Site icon BnBoi.Com

হটলাইন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

হটলাইন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 ১. রত্না দরজায় টোকা দেওয়ার আগে

হটলাইন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
প্রথম প্রকাশ – অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯

জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়–
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে;
ক্লান্ত-ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে।

–জীবনানন্দ দাশ

.

ভূমিকা

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সুইসাইড হটলাইন রয়েছে। বিষণ্ণ, হতাশাগ্রস্থ বা আত্মহত্যা করতে উদ্যত মানুষেরা সেখানে ফোন করে বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পেতে পারে। আমাদের দেশেও এরকম হটলাইন আছে এবং সেখানে যেসব কমবয়সী ভলান্টিয়ারেরা কাজ করে তাদের অনেকের সাথে আমার পরিচয়ও আছে। এই ভলান্টিয়ারদের অভিজ্ঞতাগুলো অসাধারণ কিন্তু তারা যেহেতু গোপনীয়তার অঙ্গীকার করে কাজ করে সেজন্য তাদের সেই অভিজ্ঞতাগুলো কখনোই আমি তাদের মুখ থেকে জানতে পারিনি। তাই সুইসাইড হটলাইনের এই ছোট উপন্যাসটি আমাকে কল্পনা করে লিখতে হয়েছে।

আমার কল্পনার সাথে সম্ভবত বাস্তবতার খুব মিল নেই, সুইসাইড হটলাইনের ভলান্টিয়ারেরা এই কারনে একটু বিচলিত হলেও আশা করছি পাঠকেরা আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
২৫ জানুয়ারি ২০১৯

.

এক

রত্না দরজায় টোকা দেওয়ার আগে হাতে ঘড়ির দিকে তাকালো, নয়টা বাজতে দশ মিনিট বাকী। ঠিক নয়টা থেকে তার শিফট শুরু হবে, সে দশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেছে। প্রথমদিন দেরী হলে খুব লজ্জার ব্যাপার হতো। ঢাকা শহরে অবশ্যি বিশ পঁচিশ মিনিট দেরী হলে কেউ কিছু মনে করে না, শুধু মুখে বিরক্তির ভাব করে বলতে হয়, যা ট্রাফিক জাম! শব্দটা ইংরেজী-জ্যাম, কিন্তু সবাই বলে জাম। সে জন্যে রত্নাও বলে জাম। ট্রাফিক জাম।

রত্না দরজায় টোকা দিল, সাথে সাথে খুট করে দরজা খুলে গেল। মনে হল কেউ বুঝি দরজা খোলার জন্যেই ছিটকিনিতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। রত্না দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, দরজার অন্য পাশে সুমী আপু দাঁড়িয়ে আছে। সুমী আপু রত্নার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকালো, এসে গেছো?”

“জ্বী আপু।”

“কেমন করে এসেছ?”

“আব্দু নামিয়ে দিয়েছে।”

“সত্যি?”

রত্না মাথা নাড়ল। সুমী আপু বলল, “তোমার আব্লু তো ভালো আছেন। নিজে নামিয়ে দিয়েছেন। বাহ!” রত্না আবার মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, আমার আব্ব খুব সুইট।”

সুমী আপু দরজার ছিটকিনি লাগাতে লাগাতে বলল, “বেশীর ভাগ মেয়েদের যা-তা অবস্থা। রাতের শিফট মানে নো ননা! রীতিমত

ঝগড়াঝাটি মারামারি করে আসতে হয়।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। অনেক সময় আব্দুরা রাজী হয়ে যান কিন্তু আম্মুরা আরো দুই ডিগ্রী উপরে। কিছুতেই রাজী হতে চান না। এ রকম অবস্থা হলে সুইসাইড হটলাইনটা চলবে কেমন করে?”

রত্না কী বলবে বুঝতে না পেরে বড় মানুষদের মত মুখ গম্ভীর করে বলল, “চলবে আপু। একশবার চলবে।” কীভাবে চলবে সেটা নিয়ে অবশ্যি কোনো ব্যাখ্যা দিল না।

সুমী আপু মুখ শক্ত করে বলল, “চালাতে তো হবেই, শুরু করে তো আর হঠাৎ করে বন্ধ করে দিতে পারব না।”

রত্না সুমী আপুর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। করিডোরের শেষ মাথায় সুইসাইড হটলাইনের কল সেন্টার। বন্ধ দরজা। দরজার উপর একটা কাগজ স্কচ টেপ দিয়ে লাগানো। কাগজটাতে মার্কার দিয়ে লেখা, নো এন্ট্রে-প্রবেশ নিষেধ। সুমী যখন এখানে ট্রেনিং নিয়েছে তখন সে অনেকবার এই নোটিসটার দিকে তাকিয়েছে। একটা কাগজে মার্কার দিয়ে

লিখে যদি আসল একটা সাইনবোর্ড থাকতো তাহলে মনে হয় এর গুরুত্বটা কমে যেতো, কেমন জানি খেলে মনে হতো। কাগজে লেখার কারণে এর মাঝে কেমন জানি একটা ভয় ভয় ভাব এসেছে। মনে হচ্ছে দরজার অন্য পাশে রহস্যময় কিছু আছে। আজকে প্রথমবার সে এই দরজার অন্য পাশে যাবে, একটা ডেস্কে বসবে। সামনে একটা মোবাইল ফোন থাকবে। মোবাইল ফোনটা যে কোনো মুহূর্তে বেজে উঠবে। অন্য পাশে কে থাকবে সে জানবে না, শান্ত গলায় তাকে বলতে হবে, ‘সুইসাইড হটলাইন! আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

“শিফটে বসার জন্য রেডি?” সুমী আপুর কথাটা খুবই সাধারণ একটা কথা, শুধু বলার জন্য বলা কিন্তু রত্নার কেন জানি মনে হলো এটার একটা সঠিক উত্তর দিতে হবে। কিন্তু সে সঠিক উত্তর না দিয়ে বোকার মত বলে বসল, “না।”

“না?” সুমী আপু শব্দ করে হাসল, বলল, “এতো ট্রেনিং দিয়ে তোমাকে রেডি করলাম আর তুমি এখন বলছ, না? রেডি না?”

“ভয় করছে আপু।”

“ভয়? ভয় করবে কেন? বলতে পারো নার্ভাস লাগছে।”

রত্না মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে আপু। নার্ভাস লাগছে।”

“নার্ভাস লাগার কিছু নাই। তোমার ডেস্কের উপর পুরো প্রটোকল লেখা আছে। কী বলতে হবে মনে না থাকলে চোখ বন্ধ করে একটার পর একটা পড়ে যাবে।”

“মনে আছে। বাসায় প্র্যাকটিস করেছি।”

“গুড।”

“কিন্তু-”

“কিন্তু কী?”

রত্না একটু ইতস্তত করে বলল, “যদি প্রথমেই একটা সুইসাইড কেস চলে আসে?”

সুমী আপু হাসল, বলল, “আসবে না। সত্যিকারের সুইসাইড কেস কম আসে। আর যদি চলেই আসে আসবে, সমস্যা কী? ফেস করবে। অন্যেরা করছে না?”

“অন্যদের তো কতো এক্সপেরিয়েন্স! আমি আজকে প্রথম।”

“সবারই একসময় প্রথম ছিল। এটা কোনো ব্যাপার না।”

রত্না মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে আপু।”

সুমী আপু কল সেন্টারের হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে উঁকি দিল। রত্না ফিসফিস করে বলল, “এখনো নয়টা বাজে নাই। আমি ঢুকব?”

সুমী আপু নিচু গলায় বলল, “ঢুকবে না কেন? তুমি আমাদের সার্টিফাইড ভলান্টিয়ার যখন খুশী ঢুকতে পারবে। আস। তোমাকে বসিয়ে দেই।”

রত্না সুমীর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকলো। পাশাপাশি ছয়টা চৌকোনা ডেস্ক। একটা ডেস্কে একজন মেয়ে টেলিফোনে কথা বলছে। তার পাশের একজন ছেলে ডেস্কের উপর পা তুলে দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে একটা রংচংয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। ঘরের মাঝামাঝি দুটি ছেলে এবং মেয়ে নিচু গলায় কথা বলতে বলতে হাসাহাসি করছে। মেয়েটার চুল ছেলেদের মত ছোট করে কাটা। সুমী আপুকে ঢুকতে দেখে ডেস্কের উপর পা তুলে রাখা ছেলেটি তার পা নামিয়ে হাসার ভঙ্গি করল। ঘরের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন ছেলে মেয়ে কথা থামিয়ে সুমী আপুর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল।

সুমী একটু এগিয়ে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী অবস্থা? কী রকম টেলিফোন আসছে?”

“কম। খুবই কম।”

“গুড। কল কম আসা মানে গুড নিউজ। মানুষের মনে দুঃখ কষ্ট নাই, ডিপ্রেশান নাই। সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি নাই।”

দাঁড়িয়ে থাকা চুল ছোট করে কাটা মেয়েটা বলল, “কিংবা মোবাইলে ব্যালেন্স নাই।”

সবাই চাপা স্বরে হাসল। সুমী আপু বলল, “ঠিকই বলেছিস। মনে কষ্ট আছে কিন্তু মোবাইলে ব্যালেন্স নাই।”

রত্না একটু পিছনে খানিকটা বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। সুমী আপু তার হাত ধরে টেনে সামনে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তোদের রত্নার সাথে পরিচয় হয়েছে? আমাদের লাস্ট ব্যাচের ভলান্টিয়ার।”।

দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বলল, “ইয়া মাবুদ। এ কি আমাদের ভলান্টিয়ার? আমি ভেবেছিলাম সুইসাইড হটলাইনের ভলান্টিয়ার হতে হলে এডাল্ট হতে হয়। এ-তত দশ বছরের মেয়ে!”

রত্না হাসার চেষ্টা করে বলল, “আমার বয়স আঠারো।”

মেয়েটি বলল, “খোদার কসম! দেখে মনে হয় তোমার বয়স দশ। ম্যাক্সিমাম বারো। ক্লাস সেভেনে পড়।”

“আমি ইন্টার পরীক্ষা দিয়েছি।”

সুমী আপু চুল ছোট মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, “এর নাম রুনু। ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।” তার সাথের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে ইমরান। সফটওয়ার কোম্পানীতে চাকরী করে।” রংচংয়ের ম্যাগাজিন হাতের ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, “এই হচ্ছে রাজু। আর্কিটেক্ট। আর ঐ যে টেলিফোনে কথা বলছে সে হচ্ছে তিষা।” তারপর রত্নাকে দেখিয়ে বলল, “রত্না আমাদের নতুন ভলান্টিয়ার, কিন্তু রত্না আজকে নাইট শিফট করবে!”

রংচংয়ে ম্যাগাজিন হাতে বসে থাকা ছেলেটা তার চেয়ার থেকে উঠে এগিয়ে এলো, বলল, “ওয়েলকাম রত্না। ওয়েলকাম টু আওয়ার ক্লাব।”

রত্না দুর্বল ভাবে হাসার ভঙ্গি করে বলল, “খুব নার্ভাস লাগছে!”

ম্যাগাজিন হাতে ছেলেটা বলল, “নার্ভাস লাগার কিছু নাই। নাইন্টি পার্সেন্ট কল রুটিন। মা বকা দিয়েছে, বাবা বকা দিয়েছে। জিপিএ ফাইভ হয় নাই। ব্রেক আপ হয়ে গেছে। বয় ফ্রেন্ড পালিয়ে গেছে এইসব। খালি ধৈর্য্য ধরে ওদের কথা শুনবে।”

“বাকী টেন পার্সেন্ট?”

“বাকী টেন পার্সেন্ট একটু সিরিয়াস। কেস টু কেস ডিল করতে হবে।”

রত্না বলল, “ঐ টাই তো ভয়! যদি সিরিয়াস কেস চলে আসে?”

“ভয় নাই। আসবে না। সিরিয়াস কেস কম আসে।”

“ঐ যে আমাদের ট্রেনিংয়ের সময় আপু বলেছিল একটা কেস, বত্রিশটা ঘুমের টেবলেট হাতে নিয়ে ফোন করেছে–যদি সেইরকম কেস আসে?”

“আসবে না। ঐ রকম কেস খুব কম আসে। আমি দুই বছর থেকে কাজ করছি। এখনও পাই নাই।”

সুমী আপু বলল, “যাই হোক আজকে রত্নার প্রথম দিন। তাকে একটা ভালো ডেস্কে বসিয়ে দে।”

রুনু নামের মেয়েটা মাঝামাঝি ডেস্কটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, “এইখানে বসে যাও। মোবাইলটা ভালো। কথা পরিষ্কার শোনা যায়।”

রত্না এগিয়ে গেল। ব্যাগটা টেবিলের নিচে রেখে চেয়ারটা টেনে বসল। সস্তা চেয়ার কিন্তু বসে আরাম আছে। টেবিলে একটা ক্লীপ বোর্ড, একটা বল পয়েন্ট কলম। সামনের দেওয়ালে একটা কাগজে তাদের প্রটোকল লেখা। কেউ যদি ভুলে যায় তাহলে কোন প্রশ্নের পর কোন প্রশ্ন

করতে হবে সেগুলো

গুছিয়ে বলে দেয়া আছে।

সুমী বলল, “রত্না তাহলে তুমি শুরু করে দাও। যদি খিদে লাগে ফ্রীজে টুকটাক খাবার আছে। ড্রিংকস। চীপস। রাত তিনটার সময় শিফট বদল হবে। যতক্ষণ পরের শিফট না আসে ম্যানেজ করো!”

“করব।”

সুমী সবার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোরা রত্নাকে দেখে শুনে রাখিস।”

সবাই প্রায় এক সাথে বলল, “রাখব।”

রত্না চারিদিকে তাকালো। তিষা নামের যে মেয়েটি টেলিফোনে কথা বলছিল তার কথা আবছা আবছা ভাবে শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা খুব সুন্দর করে কথা বলছে। রত্না শোনার চেষ্টা করল, শুনল তিষা বলছে”মাহরীন আপু, তোমার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগলো। থ্যাংক ইউ আপু যে তুমি আমাদের ফোন করেছ। তুমি ঠিকই বলেছ, জিশানের কাজটা ঠিক হয় নাই। কিন্তু তুমি যেভাবে পুরো ব্যাপারটা ফেস করেছ সেটা অসাধারণ।

সিমপ্লি গ্রেট। আজকে তাহলে আমরা এইখানে শেষ করে দিই?” মেয়েটা কিছুক্ষণ অন্য পাশের মাহরীন আপুর কথা শুনল, তারপর বলল, “হা হা মাহরীন আপু। তোমার যখন ইচ্ছা ফোন করতে পার। আমাদের ভলান্টিয়াররা কেউ না কেউ আছে। তারপর বেশ সুরেলা গলায় বিদায় জানাল, “বাই।”

টেলিফোনটা রেখে তিষা নামের মেয়েটা অন্য সবার দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “আমাদের দেশের মেয়েগুলো হচ্ছে বোকা আর ছেলেগুলো হচ্ছে বদমাইস।”

রংচংয়ে ম্যাগাজিন হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটা বলল, “তিষা, তুই মনে হয় এখনো জানিস না যে আমি একজন ছেলে!”

“তুই ছেলে হয়েছিস তো কী হয়েছে? আমি সত্যি কথা বলতে পারব না?” মেয়েটা মোটামুটি হিংস্র মুখে বলল, “শুরু হবে ফেসবুক দিয়ে, তারপর টেলিফোন, তারপর দুই চার দিন ফাস্টফুডের দোকান-তারপর স্ট্রেট সেক্স! সেক্স হবার পর ছেলেটা ডাম্প করে চলে যাবে।”

দাঁড়িয়ে থাকা অন্য ছেলেটা রত্নাকে দেখিয়ে বলল, “তিষা, এইখানে বাচ্চা একটা মেয়ে আছে।”

তিষা ঝাঁঝিয়ে উঠল, “খবরদার বাচ্চা বাচ্চা করবি না। এইখানে ভলান্টিয়ার হতে হলে অনেক কিছু পার হতে হয়, এখানে কেউ বাচ্চা না টেলিফোন রিসিভ করবে আর দুনিয়ার ফ্যাক্টস জানবে না এইটা তো হতে পারে না।”

তিষা নামের মেয়েটা এবারে রত্নার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপু, আমার নাম তিষা। তুমি-”

“রত্না।”

“রত্না। গুড, তুমি এতো ছোট থাকতেই ভলান্টিয়ার হতে পেরেছ হাউ নাইস। কগ্রাচুলেশন্স!”

রত্না বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু পারব কি না সেইটা তো বুঝতে পারছি না।”পারবে না কেন? খুব ভালো পারবে।”

“আমি শুনছিলাম তিষা আপু, তুমি কী সুন্দর করে কথা বলছিলে।”

“তুমিও বলবে। তুমি আমার থেকে সুন্দর করে কথা বলবে।”

রংচংয়ে ম্যাগাজিন হাতে রাজু নামের ছেলেটা বলল, “তিষা শুধু টেলিফোনে সুন্দর করে কথা বলে। সামনা সামনি তার কথাবার্তা খুবই খারাপ।”

তিষা রাজুর কথাটার কোনো গুরুত্ব দিল না, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “পরের শিফটের সবাই এসেছে? আমার যেতে হবে।”

“তুই যা। অন্যরা না আসা পর্যন্ত আমরা আছি।”

তিষা রত্নার দিকে তাকিলে বলল, “ওকে রত্না। তোমার সাথে দেখা হবে। প্রথম শিফটটাই নাইট শিফট দিয়ে শুরু করেছ দ্যাট ইজ গুড। রাত যতো গম্ভীর হয় তত বেশী ইন্টারেস্টিং ফোন আসে। দেখবে কতো এক্সাইটিং।”

তিষা ডেস্কের নিচ থেকে তার ব্যাগটা বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে কল সেন্টার থেকে বের হয়ে গেল।

ঠিক তখন রত্নার টেলিফোনটা বেজে উঠল।

রত্না একটু চমকে উঠল, তারপর মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকালো। সবাই হাসি হাসি মুখে রত্নার দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট ছোট করে কাটা চুলের রুনু নামের মেয়েটা বলল, “ধরো রত্না।”

রত্না টেলিফোনটা ধরে কল রিসিভ করার বাটনে চাপ দিয়ে কানে লাগালো তারপর শান্ত গলায় বলল, “সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আপনাকে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?”

অন্য পাশ থেকে কোনো উত্তর নেই। রত্না আবার বলল, “সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”

এবারেও কোনো উত্তর নেই। রত্না টেলিফোনটা কানে ধরে রেখে একটু অবাক হয়ে অন্যদের দিকে তাকালো। অন্যরা হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সবাই জানে মাঝে মাঝেই টেলিফোন আসে যখন অন্যপাশে যে থাকে সে কোনো কথা বলে না। মিনিট খানেক চেষ্টা করেও যদি কোনো কথা বলানো না যায় তাহলে টেলিফোনটা কেটে দিতে হয়।

রত্না তা-ই করবে। সে আরো একটু চেষ্টা করবে তারপর লাইন কেটে দেবে। রত্না আবার বলল, “হ্যালো! আমি সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?” কোনো জবাব নেই, রত্না বলল, “আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন? আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”

রত্না এবারে স্পষ্ট একটি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলো। গভীর একটি নিঃশ্বাস। অন্য পাশে যে আছে সে তার কথা শুনছে কিন্তু তার কথার

উত্তর দিচ্ছে না। যদি উত্তর না দেয় তার আর কিছু করার নেই। রত্নাকে যেভাবে শেখানো হয়েছে সে সেভাবে চেষ্টা করল, বলল, “আপনি আমাদের ফোন করেছেন সেজন্যে আমি খুব খুশী হয়েছি। আপনি যদি একটুখানি বলতেন কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি তাহলে আরো খুশী হতাম। বলবেন?”

কোনো উত্তর নেই।

“আপনি কি কথা বলবেন?”

কথা বলল না।

কথা বলার এক পর্যায়ে তাদের জানতে হয় সে মানুষটি কি আত্মহত্যা প্রবণ কিনা। সরাসরি জিজ্ঞেস করে ফেলতে হয়। যে মানুষটি কথাই বলছে

তাকে কি এটা জিজ্ঞেস করা যায়? রত্না কী করবে বুঝতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “কিছু মনে করবেন না প্লীজ, আপনি কি আপনি কি আত্মহত্যা করার কথা ভাবছেন?” অন্য পাশ থেকে কেউ কিছু বলবে রত্না আশা করেনি, কিন্তু সে প্রথমবার একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, কেউ একজন ভারী গলায় ধীরে ধীরে বলল, “হ্যাঁ। আমি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছি। লাফ দিব। এক্ষুনি লাফ দিব। ছয়তলা থেকে।”

২. জুলহাজ আবছা অন্ধকারে

জুলহাজ আবছা অন্ধকারে তার বিল্ডিংয়ের ছয়তলার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঠিক যখন নিচে লাফ দেবে তখন সেখানে একটা গাড়ী এসে থেমেছে। গাড়ী থেকে যাত্রীরা নামছে। ছোট একটা ছটফটে শিশু ছোটাছুটি করছে। জুলহাজ তাই কার্নিশে দাঁড়িয়ে রইল। গাড়ীটা সরে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকল।

ঠিক তখন তার পকেটের টেলিফোনটা বেজে উঠল। কী আশ্চর্য? এ রকম সময়ে তার পকেটে টেলিফোনটা রয়ে গেছে? বেজে বেজে টেলিফোনটা এক সময় থেমে যাবে মনে করে জুলহাজ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। টেলিফোনটা সত্যি একসময় থেমে গেল, কিন্তু থেমে গিয়ে আবার সেটা বাজতে শুরু করল। জুলহাজ তখন টেলিফোনটা বের করে সেটাকে চাপ দিয়ে নিঃশব্দ করে দেয়। অচেনা নম্বর অচেনা মানুষ কেন তাকে বিরক্ত করছে? নিচে গাড়ীটা দাঁড়িয়ে আছে তা না হলে সে মোবাইল টেলিফোনটা টুক করে নিচে ফেলে দিতো।

জুলহাজ টেলিফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কি আছে যাকে শেষ মুহূর্তে টেলিফোন করা যায়? জুলহাজ কাউকে মনে করতে পারল না। সে অনেকদিন থেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুতি নিয়েছে, সবকিছু গুছিয়ে পরিকল্পনা করেছে। সুজিতের হাতে কিছু টাকা পর্যন্ত দিয়ে রেখেছে। সুজিত তার ছেলেবেলার বন্ধু, সে একটু অবাক হয়ে জানতে চেয়েছে এই টাকাগুলো দিয়ে কী করবে? জুলহাজ বলেছে, হাতে রাখ। হঠাৎ করে ক্যাশ টাকার দরকার হলে কাজে লাগবে। সুজিত কী বুঝেছে কে জানে, হাতে রেখেছে।

সে কি সুজিতকে একটা ফোন দেবে? নিচে যতক্ষণ গাড়ীটা সরে না যাচ্ছে ততক্ষণ কি সুজিতের সাথে একটু কথা বলবে? তাকে কি বলবে তুই একটু বাসায় চলে আয়। তোকে যে টাকাগুলো দিয়েছিলাম সেগুলো নিয়ে আয়?

জুলহাজ অন্যমনস্কভাবে সুজিতের নম্বরটা বের করল। ফোন করবে? ঠিক তখন দেখলো গাড়ীটা ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে, তাই শেষ পর্যন্ত আর ফোন করল না। আবার অন্য কোনো একটা গাড়ী এসে থামবে। আবার দেরী হয়ে যাবে। জুলহাজ ফোনটা বন্ধ করতে গিয়ে সুজিতের নামের দিকে তাকালো। সুজিতের নামের ঠিক উপরে লেখা সুইসাইড হটলাইন। কী আশ্চর্য! এই নম্বরটি সে কখন তার টেলিফোনে ঢুকিয়েছে? কেন ঢুকিয়েছে?

জুলহাজ কিছুক্ষণ নম্বরটির দিকে তাকিয়ে রইল। সে কি এখানে একবার ফোন করে দেখবে? কী হবে ফোন করলে? তারা কি অনুনয় বিনুনয় করে তাকে কিছু বলবে? জুলহাজের ভেতরে রাগ, দুঃখ, হতাশা, আনন্দ, বেদনা কোনো অনুভূতিই নেই। শুধু একটুখানি কৌতূহল রয়ে গেছে। কী হবে এখানে ফোন করলে? করে দেখবে নাকী? সে কোনো কথা বলবে না, শুধু শুনবে তারা কী বলে?

জুলহাজ নম্বরটি স্পর্শ করে ফোনটা কানে লাগালো। কয়েক সেকেন্ড পর টেলিফোনটা রিং হতে শুরু করল। জুলহাজের হঠাৎ করে মনে হল শেষ মুহূর্তে এখানে ফোন করাটি খুব বোকামো হয়েছে। নিজের নির্বুদ্ধিতায় তার নিজের উপর রাগ উঠে গেলো। সে ঠিক যখন টেলিফোন লাইনটা কেটে দেবে তখন মনে হলো অন্য পাশে কেউ একজন টেলিফোন ধরেছে। নারী কণ্ঠে কিছু একটা বলছে। আবার কৌতূহল জয়ী হল। জুলহাজ টেলিফোনটা কানে লাগালো। আগে কী বলেছে সে শোনেনি, ফলে সে অপেক্ষা করে আবার কী বলে সেটা শোনার জন্য। শুনতে পেলো একটি মেয়ে বলছে, “সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”

জুলহাজ মেয়েটির গলার স্বর শুনে অবাক হয়ে গেল। বাচ্চা একটা মেয়ের গলার স্বর। শুনে মনে হয় বারো কিংবা তেরো বছরের মেয়ে। এই মুহূর্তে জুলহাজের ভেতরে রাগ, দুঃখ, হতাশা, বিস্ময় কিছু থাকার কথা নয়। তবু সে একটুখানি অবাক হলো। সুইসাইড খুবই গুরুতর একটা ব্যাপার। একজন মানুষ এমনি এমনি সুইসাইড করে না। তার কারণ হটলাইন

থাকে। জটিল কারণ থাকে। এটি ছেলেমানুষী ব্যাপার নয়। এটাকে ছেলেমানুষী ব্যাপারের মত দেখাও ঠিক নয়। বারো তেরো বছরের একটা মেয়েকে এ রকম একটা গুরুতর ব্যাপার নিয়ে কথা বলতে দেয়া ঠিক নয়। কী রকম প্রতিষ্ঠান এ রকম তামাশা করে? জুলহাজ অবাক হয়ে দেখল সে একটুখানি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। হাতের টেলিফোনটা সে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল তখন শুনলো মেয়েটি কী যেন বলছে। জুলহাজ আবার শোনার চেষ্টা করল, মেয়েটা বলছে, “হ্যালো আমি সুইসাইড হটলাইন থেকে বলছি। আপনি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?” জুলহাজ কোনো কথা না বলে ফোনটা ধরে রাখল, মেয়েটা তার রিনরিনে বাচ্চা মেয়ের আদুরে গলায় বলল, “আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন? আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?”

জুলহাজ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার মনে হলো সে বলে, “হ্যাঁ আমি তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। তোমার বাবাও পারবে না!” জুলহাজ অবশ্যি কিছু বলল না। টের পেল নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্রোধ পাক খেয়ে উঠছে। জীবনের শেষ মুহূর্তটিতে এ রকম হওয়ার কথা ছিল না। রাগ, দুঃখ, হতাশা, আনন্দ সবকিছুর বাইরে এক ধরনের নির্লিপ্ততায় থাকার কথা ছিল।

জুলহাজ অন্যমনস্কভাবে টেলিফোনটা কানে ধরে রাখল। শুনতে পেলো মেয়েটি কথা বলে যাচ্ছে। তার কথা শুনছে কিনা জানতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি একটু থামল। কয়েক সেকেন্ড কোনো কথা নেই, তখন প্রায় হঠাৎ করে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, “কিছু মনে করবেন না প্লীজ, আপনি কী–আপনি কি আত্মহত্যা করার কথা ভাবছেন?”

জুলহাজ রীতিমত চমকে উঠল, মেয়েটির কথায় তার হাসি পেয়ে গেল। কোনো কথা বলবে না ঠিক করে রেখেছিল তারপরও সে প্রথমবার মুখ খুলল, বলল, “হ্যাঁ। আমি ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছি। লাফ দিব। এক্ষুনি লাফ দিব। ছয়তলা থেকে।”

এই প্রথম জুলহাজ একটু কৌতূহলী হলো, সে অপেক্ষা করতে লাগল মেয়েটি কী বলে শোনার জন্য। রিনরিনে গলার স্বরের বাচ্চা একটা মেয়ে কীভাবে তাকে আত্মহত্যা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করে সেটা দেখার জন্য।

কৌতূহল!

নেহায়েতই কৌতূহল! জীবনের শেষ মুহূর্তের শেষ একটু কৌতূহল।

৩. মানুষটির কথা শুনে রত্না

মানুষটির কথা শুনে রত্না ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মত চমকে উঠল। সে যেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিল ঠিক সেটাই ঘটেছে। টেলিফোনের অন্য পাশে একজন মানুষ ছাদের কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে এক্ষুনি ছয়তলা থেকে লাফিয়ে পড়বে। সেই মানুষটি বেঁচে থাকবে নাকি মারা যাবে সেটি এখন নির্ভর করছে তার উপর। তার উপর? সে আঠারো বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে। সারা জীবনে সে কোনো বড় কাজ করেনি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেনি। কোনো সাহসের কাজ করেনি। এখন তাকে টেলিফোনে কথা বলতে হবে একজন মানুষের সাথে-যার কাছে জীবনের কোনো মূল্য নেই, জীবনের কোনো অর্থ নেই। জীবন আর মৃত্যুর মাঝে পার্থক্য একটি সেকেন্ড, কিংবা এক সেকেন্ড থেকেও কম। একটি মুহূর্ত? কী করবে সে? রত্না অসহায়ভাবে সবার দিকে তাকালো।

সবাই বুঝে গেল কী হচ্ছে। একটু আগের তাদের হাসি হাসি মুখটি মুহূর্তের মাঝে গম্ভীর হয়ে গেল। ইমরান এসে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে যায়, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “ইমার্জেন্সি?”

রত্না মাথা নাড়ল। ইমরান জিজ্ঞেষ করলো, “লেভেল?”

রত্না হাতের সবগুলো আঙুল মেলে ধরল। লেভেল পাঁচ। সবচেয়ে ভয়ংকর। যখন একজন সুইসাইডের প্রক্রিয়া শুরু করে দেয় সেটি হচ্ছে লেভেল ফাইভ।

রুনু রত্নার চোখের দিকে তাকিয়ে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করল। ফিসফিস করে বলল, “কথা বলে যাও।”

রত্না চোখ বন্ধ করল, একটা বড় নিঃশ্বাসকে আটকে রেখে গলার

স্বরটা শান্ত করার চেষ্টা করল, বলল, “আমি কি আপনার সাথে একটু কথা বলতে পারি?”

অন্য পাশ থেকে কোনো কথা শোনা গেল না। রত্না আবার বলল, “একটু কথা বলবেন আমার সাথে?”

এবারেও কোনো উত্তর নেই। শুধু একটা নিঃশ্বাসের শব্দ শুনল।

”বলবেন, প্লীজ?”

এবারে উত্তর শুনতে পেলো, “কী কথা বলতে চাও?”

রত্না বুকের ভেতর আটকে রাখা শ্বাসটি সাবধানে বের করল। মানুষটি শেষ পর্যন্ত কথা বলেছে, এখন রত্না প্রটোকল ধরে কথা বলতে পারবে।

রত্না বলল, “যেহেতু আপনি আমাদের ফোন করেছেন, হয়তো আপনি আমাদের সাথে কিছু একটা শেয়ার করার কথা ভাবছিলেন-”

রত্না শুনলো অন্য পাশ থেকে মানুষটা হঠাৎ প্রায় ধমকে উঠল, “আমি মোটেও তোমাদের ফোন করতে চাই নাই–এটা ভুলে হয়ে গেছে।”

রত্না বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ হতে পারে আপনি ফোন করতে চাননি-হতে পারে আপনি কথা বলতে চান না, কিন্তু কিন্তু” রত্না কথা বলতে বলতে থেমে গেল।

অন্য পাশে মানুষটা কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করল, রত্না কথাটা শেষ করল না বলে মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু কী?”

“কিন্তু যেহেতু ফোন করেই ফেলেছেন। একটু কি কথা বলা যায় না?”।

“তুমি আমার সাথে কী কথা বলবে? আমাকে লম্বা লম্বা উপদেশ দিবে?”

রত্না ব্যস্ত হয়ে বলল, “না, না, না। মোটেও উপদেশ দিব না। একবারও উপদেশ দিব না।”

“তাহলে?”

“শুধু একটু কথা বলব।”

“শুধু কথা বলবে? কী নিয়ে কথা বলবে?”

রত্না একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে অন্যদের দিকে তাকালো। রুনু আর ইমরান দুই হাত মুঠি করে রত্নাকে উৎসাহ দিল, ফিসফিস করে বলল, “ফ্যান্টাস্টিক! চালিয়ে যাও”

রত্না বলল, “এই তো, মনে করেন আগে পরিচয় দিয়ে শুরু করতে পারি। আমার নাম পরী। আপনি যদি আপনার নামটা বলতে চান।”

“না, আমি তোমাকে মোটেও আমার নাম বলতে চাই না।”

“না বলতে চাইলে বলতে হবে না। আমরা কখনো কাউকে কারো নাম বলি না। পুরোপুরি গোপন। শুধু আমি জানব, আর কেউ জানবে না আমাদের।”

মানুষটি রত্নাকে কথার মাঝখানে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোমার বয়স কতো মেয়ে?”

রত্না একটু থতমত খেয়ে বলল, “বয়স?”

“হ্যাঁ।”

“আসলে–আসলে-” রত্না ইতস্তত করে থেমে গেল।

“আসলে কী?”

“আসলে আমাদের নাম ছাড়া আর কিছু কখনো বলার পারমিশান নাই–”

“কার পারমিশান নাই?”

“আমাদের অর্গানাইজেশন, সুইসাইড হটলাইনের—”

অন্য পাশে মানুষটা কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, “তোমার গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে তুমি স্কুলে পড়। তোমার মতো বাচ্চা একটা মেয়েকে এ রকম সিরিয়াস কাজে লাগিয়ে দিয়েছে এটা কী রকম অর্গানাইজেশন?”

রত্না মানুষটাকে কথা শেষ করতে দিল, তারপর শান্ত গলায় বলল, “আপনি আসলে ঠিকই অনুমান করেছেন। আমি একটু ছোট, কিন্তু আমি আসলে স্কুলে পড়ি না-আমি আরো বড়।”

“কতো আর বড় হবে? এ রকম সিরিয়াস কাজে লাগিয়ে দিয়েছে তুমি তোমার বাপের বয়সী মানুষকে উপদেশ দিবে? কাউন্সেলিং করবে?”

রত্না গলার স্বর শান্ত রাখল, বলল, “আমি তো আপনাকে বলেছি! আমি মোটেও উপদেশ দিব না। কাউন্সেলিং করার তো প্রশ্নই আসে না!

“উপদেশ দিবে না? কাউন্সেলিং করবে না?”

“না।”

“না?” মানুষটা একটু অবাক হল বলে মনে হল।

রত্না নরম গলায় বলল, “না।”

“কেন?”

“আমি তো আপনার সম্পর্কে এখনো কিছুই জানি না। এ রকম তো হতেই পারে যে আপনি অনেক চিন্তাভাবনা করে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর একটা কারণ আছে। হয়তো কারণটা ঠিক কারণ। হয়তো আপনি এমন একটা কষ্টের ভেতরে আছেন যেটা আমরা চিন্তাও করতে পারি না। হয়তো আত্মহত্যা করলে আপনি সেই কষ্ট থেকে মুক্তি পাবেন আমি কে আপনাকে উপদেশ দেবার? কেন দিব? কীভাবে দিব?”

টেলিফোনের অন্য পাশে কিছুক্ষণ কোনো কথা নেই। তারপর মানুষটা আবার কথা বলল, “তাহলে এই হটলাইনে তোমরা কী কর?”

“আমরা শুধু একটুখানি কথা বলার চেষ্টা করি। একটু কথা শোনার চেষ্টা করি। আর কিছু না।”

“কেন?”

“কারণ-কারণ-অনেক সময় দেখা গেছে কথা বলে একজন একটু সান্ত্বনা পায়।”

“সান্ত্বনা পায়?”

“জী।”

“আমি তোমার সাথে কথা বলে সান্ত্বনা পাব?”

রত্না একটু ইতস্তত করে বলল, “সেটা এখনো জানি না-কিন্তু-কিন্তু হতেও তো পারে।”

“তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে তোমাকে জানি না শুনি না–”

”সে জন্যেই–”

“সে জন্যেই কী?”

“যেহেতু আপনি আমাকে জানেন না, চিনেন না, সে জন্যে হয়তো আপনি আমাকে অনেক কথা বলতে পারবেন যেটা আপনি কখনো কাউকে বলেননি। বলতে পারেননি”।

অন্য পাশে মানুষটা চুপ করে রইল। রত্না প্রায় অনুনয়ের স্বরে বলল,

“বলবেন? বলবেন একটু কথা?

“ঠিক আছে। বল।”

রত্না বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে অন্যদের দিকে তাকালো। অন্যরা হাত নেড়ে রত্নাকে সাহস দিল। রত্না জিব দিয়ে তার ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে বলল, “আপনি এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন?”

“কেন? কার্নিশে?”

“কার্নিশে?”

“হ্যাঁ।”

“আপনি কি কার্নিশ থেকে একটু সরে আসবেন?”

“কেন?”

“এমনিই। এমনিই-কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছে একজন আমার চিন্তা করতেই কেমন জানি গা শিরশির করছে। সেই জন্যে। আর কিছু না।”

“আমি কার্নিশে থাকি না কোথায় থাকি তাতে তোমার কী?”

“না আমার কিছু না। কিন্তু মানে তবু-”

“তবু কী?”

“না, কিছু না। কিছু না।”

“তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও।”

“যে কোনো কিছু নিয়ে। আপনার যেটা ইচ্ছা।”

“আমার কোনো ইচ্ছা নাই।”

“ঠিক আছে তাহলে আমি বলি?”

“বল।”

রত্না বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল। তারপর সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “আপনি বলবেন কেন এতো বড় একটা ডিসিশন নিলেন?”

টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে মানুষটা মেঘ স্বরে বলল, “তুমি সেটাই জানতে চাও?”

“আপনি যদি বলতে চান তাহলে। বলতে না চাইলে বলতে হবে না। আপনার ইচ্ছা।”

“আমি বলতে চাই না।”

রত্না তাড়াহুড়ো করে বলল, “তাহলে বলতে হবে না। আপনাকে বলতে হবে না। অন্য কিছু বলি। অন্য কিছু।”

“তুমি আসলেই শুনতে চাও? শুনতে চাও মেয়ে?”

“পরী। আমার নাম পরী।”

“শুনতে চাও পরী?” মানুষটা ভারী গলায় বলল, “শুনতে চাও তুমি?”

“হ্যাঁ। শুনতে চাই।”

“আমি সুইসাইড করতে চাই, কারণ-”, মানুষটা থেমে গেল।”কারণ?”

“কারণ আমি আমার স্ত্রী আর ছেলেকে খুন করেছি। খুন মানে জান?”

রত্না ঢোক গিলল। ইতস্তত করে বলল, “হ্যাঁ, মানে ইয়ে-”

মানুষটা আবার হিংস্র একটা শব্দ করল। বলল, “খুন।”

৪. জুলহাজের মাথাটা দপ দপ করতে থাকে

জুলহাজের মাথাটা দপ দপ করতে থাকে। হঠাৎ করে তার পুরো দৃশ্যটা মনে পড়ে যায়। গাড়ীটার স্টিয়ারিং ডান হাতে, বাম হাতটা পাশের সীটে। সেখানে নীলা বসে আছে। জানালা খোলা। বাতাসে নীলার চুল উড়ছে। ড্যাশ বোর্ডে একটা গান বাজছে। প্রেমের গান। জুলহাজ আঙুল দিয়ে টোকা দিয়ে তাল দিচ্ছে। গাড়ী চালাতে চালাতে সে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকালো টুটুল গভীর মনোযোগ দিয়ে তার ছবির বইটা দেখছে। ছেলেটা তার মায়ের মত শান্ত হয়েছে। কোনো কিছু নিয়ে বিরক্ত করে না। হাতে একটা বই ধরিয়ে দিলে গভীর মনোযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখতে থাকে। ছবি দেখতে দেখতে কী যেন ভাবে। এইটুকু মানুষ যখন মুখ গম্ভীর করে কিছু একটা ভাবে সেই দৃশ্যটা দেখে জুলহাজের হাসি পেয়ে যায়।

জুলহাজ স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে বাইরে তাকালো। দুইপাশে ধানক্ষেত। আর কিছুক্ষণ গেলেই চা বাগানে ঢুকে যাবে। চা বাগানের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা, দেখতে খুব ভালো লাগে। রঙিন শাড়ী পরে। চা শ্রমিকেরা মাথায় বড় বড় ঝাঁকাতে করে চা পাতা নিয়ে হাঁটছে। রাস্তাটা নিরিবিলি এখানে হাইওয়ের মতো বড় বড় বাস ট্রাক নেই।

নীলা কিছু একটা বলল, জুলহাজ ঠিক শুনতে পেলো না, একটা ছোট গাড়ীকে পাশ কাটিয়ে সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী বলছ নীলা?”

নীলা আবার বলল, আর ঠিক তখন দৈত্যের মত বিশাল একটা বাস তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় তার গাড়ীটাকে ধাক্কা দিল। জুলহাজের ছোট গাড়ীটা কেমন যেন বাতাসে উড়ে গেলো। গাড়ীটা শূন্যে পাক খাচ্ছে, একবার, দুইবার, তিনবার। রাস্তা থেকে উড়ে গিয়ে নিচে পড়েছে মুহূর্তের মাঝে সবকিছু ওলট পালট হয়ে গেলো। প্রচণ্ড একটা আঘাত, সবকিছু ভেঙেচুরে যাওয়ার শব্দ তারপর হঠাৎ চারিদিক নিঃশব্দ হয়ে গেলো, শুধু ড্যাশবোর্ডের সিডি প্লেয়ারে প্রেমের গানটি বেজে যাচ্ছে, এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনে জষ্ঠিতে হলো পরিচয়…।

জুলহাজ মাথা ঘুরিয়ে নীলাকে দেখার চেষ্টা করল, পারল না। পেছনে টুটুলকে দেখতে চাইলো কিন্তু কিছু বোঝার আগেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।

আবছা আবছা ভাবে কখনো কখনো জ্ঞান এসেছে কখনো আবার

অচেতন হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে যখন জ্ঞান এসেছে তখন বুঝতে পেরেছে সে হাসপাতালে, তাকে ঘিরে ডাক্তার, নার্স আর মানুষ। প্রচণ্ড তৃষ্ণায় তার বুক ফেটে যাচ্ছে, সে বলতে চাইছে ”পানি! পানি! একটু পানি।” কিন্তু সে বলতে পারছে না। যখনই একটু নড়ার চেষ্টা করেছে তখনই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে থরথর করে উঠেছে। সে কিছু মনে করতে পারে না, তার কী হয়েছে সে জানে না একদিন সে শুনল কেউ একজন তাকে ডাকছে, “জুলহাজ! এই জুলহাজ! চোখ খুলবি? তাকাবি একবার?” জুলহাজ চোখ খুললো। তাকালো, তার মুখের উপর সুজিত ঝুঁকে আছে। সুজিতের মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তাকে ঝাঁপসা ঝাঁপসা দেখা যাচ্ছে।

জুলহাজ জিজ্ঞেস করল, “আমি কোথায়? কী হয়েছে আমার?”

“এক্সিডেন্ট হয়েছে। তুই, তুই হাসপাতালে-”

সুজিতের কথা শুনে হঠাৎ করে জুলহাজের সব কথা মনে পড়ে গেলো। জুলহাজ গাড়ী নিয়ে যাচ্ছিল, তার পাশে বসে ছিল নীলা। পিছনে ছিল টুটুল। টুটুলের হাতে ছিল ছবির একটা বই। ড্যাশবোর্ড থেকে গানের সুর ভেসে আসছিল, ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার’-জুলহাজ তখন বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মত চমকে উঠল, নীলা আর টুটুল কেমন আছে?

জুলহাজ ধড়মড় করে উঠে বসার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। শুয়ে থেকে প্রায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল, “নীলা আর টুটুল? নীলা আর টুটুল কেমন আছে? নীলা”

সুজিত তার দৃষ্টি এড়িয়ে ফিস ফিস করে বলল, “তুই অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে এসেছিস। ডাক্তাররা তোর আশা ছেড়ে দিয়েছিল।“

জুলহাজ অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “নীলা? টুটুল?”

সুজিত বলল, “তুই বেঁচে যাবি কেউ ভাবে নাই। খুবই খারাপ অবস্থা ছিল-”

জুলহাজ এবারে চিৎকার করে উঠল, “নীলা? টুটুল?”

সুজিত অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। কোনো কথা বলল না।

জুলহাজের নাকে অক্সিজেনের টিউব, গলায় কেনোলাতে স্যালাইনের টিউব। শরীরের নানা জায়গায় সেন্সর। জুলহাজ টান দিয়ে সব খুলে ফেলে হাহাকার করে উঠল। সুজিত ভয় পেয়ে চিৎকার করে বলল, “সিস্টার! সিস্টার!”

কয়েকজন তার দিকে ছুটে এলো। কয়েকজন তাকে চেপে ধরে রাখে, একজন কোথায় জানি তাকে একটা ইনজেকশান দিল। জুলহাজ থরথর করে কাঁপতে থাকে। থরথর করে কাঁপতে থাকে।

.

ছয়তলা বিল্ডিংয়ের কার্নিশে দাঁড়িয়ে জুলহাজ থরথর করে কাঁপতে থাকে। কানে একটা ফোন ধরে রেখেছে। ফোনে কেউ একজন কথা বলছে। বাচ্চা একটা মেয়ের রিনরিনে গলা। মেয়েটা কিছু একটা বলছে। কী বলছে?

“আপনি কি বলবেন, আপনি কেমন করে আপনার ওয়াইফ আর ছেলেকে খুন করেছেন?”

জুলহাজ কোনো কথা বলল না। তার শরীর কাঁপছে। সে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।

“বলবেন? বলবেন আপনি?”

জুলহাজ একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “গাড়ী দিয়ে! আমি গাড়ী চালাচ্ছিলাম-”

“গাড়ী? গাড়ী চালাচ্ছিলেন? আপনার ওয়াইফ আর ছেলে গাড়ীতে ছিল?”

“হ্যাঁ।”

“তার মানে তারা গাড়ী একসিডেন্টে মারা গেছে! আপনি আসলে খুন করেননি-আসলে এক্সিডেন্ট-”

“একই কথা।” জুলহাজ শুনল, মেয়েটা একটু হাসির মত শব্দ করল। নার্ভাস হাসি, তারপর বলল, “মোটেও একই কথা না। মার্ডার আর এক্সিডেন্ট একই কথা না-কখনোই এক কথা না।”

মেয়েটার ছেলেমানুষী কথা শুনে জুলহাজের রেগে ওঠার কথা ছিল, জুলহাজ কেন জানি রাগতে পারল না। নরম গলায় বলল, “একই কথা। আমার কারণে দুজনে মারা গেছে। শুধু মাত্র আমার কারণে।”

অন্য পাশে মেয়েটা চুপ করে রইল। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, “আপনি যদি এভাবে ভাবেন আমার কিছু বলার নেই। আমি আসলে আপনার সাথে তর্ক করতে চাই না।”

“আমার কথা না মানলেও তর্ক করবে না?”

“না।”

“কেন না?”

“কারণ-কারণ, আমার আপনার সাথে তর্ক করার কথা না।”

“কী করার কথা?”

“আপনার কথা শোনার কথা।”

“কী কথা?”

“আপনি যেটা বলতে চান। যা ইচ্ছা-”

“কেন?”

মেয়েটা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “আপনি যদি কথা বলেন তাহলে মনটা একটু হালকা হবে। যখন মনটা হালকা হবে তখন তখন-”

“তখন আমি আমার মাইন্ড চেঞ্জ করব?”

মেয়েটা চুপ করে রইল।

জুলহাজ বলল, “আমার মাইন্ড চেঞ্জ করার কোনো স্কোপ নাই। আমি অনেকদিন প্ল্যান করে আজকের দিনটা ঠিক করেছি।”

মেয়েটা এবারেও চুপ করে রইল।

জুলহাজ বলল, “বেঁচে থাকাটাই সব না। বেঁচে থাকাটা যদি খুব কষ্টের হয় তাহলে শুধু শুধু বেঁচে থাকার কোনো মানে হয় না। বুঝেছ?”

মেয়েটা এবারেও কোনো কথা বলল না।

জুলহাজ আবার জিজ্ঞেস করল, “বুঝেছ?”

“হ্যাঁ বুঝেছি। কিন্তু—”

”কিন্তু কী?”

“একটা কিছু বুঝলেই সেটা মেনে নেয়া যায় না। বোঝা আর মেনে নেয়া আলাদা জিনিস।”

জুলহাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “তোমার বয়স কতো বলেছিলে?”

“আঠারো। আঠারো বছরের কম হলে ভলান্টিয়ার হওয়া যায় না।”

“আঠারো বছর বয়সের জন্যে তুমি বেশ গুছিয়ে কথা বল।”

“থ্যাংক ইউ।”।

“ঠিক আছে, পরী। নিচে এখন কোনো গাড়ী নাই-লাফ দেওয়ার জন্যে আইডিয়াল। আমি গেলাম-”

মেয়েটা ব্যস্ত হয়ে বলল, “এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড, এক সেকেন্ড-”

“কী হল?”

“আপনার কি ভয় করছে?”

“না। ভয় করছে না।”

“দুঃখ লাগছে?”

“মরে যাব সেই জন্যে দুঃখ?”

“হ্যাঁ।”

“না, দুঃখ লাগছে না। আমার কিছুই লাগছে নাড়”

“সুইসাইড করার আগে শেষবার কিছু একটা করার ইচ্ছা করছে?”

“না করছে না।”

“আপনার কী করতে ভালো লাগতো?”

জুলহাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী বলেছিলে, পরী?”

“হ্যাঁ, পরী।”

“পরী, তুমি খামোখা সময় নষ্ট করছ। শুধু শুধু আজে বাজে কথা বলে আমার সময় নষ্ট করছ। তাই না।”

পরী নামের মেয়েটা চুপ করে রইল।

”আমি ঠিক বলেছি কিনা?”

“হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন।”

“শুধু শুধু সময় নষ্ট করে লাভ নাই। বুঝেছ? আমি একজন বড় মানুষ। ম্যাচিওর্ড মানুষ। তুমি একটা বাচ্চা মেয়ে। আমার টুটুল থেকে তুমি খুব বেশী বড় না। বুঝেছ পরী?”

“আমার পরী নামটা আপনার কেমন লাগে?”

জুলহাজ একটু থতমত খেয়ে গেল। বলল, “কী বললে?”

আমি জিজ্ঞেস করেছি, “আমার পরী নামটা আপনার কেমন লাগে?”

“তুমি কেন এসব জিজ্ঞেস করছ? শুধু কথা বাড়ানোর চেষ্টা করছ?”

পরী নামের মেয়েটা বলল, “না, এটা কথা বাড়ানোর জন্যে জিজ্ঞেস করছি না। এটা সত্যি সত্যি জানতে চাইছি।”

“সত্যি কথা বলব?”

“বলেন।”

“নামটা ক্লিশে।”

“ক্লিশে?”

“হ্যাঁ।”

“ক্লিশে মানে কী?”

“অতি ব্যবহারে জীর্ণ।”

“কী আশ্চর্য!”

“কোন জিনিসটা আশ্চর্য?”

“এই যে অতি ব্যবহারে জীর্ণ এর জন্যে একটা শব্দ আছে।”

“যাই হোক তুমি আমার কথা শুনে মনে দুঃখ পেয়েছ?”

“না। বেশী দুঃখ পাই নাই। আপনি যে এ রকম একটা অবস্থায় আমার কথার উত্তর দিয়েছেন সেই জন্যে আপনাকে থ্যাংক ইউ।

“ইউ আর ওয়েলকাম। তাছাড়া তোমার নামটা ক্লিশে সেটা তো তোমার দোষ হতে পারে না। তোমার নাম তো তুমি রাখো নাই।”

“আসলে এই নামটা আমিই রেখেছি।”

জুলহাজ ভুরু কুঁচকালো, “তুমি রেখেছ?”

“হ্যাঁ। এইটা আমার আসল নাম না। এইটা বানানো নাম। আমরা আসল নাম বলি না। একটা বানানো নাম বলি।”

“ও।”

“হ্যাঁ। আমাদের আসল পরিচয় কেউ জানতে পারে না। এটা গোপন রাখতে হয়।”

“ও।”

“আমারও পরী নামটা পছন্দ না।”

“তাহলে রেখেছ কেন?”

“আসলে চিন্তা করার বেশী সময় পাই না। যখন আপনার ফোন এসেছে তখন যেই নামটা প্রথমে মনে এসেছে সেইটাই বলে দিয়েছি।”

“এই নামটা প্রথমে মনে এসেছে?”

“হ্যাঁ। একটা উপন্যাস পড়ছিলাম সেইটার নায়িকার নাম পরী।”

“কার লেখা উপন্যাস?”

“হুমায়ূন আহমেদ।”

“আমিও তাই ভেবেছিলাম।”

“কিন্তু আপনি যেহেতু নামটা পছন্দ করেন নাই এটা চেঞ্জ করে ফেলব।”

“কী নাম রাখবে?”

“আপনি রাগ হবেন না তো?”

জুলহাজ একটু অবাক হলো ”আমি কেন রাগ হব?”

“কারণ নামটা একটু আগে আপনার কাছ থেকে পেয়েছি। আপনার ওয়াইফের নাম। নীলা।”

“নীলা?”

“হ্যাঁ, নীলা।”

জুলহাজ আবার বলল, “নীলা?”

মেয়েটা বলল, “হ্যাঁ। নীলা।” একটু পরে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি.আমার উপরে রাগ হয়েছেন কিংবা বিরক্ত হয়েছেন?”

“রাগ হব কেন? বিরক্ত হব কেন?”

“গুড। থ্যাংক ইউ।” মেয়েটা হঠাৎ করে বলল, “আপনাকে একটা কথা বলি?”

“বল।”

“আমি আপনার ওয়াইফের নামটা নিয়েছি কিন্তু আমি তার সম্পর্কে কিছুই জানি না।”

“অফ কোর্স জান। শি ইজ ডেড।”

“না না সেইটা না। আপনার ওয়াইফ মানুষটা কী রকম-দেখতে কী রকম এই সব আর কী।”

“আবার কথা বাড়ানোর চেষ্টা করছ?”

অন্য পাশ থেকে মেয়েটা একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, “না, না-আমি এইবারে কথা বাড়ানোর চেষ্টা করছি না। এইবার আসলেই জানতে চাচ্ছি। একজন মানুষের নামটা ব্যবহার করব তার সম্পর্কে কিছু তো জানা উচিত। ঠিক কিনা?”

জুলহাজ কিছু বলল না।

মেয়েটা বলল, “একটু পরে তো আর আপনার সাথে যোগাযোগ করা যাবে না। এখনই একটু বলেন। এই একটুখানি প্লীজ।”

জুলহাজ ফোনটা কানে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। নীলার কথা সে চাইলে একটুখানি না অনেকখানি বলতে পারে। অনেকখানি মানে আসলেই অনেকখানি। কিন্তু সে তো আর এখন অনেকখানি বলে শেষ করতে পারবে না।

কোথা থেকে শুরু করবে?

শুরু করবে?

 ৫. রত্নাকে ঘিরে সবাই বসে আছে

রত্নাকে ঘিরে সবাই বসে আছে। কেউ কোনো কথা বলছে না সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে। যখনই রত্নার চোখের সাথে কারো চোখ পড়ছে সে নিঃশব্দে হাতের বুড়ো আঙুলটা উঁচু করে তাকে উৎসাহ দেওয়ার চেষ্টা করছে। সাদা একটা কাগজে ইমরান মার্কার দিয়ে লিখল, “চালিয়ে যাও।”

রুনু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কিছু লাগবে? পানি? চা কপি? কোক?”

রত্না মাথা নেড়ে জানাল কিছু লাগবে না। তারপরও রুনু একটা গ্লাসে করে পানি এনে রত্নার ডেস্কের উপর রাখল। রত্না যদিও বলেছে তার কিছু লাগবে না কিন্তু পানির গ্লাসটা রাখার সাথে সাথে সে গ্লাসটা থেকে ঢক ঢক করে প্রায় পুরো পানিটা খেয়ে ফেলল, তার এভাবে গলা শুকিয়ে আছে সে টের পায়নি।

রাজু ফিস ফিস করে বলল, “কথা বল।”

রত্না আবার কথা বলল, “শুনছেন?”

অন্যপাশ থেকে মানুষটা বলল, “হ্যাঁ। শুনছি।”

“আপনি বলবেন একটু আপনার ওয়াইফের কথা?”

“আমার ওয়াইফের কথা?”

“হ্যাঁ।”

মানুষটা অন্য পোশ থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। বলল, “তুমি কথা বলে বলে সময়টা টেনে লম্বা করার চেষ্টা করছ। ঠিক কিনা?”

“পুরোপুরি ঠিক না। একটুখানি-” আপনি যদি কার্নিশ থেকে নিচে লাফ দেন তাহলে তো সব শেষ। কিন্তু যতক্ষণ লাফ দিচ্ছেন না ততক্ষণ তো একটুখানি হলেও আশা থাকবে যে আপনি হয়তো একবারে শেষ মুহূর্তে আপনার মাইন্ড চেঞ্জ করবেন।”

“না করবো না।”

“ঠিক আছে। কিন্তু মনে করেন যখন আপনি আমাকে আপনার ওয়াইফ নিয়ে কথা বলবেন তখন আপনার একটা দুইটা সুইট মেমোরির কথা মনে পড়বে। পড়বে না?”

“হ্যাঁ পড়বে।”

“তখন আপনার মনটা কি একটু ভালো হবে না?”

“জানি না। হয়তো আরো মনটা খারাপ হবে।”

রত্না মাথা নাড়ল, বলল, “না না মনটা আরো খারাপ হবে না। যখন আপনি সুইট মেমোরিটার কথা বলবেন তখন আপনার মনটা ভালো হবে। আমি জানি।”

“তুমি কেমন করে জান?”

“আমি এই সুইসাইড হটলাইনের ভলান্টিয়ার হওয়ার জন্য ট্রেনিং নিয়েছি না? মানুষের মন কীভাবে কাজ করে সেটার উপরে আমাদের ট্রেনিং দিয়েছে।”

অন্য পাশ থেকে মানুষটা হাসার মত শব্দ করল। বলল, “মানুষের মন এত সোজা একটা জিনিস? যোগ অঙ্কের মত? যে তুমি একটা নিয়ম বলে দেবে আর সেই নিয়মে কাজ করতে থাকবে?”

“না না সোজা জিনিস মোটেও না। আমাদের ট্রেনিং দেওয়ার সময় সেটা একশবার বলেছে। আমাদের বলেছে প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। আমরা একজনের সাথে কথা বলে যেন মনে না করি সবকিছু জেনে গেছি। সবকিছু শিখে গেছি।”

“তাহলে?”

“কিন্তু এইটাও বলেছে যে কথা বললে মানুষের মন হালকা হয়। পরিচিত একজনের সাথে অনেক কথা বলা যায় না কিন্তু যাকে চিনি না

জানি না যার সাথে কোনোদিন দেখা হবে না তার সাথে অনেক কিছু বলে ফেলা যায়। তখন মন হালকা হয়। সেই জন্যে আমি আপনার কথা শুনতে চাইছি। আর কিছু না।” রত্না কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “বলবেন?”

অন্য পাশ থেকে মানুষটা কোনো কথা বলল না।

রত্না টেলিফোনটা ধরে রাখল। তার বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে। যখন এই মানুষটা কার্নিশ থেকে লাফিয়ে পড়বে তখন তার কেমন লাগবে? তার সাথে কথা বলতে বলতে একজন সুইসাইড করেছে এই ব্যাপারটা কি সে সারা জীবনে ভুলতে পারবে?

রত্না কি মানুষটাকে থামাতে পারবে? তাকে শেখানো হয়েছে এ রকম সময়ে কথা বলে যেতে হয়। রত্না কথা বলতে থাকল।

কথা বলতে থাকল।

৬. জুলহাজ কানে টেলিফোনটা ধরে

জুলহাজ কানে টেলিফোনটা ধরে অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটা কথা বলে যাচ্ছে। কী বলছে জুলহাজ ভালো করে শুনছে না। দূরে কোথায় জানি বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঠান্ডা একটা বাতাস হঠাৎ করে তার শরীরটা একটুখানি শিউরে উঠে। নীলা বৃষ্টিকে খুব পছন্দ করতো। হঠাৎ করে মাঝরাতে যদি বৃষ্টি

শুরু হতো সে জুলহাজকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে তুলতো, জুলহাজ ঘুম ঘুম গলায় বলতো, “কী হয়েছে।”

নীলা বলতো, “বৃষ্টি হচ্ছে। দেখো দেখো।”

জুলহাজ বলতো, “বৃষ্টির মাঝে দেখার কী আছে?”

নীলা তখন বিছানা থেকে নেমে জানালার পাশে এসে দাঁড়াতো। বাইরে অন্ধকার, মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এলোমেলো বাতাসে মাঝে মাঝে বৃষ্টির পানি জানালার দিয়ে ভেতরে আসছে, বৃষ্টির ঝাঁপটা এসে লাগছে নীলার গায়ে কিন্তু নীলা সরে যায় না। জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। এতে মুগ্ধ হয়ে কী দেখে জুলহাজ বুঝতে পারে না।

মনে আছে একদিন সকালে আকাশ কালো করে মেঘ এসেছে। গুড়গুড় শব্দ করে মেঘ ডাকছে, তারপর বৃষ্টি শুরু হলো। জুলহাজ জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “হায় হায় এতো ওয়েদার খারাপ, আমি অফিস যাব কেমন করে?”

নীলা কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, “কী বললে তুমি? ওয়েদার খারাপ? খারাপ? এতো সুন্দর বৃষ্টিকে তুমি খারাপ বলছ?”

জুলহাজ হাসি হাসি মুখে বলল, “বৃষ্টির মাঝে কোন জিনিষটা ভালো?”

নীলা বলল, “এক বোতল পানি তুমি কয় টাকা দিয়ে কিনো?”

আলোচনা কোনদিকে যাবে জুলহাজ অনুমান করতে পারে না, সে সরল মুখে জিজ্ঞেস করল, “পাইকারি না খুচরা?”

“ঢং করবে না-বল কতো দিয়ে কিনো?”

“এই দশ টাকার মতো।”

“তাহলে বল এখন কয় বোতল পানি পড়ছে আকাশ থেকে? বল।”

জুলহাজকে স্বীকার করতে হলো, অনেক বোতল পানি পড়ছে আকাশ থেকে। নীলা বলল, “আকাশ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকার পানি পড়ছে। কোটি কোটি টাকার পানি পড়ছে। বুঝেছ?”

জুলহাজ মাথা নেড়ে বলল, “বুঝেছি।”

নীলা মুখে একটা কৃত্রিম কাঠিন্য ধরে রেখে বলল, “খোদা যেহেতু তোমার ভেতরে বৃষ্টির সৌন্দর্য দেখার ক্ষমতা দেয় নাই সেই জন্যে টাকা পয়সার কথা বললাম। অন্তত টাকার হিসাবটা তো বুঝবে!”

জুলহাজ হাসি হাসি মুখে নীলার কথা মেনে নিল। আরেকবার দুইজন রিকশা করে আসছে, হঠাৎ তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। দেখতে দেখতে রাস্তা পানিতে ডুবে গেলো। বুড়ো রিকশাওয়ালা ভিজে চুপসে কোনোমতে রিকশাকে টেনে টেনে নিচ্ছে। তখন নীলা বলল, “চল, রিকশা থেকে থেমে যাই। বৃষ্টিতে ভিজি।”

জুলহাজ অবাক হয়ে বলল, “বৃষ্টিতে ভিজবে?”

“হ্যাঁ। সমস্যা কী?”

“সবকিছু ভিজে যাবে যে-”

“ভেজার জন্যই তো ভিজব।”

“ফোন মানিব্যাগ-”

“আমাকে দাও, ব্যাগের ভেতর রাখি।”

জুলহাজ কিছু বোঝার আগে নীলা থেমে গেল। রিকশাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে জুলহাজ নেমে আসে। নীলা পানিতে ছপছপ করে হাঁটতে থাকে। জুলহাজ আর কী করবে? নীলার পিছু পিছু যেতে থাকে। নীলা বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে গেল, একটু পরে পরে জুলহাজের দিকে তাকায় আর বলে, “কী মজা হচ্ছে। তাই না?”

জুলহাজ মজাটা কোথায় ধরতে পারল না কিন্তু নীলার কথা শুনে মাথা নাড়লো। বৃষ্টির পানি তার চুল বেয়ে মুখে, মুখ বেয়ে চিবুকে গড়িয়ে যাচ্ছে চোখের আই লাইনার ধুয়ে কালো রং মাখামাখি, কাপড় ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে-এর ভেতরে যদি একজন মজা পায় সেটা দেখেও তো তার মজা হওয়া উচিত। রাস্তার ময়লা পানিতে ছপ ছপ করে নীলা হাঁটতে থাকে, একটু পরে পরে উপরের দিকে তাকায়, বৃষ্টির পানি তার চোখ মুখ বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে আর নীলা ছোট বাচ্চার মত হি হি করে হাসছে। একজন মানুষ যে শুধু বৃষ্টি আর বৃষ্টির পানি থেকে এতো আনন্দ পেতে পারে জুলহাজ আগে কখনো চিন্তা করেনি।

দূরে মেঘ গুড়গুড় করে গর্জন করে উঠল। জুলহাজ কার্নিশে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। ঠান্ডা বাতাসটা বইতে শুরু করেছে। জুলহাজ দূরে তাকাল, মনে হয় সত্যি সত্যি নীলার বৃষ্টিটা চলে আসবে? জুলহাজ কি নিচে লাফিয়ে পড়ার আগে একটু অপেক্ষা করবে? বৃষ্টিটা আসতে দেবে?

“বলবেন?” জুলহাজ অন্যমনস্কভাবে ফোনটা ধরে রেখেছিল, ফোনে মেয়েটা কথা বলে যাচ্ছে, একটু পরে পরে জিজ্ঞেস করছে, “বলবেন?” কী বলবে সে? জুলহাজের বিরক্ত হওয়ার কথা, রেগে ওঠার কথা। কিন্তু সে বিরক্ত হয়ে উঠছে না, রেগেও যাচ্ছে না। এই সরল টাইপের কমবয়সী মেয়েটার কথাগুলোকে কেমন করে জানি প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে।

জুলহাজ শুনলো মেয়েটা বলছে, “বলবেন? আপনার ওয়াইফ নিয়ে কিছু একটা বলবেন?”

জুলহাজ বলল, “নীলা খুব বৃষ্টি পছন্দ করতো।”

অন্য পাশ থেকে মেয়েটা আনন্দে একটুখানি চিৎকার করে উঠল, বলল, “আমিও খুব বৃষ্টি পছন্দ করি।”

“আমি অবশ্যি জানি না, বৃষ্টিকে এতো পছন্দ করার কী আছে।”

“একটা কিছু পছন্দ করার জন্য আসলে কোনো কারণের দরকার হয় না।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। কোনো কোনো জিনিস কোনো কারণ ছাড়াই ভালো লেগে যায়।”

“তুমি কেমন করে জান?”

“কারণ-কারণ, আমি, আমার–”

মেয়েটা হঠাৎ থেমে গেল। জুলহাজ জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী?”

“না। বলা যাবে না।”

“কেন?”

“আমাদের ব্যক্তিগত কথা বলা নিষেধ।”

“তুমি আমার ব্যক্তিগত কথা শুনতে পারবে কিন্তু আমি তোমার ব্যক্তিগত কথা শুনতে পারব না?”

“অনেকটা সে রকম।” মেয়েটা একটু থেমে বলল, “ইচ্ছা করলে আপনিও আমাদের ভলান্টিয়ার হতে পারেন, তাহলে আপনিও অন্যের ব্যক্তিগত কথা শুনতে পারবেন।”

“আমি তোমাদের ভলান্টিয়ার হয়ে যাব?”

“আপনি চাইলে হতে পারেন।”

“যাই হোক সেটা মনে হয় কাজ করবে না। আমি আসলে কার্নিশ থেকে লাফ দিব।”

মেয়েটা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে রইল, তারপর বলল, “আমি আসলে কিছুক্ষণের জন্যে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আপনি সুইসাইড করার কার্নিশে দাঁড়িয়ে আছেন।”

“আমি ভুলি নাই।”

“জী।”

“শুধু একটুক্ষণ অপেক্ষা করছি।”

“আমিও সেটা চাই। যতক্ষণ সম্ভব অপেক্ষা করেন-যত বেশী সম্ভব কথা বলেন।”

“আসলে বৃষ্টি আসছে। আমি বৃষ্টিটার জন্যে অপেক্ষা করছি। বৃষ্টিটাতে শেষবার ভিজে যাই। নীলা থাকলে খুশী হতো।”

“নীলা ম্যাডাম বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করতেন।”

জুলহাজ একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর বলল, “খুব।”

“বৃষ্টিতে ভেজার একটা ঘটনার কথা বলবেন?”

জুলহাজ একটু ইতস্তত করে বলল, “আসলে বলার মত সেরকম ঘটনা নাই।”

“তাহলে অন্য কোনো ঘটনা। কোনো মজার ঘটনা।”

“তুমি সত্যিই মনে করো, এই রাতের বেলা কার্নিশের উপর দাঁড়িয়ে আমি একটা মজার ঘটনা বলতে পারব?”

“চেষ্টা করলেই পারবেন।”

“তুমি পারবে?” মেয়েটা একটু অবাক হয়ে বলল, “আমি?”

“হ্যাঁ। তুমি?”

“আমি? আমি-মানে, আমি-আসলে আমার কথা তো আসছে না।”

“পারবে না। একজনকে মজার ঘটনা বলতে বললেই সে বলতে পারে না।”

মেয়েটা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেমে বলল, “যদি আমি বলি তাহলে আপনি বলবেন?”

“সেটা আমি কথা দিতে পারব না।”

“ঠিক আছে কথা না দিলেন, কথা না দিয়ে বলবেন।”

জুলহাজ চুপ করে রইল।

মেয়েটা গলা পরিষ্কার করে বলল, “আমি আমার একটা মজার ঘটনার কথা বলি। এই পরশুদিন এটা ঘটেছে। বলব?”

“বল।”

জুলহাজ পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না যে সে এখন এই মুহূর্তে সতেরো আঠারো বছরের বাচ্চা একটা মেয়ের জীবনের একটা মজার ঘটনার কথা শুনতে রাজী হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি ঘটানাটা কী শোনার জন্যে তার ভেতরে খানিকটা কৌতূহল হচ্ছে। কী আশ্চর্য!

মেয়েটা বলতে শুরু করল, “আমার খালা আমেরিকা থেকে অনেকদিন পর দেশে ফিরে এসেছে। সবার জন্যে অনেক গিফট এনেছে। আমার জন্যেও এনেছে। আমার জন্যে যে গিফট এনেছে তার একটা হচ্ছে মুখে দেওয়ার ক্রীম। এটা নাকি খুব দামী ক্রীম। মুখে দিলে মুখের চামড়ার মাঝে কী কী জানি হয়। ছোট একটা কৌটা দাম সাতাইশ ডলার। সাতাইশ ডলার মানে বুঝেছেন তো, প্রায় দুই তিন হাজার টাকা দাম।

“যাই হোক এতো দামী একটা ক্ৰীম আমি খুবই যত্ন করে ব্যবহার করি। নষ্ট না হয়ে যায় সেইজন্যে ফ্রীজের ভেতরে রেখেছি। একদিন রাত্রে ঘুমানোর আগে মুখে ক্রীম দিতে গিয়ে দেখি আমার পুরো কৌটাটা প্রায় খালি। কেউ একজন পুরোটা মেখে ফেলেছে। আমি চিৎকার করে বললাম, ক্রীম! আমার ক্রীম কে মেখেছে?

“প্রথমে কেউ স্বীকার করতে চায় না, তখন আমার নানী একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, এইটা ক্রীম নাকী? আমি ভেবেছিলাম চুন, তাই পানের সাথে খেয়ে ফেলেছি। আমি চিৎকার করে বললাম, নানী তুমি মুখে দিয়েও বুঝো নাই এইটা ক্রীম? নানী বললেন, উঁহু! আমি ভেবেছি বিদেশী চুন। একটু মোলায়েম। তাই বেশী করে খেতে হয়েছে। সবাই নানীকে নিয়ে যখন হাসাহাসি করছি তখন নানী বললেন, জিনিসটা কিন্তু খেতে খারাপ না। চুনের মত ধাক নাই কিন্তু খেলে বাহ্যি পরিষ্কার হয়। মেয়েটা হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “বাহ্যি পরিষ্কার মানে বুঝেছেন?”

জুলহাজ বলল, “বুঝেছি।”

“গল্পটা মজার না?”

“হ্যাঁ, মজার।”

মেয়েটা কিচুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “এখন আপনি কী একটা মজার ঘটনার কথা বলবেন?”

“সে রকম মজার ঘটনার কথা তো মাথায় আসছে না।”

“যেটাই আসে সেটাই বলেন। মজার না হলেও ক্ষতি নাই, যে কোনো ঘটনা। সুইট একটা ঘটনা-”

“একদিন সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে বাসায় এসেছি।” জুলহাজ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না যখন দেখল সে সত্যিই মেয়েটাকে একটা মজার ঘটনার কথা বলার চেষ্টা করছে। জুলহাজ হঠাৎ করে চুপ করে গেল।

মেয়েটা বলল, “বলেন। তারপর কী হল?”

জুলহাজ বলতে শুরু করল, “বাসায় এসে দেখি নীলা রেগে ফায়ার। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, তোমার ছেলে আজকে কী করেছে জান? টুটুল তখন খুবই ছোট। মাত্র হাঁটতে শিখেছে। সারাক্ষণ হেঁটে বেড়ায়। এত ছোট ছেলে কী করেছে আমি বুঝতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কী করেছে? নীলা বলল, দুপুর বেলা শুয়েছি, হঠাৎ একটু কাশি উঠেছে। তোমার ছেলে জিজ্ঞেস করল, পানি খাবে আম্মু? পানি খাবে? আমি বলেছি, খাব। তোমার ছেলে তখন দৌড় দিয়ে গণ্ডাসে পানি এনে দিল, তাকে খুশী করার জন্য আমি পানিটা খেলাম। খাওয়ার পর মনে হল সে পানি কোথা থেকে আনবে? খাবার টেবিলে সে তো পানির বোতল নাগাল পায় না। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে কোত্থেকে এনেছে? নীলা চিৎকার করে বলল, যেখানে নাগাল পায় সেখান থেকে এনেছে। কমোড থেকে।”

জুলহাজ কথা শেষ হবার আগেই টেলিফোনের অন্য পাশ থেকে মেয়েটা হি হি করে হাসতে থাকে। মেয়েটার হাসি শুনে জুলহাজও একটুখানি হেসে ফেলল। হেসে ফেলে সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সে কি ভেবেছিল যে সে আবার কোনোদিন হাসবে? কী আশ্চর্য!

ঠিক তখন বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। জুলহাজ আকাশের দিকে তাকালো। পুরো আকাশটা বিজলীর ঝলকানীতে একবার ঝলসে ওঠে। মুহূর্তের জন্যে চারিদিক স্পষ্ট দেখা যায় তারপর আবার অন্ধকারে ডুবে যায়।

জুলহাজ বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকে। নীলা নেই, থাকলে এখন কী খুশিই না হতো। অনেকদিন ভেবেছিল টুটুলকে নিয়ে তারা তিনজন বৃষ্টিতে ভিজবে। ভেজা হয়নি। আর কখনো ভেজা হবে না। জুলহাজের বুকের ভেতরটা হঠাৎ কীভাবে জানি মোচড় দিয়ে ওঠে। বিচিত্র একটা কষ্ট, একটা শূন্যতা বুকের ভেতর খাঁখাঁ করতে থাকে। কার্নিশ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়লেই সব কষ্ট সব শূন্যতা এক মুহূর্তে শেষ হয়ে যাবে।

জুলহাজ নিচের দিকে তাকালো। এখনো টেলিফোনটা ধরে রেখেছে। মেয়েটা কিছু একটা বলছে। অর্থহীন কোনো একটা প্রশ্ন। সময় কাটানোর জন্যে কোনো একটা কথা।

হঠাৎ কী হল কে জানে জুলহাজ হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। নীলা আর টুটুল চলে যাবার পর সে একবারও কাঁদেনি। একবারও না। মনে হল জমে থাকা সব কান্না একবারে বের হয়ে আসছে।

জুলহাজ ঠোঁটে কামড় দিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে থাকে। টেলিফোনের অন্যপাশে বাচ্চা একটা মেয়ে শুনছে সে কাঁদছে। শুনুক, কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না।

৭. রত্না টেলিফোনটা শক্ত করে ধরে রাখে

রত্না টেলিফোনটা শক্ত করে ধরে রাখে। অন্যপাশে মানুষটা কাঁদছে। বড় একজন মানুষ কাঁদছে। মানুষটা কান্না থামানোর কোনো চেষ্টা করছে না। রত্নার শরীরটা কেমন জানি ঝিম ঝিম করতে থাকে, মনে হতে থাকে তার শরীরটা অবশ হয়ে আসছে। হঠাৎ করে তার ভেতরে তীব্র একটা অপরাধবোধ এসে ভর করে। তার মনে হতে থাকে সে খুব বড় একটা অন্যায় করে ফেলছে। না বুঝে না জেনে সে একজন মানুষের বুকের ভেতরের গভীর একটা যন্ত্রণার মাঝে হাত দিয়ে ফেলেছে। কে তাকে সেই অধিকার দিয়েছে? সে কেমন করে একজন মানুষের যন্ত্রণাটুকু টেনে বের করে এনেছে? এতো বড় নির্বোধ সে কেমন করে হলো?

রত্না টেলিফোনটা কান থেকে সরিয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকালো। রুনু ঝুঁকে পড়ে ফিস ফিস করে বলল, “কিছু বলবে?”

রত্না মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ। আমি একা কথা বলতে চাই।”

“একা?”

“হ্যাঁ। প্লীজ। আপু তোমরা ঘরটা খালি করে দেবে?”

রুনু উঠে দাঁড়াল, বলল, “ঠিক আছে।” সে কিছুক্ষণ রত্নার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর নরম গলায় বলল, “মনে রেখো। একেবারে শেষ মুহূর্তে কিন্তু কোনো নিয়ম নাই। তুমি যেটা বলতে চাও বলো, যেটা করতে চাও করো। সব প্রটোকল ভুলে যাও। এখন প্রটোকল একটা। তুমি একটা মানুষ-সেও একটা মানুষ। বুঝেছ?”

রত্না মাথা নাড়ল। বলল, “থ্যাংক ইউ আপু।”

ছোট ঘর থেকে সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর রত্না টেলিফোনটা কানে লাগালো। মানুষটা এখনো কাঁদছে। রত্না নরম গলায় ডাকলো, বলল, “শুনছেন।”

মানুষটা মনে হয় কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, রত্না ঠিক বুঝতে পারল না। সে আবার বলল, “আপনি শুনছেন? আমি একটা কথা বলি? খুব ইম্পরট্যান্ট। আমাকে বলতেই হবে। প্লীজ।”

মানুষটা একটু শান্ত হল। বলল, “বল।”

“আপনি আমাকে মাপ করে দেন। প্লীজ। আমি আপনার কাছে মাপ চাই।”

মানুষটা মনে হয় একটু অবাক হল, বলল, “মাপ চাও? কেন?”

“আমি খুবই বোকা একটা মেয়ে। স্টুপিড বলতে পারেন। আমি ভেবেছি আমি সবকিছু জানি আর বুঝি। আমি ভেবেছি আমি আপনার সাথে কথা বলে আপনাকে সান্ত্বনা দিতে পারব। আসলে আমি উল্টো আপনার ভেতরের সব কষ্টটাকে বের করে এনেছি। আমি সরি। আমি আসলেই সরি।

“তোমার সরি হওয়ার কিছু নাই। আমার হঠাৎ করে টুটুলের কথা মনে পড়ে গেল-” মানুষটা আবার শব্দ করে কাঁদতে থাকে।

“আমি সরি। আমি খুবই সরি। আপনাকে কিছু বলতে হবে না। আমি গাধা একটা মেয়ে সেই জন্যে আপনাকে জোর করে কথা বলিয়েছি। না বুঝে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে।”

মানুষটা রত্নার কথা শুনতে পেল কিনা বোঝা গেল না, বলল, “টুটুল যখন ছোট ছিল তখন–যখন বাসায় আসতাম সন্ধ্যাবেলা, তখন সে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে আসতো। আমাকে দেখে কী খুশী হতো-মনে হতো বেঁচে থাকাটা স্বার্থক। এই পৃথিবীতে কেউ একজন আমাকে এতো ভালোবাসে। এখন-”

রত্না ধরা গলায় বলল, “আপনি আর বলবেন না প্লিজ। প্লিজ।”

“শোনো একটু। কাউকে একটু বলি। বুঝেছ পরী, গত ছয় মাস কাউকে কিছু বলি নাই। আমি একবার হাসি নাই। একটুও কাঁদি নাই। তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে–”

“বোকা একটা মেয়ে।” রত্না কথার মাঝখানে কথা বলল, “গাধা একটা মেয়ে।”

“যেটাই হোক। তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ কী যে হলো কখনো কাঁদছি। কখনো হাসছি। এতোদিন কষ্টটা চাপা দিয়ে রেখেছিলাম, হঠাৎ করে কষ্টটা যেন বের হয়ে আসছে।”

“আমি এভাবে বের করতে চাই নাই। বিশ্বাস করেন–খোদার কসম।”

“কী বৃষ্টি হচ্ছে এখানে। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছি। বারবার নীলার কথা মনে হচ্ছে। এখন থাকলে কতো খুশী হতো। সবসময় বলতো টুটুলকে নিয়ে ভিজতে হবে, টুটুলকে নিয়ে ভিজতে হবে।”

“কখনো ভিজেন নি?”

“না ভিজা হয় নাই। আরো কতো কিছু হয় নাই। ভেবেছিলাম একদিন চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব–যাওয়া হয় নাই। ভেবেছিলাম একদিন নৌকা করে নদীতে নিয়ে যাব–নেওয়া হয় নাই। ভেবেছিলাম কাদায় মাখামাখি করে মাছ ধরতে যাব-যাওয়া হয় নাই। পাঁচ বছর তিন মাস সতেরো দিন খুবই কম সময়।”

রত্না চুপ করে রইল।

মানুষটা বলল, “ছেলেটা মনে হয় জানতে সে মাত্র পাঁচ বছর তিন মাস সতেরো দিন বেঁচে থাকবে। সেই জন্যে সে অবাক হয়ে সবকিছু দেখতো, কাউকে কিছু জ্বালাতন করতো না। ঢাকা শহরে চাঁদ থাকলেও দেখা যায় না। দেখা গেলেও কেমন জানি লাগে। একবার শ্রীমঙ্গল গিয়েছি। একটা চা বাগানে। রাত্রে এতো বড় একটা পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে-একেবারে ঝক ঝক করছে। টুটুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।“ একটু পরে পরে হাত দিয়ে দেখায় আর বলে, “চাঁদ। দেখো চাঁদ।”

রত্না এবারেও চুপ করে রইল। প্রটোকল অনুযায়ী প্রত্যেকটা কথার সাথে তার কিছু একটা বলার কথা যেন মানুষটা জানে সে তার কথা

শুনছে। রত্না আর প্রটোকল মানছে না, মানুষটা যখন তাকে কিছু জিজ্ঞেস

করবে তখন সে উত্তর দেবে। একটা বাবা যখন তার সন্তানের কথা বলছে

তখন মাঝে মাঝে কথা বলার কিছু নেই। সে শুনছে।

মানুষটা হঠাৎ ভাঙা গলায় বলল, “আমার টুটুল চলে যাবার পর আমি কী করতাম জানো?”

“কী করতেন?”

“তার একটা শার্ট মুখের মাঝে চেপে রাখতাম তার শরীরের ঘ্রাণের জন্য। একটু ঘ্রাণের জন্য। তার কিছু পৃথিবীতে নাই, শুধু তার শরীরের একটুখানি ঘ্রাণ রয়ে গেছে। একটুখানি ঘ্রাণ-” মানুষটা আবার হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। আর কী আশ্চর্য রত্নাও ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। রত্না নিজেকে কয়েকবার শান্ত করার চেষ্টা করে ভাঙা গলায় বলল, “আমি বোকার মত কেঁদে ফেলেছি। আমি সরি। আমি রিয়েলি সরি।”

মানুষটা কিছু বলল না। রত্না বলল, “হটলাইনে কথা বলার সময় যদি কেউ কেঁদে ফেলে তাহলে সে ভলান্টিয়ার হতে পারে না। আমি আর ভলান্টিয়ার হতে পারব না।”

“কেন?”

“আমি আর হতেও চাই না। আমি আসলে হতেও পারব না। আমি বোকা। দুর্বল।”

মানুষটি বলল, “না পরী। তুমি বোকা না। দুর্বল না। তুমি অনেক ভালো ভলান্টিয়ার।”

“আপনি আমাকে খুশী করার জন্যে বলেছেন।” রত্না ভাঙা গলায় একটু হেসে ফেলল, “আমার আপনাকে সাহায্য করার কথা। এখন উল্টোটা হচ্ছে। আপনি আমাকে সাহায্য করছেন। থ্যাংক ইউ।”

“তুমি যথেষ্ট ভালো ভলান্টিয়ার।”।

“আসলে আজকে আমার প্রথম দিন। আমি আসলে খুব নার্ভাস ছিলাম। ভয় পাচ্ছিলাম কার সাথে কথা বলতে হবে–সবাই সাহস দিয়েছে

বলেছে কোনো ভয় নাই। বেশীর ভাগ কেস হচ্ছে মায়ের বকা খেয়েছে, বয়ফ্রেন্ড চলে গেছে এ রকম। একবারও ভাবি নাই আপনার সাথে কথা বলতে হবে। আপনাকে সাহায্য তো করতেই পারি নাই উল্টো মনে কষ্ট দিয়েছি। আমি সরি–”

মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “না পরী।”

“আমার আসল নাম রত্না।”

“তোমার না আসল নাম বলার নিয়ম নাই।”

“নিয়ম না থাকলে নাই। আমি আর নিয়ম মানছি না। মানার দরকার নাই।”

“কেন?”

“কারণ আপনার সাথে কথা শেষ করে আমি এখান থেকে বের হয়ে চলে যাব। আর কোনোদিন আসব না–আমি আর ভলান্টিয়ার হব না। কোনও দিনও না।”

“কেন হবে না? তুমি যথেষ্ট ভালো ভলান্টিয়ার।”

“না। আমি ভালো ভলান্টিয়ার না। ভালো ভলান্টিয়ার কাউকে কষ্ট দেয় না। ভালো ভলান্টিয়ার নিজে কেঁদে ফেলে না।”

মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর এক ধরনের ক্লান্ত গলায় বলল, “তুমি আসলে আমাকে কষ্ট দাওনি। এইটা আমার ভেতরেই ছিল, আমি শুধু চাপা দিয়ে রেখেছিলাম।” মানুষটা একটু থামল, তারপর বলল, “সেটা মনে হয় আরো বেশী কষ্ট।”

“আমি আপনাকে জোর করে আটকে রেখেছিলাম, জোর করে কথা বলানোর চেষ্টা করছিলাম। আর করব না। আপনি যখন ইচ্ছা কথা বলা বন্ধ করে দিবেন। যখন ইচ্ছা-”

“আসলে টেলিফোনে চার্জ নাই। তার উপর বৃষ্টিতে ভিজে আছে। যে কোনো সময় লাইন কেটে যাবে। যদি লাইন কেটে যায় তাহলে রত্না তোমাকে থ্যাংক ইউ।”

“আমাকে থ্যাংক ইউ? সত্যি? নাকি আমাকে খুশী করার জন্য বলছেন?”

“সত্যি বলছি। থ্যাংক ইউ।”

“আমি আরো ভাবছি-”

মানুষটা রত্নাকে থামিয়ে বলল, “তোমার সাথে কথা বলতে বলতে আমার খুব অবাক একটা ফিলিংস হয়েছে। অবাক।”

“কী ফিলিংস?”

“মনে হয়েছে নীলা নাই, টুটুল নাই। এখন তাদের কী আছে জান? শুধু তাদের স্মৃতি-যখন আমি থাকব না তখন সেই স্মৃতিটাও থাকবে না। পৃথিবীতে নীলা আর টুটুলের কিছু থাকবে না।”

“তার মানে তার মানে—”

“তার মানে আমার মনে হচ্ছে, আমি পৃথিবীতে আরও কিছুদিন নীলা আর টুটুলের স্মৃতিটা রেখে দিই, কী বল?”

রত্না কিছু বলল না। বলার কিছু খুঁজে পেলো না। মানুষটা বলল, “কী হল? কিছু বলবে না?”

রত্না ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগল। শুনতে পেলো অন্য পাশ থেকে এক সময় টুক করে লাইনটা কেটে গেছে।

রত্না টেলিফোনটা রেখে টেবিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। একটু পর রুনু দরজা একটু ফাঁক করে উঁকি দিল, জিজ্ঞেস করল, “আসব?”

রত্না কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আস।”

রুনু এবং তার পিছু পিছু ইমরান আর রাজু এসে ঢুকলো। রুনু রত্নার মাথায় হাত রেখে নরম গলায় বলল, “কাদার কিছু হয় নাই। কগ্রাচুলেশনস। রত্না তুমি একজনের প্রাণ বাঁচিয়েছ।”

রত্না অবাক হয়ে তাকালো। বলল, “তুমি কেমন করে জান?”

রুনু ফিস ফিস করে বলল, “জানি। যখন কেউ একজন মানুষের প্রাণ বাঁচায় তখন সে এই ভাবে হাউমাউ করে কাঁদে।”

. ঠিক তখন আবার টেলিফোনটা বেজে উঠল।

Exit mobile version