Site icon BnBoi.Com

চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস – হুমায়ূন আহমেদ

চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস - হুমায়ূন আহমেদ

কোম্পানীর বড় সাহেবের পাশে

কোম্পানীর বড় সাহেবের পাশে গাড়িতে চড়া ভয়াবহ কষ্টের ব্যাপার। মানসিক কষ্ট, শারিরীক কষ্ট। চার ঘন্টা ধরে এই কষ্টটাই ফরহাদ করছে। বড় সাহেবের গাড়িতে রংপুর থেকে ঢাকা আসছে। বড় সাহেব সীটে হেলান দিয়ে আছেন। চোখ বন্ধ, তবে তিনি ঘুমুচ্ছেন না। গান শুনছেন। মাঝে মাঝে আংগুলে তাল দিচ্ছেন। ফরহাদ তার পাশে কাঠ হয়ে বসে আছে। তার প্রচন্ড বাথরুম পেয়েছে। সে গাড়ির ড্রাইভারকে বলতে পারছে না, ড্রাইভার সাহেব দুমিনিটের জন্যে গাড়িটা থামান। আমার একটু ইয়ে করা দরকার। বলা সম্ভব না। তার পকেটে বলতে গেলে পুরো এক প্যাকেট সিগারেট! কেনার পর তিনটা মাত্র সিগারেট খাওয়া হয়েছে। এখনো সতেরোটা আছে। কিন্তু খাওয়ার উপায় নেই। চার ঘন্টা হয়ে গেল সে সিগারেট খাচ্ছে না, ভাবাই যায় না।

গাড়ির এসি চলছে। সেই এসি এমনই এসি যে ঠাণ্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ফরহাদ ডীপ ফ্রীজের ভেতর বসে আছে। এসি কমানোর কথা ড্রাইভার সাহেবকে বলাই যাবে না। ওরিয়ন ওষুধ কোম্পানীর এমডি জামিলুর রহমান সাহেব গরম সহ্য করতে পারেন না। তার অফিসের ঘরেও এই অবস্থা। ঢুকলে মনে হয় এস্কিমোদের ইগলুতে ঢোকা হয়েছে। অফিস ঘরে ঢুকে দুতিন মিনিট ঠাণ্ডা খাওয়া এক কথা আর চার ঘন্টা ধরে ডীপ ফ্রীজে বসে থাকা অন্য কথা। সেতো আর পচনশীল কোন পদার্থ না, যে তাকে ডীপ ফ্রীজে থাকতে হবে। সে মানুষ।

গাড়ির ট্রাঙ্কে ফরহাদের হ্যান্ড ব্যাগ আছে। হ্যান্ড ব্যাগে চাদর আছে। মাফলার আছে। চাদরটা জড়িয়ে বসে থাকলে জীবন রক্ষা হত। সেটা কোনক্রমে সম্ভব না। গাড়ি থামবে। ড্রাইভারকে নেমে গিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্ক খুলতে হবে। ঘটাং করে শব্দ হবে। আবার ট্রাঙ্ক বন্ধ করা হবে। আবার ঘটাং করে শব্দ। বড় সাহেব খুবই বিরক্ত হবেন। তিনি গান শুনছেন। তার গান শোনায় বাধা পড়বে। ফরহাদের কাছে মনে হচ্ছে বড় সাহেব তালকানা। ভুল জায়গায় তাল দিচ্ছেন।

গান বাজছে। সুন্দর সুন্দর সব গান। রবীন্দ্রসংগীত। অন্য সময় এইসব গান। অনেক ভাল লাগত। এখন সহ্যই হচ্ছে না। ফরহাদ একবার অসুস্থ শরীরে ইলিশ মাছ খেয়ে খুব বমি করেছিল। সেই অসুখ কবে সেরে গেছে, কিন্তু ইলিশ মাছ সে এখনো খেতে পারে না। গন্ধ নাকে গেলেই বমি বমি ভাব হয়। এখন মনে হচ্ছে রবীন্দ্রসংগীতের ব্যাপারেও ওই অবস্থা হবে। যতবার রবীন্দ্রসংগীত কানে আসবে ততবারই বমি ভাব চলে আসবে।

ফরহাদের ডান পায়ের হাঁটুতে টনটনে যন্ত্রণা হচ্ছে। পা নাড়াতে পারলে হত। পা নাড়ানো যাচ্ছে না। পায়ের কাছে দুই পাতিল বগুড়ার দৈ। পাতিল যেন উল্টে না যায় তার জন্যে দুপা দিয়ে সামলাতে হচ্ছে।

ড্রাইভারের পাশে বসেছে বড় সাহেবের খাস বেয়ারা মোকাদ্দেস। মোকাদ্দেসেরও পায়ের কাছে দৈ, কোলের উপর দৈ। বড় সাহেব বগুড়ার সব দৈ কিনে ফেলেছেন। বাথটাবে দৈ ঢেলে গোসল করবেন না-কি? পুরানো কালে রাণীরা দুধে গোসল করতেন। এই আমলের বড় সাহেবরা হয়তো দৈ-এ গোসল করেন।

গাড়িতে ওঠার আগে আগে এক বোতল পেপসি খাওয়া বিরাট বোকামী হয়েছে। দু চুমুক খেয়েই আর খেতে ইচ্ছা করছিল না। তবু পয়সায় কেনা জিনিস ফেলতে মায়া লেগেছে বলে খেয়ে ফেলা। এখন মনে হচ্ছে মায়া করা বিরাট বোকামী হয়েছে। বাথরুম এমন চেপেছে যে বলার মত না। এক বোতল পেপসি, সাত বোতল পেচ্ছাব হয়ে চাপ দিচ্ছে। ফরহাদের ইচ্ছে করছে—গাড়িতেই কাণ্ডটা করে ফেলতে। দৈয়ের হাড়িতে পেচ্ছাব ছিটিয়ে দেয়া। পেচ্ছাব মাখা দৈ—খেতে খারাপ হবে না। নোনতা নোনতা স্বাদ হবে। ছিঃ এইসব সে কি ভাবছে? মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে না-কি?

ফরহাদ তার চিন্তা অন্যদিকে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। পেচ্ছাবের কথা কিছুতেই ভাবা যাবে না। যত ভাববে তত সমস্যা হবে। শেষে দেখা যাবে সত্যি সত্যি সে গাড়িতেই কাণ্ডটা করে ফেলেছে।

বড় সাহেব পাঞ্জাবির পকেট থেকে সিগারেট বের করলেন। সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ড্রাইভার! গাড়ি সাইড কর।

মীর্জাপুর শালবনের কাছে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। মোকাদ্দেস ছুটে নেমে এসে দরজা খুলেছে। কাজটা ফরহাদের করা উচিত ছিল—কিন্তু সে পা নাড়াতে পারছে না। ডান পায়ে ঝি ঝি ধরেছে।

বড় সাহেব বললেন, বাথরুম করা দরকার।

ফরহাদের মনে হল এমন মধুর বাক্য সে তার জীবনে শুনেনি। এখন তাকে অতি দ্রুত একশানে যেতে হবে। সময় নষ্ট করা যাবে না। বড় সাহেব যেদিকে দাঁড়িয়েছেন তার উল্টো দিকে দাঁড়াতে হবে। বড় সাহেবের কাজ শেষ হবার আগেই কাজ শেষ করে গাড়িতে ফিরে আসতে হবে। ঝিঝি ধরা পা টেনে চলাই মুশকিল। রোড ক্রশ করতে হবে। একের পর এক গাড়ি আসছে। চট করে একটা সিগারেট ধরানো যায়। কয়েকটা টান দিতে পারলেও তো লাভ। ফরহাদ পকেটে হাত দিল। তার এমন কপাল যে দেখা যাবে সিগারেট আছে দেয়াশলাই নেই। ফরহাদ অতি দ্রুত মনে মনে বলল, ও আল্লাহপাক দেয়াশলাই যেন থাকে। তার যেমন ভাগ্য দেয়াশলাই অবশ্যই থাকবে না। আর থাকলেও কাঠি থাকবে না। উত্তেজনায় ফরহাদের হাত কাঁপছে। তার ভাগ্য ভাল। সিগারেট ম্যাচ দুইই আছে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি মনে হয় নামবে। বৃষ্টি নামলে কি বড় সাহেব এসি বন্ধ করবেন?

 

গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। রবীন্দ্রসংগীত এখনো চলছে। তবে এখন শুনতে ভাল লাগছে। এখন মনে হচ্ছে বুড়ো রবীন্দ্রনাথ গানগুলি খারাপ লেখেনি।

হাসি কান্না হীরা পান্না দোলে ডালে,
কাঁপে ছন্দে ভালো মন্দ তালে তালে

পায়ে তাল দিতে ইচ্ছে করছে। সাহসে কুলুচ্ছে না। বড় সাহেবের চোখে পড়তে পারে। মুরুব্বীদের সামনে পা নাচানোটা খুবই অদ্রতা। পুরো পা না নাচিয়ে বুড়ো আংগুল নাচালে হয়। জুতার ভেতর বুড়ো আংগুল কি করছে না করছে কে দেখবে। বুড়ো আংগুল নাচালে রক্ত চলাচলটাও ঠিক থাকবে। পায়ে আগের মত ঝিঝি ধরবে না।

ফরহাদ!

ফরহাদ চমকে উঠল। বড় সাহেব তাকে ডাকছেন। তিনি যে তার নাম জানেন এটাই একটা বিস্ময়কর ঘটনা।

জি স্যার!

কটা বাজে?

এগারোটা দশ।

বড় সাহেব আবার চুপ করে গেলেন। ফরহাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভাগ্যিস তার হাতে রেডিয়াম ডায়াল দেয়া ঘড়ি ছিল। নয়তো সময় বলতে পারতো না। বড় সাহেব চোখ বন্ধ করে পড়ে আছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ। তিনি অপরিচিত কেউ হলে জিজ্ঞেস করা যেত, ভাই সাহেবের কি শরীর খারাপ? এখন তা জিজ্ঞেস করা যাবে না। তিনি প্রশ্ন করলেই শুধু জবাব দেয়া যাবে। তিনি যদি বলেন, আমার শরীরটা ভাল না তবেই শুধু উদ্বেগ নিয়ে বলা যাবে, স্যার কি হয়েছে?

বড় সাহেব বললেন, ঢাকা পৌছতে কতক্ষণ লাগবে? প্রশ্নটা কাকে করা হল ফরহাদ বুঝতে পারছে না। কারণ বড় সাহেবের চোখ বন্ধ। তিনি কারো দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন নি। প্রশ্নটা নিশ্চয়ই ড্রাইভারকে করা হয়েছে। ঢাকা পৌছতে কতক্ষণ লাগবে তা বলতে পারে ড্রাইভার। সে কত স্পীডে গাড়ি চালাবে তা সেই জানে। অথচ ড্রাইভার জবাব দিচ্ছে না। ফরহাদ খুবই অস্বস্তি বোধ করছে। বড় সাহেব একটা প্রশ্ন করলেন। গাড়িতে তিনজন মানুষ কেউ জবাব দিল না–অথচ তিনজন মানুষই প্রশ্নটা শুনেছে—তার মানে কি?

ফরহাদ বলল, স্যার আমরা ইনশাল্লাহ এক ঘন্টার মধ্যে পৌঁছে যাব।

তুমি কোম্পানীতে জয়েন করছ কবে? এক বৎসর দুই মাস হয়েছে। চাকরি ভাল লাগছে? জ্বি স্যার। খাটুনি বেশি?

ফরহাদ জবাব দিল না। খাটুনি বেশীলতা বটেই, জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়ানো আরামের ব্যাপার না। খাটুনি বেশী বললে স্যার ভাবতে পারেন—খাটুনি বেশী তাহলে ঝুলে আছ কেন? চাকরি ছেড়ে দাও। আর সে যদি বলে কোন খাটুনি নেই। তাহলে আদিখ্যেতা দেখানো হয়। মনে হয় বড় সাহেবকে দেখে সে চামচাগিরি করছে।

বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। বেশ ভাল বৃষ্টি। ড্রাইভার গাড়ি স্লো করে দিয়েছে। ফরহাদ ঘন ঘন ঘড়ি দেখছে। এভাবে গাড়ি চালালে এক ঘন্টায় ঢাকা পৌছানো যাবে না। দেড় ঘন্টা লেগে যাবে। স্যার তখন বিরক্ত হয়ে ভাবতে পারেন—এ কেমন ছেলে কোন অনুমান নেই। দেড় ঘন্টা লাগবে, বলে বসেছে এক ঘন্টা। এইসব বেআক্কেল কর্মচারীদের কোম্পানীতে থাকা ঠিক না।

গাড়ি এখন গাজিপুর চৌরাস্তা পার হচ্ছে। এখান থেকে ঢাকা কতদূর-চল্লিশ কিলোমিটার? ঘন্টায় এক কিলোমিটার করে গেলেওতো চল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যাবার কথা। ড্রাইভার গাড়ি স্লো চালাচ্ছে ঠিকই তাই বলে ঘন্টায় ষাট কিলোমিটারের নিচে চালাচ্ছে বলেতো মনে হয় না। ফরহাদ একটু সামনে এগিয়ে স্পিডোমিটার দেখার চেষ্টা করল। আর এতেই পায়ের কাছের দৈ-এর হাড়িতে মট করে শব্দ হল।

সর্বনাশ হাড়ি ভাঙ্গে নিতো?

ভাঙ্গা হাড়ি চুইয়ে দৈ পড়বে। দামী গাড়ি মাখামাখি হবে। স্যার ভাববেন এই বেকুব সামান্য একটা দৈয়ের হাড়িও ঠিকঠাকভাবে রাখতে পারে না?

 

ফার্মগেটে গাড়ি থামলো।

ফরহাদ গাড়ি থেকে নামলো। তার খুবই লজ্জা লাগছে। তার জন্যে বড় সাহেবকে গাড়ি থামিয়ে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গাড়ি থামতো আর সে চট করে নেমে যেত তাহলেও একটা কথা ছিল। তাতো না, গাড়ির ট্রাংক খুলে হ্যান্ড ব্যাগ বের করতে হচ্ছে। তার ভাগ্যটা এমনই যে ট্রাংক খুলছে না। কি যেন আটকে গেছে—ড্রাইভারকে ঘট ঘট করতে হচ্ছে। তিনবারের চেষ্টায় ট্রাংক খুললো। ফরহাদ বড় সাহেবের জানালার কাছে এসে বিনীত গলায় বলল, স্যার যাই?

বড় সাহেব জানালার কাচ নামালেন। এটা অসাধারণ জ্বতার একটা ব্যাপার। বৃষ্টি হচ্ছে, এর মধ্যে জানালার কাচ নামানোর দরকার ছিল না। ফরহাদ দ্বিতীয়বার বলল, স্যার যাই। স্নামালিকুম।

বড় সাহেব বললেন, একটা দৈয়ের হাড়ি নিয়ে যাও।

ফরহাদ অসম্ভব বিব্রত হয়ে বলল, জ্বি না স্যার।

না কেন নিয়ে যাও। আমি এত দৈ দিয়ে কি করব। মোকাদ্দেস একে এক হাড়ি দৈ দিয়ে দাও তো।

বড় সাহেব জানালার কাচ উঠিয়ে দিলেন। এখন আর কথা চলে না। মোকাদ্দেস বিরক্ত মুখে দৈয়ের হাড়ি ফরহাদের হাতে ধরিয়ে দিল।

বারোটা ত্রিশ বাজে। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। রাস্তা ঘাট ফাঁকা। ফরহাদ যাবে ঝিগাতলা। বেবীটেক্সী নিতে হবে। এত রাতে রিকশা করে যাওয়া ঠিক হবে না। হ্যান্ড ব্যাগ, দৈয়ের হাড়ি সব যাবে। খবরের কাগজের ভাষায়—গভীর রাতে দৈ ছিনতাই।

রাস্তায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার অর্থ হয় না। কোন দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আরাম করে সিগারেট ধরানো যেতে পারে। শেষ সিগারেট দুটা টান দিয়ে ফেলে দিতে হয়েছিল। এবারেরটা ফিল্টার পর্যন্ত খাওয়া যাবে। তবে ফিনফিনা বৃষ্টিতে ভিজতেও খারাপ লাগছে না। তার ঠিক সামনেই একটা পেট্রল পাম্প। পেট্রল পাম্পে অপেক্ষা করা যায়। সমস্যা একটাই পেট্রল পাম্পে সিগারেট খাওয়া যাবে না। তাছাড়া পেট্রল পাম্পে খারাপ টাইপের একটা মেয়েও দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িতে পেট্রল নিতে আসবে এমন কোন কাস্টমারের জন্যে অপেক্ষা। ফরহাদকে দেখে এই মেয়ে উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে। ফরহাদ তার দিকে তাকিয়েছিল বলে এখনই সে খানিকটা উসখুস করছে। পেট্রল পাম্প ছেড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তার কাছে চলেও আসতে পারে। প্রথমবার মেয়েটা যা করবে তা হল গম্ভীর ভঙ্গিতে সামনে দিয়ে হেঁটে যাবে। একবারও তাকাবে না। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে আসবে তখন থমকে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরিয়ে তাকাবে এবং হাসবে। তারপর ফরহাদের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে এগিয়ে আসতে থাকবে। দূর থেকে মেয়েটাকে সুন্দর দেখা গেলেও কাছে যখন আসবে তখন দেখা যাবে কুৎসিত। শরীর এবং মনের অত্যাচার মেয়েটার মুখে চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে দিয়েছে।

কি আশ্চর্য মেয়েটা সত্যি সত্যি আসছে। ফরহাদ দৈয়ের হাড়ি মাটিতে নামিয়ে সিগারেট ধরাল। যারা ধুমপান করে না তারা জানে না ধুমপায়ীদের কাছে সিগারেট শুধুমাত্র নেশা না এক ধরনের আশ্রয়ও। সে এখন সিগারেটের কাছে আশ্রয় খুঁজছে। মেয়েটাকে কি বলা যায়? তাকে বলা যেতে পারে—নিশিকন্যা শুনুন। আপনি ভুল জায়গায় এসেছেন। আমি সেই টাইপের ছেলে না। আমি একজন স্কুল শিক্ষকের জ্যৈষ্ঠ সন্তান। M.Sc পাশ করে বর্তমানে অষুধ কোম্পানীতে ছোট একটা চাকরি করছি। যে চাকরি করছি সেখানে দুনম্বরীর অনেক সুযোগ আছে। এখন পর্যন্ত তার ধারে কাছে যাই নি। কোনদিন যাব তা মনে হয় না। আমি নিতান্তই ভাল মানুষ টাইপের একজন। আমার একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছে। মেয়েটির নাম আসমানী। আমি তাকে ঠাট্টা করে ডাকি মিস স্কাই। যে কোন দিন তার সঙ্গে আমার হুট করে বিয়ে হয়ে যেতে পারে। বিয়েটা আসলে আটকে আছে মিস স্কাই-এর মামার জন্যে। তিনি থাকেন জাপানে। কিছু কিছু ভাগ্যবান মানুষ আছেন সূত্রধর টাইপ। দূর থেকে সূতা ধরে পুতুল চালান। আসমানীর এই মামা হচ্ছেন সূত্রধর মামা। তিনি জাপানে বসে আসমানীদের পরিবারের সুতা ধরে থাকেন। এই সূত্রধর মামা তিন সপ্তাহের ছুটিতে দেশে ফিরবেন। তখন আসমানী মামাকে সব বলবে। আসমানীর ধারণা মামা তখন বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। কাজেই ম্যাডাম বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার কাছে আসা অর্থহীন। আপনার জন্যে পেট্রল পাম্পে গাড়িওয়ালা কোন কাস্টমারের জন্যে অপেক্ষা করাই ভাল হবে।

মেয়েটি ফরহাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই একটা খালি বেবীটেক্সী সামনে দাঁড়াল। দরদাম করার সময় নেই। ফরহাদ বেবীটেক্সীতে উঠে পড়ল। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। ফরহাদের চট করে বেবীটেক্সীতে উঠা দেখে সে মনে হয় বেশ অবাক হয়েছে। কাছে থেকেও মেয়েটার চেহারা খারাপ লাগছে না। বৃষ্টির জন্যে মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে দিয়েছে। মেয়েটার মধ্যে বউ বউ ভাব চলে এসেছে। মিষ্টি নরম চেহারা। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার আসমানীর সঙ্গে মেয়েটার চেহারায় কোথায় যেন একটু মিল আছে। ফরহাদ লজ্জিত বোধ করল—এমন বাজে টাইপের মেয়ের সঙ্গে আসমানীর চেহারার মিল থাকবে কেন?

বেবীটেক্সীওয়ালা টেক্সী স্টার্ট দিয়েছে। ফরহাদ বলল, কলাবাগান চল। বেবীটেক্সীওয়ালা মেয়েটার দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল, একা যাইবেন?

ফরহাদ বিরক্ত মুখে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ একা। বৃষ্টি আবারো জোরে নেমেছে। মেয়েটার উচিত দৌড়ে পেট্রল পাম্পে চলে যাওয়া। সে যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। তার চোখে অবাক ভাবটা এখন আর নেই। দৈ-এর হাড়িটা মেয়েটাকে দিয়ে দিলে ভাল হত। এদেরতো কেউ কখনো কোন উপহার দেয় না। সে না হয় দিল এক হাড়ি দৈ। হাড়িটা দিয়ে সে বলতে পারত–বাড়িতে নিয়ে আরাম করে খাও। বগুড়ার মিষ্টি দৈ। ফ্রেশ দৈ। আজই কেনা হয়েছে। ফরহাদ কি বলবে বেবীটেক্সীওয়ালাকে—বেবীটেক্সী ঘুরাতে। অনেক দূর চলে এসেছে। এখন বলাটা ভাল হবে না। বেবীটেক্সীওয়ালা নানান কিছু ভাবতে পারে। ফরহাদের মন খারাপ লাগছে।

 

ঢাকা শহরের বাসাবাড়িতে আজকাল টিউবওয়েল দেখা যায় না। তবে ঝিকাতলায় ফরহাদদের বাসায় টিউবওয়েল আছে, কলতলা আছে। একতলা বাসা। তিন ইঞ্চি গাঁথুনীর দেয়াল উপরে টিনের ছাদ। টিউবওয়েলের পেছনে গ্রামের বাড়ির মত কলাগাছ। সব মিলিয়ে পাঁচটা গাছ। একটায় থোর বের হয়েছে।

টিনের দেয়াল দিয়ে ঘেরা সাত কাঠা জায়গায় চার কামরার এই বাড়ির মালিক ফরহাদের খালাতো ভাই রহমত উল্লাহ। ভদ্রলোক থাকেন সুইডেনে। বছর চারেক আগে এক সুইস মেয়ে বিয়ে করেছেন। তিনি যে দেশে ফিরবেন এবং এই জায়গার দখল নেবেন সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। এই ভরসাতেই ফরহাদের বাবা নিজের শখ মিটিয়ে বাড়ির চারপাশে গাছ পালা লাগিয়েছেন। তার নিজের হাতে লাগানো নারিকেল গাছে নারিকেল ধরে গেছে। গত বছর জাম্বুরা গাছে ছাপ্পান্নটা জাম্বুরা হয়েছিল। কমলার মত মিষ্টি জাম্বুরা। সবই পাড়াপড়শিকে বিলি করা হয়েছে। তবে তিনি ঠিক করেছেন এ বছর থেকে কিছু ফল ফলান্তি বিক্রি করবেন। গাছের পেছনে খরচ আছে, সার কিনতে হয়। হাফ কেজির এক প্যাকেট জৈব সার পঁচিশ টাকা। গোবর কিনতেও অনেক টাকা লাগে। এক বস্তা ভাল গোবর পঁচাত্তর টাকা। কেরিং খরচ আছে নার্সারীর গাছ কিনতেও টাকা লাগে। কলমের একটা দারচিনি গাছ তার খুব মনে ধরেছে। টবের গাছ, দাম চাচ্ছে তিনশ। কুলাকুলি করলে দুশতে দিয়ে দেবে। এইসব খরচপাতির জন্যে ছেলের কাছে হাত পাতার অর্থ হয় না। ফল বিক্রির টাকায় ছছাটখাট খরচ সামাল দেয়া যায়। দশ টাকা করে ধরলেও ছাপ্পান্নটা জাম্বুরার দাম হয় পাঁচশ ষাট টাকা।

ফরহাদ কলের পাড়ে সাবান ডলে গোসল করছে। পাশে বসে গভীর আগ্রহের সঙ্গে ছেলের স্নানের দৃশ্য দেখছেন বেগম রোকেয়া গার্লস হাই স্কুলের রিটায়ার্ড অংক শিক্ষক জোবেদ আলি। তিনি এখনো ভাত খাননি। ফরহাদ রাতে ফিরবে, ছেলের সঙ্গে খাবেন। এই জন্যেই অপেক্ষা। ফরহাদের মা রাহেলা বেগম ভাত চড়িয়েছেন। বোয়া উঠা সদ্য রাধা ভাত ফরহাদের অতি প্রিয়।

টিপটিপ করে বৃষ্টি এখনো পড়ছে। জোবেদ আলি এই বৃষ্টির মধ্যেও বসে আছেন। ফরহাদ বলল, বৃষ্টিতে যেভাবে ভিজছ তুমিতো বাবা ঠাণ্ডা লাগাবে।

জোবেদ আলি গম্ভীর গলায় বললেন, বৃষ্টি গাছের জন্যে যেমন দরকার মানুষের জন্যেও তেমন দরকার। বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ বিসুখ হয় না। ঘুসঘুসা জ্বরের মহৌষধ হল বৃষ্টি। অদ্রিা রোগের জন্যেও বৃষ্টি ভাল।

তাই নাকি?

গ্রামদেশে পাগলের চিকিৎসা কিভাবে করে জানিস? ভরা বৃষ্টির সময় উলংগ করে উঠানে বেধে রাখা হয়।

ও আচ্ছা।

এই চিকিৎসার নাম মেঘ চিকিৎসা। পাগলরা দেখবি মেঘ বৃষ্টি খুব ভয় পায়। কোন পাগলকে দেখবি না নিজের ইচ্ছায় বৃষ্টিতে ভিজছে।

জোবেদ আলি ছেলের সঙ্গে গল্প করে খুব আরাম পাচ্ছেন। আগে তিনি একেবারেই কথাবার্তা বলতেন না। এখন খুব কথা বলেন। তাঁর কথাবার্তা ভাল জমে ফরহাদের সঙ্গেই। ছোট ছেলে মঞ্জু গম্ভীর প্রকৃতির। অল্পতেই বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে তাকায়। তার সঙ্গে আলাপ জমে না।

ফরহাদ!

জ্বি।

দৈয়ের হাড়ি কত দিয়ে কিনলি?

আমি কিনিনি বাবা। আমাদের এমডি সাহেব কিনেছেন। উনার সঙ্গে এক গাড়িতে ফিরেছি। গাড়ি থেকে নামার সময় একটা হাড়ি দিয়ে দিলেন।

মনে হচ্ছে বিশিষ্ট ভদ্রলোক।

হ্যাঁ ভদ্রলোকতো বটেই। আমার বাসে ফেরার কথা। বাসের টিকিটও কাটা ছি। উনি বললেন আমার সঙ্গে চল।

বাসের টিকেটের টাকা কি মার গেছে?

না টিকেট ফিরত নিয়েছে। দশ টাকা কেটে রেখেছে। এমডি সাহেবের দেশ কোথায়?

জানি না কোথায়। উনার মত মানুষের সঙ্গে খেজুরে আলাপ করা যায় না। আমিতো আর জিজ্ঞেস করতে পারি না—স্যার আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়? ছেলে মেয়ে কি? ছেলে মেয়েরা কে কোন ক্লাসে পড়ে।

তাতো বটেই।

ফরহাদের গোসল শেষ হয়েছে। টিউবওয়েলের পানি বরফের মত ঠাণ্ডা। ঠাণ্ডা পানিতে দীর্ঘ গোসলের পর শরীর ঝরঝরে হয়ে গেছে। ঘুম ঘুম ভাব একেবারেই নেই। ক্ষিধে মরে গিয়েছিল—সেই ক্ষিধে জাগিয়ে উঠেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে এক গামলা ভাত খেয়ে ফেলতে পারবে।

 

রাহেলা বেগম বিরাট এক কাতল মাছের মাথা ছেলের পাতে তুলে দিয়ে মিচকি মিচকি হাসতে লাগলেন। ফরহাদ হতভম্ব গলায় বলল, এত বড় মাছ কোত্থেকে আসল।

জোবেদ আলি আনন্দিত গলায় বললেন, আজ দুপুরে কথা নেই বার্তা নেই মঞ্জু বিরাট এক কাতল মাছ নিয়ে উপস্থিত। কাতল মাছ, দুই কেজি খাসির গোশত। এক কেজি টমেটো। আর ভুটানের মরিচের আচার। কইগো আচারের বোতলটা আন।

ফরহাদ বলল, ব্যাপার কি?

জোবেদ আলি বললেন, ব্যাপার কি কিছুই জানি না। জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে বিরক্ত হয়ে বলল, সামান্য একটা মাছ আনতে ব্যাপার লাগবে না-কি। ওর যা স্বভাব অল্পতেই বিরক্ত। মহা বিরক্ত।

চাকরি পেয়েছেন না-কি?

পেতে পারে। যদি পায়ও আমরা আগে ভাগে কিছু জানব না। মাসের শেষে বেতন পেলে জানলেও জানতে পারি। আবার নাও জানতে পারি। মাঝে মধ্যে কাচা বাজার করে দিলেই বা ক্ষতি কি? অদ্ভুত এক ছেলে।

মঞ্জু ঘুমিয়ে পড়েছে?

ও ঘুমাবে না! কি বলিস তুই? দশটা না বাজতেই বাতি টাতি নিভিয়ে ঘুম।

ফরহাদ মার দিকে তাকিয়ে বলল, মাছের মাথা আমি খাব না মা।

রাহেলা বেগম বললেন, কথা না বাড়িয়ে খাতো। বড় মাছের মাথা সংসারের রোজগারী মানুষের খেতে হয়। অন্য কেউ খেলে সংসারের অকল্যাণ হয়। যতদিন তোর বাবার রোজগার ছিল মাছের মাথা তাকে দিয়েছি। তোদের দেই নি।

ফরহাদ বলল, আমি মাছের মাথা না খেলে সংসারের অকল্যাণ হবে এমন উদ্ভট কথা তোমরা বিশ্বাস কর?

জোবেদ আলি বললেন, দীর্ঘ দিন যে সব কথা চালু হয়ে আছে তার একটা মূল্য আছে। কোন কথাতো আর বিনা কারণে চালু হয় না। যেমন ধর মুরগির কলিজা পুরুষ মানুষের খাওয়া নিষেধ। এখন এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে।

কি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা?

মুরগির কলিজা হচ্ছে কোলেস্টরলের কারখানা। রোজ মুরগির কলিজা খেলে হার্টে ব্লকেজ হতে বাধ্য। একজন রোজগারী পুরুষের যদি হার্ট ব্লকেজ হয় তাহলে সংসারের অবস্থাটা কি হয় চিন্তা করে দেখ।

মেয়েদের হার্ট ব্লক হলে কোন সমস্যা নেই?

মেয়েদের হার্ট ব্লক হয় না?

ফরহাদ থালায় রাখা মাছের মাথার দিকে তাকাল। কয়েক মুহূর্তের জন্যে তার শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। মনে হচ্ছে মাছটা জীবন্ত। অপলক চোখে তাকে দেখছে। সেই চোখ ভর্তি বেদনা ও বিস্ময়।

ফরহাদ বাবার পাতে মাথা তুলে দিতে দিতে বলল, সংসারের অমঙ্গল হলেও কিছু করার নেই বাবা। এই মাথা আমি মরে গেলেও খাব না। মাথাটা জীবন্ত।

জীবন্ত মানে?

জীবন্ত মানে জীবন্ত। চোখ পিট পিট করছে।

জোবেদ আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, মাছের চোখের পাতা আছে না-কি চোখ পিট পিট করবে? অতিরিক্ত পরিশ্রমে, টেনশানে তোরতো মনে হয় মাথা টাথা খাপ হয়ে যাচ্ছে। মাছের চোখ খেয়ে দেখ। খুবই মজা পাবি। চুষে চুষে লেবেনচুষের মত খা।

মাছের চোখ তুমি খাও বাবা। তবে আমি আগে খাওয়া শেষ করি তারপর পাও।

 

ফরহাদ ঘুমুতে এল রাত দুটার দিকে। বৃষ্টির কারণে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। রাতে ভাল ঘুম হবার কথা। তবে যে সব রাতে তার মনে হয় খুব ভাল ঘুম হবে সে সব এতে এক ফোঁটাও ঘুম হয় না। আজও হয়ত হবে না। ফরহাদ ঘরে তার দাদাজান মেম্বর আলিও থাকেন। পাশাপাশি দুটা খাটের একটা মেম্বর আলির। তাঁর বয়স আশির কাছাকাছি। রাতে চোখে কিছুই দেখেন না। বেশীর ভাগ সময় না ঘুম, না জাগরণ অবস্থায় থাকেন। ফরিদ যতবার তার ঘরে ঢুকে ততবারই মনে হয় সে দেখবে দাদাজান বিছানায় মরে পরে আছেন। তার মুখের উপর ভনভন করে মাছি উড়ছে। মানুষটা কখন মারা গেছে কেউ জানেও না।

ফরহাদ দাদাজানের মশারি উঁচু করে নীচু গলায় ডাকল, দাদাজান। দাদাজান। মেম্বর আলি চোখ মেলে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার চোখ বন্ধ করলেন। ফরহাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক মানুষটা এখনো বেঁচে আছে।

রাহেলা বেগম দৈ-এর বাটি হাতে ছেলের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। এখন তার মেজাজ সামান্য খরাপ। তার মন বলছে—তাঁকে দেখেই ছেলে যে কথাটি বলবে তা তিনি জানেন। জানেন বলে এই মুহূর্তে তাঁর মন একটু খারাপ। ছেলের কথার জবাবে কঠিন কিছু কথা অনেকদিন থেকেই তিনি বলবেন বলবেন করছেন। বলা হয় নি। আজ হয়ত বলে ফেলবেন। রোজগারী ছেলেকে কঠিন কথা বলা যায় না। এতে সংসারের অকল্যাণ হয়। তবু বলবেন। সংসার ঠিক রাখার জন্যেও মাঝে মাঝে দুএকটা কঠিন কথা বলা দরকার। কঠিন কথা পেরেকের মত। সংসার নড়বড়ে হলে কঠিন কথার পেরেক লাগে।

রাহেলা জানেন তাকে দেখে ফরহাদ প্রথম যে কথাটা বলবে তা হচ্ছে—দাদাজানকে রাত্রে খেতে দিয়েছ? এটা কেমন কথা তিনি বুড়োকে খেতে দেবেন না কেন? দিনের পর দিন বৎসরের পর বৎসর যে সেবাটা করা হচ্ছে সেটা কেন তার ছেলের চোখে পড়ে না। বুড়ো আজকাল প্রায়ই বিছানা নষ্ট করে। কে সে সব পরিষ্কার করে? কাজের মেয়েরা এইসব কখনো করবে না। এইসব তাকেই করতে হয়। শ্বশুরের যত্ন এক কথা—তার নোংরা পরিষ্কার করা ভিন্ন কথা। বুড়োর নিজের ছেট মেয়ে এই শহরেই বাস করে। বুড়ো তার সঙ্গে গিয়ে থাকলেই পারে। শেষ বয়সে বুড়ো বাপের যত্ন মেয়েরা করবে এটাই স্বাভাবিক। ছেলে যদি মনে করে তার দাদাজানের যত্ন এই বড়িতে হচ্ছে না তাহলে সে বুড়োকে তার ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেই পারে। রাহেলা মনস্থির করলেন আজ যদি ফরহাদ তার দাদাজান বিষয়ে কিছু বলে তাহলে তিনি অবশ্যই বলবেন—ফরহাদ যেন তার দাদাজানকে তার ফুপুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

ফরহাদ মাকে দেখেই বলল, রাতে দাদাজানকে খেতে দিয়েছ?

রাহেলা বললেন, না। উপাস রেখে দিয়েছি।

ফরহাদ চোখ ছোট ছোট করে মার দিকে তাকাল। রাহেলা বললো, উনার পেট খারাপ করেছে। পেটে কিছুই সহ্য হচ্ছে না। এই জন্যে চিড়ার পানি দিয়েছি।

শুধু চিড়া-পানি?

লেবু দিয়া চিড়া-পানি পেটের জন্যে ভাল।

রাহেলা ছেলের খাটের এক পাশে বসতে বসতে বললেন–তোর দাদার নোংরা বিছানা চাদর পরিষ্কার কর এক সমস্যা হয়েছে। কাজের মেয়ে করতে চায় না। এই বয়সে আমিও পারি না।

ফরহাদ বলল, আমাকে দিও। আমি ধুয়ে দেব।

পাগলের মত কথা বলিসনাতো। তুই ধুবি কি?

কোন সমস্যা নেই।

তুই উনাকে কিছুদিন যাত্রাবাড়িতে রেখে আয়। কিছুদিন মেয়ের সেবা নিক। বুড়ো বাবা মার সেবা করাওতো মেয়েদের ব্যাপার। তোর ফুপু কিছু সোয়াব পাক।

ফরহাদ কিছু বলল না। রাহেলা বললেন–জানুর ছোট মেয়েটার পরশু আকিকা। সবাইকে যেতে বলেছে। খালি হাতে তো যাওয়া যায় না। সোনার আংটি হলেও নেয়া দরকার। আমার অবশ্য একটা সোনার চেইন দেয়ার শখ। মেয়ের ঘরের নাতী। একটা চেইন কেনার টাকা দিতে পারবি?

ফরহাদ বলল, না।

রাহেলা ক্লান্ত গলায় বললেন, একটা সামাজিকতার ব্যাপার আছে। সবাই জানতে চাইবে মেয়ের নানী কি দিল?

ফরহাদ বলল, যে যার সামর্থ অনুসারে দিবে। পরে ফকিরতো আর কোহিনুর ইরা দিবে না।

রাহেলা বললেন, তুই পথের ফকির না। আর আমিও কোহিনুর হীরা দিতে »াই না। সামান্য একটা চেইন। হাজার পনেরোশ টাকা দাম।

ফরহাদ বলল, মা শুয়ে পড় আমার ঘুম পাচ্ছে। দৈ-এর বাটি নিয়ে যাও। দৈ খাব না।

তুইতো আজ কিছুই খাস নাই—শরীর খারাপ?

শরীর ঠিক আছে। মাছের মাথাটা চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখছিল তাতেই ক্ষিধে মরে গেছে।

রাহেলা ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ফরহাদ হাই তুলতে তুলতে বলল, আমার কোন চিঠিপত্র এসেছে?

এসেছে। তোর ড্রয়ারে রেখেছি।

ড্রয়ারে কেন রাখবে। কতবার বলেছি চিঠি পত্র সব টেবিলের উপর পেপার ওয়েট দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখবে। ঢাকায় ফিরেই যেন চিঠিগুলি চোখে পড়ে।

পান খাবি? পান দেব?

না।

তুই হঠাৎ এমন মেজাজ খারাপ করছিস কেন?

মেজাজ খারাপ করছি না মা? যাও ঘুমুতে যাও।

মাথায় একটু নারিকেল তেল ডলে দেই। অনেক দিন মাথায় তেল না দিলে–অল্পতে মাথা গরম হয়। চুল পড়ে যায়। তোর মাথার চুল কমে যাচ্ছে।

কমুক।

চা খাবি?

আচ্ছা যাও মা। চা নিয়ে আস। চা পান সব আন।

রাহেলা চিন্তিত মুখে ঘর থেকে বের হলেন। ফরহাদ ড্রয়ার খুলে চিঠি বের। করল। সে যা ভেবেছিল তাই—আসমানীর চিঠি। যতবারই সে ঢাকার বাইরে এক সপ্তাহ কাটিয়েছে ফিরে এসে আসমানীর চিঠি পেয়েছে। এবার দিন মাত্র তিন দিন এর মধ্যেই চিঠি পাবার কথা না। কিন্তু ফরহাদের মন বলছিল চিঠি পাবে।

আসমানীর হাতের লেখা সুন্দর। সে চিঠিও খুব গুছিয়ে লেখে। একটা শুধু সমস্যা চিঠি হয় ছোট। হাতে নিতে না নিতেই শেষ। আসমানী লিখেছে—

এই যে

বাবু সাহেব,

আপনি তাহলে ঢাকায় ফিরেছেন? আপনার জন্যে খুবই দুঃসংবাদ। জাপান থেকে আমার মামা এক সপ্তাহ আগেই চলে এসেছেন। এবং আমার মাকে বলেছেন-পাত্র যদি ঠিক থাকে এই শুক্রবার আসমানীর বিয়ে দিয়ে দাও। হুলস্থুল করার কোন দরকার নেই। একজন কাজী ডেকে এনে বিয়ে। পরের দিন কোন ভাল রেস্টুরেন্টে একটা রিসিপশান। রিসিপশনের খরচ আমি দেব। মা মনে হয় রাজি। কাজেই এই শুক্রবারে তোমার বিয়ে। বাবু সাহেব এখন তোমাকে খুবই জরুরী কথা বলছি—তুমি যখনই চিঠিটা পাবে তখনি আমাদের বাসায় চলে আসবে। রাত তিনটার সময় হলে তিনটায় আসবে। কারণ তোমার মুখ দেখতে ইচ্ছা করছে।

আচ্ছা শুনতে আমার সোনার বাংলার পরের লাইনটা যেন কি?

তোমার

পুনশ্চঃ আমার সোনার বাংলার পরের লাইন হচ্ছে—

আমি তোমায় ভালবাসি

 

চিঠি এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায় তারপরেও মনে হয় চিঠি পড়া হয় নি। যে কথাগুলি লেখা হয়েছে তার বাইরেও অনেক কিছু লেখা। বাইরের লেখাগুলি পড়তে সময় লাগে। রাত তিনটার সময় চলে আসবে। এর মানে কি? এটা কি শুধু কথার কথা? না সে সত্যি চাচ্ছে গভীর রাতে সে গিয়ে উপস্থিত হবে?

বৃষ্টি পড়ছে। ঘর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। জানালা খোলা, বৃষ্টির ছাঁট আসছে। দাদাজান ঘরে না থাকলে সে জানালা খোলা রাখত। ঘুমের মধ্যে হালকা গুড়িগুড়ি বৃষ্টির কণা চোখে মুখে পড়া আনন্দের ব্যাপার। ফরহাদ জানালা বন্ধ করে ঘুমুতে গেল। ঘুম এসে পড়ল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। শুধু ঘুম না, ঘুমের সঙ্গে স্বপ্ন। স্বপ্নেও বৃষ্টি হচ্ছে। সে বৃষ্টির মধ্যে দৈ-এর হাড়ি নিয়ে ভিজছে। সে দাঁড়িয়ে আছে পেট্রল পাম্পের ভেতর। মাথার উপরে ছাদ। তার গায়ে বৃষ্টি পড়ার কথা না। কিন্তু বৃষ্টি পড়ছে। এইসব অদ্ভুত ব্যাপারগুলি স্বপ্নেই সম্ভব। পেট্রল পাম্পে তার সঙ্গে আরেকটা মেয়ে ভিজছে। এই মেয়েটা দেখতে অবিকল আসমানীর মত, কিন্তু সে আসমানী না। এই মেয়েটা নিশিকন্যা। মেয়েটা ভিজে জবজবা হয়ে গেছে। ফরহাদ বলল, এই শোন এদিকে আস। মেয়েটা হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে।

ফরহাদ বলল, নাও এই দৈয়ের হাড়িটা নাও।

কেন?

বাসায় নিয়ে যাও। বাসায় নিয়ে খাবে।

উঁহু।

উঁহু কি নিয়ে যাও। নাম কি তোমার?

আমার নাম আসমানী।

আমার সঙ্গে ফাজলামী করবে না। তোমার নাম আসমানী না।

সত্যি আমার নাম আসমানী।

এই সময় খুব ভারী এবং গম্ভীর গলায় কেউ একজন বলল, ঐ মেয়ে সত্য কথা বলছে। তার নাম আসমানী।

ফরহাদ ঘুমের মধ্যেই প্রচন্ড চমকে উঠে বলল, কে কে কথা বলল।

মেয়েটা বলল, আপনার দাদাজান।

তাইতো। দাদাজানেরইতো গলা। তিনি এখানে এলেন কেন? এই বয়সে বৃষ্টিতে ভিজলে উপায় আছে। গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। দাদাজানেরই গলার আওয়াজ। মনে হচ্ছে কেউ তাকে গলা চেপে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। ফরহাদ ব্যাকুল হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। দাদাজানকে দেখা যাচ্ছে না। অথচ তার গোঁ গোঁ চিৎকার শোনা যাচ্ছে।

ফরহাদ জেগে উঠল। পাশের খাটে দাদাজান সত্যি সত্যি গোঁ গোঁ করছেন। তাকে বোবায় ধরেছে। ফরহাদ উঠে গিয়ে দাদাজানের কপালে হাত রাখতেই তিনি বললেন–পানি খাব। পানি।

দাদাজানের শরীর কাঁপছে। ঘামে তার মুখ ভিজে জবজব হয়ে গেছে। তিনি দুহাতে ফরহাদ শক্ত করে ধরে আছেন এবং বিড়বিড় করে বলছেন—পানি, পানি।

আসমানীদের ফ্ল্যাট বাড়িতে ফরহাদ

আসমানীদের ফ্ল্যাট বাড়িতে ফরহাদ এর আগেও এসেছে।

ফ্ল্যাট বাড়িগুলি এম্নিতেই ছিমছাম ধরনের থাকে—এইটা আরো বেশি ছিমছাম। নানান কায়দাকানুন। গেটে দারোয়ানের কাছে বইতে নাম লেখতে হয়। দারোয়ান তারপর ইন্টারকম করে। ইন্টারকমে যদি ক্লিয়ারেন্স পাওয়া যায় তবেই লিফটে ওঠা যায়। ক্লিয়ারেন্স পাবার পরও দারোয়ান এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন একজন ভয়ংকর অপরাধী লিফট করে উঠে যাচ্ছে।

বাড়িতে ঢোকার পরেও সমস্যা। মনে হয় কোন হোটেলে ঢুকে পরা হয়েছে। বসার ঘর এমন করে সাজানো যে সহজ হয়ে বসা যায় না। ফরহাদের প্রধান সমস্যা হয়—জুতা পায়ে দিয়ে সে কার্পেটে উঠবে, না-কি জুতা খুলে উঠবে? জুতা যদি খুলে তাহলে জুতা রাখবে কোথায়? বসার ঘরে ঢোকার আগে দরজার পাশে, না-কি বসার ঘরের কার্পেটে। এখানে থাকা মানেই সারাক্ষণই এক ধরনের টেনশান। বসার ঘরটা কি স্মোক-ফ্রি জোন? না-কি সিগারেট খাওয়া যায়। সিগারেট খেলে ছাই কোথায় ফেলবে? একবার ছাইদানীতে ছাই ফেলার পর আসমানী ভুরু কুচকে বলল—কোথায় ছাই ফেললে? এটা এসট্রে না। মোমদানী। নিচে নোম লেগে আছে দেখেও বুঝতে পারলে না? আশ্চর্যতো। তারপর সে কাজের মেয়েটাকে ডাকল মোমদানীর ছাই ফেলে ধুয়ে আনার জন্যে। কাজের মেয়েটা এসে এমনভাবে তার দিকে তাকাল যেন সে বাংলাদেশের মহা বেকুবদের একজন প্রতিনিধি। মোমদানী এবং এসট্রের সামান্য প্রভেদটাও জানে না।

ফরহাদের ধারণা আসমানী ছাড়া এ বাড়ির একটা মানুষও তাকে দেখতে পারে। যেমন আসমানীর বাবা নেজাম উদ্দিন। ভদ্রলোক ব্যাংকার ছিলেন—এখন অবসর জীবন যাপন করছেন। রিটায়ার্ড লোকজন নিজের সংসারে তেমন পাত্তা পায় না বলে—বাইরের লোকজনের সঙ্গে তাদের ব্যবহার খুব আন্তরিক হয়ে থাকে। ব্যতিক্রম সম্ভবত নেজামত সাহেব। ফরহাদকে দেখলেই তিনি চোখ মুখ কঠিন করে ফেলেন। প্রফেশনাল উকিলদের মত জেরা করতে থাকেন। জেরার ফাঁকে ফাঁকে এমন দুএকটা কথা বলেন যে রাগে রক্ত গরম হয়ে যায়। যেমন একবার নেজামত সাহেবের দেখা হল। ফরহাদ এসে ঢুকেছে তিনি বেরুচ্ছেন এমন অবস্থায় দেখা। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুখ কঠিন করে ফেললেন। ভুরু কুচকে গেল। চোখ সরু হয়ে গেল। তিনি শীতল গলায় বললেন, তুমি কে? কাকে চাও?

ভদ্রলোক ভাল করেই জানেন ফরহাদ কে? এবং সে কার কাছে এসেছে। তারপরেও জিজ্ঞেস করা। ফরহাদ কাচু মাচু ভঙ্গিতে বলল, জি আমার নাম ফরহাদ। আমি আসমানীর কাছে এসেছি। ওকি বাসায় আছে?

ও আচ্ছা আচ্ছা। তোমাকেতো আরো কয়েকবার দেখেছি। তোমার দেশ যেন কোথায়?

জ্বি নেত্রকোনা।

নেত্রকোনার লোকদের বিশেষত্ব কি বল দেখি।

ফরহাদ চুপ করে রইল। ভদ্রলোক বললেন—নেত্রকোনার বিশেষত্ব হচ্ছে এই অঞ্চলের লোকজন সব সময় উল্টা ভাব ধরে থাকে। বুঝতে পেরেছ কি বললাম?

জ্বি না।

যে বেকুব সে বুদ্ধিমান ভাব ধরে। যে মূর্খ সে জ্ঞানীর ভাব ধরে। যে বেকার সে এমন ভাব ধরে থাকে যেন কোন কোম্পানীর জি এম।

ফরহাদ চুপ করে রইল। তার মেজাজ খুবই খারাপ হচ্ছিল কিন্তু আসমানীর বাবার সঙ্গে মেজাজ খারাপ করার প্রশ্নই উঠে না।

নেত্রকোনার মেয়েদের বিশেষগুণ কি বল দেখি।

বলতে পারছি না।

সেকি—তুমি নেত্রকোনার ছেলে হয়ে নেত্রকোনার মেয়েদের বিশেষ গুণ কি বলতে পারছ না? তাদের বড়গুণ হচ্ছে ঘরের কাজকর্ম তারা খুব ভাল পারে। বাংলাদেশে যত বুয়া আছে তার শতকরা ৬০ ভাগ আসে নেত্রকোনা থেকে। নেত্রকোনা হচ্ছে বাংলাদেশের বুয়া ভান্ডার। ভালমত খোঁজ নিলে দেখবে তোমার আত্মীয় স্বজনদের মধ্যেও দুএকজন এক্সপার্ট বুয়া বের হয়ে যাবে।

কথাগুলি অপমান করার জন্যে বলা। অপমান ফরহাদ গায়ে মাখে না তবু মনটা খারাপ হয়। সে কিছুতেই ভেবে বের করতে পারে নি নেজামত সাহেব তাকে এতটা অপছন্দ কেন করেন। তার পছন্দের মাপকাঠিটা কি?

মেয়ের প্রেমিককে অপছন্দ করা সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে। তাই বলে এত অপছন্দ? সে রাজপুত্র না, তার চেহারা পিটার ও টুলের মত না, বিদেশী কোম্পানীর ভাইস প্রেসিডেন্টও সে না। তারপরেও একজন মানুষের সঙ্গে আরেকজন মানুষ সামাজিক সৌজন্য বজায় রাখবে না? তার মেয়ে আজেবাজে টাইপের একটা ছেলেকে পছন্দ করেছে এই কারণে তিনি যদি রাগ করে থাকেন, সেই রাগটা তিনি করবেন মেয়ের উপর। ফরহাদের উপর না।

কলিংবেলে চাপ দিয়ে ফরহাদ খুবই অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছে। সম্ভাবনা শতকরা ৯০ ভাগ যে দরজা খুলবেন নেজামত সাহেব। রিটায়ার্ড করা লোকজনের উপর সংসারের আজেবাজে কাজগুলি করার দায়িত্ব এসে পরে। ছোট ছেলে হয়ত কলেজের পড়া তৈরি করছে। কলিংবেল শুনে সে যাবে না। কাজের বুয়াও যাবে না। সেও জরুরী কিছু কাজ করছে। পারাটা ভাজছে। একমাত্র কর্মহীন মানুষ হিসেবে বাড়ির কর্তাকেই যেতে হবে। বলাই বাহুল্য দরজা খুলবেন নেজামত সাহেব এবং চোখ মুখ কুঁচকে বলবেন—তুমি কে? কাকে চাও?

ফরহাদকে অবাক করে দিয়ে দরজা খুলল আসমানী। নামকরণের সার্থকতা প্রমাণ করার জন্যেই সে মনে হয় এই ভোরবেলাতেই আসমানী রঙের একটা শাড়ি পরেছে। চুল টান টান করে মাথায় যে টাওয়েলটা পেঁচানো তার রঙও হালকা নীল। ফরহাদ মনে মনে ভাবল-মেয়েরা যদি জানতে গোসলের পর মাথায় টাওয়েল জড়ানো অবস্থাতেই তাদের সবচে সুন্দর লাগে—তাহলে সব মেয়ে বিয়ে বাড়িতে কিংবা জন্মদিনের উৎসবে মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে যেত। বিউটি পার্লারে মাথায় টাওয়েল জড়িয়ে সাজিয়ে দেবার ব্যবস্থা থাকত।

আসমানী বলল, এই আমার চিঠি কখন পড়েছ?

রাত দুটায়।

চিঠিতে কি লেখা ছিল যখন এই চিঠি তোমার হাতে পড়বে তখনি তুমি এ বাড়িতে আসবে। লেখা ছিল না?

হুঁ।

আসনি কেন?

রাত দুটার সময় চলে আসব?

অবশ্যই।

তোমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ান এত রাতে আমাকে কম্পাউণ্ডের ভেতরই আসতে দিত না। সে গেট খুলত না।

গেট না খুললেও ইন্টারকমে খবর পাঠাতে। আমি নিজে এসে তোমাকে নিয়ে যেতাম। তুমি মস্ত একটা সুযোগ নষ্ট করেছ।

কি সুযোগ?

আমার প্রতি তোমার ভালবাসা যে কত তীব্র তা প্রমাণ করার সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারালে। এ রকম সুযোগ আর পাবে না।

পাব।

উঁহু পাবে না। দুদিন পর আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ের পর তুমি আমার জন্যে যত পাগলামীই কর কোন পাগলামী এখনকার মত ভাল লাগবে না। নাশতা খেয়ে এসেছ?

না।

ভাল করেছ। মামার সঙ্গে নাশতা খাও। খেতে খেতে গল্প কর। তারপর তোমাকে নিয়ে আমি বের হব।

কোথায়?

বিয়ের শপিং করব। আমি আজ দশটা শাড়ি কিনব শাড়িগুলি তুমি পছন্দ করে দেবে। আর তোমার জন্য সার্ট পেন্ট এই সব আমি পছন্দ করে কিনব। মামা আমাকে এক হাজার ডলার দিয়েছেন। আচ্ছা শোন–ডলার কোথায় ভাঙ্গাতে হয় তুমি জান?

জানি।

আজ সারাদিনের জন্যে মামা আমাকে একটা গাড়ি ভাড়া করে দিয়েছেন। মাইক্রোবাস। দুজন মাইক্রোবাসে সারাদিন ঘুরব। তোমার অফিস নেইতো?

অফিস আছে।

একদিন অফিসে না যাবার জন্যে নিশ্চয়ই তোমার চাকরি চলে যাবে না?

তা যাবে না। শুধু পাঁচ মিনিটের জন্যে একবার দেখা দিয়ে আসতে হবে।

পাঁচ মিনিট কেন তুমি আধঘন্টার জন্যে দেখা দিয়ে এসো। আমি গাড়িতে বসে কোক খাব আর তুমি আধঘন্টার জন্যে যাবে। হবে না?

হবে।

তোমাকে এমন চিন্তিত লাগছে কেন?

চিন্তিত না। রাতে ভাল ঘুম হয় নি।

আসমানী হাসতে হাসতে বলল—বিয়ের ডেট ফাইন্যাল হবার পর মেয়েরা রাতে এক ফোটা ঘুমুতে পারে না। ছেলেরা নাক ডাকিয়ে ভোস ভোস করে ঘুমায়। তোমার ব্যাপারে দেখি উল্টোটা হচ্ছে।

বিয়ের ডেট ঠিক হয়ে গেছে নাকি?

ইয়েস স্যার। আগামী শুক্রবার।

আসমানী হাসছে। ফরহাদ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। এত সুন্দর করে কোন মেয়ে হাসতে পারে তাই তার কল্পনায় ছিল না। বিয়ের পর আসমানীকে যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে প্রতিদিন ভোরে নাশতা খাবার আগে তোয়ালে দিয়ে মাথা পেঁচিয়ে তার সামনে বসে (উঁহু দাঁড়িয়ে) হাসতে হবে। হাসি থামতে না বলা পর্যন্ত হাসি থামানো যাবে না।

ফরহাদ বলল, তোমার মামা লোক কেমন?

ভয়ংকর টাইপ। একটু উনিশ বিশ করেছ কি তোমাকে কপ করে গিলে ফেলবে।

তোমার বাবার চেয়েও ভয়ংকর?

বাবা ভয়ংকর কোথায়? বাবা খুবই অর্ডিনারী টাইপ মানুষ। সামান্য বোকা। শিক্ষিত বোকা। শিক্ষিত বোকারা যেমন জ্ঞানী জ্ঞানী কথা বলেন। বাবাও তাই করেন। এটাই তার একমাত্র দোষ। রিটায়ার্ড করার পর অফিসে বোকামী করার সুযোগ পাচ্ছে না। যা করার বাসায় করছে।

তোমার মামা জ্ঞানী কথা বলেন না?

না। জ্ঞানী কথা শুনলে তিনি আছাড় দেন। খবর্দার তুমি কোন জ্ঞানী কথা বলতে যাবে না।

উনার নাম কি?

কামরুল ইসলাম। আশ্চর্য তুমি সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছ না-কি? মামা অতি অতি অতি ভালমানুষ। তার সঙ্গে পাঁচ মিনিট কথা বললেই তোমার মন ভাল হয়ে যাবে।

আসমানীর মামা কামরুল ইসলাম উদোম গায়ে চক্রাবক্রা রঙের বার্মিজ লুঙ্গি পরে চায়ের কাপ হাতে বসার ঘরে উপস্থিত হলেন। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। শরীর ভারী। মুখের ভাব গম্ভীর হলেও মানুষটা হাসিখুশি। তিনি এক হাতে নিজের ভুড়িতে থাবা দিতে দিতে অতি পরিচিত ভঙ্গিতে বললেন—তুমি হচ্ছ ফরহাদ?

ফরহাদ উঠে দাঁড়াল।

তিনি বললেন, আসমানী বলছিল তুমি বেঁটে। বেঁটে কোথায়? আমার কাছেতো লম্বাই মনে হচ্ছে। হাইট কত?

পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি।

দাঁড়িয়ে আছ কেন বোস। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি মানে কত সেন্টিমিটার? এক ইঞ্চি সমান কত? ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ ফোর সেন্টিমিটার না?

আমি বলতে পারছি না।

কাগজ কলম নিয়ে বের করে ফেলতো? কলম আছে?

জ্বি না।

আচ্ছা দাঁড়াও কাগজ কলম কিছুই লাগবে না। ক্যালকুলেটর এনে দিচ্ছি। জাপান থেকে গোটা ছএক ক্যালকুলেটর এনেছি। যাকে যাকে উপহার দিতে ইচ্ছা করছে তাদেরকে শুরুতে একটা অংক করতে দিচ্ছি। তারা যখন অংক নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে তখন গিফট হিসেবে ক্যালকুলেটর। ভাল বুদ্ধি না?

জ্বি।

এইবার তোমার ভাইবা শুরু হচ্ছে। নানান ধরনের প্রশ্ন টশ্ন করব। ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। প্রথম প্রশ্ন–তোমার সেন্স অব হিউমার কেমন?

ভাল।

তুমি কি মজার মজার কথা বলে লোকজন হাসাতে পার?

জ্বি না।

তাহলে তুমি কি করে বললে তোমার সেন্স অব হিউমার ভাল?

অন্যের কথায় হাসতে পারি।

অর্থাৎ জোকস ধরতে পার?

জ্বি পারি।

আমি আসমানীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—তুই যে ছেলেটাকে পছন্দ করেছিস, কি জন্যে করেছিস? সে বলেছে, তার সেন্স অব হিউমার দেখে। সেন্স অব হিউমার প্রসঙ্গে এই কারণেই প্রশ্ন করলাম।

ফরহাদ চুপ করে আছে। মানুষটাকে তার পছন্দ হয়েছে। বিদেশে যারা দীর্ঘদিন থাকেন তাদের মানসিকতায় সাধারণত দুধরনের পরিবর্তন হয়। একদল হয়ে পড়েন শুকনা কাঠখোট্টা রোবট। আরেক দল হন অতিরিক্ত রকমের সাধারণ মানুষ। ভদ্রলোক মনে হচ্ছে দ্বিতীয় দলের।

ফরহাদ।

জ্বি।

মেয়েদের কিছু পিকিউলিয়ার ব্যাপার আছে। তারা প্রেমিকের সেন্স অব হিউমার খুব পছন্দ করে কিন্তু স্বামীর সেন্স হিউমার পছন্দ করে না। এটা কি জান?

জি-না।

বিয়ের পর আসমানীর সঙ্গে রসিকতা করলে দেখবে সে বিরক্ত হচ্ছে বা রেগে যাচ্ছে। কিন্তু এখন তোমার সামান্য রসিকতাতেই হাসবে। ব্যাপারটা আমার কাছে সব সময়ই স্ট্রেঞ্জ মনে হয়। যাই হোক এখন তোমার সম্পর্কে বল—

কি বলব?

তুমি অষুধ কোম্পানীতে আছ?

জ্বি।

কোম্পানীর নাম কি?

ওরিয়ন ইন্টারন্যাশনাল।

বিদেশী কোম্পানী?

জ্বি-না। দেশী কোম্পানী।

কাজটা কি?

ছোট কাজ। অষুধের বাক্স নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুরা।

কাজটা করতে ভাল লাগে?

জ্বি-না।

অন্য কোন কাজের চেষ্টা করছ?

তেমন কিছু পাচ্ছি না।

বেতন যা পাও—তাতে কি তোমাদের চলে?

জ্বি।

বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না?

না।

নিজের বাড়ি?

জ্বি-না নিজের বাড়ি না।

নিজের বাড়ি না, কিন্তু ভাড়া দিতে হয় না। এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।

আমাদের এক আত্মীয়ের বাড়ি। তিনি দেশের বাইরে থাকেন।

তোমরা সেই বাড়ির কেয়ার টেকার?

জ্বি।

তোমার আত্মীয় যদি দেশে চলে আসেন তখন কি হবে? কিংবা ধর বিদেশে থেকেই বাড়িটা বিক্রি করে দেন তখন?

ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানীর মামা কিছুক্ষণ উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন। তার পর অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

বোনদের বিয়ে হয়েছে?

আমার একটিই বোন। তার বিয়ে হয়েছে।

বোনের স্বামী কি করেন?

ব্যবসা করেন।

বড় ব্যবসা না-কি ছোট ব্যবসা?

ছোট।

নাশতা চলে এসেছে। পরোটা-ভাজি, মুরগির ঝোল, পায়েস। একটা বাটিতে কলা। বিরাট আয়োজন। নাশতা নিয়ে এসেছে আসমানীর ছোটবোন নিশা। মেয়েটা এম্নিতেই গম্ভীর—আজ তাকে আরো গম্ভীর লাগছে।

সে ফরহাদের দিকে স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে তাকাল। ফরহাদ বলল কেমন আছ নিশা?

নিশা জবাব দিল না। সে ট্রে থেকে টেবিলে নাশতার থালা-বাটি নামাতে ব্যস্ত। এমন ভাব করছে যেন প্রশ্নটা শুনতে পায় নি।

আসমানীর মামা বললেন, ফরহাদ নিশার সঙ্গে তোমার বোধহয় তেমন আলাপ পরিচয় নেই। ও দারুণ রসিক মেয়ে এটা কি তুমি জান?

ফরহাদ বলল, জ্বি-না। জানি না।

ওর গল্পগুজব শুনলে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়। তাকে দেখে অবশ্যি এটা বোঝার কোন উপায়ই নেই। এই নিশা তোর দরজির গল্পটা বলতো।

নিশা গম্ভীর গলায় বলল, গল্পটা মনে নেই মামা।

অবশ্যই মনে আছে বলতো।

নাশতা খাও তারপর বলছি।

আসমানীর মামা বললেন, ও গল্প বলবে না। দাঁড়াও আমিই বলি—এক দরজি তার ছোট ছেলেকে নিয়ে বাজারে গেছে। সেখানে অন্য এক লোকের সঙ্গে দেখা। লোকটা বলল, এ আপনার ছোট ছেলে না? দরজি বলল, হ্যাঁ। লোকটা বলল, আপনার বড় ছেলেটা কত বড়? দরজি বলল, ছোটটার চেয়ে চাইর গিরা বড়।

ফরহাদ তাকিয়ে আছে। কামরুল ইসলাম সাহেব হেসেই যাচ্ছেন। তার হাসির কারণে যে সোফায় বসেছিলেন সেই সোফা কাঁপছে। ফরহাদের কাছে মনে হচ্ছে—শুধু সোফা না, পুরো বাড়িই কাপছে। ফরহাদের হাসি আসছে না। বাড়িঘর কাঁপিয়ে হাবার মত কোন গল্পও এটা না। কিন্তু ভদ্রলোক এমন হাসছেন কেন?

অস্বস্তি দূর করাবার জন্যে হাসছেন? ফরহাদের নিজেকে খুব বোকা বোকা লাগছে।

আরেকটা গল্প বলি শোন। এটা অবশ্যি নিশা বলে নি। কোন এক পত্রিকায় পড়েছিলাম। এক ছেলে তার বন্ধুকে বলেছে—শেষ পর্যন্ত আমার চাচা শান্তি পেয়েছেন। চিরশান্তি। বন্ধু বলল, তোর চাচা কি মারা গেছেন? সে বলল, না চাচা মারা যান নি চাচী মারা গেছেন।

গল্প শেষ করে ভদ্রলোক আগের চেয়েও অনেক বেশী উচ্ছাস নিয়ে হাসছেন। ফরহাদ তাকিয়ে আছে। এক সময় তিনি হাসি থামিয়ে বললেন, তোমাকে পর পর দুটা মজার মজার গল্প বললাম। তুমি একটুও হাস নি। তুমি যে বললে তোমার সেন্স অব হিউমার ভাল—এটাতো তুমি ঠিক বলনি।

 

মাইক্রোবাসে উঠতে উঠতে আসমানী বলল, মামাকে কেমন লাগল।

ফরহাদ বলল, ভাল।

মামা হলেন সেলফ মেড ম্যান। মেট্রিক পাশ করে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তিন বছর তাঁর কোন খোঁজই ছিল না। কেউ জানত না তিনি কোথায়। তিন বছর পর দেশে ফিরলেন। কলেজে ভর্তি হলেন। পাশ করলেন। ইউনির্ভাসিটিতে গেলেন। এম.এসসি শেষ করে আবারো দেশের বাইরে।

বিয়ে করেছেন?

না বিয়ে করেন নি। আমরা বিয়ে করতে বলছি! মামা বলছেন—এখন আমার বয়স চুয়ান্ন চলছে এখন বিয়ে করব কি?

আমি বললাম, মামা পিকাসোসতুর বছর বয়সে বিয়ে করেছিলেন। মামা বললেন, আমি কি পিকাসো নাকি? আমি অতি নগন্য কামরুল ইসলাম।

আসমানী হাসতে হাসতে বলল, মামা যতই না না করুক আমরা উঠে পরে লেগেছি মামাকে বিয়ে দিয়ে দেব।

ভাল। মামা ভাগ্নির এক সঙ্গে বিয়ে।

আসমানী হাসছে। মেয়েরা তাদের হাসি যে কোন সময় চট করে থামিয়ে দিতে পারে। আসমানী পারে না। একবার হাসতে শুরু করলে সে অনেকক্ষণ হাসে। ফরহাদ বলল—আমরা কোনদিকে যাব? প্রথমে তুমি কি ডলার ভাঙ্গাবে?

ডলারতো ভাঙ্গাবই তবে প্রথমে ভাঙ্গাব না। দ্বিতীয়তে ভাঙ্গাবো। প্রথমে গাড়ি করে আমরা এক ঘন্টা ঘুরব। তোমাকে অফিসে কখন যেতে হবে?

বারোটার দিকে গেলেই হবে।

মনে থাকে যেন। জাস্ট পাঁচ মিনিটের জন্যে যাবেও না, সরি তোমাকে আধঘন্টা টাইম দিয়েছিলাম।

পাঁচ মিনিটের বেশী লাগবে না।

আমি তোমাকে লম্বা একটা চিঠি লিখে রেখেছিলাম। তুমি যদি আজ না আসতে এই চিঠি তোমাদের বাসায় দিয়ে আসতাম।

চিঠি কি সঙ্গে আছে?

চিঠি সঙ্গে থাকবে কেন? আমি পোস্টম্যান নাকি?

ফরহাদ সিগারেট বের করল। আসমানী বলল—তুমি দয়া করে জানালার ধার ঘেসে বস। সিগারেটের ধোয়া জানালা দিয়ে বাইরে ফেলবে।

আচ্ছা।

যেদিন বিয়ে হবে সেদিন থেকে কিন্তু তোমার সিগারেট বন্ধ। শুধু ভোরবেলা নাশতার সময় একটা, দুপুরে ভাত খাবার পর একটা এবং রাতে ঘুমুবার আগে একটা।

আচ্ছা।

তবে বিশেষ বিশেষ উৎসবে কয়েকটা সিগারেট এড করা যেতে পারে যেমন তোমার জন্মদিন, তোমার বিবাহ বার্ষিকী…

থ্যাংক য়্যু।

সিগারেটের ধোয়া তোমারতো বাইরে ফেলার কথা ছিল। তুমি ভেতরে ফেলছ কেন?

সরি।

তোমাকে যে চিঠি লিখেছিলাম সেটা কি সত্যি সত্যি পড়তে চাও।

সঙ্গে আছে।

পড়তে চাও কি-না সেটা বল।

অবশ্যই চাই।

পড়লে কিন্তু রাগ করবে। কারণ চিঠিতে মিষ্টি মিষ্টি কোন ব্যাপারই নেই।

না থাকুক।

আসমানী তার কোলে রাখা ব্যাগ থেকে চিঠি বের করল। চিঠির সঙ্গে ছোট্ট একটা আয়না। কিশোরীদের মত আনন্দময় গলায় বলল—চিঠি পড়ার আগে আয়নাটা দেখ। আয়নাটা সুন্দর না?

হুঁ।

না দেখেই বলে ফেললে। এটা হল বিশেষ ধরনের নাইট মেকাপ আয়না। এই আয়নায় পাওয়ারফুল সোলার ব্যাটারী আছে। দিনেরবেলায় সূর্যের আলো থেকে এই ব্যাটারী চার্জ হয়ে থাকে। রাতে বোতাম টিপলেই আয়নার বাল্ক এমনভাবে জ্বলে যে আলোটা ঠিক মুখে এসে পরে। সেই আলোতে আয়নায় মুখ দেখে মেকাপ নেয়া। সুন্দর না?

খুব সুন্দর।

হাতে নিয়ে দেখ। একটা সুন্দর জিনিস তোমার হাতে নিতে ইচ্ছা করে না?

ফরহাদ আয়না হাতে নিল। বোতাম টিপে আলো জ্বালালো। আসমানী বলল, মামা প্রতিবারই যখন বিদেশ থেকে আসে সবার জন্যে মজার মজার জিনিস নিয়ে আসে। নিশার জন্যে কি এনেছে জান? মাকড়সা!

মাকড়সা?

হুঁ। প্লাস্টিকের মাকড়সা। দূর থেকে দেয়ালে ছুঁড়ে মারলে দেয়ালে লেগে যায়। তারপর এক্কেবারে আসল মাকড়সার মত দেয়াল বেয়ে নামতে থাকে।

বল কি?

খুবই ঘিন্নাকর। দেখবে?

তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ নাকি?

তোমাকে দেখাবার জন্যে এনেছি।

এখন আমি মাকড়সা দেখব না। চিঠিটা আগে পড়ি।

তুমি চিঠি পড়বে আমি কি করব?

তুমি জাপানী আয়নায় মেকাপ ঠিক কর। কিংবা মাকড়সা নিয়ে খেলা কর। ফরহাদ চিঠি পড়তে শুরু করল—

এই যে বাবু সাহেব,

আসসালামু আলায়কুম। এবার আপনি এত দেরী করে ঢাকায় ফিরলেন কেন? আমার খুবই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আপনি কি জানেন যখন আমার আপনাকে দরকার হয় তখনি আপনি ঢাকায় থাকেন না। এবং আপনার মধ্যে আছে রাক্ষস স্বভাব। যখন আপনি বলেন দুদিনের জন্যে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি তখন আপনি এক সপ্তাহ পার করে আসেন।

বাবু সাহেব আপনি কি জানেন আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে মোটামুটি ঠিক। পুরো ব্যবস্থাটা যিনি করেছেন তিনি আমার মামা। মামা এমন মানুষ যার মুখের উপর কারোরই কিছু বলার ক্ষমতা নেই। যাই হোক পুরো ঘটনাটা—অর্থাৎ মামা কিভাবে আমার পক্ষে চলে এল সেটা বলি। আমার পুরো ঘটনাটা বলতে ইচ্ছে করছে। মন দিয়ে শোনও সরি মন দিয়ে পড়।

মামা বাসায় এসে পৌঁছলেন সন্ধ্যাবেলা। তাঁর যেদিন আসার কথা ছিল তার একদিন আগে চলে এলেন কাজেই আমরা যে তাকে হৈ চৈ করে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসব তা আর করা গেল না। তিনি বাসায় পা দিতেই চারদিকে আনন্দের বন্যা শুরু হয়ে গেল। মা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করলেন সে কান্নাও আনন্দের কান্না। এই কাঁদছেন এই হাসছেন—মোটামুটি হিস্টিরিয়ার মত অবস্থা। আমরা উপহার নিয়ে টানাটানি করছি। মামা স্যুটকেস খুলে বলেছেন—যার যেটা পছন্দ বেছে নে। এতেই সমস্যা হয়েছে। কাড়াকাড়ি পরে গেছে। সারারাত আমরা কাটালাম গল্প করে। ঘুমে যখন মামার চোখ জড়িয়ে আসে তখন কফি বানিয়ে আমরা মামার ঘুম ভাঙ্গাই। এমন অবস্থা।

সকালবেলা মামার সঙ্গে দেখা করার জন্যে এক ভদ্রলোক এসে উপস্থিত। ভদ্রলোকের নাম আনিস। চব্বিশ পঁচিশ বছর বয়স। লাজুক ধরনের মানুষ। গায়ের রঙ ময়লা হলেও অতি সুদর্শন। মেয়েদের মত টানা টানা চোখ। ভদ্রলোককে বসার ঘরে বসিয়ে মামাকে খবর দিতে গেলাম। মামা বললেন, ও আচ্ছা আনিস। ওকে বসতে বল। চা-টা খাওয়া। তোরা দুই বোন গল্প কর। আমি ঘন্টা দুএক না ঘুমিয়ে উঠতে পারব না। তোরা কোম্পানী দে। নিশা বলল, ভদ্রলোক কি করেন মামা?

মামা হাই তুলতে তুলতে বললেন, জাহাজে কাজ করে। খালাসি ফালাসি হবে।

খালাসি বলেতো মনে হচ্ছে না।

মামা বিরক্ত গলায় বললেন, মানুষের কাপড় চোপড় দেখে কখনোই বিভ্রান্ত হবি না। চেহারা দেখেও হবি না। শেখ সাদীর বিখ্যাত গল্প মনে রাখবি।

মামা ঘুমুতে গেলেন। আমি খালাসি ভদ্রলোককে চা দিতে গিয়ে জানলাম ভদ্রলোক মোটেই খালাসি না। জাহাজের সেকেণ্ড ক্যাপটেন। মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। আমি যখন ভদ্রলোককে বললাম—মামা বলেছেন আপনি জাহাজের খালাসি। উনি মজা পেয়ে খুব হাসলেন। আমি বললাম, জাহাজের গল্প বলুন। তিনি বললেন, জাহাজের কোন গল্প নেই। পৃথিবীর সবচে বিরক্তিকর এবং ক্লান্তিকর জিনিস হচ্ছে জাহাজের চারপাশের সমুদ্রের পানি। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এই জিনিস দেখলে যে কোন সুস্থ মানুষই অসুস্থ হয়ে পরে।

আমি বললাম, হ্যাঁ। এখন আমার চিকিৎসা চলছে।

কী চিকিৎসা?

তিনি হাসতে হাসতে বললেন, স্থল চিকিৎসা। স্থলে সময় কাটাচ্ছি এতেই কাজ হচ্ছে।

মামা দুপুর পর্যন্ত ঘুমুলেন। আনিস সাহেব চলে যেতে চাচ্ছিলেন। নিশা তাকে ধরে রেখে দিল। দুপুরের মধ্যে এই ভদ্রলোক ঘরের মানুষ হয়ে গেলেন। মার সঙ্গে গল্প করলেন, বাবার সঙ্গে গল্প করলেন। এবং দুপুরের খাবারের আগে বাবার একটা লুঙ্গি পরে বাথরুমে গোসল করতে গেলেন। তিনি আবার গোসল না করে খেতে পারেন না।

রাতে মামা চা খেতে খেতে আমার আর নিশার সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে বললেন—এই আসমানী আনিস ছেলেটা কেমন?

আমি বললাম, খুব ভাল। ছেলেরা যতটা ভাল হয় তারচে একটু বেশি ভাল। আরেকটু কম ভাল হলেও ক্ষতি ছিল না।

সে যে অহংকারী কিন্তু এটা বুঝতে পেরেছিস?

না।

বেশ অহংকারী ছেলে। তবে দোষের অহংকার না। ওর দোষের মধ্যে একটাই মদ্যপান করে। জাহাজে চাকরি করলে যা হয়। কিছু করার নাই—তাই মদ খাওয়া। তুই অভ্যাসটা ছাড়িয়ে দিবি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি অভ্যাস ছাড়াব কেন?

মামা বললেন, তুই না ছাড়ালে কে ছাড়াবে? স্বামীর ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব স্ত্রীর না?

তুমি কি বলছ মামা?

আনিসের সঙ্গে তোর বিয়ে দেব। এই জন্যেই ছেলেকে আসতে বলেছি। আনিস যাবার সময় বলে গেছে তোকে তার খুবই পছন্দ হয়েছে। আর আমার ধারণা তোরও ছেলে পছন্দ হয়েছে। ব্যাস আমার দায়িত্ব শেষ। এখন যা করার করবেন কাজি সাহেব।

মামার কথা শেষ হওয়া মাত্র আমি শুরু করলাম কান্না। আমি যেমন হাসতে পারি, তেমন কাঁদতেও পারি। তুমিতো আমাকে কাঁদতে দেখনি। কাঁদতে দেখলে তোমার খবর হয়ে যেত।

কান্নার চোটে আমার হেঁচকি উঠে গেল। নিঃশ্বাস বন্ধ হবার জোগার হল। মামা নিশাকে জিজ্ঞেস করলেন—নিশা! ও এরকম করছে কেন? নিশা বলল, আপার একজন পছন্দের মানুষ আছে বলে এ রকম করছে।

মামা বিরক্ত হয়ে বললেন, পছন্দের মানুষ থাকলে সে পছন্দের মানুষকে বিয়ে করবে। আমি কি তাকে জোড় করে বিয়ে দিচ্ছি না-কি? হাত পা ছড়িয়ে কাঁদার কি হল। এমন বিশ্রী কান্না সে কোথায় শিখল?

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন কান্না বন্ধ করে বল কাকে বিয়ে করতে চাস। যা তাকে ধরে নিয়ে আয়। যা আজ রাতেই বিয়ে দেব।

এই হচ্ছে ঘটনা।

বুঝলেন বাবু সাহেব? চিঠি পড়তে পড়তে আপনার কি আনিস নামের ছেলেটার প্রতি হিংসা হচ্ছিল? হিংসা যাতে হয় এই জন্যেই তার সম্পর্কে বাড়িয়ে বাড়িয়ে অনেক কিছু লিখেছি। ভদ্রলোকের চেহারা আসলেই খালাসির মত।

একটা সত্যি কথা বলি? তোমাকে ছাড়া পৃথিবীর সব ছেলেকেই আমার কাছে খালাসির মত মনে হয়। কি এখন খুশীতো?

ইতি–

তোমার আ

 

দুপুর বারটায় মেইন রোডে গাড়ি রেখে ফরহাদ অফিসে গেল। কান্ট্রি। রিপ্রেজেনটেটিভ অশোক বাবুকে বলবে মফস্বলের আজেবাজে হোটেলে খেয়ে তার ফুড পয়জনিং-এর মত হয়েছে। আজ আর কাল এই দুদিনের ছুটি দরকার। অশোক বাবু ভাল মানুষ ধরনের। তিনি না করবেন না। তাছাড়া সে ছুটিছাটা তেমন নেয় না।

অশোক বাবুকে তার বিয়ের কথাটা বলতে হবে। অনেক দিনতো সে মফস্বলে মফস্বলে ঘুরল এখন যদি তাকে হেড অফিসে ট্রান্সফার করা হয়। এতে অবশ্যি তার রোজগার কমে যাবে। টিএ বিল পাবে না। না পাওয়া গেলে নাই। আসমানীর সঙ্গে থাকা এটাই কম কি?

অশোক বাবু ফরহাদের কথা শুনলেন। বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনে বললেন—কনগ্রাচুলেশন। ঐ মেয়েটির সঙ্গেই কি বিয়ে হচ্ছে যে মাঝে মধ্যে আমার টেলিফোনে টেলিফোন করে আপনাকে চাইতো?

ফরহাদ লজ্জিত গলায় বলল, জ্বি স্যার।

তাকে একদিন আমি একটু ধমকের মত দিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিতে বলবেন।

স্যার এটা কোন ব্যাপারই না। আমি আপনার কাছে হাত জোড় করছি—আমাকে ঢাকায় আনার ব্যাপারটা আপনি একটু দেখবেন।

অশোক বাবু চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে অস্বস্থির সঙ্গে বললেন ফরহাদ সাহেব আপনি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন।

ফরহাদ বলল, এইসব নিয়ে বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলার সাহস আমার নেই। যা করবার আপনি করবেন।

অশোক বাবু শুকনো মুখে বললেন—আপনার চাকরি নিয়েই একটা সমস্যা হয়েছে। আপনার যে কজন—আউট অব টাউন রিপ্রেজেনটেটিভ ছিলেন তাদের সবাইকেই টার্মিনেট করা হয়েছে। আউট অব টাউন সার্ভিসই কোম্পানী উঠিয়ে দিচ্ছে।

সেকি!

আপনি বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলেন। অন্যরা সবাই কথা বলেছে। বড় সাহেব অফিসে আছেন।

ফরহাদ ঘড়ি দেখল। সে আসমানীকে পাঁচ মিনিটের কথা বলে এসেছিল। দশ মিনিট হয়ে গেছে। বড় সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে গেলে আরো আধ ঘন্টা লাগবে।

অশোক বাবু বললেন, কথা বলে অবশ্যি কোন লাভ হবে না। ডিসিসান অনেক আগের। যাই হোক চেষ্টা করতেতো ক্ষতি নেই। আপনাদের মধ্যে যারা সিনিয়ার তাদের অন্য জায়গায় নেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

ফরহাদ সিনিয়ারদের মধ্যে পড়ে না। সে সম্ভবত সবচে জুনিয়ার। সে বড় সাহেবের ঘরের সামনে গেল। বাইরে লালবাতি জ্বলছে। কাজেই এখন যাওয়া যাবে না। সে মাইক্রোবাসের দিকে ফিরে গেল। আসমানী তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ইশারায় হাতের ঘড়ি দেখাল। দূর থেকেই বুঝিয়ে দেয়া দেরী হয়েছে।

আসমানী হাসি মুখে বলল, পাঁচ মিনিটের কথা বলে এগারো মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছ।

ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানী বলল, মুখ এমন করে রেখেছ কেন? বড় সাহেবের বকা খেয়েছ?

ফরহাদ বলল, অফিসের বড় সাহেবরা বকা দেন খুব কম। বকা দিয়ে তারা এনার্জি নষ্ট করেন না। তাদের কাজ কর্ম লেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বকা দেয়ার বদলে—এই প্রতিষ্ঠানে তোমার সার্ভিসের আর প্রয়োজন নেই লিখে নিচে নাম সই করে দেন।

তোমার তাই হয়েছে নাকি?

ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানীকে বাড়ি পাঠিয়ে তার উচিত আবার অফিসে ফিরে আসা। ব্যাপারটা কি খোঁজ নেয়া। নান্টু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা। তার চাকরি গেলে নান্টু ভাইয়েরও গেছে। সেটা সহজ হবে না। নান্টু ভাই সহজ পাত্র না। অতি ঘঘাড়েল লোক। নান্টু ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা অতি সহজ। তাঁর একটা মোবাইল টেলিফোন আছে। সবাইকে বলে দিয়েছেন—ভয়াবহ ইমার্জেন্সি হলে তবেই তাকে টেলিফোন করা যাবে। ইনকামিং কলের চার্জ দেয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। খেজুরে আলাপ করার জন্যে যদি কেউ টেলিফোন করে মিনিট হিসেব করে তাকেই বিল দিতে হবে।

এই তুমি মুখ ভোতা করে বসে আছ কেন? ঠিক করে বলতে, অফিসে কি কোন ঝামেলা হয়েছে?

না।

তাহলে গল্প কর, No মুখ ভোতা বিজনেস।

তুমি গল্প কর আমি শুনি।

আসমানী উজ্বল মুখে বলল, আচ্ছা তোমাকে একটা সহজ ধাঁধা জিজ্ঞেস করি। তুমি যদি ধাঁধাটার জবাব দিতে পার তাহলে আজ সারাদিনে তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব। আর তুমি যদি না পার তাহলে আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে। রাজি?

আমি আসলে ধাঁধা একেবারেই পারি না। এটা খুবই সহজ ধাঁধা। বলতো মানুষের দাঁত কটা থাকে?

বত্রিশটা।

হয় নি। মানুষের দাঁত থাকে ৫২টা। ছোটবেলায় যে দাঁতগুলি থাকে সেগুলি তুমি হিসাবে ধরছ না কেন? সেগুলিও তো দাঁত। কাজেই বাজিতে তুমি হেরে গেলে। এখন থেকে আমি যা বলব তাই তোমাকে শুনতে হবে।

আচ্ছা। আজকের দিনে আমার সব ইচ্ছা তুমি পূর্ণ করবে। আচ্ছা।

বিয়ের রাতে আমি তোমাকে পাঁচটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করব। পাঁচটা ধাঁধার যে কোন একটাও যদি তুমি পার তাহলে বাকি জীবন আমি তোমার কথা শুনব। পাঁচটা ধাঁধাই সহজ। খুবই সহজ। কিন্তু কেউই পারে না।

সহজ হলে পারে না কেন?

সবাই চিন্তা করে জটিল ভাবে তাই পারে না। যাই হোক আজ আমি বাজি জিতে গেছি কাজেই বাজির শর্ত অনুসারে আমার প্রতিটি ইচ্ছা তুমি পূর্ণ করবে। আমার প্রথম ইচ্ছা হল—তুমি আমাকে একটা সার্টের দোকানে নিয়ে যাবে। আমি তোমার জন্যে সাতটা সাত রঙের সার্ট কিনব। একেক দিন একেক রঙের সার্ট পরবে। যেমন রোববারে পরবে মেরুন রঙের সার্ট, শুক্রবার পরবে সাদা রঙের সার্ট। যেন তোমার গায়ের সার্ট দেখে আমি বলে দিতে পারি আজ কি বার।

ফরহাদ ক্লান্ত গলায় বলল, চল যাই। শুধু কিছুক্ষণের জন্যে আমাকে ছাড়তে হবে আমি কার্ডফোন থেকে একটা ফোন করব।

কাকে ফোন করবে?

নান্টু নামের এক ভদ্রলোককে। আমার সঙ্গে কাজ করেন। আমার সিনিয়ার ভাই।

টেলিফোন করতেই হবে? খুবই জরুরী?

হুঁ।

বেশতো আমাকে কোন একটা সার্টের দোকানে ঢুকিয়ে তুমি টেলিফোন করে আস। গুলশানের দিকে চল।

গুলশানের দিকে না গেলে? ঐদিকের দোকানগুলি খুব এক্সপেনসিভ হয়।

হোক এক্সপেনসিভ। আমি তোমাকে একটা উপহার দেব। সস্তা উপহার দেব না-কি? ড্রাইভার সাহেব গুলশানের দিকে যানতো। আর আপনার মাইক্রোবাসে যদি গান শোনার ব্যবস্থা থাকে তাহলে গান বাজান।

হিন্দী গান আছে আপা।

হিন্দী গুজরাটি কোন সমস্যা নেই।

আসমানী ফরহাদের দিকে আরেকটু ঝুঁকে এসে নিচু গলায় বলল, আমার ডান হাতের আঙ্গুলগুলি একটু পরীক্ষা করে দেখতো। আঙ্গুল কি পাঁচটাই আছে না, দু একটা বেড়েছে। আমার দ্বিতীয় ইচ্ছা যা তুমি পুরন করবে তা হল যতক্ষণ গাড়িতে থাকবে আমার হাত ধরে বসে থাকবে। মনে থাকে যেন।

 

মোবাইল টেলিফোনে কাউকে পাওয়া বেশ কঠিন। টেলিফোন করলেই কিছুক্ষণ কট কট, কট কট শব্দ হয়। তারপর খুব মিষ্টি গলায় একটা মেয়ে বলে, সকল চ্যানেল ব্যস্ত। আপনি আবার চেষ্টা করুন। মোবাইল টেলিফোনে নাম্বাররা থাকে এক গাদা। টিপতে টিপতে আংগুল ব্যথা।

অবশ্যি আজ নান্টু ভাইকে প্রথম বারেই পাওয়া গেল। নান্টু ভাই ধমকের গলায় বললেন কে?

ফরহাদ বলল, নান্টু ভাই আমি।

তুই কোথায়?

গুলশানে। গু

লশানে কি করছিস এক্ষুণি চলে আয়।

কোথায় আসব?

অফিসে চলে আয়। কথা নাই, বার্তা নাই পাঁচটা লোকের চাকরি খেয়ে ফেলবে—আর আমরা তাদের বুড়া আংগুল চুষব। পেয়েছে কি? গজব করে দেব না। আমার নাম নান্টু পাগলা।

বড় সাহেবের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে?

এক দফা হয়েছে। বড় সাহেব দেখা গেল আমাকে চিনে না। আইন দেখায়। আমাদের চাকরির শর্ত না-কি এই দিন যেকোন দিন যে কোন কারণ ছাড়াই চাকরি বাতিল হতে পারে। শালা আমাকে আইন দেখায়। আইন আমি তার গুহ্যদ্বার দিয়ে ঢুকায়ে দিব।

নান্টু ভাই আপনার আশে পাশে কেউ নাই?

থাকুক। তুই চলে আয় মারাত্মক প্ল্যান করেছি।

কি প্ল্যান?

অফিসের সামনে আমরণ অনশন। স্ত্রী পুত্র পরিবার সহ। আমি আমার বউ আর তিন বাচ্চা নিয়ে আসব। বাচ্চা তিনটার মধ্যে একটা দুধের শিশু। সে সারাক্ষণ কেউ কেউ করে কাঁদবে।

তিন বাচ্চা আপনি পাবেন কোথায়? আপনারতো একটাই ছেলে।

বৌ বাচ্চা সব ভাড়া করব। তুই এক কাজ কর তোর খালাতো বোন, মামাতো বোন কাউকে রাজি করিয়ে নিয়ে আয় বউ এর প্রক্সি দেবে।

ফরহাদ হাসল। নান্টু টেলিফোনেই ধমক দিল, হাসি বন্ধ। নো লাফিং। চাকরি ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ হাসব না। দাড়ি গোফ কামাব না। পত্রিকার অফিসে খবর দিয়ে আসব। প্রয়োজনে পত্রিকাওয়ালাদের মাল খাওয়াব। মন্ত্রী মিনিষ্টার চেনা জানা আছে?

না।

এমন কাউকে খুঁজে বের কর যাদের মন্ত্রী মিনিষ্টারের সঙ্গে কানেকশান আছে। সবচে ভাল হয় মন্ত্রীর স্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় আছে এমন কাউকে যদি পাওয়া যায়। আমরা স্ট্রেইট ম্যাডামের পা ধরে বসে থাকব। বাঙ্গালীমেয়ের পা একবার ধরতে পারলে সর্ব মুশকিল আসান। পা ধরতে পারাটাই কঠিন। তুই কথা বলে সময় নষ্ট করছিস কেন? চলে আয়।

আসছি।

আসছি না-এক্ষুণি লাফ দিয়ে বেবীটেক্সীতে ওঠ।

ফরহাদ লাফ দিয়ে বেবীটেক্সিতে উঠল না। উঠা সম্ভব না। তাকে সারাদিন আসমানীর সঙ্গে কাটাতে হবে। এক ফাঁকে জাহানারার মেয়ের জন্যে আংটি কিনতে হবে। জাহানারার মেয়ের আজ আকীকা। আংটি পৌঁছে দিতে হবে। সন্ধ্যাবেলা মার সঙ্গে পাঠিয়ে দিলেই হবে। মা সস্তার আংটি দেখে রাগ করবেন। রাগ করলেও কিছু করার নেই।

আসমানী সাতটা সার্ট কিনল রঙগুলি হল—কমলা, গাঢ় নীল, হালকা নীল, হালকা সবুজ, সাদা, ছাই, কাল।

চাইনীজ খেতে বসে কাগজ কলম নিয়ে লিষ্ট করল কোন রঙের সার্ট কখন পরা হবে।

রবিবার : (আনন্দের রঙ) কমলা

সোমবার : (আনন্দের পরই বিষাদ) কাল

মঙ্গলবার : (বিষাদ একটু কম) ছাই রঙ

বুধবার : (আবার আনন্দ ফিরে আসছে) হালকা সবুজ

বৃহস্পতিবার : (আনন্দ বাড়ছে) হালকা নীল

শুক্রবার : (পবিত্রতার রঙ) সাদা

শনিবার : (আর মাত্র একদিন পর রবিবার। খুব আনন্দ) গাঢ় নীল।

আসমানী নিজের জন্যে সাতটা শাড়ি কিনেছে। সবই লাল রঙের। বিয়ের পরের এক মাস সে লাল শাড়ি ছাড়া কিছুই পরবে না। আরেকটা খুব সুন্দর শাড়ি কিনল কণার জন্যে। কণা তার স্কুল জীবনের বান্ধবী।

ফরহাদ বলল, তোমার মধ্যে ভালই পাগলামী আছে।

আসমানী বলল, তা আছে। আচ্ছা শোন তুমি এখনো মুখ এমন আমশি করে রেখেছ কেন? তোমার কি কোন কিছু নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে?

ফরহাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। কিছু বলল না। তার দুঃশ্চিন্তা অবশ্যই হচ্ছে। এই মুহূর্তে দুঃশ্চিন্তার কথা বলে আসমানীর মন খারাপ করিয়ে দেবার কোন মানে হয় না।

দুশ্চিন্তা হল পোকার মত। পোকাটা মাথার ভেতরে মগজে জন্ম। জন্মেই মগজ খাওয়া শুরু করে। মগজ খায় আর আয়তনে বাড়ে। ফরহাদ সেই পোকাটাকে এখন অনুভব করতে পারছে। কুটকুট করে কামড়ে মগজ খাচ্ছে–সেই কুটকুট শব্দও শুনতে পাচ্ছে। আসমানীর হাসি মুখ, তার আনন্দ কোন কিছুই ভাল লাগছে না।

আসমানী বলল, এই একটা ইন্টারেস্টিং জায়গায় যাবে?

কোথায়?

এয়ারপোর্টের কাছে একটা রেস্টুরেন্ট আছে। পানির মধ্যে রেস্টুরেন্ট। নৌকায় করে যেতে হয়।

এত দূরে যাব?

দূরে সমস্যা কি? আমাদের সঙ্গে গাড়ি আছে। গাড়ি ভর্তি তেল। আমরা ইচ্ছ করলে কুমিল্লা চলে যেতে পারি। কুমিল্লা যাবে? চল কুমিল্লা চলে যাই।

কুমিল্লা?

এখন রাস্তা ভাল। যাব আর চলে আসব। রাত হয়ও যদি কেউ কিছু বলবে না।

কুমিল্লা যেতে ইচ্ছা করছে না, চল এয়ারপোর্টের কাছেই চল। নৌকা চালাই।

আসমানী উজ্জ্বল মুখ করে বলল, এক কাজ করলে কেমন হয়। চল আমরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে নৌকায় চড়ি। তারপর নৌকাটা মাঝখানে নিয়ে ড়ুবিয়ে দিয়ে সঁতরে পাড়ে আসি। তুমি নিশ্চয়ই সাঁতার জান?

ফরহাদ বিস্মিত হয়ে বলল, তাতে লাভ কি?

আসমানী হাসি মুখে বলল, যারা রেস্টুরেন্টে মজা করতে এসেছিল তারা বাড়তি মজা পাবে। বাসায় ফিরে গল্প করতে পারবে। রেস্টুরেন্টওয়ালাদেরও উচিত শিক্ষা হবে। পানির নিচ থেকে নৌকা তুলতে হবে। তারা হয়ত এর পর নৌকা ব্যবসা ছেড়ে দেবে। হি হি হি।

আসমানী হেসেই যাচ্ছে। ফরহাদ তাকিয়ে আছে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আসমানী এত হাসছে কেন?

এই শোন চলতো কিছু ক্যাসেটের দোকান থেকে ভাল ভাল ক্যাসেট কিনি। মাইক্রোবাসওয়ালার হিন্দী গান শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা।

চল কিনি।

তুমি অংক স্যারদের মত মুখ করে আছ কেন?

শরীর ভাল লাগছে না। পেট ব্যথা করছে।

পুপু?

পুপু মানে?

পুপু মানে হাগু। হি হি হি। এ রকম অবাক হয়ে তাকাচ্ছ কেন? আমি তোমার বউ, আমি যা ইচ্ছা বলতে পারি। হাগু খুবই ভদ্র শব্দ। আমি এরচে অনেক ভয়ংকর ভয়ংকর শব্দ জানি। যথাসময়ে বলব। রাগ করলেও লাভ নেই।

রাগ করব না।

পেটে ব্যথা কি বেশী?

পেট ব্যথা ছাড়াও তুমি অন্য কোন কিছু নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা করছ। সেটা কি বলতো?

ফরহাদ ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলল। চাকরির সমস্যার কথাটা আসমানীকে বলা কি ঠিক হবে? ফরহাদ বুঝতে পারছে না। মেয়েটা এত আনন্দে আছে তার আনন্দ নষ্ট করা খুবই অনুচিত হবে। ব্যাপারটা গোপন করে যাওয়াও ঠিক হবে না। সরাসরি না বলে অন্য ভাবে হলেও বলা দরকার। বিয়েটা পিছাতে হবে।

আসমানী!

বল।

ভাবছি চাকরিটা ছেড়ে দেব।

কেন?

ঘোরাঘুরির চাকরি ভাল লাগে না। আজ রংপুর তো কাল চাঁদপুর। বেতনও এমন কিছু না। আমি থাকব মফস্বলে, তুমি থাকবে ঢাকায়।

আমি ঢাকায় থাকব তোমাকে কে বলেছে? আমি তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকব। তুমি যেখানে আমিও সেখানে।

পাগল হয়েছ। আমি যে সব হোটেলে থাকি তুমি সে সব হোটেলে ঢুকবেই না। সব সময় যে হোটেলে থাকি তাও না। মাঝে মাঝে ইস্টিশনের বেঞ্চিতে শুয়ে রাত কাটিয়ে দেই।

সেতো আরো একসাইটিং। দুজন স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে গুটুর গুটুর করে গল্প করব। তুমি স্টেশনের টি স্টল থেকে এক কাপ চা নিয়ে আসবে। আমরা দুজন সেই চা ভাগাভাগি করে খাব।

চিন্তা করতে তোমার কাছে যত ইন্টারেস্টিং লাগছে, বাস্তব কিন্তু তেমন ইন্টারেস্টিং না।

ইন্টারেস্টিং ভাবলেই ইন্টারেস্টিং। আর বোরিং ভাবলে বোরিং।

ও।

এ রকম বিশ্রি ভাবে ও বললে কেন?

বিশ্রী ভাবে বলেছি?

খুবই বিশ্রী ভাবে বলেছ। তোমার ও বলা শুনে মনে হয়েছে তোমার পেটের ব্যথা শেষ পর্যায়ে গিয়েছে এবং তুমি প্যান্টে পুপু দিয়েছ। হি হি হি।

ফরহাদ তাকিয়ে আছে। আসমানী হাসি থামিয়ে বলল, অনেক ফাজলামী করেছি আর করব না। চল সুন্দর দেখে কিছু ক্যাসেট কিনি। সর্বশেষ অস্বস্তিকর জিজ্ঞাসা–পেটের ব্যথা কমেছে?

হুঁ।

আচ্ছা আজ আমার এত আনন্দ লাগছে কেন বলতো? আমার ঠিক এই মুহূর্তে কি ইচ্ছা করছে জান?

না। কি ইচ্ছা করছে?

ইচ্ছা করছে মাইকের দোকান থেকে একটা মাইক ভাড়া করতে। সেই মাইকটা পিকনিক পার্টির বাসে যেমন করে বাসের ছাদে ফিট করে, তেমন করে আমাদের মাইক্রোবাসের ছাদে ফিট করব। আমাদের মাইক্রোবাস চলবে। আমাদের পছন্দের গানগুলি আমরা বাজাব। মাঝে মাঝে আমি একটা ঘোষণা দেব। আমি বলব—

ঢাকা নগরবাসি। আমার নাম আসমানী।
আমার পাশে যে যুবকটি বসে আছে তার নাম ফরহাদ।
আমরা আগামী শুক্রবার বিয়ে করছি।
আমাদের বিয়েতে আপনাদের সবার নিমন্ত্রণ। কোন গিফট আনতে
হবে না। তবে খালি হাতে যেহেতু আসতে আপনাদের লজ্জা লাগবে
আপনারা ইচ্ছা করলে একটা করে বেলী ফুলের মালা আনতে পারেন।
বেলী আমার খুব পছন্দের ফুল।

 

ফরহাদ অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। আসমানীর এই রূপের সঙ্গে তার পরিচয় ছিল না। সে হাসি খুশি ধরনের মেয়ে। মজা করে কথা বলতে পছন্দ করে। আবেগ উচ্ছাস সবই পরিমিতির মধ্যে এতদিন পর্যন্ত এ রকম ধারণা ছিল। আজ ধারণা পাল্টে যাচ্ছে। একটা মানুষের ভিতর তিন চারটা মানুষ বাস করে। বিচিত্র পরিবেশে বিভিন্ন জন বের হয়ে আসে। আসমানীর ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। আসমানীর ভেতর থেকে অন্য এক আসমানী বের হয়ে আসছে। যাকে ফরহাদ চেনে না।

আসমানী বলল, তুমি দয়া করে আমার কপালে হাত দিয়ে দেখতে আমার জ্বর কি-না।

কপালে হাত দিয়ে ফরহাদ চমকে উঠল অনেক জ্বর।

আসমানী ক্লান্ত গলায় বলল, জ্বরটা অনেকক্ষণ ধরে টের পাচ্ছিলাম। যতক্ষণ পেরেছি অগ্রাহ্য করেছি। এখন আর পারছি না। চল বাসায় চলে যাই।

চল।

আসমানী ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল—তোমাকে একটা ট্রিকস শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি যখনই দেখবে আমি হড়বড় করে কথা বলছি তখন বুঝবে আমার জ্বর আসছে।

তোমার কি প্রায়ই জ্বর আসে?

হু। একবারতো ডাক্তাররা সন্দেহ করল ব্লাড ক্যান্সার। নানান টেস্ট ফেস্ট করল। তারপর দেখা গেল-ব্লাড ক্যান্সার না। আমার মনটা খুবই খারাপ হল।

কেন?

ব্লাড ক্যান্সার হলে সবাইকে বড় গলায় বলতে পারতাম। তখন সবাই আমার সঙ্গে অন্য রকম করে কথা বলতো। সবাই ভাবতো—আহারে মেয়েটা মাত্র অল্প কিছু দিন বাঁচবে।

মরবিড ধরনের কথা বন্ধ করতো।

ওকে বন্ধ করলাম। আচ্ছা আমার একটা প্রশ্নের সত্যি উত্তর দাও তোমার কি অফিসে চাকরি নিয়ে কোন সমস্যা হয়েছে?

হঠাৎ এই কথা জিজ্ঞেস করছ কেন?

আসমানী বলল, তুমি পাঁচ মিনিটের কথা বলে অফিসে গেলে। এগারো মিনিট ত্রিশ সেকেন্ড পরে ফিরে আসলে। তোমার মুখ ছাই বর্ণ। এর পর থেকে লক্ষ্য করছি তুমি কিছুতেই মন বসাতে পারছ না। তারপর কথা নেই, বার্তা নেই বললে এই চাকরিটা তুমি ছেড়ে দিতে চাচ্ছ। দুই এবং দুই মিলিয়ে আমি চার করেছি। আমার অনেক বুদ্ধি।

তাইতো দেখছি।

তোমার যে চাকরি চলে গেছে এই খবরটা ভুলেও আমাদের বাসার কাউকে জানাবে না। তাহলে আমাকে মামা জাহাজীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে। তোমার সঙ্গে বিয়েটা আগে হয়ে যাক তারপর যা ইচ্ছা থোক। কপালে হাত দিয়ে দেখতো–আমার জ্বর মনে হয় আরো বেড়েছে।

হ্যাঁ বেড়েছে।

মাইক্রোবাসে উঠেই আমি কিন্তু তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ব। তোমার দায়িত্ব হচ্ছে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া। পারবে না?

পারব।

একটা গাছ দশটা পাখি। তিনটা উড়ে গেল। কটা থাকল?

সাতটা। কেন?

এম্নি জিজ্ঞেস করলাম।

এটা কি কোন ধাঁধা?

না কোন ধাঁধা না।

ফরহাদ লক্ষ্য করল আসমানী ঠিকমত হাঁটতেও পারছে না। এলোমেলো ভঙ্গিতে পা ফেলছে। জ্বরের আভায় তার মুখ লালচে হয়ে আছে। ফরহাদের মনে হচ্ছে আসমানীর হাত ধরা মাত্র সে এলিয়ে তার কাঁধে পড়ে যাবে। তাদেরকে বেশ অনেক খানি পথ হাঁটতে হবে। মাইক্রোবাস অনেক দূরে অপেক্ষা করছে।

আসমানী শরীরটা কি খুব বেশী খারাপ লাগছে?

উঁহু।

হাঁটতে পারছ?

পারছি। কিন্তু আমার ফিলিং হচ্ছে আমি ভাসতে ভাসতে যাচ্ছি।

এসো আমার হাত ধর।

হাত ধরব না। হাত ধরলে ভেসে যাবার ফিলিংসটা থাকবে না। আমার মনে হয় তোমাকে কিছুক্ষণের মধ্যে একটা বিপদে ফেলব।

কি বিপদ?

মনে হয় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। নিউমার্কেটে একবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। মিনিটের মধ্যে শত শত লোক জমে গিয়েছিল। একটা সুন্দরী এবং তরুণী মেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে বিরাট ব্যাপার না? খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। আমি আর হাঁটতে পারছি না—আমার হাত ধর। যদি অজ্ঞান হয়ে যাই—মেঝেতে শোয়বে না। কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাবে। মেঝেতে শোয়ালেই শত শত লোক জমে যাবে, তুমি আর আমাকে ভীড় ঠেলে বের করতে পারবে না। বুঝতে পারছ?

পারছি।

আমাকে কোলে করে গাড়ি পর্যন্ত নিতে পারবেতো? আমার ওজন বেশী না। এইটি নাইন পাউন্ডস। খুবই পানির পিপাসা পেয়েছে। তুমি গাড়িতে উঠেই ঠাণ্ডা এক বোতল পানি কিনে আনবে। বড় বোতল আনবে না। ছোট বোতল আনবে। যাতে আমি একাই পুরো বোতল শেষ করতে পারি।

এত কথা বলছ কেন?

যাতে অজ্ঞান হয়ে না যাই এইজন্যই এত কথা বলছি। অজ্ঞান না হবার অনেক কৌশল আছে। একটা কৌশল হল প্রচুর কথা বলা এবং কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নেয়া যাতে ব্রেইনে অক্সিজেন সাপ্লাই বেশী থাকে।

ফরহাদ আসমানীর একটা হাত নিজের কাঁধে তুলে দিয়েছে। কোমর ধরেছে শক্ত করে। তোক তাকিয়ে দেখছে। দেখুক।

এই শুনছ? তোমাকে একটু হিন্টস দেব?

দরকার নেই।

খুব সহজ ধাঁধা। পানির মত সহজ। এই শোন আমার প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে।

পানির ব্যবস্থা করছি।

আচ্ছা এই প্রশ্নটা পারবে? চেয়ারের বাংলা হল কেদারা। টেবিলের বাংলা কি?

জানি না।

কেউ বলতে পারে না। শুধু কণা পেরেছিল। কণাকে চিনেছ—আমার বান্ধবী। তুমি তাকে দেখনি। অতি ভাল মেয়ে। তুমি টেবিলের বাংলা সত্যি জান না?

না।

টেবিলের বাংলা হল—মেজ। ম একের, জ। মেজ। মনে থাকবে?

থাকবে।

এই একটা মজার কথা শুনবে?

হ্যাঁ শুনব।

তুমি যখন সোনার দোকানে আংটি কিনতে ঢুকলে তখন আমি ভেবেছিলাম আমার জন্যে কিনবে। তারপর যখন ছোট্ট একটা আংটি কিনলে তখন কি ভাবলাম জান?

না।

বলতে খুবই লজ্জা লাগছে, কিন্তু বলেই ফেলি—তখন ভাবলাম আমাদের তো একটা বাবু হবে কোন একদিন। জম্নের পর পর তার মুখ দেখার জন্যে তুমি আংটি কিনেছ।

আমার ভাগ্নির আকীকা। তার জন্যে কিনেছি। তুমি যদি চাও তোমার মেয়ের আংটি আমি আগে ভাগে কিনে রাখব।

আমি চাই। অবশ্যই চাই।

আসমানী খুব ঘামছে। তার জ্বর কি কমে যাচ্ছে? না-কি শরীর ঘামা অন্য কোন কিছুর লক্ষণ। ফরহাদ ভয়ে অস্থির হয়ে গেল।

জোবেদ আলি রাতে ভাত খাননি

জোবেদ আলি রাতে ভাত খাননি। রাগ করে ভাত খাননি। রাগের কারণ অতি তুচ্ছ। তাঁর একটা গাছ কে যেন পা দিয়ে মাড়িয়ে ভর্তা বানিয়ে ফেলেছে। গাছটা তিনি তাঁর পরিচিত নার্সারী থেকে অনেক দেন দরবার করে এনেছেন। চারশ টাকা দামের চারা তাকে দিয়েছে দুশতে সেই দুশ টাকাও তিনি দিতে পারেন নি। একশ টাকা দিয়েছেন। একশ বাকি রেখে এসেছেন। জাপানি ফুলের গাছ নাম এরিকা জাপানিকা। বিশেষত্ব হচ্ছে এই গাছে সবুজ রঙের ফুল ফুটে। সবুজ পাতার রঙ, ফুলের রঙ না। সেই কারণেই সবুজ ফুল—অসম্ভব সুন্দর হবার কথা। তিনি কল্পনায় ফুল দেখতেন। বাস্তবে আর দেখা হল না।

তাঁর এই শখের চারাটার উপর কে যেন অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। শুধু যে দাঁড়িয়ে ছিল তা-না দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেয়েছে। সিগারেটের টুকরা তিনি কাছেই পেয়েছেন। কাজটা কে করেছে এখনো বুঝতে পারছেন না। তার সন্দেহ ছোট ছেলে মঞ্জুর উপর। তিনি প্রায়ই লক্ষ্য করেছেন মঞ্জু বাগানে হাঁটাহাঁটি করে সিগারেট খায়। এর আগেও সে একটা পাথরকুচি গাছের চারা মাড়িয়ে চ্যাপ্টা করেছিল। পাথরকুচির জীবনী শক্তি অনেক বেশী বলে গাছটা বেঁচে গেছে। জাপানী গাছের এত জীবনী শক্তি থাকার কথা না। বেচারা বিদেশী মাটিতে বড় হচ্ছে। তার মন পড়ে থাকে জাপানে, তার আসে পাশে সব অপরিচিত গাছ। জীবনী শক্তি বেশী থাকার কথাতো না।

জোবেদ আলি ঠিক করে রেখেছেন—ছোট ছেলেকে আজ তিনি কিছু কঠিন কথা শুনাবেন। এমন কিছু কঠিন কথা যা এই ছেলে অনেকদিন শুনেনি। সিগারেট গাঁজা যা ইচ্ছা খাও—বিছানায় শুয়ে শুয়ে খাও। গাছের উপর দাঁড়িয়ে খাবে কেন?

মঞ্জু রাত নটার মধ্যে বাসায় ফিরে। রেী করে বড় ছেলে ফরহাদ। আজ দুজনই দেরী করছে। করুক দেরী, তিনি অপেক্ষা করবেন। প্রয়োজন হলে সারারাত বারান্দায় বসে থাকবেন।

রাত এগারোটা দশ। তিনি বারান্দার মোড়ায় বসে আছেন। তাঁর খুব ভাল সিধে পেয়েছে। খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম এই বয়সে করা ঠিক না। কিন্তু রাগ কমাতে পারছেন না।

রাহেলা বারান্দায় এসে বিরক্ত গলায় বললেন—তুমি সত্যি ভাত খাবে না?

জোবেদ আলি বললেন, না। আমি ভাতের কাঁথা পুড়ি।

যত বয়স হচ্ছে তুমি তত পুলাপান হয়ে যচ্ছ। ভাত খাবে না কেন?

ক্ষিধা নাই।

একটা গাছ মরে গেছে। তাতে কি হয়েছে। মানুষ মরে যায় আর গাছ। আস ভাত খাও।

বললামতো খাব না।

আমি কিন্তু ভাতে পানি দিয়ে ফেলব।

যা ইচ্ছা দাও।

লোকে বলে না—বুড়ো হলে মানুষের ভীতি হয়—তোমার ভীমরতি হচ্ছে।

ভাল।

আমি কিন্তু আর সাধাসাধি করতে আসব না।

বললামতো আসার দরকার নাই।

এই শেষ আসা।

আচ্ছা।

এই বৃক্ষপ্রীতি জোবেদ আলির আগে ছিল না। রিটায়ার করার পর হয়েছে। যত দিন যাচ্ছে ব্যাপারটা তত বাড়ছে। প্রতিদিন কিছু সময় তিনি সাত মসজিদ রোডের এক নার্সারিতে বসে থাকেন। নার্সারির লোকদের সাহায্য করেন। গোবর মাটি এবং ডাস্টবিনের আবর্জনা মাখিয়ে বৈ সার বানান। গায়ে পড়া কোন সাহায্যই মানুষ সহজ ভাবে নিতে পারে না। তার এই সাহায্যও কেউ সহজ ভাবে নেয় না। লোকটার আসল মতলব খুঁজে বের করার চেষ্টা করে।

টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে রাখলাম। যদি খেতে ইচ্ছা করে খেয়ে আমাকে মুক্তি দিও।

আচ্ছা।

টিফিন কেরিয়ারে দুজনের মত কাচ্চি বিরিয়ানী আছে। জাহানারা দিয়ে দিয়েছে।

আচ্ছা।

ফরহাদকে বলবে কষ্ট করে যেন গরম করে নেয়। আমি রাত জাগতে পারব ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলেছি।

ভাল করেছ। আরো দুটা ঘুমের অষুধ খাও।

এটা কি কথা বললে?

জোবেদ আলি রাগী গলায় বললেন, বলে ফেলেছি বলে ফেলেছি। এখন আমাকে কি করবে? মারবে?

রাহেলা হতভম্ব হয়ে গেলেন। কথাবার্তার একি নমুনা। সামান্য একটা গাছ মরে গেছে আর লোকটা মাথা খারাপের মত কথাবার্তা বলছে। রাহেলা খুব কঠিন কিছু বলার প্রস্তুতি নিয়েও নিজেকে সামলে ফেললেন। ঘুমের অষুধ খাবার পরে রাগারাগি চেঁচামেচি করলে অষুধের ধার কমে যায়। বিছানায় শুবেন ঘুম আসবে না। এরচে ঝগড়াটা কিছু সময়ের জন্যে মূলতুবী থাকুক। স্বামীকে তিনি এত সহজে ছেড়ে দেবার মত মানুষ না। তাছাড়া মেয়ের বাড়িতে যাবার কারণে আজ তার মেজাজ ভাল। আকিকা উপলক্ষে তিনি শেষ পর্যন্ত নাতনীকে একটা চেইন দিতে পেরেছেন। তাঁর গোপন সঞ্চয়ে হাত দিতে হয়েছে। তার জন্যে মেজাজ সামান্য খারাপ ছিল। কিন্তু চেইন দেখে জাহানারা এতই খুশি হল যে মেজাজ খারাপ ভাব সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল। জাহানারা অবশ্যি বলেছে—ইশ মা তোমাকে গলার চেইন দিতে কে বলেছে? নাতনীকে দোয়া করবে—তা না।

দোয়াতো সব সময়ই করি।

এত টাকা খরচ করা তোমার ঠিক হয়নি মা।

একটা লকেটও দেয়ার ইচ্ছা ছিল। হাত একেবারে খালি।

এই রকম বাজে খরচ তুমি করো নাতো মা।

রাহেলা মেয়ের খুশি দেখে খুবই তৃপ্তি পেলেন। ভাগ্যিস আংটি না কিনে শেষ মুহূর্তে সোনার চেইন কিনেছেন। না কিনলে খুব বোকামী হত।

জাহানারা বলল, তোমার জামাই মেয়ের আকিকা উপলক্ষ্যে আমাকে কি দিয়েছ দেখ মা। দুটা বালা বানিয়ে দিয়েছে। একেকটা এক ভরি করে। ডিজাইন আমার পছন্দ হয় নি। কিন্তু আমি কিছু বলিনি বেচারা শখ করে কিনেছে।

কই ডিজাইনতো আমার কাছে সুন্দর লাগছে।

সবাই সুন্দর বলছে কিন্তু আমার কাছে ওল্ড ফ্যাশনড় মনে হচ্ছে। তাছাড়া বালা পরলে বয়স বেশি বেশি লাগে। আমি এগুলি ভাঙ্গিয়ে পাতলা করে চারটা চুড়ি বানাব। সব সময় পরা যায় এমন চুরি।

ভুলেও এই কাজ করবি না। জামাই জানতে পারলে মনে কষ্ট পাবে।

ও জানতেই পারবে না। একমাস পরে নিজেই ভুলে যাবে যে আমাকে বাবা দিয়েছিল।

জামাইয়ের ব্যবসা কি ভাল যাচ্ছে না-কি।

ওদেরতো মা অনেক রকম ব্যবসা। একটা খারাপ গেলে অন্যটা ভাল যায়। তুমি এসেছ খুব ভাল হয়েছে। তোমার সঙ্গে আমার খুবই জরুরী কিছু কথা আছে।

কি কথা?

এখন না। খাওয়া দাওয়া শেষ হোক তারপর বলব। মুখ এমন শুকনা করে ফেলেছ কেন? খারাপ কিছু না। খুবই ভাল একটা ব্যাপার আছে। তোমার জামাই আমাকে বলেছে তোমার সঙ্গে কথা বলতে। কাজেই আমি যা বলব সেটা হল অফিসিয়াল।

এখনই বল। আমার হাত পা কাঁপছে।

হাত পা কাপাতে হবে না। বললাম না, ভাল খবর।

জাহানারা রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। রাহেলা মেয়ের হাসি দেখেও তেমন স্বস্তি পেলেন না। তাঁর জীবনে ভাল কিছু ঘটতে পারে এই বোধই নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁর জীবনটা এমন এক পর্যায়ে গেছে যে এখন ঘটনা মানেই দুর্ঘটনা। স্বপ্ন মনেই দুঃস্বপ্ন। রাহেলা দুঃশ্চিন্তা নিয়ে সময় কাটাতে লাগলেন। নাতনীর আকীকা উপলক্ষ্যে তিন চারশ লোককে দাওয়াত দেয়া হয়েছে। প্যান্ডেল খাটানো হয়েছে বিয়ে বাড়ি বিয়ে বাড়ি ভাব। রাতে না-কি আবার কাওয়ালী হবে। বাচ্চু কাওয়ালকে খবর দেয়া হয়েছে। রাহেলার খুব ইচ্ছা কাওয়ালী দেখে যাওয়া। রাত বেশি হলেও সমস্যা হবে না। জামাইদের গাড়ি আছে। শাশুড়ীকে জামাই নিশ্চয়ই নামিয়ে দিয়ে যাবে।

কাওয়ালীর আসর থেকে জাহানারা মাকে উঠিয়ে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। রাহেলার বুক ধরাস ধরাস করতে লাগল। জাহানারা গলা নামিয়ে বলল, মা আমার ননদকে তুমি দেখেছ রাণী নাম। দেখেছ না?

রাহেলা বললেন, হুঁ।

খুব সুন্দর মেয়ে না?

রাহেলা আবারো ক্ষীণ স্বরে বললেন, হুঁ।

এমন মিহি করে হু বলছ কেন? সুন্দর মেয়েকে সুন্দর বলতে সমস্যা কোথায়?

একটু মোটার ধাত আছে।

তা আছে। সেটা এমন কিছু না। মেয়েটা ভাল। নিজের ননদ বলে বলছি না—আসলেই ভাল মেয়ে।

রাহেলা মেয়ের কথার আগামাথা কিছুই ধরতে পারছেন না। মেয়ে ভাল হলে তার কি যায় আসে?

জাহানারা বলল, আমার শ্বশুর বাড়ির সবার খুব ইচ্ছা রাণীর সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ে হোক। ভাইয়াকে তাদের সবার খুবই পছন্দ।

রাহেলা বললেন, ও এই ব্যাপার।

জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, মা তুমি দেখি পুরো ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলে দিলে। এরা সাত ভাইয়ের মধ্যে একটা বোন। সবার চোখের মণি। মেয়ের নামে একটা বাড়ি ঢাকা শহরে আছে। তার বয়স যখন বার তখনি তার বিয়ের জন্যে তিন সেট গয়না বানিয়ে রাখা হয়েছে। বুঝতে পারছ কিছু?

হুঁ।

ভাইয়ার জন্যে এরচে ভাল বিয়ে হবার না। ওরা ভাইয়াকে যত পছন্দই করুক। আমিতো জানি ভাইয়া মোটামুটি অপদার্থ একজন মানুষ। এম,এসসি পাশ করে তিন বছর টিউশনি করেছ। একে অপদার্থ ছাড়া কি বলবে? এই ফ্যামিলির একটা মেয়েকে বিয়ে করলে ভাইয়ার ভাগ্য ফিরে যাবে।

রাহেলা বললেন, ফরহাদের পছন্দের একটা মেয়ে মনে হয় আছে। কয়েকবার বাসায় এসেছে।

জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, এইসব ফালতু প্রেম ভাইয়াকে হজম করে ফেলতে বল। প্রেম আবার কি? পেটে ভাত থাকলে তবেই না প্রেম। উপাস পেটে আবার প্রেম কি? মা শোন ভাইয়াকে তুমি অবশ্যই রাজি করাবে।

দেখি।

দেখাদেখি না মা। ভাইয়াকে রাজি না করাতে পারলে আমার মান-সম্মান থাকবে না।

তোর মান-সম্মানের কথা আসছে কেন?

কারণ আমার শাশুড়ি নিজে আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছেন। আমি উনাকে বলেছি-আম্মা আপনি নিশ্চিত থাকেন। আমি ব্যবস্থা করছি।

তুই আগবাড়িয়ে কথা বলতে গেলি কেন?

আমি কেন বলব না?

আত্মীয়ের সঙ্গে আত্মীয়তা ভাল না।

জাহানারা বলল, মা শোন এই বিয়েটা শুধু ভাইয়া না তোমাদের সবার জন্যে দরকার। যেই আমি ভাল একটা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি ওমি তুমি ভাব ধরে ফেলছ। ঠাণ্ডা মাথায় বিবেচনা কর—ঢাকা শহরে যে বাস করছ তোমাদের পায়ের নিচে কি মাটি আছে? না মাটি নেই। আর রাণীর নামে ঢাকায় যে বাড়ি আছে সে বাড়ি থেকে মাসে ভাড়াই আসে আঠারো হাজার টাকা।

বলিস কি? সাত কাঠা জমির উপর বাড়ি। দোতলা বাড়ি—তিন তলার ফাউন্ডেশন আছে।

ও।

আমার শাশুড়ির নিজস্ব সম্পত্তি আছে অনেক। মায়ের সম্পত্তিতে মেয়ের অংশ বেশি এটা নিশ্চয়ই তুমি জান। কি জান না?

জানি।

জাহানারা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি মেয়ে মানুষ। বাপ ভাইয়ের সংসারের জন্যে মেয়েরা কিছু করতে পারে না। তারপরেও আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করলাম। বাকিটা তোমাদের বিবেচনা।

রাহেলা তারপরেও অনেকক্ষণ মেয়ের বাড়িতে রইলেন। কাওয়ালী শুনলেন। মেয়ের শাশুড়ির সঙ্গে বসে চা খেলেন। জামাই টাটকা দুধ খাবার জন্যে একটা গাই কিনেছে। দুইবেলা দুধ দেয় ছ কেজি দুধ। সেই গাই দেখে তার গায়ে হাত বুলালেন এবং তার সমস্ত কর্মকান্ডের ফাঁকে ফাঁকে রাণী মেয়েটাকে লক্ষ্য করলেন। শুরুতে তাকে যতটা মোটা লাগছিল শেষের দিকে তা আর লাগল না। বরং তাঁর কাছে মনে হল মেয়েটা শুধু যে সুন্দর তাই না—অতিরিক্ত ভদ্র বিনয়ী। বৌ হিসেবে একশতে নব্বুই পঁচানব্বুই পাওয়ার কথা। বড়লোকের মেয়ে একটু দেমাগী হবেই। কি আর করা। দেমাগ করার সামর্থ যার আছে সে দেমাগ করলেও তেমন দোষের কিছু হয় না।

রাহেলা বাসায় ফিরলেন আনন্দ নিয়ে। মেয়ে মাকে গাড়িতে তুলে দিতে এসে এক ফাঁকে একটা খাম হাতে দিয়ে বলল, ব্লাউজের ভেতর নিয়ে নাও তো মা। এটা মেয়ের পুরানো টেকনিক। খামে কিছু টাকা আছে। রাহেলা যতবারই মেয়ের কাছে এসেছেন এরকম একটা খাম পেয়েছেন। স্বামীর সংসার থেকে মাকে টাকা দেয়া খুব দূষনীয় ব্যাপার বলেই গোপনীয়তা। প্রথম দিকে রাহেলা ক্ষীণ আপত্তি করতেন। এখন করেন না। ছেলের হাতের টাকা যদি নেয়া যায় মেয়ের হাতের টাকাও নেয়া যায়।

জাহানারা বলল, টিফিনকেরিয়ারে সামান্য খাবার দিয়ে দিলাম মা। খাওয়া সর্ট পরে গেছে বলে বেশি দিতে পারি নি। দুজনের হবে। টিফিনকেরিয়ারটা ফেরত পাঠিও। আর ভাইয়াকে যেভাবেই হোক রাজি করাবে। আমার কোন স্বার্থ নেই। মা। এটা মনে রেখে এগুবে।

রাহেলা বললেন, আচ্ছা।

আজ রাতে ভাইয়াকে কিছু বলার দরকার নেই। আজ রাতটা ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা কর। আর বাবাকে এই মুহূর্তে কিছু বলবে না।

আচ্ছা।

পুরোপুরি সবকিছু ফাইন্যাল না হওয়া পর্যন্ত বাবা যেন কিছুই না জানে। বাবা সবকিছু আউলা করে ফেলে। এখানেও আউলা করবে।

রাহেলা হাসলেন। এই হাসিতে কিছু তৃপ্তিও আছে। মেয়ের সংসারী বুদ্ধি দেখে তৃপ্তির হাসি। বিয়ের আগে বোঝাই যায় নি—এই মেয়ে এত সংসারী হবে। এর সঙ্গে প্রেম, তার সঙ্গে প্রেম। ঘুমের অষুধ খাওয়া, স্টমাক ওয়াশ। কি বিশ্রী দিন কেটেছে। আজ মেয়ের স্বামী সংসার দেখে ঈর্ষা হয়। কি সুখেই না আছে। কে বলবে এই মেয়ে লোফার টাইপ একটা ছেলের জন্যে ঘুমের অষুধ টষুধ খেয়ে কত কাণ্ড করেছে। বিয়ে হল সব শেষ। এত বড় সংসার হাতের মুঠোয় নিয়ে মেয়ে সুখে আছে তার জন্যে এটাই বড় আনন্দ।

খাম খুলে দুটা পাঁচশ টাকার নোট পেয়েছেন। চেইন কিনতে সতেরোশ টাকা লেগেছিল তার অনেকটাই উঠে এসেছে। তার গোপন সঞ্চয়ে টাকাটা চলে যাবে। আবার কোন দুর্যোগে কাজে লাগবে। ছেলেরা যে সারা জীবন তাঁকে দেখবে তাতো। তাদের সংসার হলেই তারা আস্তে আস্তে সরে পড়তে থাকবে। এটাও দোষের। এটাও সংসারের কঠিন নিয়মের এক নিয়ম। ফরহাদের বাবা সংসারী মানুষ হলে তিনি এত ভাবতেন না। লোকটা মোটেই সংসারী না। গাছ মরে গেলে যে ভাত খাওয়া বন্ধ করে দেয় তার উপর বিশ্বাস রাখা যায় না। তাকে খরচের খাতায় ধরতে হয়। তাছাড়া পুরুষ মানুষের হায়াত কম হয়। মেয়েরা হয় কচ্ছপের মত দীর্ঘদিন বেঁচে থাকে। ফরহাদের বাবা বেঁচে থাকবে না, তিনি অর্থ হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকবেন তখন তার হবে কি? কার উপর ভরসা করবেন? কে দেখবে তাকে? তবে ফরহাদের বাবারা দীর্ঘজীবি গুষ্ঠি। ফরহাদের দাদার বয়স আশি দাঁড়িয়ে গেছে। দিব্যি বেঁচে আছেন। অসুখ বিসুখ হচ্ছে কিন্তু তেমন জটিল হবার আগে সেরেও যাচ্ছে। আরো কতদিন তিনি ঝুলে থাকবেন কে জানে? অচল একজন মানুষ সংসারে থাকলে সংসারটাও অচল হয়ে যায়। তার সংসার অচল হয়ে গেছে। এই দুঃখের কথা কাউকে বলা যায় না। বললে লোকে ছিঃ ছিঃ করবে।

ঘুমের অষুধ খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিছানায় যাবার নিয়ম নেই। আধ ঘন্টা ঠাণ্ডা মাথায় সময় কাটিয়ে ঘর অন্ধকার করে ঘুমুতে যেতে হয়। মাথা ঠাণ্ডা হবে কি ভাবে? ঘুমের অষুধ খাবার পর পর এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে যে মাথা গরম হতে শুরু করে। একজন ভাত খাবে না, গাছের শোকে পাথর। স্বামীকে অভুক্ত রেখে ঘুমুতে যাওয়া সংসারের জন্যে অমঙ্গলের।

এই কাজটাই তাকে বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। চুলা ধরিয়ে খাবার গরম করার কথা বলেছেন। এটা নিয়েও দুঃশ্চিন্তা হচ্ছে—চুলা ধরিয়ে ঠিকমত নিভাবেতো? গ্যাসের চুলার চাবিতে কিছু সমস্যা আছে। চাবি বন্ধ করলেও ঠিকমত বন্ধ হয় না। গ্যাস বের হতে থাকে। একবার খবরের কাগজে পড়েছিলেন—-গ্যাসের চুলা বন্ধ ঠিকমত করা হয়নি বাড়ি ভর্তি হয়ে গেল গ্যাসে। তখন বাড়ির কর্তা সিগারেট ধরাবার জন্যে ম্যাচ জ্বালিয়েছেন ওমি সারা বাড়িতে আগুন লেগে গেল। এক পরিবারে পাঁচজনের মৃত্যু। বেঁচে রইল শুধু বুড়ো নানী। এই অর্থব প্যারালিসিসের রোগী নড়তে পর্যন্ত পারে না। সে একা টিকে গেল। আল্লাহর বিচার বোঝা খুবই মুশকিল।

রাহেলা ঘড়ি দেখলেন, আধ ঘন্টা পার হতে এখনো পাঁচ মিনিট বাকি আছে। তিনি শ্বশুরের ঘরে ঢুকলেন। জেগে থাকলে দু একটা ভাল কথা বলবেন। আজ দুপুরে বুড়োর সঙ্গে খুব চেঁচামেটি করেছেন। বুড়োর তেমন দোষ ছিল না। খুব যারা বুড়ো তাদের কিছু বুঝতেই পারে না। তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করলেও তারা বুঝে না। খারাপ ব্যবহার করলেও বুঝে না।

রাহেলা ঘরে ঢোকা মাত্র মেম্বর আলি বললেন, কে বউমা। ভাল আছ?

রাহেলা বললেন, জ্বি ভাল।

খাওয়া দাওয়া করেছ?

জ্বি।

আলহামদুলিল্লাহ। আমারে খেতে দিবা না?

সন্ধ্যার সময় না আপনারে খাওয়ায়ে গেলাম।

নাশতা হিসাবে খেয়েছিলাম এখন আবার ভুখ চাপছে।

এই বয়সে খাওয়া দাওয়ার অনিয়ম করা যাবে না। ডাক্তারের নিষেধ আছে। পেট ছেড়ে দিবে। এই বয়সে পেট ছেড়ে দিলে সর্বনাশ।

ঘরে কি আজ পোলাও হয়েছে?

পোলাও হবে কেন? এটা কি রাজবাড়ি যে প্রতিদিন পোলাও হবে।

পোলাওয়ের গন্ধ পেয়েছি।

জাহানারার বাসা থেকে সামান্য কাচ্চি বিরিয়ানী পাঠিয়েছে। আজ তার মেয়ের আকীকা ছিল।

তস্তুরীতে করে একটু বিরিয়ানী দাও। খেয়ে দেখি।

বিরিয়ানী আপনাকে দেওয়াই যাবে না। এই বয়সে বিরিয়ানী আপনার জন্যে বিষ। লোভ কমাতে হবে।

গন্ধটা নাকে গেলতো…তারপর থেকে।

এত গন্ধ নিতে হবে না। আপনি ঘুমান।

নাম কি?

কিসের নাম কি?

জাহানারা মেয়ের নাম কি রেখেছে?

হোসনে আরা খানম।

আলহামদুলিল্লাহ্ সুন্দর নাম। জাহানারাকে বলবা আমি তার কন্যার জন্যে খাস দিলে দোয়া করেছি।

আচ্ছা বলব। এখন আপনি ঘুমান।

পেটে ভুখতো ঘুম আসতেছে না।

পানি খাবেন? এক গ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে থাকেন।

খালি পেটে পানি খাওয়াও ঠিক না। পিত্তনাশ হয়। আচ্ছা মা যাও। তুমি ঘুমাতে যাও।

রাহেলা ঘুমুতে গেলেন। এবারের ঘুমের অষুধগুলি ভাল—তার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এসে গেল।

 

ফরহাদ ফিরল রাত সাড়ে দশটায়। আসমানীকে বাসায় নামাতে গিয়ে দেরী হল। আসমানীর মা তাকে খেয়ে যেতে বললেন। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। আসমানী বলল, আমার শরীর এখন খুবই ভাল লাগছে। আমি রান্না করব।

ফরহাদ বলল, তুমি ভয়ংকর অসুস্থ। রান্নার নামও মুখে আনবে না।

আসমানী বলল, একবার যখন বলেছি রান্না করব, তখন রান্না করবই।

ফরহাদ বলল, আমি একজন ডাক্তার নিয়ে আসি সে দেখুক তোমার প্রেসারের কোন সমস্যা আছে কি-না। তুমি অজ্ঞানের মত হয়ে গিয়েছিলে।

আমি মোটেই অজ্ঞান হইনি। ভান করছিলাম। আমি অজ্ঞান হলে তুমি কি কর এটাই আমার দেখার ইচ্ছা ছিল।

বাসায় পুরুষ মানুষ কেউ নেই। সবাই কার যেন জন্মদিনে গিয়েছে। ফরহাদকে একা একা বসে থাকতে হল। একটু পর পর আসমানী এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছিল।

এই যে বাবু সাহেব! খুব বোর হচ্ছ?

না।

তোমার জন্যে খুব কিছু রান্নার করার ইচ্ছা ছিল। ঘরে কিছু নেই। ডীপ ফ্রীজে সব সময় কিছু না কিছু থাকে। আজ ডীপ ফ্রীজ খালি। আমি তোমার জন্যে আলু ভাজি করছি। আলু ভাজি খাও?

খাই।

গাওয়া ঘি মাখিয়ে আলু ভাজি। দেখ খুব ভাল লাগবে। সঙ্গে থাকবে ভাজা শুকনা মরিচ।

ভাল।

শুধু একটাই সমস্যা ঘরে পাতে খাবার ঘি নেই।

আসমানী তুমি আমার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ো না।

তোমার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হবোনাতো কার খাবার নিয়ে ব্যস্ত হব? এখন বল চা খাবে না, সরবত খাবে। মামা জাপান থেকে সবুজ রঙের কি একটা সিরাপ এনেছেন। সিরাপের সরবত খুব ভাল হয়। এক গ্লাস বানিয়ে দিই?

দাও।

আমার ইচ্ছা করছে রান্না ঘরে তোমার জন্যে মোড়া পেতে দেই। তুমি মোড়ায় বসে আমার রান্না দেখবে আর আমি রান্নার ফাঁকে ফাঁকে গুটুর গুটুর করে গল্প করব। মা খুবই রাগ করবে বলে বলতে পারছি না। আচ্ছা শোন, তুমি কি কোন গল্পের বই পড়বে। গল্পের বই এনে দেব?

কিছু আনতে হবে না। তুমি রান্না শেষ কর।

সবুজ রঙের সরবত এনে আসমানী উজ্জ্বল মুখে বলল, পাতে খাব ঘি সমস্যার সমাধান হয়েছে। ঘরে একটিন মাখন আছে-মাখন জ্বাল দিয়ে ঘি করব।

ভাল। কর।

যাই কেমন।

রাত দশটায় আসমানীর মা এসে গম্ভীর গলায় বললেন, তুমি খেতে এসো। টেবিলে খাবার দেয়া হয়েছে। আসমানীর শরীর খুবই খারাপ। সে খাবে না শুয়ে পড়েছে।

বেশী খারাপ?

বেশী খারাপতো বটেই জোর করে আগুনের কাছে গিয়েছে।

আমি ওকে একটু দেখে আসি।

তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি খেতে বোস।

ফরহাদ খেতে বসল। আসমানীর মা কঠিন মুখ করে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন।

এই অবস্থায় খাওয়া যায় না। গলায় ভাত আটকে যায়। ফরহাদের গলায় ভাত আটকে যেতে লাগল। আসমানীর মা বললেন, তুমি যাওয়ার পথে বড় রাস্তার পলাশ ফার্মেসী বলে একটা ফার্মেসী দেখবে। ফার্মেসীর যে কোন একজনকে বলবে আসমানীর শরীর খারাপ। তারা ডাক্তার পাঠাবে।

আসমানীর নাম বললেই হবে?

হ্যাঁ নাম বললেই হবে। ওর ছোট মামা ডাক্তার। সে ঐ ফার্মেসীতে বসে। ফার্মেসীর উপরের তলায় তার বাসা।

জ্বি আচ্ছা বলব।

তুমি ভালমত খাওয়া শেষ কর। আসমানীকে নিয়ে দুঃচিন্তা করার কিছু নেই—মাঝে মধ্যে ওর এ রকম শরীর খারাপ করে। ঘর বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে রেস্ট নিলে শরীর সেরে যায়। আলু ভাজি নিচ্ছ না কেন? আলু ভাজি নাও—আসমানী তোমার জন্য করেছে। বাটিতে ঘি আছে ঘি নাও।

ফরহাদ ভেবেছিল চলে আসার সময় আসমানীর সঙ্গে দেখা হবে তাও হল না। সে মন খারাপ করে পলাশ ফার্মেসীর দিকে রওনা হল। ডাক্তার সাহেবকে খবর দিয়ে বাসায় ফিরল হাঁটতে হাঁটতে। খুব যখন মন খারাপ থাকে তখন রিকসায় চড়তে ভাল লাগে না। হাঁটতে ইচ্ছা করে।

 

জোবেদ আলি অন্ধকার বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। ছোট ছেলের জন্যে অপেক্ষা। ফরহাদ বাসার গেটে হাত রাখা মাত্র জোবেদ আলি বললেন, কে মঞ্জু?

ফরহাদ বলল, জ্বি না আমি। আপনি এখনো জেগে আছেন? ঘুম আসছে না?

জোবেদ আলি রাগী গলায় বললেন—ঘুম আসবে কি ভাবে? বাগানের সব গাছ পাড়িয়ে মেরে ফেলেছে।

কে মেরেছে?

মঞ্জু মেরেছে। আর কে মারবে। এরিকা জাপানিকা গাছটার কি অবস্থা করেছে। আয় দেখে যা।

অন্ধকারে দেখব কি ভাবে?

আয় আমার হাতে টর্চ আছে।

ফরহাদকে বাবার সঙ্গে বাগানে যেতে হল। জোবেদ আলি টর্চ ফেলে বললেন-ভাল করে দেখ। সুস্থ সবল একটা গাছের কি অবস্থা করেছে। মানুষকে মানুষ খুন করলে তার বিচার আছে। আইন আদালত আছে, শাস্তি আছে। অথচ গাছ হত্যা করলে তার শাস্তির বিধান নাই। গাছওতো জীবন। গাছ হত্যার শাস্তি আরো বেশী হওয়া উচিত কারণ গাছের জীবন থাকলেও সে প্রতিবাদ করতে পারে না, কেউ যখন তাকে হত্যা করতে আসে সে ছুটে পালিয়ে যেতে পারে না। ঠিক বলেছি কি-না বল।

ফরহাদ বাবার প্রশ্নের জবাব দিল না কলঘরের দিকে রওনা হল। তার নিজের শরীরও খারাপ লাগছে। হাত মুখ ধুয়ে শুয়ে পড়বে। জোবেদ আলি ছেলের পেছনে পেছনে কলঘরে চলে এলেন।

তোর খাবার টেবিলে টিফিন কেরিয়ারে রাখা আছে। খেয়ে নে—আজ তোর মা জাহানারার কাছে গিয়েছিল। সে কাচ্চি বিরিয়ানী দিয়ে দিয়েছে। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করে নিতে হবে।

জাহানারার কথা বলতেই ফরহাদের মনে পড়ল তার পকেটে আংটিটা রয়ে গেছে। দেয়া হয়নি। আজ আকীকা আজই দেয়া দরকার ছিল। আংটি ঠিকই কেনা হয়েছে। দেয়ার কথা মনে হয় নি। জোবেদ আলি বললেন, হাত ধুয়ে খেতে আয়।

ফরহাদ বলল, আমি খেয়ে এসেছি।

দাওয়াত ছিল?

হ্যাঁ।

দাওয়াত থাকলে আগে বলে যাবি। সবার জন্যে রান্না হয়। খাবার নষ্ট হয়। আজ তিনজনের ভাত নষ্ট হল। তোর আমার আর মঞ্জুর।

তুমি খাও নি?

খাও নি কেন?

মঞ্জুর উপর রাগ করে খাই নি। কেমন বেয়াদপের মত চারাটা নষ্ট করল। রাগের চোটে ক্ষিধে নষ্ট হয়ে গেছে ভাত কি খাব।

এসো খেতে এসো।

জোবেদ আলি আপত্তি করলেন না ছেলের সঙ্গে খেতে গেলেন। টিফিনকেরিয়ারে কাচ্চিবিরিয়ানী ছাড়াও ঘরে ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে। তিনজনের জন্যে তিনপিস ইলিশ মাছ ছিল। জোবেদ আলি তিন পিসই খেয়ে ফেললেন। আনন্দিত গলায় বললেন–সর্ষে ইলিশ রান্না খুবই জটিল। বাংলাদেশের খুব কম মেয়ে সর্ষে ইলিশ রাধতে পারে। তোর মা আগে পারত না। তোর দাদী হাতে ধরে রান্না শিখিয়েছে। এখন তোর মার কাছ থেকে ঐ বিদ্যা শিখে নেয়া দরকার। তোর বিয়ে হলে বৌমাকে প্রথম যে কাজটা করতে বলব সেটা হচ্ছে—শাশুড়ির কাছ থেকে সর্ষে বাটা রান্না শিখে নেয়া। বৌমা ঐ বিদ্যা শেখাবে তার ছেলের বৌকে…ঐ ভাবে চলতে থাকবে।

ফরহাদ বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। জোবেদ আলি এখন আংগুল চুষে চুষে সর্ষে ইলিশের ঝোল খাচ্ছেন। তিনি ছেলের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তোর হাতে টাকা পয়সার অবস্থা কেমন?

ভাল না। কেন?

টাকা পয়সার অবস্থা ভাল থাকলে জাপানিকা গাছের একটা চারা কিনতাম! সবুজ ফুল হয়। ডেনজারাস না?

চারা কিনতে কত লাগবে?

আড়ইশ টাকা দাম। আমাকে অবশ্যি দেড়শতে দিয়ে দিবে।

ফরহাদ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে দুটা একশ টাকার নোট পানির গ্লাসের নিচে চাপা দিল। বাবাকে সরাসরি টাকা দিতে লজ্জা লাগছে। সব সময় লাগে। তাকে টাকা দিতে গেলেই ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। স্কুলে বনভোজন পনেরো টাকা চাঁদা। সেই চাঁদার জন্য এক সপ্তাহ ধরে বাবার পেছনে পেছনে ঘোরা। বাবার কত কঠিন কঠিন কথা।

বনভোজন আবার কি? বন আছে না-কি যে বনভোজন? স্কুলের মাঠে আবার বনভোজন কি। মাঠ-ভোজন। দশ টাকা নিয়ে যা—ওদেরকে বল, আমার কাছে দশটাকাই আছে। নিলে নাও। না নিলে নাই। মাঠ ভোজনের জন্যে পনেরো টাকা এক আশ্চর্য ব্যাপার। ঘরে ঘরে যেন টাকশাল আছে। টাকা ছাপালেই হল।

এখন চাকা ঘুরে গেছে। এখন জোবেদ আলি শুকনা মুখে ছেলের পেছনে পেছনে ঘুরেন।

জোবেদ আলি ডালের বাটিতে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন দুইশ লাগবে না তুই পঞ্চাশ টাকা রেখে দে। সংসারের এই অবস্থা। এখন বাজে খরচ করা ঠিক না।

কথা শেষ করার আগেই তিনি হাত বাড়িয়ে নোট দুটা নিয়ে নিলেন। ফরহাদ দি সত্যি সত্যি পঞ্চাশ টাকা রেখে দেয় তাহলে সমস্যা হবে। তিনি চন্দনগাছের একটা চারা কিনবেন বলে মনস্থির করে ফেলেছেন। চন্দন গাছের চারা আগে পাওয়া যেত না। এখন ইন্ডিয়া থেকে আসছে। শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দন দুরকম চারা আসছে—শ্বেত চন্দনটিই ভাল। তবে গাছ খুব নাজুক। শক্ত খুঁটির ব্যবস্থা করতে হবে।

জোবেদ আলি তৃপ্ত গলায় বললেন—চা খাবি নাকি রে? খেলে বল আমি বানিয়ে দেব। সমস্যা নেই। হেভী খাবার পর চা হজমের সহায়ক এবং বলবর্ধক।

না চা খাব না।

তোর কাছে সিগারেট আছে? থাকলে একটা দে। চা খাওয়া হয়েছে একটা সিগারেট খেলে ভাল লাগবে। কে যেন বলেছিল ভরাপেট খাওয়ার একটা সিগারেট হজমের সহায়ক তবে আমার মনে হয় না। সিগারেট বিষবৎ পরিতাজ্য।

ফরহাদ সিগারেট দিতে দিতে বলল, বাবা তোমাদের একটা খবর দিতে ভুলে গেছি।

জোবেদ আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কি খবর?

বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি।

জোবেদ আলি কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থেকে হড়বড় করে বললেন, এটা ঠিক করাকরি কি আছে? বিয়েতো করতেই হবে। আমাদের ইসলাম ধর্মে সন্ন্যাসের কোন স্থান নেই। যত ইচ্ছা আল্লা বিল্লা করতে পার তবে সংসারে থেকে।

ফরহাদ মাথা নিচু করে বলল, এমন কিছু বিয়ে না বাবা। কাগজে কলমে বিয়ে। কাজী সাহেবের সামনে কবুল কবুল বলা।

বিয়েটা কবে?

ডেট এখনো পুরোপুরি ফাইন্যাল হয়নি তবে শুক্রবারে হবার সম্ভাবনা।

এই শুক্রবার?

হ্যাঁ এই শুক্রবার।

তোর মা জানে?

না মা জানে না। তোমাকেই প্রথম বললাম। জোবেদ আলি সিগারেট হাতে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। তিনি সিগারেট ধরাতে ভুলে গেছেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি নিজের ছেলেকে চিনতে পারছেন না।

আজ কি বার?

আজ মঙ্গলবার।

তোর হাতে তো তাহলে একেবারেই সময় নাই।

ফরহাদ চুপ করে রইল। জোবেদ আলি বললেন, বিয়ে যে করবি হাতে টাকা পয়সা আছে? অফিস থেকে লোন পাবি?

অফিসের কথা ফরহাদ এতক্ষণ ভুলে ছিল। বাবার কথায় চট করে মনে হল। আজ রাতেই নান্টু ভাইয়ের কাছে যাওয়া দরকার। রাত অনেক হয়ে গেছে তাতে কি। নান্টু ভাইয়ের মেস সারারাতই ভোলা থাকে। হেঁটে যেতে আধঘন্টার মত লাগবে। রিক্সা করেও যাওয়া যায়। হেঁটে যাওয়া ভাল। আফটার ডিনার ওয়াক এ মাইল।

জোবেদ আলি বললেন, মেয়েটাকে কিছু গয়না টয়না দিতে হবে। সুতা বেঁধে তো আর বিয়ে করতে পারবি না। তোর মাকে যখন বিয়ে করি তখন আমার তোর মতই খারাপ অবস্থা তার মধ্যেও তোর মাকে হাতের চুড়ি দিয়েছি, কানের দুল দিয়েছি, টিকলি দিয়েছি। শুধু গলায় কিছু দিতে পারি নি। ওরা গলারটা দিয়েছিল। মুখে বলেছে—তিন ভরি সোনার হার। স্যাকড়ার দোকানে ওজন নিয়ে দেখি দুই ভরি দুই আনা। কত বড় বদ চিন্তা করে দেখ। যাই হোক তুই একটা কাজ কর। তোর মার কাছ থেকে গলার হারটা নিয়ে পালিশ টালিশ করিয়ে মেয়েকে দে।

ফরহাদ কিছু বলল না। জোবেদ আলি বললেন—বিয়ের শাড়ি কিনতে হবে। যাই হোক শাড়ি নিয়ে তুই চিন্তা করিস না। শাড়ির ব্যবস্থাটা তুই আমার হাতে ছেড়ে দে।

শাড়ি তুমি কিনে দেবে?

আরে দুর ব্যাটা। আমি শাড়ি কেনার টাকা পাব কোথায়? আমার এক ছাত্র মীরপুরে কাতান শাড়ির দোকান দিয়েছে। দোকানের নাম ক্যালকাটা শাড়ি হাউস। একদিন গিয়েছিলাম, খুব যত্ন করেছে। চা-সিংগারা মিষ্টি খাইয়েছে। ওর দোকান থেকে বাকিতে শাড়ি এনে দেব।

আচ্ছা।

জোবেদ আলি গলার স্বর নামিয়ে প্রায় ফিস ফিস করে বললেন, তোর মার হাতে ক্যাশ টাকা আছে। কত জানি না। তবে আছে। আপাতত তার কাছ থেকে নে। আমি যে তোকে বলেছি সেটা যেন আবার না জানে।

ফরহাদ বাবার দিকে তাকিয়ে হাসল। তার হাতের সিগারেট নিভে গেছে দিকে লক্ষ্য নেই। নেভানো সিগারেটই তিনি টানছেন। এবং ধোয়া ছাড়ার ভঙ্গি করছেন।

তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব দুঃশ্চিন্তা করছিস। একেবারেই দুঃশ্চিন্তা করবি না। আল্লাহর হুকুম ছাড়া বিয়ে হয় না। আল্লাহ পাকের হুকুম হয়েছে বলেই বিয়ে হচ্ছে। আল্লাহ পাকের হুকুম যেন ঠিকমত পালন হয় সেই ব্যবস্থাও উনিই করেন। দেখবি বিয়ের টাকা ঠিকই জোগাড় হবে। ঐ যে কথায় আছে না সর্প হইয়া দংশন কর ওঝা হইয়া ঝাড়। ব্যাপার সে রকমই।

আমি দুঃশ্চিন্তা করছি না—বাবা শোন আমি একটু বেরুব। তুমি দরজা বন্ধ করে দাও।

এত রাতে কোথায় বের হবি?

একটা কাজ আছে বাবা। না গেলেই না। রাতে ফিরব না। কাজেই দরজা খোলার জন্যে তোমাকে জেগে থাকতে হবে না।

জোবেদ আলি চিন্তিত গলায় বললেন, বিয়ে ঠিক ঠাক হবার পর রাতে বিরাতে বের হতে হয় না। সাবধানে থাকতে হয়।

কেন?

কেন তা জানি না। পুরানা কালের মানুষরা নিয়ম করে গেছেন।

আমার খুব দরকার বাবা। যেতেই হবে।

যেতে হলে যা। তবে সাবধানে যাবি। তোকে তো আসল কথাই জিজ্ঞেস করা হয় নি- বৌমার নাম কি?

ডাক নাম আসমানী।

মাশাল্লাহ সুন্দর নাম। ভাল নাম কি?

ভাল নাম জানি না বাবা।

জোবেদ আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, শুক্রবারে যার সঙ্গে বিয়ে হবে তার ভাল নাম জানিস না, বৌমা এই ঘটনা যদি জানে মনে খুবই কষ্ট পাবে।

জানবে না।

জানবে না কেন? অবশ্যই জানবে। আমি নিজেই বলে দেব। আমার খুবই রাগ লাগছে। আরেকটা কথা, শুক্রবারে তোর বিয়ে এই ঘটনা তুই আমাকে আগে বলেছিস এতেও তোর মা রাগ করবে। আমাকে যে আগে বলেছিস এটা তোর মাকে জানানোর দরকার নেই। পরে তোর মা যখন আমাকে বলবে তখন আমি খুবই অবাক হবার ভঙ্গি করব। তোর মা কিছু বুঝতে পারবে না।

ফরহাদ উঠে পড়ল। বাবার সামনে বসে থাকলে তিনি ক্রমাগতই কথা বলতে থাকবেন। শুধু শুধু দেরী হবে।

জোবেদ আলি বললেন, তোর দাদাজানকেও বিয়ের কথাটা নিজের মুখে বলিস। মুরুব্বী মানুষের দোয়া বিয়ে শাদীতে অত্যন্ত দরকার। তোর দাদাজান জেগে আছে—এখনি বলে যা।

এত রাতে দাদাজান জেগে আছেন কেন?

জানি না। সন্ধ্যা থেকে বিড়বিড় করছে।

শরীর খারাপ না-কি?

শরীর খারাপ হলেতো ঝিম মেরে থাকবে। বিড়বিড় বিড়বিড় করবে না। শরীর মনে হয় ভালই।

ফরহাদ দাদাজানের ঘরে ঢুকল। ঘর অন্ধকার। দাদাজানের খাটে মশারী ফেলা। অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে তিনি মশারীর ভেতর বসে আছেন—দৃশ্যটাই অস্বাভাবিক। হঠাৎ বুকে ছোট্ট একটা ধাক্কা লাগে। ফরহাদ বলল, দাদাজান জেগে আছেন?

মেম্বর আলি বললেন, হুঁ।

শরীর খারাপ না-কি?

শরীরটা আজ ভাল।

জেগে আছেন কেন? ঘুম আসছে না?

খুব ভুখ লেগেছে। এইজন্যে ঘুম আসছে না।

রাতে খান নি?

সন্ধ্যাবেলা বৌমা সাগু দিয়েছিল।

এখন কিছু খেতে ইচ্ছা করছে?

হুঁ।

কি খাবেন?

পোলাও খেতে ইচ্ছা করতেছে।

এত রাতে পোলাও কোথায় পাব দাদাজান?

জাহানারা পোলাও পাঠায়েছে।

ও আচ্ছা। আপনি খাবেন? দেব গরম করে?

দে।

পেট খারাপ করবে নাতো?

মেম্বর আলি হতাশ গলায় বললেন, খুব ভুখ লেগেছে রে ব্যাটা। পিরিচে করে সামান্য এনে দে খাই। কিচ্ছু হবে না।

আচ্ছা আমি নিয়ে আসি।

আমি তোর জন্যেই জেগে বসেছিলাম। আর কেউ খেতে দিক না দিক তুই যে দিবি এটা আমি জানি।

ফরহাদ পোলাও গরম করল। লেবু কাটল, কাচামরিচ নিল, ঘরে আমের আচার ছিল, প্লেটের কোণায় সামান্য আচারও নিল। বুড়ো যখন কুপথ্য করবে ভালমতই করুক। সাগু খেলেও পেট খারাপ, পোলাও খেলেও পেট খারাপ। ভাল জিনিশ খেয়েই পেটটা খারাপ করুক।

খাবার সাজিয়ে ঘরে ঢুকে ফরহাদ দেখল দাদাজান বিছানায় শুয়ে ঘুমুচ্ছেন। গাঢ় ঘুম। অনেক চেষ্টা করেও সেই ঘুম সে ভাঙ্গাতে পারল না। এম্নিতেই অনেক রাত হয়েছে। আর দেরী করা ঠিক হবে না। ফরহাদ বাতি নিভিয়ে দিল। আজ নান্টু ভাইয়ের কাছে না গিয়ে সকালে গেলে কেমন হয়? শরীর দুর্বল লাগছে। শেষ পর্যন্ত সে যাওয়াই ঠিক করল। তার মন বলছে যে উদ্বেগের ভেতর সে আছে—নান্টু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে সেটা অনেকটা কমবে। বাগানে নেমেই ফরহাদ দেখল—গেটের কাছে গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়ি থেকে নামছে মঞ্জু। মঞ্জুর হাতে সিগারেট। বড় ভাইকে দেখে সে সিগারেট ফেলে দিল। হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি কি বের হচ্ছ?

হ্যাঁ।

এত রাতে?

জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে। যেতেই হবে।

কোথায় যাবে?

আগামাসিহ্ লেন।

এক কাজ কর গাড়ি নিয়ে যাও।

কার গাড়ি?

ভাড়া গাড়ি। সারা দিনের জন্যে ভাড়া করেছিলাম। আমি ড্রাইভারকে বলে দিচ্ছি ও তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।

তাহলে তো ভালই হয়।

ফরহাদ মঞ্জুর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার কারণ আছে। মঞ্জু খুব স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। সে ঠিকমত দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না–সামান্য টলছে। মঞ্জুর মুখ ভর্তি জর্দা দেয়া পান। জর্দার কড়া গন্ধ মদের গন্ধ ঢাকতে পারছে না।

মঞ্জু কি একা একা হেঁটে বাসায় ঢুকতে পারবে। গেটের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাবে নাতো? সবচে ভাল হয় তাকে ধরে ধরে বাসায় নিয়ে যাওয়া। সেটাও ঠিক হবে না। মঞ্জু লজ্জা পাবে। মানুষকে লজ্জা দিয়ে লাভ কি?

একটা কাজ করলে কেমন হয়? গাড়ি যখন আছে তখন ড্রাইভারকে বললে হয় না—আগামসি লেনে যাব না। আমাকে উয়ারীতে নামিয়ে দিয়ে চলে যান। রাত খুব বেশি হয় নি। তাছাড়া ঐ বাড়িতে আজ উৎসব। উৎসবের বাড়ির লোকজন নিশ্চয়ই অনেক রাত পর্যন্ত জাগবে। একটাই সমস্যা জাহানারা নানান ধরনের আহ্লাদী করবে। এটা খাও, ওটা খাও। ওমা এত রোগা হয়েছ কেন? চোখের নিচে কালি কেন?

সহজ স্বাভাবিক মেয়েরা বিয়ের পরে ন্যাকা ধরনের হয়ে যায়। বাপের বাড়ির কাউকে পেলে নানান ধরনের ন্যাকামী করে। যাকে নিয়ে ন্যাকামী করা হচ্ছে তার কাছে যে ব্যাপারটা অসহ্য লাগে তা বুঝতেই পারে না।

শেষবার যখন ফরহাদ গিয়েছিল জাহানারা ধরা গলায় বলল, ভাইয়া আমি তোমার বোন না? ছমাস পর তুমি আমাকে দেখতে এলে? কেন এসেছ? না তুমি বসতে পারবে না। তুমি চলে যাও। বলতে বলতে কেঁদে কেটে বিশ্রী অবস্থা। ফরহাদের ধারণা জাহানারার ন্যাকামী বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে।

ফরহাদ ড্রাইভারকে বলল, ড্রাইভার সাহেব আমাকে আগামসি লেনে নামাতে হবে না। উয়ারীতে নামিয়ে দেন।

ড্রাইভার বিরক্ত মুখে বলল, আগে কইবেন না?

আগে না বলাটা খুবই অন্যায় হয়েছে ক্ষমা করে দিন।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে মনে হয় বৃষ্টি হবে। জাহানারার বাড়িতে যাবার সিদ্ধান্ত ভুল হয়েছে। ফরহাদের মন বলছে সে বাড়িতে ঢুকবে এবং শুরু হবে বৃষ্টি। জাহানারা শুরু করবে ন্যাকামী। না ভাইয়া তুমি যেতে পারবে না। বৃষ্টির মধ্যে তুমি যদি যাও আমি কিন্তু ভয়ংকর কিছু করে বসব। তুমি আজ কতদিন পর এ বাড়িতে এসেছ ভেবে দেখ।

বৃষ্টি নামল না কিন্তু জাহানারা ভাইকে দেখে ন্যাকামীর চূড়ান্ত করল। কিছু মুখে না দিয়ে সে ফরহাদকে যেতে দেবে না। সেই কিছু মানে পোলাও মুরগির রোস্ট। খাবার কম পড়েছিল বলে নতুন করে রান্না হয়েছে। নতুন রান্না মুখে দিতেই হবে। ফরহাদ যদি না পায় সে খাবে না। দুপুরেও সে ঝামেলার জন্যে খেতে পারে নি।

ফরহাদ বিরক্ত মুখে বলল, কেন এত যন্ত্রণা করছিস?

জাহানারা বলল, ভাইয়া তোমার দুর্ভাগ্য যে তোমার একটা বোন আছে। বোন যখন আছে সেতো যন্ত্রণা করবেই বোনকেতো আর ফেলে দিতে পারবে না? -কি ফেলে দেবে?

ফরহাদকে ভরাপেটে আবারো খেতে বসতে হল। খাবার নিয়ে এল জাহানারার ননদ রাণী। ফরহাদ বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল রাণী মেয়েটা তাকে দেখে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। এই মেয়েকে সে অনেকবার দেখেছে কিন্তু এত লজ্জা পেতে কখনো দেখে নি। আজ এত লজ্জা পাচ্ছে কেন?

ভাইয়া আমার ননদ রাণীকে চিনতে পারছতো?

হ্যাঁ।

দেখছ কি সুন্দর মেয়ে? সুন্দর না ভাইয়া?

ফরহাদ বলল, অবশ্যই সুন্দর।

জাহানারা হাসছে। ফরহাদ তার হাসির কারণ ধরতে না পেরে অবাক হয়ে তাকাল। রাণীর হাতে পোলাওয়ের ডিস, সে ডিস নামিয়ে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে গেল। ফরহাদ বলল, ব্যাপার কি রে?

জাহানারা হাসতে হাসতে বলল, ব্যাপার আবার কি? ব্যাপার কিছু না। মা তোমাকে কিছু বলে নি?

না।

মার সঙ্গে দেখা হয় নি?

না মা ঘুমুচ্ছিলেন।

ভাইয়া তুমি হাত গুটিয়ে বসে আছ কেন? না বললে হবে না, তোমাকে আরেকবার পোলাও নিতে হবে। রাণীর আক্কেলটা কেমন তোমাকে একবার পোলাও দিয়ে চলে গেল। সেকি চায় আমার ভাই খালে পড়ক। দাঁড়াও ওকে নিয়ে আসছি।

ওকে আনার দরকার কি?

দরকার আছে। আমি বিনা দরকারে কোন কাজ করি না।

জাহানারা গর্বিত ভঙ্গিতে চলে যাচ্ছে। ফরহাদের মেজাজ খুবই খারাপ। আংটি নিয়ে আসা ঠিক হয় নি। মা সোনার চেইন দিয়েছেন এই খবরটা আগে জানতে

নান্টু ভাইয়ের ভাল নাম–আব্দুল কাদের জিলানী

নান্টু ভাইয়ের ভাল নাম–আব্দুল কাদের জিলানী। বড় পীর সাহেবের নামে নাম। এই নাম সকলের সহ্য হয় না। আকিকার পর থেকে শুরু হল অসুখ বিসুখ। হাম সারলে হয় টাইফয়েড। টাইফয়েড সারলে হেপিং কফ। হোপিং কফ গেল তো শুরু হল ঘুসঘুসে জ্বর। বাচ্চাদের থাকবে মাথাভর্তি চুল। দুবছর বয়সে ছেলের মাথার সব চুল উঠে গেল। জ্বীন ভূতের আছর হতে পারে মনে করে মওলানা ডাকিয়ে আনা হল। মওলানা বললেন, জ্বীন ভূত কিছু না। নামের আছর পরেছে। বড় পীর সাহেবের নামে নাম রাখাই ভুল হয়েছে। আব্দুল কাদের নাম রাখলেই হত। নামের শেষে জিলানী যুক্ত হওয়াতে বিপদ শুরু হয়েছে।

নান্টুর বাবা বললেন, আরেকটা আকিকা করে নাম বদলাব?

মওলানা বললেন, সেইটাও ঠিক হবে না। যা করতে হবে তা হচ্ছে ভাল নামে কখনো ডাকা যাবে না। ভুলেও না। ভাল নাম কাউকেই জানানো যাবে না। সব কাজ সারতে হবে ডাক নামে।

সেই থেকে নান্টু। মেট্রিক সার্টিফিকেটেও নান্টু। ইন্টারমিডিয়েট সার্টিফিকেট, বিএসসি-ডিগ্রী সবজায়গায় না। ভাল নাম মুখে না নেয়ার কিছু উপকারিতা পাওয়া যাচ্ছে। তার শরীর এখন খুবই ভাল। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-বাদল কিছুই তাকে কাবু করতে পারে না। তবে আজ নান্টু সাহেব সামান্য কাবু। প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। মাথা ধরার চিকিৎসা হচ্ছে। মডার্ন সেলুনের নাপিতকে ধরে আনা হয়েছে। সে রাত এগারোটা থেকে মাথা বানাচ্ছে। ঘন্টা হিসেবে চুক্তি। ঘন্টায় পঁচিশ টাকা। নাপিত আধ ঘন্টা ননস্টপ মাথা বানিয়ে পঞ্চাশ টাকা কামিয়ে ফেলেছে কিন্তু মাথা ধরার ঊনিশ বিশ হচ্ছে না। বরং মাথা ধরা আরো বেড়েছে। নান্টুর ধারণা মাথার ভেতরের সুক্ষ্ম কোন নাট বল্টু আলগা হয়ে গেছে। দেয়ালে মাথা ঠুকে কায়দা মত করে ধাক্কা দিতে পারলে নাট বল্ট জায়গামত ফিটিং হয়ে যেত। সাহসে কুলুচ্ছে। অনেক আগে একবার সে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিল। রীতিমত রক্তারক্তি। ডাক্তারের কাছে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। ডাক্তার সাহেব সব শুনে বলেছেন—যা করেছেন করেছেন। ভবিষ্যতে এরকম কখনো করবেন না। অন্ধ হয়ে যাবেন বুঝেছেন-অন্ধ। মাথা ধরা কোন রোগ না—নানান সমস্যায় মাথা ধরে। শারীরিক সমস্যা, মানসিক সমস্যা। সেই সমস্যার চিকিৎসা করতে হবে। দেয়ালে মাথা ঠুকাঠুকি না। আপনারা সমস্যা কি?

নান্টু দাঁত বের করে হেসে ফেলে বলেছে, স্যার আমার কোন সমস্যা নেই। শারীরিক, মানসিক কোন সমস্যাই নেই। একটাই সমস্যা। মাথা ধরা।

তার কথা ঠিক না। নান্টুর বড় ধরনের সমস্যা আছে। সমস্যা এ রকম যে তা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করা সম্ভব না। ডাক্তার সাহেবকে সে নিশ্চয়ই বলতে পারে না, স্যার আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার একটা সমস্যা চলছে। সে আমার সঙ্গে থাকে না। তার বাবার বাসায় থাকে। আমার একটা পাঁচ বছরের ছেলে আছে। তার নাম অর্ণব। সেও মার সঙ্গে থাকে। ছেলেটার জন্যে যখন খুবই মন কাঁদে তখন মাথা ধরে যায়। মাথা ধরার এই হল রহস্য।

আজ অর্ণবের বাবার কাছে এসে থাকার কথা ছিল। বিকালে চলে আসবে রাতে থাকবে। সকালে অর্ণবকে মার কাছে পৌঁছে দিয়ে নান্টু চলে যাবে অফিসে। অর্ণব প্রায়ই বৃহস্পতিবার রাতে এসে বাবার সঙ্গে থাকে। শুক্র শনি স্কুল বন্ধ। এখন সামারের ছুটি চলছে যে কোন সময় আসতে পারে। ছুটিছাটার সময় বাবার সঙ্গে বেশি সময় কাটাবে এটাইতো যুক্তিযুক্ত।

নান্টু বিকেলে ছেলেকে আনতে গেল। শ্বশুর বাড়িতে যাওয়া বলে কথা, খালি হাতে উপস্থিত হওয়া যায় না। মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই শর্মিলার খুবই প্রিয়। এক কেজি রসমালাইয়ের একটা হাড়ি নিয়ে গেল।

শর্মিলা রসমালাইয়ের হাড়ি হাতে নিতে নিতে শুকনা গলায় বলল, অর্ণব আজ যেতে পারবে না।

নান্টু হতভম্ব হয়ে বলল, কেন?

সে তার ছোটমামার সঙ্গে ময়মনসিংহ গিয়েছে।

নান্টু আবারো বলল,কেন?

শর্মিলা বিরক্ত গলায় বলল, মামার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছে এর আবার কেন কি? সকাল থেকেই সে নাচানাচি করছে মামার সঙ্গে ময়মনসিংহ যাবে।

এই কথাতেই নান্টুর মাথা ধরল। অর্ণব জানে আজ সে বাবার সঙ্গে থাকবে তারপরেও সকাল থেকে মামার সঙ্গে নাচানাচি করবে কেন? সে নাচ শিখল কবে? তাছাড়া ময়মনসিংহে আছে টা কি?

শর্মিলা বলল, তুমি কি চা খাবে?

নান্টু চা খেতে ইচ্ছা করছে না। তবু সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। খাবার অজুহাতে কিছুক্ষণ শর্মিলার সামনা সামনি বসে থাকা যায়। বাপের বাড়িতে থাকতে শুরু করার পর থেকে যত দিন যাচ্ছে শর্মিলা তত সুন্দর হচ্ছে। কে বলবে তার পাঁচ বছর বয়েসী একটা ছেলে আছে। মনে হয় ক্লাস এইট নাইনে পড়া কোন কিশোরী। প্রাইভেট টিচারের কাছে অংক করছিল, নান্টু নামের এক লোক এসেছে শুনে দেখা করতে এসেছে। লোকটা চলে গেলেই বেণী দুলিয়ে পড়তে বসবে।

শর্মিলা চায়ের কাপ সামনে রাখতে রাখতে বলল, তোমার অফিসের কাজকর্ম কেমন চলছে?

নান্টু ক্ষীণ স্বরে বলল, ভাল।

মুখে মুখে তোমার সব কিছু তো ভাল চলে। আসলেই কি ভাল?

নান্টু কিছু বলল না। শর্মিলা রাগতে শুরু করেছে। রাগলে তার নাক সামান্য ফুলে উঠে। শর্মিলার সঙ্গে কথা বলার সময় তার নাকের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। রাগের সময় চুপচাপ থাকাটা ভাল বুদ্ধি। শর্মিলা বলল, তোমাকে যে উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করতে বলেছিলাম করেছ?

মোটামুটি আলাপ করেছি। ফাইন্যাল কিছু হয়নি।

মোটামুটি আলাপটা কি?

ডিভোর্সের সবচে সহজ পদ্ধতি হল মিউচুয়েলি করা। দুজন এক সঙ্গে কাজীর অফিসে উপস্থিত হতে হবে। লইয়ার থাকবে। কাবিন নামার কপিটা লাগবে।

শর্মিলা বলল, কাবিন নামাটা তো আমার কাছেই আছে। একটা দিন ঠিক করে গেলেই হয়।

নান্টু সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, যাব। অফিসে সামান্য ঝামেলা যাচ্ছে। ঝামেলাটা শেষ হোক।

ঝামেলা শেষ হবে কবে?

সপ্তাহখানিকের বেশি লাগবে না। এই সপ্তাহটা যাক—পরের সপ্তাহে।

শর্মিলা বলল, পরের সপ্তাহে আমার চিটাগাং যাবার কথা। আচ্ছা ঠিক আছে, যাওয়া বাদ দেব।

নান্টু উৎসাহের সঙ্গে বলল, বাদ দেবে কেন? এত তাড়াহুড়া তো কিছু নাই। চিটাগাং থেকে ঘুরে আস তারপর হবে। কাজী সাহেব পালিয়ে যাচ্ছেন না। লইয়ার পালাচ্ছে না, আমরাও পালাচ্ছি না। আমরা সবাই খুঁটিতে বাধা। হা হা হা।

শর্মিলা বিরক্ত গলায় বলল, বিশ্রী করে হাসছ কেন? দাঁত বের করে হাসার মত কিছু হয় নি। তোমার এইসব ধানাই পানাই আমার অসহ্য লাগছে। না আমি চিটাগাং যাব না। তুমি আগামী সপ্তাহেই ব্যবস্থা করবে।

হাতের সিগারেটটা দ্রুত টানার জন্যে শেষ হয়ে গিয়েছে। নান্টু আরেকটা সিগারেট ধরাল। সিগারেট শেষ না করে উঠা যাবে না। আরো কিছু সময় থাকা যাবে। মাথা ধরা শুরু হয়েছে। একবার এই যন্ত্রণা শুরু হলে তিন চার ঘন্টা আর সিগারেট খাওয়া যাবে না। আগে নান্টু সিগারেট ধরালেই শর্মিলা রাগ করত। এখন কিছুই বলে না। সব খারাপ জিনিসের কিছু ভাল দিক থাকে। এই একটা ভাল দিক। ডিভোর্স যদি সত্যি সত্যি হয়ে যায় তাহলে আরো কিছু ভাল দিক থাকবে। থাকতেই হবে। নান্টুর ধারণা ডিভোর্স হওয়া মাত্র শর্মিলার বিয়ে হয়ে যাবে। ডিভোর্সড হওয়া সুন্দরী মেয়েদের বাজারদর ভাল। কুমারী মেয়েদের চেয়েও ভাল। বিয়ে ভাঙ্গতে না ভাঙ্গতেই আবার বিয়ে। অর্ণবকে তখন নান্টু নিজের কাছে এনে রাখতে পারবে। তার ছোট মামা হুট করে তাকে নিয়ে ময়মনসিংহ চলে যাবে না।

শর্মিলা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোমার কথাতো শেষ হয়েছে। এখন যাও। আমি গুলশান মার্কেটে যাব।

নান্টু বলল, চল তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাই।

নামিয়ে দিয়ে যাবে মানে? তোমার সঙ্গে কি গাড়ি আছে নাকি?

না গাড়ি পাব কোথায়? বেবীটেক্সী দিয়ে নামিয়ে দিয়ে যাব। আমিও ঐ দিকেই যাব।

তোমার যে দিকে যেতে ইচ্ছা যাও। আমার কথা ভাবতে হবে না। অনেক বেশি ভেবে ফেলেছ।

নান্টু বলল, দেখি এক গ্লাস পানি দাও। পানি খাব।

আর কি কি খাবে এক সঙ্গে বলে ফেল। বার বার যাওয়া আসা করতে পারব না।

আর কিছু না। পানি দিলেই হবে। ঠাণ্ডা পানি।

পান খাবে না? জর্দা দিয়ে পান। পান খেয়ে খেয়ে দাঁতের তো বারোটা বাজিয়েছ।

নান্টুর মন খুবই খারাপ ছিল, শর্মিলার এই কথায় সামান্য ভাল হল। পানের কারণে তার দাঁত লাল হয়ে আছে। এই ব্যাপারটা শর্মিলার চোখ এড়ায় নি। এর অর্থ শর্মিলার তার প্রতি মমতা এখনো যায় নি। সামান্য হলেও আছে। নান্টু পানির জন্যে অপেক্ষা করছে। আরো কিছুক্ষণ শর্মিলার সঙ্গে কাটানোর ভাল একটা কায়দা বের করেছে। পানির গ্লাস হাতে শর্মিলা ঢুকল না। কাজের একটা ছেলে ঢুকল।

 

নান্টুর মেসে ফরহাদ যখন উপস্থিত হল তখন নান্টুর মাথা বানানো পর্ব শেষ হয়েছে। শরীর বানানো শুরু হয়েছে। নান্টু উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। নাপিত তার পিঠ খাবলা খাবলি করছে। নান্টু ফরহাদকে দেখে উঠে বসতে বসতে বিরক্ত মুখে বলল- তোকে আসতে বললাম সকালে, এখন রাত বারোটা তোর ব্যাপারটা কি?

আটকা পরে গিয়েছিলাম।

আটকা পরে গিয়েছিস ভাল কথা এত রাতে আসার দরকার কি ছিল? খেয়ে এসেছিস?

হ্যাঁ।

রাতে থাকবি না চলে যাবি?

থাকব।

তোকে খুবই আপসেট লাগছে ব্যাপার কি? এত ঘাবড়ে গেছিস ক্যান? আমি কি সহজ পাত্র না-কি। এমন বেড়াছেড়া লাগব যে চাকরি ফেরত দেবে প্লাস এডিশন্যান ফেসিলিটিজও পাৰি। তুই চুপ করে বোস—আমি গোসল করে আসি। তারপর রাতে দুজনে মিলে ছবি দেখব।

নান্টুর মেসঘরটা বেশ বড়। সেখানে নান্টুর জন্যে একটা ডাবল খাট পাতা। খাটের পাশেই একটা সিঙ্গেল চৌকি আছে হঠাৎ চলে আসা গেস্টদের জন্যে। একটা চৌদ্দ ইঞ্চি ব্ল্যাক এণ্ড হোয়াইট টিভি আছে। ভিসিপি আছে। নান্টুর ছবি দেখার বাতিক। ঘুমুতে যাবার আগে হিন্দী ছবির পুরোটা বা সিকিটা না দেখলে তার ঘুম আসে না। ফরহাদ নান্টুর এখানে এলে রাতে থেকে যায়।

গোসল সেরে এসে নান্টু বলল, কি ছবি দেখবি? একশান না সোসাল? কমেডিও আছে। সব রকম এনে রেখেছি। কার্টুনও আছে। অর্ণবের আসার কথা ছিল তার জন্যে টম এন্ড জেরী। বিড়াল আর ইঁদুরের খামচা খামচি।

একটা দেখলেই হয়।

একশান দেখি আয়। সোস্যাল ছবি এখন ভাল লাগবে না। কফি খাবি?

কফির ব্যবস্থা আছে? ইনসটেন্ট কফির একটা কৌটা কিনে রেখেছি—ভাল ছবি দেখার পর হঠাৎ হঠাৎ খেতে ইচ্ছা করে। এই মাসে যদি বেতন হয়—ঠিক করে রেখেছি একটা রকিং চেয়ার কিনব। দোল খেতে খেতে কফি খাওয়া এর মজাটা অন্য রকম তাই না?

হুঁ।

নান্টু কেরোসিনের চুলায় পানি গরম করতে করতে বলল—চাকরির সমস্যা ছাড়াও তোর অন্য কোন সমস্যা আছে। দেখেই বুঝতে পারছি। সমস্যাটা কি খুলে বলতো। ঝেড়ে কাশ। তোর গলায় কফ আটকে আছে।

ফরহাদ ইতস্তত করে বলল, নান্টু ভাই আমার বিয়ে।

নান্টু বিস্মিত হয়ে বলল, বিয়ে মানে? কবে বিয়ে?

শুক্রবারে।

এই শুক্রবারে?

জ্বি।

মেয়েটা কে? ঐ যে অফিসে তোর খুঁজে মাঝে মধ্যে আসে। আসমানী?

জ্বি।

হুট করে বিয়ে করছিস ব্যাপারটা কি?

আসমানীর মামা এসেছেন জাপান থেকে উনি চলে যাবেন। যাবার আগে ভাগ্নির বিয়ে দিয়ে যাবেন।

বিয়ে করতে যাচ্ছিস হাতে টাকা পয়সা আছে?

না।

না-মানে? একটা ফকির কখন ফকিরনীকে বিয়ে করে তারও হাজার তিনেক টাকা খরচ হয়—তোর হাতে এখন নেট কত টাকা আছে?

বারশ চল্লিশ।

বলিস কি? শুক্রবার মেয়ের বাড়িতে গিয়ে বিয়ে পড়ানো হবে?

সে রকমই জানি।

হেঁটে হেঁটে তো আর বিয়ে করতে যাওয়া যায় না–মাইক্রোবাস ভাড়া করতে হবে। ঘণ্টায় দুশ টাকা হলে চার ঘণ্টায় লাগবে আটশ। বিয়ের পর বউ নিয়ে বাসায় আসবি না-কি ওরা বউ পরে উঠিয়ে দেবে?

কিছুই জানি না।

তুইতো মহাগাধা দেখি টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলি পরিষ্কার করে রাখবি না। হাতেতো সময়ও নাই। দেখি কাল সন্ধ্যায় আমাকে ঐ বাড়িতে নিয়ে যা—।

আচ্ছা।

ঝামেলা যখন শুরু হয় একসঙ্গে শুরু হয়। যাই হোক যত মুশকিল তত আসান। চিন্তা করিস না। বউয়ের মেজাজ মর্জি দেখে চলবি। আমি যে সব ভুল করেছি সেইসব ভুল করবি না। যেমন ধর রাত বিরাতে বাড়ি ফেরা। অবশ্যই সন্ধ্যার পর ঘরে থাকবি। টাকা পয়সার সমস্যা যদিও হয় বউকে জানতে দিবি না। নিজের মধ্যে হজম করে রাখবি।

ফরহাদ বলল, ভাবীর সঙ্গে আপনার সমস্যা কি মিটিছে?

নান্টু বলল, প্রায় মিটেছে। তবে এখনো রাগ দেখাচ্ছে। দেখাক রাগ। উপরে উপরে রাগ ভেতরে অভিমান।

এটাতো ভালই।

ভাল কি-না জানি না, তবে খুবই যন্ত্রণা দায়ক। একটা জিনিস তুই খেয়াল রাখবি—মেয়েরা পুরুষ মানুষের মত না। তারা আলাদা। সম্পূর্ণ আলাদা। তোর ভাবীর কথাই ধর—বাপের বাড়িতে থাকছে। ডিভোর্সের কথা মাঝে মধ্যে বলছে। আমাকে রাগানোর জন্যেই বলছে। অন্য কিছু না। কিন্তু আজ কি হয়েছে শোন। অতিরিক্ত পান খাবার জন্যে আমার দাঁত লাল হয়েছে—এই নিয়ে তোর ভাবী যা শুরু করল বলার মত না। রাগারাগি, চিৎকার–কেন পান খেয়ে দাঁত নষ্ট করছ। তুমি পেয়েছটা কি? নিজের দিকে লক্ষ্য রাখবে না?

যে মেয়ে ডিভোর্স চায় সেকি কখনো এমন কথা বলবে?

না তা বলবে না।

তোর ভাবী জানে ডিভোর্সের কথা উঠলে আমি মন খারাপ করি এই জন্যেই বার বার কথা তুলে। মেয়েরা খুবই আজব জাত। যাকে তারা পছন্দ করে তাকে কষ্ট দিয়ে খুবই মজা পায়। তুইতো বিয়ে করছিস নিজেই বুঝবি। তিন মাসের মাথায় দেখবি হাসতে হাসতে তোর বউ এমন সব কথা বলবে যে রাগে মাথার তালু জ্বলে যাবে। চুল খাড়া হয়ে যাবে। এইসব কথাকে মোটেই গুরুত্ব দিবি না। এইসব মনের কথা না।

আচ্ছা।

তোর বউ কি পছন্দ করে না করে সে দিকেও নজর রাখবি। ধর সে রসমালাই খেতে পছন্দ করে। তুই করবি কি প্রায়ই রসমালাই এক হাড়ি কিনে বাসায় ফিরবি। তোর বউ জানবে সে কি পছন্দ অপছন্দ তা তুই জানিস।

ফরহাদ হাসল। নান্টু বিরক্ত গলায় বলল, হাসির কথা না। আমি খুব টেকনিক্যাল কথা বলছি। বউ কখন রেগে যাচ্ছে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। সেই মত ব্যবস্থা নিবি। কোন কোন মেয়ে আছে রাগলে তাদের নাক ফুলে যায়। ৩খন খেয়াল রাখতে হবে বউ-এর নাকের দিকে। একে বলে লক্ষণ বিচার। বিয়েতে সুখ যেমন আছে যন্ত্রণাও আছে। দুইই সমান সমান।

নান্টু ভিসিআর ছেড়ে দিল। ফরহাদ বলল—আপনার মাথা ধরেছে আজ ছবি না হয় না দেখলাম।

নান্টু বলল থাক বাদ দে। শুয়ে পরবি?

হ্যাঁ।

মশারি খাটানোর দরকার নেই। মশা কম। মশারি খাটালে ফ্যানের বাতাস পাবি না।

ফরহাদ শুয়ে পড়ল। হঠাৎ করে তার খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখ জড়িয়ে আসছে। মনে হচ্ছে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়বে। এরকম প্রচণ্ড ঘুম খুবই ভয়াবহ–বিছানায় যাওয়া মাত্র ও জাতীয় ঘুম কেটে যায়। ফরহাদের ধারণা পৃথিবীতে তিন রকমের ঘুম আছে—চলন্ত ঘুম। ট্রেন বা গাড়ি যখন চলে তখন এই ঘুম আসে। গাড়ি থেমে গেলেই ঘুম কেটে যায়। বসন্ত ঘুম—বসা অবস্থায় এই ঘুম আসে। বিছানায় শুলেই ঘুম নেই। আর একটা ঘুম হল—বিছানা ঘুম। এই ঘুম। বিছানায় আসে—আসল ঘুম।

নান্টু বলল, ফরহাদ ঘুমিয়ে পরেছিস?

ফরহাদ বলল, না।

নান্টু আগ্রহের সঙ্গে বলল, বিয়ের পর অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করবি।

কি রকম?

যেমন তোর ভাবীর কথাই ধর। সে মশারি ফেলে ঘুমুতে পারে না। মশা যদি তাকে খুবলে খেয়েও ফেলে সে মশারি ফেলবে না। মার কাছ থেকে ছেলেও এই অভ্যাস পেয়েছে।

অর্নবও মশারি ফেলে ঘুমুতে পারে না?

না। এদিকে সে আবার মশা ভয় পায়। মশাকে সে কি বলে জানিস?

কি বলে?

শিশা। ছোট বেলায় বলতো—এখনো বলে।

শিশা বলে কেন?

আর বলিস না। বাচ্চাদের সবই অদ্ভুত। অর্ণব নিঃশ্বাসকে কি বলে জানিস?

কি বলে?

নিঃশ্বাসকে বলে নিশ-নাশ। ইন্টারেস্টিং না?

অবশ্যই ইন্টারেস্টিং।

নান্টু বিছানায় উঠে বসে আগ্রহের সঙ্গে বলল, অর্ণবের মধ্যে একটা ব্যাপার দেখে আমি খুবই অবাক। কারো বিরুদ্ধেই তার কোন কমপ্লেইন নেই। ধর তুই তাকে অকারণে একটা আছাড় মারলি। সে কাঁদবে। কিন্তু কখনো কাউকে গিয়ে বলবে না–ফরহাদ চাচু আমাকে আছাড় মেরেছে। একবার কি হয়েছে শোন—অর্ণবকে বিছানায় নিয়ে শুয়েছি সে কাঁদছে। আমি যতই বলি কি হয়েছে। বাবা? সে উত্তর দেয় না—শুধু কাঁদে। শেষে অনেক আদর টাদর করার পর আঙ্গুল দিয়ে নিজের পা দেখালো। আমি তাকিয়ে দেখি গোবরে পোকার মত একটা পোকা তাকে কামড়াচ্ছে। বেচারা জানে একটা পোকা তাকে কামড়াচ্ছে কিন্তু সে বলবে না।

এটা কি ভাল?

ভাল নাতো বটেই? এটা হল তার স্বভাব। স্বভাবতো আর বদলানো যায় না। ছেলেটাকে নিয়ে আমি খুবই চিন্তায় থাকি। তাকে নিয়ে আজ তার মামা গেছে। ময়মনসিংহ। অর্ণবের যদি কোন অসুবিধা হয় সেতো তার মামাকে বলবে না। ধর সে পুকুরে গোসল করতে নামল তখন একটা কচ্ছপ তার আংগুল কামড়ে ধরল। সে কাঁদবে কিন্তু তার মামাকে বলবে না–কচ্ছপ আমাকে কামড়াচ্ছে। ফরহাদ সিগারেট খাবি?

না।

খা একটা সিগারেট। সিগারেট খেতে খেতে একটু গল্প করি।

আপনার মাথা ব্যথা কমেছে?

হ্যাঁ কমেছে। তুই বিয়ে করেছিস শুনে ভাল লাগছে বুঝলি—তখনই মাথা ব্যাথাটা হুস করে কমে গেল। নতুন সংসার শুরু করা খুবই আনন্দের ব্যাপার। রাতে বাসায় ফিরে যখন দেখবি তোর বউ ভাত না খেয়ে তোর জন্যে অপেক্ষা করে আছে—তখন কি যে ভাল লাগবে। আমার একটা ঘটনা বলি শোন। বিয়ের দশ দিনের দিন হঠাৎ স্কুল জীবনের এক ফ্রেণ্ডের সঙ্গে দেখা ইশতিয়াক। গল্প গুজব করতে করতে অনেক রাত করে ফেললাম। বাসায় ফিরলাম রাত দুটা দশে। দেখি তোর ভাবী না খেয়ে ভাত নিয়ে বসে আছে। এত আনন্দ হয়েছিল বুঝলি একেবারে চোখে পানি এসে গিয়েছিল। ফরহাদ।

জ্বি।

ঘুমিয়ে পর। বিয়ের টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করিস না। ইনশাল্লাহ একটা কিছু ব্যবস্থা করে ফেলব।

জ্বি আচ্ছা।

আমার আবার ঘুম আসছে না। ছেলেটার জন্যে মনটা খারাপ লাগছে। নিজের একটা গাড়ি থাকতো হুট করে ময়মনসিংহ চলে যেতাম।

অর্ণবকে নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না। মামার কাছে ও ভালই আছে।

ছেলেটা একেবারেই অন্য রকম হয়েছে। কি সুন্দর করে যে হাসে। হাসিটা একেবারে কলিজার মধ্যে গিয়ে লাগে। তুইতো বিয়ে করছিস। ছেলে মেয়ে হোক তখন বুঝবি ছেলেমেয়ের হাসি কি জিনিশ।

 

ফরহাদ ঘুমুতে পারছে না। বিছানাটা আরামদায়ক। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। সামান্য শীত শীত লাগছে। পায়ের কাছে চাদর আছে। চাদরটাও পরিষ্কার। নান্টুভাই একটা কোলবালিশও বের করে দিয়েছেন। ঘুমুবার জন্যে আয়োজন ভাল। কিন্তু ঘুম আসছে না। মাথা দপ দপ করছে। বিয়ের এই ঝামেলা হাতে নেয়া ঠিক হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। সংসারে নতুন একটা মানুষ নিয়ে আসার জন্যে অনেক প্রস্তুতি লাগে। তার কোন প্রস্তুতি নেই। আসমানী যে রাতে ঘুমুবে একটা ভাল বিছানা কি আছে? সুন্দর চাদর? দাদাজানের খাটটা সরাতে হবে? তিনি থাকবেন কোথায়? মঞ্জু তার ঘরে দাদাজানকে রাখবে না। রাগারাগি হৈ চৈ করবে। বুড়ো মানুষটা যাবে কোথায়? রাতে মশারি খাটাতে হবে—পুরানো মশারির কয়েক জায়গায় ফুটা আছে। সেফটিপিন দিয়ে ফুটা মেরামত করা হয়েছে তাতে মশা আটকায় না। গভীর রাতে মশার পিন পিন শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আলসেমী লাগে বলে সে চোখ না মেলেই মটকা মেরে পড়ে থাকে। সামান্য রক্তইতো খাবে। খাক। খেয়ে শান্ত হোক। মশারা শান্ত হয় না। রক্ত খাবার পর তাদের নাচ গানের উৎসাহ আরও বাড়ে। তারা প্রবল উৎসাহে কানের কাছে উৎসব শুরু করে। ফরহাদ তখন চাদরে মুখ ঢেকে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। আসমানী নিশ্চয়ই এ রকম কিছু করবে না। সে বলবে, এই এত মশা ঢুকল কি করে। বাতি জ্বালাওতো মশা মারতে হবে।

সে হাই তুলতে তুলতে বলবে, বাতি জ্বালাতে পারব না। ঘুম চটে যাবে।

মশার কামড় খাব না-কি?

চাদরে মুখ ঢেকে শুয়ে থাক।

গরমের মধ্যে চাদরে মুখ ঢেকে শুয়ে থাকব কি? প্লীজ বাতিটা জ্বালাওতো। তোমার মত অলস মানুষ আমি দেখিনি।

তুমিতো আর অলস না। তুমি বাতি জ্বালাও।

আমি কি তোমার বাড়ি ঘর চিনি নাকি? সুইচটা কোথায়?

দরজার পাশে।

দরজাটা কোথায়?

সুইচের পাশে।

উফ কেন এত ফাজলামী করছ?

এই পর্যায়ে ফরহাদ বিছানা থেকে নামবে। সুইচ জ্বালাবে। দুজনে মিলে মশা মারবে এবং আসমানী বলবে—তুমি কি দয়া করে কাল একটা নতুন মশারি কিনবে? সে হাসি মুখে বলবে, না। আসমানী রাগী রাগী গলায় বলবে, কেন কিনবে না? টাকা নেই?

মশারি কেনার টাকা আছে তবে কিনব না।

কারণটা জানতে পারি?

জানতে পার। নতুন মশারি কিনলে গভীর রাতে মশার কামড়ে ঘুম ভাঙ্গবে। এবং আমরা রাত জেগে গল্প করতে পারব না। আমারতো আর এ্যালার্ম ঘড়ি নেই যে রাত তিনটা এ্যালার্ম দিয়ে রাখব। ঘুম ভাঙ্গবে এবং আমরা গুটুর গুটুর করে গল্প করব। মশারাই হচ্ছে আমার জীবন্ত এ্যালার্ম ঘড়ি।

আমি তোমাকে একটা এ্যালার্ম ঘড়ি প্রেজেন্ট করব। তবু দয়া করে একটা মশারি কিনবে।

আচ্ছা।

আর নরম দেখে একটা বালিশ কিনবে।

এই বালিশটা কি শক্ত?

শক্ততো বটেই মনে হচ্ছে তুলার বদলে সীসার টুকরা ভরা। এই শোন আমার পানির পিপাসা পেয়েছে।

আমারও পানির পিপাসা পেয়েছে। ভালই হয়েছে পিপাসায় পিপাসায় কাটাকাটি।

ফাজলামী ধরনের কথা বলবেনাতো যাও দয়া করে আমার জন্যে এক গ্লাস পানি এনে দাও।

স্বামীকে এইভাবে হুকুম দিচ্ছ। তোমার কিন্তু পাপ হচ্ছে।

হোক পাপ। পানি নিয়ে এসো। জগ ভর্তি পানি আনবে।

এত পানি দিয়ে কি হবে?

হাতে মশার রক্ত লেগে গেছে হাত ধোব।

ইশ তোমার হাত ভর্তি স্বামীর রক্ত। তুমিতো ডেনজারাস মেয়ে।

উফ চুপ করবে?

না চুপ করব না।

তোমার কোন ব্যাপারটা আমার কাছে অসহ্য লাগে তাকি তুমি জান?

জানি—এই যে কথার পিঠে কথা বলে তোমাকে রাগাচ্ছি এটাই তোমার কাছে অসহ্য লাগছে।

জান যখন তখন রাগাচ্ছ কেন?

কারণটা খুব স্পষ্ট।

আমার কাছে কারণ মোটেই স্পষ্ট না।

কারণ হল—আমার সোনার বাংলা গানের দ্বিতীয় লাইন।

এই ধরনের ছেলেমানুষী কথা কার কাছ থেকে শিখেছ?

তোমার কাছ থেকে।

ফরহাদের মাথা দপদপ করছে। মনে হচ্ছে আজ রাতে তার এক ফোটা ঘুম হবে না। সারারাত বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে কাটাব। অবশ্যি খুব খারাপ কাটবে না। সারারাতই আসমানীর সঙ্গে গল্প করা যাবে।

যখন আসমানী সত্যি তার সঙ্গে থাকতে আসবে তখন কি এ রকম করে তারা রাত জেগে গল্প করবে? আগে ভাগে বলার কোন উপায়ে নেই। বিয়ের পর হয়ত দেখা যাবে আসমানী খুবই ঘুম কাতুরে। নটা বাজতেই শুয়ে পড়ছে ঘুম ভাঙ্গছে ভোরবেলায়। সারারাত সে ঘুমুচ্ছে কাঠের টুকরার মত।

পানির পিপাসা হচ্ছে। ফরহাদ সাবধানে বিছানা থেকে নামলনান্টু ভাইয়ের ঘুম যেন না ভাঙ্গে। টেবিলের উপর পিরিচে ঢাকা পানির জগ। উল্টো করে রাখা পানির গ্লাস। নান্টু ভাইয়ের সব কিছুই খুব গোছানো। পাশে হরলিক্সের কৌটা ভর্তি বিসকিটও আছে। রাতে খিদে লাগলে খাবার জন্যে। এ ধরনের ব্যবস্থা তাকেও করতে হবে। রাতে পানি খাবার জন্যে জগ কিনতে হবে। আসমানীর মনে হয় ঠাণ্ডা পানি খাবার একটা ব্যাপার আছে। রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে সে সব সময় বলবে—ভাই ফ্রীজের পানি আছে না? ফ্রীজের ঠাণ্ডা পানি দিন।

ছোট্ট একটা ফ্রীজ কিনতে পারলে ভাল হত। লাল টুকটুক ছোট্ট একটা ফ্রীজ। তাদের বড় সাহেবের খাস কামরায় আছে।

ফরহাদ খুব সাবধানে দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল। আশ্চর্য বৃষ্টি হচ্ছে। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে লাগল। টিনের ছাদ হলে ভাল হত বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শোনা যেত। আসমানী খুব বৃষ্টি পছন্দ করে প্রায়ই তার চিঠিতে থাকবে—এই শোন কাল রাত সাড়ে তিনটার দিকে অনেকক্ষণ ঝমঝম বৃষ্টি হয়েছে। ইংরেজী টাইপ বৃষ্টি। এখন বল দেখি ইংরেজী টাইপ বৃষ্টি কাকে বলে? বলতে পারলে না। জানি পারবে না। ইংরেজী টাইপ বৃষ্টি মানে Cats and dogs বৃষ্টি। আচ্ছা ঝমঝম বৃষ্টিকে Cats and dogs বৃষ্টি বলে কেন? কুকুর এবং বেড়ালরা এ জাতীয় বৃষ্টিতে ভিজে ন্যাতা ন্যাতা হয়ে যায় এই জন্যে? খুব ভাল ইংরেজী জানে এমন কাউকে পেলে জিজ্ঞেস করতাম—স্যার ঝমঝম বৃষ্টিকে Cats and dogs . বৃষ্টি বলে কেন? তোমার মাথায় এটা দিয়ে দিলাম। কাউকে পেলে জিজ্ঞেস করে জেনে আমাকে জানিও। বৃষ্টির সময় আমার সবচে বেশী যে কাজটা করতে ইচ্ছা করে তা হল টেলিফোনে কথা বলতে ইচ্ছা করে। তোমার বাসায় টেলিফোন থাকলে আমি অবশ্যই টেলিফোন করে তোমার ঘুম ভাঙ্গাতাম। ইশ তোমার টেলিফোন নেই কেন? টেলিফোনে তোমার গলা খুব সুন্দর শোনায় তাকি তুমি জান? কী তোমাকে বলে নি? আমি বললাম। তোমার গলার স্বরে বৃষ্টি আসবে, বৃষ্টি আসবে এ রকম একটা ভাব আছে। কি বাবু সাহেব, আপনার কি মনে হচ্ছে আমি পাগলী টাইপ কথা বলছি? একটা পাগল মেয়ে নিয়ে তুমি যে কি বিপদে পড়বে—আমি দিব্যচোখে তোমার বিপদ দেখতে পাচ্ছি। দশ নম্বর মহা বিপদ সংকেত। না দশের চেয়েও বেশী—১০০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত।

ফরহাদের চায়ের পিপাসা পেয়ে গেল। নান্টু ভাইকে না জাগিয়ে চুপিচুপি এককাপ চা বানাতে পারলে ভাল হত। চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে আসমানীর সঙ্গে কথা বলা। আচ্ছা এ রকম কথা কি সব ছেলেরাই বলে না সে একা বলে? মনে হয় তার মত করে বলে না। কারণ তার কথায় শুধু ভালবাসাবাসি থাকে না। অনেক জরুরী ব্যাপারও থাকে। এই মুহূর্তে সে আসমানীর সঙ্গে যে সব কথা বলবে সবই খুব জরুরী কথা। তবে শুরুটা হবে খুব নাটকীয়ভাবে।

একি তুমি আমাকে ফেলে একা একা চা খাচ্ছ। আবার মজা করে বৃষ্টিও দেখছ?

তুমি ঘুমুচ্ছিলে তাই জাগাই নি।

আমি ভয়ংকর ভয়ংকর ভয়ংকর রাগ করেছি।

একটু দাঁড়াও আমি তোমার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে আসছি।

তোমাকে কিছু করতে হবে না। আমি চলে যাচ্ছি।

কোথায় যাচ্ছ?

যেখানেই যাই তোমার কি?

আসমানী চলে গেছে। ফরহাদ আর কিছুতেই তাকে আনতে পারছে না। পুরো ব্যাপারটাই তার কল্পনা, কিন্তু এই কল্পনায় তার হাত নেই। সে নিজের ইচ্ছায় কিছু করতে পারে না। খুবই বিস্ময়কর একটা ব্যাপার। ফরহাদ হঠাৎ লক্ষ্য করল সে এমনভাবে হাত উঁচু করে আছে যেন তার হাতে সত্যি সত্যি একটা চায়ের কাপ। সে অদৃশ্য চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চা খাচ্ছে। আচ্ছা তার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাতো?

নান্টু ভাই-এর কথা

নান্টু ভাই-এর কথা অনুযায়ী আজ অফিসে চূড়ান্ত রকমের ঝামেলা হবার কথা। চাকরী নেই পাঁচজন তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে অফিসের সামনে বসে থাকবে। তারা সারাক্ষণ কঁাও মাও করবে। পত্রিকার ফটোগ্রাফররা আসরে। মজা দেখতে জড় হবে পাবলিক। অফিসের সামনের রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম শুরু হবে। ঝামেলা আরো জোড়দার করার জন্যে নির্দোষ ধরনের কয়েকটা পটকাও ফুটানো হবে। পুলিশ চলে আসবে। এইসব কর্মকান্ড শুরু হবার কথা সকাল দশটা থেকে কারণ বড় সাহেব অফিসে আসেন ঠিক সাড়ে নটায়। এখন বাজছে সাড়ে এগারোটা। আর দশটা দিন অফিসের কাজকর্ম যেমন চলে আজো তাই চলছে। কোন রকম ঝামেলা নেই।

ফরহাদ নিশ্চিত হবার জন্যে আবারো ঘড়ি দেখল—এগারোটা বত্রিশ। তাহলে কি ঝামেলা তৈরীর সময় পিছিয়ে দেয়া হয়েছে? পাঁচজনের যে কোন একজনকে জিজ্ঞেস করলে জানা যেত। কাউকেই দেখা যাচ্ছে না। দুজন দারোয়ানের একজন টুলে বসে আছে। অন্যজন হাত দিয়ে আড়াল করে বিড়ি টানছে। তাদের মধ্যে কোন উদ্বেগ বা উৎকণ্ঠা নেই। বড় সাহেব যে অফিসে আছেন তা তার গাড়ি দেখে বোঝা যাচ্ছে। গাড়ির ড্রাইভারও নিশ্চিন্ত মনে পান খাচ্ছে। ঘটনা যা ঘটার ঘটে গিয়ে এখন কি অল কোয়েয়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট হয়ে গেছে কি-না তাও বোঝা যাচ্ছে না। হয়ত সে রকমই কিছু হয়েছে। ফরহাদের আসার কথা ছিল সাড়ে নটায়। সে দুঘন্টা দেরী করে ফেলেছে। দাদাজানের হঠাৎ করে শরীর খারাপ করে ফেলল। ডাক্তার আনতে হল। ডাক্তার বললেন, অক্সিজেন দিতে হবে। অক্সিজেন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও দেয়ানো যাবে আবার প্রাইভেট ব্যবস্থাও করা যাবে। প্রাইভেট ব্যবস্থায় ঘরে এসে অক্সিজেন সিলিন্ডার দিয়ে যাবে। একজন এসে অক্সিজেন দেবার নিয়ম কানুন শিখিয়ে দেবে। ডাক্তার সাহেবের কথায় বোঝা গেল। প্রাইভেট ব্যবস্থা অনেক ভাল। সেই অনেক ভাল ব্যবস্থা করতে গিয়ে নয়শ পঞ্চাশ টাকা খরচ হয়ে গেছে। তবে অক্সিজেন কাজে দিয়েছে। মেম্বর আলি শান্তিমত নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। ফরহাদ অফিসের দিকে রওনা হবার আগে দেখে এসেছে তিনি ঘুমুচ্ছেন। বোঝা যাচ্ছে ঘুমট আরামের হচ্ছে। চোখে মুখে কষ্টের ছাপ নেই।

ফরহাদ অফিসে ঢুকল। অশোক বাবুর টেবিলে কিছুক্ষণ বসা যায়। উনি কিছু জানলেও জানতে পারেন। চাকরি নেই সহকর্মীদের দিকে সবাই করুণা এবং মমতার চোখে তাকায়। এই দৃষ্টি ঘৃণার দৃষ্টির চেয়েও খারাপ। ঘৃণার দৃষ্টি ফেরত দেয়া যায়, করুণার দৃষ্টি ফেরত দেয়া যায় না। অফিসে ঢুকেই ফরহাদের মনে হল সবাই তাকে দেখছে। অথচ ব্যাপারটা সে রকম নয়। সবাই কাজ করছে। আলাদাভাবে কেউ যে তাকে দেখছে তা না। তবে সব মানুষের তিন নম্বর একটা চোখ থাকে। সেই চোখ বাইরে থেকে দেখা যায় না। তবে সেই চোখ যদি কারো দিকে তাকিয়ে থাকে তা পরিষ্কার বোঝা যায়। ফরহাদ বুঝতে পারছে সবার তিন নম্বর চোখ তার দিকে।

সেই চোখে করুণা এবং মমতা ছাড়াও আরো একটা কিছু আছে। সেই কিছুটা বোঝা কি যাচ্ছে না। অশোক বাবু বললেন—ফরহাদ সাহেব কেমন আছেন? বসুন বসুন।

ফরহাদ বসল। অশোক বাবু বেল টিপলেন। তাঁর বেল টেপায় মোর্স কোড জাতীয় সংকেত থাকে। তাঁর বেয়ারা বেলের শব্দ শুনে বুঝতে পারে—বাবু কি চাচ্ছেন। অশোক বাবুকে মুখে কিছু চাইতে হয় না। চা চলে আসে, পানি চলে আসে, কাচা সুপারি দেয়া জর্দা ছাড়া পান চলে আসে। বেয়ারা এক কাপ চা এনে ফরহাদের সামনে রাখল। অশোক বাবু আন্তরিক গলায় বললেন, খান চা খান। সিগারেট খাবেন? খান চায়ের সঙ্গে একটা সিগারেটও খান। আমি নিজে সিগারেট ছেড়ে দিয়েছি এই জন্যেই বোধ হয় অন্য কেউ সিগারেট খাচ্ছে এই দৃশ্য দেখতে ভাল লাগে।

ফরহাদ সিগারেট নিল। অশোক বাবু সিগারেট ধরিয়ে দিলেন। ফরহাদ বলল, নান্টু ভাই কি এসেছিলেন?

অশোক বাবু বললেন—সকাল নটার দিকে এসেছিলেন। ঘন্টাখানিক ছিলেন। চা পান খেয়ে চলে গেলেন। আমি বলেছিলাম বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করে যেতে। বোধ হয় করেছেন। যাবার সময় আমার সঙ্গে দেখা হয় নি।

অশোক বাবু নিজেও একটা সিগারেট ধরালেন। লজ্জিত মুখে বললেন আমার প্রধান সমস্যা হচ্ছে কাউকে খেতে দেখলেই সিগারেট খেতে ইচ্ছা করে। নিজেও একটা ধরিয়ে ফেলি। হিসাব করে দেখেছি এতেও প্রতি দিন সাত আটটা সিগারেট হয়ে যাও।

আপনার সামনে সিগারেট খাওয়াটা ঠিক হয় নি।

খুব ঠিক হয়েছে। আরাম করে খানতো দেখি। আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি আপনার এবং নান্টু সাহেবের জন্যে মনটা খুবই খারাপ হয়েছে।

শুধু আমাদের দুজনের জন্যে মন খারাপ হবে কেন? আমরা পাঁচজন না? বাকি তিনজন কি দোষ করল?

অশোক বাবু বিস্মিত হয়ে বললেন–আপনি কিছু জানেন না? তিনজনকে অবজর্ব করে নেয়া হয়েছে। সিনিয়ারিটি দেখে নেয়া হয়েছে। তবে নান্টু সাহেব সিনিয়ার হয়েও কেন জানি বাদ পরেছেন। আমি এই জন্যেই তাকে বলেছিলাম বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে।

তিনজনের চাকরি হয়ে গেছে?

হয়েছে। কাউকে কিছু বলতে হয় নি। তার আগেই হয়েছে। আর হবে নাইবা কেন বলেন—কোম্পানীর অবস্থাতো ভাল। আমরা মিডল ইস্ট থেকে ওরস্যালাইন এবং রেগুলার সেলাইনের বিরাট একটা অর্ডার পেয়েছি। কোম্পানী কসমেটিকস প্রডাকশানে যাবে-টুথপেস্ট, হালাল সাবান। হালাল সাবানটা হঠাৎ ক্লিক করেছে। সবাই ঝুঁকেছে হালাল সাবানের দিকে।

ফরহাদ কিছু বলছে না। বলার মত কিছু পাচ্ছেও না। সে কি বলবে? হালাল সাবানের প্রসপেটস নিয়ে আলাপ করবে?

ফরহাদ সাহেব!

জ্বি।

বড় সাহেবের সঙ্গে দেখা করুন। চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই।

জ্বি না কোন ক্ষতি নেই।

গুড লাক।

গুড লাক মানে উঠে পরুন। চা খেয়েছেন, সিগারেট খেয়েছেন। অনেক সামাজিক সৌজন্য দেখানো হয়েছে—আর কত?

 

ওরিয়ন ইন্টারন্যাশনালের বড় সাহেবের খাস খামরায় কম্পিউটার বসানো হচ্ছে। নিতান্তই অল্পবয়েসী দুটি ছেলে অত্যন্ত ব্যস্ত ভঙ্গিতে নানান কানেকশন দিচ্ছে। বোতাম টেপাটেপি করছে। সুন্দর কোন খেলনার দিকে বাচ্চারা যেমন আগ্রহের সঙ্গে তাকিয়ে থাকে এমডি জামিলুর রহমান সাহেব সেই ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। যেন খেলনায় ব্যাটারী ভরা হচ্ছে। ব্যাটারী ভরার কাজটা শেষ হওয়া মাত্র তিনি বোম টিপবেন–খেলনা উদ্ভট মজাদার কিছু করবে। বড় সাহেবকে ব্যস্ত বলা যায়। এই ব্যস্ততার মধ্যে তিনি যে চাকুরিচ্যুত একজন কর্মচারীকে ঘরে ঢোকার অনুমতি দিয়েছেন এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা। ফরহাদ বড় সাহেবের ঘরে ঢুকেছে এবং বড় সাহেব দ্বিতীয় বিস্ময়কর ঘটনা ঘটিয়েছেন। তিনি হাসিমুখে ফরহাদকে বলেছেন, দাঁড়িয়ে আছ কেন বোস। তিনি কখনো তার কোন কর্মচারীকে বসতে বলেন না। যাদের দাঁড়িয়ে থাকার কথা তারা দাঁড়িয়ে থাকে। যাদের বড় সাহেবের সামনে চেয়ারে বসার যোগ্যতা আছে তারা নিজেরাই চেয়ার টেনে বসে।

ফরহাদ বসেছে। কিন্তু কিছু বলতে পারছে না, কারণ বড় সাহেব আবারো গভীর আগ্রহে কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ঘর যথারীতি ঠাণ্ডা। ফরহাদের শরীর বরফের মত হয়ে যাচ্ছে।

বড় সাহেব তার রকিং চেয়ার ঘুরিয়ে ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখন বল কি ব্যাপার?

ফরহাদের মনে হল বড় সাহেব তাকে চিনতে পারছেন না। রংপুর থেকে ঢাকা আসার পথে বড় সাহেব তাকে নাম ধরে ডেকে চমকে দিয়েছিলেন। সেই নাম এখন সম্ভবত তার মনে নেই। ফরহাদ বলল, স্যার আপনাকে একটা থ্যাংকস দিতে এসেছি।

জামিলুর রহমানের চোখ সামান্য সরু হয়ে এল। তিনি বললেন, কি জন্যে বলতো?

ফরহাদ বলল, রংপুর থেকে ঢাকা ফেরার পথে আপনি আমাকে এক হাড়ি দৈ দিয়েছিলেন। বগুড়ার দৈ। দৈটা খুবই ভাল ছিল।

ও আচ্ছা আচ্ছা। আমি নিজে অবশ্যি টেস্ট করে দেখিনি। ডায়াবেটিসতো। মিষ্টি খেতে পারি না। তুমি শুধু দৈ-এর জন্যে থ্যাংকস দিতে এসেছ?

জ্বি স্যার।

আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার নাম যেন কি?

স্যার আমার নাম ফরহাদ।

ফরহাদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, স্যার যাই।

বড় সাহেব হাসি মুখে মাথা নেড়ে চলে যাবার অনুমতি দিলেন। যে সব কথা বড় সাহেবকে বলবে বলে মনে মনে রিহার্সেল দিয়ে রেখেছিল সে সব বলা হল না তবে তার জন্যে খারাপও লাগছে না। হাত কচলে কারো কাছে কিছু চাওয়া মানসিক কষ্টের ব্যাপার।

বড় সাহেবের ঘরের ঠিক সামনেই সিদ্দিক সাহেব বসেন। হেড ক্যাশিয়ার। সিদ্দিক সাহেব হাতের ইশারায় ফরহাদকে ডাকলেন। ওরিয়ন ইন্টারন্যাশনালের হেড ক্যাশিয়ার সিদ্দিক সাহেবের অফিসের সবেই আড়ালে ডাকে মরা সিদ্দিক। দ্রলোকের কথাবার্তা, আচার আচরণ সবই মৃত মানুষের মত। মানুষটা চা খাচ্ছে, কাজ করছে, কথা বলছে কিন্তু প্রাণ বলে কোন ব্যাপার তাঁর মধ্যে নেই। আবেগ শূন্য একজন মানুষ। মাঝখানে ভদ্রলোক একবার সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। ফেরার পর সবাই বলাবলি করতে লাগল—সিদ্দিক সাহেব সিঙ্গাপুরে তার চোখ দুটা ফেলে দুটা পাথরের চোখ বসিয়ে নিয়েছেন। মানুষের চোখে তাঁর না-কি কাজকর্মে অসুবিধা হচ্ছিল।

ফরহাদ তার সামনে দাঁড়াতেই সিদ্দিক সাহেব একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এখানে সই করুন। দুমাসের সেলারী। খামে টাকা আছে। চেক না দিয়ে ক্যাশ দিয়ে দিলাম। গুণে নিন। সঙ্গে রেভিন স্ট্যাম্প আছে?

জ্বি না।

দুটা টাকা দিন রেভিন স্ট্যাম্প আনিয়ে দিচ্ছি। আপনার একটা রেজিস্টার্ড চিঠি আছে। সুইজারল্যান্ড থেকে এসেছে। চিঠিটা নিয়ে যান। চা খাবেন?

জ্বি না।

দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।

ফরহাদ বসল। মরা সিদ্দিক অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পরেছেন ফরহাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। রেভিন স্ট্যাম্প নিয়ে আমার পর হয়তবা ফিরে তাকাবেন। ফরহাদ সুইজারল্যান্ডের চিঠি পড়ছে।

রহমত উল্লাহ সাহেবের চিঠি। ভদ্রলোক দুমাস তিন মাস পর একটা চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে সব সময় তার এবং তার পরিবারের কিছু ছবি থাকে। চিঠির শেষে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ফরহাদকে ধন্যবাদ দেন। ঢাকায় তার জায়গাটা দেখে শুনে রাখার জন্যে। পুনশ্চ দিয়ে আরেকটি বাক্য থাকে দেশের বাইরে এসে ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখতে চাইলে জানিও, সাধ্যমত করব।

আজকের চিঠিতেও পুনশ্চ দিয়ে সেই বাক্যটি আছে কি-না ফরহাদ দেখে নিল। হ্যাঁ আছে। পারিবারিক ছবিও আছে। কী করার পোষাকে স্বামী-স্ত্রী। স্কী করছেন না—দুজনই মগ ভর্তি কফি খাচ্ছেন। বিদেশীনি মহিলা মাত্রই রূপবতী মহিলা এমন ধারণা প্রচলিত থাকলেও রহমত উল্লাহ সাহেবের স্ত্রীর চেহারা বেঁটে দৈত্যদের মত। এই মহিলাকে দেখলেই মনে হয় তিনি কোন আখড়া থেকে কুন্তী শেষ করে ফিরেছেন। প্রতিপক্ষ সবাইকে পরাজিত করে ফিরেছেন বলে তাঁর মুখ ভর্তি হাসি। সেই হাসিতে সমগ্র পুরুষজাতির প্রতি কুন্তীর আহ্বান আছে। এমন একজন মহিলার প্রেমে পড়ে তাকে বিয়ে করতে সাহস লাগে। রোগা পটকা রহমত উল্লাহ সাহেবের ভীত চোখ মুখ দেখে মনেই হয় না তার সে সাহস আছে।

ফরহাদ চিঠি পড়ায় মন দিল। রেভিন স্ট্যাম্প আসতে আসতে চিঠিটা পড়ে ফেলতে হবে। চিঠির জবাবও পাঠাতে হবে। জবাব পাঠাতে পঞ্চাশ টাকার মত খরচ। এই খরচটা কাঁটার মত বুকে লাগে। মনে হয় নিতান্তই অপ্রয়োজনে খরচটা করা হচ্ছে।

ফরহাদ,

এবার চিঠি পাঠাতে দেরী হল। রুথ এ্যাকসিডেন্ট করে হাসপাতালে। স্কী করতে গিয়ে এই বিপত্তি। হাতের একটা হাড় এবং বুকের পাজরের দুটা হাড় ভেঙ্গেছে। তোমাকে যে ছবিটা পাঠালাম, সেটা একটু মন দিয়ে দেখ। এ্যাকসিডেন্টের ঠিক দশ মিনিট আগে তোলা ছবি। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামার আগে আগে কফি খাওয়া হচ্ছে। কফি শেষ করার দশ মিনিটের মাথায় ঘটনা ঘটে। রুথের অবস্থা এমন ছিল যে আমি ধরেই নিয়েছিলাম তাকে বাঁচানো সম্ভব না। তবে এই উন্নত দেশে অসম্ভব বলে কোন ব্যাপার নেই। খবর ছড়িয়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে হেলিকপ্টার এ্যাম্বুলেন্স তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। দুঘন্টা সার্জারীর পর ডাক্তাররা তাকে বিপদমুক্ত ঘোষণা করলেন। খুব বড় ধরনের বিপদের হাত থেকে বেঁচেছি। আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া।

যাই হোক এখন কাজের কথা বলি—ঢাকায় আমার জায়গাটা আমি এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর কাছে বিক্রি করেছি। তারা জমির দামের একটা অংশ আমাকে ডলারে শোধ করেছে। ঢাকার জমিতে তারা মাল্টি স্টোরিড এ্যাপার্টমেন্ট হাউস বানাবে এবং আমাকে দুটা এ্যাপার্টমেন্ট দেবে। আমার কাছে ডিলটা অত্যন্ত ভাল মনে হয়েছে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানী তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। তুমি তাদেরকে সব রকম সাহায্য সহায়তা করবে। তুমিতো জানই ঢাকায় আমার স্বার্থ দেখার লোকজন নেই। কাজটা তোমাকেই করতে হবে।

তুমি ভাল থেকো। পরিবারের সবাইকে শ্ৰেণীমত সালাম এবং দোয়া দেবে।

অনেক দিন একটা জায়গায় বাস করছিলে হঠাৎ সেটা ছেড়ে দিতে গিয়ে তোমাদের হয়ত সাময়িক কিছু সমস্যা হবে। তার জন্যে আমি দুঃখিত ও লজ্জিত। বিদেশে বাস করলেও আমার আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। তোমরা ভাল থেকো। রুথের জন্যে দোয়া করো, সে এখনো পুরোপুরি সারে নি।

আরেকটি কথা বলতে ভুলে গেছি। রুথ বেবী এক্সপেট করছিল। দু মাস চলছিল। এতবড় একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পরেও বেবীর কোন ক্ষতি হয় নি। এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া আর কিছুই না।

ইতি–

রহমত উল্লাহ

পুনশ্চ : দেশের বাইরে এসে ভাগ্য পরীক্ষা করতে চাইলে জানিও সাধ্যমত চেষ্টা করব।

রেভিন্যু স্ট্যাম্প চলে এসেছে। সই করে ফরহাদ উঠে দাঁড়াল। সিদ্দিক সাহেবকে ধন্যবাদ জাতীয় কিছু বলা দরকার। না বললেও হয় ইনি যন্ত্রমানব। ধন্যবাদের ধার ধারেন না। সিদ্দিক সাহেব টাকা গুণছেন এমন সময় যদি খবর আসে তাঁর ছোট ছেলেটি পানিতে ড়ুবে মারা গেছে। তিনি টাকা গোণা বন্ধ করবেন না, কাজটা শেষ করবেন। শেষ করার পর শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করবেন—কখন মারা গেছে?

ফরহাদ সাহেব!

জ্বি।

বাসায় চলে যাচ্ছেন?

জ্বি।

সিদ্দিক সাহেব কাজ বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—চলুন আপনাকে একটু এগিয়ে দেই।

ফরহাদ বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?

শরীরটা ভাল না। বমি বমি আসছে—একটা পান খাব।

সিদ্দিক সাহেবের এই ব্যাপারটা আছে। তিনি কাউকে দিয়ে কোন কাজ করান না। চা খেতে ইচ্ছা করলে নিজে গিয়ে চা নিয়ে আসেন। পান খেতে ইচ্ছা করলে নিজেই অফিসের সামনের পানের দোকানে পান কিনতে যান।

সিদ্দিক সাহেব দুটা পান কিনলেন। একটা মুখে দিয়ে অন্যটা পকেটে রাখতে রাখতে বললেন–ফরহাদ সাহেব। আপনার খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। এই খারাপ সময় সম্পর্কে আমার ধারণা আছে। আমার বড় মেয়ের জন্মের পর পর আমার চাকরি চলে গিয়েছিল। দুবছর আমি বেকার ছিলাম। যে কষ্ট করেছি তার সীমা নাই। পৃথিবীতে নানান ধরনের কষ্ট আছে—মানসিক কষ্ট, প্রিয়জন হারানোর কষ্ট, অসুখ বিসুখের কষ্ট। সবচে বড় কষ্ট হল ক্ষিধের কষ্ট। এই কষ্টও করেছি। একবার ঠিক করেছিলাম বিষ খেয়ে মরে যাব। ঘুমের অষুধ জোগাঢ়ও করেছিলাম। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে মরতে পারি নাই। ভাই শুনুন আপনি ভরসা হারাবেন না। এই কাগজটা একটু রাখুন।

সিদ্দিক সাহেব মানিব্যাগ খুলে একটা কাগজ বের করলেন। কাগজে কার যেন ঠিকানা লেখা। ফরহাদ বলল, কি কাগজ?

সিদ্দিক সাহেব বললেন, দুটা বাচ্চাকে পড়াতে হবে প্রাইভেট টিউটর চায়। আমি আপনার কথা বলে রেখেছি। যাই পাওয়া যায় এখন তাই লাভ।

ফরহাদ কাগজটা নিল। সিদ্দিক সাহেব পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, যে চিঠিটা একটু আগে পড়ছিলেন সেখানেও একটা খারাপ সংবাদ আছে তাই না?

ফরহাদ কিছু বলল না। সিদ্দিক সাহেব বললেন—আমি লক্ষ্য করেছি চিঠিটা পড়তে পড়তে আপনার মুখ ছাই বর্ণ হয়ে গেছে। আমার নিজের বুকের মধ্যে তখন একটা ধাক্কার মত লেগেছে। সুখ যখন আসে তখন একদিক থেকে আসে না, নানান দিক থেকে আসে। বিপদ যখন আসে তখনও একদিক থেকে আসে না। নানান দিক থেকে আসে। এই ব্যাপারটা আমার চেয়ে ভাল কেউ জানে না। আমি বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি ইনশাল্লাহ আপনিও পাবেন। আমার বড় মেয়েটা ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করেছে। কমনওয়েলথ স্কলারশীপ পেয়েছে পিএইচডি করতে যাচ্ছে কানাডায়। তার জন্মের পর আমার স্ত্রীর বুকে দুধ ছিল না। টিনের দুধ কিনব এই টাকা ছিল না। বাজার থেকে চিড়া কিনে আনতাম—চিড়া কচলে তার পানিটা খাওয়াতাম। মেয়েটা সেই পানি খেতে পারে না। উগলে ফেলে দেয়। তখন আমি স্ত্রীকে বললাম,….. থাক বাদ দেন।

ফরহাদ তাকিয়ে আছে। সিদ্দিক সাহেব রুমাল বের করে চোখ মুছছেন।

সিদ্দিক সাহেব ধরা গলায় বললেন, একটা সময় ছিল রোজ কাঁদতাম। আজ অনেক দিন পরে কাঁদলাম। মেয়েটা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে মনটা দুর্বল এই জন্যে কেঁদে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না।

সিদ্দিক সাহেব উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করলেন। একবারো পেছনে ফিরলেন না।

ফরহাদ লক্ষ্য করল প্রচন্ড মন খারাপ ভাবটা এখন আর তার নেই। সে বেশ ভাল বোধ করছে। তাকে বাড়িঘর ছেড়ে দিতে হবে। সে কোথায় গিয়ে উঠবে এই চিন্তাটাও এই মুহূর্তে তার মাথায় নেই। শুক্রবারে তার বিয়ে। দুমাসের বেতনের টাকা তার পকেটে। খারাপ কি? তার কোন দুধের শিশু নেই যাকে চিড়ার পানি গুলে খাওয়াতে হবে। তাকে কি সুখী মানুষ বলা যায় না? তার ইচ্ছা করছে আসমানীকে নিয়ে বের হতে। টুকিটাকি কিছু জিনিস কিনবে। সংসারের জিনিস দুজনে মিলে কেনার অনেক আনন্দ। প্রথমে কিনতে হবে একটা মশারি। ধবধবে শাদারঙের নেটের মশারি। পাশে বড় এবং বেশ উঁচু। মশারির ভেতর বসে থাকলে যেন মশারির ছাদ মাথা স্পর্শ না করে। দুজনে চা খাবার জন্যে সুন্দর দুটা কাপ পিরিচ। বিছানার চাদর। ঘরে কোন ড্রেসিং টেবিল নেই। ড্রেসিং টেবিল কিনতে পারলে ভাল হত। সম্ভব হবে না। ভাল বড় আয়না কিনে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিতে হবে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখা যায় এমন বড় আয়না। কত দাম পড়বে কে জানে। আসল জিনিশের কথাই মনেছিল না—বালিশ। নরম বালিশ কিনতে হবে। ফ্লাক্স কিনতে হবে। ফ্লাক্স ভর্তি থাকবে গরম পানি। টি ব্যাগ, চায়ের, দুধ, চিনি থাকবে। গভীর রাতে চা খেতে ইচ্ছা করলে গরম পানি দিয়ে চা বানানো। একটা টিভি কিনতে পারলে খুব ভাল হবে। ঢাকা শহরে তাদের বাড়িটি সম্ভবত একমাত্র বাড়ি যেখানে টিভি নেই। এক সময় টিভি ছিল। ভোল্টেজ ফ্লাকচুয়েশনের কি ঝামেলায় পিকচার টিউব নষ্ট হয়ে যাবার পর আর সারানো হয় নি। টিভিটা সারাতে দিলে হয়।

টেলিফোনে আসমানীর সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে। তার শরীরটা কেমন কে জানে। শরীর খারাপ থাকলে বের হতে পারবে না। একশ টাকার নতুন একটা ফোন কার্ড কেনা হয়েছে। ফোন কার্ডের কিছুই খরচ হয় নি। পুরো কার্ডটা খরচ করলে কেমন হয়? তাহলে বলা যাবে একশ টাকায় কথা বলা হল।

আসমানী বলল, কে বলছেন?

ফরহাদ বলল, জমিন বলছি।

আসমানী হাসতে হাসতে বলল, জমিন বলছ মানে?

তুমি আসমান হলে আমি জমিন। বাংলা সিনেমা আর কি? তুমি বৃষ্টি, আমি মেঘ। তুমি জল আমি স্থল। এই শরীর কেমন?

শরীর কেমন মানে! তোমার কি ধারণা আমি চীর-রোগী। খবর্দার আর কখনো টেলিফোন করে শরীর কেমন জিজ্ঞেস করবে না।

আচ্ছা যাও করব না। আমাদের বিয়ের তারিখ কি ঠিক আছে?

দুদিন পিছিয়েছে। রবিবার। আমরা আমাদের সব আত্মীয় স্বজনদের রবিবারের কথা বলছি। মামা এর মধ্যে তোমার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলবেন। মনে হচ্ছে আজ সন্ধ্যাবেলা যাবেন। সন্ধ্যাবেলা তুমি অবশ্যই বাসায় থাকবে।

হ্যাঁ থাকব।

এখন কি করছ?

আসমানী নামের একটা মেয়ের সঙ্গে কথা বলছি। আচ্ছা শোন তুমি কি আজ আমাকে দোকানে নিয়ে যেতে পারবে?

ওমা কেন পারব না। আমার নিজেরো কিছু কেনাকাটা আছে। এই শোন কথা বাড়িয়ে এক্ষুনী চলে এসো।

এক্ষুনী চলে আসতে পারব না। তোমাকে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে হবে। আমি একশ টাকা দিয়ে একটি ফোন কার্ড কিনেছি। কার্ড শেষ না হওয়া পর্যন্ত কথা বলব।

আচ্ছা বল আমি টেলিফোন ধরে আছি।

আসমানী তোমার কোন ধরনের বালিশ পছন্দ। শক্ত না নরম?

বালিশ আবার শক্ত হয় নাকি? বালিশ মানেই তো নরম।

বালিশ যে ক্ষেত্র বিশেষে কি রকম শক্ত হয় তা আমাদের বালিশ না দেখলে বুঝবে না। আমাদের বালিশ দিয়ে মাথায় বাড়ি মারলে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু হবার সম্ভাবনা। ভাল কথা তোমার খাটের গদী কি ফোমের?

হ্যাঁ ফোমের।

কত ইঞ্চি ফোম?

মেপে দেখিনি। মাপব?

অবশ্যই মাপবে, টেলিফোনে কথা শেষ হোক তারপর মাপবে। কারণ আমি একটা ফোমের তোষক কিনব।

তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন?

খুশি খুশি লাগছে?।

হ্যাঁ খুব খুশি খুশি লাগছে। চাকরি ফেরত পেয়েছ তাই না?

চাকরি ফেরত পাইনি। আমার খুবই দুঃসময়। তাতে কি? আমাকেতো আর দুধের মেয়েকে চিড়ার পানি খাওয়াতে হচ্ছে না।

তার মানে?

তার মানে তুমি বুঝবে না।

আসমানী বলল, আচ্ছা আজ কি বৃহস্পতিবার?

ফরহাদ বলল, কেন বলতো?

তোমার আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। আমি একটা বই-এ পড়েছি একেকজন মানুষের একেকবারে আনন্দ থাকে। যেমন ধর আমি। আমি হচ্ছি সূর্যের কন্যা। আমি আনন্দে থাকি রোববারে। আচ্ছা শোন, তুমি কথা বলে শুধু সময় নষ্ট কর।

উঁহু আমি আজ একশটাকার কথা বলব। একশ টাকা এখনও শেষ হয় নি।

কখন শেষ হবে?

তাও বলতে পারছি না। তবে আর মনে হয় কথা বলতে পারব না।

কেন?

আমার পেছনে লম্বা লাইন হয়ে গেছে। লাইনের লোকগুলি বিশ্রীভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছে।

ভাল হয়েছে। অগ্নি দৃষ্টিতে তোমাকে ভস্ম করে দিক। হ্যালো শোন টেলিফোন রাখার আগে খুব জরুরী একটা কথা জিজ্ঞেস করি। কি রঙের শাড়ি পরব বলতো? তোমার পছন্দের কোন রঙের শাড়ি পরতে ইচ্ছা করছে।

আমাকে কিছু বলতে হবে না। আমি মনে মনে যে রঙটা ভাবব তোমাকে সেই রঙের শাড়ি পরেই আসতে হবে। এই বিষয়ে আমার আধ্যাত্বিক ক্ষমতা আছে। ইএসপি টাইপ ক্ষমতা, পরীক্ষা হয়ে যাক। আমি টেলিফোন রেখেই আমার পছন্দের রঙের কথা এক টুকরো কাগজে লিখে মানিব্যাগে রেখে দেব। তুমি দেখবে যে রঙের শাড়ি পরে বের হয়েছ সেই রঙটার কথাই আমি লিখেছি।

উফ ফালতু কথা বলবে নাতো। প্লীজ।

বাজি?

আচ্ছা যাও বাজি।

টেলিফোন রেখে দেই?

দাও। তবে টেলিফোন রাখার আগে দয়া করে বলতো আমার সোনার বাংলা গানটার পরের লাইনটা যেন কি?

আমি তোমায় ভালবাসি।

আসমানী তার মার কাছ থেকে নিয়ে ধবধবে শাদা রঙের একটা শিফন শাড়ি পরেছে। শাদা রঙের শাড়ি সে কখনো পরে না। ফরহাদকে শিক্ষা দেয়ার জন্যে এমন শাড়ি পরা। সে নিশ্চয়ই ভাববে না, আজকের দিনে সে শাদা শাড়ি পড়বে।

 

আসমানী হাসি হাসি মুখে বলল, দেখি তোমার মানিব্যাগের কাগজ।

ফরহাদ কাগজ বের করে আসমানীর হাতে দিল। কাগজে লেখা—শাদা। আসমানী খুবই অবাক হয়ে ফরহাদের দিকে তাকাচ্ছে। সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। আসমানীর বিষ্মিত মুখ দেখে ফরহাদের খুবই মায়া লাগছে। ইচ্ছা করছে সত্যি ব্যাপারটা বলে দিতে। মানিব্যাগে শুধু যে শাদা লেখা কাগজই ছিল তা না, একটা কাগজে লেখা ছিল নীল, একটায় সবুজ, একটায় লাল এবং একটায় কালো। অন্য কাগজগুলি রেখে ফরহাদ শাদা লেখা কাগজটা বের করে দিয়েছে। ছেলেমানুষী ম্যাজিক। পিসি সরকারের ছোটদের ম্যাজিক বই থেকে শেখা। আসমানী এতটা অভিভূত হবে সে ভাবে নি। ফরহাদের খুবই লজ্জা লাগছে। ছছাট্ট এই কৌশলটা করায় সে মনে হচ্ছে নিজের কাছে ছোট হয়ে গেছে।

ফরহাদ বলল, আসমানী তোমাকে শাদা শাড়ীতে খুবই সুন্দর লাগছে। তোমাকে আজ যত সুন্দর লাগছে তত সুন্দর এর আগে কখনো লাগে নি। শাদা শাড়ি তুমি ঘন ঘন পরবে।

আসমানী বলল, তোমাকে এই ছাই রঙা শার্ট খুবই কুৎসিত লাগছে। এরকম কুৎসিত শার্ট আর কখনো পরবে না। তোমাকে কেমন লাগছে বলব?

বল।

মাছ কাটার আগে মাছের গায়ে ছাই মাখানো হয়। মনে হচ্ছে তোমার গায়ে ছাই মাখানো হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমাকে কাটা হবে।

আসমানী খিল খিল করে হাসছে। তাকে দেখতে আসলেই সুন্দর লাগছে। শাদা শাড়িতে তাকে মেঘ কন্যা বলে মনে হচ্ছে।

আসমানীর হাতে শাদা লেখা কাগজের টুকরোটা এখনো ধরা। সে এই কাগজ ফেলে দেবে না। কোন এক ফাঁকে চট করে তার হ্যান্ড ব্যাগে লুকিয়ে ফেলবে। মেয়েরা স্মৃতি সংগ্রহ করতে খুব পছন্দ করে।

রাহেলা খুবই অবাক হয়েছেন

রাহেলা খুবই অবাক হয়েছেন এই শুক্রবারে তাঁর ছেলের বিয়ে অথচ তিনি কিছু জানেন না। শুক্রবার মানেতো আগামী কাল। এমন একটা খবর তাঁকে অন্যের কাছ থেকে শুনতে হল? তিনি কি এতই তুচ্ছ, এতই নগন্য? রাহেলা খবরটা কিছুক্ষণ আগে শুনেছেন। চা খেতে খেতে জোবেদ আলি মনের ভুলে বলে ফেললেন, ঘর দোয়ার একটু গুছাতে হয়। নতুন বৌ আসছে। তোমার কাছে টাকা পয়সা কিছু আছে? টুকটাক কিছু ইলেকট্রিকের কাজ করা দরকার। বারান্দার বাতি জ্বলে না, বাথরুমের বাতি জ্বলে না। ভাবছি বাগানেও একটা একশ পাওয়ারের বাত্ব frie i

রাহেলা বললেন, বিড়বিড় করে নিজের মনে কি বলছ?

জোবেদ আলি শংকিত গলায় বললেন, কিছু বলছিনাতো।

নতুন বৌ আসছে মানে কি?

জোবেদ আলিকে মূল ঘটনা প্রকাশ করতে হল। সকাল বেলার চা-টা তিনি আগ্রহ করে খান। চা খাওয়ার মাঝখানে একি বিপত্তি? এরিকা জাপানিকার চারা কিনেছেন। চারা লাগাবার জন্যে জমি তৈরী করতে হবে। পঁচা গোবরের সন্ধানে যেতে হবে। রাহেলার প্যাচে পড়লে বের হওয়া যাবে না।

রাহেলা বললেন, ফরহাদ বিয়ে করছে?

জোবেদ আলি বললেন, হুঁ।

সব ঠিকঠাক?

ঠিকঠাক না হলে বিয়ে হবে কি ভাবে?

আমি জানলাম না কেন?

তোমাকে বলার সুযোগ পায় নি।

তোমাকেতো ঠিকই বলার সুযোগ পেয়েছে, আমাকে পায় নি কেন?

তোমার ঘুমের সমস্যা তুমি সকাল সকাল শুয়ে পড়—তারপর ধর ইয়ে…কি যেন বলে…

বিড়বিড় করবে না। বিড়বিড় বন্ধ কর।

জোবেদ আলি চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, রাহেলা তুমি স্বভাব চরিত্র বদলাও। নতুন একটা মেয়ে আসছে এসেই দেখবে তার শাশুড়ির প্রধান কাজ হচ্ছে তার শ্বশুরকে ধমকানো এটা তার ভাল লাগবে না। সব মেয়েরাই স্বামীকে ধমকাতে পছন্দ করে। কিন্তু যখন দেখে অন্য কোন মেয়ে তার স্বামীকে ধমকাচ্ছে তখন খুব রাগ করে।

বিয়ের খবরটা তুমি কবে জেনেছ?

পরশু রাতে।

পরশু রাতে জেনেছ মাঝখানে পুরো একটা দিন গিয়েছে আর তুমি আমাকে কিছুই জানাও নি।

আহারে যন্ত্রণা। বিয়েটা যদি আমার হত আমি বিয়ে ঠিক হওয়া মাত্র তোমাকে জানাতাম। বিয়ে ফরহাদের। সে তোমাকে না জানালে আমি কি করব?

আমাকে জানাতে তার অসুবিধা কোথায়?

আছে নিশ্চয়ই কোন অসুবিধা।

রাহেলা স্বামীর সামনে থেকে উঠে গেলেন। ফরহাদ থাকলে সরাসরি তার কাছে যেতেন। ফরহাদ নেই, খুব ভোরে উঠেই চলে গেছে। নাসতা খায় নি। এক কাপ চা শুধু খেয়েছে। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় নি। ঘুমের অষুধ খাওয়ার পরেও কাল রাতে তার এক ফোটা ঘুম হয়নি। ফজরের আজান শুনে ঘুমুতে গেছেন। ঘুম ভেঙ্গেছে সকাল দশটায়। ঘুম ভেঙ্গেই দুঃসংবাদ। ছেলের বিয়ে দুঃসংবাদতো বটেই। মার কাছে মেয়ের বিয়ে সুসংবাদ। ছেলের বিয়ে দুঃসংবাদ।

মঞ্জু দাড়ি শেভ করছিল। ব্লেডে ধার না থাকায় তার গাল কেটে গেছে। রক্ত বের হয়ে শাদা ফেনায় লাল আভা। মঞ্জু বিরক্ত হয়ে আয়নার ভেতরের মঞ্জুকে দেখছে। যেন তার গাল কেটে ফেলায় সে আয়নার ভেতরের মঞ্জুকে দায়ী করছে। মাকে ঢুকতে দেখে সে তার বিরক্ত দৃষ্টি মার দিকে ফিরিয়ে দিল। এখন তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার গাল কাটায় রাহেলারও কোন সূক্ষ্ণ ভূমিকা আছে।

রাহেলা বললেন, কি করছিস?

মঞ্জু বলল, কি করছি দেখতে পাচ্ছ না?

গালতো কেটে ফেলেছিস?

দরজা থেকে সরে যাওতো মা অন্ধকার করে রেখেছ। নিজের পেটের ছেলে এমন ভঙ্গিতে কথা বলছে ভাবাই যায় না। তাঁর হাতে ক্ষমতা থাকলে দারোয়ান দিয়ে কানে ধরিয়ে এই ছেলেকে বাসার চারপাশে কয়েকটা চক্কর দেয়াতেন। অক্ষম মারা ইচ্ছা থাকলেও কিছু করতে পারেন না। তিনি দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তোর সঙ্গে ফরহাদের কথা হয়েছে?

না।

সে যে বিয়ে করছে জানিস?

জানি।

তোকে কে বলেছে?

ভাইয়া।

কখন বলেছে?

দেখছ একটা কাজ করছি। কি ভ্যানভ্যান শুরু করলে? কখন বলেছে তা দিয়ে তোমার দরকারটা কি?

তোর সঙ্গে কি কথা হয়েছে একটু বল, দরকার আছে।

বিরক্ত করোনাতো মা, প্লীজ। ভাইয়ার সঙ্গে আমার এমন কোন কথা হয়নি। আজ বিকেলে মেয়ে পক্ষের লোকজন কথা বলতে আসবে। আমাকে থাকতে বলেছে।

আজ বিকেলে আসবে?

মঞ্জু জবাব দিল না। রাহেলা বললেন, চা খাবি? মঞ্জু এই প্রশ্নের ও জবাব দিল। রাহেলা বের হয়ে রান্নাঘরে গেলেন। কিছু কিছু সময়ে তাঁর ধৈর্য সীমাহীন। তিনি চা বানিয়ে আবার ছেলের কাছে আসবেন। তখন মঞ্জু তার সঙ্গে ভদ্র ভাবে, কথা বলবে তিনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত। কারণ ছেলে মার সঙ্গে একটু আগে খুব খারাপ ব্যবহার করেছে। তার জন্যে সে কিছুটা হলেও অনুতপ্ত বোধ করবে। ছেলে যদি পুরোপুরি অমানুষ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যি ভিন্ন কথা। সেই সম্ভাবনা। তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। ছেলেবেলায় মঞ্জু অতি শান্ত ছিল। কোন অভিযোেগ নেই, কোন দুষ্টামী নেই, খাওয়া নিয়ে ঝামেলা নেই। সন্ধ্যা হলেই পড়তে বসছে। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি না বলছেন—অনেক হয়েছে বাপ ঘুমুতে যাও। ততক্ষণ পর্যন্ত মাথা ঝুলিয়ে পড়ছেই। তখনি বোঝা উচিত ছিল বড় হয়ে এই ছেলে হারামজাদা টাইপ হয়ে যাবে।

রাহেলা চা নিয়ে মঞ্জুর ঘরে ঢুকে দেখেন তার শেভ করা হয়ে গেছে। সে সিগারেট ধরিয়েছে। মাকে দেখে সে বিরক্ত মুখে সিগারেট জানালা দিয়ে ফেলে দিল। রাহেলা ছেলের এই বিরক্তি ক্ষমা করে দিলেন। দামী একটা সিগারেট, দুটা টান দিয়ে ফেলে দিতে বিরক্তি লাগবেই। তিনি যদি সিগারেট খেতেন, তিনিও বিরক্ত হতেন। রাহেলা বললেন, মঞ্জু চা নে।

চা-তো আমি চাই নি।

মঞ্জু বিরক্ত মুখে চায়ের কাপ হাতে নিল। রাহেলা ছেলের সামনে বসতে বসতে বললেন, ফরহাদ বিয়ে করছে ভাল কথা। বিয়ের বয়স হয়েছে। পাত্রী ঠিক আছে। অসুবিধা কি? সে যদি ভেবে থাকে বিয়েটা সম্পূর্ণ তার নিজের ব্যাপার, কাউকে কিছু বলার দরকার নেই, তাহলেও ঠিক আছে।

ঠিক থাকলে তোমার এত কথার দরকার কি?

বিয়ে যে করছে, বউ নিয়ে সে থাকবে কোন ঘরে? তুই কি তোর দাদাজানকে তোর ঘরে রাখবি?

না।

তাহলে তোর দাদাজান থাকবে কোথায়?

ভাইয়া নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করবে।

কি ব্যবস্থা করবে?

নতুন বাসা ভাড়া করে ভাবীকে নিয়ে উঠবে।

তোকে বলেছে?

না আমাকে কিছু বলে নি। তুমি ভাল করেই জান ভাইয়ার সঙ্গে বসে আমি খেজুরে আলাপ করি না।

আজ সন্ধ্যায় তাহলে মেয়ে পক্ষের লোকজন আসবে?

হ্যাঁ।

তুই থাকবি বাসায়?

আমি বলতে পারছি না। আমার কাজ আছে। কাজ শেষ করতে পারলে চলে আসব।

কি কাজ?

কি কাজ বললে তুমি বুঝবে?

তুই কি চাকরি বাকরি কিছু পেয়েছিস?

চাকরি পাব কোথায়? বাংলাদেশে চাকরি আছে? ব্যবসা করার চেষ্টা করছি।

ব্যবসা করতেও তো টাকা লাগে। টাকা পাবি কোথায়?

সব ব্যবসায় টাকা লাগে না। বাংলাদেশের বেশীর ভাগ ব্যবসাই বিনা টাকার ব্যবসা। এখনকার ব্যবসায় যে জিনিসটা লাগে তার নাম বুদ্ধি।

তোর ধারণা তোর অনেক বুদ্ধি?

হ্যাঁ আমার বুদ্ধি খারাপ না। এখন তুমি যাও আমি সিগারেট খাব।

ব্যবসা ট্যাবসার ব্যাপারে জামাইয়ের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারিস। ব্যবসার ব্যাপার ওরা ভাল বুঝে।

মঞ্জু সিগারেটের প্যাকেটে হাত দিল। হাতে সিগারেটের প্যাকেট দেখে যদি রাহেলা তাকে মুক্তি দেন। রাহেলা ছেলেকে মুক্তি দিলেন। বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। মেয়ের কাছে যাবেন কি-না বুঝতে পারছেন না। সংসারে সমস্যা হওয়া শুরু হয়েছে। এইসব সমস্যা নিয়ে মেয়ের সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায় আলাপ করতে হবে। সব শুনলে জাহানারা তাঁর উপর খুবই রাগ করবে। জাহানারা ধরেই নিবে মার কারণে সংসারে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। রাণীর সঙ্গে বিয়েটা হচ্ছে না কেন এই জবাবদিহিও রাহেলাকেই করতে হবে। অথচ তিনি ধরেই নিয়েছিলেন রাণীর সঙ্গে ফরহাদের বিয়েটা তিনি দিতে পারবেন। দিন রাত ভেবে সূক্ষ্ম কিছু পরিকল্পনাও তিনি করেছিলেন। এ জাতীয় পরিকল্পনা অতীতেও তিনি করেছেন। তখন কাজ করেছে। জাহানারার বিয়েতে তিনি এইভাবেই দিলেন। জাহানারা পালিয়ে গিয়ে যে ছেলেকে বিয়ে করবে বলে ঠিক করেছিল, সেই বিয়ে তিনি হতে দেননি। তার ফল শুভ হয়েছে।

রাহেলা মনে হল আজই মেয়েকে কিছু জানানো ঠিক হবে না। বিয়ের কথা হলেই যে বিয়ে হয়ে যাবে এমনতো না। চল্লিশ জায়গায় বিয়ের কথা হয়, কিন্তু বিয়ে চল্লিশ জায়গায় হয় না। বিয়ে এক জায়গাতেই হয়। তাঁর মন বলছে ফরহাদের বিয়ে রাণীর সঙ্গে হবে। তিনি ভোর রাতে এরকম একটা স্বপ্ন দেখেছেন। বউ সেজে রাণী তাঁর ঘরে ঢুকেছে। তার গা ভর্তি গয়না, পরনে লাল টুকটুকু শাড়ি। তাকে সালাম করতে করতে বলেছে—আপনাকে এত দিন মাঐ মা ডেকেছি, আজ হঠাৎ মা ডাকতে পারব না। আপনি কিন্তু কিছু মনে করতে পারবেন না।

ফজরের নামাজের স্বপ্ন ভুল হবার কথা না। চাঁদের হিসাবটা দেখতে হবে। শুক্লা পক্ষের চাঁদ হলে স্বপ্ন মিলে যাবে। কৃষ্ণপক্ষ হলে মিলতেও পারে আবার নাও মিলতে পারে।

আজ সন্ধ্যাবেলায় মেয়ে পক্ষের লোকজন কথা বলতে আসবে। তাদের সঙ্গে মুরুব্বী মহিলাও নিশ্চয়ই থাকবেন। বিয়ের আলাপে পুরুষদের সঙ্গে মহিলারা সব সময় আসেন। মহিলারা আসেন ভেতরের খবর বের করার জন্যে। সেই মহিলাকে ভেতরের খবর তিনি সবই দেবেন। কিছুই লুকাবেন না। এক ছেলের হাতে পুরো সংসার। অসুস্থ বৃদ্ধ একজন মানুষ আছে। ঢাকা শহরে নিজেদের বাড়ি ঘর বলতে কিছু নেই। অন্যের বাড়িতে পাহারাদার হিসেবে থাকা। যে কোন সময় তারা বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে। তখন যেতে হবে গাছ তলায়। দেশের বাড়িতে গিয়ে যে থাকবে সেই উপায়ও নেই। দেশে ভিটা বাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই। সেই বাড়িতে কেউ থাকে না। ঘর-দোয়ার ভেঙ্গে পড়েছে। চারদিকে জংলা, সাপ খোপের আচ্ছা।

বৌমা আছ বৌমা।

রাহেলা বিরক্ত মুখে ফরহাদের ঘরের দিকে তাকালেন। মেম্বর আলির আজ জ্বর এসেছে। কত জ্বর বোঝা যাচ্ছে না। থার্মোমিটার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাউকে দিয়ে যে থার্মোমিটার কিনে আনাবেন তাও সম্ভব না। কাজের মেয়েটা ছুটিতে গিয়েছে। মঞ্জুকে বললে লাভ হবে না। তবু বলে দেখা যেতে পারে। নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকা। কেউ যেন বলতে না পারে—শ্বশুরের জ্বর হয়েছে একটা থার্মোমিটার আনিয়ে জ্বরটা যে মাপবে তাও করেনি। তবে এক্ষুণী মঞ্জুর ঘরে ঢুকে কিছু বলার দরকার নেই। তাঁকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই মঞ্জু দপ করে জ্বলে উঠবে। তার দরকার কি। গাল বাড়ালেই যদি চড় খেতে হয় তাহলে গাল বাড়ানো কেন? একসময় না একসময় মঞ্জু ঘর থেকে বের হবে। বের হবার মুখে বললেই হবে।

বৌমা ও বৌমা।

রাহেলা মুখ অন্ধকার করে শ্বশুরের ঘরে ঢুকলেন। মেম্বর আলি বললেন, আমলকি খাব বৌমা।

কি খাবেন?

আমলকি।

রাহেলা তিক্ত গলায় বললেন—আব্বা শুনুন আপনিতো বেহেশতে বাস করছেন যে কোন একটা ফল খেতে ইচ্ছা করল মুখ দিয়ে বললেন, অমি ফলটা এসে মুখের সামনে ঝুলতে থাকল। আমলকি এখন পাব কোথায়?

লবণ দিয়ে একটা আমলকি খেলে মুখে স্বাদটা ফিরে।

বুড়ো মানুষের মুখে এত স্বাদ হওয়া ভাল না। স্বাদ হলে দুনিয়ার কুপথ্য করবেন আর পেট নামবে।

মঞ্জু বাসায় আছে না? তার কথা শুনলাম।

হ্যাঁ আছে।

মঞ্জুকে বলে দাও। এখন কার্তিক মাস, আমলকির সিজন।

আব্বা শুনুন, আপনার বয়স হয়েছে, শরীর ভাল না। আপনি আল্লাহখোদার নাম নেন। তসবি পড়ার মত আমলকি আমলকি করছেন কেন? আমলকির মধ্যে আছে টা কি?

আমলকি স্বাদ বর্ধক। আমলকি, জলপাই দুইটাই কার্তিকের ফল, দুইটাই স্বাদ বর্ধক। মা মঞ্জুকে জলপাইও আনতে বল। একটা কাগজে লিখে দাও। লিখে দিলে মনে থাকবে না।

আচ্ছা যান বলব।

লেবু চা একটু দিতে পারবে মা?

ঘরে লেবু নাই।

লেবু না থাকলে রং চা দাও। বৃদ্ধ মানুষের জন্যে রং চা মহৌষধ।

রাহেলা বললেন, চা দিচ্ছি। আব্বা আপনাকে একটা কথা বলি একটু মন দিয়ে শুনুন।

মা তোমার সব কথা আমি মন দিয়ে শুনি।

এটা একটু বেশি মন দিয়ে শুনুন। আপনার বয়স হয়েছে। এই বয়সে খুব ভাল সেবা দরকার। আপনি আপনার মেয়ের কাছে কয়েকটা দিন থেকে আসেন।

এইখানে আমার সেবা হচ্ছে না তোমাকে কে বলল? এরচে বেশি সেবা কে আমাকে করবে? রাতে যতবার ঘুম ভাঙ্গে, আমি বিছানায় নড়াচড়া করতেই তোমার ছেলে ফরহাদ লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। মশারী তুলে জিজ্ঞেস করে, দাদাজান কি হয়েছে? এরচে বেশিতে ফেরশতাও করবে না।

ফরহাদতো আর সারাজীবন আপনাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমাবেনা। ও বিয়ে করবে। সে তার সংসার দেখবে।

মেম্বর আলি হাসি মুখে বললেন, সে সংসার দেখবে, সংসারের ফাঁকে ফাঁকে আমাকেও দেখবে। যে দেখতে পারে সে সংসারে থেকেও দেখতে পারে।

রাহেলা চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকলেন। তাঁকে বিস্মিত করে দিয়ে মঞ্জুও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে ঢুকল। মঞ্জু তার নিজের ঘর আর এ বাড়ির বারান্দা ছাড়া কোথাও যায় না। রান্নাঘরে সে কখনো উঁকি দিয়েছে বলে তিনি মনে করতে পারছেন না। রাহেলা বললেন, কি আরেক কাপ চা খাবি?

মঞ্জু বলল, চা খাব না। মা শোন এই পঞ্চাশটা টাকা রাখ, দাদাজান আমলকি খেতে চাচ্ছে তাকে আমলকি এনে খাইও। আর সাথে এই টাকাটা রাখ সংসারের খরচ। এখন থেকে মাসের এক দুই তারিখে আমি যা পারি দেব।

রাহেলা আনন্দিত গলায় বললেন, এখানে কত টাকা?

দুই হাজার।

রাহেলা টাকাটা হাতে নিয়েই শুনতে শুরু করলেন। সব একশ টাকার নতুন নোট। একটার গায়ে একটা লেগে আছে। গুনতে কষ্ট হচ্ছে। পৃথিবীর সবচে আনন্দময় কষ্টের একটা কষ্ট হচ্ছে টাকা গোনার কষ্ট। একটু আগে মঞ্জু যে খারাপ ব্যবহার তাঁর সঙ্গে করেছে তার কিছুই এখন রাহেলার মনে নেই। ছেলের প্রতি মমতায় তাঁর হৃদয় এখন আদ্র। তার মন বলছে এই ছেলে ফরহাদের মত পুতু পুতু করে জীবন শুরু করবে না, সে মাথা শক্ত করে উঠে দাঁড়াবে। এই ছেলের টাকা পয়সা হবে। ঘর বাড়ি হবে। গাড়ি হবে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় ব্যাপার এই ছেলের বেলা কখনো ঘটবে না। শক্ত ধরনের ছেলে। বর্তমান সময় হল কঠিন সময় এই কঠিন সময়ে শক্ত ধরনের ছেলেপুলে দরকার। মিনমিনে মেয়ে টাইপ ছেলেদের যোগ শেষ হয়েছে।

 

গাছ লাগাবার জন্যে সবচে ভাল সময় হচ্ছে বিকাল। রোদ থাকে না। মাটি ভাল করে তৈরী করে চারা পুতে দিতে দিতেই সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যার পরই নামে রাত। রাতের ঠাণ্ডা হাওয়ায় নতুন লাগানো গাছে শান্তির পরশ পরে। রাতে শিশিরে মাটি ভিজে থাকে। গাছের গায়ে সেই শিশির জমে। গাছের জন্যে যা খুবই প্রয়োজন।

জোবেদ আলি এমন এক মহেন্দ্রক্ষণে এরিকা জাপানিকা গাছের চারা লাগালেন। চল্লিশ টাকা দিয়ে তিনি একটা বাঁশ কিনে এনেছিলেন। বাঁশ কেটে গাছের চারদিকে বেড়া দিয়ে দিলেন। লোকজন ছাগলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে গাছ বেড়া দেয়। তিনি দিচ্ছেন তার ছেলের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে। তাঁর মন বলছে মঞ্জু এই গাছটাও পাড়িয়ে মেরে ফেলবে।

গাছটা মনে হচ্ছে বেঁচে যাবে। জোবেদ আলি গাছের জীবন রক্ষার জন্যে দীর্ঘ প্রার্থনা করলেন। প্রার্থনার মাঝখানে বাঁধা পড়ল, তিনি দেখলেন, গেট খুলে নান্টু ঢুকছে। যে কেউ বাগানে ঢুকলে তিনি কিছুটা শংকিত বোধ করেন, এই বুঝি সে কোন চারার উপর দাঁড়িয়ে পড়ল। এই বুঝি হাত বাড়িয়ে গাছের কোন পাতা ছিঁড়ল। মানুষের এই এক বিচিত্র অভ্যাস, গাছ দেখলেই পাতা ছিঁড়ে গন্ধ শোঁকা। গন্ধ যদি কতেই হয় পাতা না ছিঁড়েও তো শোকা যায়। এমনোতো হতে পারতো যে গাছরা মানুষের স্বভাব পেয়েছে। কোন মানুষ যাচ্ছে গাছের নিচ দিয়ে। গাছটা টান দিয়ে মানুষের একটা হাত ছিঁড়ে ফেলল গন্ধ শোঁকার জন্যে। তখন কেমন হত? মানুষ এমন অকৃতজ্ঞ। কোন মানুষকি পারে তার নিজের ছেলেমেয়ে অন্যকে বিলিয়ে দিতে। কিন্তু গাছতত পারছে। সে তার সব ফল দিয়ে দিচ্ছে। ফলগুলি গাছের সন্তান ছাড়া আর কি?

চাচাজান কেমন আছেন?

জোবেদ আলি বললেন, ভাল। তাঁর খুবই অস্বস্থি লাগছে কারণ নান্টু ছেলেটা হেলতে দুলতে বাগানের ভেতর দিয়ে তাঁর কাছে আসছে। মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটলেও একটা কথা ছিল তিনি বুঝতেন যে সে দেখেশুনে হাঁটবে। চাড়া মাড়িয়ে দেবে না।

বাগানটাতো খুব সুন্দর করে ফেলেছেন। আমাকে চিনতে পেরেছেনতো আমি নান্টু।

হ্যাঁ চিনেছি। ঘরে গিয়ে বোস। ফরহাদ অবশ্যি বাসায় নেই সকালে বের হয়েছে এখনো ফিরেনি।

তার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যে আজ বাসায় লোকজন আসার কথা না?

হুঁ।

আমি এই জন্যেই এসেছি।

ভাল করেছ। ঘরে গিয়ে বোস আমি আসছি। হাতের কাজটা শেষ করে আসি।

গাছ লাগাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

আপনার বাগানে কি মশলার গাছ আছে? দারুচিনি, লবঙ্গ?

অবশ্যই আছে। দারুচিনি গাছ আছে দুটা। লবঙ্গ গাছ আছে চারটা। একটা এলাচ গাছ আছে। ছোট এলাচ না বড়টা।

এলাচ হয়?

এখনো জানি না। বাবা তুমি এভাবে বাগানে হাঁটাহাটি করবে না। গাছ মেরে ফেলবে। তুমি ঘরে গিয়ে বোস। চা খাও।

আপনার সঙ্গে একটু গল্প করি।

আমি কাজের সময় গল্প করি না। তুমি ঘরে গিয়ে বোস। আমি আসছি।

 

নান্টু ইস্ত্রী করা পায়জামা পাঞ্জাবী পরে এসেছে। বিয়ের কথাবার্তা হবে পরনে ভাল কাপড় থাকা দরকার। নান্টুর মুখ হাসি হাসি হলেও তার মন সাংঘাতিক খারাপ। মন খারাপের দুটি বড় কারণের একটা হচ্ছে—অর্ণবের জ্বর। ময়মনসিংহ থেকে সে জ্বর নিয়ে ফিরেছে। শর্মিলার কাছ থেকে টেলিফোনে এর বেশী কিছু জানা যায় নি। কত জ্বর? ডাক্তার এসেছে কি-না এইসব কিছু জানার আগেই শর্মিলা বলল— টেলিফোন একবার ধরলেতো তুমি ছাড়তে চাও না। এখন তোমার সঙ্গে বকবক করতে পারব না। রাখি কেমন? বলেই সে টেলিফোন রেখে দিল। এরপরে নান্টু খুব কম হলেও একশবার টেলিফোন করেছে। কেউ রিসিভার তুলেনি। শুধুই এনগেজড টোন। নান্টুর ধারণা শর্মিলা লাইন খুলে রেখেছে।

বিয়ের আলাপটা শেষ হলেই নান্টু ছেলেকে দেখতে যাবে। আলাপ কখন শেষ হয় সেটাই হল কথা। বিয়ের আলাপ হল রবারের মত শুধুই লম্বা হয়। রবার লম্বা হতে হতে এক সময় ছিঁড়ে যায়, বিয়ের আলাপ ছেড়ে না। লম্বা হতেই থাকে, হতেই থাকে।

ছেলের অসুস্থতা ছাড়াও অন্য একটা ব্যাপারে নান্টুর মন খারাপ। সে ছশ টাকা এডভান্স দিয়েছিল এফডিসি গেট থেকে একজন চেহারার মহিলা এবং দুটা বাচ্চা ভাড়া করে আনতে। কথা পাকা হয়েছিল। সকাল আটটা থেকে তারা অফিসের সামনে চায়ের দোকানে বসে থাকবে। নান্টু অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করবে। অন্যরাও তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে চায়ের দোকানে আসবে। কেউই আসে নি। অন্যরা আসেনি তার যুক্তি আছে। চাকরি ফেরত পেয়েছে আন্দোলনের আর দরকার কি? কিন্তু তার কাছ থেকে যে এডভান্স ছয়শ টাকা নিয়ে গেছে সেই লোকজন কোথায়? ঠগবাজদের যন্ত্রণায় মনে হয় এই দেশে বাস করা যাবে না হারামজাদা দালালটার কত বড় বড় কথা—একদিনের বাচ্চা চাইলে একদিনের বাচ্চা পাবেন। নাড়ি কাটা হয় নাই এমন বাচ্চা চান? তাও পাবেন। ফিলমের লাইন বলে কথা। বাঘের দুধ অনেকেই জোগাড় করতে পারবে। ফিলমের লোক বাঘের দুধ থেকে সর তুলে সেই সরে ঘি বানিয়ে নিয়ে আসবে। বাঘের ঘি কোন ব্যাপার না। আপনি চাইলে তিনশ গ্রাম বাঘের ঘি দিয়ে যাব। খেয়ে দাম দিবেন।

চাকরি চলে গেছে তাতে নান্টু যতটা মন খারাপ করেছে তারচে বেশী মন খারাপ করেছে একটা লোক তাকে বোকা বানিয়ে ছয়শ টাকা হাতিয়ে নিয়ে চলে গেছে এই দুঃখে।

ঘরে কাজের লোক নেই। রাহেলা নিজেই চা বানিয়ে নিয়ে গেলেন। দু কাপ চা। তাঁর নিজের জন্যেও এক কাপ চা খেতে খেতে তিনি কিছুক্ষণ গল্প করবেন। ভেতরের কোন খবর বের করা যায় কি-না। নান্টু ছেলেটা ফরহাদের বেশ ভাল বন্ধু। ফরহাদ মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে রাত কাটাতে যায়। বিয়ে টিয়ে নিয়ে ফরহাদ নিশ্চয়ই বন্ধুর সঙ্গে অনেক গল্প করেছে।

কেমন আছ বাবা?

নান্টু ওঠে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করল। রাহেলা খুশি হলেন। এই ছেলের সঙ্গে তার যতবার দেখা হয়েছে সে পা ছুঁয়ে সালাম করেছে। তাঁর নিজের দুই ছেলে ঈদের দিনেও সালাম করে না। একজনতো ঈদের নামাজই পড়ে না।

নান্টু বলল, ফরহাদ আজ বিকেলে আমাকে আসতে বলেছে। বিয়ের আলাপ হবে। ফরহাদ গেছে কোথায় জানেন?

রাহেলা বললেন, বাবা আমি কিছুই জানি না। আমার ছেলে যে বিয়ে করছে এটাও জানতাম না। আজ সকালে জানলাম।

আপনি কিছু জানতেন না?

না। পছন্দের মেয়ে আছে, বিয়ে করবে খুব ভাল কথা। আমাকে বলতেতো অসুবিধা নেই। আমি কি বলব—এই মেয়ে বিয়ে করিস না। আমার হাতে ভাল মেয়ে আছে। বাপ মা যখন ছেলের দয়ার উপর বাস করে তখন ছেলের কথাই তাদের কথা। ছেলে যদি বলে, উত্তর তারাও বলবে, উত্তর। ছেলে যদি বলে দক্ষিণ, তারাও বলবে, দক্ষিণ।

নান্টু চায়ের কাপ চুমুক দিতে দিতে বলল, ফরহাদের মন খুব খারাপ। বিরাট ঝামেলার মধ্যে পড়েছে। বয়স অল্প। মাথা ঠিক রাখতে পারছে না।

রাহেলা অবাক হয়ে বললেন, কি ঝামেলা?

চাকরির ঝামেলাটার কথা বলছি।

চাকরির কি ঝামেলা?

ঐ যে চাকরিটা চলে গেল।

রাহেলা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছেন। এই ছেলে কি বলছে। ফরহাদের চাকরি চলে গেছে মানে কি? চাকরি না থাকলে চলবে কি ভাবে। রাহেলার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।

চাকরি কবে গেল?

অর্ডার হয়েছে এই মাসের চার তারিখ।

ও।

রাহেলার মাথা ঝিমঝিম করছে, ছেলের চাকরি নেই, সে বিয়ে করছে। গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াচ্ছে এর মানে কি?

চাচী ফরহাদের যে চাকরি নেই আপনি জানতেন না?

না বাবা জানতাম না। সে কাউকেই কিছু বলে নাই। তোমার কাছ থেকে প্রথম শুনলাম।

চাচী আপনি এটা নিয়ে মোটেই দুঃশ্চিন্তা করবেন না। একটা কিছু ব্যবস্থা ইনশাল্লাহ হবেই।

কি ব্যবস্থা হবে?

নান্টু জবাব দিতে পারল না। কি ব্যবস্থা হবে তা সে নিজেও জানে না।

চাকরি গেল কেন? সে কি করেছিল?

কিছু করে নাই। জান দিয়ে খেটেছে। এই দেশে চাকরি হওয়ার জন্যে অনেক কারণ লাগে। চাকরি চলে যাবার জন্যে কোন কারণ লাগে না।

রাহেলা বললেন, ছেলের চাকরি নেই, এর মধ্যে তাকে বিয়ে করতে হচ্ছে। আমি তো বাবা কিছুই বুঝতে পারছি না।

বিয়ের তারিখ আগে থেকে ঠিক হয়েছিল, এর মধ্যে যে চাকরি চলে যাবে সে ভাবে নি।

তোমার বন্ধু কোন দিনই কোন কিছু ভাবে নি। তুমি বোস আমি মাগরেবের নামাজ পড়ে আসি।

নান্টু রাত আটটা পর্যন্ত অপেক্ষা করল। ফরহাদ ফিরল না। এর মধ্যে শুরু হল বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি। যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে সেই হারে হতে থাকলে রাস্তাঘাট ড়ুবে যেতে থাকবে। শর্মিলার বাড়ির সামনের রাস্তাটা তিন ফোটা বৃষ্টি হলেই ড়ুবে যায়। নান্টুকে এক্ষুণি বের হতে হবে। নয়ত অর্ণবের সঙ্গে দেখাই হবে না। কোন রিক্সা, কোন বেবীটেক্সি ঐদিকে যাবে না।

চাচী আমি আজ উঠি। আমার ছেলেটা অসুস্থ তাকে দেখতে যেতে হবে। আপনি ফরহাদকে বলবেন আমি অর্ণবকে দেখে ফেরার পথে সম্ভব হলে আবার আসব।

বৃষ্টির মধ্যে যাবে কি ভাবে?

কোন অসুবিধা হবে না। বাসায় কি ছাতা আছে? ছাতা থাকলে নিয়ে যাই।

ছাতা নেই। এই বাড়িতে এসে কখনো কিছু চেয়ো না। এটা হল নেই– বাড়ি। এই বাড়িতে কিছুই নেই।

নান্টু চলে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফরহাদ ভিজে ন্যাতা ন্যাতা হয়ে উপস্থিত হল। তার সঙ্গে অনেক জিনিসপত্র। বিছানার চাদর, মশারি, বালিশ সবই ভিজেছে। জোবেদ আলি চিন্তিত মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে। হঠাৎ এই প্রবল বর্ষণ তাঁকে চিন্তায় ফেলেছে। জাপানী গাছটা আজ পুতেছেন আর আজই এমন বৃষ্টি। পানি জমে গেলে শিকর পঁচে যাবে তো।

ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ফরহাদ জিজ্ঞেস করল, বাবা আমার কাছে কেউ এসেছিল?

জোবেদ আলি অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললেন, না। অথচ নান্টু তার সামনেই বাসায় এসেছে। বের হবার সময়ও তাঁর সঙ্গে কথা বলে বের হয়েছে। জোবেদ আলি ছেলের দিকে না তাকিয়েই বললেন, কি করা যায় বল দেখি?

কোন প্রসঙ্গে কি করা যায়?

বৃষ্টির কথা বলছি। তুই ঘরে যা ভিজে গেছিস।

বৃষ্টির কথা কি?

তুই যা ঘরে যা।

রাহেলা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছেলেকে লক্ষ্য করছেন। ছেলেকে চিন্তিত মনে হচ্ছে না। সে বেশ সহজ স্বাভাবিক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না তার কোন সমস্যা আছে। এইতো লুঙ্গি পরে কলতলায় চলে গেছে। বালতি ভর্তি করে পানি তুলছে।

মা গায়ে মাখার সাবানটা দিয়ে যাও তো।

রাহেলা সাবান নিয়ে গেলেন। গায়ে মাথায় সাবান মাখতে মাখতে ফরহাদ বলল, দাদাজান দুদিন ধরে আমলকি আমলকি করছেন। আজ আমলকি নিয়ে এসেছি। পলিথিনের একটা ব্যাগে আছে। কয়েকটা আমলকি লবণ দিয়ে দাদাজানকে দাও।

রাহেলা বললেন, আজ কি তোর কাছে কারোর আসার কথা ছিল?

ফরহাদ বলল, হ্যাঁ ছিল। আসমানীর মামা আসবেন বলেছিলেন। তিনি সিঁড়ি থেকে পরে পা মচকে ফেলেছেন। আসবেন না।

রাহেলা বললেন, তোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার জন্যে?

ফরহাদ বলল, হ্যাঁ। মা তুমি ভিজছতো ঘরে চলে যাও। গোসল শেষ করেই আমি এক কাপ আদা চা খাব। মনে হচ্ছে আমার জ্বর আসছে।

জ্বরের মধ্যে গোসল করছিস কেন?

সারাদিন ঘুরেছি। গা ঘেমেছে। বিশ্রী লাগছে।

নান্টু এসেছিল। পরে আবার আসবে বলেছে।

ও আচ্ছা।

নান্টু বলেছিল তোর চাকরি নিয়ে কি সমস্যা না-কি হয়েছে।

ফরহাদ জবাব দিল না। মগের পর মগ পানি মাথায় ঢালতে লাগল। রাহেলা রান্নাঘরে চা বানাতে গেলেন। রান্নাঘরের খোলা দরজা দিয়ে কলঘর দেখা যায়। তিনি দেখতে পাচ্ছেন—ফরহাদ এক বালতি পানি শেষ করে আরেক বালতি পানি নিয়েছে। মগে করে পানি ঢালছে। অতি দ্রুত ঢালছে। সে আবারো পানি ভরছে। বৃষ্টির জোর আরো বেড়েছে।

 

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ফরহাদ বলল, চা-টা খুব ভাল হয়েছে মা।

রাহেলা বললেন, তোর কি জ্বর এসেছে?

আসব আসব করছিল এমন গোসল দিয়েছি যে পানি দিয়ে জ্বর ধুয়ে ফেলেছি।

ক্ষিধে লেগেছে, আজ রান্না কি?

শিং মাছের ঝোল।

ইলিশ মাছের ভাজা খেতে ইচ্ছা করছে। বৃষ্টিটা যদি কমে তাহলে একটা ইলিশ মাছ নিয়ে আসব।

এত রাতে মাছ পাবি?

ইলিশ মাছ রাত একটার সময় গেলেও পাওয়া যাবে। চা-টা সত্যি ভাল হয়েছে মা। দাদাজানকে এক কাপ বানিয়ে দাও।

রাহেলা অবাক হয়ে ছেলেকে দেখছেন। ফুল হাতা শার্ট গায়ে দিয়ে ভেতরের বারান্দায় চা খেতে বসেছে। চুল আঁচড়েছে। আরাম করে চা খাচ্ছে। তাকে দেখে কে বলবে তার কোন রকম সমস্যা আছে। সুখী সুখী চেহারা। রাহেলা বললেন, তোর বাবার কাছে শুনলাম এই শুক্রবারে না-কি তোর বিয়ে।

একটু পিছিয়েছে মা, রোববারে হবে। রোববার রাতে। বিয়ে মানে দুই তিনজনকে নিয়ে ওদের বাসায় যাব। কাজী সাহেব থাকবেন। কাগজে সই করে বাসায় চলে আসা।

আমি আজ সকালেই জানলাম।

তোমাকে বলা হয় নি। নানান ঝামেলার মধ্যে মাথা আউলা হয়ে আছে।

তোর চাকরি চলে গেছে?

হ্যাঁ। তবে এরচেয়েও বড় সমস্যা আছে।

এরচে বড় সমস্যা আবার কি?

ফরহাদ ছছাট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, রহমত উল্লাহ সাহেব সুইজারল্যান্ড থেকে একটা চিঠি পাঠিয়েছেন। চিঠিটা পড়ে দেখ। চিঠি পড়লেই বুঝবে সমস্যা কত প্রকার ও কি কি? চিঠিটা আমার টেবিলের উপর আছে। উনি এই বাড়ি জমি বিক্রি করে দিয়েছেন। যাদের কাছে বিক্রি করেছেন তারা দখল নিতে আসবে। যে কোনদিন সব খালি করে দিতে হবে। বাবার জন্যেই আমার কষ্টটা বেশি হচ্ছে। শখ করে এত গাছ লাগিয়েছেন।

রাহেলা অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমরা থাকব কোথায়?

ফরহাদ জবাব দিল না। সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করল। রাহেলা ছেলেকে সিগারেট ধরাবার সুযোগ দিলেন। চলে গেলেন বাইরের বারান্দায়। এই বৃষ্টির মধ্যে জোবেদ আলি কোদাল হাতে বাগানে কি যেন করছেন।

রাহেলা শান্ত গলায় বললেন, তুমি কি করছ?

জোবেদ আলি বললেন, জমিতে পানি জমে গেছে। নালা কেটে দিচ্ছি। পানি হচ্ছে গাছের জীবন। এই পানি যদি একটু বেশী হয় তাহলে পানিই গাছের বিষ। আল্লাহপাকের কি অদ্ভুত ব্যবস্থা, এই বিষ এই অমৃত।

 

শর্মিলার বসার ঘরে ঢুকে নান্টু খুবই অবাক হল। শর্মিলা সেজেগুজে বসে আছে। তার কপালে লাল টিপ। পরনের সিল্কের শাড়িটা নতুন। শর্মিলার সামনে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। মধ্যবয়স্ক মানুষ। মনে হয় ভদ্রলোক বেশ কিছু সময় ধরেই আছেন। তাঁর সামনের এসট্রেতে পাঁচটা সিগারেটের শেষ অংশ। পাঁচটা সিগারেট, একটার পর একটা খেতেও তো পাঁচ গুণন তিন-পনেরো মিনিট লাগার কথা। তিনি নিশ্চয়ই কোন হাসির কথা বলেছেন—শর্মিলা হাসছে। নান্টুর মনে হল হুট করে ঘরে ঢুকে পরাটা তার ঠিক হয় নি। দরজা বন্ধ থাকলে সে কলিং বেল টিপে ঘরে ঢুকতো। দরজা ছিল ভেজানো হাত দিতেই খুলে গেল।

শর্মিলা হাসি বন্ধ করে নান্টুর দিকে তাকাল। তার ভুরু কুঁচকে আছে। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ। শর্মিলার সামনে বসা ভদ্রলোকও যেন কেমন করে তাকাচ্ছেন। নান্টু বলল, অর্ণব কেমন আছে। ওকে দেখতে এসেছি।

শর্মিলা উঠে দাঁড়াল। এগিয়ে এল নান্টুর দিকে। নান্টু বলল, অর্ণবের জ্বর কত?

ওর জ্বর কমেছে। ঘুমুচ্ছে।

দেখে যাই।

বললাম না ঘুমুচ্ছে। দেখে যাবে কি? সকালে এসো। সকালে এসে দেখে যেও।

জ্বর শুনে মনটা খুবই খারাপ হয়েছে।

একটা কথা কতবার বলল, জ্বর এখন নেই। মার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে।

এসেছি যখন দেখে যাই।

মার সঙ্গে ঘুমুচ্ছে। মাও ঘুমুচ্ছেন। বললাম না সকালে এসো।

নান্টু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। শর্মিলা বলতে গেলে তাকে প্রায় তাড়িয়ে দিচ্ছে। সে এরকম করছে কেন? শর্মিলার সামনে যে ভদ্রলোক বসে আছেন সেই দ্রলোকের কি কোন ভূমিকা আছে? এই ভদ্রলোকের সামনে নান্টু থাকুক শর্মিলা তা চাচ্ছে না। যার ছেলে অসুস্থ সেই বা কেন এত সেজেগুজে বসে থাকবে? বিয়ে বাড়িতে বা জন্মদিনের নিমন্ত্রণে যাবার সাজও এটা না। তাহলে গায়ে গয়না থাকত। শর্মিলার হাতে কয়েক গাছা চুড়ি ছাড়া আর কিছু নেই।

নান্টু বলল, তোমার জন্যে রসমালাই এনেছিলাম।

শর্মিলা হাত বাড়িয়ে রসমালাইয়ের হাড়ি নিতে নিতে বলল, কাল পরশু এক সময় এসে অর্ণবকে দেখে যেও।

নান্টু দরজার দিকে এগুচ্ছে। পেছনে পেছনে আসছে শর্মিলা। মনে হচ্ছে নান্টুকে একেবারে ঘর থেকে বের করে, দরজা বন্ধ করে তারপর লোকের সঙ্গে গল্প করতে যাবে। নান্টুর মনে হল অর্ণবের জ্বর আসলে সারে নি। নান্টুকে তাড়াতাড়ি বিদেয় করার জন্যে জ্বর সেরে যাবার কথা বলেছে। নান্টু কি কোন একটা রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করবে? ভদ্রলোক চলে যাবার পর আবার গিয়ে খোঁজ নেবে?

খুব বৃষ্টি হচ্ছে। শর্মিলাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় প্রায় হাঁটু পানি। আশে পাশে কোন চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে না যেখানে বসে চা খেতে খেতে এই বাড়ির দিকে লক্ষ্য রাখা যায়। নান্টু পানি ভেঙ্গে এগুচ্ছে। যে ভদ্রলোক শর্মিলার সঙ্গে কথা বলছিলেন তাঁর কি আজ এ বাড়িতে নিমন্ত্রণ? তিনি ফুল নিয়ে এসেছেন। টেবিলে গোলাপ ফুলের তোড়া। অতিথিরা আজকাল নিমন্ত্রণে ফুল নিয়ে আসেন। তার মত বেকুবরা যায় রসমালাইয়ের হাড়ি হাতে।

মেম্বর আলি একটি ভয়াবহ সত্য আবিষ্কার করলেন

মেম্বর আলি আজ সকালে একটি ভয়াবহ সত্য আবিষ্কার করলেন। তিনি চোখে একেবারেই দেখতে পারছেন না। একটা চোখ নষ্ট ছিল, সেই চোখে দিনেও দেখতে পেতেন না। অন্য চোখটা ভাল ছিল। ভাল চোখটায় দিনে দেখতে পেতেন। তিনি এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন, ঘোলাটে ধরনের ঝাপসা হলুদ আলো ছাড়া কিছু দেখছেন না। পুরোপুরি অন্ধ তিনি নিশ্চয়ই হননি—অন্ধ মানুষ অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখে না। তিনি হলুদ ধরণের আলো দেখছেন। খুব চিন্তিত হবার মত কিছু নিশ্চয়ই ঘটে নি। চোখের ডাক্তারের কাছে গেলেই হবে। মলম টলম দিয়ে দেবে। চোখে ছানি পড়লে ছানি কাটাবার ব্যবস্থা করবে। মেম্বর আলি ক্ষীণ গলায় ডাকলেন ফরহাদ ফরহাদ।

ফরহাদ ঘরে নেই মনে হয় উঠোনে। তাকে আরো শব্দ করে ডাকতে হবে। তিনি যে শব্দ করে ডাকতে পারেন না, তা না। ইচ্ছা করলেই একটা চিৎকারও দিতে পারেন। চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে না। আজ ফরহাদের বিয়ে। তিনি চোখে দেখতে পাচ্ছেন না এমন একটা খবর দিয়ে বেচারার মন খারাপ করার দরকার কি? আজকের দিনটা পার হোক তারপর বললেই হবে। শুভ দিনে অশুভ সব দূরে রাখতে হয়। ফরহাদ নিজে অনেক কিছু নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তায় আছে। বেচারার দুঃশ্চিন্তা বাড়িয়ে লাভ কি? চোখে দেখতে না পেলেও তার তেমন অসুবিধাওতো হচ্ছে না। তার দিন কাটছে বিছানায় শুয়ে শুয়ে। এমনতো না যে তাকে লেখাপড়ার কাজ করতে হবে। কাঁথা সেলাইয়ের কাজ করতে হবে।

তবে বাড়িতে নতুন বউ আসবে। নতুন বউ-এর মুখ দেখতে পারবেন না এটা খুব কষ্টের। দেখতে না পেলেও ভাব করতে হবে যেন দেখতে পাচ্ছেন।

নতুন বউ আসা পর্যন্ত তিনি এই বাড়িতে থাকতে পারবেন কি-না তাও বুঝতে পারছেন না। মনে হচ্ছে তাকে আজ মেয়ের বাড়িতে চলে যেতে হবে। জাহেদা এসে তাকে নিয়ে যাবে। সে রকমই না-কি কথা হয়েছে।

নানান রকম কথা গত কয়েকদিন ধরে এ বাড়িতে হচ্ছে। তিনি সব কথা ধরতে পারছেন না। এই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে এমন কথা তিনি অনেকবার শুনেছেন। কেন ছেড়ে দিতে হবে বুঝতে পারছেন না। কেউ তাকে কিছু বলছেও না। বাড়ি কে কিনে নিয়েছে বলে শুনেছেন। বাড়ি বিক্রি করা ঠিক না। দুটা জিনিস বিক্রি করা যায় না। যে বাড়িতে সাতদিন থাকা হয়েছে সেই বাড়ি এবং যে গয়না সাতদিন পরা হয়েছে সেই গয়না। তাঁর কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি বলতে পারতেন। তাঁর কাছে কেউ পরামর্শ চাইতেও আসছে না।

কালরাতে ফরহাদের সঙ্গে কিছু কথা হয়েছে। অনেক রাতে তার ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল। তিনি অভ্যাসমত বললেন, ফরহাদ জেগে আছিস?

ফরহাদ বলল, দাদাজান, বাথরুমে যাবেন?

না।

বিছানা নষ্ট হয়ে গেছে?

হুঁ।

দাঁড়ান চাদরটা বদলে দেই।

ফরহাদ চাদর বদলে দিল। তিনি বললেন, তোর জন্যে আমি খাস দিলে দোয়া করলামরে ব্যাটা। আসল দোয়া।

ফরহাদ বলল, ক্ষিধে লেগেছে। কিছু খাবেন?

না।

আমি আপনার জন্যে একটা বেদানা এনেছিলাম। ভেঙ্গে দেব?

দে।

ফরহাদ বেদানা ভেঙ্গে তাঁর হাতে দিচ্ছে। তিনি দুটা তিনটা করে দানা মুখে দিচ্ছেন। খুবই মিষ্টি বেদানা। ফল-ফ্রুট মানেই ভিটামিন। বুড়ো বয়সে ভিটামিন খুব কাজে আসে।

ফরহাদ বলল, কাল যে আমার বিয়ে এটা কি আপনি জানেন দাদাজান?

জানি। তুই বলেছিস।

খুবই গরীবি হালতে বিয়ে, হাত একেবারে খালি।

মেম্বর আলি শংকিত বোধ করলেন। ফরহাদ কি তার অভাব অনটনের কথা বলে তাঁর কাছে চন্দ্রহারটা চাচ্ছে? এত আদর করে বেদানা ভেঙ্গে খাওয়ানোর এটাই কি রহস্য? চন্দ্রহারটা দিয়ে দিলে তার থাকল কি? তার আজ যদি বড় কোন চিকিৎসার দরকার হয় টাকা পাবেন কোথায়?

দাদাজান।

হুঁ।

আপনি কয়েকটা দিন ফুপুর বাসায় থাকতে পারবেন না?

হুঁ।

নানান ঝামেলায় পড়েছি। সামলাতে পারছি না।

হুঁ।

ফুপু আপনাকে নিয়ে যাবে। আমি রোজ একবার আপনাকে দেখে আসব।

হুঁ।

আচ্ছা।

ফুপু আপনার জন্যে একটা ছেলে জোগাড় করেছেন যে সব সময় আপনার সঙ্গে থাকবে।

আচ্ছা।

বেদানাটা খেতে কেমন?

মিষ্টি।

আপনার যদি কখনো কিছু খেতে ইচ্ছা করে যে কাজের ছেলেটাকে ফুপু আপনার জন্যে ঠিক করেছে তাকে বলবেন। সে এনে দেবে। এর জন্যে ফুপুর কাছে টাকা চাওয়ার দরকার নেই। এই টাকাটা আপনার কাছে রাখেন। এখন বালিশের নিচে থাক। এক হাজার টাকা আছে। সব পঞ্চাশ টাকার নোট। দুইশ পঞ্চাশ টাকার নোট। ঠিক আছে দাদাজান?

হুঁ ঠিক আছে।

মেম্বর আলি মুখে ঠিক আছে বললেও হঠাৎ করে বুকে ধাক্কার মত বোধ করলেন। ফরহাদ কি তাকে জন্মের মত পাঠিয়ে দিচ্ছে। এ বাড়িতে আর কখনো ফিরিয়ে আনবে না? দু চারদিনের জন্যে পাঠালেতো এতগুলি টাকা দিত না।

 

এটা একটা বিয়ে বাড়ি।

বিয়ে বাড়ির কত রহস্য আছে। চারদিকে ব্যস্ততা থাকবে। ছোটাছুটি থাকবে। বাচ্চাদের কান্না থাকবে, হাসি থাকবে। মেয়েদের পরণের নতুন শাড়ির গন্ধ থাকবে, খিল খিল হাসি থাকবে। তার কিছুই নেই। সবাই মনে হয় নিঃশ্বাস বন্ধ করে আছে।

মেম্বর আলি তার দীর্ঘজীবনে অনেক বিয়ে দেখেছেন। আজকের বিয়েটা হয়ত তার দেখা শেষ বিয়ে। আর দেখা হবে না। অবশ্যি এই বিয়েটাতে তিনি শেষ পর্যন্ত থাকতে পারবেন না। তার মেয়ে এসে তাকে নিয়ে যাবে। এছাড়া করার কিছু নেই। তিনি যে ঘরে থাকেন সেই ঘরে ফরহাদের বাসর হবে। ঘরটা ফুল টুল দিয়ে নিশ্চয়ই সাজানো হবে। আজকের দিনটা এ বাড়িতে থেকে যেতে পারলে ভাল হত। একটা রাত না হয় থাকলেন মঞ্জুর ঘরে। কিংবা বারান্দাতেও থাকতে পারেন। থাকার জন্যে বারান্দা খারাপ না। আলো বাতাস বেশী। এখনতো শীতকাল না, যে শীতে কষ্ট পাবেন।

মেম্বর আলির গায়ে রোদ পড়েছে। তিনি হাত বাড়িয়ে রোদ স্পর্শ করলেন। বন্ধ চোখ মেললেন, না রোদ দেখতে পাচ্ছেন না। এই পৃথিবীর অপূর্ব সব দৃশ্য আর তাঁকে দেখতে দেয়া হবে না। এমন ভয়ংকর সিদ্ধান্তগুলি যিনি নেন, তিনি কেমন? মেম্বর আলির সামান্য শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এটা নিয়ে চিন্তিত হবার কিছু নেই। ঘরে অক্সিজেনের যন্ত্রপাতি আছে। ফরহাদকে বললেই সে নাকে লাগিয়ে দেবে। এখনই বলতে হবে এমন কোন কথা নেই।

এটা কি মাস? বাংলা মাসটা কি? বাংলা কোন মাসে ফরহাদের বিয়ে হচ্ছে তা জানা দরকার। তাঁর নিজের বিয়ে হয়েছিল আষাঢ় মাসে। কি বৃষ্টি কি বৃষ্টি। শত শত নাইয়রীতে বাড়ি ভর্তি হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টির মধ্যে শুরু হল প্যাক-খেলা। এ তাকে কাদায় ফেলে দিচ্ছে, ও একে ফেলছে। ধুন্দুমার কান্ড। তার বাবা খুবই রাগ। করলেন, চিঙ্কার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুললেন-তোমরা করতাছ কি? তোমরার কি আক্কেল জ্ঞান নাই। মেয়েছেলে পুরুষ ছেলে সব প্যাক কাদায় গড়াগড়ি। মৌলভী বাড়ির ইজ্জত রাখবা না? তার কথা শেষ হবার আগেই তাঁর ছোটশালা পেছন থেকে তাঁকে ঝাপ্টে ধরে কাদায় ফেলে দিল। চারদিকে শুরু হল হাসি। এদিকে শুরু হয়েছে কাদার মধ্যে শালা-দুলাভাই যুদ্ধ। কাদা খেলা সারাগ্রামে। ছড়িয়ে পড়ল। কি অদ্ভুত পাগলামী। কনের বাড়িও গ্রামের মধ্যে। একজন কে বলে বসল, শইল্যে প্যাক-কেদা মাইখ্যা বরযাত্রী গেলে কেমুন হয়? কইন্যা পক্ষের উচিত শাস্তি হয়। আমরা গিয়া বলব—শইল্যে প্যাক-কেদা। প্যাক কাদা পরিষ্কারের জোগাড় কর। ভাল কাপড় দেও।

যেই কথা সেই কাজ। বরযাত্রী যাচ্ছে কাদায় মাখামাখি হয়ে। আহারে কি দিন STRUCS1

মেম্বর আলি ছটফট করছেন। তাঁর খুবই ইচ্ছা করছে তার বিয়ের দিনের গল্পটা কারো সঙ্গে করতে। ঘরে কেউ নেই। ফরহাদের বউ-এর সঙ্গে গল্পটা করতে পারলে ভাল হত। নয়া বউরা অন্য বউদের গল্প শুনতে ভালবাসে। শ্বাসকষ্টটা মনে হয় বাড়ছে।

মেম্বর আলির প্রথম স্ত্রীর নাম ছিল অনুফা। বিয়ের পর তার নাম হল প্যাক-বউ। পাক কাদার বউ তাই প্যাক বউ। বড় সুন্দর ছিল মেয়েটা। গায়ের রঙ সামান্য কম ছিল। তাতে কি? গায়ের রঙই সব না। বিয়ের এক বছরের মাথায় তার মৃত্যু হয়। প্যাক বউ-এর চেহারা মেম্বর আলি ভুলে গেছেন। তার কোন ছবি নেই যে ছবি দেখে চেহারা মনে করবেন। শুধু মনে আছে তার খুব লম্বা চুল ছিল। চুল হাঁটু ছাড়িয়ে নেমে গিয়েছিল। একদিন সে রাগ করে সেই চুল কেটে ফেলল। তাকে দেখতে লাগল ছেলেদের মত। সে আরেক ইতিহাস। বড়ই মজার ইতিহাস। কেউ কি আছে যে এই ইতিহাসগুলি শুনবে? আচ্ছা এমন কড়া রসুনের গন্ধ আসছে কোত্থেকে? কেউ কি রসুন পুড়তে দিয়েছে। বিয়ে বাড়িতে কেউ রসুন পুড়ে? এদের কি কান্ডজ্ঞান নেই? রসুন পুড়ার গন্ধে তার নাক জ্বালা করছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

 

আজ আসমানীর বিয়ে।

আর বেছে বেছে আজকের দিনেই সে অসুখে পড়ে গেছে। সকালবেলা ঘুম ভেঙ্গেছে। বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দেখল—মাথা তুলতে পারছে না। কি আশ্চর্য তার জ্বর না-কি? সে কপালে হাত দিল, তেমন জ্বরতো বোঝা যাচ্ছে না, অথচ শরীর কেমন যেন করছে। হাত পা ভারী। খোলা জানালার দিকে তাকাতে পারছে না। চোখ জ্বালা করছে। আসমানী বালিশে মাথা রেখে আবার শরীর এলিয়ে দিল। নিজের উপর রাগ লাগছে। জ্বর হবার জন্যে তিনশ পঁয়ষট্টি দিন পড়ে আছে। আজ জ্বর হবে কেন?

রান্নাঘর থেকে সাড়াশব্দ আসছে। চা নাশতা তৈরী হচ্ছে। গায়ে জ্বর না থাকলে সে অবশ্যিই রান্নাঘরের দরজা ধরে দাঁড়াত এবং লাজুক গলায় বলতো, মা এক কাপ চা খাব। লাজুক গলায়, বলার মত কোন ব্যাপার না কিন্তু বিয়ের দিন বলে আজ লজ্জা লজ্জা লাগবেই।

আসমানীর পানির তৃষ্ণা হচ্ছে। সে প্রতিদিন ঘুমুতে যাবার আগে মাথার কাছে পানির জগ গ্লাস রাখে। কাল রাতেও রেখেছে অথচ এখন নেই। কেউ নিয়ে গেছে বোধ হয়। কে নিয়ে গেছে নিশা? কাল রাতে নিশা তার সঙ্গে ঘুমিয়েছে। নিশা কারো সঙ্গে ঘুমুতে পারে না। অন্য মানুষের গায়ের গন্ধে তার না-কি ঘুম আসে না। হঠাৎ হঠাৎ বাসায় মেহমান উপস্থিত হলে শোবার জায়গায় টানাটানি হয়, তখনো নিশা কারো সঙ্গে ঘুমুবে না। মেঝেতে কম্বল পেতে নিজের জন্যে আলাদা ছোট্ট বিছানা করবে। বিছানাটা ছোট্ট করবে এই জন্যে যেন কেউ মাঝরাতে এসে বড় বিছানার এক পাশে শুয়ে না পড়ে।

কাল রাতে নিশা যখন বালিশ নিয়ে আসমানীর সঙ্গে ঘুমুতে এল তখন আসমানী অবাক হয়ে বলল, তুই আমার সঙ্গে ঘুমুবি?

নিশা গম্ভীর গলায় বলল, হুঁ।

আসমানী বলল, কেন?

মা ঘুমুতে বলেছে। বিয়ের আগের রাতে নাকি মেয়েদের একা ঘুমুতে দেয়ার নিয়ম নেই।

তোকে নিয়ম নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না, তুই তোর মত আরাম করে ঘুমো।

নিশা বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, অসুবিধা নেই।

তুই কষ্ট করে চোখ মুখ শক্ত বানিয়ে শুয়ে থাকবি, দেখেই আমার খারাপ লাগবে। আমার নিজের ঘুম হবে না।

তোমার ঘুম এম্নিতেও হবে না, ওম্নিতেও হবে না।

নিশা তার শোবার জায়গায় আলাদা করে চাদর পাতল। বড় খাটের একটা অংশ আলাদা করে ফেলল। আসমানী বোনের কাণ্ড কারখানা দেখছে। কত ধরনের বিচিত্র স্বভাব যে মানুষের মধ্যে দেখা যায়। মেয়েটা শুয়েছেও খুব অদ্ভুতভাবে। কাঠের টুকরার মত সোজা। হাতগুলি পর্যন্ত লম্বা করে রাখা। চোখের দৃষ্টি ছাদের দিকে। নিশা বলল, তুইতো শুয়েছিস অনেকটা দূরে। এখনো আমার গায়ের গন্ধ পাচ্ছিস?

নিশা বলল, পাচ্ছি।

আমার গায়ের গন্ধটা কেমন? খুব খারাপ?

খুব খারাপ না। মোটামুটি খারাপ। সব মানুষের গায়ের গন্ধই খারাপ।

তোর নিজের গায়ের গন্ধ কেমন?

আমারটা ভাল। সাবান সাবান গন্ধ।

দেখি তোর হাতটা আমার কাছে আন শুঁকে দেখি।

শুঁকে দেখতে হবে না।

তুই কি সব সময় এ রকম স্ট্রেট লাইন হয়ে ঘুমাস?

ঘুমাবার আগে কিছুক্ষণ এ রকম শুয়ে থাকি-তারপর কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি।

তুই যে খুব অদ্ভুত ধরনের মেয়ে হয়ে যাচ্ছিস এটা কি তুই জানিস। বিচিত্র সব অভ্যাস করছিস। পরে এইসব অভ্যাসের জন্যে কষ্ট পাবি।

কষ্ট পাব কেন?

এক সময় তুই বিয়ে করবি। তোর স্বামী চাইবে তোকে জড়িয়ে ধরে ঘুমুতে। তোর যদি তখন সেই মানুষটার গায়ের গন্ধে বমি আসে তখন মানুষটা খুব কষ্ট পাবে না?

কষ্ট পাবে না, কারণ আমি বিয়েই করব না।

তোর জন্যে বিয়ে না করাটাই ভাল। তোর কি ঘুম পাচ্ছে?

উঁহু। যখন দেখবে আমি কাত হয়ে শুয়েছি তখন বুঝবে আমার ঘুম পাচ্ছে।

তুই শবাসনের মত শুয়ে আছিস। কথা বলে আরাম পাচ্ছি না। কাত হয়ে শুয়ে পড়–কিছুক্ষণ গল্প করি।

নিশা কাত হতে হতে বলল, তুমি যে লোকটাকে বিয়ে করছ তাকে কিন্তু আপা আমার একেবারেই পছন্দ না।

কেন? তার গায়ে খুব খারাপ গন্ধ?

তার গা থেকে ফুলের গন্ধ বের হলেও আমার পছন্দ হত না।

অপছন্দের কারণগুলি কি?

নিশা হাই তুলতে তুলতে বলল, জানি না। তবে লোকটার জন্যে আমার সামান্য মায়া হয়।

মায়া হয় কেন?

খুবই গরীবতো এই জন্যে মায়া হয়। তাছাড়া তুমি ছাড়া তাকে কেউ দেখতে পারে না, এই জন্যেও মায়া হয়। বেচারাকে সবাই অপছন্দ করে। সবচে অপছন্দ করে মা।

আসমানীর বুকে ধাক্কার মত লাগল। ফরহাদকে তার মা সবচে অপছন্দ করেন এই তথ্যটা জানা ছিল না। তার মা এই বিষয়ে তার সঙ্গে কখনো কোন কথা বলেননি। আসমানী বলল, মা ফরহাদকে অপছন্দ করেন এটা তোকে তিনি বলেছেন?

হ্যাঁ বলেছেন।

কেন অপছন্দ করেছেন সেটা বলেছেন?

না। উনার প্রসঙ্গ উঠলেই মা বলেন—বাঁটু ছাগল।

বাঁটু বলবেন কেন? ওতো বাঁটু না।

মার কাছে বেঁটে লেগেছে বলে মা বলেছে। মার কথায় তুমি কি মন খারাপ করলে?

একটু করেছি।

তাহলে বাবার কথায় আরো মন খারাপ করবে।

বাবাও কি তাকে বাঁটু ছাগল বলেন?

বাবা আরো খারাপ কথা বলেন।

নিশা খিলখিল করে হাসছে। আসমানী খুবই মন খারাপ করল। এমন কি খারাপ কথা বাবা বলেন যে সেই কথা মনে করে এভাবে খিল খিল করে কাউকে হাসতে হয়।

নিশা হাসি থামিয়ে বলল, বাবা যা ইচ্ছা বলুক তুমি মন খারাপ করছ কেন? তোমার কাছেতো মানুষটা ভাল। ভাল না?

হ্যাঁ।

তাহলেই হয়েছে। আপা এখন আমার ঘুম পাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়ি?

আসমানী ক্লান্ত গলায় বলল, বাবা ওর সম্পর্কে কি বলেন সেটা একটু বলবি?

না বলব না। তোমার খুবই মন খারাপ হবে। আপা শোন মা বলেছে সারারাত বাতি জ্বালিয়ে রাখতে। বিয়ের আগের রাতে বাতি নেভানো না-কি অলক্ষণ।

আলো চোখের উপর কটকট করছিল তারপরেও আসমানী বাতি নেভাল না। অলক্ষণ যখন বলা হয়েছে তখন থাকুক বাতি জ্বালানো। আসমানীর ঘুম আসছে না। অথচ নিশা কি আরাম করেই না ঘুমুচ্ছে। সে জেগে থাকলে ভাল হত। নিশার সঙ্গে গল্প করা যেত। কি গল্প করতো? ফরহাদ নামের মানুষটাকে তার হঠাৎ কেন এত পছন্দ হয়েছে সেই গল্প করতো। এতে দোষের কিছু নেই। নিশা শুধু মানুষটা কেন অপছন্দের তা জানবে, কেন পছন্দের তা জানবে না, তাতো হবে না। তাকে পছন্দের কথাটাও জানতে হবে।

ফরহাদ অসাধারণ কেউ না। খুবই সাধারণ একজন মানুষ। আর আসমানী নিজেও খুব সাধারণ একটা মেয়ে। সাধারণ পছন্দ করবে সাধারণ কে। এটাইতো নিয়ম।

ফরহাদের আশে পাশে আসমানী যখন থাকে তখন তার নিজের বয়স খুব কম মনে হয়। মনে হয় সে বুঝি স্কুলের এইট নাইনে পড়া কোন মেয়ে। তখন তার নানান ধরনের ফাজলামী করতে ইচ্ছা করে। যেমন দুজন হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তায় একটা আইসক্রীমওয়ালা দেখা গেল। আসমানী থমকে দাঁড়িয়ে বলবে, আইসক্রীম খাব। ললীপপ। আইসক্রীম কিনে দাও। ফরহাদ আইসক্রীম কিনবে। নিজের জন্যে না, শুধু তার জন্যে। আসমানী বাচ্চা মেয়েদের মত আইসক্রীম খেতে খেতে তার সঙ্গে হাঁটবে, আসমানীর এতটুকুও খারাপ লাগবে না।

কোথাও ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে এক লোক স্বপ্নে পাওয়া বাতের ওষুধ বিক্রি করছে। তাকে ঘিরে অনেক লোকজন। আসমানী বলবে, এই শোন, ম্যাজিক দেখব। অথচ এ ধরনের কাজ আসমানী যখন একা থাকবে বা অন্য কারো সঙ্গে থাকবে তখন কখনো করবে না।

মানুষটা যখন পাশে থাকে, তখন মনে হয় আসমানীকে কোন কিছু নিয়েই আর কখনো দুঃশ্চিন্তা করতে হবে না। দুঃশ্চিন্তা করার সব দায় দায়িত্ব সঙ্গের মানুষটার, তার না। তার একমাত্র কাজ হচ্ছে মানুষটার সঙ্গে থাকা। আসমানীর প্রায়ই মনে হয় সে তার বাকি জীবন শুধু এই মানুষটার পাশে পাশে হেঁটে পার করে দিতে পারবে। তার আর কিছু লাগবে না। আসমানী ঠিক করে রেখেছে একটা কাজ সে অবশ্যই করবে—মানুষটাকে রাতে ঘুম পাড়িয়ে সে তার মাথার কাছে চুপচাপ বসে থাকবে। তাকিয়ে থাকবে মানুষটার মুখের দিকে। এই কাজটা সে রাতের পর রাত করবে কিন্তু মানুষটাকে কখনো জানতে দেবে না।

আসমানীর ধারণা এই মানুষটার সঙ্গে তার দেখা হওয়াই হল তার জীবনের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটা ঘটে ১৮ই মার্চ সকাল এগারোটায়। আসমানী ঠিক করে রেখেছে ১৮ই মার্চ সে সারাজীবন পালন করবে। ম্যারেজ এ্যানিভার্সারী, জন্মদিন এইসব কিছু না। সে পালন করবে ১৮ই মার্চ, ২৬শে জিলক্বদ, চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস। ঐ দিন সে ফরহাদকে অফিসে যেতে দেবে না। তার বাচ্চারা কেউ স্কুলে যাবে না। ঈদে যেমন নতুন কাপড় দেয়া হয় সে ঐ দিন সব বাচ্চাকে নতুন কাপড় দেবে। ফরহাদকে পাঞ্জাবী পায়জামা কেনে দেবে। ঘরে যে কাজের মেয়ে থাকবে সেও লাল রঙের শাড়ি পাবে। সে নিজেও সেদিন খুব সাজবে। ফরহাদ বলবে-আচ্ছা আসমানী ঘটনাটা কি?

আসমানী রহস্যময় হাসি হেসে বলবে, কোন ঘটনা নেই। সামান্য একটু সাজগোজও করতে পারব না? শুধু সুন্দরী মেয়েরা সাজবে আর আমার মত অসুন্দরী মেয়েরা সাজবে না এটা কেমন কথা?

ফরহাদ ব্ৰিত ভঙ্গিতে বলবে, সবার নতুন জামা কাপড় এই জন্যে বলছি। আজ কি বিশেষ কোন দিন?

আজ বিশেষ দিন না, অবিশেষ দিন সেটা তোমাকে বলব না। দেখি তোমায় বুদ্ধি, তুমি নিজে নিজে বের করতে পার কিনা।

আমার বুদ্ধি খুবই কম। তুমি বলে দাও।

আমি কোনদিনও বলব না। তুমি বের করবে—এটা তোমার জন্যে একটা ধাঁধা। তবে সহজ ধাঁধার রহস্য বের করাই সবচেয়ে কঠিন। দেখি তুমি পারো কি-না।

একটু হিন্টস দাও।

হিন্টস দিচ্ছি—আজ হচ্ছে চৈত্রের দ্বিতীয় দিবস।

সেটা আবার কি?

জিলক্বদ মাসের ২৬ তারিখ।

 

আসমানীর মাথা দপদপ করছে, চোখ জ্বালা করছে। রান্নাঘরে মা মনে হয় ভাজি জাতীয় কিছু চড়িয়েছেন তার তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগছে। তার নিশ্চয়ই জ্বর বাড়ছে—তার জ্বরের থার্মোমিটার হল গন্ধ থার্মোমিটার। আশে পাশের গন্ধগুলি কত তীব্র হচ্ছে তার থেকে বোঝা যায় তার জ্বর কত বেশি। জ্বর নিশ্চয়ই একশ দুই ছাড়িয়ে গেছে। কেউ এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে বোধ হয় ভাল লাগত। সবাই ব্যস্ত। কেউ এখন আসবে না। আসমানীর কয়েকজন বান্ধবীর আসার কথা। তারা গায়ে হলুদে হৈ চৈ করবে। এদের একজন হল কণা—খুব আমুদে টাইপের মেয়ে। শুধু কণাকেই আসমানী টেলিফোনে তার বিয়ের কথা বলেছে। কণার উপরই দায়িত্ব আসমানীর অন্য বান্ধবীদের খবর দিয়ে আনা। কণা তার দায়িত্ব খুব ভালভাবে পালন করবে। হঠাৎ বিয়ের মজা থেকে কণা নিজেকে কিছুতেই বঞ্চিত করবে না। কণা এসে যখন দেখবে যে আসমানী জ্বরে প্রায় অচেতন তখন নানান হৈ চৈ শুরু হবে। সেই হৈ চৈও হবে মজার। কণা এমন মেয়ে যে সব কিছুতেই মজা খুঁজে পায়। কেউ মারা গিয়েছে কণা খবর পেয়ে গেল আর মরা বাড়িতেই কোন না কোন মজা না করে ফিরল না তা কখনো হবে না।

কাল দুপুরে সে যখন কণাকে টেলিফোন করে বলল, এই কণা তুই আগামীকাল সকালে আমার বাসায় আসতে পারবি?

কণা বলল, পারব।

রাত পর্যন্ত থাকতে হবে কিন্তু।

আচ্ছা থাকব।

কি জন্যে আসতে বলছি বলতো?

তোর বিয়ে এই জন্যে আসতে বলছিস।

কি করে বুঝলি আমার বিয়ে?

গলার স্বর থেকে বুঝলাম। কোন মেয়ে যখন বিয়ের দাওয়াত দেয় তখন তার গলা অন্য রকম হয়ে যায়।

অন্য রকম মানে কি?

পুরুষ পুরুষ গলা। আর যখন কোন ছেলে তার বিয়ের কথা বলে তখন তার গলা হয়ে যায় মেয়েলী। সে চিকন স্বরে কথা বলে।

তুই কি সত্যি সত্যি আমার গলা শুনেই বুঝে ফেলেছিস আমার বিয়ে?

হুঁ। আল্লাহর কসম গলা শুনেই টের পেয়েছি। বিয়ে কার সঙ্গে হচ্ছে? ফরহাদ নামের ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে?

হুঁ।

খুব ভাল। হাতের পাঁচ স্বামী।

হাতের পাঁচ স্বামী মানে?

হাতের পাঁচ স্বামী মানে এই স্বামী সব সময় হাতে থাকবে। হাত ছাড়া হবে। সব মিলিয়ে এই পৃথিবীতে ছয় রকম স্বামী আছেন মন দিয়ে শোন—

হাতের শূন্য স্বামী, যে কখনো হাতে থাকবে না।

হাতের এক স্বামী, হঠাৎ হঠাৎ হাতে থাকবে। বেশীর ভাগ সময় থাকবে না।

হাতের দুই স্বামী, হাতের একের চেয়ে একটু বেশী থাকবে।

হাতের পাঁচ হচ্ছে সারাক্ষণ হাতে থাকা স্বামী। তুই হাত ঝেড়ে ফেললেও দেখবি সে যাচ্ছে না, তোর কড়ে আংগুল ধরে ঝুলে আছে।

তোর মাথায় কি সব সময় এ রকম মজার মজার কথা থাকে?

হ্যাঁ থাকে। কারণ আমি হচ্ছি খুবই মজাদার একটা মেয়ে। ফানী লেডি। আচ্ছা শোন তোর বিয়েটা কি খুব শুকনা টাইপ হচ্ছে?

শুকনা টাইপ মানে?

শুকনা টাইপ মানে–ভেজা না। আগুন দিলে জ্বলবে না–শুধু ধোয়া বের হবে। যে সব বিয়ে হুট করে ঠিক হয় সে সব হয় শুকনা বিয়ে। এক টুকরা হলুদ মাথায় ঘষে আধ বালতি পানি দিয়ে গোসল। তারপরই কাজি সাহেবের পাঠানো খাতায় দুটা সিগনেচার। বিয়ে শেষ। রাত আটটায় স্বামীর কোন এক বন্ধুর কাছ থেকে চেয়ে আনা মাইক্রোবাসে করে স্বামীর বাড়ি যাত্রা। রাত এগারোটার দিকে বাসর ঘর। রাত সাড়ে এগারোটার দিকে বিয়ের শাড়ি খুলে নগ্ন হয়ে যাওয়া।

কণা চুপ কর প্লীজ।

নগ্ন হবার কথা শুনে লজ্জা লাগছে! তাহলে বিয়ে করিস না।

তোর পায়ে পড়ি প্লীজ এই লাইনের কথা বন্ধ কর।

আমি বিয়ে করছি না কেন জানিস? রাত সাড়ে এগারোটার কথা ভেবে বিয়ে করছি না–কথায় আছে না—

টকের ভয়ে দেশ ছাড়লাম
তেতুল তলায় বাসা।

আমার হবে এই দশা। যে টকের ভয়ে সব ছাড়লাম দেখা যাবে আমার জীবন কাটবে টকের মধ্যে। শেষমেষ হয়ত একটা হাউস খুলে বসব। পুরুষরা আসবে, টাকা দেবে, আর আমি টাকা গুনতে গুনতে শাড়ি খুলব……

প্লীজ কণা প্লীজ।

আচ্ছা যা এবারকার মত চুপ করলাম। আমি কাল ঠিক কাঁটায় কাঁটায় দশটার, মধ্যে চলে আসব। তুই কি তোর আর কোন বান্ধবীকে বলেছিস?

না।

কাউকে বলার দরকার নেই। আমি দলবল নিয়ে উপস্থিত হব। বিয়েটা-কি তোর বাসাতেই হচ্ছে না-কি কোন কমিউনিটি সেন্টারে?

আমাদের বাসাতেই। আমাদের এ্যাপার্টমেন্টে একটা হলরুম আছে সেখানে।

মনে হয় অল্প খরচে সব ছেড়ে দিচ্ছিস।

আমরা গরীব মানুষ না, বেশী খরচ করব এমন টাকা পয়সা কি আমাদের আছে?

যাকে বিয়ে করছিস সেতো আরো গরীব।

স্বামী গরীব হওয়া ভাল।

কেন?

গরীব স্বামীরা অর্থের অভাব ভালবাসা দিয়ে পুষিয়ে দিতে চেষ্টা করে।

তোর চমৎকার কথাটা শুনে ভাল লাগল।

তুই কথাটা যত চমৎকার ভাবছিস—তত চমৎকার কিন্তু না। এই ভালবাসা মনের ভালবাসা না, শরীরের ভালবাসা। এই ভালবাসা রাত সাড়ে এগারোটা থেকে শুরু হয়ে……

প্লীজ কণা। প্লীজ।

আচ্ছা যা তোকে এখনকার মত ক্ষমা করে দিলাম।

আসমানীর জ্বর কি আরো বাড়ছে? এখন কেমন যেন শরীর কাঁপছে। ম্যালেরিয়া নাতো? ম্যালেরিয়াতেই শরীর কাঁপিয়ে জ্বর আসে। প্রতিবারই তার জ্বর শরীর কেঁপে আসূছে। ডাক্তারকে এই কথাটা কি বলা হয়েছে? ম্যালেরিয়ার জ্বরের রহস্য কে যেন বের করেন? রোনাল্ড রস। তিনি নোবেল পুরস্কার পান এই কারণে। আচ্ছা আলফ্রেড নোবেলের কি কখনো ম্যালেরিয়া হয়েছিল? রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথের হয়েছিল? মনে হয় হয়নি। তার ম্যালেরিয়া হলে এই বিষয়ে কোন না কোন গান থাকতো। আচ্ছা তিনি কি প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে কোন গান লিখেছিলেন? ঘোর লাগা মাথায় লেখা কোন গান? কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলে ভাল হত।

আসমানী প্রাণপণে চেষ্টা করছে গানের কথা না ভাবতে। জ্বরের মধ্যে কোন একটা গানের সুর মাথায় চলে গেলে ভয়াবহ সমস্যা হবে। সেই সুর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকবে। জাগ্রত অবস্থায় সেই গান বাজবে, ঘুমের মধ্যে বাজবে। প্রথমে বাজবে মাথায় তারপর সেই সুর সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।

ভক করে আসমানীর নাকে সিগারেটের কড়া গন্ধ ঢুকে পড়ল। আসমানী চোখ মেলে দেখল বড় মামা তার পাশে বসে আছেন। তিনি কখন ঘরে ঢুকেছেন। কখন বসেছেন সে কিছুই বুঝতে পারেনি। আসমানী ক্লান্ত গলায় বলল, কটা বাজে মামা?

সাড়ে সাতটা।

মাত্র সাড়ে সাতটা, আমি ভাবলাম দুপুর হয়ে গেছে।

তোর জ্বরটা ভয়াবহ। মাথায় পানি ঢালতে হবে। বিয়ের দিনে কি অসুখ বাধালি বলতো।

সেরে যাবে।

খুব বেশী খারাপ লাগছে?

না।

তোর বাবাকে ডাক্তার আনতে পাঠিয়েছি। ডাক্তার এসে দেখুক।

আচ্ছা।

জ্বর কি রাতেই এসেছে?

জানি না মামা।

তোদের এ্যাপার্টমেন্ট হাউসে বাথটাব থাকলে ভাল হত। বাথটাব ভর্তি করে পানি দিয়ে তোকে তার মধ্যে ছেড়ে দিতাম।

বাথটাবের বাংলা কি মামা?

বাথটাবের বাংলা মানে? বাথটাবের বাংলা দিয়ে তুই কি করবি?

জানতে ইচ্ছা করছে।

এত জিনিস থাকতে বাথটাবের বাংলা জানতে ইচ্ছে করছে কেন?

তাওতো জানি না।

আমার মনে হয় জ্বরটা তোর মাথায় উঠে যাচ্ছে। জ্বর একবার মাথায় উঠলে আবোল তাবোল চিন্তা আসে।

মামা!

কি?

তুমি কি সিগারেটটা ফেলে দেবে। সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমি সিগারেটের গন্ধে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি।

সিগারেটতো খাচ্ছি না।

ও আচ্ছা। মামা কটা বাজে?

সাড়ে সাতটা।

অনেকক্ষণ আগে একবার বললে সাড়ে সাতটা এখনো সাড়ে সাতটা?

সাতটা সাইত্রিশ।

এরমধ্যে মাত্র সাত মিনিট পরে হয়েছে?

তুই চুপ করে থাকতো। দেখি আমি মাথায় পানি ঢালার ব্যবস্থা করছি। কোন কথা না। একেবারে চুপ।

জ্বি আচ্ছা।

চোখ বন্ধ করে রাখ তাকিয়ে থাকিস না। তোর লাল চোখ দেখে ভয় লাগছে।

আসমানী চোখ বন্ধ করে আছে অথচ চোখ বন্ধ অবস্থায় সে সবাইকে দেখছে। এটা কি খুবই বিস্ময়কর ঘটনা না? মাথায় পানি ঢালছেন, মা। তিনি মাথার পেছনে, চোখ খোলা অবস্থায়ও তাঁকে দেখতে পাবার কথা না। মাছি হলে দেখতে পেত। মাছিদের মাথার পেছনেও চোখ থাকে। কিন্তু সে মাছি না হয়েও দেখতে পারছে। এটা কি একটা অদ্ভুত ঘটনা না? মা কি শাড়ি পরে আছেন তাও সে দেখতে পাচ্ছে। ব্লক প্রিন্টের শাড়ি। ডিজাইনটা চোখে লাগছে। আজ তাঁর মেয়ের বিয়ে তিনি এমন কুৎসিত ডিজাইনের শাড়ি পরেছেন কেন। তাঁকে বলতে হবে সুন্দর একটা শাড়ি পরতে। মেয়ের বিয়েতে সবচে বেশী সাজ করা উচিত মেয়ের মার।

আসমানীর ঘুম ঘুম পাচ্ছে। পানির শীতল ধারা চুলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে পরছে-কি আরামই না লাগছে। ঘুমিয়ে পড়লে এই আরাম লাগবে না। জ্বরের ঘুম খুব কষ্টের ঘুম। ঘুমের মধ্যেও মাথার ভেতরটা জ্বালা করতে থাকে। আসমানীকে জেগে থাকতে হবে। আজ তার বিয়ে। কত কাজ পরে আছে। গোসল করে একটা হলুদ শাড়ি পরবে। হলুদ শাড়ি পরে ছবি তুলবে। অনেক অনেক দিন পর পুরানো এলবামে এই ছবি দেখে তার বড়মেয়ে বলবে—মা, গায়ে হলুদের দিন তোমাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছিল? তোমার কি তখন এত চুল ছিল?

হুঁ ছিল।

তোমাকে হলুদ পরীর মত লাগছে মা।

একদিন তোকেও এমন হলুদ পরীর মত লাগবে।

মাগো কি যে সুন্দর তোমাকে লাগছে। তবে মুখটা খুব রোগা।

তখন আমার খুব জ্বর ছিলরে মা।

জ্বর ছিল?

হ্যাঁ আকাশ পাতাল জ্বর। মাথায় পানি ঢালাঢালি। জ্বর নামানোর সবাই এত চেষ্টা করছে। কিন্তু জ্বর নামছে না।

আহারে। আমি থাকলে চট করে জ্বর নামিয়ে দিতাম।

কি ভাবে জ্বর নামাতি?

চুমু দিয়ে দিয়ে জ্বর নামাতাম। চোখে চুমু দিলে জ্বর নেমে যায়।

তোকে কে বলেছে।

কেউ বলেনি। আমি জানি।

আসমানী চোখ মেলল। তার মনে হল বাড়ি ভর্তি লোকজন। তাদের নিঃশ্বাসে ঘরের বাতাস পর্যন্ত ভারী হয়ে আছে। এত মানুষ কোত্থেকে এল? সে ভালমত দেখার চেষ্টা করল। না লোকতো বেশী না। এইত বড় মামা। বড়মামার পাশে নিশা। কাজের বুয়া একটু দূরে দাঁড়িয়ে। মাথার পেছনে মা। বাবা এখনো ডাক্তার নিয়ে ফেরেন নি। তাহলে বাড়ি ভর্তি লোক মনে হচ্ছে কেন? আসমানী আবারো চোখ বন্ধ করল। ফরহাদকে মনে মনে একটা চিঠি লিখলে কেমন হয়।

এইযে বাবু সাহেব। আজ যে আপনার বিয়ে সেটা কি মনে আছে? না সব ভুল মেরে বসে আছেন? গায়ে হলুদের মাছ পাঠানোর কথা মনে আছে? দয়া করে কাতল মাছ পাঠাবেন না। আমি কাতল মাছ খাই না।

শুনুন বাবু সাহেব আমার শরীর খুব খারাপ করেছে। এখন আমার মাথায় পানি এবং জলপট্টি দেয়া হচ্ছে। আমার জ্বর কত উঠেছে শুনতে চান? একশ পাঁচ। কি সর্বনাশ তাই না? একশ পাঁচ হোক বা দশ হোক বিয়ে কিন্তু হবে। আপনার বাসর রাতটা কাটবে স্ত্রীর সেবা করে। পারবেন না?

আমাদের বাসরটা হাসপাতালে হলে কেমন হয়? হাসপাতালের ধবধবে শাদা বিছানায় আমি শুয়ে আছি। আমাকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। আর আপনি আমার পায়ের কাছে মুখ শুকনো করে বসে আছেন। ঘর ভর্তি স্যাভলনের গন্ধ। সবার হয় ফুলশয্যা আমাদের হবে স্যাভলন শয্যা। মজা হবে না?

 

আসমানী চোখ মেলল। সে অবাক হয়ে দেখল রাত হয়ে গেছে। ঘর অন্ধকার। দেয়ালে জিরো পাওয়ারের বাতি জ্বলছে। সেই বাতির আলো নরম। ঘরটা অতিরিক্ত ঠাণ্ডা। বিজবিজ বিজবিজ শব্দ হচ্ছে। এসি চলছে না-কি? শব্দটা এসির আওয়াজের মত লাগছে। তাদের বাড়িতেতো এসি নেই। তাকে কি কোন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে?

হ্যাঁ ক্লিনিক বলেইতো মনে হচ্ছে। এইতো স্ট্যাণ্ডের সঙ্গে স্যালাইনের ব্যাগ ঝুলছে। তাকে স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। পায়ের কাছে একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে। নার্সটার চেহারা কোমল। নার্স এপ্রন পরে আছে। এনে তার নাম লেখা— রোকেয়া। এপ্রনের পকেটেই ষ্টেথিসকোপ। না তাহলে উনি নার্স না। নার্সরা এপ্রনের পকেটে স্টেথিসকোপ নিয়ে ঘুরেন না। ইনি ডাক্তার। ডাক্তার এগিয়ে আসছেন। তিনি আসমানীকে কি যেন বললেন। আসমানী পরিষ্কার শুনতে পেল না। এসির শব্দে ডাক্তার মেয়েটির কথা ঢাকা পরে গেছে। আসমানীর ইচ্ছা করছে তাকে জিজ্ঞেস করতে–আচ্ছা শুনুন, আজ আমার বিয়ে হবার কথা ছিল। বরযাত্রী এসেছে কি-না আপনি কি জানেন? যদি না জানেন একটু কি জেনে দেবেন? আমার আত্মীয় স্বজনরা নিশ্চয়ই আশে পাশেই আছেন। তাদের জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন।

আসমানী কথা বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু কথা বলতে পারছে না। ডাক্তার মেয়েটি এগিয়ে এসে স্যালাইনের ব্যাগ নাড়াচাড়া করছে। আসমানী স্যালাইনের ব্যাপের দিকে তাকিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

 

আসমানীর বিয়ে হয় নি। তার অসুখের কারণে যে হয় নি তা-না। বিয়ে হয়নি কারণ আজ সকাল এগারোটা দশ মিনিটে ফরহাদের দাদাজান মারা গেছেন। মরা বাড়িতে বিয়ে হয় না।

বিদেশী টুরিস্টদের মত লাগছে

কামরুল ইসলাম সাহেবকে আজ বিদেশী টুরিস্টদের মত লাগছে। তাঁর গায়ে থাই সিল্কের ঢোলা সার্ট। সেই সার্ট লাল, নীল, সবুজ অনেক কটা রঙ। চোখে সানগ্লাস। গলায় ক্যামেরা ঝুললেই পুরোপুরি টুরিস্ট। তাঁর গা থেকে ভুর ভুর করে গন্ধও বের হচ্ছে। গাড়ির পেছনের সীটে তিনি গা এলিয়ে বসে আছেন। ফরহাদ তাঁর পাশে। গাড়ি এয়ারপোর্ট রোড ধরে চলছে। তিনি কোথায় যাচ্ছেন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ফরহাদ ভেবেছিল তাকে নিয়ে তিনি যাচ্ছেন, পিজিতে। আসমানী আছে পিজিতে। কিন্তু শাহবাগের মোড়ে এসে তিনি ড্রাইভারকে বললেন—এয়ারপোর্ট রোড ধরে এগিয়ে যাও। তারপরই ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাদের এদিকে ভাল কফি শপ নেই তাই না।

ফরহাদ বলল, আমি ঠিক বলতে পারছি না।

আসমানী বলেছে নেই। আসমানী আর নিশাকে নিয়ে একবার কফি শপের সন্ধানে বের হয়েছিলাম।

পান নি?

কয়েকটি পেয়েছি। গুলশানের দিকে। তবে ঠিক কফি শপ না। ফাস্ট ফুডের দোকান। চা কফিও বিক্রি করে। সবগুলিই ইয়াং ছেলেমেয়েদের দখলে। আমার এমন কফি শপ দরকার যেখানে আমার মত বুড়ো মানুষও যেতে পারে।

আমরা কি এখন কোন কফি শপে যাচ্ছি?

হ্যাঁ। কিছু কথা আছে বাড়িতে নিরিবিলি বসে বলতে হয়। কিছু কথা আছে পার্কে হাঁটতে হাঁটতে বলতে হয়। আবার কিছু কথা আছে বলতে হয় ভীড়ের মধ্যে। কফি শপে কিংবা পাবে। তোমার চারপাশে লোজন থাকবে। তারা সবাই কথা বলবে। তুমিও বলবে। কেউ কারো কথা শুনবে না। জনতার মধ্যেই আছে নির্জনতা।

ফরহাদ কিছু বলল না। আসমানীর মামা তাকে বিশেষ কিছু কথা বলতে চান। সেই বিশেষ কথাগুলি কি সে ধরতে পারছে না। তিনি কি তাকে বলবেন, আসমানীর ভয়ংকর কোন অসুখ হয়েছে। এটা তাকে বলার দরকার নেই। এটা সে কারো সঙ্গে কথা না বলেও বুঝতে পারছে।

ফরহাদ?

জ্বি।

তোমার দাদাজানের মৃত্যুশোক তোমরা কি সামলে উঠেছ?

ফরহাদ বলল, জ্বি।

এখন কেউ কান্নাকাটি করছে না?

উনার বয়স হয়েছিল। মৃত্যু তার জন্যে প্রয়োজন ছিল। কেউ তেমন কান্নাকাটি করে নি।

তোমার খুব খারাপ সময় যাচ্ছে তাই না?

জ্বি।

শুনলাম যে বাড়িতে থাকতে সেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হচ্ছে?

জ্বি।

যাচ্ছ কোথায়? নতুন বাসা ভাড়া করছ?

এখনো করি নি।

তোমার যে চাকরি নেই এটাও জানতাম না। এটা আমাকে বলা দরকার ছিল। আসমানী কি জানে?

জ্বি জানে।

এটা ভাল যে তাকে বলেছ। তার কাছে কিছু গোপন করনি। চাকরি যে নেই, সংসার কিভাবে চলবে না চলবে কিছু ভেবেছ?

জ্বি না।

যে ছেলে বিয়ে করবে তার কোন প্ল্যানিং থাকবে না? তোমার মার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। চমৎকার মহিলা। তিনি দুঃখ করে বলছিলেন তুমি যে বিয়ে করতে যাচ্ছ এই খবরটা তুমি তাঁকেও দাও নি। তোমার যে চাকরি নেই এটাও তিনি জানতেন না। তুমি একটা মেয়ের গভীর প্রেমে পড়েছ এটা খুবই ভাল কথা। যখন ঠিক করলে মেয়েটাকে তুমি বিয়ে করবে তখনই কিন্তু রেসপনসিবিলিটির ব্যাপারই চলে আসছে। আসছে না?

জ্বি।

সিনেমায় বা রোমান্টিক উপন্যাসে কপর্দকহীন ছেলে প্রেমিকাকে বিয়ে করে। তাদের কোন সমস্যা হয় না, তারা সুখেই সময় কাটায়। রিয়েল লাইফে তা হয় না। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে কল্পনা এবং বাস্তবের সীমারেখা সম্পর্কে তুমি জান না। তুমি পুরোপুরি কল্পনাতেও বাস করছ না, আবার বাস্তবেও বাস করছ না। দুয়ের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় বাস করছ। আমি নিজে যে ভুলটা করেছি সেটা হচ্ছে আসমানীর আবেগের মূল্য দিয়েছি। তোমার বিষয়ে কোনরকম খোঁজ খবর করার প্রয়োজন বোধ করি নি।

খোঁজ খবর করে সব জানলে বিয়েতে রাজি হতেন না?

রাজি হতাম। আসমানীর দিকে তাকিয়ে রাজি হতাম।

কফি শপ একটা পাওয়া গেল। কামরুল ইসলাম সাহেবের পছন্দ হল না। ছোট্ট জায়গা। ছেলেমেয়েরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বার্গার-ফার্গার খাচ্ছে। এদের দেখে মনে হচ্ছে এদের বাড়িতে রান্না হয় না। দোকানের বার্গারই একমাত্র ভরসা। কামরুল সাহেব বললেন, চল এক কাজ করা যাক কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসি।

ফরহাদ বলল চাইনিজ রেস্টুরেন্টে কফি পাওয়া যায় না।

চাইনিজ চা নিশ্চয়ই আছে। চল চা খেতে খেতে কথা বলি। এই এলাকায় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেস্টুরেন্ট কোনটা?

আমি বলতে পারব না মামা। গুলশান বিত্তবান লোকদের এলাকা। আমি এদিকে আসি না।

চল খুঁজে বের করি। একটা পছন্দ না হলে আরেকটায় যাব। আসলে আজ আমার ঘুরতে ইচ্ছা করছে। কোন কোন দিন আসে যখন ঘরে থাকতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় সারাদিন ঘুরি। তাই না?

জ্বি।

আবার কোন কোন দিন আসে যখন ঘর থেকে বেরুতে ইচ্ছা করে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। মনে হয় দরজা জানালা বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে থাকি। মানুষ হয়ে জন্মানোর অনেক যন্ত্রণা আছে। ঠিক বলছি না ফরহাদ?

জ্বি।

আচ্ছা ধর তোমাকে একটা চয়েস দেয়া হল—তুমি মানুষ না হয়ে অন্য যে কোন পশুপাখি কীট পতঙ্গ হয়ে জন্মাতে পার। তুমি কি হতে চাইবে?

কামরুল সাহেব তাকিয়ে আছেন। কালো চশমার কাৰণে তার চোখ দেখা যাচ্ছে না, তবে তিনি যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তা বোঝা যাচ্ছে। ফরহাদ বুঝতে পারছে আসমানীর মামা অস্থির বোধ করছেন। অস্থির মানুষ নিজের অস্থিরতা চারদিকে ছড়িয়ে দিতে চায়। এই অস্থিরতা কি অসমানীর বিয়ে নিয়ে? না-কি আসমানীর অসুখ নিয়ে? চাইনিজ রেস্টুরেন্টের নিরিবিলিতে তিনি ফরহাদকে কি জিজ্ঞেস করবেন? সে পরের জন্মে কি হয়ে জন্মাতে চায়? না-কি উনি বলবেন—আসমানীর সঙ্গে তোমার বিয়ের ব্যাপারটা আপাতত স্থগিত। তুমি কোন ভদ্র চাকরি জোগাড় কর। বউকে নিয়ে কোথায় তুলবে সেই ব্যবস্থা কর। তারপর দেখা যাবে।

পছন্দের চাইনিজ রেস্টুরেন্ট একটা পাওয়া গেছে। এরা আবার কফিও বিক্রি করে। কামরুল সাহেব দু কাপ এসপ্রেসো কফির অর্ডার দিলেন ফরহাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সিগারেট খেতে ইচ্ছা করলে খাও। আমাকে গুরুজন হিসেবে সম্মান দেখাতে গিয়ে সিগারেট বন্ধ রাখার দরকার নেই। তোমার কাছে সিগারেট আছে?

জ্বি না।

আচ্ছা আমি আনিয়ে দিচ্ছি। আমার নিজেরও সিগারেট খেতে ইচ্ছা করছে।

কামরুল ইসলাম সিগারেট আনতে পাঠালেন। সব চায়নীজ রেস্টুরেন্ট অন্ধকার অন্ধকার থাকে। এটিও তাই। কামরুল ইসলাম এই অন্ধকারেও চোখ থেকে সানগ্লাস খুলেন নি।

ফরহাদ!

জ্বি।

আসমানীর অসুখটা ভাল না বলে ডাক্তাররা সন্দেহ করছেন।

ও।

আগেও একবার ডাক্তাররা এ জাতীয় সন্দেহ করেছিলেন। অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা করার পর তারা সন্দেহমুক্ত হয়েছিলেন। বিউমেটিক ফিভারের চিকিৎসা করা হয়। এতে উপকারও পাওয়া যায়। এখন মনে হচ্ছে ভুল চিকিৎসা হয়েছে। ভুল চিকিৎসার মাশুল খুব চড়া হয়। চড়া মাশুল দিতে হবে।

ওর অসুখটা কি?

এখনো জানি না। এখনো পরীক্ষা নীরিক্ষার পর্যায়ে আছে। নিশ্চিতভাবে জানা যায় নি।

ডাক্তাররা কি সন্দেহ করছেন?

ভয়ংকর কিছু সন্দেহ করছেন। রেড ব্লাড সেল কাউন্ট অনেক বেশী। বেশী হলেও এরা ঠিক মত অক্সিজেন সাপ্লাই করতে পারছে না। নানান হাবিজাবি বলছে। ব্লাড ট্রান্সফিউশান করা হয়েছে। এতে ডাক্তাররা ভাল ফল পেয়েছেন। লোহীত রক্ত কণিকার অসুখ।

চিকিৎসা আছে?

লোহিত রক্ত কণিকার অসুখের আবার না-কি নানান ভেরাইটি আছে। কিন্তু কিছু ভেরাইটির ভাল চিকিৎসা আছে। এমনও আছে যে বোন-মেরো ট্রান্সপ্রেন্ট করে রোগ পুরোপুরি সারানো যায়। বোন-মেরো পাওয়াটাই সমস্যা।

সমস্যা কেন? সব বোন-মেরো ট্রান্সপ্লেন্ট করা যাবে না। ক্রস ম্যাচিং এ দেখতে হবে ম্যাচ করে কি-না। ক্রস ম্যাচিং করতে হবে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে। বিরাট জটিলতা। বাংলাদেশে ক্রস ম্যাচিং এর ব্যবস্থাও নেই। সিঙ্গাপুরে আছে।

আসমানী কি তার অসুখের কথা জানে?

না। তাকে বলা হয়েছে রিউম্যাটিক ফিভারের কথা। তোমাকে নিরিবিলিতে ডেকে আনার উদ্দেশ্যটা কি জান?

জ্বি না।

আসমানীর অসুখের খবর দেয়ার জন্যে তোমাকে ডাকি নি। অসুখের খবর দেয়ার জন্যে চাইনিজ রেস্টুরেন্টও লাগে না, এসপ্রেসো কফিও লাগে না। তোমাকে ডেকেছি এই কথাটা বলার জন্যে যে বিয়ের ব্যাপারটা তুমি আপাতত মাথা থেকে সরিয়ে দাও। আসমানী বিয়ের জন্যে খুব অস্থির হয়ে আছে। জ্ঞান ফেরার পর প্রথম সে যে কথাটা বলেছে তা হচ্ছে আমার বিয়ে হয়নি?

ওকে কি সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হবে?

জানি না। আমার এত টাকা নেই। শুধু আসমানীকে একা নিলেতো হবে না। বোন-মোরো ক্রস ম্যাচিং করার জন্যে আরো অনেককে নিতে হবে। আমার এত টাকা নেই।

সিগারেট চলে এসেছে। ফরহাদ সিগারেট ধরাল। কামরুল ইসলাম সাহেব সিগারেট খেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ালেন না।

কফির কাপে চুমুক দিতে নড়ালেন।

ফরহাদ!

জ্বি।

চল আসমানীকে দেখতে যাই।

জ্বি চলুন।

কামরুল ইসলাম সাহেব উঠলেন না বসে রইলেন। কফি শেষ হয়ে গেছে তারপরেও তিনি শূন্য কাপে চুমুক দিচ্ছেন।

ফরহাদ।

জ্বি।

তুমি কিন্তু আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও নি।

কোন প্রশ্ন?

পরের জন্মে তুমি কি হয়ে জন্মাতে চাও? আসমানীকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম সে খুব অদ্ভুত উত্তর দিল। সে বলল…

কামরুল ইসলাম সাহেব কথা শেষ না করে উঠে পড়লেন। ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, আমি হাসপাতালে যাব না। আমাকে বাসায় নামিয়ে রেখে তুমি যাও। আরেকটা কথা আসমানীর অসুখটা যে ভয়াবহ এই তথ্য অবশ্যই গোপন রাখবে।

জ্বি রাখব।

আসমানী যখন ছোট ছিল তখন সে কিছু অদ্ভুত কান্ড করতো। একটা তোমাকে বলি…।

ফরহাদ অদ্ভুত কান্ড শোনার জন্যে অপেক্ষা করছে, কিন্তু কামরুল ইসলাম সাহেব চুপ করে গেছেন। মনে হয় অদ্ভুত কান্ডের গল্প করতে এখন তিনি আর উৎসাহ পাচ্ছেন না।

বাবু সাহেব কেমন আছেন

বাবু সাহেব কেমন আছেন?

হাসপাতালের বিছানায় বসে আসমানী চুল আঁচড়াচ্ছে। বেশ আয়োজন করেই আঁচড়াচ্ছে। বিছানার উপর স্ট্যান্ড লাগানো আয়না। নিজেকে দেখতে দেখতে চুল। আঁচড়ানো। আসমানী মনে হয় সাজগোজও করেছে। চোখে কাজল। কপালে টিপ। পরনের শাড়িটাও নতুন। মনে হচ্ছে না সে হাসপাতালে আছে। মনে হচ্ছে সে। নিজের বাড়িতেই বাস করছে। বিকেলে মহিলা সমিতিতে নাটক দেখতে যাবে। এটা তার প্রস্তুতি।

বাবু সাহেব আমার কথার জবাব দিচ্ছেন না কেন? কেমন আছেন?

ভাল।

আপনি কি কখনো লক্ষ্য করেছেন আমার চুল কত লম্বা?

এখন লক্ষ্য করছি।

দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।

ফরহাদ বসতে বসতে বলল, তুমি একা কেন?

তুমি আমাকে দেখতে আসছ এই জন্যে ইচ্ছা করে একা হয়েছি। বাবা আর নিশা ছিলেন তাদের জোর করে করে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। একজন আয়া ছিল বসিরের মা। তাকে বলেছি বিকেলে আসতে। আশা করি তুমি বিকেল পর্যন্ত থাকবে।

হ্যাঁ থাকব। শুধু বিকাল পর্যন্ত না যতক্ষণ আমাকে থাকতে দেয় ততক্ষণ থাকব।

রাতে চলে যাবে?

রাতেও যেতে চাচ্ছি না। হাসপাতালের লোকজন যদি অনুমতি দেয় তাহলে তোমার ঘরের সামনের বারান্দায় যে টুলটা আছে সেই টুলে শুয়ে থাকব। তুমি যতবার আমাকে ডাকবে ততবার আমি বাইরে থেকে জবাব দেব।

আসমানী হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, তুমি যে ভাবে কথা বললে তাতে মনে হচ্ছে তুমি সুনীলের কোন রোমান্টিক উপন্যাস থেকে উঠে এসেছ। আমি হচ্ছি নীরা। আমার অসুখ হয়েছে। নীরার অসুখ।

নীরা কে?

নীরা হল সুনীলের চির প্রেমিকা। তোমার জন্যে সিগারেট আনিয়ে রেখেছি। আমার সামনে বসে আরাম করে একটা সিগারেট খাওতো।

হাসপাতালে রোগীর ঘরে বসে সিগারেট খাবো?

হ্যাঁ খাবে। কারণ আমি ছোট্ট একটা পরীক্ষা করতে চাই। আমার শরীরটা আজ কত ভাল সেই পরীক্ষা। যদি দেখি সিগারেটের গন্ধ সহ্য হচ্ছে—তাহলে বুঝব শরীর বেশ ভাল।

শরীর ভাল লাগছে?

হ্যাঁ ভাল লাগছে। আমি গান জানলে গুনগুন করে গান গাইতাম। আমি অবশ্যি গান না জানলেও গুনগুন করে গাই। সবচে বেশি কোন গানটা গাই জান? সবচে বেশী গাই–

ভালবেসে যদি সুখ নাহি
তবে কেন মিছে এ ভালবাসা।

আচ্ছা আমি কি খুব বকবক করছি?

ফরহাদ সিগারেট ধরাল। সে তাকিয়ে আছে আসমানীর দিকে। তাকে সামান্য রোগা লাগছে। চোখের কোণে কালি, সেই কালিও সামান্য। এছাড়া তার মধ্যে অসুস্থতার কোন চিহ্ন নেই। আসমানী বিছানার মাঝখন থেকে সরে এক পাশে চলে গেল। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। হঠাৎ তাকে সামান্য ক্লান্ত মনে হচ্ছে। ফরহাদ বলল, সিগারেটের গন্ধটা কি সহ্য হচ্ছে?

আসমানী বলল, না।

ফেলে দি?

না ফেলবে না। তুমি সিগারেট খাচ্ছ দেখতে ভাল লাগছে। আচ্ছা শোন আমার উচিত ছিল তোমার দাদাজান বিষয়ে কথা বলা। তোমাদের বাড়িতে একজন মানুষ মারা গেছে অথচ তা নিয়ে আমি কোন কথা বলিনি। আসলে ইচ্ছা করে বলি নি। তোমার সঙ্গে অপ্রিয় কোন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। আমি সারা জীবণু তোমার সঙ্গে সুখ নিয়ে কথা বলতে চাই।

ফরহাদ সিগারেট ফেলে দিল। আসমানী বলল, তোমাদের খুব দুঃসময় যাচ্ছে তাই না?

ফরহাদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।

আগের বাড়িটা কি তোমরা ছেড়ে দিয়েছ?

আজ ছাড়ব।

তোমরা উঠবে কোথায়?

আমার একজন ছোটবোন আছে—-জাহানারা আপাতত তার বাড়িতে।

তুমি কোন রকম দুঃশ্চিন্তা করবে না। তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

কি ভাবে? কি ভাবে তা জানি না। কিন্তু হবে।

If winter comes can spring be far behind?

ফরহাদ হাসতে হাসতে বলল, সাহিত্যে অনেক সুন্দর সুন্দর কোটেশন আছে। কিন্তু পৃথিবীটা কোটেশন মত চলে না। পৃথিবী চলে তার নিজের নিয়মে। সেই নিয়মটা কি তাও আমরা ভালমত জানি না।

প্লীজ দার্শনিকের মত কথা বলবে না। অসহ্য লাগছে।

আচ্ছা বলব না।

আমার বড় মামা কি আমাদের বিয়ের ব্যাপারে তোমাকে কিছু বলেছেন?

না।

আমার মনে হয় বলেছেন। তিনি এখন চান না যে বিয়েটা হোক। তিনি এখন বলছেন—বিয়ে হবে আমার অসুখ সারলে।

সেটাইতো ভাল।

সেটা মোটেই ভাল না; অসুখ সারার জন্যে অপেক্ষা করলে আর আমার বিয়ে হবে না। কারণ আমার অসুখ সারবে না।

সারবে না কেন?

সারবে না কারণ, অসুখটা ভয়ংকর। যদিও সবাই আমাকে বলছে রিউম্যাটিক ফিভার। আমি জানি ব্যাপারটা কি? জেনেও ভাণ করছি জানি না। আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার সঙ্গে ভাণ করব না। কাজেই সত্যি কথা বললাম।

ফরহাদ চুপ করে গেছে। সে এখন আর আসমানীর দিকে তাকাচ্ছে না। তাকিয়ে আছে খোলা দরজার দিকে। আসমানী বলল, এই তুমি অন্যদিকে তাকিয়ে আছ কেন? তুমি যতক্ষণ আমার সামনে থাকবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।

ফরহাদ তাকাল। আসমানী বলল, এই তো ঠিক আছে। এখন মন দিয়ে আমার জরুরি কথাটা শোন—আমার অসুখ যত ভয়ংকরই হোক আমি একদিনের জন্যে হলেও তোমাকে বিয়ে করতে চাই। মামা এই বিয়ে হতে দেবে না। কাজেই তুমি যা করবে তা হচ্ছে কাজির অফিসে ব্যবস্থা করে রাখবে। আমি গোপনে উপস্থিত হব। বিয়ে শেষ হলে হাসপাতালে ফিরে এসে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে থাকব। ঠিক আছে?

হ্যাঁ ঠিক আছে।

আচ্ছা শোন পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক তার প্রেমিকার চুল হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে চায়। তুমি কখনো আমার চুল ছুঁয়ে দেখনি। নাও চুলগুলি ছুঁয়ে দেখ। কারণ বেশিদিন আমার মাথায় চুল থাকবে না। যখন কেমোথেরাপি শুরু হবে সব চুল পড়ে যাবে। নাও চুলে হাত দাও।

ফরহাদ ফুল স্পর্শ করল।

আসমানী হোট্ট করে নিশ্বাস ফেলে বলল, এখন তুমি চলে যাও।

চলে যাব।

হ্যাঁ চলে যাবে। কারণ তোমাকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। কষ্ট হচ্ছে, এবং কান্না পাচ্ছে। তুমি সারা জীবন আমার পাশে থাকবে না, ভাবতেও পারছি না। সত্যি সত্যি হয়তো কেঁদে ফেলব। আমাকে কাঁদতে দেখে তুমি কাঁদবে। পুরুষ মানুষের কান্না খুব বিশ্রী। প্লিজ তুমি বিদেয় হও। ফরহাদ অবিশ্বাসী গলায় বলল, বিদেয় হব।

হ্যাঁ বিদেয় হবে। আর শোন আমাকে বিয়ে করতে হবে না। এতক্ষণ তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছিলাম। যে মেয়ে কবরের উপর দাঁড়িয়ে আছে তার আবার বিয়ে কি? আচ্ছা বল তো আমাকে কি আজ সুন্দর লাগছে?

হ্যাঁ।

তোমার চোখে আমাকে যেন সুন্দর লাগে এই জন্যে সকাল থেকে সাজছি। কাজল দিয়েছি, মাশকারা দিয়েছি। গাল গোলাপী লাগছে না? রাসন দিয়েছি। আমার চেহারা অতি দ্রুত খারাপ হয়ে যাবে। আমি চাই না আমার সেই চেহারা তুমি দেখ। কাজেই এই তোমার আমাকে শেষ দেখা।

ফরহাদ তাকিয়ে আছে। আসমানী হাসছে। কী সুন্দর হাসি। এত সুন্দর করে একটা মেয়ে হাসে কি করে? তাছাড়া এখন কি তার হাসির সময়

আসমানী হাসি থামিয়ে বলল, আমার বাবা খুব দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। রাতে তার ঘুম হচ্ছে না। এই কদিনে তার ওজন এত কমেছে যে বলার না। কোনো প্যান্ট এখন পরতে পারেন না। ঢিলা হয়ে গেছে। বেল্ট লাগে। বাবাকে আজ দেখে খুবই মায়া লাগল। কথাবার্তাও এখন ঠিকমতো বলতে পারেন না। কথা আটকে যায়।

তোমাকে নিয়ে খুব দুঃশ্চিন্তা করছেন।

এই মুহূর্তে আমাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন না। তার ফ্ল্যাট বাড়ি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করছেন। বাড়িটা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। আমাকে দেশের বাইরে নিতে হবে। টাকা কোথায়? বাবা তার সারা জীবনে টাকা-পয়সা যা পেয়েছেন সব ঐ ফ্ল্যাট কিনতে শেষ করছেন। যেই মুহূর্তে ফ্ল্যাট বিক্রি হবে, আমরা হয়ে যাব পথের মানুষ—জাগ্রত জনতা।

আসমানী আবারো হাসছে। ফরহাদ মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে। আসমানী আজ অন্য দিনের চেয়ে বেশি হাসছে। বেশি কথা বলছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ফরহাদের কি বলা উচিত—এত কথা বলার দরকার নেই। তুমি চুপ করে থাক।

আসমানী শাড়ির আঁচলে মাথার ঘাম মুছতে মুছতে বলল–একজন ভালো মেয়ে হিসেবে আমার বাবাকে বলা উচিত ফ্ল্যাট বিক্রি করার কোন দরকার নেই। চিকিৎসা করে লাভ যা হবে তা হচ্ছে মনের সান্তনা। তোমরা বলতে পারবে মেয়ের চিকিৎসার জটি হয় নি। এই মনের সান্তনার জন্যে পথের ফকির হবে কেন? কিন্তু এরকম কোনো কথা আমি বলি নি। আমি খুব স্বার্থপর তো এই জন্যে বলিনি। এই শোন তোমাকে আজ কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। ছাই রঙা সার্টেও লাগছে। তোমাকে বলেছিলাম না ছাই রঙা সার্টটা পুড়িয়ে ফেলবে। পুড়াও নি কেন?

গরিব মানুষ তো, সার্ট পুড়াতে মায়া লাগে।

সার্ট গা থেকে খুলে দাও। আমি পুড়াব। আমিও গরিব তবে আমার এত মায়া নেই। কই খুলছ না কেন?

সার্ট সত্যি খুলব?

অবশ্যই খুলবে।

আসমানী মিটি মিটি হাসছে। মনে হয় তার মনে কোনো দুষ্ট বুদ্ধি খেলা করছে।

আমার সামনে সার্ট খুলতে লজ্জা লাগছে।

হ্যাঁ।

তাহলে একটা কাজ কর–টেবিলের উপর দেখ একটা প্যাকেট আছে। প্যাকেটটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়। মনে নেই, তোমার জন্যে সাতটা সার্ট কিনে ছিলাম? কোন বারে কোন সার্ট পরবে কাগজে লিখে রেখেছি। আজ বুধবার। আজ তোমার কপালে হালকা সবুজ রঙের সার্ট। চিরুনীটা নিয়ে যাও। মাথা আঁচড়াবে। বাথরুম থেকে বের হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসবে। তারপর স্ট্রেইট দরজা দিয়ে চলে যাবে। তোমার সঙ্গে বক বক করে আমার মাথা ধরেছে এবং মাথা ঘুরছে। আমি শুয়ে থাকব।

তোমাকে একা ফেলে চলে যাব?

হ্যাঁ চলে যাবে। আমি একা থাকব না—বাবার আসার সময় হয়ে গেছে। ও আরেকটা কথা প্রতিটি সার্টের বুক পকেটে একটা করে চিঠি আছে। যে দিন যে সার্ট পরবে সেদিন চিঠিটাও পড়বে।

আচ্ছা। আগামী সাতদিনে সাতটা চিঠি পড়া হয়ে যাবে। ইন্টারেস্টিং না।

হুঁ।

আমি কি ভেবে রেখেছিলাম জান—আমি ভেবে রেখেছিলাম সারা জীবন তোমাকে এরকম করে চিঠি লিখব। সার্ট গায়ে দিয়ে অফিসে যাচ্ছ। সার্টের বুক পকেটে একটা চিঠি। যত রাগ হোক, ঝগড়া হোক তুমি চিঠি পাবেই। আচ্ছা শোন তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন? বললাম না আমার মাথা ঘুরছে। আমি শুয়ে থাকব। আর শোন বাথরুম থেকে বের হয়ে যদি তুমি দেখ আমি ঘুমিয়ে পরেছি— খবরদার আমার ঘুম ভাঙ্গাবে না। রাতে ঘুমের অষুধ খেয়েও আমার ঘুম হচ্ছে না। ডাক্তাররা বলেছেন ঘুমটা আমার জন্যে খুবই দরকার।

ফরহাদ সার্ট বদলে মাথার চুল আঁচড়ে বাথরুমের আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করল। হাসপাতালের সব আয়না হাসপাতালের রুগীদের মতোই অসুস্থ। আয়নায় স্পষ্ট কিছু দেখা যায় না তারপরেও ফরহাদের মনে হলো সবুজ রঙের সার্টটায় তাকে খুব মানিয়েছে। বুধবারের সার্টের পকেটে শুধু যে চিঠি তাই না। একটা বলপয়েন্ট কলম। কলমটা কেন দিয়েছে কে জানে। চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করলেও এখন পড়া যাবে না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে পড়তে হবে। এখন পড়লে আসমানী বুঝে ফেলবে। এইসব ক্ষেত্রে আসমানীর সিক্সথ সেন্স অত্যন্ত প্রবল।

ফরহাদ বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখল আসমানী ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর ঘুম। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। তার ঘুম ভাঙ্গানোর কোনো মানে হয় না। ফরহাদ হাসপাতালের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। নিশা এবং তার বাবাকে আসতে দেখা যাচ্ছে। নিশার হাতে একটা প্যাকেট। নিশার বাবার হাতে কিছু বইপত্র। তিনি দূর থেকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফরহাদের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলেন। এটা ফরহাদের কল্পনাও হতে পারে। তার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকানোর এখন কিছু নেই। কেউ কাউকে দেখতে পায় নি এমন ভাব করলে কেমন হয়। ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করতে পারে। মনে হয় এটাই সবচে ভালো বুদ্ধি। তাছাড়া আসমানীর চিঠিটা পড়তে ইচ্ছা করছে। যত তাড়াতাড়ি হাসপাতালের বাইরে যাওয়া যাবে তত তাড়াতাড়ি চিঠিটা পড়া যাবে।

ফরহাদ উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল। বারান্দার শেষ মাথায় নিশ্চয়ই সিড়ি বা লিফট আছে। তার পুরানো ছাই রঙের সার্টটা হাসপাতালে রয়ে গেছে। সার্ট দেখে নিশা এবং তার বাবা নিশ্চয়ই ভ্রু কুঁচকাবেন। যার যা ইচ্ছা করুক। তাকে এই মুহূর্তে আসমানীর চিঠি পড়তে হবে।

চিঠি ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত—যতক্ষণ পড়া না হয় ততক্ষণ আঁকিবুকি টানা সামান্য এক টুকরা কাগজ। পড়তে শুরু করলেই সে একজন রক্ত মাংসের মানুষ। মানুষের মতোই সে রাগ করে। অভিমান করে।

বাবু সাহেব, প্রচণ্ড মাথা ধরা নিয়ে আপনার জন্যে আজ চিঠি লিখলাম। সব মিলিয়ে সাতটা চিঠি লেখা সহজ ব্যাপার না। শুধু এই চিঠিটাই সামান্য বড়। বাকি সবগুলি এক লাইন দুলাইনের।

এই চিঠি লিখতে লিখতে আমি মজার একটা জিনিস ঠিক করি। মজার জিনিসটা হচ্ছে তোমার জন্যে একটা পরিস্থিতি তৈরি করা। যাতে তুমি সার্ট গায়ে দিয়ে যখন বাথরুম থেকে বের হবে তখন দেখবে আমি ঘুমিয়ে। এই ঘুম আসল ঘুম নামকল যুম। অভিনয় ঘুম। আমাকে ঘুমন্ত দেখে তুমি কি কর তাই আমার দেখার ইচ্ছা। আমার ধারণা তুমি আমার পাশে বসবে এবং খুব সাবধানে (যাতে আমার ঘুম না ভাঙ্গে) কপালে হাত রাখবে। কিংবা মাথা নিচু করে ঝুঁকে এসে… থাক বাকিটা আর লিখলাম না, লজ্জা লাগছে। তুমি কি করবে তা নিয়ে আমি মনে মনে একটা বাজি ধরেছি। দেখি বাজিতে জিততে পারি কি-না। এই শোন আমি আর লিখতে পারছি

—প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে। অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল। ভুল বললাম, অনেক কিছু না একটা কথাই বারবার নানান ভঙ্গিতে লেখার ইচ্ছা, I Love You, তাও লিখতে পারছি না। শরীর বিদ্রোহ করেছে। ভালবাসাবাসির সঙ্গে শুধু মন না, এখন মনে হচ্ছে শরীরও জড়িত। তুমি ভালো থেকো।

ইতি তোমার আসমানী।

ফরহাদ আকাশের দিকে তাকালো।

কী সুন্দর ঝকঝকে নীল আকাশ। সোহরাওয়ার্দীর সামনের গাছগুলিকেও কী সুন্দর লাগছে। ফরহাদের আবার হাসপাতালে যেতে ইচ্ছা করছে।

আসমানীর বাবা যা ভাবার ভাবুক। সে আসমানীর হাত ধরে বসে থাকবে। উপায় নেই, আজ তাদের বাড়ি ছাড়তে হবে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানির লোকজন অপেক্ষা করছে।

 

জাহানারা মায়ের জন্যে দোতলার বড় একটা ঘর ছেড়ে দিয়েছে। ঘরে খাট আছে, ড্রেসিং টেবিল আছে। দুটা চেয়ার আছে। টেবিল আছে। মেঝেতে কার্পেটও আছে। কার্পেট পুরানো হলেও পরিষ্কার। ঘরের সঙ্গে এটাচড বাথরুম।

জাহানারা বলল, এসি লাগানো ঘর তোমাকে দিতে পারতাম মা। একটা ছিল, কিন্তু এটাচড বাথরুম নেই। বাবা রাতে তিন চারবার বাথরুমে যায় এই জন্যে এই ঘর। ঘরের সঙ্গে বারান্দা আছে। বিকেলে বারান্দায় বসে চা খেতে পারবে। তোমার জামাইকে বলেছি সে তার অফিস থেকে একটা টিভি এনে লাগিয়ে দেবে।

টিভির দরকার নেই।

দরকার থাকবে না কেন? অবশ্যই দরকার আছে। মা শোন তুমি এমন মুখ কালো করে আছ কেন? ঘর পছন্দ হয় নি?

ঘর খুব সুন্দর। বারান্দাটাও সুন্দর।

তাহলে মুখটা কাল কেন?

গুষ্ঠি শুদ্ধ তোর এখানে থাকতে এসেছি। ভাবতেই খারাপ লাগছে।

মেয়ের বাড়িতে মা এসে থাকে না? তুমি তো আর সারা জীবনের জন্য থাকতে আসনি?

তাও ঠিক। অল্প কিছু দিন থাকব তুই যা বাড়াবাড়ি করছিস এই জন্যেও খারাপ লাগছে। মঞ্জু বাড়ি ভাড়ার জন্যে যে রকম ছোটাছুটি করছে হয়তো আজ সন্ধ্যাবেলাতেই এসে বলবে—বাড়ি ঠিক হয়েছে চল। ছেলের যে স্বভাব যদি একবার বলে, আজ চল। আজই যেতে হবে।

আগে বলুক তারপর দেখা যাবে। মা শোন-তোমার আর বাবার জন্যে ঘরে খাবার দিয়ে যাবে। খাবার ঘরে তোমাদের খেতে যাবার দরকার নেই। মজিদের মা বলে একটা কাজের মেয়ে আছে তোমার যখন যা দরকার তাকে বলবে। মজিদের মাকে চিনেছ তো ঐ যে উঁচু দাঁত। ঠিক আছে–মা?

হ্যাঁ ঠিক আছে।

তোমার তো আবার ঘন ঘন চা খাবার অভ্যাস। তোমাকে সকালবেলায় এক ফ্লাক্স গরম পানি দিয়ে যাব। ঘরে টি কাপ, চিনি, দুধ থাকবে। শুধু চা-টা বানিয়ে নেয়া।

ফরহাদ কোথায় থাকবে?

একতলায় ব্যবস্থা করেছি। বড় ভাইজান বলেছে, সে থাকবে না। সে নাকি কোনো এক বন্ধুর সঙ্গে থাকবে। মঞ্জু ভাইয়ার সঙ্গে তো আমার দেখাই হয়নি। সে এখানে থাকবে কি না, তাও জানি না। বড় ভাইজানের ঘরে দুটা খাট আছে তারা দুইজন থাকতে পারবে। কোনো সমস্যা হবে না।

মেয়ে তাদের যত্ন করছে তাতে তার খুশি হওয়া উচিত। তিনি খুশি হতেন যদি জানতেন তার দুই ছেলে তার জন্যে বাসা ভাড়া করবে। তিনি ভাড়া বাসাতে উঠে যাবেন। মঞ্জু তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছে—পাগল হয়েছ মা। আমি বাড়ি ভাড়া করব কীভাবে? আমার আছে কি তোমাকে যে মাসে এক হাজার করে টাকা দিব বলেছি এটাই আমার ফাইন্যাল কথা। সেটা দিব। তোমাদের একটা সুবিধা করে দিচ্ছি। আমার থাকার ব্যবস্থা নিয়ে তোমাদের চিন্তা করতে হবে না। আমার ব্যবস্থা আমি করে নেব।

ফরহাদের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন। ফরহাদ মাথা নিচু করে বলেছে– দেখি একটা কিছু ব্যবস্থা করব। সেই ব্যবস্থাটা কী সে বলতে পারছে না। ব্যবস্থাটা কবে নাগাদ হবে সে সম্পর্কেও কিছু বলছে না। ফরহাদের দৃষ্টি ভরসা হারা দৃষ্টি।

তিনি ফরহাদকে মোটামুটি কঠিন গলায় বলেছেন—আমরা জামাইয়ের বাড়িতে কত দিন পড়ে থাকব? সহজ প্রশ্নের সহজ উত্তর হওয়া উচিত। সেই সহজ উত্তরটা সে দিচ্ছে না। এমন ভাব করেছে যেন মায়ের কথা সে শুনতে পাচ্ছে না।

তুই কি আমাদের সঙ্গে থাকবি?

উঁহু। আমি নান্টু ভাইয়ের মেসে থাকব।

না, তুই অবশ্যই আমাদের সঙ্গে থাকবি। আমাদের কখন কী দরকার হয়। এ বাড়িতে কাকে কি বলব?

রাহেলা মনে প্রাণে চাচ্ছেন ছেলে তার সঙ্গে থাকুক। সঙ্গে থাকলেই অন্যের বাড়িতে থাকার অপমানটা গায়ে লাগবে। তখন একটা কিছু ব্যবস্থা করার জন্যে উঠে পরে লাগবে। রাহেলার মনে ক্ষীণ ভয় ঢুকে গেছে তার দুই ছেলে কোনো ব্যবস্থাই শেষ পর্যন্ত করবে না। বাকি জীবনটা তার কাটবে জামাইয়ের অন্ন খেয়ে। অতি দ্রুত তিনি কাজের বুয়ার স্তরে নেমে যাবেন। ফরহাদের বাবা হয়ে যাবে বিনা বেতনের মালি। বাড়ির সামনে মাটি কুপিয়ে গাছ পুতবে। ঝাঝরি দিয়ে সকাল বিকাল গাছে পানি দিবে। জামাইয়ের গাড়ি এসে থামলে দৌড়ে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দিবে।

নিজের অসহায় অবস্থা নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করবেন সেই উপায় নেই। আগে যাবতীয় সমস্যা নিয়ে মেয়ের সঙ্গে কথা বলতেন। এখনকার সমস্যাটা তিনি কিছুতেই মেয়েকে জানাতে দিতে চান না। স্বামীর সঙ্গে আলাপ করার প্রশ্নই উঠে না। লোকটার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে বলে তার ধারণা। কথাবার্তার কোনো ঠিক নেই। কখন কি বলছে—কেন বলছে তাও জানে না। জাহানারার শাশুড়ি যখন বললেন, বেয়াই সাহেব! কেমন আছেন?

তার উত্তরে সে হড়বড় করে বলল, গাছের কথা বলছেন? সব তুলে ফেলেছে। জায়গা পরিষ্কার। কে বলবে দুদিন আগে কত গাছ ছিল, কত ধরনের গাছ ছিল। পাঁচটা লবঙ্গ চারা লাগিয়েছিলাম তার মধ্যে চারটা বেঁচেছে। আর একটা বছর পার করতে পারলে গাছের লবঙ্গ খাওয়াতাম।

জাহানারার শাশুড়ি বললেন, গাছের কথা না বেয়াই সাহেব, আপনার কথা জানতে চাচ্ছি।

ফরহাদের বাবা হতভম্ব হয়ে বলল, আমার কি কথা?

আপনি আছেন কেমন? শরীরটা কেমন?

ফরহাদের বাবা এমনভাবে চারদিক দেখতে লাগলো যেন এমন অদ্ভুত প্রশ্ন জীবনে কেউ তাকে করে নি।

রাহেলা বললেন, বেয়ান সাহেব উনাকে কিছু জিজ্ঞেস করা না করা অর্থহীন। গাছ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে করেন—জবাব দিবে। অন্যকোনো প্রশ্নের জবাব দিবে না। আপনার বেয়াই সাহেবের আমার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে একটা কাঁঠাল গাছের সঙ্গে বিয়ে হলে তার জীবনটা সুখে কাটত।

এই কথায় জাহানারার শাশুড়ি খুবই আনন্দ পেলেন। হেসে ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা। হাসতে হাসতে বললেন, বেয়ান তো বড়ই রসিক। বেয়ান যে এত রসিক তা তো জানতাম না।

রাহেলা মোটেই রসিক না। রস করার মতো মনের অবস্থা তাঁর না। এ বাড়িতে পা দেয়ার পর থেকে তাকে নানান ধরনের মিথ্যা কথা বলতে হচ্ছে। যেমন জাহানারার শাশুড়িকে বললেন–আমার দুই ছেলে বুঝলেন বিয়ান সাহেব। বাস্তববুদ্ধি বলে কিছু নাই। কতবার বললাম রহমত উল্লার জায়গাটা কিনে রাখ। দেশের বাড়ির জমিজমা তো কোনো কাজে আসবে না সাত ভূতে লুটেপুটে খাবে। সেই সব বিক্রি করে এই জায়গাটা কিনে ফেল। ঢাকায় বাস করছিস ঠিকানা বাগবে না? দুই ভাই-ই বলে, বাদ দাও। বাদ দিয়ে অবস্থাটা তো দেখেছেন? একেবারে রাস্তায়।

জাহানারার শাশুড়ি বললেন, কি বলেন বেয়ান সাহেব রাস্তায় হবেন কেন? আমরা আছি কি জন্যে

সেটা তো ঠিকই। ছোট ছেলে আমাকে কি বলে শুনুন। সে বলে—মা মাসের এই ভাংতি কিছুদিনের জন্যে তো আর বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি হোটেলের একটা ঘর ভাড়া করে দিচ্ছি। তোমরা দুই বুড়োবুড়ি হোটেলে থাক। ও আল্লা আমার বড় ছেলেরও দেখি তাতে সায় আছে। সেও বলল, এটাই ভালো। হোটলে থাকার অনেক মজা। চল আমরা বাকি জীবন হোটেলে কাটিয়ে দেই। আমি তখন দিলাম ধমক—বললাম, তোরা আমাকে আমার মেয়ের কাছে দিয়ে নিজেরা হোটেল ভাড়া করে থাক। সঙ্গে অবশ্যই তোর বাবাকেও নিবি। সে হোটেলের টবের গাছে পানি দিবে।

জাহানারার শাশুড়ি বললেন—বেয়ান সাহেব! আপনি এত মজা করে কথা বলেন। আপনার এই গুণের কথা তো আগে জানতাম না। আপনার ছেলেরা বাড়ি ভাড়া করলেও আপনি থাকবেন আমার সঙ্গে। আমরা দুই বুড়ি পান জর্দা খাব। গল্প করব। টিভিতে হিন্দী ছবি দেখব। বেয়ান আপনি হিন্দী বুঝেন তো?

রাহেলা জাহানারার শাশুড়ির কথায় স্বস্তি পেলেন। যাক বুড়ি তার মিথ্যা কথাগুলি বিশ্বাস করছে। এ জাতীয় মিথ্যা কথা জাহানারাকে বলা যাবে না। এই মেয়ের অনেক বুদ্ধি। মিথ্যা বললেই ধরা পড়তে হবে। তার ধারণা জাহানারাকে যখন বলেছেন ম বাড়ি ভাড়ার জন্যে ছোটাছুটি করছে—তখন মেয়ে বুঝে ফেলেছে মা মিথ্যা কথা বলছে। তবে তিনি তার মেয়ের উপর সন্তুষ্ট। খুবই সন্তুষ্ট।

মেয়ে তাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে পারত। কিছুই জিজ্ঞেস করে নি। সে বলতে পারত—ভাইয়ের বিয়ে দিচ্ছ কই আমি তো কিছু জানলাম না। আমি যখন রানীর সঙ্গে বিয়ের কথা বললাম, তখনো চুপ করে রইলে। মেয়েকে শুধু মনে পড়ে বিপদের সময়ে

জাহানারা কিছু জানতে চায় নি। দাদাজানের মৃত্যুর কারণে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে, সেই ভাঙ্গা বিয়ে আবার কবে জোড়া লাগবে সে ব্যাপারেও কোনো কৌতূহল দেখায় নি। এখন দেখায় নি বলে যে কোনদিন দেখাবে না তা না। এক সময় না এক সময় জানতে চাইবে। রাহেলা তখন কি বলবেন সব ঠিক করে রেখেছেন। তিনি বলবেন, ঐ বিয়ে হবে না। তোর ভাইয়ের বিয়ের দায়িত্ব আমি তোর হাতে দিলাম। মা তুই ব্যবস্থা কর। এটা বলতে তার কোনো অসুবিধা নেই কারণ তিনি জানেন বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙ্গে গেলে সেই বিয়ে আর কখনো হয় না। এটা তিনি যে একা জানেন তা না। সবাই জানে।

তার উপর খবর পাওয়া গেছে মেয়েটা ভয়ঙ্কর অসুস্থ। চিকিৎসার জন্যে হাসপাতালে আছে। এমন অবস্থা যে দেশে চিকিৎসা হচ্ছে না, বিদেশ যেতে হচ্ছে। তড়িঘড়ি করে যে বিয়ে দিতে চাচ্ছিল এই জন্যেই চাচ্ছিল। রোগ গোপন করে মেয়ে পার। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বাতাস না থাকলেও আপনা আপনি নড়ে। আল্লাহর ইশারায় বিয়ে ভেঙ্গে গেল। কাউকে কিছু করতে হলো না, বলতে হলো না।

রাহেলা ঠিক করে রেখেছেন রানীর সঙ্গে ফরহাদের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে এখনো কোনো কথা বলবেন না। চুপচাপ অপেক্ষা করবেন। তার মন আগেও বলেছে বিয়েটা হবে, এখনো বলছে হবে। জাহানারা একটু সাহায্য করলেই হবে। সেই সাহায্য কি জাহানারা করবে? করবে তো বটেই বাপ-ভাই বলে কথা। তবে জাহানারা মনে কষ্ট পেয়েছে। পরে এক সময় মেয়ের সঙ্গে নিরিবিলিতে অনেক কথা বলবেন।

রানী মেয়েটিকে আগে যেমন সুন্দর দেখেছিলেন, এবার তার কাছে আরো সুন্দর লাগছে। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হলেই মেয়েরা সুন্দর হতে থাকে। সবচে বেশি সুন্দর হয় গায়ে হলুদের দিন। বিয়ের রাত থেকে তাদের সৌন্দর্য কমতে শুরু করে। এটা হলো সাধারণ কথা। রানীর বিয়ের কথা শুরু হয়েছে বলেই সে সুন্দর হচ্ছে, এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। এ বাড়িতে এসেই রানীকে তিনি একটা শাড়ি দিয়েছেন। মুরুব্বিরা বেড়াতে এলে কাপড়চোপর, মিষ্টি নিয়ে আসে। সেইভাবে আনা, তবে শাড়িটা নিয়ে তার সামান্য মন খুঁত খুঁত করছে। কারণ এই শাড়ি ফরহাদ তার বউ-এর জন্যে কিনেছিল। সুন্দর করে প্যাকেট করা। ফরহাদকে জিজ্ঞেস না করেই দিয়েছেন। ফরহাদের এসব মনে থাকবে না। এখন তার হচ্ছে মাথার ঘায়ে কুত্তা পাগল অবস্থা।

রানী শাড়ির প্যাকেট হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বলল—শাড়ি কেন?

তিনি মধুর ভঙ্গিতে বললেন, তোমাকে কখনো কিছু দেয়া হয় না। কিছু দিতে ইচ্ছা করে। ফরহাদকে বললাম একটা শাড়ি কিনে দিতে। সে নিজেই পছন্দ করে কিনে এনেছে। বুঝতে পারছি না তোমার পছন্দ হবে কি না।

রানী লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, নতুন শাড়ি পরতে আমার সব সময় ভাললা লাগে।

রাহেলা বললেন, শাড়ি হাতে নিয়ে বোঝা যায় না সুন্দর না অসুন্দর। শাড়ি সুন্দর শরীরে। শাড়িটা পরে আস মা। লাল ব্লাউজ আছে না? লাল ব্লাউজ যে কোনো শাড়ির সঙ্গে মানায়। লাল ব্লাউজ দিয়ে শাড়িটা পর। দেখি তোমাকে মানায় কি-না।

রানী হ্যাঁ সুচক মাথা নেড়ে লজ্জিত এবং আনন্দিত ভঙ্গিতে বের হয়ে গেল।

রাহেলা মেয়েটাকে শাড়ি পরে আসতে বলেছেন কারণ নতুন শাড়ি পরলেই সবাই জানতে চাইবে শাড়িটা কোত্থেকে এসেছে। এটা সবার জানা দরকার। কেউ যেন মনে না করে তিনি আশ্রিতা হিসেবে মেয়ের বাড়িতে উঠেছেন। এতে তার যেমন অপমান। তার মেয়েরও অপমান। তিনি যতদিন থাকবে। খরচাপাতি করে থাকবেন। এমনভাবে খরচ করবেন যেন সবার চোখে পড়ে। কাল পরশু বিশাল একটা কাতল মাছ কিনে আনাবেন।

রানীকে শাড়ি তিনি অনেক বিচার বিবেচনা করেই দিয়েছেন। শুধু শাড়িটা কিনেছে ফরহাদ এই কথাটা না বললে ভালো হত। রানী যদি কোনোদিন ফরহাদকে কিছু জিজ্ঞেস করে তাহলে সমস্যা হবে। আজকালকার মেয়ে, অকারণে কথা বলা এদের স্বভাব। ফরহাদকে দেখে বলে বসতে পারে। আপনি তো ভালো শাড়ি চিনেন। রঙটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আর ফরহাদ এমন গাধা। এ রকম কোনো কথা বললে, সে সঙ্গে সঙ্গে বলবে—কই আমি তো তোমার জন্যে শাড়ি কিনি নি!

রাহেলা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন রানী শাড়ি পরে তাঁকে এসে সালাম করবে। তিনি বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন মেয়েটা এল না। বাড়ির পেছনে কোর্ট কেটে ব্যাডমিন্টন খেলা হচ্ছে। তিনি বারান্দা থেকে দেখলেন রানী ব্যাডমিন্টন খেলছে। তাকে দেখে লজ্জা পাবার মতো ভাবও করল না। রানীর সঙ্গে লম্বামত যে মেয়েটি খেলছে তাকে তিনি চিনতে পারলেন না। এদের কোনো আত্মীয় স্বজন হবে। এখন থেকে এ বাড়ির সবাইকে চিনতে হবে। তাদের আচার আচরণ বিশ্লেষণ করতে হবে। সবার মন যুগিয়ে এমনভাবে চলতে হবে যেন কেউ বুঝতে না পারে তিনি সবার মন যুগিয়ে চলছেন। একবার বুঝে ফেললে–সর্বনাশ।

আশ্রিতের জীবন ভয়াবহ জীবন। এই জীবন সহনীয় করার কোনো ব্যবস্থা নেই। নিজেকে এই পরিবারের কাছে অতি প্রয়োজনীয় করে তুলতে পারলে জীবনযাত্রা সহজ হবে, কিন্তু এমন সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এদের বিরাট পরিবার। অনেক লোকজন। চার পাঁচটা কাজের মেয়ে। নদশ বছর বয়েসী দুটা ছেলে—যাদের একমাত্র কাজ একটু পর পর দোকানে যাওয়া এটা ওটা নিয়ে আসা। বাজার করার লোকও আলাদা। বিশাল বলশালী একজন মানুষ। মাথা কামানো। তাকে দেখলেই মনে হয় কিছুক্ষণ আগে একটা খুন করে এসেছে। পরিশ্রম হয়েছে বলে ক্লান্ত হয়ে চা খাচ্ছে। চা খেয়ে দ্বিতীয় খুনটা করতে যাবে।

রাহেলা এই বাড়ির ভাব ধরার চেষ্টা করছেন। ধরতে পারছেন না। এত সহজে ধরা যাবে না। সময় লাগবে। জাহানারার কাছে শুনেছেন এরা একান্নবর্তি পরিবার। কিন্তু এখন দেখছেন—সবার জন্যে একসঙ্গে রান্না হয় এটা যেমন ঠিক আবার প্রত্যেক পরিবারের আলাদা রান্নাঘর আছে। সেখানেও রান্না হয়। এটাও ঠিক।

রাতে জামাইয়ের সঙ্গে রাহেলার দেখা হলো। জামাই বিনয়ে কাচুমাচু হয়ে বলল, সাভারে গিয়েছিলাম। এই কিছুক্ষণ আগে ফিরেছি। আম্মা খাওয়া দাওয়া হয়েছে।

রাহেলা বললেন, জি বাবা খেয়েছি।

খাওয়া দাওয়ার কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলবেন।

না বাবা অসুবিধা কি হবে।

আমাদের মানুষ বেশি। অসুবিধা হবেই। সবার রুচির দিকে লক্ষ রেখে তো রান্না করা সম্ভব না। এই জন্যে বলে দেয়া আছে—দিনে মাছ, রাতে মাংস।

বাবা আমার কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না। আর কয়েকটা দিনের তো ব্যাপার। মঞ্জু একটা বাড়ি ঠিক করে ফেলেছে। বাথরুমের কিছু কাজ করাবার জন্যে তিন চার দিন নাকি লাগবে।

তিন চার দিন লাগুক, বা তিন চার মাস লাগুক। আম্মা এটা আপনার নিজের বাড়ি। জাহানারা মোবাইলে বলেছিল অফিসের টিভিটা আনতে। সাভার থেকে এসেছি তো মা ভুলে গেছি। কাল সকালে অফিসে গিয়েই টিভি পাঠিয়ে দিব।

বাবা তুমি ব্যস্ত হয়ো না। এটাকি আর টিভি দেখার বয়স? আল্লা আল্লা করে দিন পার করা। তুমি পরিশ্রম করে এসেছ যাও হাত মুখ ধুয়ে খাওয়া দাওয়া কর।

জামাইয়ের কাছ থেকে এরচে ভালো ব্যবহার তিনি আশা করেন নি। ভবিষ্যতে তার জন্যে কি অপেক্ষা করছে তিনি জানেন না। ভবিষ্যৎ খুব সুখের তা মনে হয় না। স্ত্রীর ভবিষ্যৎ স্বামীর সঙ্গে যুক্ত। যেখানে স্বামী থেকেও নেই সেখানে আর ভবিষ্যৎ কি?

রাত দশটার দিকে জাহানারা পানদান নিয়ে উপস্থিত হলো। রাহেলা বললেন, খাওয়া দাওয়া করেছিস?

জাহানারা বসতে বসতে বলল, না। আমার খেতে বসতে বসতে রাত বারটা বাজবে।

রাহেলা পান মুখে দিতে দিতে বললেন, দুপুরের পর থেকে তোর বাবার সঙ্গে দেখা হয় নি। সে আছে কোথায় জানিস।

টিভি দেখছেন।

জামাই-এর বাড়িতে এসে এত টিভি দেখাদেখি কি? ওকে এসে ঘুমুতে বল।

একতলায় ভাইয়াদের জন্যে যে ঘর রেখেছি, বাবা বলেছেন সেখানে থাকবেন।

রাহেলা আঁৎকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশের কথা লোকজন কি বলবে? আমি এক ঘরে সে এক ঘরে। বুড়োকে এক্ষুনি আসতে বল। তোর বাবা বড় যন্ত্রণা করছে।

জাহানারা শান্ত গলায় বলল, বাবা যেখানে থাকতে চাচ্ছেন সেখানে থাকুন। লোকজন কি বলবে এটা নিয়ে তোমাকে এত মাথা ঘামাতে হবে না। এ বাড়ির লোকজন এত মাথা ঘামায় না।

তাই বলে স্বামী-স্ত্রী আলাদা ঘুমুচ্ছে এটা চোখে পড়বে না। সবার চোখে পড়বে।

কার চোখে কি পড়ছে এটা নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছ কেন? তুমি থাক তোমার মতো।

রাহেলা বললেন, তুই এত রাগী রাগী গলায় কথা বলছিস কেন? ঘটনা কি?

এ বাড়িতে পা দেয়ার পর থেকে তুমি ক্রমাগত মিথ্যা বলে যাচ্ছ। এই জন্যে রাগ লাগছে।

কোন মিথ্যা বললাম?

এই যে বলছ বাড়ি ভাড়া হয়েছে। বাথরুম ঠিক হয় নি বলে যেতে পারছ না। ভাইয়ারা তোমাদের হোটেলে রুম ভাড়া করে দিতে চাচ্ছিল। আসল ব্যাপার তো আমি জানি। ভাইয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে। যেখানে তার চাকরি পর্যন্ত নেই সেখানে উদ্ভট কথাবার্তা বলার দরকার কি? তার উপর হুট করে তুমি রানীকে শাড়ি কিনে দিলে কেন? আমার তো মনে হয় এই শাড়িও তুমি নিজে কেন নি। ভাইয়া তার বিয়ের জন্যে যে কটা শাড়ি কিনেছিল তার একটা দিয়ে দিয়েছ।

যদি দিয়েও থাকি তাতে দোষ কি?

দোষ আছে। যখন তোমাকে বলেছিলাম রানীর সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও তখন পা ভারী হয়ে গিয়েছিল—এক পরিবারে বিয়ে, নতুন আত্মীয় হবে না। কত রকম কথা। আজ যখন দেখছ সাত হাত পানির নিচে চলে গেছে তখন রাতারাতি শাড়ি।

শাড়িটা আমি আদর করে দিয়েছি। বিয়ের ব্যাপার আমার মাথার মধ্যে নেই।

আদর করে তুমি কিছু দাও নি। এত আদর মা তোমার মধ্যে নেই। তোমার মাথায় সব সময় নানান রকম পরিকল্পনা থাকে। এখানে আমাকে না জানিয়ে কোনো পরিকল্পনা করবে না। রানীর সঙ্গে ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে কোনো কথা বলবে না। তার বিয়ের মোটামুটি পাকা কথা হয়ে গেছে। এই বৃহস্পতিবারের পরের বৃহস্পতিবারে পানচিনি হবে। ছেলে ব্যাংকার। মেয়ে দেখে পছন্দ করে গেছে।

রাহেলা ক্ষীণ স্বরে বললেন, ফরহাদের ব্যাপারে তাদের আর আগ্রহ নেই।

জাহানারা বিরক্ত গলায় বলল, তোমার যত বয়স হচ্ছে ততই কি বুদ্ধিসুদ্ধি কমে যাচ্ছে যে ছেলে বিয়ে করতে যাচ্ছিল, কোনো একটা সমস্যায় হঠাৎ বিয়ের তারিখ পাল্টেছে তার ব্যাপারে আগ্রহ কেন থাকবে বাজারে কি ছেলে কম পড়েছে?

ফরহাদের বিয়েটা তো আর হচ্ছে না।

ঐ প্রসঙ্গ নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে আর কথা বলতে চাচ্ছি না। তুমি এখন এসো আমার সঙ্গে।

কোথায় যাব?

আমার শাশুড়ি তোমাকে ডাকছেন?

এত রাতে কি ব্যাপার?

এ বাড়ির লোকজন কেউ রাত একটার আগে ঘুমুতে যায় না। কাজেই তাদের হিসেবে রাত বেশী হয় নি। আমার শাশুড়ির কাছে প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে আক্তারী খানম নামের এক মহিলা আসেন। তিনি ধর্ম নিয়ে কথাটথা বলেন। জিগির করেন। আমার শাশুড়ি এই মহিলার খুব ভক্ত।

আমি তো ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলেছি।

বেশিক্ষণ থাকার দরকার নেই। উনার সঙ্গে দেখা করে চলে এসো।

রাহেলা বিছানা থেকে উঠতে উঠতে কোমল গলায় বললেন, তুই আমার উপর এত রেগে আছিস কেন রে মা? ভুল ত্রুটি আমার আছে। বয়স হয়েছে ভুল ত্রুটি হবে না?

জাহানারা ক্লান্ত গলায় বলল, আমি মোটেও রেগে নেই। তোমাদের অবস্থা দেখে খারাপ লাগছে। তোমরা কোন অবস্থায় পৌঁছেছ সেই সম্পর্কে তোমাদের কোনো ধারণাও নেই। দিব্যি বড় বড় কথা বলে বেড়াচ্ছ। বাবা মহাসুখে টিভিতে ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠান দেখছেন।

তোর বাবার কথা ভিন্ন। ওর মাথারই ঠিক নেই।

মাথা তোমাদের কারোরই ঠিক নেই মা।

জাহানারা মাকে তার শাশুড়ির ঘরে পৌঁছে দিয়ে বাবার সন্ধানে গেল। জোবেদ আলি টিভির অনুষ্ঠান শেষ করে ঘুমুতে এসেছেন। তাঁর মন আজ সামান্য ভালো। ঘুমুবার জন্যে একা একটা ঘর পেয়েছেন। নিশ্চিন্ত মনে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট খাওয়া যাবে। কারোর কিছু বলার থাকবে না। অনেক দিন পর টিভি দেখলেন। ভালো লাগল। এ বাড়ির লোকজনদেরও তার পছন্দ হয়েছে। সবাই বেশ হাসি খুশি। গাছপালা বিষয়ে যার সঙ্গেই তিনি কথা বলছেন সেই মন দিয়ে শুনেছে। একজন তো বলেই ফেলল—চাচা আপনি ঐ জাপানি গাছের একটা চারা এনে দিন তো টবে লাগাব। টবে হয়তো। কথাটা যে বলেছে তাকে তিনি চেনেন না। তবে যেই বলুক সে জাহানারার শ্বশুর বাড়ির। কাজেই তার কথার মর্যাদা রক্ষার জন্যে একটা চারা কাল সকালেই আনতে হবে। চারার দাম বাবত তার কাছ থেকে টাকা চাওয়া যায় না। কিন্তু তার নিজের হাত একেবারেই খালি। মঞ্জু বা ফরহাদের কাছে যে টাকা চাইবেন সে উপায় নেই। তারা কোথায় থাকে তিনি জানেন না। এটা একটা ভুল হয়েছে। এরা কে কোথায় থাকে তা জেনে আসা দরকার ছিল। কখন কী প্রয়োজন পড়ে। রাহেলার কাছে টাকা আছে তা তিনি জানেন। থাকলেও কোনো লাভ হবে না। তিনি যদি রাহেলার পা ধরেও বসে থাকেন তাতেও কিছু হবে না। জাহানারার কাছ থেকে ধার হিসেবে নিয়ে নেয়া যায়। বাবা তার মেয়ের কাছে ধার চাইতেই পারে। এতে লজ্জা বা অপমানের কিছু নেই। ধার নিয়ে ফেরত না দেয়াটা লজ্জার। তিনি ফেরত তো দেবেনই। ফরহাদের সঙ্গে যেদিন দেখা হবে তার পরদিনই ফেরত দেবেন।

বাবা পান খাবে?

জোবেদ আলি আনন্দিত চোখে মেয়েকে দেখলেন। তিনি পান খান না। তারপরেও আগ্রহের সঙ্গে পান নিতে নিতে বললেন মা শোন আমাকে সামান্য কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?

কত টাকা?

আড়াইশ। চারা কিনব, দুশ টাকা দাম। টবের মাটি তৈরির কিছু খরচ আছে। কয়েক পদের সার দিতে হবে, পটাশ, ইউরিয়া। ক্যামিকেল পটাশ দিব না। হাড়ের গুড়া পাওয়া যায়। তাই দেব। নার্সারীতে আসা যাওয়ার রিকশা ভাড়া আছে। সেটা ধরছি না। কারণ আমি রিকশায় উঠি না বললেই হয়। হাঁটি, এতে টাকা বাঁচে আবার ব্যায়ামও হয়। আমার যে বয়স এতে ব্যায়ামটা খুবই দরকার। এই বয়সে কুন্তীর আখড়ায় ভর্তি হওয়াতে সম্ভব না। হাঁটাহাঁটিটা সম্ভব। সেটাই করি। হা হা হা।

জাহানারা বিস্মিত হয়ে বাবাকে দেখছে। তার কাছে মনে হচ্ছে মা যে একটু আগে বলেছেন মানুষটার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে সেটা খুবই সত্যি।

বাবা টাকাটা কি তোমার এখনই দরকার?

না এখন দরকার নেই। সকালে দিলেও হবে। আর মা শোন আরেকটা কথা। জামাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে দেখিস তো—তাদের এত বড় বাড়ি, পেছনে এত জায়গা খামাখা পড়ে আছে।

তুমি বাগান করবে?

কোনো অসুবিধা নেই—আমার একটা কোদাল লাগবে, একটা খুরপাই, পানি দেয়ার জন্যে ঝাঝড়ি। দামটা হিসাব করি—একটা কোদাল একশ টাকা, খুরপাই পঁচিশ, ঝাঝড়ি একশ। মাত্র দুই আড়াইশ টাকার মামলা। চারা কিনতে হবে। সেটার খরচ আলাদা। নার্সারীওয়ালাদের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। নাম মাত্র মূল্যে চারা এনে দিব। বাড়ির সামনে ফুলের বাগান। পিছনে ফলের। তবে বাড়ির সামনে কিছু নারিকেল গাছ লাগিয়ে দেব। এই ধর পঞ্চাশটা নারিকেল গাছ। নিউনেশান নার্সারীতে কেরালা থেকে নারিকেল চারা এসেছে। গাছ বেশি বড় হয়

তবে দুই বছরে ফল দিবে। বছরে একেকটা গাছ থেকে তুই খুব কম করে হলেও দুশ নারিকেল পাবি। একেকটা নারিকেল পঞ্চাশ টাকা করে ধরলে কত হয়? চট করে হিসাব করে বল তো- দুশ গুণন পঞ্চাশ। কত হয়? আজকাল আর বড় বড় হিসাব কাগজ কলম ছাড়া করতে পারি না।

জোবেদ আলি উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করছেন। জাহানারা ভাবছে আর দেরী করা ঠিক হবে না। তার বাবাকে অতি দ্রুত কোনো ভালো ডাক্তার দেখাতে হবে।

 

রাহেলাকে দেখে মনে হবে তিনি গভীর আগ্রহে আক্তারী বেগমের কথা শুনছেন। আসলে তা না। ঘুমের অষুধ খাবার কারণে ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। তিনি চেষ্টা করছেন জেগে থাকতে। যে ঘরে বসেছেন—সেই ঘরের দরজা জানালা বন্ধ। আগরবাতি জ্বলছে। আগরবাতি ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। জাহানারার শাশুড়ি আবার ঘরে ঢুকা মাত্র হাতের চেটোয় আতর ঘসে দিয়েছেন। আতরের কড়া গন্ধও শরীর যেন কেমন করছে। ঘরটা ছোট সেই তুলনায় অনেক মহিলা বসে আছেন। শুধু যে এ বাড়ির মহিলারাই আছেন তা না, মনে হয় বাইরে থেকেও কেউ কেউ এসেছেন।

আক্তারী বেগম মহিলাদের মধ্যে বসে থাকলেও বোরকা পরে আছেন। কালো বোরকার ভেতর থেকে তার চোখ শুধু দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটা বড় বড় এবং শান্ত। তিনি মিষ্টি গলায় কবরের আজাবের কথা বলছেন। বেনামাজীর কি শাস্তি কবরে হবে তার বর্ণনা।

কবরে বেনামাজীর কি শাস্তি জানেন? সুজা আকরার সঙ্গে বেনামাজীর দেখা হবে কবরে। সুজা আকরা কে জানেন? সুজা আকরা একটা সাপের নাম। অজগর সাপ। সেই সাপ মানুষের মতো কথা বলবে। সাপটা পৃথিবীর সাপের মতো না। অন্য রকম। এই সাপের নখ আছে। কত বড় নখ শুনবেন? একজন মানুষ একদিনে যত পথে হাঁটতে পারে তত বড়। অর্থাৎ প্রায় চল্লিশ মাইল। এই সাপ বেনামাজীর গায়ে নখ দিয়ে আঘাত করবে। এক একটা আঘাতে বেনামাজী মাটির নিচে পঞ্চাশ গজ ডেবে যাবে। বুঝেন অবস্থা।

শাস্তি আরো আছে—কবর আপনি যত বড় করেই বানান-বেনামাজীর কবর ছোট হতে থাকে। কবর শরীরের উপর চাপ দেয়। কেমন সেই চাপ? এমন চাপ যে পাজরের বাম দিকের হাড় চলে আসে ডানদিকে। আর ডানদিকের হাড় চলে যায় বাম দিকে।…

রাহেলা বেগম ঘুম কাটানোর অনেক চেষ্টা করছেন। ধর্মীয় আসরের মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়া খুবই অন্যায় হবে। এই আসর কখন ভাঙ্গবে কে জানে। সুজা আকরা নামের সাপটা নিয়ে তিনি এই মুহূর্তে কোনো চিন্তা করছে না। সময় আসুক তখন দেখা যাবে। আপাতত যে কাজটা করতে হবে তা হচ্ছে জেগে থাকা…।

রানী মেয়েটাও সুজা আকরা সাপের কথা শুনছে। তবে মাঝেমধ্যে ফিক ফিক করে হাসছে। মেয়েটা তার দেয়া শাড়িটা পরল না কেন? রঙ পছন্দ হয়নি? না-কি মেয়েটা তাকে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছে—খাতির করতে এসো না।

রাণী মন খারাপ করে ঘুমুতে গেছে

রাণী মন খারাপ করে ঘুমুতে গেছে। ঘুমুতে যাবার আগে সবার সঙ্গে কিছুক্ষণ রাগারাগি করেছে। সবচে বেশি করেছে তার ভাবীর সঙ্গে। রাণীর একটা সুবিধা আছে যার সঙ্গে সে রাগারাগি করে সে সেটা বুঝতে পারে না। সে ভাবে নিতান্তই স্বাভাবিক ভাবে কিছু কথা বলা হল। কারণ ঝগড়া করার সময় রাণীর মুখ হাসিখুশি থাকে। এ রকম স্বভাব তার আগে ছিল না। আগে রাগারাগির সময় তার মুখ লাল হয়ে যেত। হাত পা কাঁপতে থাকত। কলেজে ভর্তি হবার পর হঠাৎ একদিন মনে হল, আচ্ছা রাগারাগি হাসিমুখে করা যায় না। কঠিন কঠিন কথা হেসে গড়িয়ে পড়তে পড়তে বললে কেমন হয়? সেই থেকে সে নতুন পদ্ধতি চেষ্টা করে যাচ্ছে। শুরুতে পদ্ধতিটা ঠিকমত প্রয়োগ করা যেত না। এখন যায়। রাণী নিজেই নিজের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়। আজও হয়েছে। জাহানারাকে সে হাসতে হাসতে কঠিন কিছু কথা বলেছে। এই কথাগুলিই না হেসে সে যদি শুধু স্বাভাবিক গলায় বলতো তা হলে জাহানারা নিশ্চয়ই কেঁদে ফেলত।

রাণী রাতের খাওয়া শেষ করে তার ঘরে গিয়েছে। দাঁত মাজবে। মুখে ফেস ক্রিম দিয়ে গল্পের বই নিয়ে বিছানায় যাবে। গল্পের বই পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পরবে। রাতে আবার যখন ঘুম ভাঙ্গবে তখন বাতি নেভাবে। এই হল পরিকল্পনা। তখন জাহানারা ঢুকল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, এই তোর কাছে রিলাক্সেন জাতীয় কোন ট্যাবলেট থাকলে দেতো।

ভাবটা এ রকম যেন ট্যাবলেট নিয়েই ভাবী চলে যাবে। তার এক মুহূর্ত দাঁড়াবার সময় নেই। অথচ রাণী খুব ভাল করে জানে জাহানারা কোন প্ল্যান নিয়ে এসেছে। এবং এসেছে দীর্ঘ সময় কাটাতে। রাণী ভাবীর সঙ্গে রাগারাগি করার জন্যে মনে মনে তৈরী হল। সে মুখটা হাসি হাসি করে ফেলল। এবং এক ফাঁকে দেখেও ফেলল তার হাসিমুখ আয়নায় কেমন দেখাচ্ছে। সুন্দর দেখাচ্ছে তবে ঠোটে লিপস্টিক থাকলে আরো সুন্দর দেখাতো। সে হাসতে হাসতে বলল, ভাবী এ জাতীয় কোন ট্যাবলেট আমার কাছে নেই! ভিটামিন ট্যাবলেট আছে অ্যারিস্টোভিট বি। ওটা দেব।

ভিটামিন ট্যাবলেট দিয়ে আমি কি করব?

খাবে। মানুষের শরীরে ভিটামিন দরকার আছে না। তোমারতো আরো অনেক বেশি দরকার। এত টেনশান নিয়ে বাস করছ।

আমার কিসের টেনশান?

রাণীর মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হল। সে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। তার পরিকল্পনা হচ্ছে কথা বলার এক ফাঁকে সে চট করে ঠোটে লিপস্টিক দিয়ে দেবে। এমন ভাবে দেবে যেন ভাবী হঠাৎ গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিকের হাসি দেখব। রাণী ড্রেসিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসেছে। সে বসেছে জাহানারাকে পেছনে রেখে। জাহানারা এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল এখন বসল। তার অর্থ হচ্ছে জাহানারা বেশ কিছুক্ষণ থাকবে।

জাহানারা বলল, তোর কথা ক্লিয়ার কর। আমার কিসের টেনশান?

তোমার বড় ভাইয়ের বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে টেনশান।

আমি তোর কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাইয়ার বিয়ের কি জটিলতা?

জাহানারা জবাব দিল না। আয়নায় তার লাল ঠোটের হাসি দেখে নিজেই মুগ্ধ হল।

তুই এই লিপস্টিক কখন দিলি।

রাণী খিলখিল করে হাসল। তার হাসি দেখে মনে হবার কোনই কারণ নেই যে এই মুহূর্তে রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে।

হাসছিস কেন বল ভাইয়ার বিয়ের কি জটিলতা?

এক সময় আমি শুনলাম তাঁর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা প্রায় ফাইন্যাল। বিয়ের বাজার করতে তুমি কোলকাতা যাবে এবং আমাকেও নিয়ে যাবে এরকম কথাও হল। আমি খুব খুশি—তোমার ভাইয়া ভ্যাবদা ধরনের মানুষ। এরা বর হিসেবে ভাল হয়। ক্যাঙ্গারুর বাচ্চার মত সারাজীবন স্ত্রীর থলির ভেতর থাকে। মাঝে মধ্যে থলির ভেতর থেকে মাথাটা বের করে আবার সুড়ৎ করে ঢুকে পরে…।

কি ভ্যার ভ্যার করছিস। আসল কথা বল।

আসল কথা হচ্ছে আমি যখন বিয়ে নিয়ে মোটামুটি নিশ্চিত। বাসর রাতে বরের সঙ্গে কি কথা টথা বলব সে সব নিয়ে রিহার্সেল দিচ্ছি তখন হঠাৎ শুনি তিনি অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করতে রওনা হয়েছেন। আকাশী না-কি ফাকাশী এই রকম নাম।

জাহানারা গম্ভীর গলায় বলল, তুই যেমন হঠাৎ করে ভাইয়ার বিয়ের কথা শুনেছিস। আমরাও হঠাৎ করে শুনেছি। বাসার কেউ জানত না। ভাইয়া কাউকে কিছু বলে নি। আসলে ওরা ট্রিকস করে অসুস্থ একটা মেয়েকে পার করতে চেয়েছিল। মেয়ের এক মামা মহাচালবাজ। ভাইয়া সহজ সাধারণ মানুষ, ঐ ধুরন্ধরের চাল কিছু বুঝতে পারে নি। ফাদে পড়ে বিয়েতে রাজি হয়েছে। বিয়ের ব্যাপারটা জানাজানি হলে সমস্যা হবে এই জন্যে ওরা এমন চাল চেলেছে যে ভাইয়া কাউকে জানায়ও নি। ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। বিয়ে ঠিকই ভেঙ্গেছে।

রাণী বলল, শুধু যে ভেঙ্গেছে তাই না। কনের এমন অসুখ সে যে কোনদিন বিয়ের শাড়ি পরবে সেই আশাও নেই। ঠিক না ভাবী?

ঠিকতো বটেই। মেয়ের ক্যানসার হয়েছে। বড়জোড় এক দু বছর।

রাণী হাসতে হাসতে বলল, তাহলে কি আমি এক দু বছর অপেক্ষা করব? এত দিন অপেক্ষা করাওতো মুশকিল ভাবী। দেখা যাবে অন্য কোন মেয়ের ধুরন্ধর মামা তোমার ভাইয়াকে ভজিয়ে ভাজিয়ে বিয়ে করাতে নিয়ে যাবে। সেই মেয়েও অসুস্থ–হাঁপানীর রোগী। অসুস্থ মেয়েকে ট্রিকস করে পার করে দেয়া।

তোর হয়েছে কি হঠাৎ এইসব কথা আমাকে বলছিস কেন?

রাণী কিছুক্ষণ খিলখিল করে হাসল। এমন হাসি যে তার প্রায় হেঁচকি উঠে গেল। হাসি থামিয়ে বলল—একটা কাজ করলে কেমন হয় ভাবী। চল আমরা আক্তারী বেগমকে বলি যেন উনি একটা স্পেশাল দোয়ার ব্যবস্থা করেন যাতে আকাশী ম্যাডামের যন্ত্রণার দ্রুত সমাপ্তি হয়। তিনি যেন মাস তিনেকের মধ্যে সিন থেকে বিদেয় হন। আর আমরা ধুমধাম করে বিয়েটা করতে পারি।

হঠাৎ করে আমাকে এইসব কথা বলার কারণ কি?

কারণ হচ্ছে তুমি এই লাইনে চিন্তা করছ।

মেয়েটা মরে যাক আমি এই চিন্তা করছি?

তুমি চিন্তা করছ যেন তোমার ভাইয়ার সঙ্গে আমার ভেঙ্গে যাওয়া বিয়েটা আবার জোড়া লাগে।

পাগলের মত এইসব কি বলছিস?

খুবই সত্যি কথা বলছি। তুমি নিজেও জান এটা সত্যি কথা। জান না?

না জানি না।

মাঐমা হঠাৎ করে আমাকে একটা শাড়ি উপহার দিয়েছেন।

আমার মা তোকে একটা শাড়ি দিতে পারেন না?

উনি বলেছেন ফরহাদ ভাই শাড়িটা আমার জন্যে কিনে এনেছেন।

মাতো আর বাজারে গিয়ে শাড়ি কিনবে না। তার যা কেনাকাটা তা ভাইয়াকে দিয়েই করাতে হয়।

আমি শাড়ির প্যাকেট খুলে দেখি—শাড়িটা তোমার ভাই তার হবু স্ত্রী আকাশীর জন্যে কিনেছে।

শাড়িতে বুঝি তার নাম লেখা ছিল?

রাণী হাসতে হাসতে বলল, নাম লেখা ছিল না। তবে একটা চিঠি ছিল। আবেগপূর্ণ চিঠিটা পড়বে?

জাহানারা তাকিয়ে আছে। রাণী বলল, ভাবী তোমাকে একটা কথা বলতে চাচ্ছি—তোমার ভাইয়াকে আমার খুবই অপছন্দ। তোমরা যখন তার সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা শুরু করলে তখনই রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছিল। যেহেতু আমি খুবই শান্ত এবং টাইপ মেয়ে সেহেতু চুপ করে ছিলাম। মনে মনে ভেবেছি–কি আর করা। কপালে যা আছে হবে। সেই ব্যাপার তোমরা আবার শুরু করেছ। এখন আর রাগ লাগছে না। এখন মজা লাগছে।

জাহানারা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোর সঙ্গে এই নিয়ে পরে কথা হবে।

ভিটামিন ট্যাবলেট দেব ভাবী?।

জাহানারা গম্ভীর মুখে চলে গেল। রাণী ঠোটের লিপস্টিক মুছল। হাত মুখ ধুয়ে গল্পের বই নিয়ে বিছানায় চলে গেল। গল্পের বইয়ের ভেতরে ফরহাদ ভাইয়ের চিঠিটা আছে। গল্পের বই পড়া শুরু করার আগে চিঠিটা কি আরেকবার পড়বে? চিঠিতে এমন কিছু নেই কিন্তু পড়তে গেলে হঠাৎ করে কেন জানি মন খারাপ হয়–

আসমানী,

তোমাকে বিয়ের শাড়ি হিসেবে খুব সস্তা ধরনের শাড়ি দিচ্ছি। সস্তা শাড়ি কেনার একমাত্র কারণ অর্থনৈতিক। আমার ভয়ংকর দরিদ্র অবস্থা দেখে তুমি যে কত বড় ধাক্কা খাবে সেটা ভেবে খুব আতংকগ্রস্ত।

শাড়িটা সস্তা হলেও রঙটা খুব সুন্দর। তুমি হচ্ছ আসমানী। আমি অনেক খুঁজে খুঁজে আসমানী রঙের শাড়িটা বের করলাম। শাড়িটা যখন পড়বে তখন মনে হবে এক টুকরা আকাশ পৃথিবীতে নেমে এসেছে। আসমানী এখন বলতো একটা গাছে দশটা পাখি ছয়টা উড়ে গেল কটা থাকল?

রাণী চিঠি বইয়ের ভেতর রেখে চিঠির ধাঁধার রহস্য বের করার চেষ্টা করতে লাগল। এই ধাঁধার অর্থ কি? এটা ধাঁধা না কোড ল্যাংগুয়েজ? খুব ইচ্ছা করছে ফরহাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করতে। সেটা সম্ভব না।

রাণীর মন খারাপ হওয়া শুরু হয়েছে। তার ভয় লাগছে। একবার তার মন খারাপ হওয়া শুরু করলে দ্রুত মন খারাপ হতে থাকে। এবং এক সময় এত বেশি মন খারাপ হয় যে বাথরুমের দরজা বন্ধ করে একগাদা ঘুমের অষুধ খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছাটা এত প্রবল যে ইচ্ছাটা চলে যাবার পরেও তার হাত পা কাঁপতে থাকে। শরীর ঘামতে থাকে। সে জানে এটা ভয়ংকর কোন অসুখ। এই অসুখ থেকে তার মুক্তি নেই।

খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। ফরহাদ নামের একজন মানুষ তার ভেতরে এই অসুখটা তৈরী করে দিয়েছে। যে অসুখটা তৈরী করেছে সে কিন্তু কিছুই জানে না। তার জানার কোন কারণও নেই। এবং সে কোনদিনও জানবে না। কোন একদিন হয়ত সে খবর পাবে রাণী নামের একটা মেয়ে বাথরুমে মারা গেছে। বাথরুমের দরজা ভেঙ্গে ডেড বডি বের করতে হয়েছে। মানুষটা হয়ত সৌজন্যবশত মরা বাড়িতে আসবে। দুএকটা সান্তনার কথা বলবে হায়াত মউত আল্লাহর হাতে। সব মানুষকে একদিন মরতে হবে ইত্যাদি। মানুষটা জানবেও না রাণী নামের এত ভাল একটা মেয়ে কেন শুধু শুধু মরে গেল? কারণ সে কোন চিঠিপত্র লিখে যাবে না।

তবে চিঠি লিখতে পারলে সে খুব গুছিয়ে লিখে বলতে পারত কি করে ফরহাদ নামের খুবই সাধারণ একজন মানুষ তার ভেতরে এত বড় সমস্যার সৃষ্টি করল। চিঠিটা সে ফরহাদকেই লিখত। সুন্দর খামে ভরে রাখত। বাসর রাতে মিষ্টি মিষ্টি কথা না বলে গম্ভীর মুখে বরের হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দেয়া। বিয়েই হচ্ছে না। কিসের বাসর, কিসের চিঠি। ঘটনাটা এরকম—

রাণী যথারীতি কলেজে গিয়েছে। গাড়ি তাকে কলেজ গেটে নামিয়ে চলে গেছে। অন্য দিনের চেয়ে আজ তার সাজগোজ সামান্য বেশি। শাড়ি পরেছে, কপালে টিপ দিয়েছে। প্রিন্সিপ্যাল আপা বলে দিয়েছেন কলেজের মেয়েরা ঠোটে লিপস্টিক দিতে পারবে না। তারপরেও সে হালকা করে লিপস্টিক দিয়েছে। কারণ আজ তার অতিপ্রিয় বান্ধবী রীতার জন্মদিন। ক্লাসের শেষে তারা দলবেধে গুলশানে যাবে। গুলশানে একটা দোকানে সাউদার্ন ফ্রায়েড চিকেন খাওয়া হবে। তারপর রীতার বাসায় যাওয়া হবে। সেখানেও অনেক হৈ চৈ এর ব্যবস্থা। সেলিম চৌধুরী নামের এক গায়ককে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি হাসন রাজার গান করবেন।

রাণী কলেজে ঢুকতে গিয়ে দেখে গেট বন্ধ। দারোয়ান বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সে বলল, আপা তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান। শহরের অবস্থা ভাল না। গন্ডগোল হবে। বিরাট গন্ডগোল।

কিসের গন্ডগোল?

কিসের গন্ডগোল বলতে পারব না। বাসায় চলে যান।

রাণী কি করবে বুঝতে পারছে না। রীতার জন্যে কি অপেক্ষা করবে? ক্লাসের মেয়েরাও অবশ্যই আসবে। গন্ডগোলের কথা তারা নিশ্চয় জানে না, কলেজে এসে জানবে। রাণী আবারো গেটের কাছে ফিরে গেল। দারোয়ানকে বললে সে যদি ছোট গেটটা খুলে দেয়। তাহলে সে কলেজ কম্পাউন্ডের ভেতরে অপেক্ষা করতে পারবে। প্রিন্সিপাল আপার অফিস থেকে টেলিফোন করা যেতে পারে। বড় ভাইজানের অফিসে টেলিফোন করলে তিনি গাড়ি পাঠিয়ে দিবেন।

গেট পর্যন্ত যাবার আগেই হঠাৎ করে ভয়াবহ ঝামেলা শুরু হয়ে গেল। নিউ মার্কেটের দিক থেকে চোখের নিমিষে একটা জঙ্গী মিছিল চলে এল। বিকট শব্দে কয়েকটা বোমা পড়ল। গাড়ির কাচ ভাঙ্গা-ভাঙ্গি শুরু হয়ে গেল। মিছিলের লোকজনের হাতে বড় বড় বাঁশ। অনেকের হাতে কেরোসিনের টিন। গাড়ি ভেঙ্গে গাড়িতে আগুন দেবার ব্যবস্থা। বাঁশ হাতে লোকগুলি এমন ভাবে ছোটাছুটি করছে যেন এরা মানুষ না। অতি হিংস্র ভয়ংকর কোন প্রাণী।

লোকজন যে যেদিকে পারছে ছুটছে। একটা লোক বাশ হাতে রাণীর দিকে আসছে। রাণীর মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবে। আর তখনি সে দেখে ফরহাদকে। অবাক হয়ে ফরহাদ ভাই জঙ্গী মিছিল দেখছেন। অবাক হয়ে দেখার মতই দৃশ্য। একটা বাস পুড়ছে। বাস ভর্তি লোকজন। বাস থেকে তারা লাফিয়ে নামার চেষ্টা করছে।

রাণী ছুটে এসে ফরহাদকে বলল, আপনি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিন। আমি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি।

ততক্ষণে উল্টো দিক থেকে আর একটা মিছিল আসতে শুরু করেছে। সেই মিছিলে মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। তারা আসছে ধীরে ধীরে তবে এই মিছিল মনে হচ্ছে আগেরটার চেয়েও ভয়াবহ। কারণ এদের কয়েক জনের হাতে খোলা বন্দুক। দিনের বেলায়ও হাতে মশাল।

ফরহাদ রাণীকে বলল, চলুন কোন একটা গলিতে ঢুকে পড়ি।

রাণী কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চলুন। আমি হাঁটতে পারছি না। আমার শরীর শক্ত হয়ে গেছে।

ফরহাদ তাকে নিয়ে প্রথমে একটা গলিতে ঢুকল। সেখান থেকে অন্য একটা গলি দিয়ে বড় রাস্তায়। সেই রাস্তায় কোন গন্ডগোল নেই, সব স্বাভাবিক। দোকান পাট খোলা। একটা দোকানে আবার হিন্দী গানও হচ্ছে। রিক্সা চলছে। ফরহাদ বলল, আপনার ভয় কি একটু কমেছে?

রাণী বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল। ফরহাদ ভাই আসলে তাকে এতক্ষণ চিনতে পারেন নি। তাকে অন্য কোন মেয়ে ভাবছেন বলেই আপনি আপনি করে বলছেন। ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে তার খুব বেশি দেখা হয় নি তার পরেও চিনতে না পারার তো কথা না। রাণী শাড়ি পরেছে বলে কি তাকে অন্য রকম লাগছে?

ফরহাদ বলল, আপনাকে এখন একটা রিক্সা করে দিলে আপনি বাসায় যেতে পারবেন না?

রাণী বলল, পারব না। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। তার আগে আমি এক গ্লাস পানি খাব।

ফরহাদ বলল, আপনার বাসা কোন দিকে?

এই প্রশ্নে রাণী পুরোপুরি নিশ্চিত হল ফরহাদ ভাই তাকে মোটেই চিনতে পারেন নি। ব্যাপারটা খুবই মজার। এত পরিচিত একজন মানুষ তাকে চিনতে পারছে না। আশ্চর্যতো!

রাণী বলল, খালি পায়ে আমি বাসায় যেতেও পারব না। আমাকে আপনি দয়া করে কোন একটা জুতার দোকানে নিয়ে যান। আমি একজোড়া স্যান্ডেল কিনব।

আগের স্যান্ডেল কোথায়?

কে জানে কোথায়। আমি স্যান্ডেল ফেলেই দৌড় দিয়েছি।

আপনার ভয় কি কমেছে?

সামান্য কমেছে। পুরোপুরি কমেনি। খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। এক গ্লাস পানি খাব আর স্যান্ডেল কিনব।

স্যান্ডেল না কিনলে হয় না? যে কোন সময় গন্ডগোল শুরু হবে।

শুরু হলেও এখন আমার ভয় লাগবে না। আপনার কি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে কোন আপত্তি আছে?

একটা রিক্সা নিন, আমি খালি পায়ে হাঁটতে পারছি না। এখন পানি না খেলেও হবে। আমার পিপাসা মরে গেছে।

ফরহাদকে দেখে মনে হল সে খুব অস্বস্তি বোধ করছে। রিক্সায় বসেছে খুব। সাবধানে যেন কিছুতেই গায়ের সঙ্গে গা লেগে না যায়। কেমন ব্ৰিত ভঙ্গিতে চারদিকে তাকাচ্ছে। মানুষটা মনে হয় কখনো কোন তরুণী মেয়েকে নিয়ে রিকশায় উঠে নি।

রাস্তায় আইসক্রীমওয়ালার এক ভ্যান গাড়ি দেখা গেল। রাণীকে অবাক করে দিয়ে ফরহাদ বলল, আইসক্রীম খাবেন?

রাণী আইসক্রীম কখনো খায় না। প্রথমত আইসক্রীম খেতে তার ভাল লাগে না। দ্বিতীয়ত তার টনসিলের সমস্যা আছে। ঠাণ্ডা কিছু খেলেই তার গলা ফুলে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে। তারপরেও সে স্বাভাবিক গলায় বলল, হ্যাঁ আইসক্রীম 3791

রাণী সেদিন বেশ কিছু কাণ্ড করল যেমন, স্যান্ডেল কেনার পর তার মনে হল, তার লেখার বল পয়েন্ট নেই। বল পয়েন্ট কিনতে হবে। সে ফরহাদকে নিয়ে বল পয়েন্ট কিনতে গেল। তারপর মনে হল রীতার জন্যে গিফট কেনা হয় নি। গিফট এবং ফুলের তোড়া কিনতে হবে। সে ফরহাদকে সঙ্গে নিয়ে গিফট কিনল। তারপর ফরহাদকে বলল তাকে রীতার বাসায় পৌঁছে দিতে।

রীতাদের বাসায় যাবার সারা পথটা রাণী গল্প করল। নানান গল্প–

আমি এখন যেখানে যাচ্ছি সেটা আমার বাসা না। আমার বন্ধুর বাসা। ওরা নাম রীতা। আজ রীতার জন্মদিন। রীতাদের বাসা থেকে আমি বড় ভাইজানকে টেলিফোন করব। তিনি গাড়ি দিয়ে নিয়ে যাবেন। রীতার বাবাকে আমরা কি ডাকি জানেন? আমরা ডাকি ফুটবল কোচ। কেন ডাকি জানেন? কারণ রীতারা এগারো ভাই বোন। এই সময়ে কোন ভদ্রলোকের এগারো ছেলে-মেয়ের কথা কখনো শুনেছেন? রীতার বাবার দলে এগারো জন প্লেয়ার আছে বলেই ওনাকে আমরা ডাকি ফুটবল কোচ। নামটা ভাল হয়েছে না?

হুঁ।

আচ্ছা শুনুন। আপনিও চলুন না রীতাদের বাসায়?

আমি আমি কেন?

ওদের বাড়িতে অনেক মজা হবে। গানের আসর হবে। সেলিম চৌধুরী নামে একজন গায়ককে খবর দেয়া হয়েছে। উনি হাসন রাজার গান শুনাবেন। আপনি কি হাসন রাজার গান শুনেছেন।

একটা দুটা শুনেছি।

হাসন রাজার আসল নাম কিন্তু হাসন রেজা। রেজা নাম তার পছন্দ হল না। তিনি সবাইকে বলে দিলেন—আমাকে এখন থেকে কেউ রেজা ডাকবে না। আমাকে ডাকতে হবে রাজা। সেই থেকে তিনি রাজা।

ও।

রীতাদের বাসার সামনে বেবীটেক্সি থেকে নামার সময় একবার রাণীর ইচ্ছা হল নিজের পরিচয় দিতে। তারপরেই মনে হল —থাক কি দরকার। কোন এক সময় মানুষটাকে এই ঘটনা বলে চমকে দেয়া যাবে।

তার পরপরই রাণীর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। তার বড় ভাই আসগর সাহেব বোনের বিয়ের পাকা কথা দিয়ে ফেলেন। ছেলে ডাক্তার। ছেলের বাবা বড় ব্যবসায়ী। ব্যবসা সূত্রে ছেলের বাবার সঙ্গে আসগর সাহেবের পরিচয়।

ছেলে তার বন্ধু বান্ধব নিয়ে মেয়ে দেখে গেল। মেয়ে তাদের পছন্দ। যেদিন বিয়ের তারিখ ঠিক হবে সেদিন রাণী অসীম সাহসের পরিচয় দিল। একা একা তার বড় ভাইয়ের অফিসে উপস্থিত হল। আসগর সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, কি ব্যাপার তুই এখানে কেন?

রাণী ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল, তার এই বিয়েতে মত নেই। এখানে বিয়ের তারিখ হলে সে ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মরে যাবে।

আসগর সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, তোর কি পছন্দের কেউ আছে? চোখ মোছ। চোখ মুছে স্বাভাবিক গলায় কথা বল। আছে কেউ?

রাণী বলল, না।

এমন কোন ছেলে কি আছে যার সঙ্গে ভাব হয়েছে? টেলিফোনে কথা হয় বা চিঠি চালাচালি হয়?

না।

তাহলে এখানে বিয়ে হতে অসুবিধে কি? ছেলে দেখতে সুন্দর। ডাক্তার। টাকা পয়সা আছে। ফ্যামিলি ভাল।

রাণী চুপ করে রইল। আসগর সাহেব বললেন, পছন্দের কেউ না থাকলে যেখানে বিয়ে ঠিক করেছি সেখানেই বিয়ে হবে। চোখের পানি ফেলে লাভ হবে না। চোখের পানির দাম দশ নয়া পয়সা।

রাণী আবার ফুঁপাতে শুরু করল। ফুঁপানির মধ্যেই কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, তার খুব পছন্দের একজন মানুষ আছে। মানুষটা হল জাহানারা ভাবীর ভাই। ফরহাদ ভাই।

আসগর সাহেব হতভম্ব গলায় বললেন, তার সঙ্গে তোর যোগাযোগ আছে?

রাণী বলল, না।

টেলিফোনে কথা হয়?

কখনো কথা হয় নি।

চিঠি লেখালেখি?

না।

ফরহাদ সাহেব কি তোর পছন্দের ব্যাপার জানেন?

না।

সত্যি কথা বল।

সত্যি কথাই বলছি। উনি কিছুই জানেন না।

কথাবার্তা চলাকালিন সময়ে রাণী এক মুহূর্তের জন্যেও ফুঁপানি বন্ধ করল না। শাড়ির অর্ধেকটা সে চোখের পানিতে ভিজিয়ে ফেলল। আসগর সাহেব ধমক দিয়ে বললেন, কান্না বন্ধ কর। আমি ব্যবস্থা করছি। তবে কেউ যেন জানতে না পারে যে ছেলে তোর নিজের পছন্দ। যদি জানে আমি টান দিয়ে তোর জিব ছিঁড়ে ফেলব। নিজেই ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেব। আমি বলব, ছেলে আমাদের নিজেদের পছন্দ। পারিবারিক ভাবে পছন্দ। এখন তুই আমার সামনে থেকে যা। তোর মুখ দেখতে ইচ্ছে করছে না।

রাণীর বড় ভাই তার কথা রেখেছিলেন। তাদের হিসাব মতে অতি অপদার্থ একজন ছেলের সঙ্গে বোনের বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টায় কোন লাভ যে হয় নি তা না। একটা লাভ হয়েছে—রাণীর ভয়ংকর এক অসুখ হয়েছে। অসুখের লক্ষণ হল তাকে হঠাৎ হঠাৎ বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতে ইচ্ছা করে। অতি সামান্য একটা ব্যাপার থেকে এত বড় অসুখ কেন হল সে জানে না। কোনদিন হয়ত জানবেও না।

রাণী গল্পের বইটা খুলল। বইয়ের ভেতর থেকে চিঠিটা আবার বের হয়ে এসেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে—এমন একটা চিঠি যদি তার কাছে লেখা হত। কিংবা এমন যদি হত সে রাণী না, তার নাম আসমানী…

রাণীর চোখ ভিজে উঠছে। কিছুক্ষণ আগেই সে অনেক হাসাহাসি করেছে এখন চোখে পানি আসবেই। কিচ্ছু করার নেই।

নান্টুর মন আজ অত্যন্ত ভাল

নান্টুর মন আজ অত্যন্ত ভাল।

গত রাতে সে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হয়েছে তার জীবনে ভয়ংকর কিছু ঘটতে যাচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে উল্টোটা ঘটবে। স্বপ্নের মধ্যে এই ব্যাপারটা আছে যা দেখা যায় তার উল্টোটা হয়। যদি কেউ দেখে সে মারা যাচ্ছে তাহলে তার হায়াত বাড়ে। নান্টু স্বপ্নের মধ্যে দেখেছে একটা ন্যাংটা পাগল তাকে তাড়া করেছে। পাগলের হাতে বর্শা। সে কিছুক্ষণ পর পর বর্শা ছুঁড়ে মারছে। বর্শা নান্টুর গায়ে লাগছে না। ঘটনাটা বাস্তব হলে বর্শা ছুঁড়ে মারার পর পাগলের হাতে আর বর্শা থাকত না। স্বপ্নের ঘটনা বলেই বর্শার কোন অভাব হচ্ছে না।

স্বপ্নের কারণেই সকালে চা খাবার সময় তার মনটা খুবই খারাপ ছিল। কিন্তু নটার দিকে তার মন অসম্ভব ভাল হয়ে গেল। শর্মিলা তাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছে। সম্বােধনহীন চিঠি হলেও চিঠি পড়ে বোঝা যায় শর্মিলার মন গলেছে।

 

আমার দূর সম্পর্কের এক ভাই অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন। তিনি যে সব গিফট নিয়ে এসেছেন তার মধ্যে আছে এক কার্টুন অস্ট্রেলিয়ান সিগারেট। এ বাড়িতে সিগারেট খাবার লোক নেই বলে তোমাকে পাঠালাম।

ভাল কথা, তুমি কি আজ দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে একটু আসতে পারবে। তোমার সঙ্গে কিছু জরুরী কথা আছে।

ইতি—

শর্মিলা।

ক্যাঙ্গারুর দেশের সিগারেট বলেই হয়তো প্যাকেটে রূপালী রঙের ক্যাঙ্গারু। এমন অসাধারণ ঘটনা ঘটল অথচ ফরহাদকে দেখানো গেল না। সে সূর্য উঠা সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে চলে যায়। ফিরে রাত দশটার পর। মেসে এসে গোসল করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। কোন কথা নেই, কিছু নেই। মানুষ না যেন রোবট। যে রোবটের একটাই কাজ সকালবেলা বের হয়ে যাওয়া গভীর রাতে ফেরা। নান্টু। ধারণা সে রাতে ঘুমায়ও না। মাঝে মধ্যে নান্টু ঘুম ভেঙ্গে দেখেছে ফরহাদ চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। সিগারেট খাচ্ছে। অন্ধকার ঘরে সিগারেটের আগুন উঠা নামা করছে।

ফরহাদ থাকলে তাকে দু প্যাকেট সিগারেট দেয়া যেত।

নান্টু দশটার অনেক আগে বের হল। শহরে ট্রাফিক জ্যাম যে ভাবে বেড়েছে কোথাও যেতে হলে এক দু ঘন্টা আগে বের হতে হয়। তাছাড়া তাকে রসোমালাই কিনতে হবে। যে দোকানে ফ্রেশ রসোমালাই পাওয়া যায় সেটা আবার উল্টো দিকে। অর্ণবের জন্যেও কিছু একটা নিতে হবে। বাবাকে দেখলেই সে প্রথমে বাবার মুখের দিকে তাকায় না, তাকায় বাবার হাতের দিকে। চট করে দেখে নেয় হাতে উপহারের কোন প্যাকেট আছে কি-না। খেলনার দোকানে পোকা মাকড় জাতীয় কোন খেলনা খোঁজ করতে হবে। বাচ্চাদের অদ্ভুত সাইকোলজি। যে সব জিনিশ তারা সবচে ভয় পায় তার খেলনা আবার তাদের জানের জান। অর্ণব সবচে ভয় পায় সাপ। অথচ রাবারের সাপ তার সবচে পছন্দের। গত জন্মদিনে তাকে একটা রাবারের সাপ দেয়া হয়েছিল সেই সাপের লেজ ধরে না থাকলে তার রাতে ঘুম হয় না। সাপ খোপ পাওয়া গেলে কিনতে হবে।

 

দরজা খুলে দিল শর্মিলা। নান্টু বলল, কেমন আছ?

শর্মিলা বলল, ভাল।

তার আজকের গলা অন্যদিনের মত বরফ শীতল না। মুখটাও মনে হচ্ছে হাসি হাসি। নান্টু বলল, সিগারেটের জন্যে ধন্যবাদ।

তুমি কি চা খাবে?

এক কাপ খেতে পারি। অর্ণব কোথায়? ওর জন্যে একটা প্লাস্টিকের মাকড়শা এনেছি।

অর্ণব স্কুলে চলে গেছে।

নান্টু সাহসে ভর করে বলে ফেলল—ওর সামারের ছুটি কবে? ওকে নিয়ে একটা প্ল্যান ছিল।

কি প্ল্যান?

নান্টু হড়বড় করে বলল, ঠিক ওকে নিয়ে প্ল্যান না। তোমাদের দুজনকে নিয়েই প্ল্যান। ভাবছিলাম এই ছুটিতে তোমাদের নিয়ে নেপাল ঘুরে আসব। হিমালয় কন্যা নেপাল। ঢাকা থেকে যে খরচে কক্সবাজারে যাওয়া যায়, সেই খরচে নেপাল ঘুরে আসা যায়। বিদেশ দেখা হল। দেশ বিদেশ ঘুরলে শিশুদের জ্ঞান বৃদ্ধি হয়। নেপালের হোটেলে দুটা ঘর নিয়ে নিলাম। একটায় তোমরা মা-বেটা, একটায় আমি। ঘর পাশাপাশি নেয়ারও দরকার নেই। তোমরা থাকলে দোতলা বা তিনতলায়, আমি একতলায়।

নান্টু ভেবেছিল কথা শুনেই শর্মিলা রেগে যাবে। সে রাগল না। তবে মুখ সামান্য গম্ভীর করে ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল চা নিয়ে। শুধু চা না। ফুট কেক আছে, রসোমালাই আছে। নান্টু এক পিস কেক হাতে নিল। মনের ভুলে কেক চায়ে ড়ুবিয়ে এক কামড় দিল। শর্মিলা দেখেও কিছু বলল না। অন্য সময় এমন একটা ব্যাপার দেখলে চোখ সরু করে তাকাতো।

তুমি তাহলে আমাদের নেপাল নিতে চাচ্ছ?

দেশের ভেতরে কোথাও যদি যেতে চাও—সেখানেও নিতে পারি। কোন সমস্যা নেই।

মনে হয় তোমার অনেক টাকা হয়েছে।

আরে না। চাকরিই নেই। টাকা পাব কোথায়? তবে ব্যবস্থা একটা হবেই। চাকরি বাকরি আর করব না বলে ঠিক করেছি। ব্যবসা করব। ফুড বিজনেস।

ফুড বিজনেস মানে?

বিরানীর দোকান দেব। বাবুর্চির সঙ্গে কথা হয়েছে। সকালে এক হাড়ি বিরানী হবে। বিকালে এক হাড়ি। মাস তিনেক বাবুর্চি রেখে রান্নার কৌশলটা শিখে ফেলব। তারপর বাবুর্চি বিদেয় করে নিজেরাই রাঁধব। বাবুর্চির খরচটা বেঁচে গেল। খুবই লাভের ব্যাপার।

তাই না-কি?

হাজির বিরিয়ানীতে বিরানী বিক্রি করে কোটিপতি হয়ে গেল।

তোমার বিরিয়ানীর নাম কি হবে—পাজীর বিরিয়ানী?

নান্টু হা হা করে হেসে ফেলল। শর্মিলার রসিকতাটা তার খুব মনে ধরেছে। শর্মিলা যে তার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে তার জন্যেও ভাল লাগছে। তার কোন ব্যাপারে শর্মিলা অনেক দিন এত আগ্রহ দেখায় নি। নান্টু চায়ে চুমুক দিয়ে আনন্দিত গলায় বলল, লাভটা কেমন হবে একটু বুঝিয়ে বলি——মিডিয়াম সাইজ একটা পাতিলে চাল ধরে বিশ কেজি। বেস্ট কোয়ালিটি বাসমতি চাল হল ত্রিশ টাকা কেজি। কাজেই চাল লাগছে ছয়শ টাকার। বিশ কেজি চালে লাগছে দশ কেজি মাংস। দশ কেজি খাসির মাংসের দাম পরে—কেজি একশ টাকা হিসেশে এক হাজার টাকা। হিসাবটা কি ফলো করছ?

চেষ্টা করছি।

ঘি মশলাপাতি এইসব ধর পনেরোশ টাকা। কাজেই টোটেল খরচ হচ্ছে তিন হাজার টাকা। ফুল প্লেট পঞ্চাশ টাকা করে বিক্রি করলে নেট পাব ছয় হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি পাতিলে লাভ থাকবে তিন হাজার টাকা। দুই পাতিলে ছয় হাজার টাকা। মাসে এক লক্ষ আশি হাজার টাকা। ইস্টাবলিশমেন্ট খরচ, বাবুর্চির বেতন, বয় বেয়ারা সব মিলিয়ে ধরলাম পঞ্চাশ হাজার টাকা তারপরেও মাসে নেট প্রফিট হবে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা। ইনশাল্লাহ।

ভালতো। নান্টু আনন্দিত গলায় বলল, দোকানের নাম ঠিক করেছি অর্ণব বিরাণী হাউস।

আমার ছেলের নামে বিরানীর নাম দিতে হবে না। তোমার নামে নাম দাও। নান্টু ভাইয়ের ভাই বিরানী। মামা হালিম আছে। ভাই বিরানীও হবে।

নান্টু সামান্য দমে গেল। বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা শর্মিলা ঠিক পছন্দ করছে না। তার চোখ সরু হয়ে গেছে। গলাও অনেক গম্ভীর শুনাচ্ছে।

শর্মিলা শীতল গলায় বলল, বাবুর্চির খরচওতো তোমার লাগবে না। তুমিতো কয়েকমাস পরে নিজেই রাঁধবে। এটা মন্দ না। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে অর্ণবের বাবা কি করেন? আমরা বলব, বাবুর্চি। আমাদের কোন খাওয়া দাওয়ার প্রয়োজন হলে তোমাকে বাবুর্চি হিসেবে ভাড়া করে নিয়ে আসব। তোমরা নিশ্চয়ই বাইরের রান্নার কাজও করবে, করবে না?

নান্টু অস্ট্রেলিয়ান সিগারেট ধরাল। ব্ৰিত গলায় বলল, তোমার পছন্দ না হলে বিরানী হাউসের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে দেব।

শর্মিলা কঠিন গলায় বলল, আমার পছন্দ অপছন্দ দিয়ে দরকার কি? আমিতো তোমার কেউ না। তোমার যা ইচ্ছা তুমি করবে। তুমি বাবুর্চি হলেও কিছু না। জুতা পালিশওয়ালা হলেও কিছু না।

নান্টু অনেক কষ্টে বলল, ও আচ্ছা।

শর্মিলা বলল, তোমাকে কি জন্যে ডেকেছি এখন শোন। তোমাকেতো বলে বলে আমি হয়রান হয়েছি। ইচ্ছা করেই তুমি গা করছ না। আজ আমি ঝামেলা চুকিয়ে ফেলব। রাজশাহী থেকে আমার বড় ভাই এসেছেন। উনি সব ব্যবস্থা করেছেন। আমাদের কোথাও যেতে হবে না। কিছু না। কাগজপত্র নিয়ে এখানে লোকজন আসবে। তুমি আমি একসঙ্গে সাইন করব।

নান্টু পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। আজকের দিনে এমন কোন ঘটনা ঘটাবে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। নান্টু প্রায় ফিস ফিস করে বলল, তুমি কি বিয়ে করছ নাকি?

শর্মিলা সহজ ভাবে বলল, হ্যাঁ করছি।

তোমাদের বিয়ের পর অর্ণব কি আমার সঙ্গে থাকবে?

শর্মিলা বিরক্ত গলায় বলল, উদ্ভট কথা বলবে না। অর্ণব তোমার সঙ্গে মেসে গিয়ে উঠবে? অবসর সময়ে বিরানী হাউসের কাস্টমারদের বিরানী খাওয়াবে? প্লেট ধুয়ে দেবে। তুমি সারা জীবনে নানান ধরনের যন্ত্রণা করেছ। আর যন্ত্রণা করবে না। আরাম করে বোস। চা খেতে চাইলে বল আবার চা দিচ্ছি।

নান্টু তাকিয়ে আছে। সে কি বলবে বুঝতে পারছে না। বসার ঘরের দরজাটা খোলা। হঠাৎ উঠে দৌড়ে কি পালিয়ে যাবে? বা অন্য কিছু কি করা যায়? শর্মিলার পা চেপে ধরলে কেমন হয়? স্বামী যদি স্ত্রীর পায়ে ধরে তাতে দোষ হয় না।

সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা মনে হয় চলে এসেছে। শর্মিলা বলল, দেব আরেক কাপ চা?

নান্টু বলল, দাও।

রাতের স্বপ্নটার কথা মনে পড়ছে। স্বপ্নে পাগল দেখা যে এমন ভয়াবহ তা কে জানত। ঘরে একটা খোয়ব নামার বই রাখা দরকার। জটিল স্বপ্নগুলির অর্থ আগে ভাগে জানা থাকলে ধাক্কা খেতে হয় না। নান্টুর চোখে পানি এসে গেছে। শর্মিলা সামনে নেই, এটা ভাল হয়েছে। তাকে চোখের পানি দেখতে হল না।

ঘরে লোকজন খাতাপত্র নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। নান্টু উঠে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলল, আসুন আসুন।

যেন সে এ বাড়িরই একজন, অতিথিকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।

ফরহাদ আসমানীদের বসার ঘরে বসে আছে

ফরহাদ আসমানীদের বসার ঘরে বসে আছে। একটা কাজের মেয়ে চা দিয়ে গেছে। সেই চা অনেকক্ষণ আগে শেষ হয়েছে। তার কাছে কেউ আসছে না। কলিংবেল টেপার পর নিশা দরজা খুলে দিয়েছে। সেই বলেছে—ভেতরে এসে বসুন। তার গলা অত্যন্ত শীতল। ফরহাদ সেই শীতল গলাকে গুরুত্ব দেয় নি। যার বোন ভয়াবহ রকম অসুস্থ তার গলায় কোন রকম উষ্ণতা থাকার কথা না।

ফরহাদ বলল, আসমানী কি বাসায়?

নিশা বলল, হুঁ।

বাসায় কখন এসেছে?

গতকাল সন্ধ্যায়।

আমি জানতাম না। আজ হাসপাতালে গিয়ে শুনি…।

আপাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর যাওয়া হবে। এই জন্যেই চলে আসা।

কবে যাচ্ছ সিঙ্গাপুর?

এখনো ঠিক হয় নি। মামা চেষ্টা করছেন। যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়।

আমি আসমানীর সঙ্গে একটু কথা বলব।

আপনি বসুন।

ফরহাদ বসেছে। এর মধ্যে এক ঘণ্টা সময় পার হয়েছে। তার চা খাওয়া হয়েছে। খবরের কাগজ পড়া হয়েছে। টেবিলে দুটা ম্যাগাজিন ছিল। সেই ম্যাগাজিনও শেষ হয়েছে। ভেতর থেকে কেউ আসে নি। চট করে ভেতরের ঘরে ঢুকে পরার অধিকার তার নেই। তাকে কেউ ডেকে না নিয়ে গেলে সে যেতে পারবে না। তাকে বাইরের গেস্টদের মত চুপচাপ বসে থাকতে হবে।

আসমানী নিশ্চয়ই তার ঘরে শুয়ে আছে। তার ঘরটা কখনো দেখা হয় নি। নিশ্চয়ই ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। আসমানী বলতো—তোমাকে আমার ঘরটা একদিন দেখাতে হবে। ঘরের মধ্যে একটা কুমারী গন্ধ আছে। যে কোন বুদ্ধিমান লোক ঘরে পা দিয়েই বুঝবে এখানে একটা কুমারী মেয়ে বাস করে।

বিবাহিতা মেয়ের ঘর কি অন্যরকম?

অবশ্যই অন্যরকম। বিয়ের পর তোমাকে নিয়ে আমি যে ঘরে থাকব সেই ঘরতো আমিই সাজাব তখন ডিফারেন্সটা বুঝবে।

ফরহাদ হাসতে হাসতে বলেছে, আমার তো ধারণা কোন প্রভেদ নেই। একটা হতে পারে তোমার এই ঘরে ছেলেদের কোন কাপড় নেই, এসট্রে নেই। বিয়ের পরে যে ঘরে থাকবে সেখানে আমার কাপড় থাকবে, একটা এসট্রে থাকবে।

আসমানী গম্ভীর গলায় বলেছে—তুমি এখনো ধরতে পার নি। আমি একটা ডিফারেন্সের কথা বলি——যেমন ধর কুমারী মেয়েদের দৃষ্টি থাকে ঘরের বাইরে। তারা আকাশ দেখতে পছন্দ করে। কিন্তু বিয়ের পর মেয়েদের দৃষ্টি ঘরের ভেতর কেন্দ্রীভূত হয়। কাজেই কুমারী মেয়ের খাটের অবস্থান এমন হবে যে খাটে শুয়ে আকাশ দেখা যায়। আর বিবাহিতা মেয়ের খাটটা হবে সিলিং ফ্যানের নিচে। খাটের পজিশন এমন যেন স্বামী-স্ত্রী দুজনই সমান বাতাস পায়। কেউ বেশি, কেউ কম তা যেন না হয়।

ফরহাদ হাসতে হাসতে বলেছে—তুমি তুচ্ছ সব ব্যাপার নিয়ে দিনরাত ভাব তাই না?

আমি তুচ্ছ বা জটিল কোন বিষয় নিয়েই দিনরাত ভাবি না–তোমাকে নিয়ে দিনরাত ভাবি। আচ্ছা এই যে আমি দিনরাত তোমাকে নিয়ে ভাবি এই কথাটা কি তোমার বিশ্বাস হয়েছে?

হ্যাঁ হয়েছে।

আসমানী তখন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলেছে—তোমার ব্যাপারটা কিন্তু অন্যরকম। তুমি সারাক্ষণ আমার কথা ভাব না। তুমি নানান ধরনের ঝামেলার মধ্যে বাস কর বলে ঝামেলা নিয়ে ভাব। আমার কথা ভাব তখনই যখন আমি তোমার সামনে থাকি। এই জন্যেই তোমাকে বিয়ে করে ফেলার জন্যে আমি এত ব্যস্ত। বিয়ের পর তোমাকে বাধ্য হয়ে আমার সঙ্গে অনেক বেশি সময় থাকতে হবে। তখন বাধ্য হয়ে আমার কথা ভাবতে হবে। বলতো আমি ঠিক বললাম কি-না।

ফরহাদ উত্তর দেয় নি। তবে আসমানীর কথা সত্যি। এই যে সে এক ঘন্টা আসমানীদের বসার ঘরে বসে আছে। এই এক ঘন্টা সে শুধু আসমানীর কথা ভাবে নি। তাকে অনেক কিছু ভাবতে হয়েছে। যেমন সে বেশ কিছু সময় ধরেই তার মার কথা ভাবছে।

আসমানীদের ফ্ল্যাট বাড়ির দিকে রওনা হবার আগে ফরহাদ মা-বাবার খোঁজ নিতে গিয়েছিল। রাহেলা বেগম ছেলেকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলেছেন—নিউ মার্কেট থেকে খুব বড় একটা কাতল বা রুই মাছ কিনে দিতে পারবি? খুব দরকার। টাকা আমি দেব। এক হাজার টাকায় হবে না?

এক হাজার টাকা দামের মাছ?

খুব বড় মাছ। যেন সবার চোখে পড়ে এ রকম মাছ।

দরকার কি?

আছে দরকার আছে। মাছটা বিকাল পাঁচটা ছটার দিকে আনবি। পারবি না।

ফরহাদ শান্ত গলায় বলল, পারব কিন্তু হঠাৎ এক হাজার টাকা দামের মাছের দরকার পড়ল কেন?

জামাইয়ের বাড়িতে পরে আছি, খরচ টরচ না করলে মান থাকে না।

মান রক্ষার জন্যে এক হাজার টাকা দামের মাছ কত দিন কিনবে?

তোর সঙ্গে তর্কের ইসকুল খুলব না। তোকে যা করতে বলছি কর।

বিকেলে আমি একটা প্রাইভেট টিউশ্যানি করি। মাছটা এখন কিনে দিয়ে যাই মা?

এখন কিনলে এরা মাছটা কেটে বেঁধে ফেলবে। বড় মাছ কেটে ফেললে তার আর সৌন্দর্য কি? জামাই দেখতে পাবে না। সে অফিসে। সে বাসায় ফিরে সন্ধ্যায়।

রাহেলা মাছের জন্যে এক হাজার টাকা দিলেন। গলা নামিয়ে বললেন, যদি কিছু বেশি লাগে তুই দিয়ে দিস।

ফরহাদের মন সামান্য খারাপ হয়েছে। তার মা জামাইয়ের বাড়িতে তার সম্মান নিয়ে ব্যস্ত। অন্য কিছুই এখন আর তাঁর চোখে পড়ছে না। একবার অন্তত বলতে পারতেন, তোর কি হয়েছে বলত? তোর চোখের নিচে কালি কেন? কিংবা জিজ্ঞেস করতে পারতেন, আসমানী মেয়েটা কেমন আছে? ওকে একবার দেখতে যাব। তুই আমাকে নিয়ে যা তো। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার আসমানী সম্পর্কে কারোর কোন আগ্রহ নেই। তার বাবা এখন পর্যন্ত আসমানীর কথা কিছু জিজ্ঞেস করেন নি। আসমানী যদি টবে লাগানো কোন জাপানী ফুলের গাছ হত, তার বাবা। নিশ্চয়ই প্রতিদিন তাকে দেখতে যেতেন।

 

ফরহাদ ঘড়ি দেখল। দেড় ঘন্টার মত হয়েছে, সে বসে আছে। এদের সমস্যাটা কি? এরা তাকে বসিয়ে রেখেছে কেন?

আসমানীর মামা বসার ঘরে ঢুকলেন। ফরহাদ উঠে দাঁড়াল। কামরুল ইসলাম সাহেবকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি সারারাত ঘুমাননি। চোখের নিচে কালি। ঠোট শুকিয়ে আছে। তিনি যে দাঁড়িয়ে আছেন সেই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটাও অস্বাভাবিক। কেমন যেন কুঁজো হয়ে আছেন। তাঁকে খুবই ক্লান্ত লাগছে।

ফরহাদ কেমন আছ?

জি ভাল।

কামরুল ইসলাম সাহেব নিজে বসলেন না, ফরহাদকেও বসতে বললেন না। কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতে লাগলেন।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছ, সরি। চা দিয়েছে?

জি।

আসমানীর শরীরটা বেশ খারাপ করেছে। এত দ্রুত এতটা খারাপ করার কথা। আমার মনে হয় —মন বিকল হয়ে গেছে। মন বিকল হলে এ রকম হয়। ভয়াবহ বিপদের সামনে দাঁড়ালে সাধারণ চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়ে যায়…।

ফরহাদ বলল, মামা আমি ওর সঙ্গে একটু কথা বলি?

কামরুল ইসলাম সাহেব ক্লান্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এইখানেই সমস্যাটা হয়েছে। ও তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে না। এতক্ষণ তাকে বুঝাবার চেষ্টা করলাম। লাভ হয় নি।

ও কি বলছে?

তোমাকে তার অসুস্থ মুখ দেখাবে না। এইসব হাবিজাবি বলছে। যেহেতু সে চাচ্ছে না, আমার মনে হয় তোমার দেখা না করাই ভাল হবে। এম্নিতেই সে প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে আছে। সেই চাপটা আর বাড়ানো ঠিক হবে না।

আমি কি চলে যাব?

হ্যাঁ চলে যাও। দেশের বাইরে যাবার আগে সে যদি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চায় আমি তোমাকে খবর দেব।

আমি কি বিকেলে একবার আসব?

আসতে পার। তবে আমার মনে হয় না সে তোমার সঙ্গে কথা বলবে। আসমানী ভয়ংকর ধরনের জেদী মেয়ে। যা বলবে তাই।

এপার্টমেন্ট হাউসে লিফট আছে, ফরহাদ নামছে সিড়ি দিয়ে। তার কাছে মনে হচ্ছে সে নেমেই যাচ্ছে নেমেই যাচ্ছে, সিড়ি শেষ হচ্ছে না। সিড়ি দিয়ে উঠতে কষ্ট, নামতে কষ্ট না, কিন্তু এখন নামতেও কষ্ট হচ্ছে। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে। ইচ্ছে করছে রেলিং ধরে খানিকক্ষণ বিশ্রাম করতে। হঠাৎ করে খুব ঘুমও পাচ্ছে। মেসে ফিরে গিয়ে আরাম করে কিছুক্ষণ ঘুমুতে পারলে ভাল হত। চিন্তা ভাবনাহীন নিশ্চিন্ত ঘুম। কতদিন হয়ে গেল সে আরাম করে ঘুমুতে পারছে না। ঘুমিয়ে পড়তে পারলে দরদাম করে মাছ কেনার কথা ভাবতে হবে না। নান্টু ভাইয়ের কথা ভাবতে হবে না। চিলড্রেনস রাইমস, পার্ট টুর বইটা কোথায় পাওয়া যাবে তা নিয়েও ভাবতে হবে না। ফরহাদ প্রাইভেট টিউশ্যানী শুরু করেছে। তার ছাত্রর মা চিলড্রেনস রাইমস পার্ট টু বইটা না-কি কোন দোকানে খুঁজে পাচ্ছেন না। ফরহাদের দায়িত্ব বইটার খোঁজ করা।

এক বিদেশী অষুধ কোম্পানী মেডিকেল রিপ্রেজনটেটিভ চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে। সেখানে লেখা—বেতন ভাতা আকর্ষণীয়। ছবি এবং বায়োডাটাসহ যোগাযোগ করুন। ফরহাদের কাছে বায়োডাটা আছে। ছবি নেই। থ্রি আর সাইজের ছবি তুলতে হবে। হাসি হাসি মুখের ছবি। কাউকে দিয়ে সুপারিশ করাতে পারলে ভাল হত। কোন মন্ত্রী বা এ ধরনের ক্ষমতাবান কেউ। তবে মন্ত্রীর সুপারিশে কাজ হবে না, কারণ পাঁচ হাজার দরখাস্ত যদি পড়ে সেই পাঁচ হাজারের মধ্যে চার হাজার দরখাস্তে মন্ত্রীর সুপারিশ থাকবে। বাংলাদেশের মন্ত্রীরা জুড়ালো সুপারিশ করতে খুব পছন্দ করেন। নতুন ধরনের কোন সুপারিশ যদি কেউ তার জন্যে করত। যেমন ধরা যাক—কবি শামসুর রাহমান সাহেব তার দরখাস্তের উপরে গোটা গোটা অক্ষরে তাকে নিয়ে দুলাইনের কবিতা লিখে সুপারিশ করলেন–

এই ছেলেটা ভাল এবং সৎ
তার বিষয়ে ইহাই আমার চিন্তিত অভিমত।
—শামসুর রাহমান

বাহ্ কবিতাটা তো ভাল হয়েছে। ফরহাদ ক্লান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে—আসমানীর বিষয়ে এখন আর কিছু ভাববে না। কিছু না।

দিনটা কেমন মেঘলা মেঘলা। এ রকম মেঘলা দিনে আসমানীকে নিয়ে বেড়াতে বের হলেই আসমানী বার বার তাকাতো আকাশের দিকে এবং বলতো তোমার কি মনে হয় বৃষ্টি হবে?

ফরহাদ বেশির ভাগ সময়ই বলতো, জানি নাতো।

আমার খুব টেনশান লাগছে।

কেন?

আকাশে ঘন কাল করে মেঘ হলেই আমার টেনশান শুরু হয়। যদি বৃষ্টি না হয়, যদি বৃষ্টি না হয়।

টেনশানের কি আছে? সব মেঘে কি আর বৃষ্টি হয়?

হয় না বলেই তো টেনশান।

আসমানী আজ সঙ্গে থাকলে তার টেনশান হত। কারণ আকাশ দ্রুত কালো হচ্ছে। কালো মেঘ নিয়ে যে গানটা আছে সেটা যেন কি?

মেঘ কালো আঁধার কালো আর কলংক যে কালো।

ফরহাদ নিউ মার্কেটের দিকে রওনা হল। রাইমসের বইটা কিনে, মাছ কিনতে ঢুকবে। এর মধ্যে যদি ভালমত বৃষ্টি নামে তাহলে মাছের দাম কমে যাবে। বৃষ্টির দিনে ইলিশ মাছের দাম বাড়ে। অন্য সব মাছের দাম কমে যায়।

মানুষের মন যদি এ রকম হত যে সে একসঙ্গে একটার বেশি কোন কিছু নিয়ে ভাবতে পারে না তাহলে চমৎকার হত। মনটাকে সব সময় কোন না কোন কিছু নিয়ে ব্যস্ত রাখা যেতে পারত। কিন্তু মানুষের মন এক সঙ্গে দশ বারোটা বিষয় নিয়ে ভাবতে পারে। ফরহাদ নিশ্চিত যে যখন মাছের বাজারে ঢুকে রুই এবং কাতল মাছের দাম কমাতে ব্যস্ত থাকবে তখনো তার মনের একটা অংশ ভাববে আসমানীর কথা। কেমন আছে আসমানী? আজ যদি বৃষ্টি নামে সে কি তার বিছানার জানালা থেকে বৃষ্টি দেখবে? রোগ যন্ত্রণায় কাতর মানুষ কি বৃষ্টি পছন্দ করে?

 

দরজা খুলে রাণী অবাক। বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে ফরহাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে কানকোয় দড়ি বাধা বিশাল একটা কাতল মাছ। ফরহাদ ব্ৰিত গলায় বলল, বাড়িতে কোন কাজের লোক আছে। মাছটা ভেতরে নেবে।

রাণী অবাক হয়ে বলল, মাছ কেন?

মা বলেছেন একটা বড় মাছ কিনে তোমাদের এখানে দিয়ে যেতে। মাকে একটু খবর দেবে?।

উনি এখন বাড়িতে নেই। পাশের বাড়িতে মিলাদ হচ্ছে—মিলাদে গেছেন। উনি যেতে চান নি আমার মা জোর করে নিয়ে গেছেন।

তুমি মাকে বলে দিও যে মাছ দিয়ে গেছি।

আপনি কি এখন চলে যাবেন?

হ্যাঁ।

বৃষ্টির মধ্যে কোথায় যাবেন? অবশ্যই যাবেন না। উনারা চলে আসবেন আমি খবর পাঠাচ্ছি।

ফরহাদ শান্ত গলায় বলল, খবর পাঠাতে হবে না। আসলে আমি মার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছি না। মার সঙ্গে এখন কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এম্নিতেই মনটা খারাপ, তাঁর সঙ্গে কথা বললে মন আরো খারাপ হয়। আমি যাই।

রানী বলল, আপনি একটু রসুন। এক মিনিট। আপনার একটা জিনিস আমার কাছে আছে। নিয়ে যান।

ফরহাদ অবাক হয়ে বলল, আমার কি জিনিস?

রাণী নীচু গলায় বলল, আপনি আপনার স্ত্রীর জন্যে বিয়ের শাড়ি কিনেছিলেন। আসমানী রঙের শাড়ি।

ফরহাদ অবাক হয়ে বলল, তোমার কাছে কি ভাবে গেল?

রাণী তার জবাব না দিয়ে চলে গেল। শাড়ির প্যাকেট হাতে ফিরে এসে বলল, আমি কিন্তু প্যাকেটটা খুলে ফেলেছিলাম। কিছু মনে করবেন না। প্যাকেটের ভেতর একটা চিঠি ছিল। চিঠিটা প্যাকেটে দিয়ে দিয়েছি।

ফরহাদ তাকিয়ে আছে। মেয়েটার ভাবভঙ্গি কেমন যেন লাগছে। তার সঙ্গে কথা বলছে কিন্তু তার দিকে তাকাচ্ছে না। মেয়েটার সঙ্গে আসমানীর চেহারার কোন মিল নেই। কিন্তু তারপরেও তাকে কেন জানি আসমানীর মত দেখাচ্ছে।

রাণী বলল, আমি শুনেছি উনি খুব অসুস্থ। আপনি আবার যখন তাঁকে দেখতে যাবেন তখন অবশ্যই শাড়ি এবং চিঠি নিয়ে যাবেন।

ও কারো সঙ্গেই দেখা করতে চাচ্ছে না। আজ আমার সঙ্গে দেখা করে নি। সকালবেলা অনেকক্ষণ বসেছিলাম।

এখন শাড়ি নিয়ে আবার যান। সকালে হয়ত মন খুব খারাপ ছিল। মানুষের মন খুব বেশিক্ষণ খারাপ থাকে না।

আসমানীর সঙ্গে মিলটা কোথায় ফরহাদ বের করতে পারছে না। গলার স্বরও অন্যরকম কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে আসমানী কথা বলছে।

ফরহাদ বৃষ্টির মধ্যেই বের হয়ে গেল। রাণী বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এই বাড়ির বারান্দা থেকে অনেক দূর দেখা যায়। মানুষটা কেমন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বৃষ্টির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। দেখতে রাণীর কষ্ট হচ্ছে। সে কেন জানি চোখও ফিরিয়ে নিতে পারছে না। মানুষটা যদি হঠাৎ কোন কারণে পেছনে ফিরে তাহলে খুব লজ্জার ব্যাপার হবে।

রাণীর হাত কাঁপছে। বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করার ইচ্ছাটা আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে। তার রীতিমত কান্না পাচ্ছে। তার কেন এই সমস্যা হল?

 

আশ্চর্য আসমানীকে মোটেই অসুস্থ দেখাচ্ছে না। সে খাটে হেলান দিয়ে বসেছে। চুল ছাড়া। তার লম্বা চুল বিছানা স্পর্শ করেছে। আসমানীর পরণের শাড়ির রঙ উজ্জ্বল। সবুজ জমিনে লাল ফুলের কাজ। তার অসুস্থতার একমাত্র লক্ষণ তার পায়ের উপর শাদা রঙের চাদর এবং বিছানার পাশের টেবিল ভর্তি অষুধ।

ফরহাদ বসেছে আসমানীর খাটে। বৃষ্টির ভেতর এসেছে বলে আধ ভেজা। মনে হয় তার ঠাণ্ডা লেগেছে। সে কয়েকবার হাঁচি দিল। আসমানী হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। তার চোখে চাপা কৌতুক। মনে হচ্ছে এক্ষুণী সে মজার কিছু বলবে, কিন্তু আসমানী চুপ করেই আছে। কিছু বলছে না। ফরহাদ বলল, কেমন আছ?

আসমানী সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, সকালে তোমার সঙ্গে দেখা করিনি বলে রাগ করো না। হঠাৎ করে খুব মন খারাপ করেছিল। হঠাৎ মনে হল কি আশ্চর্য সবাই থাকবে শুধু আমি থাকব না। এটা কেমন কথা।

মন খারাপ ভাবটা কি এখন কমেছে?

না কমে নি। তবে তোমাকে দেখে খুশি হয়েছি।

তোমাকে আজ অসুস্থ মনে হচ্ছে না।

মনে না হলেও আমি ভয়াবহ অসুস্থ। আমার রোগটার নাম হচ্ছে ক্রনিক মাইলয়েড লিউকোমিয়া। এই রোগের তিনটা স্তর থাকে। আমি আছি দ্বিতীয় স্তরে।

ও।

আসমানী হাসি হাসি মুখে বলল, হাসপাতালে থাকার সময় অল্পবয়েসী একজন ডাক্তারের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। তাকে যখন বললাম, অসুখটা কি আমি ভালমত জানতে চাই—তখন সে রাজ্যের লিটারেচর দিয়ে যেতে শুরু করল। এই রোগ বিষয়ে আমি এখন একজন বিশেষজ্ঞ। তুমি কিছু জানতে চাইলে জিজ্ঞেস করতে পার।

আমি কিছু জানতে চাচ্ছি না।

তুমি এমন গম্ভীর হয়ে আছ কেন? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার AML হয়েছে।

AML টা কি?

আরেক ধরনের ব্লাড ক্যানসার—একুউট মায়ালোজেনাস লিউকোমিয়া। মায়ালোজেনাস আবার দুরকমের হয়। মাইলোমনোসাইটিক এবং পিউর মনোসাইটিক। শুনতে বিরক্ত লাগছে?

লাগছে।

আমার ইয়াং ডাক্তার সাহেবের কাছে শুনলাম বিদেশে যাদের এ ধরনের ভয়াবহ অসুখ হয় তাদেরকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করার ব্যবস্থা থাকে। সাইকিয়াট্রিস্টরা এসে দিনের পর দিন তাদের সঙ্গে কথা বলেন। মৃত্যুর জন্যে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করেন। হাস্যকর না?

হাস্যকর কেন?

যাদের এ ধরনের অসুখ হয় তারা মৃত্যুর জন্যে আপনা থেকেই তৈরী হয়ে যায়। সাইকিয়াট্রিস্টের দরকার রুগীর আত্মীয় স্বজনদের জন্যে। তার প্রিয়জনদের জন্যে। যেমন তোমার জন্যে দরকার হবে। তুমি এক কাজ কর বিছানায় পা তোলে আরাম করে বোস। তুমি এমন ভাবে বসেছ যে দেখে মনে হচ্ছে ভাইভা পরীক্ষা দিতে বসেছ। এবং আমি হচ্ছি ভাইভা বোর্ডের চেয়ারম্যান।

ফরহাদ পা তুলে বসল। আসমানী বলল, আমি খুব শিগগীরই চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে যাচ্ছি।

কবে যাচ্ছ?

কবে তা বলব না। কারণ বললেই তুমি এয়ারপোর্টে উপস্থিত হবে। তোমাকে দেখে তখন ভয়ংকর ধরনের কষ্ট হবে। তোমাকে এখানে রেখে চলে যাচ্ছি। আর হয়তো তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। এই কষ্টটা আমার সহ্য হবে না। যখন চাকরি করতে। চাকরির প্রয়োজন দুদিন, তিন দিনের জন্যে বাইরে যেতে তখনও সহ্য হত না। সারারাত ঘুমুতে পারতাম না। ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। কাজেই আমি কবে দেশের বাইরে যাচ্ছি তা তোমাকে জানাব না। তুমি হঠাৎ একদিন শুনবে আমি চলে গেছি। দেখবে দরজায় বিরাট তালা ঝুলছে।

ফরহাদ কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল আসমানীর দিকে। আসমানীর গলার স্বর কি সামান্য বদলেছে? একটু যেন অন্যরকম লাগছে। আসমানী বলল, বাবার সঙ্গে আজ তোমার দেখা হয়েছে না?

হ্যাঁ।

তাকে আগের চেয়ে অনেক হাসিখুশি লাগে নি?

বুঝতে পারি নি।

বাবা খুশি কারণ মেয়ের চিকিৎসার জন্যে তাঁকে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হচ্ছে না। আমার চিকিৎসার জন্যে কে টাকা দিচ্ছেন জান?

না।

আনিস সাহেব নামের এক ভদ্রলোক। তাঁর কথা তোমাকে চিঠিতে লিখেছিলাম। ঐ যে মামা যার সঙ্গে আমার বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছিলেন। ভাগ্যিস ঐ ভদ্রলোক আমাদের বাসায় এসেছিলেন। আমার সঙ্গে গল্প-টল্প করেছিলেন। তা না করলে আমার প্রতি তাঁর মমতা তৈরী হত না। টাকা পয়সা দিয়ে বাবাকে সাহায্য করার জন্যেও এগিয়ে আসতেন না। আমি মাঝে মাঝে শুয়ে শুয়ে অদ্ভুত সব যোগাযোগের কথা ভাবি। মজার ব্যাপার কি জান আনিস সাহেব কিন্তু আমাকে হাসপাতালে বা বাসায় দেখতে আসেন নি। অথচ উনি ঢাকাতেই আছেন। অদ্ভুত না?

হ্যাঁ অদ্ভুত।

খুব পরিচিত অনেকেই আমাকে দেখতে আসে নি। যেমন কণা। আমার এত প্রিয় বান্ধবী। কিন্তু সে আসে নি। আবার কেউ কেউ এসেছে যাদের সঙ্গে অতি সামান্য পরিচয়। এমন একজনও এসেছে যাকে আমি কোনদিন দেখিনি।

সে কে?

খুব সুন্দর মত একটা মেয়ে। তোমাকে মনে হয় চেনে। মেয়েটা বিপদে পড়েছিল তুমি তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে। এমন কারো কথা কি মনে পড়ছে?

না। মেয়েটা তোমাকে চেনে কি ভাবে?

জানি না। জিজ্ঞেসও করি নি। আমার এখন এমন সময় যাচ্ছে যেখানে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে না। তবে আমি নিশ্চিত মেয়েটা তোমাকে খুব ভালমত চেনে। শুধু চেনে না, তোমাকে অসম্ভব পছন্দও করে। সে যেহেতু চেনে তুমিও চেন। একটু মনে করার চেষ্টা করলেই মনে পড়বে। মেয়েটার চিবুকে কাটা দাগ আছে। চোখও ছোট বড় আছে। ডান চোখটা বা চোখের চেয়ে সামান্য বড়। চট করে বোঝা যায় না, ভাল করে তাকালে বোঝা যায়।

এমন করে বর্ণনা দিচ্ছ কেন?

বর্ণনা দিচ্ছি যাতে তুমি মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে পার।

নাম বলে নি?

নাম বলেছে কিন্তু নামটা তোমাকে বলব না। মেয়েটাকে তোমার খুঁজে বের করতে হবে।

তার কি কোন দরকার আছে?

হ্যাঁ দরকার আছে। আমার অসুখটা সারবে না। আমি চাই আমি যেমন তোমাকে ভালবেসেছি তেমন কেউ তোমাকে ভালবাসুক।

আসমানী তুমি খুবই উদ্ভট কথা বলছ?

আসমানী হাসতে হাসতে বলল, অসুখে মাথার ঠিক নেই। উদ্ভট কথা বলতেও পারি। আচ্ছা তোমার দাদাজানের সঙ্গে তোমার খুব ভাব ছিল না? তুমি তার অনেক সেবাযত্ন করতে। রাতের বেলা দাদা নাতী মিলে গুটুর গুটুর করতে। করতে না?

হ্যাঁ করতাম।

এখন কি সেই দাদাজানের কথা তুমি ভাব? ভাব না। জীবিত মানুষরা অতি দ্রুত মৃত মানুষদের কথা ভুলে যায়। এখন তোমার আমার জন্যে খুব কষ্ট হবে কারণ আমি জীবিত। আমি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রতি তোমার ভালবাসা অতি দ্রুত কমতে শুরু করবে। এত দ্রুত কমবে যে তোমার নিজেরই লজ্জা। লাগবে। আচ্ছা শোন আমি অনেকক্ষণ ধরে বকবক করেছি। এখন আমার মাথা ধরে গেছে। শরীর ঝিমঝিম করছে। তুমি কি দয়া করে উঠবে?

ফরহাদ উঠল না আগের মত বসে রইল।

আসমানী বলল, তোমার হাতের এই শাড়িটা কি আমার জন্যে?

হ্যাঁ। তোমার বিয়ের শাড়ি।

বিয়ে হলে তবে না বিয়ের শাড়ি পরব। এই শাড়ি তুমি ফিরিয়ে নিয়ে যাও। যদি ভাল হয়ে দেশে ফিরি তখন শাড়ি নিয়ে এসো। খুব আগ্রহ নিয়ে শাড়ি পরব। যদিও সেই সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

আসমানী চোখ বন্ধ করে বিছানায় এলিয়ে পড়ল। তার শরীর কাঁপছে। জগৎ সংসার অস্পষ্ট হয়ে আসছে। তার খুব ইচ্ছা করছে সে ফরহাদকে বলে—খবর্দার তুমি যাবে না। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার পাশে শুয়ে থাকবে। যার যা ইচ্ছা ভাবুক। আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তা সম্ভব না। আমরা অসম্ভবের জগতে বাস করি না।

 

রাহেলার মন আজ বেশ ভাল।

বড় মাছটা আনায় খুব কাজ হয়েছে। মাছটা শুধু যে বড় ছিল তা-না, স্বাদু মাছ ছিল। জাহানারার শাশুড়ি পর্যন্ত বললেন, অনেক দিন পর এত ভাল মাছ খেলাম। টাটকা মাছের স্বাদই আলাদা।

রাহেলা খুশি খুশি গলায় বললেন, ফরহাদকে বলব ভাল পাংগাস মাছ দিয়ে যেতে। ও মাছ চেনে। খুব সকালে আরিচা ঘাটে যাবে। ফ্রেশ মাছ কিনে নিয়ে আসবে। দেখি কাল পরশুর মধ্যে…।

জাহানারার শাশুড়ি বললেন, এইসব কি বলছেন বেয়ান। রোজ রোজ মাছ কিনতে হবে না-কি।

রাহেলা তৃপ্তির গলায় বললেন, রোজ রোজ কি আর কিনছি না-কি? আছি আর মাত্র দুই চারদিন। সবাইকে নিয়ে পাংগাস মাছ একটা না হয় খেলাম।

দুই চারদিন আছেন না-কি?

জ্বি বেয়ান। মঞ্জু বাসা ঠিক করে ফেলেছে। তার বড় ভাইকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে। আমি খুবই রাগ করেছি। বড় ভাইকে দিয়ে খবর পাঠাবি কেন? তুই নিজে এসে দিবি না। তুই কোথাকার তালেবর?

ব্যস্ত থাকে।

ওর ব্যস্ততার কথা আমাকে বলবেন না বেয়ান। যত ব্যস্ততা বাবা-মার বেলায়। বন্ধু বান্ধবের বেলায় হাতে অবসর আছে। বেয়ান আমি ঠিক করেছি ওর বিয়ে দেব। একটা মেয়ে দেখবেন তো। মেয়েটা সুন্দর হতে হবে, আর ভাল বংশ। ছেলেতো আপনি দেখেছেন। শিক্ষক বাবার ছেলে আর কিছু থাকুক না থাকুক চরিত্র ঠিক আছে।

তাতো থাকবেই।

ওর বয়েসী ছেলেদের তো বেয়ান দেখি—মদ খাচ্ছে, গাঁজা খাচ্ছে আবার ফেনসিডিল খাচ্ছে। ওদের সঙ্গে যখন আমার দুই ছেলেকে মিলাই তখন বড় শান্তি লাগে। মনে মনে বলি—আল্লাহপাক তোমার দরবারে হাজার শুকুর।

বেয়ান আপনার কথা শুনে ভাল লাগল।

মঞ্জুর একটা ঘটনা বলি বেয়ান। একদিন রিকশা করে এসেছে। রিকশা ভাড়া দশ টাকা। আমার কাছে বলল–মা দশটা টাকা আছে। আমার কাছে সব বড় নোট। আমি দিলাম দশ টাকা! ও আল্লা তারপর থেকে দেখি কয়েকদিন পর পর ঐ রিকশাওয়ালা আসে। আমাকে সালাম করার জন্যে আসে। আমি ভাবলাম ব্যাপার কি। একদিন জিজ্ঞেস করলাম। রিকশাওয়ালা বলল, স্যার ঐ দিন তার দুঃখের কথা শুনে পাঁচশ টাকা বখশিস দিয়েছেন। এখন বেয়ান আমার কথা হল তুই যদি পাঁচশ টাকাই দিবি। তাহলে দশ টাকা ভাড়া দেয়ার জন্যে এত ব্যস্ত কেন?

রাহেলা ছেলের গল্প আরো কিছুক্ষণ করতেন, মেয়েকে ঘরে ঢুকতে দেখে থেমে গেলেন। জাহানারা থমথমে গলায় বলল, মা একটু বাইরে  এসোতো।

রাহেলা শংকিত গলায় বললেন, কি হয়েছে?

জাহানারা বলল, কিছু হয় নি একটু বাইরে এসো কথা আছে।

রাহেলা মেয়ের সঙ্গে বারান্দায় গেলেন। জাহানারা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তোমরা কি আমার সামান্য মান সম্মানও রাখবে না?

কেন কি হয়েছে?

জাহানারা চাপা গলায় বলল, মজু ভাইয়া তোমার জামাইয়ের অফিসে গিয়েছিল। তার না-কি পার্টনারের সঙ্গে কি সমস্যা হয়েছে। দুই দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার টাকার জোগাড় না হলে জেলে যাবে। টাকার জন্যে তোমার জামাইয়ের অফিসে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে। মদ খেয়ে গিয়েছিল। হুঁস জ্ঞান নেই জামাইয়ের পায়ে ধরতে যায়।

রাহেলা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন—জামাই কি টাকা দিয়েছে?

তোমার জামাইতো হাজি মুহম্মদ মহসিন না। কেউ চাইবে আর টাকা বের করে দিয়ে দেবে। সে খুবই বিরক্ত হয়েছে এবং আমার উপর রাগ করেছে।

তোর উপর রাগ করার কি আছে? তুইতো আর টাকা চাস নাই।

আমার বাপ ভাইতো চেয়েছে। পায়ে ধরে চেয়েছে। একবার চেয়েওতো কেউ চুপ করবে না। চাইতেই থাকবে।

আমাকে এইসব বলছিস কেন? আমি কি করব?

তুমি চারদিকে যে উল্টাপাল্টা গল্প করছ এইগুলি বন্ধ করবে। মঞ্জু ভাইয়ার কাছে খবর পাঠাবে সে যেন তোমার জামাইয়ের অফিসে ভুলেও না যায়। আর এখানেও যেন না আসে।

ও কোথায় থাকে তাইতো আমি জানি না।

জাহানারা কেঁদে ফেলে বলল, তুমি একটা কাজ কর মা। বাবাকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাও। তোমাদের জন্যে আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। বাবা কি করেছে তুমি জান? দারোয়ানের কাছ থেকে একশ টাকা ধার করেছে।

রাহেলা বললেন, আমরা যাব কোথায়?

জানি না কোথায় যাবে। আমার অসহ্য লাগছে মা। মরে যেতে ইচ্ছা করছে।

জাহানারা খুব কান্নাকাটি করলেও রাহেলা স্বাভাবিক রইলেন। অন্যদিনের মতই তাকে হাসি খুশি মনে হল। আজ বৃহস্পতিবার। রাতে আক্তারী বেগম এলেন। রাহেলা মাথায় ঘোমটা দিয়ে খুবই আগ্রহের সঙ্গে ধর্মের কথা শুনতে গেলেন। যেন আজ কোন ঘটনাই ঘটে নি। আজকের আলোচনার বিষয় আছর ওয়াক্তের গুরুত্ব।

আক্তারী বেগম বলছেন—আছর ওয়াক্তের মত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াক্ত আর নাই। কেন জানেন? জানেন না? মিলাদ, কোরানখানির দোয়া সব আছর ওয়াক্তে হয় না? কেন হয় এই কথাটাকি কখনো মনে আসে না? আচ্ছা শুনেন বলি——আছর ওয়াক্তে রোজকেয়ামত হবে। আবার এই আছর ওয়াক্তেই বাবা আদম গন্ধম ফল খেয়েছেন। ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে কখন বের হয়েছিলেন? ঠিক আছর ওয়াক্তে। ইউনুস নবী মাছের পেট থেকে বের হয়ে প্রথম যে কাজটা করেন তা হল পাক পবিত্র হয়ে দুই রাকাত শোকরানা নামায আদায় করেন। মাছের পেটে বসে ইউনুস নবী যে দোয়াটা পড়েছিলেন, সেই দোয়াটা দিয়ে আজ আমরা জিকির করব। বলেন লা ইলাহা ইল্লা আন্তা ছোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজজুয়ালেমিন।

জিকির হচ্ছে। রাহেলা বেগম চোখ বন্ধ করে গভীর মনযোগে মাথা ঝুঁকিয়ে জিকির করছেন। জাহানারা এসে মার কাঁধে হাত দিয়ে চাপা গলায় বলল, মা তুমি তোমার ঘরে যাও। মঞ্জু ভাইয়া এসেছে। তোমার ঘরে বসে আছে। তুমি অতি দ্রুত তাকে বিদায় কর। তোমার জামাই যদি শুনে সে এখানে এসেছে তাহলে খুবই রাগ করবে।

 

মঞ্জুর গায়ে ইস্ত্রী করা সার্ট প্যান্ট। জুতা জোড়া চকচক করছে, কিন্তু তাকে দেখাচ্ছে কানা তাড়য়ার মত। যে কেউ তাকে দেখে বলবে—তার জীবনের উপর দিয়ে প্রবল ঝড় বয়ে গেছে।

মঞ্জু মাকে দেখে বড়বড় করে বলল, মা আমাকে বাঁচাও। দুই দিনের মধ্যে চল্লিশ হাজার টাকা জোগাড় করতে না পারলে আমাকে জানে মেরে ফেলবে। সত্যি জানে মেরে ফেলবে। আমি যে এখানে আছি—এখানেও আমার পেছনে লোক লাগানো আছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

রাহেলা শুকনো গলায় বললেন, আমি টাকা পাব কোথায়?

তোমার কাছে টাকা আছে আমি জানি। দাদাজানের চন্দ্রহারটাও তোমার কাছে। এইগুলো দাও–আর তোমার মেয়ের কাছ থেকে টাকা জোগাড় করে আমাকে দাও।

তুই কি মদ খেয়ে এসেছিস? মদ ফদ কিছুই খাই নি। মদ খেতে পয়সা লাগে। মাগনা কেউ মদ খাওয়ায়। মা তুমি সময় নষ্ট করো না।

তোকেতো বললাম, আমার কাছে কিছুই নেই।

ধানাই পানাই করে লাভ হবে না মা। আমি টাকা না নিয়ে যাব না।

রাহেলা আতংক অস্থির হলেন। মঞ্জু বিশ্রী ভাবে তাকাচ্ছে। তার চোখ লাল। মুখ থেকে বিকট গন্ধ বের হচ্ছে। সে স্থির হয়ে বসতেও পারছে না। এই বসছে, এই উঠে দাঁড়াচ্ছে। রাহেলা কেঁদে ফেললেন।

মঞ্জু বলল, কেঁদে লাভ হবে না মা। বললামতো টাকা না নিয়ে আমি যাব না।

চিলড্রেন্স রাইমস পার্ট টু বইটা পাওয়া গেছে

চিলড্রেন্স রাইমস পার্ট টু বইটা পাওয়া গেছে। ফরহাদ বই নিয়ে ছাত্রীর বাসায় গিয়েছে।

ছাত্রীর মা বই হাতে নিয়ে বললেন, থ্যাংকস। বই পাচ্ছিলাম না, পাচ্ছিলাম না এখন দু কপি হয়ে গেছে। আমি আমার এক বান্ধবীকেও এই বইটা জোগাড় করতে বলেছিলাম। সেও এনেছে। অসুবিধা নেই। ফরহাদ সাহেব আপনি যাবার সময় বই এর দাম নিয়ে যাবেন।

ফরহাদ বলল, দাম দিতে হবে না। আমি বই ফেরত দিয়ে দেব।

ফেরত নেবে?

অবশ্যই ফেরত নেবে।

আপনার ছাত্রী বলেছে সে আজ পড়বে না। তার না-কি মাথা ধরেছে। সব বানানো কথা। আপনি চেষ্টা করে দেখুন। যদি পড়তে না চায় আজ ছুটি দিয়ে দেবেন।

জ্বি আচ্ছা।

ফরহাদের ছাত্রীর বয়স ছয়। মেয়েটা এতই সুন্দর যে দেখলেই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে। সুন্দরী মেয়েরা গম্ভীর প্রকৃতির হয়। এও সে রকম। যখন তখন ভুরু কুঁচকে বড়দের মত তাকায়। মেয়েটির নাম লীলাবতী। অতি আধুনিক যুগের ইংরেজি মিডিয়ামে পড়া মেয়ের জন্যে নামটা খুবই পুরানো। নিশ্চয়ই এই নাম। রাখার পেছনে কোন গল্প আছে। গল্পটা একদিন জেনে নিতে হবে। ফরহাদ বলল, তোমার মাথা ধরা কি খুব বেশি?

লীলাবতী চুল ঝাঁকিয়ে বলল, বেশি না অল্প।

আজ পড়তে ইচ্ছা করছে না?

না।

তাহলে থাক পড়তে হবে না। আমারো পড়াতে ইচ্ছা করছে না।

আজ আমাদের দুজনেরই ছুটি তাই না স্যার?

হ্যাঁ দুজনেরই ছুটি।

স্যার আপনারও কি শরীর খারাপ?

শরীর খারাপ না। মন খারাপ।

কেন?

আমার একজন অতি প্রিয় মানুষ ছিল। তার প্রচণ্ড শরীর খারাপ। সে চিকিৎসার জন্যে আজ দেশের বাইরে চলে গেছে। এই জন্যেই মনটা খারাপ। যাবার সময় তার সঙ্গে আমার দেখাও হয় নি। তোমার খুব প্রিয়জন কেউ যদি বাইরে চয়ে যায় তোমার মন খারাপ হবে না?

হবে।

লীলাবতী আজ উঠি?

লীলাবতী ঘাড় কাত করে সায় দিল। কিন্তু ফরহাদের উঠে যেতে ইচ্ছা করছে। বাচ্চা এই মেয়েটার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছা করছে। তাকে বলা যেতে পারে—লীলাবতী আমি যে সার্টটা পরে আছি এটা সুন্দর না। কি সুন্দর লাল রঙ আজ রোববারতো কাজেই আজকের জন্যে এই সার্ট। অসুস্থ যে মানুষটার কথা আমি বললাম, সে সপ্তাহের সাতদিনের জন্যে সাতটা সার্ট কিনে দিয়েছে। তার নাম হল আসমানী। দেখিতো তোমার কেমন বুদ্ধি। আসমানীর ইংরেজি কি বল।…

ফরহাদ উঠে দাঁড়াল। এখন কোথায় যাবে সে বুঝতে পারছে না। আসমানী বিহীন শহরটা কেমন দেখার জন্যে সারাদিন ঢাকা শহরে হেঁটে বেড়ানো যেতে পারে। হাঁটতে হাঁটতে কোন আইসক্রীমওয়ালার সঙ্গে দেখা হলে আইসক্রীম কিনতে হবে। আগে সে যখন আসমানীর সঙ্গে হাঁটতো, আসমানী আইসক্রীম খেতো। সে খেতো না। আসমানী খুব রাগ করতোলীলাবতী মেয়েটার মত ভুরু কুঁচকে বলত—তুমি এমন কেন বলত? কি হয় আমার সঙ্গে একটা আইসক্রীম খেলে। দুজন বয়স্ক মানুষ বাচ্চাদের মত আইসক্রীম খেতে খেতে যাচ্ছে মজার দৃশ্য না? না, আজ আইসক্রীম খেতে হবে।

শুধু আইসক্রীম খেলে হবে না আজ নাপিতের দোকানে গিয়ে চুলও কাটতে হবে।

আসমানীর খুব শখের দৃশ্য না-কি ছেলেদের চুল কাটার দৃশ্য। সে বলত—আমরা যখন ছোট ছিলাম, আমাদের বাসার সঙ্গেই ছিল একটা নাপিতের দোকান। নাপিত কচ কচ করে চুল কাটতো দেখতে আমার এত মজা লাগত। এখনো মজা লাগে। আমরা মেয়েরা মাথার লম্বা চুল কাটতে পারি না বলে ছেলেদের লম্বা চুল কাটা হচ্ছে দেখে মজা পাই। আমি কি ঠিক করেছি জান? চুল কাটা শিখে নেব। তোমার চুল যতবার লম্বা হবে ততবার কেটে দেব। চুল কাটা শেষ হবার পর নাপিতদের মত মাথা বানিয়ে দেব।

ফরহাদের কাছে মনে হচ্ছে সে সারাজীবন খুব পরিশ্রম করেছে। নিঃশ্বাস ফেলার মত সময়ও তার ছিল না। আজ ছুটি পাওয়া গেছে। প্রচণ্ড কর্ম ব্যস্ত এ শহরে আজ তার কাজ নেই। আজ সারাদিন রাস্তায় হাঁটা। পার্কে বসে থাকা। নাপিতের দোকানে গিয়ে চুল কাটানো, মাথা মালিশ করানো। পুরানো বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা করা যেতে পারে। অফিসে চলে যাওয়া যায়। ক্যাশিয়ার সিদ্দিক সাহেবের সঙ্গে বসে এক কাপ চা খাওয়া যেতে পারে। বিদেশে তার মেয়েটা কেমন পড়াশোনা করছে সে সম্পর্কে জানতে চাইতে পারে। দেশের পলিটিকস নিয়েও কথা বলা যায়। কথা বলার বিষয় বস্তুর কোন অভাব নেই।

গভীর রাতে ফার্মগেট পেট্রোল পাম্পের কাছে গেলে কেমন হয়। ঐ মেয়েটিকে হয়ত সেখানে পাওয়া যাবে। নিশিকন্যারাও এক অর্থে ভিক্ষুকদের মত। ভিক্ষুকরা যেমন নির্দিষ্ট জায়গায় ভিক্ষা করে, এরাও তাই করে, নিদৃষ্ট জায়গায় সেজেগুজে št তাকে বললেই হবে অনেক দিন আগে তোমাকে দেখে হঠাৎ বুকে একটা ধাক্কার মত খেয়েছিলাম। কারণ তোমার চেহারা দেখতে আমার অতি প্রিয় একজনের মত। তখন আমার হাতে এক হাড়ি বগুড়ার দৈ ছিল। আমার খুব ইচ্ছা করছিল দৈ এর হাড়িটা তোমাকে দিতে। কেন জানি দেয়া হয় নি। আজ নিয়ে এসেছি। আমি খুবই খুশি হব যদি তুমি দৈটা নাও। তুমি ভাল থেকো কেমন? আমার অতি প্রিয়জনের নামটা জানতে চাও? ওর নাম আসমানী। ওর কোন ছবি আমার কাছে নেই। ছবি থাকলে দেখতে ওর সঙ্গে তোমার চেহারার কি অদ্ভুত মিল।

জাহানারাদের বাড়িতে একবার যাওয়া যায়। বাবার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। ঐ বাড়িতে সে অনেকবার গিয়েছে। তাকে পাওয়া যায় নি। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। কোন রকম কাজ কর্ম নেই মানুষ সবচে ব্যস্ত থাকে। কাজের মানুষদের বাড়ি ঘরে পাওয়া যায়। অকাজের মানুষদের কখনোই পাওয়া যায় না।

 

জাহানারাদের বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় জোবেদ আলি কি গাছের যেন চারা পুঁতছেন। ছেলেকে দেখে বিস্মিত গলায় বললেন, আরে তুই।

ফরহাদ বলল, কেমন আছ বাবা? আমি প্রায়ই আসি। তোমার সঙ্গে দেখা হয় না। যাক আজকে দেখা হয়ে গেল। কি করছ?

জমি ঠিক করছি। এ জায়গার মাটি ভাল। গাছ ঠাই ঠাই করে বড় হবে। তোর কি শরীর খারাপ না-কি। তোকে কেমন অদ্ভুত লাগছে।

চুল কাটিয়েছি মনে হয় এই জন্যে।

শরীরের যত্ন নিবি বুঝলি। একসারসাইজ করবি। আমার নিজের শরীরটা যে ভাল আছে তার প্রধান কারণ এই বুড়ো বয়সেও কোদাল দিয়ে মাটি কোপাই। শরীর ঠিক রাখার জন্যে সবারই একসারসাইজ দরকার শুধু গাছের বেলায় ভিন্ন ব্যবস্থা। গাছের একসারসাইজ লাগে না।

ফরহাদ হাসল। জোবেদ আলি বললেন, তোর কাছে টাকা থাকলে আমাকে শ দুই টাকা দিয়ে যা। দারোয়ানের কাছ থেকে একশ টাকা নিয়েছিলাম এই নিয়ে হুলুস্থুল ব্যাপার হয়ে গেছে। এত লোক থাকতে দারোয়ানের কাছ থেকে কেন টাকা ধার করলাম। বড়লোকের কাছ থেকে টাকা ধার করলে সমস্যা নেই। দারোয়ান টাইপ মানুষদের কাছ থেকে টাকা ধার করলেই সমস্যা। আছে তোর কাছে টাকা?

ফরহাদ দুশ টাকা বের করে দিল। জোবেদ আলি লজ্জিত গলায় বললেন, যদি থাকে আরো একশটা টাকা দিয়ে যা। ছেলের কাছ থেকে ভিক্ষুকের মত টাকা নিতে হচ্ছে। মানুষ হয়ে জন্মেছি বলে আমার এই অপমানটা হচ্ছে। মানুষ না হয়ে গাছ হয়ে জন্মালে আমার এই অপমানটা হত না। তুই কখনো শুনেছিস একটা বটগাছ, চারা বট গাছের কাছে কোন জিনিস ধার চাইছে।

গাছ ছাড়া তুমি আর কিছু ভাব না বাবা?

গাছ নিয়ে ভাবা কি অন্যায়?

ফরহাদ বাবার পাশে বসতে বসতে বলল, কোন অন্যায় না। তুমি যেহেতু মানুষ, গাছ না। সেহেতু মাঝে মধ্যে আশেপাশের মানুষদের কথাও ভাববে।

ভাবি না তোকে কে বলল। ভাবিতো। খুবই ভাবি।

না বাবা তুমি ভাব না। একটা মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছিল। দাদাজান মারা যাওয়ায় বিয়েটা হয় নি। তারপর সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। তুমি কখনো তার কথা জানতে চাও নি। মেয়েটাকে একবার দেখতে যাওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করোনি।

জোবেদ আলি লজ্জিত গলায় বললেন, চল যাই দেখা করে আসি। আজই যাই। হাত ধুয়ে লুঙ্গি বদলে পাজামা পরে আসি। পাঁচ মিনিটের মামলা। খালি হাতে যাওয়া ঠিক হবে না। হরলিক্স, ডাব, কলা, এইসব নিয়ে যেতে হবে। তোর কাছে টাকা আছে না?

ও দেশে নেই বাবা। চিকিত্সার জন্যে বাইরে গেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে। ভাল হয়ে আসুক, তারপর ইনশাল্লাহ দেখতে যাব। তোর কাছে সিগারেট থাকলে দেতো খাই।

ফরহাদ সিগারেট দিল। জোবেদ আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, ঐ মেয়েটার কথা যে কিছু জিজ্ঞেস করি না, তোর মায়ের ভয়ে জিজ্ঞেস করি না। তোর মার ধারণা আমাদের সংসারে এত সব ঝামেলা যে হচ্ছে সব ঐ মেয়েটার জন্যে হচ্ছে।

তার মানে?

ওর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই ঝামেলা শুরু হল। তোর চাকরি চলে গেল। বিয়ের দিন তোর দাদাজান মারা গেলেন। আমাদের বাড়ি থেকে বের করে দিল। এখন পরের বাড়িতে অনুদাস হয়ে আছি।

তুমি কি মার কথা বিশ্বাস কর?

তুই পাগল হয়েছিস? তোর মা যখন সত্যি কথা বলে তখনো আমি বিশ্বাস করি না। ঐ দিন মঞ্জু টাকার জন্যে এসেছিল—কি কান্নাকাটি। তোর মা তাকে একটা পয়সা দেয় নি। শেষে সে এসেছে আমার কাছে। আমি জন্মদাতা পিতা। বিপদে পড়লে আমার কাছেতো আসবেই। কাঁদতে কাঁদতে বলল, বাবা আমাকে টাকা জোগাড় করে দাও।

ফরহাদ বিস্মিত হয়ে বলল, ওর টাকা দরকার কেন?

জানি না কেন। আজকাল আমি কিছু জানতে চাই না। জানতে চেয়েতো কোন লাভ নেই। কিছু করতে পারব না। শুধু শুধু জেনে কি হবে। চা খাবি রে ব্যাটা?

চা? বাড়িতে চা খেয়ে লাভ নেই, বাসার সামনে একটা রেস্টুরেন্ট আছে চল। সেখানে বাপ বেটায় চা খাই। ওরা চা-টা ভাল বানায়।

চল যাই।

জোবেদ আলি ক্লান্ত গলায় বললেন, এখানে আমি ভালই আছি। আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। কাজে কর্মে ব্যস্ত আছি। তবে মাঝে মধ্যে পুরানো দিনের কথা মনে হয়। তখন মনটা খুব খারাপ হয়।

পুরানো কোন কথা?

তুই যখন চাকরি করতি। ঢাকার বাইরে থেকে গভীর রাতে বাসায় ফিরতি। বাপ ব্যাটা এক সঙ্গে ভাত খেতাম। মনে নেই ঔ যে কাতল মাছের বিরাট এক মাথা তুই আমার পাতে তুলে দিলি। তবে এইসব ভেবে মন খারাপ করি না। মন খারাপ করলেতো কোন লাভ নেই। শুধু শুধু মন খারাপ করব কেন?

নান্টু ভাই পোলাও রান্না করছেন

নান্টু ভাই পোলাও রান্না করছেন। পোলাও এবং মুরগির কোরমা। তাঁকে খুবই আনন্দিত মনে হচ্ছে কারণ অর্ণব খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছে। আজ রাতে সে। বাবার সঙ্গে থাকবে। অর্ণব গভীর আগ্রহে বাবার কর্মকান্ড দেখছে। নান্টু ভাই। ছেলের আগ্রহ দেখেও মজা পাচ্ছেন। তিনি ফরহাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ফরহাদ এলে তাকে ডিম আনতে পাঠাবেন। ফার্মের ডিম না, দেশী ডিম। ডিমের পুডিং বানাতে হবে। ডিমের পুডিং ছেলের খুব পছন্দ। রান্না শেষ করেই ভিডিওর দোকানে যেতে হবে। মিকি মাউসের ক্যাসেট আনতে হবে। খাওয়া দাওয়ার পর বাবা বেটা মিলে ক্যাসেট দেখা হবে। যে ভাবেই হোক ছেলেকে আনন্দে রাখতে হবে। আজ অর্ণবের দুঃখের দিন। কারণ আজ সন্ধ্যায় তার মার বিয়ে। মা-বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে ছেলে মেয়ের উপস্থিত থাকা নিষিদ্ধ। সেই জন্যেই বোধ হয় শর্মিলা এত সহজে ছেলেকে ছেড়ে দিয়েছে।

নান্টু বলল, মনটা খারাপ না-কি রে ব্যাটা?

অর্ণব বলল, না।

কখনোই কোন কিছু নিয়ে মন খারাপ করবি না। সব সময় Do ফুর্তি।

অর্ণব পা দুলাতে দুলাতে বলল, আচ্ছা।

আর এই যে আমি এক জায়গায় থাকছি, তোর মা অন্য জায়গায় থাকছে। এটাও কোন ব্যাপার না। তোর জন্যে বরং লাভ। তুই একটা জায়গার বদলে দুটা জায়গা পাচ্ছিস।

হুঁ।

অর্ণবকে এখন কেন জানি অবোধ শিশু মনে হচ্ছে না। সে কেমন বয়স্ক মানুষের মত গম্ভীর ভঙ্গিতে বসে আছে। নান্টুর মনে হচ্ছে অর্ণবের সঙ্গে জটিল সংসারিক বিষয় নিয়ে আলাপ করা যায়, এবং আলাপ করাই উচিত। এই পৃথিবীতে সবচে বড় বান্ধবী হয় মা এবং কন্যা, এবং সবচে বড় বন্ধু পিতা ও পুত্র। দুই বন্ধু জটিল আলাপ যদি না করে, কে করবে?

অর্ণব।

হুঁ।

তোর মার আজ যে বিয়ে হচ্ছে সেই লোকটা কেমন?

হুঁ।

তোকে আদর করে?

হুঁ।

বেশি?

হুঁ।

আমার চেয়েও বেশি?

একটু বেশি।

ছেলের শেষ উত্তরটা নান্টুর ভাল লাগল না। নিজেকে সে এই ভেবে সান্তনা দিল যে ছেলে মানুষ, না ভেবে চিন্তে কথা বলছে। সে ঠিক করে রাখল যে ছেলেকে সত্যি ভালবাসা এবং নকল ভালবাসার মধ্যে প্রভেদটা বুঝতে হবে। তবে এখন না, একটু বড় হলেই বুঝতে হবে। সব কিছুরই একটা সময় আছে।

তোর মা আমার সম্পর্কে তোকে কিছু বলে?

না।

ভাল মন্দ কিছুই বলে না?

অর্ণব বাবার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পা নাচাতে নাচাতে বলল–পেপসি খাব।

নান্টু বলল, একটু ধৈর্য ধরে বস বাপধন। তোর ফরহাদ চাচু চলে আসবে। সে এলেই তাকে পেপসি আর ডিম আনতে পাঠাব। ডিমের পুডিং বানাব। ডিমের পুডিং কি তোর পছন্দ?

হুঁ।

ফরহাদ চাচুকে কি পছন্দ?

হুঁ।

ফরহাদ খুবই ভাল ছেলে। এরকম ভাল ছেলে বাংলাদেশে নাই। ভাল ছেলেদের কপালে দুঃখ থাকে। এই জন্যে তার কপালেও দুঃখ।

নান্টু আশা করেছিল ছেলে বলবে, কেন দুঃখ?

অর্ণব তা করল না। সে আগের মতই পা দুলাতে লাগল। নান্টুর ইচ্ছা করছে ফরহাদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে ছেলের সঙ্গে আলাপ করতে। অল্প বয়স থেকেই মানুষের দুঃখ কষ্ট সম্পর্কে ধারণা হওয়া দরকার। তাহলে বয়স কালে দুঃখী মানুষের প্রতি মমতা হয়।

নান্টু গরম ঘিয়ে চাল দিয়ে নাড়তে নাড়তে বলল, যে মেয়েটির সঙ্গে ফরহাদ চাচুর বিয়ের কথা হয়েছিল তার একটা ভয়ংকর অসুখ করেছে। খুবই ভয়ংকর অসুখ। সে চিকিৎসার জন্যে দেশের বাইরে গেছে। বুঝতে পারছিস?

হুঁ।

তোর ফরহাদ চাচুর খুব ইচ্ছা ছিল সেও সঙ্গে যাবে। টাকা নেই যাবে কি ভাবে? এখন সে পাগলের মত রাস্তায় হাঁটে। রাতে ঘুমায় না। যতবারই আমার ঘুম ভাঙ্গে আমি দেখি সে চুপচাপ বিছানায় বসে আছে। আমার চোখে পানি এসে যায়।

অর্ণব বলল, বাবা পেপসি খাব।

ধৈর্য ধর বাবা। একটু ধৈর্য ধর। জীবনে বড় হতে হলে ধৈর্য ধরতে হয়। ধৈর্য ইংরেজি কি জানিস?

পেশেন্স। আমার ধৈর্য ছিল না বলে—আজ এই দশা। টিভি দেখবি। টিভি ছেড়ে দেব?

না।

এটা ভাল। দিনরাত টিভি দেখা কোন কাজের কথা না। চোখের ক্ষতি হয়।

নান্টু পোলাও এ পানি দিয়ে পাতিলের মুখে ঢাকনা দিয়ে ছেলের কাছে এসে বসল। সে সামান্য উদ্বিগ্ন। কারণ ভাজা চালে গরম পানি দেয়ার কথা, সে দিয়েছে ঠাণ্ডা পানি। পোলাও হয়ত বা নরম হয়ে যাবে।

অর্ণব।

হুঁ।

তোর ফরহাদ চাচুর জন্যে আজ একটা সুসংবাদ আছে। সে মেসে এলেই সুসংবাদটা দেব তারপর দেখব সে কত খুশি হয়। সুসংবাদটা কি জানতে চাস?

না।

এটাতো বাবা ঠিক না। মানুষের সুখের সংবাদ, দুঃখের সংবাদ সব জানার আগ্রহ থাকতে হবে। সুসংবাদটা হল তোর ফরহাদ চাচুর জন্যে আমি টাকা জোগাড় করেছি। এখন শুধু একটা পাসপোর্ট করিয়ে প্লেনে তুলে দেয়া। পাসপোর্ট বের করা একদিনের মামলা। ইনশাল্লাহ আগামী পরশুর ফ্লাইটে তাকে তুলে দেব। বাবা কাজটা ভাল করেছি না?

জানি না।

খবরটা যখন তাকে দেব সে যে কি খুশি হবে এটা ভেবেই আনন্দে আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। খুব যখন আনন্দ হয় তখন মানুষের চোখে পানি আসে। তোর আসে না বাবা?

না।

এখন না এলেও পরে আসবে। পৃথিবীর সবচে পবিত্র পানি কি জানিস বাবা?

না।

মনের আনন্দে চোখে যে পানি আসে সেই পানি পৃথিবীর সবচে পবিত্র পানি।

বাবা পেপসি খাব।

আর দশটা মিনিট পোলাটা নামিয়ে আমি নিজেই যাব।

আমিও যাব।

অবশ্যই যাবি। তোকে ফেলে যাব না-কি? বাবারে আমি কাউকে ফেলে যাই না। লোকজন আমাকে ফেলে যায়।

নান্টু ঘড়ি দেখল। নটা বাজে। শর্মিলার বিয়ে হয়ত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিয়েতো কোন জাকজমকের বিয়ে না। দায়সারা বিয়ে। কাজির সামনে দুটা সিগনেচার। তারপর শুকনা খোরমা চিবানো। নান্টুর বিয়ের সময় খোরমা বাদ পড়ে গিয়েছিল। সব আনা হয়েছে। খোরমা আনা হয় নি। কন্যা পক্ষের একজন খুব হৈ চৈ শুরু করল—খোরমা আনতে হয় এটা জানেন না?

খোরমা নিয়ে হৈ চৈ করলেও কনের গয়না দেখে সবাই খুশি। পুরানো আমলের ভারী ভারী গয়না। খাদ কম সোনা বেশি। একটু চাপ দিলে গয়না বেঁকে যায়। সবই নান্টুর মায়ের গয়না। নান্টুর মা খুব অভাবে অনাটনে দিন কাটালেও তার বিয়ের একটি গয়না হাত ছাড়া করেন নি। ছেলের বৌকে কোন একদিন দেবেন বলে যক্ষের মত আগলে রেখেছিলেন।

নান্টু আজ সকালে খুব একটা খারাপ কাজ করেছে। শর্মিলার কাছ থেকে মার গয়না চেয়ে নিয়ে এসেছে। শর্মিলা এতে নিশ্চয়ই মনে কষ্ট পেয়েছে। কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই। গয়না বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা না করলে ফরহাদকে আসমানীর কাছে পাঠানো যেত না।

নান্টুর মনে হল বেহেশতে বসে তার মা তার উপর খুব রাগ করছেন। বিরক্ত গলায় বলছেন—নান্টু তুই কেমন ছেলে বলতো। গয়না চেয়ে নিয়ে চলে এলি? মেয়েটার কাছেই থাকতো। অর্ণবের বিয়ের সময় সে গয়নাগুলি অর্ণবের বৌকে দিত। গয়না যে বিক্রি করলি এখন অর্ণবের বৌকে কি দিবি?

নান্টু মনে মনে প্রশ্ন করল, মা কাজটা কি খুব ভুল করেছি? নান্টুর মনে হল তার মা বলছেন—তুই আমার পাগলা ছেলে। ভুল তুই করবি নাতো কে করবে? ব্যাটা শোন, ভুল করে মনে যদি আনন্দ পায় তাহলে ভুলগুলিই শুদ্ধ।

অর্ণব বিস্মিত হয়ে দেখছে তার বাবার চোখে পানি। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বাবা কাঁদছ কেন?

নান্টু বলল, রান্নার সময় চোখে ধোঁয়া লেগেছে। এই জন্যে চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কাঁদছি নাতো। আমি কাঁদব কেন? নান্টু অবাক হয়ে দেখল তার ছেলের ঠোট বেঁকে যাচ্ছে। বাবার কান্না দেখে ছেলের কান্না পেয়ে যাচ্ছে। অর্ণব প্রাণপণ চেষ্টা করছে কান্না সামলাবার। পারছে না। এইতো ছেলের চোখে পানি।

নান্টু ছেলেকে কাছে টেনে নিল। তার মনে হল এই পৃথিবীতে তারচে সুখী মানুষ আর কেউ নেই।

পেট্রোল পাম্পের মেয়েটা

পেট্রোল পাম্পের মেয়েটা অবাক হয়ে মানুষটাকে দেখছে। সুন্দর একজন মানুষ। লম্বা, ফর্সা। দৈয়ের হাড়ি হাতে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কি সুন্দর করেই না কথা বলছে। যেন সে রাস্তার কোন মেয়ে না। দ্রঘরের কোন মেয়ে। তাকে তুমি তুমি করেও বলছে না। আপনি করে বলছে।

অনেকদিন আগে আপনাকে দেখেছিলাম। তখন আমার হাতে এক হাড়ি দৈ ছিল। আমার ইচ্ছা ছিল আপনাকে দৈটা দেব। সেদিন দেয়া হয় নি। আজ নিয়ে এসেছি। আপনি যদি নেন তাহলে আমি খুব খুশি হব। আমার নাম ফরহাদ।

মেহেরুন্নিসা নামের নিশিকন্যা হাত বাড়িয়ে দৈ নিল। ক্ষীণ গলায় বলল, আমারে দৈ দেওনের ইচ্ছা ক্যান হইল?

ফরহাদ বলল, আপনি দেখতে আমার অতি প্রিয় একজনের মত। সে খুব অসুস্থ। দেশের বাইরে গেছে চিকিৎসার জন্যে। তার কথা খুব মনে পড়ছে বলেই আপনার কথা মনে পড়েছে।

আপনি তার কাছে যান না ক্যান?

টাকা ছিল না বলে যেতে পারি নি। পরে অবশ্যি আমার এক বন্ধু টাকা জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু টাকাটা আমার ভাইকে দিতে হয়েছে। ও মহাবিপদে পড়েছিল–টাকাটা পাওয়ায় উদ্ধার পেয়েছে।

মেহেরুন্নিসা সহজ ভাবে বলল, আপনের ভালবাসার মানুষটার নাম কি?

ফরহাদ বলল, তার নাম আসমানী। নামটা সুন্দর না?

বলতে বলতে ফরহাদের গলা ধরে এল। মেহেরুন্নিসা বলল, বৃষ্টি আসতেছে ভাইজান। আপনে ঘরে যান। আমি খুবই খারাপ একটা মেয়ে। তারপরেও আমি আপনেরে বললাম, দেখবেন আপনার ভালবাসার মানুষ আপনার কাছে ফিরা আসব।

বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টি নামলেই লোকজন আশ্রয়ের খুঁজে এদিক এদিক ছুটে যায়। ফরহাদ সে রকম কিছু করল না। বৃষ্টির ভেতর সে এগুচ্ছে। তার মধ্যে কোন ব্যস্ততা নেই।

আসমানী একবার বলেছিল, এই যে বাবু সাহেব শুনুন। একবার আমরা ঝুমঝুমা বৃষ্টিতে হাত ধরাধরি করে রাস্তায় হাঁটব। বৃষ্টি বিলাস করব। কেমন?

ফরহাদ বলল, আচ্ছা।

মনে থাকে যেন?

আমার মনে থাকবে।

ফরহাদের মনে আছে।

তার মনে থাকলেতো কিছু যায় আসে না। বিশ্বব্রহ্মান্ডের যিনি নিয়ন্ত্রক–তাঁর কি মনে আছে? তাঁর হয়তো মনে নেই। মানুষের মনে স্বপ্ন ঢুকিয়ে দিয়ে তিনি হয়ত দূরে সরে যান। কিংবা কে বলবে তিনি হয়ত দূরে যান না। খুব কাছেই থাকেন। স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণায় মানুষ যখন ছটফট করে, তিনিও করেন। কারণ এইসব স্বপ্নতো তিনিই তৈরি করেছেন। স্বপ্ন ভঙ্গের কষ্ট অবশ্যই তাঁকেও সইতে হবে।

ফরহাদ পেছনে তাকালো মেয়েটা ঠিক আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিজছে। একটুও নড়ে নি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। সেই দৃষ্টিতে গভীর মমতা। বৃষ্টি হচ্ছে। আসমানী একবার বলেছিল—বৃষ্টি হল মেঘের অশ্রু। মেঘ কাঁদছে, কারণ মেঘমালার জন্মই হয়েছে কাঁদার জন্যে।

Exit mobile version