Site icon BnBoi.Com

বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল – হুমায়ূন আহমেদ

বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল - হুমায়ূন আহমেদ

হেদায়েতের (হেদায়েতুল ইসলাম) বয়স তেত্রিশ

বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল

প্রথম প্রকাশ – ফেব্রুয়ারি ২০০৯

 

উৎসর্গ

উপন্যাস লেখার একটা পর্যায়ে উপন্যাসের চরিত্রগুলোকে রক্ত-মাংসের মানুষ মনে হতে থাকে। তাদেরকে বই উৎসর্গ করা কি যুক্তিযুক্ত না? ‘বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল’ বইটির হেদায়েতের বড় ভাই বেলায়েতকে।

 

০১.

হেদায়েতের (হেদায়েতুল ইসলাম) বয়স তেত্রিশ। দেখে মনে হয় চল্লিশ। জণ্ডিস রোগীর মতো হলুদ চোখ। মাথার চুল পড়ে গেছে। জুলফির কাছে যা আছে তার বর্ণ তামাটে। সে একটা মেয়েদের কলেজের (বেগম রোকেয়া মেমোরিয়াল কলেজ) অংকের শিক্ষক। ছাত্রীরা তাকে ডাকে গিরগিটি স্যার। তার চেহারার সাথে তারা গিরগিটির মিল খুঁজে পেয়েছে।

হেদায়েত একজন সুখী মানুষ। সুখী মানুষদের ঘুমের কোনো সমস্যা হয় না। হেদায়েতেরও তাই। রাত নয়টার পর থেকে সে হাই তুলতে থাকে। রাত নটায় ঘুমুতে যাওয়া সম্ভব না বলে সে কষ্ট করে জেগে থাকে। টিভিতে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করে। হেদায়েতের স্ত্রী সেতুর টিভি দেখা বাতিক আছে। সে রাত আটটার খবর শেষ হবার পর রিমোট নিয়ে বসে এবং একের পর এক চ্যানেল বদলাতে থাকে। হঠাৎ কোনো একটা চ্যানেল পছন্দ হয়ে গেলে মূতীর মতো হয়ে যায়। চোখে পলক না পড়ার মতো অবস্থা হয়। তার পছন্দ ভূত-প্রেতের ছবি। ভূতের ছবি চলার সময় সে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। এক হাতে সে হেদায়েতের হাত চেপে ধরে থাকে। সেতুর নখ লম্বা (সৌন্দর্য বিষয়ক কারণে), প্রায়ই হেদায়েতের হাতে নখের দাগ বসে যায়।

এই মুহূর্তে সেতু যে চ্যানেল দেখছে সেখানে কোনো একটা ছবি দেখানো হচ্ছে। ছবিতে একজন বৃদ্ধকে ঘিরে নাচানাচি হচ্ছে। বৃদ্ধের মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। দাড়ি সাদা কিন্তু চুল কাশে। হেদায়েত নাচানাচি দেখতে গিয়ে দু’টা জিনিস লক্ষ করল সাতটা মেয়ে নাচছে। সাত হলো একটা প্রাইম নাম্বার। এক এবং সাত ছাড়া এই সংখ্যাকে অন্য কিছু দিয়ে ভাগ দেয়া যাবে না। সাতটা মেয়ের সঙ্গে এগারোজন পুরুষও নাচছে। এগারো আরেকটা প্রাইম নাম্বার। বৃদ্ধকে নিয়ে সর্বমোট সংখ্যা উনিশ। উনিশ আরেকটা প্রাইম নাম্বার। নাচের দৃশ্যে দেখা যাচ্ছে প্রাইম নাম্বারেরই খেলা। পরিচালক কি ব্যাপারটা ইচ্ছা করেই করেছেন, না-কি কাকতালীয়ভাবে হয়ে গেছে? ছবিতে নিশ্চয়ই নাচের দৃশ্য আরো কয়েকটি থাকবে। সেখানেও যদি প্রাইম নাম্বারের খেলা দেখা যায়, তা হলে বুঝতে হবে ব্যাপারটা চিন্তা-ভাবনা করে করা। হেদায়েত এখন ছবিটি দেখার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করতে শুরু করল। নড়ে-চড়ে বসল।

সেতু বলল, অসাধারণ ছবি। তাই না?

হেদায়েত মাথা নাড়ল। এই মাথা নাড়া থেকে হা-না বুঝার কোনো উপায় নেই।

সেতু বলল, অমিতাভ আংকেলের অভিনয় দেখেছ? অভিনয় গা থেকে ঝড়ে ঝড়ে পড়ছে।

হেদায়েত প্রায় বলেই ফেলছিল, “কোন জন অমিতাভ আংকেল?” শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলালো। বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চিনতে না পারলে সেতু বিরক্ত হয়। সে মনে করে ইচ্ছা করে না চেনার ভান করা হচ্ছে। ইন্টেলেকচুয়েল সাজার চেষ্টা।

সেতুর বয়স একুশ। সে যথেষ্টই রূপবতী। সাধারণ মেয়েদের তুলনায় লম্বা (পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি)। গায়ের রঙ গোলাপী না হলেও কাছাকাছি। মাথার চুল কোকড়ানো। তবে কিছুদিন আগে পার্লার থেকে চুল স্ট্রেইট করে এনেছে। এতে তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। রূপবতী মেয়েরা সারাক্ষণ সেজেগুজে থাকতে পছন্দ করে। সেতুর মধ্যে এই ব্যাপারটা নেই। তবে আজ সে সুন্দর করে সেজে আছে। গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে। সেন্টের নাম ব্লু মুন। কোথাও বেড়াতে যাবার কথা থাকলে সেতু সাজে এবং ব্লু মুন সেন্ট গায়ে মাখে। হেদায়েতের ধারণা মুন খুব বাজে সেন্ট। পিসাবের গন্ধের সঙ্গে লেবু এবং বাসি বেলী ফুলের গন্ধ মিশালে যে গন্ধ হয় সে রকম গন্ধ। হেদায়েত অবশ্যি এই সব কথা সেতুকে বলে নি। সে ঠিক করে রেখেছে কোনো এক দিন খুব ভদ্রভাবে সেতুকে এই কথাটা বলবে। আজই বলা যেতে পারে। আজ সেন্ট থেকে পিসাবের গন্ধটা বেশি আসছে। মনে হচ্ছে ত্রিশ পার্সেন্ট পেসাব, বিশ পার্সেন্ট লেবু এবং পঞ্চাশ পার্সেন্ট বাসি বেলী ফুল। অন্য দিন পিসাবের গন্ধ দশ থেকে পনেরো পার্সেন্টের মধ্যে থাকে।

সেতু বলল, কটা বাজে দেখ তো?

হেদায়েত বলল, নয়টা সতেরো। বলে সে নিজেই চমকালো। নয় একটা প্রাইম সংখ্যা আবার সতেরো একটা প্রাইম সংখ্যা। আজ দেখি প্রাইম সংখ্যার ধুম পড়ে গেছে। ব্যাপার কি?

সেতু বলল, এত সুন্দর ছবি, শেষটা দেখতে পারব না!

হেদায়েত হাই চাপতে চাপতে বলল, শেষটা দেখ। আজ না হয় একটু দেরী করে ঘুমালাম।

সেতু বলল, সাড়ে নটার মধ্যে ব্লবিন ভাই গাড়ি পাঠাবেন। আজ রাতে মার বাসায় থাকব। তুমি ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছ কেন? তোমাকে তো যেতে বলছি না। মায়ের বাড়িতে তুমি যেতে চাও না, এই খবরটা আমি জানি। আমার মাও জানেন। কোনো অনুষ্ঠানে এই কারণেই মা তোমাকে ডাকেন না।

হেদায়েত অস্পষ্ট গলায় বলল, প্রয়োজন হলে যাব। অবশ্য আজ শরীরটা খারাপ লাগছে। জ্বর জ্বর ভাব।

সেতু বলল, জুরের অজুহাত দিতে হবে না। তোমার যাবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি কাল ভোরে দশটা নাগাদ চলে আসব।

আচ্ছা।

ইন্টারকম বাজছে। গাড়ি নিশ্চয় চলে এসেছে। সেতু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ছবিটা ভালো মতো দেখে রাখ। পরে আমাকে গল্পটা বলবে।

আচ্ছা।

ক্ষিধে হলে বুয়াকে বললেই খাবার দিবে। রাতে ডাল-গোশত করা হয়েছে। তোমার ফেবারিট আইটেম।

থ্যাংক য়ু।

হেদায়েত সামান্য ধাঁধায় পড়ে গেল। ডাগ-গোশত তা ফেবারিট আইটেম কেন হবে? কোনো দিন কি বলেছে? বলার কথা না। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আলাপ করতে তার ভালো লাগে না। অংক নিয়ে আলাপ করতে ভালো লাগে। তবে কেউ পছন্দ করে না বলে সেই আলাপও করা হয় না। ম্যাথমেটিশিয়ান ইউলারের একটা গল্প সে অনেক দিন সেতুকে বলতে চেয়েছে। কি করে ইউলার অংক দিয়ে প্রমাণ করলেন যে, ঈশ্বর আছেন। সেতু গল্পের শুরুতেই বলে, অংক মানসংকের গল্প বন্ধ। অংকের গল্প বলার চেয়ে তুমি বরং আমার গালে একটা চড় দাও।

সেতু চলে গেছে। হেদায়েতের ভালো লাগছে কারণ সেন্টের গন্ধটা এখন আর তাকে কষ্ট দিচ্ছে না। সে হাই তুলতে তুলতে ছবি দেখছে। এখন বড় করেও হাই তুললে সমস্যা নেই। সেতু দেখবে না এবং বলবে না–এত বড় করে হাই তুলছ কেন? আলজিব দেখা যায়। হেদায়েত ছবির গল্পটা মনে রাখার চেষ্টা করছে। কাহিনী কেমন যেন জট পাকিয়ে গেছে। বৃদ্ধ অভিনেতা এখন একটা পাহাড়ি ঝর্নার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হাতে পিস্তল। পিস্তলটা তিনি তার পরনের কালো রঙের সাফারির পকেটে লুকিয়ে রেখেছেন। ঝর্নার পানিতে অতি রূপবতী একজন তরুণী গোসল করছে। বৃদ্ধ এই দৃশ্য আড়াল থেকে দেখছে। রূপবতী তরুণী কে, বৃদ্ধের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী- কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। এদিকে চোখও মেলে রাখা যাচ্ছে না। হেদায়েতের মনে হচ্ছে সে সোফাতেই ঘুমিয়ে পরবে। ঘুমানোর জন্য সোফাটা আরামদায়ক। অনেকখানি চওড়া, নরম গদি। ছুটির দিনে দুপুরে (যে সব দিন সেতু বাসায় থাকে না) হেদায়েত এই সোফায় ঘুমায়।

 

হেদায়েত সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল কাজের বুয়া নাদুর মা।

ভাইজান! খাবার গরম কইরা টেবিলে দিছি, খাইতে আসেন। চোখে পানি দিয়া আসেন।

নাদুর মা আজ খাব না।

খেয়ে ঘুমাইলে আফা গোস্বা হইব। খাইতে আসেন।

হেদায়েত খেতে বস। ডাল-গোশতের সঙ্গে আলু ভাজি করা হয়েছে। সৃজনে-ডাটা রান্না হয়েছে সরিষা দিয়ে। সজনার বোটানিক্যাল নম গত সপ্তাহে এক পত্রিকায় পড়েছে। নামটা মনে আছে।

নাদুর মা’র রান্না ভালো। বেশ ভালো। তার একটাই সমস্যা–খাওয়ার সময় সে পাশে দাঁড়িয়ে থাকবে। কেউ আশপাশে থাকলে হেদায়েত খেতে পারে না। সেতুর ক্ষেত্রেও এটা সত্যি। তবে সেতু বেশির ভাগ সময় সামনে থাকে না।

হেদায়েত সজনা পাতে নিতে নিতে নাদুর মার দিকে তাকিয়ে বলল, সজনার বোটানিক্যাল নাম মোরিঙ্গা অবিফেরা।

নাদুর মা বলল, ও আচ্ছা।

সাধারণত ফলের আকার হয় গোল। আম, জাম, কাঁঠাল, লটকন, জামরুল— সবই গোল কিম্বা গোলের কাছাকাছি। সজনা একটা ফল। এই ফলটা লম্বা।

জ্বি আচ্ছা।

হেদায়েত বলল, কলাও লম্বা ফল। কলার কথাটা মনে ছিল না। সরি!

নাদু’র মা বলল, ভাইজান মাংস নেন।

মাংস নিতে নিতে হঠাৎ হেদায়েতের মনে হলো – সজনা সম্পর্কে সে এত কিছু জানে অথচ নাদু’র মা’র বিষয়ে কিছুই জানে না।

হেদায়েত বলল, তোমাকে আমরা নাদু’র মা বলি, নাদু ছেলে না মেয়ে?

ছেলে।

সে কত বড়?

বড় আছে। গত বছর শাদী করছে।

নাদু করে কী?

রিকসা চালায়। ভাইজান আপনে তারে দেখেছেন। কতবার এই বাড়িতে টাকা নিতে আসছে। আমার বেতনের টাকা সে নেয়। তার সংসারে লাগায়।

ও আচ্ছা।

একবার আপনে তারে একশ’ টেকা দিছিলেন— সিগারেট আনতে। সিগারেট আইনা বিশ টেকা আপনেরে ফিরত দিল। আপনে বললেন, টাকা ফিরত দিতে হবে না। এটা বখশিশ। ভাইজান মনে নাই?

না। ভুলে গেছি।

ভুইলা গেলেন ক্যামনে? টেকা পাইয়া আফনেরে পাও ছুইয়া সেলাম করছে।

খাওয়া শেষ করে হেদায়েত উঠে পড়েছে। নাদুর মার সিগারেট প্রসঙ্গ তোলায় তার ভালো লাগছে। আজ আরাম করে শোবার ঘরে সিগারেট খাওয়া যাবে। বিয়ের পর একদিনও বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়া হয় নি। সেতু সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারে না। তার মাথা ধরে। হেদায়েতকে সিগারেট খেতে হয় বারান্দায়। প্রতিবার সিগারেট খাবার পর ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতে হয় এবং গায়ের শার্টটা বদলাতে হয়। সার্টেও নাকি সিগারেটের গন্ধ লেগে থাকে। সেতুর নাক খুব সেনসেটিভ। হেদায়েত একবার রিডার্স ডাইজেস্টে পড়েছিল, যে সব মানুষের নাক সেনসেটিভ হয় তাদের কান কম সেনসেটিভ হয়। প্রকৃতি একটা বেশি দিলে অন্যটা কমিয়ে দেয়। হেমায়েতের কাছে ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। মানুষ কৃপণ, প্রকৃতি কৃপণ না।

অনেকদিন পর বিছানায় শুয়ে হেদায়েত পর পর দু’টা সিগারেট খেল। বড় ভালো লাগল। ভালো লাগা এমন এক জিনিস যে একবার শুরু হলে সব কিছুই ভালো লাগতে থাকে। শোবার ঘরের বিছানার চাদরটা দেখতে ভালো লাগছে। অন্যদিন এই চাদরের বড় বড় হলুদ ফুলের রঙ চোখে লাগত। আজ লাগছে না। বৃড় বিছানায় আজ আরাম করে একা ঘুমানো যাবে। এটা ভাবতেও ভালো লাগছে। হেদায়েত ঘুমের মধ্যে খুব নড়াচাড়া করে। সেতুর ঘুম খুব পাতলা বলে ঘুম ভেঙ্গে যায়। সেতু রাগ করে। আজ হেদায়েত যত নড়াচড়াই করুক সেতুর ঘুম ভাঙ্গবে না।

খাটের পাশে রাখা টেলিফোন বাজছে। নিশ্চয়ই সেতুকে কেউ টেলিফোন করেছে। এ বাড়িতে হেদায়েতকে টেলিফোনে কেউ চায় না। তা ছাড়া রাত অনেক হয়েছে। সবাই জানে এত রাত পর্যন্ত হেদায়েত জেগে থাকে না।

ধরবে না ধরবে না করেও হেদায়েত টেলিফোন ধরে অনভ্যস্ত গলায় বলল, কে? কে?

ওপাশ থেকে সেতু বলল, টেলিফোন ধরেই কেউ কে কে বলে? সাধারণ ভদ্রতাও শিখবে না? প্রথমে বলবে হ্যালো, তারপর অন্য কিছু।

সরি!

খেয়েছ?

হুঁ।

কী-জন্যে টেলিফোন করেছি মন দিয়ে শোনো। কিছুক্ষণ আগে দেখলাম আমার হতে হীরার আঙটিটা নাই। খুলে পড়ে গেছে কি-না বুঝতে পারছি না। এদিকে এত আনন্দ হচ্ছে আমি কিছুতেই মন দিতে পারছি না। তুমি কি বাথরুমে একটু দেখবে আঙটিটা আছে কি-না। মাঝে মাঝে হাত-মুখ ধোয়ার সময় আমি আঙটি খুলে বেসিনে রাখি।

দেখে আসছি। আমি টেলিফোন ধরে আছি। তুমি দেখে এসে আমাকে বল।

বাথরুমের বেসিনে বা অন্য কোথাও আঙটি নেই। হেদায়েত ফিরে এসে টেলিফোন ধরল। সেতু বলল, পেয়েছ?

হেদায়েত অস্পষ্ট স্বরে বলল, হুঁ।

সেতু বলল, স্পষ্ট করে বল পেয়েছ, না-কি পাও নি?

পেয়েছি।

থ্যাংক গড। আঙুটিটা কি এখন তোমার হাতে?

না।

তা হলে কোথায়?

যেখানে ছিল সেখানেই রেখে এসেছি।

তোমার কি মাথাটা খারাপ? আঙটিটা এনে তিন নম্বার ড্রয়ারে রাখ।

আচ্ছা রাখছি।

এখানে খুবই মজা হচ্ছে। রবিন ভাই ম্যাজিক দেখাচ্ছেন। দড়ি কাটা একটা ম্যাজিকের কৌশল আমি ধরে ফেলেছি।

কী কৌশল?

কী কৌশল আমি কি টেলিফোনে বুলব না-কি? আচ্ছা আমি রাখছি। তুমি আঙটিটা এনে টেবিলের তিন নম্বর ড্রয়ারে রাখ।

আচ্ছা।

সেতু টেলিফোন রেখে দিয়েছে। হেদায়েত সামান্য অস্বস্থি বোধ করছে। কাল সেতু যখন দেখবে ড্রয়ারে আঙটি নেই তখন কী হবে? হেদায়েত ভুড় কুঁচকে আগামীকালের কথাবার্তা কী হবে চিন্তা করার চেষ্টা করছে–

কেন বললে আঙুটি পেয়েছ? কেন মিথ্যা কথা বললে?

তুমি আনন্দ করতে পারছিলে না। মনটা খারাপ করে ছিলে।

আজ যখন দেখলাম আঙটি নাই— মনটা কি ভালো হয়েছে? চুপ হয়ে। থাকবে না, জবাব দাও।

হেদায়েত বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। আগামীকাল কী হবে সেটা আগামীকাল দেখা যাবে। মানুষ ভবিষ্যতে বাস করে না। বর্তমানে বাস করে। ঘুমানোর আগে জটিল কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হেদায়েতের ভালো লাগে। এই মুহূর্তে সে চিন্তা করছে— আলোর গতি নিয়ে। আইনস্টাইন প্রমাণ করেছেন আলোর গতি ধ্রুবক। কেউ আলোর দিকে এগিয়ে গেলেও সে যে গতি পাবে আলো থেকে উল্টো দিকে দৌড়ালেও একই গতি। সব সময় সব অবস্থায় আলোর গতি এক— এটা কি ঠিক। বিগ ব্যাং এর সময়েও কি তাই ছিল? কোনো কোনো অবস্থায় আলোর গতির হেরফের হতে পারে- এটা ভাবলে কেমন হয়? অতি ক্ষুদ্র জগৎ অর্থাৎ প্লংকের জগতেও কি আলোর একই।

বড় বড় বিজ্ঞানীরা মাঝে মাঝে বিজ্ঞানের ক্ষতিও করেন। তাদের থিওরির বাইরে অন্যরা চিন্তা বন্ধ করে দেয়। ল্যাবরেটরির ফলাফল যা-ই হোক না কেন, সবার একটাই চেষ্টা থাকে প্রচলিত থিওরিতে ফলাফল ব্যাখ্যা করা।

আচ্ছা আইনস্টাইনের জন্ম যদি না হতো তা হলে পদার্থবিদ্যার বর্তমান অবস্থা কী হতো? হেদায়েতের সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। সিগারেটের প্যাকেট হাতের কাছে। বাতি না জ্বালিয়েই প্যাকেট এবং লাইটার খুঁজে বের করা যাবে। ঘরে ঘুটঘুটি অন্ধকার। বাতি জ্বালাতে হলে সুইচবোর্ডও হাতরে হাতরে খুঁজতে হবে। হেদায়েত সামান্য দ্বিধায় পড়ে গেল। সে সুইচবোর্ড খুঁজবে, না সিগারেটের প্যাকেট এবং লাইটার খুঁজবে?

হেদায়েত সিগারেটের প্যাকেটের জন্যই ডান হাত বাড়িয়ে খাটের পাশের টেবিল হাতড়াতে শুরু করল। আর তখনি তার হাত হঠাৎ করে অন্য একজনের হাতের উপর পড়ল। নরম মেয়ে মানুষের হাত। সেই হাতের আঙ্গুল আলতো করে চেপে ধরল হেদায়েতের হাতের আঙ্গুল। ঘরে তো আর কেউ নেই। এটা কার হাত? হেদায়েত বিকট চিৎকার দিতে চেষ্টা করল চিৎকার দিতে পারল না। শব্দ গলার কাছে এসে আটকে গেল। হেদায়েত হাত ছাড়াতে চেষ্টা করল। পারল না। হেদায়েতের সমস্ত শরীর হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

এর পরের ঘটনাগুলি কীভাবে ঘটেছে, কোনটার পর কোনটা ঘটেছে— হেদায়েত জানে না। সে শুধু দেখল ঘরের বাতি জ্বলছে। ঘরে কেউ নেই। বাতি সে নিজেই জ্বালিয়েছে এটা নিশ্চিত। কোন হাতে জ্বালিয়েছে ডান হাতে না বাম হাতে?

হেদায়েত সময় দেখল- রাত এগারোটা দুই মিনিট। আজকের তারিখ হচ্ছে তিন। তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে—১১ ২ ৩… ফিবোনাক্কি রাশিমালা। ফিবোনাক্কি রাশিমালার বিশেষত্ব হলো— এই রাশিমালার যে-কোনো সংখ্যা

তার আগের দুটি সংখ্যার যোগফল।

হেদায়েতের বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন। খাট থেকে নামতে সাহস হচ্ছে না। কে জানে হাতটা হয়তো খাটের নিচে কোথাও আছে। হেদায়েত খাট থেকে নামমাত্র হাতটা তার পা চেপে ধরবে।

ব্যাপারটা কি স্বপ্নে ঘটেছে? চিন্তা করতে করতে হঠাৎ কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেই জানে না। ভয়ংকর স্বপ্নটা দেখার পর ঘুম ভেঙ্গেছে এবং সে তড়িঘড়ি করে বাতি জ্বালিয়েছে। এত জিনিস থাকতে স্বপ্নে সে হাতটাই বা কেন দেখবে? যুক্তি দাঁড়া করানো যায়। সে সেতুর সঙ্গে আঙটি নিয়ে কথাবার্তা বলেছে। আঙটি আঙ্গুলে পরা হয়। আঙুল থেকে হাত।

যুক্তি দাড়া করাবার পর হেদায়েতের ভয় কিছুটা কমল এবং সঙ্গে তৃষ্ণা অনেক বাড়ল। নাদুর মা খাটের কাছে এক গ্লাস পানি পিরিচে ঢেকে রেখে গিয়েছিল। গ্লাসটা এখনও আছে। পিরিচ দিয়ে ঢাকা। কিন্তু গ্লাসে কোনো পানি নেই। গ্লাসের পানি সে কখন খেয়েছে মনে করতে পারল না।

হেদায়েত সাবধানে খাট থেকে নামল। পানি খাবার জন্য প্রথমে রান্না ঘরে যাবে না-কি প্রথম যাবে বাথরুমে এই নিয়ে সামান্য সমস্যা হলো। ছোটখাট বিষয় নিয়ে তার মাঝে মাঝে বেশ সমস্যা হয়। সে ঠিক করল প্রথমে বাথরুমে যাবে। তৃষ্ণায় পানি খাওয়া আরামের ব্যাপার। বাথরুমের অস্বস্থি মাথায় থাকলে পানি খাবার আনন্দটা থাকবে না।

বড় এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেয়ে হেদায়েত ঘুমুতে গেল। ঘড়িতে বাজছে দু’টা পাঁচ। ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘরে বাতি জ্বললে সে ঘুমুতে পারে না। বাতি নেভাতে ভয় ভয় লাগছে। হেদায়েত বাতি নেভাল। সেতু যে দিকে শোয় সেদিকে সরে গেল। সেতুর বালিশে মাথা রাখল। এখান থেকে সুইচে সহজেই হাত যাবে। তা ছাড়া আগের মতো হাত টেবিলে যাবে না। অন্ধকারে সুইচ খুঁজে না পাওয়া গেলেও সমস্যা নেই। পাশের বালিশে টিভির রিমোট কন্ট্রোলটা রাখা আছে। পাওয়ার বাটনে চাপ দিলেই টিভি চালু হবে। সুইচ না টিপেও ঘর আলো করার মতো ব্যবস্থা করা যাবে। হেদায়েত চোখ বন্ধ করল। চোখ খোলা থাকলে ঘর যতটা অন্ধকার থাকে চোখ বন্ধ করলে ততটা থাকে না। এটা একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। মানব মস্তিষ্ক হয়তো অন্ধকার পছন্দ করে না। নিজেই নিজের জন্য কিছু আলোর ব্যবস্থা করে। হেদায়েত টিভির রিমোট কন্ট্রোলটার জন্যে হাত বাড়াল। রিমোট হাতেই ধরা থাকুক। তেমন সমস্যা দেখা দিলে যেন রিমোটের জন্য হাতড়াতে না হয়।

রিমোটটা পাওয়া যাচ্ছে না। বালিশ থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেছে। হেদায়েত বালিশ থেকে হাত বিছানায় নামিয়ে আনতেই অন্য একটা হাতের উপর হাত পড়ল। সেই হাতের আঙ্গুল আলতো করে আঙ্গুল চেপে ধরেছে। আঙ্গুল বরফের মতো শীতল।

হেদায়েত বিকট চিৎকার করতে শুরু করল। নাদুর মা জেগে উঠেছে। দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে আতঙ্কিত গলায় বলছে— ভাইজান কী হয়েছে? দরজা খুলেন ভাইজান। হেদায়েত গোংগানীর মতো করে চিৎকার করছে–সুইচটা কোন দিকে? নাদুর মা সুইচ কোন দিকে?

এ সময় সে সুইচ খুঁজে পেল। বাতি জ্বালালেী। কোথাও কিছু নেই। বালিশের উপর টিভির রিমোট কন্ট্রোল।

সেতু বাসায় ফিরল সকাল দশটার কিছু পর। হেদায়েত তখনও ঘুমুচ্ছে। নাদুর মা বলল, ভাইজানের কি জানি হইছে। রাইতে এমন চিৎকার!

বল কি!

এমন অবস্থা হইছিল একবার ভাবলাম দরজা ভাইঙ্গা ভিতরে ঢুকি।

পেটে ব্যাথা বা এরকম কিছু?

জ্বে না— স্বপ্ন দেইখ্যা এই অবস্থা।

কী স্বপ্ন?

জিজ্ঞাস করি নাই। রাইতে স্বপ্নের বিষয়ে কোনো কথা বলা ঠিক না। এখন আপনে গিয়া জিগান। দরজা খোলা আছে। ভাইজানকে বলছি দরজা খোলা রাইখা ঘুমান। আবার কী স্বপ্ন দেখেন তার নাই ঠিক।

সেতু শোবার ঘরে ঢুকে দেখে সব কটা বাতি জ্বলছে। হেদায়েত টিভির রিমোট কন্ট্রোল হাতে ধরে ঘুমাচ্ছে। গায়ে হাত দিয়ে ঘুম ভাঙ্গাতেই হেদায়েত চেঁচিয়ে বলল, না না না!

সেতু বলল, উঠে বস তো। কী স্বপ্ন দেখেছ বল? তুমি তো সাত-আট বছরের বাচ্চা না। এমন কী দুঃস্বপ্ন দেখলে যে চিৎকার চেঁচামেচি করে অস্থির? হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খেতে আস। তোমার সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব বলে আমি শুধু এক কাপ চা খেয়েছি।

হেদায়েত দেখল সেতু তিন নম্বর ড্রয়ার খুলছে। হীরার আঙটির এখনই খোঁজ পড়বে। হেদায়েত প্রায় দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে পড়ল। সে অপেক্ষা করছে কখন সেতু বলবে আঙটি কোথায়? সেতু কিছু বলছে না। মনে হয় ঝড়টা উঠবে নাশতার টেবিলে। সবকিছু গুছিয়ে রাখা দরকার। সমস্যা একটাই টেনশনের সময় হেদায়েত গুছিয়ে কথা বলতে পারে না।

নাশতার টেবিলে সেতু আঙটির প্রসঙ্গ তুলল না। পরোটা মুখে দিতে দিতে বলল, স্বপ্নটা কী দেখেছ বল?

হেদায়েত বলল, একটা হাত দেখেছি।

হাতটা কী করল, তোমার গলা চেপে ধরল?

উঁহু।

তাহলে কী? একটা হাত দেখে শুধু শুধু তো কেউ ভয় পাবে না। ছেলের হাত না মেয়ের হাত, না-কি ভূত-পেত্নীর হাত?

মেয়ের হাত।

মেয়ের হাত কী করে বুঝলে— আঙটি পরা ছিল?

হেদায়েত জবাব না দিয়ে অবাক হয়ে সেতুর হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সেতুর হাতে হীরার আঙটি ঝলমল করছে। হেদায়েত জানে এই আঙটি সে বাথরুমে খুঁজে পেয়ে তিন নম্বর ড্রয়ারে রাখে নি।

সেতু বলল, কথা বলছ না কেন? আঙটি পরা হাত দেখেছ?

হাতের আঙ্গুলগুলি কেমন ছিল? আমার আঙ্গুলের মতো সুন্দর? প্রশ্ন করে করে জানতে হচ্ছে কেন? তুমি নাশতা শেষ করে হড়হড় করে সব বলবে।

আজ তোমার কলেজ নেই? আছে তো! সর্বনাশ!

হেদায়েত নাশতার টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। বারোটায় কোঅর্ডিনেট জেওমেট্রির একটা ক্লাস তার আছে। আজকের বিষয় Circle.

বেগম রোকেয়া মেমোরিয়েল কলেজ

বেগম রোকেয়া মেমোরিয়েল কলেজ হেদায়েতের বাসা থেকে বেশি দূরে না। হেঁটে যেতে লাগে উনিশ মিনিট। রিকশায় লাগে পঁচিশ মিনিট। তবে ছুটির দিনে সময় বেশি লাগে। হেঁটে যেতে লাগে তেইশ মিনিট। রিকশায় লাগে সাতাশ মিনিট। ছুটির দিনে রাস্তাঘাট ফাঁকা থাকলেই সবার মধ্যে আলস্য চলে আসে। সবই হেদায়েতের হিসাব করা। হাঁটা পথে তিন মিনিটের আলস্য।

হেদায়েত রিকশা নিয়ে নিল। রিকশায় চিন্তা করার সুযোগ বেশি। কোনো দিকে তাকাতে হয় না। রিকশাওয়ালা যুবক, চেহারা সুন্দর। হাতে ঘড়ি আছে। ঘড়ি পরা রিকশাওয়ালা খুব কম দেখা যায়। হেদায়েত বলল, তোমার নাম কি নাদু?

রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে বলল, আমার নাম কালাম। নাদু হবে কী জন্য?

কয়টা বাজে কালাম?

ঘড়ি নষ্ট স্যার।

হেদায়েত ক্লাসে কী পড়ানো হবে সেই চিন্তায় মন দিল।

বৃত্তের ইকোয়েশন গত ক্লাসে বলা হয়েছে।

(x-a)^2 + (y-b)^2 = r^2

বৃত্ত সম্পর্কে মজার কথাটা আজ বলবেন। কোনো বৃত্তের ব্যাস যদি অসীম হয় তখন বৃত্ত আর বৃত্ত থাকে না। বৃত্ত সরল রেখা হয়ে যায়। বৃত্তের পরিধিকে ব্যাস দিয়ে ভাগ দিলে পাওয়া যায় পৃথিবীর সবচেয়ে রহস্যময় জিনিস। রহস্যময় জিনিসটার নাম ‘পাই’।

2 πr / 2r = π

এই পাইয়ের মান পৃথিবীর কোনো কম্পিউটার এখনও বের করতে পারে নি। তারা হিসাব করেই যাচ্ছে—

3.14159265…

এই হিসাব কখনও শেষ হবে না।

 

ছাত্রীদের কাছে ‘গিরগিটি স্যার’ ছাড়াও হেদায়েতের আরেকটি নাম আছে– ‘আফু স্যার’। আফু হলো আইনস্টাইনের ফুফাতো ভাই।

হেদায়েত ক্লাসে ঢুকে বেশির ভাগ সময়ই দেখেন বোর্ডে লেখা—

আ+ফু = মা+আ

উভয় পক্ষ থেকে আ বাদ দিলে হয়—

ফু = মা

হেদায়েত অনেকবার এই ইকোয়েশনের অর্থ জানতে চেয়েছে। সবাই মুখ টিপে হেসেছে, কেউ জবাব দেয় নি। এক সাহসী মেয়ে শুধু বলেছে, স্যার এটা একটা ধাঁধা। অংকের ধাঁধা। খুব জটিল।

অংকের ধাঁধাটা তেমন জটিল না। মাহজাবিন আহমেদ এই ক্লাসের একজন ছাত্রীর নাম। যার রোল নাম্বার ১৯, হেদায়েত যখনই কোনো প্রশ্ন করেন রোল নাম্বার ১৯-কে করেন। কারণ ১৯ একটা প্রাইম নাম্বার। অন্য প্রাইম নাম্বারের মেয়ে যেমন ১৭, ১৩, ৭, ৫, ৩, ২, ১ এদেরকে প্রশ্ন করে দেখেছেন। কেউ জবাব দিতে পারে না। রোল নাম্বার উনিশ পারে। ছাত্রীরা মাহজাবিনের সঙ্গে হেদায়েত স্যারকে মিলিয়ে মজা করে। মাহজাবিন ব্যাপরটা বুঝতে পেরে কান্না করে। হেদায়েত কিছুই বুঝে না বলে নির্বিকার থাকে।

 

হেদায়েত রোল কল শেষ করেছে। বোর্ডের দিকে তাকাল। আজ বোর্ডে লেখা–

A + F = (M + A)^2 মনে হচ্ছে নতুন কোনো ধাঁধা। হেদায়েত রেজিস্টার খাতা বন্ধ করতে করতে বলল, রোল নাম্বার…

হেদায়েত কথা শেষ করার আগেই ক্লাসের অধিকাংশ মেয়ে একসঙ্গে বলল, লাইনটিন।

হেদায়েতের কাছে ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক মনে হলো না। সে উঠে দাঁড়াতে বাড়াতে বলল, ইয়েস রোল নাইনটিন–দাড়াও।

রোল নাইনটিন কাঁদো কাঁদো মুখে উঠে দাঁড়াল। হেদায়েত বললেন, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে সিমেট্রিক অবজেক্ট কী?

রোল নাইনটিন প্রায় ফোঁপানোর মতো করে বলল, স্যার স্ফিয়ার! গোলক!

হেদায়েত মনে মনে বলল, বাহ! ক্লাসে Circle পড়ানো হচ্ছে। মেয়েটির পক্ষে বলা স্বাভাবিক ছিল—Circle! তা না বলে সে বলেছে Sphere।

হেদায়েত বলল তোমার Answer correct. Sphere কাটলেই আমরা পাই সার্কেল। তোমার নাম কী?

মাহজাবিন।

ক্লাসের অরেকটি মেয়ে (ছটফটি স্বভাব, রোল ১০, লম্বা ফর্সা, নাম নীতু) গম্ভীর গলায় বলল, স্যার আপনি ইচ্ছা করলে মাহজাবিন সর্ট করে মা ডাকতে পারেন।

ক্লাসে হাসির দমকা ঝড় বয়ে গেল। হেদায়েত এই হাসির কারণ ধরতে পারল না। অল্প বয়েসী মেয়েদের সব কর্মকাণ্ডের পেছনে তেমন কারণ অবশ্য থাকেও না। মাহজাবিন মেয়েটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে। হেদায়েতের হঠাৎ মনে হলো ক্লাসের সবচেয়ে বুদ্ধিমতী এই মেয়েটিকে যদি গত রাতের ঘটনাটা বলেন তাহলে সে হয়তো ঘটনার পেছনের কারণ সম্পর্কে কিছু বলতে পারবে। মেয়েটিকে আলাদা করে কিছু না বলে– পুরো ক্লাসের সবাইকে বলা যেতে পারে। ক্লাসে ছাত্রী সংখ্যা ৩৯, একটা প্রাইম সংখ্যা। প্রাইম সংখ্যার একগাদা মেয়ের মিলিত বুদ্ধি বেশি হওয়ার কথা।

হেদায়েত বললেন, রোল নাম্বার উনিশ বোস।

নীতু বলল, বসবে কেন্ স্যার? দাঁড়িয়ে থাকুক না।

আবারও সবাই হাসছে। হেদায়েত বলল, কাল রাতে আমার জীবনে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটা তোমাদের বলব। পড়াশোনার কিছু ক্ষতি হবে।

রোল দশ বলল, স্যার ক্ষতি হোক।

হেদায়েত রাতের ঘটনাটা বলল। কিছুই বাদ দিল না। স্ত্রীর আঙটি হারানো। সেই আঙটি তিন নম্বর ড্রয়ারে খুঁজে পাওয়া। কোনো কিছুই বাদ পড়ল না।

হেদায়েত কলল, তোমরা চিন্তা করবে। তোমাদের মাথায় কোনো ব্যাখ্যা যদি আসে আমাকে বলবে।

ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল। হেদায়েত টিচার্স কমনরুমের দিকে রওনা হলো। ক্লাস শেষ হবার পরপরই সে এক কাপ কড়া লিকারের চা খায়। দপ্তরী কালিপদ বিষয়টা জানে। সে চা বানিয়ে রাখে।

কালিপদ চায়ের কাপ হেদায়েতের হাতে দিতে দিতে বলল, পিনছিপাল স্যার আপনেরে দেখা করতে বলেছেন। মনে হয় প্রবলেম।

কী প্রবলেম?

সেটা জানি না। পিনছিপাল স্যাররে বেজার দেখলাম। চা খায়া দেখা করেন।

প্রিন্সিপাল হাজি এনায়েত করিম ছোটখাট মানুষ। মুখে ফিনফিনে দাড়ি আছে। মাথায় সব সময় বেতের টুপী পরেন। প্রচণ্ড গরমেও আচকান পরেন। কলেজে সানগ্লাস পরে থাকেন। তিনি মেয়েদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল। কিন্তু কখনও কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকান না।

স্যার! আমাকে ডেকেছেন?

এনায়েত করিম সাহেব কি সব ফাইল দেখছিলেন। ফাইল থেকে চোখ না তুলেই বললেন, বসুন। ক্লাস শেষ?

জ্বি স্যার।

আপনি যখন ক্লাস নিচ্ছিলেন তখন আপনার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আপনি গল্প করছেন। আমার ভুলও হতে পারে।

হেদায়েত বলল, ভুল না স্যার। কাল রাতে আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছে, সেটাই সবাইকে বলছিলাম। ভৌতিক ধরনের ঘটনা।

আপনি শিক্ষক মানুষ। আপনার কাজ শিক্ষকত। জীবনের ঘটনা বলা না। আমাকে আপনার একজন কলিগ বলল, ক্লাসে আপনি একবার দাড়িপাল্লা নিয়ে গিয়েছিলেন। এটা কি সত্যি?

জ্বি।

অংকের ক্লাসে দাড়িপাল্লাটা কি জনে বুঝলাম না।

হেদায়েত বলল, হেনরি ক্যাভেনডিস কীভাবে পৃথিবীর ওজন বের করেছিলেন এটা বুঝাবার জন্যে একটা দাড়িপাল্লা নিয়ে গিয়েছিলাম। স্যার আপনি কি পৃথিবীর ওজন জানেন?

না।

পৃথিবীর ওজন হলো (৫৯৭৬x১০)^২১ কিলোগ্রাম। ক্যাভেনডিস সাহেব ওজনটা কীভাবে বের করেছিলেন বুঝিয়ে বলব? শুনলে আনন্দ পাবেন।

এনায়েত করিম সাহেব বললেন, না। আমাকে বুঝিয়ে বলার দরকার নাই। আপনি অংকের শিক্ষক, অংক শেখাবেন। দাড়িপাল্লা দিয়ে পৃথিবীর ওজন মাপা আপনার কাজ না।

জ্বি আচ্ছা।

আপনার সঙ্গে আমার কথাবার্তা ফার্স্ট ওয়ার্নিং হিসাবে ধরবেন। আপনি ভালো শিক্ষক, এতে সন্দেহ নাই। কিন্তু নানান কমপ্লেইন আপনার সম্পর্কে আসছে। এটা ঠিক না।

কী কমপ্লেইন আসছে?

পড়া বাদ দিয়ে পৃথিবীর ওজন মাপা, ব্যক্তিগত গল্পগুজব করা। সবই তো কমপ্লেন। ক্লাস রুম ব্যক্তিগত বৈঠকখানা তো না।

স্যার উঠি?

এনায়েত করিম মাথা নাড়লেন এবং মনে মনে বললেন, গাধার বাচ্চা গাধা।

সামান্য মন খারাপ করে হেদায়েত টিচার্স কমনরুমে বসে আছে। আজ তার একটাই ক্লাস ছিল। ইচ্ছা করলে বাসায় চলে যাওয়া যায়, তবে প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছেন ক্লাস শেষ করেই কেউ বাড়ির দিকে কেউ রওনা হবেন না। ক্লাসের পরেও অনেক দায়িত্ব থাকে। অফিস যেমন দশটা-পাঁচটা, কলেজও দশটা-পাঁচটা।

কালিপদ আরেক কাপ চা নিয়ে এসেছে। হেদায়েত চায়ে চুমুক দিল। কালিপদ গলা নামিয়ে বলল, আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতাছে। অংকের নতুন শিক্ষক খুঁজা হইতাছে। শুনছি একজন পাইছে। মহিলা।

হেদায়েত বলল, ও আচ্ছা!

সবকিছুর মূলে আছে আজিজ স্যার।

হেদায়েত আবারও বলল, ও আচ্ছা।

কালিপদ গলা নামিয়ে বলল, তবে আপনেরে কিছু করতে পারবে না। আপনার মতো শিক্ষক কই পাইব? মহিলা শিক্ষক দিয়া অংক আর বাছুর দিয়া হাইল জমি চাষ এক জিনিস।

হেদায়েত বলল, হুঁ হুঁ!

আজকার মতো আপনার ক্লাস শেষ?

হুঁ।

বাড়িতে চলে যান। ঝিম ধরে বইসা থাইকা ফয়দা কী?

তাও ঠিক।

আপনেরে দেইখা মনে হয় চিন্তার মধ্যে আছেন? ঠিক ধরছি কি-না বলেন।

ঠিক ধরেছ।

কী নিয়া চিন্তা করেন?

প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে একটা ভুল তথ্য দিয়েছি, এটা নিয়ে চিন্তার মধ্যে পড়েছি।

উনারে কী বলেছেন?

পৃথিবীর ওজন কত সেটা বলেছি। মূল সত্যটা বলা হয় নাই। মূল সত্য হচ্ছে পৃথিবীর কোনো ওজন নাই। পৃথিবীর ওজন শূন্য।

শূন্য?

হুঁ। পৃথিবীর ওজন যেমন শূন্য, তোমার আমার সবার ওজনও শূন্য। বুঝিয়ে বলব- ফাল্ডামেন্টাল পার্টিকেলস হলো ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন। এদেরও ভাঙ্গা যায়। সবশেষে আমরা পাই লেপটনস। এদের কোনো ভর নাই। কাজেই পৃথিবীর কোনো ভর নাই। আমাদের কারোরও নাই। বুঝেছ?

জ্বি।

তাজ্জব হয়েছ না?

হয়েছি।

হেদায়েত বলল, স্ট্রিং থিওরি কথা শুনলে আরো তাজ্জব হবে। অদ্ভুত ব্যাপার! রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাবে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে দেখবে ছোট বড় স্ট্রিং।

কালীপদ বলল, স্যার আরেক দিন শুনব। এখন ঘণ্টা দিব। ঘণ্টার সময় হয়ে গেছে।

ঘণ্টা দিয়ে চলে আস।

স্যার আইজ না। কিছু কাজও আছে।

আচ্ছা— আরেক দিন।

হেদায়েত কাঠের চেয়ারে হেলে চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে থাকতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। বিকাল চারটার দিকে প্রিন্সিপ্যাল স্যার হেদায়েতের ঘুম ভাঙ্গালেন বিরক্ত গলায় বললেন— যান বাড়িতে যান। বাড়িতে গিয়ে ঘুমান। কোনো শিক্ষক চেয়ারে বসে নাক ডেকে ঘুমাচেই দেখতেও খারাপ লাগে। রাতে জেগে থাকেন না-কি?

হেদায়েত বলল, জ্বি আচ্ছা স্যার।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বললেন, জ্বি আচ্ছা স্যার মানে? কী প্রশ্ন করছি— আর কী জবাব দিচ্ছেন! আজ কী বার বলুন তো?

বুধবার।

যান বাড়িতে যান। আর যেন আপনাকে কলেজে এসে ঘুমোতে না দেখি।

হেদায়েত রিকশা করে বাড়ি ফিরছেন। মাথায় ঘুরছে বুধবার। বুধগ্রহ থেকে বারের নাম হয়েছে বুধ। বুধ সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ! মাত্র ৮৮ দিনে সূর্যের চারদিকে একবার চক্কর দেয়। মেরিনার দল এই গ্রহটার খুব কাছাকাছি গিয়েছিল ১৯৭৪ সনের মার্চ মাসে। মাত্র ৪৩৫ মাইল দূর থেকে মেরিনার ছবি তুলেছে।

আচ্ছা সন্ধ্যা তারা কি মারকারি না ভেনাস? হেদায়েত মনে করতে পারছে না। নিজের উপর অত্যন্ত বিরক্ত লাগছে। মনে থাকবে না কেন?

রিকসাওয়ালা বলল, কই যাবেন বললেন না?

হেদায়েত বলল, একটু পর বলি, একটা বিষয় মনে করার চেষ্টা করছি।

কোন দিকে যাব, সেটা বলেন।

হেদায়েত হতাশ গলায় বলল, কেন বিরক্ত করছ?

রিকশা উল্টা দিকে যাচ্ছে। হেদায়েত তাতে তেমন কোনো সমস্যা দেখল। কলাবাগানের কাছাকাছি গেলে রিকশা থেকে নেমে পড়লেই হবে। কলাবাগানে হেদায়েতের বড় ভাইয়ের বাড়ি। বড় ভাইয়ের নাম বেলায়েত। সপ্তাহে তিন দিন বড় ভাইকে না দেখলে হেদায়েতের খুব খারাপ লাগে। এই সপ্তাই শেষ হতে চলল, এখনও তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়নি। পর পর তিন দিন দেখা করতে হবে—বুধ, বৃহস্পতি ও শুক্র।

বাংলাদেশের অতি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষ

বাংলাদেশের অতি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষদের একজন হলো বেলায়েত। সরল রেখার মতো রোগা। ছোট মুখ। নাকের নিচে বেমানান গোঁফ। গোঁফ সবই পাকা। প্রতি পনেরো দিনে সে গোঁফে কলপ দেয়। কলপ দেয়ার পর পর তার এলার্জিক রিএকশন হয়। ঠোঁট-মুখ ফুলে উঠে। দুই দিন ফোলা এবং জ্বলুনি থাকে। বেলায়েত নানান ধরনের কলপ ব্যবহার করে দেখেছে। কোনো লাভ হয়নি।

বেলায়েত সব সময় ব্যস্ত। এই ব্যবসা সেই ব্যবসা। ঢাকা শহরে তার একটা রেস্টুরেন্ট আছে। নাম দি নিউ বিরানী হাউস এন্ড রেস্টুরেন্ট। এই রেস্টুরেন্টের সমস্ত বাজার বেলায়েত নিজে করে। সকাল আটটা বাজার আগেই বাজারে যেতে হয়। রেস্টুরেন্টের বাবুর্চির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলার পর সে যায় কাওরান বাজার। এখানে তার একটা কাঠ চেরাইয়ের কল এবং কাঠের দোকান আছে। দোকানের নাম বেলায়েত টিম্বার। দুপুর একটা পর্যন্ত সে বেলায়েত টিম্বারে থাকে। এখান থেকে সে যায় কলাবাগানে। এখানে সে এক কামরার একটা ঘর ভাড়া করেছে। নিউজ স্ট্যান্ড দেয়া হয়েছে। নানান ধরনের পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন বিক্রীর ব্যবস্থা। দোকানে এখনো কাজ চলছে। র‍্যাক বনানো হচ্ছে। পত্রিকার সঙ্গে ডিভিডি এবং গানের সিডিও বিক্রী হবে। ডিভিডির ব্যবসা এখন ভালো চলছে।

সন্ধার পর সে কলাবাগানে বাড়ির কাজ দেখে। মিস্ত্রীদের সঙ্গে পরামর্শ, টাকা-পয়সার হিসাব— এইসব। কলাবাগানের দোতলা বাড়ির ডিজাইন সে নিজেই করেছে। ডিজাইন মতো বাড়ি তৈরির কাজ দেখছে একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার–পরিমল বাবু। বয়স ষাট। পরিমল বাবুর সবচেয়ে বড় গুণ বেলায়েত যে ডিজাইন করে পরিমল বাবু বলেন, অসাধারণ! পশ্চিমের জানালা অফ করে দিয়ে আপনি ভালো করেছেন। বিকেলে সূর্যের চিড়বিড়া আলোর কোনো দরকার নেই। ফালতু খরচ। আবার পশ্চিমের জানালা রেখে দিলে তিনি বলেন, স্যার আপনি যা করেছেন বাংলাদেশে কোনো আর্কিটেক্টের মাথায় এই জিনিস ঢুকবে না। সূর্য ডোবার আগে আগে কন্যা-সুন্দর আলোর পবিত্রতা বুঝার বুদ্ধি এদের নেই। আপনি বয়সে ছোট। বয়সে ছোট না হলে আপনার পায়ের ধুলা নিতাম।

হেদায়েত তার বড় ভাইয়ের খোঁজে কলাবাগানে এসেছে। এই সময় বেলায়েতকে পাওয়া যায় বাড়ির ছাদে। কয়েক দিনের মধ্যে ছাদ ঢালাই হবে। তার প্রস্তুতি চলছে। রড বাঁধাইয়ের কাজ হচ্ছে। ব্লড মিস্ত্রী আবদুর রহমান গুনাসুতা দিয়ে রড বাঁধছে। তার কাজের সুবিধার জন্য দু’শ পাওয়ারের একটা ভান্তু তার চোখের সামনে জ্বলছে। কাজ তদারক করছেন পরিমল বাবু। তার তদারকির অর্থ সারাক্ষণ কথা বলে যাওয়া।

সব কিছুর মা আছে বুঝলে আব্দুর রহমান। বাড়ির মা হলো তার ছাদ।

কিসের মাসি কিসের পিসি কিসের বৃন্দাবন
মরা গাছে ফুল ফুটেছে মা বড় ধন।

এখন বল দেখি বাড়ির বাবা কে? মা’কে তা তো জেনে গেছ, এখন বল বাবা কে?

আব্দুর রহমান বিরক্ত মুখে বলল, জানি না স্যার।

পরিমল বাবু বললেন, একটু বুদ্ধি খেলাও। বুদ্ধি খেলালেই বলতে পারবে।

আব্দুর রহমান বিড়বিড় করে বলল, আপনে বুদ্ধি খেলায়া বলেন। আমি পারব না।

বাড়ির বাবা হলো পিলারগুলি। বাড়ি দাড়িয়ে থাকে এর উপর। বুঝেছ?

জ্বি স্যার বুঝেছি।

এখন বল দেখি বাড়ির মামা খালা—এরা কে?

কথাবার্তার এই পর্যায়ে হেদায়েত সিঁড়িঘর থেকে ছাদে এসে দাঁড়াল। তাকে অপ্রস্তুত মনে হলো। তার হাতে লাল রঙের দু’টা হাওয়াই মেঠাই। পলিথিনের প্যাকেটে ভরা। হেদায়েত তার ভাইয়ের জন্য এই হাওয়াই মেঠাই কিনেছে। এখন তার সামান্য লজ্জা লাগছে। হাওয়াই মেঠাই শিশুদের প্রিয় জিনিস। বেলায়েতের ছেলে-মেয়ে নেই যে তাদেরকে দিয়ে দেয়া যাবে। হেদায়েত হাওয়াই মিঠাইর ঠোঙ্গা দুটা লুকাতে চেষ্টা করল।

বেলায়েত বলল, আছিস কেমন?

হেদায়েত অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, ভালো।

তোর বৌ আছে কেমন?

ভালো।

ঝগড়া-টগড়া হয়েছে না-কি?

হাওয়াই মেঠাই কার জন্য এনেছিস?

তোমার জন্য।

এনেছিস যখন দে। লুকানোর কী আছে?

হেদায়েত ভাইয়ের হাতে ঠোঙ্গা দু’টা দিল। আনন্দে বেলায়েতের চোখে প্রায় পানি এসে গেল। তার ছোট ভাইটাকে সে নিজেই কোলে-পিঠে করে বড় করেছে। হেদায়েতের জন্মের পর তার মা মারা গেলেন। একলেমশিয়া রোগে। এই মা বেলায়েতের মা না, সত্যা। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর বেলায়েতের বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। হেদায়েতের যখন তিন বছর বয়স তখন তার বাবা মারা যান। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমে গেছেন দাঁত মাজতে। সেখানে ধুম করে মেঝেতে পরে যান। তাকে নিয়ে ছোটাছুটি শুরু হলো। হেদায়েত ভয় পেয়ে তার ভাইয়ের গলায় ঝুলে পড়ল। সে কিছুতেই নামবে না। ভাইকে গলায় ঝুলন্ত অবস্থায় নিয়েই বেলায়েত স্ট্যাক্সি ডেকে আনল। বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। ট্যাক্সিতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। বেলায়েত বুঝতে পারে নি, সে তখন ব্যস্ত ছোট ভাইয়ের ভয় কাটাতে।

বেলায়েত হাওয়াই মিঠাই ছিড়ে ছিড়ে মুখে দিচ্ছে। ভাব করছে যেন খুবই আনন্দ পাচ্ছে। বেচারা একটা জিনিস শখ করে এনেছে। আগ্রহ করে না খেলে মনে কষ্ট পাবে।

দাম কত নিয়েছে রে?

দশ টাকা পিস।

বেলায়েত বলল, প্রডাকশন কষ্ট কত কে জানে? অল্প হওয়ার কথা। মুখে দিলেই মিলিয়ে যাচ্ছে, আসল জিনিস নাই বললেই হয়। প্রডাকশন কস্ট যদি এক টাকাও ধরি তা হলেও পার পিসে নয় টাকা লাভ। পরিমল বাবু!

জ্বি সার।

একটু খোঁজ নিবেন তো হাওয়াই মেঠাইয়ের পার পিসে প্রডাকশন কস্ট কত হয়?

কালই খোঁজ নিব।

হাওয়াই মেঠাই এর ইংরেজি নাম কী জানেন না-কি?

জ্বি না স্যার।

হেদায়েত তুই জানিস?

হেদায়েত বলল, ইংরেজি নাম Candy Floss।

বেলায়েতের মুখে তৃপ্তির হাসি দেখা দিল। তার ভাই জানে না এমন কোনো জ্ঞান পৃথিবীতে নেই। অসাধারণ একটা ছেলে। মাশাআল্লাহ।

হেদায়েত।

জ্বি ভাইজান।

পরিমল বাবুকে পৃথিবীর ব্যাপারটা বল তো।

পৃথিবীর কোন ব্যাপারটা?

আমাকে একদিন বলেছিলি, ঐ যে পৃথিবী জীবন্ত। মৃত না— এই সব। পরিমল বাবু মন দিয়ে শুনুন। ভেরি ইন্টারেস্টিং। আব্দুর রহমান তুমিও শোন। রছে তার বেঁধে বেঁধে জীবন পার করে দিলে, কিছুই জানলে না। আফসোস!

হেদায়েত পৃথিবীর গল্প বলে যাচ্ছে, তিনজনই আগ্রহ নিয়ে শুনছে। বেলায়েতের ভাবভঙ্গিতে আগ্রহ এবং আনন্দের খাঁটি মিশ্রণ।

হেদায়েত বলছে, পৃথিবীকে আমরা মৃত বস্তু হিসাবে জানি। ভেতরটায় আছে লোহা এবং নিকেল। নব্বই ভাগ লোহা এবং দশ ভাগ নিকেল। সর্ব অর্থেই এটাকে মৃত বস্তু বলা যায়। কিন্তু পৃথিবী মৃত না। জীবিত!

আব্দুর রহমান হতভম্ব গলায় বলল, বলেন কি! এর জান আছে?

বেলায়েত বিরক্ত গলায় বলল, আগেই কথা বল কেন? পুরা ঘটনা শোন।

হেদায়েত বলল, জীবিত প্রাণী কী করে? বেঁচে থাকতে চায়। তার অসুখবিসুখ হলে চিকিৎসা নিতে চায়। তার শরীরে কোনো ক্ষতি হলে ক্ষতি পূরণ করতে চায়। পৃথিবী তাই করে। একবার পৃথিবীর ওজন লেয়ার ফুটো হয়ে গেল। বিজ্ঞানীরা হতভম্ব হয়ে গেল। কী সর্বনাশ! পৃথিবী নিজেই ওজন লেয়ার ঠিক করল। গ্রীন হাউস অ্যাফেক্টে পৃথিবীর তাপ এখন বাড়ছে। পৃথিবী চেষ্টা করে যাচ্ছে তাপ কমাতে। সমুদ্রে অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করেছে শৈবাল। শৈবাল কার্বনডাই অক্সাইড খেয়ে নিচ্ছে। গ্রিন হাউস অ্যাফেক্ট কমছে। পৃথিবী সবই নিজে নিজে করছে। কাজেই পৃথিবীকে একটা জীবিত প্রাণী ছাড়া আর কিছু বলা যায়?

বেলায়েত বলল, অবশ্যই না। পরিমল বাবু আপনার কি মত?

পরিমল বাবু আমতা আমতা করছেন। সুন্দর কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। বেলায়েত বলল, হেদায়েত এদেরকে ঐ মাছের গল্পটা বল। এরা মজা পাবে।

হেদায়েত বলল, কোন মাছ?

ঐ যে একটা মাছ আছে কিছুদিন থাকে স্ত্রী তারপর হয়ে যায় পুরুষ। অদ্ভুত ব্যাপার! শুনলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।

হেদায়েত বলল, গল্পটা আরেক দিন বুলি। তোমাকে একটা জরুরি কথা বলীর জন্য এসেছি।

বেলায়েত বলল, অবশ্যই বলবি। এখনই বল। পরিমল বাবু আপনি চলে যান। আব্দুর রহমান তুমিও যাও।

হেদায়েত তার রাতের অভিজ্ঞতা বলল। হাতের উপর হাত রাখা, আংটি পাওয়া কিছুই বাদ দিল না।

বেলায়েত বলল, জ্বিনের উপদ্রব। আর কিছুই না। তোর বৌ সুন্দর তো এই জন্যেই উপদ্রবটা হচ্ছে। একদম চিন্তা করবি না। মগবাজারের ছোট পীর সাহেবকে নিয়ে যাব। উনি বাড়ি বন্ধন করে দিবেন। তুই নিশ্চিত থাক। আর খবর্দার একা ঘুমাবি না! বৌ যদি বাপের বাড়ি যায় তুইও অবশ্যই সঙ্গে যাবি।

যেতে ভালো লাগে না।

শ্বশুরবাড়ি যেতে ভালো লাগে না, এটা কেমন কথা! তোর বাবা-মা নেই। শ্বশুর-শাশুড়ীই তোর বাবা-মা। ক্লিয়ার?

হুঁ।

আর কিছু বলবি?

হেদায়েত বলল, সেতু তার মা’র বাড়িতে গেলে আমি এসে তোমার সঙ্গে থাকব। আমি ঐ বাড়িতে যাব না।

বেলায়েত বলল, আচ্ছা যা ঠিক আছে। টেনশান করিস না। জরুরি কথা শেষ হয়েছে, না-কি আরও কিছু বলবি?

হেদায়েত মাথা নিচু করে বলল, ভাইজান সেতুকে আমার পছন্দ হয় না।

বেলায়েত হতভম্ব হয়ে বলল, সর্বনাশ এইসব কী কথা!

হেদায়েত মাথা নিচু করে বলল, সত্য কথা।

তাকে পছন্দ হয় না কেন? আমি যতদূর জানি সে তো খুবই ভালো মেয়ে।

ঘন ঘন বাপের বাড়ি যায়, এটা ছাড়া তার তো আর কোনো সমস্যা নেই।

হেদায়েত বলল, পচা একটা সেন্ট সে গায়ে মাখে। আমার দম বন্ধ লাগে।

এই সেন্ট না মাখতে বল। বাজার থেকে ভালো একটা সেন্ট কিনে নিয়ে যা।

হেদায়েত চুপ করে রইল। ভাইজানের এই বুদ্ধিটা খারাপ লাগছে না।

বেলায়েত বলল, রাত এমন কিছু বেশি হয় নি। দোকান খোলা আছে। চল আমার সঙ্গে। সেন্ট কিনে দেই। গন্ধ শুকে শুকে সেন্ট কিনবি। ঠিক আছে?

হুঁ। ঠিক আছে।

বেলায়েত বলল, তোর ভাবীকেও সঙ্গে নিয়ে নেই। মেয়ে মানুষ তো, সেন্ট ভালো বুঝবে।

হেদায়েত বলল, ভাবীকে সঙ্গে নিও না।

তার সমস্যা কী?

হেদায়েত বলল, ভাবীর গা থেকে সব সময় রসুনের গন্ধ আসে। আমার গা লায়।

বলিস কি! আমি তো রসুন-পিঁয়াজ কোনো গন্ধই পাই না। তোর তো বিরাট প্রবলেম। আমার গা থেকে কোনো গন্ধ আসে? লুকাবি না। সত্যি কথা বলবি।

হেদায়েত বলল, ঘামের গন্ধ আসে। তোমার ঘামের গন্ধ খারাপ না। ভালো।

বেলায়েত বলল, ঘামের গন্ধ আবার ভালো হয় কীভাবে?

হেদায়েত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ভাইজান ক্ষুদা লেগেছে। দুপুরে যে কিছুই খাই নি সেটা ভুলে গেছি।

তোকে নিয়ে তো বিরাট সমস্যা। দুপুরে খাওয়ার কথা কি কেউ ভুলে? চল তোকে দি নিউ বিরানী হাউসে নিয়ে যাই। নদীর এক পাঙ্গাস আজ সকালে নিজের হাতে কিনে দিয়েছি। এগারো কেজি ওজন। এখনও আছে কিনা কে জানে।

রেস্টুরেন্টে কাস্টমার গিজগিজ করছে। বসার জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না। বেলায়েত তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ম্যানেজার ছুটে এসেছে। ম্যানেজার পারলে খদ্দের গলাধাক্কা দিয়ে বের করে স্যারের জন্যে জায়গা করে।

বেলায়েত বলল, আমার জন্যে ব্যস্ত হবে না। শুধু আমার ভাইকে বসার ব্যবস্থা করে দাও।

হেদায়েত বলল, আমি তোমাকে ছাড়া খাব না ভাইজান।

বেলায়েত মনে মনে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। হেদায়েত তাকে ছাড়া যে খাবে না, এটা আগেই বোঝা উচিত ছিল। বেলায়েত গলা নামিয়ে বলল, কেমন রমরমা ব্যবসা বুঝতে পারছিস?

হেদায়েত বলল, বুঝতে পারছি। ৩৭ জন কাস্টমার।

এর মধ্যে গুনেও ফেলেছিস! মাশাআল্লাহ।

হেদায়েত বলল, ৩৭ একটা প্রাইম নাম্বার।

সেটা আবার কী?

বুঝিয়ে বলব?

এখন থাক। খাবার সময় বুঝিয়ে বলিস। ৩৭ জন কাস্টমার বললি— আমাদের দুজনকে ধরেছিস? আমরাও তো কাস্টমার। পয়সা দিয়ে খাব।

আমাদের দু’জনকে নিয়ে হয় ৩৯, এটা প্রাইম নাম্বার না।

বেলায়েত বলল, তাহলে তো সমস্যা হয়ে গেল। সমস্যা হয়েছে কি-না বল?

হেদায়েত সেতুর জন্যে সেন্ট কিনে

হেদায়েত সেতুর জন্যে সেন্ট কিনে বাসায় ফিরেছে। সেন্টের নাম ক্লিওপেট্রা। বোতলের কভারে ক্লিওপেট্রার ছবি। ক্লিওপেট্রা সাপ হতে বসে আছে। সাপটার দিকে তাকিয়ে আছে গভীর ভালোবাসায়। গন্ধটা তার কাছে যথেষ্টই ভালো লেগেছে। সে বেলায়েতকেও গন্ধ শুকিয়েছে। বেলায়েত বলেছে, আমি তো কোনো গন্ধই পাচ্ছি না। মনে হয় সর্দিতে নাক বন্ধ।

 

সেতু বলল, রাত দশটা বাজে। কোথায় ছিলে এত রাত পর্যন্ত?

ভাইজানের কাছে গিয়েছিলাম।

খবর দিলেই পারতে, চিন্তা করছিলাম।

হেদায়েত বলল, তোমার জন্যে একটা সেন্ট কিনেছি। ক্লিওপেট্রা নাম।

সেতু বিস্মিত হয়ে বলল, হঠাৎ সেন্ট কিনলে কেন? তুমি তো সেন্ট কেনার মানুষ না! ধারাপাতের একটা বই কিনে আনলে বুঝতাম হিসেব মতো কিনেছ। এই তুমি কি খেয়ে এসেছ?

হুঁ।

খেয়ে এসে ভালোই করেছ। ঘরে তেমন কিছু রান্না হয় নি। কাঁঠাল-বিচি দিয়ে ডিমের ঝোল। তুমি কী খেয়েছ?

পাঙ্গাস মাছ আর মুরগির ঝাল ফ্রাই। ভাইজানের রেস্টুরেন্টে খেয়েছি। ভাইজান তোমার জন্য খাবার দিয়ে দিয়েছেন। রান্নাঘরে রেখে এসেছি।

সেতু বলল, আমি তো খাব না।

খাবে না কেন?

আমি মা’র বাসায় যাচ্ছি। মা কোখেকে এক রেসিপি পেয়েছে— সজনে গাছের ছালের ভর্তা। খেতে না-কি অসাধারণ। রবিন ভাই আমাদের সঙ্গে খাবেন। উনি একটা ছবি নিয়ে আসবেন। ছবির নাম Swan। এমনই ভয়ের যে দুর্বল হার্টের লোকজনের দেখা নিষেধ।

সেতু সাজ-গোজ করছে। হেদায়েত সামান্য টেনশান বোধ করছে। সেতু কি তার পুরানো সেন্টটাই মাখবে? হেদায়েতের উচিত ছিল বলা, পুরানো সেন্টের গন্ধটা আমার ভালো লাগে না। এই জন্যেই ক্লিওপেট্রা কিনেছি। এখন থেকে ক্লিওপেট্রা দেবে। মেয়েরা কি অন্যের পছন্দের সেন্ট গায়ে মাখে? মনে হয় না। সব মেয়েরই নিজের পছন্দের সেন্ট থাকে।

সেতুর সাজ-গোজ শেষ হয়েছে। আজকের সাজটা ভালো হয় নি। তাকে সিনেমার এক্সট্রা মেয়েদের মতো লাগছে। তার গাড়ি এখনও আসে নি। সে হেদায়েতের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার দিকে ভালো করে তাকাও। আমার হাতে কী?

হেদায়েত বলল, দড়ি।

সেতু বলল, এক হাতে দড়ি, অন্য হাতে কঁচি। এই কাঁচি দিয়ে আমি দড়ির মাঝখানটা কেটে ফেলব।

হেদায়েত বলল, কেন?

ম্যাজিক দেখাচ্ছি। ঐ দিন কি বললাম, রবিন ভাইয়ের দড়ি কাটার একটা ম্যাজিক আমি ধরে ফেলেছি। সেইটাই এখন তোমাকে দেখাচ্ছি। এই দেখ দড়ির মাঝখানটা কাটলাম। দেখছ ঠিকমতো?

টিসুপেপার দিয়ে কাটা অংশটা ঢাকলাম। দেখছ তো? অন্য দিকে তাকাবে। আমার দিকে তাকিয়ে থাক।

আচ্ছা।

এখন দেখ দড়ি কি জোড়া লেগেছে?

হুঁ।

সেতু বলল, তুমি অবাক হও নি?

হেদায়েত বলল, না। অবাক হব কেন? তুমি তো ম্যাজিক দেখাচ্ছে। এমন যদি হতো যে, আমরা দড়ি কাটছি আর আপনা-আপনি কাটা দড়ি জোড়া লেগে যাচ্ছে তাহলে অবাক হতাম।

তুমি এমন অদ্ভুত মানুষ!

হেদায়েত বলল, সরি!

সেতু বলল, সরি বলার কিছু নেই। সব মানুষ কখনো এক রকম হয় না। একটা কাজ করে দাও।

কী কাজ করতে হবে হেদায়েত বুঝতে পারছে না। শাড়ি পরার পর সেতুর একজনকে লাগে, যে পায়ের কাছে শাড়ির পার ধরে টানাটানি করে। এই কাজ? না-কি সেফটিফিন লাগানো কাজ? ব্লাউজের বোতাম লাগানোর কাজও হতে পারে? এইসব কাজ মেয়েরা একা করতে পারে না। দ্বিতীয় একজন লাগে। সিস্টেমটা এমন হওয়া উচিত যেন এই ধরনের কাজ মেয়েরা নিজেরাই করতে পারে। হেদায়েত বলল, কী কাজ?

সেতু বলল, আমার জন্যে একটা সেন্ট কিনে এনেছ, সেন্টটা গায়ে নিজের হাতে স্প্রে করে দাও। এক গাদা দিও না।

হেদায়েত স্পেতে চাপ দিল। মিষ্টি গন্ধ বের হচ্ছে।

সেতু বলল, পুরুষদের কিছু কিছু কাজে মেয়েরা খুব খুশি হয়। এই যে তুমি সেন্ট কিনে আনলে আমি খুশি হয়েছি। গায়ে স্প্রে করে দিলে এতে আরও খুশি হয়েছি। তবে স্প্রে করার ব্যাপারটা আমাকে বলে দিতে হয়েছে, এটাই সমস্যা।

হেদায়েত বলল, সমস্যা কেন?

সেতু বলল, সমস্যা কেন তোমাকে ব্যাখ্যা করতে পারব না।

হেদায়েত হঠাৎ লক্ষ করল, সেতুর পায় থেকে আগের সেন্টের অতি বোটকা গন্ধ আসছে। দম বন্ধ হয়ে আসার মতো গন্ধ। এ রকম তো হওয়ার কথা না! আগের সেন্টটা তো সেতু গায়ে মাখে নি। সমস্যা কী?

সেতু বলল, গাড়ির হর্ন শুনতে পাচ্ছি। আমি গেলাম।

হেদায়েত বলল, আচ্ছা।

সেতু বলল, একটা চুমু খেতে চাইলে খেতে পার। চুমু খেতে ইচ্ছা করছে?

হেদায়েত বলল, চুমু খেতে ইচ্ছা করবে কেন?

সেতু বলল, তোমার স্ত্রী সুন্দর করে সেজে-গুজে বাইরে যাচ্ছে, তাকে বিদায় দেবার সময় চুমু খেতে ইচ্ছা করবে না, আশ্চর্য তো!

হেদায়েত বলল, তোমার ঠোটের লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাবে তো।

সেতু বলল, কী অদ্ভুত তোমার কথাবার্তা! Ok আমি গেলাম। রাতে টেলিফোনে কথা হবে।

হুঁ।

সব সময় হুঁ হুঁ করবে না। তুমি বোবা-কালা না।

 

হেদায়েত শোবার ঘরের খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আসে। তার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। নাদুর মা অ্যাশট্রে দিয়ে গেছে। অ্যাশট্রেতে সামান্য পানি দেয়া হয়েছে বলে সিগারেটের ছাই ওড়ছে না। নাদুর মার বুদ্ধিতে হেদায়েত মুগ্ধ। অতি সাধারণ একটা বিষয়ের জন্যে কত বড় সুবিধা হয়ে গেল। হেদায়েতের ঘুম পাচ্ছে, তবে এখন ঘুমানো যাবে না। সেতু টেলিফোন করে বলে গেছে। তার টেলিফোনের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। হেদায়েতের শান্তি শান্তি লাগছে। ঘরে টিভি চলছে না বলেই হিন্দি কথাবার্তা কানে আসছে না। রান্নাঘরও নিস্তব্ধ। নাদুর মা মনে হয় শুয়ে পড়েছে। কাজের মেয়েরা অতি দ্রুত ঘুমিয়ে পড়তে পারে। নিস্তব্ধ ফ্লাটবাড়ি জটিল চিন্তার জন্যে ভালো। কী নিয়ে। চিন্তা করা যায়? ম্যাজিক নিয়ে?

হেদায়েত গভীর চিন্তা শুরু করল। প্রকৃতি কি ম্যাজিক পছন্দ করে? সৃষ্টির রহস্যের অনেক কিছু লুকিয়ে রাখে? এমন কি হতে পারে যে, আলোর গতি ধ্রুবক না। প্রকৃতির ম্যাজিকের কারণে মানুষের কাছে মনে হচ্ছে ধ্রুবক। আলোর গতির বিষয়টা জটিল। প্রকৃতির ম্যাজিক প্রকাশ হয়ে পড়লে দেখা যাবে বিষয়টা দড়ি কাটার মতই সহজ।

টেলিফোন বাজছে। পাঁচটা রিং হবার পর হেদায়েত টেলিফোন ধরল, কারণ পাঁচ হলো প্রাইম সংখ্যা।

কে সেতু। ঠিকমতো পৌঁছেছ?

ও পাশ থেকে মিষ্টি গলা ভেসে এল, স্যার আমার নাম নীতু। রোল নাম্বার টেন।

ও আচ্ছা।

স্যার আমাকে চিনেছেন?

হুঁ।

সেতু কে স্যার। ম্যাডাম?

হুঁ।

উনি বাসায় নেই?

না।

কোথায় গেছেল?

তার মা’র বাসায় গেছে। রাতে থাকবে। তারা একটা ভূতের ছবি দেখবে। ছবির নাম Swan। দুর্বল হার্টের মানুষদের জন্যে ছবিটা নিষিদ্ধ।

তাহলে তো স্যার ছবিটা আমি দেখতে পারব না। আমার হার্ট অত্যন্ত দুর্বল। প্যালপিটিশন হয়।

সেই ক্ষেত্রে তোমার এই ছবি না দেখাই ভালো।

স্যার আমি কী জন্যে টেলিফোন করেছি জানতে চাইলেন না তো?

কী জন্যে করেছ?

আপনি ক্লাসে বলছিলেন গত কাল রাতে একটা হাতের উপর আপনার হাত পড়েছিল। সেই হাতটা কার সেটা বের করেছি। আমার ধারণা বের করে ফেলতে পেরেছি।

হেদায়েত আগ্রহের সুরে বলল, কার হাত?

নীতু বলল, মাহজাবিনের হাত স্যার। রোল নাইটিন।

তার হাত কীভাবে হবে? সে তো আমাদের ফ্লাটে থাকে না।

আত্মার ব্যাপার স্যার। সে মগবাজারে থাকে, তার আত্মা আপনাদের ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছিল।

সেটা কীভাবে সম্ভব? আত্মার হাত থাকবে কীভাবে?

নীতু বলল, তার আত্মার সঙ্গে আপনার আত্মার মিলন হয়েছে স্যার।

হেদায়েত বলল, তোমার কথায় কোনো যুক্তি পাচ্ছি না তো। Soul কোনো material বস্তু না।

নীতু বলল, অনেক বিষয় আছে স্যার যুক্তির ঊর্ধ্বে। আত্মা তো আর আপনি অংক দিয়ে প্রমাণ করতে পারবেন না।

হেদায়েত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তা ঠিক। তবে আত্মা যদি সত্যি থাকে তাহলে কোনো একদিন সেটা অংকের সীমানায় চলে আসবে। ম্যাথমেটিসিয়নরা আত্মার একটা ইকুয়েশন বের করে ফেলবেন। একটা ওয়েভ ফাংসান। ওয়েভ ফাংসানটা হতে হবে টাইম ইনডিপেনডেন্ট। কারণ আত্মা সময়ের বাইরে।

স্যার আমি রাখি? মা দুর থেকে কেমন করে জানি তাকাচ্ছে। মা ভাবছে আমি কারো সঙ্গে প্রেম করছি। আমার মা খুব সন্দেহবাতিকগ্রস্ত মহিলা।

ও আচ্ছা!

আমার বাবাও সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, তবে মার চেয়ে সামন্য কম।

ও আচ্ছা!

স্যার আপনার হাতের কাছে কি কাগজ-কলম আছে?

কাগজ-কলম হাতের কাছে নাই।

হাতের কাছে কাগজ-কলম থাকলে আমার টেলিফোন নাম্বারটা লিখে রাখতে বলতাম। আত্মার ইকুয়েশনটা যদি আপনি বের করে ফেলতে পারেন তাহলে টেলিফোনে আমাকে জানতে পারবেন। আমার ধারণা কেউ না পারলেও আত্মার ইকুয়েশনটা আপনি বের করতে পারবেন। কারণ আপনি আফু।

‘আফু’ মানে কী?

‘আফু’ মানে আপনাকে বলব না। স্যার, কাগজ-কলম পেয়েছেন?

হেদায়েত বলল, একবার শুনলেই আমার টেলিফোন নাম্বার মনে থাকে। তুমি নাম্বারটা বল।

স্যার আপনার এত স্মৃতিশক্তি!

আমার স্মৃতিশক্তি ভালো না। আমি একটা বিশেষ টেকনিক ব্যবহার করি। নাম্বার মনে রাখার জন্যে টেকনিকটা ভালো।

স্যার টেকনিকটা আমাকে বলবেন?

অবশ্যই বলব। তুমি করবে কি নাম্বারগুলি তিনটা ভিজিট করে আলাদা করবে। তারপর দেখবে প্রতিটি ভাগে কয়টা প্রাইম নাম্বার আছে। প্রাইম নাম্বারগুলির পাশের সংখ্যাটার সঙ্গে কত যোগ করলে আবার প্রাইম সংখ্যা হয় সেটা হিসাব করবে। শূন্য কয়টা আছে সেটা বের করবে। একক দশক শতক হিসাবে শূন্যের অবস্থানটা জানবে…

স্যার আপনি তো আমার মাথা পুরা আউলায়ে দিয়েছেন। আমি আমার লাম্বারটা বলি এক সপ্তাহ পরে জিজ্ঞেস করব, দেখি বলতে পারেন কিনা? আমার নাম্বার হল ৯৬৫০৩০২১, স্যার মনে থাকবে?

অবশ্যই মনে থাকবে। মোট চারটা প্রাইম সংখ্যা আছে। শূন্য আছে দু’টা। তাদের অবস্থান শতকের ঘরে এবং অযুতের ঘরে।

স্যার খোদা হাফেজ। মা এদিকে আসছেন তো আর কথা বলা যাবে না।

খোদা হাফেজ।

হেদায়েত টেলিফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন বাজতে লাগল। হেদায়েত রিসিভার কানে নিতেই সেতু বলি, টেলিফোন এতক্ষণ এনগেজ কেন? যতবারই রিং করছি এনগেজ টোন। কার সঙ্গে কথা বলছিলে?

আমার এক ছাত্রীর সঙ্গে, তার নাম নীতু। রোল নাম্বার টেন।

এত রাতে ছাত্রীর সঙ্গে কীসের কথা?

তার ধারণা সে একটা সমস্যার সমাধান করেছে। সমাধানটা আমাকে জানাতে টেলিফোন করেছিল। তবে সমাধান ঠিক না, হাস্যকর! আমার ধারণা কোনো একটা ফাজলামি করার জন্যে সে টেলিফোন করেছে।

বকবকানি রাখ। শোন তুমি শোবার ঘরে সিগারেট খাচ্ছ না তো!

একটা খেয়েছি।

আর খাবে না। খেতে ইচ্ছা হলে বারান্দায় গিয়ে খাবে।

আচ্ছা।

টেবিল-ল্যাম্পের কাছে এক পাতা ডরমিকাম ট্যাবলেট আছে। এক্ষুনি একটা খেয়ে নাও।

এই ট্যাবলেট খেলে কী হবে?

ভালো ঘুম হবে। তুমি আজে-বাজে স্বপ্ন, হাতের উপর হাত— এইসব দেখবে না।

আচ্ছা ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমাব।

এক্ষুনি খাও। নয় তো মনে থাকবে না। আমি টেলিফোন ধরে আছি, তুমি ট্যাবলেট খেয়ে আস।

হেদায়েত ট্যাবলেট খেয়ে আবার টেলিফোন ধরল। সেতু বলল, আমাদের সমস্ত প্রোগ্রাম বাতিল হয়ে গেছে। এমন মেজাজ খারাপ লাগছে!

প্রোগ্রাম বাতিল হলো কেন?

ভিসিডির প্রিন্ট খারাপ। ছবি ঝিঝিড় করছে। আটকে আটকে যাচ্ছে।

অন্য কোনো ছবি দেখ।

ভূতের ছবি দেখার মুড নিয়ে বসেছি, এখন অন্য ছবি কীভাবে দেখব?

তাও ঠিক।

তুমি মাঝে-মাঝে এত বোকার মতো কথা বল।

সরি।

সরি-ফরি বলতে হবে না। শুয়ে পর, রাত অনেক হয়েছে। ও আচ্ছা বলতে ভুলে গেছি, তোমার সেন্টাটা রবিন ভাই খুব পছন্দ করেছেন। রবিন অই বলেছেন সেন্টটার গন্ধের সঙ্গে এলিজাবেথ আর্ডেনের গন্ধের খুব মিল আছে। এলিজাবেথ আর্ডেনের নাম শুনেছ?

না।

পৃথিবীর সেরা সেন্ট। আচ্ছা রাখি তুমি শুয়ে পড়। ডরমিকাম খাবার আধ ঘণ্টার মধ্যে শুয়ে পড়তে হয়, নয় তো পরে মাথা ধরে। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়। ঘুম তাড়াতাড়ি আসবে।

হেদায়েত টেলিফোন রেখে শুয়ে পড়ল। আজকে রাতটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। গায়ের উপর চাদর রাখলে গরম লাগে। চাদর ফেলে দিলে আবার ঠাণ্ডা লাগে।

বাতি নেভানোর পর ঘর কবরের মতো অন্ধকার হয়ে গেছে। ভোরবেলায় জানালা দিয়ে আলো আসে বলে সেতুর ঘুম ভেঙ্গে যায়। এই কারণেই প্রতিটি জানালার সে ভারী পর্দা দিয়েছে। এতেও লাভ হয়নি দেখে জানালার কাচে কালো রঙ দিয়ে দিয়েছে। কোনো দিন থেকে ঘরে আলো আসার ব্যবস্থা নেই। এমন অন্ধকার ঘরে ঘুমানো যায় না। সাউন্ড অফ করে টিভি ছেড়ে দিলে ঘর সামান্য আলো হবে। টিভির রিমোট টেবিলে রাখা। রিমোটের জন্যে হাত বাড়াতেই আগের রাতের মতো নরম একটা হাতের উপর হাত পড়ল। হেদায়েত আগের রাতের মতো চেঁচিয়ে উঠল না। ভয়ে তার শরীর জমে গেছে। তার পরেও সে হাত সরাল না। ব্যাপারটা বুঝতে হবে। সে যদি শক্ত করে হাতটা ধরে তার কাছে আনে তাহলে কি হাতটা আসবে? শুধু হাতটা আসবে না হাতের মানুষটাও আসবে? চিন্তা করতে করতেই হেদায়েত উরমিকামের প্রভাবে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

গাঢ় ঘুম হলো না। সারারাতই আজে-বাজে স্বপ্ন। একটা স্বপ্নে বড় হলঘরে পুতুলের মতো চেহারার একটা লম্বা মেয়ে মেঝেতে বসে আছে। মেয়েটার হাত দুটি অসম্ভব লম্বা। দুটি হাতই মেঝেতে পরে আছে সাপের মতো। মেয়েটার আঙ্গুলগুলি অস্বাভাবিক লম্বা। প্রতিটি আঙ্গুলে আংটি। আংটি থেকে আলো বেরিয়ে আসছে। স্বপ্নে হেদায়েত মেয়েটাকে চেনে। মেয়েটার নাম এলিজাবেথ আর্ডেন। তার গা থেকে সুন্দর গন্ধ আসছে।

স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। আরেকটা স্বপ্ন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো। সেই স্বপ্নে আগের হলঘরটাই আছে, তবে এলিজাবেথ আর্ডেন নেই। হলঘর ভর্তি পুরানো আমলের টেলিফোন। এখানেও একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার মুখ গোল। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। মেয়েটি বলছে, আমি টেলিফোন অপারেটর। আমার নাম নীতু। রোল নাম্বার টেন। আপনার কাকে দরকার বলুন। আমি এক্ষুনি লাইন করে দিচ্ছি।

হেদায়েত বলল, সেতুর সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার। সে তার মায়ের বাড়িতে আছে।

মায়ের বাড়িতে কেন?

তার একটা ভূতের ছবি দেখার কথা। ছবির খুব ভালো প্রিন্ট পাওয়া গেছে।

স্যার উনাকে তো কোনো নাম্বারেই পাচ্ছি না।

চেষ্টা করে যাও।

মেয়েটা চেষ্টা করেই যাচ্ছে। লাভ হচ্ছে না। এক সময় সে হতাশ হয়ে বলল, স্যার টেলিফোনে পেলাম না। তবে উনার আত্মা নিয়ে আসতে পারি। আনব?

না না, এই কাজ করতে যাবে না। পরে তার সমস্যা হবে।

স্যার গুড নিউজ! উনাকে টেলিফোনে পাওয়া গেছে। নিন কথা বলুন।

হেদায়েতের ঘুম ভাঙলো টেলিফোনের শব্দে। টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। ঘরে ঝলমলে আলো। ঘড়িতে দশটা পাঁচ বাজে। দশটা থেকে ক্লাশ ছিল। ক্লাসটা মিস হয়েছে। কী সর্বনাশ! হেদায়েত টেলিফোন ধরে বলল, কে?

সেতু বলল, কে বলছ কেন? টেলিফোনটা ভদ্রভাবে ধরতে পার না। এতক্ষণ ধরে ঘুমাচ্ছ?

হুঁ,

ঘুমের অষুধে তাহলে ভালো কাজ করেছে।

হুঁ।

এখন থেকে অর্ধেকটা করে খাবে, পুরো ট্যাবলেট খেয়ে সারাদিন ঘুমানোর কিছু নেই।

হুঁ।

আচ্ছা শোন আমার আসতে আসতে কিন্তু বিকাল হয়ে যাবে। ছোট্ট একটা ঝামেলায় পড়ে গেছি। ঝামেলাটা কি শুনবে?

না।

এত কম কৌতূহল কেন তোমার, বল তো। একটা বোয়াল মাছের যে কৌতূহল, তোমার তাও নাই। বোয়াল মাছ পানিতে নড়া-চড়া করে। আশেপাশে কী হচ্ছে বুঝার চেষ্টা করে। তুমি তাও কর না।

সরি!

কথায় কথায় সরি বলার কিছু নেই। সরি বলে সমস্যার সমাধান হয় না। আচ্ছা শোন, কেউ কি আমার নামে কিছু তোমার কাছে লাগিয়েছে?

না তো।

উল্টা-পাল্টা কিছু কি বলেছে–যেমন আমার ইল্লিসিট রিলেশনশিপ আছে একজনের সঙ্গে।

না।

দুষ্টলোকের তো পৃথিবীতে অভাব নেই। মানুষের নামে কুৎসিত গল্প তৈরী করে এরা কী যে আনন্দ পায়। কোন একটা বদমাশ আমার নামে আজে-বাজে কথা চারদিকে ছড়াচ্ছে।

আজে-বাজে কী কথা?

আমি না-কি রাতে হোটেলে কার সঙ্গে থাকি।

হেদায়েত বলল, তুমি হোটেলে থাকবে কেন? নিজের ফ্ল্যাট আছে। মায়ের বাসা আছে। তোমার হোটেলে থাকার দরকার কী?

তুমি যত সহজে ব্যাপারটা বুঝতে পারছ, অন্যরা তা পারছে না। নাশতা খেয়েছ?

না।

হাত-মুখ ধুয়ে নাশতা খাও। কলেজে যাও। আর শোন রাতে তোমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও যাব। টি বোন স্টেক খেতে ইচ্ছা করছে। আমি একটা রেস্টুরেন্টের খোঁজ পেয়েছি, ভালো স্টেক বানায়।

হেদায়েত বলল, আচ্ছা।

নাদুর মা চা নিয়ে এসেছে। বাসি মুখে চা খেতে দেখলে সেতু রাগ করত। সেতু নেই, আরাম করে চা-টা খাওয়া যায়।

নাদুর মা বলল, ভাইজানের শরীর কি ঠিক আছে?

হুঁ।

দশটা পর্যন্ত ঘুম, এই জন্যে চিন্তাযুক্ত ছিলাম। ভাইজান, অনেক দিন ধইরা ভাবতেছি আপনারে একটা কথা বলব। সাহসে কুলায় না। কথাটা বলি? আপামণির বিষয়ে একটা কথা। আপনেরে বলা প্রয়োজন।

হেদায়েত হাই তুলতে তুলতে বলল, আরেকদিন বল। আজ শরীরটা খারাপ। নাশতা খেয়ে শুয়ে পড়ব। কলেজেও যাব না। গত রাতে একটা ঘুমের অষুধ খেয়েছিলাম। মনে হয় তার অ্যাফেক্ট। পুরোটা খাওয়া ঠিক হয় নি। এখন থেকে অর্ধেকটা করে খাব।

হেদায়েত নাশতা খেয়ে শুয়ে পড়ল। সারাদিন ঘুমাল। দুপুরে নাদুর মা কয়েকবার ডাকতে এলেও ঘুম ভাঙতে পারল না। তার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে আগে। টেলিফোনের রিংয়ের শব্দ। হেদায়েত টেলিফোন তুলে তার স্বভাবমতো বলল, কে সেতু?

স্যার আমি নীতু। রোল টেন।

 

ও আচ্ছা তুমি।

আজ ক্লাস নেননি কেন স্যার? মাহজাবিন খুব মন খারাপ করেছে।

কেন?

আপনার ক্লাস তার খুব পছন্দ। মনে হয় এই কারণে কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে।

অন্য কী? সেটা স্যার আপনাকে বলতে পারব না। সেতু ম্যাডাম এখনো ফিরেন নি?

না।

উনার সঙ্গে কি আপনার ঝগড়া হয়েছে?

না তো! আমাদের ঝগড়া হয় না। স্যার আপনাকে যে আমার টেলিফোন নাম্বার দিয়েছিলাম সেটা কি আপনার মনে আছে।

হ্যাঁ মনে আছে। ৯৬৫৪৩২১ হয়েছে?

জ্বি স্যার হয়েছে। এখন বাসায় কি আপনি একা?

একা না, নাদুর মা আছে।

আপনাদের কাজের বুয়া?

হুঁ।

নিশ্চয়ই ময়মনসিংহ বাড়ি। সব কাজের বুয়াদের বাড়ি ময়মনসিংহ হয়।

ঠিকই ধরেছ?

ওদের ফেভারিট খাবার কী জানেন স্যার?

না। কখনও জিজ্ঞেস করি নি।

পাটশাক। এরা আবার পাটশাকের শুটকিও খায়। পাটশাক রোদে শুকিয়ে গুঁড়া করে বৈয়মে ভরে রাখে। সেটা দিয়ে ভর্তার মতো বানায়। কখনো খেয়েছেন?

নাদুর মা’কে বলবেন, বানিয়ে দেবে। খেতে কিন্তু অখাদ্য। স্যার আপনাকে আরেকটা টেলিফোন নাম্বার বলি? একবার বললেই তো আপনার মনে থাকবে। মাহজাবিনের মোবাইল নাম্বার।

তার মোবাইল নাম্বার মনে রেখে কী হবে?

কিছু হবে না। তারপরও মনে থাকল। স্যার বলব?

বল।

 

নীতু মোবাইল নাম্বার বলল।

হেদায়েত বলল, নাম্বারটা খুবই ইন্টারেস্টিং। প্রতিটি সংখ্যা প্রাইম।

স্যার টেলিফোন রাখি। মায়ের সাল্ডেলের আওয়াজ পাচ্ছি। আমার হাতে টেলিফোন দেখলেই মা ভাববে আমি প্রেম করছি। আপনাকে তো বলেছি, আমার মা খুব সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মহিলা।

স্যার খোদা হাফেজ।

খোদা হাফেজ।

হেদায়েত বাথরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ ধরে চোখে-মুখে পানি দিল। মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা করছে। মনে হয় বেশি সময় ঘুমালে মাথার যন্ত্রণা হয়। দুটা প্যারাসিটামল আর এক কাপ গরম চা খেতে হবে।

নাদুর মা চা দিয়ে গেছে। চায়ের সঙ্গে একটা চিঠি। চিঠি পাঠিয়েছে বেলায়েত। চিঠিতে লেখা—

 

ছোটন

পীর সাহেবের তাৰিজ এবং পানি-পড়া যোগার করেছি। পানিটা ফ্ল্যাটের প্রতিটি ঘরে ছিটায়ে দিতে হবে। তাবিজটা বানতে হবে ডান হাতের কব্জিতে।

তুই রাতে আমার বাসায় চলে আয়। তখন তোর হাতে তাবিজ এবং পানি-পড়া দিয়ে দেব। কিশোরগঞ্জ থেকে বড় পাবদা মাছ এসেছে। তোর ভাবীকে ঝোল ঝোল করে বাঁধতে বলেছি। ঢেঁপি বুড়োর চালের ভাত আর পাবদা মাছ। সেতুকেও সঙ্গে নিয়ে আসিস। তাকে দু’একটা উপদেশ দেয়া প্রয়োজন। তোক একা ফেলে মায়ের বাড়িতে প্রায়ই যায়, এটা ঠিক না।

রাত ন’টার দিকে আমি বাসায় ফিরব। করাত কলে কি যেন নষ্ট হয়েছে। রাত আটটায় মিস্ত্রী ঠিক করতে আসবে। তখন সামনে থাকতে হবে। সব চোরের গুষ্ঠি।

আমার উপস্থিত থাকা দরকার।

বেলায়েত হোসেন

 

চিঠি শেষ করে হেদায়েত চিঠিতে মোট কতগুলি শব্দ আছে গুগল। মোট ৬৭টি শব্দ আছে, প্রাইম নাম্বার। এটা একটা ভালো বিষয়। নাদুর মা মুখ শুকনা করে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হেদায়েত বলল, কিছু বলবে?

নাদুর মা বলল, আপা তো এখনও আসে নাই।

কোনো একটা কাজে আটকা পড়েছে। চলে আসবে। আর শোন, রাতে আমি খাব না। ভাইজান পাবদা মাছ খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন।

নাদুর মা বলল, আপার মায়ের বাসার ডেরাইভার আপা সম্পর্কে অনেক আজেবাজে কথা আমাকে বলেছে। আপা নাকি প্রায়ই হোটেলে থাকে।

হেদায়েত বিরক্ত গলায় বলল, কেউ কোনো কথা বললে কথাটা লজিক দিয়ে বিচার করবে। লজিক মানে হচ্ছে যুক্তি। কারণ এই প্রকাণ্ড বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড চলছে লজিকে। তোমার আপার নিজের ফ্ল্যাট আছে। আছে না? ভাড়া হলেও তো আছে?

জ্বি আছে।

তার মায়ের বাড়ি আছে। আছে কি-না বল।

আছে।

সেতুর দুই মামা থাকেন ঢাকায়। সেতু ইচ্ছা করলে এদের বাসাও থাকতে পারে। হোটেলে থাকবে কেন?

নাদুর মা চুপ করে রইল। হেদায়েত বলল, যুক্তি বুঝতে পারছ?

নাদুর মা বিড়বিড় করে কি যেন বলল। হেদায়েত বলল, ঘড়ির দিকে একটু লক্ষ রাখ। ভাইজানের বাসায় রাত ন’টার সময় পৌঁছতে হবে। বাসা থেকে বের হব আটটা একুশ মিনিটে, ৮২১ একটা প্রাইম নাম্বার। বুঝেছ?

জ্বি ভাইজান বুঝেছি। টেলিফোনে আপার একটা খুঁজ নেন, কই আছে।

হেদায়েত বলল, অকারণে খোঁজাখুঁজির দরকার নেই। অকারণে খোজাখুঁজির মানে বিরক্ত করা। তাছাড়া সেতুর মায়ের বাড়ির টেলিফোনের নাম্বারে গণ্ডগোল আছে। একটা সংখ্যাও প্রাইম না। বুঝেছ?

নাদুর মা হ্যাঁ  সূচক মাথা নাড়ল। বুঝেছে।

 

বেলায়েত ভাইকে নিয়ে খেতে বসেছে। খাবার বেড়ে দিচ্ছে বেলায়েতের স্ত্রী হেনা। রূপবতী মহিলা কিন্তু গলব্লাডারে কি একটা অপারেশনের পর সে মোটা হতে শুরু করেছে। মুখমণ্ডল আগের মতোই ছোট। শরীর বিশাল। তাকে এলিয়েনের মতো দেখায়। বেলায়েত তার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, পাবদা মাছ পাতে তুলে দিয়ে তুমি দূরে চলে যাও। কাছে থাকবা না।

হেনা বলল, কেন?

বেলায়েত বলল, তোমার শরীর থেকে রসুনের গন্ধ বের হয়। হেদায়েতের ডিসৰ্টাব হয়।

হেনা বলল, আমি তো রান্না ঘরেই যাই না। শরীরে রসুনের গন্ধ কেন আসবে?

তর্ক বন্ধ। মাছ বেড়ে দিয়ে শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাক।

মাছ বাড়তে গিয়েও সমস্যা হলো। হেনা তার স্বামীর পাতে সবচেয়ে বড় মাছটা তুলে দিল। বেলায়েত বলল, তুমি কাজটা কী করলা? পতিপ্রেম দেখাইলা। ভাইকে দাওয়াত দিয়ে এনেছি বড় মাছটা তার পাতে দিবে। তাকে দেখায়ে দেখায়ে আমি বড় মাছটা খাব!

হেনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, সব মাছ একই সাইজ।

বেলায়েত বলল, সবই একই সাইজ! খোকন তুই বল, সবই একই সাইজ -কি আমার পাতেরটা বড়?

হেদায়েত বলল, তোমার পাতেরটা বড়।

বেলায়েত বলল, মুখের কথায় বিশ্বাস কি! স্কেল দিয়ে মাপা হবে। হেনা যাও স্কেল আন। টেবিলে স্কেল আছে।

স্কেলে প্রায় ছয়টা মাছই আলাদা আলাদা মাপা হলো। সবচেয়ে বড়টা ৮.৩ ইঞ্চি। তারপরেরটা ৮ ইঞ্চি বাকি চারটা ৭,৮, ৭.২, ৬.৫ এবং ৬ ইঞ্চি।

খেতে খেতে হেদায়েত অনেকগুলি হিসাব করেছে। মাছগুলির লম্বার গড় কত। স্ট্যান্ডার্ড ভেরিয়েশন কত। তার মনে হলো শুধু লম্বা না মেপে ওজন মাপা প্রয়োজন ছিল। Body mass index বের করা। মানুষের বডি মাস ইডেক্স ডাক্তাররা অংক করে বের করেন।

BMI = kg/M^2

Kg ইচ্ছে মুনষের শরীরের কিলোগ্রামে ওজন। আর M হলো মিটারে উচ্চতা।

বেলায়েত বলল, খেতে কেমন হয়েছে রে?

হেদায়েত বলল, খুব ভালো। তুমি পরে যদি কখনও পাবদা মাছ কিন তাহলে আমি BMI বের করব।

BMI টা কী?

হেদায়েত দীর্ঘ সময় নিয়ে BMI ব্যাখ্যা করল। ক্লাসে বক্তৃতা দেয়ার মতো করে ভাইকে বুঝানো। বেলায়েত মুগ্ধ। ছোট ভাইটার সঙ্গে খেতে বসার এই আনন্দ। খেতে খেতে কত কিছু শেখা যায়।

বেলায়েত বলল, আমার BMI কত হবে?

হেদায়েত বলল, যা Standard সেটা হবে। ১৮ থেকে ২০ এর মধ্যে।

তোর ভাবীর?

উনার চল্লিশের উপর হবে।

বেলায়েত বলল, পরের বার যখন পাবদা মাছের BMI মাপবি তখন তোর ভাবীরটা মেপে দিস। তোর ভাবীর BMI জানা থাকা দরকার।

হেদায়েত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

গুলশানে রবিন খানের একটা তিনতলা গেস্ট হাউস

গুলশানে রবিন খানের একটা তিনতলা গেস্ট হাউস আছে, নাম ওয়েসিস। লেকের দিকে মুখ করা নিরিবিলি বাড়ি। বেশির ভাগ সময় বিদেশী গেস্টরা থাকেন। দেশের কিছু নামী-দামী মানুষকেও বান্ধবীদের নিয়ে এখানে আসতে দেখা যায়। ছোটর মধ্যে চমৎকার ব্যবস্থা। ছাদে সুইমিং পুলও আছে। গেস্ট হাউসে বিদেশী অতিথি যখন বেশি হয় তখন সুইমিং পুলে পানি দেয়া হয়। ওয়েসিসের লিকার লাইসেন্স আছে। বেশির ভাগ গেস্ট হাউসের এই সুবিধা নেই।

রবিন খান মাঝে মাঝে নিজের গেস্ট হাউসে রাত্রি যাপন করেন। তিন তলায় একটা ডিলাক্স রুম তার জন্যে সব সময় আলাদা করা। ডিলাক্স কমের সুবিধা হলো বেড রুমের সঙ্গে লাগোয়া একটা বসার ঘর আছে। বসার ঘরের বড় কাচের জানালা থেকে লেকের পানি দেখা যায়। রবিন খান সোফায় শুয়ে ডিভিডিতে ছবি দেখতে পছন্দ করেন। এই ঘরে ডিভিডি লাইব্রেরি আছে। দেয়ালে ঝুলানো ৪৮ ইঞ্চির একটা ফ্ল্যাট টিভি আছে। টিভিতে ঝকঝকে ছবি আসে।

রাত দশটা, রবিন খানের হাতে গ্লাস। গ্লাসে ব্লাক লেভেল অন দ্যা রক। তিনি গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন, সেতু এক চুমুক হুইস্কি খাবে?

শোবার ঘর থেকে সেতু বলল, আমি মদ খাই না।

রবিন বললেন, এসো ছবি দেখি।

সেতু বলল, বাংলা কিছু আছে? ইংরেজি ছবি দেখতে ইচ্ছা করছে না।

তোমার ইংরেজি দেখতে ইচ্ছা করছে না। আর আমার বাংলা দেখতে ইচ্ছা করছে না। দু’জনের মতামতই সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে। এখন বল কী করা যায়?

সেতু বলল, আমার মাথায় কিছু আসছে না।

অন্য কোনো ভাষার ছবি দেই? ইংরেজি সাব টাইটেল থাকল। Is it ok?

Ok.

চায়নিজ কিছু ডিরেক্টর আছেন অসাধারণ ছবি বানান। চায়নিজ ছবি দেখবে?

সেতু শোবার ঘর থেকে বসার ঘরে এসে বসতে বসতে বলল, বাসায় চলে যাব। চব্বিশ ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে হোটেলে আছি। এখন দমবন্ধ লাগছে।

লং ড্রাইভে যাবে? চল আশুলিয়া চলে যাই। সাভারের বাগানবাড়িতে যেতে পারতাম কিন্তু জেনারেটরটা নষ্ট। এসি চলবে না। গরমে কষ্ট পাবে।

সেতু বলল, বাসায় যাব।

রবিন বললেন, হেদায়েত সাহেবের জন্যে অস্থির লাগছে?

সেতু বলল, অস্থির লাগছে। তবে কার জন্যে লাগছে বুঝতে পারছি না। তুমি আমাকে নামিয়ে দেবে, নাকি তোমার ড্রাইভার নামিয়ে দিবে?

আমিই নামিয়ে দিব। তোমার স্বামী যদি জেগে থাকেন তাহলে উনার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করব। সমস্যা আছে?

সমস্যা নেই।

আমি এত রাতে তোমাকে নামিয়ে দিচ্ছি এতেও সমস্যা নেই?

না। সে তোমার আমার মতো সাধারণ মানুষ না।

অসাধারণ মানুষ?

হ্যাঁ অসাধারণ।

কোন অর্থে অসাধারণ? নির্বোধ অর্থে?

সেতু বলল, আমি খারাপ মেয়ে। প্রায়ই তোমার সঙ্গে রাত কাটাচ্ছি। তাই বলে তুমি নির্বোধ বলে আমার স্বামীকে অপমান করতে পার না।

রবিন বললেন, যে স্বামী স্ত্রীর এইসব কর্মকাণ্ড ধরতে পারবে না তাকে সোসাইটি নির্বোধ বলবে না? একি তুমি কেঁদে ফেলছ কেন? সরি! আমি তোমার সঙ্গে কথা চালাচালি খেলা করছিলাম এর বেশি কিছু না। বিলিভ মি। চল তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি তোমার স্বামীর সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করতে চাই।

সে জেগে থাকলে তার সঙ্গে গল্প করবে। আমার ধারণা সে জেগে নেই। রাত ন’টার মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

আজ হয়তো তিনি জেগে আছেন। তুমি ফিরবেন তার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

সেতু বলল, সে কারো জন্যে অপেক্ষা করে না।

রবিন বলল, তুমি এমনভাবে কথাটা বললে যেন এটা বিরাট বড় কোনো গুণ। এটা কোনো গুণ না। আমরা মানুষ। খুবই সামাজিক প্রাণী। আমরা একে অন্যের জন্যে অপেক্ষা করব। এটাই স্বাভাবিক।

সেতু বলল, তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, সে স্বাভাবিক মানুষ না।

 

হেদায়েত জেগে ছিল। তার হাতে ডরমিকাম টেবলেট। টেবলেট দু’ভাগ করা হয়েছে। ভাগ সমান হয় নি। একদিকে একটু বেশি হয়েছে, অন্যটা কম হয়েছে। সে বেশিটা খাবে, না কমটা খাবে— এটা বুঝতে পারছে না। সেতুর সঙ্গে পরামর্শ করলে হতো। সেতুকে টেলিফোন করতে ইচ্ছা করছে। না। নাদুর মার সঙ্গে পরামর্শ করা যেতে পারে। অষুধপত্রের ব্যাপারটা মেয়েরা ভালো বুঝে।

হেদায়েত নাদুর মা’কে ডাকতে যাবে তখন দরজা ঠেলে সেতু ঢুকল। বিরক্ত মুখে বলল, এত রাত হয়েছে, সদর দরজা খোলা কেন?

হেদায়েত বলল, তুমি আসবে এই ভেবেই হয়ত নাদুর মা খোলা রেখেছে।

সেতু বলল, রনি ভাই আমার সঙ্গে এসেছেন। তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করবেন। চা খাবেন। বসার ঘরে চল। শার্ট গায়ে দিয়ে আস। একজন গেস্টের সাথে কথা বলবে খালি গায়ে! তুমি কথা বল। আমি গোসল করে ড্রেস চেঞ্জ করে তোমাদের সঙ্গে জয়েন করব।

হেদায়েত রবিন ভাইকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। অতি রূপবান একজন মানুষ। বয়স পঞ্চাশের উপর। মাথা ভর্তি সাদা-কালো চুল। বড় বড় চোখ। হাসি হাসি মুখ। রবিন হেদায়েতকে দেখে প্রথমেই বললেন, ভাই আপনার ফ্ল্যাট কি স্মোক ফ্রি জোনে? আজকাল বেশির ভাগ বাড়িই স্মোক ফ্রি। সিগারেট খেতে হলে ছাদে উঠতে হয়।

হেদায়েত বলল, আপনি সিগারেট খান। শুধু আমাদের শোবার ঘরে সিগারেট খাওয়া নিষেধ।

রবীন বললেন, আমি ভাগ্যবান যে আমাকে শোবার ঘরে বসানো হয় নি।

নাদুর মা চা নিয়ে এসেছে। তার চা বানাতে এক মিনিটেরও কম সময় লাগে। চুলায় ফুটন্ত পানির কেটলি থাকে। কেউ চা চাইলে কাপে পানি ঢেলে টি ব্যাগ দিয়ে নিয়ে আসা।

রবিন বললেন, সেতুর কাছে আপনার অনেক গল্প শুনেছি। ইদানীং নাকি রাতে ভূত দেখছেন। মেয়ে ভূত।

হেদায়েত বলল, ভূত ঠিক না। একটা হাত দেখি। দেখিও ঠিক না। আমার কাছে মনে হয় একটা হাতের উপর আমার হাত পড়েছে। মেয়েদের হাতের মতো নরম হাত।

রবিন বললেন, নেট টাইম হাতে একটা ভোলা সেফটিপিন নিয়ে ঘুমাবেন। যেই হাতের উপর হাত পড়বে ওমি সেফটিপিনের সূচ ভাবিয়ে দেবেন।

হেদায়েত বলল, কাজটা ঠিক হবে না।

ঠিক হবে না কেন?

হাতটা তো আমার কোন ক্ষতি করছে না। আমি শুধু শুধু কেন তাকে ব্যাথা দেব?

রবিন বললেন, আমি ঠাট্টা করছিলাম। আপনার যা দরকার তা হলো একজন ভালো নিউরোলজিস্টের সঙ্গে কথা বলা। আমার ধারণা আপনার সমস্যাটা নিউরোলজিক্যাল। নিউরোলজির এক্সপার্ট আমার একজন ভালো বন্ধু আছেন। তাকে দেখাবেন? অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে দেব।

হেদায়েত বলল, সমস্যাটা যদি আরো বাড়ে তা হলে আপনাকে বলব।

রবিন বললেন, এই জাতীয় সমস্যা বাড়তেই থাকে কখনও কমে না। কাজেই শুরুতেই টেক কেয়ার করা উচিত। ভাই আমি উঠি।

সেতু তো এখনও বাথরুম থেকে বের হয় নি।

রবিন বললেন, আমি তো সেতুর সঙ্গে কথা বলতে আসি নি। তার সঙ্গে তো প্রায়ই কথা হয়। আমি কথা বলতে এসেছিলাম আপনার সঙ্গে। কথা শেষ হয়েছে, কাজেই বিদায়। নিউরোলজিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আপনাকে খবর দেব। চায়ের কাপে অনেকখানি চা ছিল। রবিন এক চুমুকে চা শেষ করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

 

সেতুর গোসল করতে অনেক সময় লাগে। বাথটাবে অনেকক্ষণ পা ডুবিয়ে বসে না থেকে সে গোসল করতে পারে না। গা ডুবিয়ে বসে থাকার সময় তার গান শুনতে হয়। বাথরুমে গান শোনার ব্যাবস্থা আছে। সেতু কিছু পছন্দের গান এই সময় শুনে। পছন্দ ঘন ঘন বদলায়। এখন স্নান সঙ্গীত হিসেবে তার পছন্দ হলো— নদীর নাম ময়ূরাক্ষী কাক কালো তার জল। গানের একটা লাইনে আছে— ‘কোনো ডুবুরী সেই নদীটির পায় নি খুঁজে তল। এই লাইন আসা মাত্র সে বাথটাবের পানিতে মাথাটা পুরোপুরি ডুবিয়ে দেয়। ভাবটা এরকম যেন সে ময়ূরাক্ষী নদীর তল খোঁজার চেষ্টা করছে।

গায়ে টাওয়েল জড়িয়ে সেতু বাথরুম থেকে বের হলো। হেদায়েত বলল, তোমাকে খুব পবিত্র লাগছে।

সেতু বলল, পবিত্র লাগছে মানে কী?

হেদায়েত বলল, মানে গুছিয়ে বলতে পারব না। তবে তোমাকে দেখে নিজের মধ্যে পবিত্র ভাব হচ্ছে। তুমি গায়ে ধবধবে সাদা একটা টাওয়েল

জড়িয়ে আছ, এই জন্যেও হতে পারে। সাদা পবিত্রতার রঙ।

সেতু বলল, অপবিত্রের রঙ কোনটা? আমি যদি গায়ে কালো রঙের টাওয়েল জড়াই তা হলে কি আমাকে অপবিত্র দেখাবে?

জানি না।

সেতু বলল, কালো রঙের টাওয়াল গায়ে জড়াচ্ছি। ভালো করে দেখে বল অপবিত্র লাগছে কি-না।

সেতু কালো টাওয়েল গায়ে জড়ল। হেদায়েত বলল, এখনও পবিত্র লাগছে।

তাহলে তো ভালোই। আমাকে চা দিতে বল। চা খেয়ে পবিত্র অবস্থায় ঘুমুতে যাব। অষুধ খেয়েছ?

অর্ধেকটা খেয়েছি। কম অর্ধেকটা।

এতেই হবে। কিছুক্ষণ গল্প করে ঘুমাতে যাবো। অনেকদিন তোমার সঙ্গে গল্প করা হয় না। সুন্দর একটা গল্প রেডি কর।

ম্যাথমেটিসিয়ান এবেলিয়নের গল্প শুনবে?

ইন্টারেস্টিং তো?

ইন্টারেস্টিং না, দুঃখজনক। এমন প্রতিভাবান একজন অংকবিদ ডুয়েট লড়তে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেলেন।

দুঃখের গল্প শুনব না। তোমার অংকবিদদের মধ্যে আনন্দের বা মজার কোনো গল্প নেই।

Euler এর গল্প আছে। উনি অংক দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে আল্লাহ আছেন।

ঠিক আছে, Euler সাহেবের গল্পই শুনব।

হেদায়েতের ভালো লাগছে যে তার স্ত্রীর গা থেকে পচা সেন্টের গন্ধটা আসছে না। শোবার সময় সেতু নিশ্চয়ই গায়ে সেন্ট মেখে ঘুমাবে না।

সেতু চা খেয়ে ঘুমুতে এসে দেখে হেদায়েত আরাম করে ঘুমাচ্ছে।

সারারাতই হেদায়েত আরাম করে ঘুমালো। একবার শুধু মনে হলো তার হাত একটা মেয়ের কোমল হাতের উপর পরেছে। এটা কি সেতুরই হাত না-কি অন্য কারোর? তখন হেদায়েত স্বপ্নে ম্যাথমেটিশিয়ান ইউলারকে দেখল। তিনি অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলছেন— এটা কার হাত তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কেন করছেন? যে কোনো সমস্যার সমাধান অংক দিয়ে করা যায়।

হেদায়েত বলল, স্যার আমাকে তুমি করে বলবেন। আপনার মতো মানুষ আমাকে আপনি করে বলছেন আমার খুবই লজ্জা লাগছে।

আমি সবাইকে আপনি বলি। সাত বছরের বালককেও আপনি বলি। বুঝেছ?

ইয়েস স্যার।

এখন আসুন অংক দিয়ে আপনার সম্যাসার সমাধান করি। হাতের আঙ্গুল থাকে পাঁচটা, কাজেই আমাদের ইকুয়েশনটার ফ্যাক্টর হবে পাচটা। ফিফথ অর্ডার ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন ভেরিয়েবলও পাঁচ। হেদায়েত হাতে কি কোনো আংটি আছে?

ইয়েস স্যার।

এই তো একটা ঝামেলায় ফেললেন। আংটি কি একটা না দুটা।

একটা।

পাথর বসানো আংটি?

জ্বি স্যার।

বিরাট জটিল অংকের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। কাগজ-কলম দিয়ে ট্রাই করে দেখি।

স্বপ্নের এই পর্যায়ে হেদায়েতের ঘুম ভাঙল। সে বাতি জ্বালালো। অবাক হয়ে দেখল সেতুর হাতে হাত রেখে সে ঘুমাচ্ছে। সেতুর হাতে হীরার আংটি ঝলমল করছে। এই আংটি সেতুর যেই মামা লন্ডন থাকেন তিনি দিয়েছেন।

 

রবিন সাহেবের ঠিক করা নিউরো সার্জনের কাছে হেদায়েত গিয়েছে। সে একা যায় নি, তার ভাইকে নিয়ে গেছে। বেলায়েত ভীতু মুখে বসে আছে এবং মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়ছে। ভাইয়ের জন্যে সে দুঃশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। নিউরো সার্জনের নাম ড, আখলাক। গম্ভীর ধরণের মানুষ, কিছুটা রাগী। এর মধ্যে একবার বেলায়েতকে বলেছেন, আমি রুগীকে যে সব প্রশ্ন করছি তার উত্তর রুগী দেবে। আপনি উত্তর দিচ্ছেন কেন? আপনাদের বংশে কোনো পাগল আছে?

হেদায়েত উত্তর দেবার আগেই বেলায়েত বলল, চৌদ্দ গুষ্টিতে কেউ নেই স্যার। আমার পরদাদার পাগলামী স্বভাব ছিল, তবে উনি পাগল ছিলেন না। উনি ঠিক করেছিলেন পায়ে হেঁটে মক্কাশরীফে যাবেন। উড়িষ্যা পর্যন্ত যাবার পর তাকে একটা বাঘে খেয়ে ফেলেছিল। চিতা বাঘ। গাছের উপর ঘাপটি মেরে বসেছিল, ঝাপ দিয়ে পড়েছে।

ড. আখলাক, বেলায়েতের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি আর একটি শব্দও করবেন না।

হুঁ, হ্যাঁও না।

বেলায়েত ঝিম মেরে গেল। ড. আখলাক হেদায়েতকে বললেন, আপনার গন্ধ বিষয়ক কোনো সমস্যা আছে?

হেদায়েত বলল, জ্বি না।

বেলায়েত বলল, সে না বলছে কিন্তু স্যার তার গন্ধ বিষয়ে সমস্যা আছে। আমার স্ত্রীর গায়ে কোনো গন্ধ নাই। হেদায়েত তার গা থেকে রসুনের গন্ধ পায়।

ড, আখলাক বললেন, নিউরো সমস্যায় গন্ধ একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রুগী হঠাৎ নাকে পোড়া গন্ধ পায়। ঝাঝানো গন্ধ পায়। আবার উল্টোটাও হয়– রুগী হঠাৎ হঠাৎ কিছু কিছু সময়ের জন্যে গন্ধহীন হয়ে যায়। আমি কিছু টেস্ট দিচ্ছি। টেস্টগুলি করবেন, CT scan করতে হবে। দশদিন পর আসবেন। একা আসবেন। ভাইকে আনবেন না।

বেলায়েত বলল, স্যার আমার ভাইকে ঠিক করে দিন। টাকা-পয়সা কোনো ব্যাপার না। প্রয়োজনে তাকে ব্যাংকক-সিঙ্গাপুর যেখানে বলেন সেখানে নিয়ে যাব। আপনাদের দোয়ায় আমার টাকা-পয়সা আছে। ক্যাশ টাকা অবশ্যি কম। বেশির ভাগ টাকাই ব্যাবসায় খাটাচ্ছি। তারপরেও চব্বিশ ঘণ্টার নোটিশে দশ-পাঁচ লাখ বের করতে পারব ইনশাল্লাহ।

ড. আখলাক কঠিন গলায় বললেন, সাতদিন পর আসবেন। এবং আবারও বলছি— রুগী একা আসবে। রুগীর সঙ্গে কেউ আসবে না।

চেম্বার থেকে বের হয়ে বেলায়েত বিরস গলায় বলল, ডাক্তার সুবিধার না। বদ ডাক্তার। যে রুগীকে কথা বলতে দেয় না, সে কেমন ডাক্তার। তুই কি বলিস?

হেদায়েত বলল, ভাইজান আমাদের বংশে কোনো পাগল নাই, কথাটা তো ঠিক না। দাদাজান পাগল ছিলেন। শেষের দিকে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো।

বেলায়েত বলল, আগ বাড়িয়ে মানুষকে এইসব কথা বলার কোনো দরকার আছে? সব জিনিসই প্রকাশ করতে নাই। তোর ভাবীর কিছু সমস্যা আছে, সেটা কি কখনও তোকে বলছি?

না।

বেলায়েত বলল, যাই হোক, তুই যে সমস্যায় পড়েছিস সেটা ডাক্তারের আন্ডারে পড়ে না। পীর-ফকিরের আন্ডারে পড়ে। আমি লোক লাগিয়ে দিয়েছি তারা পাওয়ারফুল পীর-ফকির খুঁজতে শুরু করেছে।

আচ্ছা।

ইসমে আজম জানা কাউকে পাওয়া গেলে তার এক ফুতে সব ঠিক হয়ে যাবে।

হেদায়েত বলল, ইসমে আজমটা কী?

হাই লেভেলের কেরামতি, মারফতি জিনিস। তুই বুঝবি না। তোর বুঝার দরকার কী? তোর সমস্যার সমাধান হলেই তো হলো। না-কি?

হুঁ।

বেলায়েত বলল, একটা সিএনজি নিয়ে চলে যা। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আরাম করে একটা ঘুম দে।

হেদায়েত বলল, বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না।

তাহলে কী করবি?

তোমার সঙ্গে থাকব।

বেলায়েত বলল, আমার সঙ্গে থাকবি মানে কী? আমাকে তোর ভাবীর মায়ের বাসায় যেতে হবে। কার না-কি জন্মদিন। বিয়ে করে এমন যন্ত্রণায় পড়েছি শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের জন্মদিনের যন্ত্রণায় জীবন অস্থির।

হেদায়েত বলল, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাও।

তোর দাওয়াত নাই, তোকে আমি কীভাবে নিয়ে যাব।

হেদায়েত বলল, ভাবীর মায়ের বাসায় যেতে দাওয়াত লাগবে কেন?

বেলায়েত বলল, লজিকের কথা বলেছিস। তাহলে চল। পথে সস্তা টাইপের খেলনা-ফেলনা কিনতে হবে।

জন্মদিনটা কার?

জানি না কার। কোনো পুলাপানের হবে। তোর ভাবী সকাল থেকে ঐ বাড়িতে বসে আছে।

দুই ভাই একশ’ ত্রিশ টাকা দিয়ে হলুদ রঙের একটা গাড়ি কিনে জন্মদিনের উৎসবে উপস্থিত হলো। জন্মদিন হচ্ছে হেনার বড় ভাইয়ের। সে গ্রামীণফোনের একজন বড় অফিসার। জন্মদিনে হলুদ গাড়ি পেয়ে বেচারা খুবই হকচকিয়ে গেল।

হাজি এনায়েত করিম চোখ বন্ধ করে

হাজি এনায়েত করিম চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তাঁর ডান হাতে তসবি। তিনি তসবি টানছেন। যে-কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি অজিফা পাঠ করেন। আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন। হেদায়েতকে কলেজের চাকরি থেকে বাদ দেয়া হবে। কলেজের পরিচালনা পরিষদও এই মত পোষণ করে। কমিটি মেম্বার দশজনের মধ্যে ছয়জন এ বাদ দেয়ার পক্ষে। বাকি চারজনের ধারণা আরেকবার সুযোগ দেয়া উচিত। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হচ্ছে— প্রিন্সিপ্যাল সাহেব ঠিক করবেন কী করা উচিত। অংকের একজন ভালো শিক্ষক কলেজের জন্যে দরকার এটা যেমন ঠিক, আবার শিক্ষকের মেন্টালিটিও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এটা মেয়েদের কলেজ।

হেদায়েত বসে আছে প্রিন্সিপ্যালের ঠিক সামনের চেয়ারটায়। আধঘণ্টার উপর সে বসা। কী জন্যে তাকে ডাকা হয়েছে এখনো তা সে জানে না। তবে তার সময় খারাপ কাটছে না। সে তাকিয়ে আছে প্রিন্সিপ্যাল সাহেবের ঠিক মাথার উপর রাখা ঘড়িটার দিকে। তার চিন্তা ঘড়ির কাঁটা ডান দিকে ঘুরবে এই ধারণা প্রথম কার মাথায় এল? ঘড়ির কাটা বাদিকে ঘুরলে কি সমস্যা ছিল? প্রথম যিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ঘড়ির কাঁটা ডান দিকে ঘুরবে, তিনি সিদ্ধান্তটা কোন বিবেচনায় নিয়েছেন?

হেদায়েত সাহেব।

জ্বি স্যার।

অনেকক্ষণ আপনাকে বসিয়ে রাখলাম, কিছু মনে করবেন না। অজিফা পাঠ করছিলাম। মন অশান্ত হলে অজিফা পাঠ করে মন শান্ত করার চেষ্টা করি।

হেদায়েত একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে অজিফা ব্যাপারটা কী? শেষ। পর্যন্ত জিজ্ঞেস করল না। কারণ প্রিন্সিপ্যাল সাহেব এখনও চোখ বন্ধ করে আছেন। কাউকে কোনো প্রশ্ন করলে চোখের দিকে তাকিয়ে করতে হয়।

প্রিন্সিপ্যাল সাহেব, তজবি পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। হেদায়েতের দিকে চোখ মেলে তাকালেন।

হেদায়েত সাহেব।

জ্বি স্যার।

একটি অপ্রিয় কাজ করার দায়িত্ব আমার উপর পড়েছে। আপনাকে একটা সংবাদ দেব।

স্যার দিন।

কলেজ কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আপনাকে এই কলেজে রাখা হবে না। আপনার মতো শিক্ষক পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তারপরেও বাধ্য হয়ে এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।

হেদায়েত বলল, আমি কি কোনো সমস্যা করেছি?

অবশ্যই করেছেন। আপনার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে আমার রুচিতে বাঁধছে, তারপরেও বলছি। আপনি গভীর রাতে ক্লাশের ছাত্রীদের টেলিফোন করেন। তাদের অশ্লীল পর্নোগ্রাফিক কথা বলেন।

হেদায়েত অবাক হয়ে বলল, স্যার না তো!

প্রিন্সিপ্যাল বললেন, আপনি না বললে তো হবে না। নীতু নামের এক ছাত্রী কমপ্লেইন করেছে। আমার কাছেই করেছে। সে অবশ্যি written কিছু দেয় নাই। written দেয়ার প্রয়োজন নাই। চা খাবেন?

জ্বি না স্যার। আমি কি এখন বাসায় চলে যাব, আর আসব না?

এক তারিখে আসবেন। পুরো মাসের বেতন নিয়ে যাবেন। একটু অপেক্ষা করুন। খোঁজ নিয়ে দেখি। ক্যাশে টাকা থাকলে পুরো মাসের বেতন আজই নিয়ে যান। টাকার জন্য আবার আসার ঝামেলা কেন করবেন?

বেতন নিয়ে দুপুর দু’টায় হেদায়েত বাড়ি ফিরল। সেতু খেতে বসেছিল। হেদায়েতকে দেখে উঠে পড়ল। আনন্দিত গলায় বলল, চটকরে হাতে-মুখে পানি দিয়ে আস, একসঙ্গে খাই। আজ একটা নতুন ধরণের রান্না করেছি। কচুর লতির সঙ্গে মাংসের কিমা। কোনো রান্নার বই থেকে শিখে যে বেঁধেছি তা-না। নিজে নিজেই রাঁধলাম। কচুর লতির সঙ্গে যায় শুধু চিংড়ি মাছ। আমি এই তথ্য বিশ্বাস করি না। খেয়ে দেখ তো কেমন হয়েছে।

হেদায়েত বলল, খুব ভালো হয়েছে।

তুমি তো এখনও খেতে বোস নি। কীভাবে বুঝলে ভালো হয়েছে। হাত-মুখ ধুয়ে আস।

হেদায়েত নিঃশব্দে খেতে বসল। সেতু আগ্রহের সঙ্গে বলল, খেতে কেমন হয়েছে?

হেদায়েত বলল, ভালো।

সেতু বলল, শুধু ভালো? এর বেশি কিছু না?

বেশ ভালো।

এক থেকে দশের মধ্যে কত দেবে?

ছয়।

ছয়! মাত্র ছয়?

হেদায়েত বলল, ছয়কে তুচ্ছ করবে না। ছয় হলো একটি Perfect সংখ্যা। পিথাগোরাসের অত্যন্ত পছন্দের সংখ্যা। ছয়কে ভাগ করা যায় ৩, ২ এবং ১ দিয়ে। ৩+২+১ হয় ছয়। এটাই হলো পারফেক্ট সংখ্যার ধর্ম। আরেকটা পারফেক্ট সংখ্যা হলো ১২, বারোকে ৬, ৩, ২ এবং ১ দিয়ে ভাগ করা যায়। ৬+৩+২+১ কত হয়? বারো।

সেতু বলল, প্লীজ চুপ কর। তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করাই ভুল হয়েছে। ভালো কথা, আমরা কয়েক বন্ধু কক্সবাজার বেড়াতে যাচ্ছি। তুমি যাবে?

নাহ!

জানতাম তুমি যাবে না। কাজেই তোমাকে বাদ দিয়েই প্রোগ্রাম করেছি।

হেদায়েত বলল, রবিন সাহেব কি যাচ্ছেন?

সেতু বলল, হঠাৎ রবিন সাহেবের কথা উঠল কেন? উনি গেলে তোমার কোনো সমস্যা আছে। উনি তোমার মতো গর্ত-মানব না যে গর্ত খুঁড়ে গর্তে বসে থাকেন। উনি ঘুরতে পছন্দ করেন। উনার বারো সিটের একটা মাইক্রোবাস আছে। সেটা নিয়ে আমরা যাচ্ছি।

ভালো তো।

রবিন ভাইকে নিয়ে তোমার কি কোনো কনফিউশন আছে। কনফিউশন থাকলে ঝেড়ে কাশ।

কোনো কনফিউশন নেই।

তোমাকে বলতে ভুলে গেছি উনি একটা ছবি প্রডিউস করতে চাচ্ছেন। ফুল লেংথ ছবি। ইন্টিলেকচুয়াল শুকনা গরুর খড় টাইপ ছবি না। কমার্শিয়েল ছবি। নাচ থাকবে, গান থাকবে, মারপিট থাকবে। হিরো থাকবে, ভিলেন থাকবে, কমেডিয়ান থাকবে। রবিন ভাই চাচ্ছেন আমি যেন সেই ছবিতে অভিনয় করি। তোমার কি আপত্তি আছে?

না।

দিনের পর দিন আউটডোরে থাকতে হবে, এটা মাথায় রেখে তারপর বল। তোমার অসুবিধা হবে না?

উঁহু।

হেদায়েত খাওয়া শেষ করে বলল, আমি একটু ভাইজানের কাছে যাব।

সেতু বলল, যাও। এমন ভাবে বললে যেন আমার পার্মিশন চাচ্ছ। তোমার সেখানে যেতে ইচ্ছা করলে যাবে। রাতে কী খাবে বল, আমি নিজেই রান্না কব। ইটালিয়ান খাবার করব? খাবে।

হুঁ।

তোমার কি ফিরতে দেরী হবে?

বুঝতে পারছি না। ভাইজান আমাকে এক পীর সাহেবের কাছে নিয়ে যাবেন। উনি তাবিজ দিবেন।

তুমি ম্যাথের টিচার। টুয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরিতে গলায় তাবিজ বেঁধে ঘুরবে?

ভাইজান আগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। তাছাড়া আমি এখন ম্যাথের টিচার না। আমার চাকরি চলে গেছে।

সেতু বলল, তোমার চাকরি চলে গেছে মানে?

হেদায়েত বিড় বিড় করে বলল, প্রিন্সিপ্যাল সাহেব নিজেই ডেকে বলেছেন। পুরো মাসের বেতন দিয়ে দিয়েছেন।

চাকরি চলে গেল কেন?

একটা মেয়ে আমার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করেছে।

কী কমপ্লেইন করেছে?

আমি না-কি গভীর রাতে ওদের টেলিফোন করি, পর্নোগ্রাফিক কথা বলি।

সেতু বলল, মেয়েটা পাগল না অন্যকিছু? আমার তো ইচ্ছা করছে। মেয়েটাকে থাপড়াতে।

হেদায়েত বলল, বাদ দাও।

সেতু বলল, বাদ দেব কেন? আমার তো রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। একটা মেয়ে মিথ্যা করে একটা কথা বলল আর তাতেই তোমার চাকরি চলে গেল। এটা কি মগের মুল্লুক?

হেদায়েত বলল, আমি এখন যাই। রাতে কথা হবে।

 

বেলায়েতের পরিচিত পীর সাহেব ভক্তদের নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে এক বজরা টাইপ নৌকায় বাস করেন। তার যোগাযোগ নাকি পানির পীর খিজির আলায়হেস্ সালামের সঙ্গে। তাকে কোনো প্রশ্ন করলে তিনি নদীর পানি ছুঁয়ে জবাব দেন। পানি থেকে তিনি না-কি ইশারা পান।

বেলায়েত ভাইয়ের সমস্যা বিস্তারিত বলতে গেল। পানি-পীরের এক মুরিদান বেলায়েতকে থামিয়ে দিয়ে উদাস গলায় বলল, পানি-পীর কেবলাকে কিছু বলা লাগে না। তিনি সবই জানেন। খামখো সময় নষ্ট। আপনার ভাইকে পীর সাহেবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে বলেন।

হেদায়েত পানি-পীরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। পানি-পীর ডান হাত নদীর পানিতে ভিজিয়ে হেদায়েতের মাথায় রেখে চোখ বন্ধ করলেন। কিছু সময় পার করার পর চোখ মেলে বললেন, বাধা! রাতে কি ঘুম একেবারেই হয় না।

হেদায়েতের রাতের ঘুমের কোনো সমস্যা নেই। বিছানায় শোয়া মাত্রই ঘুম। তারপরেও বলল, জ্বি ঘুম হয় না।

বদ হজম হয়? কোনো কিছুই হজম হয় না। চুয়া ঠেহর।

হেদায়েতের হজমের কোনো সমস্যা নেই। তারপরেও সে ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বি।

প্রসাবেরও সমস্যা আছে? প্রসাবের রাস্তায় জ্বালাপোড়া আছে? মাঝে মাঝে রক্ত যায়?

হেদায়েত ক্ষীণ স্বরে বলল, জ্বি। তার কাছে মনে হচ্ছে নোংড়া কম্বল গায়ে বসে থাকা মানুষটা ভয়ংকর প্রকৃতির। তার প্রতিটি কথা মেনে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত।

বেলায়েত অসহায়ভাবে ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে। হেদায়েত এইসব কঠিন সমস্যা তার কাছে গোপন করেছে এই ব্যাপারটাও তাকে দুঃখ দিচ্ছে।

পানি-পীর বললেন, চিন্তার কিছু নাই। খিজির বাবার দোয়ায় সব সমস্যার আহসান হবে। আরেকবার আসতে হবে শনিবারে। শনি মঙ্গলবার ছাড়া খিজির বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।

বেলায়েত পানি-পীরকে কদমবুসি করে পাঁচশ টাকা দিল। পানি-পীর বললেন, আত্মা এতো ছোট কেন বাবা। আত্মা বড় কর। টাকা-পয়সার কোনো প্রয়োজন আমার নাই। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি খেয়ে একবার তিনমাস কাটিয়েছি। টাকা দিয়ে আমি কী করব? টাকার দরকার আমার মুরিদানদের বুঝেছ? Understand? দিলে নিম্নে এক হাজার, না দিলে এক কাপ পানি হাতে ঢাইলা দিবা, তাতেও চলবে। Understand?

বেলায়েত আরও একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে ভাইকে নিয়ে রওনা হলো। বেলায়েতের মনটা অত্যন্ত খারাপ। ভাইয়ের এত সমস্যা, সে কাউকে কিছু বলছে না।

হেদায়েত বলল, ভাইজান আমার চাকরি চলে গেছে।

বেলায়েত হতভম্ব গলায় বলল, বলিস কি! চাকরি কেন গেল?

হেদায়েত কিছু বলল না। বেলায়েত বলল, বৌকে কিছু জানানোর দরকার নাই। বেকার স্বামী কোনো স্ত্রী দেখতে পারে না। অকারণে ঝগড়াঝাটি করবে। কী দরকার? তুই কলেজ টাইমে বেলায়েত টিম্বারে চলে আসবি। বই-পুস্তক পড়বি। মাসের এক তারিখে বেতনের টাকা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবি।

আচ্ছা।

দি নিউ বিরানী হাউস এন্ড রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার তোকে বানায়ে দিতে পারি। টাকা-পয়সার হিসাব রাখবি, পারবি না?

পারব।

অংকে তোর যেরকম মাথা না পারার কোনো কারণ নেই। তবে ভাইয়ের রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার হওয়া ঠিক না।

হেদায়েত চুপ করে আছে। ভাইয়ের দুঃখে বেলায়েতের মন অদ্র। তার কেঁদে ফেলতে ইচ্ছা করছে। চোখে পানি চলে আসছে। ভাইয়ের সামনে চোখের পানি ফেলার প্রশ্নই উঠে না। বেলায়েত আলোচনা অন্য খাতে নেয়ার চেষ্টা করল। গলা খাকাড়ি দিয়ে বলল, হাওয়াই মিঠাই বানানোর একটা যন্ত্র। কিনেছি। তোকে দিয়ে দেব। মাঝে মধ্যে হাওয়াই মিঠাই বানাবি।

হেদায়েত বলল, আচ্ছা।

এখন শুধু দুই কালারে বানানো যায়। লাল আর সাদা। তুই চেষ্টা করে দেখ কয়েকটা কালারের করা যায় কি-না। একই ষ্টিকে পাঁচ কালার— সাদা, লাল, সবুজ, হলুদ, নীল।

হেদায়েত বলল, ফুড কালার লাগবে।

বেলায়েত বলল, ফুড কালার তুই ঘুরে ঘুরে জোগাড় করবি। তোর হাতে তো এখন কাজ-কর্ম নাই। তুই বেকার মানুষ।

তা ঠিক।

বেকার বলেছি বলে মনে কষ্ট পাস নাই তো?

না।

অন্য কোনো হোটেলে খান খাবি? চল দুই ভাই মিলে নতুন একটা রেস্টুরেন্টে খানা খাই। দি নিউ দিল্লী হাউস হোটেলের খানা অসাধারণ বলে শুনেছি। পরীক্ষা হয়ে যাক।

হেদায়েত বলল, সেতু আজ নিজের হাতে রান্না করবে। ইটালিয়ান খাবার। বাসায় না খেলে মন খারাপ করবে।

তাহলে বাসায় গিয়ে খা। ভোর এখন প্রধান কাজ স্ত্রীকে তুষ্ট রাখা।

হেদায়েত বলল, তুমি হোটেলে খাও, আমি সামনে বসে থাকব।

বেলায়েতের চোখে আবার পানি আসার উপক্রম হলো। এই না হলে ভাই? বড় ভাই খাবে, সে সামনে বসে থাকবে। রক্তের বন্ধন ছাড়া এই জিনিস কখনও হবে না।

হেদায়েত বাসায় ফিরে দেখে সেতু নেই। চিঠি লেখে চলে গেছে। চিঠিতে লেখা—

হ্যালো পতি!

বিরাট ঝামেলা হয়েছে। রবিন ভাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়েছেন। হাতের হাড়ি কনুইয়ের কাছে ভেঙেছে। কম্পাউন্ড ফ্রেকচার। এখন আছেন এ্যাপোলো হাসপাতালে। বেচারা খুবই ভয় পেয়েছে। আমি সান্ত্বনা দেবার। জন্যে যাচ্ছি। রাত দশটার মধ্যে চলে আসব। যদি না আসি, তাহলে বুঝবে আটকা পড়ে গেছি। রবিন ভাইয়ের নিকট আত্মীয় ঢাকায় কেউ নেই। বেচারা অল্পতেই অস্থির হয়ে পড়ে।

তুমি রাতে যা হয় কিছু খেয়ে নিও। নাদুর মাকে বলেছি কষানো মুরগী করতে। আলু চিকণ করে কেটে আলু ভাজি করতেও বলেছি। তোমার তো আলুভাজি পছন্দ। ইটালিয়ান খাবার করতে পারলাম না, সরি।

আরেকটা কথা চাকরি নিয়ে কোনো দুঃশ্চিন্তা করবে না। কোনো একটা ব্যবস্থা হবে।

ইতি

তোমার পত্নী

হেদায়েত ঘড়ি দেখল। সাড়ে দশটা বাজে। সেতু রাতে ফিরবে না। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বড় বিছানায় হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে ঘুমানো যাবে। শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়া যাবে। ভাইজানের কাছ থেকে হাওয়াই মিঠাইয়ের বাক্সটা নিয়ে এসেছে। হাওয়াই মেঠাই বানানো যেতে পারে। ফুড কালার লাগবে। হেদায়েত ডাকল, নাদুর মা!

নাদুর মা বলল, টেবিলে খানা লাগিয়েছি ভাইজান।

হেদায়েত বলল, আজ আর ভাত খাব না। দু’টা হাওয়াই মিঠাই খেয়ে শুয়ে পড়ব।

কী খাইবেন?

হাওয়াই মিঠাই। ক্যান্ডি ফ্লস। আচ্ছা শোনো, হলুদ বেটে কয়েক ফোঁটা হলুদের রস চিপে দিতে পারবে। চেষ্টা করে দেখতাম হলুদ রঙের হাওয়াই মিঠাই করা যায় কি-না।

রাতে সত্যই খাবেন না?

না। তুমি আমাকে কয়েক ফোঁটা হলুদের রস দিয়ে শুয়ে পড়।

নাদুর মা, এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে হতাশা। সে ঠিক করেছে এই বাড়িতে আর কাজ করবে না। চোখের সামনে এত কিছু ঘটতে দেখা ঠিক না।

ভাইজান একটা কথা বলি?

বল।

দেশের বাড়িত জমি নিয়া মামলা-মোকদ্দমা চলতাছে, আমার যাওয়া দরকার।

দরকার হলে অবশ্যই যাবে। কাল সকালে চলে যাও। বেতন যা পাওনা আছে আমাকে বললেই দিয়ে দিব। আমার সঙ্গে টাকা আছে। আজ মাসের এগারো তারিখ কিন্তু পুরো মাসের বেতন পেয়ে গেছি। কাল সকালে যখন যাবে তখন আমার কাছ থেকে কিছু হাওয়াই মিঠাই নিয়ে যেও। বাচ্চাকাচ্ছাদের দেবে। তারা খুশি হবে।

টেলিফোন বাজছে। হেদায়েত টেলিফোন ধরার জন্যে উঠে গেল। রিসিভার কানে লাগিয়ে বলল, কে সেতু?

ওপাশ থেকে বলল, হুঁ।

রবিন সাহেবের অবস্থা কী?

ভালো।

তুমি কি রাতে ফিরবে?

হুঁ।

অনেক রাত হয়ে গেছে। রাতে না ফিরে বরং সকালে ফির। সেটাই ভালো হবে।

ওপাশ থেকে বলল, আচ্ছা স্যার! আপনি কি ম্যাডামের গলাও চেনন না? আমি নীতু।

ও আচ্ছা, তুমি নীতু।

স্যার, আমি সরি বলার জন্যে টেলিফোন করেছি।

সরি বলবে কেন?

ঐ যে মিথ্যা করে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের কাছে আপনার নামে লাগিয়েছি।

মিথ্যা করে লাগালে কেন?

নীতু বলল, আপনাকে আমি টেলিফোন নাম্বার দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আপনি টেলিফোন করবেন। আপনি টেলিফোন করেন না। আমি রোজ রাতে অপেক্ষা করে থাকি। শেষে খুব রাগ উঠে গেল। তখন মিথ্যা করে আপনার নামে লাগিয়েছি। স্যার আপনি কি আমাকে ক্ষমা করেছেন?

হুঁ।

হুঁ না। পরিষ্কার করে বলুন ক্ষমা করেছি।

ক্ষমা করেছি।

আপনার চাকরি চলে যাবার খবর শুনেছি। আমরা খুব হৈচৈ করছি। ধর্মঘট হচ্ছে।

কী জন্যে ধর্মঘট?

আপনাকে যেন আবার নেয়া হয়, এই জন্যে ধর্মঘট।

ও আচ্ছা।

আর আমি প্রিন্সিপাল স্যারকে কী বলেছি জানেন? আমি উনাকে বলেছি – আমার ভুল হয়েছে। অন্য এক লোক টেলিফোন করত। তার গলা হেদায়েত স্যারের মতো। ভালো করেছি না?

বুঝতে পারছি না, ভালো করেছ কি-না। নীতু আমি এখন জরুরি কাজ করছি। টেলিফোনটা রাখি।

এত রাতে কী জরুরি কাজ করছেন?

হলুদ রঙের হাওয়াই মিঠাই বানানোর চেষ্টা করছি।

আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। হলুদ রঙের হাওয়াই মেঠাই কেন বানাবেন?

হাওয়াই মেঠাই বানানোর একটা যন্ত্র আমার বড় ভাই আমাকে কিনে দিয়েছেন। ঐ যন্ত্রটা দিয়ে হাওয়াই মেঠাই বানাচ্ছি।

স্যার সত্যি?

হুঁ সত্যি। নীতু রাখি?

হেদায়েত টেলিফোন রেখে হাওয়াই মেঠাই বানাতে গেল। তার মাথায় নূতন আইডিয়া এসেছে। হাওয়াই মিঠাই তৈরীতে যদি শুকনা মরিচের গুঁড়া দেওয়া হয় তা হলে কি ঝাল হাওয়াই মেঠাই তৈরী হবে? গোল মরিচের গুঁড়া দিলে কী হবে?

রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত হেদায়েত হাওয়াই মিঠাই বানালো। মোট উনিশটা। প্রাইম নাম্বার। এর মধ্যে বারোটা মিষ্টি। বারো হচ্ছে পারফেক্ট নাম্বার। নয়টা ঝাল-মিষ্টি।

রাত সাড়ে তিনটায় হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় ঘুমুতে এসে হেদায়েত অবাক হয়ে দেখল ঝলমলে শাড়ি পরে একটা তরুণী-মেয়ে বিছানায় বসে আছে। তার গায়ের রঙ শ্যামলা। চোখ বিষণ্ণ। মেয়েটাকে খুব চেনা-চেনা লাগছে। মেয়েটা বলল, অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পড়।

হেদায়েত বিড় বিড় করে বলল, আচ্ছা।

মেয়েটা বলল, আজ ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা আছে। তারপরও এসি দেয়া যায়। এসি দেব।

দাও।

মেয়েটা রিমোট টিপে এসি ছাড়ল। হেদায়েতের দিকে তাকিয়ে বলল, শুয়ে পড়। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। বাতি নিভিয়ে দিই?

দাও।

মেয়েটা হেদায়েতের মাথার চুলে বিনি করে দিচ্ছে। মেয়েটার গায়ে কচি আমপাতার গন্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই হেদায়েত গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

তার ঘুম ভাঙলেন ম্যাথমেটিসিয়ান রামনুজন। অর্থাৎ হেদায়েতের স্বপ্ন শুরু হলো। হেদায়েত সাহেব সরি আপনার ঘুম ভাঙলাম। রাত সাড়ে তিনটায় ঘুমাতে গেছেন। ঘুম ভাঙানোটা ঠিক হয় নি।

হেদায়েত বলল, কোনো সমস্যা নেই স্যার। আমি আপনাকে চিনেছি। আপনি রামানুজন। যদি অনুমতি দেন পা ছুঁয়ে কদমবুসি করি। আমি আপনার একজন ভাবশিষ্য।

প্রাইম নাম্বার নিয়ে তোমার মাতামাতি দেখে সেটা বুঝা যায়।

স্যার কি একটা ক্যান্ডি ফ্লস খাবেন?

খেতে পারি।

মিষ্টিটা খাবেন, না কি ঝাল-মিষ্টি।

ঝাল-মিষ্টিটাই দাও। ডায়াবেটিস আছে তো।

হেদায়েত অবাক হয়েছে। পরকালে ডায়াবেটিস থাকে এটা জানা ছিল না।

রামানুজন বললেন, তোমার সমস্যাটার একটা সমাধান বের করেছি।

কোন সমস্যার কথা বলছেন স্যার?

ঐ যে একটা মেয়েকে তোমার বিছানায় দেখ। মেয়েটাকে চিনেছ?

জি না স্যার।

ওর নাম মাহজাবিন। রোল নাইনটিন। প্রাইম নাম্বার। মেয়েটাকে তুমি অত্যান্ত পছন্দ কর বলে তোমার মস্তিস্ক তাকে দেখাচ্ছে।

ও আচ্ছা।

আমার ধারণা তুমি পাগল হয়ে যাচ্ছে।

হতে পারে। আমার দাদা পাগল ছিলেন।

ব্যাপারটা বংশগত কারণে নাও হতে পারে। অনেক বড় ম্যাথমেটিশিয়ানরা একটা পর্যায়ে পাগল হয়ে যায়। ক্যান্ডি ফ্লস আরেকটা দাও।

হেদায়েত ক্যান্ডি দিল। রামানুজন বললেন, তুমি আত্মার ইকুয়েশন বের করার চেষ্টা করছ। আমি খুশি। শুরুতেই বেশি জটিলভাবে চিন্তা করবে না।

জি আচ্ছা স্যার। আমি অত্যান্ত আনন্দিত যে আপনি এসেছেন।

সেতু আয়নার সামনে বসেছে

সেতু আয়নার সামনে বসেছে। চুল আঁচড়াচ্ছে। তার হাতে কাঠের চিরুণি। চিরুণির বড় বড় দাঁত। এই চিরুণিতে চুল আঁচড়ানো যায় না। বড় আয়নার সামনে বসে চিরুণি দিয়ে চুল ঘষতে ভালো লাগে। রবিন হকের গেস্ট হাউস ওয়েসিসের আয়নাগুলি ছোট ছোট। তবে এই বিশেষ ডিলাক্স স্যুটের আয়নাটা প্রকাণ্ড। সেতু লক্ষ করল, আয়নায় রবিনকে দেখা যাচ্ছে। তার হাতে সিগারেট। ঘনঘন সিগারেটে টান দিচ্ছে। সিগারেট হাতে মানুষকে সব সময় চিন্তিত দেখায়। রবিনকেও চিন্তিত দেখাচ্ছে।

রবিন বলল, তুমি আজ থাকবে, না চলে যাবে?

সেতু বলল, জানি না।

ডিসিশান নিয়ে নিলে আমার জন্যে সুবিধা।

কী সুবিধা?

তুমি যদি থেকে যাও, তাহলে আমার এক ধরনের পরিকল্পনা হবে। না থাকলে অন্যরকম।

যদি না থাকি তাহলে তোমার পরিকল্পনা কী?

রবিন বিরক্তি মুখে বলল, সেতু! তুমি অকারণে কথা চালাচালি করছ। স্টপ ইট।

সেতু বলল, Ok.

তুমি যদি আজ থেকে যাও তাহলে ওয়ালেদকে আসতে বলি।

ওয়ালেটা কে?

ফিল্ম ডিরেক্টর। আমি টাকা ঢালব, সে ছবি বানাবে।

সেতু বলল, তাকে এখানে আসতে বলার দরকার কী? এই ঘরে তো ছবি বানাবে না।

রবিন হাতের সিগারেট ছুড়ে ফেলে নতুন আরেকটা ধরাতে ধরাতে বলল, বোকার মতো কথা বলবে না। ছবির গল্প তোমাকে বুঝতে হবে না? ওয়ালেদ বুঝিয়ে দেবে।

সেতু বলল, ছবির গল্পটা কী?

রবিন বলল, কাছে আসো গল্পটা বুঝিয়ে বলি। চা খেতে খেতে বলি। চা দিতে বলব?

সেতু বলল, আমি যেখানে আছি সেখান থেকেই গল্প শুনব। কটা বাজে বলো তো?

দশটা।

সেতু বলল, রাত দশটা না দিন দশটা?

রবিন বলল, তার মানে? তুমি জানো না রাত না দিন?

সেতু বলল, তোমার এই বিশেষ স্যুটের দরজা-জানালা সব সময় বন্ধ থাকে। রাত-দিন কিভাবে বুঝব? কিছু কিছু জায়গা থাকে স্মোক ফ্রি’। তোমার এই জায়গাটা ডে-নাইট ফ্রি।

রবিন বলল, রাত দশটা। গল্পটা বলি?

সেতু বলল, গল্প বলার ব্যাপারে তোমার এত আগ্রহ কেন? ছবির গল্প কি তোমার লেখা?

আইডিয়া আমার। এখন কি গল্পটা শুনবে, না বকবক করেই যাবে?

শুনব।

তাহলে আয়নার দিকে তাকিয়ে না থেকে আমার দিকে ফেরো।

সেতু বলল, আয়নায় তোমাকে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। আয়নার কারণে দু’জন মুখোমুখি না বসেও মুখোমুখি। গল্প শুরু করো।

রবিন এসে সেতুর পাশে বসল। হাতের সিগারটে ফেলে দিয়ে গল্প শুরু 09

শহরের একটা মেয়ে অর্থাৎ তুমি। ছবিতে তোমার নাম বৃষ্টি। তুমি প্রথম গ্রাম দেখতে বের হয়েছ। তোমার গায়ে হালকা আকাশী রঙের শাড়ি। মাথায় গাঢ় নীল রঙের স্কার্ফ। তুমি আপন মনে হাঁটছ। হঠাৎ একটা সাপ এসে তোমাকে ছোবল দিল। হাঁটুর কাছে ছোবল।

আমি শাড়ি পরে আছি, আমাকে হাঁটুর কাছে ছোবল কীভাবে দেবে? আমি কি শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত তুলে হাঁটছি?

ডিরেক্টর শট কীভাবে নেবেন আমি জানি না। পুরো গল্পটা আগে শোন, তারপর সমালোচনায় যাবে।

যে সাপ আমাকে কাটল সেটা কী সাপ?

কী সাপ মানে?

সাপের একটা নাম থাকবে না? কেউটে, দাড়াস, শঙ্খচুড়।

বরিন বলল, আমাকে কি গল্পটা শেষ করতে দেবে প্লিজ?

Ok.

একটা কথাও না। তুমি শুধু শুনে যাবে।

আমাকে আধঘণ্টা সময় দাও। আধঘণ্টা পর শুনব।

আধঘণ্টা কী করবে?

বাসায় টেলিফোন করব। হেদায়েতের সঙ্গে কথা বলব। আমার কেমন জানি অস্থির লাগছে। তার সঙ্গে কথা বললে অস্থিরতাটা কমবে।

রবিন বলল, তুমি বাস করছ আমার সঙ্গে। অস্থিরতা কমাবার জন্যে স্বামীকে টেলিফোন করছ। পুরো ব্যাপারটা কতটা হাস্যকর, বুঝতে পারছ?

পারছি।

আমি তোমাকে একটা উপদেশ দেই?

দাও।

তোমার স্বামী অসম্মানের ভেতর বাস করছে। তাকে ডিভোর্স দিয়ে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচানো উচিত। আর আমাদের ছবির জন্যও ব্যাপারটা ভালো।

কেন?

বিবাহিতা মেয়েকে ছবির নায়িকা হিসেবে পাবলিক একসেপ্ট করে না।

ডিভোর্সি মেয়ে একসেপ্ট করে?

কুমারী মেয়ে হলে সবচেয়ে ভালো হয়। ডিভোর্সি হলো সেকেন্ড চয়েস।

তুমি কিন্তু মন দিয়ে আমার কথা শুনছ না। চুল আঁচড়েই যাচ্ছে।

চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে শুনছি। ঠিক আছে যাও চুল আঁচড়ানো বন্ধ করলাম।

সেতু উঠে দাঁড়ালো। রবিন বলল, কোথায় যাচ্ছ?

সেতু বলল, হেদায়েতকে টেলিফোন করতে যাচ্ছি।

টেলিফোন একটু পরে করো, গল্পটা আগে শুনে নাও।

উঁহু। এখনই টেলিফোন করব।

রবিন দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আরেকটা সিগারেট ধরালো।

হলো।

কে সেতু?

হুঁ। কী করছ?

কান্ডি ফ্লস বানাচ্ছি।

কী বানাচ্ছ?

হাওয়াই মেঠাই। ভাইজান একটা যন্ত্র কিনে দিয়েছেন, এটা দিয়ে বানাচ্ছি।

হচ্ছে?

হ্যাঁ হচ্ছে। নানান রকম ফুড কালার দিয়ে Experiment করছি। সুন্দর সুন্দর রঙ হচ্ছে।

বাহ ভালো তো!

তুমি কি রাতে ফিরবে?

না। ফিল্মের ডিরেক্টর সাহেব আসবেন। তিনি ফিল্মের গল্প শোনাবেন। আড়াই ঘণ্টার গল্প ব্যাখ্যা করে শোনাবেন তো। গল্প শুনতে শুনতেই রাত কাভার হয়ে যাবে।

হবারই কথা।

খানিকটা গল্প, মানে গুরুটা আমি শুনেছি, আমাকে সাপে কাটবে।

সত্যি কাটবে?

আরে না। ফিল্ম পুরাটাই মিথ্যা। দেখা যাবে রাবারের সাপ। তুমি কি ভাত খেয়েছ?

না।

দেরি করছ কেন? খেয়ে ঘুমিয়ে পড়।

আচ্ছা।

ঘুমের ওষুধ খেতে ভুলে যেও না।

ভুলব না।

আচ্ছা শোন, ঐ মেয়েটা কি আরো এসেছিল?

কোন মেয়েটা?

তোমার হাত ধরাধরি করে টানাটানি করে যে মেয়েটা।

এসেছিল।

পরেরবার যখন আসবে, তুমি অবশ্যই তার নাম জিজ্ঞেস করবে।

আচ্ছা। টেলিফোন রেখে দেই।

এক মিনিট ধরে রাখ। ফিল্ম লাইনের অদ্ভুত একটা ঘটনা শোন। কোনো বিবাহিত মেয়ে যদি ফিলো হিরোইনের পার্ট করে, তাহলে কেউ সেই ছবি দেখে না। ছবি ফ্লপ হয়।

তাহলে তো তোমার খুব সমস্যা হবে।

সমস্যা তো হবেই।

কী করা যায় বলো তো?

একটা কিছু ব্যবস্থা হবে, তুমি টেনশন করো না। আর শোন, আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি। কয়েকটা হাওয়াই মেঠাই পাঠিয়ে দাও, খেয়ে দেখি।

আচ্ছা।

সেতু টেলিফোন রেখে বাথরুমে ঢুকে চোখ-মুখে পানি দিয়ে বের হলো। রবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, গল্প শুরু করো।

রবিন বলল, তুমি এবং তোমার হাসব্যান্ডের কনভারসেশন আমি পাশের ঘরের লাইন থেকে শুনেছি। সরি ফর দ্যাট।

সরি হবার কিছু নেই। আমরা তো প্রেমালাপ করছিলাম না।

রবিন বলল, আমার কাছে প্রেমালাপের মতোই মনে হয়েছে। কী সহজস্বাভাবিক কথাবার্তা! একটু হিংসাও বোধ করলাম।

হিংসা কেন?

এত সহজভাবে তুমি কখনো আমার সঙ্গে কথা বলো না।

তুমি তো সহজ মানুষ না। তোমার সঙ্গে সহজ কথা কেন বলব? ভালো কথা, গাড়িটা আমার বাসায় পাঠাও। কয়েকটা ক্যান্ডি ফ্লস নিয়ে আসবে।

গাড়ি পাঠাতে হবে?

অবশ্যই।

 

হেদায়েত শুয়ে পড়েছে। সে সামান্য চিন্তিত। ভুল করে ঘুমের ওষুধ দুটা খেয়ে ফেলেছে। ভাত খাওয়ার পর পর যে একটা খেয়েছিল সেটা মনে ছিল না বলে কিছুক্ষণ আগে আরেকটা খেয়ে ফেলেছে। এতক্ষণে ঘুমে চোখ-মুখ বন্ধ। হয়ে যাবার কথা। মজার ব্যাপার, ঘুম আসছে না। মাথার ভেতর টেলিফোন বাজার মতো শব্দ হচ্ছে। খুবই হালকা শব্দ। ঘরের ভেতর হালকা গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সেন্টের গন্ধ না, টাটকা কোনো ফুলের গন্ধ। অপরিচিত ফুল। মেয়েটা কি চলে এসছে লা-কি? হেদায়েত চারদিকে তাকালো কাউকে দেখা গেল না। মেয়েটার নাম জিজ্ঞেস করতে হবে।

একবারেই ঘুম আসছে না। হেদায়েতের আরেকটা সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে। বিছানায় শুয়ে সিগারেট খাওয়া যাবে না। এক্সিডেন্ট হয়। এক্সিডেন্টে অনেকে মারাও যায়। বিছানা থেকে নেমে সিগারেট খেতে হবে। হেদায়েত সিগারেটের জন্য বালিশের নিচে হাত বাড়াতেই নরম একটা হাতের উপর তার হাত পড়ল। হেদায়েত চোখ বন্ধ করে ফেলল। ফুলের গন্ধ তীব্র হয়েছে। এখন হেদায়েত ফুলের গন্ধটা চিনতে পারছে। কদম ফুলের গন্ধ। হেদায়েত বিড়বিড় করে বলল তোমার নাম কী?

মিষ্টি গলায় থেমে থেমে একটি মেয়ে উত্তর দিল, আমার কোনো নাম নেই। আপনি আমার একটা নাম দিন।

আমি তোমার নাম দিলাম সেতু।

সেতু নাম কেন দেবেন? সেতু আপনার স্ত্রীর নাম। ভালো কোনো নাম দিন।

আমার মাথায় কোনো নাম আসছে না। তুমি নিজেই তোমার একটা নাম দাও।

আচ্ছা। আমি দিলাম।

কী নাম দিয়েছ? মাহজাবিন?

আমাকে জড়িয়ে ধরুন তারপর বলছি।

হেদায়েত মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেল। ফুলের গন্ধ তীব্র থেকে তীব্রতর হলো।

 

সেতুর ঘুম আসছে না। সে নিজেও একটা ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। তাতে লাভ হচ্ছে না। মনে হয় দুটা খাওয়ার দরকার ছিল। খাবার জিনিস কম করে হলেও দু’বার নিতে হয়। তা না হলে খালে পড়ে। সেতু এপাশ-ওপাশ করছে। তারপাশে হেদায়েত থাকলে বলতে পারত— এই আমাকে এক গ্লাস পানি আরেকটা ওষুধ এনে দাও। রবিন ভাইকে সেটা বলা যায় না।

রবিন বলল, ঘুমাচ্ছ?

না।

কোনো কিছু নিয়ে টেনশন?

না।

গরম এক কাপ কফি খাবে?

ঘুম আসছে না, এর মধ্যে কফি খাব কেন?

মাঝে মাঝে ক্যাফিন ঘুম আনতে সাহায্য করে। বিষে বিষক্ষয় টাইপ ব্যাপার। এসো কফি খেতে খেতে কিছুক্ষণ গল্প করি। আমার নিজের ঘুম আসছে না। শুয়ে শুয়ে হেদায়েত সাহেব নামের অদ্ভুত মানুষটার কথা ভাবছিলাম।

সেতু উঠে বসতে বসতে বলল, সবাই অদ্ভুত। তুমি নিজেও অদ্ভুত। আমি অদ্ভুতেরও বেশি। আমি কিস্তুত।

হেদায়েত সাহেবের সঙ্গে তোমার বিয়েটা কিভাবে হলো। এরেনজড মারেজ তো বটেই। এরেনজটা কে করল?

সেতু হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি করেছি।

তার মানে?

আমি অংকে খুব কাঁচা ছিলাম। এসএসসি পরীক্ষার আগে আগে আমার বড় মামা অংকের জন্যে একজন প্রাইভেট টিচার ঠিক করলেন।

হেদায়েত সাহেব সেই টিচার?

হুঁ।

খুব ভালো টিচার?

হুঁ। অংকে আমি নব্বই পেয়েছিলাম।

একজন লোক ভালো অংক শেখায় বলে তুমি তার প্রেমে পড়ে গেলে?

তার কথাবার্তা আচার-আচরণে আমার মনে হয়েছিল সে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ।

এখন মনে হয় না?

এখনও মনে হয়।

সেতু বিছানা থেকে নামল। ওয়ার ড্রবের দিকে তাকাল। রবিন বলল, কোথায় যাচ্ছ?

সেতু বলল, আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। আমি বাসায় গিয়ে ঘুমাব।

রবিন বলল, তার মানে?

সেতু বলল, চোখ বন্ধ কর। আমি কাপড় চেঞ্জ করব।

রবিন বলল, রাত কটা বাজে জানো?

জানি। দুটা দশ। ঢাকা শহরে এমন কোনো রাত নয়। রাস্তায় ট্রাফিক আছে।

তুমি আশা করছ রাত দু’টা দশ মিনিটে আমি তোমাকে তোমার বাসায় নামিয়ে দেব?

সেতু বলল, তুমি নামিয়ে না দিলেও তোমার ড্রাইভার নামিয়ে দেবে। সে একতলায় ড্রাইভারের ঘরে ঘুমুচ্ছে।

রবিন সিগারেট ধরতে ধারাতে বলল, তুমি যদি এখন চলে যাও আর কোনোদিন কিন্তু আমার এখানে আসতে পারবে না।

আসতে না পারলে আসব না।

রবিন বলল, আমি পাগলামী প্রশ্রয় দেই না।

সেতু বলল, পাগলামী প্রশ্রয় না দেয়াই ভালো। পাগলদের কাজকর্মের কোনো ঠিক নেই হঠাৎ দেখা গেল ঘুমের মধ্যেও তোমার মুখে আমি বালিশ চাপা দিলাম।

তুমি সত্যি সত্যি চলে যাবে?

হুঁ।

একটা ভালো সাজেশন দেই?

দাও।

যে-কোনো কারণেই হোক তোমার মন অস্থির হয়েছে। তুমি তোমার স্বামীর সঙ্গে টেলিফোনে কিছুক্ষণ কথা বলো। তারপরেও যদি বাসায় যেতে চাও আমি নিজে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসব। It is a deal.

কিছুক্ষণ চিন্তা করে সেতু বলল, ঠিক আছে।

তুমি নিরিবিলি কথা বললো, আমি পাশের ঘরে যাচ্ছি।

তোমাকে পাশের ঘরে যেতে হবে না। আমি এমন কোনো কথা বলব না। যে তুমি শুনতে পারবে না। আমি রাধা না, আমার স্বামীও কৃষ্ণ না।

পাশের ঘরে যাচ্ছি কফি বানাতে। আমার কফি খেতে ইচ্ছা করছে। মনে হয় আমার জ্বর আসবে। জ্বর আসার আগে আগে আমার খুব কফির তৃষ্ণা হয়। ব্যাপারটা অদ্ভুত।

অনেকক্ষণ রিং বাজার পর হেদায়েত টেলিফোন ধরে ক্লান্ত গলায় বলল, কে সেতু?

হুঁ। ঘুমিয়ে পড়েছিলে?

হুঁ।

তোমার পাঠানো হাওয়াই মেঠাই খেয়েছি। খুব ভালো হয়েছে। এটা বলার জন্যে টেলিফোন করেছি।

ক্যান্ডিফ্লস তো আমি পাঠাই নি। তুমি গাড়ি করে নিয়ে গেছ।

একই কথা।

না একই কথা না। দুটা দুরকম কথা।

আচ্ছা ঠিক আছে দু’টা দু’রকম কথা। তোমার হাওয়াই মেঠাই খেতে। ভালো হয়েছে এটাই মূল বিষয়।

থ্যাংক য়্যু!

ঘুম কি ভালো হচ্ছে?

হুঁ।

যেভাবে হুঁ বললে তাতে মনে হচ্ছে ঘুম ভালো হচ্ছে না। দুঃস্বপ্ন দেখছ?

ঠিক দুঃস্বপ্ন না, মেয়েটাকে দেখছি।

কোন মেয়েটা? যে হাত ধরাধরি করে টানাটানি করে?

হুঁ। তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। প্রায়ই একটা মেয়েকে দেখি যে। বিছানায় আমার সঙ্গে ঘুমিয়ে থাকে।

কী সর্বনাশ!

সর্বনাশের কিছু না। সে ভালো মেয়ে। কিছুই করে না।

কথাও বলে না।

একটা দুটা কথা বলে।

মেয়েটা দেখতে কেমন?

সুন্দর।

সুন্দর তো বুঝলাম। দেখতে কার মতো?

আমার ক্লাসের একজন ছাত্রীর চেহারার সঙ্গে কিছু মিল আছে। রোল নাইনটিন।

মেয়েটা কি এখনও আছে?

এখন নেই। তুমি টেলিফোন করলে, টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে দেখি সে নেই।

তোমাকে তার নাম জিজ্ঞেস করতে বলেছিলাম। নাম জিজ্ঞেস করেছিলে?

না।

ঠিক আছে ঘুমাও।

আচ্ছা।

সেতু টেলিফোন নামিয়ে রাখতেই রবিন দু’মগ কফি হাতে ঘরে ঢুকল। সে সেতুর দিকে কফির মগ এগিয়ে দিল। সেতু মগ নিয়ে কফিতে চুমুক দিল।

রবিন বলল, বাসায় যাবার পরিকল্পনা কি এখনও আছে, না বাদ দিয়েছ?

বাদ দিয়েছি।

ভেরি গুড।

রবিন সিগারেট ধরিয়েছে। আরাম করে ধোয়া ছাড়ছে। সেতু বলল, আমাকে একটা সিগারেট দাও। রবিন আগ্রহের সঙ্গে সিগারেট এগিয়ে দিল। রবিন বলল, মেয়েরা সিগারেট খাচ্ছে এই দৃশ্যটা দেখতে আমার কেন জানি খুব ভালো লাগে।

সেতু বলল, এইজন্যেই তো খাচ্ছি। আমার মাথা ঘুরছে। বমি বমি লাগছে, তারপরেও টানছি।

রবিন বলল, সত্যি করে বলো তো সেতু, আমাকে কি তুমি ভালোবাস?

হুঁ।

হেদায়েত সাহেবের চেয়ে বেশি না কম?

সমান সমান।

অংক ঠিকমতো শিখতে পারলে আমার পাল্লা সামান্য ভারী হতো! ঠেক খেয়ে গেছি অংকে। আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি জানতে চাও?

না।

জানতে না চাইলেও শোন। আমার প্রায়ই ইচ্ছা করে প্রফেশনাল কোনো কিলারকে দিয়ে হেদায়েত সাহেবকে খুন করে ঝামেলা শেষ করে দেই। ভিলেন মঞ্চ থেকে প্রস্থান করবে, আমরা রূপকথার এল্ডিং এর মতো সুখে ঘর সংসার করতে থাকব।

তুমি কি সত্যি আমাকে বিয়ে করবে?

Yes, Yes এবং Yes, আমার কথা কি বিশ্বাস হচ্ছে?

বুঝতে পারছি না।

রবিন বলল, মানুষ মিথ্যা কথাগুলি সহজেই বিশ্বাস করে। সত্যিটা বিশ্বাস করতে চায় না। বল তো কার কথা?

জানি না কার কথা। যারই হোক কথা সত্যি না। তবে তুমি বিয়ে করতে চাইলে আমি তোমাকে বিয়ে করব। হেদায়েতকে সব জানিয়েই বিয়ে করব। সে পুরো বিষয়টা সহজভাবে নেবে। যে-কোনো জটিল বিষয় সহজ ভাবে গ্রহন করার ক্ষমতা তার আছে।

রবিন বলল, এমন কি হতে পারে যে জীবনের জটিলতা বুঝার ক্ষমতাই মানুষটার নেই?

হতে পারে। মানুষটা মানসিকভাবে অসুস্থ। তুমি তাকে সুস্থ করার ব্যবস্থা কর, তারপর তোমার সব কথা আমি শুনব। সিনেমা করতে বললে সিনেমা করব। সিগারেট খেতে বললে সিগারেট খাব। তোমার সামনে নেংটো হয়ে নাচানাচি করতে বললে নেংটো হয়ে নাচানাচি করব। Free pass, শুধু একটাই শর্ত।

রবিন বলল, আরেকটা সিগারেট ধরাও। তুমি অদ্ভুত করে ধোয়া ছাড়, দেখতে ভালো লাগে।

সেতু দ্বিতীয় সিগারেট ধরাল। ঠোঁট গোল করে ধোয়া ছাড়তে লাগল।

রবিন বললেন, তোমার স্বামীকে তোমাদের বাসার কেউ পছন্দ করেন না। তাদের কথাবার্তায় এ রকম মনে হলো।

সেতু বলল, কেউ তার সঙ্গে কথা বলে না। কথা বললে পছন্দ করত। তার বড়ভাই একজন আছেন। তিনিও ভালো মানুষ। তাঁর নাম বেলায়েত। সরি তার নাম মুখে নিলাম। ভাসুরের নাম মুখে নেয়া ঠিক না। এতে তাকে অপমান করা হয়।

তুমি এসব মান?

আমি খুবই খারাপ মেয়ে কিন্তু মানি।

বেলায়েত সাহেব কি তোমার হাসবেন্ডের মতো একসেনট্রিক?

জানি না।

তোমার মা ঐদিন খরগোশ খরগোশ বলছিলেন। বেলায়েত সাহেবকে কি খরগোশ ডাকা হয়।

আমাদের বাসায় ডাকা হয়।

কেন?

জানি না কেন। প্লিজ এই প্রসঙ্গ অফ।

ঠিক আছে অফ।

আমি উনাকে অত্যন্ত পছন্দ করি।

 

বেলায়েত জেগে আছে। রেস্টুরেন্টের হিসাব দেখছে। তাঁর সামনে পরিমল বাবু বসে আছেন। পরিমল বাবুর সামনে কাগজ কলম। হিসাব মেলানো হচ্ছে।

হঠাৎ পরিমল বাবু উঠে দাঁড়ালেন। বেলায়েত বলল, কী ব্যাপার?

পরিমল বাবু বললেন, আরো কিছুক্ষণ থাকলে আপনাকে অসম্মান করা হবে। এই জন্যে উঠে পড়লাম।

অসম্মান হবে কেন?

ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আপনার সামনে ঘুমানোর অর্থ আপনাকে অসম্মান করা।

যান ঘুমান।

পরিমল বাবু বেলায়েতের বাড়ির একতলায় একটা ঘরে থাকেন। নিজে বেঁধে খান। একা মানুষ। তার কোনো অসুবিধা হয় না। এই বাড়িতে তিনি সুখেই আছেন।

হেনা দরজা ধরে দাঁড়িয়েছে। বেলায়েত বলল, কিছু বলবে?

হেনা বলল, ঘুমাবে না?

হিসাব শেষ করে তারপর ঘুমাব।

বুড়াটাকে হিসাব করতে দাও। অনেক রাত হয়েছে।

বেলায়েত বলল, হোক রাত। হিসাব শেষ না করে উঠব না। আরেকটা কথা, পরিমল বাবুকে বুড়া বুড়া বলবে না। বৃদ্ধ হওয়া কোনো অপরাধ না। তুমি ঘুমাতে যাও।

হেনা গেল না। দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে থাকল। বেলায়েত বলল, আর কিছু বলার বাকি আছে?

সেতুর বিষয়ে একটা কথা ছিল। অনেক আজেবাজে কথা তার বিষয়ে শুনা যাচ্ছে। মুখে বলা যায় না এমন সব কথা।

বেলায়েত বলল, মানুষের মধ্যে ভালো আছে মন্দ আছে। হেদায়েতের স্ত্রীর বিষয়ে ভালো কিছু যদি শুনে থাক সেটা বল আমি শুনব। মন্দটা শুনব না। ভালো কিছু শুনেছ?

না।

তাহলে ঘুমাতে যাও। আমার দেরি হবে। এমনও হতে পারে আজ রাতে ঘুমাবই না।

বেলায়েত হিসাবে মন দিল। তার কাছে মনে হচ্ছে হেদায়েত আশেপাশে থাকলে ভালো হতো, ফটাফট যোগ-বিয়োগ করে ফেলত।

প্রিন্সিপাল হাজি এনায়েত করিমের সামনে হেদায়েত

প্রিন্সিপাল হাজি এনায়েত করিমের সামনে হেদায়েত বসে আছে। প্রিন্সিপাল সাহেব হেদায়েতকে খবর দিয়ে এনেছেন। তার ঘরের দরজা খোলা। কলেজের কিছু মেয়েকে খোলা দরজা দিয়ে উঁকিঝুকি দিতে দেখা যাচ্ছে। প্রিন্সিপাল সাহেবের সামনে প্লেটভর্তি গরম সিঙ্গাড়া। আরেক প্লেটে পেঁয়াজ-কাচামরিচ।

এনায়েত করিম সিঙ্গাড়ার প্লেট এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, সিঙ্গাড়া খান।

হেদায়েত বলল, আমি সিঙ্গাড়া খাই না স্যার। সেতু পছন্দ করে খায়। আমি খাই না।

সেতু কে?

আমার স্ত্রী। ভালো নাম রুমানা। ডাক নাম সেতু।

ও আচ্ছা। আচ্ছা। কে যেন বলছিল আপনার স্ত্রী সিনেমা করেন। সত্যি -কি?

প্রথম ছবি করছে। কাজ এখনও শুরু হয় নি। ছবির নামটা খুব সুন্দর বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল।

দ্বিতীয় কদম ফুল মানে?

মানে আমি ঠিক জানি না। Script রাইটার জানেন। তার সঙ্গে দেখা হলে মানে জিজ্ঞেস করব।

আপনাকে ডেকেছি কি জন্যে বুঝতে পারছেন?

না।

আপনার বিষয়ে আমরা ডিসিসন চেঞ্জ করেছি। আপনি আবার জয়েন করুন। ম্যাথের নতুন যে টিচার নেয়া হয়েছে ছাত্রীরা কেউ তাকে পছন্দ করছে না। উনি ঠিক মতো না-কি বোঝাতে পারেন না।

 

ও আচ্ছা।

আপনি আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু করে দিন। একটাই শুধু শর্ত পড়াশোনার বাইরে কোনো আলাপ না। ক্লাসরুম বাড়ির বৈঠকখানা না। এটা মনে থাকলেই চলবে।

হেদায়েত বলল, আমার পক্ষে পড়ানো এখন সম্ভব না।

সম্ভব না কেন?

হেদায়েত বলল, আমার মাথা খারাপ হওয়া শুরু হয়েছে। যতই দিন যাচ্ছে ততই বেশি খারাপ হচ্ছে। এই অবস্থায় আমার পক্ষে ক্লাস নেয়া ঠিক না। কী বলতে কী বলব।

আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে এটা কে বলেছে? ডাক্তার?

ডাক্তার সেইভাবে কিছু বলছে না। আমি নিজে নিজেই বের করছি।

আপনার যে মাথা খারাপ হচ্ছে তার প্রধান লক্ষণ কী?

হেদায়েত বলল, আপনার সঙ্গে আর কথা বলতে ভালো লাগছে না। স্যার আমি উঠি?

চাকরি তাহলে করছেন না?

না।

বসুন আরও কিছুক্ষণ। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করুন। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করুন।

দুপুরে ভাইজানের সঙ্গে খাব। উনি অপেক্ষা করে থাকবেন। আজ বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবার দুপুরে সব সময় ভাইজানের সঙ্গে খাই। তিনি নানান জায়গা থেকে ভালো ভালো খাবার যোগাড় করেন। আজ আমরা খাব হরিয়াল পাখির ভুনা মাংস।

হেদায়েত উঠে দাঁড়াল।

এনায়েত করিম বললেন, ডিসিসান চেঞ্জ করলে আমাকে জানাবেন। আপনাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার আগের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। সরি ফর দ্যাট।

হেদায়েত বলল, স্যার আপনার টেলিফোন থেকে একটা টেলিফোন করে দেখি পাই কি-না।

কী পান কি-না?

দ্বিতীয়।

এনায়েত করিম অবাক হয়ে বললেন, দ্বিতীয়টা কী?

ঐ যে ছবির নামের অর্থ। দ্বিতীয় কদম ফুল।

ও আচ্ছা আচ্ছা। বাদ দিন। দরকার নাই।

হেদায়েত বলল, দরকার থাকবে না কেন? আপনার মনে একটা কৌতূহল জেগেছে। কৌতূহল মেটানো দরকার।

সব কৌতূহল মেটানো ঠিক না। আপনি চলে যাচ্ছেন যান। যদি ডিসিসান চেঞ্জ করেন আমাকে জানাবেন।

জি আচ্ছা স্যার।

এনায়েত করিম তাকিয়ে আছেন। এখন তাঁর মন কিছুটা খারাপ। অংক জানা মানুষটার মাথা মনে হয় সত্যি সত্যি খারাপ হয়েছে।

 

বেলায়েতের মেজাজ ভালো না। আজ সকাল থেকে যার সঙ্গেই দেখা হচ্ছে তার সঙ্গেই সে ঝগড়া করছে। তার এসিসটেন্ট পরিমল বাবুর চাকুরি চলে গেছে। তার চাকরি যাবার কারণ তিন বস্তা সিমেন্টের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না।

পরিমল বাবু বললেন, স্যার আপনার কি ধারণা এই তিন বস্তা সিমেন্ট আমি চুরি করেছি?

বেলায়েত বললেন, Yes you,

স্যার আপনার এই কথার পর আমার উচিত বাসার সামনে আম গাছে ফাঁসি নেয়া।

বেলায়েত বলল, তাই নিন। Hang Mango free.

প্রচণ্ড রেগে গেলে বেলায়েত ইংরেজি বলে। ইংরেজি হচ্ছে কি না হচ্ছে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না। হেদায়েত ভাইয়ের সামনে বসে আছে। টিফিন কেরিয়ারে খাবার চলে এসেছে। পরিমল বাবুর সঙ্গে হৈচৈ হচ্ছে বলে খাবার দেয়া হচ্ছে না।

বেলায়েত বলল, আপনি এখন যান। আমরা দুই ভাই খাব। খাবার সময় পারিবারিক কথাবার্তা হবে, এর মধ্যে আপনি থাকবেন না। Go street রাস্তায় যান।

পরিমল বাবু চলে গেলেন। হেদায়েত বলল, এত রাগারাগি করা ঠিক না।

বেলায়েত বলল, ঠিক না আমি জানি। সকালে পত্রিকায় ছবি দেখে রাগ উঠে গেল। ঝুম রাগ।

কী ছবি দেখে রাগ উঠল?

তোর বৌয়ের ছবি। বিনোদন পাতায় বিরাট ছবি। সে না-কি সিনেমা করবে। আমি তো কিছুই জানি না।

হঠাৎ ঠিক হয়েছে। ছবির নাম ‘বাদল দিনের দ্বিতীয় কদম ফুল’।

তুই নিষেধ করলি না?

হেদায়েত অবাক হয়ে বলল, নিষেধ কেন করব? শখ করে একটা কাজ করছে। তুমি যখন শখ করে কোনো কাজ করো, আমি নিষেধ করি?

বেলায়েত বলল, তোর কথায় যুক্তি আছে। কঠিন যুক্তি। ফেলে দেবার মতো না। তবে পত্রিকায় ছবি দেয়া ভুল হয়েছে।

হেদায়েত বলল, ভুল কেন হবে? ছবি না দিলে লোকে জানবে কীভাবে? লোকে জানবে তারপর হলে গিয়ে ছবি দেখবে।

তোর এই কথারও যুক্তি আছে। তবে যে ছবিটা ছাপা হয়েছে সেটা ভালো না।

হেদায়েত বলল, ছবির আবার ভালো মন্দ কী?

বেলায়েত বিব্রত গলায় বলল, নাভি দেখা যায়। নাভিতে আবার দুল পরেছে। দুল পরবে কানে। নাভিতে দুল পরবে কেন? আল্লাহপাক তো নাভি দুল পরার জন্যে তৈরি করেন নাই। এখন বল আমার এই কথাটার যুক্তি আছে কি-না!

হেদায়েত বলল, যুক্তি নাই। নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্যে মেয়েরা নানা কর্মকাণ্ড করে। এক সময় তারা দাঁতে কালো রঙ দিত। একে বলে মিশি। চীনা মেয়েরা লোহার জুতা পরে পা ছোট করতো। আফ্রিকান মেয়েরা জিহ্বা ফুটো করে বড় বড় রিং পরতো।

বেলায়েত বিস্মিত হয়ে বলল, জিহ্বায় রিং পরে ভাত খেত কীভাবে?

হেদায়েত বলল, জানি না।

তুই একটা বিষয় জানবি না এটা কেমন কথা! জানার দরকার না?

হেদায়েত বলল, আচ্ছা জানব। জেনে তোমাকে জানাব। থালা-বাটি এইসব দিতে বলে ভাইজান। ক্ষিধে লেগেছে।

বেলায়েত বলল, ক্ষিদে লেগেছে এটা আগে বলবি না? এতক্ষণ খামাকা বকবক করছি। একটা দুঃসংবাদ আছে, হরিয়াল পাওয়া যায় নি। ঘুঘু পাওয়া গেছে। তবে ঘুঘুর টেস্টও ভালো। সফট মাংস।

খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই বেলায়েত চুল কাটতে বসল। সকাল থেকেই নাপিত এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ভাত খাওয়ার আগে চুল কাটলে খাবারে চুলের টুকরা চলে যেতে পারে। চুল পাকস্থলিতে গেলে বিরাট সমস্যা। যে কারণে বেলায়েত সব সময় খাবারের পরে চুল কাটে।

হেদায়েত ভাইয়ের সামনে বসে আছে। চুল কাটা দেখছে। বেলায়েত নাপিতকে বলল, মাথাটা পুরো কামায়ে দাও। ইদানীং অল্পতেই মাথা গরম হচ্ছে। মাথা কামানো থাকলে গরম কমবে। বৎসরে একবার এমনিতেই মাথা কামানো দরকার। খুশকি, উকুন এইসব তখন আর জীবনেও হবে না।

নাপিত মাথা কামিয়ে দিল। হেদায়েত বলল, ভাইজান তোমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। আমিও মাথা কামাব।

বেলায়েতের চোখে পানি আসার উপক্রম হলো। এই না হলে ভাই? বড় ভাইকে মাথা কামাতে দেখেছে বলে সেও মাথা কামাবে। তার ধারণা, কোনো কারণে যদি সে ঝাঁপ দিয়ে ছাদ থেকে রাস্তায় পড়ে হেদায়েতও তাই করবে। ভাইয়ের প্রতি এত শ্রদ্ধা ভক্তি যদিও ঠিক না। বেলায়েত বলল, মাথা কামালে কামা। বাসায় গিয়ে হেভি গোসল দিবি। চুলের কাটা টুকরা গিলা আর বিষ গিলা একই। মাথা কামানোর সিদ্ধান্তটা ভালো নিয়েছিস। মাথা কামাবার। পরপরই মেজাজ অনেকখানি নেমে গেছে। পরিমল বাবুকে আবার চাকরিতে বহাল করব বলে ঠিক করেছি।

ভালো করেছ।

বেলায়েত বলল, মাথা কামানোর পর চল দুই ভাই স্টুডিওতে গিয়ে একটা ছবি তুলে আসি। স্মৃতি থাকুক।

হেদায়েত বলল, আচ্ছা।

 

সেতু হেদায়েতকে ডিভোর্সের কাগজ পাঠাবে। রবিন একজন লইয়ার নিয়ে এসেছে। কী কারণে ডিভোর্স চাওয়া হচ্ছে তা গুছিয়ে লিখতে হবে। লইয়ার একটা মুশিবিদা তৈরি করে এসেছে। সেখানে লেখা–

“আমার মক্কেল শারীরিক এবং মানসিকভাবে নির্যাতিত। প্রায় দিনই তাকে মদ্যপ স্বামীর কাছে প্রহৃত হতে হয়েছে। এতে সে এখন মানসিক ভারসাম্যহীনতার দ্বার প্রান্তে উপস্থিত। আমার মক্কেলের সন্তানের শখ কিন্তু কিছুতেই তার স্বামী তাকে সন্তান ধারণ করতে দিবে না। এমতাবস্থায় দু’জনের ছাড়াছাড়ি ছাড়া আর করণীয় কিছুই নাই।”

সেতু বলল, এইসব কী হাবিজাবি লিখে নিয়ে এসেছেন? আমার স্বামী জীবনে কখনও আমাকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করে নি। সে কোনোদিন এক ফোঁটা মদ খায় নি অথচ আপনি লিখেছেন মদ্যপ। সে সব সময় বাচ্চা চেয়েছে। আমি চাই নি। একবার কনসিভ করে ফেললাম, তাকে জানিয়ে বাচ্চা Abort করলাম। পরে অবশ্যি তাকে জানিয়েছি। সে কিছুই বলে নি। এমন একজন মানুষ সম্পর্কে কুৎসিত কথা আমি লিখব?

রবিন বলল, এগুলি সবই গৎ বাধা কথা। লিখতে হয় বলে লেখা। নিয়ম রক্ষা। কেউ এইসব বিশ্বাস করে না।

সেতু বলল, কেউ বিশ্বাস না করুক, ও বিশ্বাস করবে। মন খারাপ করবে। আমার মতে যেটা সত্যি সেটাই লেখা উচিত।

রবিন বলল, সত্যটা কী?

সেতু কঠিন গলায় বলল, সত্যিটা হচ্ছে— আমি একজন দুষ্ট স্ত্রী। বেশ্যা টাইপ। আমার মতো স্ত্রীর উচিত না ওর মতো একজন ভালো মানুষের সঙ্গে থাকা।

রবিন বলল, এইসব কী বলছ? তোমার কী মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!

সেতু বলল, উকিলের মুসিবিদ পড়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এই জাতীয় মিথ্যা আমি তাকে কখনও পাঠাবো না। নেভার। নেভার।

রবিন বলল, চিৎকার করছ কেন? মুসিবিদ অন্যভাবে লেখা হবে। যেমন তোমাদের বনিবনা হচ্ছে না বলে তুমি ডিভোর্স চাচ্ছ।

সেতু বলল, আমাদের বনিবনা হচ্ছে না, এটাও তো ঠিক না। সে আমাকে খুবই পছন্দ করে, আমিও তাকে করি।

লইয়ার বলল, স্যার! আমি বরং অন্য আরেকদিন আসি?

রবিন বলল, অন্য আরেকদিন না। আজই আসুন। সন্ধ্যার পর আসুন। সমস্যা হবে না।

সেতু কঠিন গলায় বলল, তোমার কী ধারণা সন্ধ্যার পর আমি দুই পেগ হুইস্কি খাব, তারপর তুমি যা বলবে আমি তাই করব?

রবিন বলল, না করলে না করবে। এখন চুপ করো। অকারণে চিৎকার করে তুমি আমার মাথা ধরিয়ে দিচ্ছ। চিৎকার করার মতো কিছু হয় নি। Cool down please. কফি খাবে? কফি দিতে বলি?

 

হেদায়েত বসার ঘরে বসে আছে। তার হাতে টিভির রিমোট। History চ্যানেল বলে একটা চ্যানেলে মিশর নিয়ে কী যেন দেখাচ্ছে। একজন ফারাওদের পোশাক পরে কী যেন বলছে। কোনো কথাই পরিষ্কার না। মনে হচ্ছে লোকটা তোতলাচ্ছে। কোনো ফারাও কি ভোলা ছিল?

নাদুর মা সামনে এসে দাঁড়াল। হেদায়েত বলল, কিছু বলবে নাদুর মা?

নাদুর মা বলল, জি ভাইজান বলব। আমি এইখানে আর কাজ করব না।

হেদায়েত বলল, আগেও তো একবার বলেছ চলে যাবে। যাও নি।

এইবার যাব। নাদুর মা বলল, দুই মাসের বেতন পাওনা আছে। ম্যাডাম জানেন। টাকাটা পাইলে চইলা যাব।

কখন যাবে?

আজই যাওয়ার ইচ্ছা। সইন্ধায় বাস ছাড়ে।

তোমার কত পাওনা হয়েছে?

আটশ টাকা হিসাবে দুই মাসে ষোলশ।

হেদায়েত পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করল। মানিব্যাগে তিন হাজার টাকা আছে। সে পুরো টাকাটাই নাদুর মার হাতে দিল।

নাদুর মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বলল, আপনার খাওয়াখাদ্যের কী ব্যবস্থা হইব ভাইজান?

হেদায়েত বলল, একটা-কিছু ব্যবস্থা হবে। তুমি চিন্তা করবে না।

ম্যাডামের সাথে দুইটা কথা বলতে ইচ্ছা ছিল ভাইজান। টেলিফোনে ধইরা দিবেন?

হেদায়েত অনেক চেষ্টা করল সেতুকে ধরা গেল না। রেকর্ডিং ভয়েস শোনা যায়- “ম্যাডাম দিলরুবা এখন ছবির কাজে ব্যস্ত। পরে যোগাযোগ করুন।” ম্যাডাম দিলরুবাটা কে হেদায়েত বুঝতে পারছে না। সেতু কি তার নাম বদলে দিলরুবা রেখেছে? সেতু নামটাই তো সুন্দর—বন্ধন।

 

রাত ন’টা। হেদায়েত ৰাসার কাছেই একটা হোটেল থেকে তেহারি খেয়ে এসেছে। চল্লিশ টাকা প্লেট। খাবারটা যথেষ্টই ভালো। রেস্টুরেন্টের মালিকের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তাদের হাউস সার্ভিস আছে। টিফিন ক্যারিয়ারে করে বাসায় খাবার পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা। হেদায়েত তার বাসার নাম-ঠিকানা দিয়ে এসেছে। রেস্টুরেন্টের মালিক বলেছে— খাবার যদি খারাপ পান, পচা-বাসি পান বা ঠাণ্ডা পান বাটা কোম্পানির জুতা দিয়া আমার গালে মারবেন। আমি যদি কিছু বলি তাইলে আমি মানুষের বাচ্চা না, আমি শকুনের বাচ্চা। আমার দোকানের নাম দি গ্রেট বিরানী হাউস বদলায়া রাখব ‘শকুন হাউস’।

রাতে আরাম করে সিগারেট ফুকতে ফুকতে হেদায়েত ঘুমুতে গেল। আজ সে দু’টা সিগারেট শুয়ে শুয়ে খাবে। পুরো বাড়ি খালি তার আলাদা আনন্দ আছে। ক্রিং ক্রিং শব্দে ল্যান্ডফোন বাজছে। টেলিফোন ধরবে না ধরবে না। করেও হেদায়েত টেলিফোন ধরল।

স্যার বলছেন?

কে?

স্যার আমি নীতু।

ও আচ্ছা নীতু।

কী করছেন স্যার?

সিগারেট খাচ্ছি।

কেন সিগারেট খাচ্ছেন? হার্টের অসুখ হবে। আচ্ছা স্যার আজ আপনি কলেজে এসেছিলেন না?

হুঁ।

অনেকেই আপনাকে দেখেছে। শুধু আমি দেখতে পাই নি। আমি কলেজে এসেছি আপনি যাবার পর। যখন শুনলাম আপনি এসে চলে গেছেন, তখন খুব। মন খারাপ হয়েছে। স্যার, কবে থেকে ক্লাস নেয়া শুরু করবেন?

আমি কোনো ক্লাস নে মা নীতু।

কেন?

আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তো এই জন্যে ক্লাস নেব না।

আপনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন?

হুঁ। ধীরে ধীরে পাগল হচ্ছি। আমাদের বংশে পাগলামি আছে। আমার দাদা পাগল ছিলেন।

বলেন কি! উনি কি ছোটবেলা থেকে পাগল ছিলেন?

না। তার বয়স যখন চল্লিশ তখন হঠাৎ একদিন পাগল হয়ে যান।

আপনার বয়স কত স্যার?

চল্লিশের উপর।

তাহলে তো স্যার টাইম হয়ে গেছে।

হুঁ।

স্যার, আমার টেলিফোন নাম্বারটা কি এখনো আপনার মনে আছে?

মনে আছে।

যখন পুরোপুরি পাগল হয়ে যাবেন, তখনও কি মনে থাকবে?

বুঝতে পারছি না।

আচ্ছা স্যার, আপনি যে একটা ইকুয়েশন বের করার চেষ্টা করেছিলেন ঐটার কী হলো?

কোন ইকুয়েশন?

আত্মার ইকুয়েশন।

ও আচ্ছা, একটা Wave Functin তৈরি করা কঠিন হবে। আত্মা বিষয়টা তো জানা নেই।

আপনার জন্যে মোটেই কঠিন হবে না। পাগল হবার আগেই ইকুয়েশনটা শেষ করা উচিত না স্যার? পাগল হলে তো আর পারবেন না। স্যার আমি রাখি। মা কয়েকবার এসে দেখে গেছে আমি টেলিফোনে কথা বলছি। আমি যে একটা অতি জরুরি বিষয় নিয়ে স্যারের সঙ্গে কথা বলছি, Math নিয়ে কথা, এটা মা বিশ্বাস করবে না। মা ভাববে আমি প্রেম করছি। স্যার খোদা হাফেজ

খোদা হাফেজ।

 

হেদায়েত শুয়ে পড়েছে। আত্মা নিয়ে চিন্তা করছে। আত্মাটা কী? নিশ্চয় কোনো বস্তু না। বস্তুর বিনাশ আছে। আত্মার বিনাশ নেই। এটাও তো ঠিক না। বস্তুর বিনাশ থাকবে না কেন? বস্তুরও বিনাশ নেই।

আত্মা হলো কিছু অনুভূতির আধার। প্রেম, স্নেহ, মমতা… ভালো কথা, খারাপ অনুভূতির আধারও কি আত্মা ঘৃণা, রগি, বি১দ্বেষ। সহজভাবে কী লেখা যায়—

আত্মা = f (Love) (hate)

লিমিট 0 থেকে ইনফিনিটি

আচ্ছা চিন্তাটা কি আত্মার মধ্যে পড়বে?

হেদায়েত বিছানায় উঠে বসেছে। ঘুমের ওষুধ খাবার পরেও তার ঘুম আসছে না।

রামানুজন বলে গেছেন সহজভাবে চিন্তা করতে। যদিও স্বপ্নে বলেছেন। স্বপ্নের বিষয়টা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত। রসায়নবিদ মেন্ডেলিফ পেরিওডিক টেবিল স্বপ্নে পেয়েছিলেন। রামানুজন নিজেও স্বপ্নে অনেক থিওরি পেয়েছেন।

সহজ ভাবে শুরু করা যাক।

আত্মা = a^n

তাহলে a কীসের ফাংশন?

আবার টেলিফোন বাজছে। মনে হয় নীতু মেয়েটাই করেছে। হেদায়েত অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটার চেহারা মনে করতে পারল না।

অল্প কিছুদিন মাত্র দেখা হয় নি অথচ চেহারা মনে নেই। পাগলের লক্ষণ। একজন মানুষের মাথা থেকে যখন পরিচিতজনদের ছবি মুছে যেতে থাকে। তখন বুঝতে হবে,…

টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে। হেদায়েত টেলিফোন উঠাল।

জি ভাইজান।

আমি কাল ভোরবেলা ময়মনসিংহ যাচ্ছি। যাবি আমার সঙ্গে? রাতে ফিরে আসব।

যাব।

আমি খুব ভোরে রওনা হব। এত ভোরে উঠতে পারবি?

পারব।

না থাক, তোর যাবার দরকার নেই। ট্রাকে করে যাব ড্রাইভারের পাশে বসে যাওয়া। দু’জন বসলে চাপাচাপি হবে। আমার সমস্যা না, তোর কষ্ট হবে।

হেদায়েত বলল, একটা গাড়ি কিনে ফেল।

বেলায়েত বলল, তুই যখন বলছিস তখন কিনে ফেলব। ময়মনসিংহ থেকে ফিরেই কিনব। তোর কোন রঙ পছন্দ।

মেরুন রঙ।

মেরুন রঙ আবার কোনটা। আচ্ছা যা, যেটাই হোক তোকে নিয়ে তোর পছন্দে কিনব। তুই জেগে থাকিস না ঘুমিয়ে পড়। কবিতা আছে না- early to hed, early to rise. শরীর ঠিক রাখা দরকার। শরীর ঠিক থাকলেই মন ঠিক।

বেলায়েত টেলিফোন রাখার পরপরই হঠাৎ করে হেদায়েতের মনে হলোএমন কি হতে পারে যে আত্মার অবস্থান Planck স্তরে? Planck স্তর অতি জটিল স্তর সেখানে সবই এলোমেলো। Planck দৈর্ঘ্য হলো 10^-33 সেন্টিমিটার। Planck সময় হলো 10^-45 সেকেন্ড, ভর হলো 10^-5 gm ভর এত বেশি কেন?

হেদায়েত মূর্তির মতো বসে আছে। Planck ভর সমস্যায় এই মুহূর্তে সে কাতর।

বেলায়েত নিখোঁজ হয়েছে

বেলায়েত নিখোঁজ হয়েছে। ভোরবেলা নিজের ট্রাকে করে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে ময়মনসিংহ গিয়েছিল। কাজ শেষ করে রাত আটটার মধ্যে তার ফেরার কথা। সে ফেরে নি। রাত একটায় ড্রাইভার মোবাইল ফোনে। জানিয়েছে, স্যারের কোনো খোঁজ নাই, এখন কী করি?

বেলায়েতের স্ত্রী হেনা টেনশন নিতে পারে না। সামান্যতে সে অস্থির হয়ে পড়ে। বেলায়েতের খবরে তার বুক ধড়ফর শুরু করল। তার মন বলছে মানুষটা খুন হয়েছে। অবশ্যই খুন হয়েছে। খুন করেছে ড্রাইভার কুদুস। ট্রাকের সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে উপর দিয়ে ট্রাক নিয়ে চলে গেছে। এখন বলছে স্যারের কোনো খোঁজ নাই।

রাত তিনটায় টেলিফোনের পর টেলিফোন করে হেনা, হেদায়েতের ঘুম ভাঙালো। কাঁদতে কাঁদতে বলল, তোমার ভাইয়ের কোনো খবর জানো?

হেদায়েত বলল, না তো। মনে হয় সে খুন হয়েছে।

কে খুন করেছে?

কে খুন করেছে এখনো পরিষ্কার না। ট্রাক ড্রাইভার কুদ্স সম্ভবত খুন করেছে। বাসায় চলে আস বিস্তারিত শুনবে।

ভাবি আমি এক্ষুনি আসছি, আপনি কান্না বন্ধ করেন।

হেনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার স্বামী মারা গেছে আমি কাঁদব না! ঝিম ধরে বসে থাকব! কী রকম কথা বলো!

 

হেদায়েত তার ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেখে প্রচুর লোকজন। হেনা তার আত্মীয়স্বজন সবাইকে খবর দিয়ে এনেছেন। একজন পুলিশ অফিসারও (ধানমণ্ডি থানার সেকেন্ড অফিসার) এসেছেন। পরিমল বাবু পুলিশের সঙ্গে কথা বলছেন। হেনার কথা বলার মতো অবস্থা না। সে কিছুক্ষণ পর পর এলিয়ে পড়ে যাচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ফেনা ভাঙছে।

সেকেন্ড অফিসার বিরক্ত গলায় বললেন, একজন মানুষের খবর পাওয়া যাচেছ না চব্বিশ ঘণ্টাও পার হয় নাই, আপনারা এরকম কেন করছেন?

পরিমল বাবু বললেন, স্যার, উনি কখনও রাতে ঢাকার বাইরে থাকেন না। নিজের ঘরে না শুলে তার ঘুম আসে না। এই জন্যই দুশ্চিন্তা।

দুশ্চিন্তা দূর করুন। ময়মনসিংহের তার যেসব আত্মীয়স্বজন আছে তাদের বাড়িতে খোঁজ নিন। তাঁর সঙ্গে কি মোবাইল ফোন সেট আছে?

জি স্যার আছে।

টেলিফোন করে দেখেছেন?

জি স্যার। রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না।

আমাকে নাম্বারটা দিন। আমি টেলিফোন করে দেখি! নাম্বার কত?

নাম্বার হেদায়েত বলল। তার সব নাম্বারই মুখস্থ। হেদায়েতের কাছেই জানা গেল যে, তার বড় ভাইয়ের দু’টা মোবাইল সেট। একটা সাধারণ ব্যবহারের জন্যে, অন্যটা শুধু তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য। দুটা নাম্বারেই চেষ্টা করা হলো। রিং হয় কিন্তু কেউ ধরে না।

সেকেন্ড অফিসার বললেন, হয়তো মোবাইল সেট রেখে কোথাও গেছেন। কিংবা সেট দু’টা ছিনতাই হয়েছে। আপনারা দুশ্চিন্তা করবেন না। ময়মনসিংহ থানায় আমি খবর দিয়ে দিচ্ছি। ট্রাক ড্রাইভার কুদুসকে বলুন যেন সে তার স্যারের জন্যে অপেক্ষা করে।

হেনা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, কুদুসকে এ্যারেস্ট করবেন না?

সেকেন্ড অফিসার বিরক্তি গলায় বললেন, তাকে এ্যারেস্ট করার সময় পার হয়ে যায় নি। অল্পতে অস্থির হবেন না প্লিজ। আমি নিশ্চিত কাল দিনের মধ্যে আপনার স্বামী ফেরত আসবেন।

 

সাতদিন পার হয়ে গেল, বেলায়েতের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। এখন আর মোবাইলেও কোনো রিং হয় না। হেদায়েত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাইকে খোঁজে। পথে পথে হাঁটে। বেশির ভাগ দিন তার সঙ্গে পরিমল বাবু থাকেন। তিনি অদ্ভুত অদ্ভুত জায়গায় খুঁজতে যান। যেমন বুড়িগঙ্গা নদীর নৌকা, নারায়ণগঞ্জ উর্দু বস্তি নামের এক বস্তি।

অদ্ভুত অদ্ভুত কথাও বলেন। যেমন একদিন বললেন, আমার ধারণা স্যার বিবাগী হয়েছেন।

হেদায়েত বলল, বিবাগী কেন হবেন?

সংসারে শান্তি ছিল না। এই জন্যে বিবাগী হয়েছেন। মাডামের সঙ্গে খেঁচাখেছি ছিল। সংসারে শিশু ছিল না। পিতা-মাতা হলো ইট। আর শিশু সিমেন্ট। দুই ইট আটকায়ে রাখে।

হেদায়েত বলল, ভাইজান বিবাগী হয়ে কোথায় যাবেন?

পরিমল বাবু বললেন, আগে বিবাগী হয়ে পুরুষ মানুষ আসাম চলে যেত। কামরূপ কামাক্ষ্যা। এখন পাসপোর্টের ঝামেলার কারণে দেশেই থাকে। সাধারণত পতিতাপল্লীতে আশ্রয় নেয়। মনের মতো মেয়ে খুঁজে বের করে সংসার পাতে।

বলেন কি!

আপনি চিন্তা করবেন না। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দেশের সব কটা পতিতাপল্লীতে অনুসন্ধান করব। নিজেই যাব।

কবে যাবেন?

ঢাকার খোঁজটা শেষ করে শুভদিন দেখে রওনা হব। প্রথম যাব টাঙ্গাইল। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পতিতাপল্লী টাঙ্গাইলে। সেখানে কিছু মেয়ে আছে অত্যাধিক রূপবতী। আবার কুহকিনী। মায়াজালে আটকায়ে ফেলে।

 

মৃত্যু শোক সাতদিনের বেশি স্থায়ী হয় না। কারণ সবাই জানে, যে গেছে সে আর ফিরবে না। নিখোঁজ শোক দীর্ঘস্থায়ী হয়। কারণ একটাই, নিখোঁজ ব্যক্তির ফিরে আসার সম্ভাবনা। আনন্দের সম্ভাবনাই সেখানে শোকের প্রধান কারণ।

স্বামী নিখোঁজ হওয়ায় হেনার বড় ধরনের উপকার হয়েছে। তার শরীর শুকিয়ে গেছে। চেহারায় সৌন্দর্য এবং লাবণ্য ফিরে এসেছে। স্বামীর নানান ব্যবসায় হাল ধরার জন্যেও প্রচুর ছোটাছুটি করছে। বেলায়েতের লোকজন কেউই তাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে না। এই মনকষ্টে সে আরো শুকাচ্ছে।

তার বাড়িতে মুনসি হাফিজ নামের এক মাওলানা স্থায়ী হয়েছেন। তিনি জিন সাধক এবং তার অধীনে সার্বক্ষণিক সঙ্গীর মতো একজন জিনও না-কি থাকে। জিনের নাম হাফসা।

হেনা চেষ্টা করছে হাফসা জিনের মাধ্যমে স্বামীর সংবাদ বের করতে। প্রায় প্রতিদিনই জিনের আসর বসছে।

পঞ্চাশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়ছে। রোজই নানান ধরনের লোকজন খোঁজ নিয়ে আসছে। সবার কথাই বিশ্বাস করার মতো। হেনা এদেরকে নিয়েও ব্যতিব্যস্ত। তার এখন নিঃশ্বাস ফেলারও সময় নেই। তাকে দেখে মনে হয় সে আনন্দেই সময় কাটাচ্ছে। হেনা একজন সেক্রেটারি রেখেছে। এম, এ, পাশ সেক্রেটারি। নাম শারমিন। এই সেক্রেটারি পুরুষ হলে মিস্টার বাংলাদেশ হত। এমন পুষ্ট শরীর। সে পেটমোটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে সারাক্ষণই হেনার সঙ্গে আছে।

নতুন করে এডমিনস্ট্রেশন শুরু করতে গিয়ে হেনা কয়েকজনের চাকরি খেয়েছে। তার একজন হচ্ছে পরিমল বাবু। তাঁকে চাকরি চলে যাওয়ায় মোটেই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। বাসা ছেড়ে দিতে হয়েছে বলে তিনি এখন বেলায়েত টিম্বারের অফিসে ঘুমান। তিনি হেদায়েতকে সঙ্গে নিয়ে স্যারকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন এবং একেকদিন একেক গল্প ফাঁদছেন।

প্রাণীকুলের মধ্যে ভেড়া যাবে স্বর্গে আর ছাগল হবে নরকবাসী, এটা কি জানেন?

না।

ম্যাথুর গসপেলে পরিষ্কার লেখা আছে।

আপনি খ্রিস্টান না-কি?

না। কিছুদিন এক পাদ্রীর সঙ্গে ছিলাম। তাঁর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমার স্বভাবই হলো, যার সঙ্গে থাকি তার কাছে থেকেই কিছু না কিছু শিখি।

ভাইজানের কাছ থেকে কী শিখেছেন?

উনার কাছ থেকে কিছু শিখতে পারি নাই। কারণ উনার ছিল ভালোমানুষি। এটা শেখা যায় না। জন্মসূত্রে নিয়া আসতে হয়। আপনার কাছ থেকে কী শিখেছি শুনবেন?

না।

মানুষ শুধু যে মানুষের কাছ থেকে শিখবে তা-না। পশুপাখির কাছ থেকে অনেক কিছু শেখা যায়। কাকের মতো নিকৃষ্ট যে পাখি, তার কাছেও অনেক কিছু শেখার আছে। কাক সবার সামনে ময়লা খায় না। আড়ালে খায়। কাকের কাছ থেকে এইটাই শিক্ষণীয়।

সারাদিন হাঁটাহাঁটি করে সন্ধ্যায় হেদায়েত ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে। গরম পানিতে গোসল সেরে টিভি দেখতে বসে। সে চ্যানেল টিপাটেপি করে না। টিভি চালু করার পর যে চ্যানেল আসে সেটাই দেখে। আগ্রহ নিয়েই দেখে। রাত নটায় টিফিন কেরিয়ার করে হোটেল থেকে খাবার আসে। হোটেলের বয় নান্টু (বয়স ১০) খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত দাড়িয়ে থাকে। খাওয়া শেষে থালাবাসন ধুয়ে সে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে চলে যায়। যতক্ষণ খাওয়া না হয় ততক্ষণ সে হেদায়েতের পাশেই সোফায় বসে টিভি দেখে।

 

অনেকদিন পর সেতু টেলিফোন করল। হেদায়েত আনন্দিত গলায় বলল, ভালো আছ?

হ্যাঁ। তুমি কেমন আছ?

আমি ভালো আছি। তোমাদের ছবির কাজ কি শুরু হয়েছে?

হা। এই জন্যেই এতদিন তোমাকে টেলিফোন করা হয় নি। দেশের বাইরে ছিলাম সাতদিন। ব্যাংককে একটা গানের পিকচারাইজেশন হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে।

হেদায়েত বলল, ছবির নামের অর্থটা কী বলো তো – দ্বিতীয় কদম ফুল মানে কী?

সেতু বলল, প্রথম এই নাম ছিল। রবিন ভাইয়ের দেয়া নাম। রবীন্দ্রনাথের গান থেকে নেয়া। এখন নাম চেঞ্জ হয়েছে। এখন ছবির নাম ‘দুষ্ট প্রজাপতি’। নাম সুন্দর না?

বুঝতে পারছি না, সুন্দর কি-না।

কমার্শিয়াল ছবির জন্যে খুব সুন্দর নাম। ভালো কথা, নাদুর মা ঠিকমতো কাজ করছে?

ও তো চলে গেছে।

বল কি! আমাকে তো কিছু বলো নি। কবে গেছে?

মনে নাই কবে গেছে।

তোমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কী?

হোটেল থেকে খাওয়া আসে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

রাতে ঘুম ভালো হচ্ছে?

খুব ভালো ঘুম হচ্ছে। সারাদিন খুব পরিশ্রম করি তো, এই জন্যে রাতে বিছানায় যাওয়া মাত্র ঘুম।

কীসের এত পরিশ্রম?

সারাদিন হেঁটে হেঁটে ভাইজানকে খুঁজি। উনি হারিয়ে গেছেন এই জন্যেই খুঁজা।

বলো কি? কত দিন আগের ঘটনা?

প্রায় এক মাস। সেতু আমি রাখি। খুব ঘুম পাচ্ছে।

হেদায়েত টেলিফোন রেখে ঘুমুতে গেল। ঘুমুতে যাওয়টি এখন তার জন্যে অনেক আনন্দময় হয়েছে। সারাদিনের পরিশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হয় ঘুমের ওষুধ। আরামদায়ক তন্দ্রা নিয়ে আত্মা ইকুয়েশনের চিন্তা। টাইম ইনডিপেনডেন্ট ইকুয়েশন বের করতে হবে। কারণ আত্ম সময় নির্ভর না। আচ্ছা পশু-পাখি এদের কি আত্মা আছে? নিম্ন শ্রেণীর আত্মা। এদের বোধশক্তি কিছু পরিমাণে আছে। বোধ কি আত্মার কোনো ধর্ম?

আবার টেলিফোন বাজছে। সেতু কি আবার করেছে? না-কি ভাইজান? ভাইজান হবার সম্ভাবনা কতটুকু? হেদায়েতের ঘুম পুরোপুরি কেটে গেল।

হ্যালো?

স্যার আমি নীতু।

ও আচ্ছা। আমি ভেবেছিলাম ভাইজান টেলিফোন করেছেন।

স্যার আমি টেলিফোন করতাম না খুব জরুরি কারণে টেলিফোন করেছি। সময় জানার জন্যে টেলিফোন করেছি। আমার ঘরে কোনো ঘড়ি নেই। মা’র ঘরে ঘড়ি। মা দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছেন। আমি তো ঘুম থেকে ডেকে তুলে সময় জিজ্ঞেস করতে পারি না।

এখন বাজছে এগারোটা দশ।

ও এত কম? আমি ভেবেছি বারটার উপর বাজে। সার Thank you সময় বলার জন্যে। আপনি কি এখন ঘুমুতে যাবেন?

হ্যাঁ।

আমার ঘুম আসছে না। স্যার কী করি বলুন তো?

ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়।

ঘুমের ওষুধ কই পাব? মা’র কাছে অবশ্যি আছে। আমি যদি মার কাছে ঘুমের ওষুধ চাই তাহলে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে।

তাহলে না ঘুমিয়ে রাত পার করে দাও।

ম্যাডাম কেমন আছেন স্যার?

ভালো আছে।

আসল কথা বলতে ভুলে গেছি। স্যার আমি আপনার বাসায় গিয়েছিলাম।

ঠিকানা কোথায় পেয়েছ?

ঠিকানা তো আপনিই দিয়েছেন। স্যার আপনার এত ভুলো মন কেন? আপনি হচ্ছেন Absent minded professor, আচ্ছা, স্যার আপনি কি Absent minded professor ছবিটি দেখেছেন?

না।

খুবই হাসির ছবি। হাসতে হাসতে আপনার দম বন্ধ হয়ে যাবে। হেঁচকি উঠে যাবে। Walt disney-র ছবি। ছবিটার একটা DVD আমার কাছে আপনি চাইলে আপনাকে দিতে পারি।

দরকার নেই। নীতু আমি এখন শুয়ে পড়ব।

এত সকাল সকাল কেন ঘুমিয়ে পড়বেন? এখন তো ইচ্ছা করলেই আপনি রাত জাগতে পারেন। সকালে উঠে কলেজে দৌড়াতে হবে না। আচ্ছা ঠিক আছে, ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনি আরাম করে ঘুমাবেন আর আমি জেগে থাকব। কী বিশ্রী! স্যার শেষ এক মিনিট কথা বলি?

বলো।

আমি এমন একটা মিসটেক করেছি, বুঝতে পারার পর নিজের গালে নিজে কয়েকবার চড় মেরেছি। তবে তাতে তো আর কোনো লাভ হবে না। মিসটেকটা হচ্ছে- বান্ধবীদের সঙ্গে আপনার বাসায় আসার ব্যাপারটা গল্প করেছি। এরা তার অন্য মিনিং বের করেছে।

কী মিনিং?

খারাপ মিনিং।

খারাপ মিনিংটা কী?

এটা স্যার আমি অপানাকে বলতে পারব না। আমার বয়েসী মেয়েরা তো গসিপ পছন্দ করে। এই গসিপটা খুব ছড়িয়েছে।

নীতু রাখি। ঘুমে আমার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আচ্ছা। স্যার ঘুমান।

হেদায়েত বিছানায় শোয়া মাত্র আবার টেলিফোন বেজে উঠল। আজ মনে হয় টেলিফোন দিবস। সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি লাইনটা খুলে রাখা। হেদায়েত আবার উঠে টেলিফোন ধরল। হ্যালো। কে?

কেউ কথা বলছে না। ওপাশ থেকে শো শো শব্দ আসছে। শঙ্খে কান রাখলে যেমন শব্দ আসে তেমন শব্দ। হেদায়েত বলল, কে ভাইজান?

ক্ষীণ স্বরে কেউ একজন যেন বলল, হুঁ।

ভাইজান তুমি কোথায়? হ্যালো হ্যালো।

আর কোনো শব্দ আসছে না। এমন কী হতে পারে যে ভাইজান টেলিফোন পর আছেন, কোনো কারণে কথা বলতে চাচেছন না। হেদায়েতের উচিত কথা চালিয়ে যাওয়া।

ভাইজান আমরা ভালো আছি। তুমি কোথায় লুকিয়ে আছ? ভাবি খুব দুশ্চিন্তা করছেন। তোমার সমস্যাটা কী আমাকে বলো। আমাদের খবর ভালো। তবে আমি মনে হয় পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি ঠিক করেছি এখন থেকে ডায়েরি লিখব। এতে প্রতিদিনকার কথা লেখা থাকবে। ধীরে ধীরে কীভাবে পাগল হচ্ছি সেটা বোঝা যাবে।

সেতু ভালো আছে। তার ছবিটার নাম বদল হয়েছে। তারা একটা কমার্শিয়াল নাম দিয়েছেন— দুষ্ট প্রজাপতি। সিনেমার কারণে সেতু তার নিজের নাম বদলে রেখেছে দিলরুবা। সিনেমা জগতের নিয়ম হচ্ছে, পুরনো সব ফেলে দিয়ে নতুন করে সব করতে হয়। বিবাহিতা মেয়েদের ছবি দর্শক দেখে না। এই কারণে দিলরুবা অর্থাৎ সেতু হয়তো বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে যাবে। আমি এখনও নিশ্চিত না।

তোমার খোঁজ লাগানোর আমরা নানান চেষ্টা করছি। কোনোটাতে লাভ হচ্ছে না। তোমার বাসায় একজন জিন সাধক রাখা হয়েছে। তার নিজস্ব পোষা জিন আছে। জিনের নাম হাফসা। জিন সাধক রোজই হাফসাকে নানান জায়গায় পাঠাচ্ছেন। সে এখনও কোনো খবর আনতে পারছে না। আমার কাছে পুরো বিষয়টাই মিথ্যা বলে মনে হচ্ছে। তোমার কী ধারণা?

তোমার কাষ্ঠ বিতানে একদিন গিয়েছিলাম। সেখানে তোমার একটা অদ্ভুত ক্ষমতার কথা শুনে মুগ্ধ হয়েছি। তুমি না-কি চোখ বন্ধ করে শুধু কাঠের গন্ধ কে বলতে পার এটা কোন গাছের কাঠ?

হ্যালো। ভাইজান হ্যালো। আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? হেনা ভাবির একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, উনি রোগা হয়ে গেছেন। দেখলে তুমিও চিনতে পারবে না। BMা স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে এসেছে বলে আমার ধারণা। যদিও আমি মাপি নাই। BMI মনে আছে তো বডি মাস ইনডেক্স। আঠারো থেকে বিশের মধ্যে হবার কথা। কিলোগ্রামে শরীরের ওজনকে বড়ি মাসের স্কয়ার দিয়ে ভাগ করতে হবে।

হ্যালো। হ্যালো। ভাইজান হ্যালো।

 

হেদায়েতের লেখা প্রথম দিনের ডায়েরি

আজ ২১ তারিখ। একুশ সংখ্যা হিসাবে খারাপ না। তিন এবং সাত দিয়ে বিভাজ্য। পিথাগোরাসের মতে, তিন এবং সাত এই দুটি সংখ্যাই Magical. নিউমারোলজিতে একুশ হলো তিন। তারা ২১-কে ২+১ হিসেবে তিন করে। এটি একটি হাস্যকর প্রক্রিয়া।

ভাইজান নিখোঁজ আছেন সতেরোদিন ধরে। সতেরো একটা প্রাইম সংখ্যা। এবং আমার খুবই পছন্দের সংখ্যা। এক এবং সাতে সতেরো। এখানে এক যেমন প্রাইম সংখ্যা, আবার সাতও প্রাইম সংখ্যা। আলাদা দুটি প্রাইম সংখ্যায় নতুন একটি প্রাইম সংখ্যা হচ্ছে। ব্যাপারটা আনন্দজনক।

যাই হোক ভাইজানের খোঁজ না পাওয়ায় নানান সমস্যা শুরু হবে। আমি ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে পারব না। মাসের তিন তারিখে (আরেকটা প্রাইম সংখ্যা) ফ্ল্যাটের ভাড়া দিতে হয়। এই কাজটা আগে ভাইজান করতেন। আমাকে মনে হয় ভাইজানের কলাবাগানের বাড়িতে উঠতে হবে। পরিমল বাবু আমাকে এই উপদেশ দিলেন। তিনি বললেন, নিজের ভাইয়ের বাড়িতে উঠবেন সমস্যা কি!

সামান্য সমস্যা আছে। হেনা ভাবি চাচ্ছেন না আমি তার বাড়িতে উঠি। তিনি বলেছেন— আমি নিজের যন্ত্রণায় অস্থির। তুমি নতুন যন্ত্রণা নিয়ে আসবে। আমার হাতে নাই টাকাপয়সা। ব্যাংকে তোমার ভাইয়ের একাউন্ট তার নিজের নামে। একটা পয়সা তুলতে পারছি না। তোমার ভাইয়ের বিজনেস থেকে একটা পাই পয়সা আসছে না। শাড়ি-গয়না বেচে খাচ্ছি। তুমি এই বাড়িতে উঠধে না। এটা আমার সোজা কথা।

পরিমল বাবুকে হেনা ভাবির কথা কিছু বলি নাই। এতে ভাবির বদনাম করা হয়। স্বামী নিখোঁজ, এই কারণে দ্রমহিলা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। মানসিক বিপর্যস্ত একজন মানুষ অনেক অর্থহীন কথা বলতে পারেন।

আমি যে খুব চিন্তিত তাও না। তেমন সমস্যা হলে ভাইজানের মতো নিখোঁজ হয়ে যাব। সব মানুষেরই নিখোঁজ হবার Option থাকলে ভালো হতো।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স প্যারালাল পৃথিবীর কথা বলে। নিখোঁজ হওয়া মানে এক পৃথিবী থেকে অন্য পৃথিবীতে চলে যাওয়া।

এখন বাজে এগারোটা সাত (দু’টাই প্রাইম সংখ্যা)। কিছুক্ষণ আগে চা খেয়ে পত্রিকা পড়েছি। পত্রিকার বিনোদন পাতায় দিলরুবার (সেতু) একটা ইন্টারভিউ পড়েছি। ইন্টারভিউ’র মাধ্যমে জানলাম তার পছন্দের রঙ সবুজ। কারণ আমাদের প্রফেট (দঃ) সবুজ রঙ পছন্দ করতেন। তিনি সবুজ রঙের পাগড়ি এবং জোব্বা পরতেন। বিষয়টা আমার জানা ছিল না।

দিলরুবার পছন্দের খাবার যে শুটকি এটাও জানতাম না। আমি জানতাম সে শুঁটকির গন্ধই সহ্য করতে পারে না। হয়তো এখন খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে।

আজ এই পর্যন্তই। পরিমল বাবু চলে এসেছেন। আমাকে ভাইজানের সন্ধানে যেতে হবে। পরিমল বাবু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। বেচারার হাঁটুতে কী যেন সমস্যা হয়েছে।

পরিমল বাবুকে জিজ্ঞেস করতে হবে, যিশুখ্রিস্টের প্রিয় রঙ কী? পরিমল বাবু খ্রিস্টান ধর্ম সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন।

একচল্লিশ দিন পার হয়েছে

একচল্লিশ দিন পার হয়েছে বেলায়েতের কোনো খোঁজ নেই। জিন হাফসা জানিয়েছে বেলায়েত বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়াতে আছে। তার শরীর সামান্য

হেদায়েতকে ফ্ল্যাটবাড়ি ছেড়ে দিতে হয়েছে। বাড়িওয়ালা পাওনা ভাড়া বাবদ ফ্লাটের সবকিছু রেখে দিয়েছে। শুধু হাওয়াই মিঠাই বানানোর যন্ত্রটা ফেরত দিয়েছে। হেদায়েত এখন পরিমল বাবুর সঙ্গে বেলায়েত টিম্বারের অফিস ঘরে থাকে। দুজনই তিনবেলা দি নিউ বিরানী হাউস এন্ড রেস্টুরেন্টে খায়। এই ফ্রি খাওয়াও বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। হেনার সেক্রেটারি মিস শারমিন বিষয়টা একেবারেই পছন্দ করছেন না। তিনি হেদায়েতকে সরাসরি বলেছেন, আপনার ভাই বেলায়েত সাহেব যখন নিজের রেস্টুরেন্টে খেতেন তখন পয়সা দিয়ে খেতেন। সেখানে দিনের পর দিন আপনি ফ্রি খেতে পারেন। না। আপনি যে একা খাচ্ছেন তা-না, একজন সঙ্গীও আছে। সে আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত না। সে কীভাবে ফ্রি খাচ্ছে?

হেদায়েত বলল, ভাবি কি খেতে নিষেধ করেছেন?

শারমিন বলল, উনি শোকে কাতর একজন মহিলা। সব দিক দেখা তার পক্ষে সম্ভব না। রেস্টুরেন্টটা পুরোপুরি আমি দেখছি। তবে ম্যাডাম বলেছেন, ফ্রি খাওয়া-খাওয়ি বন্ধ।

হেদায়েত বলল, আমরা কোথায় খাব?

সেটা আপনারা জানেন। আমি কী করে বলব? পরিমল বাবু যে বেলায়েত টিম্বারে থাকেন এটা ম্যাডামের খুবই অপছন্দ। অফিস ঘুমানোর জায়গা না।

উনার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নাই।

এই বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আপনার কিছু বলার থাকলে ম্যাডামকে বলুন। আমার কাছে সুপারিশ করে কিছু হবে না। সরি!

হেদায়েত হেনার সঙ্গে দেখা করতে গেল। পরিমল বাবু বাসার সামনে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে লাগলেন। হেদায়েত কী খবর নিয়ে আসে তার জন্যে অপেক্ষা। কোনো সুখবর আসবে সে-রকম মনে হচ্ছে না। আজ সকালের নাশতা খাওয়া হয়েছে। দুপুরের কোনো ব্যবস্থা হয় নি।

হেনা চোখমুখ শক্ত করে সোফায় বসে আছে। অতি কদাকার দেখতে এক মহিলা তার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। মনে হয় আরামদায়ক অবস্থা, কারণ হেনার চোখ বন্ধু।

হেনা বলল, তুমি সমস্যায় আছ সেটা আমি শুনব। কিন্তু পরিমন বাবুটা কে? তার বিষয়ে দরবার করতে এসেছ কেন?

হেদায়েত বলল, বেচারার কেউ নাই। ভাইজান ফিরে না আসা পর্যন্ত থাকুক।

তোমার ধারণা তোমার ভাইজান ফিরে আসবে?

জি।

যে একচল্লিশ দিনে ফেরে না সে একচল্লিশ বছরেও ফেরে না। বুঝেছ?

হেদায়েত বলল, বুঝতে পারছি না। একচল্লিশ দিনের সঙ্গে একচল্লিশ বৎসরের সম্পর্ক বুঝতে পারছি না। অবশ্য ৪১ একটা প্রাইম নাম্বার। ৪১ বৎসর হচ্ছে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। ৬ ঘণ্টা হিসাবে ধরা হয় না। প্রতি চার বছরে একবার হিসাবে আসে। তখন হয় ৩৬৬ দিনে বৎসর।

হেনা বলল, বকবকানি বন্ধ কর। হাজার যন্ত্রণায় অস্থির, তুমি শুরু করেছ বৎসরের হিসাব। মাথা কি পুরোপুরি গেছে?

হেদায়েত চুপ করে রইল। ভাবিকে তার খুব অচেনা লাগছে। মনে হচ্ছে অচেনা একজন মহিলা।

হেনা বলল, তোমার বিষয়ে এই মুহূর্তে কিছু করতে পারছি না। কোর্ট থেকে পাওয়ার অব এটর্নি বের করার চেষ্টা করছি। বের করতে পারলে তোমার ভাইয়ের একাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারব। তখন তোমার বিষয়ে কিছু করার চেষ্টা করব। বুঝেছ? এখন যাও। সকাল থেকে আমার মাথায় যন্ত্রণা। প্রেসারের ওষুধও এখন দুইবেলা খেতে হয়, বুঝেছ? এখন যাও।

হেদায়েত বলল, ভাইজানের রেস্টুরেন্টে কি খেতে পারব ভাবি?

হেনা জবাব দিল না। সামনে থেকে উঠে গেল। তার মানে হ্যাঁ  না-কি না এটা পরিষ্কার হচ্ছে না। না হলে মুখে সরাসরি না বলত।

 

হেদায়েত পরিমল বাবুর সঙ্গে র্যাংগস ভবনের সামনের ঝরনার পাশে বসে আছে। এখান থেকে রাংগস ভবন ভাঙার দৃশ্য দেখা যায়। হেদায়েততের সিগারেট খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। সঙ্গে সিগারেট নেই।

পরিমল বাবু বললেন, দুশ্চিন্তা করবেন না।

হেদায়েত বলল, দুশ্চিন্তা করছি না। সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে।

পরিমল বাবু বললেন, সিগারেটের ব্যবস্থা করছি।

কীভাবে করবেন?

সিগারেট ভিক্ষা চাইব। টাকা ভিক্ষার মধ্যে লজ্জা আছে। সিগারেট ভিক্ষায় লজ্জা নেই। কারণ সিগারেট ক্ষতিকর জিনিস।

পরিমল বাবু উঠে গেলেন এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন। তাঁর হাতে দু’টা সিগারেট। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, একটা এখন খান আরেকটা খাবেন লাঞ্চের পরে।

লাঞ্চ কোথায় করব?

স্যারের রেস্টুরেন্টেই করব। গলা ধাক্কা দিয়ে বের না করে দেয়া পর্যন্ত সেখানেই যাব। দুঃসময়টা আপনার জন্যে কী রকম ভালো হয়েছে লক্ষ করেছেন?

কী ভালো হয়েছে?

আপনার ভাই কোথায় আছে, তার কী হয়েছে এটা নিয়ে এখন আর চিন্তা করছেন না। এখনকার একমাত্র চিন্তা খাব কী? কোথায় খাব?

হেদায়েত বলল, ভাইজানকে নিয়ে আমি রাতে চিন্তা করি। দিনে করি না।

সেটা ভালো। চিন্তার জন্যে রাত্রি উত্তম। আচ্ছা আপনার কাছে তো হাওয়াই মেঠাই বানানোর যন্ত্রটা আছে।

জি আছে।

বিশটা হাওয়াই মেঠাই আমাকে বানিয়ে দিন। আমি বিক্রি করব। বানাতে পারবেন না?

পারব। বিশটা না বানিয়ে উনিশটা বানাই?

উনিশটা কেন?

উনিশ একটা প্রাইম নাম্বার।

ও আচ্ছা। আপনার তো আবার প্রাইমের ঝামেলা আছে। বানান উনিশটাই বানান।

 

দিলরুবা ম্যাডামের আজ সারাদিনে দু’টা মাত্র শট। প্রথমটা হয়ে গেছে। দ্বিতীয়টা কিছুক্ষণের মধ্যে হবে। আয়োজন চলছে। দোলনার শট। নায়িকা দোলনায় দুলছে। নায়ক পেছন থেকে ধাক্কা দিয়ে দোলনা দোলাচ্ছে। এক পর্যায়ে ধাক্কা বেশি হয়ে গেল। নায়িকা দোলনা থেকে পড়ে ব্যথা পেল। তার নাক দিয়েও রক্ত পড়তে লাগল। তখন একে অন্যকে দেখে হাসতে শুরু করল। এই হাসি থেকে গানের শট চলে যাওয়া হবে—

সব ফুল যদি ফাল্গুনে ফোটে
শ্রাবণে ফুটবে কী?
ভালোবাসা যদি তোমার আমার
তাহাদের গতি কী?

গানের কয়েকটা শটও আজ হওয়ার কথা ছিল। ড্যান্স ডিরেক্টর আসে নি বলে হবে না। শুটিং প্যাক আপ হয়ে যাবে। রবিন সেতুকে নিয়ে বড় কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে যাবেন। আজ রবিনের জন্মদিন।

রবিন চলে এসেছেন। দোলনার শটটা এক্ষুনি শুরু হবে। মেকআপম্যান শেষবারের মতো মেকআপ ঠিকঠাক করছেন। রবিন মেকআপ রুমে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘আজ আসার পথে মজার এক দৃশ্য দেখলাম। দৃশ্যটা তোমার সঙ্গে শেয়ার করব কি-না বুঝতে পারছি না। তোমার তো মেজাজের কোনো ঠিক নেই, কীভাবে নেবে কে জানে!

সেতু বলল, আমাকে কিছু বলার দরকার নেই।

রবিন বললেন, হেদায়েত সাহেবকে দেখলাম ছোটাছুটি করে হাওয়াই মেঠাই বিক্রি করছেন। আমার কাছেও এসেছিলেন। আমাকে চিনতে পারেন নি।

সেতু বলল, ও আচ্ছা।

তার চেহারায় কোনো ভাবান্তর হলো না। আয়নায় নিজের চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল।

ব্যাপারটা মনে হয় তোমার কাছে তেমন ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে না।

সেতু বলল, ওর আবার শুটিং দেখার শখ ছিল। তুমি এক কাজ কর, তাকে নিয়ে এসো শুটিং দেখবে।

এখন যাব?

তোমাকে যেতে হবে না। ড্রাইভারকে পাঠাও।

বাদ দাও তো, পরে দেখা যাবে।

সেতু রবিনের দিকে তাকাল। কঠিন দৃষ্টি। তারপর সেই দৃষ্টি মুহূর্তেই স্বাভাবিক করে বলল, যা করতে বলেছি কর।

রবিন বললেন, এখন গেলে তো পাওয়া যাবে না।

সে বলল, পাওয়া যেতেও তো পারে।

রবিন বলল, শুটিং দেখার ব্যাপারটা অন্য একদিন করলে হয় না? আমরা খেতে যাব।

সেতু বলল, সেও যাবে আমাদের সঙ্গে। জন্মদিনের উৎসবে একজন বাড়তি মানুষ থাকল। There is compary.

তার সঙ্গে আরো একজনকে দেখলাম। বৃদ্ধ।

বৃদ্ধও আমাদের সঙ্গে যাবেন।

 

হেদায়েতকে যথেষ্টই আনন্দিত মনে হচ্ছে। উনিশটা হাওয়াই মেঠাইয়ের মধ্যে এগারোটা বিক্রি হয়ে গেছে। বারো নম্বরটা মনে হয় এখন বিক্রি হবে। মেয়েটা যেভাবে অবাক হয়ে তাকাচ্ছে— সে না কিনেই পারে না।

হেদায়েত বলল, নতুন ধরনের কিছু হাওয়াই মেঠাই আছে—-ঝাল-মিষ্টি। ট্রাই করে দেখবেন?

মেয়েটা গাড়ি থেকে নেমে এসে বলল, স্যার আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি?

না।

স্যার আমি আপনার ছাত্রী। আমার নাম মাহজাবিন। রোল উনিশ।

হেদায়েত অবাক হয়ে বলল, খুবই আশ্চর্য ব্যাপার! আমি হাওয়াই মেঠাই বানিয়েছিলাম উনিশটা। এর মধ্যে এগারোটা বিক্রি হয়ে গেছে। তুমি যদি একটা কেন তাহলে বারোটা বিক্রি হয়ে যাবে। থাকবে সাত। সাত একটা প্রাইম নাম্বার। ‘মায়াদের কাছে সাত ছিল অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ সংখ্যা। ওরা সবসময় সাতজন করে মানুষ বলি দিত।

স্যার, আপনি হাওয়াই মেঠাই বিক্রি করছেন কেন?

হেদায়েত বলল, বিপদে পড়েছি। মহা বিপদে বলতে পার। চাকরি নেই, ওইদিকে ভাইজান নিখোঁজ। ভাইজানের রেস্টুরেন্টে খেতাম। সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। হাওয়াই মেঠাই বিক্রি করে যে টাকাটা পাব সেটা দিয়ে লাঞ্চ খাব। ভাইজানের রেস্টুরেন্টেই খাব তবে পয়সা দিয়ে খাব। ভালো কথা তুমি কাঁদছ কেন?

মাহজাবিন চোখ মুছতে মুছতে বলল, আমি কেন কাঁদছি জানি না স্যার।

হাওয়াই মেঠাই কিনবে?

জি না স্যার।

আচ্ছা ঠিক আছে। রোল নাম্বার নাইনটিন, ভালো থেকো। আসল কথা তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি তো— এই জন্যে মাঝে মাবো হ্যালোসিনেশনের মতো হয়। একটা মেয়েকে মাঝে মাঝে দেখি। মেয়েটার চেহারার সঙ্গে তোমার অদ্ভুত মিল।

স্যার, আপনি কোথায় থাকেন, ঠিকানাটা একটু বলবেন?

হেদায়েত বলল, এত দিন থাকতাম বেলায়েত টিম্বার নামের একটা দোকানে। আজ থেকে অন্য কোথাও থাকব। পরিমল বাবু ব্যবস্থা করবেন। তুমি চলে যাও, তোমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আমার বিক্রি বন্ধ।

 

সেতুরা খেতে গেছে শেরাটন হোটেলে। সুইমিং পুলের পাশেই রেস্টুরেন্ট। লাঞ্চ শুরুর আগে রবিন ব্লাডি মেরি নিয়েছেন। গরমে ব্লাডি মেরি খেতে ভালো লাগছে। রবিন বললেন, তুমি একটা ব্লাডি মেরি ট্রাই করবে?

সেতু বলল, না।

রবিন বললেন, তোমার আজকের অভিনয় দেখে খুব ভালো লাগল। এরকম একটা ডিফিকাল্ট সিকোয়েন্স এক টেকে মেরে দেবে চিন্তাই করি নি।

সেতু বলল, থ্যাংক য়্যু।

রবিন বললেন, হেদায়েত সাহেবকে খুঁজে পেলে ভালোই হতো। দুজন আসলেই খালি খালি লাগছে। ঐ রাস্তায় দু’বার আসা-যাওয়া করেছি। নো ট্রেস।

সেতু বলল, তুমি ওখানে যাও নি। মিথ্যা করে বললে গিয়েছিলে।

কে তোমাকে বলল, যাই নি?

আমি প্রডাকশনের একটি ছেলেকে গাড়ি দিয়ে তোমার পেছনে পেছনে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছে তুমি গাড়ি নিয়ে বের হয়ে রমনা গ্রিনের দিকে কিছুদূর গিয়েছ। গাড়ি থেকে নেমে একটা সিগারেট খেয়েছ, তারপর ফিরে এসেছ।

রবিন চুপ করে রইলেন। সেতু বলল, আমাকে একটা ব্লাডি মেরি দিতে বলো।

 

রাত এগারোটা।

হেনা হতভম্ব হয়ে বসে আছে। তার শরীরে জ্বলা রোগ শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে মাথাঘোরা। নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে তার সেক্রেটারি মিস শারমিন দু’টা খবর দিয়েছে। প্রথম খবর সে ব্যাংকে ছোটাছুটি করে বের করেছে ব্যাংকে বেলায়েতের চার কোটি সাতান্ন লক্ষ টাকা আছে।

দ্বিতীয় খবর বেলায়েত একটা উইল করে গেছে। রেজিস্ট্রি করা উইল। সেখানে লেখা— তার মৃত্যু হলে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তির মালিক হবে তার ছোটভাই হেদায়েত। সেখানে হেনার কোনো উল্লেখই নেই।

হেনা বলল, তুমি ঠিকমতো উইল পড়েছ?

জি ম্যাডাম।

আমার কোনো উল্লেখই নেই?

জি ম্যাডাম।

বদ্ধ উন্মাদ ছাড়া এই কাজ কেউ করে? এরা দুই ভাইই বদ্ধ উন্মাদ। সহজভাবে ঘুরে বেড়ায়, কারোর বুঝার উপায় নেই যে এরা উন্মদি। ঠিক বলেছি কি-না বলো?

অবশ্যই ঠিক বলেছেন। মাডাম উইলের একজন সাক্ষীর নাম শুনলে আপনি চমকে উঠবেন।

হেনা বলল, অনেক চমকেছি, আর চমকাতে ইচ্ছা করে না। কে সে?

পরিমল বাবু।

হেনা বিড়বিড় করে বলল, বদটা সাক্ষী? অথচ আমাকে কিছুই বুঝতে দেয় নাই। সে উইলের কথাটা আগে বললে…

হেনা কথা শেষ করল না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।

শারমিন বলল, ম্যাডাম পরিমল বাবুকে কি খবর দিয়ে আনব? তারা তো বেলায়েত টিম্বারেই রাতে থাকে।

তাকে এখন খবর দিয়ে কী হবে? আচ্ছা যাও খবর দাও।

 

হেদায়েত, পরিমল বাবু কাউকেই বেলায়েত টিম্বারে পাওয়া গেল না। তারা কোথায় গেছে তাও কেউ জানে না।

পরিমল বাবু রাত্রি যাপনের জন্যে হেদায়েতকে কমলাপুর রেলস্টেশনে নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেছেন, নিরিবিলি ঘুমের এক মজা আবার হৈচৈয়ের মধ্যে ঘুমের আরেক মজা। একেকবার ট্রেন এসে থামবে। বিরাট হৈচৈ, ইনজিনের শব্দ, হুইসেল। ঘুম ভাঙবে। কিছুক্ষণ ট্রেন দেখে আবার ঘুমিয়ে পড়বে। আসুন জায়গা খুঁজে বের করি। চোখের উপর সরাসরি আলো এসে পড়বে না এমন জায়গা।

হেদায়েত বলল, স্টেশনে আপনি আগেও রাত কাটিয়েছেন?

কত কাটালাম। একেকবার চাকরি চলে যায়। সঞ্চয় শেষ হয়। স্টেশনে এসে আশ্রয় নেই। কোলকাতায় আমার বড় বড় আত্মীয়স্বজন আছে। তারা খুব চাপাচাপি করে যাতে তাদের কাছে চলে যাই। নিজের দেশ ছেড়ে কেন যাব বলুন তো!

তারা মোটামুটি নিরিবিলি একটা জায়গা খুঁজে বের করল। চোখের উপর আলো পড়বে না। পাবলিক টয়লেট কাছেই। খবরের কাগজের উপর চাদর বিছিয়ে বিছানা। হেদায়েত বলল, যথেষ্ট আরামদায়ক ব্যবস্থা।

পরিমল বাবু বললেন, আরাম ভাবলেই আরাম। পুরো ব্যাপারটাই ভাবের উপর। একই পরিস্থিতিতে কষ্টে আছি ভাবলে কষ্টে থাকবেন। আনন্দে আছি ভাবলে আনন্দে থাকবেন।

হেদায়েত বলল, অংকেও এরকম ব্যাপার আছে। ইমাজিনারি সংখ্যার গুণিতক নিয়ে ব্যাপার। একই পরিস্থিতিতে উত্তর পজেটিভ হবে আবার নেগেটিভও হবে। যিনি অংকটা করছেন তার উপর নির্ভর করবে তিনি কোন উত্তরটা নেবেন।

বাহ ভালো তো। আসুন চা খাই। চা-সিগারেট খেতে খেতে অংক নিয়ে আলাপ। যদিও আমি অংক ভয় পাই। জীবনে কোনো পরীক্ষায় অংকে চল্লিশের উপর পাই নাই। আপনার মতো শিক্ষক পেলে কাজ হতো।

হেদায়েত বলল, আপনি চাইলে আমি আপনাকে অংক শেখাতে পারি। গোড়া থেকে শুরু করতে পারি।

পরিমল বাবু বললেন, এটা খারাপ না। শেষ বয়সে শিখলাম কিছু অংক।

প্রথমে মুখে মুখে শুরু করি তারপর কাগজ-কলমে যাব।

তাই ভালো। অংক করতে করতে ঘুম।

হেদায়েত বলল, আপনি ঘুমিয়ে পড়ার পরেও আমাকে বেশ কিছু সময় জেগে থাকতে হবে। আমি মনে মনে একটা অংক করছি তো তার জন্যে। আত্মার ইকুয়েশন বের করার চেষ্টা করছি।

আত্মার ইকুয়েশন? বলেন কি!

অনেকদূর এগিয়েছি– কিছু বাকি আছে। বাকিটাও হয়ে যাবে। বড় বড় অংকবিদরা আমাকে সাহায্য করছেন।

পরিমল বাবু চিন্তিত গলায় বললেন, ও আচ্ছা।

হেদায়ে বলল, আত্মা বাস করে Planck জগতে। সব আত্মা একসঙ্গে বাস করে বলেই আত্মার সঙ্গে আত্মার যোগাযোগ থাকে। এই যোগাযোগ অনন্তকালের।

পরিমল বাবু বললেন, আমার আত্মা আমার ভেতর থাকে না?

আপনার প্রশ্নের উত্তর— থাকে আবার থাকেও না। ইকুয়েশনটা বের করে ফেলতে পারলে বুঝাতে সুবিধা হবে।

পরিমল বাবু বললেন, তাহলে অপেক্ষা করি আপনি ইকুয়েশনটা বের করুন।

হেদায়েত বলল, একটা সমস্যা আছে।

কী সমস্যা?

ইকুয়েশনটা বের করার সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথাটা পুরোপুরি খারাপ হয়ে যাবে। কাউকে কিছু বুঝাতে পারব না।

তাহলে তো ইকুয়েশনটা নিয়ে চিন্তা না করাই ভালো।

উপায় নাই। অনেকদূর এগিয়েছি। এখন আর থামা যাবে না। ব্যাপারটা চেইন রিঅ্যাকশনের মতো। একবার শুরু হলে আর থামানো যায় না। শেষ হয়…

হেদায়েতের কথা শেষ হবার আগেই হুড়মুড় করে প্ল্যাটফর্মে ট্রেন ঢুকল। হেদায়েত মুগ্ধ হয়ে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকজনের উঠানামা দেখছে। তার খুবই ভালো লাগছে। একটা বাচ্চা মেয়ে বাবার হাত ধরে গুটগুট করে হাঁটছে। কী সুন্দর লাগছে দেখতে বাহ্!

প্রথম রাতেই হেদায়েতের হাওয়াই মেঠাইয়ের মেশিন, পরিমল বাবুর হ্যান্ডব্যাগ এবং কাপড়ের পুঁটলি চুরি হয়ে গেল। পরিমল বাবু বললেন, সম্পূর্ণ ঝামেলা মুক্ত হয়ে গেলাম। ভিক্ষাবৃত্তির নতুন জীবন শুরু করব। এর আলাদা আনন্দ আছে।

হেদায়েত বলল, কী আনন্দ!

জুয়াখেলার আনন্দের মতো আনন্দ। উত্তেজনার আনন্দ। যার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি সে ভিক্ষা দিবে, না দিবে না— এই উত্তেজনার আনন্দ।

 

নতুন জীবনে হেদায়েত অভ্যস্থ হয়ে গেছে। ঘুমুতে যাবার আগে সে পরিমল বাবুকে অংক শেখায়। তখন বাইরের কিছু মানুষও কৌতূহলী হয়ে পাশে বসে। হেদায়েতের ভালো লাগে। পরিমল বাবু ছাত্র হিসাবে বেশ ভালো। তিনি দ্রুত ব্যাপারলি ধরছেন। এটাও আনন্দের ব্যাপার।

একদিন রেলস্টেশনেই প্রিন্সিপ্যাল এনায়েত করিমের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি রাতের ট্রেনে চিটাগাং যাচ্ছিলেন। পানির বোতল কিনতে এসে হেদায়েতকে দেখে বললেন, আপনার এ কী অবস্থা!

হেদায়েত বলল, ভালো অবস্থা স্যার।

কী করছেন আজকাল?

ভিক্ষাবৃত্তি।

তার মানে?

আমি আর পরিমল বাবু সারাদিন ভিক্ষা করি। রাতে স্টেশনে শুয়ে ঘুমাই।

এনায়েত করিম বললেন, আমি আপনরি কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। স্টেশনে ঘুমান মানে কী?

হেদায়েত মানে বোঝাতে পারল না। তার আগেই ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল এনায়েত করিম দৌড়ে ট্রেনে উঠলেন। জানালা দিয়ে মুখ বের করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কারণ হেদায়েত ট্রেনের সঙ্গে প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে।

হেদায়েত এইমাত্র আত্মার ইকুয়েশন বের করে ফেলেছে। সে এই খবরটাই প্রিন্সিপাল সাহেবকে দিতে চাচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের লোকজনও তাকিয়ে আছে। তারা অবাক হয়ে মানুষটার দৌড় দেখছে। মানুষটা ট্রেনে উঠার চেষ্টা করছে না। অকারণে দৌড়াচ্ছে— এর মানেটা কী?

তেতাল্লিশদিন পর বেলায়েত ফিরেছে

তেতাল্লিশদিন পর বেলায়েত ফিরেছে। তার মুখভর্তি দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। পরনে লুঙ্গি, ঘিয়া কালারের পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। হাতে বেতের বাঁকা লাঠি। সে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, বাথরুমে গরম পানি দাও, সাবান দাও। হেভি গোসল দেব। তোমরা ভালো?

হেনা বিড়বিড় করে বলল, ভালো।

চশমাপরা কুস্তিগির টাইপ এক মেয়ে দেখলাম ঘুরঘুর করছে, সে কে?

হেনা বলল, আমার দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হয়। তুমি নাই। একা ভয় ভয় লাগে, এইজন্যে তাকে রেখেছি।

আমি নাই তো কী হয়েছে? পরিমল বাবু তো ছিলেন। খবর দিলে হেদায়েত চলে আসত। বুদ্ধি খোয়ায়া সারাজীবন কিছুই করতে পারল না।

হেনা বলল, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?

বেলায়েত বলল, ময়মনসিংহে এক পীর সাহেবের কাছে গিয়েছিলাম হেদায়েতের ব্যাপারে। তার সমস্যাটা যেন দূর হয় এই দোয়া নিতে। পীর সাহেব বললেন, আপনার ভাইয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। সংসার-টংসার সব ছেড়ে আমার সঙ্গে চল্লিশদিনের জন্যে চিল্লায় চলেন সব ঠিক করে দেব। আমি বললাম, ঠিক আছে। পীর সাহেব বললেন, এই চল্লিশদিন বাড়িঘরের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখা যাবে না। যোগাযোগ করা যাবে না। আমি রাজি হয়ে গেলাম। এই হলো ঘটনা। বুঝেছ?

বুঝেছি।

হেদায়েতের খবর কী? সে আছে কেমন?

হেনা জবাব দিল না। তার কাছে দেবার মতো কোনো জবাব ছিল না।

 

পরিশিষ্ট

হেদায়েত এখন তার বড়ভাইয়ের সঙ্গে থাকে। বাড়ির দোতলা কমপ্লিট হয়েছে। সবচেয়ে বড় ঘরটা বেলায়েত তার ভাইয়ের জন্যে ঠিক করে দিয়েছে। ধরে এসি লাগানো হয়েছে। নতুন ফার্নিচার কেনা হয়েছে।

হেদায়েতের ঠিক পাশের ঘরটা পরিমল বাবুর। তাঁর এখন একটাই দায়িত্ব, হেদায়েতের দেখাশোনা করা।

এই দায়িত্ব তাকে পালন করতে হয় না। পালন করে সেতু। মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, তুমি আমাকে চিনতে পারছ?

হেদায়েত হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে।

বলো তো আমি কে?

তুমি মাহজাবিন। রোল নাইনটিন। প্রাইম নাম্বার।

ঠিক আছে আমি রোল নাইনটিন। শোন, আমি কখনও তোমাকে ছেড়ে যাব না।

আচ্ছা।

হেদায়েত তার ভাইকে ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারে না।

বেলায়েত প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক-দেড় ঘণ্টা ভাইয়ের সামনে বসে থাকে। নানান গল্প করে।

ছোটন আমাকে চিনেছিস?

হুঁ।

বল দেখি আমি কে?

তুমি ভাইজান।

শুধু ভাইজান বললে হবে না। আমার নাম কী বল?

তোমার নাম বেলায়েত।

বেলায়েতের শেষে কী? হোসেন না ইসলাম?

হোসেন।

তোর নিজের নাম কী বল দেখি।

মনে আসছে না ভাইজান।

বেলায়েত চোখ মুছতে মুছতে বলল, ভাইজান ছাড়া দুনিয়ার সবকিছু ভুলে খাবি এটা কেমন কথা!

ভাইজান সরি!

সরি বলার কিছু নাই। তুই আমাকে গাড়ি কিনতে বলেছিলি মেরুন কালারের, সেটা কিনেছি। দুই ভাই মিলে আমরা একদিন গাড়ি নিয়ে বের হব। ড্রাইভার গাড়ি চালাবে। আমরা দুই ভাই পেছনের সিটে বসে থাকব।

আচ্ছা।

তোর ভাবি যে যন্ত্রণাটা করেছে সেটা মনে রাখিস না। আমি ক্ষমা করে। দিয়েছি, তুইও দিস। আমাদের দুই ভাইয়ের নীতি হলো মানুষের ভালোটা দেখব, মন্দটা দেখব না। ঠিক না?

হ্যাঁ। ভাইজান আমি কি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছি?

আরে না। পাগল হলে কেউ কি এত সুন্দর করে গল্প করতে পারে?

ভাইজান আমি জানি আমি পাগল হয়ে গেছি। কারণটাও জানি। আমি আত্মার ইকুয়েশনটা বের করে ফেলেছি।

মাথা থেকে ইকুয়েশন দূর কর গাধা।

আচ্ছা।

আর দূর করতে না পারলে আমাকে শিখিয়ে দে। দুই ভাই মিলে একসঙ্গে পাগল হয়ে যাই।

 

রাতে কড়া ঘুমের ওষুধ খেয়ে হেদায়েত ঘুমুতে যায়। তারপরেও কয়েকবার তার ঘুম ভাঙে। যতবারই ঘুম ভাঙে ততবারই দেখে–অতি রূপবতী এক তরুণী তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটিকে সে চিনতে পারে না, তারপরেও সে জানে এই মেয়ে তার অতি আপনজন। রোল নাইনটিন। প্রাইম নাম্বার।

Exit mobile version