Site icon BnBoi.Com

সাইক্লোন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

সাইক্লোন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

 ১. ক্লাস শেষের ঘণ্টা

বেশ কয়েক মাস আগে একজন বাবা আমার সাথে যোগাযোগ করে বললেন, তাঁর মেয়েটি আমার সাথে খুব দেখা করতে চাইছে। তারপর যেটি বললেন সেটি শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। বাবা আমাকে বললেন, মেয়েটি হাসপাতালে এবং আগামী এক-দুদিনের ভেতর সে মারা যাবে। মেয়েটি নিজেও সেটি জানে।

আমি তখন সিলেট থেকে ঢাকা এসেছি, যখন হাসপাতালে তার সাথে দেখা করতে যাচ্ছি তখন মনে হলো, আমার জীবনে এর চাইতে কঠিন কোনো কাজ হয়তো আর কখনো করতে হবে না।

যখন তার সাথে দেখা হবে তখন তাকে কী বলব, আমি জানতাম না। কিন্তু সেই ছোট মেয়েটি অসাধারণ বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে ছিল, তাই তার সাথে কথা বলার কাজটি খুব সহজ হয়ে গেল। আমি ভাণ করলাম সবকিছু ঠিক আছে, জীবন খুব আনন্দময় এবং সেই মেয়েটিও আমার সাথে অভিনয় করে গেল। আমরা হাসি-তামাশা করলাম, গল্প করলাম। সে কোনো এক অলিম্পিয়াডে আমার সাথে তোলা তার ছবি দেখাল। আমি নিজের কিছু বই উপহার দিলাম, সে তার বইগুলোতে আমার অটোগ্রাফ নিয়ে নিল। গল্প করে করে আমরা সময়টি কাটিয়ে দিলাম।

চলে আসার সময় আমি তার একটি বইয়ের পেছনে লিখে এলাম, সে যেন ভালো হয়ে ওঠে, আমি তাকে একটি বই উৎসর্গ করব।

মেয়েটি ভালো হয়ে ওঠেনি, দুদিন পর খবর পেয়েছি সে মারা গেছে।

মেয়েটির নাম নভেরা। আমি তাকে আমার এই বইটি উৎসর্গ করতে চাই।

নভেরা, তোমার জন্যে অনেক অনেক ভালোবাসা।

***

শেষ পর্যন্ত ঢং করে ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়ল। বিজলী আশা ছেড়েই দিয়েছিল, একটু আগে তার মনে হচ্ছিল আর কোনোদিন বুঝি ঘণ্টাটা পড়বে না, ক্লাসটাও শেষ হবে না। এই ক্লাসটা অঙ্ক ক্লাস, ক্লাস নেন আজীজ স্যার–যদিও কেউ তাকে আজীজ স্যার ডাকে না। কথা বলার সময় গলার কাছে একটা রগ ফুলে যায় বলে সবাই আড়ালে তাকে রগু স্যার বলে ডাকে। রপ্ত স্যার ক্লাসে এসে বোর্ডে একটার পর একটা অঙ্ক লিখতে থাকেন। তাদেরকে সেগুলো খাতায় তুলতে হয়। পরীক্ষার আগে সেই অঙ্কগুলো মুখস্থ করতে হয়। এই অঙ্কগুলো থেকে কয়েকটা অঙ্ক পরীক্ষায় আসে, পরীক্ষার খাতায় দাড়ি-কমাসহ সেগুলো মুখস্থ লিখে দিয়ে আসতে হয়। যারা রপ্ত স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে তাদেরকে রপ্ত স্যার আগে থেকে বলে দেন পরীক্ষায় কোন কোন অঙ্কটা দেবেন। তাদের বেশি অঙ্ক মুখস্থ করতে হয় না, যেগুলো পরীক্ষায় আসবে শুধু সেগুলো মুখস্থ করলেই হয়। পরীক্ষাতেও তারা বেশি নম্বর পায়। বিজলী কোনো স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে না। প্রাইভেট পড়তে যে টাকার দরকার তার সে টাকা নাই। টাকা থাকলেও কোনোদিন তাকে বাবা-মা সেই টাকা দেবেন না। সত্যি কথা বলতে কী অনেক চেষ্টাচরিত্র করে স্কুল থেকে তার টিউশন ফ্রি করা হয়েছে বলে সে স্কুলে আসতে পারছে। যদি কোনোদিন তার টিউশন ফি আবার দিতে হয় সাথে সাথে তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাবে।

ঘণ্টা পড়ার পর অঙ্ক স্যার চক ডাস্টার নিয়ে ক্লাস থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিজেদের ভেতরে কথা বলতে শুরু করে। তাদের দেখে মনে হয় একটা ঘণ্টা কথা বলতে না পেরে তাদের বুকটা বুঝি ফেটে যাচ্ছিল। বিজলী চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। জানালার পাশে এই সিটটা তার খুব প্রিয়, আগে আসতে পারলে সে সব সময় এই সিটটা দখল করে নেয়। এখানে বসে বাইরে তাকালে দূরে সমুদ্রটা দেখা যায়। ছেলেমেয়েরা যদি কথা বন্ধ করে তাহলে সমুদ্রের গর্জনটাও আবছাভাবে শোনা যায়। সমুদ্রের এই চাপা গর্জনটা শুনে বিজলী সব সময়েই বুকের ভেতর ফাঁকা ফাঁকা অনুভব করে, তার কারণটা কী কে জানে? ভাটা শুরু হয়েছে, বিজলী এখানে বসেই দেখতে পায় সমুদ্রের পানি নিচে নামতে শুরু করেছে, গাংচিলগুলো আকাশে উড়ছে। পানি নেমে যাওয়ার পর শামুক কাঁকড়া বের হতে শুরু করেছে আর গাংচিল সেগুলো খাওয়ার জন্যে ভিড় করে এসেছে।

ক্লাসের ছেলেমেয়েদের কথা হঠাৎ করে থেমে গেল, বিজলী মাথা ঘুরিয়ে দেখল তাদের বিজ্ঞান স্যার ক্লাসে ঢুকছেন। এই স্যার নতুন এসেছেন, তাই এখনো তার কোনো নাম দেয়া হয়নি। সবাই স্যারের নাম অনুযায়ী শ্যামল স্যার বলে ডাকে। বিজলীর যতগুলো ক্লাস করতে হয় তার মাঝে এই ক্লাসটা সবচেয়ে প্রিয়। স্যার একটা কিছু পড়াতে শুরু করে সেখান থেকে অন্য কিছুতে চলে যান, সেখান থেকে আবার অন্য কিছুতে চলে যান, তারপর হঠাৎ করে থেমে গিয়ে মাথা চুলকে বলেন, তোমাদের কী যেন পড়াচ্ছিলাম? স্যার কী পড়াচ্ছিলেন সেটা বলে দিলে স্যার তখন আবার সেখান থেকে পড়াতে শুরু করেন। তবে বিজলীর অবশ্যি বইয়ের পড়া থেকে স্যারের উলটাপালটা গল্পগুলো শুনতেই বেশি ভালো লাগে।

শ্যামল স্যার চক ডাস্টার টেবিলের উপর রেখে হেঁটে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকালেন। দূরে সমুদ্রটার দিকে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, সমুদ্রটা কী সুন্দর দেখেছ?

স্যারের কথা শুনে সবাই জানালাটা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকালো। ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে সমুদ্রের ধারেকাছে থাকে, তারা প্রত্যেক দিন সমুদ্রটাকে দেখে। যে জিনিস প্রত্যেক দিন দেখতে পায় সেটা আসলেই সুন্দর কি না সেটা মনে হয় কেউই ঠিক করে বুঝতে পারে না। শ্যামল স্যার বাইরে থেকে এসেছেন, তাই সমুদ্র দেখে এরকম মুগ্ধ হয়ে যান।

শ্যামল স্যার জানালা থেকে সরে হেঁটে হেঁটে টেবিলের কাছে। ফিরে এলেন, অন্যমনস্কভাবে টেবিল থেকে চকটা হাতে নিতে নিতে বললেন, এত সুন্দর শান্ত-শিষ্ট একটা সমুদ্র কিন্তু সাইক্লোনের সময় এটাই কী ভয়ংকর হয়ে যায়। সত্তর সালে এই সমুদ্র দশ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলেছিল।

বিজলী আবার জানালা দিয়ে সমুদ্রটার দিকে তাকালো। তাদের পাঠ্যবইয়ে সত্তর সালের ঘূর্ণিঝড়ের কথাটা লেখা আছে। এই ঘূর্ণিঝড়ে দশ লক্ষ লোক মারা গিয়েছিল, সেটাও বিজলী পড়েছে। কিন্তু স্যার বলার পর আজকে হঠাৎ করে বিজলী প্রথমবার বুঝতে পারল দশ লক্ষ আসলে অনেক বড় সংখ্যা! সেই ঘূর্ণিঝড়ে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল।

শ্যামল স্যার ক্লাসের ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনো মাঝে মাঝে সাইক্লোন হয় কিন্তু এখন আর এত মানুষ মারা যায় না।

একজন জিজ্ঞেস করল, কেন স্যার?

সাইক্লোন শেল্টার তৈরি হয়েছে। যখন সাইক্লোন আসে তখন সবাই শেল্টারে চলে যায়। একটা বেলা কষ্ট করে শেল্টারে থাকে, কিন্তু সবাই জানে বেঁচে যায়।

সামনে থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, সাইক্লোন কেন হয় স্যার?

স্যার এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তারপর সাইক্লোন কেন হয় সেটা বোঝাতে শুরু করলেন। সমুদ্রের পানি যখন গরম থাকে তখন জলীয় বাষ্প উপরে উঠে গিয়ে কীভাবে পানির ফোঁটাতে পাল্টে গিয়ে তাপ ছেড়ে দেয়, সেই তাপ কীভাবে সাইক্লোনকে শক্তি দেয় এই রকম কথা। বিজলী ঠিক ভালো করে বুঝতে পারল না, কিন্তু ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের সাথে সাথে বুঝে ফেলার ভাণ করে মাথা নাড়ল।

স্যার বোঝানো শেষ করে আবার জানালা দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার সব সময় কী মনে হয় জানো?

ছেলেমেয়েরা জিজ্ঞেস করল, কী মনে হয় স্যার?

আমার মনে হয় সমুদ্রটা বুঝি জীবন্ত। সে জন্যে এটা কখনো থেমে যায় না। একটার পর একটা ঢেউ পাঠাতেই থাকে। পাঠাতেই থাকে!

কয়েকজন ছেলেমেয়ে হি হি করে হাসল, তাদের কাছে মনে হয়েছে স্যারের কথাটা বুঝি হাসির একটা কথা। বিজলী অবশ্যি হাসল না, স্যার আসলে এটা মোটেই হাসির কথা হিসেবে বলেননি।

স্যার ছেলেমেয়েদের হাসিটুকু লক্ষ করলেন বলে মনে হলো না, অনেকটা আপন মনে বললেন, শুধু যে ঢেউয়ের পর ঢেউ পাঠাতে থাকে তা নয়, দিনে দুইবার জোয়ারের সময় পানি ফুলেফেঁপে উঠে আবার ভাটার সময় পানি নেমে যায়! কখনো ভুল হয় না!

একজন জিজ্ঞেস করল, জোয়ার-ভাটা কেন হয় স্যার?

চাঁদের আকর্ষণে। কত দূরে চাঁদ কিন্তু সেটা পৃথিবীর পানিকে আকর্ষণ করে ফুলিয়ে দেয়, আমরা বলি জোয়ার। আবার যখন চাঁদ সরে যায়, পানিটা সরে যায় আমরা বলি ভাটা।

বিজলী জোয়ার-ভাটার ব্যাপারটা একটু চিন্তা করল, তার হঠাৎ করে একটু খটকা লাগল। যদি চাঁদের আকর্ষণে জোয়ার হয় তাহলে তো দিনে একবার জোয়ার হওয়ার কথা। চাঁদ তো দিনে একবার পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরে আসে, দুইবার নয়। কিন্তু দিনে তো সব সময় দুইবার জোয়ার হয়, দুইবার ভাটা হয়। কেন দুইবার?

স্যারকে প্রশ্ন করে জোয়ার-ভাটার ব্যাপারটা কী একবার বুঝে নেবে? ক্লাসে সে কখনোই প্রশ্ন করে না, তার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে। কিন্তু আজকে সাত পাঁচ ভেবে বিজলী শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটা করার জন্যে হাত তুলল।

স্যার বিজলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কোনো প্রশ্ন করবে?

জি স্যার।

কর।

চাঁদের আকর্ষণে যদি জোয়ার-ভাটা হয় তাহলে তো দিনে একবার জোয়ার আর একবার ভাটা হওয়ার কথা। কিন্তু স্যার

কিন্তু?

কিন্তু স্যার দিনে তো দুইবার জোয়ার আর দুইবার ভাটা হয়।

স্যার ভুরু কুঁচকে বিজলীর দিকে তাকালেন, মনে হলো প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারছেন না।

বিজলী প্রশ্নটা আরেকটু ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করল, বলল, মানে স্যার আমি বলছিলাম কী চাঁদ তো পৃথিবীকে দিনে একবার ঘুরে আসে কিন্তু দুইবার জোয়ার হয় কেন? মানে–

শ্যামল স্যার বিজলীকে থামালেন, বললেন, তোমাকে আর বলতে হবে না। আমি বুঝেছি।

বিজলী উত্তরটা শোনার জন্যে দাঁড়িয়ে রইল। স্যার ভুরু কুঁচকে কীভাবে জানি চিন্তা করতে লাগলেন কিন্তু কোনো কথা বললেন না। এভাবে খানিকটা সময় পার হয়ে গেল, স্যার তখন বিজলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী আশ্চর্য! এই সহজ একটা জিনিস আমি কখনোই খেয়াল করিনি! তুমি ঠিকই বলেছ, দিনে একবার জোয়ার আর একবার ভাটা হওয়ার কথা।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, তাহলে দুইবার কেন হয় স্যার?

আমি জানি না।

বিজলী স্যারের দিকে অবাক হয়ে তাকালো। স্যার এই প্রশ্নের উত্তরটা জানেন না? কী আশ্চর্য।

স্যার মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, তোমার প্রশ্নটা খুবই ক্লেভার একটা প্রশ্ন। অসাধারণ প্রশ্ন!

বিজলী থতমত খেয়ে গেল। প্রশ্ন তো প্রশ্নই–সেটা আবার অসাধারণ হয় কেমন করে? বরং উল্টোটা সত্যি, স্যারদের যদি কখনো কোনো প্রশ্ন করা হয় যার উত্তর স্যারেরা জানেন না তখন স্যারেরা রেগেমেগে ধমক দিয়ে তাদের বসিয়ে দেন। শ্যামল স্যার মোটেও রাগলেন না, মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন, তুমি খুবই সুন্দর একটা প্রশ্ন করেছ। আমি কখনোই এটা চিন্তা করিনি। এখন চিন্তা করেও উত্তরটা বের করতে পারিনি।

বিজলী বসে যাচ্ছিল, তখন স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

বিজলী।

বিজলী? বাহ্ কী সুন্দর নাম!

বিজলী আবার থতমত খেয়ে গেল, বিজলী একটা সুন্দর নাম হতে পারে? তার মা সব সময় বলেন, তাকে এই নামটা দেওয়াই ভুল হয়েছে, এই নাম দেওয়ার জন্যই সে নাকি সব সময় এত যন্ত্রণা করে।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার অন্য ভাইবোনদের কী নাম? ঝড় বৃষ্টি সাইক্লোন?

ক্লাসের সব ছেলেমেয়ের সাথে বিজলীও হেসে ফেলল, বলল, না স্যার। আমার খালি একটা ছোট ভাই আছে তার নাম খোকন।

স্যার বললেন, ভেরি গুড! ভেরি গুড!

বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না কোনটা ভেরি গুড। তার ছোট ভাই থাকাটা নাকি তার নাম ঝড় বৃষ্টি সাইক্লোনের বদলে খোকন হওয়াটা। যেটাই হয়ে থাকুক সে আর মাথা না ঘামিয়ে বসে পড়ল।

স্যার হাসি হাসি মুখে বিজলীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আমার খুব ভালো লাগছে যে তুমি ছোট একটা মেয়ে কিন্তু তোমার এত সুন্দর এনালিটিকেল মাইন্ড। যে জিনিসটা কখনো আমার মাথায় আসেনি কিন্তু তুমি সেই প্রশ্নটা করেছ। তুমি কখনো লেখাপড়া বন্ধ করো না। অবশ্যই পড়াশোনা করবে, ডিগ্রি নেবে। ঠিক আছে?

বিজলীর একবার মনে হলো সে জিজ্ঞেস করে এনালিটিকেল মাইন্ড কথাটার মানে কী। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে তার লজ্জা লাগল, তাই শেষ পর্যন্ত আর জিজ্ঞেস করল না। সে মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে স্যার।

সে মুখে বলেছে ঠিক আছে, কিন্তু আসলে এটা মোটেও ঠিক নেই। তার পড়াশোনা যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাবে। বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলল। ক্লাসে স্যার পড়াতে শুরু করেছেন বিজলী মন দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু একটু পরে পরে সে আনমনা হয়ে যেতে লাগল।

.

ছুটির ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতে করতে ক্লাস থেকে বের হতে শুরু করল। বিজলীও তার বই-খাতাগুলো বুকে চেপে ধরে ক্লাস থেকে বের হয়ে আসে। এই স্কুলে আশেপাশের গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই একজন অন্যজনকে চেনে। সে আসে বহুদূর একটা চর থেকে, কেউ তাকে চেনে না। তাকে আলাদা করে ক্লাসে কেউ কখনো লক্ষ করেনি কিন্তু আজকে সবাই তাকে আলাদাভাবে লক্ষ করল, তার দিকে একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এমনকি একটা মেয়ে তাকে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করল, বিজলী তোমার বাড়ি কোন গ্রামে?।

বিজলী বলল, আমার বাড়ি অনেক দূর। কাজলডাঙ্গা চর।

মেয়েটি চোখ কপালে তুলে বলল, কাজলডাঙ্গা চর? ইয়া আল্লাহ! সেইটা তো অনেক দূর!

বিজলী মাথা নাড়ল, হ্যাঁ অনেক দূর।

প্রত্যেকদিন সেইখান থেকে আস?

হ্যাঁ।

জোয়ারের সময় পানিতে রাস্তা ডুবে যায় না?

হ্যাঁ ডুবে যায়। সেই জন্যেই তো জোয়ার-ভাটা হিসাব করে আসতে হয়। দেখো না, মাঝে মাঝে আমার ক্লাসে দেরি হয়ে যায়?

আরেকজন বলল, ইয়া মাবুদ।

কথা বলতে বলতে তারা স্কুল থেকে বের হয়ে এল, এখন তাকে হেঁটে হেঁটে কাজলডাঙ্গা চরে যেতে হবে। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে এখনো কমপক্ষে দুই ঘণ্টা! বিজলী একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল, যদি তাদের চর থেকে আরো কেউ এই স্কুলে আসত তাহলে দুজনে মিলে হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে বাড়ি চলে যেতে পারত। এতটা পথ একা একা হেঁটে যেতে তার কেমন জানি লাগে।

স্কুল থেকে বের হওয়ার সময় হঠাৎ পেছন থেকে বিজলী ডাক শুনতে পায়, বিজলীবু! বিজলীবু!

বিজলী মাথা ঘুরিয়ে অবাক হয়ে দেখতে পেল স্কুলের সামনে যে বিশাল বটগাছ তার মোটা একটা শিকড়ের ওপর খোকন বসে আছে। বিজলী চোখ কপালে তুলে বলল, খোকন? তুই এইখানে?

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ বিজলীবু! তুমি এত দেরি করছ? আমি কখন থেকে বসে আছি!

আমি দেরি করছি? এই মাত্র না ছুটি হলো। তুই কোন সময় থেকে বসে আছিস?

দুপুর থেকে?

বাড়ি যাস নাই? এইখানে চলে আসছস?

হ্যাঁ।

কেন? বাড়ি যাস নাই কেন?

খোকন লাজুক মুখে বলল, ভাবলাম তোমার লগে এক সাথে যাই।

কেন? কিছু হইছে স্কুলে?

খোকন মুখ টিপে হাসল, বলল, হ্যাঁ।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, কী হইছে?

আমি একটা প্রাইজ পাইছি।

সত্যি? বিজলী চোখ বড় বড় করে বলল, কী প্রাইজ?

আজকে স্কুলে সবাইরে রচনা লিখতে দিছে। আমারটা সবচেয়ে ভালো হইছে সেই জন্যে আমারে প্রাইজ দিছে। ফাস্ট প্রাইজ!

বিজলী আনন্দে কী করবে বুঝতে পারল না, খোকনকে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ফাস্ট প্রাইজ? ফাস্ট প্রাইজ!

হ্যাঁ।

কী দিছে প্রাইজ?

একটা বই।

দেখি বইটা দেখা। দেখা তাড়াতাড়ি।

খোকন তখন তার বইগুলোর ভেতর থেকে একটা বই বের করে আনল, বইয়ের নাম ছোটদের মহাপুরুষ। প্রচ্ছদে অনেকগুলো মহাপুরুষের ছবি।

বিজলী বইটি এমনভাবে হাতে নিল যে দেখে মনে হতে পারে সে একটা বই হাতে নিচ্ছে না, অমূল্য কোনো সম্পদ হাতে নিচ্ছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে বইয়ের প্রচ্ছদটা দেখে বইয়ের পাতা ওল্টাল, প্রথম পৃষ্ঠায় হাতে লেখা, প্রথম পুরস্কার : রচনা প্রতিযোগিতা, তারপর খোকনের নাম। বিজলী বইয়ের আরো পৃষ্ঠা ওল্টাল। ভেতরে অনেক মহাপুরুষের ছবি আর জীবন কাহিনী।

বিজলী মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার ছোট ভাইটির দিকে তাকালো, আনন্দে দাঁত বের করে হাসল, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরল।

ঠিক তখন তাদের পাশ দিয়ে তাদের ক্লাসের কয়েকজন ছেলেমেয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। বিজলী তখন খোকনকে ছেড়ে দিয়ে ঐ ছেলেমেয়েগুলোকে বলল, এই যে খোকন। আমার ছোট ভাই। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়ে। রচনা লিখে ফাস্ট প্রাইজ পাইছে!

ছেলেমেয়েগুলো বিজলীর কথা শুনে প্রথম একটু অবাক হয়ে যায়, কিন্তু তারপর হাসি হাসি মুখ করে বলে, সত্যি? কী প্রাইজ পাইছে?

বই। এই দেখো কী সুন্দর বই।

স্কুলের ছেলেমেয়েরা বইটা দেখে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সুন্দর বই। অনেক সুন্দর।

আনন্দের উত্তেজনা কমে যাবার পর বিজলী খোকনকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। স্কুলের রাস্তাটা পার হতেই লোকজন কমে আসে। বিজলী আর খোকন হেঁটে হেঁটে তখন সমুদ্রের কিনারায় যেতে থাকে। শুকনো বালুর উপর দিয়ে হাঁটা যায় না, তাই দুজন ভেজা বালুতে নেমে আসে। সমুদ্রের ঢেউ একটু পরে পরে প্রায় তাদের পা স্পর্শ করতে চলে আসছিল। খালি পায়ে ভেজা বালুতে পা ফেলে ফেলে দুজন হাঁটতে থাকে।

খোকন একটু শান্ত এবং চুপচাপ। খোকনের জন্মের পর মায়ের শরীর খুব খারাপ হয়েছিল তখন বিজলীই খোকনকে বেশির ভাগ সময় কোলে নিয়ে বড় করেছে। বিজলী মাঝে মাঝে অবাক হয়ে খোকনকে দেখে, এইটুকুন মানুষ তাকে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, এখন সেই ছোট বাচ্চাটা স্কুলে যায়, রচনা লিখে ফাস্ট প্রাইজ পেয়ে যায়।

হাঁটতে হাঁটতে বিজলী বলল, আজকে কী হইছে জানিস?

কী হইছে বিজলীবু?

আমাদের একজন নতুন বিজ্ঞান স্যার আসছে। খুবই ভালো স্যার। স্যার কী বলছে জানস?

কী বলছে?

বলছে আমার এনালিটিকেল মাইন্ড।

সেইটার মানে কী?

বিজলী নিজেও সেটার মানে জানে না, তাই আন্দাজ করে বলল, যারা খুব চিন্তা করতে পারে তারা হচ্ছে এনালিটিকেল মাইন্ড।

তুমি খুব বেশি চিন্তা করতে পারো বিজলীবু?

নিশ্চয়ই পারি। আমি স্যারকে একটা প্রশ্ন করছিলাম, স্যার সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে নাই। সেই জন্যে বলছে আমার এনালিটিকেল মাইন্ড।

স্যার তোমার উপরে রাগ হয় নাই।

না। রাগ হয় নাই। রাগ হবে কেন?

আমাদের স্যাররে প্রশ্ন করলে স্যার রাগ হয়।

বিজলী বলল, আমাদের এই স্যার রাগ হয় না।

তুমি কী প্রশ্ন করছিলে বিজলীবু?

বিজলী তখন অনেক ডালপালা লাগিয়ে তার প্রশ্ন করার কাহিনীটা খোকনকে বলল। খোকন পুরোটুকু শুনে মাথা নেড়ে বলল, তোমাদের স্যার মনে হয় ঠিকই বলছে। তোমার অনেক বুদ্ধি, তাই না বিজলীবু।

বিজলী হাসল, বলল, আমি কি বুদ্ধি ধুয়ে পানি খাব? বুদ্ধি দিয়ে কী করব?

মনে নাই একবার একটা বিড়ালের মুখ কৌটার মাঝে আটকে গেছিল, বিড়ালটা ভয় পেয়ে কী করছিল–তখন তুমি বিড়ালটারে ছুটায়ে দিছিলা?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, মনে আছে!

তারপর কাঁঠালগাছটাতে এত বড় একটা বোলতার চাক হইছিল, বোলতার কামড় খেয়ে বাবার মুখটা কেমন ফুলে উঠছিল, মনে আছে?

মনে আছে। বিজলী মাথা নাড়ল।

কেউ কাছে যেতে সাহস পায় না–তুমি তখন ধোয়া দিয়ে বোলতাগুলা সরায়ে বোলতার চাক কেটে ফেললে! মনে আছে?

বিজলী বলল, মনে আছে।

তারপর সেই ঘণ্টার অঙ্কটা? কেউ করতে পারে না, তুমি করে দিলা?

বিজলী হি হি করে হাসল, বলল, ধুর ঐটা তো সোজা অঙ্ক ছিল।

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, না বিজলীবু! ঐটা সোজা অঙ্ক ছিল না, অনেক কঠিন ছিল।

বিজলী কথা না বলে সমুদ্রের পানিতে ছলাৎ ছলাৎ করে পা ফেলে। হেঁটে যেতে থাকে। খোকন অনেকটা আপন মনে বিজলীর সাথে কথা বলতে থাকে। এমনিতে খোকন খুব বেশি কথা বলে না। আজকে কী হয়েছে কে জানে, সে অনেক কথা বলছে। খোকনের কথা শুনতে শুনতে বিজলী চোখের কোনা দিয়ে মাঝে মাঝে তাকে দেখছে। তার এই ছোট ভাইটিকে বিজলী খুব আদর করে।

বিজলী যখন ছোট, তখন নদী ভেঙে এক রাতের মাঝে তাদের বাড়িঘর জমিজমা সবকিছু পানিতে ভেসে গিয়েছিল, তখন বাবা জানি কেমন হয়ে গিয়েছিলেন। কথা বলেন না, নদীর ঘাটে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। গ্রামের কিছু লোক তখন বাবাকে বলল, দক্ষিণের এই চরে এসে ঘর বাঁধতে। বাবা তখন সবাইকে নিয়ে এই চরে এসে ঘর বেঁধেছেন। বাবা এখানে এসেও বেশি কথাবার্তা বলেন না, দেখে মনে হয় মাথার কিছু একটা দোষ হয়েছে। বাবা যখন কেমন হয়ে গেছেন তখন বাধ্য হয়ে মা সংসারের অনেক দায়িত্ব নিয়েছেন। কিন্তু মায়ের শরীর সব সময়ই খারাপ থাকে, শরীরের সাথে সাথে মেজাজটাও খারাপ থাকে। তাই দিনরাত তাদেরকে বকাবকি করেন। বিজলীকে মা মনে হয় একেবারে সহ্যই করতে পারেন না। কোনোদিন তার সাথে হাসিমুখে কথা বলেছেন, বিজলী সেটা মনেই করতে পারে না।

বাড়িতে বিজলীর একমাত্র সাথী হচ্ছে খোকন। তাকে ছোট থেকে সে মানুষ করেছে, কোলে নিয়ে কাটিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে, রাত্রে পাশে নিয়ে ঘুমিয়েছে। যখন একটু বড় হয়েছে তখন রাজ্যের গল্প শুনিয়েছে। এই ছোট ভাইটাই বিজলীর একমাত্র আপন মানুষ। খোকন না থাকলে বিজলীর জীবনটা কেমন হতো সে চিন্তাও করতে পারে না।

প্রায় ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর তারা নিচু জায়গাটাতে এসে হাজির হলো। ভাটির সময় এই জায়গাটা পানির নিচ থেকে বের হয়ে আসে। বড় বড় পাথর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, পাথরগুলোর ধারালো কোনা বের হয়ে থাকে। জোয়ারের সময় এই পাথরগুলোর উপর দিয়ে এক পাথর থেকে অন্য পাথরে লাফিয়ে বিজলী জায়গাটা পার হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তারপরেও শরীর না ভিজিয়ে পার হওয়া যায় না।

বিজলী খোকনের হাত ধরে এই নিচু এলাকাটা পার হয়ে আসে। এখানে-সেখানে পানি জমা হয়ে আছে, তার কোনো কোনোটিতে ছোট তারামাছ তিরতির করে নড়ছে।

নিচু জায়গাটা পার হয়ে দুজনে একটা বড় পাথরের মাঝে বসে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিল। জায়গাটা আশ্চর্য রকম নির্জন, আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। বহুদূরে ঝোঁপঝাড় গাছপালা, তার পেছনে আরো দূরে মানুষের জনবসতি। এরকম আশ্চর্য রকম নির্জন জায়গায় বসে থাকতে বিচিত্র এক ধরনের নিঃসঙ্গ অনুভূতি হয়।

.

খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেবার পর বিজলী উঠে দাঁড়াল, বলল, খোকন, উঠ, এখনো অনেকদূর যাইতে হবে। দেরি হলে মা বকবে।

খোকন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, দেরি না হলেও মা বকবে।

।বিজলী কিছু বলল না, খোকন ভুল বলেনি। মায়ের বকুনি খেতে খেতে এত দিনে বিজলীর অভ্যাস হয়ে যাবার কথা, কিন্তু কেন জানি বিজলীর অভ্যাস হয়নি। প্রত্যেকবার সে যখন মায়ের বকুনি খায় তার

মনটা খারাপ হয়ে যায়।

*

বাড়ি পৌঁছানোর পর মায়ের বকুনি খাওয়ার কথা, আজকে বাড়ি পৌঁছানোর আগেই বিজলী বকুনী খেলো। বকুনি দিল আমিন মোল্লা।

বিজলী আর খোকন যখন হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসছে তখন আমিন মোল্লা তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরনে লম্বা আলখাল্লা। মাথায় টুপি আর চোখে সুরমা, মুখে লম্বা দাড়ি। গালে একটা কাটা দাগ, লম্বা দাড়ি দিয়েও সেই কাটা দাগ ঢেকে রাখা যায় না। কীভাবে আমিন মোল্লার গাল কেটেছে কে জানে, তাকে কেউ সেটা কখনো জিজ্ঞেস করেনি। বিজলীর ধারণা আমিন মোল্লা এই চরে আসার আগে ডাকাত ছিল, ডাকাতদের এরকম গাল কাটা থাকে। খুন জখম করে পালিয়ে এসে এখানে মোল্লা সেজে লুকিয়ে আছে। মানুষটাকে দেখলেই বিজলীর বুকটা কেমন জানি কেঁপে ওঠে।

আমিন মোল্লার দুজন বউ কিন্তু কোনো ছেলেমেয়ে নাই। বিজলী অনুমান করতে পারে যদি ছেলেমেয়ে না হয় তাহলে কয়েক দিন পর সে আরেকটা বিয়ে করে ফেলবে।

আমিন মোল্লা আরো একটা কেন আরো বেশি বিয়ে করতে চাইলে করে ফেলুক, তাতে বিজলীর কিছু এসে যাওয়ার কথা না। কিন্তু তার চোখের দৃষ্টিটা দেখলেই তার বুকটা কেমন জানি হিম হয়ে যায়। আজকেও যখন খোকন আর বিজলী হেঁটে হেঁটে আসছিল তখন আমিন মোল্লা তার সেই ভয়ংকর দৃষ্টি দিয়ে বিজলীর দিকে তাকালো, কালো

জিব বের করে ঠোঁট চেটে বিজলীকে জিজ্ঞেস করল, কই থেকে আসতাছস?

খোকন আর বিজলী দুজনের হাতেই বই খাতা, কাজেই তারা যে স্কুল থেকে আসছে সেটা না বোঝার কোনো কারণ নেই। তারপরও বিজলী বলল, স্কুল থেকে।

স্কুল? আমিন মোল্লা এমন ভঙ্গি করল যেন স্কুল অত্যন্ত কুৎসিত নোংরা একটা জায়গা।

বিজলী মাথা নাড়ল। আমিন মোল্লা চোখ পাকিয়ে বলল, তোর বাপের এত বড় সাহস, এত বড় বেগানা মেয়েরে স্কুলে পাঠায়?

বিজলী ভেবেছিল সে চুপ করে এই মানুষটার কথা সহ্য করে যাবে, কিন্তু হঠাৎ কী হলো কে জানে সে জিজ্ঞেস করে বসল? কেন? স্কুলে গেলে কী হয়?

আমিন মোল্লা হঠাৎ খেপে গেল, মুখ খিঁচিয়ে বলল, কী? তোর এত বড় সাহস? আমার মুখের উপর কথা?

বিজলী তখন চুপ করে গেল। আমিন মোল্লা চোখ পাকিয়ে দাঁত বের করে মুখ খিঁচিয়ে বলল, আমি দেখুম, কেমন করে এই কাজলডাঙ্গা চরের মেয়ে হয়ে তুই স্কুলে যাস। এই কাজলডাঙ্গায় বেপর্দা বেগানা মেয়েছেলের জায়গা নাই। তোর বাপ মনে করে কী? তুই বড় হয়ে জজ বেরিস্টার হবি? শুনে রাখ, মেয়েলোকের জায়গা একটাই সেইটা হচ্ছে স্বামীর ঘর। আদব লেহাজ নিয়ে স্বামীর সেবা করা ছাড়া মেয়েলোকের আর কুনো কাম নাই।

বিজলী কেমন যেন অবাক হয়ে এই ভয়ংকর মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। খোকন বিজলীর হাত ধরে টান দিয়ে বলল, বিজলীবু! চলো, যাই।

বিজলী তখন আর কোনো কথা না বলে খোকনের হাত ধরে হেঁটে যেতে থাকে। হেঁটে যেতে যেতে টের পেল আমিন মোল্লা পেছন থেকে তার চোখ দিয়ে তাকে যেন চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে।

বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে মা চিৎকার করতে শুরু করলেন, এতক্ষণে বেগম সাহেবের বাড়ি ফিরে আসার সময় হলো? বেগম সাহেব লেখাপড়া করে মহারানী হবেন? খোকন যে দুপুরবেলা বাড়ি আসে নাই সেইটার কথা মনে আছে? বাড়ির মানুষজন যে চিন্তা করতে পারে একবার সেই কথাটা মনে হইছে? মনে হইছে একবার?

বিজলী চুপ করে রইল। খোকন যে দুপুরবেলা বাড়ি আসে নাই সেইটা বিজলী জেনেছে বিকেল বেলা, তার কী করার আছে? একটা প্রাইজ পেয়ে বেচারা খুশি হয়েছে, সে জানে বাড়ির আর কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামাবে না, সেই জন্যে সে বিজলীর কাছে তার স্কুলে চলে গিয়েছে, সেইটা সে কেমন করে তার মাকে বোঝাবে? তাছাড়া সেজন্য বাড়ির মানুষজন যে খুব চিন্তা করেছে সেইটাও তো মনে হয় না। বাবা চুপচাপ বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। তারা দুজন যে বাড়ি এসেছে, সেইটা মনে হয় দেখেন পর্যন্ত নাই।

মা আরেকবার এক পশলা গালি দেওয়ার জন্যে মুখ খুলছিলেন তখন বিজলী বলল, মা, খোকন একটা প্রাইজ পেয়েছে।

মা ভুরু কোঁচকালেন, কী পেয়েছে?

প্রাইজ। ফাস্ট প্রাইজ।

মা ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন, মনে হলো ঠিক বুঝতে পারছেন খবরটা শুনে খুশি হবেন নাকি রাগ হবেন। তার গালাগাল করার স্রোতটা হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে বলে মনে হয় একটু রেগেই উঠলেন, রাগটাকে কোনোরকমে চেপে রেখে বললেন, কী প্রাইজ?

বিজলী বলল, একটা বই। কী সুন্দর একটা বই। বিজলী খোকনকে বলল, খোকন, দেখা। তোর বইটা দেখা।

খোকন তার হাতের বইগুলোর ভেতর থেকে ছোটদের মহাপুরুষ বইটা বের করে আনল। বাবা কিংবা মা কেউই বইটা হাতে নিয়ে দেখার উৎসাহ দেখাল না। অপ্রস্তুত বিজলী তখন নিজেই বইটা হাতে নিয়ে বাবার দিকে এগিয়ে দিল, বাবা খুবই অনিচ্ছার সাথে বইটা হাতে নিলেন, একটু উল্টেপাল্টে দেখলেন, কিন্তু খুলে ভেতরে দেখলেন না। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বইটা বিজলীর হাতে ফিরিয়ে দিলেন। বিজলী বইটা হাতে নিয়ে খুলে ভেতরের ছবিগুলো বের করে মাকে দেখানোর চেষ্টা করল, বলল, দেখো মা, কী সুন্দর ছবি।

মা একটুখানি দেখলেন, বিজলী বলল, খোকন সবচেয়ে ভালো রচনা লিখেছে, সেই জন্যে পুরস্কার পেয়েছে। তাই না রে খোকন?

খোকন মাথা নাড়ল। মা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হয়েছে। এখন যা, গরুটারে লইয়া আয়। মুরগির খোপ খুলে দে। কুপি বাতিগুলোতে তেল ভরে আন। আমাকে তো বান্দি পাইছস। সব মহারাজা মহারানীদের সেবা করার জন্য আমার জন্ম হইছে। সংসারের কাজ সব আমার করতে হবে? অন্য সবাই ড্যাং ড্যাং করে খালি গায়ে বাতাস লাগাইয়া ঘুরে বেড়াবি?

মা ক্যাট ক্যাট করে কথা বলতেই থাকলেন। সারাদিন স্কুলে থেকে বাড়ি এসেছে, খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে। বিজলী সহ্য করে যেতে পারবে কিন্তু খোকনের মুখটা শুকিয়ে আছে দেখে বিজলীর মায়া হলো। বিজলী ইতস্তত করে বলল, মা, খোকনের দুপুরে খাওয়া হয় নাই–

মা ছ্যাৎ করে উঠলেন, বললেন, খাওয়া হয় নাই তো খাওয়া দে। চূলার উপরে দেখ ভাত-তরকারি আছে।

বিজলী মাকে আরো কিছু বলার সুযোগ দিল না, ঘরের বেড়ার উপর ঝুলিয়ে রাখা তাকটাতে বইগুলো রেখে খোকনের হাত ধরে পাকঘরে নিয়ে গেল। একটা পিঁড়িতে খোকনকে বসিয়ে তার সামনে একটা টিনের থালাতে ভাত বেড়ে দিল। শুঁটকির একটুখানি তরকারি ভাতের উপর দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি একটুখানি খেয়ে নে।

তুমি খাবা না বিজলীবু?

নাহ্। দুপুরের যেটুকু ভাত তরকারি রয়ে গেছে সেটা দিয়ে দুজনের হবে না, বিজলী তাই মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার খিদা পায় নাই।

খোকনের খাওয়া শেষ হলে বিজলী কলসি থেকে ঢেলে এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, আয় খোকন।

বিজলীর পিছু পিছু খোকন হেঁটে হেঁটে যায়। চরের মাঝামাঝি নিচু জায়গাটাতে অনেক ঘাস। চরের মানুষেরা এখানে তাদের গরু ছাগল ছেড়ে যায়। বিজলী তাদের কালো গাইটাকে দূর থেকে দেখতে পেল, ঘাস খেতে খেতে মাঝে মাঝে গলা তুলে ডাকছে, মনে হয় বাছুরটাকে খুঁজছে।

বিজলী গরুর খুঁটিটা টেনে তুলে দড়িটা পাকিয়ে ছোট করে নেয়। তাকে আর কিছু করতে হয় না, কালো গাইটা কেমন করে নিজেই জানি বুঝে গেছে এখন বাড়ি যাবার সময় হয়েছে। গাইটা আবার গলা ছেড়ে ডাকল তখন ছোট বাছুরটা অনেকটা লাফাতে লাফাতে হাজির হলো। খোকন বাছুরটাকে একটু আদর করার চেষ্টা করল, বাছুরটা অনেকটা খেলার ভঙ্গিতে লাফিয়ে লাফিয়ে সরে যায়। খোকন তখন দাঁত বের করে হেসে বলল, দেখছ বিজলীবু বাছুরটা কী করে?

বিজলী বলল, তোর সাথে খেলছে!

আমার সাথে কেন খেলছে বিজলীবু?

তুই তো একটা গরু, বাছুরটাও একটা গরু, সেই জন্যে তোর সাথে খেলে!

খোকন বিজলীকে ধাক্কা দিয়ে বলল, যাও! আমি গরু না, তুমি গরু!

বিজলী হাসল, বলল, ঠিক আছে। তুইও গরু, আমিও গরু। বিজলী তখন গরুর মতো করে ডাকল, হাম্বা!

খোকন অকারণেই হি হি করে হাসতে থাকে।

বাড়িতে এসে বিজলী গরু আর বাছুরটাকে গোয়ালঘরে ঢোকাল। বাছুরটাকে আলাদা করে বেঁধে রাখল যেন রাতের বেলা দুধ খেয়ে না ফেলে। মাটির মালসায় তুষের আগুন করে গোয়ালঘরে মশা তাড়ানোর জন্যে ধোয়া দিল। তারপর মোরগের খোঁপটা পরিষ্কার করে নিচে এক প্রস্ত ছাই দিয়ে ঢেকে দিয়ে মুখে কঁক কঁক করে শব্দ করল। মোরগ মুরগিগুলো তখন মাথা তুলে এদিক-সেদিক তাকিয়ে এগিয়ে এসে একটি একটি করে খোপের ভেতর ঢুকে যায়! একটা মা মুরগি এদিক সেদিক তাকিয়ে তার ছোট ছোট ছানাগুলোকে ভেতরে ঢুকিয়ে নিল।

বিজলী তখন বাইরে নেড়ে দেওয়া কাপড়গুলো তুলে ভেতরে নেয়, তারপর কুপি বাতিগুলো পরিষ্কার করে তার মাঝে কেরোসিন ঢেলে নেয়। বাতিগুলো সে বারান্দায় সাজিয়ে রাখে আরেকটু অন্ধকার হলে বাতিগুলো জ্বালাবে।

ঘরের কাজ শেষ করে বিজলী খোকনকে নিয়ে সমুদ্রের বালুবেলায় দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্য অস্ত যাবার পর পশ্চিম আকাশটা লাল হয়ে গেছে। কোনো কোনোদিন আকাশটা বেশি লাল হয়ে থাকে, কোনোদিন কম। তার কারণটা কী কে জানে।

সমুদ্রের ঢেউগুলো একটার পর একটা এসে তীরে আছড়ে পড়ছে। শ্যামল স্যার মনে হয় ঠিকই বলেছেন, সমুদ্রটা যেন সত্যিই জীবন্ত, প্রত্যেকটা ঢেউ যেন সমুদ্রের একটি একটি করে নিঃশ্বাস। জোয়ার শুরু হয়েছে, দেখতে দেখতে পুরো বালুবেলাটা পানিতে তলিয়ে যাবে। সমুদ্রের একধরনের গর্জন আছে। কোনো কোনোদিন সমুদ্র শান্ত থাকে, তখন গর্জনটি হয় মৃদু। কোনো কোনোদিন মনে হয় সমুদ্রটি রেগে আছে, তখন সমুদ্রের গর্জনটিও হয় ক্রুদ্ধ গর্জন। আজকে মনে হয় সমুদ্রটি শান্ত, তাই তার গর্জনটার মাঝে একধরনের শান্ত শান্ত ভাব।

বিকেলের বাতাসটি বইতে শুরু করেছে। বাতাসের মাঝে একধরনের লোনা গন্ধ, বিজলী বুক ভরে একবার নিঃশ্বাস নিল। খোকন বালুর উপর পা ছড়িয়ে বসে গালে হাত দিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝেই খোকন গালে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবে। কী ভাবে কে জানে।

দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে, বাড়ি যেতে হবে। একটু দেরি হলেই মা বকাবকি শুরু করবেন। বিজলী বলল, খোকন, আয় বাড়ি যাই।

খোকন উঠে দাঁড়াল, তারপর বিজলীর হাত ধরে বাড়ির দিকে রওনা দিল।

.

রাত্রি বেলা বেশ তাড়াতাড়ি বিজলী খোকনকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। প্রতি রাতেই তাই হয়, রাত জেগে থাকলেই কুপি বাতি জ্বালাতে হয়, কুপি বাতি জ্বালালেই বাড়তি কেরোসিনের খরচ, তাই তাদের সকাল সকাল ঘুমিয়ে যেতে হয়। ইচ্ছা থাকলেও রাত জেগে বিজলী লেখাপড়া করতে পারে না।

তাদের ছোট বাড়িতে পাকঘর ছাড়া মাত্র দুটি ঘর। একটা ঘরে বাবা-মা ঘুমায়, অন্য ঘরে ছোট একটা বিছানায় বিজলী খোকনকে নিয়ে ঘুমায়। বিছানায় শুয়েই খোকন ফিসফিস করে বলে, বিজলীবু, একটা গল্প বলো।

খোকন যখন তার কাছে গল্প শুনতে চায় বিজলী মনে মনে খুশি হয়, কিন্তু সে মিছি মিছি রাগের ভঙ্গি করে বলে, এত রাত হইছে, এখন আবার গল্প কিসের, ঘুমা।

খোকন তখন বিজলীকে জড়িয়ে ধরে বলে, বলো না একটা গল্প! মাত্র একটা–

বিজলী তখন বলে, একটা কিন্তু! একটার বেশি না।

ঠিক আছে বিজলীবু।

কিসের গল্প শুনবি?

খোকন লাজুক মুখে বলে, আমার গল্প।

বিজলী প্রতি রাতেই খোকনকে নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলে। কীভাবে খোকন কখনো দুর্ধর্ষ ডাকাত দলকে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ধরে ফেলছে কিংবা কীভাবে খোকন একটা ভেলায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে অজানা কোনো দ্বীপে গিয়ে হিংস্র বন্য মানুষের সাথে যুদ্ধ করছে, কিংবা একটা রকেট বানিয়ে কীভাবে মহাকাশে গিয়ে ভয়ংকর কোনো প্রাণীর মুখোমুখি হচ্ছে এরকম গল্প। আজকে বিজলী খোকন কীভাবে অনেক বড় বৈজ্ঞানিক হয়ে ভয়ংকর একটা অস্ত্র আবিষ্কার করেছে এবং সেই অস্ত্র চুরি করার জন্য কীভাবে আমেরিকা থেকে মানুষ এসেছে সেটা নিয়ে গল্প শুরু করল। বিজলীকে ফিস ফিস করে গল্প বলতে হয়, পাশের ঘরে মা যদি শুনতে পান তাহলে খুব বিরক্ত হয়ে বকাবকি শুরু করেন।

গল্প শুনতে শুনতে খোকন মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে যায়। গল্প শেষ হলে সে বিজলীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ে। বিজলী একা একা জেগে থাকে। জেগে জেগে সে খোকনের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে। মা সারাদিন কাজ করে করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যান। বাবা জেগে থাকেন, জেগে বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলেন। কী বলেন বোঝা যায়। বাবার জন্যে বিজলীর কষ্ট হয় কিন্তু কী করবে সে বুঝতে পারে। রাত জেগে জেগে সে সমুদ্রের গর্জন শোনে।

সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে বিজলী একসময় ঘুমিয়ে যায়।

*

বিজলীদের স্কুল দুপুর বেলাতেই ছুটি হয়ে গেল। কয়দিন থেকেই আবহাওয়া খারাপ, ঝিরঝির করে বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া। সমুদ্র পাড়ের মানুষ এরকম আবহাওয়া দেখলেই ভুরু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকায়। যতগুলো বড় সাইক্লোন হয়েছে তার আগে সব সময় এরকম খারাপ আবহাওয়া ছিল।

স্কুল ছুটির আগে শ্যামল স্যারের ক্লাস ছিল। শ্যামল স্যার আজকে ক্লাসে কিছু পড়াননি, বেশির ভাগ সময় খুব গম্ভীর মুখে জানালা দিয়ে দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়েছিলেন। এক সময় ক্লাসে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই সবাই জানো একটা সাইক্লোন আসছে। সাইক্লোন যারিনা। সাইক্লোনকে সবসময় একটা নাম দেয়, মানুষের নামে নাম। আগে শুধু মেয়েদের নাম দিত–এখন একবার মেয়ের নাম আরেকবার ছেলের নাম। আগেরটা ছেলেদের নামে ছিল তাই এইবারে মেয়েদের নামে। যারিনা।

অন্যদিন হলে কেউ না কেউ সাইক্লোনের এই নাম দেওয়া নিয়ে কিছু না কিছু বলত, আজকে কেউ কিছু বলল না। সবাই শুকনো মুখে বসে রইল। আজকে ক্লাসে ছেলেমেয়ে বেশি নেই। যারা আছে তাদের বেশির ভাগ সাইক্লোনের কথা জানত না। বিজলীও জানত না। সাইক্লোন আসছে শুনে হঠাৎ করে ভয়ে তার বুক কেঁপে উঠল।

স্যার বললেন, গতকাল পর্যন্ত সাইক্লোনটা আরো উত্তর দিকে যাচ্ছিল, আজকে সকালে হঠাৎ করে দক্ষিণে নেমে সোজাসুজি আমাদের দিকে আসছে। স্যার চুপ করলেন আর বিজলীর বুকটা কেমন জানি ধ্বক করে উঠল।

আজ শেষ রাতের দিকে সাইক্লোনটা এসে আমাদের এলাকায় আঘাত করবে। কাজেই তোমরা এখন সবাই বাসায় যাও। বাসায় গিয়ে ফেমিলির সবাইকে নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারে চলে যাবে। সাইক্লোনটা যখন আসবে তখন ভরা জোয়ারের সময়, তার মানে অনেক বড় স্টর্ম সার্জ হতে পারে।

একজন জিজ্ঞেস করল, স্টর্ম সার্জ মানে কী?

স্টর্ম সার্জ মানে হচ্ছে জলোচ্ছ্বাস। পানি ফুলে উঠবে। এই দেশের সাইক্লোনে পানি অনায়াসে ত্রিশ চল্লিশ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। মনে রেখো কিছু বোঝার আগে কিন্তু পানি চলে আসবে, কয়েক মিনিটে সবকিছু পানিতে ডুবে যেতে পারে। সাইক্লোনের প্রচণ্ড ঝড়, তার সাথে পানি–এর থেকে ভয়ংকর কিছু হতে পারে না। কাজেই কেউ কোনো রিস্ক নেবে না। আজ রাতে সবাই সাইক্লোন শেল্টারে কাটাবে। সবাই। বুঝেছ?

ক্লাসের অন্যান্য ছেলেমেয়েদের সাথে বিজলীও মাথা নাড়ল।

স্যার বললেন, তোমাদের ফেমিলি যেহেতু সারা জীবন সমুদ্রের তীরে থেকেছে তাই তারা নিশ্চয়ই এই ব্যাপারগুলো আমার থেকেও ভালো জানে। তারা নিশ্চয়ই তাদের জীবনে অনেক সাইক্লোন দেখেছে, কিন্তু তোমরা ছোট তোমরা দেখো নাই। তাই আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে বাবা মাকে বলবে অবশ্যই অবশ্যই যেন সাইক্লোন শেল্টারে যায়।

বিজলী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তার বাবা-মা সমুদ্রের তীরে জীবন কাটায়নি, সাইক্লোন দেখেনি। সাইক্লোন হলে কী করতে হয় জানে না। নদীর পাড় ভেঙে ঘরবাড়ি ভেসে যাবার পর এই চরে এসেছে। এই চরের সব মানুষই এরকম। তারা স্থানীয় মানুষ না।

শ্যামল স্যার আবার জানালার কাছে গিয়ে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর আবার ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, সাইক্লোনে বাতাস ঘুরতে থাকে। বিশাল এলাকা নিয়ে সাইক্লোন হয়। সাইক্লোনের বাতাসের বেগ একশ-দেড়শ মাইল হয়ে যেতে পারে। সাইক্লোনের ঠিক মাঝখানে কোনো বাতাস থাকে না, অনেক সময় উপরে মেঘও থাকে না। সেটাকে বলে সাইক্লোনের আই। আমি শুনেছি যে সাইক্লোনের আইয়ের ভেতর দিয়ে যাবার সময় সবকিছু একেবারে সুনসান নীরব হয়ে যায়। কোনো ঝড়বৃষ্টি কিছু নেই। আইটা পার হওয়ার পর আবার ঝড় শুরু হয়, বাতাস তখন উল্টোদিকে বইতে থাকে…

স্যার সাইক্লোন নিয়ে কথা বলতে থাকলেন। বিজলী কিছু শুনল কিছু শুনল না। কিছু বুঝল কিছু বুঝল না।

ক্লাসের ঘণ্টা বাজার আগেই স্যার ছুটি দিয়ে দিলেন। অন্যদিনের মতো চিৎকার করতে করতে ছেলেমেয়েরা ক্লাস থেকে বের হলো না। সবাই চাপা স্বরে নিজেদের ভেতর কথা বলতে বলতে প্রায় নিঃশব্দে ক্লাসঘর থেকে বের হয়ে যার যার বাড়ির দিকে রওনা দিল। বিজলী একবার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশটার রং কেমন যেন ছাই বর্ণের। দূরে সমুদ্রের দিকে তাকালো, এমনিতে নীলচে সবুজ রঙের সমুদ্রটা এখন কেমন যেন কালচে হয়ে আছে–দেখে মনে হয় সমুদ্রটা বুঝি রাগ হয়ে আছে। দূর থেকেই বোঝা যায় ঢেউগুলো অনেক উঁচু।

বিজলী বাড়ির দিকে রওনা দেয়। রাস্তাঘাটে মানুষজন খুব বেশি নেই, যারা আছে তারাও নিঃশব্দে তাড়াতাড়ি হেঁটে যাচ্ছে। বিজলী শুনতে পেল একটা রিকশার মাঝে মাইক লাগিয়ে কেউ একজন কিছু বলতে বলতে যাচ্ছে। লোকটার গলার স্বরে কিছু একটা ছিল, বিজলী তাই তার কথাটা ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। মানুষটি বলছে :

সাত নম্বর মহা বিপদ সংকেত।

সাত নম্বর মহা বিপদ সংকেত।

সবাইকে জানানো যাইতেছে যে অদ্য রাত্রি তিন ঘটিকার সময় ঘূর্ণিঝড় যারিনা উপকূলে আঘাত হানিবে। জলোচ্ছ্বাসের কবল হইতে রক্ষা পাইবার জন্য সবাইকে মধ্যরাত্রি বারোটার ভিতরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে। সবাইকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে নির্দেশ দেওয়া যাইতেছে।

একই কথা বলতে বলতে রিকশাটি দূরে চলে গেল। এখন দুপুর বারোটা, রাত বারোটা হতে এখনো হাতে বারো ঘণ্টা সময়। সবাইকে নিয়ে এর মাঝে সাইক্লোন শেল্টারে চলে আসতে পারবে। বিজলী পা চালিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে।

বিজলী যখন বাড়ি পৌঁছেছে তখন সে ভিজে চুপসে গেছে। এখনো পুরো জোয়ার আসেনি কিন্তু নিচু জায়গাটা এর মাঝে তলিয়ে গেছে, বুক পানিতে তাকে হেঁটে আসতে হয়েছে। মাঝামাঝি আসতে আসতে ঝির ঝির বৃষ্টিটা ঝম ঝম বৃষ্টিতে পাল্টে গেছে। বাড়ি এসেই সে খোকনের খোঁজ নিল, খোকনও স্কুল থেকে সকাল সকাল চলে এসেছে। তাদের স্কুলে ছেলেমেয়েরা কেউ আসেনি, তাই স্কুল ছুটি দিয়ে দিয়েছে।

বাবা বাড়ি নেই, বিজলী মাকে পাকঘরে দেখতে পেল। চুলোয় কয়টা ভেজা কাঠ দিয়ে ধোঁয়ার মাঝে বসে আছেন। বিজলী তার ভেজা কাপড় না পাল্টেই বলল, মা, আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে।

কই যেতে হবে?

সাইক্লোন শেল্টারে।

মা অবাক হয়ে বললেন, সেটা কী?

সাইক্লোনের সময় সেখানে থাকতে হয়।

কেন?

যখন পানি উঠে আসবে তখন সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেজন্যে তখন সাইক্লোন শেল্টার–মানে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে হয়।

মা সমুদ্রের মানুষ না, এইসব জানেন না, একটু অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিজলী বলল, সব জায়গায় মাইক দিয়ে বলতেছে। সাত নম্বর মহাবিপদ সংকেত দিছে। আমাদের যাইতে হবে।

মা কেমন করে জানি তাকিয়ে রইলেন, মনে হয় বিজলীর কথা বুঝতে পারলেন না। চুলার মাঝে লাকড়িগুলো ঠেসে দিতে দিতে অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমি এইসব জানি না, তোর বাবারে বল।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, বাবা কই?

জানি না। মনে হয় তোর আমিন চাচার বাড়ি।

আমিন মোল্লার বাড়িতে যাওয়ার তার কোনো ইচ্ছা নাই কিন্তু বিষয়টা অনেকই জরুরি। তাই সে রওনা দিল, বের হওয়ার সময় বিজলী খোকনকে সাথে নিয়ে নেয়। একা একা আমিন মোল্লার বাড়িতে যাওয়ার তার সাহস নাই।

বাইরে ঝম ঝম করে বৃষ্টি পড়ছে, বিজলী আর খোকন দুজনে ভিজতে ভিজতে হেঁটে যেতে থাকে। আমিন মোল্লার বাড়িতে গিয়ে মনে হলো সেখানে অনেক লোকজন।

বাইরের ঘরের দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে গ্রামের বড় মানুষ সবাই গাদাগাদি করে বসে আছে। সবাই মিলে কথা বলছিল, বিজলীকে দেখে সবাই চুপ করে গেল। বাবা বিজলীর দিকে তাকালেন কিন্তু কোনো কথা বললেন না। কথা বলল আমিন মোল্লা, অনেকটা ধমকের ভঙ্গিতে বলল, কী চাও?

বিজলী বলল, বাবার সাথে কথা বলতে আসছি। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা বাড়ি চল।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কেন?

কথা আছে বাবা, জরুরি কথা।

কী কথা?

মাইকে সবাইরে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যাইতে বলছে। আজ রাতে সাইক্লোন আসবে।

ঘরের সবাই তখন এক সাথে কথা বলতে থাকে, আমিন মোল্লা তখন ধমক দিয়ে বলল, চোপ।

সবাই তখন চুপ করে গেল। আমিন মোল্লা বলল, আমার কথার উপর তোমাগো বিশ্বাস নাই?

একজন বলল, তা আছে, কিন্তু—

কিন্তু কী?

এই তুফান তো মারাত্মক। তুফানের সাথে পানি আসে, শুনছি লাখ লাখ লোক মারা যায়।

লাখ লাখ লোক কী মুখের কথা? আমিন মোল্লা বলল, তোমাদের আমি বলছি কি না যে আমি চাইরটা পানিবন্দী তাবিজ চরের চাইর কোনায় পুঁইতা আসছি। এই চরের উপর দিয়ে ঝড় যাইব না, এই চরের ওপর পানি আসব না।

একজন বলল, কিন্তু—

কিন্তু কী?

সরকার ঘোষণা দিছে সেইটা এমনি এমনি তো দেয় নাই।

আমিন মোল্লা গর্জন করে উঠল, এমনি এমনিই দিছে, সরকারের কোন কামটা ঠিক? সব বেঠিক। সব বেদাত।

একজন হঠাৎ করে আমিন মোল্লার পক্ষে কথা বলল, ভাইজান কথাটা মিছা বলে নাই। মনে নাই গেল বছর ঘোষণা দিল তুফান আসব পানি আসব, আমরা গিয়া সারারাত কেন্দ্রের ছাদে বৃষ্টির মাঝে বইসা থাকলাম। কিছুই হইল না, বাড়ি আইসা দেখি আমার গরুটা চুরি কইরা নিছে!

অনেকে তখন এই মানুষটার সাথে মাথা নাড়ল, একজন বলল, মিয়া ভাই কথাটা মিছা বলে নাই।

বিজলী মানুষগুলোর কথা না শোনার ভান করে বাবার দিকে বলল, বাবা বাড়ি চলো। তাড়াতাড়ি।

বাবা নিরাসক্ত চোখে বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, কেন? তাড়াতাড়িটা কী জন্যে?

আশ্রয়কেন্দ্র অনেক দূর বাবা, যেতে সময় লাগবে।

আমিন মোল্লা খেঁকিয়ে উঠল, এই ছেমড়ি, আদব লেহাজ নাই? বড় মানুষেরা কথা বলতেছে তার মাঝে কথা বলিস?

বিজলী মুখ শক্ত করে বলে, আমি আমার বাবার সাথে কথা বলি।

আমিন মোল্লা হুংকার দিল, কত বড় বেয়াদপ, আবার মুখে মুখে কথা?

বিজলী আমিন মোল্লার কথা না শোনার ভান করে বলল, বাবা। বাড়ি চলো।

তুই যা। আমি আসতেছি।

আশ্রয়কেন্দ্রে যাবা না বাবা?

বাবা নিঃশ্বাস ফেললেন, বললেন, খামোখা দৌড়াদৌড়ি করে কী হবে? হায়াত মউত আল্লাহর হাতে।

কী বলো বাবা?

ঠিকই বলি।

বিজলী প্রায় আর্তনাদ করে বলল, আমাদের স্যার বলেছে অবশ্যই অবশ্যই যেন আশ্রয়কেন্দ্রে যাই।

বাবা কিছু বলার আগেই আমিন মোল্লা খেঁকিয়ে উঠল, স্কুলের স্যার! স্কুলের স্যার বেশি জানে? তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, কামটা তুমি ঠিক করো নাই। এত বড় মেয়ে আদব লেহাজ নাই, ড্যাং ড্যাং করে স্কুলে যায়? নাউজুবিল্লাহ্!

বাবা কিছু বললেন না, মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আমিন মোল্লা তখন গলা উঁচিয়ে বলল, ঠিক আছে তাহলে, সবার সাথে কথা থাকল। কেউ চর ছেড়ে কোথাও যাইবা না। আমি এই চর পানিবন্দী তাবিজ দিয়ে বেন্ধে রাখছি। কারো কোনো ভয় নাই। হায়াৎ মউত আল্লার হাতে।

সবাই মাথা নাড়ল, একজন বলল, হায়াৎ মউত আল্লাহর হাতে। যার মরণ যেইখানে নাও বাইয়া যায় সেইখানে! যদি এই চরে আমার মউৎ থাকে তাহলে কি এখান থেকে আমি বের হতে পারুম। পারুম না।

আমিন মোল্লা ধমক দিয়ে বলল, কী সব মরণের কথা বলো! মরবা কেন? কেউ মরবে না।

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, না। কেউ মরব না।

বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে যখন বিজলী ফিরে আসছে তখন দেখল আমিন মোল্লার বাড়ির উঠানের বেড়া ধরে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীকে দেখে হাত নেড়ে ডাকল। বিজলী একটু এগিয়ে যায়, মহিলাটি আমিন মোল্লার ছোট বউ। বয়স বিজলী থেকে খুব বেশি হবে বলে মনে হয় না।

বিজলী কাছে যেতেই মহিলাটি ফিস ফিস করে বলল, তুমি তোমার আমিন চাচারে রাজি করাইতে পারো নাই?

কী রাজি করানোর কথা বুঝতে বিজলীর সমস্যা হলো না। মাথা নেড়ে বলল, না।

বউটি মাথা নেড়ে বলল, আমার তুফানরে খুব ভয় করে। অনেক বেশি ভয় করে। আরেকবার বলে দেখো না রাজি করাতে পারো কি না।

বিজলী বলল, লাভ নাই। আমিন চাচা বলছে সে চরের চার কোনায় পানিবন্দী তাবিজ পুঁইতা রাখছে। এই চরে কিছু হবে না।

বউটি শাড়িটি সরিয়ে তার গলায় ঝোলানো অনেকগুলো তাবিজ দেখাল, বলল, সন্তান হয় না দেখে এই দেখো কত তাবিজ দিছে। লাভ হইছে? হয় নাই। তাবিজে কাম হয় না।

বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না। বউটি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ইয়া মাবুদ। আজ রাতে কী হবে কে বলতে পারে!

বিজলী কিছু না বলে দাঁড়িয়ে রইল। খোকন বিজলীর হাত ধরে টান দিয়ে বলল, বাড়ি চল বিজলীবু। শীত করে।

বিজলী বলল, চল যাই। বিজলী বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে একবার পেছনের দিকে তাকালো। বউটি তখনো উঠানের বেড়া ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

*

সন্ধ্যেবেলা থেকে ঝড়ের বেগ বাড়তে লাগল। প্রথম দিকে এটা দমকা হাওয়ার মতো ছিল, আস্তে আস্তে সেটা সত্যিকার ঝড় হয়ে গেল। বাতাসটা পুব দিক থেকে পশ্চিমে বইছে। বিজলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে তাকায়। নিশ্চয়ই আজ পূর্ণিমার রাত, আকাশের মেঘ ফুটে চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। চারদিকে কেমন যেন একটা অপার্থিব আলো। সেই আলোতে সবকিছু কেমন যেন অবাস্তব স্বপ্নের মতো দেখায়। বাতাসের একধরনের শব্দ শোনা যায়, শিস দেওয়ার মতো শব্দ। শব্দটা কোথা থেকে আসে কে জানে। সেই শব্দ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে সমুদ্রের গর্জন শোনা যেতে থাকে। বিজলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেল বাতাসের প্রচণ্ড আঘাতে গাছগুলো কেমন যেন মাথা কুটছে। বাড়ির সামনে নারকেলগাছের পাতাগুলো ঝাঁপটে পড়ছে, পুরো গাছটাই মাঝে মাঝে নুইয়ে পড়ছে। বিজলীদের বাড়িটা বাতাসে থরথর করে কেঁপে উঠছে, মনে হয় যেকোনো সময় বুঝি উড়ে যাবে।

যত সময় যেতে থাকে ঝড় তত বাড়তে থাকে। বাতাসের শিস দেওয়ার মতো শব্দ আরো তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। সবকিছু ছাপিয়ে সমুদ্রের গর্জন শোনা যায়। গোয়ালঘর থেকে তাদের কালো গাইয়ের ডাক শোনা যেতে থাকে, ভয় পেয়ে কেমন জানি ডাকছে। অবলা পশুটি কেমন করে জানি বিপদটুকু টের পেয়েছে।

বাবা ঘরের মাঝখানে গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। সামনে একটা কুপি বাতি জ্বলছে, বাতির শিখাঁটি বাতাসের ঝাঁপটায় মাঝে মাঝে কেঁপে উঠতে থাকে। বাবাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়, মনে হয় ঠিক বুঝতে পারছেন না কী হচ্ছে। মা ঘরের ভেতর ছটফট করছিলেন, প্রত্যেকবার বাতাসের ঝাঁপটায় যখন বাড়িটা থর থর করে কেঁপে উঠতে থাকে মা উপরের দিকে তাকান তারপর শুকনো মুখে বলেন, হায় খোদা! হায় পরওয়ার দিগার। হায় মাবুদ। হায় মাবুদ।

খোকন বিজলীকে ধরে রাখছে, বিজলী বুঝতে পারে খোকন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। সেও খোকনকে শক্ত করে ধরে রাখে, তাকে নিচু গলায় একটু পরে পরে বলে, ভয় নাই। কোনো ভয় নাই খোকন।

হঠাৎ করে মনে হলো বাতাসের বেগ প্রচণ্ড বেড়ে গেল। পুরো বাড়িটা মনে হয় একদিকে কাৎ হয়ে যায়–সবকিছু থরথর করে কাঁপতে থাকে। ঝনঝন শব্দ করে মনে হয় আকাশ দিয়ে কিছু উড়ে গেল। বৃষ্টির ঝাঁপটায় ঝমঝম শব্দ হতে থাকে। প্রথমবার মনে হলো মানুষ চিৎকার করছে, দূর থেকে তাদের চিৎকার শোনা যেতে থাকে। গোয়ালঘরের ভেতর থেকে কালো গাইটা গলা ছেড়ে ডাকছে, মাঝে মাঝে বাছুরটার চিৎকারও শোনা যেতে থাকে।

বাবা কিছু একটা বললেন, ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে কী বললেন শোেনা গেল না। তখন গলা উচিয়ে আবার বললেন, গাই আর বাছুরটাকে ছেড়ে দিতে হবে।

মা চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন করে ছাড়বে?

দড়ি কেটে দিতে হবে। একটা দা দাও।

মা পাকঘর থেকে একটা দা এনে দিলেন। বাবা দাটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, বোঝা যাচ্ছে ঝড়ের ভেতর বাইরে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। বিজলী চিৎকার করে বলল, আমাকে দাও। আমি দড়ি কেটে দিয়ে আসি।

বাবা জিজ্ঞেস করলেন, পারবি?

বিজলী মাথা নেড়ে বলল, পারব।

বাবার হাত থেকে দাটা নিয়ে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা খুলতেই ঘরের ভেতর বাতাসের একটা ঝাঁপটা ঢুকে মনে হয় সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকে, তার মাঝে বিজলী বের হয়ে গেল। প্রচণ্ড বাতাস মনে হয় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে, বৃষ্টির ঝাঁপটায় সে ভিজে চুপসে গেল।

বারান্দা থেকে নিচে নামতেই বৃষ্টির ঝাঁপটাটি আরো তীব্রভাবে তার শরীরে লাগতে থাকে, পানির একেকটা ফোঁটা মনে হয় সুইয়ের মতো তার শরীরে গেঁথে যাচ্ছে। মাথা নিচু করে সে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে, প্রচণ্ড বাতাসের জন্যে এগোতে পারে না। তার মাঝে মাথা নিচু করে সে কোনোভাবে এগিয়ে গেল, গোয়ালঘরের দরজাটা উড়ে গেছে, ভেতরে কালো গাই আর বাছুরটা হুটোপুটি করছে। বিজলী আবছা অন্ধকারে ভেতরে ঢুকে গেল, গাইটা কী বুঝল কে জানে বিজলীকে দেখে শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। বিজলী দা দিয়ে ঘষে ঘষে গাইয়ের দড়িটা কেটে দেয়, তারপর তার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, যা, যা, বাইরে যা।

গাইটা বাইরে বের হলো না, বাছুরটার দিকে তাকিয়ে গলা ছেড়ে ডাকল। বিজলী তখন বাছুরটার দড়ি কেটে দিয়ে সেটাকে ধাক্কা দিল। গাইটা এবারে গোয়ালঘরের খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে ডাকতে ডাকতে সামনে ছুটে যায়। পেছনে পেছনে বাছুরটা ছুটতে থাকে।

ঠিক তখন বাতাসের প্রচণ্ড একটা ঝাঁপটা ছুটে এল এবং গোয়াল ঘরটা বিচিত্রভাবে নড়ে ওঠে। সবকিছু ছিঁড়ে ছুঁড়ে যাবার একটা শব্দ হলো এবং মনে হলো বিজলী বুঝি আকাশে উড়ে যাবে। সে গোয়ালঘরের বেড়াটা খামচে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে টের পেল গোয়ালঘরের ছাদটা খুলে গেল, তারপর বিকট শব্দ করে উড়ে গেল। উপরে তাকিয়ে সে খোলা আকাশ দেখতে পায়। মনে হলো এবারে গোয়ালঘরটা পড়ে যাবে আর সে তার ভেতরে বুঝি চাপা পড়ে যাবে।

প্রচণ্ড বাতাস আর বৃষ্টির মাঝে বিজলী বের হয়ে এল। বৃষ্টির পানিতে সবকিছু কাদা হয়ে আছে, তার মাঝে পা ফেলে সে বাড়ির দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

প্রচণ্ড বাতাসের ঝাঁপটায় সে প্রায় উড়ে যাচ্ছিল, কোনোভাবে নিজেকে রক্ষা করে সে এগিয়ে গেল। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো মনে হয় তার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে।

হঠাৎ সে একটা ভয়াবহ গর্জন শুনতে পায়, কিসের গর্জন বোঝার জন্যে সে পেছন ফিরিয়ে তাকানোর আগেই পানির একটা দেয়াল গর্জন করতে করতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পানির ঝাঁপটায় সে মাটিতে আছড়ে পড়ে, বিজলী বুঝতে পারে তার উপর দিয়ে পানির ঢল বয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নেবার জন্যে সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়ায়, তখন পানির ঢলটা তার উপর দিয়ে যেভাবে এসেছিল সেভাবে নেমে গেল। পুরোটা নেমে গেল না–সে দেখল তার হাঁটু পর্যন্ত পানিতে ডুবে আছে। স্কুলে তার স্যার যে জলোচ্ছ্বাসের কথা বলেছিলেন এটি সেই জলোচ্ছ্বাস। এই জলোচ্ছাসে সবকিছু ভাসিয়ে নেবে।

বিজলী চিৎকার করতে থাকে, পানি! পানি! পানি আসছে। বান আসছে!

সে কোনোভাবে বাড়ির দরজায় হাজির হলো, পানির ঢলটা তাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে গেছে। যে কুপি বাতিটা জ্বলছিল সেটি অনেক আগেই নিভে গেছে। আকাশ থেকে বিচিত্র এক ধরনের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সেই আবছা আলোতে দেখতে পেল ঘরের দরজা ধরে তার বাবা-মা দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছেন। খোকনকে সে দেখতে পেল না, ভয় পেয়ে চিৎকার করে ডাকল, খোকন! খোকন!

বাড়ির ভেতর থেকে খোকন বের হয়ে আসে, কাঁপা গলায় বলে, এই যে আমি।

বিজলী ছুটে গিয়ে খোকনকে জাপটে ধরল, বলল, পানি আসছে! পানি।

খোকন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এখন কী হবে? কী হবে এখন?

এখন কী হবে বিজলী জানে না। বাতাসের ঝাঁপটা সহ্য করে কিছু একটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা যায়। কিন্তু পানির ঝাঁপটা সহ্য করে কিছু টিকে থাকতে পারে না।

বাতাসের তীব্র একটা ঝাঁপটায় সবকিছু থরথর করে উঠল আর ঠিক তখন আগের মতো ভয়াবহ গর্জনটি শুনতে পেল। আবার পানির একটা দেয়াল তার পথে সবকিছু ভেঙেচুরে গর্জন করতে করতে একটা হিংস্র পশুর মতো ছুটে আসছে। কিছু বোঝার আগে পানির সেই বিশাল দেয়ালের আঘাতে তাদের বাড়িটা টলমল করে উঠল। পানির ঝাঁপটায় বিজলী আর খোকন নিচে পড়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত কেউ কিছু বুঝতে পারে না–পানির দেয়ালটি যেভাবে ছুটে এসেছিল ঠিক সেভাবে আবার ফিরে গেল, আগের মতো পুরোটুকু ফিরে গেল না, কোমর পর্যন্ত পানি রয়ে গেল। দেখতে দেখতে চারদিক পানিতে ডুবে যাচ্ছে।

বিজলী কী করবে বুঝতে পারছিল না, মা চিৎকার করে খোদাকে ডাকছেন, বাবা হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। খোকন হাউমাউ করে কাঁদছে।

বাঁচতে হবে। বিজলী দেখল সে বিড় বিড় করে নিজেকে বলছে, যেভাবে তোক বাঁচতে হবে।

বাঁচার একটি মাত্র উপায়, কোনো একটা উঁচু জায়গায় যেতে হবে। এই চরে কোনো উঁচু জায়গা নেই, কোনো দালান নেই, বিল্ডিং নেই। উঁচু জায়গা বলতে আছে গাছ। তাদেরকে একটা শক্ত বড় গাছে উঠতে হবে। বাড়ির পেছনে যে বড় কাঁঠালগাছটা আছে সেটি হচ্ছে একমাত্র বাঁচার জায়গা।

বাতাস আর বৃষ্টির শব্দের সাথে সমুদ্রের প্রচণ্ড গর্জন, তার মাঝে বিজলী চিৎকার করে বলল, গাছে উঠতে হবে। গাছে। তাড়াতাড়ি। তাড়াতাড়ি আসো।

বিজলী খোকনের হাত ধরে উঠানে নেমে আসে, সেখানে এখন কোমর পানি। প্রচণ্ড বাতাসের মাঝে পানি ঠেলে হেঁটে যেতে যেতে সে পেছনে ফিরে তাকালো, বিজলীর কথা শুনে তার বাবা মাও পানিতে নেমে এসেছেন। বিজলী খোকনকে নিয়ে ছুটে যেতে যেতে আবার পানির ভয়ংকর গর্জন শুনতে পেল। পানির একটা ভয়াবহ দেয়াল ছুটে আসছে। বিজলী চিৎকার করে খোকনকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। গাছটার কাছে পৌঁছানোর আগে পানির ঝাঁপটা তাদেরকে আঘাত করল। দুজন হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়, পানির ধাক্কায় দুজনে ভেসে যেতে শুরু করেছে, বিজলী তার মাঝে খোকনকে ছাড়ল না, শক্ত করে ধরে রাখল।

পানি সরে যাবার পর বিজলী উঠে দাঁড়াল।

একটু আগে কোমর পানি ছিল, এখন সেটা বুক পানি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজলী খোকনকে দাঁড় করিয়ে এদিক-সেদিক তাকালো, আবছা আলোতে সে তার বাবা মাকে খুঁজল কিন্তু তাদের খুঁজে পেল না। চিৎকার করে ডাকল, বাবা! মা!

ঝড়ের প্রচণ্ড শব্দে তার গলা চাপা পড়ে গেল, কেউ তার ডাকের উত্তর দিল না। বিজলী কী করবে বুঝতে পারছিল না, সে ভালো করে চিন্তাও করতে পারছিল না। বহু দূর থেকে সে আবার পানির গর্জন শুনতে পায়। খোকনকে ধরে সে আবার ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে, বুকসমান পানি ভেঙে ছোটা সহজ নয়, পায়ের নিচে কাঠ কুটো জঞ্জাল তার মাঝে খোকনকে টেনে কাঁঠালগাছটার নিচে পৌঁছে যায়, তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল, ওঠ। খোকন, গাছের উপর ওঠ।

খোকন গাছের ডালের নাগাল পায় না, বিজলী তখন তাকে ধরে উঁচু করল, খোকন ডালটা ধরে গাছে উঠে গেল। বাতাস খোনকে প্রায় উড়িয়ে নিতে চাচ্ছিল, তার মাঝে খোকন শক্ত করে গাছের ডালটা ধরে রাখল। খোকনকে উঠিয়ে দিয়ে বিজলী নিজে গাছে ওঠার চেষ্টা করল, সেও ডালটা নাগাল পায় না। যখন ভিজে গাছটা বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করছে ঠিক তখন আবার পানির বড় একটা ঝাঁপটা গর্জন করতে করতে ছুটে এল। পানির প্রবল স্রোতে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, বিজলী তার সমস্ত শক্তি দিয়ে গাছটাকে আঁকড়ে ধরে রাখল। বিজলী শুনতে পেল গাছের উপর থেকে খোকন চিৎকার করছে। পানির গর্জন আর বাতাসের শব্দে সে কিছু বুঝতে পারে না। পানিটা নেমে যাবার পর বিজলী তার সমস্ত শক্তি দিয়ে ঠেলে কোনোভাবে গাছের উপর উঠে পড়ল। বড় ডালটা ধরে সে মুখ হাঁ করে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে খোকনকে বলল, আরো উপরে উঠে যা খোকন, আরো উপরে।

বাতাসে পুরো গাছটি উন্মত্তের মতো হুটোপুটি করছে। গাছের ডাল আর পাতা চাবুকের মতো তাদের শরীরে আঘাত করছে। ভিজে পুরো গাছটা পিচ্ছিল হয়ে আছে, তার মাঝে দুজন গাছের আরো উপরে উঠে গিয়ে একটা বড় ডালকে শক্ত করে ধরে রাখল। প্রচণ্ড বাতাস মনে হয় তাদের উড়িয়ে নিয়ে যাবে, তার মাঝে দাঁতে দাঁত কামড়ে দুজনে গাছটাকে ধরে রাখে।

খোকন চিৎকার করে কিছু একটা বলছিল, কী বলছে বিজলী শুনতে পাচ্ছিল না; বাতাসের শব্দ একটু থামতেই শুনতে পেল, খোকন চিৎকার করে বলছে, বাবা কই? মা কই?

বিজলী কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না, সমুদ্রের পানি কি তাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে? তারা কি কোনো কিছু ধরে কোথাও ভেসে আছে? কে উত্তর দেবে? খোকন কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থের মতো হয়ে গেল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকল, বাবা, মা–

কেউ তার কথার উত্তর দিল না। বাতাসের বেগ বাড়তেই থাকে, গাছের ডাল ভেঙে পড়ে, বিজলীর একসময় মনে হয় পুরো গাছটাই মনে হয় ভেঙে পড়বে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তাদের শরীরে এসে সুইয়ের মতো বিধতে থাকে, মনে হয় পুরো শরীর বুঝি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাবে।

একটার পর একটা পানির ঝাঁপটা আসতে থাকে আর প্রত্যেকবার পানির উচ্চতা আগের থেকে আরেকটু বেড়ে যেতে থাকে। পানির স্রোত গাছে এসে আঘাত করে, পানির ঝাঁপটায় সবকিছু ভেসে যেতে থাকে।

বিজলী আকাশের দিকে তাকালো, বিচিত্র একধরনের আলোর আভায় সারা আকাশ উজ্জ্বল হয়ে আছে। তার অশরীরী আলোতে চারদিকে কেমন যেন ভৌতিক আর অলৌকিক মনে হয়। উপরে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি, নিচে পানির স্রোত। বিজলীর মনে হয় এটাই কি সত্যিকারের নরক? নাকি এটি নরক থেকেও ভয়ংকর।

পানিতে নানা কিছু ভেসে যাচ্ছে। ভাঙা ঘর বাড়ি, দরজা, কাঠ কুটো, বাক্স, হাঁড়ি পাতিল। হঠাৎ হঠাৎ কোনো গরু কিংবা বাছুর। কোনো কোনোটি এখনো বেঁচে আছে, বেশির ভাগ মৃত।

পানি আরো বাড়তে থাকে। শুধু যে পানি বাড়ছে তা নয় মনে হয় যতই সময় যাচ্ছে পানিটা বুঝি আরো ক্রুদ্ধ হয়ে ফুঁসে উঠছে। বিজলী আর খোকন গাছটার আরো উপরে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু খুব বেশি দূর উপরে উঠতে পারে না। নিচের ডালগুলো মোটা, দুজন মানুষ বসে থাকতে পারে। উপরের ডালগুলো সরু, বাতাসে সেগুলো ভয়ংকরভাবে দুলতে থাকে। যেকেনো মুহূর্তে তাদের নিয়ে ভেঙে পড়তে পারে।

পানি বাড়তে বাড়তে একসময় তাদের পা স্পর্শ করে। বাতাসের ঝাঁপটায় সেই পানি অনেক সময় ফুঁসে উঠে তাদের উপর দিয়ে বয়ে যায়। পানিটুকু মনে হয় জীবন্ত এবং ক্রুদ্ধ। একটু পর পর প্রচণ্ড আক্রোশে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে।

পানিতে মাঝে মাঝেই মানুষ ভেসে যেতে থাকে। বেশিরভাগ মানুষ মৃত। মাঝে মাঝে এক দুজন জীবন্ত মানুষ পাওয়া যায়, তারা গাছটি ধরে বাঁচতে চায়। কিন্তু দুর্বল হাতে গাছটি ধরে রাখতে পারে না, পানির ঝাঁপটায় তারা ছিটকে পড়ে। বিবস্ত্র একটি মেয়ে একবার একটি ডাল ধরে ফেলে চিৎকার করতে থাকল। বিজলী তাকে ধরে গাছে তোলার আগেই মেয়েটি পানির টানে ছুটে গেল, অন্ধকারে তাকে আর দেখতে পেল না। কিন্তু বিজলীর মনে হলো মেয়েটি আমিন মোল্লার সেই কমবয়সী বউটি। যে তুফানকে সে খুব ভয় পায় সেই তুফান তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

খোকন আর বিজলী গাছের ডাল ধরে ঝুলে রইল। বাতাসের তীব্র ঝাঁপটায় মাঝে মাঝে হাত ছুটে যেতে চায়, কিন্তু তারা হাত ছাড়ল না। গাছের ডাল তাদের চাবুকের মতো আঘাত করে, বৃষ্টির পানি ধারালো বর্শার মতো তাদেরকে বিদ্ধ করে তবু তারা হাত ছাড়ল না। মাঝে মাঝেই পানি ফুঁসে উঠে তাদের ডুবিয়ে ফেলে। পানির নিচে থেকে একসময় হাঁসফাঁস করে উপরে ভেসে ওঠে, তবু তারা গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে রইল।

ভোর রাতের দিকে ঝড়ের তীব্রতা কমে আসতে থাকে। মাঝে মাঝে আকাশ চিরে আলো ঝলসে ওঠে, বজ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যায়। পায়ের নিচে ছলাৎ ছলাৎ করে পানি বয়ে যেতে থাকে। একসময় ঝড় থেমে আসে, আকাশের খোলা আলোতে চারদিকে অস্পষ্ট একটা ছবির মতো দেখায়। ধীরে ধীরে আকাশের মেঘ কেটে পূর্ণিমার ভরা চাঁদটিকে দেখা যায়। পূর্ণিমার ভরা আলোতে পানিতে ডুবে থাকা পুরো চরটিকে একটি অপার্থিব জগৎ বলে মনে হয়। চারদিকে সুনসান একটি অবিশ্বাস্য নীরবতা।

খোকন জিজ্ঞেস করল, বিজলীবু, ঝড় থেমে গেছে?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, না।

কেন না?

ঝড়ের ঠিক মাঝখানে এই রকম হয়। একটু পর আবার ঝড় শুরু হইব।

আবার?

হ্যাঁ। আবার।

আগের মতো?

হ্যাঁ। আগের মতো। খালি বাতাসটা এইবার উল্টাদিক দিয়া আসব।

খোকন আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু আকাশে তো মেঘ নাই।

মেঘ আসব। ঝড় আসব।

বিজলী ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিল না, সে খোকনের সাথে কথা বলছিল কিন্তু নিজেই জানে না কী বলছে, কেন বলছে? মনে হচ্ছে সবকিছু যেন তার অজান্তে ঘটে যাচ্ছে।

বিজলীর কথা সত্য হলো। দেখতে দেখতে আকাশের চাঁদ আবার মেঘে ঢেকে গেল। আবার আকাশ চিরে আলো ঝলসে উঠল, বজ্রপাতের শব্দে চারদিক প্রকম্পিত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে বাতাসের বেগ বাড়তে থাকল, বৃষ্টির ধারালো ফোঁটা আবার তাদের ক্ষতবিক্ষত করতে থাকল। পায়ের নিচে ক্রুদ্ধ পানি আবার ফুঁসে ফুঁসে উঠতে থাকল।

তার মাঝে খোকন আর বিজলী গাছের ডাল আঁকড়ে ঝুলে রইল। ক্লান্তিতে তাদের সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে ওঠে, তবু তারা গাছের ডাল ছাড়ল না। প্রচণ্ড ঝড়ের আঘাতে তারা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, একসময় তাদের বোধশক্তি লোপ পেয়ে যায়। তারা বুঝতে পারে না সত্যিই তারা কি বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।

একসময় মনে হতে থাকে বেঁচে থেকে কী হবে?

তবু তারা গাছের ডাল ধরে বেঁচে রইল। কেন তারা বেঁচে রইল তারা নিজেরাও জানে না।

২. গাছ থেকে নেমে

গাছ থেকে নেমেই খোকন ভেজা কাদা মাটির উপরই শুয়ে পড়তে চাইছিল, বিজলী তাকে থামিয়ে একটু সামনে টেনে নিয়ে যায়। পুরো চরটি মনে হয় একেবারে মাটির সাথে মিশে গেছে। যেখানে তাদের বাড়ি ছিল সেখানে কিছু নেই, ভিটেটা পর্যন্ত বোঝা যায় না। আমিন মোল্লার বাড়িটাও নেই, শুধু বাড়ির ভিটেতে দুই একটা পুঁতে রাখা বাঁশ বাঁকা হয়ে আছে। বাড়ির পাশে কিছু কাঁটা গাছ, সেখানে কীভাবে জানি কিছু কাপড় ঝুলে আছে।

একটু কাছে গিয়ে বিজলী দেখল, আসলে কাপড় নয়, একজন মানুষ উল্টো হয়ে ঝুলে আছে। চোখ দুটো খোলা, সেই ভোলা চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে, মানুষটার শরীরে প্রাণ নেই। প্রথমে চিনতে পারেনি এবং বিজলী হঠাৎ করে চিনতে পারল, মানুষটি আমিন মোল্লা। তাবিজ দিয়ে সে চরের সব মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছিল কিন্তু সে নিজেকেই বাঁচাতে পারেনি। বিজলী খোকনকে এই দৃশ্যটা দেখাতে চাইছিল না, তাকে আড়াল করে সামনে টেনে নিতে থাকল কিন্তু খোকন হঠাৎ দেখে ফেলল। সাথে সাথে একধরনের অমানুষিক আতঙ্কে চিৎকার করে সে বিজলীকে জাপটে ধরে ফেলল। বিজলীও তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সামনে টেনে নিয়ে যায়, সমুদ্রের তীরে খোলা জায়গাটায় গিয়ে দুজনে ধপাস করে বসে পড়ে। খোকন সাথে সাথে বালুর উপর শুয়ে পড়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। কী করবে বুঝতে না পেরে বিজলী তাকে শক্ত করে ধরে রাখে।

কিছুক্ষণের মাঝে খোকনের কাঁপুনি থেমে গেল, সে চোখ বন্ধ করে কাৎ হয়ে শুয়ে রইল। খোকন কি ঘুমিয়ে গেছে না অজ্ঞান হয়ে গেছে বিজলী বুঝতে পারল না। বিজলী চারপাশে তাকালো, পুরো চরে কোনো বাড়িঘর নেই। বড় বড় দুই চারটি গাছ ছাড়া আর কোনো গাছও নেই। ইতস্তত মানুষ কিংবা গরু বাছুর মরে পড়ে আছে। আকাশে কয়েকটা চিল উড়ছে। যে সমুদ্রটা গত রাতে ভয়ংকর আক্রোশে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে এখন সেটি শান্ত, একটু পরপর ঢেউ এসে কূলে আছড়ে পড়ছে।

বিজলী খোকনের পাশে বসে রইল, তার সমস্ত শরীরটা মনে হয় কেউ ধারালো চাকু দিয়ে ফালা ফালা করে কেটে রেখেছে। বিজলী নিজের হাত-পায়ের দিকে তাকালো, তার নিজের শরীরটাও খোকনের মতো–হাত-পা ক্ষতবিক্ষত, সমস্ত শরীর মনে হয় কেউ খুবলে খুবলে নিয়েছে। এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, এখন হঠাৎ করে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সারা শরীর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। ক্লান্তিতে তার সমস্ত শরীর ভেঙে যাচ্ছে। বিজলী নিজেও তখন খোকনের পাশে শুয়ে পড়ল। মুহূর্তে তার সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায়।

.

বিজলী কতক্ষণ অচেতন হয়ে ছিল কিংবা ঘুমিয়েছিল সে জানে না। যখন সে চোখ খুলে তাকালো তখন সূর্য ডুবে যাচ্ছে। চারপাশে কেমন জানি এক ধরনের থমথমে পরিবেশ। বিজলীর বেশ অনেকক্ষণ লাগল বুঝতে সে কোথায় আছে। হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ল তখন সে ধড়মড় করে উঠে বসে। তার পাশে খোকন এখনো ঘুমিয়ে আছে, নিঃশ্বাসের সাথে সাথে তার ছোট বুকটা উপরে উঠছে আর নিচে নামছে।

প্রচণ্ড পিপাসায় বিজলীর বুকটা ফেটে যাচ্ছিল, কিন্তু আশেপাশে কোথাও খাওয়ার মতো একটু পানি নেই। বিজলী কিছুক্ষণ নিজের হাঁটুতে মাথা রেখে বসে রইল। এতক্ষণ সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারেনি, এই প্রথমবার সে সবকিছু চিন্তা করতে পারল।

বোঝাই যাচ্ছে, খোকন আর সে নিজে ছাড়া এই চরে আর কেউ বেঁচে নেই। তার বাবা-মা, চরের অন্য মানুষজন, গরু-বাছুর কেউ বেঁচে নেই। এই সমস্ত চরে বেঁচে আছে শুধু তারা দুজন। তাদের সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত, একটুখানি নড়লেই প্রচণ্ড যন্ত্রণায় সে শিউরে শিউরে উঠছে। যদি কোনো মানুষ এসে তাদেরকে না বাঁচায় তাদের কী হবে সে জানে না।

ঠিক তখন সে একটা চাপা গুম গুম শব্দ শুনতে পেল, মনে হয় একটা হেলিকপ্টার উড়ে যাচ্ছে। বিজলী অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে হেলিকপ্টারটা দেখার চেষ্টা করল। হেলিকপ্টারটা উত্তর দিক থেকে তাদের চরের দিকে উড়ে আসছে। বিজলী হাত নেড়ে হেলিকপ্টারটির নজরে পড়ার চেষ্টা করল। হেলিকপ্টারে যারা আছে তারা তাকে দেখতে পাচ্ছে কি না সে জানে না। বিজলী অবশ্যি থামল না, যতক্ষণ হেলিকপ্টারটি দেখতে পাচ্ছিল ততক্ষণ সে হাত নাড়াতে থাকল। হেলিকপ্টারটি চরের উপর দিয়ে একটা পাক খেয়ে আবার যেদিক দিয়ে এসেছিল সেই দিকে চলে গেল।

বিজলী হতাশভাবে মাথা নাড়ে, তাকে নিশ্চয়ই দেখতে পায়নি। দেখতে পেলে নিশ্চয়ই নামত। কিংবা কে জানে হয়তো দেখেছে কিন্তু তবু নামেনি। কেন নামবে? তারা কে? তাদেরকে বাঁচাতে হবে কে বলেছে।

বিজলী আবার গুটিসুটি মেরে খোকনের পাশে শুয়ে পড়ে। প্রচণ্ড সাইক্লোন আর জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেয়ে এখন হয়তো খিদে আর পানির পিপাসায় তারা মারা যাবে। কোনো একটা বিচিত্র কারণে মরে যাওয়ার ব্যাপারটি এখন আর ভয়ংকর কিছু মনে হচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে মরে যাওয়াটিই বুঝি ভালো। মরে যাওয়াটাই বুঝি শান্তি।

বিজলী খোকনকে জড়িয়ে ধরে মরে যাওয়ার কথা চিন্তা করতে করতে আবার গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে গেল।

মানুষের গলার স্বর শুনে বিজলী হঠাৎ জেগে ওঠে। খোকনকে জড়িয়ে ধরে সে বালুর ওপর শুয়ে আছে। মাথার ওপর বিশাল একটা চাঁদ। বেশ খানিকটা দূরে কয়েকজন মানুষ টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছে। বিজলী মাথা তুলে শোনার চেষ্টা করল, শুনতে পেল একজন চিৎকার করে বলছে, কেউ কি আছে এখানে? আছে কেউ?

বিজলীর মনে হলো তার এখন উঠে বসে কিছু একটা বলা উচিত। কিন্তু কী হলো কে জানে সে কিছু বলল না। ছোট ভাইটিকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইল। কী হবে কথা বলে?

মানুষগুলো চারদিকে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এগিয়ে আসছে। মনে হয় কাউকে খুঁজছে। চিৎকার করে ডাকছে, আছে কেউ? কেউ আছে এখানে? সাড়া দাও।

বিজলী সাড়া দিল না। কী হলো কে জানে হঠাৎ করে তার দুই চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি বের হয়ে আসে। প্রচণ্ড অভিমানে তার বুকটা ভেঙে যায়? কার বিরুদ্ধে তার এত বড় অভিমান?

টর্চের আলোটা হঠাৎ তাদের উপর এসে পড়ল। আলোটা সাথে সাথে স্থির হয়ে যায়, তারপর হঠাৎ করে সে ধুপধাপ পায়ের শব্দ শুনতে পায়। মানুষগুলো তাদের দিকে ছুটে আসছে। টর্চের তীব্র আলোতে বিজলীর চোখ ধাঁধিয়ে যায়, সে হাত দিয়ে তার চোখ আড়াল করে রাখল। তারপরও সে টের পেল মানুষগুলো তাদের ঘিরে হাঁটু গেড়ে বসেছে। একজন মহিলার উত্তেজিত গলার স্বর শুনতে পেল, বেঁচে আছে! বেঁচে আছে!

একজন মহিলা তার মাথায় হাত রাখল, ফিস ফিস করে বলল, মা, এই যে মা, আমরা তোমাকে নিতে এসেছি। চোখ খুলে একটু তাকাবে? তাকাবে একটু?

বিজলী চোখ খুলে তাকালো না, ঝর ঝর করে কাঁদতে লাগল। টের পেল মহিলাটি তার মাথার নিচে হাত রেখে তাকে বসানোর চেষ্টা করতে করতে নরম গলায় বলল, ভয় নেই মা। তোমার আর কোনো ভয় নেই। আমরা তোমাদের নিতে এসেছি।

একজন মানুষ খোকনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিচু গলায় ইংরেজিতে কিছু একটা বলল। অন্য আরেকজন তার উত্তরে কী যেন বলল বিজলী বুঝতে পারল না।

বিজলী তার হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কাঁপা গলায় বলল, সবাই ভাইসা গেছে। সবাই।

মহিলাটি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোমরা কেমন করে বেঁচে আছো আমি জানি না। যারা শেল্টারে যায় নাই তাদের কেউ বেঁচে নেই! খোদা তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। খোদা নিশ্চয়ই তোমাদের দিয়ে অনেক বড় কিছু করাবেন, তাই তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন।

বিজলী ভাঙা গলায় বলল, আমার মা, বাবা!

মহিলাটি বলল, আমরা আছি। আমরা আছি। তোমাদের কোনো ভয় নেই মা–

ভারী গলায় একজন পুরুষ বলল, মেডিকেল হেল্প দরকার। দেরি করা যাবে না।

পুরুষ মানুষটির কথার উত্তরে আরেকজন কিছু একটা বলল, তার উত্তরে আরেকজন। কেউ একজন ইংরেজিতে কিছু একটা বলল, তখন মহিলাটি কিছু একটা বলল। মানুষগুলো নিজেদের ভেতর নিজেরা কথা বলছে, তাদেরকে নিয়ে কী করবে সেটা ঠিক করছে।

বিজলী চোখ বন্ধ করল। এখন সে আর কিছু চিন্তা করতে চায় না। কিছু না। কী হবে সে জানতে চায় না। সে বেঁচে থাকলে কী হবে আর মরে গেলে কী হবে সেটি নিয়েও তার কোনো মাথাব্যথা নেই। সে বুঝতে পারে তার চোখের সামনে খুব ধীরে ধীরে একটা পর্দা নেমে আসছে। অন্ধকার কালো একটা পর্দা। সেই পর্দা তার সবকিছু ঢেকে ফেলল। সে আর কিছু জানে না।

*

চশমা পরা পাতলা ছিপছিপে একজন মহিলা বলল, আমার নাম সেলিনা। সেলিনা জাহান।

বিজলী গলার স্বরটা আগে শুনেছে। কোথায় শুনেছে ঠিক মনে করতে পারল না।

আমি তোমাদের দুজনকে চর থেকে তুলে এনেছিলাম।

বিজলীর তখন মনে পড়ে গেল, সে এবারে ভালো করে চশমা পরা ছিপছিপে মহিলাটির দিকে তাকালো। সাইক্লোনের পরের রাতে এই মহিলার কথাগুলো মনে হচ্ছিল অন্য কোনো জগৎ থেকে ভেসে ভেসে আসছে।

আমি যখন খবর পেয়েছি চরে দুজন ছেলেমেয়েকে দেখা গেছে–রেস্কিউ হেলিকপ্টারের রিপোর্ট, তখন আমি অন্যদের উপর ভরসা না করে নিজেই চলে গিয়েছিলাম।

বিজলীর মনে হলো এখন তার কিছু একটা বলা উচিত, তাই বলল, আপনি আমাদের জান বাঁচাইছেন।

সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি বাঁচাই নাই। তোমরা নিজেরা তোমাদের জান বাঁচিয়েছ। ঐ চরের আর একজন মানুষও বেঁচে নাই। আমি শুধু তোমাদের চর থেকে তুলে এই হাসপাতালে এনেছি।

সেলিনা জাহান নামের মহিলাটি হাসপাতালের কেবিনটা ভালো করে দেখল। দুটো পাশাপাশি বিছানা। বিছানায় ধবধবে সাদা চাদর। একটা বিছানায় খোকন আধশোয়া হয়ে বসে আছে, অন্য বিছানায় বিজলী। দুজনের হাতে পায়ে শরীরে ব্যান্ডেজ। পরনে হাসপাতালের ঢলঢলে এক ধরনের গাউন।

খুব ব্যস্ত ছিলাম তাই নিজে এসে তোমাদের দেখে যেতে পারিনি। কিন্তু তোমাদের খোঁজ নিয়েছি। ডাক্তার বলেছে তোমরা সুস্থ হয়ে উঠছ। সপ্তাহে খানেকের মাঝে তোমাদের ছেড়ে দেবে।

বিজলী বলল, ছেড়ে দেবে?

হ্যাঁ।

তখন-–তখন–আমরা কই যাব?

সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল, বলল, তোমাদের সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। আমি ব্যবস্থা করব।

বিজলীর জানতে ইচ্ছে হলো ব্যবস্থাটি কী কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করল না। একটু পর সেলিনা জাহান নিজেই বলল, আমি খোঁজ নিয়েছি। দেশে এখন অনেক অর্গানাইজেশন আছে যারা তোমাদের মতো ছেলেমেয়েদের শেল্টার দেয়।

খোকন হঠাৎ করে বলে বসল, এতিমখানা?

সেলিনা জাহান একটু থতমত খেয়ে গেল, তারপর একটুখানি হাসার চেষ্টা করে বলল, না। এতিমখানা না। এখন দেশে শিশুদের অনেক অর্গানাইজেশন আছে। তারা ছেলেমেয়েদের আশ্রয় দেয়, দেখেশুনে রাখে। দেশী বিদেশী অনেক এনজিও আছে।

বিজলী একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, আমি আর খোকন এক সাথে থাকতে পারব?

সেলিনা জাহান এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ পারবে। নিশ্চয়ই পারবে। আমরা মেক শিওর করব যেন তোমরা দুজন এক সাথে থাকতে পারো।

আলাদা আলাদা দুই জায়গায় দুইজনরে নিবে না তো?

না, নেবে না। বয়স অনুযায়ী অনেক জায়গায় ভাগ করে ফেলে–ছেলে আর মেয়ে হিসেবেও অনেক জায়গায় আলাদা করে ফেলে। আমরা দেখব সেটা যেন না হয়। তোমরা দুজন যেন একসাথে থাকতে পার।

বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলল। হঠাৎ করে কত তাড়াতাড়ি সবকিছু কেমন ওলটপালট হয়ে গেল। এখনো সে সবকিছু ভালো করে কিছু চিন্তা করতে পারে না। এখনো মনে হচ্ছে সে বুঝি একটা ঘোরের মাঝে আছে। মনে হয় সে বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। মনে হয় হঠাৎ করে তার ঘুম ভেঙে যাবে আর সে অবাক হয়ে দেখবে সবকিছু আগের মতোই আছে। তার বাবা নির্জীবের মতো বাড়ির বারান্দায় হাঁটুমুড়ি দিয়ে বসে আছেন। মা চুলোর মাঝে শুকনো পাতা কাঠি লাকড়ি খুঁজে দিতে দিতে তাকে বকছেন।

.

গভীর রাতে বিজলীর ঘুম ভেঙে গেল। পাশের বিছানায় খোকন ছটফট করছে, যন্ত্রণার মতো শব্দ করতে করতে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলছে। বিজলী লাফ দিয়ে তার বিছানা থেকে নেমে খোকনের কাছে গেল। খোকন ছটফট করতে করতে কিছু একটা বলছে, কথা বলতে বলতে সে হঠাৎ চিৎকার করতে শুরু করে। রক্ত শীতল করা চিৎকার। নিশ্চয়ই ভয়ংকর কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। বিজলী খোকনকে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ডাকতে থাকে, খোকন, খোকন–এই খোকন–

শেষ পর্যন্ত খোকন চোখ খুলে তাকালো, কিন্তু সে কিছু দেখছে। বলে মনে হলো না। শূন্য দৃষ্টিতে বিজলীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করতে থাকে।

বিজলী খোকনকে জড়িয়ে ধরে বলে, খোকন, দেখ কিছু হয় নাই খোকন, এই যে আমি–এই যে আমি–

খোকন আতঙ্কে থরথর করে কাঁপতে থাকে, হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে। উঠে বসে বিছানা থেকে নেমে যেতে চায়–অন্য কোনো একটা জায়গায় ছুটে যেতে চায়!

বিজলী কী করবে বুঝতে পারে না। কাঁদো কাঁদো গলায় খোকনকে ধরে রেখে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, তার শরীরে হাত বুলায়, মাথায় হাত বুলায়, বুকে চেপে ধরে বলে, ভাই আমার, সোনা আমার, খোকন, খোকন সোনা, তুই তাকায়ে দেখ, আমি আছি, আমি আছি এইখানে, এই দেখ–

শেষ পর্যন্ত খোকন শান্ত হলো, বিজলীর দিকে তাকালো, প্রথমবার বিজলীকে চিনতে পারল, তারপর তাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

বিজলী নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হইছে? সোনা আমার। কী হইছে তোর?

আমি দেখছিলাম তুমি ভেসে চলে যাচ্ছ—

না, আমি ভেসে যাই নাই, আমি আছি।

আমি দেখছি, অনেক মরা মানুষ তোমারে টেনে নিয়া যাচ্ছে—

না, আমারে কেউ টেনে নেয় নাই।

খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি দেখছি আমার পায়ের বুড়া আঙুলে কে জানি কামড় দিয়া ধরছে।

বিজলী খোকনকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, কেউ তোর পায়ে কামড় দেয় নাই। কেউ কামড় দিব না।

খোকন কান্না থামাল, তারপর বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, বিজলীবু–

বল সোনা ভাই।

তুমি বলো তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবা না।

আমি তোরে ছেড়ে কেন চলে যাব? কোনোদিন যাব না।

খোদার কসম?

বিজলী খোকনকে জড়িয়ে ধরে বলল, খোদার কসম।

খোকন তখন একটু শান্ত হলো। বিজলী খোকনকে বিছানায় শুইয়ে তার মাথায় শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, তুই এখন ঘুমায়া যা। আমি তোর পাশে বসে আছি।

খোকন তখন গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। বিজলী খোকনের পাশে বসে তার শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। কিছুক্ষণের ভেতরে খোকন ঘুমিয়ে পড়ে। বিজলী তার ভাইটির পাশে নিঃশব্দে বসে থাকে। তার বুকের ভেতর কেমন জানি খাঁ খাঁ করতে থাকে।

*

নার্স ব্যান্ডেজটা খুলে নতুন ব্যান্ডেজ লাগাতে যাচ্ছিল, ডাক্তার বলল, আর ব্যান্ডেজের দরকার নেই! ঘা শুকিয়ে গেছে।

বিজলী আর খোকন তাকিয়ে দেখল আসলেই তাদের শরীরের ফালা ফালা হয়ে কেটে যাওয়া জায়গাগুলো শুকিয়ে এসেছে।

ডাক্তার খোকনের পিঠে থাবা দিয়ে বলল, ইয়ং ম্যান–দেখছ, তোমরা কত তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে গেছ? আমাদের মতো বুড়ো মানুষ হলে ভালো হতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ লেগে যেত। বুঝেছ?

খোকন মাথা নাড়ল, কেন বড় মানুষদের ভালো হতে বেশি সময় লাগে সে ঠিক বুঝে নাই। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে কথা বলল না। ডাক্তারদের তার ভয় লাগে।

ডাক্তার তারপর বিজলীর দিকে তাকালো, নার্স যখন তার ব্যান্ডেজগুলো খুলছে, তখন ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, ইয়ং লেডি। তুমি কেমন আছো?

ভালো।

গুড। তোমরা দুই ভাই-বোন খুব লাকি। আমি রিপোর্ট দেখেছি, ওই চরে একজনও বেঁচে ছিল না–

বিজলীর হঠাৎ করে তার বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ল। তার চোখে পানি চলে আসছিল, ডাক্তার সেটা লক্ষ করে তাড়াতাড়ি কথা পাল্টে ফেলে বলল, হাসপাতালের খাবার খেতে পারো?

বিজলী চোখ মুছে বলল, পারি।

আমি জানি তুমি আমাদেরকে খুশি করার জন্য বলছ! আসলে কেউ হাসপাতালের খাবার খেতে পারে না! হাসপাতালে কেন এরকম মসলা ছাড়া বিস্বাদ খাবার দেয় জানো?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল সে জানে না।

ডাক্তার গলা নামিয়ে ষড়যন্ত্রীদের মতো করে বলল, এ রকম বিস্বাদ খাবার দেয় যেন রোগীরা বাড়িতে গিয়ে ভালো করে রান্না করা খাবার খাওয়ার জন্যে তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়। কথা শেষ করে ডাক্তার হা হা করে হাসতে লাগল। বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না এটা এমন কী হাসির কথা যে এত জোরে জোরে হাসতে হবে। কিন্তু তারপরও সে ভদ্রতা করে একটু হাসার চেষ্টা করল।

ডাক্তার হাসি থামিয়ে পকেট থেকে দুইটা চকলেটের বার বের করে একটা খোনকে, আরেকটা বিজলীকে দিয়ে বলল, নাও। আমার ওয়াইফ তোমাদের দুইজনকে দিয়েছে। আমাকে বলেছে সে তোমাদেরকে একদিন দেখতে আসবে।

বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না, তাই মুখটা হাসি হাসি করে রাখল। এই হাসপাতালের সবাই তাদের কথা জানে, সবাই তাদের দুজনকে আলাদা করে আদর করে। একটু পরে পরে এসে সবাই খোঁজ নিয়ে যায়।

ডাক্তার যখন কেবিন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে তখন বিজলি তার সাথে সাথে বের হয়ে এল। ডাক্তার জিজ্ঞেস করল, কিছু বলবে?

বিজলী মাথা নাড়ল। বলল, জি।

বলো।

রাত্রিবেলা খোকন জানি কী রকম করছিল।

ডাক্তার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী রকম করছিল?

ঘুমের ভিতর ছটফট করে, পাগলের মতো হয়ে যায়। আমি যখন জাগিয়ে তুলি তখনো আমাকে চিনে না। ভয় পায়, চিৎকার করে।

ডাক্তার গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলল, অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমরা যত বড় ট্রমার ভিতর দিয়ে গিয়েছ, অন্য যে কেউ হলে ব্রেক ডাউন করত।

বিজলী বলে, খালি আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি তাকে ছেড়ে চলে যাব না তো।

এটা খুবই ইম্পরট্যান্ট। তুমি এখন তার একমাত্র অবলম্বন। তোমাকে তার সাথে থাকতে হবে। সব সময় ওর সাথে থাকতে হবে।

রাত্রিবেলা যখন ওই রকম করছিল তখন আমার অনেক ভয় করছিল। মনে হচ্ছিল আর ঠিক হবে না।

না। ভয় পেয়ো না। আমি সাইকিয়াট্রিক ডিভিশনে কথা বলব। তারা দেখে যাবে। তুমি হাসিখুশি থেকো। যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে যত কম কথা বলা যায় তত ভালো। সাংবাদিকেরা যেন চলে না আসে। কেউ যেন জানতে না চায় কী হয়েছিল। ঠিক আছে?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

.

ডাক্তার আর নার্স চলে যাবার পর বিজলী আর খোকন তাদের বিছানায় বসে একটু একটু করে তাদের চকলেটগুলো খেলো। খুবই মজার চকলেট–বিজলী তাই পুরোটা খেলো না, একটুখানি খেয়ে বাকিটা খোকনের জন্যে রেখে দিল।

বিজলী বলল, খোকন আয়, আমরা একটু বাইরে গিয়ে দেখি হাসপাতালটা কী রকম।

কেউ বকা দিবে না তো?

ধুর! বকা দিবে কেন? আমরা কি পালিয়ে যাচ্ছি নাকি?

চলো তাহলে।

এই হাসপাতালে আসার পর তারা তাদের রুম থেকে খুব বেশি বের হয় নাই। মাঝে মাঝে কী সব পরীক্ষা করার জন্যে এক-দুইবার তাদের বের হতে হয়েছে, পরীক্ষা শেষ হবার পর আবার তাদের কেবিনে নিয়ে এসেছে।

রুম থেকে বের হয়ে দুজন করিডোর ধরে হেঁটে যায়। করিডোরের শেষ মাথায় একটা জায়গায় নার্সদের বসার জায়গা। সেখানে একজন মানুষের গলায় একটা ক্যামেরা ঝোলানো, নার্সদের সাথে কথা বলছে। তাদেরকে দেখে মোটাসোটা একজন নার্স হাসি হাসি মুখে বলল, হাঁটতে বের হয়েছ?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, জি।

হাঁটো। একটা কেবিনের ভেতর চব্বিশ ঘণ্টা বসে থাকা যায় নাকি?

ক্যামেরা ঝোলানো মানুষটাও মাথা ঘুরিয়ে বিজলী আর খোকনকে দেখল, তারপর নার্সকে জিজ্ঞেস করল, এই দুইজনই কি যারিনা সাইক্লোন থেকে রক্ষা পাওয়া বাচ্চা?

নার্স মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

মানুষটা ঝট করে ক্যামেরা তুলে ছবি তোলার জন্যে চোখে লাগাল। মোটাসোটা নার্সটা হঠাৎ প্রায় ধমক দিয়ে বলল, কী করছেন? কী করছেন আপনি?

আমি সাংবাদিক, ওদের উপর একটা রিপোর্ট করার জন্যে এসেছি।

নার্সটা গলা উঁচিয়ে বলল, না। খবরদার ছবি তুলবেন না। আমার উপর অর্ডার আছে কেউ এই বাচ্চাদের নিয়ে নিউজ করতে পারবে না। কথা বলতে বলতে মোটাসোটা নার্স উঠে বিজলী আর খোকনের সামনে এসে দাঁড়াল।

সাংবাদিকটা কেমন জানি রেগে উঠল, বলল, কেন? কেন ওদের উপর রিপোর্ট করতে পারব না?

কারণ ওরা ছোট। ওদের উপর রিপোর্ট করতে হলে ওদের গার্জিয়ানদের পারমিশান নিতে হবে।

কে ওদের গার্জিয়ান?

এখন আমরা ওদের গার্জিয়ান। টিএনও ম্যাডাম আমাকে বলেছেন ওদেরকে যেন সাংবাদিকদের থেকে দূরে রাখি।

সাংবাদিক মানুষটা অবাক হবার ভঙ্গি করে বলল, কেউ এরকম কথা শুনেছে? আমরা একটা নিউজ কাভার করতে পারব না?

পারবেন না কেন? একশবার পারবেন। কিন্তু এই বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে পারবেন না।

সাংবাদিকটা রাগী রাগী মুখে বলল, আমি আপনাদের উপর রিপোর্ট করব।

নার্সটা হাসি হাসি মুখে বলল, যত ইচ্ছা করেন, কোনো সমস্যা নাই! আপনি হচ্ছেন সাত নম্বর সাংবাদিক। আপনার আগে আরো ছয়জন সাংবাদিক এসেছে! আমি কাউকে ওদের কাছে যেতে দেই নাই। আপনাকেও দিব না।

সাংবাদিকটা খুবই রেগে গটগট করে হেঁটে চলে গেল।

নার্সটা তখন বিজলী আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, নাও তোমরা হাঁটো। বুঝেছ, এই সাংবাদিকদের ভেতরে কোনো মায়া দয়া নেই। তোমরা কত কষ্টের ভিতর থেকে এসেছ, এখন সেইটা নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তোমাদের সাথে কথা বলবে! কোনো মানে আছে?

বিজলী আর খোকন করিডোরে হাঁটতে লাগল। নার্সটা গজগজ করতে করতে আবার তার আগের জায়গায় বসে কাগজপত্র দেখতে লাগল।

.

দুই দিন পর সন্ধ্যেবেলা সেলিনা জাহান বিজলী আর খোকনের সাথে দেখা করতে এল। তার হাতে একটা সুন্দর ব্যাগ। ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে বলল, আমি তোমাদের জন্য কিছু জামাকাপড় কিনে এনেছি। দেখো দেখি তোমাদের ফিট করে কি না।

বিজলী আর খোকন শেষবার কখন নতুন জামাকাপড় পেয়েছিল মনে করতে পারে না। যদি আগের সময় থাকত আর তখন কেউ যদি তাদের জন্যে নতুন কাপড় কিনে আনত তাহলে তাদের কী আনন্দই না হতো। এখন যা কিছুই হোক, তাদের আনন্দ বা দুঃখ কিছুই হয় না।

সেলিনা জাহান ব্যাগ থেকে তাদের কাপড় বের করে দিল। বাথরুমে গিয়ে প্রথমে খোকন তারপর বিজলী সেই কাপড় পরে এল। সেলিনা জাহান হাসি হাসি মুখে বলল, বাহ্! কী সুন্দর, ফিট করেছে।

সেলিনা জাহান ব্যাগের ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, এর ভেতরে তোমাদের তোয়ালে, টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, চিরুনি, স্যান্ডেল সবকিছু আছে। নতুন জায়গায় শুরু করতে যা যা লাগে সব আছে।

নতুন জায়গা? বিজলীর বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল।

সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ। হাসপাতাল থেকে তোমাদের রিলিজ করার সময় চলে এসেছে। এখন তোমাদের কোনো একটা ভালো শেল্টারে থাকার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যেখানে দুজন একসাথে থাকতে পারবে। তোমাদের আদর করে রাখবে, লেখাপড়া করাবে। খুব ভালো একটা শেল্টার–

খোকন জিজ্ঞেস করল, শেল্টার মানে কী?

সেলিনা জাহান বলল, শেল্টার হলো বাচ্চাদের থাকার জায়গা। সেখানে অনেক বাচ্চা থাকে, যারা হারিয়ে গেছে কিংবা বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে, কিংবা বাবা-মায়ের বাচ্চা মানুষ করার পয়সাকড়ি নেই এরকম।

বিজলী বলল, ও!

তোমাদের দুজনকে কোথায় রাখা যায় আমি সেটা নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। তোমাদের খবরটা মিডিয়াতে চলে এসেছে, কাজেই মোটামুটি অনেকেই জানে। অনেক কষ্ট করে সাংবাদিকদের ঠেকিয়ে রেখেছি। অনেক এনজিও তোমাদের নেয়ার জন্যে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমি মোটামুটি একটা ঠিক করে রেখেছিলাম, তখন আরেকটা অনেক বড় অর্গানাইজেশন যোগাযোগ করেছে। ওদের নাম হচ্ছে হ্যাপি চাইল্ড।

হ্যাপি চাইল্ড?

হ্যাঁ। সেলিনা জাহান মাথা নাড়ল, বলল, তারা শুধু বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করে। ওদের অনেক বড় একটা সেফ হোেম আছে, সেখানে অনেক ছেলেমেয়ে থাকে। তারা তোমাদের নেওয়ার জন্যে এতই আগ্রহী যে আমার সাথে কথা বলার জন্যে একজন কাল চলে আসছে।

বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না তাদেরকে নেওয়ার জন্যে সবার এত আগ্রহ কেন। সে অবশ্য কিছু জিজ্ঞেস করল না। খোকনকে নিয়ে থাকার জন্য একটা ভালো জায়গা পেলেই সে খুশি।

সেলিনা জাহান বলল, তোমাদের জীবনের উপর দিয়ে অনেক বড় একটা ধকল গিয়েছে। এখনো যাচ্ছে। প্রথম প্রথম তোমাদের অনেক কষ্ট হবে। আস্তে আস্তে দেখো অভ্যাস হয়ে যাবে। পৃথিবীতে অনেক মানুষের জীবনে অনেক কষ্ট হয়, খোদা আবার তাদের জীবনে শান্তি দেন। সুখ দেন। একদিন দেখবে তোমাদের জীবনে সুখ-শান্তি ফিরে আসবে। অবশ্যই আসবে।

বিজলী কোনো কথা বলল না। এই পৃথিবীতে এখন তাদের কেউ নেই। সেলিনা আপা ছাড়া আর কেউ নেই। সেলিনা আপার কথা শুনে তার চোখে পানি চলে আসতে চায়।

.

পরদিন বিকেল বেলা সেলিনা জাহান একজন মানুষকে নিয়ে এল। মানুষটার গলায় টকটকে লাল একটা টাই। বিজলী আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে, ইনি ঢাকা থেকে তোমাদের নিতে এসেছেন। ইনি কাওসার সাহেব।

কাওসার সাহেব বিজলী আর খোকনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী খবর তোমাদের? আমরা তোমাদের সম্পর্কে খবরের কাগজে পড়েছি। পড়ে আমাদের মনে হয়েছে তোমাদের সাহায্য করা দরকার। তাই তোমাদের নিতে আমি নিজেই চলে এসেছি।

বিজলী মানুষটার কথা ভালো করে শুনল না, সে সেলিনা জাহানের দিকে তাকিয়ে বলল, আপা, আপনি ভালো করে বলে দিয়েছেন তো যে আমি আর খোকন একসাথে থাকব?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলে দিয়েছি।

কাওসার নামের লাল টাই পরা মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই এক জায়গায় থাকবে।

বিজলী বলল, এক জায়গায় না, এক সাথে।

মানুষটা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, ঐ তো। একই কথা। এক জায়গা মানে এক সাথে।

বিজলী কেমন জানি ভয় পাওয়া চোখে সেলিনা জাহানের দিকে তাকালো। সেলিনা জাহান বিজলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, তোমার কোনো ভয় নেই বিজলী, আমি আছি। আমি খোঁজ রাখব।

তারপর তার ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করে বিজলীর হাতে দিয়ে বললেন, এই যে আমার কার্ড। এটা তোমার কাছে রাখো। যখনই দরকার হবে তুমি আমাকে ফোন করো।

বিজলী কার্ডটা নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখল।

হাসপাতাল থেকে বের হবার সময় মোটাসোটা নার্সটা বিজলী আর খোকনকে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

*

হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টরের অফিসঘরটা খুব সুন্দর। বিশাল বড় একটা ডেস্ক, সেই ডেস্কের গদি আঁটা চেয়ারে ডিরেক্টর নাজনীন বসে তার ল্যাপটপে কাজ করছে। ঘরের দেয়ালে পেইন্টিং, বেশির ভাগই ছোট শিশুদের ছবি। ঘরের ভেতর কেমন জানি আরাম আরাম ঠান্ডা।

লাল টাই পরা কাওসার নামের মানুষটা বিজলী আর খোকনকে নিয়ে ডিরেক্টরের ঘরে ঢুকল। নাজনীন চোখ না তুলেই বলল, কী খবর কাওসার?

মানুষটা বলল, ম্যাডাম, সাইক্লোন যারিনা সার্ভাইবার ছেলে আর মেয়েটিকে নিয়ে এসেছি।

নাজনীন এবারে মুখ তুলে তাকালো, বলল, গুড। জব ওয়েল ডান। তারপর প্রথমবার বিজলী আর খোকনের দিকে তাকালো। বিজলী ভাবল এই মহিলাটি এখন তাদের দুজনকে এখানে বসতে বলবে। মহিলাটি কিন্তু তাদের বসতে বলল না। কিছুক্ষণ তাদের দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই টায়ার্ড। যাও, একটু রেস্ট নাও।

বিজলী মাথা নাড়ল। নাজনীন তখন একটা কলবেল টিপল, সাথে সাথে ছোটখাটো পাহাড়ের মতো একজন মহিলা ঘরে এসে ঢুকল। হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টর নাজনীন মহিলাটার দিকে তাকিয়ে বলল, মর্জিনা। এই দুইজনকে নিয়ে যাও। ছেলেটাকে নর্থ বিল্ডিংয়ে আর মেয়েটাকে সাউথ বিল্ডিংয়ে।

বিজলী চমকে উঠল, দুজনকে দুই বিল্ডিংয়ে নিতে বলছে! খোকন ভয় পেয়ে খপ করে বিজলীর হাত শক্ত করে ধরে ফেলল। নাজনীন ভুরু কুচকে দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হলো? কোনো সমস্যা?

বিজলী বলল, আমরা দুজন একসাথে থাকব।

নাজনীন শীতল গলায় বলল, তোমরা যখন আমাদের অর্গানাইজেশনে থাকতে এসেছ, আমাদের অর্গানাইজেশনের নিয়ম মানতে হবে। তোমাদের জন্য আলাদা নিয়ম করা যাবে না।

বিজলী বলল, কিন্তু সেলিনা আপা বলেছেন আমরা দুজন এক সাথে থাকব। বিজলী লাল টাই পরা মানুষটাকে বলল, বলেছেন না? আপনি তাই বলেছেন না?

কাওসার ইতস্তত করে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে বলল, ম্যাডাম ব্যাপারটা হচ্ছে–

নাজনীন বলল, সেলিনা আপা মানুষটা কে?

লোকাল টিএনও।

নাজনীন কেমন জানি রেগে উঠল। বলল, আমার অর্গানাইজেশন কীভাবে চালাব, সেটা আমার একজন টিএনওর কাছ থেকে শিখতে হবে?

বিজলী মরিয়া হয়ে বলল, কিন্তু সেটা তো বলেছেন। কাওসারের দিকে তাকিয়ে বলল, বলেছেন না?

কাওসার আমতা আমতা করে বলল, না, মানে হয়েছে কী–

নাজনীন একটু ঝুঁকে পড়ে বলল, এই মেয়ে, কাওসার কী বলেছে সেটা আমার জানার দরকার নেই। আমি কাওসারের জন্যে কাজ করি না। বুঝেছ? তারপর পাহাড়ের মতো মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, মর্জিনা। নিয়ে যাও এদের।

বিজলী বলল, আমি সেলিনা আপার সাথে কথা বলব। সেলিনা আপা আমাকে বলেছে দরকার হলে তার সাথে কথা বলতে–

কীভাবে কথা বলবে?

আমাকে সেলিনা আপা কার্ড দিয়েছে। সেখানে টেলিফোন নম্বর আছে।

নাজনীন ভুরু কুঁচকে বিজলীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, দেখি কার্ডটা।

বিজলী ব্যাগ থেকে কার্ডটা বের করে নাজনীনের দিকে এগিয়ে দিল। নাজনীন কার্ডটি পড়ল, তারপর টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে তার টেবিলের নিচে ছেঁড়া কাগজের বিনটাতে ফেলে বিজলীর দিকে তাকালো, বলল, এখন?

বিজলী নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। তার গলা থেকে একটা আর্তনাদের মতো শব্দ বের হয়ে আসে। খোকন বিজলীর হাত শক্ত করে ধরে রেখে কাঁদতে শুরু করে দেয়।

হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টর নাজনীন হঠাৎ চিৎকার করে বলল, মর্জিনা–

জি ম্যাডাম!

তোমাকে কী বলেছি? নিয়ে যাও এদের।

মর্জিনা দুজনকে ধরে প্রায় শূন্যের উপর দিয়ে ঝুলিয়ে টেনে নিয়ে গেল।

.

কাওসার কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইল। তারপর মাথা তুলে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে বলল, নাজনীন ম্যাডাম, আমরা কি একটু বেশি করে ফেললাম না?

নাজনীন তার ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে বলল, কোন জিনিসটা বেশি করেছি?

এই তো–সবকিছু।

আমার অর্গানাইজেশনে থাকলে আমার নিয়ম মানতে হবে।

কাওসার ইতস্তত করে বলল, কিন্তু—

কিন্তু কী?

তারা তো আমাদের অর্গানাইজেশনে আসতে চায় নাই। আমরা অনেক আগ্রহ দেখিয়ে তাদের এনেছি। আমাকে তো কথা দিতে হয়েছে তাদেরকে একসাথে রাখব।

কীভাবে একসাথে রাখবে?

সেটা আমি ঠিক জানি না। কিন্তু চাইলে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা। করা যেত।

কেন তাদের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে?

কাওসার একটা উত্তর খুঁজে বের করার জন্যে ছটফট করে উঠল, শেষ পর্যন্ত বলল, ম্যাডাম, আপনি আমাকে বলেছেন যেভাবে হোক এই দুজনকে আনতে হবে। এদের কথা সবাই জেনে গেছে, তাই এদেরকে এখানে রাখতে পারলে আমাদের হ্যাপি চাইল্ডের অনেক বড় ব্রান্ডিং হবে। ডোনারদের এদের উদাহরণ দেখিয়ে বড় ফান্ডিং আনা যাবে।

হ্যাঁ, আমি বলেছি। এর মাঝে কোন কথাটা মিথ্যা? কোন কথাটা ভুল?।

কাওসার বলল, মিথ্যা কিংবা ভুল বলছি না, কিন্তু এই বাচ্চা দুটি যদি এত স্পেশাল হয় তাহলে তাদের জন্যে একটু স্পেশাল ব্যবস্থা করলে দোষ কী?

নাজনীন বলল, কাওসার, তুমি অনেক কথা বলেছ, এখন আমি বলি। এটা সত্যি, এই দুজনকে আমরা আনতে পেরেছি, এটা বিশাল একটা ঘটনা। আমরা এদেরকে বিক্রি করে বিশাল মাইলেজ পাব। খোঁজ নিয়ে দেখো অন্য সব এনজিও এখন মাথা চাপড়াচ্ছে!

তাহলে–

নাজনীন কাওসারকে থামিয়ে বলল, এরা স্পেশাল আমাদের কাছে, কিন্তু সে জন্যে তাদের স্পেশালভাবে দেখতে হবে কে বলেছে? এরা কোথায় থাকত বলো?

কাওসার ইতস্তত করে বলল, একটা চরে।

সেখানে কীভাবে থাকত? খুব হাই ফাঁই নাকি না খেয়েদেয়ে?

খুবই সাধারণভাবে থাকত।

যে ছেলে আর মেয়ে একটা ভাঙা বাড়িতে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাত এখন তারা এখানে দুই বেলা পেট ভরে খাবে। সকালে ব্রেকফাস্ট, এছাড়াও দুইবার স্ন্যাক। প্রতিবছর তাদের নতুন জামা কাপড়। পরিষ্কার বিছানা। ছয় মাস পর পর মেডিক্যাল চেকআপ। যাদের সম্ভব তারা দেশে বিদেশে এডপশানে চলে যাবে। অন্যেরা স্কুলে পড়বে না হয় ভোকেশনাল ট্রেনিং। এখন তুমি বলো সাইক্লোনের কারণে এদের জীবনটা কি এখন ভালো হলো নাকি খারাপ হলো?

কাওসার কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না। একটু ইতস্তত করে বলল, কিন্তু আমরা তো সেটা তাদের দয়া করে দিচ্ছি না। আমাদের ডোনাররা তাদেরকে এভাবে রাখার জন্যে আমাদের ফান্ড দিচ্ছে–

এই ফান্ডটা আগে কত ছিল, এখন কত হয়েছে?

কাওসার মাথা নেড়ে বলল, এখন বেড়েছে। আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ফান্ডিং অনেক বেড়েছে।

তাহলে তুমি বলো, আমি কি অর্গানাইজেশনটা ভালো চালাচ্ছি না খারাপ চালাচ্ছি?

কাওসার অনেক সাহস করে বলে ফেলল, যদি ফান্ডিংয়ের দিক থেকে দেখি তাহলে ভালো চালাচ্ছেন। কিন্তু যদি ছেলেমেয়েদের দিক থেকে দেখি তাহলে তাহলে

নাজনীন মুখ কালো করে বলল, তাহলে কী?

তাহলে ভালো চলছে না।

তুমি কী বলতে চাইছ?

কাওসার মরিয়া হয়ে বলল, যেমন একটু আগের ঘটনাটা দেখেন। এই ছেলে আর মেয়েটির কথা চিন্তা করেন। তারা কী আনন্দে আছে? নাই। তাদের কী মনে হচ্ছে না যে আমরা তাদেরকে একটা জেলখানায় আটকে ফেলেছি?

নাজনীন কোনো কথা না বলে শীতল চোখে কাওসারের দিকে তাকিয়ে রইল।

কাওসার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মাথা তুলে বলল, এই ছেলে আর মেয়েটির জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। আমার নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। এই মুহূর্তে ছেলে আর মেয়ে দুটি নিশ্চয়ই এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করছে। আমি তাদেরকে এভাবে না আনলে তারা নিশ্চয়ই তাদের মতো থাকতে পারত।

নাজনীন তার গলার স্বরটা একটু নরম করে বলল, তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই কাওসার। বাচ্চাগুলোর উপর যদি কোনো নিষ্ঠুরতা করা হয়ে থাকে তাহলে সেটি করেছি আমি। তুমি কিছু করোনি। তাছাড়া তোমার একটা বিষয় বুঝতে হবে।

কী বিষয়?

তোমার মনে হতে পারে আমি এই ছেলেমেয়েগুলোর সাথে নিষ্ঠুরতা করছি, কিন্তু সেটি সত্যি না। এই বাচ্চাগুলো এসেছে সমাজের সবচেয়ে নিচু অংশ থেকে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে হলে তাদেরকে অনেক শক্ত হতে হয়। বড়লোকের লুতুপুতু ছেলেমেয়ে হলে তারা একদিনও টিকে থাকতে পারত না। কাজেই ধরে নাও তোমার কাছে যেটা নিষ্ঠুরতা মনে হচ্ছে সেটা তাদের একটা ট্রেনিং। কঠিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ট্রেনিং।

কাওসার কোনো কথা না বলে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজনীন অনেকটা যন্ত্রের মতো বলল, এই যে ভাইবোনের ব্যাপারটা–এগুলো এই বাচ্চাগুলোর জন্যে একটা বিলাসিতা। সবাই তার নিজের জন্য বেঁচে থাকে। এদেরও নিজেদের মতো নিজেদের টিকে থাকতে হবে। কিসের ভাই? কিসের বোন?

কাওসার এবারেও কোনো কথা বলল না। নাজনীন বলল, বাচ্চাগুলো দেখতে দেখতে ভুলে যাবে কে কার ভাই, কে কার বোন! দুই সপ্তাহ যেতে দাও দেখবে এই ভাইবোনের ভালোবাসা কোথায় ভেসে গেছে!

কাওসার কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়াল, বলল, আমি যাই।

নাজনীন বলল, যাও। চেষ্টা করো ইমোশনাল মেলোড্রামা থেকে বের হয়ে আসতে। নাটকে অভ্যস্ত হয়ে গেলে আসল জীবনে টিকে থাকা কঠিন।

.

রাত্রিবেলা ডাইনিং রুমে বিজলী খোকনকে খুঁজে বের করল। সে আতঙ্কিত মুখে তার বয়সী কয়েকজন ছেলের সাথে বসে ছিল। বিজলীকে দেখে সে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে, ভাঙা গলায় বলতে থাকে, আমি থাকব না, আমি এইখানে থাকব না। থাকব না–

বিজলী তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, কাঁদিস না, খোকন সোনা। কাদিস না। দেখিস সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।

খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলল, কেমনে ঠিক হয়ে যাবে? কেমনে?

বিজলী ফিসফিস করে বলল, সেলিনা আপা যখন জানতে পারবে তখন আমাদের এইখান থেকে নিয়ে যাবে। দেখিস তুই আমাদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাবে।

সেলিনা আপা কেমন করে জানবে?

জানবে! নিশ্চয়ই জানবে। যখন আমাদের খোঁজ নিবে তখনই জেনে যাবে।

খোকন বিজলীর কথা শুনেও কোনো সান্ত্বনা পেল না। সে বিজলীকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতেই থাকল। ঠিক তখন দুজন আয়া এসে খোকন আর বিজুলীকে টেনে আলাদা করে দুজনকে দুই দিকে নিয়ে গেল। কমবয়সী একজন আয়া ফিসফিস করে খোকনকে বলল, কান্না থামাও। তা না হলে তোমারে অন্ধকার ঘরে খাম্বার সাথে বেন্ধে রাখব। খেতে পাবা না। রাত্রি বেলা জোঁক, বিছা, ইন্দুর আর মাকড়সার সাথে থাকতে হবে। বুঝেছ?

খোকন আতঙ্কিত হয়ে আয়াটির মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না বন্ধ করল। একটু পরে পরে এখন শুধু সে হেঁচকি তুলতে থাকে।

.

বিশাল হলঘরে পাশাপাশি রাখা বিছানাগুলোর একটিতে খোকন ঘুমিয়ে ছিল। গভীর রাতে খোকন তার বিছানার ছটফট করতে থাকে, রক্ত শীতল করা আর্তনাদ করে সে বিছানায় উঠে বসে। আশেপাশের বিছানা থেকে ঘুমিয়ে থাকা ছেলেগুলো ভয় পেয়ে জেগে ওঠে। তারা তাকিয়ে দেখে নতুন ছেলেটা বিছানার মাঝে আতঙ্কে দাপাদাপি করছে। তারা কী করবে বুঝতে পারে না।

পাশের বিল্ডিংয়ে ঠিক তখন বিজলী জানালায় শিক ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে ঘুম নেই। খোকনকে ছাড়া সে একা কখন ঘুমিয়েছে। মনে করতে পারে না। জানালার শিক ধরে সে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। ফিসফিস করে বলে, খোদা! এইটা তুমি কী করলে খোদা! কী করলে?

*

গাড়িটা রাস্তায় ওঠার পর মিলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি বুঝতে পারছি না কাজটা ঠিক হচ্ছে কি না।

রায়হান রাস্তায় ফুল বিক্রি করতে থাকা কয়েকটা বাচ্চা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল, কেন, কাজটা ঠিক হবে না কেন?

নিজের বাচ্চা হলে এক কথা। কিন্তু অন্যের একটা বাচ্চাকে নিজের বাচ্চার মতো মানুষ করতে গিয়ে যদি ভুল করে ফেলি?

ভুল? ভুল মানে কী?

বাচ্চাটাকে যদি ঠিকমতো আদর না করি? নিজের বাচ্চা হলে যেভাবে আদর করতাম সেভাবে যদি না করি।

রায়হান শব্দ করে হাসল, বলল, তুমি কী যে বলো মিলি! রাস্তায় একটা বিড়াল দেখলে তুমি সেইটাকে আদর করো–আর একটা আস্ত মানুষের বাচ্চাকে আদর করবে না?

একটা বাচ্চাকে চিনি না জানি না যদি তাকে আপন মনে না হয়? যদি বাচ্চাটা আনন্দ না পায়, আমাদের সাথে হ্যাপি না হয়?

শোনো মিলি, জিনিসটা এইভাবে দেখো। আমরা শেল্টার থেকে যে বাচ্চাটাকে আনব তার জীবনে এখন এমন কোনো আনন্দ নেই। কোনোভাবে বেঁচে আছে। আমরা যখন তাকে নিজেদের বাচ্চা হিসেবে বড় করব তখন তার জীবনটা আগের জীবন থেকে ভালো হবেই।

মিলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার আরো একটা ভয় হয়। কী ভয় হয় জানো?

কী?

মনে করো একটা বাচ্চাকে নিয়ে এলাম। আদর করে বড় করলাম, আস্তে আস্তে একেবারে নিজের বাচ্চা হয়ে গেল। তখন কোনো একদিন বাচ্চার আসল বাবা-মা এসে হাজির হলো। দাবি করল এটা তাদের বাচ্চা, তারা নিয়ে যেতে চায়–

রায়হান হাসল, বলল, সেটা হবে না। আমি শেল্টারের ডিরেক্টর নাজনীনকে বলেছি আমরা যাকে এডপ্ট করব তার কোনো আত্মীয়স্বজন থাকতে পারবে না। একেবারে সত্যিকারের অরফান যাকে বলে, সে রকম হতে হবে। নাজনীন বলেছে, সেটি কোনো সমস্যা না। তার বেশিরভাগ বাচ্চা এরকম। কাগজপত্র দেখিয়ে দেবে।

মিলি কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

মিলি আর রায়হানের বিয়ে হয়েছে এগারো বছর। তাদের কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই, বছর দুয়েক আগে তারা জানতে পেরেছে তাদের বাচ্চা হওয়ার কোনো আশা নেই। কেন বাচ্চা হতে পারবে না ডাক্তার সেটা তাদের বুঝিয়েছে। খুঁটিনাটি মিলি বুঝতে পারেনি, বোঝার চেষ্টাও করেনি। সেই ছোট থাকতে মিলি কল্পনা করত তার নিজের একটা ছোট বাচ্চা হবে, তাকে বুকে জড়িয়ে বড় করবে। যখন জানতে পারল সেটি আসলে কখনো হবে না তখন তার বুকটা ভেঙে গিয়েছিল। অনেক দিন সে নিজের ভেতর নিজে গুটিয়ে ছিল। তখন রায়হান তাকে বুঝিয়েছে একটা ছোট বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা হিসেবে মানুষ করতে। মিলি প্রথমে রাজি হয়নি, ধীরে ধীরে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে।

রায়হান তখন খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। এমনিতে একটা অনাথ শিশুকে পথ থেকে তুলে এনে নিজের বাসায় বড় করলে কেউ কিছু বলবে না। কিন্তু একেবারে আইন মেনে সত্যি সত্যি অন্যের একটা বাচ্চাকে নিজের বাচ্চা হিসেবে বড় করার অনেক রকম আইনি জটিলতা রয়েছে। সব প্রতিষ্ঠান সেগুলো ঠিকভাবে করতে পারে না। রায়হান খোঁজ নিয়ে জেনেছে, সবচেয়ে নিখুঁতভাবে এই কাজগুলো করতে পারে হ্যাপি চাইল্ড নামে একটা শেল্টার। রায়হান হ্যাপি চাইল্ডের ডিরেক্টর নাজনীনের সাথে কথা বলেছে। নাজনীন তাদেরকে একবার তাদের শেল্টারে গিয়ে বাচ্চাগুলোকে নিজের চোখে দেখে আসতে বলেছে, তাই তারা আজ দেখতে যাচ্ছে।

হ্যাপি চাইল্ড নামের প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে কত জায়গা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে মিলি অবাক হয়ে গেল। দুই পাশে দুটো বিল্ডিং, একটা বড় করিডোর দিয়ে দুটো এক সাথে লাগানো। মাঝখানে অফিস, পাশে পার্কিং লট। সামনে একটা খোলা জায়গা, মিলি ভেবেছিল দেখবে সেখানে ছোট বাচ্চারা ছোটাছুটি করছে কিন্তু সেখানে কেউ নেই।

মিলি আর রায়হান দোতলায় ডিরেক্টর নাজনীনের বড় অফিসটা খুঁজে বের করল। অফিসের দরজাটা খোলা, রায়হান মাথা ঢুকিয়ে বলল, আসতে পারি?

নাজনীন তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন, আসুন। আপনারাই নিশ্চয়ই আমাদের একটা বাচ্চাকে এডপ্ট করার ব্যাপারে এসেছেন। কী চমৎকার!

মিলি আর রায়হান অফিসে ঢুকল। নাজনীনের সামনে রাখা সুন্দর চেয়ারগুলোতে বসল, রায়হান হাতের ফাইলটা টেবিলের উপর রেখে বলল, আসলেই করতে পারব কি না এখনো জানি না। দেখি সম্ভব হয় কি না। আমরা আসলে এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আপনি সাহায্য করেছেন বলে এতদূর আসতে পেরেছি। নাজনীন হাসি হাসি মুখে বলল, কেন সাহায্য করব না? একটা বাচ্চা যদি একটা পরিবার পায় তাহলে তার জীবনটাই তো অন্যরকম হয়ে যায়। কত দুঃখী বাচ্চা এখানে আপনারা চিন্তাও করতে পারবেন না। আমরা একেবারে বুক আগলে রাখি, তারপরও আমরা চাই সবাই একটা পরিবারের সাথে থাকুক। বাবা-মায়ের ভালোবাসায় বড় হোক।

মিলি কিছু বলল না, একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলল। রায়হান বলল, আমরা একটা হাসিখুশি ছোট বাচ্চা চাই। যত ছোট তত ভালো। শুধু একটা ব্যাপার, বাচ্চাটার বাবা-মা ভাই-বোন আত্মীয়স্বজন কিংবা কোনো ধরনের অভিভাবক থাকতে পারবে না। বাচ্চাটা আমাদের নিজেদের বাচ্চার মতো বড় হবে, তারপর হঠাৎ একদিন তার আসল বাবা-মা এসে তাকে নিয়ে যেতে চায় তখন কী হবে?

নাজনীন গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল। বলল, না। এটা কখনোই হবে না। আমাদের এখানে দুই একজন বাচ্চার বাবা-মা, ভাই-বোন কিংবা আত্মীয়স্বজন থাকতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ বাচ্চা পুরোপুরি অনাথ। আপনাদের আমি শুধু সেরকম পুরোপুরি অনাথ বাচ্চাদের দেখাব। যাদের কেউ নেই।

রায়হান বলল, ঠিক আছে।

নাজনীন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনারা এক মিনিট এখানে বসেন। আমি দেখে আসি বাচ্চাগুলো রেডি আছে কি না।

নাজনীন তার অফিস থেকে বের হয়ে দ্রুত পায়ে পাশের বিল্ডিংটাতে হাজির হলো। একটা বড় ঘরে টেবিল ঘিরে ছোট ছোট চেয়ার, সেখানে নানা বয়সী বাচ্চা বসে আছে। টেবিলে বই পত্র খাতা কলম, যারা একটু ছোট তাদের সামনে কাগজ আর রং পেন্সিল। যারা আরো ছোট তাদের সামনে খেলনা। নাজনীন অফিসে ঢুকতেই বাচ্চাগুলো ভয়ে কেমন যেন শিটিয়ে গেল। এখানে যারা আছে তারা সবাই এই ভয়ংকর মহিলাটাকে ভয় পায়।

ঘরের কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী আয়াটি এগিয়ে এসে বলল, কিছু বলবেন ম্যাডাম?

হ্যাঁ। দুজন বাবা-মা বাচ্চা দেখতে এসেছেন। তাদের সামনে ভালো হয়ে থাকবি।

জি ম্যাডাম, সব সময়েই তো ভালো হয়ে থাকি। বলে আয়াটি দাঁত বের করে হাসল।

খবরদার গেস্টদের সামনে বাচ্চাদের বকাবকি করবি না, মারধোর করবি না।

জি না, ম্যাডাম। করব না।

নাজনীন তখন বাচ্চাদের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, তোমরা কেমন আছো?

বাচ্চগুলো যন্ত্রের মতো বলল, ভালো। ঘরের মাঝামাঝি খোকন বসে ছিল, সে মুখ ফুটে কিছু বলল না। সে ভালো নেই।

নাজনীন এবার ধমক দিয়ে বলল, জোরে বলো।

সবাই এবারে প্রায় চিৎকার করে বলল, ভালো।

গুড। নাজনীন এবারে মাথা ঘুরিয়ে সবগুলো বাচ্চাকে এক নজর দেখে বলল, দুজন বাবা-মা এসেছেন তোমাদের দেখতে। তোমাদের ভিতর যে সবচেয়ে ভালো থাকবে, সবচেয়ে সুইট থাকবে তাকে তারা নিয়ে যাবে। নিজের বাচ্চার মতো আদর করবে, স্কুলে লেখাপড়া করাবে। বুঝেছ?

বাচ্চাগুলো ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল। আতঙ্ক তাদের বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করতে থাকে।

নাজনীন হঠাৎ তার মুখটা কঠিন করে বলল, সবাইকে আমি একটা জিনিস সাবধান করে দিই। যদি তারা তোমাদের জিজ্ঞেস করে তোমাদের বাবা-মা কিংবা ভাই-বোন কেউ আছে কি না, তাহলে তোমরা বলবে কেউ নাই। বুঝেছ?

বাচ্চাগুলো খুব ভালো করে বুঝল না, তারপরেও ভয়ে ভয়ে মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।

যদি তোমাদের ভেতর কেউ বলে যে তার বাবা-মা কিংবা ভাই বোন আছে আমি তাহলে তাকে খুন করে ফেলব। নাজনীন হুংকার দিয়ে বলল, মনে থাকবে সবার?

বাচ্চাগুলো মাথা নাড়ল। একধরনের ভয়াবহ আতঙ্কে থোকনের বুকের ভেতরটা শুকিয়ে গেল। যে মানুষগুলো তাদের দেখতে আসবে তারা যদি তাকে জিজ্ঞেস করে তাহলে তাকে মিথ্যা বলতে হবে। বলতে হবে বিজলীবু বলে কেউ নাই। তখন যদি তাকে নিয়ে যায় তাহলে সে আর কোনোদিন বিজলীবুকে দেখতে পাবে না। ভয়ে আতঙ্কে খোকন কিছু চিন্তা করতে পারে না।

এই ছেলে, এই– খোকন চমকে উঠল। নাজনীন তার দিকে চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। ভয়ে সে শুকনো মুখে উঠে দাঁড়াল।

মুখটা এরকম পাচার মতো করে রেখেছ কেন? মুখ হাসি হাসি করো।

খোকন মুখ হাসি হাসি করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে।

নাজনীন ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে সে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। তার অনেক কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সে এখন কাঁদতে পারবে না। কিছুতেই কাঁদতে পারবে না। তাকে মুখ হাসি হাসি করে থাকতে হবে। যদি তাকে জিজ্ঞেস করে তাহলে তাকে বলতে হবে তার কেউ নাই। বাবা নাই। মা নাই। বোন নাই। বিজলীবুও নাই!

.

মিলি ঘরটার ভেতরে ঢুকতেই তার ঘরের মাঝামাঝি ছয়-সাত বছরের একটা ছেলের সাথে চোখাচোখি হলো। ছেলেটা তার দিকে কেমন জানি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, মিলিও অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মিলির মনে হলো এই ছেলেটাকে সে আগে দেখেছে, মনে হলো এই ছেলেটা তার অনেক পরিচিত। হঠাৎ করে মনে হলো এই ছেলেটাকেই সে নিজের পেটে ধরেছিল, মনে হলো সে ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে বুকে চেপে ধরে বলে, বাবা আমার! তুই এতদিন কোথায় ছিলি?

কিন্তু সে কিছু করল না, রায়হানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইল। রায়হান হাসি হাসি মুখে বাচ্চাগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। একেবারে সামনে বসে থাকা বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কী নাম তোমার বাবা?

বাচ্চাটি কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে বলল, আফজাল! আমার নাম আফজাল। মোহাম্মদ আফজাল হোসেন।

রায়হান হাসি হাসি মুখে বলল, বাহ!

বাচ্চাটি আরো উত্তেজিত হয়ে বলল, আমার বাবা, মা, ভাই বোন কেউ নাই। কেউ নাই। কথাটি শেষ করে সে নাজনীনের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালো। তাকানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায় সে নাজনীনকে বলতে চাইছে যে, সে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছে তার বাবা মা নেই।

রায়হান জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, আহা রে!

পাশে বসে থাকা আরেকটা ছোট বাচ্চা হাত তুলে বলল, আমারও বাবা মা নাই। ভাই বোন কেউ নাই।

তারা কথা শুনে আরো কয়েকটা ছোট বাচ্চা বলল, আমারও বাবা নাই। মা নাই। বাবা নাই মা নাই।

নাজনীন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, হয়েছে হয়েছে। তোমাদের নিজেদের কিছু বলতে হবে না। তোমাদের যেটা জিজ্ঞেস করা হবে শুধু তার উত্তর দাও। ঠিক আছে?

বাচ্চাগুলো সাথে সাথে ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে সবাই চুপ করে গেল। রায়হান আরো কয়েকটা বাচ্চার কাছে গেল, তাদের সাথে কথা বলল, কারো মাথায় হাত বুলিয়ে দিল, কারো পিঠ চাপড়ে দিল। মিলি রায়হানের পাশে পাশে হেঁটে যেতে থাকল কিন্তু নিজ থেকে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে শুধু চোখের কোনা দিয়ে একটু পর পর ঘরের মাঝখানে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখতে লাগল। যতবার সে ছেলেটির দিকে তাকিয়েছে অবাক হয়ে দেখেছে ছেলেটিও তার দিকে তাকিয়ে আছে।

রায়হান বেশ কয়েকটা বাচ্চার সাথে কথা বলে মিলির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, কী খবর মিলি? তুমি কোনো বাচ্চার সাথে কথা বলবে না?

মিলিও ফিসফিস করে বলল, না।

কেন?

আমি ঠিক করে ফেলেছি।

রায়হান অবাক হয়ে বলল, কী ঠিক করে ফেলেছ?

কে আমার বাচ্চা।

রায়হান অবাক হয়ে বলল, কে তোমার বাচ্চা?

হ্যাঁ।

কোনজন?

দ্বিতীয় সারিতে মাঝখানে বসে থাকা ছেলেটাকে দেখেছ? ছয় সাত বছর বয়স? চেক শার্ট?

হ্যাঁ! দেখেছি।

এইটা আমার ছেলে।

তোমার ছেলে?

হ্যাঁ।

রায়হান অবাক হয়ে বলল, তুমি কিছু জানো না, শোনো না, কোনো খোঁজখবর নাওনি আর সে তোমার ছেলে?

আমার খোঁজখবর নিতে হবে না। আমি এই ছেলেটিকে চাই!

রায়হান কিছুক্ষণ মিলির দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, চলো তাহলে যাই।

যাবার আগে বাচ্চাটার নাম জেনে যাই।

রায়হান বলল, ঠিক আছে। যাও, বাচ্চাটার নাম জিজ্ঞেস করে এসো।

রায়হান একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল, মিলি বাচ্চাগুলোর ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে দ্বিতীয় সারির মাঝখানে বসে থাকা বাচ্চাটার কাছে এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে মাথা নিচু করে বাচ্চাটার মাথায় হাত রেখে বলল, তোমার নাম কী সোনা?

বাচ্চাটি কাঁপা গলায় বলল, খোকন।

মিলি আরেকটু ঝুঁকে পড়ল। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, খোকন তুমি আমার সাথে যাবে?

খোকন মিলির দিকে তাকাল। একটু আগেই তার ভেতরে একধরনের আতঙ্ক ছিল, হঠাৎ করে তার সেই আতঙ্কটি চলে গেছে। এই মহিলাটির চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে মানুষটি তার অনেক বড় একজন আপনজন। সে মাথা নাড়ল, বলল, যাব।

মিলি খোকনের মাথায় একটা চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ঠিক আছে!

.

মিলি আর রায়হান যাবার আগে নাজনীনকে তাদের পছন্দের বাচ্চাটির কথা বলে গেল। দ্বিতীয় সারির মাঝখানে চেক শার্ট পরে থাকা বাচ্চাটি–যার নাম খোকন।

নাজনীন বলল, অফিসিয়াল কাজকর্ম শেষ করে আগামীকাল তাকে আপনার বাসায় পৌঁছে দেব! আমি নিজেই নিয়ে যাব।

মিলি বলল, থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ সো মাচ!

মিলি অবশ্য নিজে গিয়ে পৌঁছে দেবার আসল কারণটা জানত না। যদি জানত তাহলে সে নিশ্চয়ই আতঙ্কে শিউরে উঠত।

পরদিন যখন নাজনীন গাড়িতে করে খোকনকে নিয়ে মিলিদের বাসায় যাচ্ছে তখন সে খোকনকে নিয়ে পেছনে বসল। গাড়ি ছেড়ে দেবার পর সে ফিসফিস করে বলল, খোকন, তুমি জানো আমরা কোথায় যাচ্ছি?

না। কালকে যে একজন মানুষ আর মহিলা এসেছিল মনে আছে?

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, মনে আছে।

তাদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তাই তারা একজনকে নিজের ছেলের মতো বড় করতে চায়। কাল এসে তারা তোমাকে পছন্দ করে গেছে।

খোকন বলল, আর বিজলীবু?

ওরা বিজলীর কথা জানে না। জানলে তোমাকে নিত না।

খোকনের পুরো জগৎটা অন্ধকার হয়ে গেল। কী বলবে বুঝতে পারল না, কোনোমতে বলল, কিন্তু, কিন্তু–

এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। আমরা তোমার জন্যে একটা ফ্যামিলি রেডি করে দিয়েছি। তারা তোমাকে অনেক আদর করে বড় করবে। ঠিক সেরকম বিজলীর জন্যেও একটা ফ্যামিলি রেডি করে দেব। সেই ফ্যামিলিও বিজলীকে অনেক আদর করে বড় করবে।

খোকন ছটফট করে প্রায় হাহাকার করে উঠল, ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, কিন্তু আমি বিজলীবুর সাথে থাকতে চাই।

তুমি তোমার বিজলীবুর সাথে থাকতে পারবে না। মনে করো তোমার বিজলীবু মরে গেছে। সাইক্লোনের রাতে বন্যার পানিতে তোমার বাবা-মা মরে ভেসে গেছে, সেটা তোমার মনে আছে?

খোকন অবাক হয়ে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজনীন বলল, মনে করো তোমার বিজলীবুও মরে ভেসে গেছে। তোমার কেউ নেই। বুঝেছ?

কী বুঝতে হবে খোকন সেটাই বুঝতে পারল না। নাজনীন হাসি হাসি মুখে বলল, তোমার বিজলীবুকেও আমরা কোনো ফ্যামিলির সাথে দিয়ে দেব। তার বিয়ে হবে সংসার হবে, বুঝেছ। তুমি যে রকম হ্যাপি হবে তোমার বিজলীবুও হ্যাপি হবে। তবে–

নাজনীন কথা বন্ধ করে হঠাৎ তার মুখ কঠোর করল। খোকন বিস্ফারিত চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। নাজনীন বলল, তবে তুমি যদি তোমার নতুন ফ্যামিলিকে তোমার বিজলীবুর কথা বলে দাও তাহলে কিন্তু সব শেষ।

শেষ?

হ্যাঁ। তাহলে তোমার বিজলীবুকে খুন করে ফেলব!

খোকন ভয়ে আতঙ্কে পাথর হয়ে গেল। নাজনীন খুবই ঠান্ডা গলায় বলল, কাজেই তোমার বিজলীবু বেঁচে থাকবে নাকি মরে যাবে সেটা নির্ভর করছে তোমার উপর। বুঝেছ?

খোকন মাথা নাড়ল। নাজনীন বলল, তাহলে বুঝেছ তোমাকে কী করতে হবে? মরে গেলেও তুমি তোমার নতুন ফ্যামিলিকে বলবে না যে তোমার একজন বোন আছে। যাকে তুমি বিজলীবু ডাকো। মনে থাকবে?

খোকন শুকনো মুখে মাথা নাড়ল। নাজনীন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, ভেরি গুড। এই তো, তুমি হচ্ছ আমার গুড বয়। তুমি যদি গুড বয় হয়ে থাকো তাহলে তোমার বিজলীবুও গুড গার্ল হয়ে থাকবে। যদি গুড বয় না থাকো তাহলে তোমার বিজলীবুও গুড গার্ল হয়ে থাকবে না। হয়ে যাবে ডেড গার্ল। বুঝেছ?

খোকন ভালো করে কিছু শুনছিল না, শুনলেও ভালো করে বুঝতে পারছিল না। তার সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে।

নাজনীন খোকনকে নিয়ে যখন মিলি আর রায়হানের বাসায় পৌঁছেছে তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। কলিংবেল টেপার আগেই মিলি দরজা খুলে দিল। নাজনীন খোকনের হাত ধরে ঘরে ঢুকে মিলির দিকে তাকিয়ে বলল, এই যে আপনার ছেলে।

মিলির বুকের ভেতর জানি কেমন করে উঠল। তার মনে হলো খোকনকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে কিন্তু ছোট বাচ্চাটি একেবারে প্রথম দেখাতেই এরকম আদরে হয়তো বিব্রত হয়ে যাবে, তাই সে খোকনের মাথায় হাত বুলিয়েই সন্তুষ্ট থাকল। তার সামনে নিচু হয়ে বসে বলল, খোকন, তুমি তোমার ঘরটা দেখতে চাও?

খোকন কিছু না বুঝে মাথা নাড়ল। মিলি তখন তার হাত ধরে ভেতরে ছোট ঘরটাতে নিয়ে গেল। গত চব্বিশ ঘণ্টা মিলি আর রায়হান মিলে তার ঘরটা সাজিয়েছে। বিছানার উপর রঙিন বেড কভার, কমিক বইয়ের চরিত্র আঁকা কম্বল। মাথার কাছে পড়ার টেবিল, সুন্দর একটা টেবিল ল্যাম্প। ঘরের এমাথা থেকে ওমাথা জুড়ে একটা শেলফ, সেই শেলফে নানা রকম বই। দেয়ালে একটা টেবিল ক্লক, সেখানে একটা বানরের ছবি।

খোকন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ঘরটির দিকে তাকিয়ে রইল। একটু পরে পরে তার বইগুলোর দিকে চোখ পড়ছিল। কত সুন্দর সুন্দর বই, সব তার জন্য? কী আশ্চর্য! খোকনের হঠাৎ করে বিজলীবুর কথা মনে পড়ল।

সে আর কোনোদিন বিজলীবুকে দেখতে পাবে না? কোনোদিন না?

খোকন হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। মিলি তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, কেন কাঁদছ সোনা? আমরা আছি না? দেখবে তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। কোনো কষ্ট থাকবে না।

*

নাজনীন কাওসারের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি এখন গুছিয়ে একটা রিপোর্ট লিখো। চমৎকার একটা কেস স্টাডি হবে।

কাওসার একটু ইতস্তত করে বলল, কী লিখব এই রিপোর্টে?

কেন? লিখবে যারিনা সাইক্লোন থেকে যে ছেলেটি বেঁচে এসেছিল আমরা তাকে শুধু যে আশ্রয় দিয়েছি তা নয়, রেকর্ড সময়ের মাঝে তাকে আমরা এডপশানে দিয়েছি। এখন সে একটা লাভিং ফ্যামিলির সাথে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আর তার বোন সম্পর্কে কী লিখব?

সেটা নিয়ে কিছু লিখতে হবে না। যখন সময় হবে তখন লিখবে।

ঠিক তখন বাইরে একটা হইচই-চেঁচামেচির শব্দ শোনা গেল। একটা মেয়ে চিৎকার করছে এবং বেশ কয়েকজন তাকে থামাতে চেষ্টা করছে। নাজনীন ভুরু কুঁচকে বলল, কে চেঁচামেচি করছে?

কাওসার ভালো করে শোনার চেষ্টা করে বলল, মনে হয় বিজলী নামের মেয়েটা।

সে চেঁচামেচি করছে কেন? হোস্টেল থেকে বের হলো কেমন করে? নাজনীন বিরক্ত হয়ে তার কলবেলটা চেপে ধরল, তার আগেই দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বিজলী তার ঘরে এসে ঢুকল এবং তার পিছু পিছু কয়েকজন তাকে ধরার জন্যে হাজির হলো।

বিজলীর চুল এলোমেলো, গায়ের কাপড় ছিঁড়ে গেছে, যারা তাকে ধরে থামানোর চেষ্টা করেছে তাদের সাথে ধস্তাধস্তি করে সে ছুটে এসেছে। ঘরে ঢুকেই সে চিৎকার করে বলল, খোকন কই? আমার ভাই খোকন কই?

নাজনীন মুখ শক্ত করে বলল, তুমি এখানে কীভাবে এসেছ? এখন তোমার হোস্টেল থেকে বের হওয়ার কথা না–

যারা তাকে ধরে নিতে এসেছে তাদের একজন বলল, আমরা বলেছি ম্যাডাম। আমাদের কথা শুনে নাই।

বিজলী সামনে কয়েক পা এগিয়ে এসে বলল, খোকন কই? রাতের বেলা খেতে আসে নাই, সকালেও আসে নাই।

নাজনীন কঠিন মুখে বলল, তার যেখানে থাকার কথা সেখানে আছে। তুমি এভাবে চিৎকার করছ কেন?

বিজলী চিৎকার করে বলল, তার কোথায় থাকার কথা?

আমরা বাচ্চাদের এখানে শেল্টার দিই, তারপর কোনো একটা ফ্যামিলির সাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিই।

কোন ফ্যামিলি?

কেন? তুমি সেটা জেনে কী করবে?

খোকন আমার ভাই! বলতে গিয়ে বিজলী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল, আমি খোকনরে দেখতে চাই, তারে দেখতে চাই, দেখতে চাই

নাজনীন মাথা নেড়ে বলল, না! তুমি আর তাকে দেখবে না। জেনে রাখো সে খুব ভালো আছে।

নাই! ভালো নাই! বিজলী চিৎকার করে বলল, সে কই আছে। আমারে বলতে হবে। কই আছে খোকন?

নাজনীন একটু হাসির ভঙ্গি করে বলল, তোমাকে বলতে হবে?

হ্যাঁ বলতে হবে।

না বললে তুমি কী করবে?

আমি, আমি– বিজলী কথা শেষ করতে পারল না, হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগল।

নাজনীন বলল, সাইক্লোনের সময় তোমার বাবা-মা পানিতে ভেসে গিয়েছিল মনে আছে? ধরে নাও তোমার খোকনও ভেসে গেছে!

বিজলীর মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল। তার খোকন পানিতে ভেসে গেছে? মনে হলো হঠাৎ তার মাথার মাঝে রক্ত উঠে গেল। বিজলী কী করছে নিজেই জানে না, হঠাৎ সে পাগলের মতো নাজনীনের দিকে ছুটে এল, তার ধাক্কায় নাজনীনের চেয়ার উল্টে পড়ল। নাজনীন চিৎকার করে ওঠে এবং এর মাঝে বিজলী তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, মনে হলো সে বুঝি নাজনীনকে খুন করে ফেলবে।

কাওসার এবং তার পিছু পিছু দুজন গার্ড ছুটে এসে বিজলীকে ধরার চেষ্টা করল। ঝটকা মেরে বিজলী তাদের থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। তার মাথার চুল এলোমেলো, চেহারা হিংস্র বাঘিনীর মতো। গার্ড দুজন আবার তাকে ধরে টেনে সরানোর চেষ্টা করে, বিজলী গার্ডের হাতে কামড় দিয়ে নিজেকে ছুটিয়ে নেয়।

নাজনীন কোনোমতে উঠে দাঁড়িয়েছে। তাঁর চোখে-মুখে একধরনের আতঙ্ক। এই ছোট মেয়েটি এরকম বাঘিনীর মতো তাকে আক্রমণ করবে সে জীবনেও কল্পনা করে নাই। নাজনীন তার টেবিলের কোনা ধরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, ধরো, এই মেয়েটাকে ধরো।

তাকে ধরার জন্যে গার্ডেরা এগিয়ে এল, কিন্তু কেউ তাকে ধরে রাখতে পারল না। বিজলী ঝটকা মেরে আঁচড়ে কামড়ে নিজেকে ছুটিয়ে নেয়, তারপর আবার নাজনীনের দিকে ছুটে গেল।

নাজনীন একটা চিৎকার করে নিজেকে বাঁচানোর জন্যে খোলা দরজা দিয়ে বের হয়ে ছুটতে থাকে, পেছন পেছন বিজলী ছুটে আসে। নাজনীনের দৌড়াদৌড়ি করে অভ্যাস নেই, তারপরও সে করিডোর ধরে ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে।

হোস্টেলের অসংখ্য ছেলেমেয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখল তাদের ভয়ংকর নাজনীন ম্যাডামকে নতুন আসা মেয়েটি ধাওয়া করে নিয়ে যাচ্ছে। তারা দেখল সিঁড়ির গোড়ায় নাজনীন ম্যাডাম হুমড়ি খেয়ে পড়ল এবং নতুন আসা বিজলী নামের ছোটখাটো মেয়েটি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

অনেকগুলো গার্ড এসে এবারে বিজলীকে ধরে ফেলল। মোটাসোটা একজন বিজলীর মাথায় একটা ঘুষি মারল এবং তখন বিজলী কেমন যেন টলে উঠে মাটিতে পড়ে গেল, চিৎকার করে বলতে লাগল, খোকন, তুই কই গেলি? খোকন, খোকন–

৩. দেয়ালে পিঠ দিয়ে

দেয়ালে পিঠ দিয়ে বিজলী বসে ছিল। তার মাথার ভেতরে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। সে ভালো করে কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছে না। খোকনকে কোনোদিন আর সে দেখতে পারবে না, চিন্তা করলেই তার মাথাটা ঘুরে উঠছে। সাইক্লোনের রাতে সে যখন খোকনকে ধরে গাছে বসেছিল, বন্যার পানি একটু পরপর যখন তাদের টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল তখনো সে এরকম অসহায় বোধ করেনি।

গার্ডগুলো তাকে এই ঘরে ঢুকিয়ে পিটিয়েছে। বিজলী হাত দিয়ে যেটুকু সম্ভব নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে, পারেনি। সারা শরীরে ব্যথা। কপালের উপর আর ঠোঁটের কোনা কেটে গিয়েছে, মুখে নোনা রক্তের স্বাদ। বিজলী অবশ্যি সেগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। খোকন তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে, এই চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতে পারছে না, তাই শরীরের ব্যথাটাও ভালো করে টের পাচ্ছে না।

কতক্ষণ সে এই ঘরটার মাঝে বসেছিল নিজেই জানে না। একসময় খুঁট করে দরজাটা খুলে গেল। দরজার সামনে কয়েকজন মহিলা পুলিশ। একজন বলল, এই মেয়ে। তুমি বের হয়ে এসো।

একজন গার্ড বলল, হাতে হাতকড়া লাগিয়ে নেন। না হলে সমস্যা হতে পারে। এই মেয়ে খুব ডেঞ্জারাস।

মহিলা পুলিশ বলল, সেইটা আমরা দেখব। তারপর আবার বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, এসো। বের হয়ে এসো।

বিজলী উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, সারা শরীরে ব্যথা, সে দেয়াল ধরে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। মহিলা পুলিশটা এসে তাকে ধরে সাহায্য করে ঘর থেকে বাইরে নিয়ে আসে। গার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা এর গায়ে হাত দিয়েছেন? মারপিট করেছেন?

গার্ড বলল, মেরে তক্তা করে ফেলা দরকার ছিল।

মহিলা পুলিশটা বলল, কাজটা ঠিক হয় নাই।

বিজলী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমাকে কোথায় নিচ্ছেন। হাজতে?

তোমার বয়স কম। তোমাকে হাজতে নেয়া হবে না।

তাহলে?

তোমার বিরুদ্ধে অনেক বড় কমপ্লেন হয়েছে। তাই তোমাকে আমাদের হাতে দেওয়া হয়েছে।

এইখানে আমার ছোট ভাই ছিল, এরা তাকে কোথায় জানি সরিয়ে নিয়েছে।

মহিলা পুলিশ বলল, অনর্থক কথা বলো না। কোনো লাভ হবে না।

বিজলী চুপ করে গেল। হঠাৎ করে তার মনে হলো কিছুতেই আর কিছু আসে যাবে না।

.

নানা জায়গায় ঘুরিয়ে, নানা অফিসে বসিয়ে রেখে শেষ পর্যন্ত তাকে একটা বড় বিল্ডিংয়ে আনা হয়েছে। সেখানে একজন মহিলা একটা কলাপসিবল গেট খুলে তাকে ভেতরে নিয়ে যায়। একটা সরু সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে সে একটা বড় হলঘরে এসে পৌঁছাল। সেখানে মেঝেতে সারি সারি বিছানা। অনেকগুলো নানা বয়সী মেয়ে সেই বিছানাগুলোতে শুয়ে-বসে আছে।

বিজলীকে দেখে একজন বলল, হায় খোদা! এরা তো দেখি একটা দুধের বাচ্চারে ধরে নিয়ে আসছে!

আরেকজন হি হি করে হেসে বলল, আজকালকার মাইয়া জন্ম হওয়ার সাথে সাথে পাকনা মরিচ!

আরেকজন জিজ্ঞেস করল, কী করছিলা? চুরি চামারি নাকি অন্য কিছু?

বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে সে হাঁটুতে মাথা রাখল। শুনল একজন বলছে, পিটাইছে মনে হয়।

হ। শক্ত পিটান দিছে–

নিষ্ঠুর চেহারার একজন মহিলা তার শাড়ির গোজ থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে সেখান থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে লাগিয়ে সেটাতে একটা টান দিয়ে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে বলল, এই মেয়ে তোর নাম কী?

বিজলী হাঁটু থেকে মাথা তুলে নিচু গলায় বলল, বিজলী।

কই ছিলি? কী করছস?

বিজলী সিগারেট মুখে মেয়েটির দিকে তাকালো, তার সাথে তুই তুই করে কথা বলছে, মনে হয় মেয়েটা অন্যভাবে কথা বলতেই জানে না। কথা বলার ভঙ্গি যত খারাপই হোক গলায় স্বরে একটু সমবেদনা আছে। বিজলী বলল, মাথার ঠিক ছিল না, তাই একজনরে মারতে গেছিলাম।

কারে?

ডিরেক্টর না হলে চেয়ারম্যান হবে।

কী জন্যে?

আমার ছোট ভাইটারে কোথায় জানি দিয়ে দিছে। আমারে জানায় নাই। কথা শেষ করে বিজলী ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা মেয়েগুলো কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। তারপর একজন উঠে এসে তার পিঠে হাত রেখে বলল, কান্দিস না। দুনিয়াটাই এই রকম।

সিগারেট মুখে মেয়েটি এক মুখ ধোয়া ছেড়ে বলল, ঐ ডিরেক্টররে মাইর দিতে পারছিলি? ব্যাড়া মানুষরে মাইর দেওয়া খুব সোজা। দুই ঠ্যাংয়ের মাঝখানে খালি শক্ত একটা লাথি দিবি

বিজলী বলল, ডিরেক্টর, পুরুষ না। মহিলা।

এবারে সবাই একটু সোজা হয়ে বলল। একজন বলল, মাইয়া মানুষ? মাইয়া মানুষরে মাইর দিছস?।

সবাই তখন খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল সে ঠিক কীভাবে তাকে মেরেছে। বিজলী অবাক হয়ে আবিষ্কার করল, সে খুব বিস্ত রিতভাবে পুরো ঘটনাটার বর্ণনা দিল এবং সেটা শুনে সবাই আনন্দে হি হি করে হাসল।

নাজনীনকে ধাওয়া করে নেওয়ার সময় সে যখন আছাড় খেয়ে পড়েছে সেই অংশটি তাকে দুইবার বলতে হলো। এবং দুইবারই সবাই হেসে গড়াগড়ি খেল।

শুধু একটা মেয়ে না হেসে একবার একজনের মুখের দিকে আরেকবার আরেকজনের মুখের দিকে একটু অবাক হয়ে তাকাতে লাগল, মনে হলো সে বিজলীর কিংবা অন্য কারো কোনো কথা বুঝতে পারছে না।

বিজলী কিছুক্ষণের মাঝেই বুঝে গেল মেয়েগুলো অন্যরকম। তাদেরকে নানা জায়গা থেকে ধরে আনা হয়েছে। যারা আছে তারা সবাই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো ঝামেলা করে এসেছে। কয়েকজন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। একজন মহিলা পকেটমার। কয়েকজন দাবি করল তারা খারাপ মেয়েলোক, তার অর্থ কী বিজলী পরিষ্কার বুঝতে পারল না। যে মেয়েটি অন্যদের সাথে হাসিতে যোগ দেয়নি সে ইন্ডিয়ান মেয়ে, কীভাবে কীভাবে এই দেশে এসে আটকা পড়েছে। বাংলা বোঝে না কিন্তু ইংরেজি জানে। একটি মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে এবং মুখ শক্ত করে বলেছে সে আর বাড়ি ফিরে যাবে না। জায়গাটা একটা জেলখানার মতো, কিন্তু এখানে কারো কোনো বিচার হয় না, এখান থেকে কেউ কখনো জেলেও যায় না। সবাই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এখানে আটকা পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে বাইরে থেকে কেউ চেষ্টা তদবির করে কাউকে ছুটিয়ে নেয়। মাঝে মাঝে কোনো মহিলা সংগঠন এসে কাউকে কাউকে ট্রেনিং দেয়, তারপর তাকে কোথাও নিয়ে কাজে লাগিয়ে দেয়। অন্যেরা দিনের পর দিন এখানে আটকা থাকে।

.

কয়েক দিন কেটে যাবার পর বিজলীর সুলতানার সাথে পরিচয় হলো। সুলতানা কথা বলে খুব কম এবং সবার থেকে সব সময় একটু আলাদা থাকে। বয়স বিজলীর সমান কিংবা এক-দুই বছর বেশি। একদিন বিজলীকে জিজ্ঞেস করল, তুই লেখাপড়া জানিস?

বিজলী বলল, ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি।

সুলতানা তখন তার কামিজের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, এইখানে কী লেখা পড়ে শুনাবি।

বিজলী কাগজটা হাতে নিয়ে দেখল, সেটা একটা চিঠি। রুলটানা কাগজে ভুল বানানে কাঁচা হাতে লেখা লম্বা একটা চিঠি। সুলতানার মা চিঠিটা লিখেছে। বাড়িতে নানা ধরনের সমস্যার কথা দেওয়া আছে। সুলতানার ছোট বোনের লেখাপড়ার কথা আছে। ছোট ভাইয়ের দুষ্টুমির কথা আছে। চিঠির শেষে সুলতানার বাবার কথা লেখা আছে, তাকে বাজারে মাঝে মাঝে দেখা যায়, বাড়িতে আসে না।

চিঠি পড়া শেষ হলে সুলতানা চিঠিটা হাতে নিয়ে খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বাড়ি যাইতে হবে।

কেমন করে যাবে?

সুলতানা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, পালাব।

বিজলী চমকে উঠল, পালাবে?

হ্যাঁ।

কেমন করে? তোমারে তো চব্বিশ ঘণ্টা এইখানে তালা দিয়া রাখে।

উপায় বার করা লাগবে। তারপর হঠাৎ বিজলীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুই যাবি আমার সাথে?

আমি? বিজলী চমকে উঠল, আমি যাব তোমার সাথে?

হ্যাঁ।

বাইরে থাকব কই? খাব কী?

থাকবি রাস্তায়। সবাই যে রকম থাকে। খাওয়ার জন্যে কাম কাজ করবি, ভিক্ষা করবি, চুরি করবি-সমস্যা কী? লাখ লাখ বাচ্চা রাস্তায় থাকে। মেয়ে হওয়ার জন্যে একটা সমস্যা, কিন্তু সেইটারও রাস্তা আছে।

কী রাস্তা?

আমার সাথে যদি যাস তাহলে বলব।

বিজলী মাথা নাড়ল, তার সাহস হয় না। এইখানে মাথার ওপর একটা ছাদ আছে, দুই বেলা খাবার আছে। যদি কোনোভাবে সেলিনা জাহানের নাম ঠিকানা জোগাড় করে তাকে একটা চিঠি লেখা যায় তাহলে সেলিনা আপা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করে দেবে। এখান থেকে পালিয়ে সে কোথায় যাবে? কী করবে?

.

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজলী ঠিক করল সেও সুলতানার সাথে পালিয়ে যাবে। মেয়েদের এই আশ্রয়কেন্দ্রটা আসলে ভয়াবহ একটা জায়গা। প্রতি রাতেই সেখানে ভয়ানক ঘটনা ঘটে, পুরুষ মানুষ ঢুকে মেয়েদের টানাটানি করে। চিৎকার-চেঁচামেচি হতে থাকে। একজন আরেকজনের সাথে ঝগড়া করে, মারামারি করে। যদি সেরকম কিছু নাও হয় তবু বিজলী ঘুমাতে পারে না। এখানকার সবগুলো মেয়ের জীবনে একধরনের ভয়ংকর কষ্ট আছে, তারা সারাদিন সেগুলো নিজেদের মাঝে চেপে রাখে কিন্তু গভীর রাতে যখন ঘুমিয়ে যায় তখন ঘুমের ভেতর সেগুলো তাদের ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। ঘুমের মাঝে এক একজন ইনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদে। বিড়বিড় করে কথা বলে। রক্তশীতল করা গলায় চিৎকার করে ওঠে। সে নিজেও নিশ্চয়ই এরকম কিছু করে, কারণ কয়েক রাতে সুলতানা তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে, বলেছে চিৎকার বন্ধ করতে।

বিজলী যখন সুলতানাকে বলল, সেও তার সাথে পালিয়ে যাবে তখন সুলতানা কিছুক্ষণ বিজলীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, পরে কিন্তু আমারে দোষ দিতে পারবি না।

দিব না।

মনে রাখবি, মানুষ কিন্তু খুব খারাপ।

বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি।

লুতুপুতু হলে এক রাতও টিকতে পারবি না। কিন্তু তুই মারপিট করতে পারিস–তুই পারবি। সেই জন্যে তোরে বলেছি।

বিজলী একটু হাসল, সে কখনোই চিন্তা করেনি যে সে মারপিট করতে পারে, একদিন সেরকম একজন মানুষ হিসাবে পরিচিত হবে।

.

আশ্রয়কেন্দ্রের মেয়েদের দিনে একবার কয়েক ঘণ্টার জন্য বিল্ডিং থেকে বের হতে দেয়। বাইরে খোলা জায়গায় তখন তারা হেঁটে বেড়াতে পারে। পুরো কম্পাউন্ডটা বড় দেয়াল দিয়ে ঘেরা, গেটে তালা মারা থাকে, তাই এখান থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। মেয়েরা তখন কেউ কেউ মাটি কুপিয়ে গাছের চারা লাগায়, সেখানে পানি দিয়ে গাছগুলো বড় করে। কেউ বারান্দায় হেলান দিয়ে বসে থাকে। কেউ হাঁটাহাঁটি করে। কমবয়সী কয়েকজন টেনিস বল দিয়ে সাতচাড়া খেলে। আশ্রয়কেন্দ্রের একজন মানুষ এক কোনায় একটা টুলে বসে তাদের পাহারা দেয়।

এর মাঝে সুলতানা একটা প্যান্ট আর একটা শার্ট চুরি করে ফেলল। কোনো একজন মানুষ সেগুলো ধুয়ে শুকাতে দিয়েছিল। কেউ যখন লক্ষ করছে না তখন সুলতানা খুবই শান্ত ভঙ্গিতে প্রথমে শার্টটা টেনে এনে তার কামিজটা উপরে তুলে শরীরে প্যাচিয়ে ফেলল। তারপর ধীরে-সুস্থে ঘরের ভেতর গিয়ে সেটা খুলে এসে একই কায়দায় প্যান্টটাও শরীরে প্যাচিয়ে ফেলল। বিজলী বুঝতে পারল না সুলতানা পুরুষ মানুষের শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবে। সুলতানাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবা?

সুলতানা রহস্যের ভঙ্গি করে বলল, সময় হলে দেখবি।

কিছুক্ষণের মাঝেই শার্ট এবং প্যান্ট চুরি হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ধরা পড়ল। যে মানুষটির শার্ট-প্যান্ট চুরি হয়েছে সে এখানে রান্না করে। মানুষটি ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করল এবং সুলতানা তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে তার চেঁচামেচিটি উপভোগ করতে থাকে। শুধু তাই না, কে চুরি করে থাকতে পারে একটু পরে পরেই সেটা নিয়ে মতামত দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। এখানে যে মেয়েরা থাকে তাদের অনেকেই চুরি চামারি করে এখানে এসেছে, তবুও কেউই কোনো মেয়েকে সন্দেহ করল না। একটা মেয়ে পুরানো শার্ট প্যান্ট দিয়ে কী করবে?

পরের দিন একই কায়দায় সুলতানা দুই নম্বর শার্ট আর প্যান্টটাও চুরি করল। সেটা যখন ধরা পড়ল তখন কম্পাউন্ডের ভেতর একটা তুলকালাম কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। ভেতরে যে কয়জন পুরুষ মানুষ থাকে তাদের একজন আরেকজনকে সন্দেহ করে বড় ধরনের ঝগড়াঝাটি শুরু করে দেয়। আরেকটু হলে একটা মারামারি শুরু হয়ে যেত, অনেক কষ্টে সেটাকে থামানো হলো। পুরো সময়টাতে মানুষগুলোর খুব কাছাকাছি দাঁড়িয়ে সুলতানা ব্যাপারটা উপভোগ করছিল!

.

দুদিন পর গভীর রাতে সুলতানা বিজলীকে নিয়ে পালিয়ে গেল।

সেই রাতে ঘুমানোর সময়ও বিজলী অনুমান করেনি যে আজকেই তারা পালিয়ে যাবে। গভীর রাতে সুলতানা তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলে ফিস ফিস করে বলল, আয়, যাই?

বিজলী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোনখানে?

পালাব।

এখন?

হ্যাঁ। এখন। আয়। বলে সে বিজলীর জন্যে অপেক্ষা না করে অন্ধকারে হাঁটতে থাকে।

বিজলী কী করবে বুঝতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত সুলতানার পিছু পিছু যেতে থাকে। ঘরের বাইরে বিশাল কলাপসিবেল গেটে বড় বড় তালা, সুলতানা কীভাবে বের হবে বিজলী বুঝতে পারল না। সুলতানা অবশ্যি বাইরের দরজার দিকে গেল না, করিডোর ধরে হেঁটে হেঁটে বাথরুমে হাজির হলো।

বিজলীকে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে সুলতানা বাথরুমের জানালাটার দিকে এগিয়ে গেল। গ্রিলের রড ধরে ঝাঁকুনি দিতেই একটা রড বাঁকা হয়ে খানিকটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়, এখন এর ভেতর দিয়ে সহজেই একজন মানুষ বের হয়ে যেতে পারবে।

বিজলী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি জানতা এখান দিয়ে বের হওয়া যায়?

সুলতানা মাথা নাড়ল, বলল, অনেক দিন ঠেলাঠেলি করে এইটা ছুটাইছি। আয় যাই। তুই আগে যাবি নাকি আমি?

বিজলীর বুকটা ধ্বক ধ্বক করছিল, বলল, আমি যাই?

যা।

জানালা দিয়া বাইর হওয়ার পর পয়লা কার্নিশের উপর দাঁড়াবি, তখন তোর হাতে এই আমি পলিথিনের পোটলাটা দিমু। তুই সেইটা সাবধানে নিচে ফেলে দিবি।

কী আছে পোটলার ভিতরে?

সময় হলেই দেখবি। তারপর তুই নামবি। সাবধান, শব্দ করিস।

ঠিক আছে।

বিজলী জানালার ফুটো দিয়ে সাবধানে বের হয়ে এল, শরীরটা নিচু করে সে সাবধানে কার্নিশের উপরে দাঁড়াল। ভেতর থেকে তখন সুলতানা তার হাতে একটা পলিথিনের ব্যাগ ধরিয়ে দেয়। বিজলী সুলতানার কথামতো ব্যাগটা সাবধানে নিচে ফেলে দিল। তারপর কার্নিশ ধরে ঝুলে পড়ে নিচে নেমে এল।

কয়েক মিনিটের মাঝেই সুলতানাও নিচে নেমে এল। সুলতানা ব্যাগটা হাতে নিয়ে সাবধানে একটু এগিয়ে যায় তারপরে দেয়ালের আড়ালে একটা জায়গায় ব্যাগটা রেখে ফিসফিস করে বলল, বস!

আমরা বাইর হব না?

বাইর হইবার আগে রেডি হইতে হবে।

কীভাবে রেডি হবে বিজলী ঠিক বুঝতে পারল না কিন্তু কোনো কথা না বলে সে বসে পড়ল। এর মাঝেই সুলতানের উপর তার অনেক বিশ্বাস জন্মে গেছে। তার বুকটা ধ্বক ধ্বক করছে শুধু, মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ একজন এসে তাদেরকে ধরে ফেলে।

সুলতানাকে অবশ্যি মোটেও নার্ভাস দেখা গেল না। সে ব্যাগের ভেতর থেকে একটা কাচি বের করল। সেটা বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, নে। কেটে দে।

বিজলী অবাক হয়ে বলল, কী কাটব?

চুল। আমার চুল কাইটা দে। দেখে যেন মনে হয় ছেলে।

বিজলীর কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে, তারপর জিজ্ঞেস করল, চুল কাইটা দেব? ছেলেদের মতো করে?

হ্যাঁ। এইখান থেকে মাইয়া হয়ে বের হওয়া খুব বিপদের। আমরা যখন বাইর হমু তখন আমরা দুইজনই ছেলে হয়ে বাইর হমু। তোর নাম বিজলী তুই হইয়া যাবি বজলু। আমি হমু সুলতান।

হঠাৎ করে বিজলী বুঝতে পারল সুলতানা কেন শার্ট আর প্যান্ট চুরি করেছে।

সুলতানা বলল, দেরি করিস না। কাট।

বিজলী কাঁচিটা হাতে নিয়ে বলল, আমি কখনো চুল কাটি নাই!

তোর চুল কাটা জানতে হবে না। খালি ছোট করে দে।

সুলতানার মাথা ভর্তি চুল, কাটতে বিজলীর মায়া লাগছিল তারপরও নিষ্ঠুরের মতো সে তার সুন্দর চুলগুলো কাটল। কাটার পর দেখা গেল মাথা ভর্তি খোঁচা খোঁচা চুল, এখানে সেখানে খাবলা খাবলা চুল উঠে আছে। দেখে বিজলীর খুব খারাপ লাগছিল কিন্তু সুলতানা একটুও মাথা ঘামাল না। কাটা চুলগুলো সে একটা পলিথিনের ব্যাগে যত্ন করে তুলে রাখল। তারপর কাঁচিটা হাতে নিয়ে বিজলীকে বলল, আয় এখন তোরটা কাইটা দিই।

বিজলী নিজের মাথাটা এগিয়ে দিল, সুলতানা ঘ্যাচ ঘ্যাচ করে চুল কাটতে লাগল। কিছুক্ষণের মাঝেই বিজলীর মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে!

চুল কাটা শেষ হলে তারা নিজেদের কাপড় বদলে শার্ট প্যান্ট পরে নিল। বিজলী ভেবেছিল তারা এই ঢলঢলে শার্ট প্যান্ট পরেই থাকবে কিন্তু সুলতানা কাঁচি দিয়ে প্যান্টগুলো হাঁটুর উপরে কেটে হাফ প্যান্টের সাইজ করে ফেলল। বিজলী দুর্বলভাবে একটু আপত্তি করতে চেষ্টা করল, কিন্তু সুলতানা ধমক দিয়ে বলল, আমাগো বয়সের ছেলেরা এই রকম ঢলঢলা প্যান্ট পরে না।

শুধু যে প্যান্টটা কেটে ছোট করল তা না, শার্টগুলোর হাতাও কাটল এবং নিচেও কেটে ছোট করে নিল। তারপর নিজের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, আয় যাই।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, দেয়াল পার হবা কেমনে! উপরে কাঁচ দিয়া রাখছে দেখছ?

জানি! তুই আমার সাথে আয়।

বিজলী সুলতানার পিছু পিছু গেল, সুলতানা দেয়াল ধরে ধরে এগিয়ে একটা জায়গায় থেমে গিয়ে উপরে তাকাল। তারপর থেমে গিয়ে বলল, এইখানে।

এইখানে কী?

এইখানে কাঁচগুলো ভাইঙা রাখছি। কিন্তু উপরে কিছু একটা বিছাইতে হবে।

কী বিছাবা?

আমাগো কাপড়গুলা। আমি একটা তোয়ালেও আনছি।

অন্ধকারে দুইজন দেয়াল ঘেষে দাঁড়াল। সুলতানা বলল, প্রথমে আমি উঠি। তুই এখানে দাঁড়া। আমি তোর ঘাড়ে উঠুম। আমাকে ঘাড়ে নিতে পারবি তো?

পারব।

তুই দেয়ালটা ধরে বস।

বিজলী দেয়ালটা ধরে বসল। সুলতানা বিজলীর ঘাড়ে উঠে দাঁড়াল, তারপর বলল, এখন তুই আস্তে আস্তে খাড়া।

বিজলী নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেয়ালটা ধরে আস্তে আস্তে দাঁড়াল। সুলতানা তার ব্যাগ থেকে তাদের কাপড়গুলো, তোয়ালেটা বের করে দেয়ালের উপর রেখে ধারালো কাঁচগুলো ঢেকে ফেলল। তারপর হাতে ভর দিয়ে উপরে উঠে গেল।

সাবধানে একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে সুলতানা তার হাতটা নিচে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এখন তুই উইঠা আয়।

বিজলী সুলতানার হাত ধরল, সুলতানা তখন তাকে উপরে টেনে তুলতে থাকে। বিজলী দেয়ালের এবড়ো থেবড়ো জায়গায় পা রেখে অন্য হাত দিয়ে টেনে নিজেকে ওপরে তুলে ফেলল।

সুলতানা খুশি হয়ে বলল, কাম হয়া গেছে। এখন নামতে হবে।

অন্য পাশে লাফিয়ে নামার জন্য দেয়ালটা একটু বেশি উঁচু, তারপরও বিজলী সাহস করে লাফ দিল। সুলতানা তার হাতে তাদের পোটলাটা ধরিয়ে দিয়ে সহজেই লাফ দিয়ে নেমে এল। একটা ছোট নালা পার হয়ে তারা রাস্তায় উঠে আসে।

টুং টাং শব্দ করে একটা রিকশা আসছে, বিজলীর মনে হলো এখনই দৌড়ে তাদের কোথাও লুকিয়ে যেতে হবে, কিন্তু সুলতানা একটুও উত্তেজনা না দেখিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। রিকশাওয়ালা গুন গুন করে একটা গান গাইতে গাইতে চলে গেল, তাদের দিকে একবার ফিরেও তাকালো না।

সুলতানা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আয় হাঁটি। এই জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না।

বিজলী বলল, হ্যাঁ। যদি বুঝে যায় তাহলে হইচই শুরু হয়ে যাবে।

কাল সকালের আগে কেউ বুঝবে না। রাত্রে কেউ খেয়াল করবে না।

সুলতানা আর বিজলী রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকে, অনেক রাত তারপরেও মাঝে মাঝেই একটা দুইটা চায়ের দোকান খোলা।

হাঁটতে হাঁটতে তারা রাস্তার পাশে একটা ময়লা ফেলার ঢিবি পেল। সুলতানা তখন তার পলিথিনের ব্যাগটা সেখানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল, এখন আর কেউ আমাগো খুঁইজা পাবে না।

বিজলী বলল, শুধু বাথরুমে গেলে বুঝে যাবে আমরা বাথরুমের জানালা দিয়ে বাইর হইছি।

সুলতানা বলল, উহঁ। আমি রডটা আবার সোজা করে দিয়া আসছি, দরজাটাও খুলে আসছি। কেউ বুঝতে পারবে না আমরা কোন দিক দিয়া পালাইছি।

বিজলী বলল, কী মজা।

সুলতানা দাঁত বের করে হেসে বলল, বিশাল একটা হাউকাউ লাইগা যাবে। মনে হয় এক দুইজনের চাকরিও চইলা যাবে!

সত্যি?

সত্যি না তো মিথ্যা নাকি?

সুলতানা আপন মনে কিছুক্ষন হাসল। তাকে দেখে মনে হলো কারো চাকরি চলে যাওয়াটা বিশাল একটা আনন্দের ব্যাপার। একটু পরে বলল, আয় বজলু যাই। মনে আছে তো, তুই এখন থেকে বজলু।

বিজলী বলল, হ্যাঁ সুলতান ভাই। মনে আছে।

তারপর দুজন পুরোপুরি একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে হেঁটে যেতে থাকে।

*

স্কুল থেকে বের হয়েই খোকন দেখল মিলি দাঁড়িয়ে আছে। খোকনের নতুন মা। সে অবশ্যি এখনো মিলিকে মা বলে ডাকা শুরু করেনি। তার কেমন জানি লজ্জা করে। খোকন বুঝতে পারছে তার নতুন মা খুব করে চাইছে সে যেন তাকে মা বলে ডাকে, কিন্তু এখনো সে কিছু না ডেকে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছে।

খোকনকে দেখে মিলি এগিয়ে এলো, তার হাত ধরে বলল, খোকন সোনা, তোমার স্কুলটা আজকে কেমন ছিল?

খোকন বলল, ভালো।

আজকে তার দ্বিতীয় দিন। প্রথম দিন থেকে অনেক ভালো তবুও আজকেও পুরো সময়টা তার ভয় ভয় লেগেছে। স্কুলের সব ছেলেমেয়ে সুন্দর সুন্দর স্কুলের পোশাক পরে এসেছে। তারও সুন্দর পোশাক। ধবধবে সাদা শার্ট, নেভি ব্লু প্যান্ট, গলায় টাই। টাইটা গলায় কীরকম জানি ফাঁসের মতো আটকে থাকে, গলায় একটু খসখস করে, এছাড়া কোনো সমস্যা নাই। স্কুলের স্যার ম্যাডামেরা কেউ বকাবকি করে না, সব সময় আদর করে কথা বলে। সবাই অবশ্যি ইংরেজিতে কথা বলে। সেজন্যে কে কী বলছে বুঝতে তার সমস্যা হয়। মিলি বলেছে কয়দিন পরে অভ্যাস হয়ে যাবে।

মিলি জিজ্ঞেস করল, তোমার নাশতা খেতে পেরেছিলে?

খোকন মাথা নাড়ল। সে যখন চরে থাকত তখন শুধু ভাত খেয়েছে। ভাতের সাথে শুঁটকি মাছ। কখনো কখনো শাক কিংবা ডাল। নাশতা বলে যে কিছু আছে সে জানতই না। মিলিদের বাসায় এসে সে আবিষ্কার করেছে কত হাজারো রকম নাশতা আছে। বেশির ভাগ খাবারের সে নামই জানে না, আর খেতে কী মজা! কিন্তু প্রত্যেকবার নাশতা খাবার সময় তার বিজলীবুয়ের কথা মনে পড়ে। তখন তার কান্না পেয়ে যায়, সে আর খেতে পারে না। বিজলীবুয়ের কথা সে কাউকে বলতে পারবে না, যখনই সেটা মনে পড়ে তখনই তার কেমন জানি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। মাথাটা কেমন জানি এলোমেলো হয়ে আসে।

মিলি খোকনের হাত ধরে বলল, চলো, বাসায় যাই।

খোকন বলল, চলো।

মিলিদের ড্রাইভার তাদের নীল রঙের গাড়িটার দরজা খুলে দাঁড়াল। প্রথমে খোকন গাড়িতে উঠল, তারপর মিলি। গাড়ির ভেতর কী আরাম আরাম ঠান্ডা!

গাড়ি করে খোকন তার নতুন মায়ের সাথে তার নতুন বাসায় যেতে থাকে। তাদের চরে গাড়ি দূরে থাকুক একটা রিকশাও ছিল না। হেঁটে হেঁটে বাজারে গেলে সেখানে রিকশা কিংবা টেম্পো দেখা যেত। প্রথম গাড়ি দেখেছে হাসপাতালে এসে। হাসপাতালের জানালা দিয়ে যখন রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকত তখন দেখত রাস্তা দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। ছোট-বড় নানা রকম গাড়ি, নানা রকম শব্দ। এখন সে নিজেই প্রত্যেকদিন গাড়ি করে স্কুলে যায়। এটা তার নতুন মা আর নতুন বাবার গাড়ি। তার মানে এটা তার গাড়ি। খোকনের কী অবাক লাগে, কয়দিন আগে তার কিছু ছিল না, এখন তার সবকিছু আছে। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, স্কুল আছে। কিন্তু তার বাবা নাই, মা নাই, বিজলীবু নাই। বিজলীবুর কথা মনে হতেই তার বুকের মাঝে জানি কেমন করতে থাকে, তার মাথার মাঝে কেমন জানি সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। বিজলীবুয়ের কথা কাউকে বলা যাবে না। কাউকে বললেই বিজলীবুকে মেরে ফেলবে। খোকনের শরীরটা হঠাৎ কাঁপতে থাকে।

খোকনের নতুন মা খোকনের দিকে তাকালো, তারপর আদর করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, কী হয়েছে সোনা আমার? তোমার কী হয়েছে?

কিছু হয় নাই। খোকন জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, আমার কিছু হয় নাই।

মিলি আদর করে খোকনকে জড়িয়ে ধরে রাখে। এইটুকুন একটা বাচ্চা না জানি কত বড় কষ্টের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। মিলির বুকের ভেতরটা কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে।

বাসায় এসে খোকন গোসল করল। তার কী সুন্দর বাথরুম, উপর থেকে বৃষ্টির মতো পানি পড়ে। পানিটাকে গরম করা যায় আবার ঠান্ডা করা যায়। গোসল করার সময় নব ঘুরিয়ে খোকন পানিটাকে কুসুম কুসুম গরম করে নেয়। কত রকমের সাবান, চুলের জন্য কত রকম শ্যাম্পু! কী সুন্দর গন্ধ। গোসল করতে কী আরাম। গোসল করে সে বড় তোয়ালে দিয়ে শরীর মোছে। নরম তুলার মতো তোয়ালে, জিলজিলে গামছার মতো না! গোসল শেষ করে ধোয়া কাপড় পরে নেয়, প্রত্যেকদিন নতুন ধোয়া কাপড়! কী আশ্চর্য, সে জানতই না গোসল করে প্রত্যেকদিন নতুন কাপড় পরতে হয়।

সে বাথরুম থেকে বের হওয়ার সময় তার নতুন মা বাথরুমে উঁকি দিল, বলল, বাবা, দাঁড়াও আগেই কাপড় পরো না। আমি তোমার শরীরে একটু লোশন মাখিয়ে দিই!

তখন খোকন দাঁড়িয়ে রইল, আর তার নতুন মা তার সারা শরীরে আদর করে লোশন মাখিয়ে দিল। সাইক্লোনের রাতে তার সারা শরীর ফালা ফালা করে কেটে গিয়েছিল, এখনো তার শরীরে সেই দাগ আছে। তার নতুন মা সেই দাগগুলোতে চুমু খেয়ে বলে, আহারে! আমার সোনা কত কষ্ট করেছে।

খোকন কিছু বলে না। তার নতুন মায়ের সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে তার কেমন জানি লজ্জা লজ্জা লাগে। আবার ভালোও লাগে। তার নতুন মা তাকে এত আদর করে–আর কেউ তাকে এরকম আদর করে নাই। বিজলীবু ছাড়া–আবার বিজলীবুয়ের কথা মনে হতেই থোকনের বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়। কাউকে সে বিজলীবুয়ের কথা বলতে পারবে না! কাউকে না। বললেই বিজলীবুকে মেরে ফেলবে, মাথার ভেতরে আবার সবকিছু কেমন জানি এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। তার শরীরটা অল্প অল্প কাঁপতে থাকে।

খোকনের নতুন মা বিষয়টা লক্ষ করে, তখন তাকে বুকের মাঝে চেপে ধরে রেখে, মাথায় হাত বুলায়। হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে, ভয় কী সোনা? ভয় কী? আমরা আছি না তোমার সাথে?

খোকন মাথা নাড়ে, হ্যাঁ। তার নতুন মা আছে তার সাথে। তার ভয় নাই। বিজলীবুয়ের কথা যদি কাউকে না বলে তাহলে বিজলীবুয়েরও কোনো ভয় নাই।

পরিষ্কার কাপড় পরে সে তার মায়ের সাথে খেতে বসে। তার নতুন মা প্লেটে খাবার তুলে দেয়। যখন চরে ছিল তখন খাওয়ার কিছু ছিল না। ভাত আর ছোট মাছ। না হলে শুঁটকি। বড়জোর অর্ধেকটা ডিম–এখন কত কী খাবার। প্রত্যেকদিন মাছ আর গোশত থাকে। কী আশ্চর্য!

তার নতুন মা তাকে সবজি খেতে দেয়, সবজি খেলে শরীরের কত উপকার হয় সেগুলো বলে! খাওয়ার পর দই না হলে মিষ্টি থাকে। বিজলীবু মিষ্টি খেতে খুব পছন্দ করত–খোকন জোর করে তার মাথা

থেকে বিজলীবুয়ের চিন্তাটা সরিয়ে দিল, না হলে আবার তার মাথাটা এলোমেলো হয়ে যাবে।

খাবার পর খোকন তার বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা বই নিয়ে বসে। ইংরেজি বইগুলো সে এখনো পড়তে পারে না, শুধু ছবি দেখে। বাংলা বইগুলো সে পড়ে। কী মজার মজার বই! অ্যাডভেঞ্চারের বই। ভূতের বই। কোনটা ছেড়ে কোনটা পড়বে সে ঠিক করতে পারে না।

বই পড়তে পড়তে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল, তার নতুন মা বিকেলবেলা তাকে ডেকে তুলেছে। বিকেলবেলা ঘুমিয়ে গেলে যখন ঘুম ভাঙে তখন সবকিছু অন্যরকম মনে হয়। আজকেও খোকনের সবকিছু অন্যরকম মনে হলো। সে কোথায় আছে কেন আছে সেটা বুঝতেই তার অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল। যখন বুঝল সে কোথায় আছে তখন তার কেমন জানি মন খারাপ হয়ে গেল, বুকের ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল।

খোকনের নতুন মা তাকে ঘুম থেকে তুলে বাথরুমে নিয়ে গেল, নিজেই তার হাতমুখ ধুয়ে দিয়ে খাবার ঘরে নিয়ে এল। সেখানে ডাইনিং টেবিলে বসে খোকন একটুখানি অরেঞ্জ জুস খেলো। ছোট থাকতে একবার সে কমলা খেয়েছিল, কিন্তু কমলা চিপে যে রস বের করে সেই রস খাওয়া যায় সেটা সে জানতই না।

খাওয়ার পর কাপড় জামা বদলে তার নতুন মা তাকে নিয়ে বের হলো। তাকে একটা কারাটে স্কুলে নিয়ে সেখানে তাকে ভর্তি করে দিল। খোকন এর আগে কখনো কারাটে স্কুল দেখেনি, তার বয়সী ছোট ছোট বাচ্চা সাদা কাপড় পরে হাইয়া হাইয়া করে হাত-পা ছুড়ছে, দেখে খোকনের কেমন যেন হাসি পেয়ে যায়।

সন্ধ্যেবেলা খোকন বসে বসে তার হোমওয়ার্ক করল। অল্প কয়েকটা হোম ওয়ার্ক, দেখতে দেখতে সেগুলো করা হয়ে গেল। তখন সে বসার ঘরে তার নতুন মায়ের পাশে বসে টেলিভিশন দেখল। সে যখন চরে থাকত তখন সে টেলিভিশনের নাম শুনেছিল কিন্তু কখনো টেলিভিশন দেখেনি। এখন তার নিজের বাসায় কত বড় টেলিভিশন। কী সুন্দর তার রং। খোকন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।

টেলিভিশনে খোকন বসে একটা কার্টুন দেখল, একটা বিড়াল একটা ইঁদুরকে নানাভাবে ধরার চেষ্টা করছে, কিন্তু কখনোই ধরতে পারে না। ইঁদুরটার অনেক বুদ্ধি, সব সময় বিড়ালটাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। দেখে খোকনের হাসি পেয়ে যায়।

খোকন যখন বসে বসে টেলিভিশন দেখছিল তখন রায়হান এসে ঢুকল। রায়হান তার নতুন বাবা। খোকনকে দেখে হাসি হাসি মুখে বলল, ইয়াংম্যান! কেমন আছো তুমি? তোমার নতুন বাসা কেমন লাগছে?

খোকন বলল, ভালো।

রায়হান তার হাতের ব্যাগটা খুলে সেখান থেকে একটা ফুটবল বের করে সেটা সে খোকনের দিকে ছুঁড়ে দিল। খোকন দুই হাত দিয়ে সেটা ধরে ফেলে। রায়হান হাসি হাসি মুখে বলল, গুড ক্যাচ! তুমি ফুটবল খেলো?

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, খেলি!

সে যখন চরে থাকত তখন চরের ছেলেদের সাথে ফুটবল খেলত। তাদের অবশ্যি ফুটবল ছিল না। একটা জাম্বুরাকে ফুটবল বানিয়ে ফুটবল খেলত। খোকন হাতের ফুটবলটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল! সত্যিকারের ফুটবল, কেমন জানি একটা চামড়া চামড়া গন্ধ। তার নতুন বাবা গতকালকেও তার জন্যে একটা রঙের বাক্স এনেছে, আজকে একটা ফুটবল। প্রত্যেকদিনই তার জন্যে নতুন একটা উপহার, কী আশ্চর্য!

ওরা তিনজন মিলে রাতের খাবার খেলো। খোকন অবাক হয়ে দেখল ভাতগুলো কী সুন্দর ধবধবে সাদা, কী সুন্দর তার ঘ্রাণ। মনে হয় শুধু লবণ দিয়েই সে ভাত খেয়ে ফেলতে পারবে। খোকনকে অবশ্য শুধু লবণ দিয়ে খেতে হলো না। টেবিলে আছে ইলিশ মাছের ভাজা, গরুর গোশত আর ডিম ভুনা। সাথে ঘন ডাল। ডাল খাওয়ার সময় খোকনের মনে পড়ল, যখন চরে থাকত তখন তার মা তাদের জন্যে পাতলা জিলজিলে এক ধরনের ডাল রাঁধত।

খাওয়া শেষ হবার পর খোকন একটুখানি পায়েশ খেলো। তারপর আবার একটুখানি টিভি দেখে বিছানায় শুয়ে পড়ল। কী নরম একটা বিছানা, মনে হয় বিছানার মাঝে সে ডুবে যাবে। খোকনের নতুন মা বাতি নিভিয়ে দিল। জানালা দিয়ে হালকা একটা আলো আসছে, এই আলোতে সবকিছুকে কেমন জানি স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয়। শুয়ে শুয়ে সে দেখে এক পাশে একটা এসি থেকে কুলকুল করে ঠান্ডা বাতাস বের হচ্ছে। ঘরের ভেতর কী আরাম আরাম ঠান্ডা। খোকন নরম একটা কম্বল শরীরের উপর টেনে নিয়ে চোখ বন্ধ করল। খোকন একটা নিঃশ্বাস ফেলল, সে সব সময় বিজলীবুয়ের সাথে ঘুমাত–ঘুমের মাঝে সে বিজলীবুয়ের ওপর পা তুলে দিত, বিজলীবু কখনো সেজন্যে বিরক্ত হতো না! ছোট একটা বিছানায় দুজনে গাদাগাদি করে ঘুমাত–কিন্তু এখন বিজলীবুয়ের কথা কিছুতেই মনে করা যাবে না। কিছুতেই মনে করা যাবে না। হঠাৎ খোকনের মাথাটা কেমন জানি এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে।

গভীর রাতে মিলির ঘুম ভেঙে গেল। খোকনের ঘর থেকে অস্পষ্ট এক ধরনের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ কাঁদছে। মিলি একটু ভয় পেয়ে বিছানা থেকে নেমে খোকনের ঘরে এল। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেল খোকন বিছানায় ছটফট করছে, তার মুখ থেকে যন্ত্রণার মতো একধরনের শব্দ হচ্ছে।

মিলি ঘরের লাইট জ্বালাল, খোকন তার মাথা এপাশ ওপাশ করছে। চোখ আধখোলা, কিন্তু কিছু দেখছে বলে মনে হয় না। মিলি প্রায় ছুটে গিয়ে মশারি তুলে খোকনকে জড়িয়ে ধরল, তাকে একটু ঝাঁকুনি দিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল, বাবা সোনা আমার, কী হয়েছে?

খোকন বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে ছটফট করে, কান্নার মতো শব্দ করে। মিলি তাকে বুকে চেপে ধরে ব্যাকুল হয়ে বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে সোনা?

খোকন চোখ খুলে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, পানি! পানি! পানি আসছে। ভাসিয়ে নিবে, ভাসিয়ে নিবে–

কোথায় পানি? মিলি নরম গলায় বলল, পানি নেই সোনা। পানি নেই। আমি আছি।

খোকন জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? বি–বি– বিজলীবু বলতে গিয়ে খোকন থেমে গেল। বিজলীবুয়ের কথা বলা যাবে না। কিছুতেই বলা যাবে না। বললেই বিজলীবুকে মেরে ফেলবে।

মিলি বুকে চেপে ধরে বলল, আমি তোমার মা।

খোকন মিলিকে চেপে ধরে বলল, ভয় করে মা। আমার খুব ভয় করে।

মিলি একধরনের শিহরণ অনুভব করে। তার এই সন্তানটি তাকে মা বলে ডেকেছে।

ভয় নেই বাবা, তোমার কোনো ভয় নেই।

খোকন কাঁপা গলায় বলল, মা, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না তো?

না বাবা। মিলির চোখে পানি চলে এল, খোকনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, না বাবা, আমি তোমাকে কোনোদিন ছেড়ে যাব না। কোনোদিন ছেড়ে যাব না।

খোকন দেখল তার বিজলীবু আস্তে আস্তে নতুন মা হয়ে যাচ্ছে। বিজলীবু বলে এখন কেউ নেই, এখন আছে তার মা। তার এই মা এখন তাকে বুকে চেপে রাখবে।

.

ঠিক তখন বিজলীর ঘুম ভেঙে গেল। স্টেশনের মেঝেতে তার বয়সী অনেকগুলো ছেলেমেয়ের সাথে সে ঘুমিয়েছিল। হঠাৎ করে একটা পুলিশ এসে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে বিজলী অন্য বাচ্চাদের সাথে ছুটতে থাকে। পুলিশ যেন তাকে ধরতে না পারে। কিছুতেই যেন ধরতে না পারে।

*

সেলিনা তীক্ষ্ণ চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল, জিজ্ঞেস করল, আপনি কী বলছেন?

আমি কী বলেছি আপনি শুনেছেন। ছেলেটিকে এডপশানে দেয়া হয়েছে।

সেলিনা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল, বোনটিকে ভাই থেকে আলাদা করে ফেলেছেন?

বোন বড় হয়ে গেছে। তাকে কে এডপশানে নেবে?

সেলিনা প্রায় চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমি কি পরিষ্কার করে বলিনি দুই ভাইবোনকে আলাদা করা যাবে না। কিছুতেই আলাদা করা যাবে না?

আমাদের রেকর্ডে সে রকম কিছু নেই। নাজনীন ড্রয়ার থেকে কিছু কাগজ বের করে সেলিনার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বিশ্বাস না হলে দেখেন।

সেলিনা কাগজগুলো দেখার কোনো আগ্রহ দেখাল না। একটু ঝুঁকে নাজনীনকে জিজ্ঞেস করল, ছেলেটা এখন কোথায় আছে?

সেটা বলা যাবে না। যাদেরকে এডপশানে দিই তাদের ঠিকানা কাউকে বলার নিয়ম নেই। সরি।

সেলিনা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না। কোনোমতে নিজেকে শান্ত করে জিজ্ঞেস করল, আর মেয়েটি?

মেয়েটি? নাজনীন হাসির মতো শব্দ করল, বলল, শি ইজ আ ক্রিমিনাল। তাকে পুলিশে দেওয়া হয়েছে।

পুলিশে? সেলিনা কী বলবে বুঝতে পারল না।

নাজনীন হাসি হাসি মুখে বলল, আমি গত সপ্তাহে খোঁজ নিয়েছিলাম, সে কাস্টডি থেকে পালিয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে ইনোসেন্ট অসহায় কিছু বাচ্চা দেবেন। আপনি তা না দিয়ে আমাকে হার্ডকোর ক্রিমিনাল ধরিয়ে দিয়েছেন? কেমন করে এটা করতে পারলেন?

সেলিনা চোখ বড় বড় করে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারল না, সে কী একজন মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে, নাকি একটা রাক্ষুসীর দিকে তাকিয়ে আছে।

*

রাস্তার মোড়ে গাড়িগুলো ট্রাফিক জ্যামে আটকে আছে। বিজলী হাতের বইগুলো নিয়ে গাড়িগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। বইগুলো বাচ্চাদের জন্যে লেখা, রংচঙে বই, তাই যে গাড়িতে বাচ্চারা থাকে সেই গাড়িতে বিজলী বইগুলো বিক্রি করার চেষ্টা করে। বেশির ভাগ গাড়ির জানালার কাঁচ তুলে রাখায় তার কথা গাড়ির ভেতর পর্যন্ত পৌঁছায় কি না সে জানে না, তারপরও সে চেষ্টা করে, জানালার কাছে মাথা লাগিয়ে বলে, আন্টি একটা বই নিয়ে যান আপনার বাবুর জন্য। কী সুন্দর বই দেখেন। বিজলী যখন বই বিক্রি করার চেষ্টা করে তখন যতটুকু সম্ভব শুদ্ধ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করে, শুধু তাই না মাঝে মাঝে একটা দুইটা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, পাখির বই আছে, মাছের বই আছে, ফলের বই আছে। কী সুন্দর বই, বিউটিফুল বুক! আপনার বাবু সব পাখির নাম শিখে যাবে। এই দেখেন মাছরাঙা পাখি, কিংফিশার, কী সুন্দর রং দেখেন–একটা বই নিয়ে যান আন্টি!

গাড়ির ভেতরে যারা বসে থাকে, বেশির ভাগ সময় তারা বিজলীর দিকে ঘুরে তাকায় না, এরকম হলে বিজলী তাদের সাথে বেশি সময় নষ্ট করে না, অন্য গাড়িতে চলে যায়। কেউ যদি তার দিকে তাকায় তাহলে সে আবার নতুন উৎসাহে তার বই বিক্রি করার চেষ্টা করে। গাড়িতে যদি ছোট বাচ্চা থাকে তাহলে বিজলী মা-বাবাকে না দেখিয়ে সরাসরি বাচ্চাটাকে বইগুলো দেখায়। কপাল ভালো হলে বাচ্চাগুলো বই কেনার বায়না ধরে বসে, ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকে। বাবা-মা তখন অনেক সময় বিরক্ত হয়ে বই কিনে দেয়! বিজলী তখন বইগুলোর দাম অনেক বাড়িয়ে চাড়িয়ে বলে–ঘ্যানঘ্যানে ধরনের বাচ্চা হলে তার লাভ।

দামি একটা গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরের বাচ্চাটাকে দেখিয়ে বিজলী তার বইটা নাড়াচাড়া করে, বলে, বাবু এই বইটা নিবে? দেখো

কী সুন্দর বই-কাঠঠোকরার ছবি দেখো! কাঠঠোকরা মানে উডপেকার, মাছরাঙা মানে কিংফিশার–

বাচ্চাটার মা জানালার কাঁচ নামিয়ে ধমক দিয়ে বলল, এই ছেলে! বিরক্ত করো না। যাও–

বিজলী আজকাল এই ছেলে– শুনে চমকে ওঠে না। মনে হয় সে নিজেই ভুলে গেছে যে সে আসলে একটা মেয়ে। সে এখন পাকাপাকিভাবে ছেলে, তার নাম বজলু। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালিয়ে আসার কয়েকদিন পর সুলতানা তাকে একদিন রেলস্টেশনে পৌঁছে দিয়ে চলে গেছে। যাবার আগে পথে-ঘাটে থাকার কিছু নিয়ম শিখিয়ে দিয়ে গেছে। সুলতানার শেখানো নিয়মগুলো বিজলীর অনেক কাজে লেগেছে। পথে-ঘাটে থাকতে থাকতে সে নিজেও কিছু নিয়ম শিখেছে। প্রথম নিয়ম হচ্ছে বড়লোকদের গালাগাল ধৈর্য্য ধরে সহ্য করতে হবে কিন্তু পথেঘাটে তার মতো অন্যরা যারা থাকে তাদের গালাগাল ধাক্কাধাক্কি সহ্য করা যাবে না–টিকে থাকার জন্য তখন তাকে পাল্টা গালাগালি, পাল্টা ধাক্কাধাক্কি কিংবা পাল্টা মারপিট করতে হবে। বিজলী সেই নিয়মটা মেনে চলছে, তার সাথে সাথে সে নিজেও আরো নতুন নতুন কিছু নিয়ম বের করেছে।

বিজলী এতদিনে জেনে গেছে যে সে পথেঘাটে যতদিন ইচ্ছা বেঁচে থাকতে পারবে। তবে বিজলী নিজে যেটা বুঝতে পারছে না সেটা হচ্ছে নিজে না জেনেই সে ধীরে ধীরে কেমন জানি হিংস্র হয়ে উঠছে। পথেঘাটে বেঁচে থাকা অনেকটা জঙ্গলে থাকার মতো। জঙ্গলে বাঘ-ভালুকের মাঝে বেঁচে থাকতে হলে নিজেকে বাঘ-ভালুক হয়ে যেতে হয়। এখানেও তাই, পথে ঘাটে বেঁচে থাকতে হলে নিজেকে হিংস্র হয়ে যেতে হয়। কখনো হাল ছেড়ে দিতে হয় না।

কাজেই এবারেও বিজলী হাল ছাড়ল না। বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখো বাবু কত সুন্দর বই। তারপর একটা দুইটা ইংরেজি শব্দ ঢুকিয়ে দিল, বিউটিফুল বুক! বিউটিফুল বার্ডস!

বিজলীর ইংরেজিতে কাজ দিল, বাচ্চাটা এবারে নাকি সুরে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করে দিল, আম্মু বই কিনব! বই। হ্যাঁ এ্যা।

বাচ্চাটার মা ধমক দিয়ে বলল, অনেক বই আছে বাসাতে। আর বই লাগবে না।

বাচ্চাটা এবারে কাঁদতে শুরু করল, বই। বার্ডের বই। এ্যাঁ এ্যাঁ এ্যাঁ…

মা আরো জোরে ধমক দিল, চুপ। খবরদার কাঁদবে না।

বিজলী এবারে তার মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করল, একটা বই জানালা দিয়ে সরাসরি বাচ্চাটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, নাও! বাবু এই যে বই।

মা বিজলীর দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, এটা কী হচ্ছে? এই ছেলে তোমাকে আমি বই দিতে বলেছি? বলেছি?

বিজলী হাসি হাসি মুখে বলল, না আন্টি। আমি বাবুকে এটা গিফট দিয়েছি।

বাচ্চাটির মা এবারে থতমত খেয়ে গেল, কী বলবে বুঝতে পারল না। বিজলী হাসি হাসি মুখে বলল, বাবুটা এত সুইট। এত মায়া লাগে। তারপর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বলল, এনজয় দা বুক। তারপর ঘুরে পাশের গাড়ির দিকে চলে গেল, যদিও কান খাড়া করে রাখল। এই মহিলা একেবারে বাড়াবাড়ি ছোটলোক না হলে এখন তাকে ডাকবে। সত্যি সত্যি মহিলার গলা শোনা গেল। এবারে গলার স্বর যথেষ্ট নরম, এই ছেলে! এই ছেলে! বিজলী এবারে চেহারায় একটু বিব্রত ভাব ফুটিয়ে বলল, জি আন্টি।

তোমার বইয়ের দাম কত?

বিজলী জিবে কামড় দিয়ে বলল, না, আন্টি! এইটা বাবুর জন্যে গিফট। আমি দাম নিতে পারব না।

মহিলা তার ব্যাগ খুলে বলল, বলো কত দাম।

আন্টি, আপনার এত সুইট বাবুটাকে আমি গিফট দিতে পারব না? প্লিজ আন্টি! আমরা এই বইগুলো অনেক কমিশনে পাই।

তারপর মোক্ষম আরেকটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করল, বিলিভ মি!

মহিলা ভুরু কোঁচকাল, তুমি লেখাপড়া করো।

ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়েছি–এখন একটা ঝামেলার মাঝে আছি, তাই বন্ধ আছে। আবার শুরু করব।

তোমার ফ্যামিলি?

কেউ নাই। যারিনা সাইক্লোনে সবাই ভেসে গেছে।

মহিলা এবারে জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। ব্যাগ থেকে একটা বড়সড় নোট বের করে বিজলীর দিকে এগিয়ে দিল। বিজলী মাথা নিচু করে বলল, থ্যাংক ইউ আন্টি। কিন্তু আমি সত্যি বাবুকে এই গিফটটা দিয়েছি। আমরা রাস্তাঘাটে থাকি, আমাদের কোনো আপনজন নাই। মাঝে মাঝে আমাদেরও তো কাউকে গিফট দিতে ইচ্ছে করে।

মহিলাটি এবারে পুরোপুরি দ্রবীভূত হয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে বিজলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, নাও থোকা। আমি তোমার বইয়ের দাম দিচ্ছি না। আমিও তোমাকে গিফট দিচ্ছি।

বিজলীর হঠাৎ করে নিজেকে অপরাধী মনে হয়, সে ছোটখাটো অভিনয় করে মহিলাকে এভাবে নরম করে দিয়েছে। এটা একধরনের প্রতারণা। সে আগে তো এরকম প্রতারক ছিল না, পথে থাকতে থাকতে সে প্রতারণা করা শিখে গিয়েছে। বিজলী কেমন যেন কুণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মহিলাটা হাত বাড়িয়ে বলল, নাও বাবা। ছেলে থেকে বাবাতে নেমে এসেছে, বিজলী ছোট একটা নিঃশ্বাস ফেলে নোটটা হাতে নিল। আজকে সারা দিনের ব্যবসা এটা দিয়েই হয়ে গেছে। এখন আর গাড়ি থেকে গাড়িতে দৌড়াদৌড়ি না করলেও চলবে।

সামনে ট্রাফিক সিগন্যাল লাল থেকে সবুজ হয়েছে, গাড়িগুলো নড়তে শুরু করেছে। বিজলী মহিলার দিকে তাকিয়ে হাত তুলে সালাম দিয়ে সরে এল।

বিজলী চলন্ত গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে ফুটপাথে উঠে এল। হঠাৎ শুনতে পেল তার পাশে দাঁড়িয়ে কে যেন চাপা গলায় বলল, হারামজাদা।

বিজলী মাথা ঘুরে তাকালো, তার মতোই কিছু বই নিয়ে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের দৃষ্টিতে আগুন বের হচ্ছে। মানুষটা কেন খেপে আছে বিজলী বুঝে গেল, কিন্তু সে না বোঝার ভান করল, কী হয়েছে?

তুই কী করছস মনে করছিস আমি দেখি নাই?

কী করছি?

হারামজাদা। ঢং করার জায়গা পাস নাই?

খবরদার মুখ খারাপ করে কথা বলবা না।

বললে তুই কী করবি? লোকটা এবারে আরো খারাপ ভাষায় বিজলীকে তার মা-বাবা তুলে গালি দিল।

বিজলী অবলীলায় মানুষটাকে তার মা-বাবা তুলে একই ভাষায় একই ভঙ্গিতে গালি দিল। মানুষটা প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না যে এইটুকুন একটা ছেলে তার মতো একজন বড় মানুষকে এই ভাষায় গালি দিতে পারে। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, এইটা আমার জায়গা। এই জায়গায় তুই কুনো জিনিস বেচবার পারবি না।

বিজলী বলল, এইটা তোমার বাপের জায়গা না। এইটা গভর্মেন্টের জায়গা। এইখানে যার খুশি সে আসতে পারব।

মানুষটা বলল, এইটা আমার জায়গা, ভাগ এখান থেকে। ভাগ। বলে মানুষটা কুৎসিত একটা গালি দিয়ে বিজলীকে ধাক্কা দিল।

বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলল, এখন আর পিছিয়ে যাবার উপায় নেই। একটা কিছু হেস্তনেস্ত করতে হবে। সে খুবই শান্তভাবে তার হাতের টাকাগুলো পকেটে রাখল। বইগুলো মাটিতে রেখে কোমরে হাত দিল, বলল, তুমি কী বলো?

মানুষটা এবারে শুধু যে ধাক্কা দিল তা না, তার মুখে একটা চড় মারার চেষ্টা করল। বিজলী সময়মতো মাথা সরিয়ে নিয়ে মানুষটাকে একটা ঘুষি দিল। মানুষটা প্রস্তুত ছিল না, ঘুষি খেয়ে পিছিয়ে গেল এবং তাল হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিল। দুই হাত ছড়িয়ে নিজেকে সামলাতে গিয়ে তার হাতের সবগুলো বই নিচে ছড়িয়ে পড়ে গেছে। বিজলী একটা বইকে লাথি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়ে আবার মানুষটার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

দেখতে দেখতে তাদের ঘিরে একটা ভিড় জমে গেল এবং বিজলীর সাথে মানুষটার একটা তুমুল মারামারি শুরু হয়ে যায়। মানুষটা বড়, গায়ে জোর বেশি। বিজলী ছোট গায়ে জোর কম কিন্তু সে মানুষটার থেকে অনেক বেশি ক্ষিপ্র। পথে থাকতে থাকতে সে অনেক কিছু শিখেছে, মারামারিতে গায়ের জোর থেকে অনেক বেশি জরুরি হচ্ছে সাহস আর মনের জোর।

মারামারিতে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে সেটা অবশ্যি দেখার সুযোগ হলো না কারণ তার আগেই যারা দর্শক তাদের অনেকে গিয়ে দুজনকে সরিয়ে দিল। একজন পুলিশও এসে দুজনকে ধমকাধমকি করতে থাকে কিন্তু বোঝা গেল সহানুভূতিটা বিজলীর জন্যই বেশি। মানুষটা গজরাতে গজরাতে নিচ থেকে তার বইগুলো তুলতে থাকে। কয়েকজন মিলে বিজলীকে ধরে রাখল এবং সে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করতে করতে মানুষটার দিকে ছুটে আসার ভাণ করতে লাগল।

ট্রাফিকের লাল সিগন্যাল হওয়ার পর যখন গাড়িগুলো আবার থেমে গেল তখন কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে বিজলী আবার তার রংচঙে বই নিয়ে গাড়ি থেকে গাড়িতে দৌড়াতে লাগল। খোঁচা খোঁচা দাড়ি মানুষটি অত্যন্ত কঠিন মুখে রাস্তা পার হয়ে অন্যদিকে চলে গেল। বোঝা গেল তার এলাকাতে সে বিজলীর দখলদারি মেনে নিয়েছে।

সন্ধ্যেবেলা বিজলী যখন ফুটপাথে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে তখন তার পাশে একটা ছেলে এসে বসল। সে আশেপাশে থাকে, কখনো তাকে রাস্তায় কিছু বিক্রি করতে দেখা যায়নি কিন্তু দেখেই বোঝা যায় তার দিনকাল ভালোই কাটে। লোকজন চাপা গলায় বলাবলি করে সে নাকি ড্রাগের ব্যবসা করে।

ছেলেটি কানে আটকে রাখা একটা সিগারেট ঠোঁটে লাগিয়ে একটা ম্যাচের বাক্স থেকে একটা কাঠি বের করে ফস করে সিগারেটটা ধরিয়ে সিগারেটে টান দেয়। তারপর ধোয়াটা নাক দিয়ে বের করে সিগারেটটা বিজলীর দিকে এগিয়ে দেয়।

বিজলী মাথা নাড়ল, সে এখনো সিগারেট খাওয়া শুরু করে নাই। ছেলেটা সিগারেটে আরেকটা টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল, নাম কী?

বিজলী বলল, বজলু।

তুই পারবি।

কী পারব?

মাইর পিট করতে।

বিজলী একটু অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো। সে মারপিট করতে পারবে এরকম প্রশংসা অন্যের মুখে শুনতে পাবে আগে কখনো কল্পনা করেনি।

ছেলেটা বলল, তোর সব ঠিক আছে। সাহস আছে। ফাস্ট আছস। খালি হাত চালাস মাইয়া মানুষের মতো।

বিজলী চমকে উঠল, ছেলেটা বলে কী? সে মেয়েদের মতো হাত চালায়? ছেলেটা বুঝে গেছে নাকি যে সে মেয়ে?

ছেলেটা তার সিগারেটে আরো একটা লম্বা টান দিল, তারপর বলল, তোর সমস্যা হচ্ছে মাইরের সময় তুই ঘুষি মারিস হাত দিয়া।

বিজলী একটু অবাক হয়ে বলল, ঘুষি তো হাত দিয়াই মারতে হয়।

উঁহু। ঘুষি দিতে হয় পুরা শরীর দিয়া। হাতটা খালি ব্যবহার করতে হয় ঘুষিটা জায়গা মতোন লাগানোর জন্য।

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, বুঝলাম না।

আয় দেখাই। বলে ছেলেটা দেখাল কীভাবে শুধু হাতের শক্তি ব্যবহার না করে পুরো শরীরের শক্তি ব্যবহার করে কাউকে ঘুষি দিতে হয়। শুধু তাই না কীভাবে শুধু এক হাত দিয়ে ঘুষি না মেরে দুই হাত ব্যবহার করতে হয়। মারামারি করার সময় কীভাবে সবদিকে নজর রাখতে হয়। কেউ চাকু মেরে দিবে কিনা সেটা কেমন করে আন্দাজ করতে হয়।

বিজলী মারপিট-সংক্রান্ত ব্যাপারে ছেলেটার জ্ঞান দেখে মোটামুটি মুগ্ধ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, তুমি এইগুলা কেমনে শিখছ?

আমার ওস্তাদ শিখাইছে।

তোমার ওস্তাদ কে?

বখতিয়ার ভাই।

বখতিয়ার ভাই কই থাকে?

মাটির নিচে।

বিজলী অবাক হয়ে তাকালো, মাটির নিচে?

ছেলেটা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। খরচা হয়া গেছে।

কীভাবে?

ক্রসফায়ার। ছেলেটা হাত দিয়ে তার খরচা হয়ে যাওয়া ওস্ত দিকে সালাম দিয়ে বলল, আমার ওস্তাদ ছিল একেবারে আসল বাঘের বাচ্চা বাঘ। তারপর জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করল। ছেলেটা যেহেতু আর কোনো কথা বলল না তাই বিজলী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। দুজন চুপচাপ বসে রইল।

সিগারেট শেষ করে ছেলেটা সেটা ফুটপাথে ঘষে আগুন নিভিয়ে দূরে ছুঁড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুই কই থাকিস?

রাস্তায়। ইস্টিশনে।

বাড়ি থেকে পালাইছস?

না।

বাপ মা?

নাই। সাইক্লোনে ভেসে গেছে।

কী করবি ঠিক করছস?

বিজলী মাথা নাড়ল। হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়া।

কী করবি?

আমার একটা ভাই আছে, আমারে না জানাইয়া তারে পালক দিয়া দিছে। তারে খুঁজে বের করমু।

ছেলেটা বিজলীর দিকে তাকাল, তারপর হা হা করে হেসে ফেলল, বলল, ঢাকা শহরে দুই কোটি লোক থাকে। দুই কোটি লোকের মাঝ থেকে তুই তোর ভাইরে খুঁজে বের করবি?

বিজলী মাথা নাড়ল, মুখ শক্ত করে বলল, হ্যাঁ। খুঁজে বের করমু। খোদার কসম।

কীভাবে?

সেইটা এখনো ঠিক করি নাই, কিন্তু বের করমুই করমু। তারে যদি খুঁজে বের করতে না পারি তাহলে আমার বাঁইচা থাকার কোনো দরকার নাই।

ছেলেটা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, ঠিক আছে।

দুজনে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল, ছেলেটা পিচিক করে ফুটপাথে থুতু ফেলে বলল, তুই যদি আমার লগে কাজ করতে চাস তাহলে বলিস।

তোমার কী কাজ?

এখন বলা যাবে না। যদি কাজ করবার চাস তখন বলুম।

বিজলী বলল, ঠিক আছে।

.

শুধু হাত দিয়ে ঘুষি না দিয়ে পুরো শরীরের শক্তি ব্যবহার করে ঘুষি দেওয়ার টেকনিকটা দুই দিন পরেই বিজলীর কাজে লাগল।

বিজলী একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। প্রত্যেক দিনই সকালবেলা যখন মায়েরা তাদের বাচ্চাদের স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যায় সে তখন কোনো একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকটা বাচ্চাকে লক্ষ করে। খোকনকে নিশ্চয়ই তার পালক বাবা-মা কোনো একটা স্কুলে ভর্তি করে দেবে। সেই স্কুলে নিশ্চয়ই সকালবেলা খোকনকে নামিয়ে দেবে। কাজেই একটা একটা করে সে যদি প্রত্যেকটা স্কুলে সকালে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে তাহলে কোনো না কোনোদিন নিশ্চয়ই খোকনকে খুঁজে পাবে। বিজলী তাই ভোরবেলা কোনো একটা স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

আজকেও বিজলী দাঁড়িয়ে ছিল, যখন শেষ গাড়িতে শেষ মা তার ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল তখন বিজলী একটা নিঃশ্বাস ফেলে ফিরে যেতে থাকে।

রাস্তার মোড়ে একজন মহিলা দাঁড়িয়েছিল, বাচ্চাকে নামিয়ে নিজের গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে ঠিক তখন রাস্তার উল্টো দিক থেকে একটা মোটরসাইকেল ছুটে এল, মোটরসাইকেলের সামনে কালো চশমা পরা একজন মানুষ, পেছনে আরেকজন। চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে পেছনের মানুষটা খপ করে মহিলার হাতব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল। মহিলা তাল সামলাতে না পেরে রাস্তার মাঝে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। মোটরসাইকেলটা বাঁকা হয়ে ঘুরে গিয়ে আবার সোজা হয়ে গর্জন করে ছুটে যেতে থাকে। মোটরসাইকেলটা ঠিক যখন বিজলীর সামনে চলে এসেছে, তখন কী করবে বুঝতে না পেরে বিজলী খপ করে ছিনিয়ে নেওয়া হাতব্যাগটা ধরে ঝুলে পড়ল। মোটরসাইকেলটা কিছুদূর বিজলীকে টেনে নিল, তারপর তাল হারিয়ে কাত হয়ে গেল এবং পেছনের মানুষটা মোটরসাইকেল থেকে নিচে পড়ে গেল। পুরো মোটরসাইকেলটাই কাত হয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কালো চশমা পরা মানুষটা কোনোভাবে তার পা দিয়ে সামলে নিল।

যে মানুষটা ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়েছিল সে কোনোভাবে উঠে দাঁড়িয়ে হতবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা ছোট ছেলে এরকম কাণ্ড করতে পারে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। পড়ে গিয়ে মানুষটার হাত-পা ছড়ে গিয়েছে, সে দাঁত কিড়মিড় করে বিজলীর দিকে তাকালো। তারপর ব্যাগটা এক হাতে ধরে রেখে অন্য হাতটা পকেটে ঢুকিয়েছে। বিজলী জেনে গিয়েছে পকেটে মানুষ হাত ঢোকায় অস্ত্র বের করার জন্য, কাজেই কখনো সেই সুযোগ দিতে হয় না। সে তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার করে হিংস্র ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়, তারপর কয়েকদিন আগে শেখা সমস্ত শরীর দিয়ে ঘুষি মারার টেকনিক ব্যবহার করে মানুষটার মুখে একটা ঘুষি মারল। বিজলী অবাক হয়ে দেখল তার ঘুষি খেয়ে মানুষটা কাটা কলাগাছের মতো নিচে পড়ে গেছে! বিজলী তখন ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাগটা টেনে নিজের হাতে নিয়ে নেয়।

যে মানুষটা মোটরসাইকেলে বসেছিল, সে চিৎকার করে উঠল। তখন নিচে পড়ে থাকা মানুষটা কোনোমতে উঠে দাঁড়াল, টলতে টলতে কোনোমতে ছুটে গিয়ে মোটরসাইকেলের পেছনে গিয়ে বসে। মোটরসাইকেলটা তখন গর্জন করে ছুটে যেতে থাকে।

বিজলী পেছনে পেছনে ধর ধর বলে চিৎকার করতে করতে ছুটতে লাগল। হাতের ব্যাগটা ঘুরিয়ে সে মানুষটাকে মারার চেষ্টা করল। মানুষটার মাথায় কোথাও ব্যাগটা লেগেও গেল, তারপরেও কোনোভাবে তারা পালিয়ে গেল।

মোটরসাইকেলটা মোড়ে অদৃশ্য হয়ে যাবার পর বিজলী প্রথমবার ঘুরে তাকালো, যে মহিলার ব্যাগ নিয়ে এত ঘটনা সেই মহিলা ফুটপাথ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, তার চোখে বিস্ময় এবং অবিশ্বাস। বিজলী ব্যাগটা মহিলার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নেন। আপনার ব্যাগ।

মহিলা ব্যাগটা হাতে নিতে ভুলে গেল, চোখ বড় বড় করে সে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, বাবা, তোমার কী মাথা খারাপ।

বিজলী হাসার চেষ্টা করল, বলল, না আন্টি। আমার মাথা ঠিক আছে।

তুমি এটা কী করলে? তোমার এত সাহস? এই সন্ত্রাসীদের সাথে তুমি মারামারি করতে গিয়েছ? তোমাকে তো খুন করে ফেলত!

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, না, করবার পারে নাই।

তুমি এত বড় মানুষটাকে এভাবে মার দিলে? ঘুষি মেরে নিচে ফেলে দিলে?

বিজলী কোনো কথা বলল না, হাসার চেষ্টা করল। হাতের ব্যাগটা সে মহিলাটার হাতে দিয়ে বলল, নেন আপনার ব্যাগ।

মহিলা ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল, থ্যাংক ইউ। এই ব্যাগটা নিয়ে গেলে আসলেই আমি খুব বিপদে পড়ে যেতাম। ব্যাগে টাকাপয়সা বেশি নাই, কিন্তু অনেক দরকারি কাগজপত্র আছে। তুমি আমার অনেক উপকার করেছ, বাবা।

বিজলী কোনো কিছু বলল না, আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। তারা অবাক হয়ে এখন বিজলীর দিকে তাকিয়ে আছে।

বিজলী যখন চলে যাচ্ছে, মহিলাটি আবার তাকে ডাকল, বলল, বাবা, তুমি এইটুকুন ছেলে, তোমার এত সাহস হলো কেমন করে?

বিজলীর কী মনে হলো কে জানে, হঠাৎ করে সে মহিলাটার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি আসলে ছেলে না। আমি মেয়ে।

মহিলাটি চমকে উঠল, মুখে হাত দিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে উঠে বলল, কী বললে?

বিজলী দ্বিতীয়বার কথাটি না বলে শুধু মাথা নাড়ল।

মহিলাটি খপ করে তার হাত ধরে ফেলল, চাপা গলায় বলল, তুমি ছেলে সেজে আছো কেন?

বিজলী এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, আমি পথেঘাটে থাকি তো সেই জন্যে। মেয়েদের পথেঘাটে থাকলে অনেক বিপদ।

মহিলাটি কেমন যেন অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি লেখাপড়া জানো?

ক্লাস নাইন পর্যন্ত।

তুমি চাকরি করতে চাও?

আমাকে কে চাকরি দেবে?

আমি ব্যবস্থা করে দিব। গার্মেন্টসে। করবে?

বিজলী উত্তেজিত হয়ে বলল, করব। অবশ্যই করব।

মহিলাটি তার ব্যাগ খুলে একটা কার্ড বের করে বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, এই যে কার্ডটা রাখো। তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করবে। ঠিক আছে?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

কার্ডটা হারিও না যেন।

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, না, হারাব না।

আমি তোমাকে নিজেই নিয়ে যেতাম কিন্তু এখন আমার খুব একটা জরুরি কাজে যেতে হবে। তুমি যোগাযোগ করবে।

বিজলী বলল, করব।

বিজলী কার্ডটা শক্ত করে ধরে রাখল, এর আগে তাকে কার্ড দিয়েছিল সেলিনা জাহান। সেই কার্ডটা নাজনীন ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল বলে তার পুরো জীবনটা লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল। এবার সে এই মহিলার দেওয়া কার্ডটা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না। কিছুতেই না।

» ৪. মহিলার নাম রওশন আরা

মহিলার নাম রওশন আরা। বিজলী রওশন আরার সাথে যোগাযোগ করল এবং আয়েশা গার্মেন্টস নামে একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে তার চাকরি হয়ে গেল। চাকরির থেকে বড় কথা গার্মেন্টসের আরো কয়েকজন মেয়ের সাথে তার থাকার ব্যবস্থা করে দেয়া হলো।

রওশন আরা বিজলীর জন্যে সাবান, তোয়ালে, টুথপেস্ট, এর সাথে সাথে দুই জোড়া সালোয়ার-কামিজ কিনে এনেছে। প্রথম দিন বিজলীকে তার নতুন জায়গায় তুলে দেবার সময় গার্মেন্টসের মেয়েরা বিজলীর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলল, কিন্তু এইখানে তো আমরা শুধু মেয়েরা থাকি। ছেলেদের আলাদা মেস আছে–

বিজলী একটু হেসে বলল, আপু আমারে একটু সময় দেও, আমি মেয়ে হয়ে যাব!

মেয়েগুলো বিভ্রান্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বিজলী বলল, আমি আসলে মেয়ে! রাস্তাঘাটে থাকতাম সেই জন্যে ছেলে হয়ে ছিলাম।

রওশন আরা হেসে বলল, বিজলী মেয়ে হলেও তার তেজ কিন্তু ছেলেদের থেকে বেশি। একটা পাজি ছিনতাইকারী আমার ব্যাগ ছিনতাই করতে গিয়েছিল, বিজলী তাকে এমন একটা ঘুষি দিল যে এক ঘুষিতে সেই সন্ত্রাসী ধড়াম করে পড়ে গেল!

মেয়েগুলো অবাক হয়ে রওশন আরাকে ঘিরে দাঁড়াল এবং রওশন আরাকে তখন পুরো কাহিনীটা আরো একবার শোনাতে হলো।

.

বিজলী বাথরুমে ঢুকে বহুদিন পরে সারা শরীরে সাবান ঘষে পানি দিয়ে ভালোভাবে গোসল করল। ছেলে হয়ে থাকার এটাই ছিল সবচেয়ে বড় যন্ত্রণা, কখনো সে ঠিক করে গোসল করতে পারেনি। গোসল শেষ করে সে বহুদিন পর সালোয়ার-কামিজ পরে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল। মাথায় ছোট ছোট চুল থাকার পরও অনেকদিন পরে আজকে সে পুরোপুরি মেয়ে! বিজলী একটা ছোট আয়নায় অনেকক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠিক কী কারণ জানা নেই আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তার চোখে পানি এসে গেল।

.

আয়েশা গার্মেন্টসে কাজ শুরু করার পর বিজলীর জীবনটা পাল্টে গেল। সবাইকে নিয়ে সে দলবেঁধে কাজ করতে যায়। সেই ভোরবেলা থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত কাজ করে। দুপুরে খাবার সময় আয়েশা গার্মেন্টসের সাততলা ছাদে বসে সে সবার সাথে খায়। সবার মাঝে বিজলী সবচেয়ে ছোট, তাই অন্য মেয়েগুলোও তাকে নিজের বোনের মতো আদর করে। রাস্তাঘাটের জীবন থেকে এই জীবনটা একেবারেই অন্যরকম। ছুটির দিনে বিজলী অন্য মেয়েদের সাথে ঘুরতে যায়। কখনো সিনেমা দেখে, কখনো নিউমার্কেটে কেনাকাটা করে, কখনো চিড়িয়াখানায় যায়। প্রায় সবারই বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের মাসে মাসে সেখানে টাকা পাঠাতে হয়। বিজলীর কেউ নেই, তার টাকা খরচ করারও কোনো জায়গা নেই। যখন রাস্তাঘাটে থাকত তখন টাকাগুলো তার প্যান্টের ভেতরে সেলাই করে লুকিয়ে রাখত। এখন সে ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছে, ব্যাংকে টাকা জমা রাখে। যখন খোকনের সাথে দেখা হবে তখন সে খোনকে সাইকেল কিনে দেবে। নতুন জামাকাপড় কিনে দেবে। প্লেনে করে খোকনকে নিয়ে কক্সবাজারে বেড়াতে যাবে। কক্সবাজার যাবার আগে সে একটা ক্যামেরা কিনবে, তারপর খোকনকে নিয়ে সে ছবি তুলবে। অনেক অনেক ছবি।

খোকনকে খুঁজে পাওয়ার পর সে কী করবে তার খুঁটিনাটি সবকিছু সে চিন্তা করে রেখেছে কিন্তু খোকনকে সে খুঁজে পায়নি–শুধু যে খুঁজে পায়নি তা নয় তাকে কীভাবে খুঁজে পাবে, সেটাও সে জানে না। আয়েশা গার্মেন্টসে কাজ শুরু করার পর সে আর খোকনকে খুঁজতে পারছে না। এখন তাকে অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠেই কাজে যেতে হয়, তাই সে আর খোকনের খোঁজে স্কুলে স্কুলে যেতে পারে না। সে আবার কেমন করে খোকনকে খোঁজা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। গোপনে সে অন্য জায়গায় কাজ খুঁজছে, যেখানে দেরি করে কাজে যেতে পারবে। কিন্তু সে যে কোনো হিসেবে একটা বাচ্চা মেয়ে, তাকে রওশন আরা এই চাকরিটা জোগাড় করে দিয়েছে, সে চেষ্টা করলেই অন্য জায়গায় চাকরি পাবে বলে মনে হয় না।

কিন্তু হঠাৎ করেই বিজলী খোকনকে খোঁজার সুযোগ পেয়ে গেল। কিন্তু যেভাবে সুযোগটা এল সেটা এতই অভাবনীয় ছিল যে বিজলী তার জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।

.

আয়েশা গার্মেন্টসে একটা অর্ডার এসেছে, সেটা সময়মতো শেষ করতে না পারলে ঝামেলা হবে। সেজন্যে অনেককে ওভারটাইম কাজ করতে হচ্ছে। তাদের মাঝে বিজলীও একজন। একটা মেশিন দিয়ে সে শার্টের বোতাম লাগিয়ে যাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই কাজ।

রাত দশটার দিকে তারা আধাঘণ্টার বিশ্রাম পেল, হোটেল থেকে খাবারের প্যাকেট আনা হয়েছে, সবাই ছাদে বসে খাওয়া শেষ করে আবার চারতলায় নেমে এসেছে। তখন তাদের একজন নাক কুঁচকে বলল, কিসের গন্ধ?

আরেকজন জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে বলল, কই? আমি তো কোনো গন্ধ পাই না।

সবাই তখন আবার কাজে লেগে গেল এবং কয়েক মিনিট পর সবাই একসাথে একটা পোড়া গন্ধ পেল। একজন উঠে গেল গন্ধটা কোথা থেকে এসেছে দেখবার জন্যে এবং সিঁড়ির কাছে গিয়ে দরজাটা খুলতেই দেখল সিঁড়ি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া আসছে। সে চিৎকার করে দরজাটা বন্ধ করে ছুটে এসে বলল, আগুন!

তখন একসাথে সবাই লাফ দিয়ে উঠে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। কয়েকজন আবার গিয়ে দরজাটা খুলে বোঝার চেষ্টা করল আগুনটা কোথায়, সিঁড়ি দিয়ে তারা নেমে যেতে পারবে কি না। কিন্তু এবারে দরজা খোলার সাথে শুধু কুচকুচে কালো ধোয়া নয় আগুনের হলকা দেখতে পেল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবার কোনো উপায় নেই।

।একটি মেয়ে ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করল, আর সিঁড়ি নাই?

আছে, পিছনে আরেকটা সিঁড়ি আছে।

এবারে সবাই পেছনে ছুটে গেল, কিন্তু সিঁড়ির দরজাটা বাইরে থেকে তালা মারা, তারা বৃথাই কয়েকবার লাথি দেয় সেটাকে ভাঙার চেষ্টা করল। কোনো লাভ হলো না।

এবারে বেশ কয়েকজন ডুকরে কেঁদে উঠল। কয়েকজন জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী হচ্ছে। রাস্তায় অনেক মানুষ জড়ো হয়ে বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু কী বলছে বোঝার কোনো উপায় নেই।

অনেকগুলো মেয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে থাকে। বাইরে আগুনের আলো ছড়িয়ে পড়ছে। ঘরের ভেতর দেখতে দেখতে গরম হয়ে উঠছে। সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামতে পারবে না, উপরেও উঠতে পারবে না, দেখতে দেখতে আগুন ছড়িয়ে পড়ছে–হঠাৎ করে সবার ভেতরে একধরনের মৃত্যুভয় ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই চিৎকার করে খোদাকে ডাকতে থাকে। কেউ যখন মৃত্যুভয়ে খোদাকে ডাকাডাকি করে তার চাইতে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না।

বিজলী মাথা ঠান্ডা রাখল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারবে না, আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ার আগে তাদেরকে অন্য কোনোভাবে নেমে যেতে হবে। পেছনে বারান্দা আছে কিন্তু সেখানে গ্রিল দেয়া, সুলতানার সাথে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে পালিয়ে যাবার পর থেকে সে কোনো গ্রিল দেখলেই সেটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, চাপ দিয়ে খুলে ফেলা যায় কিনা পরীক্ষা করে। এই বিল্ডিংয়ের বারান্দার গ্রিলটাও সে পরীক্ষা করেছে। গ্রিলটা খুবই দুর্বল, কোনো কিছু দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলেই খুলে যাবে। একটা খন্তা হলে খুব ভালো হতো, কিন্তু এখানে কোনো খন্তা নেই।

বিজলী একটু চিন্তা করল।

তাদের টেবিলের উপর ভারী কিছু যন্ত্রপাতি আছে, ধরাধরি করে সেগুলো নিয়ে সেটা দিয়ে জোরে ধাক্কা দিলে নিশ্চয়ই গ্রিল খুলে আসবে। বিজলী দেরি করল না, চিৎকার করে বলল, আপুরা কয়েকজন আস আমার সাথে।

একজন আতঙ্কিত মুখে জিজ্ঞেস করল, কেন?

বারান্দার গ্রিল ভাঙতে হবে। তাড়াতাড়ি।

বিজলী টেবিলের উপর রাখা একটা দামি মেশিনের পাওয়ার কর্ডটা খুলে ফেলল। চিৎকার করে বলল, ধরো।

বেশ কয়েকজন সেটা ধরাধরি করে বারান্দায় নিয়ে আসে, তারপর সেটাকে দিয়ে প্রাণপণে গ্রিলকে ধাক্কা দিল। দুইবার ধাক্কা দিতেই এক পাশ থেকে গ্রিলটা ছুটে আসে। তখন উৎসাহ পেয়ে আরো কয়েকজন হাত লাগাল। সমস্ত শক্তি দিয়ে ধাক্কা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত গ্রিলের অনেকখানি খুলে গেল। এবারে বেশ কয়েকজন গ্রিলটাকে টেনে অনেকখানি জায়গা করে নেয় যেন সেদিক দিয়ে একজন মানুষ বের হয়ে যেতে পারে।

সবাই তখন বারান্দায় এসে ভিড় করে ঠেলাঠেলি শুরু করেছে, কিন্তু চারতলার বারান্দা থেকে কীভাবে নিচে নামবে কেউ বুঝতে পারছে না।

বিজলী তখন সবার দিকে তাকালো। বেশির ভাগের পরনে সালোয়ার কামিজ, কয়েকজন মাত্র শাড়ি পরে এসেছে। তাদের শাড়িগুলো দরকার। বিজলী চিৎকার করে বলল, আপুরা, যারা সুতি শাড়ি পরে আছ, শাড়ি খুলে দেও। তাড়াতাড়ি!

একজন চোখ কপালে তুলে বলল, আর আমি কী পরে থাকব?

ব্লাউজ পেটিকোট আছে না? উপরে একটা কোট পরে নাও, মেম সাহেবদের মতো।

এরকম বিপদের মাঝে কে কী পরে আছে সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাল না, ঝটপট দুইটা শাড়ি চলে এল। বিজলী প্রথমে দুইটা শাড়ি গিঁট দিয়ে সেটাকে লম্বা করে নেয়। তারপর এক পাশে একটা বড় ফঁসের মতো করল যেন একজন সেখানে বসতে পারে। এখন একজন একজন করে সেখানে বসিয়ে তাকে উপর থেকে ঝুলিয়ে নিচে নামিয়ে দেয়া হবে।

যখন এখান থেকে বের হবার কোনো উপায় ছিল না তখন সবাই। আতঙ্কে চিৎকার করছিল। এখন যখন দেখতে পেল বেঁচে যাওয়ার একটা পথ তৈরি হয়েছে, তখন হঠাৎ করে সবার মাঝে একটা সাহস ফিরে এসেছে। তারা চিৎকার থামিয়ে এবারে অপেক্ষা করতে থাকে।

বিজলী জিজ্ঞেস করল, কে আগে নামবা?

সবাই আগে নামতে চায় আবার কেউই এই বিপজ্জনক ফাঁসে প্রথম বসতে চায় না। চার-তলার উপর থেকে এভাবে কেউ নামতে সাহস পায় না, ভয়ার্ত চোখে নিচে তাকিয়ে থাকে। বিজলী আবার চিৎকার করে বলল, দেরি করলে হবে না, একজন একজন করে সবাইরে নামতে হবে!

শেষ পর্যন্ত একজন সাহসী মেয়ে রাজি হলো। তাকে শাড়ির ফাঁসটাতে বসিয়ে সাবধানে গ্রিলের ফুটো দিয়ে বের করা হলো। তখন সবাই মিলে শাড়িটার অন্য পাশে ধরে তাকে নিচে নামাতে থাকে। নামার সময় সে মাঝে মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছিল, এ ছাড়া কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই সে বেশ সহজেই নিচে পৌঁছে গেল।

প্রথম মেয়েটি নেমে যাবার পর সবার সাহস একটু বেড়ে গেল। এবারে অনেকেই নামতে রাজি। প্রথমবার যে ছোটখাটো সমস্যা হয়েছিল পরেরবার তার কিছুই হলো না। নামার সময় ঝুলন্ত অবস্থায় ঘুরপাক পর্যন্ত খেল না। বারান্দার নিচে চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে তখন আশেপাশে জমা হয়ে থাকা মানুষও সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। তারা নিচে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল এবং কাছাকাছি আসতেই মেয়েগুলোকে ধরে ধরে নামাতে লাগল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলো তাড়াহুড়ো করল না। প্রাণ বাঁচানোর জন্য একজনের আগে আরেকজন নামার চেষ্টা করল না। যারা খুব বেশি ভয় পেয়েছিল সবাই মিলে তাদেরকেই আগে নামিয়ে দিল। প্রথম প্রথম সবাই মিলে শাড়িটা ধরে রেখে খুব সাবধানে একেকজনকে নামাচ্ছিল, আস্তে আস্তে তাদের সাহস বাড়তে থাকে। শাড়িটাকে গ্রিলের সাথে দুইবার প্যাচিয়ে নেবার পর একজনই একজনকে নামাতে পারছিল। শাড়িটাকে একটুখানি ঢিলে দিলে মানুষটা নামতে থাকে, আবার টেনে ধরলেই আটকে যায়। হঠাৎ করে কেউ হাত পিছলে পড়ে যাবে তার ভয় নেই। নিচে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা ধরে ফেলবে।

মাঝে মাঝে হঠাৎ একজন বের হয়ে যায় যে আতঙ্কে নড়ার সাহস পায় না। তখন চিৎকার করে, ঠেলে, জোর করে তাকে শাড়িটার ফঁসে বসিয়ে নিচে নামাতে হয়। নিচে অনেক মানুষ দুই হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেছে মোটামুটি কাছাকাছি এলে কিছুটা উপর থেকেই খুব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়া যাচ্ছে, যারা নিচে আছে তারা সবাই মিলে তখন তাকে ধরে ফেলছে।

যখন বেশির ভাগ মেয়ে নেমে গিয়েছে তখন হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করল, যে সবচেয়ে শেষে নামবে তারে কে নামাবে?

বিজলী বলল, তার নিজে নিজে নামতে হবে।

নিজে নিজে? নিজে নিজে কীভাবে নামবে?

শাড়িটা গ্রিলের সাথে বেন্ধে সেটা ধরে পিছলে পিছলে নামবে।

সব্বোনাশ! যদি হাত ছুটে যায়?

বিজলী বলল, ছুটবে না। আমি নাম সবার শেষে।

বিল্ডিংটাতে তখন আগুন অনেকখানি ছড়িয়ে গেছে। সিঁড়ির দরজার নিচ দিয়ে ধোঁয়া এসে পুরো ঘরটা ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে। সবাই খক খক করে কাশছে। এতক্ষণ ইলেকট্রিসিটির আলো ছিল, হঠাৎ করে আলোটা নিভু নিভু হয়ে ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল। দরজার নিচ দিয়ে আগুনের আভা ছাড়া আর কোনো আলো নেই। পুরো ঘরটা ভয়ংকর গরম, সবাই দরদর করে ঘামছে। ধোঁয়ায় একেকজনের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।

ধীরে ধীরে প্রায় সবাই নেমে গেছে, শুধু বিজলী আর একটি মেয়ে বাকি, তখন হঠাৎ করে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের মতো শব্দ করে সিঁড়ির দরজাটা খুলে সারা ঘরে আগুন ছড়িয়ে পড়ল। ঘরের ভেতর দাউ দাউ আগুন, তার প্রচণ্ড তাপে বিজলীর সমস্ত শরীর যেন ঝলসে গেল।

বিজলী চিৎকার করে বলল, আর দেরি করা যাবে না। এখনই শাড়ি ধরে নামতে হবে।

বিজলী আর মেয়েটি মিলে তাড়াতাড়ি শাড়িটা গ্রিলের সাথে শক্ত করে বেঁধে নিল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে গিটটা পরীক্ষা করে প্রথমে অন্য মেয়েটি শাড়িটা ধরে ঝুলে পড়ে। আগুনের ফুলকি ছুটে আসছে, প্রচণ্ড তাপে সে মনে হয় প্রায় ঝলসে গেল! বিজলী দেখল অন্য মেয়েটি সর সর করে নেমে যাচ্ছে। মেয়েটি একেবারে নিচে পৌঁছানো পর্যন্ত বিজলী অপেক্ষা করল না। তার আগেই সে শাড়িটা ধরে নামতে শুরু করে। একসাথে দুজনের ওজন শাড়িটা সহ্য করতে পারবে কি না বিজলী জানে না কিন্তু এখন সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। বিজলী কাপড়টা ধরে প্রায় পিছলে নিচে নামতে থাকে, মনে হয় হাতের তালুর ছাল উঠে গেল, কিন্তু সে শাড়িটা ছাড়ল না। বিজলী এত তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এল যে সে নিচের মেয়েটিকে ধরে ফেলল, তার পায়ের ধাক্কায় মেয়েটির হাত ছুটে যায়, মেয়েটি ভয়ে চিৎকার করে ওঠে কিন্তু ততক্ষণে সে প্রায় নিচে নেমে এসেছে। নিচে যারা ছিল তারা মেয়েটিকে ধরে ফেলল। বিজলী দুই হাত দিয়ে কাপড়টা ধরে ঝুলতে থাকে। বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে আগুনের ফুলকি নিচে এসে পড়ছে, যারা নিচে ছিল তারা ভয় পেয়ে সরে যেতে থাকে। বিজলী তখনো ঝুলে আছে, দুই পা দিয়ে শাড়িটা ধরে রাখার চেষ্টা করল, তারপর আবার পিছলে নিচে নেমে এল। উপর থেকে আবার বিস্ফোরণের একটা শব্দ এল এবং তখন দাউ দাউ করে পুরো চারতলাটি জ্বলতে শুরু করল। বিজলী এবারে তার হাতটি ছেড়ে দিয়ে বেশ উপর থেকে নিচে এসে পড়ল।

কে যেন জিজ্ঞেস কলল, সবাই নেমেছে?

আরেকজন উত্তর দিল, হ্যাঁ।

আরেকজন বলল, খোদা মেহেরবান।

চিৎকার-চেঁচামেচিতে এরপর আর কারো কথা বোঝা গেল না।

.

ঠিক তখন জ্বলন্ত বিল্ডিংয়ের পাশে একটা সাদা মার্সিডিজ গাড়ি এসে থেমেছে। গাড়ি থেকে আয়েশা গার্মেন্টসের মালিক রায়হান সিদ্দিকী কোনোভাবে নেমে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে জ্বলন্ত বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। একজন মানুষ তার কাছে ছুটে এসে কাঁপা গলায় বলল, স্যার শেষ হয়ে গেল। সব শেষ হয়ে গেল।

ভেতরে কয়জন ছিল?

একজনও নাই স্যার।

রায়হান সিদ্দিকী আর্তনাদ করে উঠল, একজনও নাই? সবাই মারা গেছে?

মানুষটা বলল, না না স্যার! আমি সেটা বলি নাই। আমি বলেছি ভেতরে একজনও নাই। সবাই বের হয়ে আসছে। একজনও মারা যায় নাই স্যার।

রায়হান সিদ্দিকী অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল, জিজ্ঞেস করল, সবাই বের হতে পেরেছে? সবাই?

জি স্যার সবাই। উপর থেকে শাড়ি ঝুলিয়ে—

সবাই? সবাই বেঁচে আছে? সবাই?

জি স্যার সবাই।

একজনও মারা যায় নাই?

না স্যার। একজনও মারা যায় নাই।

রায়হান সিদ্দিকী তার দামি স্যুট পরা অবস্থাতেই নোংরা ফুটপাথে বসে পড়ল। একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর দুই হাতে নিজের মাথাটা ধরে বিড়বিড় করে বলল, থ্যাংক ইউ খোদা। থ্যাংক ইউ।

.

পরদিন ভোরবেলা বিজলী গিয়ে কয়েকটা খবরের কাগজ কিনে এনেছে। সব পত্রিকায় গত রাতে আয়েশা গার্মেন্টস পুড়ে যাওয়ার খবর ছাপা হয়েছে। বিজলী যখন তার মেসের মেয়েদের খবরের কাগজ থেকে খবরটা পড়ে শোনাচ্ছে তখন নিচ থেকে দারোয়ান এসে খবর দিল একজন মানুষ বিজলীকে খুঁজছে।

বিজলী একটু অবাক হয়ে নিচে নেমে এসে দেখল তাদের মেসের সামনের সরু গলিটাতে একটা বড় সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বিজলীকে দেখে গাড়ি থেকে একজন বয়স্ক মানুষ বের হয়ে এল। বিজলীকে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম বিজলী? তুমি আয়েশা গার্মেন্টসে কাজ করো?

বিজলী মাথা নাড়ল। মানুষটা বলল, আমি আয়েশা গার্মেন্টসের মালিক, আমার নাম রায়হান সিদ্দিকী।

বিজলী হাত তুলে সালাম দিল। আয়েশা গার্মেন্টসের সবাই রায়হান সিদ্দিকীর নাম শুনেছে, কেউ তাকে আগে দেখেনি। রায়হান সিদ্দিকী কিছুক্ষণ বিজলীর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি এত ছোট একটা মেয়ে আমার ফ্যাক্টরির সবগুলো মেয়ের জান বাঁচিয়েছ?

বিজলী কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। রায়হান সিদ্দিকী বলল, আমি যে তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না।

বিজলী এবারেও কোনো কথা বলল না।

রায়হান সিদ্দিকী বলল, আমি মায়ের নামে এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিটা দিয়েছি। যদি গত রাতে সেখানে কেউ পুড়ে মারা যেত তাহলে আমার মায়ের নামটিতে একটা অভিশাপ পড়ে যেত। আমি তাহলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারতাম না। তোমার জন্যে আমি আমার মায়ের সম্মানটা বাঁচাতে পেরেছি।

বিজলী প্রথমবার কথা বলার চেষ্টা করল, বলল, কিন্তু আপনার তো অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে গেল–

রায়হান সিদ্দিকী হাত দিয়ে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলল, টাকা কোনো ব্যাপার না। টাকা আসে যায়। এইবার গিয়েছে আরেকবার আসবে। মানুষের প্রাণ গেলে আর আসবে না। যাই হোক মা, আমি এই সকালে তোমার কাছে এসেছি বলার জন্যে যে তোমার এই ঋণ আমি শোধ করতে পারব না। তবু যদি কিছু একটা পারি তাহলে চেষ্টা করব। বলো তোমাকে আমি কী দিতে পারি।

বিজলী বলল, আমার কিছু লাগবে না।

সেটা তো হতে পারে না, বলো কিছু একটা।

কিছু লাগবে না।

রায়হান সিদ্দিকী বলল, কী বলছ কিছু লাগবে না। তোমার বয়সে, আমার কত কী শখ ছিল! কিছু একটা বলো।

বিজলী লাজুক মুখে বলল, বলব?

হ্যাঁ, বলো।

যখন আবার ফ্যাক্টরি চালু হবে তখন কি আমি দুই ঘণ্টা পরে কাজে আসতে পারি? বিকেলবেলা আমি বাড়তি দুই ঘণ্টা কাজ করে দিব–

রায়হান সিদ্দিকী চোখ বড় বড় করে বিজলীর কথা শুনল তারপর হঠাৎ হা হা করে হাসতে শুরু করল।

বিজলী অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, রায়হান সিদ্দিকী কেন হাসছে সে বুঝতে পারল না। রায়হান সিদ্দিকী একসময় হাসি থামিয়ে বলল, তুমি যখন খুশি কাজে এসো আর যখন খুশি চলে যেয়ো। তোমাকে কেউ কিছু বলবে না! তোমাকে আমি আমার আয়েশা গার্মেন্টসের এম্বাসাডার বানিয়ে দেব। তুমি ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবে। পারবে না?

বিজলী কী বলবে বুঝতে না পেরে লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে রইল। কিন্তু সে যেটা চেয়েছিল সেটা সে পেয়ে গেছে। সে আবার খোকনকে খোঁজা শুরু করতে পারবে।

.

পরদিন থেকে বিজলী আবার খোকনের খোঁজে স্কুলে স্কুলে যেতে শুরু করল।

*

আয়েশা গার্মেন্টস দুই মাসের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যারা এখানে কাজ করে তারা মহাখুশি, কারণ ঘোষণা করা হয়েছে এই দুই মাস সবাইকে বেতন দেওয়া হবে। কেউ এরকম কিছু জন্মেও শোনেনি যে কাজ না করেও কেউ বেতন পেতে পারে। অনেকেই এটা বিশ্বাসই করতে পারছে না, গোপনে বলাবলি করছে এটা আসলে সবাইকে ছাঁটাই করার ফন্দি!

যেহেতু দুই মাসের ছুটি, সবাই বাড়ি চলে গেল–এখন বিজলী পুরো মেসে একা। সেটা নিয়ে তার নিজের কোনো সমস্যা নেই। সে প্রায় এক বছর সময় রাস্তায় কাটিয়েছে, তার জন্যে একটা মেসে একা থাকা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু দেখা গেল একদিন একজন মানুষ তাকে নিতে চলে এসেছে। বিজলী অবাক হয়ে বলল, কোনখানে যেতে হবে আমাকে?

স্যার আপনার জন্য একটা অ্যাপার্টমেন্ট রেডি করেছেন।

বিজলীকে এর আগে কেউ কখনো আপনি করে বলেনি। এই প্রথম। সে জিজ্ঞেস করল, কোন স্যার?

রায়হান সিদ্দিকী স্যার।

আমার জন্য?

হ্যাঁ।

বিজলী অবাক হয়ে বললেন, কেন?

আপনি এখানে একা আছেন শুনে স্যার একটু দুশ্চিন্তা করছেন।

আমি এইখানে একলা আছি স্যার সেইটা কেমনে জানলেন?

মানুষটা হাসল, বলল, স্যার সব সময় আপনার খোঁজ রাখেন। আপনাকে স্যার খুব স্নেহ করেন।

বিজলী কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণ মানুষটার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে আসলেই যাইতে হবে?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে। তাহলে আপনি একটু অপেক্ষা করেন, আমি আমার জিনিসগুলা গুছায়ে নেই।

মানুষটা বলল, ঠিক আছে। কিন্তু কিছু না নিলেও কোনো সমস্যা হবে না।

কিছু না নিলেও সমস্যা হবে না?

না।

বিজলী তারপরেও তার কিছু জিনিসপত্র একটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে নিল। নিচে খুব সুন্দর একটা গাড়ি অপেক্ষা করছে। মানুষটা তাকে গাড়িতে তুলে নিল, ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?

মানুষটা তাকে একটা ঠিকানা বলে দিল।

রাস্তায় অনেক ভিড় তাই তাদের পৌঁছাতে ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেল। বড় রাস্তা থেকে ছোট রাস্তা হয়ে একটা ছিমছাম রাস্তাতে তাদের গাড়ি থেমে গেল। বিজলী মানুষটার সাথে রাস্তার পাশে একটা বিল্ডিংয়ের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান মানুষটাকে একটা লম্বা সালাম দিল।

মানুষটা বিজলীকে নিয়ে একটা লিফটে করে পাঁচ-তলায় উঠে এল। বিজলী এই প্রথমবার একটা লিফটে উঠেছে, ছোট একটা লোহার ঘর মানুষজনকে নিয়ে উপরে উঠে যায়, নিচে নেমে আসে, কী আশ্চর্য!

লিফট থেকে নেমে পকেট থেকে একটা চাবি বের করে মানুষটা ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে চাবিটা বিজলীর হাতে দিয়ে বলল, এই যে এইটা আপনার চাবি। এইটা আপনার অ্যাপার্টমেন্ট।

বিজলী মাথা ঘুরিয়ে অ্যাপার্টমেন্টটা দেখল। এক বেডরুমের ছোট একটা অ্যাপার্টমেন্ট। এক পাশে একটা কিচেন। দুটি বাথরুম। সামনে এক চিলতে বারান্দা। এতদিন সে তিনজন মেয়ের সাথে একটা ঘরে থেকে এসেছে, এখন থেকে তার নিজের জন্যে আস্তো একটা অ্যাপার্টমেন্ট?

বিজলী ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, এইটার ভাড়া কত?

মানুষটা হাসল। বলল, এটা স্যারের বিল্ডিং। স্যারের স্টাফরা এখানে থাকে। এটায় কোনো ভাড়া নাই।

আ—আ–আমার ভাড়া দিতে হবে না?

না। মানুষটা হাসল। বলল, আমি ভেবেছিলাম ফার্নিচার ফ্রিজ এই সব কিনে দিই, স্যার না করলেন। স্যার বললেন এগুলো আপনি আপনার পছন্দমতো কিনে নেবেন। নিজে নিজে কিনতে নাকি বেশি মজা!

বিজলী কোনো কথা বলল না, অবাক হয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। সে নিজে নিজে ফার্নিচার ফ্রিজ কিনবে? ফ্রিজ কী সে জানে না। কখনো দেখেনি। ভেতরে খাবার ঠান্ডা থাকে বলে শুনেছে। সেই ফ্রিজ সে নিজে কিনে ফেলবে?

মানুষটা বলল, আমি এখন যাই। তারপর পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বিজলীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এইটা আমার কার্ড। কোনো কিছু লাগলে আমাকে ফোন করবেন।

তারপর একটু এগিয়ে রান্নাঘরের কেবিনেটের একটা ড্রয়ার খুলে ভেতরে দেখিয়ে বলল, এইখানে কিছু টাকা আছে, আপনার কেনাকাটার জন্যে। আর একটা মোবাইল ফোন। সিমে আমার নাম্বারটা ঢোকানো আছে। আফজাল হোসেন নামে। যেকোনো দরকারে আপনি আমাকে ফোন করবেন। স্যার আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন আপনাকে দেখেশুনে রাখার জন্য।

বিজলী অনেকক্ষণ থেকে যে কথাটা বলতে চাইছিল সেটা শেষ পর্যন্ত বলে ফেলল, আমারে আপনি করে বলছেন কেন? আমি তো অনেক ছোট–

মানুষটি হাসল, বলল, হ্যাঁ আমারও খুব কষ্ট করে আপনি বলতে হচ্ছে। কিন্তু স্যার আপনাকে খুব স্নেহ করেন, সেই জন্যে আপনি বলছি। তুমি যদি অনুমতি দাও তাহলে আমি তুমি করে বলতে পারি।

বিজলী বলল, জি জি আফজাল চাচা আপনি আমারে তুমি করে বলবেন।

মানুষটা বলল, হ্যাঁ, বলব মা। তুমি আমার মেয়ের বয়সী। তারপর বিজলীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুমি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করো না। স্যার আমাকে বলেছেন তোমাকে দেখেশুনে রাখতে। স্যার না বললেও আমি তোমাকে দেখেশুনে রাখতাম।

মানুষটা চলে যাবার পর বিজলী অনেকক্ষণ বারান্দায় একা একা দাঁড়িয়ে রইল। কী কারণ কে জানে তার চোখে একটু পরে পরে পানি চলে আসছিল। খোকনকে যখন খুঁজে পাবে তখন তাকে নিয়ে সে ফার্নিচার আর ফ্রিজ কিনবে। খোকনের যা যা পছন্দ সবকিছু কিনবে। ড্রয়ারে টাকার বান্ডিলটা অনেক বড়। তার গুনে দেখতেও ভয় করছে।

.

বিজলী পরের দিন ভোর থেকেই খোকনকে খুঁজতে শুরু করে দিল। একটা স্কুলে ছেলেমেয়েরা আসা শুরু করার আগেই সে সেই স্কুলের বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়, তারপর যে ছেলেমেয়েরা স্কুলে আসে দূর থেকে তাদের তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। দুই বছর আগে খোকন তার থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এই দুই বছরে খোকন নিশ্চয়ই বড় হয়েছে, কত বড় হয়েছে কে জানে। চেহারা তো নিশ্চয়ই আগের মতো আছে, বড় হওয়ার জন্যে একটুখানি বদলাতে পারে কিন্তু খুব বেশি নিশ্চয়ই বদলাবে না। তার চিনতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না।

.

বিজলী পুরো এক মাস প্রত্যেক দিন সকালবেলা এক একটা স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে রইল। তখন ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল এইভাবে খোনকে খুঁজে বের করা খুবই কঠিন, বলা যেতে পারে প্রায় অসম্ভব। শহরে একটি-দুটি স্কুল নেই, একেবারে হাজার হাজার স্কুল। প্রত্যেকটা স্কুলে একদিন করে গেলেও পাঁচ-ছয় বছর লেগে যাবে। স্কুলের সময় যখন সব বাচ্চা এসে হাজির হয় তখন একটা সময় এক সাথে অনেক বাচ্চা হুড়মুড় করে ঢুকতে থাকে। সব বাচ্চাকে তখন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাও যায় না। কাজেই যে স্কুলে খোকন লেখাপড়া করে সেই স্কুলে গিয়েও তাকে খুঁজে নাও পেতে পারে। কিংবা সত্যি সত্যি হয়তো বিজলী ঠিক স্কুলে হাজির হয়েছে কিন্তু সেদিন খোকন আসেনি, তাহলেও তাকে আর জীবনেও খুঁজে পাবে না।

স্কুল শুরু হওয়ার সময় সে ঘণ্টাখানেক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, প্রত্যেকটা ছেলেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। যখন সব বাচ্চা ভেতরে ঢুকে যায় তখন সে একা একা পথেঘাটে ঘুরে বেড়ায়, খোকনকে কীভাবে খুঁজে বের করবে চিন্তা করে। অনেক চিন্তা করে বিজলী একসময় বুঝতে পারল সে নিজে নিজে এভাবে আসলে খোকনকে খুঁজে বের করতে পারবে না। তাকে বড় মানুষদের সাহায্য নিতে হবে। এখন পর্যন্ত কাউকে সে খোকনের কথা বলেনি। কেন বলেনি সে নিজেও জানে না। এখন সে অন্যদের খোকনের কথা বলবে। প্রথমে বলবে আফজাল চাচাকে। আফজাল চাচা মানুষটা খুব ভালো, বিজলীকে একেবারে নিজের মেয়ের মতো আদর করেন। আফজাল চাচা দরকার হলে আয়েশা গার্মেন্টসের মালিক রায়হান সিদ্দিকীর সাথে কথা বলবেন। তারা নিশ্চয়ই সেলিনা জাহানকে খুঁজে বের করতে পারবে। তখন সেলিনা জাহানকে নিয়ে যেতে হবে হ্যাপি চাইল্ডে। সেখানে সেই রাক্ষুসী নাজনীনের সাথে দেখা করে তার কাছ থেকে খোকনের ঠিকানা নিতে হবে। সে নিজে যখন খোকনের ঠিকানা জানতে চেয়েছিল তাকে ঠিকানাটা বলেনি। কিন্তু যখন বড় বড় মানুষ নাজনীনের কাছে খোকনের ঠিকানা জানতে চাইবে তখন সে আর না বলতে পারবে না। খোকনের ঠিকানা দিতেই হবে।

বিজলী পথে পথে ঘুরতে ঘুরতে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গেল। দোকানটিতে নানা রকম শার্ট ঝুলছে। কী সুন্দর শার্ট, এরকম একটা শার্টে খোকনকে কী সুন্দর মানাবে! বিজলী দাঁড়িয়ে গেল, অনেক দরদাম করে সে শার্টটা কিনে নিল। যখনই বাইরে যায় তখনই সে খোকনের জন্যে কিছু কিনে ফেলে। শার্ট, প্যান্ট, জুতো, বই, খাতা, কলম এমনকি একটা ফুটবলও কিনে রেখেছে। খোকন কোথায় ফুটবল খেলবে সেটা অবশ্যি বিজলী জানে না কিন্তু সেটা নিয়ে সে মাথা ঘামায় না। বিজলীর মনে আছে তারা যখন চরে ছিল তখন বাচ্চারা সবাই মিলে জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলত! খোকনকে আর জাম্বুরা দিয়ে ফুটবল খেলতে হবে না। সত্যিকারের ফুটবল দিয়ে সে খেলতে পারবে।

আফজাল সাহেবকে খোকনের কথা বলতে গিয়েও বিজলী বলতে পারে না, ঠিক কেন সে বলতে পারে না, সে নিজেও জানে না। আগে হোক পরে হোক তার বলতে হবে, যে কয়দিন বলছে না সে কয়দিন তখনো সে স্কুলে স্কুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বিজলীকে অবশ্যি আফজাল সাহেবকে কিছু বলতে হলো না, কারণ দুই দিন পর সে নিজেই খোকনের দেখা পেয়ে গেল।

.

স্কুলটা শহরের সবচেয়ে ভালো একটা স্কুল, যারা এখানে পড়তে আসে সবাই গাড়িতে করে আসে। স্কুল শুরুর সময়টাতে পুরো এলাকাতে একটা ট্রাফিক জ্যাম লেগে যায়। বিজলী গেটের কাছে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ছিল। গেটের দারোয়ান মাঝে মাঝেই তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে, আগে হলে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত এখন সে ভালো কাপড় পরে থাকে, মুখটা শক্ত করে রাখে, তাই তাড়িয়ে দিতে সাহস পায় না।

স্কুলের বাচ্চাদের ভিড় যখন সবচেয়ে বেশি তখন একটা নীল রঙের গাড়ি থামল। গাড়ির পেছনের দরজা খুলে একটা ছেলে বের হলো, ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে ড্রাইভারকে কিছু একটা বলল, তারপর ব্যাকপেকটা পেছনে ঝুলিয়ে ঘুরে দাঁড়াল এবং তাকে দেখে বিজলী একটা চাপা আর্তনাদ করল। ছেলেটি খোকন।

.

খোকন একটুখানি বড় হয়েছে, কিন্তু তার চেহারা ঠিক আগের মতো আছে। গায়ের রং হয়তো আগের থেকে একটুখানি ফর্সা হয়েছে, স্বাস্থ্যটাও হয়তো একটুখানি ভালো হয়েছে কিন্তু এ ছাড়া সবকিছু আগের মতো। বিজলীর মনে হলো সে বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, কোনোমতে দেয়ালটা ধরে সে হাঁ করে খোকনের দিকে তাকিয়ে রইল। একবার মনে হলো সে চিৎকার করে থোকনের দিকে ছুটে গিয়ে তাকে বুকের মাঝে জাপটে ধরে। কিন্তু সে ছুটে গেল না, তাকে গিয়ে জাপটে ধরল না। খোকন যতক্ষণ পর্যন্ত গেটের ভেতরে ঢুকে না গেল ততক্ষণ বিজলী দাঁড়িয়ে রইল। ভেতরে ঢুকে যাবার পর সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকে, কোনদিকে হাঁটছে সে নিজেই জানে না। সে এখনো ভালো করে কিছু চিন্তা করতে পারছে না, এখনো কেমন জানি একটা ঘোরের মাঝে রয়েছে।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সে দেখল খোকনের নীল গাড়িটা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে, ট্রাফিক জ্যামের জন্যে বেরিয়ে যেতে পারছে না। বিজলী একটু এগিয়ে গাড়ির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ড্রাইভার চাচা, খোকনের স্কুল ছুটি হবে কখন?

ড্রাইভার অবাক হয়ে গেল, উত্তর না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

আমি বিজলী।

বিজলী ভেবেছিল তার নামটা বলামাত্র ড্রাইভার তাকে চিনে ফেলবে। খোকন নিশ্চয়ই অনেকবার তার কথা সবাইকে বলেছে। সবাই নিশ্চয়ই এত দিনে তার নাম জেনে গেছে। কিন্তু ড্রাইভার তাকে চিনল না। জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কী করো?

বিজলী হঠাৎ করে বুঝতে পারল এই ড্রাইভার তার নাম শোনেনি। এই ড্রাইভার জানে না খোকন তার আপন ভাই এবং অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত সে খোকনকে খুঁজে পেয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী এখন হঠাৎ করে যদি জানে সে বিজলী, খোকনের আপন বোন তখন এই ড্রাইভার মানুষটা ঘাবড়ে যেতে পারে। তাই তাকে এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। ড্রাইভার আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কী করো?

আমি একটা গার্মেন্টসে কাজ করি। আয়েশা গার্মেন্টস।

ড্রাইভার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, যেখানে আগুন লেগেছিল?

হ্যাঁ। বিজলী মাথা নাড়ল, আমি তখন ভেতরে ছিলাম।

ড্রাইভার এতক্ষণ আস্তে আস্তে গাড়ি চালিয়ে আসছে, এবারে সামনে ফাঁকা, প্যাডেলে চাপ দিয়ে বের হয়ে যাবে। বিজলী জিজ্ঞেস করল, কখন ছুটি হবে খোকনের স্কুল?

এই তো ছুটির সময় বারোটা। কিন্তু তুমি কেন জানতে চাইছ?

বিজলী হাসল, বলল, আমার একটা কাজ আছে। আপনি আবার খোকনকে নিতে আসবেন না?

হ্যাঁ।

তখন দেখবেন।

ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে চলে গেল। বিজলী কিছুক্ষণ গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল। এখন সকাল আটটা। বারোটা বাজতে আরো চার ঘণ্টা বাকি। তাকে এখন চার ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। এই চার ঘণ্টা সময় সে কেমন করে কাটাবে?

বিজলী ফুটপাথ ধরে হাঁটতে থাকে। খোকন তাকে দেখে কী করবে? চিৎকার করে তাকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চয়ই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকবে। নিশ্চয়ই কাঁদতে কাঁদতে বলবে, বিজলীবু তুমি বলেছিলে, তুমি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না। তুমি কেন তাহলে চলে গেলে।

তখন সে খোকনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলবে, এই তো আমি আবার চলে এসেছি! তোকে খুঁজে খুঁজে বের করেছি! বের করেছি কি না?

আসলে সে মনে হয় কিছু বলতে পারবে না। খোকনকে জড়িয়ে ধরে সেও নিশ্চয়ই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকবে। রাস্তা দিয়ে যারা যাবে-আসবে তারা নিশ্চয়ই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকবে। তারা কী ভাববে কে জানে। যা ইচ্ছে ভাবুক, এতদিন পর সে তার নিজের ভাইকে খুঁজে পেয়েছে, সে তার ভাইয়ের সাথে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে। কার তাতে কী আসে যায়?

বিজলী পথে পথে ঘুরে বেড়াল, খোকনের জন্যে একটা চকলেট কিনল। যখন কান্নাকাটি থামবে তখন সে এটা খোনকে খেতে দেবে। অনেক দামি বিদেশী চকলেট, খোকন নিশ্চয়ই পছন্দ করবে।

বারোটার অনেক আগেই বিজলী স্কুলের সামনে পৌঁছে গেল। স্কুল ছুটির পর বাচ্চাদের নিতে গাড়িগুলো এখনো আসতে শুরু করেনি। বিজলী গেটের কাছাকাছি দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজনায় তার বুকটা ধুকপুক করছে। খোকন আসলেই কি চিৎকার দিয়ে তার দিকে ছুটে আসবে? নাকি এতদিন পর দেখা হয়েছে বলে একটুখানি লজ্জা পাবে? দুই বছরে তার নিজের চেহারা কি অনেক পাল্টে গেছে? তাকে দেখে যদি না চেনে? বিজলী জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিল, যতই তার চেহারা পাল্টে গিয়ে থাকুক, তাকে চিনবে না এটা হতেই পারে না! সে একেবারে এইটুকুন থেকে খোকনকে বুকে ধরে বড় করেছে।

খোকন তাকিয়ে দেখল একটি একটি করে গাড়ি এসে থামছে এবং একটু পরে খোকনের নীল গাড়িটাও এসে থামল। বিজলী গাড়িটার দিকে এগিয়ে যায় এবং তখন লক্ষ করল পেছনের সিটে একজন মহিলা বসে আছে। মহিলাটি মিলি, বিজলী তাকে কখনো দেখেনি। মিলিকে দেখে বিজলী হঠাৎ করে বুঝতে পারল তার খোকন এখন আর পুরোপুরি তার নেই। সে যেরকম আদর করে খোকনকে বড় করেছে এখন অন্য একজন মহিলাও খোকনকে আদর করে বড় করছে। হঠাৎ করে বিজলীর বুকটা কেমন জানি ধ্বক করে ওঠে।

পেছনের সিটে বসে থাকা মিলি গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এল এবং গাড়ির ড্রাইভারও অন্য পাশ থেকে বের হয়ে তার পাশে এসে দাঁড়াল। ড্রাইভার ইদ্রিস মিয়া বাসায় গিয়ে মিলিকে বিজলীর কথা বলেছে, একজন অচেনা মেয়ে খোকনের খোঁজখবর নিচ্ছে শুনে মিলি নিজেই চলে এসেছে। মিলি দেখতে চায় কে খোকনের খোঁজ করেছে। কেন খোঁজ করেছে।

বিজলী গাড়িটার দিকে এগিয়ে গেল, মিলির কাছাকাছি পৌঁছানোর পর ড্রাইভার ইদ্রিস মিয়া বলল, ম্যাডাম, এই যে, এই মেয়েটা খোকনের খোঁজ নিচ্ছিল।

মিলি বিজলীকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখল, তারপর জিজ্ঞেস করল, তুমি খোকনের খোঁজ নিচ্ছিলে কেন?

বিজলী বলল, আমি বিজলী। খোকন আমার ছোট ভাই।

মিলি ভয়ানকভাবে চমকে উঠল, কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারল না। নিজেকে সামলে নিতে তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল, তারপর বিজলীর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল, তোমার নিশ্চয়ই কোনো ভুল হয়েছে। খোকনের কোনো বোন নেই।

বিজলী হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, কাঁপা গলায় বলল, আছে। এই যে আমি। আমি খোকনের বোন। খোকন কখনো আপনাদের কাছে আমার কথা বলে নাই?

না। মিলি মাথা নাড়ল, খোকন কখনো তোমার কথা বলে নাই। সে কখনো বলে নাই যে তার অন্য কোনো ভাইবোন আছে।

বিজলী অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য!

এর মাঝে আশ্চর্যের কিছু নেই। তুমি কিছু একটা ভুল করেছ। তুমি যে খোকনের কথা বলছ নিশ্চয়ই এই খোকন সেই খোকন নয়। অন্য কোনো খোকন।

না। বিজলী শুকনো গলায় বলল, আমি অনেকদিন থেকে খোকনকে খুঁজছি। খুঁজতে খুঁজতে শেষ পর্যন্ত আজকে খোকনকে পেয়েছি। খোকনকে আমি চিনি, আমি তাকে বড় করেছি।

মিলি একটু হাসার চেষ্টা করল, বলল, তুমি এত ছোট একটা মেয়ে তুমি কেমন করে খোকনকে বড় করবে? তোমার কিছু একটা ভুল হয়েছে। আমি খুব ভালো করে জানি খোকনের কোনো ভাইবোন নেই।

বিজলী কেমন যেন অসহায় অনুভব করে। কী বলবে বুঝতে পারে না, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, ঠিক আছে। খোকন আসুক–সে আমাকে দেখলে চিনবে।

না। মিলি মাথা নাড়ল, বলল, আমি চাই না তুমি খোকনকে কিছু বলো। আমরা জানি এবং খোকন জানে তার কেউ নেই। মা বাবা, ভাই-বোন কেউ নেই। এখন হঠাৎ করে তুমি যদি তাকে বোঝাতে শুরু করো যে তুমি তার বোন, সেটা মোটেও ভালো হবে না। আমি তোমাকে সেরকম কিছু করতে দেব না। তুমি যাও।

বিজলীর মাথাটা ঘুরে উঠল, এত কষ্ট করে সে খোকনকে খুঁজে বের করেছে এখন তার সাথে সে একবার কথাও বলতে পারবে না? হঠাৎ করে বিজলীর শরীরটা শক্ত হয়ে ওঠে, সে কঠিন গলায় বলল, আমি যাব না। আমি আমার ভাইয়ের সাথে কথা বলব।

ঠিক তখন স্কুলের ভেতর ছুটির ঘণ্টা পড়ল এবং স্কুলের ছেলেমেয়েরা চিৎকার করতে করতে গেট দিয়ে বের হতে থাকল। বিজলী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, তীক্ষ্ণ চোখে গেটের দিকে তাকিয়ে রইল।

হঠাৎ করে খোকনকে দেখা গেল, সে এদিক-সেদিক তাকাল, তার নীল গাড়িটা চোখে পড়ল, তখন রাস্তা পার হয়ে খোকন গাড়িটার দিকে ছুটে আসতে থাকল। বিজলীও ছুটে গেল, খোকনকে মাঝপথে

আটকে সে চিৎকার করে ডাকল, খোকন!

খোকন ঘুরে তাকালো, বিজলীকে এক নজর দেখল, তাকে চিনতে পারল না। বিজলীকে পাশ কাটিয়ে সে তার মায়ের দিকে ছুটে যেতে থাকে। বিজলী হকচকিত হয়ে খোকনের পিছু পিছু ছুটে যেতে যেতে আবার চিৎকার করে ডাকল, খোকন! আমি বিজলী। তোর বিজলীবু।

খোকন আবার বিজলীর দিকে তাকালো, কিন্তু তাকে এবারেও চিনতে পারল না, তার চোখে-মুখে হঠাৎ একধরনের আতঙ্ক ফুটে ওঠে, সে ছুটে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকিয়ে রইল।

বিজলীর মনে হলো তার চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবীটা বুঝি টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে যাচ্ছে, সে ভাঙা গলায় বলল, খোকন, সোনা, ভাইটি আমার–তুই আমারে চিনতে পারছস না? আমি বিজলী! তোর বিজলীবু?

খোকন মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি তোমাকে চিনি না। তুমি যাও।

বিজলী হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, বলল, খোকন! তুই আমারে চিনতে পারছস না? চিনতে পারছস না?

মিলি খোকনকে নিয়ে টেনে গাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। কঠিন গলায় বিজলীকে বলল, আমি তোমাকে বলেছি মেয়ে। খোকন তোমার ভাই না। তুমি তো দেখছ সে তোমাকে চেনে না। এখন এখানে সিন ক্রিয়েট করো না। তুমি যাও! তারপর ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে বলল, ইদরিস মিয়া গাড়ি চালাও।

বিজলী তখনো হাল ছাড়ল না, ছুটে গিয়ে জানালা দিয়ে গাড়ির ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, খোকন, তোর মনে নাই, তোরে নিয়া সারারাত গাছের উপর বসে থাকলাম? মনে নাই সাইক্লোন এসে আমাদের উড়ায়ে নিচ্ছিল, তুই আর আমি সারারাত গাছ ধইরা ঝুলে রইলাম? তোর মনে নাই বাতাসে গাছের ডাল এসে তোরে আর আমারে চাবুকের মতো মারতে লাগল? মনে নাই?

খোকন কেমন যেন থর থর করে কাঁপতে থাকে, ফিসফিস করে বলল, না, আমার মনে নাই। আমার কিছু মনে নাই। তুমি যাও। প্লিজ। তুমি যাও।

বিজলী ভাঙা গলায় বলল, মনে নাই তুই আর আমি সারাদিন বালুর উপর শুয়ে রইলাম? সেলিনা আপা এসে আমাদের হাসপাতালে নিল? মনে নাই?

খোকন তার মায়ের শরীরে মুখ লাগিয়ে বলল, না, মনে নাই। তুমি যাও। যাও।

মিলি ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে বলল, কী হলো? তুমি গাড়ি ছাড়ছ কেন?

ইদরিস ড্রাইভার বলল, মেয়েটা ভিতরে মাথা ঢুকিয়ে রেখেছে, যেতে পারছি না।

মিলি বিজলীর মাথাটা ধাক্কা দিয়ে বাইরে বের করার চেষ্টা করতে করতে ধমক দিয়ে বলল, কী করছ তুমি? সরে যাও। সরে যাও বলছি।

বিজলী সরে গেল না, চিৎকার করে বলল, খোকন, তোর মনে নাই তুই আর আমি হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম! মনে নাই সমুদ্রের পার দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতাম? মনে নাই তুই একবার বই পুরস্কার পাইলি, ছোটদের মহাপুরুষ? মনে নাই?

খোকন দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে থর থর করে কাঁপতে থাকে। মিলি ধাক্কা দিয়ে বিজলীকে সরিয়ে দিল এবং সাথে সাথে ইদরিস ড্রাইভার প্যাডেলে চাপ দিয়ে গাড়িটা ছুটিয়ে নিতে থাকে। বিজলী গাড়ির জানালা ধরে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে আছড়ে পড়ল এবং সেইভাবে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

কয়েকজন বিজলীর কাছে ছুটে এসে তাকে টেনে তুলে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তোমার? কী হয়েছে মেয়ে?

বিজলীর চারপাশে মানুষের ভিড় জমে যায়। বিজলী মাথা নেড়ে বলল, না, কিছু হয় নাই। আমার কিছু হয় নাই। আপনারা যান। যান আপনারা।

তারপর ভিড় ঠেলে সে বের হয়ে আসে। তার চারপাশের জগত্তা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে? কী করবে সে এখন? কোথায় যাবে? রাস্তা দিয়ে বিশাল একটা দোতলা বাস আসছে? সে কি এখন ছুটে গিয়ে বাসের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়বে? পড়বে ঝাঁপিয়ে?

বিজলী ফুটপাথে বসে পড়ে আকুল হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।

*

বাসায় এসে খোকন কিছু খায়নি। নিজের ঘরে বিছানায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। তার মাথার ভেতরে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। কিছু একটা ঘটছে, কী ঘটছে সে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে বুঝি পাগল হয়ে যাবে।

মিলি খোকনের সামনে কারো সাথে কথা বলেনি। খোকন তার ঘরে ঢুকে যাবার পর প্রথমে রায়হানকে ফোন করে তার সাথে কথা বলেছে। তারপর হ্যাপি চাইল্ডে ফোন করে, নাজনীনের সাথে কথা বলেছে। তাকে জিজ্ঞেস করেছে, আপনি কি জানেন, খোকনের কি বিজলী নামে কোনো বোন আছে?

নাজনীন হঠাৎ কেমন জানি বিপদের গন্ধ পেল, প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, আপনি এটা কেন জিজ্ঞেস করছেন? কে বিজলীর কথা বলেছে?

আজকে খোকনের স্কুলে হঠাৎ একটা মেয়ে এসে হাজির। পনেরো ষোল বছর বয়স। সে বলছে খোকন তার ছোট ভাই?

তাই নাকি? নাজনীন অবাক হবার ভান করল, খোকন কী বলছে?

খোকন মেয়েটিকে চিনতে পারছে না।

নাজনীন বুকের ভেতর আটকে রাখা নিঃশ্বাসটা বের করে দিয়ে বলল, খোকন যদি চিনতে না পারে তাহলে সে কেমন করে তার বোন হতে পারে? এই মেয়ে নিশ্চয়ই কোনো ধরনের ক্রিমিনাল–আপনাদের ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছে। কোনো পাত্তা দেবেন না। থানায় একটা জিডি করে রাখেন।

মিলি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু মেয়েটা এত ইমোশনাল হয়ে গেল, কথাবার্তা এত রিয়েলিস্টিক যে আমার কাছে মনে হচ্ছিল সত্যি বুঝি তার আপন বোন। আমি খুবই আপসেট।

নাজনীন হা হা করে হাসল, বলল, না, না, মোটেও আপসেট হবেন না। আপনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন। খোকনের কোনো ভাইবোন নেই, আপনি চাইলে আমি আমাদের রেকর্ড দেখাতে পারি।

মিলি বলল, না, না। আপনাকে রেকর্ড দেখাতে হবে না। আপনি বললেই আমি বিশ্বাস করব। কিন্তু মেয়েটি এমনভাবে কথা বলছিল যে আমার মনে হচ্ছিল সত্যি বুঝি খোকনের বোন।

না না, মোটেও না। নাজনীন জোর দিয়ে বলল, মোটেও খোকনের বোন না। মেয়েটা নিশ্চয়ই আমাদের শেল্টারে ছিল, খোকনের সাথে পরিচয় করে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছে–এখন আপনাদের সামনে ভাণ করছে সে খোকনের সবকিছু জানে! একধরনের ব্ল্যাকমেইলের চেষ্টা। একেবারে পাত্তা দেবেন না। আপনি বরং আমাকে বলেন মেয়েটা কোথায়। আমি পুলিশকে জানিয়ে রাখতে পারি, পুলিশে আমার পরিচিত মানুষ আছে। দেখামাত্র অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে।

মিলি অন্যমনস্কের মতো বলল, না। অ্যারেস্ট করাতে হবে না। বাচ্চা একটা মেয়েকে অ্যারেস্ট করাব কেন?

.

রায়হান অফিস থেকে আসার পর মিলি আর রায়হান মিলে খোকনকে বিছানা থেকে তোলার চেষ্টা করল কিন্তু খোকন উঠতে রাজি হলো না। বালিশে মাথা গুঁজে শুয়ে রইল। মিলি অবাক হয়ে দেখল একটু পরে পরে তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। মিলি অনেকক্ষণ তার মাথায় শরীরে হাত বুলাতে লাগল কিন্তু খোকন কাঁপতেই থাকল। রাত্রে খোকন কিছু খেলো না।

খোকন অস্থির অনুভব করে। দুপুরবেলা স্কুলে যে মেয়েটাকে দেখেছে কিছুতেই সেই মেয়েটার কথা ভুলতে পারছে না। সে মেয়েটাকে চিনে না, কিন্তু কী আশ্চর্য, তবু তার মনে হচ্ছে সে মেয়েটাকে আগে দেখেছে। মনে হচ্ছে তার খুব কাছাকাছি মেয়ে। মেয়েটা সাইক্লোনের কথা বলছিল, খোকন সত্যি সত্যি মনে করতে পারে সে একটা গাছের ডাল ধরে ঝুলেছিল, সাথে আর কেউ ছিল কি না সেটা তার মনে নেই কিন্তু এখন হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ছে যে তখন আরো কেউ তার সাথে ছিল। বিজলী নামটা খুবই পরিচিত একটা নাম, কিন্তু যতবার এই নামটা মনে করতে চায় ততবারই মনে হয় খুব বড় একটা বিপদ হয়ে যাবে। কেউ একজন কাউকে খুন করে ফেলবে। কে কাকে খুন করবে? কেন খুন করবে?

খোকন কিছু মনে করতে পারে না, অস্থির হয়ে সে ছটফট করতে থাকে।

মিলি অনেক রাত পর্যন্ত খোকনের মাথার কাছে বসে রইল, একসময় মনে হলো খোকন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সে নিঃশব্দে উঠে নিজের বিছানায় শুতে গেল। মিলি একা একা বিছানায় শুয়ে রইল, সে কিছুতেই বিজলী নামের সেই বিচিত্র মেয়েটার কথা ভুলতে পারছিল না। মেয়েটার কথাবার্তার মাঝে কিছু একটা ছিল যেটা চট করে ভুলে যাওয়া যায় না। মিলি বিছানায় ছটফট করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে গেল।

গভীর রাতে মিলির ঘুম ভেঙে যায়। কেউ একজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে ঝট করে বিছানায় উঠে বসে। তারপর বিছানা থেকে নেমে সে দ্রুত পায়ে খোকনের ঘরে গেল। খোকন তার বিছানায় বসে আছে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

মিলি মশারি তুলে ভেতরে ঢুকে খোকনের মাথায় হাত রাখল, নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে বাবা?

খোকন মিলিকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমার সব মনে পড়েছে মা।

কী মনে পড়েছে।

বিজলীবুয়ের কথা।

মিলি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর বলল, বিজলী তোমার বোন?

হ্যাঁ।

তাহলে কোনোদিন বিজলীর কথা বললে না কেন?

ম্যাডাম বলেছিল বিজলীবুয়ের কথা বললে তাকে খুন করে ফেলবে।

কোন ম্যাডাম বলেছিল?

নাজনীন ম্যাডাম। সেই জন্যে আমি এত ভয় পেয়েছিলাম যে কিছু বলি নাই। তারপরে কীভাবে জানি সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম। বিজলীবুয়ের কথা বললেই মাথার ভেতর কেমন যেন উল্টাপাল্টা হয়ে যেত। মনে করতে পারতাম না।

মিলি নিঃশব্দে খোকনের মাথায় হাত বুলাল।

খোকন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বিজলীবুকে নাজনীন ম্যাডাম খুন করতে পারে নাই। বিজলীবু বেঁচে আছে–

হ্যাঁ বেঁচে আছে।

কিন্তু বিজলীবুকে তো আর খুঁজে পাব না। কোনোদিন খুঁজে পাব না! খোকন হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল।

মিলি বলল, কে বলেছে খুঁজে পাব না। একশবার খুঁজে পাব।

খোকন কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকালো, তুমি বিজলীবুকে খুঁজে বের করতে পারবে?

হ্যাঁ।

কখন?

এখন।

এখন?

হ্যাঁ। তুমি জামা কাপড় পর, আমরা এখনই বিজলীকে খুঁজতে বের হব।

মিলি শোয়ার ঘরে গিয়ে রায়হানকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে তুলল। রায়হান অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?

উঠো।

কেন?

বিজলীকে খুঁজে বের করতে হবে?

কাকে?

মিলি বলল, বিজলীকে।

কেন?

খোকনের সবকিছু মনে পড়েছে। বিজলী আসলেই তার বোন।

রায়হান কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। তারপর বলল, কিন্তু এত রাতেই কেন খুঁজে বের করতে হবে?

মিলি ড্রয়ার খুলে তার একটা শাড়ি বের করতে করতে বলল, তার কারণ আমি এই বাচ্চা মেয়েটার উপর অনেক বড় অবিচার করেছি। আমার তাকে খুঁজে বের করে তার হাত ধরে মাফ চাইতে হবে।

রায়হান কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে মিলির দিকে তাকিয়ে রইল। মিলি বলল, ইদরিসকে ফোন করো। ইদরিস জানে মেয়েটা কোন গার্মেন্টসে কাজ করে। সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে। উঠো তাড়াতাড়ি।

রায়হান বিছানা থেকে উঠল।

.

বিজলী ঘরের দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে আছে। অনেক রাত হয়েছে। সে ঘুমাতে পারছে না। ঘুমানোর চেষ্টাও করেনি, চুপচাপ বসে আছে। সে এখন কী করবে? খোকন যদি তাকে চিনতে না পারে তাহলে সে বেঁচে থেকে কী করবে? কী নিয়ে সে বেঁচে থাকবে! দিনের পর দিন সে পথেঘাটে বেঁচে থেকেছে শুধু একদিন খোকনের সাথে দেখা হবে সেই আশায়। এখন যদি সেই আশাটাও না থাকে তাহলে সে বেঁচে থেকে কী করবে?

তার এই ছোট অ্যাপার্টমেন্টটা বড় রাস্তার পাশে। সারাদিন গাড়ি বাস টেম্পোর শব্দ শুনতে পায়। রাত হলে ভারী ট্রাকের গর্জন শুনে। এখন কোনো শব্দ নেই। সবাই তার কাজ শেষ করে ঘুমুতে গেছে। শুধু বিজলীর চোখে ঘুম নেই। সাইক্লোনের রাতে গাছের ডালে বসে সে যেরকম সারারাত ছটফট করেছে, আজকেও সে সেরকম ছটফট করছে। শুধু এখন সাথে খোকন নেই।

বিজলী একটা গাড়ির শব্দ শুনল। মনে হলো তার বিল্ডিংয়ের সামনে গাড়িটা থেমেছে। এত রাতে কে এসেছে? তার মতো আজ রাতে আর কার চোখে ঘুম নেই?

কেউ একজন নিচে দারোয়ানের সাথে কথা বলছে। মনে হলো বিল্ডিংয়ে কয়েকজন এসে ঢুকল। বিজলী সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনতে পেল। পায়ের শব্দ তার দরজার সামনে এসে থেমে গেল। তারপর কেউ একজন তার দরজায় শব্দ করল। টুক টুক টুক।

বিজলী উঠে দাঁড়াল, ঘরের আলো জ্বালিয়ে সে দরজাটি খুলে দিল। বাইরে খোকন দাঁড়িয়ে আছে। তার খোকন। খোকনের হাত ধরে তার নতুন মা। পেছনে মনে হয় আরো কয়েকজন, বিজলী তাদের দেখল না।

খোকনের হাত ধরে রাখা তার নতুন মা নরম গলায় বলল, বিজলী মা। তোমার ছোট ভাইকে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।

বিজলী নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। ঘরের দরজায় আবছা অন্ধকার, খোকনের চেহারাটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। বিজলী তার হাতটা বাড়িয়ে দেয়। খোকন এসে বিজলীর হাতটা ধরল, বিজলী টের পেল খোকন সেই হাতটা শক্ত করে ধরেছে যেন আর কোনোদিন ছুটে না যায়। বিজলী তখন খুব ধীরে ধীরে খোকনকে নিজের কাছে টেনে আনে, তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে। খোকনের মাথার চুলের মাঝে নিজের মুখটা ডুবিয়ে দিয়ে বিজলী ডুকরে কেঁদে উঠল। কতদিন সে এভাবে কাঁদেনি।

মিলি, রায়হান, আফজাল সাহেব, ইদরিস ড্রাইভার এবং বিল্ডিংয়ের দারোয়ান দেখতে পেল দুটি ভাইবোন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে।

কেউ তাদের থামানোর চেষ্টা করল না। কাঁদুক। একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদুক।

যতক্ষণ ইচ্ছা কাঁদুক।

*

দরজা খুলে রায়হান মাথা ঢুকিয়ে বলল, আসতে পারি?

নাজনীন তার ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তাকালো। রায়হানকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আরে! রায়হান সাহেব, কোনো খবর না দিয়ে চলে এসেছেন? আসেন আসেন।

রায়হান ভেতরে ঢুকল, বলল, খবর না দিয়ে এসেছি, কিন্তু খবর না নিয়ে আসিনি। আমার সাথে আরো অনেকে আছে!

নাজনীনকে কেমন জানি ভীত দেখাল। ইতস্তত করে বলল, কোথায়?

আসছে। সবাই আসছে।

প্রথমে খোকনের হাত ধরে মিলি ভেতরে ঢুকল। তারপর বিজলীর হাত ধরে সেলিনা জাহান। তাদের পেছনে আফজাল সাহেব।

নাজনীন সবার দিকে একবার তাকালো এবং মুহূর্তের মাঝে সবকিছু বুঝে গেল।

সেলিনা জাহান একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি সকালের ফ্লাইটে এসেছি, বিকালের ফ্লাইটে চলে যাব।

নাজনীন কিছু বলল না। সেলিনা জাহান জিজ্ঞেস করল, কেন এসেছি জানেন?

নাজনীন দুর্বল গলায় বলল, কিছু একটা মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। ইনফরমেশন গ্যাপ–

সেলিনা জাহান আরো এক পা এগিয়ে এসে বলল, না। কোনো মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়নি। কোনো ইনফরমেশন গ্যাপ নেই। সবকিছু আপনার পরিকল্পনামতো হয়েছিল, শুধু আপনি বিজলীকে চিনতে পারেননি। এই বাচ্চা মেয়েটাকে আপনি আন্ডারএস্টিমেট করেছেন। এই বাচ্চা মেয়েটা সাইক্লোনের রাতে টাইডাল ওয়েভের মাঝে তার ভাইটিকে ধরে রেখেছিল। ছুটে যেতে দেয়নি। কিন্তু আপনি সেই ভাইটিকে ছুটিয়ে আলাদা করে এই মেয়েটাকে পথে বের করে দিয়েছেন। মেয়েটার জীবন ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, মেয়েটা ধ্বংস হয়ে যায়নি। সেলিনা জাহান একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তাই আমরা আপনাকে শুধু একটা কথা বলতে এসেছি।

নাজনীন দুর্বল গলায় বলল, কী কথা?

আপনি আসলে মানুষ না। আপনি রাক্ষুসী। আপনার মানুষের সাথে থাকার কথা না। আপনার অন্য রাক্ষস অন্য রাক্ষুসীর সাথে থাকার কথা। আমি আপনাকে বলতে এসেছি যে আমি সেই ব্যবস্থা করে দেব। খোদার কসম।

নাজনীনের মুখটা কেমন জানি ফ্যাকাসে হয়ে যায়, সে কারো চোখের দিকে তাকাতে পারে না, মাথা নিচু করে ফেলে।

মিলি খোকনের হাত ধরে রেখে বলল, চল, আমরা যাই। এখানে আমি এক সেকেন্ডও থাকতে পারব না।

খোকন বলল, হ্যাঁ। চল।

আমাদের আজকে অনেক প্রোগ্রাম। নতুন বইয়ের দোকানটা আমাদের এখনো দেখা হয়নি, মনে আছে? এসো বিজলী।

যেভাবে সবাই ঢুকেছিল, সবাই সেভাবে বের হয়ে গেল। করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বিজলী দাঁড়িয়ে গেল। সেলিনা জাহান জিজ্ঞেস করল, কী হলো?

এক সেকেন্ড। আমি নাজনীন ম্যাডামকে একটা জিনিস বলে আসি।

সেলিনা বিজলীর হাত ছেড়ে দিল। বিজলী দৌড়ে নাজনীন ম্যাডামের অফিসের দিকে ছুটে যায়।

দরজা খুলে অফিসে ঢুকতেই নাজনীন অবাক হয়ে বিজলীর দিকে তাকালো। বিজলী ঘুরে দরজাটা বন্ধ করে তার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল। নাজনীন ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হচ্ছে, দরজাটা বন্ধ করছ কেন?

বিজলী তার ওড়নাটা কোমরে প্যাচিয়ে নেয়। তারপর ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নাজনীনের দিকে এগিয়ে যায়। নাজনীন ভয় পেয়ে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। শুকনো গলায় বলল, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?

বিজলী ফিসফিস করে বলল, আপনার জন্যে আমাকে এক বছর থেকে বেশি রাস্তায় থাকতে হয়েছে। আমি ছেলে সেজে দিনের পর দিন ফুটপাথে ঘুমিয়েছি। রাস্তায় অন্যদের সাথে মারামারি করেছি। আমি এখন খুব ভালো মারামারি করতে পারি। একটা ঘুষি দিয়ে আমি একজনকে মাটিতে ফেলে দিতে পারি।

নাজনীন কাঁপা গলায় বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?

যাওয়ার আগে আমি আপনাকে দুইটা ঘুষি মারব যেন বাকি জীবন আপনার আমার কথা মনে থাকে। প্রথম ঘুষিটা আমার ভাইকে আমার থেকে আলাদা করে দেওয়ার জন্য! আর দুই নম্বর ঘুষিটা আমাকে পুলিশের কাছে দেওয়ার জন্য–

বিজলীর চোখ থেকে আগুন বের হতে থাকে। সে হিংস্র মুখে এক পা এগিয়ে যায়।

নাজনীন পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, ভীত মুখে বলল, কী বলছ। পাগলের মতো–

এর জন্যে আবার যদি আমায় জেলে যেতে হয় আমি জেলে বিজলী আরো এক পা এগিয়ে গেল, এবারে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে এই রাক্ষুসীর মুখে ঘুষি মারবে, তার নাকটা ভেঙে গল গল করে রক্ত বের হয়ে আসবে। সে হাত উপরে তুলল।

ঠিক তখন নাজনীন ধপ করে নিচে পড়ে বিজলীর পা ধরে ফেলল, বলল, প্লিজ! প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। মাফ করে দাও–আল্লাহর কসম লাগে–

বিজলী বিস্ফারিত চোখে নাজনীনের দিকে তাকিয়ে রইল। একটু আগেও এই মহিলাটি একজন মানুষ ছিল। এখন সে একটা তেলাপোকার মতো, একটা কেঁচোর মতো, একটা কেন্নোর মতো। বিজলী ইচ্ছা করলেই তাকে এখন পা দিয়ে পিষে ফেলতে পারবে। সে একটা মানুষকে পিষে ফেলতে এসেছিল, তেলাপোকা কিংবা কেঁচোকে কিংবা কেন্নোকে পিষে ফেলতে আসেনি। ঘেন্নায় হঠাৎ তার সারা শরীর ঘিন ঘিন করতে থাকে।

বিজলী নিজের পা ছাড়িয়ে পেছনে সরে এল। কয়েক সেকেন্ড মাটিতে পড়ে থাকা কুৎসিত প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে থেকে দরজা খুলে সে বাইরে বের হয়ে আসে। সেলিনা জাহান তার জন্যে করিডোরে অপেক্ষা করছে। তাকে দেখে বলল, কথা হয়েছে?

হ্যাঁ। হয়েছে।

কোনো সমস্যা?

না।

চলো তাহলে যাই।

চলেন।

সেলিনা জাহান নিচু গলায় বলল, বিজলী, তোমাকে যেদিন চর থেকে তুলে এনেছিলাম তোমাকে কী বলেছিলাম মনে আছে?

বিজলী সেলিনা জাহানের দিকে তাকালো, মাথা নেড়ে বলল, কী বলেছিলেন?

বলেছিলাম খোদা তোমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন কেন জান? কারণ তোমাদের দিয়ে অনেক বড় কোনো কাজ করাবেন।

বিজলীর মনে পড়ল। সে মাথা নাড়ল।

তাই তুমি খুব বড় কিছু করার জন্য রেডি হও। বুঝেছ? তোমাকে আবার স্কুলে যেতে হবে। লেখাপড়া করতে হবে। ঠিক আছে?

বিজলী মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

.

খোকন আর বিজলীকে নিয়ে ছোট দলটি হেঁটে যেতে থাকে। বিজলী দেখল একটু পরে পরে খোকন হি হি করে হাসছে। কী নিয়ে হাসছে কে জানে!

বিজলী নিজেও হেসে ফেলল! কেন হাসছে সেও জানে না। সব সময় সবাইকে সবকিছু জানতে হবে কে বলেছে?

Exit mobile version