মায়মুন উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু এত বড় শাড়ীটা সামলান তার পক্ষে কষ্টকর। শাড়ীটা বারবার পায়ের নিচে পড়ে তার হাঁটায় বাধার সৃষ্টি করে।
মায়মুনকে দেখে জয়গুনের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। এ চোখের পানি সুখের না দুঃখের বলা শক্ত।
সাক্ষী ও উকিল যখন ঘরে আসে, তখন মায়মুন বসে বসে ঝিমুচ্ছে। জয়গুন মাথার কাপড়টা একটু টেনে মায়মুনকে হাত দিয়ে আকষর্ণ করে—একি মায়মুন! ওঠ দ্যাখ কারা আইছে!
উকিল তখন বলতে শুরু করে—তোমারে সোলেমানের ব্যাটা ওসমানের লগে পঞ্চাশ টাকা দেন মোহরে নিকাহ দিলাম। তুমি রাজী আছ?
জয়গুন মায়মুনকে বুকে চেপে ধরে। বলে—কও মায়মুন, হ রাজী আছি।
একথা বোঝার বা বলার মধ্যে কোন নতুনত্ব নেই মায়মুনের কাছে। কথা কয়টা তার অনুভূতিকে একটুও নাড়া দেয় না। তোতা পাখীকে শিখিয়ে দিলে সে যেমন বলে, মায়মনও তেমনি মা-র কথা অনুসরণ করে।
—রাজী আছি।
সাক্ষী ও উকিল পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হাসে। জয়গুন একগ্লাস শরবত মায়মুনের হাতে দিয়ে বলে—নে লক্ষী, এক চুমক খাইয়া গেলাসটা দিয়া দে।
উকিল সরবতের গ্লাস নিয়ে সাক্ষীর সাথে বিয়ের মজলিশে চলে যায়।
এক সঙ্গে অনেকগুলো বিয়ে হচ্ছে বলে একটা ভুলিও পাওয়া যায়নি। বিয়ের পর তাই সোলেমান বা তার ছেলে-বৌকে কোলে তুলে নিয়ে সকলের সাথে বাড়ীর দিকে পথ নেয়। মায়মুনের ছোট ও পাতলা শরীরের ওজনে সোলেমান খ বিস্মিত হয়। একটা তুলো ভরা বালিশের মত মনে হচ্ছে তার কাছে। সে মনে মনে চিন্তিত হয়। জোয়ান ছেলের জন্যে এতটুকু মেয়ে নেয়া ঠিক হল না বুঝি। আরো তিন তিনটি বছর পুষতে হবে ভাত-কাপড় দিয়ে, তবে ছেলের উপযুক্ত হবে বউ। কিন্তু এ তিন বছর–
সোলেমান খাঁ জোর করে চিন্তাটাকে সরিয়ে দেয়। ভবিষ্যতের ভাবনা ভেবে সে আজকের বিয়ের আনন্দটা মাটি করে দিতে চায় না।
ভোর রাত্রের দিকে বেশ শীত পড়ে। জয়গুন বাইরে চুলোর পাশে গিয়ে বসে। চুলোর মধ্যে বিয়ের রান্নার আগুন তখনও নিবে যায়নি। জয়গুন ঠাণ্ডা হাত দুটো চুলোর ওপর মেলে ধরে। মাথাটাও ঝুঁকে পড়ে সামনের দিকে। তার চোখ-ঝরা পানি চুলোর আগুনে পুড়ে অস্পষ্ট ছ্যাং-ছ্যাৎ শব্দ করে আর সাথে সাথে বাষ্প হয়ে মিশে যায় বাতাসে।
১৫. কাসুকে কড়া নজরে পাহারা
আজকাল করিম বক্শ কাসুকে কড়া নজরে পাহারা দেয়। যত দিন মাঠ-ভরা পানি ছিল ততদিন কালাপানির বন্দীর মত ছিল কাসু। কিন্তু মাঠে পথ পড়ার সাথে সাথে করিম বক্শ চিন্তিত হয়। তার মনে আশকা জাগে—কাসু হয়তো একদিন ফুড়ুত করে ওর মা-র কাছে চলে যাবে। সেদিন আর একটু আগে দুধ বেচতে বেরিয়ে গেলে সর্বনাশ হয়েছিল আর কি!
করিম বক্শ আঞ্জুমনকে সতর্ক করে দেয়—কানা বুড়ী আমার বাড়ীতে পাও বাড়াইলে ঠাগা মাইর খোড়া কইরা দিবা। আমার তিরিসীমানায় দ্যাখতে পাইলে, ওর আর এট্টা চোখ কানা কইর্যা ছাইড়া দিমু। আমার তুমড়ীবাজি অহনও দ্যাহে নাই বুড়ী!
আঞ্জুমন করিম বকশের হৃদয় জয় করার মতলব নিয়ে বলে—বুড়ীরে দ্যাখলে ভাল। মানুষ বুইল্যা মনে হয়। কতাও কয় যেন মিছরির শরবত। দিলের মধ্যে এত কালি কে জানে!
কানা বুড়ীর দোষকীর্তন করায় আমনের ওপর করিম বক্শ মনে মনে খুশী হয়। কিন্তু সে তাকে বিশ্বাস করে না। সন্দেহ হয়—কাসুর মাথাটা হয়ত ইতিমধ্যেই আঞ্জুম বিগড়ে দিয়েছে। ঘরে-বাইরে এ রকম ষড়যন্ত্র অসহ্য। কোন রকমে মনের গোস্বা মনে চাপা দিয়ে সে কাসুকে পাহারা দেয়। বাইরে গেলেও সে কাসুকে সাথে করে নিয়ে যায়। যেদিন সাথে নেয়া সম্ভব হয় না, সেদিন গরুর দড়ি দিয়ে খুঁটির সাথে বেঁধে রাখে কাসুকে।
কয়েকদিন ধরে ধান কাটার ধুম পড়েছে। করিম বকা তার নারকেলের কোটা কাসুর হতে দেয়, আর আগুনের মালসাটা নিজের হাতের তালুতে বসিয়ে অপর হাতে দুটো কাস্তে নিয়ে মাঠে রওয়ানা হয়।
কাসুর হাতে একটা কাস্তে দিয়ে বলে—আমার লগে থাইক্যা ধান কাটতে হিগ। বড় অইলে এই কইর্যা খাইতে অইব।
কাসু তার ডান হাতের ছোট্ট মুঠোর মধ্যে কাস্তের মোটা হাতল ভালো করে সামাল দিতে পারে না। কোন রকমে হাতলটা চেপে ধরে সে দু’একটা করে ধানের ছড়া কাটতে আরম্ভ করে।
মাঠে আরো অনেক জমিতে ধান কাটা শুরু হয়েছে। দুরের একটা জমি থেকে কৃষাণদের সমবেত গান ভেসে আসে–
কচ-কচ কচ কচ-কচা-কচ
ধানরে কাটি,
মুঠা মুঠা ধান লইয়া বান্দি আঁটি-রে।
(ও ভাই) ঝিঙ্গাশাইলের হুড়ুম ভালা
বাঁশফুলেরই ভাত,
লাহি ধানের খইরে ভালা,
দইয়ে তেলেসমাত—রে।
কস্তুরগন্ধী চাউলরে আলা,
সেই চাউলেরি পিঠা ভালা,
সেই না পিঠায় সাজিয়ে থালা
দাও কুটুমের হাত—রে।
আল্লাদি বউ কোটে চিড়া
মাজায় রাইখ্যা হাত,
সেই না চিড়ায় কামড় দিয়া
বুইড়ার ভাঙে দাঁত—রে।
মিয়া বাড়ী ঘটক আসে
কন্যা-বিয়ার কথার আশে,
বোরো ধানের ভাত খাওয়ানে
মিয়ার গোল জাত—রে।
পাশের একটা জমিতে আলোচনা হচ্ছে। একজন বলে—আমরা হেদিন বৈঢকে ঠিক করলাম, সাতভাগা অইলে কেও ধান কাটতাম না। কিন্তুক দ্যাখ, ছমিরদ্দির দল সাতভাগায় গদু পরধানের ধান কাটতে শুরু করছে।
আর একজন বলে—আবার গানও লাগাইছে ফূর্তির ঠেলায়।
—হেইয়া করব না! বেয়াক্কেলরা এড়কও বোঝে না, এই বারের যেই প্রান, তা সাত ভাগের এক ভাগ নিয়া কি ওগ বাপ-মার ফত্তা করব?
—এই বচ্ছর যে ধানের অবস্থা, এই রহম অইব কে কইছিল? জুইতের ধান অইলে না অয় সাত ভাগায় কিছু অইত। কিন্তু একটা ধানের ছড়ার মধ্যে চাইর আনাই মিছা।