Site icon BnBoi.Com

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল – হুমায়ূন আহমেদ

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাইস্কুল - হুমায়ূন আহমেদ

শ্রাবণ মাসের শেষ

“হে মানব সন্তান, সহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হইয়া তুমি মুক্তির স্বাদ পাইবে। ইহাই তোমার নিয়তি।“
(প্রাচীন শিলালিপি। মায়া সভ্যতা)

০১.

শ্রাবণ মাসের শেষ।

ভ্যাপসা গরম পড়েছে। গত পনেরো দিনে এক ফোঁটা বৃষ্টি হয়নি। সারাদিন ঝাঁঝালো রোদ যায়। সূর্য ডোবার পর গরম আরো বাড়ে। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে যখন-তখন সাপ বের হয়ে পড়ে। এ পর্যন্ত দুজনকে সাপে কেটেছে।

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের টিচার্স কমনরুমে সাপ নিয়ে গল্প হচ্ছিল। ইংরেজির মাহবুব স্যার কাল রাতে কিভাবে অল্পের জন্য বেঁচেছেন সেই গল্প করছেন। খুব আগ্রহ নিয়ে করছেন, তবে কেউ মন দিয়ে শুনছে৷ বলে মনে হচ্ছে না। মাহবুব সাহেব গল্প ভাল বলতে পারেন না। কিছু দূর বলার পরই খেই হারিয়ে ফেলেন, তখন গলা খাকাড়ি দিয়ে বলেন, বুঝলেন কি-না, বুঝলেন কি-না। গল্প আবার নতুন করে শুরু হয়। এইভাবে গল্প শুনে আরাম নেই। তারপরেও সবাই শুনছে, কারণ কিছু করার নেই। হেডস্যার সবাইকে ক্লাসের পরে থাকতে বলেছেন। খুব জরুরী।

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের হেডমাষ্টার ফজলুল করিম এম, এ, (ডবল) বিটি (প্রথম শ্রেণী) কে সবাই সমীহ করে চলেন। ভদ্রলোকের বয়স পাঁচপঞ্চাশের মত। রোগা পাতলা মানুষ। হাঁটেন খানিকটা কুজো ভঙ্গিতে। হাঁটার সময় চোখ থাকে তার নিজের পায়ের পাতার উপর। সামনে কে আসছে বা কে পাশ দিয়ে যাচ্ছে তার চেয়েও তার পায়ের পাতা কোথায় পড়ছে তা তাঁর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। কথা বলেন নরম গলায়। তবে প্রতিটি শব্দ খুব স্পষ্ট করে বলেন। ১৯৬৮ সালে হেডমাস্টার হিসেবে এই স্কুলে এসেছিলেন। এখনো আছেন। তার সবচে বড় গুণ এবং সবচে বড় ত্রুটি হচ্ছে স্কুলের বাইরে তিনি কিছু চিন্তা করতে পারেন না।

মাহবুব সাহেব গলা খাকাড়ি দিয়ে বলছেন, বুঝলেন কি-না গরমষ্টা কেমন পড়েছে কাল রাতে। বুঝলেন কি-না যাকে বলে তালপাকা গরম। রাতে ভাত হতে দেরি হচ্ছে, আমি আমার মেয়েটাকে বললাম, উঠোনে পাটি পেতে দে, বিশ্রাম করি। সে দিল। তারপর বললাম, দে মা, একটা বালিশও দে, শুয়ে থাকি। রান্না হলে ডেকে দিস। সে বেশ একটা বিছানার মত করে দিল। বুঝলেন কি-না আমি একটা তালপাখা নিয়ে শুতে গেছি, হঠাৎ দেখি বালিশের কাছে এক গোছা পাটের কোষ্ঠা। বুঝলেন কি-না আসলে সাপ। চাঁদের আলোয় পাটের কোষ্ঠার মত লাগছে। আমি তো আর সাপ যে সেটা জানি না। আমি শুয়ে পড়েছি, তখন একটা গন্ধ পেলাম। মিষ্টি গন্ধ।

আরবী ও ইসলামিয়াত শিক্ষক মওলানা ইরতাজ উদ্দিন হাই তুলতে তুলতে বললেন, মিষ্টি গন্ধ পেলেন কেন? সাপ কি সেন্ট মেখে এসেছিল।

এই কথায় সবার হেসে উঠা উচিত, কিন্তু কেউ হাসল না। দুএকজন অবশ্যি মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করল। এই স্কুলে মাহবুব সাহেবকে নিয়ে কেউ হাসাহাসি করে না। মওলানা ছাড়া আর কারো এত সাহস নেই। মাহবুব সাহেব ক্ষমতাবান ব্যক্তি। এবার চেয়ারম্যান ইলেকশনে দাঁড়াবেন এরকম শোনা যাচ্ছে। স্কুলে শুধু না, এই অঞ্চলে থাকতে হলেও তাকে তোয়াজ করে চলতে হয়। মওলানা নতুন এসেছেন তিনি এই ব্যাপারটা হয়। এখনো জানেন না কিংবা জানলেও না জানার ভান করছেন।

মাহবুব সাহেব কল্পনা করেননি তার এমন ভয়াবহ গল্প নিয়ে কেউ রসিকতা করবে। তিনি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে মওলানার দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিজেকে সামলালেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, মওলানা সাহেব, আপনি বোধহয় জানেন না ভাদ্র-আশ্বিন মাসে সাপের শরীরে গন্ধ। হয়, তখন সাপ খোলস ছাড়ে। অনেকটা বাসি বকুল ফুলের গন্ধের মত গন্ধ।

আমি জানতাম না, আমার ধারণা ছিল শীতকালে খোলস ছাড়ে। এই নিয়ে পরে আপনার সঙ্গে বাহাস করা যাবে, আপাতত গল্পটা শেষ করুন। সাপটা কি করল, খোলস ছাড়ার জন্যে আপনার কাছে গেল?

মাহবুব সাহেব মওলানার সাহস দেখে অবাক হলেন। তিনি কিছু বললেন না। ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে রইলেন। তার মুখে থুথু জমে যাচ্ছে। তিনি মনে মনে বললেন, হারামজাদা মওলানা।

অংক-স্যার বিনয় বাবু পরিস্থিতি সামলাবার জন্যে বললেন, চা খাওয়া যাক, কি বলেন? হরিপদকে বলি চা-পাতা আর ভেলি গুড় নিয়ে আসুক। ভেলি গুড়ের চা ভাল হয়। কি বলেন আপনারা ডাকি হরিপদকে?

কেউ হ্যাঁ বা না কিছু বলল না। হা বললেই খরচ দেয়ার একটা প্রশ্ন চলে আসে। কে খরচ দেবে?

মাহবুব সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা কুড়ি টাকার নোট বের করে টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, আনতে বলুন, চা আর একটা করে সিঙ্গাড়া। আমরা মানুষ কজন?

বিনয় বাবু উৎসাহের সঙ্গে বললেন, হেডস্যারকে নিয়ে বার বারটা সিঙ্গাড়া আনিতে বলি, কি বলেন?

মাহবুব সাহেব বললেন, আমাকে বাদ দিয়ে হিসাব করুন। আমি সিঙ্গাড়া-ফিঙ্গাড়া খাই না।

তিনি ভেবেছিলেন, সবাই একসঙ্গে বলে উঠবে, আপনি খাবেন না মানে? আপনাকে বাদ দিয়ে আমরা খাব না-কি? তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন, কেউ কিছুই বলল না। গল্প অনেকটুকু বলা হয়েছে, বাকিটুকু শোনার প্রতিও কারো আগ্রহ নেই। মাহবুব সাহেবের ভুরু কুঞ্চিত। আশ্চর্য! একটা গল্পের শেষটুকু বলা যাবে না। আসল মজাইতো গল্পের শেষে

মওলানা সাহেব বললেন, চা আসুক, এরমধ্যে আসরের নামাজটা পড়ে ফেলি। সময়মত নামাজ পড়ার বদঅভ্যাস কি আর কারো আছে? থাকলে আসুন। জামাত ছাড়া নামাজ পড়ে আরাম পাওয়া যায় না।

মাহবুব সাহেব নিয়মিত নামাজ পড়েন। আসরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাচ্ছে এটা তিনি লক্ষ্য করছেন কিন্তু এই ব্যাটার পেছনে নামাজ পড়ার অর্থ হয় না। যার উপর রাগ থাকে তার পেছনে নামাজ পড়া যায় না। নামাজ কবুল হয় না।

চারজন শিক্ষক উঠে দাড়ালেন। মাহবুব সাহেবের ক্ষীণ সন্দেহ হলতারা বোধহয় গল্পের হাত থেকে বাচার জন্যেই উঠে গেছে। নামাজটা উপলক্ষ্য। আসর ভেঙে গেল। ভাঙা আসরে গল্প বলার কোন মানে হয় না। কিন্তু মান রক্ষার জন্যে হলেও শেষ করা দরকার। মাহবুব সাহেব বিনয় বাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, চরম বিপদ গিয়েছিল, বুঝলেন, আরেকটু হলে মরেই যেতাম। সাপ ফণা তুলে ফেলেছিল।

বিনয় বাবু অনাগ্রহের সঙ্গে বললেন, ও আচ্ছা।

আমি নিজে কিছুই দেখিনি। আমার মেয়ে প্রথম দেখল, বুঝলেন কি-না সে এক বাটি মুড়ি নিয়ে আসছে। হঠাৎ এক চিৎকার–এইটা কি? এইটা কি? আমি তাকিয়ে দেখি সাপ ফণা তুলে আছে। হাতের খাবার সাইজের এক ফণা।

গল্পে আবার বাধা পড়ল। হরিপদ চা-সিঙ্গাড়া নিয়ে এসেছে। বিনয় বাবু ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন ভাগাভাগিতে। গরম গরম সিঙ্গাড়া, ধোঁয়া উড়ছে। এর স্বাদই অন্য রকম। মাহবুব সাহেবের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। একবার খাবেন না বলার পর আর খাওয়া যায় না। বিনয় বাবুকে দেখা যাচ্ছে পিরিচে তিনটা সিঙ্গাড়া আলাদা করছেন। মাহবুব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, করছেন কি?

বিনয় বাবু বললেন, হেডস্যারকে দিয়ে আসি।

দিয়ে আসতে হবে না, এখানে এসে খাবেন। আর তিনটা সিঙ্গাড়া দিলেন কোন আন্দাজে? সবাইকে দুটা দিচ্ছেন। তাকেও দুটা দিন। যান খবর দিন। এতগুলি মানুষকে খামাখা কেন বসিয়ে রেখেছেন কে জানে। জরুরী মিটিং, আমি তো জরুরী কিছু দেখি না।

আপনাকে দেই। গরম সিঙ্গাড়া খেতে ভাল লাগবে। এরা জিনিসটা ভাল বানায়।

বললাম তো বাজারের খাবার খাই না।

হেডমাস্টার সাহেবকে আসতে দেখা যাচ্ছে। মাটির দিকে তাকিয়ে হন হন করে হাঁটা। মাহবুব সাহেব চারদিনের পুরনো খবরের কাগজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হেডমাস্টার সাহেবের সাথে তাঁর ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। এই মানুষটার মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না।

মাহবুব সাহেব, খবর কি?

ভাল।

নাস্তা-পানির ব্যবস্থা হয়েছে দেখছি, সিঙ্গাড়া কি পরিমলের দোকানের?

বিনয় বাবু হাসিমুখে বললেন, জ্বি স্যার। তিনি হেডমাস্টার সাহেবের দিকে পিরিচ এগিয়ে দিলেন।

এই সিঙ্গাড়া একটা দুটো খেলে হয় না। গোটা দশেক করে খেতে হয়। বিনয় বাবু, হরিপদকে পাঠান তো, আরো কিছু আনুক।

তিনি পকেট থেকে কুড়ি টাকার নোট বের করলেন।

নামাজীরা নামাজ শেষ করে ফিরেছে। বিনয় বাবু খুশি-খুশি গলায় বললেন, হেডস্যার আরো কুড়ি টাকার সিঙ্গাড়া আনতে দিলেন। পারহেড খ্রী পিস।

ফজলুল করিম সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, আপনাদের সবার জন্যে একটা সুসংবাদ আছে। এই জন্যেই আপনাদের এতক্ষণ আটকে রাখলাম। সুসংবাদটা কি আন্দাজ করুন দেখি?

মাহবুব সাহেব বিরস মুখে বললেন, আন্দাজ-ফান্দাজ আবার কি, কি বলতে চান বলুন। আমাদের সবারইতো কাজকর্ম আছে।

সরকার থেকে একটা স্যাংশান পাওয়া গেছে। সাত লাখ টাকা। কনস্ট্রাকশনের জন্য স্যাংশন। আজকেই চিঠি পেলাম। এইবার ইনশাল্লাহ পাকা বিল্ডিং হবে। হোস্টেল হবে। ঘটনাটা কিভাবে ঘটল তার শানে-নজুলটা আপনাদের বলি। শুনলে ভাল লাগবে সে এক ইতিহাস……।

মাহবুব সাহেব অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে লক্ষ্য করলেন–সাপের গল্প কেউ আগ্রহ নিয়ে শুনছিল না, কিন্তু সাত লাখ টাকার গল্প চোখ বড় বড় করে কনছে।

ঢাকা গিয়েছিলাম এক বৎসর আগের কথা বলছি। শ্রাবণ মাসের শেষ। বায়তুল মোকাররমের সামনে দিয়ে হাঁটছি হঠাৎ শুরু হল বৃষ্টি–দৌড় দিয়ে একটা দোকানে ঢুকলাম। দোকানে এক লোেক কি যেন কিনছে। লোকটাকে চেনা চেনা লাগছে–আবার চেনাও যাচ্ছে না। আমি তাকাতেই সে বলল, আরে স্যার, আপনি। বলেই পা ছুঁয়ে সালাম। তার সঙ্গে ফুটফুটে দুটো মেয়ে। সে মেয়ে দুটোকে বলল, সালাম কর, সালাম কর। আমার শিক্ষক।

মেয়ে দুটো ইতস্তুত করছে। একালের শহুরে মেয়ে, এরা হুট করে পা ছুঁয়ে সালাম করে না। সে দিল ধমক, মারা দাঁড়িয়ে আছ কেন? সালাম কর, সালাম কর। আমার শিক্ষক।

মাহবুব সাহেব বিরক্ত মুখে বললেন, গল্প সংক্ষেপ করুন। আপনি দেখি সাত খন্ড রামায়ন শুরু করেছেন।

হেডমাস্টার সাহেব অপ্রতিভ হলেন না। তিনি হাসিমুখে বললেন, খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। পুরোটা শুনতে হবে।

–আমাকে ছাড়ল না। জোর করে গাড়িতে নিয়ে তুলল। বাসায় নিয়ে গেল। সে শিক্ষা দপ্তরের বিরাট অফিসার। জয়েন্ট সেক্রেটারী। যেদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে সেদিনই প্রমোশন পেয়েছে। প্রমোশন উপলক্ষে ঘরোয়া খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন–আমি তার মধ্যে বাইরের লোক। অনেক কথা হলো তার সাথে, স্কুলের কথা বললাম, স্কুলের ভগ্নদশার কথা বললাম। মনজুর বলল, স্যার দেখি কি করতে পারি। আমি তার কথায় তেমন গুরুত্ব দেইনি। সরকারী অফিসাররা দেখি শব্দটা প্রচুর বলে কিন্তু কিছু দেখে না। না দেখাটাই তাদের দস্তুর। মনজুর দেখেছে। আশ্চর্য ব্যতিক্রম।

বিনয় বাবু বললেন, সেক্রেটারী সাহেবের নাম মনজুর?

সেক্রেটারী না, জয়েন্ট সেক্রেটারী। মনজুর আহমেদ।

মওলানা বললেন, পাকা বিল্ডিং হচ্ছে এ তো অতি আনন্দের সংবাদ।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আনন্দ মানে? মহানন্দ। দুপুরের ডাকে চিঠি পেয়েছি। পর পর তিনবার পড়লাম। তারপর দেখি, আমার চোখ দিয়ে আপনা আপনি পানি পড়ছে।

মাহবুব সাহেব বললেন, সরকারী টাকা হাতে না আসা পর্যন্ত বিশ্বাস নাই। আগে হাতে আসুক। পঞ্চাশ বস্তা গম সংস্থান হয়েছিল তিন বছর আগে, সেই গম কোথায়?

মাহবুব সাহেব উঠে দাঁড়ালেন।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আরে বসুন না। খানিকক্ষণ গল্পগুজব করি–এরকম একটা সুসংবাদ পাওয়া গেল। রোজদিন তো এরকম ঘটে না।

কাজ আছে।

আরেকটা কথা তো আপনাদের বলা হয় নাই-আমাদের নতুন সায়েন্স স্যার চলে আসছেন। চিঠি পেয়েছি। এখানেও ভাগ্যের ব্যাপার আছে চেয়েছিলাম বিএসসি। পেয়ে গেছি এমএসসি। তাও যতি এমএসসি না। ফার্স্টক্লাশ পাওয়া এমএসসি। ভাল ভাল ছেলেপুলে না এলে স্কুলের উন্নতি হবে না।

মাহবুব সাহেব বললেন, এরা স্কুলে থাকবে না। চাকরি-বাকরি না পেয়ে স্কুলে ঢুকছে। নাই কাজ তো খই ভাজ-এর মত অবস্থা। যেই একটা কিছু পাবে স্কুলে পেচ্ছাব করে চলে যাবে।

ফজলুল করিম সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, অশালীন শব্দ ব্যবহার করে কথা বলবেন না। আমরা শিক্ষক মানুষ। কথাবার্তায় আমাদের খুব সাবধান হওয়া দরকার। খুবই সাবধান। শিক্ষকদের প্রতিটি শব্দ চিন্তা-ভাবনা করে বলতে হবে।

বিনয় বাবু বললেন, বৃষ্টি নামবে বলে মনে হয়। উঠে পড়া যাক, স্যার যদি অনুমতি দেন।

অবশ্যই, অবশ্যই। যান, বাড়ি যান।

স্কুল ফাঁকা হয়ে গেল। শুধু মওলানা থেকে গেলেন। মাগরেবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। তিনি মাগরেবের নামাজ শেষ করে তারপর যাবেন। তার অজু আছে। নতুন করে অজু করার প্রয়োজন নেই তবু বারান্দায় অজু করতে গেলেন। হেডমাস্টার সাহেব পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। মুখ হাসি হাসি। একজন আনন্দিত মানুষের মুখের দিকে তাকালেও আনন্দ হয়। মানুষটা আনন্দে ঝলমল করছে। আনন্দ শিশুদের ধর্ম। এই মানুষটার ভেতর শিশুভাব আছে। পর্যাপ্ত পরিমাণেই আছে। মওলানার একমাত্র আফসোস–মানুষটা নামাজের ধার ধারেন না। তিনি অজু করতে করতে একবার ভাবলেন হেডমাস্টার সাহেবকে সুযোগমত একবার নামাজের কথা বলে দেখবেন।

মওলানা সাহেব।

জ্বি স্যার।

শিক্ষক হবার সবচে বড় লাভ কি জানেন?

কি লাভ?

হঠাৎ হঠাৎ ছাত্র পাওয়া যায়। কৃতী ছাত্র। এদের দেখলেও আনন্দ হয়। কৃতী ছাত্র দেখলে এত ভাল লাগে। একটা কথা আছে–জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে জয় আশা করিবে শুধু ছাত্রের এবং পুত্রের নিকট পরাজয়কেই আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করিবে। মনজুরের কথাই ধরুন। জয়েন্ট সেক্রেটারী। সহজ ব্যাপার না।

তা তো স্যার ঠিকই।

আমি চিনতেই পারিনি। বয়স হয়ে গেছে। স্মৃতিশক্তি হয়েছে দুর্বল। মনজুর তার স্ত্রীকে নানান গল্প করছে, আমি শুধু শুনে যাচ্ছি। তার মেট্রিকের রেজাল্ট যখন হল, নাইনথ স্ট্যান্ড করেছে, তখন খবর পেয়ে আমি নাকি তাকে কোলে নিয়ে স্কুলের মাঠে একটা চক্কর দিয়েছি। আমার তো কিছুই মনে নেই…..

আপনার মনে থাকবে কেন? আপনি তো কত ছেলেকেই কোলে নিয়ে চক্কর দিয়েছেন। যাদের মনে রাখার তারা ঠিকই মনে রেখেছে।

শিক্ষকতা করে এই জীবনে বড়ই তৃপ্তি পেয়েছি। শেষ জীবনে স্কুলটাকে ঠিকঠাক করে যেতে পারলে মনে শান্তি পেতাম। এতদিনের পুরানো একটা স্কুল।

মওলানা সাহেবের নামাজের সময় যাচ্ছে। কিন্তু হেডস্যার এত আগ্রহ করে কথা বলছেন, তাকে ফেলে চলে যেতেও মায়া লাগছে।

নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে স্যার।

ও আচ্ছা, আচ্ছা। যান, নামাজ পড়ন। নামাজ পড়ন। স্কুলের জন্যেও দোয়া করবেন।

অবশ্যই করব, স্যার।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। হেডমাস্টার সাহেব প্রাইমারী সেকশানের দিকে যাচ্ছেন। বছরের প্রথম কালবোশেখির ঝড়ে প্রাইমারী সেকশানের খুব ক্ষতি হল। দুটা টিনের চালা উড়ে গেছে। খুঁজে এনে কোনমতে লাগানো হয়েছে। ফাঁক-ফোকর আছে। বৃষ্টি নামলেই ক্লাশের ভেতর পানি পড়ে। পাকা দালান হলে আর দেখতে হবে না। পাকা দালানে ছাত্ররা ক্লাশ করবে। স্কুলের বিশাল কম্পাউণ্ডের ভেতরে থাকবে ফুলের বাগান। এসেমব্লীতে ছাত্রছাত্রীরা লাইন ধরে দাড়াবে, জাতীয় সংগীত গাইবে–আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি। আহ, কি সুন্দর জাতীয় সংগীত! এত সুন্দর জাতীয় সংগীত কি আর কোন জাতির আছে?

স্কুল লাইব্রেরীটা ঠিকমত করতে হবে। কাচের আলমীরার ভেতর থরে থরে বই সাজানো থাকবে, দেয়ালে থাকবে মহাপুরুষদের ছবি। মহাপুরুষদের ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও মন পবিত্র হয়। মহাপুরুষদের ছবি জোগাড়ের চেষ্টা চালাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয়, আইনস্টাইন, মহাত্মা গান্ধী, শেখ মুজিব……

হেডমাস্টার সাহেব অফিস ঘরে ফিরে গেলেন। তিনি সন্ধ্যার পরেও খানিকক্ষণ অফিসে থাকেন। হরিপদ হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। হারিকেনের কাচের একটা কণা ভাঙ্গা। ধুঁয়া বেরুচ্ছে। সব কিছুরই ভগ্নদশী, তবে এই ভগ্নদশা থাকবে না। হেডমাস্টার সাহেব ঠিক করলেন, মনজুরকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানাবেন। চিঠিটা আজই লিখে ফেলা দরকার। এইসব ব্যাপারে দেরি করতে নেই। তিনি গোটা গোটা হরফে ইংরেজিতে একটা চিঠি লিখলেন। তিনি ইংরেজির শিক্ষক। ইংরেজিতেই ভাল লিখতে পারেন। বাংলা তেমন আসে না। তাঁর চিঠির বাংলা তর্জমা অনেকটা এরকম–

আমার পুত্রপ্রতিম ছাত্র মনজুর আহমেদ
জয়েন্ট সেক্রেটারী। শিক্ষা দপ্তর।

তোমার অসীম বদান্যতায় আমি মুগ্ধ, ও অভিভূত। আমার জীবনে আজ একটি বিশেষ দিন–সরকারি অনুদানের চিঠি আজ আমার হস্তগত হয়েছে। পর পর তিনবার এই চিঠি পাঠ করার পর আজ আমি অশ্রুবর্ষণ করিয়াছি। এই অশ্রু সুখের ও আনন্দের মিলিত ফসল। আজ আমার মনে হইতেছে আমার দীর্ঘ দিনের শিক্ষাদান বিফল হয় নাই….। আমি তোমার মত দরদী ছাত্র তৈরি করিতে পারিয়াছি…।

 

মওলানা ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে উঁকি দিয়ে বললেন, স্যার এখনো যাননি?

একটা চিঠি লিখতে বসেছি। চিঠি শেষ করে উঠব। আপনার নামাজ হয়ে গেল?

জি স্যার।

বসুন তাহলে, চিঠিটা শেষ করি। চিঠির মুসাবিদাটা শুনে যান।

মওলানা বসলেন। হেডমাস্টার সাহেবের আনন্দময় মুখ দেখতে দেখতে তাঁর মন খুব খারাপ হয়ে গেল, কারণ তিনি জানেন জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে। এই স্কুলের আয়ু আর অল্প কিছুদিন। স্থানীয় এলাকার মন্ত্রী রমিজ সাহেব এখন স্কুল দিচ্ছেন। পাকা দালান হবে। রাজমিস্ত্রীরা মাপজোখ করে কাজ শুরু করে দিয়েছে। নতুন স্কুলের পাশে জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল টিকতে পারবে না। সাত লক্ষ টাকার অনুদান কাজে আসবে না। এই অনুদানের চেক স্কুলে এসে পৌছুবে না। আর পৌছুলেও ফেরত যাবে।

 

চিঠি শেষ হয়েছে। কপি করতে হবে। অফিস কপি রাখতে হবে। কার্বন পেপার নেই। কপির কাজ হাতে করা ছাড়া গতি নেই। বানান ভুল কি আছে? ভাল করে আরেকবার দেখতে হবে। চিঠি ছাত্রের কাছে যাচ্ছে–সে চিঠিতে বানান ভুল থাকলে হবে না। ছাত্ররা সব সহ্য করতে পারে, শিক্ষকদের বানান ভুল সহ্য করতে পারে না।

মওলানা সাহেব।

জ্বি স্যার।

আমার আরো খানিকটা দেরী হবে। আপনি না হয় চলে যান।

আমার তাড়া কিছু নেই–বসি।

আচ্ছা বসুন। একা একা কাজ করতেও ভাল লাগে না। আকাশের অবস্থা কি? বৃষ্টি হবে?

টিপ টিপ করে তো পড়ছে।

এই বছর ভাল বৃষ্টি হল, অতি বৃষ্টি। তবে অতি বৃষ্টি হওয়া ভালআপাতত ক্ষতি হলেও পরবর্তি সময়ে ফল হয় শুভ। মঙ্গল সব সময় অমঙ্গলের পেছনে থাকে।

ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। গল্প করতে করতে চিঠি কপি করতে যাওয়ার এই সমস্যা। বানান ভুল হয়েছে। হাতের লেখাও ভাল হয়নি, লাইন বাঁকা হয়ে গেছে। তিনি কাগজ ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে লিখতে বসলেন।

মওলানা পাঞ্জাবীর পকেট থেকে ছবির ছড়া বের করেছেন। চুপচাপ বসে না থেকে সময়টা কাজে লাগানো যাক। বৃষ্টি পড়ছে। বড় বড় ফোঁটা পড়ছে। টিনের চালে বৃষ্টির ফোঁটায় কি সুন্দর ঝম ঝম শব্দ হচ্ছে। মওলানা বললেন, স্যার, আপনি কাজ করুন আমি বারান্দায় বসি।

আচ্ছা, আচ্ছা। বৃষ্টি মনে হয় জোরেসোরে পড়ছে।

জ্বি স্যার।

পাকা দালানটা হয়ে যাক–তাহলে ঝড় বৃষ্টিতে কিছুই হবে না। অল্প কিছু দিনের ব্যাপার।

জ্বি স্যার। আপনি কাজ শেষ করুন।

ফজলুল করিম সাহেব চিঠি শেষ করলেন। বৃষ্টি আরো বেড়েছে। বৃষ্টির ছাঁট আর ভেজা বাতাস ঘরে ঢুকছে। হারিকেনের শিখা দপ দপ করছে। নিভে যাবে কিনা কে জানে। ড্রয়ারে মোম আছে। ফজলুল করিম সাহেবের আরো কয়েকটা চিঠি লেখার ইচ্ছে আছে। তাঁর দুই মেয়েকে তিনি অনেক দিন চিঠি লেখেন না। ছোট মেয়ে থাকে সিরাজগঞ্জ, ডাক্তার। তার ভাল প্রাকটিস। সেও চিঠি লিখতে পারে না। এই মেয়ের তিনি বিয়ে দিতে পারেননি। মেয়েই রাজি হল না। বিয়ের কথা বার্তা হলেই শুকনো গলায় বলে,–

আমার বিয়ের ব্যবস্থা আমি নিজে করব বাবা। আমার বিয়ে নিয়ে তুমি কিছু ভাববে না।

মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা দেবার এই এক সমস্যা। উচ্চ শিক্ষা স্বাধীন মতামত দেয়ার ক্ষমতা তৈরি করে দেয়। তার ফল সব সময় শুভ হয় না। তাঁর মেয়ের বেলায় হয়নি। মেয়ে বিয়ে করেনি। করবে বলেও মনে হচ্ছে না।

তাঁর বড় মেয়েকে তিনি যথাসময়ে বিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর পরই বিয়ে। এর ফলও শুভ হয়নি। মেয়ের আর পড়াশোনা হয়নি। অথচ তার বড় মেয়েটাই ছিল পড়াশোনায় সবচেয়ে ভাল। মুক্তার মত হাতের লেখা। তিনি তার দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে এত সুন্দর হাতের লেখা কোন ছাত্রের দেখেননি। বড় মেয়ে এখন নিউ জার্সিতে থাকে। ঘর সংসার দেখে। তার স্বামী কাজ করে সেখানকার এক ব্যাংকে, ফাস্ট ন্যাশনাল ব্যাংক। স্ত্রী হাউস ওয়াইফ।

বৃষ্টির রাত হচ্ছে চিঠি লেখার জন্যে সবচে ভাল রাত। মেয়ে দুটিকে দুটা চিঠি লিখে ফেললে হয়। এত সকাল সকাল ঘরে গিয়ে করারও কিছু নেই। ফজলুল করিম সাহেব বাঁ পাশের তালাবন্ধ ড্রয়ার খুললেন। ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্যে কাগজ, কলম, খাম ডাকটিকিট এই ড্রয়ারে থাকে। ব্যক্তিগত কাজে তো আর স্কুলের জিনিস ব্যবহার করা যায় না। শুধু স্কুলের জিনিস না, স্কুলের সময়ও ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করা যায় না।……

ফজলুল করিম সাহেব ড্রয়ার খুলে কাগজ কলম খাম বের করলেন। সাত লক্ষ টাকা অনুদানের ব্যাপারটা মেয়েদের জানানো উচিত। ওরা খুশি হবে……।

তিনি চিঠি লিখছেন। তার জন্যে একজন বারান্দায় অপেক্ষা করছে এটা তার আর মনে নেই। দুই মেয়েকেই তিনি দীর্ঘ চিঠি লিখলেন। দুটি চিঠিই ইংরেজিতে।

লিখতে সময় লাগল কারণ পছন্দের কোটেশন পাচ্ছিলেন না। তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস মেয়েদের চিঠিতে মহাপুরুষদের বাণীর উদ্ধৃতি দেয়া। ছাত্র জীবনে একটি বই কিনেছিলেন Great Sayings.-বইটি এখনো আছে। চিঠি লেখার সময় খুব কাজে আসে। তেমন পছন্দের কোন কোটেশন খুঁজে পেলেন না। সেক্সপিয়ারের একটা পেলেন সেটা তেমন পছন্দ হল না। তবুও চিঠির শেষে পুনশ্চ দিয়ে লিখে দিলেন–

One Fire burns out anothers burning;
One pain is lessend by anothers anguish.
–Shakespeare (Remed and Juliet)

চিঠি শেষ করতে করতে এশার আজান হয়ে গেল। তিনি বারান্দায় এসে দেখেন–বারান্দায় জায়নামাজ পেতে মওলানা নামাজে দাঁড়িয়েছেন। অন্ধকার বারান্দায়, বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। এর মধ্যে সাদা পাঞ্জাবী পড়া লম্বা একজন নামাজ পড়ছে–দেখতে ভাল লাগে। নামাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফজলুল করিম বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলেন।

 

একটাই ছাতা।

মওলানাকে বাজারে পৌঁছে দিয়ে সেই ছাতা দিয়ে হেডমাস্টার সাহেব তার ঘরে ফিরবেন। মওলানা খাকেন মজিদ মিয়ার কাপড়ের দোকান রূপসা ক্লথ হাউসে। এই অঞ্চলের সবচে বড় কাপড়ের দোকান। দোকানের পেছনে বিস্তর জায়গা। কয়েকটা খুপড়ি খুপড়ি ঘর। জায়গীর রাখার মত একটা খুপড়ি মওলানার। মজিদ মিয়া খুব আগ্রহ করে মওলানাকে রেখেছেন। তার বিনিময়ে মজিদ মিয়াকে কোরআন শরীফ পড়া শেখানোর কথা। বছর দুই হয়ে গেল এখনো কোরআন পাঠ শুরু হয়নি। মওলানা মনে করিয়ে দিলেই মজিদ মিয়া বলেন–ভাল দিন দেখে শুরু করতে হয়–দেখি রমজান মাসটা আসুক। রমজানে শুরু করব, রমজানেই কোরআন মজিদ শেষ করব, ইনশাল্লাহ। এই রমজানও পার হয়ে গেল, এখন সামনের রমজানের অপেক্ষা।

হেডমাস্টার সাহেবকে দেখে মজিদ মিয়া আনন্দিত গলায় বললেনস্যার, আসেন আসেন। ভাল দিনে এসেছেন। আজ আপনাকে ছাড়ব না। খানা খেয়ে যাবেন। বিরিয়ানী পাকাতে বলেছি।

বিরিয়ানী তো খাই না মজিদ সাহেব। পেটের অবস্থা ভাল না। তৈলাক্ত খাবার সহ্য হয় না।

একদিন খেলে কিছু হবে না। বসুন বসুন……

জি–না। আজ না আরেকদিন।

আর আরেক দিন। আপনাকে এখন পর্যন্ত চারটা ভালভাত খাওয়াতে পারলাম না–এই এক আফসোস-?

খাব, একদিন এসে খেয়ে যাব।

তাহলে বেলের শরবত খেয়ে যান, বেলের শরবত করতে বলছি।

এই সময় বেল পেলেন কোথায়?

আছে, ব্যবস্থা আছে। আপনাকে খাওয়ায়ে দিচ্ছি। মনে থাকবে–কই রে বেলের শরবত আন। আমার শ্বশুর বাড়ি সান্দিকোনা থেকে আনী। বরমেসে বেল।

অসময়ে বেলের শরবত খাওয়ার কোন ইচ্ছা ফজলুল করিম সাহেবের ছিল না। বাধ্য হয়ে বসলেন। এতে কিছুটা লাভ হল, তিনি তাঁর কাজের মেয়েটার জন্য একটা শাড়ি কিনলেন। মেয়েটাকে একটা শাড়ি দেয়া দরকার–মনে থাকে না। আজ চোখের সামনে শাড়ি বেচা-কেনা হচ্ছে দেখে মনে পড়ল।

মজিদ মিয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তারপর স্যার, বলেন স্কুলের খবরটা কি?

জ্বি খবর ভাল। সরকারি একটা অনুদান পেয়েছি। সাত লক্ষ টাকা…

তাই নাকি?

ফজলুল করিম সাহেব বেলের শরবত খেতে খেতে সরকারি অনুদানের ইতিহাসটা পুরোটা বর্ণনা করলেন। গল্প শুরু হলো ছাত্রের সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে। মজিদ মিয়া এই গল্পে তেমন আগ্রহ বোধ করছিল না। তবু সে বেশ মন দিয়েই শুনল।

গল্পের শেষে হেডমাস্টার সাহেব তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, স্কুলটা এবার দাঁড়িয়ে গেল।

তাইতো দেখতাছি।

পাকা দালান হবে। হোয়াইট ওয়াশ করে দেব। দূর থেকে চোখে পড়বে….মওলানা বললেন, ইনশাআল্লাহ্ বলেন স্যার। প্রতিটি সৃৎ নিয়তের শেষে ইনশাআল্লাহ্ বলতে হয়। নবী-এ-করিম একবার ইনশাআল্লাহ্ না বলায় আল্লাহ পাক নারাজ হয়েছিলেন–কোরআন শরীফে এই বিষয়ে আয়াত নাজেল হয়েছে।

ফজলুল করিম পর পর দুবার বললেন,–ইনশাআল্লাহ্, ইনশাআল্লাহ।

বৃষ্টি আরো বেড়েছে। হেডমাস্টার সাহেবকে পৌঁছে দেবার জন্যে মজিদ মিয়ার নিজস্ব রিকশা চলে এসেছে। রাস্তা ঘোর অন্ধকার। মওলানা সাহেব তার টর্চ লাইট দিয়ে দিয়েছেন। ব্যাটারী ডাউন হয়ে আছে। টর্চ জ্বালালে চারদিকের অন্ধকার আরো গাঢ় মনে হয়। তাঁকে কাঠেরপুল পার হয়ে মগরা নদীর ঐ পারে যেতে হবে।

রিকশা নিয়ে এই অন্ধকারে কাঠের পুলে ওঠা দুরুহ ব্যাপার, পিছল কাঁচা রাস্তা থেকে খাড়াখাড়ি টেনে অনেকদূর উঠতে হয়। পুলের উপর দিয়ে যখন রিকশা যায় মচমচ শব্দ হয়। মনে হয় এই বুঝি কাঠের কোন একটা টুকরা ভেঙে পড়ে গেল।

দেশের কত পরিবর্তন হল–নীলগঞ্জে কিছু হচ্ছে না। নীলগঞ্জ থেমে আছে।

কাঠেরপুলের কাছাকাছি এসে ফজলুল করিম সাহেব বললেন,বাবা আমি রিকশা থেকে নেমে যাই–তুই টেনে তোল।

স্যার, আফনে টাইট হইয়া বইয়া থাকেন, আল্লাহ মালিক।

রিকশাওয়ালা ঝড়ের গতিতে রিকশা টেনে পুলের উপর তুলে হাঁপাতে লাগল। ফজলুল করিম সাহেব ঠিক করে ফেললেন এইবার শহরে বাসা নেবেন। আর পুল পাড়ি দেয়া না। যদিও তিনি জানেন শেষ পর্যন্ত কোনটাই করা হবে না। শহরের বাইরে মগরা নদীর পশ্চিম পাড়ের এই বাসাবাড়ি ছেড়ে দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। গাছ গাছালিতে ছাওয়া ছোট্ট ছিমছাম বাড়ি, যার কাছাকাছি এলেই মন ভাল হয়ে যায়। টমাস হার্ডির উপন্যাসটার কথা। মনে পড়ে–Far from the mading crowd.

রিকশাওয়ালা এখনো ধাতস্থ হয়নি–লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেবের খুব মায়া লাগছে। তিনি রিকশা থেকে নেমে কাঠের পুলের রেলিং ধরে দাঁড়ালেন। মাথায় ছাতা ধরা নেই–পা ভিজে যাচ্ছে, ভিজতে ভাল লাগছে। রিকশাওয়ালা বলল, এই বচ্ছর বিষ্টি বাদলা হয় নাই, কিন্তু পানির কি টান দেখছেন স্যার? পুল কাঁপতাছে।

পাহাড়ি পানি। পাহাড় থেকে নামে–বৃষ্টির সঙ্গে এর সম্পর্ক নাই।

টান যেবায় বাড়ছে পুল ভাঙ্গল বইল্যা।

ফজলুল করিম কিছু বললেন না। পানির টান অনুভব করার চেষ্টা করলেন। কাঠের এই পুলটিও জীবনকৃষ্ণ বাবু বানিয়েছেন। পুল ভেঙে গেলে জীবনকৃষ্ণ বাবুর একটি স্মৃতি নষ্ট হবে। সব চলে গেলেও স্কুল থাকবে। স্কুলের সঙ্গে তিনিও থাকবেন। মহাপুরুষেরা কোন না কোনভাবে থেকেই যান। তবে জীবনকৃষ্ণ বাবুকে মহাপুরুষ বলাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না।

স্যার, উঠেন।

নামার সময় সাবধানে নামবে।

ঝড়ের গতিতে রিকশা নামছে। উঁচু নিচু রাস্তা। প্রবল ঝাঁকুনি হচ্ছে। একবার মনে হল তিনি বোধহয় ছিটকে পড়েই যাবেন।

ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তা ছেড়ে রিকশা এবার কাঁচা রাস্তায় নেমেছে। চাকা থেকে ছপছপ শব্দ হচ্ছে। রাস্তায় পানি জমে গেছে।

স্যার, মনে লইতাছে, এই বছর বান হইব।

হতে পারে। প্রতি দুবছর পর পর বন্যা হয়। গত দুবছর বন্যা হয় নি।

ফজলুল করিম সাহেবের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। বাইরের উঠোনে রেশমী হারিকেন জ্বালিয়ে রেখেছে। হারিকেনে এত আলো হয়? চারিদিকের সুপারি গাছ পর্যন্ত চোখে পড়ছে।

ফজলুল করিম সাহেবের মন ভাল হয়ে গেল। তিনি জানেন–রেশমী ঘর বাড়ি ঝকঝক করে রেখেছে। উঠোনে জ্বলন্ত হারিকেনের পাশে জলচৌকি। জলচৌকির পাশে বালতি ভর্তি পানি আর একটা মগ। তার পাশেই সাবানদানীতে সাবান। হাত পা ধুতে ধুতেই শুকনা একটা গামছা নিয়ে রেশমী দাঁড়াবে। এই মেয়েটা বোধহয় মনের কথা বুঝতে পারে। সে তাকে তখনই খেতে ডাকবে যখন তিনি ক্ষুধার্ত। খেতে বসে দেখবেন–যে সব খাবার তিনি খেতে চেয়েছেন সেগুলিই রান্না করা হয়েছে। মাঝে মাঝে রাতে তাঁর চা খেতে ইচ্ছা করে। রেশমী সেই সব রাতেই চা বানায়। তার চা খেতে ইচ্ছা করছে না অথচ রেশমী চা বানিয়ে এনেছে এরকম কখনো হয়নি।

রেশমী উদ্বিগ্ন মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। ফজলুল করিম সাহেবকে দেখে তার উদ্বেগ কিছুটা কমল। সে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল।

রেশমীর বয়স তেইশ চব্বিশ। হালকা পাতলা গড়নের জন্যে তাকে আরো কম দেখায়। গায়ের রঙ শ্যামলা। তার চেহারা খুবই সাধারণ, কিন্তু চোখে অসহায় ভাব আছে বলে ফজলুল করিম সাহেব যতবারই তার দিকে তাকনি ততবারই তার খুব মায়া লাগে।

রেশমী বলল, কাঠের পুলটা না-কি ভাইঙ্গা গেছে?

না-তো।

আমি খুব চিন্তার মইধ্যে ছিলাম।

না, পুল ভাঙ্গে নাই। পুলের উপর দিয়েই তো আসলাম।

এই দিকে রটনা পুল ভাঙ্গছে। একটা গরুর গাড়ি পুল ভাইঙ্গা নিচে পরছে।

তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। মানুষ গল্প তৈরী করতে পছন্দ করে। পুল ভাঙ্গেনি অথচ পুল ভাঙ্গার গল্প তৈরী হয়ে গেছে। কেউ এসে চাক্ষুষ দেখে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করছে না।

ফজলুল করিম সাহেব জলচৌকির উপর উঠে দাঁড়ালেন। হাত পা ধুবেন। জলচৌকির পাশেই কাঠের বৌলাওয়ালা খড়ম সাজানো। রেশমীর কাজে কোন রকম খুঁত নেই। তিনি বালতি থেকে মগ ভর্তি পানি নিলেন। পায়ে পানি ঢালতে যাবেন। রেশমী এসে হাত থেকে মগ নিয়ে নিল।

আপত্তি করা অর্থহীন, রেশমী পায়ে পানি ঢালতে দেবে না। কখনো দেয়। পায়ে পানি ঢালার কাজটা সে খুব আগ্রহের সঙ্গে করে।

ফজলুল করিম সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। রেশমী এক হাতে পায়ে পানি ঢালছে। অন্য হাতে কাদা মুছে দিচ্ছে। রেশমীর পিঠ দেখা যাচ্ছে। তার মুখটা শ্যামলা হলেও পিঠতো বেশ ফর্সা দেখাচ্ছে। তার মাথার চুল বাঁধা। এই মেয়েটির চুল খুব লম্বা। ফজলুল করিম সাহেবের শরীর কেমন ঝিম ঝিম করতে লাগল। তিনি চেষ্টা করেও রেশমীর ফর্সা পিঠ থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। তিনি বুঝতে পারছেন কাজটা ঠিক হচ্ছে না। ভুল হচ্ছে। অন্যায় হচ্ছে।

রেশমী।

জি।

সাত লাখ টাকা স্কুলের জন্যে পাওয়া গেছে। সরকারি অনুদান। আমার এক ছাত্রের কথা তোমাকে বলেছিলাম না? জয়েন্ট সেক্রেটারী, ও-ই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

ভাল তো।

হ্যাঁ, ভাল। অনেক দিনের ইচ্ছা স্কুলটা পাকা করা। স্কুল ঘর পাকা হবে। ছাত্রদের হোস্টেল থাকবে। টিউব ওয়েল বসানো হবে…….

পা ধোয়ানো হয়েছে। জলচৌকি থেকে নামার সময় ফজলুল করিম সাহেব রেশমীর কাঁধে হাত রেখে নামলেন। এমন না যে তিনি ঢলে পড়ে যাচ্ছিলেন। কাঁধে হাত রেখে তিনি নিজেই লজ্জায় এবং সংকোচে এতটুকু হয়ে গেলেন। রেশমীর কোন ভাবান্তর হল না–যেন এটাই স্বাভাবিক।

খেতে বসে ফজলুল করিম সাহেব অনর্গল কথা বলে যেতে লাগলেন। এটা নতুন কিছু না–রেশমীর সঙ্গে তিনি প্রায়ই গল্প করেন। রেশমী চুপচাপ শুনছে। তার সব গল্পই রেশমীর আগের শোন–একবার না, অনেকবার শোনা–কিন্তু রেশমী এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে মনে হচ্ছে সে এই প্রথমবার শুনছে।

 

বুঝলে রেশমী, ১১ই মে নাইননি সেভেন্টি ওয়ান, পাক আর্মি হঠাৎ নীলগঞ্জ এসে উপস্থিত। চারদিকে ছছাটাছুটি হৈ চৈ পড়ে গেল। এখন যে মন্ত্রী আছেন সিরাজ সাহেব তাঁর বাবা মফিজ তালুকদার তখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। মিলিটারী গিয়ে উঠল তাঁর বাড়িতে। আমরা সবাই আতংকে অস্থির–কি হয়, কি না হয়। হিন্দু যারা ছিল আগেই চলে গেছে। আমাদের স্কুলের বিনয় বাবু শুধু ছিলেন। তাকে ধরে নিয়ে গেল। তাঁর বাড়িতে মরা কান্না……।

গল্পের মাঝখানে ফজলুল করিম সাহেবের মনে হল–রেশমীর জন্যে তিনি একটা শাড়ি কিনেছিলেন। শাড়িটা রিকশা থেকে রাস্তার কোথাও পড়ে গেছে। নতুন শাড়ি পেলে মেয়েটা খুশি হত। একটা ভুল হয়ে গেল। বিরাট ভুল।

রেশমী।

জ্বি।

বিছানা কর, শুয়ে পড়ব।

গল্পটা শেষ করেন।

আরেক দিন। আজ আর ইচ্ছা করছে না। তুমি বিছানা করে দাও।

খাওয়া দাওয়া করবেন না।

না। শরীরটা ভাল না। উপোস দেব। পঞ্চাশের পর মাঝে মাঝে উপোস দেয়া লাগে।

 

ফজলুল করিম সাহেব ঘুমুতে গেলেন। রেশমী মশারি খাটিয়ে দিল। বিছানার চারদিকে মশারি খুঁজে দিল। পাতলা একটা চাদর গায়ে জড়িয়ে দিল। মেয়েটা কত অসংকোচেই না তার গায়ের উপর ঝুঁকে আছে। করিম সাহেবের নাক ঘেঁষে রেশমীর শাড়ির আঁচল, ফজলুল করিম সাহেব চোখ বন্ধ করে ফেললেন–রেশমীর দিকে তাকিয়ে থাকতে তার এখন কেমন জানি ভয় লাগছে। মেয়েটা গায়ে চাদর জড়াতে এত সময় নিচ্ছে কেন?

খালুজান, হারিকেন জ্বালা থাকুক–সাপের খুব উপদ্রব।

থাকুক, জ্বালা থাকুক।

জ্বলন্ত হারিকেনের দিকে তাকিয়ে থাকতে অনেকদিন পর ফজলুল করিম সাহেব ভয়ংকর সেই স্বপ্ন আবারও দেখলেন। একটা কালো লম্বা লোক তাকে কানে ধরে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। তাঁর নিজের গায়ে কোন কাপড় নেই। তিনি সম্পূর্ণ নগ্ন। তিনি চক্কর দিচ্ছেন জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের কম্পাউণ্ডের চারদিকে। চক্কর দিচ্ছেন তো দিচ্ছেনই। তাঁর স্ত্রী দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে এই দৃশ্য দেখছে। তারা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এই অঞ্চলের আরো অনেকেই আছে। কেউ অবশ্যি হাসছে না। এমন অজর দৃশ্য সবার হাসা উচিত, কিন্তু হাসছে না।

গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে তার ঘুম ভাঙ্গল। তিনি দেখলেন রেশমীর এক হাতে পাখা, সে প্রবল বেগে পাখার বাতাস করছে। ফজলুল করিম সাহেব ক্ষীণ গলায় বললেন–স্বপ্নটা আবার দেখলাম। পানি দাও, পানি খাব।

বাবু জীবনকৃষ্ণ রায় ময়মনসিংহ জজকোর্টের পেশকার

বাবু জীবনকৃষ্ণ রায় ময়মনসিংহ জজকোর্টের পেশকার ছিলেন। ঘোৱ বিষয়ী মানুষ। পেশকারী আয় ছাড়াও পাটের ব্যবসা, ধানের ব্যবসা করে ফুলে ফেঁপে একাকার হয়ে গেলেন। ইংরেজি ১৯৪০ সালে কেন্দুয়ায় রায় বাজারে নিজ বসত বাটিতে লাখের প্রদীপ জ্বালেন। লাখ টাকা ঘরে থাকলে লাখের প্রদীপ জ্বালাবার নিয়ম। লম্বা একটা বাঁশের মাথায় হারিকেন। হারিকেনের চিমনী লাল রঙ করা। এই হল লাখের বাতি।

জীবনকৃষ্ণ রায় লাখের বাতি জ্বালালেন, অষ্টপ্রহর নামগানের আয়োজন করলেন, কাঙ্গালী ভোজ করালেন। তার হাতির খুব শখ। সেই রাতেই দুহাজার টাকা দিয়ে লোক পাঠালেন সুসং দুর্গাপুরে একটা মাদী হাতি কেনার জন্যে। লাখের বাতি জ্বালাবার মহা আনন্দ নিয়ে ঘুমুতে গেলেন। তখন একটা কিছু হল। কি হল তা পরিস্কার না। হয়ত কোন স্বপ্ন দেখলেন–কিংবা অন্য কিছু। সকালবেলা জীবনকৃষ্ণ বাবুকে দেখা গেল, তাঁর ঘরের উঠোনে জলচৌকির উপর পা তুলে বসে আছেন। তাঁর চোখ লাল উদভ্রান্ত চেহারা। তাঁর বড় ছেলের স্ত্রী সরজুবালা তার কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, বাবা আপনার কি হয়েছে? তিনি সহজ গলায় বললেন, কিছু হয় নাই।

তাঁকে সকালের নাশতা দেয়া হল। কাসার জামবাটিতে এক বাটি কালি-পেঁপে। আরেকটা ছোট বাটিতে সুন্দরবনের খাটি মধু। সকালের নাশতা হিসেবে তিনি পেঁপে, মধু এবং সবশেষে বিশাল এক গ্লাস কুসুম গরম পানি খান। কবিরাজের এই ব্যবস্থা।

জীবনকৃষ্ণ রায় দুটুকরো পেঁপে খেয়ে জামবাটি সরিয়ে দিয়ে বললেন, সরকার মশাইকে খবর দাও।

সরজুবালা আবার বললেন, আপনার কি হয়েছে বাবা?

তিনি বললেন, আমার মন কিঞ্চিত বিক্ষিপ্ত। এক্ষুণি সব ঠিক হয়ে যাৰে। তোমরা চিন্তিত হয়ো না। আমারে দিং (বিরক্ত) করবা না।

সবাইকে গভীর চিন্তায় রেখে তিনি জলচৌকিতে বসে সরকার বাবুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।

 

সরকার বাবু মোকদ্দমার কাজে কেন্দুয়া গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেল। দুপুর পর্যন্ত জীবনকৃষ্ণ বাবু জলচৌকিতেই বসে রইলেন। সরকার বাবু আসার পর তাঁর সঙ্গে তিনি কিছু কথাবার্তা বললেন যা পরিবারের অন্য কেউ শুনল না।

তিনি বললেন–নিতাই, অমিার মন অস্থির হয়েছে। অস্থিরতা দূর করতে চাই।

নিতাই কিছুই বলল না, তাকিয়ে রইল। জীবন বাবু বললেন, আমি এ জীবনে যত অর্থ উপার্জন করেছি তার সবটাই সৎ কাজে ব্যয় করতে চাই।

নিতাই শুকনো গলায় বলল, এটা তো খুবই উত্তম কথা।

উত্তম কথা না অধম কথা আমি জানি না। আমার মনের ইচ্ছা তোমাকে বললাম। সেই মত ব্যবস্থা কর।

ব্যবস্থা করছি। আপনি খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম করুন।

আমার বিশ্রাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না। তোমার যা করতে বলছি কর।

সময় সাপেক্ষ ব্যাপার, বললেই তো ব্যবস্থা হয় না। সৎ কাজে অর্থ কিভাবে খরচ করতে চান তাও জানা দরকার। কালি মন্দির বানাবেন? এই অঞ্চলে মন্দির নাই। আপনারা কালির উপাসক…..

মন্দির না। মানুষের সরাসরি কল্যাণ হয় এই ধরনের কোন ব্যবস্থা। রাস্তা ঘাট করতে পারো–ভূমিহীন চাষিদের জমিজমা দিতে পারো। স্কুল করতে পার।

স্কুল দিয়ে তো লাভ হবে না। ছাত্র কোথায়? স্কুল চলবে কিভাবে?

স্কুল হোক, তারপর দেখবে ছাত্র হবে।

জীবনকৃষ্ণ বাবু সৎ কাজে অর্থ ব্যয় শুরু করলেন। তার বিপুল বিত্ত অতি দ্রুত ফুরিয়ে আসতে লাগল। তার পরিবারের লোকজন শুরুতে ধারণা করেছিলেন–মাথায় গন্ডােগোল হয়েছে। ঝাড়-ফুক, গোপন তন্ত্র মন্ত্র সবই করানো হয়েছিল। তাঁর বড় ছেলে বাবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে এই মর্মে কোর্টে আর্জিও জারি করিয়েছিল যাতে জীবনকৃষ্ণ বাবু সম্পত্তিতে হাত দিতে না পারেন। কোর্ট সেই আবেদন গ্রাহ্য করেনি। জীবনকৃষ্ণ বাবু দুবছরের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে গেলেন। সেবার শীতের শুরুতে তিনি অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। ময়মনসিংহ থেকে বড় চিকিৎসক এনে চিকিৎসা করার সঙ্গতি তাঁর ছিল না। এক সময় রোগ গুরুতর আকার ধারণ করল। শ্বাস কষ্ট শুরু হল। মৃত্যু অশুচি। ঘরে মৃত্যু হলে ঘর অশুচি হবে, কাজেই তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। তিনি ক্ষীণ স্বরে তাঁর দীর্ঘদিনের সঙ্গী নিতাইকে বললেন–নিঃস্ব অবস্থায় পৃথিবীতে এসেছিলাম। নিঃস্ব অবস্থায় ফিরে যেতে চাই।

নিতাই বিষণ্ণ গলায় বলল, তাই তো যাচ্ছেন।

তিনি আঙুলের ইশারায় তার বসতবাটি দেখালেন। নিতাই ইঙ্গিত বুঝল। বিরক্ত গলায় বলল, আপনার পুত্র এবং পুত্রবধুদের প্রতি আপনার কিছু দায়িত্ব আছে। এরা থাকবে কোথায়?

জীবনকৃষ্ণ বাবুর পুত্রবধু সরজুবালা বললেন, সবই তো দানে চলে গেছে। সামান্য বসতবাটি দিয়ে কি হবে। বাবার ইচ্ছা পূর্ণ হোক। তাঁকে শান্তি মতো যেতে দিন।

বাড়ির উঠোনে খাটিয়াতে শুয়ে শুয়ে জীবনবাবু তার বসতবাটি মৌখিকভাবে দান করে গেলেন। তিনি নিঃস্ব হয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন, নিঃস্ব হয়েই পৃথিবী থেকে ফেরত গেলেন। এমন অসাধারণ ভাগ্য নিয়ে খুব কম মানুষই পৃথিবীতে আসেন।

 

জীবনকৃষ্ণু বাবুর চেহারা কেমন ছিল তার একটা নমুনা স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে আছে। তিন ফুট বাই চার ফুটের বিশাল এক তৈলচিত্র লাইব্রেরীতে টানানো আছে। যেখানে খালি গায়ে খানিকটা কুঁজো হয়ে এক লোক জলচৌকিতে বসা। ছোট ছোট চোখ। কপালও ছোট। ছোট কপাল ও ছোট ছোট চোখের জন্যে তৈলচিত্রের মানুষটাকে ক্রুর ধরনের একজন বলে মনে হত। ঠোঁটের নিচে বিশাল গোঁফের কারণে সেই ক্রুরতার সঙ্গে মিশেছিল নিষ্ঠুরতা। ছবি দেখে লাঠিয়াল বাহিনীর নেতা ছাড়া ভাঁকে আর কিছু মনে করার কোন কারণ ছিল না।

একাত্তরে পাকিস্তানী মিলিটারী এসে ক্যাম্প করল জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলে। বর্তমান মন্ত্রী সিরাজ সাহেবের বাবা মফিজ সাহেব তখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় রাজাকার বাহিনীর প্রধান।

মিলিটারী ক্যাপ্টেন এজাজ মফিজ সাহেবকে বিরক্ত হয়ে বলল, আপনার মত মানুষ থাকতে হিন্দুর নামে স্কুল, এ ৰ্মেন কথা?

মফিজ সাহেব হাত কচলে বললেন, স্যার, আপনি একটা নাম দিয়ে যান। সুন্দর একটা ইসলামী নাম।

ক্যাপ্টেন এজাজ বললেন, স্কুল কলেজ এইসবের নাম হবে বিশিষ্ট দেশপ্রেমী মানুষের নামে।

মফিজ সাহেব বললেন, অবশ্যই অবশ্যই।

স্কুলের নাম দিন কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান স্কুল।

আলহামদুলিল্লাহ, বড় সুন্দর নাম। ময়মনসিংহ থেকে সাইন বোর্ড লিখায়ে এনে আপনার হাতে টানায়ে দিব।

নতুন সাইন বোর্ড টানানো হল–ক্যাপ্টেন এজাজ নিজের হাতেই নতুন সাইন বোর্ড টানতে গেলেন। ফজলুল করিম সাহেব তখন বললেন–স্যার, এইটা আপনি করতে পারেন না। জীবনকৃষ্ণ বাৰু এই অঞ্চলের অতি বিশিষ্ট একজন মানুষ। অতি শ্রদ্ধায় তার নাম স্মরণ করা হয়……

এজাজ বিস্মিত হয়ে বললেন, তুমি কে?

আমি এই স্কুলের একজন শিক্ষক।

তুমি বলতে চাও একজন হিন্দু এই অঞ্চলের একজন বিশিষ্ট মানুষ। সে কি কায়দে মিল্লাত লিয়াকত আলী খানের চেয়েও বড়?

স্যার, উনার নিজের জমিতে উনার টাকায় স্কুল হয়েছে।

প্রশ্নের জবাব দাও। উনি কি কায়দে মিল্লাতের চেয়েও বড়?

ফজলুল করিম সাহেব ইতস্তত করতে লাগলেন। ক্যাপ্টেন এজাজ বললেন, কায়দে মিল্লাত শব্দের অর্থ জানেন?

জ্বি স্যার জানি। সমস্যাটা হল–স্কুল বোর্ডের অনুমতি ছাড়া আপনি নাম পাল্টাতে পারেন না।

আচ্ছা, ঠিক আছে, স্কুল বোর্ডের সভা ডাকা হোক।

সেই দিন বিকেলেই স্কুল বোর্ডের সভা হল। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হল–স্কুলের নাম পাল্টানো হবে।

সভা শেষে ক্যাপ্টেন এজাজ হুকুম দিলেন ফজলুল করিম নামের শিক্ষককে নেংটা করে এই স্কুলের চারিদিকে যেন পঞ্চাশবার চক্কর দেয়া হয়।

মফিজ সাহেবের ক্ষীণ আপত্তি সত্ত্বেও মিলিটারী হুকুম যথাযথভাবে পালন করা হয়। ফজলুল করিম সাহেবের স্ত্রী তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী। খবর শুনে মাথা ঘুরে উঠোনে পড়ে যান। তাঁর মৃত্যু হয় পরদিন ভোরবেলা।

স্কুলের ঘণ্টা এরকম করে বাজছে কেন

স্কুলের ঘণ্টা এরকম করে বাজছে কেন? শব্দটা ঠিক মত আসছে না। ঝনঝন শব্দ না চাপা শব্দ। ব্যাপার কি? ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। হরিপদকে ডাকা দরকার। এই মুহুর্তে ডাকলে সে ঘণ্টা পেটা বন্ধ করে ছুটে আসবে। কাজেই পাঁচটা ঘণ্টা পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। বয়সের কারণে হরিপদের সমস্যা হচ্ছে। গত সপ্তাহেই ফোর্থ পিরিয়ড শুরু হচ্ছে সে পাঁচটা ঘণ্টা বাজিয়ে বসে আছে। এইসব অপরাধ ক্ষমার যোগ্য না। তিনি দুটাকা ফাইন করেছেন। বেতন থেকে কাটা যাবে। যার প্রধান কাজই ঘণ্টা পেটানো। সে যদি তাতেই ভুল করে বসে তাহলে হবে কিভাবে?

দুটাকা ফাইন করে তার নিজেরও মন খারাপ হয়েছে। দুটাকার মূল্য হরিপদের কাছে অনেক। তারপরেও স্কুলের শৃঙ্খলার ব্যাপার আছে। ক্লাসে ক্লাসে ছেলেরা কান খাড়া করে আছে ঘণ্টা শোনার জন্য। চারটার জায়গায় পাঁচটা ঘণ্টা শুনলে ওদের কেমন লাগবে?

ফজলুল করিম সাহেব টিচারদের রোস্টারের দিকে তাকিয়ে আছেন। মমতাজ সাহেব আজও এবসেন্ট। মাহবুব সাহেব এসেছেন ফার্স্ট পিরিয়ডের পর। শিক্ষকদেরও ফাইন করার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন ছিল। নিয়ম সবার জন্যেই এক হওয়া উচিত। কারো জন্যে কঠিন নিয়ম। কারো জন্যে সহজ, অ হয় না।

হরিপদ।

আজ্ঞে।

ঘণ্টা নিয়ে ভেতরে আস।

হরিপদ স্কুল-ঘণ্টা বগলদাবা করে ভয়ে ভয়ে ঢুকল। বিনয়ে নিচু হয়ে পড়ল। এখন অবশ্যি বিনয় ছাড়াই তার শরীর নুয়ে পড়েছে। কোমর বেঁকে গেছে। বয়স মানুষকে বাকা করে ফেলে।

স্কুলের ঘণ্টার আওয়াজ ঠিকমত শোনা যাচ্ছে না ব্যাপার কি?

হরিপদ আরো নিচু হয়ে গেল। মাথা প্রায় মাটির সঙ্গে যাচ্ছে।

দেখি ঘণ্টা দেখি। ঘণ্টা ঠিক আছে।

হরিপদ ঘণ্টাটা টেবিলের ওপর রাখল। ঘণ্টা ঠিক আছে। ফেটে যায়নি। এই স্কুলের সবচে মূল্যবান সম্পত্তি হল–ঘণ্টাটা। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল শুরু হয় এই ঘণ্টা দিয়ে। ফজলুল করিম সাহেব তখন ছিলেন না–কত আগের কথা। তবে তিনি শুনছেন–স্কুল শুরু হবার প্রথম ঘণ্টা জীবনকৃষ্ণ বাবু নিজে বাজিয়েছিলেন। ঘণ্টা বাজিয়ে তিনি কিছুক্ষণ কেঁদেছিলেন। কি জন্যে কেঁদেছিলেন? মনের আনন্দে?

হরিপদ?

আজ্ঞে?

ঘণ্টাতো ঠিকই আছে। শব্দ এরকম হয় কেন?

হাতুড়ি চুরি গেছে স্যার। এই জন্যে শব্দ কম হয়।

ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত চোখে তাকালেন। কি ভয়ংকর কথা। হাতুড়ি চুরি গেছে। আজ হাতুড়ি গেলে, কাল যাবে ঘণ্টা।

কখন চুরি গেছে?

কাইল থাইক্যা পাই না।

তুমি তো অসম্ভব কথা বলছ হরিপদ। স্কুলের প্রাণ হল তার ঘণ্টা। ঘণ্টা হাতুড়ি থাকে তোমার দায়িত্বে। সেই হাতুড়ি চলে গেল তুমি খবর পর্যন্ত দিলে না। তুমি ঘোরর অন্যায় করেছ। তোমাকে আরো দুটাকা ফাইন করা হল। ঘণ্টার হাতুড়ি চুরি হবার মত কোন বস্তু না। নিশ্চয়ই কোথাও আছে। খুঁজে বের কর।

জ্বে আজ্ঞে।

মাহবুব সাহেব গম্ভীর ভঙ্গিতে ঢুকলেন। মনে হচ্ছে তাকে ডেকে আনায় তিনি বিরক্ত। তিনি হেডমাস্টার সাহেবের সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, ডেকেছেন?

মাহবুব সাহেব আজকের ফাস্ট পিরিয়ড মিস করেছেন।

কাজ ছিল।

কাজ থাকলে আগে ভাগে ছুটি নেবেন যাতে আমরা বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে পারি।

হঠাৎ কাজ পড়ে গেল, আগে জানানো সম্ভব ছিল না। ময়মনসিংহ-এর ডিসি সাহেব হঠাৎ চলে এসেছেন। উঠেছেন ডাকবাংলায়…… সকালে তাঁর সঙ্গে চা খেতে বললেন। তাকে তো আর বলতে পারি না–চা খাব না।

সেটা কেন বলবেন? চা খেতে ডেকেছে চা খাবেন। আবার আপনার জন্যে ছাত্ররা যাতে অসুবিধায় না পড়ে সেই দিকেও লক্ষ্য রাখবেন। ডিসি সাহেবের সঙ্গে চায়ের চেয়ে ছাত্রদের ক্লাশ অনেক জরুরী। আপনি শিক্ষক মানুষ। এই ব্যাপারটা আপনি ছাড়া কে বুঝবে?

মাহবুব সাহেব চোখ মুখ কঠিন করে বসে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আচ্ছা যান, এইটা বলার জন্যই ডেকেছিলাম। শুধু যে আজই আপনি ক্লাস মিস করেছেন তাই না। গতকালও স্কুলে এসেছেন টিফিন টাইমের পরে।

গতকাল স্কুলের কাজেই বাইরে ছিলাম। বাজার কমিটির সাথে একটা সভা ছিল। বাজার কমিটির চাদা ছাড়া তো স্কুল চলবে না। না-কি চলবে?

বাজার কমিটির টাকা আমাদের অবশ্যই দরকার। কিন্তু এদের মিটিং এমনভাবে ফেলতে হবে যেন স্কুল এফেকটেড না হয়। ছুটির দিনে মিটিং করবেন কিংবা সন্ধ্যাবেলা করবেন।

মাহবুব সাহেবের মুখে খুব কঠিন কিছু কথা এসে গিয়েছিল সেই সব কথা তিনি সামলে নিলেন। কঠিন কথা বলার সময় পাওয়া যাবে। প্রচন্ড রাগ নিয়ে কঠিন কথা ঠিক না। কঠিন কথা বলতে হয় ঠাণ্ডা মাথায়। খুব ঠাণ্ডা মাথায়।

মাহবুব সাহেব।

জ্বি স্যার।

আমাদের স্কুলের সায়েন্স টিচার আসবেন পরশু সন্ধ্যায়। বিদেশী মানুষ, তাঁর থাকা খাওয়ার একটা ব্যবস্থা তো করতে হয়…।

দেখি, একটা ব্যবস্থা করব।

কি ব্যবস্থা করবেন আমাকে জানাবেন। ষ্টেশনে কাউকে পাঠাতেও হবে উনাকে আনার জন্যে। আমি নিজেই যেতাম। আমার শরীরটা খারাপ রাতে ভাল ঘুম হচ্ছে না। শরীর ভাল লাগলে নিজেই যাব।

মাহবুব সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাঁড়াতে বললেন সার আমি তাহলে উঠি?

আচ্ছা। মাহবুব সাহেব!

জ্বি স্যার।

অনেক কঠিন কথা বলে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না। মেজাজও খুব খারাপ, হাতুড়ি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কি রকম অব্যবস্থা–স্কুলের হাতুড়ি চুরি গেছে। ডাষ্টার দিয়ে ঘণ্টা পিটাচ্ছে…। আচ্ছা যান। আপনার ক্লাসের সময় হয়ে গেল।

ফিফথ পিরিয়ড শুরু হচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেব ঘণ্টার শব্দ শুনছেন। হাতুড়ি পাওয়া যায় নি। ঘণ্টার শব্দ থেকেই বোঝা যাচ্ছে হাতুড়ি পাওয়া যায়নি। ফজলুল করিম সাহেব স্কুলের প্যান্ডে হরিপদের জরিমানা সংক্রান্ত নোটিশ লিখতে শুরু করলেন। সব কিছুর রেকর্ড থাকা দরকার। ফজলুল করিম সাহেব লিখলেন বিষয়ঃ কর্তব্য কার্যে গুরুতর অবহেলা।

সন্ধ্যাবেলা হরিপদ এসে জানালো হাতুড়ি খুঁজে পাওয়া যায় নি। হেডমাস্টার সাহেব তাকে জরিমানার চিঠি ধরিয়ে দিলেন। হরিপদ বিনয়ে নিচু হয়ে রইল। কিছু বলল না।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, শেক্সপিয়ারের একটা কথা আছে আই হ্যাভ টু বি ক্রুয়েল ওনলি টু বি কাইন্ড। অর্থাৎ তোমার প্রতি নিষ্ঠুর হচ্ছি, তৈমাকে করুণী প্রদর্শনের জন্যেই। বুঝছি

জ্বে আজ্ঞে।

আচ্ছা যাও। আমি আরো কিছুক্ষণ থাকব। রাতে এক জায়গায় দাওয়াত আছে। কাজেই রাত আটটা পর্যন্ত স্কুলে থাকব। তোমার থাকার কোন দরকার নেই। তুমি চলে যাও।

জ্বে আজ্ঞে।

যাবার আগে হারিকেনে তেল ভরে দিয়ে ঠিকঠাক করে দিয়ে যেও।

তেল কিনতে হবে স্যার। তেল নাই।

ফজলুল করিম সাহেব দশটাকার একটা নোট বের করে দিলেন।

বোতল নিয়ে যাও ছটাকার কেরোসিন আনবে।

জ্বে আজ্ঞে।

হেডমাস্টার সাহেব ঠিক করে রেখেছেন যে চারটাকা ফেরত আসবে সেই টাকাটা তিনি রাখবেন না এতে দুটাকা দুটাকা করে যে চার টাকা ফাইন হয়েছিল সেটা হরিপদ সামলে ফেলতে পারবে। বোকা মানুষ বলে সে ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না।

ফজলুল করিম সাহেবের ঘরে হারিকেন জ্বলছে। হরিপদ বারান্দায় জবুথবু হয়ে বসে আছে। হেড স্যারকে ফেলে সে যেতে পারে না। এটা সম্ভব না।

আজো বৃষ্টি পড়ছে। কাল যেমন বৃষ্টি পড়ছিল আজ তারচেয়েও বেগে বৃষ্টি নেমেছে। এইবার বন্যা না হয়েই যায় না। লাইব্রেরী ঘরের দিকে খটখট শব্দ হচ্ছে। শব্দ শুনে মনে হয় কারা যেন চেয়ার টেবিল টানাটানি করছে। হরিপদের গা সামান্য ছমছম করতে লাগল। স্কুলে একটা গুজব প্রচলিত আছে লাইব্রেরী ঘরে স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা জীবন বাবুকে মাঝে মধ্যে দেখা যায়। ব্যাপারটা পুরোপুরি গুজবও নয়। হরিপদ নিজেও একবার দেখেছে। তিন বছর আগের কথা। শীতকাল, সে স্কুল লাইব্রেরী বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিল–হঠাৎ শুনে খটমট শব্দ। লাইব্রেরী দরজা তালা দেয়া, সে ঘুলঘুলি ফাঁক করে তাকিয়েই চমকে উঠল। চেয়ারে জীবন বাবু বসে আছেন। খালি গা-ধবধবে ফর্সা শরীর, মোটা একটা বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন। হরিপদকে তাকাতে দেখে তিনি চোখ তুললেন। কি কঠিন সেই চোখের দৃষ্টি। হরিপদের বুক হিম হয়ে গেল। জীবন বাবু ধমকে উঠলেন–কি চাও? হরিপদ ছুটে চলে এল। এই ঘটনার কথা সে কাউকে বলেনি। এইসব ব্যাপার বলতে নেই।

লাইব্রেরী ঘরে শব্দ হচ্ছে, হরিপদের বুক কাপছে। ভরসার কথা এই যে শুধু যে হেডমাস্টার সাহেব আছেন তাই না, মওলানা সাহেবও আছেন। মওলানা সাহেব টিচার্স কমনরুমে নামাজ পড়ছেন।

শুধু যে হরিপদ হেডমাস্টার সাহেবের জন্যে অপেক্ষা করে তাই না। মওলানা সাহেবও অপেক্ষা করেন। এই এক দিকে দুজনের মিল আছে।

নামাজ শেষ করে মওলানা সাহেব ফজলুল করিম সাহেবের ঘরে উঁকি দিলেন।

স্যার যাবেন কখন?

একটু দেরী হবে। সিরাজ সাহেবের ওখানে রাতের খাওয়ার দাওয়াত। নটার সময় যেতে বলেছেন।

নটা বাজতে তো অনেক দেরী, এতক্ষণ বসে থাকবেন?

বসে নেই তো কাজ করছি। এইবার যে কজন ছেলে মেয়ে এসএসসি দিবে ওদের খুব স্পেশাল কোচিং-এর কি ব্যবস্থা করা যায় সেটা নিয়ে ভাবছি। পরিকল্পনা করছি।

আপনি বসুন পরিকল্পনাটা নিয়ে আপনার সঙ্গে ডিসকাস করি।

মওলানা সাহেব বসতে বসতে বললেন–যে বৃষ্টি নেমেছে–চা খেলে কেমন হয় স্যার?

চা খাবেন কিভাবে?

হরিপদ আছে। ওকে ফ্লাক্স দিয়ে পাঠিয়ে দেই।

চা খেতে পারলে মন্দ হয় না অবশ্যি। ফ্লাক্স কোথায় পাবেন?

আমার একটা আছে।

তাহলে তো ভালই হয়। আপনি এখনো যাননি, স্কুলে পড়ে আছেন ব্যাপারটা কি?

একা মানুষ গিয়েই বা কি করব? আপনি আছেন দেখে আমিও থেকে গেলাম।

ভাল করেছেন। আপনার সঙ্গে আমার পরিকল্পনাটা নিয়ে আলাপ করি। বিরাট পরিকল্পনা নিয়েছি।

বলুন শুনি আপনার পরিকল্পনা।

যারা এবার এসএসসি দেবে তারা থাকবে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা কোচিং-এর আওতায়। লাইব্রেরী ঘরের জিনিসপত্র খালি করে ঐখানে টানা বিছানা করে দেব। সার্বক্ষণিক শিক্ষক থাকবেন। শিক্ষকদের ডিউটি ভাগ করে দেয়া হবে। ব্যবস্থাটা কেমন মনে হচ্ছে?

খুব ভাল মনে হচ্ছে না। সম্ভব না। সম্ভব না কেন?

এইবার চল্লিশজন ছেলে পরীক্ষা দিচ্ছে। ঊনত্রিশটা ছেলে, এগারোটা মেয়ে এদের আপনি কোথায় রাখবেন? এদের খাওয়ার খরচ কে দিবে? শিক্ষকরাই বা বাড়তি ঝামেলা কেন করবেন?

স্কুলের দিকে তাকিয়ে শিক্ষকরা বাড়তি ঝামেলাটা করবেন। এইটা ছাড়া এখন আমাদের উপায় নেই। শহরের স্কুলগুলির সঙ্গে গ্রামের স্কুলগুলি পারছে না। এসএসসির রেজাল্ট হলে আপনি কখনো শুনবেন না গ্রামের কোন স্কুল থেকে একটা ছেলে ফার্স্ট হয়েছে… এমন তো না যে আমাদের ছাত্র খারাপ……

না ছাত্র খারাপ না।

দুটো ছেলে এবার আমাদের ভাল আছে। খুবই ভাল। এদের ঠিক মত তৈরি করতে পারলে……

তাহলে স্যার এই দুজনকে নিয়েই কাজ করুন।

এটাও মন্দ না। আমার নিজের বাড়িতেই রেখে দিতে পারি…. পরের বন্ধুর স্কুলের হোষ্টেল যখন হয়ে যাবে তখন বাধ্যতামুলকভাবে এসএসসির সব ছাত্রকে হোস্টেলে থাকতে হবে….. কি বলেন?

তা করা যাবে।

জোরে সোরে নামতে হবে বুঝলেন মওলানা সাহেব। শহরের স্কুল আমাদের টেক্কা দিয়ে চলে যাবে তা হয় না।

হেডমাস্টার সাহেবের চোখ চকচক করতে লাগল।

 

তাঁরা স্কুল থেকে বেরুলেন সাড়ে আটটায়। বৃষ্টি থেমে গেছে। রাস্তায় পঁাচ প্যাচ কাদা। সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। পোস্টাপিস পর্যন্ত দুজন এক সঙ্গে এলেন। এখান থেকে দুজন দুদিকে যাবেন! ফজলুল করিম সাহেব বললেন, মওলানা সাহেব যাই।

জ্বি আচ্ছা স্যার।

আপনার কথাটাই রাখব ঠিক করেছি, দুটা ছেলেকেই চব্বিশ ঘণ্টা তত্ত্বাবধানে রাখব। সব টিচারদের ডিউটি ভাগ করে দেব……

ইনশাআল্লাহ্।

মওলানা রওনা হতে গিয়েও হলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আপনি কি কিছু বলবেন?

জি না।

আপনার ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কিছু বলতে চান।

যদি কিছু মনে না করেন, স্যার।

কিছুই মনে করব না। বলুন কি ব্যাপার।

আপনার বাসায় কাজের যে মেয়েটা আছে কি যেন নাম?

রেশমী।

হ্যাঁ। রেশমী প্রসঙ্গে একটা কথা।

ওর প্রসঙ্গে কি কথা।

মেয়েটার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়?

হঠাৎ বিয়ের কথা উঠছে কেন?

মওলানা ইতস্তত করে বললেন–যুবতী মেয়ে বিয়ে হয়ে যাওয়া উচিত। তাছাড়া……

তাছাড়া কি?

আপনি বিপত্নীক মানুষ–তরুণী এক মেয়েকে নিয়ে বাস করছেন। আমাদের মন তো ছোট, হঠাৎ কেউ কিছু বলা শুরু করলে…… সবাই বিশ্বাস করা শুরু করবে…… সত্য আমরা বিশ্বাস করতে চাই না। অসত্য বিশ্বাস করি, কারণ অসত্য বিশ্বাস করানোর জন্য শয়তান আমাদের সব সময় প্ররোচিত করছে।

ফজলুল করিম সাহেব তীব্র গলায় বললেন, কেউ কি আপনাকে কিছু বলেছে? মওলানা জবাব দিলেন না। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, মেয়েটা ছোট থেকে আমার সঙ্গে আছে। আমার স্ত্রীর দেশের মেয়ে। সে দেশ থেকে নিয়ে এসেছিল। আমাকে খালু ডাকে।

জানি। সবই জানি–কথা হলো কি, বিয়ে হলে মেয়েটার জন্যেও ভাল। দরিদ্র মেয়ে বিয়ে হলে জীবনের গতি হয়। আমার হাতে একটা ছেলে আছে। মোটর মেকানিক। ভাল রোজগার করে। সংসারে শুধু মা আছে, আর কেউ নেই। যদি বলেন তো কথা বলে দেখি। বলব?

ফজলুল করিম সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, বলুন। বলে দেখুন। বিয়ের যাবতীয় খরচ দেব। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব করব। মেয়েটা আমার অতি প্রিয়। তার ভাল বিয়ে হলে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবে না।

মওলানা চুপ করে রইলেন। ফজলুল করিম সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, পরও আমাদের নতুন টিচার আসছে শুনেছেন বোধ হয়। সায়েন্স টিচার।

জ্বি, শুনেছি।

তার থাকার ব্যবস্থা করতে হয়। মাহবুব সাহেবকে অবশ্যি বলেছি।

আমার সঙ্গে রাখতে পারি। আমার ঘরে দুটা খাট আছে। উনি একটাতে থাকতে পারেন। থাকতে রাজি হবেন কি-না কে জানে।

রাজি হবেন না কেন?

মওলানা টাইপ কারো সঙ্গে লোকজন রাত্রিযাপন করতে চায় না।

এই জাতীয় অদ্ভুত কথা কেন বলছেন?

অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মওলানার প্রয়োজন পড়ে মিলাদ পড়াবার সময়, কিংবা কেউ মারা গেলে। অন্য সময় তাদের দরকার নেই। আপনি লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না কেউ কোন মওলানাকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেয় না।

কি যে অদ্ভুত কথা আপনি বলেন।

আপনি নিজেই দেন না। স্কুলের অনেক ঝামেলার কাজ আপনি নিজে করেছেন কিংবা অন্যকে দিয়ে করিয়েছেন আমাকে কখনো দেন নি।

ফজলুল করিম সাহেব চুপ করে রইলেন। মওলানা সত্যি কথাই বলছেন। তিনি ব্যাপারটাকে এ ভাবে কখনো দেখেন নি।

সিরাজ সাহেব প্রচুর লোক দাওয়াত করেছেন

সিরাজ সাহেব প্রচুর লোক দাওয়াত করেছেন। আজ তাঁর মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী। মিলাদ পড়ানো হয়েছে। মিলাদের পর খাবার ব্যবস্থা। আয়োজনও প্রচুর। বড় মাছ, মাংস পোলাও, দৈ মিষ্টি। দৈ এসেছে টাঙ্গাইল থেকে। সিরাজ সাহেব নিজেই অতিথিদের পাতে দৈ উঠিয়ে দিচ্ছেন। ময়মনসিংহ থেকে ভিসি এবং এসপি এসেছেন। তারাও খেতে বসেছেন। মন্ত্রী স্বয়ং তাঁদের পাতে দৈ তুলে দিচ্ছেন। এই দৃশ্যে তারা বড়ই বিব্রত। এসপি সাহেবের গলায় খাবার আটকে যাবার মত অবস্থা।

স্যার আপনি কেন?

সিরাজ সাহেব বললেন, কেন আমি কি দৈ দিতে পারি না? না-কি আপনার সন্দেহ আমি পরিমাণে আপনাকে কম দেব?

সবাই হেসে উঠল। হাসি থামতেই চায় না। সিরাজ সাহেব ক্রমাগত রসিকতা করে যাচ্ছেন–সবাই হেসে যাচ্ছে।

ঢাকা থেকে পত্রিকার এক সাংবাদিকও এসেছেন। সিরাজ সাহেব তাঁর কাছে গিয়ে বললেন, যতদূর জানি আপনি সাহিত্যের ছাত্র। আপনি আমাকে বলুন মাথায় ঘোল ঢেলে দেয়ার বাগধারা শোনা যায়। দৈ ঢেলে দেয়া শোনা যায় না কেন?

সাংবাদিক কিছু বলার আগেই সবাই হাসতে শুরু করল। ফজলুল করিম সাহেবের পুরো ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। মায়ের মৃত্যু বার্ষিকীতে এত হাসাহাসি কেন? এ তো কোন আনন্দময় উৎসব নয়।

খাওয়া শেষ হতে হতে দশটা বেজে গেল। সিরাজ সাহেব বললেন, আপনারা কেউ যাবেন না, একটা জরুরী ঘোষণা আছে। আজ একটা বিশেষ দিন। আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম বিশেষ দিনে একটা জরুরী ঘোষণা দেব। তাছাড়া ইচ্ছা করলেও আপনারা কেউ যেতে পারবেন বলে মনে হয় না, যে বৃষ্টি নেমেছে। রাস্তায় এক হাঁটু পানি

সবাই আবারো হাসতে শুরু করলো। রাস্তায় এক হাঁটু পানি এই খবরে হাসার কি আছে ফজলুল করিম সাহেব বুঝতে পারছেন না। না-কি মন্ত্রীদের প্রতিটি কথায় হাসতে হয়, এটাই নিয়ম।

সিরাজ সাহেব বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতেই ঘোষণা দিলেন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। মাথায় টুপি পরে বিসমিল্লাহ হির রহমানির রাহিম বলে শুরু করলেন

আজ আমি যদিও আপনাদের সবার সঙ্গে খুব হাসাহাসি করছি তবু আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন আজ আমার মার মৃত্যু দিবস। মা নয় বছর আগে এই বাড়িতে মারা গেছেন। আমি আমার মার কু পুত্র। র জন্যে। কিছুই করতে পারিনি। কাজেই ঠিক করেছি, মার স্মৃতির রক্ষার জন্যে এই অঞ্চলে একটা স্কুল দেব। তবে লোকজন যেমন নাম দিয়ে স্কুল দেয় সে রকম কিছু না, স্কুলের নাম হবে নীলগঞ্জ হাই স্কুল। আমার মায়ের নাম স্কুলের সঙ্গে যুক্ত রাখব না। এটা আমার কাছে অরুচিকর মনে হয়। তাছাড়া আপনারা অনেকেই জানেন আমার মা ছিলেন অত্যন্ত পর্দানশীন মহিলা। তাঁর নাম। সবাই মুখে নেবে এটা তার ভাল লাগার কথা না।

প্রচণ্ড হাততালিতে সিরাজ সাহেবের কথা চাপা পড়ে গেল। তিনটা হ্যাজাক বাতির একটা দপ দপ করছে, এতেও তাঁর বক্তৃতা বাধা পাচ্ছিল। হ্যাজাক ঠিক করার পর রমিজ সাহেব আবার শুরু করলেন,

আমি আমাদের পৈত্রিক বসত বাটি সেই সঙ্গে দশ একর জমি এবং নগদ পাঁচ লাখ টাকা স্কুলের নামে লিখে পড়ে দিয়েছি। কাগজপত্র রেজিষ্ট্রি হয়েছে। কাগজপত্র ফাইলে রাখা হয়েছে–আপনারা ইচ্ছে করলে দেখতে পারেন।

মন্ত্রীরা ক্ষমতা অপব্যবহার করে অনেক আজেবাজে কাজ করেন-আমিও একটু করেছি। সরকারি স্যাংশন করিয়ে ফেলেছি। এতে আমার যদি অধর্ম হয়ে থাকে ক্ষমা করবেন।

আমাদের এই নীলগঞ্জ স্কুলের ছাত্ররা ইনশাল্লাহ্ এই সেশানের পরের সেশান থেকেই এসএসসি পরীক্ষা দেবে। এখন আমি যা চাই সেটা হলআপনাদের সাহায্য। এটা আমার মার স্কুল না, এটা আপনাদেরই স্কুল। আমি কিছু করছি না, যা করছেন আপনারাই করছেন।

ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন–স্যার এখানে তো একটা স্কুল আছে। অনেক দিনের পুরানো স্কুল।

সিরাজ সাহেব বললেন, মার কাছে মামার বাড়ির গল্প কেন করছেন হেডমাষ্টার সাহেবঃ জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল যে এখানে আছে সেটা আমি জানব না? আমি সেই স্কুলের ছাত্র না?

সবাই আবারো হো হো করে হাসছে। ফজলুল করিম সাহেব সেই হাসি অগ্রাহ্য করে বললেন, দুটো স্কুল চলার মত অবস্থা স্যার নীলগঞ্জের নাই।

এখন নেই–পরে হবে। শিক্ষার হার জিওমেট্রি প্রগ্রেসানে বাড়বে। দুটা স্কুলে আমাদের চলবে না। তিনটা চারটা স্কুল লাগবে।

ফজলুল করিম সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন, এতো পুরানো দিনের স্কুল উঠে যাবে এটা কি ঠিক হবে? স্যার আপনিই বলুন–আপনি সাহায্য করতে চান। সাহায্য করুন, আমাদের স্কুলকে করুন

আপনার স্কুলের সাহায্য লাগবে কেন? আপনার মত হেডমাস্টার থাকতে স্কুলের কি চিন্তা? তাছাড়া দুটো স্কুল থাকলে কম্পিটিশন হবে। কম্পিটিশনের ফল সব সময় শুভ হয়। সাহায্যের কথা বলছেন না হয় আপনাদেরও সাহায্য করব, শর্ত একটাই আপনারা আমার স্কুল দাড়া করিয়ে দেবেন।

ফজলুল করিম সাহেব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, মাহবুব সাহেব তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, স্যার আমরা যা করার ইনশাআল্লাহ্ করব। এই বিষয়ে আপনি কোন দুশ্চিন্তা করবেন না। আল্লাহ হাফেজ।

সিরাজ সাহেব বললেন, চায়ের ব্যবস্থা আছে। চা না খেয়ে কেউ যাবেন। বৃষ্টি কিন্তু এখনো পড়ছে। আপনাদের জন্যে নৌকার ব্যবস্থা করেছিনৌকা দিয়ে আপনাদের পৌঁছে দেয়া হবে। হা-হা-হা।

আবারো হাসি শুরু হল।

ফজলুল করিম সাহেব বাসায় ফিরলেন মাঝরাতে। বাইরের বারান্দার উঠোনে হারিকেন জ্বালিয়ে রেশমী বসে আছে। কি সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। রেশমী উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কই ছিলেন?

দাওয়াত ছিল রেশমী।

আমারে কিছু বলে যাবেন না। না-কি আমি কোন মানুষ না?

রেশমী কেঁদে ফেলল। সহজ কান্না না-হাউ মাউ করে কান্না। ফজলুল করিম সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। কি করবেন, কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। রেশমী ফোপাতে ফেঁপাতে বলল, আমি আপনার কে? আমি আপনার কেউ না।

এই প্রথম ফজলুল করিম সাহেবের নিজেকেই নিজের পায়ে পানি টলিতে হল। ঘরে ঢুকে দেখেন রেশমী তার নিজের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ফজলুল করিম সাহেব বিছানায় শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। তার মন বলছে এক সময় রেশমীর রাগ ভাঙ্গবে। সে দরজা খুলে বের হয়ে এলে তাকে বলবেন, দুকাপ চা কর রেশমী, আমার মনটা খুব খারাপ। কি জন্যে খারাপ তোমাকে বলি।

রেশমী দরজা খুলল না। অপেক্ষা করতে করতে ফজলুল করিম সাহেব ঘুমিয়ে পড়লেন। এক সময় তার ঘুম ভাঙ্গলো–তিনি দেখলেন তার মশারী ফেলা। গায়ের উপর চাদর দেয়া। বাইরে মুষল বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দ শুনেই তার মন ভার হচ্ছে? নিজেকে একা লাগছে? কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। রেশমীকে কি তিনি ডেকে তুলবেন? সেটা কি ঠিক হবে। নিশিরাতে তিনি রেশমীকে ডেকে তুলছেন কথা বলার জন্যে। ডেকে তোলার জন্যে কোন অজুহাত থাকলে ভাল হত। চায়ের পিপাসা হচ্ছে। এই অজুহাতে কি ডাকা যায় না?

ফজলুল করিম  সাহেব মশারীর ভেতর থেকে বের হলেন। খাটের পাশে  রাখা চেয়ারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শব্দ হয়। ভালই হল শব্দ উব্দ শুনে যদি রেশমীর ঘুম ভাঙ্গে। তিনি হাত দিয়ে চেয়ার টানলেন আরো শব্দ হল। দরজার সিটকিনি খুললেন। বারান্দায় বেশ খানিকক্ষণ বসে থাকবেন, বৃষ্টির শব্দ শুনবেন।

বৃষ্টির ছাটে বারান্দায় রাখা ইজিচেয়ারের কাপড় ভিজে গেছে। ভেজা কাপড়ের উপরই বসে থাকতে হবে। ব্যাঙ ডাকছে। আচ্ছা ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী কি? শব্দটা মনে পড়ছে না কেন? ফজলুল করিম সাহেব ভুরু কুঁচকে বসে আছেন। ইংরেজীটা যদি মনে পড়ে। বয়সের সমস্যা শুরু হয়েছে। স্মৃতি নষ্ট হচ্ছে।

ফজলুল করিম সাহেব অপেক্ষা করছেন। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী মনে পড়ার অপেক্ষা এবং সেই সঙ্গে রেশমীর জন্যে অপেক্ষা। তাঁর মন বলছে রেশমী ঘুমায় নি। ঘুমুলেও সাড়া শব্দে ঘুম ভেঙ্গেছে। রেশমী উঠে আসবে।

বৃষ্টির ছাটে বসে থাকার জন্যে রাগারাগি করবে। তখন তিনি রেশমীকে চা করতে বলবেন। চা খেতে খেতে গল্প করবেন। বয়সের অনেক লক্ষণের। একটি হল-~-ঘুম কমে যায়। মাঝ রাতে কারো সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করে।

তিনি বসেই রইলেন। রেশমী এল না। বৃষ্টির বেগ কখনো কমছে, কখনো বাড়ছে। ব্যাঙের ডাকের কোন উঠা নামা নেই। ফজলুল করিম সাহেব–জবুথবু হয়ে বসে আছেন। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী কি ভাবতে ভাবতে বৃষ্টি দেখছেন।

মমিন ট্রেন থেকে নামল ঘোর বৃষ্টিতে

মমিন ট্রেন থেকে নামল ঘোর বৃষ্টিতে। তার হাতে একটা সুটকেস, ট্রেনে দুটা প্রকান্ড বোচকা পড়ে আছে–নামাতে হবে। তার একার পক্ষে নামানো সম্ভব না। সে নেমেছে কুলীর সন্ধানে। নেমেই সে তার বোকামী টের পেল। এইসব গ্রামের মায়ে খেদানো, বাপে তাড়ানো টাইপ ষ্টেশনে কুলী থাকার কোন কারণ নেই। কুলী কুলী বলে চেঁচামেচি করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দেবে। গার্ড সাহেব জানালা দিয়ে মাথা বের করে ফেলেছেন।

মমিন সুটকেস প্লাটফরমে নামিয়ে আবার ট্রেনে উঠল। মন পড়ে রইল প্লটফরমে। স্যুটকেস কেউ নিয়ে পালিয়ে যাবে নাতো। কাপড় চোপড় যা আছে সবই স্যুটকেসে।

আমি জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের হেড মাষ্টার। ফজলুল করিম। আপনার জিনিসপত্র কি আছে দিন।

মমিন এক ঝলক তাকিয়ে দেখল। সৌজন্য আলাপ পড়ে হবে আগে মালপত্র নামানো যাক। মমিন বলল, স্যার এই পুটলিটা একটু ধরুন।

বেঞ্চের নীচ থেকে পুটলি টেনে বের করা যাচ্ছে না। এমন ওজন।

ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি আছে এর মধ্যে?

স্যার বই।

ফজলুল করিম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। যে শিক্ষকের এত বই সে ভাল শিক্ষক না হয়েই যায় না। তিনি মনে মনেই বললেন–গুড, ভেরী গুড।

মমিন বলল, ট্রেন কি ছেড়ে দিচ্ছে স্যার?

ছাড়লেও নামতে পারবেন। গ্রামের ষ্টেশন চলন্ত ট্রেনেই লোকজন ওঠানামা করে।

একটা পুটলি বের হয়েছে। মমিন দ্বিতীয় পুটলি ধরে টানাটানি করছে। ফজলুল করিম বললেন, এর মধ্যেও কি বই?

জ্বি স্যার।

ফজলুল করিম সাহেব আবারো মনে মনে বললেন, গুড ভেরী গুড। ছেলেটি লম্বা, অতিরিক্ত রকমের রোগা, ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় রাগী হবে। হোক। রাগী শিক্ষকই ভাল। ছাত্ররা ভয় পাবে। ভয়ের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক আছে। অদির করে কোলে বসিয়ে শিক্ষা হয় না। প্রাচীন কালে গুরুগৃহে কঠিন শাসন ছিল।

স্কুল স্টেশন থেকে কতদূর?

আছে সামান্য দূর। পাঁচ মাইলের কম।

যাব কি ভাবে?

আগে রিকশায় যাওয়া যেত। বর্ষা শুরু হওয়ায় রিক্সা বন্ধ। হেঁটেই যাতায়াত করতে হয়।

বলেন কি?

রোজ রোজতো আর স্টেশনে আসা হয় না।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ফজলুল করিম নতুন সায়েন্স টিচারকে নিয়ে স্টেশনের পাশের টি স্টলে চা খেতে ঢুকেছেন। বৃষ্টি না ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একটা মাত্র ছাতা। দুজন এই ছাতায় কুলুবে না। ফজলুল করিম সাহেব লক্ষ্য করলেন নতুন টিচার বেশ আগ্রহ নিয়ে বৃষ্টি দেখছে। নিশ্চয়ই শহুরে ছেলে। গ্রামের বর্ষা দেখেনি। শহুরে ছেলে হলেই ভাল। এরা গ্রাম পছন্দ করে। হয়ত স্কুলে টিকে যাবে। গ্রামের শিক্ষিত ছেলেপুলেদের গ্রাম বেশী অপছন্দ। তারা শুধু খুঁজে শহর।

ফজলুল করিম ঝুঁকে এসে বসলেন, আপনি কি গ্রামে ছিলেন কখনো?

জ্বি-না।

তাহলে ভাল লাগবে। পল্লীগ্রামের বর্ষা সুন্দর।

স্কুলটা কেমন?

স্কুলটাও সুন্দর। প্রাচীন স্কুল।

সেই সুন্দর জানতে চাচ্ছি না। বেতন টেন রেগুলার পাওয়া যাবে? শুনেছি গ্রামের স্কুলের বেতন খুবই অনিশ্চিত ব্যাপার?

ফজলুল করিম সাহেব জবাব দিলেন না। চা খাবার ব্যাপারে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়লেন। স্কুলের অবস্থা শুধু যে ভাল না, তাই না–স্কুলের অবস্থা শোচনীয়। এই খবর দিয়ে শুরুতেই ভড়কে দেবার দরকার কি?

স্যার কিছু বলছেন না যে স্কুলের অবস্থা কেমন?

আছে মোটামুটি। তবে ইনশাআল্লাহ্ অবস্থা ভাল হবে।

কি ভাবে ভাল হবে?

স্কুলের নাম ডাক ছড়ালেই ছাত্র আসতে থাকবে।

মমিন বিস্মিত হয়ে বলল, ছাত্র সব চলে গেছে নাকি?

না না তা না। আসুন বৃষ্টি কমেছে, রওনা দেয়া যাক। জিনিস পত্র থাকুক, পরে নোর ব্যবস্থা করব।

আমার থাকার ব্যবস্থা কোথায় হয়েছে?

আপাতত ইরতাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে থাকবেন। অতি সজ্জন। আরবী এবং ইসলামিয়াতের শিক্ষক। খাওয়া দাওয়া উনার এখানে থাকা খাওয়ার কোন খরচ নাই।

কেন?

পল্লীগ্রামতো–এখানে শিক্ষকদের খুব মর্যাদা। সভ্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের বাড়িতে শিক্ষকদের রাখেন। আদর যত্ন করেন।

জায়গীর? বিনিময়ে প্রাইভেট টিউশনি?

অনেকটা সে রকমই। তবে আপনাকে ছাত্র পড়াতে হবে না।

মামুন হতাশ গলায় বলল, কিছু মনে করবেন না স্যার অবস্থাতো আমার কাছে মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। মনে তো হচ্ছে পেটে ভাতে চাকরি।

সরকারী ডি এ আছে। ছাত্রদের কাছ থেকে কিছু কালেকশন হয়। বাজার কমিটির চাঁদা…. তাছাড়া পল্লীগ্রাম খরচও তো তেমন নেই।

আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে। একটা ছাতায় বৃষ্টি মানছে না। মামুন বলল, ছাতা বন্ধ করে ফেলুন স্যার। আধাভেজা হয়ে যাবার চেয়ে পুরোপুরি ভিজে যাওয়াই ভাল। আমারতো বৃষ্টিতে ভিজতে ভালই লাগছে।

ফজলুল করিম সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নতুন সায়েন্স টিচার টিকে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এমন ঘন বর্ষণে ভিজতে যার খারাপ লাগছে না তার হয়ত কোন কিছুতেই খারাপ লাগবে না। কোন সায়েন্স টিচারই এই স্কুলে টিকে না। গত একবছরে তিনজন চলে গেল।

মামুন সাহেব।

জ্বি স্যার।

আপনার রেজাল্টতো খুব ভাল। এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাশ। গ্রামের স্কুলে আসতে রাজি হলেন ব্যাপারটা কি?

ইচ্ছা করেই রাজি হয়েছি। গ্রামের দিকে থাকব নিরিবিলিতে পড়াশোনা করব। আমি বি সি এস দিচ্ছি। বই পত্র নিয়ে এসেছি।

ও আচ্ছা। বি সি এস পাশ করলে চলে যাবেন।

অবশ্যই। তবে যে কদিন আমি থাকব–ঠিকমতই থাকব। আমি ভাল শিক্ষক।

করিম সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। এও থাকবে না। ভাল স্কুলের পূর্ব শর্ত হল ভাল শিক্ষক। দালান কোঠায় স্কুল হয় না। স্কুল হয় শিক্ষকে। মামুন বলল, ঠাণ্ডায় কাহিল হয়ে পড়েছি। স্যার যদি অনুমতি দেন একটা সিগারেট ধরাই।

অবশ্যই অবশ্যই সিগারেট ধরাবেন এতে কি। আপনি আমার সহকর্মী।

সহকর্মী হলেও আপনি বয়োজৈষ্ঠ। স্যার কি ধুমপান করেন?

জ্বি–না আগে করতাম। হঠাৎ এক সময় মনে হল ছাত্ররাই শিক্ষকদের দেখে শিখবে। আমাকে দেখে যদি সিগারেট খাওয়া শিখে সেটা ঠিক হবে না। ছেড়ে দিলাম।

বলেন কি?

মাঝে মধ্যে খাই না যে তা না–হঠাৎ হঠাৎ খাই।

স্যার, এখন কি একটা খাবেন। আশে পাশে ছাত্র নেই–কেউ দেখবে না।

না না। ইচ্ছা করছে না।

ইচ্ছা করলেও পারবেন না। এই বৃষ্টির মধ্যে সিগারেট না ভিজিয়ে খাওয়া সহজ কর্ম না। শুধু প্রফেশনালরা পারবে। হা হা হা হা।

 

করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে নতুন সায়েন্স টিচারের হাসি শুনছেন। এমন প্রবল হাসি হাসার মত কি ঘটনা ঘটেছে তাও তিনি বুঝতে পারছেন না।

মামুন সাহেব।

জ্বি স্যার।

ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী জানেন না-কি?

মামুন বিস্মিত হয়ে বলল জ্বি–না জানি না। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী দরকার কি?

মামুন এই প্রথম হেডমাষ্টার সাহেবকে ভালমত লক্ষ্য করল। পাঁচ মাইল হেঁটে ইনি তাকে নিতে এসেছেন। এতক্ষণ ব্যাপারটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি, এখন মনে হচ্ছে। স্কুলের দপ্তরীকেও তো উনি পাঠাতে পারতেন। বৃদ্ধ বয়স্ক একজন মানুষ ঝড় বৃষ্টির দিনে এতটা কষ্ট করবেন কেন? স্বার্থ ছাড়া মানুষ সচরাচর কষ্ট করতে রাজি হয় না। এই মানুষটার স্বার্থ কি?

মামুন বলল, আর আপনি নিজে আমাকে নিতে এসেছেন কেন? কোন দরকার ছিল না।

করিম সাহেব কিছু বললেন না। তাঁর মাথায় ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী কি সেটাই ঘুরছে। বয়সের লক্ষণ। বেশী বয়সে মাথায় কিছু ঢুকে গেলে সেটা বেরুতে চায় না। প্যাচ কেটে যাওয়া রেকর্ডের মত এক জায়গায় বাজতে থাকে।

স্যার আপনার স্কুলের ছাত্র কতজন?

একশ তেইশ। আগামী কাল একজন ভর্তি হবে–একশ চব্বিশ হবে।

স্যার কিছু মনে করবেন না–ব্যক্তিগত কৌতুহল থেকে প্রশ্নটা করছি আপনি কি এই একশ চব্বিশ জন ছাত্রের নাম জানেন?

ফজলুল করিম সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, জানি।

মামুন সিগারেট ফেলে দিতে দিতে বলল, আমিও এ রকমই অনুমান করেছিলাম।

মওলানা ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে

মওলানা ইরতাজউদ্দিন হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে ঢুকলেন। তার পেছনে বোকা বোকা চেহারার এক যুবক। যুবকের গা থেকে বিড়ির কড়া গন্ধ আসছে। তার দাঁত হলুদ হয়ে আছে। দাঁত মাজার ব্যাপারটি সে সম্ভবত জানে না, আর জানলেও তার প্রয়োজন বোধ করে না। মাথা ভর্তি চুল। সেই চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। এই চুল সে নিশ্চয়ই উকুনের চাষের জন্যে বড় করছে।

মওলানা বললেন, রহমত! স্যারকে সালাম কর।

রহমত টেবিলের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার ঝাপ দেয়া দেখেও ফজলুল করিম সাহেব আঁৎকে উঠলেন। এর চলাফেরা, কাজ কর্ম সব কিছুর মধ্যেই পশু ভাব আছে। পশুদের গায়ে যেমন কড়া গন্ধ থাকে এর গায়েও আছে। টক টক গন্ধ।

মওলানা বললেন, স্যার এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম।

কি বলেছিলেন?

ঐ যে রেশমীর সঙ্গে…

ও আচ্ছা আচ্ছা

মোটরের ভাল মেকানিক। ওস্তাদ কারিগর। অন্যের গ্যারেজে কাজ করে, টাকা পয়সা জোগাড় করতে পারলে সে নিজেই নেত্রকোনা শহরে স্বাধীন ব্যবসা করবে।

ভাল খুব ভাল।

আপনাকে দেখানোর জন্যে খবর দিয়ে এনেছি।

ভাল করেছেন খুব ভাল করেছেন।

মওলানা রহমতের দিকে তাকিয়ে বললেন, রহমত তুমি বারান্দায় একটু দাঁড়াও আমি স্যারের সঙ্গে একান্তে দুটা কথা বলি।

রহমত তার সব কটি হলুদ দাঁত বের করে হেসে ফেলল। ফজলুল করিম সাহেব হাসি দেখেও চমকালেন। এটা তো হাসি না, যেন কামড়াতে আসছে। রহমত বারান্দায় চলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে বিড়ি ধরাল। বিড়ির কড়া গন্ধে ঘরে থাকাই মুশকিল।

মওলানা বললেন, স্যার ওকে এনেছি রেশমীকে দেখানোর জন্যে। দেখে যদি পছন্দ হয় আজ রাতেই আমি বিয়ে পড়িয়ে দেব। রহমত বৌ নিয়ে চলে যাবে।

কি বলছেন আপনি?

ওর সঙ্গে এরকমই কথা হয়েছে।

হুট করে বিয়ে?

গরীব মানুষদের বিয়ে এরকম হুট হাট করেই হয়।

এর সঙ্গে রেশমীর বিয়ে হতে পারে না।

কেন?

ছেলেটাকে আমার পছন্দ না।

আপনার পছন্দের কথা তো এখানে আসছে না। রেশমীর পছন্দ নিয়ে কথা।

ওর তো পছন্দের প্রশ্নই উঠে না। পছন্দ করার মত কি আছে এই ছেলের মধ্যে?

অনেক কিছুই আছে। ছেলের রোজগার ভাল। ভাল টাকা কামায়। এই জাতীয় ছেলে নেশাভাঙ করে। তার সে বদঅভ্যাস নেই।

ফজলুল করিম সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, খামাখা একটা বিষয় নিয়ে পিড়াপিড়ি করছেন কেন? ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয়নি। পও শ্রেণীর মানুষ বলে মনে হয়েছে। জেনেশুনে এমন একজনের সঙ্গে রেশমীর বিয়ে দেয়া যায় না। ওকে চলে যেতে বলুন।

একটু ভেবে বলুন স্যার।

ভেবে বলাবলির কিছু নেই।

জি আচ্ছা স্যার।

স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে এটাও তো খুব আপত্তিজনক কথা। আমার নিষেধ আছে শিক্ষকরাও ছাত্রদের সামনে ধূমপান করবেন না। খারাপ ব্যাপারগুলি ছাত্রদের আগে আকৃষ্ট করে। আপনি বের হয়ে রহমত না কি যেন নাম, তাকে একটা কড়া ধমক দিন, তার পর চলে যেতে বলুন।

জি আচ্ছা।

ওকে বিদেয় করে আসুন আপনার সঙ্গে কথা আছে।

জ্বি আচ্ছা।

ইরতাজউদ্দিন ফিরে এলেন। তাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আমাদের নতুন টিচারকে কেমন লাগছে।

ভাল।

এক শব্দে জবাব দেবেন না। কেন ভাল সেটা বলুন।

যুবক মানুষ। উৎসাহ আছে।

পড়াচ্ছে কেমন?

ভাল।

আপনার যে এক শব্দে জবাব দেবার একটা বিশ্রী অভ্যাস হয়েছে তার কি করা যায় বলুনতো। খোঁজ নিয়েছেন ভাল, না-কি খোঁজ না নিয়েই বলেছেন ভাল।

খোঁজ নেই নাই, অনুমানে বলেছি।

অনুমানে কিছু বলবেন না। যা বলবার অনুসন্ধানের পর বলবেন। প্রথমে অনুমান তারপর অনুসন্ধান এই কাজটা করবেন না। প্রথমে অনুসন্ধান। তারপর অনুমান। বুঝতে পারলেন?

জ্বি স্যার। এখন যদি অনুমতি দেন উঠি।

আচ্ছা যান। ভাল কথা ব্যাঙের ডাকের আরবী কি বলুনতো।

বুঝতে পারছি না কিসের আরবী?

ব্যাঙের ডাকের।

ইরতাজউদ্দিন সাহেব চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন ব্যাপারটা ধরতে পারছেন না। হেডমাস্টার সাহেব আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছেন। মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি তিনি ব্যাঙের ডাকের আরবী জানতে আগ্রহী। মানুষটার মাথায় কি গোলমাল হচ্ছে? মাথার অসুখ হঠাৎ করে শুরু হয় না। আস্তে আস্তে শুরু হয়।

সেকেন্ড পিরিয়ড শুরু হবার ঘণ্টা পড়ল। ঘণ্টা ঠিকমত পড়ল। সুন্দর আওয়াজ হল। হরিপদ স্কুলের ঘণ্টা খুঁজে পেয়েছে। ফজলুল করিম সাহেব ফাইন মাফ করে তাকে চিঠি দিয়েছেন। সেকেন্ড পিরিয়ডে ক্লাস নাইনের সঙ্গে তাঁর ক্লাস-ইংরেজী ফাস্ট পেপার। আজ পড়াবেন কবিতা।

তেত্রিশজন ছাত্র ছিল ক্লাসে, আজ সেখানে বারজন ছাত্র বসে আছে। সব কটা বেঞ্চ ফাঁকা। নীলগঞ্জ হাইস্কুল চালু হয়েছে। ছাত্ররা দল বেঁধে চলে যাচ্ছে। মাত্র দুমাসে এই অবস্থা। সারভাইভেল ফর দি ফিটেস্ট। যে ফিট সে টিকে থাকবে। যে আনফিট তাকে চলে যেতে হবে। এটা জগতের কঠিন নিয়মের এক নিয়ম।

ফজলুল করিম সাহেব ডায়াসের চেয়ারে চুপচাপ বসে রইলেন। পড়ানো শুরু করতে ইচ্ছে করছে না। ক্লাস ভর্তি থাকবে ছেলেমেয়ে তবেই না পড়িয়ে আরাম। অল্প কটা ছেলেকে তিনি কি পড়াবেন? তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন। পড়ানো শুরু করার আগে শিক্ষকরা হাসি হাসি মুখে থাকলে ছাত্ররা ভরসা পায়। ছাত্ররা তেমন ভরসা পেল বলে মনে হল না। তিনি বললেন, সবাই দেখি নতুন স্কুলে যাচ্ছে। তোমরা যাচ্ছি না কেন?

একজন বলল, আমরা স্যার যাব না।

ফজলুল করিম সাহেবের ভুরু কুঁচকে গেল। ছেলেটা কথা বলেছে বেয়াদবের মত। উঠে দাড়ায়নি। স্যারের সঙ্গে কথা বললে–উঠে দাড়াবে। যা বলবে স্পষ্ট করে বলবে।

তোমার নাম ফরহাদ উদ্দিন না?

জ্বি স্যার।

শোন ফরহাদ উদ্দিন। তুমি যে বললে, তোমরা যাবে না। শুনে আমি সঙ্গত কারণেই খুশি হয়েছি। কিন্তু কথাগুলি তুমি বলেছে বসে বসে। অত্যন্ত বেয়াদবের মত কাজ করেছ। ভবিষ্যতে আর কখনো করবে না।

জি আচ্ছা স্যার।

এখন বল তোমরা যাবে না কেন?

এই স্কুলই ভাল।

নীলগঞ্জ স্কুল যে খারাপ এটা তো তুমি বলতে পার না। কারণ তুমি ঐ স্কুলে পড়নি। পড়েছ?

জি না।

তাহলে বললে কেন এই স্কুলই ভাল? যা মনে আসে তাই বলে বসবে। কথা বলার আগে অবশ্যই আমাদের অনেক সাবধান হতে হবে। কথা বলাটাও শিক্ষারই একটা অঙ্গ। মনে থাকবে?

জ্বি স্যার!

আজকে আমরা কি পড়ব?

ইংরেজী কবিতা।

কবিতার নাম কি?

The Sands of Dee.

যে কবি কবিতাটা লিখেছেন তার নাম কি? কেউ জান না। জানা উচিত ছিল না-কি? কবির নাম চার্লস কিংসলে। সবাই এক সঙ্গে বল চার্লস কিংসলে।

সবাই এক সঙ্গে বলল, চার্লস কিংসলে।

আবার বল।

ছাত্ররা আবার বলল।

ফজলুল করিম সাহেব বোর্ডের কাছে গেলেন। চক দিয়ে বড় বড় করে লিখলেন Charles Kingsley.কবির নামের নিচে লিখলেন কবিতার নাম The sands of Dee. প্রথমে স্রষ্টা তারপর তার সৃষ্টি। কাজটা কি ঠিক করলেন? সৃষ্টি কি বেশির ভাগ সময়ই স্রষ্টাকে ছাড়িয়ে যায় না? জীবনকৃষ্ণ বাবুর চেয়েও কি জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল অনেক গুরুত্বপূর্ণ নয়?

তিনি মিষ্টি গলায় কবিতার প্রথম চার লাইন আবৃত্তি করলেন।

O Mary, go and call the cattle home.
And call the cattle home,
And call the cattle home,
Across the sands of Dee.

বাবারা বল Dee মানে কি?

নদীর নাম স্যার।

হ্যাঁ। ইংল্যাণ্ডের একটা নদীর নাম। লিভারপুলের কাছে এই নদী সমুদ্রে পড়েছে। এই কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের দেশের এক কবিও অসাধারণ একটা কবিতা লিখেছিলেন। তোমরা কেউ সেটা জান?

ছাত্ররা চুপ করে আছে। কেউ জবাব দিচ্ছে না। ফজলুল করিম সাহেব বিষণ্ণ গলায় বললেন, কবিতাটা তোমরা ক্লাস সেভেনে পড়েছ। তোমাদের পাঠ্য ছিল

শোন মা আমিনা, রেখে দে রে কাজ, ত্বরা করে মাঠে চল
এল মেঘনায় জোয়ারে বেলা এখনি নামিবে ঢল।
নদীর কিনারা ঘন ঘাসে ভরা,
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা,
করিস না দেরি আসিয়া পড়িবে সহসা অথই জল।
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় তৃরা মেম্বনায় নামে ঢল।

ফজলুল করিম সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। ভাল লাগছে না। কিছু ভাল লাগছে না। ঘণ্টা পড়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বোর্ডের দিকে তাকালেন। ভুল করেছেন। কবির নামের আগে কবিতার নাম থাকা উচিত ছিল।

 

আজ বৃহস্পতিবার হাফ স্কুল ফজলুল করিম সাহেব ঠিক করে ফেললেন বাসায় যাবেন না। স্কুলেই সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকবেন। রেশমী মন খারাপ করবে। করুক। দুটার দিকে ডাক আসে। ডাকের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সরকারি অনুদানের চিঠি পেয়েছেন। চেক আসছে না। মনজুরকে কয়েকটা চিঠি দিয়েছেন। মনজুর চিঠির জবাব দিচ্ছে না। একবার ঢাকা যাওয়া উচিত।

গত মাসে শিক্ষকদের বেতন দিতে পারেন নি। সরকারী ডি, এর টাকাটা দিতে পারলেও হত। সেই টাকাও আসেনি। স্কুলের এমন কোন ফান্ড নেই যে সেখান থেকে টাকা ধার করেন। এত দিনের পুরানো একটা স্কুল অনার বোর্ডের দিকে তাকালে মন ভরে যায়। কত বিখ্যাত মানুষ এই স্কুল তৈরি করেছে।

ফজলুল করিম সাহেব ছাত্রদের দিকে তাকালেন। তারা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি বললেন, আজ পড়াতে ভাল লাগছে না। খুব মাথা ধরেছে …

বলেই তিনি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। তাঁর মাথা ধরেনি। ছাত্রদের মিথ্যা কথা বলা হল। মাথা না ধরলেও শারীরিকভাবে স্বস্তিবোধ করছেন না। গরম লাগছে। কোটের কারণে গরম লাগছে বোধ হয় …।

ফজলুল করিম সাহেব ক্লাস শেষ হবার ঘণ্টার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সময় কাটছেই না।

 

স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। শিক্ষকরা সবাই চলে গেছেন। শুধু মাহবুব সাহেব এবং বিনয় বাবু বসে আছেন। বিনয় বাবু গোপনে কিছু কথা বলতে চান। তিনি টিচার্স কমনরুমে অপেক্ষা করছেন। মাহবুব সাহেব ফজলুল করিম। সাহেবের সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁর কথা শেষ হলেই বিনয় বাবু ঢুকবেন।

মাহবুব সাহেব বললেন, স্যার বেতনের কি ব্যবস্থা?

ফজলুল করিম হাসিমুখে বললেন, হবে হবে।

কি ভাবে হবে?

সরকারি ডি এর জন্য আমি নিজেই ঢাকা যাব।

কবে যাবেন?

দুই একদিনের মধ্যে।

সরকারি ভি, এ টা না হয় হল। বাকি বেতনের কি করবেন?

বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে সাহায্যের জন্যে যাব। স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র …বাজার সমিতি গত বছরের টাকাটা দেয় নি …ওদের…

ওদের কথা ভুলে যান। ওরা কিছু দিবে না।

দিবে না কেন?

আর কত দিবে। দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। ওদের একটা প্রস্তাব আছে। স্কুলের কিছু জমি তারা কিনে নিতে রাজি আছে, এ থেকে কিছু টাকা পাওয়া যায়।

সেটা সম্ভব না। জীবন বাবুর দানপত্র করা জমি বিক্রি করা যাবে না।

তাহলে সমস্যার সমাধান কি?

আছে সমস্যার সমাধান অবশ্যই আছে।

সেটা কি বলুন।

স্কুলের ছাত্র বাড়বে, তাদের বেতন থেকে যে আয় হবে…

ছাত্র বাড়বে কিভাবে?

লোকে যখন জানবে এটা ভাল স্কুল তখন দূর দূর থেকে ছাত্ররা আসবে। হোস্টেলে থাকবে…

মাহবুব সাহেব হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, স্যার উঠি। হেডমাস্টার সাহেব তৎক্ষণাৎ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, জ্বি আচ্ছা জ্বি আচ্ছা।

দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি, ক্ষিধে জানান দিচ্ছে। বয়স হয়ে গেলে ক্ষিধের কষ্টই প্রবল হয়ে দাড়ায়। হরিপদকে পাঠিয়ে কোন খাবার টাবার আনলে হত। একটা কলা দুটা বিসর্কিট….

বিনয় বাবু বললেন, স্যার আসব?

আসুন বিনয় বাবু। আপনি এখনো যাননি?

আজ্ঞে না। আপনার সঙ্গে সামান্য কথা ছিল।

বলুন।

বিনয় বাবু বসতে বসতে বললেন, আমার সংসারের অবস্থার কথা তো স্যার আপনি জানেন, অভাবে অনটনে পর্যন্ত হয়েছি। ঘরে বিবাহযোগ্যা কন্যা। বিবাহ দিতে পারছি না। পণ ছাড়া হিন্দু মেয়ের বিয়ে হয় না। এক লাখ দুলাখ টাকা পণ চায়। কোথায় পাব এত টাকা?

জ্বি তা তো ঠিকই। বড়ই দুঃসময়। সবার জন্যই দুঃসময়। তবে পৃথিবীর সব দুঃসময়ই সাময়িক। শীতের পরে বসন্ত আসে এটা জাগতিক নিয়ম।

জাগতিক নিয়ম সবার জন্য না স্যার। আমার বেলায় শীতের পর শীত আসে, তার পর আসে আরো শীত। স্যার আমি জানি আপনি মনে কষ্ট পাবেন কিন্তু না বলে পারছি না …

বলুন কি ব্যাপার?

বিনয় বাবু কিছু বললেন না। পাঞ্জাবীর কোণায় চোখ মুছতে লাগলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আপনি কি নীলগঞ্জ স্কুলে যোগ দিয়েছেন?

বিনয় বাবু হা সূচক মাথা নাড়লেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আপনাকে ছাড়া আমি স্কুল চালাব কিভাবে? আপনার মত অংকের শিক্ষক আমি কোথায় পাব?

নতুন শিক্ষক যিনি এসেছেন, মামুন সাহেব তিনি ভাল অংক জানেন। শুধু ভাল না। খুব ভাল। আমি ক্লাশ টেনের ছাত্রদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়েছি।

ও আচ্ছা।

কারো জনোই কিছু আটকে থাকে না স্যার। আমি যা করেছি না পেরে করেছি। এই অপরাধের জন্যে নরকে আমার স্থান হবে। তা হোক, শুধু আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ঈশ্বরের ক্ষমা চাই না। আপনার ক্ষমা চাই।

আপনি চলে গেলে আরো অনেকেই যাবে।

তা যাবে।

স্কুলটা কি উঠে যাবে?

না উঠবে না। আপনার মত মানুষ থাকলে স্কুল উঠবে না। স্যার উঠি।

বিনয় বাবু হঠাৎ নিচু হয়ে ফজলুল করিম সাহেবকে প্রণাম করতে গেলেন। ফজলুল করিম সাহেব আঁৎকে উঠে বললেন, করেন কি, করেন কি, বয়সে আপনি আমার বড়ই হবেন।

বিনয় বাবু ধরা গলায় বললেন, আমি তো স্যার আপনাকে প্রণাম করছি। আপনার ভেতর যিনি বাস করছেন আঁকে প্রণাম করছি। তিনি নমস্য।

 

সরকারি চিঠি আজকের ডাকেও আসেনি। ফজলুল করিম সাহেব তাঁর বড় মেয়ের একটি চিঠি পেলেন। মেয়ের চিঠিটা একটু যেন রহস্যময়। মেয়ে লিখেছে–

বাবা,

আমি প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি বলে তোমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতে পারি না। তবে তোমার খোঁজ খবর সব সময় রাখি। সম্প্রতি তোমার বিষয়ে কিছু অস্বস্তিকর খবর পেয়ে অত্যন্ত বিব্রত আছি। আশা করি আমি কি বলছি তুমি বুঝতে পারছ। তোমার সামাজিক মান মর্যাদার দিকে তুমি লক্ষ্য রাখবে এটা আশা করা অন্যায় না। নিঃসঙ্গ মানুষ নিজের নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্যে মাঝে মাঝে উদ্ভট সব কান্ড করে। তোমার এই বয়সে, তুমি এমন কিছু করবে না–এটুক আশা তোমার মেয়ে হিসেবে আমি অবশ্যই করতে পারি।

ফজলুল করিম সাহেব মেয়ের চিঠি কয়েকবার পড়লেন কিন্তু চিঠির মূল বিষয় ধরতে পারলেন না।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মওলানা ইরতাজউদ্দিন বারান্দায় আজান দিয়ে নামাজ পড়ছেন। হেড মাস্টার সাহেব তার ঘরে একা একা বসে আছেন। মওলানার নামাজ শেষ হলে এক সঙ্গে বেরুবেন।

দপ্তরী এসে ঢুকল। করিম সাহেব বললেন, কিছু বলবি? হরিপদ মাথা চুলকে বলল, নতুন মাস্টার সাব লাইব্রেরি ঘরের বেবাক বই নামাইয়া একটা বিষয় করতাছে।

কি করছেন?

এই ঘাটাঘাটি।

করুক। বই সাজিয়ে রাখার জন্যে না। পড়ার জন্য। ঘাটাঘাটি করার জন্য। বুঝলি?

জ্বি স্যার।

এর মধ্যেই খবর হয়ে গেছে। মামুন সাহেব অতি ভাল শিক্ষক। একজন ভাল শিক্ষক ১০০ হাতীর সমান।

ফজলুল করিম সাহেবের বিষণ্ণ ভাবটা কেটে যাচ্ছে। নতুন শিক্ষক স্কুলের লাইব্রেরীর বই ঘাটাঘাটি করছেন। খুবই ভাল লক্ষণ। স্কুল লাইব্রেরীর দায়িত্ব তাকে দিয়ে দেয়া যায়।

বিনয় বাবুর জন্য মনটা খারাপ লাগছে। অতি সজ্জন। অংকের জাহাজ। যে কোন অংক মুখে মুখে করে ফেলতে পারেন। এ রকম শিক্ষক যে কোন স্কুলের জন্যে স্তম্ভের মত।

মাহবুব সাহেবের বাড়িতে

মাহবুব সাহেবের বাড়িতে আজ মামুনের রাতের খাবার দাওয়াত। মাহবুব সাহেব বলে দিয়েছেন, সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় চলে আসবেন গল্পগুজব করব। বাড়িতে টিভি আছে ব্যাটারীতে চলে। আজ আবার নাটক আছে। মজা করে নাটক দেখবেন।

মামুন বলল, আমি যথাসময়ে উপস্থিত হব। তবে নাটক দেখব না।

টিভির নাটকগুলিতো অতি উত্তম। দেখবেন না কেন?

ভাল লাগে না।

ভাল না লাগলে দেখবেন না। আমরা বারান্দায় বসে গল্প করব। একবার সাপের হাতে জীবন যেতে বসেছিল গল্পটা আপনাকে বলা হয় নাই। বিষধর সর্প।

জ্বি আচ্ছা আপনার বিষধর সর্পের গল্পও শুনব। দাওয়াত কি আমি একা যায়? ইরতাজউদ্দিন সাহেব যাবেন না? দুজন এক সঙ্গে থাকি এর মধ্যে আমি একা দাওয়াত খেতে যাওয়া ব্যাপারটা খারাপ দেখায় না?

আসুন উনাকেও নিয়ে আসুন। অসুবিধা কিছু নাই। খাওয়া দাওয়াতো কোন ব্যাপার না–গল্প গুজব করা।

ইরতাজউদ্দিন সাহেব আসতে রাজি হলেন না। মামুন একাই উপস্থিত হল। মাহবুব সাহেবের বাড়িটা সুন্দর। অনেকখানি জায়গা নিয়ে হাফ বিল্ডিং। উপরে টিনের ছুদি। বাড়ির সামনে দেশী গাছ গাছড়ার বাগান। মামুন মুগ্ধ হয়ে বলল, এটা দেখি ইন্দ্রপুরীর বাগান।

মাহবুব সাহেব নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, কোন মতে বেঁচে থাকা। বাড়ির পেছনে পুকুর আছে। পুকুরটা সুন্দর। গত বছর ঘাট বাধিয়ে দিয়েছি। দেখাব আপনাকে। বর্শি বাওয়ার অভ্যাস আছে?

জ্বি-না?

অভ্যাস থাকলে বর্শি বাইতে বলতাম। দুবছর আগে রুই মাছের পোনা ছেড়ে ছিলাম বড় হয়েছে।

আপনিতো রাজার হালে আছেন মনে হয়।

আর রাজার হাল। পল্লীগ্রামে পড়ে আছি। নানা সমস্যা।

কি সমস্যা?

পল্লীগ্রামের সমস্যা একটা থাকে না। পল্লীগ্রামের সমস্যা থাকে এক হাজার একটা। স্কুল উঠে যাচ্ছে–এতদিনের পুরনো স্কুল। দীর্ঘদিন থেকে যুক্ত স্কুলের সঙ্গে এটাওতো বড় সমস্যা।

স্কুল উঠে যাচ্ছে না-কি?

জি। আপনি নতুন জয়েন করেছেন। আপনাকে বলা ঠিক না। তবে এইসবতো গোপন রাখার জিনিস না। আজ হোক, কাল হোক আপনি জানবেন।

স্কুল উঠে যাচ্ছে কেন?

নানান কারণ আছে। হেড মাস্টার সাহেবও একটা কারণ। স্কুলের হেড মাস্টার হল নৌকার কান্ডারীর মত। নৌকার কান্ডারি যদি ঠিক না থাকে তাহলে নৌকাতো ভুববেই।

হেড মাস্টার সাহেবের সমস্যাটা কি?

হুজুগে লোক আর কি? হুজুগে কি আর স্কুল টিকে? তাছাড়া বয়স হয়েছে। বয়স হলে ভীমরতি হয় বলে প্রবাদ আছে, উনারও তাই হয়েছে।

ভীমরতি হয়েছে বলতে চাচ্ছেন?

অনেকটা সে রকমই। উনার সম্পর্কে অনেক কেলেংকারী ধরণের কথা চালু আছে–সে সব কথা ঠিক হবে না। বাড়ির দাসির সঙ্গে সম্পর্ক।

বুঝলাম না কি বলতে চাচ্ছেন শারীরিক সম্পর্ক?

লোকে তো তাই বলে। একজন স্কুলের হেড মাস্টারের সম্পর্কে যদি এই জাতীয় গুজব চালু থাকে তাহলে কি আর স্কুল টিকে?

আপনারা উনাকে সরিয়ে নতুন কাউকে নিয়ে আসেন না কেন? আপনি নিজেওতো হেড মাস্টারের দায়িত্ব নিতে পারেন। আপনার সম্পর্কে নিশ্চয়ই

এই জাতীয় কোন জব নেই?

আরে ছিঃ ছিঃ কি বলেন?

স্কুল টিকিয়ে রাখতো অনেক জরুরী।

নতুন একটা স্কুল চালু হয়েছে। এইটাই আশার কথা। ভাল স্কুল। ষ্টাফ ভাল। আমাদের স্কুলের কিছু একসেলেন্ট ষ্টাফ ঐ স্কুলে চলে গেছেন। ভাল বেতন। ষ্টাফ কোয়ার্টার! কেন যাবে না বলুন।

আপনি যাচ্ছেন না?

আমাকে হেড মাষ্টারের দায়িত্ব নিতে বলছে।

নিচ্ছেন না কেন?

এতদিনের পুরনো একটা স্কুল। বললেইতো ছাড়া যায় না।

মায়ার কারণে এখনো লেগে আছেন?

তা বলতে পারেন। আপনার ক্ষিধে হলে বলবেন, খাওয়া গরম করতে বলব। আমি আবার ঠাণ্ডা কিছু খেতে পারি না।

আমি ঠাণ্ডা গরম সবই খেতে পারি। আপনার যখন ক্ষিধে হবে খাবার দিতে বলবেন।

মাছ ভাতের ব্যবস্থা করেছি। শহুরে মানুষ। মাছ ভাতটাই বেশী পছন্দ করে। গো মাংসের সন্ধান করেছিলাম। পাইনি। আমার স্ত্রী আবার গো মাংসের খুব ভাল পাক করেন। একদিন খাওয়াব আপনাকে। ছোট ছেলের এখনো আকীকা হয়নি। ভাবছি তার আকীকায় একটা গরু কোরবানী দেব।

বাংলাদেশে আপনিই সম্ভবত সবচে ধনবান এসিসটেন্ট হেডমাস্টার।

এই কথায় মাহবুব সাহেব আনন্দিত হলেন। আনন্দ তার চোখে মুখে ফুটে উঠল। মামুন বলল, আপনার মত এমন ক্ষমতাবান লোক থাকতে স্কুলটা জলে ভেসে যাবে এটা কেমন কথা-…..

হেড মাস্টার সাহেবের সন্যেই কিছু করা গেল না।

উনাকে বিদেয় করে দিন। স্কুল ইম্পর্টেন্ট। হেড মাস্টারতো ইম্পর্টেন্ট না।

বিদায় করে দিতে বললেইতো করা যায় না।

যায় না কেন? চরিত্রহীন একজন মানুষ……।

আসুন খেতে আসুন। খেতে খেতে গল্প করি। সাপের গল্পটা আপনাকে বলা হয় নাই…..।

খাবার আয়োজন প্রচুর। রুই মাছের ভাজা, বড় বড় পাবদা মাছের ঝোল, টাকি মাছের ভর্তা, সরপুটি। মাছ ভাতের কথা বলা হলেও বড় জামবাটি ভর্তি মুরগীর মাংসও দেখা যাচ্ছে। মামুন বিস্মিত হয়ে বলল, করেছেন কি আপনি?

সামান্য আয়োজন। পোলাও করার ইচ্ছা ছিল, পরে ভাবলাম মাছ দিয়ে পোলাও ভাল লাগবে না। রান্না কেমন হয়েছে কে জানে আমার স্ত্রীর অবশ্যি রান্নার সুনাম আছে।

রান্না অসাধারণ হয়েছে। আমি কোনদিন এত পদ নিয়ে খেতে বসেছি বলে মনে পড়ে না।

খান আরাম করে খান। কেউ তৃপ্তি করে খাচ্ছে দেখতেও ভাল লাগে। ঘরে পাতা টক দৈ আছে। খাওয়ার শেষে এক বাটি টক দৈ খাবেন দেখবেন সব হজম।

খাওয়ার সময় মাহবুব সাহেব অনবরত কথা বলে গেলেন। সাপের গল্প হল, জীনের গল্প হল। তাহাজ্জুদের নামাজ একা পড়তে গিয়েছেন নামাজ শেষ করে সালাম ফিরাতে গিয়ে দেখেন ডান দিকে লম্বা একজন নামাজ পড়ছে। মাথা দে ঠেকে গেছে পরনে সফেদ ড্রেস……..

খাবার পরও অনেকক্ষণ গল্প হল। সব গল্পই স্কুল নিয়ে! হেডমাস্টার সাহেব স্কুলের কি কি ক্ষতি করেছেন মাহবুব সাহেব তার বিষদ বর্ণনা দিলেন। উঠতে উঠতে রাত দশটা বেজে গেল। মামুন বলল, আজ উঠি? যাবার সময় হেড মাস্টার সাহেব সম্পর্কে একটা ভাল কিছু বলুনতো শুনে যাই। একটা কিছু ভাল গুণতো মানুষটার আছে। আছে না?

তা আছে, নীতিবান। তবে নীতিতে স্কুলের ক্ষতিই হয়েছে। লাভ কিছু হয়নি।

সেটা কি রকম।

ফুড ফর ওয়ার্ক প্রোগ্রাম স্কুল একবার ১০০ বস্তা গম পেল। এটাই শুধু সমস্যা দুশ বস্তা গম পেয়েছি লিখে দিয়ে একশ বস্তা গম নিতে হবে। হেড সাহেব নিলেন না। তাঁর একটা কথা স্কুল নীতি শিক্ষার জায়গা। দুর্নীতি দিয়ে স্কুলের উন্নতির দরকার নেই। নীতি নীতি করে উনার স্কুলের লাভটা কি হল?

তাতো বটেই।

যে যুগের সে বাতাস, সেই বাতাসে নৌকা চালাতে হবে না?

মামুন বলল ইঞ্জিনের নৌকা হলে অবশ্যি বাতাসের ধার ধারতে হয় না। নীতিবান মানুষ হল ইঞ্জিনের নৌকা।

ইঞ্জিন ঠিকই আছে। তেল নেই, ইঞ্জিন চলে না। আপনি যুবক মানুষ। মনে উৎসাহ আছে, চার মাস যখন বেতন পাবেন না তখন আর উৎসাহ থাকবে না।

না থাকারই কথা।

যাই হোক, আছেন যখন নিজের চোখে সব দেখবেন। সরকারী ডি এ আছে বলে কিছু শিক্ষক এখনো আছেন। ডি এ যখন থাকবে না তখন কি হবে?

ডি এ থাকবে না?

থাকবে কি জন্যে ছাত্র নেই স্কুলের আবার ডি এ কি?

ছাত্র কিছুতো আছে।

এও থাকবে না। দেখবেন ফাঁকা স্কুল ঘরে হেড মাস্টার সাহেব বসে থাকবেন। মাছি টাছি মারবেন।

কিছু করার উপায় নেই?

ধ্বস নামলে কিছু করার থাকে না। ধ্বস নেমে গেছে। আপনি বাইরে থেকে এসেছেন। কিছু বুঝতে পারছেন না। গত মাসের বেতন পেয়েছেন?

জি-না।

কোত্থেকে পাবেন? একটা ফুটা পয়সা স্কুলের নাই। হা হা হা।

মামুন বিস্মিত হয়ে বলল, আপনি এত আনন্দিত কেন? আপনিওতো স্কুলের একজন।

মাহবুব সাহেব শুকনো গলায় বললেন, হেসে ফেলেছি দেখে ভেবেছেন আনন্দিত। আসলে তা না, মনের দুঃখে হেসেছি। এক সময় এই স্কুলের কি রমরমা ছিল আর আজ কি অবস্থা। আফসোস। বিরাট আফসোস।

অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার

অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলে আজ শিক্ষকদের বেতন হচ্ছে। তাও ভাঙ্গা বেতন না। পুরো বেতন। পুরো ব্যাপারটা শিক্ষকদের কাছে অপ্রত্যাশিত। বেতন হবে, এই সম্পর্কে হেড স্যার আগে কিছু বলেন নি। কোন আদায় পত্রও হয়নি। টাকাটা পাওয়া গেল কোথায়? কেউ এ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করছে না। বেতন হচ্ছে এটাই বড় কথা। কোত্থেকে হচ্ছে, কি ভাবে হচ্ছে সেটা বড় কথা না। জানতে না চাওয়াই ভাল। শিক্ষকরা হেড সারের ঘরে ঢুকছেন, রেভিনিত্যু ষ্ট্যাম্পে সই করে বেতন নিচ্ছেন।

মাহবুব সাহেব বেতন নিতে এলেন শেষে। এসিসট্যান্ট হেড মাস্টার হিসেবে ভার একটা দায়িত্ব আছে। ফান্ড কোথায় পাওয়া গেল তার জানা দরকার। তিনি শুকনো মুখে বললেন, টাকাটা কোত্থেকে দেয়া হচ্ছে?

ইমার্জেন্সি ফান্ড থেকে দিচ্ছি।

স্কুল কমিটির অনুমতি ছাড়াতো স্যার আপনি ইমার্জেন্সি ফান্ড ভাঙতে পারেন না।

অনুমতি পরে নিয়ে নিব। শিক্ষকরা অনেকদিন থেকে কষ্ট করছেন। তিন মাস বেতন হচ্ছে না। তাদের ইমার্জেন্সিওতো ইমার্জেন্সি।

আমাদের তো স্যার আইন কানুন মানতে হবে।

ইমার্জেন্সির সময় কোন আইন কানুন থাকে না। সাধারণ সময়ের সাধারণ আইন। জরুরী সময়ের জরুরী আইন। মাহবুব সাহেব টাকা গুনে Fani

কাজটা স্যার ভুল করলেন।

মানুষ হয়ে জন্মেছি ভুল করব না তাতো হয় না। দশবার শুদ্ধ করব, একবার ভুল করব তবেই না আমি মানুষ। আজ আমি একটা মিটিং দিয়েছি মাহবুব সাহেব।

কিসের মিটিং?

স্কুল বিষয়ে আপনাদের সবার সঙ্গে কিছু কথা বলব। মুক্ত আলোচনা। আপনারও যদি বলার কিছু থাকে আপনিও বলবেন।

মিটিং হবে কখন?

পাঁচটার সময়।

চারটার দিকে করতে পারেন না? আমার পাঁচটার সময় এক জায়গায় যাবার কথা।

স্কুল পিরিয়ডে ছাত্রদের ক্ষতি করে তো আর মিটিং করতে পারি না। আপনার খুব জরুরী কোন কাজ থাকলে কাজে যাবেন। খুব জরুরী কিছু না থাকলে থাকুন, গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলব।

দেখি।

মাহবুব সাহেবের কাজটা তেমন জরুরী না। আজ নিমখালি বাজারে হাট বার। হাটে গরু-ছাগল উঠে। ছেলের আকীকার জন্যে একটা গরু কেনার কথা। ফজলুল করিম সাহেবের মিটিংয়ের চেয়ে ছেলের আকীকা অনেক জরুরী। দুদিন পর পর ছেলে অসুখে ভুগছে। শরীর হয়েছে পাট কাঠির মত। আকীকা করা থাকলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়। তাছাড়া হেড মাস্টার সাহেবের গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতায় আসলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু থাকবে না। স্কুল স্কুল বলে চেঁচিয়ে তো কিছু হবে না। তারপরেও মাহবুব সাহেব মিটিং এ থেকে যাওয়াই ঠিক করলেন। আরেক বুধবার পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। উপায় কি?

 

দপ্তরী হরিপদ বড় একটা ধামায় পেঁয়াজ কাঁচামরিচ দিয়ে মুড়ি মাখছে। কেতলীতে করে চা এসেছে। মুড়ি খাওয়ার পর চা দেয়া হবে। মুড়ি এবং চা দুটার টাকাই হেড মাস্টার সাহেব দিয়েছেন।

খবরের কাগজ বিছিয়ে মুড়ি টেলে দেয়া হয়েছে। মুড়ি চিবানোর কচাকচ শব্দের ভেতর ফজলুল করিম সাহেব ঢুকলেন। শিক্ষকরা উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গি করলেন তবে কেউ পুরোপুরি উঠলেন না।

ফজলুল করিম সাহেব হাসি মুখে বললেন, মুড়ি খাওয়ার কচ কচ শব্দ একটু কমুক তারপর কথা বলি।

মাহবুব সাহেব বললেন, যা বলার এর মধ্যেই বলুন। কথা শুনতেতো অসুবিধা হচ্ছে না। সবারই তাড়া আছে।

করিম সাহেবের জন্যে পিরিচে করে মুড়ি এবং একটা চামুচ এসেছে। তিনি মুড়ির দিকে তাকালেন মুড়ি মুখে নিলেন না।

নীচু গলায় কথা বলা শুরু করলেন। একটা দুঃসময়ের ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি। নতুন করে বলার কিছু না সবাই তো জানেন। আমি যা বলতে চাচ্ছি তা হচ্ছে দুঃসময়টা সাময়িক।

মাহবুব সাহেব বললেন, দুঃসময় সাময়িক মনে হবার কারণ কি?

তেমন কোন কারণ অবশ্যি দেখছি না, তবু মনের ভেতর থেকে কে যেন বলছে দুঃসময় থাকবে না।

নতুন সায়েন্স টিচার হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন, উইথফুল থিংকিং নাতো স্যার!

হতে পারে, উইথফুল থিংকিং হতে পারে। দেখি এক কাপ চা খাওয়া যাক।

হরিপদ চায়ের কাপ এনে সামনে রাখল। করিম সাহেব মামুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, সিগারেট খেতে ইচ্ছা হচ্ছে আপনার কাছে কি আছে?

মামুন সিগারেট বের করে দিল। করিম সাহেব সিগারেট টান দিয়ে কাশতে লাগলেন। কাশি থামিয়ে সহজ গলায় বললেন, মামুন সাহেব আমি যা বলছি তা ঠিক উইথফুল থিংকিংও না। কিছু যুক্তি আছে। এত দিনের পুরনো একটা স্কুলতো জলে ভেসে যেতে পারে না।

এটাতো স্যার কোন যুক্তি হল না।

তা অবশ্যি হল না।

মাহবুব সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, এটা বলার জন্যেই কি মিটিং ডেকেছেন?

না, আসল কথা বলা হয়নি আসল কথা হচ্ছে–এস, এস, সি পরীক্ষার আর আছে মাত্র তিন মাস। এই তিনমাস আমাদের প্রাণপন খাটতে হবে। এবারে তিনজন খুব ভাল ছেলে আছে। এর মধ্যে একজন তো অসম্ভব। ভাল–বদরুল আলম। এদের ঠিক ঠাক মত কোচিং করতে হবে। অসাধারণ একটা রেজাল্ট ওদের দিয়ে করাতে হবে। স্কুলের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনার একটা সুযোগ এসেছে। সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। এদের কোচিং এর বিষয়ে আপনাদের কোন মতামত আছে?

কেউ কোন জবাব দিল না। কোচিং এর বিষয়ে নতুন তো কিছু বলার নেই। আগে যেমন হয়েছে এবারও তেমন হবে।

করিম সাহেব বললেন, আমি চিন্তা করছি দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা এই ছেলেদের মনিটার করলে কেমন হয়। ইরতাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হয়েছে। আপনাদের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। আমি যা ভাবছি তা হচ্ছে না…

পরীক্ষার্থী যারা সবাই একসঙ্গে থাকবে। একসঙ্গে পড়বে। এতে একটা টিম স্পিরিট তৈরী হবে। দায়িত্ব শিক্ষকদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া হবে। যেমন ভোর ছটা থেকে দুপুর বারটা পর্যন্ত একজন শিক্ষক। দুপুর বারটা থেকে সন্ধ্যা ছটা পর্যন্ত একজন এ রকম। প্রতিট বিষয়ের জন্যে আলাদা আলাদা ক্লাস হবে। আইডিয়াটা আপনাদের কাছে কেমন লাগছে।

এবারো কোন জবাব পাওয়া গেল না। করিম সাহেব উৎসাহের সঙ্গে বললেন, এটা যে পুরোপুরি আমার মৌলিক আইডিয়া তাও না। তিব্বতে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের এইভাবে বড় বড় পরীক্ষার জন্যে তৈরী করা হয়।

মাহবুব সাহেব বললেন, এটাতো স্যার তিব্বত না।

আমি জানি এটা তিব্বত না। আমার কথা হল, তিব্বত যদি এই নিয়মে কাজ করে আমাদের দেশেও করবে। একটা বড় কিছুর জন্যে সবাইকে এক সঙ্গে তৈরী করা। একটা টিম স্পিরিট সবার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া। যদি আমাদের এই গ্রামের দরিদ্র স্কুল অসাধারণ একটা রেজাল্ট করে তার ফল হবে সুদূর প্রসারী। স্কুল তখন টিকে যাবে। দূর দূর থেকে ছাত্ররা আমাদের এই স্কুলে পড়তে আসবে। সরকারী সাহায্য আসবে। দানশীল মানুষেরা এগিয়ে আসবেন।

মাহবুব সাহেব বললেন, আপনার কথা শুনতে ভাল লাগছে। কিন্তু যে আইডিয়া শুনতে যত ভাল সেই আইডিয়ার মূল্য ততকম। তিনমাস পড়িয়ে ছেলেদের ফার্স্ট সেকেন্ড বানাবেন তা হয় না।

হবে না এটা আগে থেকে ধরে নেয়াটা কি ঠিক? চেষ্টাতো করা যেতে পারে।

এতগুলি ছেলে একসঙ্গে থাকবে কোথায় থাকবে। এরা খাবে কি?

এইগুলি নিয়ে আলোচনা করার জন্যেইতো মিটিং। আপনারা বলুন কি ভাবে করা যায়?

চায়ের কাপে চুমুক দেয়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ হচ্ছে না। মাহবুব সাহেব উঠে দাঁড়াতে দাড়াতে বললেন, স্যার আমি তাহলে উঠি?

উঠবেন? কিছু বলবেন কি?

এখনি বলতে হবে? পরে বলি?

করিম সাহেব ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, আচ্ছা বলুন পরেই বলুন।

শেষ পর্যন্ত সরকারি চিঠি এসেছে

শেষ পর্যন্ত সরকারি চিঠি এসেছে। আগের চিঠির মেমো নাম্বার উল্লেখ করে সরকার জানাচ্ছে,

জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের ছাত্র সংখ্যা আশংকাজনকভাবে কমিয়া গিয়াছে। শিক্ষক সংখ্যাও অপ্রতুল। এই অবস্থায় সরকারী অনুদান কাজে আসিবে কি আসিবে না তাহা পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন। বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্যে ময়মনসিংহের ডেপুটি কমিশনারকে আহবায়ক করিয়া একটি কমিটি গঠন করা হইয়াছে। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটিকে আগামী তিন মাসের ভিতর স্কুল সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ বিপোর্ট দেবার জন্যে অনুরোধ করা যাইতেছে।

ফজলুল করিম সাহেব দীর্ঘ সময় চিঠিটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। সব চিঠিই তিনি কয়েকবার করে পড়েন। শুধু এই চিঠিটিই একবার পড়লেন। আগামীকাল থেকে গরমের ছুটি শুরু হবে। আজ শেষ ক্লাস। ছুটির আগের শেষ ক্লাসে ছাত্ররা সব আনন্দ করে। আজ কিছুই হচ্ছে না। সব কেমন মরা। মরা। ছাত্রই নেই প্রাণ আসবে কোত্থেকে, স্কুলের প্রাণ হচ্ছে তার ছাত্র। দালান কোঠা তো স্কুলের প্রাণ না।

মওলানা সাহেব সন্ধ্যাবেলা হেডমাস্টার সাহেবের ঘরে এসে বললেন, স্যার বাসায় যাবেন না?

আপনি চলে যান। আমি একটু পরে যাব।

আপনার কি শরীর খারাপ করেছে?

না। এমনিতেই ভাল লাগছে না।

মামুন সাহেবের একটা চাকরি হয়েছে শুনেছেন বোধহয়।

না শুনিনি–কোথায় চাকরি হয়েছে?

সরকারী কলেজের লেকচারার। বরিশাল বিএম কলেজ। ইন্টারভ্যু দিয়ে এসেছিলেন। গতকাল চিঠি এসেছে।

উনার না এখানে নিরিবিলিতে থেকে বি সি এস পরীক্ষার জন্যে তৈরী হবার কথা। বি, সি,এস দিচ্ছেন না।

আমাকে বললেন–বি সি এস দেবেন না। মাষ্টারী করবেন। খুব খুশী।

খুশী হবারই কথা।

আপনাকে কিছু জানাননি?

প্রথমেই তো বলেছি জানায়নি। একই প্রশ্ন দুবার তিনবার করে কেন করেন।

ভুল হয়ে গেছে স্যার ক্ষমা করে দেবেন। ক্ষমা করলাম। আপনার কথা শেষ হয়ে থাকলে চলে যান। আমি নিরিবিলিতে কিছুক্ষণ বসে থাকব।

দুটা কথা বাকি আছে। বলেই চলে যাব। প্রথম কথাটা হল। এস,এস, সি ছাত্রদের কোচিং এর ব্যাপারে আপনি যা বলেছেন সেটা করা সম্ভব বলে আমার ধারণা। আমি মামুন সাহেবকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করেছি। শিক্ষকদের ডিউটি ভাগ করা হয়েছে। স্কুলের লাইব্রেরী ঘরে ছাত্ররা থাকবে।

এতগুলি ছাত্র লাইব্রেরী ঘরে থাকবে কি ভাবে?

সব ছাত্র না–আমরা ৫ জন বেছে নিব। প্রথম পাঁচ জন।

সেটা হবে না। একজনের জন্যে যে ব্যবস্থা বাকিদের জন্যেও একই ব্যবস্থা।

মামুন সাহেব বলেছিলেন যে আপনি পাঁচজনের ব্যাপারে রাজি হবেন। সবাইকে নিয়ে একটা পরিকল্পনা করা হয়েছে। সেখানে একটা ক্লাস ঘর খালি করে দিতে হবে। মামুন সাহেব পুরো ব্যাপার দেখবেন।

কলেজের চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছেন–তাহলে দেখবেন কি ভাবে?

এস. এস. সি পরীক্ষা পর্যন্ত উনি থাকবেন। পরীক্ষার পর কলেজে জয়েন করবেন। আমার সঙ্গে সে রকম কধ্যা হয়েছে।

ও আচ্ছা।

খুব কর্মী ছেলে। একাই একশ। উনি থাকলে আর কিছু লাগবে।

উনি নিজে থেকে রাজি হয়েছেন না আপনি বলে কয়ে ঠিক করেছেন?

নিজ থেকে রাজি হয়েছেন। আমাকে কিছু বলতে হয়নি। কলেজের এপয়েনমেন্ট লেটার পেয়ে খানিকক্ষণ খুশীতে খুব লাফালাফি করলেন তারপর আমাকে বললেন–মওলানা সাহেব, আমাদের হেডমাষ্টার সাহেব স্কুলটা নিয়ে একা একা যুদ্ধ করছেন। যুদ্ধে প্রায় পরাজিত। আমি একজন ভাল সৈনিক। এই সময়ে আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব তা হয় না। এস, এস, সি পরীক্ষা পর্যন্ত দেখে যাবেন। তার যতটুকু সাধ্য করবেন।

ভাল।

আমার স্যার আরেকটা কথা বাকি, ঐটা শেষ করে চলে যাব।

বলুন।

একটা ভাল ছেলে পাওয়া গেছে স্যার।

ভাল ছেলে পাওয়া গেছে মানে কি? যা বলার গুছিয়ে বলুন।

রেশমীর জন্যে একটা ছেলে পেয়েছি। দোকানে কাজ করে।

ও আচ্ছা।

ছেলেটিকে খবর দিয়ে এনেছি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আপনি তার সঙ্গে কথা বলবেন?

না।

অন্য কোন সময় আসতে বলব?

মওলানা ইতস্তত করে বললেন, নানান ধরনের কথা হচ্ছে। নানান রটনা।

কি রটনা?

এইসব কথা মুখ ফুটে আপনাকে বলা সম্ভব না।

বলা সম্ভব না হলে বলবেন না।

জ্বি আচ্ছা।

মওলানা সাহেব এই সমস্যা নিয়ে আপনাকে আর মাথা ঘামাতে হবে। স্কুলের সমস্যা নিয়ে ভাবুন।

জ্বি আচ্ছা।

যাবার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাবেন।

মওলানা সাহেব দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের হেডমাষ্টার ফজলুল করিম সাহেবের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি মুছলেন না। কারণ চোখে যে পানি এসেছে তা তিনি নিজে বুঝতে পারেন নি।

ফজলুল করিম সাহেব

ফজলুল করিম সাহেব তেমন কিছু খাচ্ছেন না। প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করছেন। প্লেটে ডাল নিতে গিয়েও নিলেন না। অথচ সজনে দিয়ে ব্রাধা ডাল তার অতি প্রিয়। রেশমী বলল, আপনার কি হইছে?

কিছু হয় নাই। আমার ক্ষিধা একেবারেই নাই।

দুপুরে স্কুলে কি খাইছেন?

দুপুরে কিছু খাইনি। এই জন্যেই মনে হয় পিত্ত পড়ে গেছে। কিছু খেতে ভাল লাগছে না।

জ্বর জ্বারি হয় নাই তো?

রেশমী ফজলুল করিম সাহেবের কপালে হাত রাখল। ফজলুল করিম সাহেবের মনে হল উত্তাপ দেখতে যতটুকু সময় লাগে রেশমী যেন তার চেয়ে বেশি সময় হাত কপালে রাখল।

আপনি কি কিছু নিয়া চিন্তিত? উঁহুঁ।

নতুন স্কুলে না-কি আপনার স্কুলের সব ছাত্র চইল্যা যাইতেছে। তা যাচ্ছে।

রেশমী হাসি মুখে বলল, খালি স্কুল নিয়ে আপনি বইস্যা আছেন। দোকান আছে, দোকানদার আছে সওদা নাই।

হাসি তামশা কিছু হয়নি রেশমী। হসিবে না।

মনের ভুলে হাসছি। পান দাও রেশমী, পান খাব।

রেশমী পান এনে দিল। ফজলুল করিম সাহেব পান মুখে দিতে দিতে বললেন, খালি স্কুল আবার পূর্ণ হবে।

ক্যামনে হবে? এবার এসএসসির রেজাল্ট হলেই দেখবে ছাত্র ছাত্রীরা আবার আসতে শুরু করেছে।

কেন?

ষ্টান্ড করবে। অবশ্যই করবে। গ্রামের স্কুল থেকে স্ট্যান্ড করলে সবার নজর পড়বে স্কুলের দিকে। আমাদের কয়েকজন ভাল ছাত্র এইবার আছে। এর মধ্যে একজন আছে–খুবই ভাল। শুধু হাতের লেখাটা খারাপ। লেখাটা যদি একটু ভাল হত।

ছাত্রটা কে বদরুল আলম

ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন,তুমি জান কিভাবে? রেশমী হাসিমুখে বলল, আপনার স্কুলে কি হইতেছে না হইতেছে আমি জানব না?

অবশ্যই জানবে। কেন জানবে না?

আপনে স্কুল নিয়া অত চিন্তা কইরেন না। অত চিন্তার কি আছে?

চিন্তা করব না কি বল তুমি। স্কুল যদি উঠে যায়?

উঠে গেলে কি আর করণ। দুনিয়ায় কিছু টিক্যা থাকে না।

ফজলুল করিম সাহেব তাকিয়ে রইলেন। রেশমী বলল, একটা স্কুল চইল্যা গেলে চইল্যা যাবে। আরেকটা নয়া স্কুল হইছে। আফনে আমার একটা কথা হুনবেন?

কি কথা?

আফনে গিয়া নীলগঞ্জ ইস্কুলের হেডমাস্টার হন।

নতুন স্কুলের হেডমাস্টার হব?

হুঁ। আপনের ছাত্র পড়ানি দিয়া কথা। কোন ইস্কুল সেইটা দিয়া দরকার কি? তার উপরে এমন না যে এই ইস্কুল আফনে বানাইছেন।

ফজলুল করিম সাহেব আহত গলায় বললেন, এই নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করতে চাচ্ছি না। চুপ কর। যা জান না তা নিয়ে তর্ক করাও ঠিক TI

রেশমী আহত গলায় বলল, আমি হইলাম দাসী বান্দি–আমার জানা অজানার দাম কি?

সে তার ঘরে দরজা জানালা বন্ধ করে বসে রইল। রাতে ভাত খেল না। ফজলুল করিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, আজকাল তোমার হয়েছে কি বল

তো দেখি–কথায় কথায় রাগ।

রেশমী জবাব দিল না।

এরকম করলে কিন্তু আমি চলে যাব। স্কুল ঘরে রাত কাটাব। সেটা ভাল হবে

রেশমী দরজা খুলে বের হয়ে এল। সে কাঁদছিল। তার গাল ভেজা। ভেজা গাল সে মুছল না। ভেজা গালেই খেতে বসল। ফজলুল করিম সাহেব মোড়া টেনে তার পাশে বসলেন। রেশমী বলল, কেউ চাইয়া থাকলে আমি খাইতে পারি না। আপনে অন্য ঘরে গিয়ে বসেন। তিনি নড়লেন না। রেশমীর কোন কথা তিনি শুনতে পাচ্ছেন বলে মনে হল না। তিনি তাকিয়ে আছেন রেশমীর দিকে, কিন্তু ভাবছেন অন্য কথা। পাশ বই-এ তাঁর কিছু টাকা আছে। গ্রামের বসতবাড়ি-সম্পত্তি বিক্রি করে নগদ টাকা রেখে দিয়েছিলেন ভবিষ্যতের জন্যে। নব্বই হাজারের মত। সুদ টদ নিয়ে সেই টাকা এখন বেড়ে এক লাখ তিরিশ হাজার হয়েছে। এই টাকা ব্যবহার করা যেতে পারে। তার স্ত্রীর কিছু গয়না আছে। সামান্যই–গয়না এখন আর কি কাজে আসবে? সকাজ তো তেমন কিছু তিনি করেননি। সামান্য সৎকাজ করা হল।

স্কুলের কত ছাত্র দেশে বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের কাছে কোনমতে খবরটা পৌছাতে পারলেও তো কাজ হবে।

রেশমী বলল, কি ভাবেন?

না কিছু ভাবি না।

আপনে দিন রাইত ভাবেন। অত ভাইব্যা ফয়দা নাই। যা হওনের হইব।

ফজলুল করিম জবাব দিলেন না। যা হবার তা হবে ঠিকই–তবু চেষ্টা করে যেতে হবে।

বেতন দিতে না পারলে স্কুলের শিক্ষকরা থাকবেন না। শিক্ষক না থাকলে ছাত্র থাকবে না… আচ্ছা সিরাজ সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করলে কেমন হয়? তিনিও তো সাহায্যের কথা বলেছিলেন। তিনি যদি তার মার নামে স্কুল না দিয়ে কলেজ দিতেন তাহলে খুব ভাল হত। ছাত্ররা তার স্কুল থেকে পাশ করে পাশেই কলেজে ভর্তি হয়ে যেতে পারত।

চা খাইবেন? এটু চা বানাইয়া দেই?

দাও।

রেশমী চা বানাতে বানাতে বলল, চিন্তায় চিন্তায় আফনের চউক্ষের নিচে কালি জমছে। আফনের অত কি চিন্তা? এই ইস্কুল কি আফনের একলার ইস্কুল?

স্কুল সবার। কিন্তু আমি হচ্ছি স্কুলের প্রধান।

 

বারান্দায় বসে ফজলুল করিম সাহেব চা খাচ্ছেন। একটু দূরে খুঁটিতে হেলান দিয়ে রেশমী বসে আছে। রেশমী হাসছে। অকারণেই খিলখিল করে হাসছে। হাসির কোন কথা তো হয়নি। মেয়েটা হাসছে কেন? ফজলুল করিম সাহেব বললেন, হাস কেন?

রেশমী মুখে আঁচল চাপা দিতে দিতে বলল, নিজেই জানি না ক্যান হাসি। আফনে যখন ঘরে থাকেন না তখন আরো বেশি হাসি। হি হি হি।

হাসি সামলাবার জন্যে রেশমী ঘরে ঢুকে গেল। চায়ের কাপ হাতে অস্বস্তি ও বিস্ময় নিয়ে ফজলুল করিম সাহেব বসে রইলেন। তাঁর ইচ্ছা করছে রাতে একবার স্কুলে যেতে! লাইব্রেরী ঘর খালি করে চারটা ছেলেকে রাখা হয়েছে। ওরা পড়াশোনা কেমন করছে না করছে দেখা দরকার। অবশ্যি শিক্ষকদের ডিউটি ভাগ করে দেয়া হয়েছে। মৌলানা ইরতাজউদ্দিন রাত এগারোটা পর্যন্ত থাকবেন। আবার ফজর ওয়াক্তে ফজরের নামাজের পর ছাত্রদের ঘুম থেকে ডেকে তুলবেন। খুব ভোরবেলা অংক করার জন্য সবচে ভাল সময়। বিনয় বাবু নীলগঞ্জ স্কুলে যোগ দিলেও ভোরবেলা এসে অংক করিয়ে দেন। অনেকদিন বিনয় বাবুর সঙ্গে দেখা হয় না। লজ্জায় পড়েই বোধ হয় বিনয় বাবু তাকে এড়িয়ে চলেন। নীলগঞ্জ স্কুলে গিয়ে একবার বিনয় বাবুর লজ্জা ভাঙ্গিয়ে দিয়ে আসতে হবে। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের সুদিন যদি আসে বিনয় বাবু ফিরেও আসতে পারেন। তার মত অংক জানা একজন লোক থাকা স্কুলের জন্যে বিরাট ব্যাপার।

রেশমী।

জ্বি।

একটু স্কুলে যাচ্ছি।

এই রাইতে?

দেখে আসি ছেলেগুলি কি করে। তাছাড়া রাতের খাবারের পর একটু হাঁটাহাটি করা শরীরের জন্যে ভাল। কথায় আছে আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল।

চলেন যাই।

ফজলুল করিম বললেন, তুমিও যাবে?

সুন্দর চান্নি পসর রাইত। হাঁটতে ইচ্ছা করতাছে।

ফজলুল করিম সাহেব চুপ করে রইলেন। রেশমী বলল, নয়া ইস্কুলে কি–কি দোলনা বসাইছে–দেইখ্যা আসি।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, দোলনা, সি সো স্লাইড এইসব বসিয়ে পার্কের মত করেছে। ছাত্ররা খেলাধুলা করে। আমরাও ইনশাআল্লাহ্ বসাব। তুমি কি সত্যি যাবে?

হুঁ।

চল তাহলে।

কাপড়টা বদলাইয়া একটা ভাল কাপড় পরি।

রেশমী স্কুল ঘরে ঢুকল না। স্কুলের বাইরে বকুল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল। ফজলুল করিম সাহেব একাই গেলেন। মওলানা ইরতাজউদ্দিন আছেন। বারান্দায় জায়নামাজ পেতে তসবি পড়ছেন। ছেলেরা হারিকেন জ্বালিয়ে পড়ছে। হরিপদও আছে। তার এখন দিন রাত্রি ডিউটি। রাতে বারান্দায় মশারি খাটিয়ে শুয়ে থাকে। ছাত্রদের কখন কি দরকার হয়। রাতে তার ভাল ঘুম হয় না। সে ভূতের ভয়ে অস্থির থাকে। লাইব্রেরী ঘরেই সে জীবন বাবুর ভুত দেখেছিল। ছাত্রদের সে এই ঘটনা বলেনি। বাচ্চা মানুষ শুধু শুধু ভয় পাবে, কি দরকার।

মওলানা জায়নামাজ থেকে উঠে এলেন। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, পড়াশোনা চলছে ঠিক মত?

জি চলছে। আপনার আসার দরকার ছিল না। অনেকটা পথ। এসেছেন কিভাবে? হেটে?

হুঁ। চাঁদনী আলোয় হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি। চলুন ছেলেদের দেখে আসি।

চলুন যাই, আপনাকে দেখলে ওরা উৎসাহ পাবে।

ছেলেরা হেড স্যারকে দেখে অভিভূত হয়ে গেল। মওলানা বললেন, তোমরা এমন পাথরের মুর্তির মত বসে আছ কেন? স্যারের পা ছুঁয়ে সালাম কর। দোয়া পাবে। দোয়াটা খুব দরকার। আল্লাহ্ পাক বলেছেন–আমি যাহাকে ইচ্ছা সম্পদ দেই। যাহাকে ইচ্ছা সম্মান কেড়ে নেই।

ছাত্ররা সালাম করতে এগিয়ে এল। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, বদরুল তোমার হাতের লেখার অবস্থাটা কি? কিছু উন্নতি হয়েছেঃ

বদরুল মাথা নিচু করে রাখল।

রোজ কুড়ি পাতা করে হাতের লেখা লেখার কথা, লিখছ তো?

জ্বি স্যার।

কই আজকে কি লিখলে দেখি।

বদরুল কাগজের তাড়া নিয়ে এল। হাতের লেখার তেমন উন্নতি হয়নি, তবে আগের চেয়ে পরিস্কার হয়েছে।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, এই স্কুল রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের উপর। তোমরা যদি অসাধারণ রেজাল্ট করে সবাইকে চমকে দিতে পার তাহলে আমরা টিকে যাব। পারবে না বাবারা?

কেউ জবাব দিল না। তারা হেড স্যারকে অসম্ভব ভয় পায়। হেড স্যারের সামনে কথা বলা তাদের পক্ষে সম্ভব না।

মওলানা হেড স্যারকে এগিয়ে দিতে আসছেন। বকুল গাছের কাছে এসে চমকে উঠে বললেন, এ কে?

রেশমী চট করে আড়ালে সরে গেল। ফজলুল করিম সাহেব বললেন–ও রেশমী। আমার সঙ্গে এসেছে। চাদনি পসর রাত দেখে তার হাঁটার শখ হয়েছে।

মওলানা গম্ভীর গলায় বললেন, ও আচ্ছা।

নতুন স্কুলটাও দেখতে চেয়েছিল। দেখায়ে এনেছি।

ভাল।

মওলানা তাদের জীবন বাবুর কাঠের পুল পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। সারা পথে কঠিন দৃষ্টিতে রেশমীর দিকে কয়েকবার তাকানো ছাড়া একটি কথাও বললেন না। ফজলুল করিম সাহেব অনর্গল কথা বলে গেলেন বুঝলেন মওলানা সাহেব, শিক্ষকদের বেতনের একটা ব্যবস্থা করেছি। অস্থায়ী ব্যবস্থা স্থায়ী কিছু চিন্তা করতে হবে। বাজারে যে জমি স্কুলের আছে সেখানে ঘর তুলে দিলে কেমন হয়? ভাড়া যা আসবে তাতে স্কুলের কিছু আয় হবে। কিছু জমি বিক্রির ব্যাপারও চিন্তা করা যেতে পারে। স্কুল কমিটির সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এতদিনের স্কুল বানের জলে ভেসে যেতে পারে না। কি বলেন! তবে সরকারী অনুদানটা চলে এলে অবস্থা অন্য রকম হয়ে যাবে কি বলেন?

মওলানা শুধু মাথা নাড়ালেন, কিছু বললেন না।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, আমার এখন পরিকল্পনা হল স্কুলের ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে পুরানো ছাত্রদের ঠিকানা বের করা। সাহায্য চেয়ে এদের সবার কাছে চিঠি যাবে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিব।

হুঁ।

আমি আশা হারাবার কিছু দেখছি না।

মওলানা ক্ষীণ গলায় বললেন, মাহবুব সাহেব নীলগঞ্জ স্কুলে এ্যাসিসটেন্ট হেড মাষ্টার হিসেবে জয়েন করেছেন, শুনেছেন বোধ হয়।

ফজলুল করিম সাহেব অবাক হয়ে বললেন, শুনিনি তো।

আজই জয়েন করেছেন।

একটা স্কুল থেকে রিজাইন না করে অন্য স্কুলে জয়েন করবেন কিভাবে?

রিজাইন করেছেন। আমার কাছে রেজিগনেশন লেটার দিয়ে গেছেন।

উনি চলে যাবেন ভাবিনি!

উনার দেখাদেখি আরো অনেকেই যাবে। কে জানে হয়ত আমিও যাব। শুধু আপনি একাই থাকবেন।

রেশমী হাসছে। প্রথমে চাপা হাসি। তারপর মুখে আঁচল মুখে খিলখিল হাসি। ফজলুল করিম সাহেব মেয়েটির হঠাৎ হঠাৎ হাসির কারণ ধরতে পারছেন না। এটা কি হাসির সময়? ভার তীব্র মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। হঠাৎ করে মাথা ব্যথা শুরু হয়েছে। প্রেসার কি বেড়ে গেল?

স্যার, আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানবেন

স্যার,

আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানবেন। অনেকদিন পর আপনাকে লিখছি। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজীটা প্রথমে বলে নেই–Croak স্কুলে থাকার সময়ই ডিকশনারী ঘেঁটে ইংরেজীটা খুঁজে পেয়েছিলাম আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কিছু কিছু মানুষের জরুরী কথা ভুলে যাবার প্রবণতা থাকে। আমার তো খুবই আছে। আমি আপনাদের ছেড়ে চলে এসেছি আসার আগে সবচে জরুরী কথাটা বলতেও ভুলে গেলাম। সেটা হচ্ছে মানুষ হিসেবে আপনার তুলনা নেই। প্রতিষ্ঠান কখনো বড় হয় না। প্রতিষ্ঠানের পেছনে মানুষরা বড় হয়। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল ধ্বংস হতে বসেছে তা আমাকে তেমন আলোড়িত করছে না, ধ্বংস প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়। ডাইনোসারের মত বিশাল প্রাণী লোপ পেয়েছে। কিন্তু স্কুল টিকিয়ে রাখার জন্যে আপনি যে একক যুদ্ধ শুরু করেছেন তা আমাকে অভিভুত করেছে।

মানুষ কঠিন পরিশ্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভারেস্টের চুঁড়ায় উঠতে যায়। ব্যাপারটা সব সময় আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। আপনাকে দেখার পর আর মনে হচ্ছে না। আপনাকে দেখার পর মনে হচ্ছে সব মানুষকেই তার ব্যক্তিগত এভারেষ্টের চূড়ায় উঠতে হয়। মানুষের এই হচ্ছে নিয়তি।

আপনার দুঃসময়ে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে এসেছি। তার জন্যে আমি ক্ষমা প্রার্থী। আমি নিতান্তই দরিদ্র একজন মানুষ। বেঁচে থাকার সংগ্রামে আমাকে নামতে হয়েছে। আপনাকে ছেড়ে চলে এসেছি তার জন্যে আমার লজ্জার সীমা নেই।

আপনার ছাত্রদের আমি মোটামুটি ভাবে তৈরী করে দিয়েছি। আমি আমার সাধ্যমত করেছি। শহরের স্কুলগুলির সঙ্গে তারা পারবে কি না বলতে পারছি না। তবুও আশা করছি। শুনেছি দুএকদিনের ভেতর রেজাল্ট হবে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি।

স্যার চলে আসার দিন আপনি আমাকে বিদায় দিতে ষ্টেশন পর্যন্ত এলেন। আমার খুব ইচ্ছা করছিল–পা ছুঁয়ে আপনাকে সালাম করি। কেন জানি পারলাম না–ট্রেন ছেড়ে দেবার পর দেখি আপনি চোখ মুছছেন। একজন মানুষের জীবনের সঞ্চয় খুব বেশী থাকে না। আপনার চোখের জল আমার জীবনের পরম সঞ্চয়ের একটি। আপনি ভাল থাকুন–এই শুভ কামনা। আমি দূর থেকে আপনার পা স্পর্শ করে সালাম করছি। সালাম গ্রহণ করবেন-এই আমার বিনীত অনুরোধ।

 

স্যার আসব?

ইরতাজউদ্দিন সাহেব দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছেন। ফজলুল করিম সাহেব চিঠিটা ভাজ করে কোটের পকেটে রাখতে বললেন, আসুন। এস. এস. সির রেজাল্ট কবে হবে শুনেছেন কিছু?

যে কোনোদিন হতে পারে।

রেডিওর খবরটা প্রতিদিন মন দিয়ে শুনবেন। আমার রেডিও নেই। রেজাল্ট কেমন হবে মনে করছেন?

মওলানা জবাব দিলেন না। সবচে আশা যার উপর ছিল সেই বদরুল শেষ পরীক্ষার দুদিন আগে জ্বরে পড়ে গেল। শেষ পরীক্ষা দিয়েছে ১০৩ জ্বর নিয়ে। পরীক্ষার হল থেকে বেরুবা মাত্র তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে।

ফজলুল করিম সাহেব বললেন, রেজাল্ট তেমন কিছু হবে বলে আপনি বোধহয় আশা করছেন না।

জি-না।

হতেও পারে। রেডিওর খবর রোজ শুনবেন।

জ্বি আচ্ছা শুনব।

জ্বর গায়ে পরীক্ষা দিলেও ভুল তো কিছু করেনি? তাই না?

মওলানা জবাব দিলেন না। ফজলুল করিম সাহেব সরকারি চিঠিটা এগিয়ে দিলেন। ইরতাজউদ্দিন সাহেব চিঠি শেষ করে হেডমাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখেন তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

মওলানা বললেন, মন শান্ত করুন। যা হয় সব আল্লাহপাকের হুকুমেই হয়। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, এই স্কুলের চারপাশে মিলিটারী আমাকে নেংটো করে ঘুরিয়েছে। সেও কি আল্লাহর হুকুমে?

অবশ্যই। পরম মঙ্গলময় কিভাবে কি করেন তা বোঝার সাধ্য আমাদের নেই। স্যার আপনি শান্ত হোন। চলুন আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি। চলুন।

ফজলুল করিম সাহেব প্রবল জ্বর নিয়ে বাসায় ফিরলেন। সেদিন সন্ধ্যাতেই রেডিও বাংলাদেশের স্থানীয় সংবাদে ঢাকা বোর্ডের রেজাল্ট প্রকাশের খবর ঘোষণা করা হল। বলা হল জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের মোঃ বদরুল আলম সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এই অসম্ভব গুরুত্বপুর্ণ খবরটি এলাকায় কেউ শুনল না। শুনলেও হয়তো বুঝতে পারলো না যে তাদের স্কুলের কথাই রেডিওতে বলা হচ্ছে।

রাত আটটার খবরের পর নীলগঞ্জ হাই স্কুলের নতুন এসিসটেন্ট হেডমাষ্টার মাহবুব সাহেব ছুটতে ছুটতে এলেন। তিনি সম্ভবত মনের ভুলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন–আমাদের স্কুল সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেছে। আমাদের জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল।

তার পেছনে পেছনে এলেন নীলগঞ্জ স্কুলের অন্য শিক্ষকরা। রাত দশটায় জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। এমন আনন্দময় ঘটনা এই অঞ্চলের ইতিহাসে অনেকদিন ঘটেনি।

ফজলুল করিম সাহেব চলে এসেছেন। তাঁর শরীর কাঁপছে জ্বরের ঘোরে আনন্দে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। বদরুল আলম এসেছে সে স্যারকে সালাম করবার জন্যে নিচু হতেই ফজলুল করিম সাহেব তাকে জাপটে ধরে ফেললেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন–আয় তো দেখি তোকে কোলে নিয়ে স্কুলের চারদিকে একটা চক্কর দিতে পারি কি না। আয়।…..

সত্যি সত্যি বদরুলকে কোলে নিয়ে ফজলুল করিম সাহেব দৌড়ানোর চেষ্টা করছেন। বদরুল স্যারের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। সে খুব কাঁদছে। ফজলুল করিম সাহেবের সঙ্গে অনেকেই দৌড়াচ্ছে। শুধু তার অতি প্রিয়জন মওলানা ইরতাজউদ্দিন নেই।

স্কুলে হৈ চৈ হচ্ছে

স্কুলে হৈ চৈ হচ্ছে। মওলানা ইরতাজউদ্দিন হৈ চৈ অগ্রাহ্য করে ফজলুল করিম সাহেবের বাসায় এসেছেন। রেশমীর সঙ্গে জরুরী কথা বলা দরকার। এখনই বলা দরকার।

মওলানাকে দেখেই রেশমী বের হয়ে গেল। সেও আনন্দে ঝলমল করছে।

মওলানা বললেন, খবর জান তো রেশমী?

জি জানি। খালুজান কই?

উনি বদরুলকে কোলে নিয়ে চক্কর দেয়ার চেষ্টা করছেন।

রেশমী শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করছে। মওলানা বললেন, রেশমী শোন–আমাদের স্কুল আবার শুরু হবে। নতুন করে শুরু হবে। খুব ভালোমত শুরু হবে।

জ্বি আমি জানি।

এখন তোমার কাছে একটা অনুরোধ। তুমি উনাকে ছেড়ে চলে যাবে।

আমি কি করেছি?

তুমি খুব ভাল করে জান আমি কেন এইসব বলছি। তুমি বুদ্ধিমতি মেয়ে, তোমার বুদ্ধির অভাব নেই। তুমি উনার মনের ভাব জান। ওনারটাও জান।

রেশমী মাথা নিচু করে রইল। মওলানা বললেন, হেড স্যারকে নিয়ে কোন রটনা হতে দেয়া যাবে না। তুমি যদি থাক ঘটনা অনেক দূর গড়াবে। লোকজন হেড স্যারকে ছিঃ ছিঃ করবে। তুমি কি সেটা জান না?

জানি।

তুমি চাও না আমরা স্কুলটাকে নিয়ে অনেক দুর যাই?

চাই। আমি চলে যাব।

কখন যাবে?

আপনি যদি বলেন এখন, তা হইলে এখনই যাব।

হ্যাঁ, এখনই চলে যাও।

উনার পা ধোয়ার পানির ব্যবস্থা করে তারপরে যাই?

আচ্ছা।

রেশমী জলচৌকির পাশে পানির বালতি টেনে আনছে। খড়ম জোড়া এনে রাখল। রেশমী কাদছে। টপ টপ করে তার চোখ থেকে দু ফোটা পানি জলচৌকিতে পড়ল।

মওলানা দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি মনে মনে মেয়েটির জন্যে প্রার্থনা করলেন। এই মেয়েটা ভাল। আল্লাহ এর ভাল কর। বাজী পোড়ানোর শব্দ হচ্ছে। স্কুলে মনে হয় বাজী পোড়ানো হচ্ছে। ঢোল বাজানোর শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই হরিপদের কান্ড। ঢোলের শব্দ প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে।

Exit mobile version