Site icon BnBoi.Com

মা – আনিসুল হক

আনিসুল হকের উপন্যাস সমগ্র - আনিসুল হক

মা – ভূমিকা

মা
আনিসুল হক
১ম প্রকাশ ফেব্রুয়ারী বইমেলা

প্রকাশক : ফরিদ আহমেদ, সময় প্রকাশন, ৩৮/২ক, বাংলাবাজার, ঢাকা।

উৎসর্গ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নিযুত শহীদের প্রত্যেকের মা-কে

প্রথম সংস্করণের ভূমিকা

এই কাহিনীর সন্ধান সর্বপ্রথম আমাকে দেন মুক্তিযোদ্ধা নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ৷ তারপর অনেক দিন এই কাহিনী আমাকে তাড়িয়ে ফেরে ৷ অতঃপর আমি একটা উপন্যাস লেখার আশায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে শুরু করি ৷ শহীদ আজাদের আত্মীয়স্বজনের খোঁজ পাওয়ার জন্যে আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলাম ৷ বিজ্ঞাপনের সূত্র ধরেই শহীদ আজাদ সম্পর্কে যাঁরা জানেন, এমন অনেকের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে ৷ তাঁরা আমাকে দিনের পর দিন তথ্য দিয়ে, উপাত্ত দিয়ে সাহায্য করেছেন ৷ যাঁদের সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি, তাঁদের নামের তালিকা এ বইয়ের শেষে সংযুক্ত করে দিলাম ৷ তাঁদের সকলের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ ৷ আর বেশ কিছু বইয়েরও সাহায্য দরকার হয়েছে ৷ সেই তালিকাটাও এই বইয়ের শেষে থাকল ৷
এই উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে আমি নানা জনের কাছ থেকে উৎসাহ, অনুপ্রেরণা পেয়েছি ৷ ফেরদৌস আহমেদ জায়েদের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় ৷ সাপ্তাহিক ২০০০-এর সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী আমাকে দিনের পর দিন সময় দিয়েছেন, সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, উৎসাহ দিয়েছেন এবং এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি সংশোধন করে দিয়েছেন ৷ তাঁদের কাছে আমার ঋণ জীবনেও শোধ হওয়ার নয় ৷
এই উপন্যাস রচনাকালে এবং ঈদসংখ্যা প্রথম আলো ২০০২-এ এর সংক্ষিপ্ত রূপ প্রকাশের পর অনেকের কাছ থেকেই আমি অনেক উৎসাহ পেয়েছি ৷ বিশেষ করে পাঠকেরা, তাঁরা ঈদসংখ্যা প্রথম আলো পড়ে এবং সাপ্তাহিক ২০০০-এ ১৬ ডিসেম্বর ২০০২-এ প্রকাশিত আমার লেখা প্রচ্ছদকাহিনী শহীদ আজাদের মায়ের সন্ধানে পড়ে ফোনে, চিঠিতে ও সরাসরি কথা বলে আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন ৷ আলাদা করে আমি আর তাঁদের নাম বলতে চাই না, তাঁরা নিশ্চয়ই এই লেখা থেকেই আমার কৃতজ্ঞতাটুকু গ্রহণ করে নেবেন ৷
এখন একটা দরকারি কথা ৷ এই উপন্যাস সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত ৷ তবে এটা ইতিহাস নয়, উপন্যাস ৷ ইংরেজিতে যাকে বলে ফিকশন ৷ ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর বেলায় সত্যতা রক্ষার চেষ্টা করেছি পুরোপুরি ৷ যেমন শহীদ আজাদের চিঠিগুলো আসল ৷ ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনাগুলোর বেলায় অনেক জায়গায় কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়েছে, এটা বোধহয় বলাই বাহুল্য ৷ সব ফিকশনেই এটা নেওয়া হয় ৷ উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, মিলি-সংক্রান্ত বিবরণগুলো পুরোটাই বানানো ৷ কিন্তু একটি মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা আজাদ নিজেই লিখেছিলেন তাঁর মাকে লেখা চিঠিতে ৷
এই উপন্যাস কাউকে আঘাত দেওয়ার বাসনা থেকে রচিত নয়, বরং বাঙালির এক বীরোচিত আখ্যানকে তুলে ধরার আশায় লিখিত ও প্রকাশিত ৷ যদি কোনো অংশ কাউকে সামান্যতম অস্বস্তিতে ফেলে, তবে আমি তাঁকে বলব, ওই অংশটুকু সম্পূর্ণ কাল্পনিক ধরে নেবেন ৷
প্রিয় পাঠক, আপনার মঙ্গল হোক, মঙ্গল হোক এই দেশটার ৷
এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা আনিসুল হক
২৪ জানুয়ারি, ২০০৩

দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা

মা বই হিসাবে প্রকাশিত হওয়ার পর আমি আরো তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ পাই ৷ তাঁরা হলেন: শহীদ আজাদের আরেক খালাতো ভাই, আজাদের ধরা পড়ার রাতে গুলিবিদ্ধ মুসলেহ উদ্দিন চৌধুরী টগর, আজাদের আরেক সার্বক্ষণিক সঙ্গী ক্রিকেটার সৈয়দ আশরাফুল হক এবং তাঁদের আরেক বন্ধু ইব্রাহিম সাবের ৷ তাঁদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রাপ্ত কিছু তথ্য ও ঘটনা আমার কাছে অপরিহার্য বিবেচিত হওয়ায় এই বইয়ে তা সংযুক্ত না করে পারলাম না ৷ এর বাইরেও কিছু সংযোজন, বিয়োজন, পরিবর্ধন, পরিমার্জন করা হলো, যা হয়তো প্রথম সংস্করণের চেয়ে এই সংস্করণটাকে কিছুটা পরিপূর্ণ করে তুলবে ৷
উপন্যাসের ব্যাপারে আমি একটা পুরনো সূত্র এখনও মাথা থেকে তাড়াতে পারি না-কী বলা হলো তার চেয়েও কীভাবে বলা হলো, সেটা গুরুত্বপূর্ণ ৷
মা বই হিসাবে প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বস্তরের পাঠকের কাছ থেকে আমি যে সাড়া পেয়েছি-এরই মধ্যে এটির তিনটি মুদ্রণ হয়ে গেছে, এবং এটি এ বইয়ের চতুর্থ মুদ্রণ-শুধু বিক্রি বড় কথা নয়, পড়ার পর পাঠকের প্রতিক্রিয়াটাই হলো আসল, সেই জায়গায় আমি অভিভূত ৷ শ্রদ্ধেয় জ্যেষ্ঠ লেখক থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মের রাগী/অনুরাগী সদস্যটিও যেভাবে আমাকে ফোনে/চিঠিতে/ই-মেইলে/আলোচনায়/সাক্ষাতে তাদের ভালো লাগার কথা জানিয়েছেন, তাতে আমি সত্যি অনুপ্রাণিত ৷
আমি জানি, এই ভালোবাসা বা ভালো লাগাটা আমার কৃতিত্ব নয়; এটা আসলে দেশের জন্যে, মুক্তিযুদ্ধের জন্যে, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে, শহীদদের জন্যে, মায়ের জন্যে, সন্তানের জন্যে মানুষের ভালোবাসারই উৎসারণ ৷
দ্বিতীয় সংস্করণটির পাণ্ডুলিপিও সংশোধন করে দেওয়ার জন্যে দিয়েছিলাম সাপ্তাহিক ২০০০-এর সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা শ্রদ্ধেয় শাহাদত চৌধুরীকে ৷ তিনি দ্বিতীয়বারও কষ্ট করে বইখানা পড়েছেন ৷ তারপর একটা মন্তব্য জুড়ে দিয়েছেন : ‘এটা ডকু-ফিকশন ৷ তোমার লেখায় ঢাকার গেরিলাদের চিত্রটা তো চমৎকার এসেছে ৷ আমিও তো অনেক কথা ভুলে গিয়েছিলাম ৷ তোমার উপন্যাস পড়ে মনে পড়ল ৷ তুমি যেভাবে দেখেছ, শুনেছ, সেভাবেই থাকুক ৷ ঘটনা কিন্তু একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করে ৷ সেইভাবে দেখলে সংশোধন করাটা দরকারি নয় ৷’
তথাস্তু ৷ নানা জনের কাছে শুনে, নানা বইপত্র ঘেঁটে যা পেয়েছি, সেভাবেই থাকুক ৷ তবে কুশীলবদের কারো যদি মনে হয়, বড় রকমের কোনো ভুল রয়ে গেছে, নিশ্চয় ভবিষ্যতে সেটা সংশোধনের চেষ্টা করব ৷
আসলে তো, এরপরও ভুলত্রুটি থাকবে এবং থাকবে বিরূপ সমালোচনাও, তা থেকে আমরা আবারও নিশ্চিত হতে পারব যে আমরা কাজ করছি ৷
আনিসুল হক
১লা এপ্রিল, ২০০৩

০১. মা


আজাদের মা মারা গেছেন গতকাল বিকালে, পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে আজাদের ধরা পড়ার ঠিক ১৪ বছরের মাথায়, একই দিনে ৷
আজ তাঁর দাফন ৷
আলোকোজ্জ্বল শারদীয় দুপুর ৷ আকাশ ঘন নীল ৷ বর্ষাধোয়া গাছগাছালির সবুজ পাতায় রৌদ্ররশ্মি আছড়ে পড়ে পিছলে যাচ্ছে স্বর্ণলতার মতো ৷ শেওলা-ধরা ঘরবাড়ি দরদালানগুলো রোদে শুকুচ্ছে, যেন তারা বিছানা-বালিশ, বর্ষার আর্দ্রতা তাড়াতে তাদের কে যেন মেলে দিয়েছে রোদে ৷ রাস্তার কারুকার্যময় রিকশাগুলো ঝকমক করছে আলোয় আলোয় ৷ রিকশার ঘন্টির ক্রিং ক্রিং আওয়াজও যেন রোদে ঝিলিক দিচ্ছে ৷ এই চনমনে রোদের নিচে জুরাইন গোরস্তান চত্বরে সমবেত হয়েছেন এক দল শবযাত্রী ৷ তাঁদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ৷ গোরস্তানের সীমানা-প্রাচীরের বাইরে রাস্তায় গাড়িতে বসে আছেন জাহানারা ইমাম ৷
আজাদের মাকে সমাহিত করা হবে একটু পরেই ৷
আজ ৩১শে আগস্ট ৷ ১৯৮৫ সাল ৷ গতকাল, ৩০শে আগস্ট, আজাদের মা মারা গেছেন ৷
১৪ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ৩০শে আগস্ট রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা আজাদকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ৷ আজাদ আর ফিরে আসেনি ৷ এটা শহরের অনেক মুক্তিযোদ্ধারই জানা যে, এই ১৪টা বছর আজাদের মা একটা দানা ভাতও মুখে দেননি, কেবল একবেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন; কারণ তাঁর একমাত্র ছেলে আজাদ তাঁর কাছে ১৪ বছর আগে একদিন ভাত খেতে চেয়েছিল; পরদিন তিনি ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন রমনা থানায়, কিন্তু ছেলের দেখা আর পাননি ৷ তিনি অপেক্ষা করেছেন ১৪টা বছর, ছেলের আগমনের আশায় পথের দিকে চেয়ে থেকে ৷ অপেক্ষার এই ১৪টা বছর তিনি কোনো দিন বিছানায় শোননি, শানের মেঝেতে শুয়েছেন, কি শীত কি গ্রীষ্ম, তাঁর ছিল একটাই পাষাণশয্যা, কারণ তাঁর ছেলে আজাদ শোওয়ার জন্যে রমনা কি তেজগাঁ থানায়, কি তেজগাঁ ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে বিছানা পায়নি ৷
শহরের মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে যাঁরা ছিলেন আরবান গেরিলা দলের সদস্য, তাঁরা এসেছেন আজাদের মায়ের দাফনে শরিক হতে ৷ আজাদের মা মারা যাওয়ার আগে বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি মারা যাচ্ছেন, তিনি তাঁর ভাগ্নে জায়েদকে বলে রেখেছিলেন যেন আত্মীয়স্বজন কাউকে তাঁর মৃতু্যসংবাদ অবহিত না করা হয়; কিন্তু জায়েদ মুক্তিযোদ্ধাদের খবরটা না দিয়ে পারে না ৷ জায়েদের কোমরে আর উরুতে আছে বুলেট বের করে নেওয়ার ক্ষতচিহ্ন, ১৪ বছর আগে এই ৩০শে আগস্টের রাত্রির শূন্য ঘন্টায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ছোড়া বুলেট তার শরীরে বিদ্ধ হয়েছিল, তারপর থেকে সে সারাক্ষণ ভুগে আসছে হাত-পা-শরীরের অস্বাভাবিক জ্বলুনিতে ৷ এই জায়েদ মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামালকে ফোন করে আজাদের মায়ের মৃতু্যসংবাদ অবহিত করে ৷ আম্মার মারা যাওয়ার খবরটা-এই খালাকে জায়েদরা ডাকত আম্মা বলে-মিসেস জাহানারা ইমামকে জানানোও জায়েদ অবশ্যকর্তব্য বলে জ্ঞান করে ৷ কারণ জাহানারা ইমাম আর কেউ নন, রুমীর আম্মা; আজাদ দাদার বন্ধু, সহযোদ্ধা, সহ-শহীদ রুমী ভাইয়ের আম্মা ৷ ১৯৭১ থেকে ১৯৮৫-সন্তানের জন্যে নীরবে অপেক্ষা করা, আর পথ চেয়ে থাকা, আর ক্রমশ চারদিক থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার এই ১৪টা অন্ধকার নির্জন করুণ বছরে আজাদের মায়ের কাছে যে অল্প কজন সুহৃদ আসতেন, তাঁর খোঁজখবর নিতেন, তাঁর মনের ভেতরের দুষ্পাঠ্য শিলালিপি পাঠ করতে পারতেন সমবেদনার সঙ্গে, জাহানারা ইমাম তাঁদের একজন ৷
জাহানারা ইমাম অতঃপর রুমীর সহযোদ্ধা বন্ধুদের খবর দিতে থাকেন; শাহাদত চৌধুরী থেকে ফতেহ চৌধুরী, হাবিবুল আলম থেকে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদ থেকে চুল্লু ভাই, আবুল বারক আলভী থেকে শহীদুল্লাহ খান বাদল, সামাদ, মাহবুব, হ্যারিস, উলফত, লিনু বিল্লাহ, হিউবার্ট রোজারিও-সবাই খবর পেয়ে যান-আজাদের মা মারা গেছেন, তাঁর দাফন হবে জুরাইন গোরস্তানে ৷ জনা তিরিশেক মুক্তিযোদ্ধার কেউ সরাসরি, কেউবা শাহজাহানপুরে আজাদের মায়ের বাসা ঘুরে এসে জুরাইন গোরস্তান এলাকায় জড়ো হয়েছেন ৷
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর স্মৃতিতে আজাদের মায়ের দাফনের দৃশ্যটাও চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয়ে যায় ৷ তাঁর মাথায় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নও চিরকালের মতো আঁকা হয়ে যায়-শরৎকালের এ রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটায় বেলা ১২টার ঘন নীল আকাশ থেকে বৃষ্টি নামল কীভাবে ৷ আজাদের মায়ের শবদেহ খাটিয়ায় করে বয়ে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধারা, জুরাইন গোরস্তানের দিকে ৷ জুরাইন গোরস্তানটা দেখতে অন্য যে-কোনো গোরস্তানের মতোই-কিছু কাঁচা কবর, কিছু পাকা; পাকা কবরগুলোর কোনোটার চারদিকে কেবল ৫ ইঞ্চি ইটের দেয়াল, পলেস্তারাহীন, শেওলা-লাগা, আবার কোনোটা মার্বেল পাথরে ঢাকা, এপিটাফে নামধাম জন্মমৃতু্যসনতারিখ, কোনো কোনো সমাধিসৌধ বেশ জলুসপূর্ণ, তাতে নানা রঙিন কাচ-পাথর বসানো, কোনোটায় টাইলস বসানো, দু-তিন দিন বয়সী কবরের মাটি এখনও ঝুরঝুরে, শিয়রে খেজুরপাতা, একটা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে চোখ বন্ধ করে মোনাজাত করছে দুজন টুপি-মাথা শাদা-পাঞ্জাবি তরুণ-এসব দৃশ্যের মধ্যে এমন কিছু নাই যা আলাদা করে চোখে পড়বে ৷ আম্মা, জাহানারা ইমাম, গোরস্তানের মধ্যে মহিলাদের ঢোকা শাস্ত্রসম্মত নয় বলে বাইরে রাস্তায় বসে আছেন গাড়িতে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটা এগিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া এক সহযোদ্ধার মাকে খাটিয়ায় তুলে নিয়ে ৷ সঙ্গে মরহুমার কিছুসংখ্যক আত্মীয়স্বজন ৷ তাদের অনেকের মাথায় টুপি ৷ কবরে নামানো হয় শাদা কাফনে মোড়ানো নাতিদীর্ঘ শরীরটাকে, প্রথম মাটিটা দিতে বলা হয় আজাদের খালাতো ভাই জায়েদকে, জায়েদ কথার মানে বুঝতে পারে না, তাকিয়ে থাকে নির্বাক আর নিষ্ক্রিয়, তখন একজন তাকে ধরে তার হাতে একমুঠো মাটি তুলে দেয়, এবং মাটিটা ফেলে দেওয়ার জন্যে তার আঙুলগুলো আলগা করে ধরে, জায়েদের হাত থেকে মাটি ঝরে যায় ৷ তারপর একজন একজন করে মুক্তিযোদ্ধা গোরে মাটি দিতে থাকেন, ঠিক তখনই নির্মেঘ আলোকোজ্জ্বল আকাশ থেকে ঝিরঝির করে নেমে আসে বৃষ্টি ৷ একই সঙ্গে প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধার ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে একটা অজানা মিষ্টি সুগন্ধ হানা দেয়, আর তাঁরা মাথার ওপরে তাকালে দেখতে পান একখণ্ড বিচ্ছিন্ন মেঘ ৷ রোদ আর বৃষ্টি একসঙ্গে পড়াটা এই বাংলায় কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে খেঁকশিয়ালির বিয়ে হচ্ছে-ছোটবেলা থেকে এ ছড়াটা কারই বা জানা নাই, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধার মনে হতে থাকে-এই সুগন্ধ, এই সালোক বৃষ্টির অন্য কোনো মানে আছে; তাঁদের মনে হয়-এই শবযাত্রীদলে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া শহীদ-বন্ধুরা ফিরে এসেছে, যোগ দিয়েছে ৷ বাচ্চু এর পরে বহু বছর এ আফসোস করবেন যে কেন তাঁরা সেদিন ঘাড় ঘোরাননি, ঘোরালেই তো দেখতে পেতেন যুদ্ধদিনে চিরতরে হারিয়ে ফেলা তাঁর সহযোদ্ধা বন্ধুদের অনেককেই, আবার এই ১৪ বছর পরে; হাতের এতটা কাছে তিনি পেয়ে যেতেন শহীদ জুয়েলকে, পূর্ব পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান জুয়েল, যার হাতে গুলি লেগেছিল বলে ধরা পড়ার রাতেও ডান হাতের আঙুলে ছিল ব্যান্ডেজ, সেই ব্যান্ডেজঅলা আঙুলেই জুয়েল কবরে মাটি দিচ্ছে; দেখতে পেতেন শহীদ বদিকে, স্ট্যান্ড করা ছাত্র বদিউল আলম হয়তো আলবেয়ার কামুর আউটসাইডারটা প্যান্টের কোমরে গুঁজে এক হাতে মাটি দিচ্ছে সমাধিতে; দেখতে পেতেন শহীদ আজাদকে, মরহুমার একমাত্র সন্তান হিসেবে যে এসেছে কর্তব্য পালন করতে, মায়ের শেষকৃত্যে অংশ নিতে; কিন্তু যার পকেটে এখনও আছে জর্জ হ্যারিসনের গানের নিজের হাতে লেখা কপি, মাই ফ্রেন্ড কেম টু মি, স্যাডনেস ইন হিজ আইস…বাংলা দেশ, বাংলা দেশ, সে যেন জর্জ হ্যারিসনের মতোই ভাঙা উচ্চারণে গাইছে ব্যাংলা দেশ, ব্যাংলা দেশ আর গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের মতো মাটি ছিটিয়ে ঢেকে দিচ্ছে কবরখানি ৷ আবুল বারক আলভী দেখতে পান শহীদ আলতাফ মাহমুদকে, যে-কোদাল দিয়ে একাত্তরের ৩০শে আগস্ট ভোরে তিনি তাঁর রাজারবাগের বাসার আঙিনায় লুকিয়ে রাখা অস্ত্র তুলছিলেন মিলিটারির বেয়নটের খোঁচা খেতে খেতে, সেই কোদাল নিয়েই এসে গেছেন আলতাফ মাহমুদ, একটু একটু করে মাটি ঢালছেন গোরে ৷ তাঁর কপালে বেয়নটের একটা খোঁচা লাগায় ভুরুর ওপর থেকে চামড়া কেটে নেমে গিয়ে ঝুলে আছে কপালের ওপর, এখনও, যেমনটা ছিল ১৪ বছর আগের সেই ভোরে ৷ আজ তাঁর মুখে যেন আবার বেজে উঠছে অস্ফুট সুর, তারই নিজের কম্পোজিশন : আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি ৷ হয়তো শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের এই ভিড়ে এসেছে শহীদ বাকের, এসেছে শহীদ আশফাকুস সামাদ, এসেছে আজাদদের বাসায় থাকা পেয়িং গেস্ট মর্নিং নিউজের সাংবাদিক শহীদ বাশার ৷ এসেছে শহীদ আজাদের সহযোদ্ধা আরো আরো শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা ৷
আজাদের মাকে সমাহিত করে প্রথানুযায়ী দোয়া-দরুদ পড়ে মোনাজাত সেরে একে একে গোরস্তান ছেড়ে চলে আসেন শবযাত্রীদলের সবাই ৷ জায়েদ কবরের গায়ে মরহুমার একটামাত্র পরিচয় উৎকীর্ণ করে রাখে : শহীদ আজাদের মা ৷ এই তাঁর একমাত্র পরিচয় ৷ তাঁর আর কোনো পরিচয়ের দরকার নাই ৷ এই পরিচয়-ফলক দেখে কেউ কেউ, যেমন আজাদের দূর-সম্পর্কের মামারা, সরোষে এ মত প্রদান করেছিলেন যে কবরের গায়ে মুসলমান মহিলার অবশ্যই স্বামীর নাম থাকা উচিত, কিন্তু জায়েদ নাছোড়, ‘আম্মা মরার আগে আমারে স্পষ্ট ভাষায় কইয়া গেছে, বাবা রে, আমি যাইতেছি, তুমি এইটা এইটা কইরো, এইটা এইটা কইরো না, আম্মার হুকুম, কবরের গায়ে একটাই পরিচয় থাকব, শহীদ আজাদের মা ৷ ব্যস আর কিছু না ৷’
১৯৮৫ সালের শরতেই শুধু নয়, তারও এক দশক দু দশক পরে, যে জিয়ারতকারীরা বা শবযাত্রীরা জুরাইন গোরস্তানে যাবে, যদি লক্ষ করে, তারা দেখতে পাবে একটি কবরের গায়ে এই নিরাভরণ পরিচয়-ফলকখানি: মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা ৷ কী জানি, তাদের মনে কোনো প্রশ্ন জাগবে কি জাগবে না ৷ কিন্তু জায়েদ জানে, এ ছাড়া আর কোনো পরিচয়েরই আম্মার দরকার নাই, বরং অন্য কোনো পরিচয় কেবল অনাবশ্যক নয়, অবাঞ্ছিত বলে গণ্য হতে পারে ৷
তবু ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কারো কারো মনে হবে, তাঁর পরিচয়টা শুধু শহীদ আজাদের মা-ই নয়, তিনি নিজেও এক অসমসাহসিকা যোদ্ধা, তিনি বীর, তিনি সংশপ্তক, তিনি কেবল জাতির মুক্তিযুদ্ধে ছেলেকে উৎসর্গ করেছেন, তা-ই নয়, সারাটা জীবন লড়ে গেছেন তাঁর নিজের লড়াই এবং সেই যুদ্ধে তিনি হার মানেননি ৷

 ০২. মা


১৯৮৫ সাল ৷ শরৎ এসেছে এই বাংলায়, এই ঢাকায়, সদ্য-মাজা কাঁসার বাসনের মতো আলোকোজ্জ্বল আকাশ, তার তীব্র নীল, আর ভাসমান দুধের সরের মতো মেঘমালা, আর শিউলির বোঁটায় বোঁটায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু নিয়ে ৷ রাতের রাজপথ এখানে এখন কারফিউ-কাতর, দিনের রাজপথ জনতার বিক্ষোভ-মিছিলের পদচ্ছাপগুলো ধারণ করবে বলে প্রতীক্ষমাণ ৷ প্রতিবছর শরৎ এলেই ঢাকার বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধার মাথা এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে ৷ স্বাধীনতার ১৪ বছর পর ১৯৮৫-র এই শরৎও তার ব্যতিক্রম নয় ৷ বরং ৩০শে আগস্ট আজাদের মায়ের মৃতু্য আর ৩১শে আগস্ট তাঁর দাফনের পর ঢাকার মুক্তিযোদ্ধারা সবাই যেন বড় বেশি তাড়িত, বড় বেশি নিমজ্জিত হয়ে পড়েন ৷ অতীত তাঁদের তাড়িয়ে ফেরে, স্মৃতি তাঁদের ঘিরে ধরে অক্টোপাসের মতো ৷ কাজী কামাল উদ্দিন বীরবিক্রম চন্দ্রগ্রস্তের মতো হয়ে যান ৷ চাঁদটা যেন তাঁর কাছে একটা পেয়ালা, জ্যোৎস্না যেন পানযোগ্য, চরাচরব্যাপী যতটা জ্যোৎস্না, সবটা তিনি গলাধঃকরণ করে ফেলতে পারেন ৷ তাঁর আফসোস হতে থাকে, রেইডের রাতে তিনি যদি সমর্থ হতেন পাকিস্তানি আর্মি অফিসারের হাত থেকে মেশিনগানটা কেড়ে নিয়ে পুরোপুরি তার দখল নিয়ে নিতে, যদি জিম্মি করতে পারতেন পাকিস্তানি অফিসারটাকে, তাহলে তো তাঁদের হারাতে হতো না এত এত সহযোদ্ধাকে! আর কী দামি একেকটা অস্ত্র ৷ তাঁর প্রিয় পিস্তলটা! আর সেই রকেট লাঞ্চারটা! হাবিবুল আলম বীরপ্রতীকের মনে হতে থাকে, আরেকটু সাবধান বোধহয় হওয়া যেতে পারত ৷ খালেদ মোশাররফ তো বলেইছেন, ইউ ডিড নট ফাইট লাইক আ গেরিলা, ইউ ফট লাইক আ কাউবয় ৷ শাহাদত চৌধুরী চোখের জল আটকাতে পারেন না ৷ তাঁর চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে যায় ৷ সামান্য ভুলের জন্যে এতগুলো প্রাণ গেল, এত অস্ত্র গোলাবারুদ! তিনি বা আলম যদি তখন ঢাকায় থাকতেন, তাহলে হয়তো এতগুলো তরুণপ্রাণের ক্ষয় রোধ করা যেত! বড় ভাই হিসাবে, শাচৌ হিসাবে মৃতু্যভয়-তুচ্ছজ্ঞানকারী এইসব কিশোর-তরুণের নিরাপত্তা-বিধানের তথা তাদের গাইড করার একটা অলিখিত দায়িত্ব তাঁর ছিলই! ফতেহ চৌধুরীর মনে হয়, ২৯শে আগস্ট বিকালেই যখন জানা গেল, উলফত খবর দিল, সামাদ ভাই ধরা পড়েছে, তখনও যদি তিনি সবগুলো বাড়ি চিনতেন, যদি সবাইকে বলে দিতে পারতেন, সাবধান, তাহলে হয়তো রুমী মরত না, জুয়েল মরত না, আজাদ মরত না, বাশার মরত না…
শহীদ রুমীর মা জাহানারা ইমামের মনে হয়, রুমী যখন যুদ্ধে যাওয়ার জন্যে জিদ ধরল, তখন তিনি কেন বলে ফেললেন, যা, তোকে দেশের জন্যে কুরবানি করে দিলাম, আল্লাহ বুঝি তাঁর কুরবানি কথাটাই শুনেছেন, আহা রে, এ কথাটা যদি তিনি না বলতেন, যদি বলতেন, যা রুমী যুদ্ধ জয় করে বীরের বেশে স্বাধীন দেশে ফিরে আয়, তাহলে হয়তো আল্লাহ তাঁর ছেলেটাকে নিতেন না, ছেলেটা ফিরে আসত ১৬ই ডিসেম্বরে, যেমন করে ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ তাঁর এলিফ্যান্ট রোডের বাসা কণিকায় এসেছিল শাহাদত, মেজর হায়দার, বাচ্চু, হাবিবুল আলমেরা, স্টেনগান কাঁধে নিয়ে, লম্বা চুল, কারো কারো গালে দাড়ি, দাড়িতে কেমন লাগত রুমীকে… আচ্ছা ওটা তো আমার মনের কথা ছিল না, শাহাদত, বাচ্চু, উলফত, চুল্লু, হাবিব, কামাল, ওটা তো আমার মনের কথা ছিল না, আল্লাহ না অন্তর্যামী, তিনি আমার মুখের কথাটা ধরলেন, আমার মনের কথাটা পড়তে পারলেন না…
শরৎ এলেই এইসব স্মৃতি আর শোচনা তাঁদের উদ্বান্ত করে ফেলে, মনে হয়, পৃথিবীর সমান নিঃসঙ্গতা তাঁদের গিলে ফেলতে আসছে, তার আগেই যদি তাঁরা ধরে ফেলতে পারেন পরস্পরের বিশ্বস্ত আঙুল ৷ কিন্তু এটা ১৯৮৫ সাল, ১৯৭১ নয় ৷ যুদ্ধদিনের পরশপাথর ছোঁয়ানো দিন কি আর ফিরে আসবে ? কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কুলি সর্দার রশিদ আর সাপ্তাহিক বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী কি আবার একই সিগারেট ভাগ করে খাওয়ার শ্রেণীভেদাভেদ ভুলে যাওয়া দিনে ফিরে যেতে পারেন ?
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ঘুমহীনতায় জেগে ওঠেন! কেবল যুদ্ধে হারানো সহযোদ্ধাদের মুখই নয়, নয় শুধু কিশোর মুক্তিযোদ্ধা টিটোর গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহের ছবি, নয় শুধু গুলিবেঁধা শরীর নিয়ে শেষবারের মতো নড়ে ওঠা মানিকের চোয়াল আর দুই ঠোঁটের অব্যক্ত ধ্বনির ফিসফাস, তিনি দেখতে পান যুদ্ধের পরও প্রতিবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের একে একে মরে যাওয়ার ছবি, চলচ্চিত্রের মতো, একের পর এক, সার সার মৃতদেহ শুধু, মুক্তিযোদ্ধাদের-খালেদ মোশাররফ নাই, হায়দার নাই, মুখতারের লাশ পড়ে আছে স্বাধীন দেশের রাস্তায়, খালেদ মোশাররফ বলতেন, স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলাদের নিতে পারে না, তার চাই শহীদ…
জায়েদ হাহাকার করে ওঠে ৷ মোটরের গ্যারাজ থেকে ফিরতে ফিরতে রাতের বেলা সে ফিসফিস করে, ‘আমি আজাদ দাদাকে সাবধান কইরা দিছলাম, ওই বেটা কামরুজ্জামান পাকিস্তানি আর্মির ইনফরমার, ওই বেটা ক্যান আমগো বাড়ির চারদিকে ঘুরে, দাদা কয় বাদ দে, তুই আজাইরা ভয় পাস! ক্যান ওই বাড়িতে রাইতের বেলা ওনারা থাকতে গেল ?’
আফসোস করে ওঠেন আজাদের বন্ধু বাস্কেটবল খেলোয়াড় ইব্রাহিম সাবেরও-ওই দিন দুপুরবেলা, একাত্তরের ২৯শে আগস্টেই, তিনি যখন আজাদদের বাসায় যাচ্ছিলেন-প্রায়ই তিনি ওদের বাসায় দুপুরে খেতে যেতেন, আজাদের মা ইলিশ পোলাওটা খুব ভালো রাঁধতেন-বাসার কাছেই একটা দোকান, তাতে তিনজন যুবক বসে, তিনি আজাদের বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছেন আর যুবকত্রয় মাথা বের করে দেখছে, একজন তাঁকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, ‘ভৈরব ব্রিজটা পাহারা দিতেছে পাকিস্তানি আর্মিরা, ওই আর্মিগো অ্যাটাক করতে হইলে আমি সাহায্য করতে পারি’, শুনে তাঁর সন্দেহ হয়, এরা বাসাটায় নজর রাখছে নাকি, আর্মির ইনফরমার নয় তো, আজাদদের বাসায় গিয়ে তিনি আজাদকে বলেন, ‘আজকের রাতটা তোরা এখানে থাকিস না’, কিন্তু ওরা তাঁর কথায় পাত্তাই দিল না, কেন যে দিল না ?
একেকজন মুক্তিযোদ্ধার বিচ্ছিন্ন দশটা আঙুল কোনো এক সহযোদ্ধার আরো দশটা আঙুলের সন্ধানে মিকেলাঞ্জেলোর ছবির মতো সঞ্চরণশীল হয়ে ওঠে ৷ একজন আরেকজনকে পেয়ে যান ৷ সরব স্মৃতিচারণ কিংবা নীরব স্মৃতি রোমন্থনের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে নিজেদেরই যাপিত জীবনের কিংবদন্তি ৷ এ-কথা সে-কথায় এসে যায় আজাদের প্রসঙ্গ ৷ উচ্চারিত হয়, কিংবা স্মৃত হয়, শেষ পর্যন্ত মাথা নত না করে লড়ে যাওয়া আজাদের মায়ের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিগত সংগ্রামের কথা ৷
তাঁদের মনে পড়ে যায়, আজাদের শেষ দিনগুলো কেটেছে মগবাজারের বাসায়, যুদ্ধদিনের বন্ধুরা এ বাসায় গেছেন অনেকেই ৷ কিন্তু যাঁরা তার ছোটবেলার বন্ধু, তাঁরা স্মরণ করেন যে, ২০৮ নিউ ইস্কাটনে আজাদদের বাসাটা ছিল ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ বাসা ৷ তাঁরা নিঃসন্দেহ যে এই বাসার কোনো তুলনা ছিল না ৷
‘বাসাটা ছিল দুই বিঘা জমির ওপরে’-একজন বলেন ৷
‘বাসাটায় হরিণ ছিল, একদিন আমার হাত থেকে বাদাম নিতে গিয়ে একটা হরিণ আমার হাতের তালু চেটে দিয়েছিল ৷’ কাজী কামাল এ কথা বলতেই পারেন ৷ কারণ তিনি ছিলেন আজাদের সহপাঠী ৷ সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের ছাত্র ছিল আজাদ ৷ গ্রেগরি স্কুলের ছাত্র ছিল লে. সেলিমও ৷ সেও তো শহীদ ৷ সেন্ট গ্রেগরির ছাত্র ছিল রুমী, রউফুল হাসান, ওমর ফারুক, চৌধুরী কামরান আলী বেগ, মেজর সালেক চৌধুরী ৷ তাঁদের মনে না পড়ে কোনো উপায় থাকে না ৷ তাঁরা ফিরে যান সুদূর অতীতে, তাঁদের শৈশবের দিনগুলোয়, যে-অতীত এত দিন ঢাকা ছিল কালের যবনিকার আড়ালে ৷
‘হরিণের বাচ্চা হচ্ছে, সেগুলো বড় হচ্ছে, এইভাবে হরিণের সংখ্যা দাঁড়ায় অনেকগুলো’-স্মরণ করে টগর, আজাদের আরেক খালাতো ভাই, জায়েদের সঙ্গে একাত্তরের ৩০শে আগস্টের সেই রাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল যে ৷
‘বাড়িতে তাদের ঝরনা ছিল, সরোবরে রাজহাঁস সাঁতার কাটত, বিরাট লন ছিল, ছিল মসলার বাগান ৷ আমি একদিন ওদের দারুচিনির গাছ থেকে পকেট ভরে ছালবাকল এনেছিলাম’-একজন বিড়বিড় করেন ৷
‘বিরাট বাড়ি, আগাপাস্তলা মোজাইক, ঝকঝকে দামি সব ফিটিংস, আজাদের মায়ের ড্রেসিং রুমটাই একটা বেডরুমের সমান বড়’-জাহানারা ইমাম লেখেন ৷
‘আজাদের বাবা ইউনুস চৌধুরী ছিল ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড়লোকদের একজন’-বলেন একজন ৷
‘বড়লোকদের একজন না ৷ সবচেয়ে বড়লোক’-আরেকজন প্রতিবাদ করে ওঠেন ৷
তখন অভিজ্ঞতা আর কিংবদন্তি এসে তাঁদের সম্মিলিত স্মৃতিকে সরগরম করে তোলে ৷ সেই স্মৃতি, সেই কিংবদন্তি, সেই ইতিহাস, সেই পুরাণ, মগবাজারের সেই বাড়িটার দেয়ালে বিঁধে থাকা গুলির প্রত্নগাথা, জায়েদের ট্রাঙ্কে সযত্নে তুলে রাখা আজাদের মাকে লেখা আজাদের চিঠির মধ্যে চিরস্থায়ী হয়ে বেঁচে থাকা ইতিহাস-এইসব যদি জোড়া দেওয়া যায়, কী দাঁড়ায় ?
যুদ্ধের ভেতর থেকে উঠে আসে আরেক যুদ্ধ, ইতিহাসের ভেতর থেকে উঠে আসে এক মহিলার নিজস্ব সংগ্রামের অবিশ্বাস্য অবিস্মরণীয় উপ্যাখ্যান ৷

 ০৩. মা

তখনও আদমজীর বাড়ি হয়নি ৷ বাওয়ানির বাড়িও ছিল খুব বিখ্যাত, কিন্তু সেটা আজাদদের ইস্কাটনের বাড়ির তুলনায় ছিল নিষ্প্রভ ৷ আজাদের বাবা ইউনুস চৌধুরী ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, টাটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন, ছিলেন বোম্বেতে, কানপুরে, কলকাতায় ৷ কানপুরেই জন্ম হয় আজাদের ৷ ইউনুস চৌধুরী আর সাফিয়া বেগমের একটা মেয়ে হয়েছিল, তার নাম ছিল বিন্দু, কিন্তু সে বেশি দিন বাঁচেনি ৷ বসন্ত কেড়ে নিয়েছিল তার জীবন ৷ প্রথম মেয়েকে হারিয়ে সাফিয়া বেগম অনেকটা পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন, ফলে তাঁর কোলে যখন আজাদ এল, তিনি আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো করে আগলে রাখতে শুরু করলেন ছেলেকে ৷ আজাদের একটা ছোট ভাইও হয়েছিল পরে, বিক্রমপুরে, কিন্তু সাত দিনের মাথায় সেও মারা যায় আঁতুড়ঘরেই ৷ ফলে আগে-পরে আজাদই ছিল সাফিয়া বেগমের একমাত্র সন্তান ৷ অন্ধের যষ্টি বাগধারাটা আজাদ আর তার মায়ের বেলায় প্রয়োগ করা যেতে পারত ৷ আজাদ ছিল পাকিস্তানের প্রায় সমবয়সী, তবে আজাদই একটু বয়োজ্যেষ্ঠ ৷ তাঁর জন্ম হয় ১১ই জুলাই, ১৯৪৬ ৷ আজাদি আজাদি বলে যখন পাগল হয়ে উঠেছিল সারা ভারতবর্ষ, তখনই আজাদের জন্ম বলে তার নাম রাখা হয় আজাদ ৷ ১৯৪৭-এর আগস্টে ভারত-পাকিস্তান দুটো দেশ আলাদা হওয়ার পর বোম্বে থেকে চৌধুরী সাহেব চলে আসেন ঢাকায় ৷ নিয়তির হাতে নিজেকে সঁপে দিয়ে চলে আসেন তিনি ৷ আসবার ইচ্ছা তেমন ছিল না তাঁর, কিন্তু সাফিয়া বেগম জন্মভূমি ফেলে রেখে অন্য দেশে রয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না একেবারেই ৷ ইউনুস চৌধুরী বিক্রমপুরের ছেলে, মেদিনীমণ্ডল গ্রামে তাঁর পৈতৃক নিবাস ৷ টাটা কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঢাকায় এসে ইউনুস চৌধুরী ব্যবসা শুরু করেন ৷ নানা ধরনের ব্যবসা ৷ যেমন সাপ্লাই আর কন্ট্রাকটরি ৷ প্রভূত উন্নতি করেন তিনি, বিষয়-সম্পত্তি বাড়তে থাকে অভাবনীয় হারে ৷ লোকে বলে, ইউনুস চৌধুরীও বলে বেড়ান, এসবের মূলে ছিল একজনের সৌভাগ্য : আজাদের মা ৷ বউয়ের ভাগ্যেই সৌভাগ্যের সিংহদুয়ার খুলে যায় চৌধুরীর ৷ যদিও তাত্তি্বকেরা এ রকম ব্যাখ্যা দিতে পারে যে, পাকিস্তান কায়েম করাই হয়েছিল মুসলমান মুৎসুদ্দি ও উঠতি ধনিকদের স্বার্থকে নিরঙ্কুশ করার জন্যে, সে-সুযোগ কাজে লাগান ইউনুস চৌধুরী; তবু, চৌধুরী নিজেই তাঁর বৈষয়িক উন্নতির জন্য তাঁর স্ত্রীর ভাগ্যকে মূল্য দিতেন ৷ আসলে, এটা দৃষ্টিগ্রাহ্য যে, বিয়ের পরই ধীরে ধীরে ভাগ্য খুলতে থাকে তাঁর ৷ ইউনুস চৌধুরী যে কানপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়েছেন, তার টাকা যুগিয়েছেন সাফিয়া বেগম ৷ ঢাকায় আসার পর তিনি যে ব্যবসাপাতি শুরু করেন, তারও প্রাথমিক মূলধন যুগিয়েছিলেন সাফিয়া বেগমই, বাবার কাছ থেকে বিয়ের সময় পাওয়া গয়নার কিয়দংশ বিক্রি করে ৷ পাকিস্তানে চলে আসার পর আস্তে আস্তে আজাদের বাবা হয়ে ওঠেন ইউনিয়ন ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান, চিত্তরঞ্জন কটন মিলের চেয়ারম্যান, একুয়াটি শিপিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ৷ একটা কাস্টম ফোর্ড গাড়ি ছিল তাঁর ৷ গাড়ির নম্বর ছিল ইপিডি ৪৩৪৯ ৷ জনশ্রুতি আছে যে, ইরানের শাহ পাহলভি যখন পূর্ব পাকিস্তানে আসেন, তখন তাঁর গাড়ি হিসাবে ব্যবহারের জন্য ইউনুস চৌধুরীর গাড়ি সরকার ধার নিয়েছিল ৷ এ রকমও শোনা যায়, প্রিন্স ফিলিপ শিকারে এসে আজাদদের বাসায় উঠেছিলেন ৷ ভিন্নমতও শোনা যায়, না ঠিক বাসায় ওঠেননি, চৌধুরীর গাড়িটা প্রিন্সের জন্যে ধার নিয়েছিল সরকার, আর আজাদের বাবা তাদের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন ৷
যা-ই হোক না কেন, আজাদের বাবা ছিলেন এই শহরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি ৷
আর আজাদদের ইস্কাটনের বাড়িটা ছিল শহরের সবচেয়ে দর্শনীয় বাড়ি ৷ বহু লোক শুধু বাড়ি দেখতেই এ ঠিকানায় আসত ৷
স্মৃতিচারণকারীদের মনে পড়ে যায়, এই বাড়ির একটা রেকর্ড রয়ে গেছে ৩৫ মিলিমিটার সেলুলয়েডে ৷ ডাকে পাখি, খোলো আঁখি, দেখো সোনালি আকাশ, বহে ভোরের বাতাস-সিনেমার এই গানটা শুটিং হয়েছিল এই বাসাতেই ৷ টেলিভিশনের ছায়াছবির গানের অনুষ্ঠানে এটা অনেকবার দেখানো হয়েছে ৷
সিনেমার ওই গানের অংশটা খেয়াল করে দেখলেই বোঝা যাবে বড় জব্বর ছিল ওই বাড়িটা ৷
আজাদ ছিল বাড়ির একমাত্র ছেলে ৷
আর আজাদের মা সাফিয়া বেগম ছিলেন বাড়ির সুখী গৃহিণী ৷ ছোটখাটো মানুষটার শাড়ির আঁচলে থাকত চাবি ৷ তিনি বাড়িময় ঘুরে বেড়াতেন ৷ আর আল্লার কাছে শোকর করতেন ৷ জাহানারা ইমামের বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরোয়-আজাদের মাকে তিনি দেখেছেন এ রকম : ‘ভরাস্বাস্থ্যে গায়ের রঙ ফেটে পড়ছে, হাতে-কানে-গলায় সোনার গহনা ঝকমক করছে, চওড়া পাড়ের দামি শাড়ির আঁচলে চাবি বাঁধা, পানের রসে ঠোঁট টুকটুকে, মুখে সব সময় মৃদু হাসি, সনাতন বাঙালির গৃহলক্ষ্মীর প্রতিমূর্তি ৷’
ইউনুস চৌধুরী সেদিন বলেছেন, ‘ওগো শুনছ, আজাদের মা! বাড়িটা আমি তোমার নামেই রেজিস্ট্রি করিয়েছি ৷ এ বাড়ির মালিক তো তুমি ৷’
সাফিয়া বেগম রাগ করেছেন ৷ ‘আমি বিষয়-সম্পত্তির কী বুঝি ? এটা আপনি কী করেছেন ? না না ৷ আপনার বাড়ি আপনি নিজের নামে রেখে দিন ৷’
ইউনুস চৌধুরী হেসে উঠেছেন ৷ ছাদ কাঁপানো হাসি ৷ ‘তুমি তো আমার আছই ৷ তাইলে বিষয়-সম্পত্তিও আমার আছে ৷ কেন, ফরাশগঞ্জের বাড়িও তো আমি তোমার নামে রেখেছি ৷ হা-হা-হা ৷’ তারপর হাসি থামিয়ে বলেছেন, ‘তোমার বরাতেই আমার বরাত খুলেছে ৷ বাড়িটা তোমার নামেই রাখাটা ন্যায্য ৷’
স্বামীর কথা শুনে আশ্বস্ত বোধ করলেও কী এক অজানা আশঙ্কায় সাফিয়া বেগমের মনটা তবু যেন কেন কেঁপে উঠেছে ৷ বেশি সম্পত্তির মালিক হওয়া ভালো নয় ৷ টাকা-পয়সা বেশি হলে মানুষ বদলে যায় ৷ আর আজাদের বাবা লোকটা দেখতে এত সুন্দর-তিনি লম্বা, তাঁর গাত্রবর্ণ ফরসা, গাঢ় ভুরু, উন্নত কপাল, উন্নত নাক, উজ্জ্বল চোখ, ভরাট কন্ঠস্বর-সব মিলিয়ে তিনি এমনি যে মেয়ে-মাত্রই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য ৷ আরেকটা ছবি, হয়তো অকারণেই, সাফিয়া বেগমের মনের পটে মাঝে মধ্যে উদিত হতে থাকে ৷ বোম্বে থাকতে ইউনুস চৌধুরী একটা মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছিলেন কৃষ্ণের চরিত্রে, একদিকে রাধা, অন্যদিকে অনেকগুলো গোপিনী কৃষ্ণের জন্যে প্রাণপাত করছে, এই দৃশ্য প্রেক্ষাগৃহের সামনের আসনে বসে দেখেছিলেন সাফিয়া বেগম, বহুদিন আগে, কিন্তু এ দৃশ্যটা মাঝে মধ্যেই দুঃস্বপ্নের মতো তাঁকে তাড়া করে ফেরে ৷
এই বাড়ি এত বড়, তবু যেন মনে হয় ফরাশগঞ্জের বাড়িই ভালো ছিল ৷ তিনতলার ও-বাড়িটা এত জাঁকজমকঅলা নয়, কিন্তু যেন ওই বাড়িটাতে তিনি নিজেকে খুঁজে পেতেন ৷ ইস্কাটনের বাড়িটা বাড়াবাড়ি রকমের বড় ৷ এটায় নিজেকে কেমন অথৈ বলে মনে হয় ৷ তাই তো তিনি চাবি আঁচলে বেঁধে বাড়িময় ঘুরে বেড়ান ৷ চাকর-বাকর, মালি-বাবুর্চি, দারোয়ান-ড্রাইভার মিলে বাড়ি সারাক্ষণই গমগম করছে ৷ আর আছে আত্মীয়স্বজন, আশ্রিতরা ৷ বাড়িতে রোজ রান্না হয় ৫০ জনের খাবার ৷ তাদের কে কী খায়, না খায়, এসব দিকেও খুবই খেয়াল রাখেন আজাদের মা ৷ আল্লাহতায়ালা তাঁদের দু হাত ভরে দিয়েছেন, সেখান থেকে আল্লাহর বান্দাদের খানিকটা দেওয়া-থোয়া করলে তো তাঁদের কমছে না, বরং ওদেরও হক আছে এসবের ওপর ৷
ফরাশগঞ্জের তিনতলা বাড়িটাই যেন তাঁর বেশি প্রিয় ছিল বলে মনে হয় ৷ ওখান থেকে আজাদের স্কুলও ছিল কাছে ৷ আজাদ সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে ভর্তি হয়েছিল ইনফ্যান্ট ক্লাস থেকেই ৷ একেক দিন একেক পোশাক আর জুতো-মোজা পরে সে যখন স্কুলের দিকে রওনা হতো, ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সাফিয়া বেগমের চোখে অশ্রু এসে যেত ৷ আনন্দের অশ্রু, মায়ার অশ্রু ৷ ছেলেটা দেখতেও হয়েছে মাশাল্লাহ চোখজুড়োনো ৷ নিজের ছেলে বলে কি তাকে বেশি সুন্দর দেখছেন ? না ৷ ফরসা, লম্বা, নাকটা টিকালো, চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ ৷ স্বাস্থ্যও মাশাল্লাহ ভালো ৷ কাছেই বুড়িগঙ্গা ৷ স্টিমারের শব্দ শোনা যেত ৷ রাত্রিবেলা যখন স্টিমারের সিটির আওয়াজ আসত কানে, কিংবা সার্চ লাইটের বিক্ষিপ্ত আলোয় হঠাৎ হঠাৎ ঝলকে উঠত আকাশ, বাড়ির ছাদ, মাওয়ার সারেং পরিবারের মেয়ে সাফিয়া বেগমের মনটা নিজের অজান্তেই চলে যেত তাঁর শৈশবের দিনগুলোতে ৷ তাঁদের মাওয়ার বাড়িতে ছিল নতুন টিনের চকচকে বড় বড় ঘর, তাতে নানা নকশা কাটা, টিনের চালে টিন-কাটা মোরগ, বাতাসে ঘুরছে আর বাতাসের দিক বলে দিচ্ছে ৷ দূর থেকে লোকে দেখতে আসত তাদের পৈতৃক বাড়িটা ৷ তাঁর বাবার সারেং হওয়ার কাহিনীটাও কিংবদন্তির মতো ভাসছে মাওয়ার আকাশে-বাতাসে : তাঁর বাবা ভাগ্যান্বেষণে উঠে পড়েছিলেন এক ব্রিটিশ জাহাজে, স্টিম ইঞ্জিনচালিত জাহাজ ৷ কী কারণে ব্রিটিশরা তাঁকে ছুড়ে ফেলেছিল গনগনে কয়লার আগুনে, তারপর তাঁকে ফেলে দিয়েছিল সমুদ্রের জলে, কিন্তু তিনি মারা যাননি ৷ তখন ব্রিটিশ নাবিকেরা বলাবলি করতে লাগল, এই ছেলে যদি বাঁচে, তাহলে সে একদিন কাপ্তান হবে ৷ অগি্নদগ্ধ শরীরটাকে নিয়ে আসা হলো মাওয়ায়, তাঁকে ডুবিয়ে রাখা হতো কেঁচোর তেলে, মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে তোলা হতো কেঁচো আর কেঁচো, তখন সারেংবাড়ির আশপাশে লোকজনের প্রধান কাজ দাঁড়িয়ে যায় কোদাল হাতে খুরপি হাতে মাটি খোঁড়া আর কেঁচো ধরা, বড় বড় চাড়িতে কেঁচো সব কিলবিল করছে, মোটা কেঁচো, চিকন কেঁচো, লাল কেঁচো, কালচে কেঁচো, সেসব পিষে তৈরি করা হচ্ছে তেল, আর সেই তেল দু বেলা মাখা হতো আজাদের নানার শরীরে, এই আশ্চর্য ওষুধের গুণে তিনি বেঁচে যান, সেরে ওঠেন এবং শেষতক ফিরিঙ্গিদের ভবিষ্যদ্বাণীকে অব্যর্থ প্রমাণ করে হয়ে ওঠেন জাহাজের কাপ্তান ৷ ধনসম্পদের মালিক হন, মাওয়ার সবচেয়ে দর্শনীয় বাড়িটার অধিকারী হন ৷ সারেংবাড়ির মেয়ে হিসাবে সাফিয়া বেগমের মাথা সব সময় উঁচুই ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও বলতে হবে, মাওয়ার দিনগুলোতে, বিয়ের আগে, নিজের বিবাহোত্তর জীবনের যে সুখ-সম্পদময় ছবি সাফিয়া কল্পনা করতেন, নদীর ধারে দাঁড়িয়ে সওদাগরি বড় নৌকাগুলোর দিকে তাকিয়ে যে বিত্তবৈভবশালী সওদাগর বরের কথা তিনি ভাবতে পারতেন, বিয়ের রাতে বিশেষভাবে রিজার্ভ করা লঞ্চে করে শ্বশুরবাড়ি বিক্রমপুর যাওয়ার পথে নদীর বাতাস চুলে-মাথায়-ঘোমটায় মাখতে মাখতে যে ঐশ্বর্যময় ভবিষ্যতের ছবি তিনি আঁকতে পেরেছিলেন, তার জঙ্গিতম সংস্করণের চেয়েও আজ তিনি পেয়েছেন বেশি ৷ এই বোম্বে কানপুর, এই ঢাকার ফরাশগঞ্জের বাড়ি, আবার ইস্কাটনে দুবিঘা জমির ওপর নিজের প্রাসাদোপম বাড়ি ৷
তাঁরা ফরাশগঞ্জের বাড়িতে থাকতেই আজাদদের স্কুলে একটা মজার কাণ্ড ঘটেছিল ৷ ব্রাদার ফুল জেম তখন সেন্ট গ্রেগরির প্রিন্সিপ্যাল ৷ সে-সময় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ছিলেন এক বিখ্যাত বাঙালি ৷ ভালো ছাত্র হিসাবে যাঁর নামডাক এখনও রয়ে গেছে কিংবদন্তি হিসেবে ৷ তাঁর ছেলে পড়ত সেন্ট গ্রেগরিতে ৷ গভর্নর সাহেব একদিন স্কুলের শিক্ষকসহ বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে দাওয়াত করলেন নিজের বাসভবনে ৷ উদ্দেশ্য, তাঁদের ভালো করে খাওয়াবেন ৷ সে দাওয়াতে আজাদরাও ছিল আমন্ত্রিত ৷ ভোজনপর্ব যা হলো তা ঐতিহাসিকই বলা চলে ৷ তবে খেতে খেতে শিক্ষকদের মধ্যে শুরু হলো গুঞ্জন ৷ কারণ গভর্নর জানাচ্ছেন, আজকের এই মজলিশের উপলক্ষ হলো তাঁর সেন্ট গ্রেগরিতে অধ্যয়নরত ছেলের ভালো ফল ৷ শিক্ষকদের মধ্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে-গর্ভনরের ছেলে তো মোটেও ভালো ফল করেনি! তাহলে গভর্নর কেন এত বড় পার্টি এত ধুমধামের সাথে দিলেন ? পরে জানা গেল ঘটনার গোমর ৷ একই নামে দুজন ছাত্র আছে ক্লাসে ৷ এর মধ্যে অপরজনের রেজাল্ট খুবই ভালো ৷ গভর্নরের ছেলে সেই চমৎকার প্রগ্রেসিভ রিপোর্টটা তুলে দিয়েছে তার বাবার হাতে ৷ সেটা দেখেই বাবা উচ্ছ্বসিত হয়েছেন-বাহ্, এক বছরেই ছেলের এত উন্নতি ৷ যাক, ছেলে তাঁর বাবার নাম রেখেছে ৷ কী সুখের বিষয়! দাওয়াত করো সবাইকে ৷ সেই দাওয়াত খেয়ে শিক্ষকদের সবার মনমেজাজ অন্তত এক মাস খারাপ ছিল ৷
শুধু মন নয়, পেটও খারাপ ছিল ৷

 ০৪. মা

দোহার এলাকার মুক্তিযোদ্ধা গাজী আলী হোসেন এসেছিলেন আজাদের মায়ের জানাজায় ৷ সম্পর্কে আজাদের চাচা হন তিনি ৷ ইউনুস চৌধুরীর খালাতো ভাই ৷ আজাদের মা মারা গেছেন শুনে ছুটে এসেছেন ৷ গোরের পাশে যখন তিনি দাঁড়িয়ে, নানা স্মৃতির ভিড়ে তাঁর চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ৷ তাঁর মনের ভেতরে বইতে থাকে রোদনধারা ৷ ভাবি আকারে ছিলেন ছোটখাটো, কিন্তু তাঁর হৃদয়টা ছিল অনেক বড় ৷ ইস্কাটনের বাড়িতে আলী হোসেনও থাকতেন ৷ এ রকম আশ্রিত বা অতিথি আরো অনেকেই থাকত বাসায় ৷ আজাদ আর ভাবির সঙ্গে তিনি বহুদিন ক্যারমও খেলেছেন ৷ পরহেজগার মহিলা ছিলেন আজাদের মা ৷ নামাজ-রোজা ঠিকভাবে করতেন ৷ দান-খয়রাত করতেন দু হাতে ৷ বাড়ির সব আত্মীয়স্বজন অনাত্মীয় আশ্রিত প্রতিটা লোকেরই আতিথেয়তা করতেন আন্তরিকতার সঙ্গে ৷
আলী হোসেনের বন্ধুবান্ধবরা খুব একটা এ বাড়িতে আসত না ৷ কিন্তু আলী হোসেনের শখ বন্ধুদের বাড়িটায় আনেন, বাড়িটা বন্ধুরা ঘুরেফিরে দেখুক ৷ এই সুবিশাল আর জাঁকজমকপূর্ণ বাড়িটা তো বাইরের কত লোক শুধু দেখতেই আসে ৷ এই বাড়িতে তিনি থাকেন, সেটা বন্ধুবান্ধবদের একটিবার দেখাতে কি সাধ হয় না! বন্ধুরা বাড়িটাও দেখুক, আর তাঁর ভাবির হাতের রান্না একটু ভালোমন্দ খেয়ে যাক ৷ ওরা তো হলে থাকে, কী খায় না খায় কে জানে!
কথাটা তিনি পাড়েন সাফিয়া বেগমের কাছে, ‘ভাবি, আমার বন্ধুরা তো জানতে চায় আমি কোথায় থাকি, বললাম, ইস্কাটনে ইউনুস চৌধুরীর বাড়িতে, শুনে ওরা বিশ্বাসই করতে চায় না, বলে গুলগাপ্পি বাদ দাও তো ভায়া… কী করি বলেন তো!’
ভাবি বলেন, ‘একদিন নিয়ে আসেন তাদের ৷ কবে আনবেন, আগে থেকে জানাবেন ৷’ আলী হোসেন বন্ধুদের সাঙ্গে আলাপ করে দিনক্ষণ ঠিক করেন ৷ ভাবিকে জানান ৷ ভাবি রান্না করতে পছন্দ করেন খুব ৷ আলীর বন্ধুরা আসবে, এ উপলক্ষ পেয়ে লেগে যান রাঁধতে ৷ কত পদের কত রান্নাই না রাঁধেন ৷ বন্ধুরা আসে ৷ তখন আলী সাফিয়া বেগমকে বলেন, ‘ভাবি, আপনি কি ওদের সামনে একটু আসবেন ?’
সাফিয়া বেগম হেসে বলেন, ‘আমি তো আপনার বন্ধুদের চিনিও না, তাদের সাথে আমার পরিচয়ও হয়নি, কিন্তু আপনি যখন বলছেন, আমি নিশ্চয় তাদের সামনে যাব ৷ আর তা ছাড়া তাদের খাওয়ার তদারকিটাও তো করতে হবে ৷ তুলে না দিলে মেহমানরা কী খাবে না খাবে কে জানে! আমি তাদের তুলে খাওয়াব ৷’
ভাবি সামনে আসেন আলী হোসেনের বন্ধুদের ৷ হেসে হেসে কথা বলেন ৷ বন্ধুরা সহজেই আপন হয়ে যায় তাঁর ৷ তিনি খুব যত্ন করে দেবরের বন্ধুদের পাতে খাবার তুলে তুলে দেন ৷ বন্ধুরা ফিরে যায় মোহিত হয়ে ৷
কিন্তু সবচেয়ে মোহিত হন গাজী আলী হোসেন নিজে, যখন আরেক দিন সাফিয়া বেগম বলেন, ‘বাচ্চু ভাই (আলী হোসেনের ডাকনাম), আপনার বন্ধুদের মাঝে মধ্যে আনবেন ৷ হলে থাকে ৷ বাবা-মার কাছ থেকে কত দূরে ৷ এদের খাওয়াতে পারলে দিলের মধ্যে একটা শান্তি লাগে ৷’
গোরের পাশ থেকে ফিরতে ফিরতে আরো কত কথাই না মনে পড়ে আলী হোসেনের ৷ ইস্কাটনের বাসায় অনেক ফালতু মেহমানও থাকত আশ্রিতের মতো ৷ এদের সবাইকে যে সাফিয়া বেগমের পছন্দ হতে হবে, এমন তো নয় ৷ সবাই পছন্দের ছিলও না হয়তো ৷ আলী হোসেন ছিলেন দেবর, তাঁর ভাবি হিসাবে সাফিয়া বেগম নানা আবদার অত্যাচার সহ্য করতেন ৷ কিন্তু আলী হোসেনের একজন মামা ছিলেন, কাদের, যাঁকে সাফিয়া বেগম ঠিক পছন্দ করতেন না ৷ এটা কাদেরও বুঝতেন, সাফিয়াও যেন বোঝাতে চাইতেন ৷ একদিন আলী হোসেন আর কাদের একসঙ্গে বসেছেন সকালের নাশতা করতে, সাফিয়া বেগম আলী হোসেনের পাতে দুটো ডিমের অমলেট দিলেন, তারপর কাদেরের পাতেও দিলেন দুটো ডিমেরই অমলেট ৷ পরে কাদের বলেন, ‘বুঝলে ভাগ্নে, তোমার ভাবির মনটা অনেক বড় ৷ ছোটলোকি ব্যাপারটাই তার মধ্যে নাই ৷’

০৫. মা

গাড়ির মধ্যে বসে ছিলেন জাহানারা ইমাম, জুরাইন গোরস্তানের বাইরে; ভেতরে অল্প কজন আত্মীয় আর বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা দাফন করছিলেন আজাদের মাকে ৷ হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে জাহানারা ইমাম বেরিয়ে আসেন গাড়ি থেকে ৷ তাঁর কী হয় তিনিই জানেন ৷ তাঁর মতো স্নিগ্ধরুচি সূক্ষ্ম আচারবোধসম্পন্ন মানুষের এ রকমটা করার কথা নয়-দিনের বেলা বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি থেকে নেমে সেধে সেধে ভেজা ৷ জাহানারা ইমাম তা করেন ৷ গোরস্তানের ফটকের কাছে বসে থাকা ভিক্ষুকেরা তাদের বিলাপ ও যাচনা বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, এক ভদ্রমহিলা অকারণে হঠাৎ আসা বৃষ্টিতে ভিজছে ৷ কারণটা তারা আন্দাজ করতে পারে না, এবং সেটা নিয়ে গবেষণা করার আগেই তাদের নিজেদের মাথা বাঁচানোর জন্যে সচেষ্ট হতে হয় ৷ এভাবে বৃষ্টিতে ভেজার কারণটা স্বয়ং জাহানারা ইমামও ধরতে পারেন না ৷ শুধু আবছা একটা অনুভব, হয়তো বেহেশতের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে, আর শহীদেরা, তাঁর রুমীরা, আজাদেরা আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করছে ৷ এই বৃষ্টি যেন বৃষ্টি নয় ৷ আর এই যে সুবাসটা, না, এটা আতরের নয়, গোলাপজলের নয়, লোবানের নয়, এ হলো বেহেশ্ত থেকে নেমে আসা অপার্থিব সৌরভ ৷ দাফন শেষ করে বাচ্চু, শাহাদত, কাজী কামাল, হ্যারিস, হাবিবুল আলম প্রমুখ ফিরে এলে জাহানারা ইমাম সংবিৎ ফিরে পান ৷ তিনি গাড়িতে ওঠেন ৷ তাঁর গাড়িতে কেউ কেউ লিফ্ট নেয় ৷ গাড়িতে উঠেও এই মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই বৃষ্টিতে ভেজার ব্যাপারটা নিয়ে কোনো কথা বলে না ৷ কারণ তারা নিজেরাই ঘোরগ্রস্ত ৷ কেবল তরুণ ড্রাইভার বলে, ‘খালাম্মা, তোয়ালে দিব, মাথা মুছবেন নাকি ?’ জাহানারা ইমাম মাথা নাড়েন না-সূচক ভঙ্গিতে ৷ গাড়ি চলতে থাকে ৷ তিনি প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের শেষ গন্তব্যে নামিয়ে দিয়ে এলিফ্যান্ট রোডের বাসা কণিকায় ফিরে আসেন ৷ স্মৃতির দংশন তাঁকে অস্থির করে তোলে ৷
আজাদের বাবার সঙ্গে জাহানারা ইমামদের পরিচয় মেছের নামে তাঁদের এক ভাগ্নের মাধ্যমে ৷ জাহানারা ইমাম কয়েকবার গেছেন আজাদদের ফরাশগঞ্জের বাড়িতে ৷ ইস্কাটনের বাড়িতে গেছেন অনেকবার ৷ সঙ্গে থাকত তাঁর দুই ছেলে রুমী আর জামী ৷ জামী তখন খুবই ছোট ৷ রুমীর সঙ্গে খুব সহজেই বন্ধুত্ব হয়ে যায় আজাদের ৷ এত বড় বাড়ি পেয়ে রুমী তো আনন্দে অস্থির হয়ে যেত ৷ এই লংপ্লে রেকর্ড চালাচ্ছে, এই টেপ রেকর্ডার নিয়ে ছড়া টেপ করছে, এই আবার যাচ্ছে হরিণ দেখতে ৷ আজাদ বলেছে রুমীকে, একটা বাঘও আনার কথা ছিল ৷ কিনেও নাকি ফেলেছিলেন আজাদের বাবা ৷ কিন্তু আনার পথে বাঘটা মরে যায় ৷
আজাদের মা খুবই পছন্দ করতেন রাঁধতে ৷ রেঁধে মেহমানদের খাওয়াতে ৷ বাসায় বাবুর্চি ছিল ৷ কাজের লোকে গমগম করত বাড়িটা ৷ তবু জাহানারা ইমামদের জন্যে নিজ হাতে নানান পদ রেঁধে তাঁদের খাওয়ানোর জন্যে তিনি উদ্বেল হয়ে উঠতেন ৷ জাহানারা ইমাম বলতেন, ‘আপা, আপনি বসেন ৷ আমরা কি খেতে এসেছি, নাকি আপনার সাথে গল্প করতে এসেছি ?’ আজাদের মা হাসতেন ৷ স্মিত স্নিগ্ধ হাসি ৷ কথা তিনি বেশি বলতেন না ৷ কিন্তু হাসিটা দিয়েই যেন অনেক কথা বলা হয়ে যেত ৷ বলতেন, ‘পান খান ৷ রেকর্ডের গান শোনেন ৷ আপনি তো দেখতে লোকে বলে সুচিত্রা সেনের মতো ৷ সুচিত্রা সেনের সিনেমার গানের রেকর্ড আছে শোনেন ৷ আমি আগে সিনেমা থিয়েটার দেখতাম ৷ এখন আর দেখি না ৷ আপনি বোন বসেন ৷ আমি যাব আর আসব ৷ রুমী কী খেতে পছন্দ করে ? জামীর জন্য কি আলাদা কিছু রাঁধতে হবে ? আপনার সাহেবকে আনেননি কেন ?’
পানের একটা রেকাবি জাহানারা ইমামের সামনে রেখে আজাদের মা রান্নাঘরে চলে যেতেন ৷ এই রেকাবিটাও ছিল যেন শিল্পকর্মের একটা অপূর্ব নিদর্শন ৷ কত ধরনের জর্দাই না তাতে থাকত ৷ একেকটা খোপে একেক রকম জর্দা আর তবক সাজানো ৷ আজাদের মা বলতেন, ‘এটা হলো কিমাম জর্দা, এটা হলো কস্তুরি ৷ পাকিস্তান থেকে আনানো ৷’ জাহানারা ইমাম তেমন পান খেতেন না ৷ আজাদের মাকে খুশি করার জন্যে খানিকটা মুখে দিতেন ৷
টমি নামে আজাদদের পোষা কুকুর ছিল একটা, স্প্যানিয়েল ৷ এসে জাহানারা ইমামের গায়ের ঘ্রাণ নিত ৷ এই কুকুর দেখে রুমী আর জামীর শখ হলো তারা কুকুর পুষবে ৷
রুমীদের পোষা কুকুর মিকি মারা গেছে একাত্তরের ২৫শে মার্চের রাতে ৷ আজ থেকে ১৪ বছর আগে! জাহানারার বুক চিরে শুধুই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চায় ৷ রুমীর ১৪তম মৃতু্যদিনও হয়তো সামনের কোনো একটা দিন ৷ এই সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ হলেও হতে পারে ৷ রুমীর বাবা শরিফ ইমামও আজ ১৪ বছর হলো নাই ৷

 ০৬. মা

আজাদের মায়ের জীবনে এত সুখ, এত প্রাচুর্য! তবু তাঁর বুকটা কেমন যেন হঠাৎ হঠাৎ কেঁপে ওঠে ৷ এখান থেকে ওখান থেকে মেয়েরা ফোন করে, আজাদের বাবাকে চায় ৷ আবার মাঝে মধ্যে ফোন আসে, তিনি ধরেন, হয়তো তাঁর গলা শুনেই ফোন রেখে দেয় ৷ তিনি আজাদের বাবাকে বলেন, ‘কী ব্যাপার, মেয়েরা আপনাকে এত ফোন করে কেন ?’
আজাদের বাবা হাসেন ৷ ‘আরে সব কাজের ফোন ৷ তুমি এত চিন্তা করো কেন ? চিন্তা করতে করতে তুমি শুকিয়ে যাচ্ছ ৷’
‘কাজের ফোন, তাহলে আমি ধরলে কেটে দেয় কেন ?’
‘কেটে দেয় নাকি ? তাহলে মনে হয় তোমাকে কাজের লোক ভাবে না ৷ হা-হা-হা ৷’ আজাদের বাবা হাসি দিয়েই যেন সবকিছু আড়াল করতে চান ৷
আজাদের মা স্বামীর কোনো দোষত্রুটি এখনও দেখেননি ৷ কিন্তু তাঁর মনের ভেতরে কেমন যেন কাঁটা খচখচ করে ৷ বোম্বের দিনগুলোতে সেই যে কৃষ্ণরূপী ইউনুস আর তাঁকে ঘিরে থাকা রাধার সখিদের কলকাকলির দৃশ্য তিনি দেখেছিলেন, সেটা তিনি সারাক্ষণ মানস-চোখে দেখতে পান ৷
আর যেখানে কাঁটার ক্ষত, বাইরের আঘাতগুলো এসে সেই জায়গাতেই লাগে ৷
একদিন একটা ফোন আসে ৷ ‘হ্যালো, আজাদের মা কইতেছেন ?’
‘জি ৷’
‘আমারে আপনে চিনবেন না ৷ তয় আমি আপনার উপকারের জন্যে ফোন করতেছি ৷ আপনার আজাদের বাপেরে আপনে কতটা চিনেন ?’
‘আমি তাকে কতটা চিনি, সেটা কি আপনাকে বলতে হবে ?’
‘আরে রাগ করেন ক্যান ৷ আমি আপনের উপকার করনের লাইগাই ফোন করছি ৷ আজাদের বাপে যে এক মহিলার লগে গিয়া দেখা করে, আপনি কিছু জানেন না ?’
‘আপনি কে আমি জানি না ৷ কিন্তু আপনাকে যদি আমার সামনে পেতাম, চড় দিয়ে দাঁত নড়িয়ে দিতাম ৷’
‘রাগ করেন ক্যান ? আমারে চড় মারলে কি আপনে আপনের স্বামীরে বশ করতে পারবেন ? নিজের ঘরটা সামলান ৷’
সাফিয়া বেগম ফোন রেখে দেন ৷ দুপুরে ভাত খান না ৷ রাতেও না ৷
আজাদের দাদীর বোধহয় তৃতীয় নয়ন আছে ৷ তিনি তাঁর বিছানায় বসে পেষা পান চিবাচ্ছেন আর বকে চলেছেন, ‘অ আজাদের মা, তুমি যে দুপুরের ভাত অহনও খাইলা না! পিত্তি পইড়া যাইব না ?’
সাফিয়া বেগম জবাব দেন না ৷
রাত্রিবেলা স্বামী আসেন ৷ তিনি তাঁর সামনে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন ৷
ইউনুস চৌধুরী বিস্মিত হন ৷ তিনি ঘরে আসামাত্রই সাফিয়া তাঁর কাছে আসে, তাঁর কোট খুলে দেয়, তাঁর ঘরে পরার স্যান্ডেল পোশাক এগিয়ে দেয়, তাঁর খোঁজখবর নেয় ৷ কিন্তু আজকে সাফিয়ার কী হলো ?
সাফিয়া বেগমের কাছে যাওয়ার আগে চৌধুরীকে যেতে হয় তাঁর মায়ের কাছে ৷ তিনি ডাকছেন, ‘তারা, তারা, এদিকে আয় ৷’ (তারা ইউনুস চৌধুরীর ডাকনাম)
ইউনুস চৌধুরী মায়ের ঘরে যান ৷
‘বউমা ভাত খাইতেছে না ক্যান ৷ দুপুরে খায় নাই ৷ বিকালে খায় নাই ৷ অহনও দেখি ঘর থন বারাইতেছে না ৷ ব্যাপার কী ?’
আজাদের বাবা প্রমাদ গোনেন ৷
‘যা দ্যাখ বউয়ে কী চায় ?’
চৌধুরী এবার মনে মনে একটু হাসেন ৷ সাফিয়া আর কী চাইতে পারে! তার চাইবার কিছু থাকলে অবশ্যই তাকে তা তিনি দিতেন ৷ সেটা অনেক বেশি সহজ হতো ৷ কিন্তু তিনি জানেন সাফিয়া কিছুই চাইবে না ৷ বরং সে জেদ ধরেছে নিশ্চয় না চাইবার জন্যে ৷
আজাদ কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছে মা তার রাগ করেছেন ৷ সে আস্তে করে তার ঘরে গিয়ে নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে কমিক্স পড়ায় ৷ তাতে মন বসাতে না পেরে সে বের করে স্কুলে হোম-টাস্কের খাতা ৷ বিছানায় বইখাতা ছড়িয়ে লিখতে থাকে ৷
চৌধুরী তাঁদের শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ান ৷ বিরাট শয়নকক্ষ ৷ সঙ্গে বাথরুম ৷ তার সংলগ্ন ড্রেসিং রুমটাই একটা বেডরুমের সমান ৷ ঝাড়বাতি নেমে এসেছে ছাদ থেকে ৷ বিদেশী ফিটিংস সব ৷ আসবাবপত্র সব সেগুন কাঠের ৷ বড় বড় জানালায় ভারী বিদেশী পর্দা ৷ খাটটা কারুকার্যময় ৷ তাতে শাদা চাদর ৷ তারই ওপরে একপাশে ঘাড় কাত করে শুয়ে আছেন সাফিয়া বেগম ৷ হাতে একটা বই, তবে সেটা তিনি পড়ছেন, নাকি মুখটা সরিয়ে রাখার জন্যে ধরে আছেন, বলা মুশকিল ৷
‘কী ব্যাপার, শরীরটা কি খারাপ ?’
আজাদের মা কথার জবাব দেন না ৷
‘আজকে তো আমি তাড়াতাড়িই ফিরেছি, নাকি ?’
আজাদের মা চুপ করে থাকেন ৷
‘খুব খিদে পেয়েছে ৷ আসো ৷ ভাত দাও ৷’
আজাদের মা উঠে পড়েন ৷ ‘বাবুর্চি, টেবিলে সাহেবের খানা লাগাওনি ?’
‘আরে, বাবুর্চি তো টেবিলে খানা লাগাবেই ৷ তুমি না থাকলে আমি একা একা খাব নাকি ?’
চৌধুরী হাতমুখ ধুয়ে এসে টেবিলে বসেন ৷ সাফিয়া বেগম কোনো কথা না বলে প্লেটে ভাত তুলে দেন ৷
‘নাও ৷ তুমিও বসো’-চৌধুরী বলেন ৷
সাফিয়া বেগম কথা বলেন না ৷ স্বামীর সঙ্গে খেতে বসার কোনো লক্ষণও তাঁর মধ্যে দেখা যায় না ৷
‘দুপুরেও নাকি খাওনি ?’
জবাব নাই ৷
‘নাও ৷ বসো ৷ তুমি না খেলে আমি খাব না ৷’
চৌধুরী স্ত্রীর হাত ধরেন ৷ সাফিয়া বেগম হাত শক্ত করে ফেলেন ৷
‘থাকুক ৷ বড় খিদে পেয়েছিল ৷ আজকে আর খাওয়া হলো না ৷’ ইউনুস চৌধুরী উঠে পড়ার ভঙ্গি করেন ৷
‘বসেন ৷ আপনি খাবেন না কেন ?’
‘তাইলে তুমিও বসো ৷’
‘হাত ছাড়েন ৷ আম্মা ওই ঘরে ৷’
‘আম্মাই তো বেশি চিন্তা করছে ৷ তুমি বসো ৷’
‘না, আমি পরে খাব ৷ বাসার আরো লোক খাওয়ার আছে ৷’
‘বাসার আরো লোকদের নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না ৷ তুমি বসো ৷’
সাফিয়া বেগম খেতে বসেন ৷ কিন্তু তার মুখে অন্ন রুচছে না ৷ তিনি শুধু ভাত নাড়েন-চাড়েন, খান না ৷
চৌধুরী বলেন, ‘তোমার সমস্যাটা কী বলবা তো!’
‘বলব ৷ আপনি খেয়ে ওঠেন ৷’
ভাত খাওয়া হয়ে গেলে সাফিয়া বেগম স্বামীর জন্যে পান সাজিয়ে নিয়ে ঘরে যান ৷ আস্তে আস্তে মুখ খোলেন, ‘আজকে একটা ফোন এসেছিল ৷ বলল, চৌধুরী সাহেব কী করে, কার কাছে যায়, কিছু জানেন ? এক মহিলার কাছে…’
সাফিয়া বেগম ডুকরে কেঁদে ওঠেন ৷
চৌধুরী বিপন্ন বোধ করেন ৷ তিনি পরিস্থিতি সামলানোর জন্যেই বোধহয় বলেন, ‘আমাকে নিয়ে এসব কথা তোমাকে কে লাগিয়েছে ৷ ছি-ছি-ছি ৷ এত বড় মিথ্যা কথা বলতে পারল ৷ তার মুখে পোকা পড়বে ৷ আর তুমিও কেমন ? তুমি আমাকে না জিজ্ঞাসা করে কে কী বলল না বলল সেইটাই মনে করে বসে আছ ৷ আরে তোমার স্বামী বড়, না ফোনের লোক বড় ৷ কে ফোন করেছে, নাম বলেছে ? দাঁড়াও, তাকে আমি দেশছাড়া করব!’
‘না, নাম বলেনি ৷’
‘তাইলে তুমি কেন একটা অচেনা অজানা লোকের কথায় বিশ্বাস করলা ? বলো ৷’
‘আপনি এক মহিলার সাথে দেখা করতে যান না ?’
‘না ৷’
‘আমার মাথা ছুঁয়ে বলেন ৷’
‘তোমার মাথা ছুঁয়ে বলতে হবে না ৷ আমি আমার মাথা ছুঁয়েই বলতে পারি ৷ আমি যদি মিথ্যা কথা বলি তাহলে আমার মাথাতেই যেন বাজ পড়ে ৷ মাথা হলো পবিত্র জিনিস ৷ আল্লাহর কালামের মতোই শরিফ জিনিস ৷’
সাফিয়া বেগম স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন ৷ তারপর ধীর কিন্তু স্পষ্টস্বরে বলেন, ‘আপনাকে একটা কথা বলে রাখি, আপনি যদি কোনো কিছু উল্টাপাল্টা করেন, আমি কিন্তু সোজা এই বাড়ি ছেড়ে আজাদকে নিয়ে চলে যাব, আর আমার মরা মুখটাও আমি আপনাকে দেখতে দেব না ৷’
বিদু্যৎ-বাতির আলোয় সাফিয়া বেগমের মুখটাকে পিতলের তৈরি ভাস্কর্যের মতো কঠিন বলে মনে হয় ৷ আর তাঁর কন্ঠস্বর যেন ভেসে আসে কোনো গভীর কুয়ার তলদেশ থেকে ৷ ইউনুস চৌধুরীর ছেলেবেলায় মেদিনীমণ্ডল গ্রামে কাঁঠালতলার পাকা ইঁদারায় পড়ে গিয়েছিল এক মহিলা, সম্ভবত ঝাঁপিয়েই পড়েছিল, ইঁদারার গভীর থেকে তার কন্ঠস্বর যে রকম গমগম করে ভেসে এসেছিল, আজ সাফিয়ার গলায় তিনি যেন সেই সুর শুনতে পান ৷ চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ ৷ তখন এমন নীরবতা নেমে আসে যে, মাথার ওপরে ঘূর্ণমান ফ্যানের শব্দকেও প্রায় কর্ণবিদারী বলে ভ্রম হয় ৷
চৌধুরী বলেন, ‘এইসব উল্টাপাল্টা চিন্তা করে তুমি তোমার মনটাকে বিষিয়ে রেখো না ৷ তোমার মনে দুঃখ লাগে, এ রকম কোনো কিছু আমি করব না ৷’
সাফিয়া বেগম স্বামীর কথায় আশ্বস্ত বোধ করেন ৷ তিনি এশার নামাজ পড়ার জন্যে ওজু করবেন বলে ওঠেন ৷
তিনি আজাদের ঘরে উঁকি দেন ৷ আজাদ বিছানার ওপরে বইখাতা ছড়িয়ে হোম-টাস্ক করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছে ৷ ইস্ ৷ স্কুলটাতে এত পড়ার চাপ কেন ? কত ইংরেজি বাংলা বই-আজাদের বইপত্র গুছিয়ে রাখতে রাখতে সাফিয়া বেগম ভাবেন ৷ ছেলেটা হাতমুখ না ধুয়েই শুয়ে পড়েছে ৷ এতগুলো কাজের লোক ৷ কিন্তু ছেলেটাকে একটু যত্নআত্তি করবে, তার লোক নাই ৷ অবশ্য সাফিয়া বেগম ছেলের যত্নের ভার অন্যের ওপর ছেড়ে দিতে পছন্দ করেন না ৷ আজকে দিতে হয়েছে, কারণ আজ তিনি রাগ করে ছিলেন ৷ এখন রাগ কিছুটা কমেছে ৷ মাথা ঠাণ্ডা হচ্ছে ৷ ছেলেটাকে কি এরা ঠিকমতো রাতের খাবার খাইয়েছে ? ছেলে তাঁর মাছ খেতে পছন্দ করে, কিন্তু মাছের কাঁটা বাছতে পারে না ৷ ছেলের বয়স আর কত হবে ? সে হিসাবে ভালোই লম্বা হয়েছে ৷ বিছানায় এলিয়ে পড়া আজাদের শরীরটা দেখতে দেখতে সাফিয়া এক ধরনের আত্মপ্রসাদ অনুভব করেন ৷ ছেলেটার হাতপা কী রকম ডাঙর হয়েছে! পরক্ষণেই তিনি মাশাল্লা মাশাল্লা বলে নিজের দু গালে দুবার করে ডান হাত বোলান ৷ মায়ের নজর না আবার ছেলের গায়ে লেগে যায় ৷ আস্তে আস্তে ছেলেকে ডাকেন, ‘আজাদ, আজাদ, ঘুম ? বাবা, ঘুমাবি, না উঠবি ? ওঠ ৷ হাত-পা ধুসনি, বিকালে কী খেয়েছিস না খেয়েছিস, রাতেও তো খাওয়া দেখতে পারিনি, উঠে পড় বাবা ৷ হোম-টাস্ক কি বাকি আছে ?’
আজাদের ঘুম ভেঙে যায় ৷ সে কেঁদে ওঠে-‘উম্ম্ ৷ আমাকে ঘুমাতে দাও ৷’
‘খিদে লাগেনি ? কী খেয়েছিস না খেয়েছিস ?’
‘আরে ভাত খেয়েছি না ৷ সরো তো ৷’
‘হোম-টাস্ক করেছিস ?’
‘ভোরে ডেকে দিও ৷’
‘আচ্ছা ঘুমা ৷ আমি একটু ভাত মেখে আনি ৷’
সাফিয়া বেগমের মন মানে না ৷ তিনি আবার ডাইনিং টেবিলে যান ৷ আজাদের ফুলঅলা প্লেটে ভাত বাড়েন ৷ তরকারি নেন ৷ রুই মাছের দুটো টুকরো নিয়ে তাড়াতাড়ি কাঁটা বাছতে লেগে পড়েন ৷ তারপর ছেলের ঘরে এসে দেখেন সে ঘুম ৷ দুটো বালিশ দেয়ালে দিয়ে তিনি ছেলেকে বিছানায় বসান ৷ ঘুমন্ত ছেলে বালিশের চেয়ারে বসে থাকে ৷ ‘দেখি বাবা, হা কর তো’ বলে তিনি ছেলের মুখে ভাত পুরে দেন ৷ ছেলে মুখে ভাত নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ৷
পুরনো গৃহপরিচারিকা জয়নব তাই দেখে বকতে থাকে, ‘দ্যাখো তো আম্মাজানের কারবার ৷ ছেলেটারে কেমনে খাওয়ায় ৷ ও খাইছে না ৷ আমগো সামনেই তো খাইল ৷’
‘নিজের হাতে আজাদ খেতে পারে ? মাছের কাঁটা বাছতে পারে ? কী যে বলো না তুমি ?’ সাফিয়া পরিচারিকাকে বলেন ৷
কয়েক গ্রাস ভাত ছেলের মুখে তুলে দিয়ে তারপর প্রশান্তি আসে ৷ এক গেলাস পানি একই কায়দায় খাইয়ে দিয়ে ছেলের মুখটা ভালো করে মুছে দেন তিনি ৷ শেষে একটা ছোট বালতিতে করে পানি আর তোয়ালে আনান ৷ খাটের একপাশে ছেলের দু পা ঝুলিয়ে দেন ৷ তারপর বালতির পানিতে তার ছোট্ট পা দুটো ডোবান ৷ নিজের হাত দিয়ে ডলে ডলে ছেলের পা দুটো তিনি পরিষ্কার করেন ৷ বালতি মেঝেতে রেখে পা দুটো তোয়ালে দিয়ে মুছে দেন ভালো করে ৷ ভেজা তোয়ালে ডলে ছেলের হাত দুটো আর মুখটা মুছে দিয়ে তারপর তিনি ক্ষান্ত হন ৷ ছেলেকে ঠিকভাবে শুইয়ে দিয়ে কোলবালিশটা তার একপাশে যথাস্থানে রেখে ছেলের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকান ৷ ছেলে তাঁর ঘুমের কোন অজানা দেশে! শেষে ডিমলাইট জ্বালিয়ে বাতি নিভিয়ে মা কক্ষ ত্যাগ করেন ৷

 ০৭. মা

আজাদ একটু একটু করে বড় হতে থাকে, আর ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে থাকে দুষ্টের শিরোমণি ৷ সিনেমা দেখার পোকা যেন সে ৷ নাজ সিনেমা হলে ইংরেজি ছবি বেশি চলে ৷ দেখতে যায় বন্ধুবান্ধব মিলে ৷ ছুটির দিনের মর্নিং শো প্রায় কোনোটাই বাদ যায় না ৷ সম্প্রতি তারা একটা ছবি দেখেছে ৷ তাতে পাত্রপাত্রীরা চোখ ঢেকে রাখে চামড়ার মুখোশে ৷ ঢাকার একটা দোকানে সেই মুখোশ পাওয়া যাচ্ছে ৷ বন্ধুবান্ধব মিলে বেরিয়ে পড়ে সেই মুখোশ কিনতে ৷ দোকানে গিয়ে এক ঢিলে দু পাখি শিকার ৷ স্মোকগান পাওয়া যায় ৷ বন্দুক, গুলি করলে ধোঁয়া বের হয় নল দিয়ে ৷ বন্দুক আর মুখোশ কিনে ফেলে তারা ৷ চলে আসে বাসায় ৷ দরজা লাগিয়ে চলে খেলা ৷ স্মোকগান খেলা ৷ চোখে মুখোশ ৷ তারপর এ ওকে ঘুসি মারে, ও একে ৷ ঘুসি খেয়ে কেউ পড়ে যায় ৷ কেউবা পড়তে চায় না ৷ চালাও গুলি ৷ বন্দুকের মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে ৷ ‘এই তু্ই মরা, মরা, তোকে তো আমি গুলি করেছি ৷’ ‘কিসের ৷ তার আগেই তোকে না আমি ফায়ার করলাম ৷ না, আমি মরা না ৷’ খেলার নিয়মকানুন কেউ মানতে চায় না ৷ গুলি খেয়েও উঠে পড়ে ৷ একটা রেফারি থাকলে ভালো হতো ৷ তবু খেলা চলে ৷ হৈচৈয়ে ঘরের আশপাশে কারো তিষ্ঠানো দায় ৷ এরই মধ্যে আজাদের খালাতো ভাই ছোট্ট জায়েদ আসে ৷ দরজায় নক করে ৷
‘কে ?’ আজাদ বলে ৷
‘আমি জায়েদ ৷’
‘কী চাস ?’
‘আমাকেও খেলায় ন্যাও ৷’
‘যা যা, এটা বড়দের খেলা ৷’
‘আমিও বড় হইছি ৷’
‘হি-হি-হি-হি ৷ আরো বড়ো হ ৷ তুই তো মার ইনফরমার ৷’
‘না, আমি আম্মারে কিছু কই না ৷’
‘আমি আম্মারে কিছু কই না ৷ কস ৷ সেদিন যে স্কুল পালিয়ে স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে গিয়েছিলাম, তুই ছাড়া মারে কে লাগিয়েছে ?’
‘আমি না ৷’
‘যা ভাগ, ডোন্ট ডিস্টার্ব ৷ গেট লস্ট ৷’
জায়েদ বুঝতে পারে, এরা শুধু স্মোকগান খেলে না ৷ অন্য কোনো ব্যাপার আছে ৷ জানালার পর্দা তুলে দেখে, হ্যাঁ, স্মোকগানের আড়ালে বেশ চলছে সিগারেট খাওয়া ৷ দাদা একটা করে টান দেয়, আর কাশে ৷
কামাল বলে, ‘তুই তো ফল্স টান দিচ্ছিস ৷ জেনুইন টান দে ৷’
আজাদ বলে, ‘সুয়ের আপঅন, জেনুইন টান দিচ্ছি ৷’
‘নাক দিয়ে স্মোক ছাড় তো!’
আজাদ নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করার চেষ্টা করে ৷ কাশি দিতে দিতে তার চোখ দিয়ে পানি এসে যায় ৷
জায়েদ দৌড় ধরে ৷ আম্মাকে এই গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশনটা জানানো জরুরি ৷ খালাকে আম্মা বলে ডাকে সে ৷ সমস্যা হলো, দাদা সহজেই ধরে ফেলে ইনফরমারটা কে! তা ধরে ফেলুক ৷ দৌড়ে সাফিয়া বেগমের কাছে পেঁৗছে যায় জায়েদ ৷ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘আম্মা, আম্মা, দেইখা যান ৷’
‘কী ?’
‘আরে চলেন না ওই ঘরে ৷ দাদায় কী করে ?’
‘কী করে ?’
‘সিগারেট খায় ৷’
‘তুই কেমন করে বুঝলি!’
‘আমি দেখছি ৷’
‘আরে ওরা স্মোকগান খেলে ৷ তার ধোঁয়া ৷ যা তো ৷ আমার কাজ আছে ৷’
‘আরে না, আমি নিজ চোখে দেইখা আইলাম ৷ বগা সিগারেট খাইতেছে ৷ আয়েন না ৷’
সাফিয়া বেগম ভাগ্নের হাত ধরে যান ৷ জানালার কাছে যেতেই নাকে পান সিগারেটের গন্ধ ৷ তিনি দরজায় ধাক্কা দেন-’এই, দরজা খোল ৷’
সর্বনাশ ৷ মা এসে গেছে ৷ মুহূর্তে স্থির হয়ে যায় কর্তব্য ৷ তারা লুকিয়ে ফেলে যে যার সিগারেট ৷ তারপর ভেজা বেড়ালের মতো মুখটি করে খোলে দরজা ৷
‘ঘরে ধোঁয়া কিসের ?’ মা বলেন ৷
‘স্মোকগান খেলছি না!’ আজাদ জবাব দেয় ৷
‘গন্ধ কিসের!’
‘স্মোকগানের স্মোকের!’
‘স্মোকগানের স্মোকের মধ্যে কি ওরা তামাক দিয়েছে ?’
মা সিগারেট খোঁজেন ৷ গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে ৷ মনে হয় এখনও ধোঁয়া উঠছে ৷ কিন্তু জিনিসটা ওরা লুকিয়ে রেখেছে কোথায় ? খোঁজ খোঁজ ৷ শেষে পাওয়া যায় এক দুর্গম এলাকায় ৷ হুঁকার নল ধরে যাত্রা শুরু করে অন্তিমে হুঁকার মধ্য থেকে বেরোয় সিগারেট ৷
কিন্তু সেদিনও আজাদের মা মারেননি আজাদকে ৷ কঠিন মহিলা ছিলেন তিনি ৷ খুবই কঠিন ৷ তা সত্ত্বেও নিজের ছেলের গায়ে কোনোদিন হাত তোলেননি সাফিয়া বেগম ৷ বাচ্চাদের মারধর করা তাঁর নীতিবিরুদ্ধ ছিল ৷
কত কথা, কত স্মৃতি ৷ হাতের তালু আবার ঘামতে থাকে জায়েদের ৷ সমস্ত শরীর যেন পুড়ে যাচ্ছে, এত দাহ ৷ আম্মাকে কবরে নামিয়ে রেখে এসে সে যেন আর শান্তি পাচ্ছে না একটুও ৷ মোটরের গ্যারাজের কাজে যাওয়া হয় না তার ইদানীং ৷ কিছুই ভালো লাগে না ৷ শুধুই উত্তাপ! শুধুই উত্তাপ! বারবার মনে হয় একাত্তরের আগস্টের সেই দৃশ্যটা, আজাদ দাদা দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মগবাজারের বাড়িতে, ঘরভরা আজাদের খালাতো ভাইবোন, মা তাদের পাতে ভাত তুলে দিচ্ছে, রাত্রিবেলা, ইলেকট্রিসিটির হলুদ আলোয় পুরোটা ঘরের সব কটা মানুষ যেন ভিজছে, কোনো প্রসঙ্গ ছাড়াই আজাদ বলে, ‘মা, তুমি কিন্তু মা আমাকে কোনো দিনও মারো নাই…’
স্মোকগানের ঘটনাটা মনে হয় ফরাশগঞ্জের বাড়ির ৷ তিনতলায় আজাদ দাদার একটা আলাদা ঘর ছিল ৷ সেই ঘরেই ঘটে থাকবে এই ছেলেবেলাকার ছেলেখেলা ৷
ফরিদাবাদে এক চাচার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল আজাদ আর জায়েদরা ৷ আজাদ তখন হয়তো সদ্যতরুণ, আর জায়েদ নিতান্তই বালক ৷ ঠিক কোন সময়ের কথা, এতদিন পরে জায়েদ সেটা হুবহু মনে করতে পারে না ৷ গ্রামে গিয়ে তারা বেরিয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে-প্রান্তরে ৷ পুকুরপাড়, শ্মশানঘাট, বাজে পোড়া জামগাছতলা ৷ একটা শীর্ণ নদীও বয়ে যাচ্ছে গ্রামের একপাশ দিয়ে ৷ আজাদের পায়ে জুতা ৷ জায়েদেরও ৷
নদীতীরে দাঁড়িয়ে আজাদ বলে, ‘দেখবি, আমার জুতার কী রকম পাওয়ার!’ পকেট থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি বের করে জুতায় ঘষতেই আগুন জ্বলে ওঠে ৷ ঠোঁটের সিগারেটে আগুন ধরিয়ে টানতে থাকে আজাদ ৷ তারপর সিগারেটটা হাতে নিয়ে এক পশলা ধোঁয়া সে ছেড়ে দেয় জায়েদের মুখ বরাবর ৷
জায়েদ বলে, ‘আমারে একটা কাঠি দ্যাও ৷ আমিও পারুম ৷’
‘কী পারবি ?’
‘আমার জুতা থাইকা আগুন জ্বালাইতে!’
‘পারবি না!’
‘পারুম ৷’
‘আরে এটা জ্বালাতে শরীরে পাওয়ার লাগে ৷ তাহলে জুতায় এই পাওয়ার আসে ৷’
‘দ্যাও না দাদা একটা কাঠি ৷’
‘নে ৷’
আজাদ দিয়াশলাইয়ের অনেক কটা কাঠি তুলে দেয় জায়েদের হাতে ৷ জায়েদ নিজের জুতার গায়ে কাঠি ঘষে ৷ আগুন জ্বলে না ৷ কাঠির মুখের বারুদ ক্ষয়ে যায় ৷ কাঠি ভেঙে যায় ৷ একটার পর একটা ৷ না, কাঠি আর জ্বলে না ৷
‘দাদা, ঘটনা কী ? কও দেখি ৷’
‘পাওয়ার রে ৷ পাওয়ার ৷ সিনেমায় দেখিস না ৷ হিরোরা কেমনে পারে ৷ একটা হিরো কয়েকটা ভিলেনকে একাই মেরে ছাতু বানায় ৷ কেমন করে ? শরীরে পাওয়ার থাকে তো তাই ৷ আমার শরীরে সেই রকম পাওয়ার আছে ৷’
নাজ সিনেমা হলের শিক্ষা এসব ৷ মর্নিং শোর ৷
জায়েদের মনে পড়ে, ফরাশগঞ্জের বাসাতেও তো জাহানারা ইমাম আসতেন ৷ রুমী আসত ৷ জামী আসত ৷ প্রথম দিন যেদিন জাহানারা ইমামকে দেখল জায়েদ, সেদিনটার কথা তার খুব মনে আছে ৷ হারানো সুর নামে একটা ছবি দেখতে সে ঢুকেছিল গুলিস্তান হলে ৷ তাতে অভিনয় করেছেন সুচিত্রা সেন ৷ ছবি দেখে কেবল সে ফিরে আসছে ফরাশগঞ্জের বাসায় ৷ হলের মধ্যে অন্ধকার ৷ আবার বৃষ্টির দৃশ্যও ছিল ৷ জায়েদের ধারণা, বাইরেও খুব অন্ধকার নেমে এসেছে আর বৃষ্টি হচ্ছে ৷ মেটিনি শোর ছবি ভাঙলে গ্রীষ্মের এই দিনে সে দেখতে পায় বাইরে এখনও সূর্যের আলো ৷ পুরো ব্যাপারটায় কেমন ধন্দ লাগে তার ৷ আর ছবিটাও বড় আবেগজাগানিয়া ৷ সবটা মিলে একটা ঘোরের মধ্যে ছিল জায়েদ ৷ নবাবপুর রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে দুপাশের রিকশার ঘন্টির আওয়াজ মাথার মধ্যে যেন ঝিঁঝিপোকার ডাকের মতো অবিশ্রান্ত বলে মনে হয় ৷ ফরাশগঞ্জের বাসায় ফেরে সে ৷ কনে-দেখা হলুদ আলো পড়েছে বাড়ির দোতলা তিনতলায় ৷ জায়েদের পুরো ব্যাপারটা অবাস্তব লাগছে ৷ সদর দরজা পেরিয়ে বৈঠকখানায় যেতেই তার চক্ষুস্থির ৷ আরে আরে, হারানো সুর ছবির নায়িকা এখানে বসে আছে কেন ? সে চোখ ডলে ৷ না, সুচিত্রা সেনই তো ৷ সে কলতলায় যায় ৷ চোখ ধোয় ৷ আবার উঁকি দেয় বৈঠকখানায় ৷ না তো, কোনো ভুল নাই ৷ সুচিত্রা সেন তাদের বাসায় ৷ আসা অসম্ভব নয় ৷ এদের বাসায় নানা রকমের বড় বড় মানুষেরা আসে ৷
তখন সে পাশের ঘরে মামা-চাচাদের ফিসফাস শুনতে পায় ৷ সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের হেড মিস্ট্রেস এসেছেন তাঁর দুই ছেলে নিয়ে ৷ আজাদ দাদার তিনতলার ঘরে যায় জায়েদ ৷ দেখতে পায় হেড মিস্ট্রেসের দুই ছেলেকে ৷ বড়টা রুমী ৷ আজাদ দাদার চেয়ে লম্বায় একটু ছোট ৷ আরেকটা জামী ৷ সে তার (জায়েদের) চেয়ে একটু ছোট হতে পারে ৷
কিছুক্ষণের ভেতরেই তারা ছাদে গিয়ে খেলতে আরম্ভ করে ৷ বাড়ির আরো ছেলেমেয়েরা তাদের সঙ্গে যোগ দেয় ৷
ওপেনটি বায়োস্কোপ,
নাইন টেন তেইশকোপ,
সুলতানা বিবিয়ানা,
সাহেব বাবুর বৈঠকখানা,
মেম বলেছেন যেতে…
পান সুপারি খেতে
আমার নাম রেণুবালা,
গলায় আমার মুক্তার মালা ৷
আজাদ আর রুমী পরস্পরের হাত ধরে তোরণের মতো দাঁড়িয়ে আছে ৷ আজাদ দাদা করে কি, পুরো ছড়াটা বলে না, যেই মেয়েকে পছন্দ হয়, তার গলাতেই মুক্তার মালা না হলেও তার হাতের মালা পরিয়ে দেয় ৷ তখন মেয়েরা ‘হয় নাই, চোট্টামি করছে’ বলে চেঁচাতে থাকে ৷ রুমী বলে, ‘এই আজাদ, বারবার তুমি ছড়াটা ভুলে যাচ্ছ কেন ? নাও, এবার পুরোটা ঠিকমতো বলো ৷’
‘ওপেনটি বায়োস্কোপ
নাইন টেন টুয়েন্টিথ্রি কোপ…’ আজাদ বলতে শুরু করে ৷
‘এই, কী বলো ?’ রুমী বলে, ‘তেইশ কোপ তো ৷’
‘নাইন টেনের পরে টুয়েন্টিথ্রি হওয়া উচিত না ? ইংরেজির সাথে আবার বাংলা আসে কী করে ?’ আজাদ হাসে ৷
কাজী কামালের মনে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের সহপাঠী হিসাবে আজাদের স্মৃতি উদিত হয় কেমন ছাড়া-ছাড়া ভাবে ৷ হয়তো স্মৃতি মাত্রই তাই ৷ আজকে কে বলতে পারবে গতকাল ২৪ ঘন্টায় প্রতিটা মিনিটে সে কী করেছে, কী ভেবেছে ? কী করেছে গত এক বছরে, রোজ ? আজাদের সঙ্গে একই স্কুলে একই সঙ্গে পড়বার স্মৃতির সবই যে নিখাঁদ ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের, তাও কিন্তু নয় ৷ আজাদ যে ভয়াবহ বড়লোকের ছেলে ছিল, একেক দিন একেকটা পোশাক পরে আসত, আসত ভীষণ দামি গাড়ি চড়ে, তার পকেটে সব সময় টাকা-পয়সা থাকত, এসব নিয়ে কাজী কামালের ছোটবেলায় একটা অব্যাখ্যাত শ্রেণীহিংসাও হয়তো ছিল ৷ তবুও আজাদকে পছন্দ না করেও তাদের নিম্নমধ্যবিত্ত দলের কোনো উপায় ছিল না ৷ কারণ আজাদ তাদের সিনেমা দেখাত ৷ সিনেমা দেখার একটা প্রবল ঝোঁক ছিল আজাদের ৷ আর বন্ধুদের দেখানোর বেলাতেও তার কোনো কার্পণ্য ছিল না ৷ আজাদের সঙ্গেই সে দেখেছিল মৌলভীবাজারের ভেতরে তাজমহল সিনেমা হলে দি ওল্ডম্যান অ্যান্ড সি ৷ বুড়ো জেলে একটা বিরাটকায় মাছ ধরার জন্যে সংগ্রাম করছে, এই সংগ্রামে সে কিছুতেই হার মানবে না-দেখে ভালোই লেগেছিল কামালের ৷ তখন টিকেটের দাম ছিল কম, মর্নিং শোতে বারো আনা হলেই ডিসিতে ছবি দেখা যেত ৷ কামালরা ছবি দেখলে কোন ক্লাসে দেখত, সেটা বড় ব্যাপার ছিল না ৷ কিন্তু আজাদের কাছে এগুলো অনেক বড় ব্যাপার ছিল ৷ সে কখনও থার্ড ক্লাসে ছবি দেখেওনি, দেখায়ওনি ৷ লায়ন, রূপমহল, মুকুল, মায়া-এসব সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা চলত ৷ তবে নাজে আসত ভালো ভালো ইংরেজি ছবি ৷
আজাদদের বাসায় যাওয়াটাও একটা আনন্দের ব্যাপার ছিল তার সহপাঠীদের জন্যে ৷ কারণ তার মা খাওয়াতে খুব পছন্দ করতেন ৷ খালাম্মা সেধে সেধে একদম পেটপুরে খাওয়াতেন ৷ নানা পদের খাবার ৷ সেই লোভেও অনেক সময় যাওয়া চলত আজাদদের বাড়িতে ৷ সে ফরাশগঞ্জের বাড়ি হোক, আর নিউ ইস্কাটনের বাড়িই হোক ৷
আজাদ যে পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল, তা নয় ৷ তবে খারাপ সে ছিল না ৷ পরীক্ষায় কখনও ফেইল করেনি ৷ আবার ফার্স্ট সেকেন্ডও হয়নি ৷ কিন্তু আশ্চর্য ভালো করেছিল রহমতউল্লা স্যারের ক্লাসে ৷ তিনি নিতেন আজাদদের হাতের লেখা ভালো করার ক্লাস-পেনম্যানশিপ ক্লাস ৷ একটা চার্ট ঝোলানো থাকত এই ক্লাসে, আমেরিকান স্টাইলে বাঁকা বাঁকা হরফে তাতে ইংরেজি বর্ণমালা লেখা ৷ কলম না তুলে তেরছা করে অ থেকে ত পর্যন্ত লিখতে হতো ৷ কোনো অক্ষরের সময়ই কলম তোলা যাবে না ৷ রহমতউল্লা স্যারের নিজের হাতের লেখা ছিল অতি চমৎকার ৷ দেখে মনে হতো সার্টিফিকেটের লেখা নিশ্চয় এই স্যারের কাছ থেকে লিখিয়ে নেওয়া হয় ৷ হাতের লেখার এই ক্লাসে আজাদ খুব ভালো করত ৷ প্রায়ই ভেরি গুড পেত আজাদ, তার কপিতে ৷
আজাদের এই ভালো ইংরেজি লেখাটা শেষ পর্যন্ত কাজে লেগেছিল তার ধরা পড়ার মাত্র দিন সাতেক আগে ৷ সে জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ গানটা কপি করে নিয়েছিল নিজের জন্যে, আর তখন রুমী, জুয়েল, কামাল, বদি তাকে অনুরোধ করেছিল তাদেরকেও একটা করে কপি দেওয়ার জন্যে ৷ আজাদ ছবিও ভালো আঁকত ৷ মধু মোল্লা নামের এক আর্টের শিক্ষক তাকে ছবি আঁকা শেখাতে আসতেন বাসায় ৷ তাঁর কাছে শিখে শিখে আজাদ একটা ছোটখাটো আর্টিস্ট হয়ে গিয়েছিল ৷ বিজি চৌধুরী স্যার শুক্রবার স্কুল ছুটির পর আলাদাভাবে বসাতেন ড্রয়িংয়ের ক্লাস ৷ এই ক্লাস করতে চাইলে স্যারের কাছে গিয়ে নাম লেখাতে হতো ৷ আজাদও নাম লিখিয়েছিল ৷ কিন্তু সে ক্লাস করতে চাইত না ৷ বলত, ‘আরে রাখ রাখ, এ সময়টা ক্রিকেট মাঠে না-হলে সিনেমা হলে কাটিয়ে আসাটাই তো বেশি লাভের ব্যাপার ৷’ বিজি চৌধুরী স্যার বছরে দুবার ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন ৷ পুরস্কার থাকত খুবই আকর্ষণীয় ৷ সেই পুরস্কারের লোভে হোক, অথবা নিজের প্রতিভা যাচাই করে নেওয়ার খাতিরে হোক, আজাদ ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় একবার অংশ নিয়েছিল ৷ ওর ছবিটা ভালো হয়েছিল ৷ আর ও পেয়েছিল ৮০-তে ৭৫ ৷ আর প্রতিদ্বন্দ্বী কাশেম পেয়েছিল ৮০-তে ৬০ ৷ কিন্তু স্যার প্রথম পুরস্কার দিলেন কাশেমকে, তার কারণ হিসেবে স্যার বলেছিলেন বাকি ২০ মার্কস হলো উপস্থিতির জন্যে ৷ এতে কাশেম ২০-এ ২০ পেয়েছে ৷ আজাদ পেয়েছে ০ ৷ দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়ে আজাদ বেশি খুশি হয়েছিল, কারণ প্রথম পুরস্কারটা ছিল রঙের বাঙ্, আর দ্বিতীয়টা ছিল একটা খেলনা গাড়ি ৷ ও ঠোঁট উল্টে বলেছিল, ‘আরে কালার বঙ্ আমার বহুত আছে ৷’
আজাদের আরেক সহপাঠী কামরান আলী বেগের মনে পড়ে যায়, ক্লাসে সূত্রধর স্যার একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, এয়ার-বাস কী ? ঢাকা টু ঈশ্বরদী তখন এয়ার-বাস চলতে শুরু করেছে ৷ স্যার এই ব্যাপারটাই বোঝাচ্ছিলেন ৷ আজাদ স্যারের কথা শুনছিল না ৷ সে ব্যস্ত ছিল পাশর্্ববর্তী সহপাঠীর সঙ্গে কাটাকুটি খেলায় ৷ স্যারের নজরে পড়ে যায় সে ৷ স্যার জিজ্ঞেস করেন, ‘আজাদ, ওঠো ৷ কী করছিলে ?’
‘কিছু না স্যার ৷’
‘আমি কী পড়াচ্ছি, শুনছিলে ?’
‘জি স্যার ৷’
‘আচ্ছা বলো তো এয়ার-বাস কী ?’
আজাদ উসখুস করে ৷ ঠিক এই সময় পিয়ন আসে কী একটা নোটিস নিয়ে ৷ স্যার সে-নোটিসটা পড়ে তাতে স্বাক্ষর করে পিয়নকে বিদায় করেন ৷ ইত্যবসরে আজাদ পেছনে বসা বেগকে জিজ্ঞেস করে ফিসফিসিয়ে, ‘এই, এয়ার-বাস কী রে ?’
বেগ বলে, ‘আরে এয়ার-বাস বুঝলি না ? আকাশ দিয়ে বাস ওড়ে ৷ তার দরজায় থাকে কন্ডাক্টর ৷ সে বাসের গায়ে চাপড় মেরে বলে, আইসা পড়েন ডাইরেক্ট সদরঘাট ৷ তার দরজায় ঝোলানো থাকে দড়ির সিঁড়ি ৷ প্যাসেঞ্জাররা সেই সিঁড়ি দিয়ে তাতে উঠে পড়ে ৷’
পিয়নকে বিদায় করে সূত্রধর স্যার আবার গর্জন করে ওঠেন, ‘হ্যাঁ আজাদ, বলো, এয়ার-বাস কী ?’
আজাদ বলতে শুরু করে, ‘আকাশ দিয়া বাস যায় স্যার, দরজায় থাকে দড়ির সিঁড়ি, সেই সিঁড়ি দিয়া প্যাসেঞ্জার উঠিয়া থাকে…’
পুরো ক্লাস হেসে গড়িয়ে পড়ছে ৷ স্যার হাসবেন না কাঁদবেন, বুঝতে পারছেন না ৷ শেষে হাসি চেপে বলেন, ‘দাঁড়িয়ে থাকো ৷ ঘন্টা না বাজা পর্যন্ত বসবে না ৷’

০৮. মা

শহরের মুক্তিযোদ্ধা আর আজাদের বন্ধুবান্ধবদের মনে পড়ে যে, আজাদের মায়ের দুঃস্বপ্নের দৃশ্যটাই শেষতক ইউনুস চৌধুরীর জীবনে বাস্তব রূপ লাভ করেছিল ৷ এখান থেকে ওখান থেকে কৃষ্ণের ষোলশ গোপিনী না হলেও চৌধুরীর জীবনে নারী-ভক্তের উপস্থিতি সাফিয়া বেগম টের পেতে শুরু করেন ৷
এরই মধ্যে একজন ছিলেন যিনি চৌধুরীর আত্মীয়া, বিবাহিতা, আর সম্পর্কে তাঁর বড় ভাইয়ের স্ত্রী ৷ তাঁর সঙ্গে মেলামেশাটা সাফিয়া বেগম একদমই সহ্য করতে পারতেন না ৷
মহিলা নিউ ইস্কাটনের বাসায় একবার বেড়াতেও এসেছিলেন ৷ অতিথি-বৎসল সাফিয়া বেগম সব ধরনের অতিথির ঝামেলা হাসিমুখে সহ্য করলেও এই মহিলাকে সহ্য করতে পারেননি ৷ সম্ভবত তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাঁকে ভবিষ্যতের অশনিসংকেত জানান দিচ্ছিল ৷
সাফিয়া বেগম স্বামীকে বলেন, ‘এই মহিলাকে আপনি আমার বাসা থেকে যেতে বলেন ৷ আমি আর এক মুহূর্তও তাকে এই বাড়িতে দেখতে চাই না ৷’
চৌধুরী সাহেব তখন তরলের গুণে বেশ উচ্চমার্গে অবস্থান করছিলেন ৷ তিনি বলেন, ‘কেন ? থাকতে পারবে না কেন ?’
‘কারণ ওই মহিলা ভালো না ৷ তার স্বভাব-চরিত্র চালচলন আমার ভালো ঠেকছে না ৷’
‘কিন্তু আমার কাছে ভালো ঠেকছে ৷’
‘তা তো ঠেকবেই ৷ আপনার সাথে তার কী সম্পর্ক, আমি বুঝি না ৷ ছি-ছি-ছি ৷ উনি না আপনার সম্পর্কে ভাবি হয় ?’
‘নিজের তো আর ভাবি না ৷’
‘নিজের ভাবি না হলেই আপনি একটা ছেলের বাবা হয়ে আরেকটা ছেলের মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখবেন ?’
‘কী সম্পর্ক ?’
‘তা আমি কী জানি ?’
‘তাহলে কথা বলো কেন ?’
‘আপনি তাকে বের করে দেবেন, এই হলো আমার শেষ কথা!’
‘যদি বের করে না দেই ৷’
‘তাহলে আমি বের করে দেব ৷ সে এখানে এসেছে কোন অধিকারে ?’
‘তুমি অধিকারের কথা জিজ্ঞাসা করো ৷ তাহলে আমি তাকে অধিকার দিব ৷ সে এখানে থাকবে আমার স্ত্রীর অধিকার নিয়ে ৷’
‘খবরদার ৷ এই কথা শোনার আগে আমার মরণ হলো না কেন ?’
‘আমার হক আছে, আমি চারটা পর্যন্ত বিবাহ করতে পারি ৷ তুমি তো শরিয়ত মানো, নামাজ রোজা ইবাদত বন্দেগি করো, তুমি আমার হক মানবা না ?’
‘না ৷ মানব না ৷ শরিয়তে আছে চারটা বিয়ে করা যাবে ৷ কিন্তু চার বউকে একদম এক সমান নজরে দেখতে হবে ৷ কাউকে এক সরিষা পরিমাণ বেশি বা কম ভালোবাসা যাবে না ৷ আবার একটু কম বা বেশি অপছন্দও করা যাবে না ৷ সেটা কারো পক্ষে করা সম্ভব না ৷ কাজেই দুই বিয়ে করা ধর্মের মতে উচিত না ৷’
‘তুমি বেশি বোঝো ? তুমি জানো আমার পায়ের নিচে তোমার বেহেশত ৷’
‘যে স্বামী স্ত্রীর হক আদায় করতে পারে না, তার পায়ের নিচে বেহেশত থাকতে পারে না ৷’
‘কথা পেঁচিও না ৷ আমি ওকে বিয়ে করবই ৷’
‘আপনি ওই মহিলাকে বিয়ে করলে আমার মুখ আর জীবনেও দেখবেন না ৷ বড় ভাইয়ের বউকে বিয়ের কথা ভাবে, আমি কী আজরাইলের পাল্লায় পড়েছি ৷’
‘আমি তোমাকে আরো গয়না দেব ৷ তোমার নামে একটা জাহাজ লিখে দেব ৷’
‘আপনার গয়নায় আমি থুতু দেই ৷’
‘কী বললা তুমি ?’
‘আপনাকে মিনতি করে বলি ৷ আপনি ওই মহিলাকে ছাড়েন ৷ এই বাড়ি-টাড়ি সব আমি আপনার নামেই লিখে দেব ৷ তবু পাগলামি ছাড়েন ৷’
‘না, আমি ওকে বিবাহ করবই ৷’
‘তাহলে আপনি আমার মরা মুখ দেখবেন ৷’
সাফিয়া বেগম কেঁদেকেটে অন্য ঘরে চলে যান ৷ পাশের ঘরে আজাদ ৷ সে সব কথা শুনছে ৷ তার মাথা গরম হচ্ছে ৷ অথচ ঠিক করতে পারছে না সে কী করবে ৷ মা-বাবা ঝগড়া করছেন ৷ বাবা আরেকটা বিয়ে করতে চাইছেন ৷ বাড়িতে এইসব হতে থাকলে তার বুঝি কষ্ট হয় না ? তার বুঝি খারাপ লাগে না ? তার বুঝি ইচ্ছা হয় না নিজের ওপরে শোধ নিতে ৷ তার কান দুটো গরম হয়ে ওঠে ৷ সে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে জোরে গান ছেড়ে দেয় ৷ শক্তিশালী গানের যন্ত্র মাথায় তোলে পুরোটা বাড়িকে ৷
মহিলাকে চৌধুরী আপাতত বিদায় করেন ইস্কাটনের বাসা থেকে ৷
কিন্তু তাঁর জীবন থেকে নয় ৷ মাঝখানে কিছুদিন চৌধুরী ব্যয় করেন তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের আনজাম সম্পন্ন করতে ৷ তাঁর বৃদ্ধ পিতা আর মাতার অনুমতি আদায় করেন দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে ৷ আজাদের দাদা-দাদী বিয়ের অনুমতি দিতে খুব বেশি কুন্ঠা দেখান না ৷ ছেলে তাঁদের শিক্ষিত হয়েছে, বড় হয়েছে, আর টাকাকড়ি আয়-উন্নতি করেছে কত! তার তো একাধিক স্ত্রী থাকতেই পারে ৷ মহিলার দিক থেকেও আইনগত প্রস্তুতির ব্যাপার ছিল ৷ তাঁকে প্রথম স্বামীর কাছ থেকে ডিভোর্স নিতে হয় ৷ তারপর চৌধুরীর কয়েকজন অতি ঘনিষ্ঠ নিকটাত্মীয় আর বন্ধুর উপস্থিতিতে মগবাজারের এক আত্মীয়ের বাসায় এক রাতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয় ৷
রাত তখন একটার মতো বাজে ৷ সাফিয়া বেগমের বিশ্বস্ত পরিচারিকা জয়নব এসে খবর দেয়, ‘আম্মাজান, আব্বায় আরেকটা বিয়া কইরা বউ নিয়া এ বাড়িতেই আইছে ৷’
সাফিয়া বেগম মুহূর্তখানেক স্তব্ধ হয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকেন ৷ মুহূর্তখানেকই শুধু ৷ তখন পুরোটা পৃথিবী নৌকার মতো একবারের জন্যে দোল খেয়ে ওঠে ৷ তারপর স্থির হয় ৷ তিনি পরিস্থিতি অনুধাবন করার চেষ্টা করেন ৷ তাঁর সমস্ত শরীর সংকল্পে নড়ে ওঠে ৷ মাথা থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত গলিত আগুনের ধারা বয়ে যায় ৷ তিনি কর্তব্য স্থির করেন ৷ পরিচারিকাকে বলেন, ‘আজাদকে এখানে আসতে বলো ৷’ তাঁর কন্ঠস্বরে প্রতিজ্ঞার ধাতব টঙ্কার ৷
আজাদ আসে ৷ তার মাথার চুল এলোমেলো, চোখের নিচে কালির আভাস, পরনে নিদ্রাপোশাক ৷ সে নিচের পাটির দাঁত ওপরের পাটির সামনে আনছে ৷
মা বলেন, ‘আমি এখন এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি ৷ আর কোনো দিন আমি তোর বাবার মুখ দেখব না ৷ তুই কি এই বাড়িতে থাকবি, না আমার সাথে যাবি ?’
আজাদের সাত-পাঁচ ভাবার দরকার নাই ৷ সে বলে, ‘তোমার সাথে যাব ৷’
‘চল ৷ বইপত্র গুছিয়ে নে ৷ তাড়াতাড়ি কর ৷ ৫ মিনিট টাইম দিলাম ৷’
আজাদ তার ঘরে যায় ৷ তার জিনিসপত্র গোছাতে থাকে ৷ স্কুলের ব্যাগে বইপত্র গোছানোই আছে ৷ কিন্তু তা-ই তো সব নয় ৷ কত কাপড়চোপড় ৷ কতশত গল্পের বই, কমিক্সের বই ৷ খেলনা শত পদের ৷ ক্যামেরা, আর আছে সত্যিকারের একটা রিভলবার ৷ তাদের একটা বন্দুকের দোকানও আছে ৷ সেখান থেকে রিভলভারটা সে নিয়েছে, তার নামেই লাইসেন্স করে ৷
আজাদ কোনটা রাখবে, কোনটা নেবে! রিভলবারটা সে সঙ্গে নেয় ৷ এটা এই গণ্ডগোলের সময়ে কাজে লাগতে পারে ৷ সে আর তার মা একা বের হচ্ছে ৷ রাত্রির এই ঘন অন্ধকারের অজানা পেটের ভেতরে ঢুকে যাবে তারা ৷ কোথায় যাবে, কী হবে, সবই অনিশ্চিত ৷ তার টেপ রেকর্ডারে রুমীর কন্ঠে একটা কবিতার আবৃত্তি টেপ করা আছে ৷
বীরশিশু ৷
মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে,
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে,
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে,
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে…
এমন সময় হারেরেরেরে,
ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে…
ওই ডাকাতদলের হাত থেকে মাকে কে রক্ষা করেছিল ? তার ছেলেই তো ৷
পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে,
‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে ৷’
আর আজাদের মায়ের যদি কিছু হয়! কে তাঁকে বাঁচাবে বিপদ-আপদ থেকে! আজাদকেই তো দায়িত্ব নিতে হবে ৷
আজাদ তার স্কুলের ব্যাগের মধ্যে রিভলবার আর বুলেট তুলে নেয় ৷
সাফিয়া বেগম এই বাড়ির কোনো কিছু সঙ্গে নেবেন না ৷ যাকে বলে একবস্ত্রে যাওয়া, তা-ই তিনি যাবেন ৷ কিন্তু তাঁর বাবার দেওয়া গয়নাগুলো আলমারিতে একটা আলাদা বাঙ্যে তোলা আছে ৷ এগুলো না নেওয়াটা উচিত হবে না ৷ এগুলো চৌধুরীর নয় ৷ আর তা ছাড়া আজাদ থাকবে তাঁর সঙ্গে ৷ তাকে তো মানুষ করতে হবে ৷ পড়াতে হবে ৷ খাওয়াতে হবে ৷ পরাতে হবে ৷
তিনি আলমারি খোলেন ৷ রাশি রাশি গয়নার মধ্যে থেকে কেবল নিজের পিতৃদত্তটুকুন একটা পুঁটলিতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন ৷ ‘বাদশা, গাড়ি বের করো ৷’
বাদশা বাড়ির ড্রাইভার ৷ বেগম সাহেবার নির্দেশে সে গাড়ি বের করে ৷ পোর্চে রাখে ৷
আজাদ আর তার মা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে ৷ বাড়ির কাজের লোক, আশ্রিতজন, আত্মীয়স্বজন সব নীরবে তাকিয়ে থাকে তাদের চলে যাওয়ার দিকে ৷ তাদের মাথার ওপর থেকে যেন ছায়া সরে যাচ্ছে ৷
পরিচারিকা জয়নব কেঁদে ওঠে ৷ সাফিয়া বেগম চাপা গলায় তাঁকে ধমকে দেন, ‘পাড়ার লোকদের রাতের বেলায় জাগিয়ে তুলবি নাকি ? বাড়িতে কি লোক মারা গেছে ? চুপ ৷’
আজাদ আর তার মা বারান্দা পেরোয় ৷ বারান্দার চারদিকে লাইট ৷ আজাদের পায়ের কাছে নিজের অনেকগুলো ছায়া তাকে ঘিরে ধরে এগিয়ে যাচ্ছে ৷ ছায়াগুলোর দৈর্ঘ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে ৷ টমি, স্প্যানিয়েল কুকুরটা, কী করবে বুঝে উঠছে না ৷ একবার আজাদের কাছে আসছে, একবার ভেতরে ঢুকছে ৷ আজাদ সেদিকে তাকাবে না ৷ তারা গিয়ে গাড়িতে ওঠে ৷ গাড়ি স্টার্ট নেয় ৷ দারোয়ান দৌড়ে এসে সদর দরজা খুলে দেয় ৷ মেম সাহেব বেরিয়ে যাচ্ছেন, সঙ্গে ছোট সাহেব, সে সালাম দেয় ৷ গাড়ি গেট পেরোয় ৷
আজাদ আর তার মায়ের পেছনে ইস্কাটনের বাড়ির গেট বন্ধ হয়ে যাওয়ার শব্দ রাত্রির নীরবতা ভেদ করে প্রকটিত হয়ে উঠলেও তারা পেছনে তাকায় না ৷
জীবনে শেষবারের মতো সাফিয়া বেগম তাঁর নিজ নামে রেজিস্ট্রিকৃত ইস্কাটনের রাজপ্রাসাদতুল্য বাড়িটা ছেড়ে চলে যান ৷
গাড়ি ইস্কাটন থেকে বেরিয়ে অগ্রসর হতে থাকে ফরাশগঞ্জের দিকে ৷ রাতের রাস্তাঘাট দেখতে অন্য রকম লাগে ৷ দোকানপাট বন্ধ ৷ রাস্তাজুড়ে নেড়ি কুকুরের রাজত্ব ৷ সেকেন্ড শো সিনেমা দেখে দর্শকরা ফিরছে ৷ নিয়ন সাইন জ্বলছে এখানে-ওখানে ৷ হঠাৎ হঠাৎ একটা দুটো রিকশা ৷ সেই রিকশার যাত্রী আর চালক দুজনকেই মনে হয় ঘুমন্ত ৷ হয়তো গাড়ির হেড লাইটের আলো চোখে পড়ায় তারা চোখ বন্ধ করে ফেলে বলে এ রকম মনে হয় আজাদের ৷ গাড়ি গিয়ে ফরাশগঞ্জের বাসার সামনে থামে ৷ এ বাসাটায় এখন সাফিয়া বেগমের নিজের ছোট বোন শোভনা আছে ছেলেমেয়ে নিয়ে ৷ আছে জায়েদ, চঞ্চল, মহুয়া, টিসু, কচি প্রমুখ আজাদের খালাতো ভাইবোনেরা ৷ এদের বাবা আবার সম্পর্কে চৌধুরীর ভাই হয় ৷ জিনিসপত্র নিয়ে আজাদ নামে ৷ মায়ের সঙ্গে তেমন কিছু নাই ৷ শুধু একটা ছোট্ট থলে ছাড়া ৷ ড্রাইভার বলে, ‘আম্মা, আমি কি থাকব ?’ মা মাথা নেড়ে ‘না’ বলেন ৷ আজাদ ডোরবেল টিপলে প্রথমে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না ৷ আজাদ ফের বেল টেপে ৷ ভেতর থেকে শোনা যায় আজাদের খালা শোভনার কন্ঠস্বর : ‘কে ?’ ‘আমি আজাদ’ উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে যায় ৷ খালার চোখেমুখে শাড়িতে ঘুমের চিহ্ন ৷ তিনি বলেন, ‘এত রাতে যে, বুবু ?’ সাফিয়া বেগম তাঁর প্রশ্নের জবাব দেন না ৷ সিঁড়ি ভেঙে সোজা ওঠেন তিনতলার একলা ঘরটায় ৷ এটা আগে ছিল আজাদের ঘর ৷ তিনি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেন ৷
আজাদ আর তার খালা সাফিয়া বেগমকে অনুসরণ করে তিনতলা পর্যন্ত এসে বারান্দায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ৷ খালা বলেন, ‘কী রে ? বুবু রাগ ?’
‘হুঁ ৷’
‘কেন ?’
‘আব্বা বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে এসেছেন ৷’
‘বলিস কি!’ শোভনা বেগম এমনভাবে আর্তনাদ করে ওঠেন যেন তার নিজের স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে এইমাত্র ঘরে ঢুকল ৷ তারপর তিনি নিজেও নীরব হয়ে যান ৷
সাফিয়া বেগম পাঁচ দিন তিনতলার ঘরের দরজা বন্ধ করে রাখেন ৷ একটাবারের জন্যেও দরজা খোলেন না ৷
তাঁর ছোটবোন শোভনা, বোনের ছেলেমেয়েরা আর আজাদ প্রথম দিন দুপুর থেকে দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে ৷ সাফিয়া বেগম স্পষ্ট গলায় বলেন, ‘এই, দরজায় ধাক্কা দিবি না ৷ সবাই সবার নিজের কাজে যা ৷’
তাঁর কন্ঠস্বরে কী একটা ক্ষমতা ছিল, কেউ আর তাঁকে জ্বালাতন করে না ৷ সবাই নিচে নেমে যায় ৷
পরের দিন আবার সকালে সবাই চিন্তিত উদ্বিগ্ন মুখে তিনতলার ঘরের সামনে জড়ো হয় ৷ তারা দরজায় ধাক্কা দিতে আরম্ভ করলে তিনি আবার শান্ত কিন্তু গম্ভীর কন্ঠে বলেন, ‘এই, বলেছি না, দরজায় ধাক্কা দিবি না ৷’
সবাই আবার নেমে যায় ৷
তৃতীয় দিন সকালে ফের সবাই ভীষণ চিন্তিত হয়ে সাফিয়া বেগমের বন্ধ দরজার সামনে অবস্থান নেয় ৷ জায়েদের মা শোভনা বেগম আজাদকে শিখিয়ে দিয়েছেন, ‘বল, তুমি কিছু খাবে না ? না খেয়ে মরে যাবে ? তাহলে আমি বাঁচব কাকে নিয়ে ? আমাকে দেখবে কে ?’ আজাদ এত কিছু বলতে পারে না ৷ শুধু বলে, ‘মা কিছু খাবা না ? না খেয়ে মরবা নাকি ?’
মা বলে, ‘না খাব না ৷ খিদে পায়নি ৷ খিদে লাগলে নিজেই খাবার চেয়ে নেব ৷’
চতুর্থ দিনে সবাই ভাবে, সাফিয়া বেগম নিশ্চিত মরতে যাচ্ছেন ৷ শোভনা বলেন, ‘বুবু, তুমি কি আত্মহত্যা করবা ? তাইলে তো তোমার দোজখেও জায়গা হবে না ৷’
সাফিয়া বেগম বলেন, ‘না, আমি মরব না ৷ একটা আজরাইলের জন্যে আমি মরব না ৷’
‘ঘর থেকে বার না হও, কিছু একটা খাও ৷ জানলা দিয়া ভাত দেই ?’
সাফিয়া বলেন, ‘তুই বেশি কথা বলিস ৷ চুপ থাক ৷’
ওই দিন রাতেই চৌধুরী সাহেবের গাড়ি দেখা যায় ফরাশগঞ্জের বাসার সামনে ৷ জায়েদ এসে খবর দেয় আজাদকে, ‘দাদা, আপনের আব্বায় আইছে ৷’
আজাদ তখন তার সঞ্চয় থেকে তার জিনিসটা বের করে ৷ রিভলবার ৷ এটা সে সঙ্গে এনেছিল ভবিষ্যতে কোনো না কোনো কাজে লাগতে পারে, এ আশায় ৷ কিন্তু এত তাড়াতাড়ি যে কাজে লেগে যাবে, সে বুঝতে পারে নাই ৷ সে রিভলবারের মধ্যে গুলি ভরে ৷ তারপর রিভলবারটা হাতে নিয়ে তিনতলার সিঁড়ির মুখে দাঁড়ায় ৷
চৌধুরী নিচের তলার ঘর পর্যন্ত ঢোকেন ৷ তাঁকে গৃহবাসীরা সাবধান করে দেয়, যেন তিনি ওপরে না ওঠেন ৷ তাঁকে আরো বলা হয়, তিনি যদি ওপরে ওঠার চেষ্টা করেন, তাহলে আজাদের হাতের অস্ত্র গর্জে উঠতে পারে ৷ সে তার মাকে পাহারা দিয়ে রেখেছে ৷
চৌধুরী ফিরে যান ৷
বদ্ধ ঘরের জানালার অন্যপাশ থেকে ঘটনা বিবৃত করা হয় সাফিয়া বেগমকে ৷ সাফিয়া বেগম সব শোনেন ৷ পঞ্চম দিন সকালে তিনি বন্ধ দরজা খুলে দেন ৷
জায়েদের মা তাঁর জন্যে ভাত আনেন ৷ তরকারি আনেন ৷ তিনি বলেন, ‘মাছমাংস কেন এনেছ ? এইসব নিয়ে যাও ৷ খালি একটু ডাল-ভাত দাও ৷ আর শোনো, আমাকে একটা শাদা শাড়ি দাও ৷ আমার স্বামী তো আর আমার কাছে জীবিত নাই ৷ আমি কি আর রঙিন শাড়ি পরতে পারি!’
বাড়ির পরিচারিকারা আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্তে আসে যে, বড় আম্মার পোষা জিন আছে ৷ তারাই তাঁকে এ পাঁচ দিন খাবার সরবরাহ করেছে ৷ না হলে পাঁচ-পাঁচটা দিন একটা দানা মুখে না দিয়ে কেউ বাঁচতে পারে!
এর পরের তিনটা বছর তিনি কারো সঙ্গে বলতে গেলে কথাই বলেননি ৷

 ০৯. মা

চৌধুরী সাহেব এত দূর পর্যন্ত ভাবতে পারেননি ৷ কে-ইবা ভাবতে পেরেছে ? আজাদের মা কঠিন মহিলা, কিন্তু তিনি যে হীরার চেয়েও কঠিন, পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন পদার্থের চেয়েও কঠিন, সেটা একটু একটু করে উদ্ঘাটিত হতে থাকে ৷ এবং যতই দিন যায়, তখন আগের উপলব্ধিটাও যথেষ্ট ছিল না বলে মনে হয় ৷ চৌধুরী সাহেব ভেবেছিলেন, আজাদের মা তাঁর দ্বিতীয় বিয়েটা মেনে নেবে ৷ কেন নেবে না ? তাকে তিনি অর্থে-অন্নে-বস্ত্রে রানীর হালেই রাখতে পারেন ৷ তার বদলে একবস্ত্রে বের হয়ে আজাদের মা কি ভিখিরিনীর মতো করে জীবনযাপন করতে পারবে ? আজাদই কি পারবে এই রাজৈশ্বর্য ছেড়ে গিয়ে দীনহীন জীবন বেছে নিতে ? নিশ্চয় পারবে না ৷ তাদের ফিরে আসতেই হবে ৷
দিন যায় ৷ চৌধুরীর মনোবাঞ্ছা পূরণ হয় না ৷ আজাদের মায়ের নমনীয় হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না ৷ তিনি তাঁর অর্থসাহায্য গ্রহণ করা তো দূরের কথা, মুখটা পর্যন্ত দেখতে নারাজ ৷
আজাদ স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেয় ৷ তার কিছু ভালো লাগে না ৷ বাবার কাছ থেকে যে-মাসোহারা পায়, ওই সময়ে সেই মাসোহারা তার পক্ষে অধঃপাতে যাওয়ার জন্যে যথেষ্ট ৷ মা তার এই মাসোহারার টাকা থেকে কিছুই নেবেন না, একটা পয়সা না, একটা দানা না ৷ সে বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখে ৷ গল্পের বই কেনে ইচ্ছামতো ৷ সন্ধ্যার সময় রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা মারে ৷ তার বন্ধুরা খেলাধুলা করে ৷ সৈয়দ আশরাফুল হক, কাজী কামাল, ইব্রাহিম সাবের, রউফুল হাসান আর জুয়েল ৷ তাদের সঙ্গে সেও কখনও কখনও যায় মাঠে ৷ সারা দুপুর ক্রিকেট খেলে ৷ প্রায় প্রতিটা ইংরেজি ছবি দেখে ৷ মাঝে মধ্যে চলে যায় শিকার করতে ৷ সব হয়, শুধু স্কুলে যাওয়ার বেলায় তার দেখা নাই ৷
প্রথম প্রথম বহুদিন সে যায়নি ইস্কাটনের বাসায় ৷ মাসোহারার টাকা আনার জন্যে ওই বাসায় সে পাঠিয়ে দিত জায়েদকে ৷ তার বইপত্র আর কত সংগ্রহের জিনিসপাতি সবই তো পড়ে আছে ইস্কাটনের বাসায় ৷ কয়েক মাস পর থেকে সেসব আনতে মাঝে মধ্যে আজাদ যায় সেখানে ৷ দেখা হয় নতুন মায়ের সঙ্গে ৷
ভদ্রমহিলাও এক অদ্ভুত সংকটেই পড়েছেন ৷ ভালোবেসে, মোহগ্রস্ত হয়ে, দিওয়ানা হয়ে-যেভাবেই হোক আত্মসংবরণ করতে না পেরে তিনি ছুটে চলে এসেছেন চৌধুরীর ঘরে ৷ আগুনের টানে পতঙ্গ যে রকম ছুটে আসে, তেমনি করে চলে এসেছেন তাঁর অতীতকে অবলীলায় ত্যাগ করে ৷ এটাও কি একটা ত্যাগস্বীকার নয় ? কিন্তু এ বাড়িতে পরিবেশ তেমন অনুকূল নয় ৷ বাড়ির চাকর-বাকরেরা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ভালো করে কথা বলে না ৷ আত্মীয়স্বজনরা তাঁর দিকে কেমন রোষের দৃষ্টিতে তাকায় ৷ তিনি চান সবার চিত্ত জয় করতে ৷ কিন্তু সে চেষ্টা সুদূরপরাহত বলে মনে হয় ৷
আজাদ এ বাসায় এলে তিনি চেষ্টা করেন তাকে পটানোর ৷ বলেন, ‘কী খাবে ? কী লাগবে ? কিছু কিনে দেব ?’
আজাদ তাঁর কথার জবাব দেয় না ৷ গোঁ ধরে থাকে ৷ বেশি পীড়াপীড়ি করলে বাসা থেকে চলে যায় ৷
যেমন মা তেমনি ছেলের বাবা!
চৌধুরীর দ্বিতীয় বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় ফরাশগঞ্জের বাড়িতে একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে ৷ জায়েদের সে-সময়টা এখনও মনে আছে ৷ সে খুবই ছোট তখন ৷ বালক বয়স ৷ শেরে বাংলা ফজলুল হক মারা গেছেন ৷ সমস্ত প্রদেশে শোকের ছায়া ৷ এদিকে ফুটো পয়সা উঠে যাচ্ছে ৷ প্রবর্তিত হচ্ছে নয়া পয়সা ৷ জায়েদ নয়া পয়সার হিসাব শিখছে কাগজ-কলম নিয়ে ৷ কাগজে ফুটো পয়সা আর নয়া পয়সা গোল গোল করে এঁকে এঁকে তাকে শিখতে হচ্ছে ৬ পয়সায় এক আনা, ১২ পয়সায় দুই আনা, ৫০ পয়সায় আট আনা ৷ ১০০ পয়সায় এক টাকা ৷ এই হিসাবের ফেরে পড়ে একদিন সে মুশকিলেও পড়েছিল, তার মনে আছে ৷ আট আনা হলে হয় ৫০ পয়সা ৷ সে এক আনা এক আনা করে আট আনা জোগাড় করেছে ৷ একটা ৫ পয়সা আরেকটা ১ পয়সা মানে এক আনা ৷ এভাবে ৮ বার ৷ তাহলে তো আট আনাই হলো ৷ একটা সিনেমার টিকেটের দাম আট আনা ৷ কিন্তু সিনেমা হলে গিয়ে দেখা গেল পয়সা কম পড়ে গেছে ৷ কারণ একটা ১ পয়সা পকেটের কোন ফাঁক দিয়ে গেছে পড়ে ৷ আর ৬ পয়সা করে আট আনায় হয় ৪৮ পয়সা ৷ ১ পয়সা পড়ে যাওয়ায় তার কাছে আছে ৪৭ পয়সা ৷ হলের কাউন্টার ছিল ফাঁকা ৷ টিকেট বিক্রেতা বুড়োটা বলে, তিন পাইসা কম ৷ টিকেট নেহি মিলেগা ৷ ১ পয়সা কম কী করে তিন পাইসা কম হলো, জায়েদ বুঝতে পারে না ৷
ঠিক সেই সময় হঠাৎ বাসায় চিল্লাচিল্লি, জায়েদের মা মইরা যাইতেছে ৷
মা কেন মারা গেল, কীভাবে, জায়েদ সেই রহস্য আজো ভেদ করতে পারে না ৷ তবে তার মৃত্যুটা স্বাভাবিক ছিল না, আজ তার মনে হয় ৷ তার বাবা আর চৌধুরী ছিলেন ভাই আর বন্ধু ৷ আর তার মা আর আজাদের মা ছিলেন বোন আর হরিহর আত্মা ৷ আজাদের মাকে বশীভূত করার জন্যে হয়তো কেউ প্রয়োজন মনে করেছিল তাঁকে একলা করে ফেলার ৷ হয়তো সে জন্যেই জায়েদের মাকে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়েছে ৷ এ সবই আজ জায়েদের সন্দেহ হয় ৷ তখন সে ছিল অনেক ছোট ৷ বালক মাত্র ৷ কিছু বুঝতে পারেনি ৷ শুধু মনে আছে সে গিয়ে দেখতে পায় মা শুয়ে আছে আর তার শরীরটা সম্পূর্ণ নীল ৷ আর এরপর বহুদিন জায়েদ সবকিছুকে নীল দেখত ৷ তার মনে আছে, আম্মা মানে আজাদ দাদার মা নিজহাতে গোসল করালেন মাকে, কাফনের কাপড় পরালেন ৷ সেই কাফনের কাপড়টাকে পর্যন্ত নীল দেখাচ্ছে ৷ আগরবাতি জ্বলছে ৷ তা থেকে বেরুচ্ছে নীল রঙের ধোঁয়া ৷ ভাইবোনেরা, আত্মীয়স্বজন মহিলারা কাঁদছে ৷ কিন্তু আম্মা কাঁদছেন না ৷ তিনি কাফন পরানো শেষে কোরআন শরিফ নিয়ে বসলেন ৷ তাঁর এককোলে জায়েদের ১ মাস ৭ দিন বয়সের ছোট ভাই লিমন ৷ তারপর এক সময় মাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে খাটিয়া তোলা হয় চারজনের কাঁধে ৷ জায়েদকেও বলা হয়, ‘বাবা, তোমার মা যাইতাছে, তুমিও একটু কাঁধ লাগাইবা নি ?’ সে তো তখন অন্য বাহকদের বুকসমান ৷ সে কী করে কাঁধ দেবে, সে কিছুই বুঝতে পারে না ৷ শুধু দেখতে পায় নীল রঙের খাটিয়ায় নীল কাফনে মোড়ানো তার মা যায় ৷
আজাদের মায়ের ঘাড়ে এসে পড়ে ছোট্ট লিমন আর জায়েদ, মহুয়া, চঞ্চল, কচি, টিসু-বোনের ছেলেমেয়েরা ৷ আর এদের বড় ভাই আজাদ ৷ জায়েদের বাবাও এই বাড়িতে আসা আর খোঁজখবর করা ছেড়ে দেন ৷ তিনিও অন্য কোথাও অন্য কোনো মধুকুঞ্জের সন্ধান পেয়ে গেছেন কিনা, জায়েদ ছিল ছোট, সে বুঝতে পারে না ৷ আজাদের মা কথা বলেন না, কিন্তু ছেলেমেয়েদের বুক দিয়ে আগলে রাখেন ৷
জায়েদের মা মারা যাওয়ার পর আজাদের মা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন, নিরবলম্বও ৷ কিন্তু তিনি ভেঙে পড়েন না ৷ মচকানো তো দূরের কথা ৷
ইউনুস চৌধুরীর পক্ষ থেকে আবার মীমাংসার প্রস্তাব পাঠানো হয় সাফিয়া বেগমের কাছে ৷ তাঁকে সসম্মানে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, এ গ্যারান্টি দেওয়া হয় ৷ কিন্তু আজাদের মা রাজি হন না ৷ তাঁর জবান, এক জবান ৷ তিনি চৌধুরীকে তো আগেই বলে দিয়েছিলেন চৌধুরী যদি ওই বিয়ে করেন, তবে তাঁর মরা মুখটাও চৌধুরী দেখতে পাবেন না ৷ এই কথার কোনো নড়চড় তাঁর জীবদ্দশায় তো হবেই না, মৃত্যুর পরেও হবে না ৷ সাফিয়া বেগমের এ কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল ৷
চৌধুরী ক্ষিপ্ত হন ৷ সমস্তটা ঢাকা শহর তাঁর হাতের মুঠোয় ৷ তিনি ইচ্ছা করলে এই ঢাকা শহরটার যাকে ইচ্ছা তাকে কিনে ফেলতে পারেন ৷ প্রদেশের গভর্নর তাঁর বন্ধু, সেক্রেটারিরা তাঁর গেলাস-বান্ধব ৷ হুজ হু-তে তাঁর নাম উঠেছে: আ জমিনডার ফ্রম বিক্রমপুর ৷ আর কিনা একটা ছোটখাটো মহিলা তাঁর কথা শুনছে না ৷ এত জেদ! এত জেদ! এখন তো সার্বক্ষণিক পরামর্শদাত্রী কুটনি বোনটাও নাই ৷ তাহলে সে কেন আসে না ? চৌধুরীর পানাসক্তি আরো বেড়ে যায় ৷
আজাদের মা সাধারণত কথা বলেন না ৷ কিন্তু একদিন তিনি আজাদকে বলেন, ‘বাবা, কথা আছে, আয় ৷ বস ৷’
আজাদ মায়ের কাছে যায় ৷ বিছানায় বসে ৷
‘তুই নাকি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিস ?’
আজাদ উত্তর দেয় না ৷
‘কাল থেকে আবার স্কুল যাবি ৷’
‘এখন আর যাওয়া যাবে না ৷ পরীক্ষা দেই নাই ৷ টিউশন ফি দেই না কয় মাস ৷ নাম কেটে দিয়েছে ৷’
‘তাহলে তুই কী করবি ? মূর্খ হয়ে থাকবি ?’
আজাদ চুপ করে থাকে ৷
মা বলেন, ‘তুই ছাড়া আমার আছে কে ? আমি তো মরেই যেতাম ৷ বেঁচে আছি কেন ? তোকে মানুষ করার জন্যে ৷ তুই যদি মানুষ না হবি, তাহলে আমি আর বাঁচি কেন ?’
আজাদ কেঁদে ফেলে ৷ আসলেই তার খুবই অনুশোচনা হচ্ছিল কদিন থেকে! কী করছে সে ? তার মনে পড়ে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলের অন্ধ পিয়ন পিটারকে ৷ স্কুলে আজও ঘন্টা বাজিয়ে চলেছে অন্ধ পিটার, হাত দুটো সামনে মেলে ধরে হাতড়ে হাতড়ে পথ হাঁটে যে পিটার, সেও তার কাজ ঠিকভাবে করে চলেছে, ওই তো এখনও ঘন্টাধ্বনি আসছে স্কুল থেকে, কত কষ্ট করেই না ঘন্টাটা দড়ি টেনে টেনে রোজ তোলে পিটার, অথচ সে কিনা চোখ থাকতেও পথ খুঁজে পাচ্ছে না ৷ পড়াশোনা বাদ দিয়ে কী করবে সে ?
সে বলে, ‘আমার ফ্রেন্ডদের সাথেই আমি মেট্রিক পাস করব ৷’
মা জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন করে ?’
‘প্রাইভেটে এই বছরই ম্যাট্রিক দিব ৷’
মার মুখে মৃদু একটা হাসি ফুটে ওঠে ৷
আজাদ মাকে কথা দিয়েছে, বন্ধুদের সঙ্গেই সে এই বছরে মেট্রিক পাস করবে ৷ এ-কথা তো তাকে এখন রাখতেই হবে ৷ আরপি সাহার স্কুল থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসাবে নাম তালিকাভুক্ত করায় সে ৷ তারপর ধুমসে পড়া শুরু করে ৷ বই কেনে ৷ টিউটর রাখে ৷ মা তাঁর সোনার গয়নার সঞ্চয় ভেঙে টিউটরের টাকা যোগাড় করেন ৷ বাবার মাসোহারা থেকেও তো টাকা ভালোই আসে ৷ আজাদের বন্ধুরা অবাক হয়ে যায় ৷ বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে পেয়ে যারা এতদিন তার কাছে ঘুরঘুর করত, তাদের সঙ্গ এখন আর ভালো লাগে না আজাদের ৷ তারাও পরিস্থিতি বুঝে বিকল্পের সন্ধানে কেটে পড়ে ৷ পরীক্ষার সময় নিকটবর্তী হয় ৷ একদিন আজাদ এসে কদমবুসি করে মাকে ৷ ‘মা, দোয়া করো ৷ টাঙ্গাইল যাচ্ছি ৷ পরীক্ষা শেষ করে তারপর আসব ৷’
মা ছেলের মাথায় হাত রাখেন ৷ তাঁর ছেলে ম্যাট্রিক দিচ্ছে ৷ এই দুঃখের দিনে এটা কত বড় আনন্দের সংবাদ ৷ তিনি ছেলেকে কাঁধে ধরে দাঁড় করিয়ে দেন ৷ ছেলের মাথায় হাত রাখেন ৷ বলেন, ‘আমার দোয়া তো আছেই ৷ ইনশাল্লাহ তুই ভালোভাবে পাস করবি ৷’
ছেলের মুখের দিকে একবার অলক্ষ্যে তাকান মা ৷ ছেলের নাকের নিচে গোঁফের রেখা ৷ কন্ঠস্বর ভাঙা ভাঙা ৷ মুখে একটা দুটো ব্রণ ৷ চুলে আবার একটুখানি টেড়ির লক্ষণ ৷ ছেলে তাঁর বড় হয়ে যাচ্ছে ৷ হোক! তাই-তো তিনি চান ৷ এই ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে এই পৃথিবীর বুকে দাঁড় করাতে পারলেই তাঁর সব কষ্টের অবসান হবে ৷ তিনি আল্লাহতায়ালার কাছে আর কিছু চান না ৷
‘কী মা, কী ভাবো ?’
ছেলের প্রশ্নে সংবিৎ ফিরে পান মা ৷ ‘আল্লাহ’ বলে একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন ৷ বলেন, ‘তোর কিছু লাগলে আমাকে বল ৷’
‘আমার আবার কী লাগবে ? যা লাগে সবই তো কিনেছি ৷ প্রাকটিক্যাল খাতা কিনলাম, টেস্ট পেপার কিনলাম ৷ বাদ তো রাখি নাকিছু ৷’
‘তুই ভালো করে পাস কর ৷ তোকে কমপ্লিট সু্যট বানিয়ে দেব ৷’
‘আরে, আমি কমপ্লিট দিয়া কী করব ?’ আজাদ হাসে ৷ মনে মনে খুশি হয় ৷ মায়ের মনোভাবটা সেও বোঝে, তারা এখন বাবার সাহায্য ছাড়া বেশ অর্থকষ্টের মধ্যে আছে, এটা তিনি বাইরের কাউকে বুঝতে দিতে চান না ৷ বাইরের লোকদের কাছে তারা মাথাটা উঁচু করেই রাখতে চায় ৷
আজাদ পাস করে সেকেন্ড ডিভিশনে ৷ রেজাল্টের দিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল ৷ রেজাল্ট দেখার জন্যে তারা যায় বোর্ড অফিসে ৷ দেয়ালে রেজাল্ট শিট টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ লোকজন ছাতা মাথায় তাই দেখছে ৷ তার সঙ্গে ফারুক নামের আরেকজন বন্ধু টাঙ্গাইল গিয়েছিল পরীক্ষা দিতে ৷ দুজনে দুরুদুরু বক্ষে গিয়ে একদৌড়ে দেয়ালের পাশে সারি সারি কালো ছাতাগুলোর নিচে ঢুকে পড়ে ৷ আজাদের খুবই ভয় লাগছিল ৷ নিজের জন্যে নয় ৷ মায়ের জন্যে ৷ যদি সে ফেইল করে, মা বড় আঘাত পাবেন ৷ এটা কেবল তার ম্যাট্রিক পাস করা বা ফেইল করার ব্যাপার নয়, মায়ের ব্যক্তিগত জেদের লড়াইয়ের প্রশ্ন ৷ সে ফেইল করলে তার বাবা কী হাসিটাই না হাসবে! মায়ের বুকে সেই বিদ্রূপটা কী ভয়ঙ্কর শেল হয়েই না বিদ্ধ হবে! কোথায় রোল তার ? থার্ড ডিভিশনের ঘর দেখে ৷ পাওয়া যায় না ৷ আজাদ খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ে! তার শ্বাস ঘন হয়ে ওঠে ৷ সে বারবার জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটতে থাকে ৷ এটা কি হতে পারে, সে ফেইল করবে ? জিওগ্রাফি এক্সামটা তত ভালো হয়নি, তাই বলে ফেইল ৷ শেষে মরিয়া হয়ে সে তাকায় সেকেন্ড ডিভিশনের ঘরে ৷ বিড়বিড় করে পড়ছে ইন্নালিল্লাহি…রাজিউন, কোনো কিছু হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়ার দোয়া, ওই তো রোল নম্বর আরপি ৩৬৩৪ ৷ সেকেন্ড ডিভিশনের ঘরে ৷ ওহ্! মা! সে ছুটতে থাকে ৷ তার সঙ্গের বন্ধুটির রেজাল্ট কী তা না জেনেই ৷ তাকে সঙ্গে না নিয়েই ৷ বৃষ্টির মধ্যে ভিজতে ভিজতে ৷
তার বন্ধুটি, ফারুক, এই কথা আর কোনো দিন ভুলতে পারবে না ৷
‘মা, মা, মা কোথায়, কয় তলায়, মা, কচি মা কোথায়, মহুয়া মা কোথায়, মা ৷’ আজাদ দৌড়ে যায়, মায়ের ঘরে মা নাই ৷ ‘কোথায় গেছে, ওজু করতে, কই ?’ ‘এই যে মা, আমার রেজাল্ট হয়েছে, আমি পাস করেছি, সেকেন্ড ডিভিশন’, আজাদ মাকে কদমবুসি করতে যায়, মা তাকে টেনে তোলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, তিনি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকেন, না, তাঁর চোখে হাসি ঝিলিক দেয় না, না তাঁর চোখে অশ্রু ঝরে না, তিনি নিজেকে সামলে নেন ৷ তিনি শান্তস্বরে বলেন, ‘তুই তো পাস করবি, তোর ব্রেন ভালো না!’
আজাদ বোকার মতো হাসে ৷ মা যে কী বলে! আরেকটু হলে তো গিয়েছিলই ৷
‘শোন, তুই এক কাজ কর, ১০ সের মিষ্টি কিনে আন ৷ মরণচাঁদ থেকে কিনিস, আজেবাজে মিষ্টি কিনবি না ৷’ তিনি তাঁর ড্রয়ারের কাছে যান ৷ টাকা বের করেন ৷ ‘মিষ্টি কিনে নিয়ে ইস্কাটন যাবি, তোর দাদির হাতে দিবি, দাদিকে সালাম করবি, দাদার হাতে দিবি, দাদাকে সালাম করবি ৷ বুঝিয়ে বলবি, কিসের মিষ্টি ৷’
আজাদ অবাক হয় ৷ সে ভাবতেও পারেনি, মা তাকে ইস্কাটন যেতে বলতে পারেন ৷
আজাদ মিষ্টির দোকানে যায় ৷ সঙ্গে জায়েদ ৷ মিষ্টির দোকানে বসেই জায়েদ কয়েক পদের মিষ্টি সাবাড় করে ৷ কয়েক সের মিষ্টি কেনে তারা ৷ মিষ্টির ঠোঙা নিয়ে তারা প্রথমে আসে ফরাশগঞ্জের বাসায় ৷ মাকে প্রথমে মিষ্টিমুখ করানো দরকার ৷ মা তো কোনো কিছু খেতেই চান না ৷ আমিষ খাওয়া ছেড়েছেন সেই যে ইস্কাটন ছাড়ার পর থেকে, আর ধরেননি ৷ ‘মা, একটু খাও ৷ এই বাসার জন্যে একটু মিষ্টি কিনলাম ৷ বুঝলা না, ওই বাসার আগে তো এই বাসার লোকদের মিষ্টিমুখ করানো দরকার ৷’
মা মিষ্টি দেখে মুখ সরিয়ে নেন ৷ ‘না রে, খেতে ইচ্ছা করে না ৷’
‘অল্প খাও ৷ অল্প ৷’ আজাদ নাছোড় ৷
মা একটুখানি মিষ্টি মুখে দেন ৷ বলেন, ‘এই দুটো ঠোঙা রেখে দে ৷ পাড়াপড়শিদের দিতে হবে ৷ ভালো খবর ৷ সবাই জানুক ৷ আর এখানে কত ?’
‘১০ সের’-হাতের মিষ্টির রস চাটতে চাটতে জায়েদ জবাব দেয় ৷
‘এগুলো নিয়ে ইস্কাটনে যা ৷ আজকে সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলবি ৷ আজকে আমাদের হাসার দিন’-মা বলেন ৷
১০ সের মিষ্টি নিয়ে আজাদ ইস্কাটনের বাসার সামনে নামে ৷ কত দিন পর এ বাড়িতে আসা হলো তার ৷ এটা যে তাদের বাড়ি, অনভ্যাসে সেটা মনেও হয়নি এ কদিন ৷ আশ্চর্য ৷ না, সে হরিণগুলোর দিকে তাকাবে না, রাজহাঁসগুলোর দিকে না, তার স্প্যানিয়েল ডগ টমির দিকে না ৷
সে সোজা দাদা-দাদির ঘরে যায় ৷ দাদির সামনে মিষ্টির প্যাকেটগুলো রাখে ৷ দাদিকে সালাম করে ৷ ‘আমি ম্যাট্রিক পাস করেছি ৷ তার মিষ্টি রেখে গেলাম ৷’
‘এতগুলা মিষ্টি আনা লাগে ৷ খালি টাকা খরচ’-দাদি বলেন ৷
‘আর নাই তো ৷ রেজাল্ট হয়েছে তো, সবাই মিষ্টির দোকানে ভিড় করছে ৷ যা পেয়েছি এনে দিলাম ৷ কম হলে বলো ৷ কালকে আরো এনে দেব ৷’
‘দুরো আভাগা ৷ আমি কী কই, হে কী বুঝে ৷’
বাসার বাবুর্চি, কাজের লোক, পরিচারিকারা সবাই আড়ালে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে ঘটনাটা ৷ আজকে কেন ভাইয়া এতদিন পরে এ বাড়িতে এল ৷ তাহলে কি বেগম সাহেবা ফিরে আসবেন আবার ?
তারা উঁকিঝুঁকি দিয়ে ঘটনার তাৎপর্য বুঝে ফেলে ৷ ছোট সাহেবে মেট্রিক পাস দিছে ৷
ছোটমায়ের কাছে খবর যায় ৷ ছোট সাহেবে আসছে ৷ মিষ্টি আনছে মেলা ৷ উনি ম্যাট্রিক পাস দিছে ৷
বেরিয়ে যাওয়ার পথে ছোটমায়ের সাঙ্গে দেখা হয় আজাদের ৷ তিনি হাসিমুখে বলেন, ‘বাবা, তুমি পাস করেছ, আমি খুব খুশি হয়েছি ৷ বসো ৷ একটু মিষ্টি খেয়ে যাও ৷’
আজাদ তাঁকে আগে থেকেই চেনে ৷ বড়মা বলে তাঁর কাছ থেকে আগে আদরও নিয়েছে ৷ আজকে তার কেমন যেন লাগে ৷ কিন্তু তার মনে হয়, মা যে আজকে এ বাড়িতে মিষ্টি দিয়ে পাঠিয়েছেন, এ তো তার বিজয় উদযাপন করবার জন্যেই ৷ অসুবিধা কী ছোটমার কথা শুনতে!
আজাদ বসে ৷ ছোটমা বলেন, ‘তুমি কোনদিকে যাবা এখন ?’
‘এই তো গুলিস্তানের দিকে ৷’
‘আমিও ওই দিকে যাচ্ছি ৷ তুমি আমার সাথে চলো ৷’
‘না, আমি একলাই যেতে পারব ৷’
‘আরে না, চলো তো ৷’
ছোটমা গাড়ি বের করেন ৷ নিজেই তিনি ড্রাইভ করছেন ৷ আজাদকে পাশে বসান ৷ মহিলার পাশে বসে তার নিজেকে সিনেমায় দেখা কোনো চরিত্র বলে মনে হয় ৷ ঢাকার রাস্তায় মহিলারা সাধারণত গাড়ি চালায় না ৷ ইনি চালাচ্ছেন ৷ দুপাশের লোকেরা বেশ কৌতূহল নিয়েই তাদের দিকে তাকিয়ে আছে ৷ ছোটমা গুলিস্তানের আগে বিজয়নগরের ভোগ দোকানের সামনে গাড়ি থামান ৷ বলেন, ‘আসো ৷ তুমি না লংপ্লে পছন্দ করো ৷ তোমাকে লংপ্লে কিনে দেই ৷’
‘না, লাগবে না ৷’
‘আরে আসো তো ৷’
আজাদ ভাবে, ছোটমাকে জব্দ করব ৷ যত এলভিস প্রিসলি আছে, সব কিনব ৷ দেখি কী করে ৷
দোকানে ঢুকে একটার পর একটা এলভিস প্রিসলি নামাতে থাকে আজাদ ৷ দু হাত ভরে যায় ৷ দোকানদাররা বিস্মিত ৷ ছোট মা অবিচলিত ৷ ‘কত দাম এসেছে ?’
দোকানি দাম হিসাব কষতে গিয়ে গলদঘর্ম ৷ দেড় হাজার রুপিয়া বেগম সাব ৷
ছোটমা ব্যাগ থেকে চেক বের করে খসখস করে সিগনেচার করে দেন ৷
আজাদ মনে মনে খুশি হয় ৷ এই রেকর্ডগুলো তার খুব প্রিয় ৷ এগুলো সে অনেকবার জোগাড় করতে চেয়েছে ৷ শুধু জায়েদকে দিয়ে ও বাসা থেকে তার নিজের রেকর্ড প্লেয়ারটা আনিয়ে নিতে হবে ৷ তবে মাকে এ ব্যাপারে কিছু বলা যাবে না ৷ ব্যাপারটা স্ট্রেইট চেপে যেতে হবে ৷

 ১০. মা

ইউনুস চৌধুরী আজকে বাসাতেই বসেছেন সন্ধ্যাটা যাপন করতে ৷ বসন্তের হাওয়া বইতে শুরু করেছে বাইরে ৷ তিনি বাগানে বসেছেন গার্ডেন-চেয়ার নিয়ে ৷ দখিনা বাতাস মসলার বাগান থেকে সুগন্ধ বয়ে আনছে ৷ বেয়ারা তৎপর ৷ বরফ আসছে ৷ পানীয় ঢালা হচ্ছে ৷ চৌধুরীকে আজ সঙ্গ দিচ্ছেন তাঁর বন্ধু খালাতো ভাই রতন চৌধুরী ৷ আকাশের গায়ে একটা প্রায় পূর্ণ চাঁদ ৷ চাঁদের পাশে ছুটন্ত মেঘগুলো দেখে মনে হচ্ছে, চাঁদটাই ছুটছে ৷ আর মেঘগুলো যেন স্থির ৷ ইউনুস চৌধুরী সেদিকে তাকিয়ে আছেন ৷ ছাত্রাবস্থায় পড়া থিয়োরি অব রিলেটিভিটির কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায় ৷ চাঁদটা স্থির, নাকি মেঘগুলো ? কে জানে রে বাবা ? রাত দশটার পরে তাঁর নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না ৷ তিনি নিজের চুল ধরে নিজেই টানতে থাকেন ৷
‘রতন ৷’
‘ভাইজান ৷’
‘সাফিয়া কি আমার বাধ্য হবে না ?’
‘ভাইজান ৷’
‘আমার ছেলেকে কি আমি আর ফিরে পাব না ?’
‘আপনার তো আরেকটা ছেলে হয়েছে ভাইজান ৷ ছোট ভাবি তো মা হয়েছেন!’
‘কিন্তু আমার আজাদকে কি আমি পাব না ?’
‘আজাদ তো আপনার আছেই ভাইজান ৷ ও তো ম্যাট্রিক পাস করেই এসেছিল ৷ বাপকে কি কোনো ছেলে ভুলতে পারে ? রক্তের টান বংশের ধারা কোথায় যাবে ?’
‘কিন্তু সারেংয়ের মেয়েটা কি আমার কথা শুনবে না ?’
‘শুনবে ৷ শুনবে ৷’
‘কবে ?’
‘কোনো বাঘই তো প্রথমে বশ মানে না ৷ সার্কাসের বাঘের কথা বলছি ৷ বাঘকে ধরে ইলেকট্রিক পাওয়ারঅলা চাবুক দিয়ে ভয় দেখানো হয় ৷ আঘাত খেয়ে খেয়ে তারপর বাঘ বশ মানে ৷’
‘বাট হোয়েন উইল শি গিভ ইন ?’
‘টুডে অর টুমরো ৷’
‘তোমার টুডে কবে আসবে ?’
‘টুমরো ৷’
‘তোমার টুমরো কবে আসবে ৷ দি ডে আফটার টুমরো ?’
‘ভাইজান ৷ এক কাজ করেন ৷ ফরাশগঞ্জের বাসা থেকে ওদের উৎখাত করে দেন ৷’
‘বলো কি! আজাদ আমার ছেলে না ?’
‘আজাদকে বলেন এ বাসায় এসে থাকতে ৷’
‘সাফিয়াও তো আমার ওয়াইফ ৷’
‘তাকেও তো আমরা এ বাসায় এসে থাকতে বলছি ৷’
‘তুমি বলছ বাসা থেকে তাড়িয়ে দিলে তারা নরম হবে ?’
‘অবশ্যই ৷ তেজ কমে যাবে ৷’
‘কীভাবে তাড়াব ? আজাদ তো রিভলবার নিয়ে আমাকে মারতে আসবে ৷ ছেলেটা একদম মা-নেওটা হয়েছে ৷ আনলাইক মি ৷’
‘আপনার বাবা-মাও তো আপনার সাথেই আছে ৷ আপনি তাদের যথেষ্ট ভক্তি করেন ৷’
‘করি ৷ জন্মদাতা বাপ, জন্মদাত্রী মা ৷ না করে পারব ? কিন্তু সে তো বাপ মানে না ৷’
‘মানে ৷ তবে মাকে বেশি মানে ৷’
‘শোনো ৷ আই অ্যাম এ জমিনডার ফ্রম বিক্রমপুর ৷ আমার টাকা আছে ৷ আমার পাওয়ার আছে ৷ আমার মেয়েমানুষ থাকবে ৷ থাকবে না ?’
‘জি!’
‘জমিদারদের মেয়েমানুষ থাকত কি না!’
‘হক সাহেব তো জমিদারি রাখল না ৷ কৃষক প্রজা পার্টি করল ৷’
‘এখন হক সাহেব কোথায় ? হয়্যার ইজ হি নাউ!’
‘ভাইজান, আর খাবেন না ৷ ওঠেন ৷’
‘আরে নাইট ইজ স্টিল ইয়াং ৷ বসো বসো ৷’
‘ভাবি রাগ করবেন ৷’
‘কেন করবে ৷ সে জেনেশুনে আমার কাছে এসেছে ৷ শোনো ৷ আজাদকে বলে দাও সে জমিদারের ছেলে ৷ তারও চালচলন হবে জমিদারের মতো ৷’
‘সে তো জমিদারের ছেলে না ৷ সে ইঞ্জিনিয়ারের ছেলে ৷’
‘কিসের ইঞ্জিনিয়ার ? আই অ্যাম নো মোর ইঞ্জিনিয়ার ৷’
‘দেন ইউ আর আ বিজনেসম্যান ৷ সদাগর ৷ আপনার ফিউডাল নেচার তার রক্তে যাবে কেন ?’
‘বুর্জোয়ারাও ধোয়া তুলসিপাতা নয় ৷ ক্যাপিটালিজম মানে হচ্ছে পাপ ৷ তুমি পাপী ৷ আমি পাপী ৷’
‘আপনি পাপী ৷ আমি না ৷’
‘কী! চোপ শালা! আয়ুব খানের পাকিস্তানে কোনো পাপ নাই ৷ নো ওয়াইন ৷ নো ক্রাইম ৷ চোপ শালা ৷’
‘এই, শালা বলবি না শালা!’
গার্ডেন চেয়ার উল্টে পড়ে ৷ গেলাস কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ে মাটিতে ৷ দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে চোপ শালা চোপ শালা বলে চলেন ৷ বেয়ারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ৷
বাতাসের বেগ কমে আসছে ৷ মেঘগুলো এখন স্থির ৷ চাঁদটাকে এখন লাগছে ডিমপোচের কুসুমের মতো ৷ মেঘগুলো যেন ডিমের শাদা অংশ ৷ মসলার গন্ধের বদলে এখন নাকে এসে লাগছে নানা মৌসুমি ফুলের সুঘ্রাণ ৷ পানীয়র গন্ধের সঙ্গে মিশে ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত হয়ে উঠছে ৷ দুজন মধ্যবয়স্ক লোক গালাগালি ছেড়ে এখন গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছে ৷

 ১১. মা

আজাদ আইএ পড়ার জন্যে ভর্তি হয় সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ৷ কলেজে পড়ে, নাজ কিংবা গুলিস্তান হলে ছবি দেখে, বন্ধুদের সাঙ্গে আড্ডা দেয় ৷ সে খুবই ভক্ত এলভিস প্রিসলির ৷ ছোটবেলা থেকেই খুব কমিকস পড়ে ৷ বড় হতে হতে সাহিত্যের প্রতি তার আগ্রহ জন্মে ৷ প্রচুর উপন্যাস পড়েছে, বাংলা উপন্যাস, ইংরেজি উপন্যাস ৷ এর মধ্যে মিলস অ্যান্ড বুন থেকে শুরু করে পেঙ্গুইন ক্লাসিক্স ৷ লরেন্স থেকে টলস্টয়-ডস্টয়ভস্কি পর্যন্ত ৷ বঙ্কিম থেকে শরৎচন্দ্র-রবীন্দ্রনাথ ৷
সিনেমা দেখতে গেলে তার সঙ্গী হয় জায়েদ ৷ অন্য বন্ধুরাও হয় কখনও কখনও ৷ তবে তার আশ্চর্য লাগে বড়লোক বন্ধুদের ৷ আজাদরা ফরাশগঞ্জের বাড়িতে চলে আসার পর তার অনেক বড়লোকের ছেলে বন্ধু তাকে এড়িয়ে চলে ৷ যেন তার সঙ্গে মিশলে তাদের জাত চলে যাবে ৷ আশ্চর্য তো ৷
জায়েদের মা নাই ৷ তারা পাঁচ-পাঁচটা বাচ্চা এ বাড়িতেই থাকে ৷ সাফিয়া বেগমকেই সব দেখাশোনা করতে হয় ৷ তাদের খাওয়া-দাওয়া, পড়াশোনার খরচের ব্যাপার আছে ৷ সাফিয়া বেগমকে একটু একটু করে গয়না ভাঙিয়ে টাকা-পয়সা জোগাড় করতে হয় ৷
এর মধ্যে আজাদ বাবার কাছ থেকে তার মাসোহারা পায় ৷ মাসে মাসে টাকাটা ওঠাতে যায় জায়েদ ৷ জায়েদও স্কুলে যায় ৷ লেখাপড়া করে ৷ তবে পড়াশোনার দিকে তার তেমন মনোযোগ নাই ৷
একদিনের ঘটনা ৷ বাসায় চাল নাই ৷ হঠাৎ রাতে চাল শেষ হয়ে গেছে ৷ রাতের বেলা আজাদের আরেক খালা এসেছে, আরো অতিথি এসেছে ৷ অতিরিক্ত রাঁধা হয়ে গেছে ৷ সকালবেলা চাল কিনতে হবে ৷ রেশনের দোকানে যেতে হবে ৷ আজাদের মায়ের কাছে নগদ টাকা নাই ৷ রেশনটা না তুললে আবার দোকান থেকে বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে ৷ নাহলে দুপুরে আজকে হাঁড়ি উঠবে না চুলায় ৷
আজাদের মা বলেন, ‘জায়েদ, কী করি, বল তো!’
জায়েদ বলে, ‘আমার কাছে কিছু টাকা জমানো আছে ৷ আমি রেশন নিয়া আসি ৷ আপনি পরে দিয়েন আম্মা ৷’
‘তাহলে তাই কর ৷’
জায়েদের কিন্তু ভরসা আজাদ ৷ আজাদের কাছে হাতখরচের টাকা থাকে ৷ সেখান থেকে ধার নিতে হবে ৷ তবে সেটা আম্মাকে জানানো যাবে না ৷ চৌধুরীর টাকা শুনলে আম্মা সেই টাকায় কেনা অন্ন স্পর্শ করবেন না ৷
জায়েদ গিয়ে ধরে আজাদকে ৷ ‘দাদা, কিছু টাকা ধার দ্যাও তো ৷’
‘কত ?’
‘দ্যাও না ৷’
‘কী করবি ? সিনেমা দেখবি ?’
‘না ৷ বাজার সদাই করব ৷’
‘আচ্ছা চল ৷ এক জায়গায় টাকা পাই ৷ তুলে আনি ৷’
আজাদ আর জায়েদ বের হয় ৷ আলী নামে এক লোকের কাছে আজাদের মাসোহারার টাকা থাকে ৷ সেখান থেকে কিস্তিতে কিস্তিতে টাকাটা তোলা হয় ৷ তবে এ মাসের শেষ কিস্তির টাকাটা আলী ঠিকমতো দেয়নি ৷ জায়েদকে অযথা ঘোরাচ্ছে ৷
আলী বসেছিল গদিতে ৷ আজাদকে দেখে তটস্থ হয়-’এই, চেয়ার দে ৷ আরে মুছে দে ৷ ভাইয়া বসেন ৷ কী খাবেন ? চা আনাই ৷ লেমনেড খাবেন ?’
‘টাকাটা দাও ৷ যাইগা’-আজাদ দাঁড়িয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বলে ৷
১০০ টাকা পাওয়া যায় ৷ তাই নিয়ে আজাদ আর জায়েদ বের হয় ৷ সদরঘাট থেকে বাংলাবাজার ৷ বটগাছটার নিচে একটা বড় বইয়ের দোকান ৷ হিউবার্ট নামে এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এটা চালান ৷ আজাদকে দেখেই তিনি গুড মর্নিং বলে ওঠেন ৷
আজাদও গুড মর্নিং বলে সম্ভাষণের জবাব দেয় ৷
‘নয়া বই আসিয়াছে স্যার’-হিউবার্ট বলেন ৷
আজাদ বই দেখায় মগ্ন ৷ কী সব ইংরেজি বই ৷ জায়েদ বইগুলোতে কোনো মজা পায় না ৷ সে খানিকক্ষণ হিউবার্টের দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ লোকটার গায়ের রঙ ফরসা, তবে চামড়ায় বুটি বুটি দাগ, ভুরুগুলো বড় বড় আর শাদা, চুলও শাদা, গায়ে কোট, পরনে প্যান্ট ৷ লোকটা কথা বলছে হয় ইংরেজিতে, নয়তো বইয়ের বাংলায় ৷ আর বটগাছ থেকে পাখির বর্জ্য পড়ছে টুপটাপ ৷ জায়েদ লক্ষ্য করে, বটের ফল খেয়ে পাখিগুলো যা ত্যাগ করে, তাও আসলে ফল, তাই মাথায় পড়লেও কেউ ব্যাপারটা গায়ে মাখছে না, গায়ে লাগছেও না ৷ জায়েদ এদিক-ওদিক তাকিয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, দাদা, যাইবা না, চলো ৷
আজাদ বই থেকে মুখ না তুলে বলে, ‘যা, তুই ওই হোটেলে মাটন কাটলেট ভাজছে, খেয়ে আয় যা ৷ নে, টাকা নে ৷’
জায়েদ তো খুশিতে লাফাতে লাফাতে বাতাসের আগে আগে ছুটে যায় ৷
এদিকে আজাদ বইয়ের মধ্যে মজা পেয়ে গেছে ৷ সে একটার পরে একটা বই নামাচ্ছে ৷ একটা মোটা ছবিঅলা বই পেয়ে সে পাগলের মতো খুশি হয় ৷ দেখেন তো এই কয়টার দাম কত হয় ?
দাম একশ টাকা ছাড়িয়ে যায় ৷
‘আচ্ছা তাহলে এটা বাদ দ্যান ৷ এখন দেখেন’-আজাদ একটা বই বাদ দিয়ে বাকিগুলো এগিয়ে দেয় ৷
‘ওয়ান হান্ড্রেড ফোর’-হিউবার্ট বলেন ৷
আজাদ পকেট হাতড়ে খুচরো বের করে দাম মিটিয়ে দেয় ৷
জায়েদ আসে ৷
আজাদ তার হাতে বইয়ের বোঝা ধরিয়ে দিয়ে বলে, ‘নে ৷ যাইগা ৷ দেরি হয়ে যাচ্ছে ৷’
তারা বাসায় ফেরে রিকশায় ৷ জায়েদ বইগুলো দাদার ঘরে নামিয়ে দেয় ৷ তারপর বলে, ‘টাকা দ্যাও ৷’
‘কিসের টাকা ?’
‘রেশন আনুম না ?’
‘ও ৷ রেশনের টাকা ৷ কত লাগে ?’
‘৫০ টাকা দ্যাও ৷’
‘অত টাকা তো এখন নাই ৷’
‘আরি এখনই না পাইলা!’
‘হাতে করে কী আনলি!’
‘বই ৷’
‘বই কিনতে টাকা লাগে না ?’
‘এত টাকার বই তুমি আনলা!’
‘তুই-ই তো বেটা বয়ে আনলি ৷ দেখলি না কত ভারী ৷’
‘অহন ৷ আইজকা রেশন না আনলে তো ল্যাপ্স হইয়া যাইব ৷’
‘আরে কিসের ল্যাপস হইব ৷ কালকে আনিস ৷’
‘আজকা খাইবা কী! চাউল নাই ৷’
‘দোকান থেকে দুই সের চাউল কিনে আন ৷ টেবিল ক্লথটার নিচে দ্যাখ খুচরা পয়সা আছে ৷ ঝাড় ঝাড় ৷ দেখলি ৷ নে ৷ আজকার দিনটা পার কর ৷ কালকের চিন্তা কাল ৷’
খুচরা পয়সা একসঙ্গে করে কম টাকা হয় না ৷ জায়েদ বলে, ‘চলব ৷ কিন্তু তোমার মতন পাগল দেখি নাই ৷ চাউল কেনার টাকা জোগাড় কইরা কেউ বই কিনে ?’
আজাদ হাসে ৷ ‘আর তুই কী করেছিস ৷ চাউল কেনার টাকা দিয়ে কাটলেট খেয়েছিস ৷ ছি ৷’
জায়েদ লজ্জা পায় ৷ সে দোকানের দিকে দৌড় ধরে ৷ আজাদ হাসে ৷ কিন্তু তার বুকের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম বেদনাও যেন সুচের মতো ফুটছে ৷ আজকে মাকে চাউল কেনার টাকার কথাও ভাবতে হচ্ছে ৷ অথচ মায়ের নামে এই ফরাশগঞ্জের বাড়িটা, ওই ইস্কাটনের বাড়িটা ৷ পৃথিবীটা কি একটা নাগরদোলা ? মানুষ আজ ওপরে তো কাল নিচে! নিয়তির হাতের পুতুল মাত্র! তাদের ম্যাট্রিকের বাংলা ব্যাকরণে একটা সমাস পড়তে হয়েছে ৷ রাজভিখিরি ৷ যিনি রাজা তিনিই ভিখিরি ৷ বা রাজা হইয়াও যিনি ভিখিরি ৷ তার মা কি তাই ? যিনিই রানী তিনিই ভিখিরিনী!
এইসব হতাশা থেকেই বোধকরি আজাদ সিগারেটটা মজবুত-মতো ধরে ফেলে ৷ তবে সে খায় সবচেয়ে দামি সিগারেট, বিদেশী ব্রান্ডের সিগারেট ৷ চৌধুরী সাহেবের রক্তের ধারা আর যাবে কোথায় ? আজাদ সিগারেট কেনার জন্যে স্টেডিয়ামে মোহামেডান ক্লাবের উল্টো দিকে রহমত মিয়ার বিখ্যাত দোকানে যায়, বিদেশী সিগারেট কেবল ওই দোকানেই পাওয়া যায় ঢাকায় ৷ আড়াই টাকা দামের এক প্যাকেট সিগারেট কেনার জন্যে আড়াই টাকার ট্যাক্সিভাড়া দিতে তার কার্পণ্য নাই ৷
সিদ্ধেশ্বরী কলেজ থেকে আজাদ আইএ পরীক্ষা দেয় ৷ সেকেন্ড ডিভিশনে পাসও করে ৷ এবার সে পড়বে কোথায় ?
ঢাকার পরিস্থিতি বেশি সুবিধার নয় ৷ ছাত্ররা নানা রাজনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত ৷ তারা এখন তৎপর সর্বজনীন ভোটাধিকারের দাবিতে আন্দোলন নিয়ে ৷ সারা দেশে হরতাল পালিত হচ্ছে ৷ শোভাযাত্রা-সমাবেশ এসব তো আছেই ৷ তার ওপর বছরের শুরুতেই ঢাকায় সংঘটিত হয়ে গেছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ৷ এখন আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আবার সংগঠিত হচ্ছে ৷ তাদের স্মৃতি থেকে দু বছর আগে ১৭ সেপ্টেম্বরে শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে হরতাল, মিছিলে গুলি, টিয়ারগ্যাস, লাঠিচার্জ, একজনের শাহাদত বরণ-এসব মুছে যায়নি ৷
আজাদ একদিন আড্ডা দিতে গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ৷ কাদের যেন কর্মসূচি ছিল সেদিন, ওরা জানত না ৷ মিছিল হচ্ছে, হঠাৎই শুরু হয় দৌড়াদৌড়ি ৷ ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ৷ পালাতে গিয়ে একটা ড্রেনের মধ্যে পড়ে পা মচকে যায় আজাদের ৷ সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফিরে আসে বাসায় ৷
জায়েদ এসে বলে, ‘দাদা, পা টিপা দিমু ৷’
‘আরে না ৷ মাথা খারাপ ৷ তুলা দিয়ে নাড়লেও মরে যাব ৷ উফ্, কী ব্যথা রে!’
‘দাদা, এক কাম করি, কাইলকা যাই ইস্কাটনে, চৌধুরী সাবরে কই দাদার পাও ভাইঙা গেছে, ট্রিটমেন্ট করান লাগব, মালপানি ছাড়েন ৷’
‘ভালো বুদ্ধি বের করেছিস তো ৷ হ্যাঁ ৷ কালকে যাবি ৷’
জায়েদ পরের দিন গিয়ে হাজির ইস্কাটনের বাসায় ৷ দারোয়ান পথ আটকে দাঁড়ায়-’কই যাইবেন ?’
‘চৌধুরী সাবের লগে দেখা করুম’-জায়েদ বলে ৷
‘ক্যান ?’
‘ছোট সাবে পাঠাইছে ৷ হের পা ভাইঙা গেছে ৷ হেই খবর দিতে হইব ৷’
দারোয়ান গেইট ছাড়ে ৷ ভেতরে গিয়ে সে দাঁড়ায় চৌধুরী সাহেবের কাছে ৷
‘সালামালেকুম খালু ৷’
‘ওয়ালাইকুম ৷ ক্যান আইছ ?’
‘আজাদ দাদা পাঠাইছে ৷ হের পাও ভাঙছে ৷’
‘পা ভেঙেছে ৷ কী করে ভাঙল ?’
‘ইউনিভার্সিটিতে গেছল ৷ গণ্ডগোল লাগছে ৷ হে বেকায়দায় পইড়া পাও ভাইঙা ফেলাইছে ৷’
চৌধুরী সাহেবের ফরসা মুখটা সঙ্গে সঙ্গে লাল হয়ে যায় ৷ কিছুক্ষণ ভেবে তিনি বলেন, ‘আজাদরে বলো এই বাসায় এসে থাকতে!’
‘কমুনে ৷ আইব না ৷ আপনেরে টাকা দিবার কইছে ৷’
চৌধুরী সাহেব ভেতরে যান ৷ জায়েদ বৈঠকখানায় দাঁড়িয়েই থাকে ৷ টমি এসে তার গা শোঁকে ৷ পরিচিত গন্ধ পেয়ে লেজ নাড়ে ৷ একটু পরে কদম আলী এসে হাত বাড়িয়ে দেয় ৷ তার হাতে টাকা ৷
জায়েদ জিজ্ঞেস করে, ‘কত ?’
‘এক হাজার ৷ গইনা লও ৷’
জায়েদ টাকাটা গোনে ৷ তারপর খুশি মনে বেরিয়ে যায় ৷ আজাদ দাদার কাছ থেকে আজ মোটা অঙ্কের ভেট আদায় করা যাবে ৷ অন্তত চার দিন সিনেমা দেখা যাবে ডিসিতে ৷
রাত্রিবেলা ঢাকা ক্লাবে আবার ইউনুস চৌধুরীর প্রথম পত্নীর জন্যে শোক উথলে ওঠে ৷ তিনি গেলাসের পরে গেলাস উজাড় করতে করতে সামনে বসা এআই খানকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আচ্ছা বলেন তো, সাফিয়া বেগম কবে আমার পায়ের কাছে এসে পড়বে ?’
এআই খানের অবস্থাও তখন খারাপ ৷ তিনি বলেন, ‘পায়ের কাছে কেন পড়বে ? হোয়াই অ্যাট দি ফিট ৷ নো ৷ ইউ হ্যাভ গট হার হেভেন আন্ডার ইয়োর ফিট ৷ ইউ শুড নট অ্যালাউ হার এনটারিং ইন টু দি হেভেন সো ইজিলি ৷’
‘সে তো কিছুতেই আমার কাছে আসছে না ৷ একটা মহিলার কেন এত তেজ ? কেন ? আমি কী দেইনি তাকে ? বাড়ি তার ৷ ছেলে তার!’
এআই খান বুদ্ধি দেন, ‘শোনেন, তার ছেলেকে তার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেন ৷ সেন্ড হিম টু করাচি ৷ মেক হার আইসোলেটেড ৷ দেন শি উইল গিভ ইন ৷ শি মাস্ট ৷’
এরই মধ্যে আজাদের মায়ের কোল থেকে দু বছর বয়সী জায়েদের ছোট্ট ভাই লিমনকে এক রকম প্রায় কেড়েই নিয়ে গেছেন জায়েদের বাবা ৷ বাচ্চাটাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে ৷ সেই বাচ্চা মারা গেছে ৷ সেই শোকে জায়েদ ও তার ভাইবোন আর আজাদের মা খুবই ভেঙে পড়েছে ৷ একটা বাচ্চা যখন বাড়িতে থাকে, সে পুরোটা বাড়ি জুড়ে থাকে ৷ এই বাড়িতেও লিমন ছিল সবার কোলজুড়ে ৷ সে চলে যাওয়ার পরই সবার মন ছিল খারাপ ৷ তার ওপর সে মারা গেছে, এই খবর শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে যায় ৷ বাসার ঠিকে ঝিটা পর্যন্ত কেঁদে কেঁদে ওঠে, ‘বাচ্চাটারে এইখান থাইকা নিয়া গিয়াই মাইরা ফেলল ৷ কেমন পাষাণ বাবা রে ৷’
আজাদকে ঢাকা থেকে সরিয়ে দেওয়ার বুদ্ধিটা চৌধুরী সাহেবের মাথায় খেলে যায় ৷ আজাদকে ঢাকায় রাখা যাবে না ৷ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়ার পরিবেশ নাই ৷ সক্ষম লোকের ছেলেমেয়ে কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে ? আজাদকে করাচি পাঠাতে হবে ৷ তাতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা হবে ৷ ছেলেটার ভালো হবে ৷ এই গণ্ডগোলের বাইরে থেকে সে ভালো করে লেখাপড়া করতে পারবে ৷ তার জীবনের নিরাপত্তা থাকবে ৷ আবার মায়ের কাছ থেকে ছেলেকে আলাদা করা যাবে ৷ তখন দেখা যাবে, মা কী করে একা ঢাকায় থাকে ৷ এখন আমি আজাদকে যে মাসোহারা দেই, সেটা নিশ্চয়ই আজাদ তার মা আর তার খালাতো ভাইবোন পঙ্গপালের পেছনে ব্যয় করে ৷ এটাও বন্ধ হবে ৷ ছেলেকে করাচিতে যে খরচ পাঠাব, সেটা নিশ্চয় সে আর মায়ের পেছনে ব্যয় করতে পারবে না ৷
চৌধুরী সাহেব আজাদের এক মামাকে ফোন করে আনান ৷ তাঁকে আজাদ ডাকে পাতলা মামা বলে ৷ বিক্রমপুরে যেহেতু বেশির ভাগ বিয়েই আত্মীয়দের মধ্যে হতো, কাজেই পাতলা মামা আবার পাতলা চাচাও হয় ৷ চৌধুরী সাহেব আজাদের মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন এই পাতলা মামাকে ৷
পাতলা মামা হাজির হন ফরাশগঞ্জের বাসায় ৷ দেখা করেন সাফিয়া বেগমের সঙ্গে ৷ তাঁকে বলেন, ‘বুবু, ছেলে তো শুনছি আইএ পাস করছে ৷ খুব খুশির খবর ৷ আলহামদুলিল্লাহ ৷ এবার ছেলেকে পড়াবা কই ?’
সাফিয়া বেগম বলেন, ‘আজাদ তো বলে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়বে ৷ সে তো সারা দিন ওই দিকে ঘুরঘুর করে ৷’
পাতলা মামা বলেন, ‘না না না না ৷ এইখানে আজাদের থাকাটা ঠিক হবে না ৷ বিশেষ করে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়া একদম অনুচিত হবে ৷ দেশের পরিস্থিতি ভালো না ৷ আরো খারাপ হবে ৷ ভদ্রলোকের ছেলেরা তো ঢাকায় পড়ে না ৷’
‘তাহলে তারা কই কই পড়ে ?’ আজাদের মার চোখেমুখে উদ্বেগ!
পাতলা মামা একটা পানের খিলি মুখে পুরে বুড়ো আঙুলে চুন লাগিয়ে সেটা নিজের জিভে লাগান ৷ তারপর আঙুলে লেগে থাকা চুনের অবশিষ্টটা গোপনে টেবিলের নিচে মুছতে মুছতে বলেন, ‘করাচি ৷ ভদ্রলোকের ছেলেরা পড়ে করাচিতে ৷’
সাফিয়া বেগমের মুখটা সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে পড়ে ৷ এই কথা তাঁর প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ ৷ করাচিতে ছেলেকে পাঠিয়ে তিনি একা একা কী করে থাকবেন! আর খরচই বা আসবে কোত্থেকে ?
পাতলা মামা বলে চলেন, ‘করাচিতে পড়ার খরচ যা লাগে, তা তো আজাদের বাবার কাছ থাইকাই আদায় করা যাবে ৷ আপনি আজাদের বাবার কাছ থাইকা দূরে সইরা আসছেন, তাই বইলা তো বাবার ওপর থাইকা আজাদের হক চইলা যায় না ৷ আর মাসের হাতখরচ অর বাবা অরে যা দেয়, তা একটু বাড়ায়া দিলেই তো আজাদের করাচির খরচ হইয়া যায় ৷’
আজাদের মা তাঁর ভাইয়ের এ প্রস্তাবটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন ৷ আসলেই এখানে থাকলে আজাদের লেখাপড়া হবে না ৷ এমনিতে তার বন্ধুবান্ধব বেশি ৷ তাদের সবার স্বভাব-চরিত্র যে এক রকম তা নয় ৷ তার ওপর আবার দেশের যা পরিস্থিতি ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অগি্নগর্ভ হয়ে আছে ৷ ছেলেকে করাচি পাঠানোই ভালো ৷ তিনি বলেন, ‘পাঠাতে পারলে তো খারাপ হতো না ৷ কিন্তু আমার পক্ষে কারো কাছে কোনো সাহায্য চাওয়া সম্ভব না ৷’
‘তাইলে আমি অ্যারেঞ্জ করি’-পাতলা মামা বলেন, ‘চৌধুরী এতে আপত্তি করবে বইলা মনে হয় না ৷’
পাতলা মামা আজাদের করাচি যাওয়ার সব ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করে ফেলেন ৷
রাত্রিবেলা ৷ ফরাশগঞ্জের বাসার ডাইনিং টেবিলটা সেগুনকাঠের ৷ অনেক বড় ৷ তবে ওপরের রেঙ্েিনর টেবিল-ঢাকনিটা পুরনো হয়ে গেছে ৷ একপাশটা সামান্য ছেঁড়া ৷ আজাদের পাতে ভাত তুলে দিচ্ছেন মা ৷ আজাদ ভাতের দলা ভাঙছে ৷
মা টেবিল-ঢাকনিটার ছেঁড়া অংশটায় নখ খুঁটতে খুঁটতে বলেন, ‘দুপুরে খেয়েছিস কই ?’
‘খেয়েছি ৷ পপুলার হোটেলে ৷’
‘হোটেলে মোটেলে খেয়ে পেটে গ্যাস্ট্রিক বানাবি ?’ তিনি ছেলের পাতে শাক তুলে দিতে দিতে বলেন ৷
‘না ৷ রোজ খাই না তো!’
‘লেবু দিয়ে শাক দিয়ে ভাতটা মেখে খা ৷ শাকের মরিচটা একটু ডলে নে ৷’
‘ঝাল খেতে পারি না ৷’
‘তাহলে ৷ হোটেলের লাল ঝোল খাস কেমন করে ?’
ছেলে খায় ৷ মা তাকিয়ে তাকিয়ে তার খাওয়া দেখেন ৷ টমেটো দিয়ে ধনে পাতা দিয়ে রুই মাছের ঝোল করেছেন ৷ ছেলের পাতে তুলে দিতে দিতে বলেন, ‘শোন, তোর করাচি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যবস্থা আমি করে ফেলেছি ৷ তোকে ১০/১৫ দিনের মধ্যে রওনা হতে হবে ৷’
‘বলো কি তুমি! তোমাকে ছেড়ে আমি যেতে পারব না’-আজাদ বলে ৷
‘কয় কী পাগলে! তোকে যেতেই হবে ৷ তুই ওখানে বিএ-এমএ পড়বি, ডিগ্রি নিবি, দেশে ফিরে এসে চাকরি করবি, নাহলে ব্যবসা করবি, তখন আমার মনে শান্তি আসবে ৷ আমি বেঁচে আছি তো তোকে মানুষ দেখে যাব বলে ৷ আরেকটু ভাত দেই ?’
‘কেন, এইখানে আর লোকের ছেলেমেয়ে পড়ছে না ?’
‘পড়ুক ৷ লোকের কথা আর আমার কথা এক না ৷ লোকের কি আর আমার মতন একটা মাত্র ছেলে ? আর কেউ নাই! জামাই নাই ৷ ভাই নাই ৷ বাপ নাই ৷ মা নাই!’
‘সেই জন্যেই তো আমি যেতে চাই না ৷’
‘সেই জন্যেই তোকে তাড়াতাড়ি পাঠাতে চাই ৷ এইখানে ইউনিভার্সিটি গিয়ে কেমন পা ভেঙে এসেছিস ৷ আর না ৷ ভাত খাওয়ার মধ্যে আবার পানি খাস কেন ? খাওয়া শেষ করে খা ৷’
মায়ের জেদের কাছে পরাভব মানতে হয় আজাদকে ৷
পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের টিকেট তার জন্যে কেনা হয় ৷
দাদা চলে যাচ্ছে ৷ জায়েদের খুব মন খারাপ ৷ সে আজ আর স্কুলে যাবে না ৷ সে দাদার সঙ্গে সঙ্গে থাকবে ৷ আম্মা সকালবেলা স্কুলে যাওয়ার সময় জায়েদের কোনো তৎপরতা না দেখে জিজ্ঞেস করেন, ‘কিরে, তুই ঢিলা মেরে বসে আছিস কেন ? স্কুল তো লেট হয়ে যাবি ৷’
‘স্কুল যামু না ৷’ জায়েদ বলে ৷
‘কেন, যাবি না কেন ?’
‘দাদার লগে লগে থাকুম ৷’
‘দাদা কি সকালে যাচ্ছে নাকি! তুই স্কুল থেকে এসেও তো দাদার সঙ্গে থাকতে পারবি! যা, স্কুল যা ৷’
‘দাদা আমারে যাইতে নিষেধ করছে ৷’
করাচি যাওয়ার জন্যে দাদা ব্যাগ গোছাচ্ছে ৷ জায়েদ তাকে জিনিসপত্র এগিয়ে দিতে থাকে ৷ কাপড়-চোপড় ৷ শেভিং ক্রিম, ব্রাশ, সেফটি রেজর ৷ বইপত্র ৷ এলভিস প্রিসলির রেকর্ডটা ৷ জায়েদ বলে, ‘রেকর্ড লইয়া কী করবা দাদা ? প্লেয়ার পাইবা কই ?’
‘করাচি কি গ্রাম নাকি ?’ আজাদ জবাব দেয় ৷
‘নাজে তো ভালো সিনেমা আসতেছে ৷ দেখবার পারবা না ৷’
‘করাচিতেও সিনেমা হল আছে ৷’
‘থাকুক ৷ বাংলা বই তো আর চলব না ৷ সুচিত্রা-উত্তমের বই কই দেখবা ?’
‘ওইখানেও নিশ্চয় চলবে ৷ নাইলে আর কী! তুই দেখিস ৷’
‘ক্যামনে দেখুম ৷ পয়সা দিব কে ?’
‘তোকে মাসে মাসে আমি সিনেমা দেখার টাকা পাঠিয়ে দেব ৷ এই শোন, তোর কলম লাগবে ? ধর ৷’
আজাদ তার ড্রয়ারে রাখা কতগুলো কলম মুঠো করে জায়েদকে দেয় ৷ জায়েদ ‘না লাগব না’ বলে নেয় ৷ ড্রয়ারে আরো কতগুলো মূল্যবান সম্পদ আছে ৷ একটা চাকু, এটা দিয়ে আম কাটা যাবে, একটা ঘড়ি, দাদা এটা পরে না, চাবিও দেয় না বহুদিন, আরো না জানি কত কিছু ৷
‘কিরে, ড্যাবড্যাব করে কী দেখিস ?’ আজাদ বলে ৷
‘ঘড়িটা নষ্ট নাকি! চাবি দ্যাও না কদ্দিন ৷ আমার কাছে রাইখা যাও ৷ ডেলি চাবি দিমুনে ৷ ভালো থাকব ৷’
‘তোকে দিলে বেচে দিয়ে সিনেমা দেখবি ৷’
‘এত দামি ঘড়ি ৷ মাথা খারাপ, নাকি পেট খারাপ ?’
‘তাইলে যা এটা তোকে দিয়ে দিলাম ৷’
‘চাকুটা কী করবা ? ধার দেওন লাগব না!’
‘এটা দিলে তোর দশ আঙুল কেটে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে ৷ এইটা দেওয়া যাবে না ৷’
দুটো প্লেবয় আছে ৷ এগুলো ড্রয়ারে চাবি দিয়ে লুকিয়ে রাখতে হবে ৷ নাহলে জায়েদের হাতে পড়ে গেলে মুশকিল ৷
‘জায়েদ যা, ঘর ছাড় ৷’
‘ক্যান ৷ তোমার লগে থাকুম বইলা স্কুল গেলাম না ৷ আর আমারে তুমি বাইর কইরা দ্যাও ৷’
‘আরে হতভাগা ৷ বের করে দিচ্ছি নাকি ৷ দুইটা মিনিট একটু ঘরের বাইরে যা না ৷ দুইটা মিনিট ৷’
মা এক সময় রাঁধতে ভালোবাসতেন ৷ এখনও বাসেন হয়তো ৷ কিন্তু সামর্থ্য তো নাই ৷ রান্না করতে হলে বাজার করতে হয় ৷ কে বাজার করবে ? টাকা আসবে কোত্থেকে ? কিন্তু আজকে মা অনেক কিছু রাঁধতে বসে গেছেন ৷ ছেলে তাঁর যা কিছু খেতে ভালোবাসে, তার সব ৷ পোলাওয়ের চেয়ে তার শাদা ভাত পছন্দ বেশি ৷ ইলিশ মাছ সর্ষে দিয়ে ৷ পাবদা মাছের ঝোল ৷ চিংড়ির মালাইকারি ৷ গোরুর মাংস ভুনা ৷ মুরগির দোপেঁয়াজা ৷ একটু আলুভর্তা ৷ দুটো বেগুন ভাজি ৷ মসুরের ডাল ৷ আহা, ছেলে আজ তাঁর দূরে চলে যাচ্ছে ৷ এটা তো শুধু পড়তে কয়েক মাস কি কয়েক দিনের জন্যে চলে যাওয়া নয়, এ হলো জীবন থেকেই চলে যাওয়া ৷ বিদেশে ছেলে যাবে পড়তেই বটে, কিন্তু বিএ এমএ পাস করে সে কি আর ফিরে আসবে, কার ছেলেই বা ফিরে আসে, ফিরে এলেও সে কি আর আগের ছেলে থাকে, অন্য রকম হয়ে ফেরে, তার মাথার মধ্যে তখন অন্য আকাশ, অন্য জগৎ, সে কি আর মায়ের বুকে ফিরে আসে ? মাকে জড়িয়ে ধরে ? জ্বর হলে মা মা বলে বিলাপ করে ? মাথার চুলে মায়ের আঙুলের বিলির জন্যে কাতর হয়ে পড়ে ? ছেলের সঙ্গে মায়ের তখন অপার ফারাক, দুজনের দুই জগৎ, ছেলে তখন অচেনা, তাকে ডাকে বাইরের জগৎ, সে তখন কাজের মানুষ, আর তার যেটুকু ভালোবাসা, যেটুকু স্নেহ, তা থাকে অন্যের জন্যে, অন্য নারী, অন্য কাজ, অন্য দরজা, অন্য আকাশের জন্যে ৷ মায়ের চোখ ভিজে আসতে চায়, কারণ তিনি পেঁয়াজ কাটছেন, এ ছাড়া আর কিছু নয় ৷ আর কোনো কারণ থাকতে পারে না ৷
‘মা, আমি একটু বাইরে গেলাম’-আজাদ বলে ৷
‘আবার কই যাস ? দুপুরে বাসায় খাস বাবা ৷’
‘আচ্ছা ৷’
‘আচ্ছা না ৷ তোর জন্যে আমি রাঁধতে বসেছি ৷ অবশ্যই খাবি ৷’
‘কী কী রাঁধছ ?’
‘খেতে বসলেই দেখতে পাবি ৷’
‘আচ্ছা আসব ‘খন ৷’
দুপুর গড়িয়ে যায় ৷ আজাদ ফেরে না ৷ মায়ের মন খারাপ ৷ জায়েদ মাতৃহারা গোবৎসের মতো বাড়ির এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায় ৷ তার বাঁ হাতে ঘড়ি ৷ ঘড়িটা চলছে ৷ কানের কাছে নিয়ে সে টিক টিক শব্দ শোনে ৷
আজাদ ফেরে বিকালে ৷ ‘মা, খিদা লেগেছে ৷ খাবার দাও ৷’
‘দেওয়াই আছে ৷ আয় ৷ বস ৷ হাত ধুয়ে আয়’-মা বলেন ৷
‘তুমি খেয়েছ ?’
‘আমার খাওয়া ৷ আমি এইসব খাই ?’
‘না খেলে ৷ ভাত তো খাও ৷ এত বেলা না খেয়ে আছ ৷ নাও ৷ তুমিও নাও ৷ জায়েদ খেয়েছে ? ডালু খেয়েছে ?’
‘হ্যাঁ ৷ ওদের খাইয়ে দিয়েছি ৷’
‘ভালো করেছ ৷ জায়েদ, এই জায়েদ, আয় বস ৷’ আজাদ উচ্চৈঃস্বরে বলে ৷
জায়েদ আসে ৷ ‘আমি খাইছি ৷ প্যাট ফুইলা আছে ৷’
‘আরে আবার বস ৷ নে ৷ বস ৷ যা হাত ধুয়ে আয় ৷ জলদি ৷ জলদি ৷’ জায়েদ ‘না’ করতে পারে না ৷ সত্যি তার পেটে কোনো জায়গা নাই ৷ তবু দাদার পাশে বসার এ সুযোগ ৷ আরেকটু কাছে থাকার সুযোগ! সে কি ছাড়তে পারে ? সে বসে পড়ে ৷
মা আজাদের পাতে ভাত তুলে দেন ৷ আজাদ অন্যমনস্ক ৷ সে থালার ভাত এক কোণে পালা করে ৷ মা পাতে লেবু তুলে দিলে সে লেবু চিপতে থাকে ৷ রস বেরিয়ে তার চোখে যায় ৷ সে বাঁ হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ ডলে ৷ মা প্লেটে আলুভর্তা তুলে দেন ৷ সে ভালো করে না মেখেই গাপুসগুপুস করে ভাত মুখে তোলে ৷
মা বলেন, ‘আস্তে আস্তে খাও বাবা ৷ ভালো করে মেখে খাও ৷ কোথায় থাকবে না থাকবে, কী খাবে না খাবে, ভাত তো পাবেই না, রুটি পাবে ৷’
আজাদ মুখ তুলে মায়ের মুখে দিকে তাকায় ৷ ‘আরে না ৷ ভাত পাওয়া যাবে ৷’
জায়েদ বলে, ‘করাচিতে নাকি খুব ভালো কাবাব হয় ৷ আস্ত খাসি আগুনে পুড়ায়া কাবাব বানায় ৷ দাদা আরাম কইরা খাইতে পারব ৷’
আজাদ হাসে ৷ ‘খাসির ভুঁড়ি কি বের করে নেয়, না পেটের ভিতরেই থাকে!’
মা বলেন, ‘আজাদ ৷ শোনো ৷ মনে রেখো, তুমি করাচি যাচ্ছ পড়তে ৷ পড়াশোনাটা ঠিকমতো করবে ৷ কষ্ট হলেও পড়াশোনাটা শেষ করবে ৷ বিদেশে নানা কষ্ট হয় ৷ কিন্তু পড়তে গেলে কষ্ট করতেই হবে ৷ মনটা উতলা করবে না ৷ ধ্যান ধরে পড়বে ৷ আমাদের জন্যে চিন্তা করবে না ৷ আমরা আল্লাহর ইচ্ছায় ভালো থাকব ৷ চিঠি লিখবে ৷’
আজাদ বলে, ‘মা শোনো ৷ তোমাকে একটা কথা বলি ৷ আমি করাচি যেতে রাজি হয়েছি কেন জানো ? রেজাল্ট ভালো করার জন্য ৷ এখানে তো বন্ধুবান্ধব বেশি হয়ে গেছে ৷ ওখানে তো আর কেউ থাকবে না ৷ খেলা নাই, আড্ডা নাই ৷ খালি পড়া ৷ দেখো, আমি যদি ফার্স্ট ক্লাস না পেয়েছি…’
‘খাও বাবা ৷ খাও ৷’ মা একটা মুরগির রান তুলে দেন ছেলের পাতে ৷
সন্ধ্যার পরে রুমী আসে ৷ সৈয়দ আশরাফুল হক আসে ৷ ফারুক আসে ৷ ইব্রাহিম সাবের আসে ৷ তারা তিনতলায় আজাদের ঘরে বসে গল্পগুজব করে ৷ হাসিঠাট্টা আমোদে মেতে ওঠে ৷ ফারুক বলে, ‘দোস্তো, পাকিস্তানি মেয়ে পাইলে প্রথমে গায়ে পানি ছিটাইবা ৷ যদি দেখো ঝাইড়া দৌড় দিতাছে, তাইলে যাইতে দিও ৷ পিছনে পিছনে দৌড়াইও না ৷ আর যদি দেখো পানি সহ্য করতে পারে, তাইলে কাছে যাইও ৷ নাইলে বুঝলা না, এক মাস গোসল করে না, গায়ে গন্ধ করব ৷’
বন্ধুরা সবাই রাতে এখানে ভাত খায় ৷ আজাদের মা অনেকদিন পরে তাঁর বাসায় বাইরের লোকদের আপ্যায়ন করেন ৷ অথচ আগে প্রায় প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন ৷ রাতের বেলা আবার তিনি ইলিশ-পোলাও রেঁধেছেন ৷ এই পদ রান্নার জন্যে তাঁর খ্যাতি বিশেষজ্ঞ-পর্যায়ের ৷ ইস্কাটনের বাসা থেকে বেরিয়ে আসার পরে সেটা আর করা হয় না ৷
জায়েদ কিন্তু এত লোকের উপস্থিতি পছন্দ করছে না ৷ একটু পরে দাদা চলে যাবে এয়ারপোর্টের উদ্দেশে, এখন কি সে দাদাকে একটু একা পেতে পারত না!
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে মা বলে, ‘বাবা, রাত কোরো না, দিনকাল ভালো না, বিসমিল্লাহ করে বের হয়ে যাও ৷ তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে গিয়ে বসে থাকতে তো অসুবিধা নাই ৷’
মা সব সময় আজাদকে ‘তুই’ করে বলেন ৷ কিন্তু এখন বলছেন তুমি তুমি করে ৷ মা বাইরে যতই শক্ত ভাব দেখানোর চেষ্টা করুন না কেন, ভেতরে ভেতরে তিনি বিদায়-ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েছেন ৷
আজাদ বেরিয়ে পড়ে ৷ সঙ্গে বন্ধুরা ৷ মা, জায়েদ, চঞ্চল, টিসুকে কোলে নিয়ে মহুয়া-এরাও আসে রাস্তায় ৷ আরেক খালাতো ভাই ডালু আসে ৷ তার হাতে আজাদের সুটকেস ৷
একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে ৷ আজাদের বন্ধু ফারুকের গাড়ি ৷
মা বলেন, ‘ঠিক আছে বাবা, আসো ৷ দেখেশুনে যাও ৷ টিকেট ঠিকমতো রেখেছ তো ?’
‘জি রেখেছি’-আজাদ বলে ৷
‘আল্লাহর নাম নিয়ে রওনা দাও ৷’
আজাদ মাকে কদমবুসি করে ৷ মায়ের বুকের ভেতর থেকে কান্না উগরে আসতে চাইছে ৷ চোখের পানি বাঁধ মানতে চাইছে না ৷ কিন্তু তিনি বাইরে থেকে তার কিছুই বুঝতে দেন না ৷ মুখটা হাসি হাসি করে রাখেন ৷ তাঁকে দেখলে বোঝার উপায় নাই যে ভেতরে তাঁর ঝড় বয়ে যাচ্ছে ৷ আজাদ মায়ের ‘তুমি’ বলা শুনেই সব বুঝছে ৷
আজাদ গাড়িতে ওঠে ৷ তার বন্ধুদেরও কেউ কেউ ৷ গাড়ির হেডলাইট জ্বলে ওঠে ৷ শব্দ করে স্টার্ট নেয় গাড়িটা ৷ একটু একটু করে এগোতে থাকে ৷ তারপর পেছনের লাল লাইট দেখিয়ে এক সময় সেটা অদৃশ্য হয়ে যায় ৷ তখন ঝপ করে এই জায়গাটায় একটা নিস্তব্ধতা এসে ভর করে ৷ ডালু কোনো কথা বলে না, জায়েদ কোনো কথা বলে না, চঞ্চল কোনো কথা বলে না, টিসু না, বোনেরা না, মা না ৷ তারা ঘরের ভেতরেও যায় না ৷ আবার রাস্তার দিকে তাকিয়েও থাকে না ৷ কয়েকটা মুহূর্ত শুধু, কিন্তু সে মুহূর্ত কয়েকটাই অনন্তকালের মতো সরণিজুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ৷
‘আল্লাহ মাবুদ’-আজাদের মায়ের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যাওয়ার পরে সবাই ঘরে ফিরে আসে ৷
গাড়িটা বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর, একটা রুমাল বের করে আজাদ চোখ মোছে ৷

 ১২. মা

আজাদ নাই ৷ সে করাচির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছে ৷ উড়োজাহাজ তাকে নিয়ে চলে গেছে ওই আকাশের ওপর দিয়ে ৷ এ তো যে-সে কথা নয় ৷ এ তো মাওয়া বা বিক্রমপুর যাওয়া নয় যে বেলাবেলি চলে আসা যাবে ৷ ইচ্ছা করলেই তো হুট করে চলে আসা যাবে না ৷ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান, মধ্যখানে অন্য দেশ, হাজার মাইলের ব্যবধান ৷ ওখানকার ভাষা আলাদা, খাবার আলাদা, চালচলন আলাদা ৷ পাসপোর্ট লাগে না সত্য, কিন্তু আলাদাই তো দেশ ৷ একা ছেলে তাঁর কোথায় থাকবে, কী খাবে ? অসুখ-বিসুখ হলে তাকে কে দেখবে ?
মা সারা দিন ডাকপিয়নের জন্যে পথ চেয়ে থাকেন ৷ ছেলের কোনো কুশল যদি পাওয়া যায়! নফল রোজা রেখেছেন তিনি ৷ বাসার সবাই, তাঁর ভাগ্নে-ভাগি্নরা, তাঁর বড় বোনের ছেলে ডালু, সবাই তাঁকে দেখলেই গম্ভীর হয়ে যায় ৷ এ হয়েছে আরেক মুশকিল ৷
তিনি প্রথমে কল্পনা করতেন আজাদ কোথায় কী করছে, সারাক্ষণ বিড়বিড় করতেন-’এই তো, এখন আজাদ প্লেনে ৷ এই তো এখন আজাদ করাচি পৌঁছেছে ইনশাল্লাহ ৷’ তারপর তো তিনি আর বলতে পারেন না, আজাদ কোথায় কার কাছে গিয়ে উঠেছে ৷ তখন তিনি গুনতে আরম্ভ করেন ঘন্টা, ১২ ঘন্টা হলো আজাদ গেছে ৷ ১৮ ঘন্টা হলো আজাদ ঢাকা ছেড়েছে ৷ তারপর এল দিন গণনার পালা ৷ আজ দুদিন হলো আজাদ করাচিতে ৷ তাহলে চিঠি আসে না কেন ? ও যদি পৌঁছেই একটা চিঠি লেখে, তাহলে কালকের প্লেনে চিঠিটা কি ঢাকায় আসতে পারে না ? তাহলে পিয়ন কেন আজও চিঠি দিল না ? এক দিন, দু দিন, তিন দিন, চার দিন ৷
সাফিয়া বেগমের বুকের ওপরে যেন পাথর চেপে বসে ৷ আজাদ ঠিকভাবে পৌঁছেছে তো ? বিমান ঠিকভাবে নেমেছে তো ? কোনো দুর্ঘটনা ? আল্লাহ না করুন ৷ কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তো রেডিওতে পত্রপত্রিকায় খবর পাওয়া যেত ৷ তিনি জায়নামাজে বসেন ৷ নামাজ শেষে দোয়া-দরুদ পড়েন ৷ তারপর করেন দীর্ঘ মোনাজাত ৷ ‘হে আল্লাহ, আমার ছেলেটাকে ঠিকভাবে রেখো আল্লাহ ৷’
চার দিন পরে চিঠি আসে ৷ একটা চিঠি ৷
পিয়ন এসে দরজায় কড়া নাড়তেই ছুটে যান সাফিয়া বেগম ৷ এর আগেও অনেকবার পিয়ন এসেছে ভেবে তিনি ছুটে ছুটে গেছেন ৷ কিন্তু এ-ও এসেছে ৷ পিয়ন আসেনি ৷ এবার সত্যি পিয়ন ৷ সাফিয়া বেগমের বুক ধড়পড় করে ৷ তিনি চিঠি হাতে নিয়ে খামটাই উল্টেপাল্টে দেখেন ৷ বাই এয়ার মেইল ৷
তাঁর আজাদের হাতের লেখা ৷
TO
Mrs. Safia Begam
61 B. K Das Road
Farashganj
Dacca-1
East Pakistan
খামটা তিনি ছিঁড়বেন কী করে ? ভেতরে আজাদের লেখা চিঠিটা যদি ছিঁড়ে যায় ৷ খানিকক্ষণ তঁাঁর নিজেকে হতবুদ্ধি লাগে ৷ তারপর তিনি আলোর বিপরীতে ধরেন খামটা ৷ ভেতরের চিঠিটার অবস্থানটা বোঝা যায় ৷ তিনি একপাশ দিয়ে খামটা যত্ন করে ছেঁড়েন ৷ তাঁর সমস্তটা শরীর কাঁপছে ৷
11.8.64
Karachi
মা,
আমার ভালোবাসা গ্রহণ করিও ৷ আশা করি ভালোই আছ ৷ আমি সুস্থভাবেই করাচি পৌঁছেছি ৷ এয়ারপোর্টে ডলদাদা এবং তার দুই বন্ধু ছিল ৷ এখন আমি ‘প্যালেস হোটেলে’ আছি ৷ গতকাল ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম ৷ ইউনিভার্সিটি করাচি শহর থেকে ১৫-২০ মাইল দূরে ৷ হোস্টেল দেখলাম ভালোই কিন্তু খুব কড়া ৷ হোস্টেলের গেট লোহার তৈরি এবং খুব উঁচা ৷ পাশে খুব ছোট ৷ দেওয়ালগুলি খুব উঁচা এবং দেওয়ালের উপরে ভাংগা কাচ বসান ৷ এখন সকাল ৮টা বাজে, ৯টার সময় ডল আসবে এবং পরে ইউনিভার্সিটিতে যাব ভর্তির ব্যাপারে ৷ যা হোক, আমার জন্যে তুমি চিন্তা কোরো না ৷ তুমি নিজ স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিও ৷ এখন আর সময় নেই, পরে আরো চিঠি লিখে সব জানাব ৷ আশীর্বাদ কোরো, যেন আমার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয় ৷
ইতি তোমার
আজাদ
এই ঠিকানায় চিঠি দিও
Azad.
C/O Q. B. Islam
19-F Block 6
PECHS
KARACHI-19
মা ঘুরেফিরে কয়েকবার চিঠিটা পড়েন ৷ তারপর বড় বোনের ছেলে ডালুকে ডেকে পড়তে দেন ৷ জায়েদ এসে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, আজাদ দাদার চিঠি সেও পড়বে ৷
জুরাইন গোরস্তানে আম্মাকে শুইয়ে রেখে এসে জায়েদের দিনগুলো এলোমেলো হয়ে যায় ৷ সে হিসাব করে কূল পায় না, কী কঠিন মহিলা ছিলেন তিনি, আজাদের মা ৷ তাঁর সমস্ত ব্যথা, সমস্ত দুঃখ তিনি একাই পুরোটা জীবন বহন করে গেছেন ৷ সুখের সংসার ছাড়ার দুঃখ, মুক্তিযুদ্ধে নিজের ছেলেকে হারানোর দুঃখ ৷ কিন্তু তিনি কোনো দিনও চাননি, এসব কথা মানুষ জানুক, এসব নিয়ে লেখালেখি হোক ৷ জাহানারা ইমাম এসেছিলেন অনেকবার, ‘আপা, আপনার জীবনের কথা বলেন, এসব লিখে রাখা দরকার ৷’ তিনি রাজি হননি ৷ জায়েদকে বলে গেছেন, ‘খবরদার, আমার ছবি কাউকে দেবে না ৷’ জায়েদ আম্মার ছবি কাউকে দেবে না ৷ এ সত্যি ৷ কিন্তু আরো কিছু জিনিস তো আছে তার কাছে ৷ যেমন আছে করাচি থেকে মাকে লেখা আজাদ দাদার চিঠি ৷
জায়েদ তার বাক্সে হাত দেয় ৷ চিঠিগুলো বের করে ৷ আপন মনে পড়ে ৷ পড়ে কাঁদে ৷ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে ৷ কী করবে এখন এসব নিয়ে সে ৷
করাচি থেকে লেখা আজাদ দাদার প্রথম চিঠিটা এত দিন পর পড়ে নানা কথাই মনে হয়ে জায়েদের ৷ আজাদ কথাটার অর্থই তো স্বাধীন ৷ আর দ্যাখো, তার আজাদ দাদা করাচিতে তার হোস্টেল দেখে প্রথমেই যেটা লক্ষ করল, তা হলো, চারদিকের দেয়াল উঁচু, দেয়ালের ওপরে কাচ বসানো, গেট লোহার, আর পাশে ছোট ৷ আশ্চর্য না ? তার স্বাধীনতা যে এ হোস্টেলে থাকলে চলে যাবে, এটাই ছিল তার প্রথম চিন্তা ৷
এই চিঠি যে-তারিখে লেখা, ঠিক তার দুদিন পরের তারিখের আরেকটা চিঠি বের হয় ৷ এ চিঠিতে আজাদ মাকে জানায়, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির ব্যাপার প্রায় পাকা, ইউনিভার্সিটিতে বেশ কিছু বাঙালি ছেলে আছে, আর মায়ের প্রতি অনুরোধ জানায় চিন্তা না করার জন্যে, শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়ার জন্যে, তার জন্যে দোয়া করার জন্যে আর একটা চাকর রাখার জন্যে ৷
এ চিঠিতে আর পরের চিঠিগুলোতে আজাদ বারবার বলেছে, এবার সে ফার্স্ট ক্লাস পেতে চায়, যাতে সে পড়াশোনা করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে মার মুখে হাসি ফোটাতে পারে ৷
এদিকে মা ছেলের জন্যে পাঠিয়েছেন সন্দেশ ৷ আজাদ সেটা নিজে খেয়েছে, খাইয়েছে আশপাশের অনেক ছাত্রকে ৷ তারা সবাই সন্দেশের প্রশংসা করেছে ৷ চিঠিতে আজাদ সে-কথা লিখতে ভোলেনি ৷
আজাদ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ৷ তার নিজের নামে বরাদ্দ করা হোস্টেলের সিটে উঠেছে ৷
একদিন গভীর রাতে তার ঘুম ভেঙে যায় ৷ তার রুমমেট আরো দুজন ৷ তারা ঘুমাচ্ছে ৷ এদের একজন সিন্ধি, আরেকজন করাচির ৷ এদের প্রত্যেকের বাবা দ্বিতীয়বার সৎকার্য করেছেন ৷ তিনজন একই রকম ভাগ্যঅলা মানুষ যে কীভাবে একত্র হলো, আল্লাহ জানে ৷
‘আমি এখন এই করাচির হোস্টেলে’, আজাদ ভাবে ৷ ‘আর জানি না, ঢাকায় মা কী করছে’-সে বিড়বিড় করে ৷ তার ইচ্ছা করছে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে আলো জ্বালিয়ে চিঠি লিখতে বসে ৷ কিন্তু তা উচিত হবে না ৷ এত রাতে আলো জ্বালালে রুমমেটদের অসুবিধা হবে ৷ কালকে ভোরে উঠে সে লিখতে বসবে চিঠি ৷ অনেক বড় চিঠি লিখবে মাকে ৷ কী লিখবে সে ?
‘মা, এখানে আমি ভালোই আছি ৷ কোনো গণ্ডগোল নাই ৷ ভালো ইউনিভার্সিটি আর সুশৃঙ্খল পরিবেশ ৷
তবে দূরে থাকি বলে, একা থাকি বলে, খুব ছোটখাটো বিষয়ের জন্যে মনটা মাঝে মধ্যে কেমন করে ওঠে ৷ যেমন ধরো ভাত ৷ এমন তো না যে ঢাকায় থাকতে রোজই ভাত খেতাম ৷ রুটি-তন্দুরি-মোগলাই দিয়ে দু-তিন দিন পার যে কখনও করিনি, তেমন তো নয় ৷ কিন্তু করাচিতে এসে ভাত জিনিসটা হোস্টেলের ডাইনিংয়ে খেতে পাচ্ছি না, ভাত খাওয়ার জন্যে তিন মাইল দূরে ইস্ট পাকিস্তান হোটেলে যেতে হবে, এটা যেন সহ্য হয় না ৷ এখন মনে হয়, তুমি যে ভাত রাঁধতে, তাতে বলক উঠত, সুন্দর মাড়ের গন্ধ বেরুত, সেই গন্ধটাও কত সুন্দর ছিল ৷ শুধু একটু ভাতের গন্ধের জন্যেও মনটা খারাপ করে মা ৷ একই রকম মনটা আকুল হয়ে ওঠে একটু বাংলায় কথা বলার জন্যে, বাংলায় কথা শোনার জন্যে ৷ আমাদের হোস্টেলে যে কজন বাঙালি ছেলে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছি, তারা এখন একসাথে হওয়ার জন্যে, একসাথে চলার জন্যে, একটু বাংলায় কথা বলার জন্যে, একটু বাংলা কথা শোনার জন্যে আঁকুপাঁকু করি ৷ রাস্তায় যদি কোনো পূর্ব পাকিস্তানের ট্যাঙ্অিলার সঙ্গে দেখা হয়, যদি তার সঙ্গে উর্দুতে কথা বলে খানিকক্ষণ পথ চলার পরে জানতে পারি সে বাঙালি, কী আনন্দটাই না হয় ৷ তার সাথে বেমালুম তখন বাংলা কথা বলা শুরু করে দিই ৷ মনে হয় সাত জনমের আপন একজনকে পেলাম ৷ এখন মনে হচ্ছে, বাঙালি আমরা আরেক জাতি ৷ ওরা, পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুঅলারা আরেক জাতি ৷ মুসলমান হলেই জাতি এক হয় না ৷
এক যে হয় না, সেটা ওদের আচার-আচরণেও টের পাওয়া যায় ৷ ইতিমধ্যে আমার এক বন্ধু পেয়ে গেছি, রাওয়ালপিন্ডি বাড়ি, হিজাজি খান ৷ সে খুব ভালো ছেলে ৷ আমাকে খুবই পছন্দ করে ৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি বলব, পুরো পূর্ব পাকিস্তান সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের লোকদের ধারণা হয় খুব খারাপ, নয় তো ধারণাই নাই ৷ ওরা আমাদের মুসলমানও ভালোমতো মনে করে না, মানুষও ঠিক মনে করে কি না, সন্দেহ ৷ পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছি শুনলেই নানা রকমের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে ৷
আর আছে নানা রকমের বৈষম্য ৷ পশ্চিম পাকিস্তানে না এলে বোঝা যাবে না, বাঙালিদের ওরা কতভাবে বঞ্চিত করে রেখেছে ৷ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে বাঙালি নাই বললেই চলে, সেনাবাহিনীতেও বাঙালি কম নেওয়া হয় ৷ বার্ষিক বাজেটে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে বরাদ্দ অনেক বেশি ৷ আমাদের ঢাকার সঙ্গে ওদের করাচির তুলনা করলে আকাশ-পাতাল পার্থক্য আর বৈষম্য চোখে পড়ে ৷
আমার সাথে একটা মেয়ের বন্ধুত্ব হয়েছিল ৷ পাঞ্জাবি মেয়ে ৷ তবে মোহাজের ৷ ইন্ডিয়ান পাঞ্জাব থেকে এসেছে ‘৪৭-এর পরে ৷ একদিন কতগুলো পাঞ্জাবি এসে বলল, খবরদার, বাঙালি হয়ে পাঞ্জাবি মেয়ের সাথে মিশবি না ৷ তারা সব গুণ্ডা ধরনের ছেলে ৷
আমার ইচ্ছা হলো কষে মার লাগাই ৷ ঢাকা হলে আমার সাথে কেউ এ রকম বাজে ব্যবহার করলে আমি কী করতাম তুমি কল্পনা করতে পারো! মেরে সব কটার চামড়া খুলে ফেলতাম ৷ কিন্তু বিদেশ বলে কিছুই করতে পারলাম না ৷ দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছি ৷ মাঝে মধ্যে মনে হয়, কিসের পড়াশোনা, দেশে ফিরে যাই ৷
করাচি আর যাই হোক, দেশ নয়, বিদেশ ৷
আমি শুধু তোমার মুখের দিকে চেয়ে এই বিদেশে থাকা আর অপমান সহ্য করার কষ্ট করছি ৷ দোয়া করো, যেন তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে তোমার কষ্ট দূর করতে পারি ৷’
এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ভোর হয়ে আসে ৷ আজানের ধ্বনি শোনা যায় ৷ আজাদ ঘুমিয়ে পড়ে ৷
সকালবেলা ক্লাস ৷ ক্লাস থেকে ফিরে এসে সে মাকে চিঠি লিখতে বসে যায় ৷ চিঠি লেখার জন্য নীল রঙের প্যাড কিনে রেখেছে সে ৷ নীল রঙের কালিতে লেখে :
মা,
চিঠি লিখতে দেরি হয়ে গেল বলে কিছু মনে কোরো না ৷ কারণ একদম সময় পাই নাই ৷ এখানে সবাই সব সময় ব্যস্ত থাকে ৷ আমি এখন হোস্টেলে ভালোই আছি ৷ আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে ৷ আমি এখনও রীতিমতো পড়া শুরু করি নাই ৷ আমরা তিনজন এক রুমে থাকি ৷ এখানকার খাবার জিনিস মোটেই ভালো না ৷ এখানে অনেক পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ছেলে আছে এবং আমাদের আলাদা বাংলা সমিতি আর ক্লাব আছে ৷ এখানকার মাস্টাররা খুব ভালো ৷ এখানে নিয়ম করেছে যে ক্লাসে মাস্টাররা উর্দুতে পড়াবে ৷ কিন্তু আমাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হবে আশা করি ৷ উর্দুর জন্য খুব অসুবিধা হচ্ছে ৷ দোয়া কোরো যেন অসুবিধা না হয় ৷ আর তোমার শরীর কেমন আছে ৷ নতুন কোনো খবর থাকলে বোলো ৷ চিঠির উত্তর দিও ৷ এখন আসি ৷ আমার জন্য চিন্তা কোরো না ৷
ঠিকানা
Magferuddin Ahmed Chowdhury
BLOCK 2 Room No 28
KARACHI UNIVERSITY HOSTEL
KARACHI 32
রাতের বেলা মনে মনে লেখা চিঠিতে সে কত কথাই না লিখেছিল ৷ আর এখন দিনের আলোয় যখন সত্যি সত্যি মাকে সে চিঠি লিখতে বসেছে, তখন কিন্তু আর অত কথা লেখা হয় না ৷ সংক্ষেপে গুছিয়ে, মা যেন আহত না হন, এমন কায়দা করে চিঠিটা লিখতে হয় ৷ মানুষের মনের কথা আর মুখের কথাই এক হয় না, মনের কথা আর চিঠির কথা এক হওয়া তো আরো অসম্ভব ৷
চিঠি পেয়ে মা চিন্তিত হন ৷ আজাদ লিখেছে, ওখানকার খাবার খুব খারাপ ৷ কত খারাপ ? হায়! আমার ছেলে ভাত পছন্দ করে ৷ করাচিতে এখন সে ভাত পাবে কোথায় ? মাছ পাবে কোথায় ? আর দ্যাখো, তিনি নিজে কত রাঁধতে পছন্দ করেন ৷ কতজনকে রেঁধে রেঁধে এই জীবনে খাইয়েছেন ৷ আর তাঁর নিজের ছেলে ভাতের জন্যে আনচান করছে ৷ তাঁর দুঃখের যেন সীমা-পরিসীমা থাকে না ৷ আবার তিনি শাসন করেন নিজের মনকে ৷ আজাদ করাচি গেছে পড়তে, ভালো রেজাল্ট করতে, ভাত-মাছ খেতে নয় ৷ বিদেশে গেলে কষ্ট তো হবেই ৷ মহানবী (সা:) বলেছেন, জ্ঞানার্জনের জন্যে সুদূর চীন দেশে হলেও যাও ৷ আরব দেশ থেকে চীন দেশে কেউ গেলে চায়নিজ খাবার দেখলে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে ৷ কিন্তু তবু তাকে যেতে হবে ৷ কষ্ট স্বীকার করতে হবে ৷ কারণ সে গেছে এল্ম তালিম করতে ৷
আর দ্যাখো তো কাণ্ড ৷ ওরা নাকি উর্দুতে পড়াবে ৷ উর্দু তো ছেলে আমার একদমই জানে না ৷ কেন বাবা ইংরেজিতে পড়াতে পারো না ? আজাদ খুব ভালো ইংরেজি জানে ৷
এইসব সাত-পাঁচ ভাবেন আর তিনি লেগে যান চাল কুরে আটা বানাতে ৷ তাঁর সঙ্গে যোগ দেয় বাসার আর মেয়েরা ৷ উরুনগাইনে ভেজা চাল গুঁড়ো করা চলে ৷ বেরিয়ে পড়ে শাদা আটা ৷ তারপর সেই আটা নিয়ে সাফিয়া বেগম বসে যান পিঠা বানাতে ৷ বাঙালি পিঠা ৷
মা এখন তক্কে তক্কে থাকেন, কে কখন করাচি যাবে ৷ তার হাত দিয়ে তিনি পিঠাটা, মিষ্টিটা পাঠিয়ে দেন ৷ পিঠা খেয়ে আর বন্ধুদের খাইয়ে ছেলে চিঠি লেখে, ‘মা তোমার পিঠা খেয়ে আমার বন্ধুরা কত প্রশংসাই না করেছে ৷’ সেই চিঠি পড়ে মায়ের মন প্রশান্তিতে ভরে যায় ৷ যাক, ছেলে তাঁর পিঠা খেয়েছে, আর শুধু খায়নি, বন্ধুবান্ধবদেরও খাইয়েছে ৷ আর ওরা, মাউড়ারা তাঁর বাঙালি পিঠার প্রশংসা করেছে ৷

১৩. মা

প্রবাসে গেলে বাঙালি মাত্রেরই যা হয়, ভাষা আর ভাতের জন্যে হা-পিত্যেশ করা, তা তো আজাদের বেলায়ও ঘটে ৷ অন্য লক্ষণটাও বাদ থাকে না ৷ সমিতি করা ৷ বাঙালি সমিতি করা ৷
আর এইসব সাংগঠনিক কাজে যুক্ত থাকায় আজাদের আরেকটা লাভ হয় ৷ করাচিতেই এক বাঙালি মেয়েকে তার ভালো লেগে যায় ৷ একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে মেয়েটা ৷
বাঙালি সমিতির অনুষ্ঠানে মেয়েটা গান গেয়েছিল ৷ আধুনিক গান ৷ সাতটি রঙের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই, জানি না তো কেমন করে নিজেকে সাজাই ৷ শাদা রঙের জামা, সে তো ভালো নয়, হলুদ না হয় নীলে কেমন জানি হয়!
মেয়েটা পরে এসেছিল শাড়ি ৷ কপালে দিয়েছিল টিপ ৷ আজাদের চোখে লেগে গিয়েছিল সে ৷ আজাদ সুযোগ খুঁজছিল মেয়েটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করার ৷ সুযোগ সহজেই মিলে যায় ৷ অনুষ্ঠানশেষে ছিল চা-পর্ব ৷ হলঘরের পেছন দিকে বড় টেবিলে চায়ের কাপ আর কেতলি সাজানো ৷ পিরিচে পিরিচে বিস্কিট আর সামুচা ৷ অনুষ্ঠান শেষ হলে সবাই একসঙ্গে উঠে পড়ে চায়ের টেবিলের দিকে যাত্রা শুরু করলে খানিকটা মানবজট লেগে যায় ৷ আজাদ কিন্তু প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়ে না চায়ের কাপের দিকে ৷ তার নজর শাড়ি পরা গায়িকাটির ওপরে ৷ সে যখন যাবে, আজাদও তখন যাবে টেবিলের দিকে ৷ ভিড় এড়াতে মেয়েটা দর্শক-চেয়ারেই বসে থাকে ৷ তার মাথার ওপরে একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছে ৷ মেয়েটার চুল সেই বাতাসে উড়ছে ৷ আজাদ এগিয়ে যায় তার কাছে, গলার স্বর ঠিকমতো বেরুতে চাইছে না, একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে যথাসম্ভব স্মার্টভাবে সে বলে, ‘আপনি গাইলেন, আপনি জানেন না কেমন করে কী দিয়ে সাজবেন, কিন্তু খুব সুন্দর করে সেজেছেন ৷’
মেয়েটা সপ্রতিভ ৷ হাত দিয়ে উড়ন্ত কেশদাম শাসন করতে করতে সে বলে, ‘ওমা ৷ গাইলাম গান, প্রশংসা করলেন সাজের ৷ ব্যাপার কী ? গান বুঝি ভালো হয়নি ?’
‘আরে না ৷ গানও ভালো হয়েছে ৷ বোঝেনই তো, কত দিন পরে নিজের দেশের গান শুনলাম ৷ আপনি কি ফার্স্ট ইয়ারে ?’
‘হ্যাঁ ৷ আপনি ?’
‘সেকেন্ড ইয়ার চলছে ৷ কেমন লাগছে ?’ আজাদ বলে ৷
‘উর্দু বুঝতে কষ্ট হচ্ছে ৷’
‘আমারও খুব হয় ৷ স্যাররা ভালো পড়ায়, কিন্তু কেন যে উর্দুতে পড়ায়, বুঝি না ৷ ইংলিশে পড়ালে কিন্তু বুঝতাম ৷ চা নেবেন না ?’
‘নেব ৷ ভিড়টা একটু কমুক ৷’
‘চলেন ৷ এখন নেওয়া যাবে ৷’
মেয়েটা ওঠে ৷ হাতব্যাগটা কাঁধে ঝোলায় ৷
‘ঢাকায় কোথায় বাসা আপনার ?’ আজাদ জিজ্ঞেস করে ৷
‘পুরানা পল্টন ৷’
‘পুরানা পল্টন কোন বাসাটা বলেন তো!’
‘ওই যে পানির ট্যাঙ্কটা আছে না, ওখানে ৷’
‘ও ৷’
‘আপনাদের বাসা কোথায় ?’
আজাদ বিপদে পড়ে ৷ কোন বাসার কথা বলবে ৷ শেষে বলে, ‘ফরাশগঞ্জ ৷’ আজাদ কেতলি থেকে চা ঢালে পেয়ালায় ৷ মেয়েটিকে এগিয়ে দেয় ৷ নিজে নেয় এক কাপ ৷ তারপর দুজনে এক কোণে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে ৷
আর বেশি গল্প করা যায় না ৷ অন্য ছাত্ররা এসে পড়ছে ৷ চা নিয়ে সামুচা নিয়ে আশপাশে দাঁড়িয়ে পড়ছে ৷ মেয়েটাও তার পরিচিতজন, ক্লাসমেটদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছে ৷ আজাদ চায়ের কাপ হাতে তার বন্ধুদের দিকে এগিয়ে যায় ৷
বাশার, রানা, কায়েসরা সব একসঙ্গে ৷ তাদের সঙ্গে গল্পগুজবে নিজেকে নিয়োজিত করে সে ৷
বাশার বলে, ‘আজাদ, তোমার সাথে আগে থেকেই আলাপ ছিল নাকি মিলির ?’
আজাদ বলে, ‘হ্যাঁ ৷ ওই তো পুরানা পল্টনে বাসা ৷ আপনি চিনবেন ৷’
বাশার বলে, ‘আমি চিনব কী করে! টাঙ্গাইলে বাড়ি হলে না চিনতাম ৷’
আজাদ বলে, ‘আমি ওদের বাসায় আগেও গেছি ৷ ওর মাকে খালাম্মা বলে ডাকি!’
মেয়েটা কাছে আসে ৷ আজাদ বলে, ‘শোনেন, আপনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিই, ইনি হলেন আবুল বাশার, আর ইনি হলেন রানা ৷ আর ইনি মিলি ৷ খুব ভালো গান করেন ৷ ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছেন ৷’
মিলি বলে, ‘তা তো হলো ৷ কিন্তু আপনি তো আপনার নামটাই বললেন না ৷ নিজের পরিচয়টা আগে দেন ৷
‘আমার নাম আজাদ ৷’
‘ঠিক আছে ৷ আপনার নামটা জানার জন্যেই আমি আবার এদিকটায় এলাম ৷’
মিলি চলে যায় ৷ রানা আজাদের গায়ে চাপড় মেরে বলে, ‘তুমি তো দেখি এক নম্বরের গুলবাজ, উনি তোমার নামই জানেন না, আর বলছ বাসায় অনেকবার গেছ ৷’
‘গেছি ৷ কিন্তু ও আমার নাম ভুলে গেছে ৷’
মিলির সঙ্গে দেখা হওয়ার পর, কথা হওয়ার পর, আজাদের নিজেকে কেমন যেন তুচ্ছ লাগতে শুরু করে ৷ মনে হয়, এ জীবনের কোনো মানে নাই ৷ মনে হয়, ইস্ আবার যদি তার দেখা পাওয়া যেত! আবার কবে বাঙালি সমিতির অনুষ্ঠান হবে ? সে মনে মনে মিলির সঙ্গে কথা বলে ৷ রাতের বেলা বই নিয়ে পড়ছে, খানিকক্ষণ পর হুঁশ হয়, আসলে সে পড়ছে না, মিলির কথা ভাবছে ৷ সে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে নিজের অজান্তেই খুঁজতে থাকে মিলিকে ৷ যদি আরেকবার মিলির দেখা পাওয়া যায়!
দেখা না পাওয়ার কোনো কারণ নাই ৷ ওদের ক্লাস যেখানে হয় সেখানে দু-একবার ঘুরঘুর করতেই মিলিকে করিডরে দেখতে পাওয়া যায় ৷ কী আশ্চর্য, মেয়েটা তার চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আজাদের বুক কাঁপতে থাকে ৷
‘কেমন আছেন ?’ আজাদ গলায় যথাসম্ভব জোর এনে বলে ৷
মিলি চোখ তুলে তাকায় ৷ বাংলায় তার সঙ্গে কথা বলে কে রে ? আরে, এ তো সেদিনের ছেলেটা ৷ বাহ্ ৷ আজকে তো আরো চমৎকার পোশাক পরে এসেছে! মিলি মনে মনে তারিফ করে ৷
‘ভালো ৷ আপনি ভালো ?’ মিলি বলে ৷
‘আছি ৷ আপনার আরো ক্লাস আছে ?’
‘না ৷ ক্লাস শেষ ৷ বাসায় চলে যাব ৷’
‘বাসাটা কোন দিকে যেন ?’
‘পিইসিএইচ ৷ আমার খালার বাসা ৷ ওদের সঙ্গে থাকি আমি ৷’
‘আরে, ওদিকে তো আমিও যাব! ওখানে আমার এক বোনের দেবর থাকেন ৷’
‘চলেন তাহলে ৷ আমি একটা বাস ধরব ৷’
‘আমিও ৷’
বাসস্টপেজে দুজন গিয়ে দাঁড়ায় ৷ আজ রোদটা ভীষণ চড়া ৷ মিলি বলে, ‘আমি যদি ছাতা বের করি, আপনি মাইন্ড করবেন না তো ?’
‘না ৷ মাইন্ড করব কেন! রোদ লেগে আপনার রঙ ময়লা হলে তো জাতীয় ক্ষতি!’
‘মানে ?’
‘মানে বাঙালি মেয়ে তো এখানে বেশি নাই ৷ আপনি আছেন ৷ আপনাকে দেখতে সুন্দর লাগলে আমরা সব বাঙালি ছেলেরাই সেটা নিয়ে গর্ব করতে পারি ৷ আপনার রঙ যদি একটু রোদে পুড়ে যায়, তাহলে সেটা আমাদের ন্যাশনাল লস না!’
‘আপনি তো বেশ সুন্দর করে কথা বলেন ৷ মেয়ে-পটানো কথা ৷ কার কাছ থেকে শিখেছেন ?’
‘মনে হয় জন্মগত প্রতিভা ৷’ আজাদ হাসতে হাসতে বলে বটে, তবে তার এই প্রতিভাটার জন্যে সে তার জন্মদাতা পিতাকেই কৃতিত্ব দিতে প্রস্তুত আছে ৷
দুজনে এক বাসে ওঠে ৷ গল্প করতে করতে যায় ৷ একই স্টপেজে নামে তারা ৷ মিলি বলে, ‘আপনি কোন দিকে যাবেন ?’
আজাদ বলে, ‘এই তো এই রাস্তা ৷ সামনের দুটো লেন পরেই বাসাটা ৷’ আজাদ তাড়াতাড়ি করে যা হোক একটা কিছু বলে ৷
মিলি বলে, ‘আমি তো যাব উল্টো পথে ৷ আসবেন আজকে আমাদের বাসায় ?’
মনে মনে আজাদ বলে, ‘যাব, একশবার যাব’; মুখে বলে, ‘না, আজ না ৷ আরেক দিন ৷ আসি!’
তারপর সামনে গিয়ে একটা বাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে, চুপিসারে তাকিয়ে থাকে মিলির চলে যাওয়ার দিকে, তার মনে হয়, প্রতিটা পদক্ষেপে মেয়েটা সমস্তটা পথকে ধন্য করে দিয়ে চলে যাচ্ছে, তার মনে হয়, ওই পথের ধুলোগুলোও কতটা ধন্য হয়ে যাচ্ছে তার পদস্পর্শ পেয়ে ৷ মিলি অদৃশ্য হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে সে উল্টো পথে হেঁটে আবার ফিরে যায় বাসস্টপেজে ৷ কিসের বোন, আর কিসের দেবর ?
আবার বাঙালি সমিতির অনুষ্ঠান করার জন্যে আজাদ মরিয়া হয়ে উঠেছে ৷ আসলে এই সুযোগে সে যেতে চায় মিলিদের বাসায় ৷ তাকে অনুষ্ঠানে গান গাইতে বলতে ৷ তা ছাড়া একটা কোরাসও রাখা উচিত ৷ ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ গানটা হতে পারে ৷ তা কোরাস গাইতে হলে তো রিহার্সাল লাগবে, নাকি!
এইসব ছুঁতোয় আজাদকে যেতে হয় মিলির বাসায় ৷ মিলির খালার সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে ৷ খালা জানতে চান আজাদের সম্পর্কে ৷ তার বাবার নাম ৷ আজাদ জানায় ৷ সঙ্গে সঙ্গে মিলির খালা ঝলমলিয়ে ওঠেন : ‘ইউনুস চৌধুরীর ছেলে তুমি ? বাপরে!’
আজাদ চলে গেলে খালা শতমুখে বলতে থাকেন, ‘উরে বাবা ৷ মিলি তুই জানিস না ওরা কত বড়লোক ৷’
মিলি রোজ ক্লাস শেষে বাঙালি সমিতির রিহার্সালে আসে ৷ আজাদ মিলিদের ক্লাসের সামনে থেকে তাকে নিয়ে আসে ৷ মিলির রিহার্সাল শেষ হলে তাকে বাসস্টপেজ পর্যন্ত এগিয়ে দেয় ৷
বাশার, রানা, কায়েস-আজাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আজাদকে ধরে ৷ ‘আজাদ, তুমি তো কিল্লা ফতে করে দিয়েছ, আমাদের খাওয়াও ৷’
‘খেতে চাইলে খাবে ৷ এর সাথে অন্য কোনো কিছুকে মিলিও না ৷’ আজাদ জবাব দেয় ৷
‘মিলিও না মানে কী’ ? রানা বলে, ‘মিলিও না নয়, কথাটা হবে মিলি ও হ্যাঁ ৷’
খাওয়ানোর বেলায় মায়ের মতোই দিলদরিয়া আজাদ ৷ সোৎসাহে বন্ধুদের নিয়ে যায় গ্রান্ড জাহাঙ্গীর হোটেলে ৷ কাবাব-তন্দুর খাইয়ে দেয় ভরপেট ৷
মাকে চিঠি লিখে মিলির কথা জানায় আজাদ ৷ মা ছাড়া এ পৃথিবীতে কে আছে আর তার! তাঁকে তো অবশ্যই তার জীবনের সব কথাই বলতে হবে ৷
মা মনে মনে খুশিই হন ৷ ছেলের বউয়ের জন্যে তিনি অনেক ভরি গয়না আলাদা করে রেখে দিয়েছেন ৷ এগুলো বউয়ের হাতে দিতে পারলে না তাঁর শান্তি!
কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই ক্লাসে আসা বন্ধ করে দেয় মিলি ৷ কী ব্যাপার ? মিলির কী হলো ? অসুখ-বিসুখ ? আজাদের বুক কাঁপে ৷ দুদিন মিলিকে না দেখে ভেতরে ভেতরে দারুণ অস্থির বোধ করে সে ৷ তারপর সে যায় মিলির খালার বাসায় ৷ দরজায় নক করে ৷ মিলির খালা তাকে বৈঠকখানায় বসতে দেন ৷ তারপর দরজায় দাঁড়িয়ে দু হাতের আঙুল কচলাতে কচলাতে বলেন, ‘বাবা, এসেছ ৷ খুব ভালো করেছ ৷ তোমাকে তো একটা কথা বলাই হয়নি ৷ মিলির তো বিয়ে হয়ে গেছে ৷ হঠাৎই ভালো সম্বন্ধ এসেছে ৷ বিয়ে দিয়ে দিয়েছি ৷ ছেলে বাঙালি ৷ লাহোরে পোস্টিং ৷’
আজাদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে ৷ নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে, ‘আশ্চর্য তো ৷ মিলি আমাকে কিছুই বলল না ৷’
‘বলবে কী করে ? ও জানে নাকি! আমরাই জানি না ৷ মেয়ে দেখার কথা বলে ওরা এসেছিল ৷ পছন্দ হয়ে গেছে ৷ বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে গেছে ৷ নাও মিষ্টি খাও ৷ ওর বিয়ের মিষ্টি ৷’
ব্যাপার আজাদ এটুকুনই শুধু জানতে পারে ৷ বেশি কিছু নয় ৷ কিন্তু এর-ওর মাধ্যমে আজাদের বন্ধুরা জেনে যায়, আজাদের বাবা যে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন, এই খবর, আর তার বাবার সঙ্গে আরো আরো মেয়ের সম্পর্ক আছে-এ ধরনের গুজব মিলিদের বাসায় গিয়ে পৌঁছেছিল ৷ মিলির বাবা-মা তাই চাননি আজাদের সঙ্গে মিলির কোনো সম্পর্ক হোক ৷ সে কারণেই তড়িঘড়ি করে মিলিকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে ৷ আজাদকে জানতেও দেওয়া হয়নি ৷
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ বেধে যায় ৷ করাচিতে ব্লাক আউট হয় মাঝে মধ্যেই ৷ আজাদের এই অন্ধকার সহ্য হয় না ৷ অন্ধকার হলেই তার মনে পড়ে যায় মিলির কথা ৷ মেয়েটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলত ৷ তার দু চোখে সে দেখতে পেয়েছিল মুগ্ধতা ৷ এমনকি আজাদের মধ্যে কী কী দেখে সে পটে গেছে, এসব নিয়েও সে কথা বলেছিল ৷ তা বলে সে হঠাৎ এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারল! মেয়ে মাত্রই কি অভিনেত্রী! শুধু মিলি প্রসঙ্গ নয়, তার খারাপ লাগে যখন মনে পড়ে পরীক্ষার রেজাল্ট ৷ পরীক্ষা সে তত খারাপ দেয়নি, কিন্তু তার রেজাল্ট তেমন ভালো হয়নি ৷ এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না ৷ স্যাররা কি বাঙালি বলে তাকে কম নম্বর দিয়েছেন ? এটা কি হতে পারে! তাও কি হয়! তার খারাপ লাগে ৷ চারদিকে অন্ধকার ৷ ইন্ডিয়ান বিমান আসবে, এই ভয়ে ৷ মরার বিমান আসে না কেন ? কেন মাথায় বোমা মেরে সবকিছু ধ্বংস করে দেয় না! একটা মোমবাতি জ্বালাবে নাকি সে ? না ৷ জ্বালাবে না ৷ এই অন্ধকারই তার ভালো লাগে ৷
আজাদ নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে আরো বেশি করে বাঙালি সমিতি আর বাংলা ক্লাবের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে ফেলে ৷
পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর ভারত-বিরোধিতার ধুয়া তুলে রেডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে শুরু করে হিন্দু লেখকদের গান প্রচার করা, দেশে ভারতীয় বই আমদানি করা ইত্যাদি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হতে থাকে ৷ সিনেমা হলে আর আসবে না উত্তম-সুচিত্রার ছবি ৷ এরই প্রেক্ষাপটে আসে ২১শে ফেব্রুয়ারি ৷ পূর্ব পাকিস্তানে ২১শে ফেব্রুয়ারি মহাসমারোহে পালিত হচ্ছে শুনতে পেয়ে করাচিতেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছেলেরা বাঙালি সমিতির মাধ্যমে জোরেশোরে ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠান পালন করে ৷ দুদিন অনুষ্ঠান হয় ৷ এক দিন ছিল আলোচনা অনুষ্ঠান ৷ আরেক দিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ৷ দুদিনই অনুষ্ঠান শুরু হয় আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গান দিয়ে ৷
আজাদ এ অনুষ্ঠান নিয়ে একটু বেশিই মাতামাতি করে ৷ ক্লাস করার সময় তো সে পায়ই না, মাকে চিঠি লেখার সময়ও সে করে উঠতে পারে না ৷ পরে, ২৬শে ফেব্রুয়ারিতে সময় করে নিয়ে মাকে সে লেখে :
মা,
চিঠির উত্তর দিতে অনেক দেরি হয়ে গেল ৷ মাফ কেরো ৷ একে ত পরীক্ষা কাছে অর্থাৎ ১২ জুন শুরু হবে ৷ এদিকে ২১ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি সমিতির দুইটা ফাংকশন করতে হয়েছে ৷ তাই চিঠি লেখার এমনকি ক্লাস করার সময় পাই নাই ৷ যা হোক, আমি এখন ভালোই আছি ৷ পড়াশুনা শুরু করি নাই ৷ করব ৷ দোয়া কোরো ৷ তুমি কেমন আছ, চিঠির উত্তরে জানাইও ৷ খাওয়া-দাওয়া ঠিকমত কোরো ৷ এবং বসন্তের টিকা মনে করে নিও ৷
আর সেই যে একটি মেয়ের কথা লিখেছিলাম, ওর বিয়ে হয়ে গেছে ৷ জীবনের একটা বিরাট দিক আমি হারালাম, আর পাব না ৷ আমি বুঝতে পারছি না আমার সব ব্যাপারে কপাল খারাপ! জীবনে শান্তি বোধহয় মৃত্যু পর্যন্ত পাব না ৷ দোয়া কোরো যেন কিছু মনে শান্তি পাই ৷ চারদিক থেকে অশান্তি আমাকে ঘিরে রেখেছে ৷ যা হোক, এখন আসি ৷
ইতি তোমার আজাদ
এ চিঠির জবাবে মা লেখেন, ‘ফাংশন নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার দরকার নাই ৷’ আজাদকে তিনি মনে করিয়ে দেন, করাচিতে তাকে পাঠানো হয়েছে লেখাপড়া করার জন্যে ৷ ভালো রেজাল্ট করার জন্যে ৷ অন্য কোনো কিছু করে সে যেন সময় নষ্ট না করে ৷ মা আরো লেখেন, ‘পড়াশোনা করে মানুষ হয়ে তুমি মাকে খাওয়াবে, পরাবে ভালো রাখবে, এ আশায় আমি তোমাকে পড়তে বলছি না ৷ তোমার নিজের জন্যেই তুমি পড়াশোনা করবে ৷ ভালো রেজাল্ট করবে ৷ মানুষের মতো মানুষ হবে ৷ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে ৷’

১৪. মা

চৌধুরী সাহেব আজাদকে করাচি পাঠিয়েছিলেন আসলে দুটো উদ্দেশ্যে ৷ এক. ছেলের ভালো লেখাপড়া হোক ৷ দুই. আজাদের মা দুর্বল হোক ৷ প্রথমটা হয়তো ভালোই চলছে, কিন্তু দ্বিতীয়টা ? সাফিয়া বেগম কি তাঁর বশ্যতা স্বীকার করবে না! তাঁর পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করবে না! ফরাশগঞ্জের বাসা থেকে এসে এই ইস্কাটনের বাসায় উঠবে না! তাহলে কীভাবে তাকে বশ্যতা স্বীকার করানো যায় ? তাঁর কুবুদ্ধিদাতারা পরামর্শ দিল, ‘এই সুযোগ, আজাদের মাকে ফরাশগঞ্জের বাসা থেকে উচ্ছেদ করে দিন ৷ বাসা ভাড়া নিয়ে থাকুক ঢাকায়, সব তেজ গলে পানি হয়ে যাবে ৷ বাপ বাপ করে চলে আসবে আপনার পা ধরে ভিক্ষা মাগতে ৷ ও ভেবেছে কী! সম্পত্তিগুলো সব ওর নামে বলে ওগুলোর মালিক ও হয়ে গেল! ও যা খুশি তা করতে পারবে! ওকে একটু বোঝানো দরকার যে ঢাকা শহরটা এখনও চৌধুরীর কথায় চলে ৷ চৌধুরী যা চাইবে, তা-ই হবে ৷’
চৌধুরী এক রাতে আসেন ফরাশগঞ্জের বাসায় ৷ নিচের ঘরে বসেন ৷ আজাদের মা তখন এশার নামাজ পড়া শেষে তেলাওয়াত পড়ছিলেন ৷ তাঁর কাছে দৌড়ে যায় জায়েদ ৷ ‘আম্মা আম্মা, আজাদ দাদার আব্বা আইছে ৷’
‘কে ?’
‘চৌধুরী সাবে ৷’
‘কেন এসেছে ? তাকে যেতে বল ৷ তুই বের হ ঘর থেকে ৷ আমি দরজা আটকে দেব ৷ তুই গিয়ে বল আমি দেখা করব না ৷’
জায়েদ নিচে নামে ৷ চৌধুরী সাহেবকে জানায় সাফিয়া বেগমের বক্তব্য : ‘এক্ষুন আপনেরে চইলা যাইতে কইছে, ঘরে খিল দিছে, আর কইছে, জীবনেও আপনের মুখ দেখব না ৷’
চৌধুরী বলেন, ‘জায়েদ, শোনো, আজাদের মাকে বলো, সাত দিন সময় দিলাম, সাত দিনের মধ্যে আমার সাথে দেখা করে আমার পায়ে ধরে মাফ না চাইলে আমি এই বাড়ি থেকে সবাইকে তাড়িয়ে দেব ৷ বুঝলে ?’
জায়েদ চুপ করে থাকে ৷
‘বোঝো নাই ৷ তোমার আম্মাকে বলবা আমার সাথে দেখা করে মাফ চাইতে ৷ না হলে এ বাসা থেকে বের করে দেব ৷’ চৌধুরী সাহেব গটগট করে চলে যান ৷
আজাদের মা সব শুনতে পান জায়েদের কাছ থেকে ৷ কিন্তু তিনি অনন্যোপায় ৷ কী করবেন ? চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করার প্রশ্নই আসে না ৷ মাফ চাওয়া ? জীবন থাকতে নয় ৷ আর এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ? যেতে হলে যাবেন ৷
আজাদকে খবর পাঠানো যায় ৷ সেটাও উচিত হবে না ৷ কারণ তার পরীক্ষা চলছে ৷
একদিন সত্যি সত্যি গুণ্ডাপাণ্ডা চলে আসে ফরাশগঞ্জের বাসায় ৷ এ বাসা ছাড়তে হবে ৷ আজই ৷ এখনই ৷
আজাদের মা রুখে দাঁড়ান, ‘ফাজলামো পেয়েছ তোমরা, এটা আমার বাসা, কেন আমি বাসা ছাড়ব, ছেড়ে পাঁচ-পাঁচটা ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় যাব ?’
গুণ্ডারা বলে, ‘এটা যে আপনার বাড়ি, কোনো প্রমাণ আছে ?’
প্রমাণ তো সাফিয়া বেগম সঙ্গে রাখেননি ৷ ইস্কাটনের বাড়ি, এ বাড়ি, গেন্ডারিয়ার আরো আরো সম্পত্তি সব তাঁর নামে ৷ এটা তিনি জানেন ৷ কিন্তু দলিল তো একটাও তাঁর কাছে নাই ৷ আর এদিকে গুণ্ডারাও কোনো কথা শুনছে না ৷ তারা জিনিসপত্র ধরে একটা একটা করে নিচে রাস্তায় নামিয়ে দিচ্ছে ৷ আজাদের মায়ের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় ৷ কিন্তু মাথা গরম করলে তো চলবে না ৷ উপায় একটা বের করতে হবে ৷ তিনি বের হন ৷ পাশের একটা বাসায় গিয়ে ফোন করেন পুলিশের ডিআইজি আলম সাহেবকে ৷ আলম সাহেব লোক ভালো, তাঁর পূর্বপরিচিত, আর তাঁর গত ক বছরের দুর্দিনে তিনি মাঝে মধ্যে এসে খোঁজখবর নিয়ে গেছেন ৷ আলম সাহেবকে পাওয়া যায় ৷ তিনি ঘটনা শোনেন ৷ এক্ষুনি কী করা যায় তার উপায় করবেন বলে আশ্বাস দেন ৷ কিন্তু তাঁর পক্ষেও বেশি দূর তৎপরতা করা সম্ভব হয় না ৷ ইউনুস চৌধুরীর সখ্য গভর্নর মোনায়েম খাঁ পর্যন্ত, তিনি দাবি করেছেন এই বাড়ি তাঁর, আর সাফিয়া বেগম এটায় অন্যায়ভাবে জোর করে বসবাস করছে ৷ তাদের হটিয়ে দেওয়াটাই হলো ন্যায় ৷ ডিআইজি আলম সাহেব ফরাশগঞ্জের বাসায় চলে আসেন ৷ তিনি উচ্ছেদ করতে আসা গুণ্ডাপাণ্ডাদের বলেন কোনো রকমের জুলুম জবরদস্তি না করতে ৷ গুণ্ডারা বলে, ‘এটা আপনাকে কইয়া দিতে হইব না, আমগো ওপর হুকুম আছে, আমরা কাউরে অপমান করুম না ৷’ আলম সাহেব সাফিয়া বেগমকে জানান তাঁর ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কথা, ক্ষমা চান তাঁর কাছে ৷ সাফিয়া বেগম বলেন, ‘এখন এই ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে আমি কই যাব ৷ একটা বিহিত করে দেন ভাই ৷’
আলম সাহেব বলেন, ‘ঠিক আছে, আমি দেখছি কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া যায় কি না ৷’
জুরাইনের মাজারের সামনে একটা ছোট্ট বাসা খালি পাওয়া যায় ৷ রাস্তার ওপর সব জিনিসপাতি ছড়ানো, উপায়ান্তর না পেয়ে সাফিয়া বেগম জুরাইনের বাসায় এসে ওঠেন ৷ টিনের ঘর ৷ মেঝেটা অবশ্য পাকা ৷ সেটাই কিছুটা সান্ত্বনা ৷ দুটোমাত্র ঘর ৷ তার মধ্যে এতগুলো মানুষ ৷ কোনো আসবাবপত্র নাই ৷ থালা-বাসন হাঁড়ি-পাতিল কিছু আনা গেছে ৷ তাতে রান্না চড়াতে হয় ৷ আবার গয়নার বাক্সে হাত দেন সাফিয়া বেগম ৷ আলম সাহেব অবশ্য কিছু টাকা ধার দিয়ে গেছেন ৷ তাঁরই লোক দিয়ে দুটো সস্তা খাট আর এটা-সেটা জিনিসপাতি কেনানো হয় ৷
জায়েদের বড় কান্না পায় ৷ সে হঠাৎ করে আবার, যেমন তার হয়েছিল মায়ের মৃত্যুর পরে, সবকিছুকে নীল দেখতে থাকে ৷ জুরাইনের এই উপশহর ধরনের পরিবেশ, চিকন রাস্তা, ঘিঞ্জি হয়ে উঠতে থাকা ঘরবাড়ি, আর তাদের ভাড়া করা এই ছোট্ট বাসা সব যেন নীল ৷ নিজেকে তার মনে হয় বড় অভাগা ৷ তার মা নাই ৷ বাবা থেকেও নাই ৷ খালার কাছে আছে তারা, আর খালার ওপর একে একে কত গজব নেমে আসছে ৷ এই এতটুকুন ফকিরের বাড়ির মতো বাড়িতে তারা থাকবে কেমন করে!
দিন যায় ৷ তারা জুরাইনের বাসা ছেড়ে আরেকটু ভালো দেখে একটা বাড়িতে ওঠে মালিবাগ মসজিদের সামনে ৷ এখানে তবু আজাদকে রাখার একটা পরিসর মিলবে ৷
সাফিয়া বেগম কিন্তু আজাদকে তাঁর এইসব বিপর্যয়ের কথা কিছুই জানতে দেন না ৷ কারণ ছেলের পরীক্ষা ৷ শুধু আজাদকে চিঠি লিখে জানান, পরীক্ষা শেষে সে যেন প্রথমে তার বাবার কাছে যায়, দাদা-দাদির কাছে যায়, তাঁদের সালাম করে ৷ কারণ এটাই হলো সাফিয়া বেগমের জীবনের বড় বিজয় যে তাঁর ছেলেকে তিনি লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে পেরেছেন ৷
পরীক্ষা শেষ করেই আজাদ ছুটে আসে ঢাকায় ৷ উফ্ ৷ কী দম বন্ধ করা সময়ই তার গেছে এই করাচির দিনগুলোতে ৷ মধ্যখানে সে অবশ্য ছুটিছাটায় এসেছে দুবার ৷ প্লেনের টিকেটের দাম বেশি হওয়ায় ঘন ঘন আসা সম্ভব হয় নি ৷ এসে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করা, আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি করতে না করতেই আবার এসে গেছে ফিরে যাওয়ার তারিখ ৷ এবার সে ছুটি পাবে বেশ কিছু দিনের জন্যে ৷ গ্রাজুয়েশনের জন্য পরীক্ষা হয়ে গেল ৷ এরপর মাস্টার্স ৷ বিমান যখন ঢাকা এয়ারপোর্টের রানওয়ে স্পর্শ করে, সঙ্গে সঙ্গে এক অনাবিল আনন্দে আজাদের হৃদয় ওঠে ভরে ৷ সে নিজে নিজেই হেসে ওঠে ৷
মাকে সে চিঠি লিখেছিল ফেরার দিনক্ষণ জানিয়ে ৷ সেটা সে লিখেছিল ফরাশগঞ্জের ঠিকানায় ৷ জায়েদ পোস্টম্যানকে বলে রেখেছিল, সাফিয়া বেগমের নামে কোনো চিঠি এলে যেন মালিবাগের বাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় ৷ আজাদ তো আর সেটা জানে না ৷ সে এয়ারপোর্টে দেখতে পায় জায়েদ দাঁড়িয়ে ৷ জায়েদ ‘দাদা দাদা’ বলে জড়িয়ে ধরে আজাদকে ৷ আর আজাদকে দেখা যাচ্ছে কত সুন্দর ৷ ফিটফাট পোশাক, গলায় টাই ঝুলছে, জায়েদের কিছুটা অস্বস্তি লাগে, ভেতর থেকে শ্রেণীভেদটা একটুখানি উঁকি দেয় ৷ কিন্তু সেও সাময়িক ৷ আজাদ দাদা তার আগের মতোই আছে ৷
‘চল চল, একটা ট্যাক্সি নিয়ে চল বাসায় যাই ৷ মা নিশ্চয় অস্থির হয়ে আছে ৷ ফ্লাইটটা একটু ডিলে হয়েছে তো’-আজাদ তাড়া লাগায় ৷
তারা এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসে ৷ ট্যাক্সি ভাড়া করতে হবে ৷
প্রত্যেকবার এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে এই জায়গাটায় দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কী এক ভালো লাগায় আজাদের অন্তরটা ভরে ওঠে ৷ এই নীল আকাশ, ওই সবুজ গাছ, এই বেবিট্যাক্সি আর ট্যাঙ্অিলাকে তার কতই না আপন বলে মনে হচ্ছে ৷
জায়েদ ট্যাক্সিওয়ালাকে বলে, ‘যাইব, ইস্কাটন ?’
‘ক্যান রে, ইস্কাটন ক্যান ৷ ফরাশগঞ্জ যাব’-আজাদ বলে ৷
‘আম্মা আপনেরে ইস্কাটনে উইঠা রেস্ট-টেস্ট লইয়া তারপরে যাইতে কইছে আমগো বাড়ি’-জায়েদ বলে ৷
‘আমাকে রেস্ট নিতে হবে ইস্কাটনে ? কী যে বলিস না তুই ৷ চল চল ফরাশগঞ্জ ৷’
জায়েদ কী বলবে আজাদকে ? তারা যে ফরশগঞ্জের বাসা থেকে বিতাড়িত, এটা তো আজাদ জানে না ৷ তাকে জানানোর কাজটা কে করবে ?
ট্যাক্সি চলছে ৷
আজাদ দু চোখ ভরে দেখে ঢাকা শহর ৷ আহ্, সেই পরিচিত রাস্তাঘাট ৷ ফার্মগেট, কাওরানবাজার ৷ সেই রিকশা, সেই ইপিআরটিসির বাস ৷ সেই গরিব গরিব ট্রাফিক পুলিশের মুখ ৷
‘দাদা, আম্মায় কইছে আগে ইস্কাটনে গিয়া আপনে দাদা-দাদিরে সালাম করবেন ৷ তারপর বিকালবেলা আমি আইসা আপনারে আমগো বাড়িতে নিয়া যামু ৷’
‘আরে, কথা বেশি বলিস কেন ৷ এই চলো সোজা ফরাশগঞ্জ ৷’
জায়েদ তো আজাদের সঙ্গে তর্ক করতে পারে না ৷ খানিক পরে সে বলেই দেয়, ‘দাদা, আমরা তো আর ফরাশগঞ্জ থাকি না, মালিবাগ থাকি ৷’
‘কেন ?’
‘আমগো তাড়ায়া দিছে ৷’
‘কে ?’
‘গুণ্ডাপাণ্ডা আইসা ৷’
‘কী বলিস ?’
‘জুরাইনে একটা টিনের ঘর ভাড়া লইছিলাম ৷ সেইখানে থাকনের মতো অবস্থা ছিল না ৷ সেইখান থাইকা অহন আইয়া পড়ছি মালিবাগ ৷ মসজিদের সামনে ৷’
আজাদ গম্ভীর হয়ে যায় ৷ তার মুখ দিয়ে আর কোনো রা সরে না ৷
মালিবাগের বাসার কাছে গলির মুখে ট্যাক্সি এসে থামে ৷ এর পরে আর ট্যাক্সি যাবে না ৷ জায়েদ তার সুটকেস নিয়ে আগে আগে হাঁটে ৷ এত ছোট বাসা, আসবাবপত্র নাই বললেই চলে, গলির ভেতরে ঢুকতে হয়, এসব দেখে সে ভড়কে যায় ৷ মা কিন্তু হাসিমুখে তাকে বরণ করেন ৷
আজাদ গম্ভীর স্বরে বলে, ‘তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে, আমাকে বলো নাই কেন ?’
মা হাসেন ৷ বলেন, ‘তোর পরীক্ষা ছিল না বাবা! এটা এমন কি! এই বাসা তো খারাপ না ৷ চৌধুরী চেয়েছিল আমাদের হার মানাতে ৷ ভেবেছিল বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথা বললে আমি তার পায়ে গিয়ে পড়ব ৷ আমি তো সেই পদের না ৷ আমি যাইনি ৷ আমারই জিত হয়েছে ৷’
‘কিন্তু তোমাদের গুণ্ডা দিয়ে তাড়িয়ে দিল, তার এত বড় সাহস ৷ আমার রিভলবারটা এনেছ না ? কই সেটা ৷’
মা আরো শান্তভাবে হাসেন ৷ বলেন, ‘রিভলবার দিয়ে কী করবি ?’
‘আমি যাই তার কাছে ৷ গিয়ে জিজ্ঞেস করি, তার স্ত্রীকে অপমান করার আগে সে ভেবেছে কি ভাবে নাই যে তুমি আমার মা ৷ আমার মাকে অপমান করে, তার এত বড় সাহস ৷’ আজাদ উঠে পড়ে-‘ডালু কই, জায়েদ আমার রিভলবার কই ৷’
মা তার হাত ধরেন ৷ বলেন, ‘খবরদার আজাদ, মাথা গরম কোরো না, সে আমার কিছু না হতে পারে, সে তোমার বাবা ৷ স্বামী-স্ত্রী ছাড়াছাড়ি হতে পারে, কিন্তু বাপ-ছেলেতে কখনও ছাড়াছাড়ি হয় না ৷ সে তোমার বাবাই ৷ নিজের বাবাকে অপমান করতে হয় না ৷’
‘না, আমি আজকা হেরে মাইরাই ফেলামু ৷’ রাগে আজাদের মুখ দিয়ে ঢাকাইয়া বাক্য বেরুতে থাকে ৷
‘এদিকে আসো ৷ এই আমার মাথার কিরা লাগে ৷ বাপের সাথে গণ্ডগোল কোরো না ৷ এটা তার আর আমার ব্যাপার ৷ এর মধ্যে তোমার আসার দরকারই নাই ৷’
আজাদ রাগে ফোঁসে ৷ কিন্তু কিছুই আর করার নাই ৷ মা তাকে মাথার কিরা দিয়েছেন ৷ সে সবকিছু করতে পারে, মায়ের মাথার কিরার অবাধ্য তো হতে পারে না ৷ মা যে কথাটা খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বলছেন, এটা বোঝা যায় তার তুই থেকে তুমিতে নেমে আসা সম্বোধনে ৷
মা বলেন, ‘এত দিন পরে এসেছ, যাও, হাত-পা ধোও, জিরিয়ে নাও ৷ তোমার জন্যে ভাত-তরকারি রেঁধে রেখেছি ৷ খেতে বসো ৷’

 ১৫. মা

কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে আজাদ আবার চলে আসে করাচিতে ৷ এমএ-তে ভর্তি হয় ৷ একটা ব্যবসাও সে শুরু করে সেখানে ৷ ব্যবসায় সে ভালো করবে, এই রকম আশা তার ছিল ৷ এ সময় সে মাকে মাঝে মধ্যে টাকা পাঠাত ৷ মাকে সে চিঠি লিখত নিয়মিত, আর সেসব চিঠিতে মাকে বারবার করে অনুরোধ করত মা যেন তাঁর শরীর ও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেন ৷ লিখত, মা যেন টাকার জন্যে চিন্তা না করেন ৷ দরকার হলেই যেন ব্যাঙ্ক থেকে সোনা তুলে মা বিক্রি করে দেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যয়নির্বাহ করেন ৷ সে লিখেছিল : ‘টাকার দরকার হলে যদি তুমি বিক্রি না করো, তবে আমি দুঃখিত হব ৷ এইসব গয়না কারু জন্যে রাখতে হবে না ৷ এই আমার অনুরোধ ৷’ কিন্তু মা সোনায় হাত দিতে চাইতেন না ৷ এই সোনা তো আসলে আজাদের বউয়ের হক ৷ ছেলের বিয়ের সময় কনেকে সোনা দিয়ে সাজাতে হবে না!
করাচিতে হোস্টেল ছেড়ে দিয়ে একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়েছিল আজাদ ৷ মাকে লিখেছিল,
মা,
আমি ভালোই আছি ৷ আমার জন্য কোন চিন্তা করিও না ৷ চিঠি লিখতে অবশ্য দেরি হয়ে গেল ৷
দোয়া কোরো, এখনো কোনো অসুবিধা হয় নাই ৷ ব্যবসা ইনশাল্লাহ ভালোই চলবে মনে হয় ৷ আমি ছোট্ট একটা বাড়ি নিয়েছি ৷ কয়েক মাস পরে বড় বাড়ি নেব, তখন তোমাকে নিয়ে আসব ৷ আর এই মাসের শেষের দিকে তোমাকে আমি কিছু টাকা পাঠাব ৷ আগেও পাঠাতে পারি, ঠিক নেই ৷ তবে দেরি হবে না ৷ তুমি কোথায় থাকবে তখন চিঠি দিয়ে জানাইও ৷ এমএতে ভর্তি হয়ে গেছি ৷
আর বিশেষ কিছু লেখার নেই ৷ দোয়া কোরো যেন ইনশাল্লাহ ব্যবসাতে উন্নতি করতে পারি ৷
ইতি
আজাদ
ঠিকানা
AZAD
646, C, CENTRAL COMMERCIAL AREA
PECHS
KARACHI 29
এই চিঠি লিখিত হওয়ার ২০ বছর পর জায়েদ আজাদের এইসব চিঠি পড়ে, আর তার মনে নানা প্রতিক্রিয়া হয় ৷ কোনো চিঠিতে আছে, ‘মা, টাকার অভাবে তোমাকে চিঠি লিখতে পারি নাই ৷’ কী রকম অর্থকষ্টটাই সহ্য করতে হয়েছিল আজাদকে যে একটা চিঠি পোস্ট করার মতো টাকা তার ছিল না ৷ জায়েদ একটা এরোগ্রাম মেলে ধরে ৷ এটায় খাম আর চিঠি একই কাগজে লিখতে হতো ৷ তাতে বোধ করি ডাকখরচ কম পড়ত ৷
BY AIR MAIL
INLAND
AEROGRAM
If anything is enclosed this letter will be sent by ordinary mail
ইংরেজি, উর্দু আর বাংলায় লেখা পাকিস্তান ৷ পোস্টেজ ১৩ পয়সা ৷ আর তাতে টিকেটের ঘরের মতো চৌকোয় যে ছবিটা আঁকা, সেটা পূর্ব বাংলার-নারকেলগাছ, ধান বা পাটক্ষেত আর নদীতে পালতোলা নৌকা ৷
মাত্র ১৩ পয়সা জোগাড় করতেও কষ্ট হয়েছিল আজাদ দাদার!
করাচি বিশ্ববিদ্যালয়েই আজাদের পরিচয় ঘটে আবুল বাশারের সঙ্গে ৷ টাঙ্গাইলের সম্পন্ন ঘরের ছেলে বাশার ৷ পড়তে গেছে করাচিতে ৷ বাঙালি সমিতি করে ৷ সমিতির অনুষ্ঠানের জন্যে খায়খাটুনি করে ৷ আর তার আছে বই পড়ার অভ্যাস ৷ আজাদের রুমে এসে দেখে প্রচুর বই, নানা রকমের ইংরেজি উপন্যাস, বাশার ধার নেয় সেসব বই ৷ আবার সময়মতো ফিরিয়েও দেয় ৷ এভাবেই আজাদের সঙ্গে বাশারের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় ৷
বাঙালিরা যখন একত্র হয়, তখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয় ৷ শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা দাবি ঘোষণা করেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের সমাবর্তন উৎসবে মোনায়েম খানের হাত থেকে সনদ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আন্দোলন করেছে, ছাত্রদের ওপর হামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছে বহু ছাত্র, ৬ দফার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, শেখ মুজিব প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় জনসভা করে ৬ দফার পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন, আইয়ুব খান দমননীতির আশ্রয় নিচ্ছেন, শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সঙ্গে আরো আরো নেতা আর কর্মীকে, তাঁর মুক্তি ও ৬ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়েছে, হরতালে গুলি চলেছে, ঢাকা নারায়ণগঞ্জে বহু শ্রমিক হতাহত-ঘটনা ঘটতে থাকে দ্রুত ৷ এইসব নিয়ে বাঙালি ছাত্ররা তর্ক-বিতর্ক করে, বাম-ঘেঁষা ছাত্ররা মনে করে, আওয়ামী লীগ বুর্জোয়াদের দল, তাদের দিয়ে জাতীয় মুক্তি অসম্ভব ৷
ইউনুস আহমেদ চৌধুরী জার্মানি যান ৷ সেখান থেকে তিনি চিঠি লেখেন সাফিয়া বেগমকে ৷ বড়ই আবেগপূর্ণ চিঠি ৷ সাফিয়া বেগমকে তিনি সম্বোধন করেন প্রাণের পুতুল বলে ৷ তিনি তাঁর জন্যে হা-হুতাশ করেন, নিজের ভুলের কথা স্বীকার করেন, তাঁকে ছাড়া যে তার চলছে না, তিনি তিষ্ঠাতে পারছেন না, এটা তিনি বলেন বড়ই আকুল স্বরে ৷ তিনি সবকিছু ভুলে আবার সাফিয়াকে তাঁর কাছে আসতে বলেন ৷ মিনতি করেন আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করতে ৷
চিঠি পেয়ে সাফিয়া বেগম আরো কঠিন হয়ে পড়েন ৷ না, মিষ্টি কথায় ভোলা যাবে না ৷ কত কষ্ট করে ছেলেকে নিয়ে তিনি একা দিনগুজরান করছেন ৷ ছেলেকে লেখাপড়া শেখাচ্ছেন ৷ ছেলেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করিয়েছেন, আইএ পাস করিয়েছেন, বিএ পাস করিয়েছেন, এখন ছেলে এমএ পড়ছে ৷ কত কষ্টই না তাঁর হয়েছে এই কটা বছর ৷ গয়না বিক্রি করে পুঁজি জোগাড় করে ব্যবসা করতে দিয়েছেন একে-ওকে ৷ কিন্তু টাকা লগি্নই সার হয়েছে, লাভ তো দূরের কথা, তিনি আসলই ফিরে পাননি ৷ তাঁর ছেলেও কত কষ্ট করেছে ৷ টাকার অভাবে চিঠি পর্যন্ত লিখতে পারেনি ৷ শেষতক তাকে ব্যবসায় নামতে হয়েছে ৷ এত কষ্ট সহ্য করে এতটা কাঁটা-বিছানো পথ পাড়ি দিয়ে অনেক রক্ত ঝরিয়ে যখন প্রায় মসৃণ পথে তাঁরা এসে পড়েছেন, তখন কিনা তিনি নতি স্বীকার করবেন!
আমেরিকা গিয়েছিলেন ইউনুস চৌধুরী ৷ সেখান থেকেও তিনি সাফিয়াকে চিঠি লিখেছেন ভয়ানক কাকুতি-মিনতি করে ৷ লিখেছেন, ‘হাজার হাজার মাইল দূরে এক অচেনা জায়গায় বসে আর কাউকে নয়, শুধু তোমাকে মনে পড়ছে বলে তোমাকেই চিঠি লিখতে বসেছি ৷ মানুষ মাত্রই ভুল করে ৷ আমিও একটা ভুল করেছি ৷ তুমি কি আমাকে ক্ষমা করে দিতে পার না ? আমাদের আগেকার সুখের জীবনে আবার কি আমরা ফিরে যেতে পারি না ? আমি যেখানেই যাচ্ছি, প্রাণে তো সুখ পাচ্ছি না ৷ তোমাকে ছাড়া এ জীবনে আর সুখ পাব না, এটা নিশ্চিত ৷ শুধু মৃত্যুর পরে যেন হাশরের ময়দানে তোমার মুখটা আমি দেখতে পাই ৷ যেন তোমার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি ৷’
চিঠি পেয়ে সাফিয়া বেগমের সমস্ত শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায় ৷ তিনি খানিকক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকেন ৷ লোকটা এখন মৃত্যুর পরে হাশরের ময়দানে তাঁর দেখা পাবে বলে অপেক্ষা করছে ৷ নতুন বিয়ে, নতুন সম্পর্ক-এসব কিছুতে তাঁর আত্মা সুখ পেল না! পাওয়ার তো কথা না ৷ নিজের ছেলে, নিজের স্ত্রীকে ফেলে যারা অন্যের কাছে যায়, জীবনে সুখ কিংবা স্থিতি তারা কে কবে কোথায় পেয়েছে! মরীচিকার দিকে ছুটলে তো তৃষ্ণা মেটে না ৷ বরং বিভ্রান্তি আর পণ্ডশ্রমে জীবন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় মাত্র ৷
কী করবেন সাফিয়া বেগম ? ফিরে যাবেন চৌধুরীর কাছে ? ফিরে যাবেন ইস্কাটনের বাড়িতে ? কর্তৃত্ব তুলে নেবেন ওই বাড়ির! যে চিত্রা হরিণটা তাঁর হাতে সবুজ গাছের পাতা খাওয়ার জন্যে রোজ ভোরবেলা কাতর নয়নে তাকিয়ে থাকত, সে যে তাঁকে তার নীরব চোখের ভাষায় ডাকছে ৷ পোষা কুকুর টমি যে রোজ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে তাঁর ঘ্রাণ শুঁকবে বলে! গৃহপরিচারিকা জয়নব নাকি এখনও রোজ রাতে মিহি সুরে কাঁদে! আত্মীয়স্বজন আশ্রিতেরা নাকি তাঁর অনুপস্থিতির কথা ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ৷
সাফিয়া বেগমের মনটা দুর্বল হয়ে পড়ে ৷ সারা দিন তিনি ঘোরের মধ্যে থাকেন ৷ রাত্রিবেলা ভালো করে ঘুম হয় না তাঁর ৷ ভোরবেলা ফজরের নামাজ পড়ে আবার তিনি চিঠিটা মেলে ধরেন ৷ আগাগোড়া পড়েন ৷ পড়তে পড়তেই সেই নাট্যদৃশ্য আবার তাঁর চোখের সামনে ভেসে ওঠে : ষোলশ গোপিনী টানাটানি করছে কৃষ্ণরূপী চৌধুরীকে; মুহূর্তে তাঁর সমস্ত সত্তাজুড়ে নাছোড় প্রত্যাখ্যানের শক্তি জেগে ওঠে, সমস্ত আকাশ-বাতাস যেন বলে ওঠে : না ৷ তিনি ফিরে যেতে পারেন না ৷ চৌধুরীর এই হলো কৌশল ৷ এভাবেই সে একের পরে এক নারীকে মোহজালে আটকে ফেলে ৷ তাঁর এই ছল সাফিয়া বেগমের ভালো করেই জানা আছে ৷
আর তা ছাড়া তাঁর প্রতিজ্ঞার একটা দাম আছে না ? তিনি চৌধুরীকে বলেছিলেন ওই অনৈতিক সম্পর্কটাতে না যেতে, স্পষ্ট ভাষাতেই তো জানিয়েছিলেন, ওই মহিলাকে বিয়ে করার একটাই মানে, মৃত্যুর পরেও সাফিয়ার মুখ আর চৌধুরী দেখতে পাবে না ৷
সাফিয়া বেগম তাঁর স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ের পরে আরো ২৪ বছর বেঁচে ছিলেন, তিনি তাঁর কথাটা আশ্চর্য রকমভাবে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন ৷ একই শহরে তাঁরা ছিলেন ২৪টা বছর, কখনও কখনও একই পাড়াতেই, একই মাহফিলে, একই মাজারে, একই মিলাদে দুজনই গিয়েছেন, এ রকম একাধিকবার হয়েছে, কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য যে, কেউ কারো মুখ দেখতে পাননি ৷
জায়েদ এ কথা স্মরণ করে ৷ তার মনে পড়ে, আম্মা বলতেন, পাবে না রে, পাবে না, আমার মুখ সে বেঁচে থাকতে দেখতে পাবে না ৷

সাফিয়া বেগমের শরীরটা খারাপ ৷ শ্বাস নিতে কষ্ট হয় ৷ রাত্রিবেলা কাশির গমকে ঘুম আসতে চায় না ৷ একটুক্ষণ চোখ জোড়া লাগতে না লাগতেই আবার কাশির চোটে তিনি জেগে ওঠেন ৷ বুকের মধ্যে টান পড়ে ৷ তাঁর পাঁজর হাপরের মতো ওঠানামা করে ৷ হা করে তিনি শ্বাস নেন, শ্বাস ছাড়েন গোঁয়ারের মতো ৷ চোখ পানিতে ভরে ওঠে ৷ বিছানায় বসে থাকেন ৷ তাঁর অসুখটা যে বেড়েছে, এই খবর তিনি আজাদকে জানাননি ৷ খবর পেলে ছেলে উতলা হয়ে পড়বে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে ছুটে আসবে মাকে দেখতে ৷ শরীর তো যন্ত্রেরই মতো, মাঝে মধ্যে একটু বিগড়াবেই ৷ তাই নিয়ে একেবারে ডাক্তার ডাকো রে, হাসপাতালে চলো রে, আত্মীয়স্বজনদের খবর দাও রে করে জগৎটাকে আছড়ে-পিছড়ে মারার তো দরকার নাই ৷ নীরবে সহ্য করতে পারলে আর কিছুই লাগে না ৷
কিন্তু এবার ব্যারামটা তাঁকে সাঁড়াশির মতো করে চেপে ধরেছে ৷ মনে হচ্ছে, এতটুকুন শরীর এতটা ধকল এ যাত্রা আর সইতে পারবে না ৷ ডালু ডাক্তার ডেকে এনেছিল ৷ ডাক্তার ওষুধ দিয়েছেন ৷ ভালো ভালো খেতে বলেছেন ৷ অসুখ বেশি হলে, বলেছেন, হাসপাতালে নেওয়ার জন্যে ৷ কিন্তু সাফিয়া বেগম টাকা খরচ করতে চান না ৷ ব্যাঙ্কের ফোল্ডে তাঁর গয়না জমা আছে, এখন তাঁর চিকিৎসার জন্যে সেই গয়নার কিছুটা তুলে বেচতে তাঁর মন থেকে সাড়া আসে না ৷ ছেলের পড়ালেখার খরচের জন্যে টাকা খরচ করা যায়, গয়নাও বিক্রি করা যায়, কিন্তু নিজের চিকিৎসার জন্যে কি তা করা যায় ? গয়না কি তাঁর, নাকি তাঁর ছেলের বউয়ের ?
আজকের রাতটা মনে হয় আর পার হবে না-এতটাই কষ্ট হচ্ছে সাফিয়া বেগমের ৷ বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসে জলকণা উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, তাতেই তাঁর শ্বাসকষ্টটা গেছে বেড়ে ৷ একটা ওষুধ আছে, তার ভাপ মুখে টেনে নাকে নিতে হয়, দাম বেশি বলে তিনি সেটা সাধারণত ব্যবহার করেন না, সেটা এখন হাতের কাছে থাকলে ভালো হতো ৷
বিছানায় বসে থেকে অতিকষ্টে তিনি শ্বাস টানেন ৷ আজকের রাতটা কি আর পার হবে না ?
তখন তাঁর খুব আজাদকে দেখতে ইচ্ছা হয় ৷ শরীরটা তাঁর আর চলছে না, কী জানি যদি না টেকে, যদি আজ রাতেই তাঁর মৃত্যু লেখা থাকে, তাহলে তো আর আজাদের মুখটা তিনি মরার আগে দেখতে পাবেন না ৷ ছেলেকে খবর না দেওয়াটা মনে হয় ভুলই হলো!
শেষরাতে সাফিয়া বেগমের কাশির গমক খুব বেড়ে গেলে তার ভাগি্ন মহুয়ার ঘুম ভেঙে যায় ৷ সে উঠে দেখে, আম্মার প্রাণ বুঝি যায় ৷ সে ডালুকে খবর দিলে ডালু এসে সাফিয়া বেগমকে ঘুমের ওষুধ ডাব্ল ডোজ খাইয়ে দেয় ৷ কাশি তাতেও কমে না, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে, এক সময় সাফিয়া বেগম ঘুমিয়ে পড়েন ৷ ঘুমের আগে তিনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু পড়ে নেন, তাঁর মনে হয়, এই ঘুমই তাঁর শেষ ঘুম, তিনি আর কোনো দিন জাগবেন না, ঘুমের আগে তিনি আজাদের মুখটা মনে করবার চেষ্টা করেন, কিন্তু তার বড়বেলার চেহারাটা কিছুতেই তাঁর মনে আসে না, কেবল ছোটবেলায় যখন সে কেবল স্কুল যেতে শুরু করেছে, সেই সময়ের চেহারাটা মনে আসে, স্কুলের ব্যাগ কাঁধে, পায়ে কেডস, আজাদ ফিরছে…আজাদকে না দেখেই কি তাঁকে চলে যেতে হবে দুনিয়া ছেড়ে ৷ তাঁর দু চোখ গরম জলে ভেসে যেতে চায় ৷
ঘুম ভেঙে গেলে তিনি দেখতে পান, তাঁর শিয়রের কাছে বসে আজাদ, তাঁর ধন্দ লাগে ৷ তিনি কি জেগে আছেন, নাকি স্বপ্ন দেখছেন ৷ নাকি এটা ঠিক মরজগৎ নয়, তিনি অন্য কোথাও ৷ শরীর খুবই দুর্বল, জোর পাওয়া যাচ্ছে না একটুও, কিন্তু ধীর গলায় কে যেন ডাকছে, এ যে ঠিক আজাদেরই গলা ৷ তিনি চোখ খোলেন ৷ দেখেন তাঁর মুখের ওপরে আজাদের মুখ ৷ তিনি বলেন, ‘আজাদ ? কখন এলে বাবা ?’
‘এই তো এখনই ৷ তুমি ঘুমাও ৷’
মার মনটা প্রশান্তিতে ভরে ওঠে ৷ ঘুমটা চোখ থেকে পুরোপুরি উবে যায়, তিনি উঠে বসার চেষ্টা করেন ৷ স্বপ্নের মতোই মিষ্টি একটা ব্যাপার ঘটে গেল, তাঁর আজাদ এসে বসে আছে তাঁরই শিয়রের কাছে ৷ মায়ের মনের ডাক সে নিশ্চয় শুনতে পেয়েছে তার মনের গ্রাহকযন্ত্রে ৷ তিনি ওঠার জন্যে মাথাটা তোলেন, হাত দিয়ে বিছানা ধরেন ৷
আজাদ বলে, ‘না, তুমি শুয়ে থাকো ৷ তোমার শরীর এতটা খারাপ, তুমি আমাকে খবর দাওনি কেন ৷ কেন আমাকে লোকমুখে তোমার অসুখের খবর পেতে হলো ?
‘কী এমন অসুখ ৷ এমনি ভালো হয়ে যাব!’
‘এমনি এমনি অসুখ ভালো হয় ? তোমাকে হসপিটালে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে ৷’
‘তুই এসেছিস ৷ আমি এখন এমনি ভালো হয়ে যাব ৷’
মা উঠে পড়েন ৷ বলেন, আজাদ এসেছে, আর আমি শুয়ে থাকব নাকি! সবাই তাঁকে নিষেধ করে রান্নাঘরে হেঁশেলের ধারে যেতে, চুলার গরমে তাঁর শরীর খারাপ করবে, কিন্তু কে শোনে কার কথা! তিনি সন্ধ্যার মধ্যেই রান্নাঘরে ঢুকে পড়েন, ছেলের কিছু প্রিয় খাবার আছে, তিনি লেগে পড়েন তারই একটা দুটো পদ রান্নায় মহুয়াকে সাহায্য করতে ৷ ছেলের আকস্মিক আগমনের উৎসাহে শরীরটা তাঁর দাঁড়িয়ে যায়, রান্নাঘরের কাজটা ভালোই এগোয়; কিন্তু রাতের বেলা শরীর তার খাজনা আদায় করে নিতে থাকে, তিনি ভয়াবহ রকম অসুস্থ হয়ে পড়েন ৷
মহুয়া, কচি কাঁদতে থাকে ৷ আজাদ ছুটে যায় রাস্তায় ৷ একটা ফোন করা দরকার ৷ দরকার একটা অ্যাম্বুলেন্স ৷ মাকে হাসপাতালে নিতে হবে ৷ এক্ষুনি ৷
অ্যাম্বুলেন্স পাওয়া যায় না ৷ কিন্তু ফোন করে সে তার বন্ধু ফারুকের গাড়িটা পেয়ে যায় ড্রাইভার-সমেত ৷ মাকে নিয়ে সে সোজা চলে যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৷ সারাটা রাস্তা সে শুধু আল্লাহর নাম জপতে থাকে ৷
কেবিন খালি পাওয়া যায় ৷ মাকে সে ভর্তি করিয়ে দেয় কেবিনে ৷ সারা রাত সে বসে থাকে মার শয্যাপাশে ৷ রাত বাড়ে ৷ চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আসে ৷ ঘড়ির কাঁটার টিক টিক আর মায়ের শ্বাস নেওযার শব্দ শোনা যায় ৷
আজাদ আল্লাহকে বলে, ‘হে আল্লাহ, আমার মাকে তুমি বাঁচিয়ে রাখো ৷ আমার মা বড় দুঃখী ৷ তিনি আমার জন্যে অনেক দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন ৷ আমাকে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন ৷ তাঁর কষ্টের পালা তিনি অতিবাহিত করেছেন ৷ এখন আমার পালা ৷ আমি করাচিতে ব্যবসা শুরু করেছি ৷ কিছু কিছু লাভও হচ্ছে ৷ ভবিষ্যতে এমএ শেষ করে পুরোপুরি আয় করতে লেগে যাব ৷ ভালো বাসা নেব ৷ মাকে সেই বাসায় তুলব ৷ মাকে আর কষ্ট করতে হবে না ৷ এই সময়টায় মাকে তুমি নিও না ৷ মাকে বাঁচিয়ে রাখো ৷ তাঁকে সুস্থ রাখো ৷ তাঁকে নীরোগ রাখো ৷ তাঁকে সুখে রাখো ৷ তাঁকে শান্তিতে রাখো ৷’
আজাদ বিড়বিড় করে এই প্রার্থনা করে আর তার দু চোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়াতে থাকে ৷ নাক দিয়েও জল ঝরতে থাকে টপ টপ করে ৷
দুদিন পর মা কিছুটা সুস্থ হলে সে মায়ের সামনে হাজির করে ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা সোনার গয়না তোলার কাগজ, বলে, ‘সাইন করো ৷’
‘কেন, সাইন করব কেন ?’
‘গয়না তুলতে হবে ৷’
‘না ৷ আমি সাইন করব না ৷’
‘কেন, করবা না কেন ?’
‘এই গয়না আমার না ৷ আমি এটা আমার চিকিৎসার জন্যে খরচ করতে পারব না ৷’
‘এই গয়না তোমার না ? এগুলো না তুমি তোমার বিয়ের সময় পেয়েছিলে, তোমার বাপের বাড়ি থেকে ?
‘পেয়েছিলাম ৷ কিন্তু এগুলো আমার জন্য খরচের কোনো অধিকার আমার নাই ৷’
‘মানে ?’
‘এগুলো তোর বউয়ের হক ৷ আমি এগুলো তার জন্যে জমা করে রেখেছি ৷ এগুলো আমি তোর বউয়ের হাতে তুলে দিতে চাই ৷’
আজাদ কাঁদবে না হাসবে বুঝতে পারে না ৷ এই মহিলা তো আচ্ছা বাতিকঅলা ৷ কবে আজাদ বিয়ে করবে, কবে তার বউ হবে, তার জন্যে সে গয়না জমিয়ে রেখেছে, আর নিজে বিনা চিকিৎসায় মরতে বসেছে ৷
‘দ্যাখো মা ৷ তুমি যদি এখন সাইন করলা তো করলা ৷ না করলে আমিও তোমারই ছেলে ৷ আমার কিন্তু তোমার মতোই জেদ ৷ সোজা দুই চোখ যেদিকে চায় চলে যাব ৷ আর কোনো দিন আসব না ৷ করো সাইন ৷ তোমার এত গয়না দিয়ে কী হবে ৷ দুই ভরি এখন বেচি ৷ বাকিগুলো তো থাকলই ৷’
মা কাগজে স্বাক্ষর করে দিলে ব্যাঙ্ক থেকে গয়না তুলে দুই ভরি সোনার জিনিস বিক্রি করে দিয়ে বেশ কিছু টাকা জোগাড় করা যায় ৷ তা থেকে চিকিৎসার ব্যয়নির্বাহ করে যা বাঁচে, তা আজাদ তুলে দেয় মহুয়ার হাতে ৷ মায়ের যখন যা লাগে, তা যেন এই টাকা দিয়ে সে কিনে দেয় ৷
আজাদ ঢাকায় ফিরে এসে যখন হাসপাতাল, ডাক্তার, ব্যাঙ্ক ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত, তখন পূর্ব পাকিস্তান ধীরে ধীরে ফুঁসে উঠছে ৷ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়েছে, গ্রেপ্তারপর্ব শুরু হয়ে গেছে ৷ ৬ দফা দাবিও পূর্ববাংলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ৷ রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করে জারি করা আদেশের প্রতিবাদে এ অঞ্চলের শিল্পী-সাহিত্যিকেরা নানা রকম প্রতিবাদী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ৷ এমনকি ঢাকায় বসবাসকারী উর্দুভাষীদের পক্ষ থেকে নয়জন লেখক ও দুটি প্রতিষ্ঠান রবীন্দ্রপক্ষ সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছেন ৷ যদিও অচিরেই সরকার তাদের রবীন্দ্রবিরোধী আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়, তবু সারা প্রদেশে সভা-সমাবেশ-মিছিল চলতেই থাকে ৷
এইসব ঘটনা নিয়ে আজাদের কোনো কোনো বন্ধু ব্যস্ত হয়ে পড়ে ৷ মেনন গ্রুপ, মতিয়া গ্রুপ ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গেও সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ ৷ আজাদ ব্যস্ত তার মাকে নিয়ে ৷ বন্ধুদের কেউ কেউ ব্যস্ত দেশমাতার জন্যে ৷
আজাদের আর করাচি ফিরে যাওয়া হয় না ৷ সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে ঢাকাতেই থেকে যাবে ৷ ঢাকাতেই ব্যবসা-বাণিজ্য করবে ৷ পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে এমএটা সম্পন্ন করবে ৷
মাকে সে জানায় তার সিদ্ধান্তের কথা ৷
মা বলেন, ‘না, কেন তুই যাবি না ৷ আমার জন্যে ? না, তা হবে না ? আমার জন্যে তোর লেখাপড়ায় ছেদ পড়বে, এটা আমি হতে দেব না ৷ তুই অবশ্যই করাচি যাবি ৷’
আজাদ বলে, ‘না তো, তোমার জন্যে না তো ৷ আমি যাচ্ছি না আমার নিজের জন্য ৷ করাচি আমার ভালো লাগে না ৷ পশ্চিম পাকিস্তান আমার ভালো লাগে না ৷ উর্দু বলতে আমার ভালো লাগে না ৷ রুটি-ছাতু খেতে আমার ভালো লাগে না ৷’
মা বলেন, ‘করাচিতে তোর বুঝি খুব কষ্ট হয় ?’
আজাদ বলে, ‘হয় ৷ কেমন কষ্ট, এটা ঠিক বোঝানো যাবে না ৷ ধরো আমাকে না দেখলে তোমার কষ্ট হয় না ? এই রকম কষ্ট ৷ নিজের দেশ হলো আমার নিজের দেশ ৷’
‘পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের নিজের দেশ না ?’
‘না ৷ তুমি ওদেরকে আপন ভাবতে পারো, ওরা ভাবে না ৷’
‘তাহলে তুই কী করবি ? যাবি না আর ?’
‘না ৷ ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাব ‘খন ৷’
মা মনে মনে খুশি হন ৷ আজাদকে চোখের আড়াল করতে কি তাঁর ভালো লাগে ? তবে সেটা তো তাঁর নিজের স্বার্থ ৷ তাঁর নিজের স্বার্থে তিনি ছেলের পড়াশোনার পথে অন্তরায় হতে চান না ৷

১৭. মা

Exit mobile version