Site icon BnBoi.Com

বুবুনের বাবা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

বুবুনের বাবা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

০১. নতুন জায়গা

বুবুনের বাবা
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১. নতুন জায়গা

যে সুটকেসটা বুবুন আর আম্মা মিলে টেনে নাড়াতে পারেনি জাহিদ চাচা সেটা এক হাতে তুলে একেবারে বাসার দরজার সামনে রেখে দিলেন। জাহিদ চাচার শরীরে মনে হয় মোষের মতো জোর। যাদের শরীরে মোষের মতো জোর হয় তাদের চেহারায় একটা গুণ্ড-গুণ্ডা ভাব থাকে, কিন্তু জাহিদ চাচার বেলায় সেটা সত্যি না। তার চেহারাটা একেবারেই ভালোমানুষের মতো। ফরসা গায়ের রং চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কথা বলেন সুন্দর করে আর যখন হাসেন তখন মনে হয় তার এত আনন্দ হচ্ছে যে সেই আনন্দে চোখ দুটি বুজে আছে। বুবুন মানুষজনের বেলায় খুব খুঁতখুতে, কিন্তু এই মানুষটাকে তার বেশ পছন্দ হল।

জাহিদ চাচা পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজার তালা খুলে আম্মাকে বললেন, “ডক্টর রওশান, এই হচ্ছে আপনার নতুন বাসা।”

আম্মা ভিতরে ঢুকে বললেন, “বাহ!”

বুবুন বুঝতে পারল বাসাটা আম্মার পছন্দ হয়েছে। পছন্দ না হলে আম্মা চুপচাপ থাকতেন আর জিজ্ঞেস করলে বলতেন, “হুশ! বেশ ভালোই তো মনে হচ্ছে।”

জাহিদ চাচা ভারী সুটকেসটা আবার এক হাতে টেনে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলে বললেন, “বাসাটা ভালো, আপনাদের পছন্দ হবে। একটু ছোট, তবে

আম্মা বললেন, “ছোট কোথায়? দুজন মানুষের জন্য ঠিকই আছে। ময়লা করার জন্যে বুবুনের যথেষ্ট জায়গা আছে। এইখানে সে তার নোংরা কাপড় ফেলবে, ঐখানে কমিক। এইখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে আগুন ধরাবে, এইখানে চিউয়িংগাম চিবিয়ে ফেলে রাখবে, এইখানে চশমা হারাবে। ঐখানে”

আম্মার কথা শুনে জাহিদ চাচা চোখ ছোট ছোট করে আবার হা হা করে হেসে উঠলেন যেন খুব একটা মজার কথা শুনেছেন। বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাই নাকি ইয়ংম্যান?”

বুবুন কিছু বলার আগেই আম্মা বললেন, “আসলে নাম দেওয়া উচিত ছিল বেবুন–”

জাহিদ এবারে না হেসে বুবুনের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “না না ডক্টর রওশান, এটা আপনি ঠিক বললেন না। এরকম হ্যাঁন্ডসাম একটা মানুষের আপনি নাম রাখবেন বেবুন?”

বুবুন জাহিদ চাচার দিকে তাকাল, না, মানুষটা ঠাট্টা করছে না, সত্যি সত্যিই বলছে। সে ঠিকই ধরেছে, মানুষটা মনে হয় আসলেই ভালো। জাহিদ চাচা টেবিলের উপর চাবিটা রেখে বললেন, “ডক্টর রওশান, আপনারা ধীরে-সুস্থে গুছিয়ে নেন। কিছু দরকার আছে কি-না দেখার জন্যে পরে আসব। আজ রাতে আপনাদের রান্না করতে হবে না, খাবার পাঠিয়ে দেব। আর কিছু লাগবে?”

“না না, আর কিছু লাগবে না।” আম্মা হেসে বললেন, “ভয়ে ভয়ে ছিলাম নতুন জায়গায় এসে কোন ঝামেলায় পড়ি–আপনি তো দেখি সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।”

জাহিদ চাচা জোরেজোরে মাথা নেড়ে বললেন, “না না, সব ব্যবস্থা মোটেই করতে পারিনি, আপনি নিজেই টের পাবেন।”

জাহিদ চাচা চলে যাবার পর বুবুন বলল, “আম্মা, তুমি দেখেছ জাহিদ চাচা যখন হাসেন তখন তার চোখ দুটো কেমন জানি বন্ধ হয়ে যায়?”

আম্মা সুটকেসটা খোলার চেষ্টা করছিলেন, নতুন একটা চাবি নিয়ে দিয়ে খোঁচাখুচি করতে করতে বললেন, “তোর এ কী বাজে অভ্যাস হয়েছে? একজন মানুষকে দেখলে প্রথমেই তার দোষটা চোখে পড়ে!”

বুবুন থতমত খেয়ে বলল, “কখন দোষ চেখে পড়ল?”

“ঐ যে বললি হাসলে চোখ বন্ধ হয়ে যায়!”

“এটা কী দোষ?”

“তা হলে এটা কী?”

“ওটা, ওটা”–বুবুন কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, কেউ যখন অনেক জোরে হাসে তখন তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়।”

“তোকে বলেছে!”

“তুমি বিশ্বাস কর না? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করে দেখো।”

“আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খামোখা বোকার মতো হাসার চেষ্টা করি!”

বুবুন হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “তোমার সাথে কথা বলাই মুশকিল। আমার কোনো কথা তুমি শুনতে চাও না।”

“ভালো কথা বল শুনব, ফ্যাচর-ফ্যাচর করবি তো শুনব কোনটা!”

আম্মা খুব কাজের মহিলা, কোমরে শাড়ি প্যাচিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই ঘর গোছানোর কাজ শুরু করে দিলেন। সুটকেস খুলে জামাকাপড় সাবান তোয়ালে বের করলেন, রান্নাঘরে গিয়ে চুলার উপর চায়ের কেতলি বসিয়ে দিলেন, ঘর ঝাঁট দিয়ে বিছানার চাঁদর বিছিয়ে দিলেন। দেখতে দেখতে পুরো বাসাটা খালি-খালি ভাবটা কাটিয়ে উঠে বেশ থাকার যোগ্য হয়ে উঠল।

বুবুন খানিকক্ষণ আম্মার পিছনে ঘুরঘুর করে ঠিক কী করবে বুঝতে না পেরে বাইরের ঘরে একটা কমিক নিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। সুপারম্যানের কমিক, জিরকনিয়াম পাথর দিয়ে উত্তর মেরুর একটা পাহাড়ে তাকে বন্দি করে রেখেছে, কীভাবে সেখান থেকে ছুটে আসবে সেটা নিয়ে একটা জটিল রহস্য তৈরি হচ্ছে, তার মাঝে হঠাৎ আম্মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হচ্ছে? এটা কী হচ্ছে?”

কেউ যখন কী হচ্ছে চোখের সামনে দেখেও জিজ্ঞেস করে কী হচ্ছে তখন তার উত্তর দেওয়া খুব সোজা না। কেন সোজা না বুবুন সেটাও খুব ভালো করে জানে, তার চোখ বাড়াবাড়ি রকম খারাপ, চোখে ভারী কাঁচের চশমা, যখন-তখন যেখানে-সেখানে যা ইচ্ছে তা-ই পড়ার উপর কারফিউ দেওয়া আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে মুখে সরল একটা ভাব ফুটিয়ে বলল, “কমিক দেখছি।”

“এই বিকেলবেলা কমিক দেখার সময় হল? চোখের যে বারোটা বাজিয়েছিস খেয়াল আছে?”

“আম্মা, আজকাল চোখ খারাপ হওয়া কোনো ব্যাপারই না। চশমা আছে, কন্টাক্ট লেন্স আছে—”

“পাকামো করবি না। কতবার বলেছি বিকেলে বই পড়বি না!”

“এটা বই না। এটা কমিক।”

“পার্থক্যটা কী?”

“বই পড়তে হয়। কমিক পড়তে হয় না, দেখলেই হয়। যেরকম করে ঘরবাড়ি দেখি গাছপালা দেখি। বিকালবেলা কি আমরা দেখি না? চোখ বন্ধ করে রাখি?”

ব্যাখ্যা শেষ হবার আগেই আম্মা এসে বুবুনের কান ধরে তাকে টেনে তুলে ফেললেন, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বের হ ঘর থেকে। বাইরে গিয়ে খেলাধুলা কর–”

বুবুন কোনোমতে নিজের কানকে উদ্ধার করে বলল, “এটা তোমার কীরকম অভ্যাস আম্মা? ঝপ করে কান ধরে ফেল? কেউ দেখে ফেললে—”

“কেউ দেখলে কী হবে? তোর জাত চলে যাবে?”

“আমি এত বড় হয়েছি, আর তুমি–”

আম্মা খুব অবাক হবার ভান করে বললেন, “তাই নাকি? তুই অনেক বড় হয়েছিস? কত জানি বয়স হল তোর? একশো চল্লিশ?”

“যাও! বিদেশে আমার বয়সী ছেলেরা কত কী করে, আর তুমি কথা নেই বার্তা নেই কান ধরে ফেল, চুল ধরে ফেল–”

“পাকামো করবি না। ঘর থেকে বের হ। মাহয় শুধু কান ধরব না, টেনে ছিঁড়ে ফেলব। একেবারে ভ্যান গ হয়ে যাবি। যা–”

বুবুন মুখ শক্ত করে বলল, “কোথায় যাব?”

“বাইরে। নতুন জায়গায় এসেছিস একটু কৌতূহলও নেই কী আছে আশেপাশে? পাড়ার ছেলেপিলেদের সাথে পরিচয় করবি না? দেখলি না ক্রিকেট খেলছে”

“চিনি না শুনি না গিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করে দেব?”

“যদি না খেলিস তা হলে চেনাশোনাটা হবে কীভাবে? আর পচা তর্ক করবি, যা, বের হ।”

বুবুন বিরসমুখে বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে জুতো পরল। খামোখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ চুল আঁচড়াল। শার্টটা বদলে নিল–তারপর যখন দেখল আর কিছুই করার নেই তখন ঘর থেকে বের হল। আম্মার উপর যা রাগ উঠল সেটা আর বলার মতো নয়। এমনিতে আম্মা দেখতে একেবারে সিনেমার নায়িকাঁদের মতে, পড়াশুনাও করেছেন অনেক। সোশিওলজিতে পিএইচ. ডি. অথচ কথাবার্তা বাসের কন্ডারক্টরদের মতো। গলা উঁচিয়ে ধমক না দিয়ে কোনো কথা বলতে পারে না। তার বাবা না থাকায় এটাই হয়েছে মুশকিল। বাসায় কোনো পুরুষমানুষ না থাকলে মনে হয় মেয়েরাই পুরুষ মানুষদের মতো হয়ে যায়। বুবুন একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বাবা থাকাটা কেমন কে জানে!

একটু আগে বাইরে খুব হৈচৈ করে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল বুবুন খেলাধুলায় একেবারে যাচ্ছেতাই আর ক্রিকেটে হলে তো কথাই নেই, না পারে বল করতে না পারে ব্যাট করতে। ফিল্ডিং তো আরও খারাপ, সোজা ক্যাচগুলো কীভাবে জানি ফস্কে যায়। পায়ের পাশ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বল বাউন্ডারি পার হয়ে যায়। তাই ঘর থেকে বের হয়ে যখন দেখল বাইরে এখন কেউ ক্রিকেট খেলছে না বুবুন একটু স্বস্তি পেল। ছেলেপিলেরা কোথায় গিয়েছে কে জানে।

এই এলাকাটা একটু অন্যরকম। শহরতলির বাসা, আশেপাশে অনেক গাছ গাছালি, দূরে একটা টিলামতন রয়েছে, তার ওপাশে নাকি একটা নদীও আছে। তাদের আগের বাসা ছিল একেবারে শহরের মাঝখানে, একটার পাশে আরেকটা কংক্রিটের দালান, গাছপালা যে দুএকটা ছিল ধুলার আস্তরণে তারা একেবারে ডুবে থাকত। বুবুন প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীরেসুস্থে জায়গাটা দেখতে বের হল। বাসার পিছনে কয়েকটা বড় বড় গাছ, তার পাশে একটা নিচু জায়গা, সেখানে পানি জমে আছে, কাছে আসতেই কয়েকটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আরেকটু এগিয়ে যেতেই সে ছেলেপিলের দলটাকে আবিষ্কার করল, তারা একটা গাছের নিচে জমা হয়েছে। একজনের হাতে একটা বাঁশ সেই বাঁশের উপরে কয়েকটা খবরের কাগজ শক্ত করে বাঁধা, হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটির যে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেটি একটি মেয়ে, বয়স বুবুনের সমান কিংবা একটু ছোট। বুবুনকে দেখে একজন বলল, “বেশি কাছে এসো না।”

বুবুন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কেন? কী হবে কাছে এলে?”

“আগুন জ্বালাব।”

বুবুন এইবার ভালো করে তাকাল, “বাঁশের ডগায় আগুন লাগানোর ব্যবস্থাটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, নীল রঙের শিশি থেকে যে তরল পদার্থটি খবরের কাগজে ঢালা হল সেটা নিশ্চয়ই কেরোসিন। বুবুন জিজ্ঞেস না করে পারল না, “আগুন জ্বালাচ্ছ কেন?”

যে-মেয়েটা আগুন জ্বালানোর জন্যে ম্যাচ বের করছিল সে বুবুনের দিকে না তাকিয়েই বলল, “বোলতার ইয়া বড় চাক হয়েছে। আগুন লাগিয়ে ছ্যাড়ভাড়া করে দেব।”

বুবুন ভিতরে ভিতরে চমকে উঠল, সে আগে কখনো বোলতার চাক দেখেনি বইপত্রে দুষ্টু ছেলেদের। বোলতার চাক ভাঙা নিয়ে অনেক রকম ভয়ের কাহিনী পড়েছে এখন কি তারই একটা তার চোখের সামনে ঘটবে? বুবুন গাছের উপরে তাকাল, কিন্তু চাকটা কোথায় ঠিক দেখতে পেল না।

এর মধ্যে বাঁশের ডগার মাঝে আগুন লাগানো হয়েছে, বিশাল মশালের মতো দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠতেই সবাই মিলে একটা আনন্দের মতো শব্দ করল। মেয়েটা বাঁশটা নিয়ে আগুনটাকে উঁচু করতে থাকে এবং তখন বুবুন বোলতার বিশাল চাকটা দেখতে পেল। যে-ঘটনাটি এক্ষুনি ঘটতে যাচ্ছে সেটা যে বুদ্ধিমানের কাজ নয় সেটা বুঝতে দেরি হল না। মেয়েটা চকচকে চোখে বলল,”সবাই দৌড় দেবার জন্যে রেডি হও।”

বুবুন আবার চমকে উঠল এবং কিছু বোঝার আগেই দেখতে পেল বাঁশের ডগার দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন বোলতার চাককে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে। চাকটি ভাঙামাত্রই প্লেনের ইঞ্জিনের মতো একটা গুঞ্জন শোনা গেল এবং সাথে সাথে ছেলেপিলের পুরো দলটি আধা-উল্লাস এবং আধা-আতঙ্কের শব্দ করে ছুটতে শুরু করল। মেয়েটি হাতের বাঁশটি ছুঁড়ে ফেলে চিৎকার বলে বলল, “পালাও।”

.

দৌড়াদৌড়ি করা বুবুনের খুব অভ্যাস নেই, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করারও সময় নেই, সে প্রাণপণে মেয়েটার পিছুপিছু ছুটতে লাগল। কে তাদের এত বড় সর্বনাশ করেছে বুঝতে বোলতাদের এতটুকু দেরি হল না তারা পুরো ঝাক বেধে পিছুপিছু ছুটে এল। বোলতার ঝক যদি ধৈর্য ধরে তাদের পিছুপছু ছুটে আসত তা হলে বড় ধরনের বিপদ হয়ে যেত, কিন্তু দেখা গেল মাঝপথেই তারা হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেল। মনে হয় তাদের কতটা ক্ষতি হয়েছে সেটা দেখতে ফিরে গেছে।

ছেলেমেয়েদের ছোট দলটি অবিশ্যি আরও খানিকক্ষণ দৌড়ে গিয়ে একটা খোলামতন জায়গায় হাজির হয়। সবাই হাঁপাচ্ছে, হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটা বলল, “একেবারে ছ্যাড়াভ্যাড়া করে দিয়েছ। আগেবার থেকে ভালো হয়েছে এইবাব।”

বুবুন মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, “আগেও করেছ এরকম?” মেয়েটির মুখ গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “করি নাই আবার!”

গাট্টাগোট্টা ধরনের একটা ছেলে বলল, “বোলতার চাক জ্বালানোর মাঝে সুমি হচ্ছে এক নম্বর এক্সপার্ট।”

সুমি নিশ্চয়ই মেয়েটার নাম, তাকে দেখে বুবুন মনে-মনে অবাক না হয়ে পারল না। সব মেয়েই যদি এরকম হত তা হলে ছেলেদের মনে হয় বড় বিপদ হয়ে যেত। বুবুন মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, “বোলতা কামড়ায়নি কখনো?”

গাট্টাগোট্টা ছেলেটা হিহি করে হাসতে হাসতে বলল, “কামড়ায় নাই আবার! একবার দৌড়াতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল, তখন সব বোলতা এসে

সুমি বলল, “বোলতার মতো ফাজিল আর জেঞ্জারাস কিছু নেই। সোজা এসে চোখের মাঝে অ্যাটাক করে–”

বুবুন একটু শিউরে উঠল, বলল ”বোলতা কামড় দিলে কি খুব ব্যথা করে?” সুমি অবাক হয়ে বলল, “তুমি কখনো বোলতার কামড় খাও নাই?”

“না।”

সবাই ঘুরে বুবুনের দিকে তাকাল, তাদের চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হল সে বুঝি মঙ্গল গ্রহ থেকে নেমে-আসা আট হাত-পাওয়ালা একটা প্রাণী! সুমি জিজ্ঞেস করল, “তুমি নতুন এসেছ, তাই না?

“হুঁ।“

“এর আগে কোথায় ছিলে?”

“ঢাকায়।”

“সেখানে বোলতা নাই?”

“থাকবে না কেন? কিন্তু থাকলেই কি খোঁচাখুঁচি করতে হয়?”

গাট্টাগোট্টা ছেলেটা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আসলে ঢাকায় বোলতা নাই। ঢাকায় শুধু মশা। দেখিসনি খবরের কাগজে?”

সুমি নামের মেয়েটা একটা চোরা-কাঁটা হ্যাঁচকা টানে তুলে এনে তার গোড়াটা চিবুতে চিবুতে বল, “তোমার নাম কী?”

বুবুন মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, নাম বলামাত্রই সবাই হো হো করে হেসে উঠবে। মানুষ কেমন করে একটা বাচ্চার নাম রাখে বুবুন? তাও নিজের বাচ্চার?

“কী নাম?”

“বুবুন।”

“বুবুন?” সত্যি সত্যি গাট্টাগোট্টা ছেলেটা হি হি করে হাসতে শুরু করল।

সুমি চোখ পাকিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই হাসছিস যে?”

ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল, “নাম বুবুন হি হি হি। আরেকটু হলে বেবুন হয়ে যেত।

“তোর নিজের নাম হচ্ছে গাব্বু আর তুই অন্যের নাম নিয়ে হাসিস?” গাব্বু যুক্তিতর্কের ধারেকাছে গেল না, হি হি করে হাসতেই থাকল। সুমি বলল, ‘হাসি থামা। আবার ফ্যাকফ্যাক করে হাসবি তো বক্সিং দিয়ে নাক চ্যাপটা করে দেব।”

গাব্বু সাথে সাথে হাসি থামিয়ে ফেলল। বোঝা গেল সুমি দরকার হলে কমবেশি ভোলাই দিতে পারে। বুবুন বলল, “আমার নামটা আসলেই একটু অন্যকরম। আসলে আমার আব্বা একটু অন্যরকম মানুষ ছিলেন তো–”

“তোমার আব্বা কোথায়?”

বুবুন আবার ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার আব্বা নিয়ে আলোচনাটি এখন শুরু হতে যাচ্ছে। আগে হোক পরে হোক এটা শুরু হত, এখনই শুরু হয়ে শেষ হয়ে যাওয়াটা ভালো। বুবুন গলা পরিষ্কার করে বলল, “আমার আব্বা নেই।”

সুমি জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে জিজ্ঞেস করে বলল, “মারা গেছেন?”

“না।”

“তা হলে?”

গাব্বু চোখ ছোট ছোট করে বলল, ‘ডিভোর্স?”

“না।” বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার আব্বা হারিয়ে গেছেন।

“হারিয়ে গেছেন?” সুমি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”

“সত্যি।”

গাব্বু একটা ঢোক গিলে বলল, “বড় মানুষ আবার হারিয়ে যায় কেমন করে?”

বুবুন মাথা নাড়ল, “জানি না। একদিন বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, আর ফিরে আসেননি।”

গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “তোমার আম্মার সাথে ঝগড়া করেছিল নাকি?”

বুবুন হেসে ফেলল, বলল, “সেটা তো জানি না। আমি তখন ছোট-ন্যাদা ন্যাদা বাচ্চা। দুই-তিন বছর বয়স।”

সুমি জিজ্ঞেস করল, “তোমার আব্বার কথা মনে নাই?”

“না!”

সুমি কেমন জানি মায়া-মায়া চোখে বুবুনের দিকে তাকিয়ে বলল,”ইশ!”

কথাবার্তা কম বলে সেরকম একটা ছেলে এতক্ষণ চুপ করে কথা শুনছিল, এখন হঠাৎ ধমকে উঠল,”ইশ ইশ করছিস কেন? তোর ধারণা আব্বা না থাকাটা খারাপ?”

গাব্বু হি হি করে হেসে ছেলেটার মাথায় একটা চাটি দিয়ে দিয়ে বলল, “তোর আব্বার মতো হলে তো না থাকাটা খারাপ না।”

সুমি বলল, “বাজে কথা বলিস না–পিয়াল যে-সমস্ত কাজকর্ম করে যে কোনো আব্বা ফাটাফাটি করে ফেলবে।”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী করেছে পিয়াল?”

“গত সপ্তাহে রান্নাঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এর আগের সপ্তাহে বাথরুমের পাইপ ফেটে পানি দিয়ে ভাসাভাসি। একবার ইলেকট্রিক শক দিয়ে তার আব্বাকে প্রায় মেরে ফেলেছিল।”

“সাপের ঘটনাটা বল–”

”হ্যাঁ। সাপ পুষতে গিয়ে—”

পিয়াল নামের ছেলেটা চোখ পাকিয়ে বলল, “এমনভাবে বলছিস যেন সব দোষ আমার!”

“তা হলে দোষ কার?”

“যে-কোনো গবেষণা করলে তার মাঝে একটা ইয়ে থাকে। যেটা জানিস না সেটা নিয়ে রেগে গিয়ে পিয়াল কথা শেষ করতে পারল না।

সুমি চোখ টিপে বলল, “পিয়াল হচ্ছে আমাদের সায়েন্টিস্ট। বদরাগি সায়েন্টিস্ট!”

“ইনডাকশান কয়েল দিয়ে এমন একটা ইলেকট্রনিক শক দেব একদিন তখন মজাটা টের পাবি।”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাছে ইনডাকশান কয়েল আছে? গাড়ির কয়েল?”

“না। গাড়ির না।” পিয়াল চকচকে চোখে বলল, “তোমার আছে?”

“হ্যাঁ। চারটা ব্যাটারি দিলে একেবারে ছয় ইঞ্চির একটা স্পার্ক হয়!”

“ছয় ইঞ্চি? যাহ!”

“সত্যি! যখন টেলিভিশনে প্যানপ্যানানি বাংলা নাটক হত আমি স্পার্ক দিয়ে সবার নাটক দেখা বন্ধ করে দিতাম। কেউ বুঝতে পারত না। শেষে একদিন আম্মা ধরে ফেলেছিল। তারপর–”

“তারপর কী? রাম ধোলাই?”

“নাহ্, ঠিক রাম ধোলাই না–তবে যা একটা পালিশ দিলেন!”

সুমি বলল, “তোমার আম্মা তোমাকে পালিশ দিলেন? হতেই পারে না–”

বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেন হতেই পারে না?”

“তোমরা যখন এসেছ আমি দেখেছি, তোমার আম্মা দেখতে একেবারে সিনেমার নায়িকাঁদের মতো। যারা দেখতে এত সুন্দর তারা পালিশ দিতে পারে না।”

বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “খালি চেহারাটাই!”

“মানে?”

“মানে খালি চেহারাটাই ভালো। আম্মার কথাবার্তা হাবভাব একেবারে বাস কন্ডাক্টারদের মতো। দুধছাড়া চায়ের মতন কড়া মেজাজ।”

“সত্যি?”

“সত্যি না তো মিথ্যা? এই যে দ্যাখো আমার বাম কানটা ডান থেকে একটু লম্বা-আম্মা টেনে টেনে এটা লম্বা করে ফেলেছেন!”

বুবুনের কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল। বুবুন নিজেও হাসতে লাগল। নতুন জায়গায় এসে আশেপাশে ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচয় করা নিয়ে ভিতরে ভিতরে দুশ্চিন্তা ছিল। মনে হচ্ছে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বিশেষ করে পিয়ালের সাথে জমবে ভালো। দুজনে মিলে মনে হয় একটা রকেট তৈরি করা যেতে পারে। আশেপাশে ফাঁকা জায়গা আছে–রকেট উপরে না উঠে যদি পাশে যায় তা হলেও বড় সমস্যা নেই। নতুন জায়গায় এসে এই প্রথম বুবুনের বেশ ভালোই লাগতে থাকে।

০২. খবিরউদ্দিন ও মোষের দই

খবিরউদ্দিন ও মোষের দই

খাবার টেবিলে আম্মা টিফিন-ক্যারিয়ার থেকে খাবার বের করতে করতে বললেন, “পরিচয় হল সবার সাথে?”

“হয়েছে। একটা মেয়ে তার নাম হচ্ছে সুমি। সেই মেয়েটা–” বুবুন হঠাৎ থেমে গেল। বাঁশের ডগায় খবরের কাগজ বেঁধে আগুন ধরানোর কথাটা বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারল না।

“কী হয়েছে মেয়েটার?”

“নাহ্! কিছু না।” বুবুন প্লেটে ভাত নিতে নিতে বলল, “একটা ছেলে আছে। তার নাম পিয়াল। পিয়াল করেছে কি-বুবুন আবার থেমে গেল, পিয়াল যে তাদের বাসা প্রায় পুড়িয়ে দিয়েছিল কিংবা ইলেকট্রিক শক দিয়ে বাবাকে প্রায় মেরে ফেলেছিল সেটাও হয়তো বলা ঠিক হবে না।

“কী হয়েছে পিয়ালের?”

“নাহ্। কিছু হয় নি।”

আম্মা আড়চোখে বুবুনকে একবার দেখলেন, কিছু বললেন না। বুবুন ভাতের সাথে বিদঘুঁটে রকমের একটা সবজি মাখাতে মাখাতে বলল, “একটা ছেলে আছে, বেশি বড় না, ছোটখাটো সাইজ–তার নাম হচ্ছে গাব্ব–হি হি হি—”

“খুব যে হাসছিস? তোর নিজের নামটা কী?”

বুবুন মুখ শক্ত করে বলল, “সত্যিই আম্মা তোমরা আমার নাম বুবুন কেমন করে রাখলে?”

“আমি রাখিনি।”

“তা হলে কে রেখেছে?”

‘তোর আব্বা।” বুবুন লক্ষ করল খুব সাবধানে আম্মা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন।

“আব্বা?”

“হুম।”

আম্মা কোনো কথা না বলে অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। বুবুন পরিবেশটা হালকা করার জন্যে বলল, “আব্বার কি মাথা খারাপ ছিল?”

আম্মা কিছুক্ষণ বুবুনের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “ছিল।”

আম্মার গলায় ঠাট্টার কোনো চিহ্ন নেই–বুবুন কেমন জানি চমকে ওঠে। ভালো করে আম্মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী বললে আম্মা?”

“কথা না বলে এখন ভাত খা।”

“কিন্তু আম্মা–”

“কী?”

“আব্বার কথা কী বললে?”

“কিছু না–”

“বলো-না–”

আম্মা সোজা হয়ে বসে সোজাসুজি তাকালেন বুবুনের দিকে, তারপর কেমন যেন কঠিন গলায় বললেন, “ঠিক আছে বলব। তুই এখন বড় হয়েছিস, এখন হয়তো শুনতে পারবি। আসলেই শেষের দিকে তোর আব্বার মাখা-খারাপ হয়ে গিয়েছিল।”

“কেন?”

“ঠিক জানি না। মাথায় একটা টিউমারমতো হয়েছিল, ঠিক ডায়াগনসিস করার আগেই উধাও হয়ে গেল।”

“কোথায় আম্মা? কেমন করে?”

আম্মা কোনো কথা না বলে খানিকক্ষণ প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করলেন, তারপর মুখ তুলে বললেন, “সারারাত মাথার ব্যথায় ছটফট করল। ভোররাতে উঠে বসল, চোখ দুটি লাল, চুল এলোমোলো। আমার দিকে কীরকম অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, তুমি কে? আমি বললাম, মাসুদ তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? মাসুদ বলল, না। আমি তখন কাছে গেলাম, পায়ের শিকল ধরে–”

“পায়ের শিকল?”

আম্মা ন্যাপকিন দিয়ে সাবধানে চোখের কোনো মুছলেন, বললেন, “হ্যাঁ, একটা পা শিকল দিয়ে জানালার শিকের সাথে বাঁধা ছিল। মাঝে মাঝে ভায়োলেন্ট হয়ে ঘর থেকে চলে যেত, তাই।”

“কেমন করে হল আম্মা?”

“জানি না।” আম্মা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট একটা মানুষ ছিল। তোর জন্মের কিছুদিন পর থেকে মাঝে মাঝে বলত মাথায় ব্যথা করে। ভোতা একরকমের ব্যথা। ডাক্তারের কাছে যেতে চাইত না, অনেক ঠেলেঠুলে পাঠানো হল। ডাক্তার দেখেটেখে কিছু পেল না, বলল ক্যাট স্ক্যান করতে হবে। করতে চায় না–একরকম জোর করে পাঠানো হল। সেখানে ছোট একটা টিউমারের মতো দেখা গেল, কিন্তু সেটা কী সমস্যা ঠিক করে বলতে পারে না। বলল, বিদেশে নিয়ে যান।”

আম্মা একটু থামলেন, মনে হল এই অল্প কয়টা কথা বলেই কীরকম জানি ক্লান্ত হয়ে গেছেন। পেটের ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, “বিদেশে নেব, তার পয়সা কই? দুজনে মিলে চাকরি করে কোনোমতে সংসার চালাই। আর তোর আব্বার কীকরম একটা গো, বিদেশে যাবে না। বলে মরতে হলে। দেশের মাটিতে মরব।“

“ধার কর্জ করে কিছু টাকা জোগাড় করেছি। এর মাঝে দেখতে দেখতে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎ হঠাৎ ভায়োলেন্ট হয়ে ওঠে, তখন ধরে রাখা যায় না। বাসা থেকে বের হয়ে যায়। কোথায় যায়, কী করে বুঝতে পারি না। একসময় দেখা গেল মানুষজনকে চিনতে পারছে না। বেশির ভাগ সময় ছটফট করছে–শুধু তোকে দেখলে শান্ত হয়ে যেত। তুই তখন ছোট ন্যাদা-ন্যাদা বাচ্চা। তোর আব্বার কাছে যাবার জন্যে খুব ব্যস্ত ছিলি। কিন্তু ডাক্তারেরা ভয় দেখাল, বলল, কাছে নেবেন না। হঠাৎ করে কিছু-একটা হয়ে যেতে পারে। আমিও নিই না–“

আম্মা হঠাৎ কাঁদতে শুরু করলেন। বুবুন এর আগে আম্মাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি, তার এত কষ্ট হতে লাগল যে সেটি আর বলার মতো নয়। আম্মাকে শান্ত করার জন্যে তাকে ধরে কিছু-একটা বলতে গিয়ে নিজেই ভেউভেউ করে কাঁদতে শুরু করল। আম্মা তখন নিজের চোখ মুছে বুবুনকে আদর করে বললেন, “কাঁদে না বোকা ছেলে!”

বুবুন কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমিও তো কাঁদছ!”

আম্মা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললেন, “হ্যাঁ। কিরকম বোকার মতো কেঁদে ফেললাম, দেখলি? হঠাৎ করে তোর আব্বার কথা মনে হয়ে” আম্মা আবার আকুল হয়ে কেঁদে উঠলেন।

ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। বুবুন আর তার আম্মা একজন আরেকজনের দিকে তাকালেন। আম্মা ন্যাপকিন দিয়ে চোখ মুছে বললেন, “দরজাটা খুলে দে। মনে হয় জাহিদ সাহেব এসেছেন।”

বুবুন দরজা খুলে দিল, সত্যিই তাই–জাহিদ চাচা। হাতে একটা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বুবুনকে দেখে হেসে বললেন, “কী খবর বুবুন?”

বুবুন জোর করে হাসিহাসি মুখ করে বলল, “ভালো।”

জাহিদ চাচা ভিতরে ঢুকে থতমত খেয়ে গেলেন, আম্মা তখনও মুখে আঁচলচাপা দিয়ে টেবিলে বসে আছেন, সামনে টেবিলে খোলা টিফিন-ক্যারিয়ার দৃশ্যটা মোটেও স্বাভাবিক না। জাহিদ চাচা চোখে একটা প্রশ্ন নিয়ে বুবুনের দিকে তাকালেন, বুবুন কি বলবে বুঝতে না পেরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। জাহিদ চাচা হাতের প্যাকেটটা টেবিলের উপর রেখে অপরাধীর মতো বললেন, “আমার একটা বহুদিনের স্বভাব–সব জায়গায় আমি ভুল সময়ে হাজির হই।”

আম্মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মুখ তুলে বললেন, “আপনার দোষ কী? আপনি কেমন করে জানবেন আজ আমাদের ফ্যামিলির কান্নাকাটি করার সময়!”

“কান্নাকাটি?”

আম্মা সহজ গলায় বললেন, “বুবুন তার আব্বার কথা শুনতে চাইল। বলতে গিয়ে হঠাৎ এত ইমোশনাল হয়ে গেলাম–”

জাহিদ চাচার মুখে দুঃখের একটা ছাপ পড়ল, নরম গলায় বললেন, “আমি বুঝতে পারছি ডক্টর রওশান। একজন যে কতটুকু কষ্ট পেতে পারে, তার মাঝেও যে কতটুকু শক্ত থাকা যায় সেটা আপনাকে দিয়ে বোঝা যায়।”

আম্মা কিছু বললেন না। জাহিদ চাচা বললেন, “আমি দেখতে এসেছিলাম সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না–কিন্তু দেখতেই পাচ্ছেন ভুল সময়ে এসে গেছি! এখন যাই, পরে একসময় আসব।”

“এসেই যখন গিয়েছেন, বসুন।”

জাহিদ চাচা অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, “না ডক্টর রওশান, আমি এখন যাই। কোনো কোনো সময়ে মানুষের একা থাকার ইচ্ছে করে, তখন আপেশাপে অন্য কেউ থাকলে খুব যন্ত্রণা হয়। আপনারা কথা বলেন। ইট ইজ ইম্পর্ট্যান্ট। আমি পরে আসব।”

আম্মা বললেন, “ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। আপনি বসুন।”

“আপনারা এখনও খাওয়া শুরু করেননি।”

“শুরু করে দেব। আপনিও আমাদের সাথে খেয়ে নিন। আপনি যত খাবার পাঠিয়েছেন সেটা দিয়ে তো প্রায় এক পল্টন খেয়ে নিতে পারবে।

জাহিদ চাচা লাফিয়ে উঠে বললেন, “না-না, সে কী করে হয়!”

জাহিদ চাচা সত্যিই চলে যেতে চাইছিলেন কিন্তু আম্মা কিছুতেই রাজি হলেন না। শেষ পর্যন্ত খাবার টেবিলে তাকে বসতে হল। আম্মা প্লেটে খাবার তুলে দিলেন, খেতে খেতে জাহিদ চাচা বললেন, “বুঝলেন ডক্টর রওশান, আমি সবসময় সব জায়গায় উলটাপালটা সময়ে যাই। একবার অনেকদিন পর এক বন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখি তারা স্বামী-স্ত্রী ফাটাফাটি ঝগড়া করে বসে আছে। বন্ধুর বউ কামড় দিয়ে বন্ধুর কানের লতির আধ ইঞ্চির মতো ছিঁড়ে ফেলেছে। রক্তারক্তি অবস্থা–আমি না পারি থাকতে না পারি যেতে!”

জাহিদ চাচার কথা শুনে আম্মা হাসতে হাসতে বিষম খেলেন। জাহিদ চাচা বললেন, “আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না? আরেকবার শোনেন কী হয়েছে। এক বাসায় গিয়ে দেখি বাসার বড় মেয়ে প্রাইভেট টিউটারকে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে ফেলেছে। ভদ্রলোক একটা দোনলা বন্দুক নিয়ে লাফাচ্ছেন–মেয়ে, মেয়ে-জামাই যাকেই দেখবেন তাকেই খুন করে ফেলবেন!”

জাহিদ চাচার কথা শুনে আম্মা হাসতে লাগলেন বুবুন অবিশ্যি ঠিক বুঝতে পারল না কোর্ট ম্যারেজ করার সাথে গুলি করে মেরে ফেলার সম্পর্কটা কী। খেতে খেতে বুবুন একসময় জিজ্ঞেস করল, “চাচা, এখানে দেখার মতো কিছু আছে?”

জাহিদ চাচা মাথা নাড়লেন, নাই। কিছু নাই। এই পোড়া জায়গায় বিখ্যাত বলতে রয়েছে খবিরউদ্দিন।

আম্মা হেসে ফেললেন, বুবুন জিজ্ঞেস করল, ”খবিরউদ্দিন কে?”

জাহিদ চাচা অনেকটা বক্তৃতা দেওয়ার মতো করে বললেন, “উনিশ শো একাত্তর সালের রাজাকার কমান্ডার, জামাতে ইসলামীর লিডার এনজিও বিরোধী, নারীশিক্ষা বিরোধী, ধর্মব্যবসায়ী রগকাটা নেতা–”

আম্মা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলেন, “এত বড় বিখ্যাত জিনিস আমরা দেখতে যাব না?”

“আপনাকে দেখতে যেতে হবে না ডক্টর রওশান। খবিরউদ্দিন যখন খবর পাবে আপনি মেয়েদের স্কুলের প্রোগ্রাম নিয়ে এসেছেন তখন সে নিজেই তার দলবল লাঠিসোটা নিয়ে আপনাকে দেখতে আসবে।”

“ভেরি গুড! তা হলে তো দেখা হবেই।”

“হ্যাঁ। আর এখানকার দ্বিতীয় বিখ্যাত জিনিস হচ্ছে মোষের দই।”

বুবুন অবাক হয়ে বলল, “মোষের দই! মোষকে কেমন করে দই বানায়?”

“মোষকে তো সোজাসুজি দই বানানো যায় না–এত বড় একটা প্রাণী, শিং টিং থাকে তাকে ঘটানোও ঠিক নয়। তাই প্রথমে নেয়া হয় মোষের দুধ। সেটা থেকে হয় দই।”

বুবুন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আমি কি তাই বলছি নাকি?”

জাহিদ চাচা বুবুনের চুলগুলো একটু এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, “আমি জানি বুবুন–তোমার সাথে একটু ঠাট্টা করছি। এই মোষের দুধ অত্যন্ত বিখ্যাত, অনেক দূর থেকে মানুষেরা মোষের দই নিতে আসে। জিনিসটাতে বোটকা একধরনের গন্ধ, একই সাথে সেটা টক মিষ্টি এং ঝাল। বিক্রি হয় বড় মালশা করে। এক চামচ মুখে দিয়ে মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে এরকম ঘটনা শোনা যায়।”

আম্মা টেবিলের উপর প্যাকেটটা দেখিয়ে বললেন, “আপনার ঐ প্যাকেটে তাই আছে?”

“আপনি ঠিকই ধরেছেন। আপনাদের জন্যে এক মালশা বিখ্যাত মোষের দই নিয়ে এসেছি। যদি সাহস থাকে খাবার পর এক চামচ করে খেয়ে দেখবেন!”

বুবুন নাক কুঁচকে বলল, “আমার এত সাহস নাই বাবা, আমি খাচ্ছি না।”

“এই এলাকার এত বিখ্যাত একটা জিনিস না খেলে কেমন করে হবে? তা ছাড়া তুমি যখন স্কুলে যাবে তখন তো খেতেই হবে।”

বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

“শুনেছি তোমাদের স্কুলে নাকি টিফিন দেওয়া হয় মোষের দই।”

“মোষের দই? স্কুলের টিফিন?”

“হ্যাঁ–”

”কেন?”

“চরিত্রের দৃঢ়তা বাড়ানোর জন্যে। স্কুলের নিয়ম-কানুন তো খুব কড়া।”

“কড়া?”

“হ্যাঁ, ড্রিল টিচার হচ্ছে একজন সুবেদার। দুপুরবেলা পাকা একঘণ্টা পিটি,তারপর পাঁচ কিলোমিটার দৌড়।”

“পাঁ-পাঁচ কিলোমিটার?”

“হুম। প্রিন্সিপালও খুব কড়া মানুষ। ডিসিপ্লিন রাখার জন্য গত বছর থেকে বেত মারার নিয়ম করেছেন।”

“বেত?” বুবুন প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।

“হুঁ। বেত মারা শুরু করার পর পড়াশোনার মান বেড়ে গেছে। গত বছর এস. এস. সি.-তে দুইজন স্ট্যান্ড করেছে।

“তাই বলে বেত?”

“ছাত্রেরা পছন্দ না করলেও গার্জিয়ানরা খুব পছন্দ করছে। আজকাল হোমওয়ার্ক আর মিস হয় না। হোমওয়ার্ক না পারলে বেত, পড়া না পারলে বেত আর দুষ্টুমি করলে তো কথাই নেই–রীতিমতো চাবুক। গত সপ্তাহে একটা ছেলেকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল।”

“হা-হাসপাতাল?”

“বেশি কিছু হয়নি। শুধু পাঁজরের একটা হাড় ভেঙে গিয়েছিল।”

বুবুন ফ্যাকাশে মুখে আম্মার দিকে তাকাল, দেখল আম্মা মুখ টিপে হাসছেন এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল জাহিদ চাচা ঠাট্টা করছেন। তাকে এমনভাবে বোকা বানিয়েছেন জাহিদ চাচা-বুবুন হঠাৎ খুব লজ্জা পেয়ে গেল। জাহিদ চাচা হা হা করে হাসতে হাসতে বুবুনের মাথায় হাত বুলিয়ে তার চুলগুলি এলোমেলো করে দিয়ে বললেন, “ইয়ংম্যান, তোমার কোনো ভয় নেই। এই স্কুলের বোর্ড অফ ডিরেক্টরসরা অসম্ভব প্রগ্রেসিভ। কেউ কবি, কেউ দার্শনিক, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, কেউ প্রফেসর, অর্ধেকের বেশি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা। খুব ভালো স্কুল তোমার। ছোট থাকতে আমি যদি এরকম ভালো একটা স্কুলে পড়তে পারতাম তা হলে আমি হয়তো তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট হতাম।”

আম্মা বললেন, “আপনি যদি আমাকে ব্রিলিয়ান্ট বলেন তা হলে স্বীকার করতেই হবে আপনি মানুষটা বেশি বুদ্ধিমান না।”

জাহিদ চাচা বললেন, “আপনি ঠিকই ধরেছেন। আমি আসলেই একটু গাধা টাইপের।”

বুবুন আড়চোখে তাকাল, জাহিদ চাচা মোটেই গাধা টাইপের না, ইনি সাংঘাতিক মানুষ। ইশ! তার যদি জাহিদ চাচার মতো একটা বাবা থাকত!

রাতে ঘুমানোর সময় বুবুন আম্মার কাছে এসে দাঁড়াল। আম্মা নাকের ডগায় একটা চশমা লাগিয়ে কী একটা পড়ছিলেন, বুবুনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী রে? কিছু বলবি?”

“হ্যাঁ”

“কী?”

“জাহিদ চাচার কি বিয়ে হয়েছে”

“না। কেন?”

“তুমি আগে বলো যে রেগে যাবে না কিংবা খপ করে আমার কান ধরে ফেলবে না।”

“কী বলছিস না শোনা পর্যন্ত আমি কোনো প্রতিজ্ঞা করছি না। আমাকে তুই এত বোকা পাসনি।”

“ঠিক আছে বলছি।” বুবুন একটা মুখ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বড় খালা, নানু তারা সবাই তোমাকে আবার—”

“আমাকে আবার?”

“বিয়ে করতে বলছে। তুমি করতে চাইলে করো আম্মা–আমি কিছু মনে করব না।”

আম্মা খপ করে বুবুনের কান ধরার চেষ্টা করলেন, পারলেন না। সে ছিটকে সরে গিয়ে বলল, “আমার মনে হয় আমার যদি একটা বাবা হয় তা হলে আমার ভালোই লাগবে।”

আম্মা বিছানা থেকে উঠে বুবুনকে ধরার চেষ্টা করলেন, বুবুন আগে থেকে তৈরি ছিল বলে এবারেও ধরতে পারলে না।

রাতে ঘুমানোর সময় আম্মার চোখে একটু পরে পরে পানি এসে যাচ্ছিল, ঠিক কী কারণে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।

০৩. শেয়ালের গর্ত

৩. শেয়ালের গর্ত

বিকেলবেলা খেলতে বের হয়ে বুবুন দেখল গাব্ব, পিয়াল এবং অন্য ছেলেরা ক্রিকেট ব্যাট এবং বল নিয়ে খেলার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। বুবুন মনে-মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল–সে এই খেলাটাতে কিছুতেই সুবিধে করতে পারে না। ছেলেরা যখন বাঁশের কঞ্চি দিয়ে স্ট্যাম্প তৈরি করে মাটিতে গাঁথছে তখন সুমি এসে বলল, “এই, তোমরা এখন ক্রিকেট খেলবে?”

পিয়াল মুখ ভেংচে বলল, “না আমরা বুড়ি চি খেলব!”

“ফাজলেমি করবি না বলছি, মুখ ভেঙে দেব।

পিয়াল কোনো কথা বলল না, সুমি মনে হয় ভুল করে মেয়ে হয়ে জন্মেছে, তার ছেলে হওয়ার কথা ছিল, তাকে সবাই অল্পবিস্তর ভয় পায়। সুমি বলল, “আমরা এখানে আগে খেলতে এসেছি, আমরা খেলব। তোরা অন্য জায়গায় যা।”

সুমির কথা শুনে পিয়াল মনে হল একটু অবাক হয়ে গেল, বলল, “তোরা খেলবি? মানে মেয়েরা?”

“হ্যাঁ। তোরা যদি চাস আমাদের সাথে খেলতে পারিস।”

“কী খেলবি তোরা?”

“সাত-চাড়া।”

“সাত-চাড়া?” গাব্বু এবং পিয়াল একসাথে হেসে উঠল।”হাসছিস যে বড়? খেলিসনি কখনো সাত-চাড়া?”

“খেলব না কেন? কিন্তু সাত-চাড়া কি একটা খেলা হল? কোথায় ক্রিকেট আর কোথায় সাত-চাড়া!”

“খেলা তো খেলাই। যেটা খেলতে মজা লাগে সেটাই খেলা।”

“তোকে বলেছে!” পিয়াল মুখ শক্ত করে বলল, “কোনোদিন শুনেছিস সাত চাড়া টুর্নামেন্ট হচ্ছে? শুনেছিস ওয়ার্ল্ড কাপ হচ্ছে সাত-চাড়া খেলায়?”

গাব্বু হিহি করে হাসতে হাসতে বলল, “সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ! হি হি হি!”

পিয়াল বলল, “বুকের পাটা থাকে তো আয় ক্রিকেট খেলতে। টেনিস বল না, একেবারে খাঁটি ক্রিকেট বল!”

সুমি কোমরে হাত দিয়ে বলল, “কী ভাবছিস? আমি পারব না?”

সুমির সাথে আরও কয়েকজন মেয়ে ছিল, তাদের একজন বলল, “থাক বাবা দরকার নেই। চল যাই আমরা আমাদের খেলা খেলি।”

সুমি চোখে আগুন ঢেলে বলল, “আমরা মাঠে আগে এসেছি আমরা খেলব।”

মেয়েটা নরম গলায় বলল, “থাক সুমি। ছেড়ে দে। ঝগড়া করে কী লাভ? আয়, আমরা ওইপাশে চলে যাই।”

“ফাজলেমি নাকি? কক্ষনো না।”

“আয়, আয়। ছেলেদের সাথে ঝগড়া করে কী লাভ! আমাদের তো বেশি জায়গাও লাগবে না!”

সুমি আরও কী-একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু অন্য মেয়েরা তাকে টেনে সরিয়ে নিল। গাব্বু হা হা করে হেসে বলল”সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ! সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ!”

পিয়াল চেঁচিয়ে বলল, “সাত-চাড়া চ্যাম্পিওন সুমি!”

বুবুন একটু অস্বস্তি নিয়ে বলল, “কেন তোমরা ওকে জ্বালাচ্ছ? ও তো ঠিকই বলেছে। ওরা আগে এসেছে ওদেরই তো খেলার কথা!”

“ধুর! মেয়েরা আবার কী খেলবে?”

“একসাথে সাত-চাড়া খেললেই হত। আমার তো ভালোই লাগে সাত-চাড়া খেলতে।”

“ভলো লাগে”

“ধুর!” গাব্বু হাত নেড়ে উড়িয়ে দিয়ে দল ভাগাভাগি শুরু করে দিল।

কিছুক্ষণের মাঝেই খেলা শুরু হয়ে গেল। পিয়াল ব্যাট করতে নেমেছে, গাব্বু উইকেট কিপার। ফরসামতন হালকা-পাতলা একটা ছেলে ছুটে এসে বল করল। পিয়াল বড় হয়ে দুর্ধর্ষ ব্যাটসম্যান হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই, শরীর ঘুরিয়ে মারতেই বল উড়ে গেল আকাশে, সবাই অবাক হয়ে দেখল ঘুরতে ঘুরতে নেমে এসে লাগল জানালার কাঁচে। শক্ত জানালার কাঁচ–ক্রিকেট বল পর্যন্ত ধাক্কা খেয়ে ফিরে এল। আতঙ্কে আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি মাত্র বুক থেকে বের করেছে ঠিক তখন কথা নেই বার্তা নেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল জানালার কাঁচ।

পিয়াল রক্তশূন্য মুখে বলল, “সর্বনাশ!”

গাব্বু বলল, “পালা।”

কথা শেষ হবার আগেই ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে স্ট্যাম্প তুলে নিয়ে সবাই উধাও হয়ে গেল। দৌড়ে পালাতে বুবুনের কেমন জানি লজ্জা করছিল, কিন্তু যখন অন্য সবাই পালিয়ে গেছে তখন একা দাঁড়িয়ে থাকা মনে হয় বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বুবুন ঠিক যখন দৌড় দেবে তখন ভাঙা জানালা দিয়ে পাহাড়ের মতো একজন মানুষের মাথা উঁকি দিল, মানুষটির পিয়ালের মতো বোচা নাক এবং উঁচু কপাল, দেখেই বোঝা যায় তার বাবা। বুবুন আর দৌড়ানোর সাহস পেল না, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।

মানুষটি ভাঙা জানালা দিয়ে মাথা বের করে একটা হুংকার দিয়ে বলল, “কে কাঁচ ভেঙেছে?”

মেয়েদের সবাই কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল, এই মানুষটাকে শুধু পিয়াল নয়, মনে হয় সবাই ভয় পায়। মানুষটা চোখ পাকিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে আরও জোরে হুংহার দিয়ে বলল, “কে ভেঙেছে?”

সুমি সাত-চাড়া খেলার টেনিস বল হাতে নিয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমরা দেখি নাই চাচা।”

“দেখ নাই মানে? তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছ না?”

“না চাচা, আমরা তো খেলছিলাম?”

“পিয়াল হারামজাদা কই? নিশ্চয়ই পিয়াল–ক্রিকেট বল দিয়ে—”

সুমি জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না চাচা, আজকে কেউ ক্রিকেট খেলছে না। সবাই মিলে সাত-চাড়া খেলছি।” সুমি বুবুনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তা-ই বুবুন?”

বুবুন বোকার মতো মাথা নাড়ল। সুমি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “আজকে ছেলের টিম আর মেয়ের টিম খেলা হচ্ছে।”

“কোথায় গেছে সবাই?”

“চাড়া ভেঙ্গে লুকিয়ে আছে। সাত-চাড়া খেলার নিয়ম জানেন তো? প্রথমে চাড়া ভেঙে—”

“তা হলে জানালার কাঁচ ভাঙল কেমন করে?”

“মনে হয় মডেল স্কুলের ছেলেরা ভেঙেছে।”

পিয়ালের আব্বা অবাক হয়ে বললেন, “মডেল স্কুলের ছেলেরা?”

“জি চাচা। ডিবেটে আমাদের স্কুলের টিমের কাছে হেরে গিয়েছিল তো তাই আমাদের উপর খুব রাগ। আমাদের দেখলেই ঢিল মারে।” সুমি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে-থাকা একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “তাই না রে বকুল?”

বকুল নামের মেয়েটি ফ্যাকাশে হয়ে ঢোক গিলে মাথা নাড়ল। পিয়ালের আব্বা সুমির কথা বিশ্বাস করলেন কি না বোঝা গেল না। নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভিতরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণের মাঝেই গুটিগুটি পায়ে ছেলের দল এসে হাজির হল–তারা কাছাকাছি কোথায় লুকিয়ে থেকে সুমির সাথে পিয়ালের আব্বার কথাবার্তা শুনেছে। পিয়াল দুর্বল গলায় বলল, “সুমি!”

“কী হল?”

“আমি তোকে আচার কিনে-খাওয়াব। খোদার কসম।”

সুমি মুখ ভেংচে বলল, “আমি তোর আচার খাওয়ার জন্য মারা যাচ্ছি!”

“সত্যি সুমি। তুই বাঁচিয়েছিস আমাকে–এখনও বিপদ পুরোপুরি যায়নি কিন্তু যদি সত্যি কথাটা বলে ফেলতি একেবারে অবস্থা কেরোসিন হয়ে যেত।”

গাব্বু মাথা নেড়ে বলল, “একেবারে কেরাসিন!”

“আব্বা মেরে একেবারে ভর্তা করে ফেলতেন।”

গাব্বু বলল, “লাশ পড়ে যেত।”

সুমি মুখ শক্ত করে বলল, “দ্যাখ পিয়াল, অন্য কেউ হলে আমি কখনো এত বড় মিথ্যা কথাটা বলতাম না। কখনো না। শুধু তো আব্বা বলে”

বুকুল নামের মেয়েটি এগিয়ে বলল, “সত্যি কথাটাই বলা উচিত ছিল। মনে আছে আমাদের সাথে কীরকম ব্যবহার করেছিস?”

আরেকটি মেয়ে বলল, “মনে আছে?”

সুমি হাত নেড়ে বলল, “ছেড়ে দে! এরা তো বড় হয়ে পুরুষমানুষ হবে তাই এখন থেকে প্র্যাকটিস করছে।”

পিয়াল বলল, “আর কখনো করব না, খোদার কসম।”

বুবুন বলল, “এখানে এরকম দাঁড়িয়ে না থেকে আসলে আমাদের সবাই মিলে এখন সাত-চাড়া খেলা উচিত।”

গাব্বু মাথা নাড়ল, “ঠিকই বলেছে বুবুন। নইলে সন্দেহ করতে পারে।”

“হ্যাঁ। চল খেলা শুরু করে দিই।”

সুমি দাঁত বের করে হেসে বলল, “চল। কে জানে তোরা হয়তো একদিন সাত-চাড়া ওয়ার্ল্ড কাপ খেলতে পারবি!”

পিয়াল অপরাধীর মতো সুমির দিকে তাকাল, কিছু বলল না।

সাত-চাড়া খেলা নিয়ে ছেলেদের একটা তাচ্ছিল্যের ভাব থাকলেও দেখতে দেখতে খেলা খুব জমে উঠল। একেবারে সন্ধ্যে না হওয়া পর্যন্ত তারা খেলে গেল। খেলাশেষে সবাই নিজেদের বাসায় ফিরে যাচ্ছে। পিয়াল বিপদ হতে পারে বলে ক্রিকেট ব্যাটটা বুবুনকে রাখতে দিয়েছে, বুবুন ব্যাটটা ঘাড়ে করে হাঁটছে সাথে গাঙ্কু আর সুমি। গাব্বু বলল, “সাত-চাড়া খেলাটা আসলে খারাপ না।”

বুবুন বলল, “আসলে সবাই মিলে খেললে সব খেলাই মজার।”

সুমি বলল, “দিনরাত ক্রিকেট খেলে তোরা যে কী মজা পাস।”

গাব্বু বলল, “খেলিসনি তো, তাই জানিস না।”

বুবুন হঠাৎ ঘুরে তাকিয়ে বলল, “পিয়ালের আব্বা যদি জানতে পারেন ক্রিকেট বল দিয়ে জানালার কাঁচ ভেঙেছে তা হলে সত্যি সত্যি পিয়ালকে মারবেন?”

সুমি বলল, “জানে শেষ করে দেবেন।”

বুবুন বলল, “সত্যি? ইচ্ছে করে তো ভাঙেনি।”

“তাতে কী হয়েছে?”

গাব্বু দার্শনিকের মতো বলল, “আসলে আব্বা জিনিসটা হচ্ছে একটা কপালের ব্যাপার। যেমন মনে করো সুমির কপালটা একেবারে ফাস্ট ক্লাস। সুমি যদি একটা মার্ডার করে আসে সুমির আব্বা বলবেন, ভেরি গুড সুমি। কী সুন্দর করে মার্ডার করেছে দেখেছ! আর কেউ এত সুন্দর করে মার্ডার করতে পারবে?”

গাব্বুর কথা বলার ভঙ্গি শুনে সুমি আর বুবুন দুজনেই হেসে ফেলল। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “সত্যি?”

গাব্বু বলল, “সত্যি না তো মিথ্যা? সুমি যে এইরকম বেড়েছে তার কারণটা কী? আমাদের ছেলেদের যেসব জিনিস করা নিষেধ সুমি সেগুলো পর্যন্ত করতে পারে ওর আব্বা কিছু বলেন না। উলটো উৎসাহ দেন। একেবারে ফার্স্ট ক্লাস আব্বা!”

“তোমার আব্বা?”

“আমার আব্বা মাঝামাঝি। পিয়ালের আব্বা হচ্ছে ডেঞ্জারাস। ওর কপালটা খারাপ। এখন মনে করো জানালার কাঁচ ভেঙেছে, সুমি চেষ্টা করছে ওকে বাঁচানোর, কিন্তু তবু মনে হয় মার কিছু খাবে। যদি জানালার কাঁচ না ভাঙত তবু মার খেত–”

“কেন?”

“যদি ভেঙে যেত সেজন্যে। পিয়ালের আব্বা সবসময় অ্যাডভান্স কিছু পিটিয়ে রাখেন।”

সুমি মাথা নাড়ল, বলল, “আসলেই পিয়ালটার কপাল খারাপ।”

বাসায় ফিরে যেতে যেতে বুবুনের মাথায় একটা প্রশ্ন এল, যদি সুমির কপাল ভালো, গাবুর কপাল মাঝামাঝি এবং পিয়ালের কপাল খারাপ হয়ে থাকে তা হলে তার কপাল কি? কপার কি কখনো নাই’ হতে পারে?

রাত্রিবেলা বুবুন নিজের ঘরে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। অনেক মানুষই আছে যারা শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে যায়, বুবুন ওরকম না,শোয়ার সময় হলেই ঘুরেফিরে তার মাথায় রাজ্যের যত চিন্তা এসে জড়ো হয়। আজকেও শুরু হচ্ছিল কিন্তু সে জোর করে সব ঠেলে সরিয়ে দিল। চেষ্টা করে সে যখন প্রায় ঘুমিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে কে যেন তাদের বাসার খুব কাছে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠল, সাথে সাথে আরও অনেকে। বুবুন ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠে বসল, তারপর তড়াক করে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে একেবারে আম্মার কাছে। আম্মা নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে কী-একটা বই পড়ছিলেন, বুবুনকে দৌড়ে আসতে দেখে বললেন, “কী হল, বুবুন?”

“ওটা কিসের শব্দ?”

আম্মা হেসে ফেলে বললেন, “কী লজ্জার কথা! বাঙালির ছেলে শেয়ালের ডাক চেনে না!”

“এটা শেয়ালের ডাক?”

“হ্যাঁ।”

“কিন্তু শেয়াল নাকি হুক্কা হুয়া হুক্কা বলে ডাকে? এটা তো সম্পূর্ণ অন্যরকম। মনে হয় কেউ কাঁদছে।”

“এটাই শেয়ালের ডাক। আগে তো শহরের মাঝখানে ছিলি, শেয়ালের ডাক শুনিসনি। এখন পিছনে টিলা জঙ্গল নদী এসব আগে তা-ই শুনছিস। যা ঘুমা গিয়ে।”

বুবুন আবার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে একটু দূরে থেকে আবার শেয়ালেরা ডেকে উঠল। প্রথমে একটা ডেকে ওঠে তারপর একসাথে অনেকগুলো। আর সবচেয়ে অবাক ব্যাপার শেয়ালের ডাক শুনলেই বুকের ভিতরে কীরকম জানি করতে থাকে। একই সাথে এরকম ভয় আর একরকম খালি-খালি মন-খারাপ-করা ভাব। কেন এটা হয়?

বুকের মাঝে খালি-খালি এক ধরনের ভাব নিয়ে বুবুন একসময় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন বিকেলে সবাই একত্র হয়েছে, জানালার কাঁচ ভাঙার ঘটনার পর থেকে কয়েকদিন হল ক্রিকেট খেলা আপাতত বন্ধ। কী খেলা যেতে পারে সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তখন বুবুন হঠাৎ করে বলল, “কাল রাত্রে তোমরা শেয়ালের ডাক শুনেছিলে?”

গাব্বু অবাক হয়ে বলল, “কেন? কী হয়েছিল শেয়ালের ডাকে?”

“কিছু হয়নি। কিন্তু–”

“কিন্তু কী?”

“শুনলে কীরকম লাগে না? ভয়-ভয় খালি-খালি–”

পিয়াল চোখ ছোট ছোট করে বলল, “তুমি আগে কখনো শেয়ালের ডাক শোননি?”

“না। কীভাবে শুনব? বইয়ে পড়েছিলাম হুক্কা হুয়া–”

সুমি হি হি করে হেসে বলল, “তুই কি মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছিস নাকি? পরে শুনব কোনদিন মশাও দেখিসনি।”

এখানে সবাই সবাইকে তুই তুই করে বলে, বুবুন নুতন এসেছে বলে এখনও তুমি তুমি করে বলছে। সুমি অবশ্যি তুই শুরু করে দিয়েছে। সুমির কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল, বুবুন একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “আমাকে নিয়ে হাসছ কেন? খোঁজ নিয়ে দেখো ঢাকা শহরে কয়জন শেয়ালের ডাক শুনেছে!”

পিয়াল বলল, “তার মানে তুমি শেয়াল দেখওনি!”

“না। কিন্তু টেলিভিশনে দেখেছি। অনেকটা কুকুরের মতো।”

গাব্বু বলল, “লজ্জার ব্যাপার। একটা মানুষ কোনোদিন শেয়াল দেখেনি।”

সুমি বলল, “চল শেয়াল দেখিয়ে আনি।”

বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে দেখাবে?”

গাব্বু বলল, “শেয়ালদের কলেজ আছে, সেখানে গেলেই দেখবে সবাই বই খাতা নিয়ে পড়াশোনা করছে। হি হি হি–” গাব্বু নিজের রসিকতায় নিজেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল।

পিয়াল বলল, “বেশির ভাগ সময় পড়াশোনা না করে পলিটিক্স করে। শ্লোগান দিতে থাকে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া–” এটা শুনে গাবুর মনে হল আরও বেশি আনন্দ হল, হাসতে হাসতে সে এবারে প্রায় মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।

বুবুন বলল, “যাও! ঠিক করে বলল-না–”

সুমি বলল, “ঐ টিলায় শেয়ালের গর্ত আছে। গর্তের মুখে আগুন দিয়ে ধোঁয়া দিলেই শেয়াল বের হয়ে আসবে।

“সত্যি?”

“সত্যি না তো মিথ্যা?”

“আগে কখনো বের করেছ?”

“এখনও বের করিনি, চল, আজকে বের করব।”

“ধোয়া কেমন করে দিতে হয়?”

“খবরের কাগজ পেঁচিয়ে আগুন ধরালেই ধোঁয়া হবে। আবার কঠিন কী?”

গাব্বু বলল, “সবচেয়ে ভালো হয় যদি একটা টেম্পো ধরাধরি করে টিলার উপরে নিয়ে যাই। টেম্পোর পিছনে দিয়ে কীরকম কালো ধোঁয়া বের হয় দেখেছিস?”

গাব্বু আবার নিজের রসিকতায় নিজেই হি হি করে হাসতে শুরু করল। সুমি চোখ পাকিয়ে বলল, “গা! তুই দিনে দিনে দেখি সিনেমার জোকার হয়ে যাচ্ছিস!”

কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল এই ছোট দলটি টিলার দিকে হেঁটে যাচ্ছে। ধোঁয়া দিয়ে শেয়ালের গর্ত থেকে শেয়াল বের করা হবে শুনে আরও কিছু বাচ্চাকাচ্চা দলে যোগ দিয়েছে। সুমি অন্য মেয়েদের ডাকাডাকি করছিল, কিন্তু তাদের কেউ আসতে সাহস পেল না। বকুল সুমিকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে থামানোর চেষ্টা করছিল কিছু-কিছু কাজ মেয়েদের করতে হয় না সেটা নিয়েও একটা লেকচার দিয়েছিল, কিন্তু কোনো লাভ হল না।

টিলার নিচে একটা ডোবামতো জায়গা আছে, সেটাকে পাশ কাটিয়ে তারা উপরে উঠে গেল। জায়গাটা বেশ নির্জন, কিন্তু একেবারে উপরে উঠে দেখতে পেল সেখানে একজন মানুষ বসে আছে। মানুষটার চেহারায় একটা ইঁদুর-দুর ভাব, কালচে গায়ের রং, ছুঁচালো মুখ, সরু গোঁফের রেখা। মানুষটা তাদের দিকে খুব সন্দেহের চোখে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না। সুমির পিছনে পিছনে অন্য সবাই হেঁটে হেঁটে টিলার অন্যপাশে হাজির হল। খানিকটা জায়গা বেশ খাড়া, পাথর মাটিতে মেশানো, ছোট ছোট ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা। সেখানে ছোটবড় অনেকগুলো গর্ত। সুমি থেমে বলল, “এই যে শেয়ালের গর্ত।”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “তুমি কেমন করে জান?”

“একদিন শেয়ালকে ধাওয়া করেছিলাম, তখন দেখেছি এখানে এসে ঢুকেছে।”

গাব্বু বলল, “হতে পারে চা-নাশতা খাওয়ার জন্যে ঢুকেছে, কিন্তু থাকে অন্য জায়গায়।”

সুমি ধমক দিয়ে বলল, “খালি বাজে কথা বলিস না।”

খবরের কাগজ পেঁচিয়ে দলা পাকানো হল, ম্যাচ বের করে সেখানে আগুন দেয়া হল, একটু আগুন এবং অনেকখানি ধোয়া হওয়ার কথা ছিল কিন্তু হল উলটোটা, অনেকখানি আগুন এবং একটুখানি ধোয়া। সেই ধোঁয়া শেয়ালের গর্তে ঢোকার কথা কিন্তু ধোঁয়া ভিতরে না ঢুকে গর্তের মুখে পাক খেতে থাকল। বুবুন মাথা নেড়ে বলল, “ধোঁয়া তো ঢুকছে না!”

গাব্বু বলল, “যারা সিগারেট খায় তাদের নিয়ে এলে হত, সবাই মিলে। সিগারেটে টান দিয়ে ভিতরে ধোয়া ছাড়ত।”

সুমি কোনো কথা না বলে বিষদৃষ্টিতে গাব্বর দিকে তাকাল। কিছুক্ষণের মাঝেই যেটুকু খবরের কাগজ আনা হয়েছিল পুড়ে ছাই হয়ে গেল, লাভের মাঝে লাভ হল সবাই কয়েক জায়গায় ছ্যাকা খেল, নাক দিয়ে ধোঁয়া ঢুকে খানিকক্ষণ কাশাকাশি করল, চোখে লেগে চোখ জ্বালা করতে লাগল। যে-শেয়ালকে বের করার জন্যে এত চেষ্টা-চরিত্র তার টিকিটিও দেখা গেল না। সুমি বলল, “পরের বার বেশি করে খবরের কাগজ আনতে হবে।”

“খবরের কাগজে হবে না–” পিয়াল মাথা নেড়ে বলল, “লাকড়ি নিয়ে আসতে হবে। সাথে বড় টেবিল ফ্যান। ফ্যান দিয়ে ধোঁয়া ভিতরে ঢোকাতে হবে।”

“ফ্যানটার প্রাগ লাগাবে কোথায়?”

পিয়াল থতমত খেয়ে বলল, “তাও তো কথা!”

সবাই মিলে হেঁটে হেঁটে ফিরে যেতে যেতে টিলার চূড়োয় এসে আবার সেই আগের ইঁদুরের মতো মানুষটাকে দেখতে পেল, উদাস-উদাস মুখ করে তাকিয়ে আছে। তাদের এই ছোট দলটাকে দেখে আবার কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকাল। ওরা যখন প্রায় চলে যাচ্ছিল তখন লোকটা বলল, “তোমরা কোথায় থাক?”

অচেনা সন্দেহজনক মানুষের সাথে কথাবার্তা বলা ঠিক না, কিন্তু একজন মানুষ যখন প্রশ্ন করছে কিছু-একটা তো বলতে হয়। গা অনিশ্চিতের মতো হাত নেড়ে বলল, ঐ তো ওইখানে।”

মানুষটা দূরে তাদের বাসার দিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “রওশন মানে একজন মেয়েলোক থাকে তারা বাসা কোনটা জান?”

বুবুন একটু চমকে উঠল, তার আম্মার নাম রওশন জাহান কিন্তু সবাই ডাকে ডক্টর রওশান। কখনো কেউ তাকে মেয়েলোক’ বলবে না, আরকিছু না হলে অন্ততপক্ষে ভদ্রমহিলা তো বলবে। বুবুনের সাথে সাথে সবাই তখন লোকটার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাল। গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “কি করবেন তার বাসা দিয়ে?”

লোকটা এইবার থতমত খেয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, “না, মানে, এমনি জানতে চাচ্ছিলাম।”

বুবুন একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কী করেন?”

“আমি?”

“হ্যাঁ। কী করেন আপনি? নাম কী আপনার? কোথায় থাকেন?”

লোকটার মুখ হঠাৎ কেমন জানি শক্ত হয়ে যায়, কর্কশস্বরে বলল, “আমি কী করি না-করি সেটা দিয়ে তুমি কী করবে?”

বুবুন বলল, “আপনি কিছু জানতে চাইলে দোষ নেই, আমরা জানতে চাইলে দোষ?”

সুমি বলল, “কথা বলে কাজ নই বুবুন, চলে আয়।”

বুবুন অন্য সবার সাথে ফিরে চলল, যেতে যেতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখল মানুষটা চোখ ছোট ঘোট করে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেন মানুষটা আম্মা কোন বাসায় থাকেন জানতে চেয়েছিল?

রাতে আম্মা একটা খাম খুলে একটা চিঠি বের করে পড়তে পড়তে হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে গেলেন। বুবুন একটু ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে আম্মা?”

“না, কিছু না।” খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “এই চিঠিটা কে দিয়েছে তুই জানিস?”

“না, আম্মা। কিন্তু–”

“কিন্তু কী?”

শেয়ালের গর্তে আগুন দিতে গিয়ে যে-মানুষটার সাথে দেখা হয়েছিল তার কথা বলবে কি না চিন্তা করে বুবুন বলেই ফেলল।”আমরা টিলায় গিয়েছিলাম সেখানে একটা লোক তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল।”

“কী রকম দেখতে?”

“ইঁদুরের মতো।”

আম্মা হেসে ফেলেন, “মানুষের চেহারা আবার ইঁদুরের মতো হয় কেমন। করে?”

“হয় আম্মা হয়। তুমি দেখলেই বুঝতে পারবে।”

আম্মা কিছু বললেন না, হাতের চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কী লেখা আছে চিঠিতে!”

আম্মা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বললেন, “ঐ তো যা থাকে। ভয়-টয় দেখার আর কি!”

“কেন ভয় দেখায় আম্মা?”

“নিজেরা ভয় পায় তো সেইজন্যে ভয় দেখায়। আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষ তো পড়াশোনা জানে না তাই ধর্মের কথা বলে কাঠমোল্লারা তাদের কন্ট্রোল করে। যখন মানুষ পড়াশোনা করে তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় এই কাঠমোল্লাদের। তাই মানুষজন পড়াশোনা করলে তারা খুব রেগে যায়।”

“পড়াশোনা করলে ক্ষতি হয় কেন আম্মা?”

“মনে কর এক জায়গায় ভূমিকম্প হল। তখন এই কাঠমোল্লারা বলবে এখানে আল্লাহর গজব হয়েছে। কিন্তু যদি তারা পড়াশোনা করে তা হলে জানবে আসলে আল্লাহর গজব না, এটা হয় ফল্ট লাইন থেকে টেকটোনিক প্লেটের নড়াচড়া থেকে। তখন তো তাদের ধোঁকা দেওয়া যায় না। যারা পড়াশোনা জানে না অসুখ হলে তারা পানিপড়া খায় আর যারা পড়াশোনা করেছে তারা খায় ওষুধ। এই হচ্ছে পার্থক্য।“

“কিন্তু তোমাকে কেন ভয় দেখায়?”

“আমার উপরে রাগ বেশি। একে আমি পড়াশোনার কথা বলি, তার উপর মেয়েদের পড়াশোনার–সেইজন্যে যা এখন ঘুমা গিয়ে।”

বুবুন যেতে ফিরে এসে বলল, “তারা তোমার কিছু করবে আম্মা?”

আম্মা হেসে বললেন, “ধুর বোকা! কী করবে আবার? এরা হচ্ছে যত রাজাকার আলবদর জামাতিদের দল। সেভেনটি ওয়ানে একবার তাদের টাইট দেওয়া হয়েছে–এখন আবার দেবে!”

বুবুন নিজের ঘরে ফিরে এল। আম্মা পুরো ব্যাপারটি হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ভান করেছেন কিন্তু বুবুন লক্ষ্য করেছে আম্মার মুখে সূক্ষ্ম একটা দুশ্চিন্তার ছায়া।

ইশ! তার যদি একটা বাবা থাকত! বিশাল শক্তিশালী একটা বাবা। সেই বাবা যদি তাকে আর তার আম্মাকে সমস্ত বিপদ থেকে বুক পেতে রক্ষা করত।

বুবুন বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

০৪. খবর

৪. খবর

বুবুন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল তাদের বাসার সামনে আবছা অন্ধকারে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা তাদের বাসার দিকে আসতে শুরু করে আবার পিছিয়ে গেল। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে খুব ধীরে ধীরে বাসার সামনে পায়চারি করতে থাকে। সেখানে থাকে হেঁটে হেঁটে অন্যদিকে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর আবার তাদের বাসায় সামনে দাঁড়িয়ে গেল।

বুবুন কেমন জানি ভয় পেয়ে যায়। আম্মা রান্নাঘরে কাটাকাটি করছিলেন, বুবুন কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, “আম্মা, একটা লোক বাসার সামনে অনেকক্ষণ থেকে ঘোরাঘুরি করছে।”

“তুই কেমন করে জানিস?”

“আমি দেখেছি। বাসার দিকে আসতে শুরু করে আবার পিছিয়ে যায়।”

আম্মা গম্ভীর হয়ে গেলেন। সবজি কাটার ছুরিটা টেবিলে রেখে বললেন, “আয় দেখি।”

ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। বুবুন বলল, “ঐ যে, এসেছে।”

আম্মা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন, দরজার অন্যপাশে একজন বয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটার চোখে চশমা, মাথার চুল বেশিরভাগ সাদা। আম্মাকে দেখে বললেন, “আপনি নিশ্চয়ই ডক্টর রওশান। আমি একজন ডাক্তার, আমার নাম রাজীব হাসান। আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে এসেছিলাম।”

আম্মা দরজা থেকে সরে গিয়ে বললেন, “আসেন। ভিতরে আসেন।”

ডাক্তার রাজীব হাসান ভিতরে এসে সোফায় বসে বুবুনকে দেখিয়ে বললেন, “এ নিশ্চয়ই আপনার ছেলে বুবুন?”

আম্মা মাথা নাড়লেন। ডাক্তার সাহেব মুখটা হাসিহাসি করে বললেন, “আপনার ছেলের বয়স এখন তেরো। যখন তার দুই বছর বয়স তখন থেকে আপনার হাসব্যান্ড মিসিং।”

হঠাৎ করে আম্মার মুখটা কেমন যেন কঠিন হয়ে গেল। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, “আপনি ঠিক কী নিয়ে কথা বলতে এসেছেন?”

ডাক্তার রাজীব হাসান কেমন যেন কাঁচুমাচু হয়ে গেলেন। খানিকক্ষণ নিজের নখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “বলছি। তার আগে এক গ্লাস পানি খেতে পারি?”

আম্মা উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। ডাক্তার সাহেবের পানি খাওয়া দেখে মনে হল আসলে তার পানি তেষ্টা পায়নি, এমনি সময় নেওয়ার জন্যে খাচ্ছেন। একরকম জোর করে পুরো গ্লাস শেষ করে হাতের উলটোপিঠ দিয়ে মুখ মুছে বললেন, “আমি ঠিক কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। সত্যি কথা বলতে কি আমি অনেকক্ষণ থেকে আপনার বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করছি।”

আম্মা বললেন, “জি, আমি জানি।”

“ব্যাপারটা আপনার ছেলের সামনেই বলব কি না বুঝতে পারছি না।”

আম্মা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “কথাটা না শোনা পর্যন্ত আমিও তো বলতে পারছি না আমার ছেলের সেটা শোনা উচিত হবে কি না।”

“কোনো-না-কোনো সময়ে তাকে তো জানতেই হবে”

“তা হলে তার সামনেই বলুন।”

ডাক্তার রাজীব হাসান আবার নিজের নখের দিকে তাকালেন, তারপর একরকম জোর করে মুখ তুলে আম্মার দিকে তাকালেন। একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “কথাটা আপনার স্বামীকে নিয়ে।”

আম্মা হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠে সোজা হয়ে বসে প্রায় আর্তচিৎকার করে বললেন কী কথা?”

“আপনার স্বামী—”

রাজীব হাসান কথা শেষ করার আগেই আম্মা প্রায় দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে বললেন, “বেঁচে আছে?”

রাজীব হাসান কিছু-একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু ঠিক বলতে পারলেন না। আম্মা ভাঙা গলায় চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, “বেঁচে আছে এখনও?”

রাজীব হাসান আস্তে আস্তে বললেন, “আমি ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি ডক্টর রওশান। হ্যাঁ, আপনার স্বামী মাসুদ আহমেদ বেঁচে আছে, তবে

আম্মা হঠাৎ বুবুনকে ঝাঁপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “বুবুন! তোর আব্বা বেঁচে আছে–

ডক্টর রাজীব হাসান সোফা থেকে উঠে আম্মার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, “ডক্টর রওশান, প্লিজ আপনি আমাকে আমার কথা শেষ করতে দিন, নাহয় আপনার ভয়ংকর আশাভঙ্গ হবে, আমি তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। প্লিজ—প্লিজ–”

আম্মা রাজীব হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “না ডাক্তার সাহেব, আমার আশাভঙ্গ হবে না। মানুষটা যদি শুধু বেঁচে থাকে তা হলেই হবে, আমি আর কিছু চাই না। মানুষটা পাগল হোক, বদ্ধ উন্মাদ হোক, শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হোক, কিছু আসে যায় না। গত এগারো বছর প্রতি রাতে আমি খোদার কাছে দোয়া করেছি, খোদা, মানুষটাকে বাঁচিয়েং রাখো, বাঁচিয়ে রাখো–”

রাজীব হাসান আম্মার পাশে বসে বললেন, “খোদা আপনার দোয়া শুনেছেন ডক্টর রওশান। আপনার স্বামী বেঁচে আছেন সত্যি, কিন্তু পুরোটুকু আগে শুনুন”

আম্মা চোখ মুছলেন, বুবুন বুঝতে পারল আম্মা এখনও থরথর করে কাঁপছেন। ডাক্তার রাজীব হাসান বললেন, “আপনার স্বামী অর্থাৎ মাসুদ বেঁচে আছে, কিন্তু তার কোনকিছু মনে নেই। তার থেকেও যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে–” ডাক্তার রাজীব হাসান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তার ব্রেনের সেরেব্রাল করটেক্সে যে ম্যালিগনেন্ট টিউমার হয়েছিল সেটা সরানোর সময় ব্রেনে মেজর ড্যামেজ হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম সে পুরোপুরি একটা ভেজিটেবলে হয়ে যাবে। সত্যি কথা বলতে কি প্রথমে তাই ছিল কিন্তু খুব ধীরে ধীরে বাউন্স ব্যাক করেছে। তার শরীরের কোঅর্ডিনেশান ফেরত পেয়েছে। কিন্তু–”

ডাক্তার রাজীব হাসান আবার একটু থেমে খুব মনোযোগ দিয়ে নিজের নখগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। আম্মা নিঃশ্বাস আটকে রেখে বললেন, “কিন্তু?”

“কিন্তু মাসুদ একটা শিশুর মতো হয়ে গেছে। তার মানসিক বয়স আট-নয় বৎসর বয়সের একটা বাচ্চার মতো।”

আম্মা বুকে আটকে-থাকা নিঃশ্বাসটা বের করে আবার ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, “আমার একটা বাচ্চা আছে, এখন নাহয় দুটো বাচ্চা থাকবে।”

রাজীব হাসান মাথা নেড়ে বললেন, “আপনার অ্যাটিচুড আমার খুব পছন্দ হয়েছে ডক্টর রওশান। আমি এটা নিয়ে একটু ভয় পাচ্ছিলাম। এতদিনের ব্যাপার, কিছু-একটা অন্যরকমও তো হতে পারত।”

“কী হবে? আমি এগারো বছর ধরে অপেক্ষা করছি!”

“এখনও অবিশ্যি একটা সমস্যা রয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি সবচেয়ে বড় সমস্যা।”

আম্মার মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ল, “কী সমস্যা?”

‘মাসুদকে আপনাদের হাতে তুলে দেওয়া! বুঝতেই পারছেন, সে একেবারে সাত-আট বছরের বাচ্চার মতো–আমার ওখানেই মোটামুটি আছে। আপনাদের কথা জানে না–এখন সে তো আপনাদের সাথে থাকতে চাইবে না!”

বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেন?”

“তুমি কি এখন তোমার মাকে ছেড়ে আরেকজনের সাথে থাকতে পারবে? সেই একই ব্যাপার। তোমার আব্বা এখন বয়সে তোমার থেকেও ছোট একটা বাচ্চার মতো!”

বুবুন কথাটা বুঝতে পারল কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব সেটা কোনোভাবেই ভেবে পেল না। রাজীব হাসান বললেন, “এখন একটা দিন ঠিক করে, খুব সাবধানে মাসুদকে এখানে আনতে হবে। প্রথম আপনাদের একসেপ্ট করবে না–“

আম্মা রাজীব হাসানকে বাধা দিয়ে বললেন, “আপনার কাছে ছবি আছে? মাসুদের ছবি?”

“হ্যাঁ। আমি একটা ছবি এনেছি। এই যে–” বলে রাজীব হাসান বুকপকেট থেকে একটা ছবি বের করলেন, আম্মা প্রায় এক নিমিষে ছিনিয়ে নিলেন ছবিটা। এক নজর দেখে ছবিটা দুই হাতে বুকের মাঝে চেপে ধরে আবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন।

ঠিক এই সময় দরজায় শব্দ হল, আম্মা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছর চেষ্টা করলেন, বুবুন গিয়ে খুলে দিল। দরজায় জাহিদ চাচা দাঁড়িয়ে আছেন, হাসিহাসি মুখে বললেন, “কী খবর মিস্টার বুবুন?”

বুবুন কী বলবে বুঝতে পারল না, জাহিদ চাচা ভিতরে ঢুকে আম্মাকে আঁচল দিয়ে চোখমুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে একেবারে থতমত খেয়ে গেলেন। জাহিদ চাচা একবার ডাক্তার রাজীব হাসান আরেকবার বুবুনের দিকে তাকালেন, তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “আমি বলেছি না, আমি প্রত্যেকবার ভুল সময়ে চলে আসি!”

বুবুন বলল, “জাহিদ চাচা আমার আব্বা বেঁচে আছেন?”

জাহিদ চাচা চমকে উঠলেন, “কী বললে?”

“আমার আব্বা বেঁচে আছেন।”

“বেঁচে আছেন? সত্যি?”

“হ্যাঁ চাচা। আমাদের কারও কথা নাকি মনে নেই!”

জাহিদ চাচা তখনও চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন, কোনোমতে আবার বললেন, “বেঁচে আছেন! বেঁচে আছেন?”

“হ্যাঁ চাচা। কিন্তু ব্রেনে টিউমার হয়েছিল তো তাই আমার আব্বা নাকি বাচ্চাদের মতো হয়ে গিয়েছেন।”

জাহিদ চাচা বললেন, “বেঁচে আছেন তা হলে! কী আশ্চর্য!”

.

ডাক্তার রাজীব হাসান আর জহিদ চাচাকে রাতে খেয়ে যেতে হল। খেতে খেতে ডাক্তার রাজীব হাসান আব্বার গল্প করলেন। কেমন করে তাকে পাওয়া গেল, কেমন করে তাকে হাসপাতালে রাখা হল, কেমন করে তার নাক দিয়ে চোখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল কোনো উপায় না দেখে কীভাবে তাঁর অপারেশান করা হল। কীভাবে কীভাবে আব্বা সুস্থ হলেন শুনতে শুনতে বুবুনের চোখে পানি এসে যাচ্ছিল। আব্বার শার্টে যে ঠিকানা সেলাই করে রাখা ছিল এবং সেটা কীভাবে হারিয়ে গিয়েছিল সেটা শুনে বুবুনের প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ এতদিন পরে কেমন করে সেই ঠিকানাটা খুঁজে পাওয়া গেল আর ডাক্তার রাজীব হাসান কীভাবে খুঁজে খুঁজে আম্মাকে বের করল সেই অংশটা শুনে বুবুন আনন্দে প্রায় হাততালি দিতে থাকে।

গভীর রাতে সবাই চলে গেলে আম্মা বুবুনকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বললেন, “বুঝলি বুবুন, সবাই বলেছিল তোর আব্বাকে ভুলে যেতে। সবাই! তুই পর্যন্ত বলেছিলি। আমি তবু মানুষটাকে মনে রেখেছিলাম। প্রত্যেকদিন রাতে আমি খোদাকে বলেছি, হে খোদা, মানুষটাকে ফিরিয়ে দাও। দেখলি, খোদা মানুষটাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে!”

“আমরা আব্বাকে আনতে কবে যাব আম্মা?”

“আমি তো আজ রাতেই যেতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু ডাক্তার সাহেব যে না। করলেন! বললেন একটু সময় দিতে।”

“কেন আম্মা?”

“তোর আব্বা তো এখন একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো, জোর করে আনা যাবে না, বুঝিয়ে আনতে হবে! ডাক্তার সাহেব গিয়ে বোঝাবেন, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিয়ে আসবেন। আমরা এই ফাঁকে বাসাটা রেডি করে ফেলব!”

“আম্মা!”

“কীরে বুবুন?”

“আব্বা যে তোমাকে ভুলে গেছে, বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছে, সেজন্যে তোমার মন-খারাপ হচ্ছে না?”

“ধূর বোকা ছেলে, মন-খারাপ হবে কেন! তোর আব্বা আগেই ভুলোমনের ছিল। তুই কি ভাবছিস আগে সে খুব বড় মানুষের মতো ছিল?”

বুবুন আম্মার গা ঘেঁষে বলল, “আম্মা!”

“কীরে বুবুন?”

“আব্বার একটা গল্প বলো না!” শুনবি? কীরকম বোকা ছিল মানুষটা বলি শোন!”

রাতে গল্প শেষ করে যখন বুবুন আর আম্মা শুতে গেলেন তখন ঘড়িতে রাত আড়াইটা বাজে। বুবুন অনেকক্ষণ জেগে রইল, তার মনে হচ্ছিল বুঝি কোনোদিন ঘুমাতে পারবে না। কিন্তু একসময় তার চোখেও ঘুম নেমে এল, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল তার আব্বা এসেছেন,বাচ্চা ছেলের মতো মোটেই নন, কী সুন্দর তার চেহারা, বিশাল পাহাড়ের মতো শক্ত শরীর। সে তার আব্বার ঘাড়ে চেপে বসে রইল আর আব্বা তাকে নিয়ে পাহাড়-জঙ্গল নদী পার হয়ে যাচ্ছেন, খবিরউদ্দিন আসছিল হাতে রামদা নিয়ে, আব্বা এক লাথি দিতেই সে উলটেপালটে ছিটকে গেল, টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গেল, উড়ে গেল বাতাসে! কী যে ভালো লাগল বুবুনের সে আর বলার মতো নয়।

বুবুন ঘুম থেকে উঠল বুকের ভিতরে একটা ফুরফুরে আনন্দ নিয়ে। বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে এসে দেখল আম্মা কোমরে আঁচল পেঁচিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করছেন। বুবুনকে দেখে বললেন, “কী হল? ঘুম ভাঙল?”

“কয়টা বাজে আম্মা?”

“অনেক বেলা হয়ে গেছে, ঘড়ি দ্যাখ!”

“স্কুল! আমার স্কুল?”

“হবে না আজকে।”

বুবুন ঘড়ি দেখতে যাচ্ছিল ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল, সাথে পিয়ালের গলার স্বর, “বুবুন তাড়াতাড়ি!”

বুবুন দরজা খুলতেই দেখতে পেল বাইরে পিয়াল আর সুমি স্কুলের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে আছে। গাব্বু পিঠে ব্যাগ ঝোলাতে ঝোলাতে আসছে। সুমি অবাক হয়ে বলল, “কী হল? তুইও এখনও রেডি হোসনি? স্কুলে যাবি না?”

“নাহ্!”

“কেন?”

“আমার আব্বাকে পাওয়া গেছে!”

“কী?” একসাথে সবাই চিৎকার করে উঠল, “কী বললি?”

বুবুন মাথা নাড়ল, “আমাদের কথা অবশ্যি মনে নাই। সব স্মৃতি নষ্ট হয়ে গেছে। আর—”

“আর কী?”

তার আব্বা যে বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছেন সেটা এখনই বলবে কি না বুঝতে পারছিল না, কিন্তু এত বড় একটা খবর চেপে রাখে কেমন করে? বলল, “আমার আব্বা এখন বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছেন।”

“বাচ্চা ছেলের মতো?”

“হ্যাঁ। আম্মা বলেছেন আমার ছোট ভাইয়ের মতো দেখে রাখতে হবে। সেজন্যে আজকে ঘরদোর গোছাতে হবে। তোরা যা।”

সুমির চোখ গোল গোল হয়ে উঠল, “কীভাবে ঘর গোছাবি?”

“এখনও জানি না। ছোট বাচ্চা থাকলে যেরকম ধারালো চাকু টাকু সরিয়ে রাখতে হয়, ম্যাচ লুকিয়ে রাখতে হয় মনে হয় সেরকম।”

“সত্যি?”

বুবুন মাথা নাড়ল।

সুমি উত্তেজনা লুকিয়ে রাখতে পারল না, “স্কুল থেকে এসে আমিও তোর আব্বার জন্যে ঘর সাজিয়ে দেব। ঠিক আছে?”

পিয়াল মুখ শক্ত করে বলল, “বুবুনের আব্বা ছোট ছেলের মতো হয়ে গেছেন–ছোট মেয়ের মতো তো হননি। তুই কেন সাজাবি?”

সুমি চোখ পাকিয়ে বলল, “সেটা বোঝার মতো ঘিলু যদি থাকত তা হলে তো তুই মেয়ে হয়েই জন্মতি!”

বাকবিতণ্ডা আরও খানিক দূর এগিয়ে যেত কিন্তু স্কুলের দেরি হয়ে যাচ্ছিল, অন্য বাচ্চারা ডাকাডাকি শুরু করেছে বলে সুমি, পিয়াল আর গাবুকে চলে যেতে হল।

আম্মা আর বুবুন মিলে ঘরদোর পরিষ্কার করল। যেটা ছিল বুবুনের ঘর সেখানে আব্বা থাকবেন, বুবুন ঘুমাবে তার আম্মার সাথে। বুবুনের টেবিলটা খালি করা হল, তার খেলনা বই আর খাতাপত্র সরিয়ে আম্মার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। একটা শেলফ এনে সেখানে কিছু বই রাখা হল, আব্বা যখন ভালো ছিলেন তখন নাকি সেই বইগুলো পড়তেন। আগে বাসায় আব্বার কোনো ছবি টাঙানো থাকত না–দেখলেই আম্মার মন-খারাপ হয়ে যেত, সেজন্যে। এখন আর সেই সমস্যা নেই তাই আব্বার ছবিগুলো বের করে টানানো হল। বুবুনের বিছানায় ডাইনোসরের ছবি আঁকা বিছানার চাঁদর আর বালিশ ছিল, সেগুলো পালটে সাদা চাঁদর বালিশ দেওয়া হল। আব্বা গান শুনতে ভালোবাসতেন বলে একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আর অনেকগুলি বরীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট রাখা হল, বুবুন অবিশ্যি আপত্তি করে বলল, “আম্মা, আব্বা যদি বাচ্চা ছেলের মতন হয়ে থাকেন তা হলে কি আর বরীন্দ্রসংগীত শুনবেন?”

আম্মা ভুরু কুচকে বললেন, “কী শুনবে তা হলে?”

“রবীন্দ্রসংগীত তো শোনে বুড়োমানুষেরা–”

“আমি বুড়ো?”

“আমার থেকে তো বুড়ো।”

“তা হলে কী গান রাখতে চাস?”

“খুব হৈচৈ মার্কা তালের গান।”

আম্মা বেশি কিছু বললেন না। দিনের বড় একটা অংশ গেল খাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে। আব্বা যেসব জিনিস খেতে পছন্দ করতেন সেগুলো বাজার করে আনা হল, আম্মা হৈচৈ করে যেসব রান্না করলেন। বিকেলবেলা, সুমি, পিয়াল, গাব্ব, বকুল সবাই হাজির হল। সুমি বাগান থেকে ফুল তুলে এনেছে সেটা দিয়ে ফুলের তোড়া তৈরি করে ফুলদানিতে রাখা হল। গাব্বু এনেছে একটা সুপারম্যান এর পোস্টার আব্বা যখন বাচ্চা ছেলের মতো হয়ে গেছেন তখন বাচ্চা ছেলেরা যেসব পছন্দ করে সেসব নিশ্চয়ই পছন্দ করবেন–কিন্তু সুমি আর বকুলের প্রবল আপত্তির জন্যে সেটা টানানো গেল না!

বিকেলবেলা জাহিদ চাচা আব্বার জন্যে কিছু জামাকাপড় ভোয়ালে গেঞ্জি এসব কিনে আনলেন। আব্বা নাকি আগে ভালো চা পছন্দ করতেন সেইজন্যে ভালো দার্জিলিং চা নিয়ে এসেছেন। সাথে ভালো বিস্কুট।

সব মিলিয়ে চারিদিকে শুধু উৎসব-উৎসব ভাব। এখন বাকি শুধু আব্বার হাজির হওয়া। বুবুনের আর সময় কাটতে চায় না।

০৫. বাবা

৫. বাবা

দরজা খুলে বুবুন দেখল ডক্টর রাজীব হাসান হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, তার পাশে ফরসামতন একজন লম্বা মানুষ। রাজীব হাসান বললেন, “ভিতরে যাও মাসুদ।

ফরসা মতন লম্বা মানুষটি একটু অনিশ্চিতের মতো ভিতরে ঢুকল, বুবুন দেখল তার আম্মা অনেক কষ্টে নিজেকে থামিয়ে রেখেছেন, কিন্তু তার দুই চোখ : থেকে ঝরঝর করে পানি বের হতে শুরু করেছে। রাজীব হাসান অনেকবার বলে দিয়েছেন যেন কিছুতেই কোনোরকম হৈচৈ করা না হয়, এমন একটি ভান করতে হবে যেন পুরো ব্যাপারটি খুবই স্বাভাবিক। রাজীব হাসান যদি না বলতেন তা হলে আম্মা নিশ্চয়ই এখন ছুটে গিয়ে আব্বাকে ধরে ফেলতেন।

বুবুন অবাক হয়ে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল, বাসায় আব্বার সব ছবিতে আব্বা কালো ফ্রেমের চশমা পরে আছেন, কিন্তু এখন আব্বার চোখে কোনো চশমা নেই। আব্বার গায়ে খুব সাধারণ পোশাক, শার্টটা নতুন কিন্তু ইস্ত্রি নেই এরকম একটা প্যান্ট। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, দেখে মনে হয় হাত দুটি নিয়ে কী করবেন বুঝতে পারছেন না। আব্বার চেহারা দেখে মনে হয় কিছু-একটা দেখে একেবারে হকচকিয়ে গেছেন, দুই চোখে একই সাথে বিস্ময় এবং ভয়। বুবুন হতচকিত হয়ে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল, এই তার আব্বা? তার নিজের আব্বা? আব্বা সম্পর্কে তার নিজের ভিতরে যেসব ধারণা ছিল তার কিছুই এই মানুষটার মাঝে নেই, এই মানুষটা একেবারে সাধারণ চেহারার সাধারণ একজন মানুষ, বড়দের মাঝে যেরকম একটা আত্মবিশ্বাস থাকে, তার কিছুই এর মাঝে নেই, একেবারে ছোট একজন বাচ্চার মতো। একজন বড় মানুষের শরীরে যেন একটা ছোট বাচ্চা আটকা পড়ে আছে–দেখে বুবুনের এমন মায়া হল যে সেটি আর বলার মতো নয়।

রাজীব হাসান বুবুন এবং আম্মাকে দেখিয়ে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলেন, “মাসুদ, তুমি এদের চিনতে পারছ?”

আব্বা ভালো করে বুবুন বা আম্মার দিকে না তাকিয়েই বললেন, “নাহ্!”

“দেখো ভালো করে তাকিয়ে। এই যে ইনি হচ্ছেন তোমার স্ত্রী। আর এই যে তোমার ছেলে।”

আব্বা কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলেন, বলেন, “ধুর!”

“সত্যি।”

আব্বা এবার হেসে ফেললেন যেন ডক্টর রাজীব হাসান খুব মজার কথা বলেছেন। আম্মা এই প্রথমবার আব্বার সাথে কথা বললেন। অনেক চেষ্টা করে নিজেকে শান্ত রেখে বললেন, “মাসুদ। তুমি আমার দিকে তাকিয়ে দেখ চিনতে পার কি না।”

আব্বা আম্বার দিকে না তাকিয়েই বললেন, “না।”

রাজীব হাসান বললেন, “ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখ। ইনি তোমার স্ত্রী।”

আব্বা আবার কেমন জানি লজ্জা পেয়ে হেসে বললেন, “ডাক্তার সাহেব শুধু আমার সাথে ঠাট্টা করেন।

“না মাসুদ, আমি মোটেই ঠাট্টা করছি না। তোমার মনে নেই তাই তুমি চিনতে পারছ না।”

আব্বা কিছু বললেন না কিন্তু তার মুখ দেখে বোঝা গেল রাজীব হাসানের একটা কথাও বিশ্বাস করেননি।

রাজীব হাসান আবার বলেলন, “তুমি এখানে কয়েকদিন থাকবে মাসুদ?”

আব্বা কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলেন, তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে বললেন, “না।”

“কেন না?”

“আমি আপনার সাথে যাব।”

“ঠিক আছে আমি নাহয় কয়েকদিন পরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমি কয়েকদিন এখানে থাকো। ঠিক আছে?”

আব্বা কেমন যেন ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকালেন, আম্মার চোখে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন, বুবুনের দিকে ভালো করে তাকালেন না, ঘুরে ডক্টর রাজীব হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “না, আমি এখানে থাকব না।”

“কেন থাকবে না?”

আব্বা কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে বসে রইলেন। রাজীব হাসান জিজ্ঞেস করলেন, “ভয় করে?”

আব্বা কোনো কথা না বলে মাথা নাড়লেন। রাজীব হাসান বললেন, “তোমার ভয় কী? এরা তোমার একেবারে সবচেয়ে আপন মানুষ। একজন হচ্ছে তোমার স্ত্রী, আরেকজন ছেলে। এরা তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে–আমি তোমাকে যত ভালোবাসি তার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসে।”

“না, আমি থাকব না। আমি যাব” বলে আব্বা দাঁড়িয়ে গেলেন। বুবুন আম্মার দিকে তাকাতে পারছিল না। আম্মাকে দেখে মনে হচ্ছিল বুঝি এক্ষুনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠবেন, কিন্তু আম্মা কাঁদলেন না, অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।

আব্বা দরজার দিকে হেঁটে যেতে যেতে হঠাৎ থেমে পিছনে তাকালেন এবং প্রথমবার দেয়ালে ফ্রেম-করা তাঁর নিজের ছবিটা দেখতে পেলেন। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা সাদা একটা পাঞ্জাবি পরে আছেন–আব্বার কোলে বুবুন, তার বয়স তখন এক কিংবা দুই, বুবুনের হাতে একটা লা। দমকলের খেলনাগাড়ি। আব্বা কী মনে করে হেঁটে হেঁটে ছবিটার কাছে গেলেন, কেমন যেন হতচকিতের মতো ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখে মনে হল কিছু-একটা মনে করার চেষ্টা করছেন, তাঁর চোখেমুখে কেমন যেন একটা যন্ত্রণার ভাব ফুটে উঠল। আব্বা হাত দিয়ে ছবির যেই অংশে বুবুন রয়েছে সেখানে হাত বুলালেন, বুবুন দেখল আব্বার চোখ হঠাৎ পানিতে ভরে উঠেছে। আব্বা ঘরে রাজীব হাসানের দিকে তাকালেই তারপর ফিসফিস করে বললেন, “বুবুন!”

ঘরের সবাই একসাথে চমকে উঠল, আব্বা বুবুনকে চিনতে পেরেছেন! আম্মা দুই পা এগিয়ে এসে বললেন, “হ্যাঁ বুবুন!”

আব্বা আবার আস্তে আস্তে বললেন, “আমার বুবুন।”

আম্মা বললেন, “হ্যাঁ, তোমার বুবুন। এই দ্যাখ তোমার বুবুন কত বড় হয়েছে।”

আব্বা এবারে প্রথমবার বুবুনের দিকে ভালো করে তাকালেন। কেমন জানি একধরনের বিস্ময় এবং কৌতূহল নিয়ে বুবুনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আবার তার মুখে একধরনের যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠল। বুবুন একদৃষ্টে তার আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। আর নিজের আব্বা তার এত কাছে দাঁড়িয়েও তাকে চিনতে পারছেন না! হঠাৎ করে তার বুকের ভিতরে কী যেন হয়ে গেল, সবকিছু ভুলে সে ভাঙা গলায় ডাকল, “আব্বা!”

আব্বার মুখে যন্ত্রণার চিহ্নটা হঠাৎ যেন আরও বেড়ে গেল। বুবুনের চোখে পানি এসে যায় হঠাৎ, অনেক কষ্টে চোখের পানি আটকে রেখে বলল, “আব্বা! আমি বুবুন।”

খুব ধীরে ধীরে আব্বার মুখে শিশুর মতো একধরনের হাসি ফুটে উঠল, বুবুনের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “বুবুন! আমার বুবুন?”

“হ্যাঁ আব্বা।” বুবুন হঠাৎ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আব্বা এগিয়ে এসে শার্টের আস্তিন দিয়ে বুবুনের চোখ মুছিয়ে দিয়ে রাজীব হাসানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বুবুন অনেক বড় হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ। বড় হয়ে গেছে।”

“অনেক বড় হয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ, অনেক বড় হয়ে গেছে।”

“আগে ছোট ছিল।” আব্বা হাত দিয়ে দেখালেন, “এতটুকু ছিল আগে। এই যে এতটুকু।”

রাজীব হাসান এগিয়ে এসে আব্বার পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “তুমি কয়েকদিন তোমার ছেলের সাথে থাকো। যদি তোমার ভালো না লাগে তা হলে আমি নিয়ে যাব।”

আব্বা কিছু বললেন না, কেমন যেন খুব চিন্তিত মুখে রাজীব হাসানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। রাজীব হাসান বললেন, “থাকবে?”

আব্বা বললেন, “সত্যি সত্যি আমাকে নিয়ে যাবেন তো?”

রাজীব হাসান হেসে ফেলে বললেন, “আমি কি কখনো তোমার সাথে মিথ্যা কথা বলেছি?”

আব্বা মাথা নাড়লেন, “না, বলেন নাই।”

“তাহলে?”

রাজীব হাসান চলে যাবার পর আব্বা সোফায় সোজা হয়ে বসে রইলেন। আম্মা পাশের সোফায় বসলেন, আম্মার পাশে বসল বুবুন। আব্বা আড়চোখে একবার আম্মার দিকে তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আম্মা নরম গলায় বললেন, “মাসুদ। তোমার খিদে পেয়েছে?”

“নাহ্।”

“কী খেয়েছ?”

“ভাত। ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত।”

“তা হলে কি চা খাবে একটু?”

“আমি চা খাই না। চা খাওয়া ভালো না।”

“কেন? কী হয় চা খেলে?”

“চা খেলে রাতে ঘুম হয় না। আর গায়ের রং কালো হয়ে যায়।”

আম্মা হেসে ফেলে বললেন, “আমি তো অনেক চা খাই। আমার গায়ের রং কি কালো হয়েছে?”

আব্বা আড়চোখে একবার আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাহ! এখনও হয় নাই।”

“তুমি কি তা হলে দুধ খাবে?”

“দুধ খাওয়া ভালো। গায়ে জোর হয়।”

“খাবে তা হলে?”

“নাহ্। আমি খাব না। বুবুন খাবে।”

আম্মা বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বুবুন, তোমার আব্বা বলেছে তোমাকে দুধ খেতে হবে!”

বুবুন কাতর গলায় বলল, “না আম্মা! প্লিজ!”

আব্বা হাসি-হাসি মুখে বললেন, “বুবুন দুষ্টু। দুধ খেতে চায় না।”

আব্বাকে খুশি করার জন্য বুবুনকে এক গ্লাস দুধ আর আস্ত একটা কলা খেতে হল। আব্বার সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ার নিয়ম। তাই একটু পরেই আম্মা আর বুবুন মিলে তাকে তার শোয়ার ঘরে নিয়ে গেলেন। আব্বা তার বিছানাটা ভালো করে উলটে পালটে দেখলেন, জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলেন, তারপর বেশ অনেকবার লাইট-সুইচ অন-অফ করে দেখলেন। আব্বার জন্যে নতুন একটা স্লিপিং সুট কেনা হয়েছে, আব্বার সেটা খুব পছন্দ হল বলে মনে হল। আব্বাকে বাখরুম দেখিয়ে দেওয়া হল, সেখানে তার জন্যে নতুন টুথব্রাশ টুথপেস্ট রাখা আছে। আব্বা টুব্রাশে টুথপেস্ট লাগাতে গিয়ে ভুলে বেশি জোরে টিপে অনেকখানি টুথপেস্ট বের করে ফেললেন। আব্বা তখন বাড়তি টুথপেস্টটা আবার টুথপেস্টের টিউবে ঢোকানোর চেষ্টা করতে লাগলেন, কাজটি মোটেও সহজ নয়, কিছুক্ষণের মাঝেই তার হাত টুথপেস্টে মাখামাখি হেয় গেল। আব্বা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, “পাজি টুথপেস্ট।”

বুবুন বলল, “টুথপেস্ট একবার বের হয়ে গেলে ভিতরে ঢোকানো যায় না, আব্বা।”

আব্বা মনে হল খুব অবাক হয়ে গেলেন, “যায় না?”

“না।”

আব্বা তখন বাচ্চাদের মতো মুখ উঁচু করে দাঁত ব্রাশ করতে শুরু করলেন তাকে দেখে মনে হতে লাগল ঠিক করে দাঁত ব্রাশ করার মাঝেই পৃথিবীর সবকিছু নির্ভর করছে।

দাঁত ব্রাশ করে আব্বা বিছানায় পিঠ সোজা করে বসে রইলেন। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “আব্বা, তোমার এই ঘরটা পছন্দ হয়েছে?”

আব্বা মাথা নাড়লেন, “নাহ্। বেশি পছন্দ হয় নাই।”

বুবুন খুকখুক করে হেসে ফেলল, আব্বা যে সত্যিই করে ছোট একটা বাচ্চার মতো হয়ে গেছেন এটাই তার প্রমাণ। একজন বড় মানুষ কখনোই এরকম কথা বলে না। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কেন বেশি পছন্দ হয় নাই?”

“জানালাটা উলটা দিকে।”

“উলটা দিকে?”

“হ্যাঁ। সবসময় মাথার কাছে জানালা থাকতে হয়। আব্বা বিছানাটা দেখিয়ে বললেন, “এইখানে জানালাটা পায়ের কাছে।”

বুবুন বালিশটা নিয়ে বিছানার অন্যপাশে দিয়ে বলল, “এখন এই দিকে মাথা দিয়ে ঘুমাবে। তা হলেই মাথার দিকে জানালা হবে।”

ব্যাপারটা বুঝতে আব্বার খানিকক্ষণ সময় লাগল। যখন বুঝতে পারলেন তখন হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে উঠলেন। মাথা নেড়ে নেড়ে বললেন, “ফার্স্টক্লাস বুদ্ধি। বুবুনের ফার্স্টক্লাস বুদ্ধি!”

.

অনেকদিন পর বুবুন আম্মার সাথে শুয়েছে। অনেক বড় হয়েছে তাই আম্মার সাথে শোয়া হয় না, সবসময় আলাদা ঘরে নিজের বিছানায় ঘুমায়। আজকে শুয়ে সে হাত দিয়ে আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আম্মা, তোমার কি মন-খারাপ?”

“কেন? মন-খারাপ হবে কেন?”

“আব্বা যে তোমার সাথে কথা বলছেন না?”

আম্মার একটু হাসলেন,বললেন, “না রে পাগল! সেজন্যে আমার একটুও মন-খারাপ না। আস্তে আস্তে আমাকে যখন চিনবে তখন কথা বলবে। আমি এগারো বছর অপেক্ষা করলাম আর এই কয়দিনে কী হবে?”

“আম্মা!”

“কী?”

“তোমাকে দেখলেই আব্বা কেমন জানি লজ্জা পেয়ে যাচ্ছে। দেখেছ?”

বুবুনের কথা শুনে আম্মাও মনে হল একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন, বললেন, “সে রকমই মনে হচ্ছে।”

“কী আশ্চর্য! নিজের বউকে দেখে লজ্জা! হি হি হি!”

“পাকামো করবি না, ঘুমা।”

“আম্মা, আব্বা যদি কখনোই তোমাকে না চিনতে পারে, তা হলে কী হবে?”

“না চিনলে নাই। আমার সামনে তো থাকবে। তা হলেই হবে–আমি আরকিছু চাই না!”

গভীর রাতে বুবুনের মনে হল আম্মা বিছানা থেকে উঠছেন। বুবুন জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাও মা?”

আম্মা ফিসফিস করে বললেন, “তোর আব্বাকে দেখে আসি।”

“আমিও আসি?”

“আয়। শব্দ করিস না কিন্তু!”

বুবুন আম্মার সাথে সাথে আব্বার ঘরে গেল। জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসেছে, সেই আলোতে দেখা যাচ্ছে আব্বা গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছেন। ছোট বাচ্চারা যেভাবে পা ভাঁজ করে গোল হয়ে শুয়ে থাকে, থুতনি লেগে যায় হাঁটুর মাঝে ঠিক সেভাবে। আম্মা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলেন, বুবুন একেবার আম্মার গায়ের সাথে লেগে রইল। আম্মা কিছুক্ষণ একেবারে বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর খুব সাবধানে মশারি তুলে আব্বার কপালে হাত রাখলেন। বুবুন ফিসফিস করে বলল, “কী করছ আম্মা?”

“একটু ছুঁয়ে দেখি।”

আব্বা হঠাৎ ঘুমের মাঝে বিড়বিড় করে কিছু-একটা বলে মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরে শুলেন–আম্মা তাড়াতাড়ি পিছনে সরে এলেন। বুবুনকে ফিসফিস করে বললেন”তুই যা ঘুমা।”

“তুমি কী করবে?”

“আমি এখানে বসে থাকি কিছুক্ষণ।”

“কোথায় বসবে?”

“এই তো এখানে।” বলে আম্মা দরজায় হেলান দিয়ে বসলেন। হাঁটুতে মুখ রেখে বললেন, “তোর আব্বাকে দেখি খানিকক্ষণ। কতদিন দেখি না!”

বুবুন বিছানায় চুপচাপ শুয়ে রইল, চারিদিকে কী সুমসাম নীরবতা–মনে হয় যেন একটা ফিনফিনে পাতলা কাঁচের গ্লাস, টুং করে শব্দ হলেই ঝনঝন করে ভেঙে পড়বে।

০৬. শেয়াল দেখা

বিকালবেলা সবাই দল বেঁধে আব্বাকে দেখতে এল। বুবুন সবার সাথে আব্বার

পরিচয় করিয়ে দিল, “আব্বা, এই যে ছেলেটা-এর নাম পিয়াল।”

“পিয়াল?”

“হ্যাঁ।”

গাব্বু বলল, “ওর নাম রাখার কথা ছিল শিয়াল, ভুল করে শ-এর জায়গায় প লিখে–হি হি হি—”

আব্বা বললেন, “ধুর! শিয়াল কি কখনো কারও নাম হয়?”

বুবুন গাল্লুকে দেখিয়ে বলল, “আর এর হচ্ছে গাব্ব।”

আব্বা হেসে বললেন, “খালি ঠাট্টা করে! গাব্বু কখনো কারও নাম হয় না।”

সুমি মাথা নেড়ে বলল, “চাচা, আপনি ঠিকই বলেছেন, গাব্বু কারও নাম হয়। কিন্তু বিশ্বাস করেন তবু এর নাম গাব্বু।”

বুবুন সুমিকে দেখিয়ে বলল, “আর এই মেয়েটার নাম সুমি।”

গাব্বু বলল, “বল, এই মেলেটার নাম সুমি।”

আব্বা অবাক হয়ে বললেন, “মেলে?”

“হ্যাঁ। সুমি হচ্ছে অর্ধেক মেয়ে আর অর্ধেক ছেলে। তাই সে হচ্ছে মেলে।”সত্যি?”

“সুমি বড় হলে মনে হয় গুণ্ডা হবে।”

“গুণ্ডা?”

“হ্যাঁ। স্কুলে সেদিন একটা ছেলে তার সাথে ফাজলেমি করেছিল, তাই সুমি তাকে ল্যাং মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছিল।”

আব্বা অবাক হয়ে সুমির দিকে তাকালেন। বুবুন বলল, “আব্বা, তুমি গাব্বুর সব কথা বিশ্বাস করো না। গাব্বু সবসময় বাড়িয়ে চাড়িয়ে কথা বলে। একটা উকুন মারলে গাব্বু এসে বলে সে একটা ইঁদুর মেরেছে। ইঁদুর মারলে বলে হাতি মেরেছে।”

আব্বা বললেন, “আর হাতি মারলে?”

“এখনও মারে নাই, কিন্তু যদি মারে তা হলে মনে হয় বলবে ডাইনোসর মেরে ফেলেছেন হয় আব্বা আপন

কথাটা মনে হয় আব্বার খুব পছন্দ হল, আব্বা খুকখুক করে হেসে উঠলেন।”

সুমি জিজ্ঞেস করল, “চাচা আপনার আগের কথা কিছু মনে নেই?”

আব্বা মাথা নাড়লেন, “নাহ্!”

“বুবুনের কথা? চাচির কথা?”

“বুবুন যখন খুব ছোট ছিল সেই কথা একটু একটু মনে আছে।”

“কী করত বুবুন?”

আব্বা ভুরু কুঁচকে কিছু-একটা মনে করার চেষ্টা করে বললেন, “মাথাটা মেঝেতে লাগিয়ে পিছনটা উপরে তুলে পায়ের নিচে দিয়ে তাকিয়ে বলত বুঁদ বুদ বুদ-_”

“বুদ বুঁদ বুদ?” গাব্বু আবার হি হি হি করে হেসে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু সুমি এমনভাবে চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল যে সে আর সাহস পেল না। সুমি জিজ্ঞেস করল, “আপনার আর কিছু মনে নেই? চাচির কথা মনে নেই?”

“চাচি? সেটা কে?”

সুমি বুবুন পিয়াল এবং গাব্বু সবাই একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। বুবুন বলল, “আম্মা। আমার আম্মা।”

সুমি জিজ্ঞেস করল, “মনে নেই?”

আব্বা কেমন যেন লজ্জা পেয়ে গেলেন, লাজুক-লাজুক মুখে বললেন, “নাহ্।”

“দেখেন চেষ্টা করে।” সুমি হাল ছাড়ল না, বলল, “বুবুন যে-সময় পিছনটা উঁচু করে বলত বুঁদ বুদ বুঁদ তখন কাছে আরেকজন সুন্দর মহিলা থাকত না? সিনেমার নায়িকার মতো সুন্দর?”

আব্বা আবার খানিকক্ষণ চিন্তা করে চিন্তিত মুখে বললেন, “নাহ্।”

“এটা হতেই পারে না।” সুমি এবারে কেমন যেন রেগে গেল, “চাচা এটা হতেই পারে না। এরকম সুন্দর একজন মানুষের কথা কেমন করে ভুলে গেলেন! নিশ্চয়ই আপনার মনে আছে। আছে না?”

আব্বাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখা গেল, মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করতে লাগলেন, সুমি আবার কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল বুবুন তাকে থামাল। বলল, “সুমি, আব্বার ব্রেনে অপারেশন করেছিল সেজন্যে মনে নাই। এখন তো আর জোর করে মনে করানো যাবে না।”

“তা-ই বলে চাচির মতো সুন্দর একজন মানুষকে কি কেউ ভুলতে পারে? সেটাও কি সম্ভব?” সুমি অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই মনে পড়বে। এমনি যদি মনে না পড়ে তা হলে সাহায্য করতে হবে।”

“কীভাবে সাহায্য করবি?”

“জানি না। দেখি চিন্তা করে।”

বিকালবেলা যখন সব বাচ্চারা মাঠে হৈচৈ করে খেলছে তখন বুবুন তার আব্বাকে নিয়ে বাইরে এল। আব্বা হাত পকেটে ঢুকিয়ে মাথাটা একটু নিচু করে কেমন যেন একটু বিচিত্র ভঙ্গি করে খুব মনোযোগ দিয়ে বাচ্চাদের খেলা দেখতে লাগলেন। বাচ্চারা অবশ্য কিছুক্ষণের মাঝেই খেলা বন্ধ করে বুবুনের আব্বাকে দেখতে চলে এল। এর মাঝেই চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পড়েছে বুবুনের আব্বা মানুষটা বড় হলেও আসলে একেবারে বাচ্চাদের মতো। এতজন বাচ্চাকাচ্চা যে আব্বাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে সেজন্যে আব্বাকে মোটেও অপ্রস্তুত মনে হল না, বরং আব্বাকে কেমন জানি খুশি-খুশি দেখাতে লাগল। নিজের থেকেই জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই এখানে থাক?”

বাচ্চারা মাথা নাড়ল। আব্বারও মাথা নেড়ে বললেন, “বিকালে খেলাধুলা করতে হয়। তা হলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।”

ছোট একটা বাচ্চা জিজ্ঞেস করল, “আপনি আমাদের সাথে খেলবেন?”

আব্বা সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলেন। সবাই মিলে কিং-কুইন খেলছিল, তারা আব্বাকে টেনে মাঠে নিয়ে গেল। খেলার নিয়ম-কানুন বুঝিয়ে দেওয়া হল এবং আব্বাকে নিয়ে খেলা শুরু হল। কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি দেখা গেল আব্বা যত উৎসাহ নিয়ে খেলতে নেমেছেন তত উৎসাহ নিয়ে খেলতে পারেন না। বলটা ধরতে সমস্যা হয়, ধরার পরেও কার দিকে ছুঁড়ে মারতে হয় সেটা নিয়েও কিছুতেই মনস্থির করতে পারেন না। কোনোভাবে যদি মনস্থির করেও ফেলেন তার পরেও বলটা ছুঁড়তে চান না পাছে কেউ ব্যথা পেয়ে যায়।

খেলার অবস্থা দেখে গাম্বু বলল, “এর থেকে চল চাচাকে নিয়ে টিলা বেড়িয়ে আসি।”

সাথে সাথে সবাই রাজি হয়ে গেল এবং আব্বাকে নিয়ে সবাই টিলার দিকে রওনা দিল। পিছনের ভোলা মাঠ নিচু জায়গায় জমে-থাকা পানি, ঝোঁপঝাড় এবং টিলা, টিলার পিছনে ছোট নদী–সবকিছু দেখে আব্বা কেমন জানি ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে উঠলেন। ফিরে আসার সময় গাঙ্কু বলল, “চাচা আপনি কি শিয়াল চেনেন?”

“শিয়াল?”

“হ্যাঁ, ঐ যে হুক্কা হুয়া হুক্কা হুয়া করে ডাকে?”

আব্বা অনেকক্ষণ ভরু কুঁচকে চিন্তা কের বললেন, “না, চিনি না।”

“এই টিলায় শিয়ালের গর্ত আছে। গর্তের মুখে আগুন দিলে শিয়াল বের হয়ে আসে।”

“সত্যি?”

গাব্বু মাথা চুলকে বলল, “আমরা একবার চেষ্টা করেছিলাম, তখন অবিশ্যি বের হয় নাই।”

সুমি বলল, “অনেক বড় আগুন করতে হবে, আমরা আসলে বেশি বড় আগুন করতে পারি নাই।”

আব্বা অবাক-চোখে সুমি এবং গাব্বর চোখে তাকিয়ে রইলেন। পিয়াল বলল, “আপনি দেখবেন চাচা?”

আব্বা উৎসাহে মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ, দেখব। দেখাও।”

সুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকে তো প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে। আজকে হবে না, কালকে দেখাব।”

আব্বার মুখ দেখে মনে হল ব্যাপারটা আজকেই দেখা যাবে না বলে তার বেশ মন খারাপ হয়ে গেল।

সন্ধ্যেবেলা বাসায় ফেরার সময় বুবুন বলল, “আব্বা!”

“কী হল?”

আমরা যে কালকে শেয়াল দেখতে যাব সেই কথাটা তুমি কিন্তু আম্মাকে বলো না। ঠিক আছে?”

আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “বলব না।” একটু থেমে বললেন, “আমি তো তোমার আম্মার সাথে এমনিতেও কথা বলি না।”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কেন বল না আব্বা?”

“চিনি না তো তাই।”

.

পরদিন বিকেলে যখন দলটি শেয়াল দেখতে বের হল তখন তাদের সাথে অনেক রকম জোগাড়যন্ত্র নেওয়া হয়েছে। কয়েকজনের হাতে খবরের কাগজের বাণ্ডিল, একজনের হাতে কেরোসিনের বোতল এবং ম্যাচ, গর্তের মুখে শব্দ করার জন্যে কয়েকটা খালি টিন এবং লাঠি। দূর থেকে তাদের দেখে মনে হল একটা অভিযাত্রীর দল।

দলটা ডোবার পাশে দিয়ে হেঁটে যখন টিলার উপরে উঠতে শুরু করল তখন আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরও কিছু গ্রামের বাচ্চাকাচ্চা তাদের সাথে যোগ দিল। শুধু তাই নয়, এক-দুইজন বয়স্ক মানুষও কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এল। এর আগে যতবার তারা কোথাও দল বেঁধে গিয়েছে বয়স্ক মানুষেরা খুব সন্দেহের চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে, কিন্তু এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। তাদের সাথে আব্বাও আছেন কাজেই সবাই ধরে নিল তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করতে যাচ্ছে।

মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় চলেছেন সবাইকে নিয়ে?”

আব্বা কিছু বলার আগেই গাব্বু বলল, “শেয়াল দেখতে।”

মানুষটা খুব অবাক হয়ে বলল, “শেয়াল দেখতে?”

আব্বা মাথা নাড়লেন। মানুষটা জিজ্ঞেস করল, “কেমন করে শেয়াল দেখা যাবে?”

আব্বা কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই সুমি বলল, “ শেয়ালের গর্তে ধোঁয়া দিয়ে।”

“ধোঁয়া?”

“হ্যাঁ?”

পিয়াল বলল, “সাথে খালি টিন এনেছি, সেটা পিটিয়ে ঢংঢং করে শব্দ করতে হবে।”

“তা হলেই শেয়াল দেখা যাবে?”

আব্বা মাথা নাড়লেন। মধ্যবয়স্ক মানুষটাকে পুরো ব্যাপারে খুব উৎসাহী দেখা গেল, সেও তাদের সাথে চলল। আব্বা যদি সাথে না থাকতেন তা হলে পুরো ব্যাপারটাই অন্যরকম হত, তারা শেয়ালের গর্তের মুখে আগুন দেবে শুনেই সবাই একেবারে হা হা করে উঠে আপত্তি করত। সাথে আব্বা থাকায় আজকে কোনো সমস্যা নেই।

টিলার উপরে উঠে গর্তের সামনে পুরো দলটি দাঁড়াল। মধ্যবয়স্ক মানুটা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন গর্তটা?”

সুমি বড়সড় একটা গর্তকে দেখিয়ে দিল। সেই গর্তেই সামনে খবরের কাগজ স্থূপ করে রাখা হল। সেখানে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেবার সময় মানুষটা মাথা নেড়ে বলল, “তা হলে তো খালি আগুন হবে, ‘ধোয়া তো হবে না!”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “ধোয়া কেমন করে হয়?”

“আগুন যখন ঠিক করে জ্বলতে পারে না তখন ধোয়া হয়। মানুষটা আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল, “তা-ই না স্যার?”

আব্বা অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়লেন। লোকটা বলল, “ভালো করে একটা আগুন জ্বালিয়ে তখন সেটাকে ভেজা লতাপাতা দিয়ে চাপা দিতে হবে।” তারপর সে নিজেই গাছের লতাপাতা আধভেজা খড়কুটো খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে গেল।

কিছুক্ষণের মাঝেই দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে, আগুনের আঁচে কাছে যাওয়া যায় না। তার উপরে গাছের লতাপাতা, আধভেজা খড়কুটো চাপা দেওয়া হল, সত্যি সত্যি তখন সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে থাকে। গাব্বু খালি টিন হাতে নিয়ে সেটাকে পেটাতে শুরু করল, তার দেখাদেখি অন্যেরাও। শব্দে কানের পর্দা প্রায় ফেটে যাবার অবস্থা। মজা দেখার জন্যে আরও মানুষ জড়ো হয়েছে, তারাও যে যেভাবে পারছে শব্দ করছে, আগুনটাকে খুঁচিয়ে দিচ্ছে, লতাপাতা, খড়কুটো এনে আগুনের উপরে দিচ্ছে।

ঠিক তখন একটা বিচিত্র ব্যাপার ঘটল, গর্তের ভিতর থেকে হঠাৎ বিদঘুঁটে কী-একটা জিনিস ছুটে এল, আগুনের কাছে এসে সেটা এক মুহূর্ত থেমে যায় এবং হঠাৎ করে সেই বিদঘুঁটে জন্তুটার সারা শরীরে অসংখ্যা কাটা খাড়া হয়ে যায়। বাচ্চাকাচ্চা যারা ছিল তারা ভয় পেয়ে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে থাকে, বুবুনের মনে হতে থাকে এখন সেটা বুঝি তাদের উপর লাফিয়ে পড়বে। সবাই ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করছিল, আব্বা কিন্তু একটুও ভয় না পেয়ে জিনিসটাকে আরও ভালো করে দেখার জন্যে একেবারে কাছে এগিয়ে গেলেন। সেই অদ্ভুত জন্তু আগুনটাকে পাশ কাটিয়ে বাইরে বের হয়ে এল, তারপর ঝমঝম শব্দ করতে করতে টিলা বেয়ে নিচে নেমে গিয়ে গাছ-গাছালির মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেল।

সবাই গলা ফাটিয়ে চাচামেচি করছে আব্বা তখন মুখে হাসি ফুটিয়ে চোখ বড় বড় করে বললেন, “কী আশ্চর্য! শজারু! এটা নিশ্চয় শজারু।”

মজা দেখার জন্য যারা হাজির হয়েছিল তাদের মাঝেও একজন মাথা নেড়ে বলল যে এটা নিশ্চয় শজারুই হবে। শজারুর গায়ে নাকি এরকম কাঁটা থাকে এবং ভয় পেলে তাদের কাঁটাগুলো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।

পুরো এলাকাটাতে যখন সবকিছু নিয়ে খুব হৈচৈ হচ্ছে তখন বুবুন আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, “আব্বা, তুমি আগে কখনো শজারু দেখেছ?”

“নাহ!”

“তা হলে এটা তুমি চিনলে কেমন করে? তুমি না সবকিছু ভুলে গেছ?” আব্বাকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখাল, মাথা চুলকে বললেন, “তা তো জানি না!”

“তার মানে আসলে তোমার সবকিছু মনে আছে, তুমি জান না।”

“আমি জানি না?”

“না। চেষ্টা করলে আবার তোমার মনে পড়ে যাবে।”

শেয়াল দেখার চেষ্টা করে যে-দলটা শজারু দেখে ফেলেছে তারা আবার দল বেঁধে ফিরে আসতে থাকে। পিছন দিকে বুবুন, সুমি, পিয়াল এবং গাব্ব। আব্বা কেমন হঠাৎ করে শজারু চিনে ফেলেছেন সেটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সুমি বলল, “তার মানে যদি চাচাকে হঠাৎ করে কোনোকিছু দিয়ে চমকে দেওয়া যায় তা হলে আবার সবকিছু মনে পড়ে যাবে।”

গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “তুই কেমন করে জানিস?”

“আমি একটা উপন্যাসে পড়েছি। নায়িকা সবকিছু ভুলে গিয়েছিল, তখন নায়ক এসে–”

সুমিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে গাঙ্কু বলল, “আমি একটা উপন্যাস পড়েছি সেখানে নায়ক ব্যাঙ হয়ে গেছে। নায়িকা এসে সেই ব্যাঙকে চুমো দিয়েছে–”

সুমি রেগে গাব্বুর পেটে একটা ঘুসি মারার চেষ্টা করল, কিন্তু গাব্বু সাবধান ছিল বলে সময়মতো লাফিয়ে সরে গেল।

বুবুন বলল, “তোমরা মারপিট করছ কেন? নিজেরাই তো দেখতে পেলে হঠাৎ করে আব্বার শজারুর কথা মনে পড়ে গেল। যদি শজারুর কথা মনে পড়ে যায় তা হলে অন্যকিছু মনে পড়তে অসুবিধে কী আছে?”

পিয়াল মাথা নাড়ল, “নাই। কোনো অসুবিধা নাই। শুধু চমকে দিতে হবে।”

সুমি চিন্তিত মুখে বলল, “কী দিয়ে চমকে দেওয়া যায়?”

গাব্বু বলল, “একটা সাপ ধরে এনে ছেড়ে দিলে কেমন হয়?

“ধুর গাধা! সাপ ব্যাঙ শজারু এইসব চিনিয়ে কী হবে! যদি চাচিকে চেনানো যেত তা হলে লাভ হত।”

“যদি মনে কর আমরা একটা নাটকের মতো করি। চাচিকে আগে থেকে রাজী করালাম। একটা ডাকাত এসে গুলি করল, চাচি গুলি খেয়ে পড়ে গেলেন–”

বুবুন মাথা নাড়ল, বলল, “আম্মা কোনোদিন রাজি হবেন না। আব্বার সামনে একটা নাটকের মতো করা? অসম্ভব!”

পিয়াল পিছিয়ে পড়েছিল, এইবার দুই পা এগিয়ে এসে বলল, “আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে।”

“কী আইডিয়া।”

“চাচা তো আসলে সায়েন্টিস্ট। বুবুন তুই বলেছিস না চাচা ফিজিক্সে পিএইচ. ডি. করেছে?”

“হ্যাঁ।”

“সায়েন্টিস্ট মানুষকে চমকে দেওয়া খুব সোজা।”

“কী রকম?”

যদি দেখানো যায় বিজ্ঞানের সূত্র কাজ করছে না তারা চমকে ওঠে?”

বুবুন ভুরু কুঁচকে বলল, “বিজ্ঞানের সূত্র?”

“হ্যাঁ। মনে কর যদি দেখানো যায় আলোর গতি হঠাৎ কমে অর্ধেক হয়ে গেছে কিংবা ইকুয়েল টু এম সি স্কয়ারটা ভুল। কিংবা আর্কিমিডিসের সূত্র ভুল। কিংবা–”

সুমি এবং গাব্বু হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বুবুন ভদ্রতা করে কিছু বলল না। সুমি দ্রতা নিয়ে মাথা ঘামায় না, সোজাসুজি বলে ফেলল, “পিয়াল, তোর মাথাটা খারাপ।”

“মাথা-খারাপ?” পিয়াল চোখ লাল করে বলল, “কেন বলছিস আমার মাথা খারাপ?

“কেন মাথা-খারাপ সেটা যে বুঝতে পারিস না সেটাই হচ্ছে তার প্রমাণ।”

পিয়াল এবারে রেগে গেল। পিয়াল রেগে গেলে তার কথার মাঝে একটু তোতলামো এসে যায়। তোতলাতে তোতলাতে বলল, “য-য-যদি দেখা যায় মা মা মাধ্যাকর্ষণ কাজ করছে না, বু-বু-বুবুন হঠাৎ হুশ করে আকাশে উঠে গেল–”

“কী বললে? বুবুন চোখ বড় বড় করে বলল, “আমি আকাশে উঠে গেলাম?”

“হ্যাঁ। তা হলে চাচা অবাক হবেন না? চমকে উঠবেন না?”

সুমি এবং গাকেও স্বীকার করতে হল যদি এরকম একটা ব্যাপার ঘটে তা হলে আব্বা রীতিমতো চমকে উঠবেন এবং ভুলে-যাওয়া অনেক কিছু মনে পড়ে যেতে পারে। গাব্বু কানে আঙুল দিয়ে খানিকক্ষণ কান চুলকে বলল, “কিন্তু বুবুনকে হুশ করে আকাশে পাঠাবি কেমন করে? পিঠে রকেট বেঁধে আগুন জ্বালিয়ে দিবি নাকি?”

পিয়াল মাথা চুলকে বলল, “সেটাই চিন্তা করে করতে হবে। সত্যি সত্যি তো আর আকাশে পাঠানো যাবে না, দেখে যেন মনে হয় আকাশে উঠে যাচ্ছে।”

“কিন্তু সেটা করবি কেমন করে?”

পিয়াল আবার মাথা চুলকাল।”দড়ি দিয়ে বেঁধে কপিকল দিয়ে টেনে তোলা যায়। যদি দড়ি রং করে নেওয়া যায় যেন দেখা না যায়।

এরকম সময় আলোচনাটা থামিয়ে দিতে হল, কারণ হাঁটতে হাঁটতে সবাই নিচু জলার মতো জায়গাটায় এসে হাজির হয়েছে এবং ব্যাঙকে চমকে দিলে তারা কীরকম কাণ্ড জ্ঞান হারিয়ে লাফিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে সেটা সবাই আবিষ্কার করে ফেলেছে। আব্বা পিছিয়ে এসে বুবুনদেরকে বললেন, “ব্যাঙেরা খুব জোরে লাফ দেয়।”

বুবুন মাথা নাড়ল। সুমি বলল, “জি চাচা।”

আব্বা খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, “ব্যাঙরা বসে থেকেই লাফ দিতে পারে। দাঁড়াতে হয় না।”

বুবুন একটু অবাক হয়ে আব্বার দিকে তাকাল, ব্যাঙ যে দাঁড়াতে পারে এই জিনিসটাই কখনো তার মনে হয়নি। গাব্বু খানিকক্ষণ আব্বার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হি হি করে হাসতে শুরু করল। আব্বা অবাক হয়ে গাব্বর দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “কী হল ছেলে তুমি হাস কেন?”

০৭. চমক

আব্বাকে চমকে দেওয়ার পরিকল্পনাটা খানিকটার রদবদল করা হল। ঠিক করা হল বুবুনকে হুশ করে আকাশে পাঠানোর বদলে সেখানে গাব্বকে ব্যবহার করা হবে। তার কয়েকটা কারণ প্রথম কারণ হচ্ছে ব্যাপারটা রাত্রে না করে উপায় নেই। দিনের বেলায় কারও কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে উপরে তুললে সেটা যে কেউ বুঝে ফেলবে। রাত্রিবেলা বুবুনকে দড়ি বেঁধে টেনে উপরে তোলার জন্যে প্রস্তুতি নেওয়া খুব সহজ হবে না–বুবুনকে কিছুক্ষণ না দেখলেই আব্বা বেশ অস্থির হয়ে যান। গাব্বকে ব্যবহার করা হলে সেই সমস্যা নেই। শুধু তাই নয়, যখন গাকে আকাশে টেনে তোলার সময় হবে তখন বুবুন আব্বাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে জানালার কাছে নিয়ে আসতে পারবে। জানালার কাছেই একটা বড় নিমগাছ রয়েছে, সেই নিমগাছে একটা কপিকল বাঁধা হয়েছে। বাজার থেকে নাইলনের দড়ি কেনা হয়েছে, গাব্বর বেল্টের সাথে সেই দড়ি বেঁধে তাকে টেনে উপরে তোলাও বেশ কয়েকবার প্যাকটিস করা হয়ে গেছে।

যেদিন ঘটনাটা ঘটানো হবে সেদিন সবার ভিতরেই খানিকটা উত্তেজনা টের পাওয়া গেল। সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বের হওয়ার জন্যে আগে থেকে বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরি করে রাখা হয়েছে। সুমি বলল তাকে বকুলের বাসায় যেতে হবে। টেলিভিশনে একটা গানের প্রোগ্রাম দুজন একসাথে না দেখলেই নয়। গাব্বু বলল বুবুন তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। পিয়ালের বাসায় কঠিন শাসন, সে বলল স্কুলে পরের দিন জ্যামিতির টেস্ট পরীক্ষা হবে, একটা বিশেষ উপপাদ্য গার বাসা থেকে বুঝে আসতে হবে।

ঠিক সময়ে সবাই গুটিগুটি হাজির হয়েছে, গাব্বকে গাছের নিচে দাঁড় করিয়ে কোমরের বেল্টে দড়ি বেঁধে দেওয়া হয়েছে। আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাবে না বলে গাব্বু হাতে একটা বড় টর্চলাইট নিয়েছে। সময় হলে নিজেই নিজের দিকে জ্বালিয়ে ধরবে।

নিমগাছের নিচে সব প্রস্তুতি শেষ করে সেখান থেকে ছোট এক টুকরা ঢিল জানালায় ছুঁড়ে মারা হল। শব্দ শুনে বুবুন জানালা খুলে তার আব্বাকে ডাকাল, “আব্বা দেখে যাও।”

আব্বা খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ঘাসফড়িংকে পরীক্ষা করছিলেন। কীভাবে সেটা জানি ঘরের ভিতরে ঢুকে গেছে। বুবুনের কথা শুনে জানালার কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, “কী দেখব?”

কী প্রশ্ন করলে কী বলা হবে আগে ঠিক করে রাখা ছিল, বুবুন বলল, “গাব্বু দেখা করতে এসেছে।”

গাব্বু তখন টর্চলাইট জ্বালিয়ে নিজেকে দেখিয়ে দিল। গাব্বু কেন সামনের দরজা দিয়ে না এসে বাসার পিছনে নিমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে সেটারও উত্তর ঠিক করা ছিল কিন্তু আব্বা সেটা নিয়ে প্রশ্ন করলেন না। বললেন, ‘ও!”

ঠিক এই সময়ে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সুমি আর পিয়াল গাবুকে টেনে ওপরে তুলতে শুরু করল। একটা হ্যাঁচকা টান দিতেই সে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে উঠে বাঁকা হয়ে ঝুলতে লাগল। আব্বা বললেন, “গাব্বুর কী হয়েছে?”

বুবুন বলল, “বাতাসে ভাসছে আব্বা।”

আব্বা বললেন, “ও!”

আব্বা যে এত সহজে ব্যাপারটা মেনে নেবেন বুবুন মোটেও সেটা আশা করেনি। সে ব্যাপারটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্যে আবার কী-একটা বলতে যাচ্ছিল তখন আবার হ্যাঁচকা টানে গাবুকে আরও খানিকটা উপরে তোলা হল। সুপারম্যান এর কমিকে সুপারম্যান যে-ভঙ্গিতে আকাশে ওড়ে গাব্বু সেরকম ভঙ্গি করার চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু সে বাঁকা হয়ে ঝুলেছিল বলে ভঙ্গি দেখাতে লাগল বিচিত্র। ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে দেওয়ার জন্যে গাব্বু দড়িতে বাধা

অবস্থায় ঘুরপাক খেতে শুরু করল। আব্বা বললেন, “গাব্বু ঘুরছে।”

দড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় ঘুরপাক খাওয়ার অংশটুকু পরিকল্পনার মাঝে ছিল না, গাব্বু নিজেকে থামানোর চেষ্টা করতে লাগল কিন্তু খুব সুবিধে করতে পারল না। হাত-পা নাড়া অবস্থায় তাকে অত্যন্ত হাস্যকর দেখাতে থাকে, দেখে আব্বা পর্যন্ত খুকখুক করে হেসে ফেললেন।

পরিকল্পনাটি এমনিতেই মাঠে মারা যাচ্ছিল কিন্তু এর পর যা ঘটল তাতে পরিকল্পনাটি শুধু মাঠে মারা গেল না, মরে একেবারে ভূত হয়ে গেল। হঠাৎ পটাং শব্দ করে গাব্বর বেল্ট খুলে গিয়ে সে উপর থেকে ধড়াম করে নিচে এসে পড়ল এবং শূন্যে শুধু তার বেল্ট ঝুলতে লাগল। গাব্বর যে ইচ্ছে করে বেল্ট খুলে গিয়েছে সেটা সে বুঝতে পারল না, মনে করল তাকে বুঝি আর পিয়াল নিচে ফেলে দিয়েছে। গায়ের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে সে চিৎকার দিয়ে বলল, “গাধার বাচ্চারা আমাকে ফেরে দিলি যে?”

পিয়াল এবং সুমি লুকিয়ে থেকে যতটুকু সম্ভব পরিকল্পনাটা উদ্ধার করার চেষ্টা করছিল কিন্তু গাব্বু তার সুযোগ দিল না। দাঁত-কিড়মিড় করে বলল, “ঐ ছাগলের বাচ্চারা, কথা বলিস না কেন? কই গেলি তোরা? পিয়াল? সুমি?”

আব্বা বললেন, “গাব্বু রাগ করেছে। অনেক রাগ করেছে।”

কোনো উপায় না দেখে পিয়াল আর সুমি আড়াল থেকে বের হয়ে এল, গাব্বু তখন প্রায় খ্যাপা মোষের মতো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ব্যাপারটাকে আরও গুরুতর করার জন্য ঠিক সেই সময় আম্মা ঘরে এসে হাজির হলেন, বুবুন আর আব্বাকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? কী দেখছ?”

এই কয়েকদিনে আব্বা আম্মার সাথে খানিকটা সহজ হয়েছেন, আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, “গাব্বু উড়ার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ করে পড়ে গেছে।”

আম্মা জানালার কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “কী বললে? উড়ার চেষ্টা করছিল?”

নিমগাছের নিচে তখন প্রচণ্ড মারামারি চলছে। গাব্বু ধরেই নিয়েছে তাকে হেনস্থা করার জন্যে ইচ্ছে করে উপর থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আব্বা আম্মাকে বললে, “ঐ যে দ্যাখো। গাব্বর বেল্টটা এখনও উড়ছে।”

আম্মা বেল্টটা নিয়ে ব্যস্ত হলেন না, উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “ওরা কারা? ঝগড়া করছে কেন?”

আম্মার গলার স্বর শুনে নিচে মারামারি বন্ধ হয়ে গেল। সুমি বলল, “চাচি ভালো আছেন?”

“হ্যাঁ মা ভালো আছি। তোমরা কী করছ এখানে?”

“না মানে ইয়ে এই তো–“

পিয়াল বলল, “ইয়ে, গাব্বর বেল্ট–”

“ও হা গাঙ্কুর বেল্ট। বেল্টটা নিতে এসেছে। তাই ভাবলাম–” সুমি গলার স্বর পালটে বলল, “চাচা ভালো আছেন?”

আব্বা বললেন, “বেশি ভালো নেই।” ডান হাতটা উপরে তুলে আঙ্গুলটা দেখিয়ে বললেন, “এই যে নখ কাটার সময় বেশি কেটে ফেলেছি, এখন ব্যথা করছে।

সুমি বলল, “ভালো হয়ে যাবে চাচা।”

আব্বা বললেন, “গাল্লুকে বলো যাদের পাখা নেই তাদের ওড়া ঠিক না। পড়ে ব্যথা পাবে।”

গাবু, সুমি এবং পিয়াল কথাটা না শোনার ভান করে চলে যাওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আম্মা চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী হচ্ছে ওখানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!”

বুবুন অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে এরকম সময়ে সরাসরি সবকিছু স্বীকার করে ফেলে আধাঘণ্টার একটা লেকচার শুনে ফেলাই সবচেয়ে সহজ সমাধান। সে গলা-খাঁকারি দিয়ে বলল, “আমি বলছি আম্মা।”

আব্বা মাথা নাড়লেন, বললেন, “হ্যাঁ তুই বল।” তারপর জানালা দিয়ে মাথা বের করে অন্যদেরকে বললেন, “তোমরা ভিতরে চলে আসো। বাইরে মশা কামড়াবে।”

সুমি বলল, “না চাচা। আজকে যাই” বলে আর কাউকে কিছু বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে তিনজনই অদৃশ্য হয়ে গেল।

আব্বা সেদিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “গাল্লুকে ভালো করে বোঝাতে হবে। মানুষ তো ফড়িং না যে আকাশে উড়বে।

আম্মা চোখ পাকিয়ে বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী বলতে চাস বলে ফেল। কপালে দুঃখ আছে নাহলে জানিস তো?”

বুবুন মনে-মনে একটা নিঃশ্বাস ফেলল, পৃথিবীর কত মহৎ পরিকল্পনা না জানি এইভাবে মাঠে মারা গেছে।

.

গাবুকে আকাশে ওড়ানোর চেষ্টা নিয়ে যত বড় ঝামেলা হবে সন্দেহ করেছিল দেখা গেল সেরকম কিছু হল না। আব্বাকে কোনোভাবে চমকে দিয়ে তাঁকে সবকিছু মনে করিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা মনে হর আম্মা একটু বিশ্বাসও করে ফেললেন। ভবিষ্যতে আর যেন কোনো ধরনের পাগলামো করা না হয় এরকম একটা কথা দেওয়ার পর আম্মা হালকাভাবে বুবুনের কান মলে দিয়ে তাকে ছেড়ে দিলেন।

পরের দুইদিন হঠাৎ করে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হল, বাসার আশেপাশে নিচু জায়গায় পানি জমে পুরো এলাকাটাকে একটা সমুদ্রের মতো দেখাতে লাগল। ব্যাঙদের আনন্দ হল সবচেয়ে বেশি, গলা ফুলিয়ে ঘা ঘো ঘা ঘো করে ডেকে ডেকে এলাকার সবার কান ঝালাপালা করে দিল। মেয়েদের স্কুলের কী একটা ব্যাপার নিয়ে আম্মা খুব ব্যস্ত ছিলেন, আশেপাশে গ্রামে-গ্রামে বৃষ্টির মাঝে ঘোরাঘুরি করে করে তাঁর বাসায় ফিরতে দেরি হতে লাগল।

বৃষ্টির প্রথম দিনেই গাব্বু একটা প্রস্তাব নিয়ে এল, টিলার কাছে নিচু জায়গা আছে সেখানে পানি জমে ছোটখাটো একটা সমুদ্রের মতো হয়ে গেছে সেখানে একটা ভেলা ভাসিয়ে দেওয়া। আগেও এক-দুইবার চেষ্টা করা হয়েছিল খুব একটা সুবিধে করা যায়নি। ভেলা তৈরি করার জন্যে কলাগাছ জোগার করা খুব সহজ ব্যাপার নয়। এবারে অবিশ্যি অন্য ব্যাপার, আব্বাকে নিয়ে গ্রামে হাজির হয়ে কয়েকটা কলা গাছ চাইলেই গ্রামের লোকেরা খুশি হয়ে দিয়ে দেবে। আব্বা যে ডক্টর রওশানের স্বামী, নিজেও ফিজিক্সে পিএইচ. ডি. করেছেন এই সব কথা শুধু একটু গলা বাড়িয়ে বলে দিতে হবে।

আব্বাকে ভেলা তৈরি করার প্রস্তাবটা দেওয়ামাত্রই খুব খুশি হয়ে রাজি হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল ছোট একটা দল আব্বার পিছুপিছু গ্রামের দিকে যাচ্ছে। এসব ব্যাপারে সুমি সবসময় আগে থাকে কিন্তু কোনো-একটা বিচিত্র কারণে এবার সুমি আসতে চাইছিল না। বুবুন বলল, “মাঠে তো পানি একেবারেই বেশি না, এই হাঁটুপানি, ভয়ের কী আছে?”

সুমি মুখ শক্ত করে বলল, “আমি ভয় পেয়েছি তোকে কে বলল?”

“তা হলে আসতে চাইছ না কেন?”

গাব্বু বলল, “ছিপ নিয়ে যাব, কেঁচো দিয়ে টোপ দিলেই কপাকপ করে মাছ ধরবে।”

সুমি বলল, “কেঁচো? ছি!”

“দেখবি ভেলায় উঠতে কী মজা লাগে। নিচে পরিষ্কার কাঁচের মতো পানি। তার মাঝে মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

সুমি কিছু বলল না। বুবুন বলল, “দেখবে লগি দিয়ে ধাক্কা দিতেই ভেলা ভাসতে থাকবে। কী মজা হবে!”

শেষ পর্যন্ত সুমি রাজি হল। কাদা এবং পানির মাঝে ছপছপ করে সবাই যাচ্ছে এবং হঠাৎ করে একজন পানিতে একটা জোক আবিষ্কার করে ফেলল, সাপের বাচ্চার মতো সেটা কিলবিল করে যাচ্ছে। জোকটা দেখেই সুমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে একেবারে লাফ দিয়ে আব্বার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়ল। আব্বা প্রথমে খুব অবাক হলেন, একটু পরে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে খুকখুক করে হাসতে লাগলেন। বললেন, “জোককে এত ভয় পাওয়া ঠিক না।”

“কেন না চাচা? যদি ধরে?”

“ধরলে একটু লবণ দিলেই ছেড়ে দেবে।”

“লবণ? লবণ কোথায় পাব?”

“ঐ বাড়ি থেকে নিয়ে নেব।”

আব্বার কথা শুনে সুমি ভয়ে ভয়ে আব্বার ঘাড় ছেড়ে দিয়ে নেমে এল। সুমির মতো এরকম হৈহৈ করা মেয়ে কেন ভেলার মাঝে ভেসে বেড়ানোর মতো একটা মজার ব্যাপারে আসতে চাচ্ছিল না সেটা হঠাৎ করে সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, সে জোঁককে অসম্ভব ভয় পায়। ব্যাপারটা অন্যেরা জেনে ফেলার পর সবাই মিলে তার জীবন অতিষ্ঠ করে ফেলল। একটু পরেপরে মিছিমিছি তাকে ভয় দেখাতে লাগল। সুমি এমনিতে জাঁদরেল ধরনের মেয়ে তার, সাথে ফাজলেমি করলে সে সহজে কাউকে ছেড়ে দেয় না, কিন্তু জোঁকের বেলায় সে একেবারে ভয়ে কেঁচো হয়ে যায়। সত্য মিথ্যা যাই হোক জোঁক কথাটা উচ্চারণ করলেই সে একেবারে ছুটে গিয়ে আব্বার ঘাড় ধরে ঝুলে পড়তে লাগল, সেটা দেখে সবাই যা মজা পেল সেটা আর বলার মতো নয়।

টিলার নিচে পানি জমে সমুদ্র হয়ে থাকা অংশের অন্য মাথায় যেখানে গ্রামের মানুষেরা বাসা তৈরি করে রয়েছে, সেখানে পৌঁছাতে অনেকক্ষণ লেগে গেল। তারা ভেলা তৈরি করার জন্যে কলাগাছ নিতে এসেছে শুনে সবাই বেশ মজা পেল। আব্বাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আগেই বেশ কয়েকটা কলাগাছ কেটে ফেলা হল। পিয়াল যখন আব্বার পরিচয় দিল তখন গ্রামের মানুষেরা দৌড়াদৌড়ি করে তাঁর বসার জন্য হাতলওয়ালা নকশাকাটা একটা চেয়ার নিয়ে এল। আব্বা অবশ্য সেই চেয়ারে বসলেন না, অন্য সবার সাথে ভেলা তৈরি করার কাজে যোগ দিলেন। প্রথমে কাটা কলাগাছগুলো ঠেলে পানিতে নেওয়া হল। পাশাপাশি সাজিয়ে নিয়ে দুই টুকরো বাঁশ কয়েক জায়গায় আড়াআড়িভাবে লাগিয়ে নিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেওয়া হল। ভেলাকে ঠেলাঠেলি করার জন্যে একটা বাঁশের লগি দেওয়া হল।

কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল আব্বাকে নিয়ে বাচ্চাদের এই ছোট দলটা পানিতে ভাসতে শুরু করেছে। পানি নিয়ে গার বেশি ভয়ডর নেই, সে একপাশে পা ঝুলিয়ে বসেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই পানিতে ভিজে এবং কাদা মেখে সে ভূতের মতো হয়ে গেল। আব্বা বসেছেন মাঝখানে, তার ওজন বেশি বলে একট নড়াচড়া করলেই ভেলা টলমল করে ওঠে। জোঁকের ভয়ে সুমি আব্বার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে শক্ত করে ধরে রাখা কাগজে প্যাচানো খানিকটা লবণ। পিয়াল এবং বুবুন পালা করে লগি দিয়ে ঠেলা ঠেলে নিয়ে যেতে লাগল। নিচে পানি একেবারেই কম, বৃষ্টির পরিষ্কার পানিতে সবকিছু দেখা যায়। মাছ ভেসে বেড়াবে বলে যেরকম আশা করেছিল সেরকম অবিশ্যি দেখা গেল না, মাছেরা সম্ভবত ভেলা দেখেই সতর্ক হয়ে গেছে।

বুবুনদের দেখাদেখি গ্রামের বাচ্চারাও নিজেদের ভেলা তৈরি করে পানিতে নামিয়ে এনেছে–তারা বুবুনদের থেকে অনেক বেশি দুর্দান্ত–ভেলার উপর থেকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে লাগল। যারা পানিতে নামতে চাইছিল না ভেলা উলটিয়ে তাদের সবাইকে পানিতে নামিয়ে দেওয়া হল।

ভেলায় করে সমুদ্রের মতো জমে থাকা পানির মাঝে আব্বাকে নিয়ে সবাই ভেসে বেড়াল। আকাশে আবার মেঘ করেছে, বৃষ্টি হতে পারে ভেবে তারা একসময় ফিরে আসতে শুরু করে। মাঝপথেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, তখন আব্বার আনন্দ দেখে কে! তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল বৃষ্টিতে ভেজার মতো আনন্দ বুঝি আর কিছুতেই নেই। আনন্দ জিনিসটা সংক্রামক, কিছুক্ষণের মাঝেই অন্যেরাও সেই আনন্দের ভাগ পেয়ে গেল। চুপচাপ বসে আনন্দ করা যায়

বলে ভেলার ওপরেই নাচানাচি শুরু হয়ে গেল এবং হঠাৎ কিছু বোঝার আগে দেখা গেল গাব্বু ঝপাং করে পানির মাঝে পড়েছে। আব্বা ভয় পেয়ে যেই গাকে ভোলার জন্যে ভেলার পাশে এগিয়ে গেলেন ভেলা কাত হয়ে পিয়াল। এবং বুবুনও পানিতে পড়ে গেল, তখন যা একটা মজা হল সে বলার মতো নয়। সবাইকে টেনে আবার ভেলার মাঝে তোলা হল এবং হঠাৎ করে দেখা গেল পিয়ালের শার্টের মাঝে ছোট একটা চকচকে মাছ লেগে আছে। পানির বাইরে এসে নির্জীবের মতো মাছটা তিরতির করে নড়ছে, আব্বা বললেন, “আহা বেচারা, কষ্ট পাচ্ছে। পানিতে ছেড়ে দাও আবার।”

কারোই মাছটাকে ছেড়ে দেবার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু আব্বার কথা শুনে মাছটাকে পানিতে ছেড়ে দিতেই সেটা মুহূর্তে যেন প্রাণ ফিরে পেয়ে চোখের পলকে সারা শরীর দুলিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আকাশে মেঘ তখন আরও ঘন হয়ে এসেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা আরও চেপে এসেছে, হঠাৎ করে একটু বাতাসও দিতে শুরু করেছে।

পানিতে ভিজে একেকজনের যা চেহারা হয়েছে সেটা বলার মতো না। গাব্বু দাঁত বের করে হেসে পিয়ালকে বলল, “তোকে আজ তোর বাবা যা বানানো বানাবে!”

পিয়াল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “বানালে বানাবে। তুই হাসছিস কেন?”

গাঙ্কু তার হাসিটা আরও বিস্তৃত করে বলল, “কে বলল, আমি হাসছি? হি হি হি।”

০৮. ভূত

রাতে বিছানায় শুয়ে বুবুন আম্মাকে জিজ্ঞেস করল, “আম্মা, তোমার আজকাল বাসায় আসতে এত দেরি হয় কেন?”

“বদমাইশগুলো খুব খেপেছে তো, তাই কাজ বেড়ে গেছে।”

আম্মা বদমাইশ বলতে কাঁদের বোঝাচ্ছেন বুবুন জানে–তারা হচ্ছে খবিরউদ্দিন আর তার দলবল। সে জিজ্ঞেস করল, “কী করে আম্মা?”

“একটা মেয়েদের স্কুল পুড়িয়ে দেয়, নাহলে কোনো স্কুলে যায় বলে কাফের বলে ফতোয়া দিয়ে দেয়, এইসব ভণ্ডামি।” আম্মা দাঁত-কিড়মিড় করে বললেন, “ইচ্ছে করে সবগুলোর মুখ ছিঁড়ে ফেলি।”

আম্মা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, কেমন জানি ক্লান্তির নিঃশ্বাস। বুবুনের আম্মার জন্যে এত মায়া লাগল সেটি আর বলার মতো নয়। আম্মা মানুষটি যে এত একা বুবুন সেটা আগে কখনোই টের পায়নি, আব্বা আসার পর বুঝতে পেরেছে। বুবুন যখন কখনো কখনো সুমির বাসায় যায়, দেখে সুমির আব্বা আর আম্মা বসে বসে গল্প করছেন, হাসিঠাট্টা করছেন, মাঝে মাঝে বিকেলবেলা দুজনে গল্প করতে করতে হাঁটতে বের হন। দেখে কী ভালোই না লাগে! অথচ তার আব্বা থেকেও নেই, আম্মা একেবারে একা। আব্বা মানুষটা একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো, বুবুন যেসব জিনিস নিয়ে কথা বলে আব্বাও ঠিক একই জিনিস নিয়ে কথা বলেন! আম্মার কথা বলার কোনো মানুষ নেই। রাত দশটা বাজতে -বাজতেই আব্বা দাঁত মেজে বিছানায় শুয়ে পড়েন। যদি কোনোভাবে আব্বার স্মৃতি ফিরিয়ে আনা যেত কী মজাটাই-না হত! আগেরবারের চেষ্টাটা একেবারে মাঠে মারা গেছে, কিন্তু তাই বলে কি হাল ছেড়ে দেওয়া যায়? আবার চেষ্টা করতে হবে, কী দিয়ে চেষ্টা করবে সেটা ঠিক করতে হবে। বুবুন আম্মার গলা জড়িয়ে ডাকল, “আম্মা”

“ঘুমিয়ে গেছ?”

“ঘুমুতে দিচ্ছিস কই!”

“একটা গল্প বলো-না আম্মা!”

“গল্প? এখন? তোর মাথা-খারাপ হয়ে গেছে?”

“আব্বার গল্প।”

আম্মা অন্ধকারেই বুবুনের দিকে তাকালেন, “আব্বার গল্প?”

“হ্যাঁ, আব্বা যখন ভালো ছিলেন তখন কী করতেন সেই গল্প?”

“কেন? সেই গল্প এখন কেন?”

“এমনি শুনতে ইচ্ছা করে। বলো-না!”

বুবুন ভেবেছিল এই মাঝরাতে আম্মা নিশ্চয়ই গল্প বলবেন না কিন্তু কী ভেবে সত্যি সত্যি গল্প বলতে লাগলেন। আমেরিকায় যখন পিএইচ. ডি. করছেন তখন বাসায় বেড়াতে এসেছে বন্ধুবান্ধব। একজন একটু চালবাজ ধরনের মানুষ, শুধু বড় বড় কথা বলছিল, রাতে আব্বা মুখোশ পরে তাকে কীভাবে ভয় দেখালেন সেই গল্প। শুনে হাসতে হাসতে কুটিকুটি হয়ে গেল বুবুন।

.

পরদিন খুব ভোরে জাহিদ চাচা এবং আরও কয়েকজন মহিলা এসে হাজির। তাদের সবারই কিছু-একটা ব্যাপার হয়েছে, আম্মার সাথে চাপা গলায় গম্ভীরমুখে সবাই কিছু-একটা আলোচনা করলেন, তারপর সবাই মিলে নাশতা না করেই বের হয়ে গেলেন।

বুবুন আব্বাকে আবিষ্কার করল বাসার বাইরে। চারিদিকে অযত্নে কিছু ফুলগাছ লাগানো ছিল, আব্বা সেগুলো ঠিক করতে শুরু করেছেন। আব্বা যখন ডাক্তার রাজীব হাসানের কাছে ছিলেন তখন নাকি শুধু ফুলগাছ নিয়েই থাকতেন। বুবুন বেশ খানিকক্ষণ আব্বার সাথে সাথে ফুলগাছের নিচে মাটি নিড়িয়ে দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার, শুকনো পাতা, মরা ডাল কেটে দেওয়া এইসব দেখল। আব্বা এই কাজগুলো করেন খুব যত্ন করে, দেখে মনে হয় ফুলগাছ নয় যেন একটা ছোট বাচ্চাকে আদর করছেন। আব্বাকে দেখে বুবুন আরও একটা মজার জিনিস আবিষ্কার করল, আব্বা কথা বলতে বলতে কাজ করতে পারেন না। বুবুন যখন কিছু-একটা জিজ্ঞেস করে, আব্বা তখন কাজ বন্ধ করে ঘুরে বুবুনের দিকে তাকান এবং উত্তর দেন। উত্তর দেওয়া শেষ হলে আবার কাজ শুরু করেন। কিন্তু প্রায় সময়েই দেখা যায় আগে কী করছিলেন সেটা এর মাঝে ভুলে গেছেন, নতুন করে অন্য একটা-কিছু করতে শুরু করেছেন! দেখে বুবুনের আব্বার জন্যে ভারি মায়া লাগতে থাকে, সে আব্বাকে একা একা কাজ করতে দিয়ে হাঁটতে বের হল।

হেঁটে হেঁটে সুমিদের বাসায় কাছে এসে সে দেখতে পেল সুমি বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আচার খেতে খেতে একটা বই পড়ছে। বুবুনকে দেখে মুখ তুলে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”

“কোথাও না। এমনি–”

”এমনি কী?””মনটা বেশি ভালো না তাই–”

“মন ভালো না?” সুমি অবাক হয়ে বলল, “মন আবার ভালো না হয় কেমন করে?” কী হয়েছে?”

“না, কিছু না।” বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “যাই, হেঁটে আসি।”

বুবুন পকেটে হাত দিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করছিল, সুমি তখন বই বন্ধ করে উঠে এল। হাতের আচারটুকু বুবুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে খা। আচার খা। মন ভালো হবে।”

“না।” বুবুন মাথা নাড়ল, “আমার আচার ভালো লাগে না।”

“আচার ভালো লাগে না?” সুমি চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বলছিস

“দাঁত টক হয়ে যায়।”

সুমি আঙুল চেটে খেতে খেতে বলল, “সেটাই তো মজা!”

বুবুন কোনো কথা বলল না, সুমি জিজ্ঞেস করল, “এখন বল তোর মন খারাপ কেন?”

বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ব্যাপারটা হচ্ছে আম্মাকে নিয়ে।”

“কী হয়েছে চাচির?”

“কিছু হয়নি, কিন্তু এই মেয়েদের স্কুল, নারী নির্যাতন, ফতোয়াবাজি এইসব নিয়ে একেবারে সকাল থেকে শুরু করে রাত পর্যন্ত ঘুরতে থাকেন। কোনো

কোনো দিন বাসায় আসতে আসতে রাত দশটা বেজে যায়।”

“হু।” সুমি মাথা নাড়ল,”চাচির খুব খাটনি হয়।”

“কিন্তু খাটনিটা তো ঠিক আছে। আম্মা একেবারে মোঘের মতো খাটতে পারে। একজন মানুষ যখন এত পরিশ্রম করে রাতে ফিরে আসে তখন তার কি একটু কথাবার্তা বলার ইচ্ছা করে না?”

সুমি মাথা নাড়ল। বুবুন বলতে লাগল, “সমান-সমান একজন মানুষের সাথে কথা বলার ইচ্ছা করে। কিন্তু আম্মার সেই কথা বলার মানুষ নেই। বাসায় এসে একা একা গালে হাত দিয়ে বসে বসে দেখেন আমি আর আব্বা কী করছি!”

কথা বলতে বলতে হঠাৎ বুবুনের চোখে পানি এসে গেল, সে খুব চেষ্টা করল সেটা লুকিয়ে রাখতে, সুমিও এমন ভান করল যেন দেখতে পায়নি। আঙুল চাটতে চাটতে বলল, “তুই মন খারাপ করিস না, চাচার নিশ্চয়ই একসময় সবকিছু মনে পড়ে যাবে। আগের বার এমন ঘাপলা হয়ে গেল–”

“হুঁ।“

“আরেকবার চেষ্টা করতে হবে। এইবারে ঠিক করে প্ল্যান করতে হবে। আগেরবারের মতো আউলাঝাউলা করলে হবে না। প্রথমে চাচার জীবনের একটা ঘটনা জানতে হবে। সেখানে যা যা ঘটেছিল হুবহু সেটাই করতে হবে। তা হলে দেখিস ঝপাং করে সব মনে পড়ে যাবে!”

বুবুন সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, “কাল রাত্রে আম্মা একটা গল্প বলেছেন। যখন আমেরিকা ছিলেন তখন কী হয়েছিল সেই গল্প।”

“কী হয়েছিল?”

আব্বা কীভাবে মুখোশ পরে তাঁর চালবাজ বন্ধুকে ভয় দেখিয়েছিলেন বুবুন সেই গল্পটা সুমিকে খুলে বলল। শুনে সুমি হাতে কিল দিয়ে বলল, “এই তো চাই! এইটাই করতে হবে?”

“এইটাই?”

“হ্যাঁ, বুঝতে পারছিস না এর মাঝে সব আছে। মুখোশ পরে যখন ভয় দেখানো হবে সেই ভয় পেয়ে হঠাৎ করে সবকিছু মনে পড়ে যাবে। ফার্স্টক্লাস! চল গাব্বু আর পিয়ালকে গিয়ে বলি।”

“এখনই?”

“এখন নয় তো কখন? দেরি করে লাভ কী?”

.

এবারের পরিকল্পনাটা আগেরবার থেকে বেশি যত্ন করে করা হল। গাব্বর একটা রবারের মুখোশ আছে, মুখোশটা পরানো গাল্লুকে, একটা সাদা চাঁদর দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল সারা শরীর, দুই হাত উপরে তুলে যখন সে হেঁটে আসতে লাগল তাকে দেখতে ভয়ংকর দেখাতে লাগল সত্যি, কিন্তু আরে ছোটখাটো হওয়ায় দেখে কেন জানি ভূত না হয়ে ভূতের বাচ্চার মতো মনে হতে লাগল। সুমি মাথা নেড়ে বলল, “আরও লম্বা হতে হবে।”

গাব্বু বিরক্ত হয়ে বলল, “আমি এখন লম্বা হব কেমন করে?”

“পিয়াল, তুই পর দেখি।”

পিয়াল মাথা নেড়ে বলল,”আগে মুখোশটা সাবান দিয়ে ধুয়ে আন। ভিতরে গাব্বুর সব জীবাণু আছে–”

“ফাজলেমি করবি না। দাবড়ানি দিয়ে একেবারে ছাড়াভ্যাড়া করে দেব।”

পিয়ালকে মুখোশ পরিয়েও খুব লাভ হল না। বুবুন বলল, “একজনের ঘাড়ে আরেকজন উঠলে হয়।”

সুমি হাতে কিল দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছিস!”

গাব্বু এবং পিয়াল দুইজনেই মাথা নেড়ে প্রবল আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত গাবুকে পিয়ালের ঘাড়ে উঠতে হল এবং এবার সাদা চাঁদর দিয়ে ঢেকে দেবার পর সত্যি সত্যি তাদের দুজনকে একটা সত্যিকারের বিদঘুঁটে ভূতের মতো দেখাতে লাগল। সুমি খুশি হয়ে বলল, “ফার্স্ট ক্লাস!”

বুবুন, সুমি, গাব্বু আর পিয়াল মিলে অনেক সময় নিয়ে পুরো ব্যাপারটা বেশ কয়েকবার প্র্যাকটিস করে নিল। গাব্বু কখন পিয়ালের ঘাড়ে উঠবে, কখন হাঁটবে, তখন সুমি কোথায় থাকবে, বুবুন কী করবে, যদি কোনো-একটা ঝামেলা হয়ে যায় তখন কী করা হবে, বড় মানুষদের এসে গেলে কীভাবে সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া যাবে এইরকম খুঁটিনাটি বাদ দেওয়া হল না। কবে ভূত সেজে আব্বাকে ভয় দেখানো হবে সেটা নিয়েও একটু আলোচনা করা হল, দেখা গেল কেউই বেশি দেরি করতে রাজি না, পারলে এখনই করে ফেলে। কিন্তু একজন মানুষকে তো আর দিনের বেলায় ভূতের ভয় দেখানো যায় না অন্তত সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সন্ধ্যেবেলা বাসা থেকে বের হতে হলে একটা জুতসই কৈফিয়তও দিতে হবে। আগেরবার যে-ঝামেলাটা হয়ে গিয়েছিল সেটা জানজানি হয়নি সেটাই ভরসা, তা হলে আর কোনো কথাই কাজে লাগত না।

সন্ধ্যেবেলা পিয়াল খবর নিতে এল যে আব্বাকে ভূত সেজে ভয় দেখানোর ঘটনাটি কী আজকেই করা হবে কি না। আম্মা তখনও আসেননি, আব্বা নিজের ঘরে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা টিকটিকির দিকে তাকিয়ে আছেন, বাসায় আর কেউ নেই কাজেই মনে হয় ভয় দেখানোর জন্যে এটাই ভালো সময়। পিয়াল খবর নিয়ে চলে গেল, কিছুক্ষণের মাঝেই অন্য সবাইকে নিয়ে চলে আসবে। বুবুনের বুকের ভিতর ধক ধক করতে থাকে–আব্বার মতো এরকম ভালোমানুষকে ভয় দেখানো কি ঠিক হচ্ছে? ভয় পেয়ে যদি কিছু-একটা হয়ে যায়? বুবুন জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিল, এটা অনেকটা অসুখ হলে ইনজেকশান দেওয়ার মতো বা পেট কেটে অ্যাপেন্ডিক্স বের করার মতো, জিনিসটা করার সময় কষ্ট হয় কিন্তু করার পর তার ফল হয় ভালো।

বুবুন ঘুরে আরও একবার আব্বাকে দেখে এল, আব্বা এখনও খুব মনোযোগ দিয়ে দেয়ালের টিকটিকির দিকে তাকিয়ে আছেন, টিকটিকি বা ঘাসফড়িঙের মতো জিনিসের মধ্যেই আব্বা কী এত কৌতূহলের ব্যাপার খুঁজে পান কে জানে! কিছুক্ষণের মাঝেই দরজার মাঝে টুকটুক করে শব্দ হল, বুবুন সাবধানে দরজা খুলে দিতেই পিয়াল গাব্বু আর সুমি নিঃশব্দে ঘরের মাঝে ঢুকল। সুমি ফিসফিস করে বলল, “চাচা কোথায়?”

“ঐ ঘরে।”

“সবাই রেডি হয়ে যাও।”

কোনো শব্দ না করে গা মুখোশটা পরে পিয়ালের ঘাড়ের উপরে উঠে গেল। সাদা চাঁদর দিয়ে পুরোটা ঢেকে দেওয়া হল। গাব্বর হাতে একটা মোমবাতি, সেই মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দেওয়া হল। সুমি হাতে একটা দুধের খালি টিন নিয়ে এসেছে, ভিতরে মুখ লাগিয়ে কথা বললে থমথমে একটা আওয়াজ বের হয়। সবকিছু ঠিকঠাক আছে দেখার পর বুবুন বাইরের ঘরে গিয়ে মেইন সুইচটা অফ করে দিল সাথে সাথে সারা বাসা অন্ধকার হয়ে যায়, শুধু করিডোরে পিয়ালের ঘাড়ে বসে থাকা গাব্বর হাতে একটা মোমবাতি টিমটিম করে জ্বলছে।

সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, বুবুন শুনতে পেল আব্বা তার ঘরে বসে থেকে নিজের মনে বললেন, “কারেন্ট চলে গেছে।” খানিকক্ষণ কোনো শব্দ নেই, তারপর আব্বা ডাকলেন, “বুবুন!”

বুবুন কোনো কথা বলল না। সুমি তখন টিনের ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে থমথমে গলায় বলল, “আজ থেকে প্রায় এক যুগ আগের কথা। ডক্টর রওশানের স্বামী মাসুদ আহমেদ ফিজিক্সে পিএইচ. ডি, করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়াশিংটনে।”

আব্বা ভয়-পাওয়া গলায় বললেন, “কে কথা বলে?”

”অতীত কথা বলে। কথা বলে পুরানো দিনের স্মৃতি।”

“বুবুন!” আব্বা ডাকলেন, “বুবুন, তুই কোথায়?”

“সেই সময় একদিন মাসুদ আহমেদের বাসায় এল তাঁর এক বন্ধু। বন্ধুকে ভয় দেখাবেন ঠিক করলেন মাসুদ আহমেদ। তার এই কাজে সহযোগী ছিলেন তার স্ত্রী রওশান।”

আব্বা ভাঙা গলায় ডাকলেন, “বুবুন!”

সুমি বলল, “মুখে মুখোশ পরে ভূত সাজলেন মাসুদ আহমেদ। ভয়ংকর চেহারার ভূত! কেমন ছিল সেই ভূত? তাকে কি দেখতে চান?”

আব্বা ঘর থেকে বের হয়ে এলেন, করিডোরে এসে দেখলেন লম্বা সাদা কাপড় পরা ভয়ংকর দর্শন বীভৎস একটি ভূত দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মোমবাতি জ্বলছে, মোমবাতির সেই ক্ষীণ আলোতে ভূতটির সমস্ত বীভৎসতা যেন একশো গুণ বেড়ে গেছে। সুমি বলল, “আমি ভয় দেখাতে আসিনি মাসুদ আহমেদ। আমি এসেছি স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনতে। মনে আছে এইভাবে ভূত সেজে আপনি ভয় দেখিয়েছিলেন?”

আব্বা কোনো কথা না বলে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন। কিছু-একটা বলার চেষ্টা করলেন কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। গাব্বকে ঘাড়ে নিয়ে পিয়াল তখন এক পা এগিয়ে এল। সুমি তার থমথমে গলায় বলল, “মনে আছে? মনে আছে আপনার?”

আগে যেভাবে রিহার্সাল দেওয়া ছিল সেই হিসেবে তখন পিয়ালের আরও এক পা এগিয়ে যাবার কথা, পিয়াল ঠিক সেভাবে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করে তাল হারিয়ে ফেলল, তাল সামলাতে গিয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে গেল, পায়ের নিচে চাঁদর আটকে গেল হঠাৎ এবং কিছু বোঝার আগে প্রচণ্ড শব্দে গাব্বকে নিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল পিয়াল। হাতের মোমবাতি ছিটকে পড়ল নিচে, নিভে না গিয়ে সেটা জ্বলতে থাকে একটা কাগজের উপরে, দেখতে দেখতে সেখানে আগুন জ্বলে উঠল। গাব্বু চিৎকার করে উঠল যন্ত্রণায়, পিয়াল বিকট স্বরে আর্তনাদ করতে লাগল, আর আব্বা ডাকতে লাগলেন, “বুবুন! বুবুন!” সুমি গলা ফাটিয়ে চাচাতে লাগল, “আগুন! আগুন!”

বুবুন মেইন সুইচ টিপে আলোটা জ্বালিয়ে দিলেই সমস্যার বড় অংশ মিটে যেত কিন্তু এই বিশাল গোলমালের মাঝে সেটা তার আর মনে পড়ল না, সেও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে অন্ধকারে দৌড়াদৌড়ি করতে লাগল।

আগুন নেভানোর জন্যে অন্ধকারে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খেতে লাগল, তার মাঝে বুবুন হাতড়ে বাথরুম থেকে বালতি দিয়ে পানি এনে ঢেলে দিল আগুনের মাঝে, আগুন নিভে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হয়ে গেল সাথে সাথে। ঠিক সেই সময় শুনতে পেল দরজার ধাক্কা দিচ্ছে অনেকে মিলে, বুবুনের মেইন সুইচের কথা মনে পড়ল তখন। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে মেইন সুইচ অন করার চেষ্টা করার কোনো মানে হয় না, আছাড় খেয়ে পড়ে গাব্বু বা পিয়ালের কী অবস্থা হয়েছে কে জানে–বুবুন আগে পরে কিছু চিন্তা না করে দরজা খুলে দিল। বাইরে অনেক মানুষ–অন্ধকারে দেখা যায় না, গলায় স্বর শুনে বুঝতে পারল সেখানে আম্মা আছেন, জাহিদ চাচা আছেন, গাব্বর বড় ভাই, পিয়ালের আব্বা, পাশের বাসার দারোয়ান, আম্মার অফিসের কিছু লোকজন, গাড়ির ড্রাইভার এমনকি মনে হল দুই-একজন পুলিশও আছে। সবাই মিলে চিৎকার করতে লাগল এবং আম্মার গলা উঠল সবার উপরে, “কী হয়েছে? বুবুন কই? মাসুদ কই? চিৎকার করে কে?”

বুবুন বুঝতে পারল তারা এখন যে-বিপদে পড়েছে খোদা নিজে যদি উদ্ধার করেন কেউ তাদের উদ্ধার করতে পারবে না। কী করবে বুঝতে না পেরে সে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল, সবাই হুড়মুড় করে ভিতরে ঢুকে গেল, আম্মা তখন ভাঙা গলায় কেমন যেন ভয়-পাওয়া গলায় ডেকে উঠলেন, “বুবুন! বাবা তুই কোথায়?”

“এই তো আম্মা!”

আম্মা হঠাৎ জাপটে ধরে ফেললেন, তারপর ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলেন, “ভালো আছিস তুই বাবা? ভালো আছিস?”

বুবুন ঠিক বুঝতে পারল না কেন আম্মা তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। একজন একটা ম্যাচ জ্বালাল এবং তখন বুবুনের মেইন সুইচের কথা মনে পড়ল। সেটা বলার পর জাহিদ চাচা গিয়ে মেইন সুইচটা অন করতেই সারা বাসাটি আলোকিত হয়ে উঠল চারিদিক এক নজর দেখে বুবুনের হঠাৎ মনে হল অন্ধকারই অনেক ভালো ছিল।

গাঙ্কুর গলা থেকে তখনও সেই ভয়ংকর মুখোশটা ঝুলছে, কপালের খানিকটা কেটে সেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছে, পিয়ালের গায়ে সাদা চাঁদরটা লেপটে আছে, সেটা পানিতে ভেজা এবং সে মেঝেতে বেকায়দাভাবে শুয়ে আছে। আব্বা খুব কাছেই উবু হয়ে বসে এই দুজনকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছেন, পিছনে দাঁড়িয়ে আছে সুমি, হাতের খালি দুধের টিনটা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না। মেঝেতে পোড়া কাগজ এবং পানি থৈথৈ করছে, ঘরের ভিতরে ধোয়ার গন্ধ। সবচেয়ে প্রথমে কথা বললেন, পিয়ালের আব্বা, হুংকার দিয়ে বললেন, “পিয়াল, হারামজাদা উঠে আয়।”

আব্বা উবু হয়ে বসে থেকে বললেন, “পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে।”

পিয়ালের আব্বা তখন কয়েক পা এগিয়ে এসে, “আমি ব্যথা পাওয়ার মজা টের পাওয়াচ্ছি।”

কয়েকজন মিলে তখন পিয়ালের আব্বাকে না থামালে সেখানেই একটা রক্তারক্তি হয়ে যেত। গাব্বর বড় ভাই বলল, “কী হয়েছে এখানে?”

জাহিদ চাচা বললেন, “সেটা আমরা পরে দেখব। এখন দেখা যাক কেউ বেশি ব্যথা পেয়েছে কি না।”

পিয়াল ওঠার চেষ্টা করল, আম্মা এবং জাহিদ চাচা এগিয়ে গেলেন, কিন্তু তার আগেই আব্বাকে ধরে পিয়াল উঠে বসেছে। গাব্বও মুখোশটা খুলে পিছনে দাঁড়িয়ে গেল। সুমি দুধের টিনটা হাতে নিয়েই আব্বার গা-ঘেঁষে দাঁড়াল।

জাহিদ চাচা বললেন, “মনে হচ্ছে কেউ বেশি ব্যথা পায়নি।” গাব্বু কপালের রক্তটা মুছে ফেলে মাথা নাড়ল। আম্মা বললেন, “ব্যথা নয়, এখন যেটা পাচ্ছে সেটা হচ্ছে ভয়।”

পিয়ালের আব্বা হুংকার দিয়ে বললেন, ‘ভয়ের দেখেছ কী? আমি যখন বাপের নাম ভুলিয়ে দেব তখন বুঝবে ভয় কাকে বলে!”

আম্মা হাসার চেষ্টা করে বললেন, “বাচ্চা মানুষ, কিছু-একটা অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে গুবলেট করে ফেলেছে। আমি দেখছি কী হয়েছে!” পিয়ালের আব্বা বললেন, “বাসায় নিয়ে যাই আমি।”

আম্মা বললেন, “আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমরা ওদের বাসায় পৌঁছে দেব।”

আব্বা বললেন, “হ্যাঁ। এখন ওরা খুব ভয় পাচ্ছে। আমাকে ভয় দেখাতে গিয়ে নিজেরাই ভয় পেয়ে গেছে।”

পিয়ালের আব্বা আবার হুংকার দিলেন,”আপনাকে ভয় দেখাতে এসেছিল? আপনাকে?”

আব্বা তাড়াতাড়ি পিয়াল, গাব্বু এবং সুমিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “না-না, এমনি এমনি মিছিমিছি ভয়।” আব্বা তারপর হাসার চেষ্টা করে বোঝানোর চেষ্টা করলেন পুরো ব্যাপারটিতে ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই। ছোট বাচ্চারা যেভাবে হেসে একটা জটিল ব্যাপারকে সহজ করে দেওয়ার চেষ্টা করে অনেকটা সেরকম।

আম্মা পিয়ালের আব্বাকে বলল, “আপনি বাসায় গিয়ে শান্ত হন, আমরা ওদের দেখছি।”

বাসা থেকে সবাই বের হওয়ামাত্র সুমি আম্মার কাছে এসে বলল, “চাচি। আমি সব পরিষ্কার করে দেব। আপনি বুঝতেই পারবেন না কিছু হয়েছে এখানে।”

আম্মা বললেন, “তোমাকে কিছু করতে হবে না মা। তোমাদের কারও কিছু যে হয়নি তার জন্যেই খোদার কাছে হাজার শোকর।”

আব্বা মাথা নাড়লেন, “হাজার শোকর।”

আম্মা খানিকটা তুলো নিয়ে গাব্বর কপাল পরিষ্কার করতে করতে বললেন, “এখন তো কেউ নেই, বলো দেখি ব্যাপারটি কী হয়েছে?”

কেউ কোনো কথা বলল না। আম্মা মাথা নেড়ে বললেন, “পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে বুবুনের আব্বাকে তোমরা ভয় দেখাতে এসেছিলে কেন?”

সুমি বলল, “আসলে ভয় দেখাতে আসিনি। চাচার যেন সবকিছু মনে পড়ে যায়–”

আম্মা ভুরু কুচকে তাকালেন। বুবুন বলল, “মনে নেই, তুমি যে বলেছিলে আব্বা ভূত সেজে ভয় দেখিয়েছিল? ঠিক সেরকম–”

পিয়াল বলল, “ঠিক সেইরকম করতে যাচ্ছিলাম যেন দেখেই চাচার সবকিছু মনে পড়ে যায়। এই গাধা গাবুটার জন্য”

গাব্বু ফোঁস করে উঠে বলল, “আমাকে দোষ দিচ্ছিস কেন? নিজে আছাড় খেয়ে পড়েছিস আর দোষ আমার?”

আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “একজনের ঘাড়ে আরেক জনের ওঠা ঠিক হয় নাই। ওজনের চাপে সাইজ ছোট হয়ে যায়।”

আম্মা চোখ কপালে তুলে বললেন, “কী বললে? একজনের ঘাড়ে আরেকজন উঠেছিলে?”

সুমি বোকার মতো একটু হেসে বলল, “বেশিক্ষণের জন্যে তো না, এই একটু সময়ের জন্যে!”

আম্মা হাল ছেড়ে দেবার চেষ্টা করে বললেন, “তোমরা যে বুবুনের আব্বাকে সবকিছু মনে করানোর চেষ্টা করছ, সেই কাজটা খুবই মহৎ, কিন্তু আর করো না। যদি করতেই চাও অন্যভাবে করো যেখানে কারও ঘাড় ভাঙার ভয় থাকে না, বাড়িতে আগুন লাগার ভয় থাকে না, দুই-চারজন খুন-জখম হওয়ার চান্স থাকে না। ঠিক আছে?”

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে।”

.

রাতে ঘুমানোর সময় আম্মা বুবুনকে বললেন, “বুবুন, তোকে একটা কথা বলি।”

আম্মার গলায় স্বর শুনে ভয় পেয়ে গেল, জিজ্ঞেস করল, “কী কথা আম্মা?”

“তুই যখন স্কুলে যাবি স্কুল থেকে বাসায় আসবি বা বাইরে খেলবি তখন কখনো কোনো অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলবি না।”

“কেন আম্মা? কী হয়েছে”

“খুব সাবধানে থাকবি। কখনো একা থাকবি না, সবাই একসাথে থাকবি। সবসময়। ঠিক আছে?”

“কেন আম্মা?”

আম্মা একটা নিঃশ্বাস ফেলেন, তারপর বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঐ যে খবিরউদ্দিন আর তার জামাতি দল আছে না, তারা একেবারে খেপে গেছে। আমাকে থামানোর জন্যে এরা যা খুশি করতে পারে। একাত্তর সালে করেছে না! ইউনিভার্সিটির সব টিচারকে মেরে শেষ করে ফেলেছিল। তাই ভাবছিলাম,

“কী ভাবছিলে?”

“আমাকে ভয় দেখানোর জন্যে যদি তোকে কিডন্যাপ করে নেয়। তাই বলছিলাম খুব সাবধানে থাকবি। ঠিক আছে?”

“ঠিক আছে।”

“আজকে বাসায় এসে যখন দেখলাম এরকম তুলকালাম হচ্ছে আমি ভেবেছিলাম বুঝি তোকে ধরে নিয়ে গেছে, যা ভয়টা পেয়েছিলাম! ওহ!”

বুবুন আম্মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল, কেন আজকে এত বড় ঘটনার পরেও আম্মা একটুও রাগ করেননি হঠাৎ করে পরিষ্কার হয়ে গেল বুবুনের কাছে।

০৯. কিডন্যাপ

সবাই মিলে স্কুলে যেতে যেতে কথা বলছিল, হঠাৎ করে বুবুন সবাইকে থামিয়ে বলল, “কাল রাতে আম্মা কী বলেছে জান?”

“কী?”

“খবিরউদ্দিনের দল আমাকে কিডন্যাপ করে নেবে!” সুমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বলল, “যাহ্! গুল মারছিস!”

“আমার কথা বিশ্বাস হল না? আম্মাকে জিজ্ঞেস করে দেখো।”

“কেন? তোকে কেন কিডন্যাপ করবে?”

“আম্মাকে ভয় দেখানোর জন্য। আম্মা তো মেয়েদের স্কুলের জন্যে কাজ করেন–এইজন্যে খবিরউদ্দিনের খুব রাগ আম্মার উপরে।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। মাঝে মাঝে আম্মার কাছে চিঠি লেখে খবিরউদ্দিনের দলবল।”

“কী লেখা থাকে চিঠিতে?”

“জানি না–আম্মা আমাকে কখনো দেখায় না। নানারকম ভয়ের জিনিস থাকে তো!”

গাব্বু একটা চিউয়িংগাম চিবুতে চিবুতে সুমি আর বুবুনের কথা শুনছিল, এবারে এগিয়ে এসে চোখ বড় বড় করে বলল, “ইশ! কী মজাটাই-না হবে!”

সুমি অবাক হয়ে বলল, “কখন মজা হবে?”

“যখন বুবুনকে ধরে নিয়ে যাবে।”

“মজা হবে?”বুবুন একটু রেগে গেল, “মজা হবে কেন?”

“খালি ডিটেকটিভ বইয়ে পড়েছি মানুষকে কিডন্যাপ করে নেয়, তাকে যখন নেবে তখন সত্যি সত্যি দেখব।”

“সেটা মজা হল?”

“মজা হবে না। আমরা সবাই মিলে তোকে উদ্ধার করে আনব। একেবারে অ্যাডভেঞ্চার বইয়ের মতো!”

“আর যদি না পারিস? আমার রগ যদি কেটে ফেলে?”

“ধুর! রগ কাটতে দেব নাকি আমরা! তার আগেই তোকে উদ্ধার করে ফেলব না?”

পিয়াল বলল, “গাব্বু ঠিকই বলেছে। আসলেই যদি তোকে কিডন্যাপ করে নেয় আর আমরা যদি তোকে উদ্ধার করি কী মজাটাই-না হবে!”

সুমিও মাথা নাড়ল, “সেটা ঠিক।”

গাব্বু পিচিক করে থুতুর সাথে চিউয়িংগামটা ফেলে দিয়ে বলল, “আমাদের জীবনটা একেবারে পানশে হয়ে গেছে। কোনোই আনন্দ নাই। কিছু-একটা না হলে আর মজা লাগছে না। সত্যি সত্যি তোকে কিডন্যাপ করবে তো?”

বুবুন হেসে ফেলল, “তোকে মজা লাগানোর জন্যে আমাকে কিডন্যাপ হতে হবে?”

পিয়াল হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বলল, “আমরা আগে থেকে শুরু করতে পারি না?”

সুমি ভুরু কুঁচকে বলল, “আগে থেকে কী শুরু করবি?”

“মনে কর পিয়ালকে হাইজ্যাক করে নিল। তখন আমাদের কী করতে হবে?”

সুমি মাথা চুলকাল, “ইয়ে, সেটা তো বলা মুশকিল!”

“দেখলি তুই জানিস না! তার মানে যদি সত্যি সত্যি বুবুনকে ধরে নিয়ে যায় তখন কী করতে হবে আমরা বুঝতেই পারব না। কাজেই আগে থেকে যদি কাজ এগিয়ে রাখি–”

গাব্বু হাতে কিল দিয়ে আনন্দে হেসে ফেলে বলল, “ঠিক বলেছিস। এখন থেকেই শুরু করে দিই! বুবুনকে হাইজ্যাক না করলেও ক্ষতি নাই–আমরা ধরে নেব হাইজ্যাক হয়ে গেছে।”

“কিন্তু কী করা শুরু করবি?”

পিয়াল মুখ গম্ভীর করে বলল, “যেমন মনে কর আমরা একটা ওয়ারলেস ট্রান্সমিটার তৈরি করে ফেলতে পারি। সেইটা বুবুনের পকেটে থাকবে, কাজেই তাকে যেখানেই নেবে আমরা বাইরে থেকে সেটা বুঝে ফেলব।”

সুমি ভুরু কুঁচকে বলল, “বানাতে পারবি তুই?” পিয়াল মুখে তাচ্ছিল্যের একটা ভাব করে বলল, “এইটা বানানো কঠিন কী? একেবারে পানিভাত! আমার কাছে সার্কিট আছে।”

গাব্বু বলল, “আমরা আগে থেকে খবিরউদ্দিনের দলবলের লিস্ট করে ফেলতে পারি।”

পিয়াল মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। তা হলে যখন পুলিশ ধরতে আসবে তখন কাকে কাকে ধরতে হবে বুঝতে কোনো অসুবিধাই হবে না।”

গাব্বুর চোখ চকচক করতে থাকে, “আমাদের যখন ফাঁইট দিতে হবে তখন ব্যবহার করার জন্য কিছু ডেঞ্জারাস অস্ত্র জোগাড় করতে পারি।”

“হ্যাঁ, আর বুবুন যেন পালিয়ে আসতে পারে সেইজন্যে তার হাতে একটা হ্যাঁকস দিতে হবে। শিকল কেটে চলে আসতে পারবে। তার সাথে টর্চলাইট। আর চাকু।”

গাব্বু জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তার সাথে কয়েকটা পেট্রোল বোমা।”

বুবুন চোখ কপালে তুলে বলল, “পেট্রোল বোমা?”

“হ্যাঁ। পেট্রোল বোমা ছাড়া কোন অ্যাডভেঞ্চার করাই ঠিক না।”

বুবুন বলল, “আসলে যদি খবিরউদ্দিনের আস্তানাগুলো আগে থেকে বের করে রাখতে পারি তা হলেই অনেক বড় কাজ হবে।”

পিয়াল বলল, “মুশকিল হল আমরা তো খবিরউদ্দিনকেই কোনোদিন দেখি নাই।”

বুবুন হঠাৎ চমকে উঠে বলল, “কিন্তু আমরা তো তার এক সাগরেদকে দেখেছি, মনে নেই?”

“কোন সাগরেদ?”

“ঐ যে টিলার উপরে দেখেছিলাম ইঁদুরের মতো দেখতে! আমরা শিয়াল দেখতে গিয়ে ফিরে আসছিলাম, তখন একজন জিজ্ঞেস করল রওশান নামের মেয়েলোকটার বাসা কোথায়?”

পিয়াল বলল, “ও! ও! সেই লোকটা? আমি তো ওকে আরও দেখেছি?”

“কোথায় দেখেছ?””আমাদের স্কুলের সামনে যে একটা ফার্মেসি আছে সেখানে বসেছিল।”

সুমি চোখ বড় বড় করে বলল, “মনে হয় বুবুনকে হাইজ্যাক করার জন্যে এসেছিল।”

“হতে পারে।”

বুবুন গম্ভীর হয়ে বলল, “আম্মা বলেছে, এদেরকে কোনো বিশ্বাস নাই।’

“খুব সাবধানে থাকতে হবে বুবুনকে।” সুমি গম্ভীর হয়ে বলল, “পাহারা দিয়ে রাখতে হবে সবসময়।”

গাব্বু মুখ শক্ত করে বলল, “কাছে এসে দেখুক না, লাথি মেরে হাঁটুর জয়েন্ট খুলে দেব।”

.

সেদিন সন্ধ্যেবেলা অনেকদিন পর ডক্টর রাজীব হাসান আব্বাকে দেখতে এলেন। দুজনেই দুজনকে দেখে খুব খুশি হয়ে উঠলেন, রাজীব হাসান আব্বার ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, “ভালো আছ মাসুদ?”

“জি ডাক্তার সাহেব, ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?”

“হ্যাঁ, আমিও ভালো আছি।”

“আমার গাছগুলোও ভালো আছে? বারান্দার পাশে যেগুলো লাগিয়েছিলাম?”

“হ্যাঁ, সেইগুলো ভালো আছে। এত বড় বড় ফুল ফুটেছে, তুমি থাকলে নিশ্চয়ই আরও বড় ফুল ফুটত।”

“আর পিছনেরগুলো?”

”সেগুলোও ভালো আছে। এখন তুমি বলো এখানে তোমার কেমন লাগছে।”

“ভালোই লাগছে। তবে—”

”তবে কী?”

“বাচ্চাদের সবসময় দেখে রাখতে হয়। বুবুনের বন্ধুরা আছে, তাদের মাথায় একবারে বুদ্ধি নাই।”

“বুদ্ধি নাই?”

“না, সবসময় উলটাপালটা কাজ করে বিপদে পড়ে যায়।” আব্বা মুখ গম্ভীর করে মাথা নাড়তে লাগলেন।

“তাই নাকি?”

“জি। আমি না থাকলে আরও বড় বিপদে পড়ে যাবে।”

“তা হলে তো তোমার থাকতেই হবে।”

“মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন থাকতে হবে। তা ছাড়া এখানে একটা বাগান শুরু করেছি সেটারও দেখাশোনা করা দরকার। মাটি ভালো না এখানে।”

রাজীব হাসান মুচকি হেসে বললেন, “তোমার স্ত্রীর সাথে ভাব হয়েছে?”

আব্বাকে এক মুহূর্তের জন্যে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখাল, “স্ত্রী?” পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “ও! বুবুনের আম্মা?”

“হ্যাঁ।”

“একটু একটু হয়েছে। খুব ব্যস্ত থাকে তো, বাসায় আসতে আসতেই রাত হয়ে যায়।”

ডাক্তার রাজীব হাসান আব্বার সাথে আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তাঁকে পরীক্ষা করলেন, চেয়ারে বসিয়ে হাঁটুর মাঝে ঠোকা দেওয়া, চোখের মণির দিকে তাকিয়ে দেখা, হাতের আঙুল পায়ের আঙুল টিপে টিপে দেখা এই ধরনের নানারকম পরীক্ষা। সবকিছু দেখে ডাক্তার রাজীব হাসান খুব খুশি হয়ে বললেন, “তোমার আর কোনো চিন্তা নেই মাসুদ। এইভাবে যদি আরও কিছুদিন চলতে থাকে তোমার শরীর একেবারে ঠিক হয়ে যাবে।”

আম্মা একটু পরেই এলেন, তাঁকে অফিসের গাড়ি নামিয়ে দিতে এসেছে। সাথে জাহিদ চাচাও ছিলেন, আম্মা তাঁকেও নামিয়ে নিলেন। রাতে সবাই একসাথে খেল, আগে থেকে ঠিক করা ছিল না বলে আয়োজন খুব সামান্য, কিন্তু সবাই খুব মজা করে খেল। খেতে খেতে খবিরউদ্দিনের কাজকর্মের কথা শুরু হল। আব্বা খানিকক্ষণ শুনে বললেন, “খবিরউদ্দিন কে?”

আম্মা বললেন, “একজন খুব খারাপ মানুষ।”

আব্বা বললেন, “ও।”

আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, “কেন খারাপ শুনবে না?”

“কেন খারাপ?”

আম্মা বলতে শুরু করেছিলেন তখন বুবুন বলল, “আম্মা তুমি ঠিক করে বলতে পারবে না, জাহিদ চাচা খুব সুন্দর করে বলেন। জাহিদ চাচা আপনি বলেন–”

জাহিদ চাচা হেসে চোখ পাকিয়ে হাত-পা নেড়ে বক্তৃতার মতো করে বলতে শুরু করলেন, “উনিশ শো একাত্তর সালের রাজাকার কমান্ডার, জামাতে ইসলামীর লিডার, এন-জিও-বিরোধী, নারীশিক্ষা বিরোধী, ফতোয়াবাজ, ধর্মব্যবসায়ী রগকাটা নেতা খবিরউদ্দিন বদের হাঁড়ি—”

জাহিদ চাচার কথা শুনে সবাই হাসতে শুরু করল, আব্বা হাসিতে যোগ না দিয়ে খুব চিন্তিত মুখে আম্মা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

পরদিন স্কুলে যাবার সময় পিয়াল তার পকেট থেকে একটা ছোট পকেট রেডিও বের করে বুবুনকে দিয়ে বলল, “শোন।”

“কী শুনব? ক্রিকেট খেলা আছে নাকি?”

“না, ক্রিকেট খেলা না। এফ. এম. ট্রান্সমিটার তৈরি হয়ে গেছে, দুইশো মিটার দূর থেকে শুনতে পারবি।”

বুবুন রেডিওটা অন করতেই সেটা কটকট শব্দ করতে শুরু করল। পিয়াল বুক-পকেট থেকে আরেকটা ছোট সার্কিট বোর্ড বের করে বলল, “এই যে আমার ট্রান্সমিটার। এইখানে থেকে সিগনাল আসছে।”

“ধুর!” গাব্বু মুখ বাঁকা করে বলল, “গুল মারছিস!”

“বিশ্বাস করলি না? এই দ্যাখ–বলে পিয়াল কোথায় জানি কানেকশান খুলে নিতেই কটকট শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। গালুর মুখ হাঁ হয়ে যায়।”তুই নিজে তৈরি করেছিস?”

“নিজে নয়তো কী? আমার কী অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে নাকি! এই দ্যাখ এই যে ভেরিয়েবল রেজিস্টর এটা বাড়িয়ে কমিয়ে কটকট শব্দ তাড়াতাড়ি করা যায়।”

পিয়াল কী-একটা জিনিস ঘুরিয়ে দিতেই কটকট শব্দটা খুব দ্রুত হতে শুরু করল আবার উলটোদিকে ঘোরাতেই শব্দটা আস্তে আস্তে হতে লাগল। পিয়াল মুখে একটা দুনিয়া জয় করার ভাব করে বলল, “যদি বুবুন দেখে ভিতরে বিপদ বেশি তা হলে রেজিস্ট্যান্স কমিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি বাড়িয়ে দেবে তখন শব্দ হবে কট কট-কট-কট-কট আবার যদি দেখে অবস্থা নিরাপদ তা হলে রেজিস্ট্যান্স বাড়িয়ে দেবে, তখন শব্দ হবে ক… ট … ক … ট, আমরাও তখন ঢুকে যাব–”

গাব্বু মাথা নাড়ল, “সব অস্ত্রপাতি নিয়ে।”

বুবুন পিয়ালের তৈরি ট্রান্সমিটার হাতে নিয়ে বলল, “কত দূর থেকে এটা কাজ করে?”

“ফাঁকা জায়গা হলে তিন-চারশো মিটার হওয়া কথা। আমি অবিশ্যি পরীক্ষা করে দেখিনি।”

চল পরীক্ষা করে দেখি।”

“চল।”

তখন-তখনই তারা দুই দলে ভাগ হয়ে গেল, এক দল তাড়াতাড়ি সামনে হেঁটে গেল, অন্য দল পিছনে দাঁড়িয়ে রইল, দেখা গেল প্রায় আধ কিলোমিটার সামনে চলে যাবার পরেও শব্দ বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

.

বিকেলবেলা স্কুল ছুটির পর সবাই বাসার দিকে রওনা দিয়েছে হঠাৎ পিয়াল চাপা গলায় বলল, “সর্বনাশ!”

গাব্বু ভয় পেয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

“ঐ লোকটা!”

“কোন লোকটা!”

পিয়াল চাপা গলায় বলল, “ঐ যে টিলার উপরে ছিল। বুবুনের বাসার খোঁজ নিচ্ছিল। ইঁদুরের মতো দেখতে

সুমি বলল, “খবরদার কেউ ঘুরে তাকাবি না। কিছুই হয়নি এরকম ভাব করে হেঁটে যা।”

সবাই খুব স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে লাগল। সুমি চাপা গলায় বলল, “পিয়াল, লোকটা কি আমাদের পিছনে পিছনে আসছে? তুই তাকিয়ে দ্যাখ, লোকটা যেন বুঝতে না পারে সেভাবে তাকাবি।”

পিয়াল সাবধানে চোখের কোন দিয়ে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ আসছে। সাথে আরও একজন আসছে।”

“কীরকম দেখতে?”

“কালো দাড়ি। খাটাশের মতো চেহারা।”

“সবাই স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে থাক। দেখে যেন সন্দেহ না করে।”

সবাই স্বাভাবিক ভঙ্গি করে হাঁটতে থাকল, ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তায় ওঠার পরেও লোক দুইজন পিছনে পিছনে আসতে লাগল, দেখে কোনো সন্দেহই রইল না যে মানুষগুলো ওদের পিছনে পিছনে আসছে। সুমি বলল, “গাব্বু আর পিয়াল। তোরা এই দোকানে থেমে যাবি ভান করবি দোকান থেকে কিছু কিনছিস। আমরা হাঁটতে থাকব।”

“কী লাভ তা হলে?”

“তোরা মানুষ দুইজনের পিছনে চলে যাবি। তা হলে দেখতে পারবি কী করছি। বিপদ দেখলে সাবধান করতে পারবি।”

“ঠিক আছে।”

“আমরা মানুষ দুইজনকে খসিয়ে দেবার চেষ্টা করব।”

“কীভাবে?”

“হঠাৎ দৌড়ে কোনো একটা গলিতে ঢুকে যাব।”

“তখন আমরা কী করব?”

“তোরা পারলে মানুষ দুজনকে ফলো করবি–দেখিস কোথায় যায়।”

“ঠিক আছে।”

পিয়াল আর গাঙ্কু একটা দোকানে থেমে গেল, ভান করতে লাগল সেই দোকান থেকে কিছু কিনবে। সামনে একটা গলি, ইচ্ছে করলে এই গলিটা দিয়েও বেশ খানিকটা ঘুরে বাসায় যাওয়া যায়। সুমি ফিসফিস করে বুবুনকে বলল, “গলিটার কাছে এসে হঠাৎ করে ভিতরে ছুট দিবি।”

বুবুনের বুক ধ্বকধ্বক করছে, কোনোমতে ঢোক গিলে বলল, “ঠিক আছে।”

দুজনে খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে যেন কিছুই হয়নি সেইভাবে হেঁটে যেতে থাকে। হঠাৎ মনে হল পিছন থেকে একটা মাইক্রোবাস এসে থামল। বুবুনের চোখের কোনা দিয়ে দেখল হঠাৎ করে একজন মানুষ তার দুই হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তাকে ধরার জন্যে। সত্যিই মানুষটা তাকে ধরতে চাইছে নাকি অন্যকিছু করছে বুবুন সেটা আর যাচাই করার জন্যে অপেক্ষা করল না। হঠাৎ করে ঝটকা মেরে মানুষটির হাতের নাগালের বাইরে সরে গিয়ে এক দৌড়ে গলির মাঝে ঢুকে গেল। সুমি পিছনে পিছনে ছুটতে ছুটতে চিৎকার করে বলল, “পালা!”

পিছনে অনেক কয়জন মানুষের পায়ের শব্দ এবং গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা গেল কিন্তু বুবুন বা সুমির পিছনে ঘুরে তাকানোর সাহস হল না। দুজনে প্রাণপণে ছুটতে থাকে, পিছনে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে দৌড়ানো খুব সোজা ব্যাপার নয় কিন্তু সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ ডানদিকে আরেকটা সরু গলি দেখা গেল, দুজন মানুষ কষ্ট করে যেতে পারে এরকম। সুমি চাপা গলায় বলল, “ডানদিকে!”

বুবুন সুমির পিছনে পিছনে গলিতে ঢুকে গেল। আঁকাবাকা গলি সেদিক দিয়ে আরও খানিকক্ষণ দৌড়ে একটা বাসায় পিছনে লুকিয়ে দুজনে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে। বুবুন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “কী মনে হয়? লোকগুলোকে খসাতে পেরেছি?”

সুমি সাবধানে মাথা বের করে পিছনে উঁকি মারার চেষ্টা করতে করতে বলল, “মনে হয় পেরেছি। কাউকে তো দেখি না?”

“মাইক্রোবাসটা কি আমাকে ধরতে এসেছিল?”

“তাই তো মনে হয়।”

“খুব বাচা বেঁচে গেছি। কী সর্বনাশ!”

“সুমি কোনো কথা না বলে খুব চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে রইল!”

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে দুজনে আবার হাঁটতে শুরু করে। একটু পরে পরে পিছনে তাকাচ্ছিল কাউকে দেখা যায় কি না দেখতে। অনেক রাস্তা ঘুরে তারা শেষ পর্যন্ত বাসায় পৌঁছাল। দেরি দেখে সুমির আম্মা চিন্তা করছিলেন, তাদের দেখে নিশ্চিন্ত হলেন। বুবুনের বাসায় আম্মা নেই, আব্বা সাধারণত বাইরে বাগানে কাজ করেন, আজকে আব্বাকেও দেখা গেল না। এখানকার মাটি খারাপ বলে মাঝে মাঝে টিলার কাছ থেকে মাটি আনতে যান, এখনও সেরকম কোথাও গিয়েছেন হয়তো। গাব্বু আর পিয়ালকে দেখা গেল না, এখনও বাসায় আসেনি।

রাস্তায় যে বুবুনকে প্রায় ধরে নিয়ে যাচ্ছিল সেই কথাটা কাউকে বলা হল না, আম্মা এলে আম্মাকে বলা যেতে পারে। অন্যেরা কথাটা মনেহয় বিশ্বাস করবে না, আর যদি বা বিশ্বাস করে পুরো দোষটা তাদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া হবে। কিছু-কিছু ব্যাপারে বড়মানুষেরা খুব চিবিত্র।

আরো ঘণ্টাখানেক পরে গাব্বু আর পিয়াল ফিরে এল, তাদের দুজনকেই খুব উত্তেজিত দেখাচ্ছে। গাব্বু হাতে কিল দিয়ে বলল, “পেয়ে গেছি!”

“কী পেয়েছিস?”

“খবিরউদ্দিনের ঘাটি।”

“কেমন করে পেয়েছিস?”

“বলছি, শোন।”

গাব্বুর কথা বলার ধরন ভালো না, কোনোকিছু গুছিয়ে বলতে পারে না। ছোট একটা জিনিস নিয়ে মাথা-গরম করে সেটা নিয়েই চেঁচামেচি করতে থাকে। সেদিক দিয়ে পিয়াল আবার অন্যরকম, অল্প খানিকটা বলেই থেমে যায়, ধরে নেয় সেটা থেকেই সবাই সবকিছু বুঝে নেবে।

দুজনের কথা থেকে যেটুকু বোঝা গেল সেটা এরকম: এরা যখন দোকান থেকে কিছু কিনবে ভান করে মানুষ দুজনের পিছনে চলে এল তার একটু পরেই একটা সাদা রঙের মাইক্রোবাস এসে থামল বুবুনকে ধরার জন্যে। ঠিক যখন ভিতর থেকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলবে তখন বুবুন আর সুমি দৌড়ে গলিতে ঢুকে গেল–মানুষগুলো তখন একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল, ওরা তো জানে না বুবুন আর সুমি এরকম একটা জিনিসের জন্যে তৈরি হয়ে আছে!

মাইক্রোবাসটা ঘুরিয়ে গলিতে ঢোকানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে আবার বের হয়ে এল। তখন কালো দাড়িওয়ালা মানুষটা মাইক্রোবাসটায় উঠে চলে গেল–গাব্বু আর পিয়াল কিছু করতে না পেরে তার নম্বরটা শুধু টুকে রাখল।

ইঁদুরের মতো মানুষটা তখন শহরের দিকে ফিরে যেতে লাগল। গাব্বু আর পিয়াল তখন তার পিছুপিছু আসতে লাগল। শহরে, ফোন ফ্যাক্স-এর একটা দোকান থেকে কয়েকটা টেলিফোন করল, কাকে করল কী বলল সেটা তারা ধরতে পারেনি। মানুষটা সেখান থেকে বের হয়ে একটা ফার্মেসিতে গেল, সেখান থেকে একটা হার্ডওয়্যারের দোকানে। সেই দোকান থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিল, তখন পিয়াল আর গাব্বও একটা রিকশা নিল, তাদের কপাল ভালো যে পকেটে রিকশাভাড়া ছিল। সেই রিকশা করে মানুষটা শহরের প্রায় বাইরে একটা বাড়িতে হাজির হয়। বাড়িটা নির্জন একটা জায়গায়, চারিদিকে দেয়াল, সামনে বড় গেট। সেই গেটে অনেক বড় তালা ঝুলছে। মানুষটা সেই গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চারিদিকে খুব সন্দেহের চোখে তাকাল, গাব্বু আর পিয়ালের কপাল ভালো, কারণ তারা ততক্ষণে রিকশা থেকে নেমে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে গেছে।

একটু পরে ভিতর থেকে একজন মানুষ গেট খুলে দিল, তখন তারা দেখতে পেল ভিতরে সেই মাইক্রোবাসটা দাঁড়িয়ে আছে, নম্বরটা টুকে রেখেছিল বলে বুঝতে কোনো অসুবিধে হয়নি!

গাব্বু আর পিয়াল দূর থেকে বাসাটা ভালো করে দেখে চলে এসেছে, আসার সময় কাছাকাছি দোকানে, এক-দুইজন মানুষকে জিজ্ঞেস করেছে বাসাটা কার, তারা কেউ বলতে পারেনি। সবার ধারণা বাসাটাতে কেউ থাকে না, খালি পড়ে থাকে। তবে গাব্বু আর পিয়ালের মনে এতটুকু সন্দেহ নেই যে বুবুনকে যদি ধরতে পারত তা হলে এই বাসাতেই নিয়ে আসত।

গাব্বু আর পিয়ালের গল্প শেষ হবার পর চারজনই খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। সত্যি সত্যি যদি খবিরউদ্দিনের দলবল বুবুনকে ধরে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে থাকে তা হলে আসলেই খুব ভয়ের কথা। কিছু-একটা করা না হলে বুবুনের তো স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিতে হবে।

স্কুল থেকে দেরি করে এসেছে বলে গাব্বু আর পিয়াল তাড়াতাড়ি বাসায় চলে গেল। সুমিও কিছুক্ষণ বসে থেকে চলে গেল, বুবুন একা একা বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে রইল। আব্বা কোথায় গেছেন কে জানে, আব্বা চলে এলে গল্পগুজব করা যেত। টিলার দিকে গিয়ে দেখে আসা যায় আব্বা কোথায় আছেন, কিন্তু আজকের ঘটনার পর একা একা যাওয়ার সাহস করছে না।

আস্তে আস্তে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল তখনও আব্বার দেখা নেই। এবার বুবুনের একটু একটু ভয় লাগতে থাকে। কোথায় গেছেন আব্বা? একা একা বের হয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেননি তো? একেবারে বাচ্চা একজন মানুষের মতো–যদি কিছু-একটা বিপদ হয় তখন কী হবে?

ঠিক সন্ধ্যেবেলা আম্মা ফিরে এলেন, গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে জাহিদ চাচা বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কী খবর ইয়ংম্যান।”

বুবুন বলল, “খবর ভালো না।”

জাহিদ চাচা ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী হয়েছে?”

“আজকে কয়েকজন লোক আমাকে কিডন্যাপ করার চেষ্টা করছিল।”

আম্মা আর জাহিদ চাচা একসাথে চিৎকার করে উঠলেন, কী বলছ!”

“হ্যাঁ। তাছাড়া আব্বাকে দেখছি না বিকাল থেকে।”

জাহিদ চাচা গাড়ি থেকে প্রায় লাফিয়ে নেমে পড়লেন।”কোথায় গিয়েছেন?”

“জানি না।”

আম্মা হঠাৎ কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। তাঁকে দেখে মনে হতে লাগল যে তার বুকের ভিতরে কোনো ধরনের যন্ত্রণা হচ্ছে। মনে হচ্ছিল বুঝি পড়ে যাবেন, কোনোভাবে গাড়ির জানালা ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “বুবুন বাবা, কাছে আয়।”

বুবুন আম্মার কাছে এগিয়ে গেল, আম্মা কীরকম জানি শক্ত করে তাকে ধরে ফেলে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “তোকে কখন কিডন্যাপ করতে চেষ্টা করছিল? কীভাবে? কোথায়?”

বুবুন মাত্র বলতে শুরু করেছে ঠিক তখন আট-নয় বছরের একটি ছেলে হাতে একটা ঠোঙা নিয়ে এসে হাজির হল। ছেলেটা আম্মাকে জিজ্ঞেস করল, “এখানে রওশান কার নাম?”

আম্মা বললেন, “আমার নাম। কেন, কী হয়েছে?”

ছেলেটা ঠোঙাটা আম্মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে এইটা আপনারে দিতে বলেছে।”

“কে বলেছে?”

“একটা লোক। আমারে দশ টাকা দিছে।”

আম্মা কেমন জানি বিবর্ণ হয়ে ঠোঙাটা নিয়ে খুললেন, ভিতরে ভঁজ-করা একটা কাগজ। কাগজটা খুলে আবো-অন্ধকারে পড়ার চেষ্টা করলেন। বুবুন জিজ্ঞেন করল, “কী লেখা আম্মা?”

আম্মা বিড়বিড় করে পড়লেন, “এইবার ঠোঙাটা খালি। কাল ভোরের মাঝে তুমি যদি এই এলাকা ছেড়ে না যাও অরেকটা ঠোঙা পাঠাব, সেই ঠোঙায় থাকবে তোমার স্বামীর একটা আঙুল। কাল রাতের মাঝে যদি না যাও যে-ঠোঙাটা আসবে সেটা হবে আরও বড় কারণ তার মাঝে থাকবে তোমার বেকুব স্বামীর মাথা! আল্লাহর কসম আমরা বাজে কথা বলি না।”

আম্মা একটা চাপা আর্তনাদ করে উঠলেন, বুবুনের মাথা ঘুরে উঠল হঠাৎ তার আব্বাকে ধরে নিয়ে গেছে খবিরউদ্দিনের লোক!

জাহিদ চাচা বললেন, “দেখি চিঠিটা!”

“আরও একটা লাইন আছে।” আম্মা কাঁপা গলায় পড়লেন শেষ লাইনটা, “এই চিঠির কথা যদি জানাজানি হয় বড় ঠোঙাটা কাল ভোরেই চলে আসবে।”

আম্মা অপ্রকৃতিস্থের মতো তাকালেন, বুবুন অবাক হয়ে দেখল, আম্মা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না বুবুনকে ধরে হঠাৎ মাটিতে উবু হয়ে পড়ে গেলেন।

১০. পরিকল্পনা

আম্মা সোফায় বসে আছেন, জাহিদ চাচা খাবার টেবিলের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বললেন”ডক্টর রওশান, আপনার দরকারি জিনিসগুলো একটা ব্যাগে ভরে নেন।”

মনে হল আম্মা কথাটা ঠিক বুঝতে পারলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যাগে ভরে নেব?”

“হ্যাঁ। আপনাকে আর বুবুনকে নিয়ে যাই। আজ রাতেই।”

“ওরা যেটা চাইছে?”

জাহিদ চাচা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, বললেন, হ্যাঁ। মানুষের সাথে মানুষ যুদ্ধ করতে পারে। জানোয়ারের সাথে কেউ যুদ্ধ করে না।”

“জানোয়ার?”

“হ্যাঁ। একাত্তরে ওরা আমার স্যারদের ধরে ধরে মেরেছে। ওরা মানুষ নয় ডক্টর রওশান। আপনাকে আমরা ঢাকায় রেখে আসব, মাসুদ সাহেবকে ছাড়িয়ে আনব, তারপর আমি দেখব ওই জানোয়ারের দলের কত বড় সাহস। কিন্তু এখন কোনোরকম ঝুঁকি নেব না। একটুও না। আপনি রেডি হয়ে নেন।”

‘কিন্তু ওরা তো আজ রাত পর্যন্ত সময় দিয়েছে।”

“তা দিয়েছে।” জাহিদ চাচা এক মুহূর্তে কী যেন চিন্তা করলেন, তারপর বললেন, “ঠিক আছে। আপনারা আজ রাতে রেডি থাকেন, কাল খুব ভোরে নিয়ে যাব।”

“আমি রেডি আছি।” আম্মা ফিসফিস করে বললেন, “আমার নতুন করে রেডি হতে হবে না।”

বুবুন ইতস্তত করে বলল, ‘জাহিদ চাচা!”

“কী, বুবুন?”

“আমার মনে হয় আব্বাকে কোথায় ধরে নিয়েছে আমরা জানি।”

জাহিদ চাচা এবং আম্মা ভয়ানকভাবে চমকে উঠলেন।”কী বললে?” জাহিদ চাচা দুই পা এগিয়ে এসে বললেন, “কী বললে তুমি?”

“আমাকে যারা ধরতে চেষ্টা করেছিল–আমার বন্ধুরা তাদের আস্তানা দেখে এসেছে।”

“তাদের আস্তানা?” জাহিদ চাচা আশাভঙ্গের একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তাদের আস্তানা তো অনেক। কোনটা দেখেছে?”

“আমি জানি না, জিজ্ঞেস করে আসব?”

“না না। জানাজানি করা যাবে না। আমরা একেবারে কোনো রিস্ক নেব না। কাল ভোরে তোমরা ঢাকা যাবে, তোমার আব্বাকে ছাড়িয়ে আনা হবে তারপর।”

“কিন্তু পুলিশ নিয়ে যদি সেই জায়গায় যান?”

“এখন পুলিশকে বলা ঠিক হবে না। একেবারে হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর হলেই শুধু বলা যায়–কিন্তু শুধু সন্দেহ হলে হবে না।” জাহিদ চাচা মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “হবে না। তুমি জান না এরা কী ভয়ানক মানুষ। যদি গিয়ে দেখা যায় তোমরা ভুল করেছ, তোমার আব্বা সেখানে নেই? সর্বনাশ হয়ে যাবে!”

আব্বার ঘরে গিয়ে বুবুনের চোখে একেবারে পানি এসে গেল, তার একেবারে ছেলেমানুষের আব্বাটি এখন না জানি কী ভয় পাচ্ছেন–তাকে না জানি কীভাবে অত্যাচার করছে। তাকে কীভাবে রেখেছে, কী খেতে দিয়েছে কে জানে! বুবুন ঘরের মাঝখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে আর হঠাৎ করে ধর্মের নামে যারা এত বড় অন্যায় কাজ করতে পারে তাদের উপর রাগে, ঘৃণায় তার প্রায় বমি এসে যেতে চায়। কী ভয়ানক খারাপ মানুষ এরা অথচ তারা যেটা চাইছে সেটাই হবে? আম্মা চলে যাবার পর আনন্দে তারা নিশ্চয়ই নাচানাচি করবে, মেয়েদের স্কুলগুলি জ্বালিয়ে দেবে আর আবার যদি কেউ এসে কিছু করতে চায় তার বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে নেবে। এটা কেমন করে হয়?

বুবুন ঘরের মাঝখানে থেকে হেঁটে জানালার কাছে এসে দাঁড়াল, যদি কোনোভাবে খবিরউদ্দিনের আস্তানায় গিয়ে দেখা যেত আব্বাকে সেখানেই আটকে রেখেছে তা হলেই তো পুলিশ নিয়ে আসা যাবে। জাহিদ চাচা বলেছেন, হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর হতে হবে–সেটাই কি করা যায় না? খবিরউদ্দিনের আস্তানায় গিয়ে হাজির হওয়া যায় না?

বুবুন হঠাৎ চমকে উঠল, পিয়ালের সেই ট্রান্সমিটার দিয়ে ভেতর থেকে বাইরে খবর পাঠানো যায় না? একটামাত্র খবর দরকার, আব্বা সেখানে আছেন কি নেই। সেটা বের করা কি এতই কঠিন? সে একা পারবে না, তার সাথে আরও একজনকে নিতে হবে, পিয়াল কিংবা গাব্ব। একজন যাবে ভিতরে একজন বাইরে। যে ভিতরে যাবে তার কাছে থাকবে পিয়ালের ট্রান্সমিটার, যে বাইরে থাকবে তার কাছে থাকবে পকেট-রেডিওটা। ভিতরে গিয়ে যদি দেখা যায় আব্বাকে সেখানে আটকে রেখেছে তাহলে ট্রান্সমিটারটা অন করে দেয়া হবে সাথে সাথে বাইরে খবর চলে যাবে। তখন গিয়ে পুলিশকে জানানো যাবে।

বুবুন পুরো পরিকল্পনাটা আরও একবার ভেবে দেখল, কাজ না করার কোনো কারণ নেই। যদি ভিতরে গিয়ে ধরাও পড়ে যায় তবু একজন বাইরে থাকবে, সে গিয়ে অন্যদের খবর দিতে পারবে। সত্যি সত্যি যদি আব্বাকে ভিতরে পাওয়া যায় আর পুলিশ নিয়ে এসে খবিরউদ্দিনের দলবলের কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া যায়, বদমাইশগুলো কি তা হলে জন্মের সোজা হয়ে যাবে না?

বুবুন জানালা দিয়ে বাইরে অন্ধকারে নিমগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে ঠিক করে ফেলল যেভাবেই হোক সে যাবে তার আব্বার কাছে।

বাসা থেকে চুপিচুপি বের হয়ে এল বুবুন। সে একা যেতে পারবে না। জায়গাটা সে চেনেও না, একা যেতে চাইলেও যেতে পারবে না। গাব্বু নাহয় পিয়ালকে নিয়ে যেতে হবে। পিয়ালকে নেওয়া খুব সোজা হবে না, তার আব্বা অত্যন্ত কঠিন মানুষ, বুবুন তাই গাব্বর বাসায় হাজির হল। এরকম অসময়ে বুবুনকে দেখে গাব্বু খুব অবাক হল বলে মনে হল না, জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”

বুবুন চাপা গলায় বলল, “এখানে বলা যাবে না।”

গাব্বু সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল, বলল, “চল বাইরে যাই।”

বাইরে এসে বুবনের মুখে পুরো ঘটনা শুনে গাব্বর মুখ শক্ত হয়ে উঠল, মাটিতে থুতু ফেলে বলল,”শুওরের বাচ্চাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেব। দাড়ি টেনে ছিঁড়ে নেব–লাথি মেরে হাঁটুর জয়েন্ট খুলে দেব–”

“এতকিছু করতে হবে না। তুমি আমাকে সেই বাসাটা চিনিয়ে দাও, তা হলেই হবে।”

“কী করবে তুমি?”

“দেখব ভিতরে আব্বা আছেন কি না। পিয়ালের ট্রান্সমিটারটা নিয়ে যাব, যদি থাকেন সিগনাল দেব, আর তুমি বাসায় এসে খবর দেবে।”

গাব্বু বলল, “পিয়ালকেও নিতে হবে।”

“ওর আব্বা–”

“এরকম সময়ে আব্বাদের ভয় করলে হবে না। পিয়ালকে খবর দিলেই চলে আসবেই।”

গাব্বুর কথা সত্যি, পিয়ালকে বলামাত্র সে বাসার পিছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে এল। পিঠে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছে–তার ভিতরে টর্চলাইট, নাইলনের দড়ি, চাকু এরকম আরও নানাকরম জিনিস রয়েছে। বুবুনকে দেখে বলল, বুবুন, তুমি কোনো চিন্তা করো না, আমরা চাচাকে ঠিক উদ্ধার করে ফেলব।”

সত্যি সত্যি কিছু করতে পারবে কি না কেউ জানে না কিন্তু পিয়ালের কথা শুনে হঠাৎ বুবুনের চোখে পানি এসে গেল।

গাব্বু বলল, “আমাদের খুব তাড়াতাড়ি রওনা দিতে হবে। বাসায় যখন খোজাখুঁজি শুরু হবে তখন ধারেকাছে থাকলে বিপদ হয়ে যাবে।”

পিয়াল বলল, “আয় শেষবার দেখে নিই সবকিছু নেয়া হয়েছে কি না।”

গাব্বু বলল, “এইখানে দাঁড়িয়ে থাকিস না, হঠাৎ করে কেউ দেখে ফেলবে। আয় আরও সামনে যাই।”

ওরা তিনজন বুবুনদের বাসা পার হয়ে সুমিদের বাসায় কাছে চলে গেল। বাসায় সামনে পেয়ারা গাছটার নিচে বসে অন্ধকারে জিনিসপত্র হাতড়ে হাতড়ে দেখে আবার সবকিছু ব্যাগে ভরে রওনা দিয়ে দেয়–অনেকটা দূর যেতে হবে, পকেটে পয়সা থাকলে রিকশা করে যাওয়া যেত।

তারা তিনজন মাত্র কয়েক পা গিয়েছে হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, প্রচণ্ড আতঙ্কে ওরা প্রায় চিৎকার দিয়ে দিচ্ছিল, হঠাৎ করে দেখতে পেল মানুষটা সুমি!

গাব্বু বলল, “ও, তুই? ওহ্! কী ভয়টা পেয়েছিলাম!”

সুমি হেসে বলল, “কোথায় যাচ্ছিস তোরা চোরের মতো? জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি গাছের নিচে বসে গুজগুজ করছিস, তখন বুঝতে পারলাম কিছু-একটা ব্যাপার আছে।”

পিয়াল গম্ভীর গলায় বলল, “আসলেই ব্যাপার আছে।”

পিয়ালের গলায় স্বর শুনে সুমি ভয়-পাওয়া গলায় বলল, “কী ব্যাপার?”

“চাচাকে খবিরউদ্দিনের লোকেরা ধরে নিয়ে গেছে।”

সুমি চাপা গলায় চিৎকার করে বলল, “কী বললি?”

“হ্যাঁ। আমরা তাই যাচ্ছি।”

“কী করবি তোরা?”

গাব্বু গম্ভীর গলায় বলল, “চাচাকে উদ্ধার করব।”

সুমি এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “দাঁড়া, আমিও যাব।” গাব্বু চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই? তুই কেমন করে যাবি?”

“কেন, কী হয়েছে?”

“এই রাত্রে! একটা মেয়েমানুষ–”

”আমাকে মেয়েমানুষ বলবি তো ঘুসি মেরে নাক ভিতরে ঢুকিয়ে দেব।”

“মেয়েমানুষকে মেয়ে বলতে পারব না?”

পিয়াল বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ! ছেলে মেয়ে এইসব এখন রাখ দেখি।”

সুমি বলল, “তোরা দুই মিনিট দাঁড়া, আমি আসছি।”

“উঁহু। রাত্রিবেলা তোকে নিয়ে যাওয়া যাবে না।”

“ঠিক আছে। আমাকে ছাড়া যাওয়ার চেষ্টা করে দেখ আমি কী করি।”

“কী করবি?”

”এক্ষুনি চিৎকার করে আমি সবাইকে বলে দেব।”

বুবুন বলল, “তুমি সত্যিই যেতে চাও?”

সুমি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। আমি যদি না যাই হলে তোমাদের কপালে অনেক দুঃখ আছে।”

“কেন?”

“তোমাদের দলের মাঝে একজন থাকা দরকার যার মাথায় খানিকটা ঘিলু আছে, গায়ে জোর আছে আর বুকে সাহস আছে। তা ছাড়া

“তা ছাড়া কী?”

এরকম ব্যাপারে মানুষ যত বেশি থাকে তত ভালো। তোরা দাঁড়া আমি আসছি।”

বুবুন, গাব্বু আর পিয়াল দাঁড়িয়ে রইল, সত্যি কথা বলতে কি সুমি আসছে বলে হঠাৎ করে তাদের ভিতরে জোর খানিকটা বেড়ে গিয়েছে। সুমিকে খোদা নিশ্চয়ই ছেলে তৈরি করতে গিয়ে ভুল করে মেয়ে তৈরি করে ফেলেছে।

সুমি আসতে অবিশ্যি একটু দেরি করল, জিনসের প্যান্টের সাথে ঢলঢলে একটা টি-শার্ট পরে এসেছে, মাথায় বেসবল ক্যাপ, তার ভিতরে চুল ঢুকিয়ে রেখেছে, হঠাৎ দেখলে ছেলে মনে হয়। পিঠে একটা ব্যাগ-সেখানে নানা জিনিসপত্র।

.

শহরের শেষ মাথায় নির্জন এলাকাটায় পোঁছে বুবুন, গাবু, পিয়াল আর সুমি রিকশা থেকে নেমে পড়ল। বাকি জায়গাটা সাবধানে হেঁটে হেঁটে তারা অন্ধকার বাসাটার সামনে এসে হাজির হল। বাইরে থেকে মনে হয় ভিতরে কেউ নেই। চারিদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। খুব ভালো করে তাকালে অবিশ্যি দেখা যায় একটি দুটি ঘরে জানালার ফাঁক দিয়ে খুব অল্প আলো বের হয়ে আসছে। ওরা সাবধানে গেটটা কাটিয়ে দেয়ালের পাশে একটা গাছের নিচে এসে হাজির হল।

বুবুন ফিসফিস করে বলল, “পিয়াল, তোমার ট্রান্সমিটারটা আমাকে দাও। তোমরা বাইরে থেকে রেডিওটাতে কান লাগিয়ে শোনার চেষ্টা করো। আমি যদি আব্বাকে পেয়ে যাই তা হলেই সিগনাল পাঠাব, সাথে সাথে বাসায় গিয়ে খবর দেবে।”

সুমি ফিসফিস করেই যেটুকু জোরে বলা যায় সেভাবে বলল, “তুই কেন ভিতরে যাচ্ছিস?”

“তা হলে কে যাবে? আমার আব্বা–”

“তোর আব্বা হয়েছে তো কী হয়েছে! দুইজন যাবে ভিতরে। দুইজন থাকবে বাইরে।”

গাব্বু মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আমি আর বুবুন ভিতরে।”

‘উঁহু।” পিয়াল মাথা নাড়ল, “আমি আর বুবুন। আমি এই ট্রান্সমিটার তৈরি করেছি, আমি নিয়ে যাব ভিতরে।”

সুমি অধৈর্য হয়ে বলল, “এখন ঝগড়া করার সময় নাই, কে যাবে সেটা ঠিক হবে লটারি করে।”

“লটারি?”

“হ্যাঁ।”

“এই অন্ধকারে লটারি করবি কেমন করে?”

“সোজা। একজন বাম হাতে না হয় ডান হাতে একটা জিনিস রাখবে, অন্যজন বলবে কোন হাতে, যদি ঠিক ঠিক বলতে পারে তা হলে লটারিতে জিতে গেল।”

“যদি সবাই জিতে যায়!”

‘তা হলে আবার হবে লটারি। যতক্ষণ পর্যন্ত দুইজন না জিতছে ততক্ষণ লটারি হবে।”

“ঠিক আছে।”

“আগে থেকে বলে রাখছি কেউ পরে আপত্তি করতে পারবি না কিন্তু!”

“ঠিক আছে।”

লটারি কয়েকবার করতে হল এবং শেষ পর্যন্ত জিতে গেল বুবুন আর সুমি। যদিও আপত্তি করবে না বলে আগে কথা দিয়েছিল তবু পিয়াল আর গাব্বু একটু আপত্তি করার টেষ্টা করল, তাতে অবিশ্যি কোনো লাভ হল না।

ট্রান্সমিটারটা রাখল বুবুনের পকেটে। অন্য জিনিসপত্রগুলি দুটি ব্যাগে ভাগাভাগি করে নেওয়া হল। ব্যাগগুলো বেশ ভারী হয়েছে কারণ সুমি বাসা থেকে তার ব্যাগে অনেক জিনিস এনেছে। বাইরে থেকে আটকে দেওয়ার জন্যে বেশ কয়েকটা তালা, বোতলের মাঝে কেরাসিন তেল, সাবান, পানি, ম্যাচ, দড়ি, ছোটবড় ঢেলা। কোন জিনিসটা কোন কাজে লাগবে সেটা এখনও সবার কাছে পুরোপুরি পরিষ্কার নয় কিন্তু সুমি ভালোভাবে প্রস্তুত না হয়ে ভিতরে ঢুকতে রাজি নয়।

ব্যাগটা পিঠে ঝুলিয়ে নিয়েছে দুইজন, জুতোর ফিতা ভালো করে বেঁধেছে। বুবুন তার চশমাটা সুতো দিয়ে পিছনে বেঁধে নিয়েছে, খুলে গেলেও যেন পড়ে না যায়। বুবুনের শার্টটা হালকা রঙের ছিল, অন্ধকারে যেন দেখা না যায় সেজন্যে গাব্বু নীল রঙের শার্টের সাথে বদলে নিয়েছে। সবকিছু ঠিক আছে কি না দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করে নিয়ে বুবুন বলল, “আমরা গেলাম তা হলে।”

পিয়াল বলল, “যা। কোনো চিন্তা করিস না। আমরা আছি বাইরে।”

গাব্বু বলল, “বিপদ দেখলেই আমরা বাসায় খবর দেব।”

বুবুন আর সুমি দেয়াল টপকানোর জন্যে ভালো একটা জায়গা খুঁজে নিয়ে দাঁড়াল। অন্ধকারে ভালো করে কিছু দেখা যায় না তা-ই সুমির মুখের দিকে তাকাতে পারছিল না, বুবুন যদিও জানে এখন নিশ্চয়ই তার মুখটাও পাথরের মতো শক্ত। দেয়ালে ইটের ফাঁকে পা দেওয়ার আগে মনে-মনে বলল, “খোদা, তুমি আমাদের রক্ষা করো।”

১১. অ্যাডভেঞ্চার

প্রথমে বুবুন এবং তার কয়েক সেকেন্ড পরে সুমি ভিতরে লাফিয়ে পড়ল। দুজনেই খানিকক্ষণ গুটিসুটি মেরে বসে থেকে যখন নিশ্চিত হল কেউ তাদের দেখতে পায়নি তখন তারা গুঁড়ি মেরে ভিতরে বাসাটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

বাসাটার কাছাকাছি গিয়ে তারা দেয়ালে কান লাগিয়ে ভিতরের কথাবার্তা শুনতে চেষ্টা করল, যদি কোনোভাবে আব্বার গলার আওয়াজ শুনতে পারে তা হলে সাথে সাথে ট্রান্সমিটারের সুইচটা অন করে দিয়ে ঠিক যেভাবে গোপনে এসে ঢুকেছে সেভাবে গোপনে বের হয়ে যাবে।

বুবুন ফিসফিস করে বলল, “সুমি!”

“কী হল?”

“দুজন এক জায়গায় থাক ঠিক না। হঠাৎ করে যদি ধরা পড়ে যাই তা হলে দু’জনেই একসাথে ধরা পড়ে যাব।”

“ঠিকই বলেছিস।”

“তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি পুরো বাসাটা একবার চক্কর দিয়ে আসি।”

“ঠিক আছে।”

বুবুন পুরো বাসাটা একবার চক্কর দিয়ে এল, জানালার নিচে দাঁড়িয়ে ভিতরের কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করল, ফাঁকফোকর দিয়ে সাবধানে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হল না। আগের জায়গায় ফিরে এসে দেখল সুমি সেখানে নেই, বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে বুবুনের। ধরা পড়ে গেল নাকি? তা হলে অবিশ্যি হৈচৈ দৌড়াদৌড়ি হত, কিন্তু সেরকম কিছুই তো শোনেনি। নিশ্চয়ই কোথাও গিয়েছে, এক্ষুনি ফিরে আসবে।

সত্যি সত্যি কিছুক্ষণের মাঝে সুমি ফিরে এল, কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “ভিতরে ঢোকার একটা উপায় পেয়েছি।”

“ভিতরে ঢোকার?”

“হ্যাঁ।”

“কীভাবে ঢুকবে?”

“বৃষ্টির পানির যে পাইপ রয়েছে সেটা বেয়ে ছাদে যাব, তারপর ছাদ থেকে ভিতরের বারান্দায়।”

বুবুনের পেটের ভিতরে কেমন জানি পাক খেয়ে ওঠে। ঢোক গিলে বলল, “কোনো বিপদ হবে না তো?”

“হলে হবে। আয়, আর দেরি করিস না।”

কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল প্রথমে সুমি এবং তার পিছুপিছু বুবুন পানির পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে যাচ্ছে। এধরনের একটি কাজ যে বুবুন করতে পারবে তার বিশ্বাস ছিল না, কিন্তু সুমি দেখে তার নিজের উপর খানিকটা বিশ্বাস ফিরে আসে। পাইপটা শক্ত করে ধরে রেখে নিচের দিকে না তাকিয়ে হাঁচড়-পাঁচড় করে দুজন উপরে উঠে এল। ছাদে পানির একটা ট্যাংক রয়েছে, দুজনে সেটার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাসার ভিতরে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করল। আবছা অন্ধকার, ভিতরে নির্জন সুমসাম, কোনো মানুষ আছে বলেই মনে হল না। দুই পাশে দুটি ঘরে আলো জ্বলছে, সেখানে হয়তো কেউ থাকতে পারে। সুমি ফিসফিস করে বলল, “ছাদে থেকে ভালো করে নিচে তাকিয়ে দেখ।”

“কী দেখব?”

“কিছু দেখা যায় কি না। কতজন মানুষ আছে কী সমাচার।”

দুজনে ছাদ থেকে নিচে উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। বাসাটা কত বড়, কয়টা রুম, কোথায় বারান্দা, কোথায় লুকানোর জায়গা আছে, কোথায় আলো, কোথায় অন্ধকার, হঠাৎ করে কেউ তাড়া করলে কোনদিকে পালিয়ে যাবে এই ধরনের ব্যাপারগুলো ছাদে বসেই আন্দাজ করার চেষ্টা করে। যখন বাসাটা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা হল তখন সুমি বলল, “চল, নিচে যাই।”

“কীভাবে যাবে?”

“কার্নিস ধরে ঝুলে নিচে রেলিঙের উপর নেমে পড়ব।”

“যদি পড়ে যাই?”

“পড়ব কেন! যদি ভয় পাস তা হলে উপর থেকে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিই, সেই দড়ি বেয়ে নেমে যাব।”

“সেইটাই ভালো, তা হলে আবার দরকার পড়লে দড়ি বেয়ে উঠে যাব।”

দুজনে মিলে লম্বা খানিকটা দড়ি নিয়ে ছাদে পানির ট্যাংকের পাইপের সাথে বেঁধে নিচে ঝুলিয়ে দিল। দুই প্রস্থ দড়ির মাঝে মাঝে গিঁট বেঁধে দেওয়া আছে, তার মাঝে পা দিয়ে বুবুন আর সুমি বেশ সহজেই নিচে নেমে এল। বারান্দা দিয়ে হেঁটে দুজন বাসার এক অন্ধকার কোণায় লুকিয়ে পড়ল। বুবুনের বুক ধ্বক ধ্বক করে শব্দ করছে, সে ফিসফিস করে বলল, “এখন আব্বাকে খুঁজে বের করতে হবে।”

“হ্যাঁ।”

“দুজনই একসাথে যাওয়ার দরকার নেই। তুমি এখানে পাহারা দাও, আমি যাই।”

“ঠিক আছে। চাচাকে কীভাবে খুঁজে বের করবি?”

“আব্বা যদি থাকেন তা হলে নিশ্চয়ই কোনো ঘরে দরজা বন্ধ করে না হয় তালা মেরে রেখেছে।”

“তাই যেসব ঘর বাইরে থেকে বন্ধ থাকবে না হয় তালা মারা থাকবে সেখানে টোকা দিয়ে জিজ্ঞেস করব কেউ আছে কি না।”

“ঠিক আছে। খুব সাবধান কিন্তু!”

“আমার ব্যাগটা রেখে গেলাম। এর মাঝে সব দরকারি জিনিসপত্র।”

“ঠিক আছে।”

বুবুন একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে অন্ধকার কোণা থেকে খুব সাবধানে বের হল। পা টিপে টিপে নিঃশব্দে সে হাঁটতে থাকে। কোনো ঘর বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো থাকলে সে আস্তে আস্তে দরজায় টোকা দিয়ে চাপা গলায় আব্বাকে ডেকে দেখল। দরজা খোলা থাকলে বাইরে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল ভিতরে কারও নড়াচড়ার বা নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ শোনা যায় কি না। কোনো ঘরে তালা দেওয়া থাকলে সাবধানে দরজা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল। বাসার একেবারে শেষ মাথায় একটা ঘরে বাতি জ্বলছে, ঘরের দরজায় তালা লাগানো, বুবুন দরজা ফাঁক করে উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করতেই ভিতর থেকে আব্বার গলার আওয়াজ শুনতে পেল, “কে?”

বুবুন উত্তেজনায় প্রায় চিৎকার করে উঠছিল, অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে দরজায় মুখ লাগিয়ে চাপা গলায় বলল, “আব্বা আমি বুবুন।”

আব্বা ভিতর থেকে বললেন, “বুবুন, তুই এসেছিস? দরজাটা খোল, বাইরে থেকে কেন জানি বন্ধ করে রেখেছে।”

বুবুন আবার দরজায় মুখ লাগিয়ে চাপা গলায় বলল, “আব্বা, তুমি কোনো কথা বলো না, শুনতে পেলে বিপদ হয়ে যাবে।”

“ঠিক আছে বলব না।” আব্বা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, “তোর কোনো বিপদ হয়নি তো?”

“না আব্বা হয়নি।” উত্তেজনায় বুবুনের সবকিছু গোলমাল হয়ে যেতে থাকে। শব্দ শুনে যদি কেউ চলে আসে? কিন্তু অন্যকিছু করার আগে তাকে তার ট্রান্সমিটারটা অন করতে হবে। সবচেয়ে প্রথমে গাঙ্কু আর পিয়ালকে খবর পাঠাতে হবে যে আব্বা এখানে আছে। তারপর শুধু অপেক্ষা করা।

বুবুন পকেট থেকে ট্রান্সমিটারটা বের করে সুইচটা অন করতে যাচ্ছিল হঠাৎ তার ঘাড়ের মাঝে বাঘের মতো থাবা দিয়ে কে যেন জাপটে পড়ল, হুংকার দিয়ে বলল, “তুই কে? ভিতরে কীভাবে ঢুকেছিস?”

বুবুন ভয়ানক চমকে উঠল, মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে রোমশ ভুরু কুচকুচে কালো দাড়ি আর লালচোখের একজন মানুষ। বুবুনের হাত থেকে ট্রান্সমিটারটা ছিনিয়ে নিয়ে চিৎকার করে বলল, “এটা কী?”

বুবুন কোনো কথা না বলে প্রাণপণে চেষ্টা করল মানুষটার হাত থেকে ট্রান্সমিটারটা নিয়ে নিতে কিন্তু পারল না। মানুষটা বুবুনের চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে বলল, “তুই ভিতরে ঢুকেছিস কেমন করে?”

বুবুন কোনো কথা বলল না, যদি কোনোভাবে সুইচটা শুধু অন করে দিতে পারত তা হলেই গাব্বু আর পিয়ালের খবর চলে যেত। কিন্তু সেটা করতে পারল না। দুঃখে হতাশায় তার মরে যেতে ইচ্ছে করছিল, মানুষটা হয়তো তাকে সত্যি সত্যি মেরেই ফেলবে–বুবুন আর কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছিল না। রোমশ ভুরু আর কুচকুচে কালো দাড়ির মানুষটা বুবুনের হাত ধরে কীভাবে জানি মোচড় দিতেই সেটা বাঁকা হয়ে পিছনের দিকে চলে গেল প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল বুবুন। আব্বা দরজা ধাক্কা দিয়ে বললেন, “কী হয়েছে বুবুন?”

বুবুন কোনো কথা বলতে পারল না, মানুষটা দাঁতে দাঁত ঘষে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “বল, ভিতরে ঢুকেছিস কেমন করে?”

কিছু-একটা বলতে হবে এখন, সত্যি কথা বললে সুমিও ধরা পড়ে যাবে, সত্যি কথা বলা যাবে না কিছুতেই। বুবুন কোনোমতে বলল, “একটা জানালা খোলা ছিল।”

“কোন জানালা?”

বুবুন অনিশ্চিতের মতো বলল, “ঐ তো ঐদিকে।”

মানুষটা কী যেন ভাবল এক সেকেন্ড তারপর পকেট থেকে চাবির গোছা বের করে তালা খুলে বুবুনকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। বুবুন তাল হারিয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিল, কোনোমতে উঠে বসে আব্বাকে দেখতে পেল। আব্বা খুব অবাক হয়ে বুবুনের দিকে তাকিয়ে আছেন, কাছে এসে তাকে ধরে তুলে তার শরীরের ধুলো ঝাড়তে লাগলেন, আব্বাকে দেখে মনে হতে লাগল এখন শরীর থেকে ধুলো ঝাড়াই সবচেয়ে জরুরি ব্যাপার। আব্বা ধুলো ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথা পেয়েছিস বুবুন?”

বুবুন হাতে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে, এখনও কাঁধে এবং কনুইয়ে টনটন করছে। কিন্তু আব্বাকে সেটা বলে কী লাভ? মাথা নেড়ে বলল, “না আব্বা।”

আব্বা খুব চিন্তিত মুখে বললেন, “এরা কারা বুবুন? আমাকে বলল তোর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। আমাকে তাই নিতে এসেছে। আমি তাদের সাথে গেলাম আর তখন এই ঘরে এনে আটকে ফেলেছে। কিছু খেতেও দিচ্ছে না।”

বুবুন কিছু বলল না, আব্বা আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোর কি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল?”

“না আব্বা। তোমাকে ধরার জন্য মিথ্যা কথা বলেছে।”

আব্বা মাথা নেড়ে বললেন, “এরা মনে হয় খুব খারাপ মানুষ।”

এত দুঃখেও বুবুনের হাসি পেয়ে গেল, আব্বা এতক্ষণে বুঝতে পেরেছেন যে এরা খুব খারাপ মানুষ! এরা সেই মানুষ যারা একাত্তর সালে রাজাকার আলবদর হয়ে পাকিস্তানিদের সাথে মানুষ খুন করেছে, যখন বুঝতে পেরেছে দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে তখন দেশের সব ভালো ভালো প্রফেসর, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তারকে খুন করেছে। এতদিন পরে আবার সেই একই জিনিস করতে চাইছে?

আব্বা ঘরের মাঝে খানিকক্ষণ পায়চারি করে ঘরের এক কোণায় চেয়ারে চুপ করে বসে রইলেন, তাকে কেমন জানি দুঃখী দেখাতে লাগল, মনে হতে লাগল কিছু-একটা বুঝতে পারছেন না।

বুবুন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনার চেষ্টা করল বাইরে কী হচ্ছে। সুমি এখনও বাইরে আছে সেটাই একমাত্র ভরসা। রোমশ ভুরুর মানুষটা দূরে কোথাও গিয়ে চিৎকার করে কারও সাথে কথা বলছে, মনে হয় টেলিফোনে কাউকে বুবুনের খবর দিচ্ছে। আরও কিছু মানুষ বাইরে হাঁটাহাঁটি করছে বলে মনে হল। বুবুন খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভিতরের দিকে হেঁটে আসছিল হঠাৎ সুমির চাপা গলায় ডাক শুনতে পারল, “বুবুন! শুনে যা!”

বুবুন ছুটে গেল, “সুমি! এখানে এসেছিস তুই–ধরা পড়ে যাবি তো!”

সুমি কোনো কথা না বলে দ্রুত তার ব্যাগের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে হ্যাঁকস’টা বের করে বুবুনের হাতে দিল। ফিসফিস করে বলল, “নে, এইটা রাখ।”

“কী করব?”

“জানালার শিক নাহয় দরজার কড়া কিছু-একটা কেটে ফেল বের হওয়ার জন্যে।” সুমি হঠাৎ দূরে কোথাও তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কেউ আসছে, আমি গেলাম।”

সুমি গুঁড়ি মেরে সরে গেল, বুবুন হাতের হ্যাঁকস’টা ঘরের কোণায় একটা টেবিলের নিচে লুকিয়ে ফেলল। একটা মানুষ হেঁটে হেঁটে ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দিল। বুবুন মানুষটাকে চিনতে পারল, ইঁদুরের মতো দেখতে সেই মানুষটা। দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে মানুষটা তার ময়লা হলুদ দাঁত বের করে হেসে বলল, “পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে। ভেবেছিলাম খালি বড়টারে ধরব এখন দেখি ছোটটাও চলে এসেছে।”

বুবুন বিষদৃষ্টিতে মানুষটার দিতে তাকাল, কিছু বলল না। ইঁদুরের মতো মানুষটা আরও কিছুক্ষণ দরজার ফাঁক দিয়ে তাদের লক্ষ্য করে চলে গেল। মানুষটা সরে যেতেই বুবুন দরজার কাছে এসে কড়া দুটি লক্ষ করল। দুটি কড়া একত্র করে বাইরে বড় একটা তালা ঝুলছে। হ্যাঁকস দিয়ে বাইরের সেই তারটি কাটা খুব সহজ হবে না। কিন্তু কড়ার যে-অংশটা দরজা দিয়ে ভিতরে এসে একটা বল্টু দিয়ে দিয়ে লাগানো রয়েছে সেটা মনে হয় খুব সহজেই কেটে ফেলা যাবে। তখন কড়াটা ঠেলে বের করলেই ঘর থেকে বের হয়ে আসা যাবে। যদি আশেপাশে কেউ না থাকে তা হলে দরজা খুলে বের হয়ে যাওয়াও কোনো কঠিন ব্যাপার নয়।

বুবুন কাজে লেগে গেল, হ্যাঁক’সটা দিয়ে কাটতে একধরনের শব্দ হয়। শব্দটা ঝিঁঝিপোকার কর্কশ ডাকের মতে, বাইরের ঝিঁঝিপোকার শব্দের সাথে সেটা বেশ মিলে গিয়েছে। বুবুন কী করছে আব্বা তীক্ষ্ণচোখে সেটা দেখতে লাগলেন কিন্তু সেটা নিয়ে ভালোমন্দ কিছুই বললেন না।

পাঁচ মিনিটের মাঝেই কড়াটার একটা অংশ খুলে এল, ইচ্ছে করলেই এখন বুবুন তার আব্বাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসতে পারে কিন্তু সে বের হল না। বুবুন কড়াটা ঠিক জায়গায় লাগিয়ে রাখল, বাইরে থেকে কেউ যেন বুঝতে না পারে যে এটা আসলে খুলে নেওয়া হয়েছে।

কিছুক্ষণের মাঝেই সুমিকে আবার দেখা গেল। সে গুঁড়ি মেরে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। বুবুন সাথে সাথে কড়াটা ঠেলে বের করে দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলল। সুমি চারিদিকে তীক্ষ্ণচোখে তাকাতে তাকাতে ফিসফিস করে বলল, “দরজা খুলে ফেলেছিস?”

“হ্যাঁ।”

“চল বের হয়ে আয় এখন। চাচাকে নিয়ে আয়।”

আব্বা কেমন জানি বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছেন। কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছেন না। বুবুন ফিসফিস করে বলল, “আব্বা, কোনো শব্দ করো না। আস্তে আস্তে বের হয়ে আসো।

আব্বা বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়লেন। সুমি তার ব্যাগ থেকে একটা বোতল বের করে ভিতর থেকে কী যেন মেঝেতে ঢেলে দিল। বুবুন জিজ্ঞেস করল, “এটা কী?”

“সাবান পানি। পিছলে করার জন্যে।”

“পিছলে করে কী লাভ?”

“দেখবি একটু পরেই।”

সুমি দরজাটা বন্ধ করে আবার কাটা কড়াটা ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে দিল, বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে দরজায় তালা লাগানো রয়েছে।

কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি তারা বাসার কোণায় সেই অন্ধকার অংশে গিয়ে লুকিয়ে গেল। আব্বা কেমন যেন শান্ত হয়ে গেছেন, মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। দুজনে মিলে প্রায় হাত ধরে টেনে তাঁকে সরিয়ে নিতে হল। অন্ধকারে লুকিয়ে গিয়ে বুবুন ফিসফিস করে বলল, “এখন কী করবে?”

“মানুষগুলিকে এই ঘরে আটকে ফেলতে হবে। তারপর পালাব।”

“কেমন করে আটকাবে?”

“যখন এই ঘরে ঢুকবে তখন বাইরে থেকে ছিটকানি লাগিয়ে দেব।”যদি না ঢোকে?”

“একশোবার ঢুকবে। এই দ্যাখ!” সুমি তার ব্যাগ থেকে একটা বড় ঢেলা বের করে হঠাৎ একটা জানালার দিকে ছুঁড়ে দিল, ঝনঝন করে কাঁচ ভেঙে পড়ল প্রচণ্ড শব্দে সাথে সাথে ঘর থেকে কয়েকজন মানুষ বের হয়ে এল। রোমশ ভুরুর মানুষটি, অন্যটি ইঁদুরের মতো চেহারার মানুষ, বাকি দুজনকে তারা আগে দেখেনি।

ইঁদুরের মতো দেখতে মানুষটি বলল, “কে? কে কাঁচ ভেঙেছে?”

“বেকুব ছেলেটা হবে নিশ্চয়ই।”

“দেখে আয় তো!”

“যাই।” বলে একজন মানুষ তাদেরকে যে-ঘরে আটকে রেখেছিল সেদিকে এগিয়ে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়েই সে চেঁচিয়ে উঠে বলল, “ঘরে কেউ নেই।”

ইঁদুরের মতো মানুষটা খেঁকিয়ে উঠে বলল, “কেউ নেই মানে? দরজায় তালা মারা আছে না?”

মানুষটা দরজার দিকে ভালো করে তাকাল, তালাটা ধরে একটা ঝাঁকুনি দিল, বুবুন আর সুমি ভয় পাচ্ছিল যে দরজার কড়াটা বুঝি খুলে আসবে, কিন্তু কপাল ভাল, সেটা খুলল না। মানুষটা এবারে হতভম্বের মতো বলল, “দরজায় তালা মারা আছে, কিন্তু ভিতরে মানুষ নাই।”

“কী বলছিস ছাগলের মতো?” এবারে অন্য তিনজনও দরজার সামনে দাঁড়াল, ভিতরে উঁকি দিল এবং কাউকে না দেখে খুব অবাক হয়ে গেল।

ইঁদুরের মতো মানুষটা বলল, “তালাটা খুল দেখি!”

রোমশ ভুরুর মানুষটা পকেট থেকে চাবি বের করে তালাটা খুলে ভিতরে ঢুকল, তার পিছনে অন্যরাও।

সুমি বুবুনকে খোঁচা দিয়ে বলল, “এখন চল। তুই দরজাটা চেপে রাখবি আর আমি ছিটকানি লাগাব।”

বুবুন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, “ঠিক আছে।” যদি ওরা ঠিকমতো ছিটকানি লাগাতে না পারে তা হলে কী হবে বুবুন এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে আর ভাবতে চায় না।

বুবুন আর সুমি শুনতে পেল ঘরের ভিতর থেকে একজন বলছে, “এখানে পানি ফেলেছে কে?”

“জানি না। কিন্তু বের হল কোনদিক দিয়ে?”

“তাজ্জবের ব্যাপার! কুফুরী কালাম জানে নাকি?”

মানুষগুলো হেঁটে জানালার কাছে গিয়েছে, এই ফাঁকে বুবুন আর সুমি পা টিপে টিপে দরজা দড়াম করে বন্ধ করে দিল, বন্ধ করার আগের মুহূর্তে ইঁদুরের মতো চেহারার মানুষটা বুবুনকে দেখে ফেলে ছুটে আসতে গিয়ে মেঝেতে ঢেলে রাখা-সাবান পানিতে ভয়ংকর শব্দ করে পিছলে পড়ে। বুবুন প্রাণপণে দরজা চেপে রাখল এবং সুমি দ্রুত ছিটকানিটা তুলে দিল। ভিতরে আবার প্রচণ্ড একটা শব্দ হল, আরও কেউ নিশ্চয়ই আছাড় খেয়ে পড়েছে। সুমি আর বুবুন হাত তুলে একজন আরেকজনকে থাবা দিয়ে আনন্দে চিৎকার করে উঠল। বুবুন বলল, “দেরি করে কাজ নেই, পালাও।”

“হ্যাঁ চল।”

আব্বাকে নিয়ে তারা যখন বারান্দা ধরে ছুটতে শুরু করেছে তখন শুনল দরজার দমাদম লাথি পড়ছে। শক্ত দরজায় শক্ত ছিটকানি কিন্তু চারজন মানুষের লাথি কতক্ষণ আটকাতে পারবে কে জানে!”

বাসার বাইরে বের হয়ে সুমি তার ব্যাগ থেকে তালা বের করে দরজায় তালা লাগিয়ে দেয়। এখন দরজা ভেঙে বের হয়ে এলেও ক্ষতি নেই। এখান থেকে বের হবার জন্যে এবারে বাকি রয়েছে গেট। সাথে যদি আব্বা না থাকতেন তা হলে বুবুন আর সুমি দেয়াল টপকে পার হয়ে যেত, কিন্তু আব্বাকে নিয়ে তো আর সেটা করা যাবে না, গেট দিয়েই বের হতে হবে। গেটে যে-মানুষটা রয়েছে সে বাসার ভিতরে কী হয়েছে না হচ্ছে সেসব কিছু জানে বলে মনে হয় না।

সুমি আব্বাকে বলল, “চাচা, আপনি গেটের দিকে যান। গেট খোলা না থাকলে দারোয়ানকে বলবেন গেট খুলে দিতে।”

আব্বা কথাটা শুনলেন কি না কিংবা শুনলেও ঠিক বুঝতে পেরেছেন কি না বোঝা গেল না, কিন্তু মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেলেন। সুমি বুবুনকে নিয়ে অন্ধকারে লুকিয়ে গেল। বুবুন জিজ্ঞেন করল, “কী করবি এখন?”

সুমি ব্যাগ খুলে একটা চাকু বের করে বলল, “দারোয়ান যখন চাচার সাথে কথা বলবে তখন পিছন থেকে দারোয়ানের উপর লাফিয়ে পড়তে হবে, ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে গলায় চাকুটা ধরতে হবে। হিন্দি সিনেমাতে যেরকম করে”

“যদি ফেলতে না পারি?”

“ফেলতে হবে। আমরা পিছনে থাকব, দারোয়ান বুঝতেও পারবে না আমরা ছোট না বড়, ভয় পেয়ে শুয়ে থাকবে।”

বুবুন ঢোক গিলে বলল, “ঠিক আছে।”

“এত ভয় পাওয়ার কী আছে? গাব্বু আর পিয়াল গেটের ওইপাশে আছে না? ডাক দিলেই গেট টপকে চলে আসবে।

“তা ঠিক।”

আব্বা ততক্ষণে গেটের পাশে চলে এসেছেন। আব্বাকে দেখে শুকনোমতন একজন লোক বের হয়ে এল, সে বেশ অবাক হয়ে আব্বাকে দেখছে ঠিক তখন বুবুন আর সুমি পিছন থেকে মানুষটার উপরে লাফিয়ে পড়ল। এ-ধরনের একটা ব্যাপারের জন্যে মানুষটা একটুও প্রস্তুত ছিল না, ভয় পেয়ে ডাক ছেড়ে একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল। বুবুন চাকুটা গলার কাছে ধরে রেখে গলার স্বর যথা সম্ভব মোটা করে বলল, “খবরদার, নড়াচাড়া করলে কিন্তু জবাই করে ফেলব।”

সুমি হুংকার দিয়ে বলল, “গেটের চাবি কই?” মানুষটা চিচি করে বলল, “গেটে তালা দেওয়া নাই।”

বুবুন ব্যাগ থেকে দড়ি বের করে মানুষটার হাত বাঁধতে বাঁধতে বলল, “আব্বা গেট খুলে বাইরে চলে যাও।”

“বাইরে?”

“হ্যাঁ। দেখো সেখানে গাব্বু আর পিয়াল আছে।”

“ও।” আব্বা বেশ কষ্ট করে গেট খুললেন। দারোয়ানকে ততক্ষণে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সুমি বুবুনের দিকে দাঁত বের করে হেসে বলল, “অপারেশান সাকসেসফুল।”

“চলো পালাই।”

আব্বা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গেটের কাছে গাব্বু আর পিয়ালের দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল, তাদেরকে দেখা গেল না। বুবুন আব্বার হাত ধরে বলল, “আব্বা চলো যাই।”

আব্বা আস্তে আস্তে বললেন, “একটা গাড়ি আসছে।”

বুবুন চমকে উঠে সামনে তাকাল, সত্যি সত্যি একটা গাড়ি ছুটে আসছে এদিকে। সুমি আর বুবুন কী করবে বুঝতে পারছিল না, আব্বাকে নিয়ে লুকিয়ে পড়ার আগেই এদিকে তীব্র হেডলাইট পড়ল তাদের উপর। গাড়ি প্রচণ্ড বেগে কাছে ছুটে এসে হঠাৎ টায়ার পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে ব্রেক করল। কিছু বোঝার আগেই গাড়ির চারটা দরজা খুলে চারজন মানুষ লাফিয়ে নামল। হেডলাইটের তীব্র আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে আছে বলে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু মানুষগুলোর হাতে বন্দুক। মানুষগুলো বন্দুক তাক করে আছে তাদের দিকে। গাড়ির পিছনের সিট থেকে আরও একজন মানুষ নামছে, ভালো করে দেখা যাচ্ছে না মানুষটাকে।

হেঁটে হেঁটে কাছে এল মানুষটা। মুখে দাড়ি মাথায় টুপি। গায়ে লম্বা আচকান, হাতে একটা লাঠি। লাঠিতে ভর দিয়ে মানুষটা কাছে এসে দাঁড়াল। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু বুবুন জানে এই মানুষটা খবিরউদ্দিন। মানুষটা খসখসে গলায় বলল, “ধর এইগুলোরে। ভিতরে নে।”

দুজন মানুষ এসে খপ করে বুবুন আর সুমিকে ধরল, সুমি এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করতেই তার মাথায় টুপি খুলে লম্বা চুল বের হয়ে আসে।

সুমিকে ধরে-রাখা মানুষটা চোখ বড় বড় করে বলল, “নাউজুবিল্লাহ্! এইটা দেখি মাইয়া!”

খবিরউদ্দিন দাঁতে দাঁত ঘঁষে বলল, “মাইয়া আর পোলা আমি বুঝি না, ভিতরে নে আগে।”

প্রথমে আব্বা তার পিছনে সুমি এবং সবার পিছনে বুবুনকে ধরে লোকগুলো ভিতরে রওনা দেয়।

বুবুন মাথা ঘুরিয়ে লোকগুলোকে দেখল। এটা কি সত্যিই ঘটছে নাকি এটা একটা দুঃস্বপ্ন?

১২. পথ-কুক্কুর

আব্বা একটা চেয়ারে সোজা হয়ে বসে আছেন। বুবুন আর সুমি আব্বার পিছনে ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। খবির উদ্দিনের জন্য একটা গদিওয়ালা চেয়ার আনা হয়েছে, সেখানে সে দুই পা ছড়িয়ে কুৎসিত ভঙ্গিতে বসে আছে। তাকে ঘিরে আটজন মানুষ। মানুষগুলোর একেকজনের চেহারা একেক রকম কিন্তু তবু কোথায় জানি একটা মিল রয়েছে। নিষ্ঠুরতার মনে হয় নিজস্ব একটা রূপ আছে।

ইঁদুরের মতো চেহারার মানুষটা এইমাত্র ঠিক কী ঘটেছে তার একটা বর্ণনা দিল, তাদেরকে যে কীভাবে বোকা বানানো হয়েছে সেটা গোপন রাখার চেষ্টা করে লাভ হল না, তার গল্প থেকেই সেটা প্রকাশ হয়ে গেল। সবকিছু শুনে খবিরউদ্দিন মুখ শক্ত করে বলল, “কিন্তু এই পোলা আর মাইয়া এইখানে আসল কেমন করে?”

মানুষটা মাথা চুলকে বলল, “তা তো জানি না!”

খবিরউদ্দিন খেঁকিয়ে উঠে বলল, “সেটা না জানলে চলবে কেমন করে? সাথে যদি আরও কিছু পোলা-মাইয়া এসে থাকে? তারা যদি এখন পুলিশকে খবর দেয়?”

ইঁদুরের মতো মানুষটা হলুদ দাঁত বের করে হিহি করে হেসে ফেলল, “হুজুর যে কী বলেন! পুলিশকে বললেই কি আসবে? আমরা তা হলে মাসে মাসে তাদেরকে এত টাকা দেই কেন?”

“খামোশ!” খবিরউদ্দিন বিকট ধমক দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলবি না।”

রোমশ ভুরুর মানুষটা বলল, “হুজুর যদি অনুমতি দেন তা হলে এদের পেটের মাঝে থেকে কথা বের করে ফেলি।”

খুব মজার একটা রসিকতা শুনেছে এরকম ভান করে খবিরউদ্দিন হা হা করে হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে বলল, “সেটা খারাপ হয় না! নে, বার কর। রক্ত ফক্ত দেখতে হবে না তো?”

“জে না। শাহবাজ আলির ছুরি চাকু লাগে না।”

ইঁদুরের মতো মানুষটা চোখ ছোট ছোট করে বলল, “শাহবাজ আলির কাজ এক নম্বর। মনে নাই নির্মূল কমিটির ছেলেটার হাত কবজির কাছে কীরকম আলগা করে ফেলল?”

শাহবাজ আলি নামের মানুষটা দাড়ির মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে কাটতে কাটতে এগিয়ে এল। লাল চোখ একবার বুবুনের দিকে তাকাল, তারপর সুমির দিকে তাকিয়ে ভারী গলায় বলল, “এই শুওরের বাচ্চা হারামখোরেরা। তোরা নিজের থেকে বলবি নাকি এক চড় মেরে চোয়াল ভেঙে সব কয়টা দাঁত আলগা বরে ফেলব?”

বুবুনের মাথায় হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। সে তীব্র দৃষ্টিতে মানুষটার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের সাথে কথা বলতে চাইলে ভদ্রভাবে কথা বলবেন।”

ঘরের মাঝে হঠাৎ একটা আশ্চর্য ধরনের শীতলতা নেমে আসে। শাহবাজ আলির মুখটা ভয়ংকর হয়ে উঠল, সে হিস হিস করে বলল, “যদি না বলি তা হলে কী করবি শুওরের বাচ্চারা?”

বুবুন কী-একটা বলতে যাচ্ছিল তার আগেই সুমি বলল, “লাথি মেরে দাঁত ভেঙে দেব। কাছে আসো, তোমার দাড়ি যদি আমি টেনে না ছিঁড়ি–”

শাহবাজ আলি মনে হয় নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, যে এরকম অবস্থায় একটা বাচ্চা তাকে এরকম কথা বলতে পারে! প্রচণ্ড রাগে কী করবে বুঝতে পারছিল না, মনে হল লাফিয়ে পড়ে তাদের টুটি চেপে ধরবে, ঠিক তখন খবিরউদ্দিন হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল। তারপর মাথা ঘুরিয়ে বুবুন আর সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, “এই পোলা আর মাইয়া, তোদের বাপ-মা আদব লেহাজ শেখায় নাই তোদের? মুরুব্বির সাথে কথা বলতে জানিস না?”

বুবুন আর সুমি কোনো কথা বলল না। খবিরউদ্দিন আবার বলল, “এত তেজ কোথা থেকে আসছে? বেশি তেজ যে স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো না সেটা জানিস না?”

আব্বা হঠাৎ কী-একটা বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর মুখ দেখে মনে হল কিছু-একটা নিয়ে খুব কষ্ট হচ্ছে। খবিরউদ্দিন হঠাৎ কেমন যে, ভয় পেয়ে গেল, বলল, এই লোকটারে বেঁধে রাখিস নাই কেন?”

ইঁদুরের মতো দেখতে মানুষটা বলল, “হুজুর, এই মানুষটার বুদ্ধিশুদ্ধি কুত্তা বিলাইয়ের সমান। এরে বেঁধে রাখার কোনো দরকার নাই। এই দেখেন হুজুর—” মানুষটা এগিয়ে এসে আব্বাকে ধমক দিয়ে বলল, “তুমি দাঁড়িয়ে কেন? বসো।”

আব্বা সাথে সাথে বসে গেলেন। ইঁদুরের মতো মানুষটা বলল, “দেখলেন হুজুর? এই লোকের মেরুদণ্ড নাই। পাগল-ছাগল মানুষ।”

শাহবাজ আলি তার পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে এক পা এগিয়ে এসে খবিরউদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, “হুজুর যদি অনুমতি দেন।”

খবিরউদ্দিন হাত নেড়ে অনুমতি দেবার ভান করল। সাথে সাথে শাহবাজ আলি একটা মোষের মতো ছুটে এসে বুবুনের চুল ধরে নিজের কাছে টেনে আনে। তারপর বুবুনের ডান হাতটা ধরে সেটাকে পেঁচিয়ে ধরতেই তার সারা শরীর ঘুরে হাতটা পিছনে চলে এল, প্রচণ্ড যন্ত্রণায় বুবুন চিৎকার করে ওঠে, মনে হয় তার হাতটা বুঝি এক্ষুনি ভেঙে খুলে আসবে।

সুমি হঠাৎ চিতাবাঘের মতো মানুষটার উপরে লাফিয়ে পড়ল, মানুষটার হাঁটুতে সে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মারতেই, “মাগো” বলে মানুষটা বুবুনকে ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ে।

খবিরউদ্দিনকে ঘিরে থাকা অন্য মানুষগুলো শাহবাজ আলির কাছে ছুটে আসে, সে দুইজনের কাছে বন্দুক ছিল তারা বন্দুক দুটি বুবুন আর সুমির দিকে তাক করল, মুখ দেখে মনে হল বুঝি সত্যি সত্যি গুলি করে দেবে।

আব্বা হঠাৎ আবার উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে কিছু-একটা বলছেন, কী বলছেন ঠিক বোঝা গেল না। খবিরউদ্দিন আব্বার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বলল, “তুমি দাঁড়িয়েছ কেন? বসো।”

আব্বা বসলেন না, “দাঁড়িয়েই রইলেন। সবগুলো মানুষের দিকে একবার তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, “যখনি–”

“কী?” খবিরউদ্দিন ধমক দিয়ে বলল, “কী বলছ?”

“যখনি–”

“যখনি কী?”

“যখনি দাঁড়াবে তুমি–”

খবিরউদ্দিন চোখ বড় বড় করে আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল, বোঝার চেষ্টা করল আব্বা কী বলছেন। আব্বা আবার বললেন, কবিতা আবৃত্তির সুরে, তাঁর সুন্দর গলা সারা ঘরে হঠাৎ গম গম করে উঠল,

“যখনি দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার তখনি সে
পথ কুকুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবি মিশে।”

বুবুন চমকে উঠে আব্বার দিকে তাকাল, এ কোন আব্বা? ছেলেমানুষি ভঙ্গি জবুথবু হয়ে বসে থাকা, কিছুই তো নেই তার মাঝে! কী সুন্দর বুক উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছেন, চেহারায় কী আশ্চর্য পৌরুষ, চোখেমুখে কী ভয়ংকর আত্মবিশ্বাস। বুবুন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না।

খবিরউদ্দিন গদিওয়ালা চেয়ার থেকে ছটফট করে ওঠার চেষ্টা করতে করতে বলল, “কী? কী বলছ তুমি?”

“রবি ঠাকুরের কবিতা। একশো বছর আগে লিখে গিয়েছিলেন।” আব্বা হাত তুলে আঙুল দিয়ে তাদের দেখিয়ে বললেন, “তোমাদের কথা লিখেছেন। তোমরা হচ্ছ পথ-কুকুর! তোমাদের সামনে আমরা যখন দাঁড়াই তখন তোমরা সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে!”

বুবুন হতচকিত হয়ে তার আব্বার দিকে তাকিয়ে রইল। সুমি বুবুনের হাত ধরে বলল, “চাচা ভালো হয়ে গেছেন! কী দারুণ দেখছিস?”

খবিরউদ্দিন চিৎকার করে বলল, “ধর এই লোকটাকে। বেঁধে ফেল।”

আব্বার মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠল, খবিরউদ্দিন যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে এরকম ভঙ্গি করে বললেন, “আমাকে ধরবে? তোমরা?”

খবিরউদ্দিন আবার চিৎকার করে উঠল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন বেকুবের দল?”

বন্দুক-হাতের মানুষ দুইজন এবারে আব্বার দিকে বন্দুক তাক করল, একজন মোটা গলায় বলল, “খামোশ। গুলি করে দেব।”

আব্বা এবারে সত্যি সত্যি হেসে ফেললেন। তারপর চোখ মটকে বললেন, “গুলি করবে? তুমি? এই চামচিৎকার দল আমাকে গুলি করবে?”

মানুষগুলো হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, আব্বা বললেন, “তুমি জান আমি যখন মুক্তিযুদ্ধে গেছি আমার বয়স তখন মোলো।” আব্বা তাঁর হাত দুটি উপরে তুলে বললেন”এই হাতে আমি মেশিনগানে গুলি করেছি, পাকিস্তানিদের বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়েছি। শুধু তোমাদের মতো চামচিকা রাজাকাররা না, তোমাদের বাবা পাকিস্তানি মিলিটারিরাও আমাকে মারতে পারেনি। কেন পারেনি জান?”

মানুষগুলো জানতে চাইছে কি না বোঝা গেল না, আব্বা সেটা লক্ষ্যও করলেন না, বললেন, “পারেনি তার কারণ আল্লাহ্ আমার দিকে ছিলেন! আল্লাহ্ মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ছিলেন। আল্লাহ্ যদি তোমাদের দিকে থাকতেন তা হলে সেভেন্টিওয়ানে তোমরা জিততে। তোমরা জেতনি। তোমরা কোনোদিন জিতবে না–“

খবিরউদ্দিন দাঁড়িয়ে গেল, কাছে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে ধাক্কা দিয়ে বলল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন শুওরের বাচ্চা? থামা একে।”

বন্দুক-হাতের মানুষটা বন্দুক তুলে এবারে চিৎকার করে বলল, “চুপ কর গাদ্দার। গুলি করে দেব।”

আব্বার চোখ হঠাৎ ধ্বক করে জ্বলে উঠল। টান দিয়ে শার্টের বোতাম ছিঁড়ে আব্বা তার বুকটা বের করে ফেললেন, যে-মানুষটা বন্দুক ধরে রেখেছিল তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “করো গুলি।”

মানুষটা নিষ্ঠুর চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে ট্রিগারে হাত দিল। আব্বা আরও এক পা এগিয়ে গিয়ে বললেন, “দেখি তোমার কত বড় সাহস! করো দেখি গুলি!” আব্বা চিৎকার করে বললেন, “করো দেখি!”

বুবুন নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইল, মানুষটির নিষ্ঠুর মুখ বিচিত্র একধরনের জিঘাংসায়ে কুৎসিত হয়ে যাচ্ছে। আব্বার মুখে এতটুকু ভয় নেই। ভয়ংকর এক আত্মবিশ্বাস নিয়ে আব্বা আরও এক পা এগিয়ে গেলেন। বুবুন দেখতে পেল মানুষটা ট্রিগার টেনে ধরছে, সত্যিই কি গুলি করে দেবে মানুষটা? আতঙ্কে বুবুনের হৃৎস্পন্দন থেমে আসতে চায়। তাকিয়ে থাকতে পারে না সে, আর্তচিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। ঠিক তখন প্রচণ্ড একটা গুলির শব্দে সমস্ত ঘর কেঁপে উঠল। বুবুন দুই হাতে মুখ ঢেকে রক্ত-শীতল-করা স্বরে চিৎকার করে উঠল। মানুষটা কি মেরে ফেলেছে আব্বাকে? তার দুঃসাহসী আব্বাকে?”

হঠাৎ করে কে যেন তার কাঁধ স্পর্শ করল, বুবুন শুনল সুমি ডাকছে তাকে, “বুবুন, তাকিয়ে দ্যাখ।”

বুবুন ভয়ে ভয়ে তাকাল, দেখল তার আব্বা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। এক হাতে বন্দুক অন্য হাতে মানুষটার শার্টের কলার ধরে রেখেছেন। আব্বা তার কলার ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ময়লা আবর্জনার মতো ছুঁড়ে ফেললেন দূরে। আরো দুজন মানুষে নিয়ে সে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল। আব্বা তখন ঘুরে তাকালেন বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নম্বর মানুষটা দিকে। আব্বা আলগোছে বন্দুকটা ধরে রেখেছেন, কী সহজেই-না সেটা হাতবদল করলেন, কেউ বলে দেয়নি কিন্তু কার বুঝতে এতটুকু দেরি হল না দুই যুগ আগে যেভাবে তাঁর হাতে অস্ত্র গর্জন করেছিল দরকার হলে ঠিক সেভাবে আবার তাঁর হাতে বন্দুক গর্জন করে উঠবে।

আব্বা পাথরের মতো শক্ত মুখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বন্দুকটা দাও।”

মানুষটা এক মুহূর্তে দ্বিধা করে আব্বার হাতে বন্দুকটা তুলে দিল। আব্বা সেটা হাতে নিয়ে হঠাৎ বুবুন আর সুমির দিকে ছুঁড়ে দিলেন। তারা প্রস্তুত ছিল না, কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ে সেটা শূন্যে ধরে ফেলল। বুবুন আর সুমি কখনো বন্দুক ধরেনি, হাতে নিতেই তাদের বুকের মাঝে কেমন যেন করে ওঠে!

আব্বা আলগোছে বন্দুকটা ধরে রেখে বললেন, “সবাই লম্বা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়। সেভেন্টিওয়ানের রতনপুর ব্রিজে এক ডজন রাজাকার এইভাবে ধরেছিলাম আমরা। কেউ পালানোর চেষ্টা করো না! তোমরা জান আমার হাত থেকে কোনো রাজাকার কখনো পালাতে পারে নাই।”

মানুষগুলো ইতস্তত করে একজন একজন করে মেঝেতে শুয়ে পড়তে থাকে। খবিরউদ্দিন ফ্যাকাশে মুখে আব্বার দিকে তাকিয়েছিল, আব্বা বন্দুকের বাঁট দিয়ে তার মাথায় টোকা দিতেই সে ধড়মড় করে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল।

সুমি দাঁড়িয়ে বলল চাচা, “ওদেরকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলি?”

আব্বা হেসে ফেলে বললেন, “চাইলে বাঁধতে পার মা। কিন্তু ওরা পালাবে।”

“কেন পালাবে না চাচা?”

“কারণ ওদের পালানোর সাহস নেই। ওরা হচ্ছে পথ-কুকুর! পথ কুকুরের সামনে যখন কেউ সাহস করে দাঁড়ায় তখন ওদের সব সাহস উবে যায়।”

বুবুন বলল, “সুমি, বেঁধে ফ্যালো তবু। আমি বন্দুকটা ধরে রেখেছি, পালানোর চেষ্টা করলেই গুলি।”

আব্বা এসে বুবুনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “আজকের দিনের জন্যে ঠিক আছে কিন্তু বাবা আর কখানো যেন তোর বন্দুক ছুঁতে না হয়। কখানো যেন ছুঁতে না হয়। কখনো কখনো কখনো যেন ছুঁতে না হয়।”

বাইরে হঠাৎ কয়েকটা গাড়ির শব্দ শোনা গেল। আব্বা জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই, নিচু গলায় বললেন, “পুলিশ এসেছে বুবুন।”

“সত্যি? কেমন করে এল! আমরা তো ট্রান্সমিটারের সিগনাল দিতেই পারলাম না।”

‘ট্রান্সমিটার?”

“হ্যাঁ–” বুবুন ট্রান্সমিটারের গল্প শেষ করার আগে সিঁড়িতে ভারী বুটের শব্দ শোনা গেল, দড়াম করে দরজা খুলে হঠাৎ, সেখানে অসংখ্য পুলিশ।

পুলিশের ভিড় ঠেলে জাহিদ চাচা শঙ্কিত মুখে এগিয়ে এলেন, তার পিছনে পাংশু মুখে আম্মা। বুবুন আম্মার কাছে ছুটে যাচ্ছিল, সুমি খপ করে তার হাত ধরে ফেলল, “চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক গাধা! দেখি চাচা-চাচি কী করে!”

আম্মা প্রথমে বুবুনের দিকে তারপর আব্বার দিকে তাকালেন। আব্বার দিকে তাকিয়েই হঠাৎ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠলেন, বিস্ফারিত চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে থেকে ফিসফিস করে বললেন, “মাসুদ!”

আব্বা এক পা এগিয়ে এসে আম্মাকে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে বললেন, “রওশান! তুমি ভালো ছিলে রওশান?”

আম্মা হঠাৎ দুই হাতে মুখ ঢেকে ভেউভেউ করে কাঁদতে লাগলেন। আব্বার বোতাম-ঘেঁড়া শার্ট ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন, “এতদিন তুমি কোথায় ছিলে? কোথায় ছিলে আমাকে ছেড়ে?”

জাহিদ চাচা বুবুনের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বললেন, “ইয়ংম্যান! আমি বলেছি না তোমাকে, আমি সবসময় ভুল জায়গায় চলে যাই!”

বুবুন বলল, “চাচা, এইটা ভুল জায়গা না।”

জাহিদ চাচা বললেন, “ঠিক বলেছ! এটা ঠিক জায়গা, এটা ঠিক সময়। একেবারে হান্ড্রেট পার্সেন্ট ঠিক সময়।”

ঠিক এই সময় বুবুন আর সুমি দেখতে পেল, ভিড় ঠেলে গাব্বু আর পিয়াল আসছে। বুবুন আর সুমিকে দেখে তারা ছুটে এল। পিয়াল হেসে বলল, “পুলিশ নিয়ে এসেছি কি না?”

বুবুন অবাক হয়ে বলল, “তুই? তুই পুলিশ এনেছিস?”

“হ্যাঁ। আমি আর গাব্ব। যেই রেডিওতে শুনলাম কট কট–”

“রেডিওতে শুনলি?” বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেমন করে শুনলি আমি তো সিগনাল দিতেই পারলাম না। তার আগেই–”

সুমি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে বলল, “এ বেয়াদব মানুষটা মনে হয় ভুল করে অন করে ফেলেছিল।

“তাই হবে নিশ্চয়ই!” বুবুনও হাসতে শুরু করে।

হাসি জিনিসটা সংক্রামক, কিছুক্ষণের মাঝে চারজনই হাসতে শুরু করল। তাদের হাসি দেখে আম্মাও চোখ মুছে হঠাৎ একটুখানি হেসে ফেললেন।

আম্মা যখন হাসেন তখন তাকে যে কী সুন্দর দেখায়!

 ১৩. শেষ কথা

এলাকার মেয়েদের স্কুলগুলো ঠিক যেভাবে তৈরি হওয়ার কথা ছিল সেভাবে তৈরি হচ্ছে। আম্মা সারাদিন কাজ করেন আর রাতে নাকের উপর চশমা লাগিয়ে বসে বসে রিপোর্ট লিখেন। এই রিপোর্টগুলো অন্য এলাকায় ব্যবহার করা হবে। একাত্তরের জামাতি রাজাকারদের দিয়ে কী সমস্যা হতে পারে, তাদের কী কী জিনিস নিয়ে সতর্ক থাকতে হয়, এইসবও নাকি রিপোর্টে লেখা হয়। তাদের ঠিকমতো শাস্তি কীভাবে দেওয়া যায়, জেল থেকে বের হবার পর তাদের নিয়ে কী করতে হবে এইসবও নাকি রিপোর্টে লেখা আছে। আম্মা যখন রিপোর্ট লেখেন তখন আব্বা টেবিলের অন্যপাশে গালে হাত দিয়ে বসে বসে আম্মার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বুবুন কাছে এলে তাকে টেনে এনে কানের মাঝে ফিসফিস করে বলেন, “দেখ, দেখ তোর আম্মাকে দেখ!”

“কী দেখব?”

“তোর আম্মাকে কেমন বদমেজাকি মাস্টারনির মতো দেখায় না?”

বুবুন ফিসফিস করে বলে, “আম্মা তো আসলেই বদমেজাজি মাস্টারনি–তাকে আর কীরকম লাগবে?”

আম্মা চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বলেন, “কী বললি? কী বললি বুবুন? কান ছিঁড়ে একেবারে ভ্যান গ বানিয়ে দেব।”

পাড়ার ছেলেমেয়েরা বিকেলবেলা হৈ-হুঁল্লোড় করে ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, সাতচাড়া, কিং কুইন খেলে। তার সাথে নতুন একটা খেলা যোগ হয়েছে, যেখানে খবিরউদ্দিনের আস্তানায় আব্বার সেই ঘটনাটি তারা নিজেরা অভিনয় করে দেখায়।

অভিনয় করে দেখানোর সময় টান দিয়ে যখন-তখন তারা শার্টের বোতাম ছিঁড়ে খালি বুক বের করে ফেলে।

ছেঁড়া শার্টের বোম সেলাই করে লাগাতে এই লাগাতে পাড়ার আম্মারা একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে গেছেন!

Exit mobile version