Site icon BnBoi.Com

তোমাকে – হুমায়ূন আহমেদ

তোমাকে - হুমায়ূন আহমেদ

নীলু আমার চেয়ে এগারো মিনিটের বড়

নীলু বয়সে আমার চেয়ে এগারো মিনিটের বড়। তার জন্মের এগারো মিনিট পর আমার জন্ম হয় এবং দারুণ একটা হৈচৈ শুরু হয়। ডাক্তার শমসের আলি অবাক হয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, আরে যমজ। বাচ্চা দেখি। ঠিক তখন ইলেকট্রসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। আমরা দুই বোন গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে থাকি। ডাক্তার শমসের আলি হারিকেনের জন্যে চোঁচাতে থাকেন। আমার নানিজান ছুটে ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে পানির একটা গামলা উল্টে ফেলেন।

আমার জন্মের সময় চারদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল বলে বাবা আমার নাম রাখেন রাত্রি। নীলু জনের পর পর খুব কাদছিল, তাই তার নাম কান্না। এইসব কাব্যিক নাম অবশ্যি টিকল না। একজন হল নীলু। তার সাথে মিলে রেখে আমি হলাম বিলু। তার চার বছর পর আমাদের তিন নম্বর বোনটি হল; মিল দিয়ে নাম রাখলে শুধু মেয়েই হতে থাকবে এই জন্যে তার নাম হল সেতারা। নীলু, বিলু এবং সেতারা।

বাবার রাখা নাম না টিকলেও বাবা কিন্তু হাল ছাড়লেন না। সুযোগ পেলেই চেঁচিয়ে ডাকতেন, কোথায় আমার বড় বেটি কান্না? কোথায় আমার মেজো বেটি রাত্রি? জন্মদিনে বই উপহার দেবার সময় বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় গোটা গোটা হরফে লিখতেন, মামণি রাত্রিকে ভালবাসার সহিত দিলাম কিংবা মামণি কান্নাকে পরম আদরের সহিত দেওয়া হইল।

বইয়ের সঙ্গে সব সময় একটা করে তার স্বরচিত কবিতা থাকত। সে কবিতা তিনি তার প্রেস থেকে ছাপিয়ে ফ্রেম করে বঁধিয়ে আনতেন। আট বছরেব জন্মদিনে আমি এবং নীলু। যে কবিতাটি পেলাম সেটা শুরু হয়েছে এভাবে।–

‘সাতটি বছর গেল পর পর
আজকে পড়েছে আটে
তব জন্মদিন নয়তো মলিন
ভয়াল বিশ্বহাটে।’

যমজ বোন বলেই আমরা দু’জন সব সময় একই কবিতা পেতাম। শুধু কবিতা নয়। গল্পের বইও একই হত। দুজনের জন্যে দুটি শিশু ভোলানাথ কিংবা ঠাকুরমার ঝুলি।

আমরা দু’জন যে দেখতে অবিকল একরকম এ নিয়ে বাবার মধ্যে একটা গোপন গর্ব এবং অহংকার ছিল! নতুবা কেউ এলেই হাসিমুখে বলতেন–এরা যমজ। একজনের নাম রাত্রি, একজনের নাম কান্না। যার চুল ছোট ছোট ও হচ্ছে কান্না। মা বড় বিরক্ত হতেন। ভ্রূ কুঁচকে বলতেন— যমজ মেয়ে নিয়ে এত ঢোল পিটানোর কি আছে? যমজ-ফমজ আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না, ছিঃ!

আমাদের দু’জনকে যাতে দেখতে এক রকম না দেখায় এ জন্যে তার চেষ্টার ক্রটি ছিল না। আমার চুল কেটে ছোট ছোট করে দিলেন। একজনের গায়ের রঙ যেন অন্যজনের চেয়ে আলাদা হয় সে জন্যে নীলুকে সপ্তাহে তিন দিন কাঁচা হলুদ দিয়ে গোসল করাতে লাগলেন। কিছুতেই কিছু হল না। আমরা যতই বড় হতে থাকলাম আমাদের চেহারার মিল ততই বাড়তে লাগল। নীলু। যেমন লম্বা। আমিও তেমন লম্বা। তার চিবুকের নিচে যে রকম একটি লাল রঙের তিল আমারও অবিকল সে রকম তিল। তার যেমন শ্যামলা গায়ের রঙ আমার তাই। মা পর্যন্ত ভুল করতে লাগলেন। যেমন একদিন বারান্দায় বসে তেঁতুলের খোসা ছড়াচ্ছি, মা ঝডের মত এসে প্রচণ্ড একটা চড় কষালেন।

এক খিলি পান দিতে বললাম। কতক্ষণ আগে?

আমি শান্ত স্বরে বললাম, আমাকে বলনি। বোধহয় নীলুকে বলেছ। আমি বিলু।

আমার ছোট চুল যখন লম্বা হল তখন দেখা গেল বাবা এবং মা ছাড়া আমাদের কেউ আলাদা করতে পারে না। কেন পারে না সে-ও এক রহস্য। নীলুর সঙ্গে আমার বেশ কিছু অমিল আছে। যেমন নীলুর নাক একটুখানি চাপা। ওর চোখ দুটি একটুখানি উপরের দিকে ওঠানো। তবুও দোতলার নজমুল চাচা আমাদের দুবোনকে যখনি দেখেন তখনি বলেন, কে কোন জন? কে কোন জন? নীলু। তাতে খুব মজা পায়। আমার অবশ্যি রাগ লাগে। এইসব আবার কি ঢং? নজমুল চাচা সব সময়ই ঢং করেন। মা নজমুল চাচাকে সহ্যই করতে পারেন না। নজমুল চাচার গলা শুনলেই মুখ কুঁচকে বলেন, ভাঁড় কোথাকার। সব সময় ভাঁড়ামি।

আমাদের নিয়ে সবচে বেশি ভাঁড়ামি করেন অবশ্যি আমার বড় মামা। দিনাজপুর থেকে বেড়াতে এলেই মহা উৎসাহে আমাদের দু’জনকে সামনে বসিয়ে উঁচু গলায় বলেন, দেখা যাক আমি নীলু বিলুকে আলাদা করতে পারি কি-না। ওয়ান টু থ্রি হুঁ এই জন হচ্ছে আমাদের বিলুমণি। বড় মামা ভাঁড়ামি করলে মা রাগ করতেন না, বরং একটু যেন খুশিই হতেন। সবচে খুশি হত নীলু। সে হেসে কুটিকুটি। নীলুর নাম কান্না না হয়েই ভালই হয়েছে। সে হাসতেই জানে, কাঁদতে জানে না। আমরা যখন ক্লাস সেভেনে উঠলাম নীলু আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল তার হাসি নিয়ে। যা-ই দেখে তাতেই তার হাসি পায়। মা হয়ত কিছু নিয়ে ধমক দিয়েছেন। সে মুখ ফিরিয়ে হাসি গোপন করবার চেষ্টা করছে। মা কঠিন স্বরে বলছেন, হাসছ কেন তুমি?

কই হাসছি না তো।

মুখ ফেরাও। তাকাও আমার দিকে।

নীলু মুখ ফেরালে আমরা দেখতাম হাসি থামাবার চেষ্টায় তার গাল লালচে হয়ে উঠেছে।

কেন তুমি শুধু শুধু হাসছ? হাসির কি হয়েছে বল তুমি, তোমাকে বলতে হবে।

আর হাসব না। মা! এখন থেকে শুধু কাঁদব।

বলেই সে আমার ফিক করে হেসে ফেলল। মা প্রচণ্ড একটা চড় কষলেন।

বাঁদর কোথাকার। তোমার হাসি আমি ঘুচিয়ে দিচ্ছি দেখ!

নীলুর চোখে জল আসছে কিনা মা দেখতে চেষ্টা করতেন। কোথায় কি? নীলু। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন কিছুই হয়নি। মা ক্লান্ত হয়ে বলতেন, ঠিক আছে যাও আমার সামনে থেকে।

নীলু এমনভাবে ছুটে যেত যেন আড়ালে গিয়ে হেসে বুক হালকা করবে। নীলুটা এমন হয়েছে কেন? এ বাড়িতে সবাই একটু গম্ভীর। সেতারা যার বয়স মাত্র পাঁচ সে পর্যন্ত কম কথা বলে। নীলুকার কাছ থেকে এত কথা বলা শিখল? কার কাছ থেকে অকারণে হাসরি এই অদ্ভুত অসুখ জোগাড় করল?

আমার এবং নীলুর খাট দক্ষিণ দিকের বড় ঘরটায়। নীলু ঘুমায় সেতারাকে সঙ্গে নিয়ে। তার একা এক ভয় করে। আকবরের মা ঘুমায় বারান্দায়। আমরা ডাকাডাকি করলে তার উঠে আসার কথা। সে একবার ঘুমালে নিশ্চিন্ত। সারা রাতে এক সেকেন্ডের জন্যেও জাগবে না। এমনিতে অবশ্যি বলবে, ভইন, আমার সজাগ ঘুম। ইটু শব্দ হইলেই চউখ খোলা। আকবরের মা কোন কাজ ঠিকমত করতে পারে না। প্রচুর মিথ্যা কথা বলে। অনেকবার তাকে বিদায় দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, লাভ হয়নি কিছুই। সে ঘাড় বাঁকিয়ে বলেছে, যাইতাম না। দেহি কেমনে বিদায় দেয়। তামাশা না? এই বুড়ো বয়সে যাইতাম কই?

আকবরের মা রাতে ভাতটাত খেয়ে ঘুমাতে এসে জিজ্ঞেস করে, কইগো মাইয়ারা, ভূতের কিচ্ছা হুঁনতে চাও? নীলু ভীতু সে শুনবে না, কিন্তু যেহেতু আমি শুনি কাজেই তাকেও শুনতে হয়। আকবরের বাপের গপটা কই। শাইলের মইধ্যের লোম খাড়া হইয়া যায় বুঝছনি মাইয়ারা। শীতের সময়। খুব জার। আকবরের বাপের মাছ মারতে যাওনের কথা। আমারে কইল তামুক দে…

নীলু গল্পের মাঝখানে জিজ্ঞেস করে, তুই করে বলত?

তা ঠিক। গরিব মাইনষের কথাবার্তা তুই-তুকারি দিয়া।

আকবরের মার ভাষা ঠিক বোঝা না গেলেও গল্প ধরতে কোনো অসুবিধে হয় না। সব গল্পের শেষে আকবরের বাবা। যার সাহসের কোনো সীমা নেই, একটা ভূতের গলা সাপ্টে ধরে কুমড়ো গড়াগড়ি করবে। এবং সব শেষে ভূতটা জঙ্গল ভেঙে ছুটে যাবে। যাবার সময় বলবে, এঁই বাঁর ছাঁইরা দিলাম। বুঁঝছস? জাঁনে বাঁচলি।

গল্প শেষ হলেই নীলু বলবে, দূর, ভূত আবার আছে নাকি?

আকবরের মা চোখ কপালে তুলে বলবে, এইটা কেমুন বেকুবের মতো কথা কইলা? দেশটা ভর্তি ভূত আর পেত্নীতে। আমার সাথে একবার যাইও আমরার নীলগঞ্জের বাড়িত। নিজের চউক্ষে ভূত দেখবা।

আকবরের মা শুধু যে আমাদের ভূতের গল্প শোনাবার চেষ্টা করে তাই না, মাকেও শোনাতে চেষ্টা করে। সুযোগ পেলেই একটা গল্প টেনে আনতে চায়, বুঝছেন আম্মা, একবার হইল। কি…। মা এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। আজেবাজে গল্প মা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। শুধু আকবরের মা নয় বাবাকেও এমনিভাবে থামানো হয়, যা বলতে চাও সরাসরি বলতে পার না? এত ফেনও কেন?

ফেনাই নাকি?

হ্যাঁ, ফেনাও। বেশি রকম ফেনাও। যা বলার তা সহজভাবে বলতে পারা উচিত।

ও।

রাগ করলে নাকি আবার?

না। আমি এত সহজে রাগ করি না।

বাবার এই কথাটি খুব সত্যি। বাবা রাগ করতে পারেন না। নীলুর ধারণা বাবা মোটা বলেই রাগ করতে জানেন না। মোটা মানুষদের এই একটা বড় অসুবিধে। কথাটা হয়ত সত্যি। আমাদের স্কুলের মোটা আপাগুলিকে কিছুতেই রাগানো যায় না। আর চিকনা। আপাগুলি কারণ ছাড়াই চিড়বিড়, করছে। আমাদের মা নিজেও রোগা বলেই বোধহয় তার রাগ বেশি। তিনি রাগেন না। শুধু আমাদের প্রেসের ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে। তার নাম প্রণব বসু। এর অনেক রকম গুণ আছে। চমৎকার গান গাইতে পারেন। এবং চমৎকার গল্প করতে পারেন। তারচে বড় কথা চমৎকার রসিকতা করতে পারেন। এবং রসিকতাগুলি করেন গম্ভীর মুখে।

যেমন একদিন নীলুকে বললেন, এই নীলু কাল কি হয়েছে জানিস?

না তো কি হয়েছে?

উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের যে ওস্তাদ আছেন মুনসি মীর আলি, তিনি কাল জিলা স্কুলের মাঠে রাগ জয়জয়ন্তী গেয়ে দুটি মেডেল পেয়েছেন। একটা বড় মেডেল। একটা ছোট মেডেল। ছোটটা পেয়েছেন গান গাওয়ার জন্যে আর বড়টা পেয়েছেন গান থামানোর জন্যে।

প্রণব বাবুকে আমরা ডাকি ম্যানেজার কাকু। মা ডাকেন ম্যানেজার। বাবা ডাকেন বোস। ভাল কিছু রান্নাটান্না হলে বাবা বলবে, দেখি বোসকে একটা খবর দাও তো। খাওয়া-দাওয়ার পর একটু গান-বাজনা হবে।

ম্যানেজার কাকু অবশ্যি সহজে গান-বাজনা করেন না। তবে যদি ধরে-বেঁধে একবার বসানো যায় তখন গান চলে গভীর রাত পর্যন্ত। আমরা অবশ্যি এত রাত পর্যন্ত থাকতে পারি না। ধমক দিয়ে মা আমাদের নিচে পাঠিয়ে দেন। তবে অনেক রাত পর্যন্ত আমরা জেগে গান শুনি। আমাদের নিজের গান শেখার খুবই সখ। মাকে বেশ কয়েকবার বলতে মা ম্যানেজার কাকুকে বললেন, ওদের একটু গান শেখান না।

ম্যানেজার কাকু গম্ভীর গলায় বললেন, বৌদি ওদের বয়স কম।

কম বয়স থেকেই তো শুনেছি গান-বাজনা শুরু করতে হয়।

উঁহু, সংগীতের জন্যে মমতা ছাড়া কিছু হয় না। সেই মমতোটা অল্প বয়সে হয় না। আপনি যদি শিখতে চান শেখাতে পারি।

রক্ষা কর, এই বয়সে আর আঁ আঁ করতে পারব না।

ম্যানেজার কাকুকে একমাত্র নীলু ছাড়া আমরা সবাই বেশ পছন্দ করি। নীলু। যদিও ম্যানেজার কাকুর রসিকতায় সবচে উঁচু গলায় হাসে কিন্তু আড়ালে বলে, আমার ম্যানেজার কাকুকে ভাল লাগে না।

কেন, ভাল না লাগার কি আছে?

আছে একটা–কিছু। আমি জানি না কি।

নীলু। মাঝে মাঝে এলোমেলো কথাবার্তা বলে এবং সেগুলি সত্যিা হয়ে যায়। সেতারা যেদিন স্ক্রিীড় থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছে সেদিন সকালবেলাতেই নীলু বলেছে, আমি রাতে স্বপ্নে দেখেছি সেতারা খাট থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছে। ম্যানেজার কাকু প্রসঙ্গে নীলুর আশংকাও সত্যি হয়ে গেল।

আমরা স্কুলে গিয়েছি। থার্ড পিরিয়ডে জিওগ্রাফি আপা এসে বললেন, নীলু বিলু তোমরা দু’জন বাসায় যাও তো, তোমাদের নিতে এসেছে। আমরা অবাক হয়ে বাসায় এসে দেখি আকবরের মা সেতারাকে ঘুম পাড়াচ্ছে, বাসায় মা-বাবা কেউ নেই। দোতলার নজমুল চাচা শুধু বসার ঘরে মুখ কালো করে বসে আছেন। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা অদ্ভুত কথা শুনলাম। মা নাকি ম্যানেজার কাকুর সঙ্গে কোথায় চলে গেছেন। আর আসবেন না–এ রকম একটা চিঠি লিখে গেছেন।

বাবা ফিরলেন রাত এগারোটায়। আমরা জেগে বসে আছি। অনেক লোকজন এসেছে। কেউ যাচ্ছে না। সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছেন বসবার ঘরে। বাবা ঘরে ঢুকে এমন ভাব করলেন যেন কিছুই হয়নি। হাসিমুখে বললেন, রেণু ঝগড়া করে সকালের ট্রেনে দিনাজপুর তার বাবার বাড়ি চলে গেছে। আমি ছিলাম না। ভাগ্যিস প্রণব বাবু বুদ্ধি করে সঙ্গে গেছেন। নয়তো একা এক মেয়েছেলে এত দূর যাবে, দেখেন না অবস্থাটা। এই মেয়েজাতটার মত রাগ আর কারোর নেই। হা হা হয়। এদের নিয়েও চলে না। না নিয়েও চলে না।

লোকজন সব বারটার মধ্যে চলে গেল। আমরা নিজেদের ঘরে চুপচাপ শুয়ে ছিলাম। বাবা এসে ঘরে ঢুকলেন।

মামণিরা ঘুমাচ্ছ?

আমরা কেউ জবাব দিলাম না। বাবা মৃদু স্বরে বললেন, আজ রাতে তোমরা আমার সঙ্গে ঘুমাবে মামণিরা?

নীলু শব্দ করে কেঁদে উঠল।

সে সময় আমার এবং নীলুর বয়স বার, সেতারার সাত।

মা চলে গিয়েছেন

মা চলে গিয়েছেন এবং আর কোনোদিন ফিরে আসবে না— এটা আমরা খুব সহজেই বুঝে ফেললাম। শুধু সেতারা বুঝতে চাইল না। সে এমনিতেই কম কথা বলে। এখন কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। দিনরাত সে শুধু মাকে খুঁজত। মার শোবার ঘরের সামনে কতবার যে গিয়ে দাঁড়াত। ডাকাডাকি না কিছু না, শুধু দরজার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা। আমি একদিন দেখতে পেয়ে ডাকলাম, এই সেতারা।

উঁ।

এখানে একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

সেতারা মাথাটা অনেকখানি নিচু করে ফেলল যেন খুব-একটা অপরাধ করেছে।

কি করছিস তুই?

কিছু না।

আয় আমার সাথে নদীর পাড়ে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করব, আসবি?

না।

আমি লক্ষ্য করি সে একা একা ঘুরে বেড়াতে চায়। কারো সঙ্গে থাকতে চায় না। সন্ধ্যাবেলা কেউ কিছু বলার আগেই সে আমার সাথী বই নিয়ে বসে একদম নিচু স্বরে পড়তে থাকে

‘কমলাফুলি কমলা ফুলি
কমলা লেবুর ফুল
কমলা ফুলির বিয়ে হবে
কানে মোতির দুল।’

যখনি সে পড়তে বসে এই একটি কবিতাই সে পড়ে। তখন যদি বাড়ির সামনে কোনো রিকশা। এসে থামে সে পড়া বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। এক সময় বই বন্ধ করে অপরাধীর মত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে চলে যায় বারান্দায়। আবার ফিরে এসে পড়তে বসে–কমলাফুলি, কমলাফুলি কমলা লেবুর ফুল…।

একদিন নীলু বলল, সেতারা মা আমাদের কাউকে পছন্দ করেন না তো তাই চলে গেছেন। আর আসবেন না।

আচ্ছা।

যে আমাদের ভালবাসে না। আমরাও তাকে ভালবাসি না, ঠিক না?

হুঁ।

তুই আর মাকে খুঁজবি না–আচ্ছা?

সেতারা মৃদু স্বরে বলল, আমাদের পছন্দ করে না কেন?

আমরা সবাই তো মেয়ে এই জন্যে, ছেলে হলে পছন্দ হত। আমাদের তো কোন ভাই নেই। বুঝেছিস?

হুঁ।

সেতারা মায়ের আদর পায়নি বললেই হয়। তার জন্মের পর পর মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেতারা বড় হতে থাকে আকবরের মার কোলে। মার অসুখ যখন সারল তখনো অবস্থার পরিবর্তন হল না। মা মাঝে মাঝেই বিরক্ত স্বরে বলতে লাগলেন, ঘর ভর্তি হয়ে যাচ্ছে মেয়ে দিয়ে, ভাল লাগে না। সেতারা যখন হাঁটতে শিখল, টুকটুক করে হাটত। মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়াত সুযোগ পেলেই। মা গভীর গলায় ডাকতেন, আকবরের মা ওকে নিয়ে যাও তো, এখুনি ঘর নোংরা। করবে। তার দুবছর বয়স হতেই মা ওকে পাঠিয়ে দিলেন আমাদের ঘরে। রাতে ঘুমাবে নীলুর সঙ্গে। দুধ খাবার জন্যে কাঁদলে আকবরের মা উঠে দুধ বানিয়ে দেবে। সেতারা তখন কোনো ঝামেলা করেনি। এখনো করে না। নীলুর গলা জড়িয়ে ঘুমায়। নীলু বলে, গল্প শুনবি?

বল।

এক দেশে ছিল এক রাজা। তার দুই রানী দুয়ো ও সুয়ো…

এ পর্যন্ত আসতেই সেতারার চোখ বুজে আসে। কোনোদিন আর সে গল্প শেষ পর্যন্ত শোনা ट्र म्षी।

ইদানীং বাবা সেতারাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাতে চান। সেতারাও বেশ ভাল-মানুষের মত যায়।

কিন্তু মাঝরাতে একা একা চুলে আসে আমাদের ঘরে। রোজ এই কাণ্ড। একরাতে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল, সেতারা সবাইকে ডাকতে লাগল, মা এসেছে রিকশা নিয়ে। আমরা ধড়মড় করে উঠে বসলাম, কোথায়?

বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখলাম।

বলিস কি?

হৈচৈ শুনে বাবা উঠে এলেন। কোথায় কি, খা-খা করছে চারদিক! সেতারা দারুণ অবাক হল। বাবা বললেন, স্বপ্ন দেখেছি মা।

উঁহু, স্বপ্ন না। আমি দেখলাম।

সেতারা চোখ বড় বড় করে সবার দিকে তাকাতে লাগল। সে ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে পারছে না। বাবা সেতারাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন। সে রাতে আমি এবং নীলু এক খাটে ঘুমাতে গেলাম। এবং অনেক রাত পর্যন্ত দুজনেই নিঃশব্দে কাদলাম। অথচ দু’জনই এমন ভাব করতে লাগলাম যেন ঘুমিয়ে পড়েছি।

 

ধীরে ধীরে অনেকগুলি পরিবর্তন ঘটল বাড়িতে। বাবা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন। তিনি পরিবর্তনগুলি করলেন খুব সাবধানে। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি মার আলনায় কোনো কাপড় নেই। সব বাবা কোথায় সরিয়ে ফেলেন। তার দিন সাতেক পর বারান্দায় মার যে বড় বাধাই করা ছবিটি ছিল সেটিকে আর দেখা গেল না। বাবা-মার শোবার ঘরে তাদের বেশ কয়েকটি ছবি ছিল, সেগুলিও সরানো হল।

আমাদের ঘরে মা-বাবা এবং আমাদের তিন জনের যে ছবিটি ছিল সেটি শুধু বাবা সরালেন না। রান্নাবান্না করবার জন্যে রমজান নামের একজন বুড়ো মানুষ রাখা হল। এই লোকটি এসেই প্রচণ্ড ঝগড়া শুরু করল আকবরের মার সঙ্গে। দুজনেরই কি ঝাঁঝাল কথাবার্তা। কিন্তু রমজান লোকটি ভাল। সে সেতারাকে কোলে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভাত খাওয়াত। আমাদের ওপর তার খবরদারিরও সীমা ছিল না।

এই সইন্ধ্যা রাইতে বাগানো ঘুরাঘুরি করণ ঠিক না।

অত তেঁতুল খাওন বালা না, বুদ্ধি নষ্ট হয়।

ভাত খাওনের আগে বিসমিল্লা কইরা এট্টু লবণ মুখের মইধ্যে দেওন দরকার।

রাতের বেলায় খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে সে গম্ভীর হয়ে একটা খবরের কাগজ নিয়ে আমাদের পড়ার ঘরে গিয়ে বসত। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে এমন সব কথাবার্তা বলত যে নীলু হেসে উঠত খিলখিল করে।

হুঁ খুব সংকটময় অবস্থা। বুঝছি নীলু আপা, অবস্থা সংকটময়।

কেন?

নেপালে পাহাড়ি ঢল। হুঁ।

এই অবস্থায় ঝগড়া লেগে যেত আকবরের মার সঙ্গে, আকবরের মা কোমরে দুই হাত দিয়ে রণরঙ্গিনী মূর্তিতে এসে দাঁড়াত।

বিদ্যার জাহাজ যে বইছেন পাকঘরের বাসনডি কেডা ধুইব?

চুপ থাক। অশিক্ষিত মূর্খ মেয়ে মানুষ, এদের নিয়ে চলাফেরা মুশকিল।

রমজান ছাড়াও একজন ভয়ংকর রোগা দাঁত নেই ওস্তাদ রাখা হল। এই ওস্তাদটির নাম মুনশী সোভােহান। তিনি আমাদের তিন বোনকে সপ্তাহে তিন দিন গান শেখাবেন। আমরা তিন জনেই গান শিখতে শুরু করলাম। সকাললো হরমোনিয়াম নিয়ে বসে সারেগা রেগামা গামাপা। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। ওস্তাদ সোভােহান বেশিক্ষণ গান শেখাতে পারেন না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাঁপানির টান ওঠে। গান থামিয়ে বলেন, ঘরে কোনো টিফিন আছে কিনা দেখ তো খুকি। না থাকলে একটা মুরগির ডিম ভেজে দিতে বল। হাসের ডিম না। হাসের ডিম গন্ধ করে, খেতে পারি না।

গানের ওপর থেকে আমাদের মন উঠে গিয়েছিল, কাজেই আমাকে দিয়ে গান হল না। সেতারা এবং নীলু। শিখতে লাগল। কিছুদিন পর নীলুও কেটে পড়ল। রইল। শুধু সেতারা। মাস ছয়েকের মধ্যে দেখা গেল বেণী দুলিয়ে হারমোনিয়াম বাজিয়ে সেতারা গাইছে, নবীর দুলালী মেয়ে খেলে মদিনায়। ও ও ও খেলে মদিনায়।

ওস্তাদ সোভাহান ঘাড়-টান দুলিয়ে বলেছেন, মারহাবা মারহাবা কি টনটনে গলা। এইবার লক্ষ্মী ময়না গিয়ে দেখ তো কোনো টিফিন আছে কিনা। না থাকলে মধুর দোকান থেকে যেন একটা আমৃত্তি নিয়ে আসে। আর চা দিতে বল।

 

সে বছর শীতের সময় মা আমাদের তিন বোনকে সিরাজগঞ্জ থেকে আলাদা আলাদা চিঠি লিখলেন। বাবা একদিন সন্ধ্যায় পাংশুমুখে তিনটি খামে বন্ধ চিঠি নিয়ে আমাদের ঘরে এসে দাঁড়ালেন। কাঁপা গলায় বললেন, তোমাদের মা চিঠি লিখেছেন। তোমরা কি সেই চিঠি পড়তে চাও?

বাবার গলা কাঁপছিল। আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম। বাবা চাচ্ছেন আমরা বলি, না। বাবা কপালের ঘাম মুছে নিচু স্বরে বললেন, আমরা সবাই তাকে ভুলতে চেষ্টা করছি। এখন আবার চিঠিপত্র শুরু করলে কষ্ট হবে। নতুন করে কষ্ট হবে।

বাবা থামতেই সেতারা বলল, আমার চিঠি দাও। খানিকক্ষণ চুপ থেকে নীলু বলল, আমার চিঠিটাও দাও। শুধু আমি কিছুই বললাম না। বাবা ধরা গলায় বললেন, মামণি রাত্রি, তোমারটা?

আমি চাই না।

কি লেখা ছিল নীলু এবং সেতারার চিঠিতে আমি জানি না। নীলু। সমস্ত কথাই আমাকে বলে। শুধু চিঠির ব্যাপারে কিছু বলল না। আর সেতারা তো তার খামই খুলল না। বন্ধ খাম হাতে নিয়েই ঘুরে বেড়াতে লাগল।

আমি বললাম, খুলে দেব?

না।

না খুললে পড়বি কি করে?

আমি পরে পড়ব।

যেন পড়লেই চিঠির মজা শেষ হয়ে যাবে। আমি সমস্ত দিন ভাবলাম কি লিখেছেন মা চিঠিতে? ক্লাসে আপারা কি পড়ালেন কিছুই বুঝতে পারলাম না। অংক আপা দুবার ধমক দিলেন, এই বিলু তোমার পড়ায় আজকে মন নেই, কি ব্যাপার?

কিছু না আপা।

আমি কি বলছি তুমি তো কিছুই শুনিছ না।

শুনছি আপা।

না শুনিছ না। বল তো আমি কি বলছিলাম?

আমি বলতে পারলাম না। সব মেয়েরা হেসে গড়িয়ে পড়তে লাগল। আমার ক্লাসের মেয়েরা বিচিত্র কারণে আমাকে অপছন্দ করে। সব সময় আমার পেছনে লেগে থাকে। আমাদের বাথরুমের দেয়ালে আমাকে নিয়ে অনেক কথাবার্তা লেখা। একটা নেংটা মেয়ে এবং একটা নেংটা ছেলের ছবি আঁকা আছে। মেয়েটার গায়ে লেখা বিলু ক্লাস নাইন খ শাখা। অথচ কোথাও নীলুর নামে কিছু লেখা নেই। আমি কখনো বাথরুমে যাই না। যদি যেতেই হয় তাহলে অনেকক্ষণ সেখানে বসে কাদি। ইরেজার দিয়ে লেখাগুলি তুলে ফেলতে চেষ্টা করি–কিছুতেই সেগুলি উঠানো যায় না।

বিলু মন দিয়ে পড়াশুনা করবে, বুঝলে। এরকম করলে তো হবে না।

ক্লাসের মেয়েগুলি আবার হৈচৈ করে হেসে উঠল। বাড়িতে ফিরে এসে অনেকক্ষণ একা একা বসে রইলাম। রাতে রমজান ভাইকে বলে দিলাম, ক্ষিধে নেই, কিছু খাব না। অনেক রাতে ঘুমাতে গিয়ে দেখি আমার-বালিশ্রের নিচে মায়ের পাঠানো খামটা রেখে দেয়া। নিশ্চয়ই বাবার কাণ্ড।

ঘরে কেউ নেই। নীলু এখনো পড়ছে। সেতারা রান্নাঘরে রমজান ভাইয়ের সঙ্গে কি যেন করছে। আমি দরজা বন্ধ করে খাম খুলে ফেললাম। মা আমাকে বিলু নামে সম্বোধন করেননি, প্রথমবারের মত লিখেছেন রাত্রি।

মামণি রাত্রি,
আমি জানি রাগ করেছ তুমি। কিন্তু কি করব মা। উপায় ছিল না। তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে। মানুষের মন খুব বিচিত্র জিনিস। একবার কোনো কিছুতে মন বসে গেলে তা ফেরানো যায় না। আমি বহু চেষ্টা করেছি। মানুষ হয়ে জন্মানোর মতো কষ্টের কিছু নেই। আমি তোমাদের ছেড়েছুড়ে এসেছি। তবু রাতদিন তোমাদের কথাই ভাবি। রাতদিন প্রার্থনা করি যে কষ্ট আমি পাচ্ছি। তা যেন কখনো আমার মামণিদের না হয়।
–তোমার মা।

থার্ড পিরিয়ডে অংক আপা

থার্ড পিরিয়ডে অংক আপা ক্লাসে ঢুকেই বললেন, বিলু ক্লাস শেষে আজি তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে।

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। অংক আপা আজেবাজে প্রশ্ন করবেন। কয়েকদিন আগে হাফ টাইমের সময় অংক আপার সঙ্গে দেখা। আপা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, তোমার মা শুনলাম ঐ লোকটার সঙ্গে ইন্ডিয়া চলে গেছে, সত্যি নাকি?

না সত্যি না।

কোথায় আছে তাহলে?

আমি চুপ করে রইলাম।

আপা গলা নিচু করে বললেন, বলতে পার না, না?

সিরাজগঞ্জে আছেন।

ও বাচ্চাকাঁচা হয়েছে নাকি?

আমি জানি না আপা?

আমাকে কে যেন বলল একটা ছেলে হয়েছে।

আমার নিজের ধারণা মেয়েদের মতো হৃদয়হীন পুরুষরা হতে পারে না। ছেলেরা কেউ এখনো আমাকে আমার মা প্রসঙ্গে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। অথচ চেনাজানা মেয়েদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে কিছু জানতে চায়নি।

ক্লাসের বন্ধুদের কথা বাদই দিই, বন্ধুদের মা-খালাদের পর্যন্ত কৌতূহলের সীমা নেই। কোনো না কোনো ভাবে টেনেন্টুনে ঐ প্রসঙ্গ আনবেই।

বিলু তোমরা আগে কিছু টের পাওনি? আগেই তো টের পাওয়া উচিত।

তোমার মা নাকি যাবার আগে বহু টাকা-পয়সা নিয়ে গেছে?

মা গিয়েছেন প্রায় দুবছর আগে। এখনো কেউ সেটা ভুলতে পারে না কেন কে জানে?

অংক ক্লাসটা আমার খুব খারাপভাবে কাটল। ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র গেলাম। আপার কাছে। আপার নিজের কোনো ঘর নেই। কমন রুমে একগাদা টিচারের সঙ্গে বসে আছেন। তিনি আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোমাদের বাড়িতে বয়স্ক মহিলা কেউ নেই?

কাজের একটি মেয়ে আছে। আকবরের মা।

সে ছাড়া কেউ নেই?

জি না আপা। কেন?

তোমরা তো বড় হচ্ছে এখন, কিছু কিছু জিনিস তোমাদেব বলা দরকার, কেউ বলছে না। তাই তোমাকে ডাকলাম।

আমি আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আপা খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললেন, বিলু তোমার এবং নীলুর দুজনেরই এখন ব্ৰা পরা উচিত।

আমি চোখ-মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

তোমার বাবাকে বলবে কিনে দিতে। বাবাকে বলাব মধ্যে লজ্জার কিছু নেই। আর যদি লজ্জা লাগে তাকে আমি একটি চিঠি লিখে দিতে পারি।

দিন, একটা চিঠি লিখে দিন।

ঠিক আছে, ক্লাস ছুটির পর চিঠি নিয়ে যেও। আরেকটি কথা, নীলু। মোটেই পড়াশোনা করছে না। তোমার বাবাকে বলবে কোনো প্রাইভেট টিচার রেখে দিতে। অংকে সে খুব কাঁচা। অংক জানে না বললেই হয়।

আপা আমি বলব।

আছে তুমি যাও এখন। এই সব বললাম দেখে কিছু মনে করনি তো?

জি না।

মনে হচ্ছে তুমি আমার ওপর রাগ করেছ। রাগ করার কিছু নেই বিলু। তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি। এত ঝামেলার মধ্যেও যে মেয়ে প্রতি বিষয়ে সবচে বেশি নাম্বার পায় তার প্রশংসা তো করতেই হয়।

অংক আপা একটু হাসলেন।

বিলু?

জি।

কখনো কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলবে।

ঠিক আছে আপা বলব।

শোন আরেকটা কথা। ইয়ে কি যেন বলে তোমার বাবা-নাকি আবার বিয়ে করছেন?

জি না।

তুমি বোধহয় জানো না। বাবার বিয়ের কথা তো মেয়েদের জানার কথা নয়।

বাবার বিয়ের কথা কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছে। দিনাজপুর থেকে বড় মামা এসেছিলেন। তিনি পর্যন্ত নিলুকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করেছেন, দুলাভাই নাকি বিয়ে করছেন? নিলু তার স্বভাবমত হেসে ভেঙে পড়েছে।

হাসছিস কেন?

হাসির কথা বললে হাসব না মামা?

আমি কি হাসির কথা বললাম নাকি? বিয়ে করলে তোদের অবস্থাটা কি হবে ভেবেছিস?

কি আর হবে। আমার তো মনে হয়। ভালই হবে। কথা বলার একজন লোক পাওয়া যাবে।

কথা বলার লোকের তোর অভাব?

হ্যাঁ মামা। বিলুর সঙ্গে কি আর কথা সব বলা যায়? মা জাতীয় একজন কেউ লাগে। বাবা বিয়ে করলে ভাল হয় মামা।

করছেন নাকি?

জানি না মামা। তবে দোতলার নজমুল চাচা একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাবা এখন একটা বিয়ে করলে মনে হয় সংসার স্বাভাবিক হয়।

তুই কি বললি?

আমি বললাম, তা তো ঠিকই।

মামা গম্ভীর হয়ে পড়লেন। নীলু বলল, তারপর একদিন এক বুড়োমত ভদ্রলোক এসে বাড়িটাড়ি ঘুরেটুরে দেখলেন। মার সঙ্গে বাবার সম্পর্ক কি রকম ছিল জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করলেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ মামা, বিয়ে বোধহয় লেগে যাচ্ছে।

নীলু খিলখিল করে উঠল। আমি নিজেও অবাক হলাম। এসব কিছুই আমি জানি না। নীলু আজকাল অনেক কথাই আমাকে বলে না। প্রায়ই সে তার বান্ধবীর বাড়ি যাচ্ছে হঠাৎ করে তার সঙ্গে এত খাতির হল কেন–জিজ্ঞেস করাতে সে গা এলিয়ে হোসেছে। এ বাড়ির সবাই বদলে যাচ্ছে। বাবা বদলেছেন সবচেয়ে বেশি। আমাদের জন্মদিন গেল। জুন মাসের দশ তারিখ। বাবা কোনো কবিতা লিখলেন না। কয়েকদিন আগে দেখলাম সেতারাকে কি জন্যে যেন ধমকাচ্ছেন। সেতারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বাবার এরকম আচরণ তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। বাড়িও ফিরছেন। আজকাল অনেক রাতে। গতকাল বাড়ি ফিরলেন সাড়ে এগারোটার দিকে। আমি জেগে বসে ছিলাম। বাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, এত রাত পর্যন্ত জেগে বসে আছ কেন? আর থাকবে না। দশটা বাজতেই ঘুমাতে যাবে।

আমি শান্ত স্বরে বললাম, তুমি আমার সঙ্গে এত রেগে রেগে কথা বলছ কেন?

রেগে রেগে কথা বলছি নাকি?

আমি উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলাম। বাবা খাওয়া-দাওয়ার পর আমার ঘরে পাশের জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে ডাকলেন, এই বিলু, বিলু। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম। বাবা বেশ খানিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলেন।

বাবা এরকম ছিলেন না, বাবা বদলে যাচ্ছেন। নীলু। তো বদলে গেছে। আমি নিজেও বোধহয় বদলাচ্ছি। একা একা থাকতে ইচ্ছে করে। সেদিন খুব ঝগড়া করলাম নীলুর সঙ্গে। আমি মাঝে মাঝে অচেনা সব মানুষদের মন গড়া চিঠি লিখি, নীলু। সেটা জানে। তবু সে একটা চিঠি হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, প্রেমপত্র নাকি রে? তারপর মুখ বাঁকা করে পড়তে শুরু করল–আপনাকে একটি কথা বলা হয়নি। এখন শ্রাবণ মাস তো, তাই খুব বৃষ্টি হচ্ছে। রাতদিন ঝমঝম বৃষ্টিশ নীলু। বহু কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, শ্রাবণ মাস কোথায় রে, এটা তো আশ্বিন মাস। তোর মাথাটা খারাপ। হি-হি-হি। আমি চিঠি কেড়ে নিয়ে নীলুর গালে একটা চড় কষিয়ে দিলাম। নীলু দারুণ অবাক হয়ে গেল। আমি এরকম ছিলাম না।

বাবা বিয়ে করলে সংসার স্বাভাবিক হলে তো ভালই হয়। নীলু ঠিকই বলেছে, সব বাড়িতে মা জাতীয় একজন কেউ দরকার। সে সময়মত মেয়েদের ব্ৰা কিনে দেবে।

কিন্তু আমার বড় মামা সেদিকটা দেখছেন না। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে খুব খারাপ কিছু-একটা হতে যাচ্ছে। মামা বললেন, খোঁজখবর না রাখায় এটা হচ্ছে। নানান ধান্ধায় থাকি। খোঁজখবর নেই তা ঠিক। মামার বাড়ির সঙ্গে এখন সম্পর্ক নেই বললেই হয়। মামারা অনেকদিন ধরে আসেন না। আগে ঘনঘন আসতেন এবং যতবার আসতেন ততবারই জিদ করতেন। আমাদের দিনাজপুরে নেবার জন্যে। বাবা ব্যবসাপাতির ঝামেলা তুলে এড়িয়ে যেতেন। মা স্পষ্ট বলতেন, তোমাদের বৌদের সঙ্গে আমার বনে না। বাবা মা মারা গেলে বাপের বাড়ি থাকে না। সেখানে যাওয়া যায় না।

বাবা আবার বিয়ে করবেন কি-না এই প্রসঙ্গে বড় মামার এরকম কৌতূহলের কারণ কি আমি ধরতে পারি না। মামাদের সঙ্গে আমার বাবার তেমন আন্তরিকতা নেই। এইসব নিয়েও মার সঙ্গে তার ঝগড়া হত। মা বলতেন, আমার ভাইদের তুমি সহ্য করতে পার না, এর কারণ কি আমাকে বল তো?

সহ্য করতে না পারার কি আছে?

কথা বল না, চুপচাপ থাক।

একেক জনের একেক রকম স্বভাব। আমার স্বভাবই হচ্ছে কথা কম বলা।

দোতলার নজমুল হুঁদা সাহেরের সঙ্গে তো খুব বকবক কর।

আমি বকবক করি না। উনি করেন। আমি শুনি।

আমার ভাইদের সঙ্গে তো তাও কর না।

ওনার বকবকানি শোনা যায়। তোমার ভাইদেরটা শোনা যায় না।

ও–তাই বুঝি?

বাবা চুপ। মা কাটা কাটা গলায় বললেন, বেশ তো আমি ওদের বলব যেন আর না আসে।

মামাদের আসা বন্ধ হয়নি। আমার ধারণা বাবার কাছ থেকে তারা টাকা-পয়সা নিতেন। আমার সব মামারাই ব্যবসা করতেন। টাকার দরকার তাদের লেগেই থাকত। এটা অবশ্যি আমাদের অনুমান। কারণ মামারা হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেই মা গম্ভীর মুখে বলতেন, দরকার ছাড়া তো তোদের আসা হয় না, আবার দরকার হয়েছে বুঝি? মামারা অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসতেন।

এবারো যখন এলেন সম্ভবত টাকার জন্যেই এলেন। বাবার ব্যবসা পাতির অবস্থা সম্পর্কে খুব ব্যস্ত হয়ে খোঁজখবর শুরু করলেন। আমার ঘরে ঢুকে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন, দুলাভাইয়ের ব্যবসা কেমন চলছে রে?

ভালই বোধহয়। আমি তো এইসব ঠিক জানি না।

না জানলে হবে কেন? খোঁজখবর রাখতে হয়। দুলাভাইয়ের ছেলে নেই। তোদেরই তো খোঁজ করতে হবে। ঠিক না?

আমি চুপ করে থাকি। বড় মামা সিগারেট ধরান একটা। নিচু গলায় বললেন, মনে হল দুলাভাইয়ের ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। তোদের গান-বাজনা শেখাচ্ছেন, এসব তো দারুণ খবচান্ত ব্যাপার। হাতি পোষার মতো, লাভ হয় না কিছু।

লাভ হবে না কেন?

আরে দূর, দুই-একদিন সারেগামা করলেই যদি গান হত তাহলে কি আর কথা ছিল নাকি? আমি কোনো উত্তর দিলাম না। বড় মামা হঠাৎ করে বললেন, তোদের এখন শাড়ি পরা উচিত, বুঝলি? তোর আর নীলুর। বড় হয়ে গেছিস।

কথাটা এমন অপ্রাসঙ্গিকভাবে বলা যে আমি হকচাকিয়ে পেলাম। বড় হয়ে যাচ্ছি। বড় হওয়াটা খুব-একটা কি বাজে ব্যাপার?

রাস্তাঘাটে একা একা চলাফেরা করবি না। ঐদিন দেখলাম সন্ধ্যার পব নীলু বাড়ি আসল।

বন্ধুর বাড়ি গিয়েছিল। জন্মদিন।

জন্মদিন-ফন্মদিন যাই হোক একা একা যেন না যায়। সুন্দরী মেয়েদের অনেক রকম যন্ত্রণা।

আমরা সুন্দরী বুঝি?

হুঁ, ইয়ে সুন্দরী তো বটেই। আয়না দিয়ে নিজেদের দেখিস না?

আমি হঠাৎ বলে বসলাম, কে বেশি সুন্দর মামা? আমি না নীলু?

মামা জবাব দিলেন না। তাঁকে খুব বেশি চিন্তিত মনে হতে লাগল।

 

ক্লাস নাইনের হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষাতে নীলু অংক এবং ইংরেজিতে পাস করতে পারল না। অংকে পেল। তেইশ আর ইংরেজিতে একত্রিশ। তাকে খুব বিচলিত মনে হল না। হাসিমুখে বলল, দূর–আমি আর পড়াশুনা করব না।

করবি না তো কি কারবি?

বিয়ে করব।

বিয়ে করবি মানে? কাকে বিয়ে করবি?

বিয়ে করার লোকের অভাব আছে নাকি? আমি হ্যাঁ বললে এক্ষুণি দুতিনটা ছেলে চলে আসবে।

তাই নাকি?

হুঁ, তুই কী ভাবিস আমাকে?

আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, বাবা পরীক্ষার রেজাল্ট দেখে রাগ করবেন।

রাগ করবার কী আছে? সবাই একরকম হয়? কেউ ভাল করে, কেউ করে না।

বাবা রাগ করলেন না। প্রগ্রেস রিপোটটা দেখলেন অবাক হয়ে।

এ রকম হয়েছে কেন নীলু?

পড়াশুনা করতে আমার ভাল লাগে না বাবা।

আগে তো লাগত।

আগেও লাগত না। জোর করে পড়ড়াম।

ভাল না লাগলেও অনেক কিছু করতে হয় নীলু। তোমাদের জন্যে একজন টিচার রেখে দিলে কেমন হয়?

নীলু কথা বলে না। বাবা বললেন, তোমার কী মনে হয় বিলু মা?

ভালই হবে।

নীলু হালকা স্বরে বলল, এখন থেকে আমি একা একটা ঘরে থাকতে চাই বাবা।

পশ্চিমের ঐ ঘরটা পরিষ্কার করে দিলেই হবে। আমি রমজান ভাইকে বলব।

একা থাকার দরকার কী? তোমার তো আবার ভূতের ভয়।

এখন আমার ভূতের ভয় নেই বাবা।

আমার মনে হয় না। এটা ভাল হবে।

ভালই হবে বাবা।

ঠিক আছে। সেতারা কার সঙ্গে থাকবে?

তোমার সঙ্গে কিংবা বিলুর সঙ্গে।

উঠি চলে গেল। বাবা গন্ধীর হয়ে বললেন, তোর সঙ্গে ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে?

জি না।

নীলু সারা দুপুর জিনিসপত্র সরিয়ে পশ্চিমের ঘরটা গোছাল। আমি কয়েকবার বললাম, এই–রাত্ৰিবেলা ভয় পাবি। নীলু। কোনো উত্তর দিল না। বিকেলের মধ্যে দেখলাম ঘর তৈরি হয়ে গেছে। একটা খাট। পড়ার টেবিল। আলনা। মায়ের ড্রেসিং টেবিল দিয়ে চমৎকার সাজিয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এক ফাঁকে আমাদের ঘর থেকে মায়ের ছবিটাও নিয়ে গেছে।

সেতারা পড়েছে খুব মুশকিলে। সে রাতে কার সঙ্গে ঘুমোবে বুঝতে পাছে না। আমাকে সে ঠিক পছন্দ করে না। বাবার সঙ্গেও থাকতে চায় না। কিন্তু নীলু বলে দিয়েছে সে একা একা ঘুমোবে। আমি সেতারাকে বললাম, ওর যা ভূতের ভয়, দেখবি রাত আটটা বাজিলেই এই ঘরে চলে আসবে কিংবা তোকে নিয়ে যাবে।

সেতারা খুব-একটা ভরসা পাচ্ছে না। সে মুখ কালো করে দুপুর থেকেই আমার পেছনে ঘুরছে।

ছুটির দিন বিকালে সাধারণত নজমুল চাচা আমাদের সঙ্গে এসে চা খান। আজ তিনি খবর পাঠালেন তার ঘরে গিয়ে যেন আজকের চাটা খাওয়া হয়। তিনি মুক্তাগাছার মণ্ডা আনিয়েছেন। নীলু বলল, দূর–আমি যাব না।

যাবি না কেন?

আমার মাথা ধরেছে।

দুটো এসপিরিন খা।

বললাম তো ভাল লাগছে না।

নীলু তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

নজমুল চাচার শরীর ভাল ছিল না। চাদর মুড়ি দিয়ে বসে ছিলেন। নজমুল চাচা, সাধারণত চা খেতে খেতে মজার মজার গল্পগুজব করেন। আজ সে সব কিছুই হল না। নজমুল চাচা বিরসমুখে বললেন, তোর বাবার একটা বিয়ের কথা হচ্ছে। মেয়েটির হাসবেন্ড মারা গেছে একাত্তুরের যুদ্ধে। একটি ছেলে আছে। ন’বছর বয়স। ছেলেটা তার নানার কাছে থাকে।

আমি কিছু বললাম না। নজমুল চাচা বললেন, মেয়েটা খুব ভাল। আমি চিনি। প্রাইমারি স্কুলের টিচার। একদিন নিয়ে আসব। এখানে। তোরা কথাবার্তা বলিস।

জি আচ্ছা।

সৎ মায়ের অত্যাচার-টত্যাচার সম্পর্কে যা শোনা যায় সে সব ঠিক না। তাছাড়া তোরা তো যথেষ্ট বড় হয়েছিস। এত বড় বড় মেয়েরা তো সাধারণত বন্ধুর মতো হয়। ঠিক না?

জানি না, হয়ত হয়।

তোর বাবার অবস্থাটা দেখতে হবে না? রাত-বিরাতে বাড়ি ফেরার বাজে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে।

আমি চুপচাপ বসে রইলাম।

নীলু আসেনি যে?

ওরা নাকি মাথা ধরেছে।

ও নাকি পরীক্ষা খুব খারাপ করেছে?

জি।

সংসারে বিশৃঙ্খলা আসার জন্যে এটা হয়েছে। বুঝতে পারছিস তো?

চাচা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, রমজান ভাই এসে বলল, ইউনিভার্সিটির একজন মাস্টার নাকি নিচে বসে আছে।

চাচা অবাক হয়ে বললেন, কিসের মাস্টাের? মাস্টার এখানে কী জন্যে? বিলু তুই উপরে আমার কাছে পাঠিয়ে দে তো।

বসার ঘরে গম্ভীর চেহারার একজন ভদ্রলোক বসে আছেন। বয়স খুব বেশি নয়। কিন্তু অন্য রকমের একটি ভারিক্কি ভাব আছে। ভদ্রলোক আমাকে দেখেই বললেন, একটু দেরি করে ফেললাম, না?

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

আমি আগেই আসতাম। ভাবলাম জন্যদিনে খালি হাতে আসা ঠিক না। কিন্তু তোমাদের এখানে তো কিছু পাওয়া যায় না। আমি ঘণ্টাখানিক ঘোরাঘুরি করেছি। কবিতার বই পাওয়া যায়। কবিতা তো তুমি পড় না, নাকি পড়?

আমি অবাক হয়ে বললাম, আপনি বোধহয় নীলুর কাছে এসেছেন। আমি ওর ছোট বোন বিলু। আমরা যমজ বোন। ভদ্রলোক দীর্ঘ সময় স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলেন।

নীলু আমাকে বলেনি। তার যমজ বোন আছে। লোকজন কী সব চলে গেছে নাকি?

কিসের লোকজন?

আজি নীলুর জন্মদিন না?

না তো।

ও আমাকে বলেছিল আসতে। সম্ভবত ঠাট্টা। আমি বুঝতে পারিনি। আমি ঠাট্টা বুঝতে পারি না।

ভদ্রলোক চোখ থেকে চশমা খুলে কাঁচ মুছতে লাগলেন। আমি বললাম, আপনি বসুন, আমি নীলুকে ডেকে নিয়ে আসি।

তোমাদের চেহারায় অদ্ভুত মিল। যমজ বোনদের মধ্যেও কিছু ডিফারেন্স থাকে। একজন মোটা হয়। অন্যজন রোগা কিন্তু…।

ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন।

আপনি বসুন আমি এক্ষুণি ডেকে আনছি।

নীলুকে ভদ্রলোকের কথা বলতে সে ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

এইসব কী রে নীলু? ভদ্রলোক কে?

মুন্নিকে তো চিনিস? মুন্নির দূর-সম্পর্কের ভাই।

তাকে আসতে বলেছিলি?

হুঁ।

কেন?

এমনি বলেছি।

আয় তাহলে। কী যে কাণ্ড।

আমি যেতে পারব না। আমার মাথা ধরেছে।

নীলুর মাথা ধরেছে এবং গায়ে বেশ জ্বর শুনে ভদ্রলোক অল্প হাসলেন।

আচ্ছা ঠিক আছে, আমি তাহলে যাই। ওর জন্যে দুটো বই এনেছিলাম— দিয়ে দিও।

আপনি বসুন, চা খেয়ে যান।

তোমার বাবা আছেন?

জি না। উনি রাত করে ফেরেন।

তোমার বাবা যখন থাকবেন তখন একদিন আসব।

ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। হাসিমুখে বললেন, আমি আসব। এটা বোধহয় নীলু ভাবেনি। এসে পড়েছি দেখে হকচাকিয়ে গেছে।

আপনি বসুন না, চা খেয়ে যান। উপরে নজমুল হুদা চাচা আছেন, তাঁর কাছেও বসতে পারেন।

না না, ঠিক আছে।

আমি ভদ্রলোককে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক শান্ত স্বরে বললেন, বেশ একটা অস্বস্তিকর অবস্থা হয়ে গেল। তাই না? আমার প্রবলেম হচ্ছে আমি ঠাট্টা-তামাশা ঠিক ধরতে পারি না। মনে হয় আমার বুদ্ধিশুদ্ধি নিচু স্তরের।

বলেই ভদ্রলোক উঁচু গলায় হেসে উঠলেন। একজন ভারিক্কি ধরনের গম্ভীর চেহারার ভদ্রলোক এমন ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠবেন আমি কল্পনাও করিনি।

নীলু বলল সে রাতে খাবে না

নীলু বলল সে রাতে খাবে না।

কোন খাবি না রে?

বললাম না। জ্বর।

রমজান ভাই কাউকে না খাইয়ে ছাড়ে না। সে ক্রমাগত ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল, রাইতে ভাত না খাইলে এক চড়ুইয়ের রক্ত পানি হয়।

নীলু শব্দ করল না। তার ঘরের দরজাও খুলল না। সেতারার মনে ক্ষীণ আশা ছিল হয়তো শেষপর্যন্ত নীলু। তাকে ডেকে নেবে। সে সব কিছুই হল না। রাত নটা বাজতেই নীলু। তার ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল।

খুব বৃষ্টি হল সে রাতে–ঝমঝম করে বৃষ্টি। আকবরের মা বলল, আশ্বিন মাসে বিষ্টি, লক্ষণ খুব বালা।

আমি অনেক রাত পর্যন্ত বাবার জন্যে অপেক্ষ করতে লাগলাম। বাবাকে কী সব খুলে বলা উচিত? বাবা খুব দেরি করতে লাগলেন। ঝড়বৃষ্টিতে এদিকে সব ভাসিয়ে নিচ্ছে।

বাবা ফিরলেন গভীর রাতে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। রমজান ভাই আমাকে ডেকে তুলে ফিসফিস করে বলল, ছোট আফা, লক্ষণ বেশি বালা না।

কেন কী হয়েছে?

মদ খাইয়া আইছে।

সমস্ত রাত আমার ঘুম হল না।

 

সেতারা এক কাণ্ড করেছে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেছে। দুটি পত্রিকার (দৈনিক বাংলা, অবজার্ভার) প্রথম পাতায় তার ছবি ছাপা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত থেকে শিশুসংগীত সম্মেলনের গ শাখায় স্বর্ণপদক নিচ্ছে।

অথচ বাবা সেতারাকে ঢাকায় যেতেই দিতে চাননি। গানের স্যারের কত ধরাধরি কত সুপারিশ। বাবার এক কথা, না, এইসবের দরকার নেই।

শেষপর্যন্ত নজমুল চাচা যখন সঙ্গে যেতে রাজি হলেন তখনই শুধু গম্ভীর মুখে বাবা রাজি হলেন।

ঢাকায় গিয়ে সে যে এই কাণ্ড করেছে তাও আমরা জানি না। রমজান ভাই পত্রিকা পড়ে। প্রথম জানল এবং এমন চোঁচামেচি শুরু করল–।

সেতারা যে ভেতরে ভেতরে এমন ওস্তাদ হয়ে উঠেছে তা আমরা বুঝতেই পারিনি। সকাল বেলা ঘুম ভেঙেই অবশ্যি শুনতাম—

কোয়েলিয়া বলেরে মাই
অঙ্গনা মোরে বারে বারে
পিয়া পরদেশ গাওন কিন্নু
সদরঙ্গ পিয়ারাবা তোমাবিনা নয়নানা দরশন বারে বারে।

 

একই জিনিস সকালে একবার বিকেলে একবার। মাথা ধরে যাওয়ার মত অবস্থা। বাবা পর্যন্ত গানের স্যারকে একদিন বললেন, ছয় সাত মাস ধরে একই জিনিস গাচ্ছে শুনতে খুবই বিরক্ত লাগে।

গানের স্যার একগাল হেসে বললেন, সময় হলে দেখবেন। হা হা হা। সময় হোক না।

ফিরে আসবার পর সেতারার একটা সংবর্ধনাও হল। আমি সেতারাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম। বাবা কোথাও যানটান না। নীলুও যাবে না।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এলেন, আরে নীলু, এই মেয়ে তোমার বোন? তুমি তো বলনি তোমার এমন গুণী বোন আছে। আস তুমি, তোমার সঙ্গে কথা আছে।

একবার ভাবলাম বলি, আমি বিলু। কিন্তু কিছুই বললাম না।

আমি দিন দশোকের মধ্যে চলে যাব। ইউনিভার্সিটি খুলে যাচ্ছে।

ও।

পরশুদিন আসতে বলেছিলাম আসিনি তো?

আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম।

আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। একবার ভাবলাম যাই তোমাদের বাসায়।

আমি বিলু। নীলু আসেনি।

ভদ্রলোক চশমা খুলে কাঁচ পরিষ্কার করতে লাগলেন।

এত পরে বলছ কেন? প্রথমে বললেই হত।

ভদ্রলোক রাগী চোখে তাকালেন। আমার দিকে। আমি এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। একবার পেছন ফিরে দেখলাম তিনি কেমন যেন খড়গ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমার কেন জানি খুব কষ্ট হতে লাগল।

আমাকে কেউ তেমন পছন্দ করে না। কেন করে না। আমি জানি না। নীলু অন্য ঘরে চলে যাবার পর সেতারাও চলে গিয়েছে তার সঙ্গে। আকবরের মা আগে আমার ঘরের সামনে পাটি পেতে ঘুমাত, এখন ঘুমোচ্ছে ওদের ঘরের সামনে। নজমুল চাচা সব ঈদে আমাদের উপহার দেন। আমি লক্ষ্য করেছি নীলুর উপহারটা হয় অনেক সুন্দর অনেক দামি।

ক্লাসের মেয়েরাও আমাকে পছন্দ করে না। টগরেব বোনের বিয়েতে টগর ক্লাসের পাঁচটি মেয়ে ছাড়া সবাইকে দাওয়াত করল। আমি ঐ চার-পাঁচজন মেয়েদের মধ্যে একজন। সবাই এরকম করে কেন আমার সঙ্গে?

নীলু ইদানীং আমার সঙ্গে কথা বলা ছেড়েই দিয়েছে। নিজের থেকে কিছু জিজ্ঞেস কবলে তবেই জবাব। সেদিন দেখলাম খুব সাজগোজ করছে। আমি বললাম, কোথায় যাচ্ছিস রে?

যাচিছ এক জায়গায়।

কোথায়? কোনো বন্ধু?

নীলু চুপ করে রইল।

ঐ ভদ্রলোকের কাছে যাচ্ছিস বুঝি?

গেলে কী হয়?

প্রায়ই যাস নাকি?

মাঝে মাঝে যাই।

এরকম যাওয়া ঠিক না। লোকজন খারাপ বলবে।

খারাপ বললে বলুক না। আমি কী পায়ে ধরে সোধছি–আমাকে খারাপ না বলার জন্যে।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, ঐ ভদ্রলোকের নাম কী?

রকিব ভাই, অংক পড়ায়। খুব শিগগির আমেরিকা চলে যাবে।

উনিই বলেছেন বুঝি?

মুন্নি বলেছে। উনি মুন্নির খালাতো ভাই হন।

কোন মুন্নি? কালো মুন্নি?

হুঁ।

নীলু কপালে একটা টিপ পরে অনেকক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে আবার টিপটি তুলে ফেলল। হালকা গলায় বলল, মুন্নির ধারণা রকিব ভাই ওকে বিয়ে করবে।

করবে নাকি?

কী জানি করতেও পারে। আমার কিছু যায় আসে না। করতে চাইলে করবে।

যায় আসে না, তাহলে যাস কেন?

নীলু থেমে থেমে বলল, আমি ওদের বাড়ি গেলেই মুন্নি রাগ করে। দারুণ রাগ করে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না। আমার খুব মজা লাগে। সেই জন্যে যাই।

ছিঃ, নীলু। এইসব কী?

শুধু মুনি না। ওর মাও রাগ করেন। সেদিন কি বলছিলেন শুনবি?

কি বলছিলেন?

বলছিলেন, মুন্নির সঙ্গে রকিব ভাইয়ের বিয়ের কথা সব পাকাপাকি হয়ে আছে, শ্রাবণ মাসে। বিয়ে? ডাহা মিথ্যা। কোনো কথাই হয়নি।

তুই জানালি কী করে কোনো কথা হয়নি?

আমি জিজ্ঞেস করলাম।

কাকে জিজ্ঞেস করলি?

রকিব ভাইকে। আবার কাকে?

খুব খারাপ হচ্ছে নীলু।

খারাপ হলে আমার হচ্ছে, তোর তো হচ্ছে না। তুই আমার সঙ্গে বকবক করিস না। যা ভাগ।

নীলু আজকাল স্কুলেও নিয়মিত যাচ্ছে না। সকালবেলা স্কুলে যাবার জন্যে তৈরি টৈরি হয়ে হঠাৎ বলবে, আজকে আর যাব না। পেট ব্যথা করছে।

সেদিন সেলিনা আপা (আমাদের হেড মিসট্রেস) আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। রাগী গলায় বললেন, তুমি কী গত শুক্রবার কালোমত রোগা একটা ছেলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলে? বিউটি লন্ড্রির সামনে?

কই না তো আপা।

আমিও তাই ভাবছিলাম। ঐটা নীলু। আজেবাজে ছেলের সঙ্গে আজকাল খুব মিশছে মনে হয়। তোমার বাবাকে বলবে। ঐ সব লোফার টাইপের ছেলে। পানের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায়, মেয়ে দেখলে শিস দেয়। বলবে তুমি তোমার বাবাকে।

জি বলব।

ঠিক আছে তোমার বলার দরকার নেই। তাকে বলবে। আমার সঙ্গে দেখা করতে।

জি আচ্ছা।

তাছাড়া ও তো রেগুলার ক্লাসেও আসে না। বাড়িতে শাসন না থাকলে যা হয়।

নীলু। এসব শুনে গা দুলিয়ে হাসতে লাগল, দূর ঐ ছেলের সঙ্গে আমি ঘষাঘষি করব কেন? আমাকে জিজ্ঞেস করল কটা বাজে। আমি বললাম। তারপর আমি বললাম।–আপনার হাতে তো ঘড়ি আছে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? সে ব্যাটা একদম ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল আমার ঘড়ি নষ্ট। আমি বললাম— মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে খুব ভাল লাগে, না? ছেলেটার যে কী অবস্থা। দূর থেকে অন্য বন্ধুগুলি তাকে দেখছে। হি-হি-হি। ঐ পাঁজিগুলি আগে আমাকে দেখলেই শিস দিত। এখন আর দেয় না।

আর কথা হয়নি। ঐ ছেলের সাথে?

আর কথা হবে কেন?

সেলিনা আপা বাবার সঙ্গে কথা বলবেন।

বলুক।

বাবা খুব রাগ করবেন।

করলে করবে।

 

বাবা সত্যি সত্যি রাগ করলেন। বেশ রাগ। চিৎকার চেঁচামেচি। শুধু তাই না, এক পর্যায়ে প্রচণ্ড একটা চড় কষিয়ে দিলেন। নজমুল চাচা ছুটে এলেন, ছিঃ ছিঃ এসব কী কাণ্ড! মেয়ে বড় হয়েছে না?

বাবা ঝাঁঝাল স্বরে বললেন, ওর স্কুল এখন বন্ধ। তুমি একটা ছেলে দেখ তো, ওর বিয়ে দিয়ে দেব।

আচ্ছা সেটা দেখা যাবে। বিয়ে দিতে চাইলে বিয়ে দেবে। বিলু, মা, তুমি আমাদের দুকাপ চা দাও তো। লেবু দিয়ে।

নীলু যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে বলল, আমাকেও এক কাপ চা দিস তো।

পরদিন নীলু স্কুলে গেল না। সন্ধ্যাবেলা বাবার সামনেই তার সমস্ত বই-খাতা বারান্দায় জমা করতে লাগল। বাবা ইজিচেয়ারে বসে অবাক হয়ে দেখতে লাগল।

কী করছিস নীলু?

বইপত্রগুলি সব ফেলে দিচ্ছি বাবা। পড়াশোনা তো আর করছি না। বই দিয়ে কী হবে?

পড়াশোনা করবি না আর?

না। তুমি নিষেধ করলে। তাছাড়া আমারও ভাল লাগে না।

কী করবি ঠিক করেছিস?

এখনো কিছু ঠিক করিনি।

বাবা আর কিছু বললেন না। রাতে ভাত খাবার সময় হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে বললেন, রাগে মাথায় অনেকে অনেক কিছু বলে, সে সব মনের মধ্যে পুষে রাখা ঠিক না।

নীলু মুখ না তুলেই বলল, আমি মনের মধ্যে কিছু পুষে রাখিনি।

আর কোনো কথাবার্তা হল না।

সে রাতে বাবা বাইরে গেলেন না। গম্ভীর হয়ে সেতারার পড়া দেখিয়ে দিতে বসলেন। সেতারা ক্লাস সিক্সে উঠেছে। নতুন ক্লাসে উঠেছে বলেই পড়াশোনায় খুব আগ্রহ। সে হাসিমুখে তার বইপত্র দেখাতে লাগল। বাবা এক সময় আমার পড়াশোনারও খোঁজ নিলেন, পড়াশোনা ঠিকমত হচ্ছে  তো?

জি হচ্ছে।

প্রি-টেস্ট কবে?

এখনো দেরি আছে।

কোন কলেজে পড়বি কিছু ভোবিছিস? ঢাকায় যেতে চাস নাকি?

নাহ।

ঢাকা না যাওয়াই ভাল, যা গোলমাল। এই স্ট্রাইক ওই স্ট্রাইক।

তা ঠিক।

নীলু আমাদের কাছেই কি-একটা গল্পের বই নিয়ে উবু হয়ে আছে, যেন কোনো কিছুই তার কানে যাচ্ছে না।

নীলু এত মন দিয়ে কী পড়ছিস?

ভূতের গল্প।

নাম কী?

ডাকবাংলা রহস্য।

খুব ভয়ের নাকি?

খুব না। কিছু ভয়ের।

বাবা হঠাৎ বললেন, তোরা সবাই মিলে মামার বাড়ি থেকে ঘুরে আয় না। একটা চেঞ্জ হবে। সেতারার তো বোধহয় মনেই নেই।

মনে আছে বাবা, পুকুর পাড়ে দুটো তাল গাছ আছে। আর পুকুরের ঘাটে বসে থাকলে এক রকম মাছ আসে। চোখগুলো বড় বড়। ঠিক না নীলু আপা?

হুঁ। চ্যালা মাছ।

বাবা আবার বললেন, কী রে যাবি তোরা? যাস যদি তোর মামাকে লিখি। এসে নিয়ে যাবে।

তুমি যাবে না?

নাহ। আমার ব্যবসাট্যবসা খুব খারাপ। তোরা তো জানিস না। অবশ্যি আমি নিজেই বলি না। কিছু। প্রেসটা আমি খুব সম্ভব বিক্রি করে দেব। বয়স হয়ে গেছে, এইসব ঝামেলা এখন আর ভাল লাগে না।

নীলু বাবার কথা শুনল, কিন্তু কিছু বলল না।

যাবি মামার বাড়ি?

যাওয়া যায়।

আচ্ছা ঠিক আছে, লিখে দেব তোর মামাকে। পৌষ মাসের দিকে গেলে ধান কাটা দেখবি।

সে রাতে ঘুমাতে গেলাম দশটার দিকে। সেতারা তার বালিশ নিয়ে এসে হাজির। আপা, আজ তোমার সঙ্গে ঘুমাব।

আয়। হঠাৎ আমার সঙ্গে যে।

নীলু আপা বলেছে আজ সে একা একা ঘুমোতে চায়।

বাতি নেভাতে সেতারা ফিসফিস করে বলল, একটা কথা জিজ্ঞেস করি আপা, রাগ করবে না তো?

না রাগ করব কেন?

আগে গা ছুঁয়ে বল রাগ করবে না।

রাগ করব না, বল।

সেতারা বেশ খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, মেয়েদের যখন শরীর খারাপ থাকে তখন কোনো ছেলেকে চুমু খেলে নাকি পেটে বাচ্চা হয়?

বলেছে কে এসব?

বলছে কে এসব?

না হয় না। এই সব জিনিস নিয়ে না ভাবাই ভাল।

তাহলে বাচ্চা কিভাবে হয়?

জানি না কিভাবে হয়, ঘুমা তো।

সেতারা ঘুমিয়ে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। সেতারাও অনেকটা আমার মত, এ বাড়িতে তার কথা বলার কেউ নেই। স্কুলে তেমন বন্ধুবান্ধব নেই। সেদিন দেখলাম টিফিনের সময় ওদের ক্লাসের সব মেয়ে মিলে চুলটান। বিবিয়ানা সাহেববাবুর বৈঠকখানা খেলা খেলছে। সেতারা দূরে দাঁড়িয়ে তৃষিত নয়নে দেখছে।

আমি সেতারার গায়ে হাত রাখতেই সেতারা বলল, মাকে কাল রাতে আমি স্বপ্নে দেখেছি আপা। খুব লম্বা লম্বা চুল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, তুই ঘুমাসনি?

উঁহু।

আয় দুজনে মিলে এক কাজ করি, নীলুকে ভয় দেখিয়ে আসি।

সেতারা উত্তেজনায় উঠে বসল। কিভাবে ভয় দেখাবে? জানালার কাছে গিয়ে ‘হুঁম’ করবে?

তা করা যায়। যাবি?

চল।

আমরা দরজা খুলে পা টিপে টিপে বাইরে এসে দেখি বাবা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছেন। তার পাশের মোড়ায় গুটিশুটি মেরে নীলু বসে আছে। বাবা নীলুর মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। নীলু। সম্ভবত কাদছে। বাবা আমাদের দেখে হালকা গলায় বললেন, কিরে সেতারা–বাথরুমে যাবি নাকি?

না বাবা, আমরা নীলু আপাকে ভয় দেখাবার জন্যে এসেছি।

বাবা হেসে উঠেলেন। দীর্ঘদিন পর বাবা এমন উঁচু গলায় হাসলেন।

নীলু, চোখ মুছে বলল, আমাকে ভয় দেখানো এত সস্তা না!

 

আমাদের বাড়িটির একটি নাম আছে ‘উত্তর দীঘি’। বাড়ির কত সুন্দর সুন্দর নাম থাকে। কিন্তু এ বাড়িটি দেখতে যেমন অদ্ভুত, নামটিও তেমনি। মায়ের খুব সখ ছিল শ্বেত পাথরের একটা নতুন নেম প্লেট লাগাবেন, মাধবী ভিলা লেখা থাকবে সেখানে।

বাড়িটি কিনেছিলেন আমার দাদা। তিনি ধুরন্ধর প্রকৃতির লোক ছিলেন। দাঙ্গার সময় যখন ময়মনসিংহ শহরের বেশির ভাগ ধনী হিন্দু জলের দামে বাড়ি বিক্রি করে কলকাতায় চলে গেল, আমার দাদা। তখন উত্তর দীঘি ও শ্ৰীকালী প্রেস কিনে ফেললেন। টাকা যা দেয়ার কথা তার অর্ধেকও নাকি দেননি। এই সব আমার মায়ের কাছ থেকে শোনা। মা নাকি বিয়ের পর অনেকদিন দেখছেন বাড়ির মালিক বাকি টাকার জন্যে এসে বসে আছে এবং দাদা নানান রকম টালবাহানা করছেন। তার কিছু দিন পর দাদা মারা যান। আমার ধারণা লোকটিকে টাকা-পয়সা না দেয়ার জন্যেই নিদারুণ যন্ত্রণায় দাদার মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পেটে ক্যান্সার হয়েছিল।

আমাদের উত্তর দীঘি বাড়িটি প্রকাণ্ড। দোতলা বাড়ি। তবে ছাদে ওঠার কোনো সিঁড়ি নেই। মার খুব সখ ছিল ছাদে ওঠার সিঁড়ি করবেন। জোছনা রাতে ছাদে হাঁটাহাঁটি করা যাবে। হাঁটাহাটি করার জায়গার অভাব এ বাড়িতে নেই। অনেকখানি জায়গা জুড়ে বাড়ি। কাঁঠাল পেয়ারা আম এবং তেঁতুল গাছ দিয়ে বাড়িটা ঘেরা। বাড়ির সামনে ফুলের গাছ আছে বেশ কয়েকটা এবং জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট দিয়ে উঁচু বেদীর মত করে বাধানো। সেখানে বসে খুব আরাম করে গল্পের বই পড়া যায়। আমার যখন কিছু ভাল লাগে না তখন আমি লাল বেদীগুলোর কোনো-একটিতে বসে থাকি। নীলুর মতে ওগুলো আমার গোসাঘর।

আজ আমার মন খুব ভাল ছিল। মন ভাল হওয়ার কোনো কারণ ঘটেনি। কিন্তু ভালো লাগছিল। তবু আমি গোসাঘরে এসে চুপচাপ বসে রইলাম। সেতারা দোতলার বারান্দায় বসে গলা সাধছিল। বেশ লাগছিল শুনতে। এমন সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। নীলুর সেই রকিব ভাই হঠাৎ করেই যেন আমার সামনে এসে উপস্থিত হলেন। এখানে আসতে হলে গেট খুলে অনেকখানি হাঁটতে হয়। কখন গেট খুললেন এবং কখনই-বা এলেন।

ভাল আছ?

আপনি ভাল আছেন?

আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছিলাম, তুমি পাথরের মূর্তির মত বসে আছ। তোমার বাবা বাসায় আছেন?

জি না। সন্ধ্যা নাগাদ আসবেন।

আমি তার সঙ্গে দেখা করব আজকে, কী বল?

ঠিক আছে।

আমি পরশুদিন সকালে ঢাকা চলে যাব। ভাবলাম যাবার আগে দেখা করে যাই। আর আসা হবে কিনা জানি না।

আর আসবেন না বুঝি?

ভদ্রলোক গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি কী আসতে বল?

আমি চুপ করে রইলাম।

কি, কথা বলছি না যে?

আমি কিন্তু বিলু, আপনি আমাকে নীলু ভাবছিলেন।

ভদ্রলোক চশমা খুলে কাঁচ পরিষ্কার করতে লাগলেন।

নীলু কি বাসায় আছে?

জি আছে। আপনি ভেতরে এসে বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি।

না ঠিক আছে ডাকতে হবে না।

ডাকতে হবে না কেন? আপনি তো ওর সঙ্গেই কথা বলতে এসেছেন?

ভদ্রলোক মাথা নাড়লেন।

ঠিক তা না। আমি নদীর ধার দিয়ে অনেকখানি হাঁটি। আজও তাই করছিলাম। হঠাৎ তোমাকে দেখলাম। ভাবলাম নীলু।

ও।

নীলু অনেকদিন মুন্নিদের বাড়িতে যায় না। মনে হয় ওর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। তুমি জানো কিছু?

জি না। ওর সঙ্গে আমার কথা বন্ধ।

ভদ্রলোক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, তোমরা যে বাচ্চা মেয়ে এটাও মনে থাকে না।

আমি বুঝি বাচ্চা মেয়ে?

হুঁ! তোমরা আড়ি দাও এবং ভাব দাও। ঠিক না?

আমি দেই না, নীলু দিতে পারে। আসুন, ভেতরে এসে বসুন। নজমুল চাচা আছেন, দোতলায় তার ঘরে ও বসতে পারেন।

নজমুল চাচা কে?

আমাদের একজন ভাড়াটে দোতলায় একটা ঘর নিয়ে থাকেন।

নীলু শোন, আমি এখন আর ঘরে ঢুকব না।

আমি কিন্তু বিলু।

ও হ্যাঁ বিলু। তুমি এক কাজ কর, আমি নীলুব জন্যে একটা গল্পের বই এনেছিলাম, ‘ঘনাদার গল্প’ ওটা ওকে দিয়ে দিও।

আমি অল্প হাসলাম। ভদ্রলোক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন, হাসছ কেন?

আপনি একটু আগে বলেছিলেন নীলুর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে আসেননি, এখন বলছেন বই নিয়ে এসেছেন তাই হাসছি।

ঠিক তখন দোতলার বারান্দা থেকে নজমুল চাচা ডাকলেন, এই–এই বিলু উনি কে?

নজমুল চাচার গলা ভয় ধরানো, যেন হঠাৎ ভূত দেখেছেন। অনেকক্ষণ থেকেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন হয়ত।

পরিচয় করিয়ে দেবার পর নজমুল চাচা অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

আরে আপনি জমির আহমেদ সাহেবের ছেলে? আপনাকে চিনিব না বলেন কি? আপনার বাবা ছিলেন কালিনারায়ণ স্কলার।

আমি বাবার মত হইনি অবশ্যি।

আরে আপনিই কম কি। অংকের প্রফেসর! কি সর্বনাশ।

প্রফেসর না। লেকচারার

আমার কাছে লেকচারারও যা প্রেফেসরও তা। কী আশ্চৰ্য কাণ্ড বলেন দেখি! নীলুর সঙ্গে আলাপ হল কিভাবে?

ও আমাকে একটা অংক জিজ্ঞেস করেছিল, আমি করতে পারিনি।

বলেন কি! কী অংক?

ও জিজ্ঞেস করল–পাঁচের সঙ্গে দুই যোগ করলে কখন ছয় হয়?

কখন হয়?

যখন ভুল হয় তখন হয়। অংকটা আসলে সহজ।

নজমুল চাচা ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন। আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, যা নীলুকে আসতে বল। বলবি প্রফেসর সাহেব এসেছেন। চা-টার ব্যবস্থা করতে হবে।

আমি ঘর থেকে বেরোবার সময় শুনলাম ভদ্রলোক বলছেন, আপনি কি বুঝতে পারেন কে বিলু কে নীলু?

পারি। নীলুটা খুব হাত নেড়ে কথা বলে।

রকিব সাহেব দোতলায় বসে আছেন শুনে নীলু দারুণ অবাক হল। সে কি, আমি তো বলেছি এ বাড়িতে যেন কখনো না আসেন।

কি জন্যে বলেছিস?

দূর ভাল্লাগে না।

ভাল্লাগে না কেন?

এমনভাবে কথা বলে যেন আমি বাচ্চা মেয়ে।

যাবি না তাহলে?

উঁহু।

নীলু যদিও বলল উঁহু, কিন্তু আমি দেখলাম সে কামিজ বদলে শাড়ি পরছে।

শাড়ি পরছিস কেন?

ইচ্ছা হয়েছে পরছি। তোকে জিজ্ঞেস করে কাপড় পরতে হবে?

নীলু অনেক সময় নিয়ে মুখে পাউডার দিল। এবং এক সময় চিরুনী হাতে এসে বলল, চুল বেঁধে দিবি?

আমি চুল বেঁধে দিয়ে বললাম, আজ আর তোকে কেউ বাচ্চা মেয়ে বলবে না।

নীলু রাগী স্বরে বলল, তুই কি ভাবছিস আমি তোতলায় যাচ্ছি? মোটেই না, আমি বাগানে হাঁটতে যাচ্ছি। সেতারার গলা সাধা শেষ হলেই যাব।

আমি দেখলাম নীলু। সত্যি সত্যি সেতারাকে নিয়ে বাগানে বেড়াচ্ছে। অপূর্ব লাগছে তাকে। আমার মনে হল এমন রূপবতী মেয়ে আমি আর কখনো দেখেনি।

 

বড় মামার চিঠি এসেছে।

সুদীর্ঘ চিঠি। যার বক্তব্য হচ্ছে–এ সময় গ্রামের বাড়িতে নীলু-বিলুদের বেড়াতে আসা ঠিক হবে না। কি কারণে ঠিক হবে না তা স্পষ্ট করে বলা নেই। শুধু লেখা–গাঁয়ের লোকজন এদের

দেখতে এসে নানান কথা বলবে, এটা ওদের ভাল লাগবে না। মনের ওপর চাপ পড়বে। এইসব। আমার কাছে একটা ব্যাপার খুব অবাক লাগল। চিঠির শেষে পুনশ্চতে লেখা–যা হবার হইয়াছে, এখন দুলাভাই আপনি যদি হৃদয়ের মহত্ত্ব দেখাইয়া সব ভুলিয়া যান তাহা হইলে বড়ই আনন্দের বিষয় হয়। ভুল মানুষ মাত্রই করে। ইহাই মানব ধর্ম।

এর মানে কি? নতুন করে এইসব কথা তোলা হচ্ছে কেন?

নীলুকে জিজ্ঞেস করতেই সে হেসে বলল, বুঝতে পারছিস না? মা এখন মামার বাড়িতে।

তার মানে?

মানেটানে জানি না। মা এখন মামার ঘাড়ে চেপে বসে আছে। মামা ঘাড় থেকে নামাতে চাইছে।

বুঝলি কি করে?

এখানে না বোঝারী কিছু আছে নাকি?

নীলু। তরল গলায় হাসল।

শেষ পর্যন্ত দেখবি বাবা বলবেন, ঠিক আছে চলে আসুক। আর মা তার ছেলে কোলে নিয়ে এ বাড়িতে উঠে আসবেন। খুব কান্নাকাটি হবে কিছুদিন। তারপর সব ঠিকঠাক। মাঝখান থেকে আমরা একটা ভাই পেয়ে যাব।

তোর কথার কোনো ঠিকাঠিকানা নেই নীলু।

না থাকলে কি আর করা। তবে এ রকম হলে মন্দ হয় না। কি বলিস? বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যাচেছ। যাচ্ছে না?

হুঁ।

বাবা যে হারে মদ-টদ খাচ্ছে। একেবারে দেবদাসের মতো–

নীলু। হেসে উঠল।

এর মধ্যে হাসির কি আছে?

কান্নারও কিছু নেই।

নীলু গম্ভীর মুখে বই নিয়ে পড়তে বসল। ইদানীং তার পড়াশোনায় খুব মনোযোগ হয়েছে। এই নিয়ে কিছু বললে সে গম্ভীর হয়ে বলে, তোরা সব স্টার-ফার পেয়ে পাস করবি আর আমি বুঝি ফেল করব? সেটা হচ্ছে না।

এখন আমাদের স্কুলটুল নেই। পরীক্ষার প্রস্তুতি চলছে জোরেসোরে। সপ্তাহে তিনদিন কোচিং ক্লাস হয়। সেখানে মেয়েরা সবাই ভান করে যে কিছু পড়াশোনা হচ্ছে না। কে কোন কলেজে পড়বে। সে নিয়েও ক্ষীণ আলোচনা হয়। হলিক্রস কলেজ ভাল না। ইডেন ভাল সব মেয়েরাই সেটা জানে।

এমন সিরিয়াস পড়াশোনার সময়টাতেও আমাদের ক্লাসের রুবিনার বিয়ে হয়ে গেল। সেলিনা আপা খুব রাগ করলেন–বাবা-মাদের কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই নাকি? সেলিনা আপা খুব কাটা কাটা কথা বলে অপমান করলেন রুবিনার বাবাকে। ঝাঁঝাল গলায় বললেন, আপনাদের মত শিক্ষিত মূর্থের জন্যে দেশের এমন খারাপ অবস্থা।

রুবিনা খুবই কান্নাকাটি করতে লাগল। গায়ে হলুদের দিন দেখি কেঁদে মুখটুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। রুবিনার এক মোটাসোটা খালা পানিভর্তি মুখ নিয়ে বলে বেড়াচ্ছেন, মেট্রিক ক্লাসটা হচ্ছে মেয়েদের বিয়ের বয়স। এরপর আর রসকষ থাকে না। নীলুটা ফস করে বলে বসল, কেন, তখন রস কি হয়?

রুবিনার খালা চোখ বড় বড় করে বললেন, এই ফাজিল মেয়েটা কে?

নীলু হাসিমুখে বলল, ফাজিল বলছেন কেন?

খুব হাসোহাসি শুরু হয়ে গেল চারদিকে। রুবিনার খালা রেগেমেগে অস্থির। কয়েকবার বললেন, আজিকালিকার মেয়েগুলি এমন কেন?

অনেকদিন পর রুবিনার গায়ে হলুদ উপলক্ষে আমরা খুব হৈচৈ করলাম। বিয়েটিয়ে এই জাতীয় অনুষ্ঠান আমার ভাল লাগে না। গাদাগাদি ভিড়। মেয়েদের লোক দেখান আহাদীপনা। খাবার টেবিলে তাড়াহুড়ো করে বসতে গিয়ে শাড়িতে রেজালার ঝোল ফেলে দেয়া। অসহ্য! কিন্তু রুবিনার গায়ে হলুদ আমার কেন যে এত ভাল লাগল। বরের বাড়ি থেকে এলা নামের একটি মেয়ে এসেছিল, সে ঢাকায় ও লেভেলে পড়ে। ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। জন্মের বন্ধুত্ব। এর আগে আর কোনো মেয়ের সঙ্গে এত বন্ধুত্ব হয়নি। আমরা দু’জন এক ফাঁকে ছাদে চলে গেলাম। মেয়েটি নানান কথা বলতে লাগল। একটি ছেলের সঙ্গে তার ভাব হয়েছে। ছেলেটি মেডিক্যালে পড়ে। এক বিয়ে বাড়িতে আলাপ হয়েছিল। খুব নাকি লাজুক ছেলে। আর দারুণ ভদ্র। এলা নিচু স্বরে বলল, জানো ভাই, ও একবার যা অসভ্য কথা লিখেছিল আমাকে। আমি খুব রাগ করলাম। ওর সঙ্গে দেখা করাই বন্ধ করে দিলাম। টেলিফোন করলে টেলিফোন নামিয়ে রাখতাম। শেষে কি করল সে জান?

কি করল?

বলল সে বিষ খাবে। আমি তো জানি তাকে। খাবে বলেছে। যখন তখন খাবেই। ছেলেরা দারুণ সেন্টিমেন্টাল হয় ভাই।

তখন তুমি কি করলে?

কি আর করব, দেখা করলাম।

আমি ইতস্তত করে বললাম, অসভ্য কথাটা কি লিখেছিল?

এলা তরল গলায় হেসে উঠল, দূর তা বলা যায় নাকি? বিয়ের দিন তুমি আসবে তো? ঐ দিন তোমাকে ওর ঐ চিঠিটাই পড়াব। দেখবে ছেলেরা কি রকম অসভ্য হয়।

রুবিনার বিয়ের দিন

রুবিনার বিয়ের দিন আমরা কেউ ও-বাড়িতে গেলাম না। নীলুর জন্যেই যাওয়া হল না। সে কিছুতেই যাবে না এবং আমাকেও যেতে দেবে না।

তুই না গেলে না যাবি। আমি যাই।

না বললাম তো যেতে পারবি না।

কেন অসুবিধেটা কি?

ওরা আজেবাজে কথা বলছিল, তোকে বলতে চাই না।

বলতে চাস না কেন?

কারণ শুনলে তোর খারাপ লাগবে।

লাগুক খারাপ

নীলু মৃদু স্বরে বলল, ওরা বলছিল সেতারার চেহারার সঙ্গে নাকি ঐ লোকটির খুব মিল। আর সেতারা গান-বাজনাও ঐ লোকটির মত জানে।

কখন বলছিল?

রুবিনার খালা বলছিল, আমি পাশের ঘরে ছিলাম।

আমি চুপ করে রইলাম।

নীলু বলল, তোর মন খারাপ লাগবে বলেছিলাম না। তবুও তো শোনা চাই।

আমি সে রাতে ঘুমোতে পারলাম না। বাবা ফিরলেন অনেক রাতে। সিঁড়িতে ধুপধ্যাপ শব্দ হতে লাগল। রমজান ভাইয়ের গলা শোনা গেল, ছিঃ, আপনের শরম করে না?

চুপ থাক।

আপনে চুপ থাকেন।

ধুপ করে একটা শব্দ হল। বাবার গলা।

ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেব। শুয়োরের বাচ্চা। বেশি সাহস হয়েছে।

মেয়েরা বড় হইছে না? হায়া-শরাম নাই?

চুপ থাক।

আপনে চুপ থাকেন।

পানি ঢালার শব্দ। আকবরের মা উঠে গেল। নবান করে কি যেন পড়ল। আবার পানি ঢালা হচ্ছে। কি হচ্ছে এসব?

বাবা আজকাল বড্ড ঝামেলা করছেন। আবার একটা বিয়ে করলে তার জন্যে ভালই হত। নজমুল চাচা যাকে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন সেই মহিলাটিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। ছোটখাটো মানুষ, লম্বা চুল। কথা বলেন টেনে টেনে। আমাদের সঙ্গে বেশ আগ্রহ করে কথা বললেন। নীলু যখন বলল, আচ্ছ। আপনি কি আমাদের দু’জনকে আলাদা করতে পারবেন? আমার নাম নীলু ওর নাম বিলু। কিছুক্ষণ পর যদি আমরা দু’জন এক রকম কাপড় পরে আসি তাহলে কি বলতে পারবেন। কে বিলু কে নীলু?

তিনি হাসিমুখে বললেন, আরে এ মেয়ে তো দেখি খুব পাগলী!

আমাদের দু’জনারই ভদ্রমহিলাকে খুব পছন্দ হল। শুধু সেতারা মুখ গোজ করে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি ডাকলেন, এই কি যেন নাম তোমার?

সে উঠে চলে গেল। আমরা তাকে বাগান দেখাবার জন্যে নিয়ে গেলাম। সেতারা কিছুতেই যাবে না। আমরা সেতারাকে ছাড়াই বাগানে বেড়াতে গেলাম। বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া তেঁতুল গাছ দুটি দেখে তিনি খুব অবাক হলেন। আশ্চর্য হয়ে বললেন, বসতবাড়ির কাছে কেউ তেঁতুল গাছ লাগায় নাকি?

নীলু বলল, লাগালে কি হয়?

বুদ্ধি কমে যায়। তেঁতুল খেলেও বুদ্ধি কমে।

এটা কিন্তু ঠিক না। রকিব ভাই খুব তেঁতুল খান। কিন্তু তার খুব বুদ্ধি।

রকিব ভাই কে? নীলু চুপ করে গেল। তিনিও আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। একবার শুধু বললেন, এত বড় বাড়িতে থাক, ভয় লাগে না?

আমরা কিছু বললাম না। ভদ্রমহিলা যাবার আগে নীলুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং অত্যন্ত মৃদুস্বরে বললেন, তোমাদের মোর সঙ্গে কি তোমাদের যোগাযোগ আছে?

নীলু বলল, না নেই।

তোমরা চিঠি লিখেলেই পার। তোমরা কেন লিখবে না? তোমরা লিখবে।

আমাদের খুব আশা ছিল ভদ্রমহিলার সঙ্গে বাবার বিয়ে হবে কিন্তু বিয়ে হয়নি। বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। নজমুল চাচার ওপর রেগে গিয়ে আজেবাজে কথা বলতে লাগলেন, তোমরা পেয়েছিটা কি? আমাকে না বলে এই সব কি শুরু করেছ?

নজমুল চাচাও কি সব যেন বললেন। তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল।

এক পর্যায়ে বাবা বললেন, যাও তুমি আমার বাড়ি থেকে এক্ষুণি বিদেয় হও। নজমুল চাচাও চোঁচাতে লাগলেন, আমি তোমার দয়ার ওপর আছি নাকি? নগদ ভাড়া দিয়ে থাকি।

সে এক বিশ্ৰী অবস্থা। নজমুল চাচা সেই রাতেই ঠেলা গাড়ি নিয়ে এলেন। মালপত্র পাঠানো হতে লাগল। আমরা বসে বসে দেখলাম। ঠেলা গাড়ি এসেছে দুটি। নজমুল চাচার জিনিসপত্র তেমন কিছু নেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব তোলা হয়ে গেল। আমরা দেখলাম। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির কাছে আর নজমুল চাচা একটা বেতের ঝুড়ি হাতে নিয়ে নেমে যাচ্ছেন।

নীলু তখন ছুটে গিয়ে সিঁড়ির মাথায় তাকে ঝাপ্টে ধরল।

নজমুল চাচা বললেন, আরে মা, কি করিস তুই ছাড় ছাড়া।

নীলু ছাড়ল না।

নজমুল চাচা বললেন, এতো বড় মুসিবন্ত হল দেখছি। আরে বেটি কি করিস।

তার হাত থেকে বেতের ঝুড়ি ছিটকে পড়ে গেল।

নজমুল চাচা ভারী গলায় বললেন, এই মালপত্র সব তুলে রাখা। সাবধানে তুলিস।

নজমুল চাচা আমাদের কোন আত্মীয় নন। দোতলার তিনটি কামড়া ভাড়া নিয়ে আমাদের সঙ্গে আছেন। পনের বছরের মতো। তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছেন ষোল-সতের বছর আগে। একটিমাত্র মেয়ে, অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মেয়ে নেদারল্যান্ড না কোথায় যেন থাকে। বছরে দুতিনটি চিঠি দেয়। চিঠিতে খুব স্বাস্থ্যবান কিছু ছেলেমেয়ের ছবি থাকে। নজমুল চাচা সেই চিঠি পড়ে গম্ভীর হয়ে বলেন, উফ এ্যারন বাংলাটা এখনো শেখে নাই। খুব খারাপ খুব খারাপ।

এ্যারন তাঁর নাতনী।

নীলু অনেক কিছুই করতে পারে যা আমি পারি না। নজমুল চাচা যখন চলে যাচ্ছিলেন আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে তাকে ফেরাই। কিন্তু আমি গোলাম না, ছুটে গেল নীলু। আমরা দুজনে দেখতে অবিকল এক রকম, কিন্তু দু’জন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ হয়ে উঠছি। আমরা এ রকম কেন?

কাল রাতে আমি চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখেছি। এমন চমৎকার স্বপ্ন যে ঘুম ভেঙে খানিকক্ষণ কাদলাম। একবার ইচ্ছে হল নীলুকে ডেকে তুলি। স্বপ্নের কথাটা বলি ওকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছুই করলাম না। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে স্বপ্নটার কথা ভাবলাম। ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্লটিকে অর্থবহ মনে হচ্ছিল জেগে থেকে তা আর মনে হল না। আমি দেখেছিলাম একটি নদী। নদীর চারপাশে ঘন বন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বন অদৃশ্য হয়ে গেল। দেখলাম শুধুই নদী। সেই নদীতে বালি চিকচিক করছে। কোথাও কেউ নেই। আমার একটু ভয় ভয় করছে। তবু আমি নদীতে নামতেই নদীটি আমাদের নানার বাড়ির পুকুর হয়ে গেল। সে পুকুরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কুমীর কুমীর খেলছে। স্বপ্নে নদীর পুকুর হয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। আমি একটুও অবাক না হয়ে ছেলেমেয়েগুলির সঙ্গে কুমীর কুমীর খেলতে লাগলাম। একটি পাঁজি ছেলে ডুব সাতার দিয়ে কেবলই আমার পা জড়িয়ে গভীর জলের দিকে টেনে নিতে চাচ্ছিল। আমার রাগ লাগছিল। কিন্তু কিছুই বলছিলাম না। কারণ স্বপ্নের মধ্যে মনে হচ্ছিল এই ছেলেটি যেন আমার স্বামী। এক সময় ছেলেটি আমাকে মাঝপুকুরে নিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, এই সুশী তোমাকে এখন ছেড়ে দেই?

কেন মানুষ এমন অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে? আমি জেগে এই ছেলেটির মুখ খুব মনে করবার চেষ্টা করলাম, কিছুতেই মনে পড়ল না। শুধু মনে পড়ল ছেলেটির চোখগুলো মেয়েদের চোখের মত টানা টানা। আর ওর হাত দুটি লম্বা এবং খুব ফরসা! কে জানে এ রকম একটি ছেলে সঙ্গেই হয়ত আমার বিয়ে হবে। সে আমাকে আদর করে ডাকবে সুশী। কী আশ্চর্য এরকম একটা অদ্ভুত নাম এল কোথেকে? ভাবতে ভাবতে আবার আমার চোখ ভিজে উঠল। বাকি রাত এক ফোঁটা ঘুম এল না।

এত ভোরে কখনো আমি আগে উঠিনি। অদ্ভুত লাগছিল আমার। আলোটাই অন্য রকম। কেমন মায়া মায়া আলো, স্বপ্নের মধ্যে যে রকম আলো দেখা যায়। সে রকম। আমি নিচে বাগানে নেমে গেলাম। কদম গাছের নিচটায়। তখনো খুব অন্ধকার। আমার একটু ভয় ভয় করছিল। কিন্তু গাছের নিচের এসে দাঁড়ানো মাত্র দেখলাম নীলু। জেগে উঠেছে। টুথব্রাশ নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। নীলু সব সময় খুব ভোরে ওঠে। কিন্তু সে যে এ রকম অন্ধকার ভোর তা জানা ছিল না। আমি ডাকলাম, এ্যাই নীলু।

নীলু আমাকে দেখতে পেল না। সে অবাক হয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল। তারপর একটি কাণ্ড করল, মা এসেছে মা এসেছে বলে ছুটে গেল গেটের দিকে।

আমি এগিয়ে এসে বললাম, এ্যাই নীলু কি হয়েছে রে?

নীলু। খুব অবাক হল। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। এক সময় থেমে থেমে বলল, আমি ভাবলাম মা বুঝি। গলার স্বর অবিকল সে রকম লাগল।

নীলুর কি কিছুটা আশাভঙ্গ হয়েছে? কী জানি হয়ত হয়েছে। মার কথা সে হয়তো সারাক্ষণই ভাবে। মুখে বলে না।

আজ এত সকালে উঠেছিস যে?

দেখলাম একদিন উঠে কেমন লাগে।

কেমন লাগে?

ভালই তো।

নীলু চুপচাপ দাঁত ঘষতে লাগল। আমি বললাম, তুই কি মার কথা খুব ভাবিস?

নাহ।

তাহলে আজ এ রকম ছুটে গেলি যে?

আমার ইচ্ছে হয়েছে গিয়েছি। তোর তাতে কি?

রাগ করছিস কেন?

নীলু জবাব না দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। তখন মনে পড়ল। নীলুর সঙ্গে আমার ঝগড়া চলছে। গত এক সপ্তাহ ধরে কথাবার্তা বন্ধ। ঝগড়ার কারণটি অতি তুচ্ছ। আমি নীলুর একটি চিঠি খুলে পড়ে ফেলেছি। কিছুই নেই সে চিঠিতে। ছয় লাইনের একটা চিঠি। নীলুর পরিচিত প্রফেসরটি লিখেছেন। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার যে বইটি নীলু। পড়তে চেয়েছে সেটি তিনি দোকানে খুঁজে পান নি। পেলেই পাঠাবেন।

এমন কী আছে সেই চিঠিতে যে নীলু রাগ করল? কিন্তু সে এমন ভাব করতে লাগল যেন আমি তার কাছে লেখা খুব গোপন একটি প্রেমপত্র পড়ে ফেলেছি। আমি যখন বললাম, কি আছে এই চিঠিতে যে তুই এ রকম করছিস?

যাই থাকুক, কেন আমার চিঠি পড়বি?

বেশ আর পড়ব না।

পড়বি না। শুধু না, তুই আমার ঘরেও কোনোদিন ঢুকবি না।

বেশ ঢুকব না।

আর আমার সঙ্গে কথাও বলবি না।

ঠিক আছে বলব না।

ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। সন্ধ্যাবেল বাবা প্রেস থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সে নালিশ করল, বাবা বিলু আমার সব চিঠিপত্র পড়ে ফেলে।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তুমি ওকে ডেকে নিষেধ করে দাও।

ঠিক আছে করব।

না এখনই কর।

বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। শান্তস্বরে বললেন, একজনের কাছে লেখা চিঠি অন্যের পড়াটা ঠিক না মা। আমি লজ্জায় বাঁচি না। নীলুটা এমন হচ্ছে কেন কে জানে। আগে এ রকম ছিল না। তার কাছে চিঠি এলেই আমাকে সে চিঠি পড়তে হত। একবার সে পেনফ্রেন্ডশিপ করল বুলগেরিয়ার কি একটা ছেলের সঙ্গে। সেই ছেলেটা সবুজ রঙের কাগজে লম্বা লম্বা চিঠি লিখিত ভুল ইংরেজিতে। চিঠির শেষে একটা ঠোঁটের ছবি একে লিখিত Kiss। নীলু আমাকে সেই চিঠি পড়তে দিয়ে বলত, মা গো কি অসভ্য! নীলুর সেই সব চিঠির জবাবও লিখে দিতাম। আমি। একদিন সে লজ্জায় লাল হয়ে বলল, বিলু চিঠির শেষে তুইও লিখে দে Kuss। ঐ বাঁদরটার সাথে তো আর দেখা হচ্ছে না। কি বলিস? আমি লিখলাম Kiss। নীলু বহু যত্নে একটা ঠোঁটের ছবিও আঁকল। তারপর ঐ ছেলে তার ছবি পাঠাল। মাথায় চুল নেই একটিও। গালে এত বড় একটা আঁচিল। হাতির কানের মত বড় বড় কান। ছবি দেখে দারুণ রেগে গেল নীলু। ছেলেটি লিখেছিল সুযোগ পেলেই সে তার বাংলাদেশী পেনফ্রেন্ড নীলুর সঙ্গে দেখা করতে আসবে। নীলু বলল, লিখে দে হাঁদারাম তুমি বাংলাদেশে এলে তোমার ঠ্যাং ভেঙে দেব। বাঁদর কোথাকার।

নীলু চিঠি লেখা বন্ধ করে দিলেও আমি চালিয়ে যেতে লাগলাম। মজাই লাগত। আমার। বানিয়ে বানিয়ে কত কিছু যে লিখছি। যেমন একবার লিখলাম, কাল আমরা সমুদ্রে নৌকা নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কি যে সুন্দর সমুদ্র আমাদের। খুব মজা হয়েছে। একবার সে লিখল, তোমার কি কোনো ছেলেবন্ধু আছে? আমি লিখলাম, হ্যাঁ আছে। আমার ছেলে-বন্ধুটি একজন কবি। সে আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে।

ছেলেটা সত্যি সত্যি হাঁদারাম। যা লিখতাম তাই বিশ্বাস করত। তারপর একদিন সে হঠাৎ লিখে বসিল, আসছে সামারে আমি বাংলাদেশে আসব। কী সর্বনাশ! ভয়ে আমি এবং নীলু দু’জনই অস্থির। একি ঝামেলা হল। কি যে ভয়ে ভয়ে কেটেছে সেই সময়টা। রাতে ভাল ঘুম পর্যন্ত হত না। নীলু অবশ্যি খুব একটা ভয় পায়নি। ও বলত, খামোকা ভয় পাচ্ছিস, আসবে-টাসবে না। আর যদি এসেও পড়ে তাহলে বলব নীলু নামের মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে।

ছেলেটি অবশ্যি আসেনি। এবং চিঠিপত্রও দেয়নি। আর। হয়তো অন্য কোনো দেশের কোনো মেয়ে পেনফ্রেন্ডশিপ করেছে।

নীলুর যন্ত্রণায় আরো সব চিঠি লিখতে হয়েছে আমাকে। একবার সে বলল, খুব ভাষা-টাষা দিয়ে একটা চিঠি লিখে দে তো বিলু। কার কাছে, কী–কিছুই বলবে না। লিখলাম একটা চিঠি। সেটা তার পছন্দ হল না। আবার একটা লিখলাম। কত কাণ্ড হল সে চিঠি নিয়ে। ক্লাসের মেয়েরা সেই চিঠির লাইন বলে বলে নীলুকে খ্যাপাতে লাগল। কোথায় পেয়েছে তারা সেই চিঠি কে জানে! নীলু। যে ছেলেকে লিখেছিল সে-ই হয়ত বলে দিয়েছে। নীলু বাসায় এসে কেঁদে-টেদে অস্থির। সেই সময় নীলুর সঙ্গে খুব ভাব ছিল আমার। নীলু হঠাৎ করেই অন্য রকম হয়ে গেল। আমার কোনো বন্ধুটন্ধু নেই। নীলু দূরে সরে যেতেই আমি একা হয়ে গেলাম। এরকম একটি অদ্ভুত সুন্দর সকালে একা থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি নীলুর খোজে বাগানের পেছনের দিকে এসে দেখি নীলু কাঁদছে। কী আশ্চর্য! আমি বললাম, কি হয়েছে রে?

কিছু হয়নি।

কাঁদছিস কেন?

তোর কাছে সব কিছু বলতে হবে নাকি?

বললে দোষ কি?

নীলু। কোনো জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে বাগান ছেড়ে চলে গেল। সকালটা হঠাৎ করেই অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। লোকজন সবাই জেগে উঠেছে। রমজান ভাই ঘটং ঘটং করে টিউবওয়েলের পানি তুলছে। আকবরের মা ময়লা থালা-বাসন এনে জমা করছে টিউবওয়েলের পাশে। এক সময় ঝগড়া লেগে গেল দুজনের মধ্যে। এরা দু’জন দু’জনকে সহ্যই করতে পারে না। তবু কেমন করে থাকে এক সঙ্গে? এদের চেঁচামেচিতেই বোধ হয় বাবার ঘুম ভাঙল। বাবা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই চারদিক আবার চুপচাপ। বাবা বললেন, আমাকে চা দাও এক কাপ। এরা দুজনে কেউ কোনো উত্তর করল না। আকবরের মা বেড়ালের মতো ফ্যাসফ্যাস করে কি বলতেই আবার বেঁধে গোল রমজান ভাইয়ের সঙ্গে। বাবা দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। আজকাল কেউ আর বাবাকে তেমন গ্রাহ্য করে না। আমি এগিয়ে এসে বললাম, আমি বানিয়ে আনছি। বাবা।

তুই আবার চা বানাতেও জানিস নাকি?

জানিব না কেন?

বাবা অবাক হয়ে বললেন, কার কাছে শিখলি?

কী আশ্চর্য কাণ্ড, চা বানানো আবার শিখতে হয় নাকি? বাবা এরকম ভান করতে লাগলেন

যেন খুব অবাক হয়েছেন।

আর কি জানিস, রান্নাবান্না করতে পারিস? ভাত-মাছ এইসব?

নাহ।

এইগুলিও শিখে ফেল। একদিন বিয়েটিয়ে হবে। রান্নাবান্না না জানলে বিয়ে দেয়াই যাবে না, হা হা হা।

অনেক দিন পর বাবা হাসলেন। মানুষের হাসির মতো সুন্দর কি কিছু আছে? বাবার হাসির সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে রোদ ঝলমল করে উঠল।

মা একটা কথা সব সময় বলতেন, মানুষ যখন হাসে তখন তার সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী হাসে। কিন্তু সে যখন কাঁদে, তার সঙ্গে আর কেউ কাঁদে না। কাঁদতে হয় একা একা।

চা বানাতে বানাতেই শুনলাম সেতারা গলা সাধা শুরু করেছে। নিসা গামা পামা গামা। গামা পামা গারে সা। গান-টান কিছু না, সামান্য সারে গামা, কিন্তু কি যে ভাল লাগছে শুনতে।

বাবাকে চা নিয়ে দিতেই বাবা বললেন, ভাবছি তোদের নিয়ে কোথাও ঘুরেটুরে আসব। যাবি নাকি?

কোথায়?

গারো পাহাড়ে গেলে কেমন হয়? জাড়িয়া জঞ্জাইল লাইনে বেশি দূর হবে না। ছয়-সাত ঘণ্টা লাগবে ট্রেনে। বন বিভাগের একটা রেস্ট হাউস আছে। যাবি নাকি?

যাব বাবা।

জায়গাটা সুন্দর। রাতের বেলা একটু ভয় ভয় লাগে।

কেন?

বন্য হাতির শব্দটব্দ পাওয়া যায়। এখন বোধ হয়। আর সে রকম নেই। তোরা যদি যেতে চাস তাহলে একটা প্রোগ্রাম করি।

যাবে কবে?

দুই দিনের মাত্র ব্যাপার, একটা তারিখ করলেই হয়। তুই নীলুকে জিজ্ঞেস করে আয় ও যাবে কি-না।

নীলু সব শুনে লাফিয়ে উঠল। বেড়ানোর ব্যাপারে নীলুর মতো উৎসাহী আর কেউ নেই। গারো পাহাড় দেখতে যাওয়া হবে শুনেই তার সব রাগ পড়ে গেল। নানান রকম পরিকল্পনা করে ফেললাম আমরা। যেমন শম্পাদের ক্যামেরাটা নিয়ে যাব এবং খুব ছবি তুলব। সেখানে আমরা দুজনেই শাড়ি পরব। এবং এই উপলক্ষে বাবাকে বলব দুটি শাড়ি কিনে দিতে। বন বিভাগের রেস্ট হাউসে রাতের খাবার-টাবার হয়ে যাবার পর বাবাকে বলব। গল্প বলার জন্যে। বাবা অবশ্যি গল্পটল্প তেমন বলতে পারে না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা হারিকেন জ্বলিয়ে বসে। থাকব। হারিকেনের আলো কী যে ভাল লাগে আমার।

একেকটা দিন এমন অন্যরকম হয়। মনে হয় দুঃখ-টুঃখ সব বানানো ব্যাপার। চারদিকে শুধু সুখ এবং সুখ। সন্ধ্যাবেলা আমরা দুবোন শাড়ি পরে বারান্দায় হাঁটছি, নজমুল চাচা ডেকে পাঠালেন।

কিরে বেটিরা শুনলাম দল বেঁধে নাকি পাহাড়ে যাচ্ছিস?

জি চাচা।

তা আমাকে একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করিল না? আমারও তো পাহাড়-টাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে।

সত্যি সত্যি যাবেন আমাদের সাথে?

এরকম পরীর মতো মেয়েদের পাহারা দিয়ে রাখার জন্যেও তো লোকজন দরকার।

 

পরের কয়েকটি দিন আমাদের দারুণ উত্তেজনার মধ্যে কাটল। একদিন শুনলাম বন বিভাগের ডাকবাংলোটা পাওয়া গেছে। তারপর দিন-ক্ষণ ঠিক হল। নতারিখে ভোরের ট্রেনে যাব, পৌঁছব বিকাল নাগাদ। নজমুল চাচা যাবেন। রমজান যাবে। বাবার প্রেসের একজন কম্পোজিটর মাখন মিয়া সেও যাবে। কারণ মাখন মিয়ার বাড়ি ঐ অঞ্চলে, সে সব খুব ভাল চেনে।

আট তারিখ রাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন না। রাত একটায় নজমুল চাচা খোঁজ নিতে গেলেন। আমরা তিন বোন বসার ঘরে বসে রইলাম চুপচাপ। নজমুল চাচা ফিরলেন দুটার দিকে এবং হালকা গলায় বললেন, কাজে আটকা পড়ে গেছে, সকাল বেলাতেই চলে আসবে। ঘুমিয়ে পড়! নীলু, শান্ত স্বরে বলল, বাবার কি হয়েছে বলেন?

কি আবার হবে। কাজ থেকে না মানুষের?

নজমুল চাচা রেগে গেলেন। নীলুও রেগে গেল।

বাবার কি হয়েছে বলেন।

কাল সকালে আসবে, তখন জিজ্ঞেস করিস। কিছু হয়নি, ভালই আছে।

নীলু তেজী গলায় বলল, আপনাকে এখন বলতে হবে।

এরকম করে তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস কেন?

নীলু কেঁদে ফেলল। বাবা ফিরলেন। পরদিন দুপুরে। কোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে। তার রাত কেটেছিল থানা হাজতে। মদ খেয়ে খুব নাকি হৈচৈ করছিলেন বা এই জাতীয় কিছু। খুবই কেলেংকারি ব্যাপার। আমরা সপ্তাহখানেক কেউ স্কুলে গেলাম না। ঠিক করলাম বাবার সঙ্গে কেউ কোনো কথা বলব না। ডাকলেও সাড়া দেব না। এমন ভাব করব যেন শুনতে পাইনি। কোনো লাভ অবশ্যি তাতে হল না। বাবা আমাদের ডাকাডাকি বন্ধ করে দিলেন। যতক্ষণ বাসায় থাকেন। চুপ করে থাকেন।

একদিন দেখি একটি টেলিভিশন কিনে আনলেন। সেতারার খুব সখ ছিল টিভির। কথা ছিল সেতারা আগামী জন্মদিনে ঢাকা থেকে এটি কিনে আনা হবে এবং সেই উপলক্ষে আমরা সবাই দল বেঁধে ঢাকা যাব। তিনি বোধ হয় আমাদের সঙ্গে ভাব করবার জন্যেই আগে-ভাগে কিনে ফেললেন। সন্ধ্যাবেল টিভি চালু হল। আমরা কেউ দেখতে গেলাম না। আকবরের মা এবং রমজান ভাই মোড়া পেতে টিভির সামনে রাত এগারটা পর্যন্ত বসে রইল।

বাবার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেলাম আমরা। সেই সময় বড় মামার চিঠিতে জানলাম মার একটি ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম কাজল।

মায়ের শরীর খুব খারাপ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছেন। কি যে কষ্ট হল আমার। কত লক্ষ বার যে বললাম–মা ভালো হয়ে যাক। মাকে ভাল করে দাও। রোজ রাতে তাকে স্বপ্নে দেখতাম। রক্তশূন্য একটি লম্বাটে ফরসা মুখ। চাদর দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢাকা। স্বপ্ন দেখে রোজ রাতেই কান্দতাম। আমরা তিন বোনই নিশ্চিত ছিলাম মা মারা যাবেন। কিন্তু তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। চিঠি লিখল মা নীলুকে। নীলু তার কোনো চিঠি আমাকে পড়তে দেয় না। কী লেখা ছিল সে চিঠিতে তা জানলাম না। নীলু শুধু বলল, কাজল খুব বিরক্ত করে রাতে মাকে মাতে দেয় না।

এস.এস.সি. পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট

এস.এস.সি. পরীক্ষায় খুব ভাল রেজাল্ট করলাম। এত ভাল যে সেলিনা আপা একদিনের জন্যে স্কুল ছুটি দিলেন। এবং একটি গোন্ড মেডেল দেবার ব্যবস্থা করলেন। খায়রুন্নেসা গোন্ড মেডেল। খায়রুন্নেসা তার মায়ের নাম। এই গোন্ড মেডেলটি সেবারই প্রথম ঘোষণা করা হল। আমাদের স্কুলের কোনো ছাত্রী যদি এস.এস.সি. পরীক্ষায় সমস্ত বোর্ডে প্রথম তিনজনের মধ্যে থাকতে পারে তবেই সে এই গোন্ড মেডেল পাবে। ময়মনসিংহ ডিস্টিক্ট বোর্ড থেকে আমাকে পাঁচশ টাকা দেয়া হল। শুধু তাই না, একদিন সকালবেলা একজন স্থানীয় সংবাদদাতা আমার ইন্টারভ্যু নিতে এলেন। নজমুল চাচার উৎসাহের সীমা নেই। শাড়ি খুলে একটা কামিজ-টামিজ পর, বয়স কম দেখা যাবে। কানের দুলগুলি খুলে ফেল তো, ভাল ছাত্রীদের এই সব গয়না-টয়না মানায় না। মুখে হালকা করে পাউডার দে।

ইন্টারভ্যু পর্ব সমাধা হতে অনেক সময় লাগল। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর দিতে লাগলেন নজমুল চাচা। যেমন ভদ্রলোক যখন জিজ্ঞেস করলেন, দৈনিক কঘণ্টা পড়াশুনা করতে? আমি কিছু বলার আগেই নজমুল চাচা বললেন, ঘণ্টার কি কোনো হিসাব আছে ভাই? রাতদিনই পড়ছে। যখনই দেখি তখনি মুখের ওপর একটা বই। হা হা হা।

নজমুল চাচা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, এই মেয়ের প্রাইভেট টিচার লাগে। কী যে বলেন ভাই।

কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা। আজিজ স্যার আমাকে আর নীলুকে সপ্তাহে চারদিন অংক করাতেন। নলিনীবাবু স্যার পড়াতেন ইংরেজি।

পাঠ্য বই ছাড়া বাইরের বই কেমন পড়েছ তুমি?

বাইরের বইতো বেশি পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ টলস্টয় সব আপনার নিচের ক্লাসেই পড়ে শেষ করেছে। হা হা হা।

ইন্টারভ্যু হল আসলে নজুমলা চাচার সঙ্গে। আমি শুধু হাসিমুখে তার পাশে রইলাম। এবং সেই ইন্টারভ্যু খানিকটা ছাপাও হল একটি ইরেজি পত্রিকায়। তার পরপরই একটি চিঠি পেলাম আমরা দু বোন।

কল্যানীয়াষু নীলু অথবা বিলু তোমাদের দুবোনের একজনের ছবি দেখলুম। পত্রিকায়। ছবির সঙ্গে ডাকনাম দেয়া ছিল না। কাজেই বুঝতে পারছি না ছবিটি কার?

যার ছবি তার জন্যে আমার আন্তরিক অভিনন্দন। মফস্বলের একটি স্কুল থেকে এমন চমৎকার রেজাল্ট করা দারুণ ব্যাপার। আমার খুবই ভাল লাগছে। এর মধ্যে একবার ময়মনসিংহ এসেছিলাম। তোমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে গিয়েছি। গেট বন্ধ ছিল। কাজেই ভেতরে আর ঢুকিনি। পরে ভেবেছি গেট খুলে ঢুকলেই হত।

অনেক সময় আমরা যা করতে চাই করতে পারি না। কেন পারি না তাও জানি না। পরে তা নিয়ে কষ্ট পাই। ঠিক না?

আমরা কেন যেন মনে হচ্ছে তোমরা দুবোন আমার চিঠি পড়ে খুব হাসবে। অবশ্যি একটি ক্ষীণ আশা যে এই চিঠি তোমাদের হাতে পৌঁছবে না। কারণ তোমাদের ঠিকানা আমার জানা নেই। শুধু জানি তোমাদের দুবোনের একজন হচ্ছে নীলু, একজন বিলু এবং তোমাদের বাড়িটির নাম উত্তর দীঘি। এ রকম সংক্ষিপ্ত ঠিকানায় চিঠি যাওয়ার কথা নয়। ঠিক না?
রকিব হাসান

 

কত অসংখ্যবার যে সেই চিঠি আমি পড়লাম। প্রতিবারই আমার মনে হয়েছে এই চিঠিতে যা লেখা হয়েছে তার বাইরেও কিছু আছে। আর একবার পড়লেই তা বোঝা যাবে।

চিঠিটি নজমুল চাচাও পড়লেন এবং বললেন, বিশিষ্ট ভদ্রলোক। খুব আদব-কায়দা। একটা ভাল সংবাদ পেয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে চিঠি দিয়েছে। এইসব ভদ্রতা কি দেশে আজকাল আছে। সং শুনলে লোকজন আজকাল বিরক্ত হয়। মা সুন্দর করে গুছিয়ে একটা চিঠি লেখ। বানান ভুল যেন না। থাকে। সাবধান! ডিকশনারি দেখবে। আর শোন, এই চিঠি যত্ন করে তুলে রাখবে। রেজাল্ট নিয়ে যত চিঠি যত টেলিগ্রাম আসবে সব তুলে রাখবে। আলাদা একটা ফাইল করে রাখবে। আমি অফিস থেকে ফাইল নিয়ে আসব।

নীলু চিঠিটার শুরুটা পড়েই গম্ভীর মুখে বলল, তোর চিঠি আমাকে দিচ্ছিস কেন? আমি অন্যের চিঠি পড়ি না।

পড়া যাবে না। এমন কিছু এখানে লেখা নেই।

না থাকুক।

নীলু পাশ ফিরে বালিশে মুখ ঢাকল। তার বেশ কদিন ধরে জ্বর যাচ্ছে। তেমন কিছু নয়, কিন্তু বিছানা ছেড়ে উঠছে না। আমার ধারণা, সে আশা করেছিল তার রেজাল্ট অনেক ভাল হবে। রেজাল্ট মোটেও ভাল হয়নি। ফাস্ট ডিভিশন দেখা শেষ করে আমরা যখন সেকেন্ড ডিভিশন দেখতে শুরু করেছি। সে তখন দৌড়ে পালিয়েছে। নজমুল চাচা তাকে পাসের খবর দিতেই সে কেঁদে-টেদে একটা কাণ্ড করেছে।

পরের বার অনেক ভাল হবে দেখবি।

আর দেখতে হবে না।

সবাই কি আর ফাস্ট-সেকেন্ডে হয় নাকি রে বোকা? আমি নিজে তিন বারের বার মেট্রিক পাস করলাম। কিন্তু আইএ-তে আবার ফাস্ট ডিভিশন।

থাক, আপনাকে আর বকবক করতে হবে না।

বাবা নিজে এসেও সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করলেন।

আরো সেকেন্ড ডিভিশন খারাপ নাকি?

খারাপ হবে কেন? খুব ভাল, তুমি যাও তো এখন।

নীলুকে আমরা খুব শক্ত মেয়ে হিসেবে জানতাম। এই ব্যাপারটায় যে সে এতটা মন খারাপ করবে ভাবতেও পারিনি। কিছু দিন পরই সে জুরে পড়ে গেল। অল্পদিনের জুরেই শুকিয়ে-টুকিয়ে অন্য রকম হয়ে গেল। এক রাতে ঘুমুতে এল আমার ঘরে; একা একা তার নাকি ভয় লাগছে। কে যেন বারবার তার জানালার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে। আমরা দু’জন অনেকদিন পর একসঙ্গে ঘুমুতে গেলাম। সেতারা শুয়েছে একা একটি খাটে। আমরা দু’জন একটিতে। আমি নরম স্বরে বললাম, এত মন খারাপ করেছিস কেন?

জানি না কেন।

ভুক্তি পড়াশোনাই কািরসন, রেজাল্ট কোথেকে ভাল হবে।

তা ঠিক।

নীলু একটি হাত আমার গায়ের ওপর রেখে বলল, দু’জন এবার আলাদা হয়ে যাব; তুই যাবি ঢাকায় আর আমি এখানে কোনো ভাঙা কলেজে।

আমি ঢাকায় যাব না, এইখানে থাকব।

তুই ঢাকায় পড়তে যাবি একটা তো জনা কথা। সেটাই ভাল। তুই এত ভাল ছাত্রী, তোর তো ভাল কলেজেই যাওয়া উচিত।

আমরা দু’জন হালকা গলায় নানান কথাবার্তা বলতে লাগলাম। অনেক রাতে শুনলাম বাবা ঘরে ফিরেছেন। গুনগুন করে কি বলছেন। রমজান ভাই রাগী গলায় কি-সব বলছেন। নীলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চল ঘুমিয়ে পড়ি।

প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছি, তখন নীলু বলল, বিলু একটা কথা। জেগে আছিস তো?

আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হবে তোকে।

কী প্রতিজ্ঞা?

নীলু চুপ করে রইল। আমি অবাক হয়ে বললাম, কীসের প্রতিজ্ঞা?

ঢাকায় গিয়ে রকিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে পারবি না।

এসব কি বলছিস, আমি দেখা করব কেন?

আর ওর চিঠির জবাব দিবি না।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। নীলু, কাঁদতে শুরু করল। ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, কথা দে আমাকে আমার গা ছুঁয়ে বল।

কী যে কাণ্ড তোর!

আমি নীলুকে জড়িয়ে ধরলাম। এমন বোকা কেন নীলুটা?

 

সেদিন আকাশের রঙ ছিল ঘন নীল।

আমরা এমনিত কখনো আকাশ দেখি না। আমরা আকাশের দিকে তাকাই মন খারাপ হলে। মন বিষন্ন হলে আকাশও বিষন্ন হয়। হেমন্তের এই ঝকঝকে সকালে আকাশটা অসম্ভব বিষন্ন হয়ে গেল। আমি তবু মুখে হাসি টেনে রাখলাম। ভোরবেলা নাশতা খাবার সময় খুব হাসিখুশি থাকতে চেষ্টা করলাম। নজুমলা চাচাও আজ আমাদের সঙ্গে নাশতা খেলেন। নীলু বসে রইল পাথরের মত মুখ করে। বাবা একবার সাবধানে চলাফেরার কথা বললেন।

একা একা কোথাও যাবার দরকার নেই। কোথাও যেতে হলে বন্ধু-বান্ধব কাউকে সঙ্গে নিবি।

নজমুল চাচা বললেন, চিন্তার কিছু নেই, সফদর সাহেব প্রতি শুক্রবারে এসে বাসায় নিয়ে যাবেন। আর ছুটি ছাটা হলো নিজে ময়মনসিংহে এসে পৌঁছে দেবেন। অতি ভদ্র সজ্জন ব্যক্তি।

আমি তাদের কথায় হা-না কিছুই বললাম না। ঠিক যখন যাবার সময় হল তখন ইচ্ছে করল। চেঁচিয়ে বলি–আমি এইখানেই থাকব। এখানকার কলেজে ভর্তি হব। কিছুই বলা হল না।

নজমুল চাচা আমাকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেনে উঠলেন। ট্রেন ছাড়তে খুব দেরি করতে লাগল। বাবা প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে রইলেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে। নীলু সেতারা কেউ আসেনি। ওরা খুব কাদছিল। বাবা বলেছিলেন, তোরা আসিস না। তোরা থাক এখানে। আর এত কান্নাকাটির কি আছে। দুই মাস পরে তো আসছেই।

ট্রেন ছেড়ে দেবার সময় বাবা মনে হল খুব অবাক হয়ে পড়েছেন। যেন ভাবতে পারেননি ট্রেন এক সময় ছেড়ে দেবে। তিনি জানোলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার বা হাত শক্ত করে চেপে ধরে ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে আসতে লাগলেন। নজমুল চাচা বললেন, আরে কর কি, হাত ছেড়ে দাও। বাবা হাত ছাড়লেন না। যেন শেষমূহুর্তে তার মনে হল আমি চলে যাচ্ছি। তিনি ট্রেনের লোকজন, প্লাটফরমের গাদাগাদি ভিড় সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ফুপিয়ে উঠলেন, আমার আম্মি। আমার রাত্ৰিমণি। ওরে বেটি টুনটুন।

আমি পাথরের মত মুখ করে বসে রইলাম। পৃথিবীতে এত কষ্ট কেন থাকে? কেন এত দুঃখ চারদিকে? জানালার ওপাশে কি সুন্দর সব দৃশ্য। গাঢ় নীল রঙের ডোবা একটি। তার ওপর সাদা মেঘের ছায়া পড়েছে। কঞ্চি হাতে একটি ছোট্ট ছেলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ট্রেনের দিকে। পাট বোঝাই একটি গরুর গাড়ির চাকা আটকে গেছে। গরুটি ধবধবে সাদা। এক সময় নজমুল চাচা বললেন, ছিঃ মা কাঁদে না।

চিঠিপত্র

বিলু,

তোর দুটি চিঠিই পেয়েছি। প্রথমটির জবাব সঙ্গে সঙ্গে লিখেছিলাম। রমজান ভাইকে পোস্ট করতে দিয়েছি। ওমা দুই দিন পরে দেখি তার বাজারের ব্যাগ থেকে চিঠি বেরুল। ভিজে ন্যাত। ন্যাতা! অথচ রমজান ভাই আমাকে বলেছে সে নিজ হাতে চিঠি ফেলেছে। দেখ অবস্থা। তারপর তোমার দুনম্বর চিঠিটি এল। ভাবলাম রাতে জবাব লিখব। রাত ছাড়া চিঠি লিখতে ভাল লাগে না। কিন্তু রাতে বাবার খুব জ্বর এল। মাথায় পানি ঢালতে হল, ডাক্তার আনতে হল। ডাক্তার বলছেন ম্যালেরিয়া। দেশে কী এখন ম্যালেরিয়া আছে নাকি যে ম্যালেরিয়া হবে। ডাক্তারটির বয়স খুব কম, আমার মনে হয় নতুন পাস করেছে। আমার মত পাস। বইটই ভালমতো পড়েনি। আমার সঙ্গে গম্ভীর হয়ে কথা বলছিল।

মিস নীলু, ভয়ের কিছু নেই। আমি আবার এসে দেখে যাব।

আমি হেসে বাঁচি না। মিস নীলু আবার কি! কলেজে ওঠার পর দেখি অনেকেই সম্মান-টম্মান করছে। বিশেষ করে আমাদের কলেজের একজন লজিকের স্যার–নাজিবর রহমান ভুইয়া। উনি সব সময় আপনি আপনি করছেন। ছাত্রীরা তার নাম দিয়েছে প্ৰেমকুমার। কারণ তিনি নাকি সব মেয়ের সঙ্গে প্ৰেম করবার চেষ্টা করেন। তাকে প্রতি বছর পাঁচ ছ’বছর হাফসোল খেতে হয়। হাফসোল কী জানিস তো? নাকি তোদের কলেজে এসব কথা বলে না?

যাই হোক নজিবর রহমান স্যার কী করল তোকে বলি। ক্লাসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ নজিবর রহমান স্যারের সঙ্গে দেখা। তিনি ভ্রূ কুচকে বললেন, তুমি ফাস্ট ইয়ারের না?

জি স্যার।

গত ক্লাসে আসিনি কেন?

বাবার জ্বর ছিল তাই আসিনি।

লজিকের কতগুলি ইম্পর্টেন্ট ডেফিনেশন পড়িয়েছি। মিস করলে পরেরগুলি ধরতে পারবে না।

আমি চুপ করে রইলাম। নজিবর রহমান স্যার গভীরভাবে কিছুক্ষণ মাথা দুলিয়ে বললেন, ঠিক আছে আমার কাছে প্রিপেয়ারড নোট আছে। একবার এসে নিয়ে যেও।

আমি অবশ্যি নোট নিতে যাইনি। গেলেই আমার নাম হয়ে যেত প্রেমকুমারী। হিহিহি। উঁচু ক্লাসের মেয়েদের কাছে শুনেছি তার কাছে ক্লাস নোটের দশ-বারোটা কপি তৈরি থাকে। যাদের সঙ্গে তাঁর প্রেম করার ইচ্ছে হয় তাদের তিনি ডেকে ডেকে দেন। ভদ্রলোক কিন্তু পড়ান খুব ভাল। আমাদের আরেকজন স্যার আছে খুব ভাল পড়ান। তাঁর নাম কি জানিস? তাঁর নাম মুরগির গু। কী জন্যে বেচারার এই নাম হল। অনেকদিন ধরে তাঁর এই নাম চলছে। ছোটখাটো মানুষ, খুব পান খান। ক্লাস শুরু করবার আগে ডাস্টার দিয়ে টেবিলে একটা প্রচণ্ড বাড়ি দিয়ে বলেন, নিস্তব্ধতা! ছাত্রীগণ নিস্তব্ধতা হিরন্ময়!। প্রথম দিন তো আমি বহু কষ্টে হাসি সামলালাম, কিন্তু পরে দেখি সাংঘাতিক ভাল পড়ান। তার একটা ভাল নাম হওয়া দরকার ছিল।

ক্লাসের অনেক কথা লিখলাম। আরো মজার মজার ব্যাপার আছে, পরে লিখব। একজন আপা আছেন তার নাম মিস চাটা। দারুণ অসভ্য অসভ্য সব গল্প তাকে নিয়ে। চিঠিতে লেখা যাবে না।

এবার অন্য খবর বলি। মুন্নির বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে পিডিবির ইঞ্জিনিয়ার। খুব নাকি বড়লোক। আমি অবশ্যি বিয়েতে যাইনি। কারণ আমাকে যেতে বলেনি। মুন্নি ক্লাসের প্রায় সব মেয়েকে বলেছে, আমাকে বলেনি। রকিব ভাই এসেছিলেন ঢাকা থেকে। আমার অবশ্যি ধারণা ছিল আসবেন। না। বিয়ের পরদিন আমাদের বাড়িতে এলেন। কখন এসেছেন আমি কিছুই জানি না। কি জন্যে যেন বসার ঘরে গিয়েছি, দেখি তিনি বসে বসে বাবার সঙ্গে গল্প করছেন। তাঁর গায়ে নীল রঙের স্ট্রাইপ দেয়া একটা শার্ট ছিল। এমন মানিয়েছিল তাকে কী বলব।

আমার গায়ে ছিল বোম্বে প্রিন্টের ঐ জংলি শাড়িটা। আমাকে নিশ্চয় ভূতের মত লাগছিল। কারণ ঐ দিন আমি চুলও বাঁধিনি, কিছুই করিনি। আকবরের মাকে বলেছিলাম চুল বেঁধে দিতে। সে দিতাছি আপা বলে সেই যে গিয়েছে গিয়েছেই। আর দেখা নেই। আমি গিয়ে দেখি দিব্যি। ঘুমাচ্ছে। তারপর আমিও ঘুমাতে গেলাম। এখন চিন্তা করে দেখ অবস্থা। চুল বাধা নেই। ঘুম ঘুম ফোলা মুখ, পরনে জংলি শাড়ি। কি ভাবলেন উনি কে জানে। আমি তো একদম হতভম্ব হয়ে গেছি। উনি বললেন, তুমি কে নীলু না বিলু?

আর বাবার যা কাণ্ড। বাবা বললেন, সালাম কর নীলু, সালাম কর। সালাম করব কি। আমি বললাম, আপনি বসুন, আমি হাত-মুখ ধুয়ে আসছি। উঁহু, আমি বেশিক্ষণ বসতে পারব না। উনি অবশ্যি অনেকক্ষণ বসলেন। চা-টা খেলেন। যাবার আগে আমাকে দুটো বই দিয়ে গেছেন। একটা হচ্ছে–ঘনাদার গল্প (দেখ না কাণ্ড, ঘনাদার গল্প পড়ার বয়স এখন আছে?) অন্যটি হচ্ছে একটি কবিতার বই, নাম–পালক। আজ আর লিখব না, ঘুম পাচ্ছে।

–নীলু

পুনশ্চঃ তোর সঙ্গে যে রকিব ভাইয়ের দেখা হয়েছিল ঢাকায় এই কথাটি তুই কোনো চিঠিতেই লিখিসনি।

 

প্রিয় আপা,

আমি তোমাকে চারটি চিঠি দিয়েছি, তুমি মাত্র দুটি চিঠির জবাব দিয়েছ। এরকম করলে আমি আড়ি নেব। তখন মজা টের পাবে। বাবার খুব অসুখ। ডাক্তার বলেছেন ম্যালেরিয়া। খুব দুর্বল হয়ে গেছেন। এখন আর বাইরে যান না। আর বাবা তার প্রেসটা বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু কাউকে সেটা বলেননি। নজমুল চাচা এটা শুনে খুব রাগ করেছেন।

আরেকটা খুব খারাপ খবর আছে। আমার গানের স্যারের ছোট ছেলেটা পানিতে ডুবে মরে গেছে। ছেলেটার বয়স সাত। তার নাম দীপন। তুমি তাকে দেখেছিলে। তোমার মনে আছে। তবলা বাজিয়েছিল। তুমি বললে ওমা এইটুকু ছেলে আবার তবলা বাজায়। তোমার কলেজ। কবে

ছুটি হবে?

–সেতারা

 

প্রিয় মা বিলু,

দোয়া নিও। তোমার বাবার অসুখের সংবাদ পাইয়াছ। এখন কিছুটা সুস্থ, তবে পুরোপুরি সারে নাই। চিন্তার কোনো কারণ নাই। ইতিমধ্যে তোমার লোকাল গার্জেন সফদর সাহেবের একখানি পত্র পাইয়াছি। তুমি নাকি তাকে বলেছি–তুমি ছুটির দিনে হোস্টেলেই থাকতে চাও। এটা ঠিক না। সফদর সাহেব অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তার কথা শুনিবে। এবং সেই মত চলিবে।

তোমার বাবার ব্যবসা কিঞ্চিৎ মন্দা যাইতেছে। তিনি খুব সম্ভবত প্রেস বিক্রি করিয়া দিয়াছেন। কাজটা ঠিক হয় নাই। চালু প্রেস বিক্রয় করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তুমি কোনরূপ চিন্তা করিও না। তোমাদের অন্য অংশটি ভাড়া দেওয়ার চেষ্টা করিতেছি। দুই একজনের সঙ্গে কথাবার্তা হইয়াছে। যে কোনো ভাড়াটেকে হুঁট করিয়া ঢুকানো ঠিক হইব না, তাই বিলম্ব হইতেছে।

ভাল থাকিও ঠিকমত পড়াশুনা করিও।

–তোমার চাচা
নজমুল ইসলাম

 

নীলু,

তোর চিঠি পেয়েছি আজ বিকেলে।

এখন রাত প্রায় এগারোটা। অনেক রাতে উত্তর লিখতে বসেছি, কারণ আমার রুমমেট কিছু লেখার সময় খুব বিরক্ত করে। ঘাড়ের কাছে মাথা এনে সে চিঠি পড়বে। আমি এতটুকুও পছন্দ করি না, তবু সে এটা করবেই। তার ধারণা আমি কোনো ছেলেকে চিঠি লিখছি। আমার তো আর খেয়ে-দোয়ে কাজ নেই।

বাবার অসুখের খবর পেয়ে খুব খারাপ লেগেছে। এতদিনে সেরেছে নিশ্চয়ই সব জানাবি। নজমুল চাচা লিখেছেন প্রেস বিক্রি হয়ে গেছে। শুনে যা ভয় লাগছে। এখন আমাদের চলবে কি করে? আজ সমস্ত দিন আমার এইসব ভেবে খুব খারাপ লেগেছে। তার ওপর আজ বায়োলজি ল্যাব ছিল। আমাদের ডেমনেসট্রেটর একটা ব্যাঙ এনে ক্লোরফরমন্ড করলেন। আমরা শুধু দূর থেকে দেখলাম। তারপর উনি সেটা কচ করে কেটে ফেললেন। ব্যাঙের হৃৎপিণ্ডটা তখনো লাফাচ্ছে। কি যে খারাপ লেগেছে।

বিকেলে হোস্টেলে ফিরে এসেও বমি বমি লাগছিল। রাতে ভাত খাইনি। আমার রুমমেট তখন ফ্রেঞ্চ টোস্ট করে খাওয়াল। ওর একটা কেরোসিন কুকার আছে। খাটের নিচে লুকিয়ে রাখে। কারণ হলে এই সব এলাউ করে না। কিন্তু বেচারীর খুব রান্নার সখ। কয়েক দিন আগে গাজরের হালুয়া বানোল। এটা বানানো যে এত সহজ তা জানতাম না। খেতেও খুব ভাল হয়েছিল। মেয়েটির নাম মালা। রাজশাহী থেকে এসেছে। অনেক রকম রান্না জানে। দারুণ স্মার্ট মেয়ে। হোস্টেল সুপারের পারমিশন না নিয়েই সে দু’দিন তার এক আত্মীয় বাড়ি থেকে এসেছে!

এখানে নিয়মের খুব কড়াকড়ি। তবে সিনিয়র মেয়েদের বেলায় এতটা নয়। সিনিয়র মেয়েরা দোতলায় থাকে। ওদের সঙ্গে আমাদের তেমন যোগ নেই। ওরা অনেক রকম কাণ্ড-কারখানা করে। গত শুক্রবারে কি হয়েছে জানিস! রাত একটায় হঠাৎ শুনি দারুণ হৈচৈ হচ্ছে। পরে শোনা গেল দোতলার কাটি মেয়ে প্ল্যানচেট করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মা নিয়ে এসেছে। সে আত্মা আবার কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। হোস্টেল সুপারটুপার এলেন। হুলুস্কুল কাণ্ড।

তুই লিখেছিস তোর রকিব ভাইয়ের সঙ্গে যে দেখা হয়েছিল সে সম্পর্কে কিছু লিখিনি। ইচ্ছে করেই লিখিনি। তুই আবার কি ভাবতে কি ভাববি। যাক এখন লিখছি। সেদিন কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যাল খাতা কিনতে ন্যুমার্কেটে গিয়েছি। আমার সঙ্গে আছে আমার রুমমেট মালা। সে চুল বাঁধার রাবার ব্যান্ড আর টিপ কিনবে। কেনাকাটা শেষ হবার পর আমরা ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ মালা বলল-দ্যাখ ঐ ভদ্রলোক তখন থেকে আমাদের পিছে পিছে আসছে আর মিচকি মিচিকি হাসছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি একজন দাড়িওয়ালা ভদ্রলোক। আমাকে তাকাতে দেখেই সে বলল–তুমি নীলু না বিলু?

আমি তখনো চিনতে পারিনি। তখন ভদ্রলোক রাগী গলায় বললেন–চিঠির জবাব দাওনি কেন? তখন চিনলাম। খুব অবাক হয়েছিলাম। এ রকম দাড়িগোঁফ কল্পনাও করিনি। তারপর উনি আমাদের আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে গেলেন। মালা কিছুতেই যাবে না। শেষপর্যন্ত অবশ্যি গেল। তিনি সারাক্ষণই তোর কথা জিজ্ঞেস করছিলেন। তার কি ধরণা জানিস? তার ধারণা–না বলব না।

শোন নীলু একটা কথা–তুই ঐ ভদ্রলোককে বলবি উনি যেন দাড়িগোঁফ কামিয়ে ফেলেন। যা জঘন্য লাগছিল। ওঁকে।

এই যা–একটা বেজে যাচ্ছে, শুয়ে পড়ি। কাল পরশু আবার চিঠি লিখব।

–বিলু

 

মা বিলু,

দোয়া নিও। নীলুর নিকট হইতে শুনিলাম তোমাদের দোতলার মেয়েরা প্ল্যানচেটে আত্মা আনিয়াছে। উহাদের সহিত কোনোরূপ সম্পর্ক রাখিবে না। সব কিছু নিয়া ছেলেখেলা ভাল না।

তোমাদের উপরের তলায় নতুন ভাড়াটে আসিয়াছে। অতি সজ্জন ভদ্রলোক। স্বামী-স্ত্রী ও একটি ছেলে। ছেলেটি ঈষৎ দুরন্ত।

তোমার বাবার অসুখ অল্প বাড়িয়াছে। তবে চিন্তার কারণ নাই। শরীরের ওপর অযত্ন ও অবহেলার এই ফল। কিছুদিন ভূগাইবে। আর সব সংবাদ ভালো। জনৈক লোক মারফত আমি মুক্তাগাছার কিছু মণ্ডা পাঠাইলাম। বন্ধু-বান্ধব নিয়া খাইও। আর তোমাদের হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টের নিকট একটি পৃথক পত্র দিলাম। পত্রটি তাহাকে পৌছাইও এবং আমার সালাম দিও। ইতি।
তোমার চাচা
–নজমুল ইসলাম

 

হোস্টেল সুপার।

জনাবা,

সবিনয় নিবেদন এই যে, জানিতে পারিলাম। আপনার হোস্টেলের কতিপয় ছাত্রী প্ল্যানচেট না কি যেন করিতেছে। এই সব বিষয় নিয়া ঠাট্টা-তামাশা শুভ নয়। ছাত্রীর অভিভাবক হিসাবে আমি চিন্তাযুক্ত আছি। আপনি যথাবিহিত ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়া চিন্তামুক্ত করিবেন। আপনার নিকট এই আমার বিনীত প্রার্থনা। ইতি।

–নজমুল ইসলাম

 

আপা,

তুমি নীলু আপাকে এত লম্বা লিখেছ, আমাকে লেখোনি কেন? আমি খুব রাগ করেছি। আর কোনোদিন তোমাকে চিঠি লিখব না। আল্লাহর কসম।

বাবার অসুখ খুব বেড়েছে। আর আকবরের মার হাতের আঙুলের নিচে ঘা হয়েছে। নজমুল চাচা বলেছেন বেশি পানি ঘাঁটাঘাঁটির জন্যে এটা হয়েছে।

দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে করিম সাহেব ভদ্রলোক খুব মোটা। তাঁর ছেলেটি দারুণ দুষ্ট। এবং খুব ফাজিল। সে আমাদের কাচের জগটা ভেঙে ফেলেছে। ভেঙে আবার দাঁত বের করে হাসে। এমন ফাজিল।

–সেতারা

পুনশ্চঃ আপা তোমরা যে রবীন্দ্রনাথের আত্মা এনেছ সে কি করেছে? আমাদের ক্লাসের একটি মেয়ে বলেছে সেও নাকি প্ল্যানচেট করতে পারে। আমার বিশ্বাস হয় না, সে খুব গুল ছাড়ে। এই জন্যে আমরা তার নাম দিয়েছি গুল বাহার।

 

প্রিয় বিলু,

তোদের হোস্টেলের মেয়েরা ভূত এনেছে শুনে নজমুল চাচা খুব রাগ করেছেন। তিনি বলেছেন তিনি হোস্টেল সুপার এবং প্রিন্সিপ্যালকে চিঠি লিখবেন।

আমাদের দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছেন। তাঁর স্ত্রীর নাম নীনা। ভদ্রমহিলা নাকি-স্বরে কথা বলেন। প্রথম দিন বাড়িতে এসে বললেন–বাড়িত খুব বড়। তবে চারদিকে খুব জঙ্গলা। আমি বহু কষ্টে হাসি সামলেছি। তবে ভদ্রমহিলা খুব ভাল। বাবার জন্যে সুপ করে পাঠান। এবং খুব খোঁজখবর করেন। তবে ভদ্রমহিলার শুচিবায়ু আছে। রোজ তিন চারবার ঘর ধোয়া মোছা করেন।

বিলু তোকে এখন একটা কথা বলি–আমি রকিব ভাইয়ের একটা খুব চমৎকার চিঠি পেয়েছি। এত সুন্দর চিঠি যে আমি খুব কাদলাম। কত লক্ষ বার যে পড়লাম। সেই চিঠি। আমার কি ইচ্ছে করে জানিস? ইচ্ছে করে একদিন হুঁট করে ভদ্রলোকের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে খুব চমকে দেই। তারপর তিনি যখন বলবেন—তুমি কে, নীলু না বিলু? আমি তখন বলব, আমি বিলু। এবং অনেকক্ষণ বিলু হিসেবে কথাবার্তা বলার পর হঠাৎ বলব, আমি কিন্তু নীলু ভদ্রলোকের মুখের অবস্থাটা কি হবে ভেবে দেখ।

বিলু, ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে কি করে আমার পরিচয় হল তোকে বলি। মুন্নিদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। অপলারাও গিয়েছে। মুন্নি বলল, আমার এক ভাই এসেছেন ইউনিভার্সিটির টিচার। অংকের টিচার, যা গম্ভীর। আমরা আড়াল থেকে দেখলাম সত্যি গম্ভীর। মুন্নি তখন করল কি জানিস? আমাকে বলল–এই নীলু, তুই যদি আমার ঐ ভাইয়ের কাছ থেকে একটা সিগারেট নিয়ে খেতে পারিস তো বুঝব তোর সাহস। আমি বললাম–আমি শুধু শুধু তার কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে খাব কেন?

তুই তো টেনেছিস সিগারেট। স্কুলের বাথরুমে। এখন দেখি তোর সাহস। যদি সিগারেট চাইতে পারিস তাহলে প্রমাণ হবে আমাদের ক্লাসে তোর চেয়ে সাহসী মেয়ে নেই।

আমি ইতস্তত করে ঢুকে পড়লাম ভদ্রলোকের ঘরে। কোনোমতে বললাম–মুন্নির সঙ্গে আমার একটা বাজি হয়েছে। সেই বাজিতে আমি জিতব, যদি আপনি আমাকে একটা সিগারেট দেন।

ভদ্রলোক কিছুই বুঝতে পারলেন না, একটা সিগারেট বের করে দিলেন। আমি বললাম, আপনি রাগ করবেন না। সিগারেটটা আমাকে ধরাতে হবে। ভদ্রলোক দিয়াশলাই বের করে দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার দিকে। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কি?

নীলু

ও নীলু তোমার কথা বলেছে আমাকে মুন্নি।

কি বলেছে?

বলেছে যে তুমি খুব তেজী মেয়ে।

আরো অনেক কিছু বলেছে নিশ্চয়ই।

ভদ্রলোক তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি বললাম, আর কিছু বলেনি মুন্নি?

আর কি বলবে?

বলেনি আমার মা পালিয়ে গেছে? আমাদের সম্পর্কে যখন কেউ কিছু বলে সেটাই সবার আগে বলে।

ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন। আমি বললাম, মুন্নি বলেনি সে সব?

বলেছে।

আমি দেখলাম জানালার আড়াল থেকে মুন্নি ও অপলা অবাক হয়ে দেখছে আমার হাতে জুলন্ত সিগারেট।

আমি বললাম, আজ উঠি। আপনি আমার ওপর রাগ করেননি তো।

রাগ করব কেন?

আপনার সামনে সিগারেট টানলাম যে।

না। রাগ করিনি। মাঝে মাঝে এই সব ছেলেমানুষি দেখতে ভালই লাগে।

আমি উঠে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক বললেন–নীলু বস, তোমার সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভাল লাগছে। প্লিজ বাস। আমি অবাক হয়েই বসলাম। আর আমার কি যে ভাল লাগল। এখনো মনে আছে সে রাতে অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমুতে পারিনি। শেষ রাতের দিকে ঘুম এল এবং আমি ভদ্রলোকেকে স্বপ্ন দেখলাম। যেন আমি চা বানাচ্ছি, তিনি এসে বললেন–নীলু আমার আজ ফিরতে দেরি হবে, তুমি খেয়ে নিও। অপেক্ষা করবার দরকার নেই। আমি রাগের ভঙ্গি করে বললাম।–না। আজ কোথাও যেতে পারবে না। আজ আমরা বাগানে হাঁটব।

অদ্ভুত মিষ্টি স্বপ্নের ভেতরই আমি কেঁদে বুক ভাসিয়েছি। কাউকে এই স্বপ্নের কথা বলতে পারিনি। তোকে বলার ইচ্ছে হয়েছে, কিন্তু সাহস হয়নি। যদি তুই হাসোহাসি করিস।

তোকে আমি অনেক কথা বলতে চাই বিলু। ছুটি হতে তো অনেক দেরি। একবার চালে আয় না। তাছাড়া এমনিতেও তোর আসা উচিত। বাবার শরীর খুব খারাপ, কেউ তোকে জানাচ্ছে না। কাল রাতে আমি ঘরে ঢুকতেই বাবা বললেন, কে রেনু? আমি বললাম–বাবা আমি নীলু বাবা কেমন চোখে তাকালেন আমার দিকে, তারপর বললেন–নীলু, তোর মা বোধ হয় এসেছে। বসতে-টসতে দে। পুরোনো কথা মনে রেখে লাভ নেই।

বিলু চলে আয়।

–তোর
নীলু

বাড়ি ফিরে

বাড়ি ফিরে অবাক হলাম।

সব কিছুই অন্যরকম লাগছে। চারদিকে কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। সব কিছুই অন্যরকম হয়ে গেছে। সেতারাকেও মনে হল এই তিন মাসে অনেকখানি বড় হয়ে গেছে। সবচে বদলেছেন বাবা। কী যে খারাপ হয়েছে তার স্বাস্থ্য। চোখ হলুদ। মাথার সামনের দিকের চুল সব পড়ে গেছে। আমি তাঁর ঘরে গিয়ে ঢুকতেই তিনি বলবেন, কে, রেনু?

আমি অনেকক্ষণ অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম, বাবা আমাকে চিনতে পারছেন না?

চিনতে পারব না কেন? কখন এসেছিস?

এই তো কিছুক্ষণ আগে।

বস মা আমার কাছে।

বাবা তার রোগা একটা হাত আমার কোলে তুলে দিলেন।

তুমি আমাকে একটা চিঠিও লেখোনি বাবা।

শরীরটা খারাপ মা। খুব খারাপ।

ঠিক তখন নীলু চা নিয়ে ঢুকল। বাবা মাথা তুলে বললেন, কে, রেনু?

নীলু অত্যন্ত যত্নে বাবাকে বালিশে হেলান দিয়ে বসাল। পিরিচে ঢেলে ঢেলে চা খাওয়াল। নীলু দেখি অনেক কাজ শিখেছে। গিনি গিন্নি ভাব।

সে কোমরে আঁচল জড়িয়ে ছুটোছুটি করে অনেক কাজ করছে। এক ফাঁকে বলল, সংসারের হাল ধরেছি।

তাই দেখছি।

কি যে ঝামেলা গেছে তুই তো জানিস না। তোকে জানানো হয়নি।

তা জানাবি কেন, আমি কে?

তাও ঠিক।

নীলু হাসল।

আমি বললাম–তুই খুব সুন্দর হয়ে গেছিস নীলু নীলু কিছু বলল না। অন্য সময় হলে সে কিছু-একটা ঠাট্টার কথা বলত। আজ দেখলাম লজ্জা পাচ্ছে।

নীলু তুই কেমন অন্য রকম হয়ে গেছিস।

অন্য রকম মানে কী রকম?

তোর মধ্যে কেমন একটা মা মা ভাব চলে এসেছে।

নীলু এবারও লজ্জিত ভঙ্গিতে আবার হাসল। সত্যি সত্যি সে বদলে গেছে। কিন্তু এই নীলুকেও ভাল লাগছে। আমি মৃদু স্বরে বললাম, আজ রাতে আমরা দু’জন একসঙ্গে শোব, কেমন নীলু?

ঠিক আছে।

সারারাত গল্প করব।

নীলু হাসল। ছোট বোনদের পাগলামী কথাবার্তা শুনে বড় বোনটা যেমন প্রশ্রয়ের হাসি হাসে সে রকম হাসি। ওরা আমার ঘরটি ঠিক আগের মতো করে সাজিয়ে রেখেছে। টেবিলের ওপর বইপত্র যা ছিল সব সে রকমই আছে। একটা বাজারের লিস্ট করেছিলাম, সেই লিস্টটা পর্যন্ত বুলিয়ে রেখেছে।

আমার বিছানায় এখন কে শোয় নীলু? সেতারা?

হুঁ সেতারা বুঝি সে রকম? ও এখনো আমার সঙ্গে ঘুমায়। আরো অনেক মজার ব্যাপার আছে সেতারার।

সেতারা বলল, ভাল হবে না। আপা।

আমি বললাম, কী ব্যাপার?

সেতারাকে কে যেন প্ৰেমপত্র লিখেছে। রুল টানা কাগজে।

নীলু খিলখিল করে হেসে উঠল। কে বলবে এই বাড়িতে কোনো দুঃখ-কষ্ট আছে?

নিলু বলল, নজমুল চাচা তাঁর মেয়ের কাছে যাচ্ছেন জানিস?

না তো।

সামনের মাসের মাঝামাঝি যাবেন। ওর মেয়ের কি যেন একটা অপারেশন হবে। গল ব্লাডার না কি যেন, ঠিক জানি না। মেয়ে বাবার জন্যে টিকিট পাঠিয়েছেন।

নজমুল চাচা নিশ্চয়ই খুব খুশি?

না, খুব না। এত দূর একা একা যেতে ভয় পাচ্ছেন।

ভয়ের কি?

কি জানি চাচার হেনতেন। কত কথা, আসলে যাবার ইচ্ছা নেই।

যাচ্ছেন তো?

তা যাচ্ছেন।

নজমুল চাচার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। নজমুল চাচা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদতে লাগলেন। যেন আমি তার হারিয়ে-যাওয়া একটি মেয়ে, কোনোদিন ফিরে পাবেন ভাবেননি, হঠাৎ ফিরে পেয়েছেন। তার কাণ্ড দেখে দরজায় পাশে দাঁড়িয়ে নীলু হাসতে লাগল। চাচা রাগী গলায় ধমক দিলেন, হাসছিস কেন?

নীলু মুখ টিপে বলল, এমনি হাসছি। কাঁদলে দোষ নেই, হাসলে দোষ।

তুই নিচে যা তো নীলু

ঠিক আছে যাচ্ছি। কিন্তু বিলু ভেবে যাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা হচ্ছে সে কিন্তু বিলু নয়। আমি বিলু।

নজমুল চাচা হকচাকিয়ে গেলেন। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাতে লাগলেন। তাঁর মনে সন্দেহ ঢুকে গেল।

তুই কে নীলু না বিলু?

আমি বিলু।

সত্যি করে বল।

সত্যি বলছি।

না, তুই নীলু বড় ফাজিলে হয়েছিস, যা বিলুকে পাঠিয়ে দে। আমি হাসতে হাসতে নিচে নেমে গেলাম। বাড়িতে এসে বড় ভাল লাগছে।

দোতলার নতুন ভাড়াটেদের সঙ্গেও দেখা হল। নীলু বলেছিল নাকি-স্বরে কথা বলেন। কোথায় কী দিব্যি ভাল মানুষের মত কথাবার্তা। নীলুটা এমন বানাতে পারে। ভদ্রমহিলাকে আমার বেশ পছন্দ হল। তবে একটু কথা বেশি বলেন। আমার সঙ্গে দুতিন মিনিট কথা হল, এর মধ্যে হড়বড় করে একশ গণ্ডী কথা বলে ফেললেন। তবে যে সব মেয়েরা বেশি কথা বলে ওদের মনে কোনো ঘোরপ্যাচ থাকে না। এইটা খুব সত্যি। বেশি কথা বলা মেয়েরা খুব দিলখোলা হয়।

সমস্ত দিন আমি অন্য এক ধরনের ভাল লাগা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। দুপুরে নীল আমাকে বাগানে নিয়ে গেল। পেয়ারা গাছে নাকি ডাসা পেয়ারা হয়েছে। খুব মিষ্টি।

বাগান পরিষ্কার করেছে কে?

দোতলার ঐ ভদ্রমহিলা করিয়েছেন। এখন ভাল লাগছে না?

হুঁ। চমৎকার লাগছে।

এ ভদ্রমহিলা আর তার হ্যাঁসবেন্ড প্রায়ই সন্ধ্যাবেলা বাগানে বসে চা খান। একদিন দেখি হাত ধরাধরি করে হাঁটছেন। খুব রোমান্টিক।

আমি ঘাসের ওপর বসতে বসতে বললাম, তোর রকিব ভাই আর চিঠি-ফিঠি লেখে না?

নীলু লাল হয়ে বলল, লেখে মাঝে মাঝে।

কী লেখেন?

এই সব আজেবাজে তেমন কিছু না।

তুমি নিশ্চয়ই খুব লিখিস?

নীলু জবাব দিল না।

কী রে, লিখিস না তুই?

লিখি মাঝে মাঝে।

তুই কী লিখিস নীলু?

নীলু চুপ করে রইল।

বল না।

যা মনে আসে তাই লিখি। বাবার কথা লিখি, মার কথা লিখি। তোর কথা সেতারার কথা সবার কথা লিখি।

লিখতে খুব ভাল লাগে?

হুঁ।

আমি একটি ছোট্ট নিঃশ্বাস গোপন করে হালকা স্বরে বললাম, তোদের বিয়ে হলে বেশ মানাবে। দুজনেই চিঠি লেখার ওস্তাদ।

নীলু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। হয়ত তার চোখে পানি আসছে। চাচ্ছে না। আমি দেখে ফেলি।

 

সন্ধ্যাবেলা আমরা তিন বোন নদীর পাড়ে হাঁটতে গেলাম। মা যখন ছিলেন তখন আমরা প্রায়ই হাঁটতে আসতাম। প্ৰায় মাইলখানিক হাঁটা হয়ে যেত। এক সময় ক্লান্তিতে পা ভারী হয়ে আসত, তবু মায়ের হাঁটার শেষ নেই।

নীলু বলত, আর পারব না। ক্ষমা চাই। আমি এখানে বসে থাকব, তোমরা যাও। মা বলতেন, অল্প কিছু দূর যাব। সামনেই নদীটা খুব সুন্দর। একই রকম নদী। একই দৃশ্য দুপাশে। তবু কিছু কিছু জায়গায় দাঁড়িয়ে মুগ্ধ কণ্ঠে বলতেন, আহ। কী সুন্দর! তেমন বিশেষ সৌন্দর্যের কিছু আমরা দেখতে পেতাম না। কিন্তু মার মুগ্ধ ভাব আমাদের ও স্পর্শ করত। নীলু হাই তুলে বলত, মন্দ না, ভালই। মা চলে যাবার পর আমরা আর নদীর কাছে আসি নি। না কথাটা ঠিক না। বাবার সঙ্গে এসেছিলাম একদিন। গত শীতে আগের শীতে বাবার হঠাৎ সখ হল আমাদের নিয়ে বেড়াবেন। খুব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ফ্রাস্কে করে চা নিয়ে যাব। নদীর পাড়ে বসে চা খাব, কী বলিস? আমরা কেউ তেমন উৎসাহ দেখলাম না। শুধু সেতারা খুব উৎসাহ দেখাতে লাগল।

প্রচণ্ড শীতে কাঁপতে কাঁপতে আমরা বেড়াতে বের হলাম। বাবার কাঁধে ফ্লাস্ক। আমরা তিন বোন হাত ধরাধরি করে তাঁর পিছু পিছু যাচ্ছি। কুয়াশায় চারদিক ঢাকা। দেখার মতো কিছুই নেই। নদীটিও শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে। বাবার উৎসাহ মিইয়ে এসেছে। মৃদু স্বরে বললেন, ফিরে যাবি নাকি? নীলু বলল, কোথাও বসে চা শেষ করি। এত কষ্ট করে ফ্লাস্কটা আনলে। কোথাও বসার মত জায়গা পাওয়া গেল না। সব শিশিরে ভিজে আছে। বাবা অত্যন্ত বিব্রত বোধ করতে লাগলেন। সেই আমাদের শেষবারের মতো যাওয়া।

বাবা সুস্থ থাকলে বাবাকে নিয়ে আসা যেত। তিনি আমাদের তিন বোনকে বেরুতে দেখে আগ্রহ নিয়ে বলেছিলেন, কোথায় যাচ্ছিস তোরা? সেতারা বলেছে, নদীর পাড়ে হাঁটতে যাচ্ছি। বাবা। তিনি ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বললেন, ভাল, খুব ভাল।

বেশিক্ষণ থাকব না। যাব। আর আসব।

যতক্ষণ ইচ্ছা থাকিস মা। আমার জন্যে ভাবতে হবে না। আমি ভালোই আছি। খুব ভাল।

আমরা হাঁটছি নিঃশব্দে। অনেকেই কৌতূহলী হয়ে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে। দু’একজন বুড়োমত ভদ্রলোক সেতারাকে জিজ্ঞেস করলেন, ভাল আছ?

নীলু বলল, সেতারাকে সবাই চেনে। ইস আগে যদি মন দিয়ে গানটা শিখতাম।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে শহরের শেষপ্রান্তে চলে এলাম প্ৰায়। সেখানে প্রকাণ্ড একটা ঝাঁকড়া রেন্টি গাছ। তার শিকড় নেমে গেছে নদীর দিকে। কয়েকজন কলেজের ছেলে-টেলে হবে গাছের গুড়ির ওপর বসে সিগারেট টানছিল। ওরা আমাদের দেখেই উঠে দাঁড়াল। একজন এগিয়ে এসে বলল, আপনারা বসবেন?

নাহ।

বসুন না একটু আমাদের সঙ্গে। বসুন।

সেতারা বলল, কিন্তু আপনারা গান গাইতে বলতে পারবেন না।

সব কটি ছেলে একসঙ্গে হেসে উঠল। আমরা তিন বোন পাশাপাশি বসলাম। ছেলেগুলি বসল। আমাদের সামনে।

নীলু বলল, আপনারা রোজ এখানে আসেন? জায়গাটা খুব সুন্দর।

ছেলেগুলি কোনো উত্তর দিল না।

সেতারা বলল, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়ি যাওয়া দরকার।

আমরা আপনাদের পৌঁছে দেব। আমরা উত্তর দীঘির পাশ দিয়েই রোজ যাই।

আমরা বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। ছেলেগুলি সেতারাকে গান গাইতে বলল না। কিন্তু সেতারা নিজ থেকেই গুনগুন করতে শুরু করল। খোলা মাঠ। অদূরেই শীর্ণকায় ব্রহ্মপুত্র। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পাখিরা ডানা ঝাপটাচ্ছে গাছে গাছে। এর মধ্যে সেতারার কিন্নর কণ্ঠ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল—

‘চাহিতে যেমন আগের দিনে
তেমনি মদির চোখে চাহিও
যদি গো সেদিন চোখে আসে জল
লুকাতে সে জল করিও না ছল…’

আমাদের তিন বোনের চোখ ভিজে উঠল। আমরা কতগুলি অপিরিচিত ছেলেকে সামনে বসিয়ে কাঁদতে শুরু করলাম। কান্নার মতো গভীর তো কিছু নেই। একজনের দুঃখ অন্যজনকে স্পর্শ করে না। কিন্তু একজনের চোখের জল অন্যকে স্পর্শ করে। ছেলেগুলি দেখলাম। একে একে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাচ্ছে। পুরুষরা তাদের চোখের জল মেয়েদের দেখাতে চায় না।

একটি ছেলে কোমল স্বরে বলল, আরেকটা গাইবেন?

কোনো অলৌকিক জগৎ থেকে সেতারার গান আসে? বুকের মধ্যে প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে শুনলাম সে গাইছে, ‘নহে নহে প্রিয়, এ নয় আঁখি জল।’

ক্রমে ক্রমে সন্ধ্যা মিলিয়ে এল। ব্রহ্মপুত্রের ওপর দিয়ে উড়ে আসতে লাগল শীতল হাওয়া। অন্ধকার ঝোপগুলিতে চিকমিক করতে লাগল জোনাকী। ছেলেগুলি আমাদের বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। সেতারা বলল, ভেতরে আসবেন?

জি না, জি না।

কিন্তু ওরা চলেও গেল না। গোটে বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ।

একজন মৃদু স্বরে বলল, আপনার বাবার শরীর কী এখন ভাল?

নীলু বলল, একটু ভাল।

কিন্তু বাবার শরীর ভাল নয়। আমি জানি বাবা মারা যাবেন খুব শিগগিরই। মৃত্যু টের পাওয়া যায়। তার পদশব্দ ক্ষীণ কিন্তু অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। বাবা মারা যাবার পরপরই আমরা একা হয়ে যাব। কেউ কি তখন এগিয়ে আসবে আমাদের কাছে? একমুখ দাড়িগোফ নিয়ে রকিব ভাই হাসিমুখে বলবেন-কে বিলু আর কে নীলু? গাঢ় ভালবাসার সুবিশাল বাহু প্রসারিত করবে। আমাদের দিকে। হয়ত করবেন, হয়ত করবেন না। এখানে কিছুই নিশ্চিত করে বলা যায় না।

 

বসবার ঘরে বাতি জ্বলছিল। আমরা ঘরে ঢুকেই দেখলাম আমাদের লাল রঙের সোফাটিতে মা বসে আছেন। কেমন অদ্ভুত একটি শান্ত বিষন্ন ভঙ্গি। মা মাথা নিচু করে বললেন, তোমাদের বাবাকে দেখতে এলাম। নজমুল সাহেব টেলিগ্রাম করেছিলেন।

মার পরনে সাদার উপর নীল নকশার একটা শাড়ি। মাথায় আঁচল দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। বয়সের ছাপ পড়েছে চোখে-মুখে। কাপালের কাছে এক গোছ রুপালি চুল। তবুও কি চমৎকারই না লাগছে তাকে।

মা বললেন, তোমরা কেমন আছ?

কেউ কোনো জবাব দিলাম না। মা কি আমাদের তুমি করে বলতেন না তুই কবে বলতেন কিছুতেই মনে পড়ল না।

সবাই অনেক বড় হয়ে গেছে। এবং খুব সুন্দর হয়েছ সবাই। বস। কথা বলি তোমাদের সঙ্গে।

আমরা বসলাম।

মা বললেন, তোমরা নাকি নদীর পাড়ে গিয়েছিলে?

আমরা সে কথার জবাব দিলাম না।

মা থেমে থেমে বললেন, কয়েকদিন আগে সেতারার গান শুনলাম রেডিওতে। বিশ্বাসই হয় নি। আমার একটি মেয়ে এত সুন্দর গান গায়।

সেতারা তাকিয়ে আছে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কিছু-একটা দেখতে চেষ্টা করছে মার মধ্যে। নিজের মনের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছে হয়ত।

তুমি মা খুব নাম করবে। দেশের মানুষের ভালবাসা তুমি পাবে এখনই অবশ্যি পেয়েছ, আরো পাবে।

নীলু বলল, আপনি কখন এসেছেন?

কিছুক্ষণ আগে এসেছি।

বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

মা ইতস্তত করে বললেন, না।

যান বাবার কাছে যান। উনি আপনার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়ে আছেন।

মা নড়লেন না। বসেই রইলেন।

আমি বললাম, আসুন, আপনাকে বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছি।

বাবার ঘরে ঢোকা মাত্র বাবা তার অভ্যাসমত বললেন, কে, রেনু?

মা দরজার পাশে থমকে দাঁড়াল। বাবা বললেন, ভাল আছ রেনু?

 

সেই রাতেই বাবার অসুখ বেড়ে গেল। বুকে হাত দিয়ে বহু কষ্টে টেনে টেনে শ্বাস নিতে লাগলেন। কথাবার্তা জড়িয়ে গেল। তবু একটু কোনো শব্দ হতেই মাথা তুলে বলতে লাগলেন, কে, রেনু?

মা তাঁর এত পাশে দাঁড়িয়ে কিন্তু তাকে চিনতে পারলেন না।

আমি চলে এলাম আমার ঘরে। নীলুর বিছানার ওপর দেখি একটি নীল খাম পড়ে আছে। রকিব ভাইয়ের লেখা চিঠি নিশ্চয়ই। নীলু হয়ত আজই পেয়েছে। রেখে দিয়েছে গভীর রাতে একা একা পড়বার জন্যে।

চারদিকে সুনসান নীরবতা। আমি বসে আছি চুপচাপ। আমার পাশেই ভালবাসার একটি নীল চিঠি। আমি হাত বাড়িয়ে চিঠিটি স্পর্শ করলাম। ঠিক তখনি নিচ থেকে একটি তীব্র ও তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দ ভেসে এল।

মা কাঁদছেন।

Exit mobile version