডিবি ইন্সপেক্টর খলিল টেলিফোন করল। রুবিনা টেলিফোন ধরল। খলিল বলল, ম্যাডাম, আপনাদের বাড়ির কেয়ারটেকারকে মহাখালী বাসস্টেশন থেকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তাকে থানা হাজতে নিয়ে যাব, না কি আপনার কাছে পাঠিয়ে দেব?

রুবিনা বলল, আমার কাছে পাঠিয়ে দিন।

আপনার বাসার কাজের মেয়ে সালমার মোবাইল ফোন আমরা ট্র্যাক করছিলাম। তাকেও ধরা হয়েছে। তার ব্যাগে বেশ কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। তাকেও কি পাঠিয়ে দেব।

হ্যাঁ। রাতে রান্না করবে।

খলিল বলল, ম্যাডাম, আমি আমার জীবনে অনেক অদ্ভুত মানুষ দেখেছি, আপনার মতো দেখিনি।

রুবিনা বলল, আমার চেয়েও অনেক অদ্ভুত আমার স্বামী। তিনি মারা গেছেন, তাঁর সব অদ্ভুতের সমাপ্তি হয়েছে। আমি কি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?

পারেন। স্বা

মীর ডেডবডি নিয়ে আমি বিপদে পড়েছি। ভালো বিপদে পড়েছি। আপনি কি কোনো গতি করতে পারেন?

কী ধরনের গতি?

ডেডবড়ি তাঁর গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে পারেন?

হ্যাঁ, পারি।

সাসপেক্ট হিসেবে আপনারা কি আমাকে অ্যারেস্ট করবেন?

এখনো না। আপনি তো পালিয়ে যাচ্ছেন না, আমাদের নজরদারিতেই আছেন। তবে আপনার বন্ধু রবিউলকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। যাকে আপনি আদর করে রবি ডাকেন।

ও, আচ্ছা।

আপনার জন্য আরেকটি দুঃসংবাদ আছে। আপনার হাজব্যান্ডের বড় মামা কিছুক্ষণ আগে মারা গেছেন। সরি।

রুবিনা বলল, আপনি সরি হচ্ছেন কেন? আপনি তো তাকে মারেননি।

আপনাকে একটি দুঃসংবাদ দিয়ে কষ্টের কারণ হয়েছি বলে সরি বললাম।

ঠিক আছে।

আমার কাছ থেকে আর কোনো সাহায্য কি আপনি চান।

চাই। এনায়েত নামের একজনের টেলিফোন নাম্বার দেবেন বলেছিলেন। টেলিফোন নাম্বারটা চাই। তার আগে জানতে চাই আমি আপনার প্রধান সাসপেক্ট। আমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছেন কেন?

আপনার মতো রূপবতী একজন ফাঁসিতে ঝুলবে ভাবতে কষ্ট লাগছে বলেই হয়তো বলছি।

আমি কুরূপা হলে কি এনায়েতের নাম্বার আপনি দিতেন না?

হয়তো না। নাম্বারটা লিখুন।

একটু ধরুন, আমি কাগজ-কলম নিয়ে আসছি।

রুবিনা কাগজ-কলম আনতে গেছে আমি আর্তচিৎকার করছি—রুবিনা ভুল করবে না। ভয়ংকর ফাঁদে পা দেবে না। খবরদার খবরদার খবরদার।

রুবিনা শান্ত ভঙ্গিতে টেলিফোন নাম্বার লিখল। রুবিনা ফাঁদে পা দিতে যাচ্ছে, আমি তাকে আটকাতে পারছি না। আমি একজন অবজার্ভার ছাড়া কিছুই না। শুধু দেখা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।

রুবিনার ঠোটের ফাঁকে বাঁকা হাসি। এই হাসি আমার পরিচিত। কোনো দুষ্টু বুদ্ধি তার মাথায় এসেছে। ভয়ংকর কোনো দুষ্টু বুদ্ধি। দুষ্টু বুদ্ধিটা কী হতে পারে।

রুবিনা এনায়েত নামের ডিবি পুলিশের এজেন্টের কাছে টেলিফোন করছে। আমি আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করছি।

আপনি এনায়েত।

হুঁ।

শুনেছি, আপনি মানুষের দস্তখত নকল করতে পারেন। আসলেই কি পারেন?

আপনার কী দরকার সেটা বলেন। ধানাই-পানাই কথা না। কাজের কথায় আসুন।

আমার স্বামীর দস্তখত নকল করতে পারবেন?

না পারার কারণ দেখি না।

একটা কাগজে লেখা থাকবে, আমার মৃত্যুর জন্য ডিবি ইন্সপেক্টর খলিল দায়ী। এর নিচে আমার স্বামীর দস্তখত করে দিবেন। পারবেন? দস্তখতের নমুনা ডিবি ইন্সপেক্টর খলিল সাহেবের কাছে আছে। তার কাছ থেকে নিয়ে নেবেন। এই কাজের জন্য কত টাকা নেবেন?

আমি বললাম, সাবাস।

আফসোস আমার সাবাস বলাটা রুবিনা শুনতে পেল না। রুবিনার বুদ্ধিতে চমকৃত হয়ে আমি একজীবনে অনেকবার বলেছি, সাবাস।

একবার আমার দামি একটা মোবাইল ফোন হারিয়ে গেল। মোবাইল ফোনটা বাথরুমের বেসিনের ওপর রেখে মুখ ধুয়ে শোবার ঘরে ঢুকেছি।

তখন মনে পড়ল মোবাইল ফোন বাথরুমে রেখে এসেছি। বাথরুমে ঢুকে দেখি ফোন নেই। শুধু বাথরুমে কেন সারা বাড়িতে কোথাও নেই।

রুবিনা বলল, শোবার ঘরে আমি বসে আছি। তুমি বাথরুম থেকে বের হওয়ার পর সেখানে কেউ ঢোকেনি।

আমি বললাম, মোবাইল ফোনটা বাথরুমের বেসিনে আমি রেখেছি। বেসিন সামান্য ভেজা ছিল, টাওয়েল দিয়ে মুছে তার ওপর রেখেছি।

রুবিনা বলল, তাহলে এই কাজটা তুমি করেছ তোমাদের ইউনিভার্সিটির বাথরুমে। তোমার ব্রেইন ইউনিভার্সিটির বাথরুম আর বাড়ির বাথরুমে গুলিয়ে ফেলছে। টেলিফোন করে খোঁজ নাও।

খোঁজ নিয়ে ইউনিভার্সিটির বাথরুমে মোবাইল ফোন পাওয়া গেল। আমি মনে মনে বললাম, সাবাস!

মাইক্রোবাসে করে আমার ডেডবডি

সন্ধ্যা ছয়টা।

মাইক্রোবাসে করে আমার ডেডবডি গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে। ড্রাইভারের পাশে বসেছে কাদের। এক দিনে সে বুড়ো হয়ে গেছে। সোজা হয়ে হাঁটতে পারছে না, বাঁকা হয়ে হাঁটছে। কথাও পরিষ্কার বলতে পারছে না। সব কথাই জড়ানো। ধরা পড়ার পর পুলিশ তাকে ভালোমতো ডলা দিয়েছে। নিচের ঠোট কেটে ফুলে উঠেছে। এই ফোলা মনে হয় আরও বাড়বে। সে কেন পালিয়ে গিয়েছিল, এই ব্যাখ্যা রুবিনাকে দিতে গিয়েছিল। রুবিনা বলল, তোমার কথা পরে শুনব। তোমার স্যারের ডেডবডি নিয়ে রওনা হয়ে যাও।

কী নিয়ে রওনা হব, ম্যাডাম?

তোমার স্যারের ডেডবডি।

কাদের ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, ‘জি ম্যাডাম।‘ এমনিতেই সে আতঙ্কে ছিল, এখন সেই আতঙ্ক দশ গুণ বাড়ল। চোখ কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম হলো।

কাজের মেয়ে সালমা ফিরে এসেছে। যেন কিছুই হয়নি, এই ভাব নিয়ে সে রান্না বসাচ্ছে। একবার এসে বলে গেল, মরা বাড়িতে মাছ খাওয়া নিষেধ। ইলিশ মাছের বদলে ডিমের সালুন করি?

রুবিনা হাই তুলতে তুলতে বলল, যা ইচ্ছা করো।

ডিবি ইন্সপেক্টর খলিল আমার স্টাডিরুমে। সেখানে সে কী করছে, কিছুই বুঝতে পারছি না। সেই ঘরটা দেখতে পাচ্ছি না। রুবিনাকে দেখতে পাচ্ছি, সে সন্ধ্যাবেলার শাওয়ার নিচ্ছে। পলিনকে দেখছি, সে কম্পিউটারে গেম খেলছে। গেমের নাম ‘ডায়মন্ড রাশ’। পলিনের সঙ্গে এই খেলা আমিও অনেকবার খেলেছি। অ্যাংকরের গোপন গুহায় ঢুকে হীরা সংগ্রহ করতে হয়। নানা ঝামেলা আছে। মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়ে, সাপ এসে ছোবল দেয়। আমি সব ঝামেলা এড়াতে পারি না। পলিন পারে।

আমি এখন শীতার্ত। শরীর থাকলে বলতাম, শীতে শরীর কাঁপছে। শরীর নেই, তার পরও শীতের অনুভূতি। ভয় হচ্ছে, এই শীত কি আরও বাড়বে? যদি আরও বাড়ে, তখন কী হবে? তার চেয়ে বড় চিন্তা, আমার ডেডবডি কবর হয়ে যাওয়ার পর আমার কী হবে? আমার অস্তিত্ব থাকবে, নাকি থাকবে না? কবরে নামানোর দৃশ্য কি আমি দেখতে পাব? এই দৃশ্যটা আমার দেখার শখ আছে।

ইন্সপেক্টর খলিল টেলিফোনে জানিয়েছিল, বড় মামা মারা গেছেন। আমার জন্য এটা ছিল অতি আনন্দের সংবাদ। বড় মামার নিশ্চয়ই আমার অবস্থা হয়েছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।

এখনো সেটা সম্ভব হয়নি। যে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে বড় মামার সঙ্গে আমাকে দেখা করায়নি। সে কি আমাকে নিয়ে বিশেষ কোনো পরিকল্পনা করছে? পরিকল্পনাটা কী?

পুরো স্মৃতিশক্তি আমাকে দেওয়া হয়নি। আমাকে বিষ খাওয়ানোর বিষয় আমার মনে নেই। জুঁই নামের যে মেয়েটি রাত তিনটায় রুবিনাকে টেলিফোন করেছিল, তার কথা মনে নেই। পলিনের বাবা কে, তা-ও মনে নেই।

এমনকি হতে পারে যে আমাকে শুধু প্রয়োজনীয় তথ্য দেওয়া হচ্ছে? অপ্রয়োজনীয় তথ্য কম্পিউটারের ভাইরাসের মতো। অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রাম। দিয়ে আটকে দেওয়া হচ্ছে। আদার রিয়েলিটি বইয়ে পড়েছিলাম, মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা—সবই হলো ম্যাট্রিক্স ছবিটার মতো, কম্পিউটারের খেলার মতো ভারচুয়াল গেম। আমরা একজন মাস্টার প্রোগ্রামের তৈরি বিনোদন খেলা।

রুবিনা মেয়েকে নিয়ে চা খেতে বসেছে। রুবিনা যথারীতি এক পট চা নিয়ে বসেছে। পিরিচে কাটা আপেল, মাখন লাগানো টোস্ট বিস্কুট। ছোট্ট গ্লাসে বেদানার রস। রুবিনা চোখমুখ কুঁচকে বেদানার রস খেল। পলিন বলল, বেদানার রস তুমি পছন্দ করো না?

করি তো?

তা হলে খাওয়ার সময় মুখ কুঁচকাও কেন?

রুবিনা বলল, কষ্টা, এই জন্য পছন্দ করি না।

তা হলে খাও কেন?

প্রচুর ভিটামিন-ই আছে, এই জন্য খাই। অ্যান্টি-এজিং প্রপার্টি আছে।

বেদানার রস খেলে তোমার বয়স বাড়বে না?

ধীরে বাড়বে।

তুমি কি অনেক দিন বেঁচে থাকতে চাও?

সবাই চায়।

আমি চাই না।

অল্প বয়সে মরে যেতে চাও?

হুঁ। ওই লোক বাবার স্টাডিরুমে এতক্ষণ ধরে কী করছে?

রুবিনা চমকে উঠে বলল, বাবা বলছ কেন? তুমি তো ওকে কখনো বাবা ডাকতে না।

মনে মনে ডাকতাম। এখন উনি মারা গেছেন, তাই মনে মনে না ডেকে ঠিকমতো ডাকছি।

তুমি তাকে পছন্দ কর?

হুঁ। তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দিচ্ছ না কেন? ওই লোকটা বাবার স্টাডিরুমে ঢুকে কী করছে?

তার কাগজপত্র, ডায়েরি—এই সব ঘাঁটাঘাঁটি করছে।

কেন?

সে ডিবি পুলিশের লোক। তার ধারণা, তুমি এখন যাকে বাবা ডাকছ, তাকে খুন করা হয়েছে। এই বিষয়ে তদন্ত করছে।

কে খুন করেছে?

এখনো সে বের করতে পারেনি।

বের করতে পারবে?

জানি না পারবে কি না।

শার্লক হোমস থাকলে পারত। শার্লক হোমসের অনেক বুদ্ধি। তুমিও পারবে, তোমার অনেক বুদ্ধি। মা, তুমি কি জান, কে খুন করেছে?

না।

ওই লোক কি জানে?

সে-ও জানে না। তবে তার ধারণা, আমি খুন করেছি।

মা, তুমি কি করেছ?

না, আমি খুন করিনি। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করেছ?

পলিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, করেছি। কারণ, তুমি কখনো মিথ্যা বল না।

রুবিনা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি যাকে এখন বাবা ডাকছ, এই মানুষটা পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ভালো মানুষ। বিবাহিত জীবনে কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে রাগ করেনি।

বাবা যে ভালো মানুষ, এটা আমি জানি। কম্পিউটার গেমের সাপগুলোও জানে। তারা সহজে বাবাকে ছোবল দিতে চায় না।

আমি এখন আর রুবিনা ও পলিনকে দেখতে পাচ্ছি না। রুবিনা ও পলিন এই মুহূর্তে যে কথাটি বলল, তা আমাকে জানানোর জন্যই হয়তো এই দুজনকে এতক্ষণ দেখছিলাম। আমাকে জানানো শেষ হয়েছে বলে এদের দেখছি না। আমি দেখছি খলিলকে। সে বইয়ের তাকের পেছন থেকে ছোট্ট একটা শিশি উদ্ধার করেছে। শিশির গায়ে লেখা, ‘উইপোকার বিষ’। শিশির অর্ধেকটা খালি। খলিল খুব সাবধানে পলিথিনের ব্যাগে শিশি ভরে পকেটে রাখল। তাকে অসম্ভব চিন্তিত মনে হচ্ছে। যে বিষ খাইয়ে হত্যা করবে, সে বিষের শিশি ফেলে যাবে না। তবে অসম্ভব বুদ্ধিমতী রুবিনা এই কাজটি করতে পারে।

খলিল ভাবছে, এই মহিলার সঙ্গে কথাবার্তায় আরও সাবধান হতে হবে। ছোটখাটো ফাঁদ পেতে একে ধরা যাবে না। তার জন্য লাগবে বড় ফাঁদ। এনায়েতের ব্যাপারটা এই মেয়ে যেভাবে হ্যান্ডেল করেছে, তা বিস্ময়কর।

খলিল এখন আমার ডায়েরির পাতা উল্টাচ্ছে। এখানে সে কিছুই পাবে না। আমি ডায়েরিতে ব্যক্তিগত কিছুই লেখি না। কোয়ান্টাম জগতের রহস্যময়তা নিয়ে লেখি। অঙ্কের কিছু প্যারাডক্স লেখা হয়েছে। প্যারাডক্সগুলো পলিনের জন্য লেখা। সে অত্যন্ত পছন্দ করে। এই মুহূর্তে খলিল আগ্রহ নিয়ে অঙ্কের একটা প্যারাডক্স দেখছে। আমি লিখেছি:

৩৬ ইঞ্চি=১ গজ

উভয় পক্ষকে ৪ দিয়ে ভাগ দিলাম

৯ ইঞ্চি = ১/৪ গজ

উভয় পক্ষে বর্গমূল করা হলো

৯ = ১/৪

তাহলে দাঁড়ায়

৩ = ১/২

অর্থাৎ ৬ ইঞ্চি = ১ গজ

একটু আগে দেখানো হয়েছে, ৩৬ ইঞ্চি সমান এক গজ। এখন অঙ্কে প্রমাণ করা হলো ৬ ইঞ্চি সমান এক গজ। কী করে সম্ভব?

খলিল মাথা চুলকাচ্ছে। কাগজ-কলম নিয়ে বসেছে। প্যারাডক্স মাথায় ঢুকে গেছে। অতি সামান্য প্যারাডক্সে সে অস্থির, আর আমি ঢুকে গেছি প্যারাডক্সের মহাসমুদ্রে।

.

খলিল ও রুবিনা বসার ঘরে। রুবিনা ব্যস্ত নখে নেলপলিশ দেওয়া নিয়ে। অ্যাশট্রের এক কোনায় তার ধরানো সিগারেট পুড়ছে। সিগারেটের ভেতর গাঁজা ভরা আছে। বিকট গন্ধ আসছে। রুবিনার হাতে নেলপলিশের ব্রাশ। আমি দুজনকে দেখছি। রুবিনা কী ভাবছে, বুঝতে পারছি না। খলিলের চিন্তা ধরতে পারছি। রুবিনার চিন্তা-কল্পনা ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। এমন সময় কি আসবে যে আমি দেখতে পাব; কিন্তু কে কী বলছে, তা শুনতে পাব না? মৃতের জগৎ পরাবাস্তব জগৎ। বাস্তবতা ব্যাপারটাই অবশ্য অত্যন্ত ধোঁয়াটে।

ক্লাসে বাস্তবতা নিয়ে আমি একবার একটা বক্তৃতা দিয়েছিলাম। আমার বক্তৃতার বিষয় ছিল বাস্তবতার বিষয়টি মানুষের মস্তিষ্ক তৈরি করে। রেটিনা থেকে ইনফরমেশন মস্তিষ্কে যায়। মস্তিষ্ক তা প্রসেস করে আমাদের যা দেখায়, তা-ই আমাদের কাছে রিয়েলিটি। প্রসেসিং প্রক্রিয়ায় সামান্য ত্রুটি হলে রিয়েলিটি অন্য রকম হবে। আমরা যা দেখছি, তা-ই বাস্তব মনে করার কিছু নেই। আমাদের মস্তিষ্ক যা ভাবতে বাধ্য করছে, তা-ই বাস্তব।

ক্লাসের একটি মেয়ে প্রশ্ন কলল, স্যার, আমি যে ক্লাসে বসে আছি, এটা কি বাস্তব?

আমি বললাম, তোমার নাম কী?

সে বলল, বকুল।

আমি বললাম, আমাদের মস্তিষ্ক এমন ট্রিক করতে পারে যে ফুলের নামে যাদের নাম, তাদের দেখামাত্র সেই ফুলের গন্ধে চারদিক ম ম করতে থাকবে। মস্তিষ্ক এই রিয়েলিটি তৈরি করছে, যা মূল রিয়েলিটির বাইরে।

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ক্লাসের একজন ছাত্র মুখ শুকনা করে বলল, স্যার, ওর গা থেকে গোবরের গন্ধ আসছে। সে কি তাহলে গোবর?

সবাই হো হো করে হাসতে শুরু করল। সবার আগে হাসল বকুল। আমার হাসি এল না। ক্লাসভর্তি ছাত্রছাত্রীর হাসির শব্দে মাথা গমগম করতে লাগল।

এখন আবার হাসির শব্দ শুনছি। ত্রিশ-চল্লিশজন ছাত্রছাত্রীর হাসির শব্দ নয়। হাজার হাজার মানুষের চাপা হাসি। কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কী ঘটতে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না। আমি কি অন্য কোনো বাস্তবতায় ঢুকতে যাচ্ছি? হাসির শব্দ ছাপিয়ে রুবিনার গলা শুনলাম, স্টাডিরুমে কিছু পেয়েছেন?

ইনসেকটিসাইডের একটা বোতল পেয়েছি। বোতলে কী আছে, তা জানার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠাব।

খাতাপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে কিছু পাননি?

না। আমি আপনার মেয়ে পলিনকে কিছু প্রশ্ন করতে চাই।

আজ বাদ থাক। আরেক দিন করুন। তার বাবার ডেডবডি সারা দিন বারান্দায় পড়ে ছিল। সে সংগত কারণেই আপসেট।

খলিল বলল, আমি যত দূর জানি, ইফতেখার সাহেব তার বাবা নন।

বাবা না হলেও পলিন তাকে বাবা ডাকা শুরু করেছে। আগে ডাকত না। আজ থেকে ডাকছে। পলিনকে প্রশ্ন না করে আপনি আমাকে প্রশ্ন করুন। যত ইচ্ছা করুন। আমি মিথ্যা কথা বলি না।

যারা মিথ্যা বলে না, তারা খুবই বিপজ্জনক।

কোন অর্থে?

তারা যখন একটা-দুটো মিথ্যা বলে, তখন সেই মিথ্যাকে সত্য ধরা হয়। এক হাজার ভেড়ার পালে একটা নেকড়ে ঢুকে পড়ার মতো। এক হাজার সত্যির মধ্যে একটা মিথ্যা। ভয়ংকর মিথ্যা।

রুবিনা হাসল। খলিলের উপমা তার পছন্দ হয়েছে। খলিল বলল, আপনার সঙ্গে রবিউল সাহেবের যে বন্ধুত্ব, তা আপনার স্বামী কীভাবে দেখতেন?

কোনোভাবেই দেখত না। সে জানত, রবির সঙ্গে আমার কোনো বন্ধুত্ব নেই। রবি অতি কর্মঠ একজন। সর্বকর্মে পারদর্শী। তাকে দিয়ে আমি নানা কাজ করিয়ে নিতাম। বিনিময়ে সামান্য অভিনয়।

‘বিনিময়ে সামান্য অভিনয়’ ব্যাপারটা বুঝলাম না।

ভাব করা যে, আমি তাকে অসম্ভব পছন্দ করি। হয়তো বা গোপনে ভালোবাসি। বিবাহিত হওয়ায় বাধা পড়ে গেছি। নয় তো তার সঙ্গে ভেগে যেতাম।

অভিনয় করে আপনি কাজ আদায় করে নেন?

অভিনয় ছাড়াও আমি কাজ আদায় করতে পারি, অন্যকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারি। যেমন, আপনাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিলাম। আপনি মাইক্রোবাসের ব্যবস্থা করলেন, একজন পুলিশ দিলেন। কোনো সমস্যা ছাড়াই আমার স্বামীর ডেডবড়ি গ্রামের বাড়িতে রওনা হয়ে গেল।

আপনার স্বামী যে রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লেন, সে রাতের ঘটনা বলুন। কোনো কিছু বাদ দেবেন না বা কোনো কিছু যুক্ত করবেন না।

ক্ষুদ্র ডিটেইলসও কি বলব?

হ্যাঁ, বলবেন।

রাত ১০টার পর থেকে বলা শুরু করি। তার আগে থেকে বলার কিছু নেই।

করুন। নেলপলিশ দেওয়া শেষ করে বলুন। আমি চাই, কথা বলার সময় আপনি আমার চোখের ওপর চোখ রাখবেন। কেউ অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বললে আমার অস্বস্তি লাগে।

রুবিনা নেলপলিশ দেওয়া শেষ করল। দুই হাত মেলে দেখল, তারপর কথা বলা শুরু করল।

রাত ১০টার মধ্যে আমাদের রাতের খাবার হয়ে যায়। আমরা যে যার মতো আমাদের কর্মকাণ্ড শুরু করি।

ব্যাখ্যা করে বলুন। যে যার মতো কর্মকাণ্ড মানে কী?

রুবিনা সিগারেট ধরিয়ে কথা বলছে, আমি খলিলের চেয়েও অনেক আগ্রহ নিয়ে শুনছি। রুবিনা এখন যা বলছে, তার স্মৃতি আমার নেই। সবই নতুন শুনছি।

রুবিনা বলছে, আমাদের যে যার কর্মকাণ্ড ব্যাখ্যা করতে বলছেন, করছি। আমার মেয়ে পলিন অটিস্টিক। সে অনেক রাত পর্যন্ত জাগে। কম্পিউটারে গেম খেলে। ফেসবুক খুলে বসে থাকে। তার ফেসবুকের বন্ধুর সংখ্যা পাঁচ হাজার আঠারো। এদের প্রত্যেকের নাম সে জানে।

আমার স্বামী স্টাডিরুমের দরজা ভিড়িয়ে বসে থাকেন। বই পড়েন, লেখালেখি করেন। প্রতি রাতে আধঘণ্টা মেডিটেশন করেন। আমি কখনো সেই ঘরে যাই না।

আমি থাকি শোবার ঘরে। বেশির ভাগে রাতে ভূতের ছবি দেখি। ছবি দেখার মাঝখানে একবার এসে বেদানার রস খাই। আমি দুই গ্লাস করে বেদানার রস খাই। সকালে এক গ্লাস, রাতে এক গ্লাস। বেদানার রস খেয়ে পলিনের ঘরে উঁকি দেই। আমাকে দেখে পলিন বলে, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি, প্লিজ। আমি বলি, আই লাভ ইউ।

পলিনের ঘর থেকে নিজের ঘরে আসি। ছবি দেখা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ি।

সেই রাতে আমি পার্পল স্কাই নামের একটা ভূতের ছবি দেখছিলাম। ছবির মাঝখানে বেদানার জুস খেতে গিয়ে দেখি টেবিলে জুসের গ্লাস নেই। কাজের মেয়েটা নতুন, সে জুস বানিয়ে তাতে দুই টুকরা বরফ দিয়ে খাবার টেবিলে রাখতে ভুলে গেছে। আমি গেলাম পলিনের ঘরে। পলিন বলল, ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। আমি বলি, আই লাভ ইউ।

নিজের ঘরে এসে ছবি শেষ করে ঘুমুতে গেলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছি, জানি না। ঘুম ভাঙল পলিনের ঝাঁকুনিতে। খোলা দরজা দিয়ে সে ঢুকেছে। আমার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করছে।

আমি ধড়মড় করে জেগে উঠে বললাম, কী হয়েছে মা?

পলিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাসায় ভূত এসেছে।

ভূতটা কী করছে?

আমাকে ডিস্টার্ব করছে।

কীভাবে ডিসটার্ব করছে?

গোঁ গোঁ, ঘত ঘত করে শব্দ করছে। দরজায় বাড়ি দিচ্ছে।

চল দেখি।

পলিন বলল, আমি যাব না। তুমি দেখে এসো। ভূতটাকে তাড়িয়ে দিয়ে আসবে।

আমি পলিনের ঘরে গেলাম। সেখান থেকে গেলাম স্টাডিরুমে। ভূতরহস্য ভেদ হলো। আমার স্বামী মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। গোঁ গোঁ শব্দ মনে হয় সেই এতক্ষণ করছিল। তার ঘরে ভাঙা গ্লাসের টুকরা। টুকরায় বেদানার রস লেগে আছে।

অ্যাম্বুলেন্সের জন্য টেলিফোন করলাম। রবিকে টেলিফোন করলাম। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।

খলিল বলল, ডাক্তাররা কি ফুড পয়জনিংয়ের চিকিৎসা করেছে? স্টমাক ওয়াশ করেছে?

না। তারা মাইন্ড স্ট্রোক ধরে নিয়েছে। সেভাবে চিকিৎসা করেছে। আমি যে সত্যি কথা বলছি, এ রকম কি মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ। তবে কাজের মেয়েটা নতুন এসেছে, কথাটা তো মিথ্যা। আমি যত দূর জানি, সালমা নামের মেয়েটা আপনার স্বামীর মৃত্যুর পর জয়েন করেছে। আপনার এই অংশটা কি মিথ্যা নয়?

হ্যাঁ, মিথ্যা।

এই মিথ্যাটা কেন বলেছেন?

জানি না কেন বললাম।

খলিল বলল, আমি জানি। আপনি খুব গুছিয়ে গল্প বলতে গেছেন। গুছিয়ে গল্প বলতে গেলে অপ্রয়োজনীয় জিনিস চলে আসে। আপনারও এসেছে।

হতে পারে।

আপনার মেয়ে পলিন তার বাবাকে খুব পছন্দ করে, আপনি বলেছেন। ঠিক না?

হ্যাঁ, ঠিক।

সে তার বাবার সঙ্গে রাত জেগে কম্পিউটার গেম খেলে।

হ্যাঁ।

তার ঘরের পাশেই তার বাবার স্টাডিরুম। সে ভূতের ভয় পেয়ে তার বাবার ঘরে না গিয়ে আপনাকে কেন জাগাল?

জানি না।

আমার ধারণা, আপনার মেয়ে আপনার কাছে আসেনি। আপনি হরর মুভি দেখেন। ভূতের শব্দ আপনারই শোনার কথা। তা ছাড়া অটিস্টিক শিশুরা ভূত ভয় পায় না, মানুষ ভয় পায়।

রুবিনা কিছু বলল না। সে সামান্য ভয় পাচ্ছে। ঘন ঘন সিগারেটে টান দিতে দেখে সে রকমই মনে হচ্ছে। খলিল বলল, কাজের মেয়ের প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি। ওই রাতে আপনার বাসায় কাজের মেয়ে ছিল না, তাই না?

হ্যাঁ।

কাদের কি বেদানার রস বানায়?

না।

তাহলে আমি কি ধরে নিতে পারি, বেদানার রস আপনি বানিয়েছিলেন?

ধরে নিতে পারেন।

আচ্ছা, এ রকম কি হতে পারে, ওই রাতে আপনার বেদানার রস খেতেই ইচ্ছে করছিল না, আপনি স্বামীর কাছে গ্লাস নিয়ে গেলেন। বেদানার রসটা নষ্ট না করে তাকে খেয়ে ফেলতে বললেন।

রুবিনা কঠিন গলায় বলল, আপনি কি প্রমাণ করতে চাচ্ছেন, ওই রাতে আমি বেদানার রস বানিয়ে তাতে বিষ মিশিয়ে আমার স্বামীকে খাইয়েছি?

আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাচ্ছি না। আমি অনুমানের কথা বলছি। একটা বিশ্বাসযোগ্য সিনারিও দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। এর বেশি কিছু নয়।

রুবিনা বলল, আজকের মতো জেরা করাটা কি বন্ধ করা যায়?

জেরা করছি না তো। জেরা করবে উকিল। আপনি কাঠগড়ায় দাঁড়াবেন, উকিল একের পর এক প্রশ্ন করবে। অনেক নোংরা প্রশ্ন করবে। ক্রিমিনাল লইয়াররা রূপবতীদের নোংরা প্রশ্ন করতে পছন্দ করে। উকিলদের নোংরা প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচার একটা উপায় হচ্ছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া।

রুবিনা বলল, তারপর হাসিমুখে ফাঁসিতে ঝুলে পড়া।

খলিল বলল, মেয়েদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ব্যাপারে আদালত নমনীয় থাকে। আপনি প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন যে আপনার স্বামী আপনাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন করত। ঘরে রূপবতী স্ত্রী রেখে সে বেশ্যায় গমন করত। কাজের মেয়েদের সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল। এসব দেখেশুনে আপনার মাথা ঠিক ছিল না। ভেবে দেখবেন। ম্যাডাম, আমি উঠি। আগামীকাল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দেবেন। ছোট্ট একটা দুঃসংবাদ আছে। দুঃসংবাদটা কি দেব?

দিন। আপনার সুসংবাদগুলোও দুঃসংবাদের মতো।

খলিল উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, খুব বড় দুঃসংবাদ অবশ্য নয়। আপনার স্বামীর ডেডবড়ি নিয়ে যে মাইক্রোবাসটি যাচ্ছিল, সেটি খাদে পড়ে গেছে। কাদেরের ঠ্যাং ভেঙে গেছে। সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।

রুবিনা শব্দ করে হেসে ফেলল। আমার নিজেরও হাসি আসছে। রুবিনা হেসে ফেলার কারণ খলিল ধরতে পারছে না। তাকে খানিকটা কনফিউজড় মনে হচ্ছে। কাদের যে কয়বার মাইক্রোবাস বা বাসে করে ঢাকার বাইরে গেছে, সে কবারই অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে এবং প্রতিবারই তার পা ভেঙেছে। ব্যাপারটা কাকতালীয়, নাকি বোধের অগম্য অন্য কিছু?

রুবিনা গা দুলিয়ে হাসছে। এই হাসির একটা নাম আছে, শুধু ঠোটে হাসা না, সর্বাঙ্গে হাসা। শরীর হাসা।

খলিল বলল, আপনার মেয়ে পলিন সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি। সে কি আপনার আগের হাজব্যান্ডের সন্তান?

রুবিনা বলল, আমি একবারই বিয়ে করেছি। আমার আগের হাজব্যান্ড বলে কিছু নেই।

তাহলে পলিন কে?

পলিন আমার ছোট বোনের মেয়ে। আমার ছোট বোনের বিয়ে হয়নি। পলিনের জন্ম তার জন্য বিরাট সমস্যা হয়েছিল। পলিনকে তার কাছ থেকে নিয়ে আমি আমার বোনকে মুক্তি দেই। পলিন জানে, আমি তার মা।

আপনার ছোট বোনের বিষয়ে বলুন।

সে আমেরিকায় থাকে। বিয়ে করেছে। সুখে আছে। এই হত্যা মামলায় সে কোনোভাবেই যুক্ত নয়। কাজেই তার বিষয়ে কিছু বলব না।

আপনি পালিয়ে মা সেজেছেন। আপনার স্বামী কেন বাবা সাজলেন না। আমি চাইনি।

আমার স্বামী একজন পবিত্র মানুষ। অপবিত্র কোনো কিছুর সঙ্গে সে যুক্ত হোক, তা চাইনি।

অপবিত্র কোনো কিছুর সঙ্গে যুক্ত থাকতে আপনার আপত্তি নেই, না?

.

গাড়ি খাদে পড়েছে শুনলে মনে হয় গিরিখাদ। প্রথম যখন শুনলাম আমার ডেডবডি বহন করা মাইক্রোবাস খাদে পড়েছে, তখন ভেবেছিলাম, ভয়াবহ কিছু ঘটেছে। এখন আমি অকুস্থলে আছি। তেমন কিছু ঘটেনি। রাস্তার পাশের নর্দমায় পড়ে গিয়েছিল। ধাক্কাধাক্কি করে গাড়ি তোলা হয়েছে। ড্রাইভার স্টার্ট নেওয়ার চেষ্টা করছে। ইঞ্জিন কিছুটা ঘররর শব্দ করে থেমে যাচ্ছে।

কাদেরকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে শুনেছিলাম, এটাও সত্যি নয়। সে কিছুক্ষণ পর পর পা চেপে ধরে গোঙানির আওয়াজ করছে। তার চেহারা নীল বর্ণ ধারণ করেছে। অক্সিজেনের ঘাটতি হলে মানুষ নীল বর্ণ ধারণ করে। কাদেরের অবশ্যই অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। তাকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া দরকার।

অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে শালবনের ভেতরের রাস্তায়। আশপাশে কোনো লোকজন নেই, তবে পুলিশের একটা জিপ এসেছে। মাইক্রোবাস দড়ি দিয়ে জিপের সঙ্গে বাঁধা হচ্ছে। দড়ি টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।

মাইক্রোবাস যখন চলে যাবে, তখন আমিও কি তাদের সঙ্গে যাব? নাকি আমি একা পড়ে থাকব শালবনে? কী ঘটবে, কিছুই জানি না। আমার শীতভাব প্রবল ভাবছে। হিমশীতল হাওয়া একটা বিশেষ দিক থেকে আসছে। সেই দিক উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব না পশ্চিম, কে জানে!

পুলিশের জিপ মাইক্রোবাস নিয়ে চলে গেছে। মাইক্রোবাসের ভেতর আমার ডেডবডি। আমি (বা আমার চেতনা) একা পড়ে আছি। এর কোনো মানে হয়? কতক্ষণ থাকব এখানে?

মৃত্যুর পরের জগতে সময় থাকার কথা নয়। কাজেই কতক্ষণ একা পড়ে থাকব, এই চিন্তাও অর্থহীন। হয়তো অনন্তকাল পড়ে থাকব। সূর্য একসময় বামন নক্ষত্র হয়ে পৃথিবী গিলে খাবে, আমি এখানেই পড়ে থাকব।

যেদিক থেকে হিমশীতল হাওয়া আসছে, সেদিকে আকাশে একধরনের আভা দেখছি। এর মানে কী? হঠাৎ সেই আভার দিকে একধরনের টান অনুভব করলাম। খুব হালকাভাবে কিছু একটা আমাকে টানছে। আমার অনন্ত যাত্রা কি সেই দিকে? কোথায় যাব?

আমি হতাশ গলায় বললাম, এখানে কেউ কি আছেন, যিনি আমাকে সাহায্য করবেন? কথা শেষ হওয়ার আগেই বনের ভেতর থেকে শিয়াল ডাকতে লাগল। শিয়াল প্রহরে প্রহরে ডাকে। এখন কোন প্রহর?

কেউ একজন শিয়ালের ডাকের সঙ্গে মিলিয়ে ছড়া বলছে—

শিয়াল ডাকে হুক্কাহুয়া
তুহিনদের কাজের বুয়া
তাই পেয়েছে ভয়
তার যত সাহস ছিল
সব হয়েছে ক্ষয়।
জয় শিয়ালের জয়।

ছড়া পাঠ করছে খলিল। আমার অবস্থান এখন খলিলদের বাসায়। খলিলের সামনে পাঁচ-ছয় বছরের একটি মেয়ে। এর নাম নিশ্চয়ই তুহিন। খলিল তার সদ্য লেখা ছড়া মেয়েকে পড়ে শোনাচ্ছে। তুহিনের ছড়া শোনার আগ্রহ নেই। সে রাক্ষসের ছবি আঁকছে।

খলিলের স্ত্রী রান্নাঘরে। সে রান্নার তদারকি করছে। আজ তাদের বাসায় পোলাও, খাসির রেজালা এবং রোস্ট রান্না হচ্ছে। খলিলের স্ত্রীর কিশোরী-কিশোরী চেহারা। নতুন শাড়ি পরায় তাকে সুন্দর লাগছে। আজ তাদের বিয়ের ছয় বছর পূর্তি।

মেয়েটি রান্নাঘর থেকে বলল, তুহিনের বাবা, আজ তুমি কাউকে খেতে বলনি? তোমার বন্ধুবান্ধব কেউ আসবে না?

খলিল বলল, কিছু কিছু অনুষ্ঠান শুধু স্বামী-স্ত্রীর জন্য। বাইরের কেউ সেখানে থাকবে না।

আমি একগাদা খাবার রান্না করেছি। সব বারই তো তুমি অন্যদের বলতে।

আর বলব না। শুধু তুমি আর আমি।

মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, তুমি আসলে ম্যারেজ অ্যানিভার্সারির কথা ভুলে গেছ। ঠিক বলেছি না?

হুঁ।

ইচ্ছা করলে এখনো বলতে পারো। মাত্র আটটা দশ বাজে।

এখন আর বলতে ইচ্ছে করছে না। পাশে এসে বসো।

রান্না দেখাচ্ছি তো।

রান্না কাজের বুয়া যা পারে, দেখবে।

তরুণী সামনে এসে বসল। তুহিন ছবি আঁকা বন্ধ করে মুখ তুলে বলল, বাবা, তোমরা কিন্তু হাত ধরাধরি করবে না। তাহলে আমি রাগ হব।

স্বামী-স্ত্রী দুজনই হাসছে। তুহিন মা-বাবার হাত ধরাধরি ছাড়াই রাগ হয়েছে। সে রাক্ষসের ছবি নিয়ে চলে গেল। খলিল বলল, এশা! বিবাহবার্ষিকী কী জন্য ভুলে গেছি শোনো।

এশা বলল, বাদ দাও তো। বিবাহবার্ষিকী ভুলে যাওয়া তোমার জন্য নতুন কিছু না। প্রথম দুই বছর ছাড়া সব বারই ভুলে গেছ। শেষ মুহূর্তে আমি মনে করিয়ে দিয়েছি।

এবার মনে করিয়ে দিলে না কেন?

সন্ধ্যা ছয়টার সময় অনেকবার টেলিফোন করেছি।

তখন মোবাইল ফোন বন্ধ ছিল। আমি ভয়ংকর এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছিলাম।

ভয়ংকর কেন?

সে তার স্বামীকে বিষ খাইয়ে মেরেছে। তার পরেও কোনো বিকার নেই। তার স্বামীর ডেডবড়ি গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে সে সাজগোজ করছিল।

এশা বলল, বানিয়ে কথা বলবে না তো।

বানিয়ে বলছি না। আমার সামনে বসে নখে নেলপলিশ দিচ্ছিল। আমি হতভম্ব।

এশা বলল, হয়তো তোমাকে হতভম্ব করার জন্যই কাজটা করেছে। মেয়েটা যে খুন করেছে, তুমি নিশ্চিত?

হ্যাঁ। সব সন্দেহ রুবিনার ওপর।

রুবিনা নাম?

হুঁ। তার গাঁজা খাওয়ার অভ্যাসও আছে। হোয়াট এ ক্যারেক্টর?

এশা বলল, সাধারণত দেখা যায়, সব সন্দেহ যার ওপর, সে খুন করেনি। যাকে কেউ সন্দেহ করছে না, সে খুন করেছে।

খলিল বলল, গল্প-উপন্যাসে এ রকম দেখা যায়। এ রকম না হলে ডিটেকটিভ গল্প দাঁড়ায় না। বাস্তবে সব সন্দেহ যার ওপর, সে-ই খুনি। রুবিনা কী করেছে শুনতে চাও?

না। বিবাহবার্ষিকীতে খুনখারাবির গল্প কেন শুনব?

খলিল বলল, তাও ঠিক। আচ্ছা যাও, বাদ।

এশা বলল, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তোমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে। বললা, শুনি।

খলিল বলল, রুবিনা উইপোকা মারার বিষয় কিনে এনেছে। উইপোকার বিষয় হলো কঠিন বিষ। বেদানার জুসভর্তি গ্লাসে অর্ধেক বোতল ঢেলেছে। তার স্বামীকে খাইয়েছে।

এশা বলল, রুবিনা দেখতে কেমন?

খলিল বলল, খুনি হলো খুনি। দেখতে রাজকন্যার মতো হলেও খুনি, দাঁত-উঁচা তাড়কা রাক্ষসীর মতো হলেও খুনি।

তার মানে, তোমার এই খুনি খুবই রূপবতী?

হ্যাঁ, রূপবতী। রূপবতীদের নানান ফ্যাকড়া থাকে। স্বামীর বন্ধুদের সঙ্গে প্রেম তাদের একটি। মোটিভ এটাই হবে।

আলোচনার এ পর্যায়ে আমি হঠাৎ বলে উঠলাম, এশা। তোমার স্বামীর কথা বিশ্বাস করবে না। উইপোকার বিষের বিষয়টা আমার মনে পড়েছে। বিষ আমি আনিয়েছি। বড় মামার ফার্মেসির একটি ছেলেকে দিয়ে কিনিয়েছি। বিষ কিনিয়েছি আর একটা স্প্রে কিনিয়েছি। আমার বইয়ে উইপোকা ধরেছে। উইপোকা মারার জন্য। উইপোকার ওষুধ যেখানে পাওয়া গেছে, স্প্রেটাও সেখানে ছিল।

আমি কথা শেষ করলাম। কথা শেষ করা না-করায় কিছু যায়-আসে না। এশা মেয়েটির সঙ্গে বা জীবিত কারও সঙ্গেই আমার যোগাযোগের ক্ষমতা নেই।

এশা আমাকে চমকে দিয়ে তার স্বামীকে বলল, উইপোকার ওষুধ কেনা হয়েছে বইপত্রে দেওয়ার জন্য।

খলিল বলল, তুমি জানলে কোত্থেকে? তোমাকে কে বলেছে?

এশা বলল, আমাকে কে আবার বলবে? এ রকম মনে হচ্ছে বলে বলছি। ওষুধ যেখানে ছিল, সেখানে স্প্রে ছিল না? থাকার তো কথা।

খলিল চিন্তিত মুখে বলল, হ্যাঁ, ছিল। এখন মনে পড়েছে। তুমি কীভাবে বলছ?

এশা হাসতে হাসতে বলল, আমি প্রায়ই মন থেকে এমন সব কথা বলি, তা সত্যি হয়। তুমি তো এটা জানো।

খলিল হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়ল। আমি বললাম, এশা! প্লিজ তোমার স্বামীকে বলল, রুবিনা তার স্বামীকে খুন করেনি। কেউ খুন করেনি। এটা ছিল সাধারণ মৃত্যু, হার্ট অ্যাটাক বা অন্য কিছু। বলো এশা, বলো।

এশা বলল, রান্না হতে দেরি হবে। তুমি কি এক কাপ চা খাবে?

না।

খাও, এক কাপ চা। দুজন বারান্দায় বসে চা খাই, চলো। এক কাপ চা বানাব। তুমি একবার চুমুক দেবে। আমি একবার।

আচ্ছা যাও, চা বানাও।

আমি বললাম, চা পরে বানাবে এশা। আগে রুবিনা নির্দোষ, এটা বলো। দেরি করছ কেন?

এশা বলল, আমি মোটামুটি নিশ্চিত, রুবিনা মেয়েটা নির্দোষ। তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

ভিসেরা রিপোর্টে অরগ্যানো ফসফরাস পাওয়া গেছে।

রিপোর্ট ভুল হয়েছে। আবার পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করো।

দেখা যাক।

দেখা যাক না। ব্যবস্থা করতেই হবে। একটা নির্দোষ মেয়ে ফাঁসিতে ঝুলবে নাকি?

খলিল বলল, এই প্রসঙ্গটা থাক।

এশা বলল, না, থাকবে না। রুবিনা মেয়েটা নিশ্চয়ই ভয়ংকর কষ্টে আছে। তুমি তার কষ্ট দূর করো।

কীভাবে?

টেলিফোন করে বলল যে তুমি নিশ্চিত, তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।

আমি নিশ্চিত না।

এশা বলল, তুমিও এখন নিশ্চিত। মুখে বলছ, নিশ্চিত না।

আমি বললাম, এশা, তুমি তোমার স্বামীকে বলল, রুবিনার মতো ভালো মেয়ে খুব কম জন্মেছে। তার চেয়ে বড় কথা, সে অসম্ভব বুদ্ধিমতী। সে যদি তার স্বামীকে খুন করত, তাহলে এমনভাবে করত যে তোমার স্বামীর সাধ্যও হতো না খুনের রহস্য উদ্ধারের। এই কথাটা তাকে বলে তারপর চা বানাতে যাও।

এশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, রুবিনা মেয়েটা অতি বুদ্ধিমতী। সে খুন করলে এমনভাবে করত যে তুমি ধরতে পারতে না।

রুবিনা অতি বুদ্ধিমতী, তোমাকে কে বলেছে?

কেউ বলেনি। আমার মন বলছে।

কথা সত্যি। শি ইজ ভেরি স্মার্ট।

.

খলিল তার স্ত্রীকে নিয়ে বারান্দায় বসেছে। তাদের সামনে এক কাপ চা। সেই কাপে একবার খলিল চুমুক দিচ্ছে, একবার এশা চুমুক দিচ্ছে।

তুহিন রাক্ষসের ছবি নিয়ে বারান্দায় ঢুকল। গাল ফুলিয়ে বলল, তোমরা হাত ধরাধরি করে বসে আছ কেন? হাত ছাড়ো। আমি খুব রাগ করেছি।

খলিল হাত ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। এশা বলল, কোথায় যাচ্ছ?

খলিল বলল, রুবিনা ম্যাডামকে একটা টেলিফোন করব।

.

রুবিনা তার মেয়ের ঘরে বসে আছে। পলিন হীরক সংগ্রহের খেলা খেলছে। একটা ভয়ংকর জায়গা পার হতে পারছে না। দুটা সাপ ছোবল দিয়ে মেরে ফেলছে। পলিন বলল, বাবা থাকলে এই সাপের জায়গাটা পার করে দিত। বাবা পারে, আমি পারি না।

রুবিনা বলল, সে এখন নেই। সাপখোপের জায়গা তোমাকে একাই পার হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত গান আছে, একলা চলো, একলা চলো রে। রবীন্দ্রনাথকে চেনো না?

চিনি। সাদা দাড়ি আছে।

রুবিনার টেলিফোন বাজছে। সে টেলিফোন ধরল।

ম্যাডাম, আমি খলিল।

রুবিনা বলল, জানি। আপনার নাম উঠেছে।

আপনাকে টেলিফোন করলাম একটা কথা জানানোর জন্য। আপনি সন্দেহের তালিকায় নেই।

কে আছে, পলিন?

কেউ নেই। আপনার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতাল থেকে দেওয়া ডাক্তারের ডেথ সার্টিফিকেটে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুর কথা লেখা। ভিসেরা রিপোর্ট মনে হয় ঠিক নয়। ভিসেরা পরীক্ষা নতুন করে করার ব্যবস্থা করছি।

রুবিনা বলল, আমি এখন খেতে যাব। আপনার কথা কি শেষ হয়েছে?

সামান্য বাকি আছে। আজ আমাদের ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। এই উপলক্ষে আমার স্ত্রী প্রচুর খাবারদাবার রান্না করেছে। মৃত বাড়িতে বন্ধুবান্ধবের খাবার পাঠানোর প্রাচীন রীতি আছে। আমি কিছু খাবার পাঠাতে পারি?

রুবিনা বলল, পারেন। হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি।

হঠাৎ একটা ধাক্কা অনুভব করলাম। সব অস্পষ্ট হয়ে যেতে শুরু করেছে। যে পরিকল্পনায় আমাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরানো হয়েছে, সে পরিকল্পনার সমাপ্তি হয়েছে।

বুঝতে পারছি, আমাকে চলে যেতে হবে। কোথায় যাব? জানি না। মানুষ কোত্থেকে এসেছে, তা-ই সে জানে না। কোথায় যাবে, সেটা জানবে কীভাবে?

ইশ, আমার যদি শরীর থাকত, আমি রুবিনার হাতে হাত রাখতে পারতাম। পলিনের কপালে একটা চুমু খেতাম। মেয়েটা সাপের জায়গা নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে, তাকে সাপের জায়গাটা পার করে দিতাম।

ঘণ্টার শব্দ হচ্ছে। ঘণ্টা বেজেই থেমে যাচ্ছে না, অনেকক্ষণ ধরে রিনরিন করছে। ভয়াবহ শৈত্য আমাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে।

পলিনের আনন্দিত গলা শুনলাম। যে বলল, মা দেখো, আমি সাপের জায়গাটা পার হয়ে গেছি।

রুবিনা কী যেন বলল, তার কথা শুনতে পেলাম না। আমার শব্দ শোনার শক্তি কি নিয়ে নেওয়া হয়েছে? তাহলে ঘণ্টাধ্বনি শুনছি কীভাবে?

চারদিক কেমন জানি গুটিয়ে সিলিন্ডারের মতো হয়ে যাচ্ছে। সিলিন্ডারের শেষ প্রান্তে আলোর বন্যা। সেই আলোর ভয়াবহ চৌম্বক শক্তি। আমি ছুটে যাচ্ছি। আমি পেছন ফিরে বললাম, পৃথিবীর মানুষেরা! তোমরা ভালো থেকো। সুখে থেকো! আমি ছুটে যাচ্ছি আলোর দিকে। আমি জানি, আমাকে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। অসীম কখনো শেষ হয় না। তাহলে যাত্রা শেষ হবে কীভাবে?

কে বলে দেবে আমাকে?

.

পরিশিষ্ট

চিরকাল এইসব রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর
জন্মান্তের নবপ্রাতে সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তরা।।

—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Exit mobile version