Site icon BnBoi.Com

নিতু আর তার বন্ধুরা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

নিতু আর তার বন্ধুরা – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

০১. বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়

নিতুর বয়স যখন দশ বছর তিন মাস এগার দিন তখন নিতুর মা মারা গেলেন। নিতুর বাবা তখন, ও নিতুর মা গো, তুমি আমাকে কোথায় ফেলে চলে গেলে গো, আমার কী হবে গো এই সব বলে মাথা চাপড়ে হাউমাউ করে কাঁদলেন টানা সাতদিন। আট দিনের দিন নিতুর বাবা কান্না থামিয়ে নিতুকে জিজ্ঞেস করলেন, নিতু রে, তোর নিশ্চয়ই একা একা খারাপ লাগছে?

নিতু মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

বাবা উদাস উদাস চেহারা করে বললেন, তোর জন্য একটা নূতন মা খুঁজে আনতে হবে।

নিতু চোখ কপালে তুলে হা হা করে বলল, না, না, বাবা লাগবে না! একেবারেই লাগবে না।

নিতুর বাবা কথা শুনলেন না এক মাসের মাঝে বিয়ে করে একজন নূতন মা নিয়ে এলেন। নিতুর আসল মা ছিলেন হালকা পাতলা এই মা হলেন মোটাসোটা। আগের মা ছিলেন হাসিখুশি আর, এই মা হলেন বদরাগী। সত্যিকারের মা ছিলেন সাদাসিধে ভালোমানুষ আর এই মা হলেন কুটনী বুড়ি। বিয়ের পর অনেক কষ্ট করে এক দুই সপ্তাহ মুখে হাসি ধরে রাখলেন তারপর তার আসল রূপ বের হয়ে এল। নূতন মায়ের যন্ত্রণায় নিতুর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে

নিতুর বয়স যখন দশ বছর পাঁচ মাস সতের দিন তখন একদিন তার বাবা তাকে ডেকে বললেন, আজকাল স্কুলে কোনো লেখা পড়া হয় না। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন পড়াশোনা ছিল খুব হাই স্ট্যান্ডার্ড।

নিতুর বাবা আসলে কী বলতে চাইছেন বোঝার জন্যে নিতু চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। নিতুর বাবা বললেন, আমরা যখন তোর মতো ছোট ছিলাম তখন বাবোর নাম বলতে পারতাম, কান চুলকানোর ইংরেজি বলতে পারতাম।

আমরাও পারি।

পারিস নাকি? শুনে মনে হল বাবার একটু মন খারাপ হল। মুখ গম্ভীর করে বললেন, যাই হোক, পড়াশোনার পুরো ব্যাপারটা আসলে একটা কমপ্লিট প্যাকেজ।

প্যাকেজ?

হ্যাঁ। বুঝলি—অঙ্ক করার সাথে সাথে ঘুমানো শিখতে হয়, ইংরেজি গ্রামারের সাথে ভাত খাওয়া।

বাবা কী বলতে চাইছেন বুঝতে না পেরে নিতু এবারে খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে তার চোখের দিকে তাকাল। বাবা নিতুর চোখের দৃষ্টি এড়িয়ে বললেন, তাই ঠিক করেছি তোকে একটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে দিয়ে দেব।

কী স্কুল?

রেসিডেন্সিয়াল স্কুল। মানে যেখানে তুই থাকবি এবং পড়াশোনা করবি। একই সাথে স্কুল আর হোস্টেল।

নিতু অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল, তার নূতন মা শেষ পর্যন্ত বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে বাড়ি ছাড়া করতে রাজি করিয়ে ফেলেছেন! বাৰা জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, দেখবি কী সুন্দর স্কুল। ফিটফাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। যে রকম ডিসিপ্লিন সে রকম পড়াশোনা।

নিতু কোনো কথা না বলে একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবা অন্যদিকে তাকিয়ে বললেন, দেখবি তোর কত ভালো লাগবে। নিজে নিজে স্বাধীনভাবে থাকবি।

নিতু এবারে বাবার দিকে তাকিয়ে একরকম জোর করে দাঁত বের করে হাসল। বাবা একটু অবাক হয়ে বললেন, কী হল? এরকম করে হাসছিস কেন?

আনন্দে।

আনন্দে?

হ্যাঁ।

কীসের আনন্দে?

আমার বয়স মাত্র দশ সেই আনন্দে। যদি আমি আরেকটু বড় হতাম তাহলে তোমরা আমাকে জোর করে ধরে কারো সাথে বিয়ে দিয়ে দিতে। কী বাঁচা বেঁচে গেছি সেই আনন্দে।

বাবা অবাক হয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইলেন, কয়েকবার কিছু একটা বলার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত কিছু বললেন না। নিতু ঠিকই আন্দাজ করেছে, তার নূতন মা সত্যি সত্যি আফসোস করেছে কেন সে আরো কয়েক বছর বড় হল না তাহলেই তো বিয়ে দিয়ে আপদ বিদায় করে দেয়া যেত।

সপ্তাহখানেক পরে নিতু একটা স্যুটকেসে তার জামা কাপড়, তার প্রিয় গল্পের বই আর তার ছেলেবেলার কয়েকটা পুতুল ভরে নিল। স্যুটকেসের তলায় রাখল তার মায়ের একটা ফ্রেম করা ছবি। তার ঘুমানোর সাথী টেডি বিয়ার ভোটকা মিয়াকে হাতে নিয়ে নূতন স্কুলে রওনা দিল। বাবা তাকে নিয়ে প্রথমে গেলেন ট্রেনে, ট্রেন থেকে নেমে বাস। বাস থেকে নেমে ফেরি। ফেরি থেকে স্কুটার। স্কুটার এসে থামল উঁচু দেওয়াল ঘেরা একটা পুরানো বাড়িতে, দেখে দিনের বেলাতেই কেমন জানি গা ছম ছম করে। উঁচু দেওয়ালের ওপর কাঁটাতার দেওয়া দেখে মনে হয় বুঝি জেলখানা। সামনে একটা বড় লোহার গেট, গেটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায় ভিতরে বড় বড় গাছ। গেটের উপরে একটা সাইন বোর্ড, সাইনবোর্ডে লেখা :

বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়
স্থাপিত ১৯৬৭ ইং
বালিকাদের আবাসিক শিক্ষাঙ্গন
শিক্ষা এবং শৃঙ্খলার সমন্বয়।

নিতু ভয়ে ভয়ে দেখল শৃঙ্খলা কথাটি লাল রং দিয়ে লেখা, দেখেই কেমন জানি গা শির শির করে উঠে।

গেটটা ভিতর থেকে বন্ধ করে রাখা, বাবা ভয়ে ভয়ে কয়েকবার শব্দ করতেই পাশের ছোট ঘর থেকে দরজা খুলে একটা মাথা উঁকি দিল। মানুষটা সম্ভবত দারোয়ান, সারা মুখ চুল দাড়িতে টাকা। কবি রবীন্দ্রনাথেরও বড় বড় চুল দাড়ি কিন্তু তাকে দেখে কেমন জানি শ্রদ্ধা শ্রদ্ধা ভাব হয়, এই মানুষটার বেলায় একেবারে উল্টো দেখেই কেমন জানি ডাকাত ডাকাত মনে হয়। লোকটার চুল দাড়ি খাড়া হয়ে আছে দেখে মনে হয় মাথার ওপরে বাজ পড়ে ইলেকট্রিক শক খেয়ে সব চুল দাড়ি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। মানুষটা লাল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বাজখাই গলায় হুংকার দিল, কী চাই?

বাবা মিন মিন করে বললেন, না, মানে ইয়ে আমার মেয়েকে দিয়ে যেতে এসেছি।

কোন মেয়ে?

ওর নাম হচ্ছে মানে—

মানুষটা ধমক দিয়ে বলল, নাম দিয়ে কী হবে? এখানে সব নম্বর। কত নম্বর মেয়ে?

বাবা তাড়াতাড়ি নিতুর কাগজপত্র বের করে নম্বর দেখে বললেন, সাতশ বিয়াল্লিশ।

ইলেকট্রিক শক খাওয়া মানুষটা তার হাতের রেজিস্টার খাতাতে কিছু একটা দেখে গেট খুলে দিয়ে বলল, ভিতরে।

বাবা নিতুকে নিয়ে ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলেন তখন লোকটা আবার ধমক দিয়ে বলল, আপনি ঢুকছেন কেন? আপনি কি এই স্কুলে পড়বেন?

না—মানে ভিতরে দিয়ে আসি।

এর ভিতরে বাইরের মানুষের টোকা নিষেধ।

বাবা নিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে মুখে জোর করে একটা খুশি খুশি ভাব ফুটিয়ে বললেন, বলেছিলাম না খুব ভালো স্কুল? দেখেছিস শৃঙ্খলার দিকে কী রকম নজর?

নিতু মাথা নাড়ল, বলল, একটু বেশি নজর। মনে হয় এখানে চোর

ডাকাতের মেয়েরা পড়তে আসে।

নিতুর কথা শুনে বাবা চোখ পাকিয়ে তাকালেন তারপর শুকনো গলায় বললেন, তুই তাহলে ভিতরে যা। ভালো হয়ে থাকিস।।

খাড়া খাড়া চুল দাড়িওয়ালা ডাকাতের মতো মানুষটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলল, সেটা আর বলে দিতে হবে না। এই খানে ভালো হয়ে না থাকলে– মানুষটা কথা শেষ না করে ডান হাত দিয়ে ম্যাচ করে গলায় পোচ দেবার মতো একটা ভঙ্গি করল। দেখে হঠাৎ নিতুর শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

বাবা নিতুর হাতে কাগজগুলি দিয়ে বললেন, যা, দেরি করিস না।

নিতু এক হাতে তার টেডি রিয়ার ভোটকা মিয়াকে আঁকড়ে ধরে অন্য হাতে ভারী স্যুটকেসটা টেনে টেনে ভিতরে ঢুকল। গেটটা পার হওয়া মাত্র পিছনে ঘর ঘর করে সেটা বন্ধ হয়ে গেল, নিতুর হঠাৎ মনে হয় সে বুঝি সমস্ত পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে গেছে।

গেট থেকে খোয়া বাধানো রাস্তা ভিতরে চলে গেছে। রাস্তার দুই পাশে নানা ধরণের গাছ গাছালি, একটু ভিতরে পোড়াবাড়ির মতো একটা মন খারাপ করা দালান। তার পিছনে টিনের ছাদের ছোট ছোট বাসা। স্কুল হলে যেরকম ছোট ছোট বাচ্চা ছেলে মেয়ের হৈ চৈ কলরব শোনা যাবার কথা এখানে সেরকম কিছু নেই। চারিদিকে কেমন জানি সুমসাম নীরবতা। এটি যেন স্কুল নয়—এটি যেন একটি কবরস্থান।

কী করবে বুঝতে না পেরে নিতু কয়েক সেকেণ্ড দাঁড়িয়ে রইল তারপর ভারী সুটকেসটা টানতে টানতে মন খারাপ করা দালানটার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। যেতে যেতে সে ফিস ফিস করে বুকে আঁকড়ে থাকা টেডি রিয়ারটার সাথে কথা বলতে শুরু করে, বুঝলে ভোটকা মিয়া, তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নাই। ঐ দালানটা দেখে ভয় ভয় লাগলেও দেখবে সেখানে সব ভালো ভালো মানুষেরা থাকে। আমারা হাজির হতেই দেখবে সবাই ছুটে আসবে!

দালানটার কাছে পৌঁছানোর পর কেউ অবিশ্যি ছুটে এল না। ভারী স্যুটকেসটা অনেক কষ্ট করেও সিঁড়ি দিয়ে তুলতে না পেরে সে হাল ছেড়ে দিয়ে স্যুটকেসটার উপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। ভোটকা মিয়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, বুঝলে ভোটকা মিয়া, আমরা এখানেই বসে থাকি, যার দরকার সেই আমাদের খুঁজে বের করবে।

নিতুর সন্দেহ সত্যি প্রমাণিত হল, কিছুক্ষণের মাঝেই হঠাৎ মনে হল তার সামনে একটি পাহাড় এসে দাঁড়িয়েছে। নিতু ভয়ে ভয়ে উপরের দিকে তাকাল, মনে হল প্রায় আকাশের কাছাকাছি মাথা পৌছে গেছে এরকম একজন তার সামনে এসে হাজির হয়েছে। মানুষটি নিশ্চয়ই একজন মহিলা কারণ একটা শাড়ি পরে আছে, কিন্তু তার চেহারা দেখে সেটা বোঝার কোন উপায় নেই। মাথার চুল শক্ত করে টেনে পিছনে ঝুঁটি করে বেঁধে রাখা, সামনে থেকে মাথায় কোনো চুল আছে কী নেই সেটা বোঝা যায় না। গায়ের রং শ্যামলা, শরীর পাথরের মতো শক্ত। শাড়ি পরলে মেয়েদের চেহারার একটা কমনীয়তা চলে আসে কিন্তু এই মহিলার বেলায় সেটা সত্যি নয়। মেয়েরা যদি আমীর হাবিলদার হতো তাহলে নিশ্চয়ই এই ভাবে শাড়ি পরতো। মহিলার চোখ লাল এবং নিতুকে দেখে সেটা

আরো লাল হয়ে উঠল। সেই আকাশের কাছাকাছি মাথা থেকে হঠাৎ যেন বিজলী চমকে উঠল, বিশাল একটা মুখ হঠাৎ একটা বড় ট্রাঙ্কের ঢাকনার মতো খুলে যায়, ভিতর থেকে কালো মাড়ি এবং ধারালো দাঁত বের হয়ে আসে এবং নিতু একটা গর্জন শুনতে পায়, এটেনশান।

নিতু কী করবে বুঝতে পারল না, রাস্তা ঘাটে পুলিশ মিলিটারি যখন মার্চ করে তখন এটেনশন বললে তারা পা ঠুকে সোজা হয় দাঁড়িয়ে যায়। তাকেও কি সে রকম কিছু করতে হবে? কী করবে ঠিক করতে নিশ্চয়ই তার দেরি হয়ে গিয়েছিল কারণ কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ মনে হল একটা বাঘ তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং তার ঝুঁটি ধরে প্রায় শূন্যে তুলে তাকে দাড় করিয়ে দিয়েছে। নিতু পিট পিট করে তাকাল এবং দেখতে পেল বিশাল কেঁদো বাঘের মাখার মতো একটা মুখ তার দিকে নেমে আসছে, মাথাটি নামতে নামতে একেবারে তার মুখের কাছে নেমে এল, এত কাছে নেমে যে নিতু তার চোখের লাল শিরা, নাকের ভিতরে লেমি এবং দাঁতের ফাকে লেগে থাকা মাংসের টুকরাগুলি পর্যন্ত স্পষ্ট দেখতে পেল। শুধু তাই নয় তার নাকে ভক করে একটা দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়—কেউ যদি বাঘের মুখ খুলে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দেয় তাহলে সে নিশ্চয়ই এরকম একটা গন্ধ পাবে। কেঁদো বাঘের মুখের ভিতর থেকে আরেকটা গর্জন বের হয়ে আসে, তু-ই-কে-রে?

নিতু নাম বলতে গিয়ে হঠাৎ করে থেমে গেল, মনে পড়ল এখানে কারো নাম নেই, সবার একটি করে নম্বর। সে ঢোক গিলে শুকনো গলায় বলল, আমি সাতশ বিয়াল্লিশ।

কেঁদো বাঘের বিশাল ভয়ংকর মাথাটা আস্তে আস্তে আবার উঠে যায়। আকাশের কাছাকাছি থেকে আবার একটা গর্জন ভেসে এল, তোর হাতে এইটা কী?

নিতু তার হাতের দিকে তাকাল, দুই হাতে সে শক্ত করে তার ভোটকা মিয়াকে ধরে রেখেছে। সে সেটাকে তুলে এনে বুকে চেপে ধরে বলল, এইটা আমার টেডি বিয়ায়। আমি যখন–

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কেঁদো বাঘের বিশাল মুখ দেখে মাঝখানে তার কথা বন্ধ হয়ে গেল।

তুই যখন?

আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার মা এইটা আমাকে দিয়েছেন।

নিচে ফ্যাল।

নিতু না বুঝে অবাক হয়ে তাকাল তখন সেই পাহাড়ের ভিতর থেকে গর্জন বের হয়ে এল, নি-চে-ফে-লে-দে।

নিতু ভয়ে ভয়ে তার ভোটকা মিয়াকে নিচে ফেলল, সাথে সাথে সেই বিশাল পাহাড় এগিয়ে এসে ফুটবলে যেভাবে কিক দেয় সেই ভাবে ভোটকা মিয়াকে একটা কিক দিল—ভোটকা মিয়া গুলির মতো আকাশে উড়ে গেল। নিতু একটা চিৎকার করে উঠে মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চাইল সেটা কোথায় গিয়ে পড়েছে তখন সেই ধুমসো পাহাড় আবার গর্জন করে উঠল, খবরদার নড়বি না।

নিতু পাথরের মতো জমে গেল।

সামনে তাকা। নিতু সামনে তাকাল।

সীনা টান, মুখ উঁচু। নিতু সীনা টান করে মুখ উঁচু করল।

হাত পাশে, আঙুল মুঠ। নিতু হাত পাশে এনে আঙুল মুঠিবদ্ধ করল।

গোড়ালী জয়েন, মুখ বন্ধ, চোখ খোল। নিতু দুই পায়ের গোড়ালী একসাথে লাগিয়ে মুখ বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে খুলে তাকাল।

সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল পাহাড় এবারে স্টীম ইঞ্জিনের মতো ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুই কী করেছিস?

নিতু প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না, ভয়ে সে ঠিক করে চিন্তাও করতে পারছিল না, তার চোখে পানি এসে যাচ্ছিল, তার মাঝে কোনো ভাবে নিজেকে সামলে বলল, আমি কিছু করি নাই।

কেঁদো বাঘের মতো মুখটা এবারে আবার নিচে নেমে এলো, নিতুর নাকে আবার ভুক করে একটা মাংস পচা গন্ধ এসে লাগে। মুখটা আবার ট্রাঙ্কের ডালার মতো খুলে যায়, ভিতর থেকে ধারালো দাঁত আর লকলকে কালো জিব বের হয়ে আসে, ভেতর থেকে হিস করে আওয়াজ আসে, বল, আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।

আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।

কেঁদো বাঘ হুংকার দিয়ে বলল, জো-রে। শব্দের ঝাপটায় মুখ থেকে থুতু বের হয়ে এসে নিতুর মুখে লাগল, ঘেন্নায় নিতুর শরীর স্ত্রী রী করে উঠে কিন্তু সে নড়ল না, ভয়ে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।

কেঁদো বাঘের মাথা আবার ওঠে যায়, নাক দিয়ে আবার ইঞ্জিনের মতো শব্দ হয়, মুখের ডালা খুলে আবার শব্দ বের হয়, নিশ্চয়ই কিছু করেছিস, না হলে এখানে কেন পাঠাল?

নিতু চুপ করে রইল, সত্যি সত্যি তার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

কথা বল নর্দমার পোকা, ছারপোকার ছাও।

নিতু ভাঙ্গা গলায় যতটুকু সম্ভব জোরে জোরে বলল, আমি কিছু করি নাই ম্যাডাম।

আমার সাথে মামদোবাজী? এক দিনে পিটেয়ে সিধা করে দেব। হাড়ি ভেঙ্গে গুড়া করে দেব। চামড়া ছিলে ডুগডুগী বানাব। আমাকে চিনিস না তুই বানরের বাচ্চা বানর? তেলাপোকার ডিম? বল সত্যি কথা।

এবারে নিতু সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল, তার চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে পানি বের হয়ে আসে। ধুমসো পাহাড় আবার হুংকার দিয়ে বলল খবরদার কাঁদবি না, ছিচকাঁদুনে ইঁদুর।

নিতু অনেক কষ্ট করে চোখের পানি আটকে ফেলল।

তুই কী মনে করিস আমি কিছু বুঝি না? আমার নাক টিপলে দুখ বের হয়? এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে আমি আছি চৌদ্দ বছর। আমি তোর মতো শত শত ছেমড়ী দেখেছি। যাদের স্বভাব ইঁদুরের মতো। চোর ছ্যাচড়ের বাচ্চা। গুণ্ডা বদমাইসের বাচ্চা। আমার হাত দিয়ে বের হয়েছে, আমি টিপে টিপে তাদের ভূড়ি ফাঁসিয়ে দিয়েছি। সাপ হয়ে এসেছে, আরশালা হয়ে বের হয়ে গেছে। দেশের যত পাজী হতছাড়া বেয়াদপ বদমাইস শয়তান মেয়েগুলিকে যখন বাপমা সিধে করতে পারে না তখন তাদেরকে পাঠায় এইখানে। আমি সিধে করে ছেড়ে দেই। তোকেও আমি সিধে করব।

নিতু এবারেও কিছু বলল না, হঠাৎ করে তার চোখের সামনে সারা পৃথিবী টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙ্গে পড়তে শুরু করেছে। তার বাবা আর মা মিলে কোথায় পাঠিয়েছে তাকে? কী হবে তার এইখানে?

পাহাড়ের মতো মহিলা এইবারে কাকে যেন ডাকল, জমিলার মা।

সাথে সাথে কোথা থেকে যেন জমিলার মা হাজির হল, বেঁটেখাটো একজন মহিলা মুখ দেখে মনে হয় যেন একটা রবোট। কাছে এসে মিলিটারিদের মতন এটেনশান হয়ে বলল, আমাকে ডেকেছেন মাভাম?

হ্যাঁ। এই নর্দমার পোকা ছারপোকার ছাও, হুক ওয়ার্মকে বি ব্লকে দুইশ কারো নম্বর রুমে দিয়ে আস।

কোন সিটে ম্যাডাম?

গিয়ে দেখ, একটাই সিট খালি আছে।

ঠিক আছে ম্যাডাম।

মুখে কোনো ভাবভঙ্গি নেই বেঁটেখাটো কিন্তু শক্ত টাইপের সেই রবোট মহিলা নিতুর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নিতুকে বলল, চল।

নিতু পাহাড়ের মতো বিশাল মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার টেডি বিয়ার, ম্যাডাম।

পাহাড় হুংকার দিয়ে বলল, চোপ। এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে মানুষ ছাড়া আর কিছু থাকতে পারবে না।

কিন্তু ম্যাডাম। এই টেডি বিয়ারটা আমার আম্মা আমাকে দিয়েছিলেন চোপ বেয়াদপ। চোপ। খামোশ। নিতু কী বলবে বুঝতে পারল না। পাহাড় আবার গর্জন করে বলল, যখন এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় থেকে বের হবি তখন তোর মাকে বলিস আরেকটা কিনে দিতে।

কিন্তু আমার আম্মা মারা গেছেন। কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ করে তার মায়ের কথা মনে পড়ে সে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।

তোর মা মারা গেছে? নিতুর মনে হল এই প্রথমবার কেঁদো বাঘের মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, তুই নিশ্চয়ই এত যন্ত্রণা দিয়েছিস যে সেই যন্ত্রণায় তোর মা মরেছে? ঠিক কি না?

নিতু কিছু বলল না, অনেক কষ্ট করে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করল। পাহাড়ের মতো মহিলা হঠাৎ আকাশ কাঁপিয়ে চিৎকার করে বলল, কুইক মার্চ।

নিতু বুঝল তাকে যেতে বলা হচ্ছে। সে রবোট মহিলার পিছনে পিছনে হাঁটতে হাঁটতে শেষবার এই দানবীর দিকে তাকাল তারপর ফিসফিস করে মনে মনে বলল, আমি যদি আমার মায়ের বেটি হই তাহলে তোমাকে আমি একদিন টাইট করব।

পাহাড়ের মতো দানবী সেই কথা শুনতে পেল না, শুনতে পেলে সেই মুহূর্তে তার মাথা টেনে ছিঁড়ে ফেলত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

০২. রুমমেট

রোট মহিলা প্রথমে নিতুকে নিয়ে গেল তার হোস্টেলে। সেখানে দুইশ বারো নম্বর রুমে হাসপাতালের বেডের মতো ছয়টা বিছানা, তার একটা খালি। সেখানে তার স্যুটকেসটা রেখে তাকে নিয়ে যাওয়া হল সুপারিনটেন্ডেন্টের অফিসে। সুপারিনটেন্ডেন্ট একজন খিটখিটে মহিলা, তার বেড়ানো গাল, কোটরের ভিতর ঢুকে থাকা চোখ, শিরা ওঠা শুকনা হাত। সুপারিনটেন্ডেন্ট নিতুর কাগজপত্র নিয়ে বড় বড় কয়েকটা খাতায় অনেকক্ষণ সময় নিয়ে কী যেন লেখালেখি করল তারপর নিতুকে দাঁড় করিয়ে টানা আধঘণ্টা একটা লেকচার দিল। লেকচারের বিষয়বস্তু হল এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে নিয়ম-শৃঙ্খলা কত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই নিয়ম ভাঙ্গলে কী রকম কঠোর শাস্তি দেয়া হয় তার লোমহর্ষক বর্ণনা। অন্য যে কোনো সময় হলে এরকম একটা বক্তৃতা শুনে নিতুর হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতো কিন্তু কিছুক্ষণ আগে কেঁদো বাঘের মতো দেখতে সেই রাক্ষসী ম্যাডামের সাথে তার যে ঘটনাটা ঘটেছে সেটা তাকে একেবারে পাথরের মতো করে দিয়েছে, তার ভিতরে এখন ভয়-ভীতি, রাগ-দুঃখ কোনো কিছুই নেই। কেমন জানি বোধশক্তি ছাড়া একটা পুতুলের মতো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

হোস্টেলে সুপারিনটেন্ডেন্ট লেকচার শেষ করে জমিলার মা নামের রবোট মহিলার সাথে তাকে পাঠালো স্টোর রুমে। সেখানে ইঁদুরের মতো দেখতে আরেকজন মহিলা নিতুর শরীরের মাপ নিয়ে তাকে এক জোড়া স্কুলের পোশাক ধরিয়ে দিল। সাদা ব্লাউস আর ভুসভুসে কালো টিউনিক, দেখলেই নাড়ী উল্টে আসে। এই মন খারাপ করা পোশাক পরে তাকে এই স্কুলে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে চিন্তা করেও নিতু খুব বেশি মুষড়ে পড়ল না—মুষড়ে পড়ার ক্ষমতাও তার শেষ হয়ে গেছে। স্কুলের পোশাক দুটি দেওয়ার পর ইঁদুরের মতো দেখতে মহিলাটি আবার অনেকক্ষণ নাকী সুরে কথা বলে গেল। কথার বিষয়বস্তু হচ্ছে কীভাবে এই পোশাকের যত্ন নিতে হবে এবং পোশাকের এতটুকু ছিঁড়ে গেলে তাকে কী কী কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে। স্টোর রুম থেকে তাকে নেওয়া হল লাইব্রেরিতে, সেখানে তাকে তার ক্লাশের বই দিল থলথলে মোটা একজন মহিলা। মহিলাটি সব সময় বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে, একটু নড়লেই বা একটা কথা বললেই দুইবার বড় বড় নিশ্বাস নিতে হয়। বই এবং খাতা নিতুর হাতে তুলে দিয়েও এই মহিলা একটা বড় লেকচার দিল–এখানেও লেকচারের বিষয়বস্তু এক, বই ছিঁড়ে ফেললে বা ময়লা করলে কী কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে তার একটা ভয়ংকর বর্ণনা।

রবোট মহিলা সেখান থেকে নিতুকে নিয়ে গেল ডাইনিং রুমে, ডাইনিং রুম থেকে একটা ছোট অন্ধকার জিমনাসিয়ামে সেখান থেকে নিজের রুমে। এতক্ষণে ক্লাশ ছুটি হয়ে গেছে, সবাই নিজের রুমে চলে এসেছে। নিতু তার নিজের ঘরে এসে দেখল প্রত্যেকটা বিছানায় একটা মেয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে মনে হয় এই ঘরটিতে বুঝি কোনো বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সেই গ্যাসে সবাই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। নিতু কী করবে বুঝতে পারল না, হেঁটে হেঁটে কাছাকাছি বিছানায় শুয়ে থাকা একটা মেয়ের কাছে যেতেই মেয়েটা চোখ খুলে ফিসফিস করে বলল, তাড়াতাড়ি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়।

নিতু অবাক হয়ে বলল, কেন?

কথা বল না। যদি জানে বাচতে চাও শুয়ে পড়ো।

নিতু কিছু বুঝতে পারল না, কিন্তু এটা নিয়ে আর তর্ক করার সাহস পেল। নিজের বিছানায় গিয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। প্রায় সাথে সাথে শুনতে পেল দুম দুম করে শব্দ হচ্ছে। মনে হয় ভয়ংকর কোনো একটা প্রাণী হেঁটে হেঁটে আসছে। দড়াম করে ঘরের দরজা খুলে গেল, নিতু বুঝতে পারল তাদের ঘরে সেই প্রাণীটা এসে ঢুকেছে, সে তার চোখ বন্ধ করে ফেলল, চোখ বন্ধ করেই টের পেল একজন ঘরের মাঝে হেঁটে হেঁটে তাদের পরীক্ষা করছে। ঠিক তার বিছানার কাছে এসে পায়ের শব্দ থেমে যায়, প্রাণীটা তাকে পরীক্ষা করছে। নিতু একবার ভাবল চোখের কোণা দিয়ে তাকিয়ে দেখে কিন্তু সাহস পেল না, তার মনে হতে লাগল এক্ষুনি বুঝি তার চুলের ঝুঁটি ধরে কেউ টেনে তুলে ফেলবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা ঘটল না। শুনতে পেল দুম দুম করে পায়ের শব্দ দূরে সরে যাচ্ছে, দরজার কাছে গিয়ে শব্দটী এক মুহূর্তের জন্যে থামল তারপর দরজা খুলে দড়াম করে আবার বন্ধ হয়ে গেল। সাথে সাথে নিতু চোখ খুলে তাকায়, দেখে আশপাশে সব বিছানায় মেয়েগুলি চোখ পিট পিট করে তাকাচ্ছে।

নিতু ভয়ে ভয়ে বিছানায় উঠে বসে, সাথে সাথে অন্যেরাও সাবধানে উঠে বসে। একজন পা টিপে টিপে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাল। তারপর নিতুর কাছে এগিয়ে এল। নিতু শুকনো গলায় বলল, কী হচ্ছে এখানে?

চশমা পরা একটা মেয়ে বলল, তিনটার সময় স্কুল ছুটি হয়, এসে হাত মুখ ধুয়ে সাড়ে তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত ঘুম।

ঘুম?

হ্যাঁ। কেউ না ঘুমালে— চশমা পরা মেয়েটা কথা বন্ধ করে হাত দিয়ে ঘ্যাচ করে গলায় একটা পোচ দেওয়ার ভঙ্গি করল। নিতু আজকে দিনে এর মাঝে বেশ কয়েকবার এই দৃশ্য দেখে ফেলেছে।

গোলগাল মতন ফর্সা একটা মেয়ে এসে গলা নামিয়ে বলল, চারটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত নাস্তা। সাড়ে চারটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত খেলাধুলা। সাড়ে পাচটা থেকে–

চশমাপরা মেয়েটা বলল, খেলাধুলা না কছু। মাঠে নিয়ে খালি গরুর মতো দোঁড়ানো, ছাগলের মতো লাফানেনা?

যেটাই হোক। নাম তো খেলাধূলা। সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মাঝে হাত মুখ ধুয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হওয়া। ছয়টা থেকে আটটা পড়াশোনা। আটটা থেকে সাড়ে আটটা খাওয়া। সাড়ে আটটা থেকে সাড়ে নয়টা আবার পড়াশোনা। সাড়ে নয়টা থেকে দশটার ভিতরে ঘুমের জন্যে রেডি হওয়া। দশটার ভিতরে ঘুম।

নিতু হা করে চশমা পরা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, সব এইভাবে ভাগ করে রাখা আছে?

হ্যাঁ।

সব এইভাবে মানতে হয়।

গোলগাল চেহারার মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, হা। তোমার কাজের জন্যে এটা হচ্ছে শাস্তি।।

নিতু অবাক হয়ে বলল, কী কাজ?

তুমি যেটা করেছ।

আমি কী করেছি?

তুমি নিশ্চয়ই কিছু একটা করেছ। না হলে তোমাকে এখানে পাঠাল কেন? এখানে শাস্তি দেওয়ার জন্যে পাঠানো হয়।

নিতু মুখ শক্ত করে বলল, আমি কিছু করি নাই।

শ্যামলা রংয়ের মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে বলল, তাহলে নিশ্চয়ই তোমার বাবা-মা ডিভোর্স।

না, ডিভোর্স না।

পাশে দাঁড়ানো আরেকটা মেয়ে বলল, তাহলে নিশ্চয়ই তোমার মা মারা গেছেন।

নিতু ঘুরে তাকিয়ে দেখল এই মেয়েটাও শ্যামলা রংয়ের আর মিষ্টি চেহারার। ভালো করে তাকিয়ে দেখল দুজন দেখতে হুবহু একই রকম। নিতুর ভ্যাবাচেকা খাওয়া দেখে সবাই হি হি করে হেসে উঠল। চশমা পরা মেয়েটা বলল, এরা দুইজন জমজ বোন। রুনু আর ঝুনু।

কোনজন রুনু আর কোনজন ঝুনু?

গোলগাল চেহারার মেয়েটা বলল, তাতে কিছু আসে যায় না, একজন রুনু আরেকজন ঝুনু।।

তোমরাও জান না?

চশমা পরা মেয়েটা বলল, জানি। এই সপ্তাহে ঝুনুর হাঁটুর ছাল উঠে গেছে, তাই এই সপ্তাহে ঝুনু হচ্ছে হাঁটু ছাল ওঠা মেয়ে।

কিন্তু কয়েকদিন পরে তো ভালো হয়ে যাবে, তখন?

তখন ওর কনুইয়ে ছাল উঠে যাবে। না হলে কপাল কেটে যাবে। এরা দুইজনই দোড়। কিন্তু ঝুনুটা বেশি তঁাদোড় তাই ওর শরীরে কাঁটাকাটি বেশি হয়।

ঝুনু (নিতু হাঁটুর দিকে তাকিয়ে নিঃসন্দেহ হল মাথা নেড়ে বলল, এইখানে কে বেশি তাদোড় সেটা সে নিজেই দেখবে তোমাদের আর বক্তৃতা দিতে হবে না। তারপর ঘুরে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু তুমি এখনো বল নাই, তোমার মা মারা গেছেন কি না।

নিতু মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। মারা গেছেন। তুমি কেমন করে বুঝেছ?

ঝুনু বলল, এটা বোঝা আর এমন কী কঠিন। কোন বাবা-মা নিজের ছেলেমেয়েকে এইখানে পাঠাবে? মা মারা গেলে যখন বাবা আরেকবার বিয়ে করে তখন সেই মায়ের যখন বাচ্চাকাচ্চা হয় তখন এইখানে পাঠিয়ে দেয়।

নিতু কয়েকবার মুখ খুলল আর বন্ধ করল, তারপর বলল, এইটা— এইটা—

এইটার আসল নাম হওয়া উচিত বুতরুন্নেসা কনসেনট্রেশন ক্যাম্প।

চশমা পরা মেয়েটা বলল, কিংবা বুতুরুন্নেসা সেন্ট্রাল জেল।

গোলগাল মেয়েটা বলল, আহা-হা-এরকম করছিস কেন? বেচারী মাত্র এসেছে এখনই ভয় দেখাচ্ছিস কেন?

রুনু (নিতু হাঁটুর দিকে তাকিয়ে নিঃসন্দেহ হল) বলল, কে বলল ভয় দেখাচ্ছি—সত্যি কথাটা বলছি। সত্যি কথাটি যত আগে জানবে ততই ভালো। রুনু নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি হয়তো মনে করছো এইটা স্কুল। আসলে

এইটা স্কুল না।

এইটা তাহলে কী?

আমার মনে হয় পাগলা গারদ।

পাগলা গারদ?

হ্যাঁ। খালি একটা পার্থক্য। পাগলা গারদে পাগল মানুষেরা আসে ভালো হয়ে ফিরে যায়। এইখানে ভালো মানুষেরা আসে পাগল হয়ে ফিরে যায়।

চশমা পরা মেয়েটা হি হি করে হেসে বলল, আমরা কী পাগল হয়ে গেছি?

হই নাই আবার? একশবার হয়েছি। পাগল না হলে আমরা এখানে থাকতে পারি? চিন্তা করতে পারিস যখন খোরসানী ম্যাডাম চারটার সময় আমাদের দেখতে আসে আমরা তখন নাক মুখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে থাকি? মানুষ পাগল না হলে এটা করতে পারে?

নিতু একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, খোরাসানী ম্যাডাম কে?

গোলগাল মেয়েটা বলল,  কে না, বল কী!

সবাই আবার হাসতে শুরু করে হঠাৎ করে থেমে গেল, খোরাসানী ম্যাডাম এত ভয়ংকর যে তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতেও তারা ভয় পায়।

নিতু আবার জিজ্ঞেস করল, খোরাসানী ম্যাডাম কী?

একটা রাক্ষসী। এই পাহাড়ের মতো বড়, মুখটা এই এত বড় গোলগাল মেয়েটা দুই হাত ছড়িয়ে দেখাল।

বুঝেছি। আমার সাথে দেখা হয়েছে।

দেখা হয়েছে? মেয়েগুলি অবাক হয়ে নিতুর দিকে ঘুরে তাকাল, এর মাঝে দেখা হয়ে গেছে?

হ্যাঁ।

কিছু করেছে তোমাকে?

আমার টেডি বিয়ারকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে।

চশমাপরা মেয়েটা বলল, তোমার কপাল ভালো তোমাকে লাথি মারে নাই। গত বছর ক্লাশ সিক্সের একটা মেয়েকে লাথি মেরে তার বুকের হাড়ি ভেঙ্গে ফেলেছিল।

রুনু বলল (হাঁটু দেখে বোঝা গেল, রুনু, ছাল ওঠা নেই), ম্যাডাম খোরাসানীর হবি হচ্ছে চড় মারা। চড় মেরে সে আসলেই দাঁত ফেলে দিতে পাবে। এখন পর্যন্ত তার রেকর্ড এক চড়ে তিন দাঁত।

ঝুনু বলল, তার মাঝে অবিশ্যি দুইটা দুধ দাঁত। তবুও তো দাঁত।

মেয়েদের মাঝে যে সবচেয়ে ছোট এবং সবচেয়ে গম্ভীর এবং এতক্ষণ পর্যন্ত যে একটাও কথা বলে নি এবারে মুখ খুলল, বলল, তোমরা খালি নিজেরা কথা বলছ। আমাদের যে নূতন একটা রুমমেট এসেছে তার নাম টাম জিজ্ঞেস করবে না?

গোলগাল মেয়েটা বলল, হঁ, ঠিকই বলেছিস। তোমার নাম কী ভাই?

আমার নাম নিতু। তোমাদের নাম?

চশমা পরা মেয়েটা বলল, আমার নাম রেবেকা।

গোলগাল মেয়েটা হি হি করে হেসে বলল, আমরা নামটা আরো শর্ট করে নিয়েছি। আমরা ডাকি বেকা!

আর তোমার নাম?

মিতুল।

চশমা পরা মেয়েটি যার নাম রেবেকা এবং যার নাম শর্ট করে বেকা করে ফেলা হয়েছে এবারে মাথা নেড়ে বলল, আর মিতুলের নামটা অবিশ্যি শর্ট করি নাই আরেকটু বড় করেছি! মিতুল হচ্ছে তুলতুলে মিতুল!

রুনু (কিংবা কে জানে ঝুনুও হতে পারে) বলল, কেন তুলতুলে মিতুল বুঝেছ তো? কারণ সে নাদুস নুদুস গোলগাল তুলতুল।

গোলগাল চেহারার তুলতুলে মিতুল, চোখ পাকিয়ে বলল, দেব একটা দাবড়ানি। কিন্তু বলা পর্যন্তই মুখ দেখে মনে হয় তার নিজের নামটা সে পছন্দই করেছে।

মেয়েগুলির মাঝে যে সবচেয়ে ছোট এবং এদের মাঝে যে সবচেয়ে কম কথা বলে সে গম্ভীর গলায় বলল, এই দুইজনের নাম তো বলেছি—রুনু আর ঝুনু। আর আমি হচ্ছি তানিয়া।

মিতুল আবার হি হি করে হেসে বলল, কি নিয়া?

তানিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, ফাজলেমি করবি না।

মিতুল চোখ বড় বড় করে অভিনয় করার মতো করে বলল, চা-নিয়া? উহুঁ তানিয়া!

তানিয়া মুখ আরো গম্ভীর করে বলল, দ্যাখ নাম নিয়ে কখনো ফাজলেমি করবি না। মানুষের নাম খুব ইম্পর্ট্যান্ট। কবি রবীন্দ্রনাথের নাম যদি রবীন্দ্রনাথ না হয়ে মাহতাব মিয়া হতো তাহলে কি কখনো কবিতা লিখতে পারতেন?

চশমা পরা রেবেকা বলল, ভাই তুমি তো বুঝতেই পারছ আমাদের মাঝে তানিয়া হচ্ছে মাস্টার মশাই। চল্লিশ বছরের একটা মানুষ ওই ছোট শরীরের মাঝে আটকা পড়ে আছে।

উহুঁ চল্লিশ না। গোলগাল মিতুল মাথা নেড়ে বলল, ফিফটি ফাইভ।

তানিয়া আরো গম্ভীর হয়ে বলল, দ্যাখ, তোরা বেশি ফাজলেমি শুরু করেছিস।

রুনু (কিংবা ঝুনু হেসে বলল, আমাদের তানিয়া সব সময় তোমাকে উপদেশ দিবে।

ঝুনু কিংবা রুন) বলল, যে কোনো বিষয়ে উপদেশ। কেমন করে কথা বলতে হয়, কেমন করে নাক ঝাড়তে হয়, কেমন করে কান চুলকাতে হয়—

তানিয়া আবার বলল, বাজে কথা বলবি না ঝুনু। তোরা বড় বেশি কথা বলিস।

চশমাপরা রেবেকা বলল, আসলে আমরা বেশি কথা বলি না। আমাদের এই বেডটা খালি ছিল তো তাই খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম কে মা কে রুমমেট হিসাবে আসে! তোমাকে দেখে ভয় কেটে গেছে তো তাই সবাই বকবক করছে।

নিতু একটু অবাক হয়ে বলল, আমাকে দেখে ভয় কেটে গেছে? আমার সম্পর্কে তো কিছুই জান না!

জান না কেন। তোমার মা মারা গেছেন তাই তোমাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। এইটুকুন জানলেই তো সব জানা হয়ে যায়। তুমি তো আমাদের মতোই একজন।

এখানে তোমরা সবাই এরকম?

হ্যাঁ। হয় বাবা মা ডিভোর্স না হলে বাবা-মা মারা গেছেন, তা না হলে মা মারা গেছেন।

নিতু একটু অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাল, কত অল্প বয়সের সবাই এর মাঝে সবাই কত বড় বিপদের মাঝে দিয়ে গিয়েছে!

মিতুল নিতুর গায়ে হাত দিয়ে বলল, তুমি মন খারাপ করো না। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগবে, তারপর দেখবে অভ্যাস হয়ে গেছে।

নিতু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন বাইরে থেকে একটা কর্কশ হুইসিলের শব্দ শুনতে পেল। রেবেকা লাফিয়ে উঠে বলল, বাঁশি বেজে গেছে! তাড়াতাড়ি।

কীসের বাঁশি?

নাস্তা করে খেলার মাঠে যাওয়ার বাঁশি! দেরি যেন না হয় বিপদ হয়ে যাবে। তাহলে।

অন্য সবার সাথে নিতুও ছোটাছুটি করে রেডি হতে শুরু করে, বুতুরুন্নেসা আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ে পদে পদে বিপদ, সেটা সে এতক্ষণে বেশ ভালো করেই বুঝে গেছে।

০৩. ললিপপ

দশটা বাজার কয়েক মিনিট আগে ঘরের বাতি নিভিয়ে সবাই শুয়ে পড়ল। ঘরে সুমসাম নীরবতা, মনে হয় বুঝি কেউ নেই। মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে একটু নাড়াচাড়া করে, নিশ্বাসের শব্দ হয়, কেউ কেউ ঘুমের মাঝে একটা দুইটা কথা বলে। কিন্তু যখন কেউ ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে তখন তারা টু শব্দটাও করে না, তাই ঘরে একটু শব্দও নেই।

আলো নিভিয়ে দেয়ার পর ঘরের ভিতরে প্রথমে ঘুটঘুটে অন্ধকার থাকলেও আস্তে আস্তে চোখে অন্ধকার সয়ে এসে এখন বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ছয়টা বাক্সের মতন ঘরের মাঝে ছয়টা মশারি টানানো এবং তার ভিতরে ছয়টি মেয়ে ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। নিতু শুয়ে শুয়ে শুনতে পায় বারান্দা দিয়ে প্রথমে গুম গুম শব্দ করে একজন হেঁটে গেল, নিশ্চয়ই খোরাসানী ম্যাডাম। এরপর খ্যাস খাস শব্দ করে সেন্ডেল ঘষে আরেকজন, সম্ভবত হোস্টেল সুপারিনটেন্ড যাকে দেখলে মনে হয় তার শরীরের মাঝে নল ঢুকিয়ে কেউ একজন তাকে চুষে খেয়ে নিয়ে ছিবড়েটা ফেলে গেছে। নিতু বিছানায় শুয়ে কয়েকবার এপাশ ওপাশ করল এবং ঘুমানোর চেষ্টা করল তারপর বুঝতে পারল আসলে সে ঘুমাতে পারবে না। নতুন জায়গায় সবাই ঘুমাতে দেরি হয় কিন্তু নিতর সমস্যাটা অন্য জায়গায়। সে যখন খুব ছোট তখন তার জন্মদিনে তার মা তাকে একটা টেডি বিয়ার উপহার দিয়েছিলেন, পেট-মোটা তুলতুলে নরম হালকা বাদামি রংয়ের টেডি বিয়ারটাকে বুকে জড়িয়ে সে সাথে সাথে তার নাম দিয়েছিল ভোটকা। মিয়া। নিতু কখনো তার এই ভোটকা মিয়াকে কাছ ছাড়া করে নি। রাতের বেলা বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে, তার সাথে কথা বলেছে। এই প্রথম আজ রাতে তার সাথে ভোটকা মিয়া নেই, নিতুর মনে হচ্ছে তার নিজের শরীরের একটা অংশ হারিয়ে গেছে। ভোটকা মিয়া ছাড়া সে ঘুমাবে কেমন করে? নিতু তখন হঠাৎ করে তার বিছানায় উঠে বসল। কী করতে হবে সে বুঝতে পেরেছে, ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করে আনতে হবে।

বিকাল বেলা যখল খেলাধূলার নামে তাদের ওপর অত্যাচর করা হচ্ছিল, মাঠের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছিল, খোয়া বাঁধানো পথে লাফাতে হচ্ছিল তখন সে পুরো এলাকাঁটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছে। স্কুলের সামনে সিঁড়ির কাছে যেখানে তার রাক্ষসী খোরাসানী ম্যাডামের সাথে দেখা হয়েছে সেখান থেকে লাথি মেরে তার ভোটকা মিয়াকে ফেলে দেয়া হলে সেটা কোনদিকে যেতে পারে আন্দাজ করে খুঁজে দেখেছে। স্কুলের সীমানার কাছাকাছি একটা বড় ঝাপড়া গাছে ভোটকা মিয়া আটকা পড়ে আছে। খোরাসানী ম্যাডাম অবিশ্যি চেষ্টা করেছিল লাথি মেরে স্কুলের সীমানার বাইরে পাঠিয়ে দিতে কিন্তু ঝাপড়া গাছটা বাঁচিয়েছে। বিকেল বেলা যখন খেলাধূলার নামে তাদেরকে দৌড়িয়ে নেয়া হচ্ছিল নিতু তার মাঝেও চেষ্টা করেছিল কোনোভাবে সরে গিয়ে ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করে আনতে কিন্তু পারে নি। এখন রাত হয়েছে, একটু পরে সবাই ঘুমিয়ে যাবে তখন গিয়ে ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করে আনা যাবে।

নিতু নিঘুম বিছানায় শুয়ে রইল। কান পেতে শুনতে পেল ঝুন ঝুন দুই বোন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে কথা বলছে। মিতুলের বিছানা থেকে নিয়মিত নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে, মনে হয় এর মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রেবেকার বিছানা থেকে মনে হল খুব চাপা কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে, মেয়েটা মনে হয় কাঁদছে। এখানে যারা আছে সবার মনের ভিতরেই তো দুঃখ, সারাদিন চেপে চুপে রাখে কাউকে বুঝতে দেয় না। যখন রাত্রে ঘুমাতে আসে তখন মনে হয় নিজের কাছেই সেটা নিজে প্রকাশ হয়ে যায়। নিতু তার মাঝে নিশ্বাস বন্ধ করে শুয়ে রইল।

এভাবে আরো অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল। নিতর যখন মনে হল সবাই ঘুমিয়ে গেছে তখন সে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে এল। বিছানার নিচে জুতো রাখা ছিল সাবধানে সেগুলি পায়ে লাগিয়ে নেয় তারপর পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগুতে থাকে। দরজার ছিটকানিটা বেশ শক্ত করে লাগানো টেনে খুলতে গিয়ে সেটা খুট করে শব্দ করে ফেলল—সাথে সাথে মিতুল ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করল, কে?

আমি। নিতু ফিসফিস করে বলল, আমি নিতু।

ও! বাথরুমে যাবে?

উঁহু।

মিতুল এবারে পুরোপুরি জেগে উঠে বলল, তাহলে?

আমার টেডি বিয়ারটা আনতে যাচ্ছি।

এবারে মিতুল লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসল। চাপা গলায় যতটুকু জোরে কথা বলা সম্ভব ততটুকু জোরে বলল, কী বলছ তুমি? তোমার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে?

নিতু আর কথা না বাড়িয়ে দরজা খুলে বের হয়ে গেল। মিতুল পিছনে পিছনে ছুটে এসে চাপা গলায় বলল, দাঁড়াও নিতু! দাঁড়াও! যেও না।

কিন্তু নিতু তার কথা না শুনে বারান্দা দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। মিতুল কী করবে বুঝতে না পেরে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বারান্দায় আলো জ্বলছে বের হলে কেউ না কেউ দেখে ফেলতে পারে তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ভয়ে মিতুলের শরীর কাঁপতে থাকে, নিতু নূতন এসেছে তাই এখনো বুঝতে পারছে না। তাদের হোস্টেলের বড় গেট রাত্রে তালা দেওয়া থাকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। সেটা একটা বিশাল সৌভাগ্য না হয় মাঝে মাঝেই কোনো না কোনো মেয়ে এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করত আর তাহলেই হতো সর্বনাশ। খোরসানী ম্যাডামের ভয়ংকর—কুকুর সিংঘিকে রাতের বেলা ছেড়ে দেওয়া হয়। স্কুল কম্পাউন্ডের ভিতর কেউ এলে তাকে একেবারে টুকরা টুকরা করে ছিঁড়ে ফেলবে। এই স্কুলের মাঝে কে বেশি ভয়ংকর খোরাসানী ম্যাডাম না কি তার কুকুর সিংঘি সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে তর্ক বিতর্ক হয়। দিনের বেলা সিংঘিকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। বিশাল কুকুরটী তখন ধারালো দাঁত বের করে স্কুলের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে, কেউ কাছাকাছি এলে মেঘের গর্জনের মতো শব্দ করে শেকল ছিঁড়ে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। কোনোভাবে যদি শেকল ছিঁড়ে বের হয়ে আসে তখন কী হবে সেটা চিন্তা করে মিতুলের মতো অনেকেরই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে।

মিতুল নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল, নিতু নামের এই নূতন পাগলাটে মেয়েটা গেট বন্ধ দেখে এখন নিশ্চয়ই ফিরে আসবে, কিন্তু সে ফিরে এল না আর তাই দেখে মিতুলের মনে হল সে ভয়ে, আতংকে আর দুশ্চিন্তায় বুঝি হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাবে! কী হয়েছে মেয়েটার? কোথায় গিয়েছে?

 

নিতু ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দা ধরে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে সাবধানে এক তলায় নেমে এল। চারিদিকে আলো জ্বলছে কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। গেটের সামনে এসে নিতু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সেখানে এত বড় একটা তালা ঝুলছে, বের হবার কোনো উপায় নেই। এতগুলি মেয়েকে তালা মেরে আটকে রাখা হয় ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখেও তার বিশ্বাস হয় না। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে সেটা নিয়ে খানিকক্ষণ চিন্তা করে সে আবার খুব সাবধানে নিঃশব্দে উপরে উঠে এল। বারান্দার রেলিং টপকে সে খুব সাবধানে কার্নিশে নেমে এল। কার্নিশ ধরে সে শুড়ি মেরে হেঁটে যেতে থকে বাথরুমের কাছাকাছি পানির পাইপ নিচে নেমে গেছে, সে সেই পাইপ বেয়ে নেমে যাবে। আধো আলো আধো অন্ধকারে গুড়ি মেরে কার্নিশের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে শেষ পর্যন্ত বাথরুমের কাছে পৌঁছাল, যে রকম ভেবেছিল ঠিক সে রকম সত্যি সত্যি কয়টা পানির পাইপ নিচে নেমে গেছে। নিতু সাবধানে একটা পাইপ ধরে পিছলে পিছলে নিচে নেমে এল। পাইপ বেয়ে নামা খুব সহজ, কিন্তু কীভাবে উঠে আসবে কে জানে? এখন অবিশ্যি সেটা চিন্তা করে লাভ নেই।

নিচে নেমে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিতু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সে এখানে এসেছে এখনো পুরো একদিন হয় নি, স্কুলটা এখনো ভালো করে চেনা হয় নি। কোন দিক দিয়ে গেলে সবচেয়ে সহজ হবে সে ভালো করে জানে না। তার মাঝেও সে আন্দাজ করে নিয়ে সাবধানে হাঁটতে শুরু করে। স্কুল কম্পাউন্ডের মাঝে মাঝে লাইট জ্বলছে, সে সেগুলি এড়িয়ে অন্ধকারে অন্ধকারে হেঁটে যেতে থাকে। নিশুতি রাত কোথাও কেউ নেই, তার মাঝে একা একা যেতে তার কেমন জানি ভয় করতে থাকে। দিনের বেলা সে ভূত বিশ্বাস করে না, কিন্তু এই রাত্রি বেলা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার, সে যতগুলি ভূতের গল্প পড়েছিল হঠাৎ করে সবগুলি গল্প তার এক সাথে মনে পড়ে গেল।

নিতু অন্ধকারে নিজেকে আড়াল করে সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে। হোস্টেলটা পার হয়ে খানিকটা ফাঁকা জায়গা, তারপর একটা টিউবওয়েল, টিউবওয়েল্টা পার হয়ে এগিয়ে গেলে বেশ কয়েকটা গাছ, তারপর স্কুল বিল্ডিং, তারপর আরো কিছুগাছ সেগুলি পার হয়ে গেলে স্কুলের মাঠ তার অন্যপাশে স্কুলের সীমানার উঁচু দেওয়াল। সেই দেওয়ালের কাছে বড় একটা ঝপড়া গাছে তার ভোটকা মিয়া আটকা পড়ে আছে। নিতু যখন স্কুলের মাঠের কাছাকাছি এসেছে ঠিক তখন সে একটা চাপা গর্জন শুনতে পেল এবং কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ করে কী যেন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। নিতু মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে ভয়ে আতংকে সে একটা চিৎকার দিয়েই দিচ্ছিল কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়, অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না কিন্তু তার মাঝেও বোঝা যাচ্ছে বিশাল একটা কুকুর তাকে মাটিতে চেপে ধরে রেখেছে, চোখগুলি জ্বলছে আগুনের মতে, ধারালো দাঁত বের হয়ে আছে আর চাপা স্বরে গর্জন করছে, মনে হয় এক্ষুনি বুঝি ধারালো দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলবে তাকে।

কুকুরটা দেখে নিতুর শরীরে প্রাণ ফিরে এল, ফিক করে হেসেও ফেলল সে, চাপা স্বরে বলল, ও মা! একটা কুকুর! কী সুইট। আমি ভেবেছিলাম ভূত!

কুকুরটা তীক্ষ্ণ চোখে নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে, নিতু হাত দিয়ে অবলীলায় কুকুরটাকে উপর থেকে সরিয়ে উঠে বসে সেটার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আয় আমার কাছে আয় পাগল কোথাকার। কী ভয় দেখিয়েছি আমাকে।

একটু আগে যে কুকুরটা একটা ভয়ংকর প্রাণী ছিল হঠাৎ করে নিতুর আদর পেয়ে সেটা কেমন জানি বাচ্চা শিশুর মতো হয়ে উঠে। লেজ নাড়িয়ে দুই পা নিতর শরীরে তুলে তাকে দুই একবার চেটে ফেলল। নিতু খিলখিল করে হেসে ফিস ফিস করে বলল, খবরদার পাজী কুকুর, আমাকে কি লজেন্স পেয়েছিস নাকি? চাটছিস কেন? দেব একটা চড়!

নিতু কুকুরটার গলা ধরে মুখে আদর করে হাত বুলিয়ে দেয় তারপর ফিস ফিস করে বলে, আর আমার সাথে। একা একা যা ভয় পাচ্ছিলাম। এখন আমার আর কোনো ভয় নাই। যদি ভূত আসে তাহলে তুই ধাওয়া করে তাড়িয়ে দিবি। পারবি না?

কুকরটা গররর আওয়াজ করে নিতকে জানিয়ে দিল সে পারবে। তাকে এখন পর্যন্ত কেউ কখনো আদর করে নি। কেউ যদি তাকে আদর করে সে তার জন্যে জীবন দিয়ে দেবে।

কুকুরটাকে পাওয়ার পর নিতুর সাহস একশ গুণ বেড়ে গেল। কিছুক্ষণের মাঝেই অন্ধকারে গুড়ি মেরে সে হেঁটে হেঁটে স্কুল সীমানার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। এদিক সেদিক তাকিয়ে সে ঝাপড়া গাছটার নিচে এসে দাঁড়ায়। আবছা অন্ধকারে ওপরে তার ভোটকা মিয়াকে দেখা যাচ্ছে, কী রকম অসহায়ভাবে সে ঝুলে আছে। নিতু ফিস ফিস করে বলল, ভয় নাই ভোটকা মিয়া, আমি এসে গেছি!

ঝাঁপড়া গাছটায় ওঠা খুব সহজ হল না, নিচে কয়েকটা ডাল ছিল বলে রক্ষা, হাঁচড়-পাচড় করে কোনোভাবে নিতু গাছে উঠে গেল, অন্ধকারে ডাল বেয়ে বেয়ে সে ভোটকা মিয়ার কাছে পৌঁছে যায়, ছোট একটা ডালে আটকে ছিল সাবধানে সেখান থেকে ছুটিয়ে নিয়ে এসে বুকে চেপে ধরে ফিসফিস করে বলল, আমার ভোটকা মিয়া! আমি খুব সরি যে তোকে এই রাত্রিবেলা অন্ধকারে গাছের উপর ফেলে রেখেছিলাম। তুই তো নিজেই দেখেছিস রাক্ষসী মহিলা কী ডেঞ্জারাস! তোকে যে লাথি মেরেছিল তুই ব্যথা পাস নি তো? আহারে আমার সোনামণি! আর কেউ তোর গায়ে হাত দিতে পারবে না। আর এখন গিয়ে আমরা ঘুমিয়ে যাই। ঐ দেখ নিচে আমার নূতন বন্ধু! কী সুন্দর দেখেছিস কুকুরটা? একটা নাম দিতে হবে কী নাম দেয়া যায় বল দেখি?

নিতু কখনো মনে মনে কখনো ফিসফিস করে ভোটকা মিয়ার সাথে কথা বলতে বলতে গাছ থেকে নেমে এল, নিচে কুকুরটা তার জন্যে অপেক্ষা করছিল, আবার তার শরীরের উপর সামনের দুই পা তুলে দিয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে নিতুকে চেটে দিল। নিতু আবার খিল খিল করে হেসে বলল, আহ্! কী যন্ত্রণা! আমাকে কি ললিপপ পেয়েছিস নাকি যে চেটে দিচ্ছিস? দেব একটা থাবড়া।

কুকুরটা অবিশ্যি থাবড়াকে ভয় পেল না, লেজ নাড়তে নাড়তে নিতুকে ঘিরে ঘুরতে লাগল, কখনো কারো কাছে আদর পায় নি, নিতুর আদর পেয়ে একেবারে গলে গিয়েছে। নিতু কুকুরটার গলা জড়িয়ে বলল, তুই এত চাটাচাটি করিস— তোর নাম হওয়া উচিত ললিপপ। ঠিক আছে? পছন্দ হয়েছে নামটা? ললিপপ?

কুকুরটা দুই পা তুলে কুঁই কুঁই শব্দ করে নূতন নামটা তার কত পছন্দ হয়েছে সেটা জানানোর চেষ্টা করল।

 

নিতু যখন তার ঘরে ফিরে এসেছে তখন রাত সাড়ে বারটা বাজে। মিতুল ভয় পেয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে একে একে সবাইকে ডেকে তুলেছে। সবাই দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল এবং যখন দেখল নিতু তার টেডি বিয়ারটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে একেবারে অক্ষত দেহে ফিরে আসছে তারা এত অবাক হল যে

বলার মতো নয়। সত্যি কথা বলতে কী যেটুকু অবাক হল খুশি হল তার চাইতে অনেক বেশি। নিতুকে জাপটে ধরে মিতুল বলল, তুই-তুই-তুই মানে তুমি—

আমি কী?

আমি শীওর ছিলাম কুকুরটা তোমাকে দেখে ফেলবে তারপর ধরে কাচা খেয়ে ফেবে। খোরাসানী ম্যাডামের বাঘের মতো একটা কুকুর আছে। কাউকে পেলে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে!

যা! নিতু হেসে বলল, কী সুইট কুকুরটা।

রেবেকা চাপা গলায় বলল, সুইট! তুই দেখেছিস কুকুরটাকে?

দেখব না কেন! কুকুরটাকে পেয়ে গেলাম বলেই তো বেশি ভয় পাই নাই। আমার সাথে ছিল সারাক্ষণ। নাম দিয়েছি ললিপপ।

ললিপপ! রুনু (কিংবা ঝুনু। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। তুই—মানে তুমি, মানে তুই নাম দিয়েছিস ললিপপ?

হ্যাঁ। কুকুরকে আমার যা ভালো লাগে!

ভালো লাগে? ঝুনু (কিংবা রুনু) চোখ কপালে তুলে বলল, তোর ভয় লাগে না?

নিতু আবার হেসে ফেলল, বলল, ধুর বোকা! কুকুরকে ভয় লাগবে কেন? ভয় লাগলে লাগতে পারে মানুষকে পশুপাখিকে কোনো ভয় নাই। কুকুর হচ্ছে ছোট বাচ্চার মতো। আদর করলেই বাধ্য হয়ে যায়।

তানিয়া মাথা নেড়ে বলল, তুমি বলছ যে সিংঘি তোমার বাধ্য হয়ে গেছে?

সিংঘি! নিতু অবাক হয়ে বলল, এত সুইট একটা কুকুরের নাম দিয়েছে সিংঘি? কী সর্বনাশ!

ঠিক এই সময়ে বারান্দায় খ্যাস খ্যাস করে সেন্ডেলের শব্দ হল এবং সাথে সাথে সবাই নিঃশব্দে নিজেদের বিছানায় ঢুকে গেল। সেন্ডেলের শব্দ তাদের ঘরের সামনে এসে থেমে যায় তারপর আবার ফিরে গেল, ঠিক কোন ঘর থেকে কথাবার্তা আসছে চিমশে যাওয়া তাড়ানো হোস্টেল সুপার মনে হয় ধরতে পারল না।

নিতু রাতে ভোটকা মিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল, ফিস ফিস করে বলল, বুঝলে ভোটকা মিয়া তোমার আর ভয় নাই! দিনের বেলা তোমাকে অবিশ্যি লুকিয়ে থাকতে হবে, কিন্তু সেটা আর কঠিন কী? তুমি চুপ করে লুকিয়ে থেকো—কোনো শব্দ করো না। এখন অনেক রাত হয়েছে ভোটকা মিয়া, ঘুমিয়ে যাও।

নিতু ঘুমানোর জন্যে চাদরটা গায়ে টেনে আনতে গিয়ে হঠাৎ আবিষ্কার করল তার কাপড়ের একটা অংশ ছেড়া। শুধু ছেড়া নয়, ছিঁড়ে আলাদা হয়ে গেছে। ভোটকা মিয়াকে উদ্ধার করতে যাওয়ার সময় কোনো এক জায়গায় ছিঁড়ে রয়ে গেছে। নিতুর বুকটা হঠাৎ ধ্বক করে উঠল।

ঠিক এই রকম সময়ে হোস্টেলের বুয়া রবোট মহিলা জমিলার মা তার বিছানায় বসে ঠক ঠক করে কাপতে কাপতে আয়াতুল কুরসি পড়ছিল। বাথরুমে যাওয়ার জন্যে ঘর থেকে বের হয়ে সে স্পষ্ট দেখেছে একটা পরী আকাশ থেকে নেমে দেওয়ালের কাছে আঁপড়া ছাতিম গাছটিতে এসে বসেছে। খিল খিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে গাছ থেকে নেমে আসছে। আর কী আশ্চর্য, সেই পরী যাদু করে খোরাসানী ম্যাডামের ভয়ংকর কুকুরটাকেও বশ করে ফেলেছে। যে কুকুরটা কাউকে পেলে কামড়ে টুকরো টুকরো করে ফেল্লার কথা সেটা সেই পরীর সাথে খেলছে! তাকে ঘিরে ঘিরে নাচছে।

জমিলার মা ভয়ে জ্ঞান প্রায় হারিয়ে ফেলছিল, তার মাঝে অনেক কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে ঘরের মাঝে ফিরে গিয়ে বিছানায় বসে রইল।

০৪. স্লীপ ওয়াকিং

ক্লাশ শুরু হওয়ার আগে এসেমব্লিতে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কী কারণ কারো জানা নেই এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে কয়েকবার হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে ব্যায়াম করতে হয়। ব্যায়াম শেষ করে সবাই এখন ক্লাশরুমে যাবে, ঠিক তখন খোরাসানী ম্যাডাম দুই পা এগিয়ে এসে হুংকার দিয়ে বলল, চামচিকার দল। ছারপোকার ডিম। ইঁদুরের বাচ্চারা

এটি নূতন কিছু নয়, খোরাসানী ম্যাডাম গালি না দিয়ে কথা বলে না, কাজেই এর পরে কী বলবে শোনার জন্যে সবাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ম্যাডাম নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, জমিলার মা বলেছে কাল রাতে ছাতিম গাছটাতে নাকি একটা পরী নেমেছিল। সে নিজের চোখে দেখেছে।

নিতুর বুকটা ধ্বক করে উঠে, হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ যেন লাফিয়ে গলার কাছে এসে ঢোল বাজানোর মতো শব্দ করতে থাকে। খোরাসানী ম্যাডাম জল্লাদের মতো সামনে দিয়ে একবার হেঁটে গিয়ে হঠাৎ চিৎকার করে বলল, জীন পরী এত জায়গা থাকতে বুতুরুন্নেসা স্কুলে হাজির হল কেন?

কেউ কোনো কথা বলল না।

সকাল বেলা আমি ছাতিম গাছটা দেখতে গিয়েছিলাম। পরী ভুল করে তার পাখা ফেলে গিয়েছে কী না দেখতে। খোরাসানী ম্যাডাম আরেকবার সামনে দিয়ে হেঁটে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, কী দেখেছি জানিস ছারপোকার দল, হুকওয়ার্মের ছাও?

নিতু এবং তার পাঁচ রুমমেট ছাড়া অন্য সবার মাঝে সূক্ষ্ম কৌতুহল জেগে উঠলেও কেউ কোনো কথা বলল না। খোরাসানী ম্যাডাম তার কেঁদো বাঘের মতো মুখটাকে আরো ভয়ংকর করে হাত উপরে তুলে মুঠিটা খুলে ফেলল, নিতু দেখল তার ঘুমের কাপড়ের ছেড়া অংশটুকু হঠাৎ করে তার মনে হল সে বুঝি হাঁটু ভেঙ্গে ধড়াস করে পড়ে যাবে। অনেক কষ্ট করে নিতু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, এইটা কার কাপড়ের টুকরা? এক্ষুনি বল, না হলে আমি তোদের সবাইকে এই খানে নীল ডাউন করিয়ে রেখে ঘরে ঘরে গিয়ে তোদের কাপড় চেক করে দেখব। এটা যার কাপড়ের টুকরা তাকে আমি–

খোরাসানী ম্যাডাম কথা শেষ না করে মুণ্ডু ছিঁড়ে নিয়ে ওপরে ছুঁড়ে দিয়ে মুখ হাঁ করে কোৎ করে গিলে ফেলার ভঙ্গি করল এবং ব্যাপারটি কারো কাছে এতটুকু অসম্ভব বলে মনে হল না।

নিতু ঘামতে শুরু করল, সত্যি সত্যি যদি ঘরে ঘরে গিয়ে কাপড় চেক করতে শুরু করা হয় তাহলে সে ধরা পড়ে যাবে। শুধু যে সে ধরা পড়বে তাই নয়, কাপড় খুঁজতে গিয়ে যখন ভোটকা মিয়াকে পেয়ে যাবে তখন কেন সে মাঝ রাতে ছাতিম গাছে উঠেছিল সেটা বুঝতে কারো বাকি থাকবে না। সে নিজে যদি এখন স্বীকার করে একটা গল্প ফেঁদে বসে–

কোন ইবলিশের বাচ্চা শয়তানের ছাও সাপের বংশ ছাতিম গাছে ওঠেছিলি?

কেউ কোনো কথা বলে না। নিতু দ্রুত চিন্তা করতে থাকে—ঠিক ঠিক সিদ্ধান্ত যদি না নেয় সে জন্মের মতো শেষ হয়ে যাবে।

খোরাসানী ম্যাডাম হঠাৎ আবার আকাশ ফাটিয়ে হুংকার দিল, কথা বল বিষ ফোড়ার পুঁজ, বাদুরের বমি–

নিতু তখন হঠাৎ হাত তুলে গলায় স্বর খুব স্বাভাবিক রেখে বলল, ম্যাডাম, কাপড়ের টুকরাটা কী একটু দেখতে পারি।

এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় একশ জন মেয়ে এবং ছয়জন ম্যাডাম আর একজন বুয়া এক সাথে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল। এসেমব্লিতে দাঁড়িয়ে মাথা ঘোরানো ঘোরতর বেআইনী কাজ জেনেও সব কয়টি মেয়ে মাথা ঘুরিয়ে নিতুকে দেখার চেষ্টা করল।

খোরাসানী ম্যাডামকে দেখে মনে হল তার মাথায় বুঝি বাজ পড়েছে, খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইল তারপর তোতলাতে তোতলাতে বলর, কী? কী বললি?

নিতুর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড ঢাকের মতো শব্দ করছে কিন্তু সে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে খুব স্বাভাবিক থাকার ভান করে শান্ত গলায় বলল, আমি কাপড়টা একটু কাছে থেকে দেখতে চাইছিলাম।

খোরাসানী ম্যাডাম নিতুর কথা শুনে এত অবাক হয়েছে যে রেগে উঠতেও ভুলে গেছে, আবার তোতলাতে তোতলাতে বলল, কে-কে-কেন?

আমার ঘুমের কাপড়টা অনেকটা এই রকম।

অনেকটা এইরকম?

জি ম্যাডাম?

খোরাসানী ম্যাডাম কাপড়ের টুকরাটা হাতে নিয়ে এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেল—এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। মুখটা ভয়ংকর করে বাঘের গর্জনের মতো হুংকার দিয়ে বলল, এইখানে আয়।

নিতু তখন কুলকুল করে ঘামছে, মনে হচ্ছে এক্ষুনি বুঝি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, কিন্তু প্রাণপণে নিজেকে শান্ত রেখে হেঁটে হেঁটে খোরাসানী ম্যাডামের কাছে এগিয়ে এল। খোরাসানী ম্যাডাম তার ঘুমের কাপড়ের ভেঁড়া টুকরাটা ওপরে ধরে রাখল যেন নিতুকে মাথা উঁচু করে দেখতে হয়। নিতু কাছে আসতেই কাক করে তার ঘাড় ধরে হ্যাচকা টানে উপরে তুলে নিয়ে কাপড়ের টুকরাটার সামনে তাকে ধরে রাখে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নিতু ছটফট করতে থাকে, যখন মনে হয় নিশ্বাস আটকে তার বুক ফেটে যাবে তখন খোরাসানী ম্যাডাম তাকে ওপর থেকে ছেড়ে দিল, সে নিচে পড়ে গিয়ে তাল সামলে কোনোমতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। খোরাসানী ম্যাডাম তখন তার কেঁদো বাঘের মতো মুখটা নিচে নামিয়ে এনে দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় জিজ্ঞেস করল, কাপড়টা কি চিনেছিস ঘেসে সাপ? চিনে জোক? মাকড়শীর ডিম?

জি ম্যাডাম। নিতু মুখের চেহারা স্বাভাবিক রেখে সবাই শুনতে পারে সে রকম ভাবে বলল, এইটা আমার জামার কাপড়ের টুকরা।

নিতর গলার স্বর শুনে সবাই এত অবাক হল যে আকাশ থেকে একটা বজ্রপাত হলেও বুঝি কেউ এত অবাক হত না। সবচেয়ে বেশি অবাক হল খোরাসানী ম্যাডাম নিজে, তার সামনে দাঁড়িয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে কেউ এইভাবে একটা কথা বলতে পারে খোরাসানী ম্যাডাম চিন্তাও করতে পারে না। খানিকক্ষণ মুখ হাঁ করে তাকিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, তোর জামার কাপড়ের টুকরা মাঝ রাতে ছাতিম গাছে কেমন করে গেল?

জানি না ম্যাডাম।

জানিস না?

না, ম্যাডাম।

খোরাসানী ম্যাডাম চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ নিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুই মাঝরাতে কেন ছাতিম গাছে উঠেছিলি জানিস না?

না ম্যাডাম। তবে—

খোরাসানী ম্যাডাম চোখ ছোট ছোট করে বলল, তবে?

তবে আমার শরীরে ব্যথা এবং পায়ে খামচির দাগ দেখে মনে হয়—

দেখে মনে হয়?

দেখে মনে হয় আমি নিশ্চয়ই উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়েছি। আর–

আর?

কুকুর বিড়াল কিছুএকটা আমাকে আঁচড়ে দিয়েছে।

খোরাসানী ম্যাডাম মুখ হাঁ করে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইল এবং তার সামনে প্রায় একশ মেয়ে বিস্ফোরিত চোখে এই নাটক দেখতে লাগল। খোরাসানী ম্যাডামের কেঁদো বাঘের মতো মুখটাকে কেমন জানি বিচিত্র দেখাতে থাকে। হঠাৎ করে তার ভয়ংকর কুকুর সিংঘির কথা মনে পড়েছে, যদি দশ বার বছরের একটা মেয়ে সেই ভয়ংকর কুকুরের আক্রমণকে কুকুর বিড়াল আঁচড়ে দিয়েছে বলে ব্যাখ্যা করে তবে সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ আছে।

নিতু মুখ শক্ত করে বলল, আমি শুনেছি আমি নাকি ঘুমের মাঝে স্লিপ ওয়াকিং করি। নিশ্চয়ই গত রাতে আমি স্লিপ ওয়াকিং করেছি।

খোরাসানী ম্যাডাম খানিকক্ষণ নিতুর মুখের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল, স্লিপ ওয়াকিং করার জন্যে এখনই এই মেয়েটার মুণ্ডু ছিঁড়ে ফেলবে নাকি ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখবে চিন্তা করে শেষ পর্যন্ত আরেকটু অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যা। লাইনে গিয়ে দাঁড়া। দেখি তুই কত বড় ধড়িবাজ। খালি মুণ্ডুটা ছিড়ব না কি পুরো শরীরটাকে কিমা বানিয়ে সিংঘিকে খেতে দিব একটু ভেবে দেখি।

নিতু বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে লাইনে নিজের জায়গায় দাঁড়াল। এ যাত্রা সে বেঁচে গিয়েছে, কিন্তু কতক্ষণের জন্যে বেঁচেছে কে জানে।

টিফিনের ছুটিতে লম্বা মতন একটা মেয়ে এসে নিতুর চুল টেনে ধরল, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, এই ছেমড়ি।

নিতু মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল, জোড়া ভুরু, কেঁকড়া চুল দুই গালে ফুস্কুরির মতো ব্রণ। নিতুর চুল টেনে মাথা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল, এই

ছেমড়ি, তুই গুল গপ্পা মারার জায়গা পাস না?

নিতু ঝটকা মেরে নিজের মাথা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আমাকে ছেমড়ি বলবে না।

তাহলে কী বলব?

আমার নাম নিতু।

মেয়েটা তার ছোট ছোট ধারালো দাঁত বের করে হেসে বলল, নিতু বড় কঠিন নাম, বলতে গিয়ে দাও ভেঙ্গে যায়। ছেমড়ি কলা খুব সোজা। এই দ্যাখ ছে-ম-ড়ি! কতসোজা! যেন খুব মজার ব্যাপার হয়েছে সে রকম ভান করে মেয়েটা দুলে দুলে হি-হি করে হাসতে শুরু করল।

নিতু কী করবে বুঝতে পারল না। সব ক্লাশে এ রকম একটা করে মেয়ে থাকে যার যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ট হয়ে যায়। আগে স্কুল থেকে বাসায় গেলে এদের যন্ত্রণা থেকে বাঁচা যেতো কিন্তু এখানে কী হবে? স্কুল থেকে যাবে হোস্টেলে সেখানে তো এই যন্ত্রণা আরো দশগুণ বেড়ে যাবে।

মেয়েটা নিতুর আরো কাছে এসে বলল, ভেবেছি তোর গুল পট্টি আমি বিশ্বাস করেছি?

কর নাই?

না। তোর মতো মিথুকদেরকে দেখলেই চেনা যায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তুই নিশ্চয়ই মহা বদমাইস সেই জন্যে তোকে টাইট করার জন্যে এখানে পাঠিয়েছে।

নিতু মাথা নাড়ল। বলল, ঠিকই বলেছিস। মেয়েটা একটু হকচকিয়ে গেল, বলল, কী বললি?

বলেছি যে তুই ঠিকই বলেছিস। আমি এত বড় বদমাইস যে আমার বাসায় কেউ আমাকে টাইট করতে পারে নাই।

মেয়েটা ছোট ছোট চোখে তাকাল, তুই কী করেছিলি?

তুই পত্রিকা পড়িস? ভোরের কাগজে বের হয়েছিল। জুলাই মাসের আঠার তারিখে। তৃতীয় পৃষ্ঠা।

কি বের হয়েছিল?

নিতু উদাস উদাস মুখ করে বলর, তোর যদি সখ থাকে তাহলে তুই নিজেই পড়ে নে। খরবটার হেড লাইন ছিল অমানুষিক!

অ-অমানুষিক?

হ্যাঁ। আমি সে রাতেও স্লিপ ওয়াকিং করতে বের হয়েছিলাম। তবে সেদিন খালি হাতে ছিলাম না। হাতে ছিল একটা কুড়াল।

কুড়াল?

হ্যাঁ। চাইনিজ কুড়াল। এইরকম ছোট। নিতু হাত দিয়ে দেখাল, তবে খুব খার।

মেয়েটার চোখে প্রথমে অবিশ্বাস তারপর বিস্ময় এবং শেষে আত ওঠল। শুকনো গলায় বলল, কী করেছিলি চাইনিজ কুড়াল দিয়ে?

নিতু ঠোঁট উল্টে তার একটা বই টেনে নিয়ে বলল, তোর জানার ইচ্ছা থাকলে তুই বের করে নে।

মেয়েটা কিছুক্ষণ নিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে পায়ে হেঁটে সরে গেল। নিতু চোখের কোনা দিয়ে দেখল পিছনে বসে আরো কয়েকজন মেয়ের সাথে। বসে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলছে সবার চোখে এক ধরনের ভয়। নিতু তার পাশে বসে থাকা মিতুলকে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটা কে?

কাসেম।

কাসেম? কাসেম তো ছেলেদের নাম।

হ্যাঁ। ওর ভাবভঙ্গি ছেলেদের মতো নামও ছেলেদের।

নিতু অবিশ্বাসের ভঙ্গি করে মিতুলের দিকে তাকাল, মিতুল মাথা নেড়ে বলল, সত্যি! কাসেমের বাবা নেই। যখন জন্ম হয়েছে মায়ের খুব ঝামেলা ছিল তাই খেয়াল করে দেখে নাই ছেলে না মেয়ে। ভেবেছে ছেলে হয়েছে তাই নাম রেখেছে কাসেম। পরে দেখেছে মেয়ে তখন আলসেমী করে নাম আর পাল্টায় নাই।

আশ্চর্য!

এরকম সময়ে হেঁটে হেঁটে রুনু আর ঝুনু হাজির হল। এদিক সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে ঝুনু বলল, নিতু! তোর কী সাংঘাতিক সাহস?

রুনু মাথা নেড়ে বলল, হা! কেমন করে তুই পারলি?

নিতু গলা নামিয়ে বলল, কী করব? ধরা পড়লে তো এমনিতেই খুন হয়ে যাব।

তা ঠিক।

এখন কী হবে?

নিতু আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় ঘণ্টা পড়ে গেল বলে বলতে পারল না, সবাই ক্লাশে ফিরে এল।

 

বুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে মেয়েরা নিজেদের মাঝে কথা বলার বিশেষ সুযোগ পায় না—তার মাঝেও খুব কষ্ট করে তারা খানিকটা সময় করে নিল, বিকালে ঘুমের পরে, রাত্রে খাবার টেবিলে, খাবার পরে এবং ঘুমানোর ঠিক আগে। নিতু যে মহাবিপদে পড়েছে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করা যায় কী না সেটা নিয়ে আলোচনা। তানিয়া খুব কম কথা বলে, সে মাথা নেড়ে বলল, একটা মাত্র উপায়।

রেবেকা চোখে চশমাটা চেপে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, কী উপায়?

যদি কোনোভাবে বিশ্বাস করানো যায় যে সত্যি সত্যি নিতু স্লিপ ওয়াকিং করে, সত্যি সত্যি ঘুমের মাঝে হাঁটে, তাহলে বিপদ কাটতে পারে।

সেটা কীভাবে করবি?

আবার নিতুকে ঘুমের মাঝে হাঁটতে হবে। সবাইকে দেখিয়ে।

নিতু বলল, এটা আর কঠিন কী? আমি তো হাঁটতেই পারি।

তানিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, কিন্তু সেটা সবার বিশ্বাস হতে হবে। বিশেষ করে হোস্টেল সুপার। আর খোরাসানী ম্যাডাম।

মিল বলল, সেটা কীভাবে করা যায়।

তানিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, এমন ভাবে স্লিপ ওয়াকিং করতে হবে যেটা খুব ভয়ংকর। যেটা কেউ করে না। যেটা দেখলেই সবাই বিশ্বাস করবে যে এইটা সত্যি।

নিতু বলল, ঠিক বলেছিস। কী করা যায়?

একটা ভয়ংকর ব্যাপার হতে পারে তুই যদি কার্নিশ ধরে হাঁটতে থাকিস আর আমরা হোস্টেল সুপারকে ডেকে আনি, তার সামনে তুই হাঁটবি।

রুনু একটু শিউরে উঠে বলল, সর্বনাশ! যদি পড়ে যায়?

পড়ে গেলে তো শেষ।

আরো ভয়ংকর করা যায়। যদি চোখ বন্ধ করে ছাদের রেলিংয়ের উপর দিয়ে হাঁটতে পারিস।

রেবেকা শিউরে উঠে বলল, সর্বনাশ! দৃশ্যটি চিন্তা করেই তার হাত যা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

পারবি তুই? পারব না কেন। একবার পারব।

তানিয়া হঠাৎ বলল, দাঁড়া, আমার মাথায়, আরেকটা বুদ্ধি এসেছে। যদি শিপ ওয়াকিং করে ভয়ংকর কিছু একটা করতেই চাস তাহলে সবচেয়ে ভয়ংকর কাজটা করলে কী হয়?

সবাই তানিয়ার দিকে ঘুরে তাকাল, সবচেয়ে ভয়ংকর?

হ্যাঁ।

কী সেটা?

তানিয়া এদিক সেদিক তাকিয়ে গলা নামিয়ে কাজটা কী বলতেই সবাই মুখে হাত দিয়ে আর্ত চিৎকার করে ওঠে। তানিয়া সরু চোখে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, পারবি?

নিতু বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে মুখ শক্ত করে বলল, পারব।

রুনু ঝুনু চিৎকার করে বলল, না! না নিতু না।

রেবেকা নিতুর হাত ধরে বলল, খবরদার নিতু, পাগলামো করিস না। এটা করতে যাস নে।

মিতুল ফ্যাকাসে হয়ে মাথা নাড়তে থাকে, বলে, না, না, কী সর্বনাশ!

নিতু শুধু মুখ শক্ত করে বলল, না। এটাই সবচেয়ে ভালো। তাহলে কেউ আর অবিশ্বাস করবে না।

 

গভীর রাত। সবাই ঘুমুচ্ছে, তার মাঝে নিতু এবং অন্য সবকয়টি মেয়ে বিছানা থেকে নেমে এল। নিতু তার টেবিলের উপর থেকে একটা পুরানো খবরের কাগজ নিয়ে সেটা পাকিয়ে একটা লাঠির মতো করে নিল, তারপর গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল, গেলাম।

সাবধানে থাকিস।

এর মাঝে আবার সাবধানে থাকব কী করে?

তাও ঠিক।

খুব সাবধানে দরজা খুলে নিতু বের হয়ে গেল। ওরা চুপ করে বসে থেকে খানিকক্ষণ সময় দেয়। নিতু গতকালকের মতো আজকেও কার্নিশ ধরে হেঁটে গিয়ে পাইপ বেয়ে নেমে যাবে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে পেল নিতু খোয়া বাঁধানো রাস্তাটার কাছে চলে এসেছে। খোরাসানী ম্যাডামের ভয়ংকর কুকুরটাও ছুটে এসে নিতুকে ঘিরে নাচানাচি করছে। এরকম ভয়ংকর কুকুরকে যে এভাবে বশ করে ফেলা সম্ভব নিজের চোখে না দেখলে ওরা কেউ বিশ্বাস করত না।

তানিয়া সবার দিকে তাকিয়ে বলল, রেডি?

অন্যেরা মাথা নাড়ল।

চল তাহলে।

পাঁচজন দড়াম করে যত জোরে সম্ভব দরজাটা খুলে ঘর থেকে ছুটে বের হল। তারপর সবাই দুদ্দাড় করে বারান্দা ধরে দৌড়াতে থাকে, মধ্যরাতে তাদের পায়ের শব্দ আর আধা আতংকিত কথাবার্তায় হঠাৎ হোস্টেলের অনেকে জেগে ওঠে জানালা দিয়ে উঁকি দেয়। রুনু ঝুনু তানিয়া মিতুল আর রেবেকা এই পাঁচজন হোস্টেল সুপারের দরজা ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করল, প্রায় সাথে সাথেই হোস্টেল সুপার দরজা খুলে বের হয়ে এল। মহিলা এমনিতেই শুকনো চিমশে এই মধ্যরাতে ঘুম থেকে ওঠার পর তাকে আরো শুকনো দেখাচ্ছে, ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলে, কী? কী হয়েছে?

মিতু বলল, সর্বনাশ।

হোস্টেল সুপার আরো ভয় পেয়ে বলল, কী সর্বনাশ?

আমাদের রুমে যে নতুন মেয়েটা এসেছে—

হ্যাঁ। কী হয়েছে তার? মরে গেছে?

না, মরে নাই।

তাহলে?

সে নাই।

না। রেবেকা চোখে মুখে আতংকের একটা ভাব ফুটিয়ে বলল, হঠাৎ করে বিছানা থেকে উঠে চোখ বন্ধ করে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে গেল।

হোস্টেল সুপার ভুরু কুচকে বলল, বের হয়ে গেল? কোথায় বের হয়ে গেল?

জানি না।

রুনু কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, দেখলাম রেলিং ধরে কার্নিশে নেমে গেছে।

কার্নিশ? হোস্টেল সুপার চিৎকার করে বলল, কার্নিশে?

হ্যাঁ।

সর্বনাশ! বলে প্রায় দৌড়ে হোস্টেল সুপার বারান্দায় রেলিংয়ের পাশে এসে দাঁড়াল। বাইরে দাঁড়িয়ে এবারে সবাই দেখতে পায়, অনেক দূরে ছায়ামূর্তির মতো নিতুকে দেখা যাচ্ছে, অন্ধকারে হাঁটছে, তাকে ঘিরে নাচানাচি করছে। ভয়ংকর দর্শন একটা কুকুর।

হোস্টেল সুপারের চোয়াল স্কুলে পড়ল। খানিকক্ষণ সেই দৃশ্যের দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার শরীর থর থর করে কাঁপতে থাকে। কোনোভাবে একটা টোক গিলে বলল, নিশ্চয়ই জীনের আছর হয়েছে।

তানিয়া মাথা নাড়ল, না ম্যাডাম। স্লিপ ওয়াকিং।

স্লিপ ওয়াকিং?

হ্যাঁ। ঘুমের মাঝে হাঁটা।

ঐ ঐ মেয়েটা ঘুমের মাঝে হাঁটছে? এখন ঘুমাচ্ছে?

জি ম্যাডাম। তানিয়া গম্ভীর গলায় বলল, যখন বারান্দায় হাঁটছিল তখন আমরা দেখেছি চোখ বন্ধ ছিল।

হোস্টেল সুপার খানিকটা জড় বুদ্ধি মানুষের মতো কাজেই সে নিজে থেকে কিছুই করতে পারছিল না, তানিয়া তাই তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করে, ম্যাডাম।

কী?

আমাদের কি খোরাসানী ম্যাডামকে খবর দেওয়া উচিত না?

হোস্টেল সুপারের শুকনো চিমশে থাকা মুখ ভয়ে আরো চিমশে হয়ে উঠল, মেয়েদের মতো অন্য সবাই খোরাসানী ম্যাডামকে ভয় পায়। শুকনো গলায় বলল, খোরাসানী ম্যাডামকে কেন?

নিতুকে তার ঘরে এনে ঘুম পাড়াতে হবে না?

তাহলে?

কুকুরটা যে সাথে আছে। অন্য কেউ কাছে গেলে যদি কামড়ে দেয়?

ও।

যদি কুকুরটা নিতুকে কামড়ে দেয়?

ও। হোস্টেল সুপারকে খুব বিভ্রান্ত দেখাল বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, তাহলে খোরাসানী ম্যাডামকে ডাকা উচিত?

রেবেকা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, ম্যাডাম। ভালোমন্দ যদি কিছু হয়—

কিন্তু কিন্তু–

কিন্তু কী?

আমার মনে হয় জীনের আছর। হোস্টেল সুপার ফ্যাকাশে মুখে বিড় বিড় করে সূরা পড়তে থাকে। তারপর শুকনো মুখে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, একা একা যাওয়া কী ঠিক হবে?

জমিলার মাকে ডেকে আনি?

সেইটা তো আর ভীতু।

তাহলে।

তো-তোরা গিয়ে ডাকতে পারবি না?

সর্বনাশ! ওরা ভয়ে দুই পা পিছিয়ে গেল। না ম্যাডাম। খোরাসানী ম্যাডামকে আমরা খুব ভয় পাই।

আ-আ-আমরাও কিছু একটা বলতে গিয়ে হোস্টেল সুপার থেমে গেল।

আপনারাও ভয় পান?

হোস্টেল সুপার কোনো কথা না বলে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

মাঝ রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা হোস্টেল সুপার এবং আরো কয়েকজনের কথাবার্তা শুনে ভয়ে ভয়ে আরো দু-একজন মেয়ে দরজা খুলে উঁকি দিল, তার মাঝে যাদের সাহস বেশি তারা কী হচ্ছে দেখার জন্যে বের হয়ে এল। সবাই বারান্দায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখে স্কুলের মাঠে গভীর রাতে একটি মেয়ে হাঁটছে, তাড়াতাড়ি হাঁটা নয়, খুব ধীরে ধীরে হাঁটা, অনেকটা যেন স্বপ্নের একটা দৃশ্য। তাকে ঘিরে একটা কুকুর নেচে কুদে বেড়াচ্ছে কিন্তু সেই মেয়েটার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।

হোস্টেল সুপার শেষ পর্যন্ত জমিলার মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। জমিলার মা এবং ঘুম থেকে জেগে ওঠা মেয়েগুলোকে নিয়ে একটা ছোট মিছিলের মতো সবাই খোরাসানী ম্যাডামের বাসার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। সবার হাতেই কোনো না কোনো ধরনের লাঠি সোটা হঠাৎ করে কুকুরটা যদি তাদের দিকে তেড়ে আসে সে জন্যে। সবার সামনে জমিলার মা, তার হাতে একটা ছয় ব্যাটারির টর্চ লাইট। কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে ছোট মিছিলটা খোরাসানী ম্যাডামের বাসার দিকে এগুতে থাকে। স্কুলের সীমানার একেবারে শেষ মাথায় তার ছোট একতালা বাসা। খোরাসানী ম্যাডাম একা সেই বাসায় থাকে, তার সাথে আর কেউ থাকতে পারে সেটা অবিশ্যি বিশ্বাস করার কথাও নয়।

ঘরের দরজায় কয়েকবার শব্দ করার পর ভেতর থেকে একটা হুংকার শোমা গেল, কে?

হোস্টেল সুপার চি চি করে বলল, আমি।

ভেতর থেকে খোরাসানী ম্যাডাম ধমক দিয়ে বলল, আমি কে?

হোস্টেল সুপার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, আমি হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্ট।

এত রাত্রে কী ব্যাপার? বলে খুট করে দরজা খুলে গেল এবং তাকে দেখে সবগুলো মেয়ে একটা আর্ত চিৎকার করে পিছনে সারে এল। খোরাসানী ম্যাডাম একটা হাফপ্যান্ট এবং তার উপরে একটা টী-সার্ট পরে আছে, চুলগুলো উশখু খুশকু চোখ লাল দেখে মনে হয় পাগলা গারদ থেকে কোনো একটা জন্তু ছুটে এসেছে।

খোরাসানী ম্যাডাম হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্টের সাথে এতগুলো মেয়েকে দেখে হকচকিয়ে গেল, তাদের সামনে এরকম পোশাকে চলে এসেছে বলে একটু অপ্রস্তুতও হল। কিন্তু খোরাসানী ম্যাডাম মেয়েদের মানুষ বলেই গণ্য করে না, কাজেই অপ্রস্তুত ভাবটা ঝেড়ে ফেলে গলা ফাটিয়ে ধমক দিয়ে বলল, কী হয়েছে?

হোস্টেল সুপার থতমত খেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, নতুন মেয়েটা কীভাবে কীভাবে জানি বের হয়ে গেছে।

বের হয়ে গেছে? হ্যাঁ, স্লিপ ওয়াকিং।

স্লিপ ওয়াকিং? খোরাসানী ম্যাডাম একটু গম্ভীর হয়ে গেল। সকাল বেলা এসেমব্লিতে স্লিপ ওয়াকিংয়ের কথা শোনার পর সে একটু খোঁজ খবর নিয়েছে। শহরের একজন ডাক্তার বলেছে এই বয়সের ছেলে মেয়েদের মাঝে এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ঘুমের মাঝে ওরা খুব বিচিত্র কাজ করে ফেলতে পারে। খোরাসানী ম্যাডাম অবিশ্যি ডাক্তারের সাথে পুরোপুরি একমত নয়—-তার ধারণা শক্ত পিটুনি দিয়ে এই ধরনের রোগ বালাই সারিয়ে তোলা সম্ভব। খোরাসানী ম্যাডাম একবার হোস্টেল সুপারের পিছনে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, এই চামচিকাগুলো এখানে কী করছে?।

হোস্টেল সুপার মিন মিন করে বলল, না মানে এত রাত তাই মানে ইয়ে–

খোরাসানী ম্যাডাম ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কোথায় আছে ঐ ধড়িবাজ আরশোলা? নেউলের বাচ্চা?

মাডামের কথা শেষ হবার আগেই দেখা গেল টুক টুক করে পা ফেলে। ঘুমের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে নিতু এই দিকেই এগিয়ে আসছে। সবাই হঠাৎ করে একেবারে চুপ করে এক পাশে সরে গেল, শুধু খোরাসানী ম্যাডাম দুই হাত কোমরে রেখে যুদ্ধের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।

সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে, তার মাঝে নিতু এগিয়ে আসছে। হাত দুটি সামনে তুলে ধরা, সেই হাতে লাঠির মতো কিছু একটা ধরে রেখেছে, আরো একটু কাছে এলে বোঝা গেল সেটা একটা খবরের কাগজ পাকিয়ে একটা লাঠির মলে করা হয়েছে। সবচেয়ে বিচিত্র হচ্ছে খোরাসীন ম্যাডামের কুকুরটা, সেটা লেজ নাড়তে নাড়তে এগিয়ে আসছে যেন খুব একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে।

খোরাসানী ম্যাডাম আরো একটু এগিয়ে গেল। কোমরে হাত দিয়ে মাথাটা আরো একটু নিচু করে নিয়ে আসে যেন নিতুর মুখটা ভালো করে দেখতে পারে। নিতু ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে আরো একটু এগিয়ে এল, সবাই দেখতে পেল তার দুই চোখ বন্ধ। সে ঘুমের মাঝে হাঁটছে। নিতু হেঁটে হেঁটে খোরাসানী ম্যাডামের একেবারে কাছে এসে দাঁড়াল, তারপর যে ব্যাপারটি ঘটল তার জন্যে কেউ প্রস্তুত ছিল না। নিতু খবরের কাগজ পাকিয়ে তৈরি করা খাটো লাঠিটা দিয়ে চটাশ করে গায়ের জোরে খোরাসানী ম্যাডামের গালে মেরে বসল। ঘটনাটা ঘটল এত হঠাৎ করে যে কেউ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। সবাই একটা চিৎকার করতে গিয়ে মুখে হাত দিয়ে থেমে যায়। নিতু তখন খবরের কাগজের পাকানো লাঠিটা হাতে নিয়ে খোরাসানী মাল্লামের অপর গালে মেরে বসল, এবারে আগের থেকেও জোরে। খোরাসানী ম্যাডাম কাক করে একটা শব্দ করে তাল হারিয়ে নিচে পড়ে যায়, তার চোখ বিস্ফোরিত সেখানে বিস্ময়, অবিশ্বাস এবং আতংক!

নিতু হঠাৎ করে ঘুরে গেল, তারপর যেভাবে এসেছিল ঠিক সেইভাবে চোখ বন্ধ করে দুই হাত সামনে তুলে হেঁটে যেতে শুরু করে যেন কিছুই হয় নি। খোরাসানী ম্যাডামের কয়েক মুহূর্ত লাগল ব্যাপারটা বুঝতে, যখন বুঝতে পারল কী ঘটেছে তখন হঠাৎ আঁ আঁ করে শব্দ করে ওঠে দাঁত কিড় মিড় করে নিতুর দিকে ছুটে যেতে থাকে। ভয়ে আতংকে সবাই চোখ বন্ধ করে ফেলল, এক্ষুনি শুনবে নিতুর আর্তনাদ এবং যখন চোখ খুলে তাকাবে দেখবে খোরাসানী ম্যাডাম টেনে নিতুর মাথা ছিঁড়ে আলাদা করে ফেলেছে, ফিনকি দিয়ে নিতুর কাঁটা মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছে সেই রক্তে খোরাসানী ম্যাড্রিম ভিজে চুপচুপে হয়ে আছে!

কিন্তু তার বদলে হঠাৎ সবাই শুনতে পেল কুকুরের গর্জন এবং তার পর হঠাৎ করে বিশাল কিছু যেন প্রচণ্ড শব্দ করে আছড়ে পড়ল। ভয়ে ভয়ে সবাই চোখ খুলে তাকাল এবং দেখল খোরাসানী ম্যাডাম মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, তার বুকের ওপর দুই পা তুলে কুকুরটা দাঁড়িয়ে আছে। সবগুলি দাঁত বের করে সেটা হিংস্র চোখে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে আছে, তার ভাবভঙ্গিতে কোনো লুকাছাপা নেই। একটু নড়লেই সে খোরাসানী ম্যাডামের টুটি ছিঁড়ে ফেলবে। নিতু তার নতুন মনিব তাকে সে যেভাবে পারবে সেভাবেই রক্ষা করবে।

খোরাসানী ম্যাডাম হতভম্ব হয়ে ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে শুয়ে রইল। সবাই দেখতে পেল এত হৈ চৈ গোলমালের মাঝেও নিতু এতটুকু বিচলিত না হয়ে সোজা হোস্টেলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

তানিয়া নিচু গলায় অন্যদেরকে বলল, চল, আমরা যাই।

চল।

মেয়েদের দল যখন নিতুর পিছু পিছু হোস্টেলে ফিরে যেতে শুরু করল তখন খোরাসানী ম্যাডাম চিঁ চিঁ করে বলল, এই কুত্তাটাকে কেউ সরাও না কেন?

হোস্টেল সুপার তোতলাতে তোতলাতে বললেন, আ-আ-আপনার কুকুর। আপনি বললেই সরে যাবে নিশ্চয়ই।

খোরাসানী ম্যাডাম মিন মিন করে বলল, এই সিংঘি, সর বলছি।

কুকুরটা সরে যাবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না বরং ধারালো দাঁত বের করে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে গর্জন করে এগিয়ে গেল, যতক্ষণ পর্যন্ত নিতু হোস্টেলে নিরাপদে ফিরে না যাচ্ছে সে তাকে নড়তে দেবে না!

নিতু ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে তার বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল, পিছু পিছু অন্য সবাই। কিছুক্ষণের মাঝেই সরা হোস্টেল নীরব হয়ে পড়ে। তবে, কেউ যদি অত্যন্ত কৌতুহলী হয়ে শোনার চেষ্টা করত তাহলে আবিষ্কার করত দোতালার মাঝামাঝি দুইশ বারো নম্বর ঘর থেকে ছয়টি মেয়ে প্রাণপণে তাদের হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করেও সুবিধে করতে পারছে না। একটু পরে পরে তাদের হাসির শব্দ বালিশ চাপা দেয়া সত্ত্বেও বের হয়ে আসছে।

 ০৫. কাসেম

মাস খানেক পরের কথা। নিতু শেষ পর্যন্ত নতুন স্কুলে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেছে। স্লিপ ওয়াকিংয়ের বিপদটা মনে হয় কেটে গেছে। যদিও খোরাসানী ম্যাডাম ব্যাপারটা গ্রহণ করতে পারে নি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস করেছে যে নিতুর কাজকর্ম পুরোটুকুই এক ধরনের স্লিপ ওয়াকিং। সে জন্যে তাকে এখনো বড় ধরনের শাস্তি দেয়া হয় নি, এই স্কুলে যখন এসেছে এখানে দীর্ঘদিন থাকবে, নিতুর মতো পুচকে মেয়েকে সিধে করে ছেড়ে দেওয়ার অনেক সুযোগ পাবে। সকলের সামনে খবরের কাগজ পাকিয়ে গালের মাঝে দুই ঘা বসিয়ে দেওয়ার অপমানটুকু সহ্য করতে হয়েছে এবং সেটা নিয়ে কিছু করতে পারছে না সেটাই খোরাসানী ম্যাডাম সহ্য করতে পারছে না। তবে কুকুরটাকে তার উপযুক্ত শাস্তি দেয়া হয়েছে, সেটি আর স্কুলে নেই। তাকে কী করা হয়েছে কেউ জানে না, স্কুলে জোর গুজব যে খোরাসানী ম্যাডাম নিজের হাতে কুকুরটা গলায় পাথর বেঁধে নদীতে ডুবিয়ে মেরেছে–খোরাসানী ম্যাডামের জন্যে সেটা মোটেও অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়।

নিতুর সাথে তার পাঁচ রুমমেটের বন্ধুত্ব আরো বেড়েছে, অন্যেরা মনে হয় তাকে একটু ভয়ই পায়। যে খোরাসানী ম্যাডামের গালে খবরের কাগজ পাকিয়ে সেটা দিয়ে মেরে বসতে পারে, হোক না সেটা ঘুমের মাঝে-তাকে একটু ভয় পাওয়া বিচিত্র কিছু নয়।

হোস্টেলে দুটি জিনিসের অবশ্যি খুব অবনতি হয়েছে, একটি হচ্ছে হোস্টেল সুপারের অত্যাচার অন্যটি কাসেমের চালবাজী। হোস্টেলের সব নিয়ম কানুন তৈরি করে রাখা আছে, কোন কাজ কতক্ষণ করা যাবে আগে থেকে ঠিক করা তার একটু উনিশ-বিশ হলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা। শুধু যে শাস্তি তাই নয়—নাম পাঠিয়ে দেয়া হয় খোরাসানী ম্যাডামের কাছে, তখন যা একটা অবস্থা হয় সেটা বলার মতো নয়। দিনে দিনে কাসেমের চালবাজীও অসহ্য হয়ে উঠেছে। কোনো একটা বিশেষ কারণে কাসেম নিতুকে একেবারে দুই চোখে দেখতে পারে না, সেটা নিতুকে জানাতেও কাসেম কখনো ভুলে না। ক্লাশে কিংবা হোস্টেলে তাকে জ্বালানোর খুব বেশি সুযোগ পায় না, কিন্তু বিকাল বেলা খেলার মাঠে খেলাধূলার নামে কাসেম একেবারে নিতুর বারটা বাজিয়ে ছেড়ে দেয়।

সেদিন ক্লাশ ছুটির পর সবাই হোস্টেলে ফিরে আসছে সিঁড়ির গোড়ায় কাসেম নিতুকে দেয়ালে চেপে ধরল, বলল, এই ছেমড়ি।

নিতু রাগ চেপে রেখে বলল, খবরদার আমাকে ছেমড়ি বলবে না।

তাই নাকি? কী বলব তাহলে? ছেমড়া? নাকি দামড়া?

আমার নাম নিতু।

তোর বাবা-মা তোর নাম রেখেছে নিতু। এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে তোর বাবা-মা আছে?

নিতু কোনো কথা বলল না, কাসেম তার ধারালো দাঁত বের করে হেসে বলল, নেই। এই খানে তোর বাবা মা হচ্ছি আমি। তাই আমি তোর নাম দিলাম দামড়া। আজ থেকে সবাই তোকে ডাকবে মিস দামড়া বেগম!

এই বলে সে হি হি করে হাসতে শুরু করল, যেন ভারি একটা মজার ব্যাপার হয়েছে। আশে পাশে যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল তাদের সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আজ থেকে তোরা সবাই একে ডাকবি দামড়া—না হয় তোদের ঠ্যাঙ ভেঙে ফেলব।

নিতুকে কেউ অবিশ্যি দামড়া ডাকে না, কাসেম যে কী জিনিস সেটা সবাই এতদিনে জেনে গেছে।

এর কয়দিন পর রাতে ঘুমানোর আগে বাথরুমে নিতু দাঁত ব্রাশ করছে তখন হঠাৎ করে কাসেম এসে হাজির হল। পিছন থেকে নিতুর চুল টেনে ধরে বলল, এই ছেমড়ি।

নিতু ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, কী হয়েছে?

সামনে ঈদ আসছে জানিস তো?

তাতে কী হয়েছে?

তুই তো নতুন এসেছিস তাই জানিস না। ঈদের আগে আমি সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলি।

চাঁদা?

হ্যাঁ।

একেকজনের এক এক রেট। তোর রেট হল পঞ্চাশ টাকা।

পঞ্চাশ টাকা?

হ্যাঁ। এক সপ্তাহের মাঝে তুই যদি পঞ্চাশ টাকা না দিস তাহলে তোর কপালে দুঃখ আছে।

আমি এত টাকা কোথায় পাব?

তোর বাবার কাছে চিঠি লিখে দে! তোদের ক্লাশে পাঠ্য আছে না, বাবার কাছে টাকা চাহিয়া পত্র লিখ—সেইটা এখন পরীক্ষা হয়ে যাবে, দেখা যাবে কত ভালো করে চিঠি লিখা শিখেছিস। কাসেম তার ধারালো দাঁত বের করে হি হি করে হাসতে শুরু করল।

ধীরে ধীরে নিতুর জীবন মোটামুটি অতিষ্ঠ হয়ে গেল। শুধু যে নিতুর জীবন সেটা সত্যি নয়, মোটামুটি সবার জীবনই, কাসেমের মতো একটা মেয়ে থাকলে মনে হয় জীবনের খুব বেশি কিছু বাকি থাকে না। শেষে এরকম অবস্থা হল যে মনে হতে থাকে কিছু একটা করা না হলে আর এই হোস্টেলে টিকে থাকা যাবে না।

সেদিন রাত্রে ঘুমানোর আগে মশারি টানাতে টানাতে কাসেমকে নিয়েই কথা বার্তা হচ্ছিল। রুনু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, এই দ্যাখ, কাসেম কী করেছে।

মিতুল এগিয়ে বলল, কী করেছে?

রুনু তার গালটা দেখালো, সেখানে খামচির দাগ। মিতুল জিজ্ঞেস করল, খামচি দিয়েছে

হ্যাঁ। বলে কী তোদের মাঝে কে রুনু কে ঝুনু বুঝতে পারি না। তাই তোর গালে খামচি দিয়ে দিলাম, যার গালে খামচির দাগ সে হচ্ছে রুন।

মিতুল মাথা নেড়ে বলল, ইশ!

নিতু বলল, এভাবে আর চলতে পারে না।

কী করবি?

কিছু একটা করতে হবে— নিতুর কথা শেষ হবার আগেই দরজায় শব্দ হল, এই হোস্টেলে দরজায় শব্দ হওয়া মানেই দুঃসংবাদ, নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে আর হোস্টেল সুপার এসেছে তার শাস্তি দিতে। রেবেকা ভয়ে ভয়ে দরজা খুলে দিতেই কাসেম এসে ঢুকল, রেবেকাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভিতরে ঢুকে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, তোরা আছিস তাহলে?

কেউ কোনো কথা বলল না। কাসেম তার ধারালো উঁত বের করে হাসার ভান করে বলল, আমার চাঁদার টাকা যোগাড় হয়েছে তো?

এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। কাসেম কয়েক পা এগিয়ে এসে নিতুর বুকে ধাক্কা দিয়ে প্রায় ফেলে দিয়ে বলল, চাঁদা আদায় করতে খুব কষ্ট হচ্ছে। মেয়েদের সন্ত্রাসী হওয়ার খুব ঝামেলা। বুঝলি? এতদিন চেষ্টা করেও একটা অস্ত্র জোগাড় করতে পারলাম না।

অস্ত্র? নিতু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, কী অস্ত্র?

কাঁটা রাইফেল, চাইনিজ কুড়াল যেটাই পাওয়া যায়।

কী করবি অস্ত্র দিয়ে?

অস্ত্র দিয়ে আবার কী করে? গাধা কোথাকার?

রেবেকা নিচু গলায় বলল, কাসেম। এখন তো ঘুমানোর সময়। হোস্টেল সুপার যদি জানতে পারেন তুই এখানে–

কাসেম রেবেকার মাথায় চাটি মেরে বলল, আমাকে কী বেকুব পেয়েছিস নাকি? হোস্টেল সুপার বাইরে গিয়েছে, আমি একজনকে গেটে পাহারা রেখে এসেছি। যখনি দেখবে আমাকে খবর দিয়ে যাবে।

রেবেকা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল ও।

তোদের মতো বুদ্ধি নিয়ে তো আমি থাকি না।

রেবেকা শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, তা ঠিক।

কাসেম তার মাথার কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, চাঁদা আদায় করতে ঝামেলা হচ্ছে। তাই ঠিক করেছি—

নিতু ভুরু কুচকে বলল, কী ঠিক করেছিস?

ঠিক করেছি তোকে সাব-কন্ট্রাক্ট দিব।

কী দিবি?

সাব-কন্ট্রাক্ট। কাসেম ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে, অর্থাৎ তুই আমার জন্যে চাঁদা তুলে দিবি। আমি দেখেছি তোকেও মেয়েরা একটু একটু ভয় পায়। তুই পারবি।

নিতু মাথা নাড়ল, আমি পারব না।

পারবি। তোকে পঞ্চাশ টাকা চাঁদা ধরেছিলাম, সেটা কমিয়ে তিরিশ করে ফেলেছি। কাসেম দাঁত বের করে হাসল যেন সে নিতুর জন্যে বিরাট একটা মহান কাজ করে ফেলেছে।

নিতু জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, তোর চাঁদাবাজী তোকেই করতে হবে। আর কেউ তোর হয়ে চাঁদাবাজী করে দেবে না।

কাসেম খানিকক্ষণ নিতুর দিকে তাকিয়ে মুখ শক্ত করে বলল, আর কেউ করুক আর নাই করুক, তুই করবি।

তুই কেন করবি জানিস? নিতু অবাক হয়ে বলল, কেন?

কারণ তুই যদি না করিস তাহলে আমি খোরাসানী ম্যাডামকে বলে দেব তুই হোস্টেলের ডাইনিং রুমের জানালা ভাংচুর করেছিস।

নিতু চোখ কপালে তুলে বলল, আমি মোটেও হোস্টেলের ডাইনিং রুমের জানালা ভাংচুর করি নাই।

সেটা নিয়ে তার মাথা ঘামাতে হবে না। আমিই ভাংচুর করে দিয়ে খোরাসানী ম্যাডামকে নালিশ দেব। ম্যাডাম কার কথা বিশ্বাস করবে বল দেখি —তোর না আমার?

নিতু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই দরজা খুলে ছোটখাট একটা মেয়ে ঢুকে বলল, কাসেম আপা-হোস্টেল সুপার এসে যাচ্ছে।

ঠিক আছে যাচ্ছি। কাসেম খোলা দরজা দিয়ে বের হতে হতে বলল, মনে থাকবে তো? এক সপ্তাহ সময়। ক্লাশ সেভেনের ওপরে দশ টাকা, নিচে পাঁচ টাকা। বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে হাত পা না ভেঙ্গে আস্ত থাকার ফি!

কাসেম হি হি করে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেল। নিতু ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা সবার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখলি? দেখলি ব্যাপারটা? কত বড় বদমাইস দেখলি?

তানিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মেয়ে জাতির অপমান। আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানিস?

ছেলের নাম থাকার কারণে কাসেম এরকম বদমাইস হয়ে যাচ্ছে।

রুনু তার গালে হাত বুলিয়ে বলল, কারণ কী জানি না কিন্তু বদমাইস যে বের হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।

নিতু আবার বলল, কিছু একটা করতেই হবে।

কী করবি?

আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। তোরা ভেবে দ্যাখ কাজ করবে কি না।

সবাই এগিয়ে আসে, কী বুদ্ধি? শুনি।

বুদ্ধিটা কাজে লাগানোর আগে অবিশ্যি কোনো একটা অস্ত্র লাগবে। একটা দা, কুড়াল বা কাঁটা রাইফেল।

রেবেকা শুকনো মুখে বলল, অস্ত্র পাব কোথায়?

তানিয়া বলল, আহ! বুদ্ধিটা কি শুনি না আগে।

দাঁড়া, আগে লাইট নিবিয়ে দিয়ে আসি, হোস্টেল সুপার টের পেলে বিপদ আছে।

 

তিনদিন পরের কথা। হোস্টেলটি দেখে মনে হবে সবাই বুঝি শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। সব ঘরের আলো নেবানো, শুধু বারান্দায় কয়টি আলো জ্বলছে। প্রকৃত ব্যাপারটি একেবারে অন্যরকম, দোতালার মাঝামাঝি ঘরটিতে ছয়টি মেয়ে এখনো জেগে আছে। কাসেমকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে যে নাটকটি করা হবে সেটি কয়েকবার রিহার্সাল দেওয়া হয়েছে, এখন সেটি অভিনয় করা হবে। নিচে ডাইনিং হলের রান্নাঘর থেকে একটা দা গোপনে সরিয়ে আনা হয়েছে কাজটি খুব সহজ হয় নি। সত্যি কথা বলতে কি দা যোগাড় করতে একটু সময় লেগে গেছে, না হয় আরো আগেই এই নাটক অভিনয় করা হতো। এই নাটকে অবিশ্যি কোনো দর্শক নেই, জেনে হোক না জেনে হোক সবাই অভিনেতা!

প্রথমে নিতু ঘর থেকে বের হয়ে সাবধানে পা টিপে টিপে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল, নাটকের ঠিক সময় সে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে উপর উঠে আসবে। এর কয়েক মিনিট পর তানিয়া আর রেবেকা গেল হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্টের ঘরে, রুনু-ঝুনু আর মিতুল দাঁড়াল কাসেমের ঘরের সামনে। ঠিক যখন হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্টের দরজায় শব্দ করা শুরু হল তখন রুনু ঝুনু আর মিতুলও উচ্চ স্বরে চেঁচামেচি করতে শুরু করল। প্রথমে মিতুল একটা আর্ত চিৎকার দিল–যে কারণেই হোক মিতুল খুব ভালো চিৎকার করতে পারে। তার চিৎকার শেষে। হতেই রুনু উত্তেজিত গলায় বলল, কোথায় গেছে? কোথায় গেছে?

ঝুনু বলল, এ দিকে ঐ দিকে–

মিতুল বলল, সর্বনাশ, এখন কী হবে?

রুনু ঝুনু একসাথে, ভয় করছে, আমার ভয় করছে—

মিতুল বলল, হোস্টেল সুপারের কাছে চল—

চেঁচামেচিতে কাজ হল, ঘরের ভেতর মেয়েগুলো জেগে উঠল, কাসেম গলা উঁচিয়ে বলল, কী হয়েছে রে?

মিতুল ভয় পাওয়া গলায় বলল, নিতুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? বলতে বলতে কাসেম দরজা খুলে বের হয়ে এল। রুনু ঝুনু আর মিতুল এক সাথে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়, তাদের নাটকের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যেখানে কাসেমের ঘরে দরজা খোলা থাকতে হবে। রুনু ঝুনু আর মিতুল খুব উত্তেজিত অবস্থায় চেঁচামেচি এবং চিৎকার করার ভঙ্গি করে ছোটাছুটি করার ভান করতে থাকে এবং দেখতে পায় তানিয়া আর রেবেকাও নাটকে তাদের অংশটা ঠিক ঠিক অভিনয় করে এসেছে, তারা উদ্বিগ্ন মুখে এই দিকে আসছে এবং তাদের পিছু পিছু রোগী কাঠির মতো চিমশে যাওয়া হোস্টেল সুপার লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে। কোনো একটি বিচিত্র কারণে গভীর রাতে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলে সবসময়েই তাকে আরো অনেক বেশি চিমশে দেখায়।

কিছুক্ষণের মাঝেই মাঝরাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠা পুরো দলটি কাসেমের দরজার সামনে একত্র হল এবং উত্তেজিত গলায় কথা বার্তা হতে লাগল। নাটকটি যেভাবে রিহার্সাল দেওয়া আছে, এখন পর্যন্ত ঠিক সেইবাবে অগ্রসর হচ্ছে। ঠিক এখন সিঁড়ি বেয়ে নিতুর ধীরে পায়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ওঠে আসার কথা এবং ঠিক ঠিক সিঁড়ি বেয়ে সে উপরে উঠে এল, দুই হাত দিয়ে সে কিছু একটা ধরে রেখেছে, জিনিসটা শরীরের পিছনে তাই সামনে থেকে দেখা যাচ্ছে না। যেভাবে রিহার্সাল করা হয়েছিল তার সাথে মিল রেখে মিতুল হাত দিয়ে নিতুকে দেখিয়ে একটা চিৎকার দেয়, সবাই সেদিকে তাকাতেই সে হঠাৎ করে মুখে হাত দিয়ে চিৎকার থামিয়ে দেয়। তানিয়া চাপা স্বরে বলল, খবরদার, কেউ শব্দ করবি না। দেখছিস না স্লিপ ওয়াকিং করছে? ঘুম ভেঙ্গে গেলে বিপদ হবে।

রুনু ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ঘুম ভেঙ্গে গেলে কী হয়?

তানিয়া গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ব্রেনে খুব প্রেসার পড়ে। পাগল টাগল হয়ে যায়।

ঝুনু বলল, ও।

ছোট দলটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে রইল এবং তাদের সবার সামনে দিয়ে নিতু খুব ধীর পায়ে হেঁটে যায়, আজকে তার চোখ খোলা কিন্তু সেই চোখ দিয়ে সে কিছু দেখছে না, দৃষ্টি বহুদূরে কোনো এক অজানা লক্ষ্যে স্থির হয়ে আছে। নিতু তাদেরকে অতিক্রম করা মাত্রই সবাই অবিশ্যি চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠে কারণ দুই হাত দিয়ে সে কী ধরে রেখেছে সবাই সেটা দেখতে পায়—সেটি হচ্ছে একটি দা, বারান্দার আলো প্রতিফলিত হয়ে সেটি চকচক করে ওঠে।

হোস্টেল সুপার কাঁপা গলায় বলল, দা নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?

জানি না রেবেকা কাঁপা গলায় বলল, আমার ভয় করছে। ভয় চিকেন পক্স থেকেও বেশি সংক্রামক, রেবেকার কথা শোনা মাত্র সমস্তু দলটির মাঝে ভয়ের একটা শিহরণ বয়ে গেল। সবাই ফ্যাকাসে মুখে নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে, মেঝেতে পা ঘষে ঘষে সে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল তখন সবাই আবার চাপা আর্তনাদ করে উঠল। নিতু খুব ধীরে ধীরে ঘুরে গিয়ে এবারে তাদের দিকে হেঁটে ফিরে আসতে থাকে। শরীরে সাদা একটা ঘুমের পোশাক, চুল উশখুশকো হয়ে ওড়ছে, চোখে ভয়ংকর একটা প্রাণহীন দৃষ্টি, দুই হাতে শক্ত করে রাখা ধারালো দা, ঘটনাটা সাজানো জেনেও তানিয়ার সারা শরীর শিউরে উঠল।

রেবেকা ফিস ফিস করে বলল, সর্বনাশ! আমাদের দিকে আসছে।

রুনু চাপা গলায় বলল, আমরা কী করব?

তানিয়া বলল, কেউ নড়বি না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। হঠাৎ করে নড়লে চমকে উঠে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে।

নিতু পা ঘষে ঘষে তাদের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। কাছাকাছি এসে হঠাৎ করে একটু ঘুরে সোজাসুজি কাসেমের দিকে তাকায়। হঠাৎ করে তার নাক ফুলে উঠে, মুখ অল্প হা হয়ে দাঁত বের হয়ে যায়, সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে, শরীর অল্প অল্প করে কাঁপতে থাকে, দেখে মনে হয় এই মুহূর্তে কিছু একটা ঘটে যাবে। মিতুল আর্ত চিৎকার করে বলল, সর্বনাশ! কাসেম – তোর দিকে যাচ্ছে নাকি?

কাসেম রক্তশূন্য মুখে নিতুর দিকে তাকিয়ে দুই পা পিছনে সরে এল, সাথে সাথে নিতুও কাসেমের দিকে আবার ঘুরে দাঁড়াল এবার কারো মনে এতটুকু সন্দেহ নেই যে নিতু কাসেমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঝুনু ভাঙ্গা গলায় বলল, এখন কী হবে?

দেখা গেল নিতু ধীরে ধীরে ধারালো দাটা উপরে তুলছে, আজকের নাটকের একটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ, একটু ভুল হলে রক্তারক্তি ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। কাসেম রক্তশূন্য মুখে দুই পা পিছিয়ে যায় নিতুও তার দিকে দুই পা এগিয়ে যায়।

সর্বনাশ! মিতুল আর্ত চিৎকার করে নিতুকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল, নিতু হাত দিয়ে ঝটকা দিতেই মিতুল ছিটকে গিয়ে পড়ল, হঠাৎ করে নিতুর শরীরে মনে হয় মত্ত হাতির জোর চলে এসেছে। মিতুল মেঝেতে পড়ে থেকে কো কো করে কেঁাকাতে থাকল তখন রুনু আর কুনু গিয়ে নিতুকে দুই পাশ থেকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করল, নিতু আবার একটা ঝটকা দিতেই দুজন ছিটকে দুই পাশে আছাড় খেয়ে পড়ল। নিতু তার ধারালো দা টি আরো উপরে তুলে নেয়, এখন একটা কোপ বসালে নির্ঘাত কাসেমের মাথায় পড়বে। কাসেম ভয়ে চিল্কার করে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যায়, মেঝেতে ঘষে ঘষে নিজেকে পিছনে টেনে নেয়, নিতু ও তখন আরো দুই পা এগিয়ে যায়, আর এক মুহূর্ত তারপরেই একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যাবে। ভয়ে আতংকে সবাই চুপ করে গেছে কোখাও কোনো শব্দ নেই। সবাই চোখ বন্ধ করে আছে, এভাবে কয়েকমুহুর্ত কেটে যায়, কাসেম সাবধানে চোখ খুলে তাকায় তখন, নিতু তখনো দা উপরে তুলে রেখেছে, সেইভাবে দাঁড়িয়ে থেকে খুব সহজ গলায় বলল, কাসেম।

কাসেমের কথা বলায় কোনো ক্ষমতা নেই, অস্পষ্ট একটা শব্দ করল মাত্র।

নিতু সাবধানে দাটা নিচে নামিয়ে বলল, কাসেম, আমি তোর জন্যে চাঁদা তুলতে পারব না।

ঘরে কোনো শব্দ নেই। হোস্টেল সুপার বিড় বিড় করে কী একটা সূরা পড়ছিল এবারে সেটা থামিয়ে এগিয়ে এল, বলল, কীঃ কী বলছেঃ

কেউ কোনো কথা বলল না। নিতু হাত দিয়ে চোখ কচলে ঘুম থেকে ওঠার ভঙ্গি করে বলল, কাসেম! তুই তোর চাঁদা নিজে তুলে নে–

হঠাৎ করে নিতু চারিদিকে ঘুরে তাকাল, মনে হল ঘুম থেকে পুরোপুরি জেগে উঠেছে। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে এখানে?

নিতু তাকিয়ে দেখে কাসেম তার পায়ের কাছে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে আছে, সে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, আমি কী একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। তুই যেন আমাকে বলছিস আমি চাঁদা না তুললে আমাকে মেরে ফেলবি, আমিও যেন–।

নিতু কথা বলতে বলতে চারিদিকে তাকায় তারপর কেমন জানি অপ্রস্তুত হয়ে যায়। হাতের দাটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, কী হচ্ছে এখানে।

মিতুল এগিয়ে এসে তার হাত থেকে দাটা নিয়ে বলল, তুই স্নিপ ওয়াকিং করছিলি।

স্লিপ ওয়াকিং?

হ্যাঁ।

নিতু মুখ কাচু মাচু করে বলল, আসলে ঐ চাঁদার ব্যাপারটা নিয়ে এত দুশ্চিন্তার মাঝে ছিলাম, সারাক্ষণ মাথায় মাঝে ঘুরছে। ঘুমালেও স্বপ্ন দেখি।

তানিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ, অবচেতন মনে থেকে যায় তো। সেই জন্যে।

হোস্টেল সুপার পুরো ব্যাপারটির মাঝে একটা রহস্যের গন্ধ পেল, এগিয়ে এসে তার চিমশে মুখটিকে আরো চিমশে করে ধমক দিয়ে বলল, এখানে কী হচ্ছে আমাকে কেউ বুঝিয়ে বলবে?

কাজেই পুরো ব্যাপারটা হোস্টেল সুপারকে বুঝিয়ে বলতে হল। নিতু ভান করল একেবারেই বলতে চাইছে না কিন্তু বাধ্য হয়ে বলছে। কাসেমের কীর্তিকলাপ অত্যাচার, চালবাজী কিছুই আর বাকি থাকল না। তার চাঁদা তোলার কথা, সে জন্যে নিতুকে সাব কন্ট্রাক্ট দেওয়া, ভয় দেখানো রুনুর গালে খামচি, সব কিছুই খুলে বলতে হল।

মধ্যরাতে সবাই যখন নিজের ঘরে ফিরে যাচ্ছে তখন নিতু কাসেমের কাছে গিয়ে গলা নিচু করে বলল, তোর কপাল খুব ভালো, ঠিক সময়ে ঘুম ভেঙ্গে গেছে। নাহলে যে কী হতো! নিতু ঘটনাটা চিন্তা করে শিউরে উঠে বলল, একেবারে ইত্তেফাকে খবর উঠে যেতো হেড লাইন হয়ে যেতো নৃসংস।

ইত্তেফাকে খবর ওঠার ভয়েই হোক আর হোস্টেল সুপার এবং খোরাসানী ম্যাডামের দলাই মলাইয়ের ভয়েই হোক কাসেম টুঁ শব্দটি করল না।

০৬. কিন্নর কণ্ঠ

মাসখানেক পরের কথা। রাত দশটা বেজে গিয়েছে বলে সবাই বিছানায় শুয়ে পড়েছে এবং শোওয়ার পর হঠাৎ করে মনে পড়েছে ঘরের আলো নেবানো হয় নি। রেবেকা বলল, কী হল, লাইট না নিবিয়ে শুয়ে পড়লি যে বড়।

রুনু বলল, যে সবার শেষে শুকে তার নেবানোর কথা।

ঝুনু বলল, আমি সবার আগে শুয়েছি।

রেবেকা বলল, আমিও সবার আগে শুয়েছি।

তাহলে সবার শেষে কে শুয়েছে?

নিতু তার ভোটকা মিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি।

রেবেকা বলল, তাহলে বাতি না নিৰিয়ে শুয়ে পড়লি যে?

যাচ্ছি বাবা যাচ্ছি। তোরা সবাই দেখি খোরাসানী ম্যাডাম হয়ে গেলি?

নিতু বিছানায় উঠে বসে তখন মিতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আগে আমি বিছানায় শুয়েই লাইট নেবাতে পারতাম।

কী ভাবে? বেড় সুইচ?

উঁহু। গান গেয়ে।

গান গেয়ে?

হ্যাঁ। মিতুল কয়েকমুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমার গলার স্বর খুব তেজী ছিল। ঠিকভাবে সুরে টান দিয়ে গ্লাস, বোতল, লাইট বাল্ব ভেঙ্গে ফেলতে পারতাম!

নিতু অবাক হয়ে মিতুলের দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, গুল মারছিস, তাই না?

না। গুল মারব কেন? একসিডেন্টে মারা যাবার আগে আমার বাবা মা দুজনেই বড় গায়ক গায়িকা ছিলেন। আমি এক বছর বয়স থেকে রেওয়াজ করতাম। বাবা বলতেন আমার গলা নাকি খুব ভালো ছিল— কথা শেষ করতে গিয়ে হঠাৎ মিতুলের গলা ধরে এল।

নিতু বিছানা থেকে নেমে বলল, এখন পারবি?

এখন?

হ্যাঁ, পারবি?

অনেকদিন তো চেষ্টা করি নি জানি না পারব কিনা?

দ্যাখ না চেষ্টা করে।

মিতুল মাথা নেড়ে বলল, চেষ্টা করি আর হোস্টেল সুপার এসে কান ধরে ঘর থেকে বের করে দিক।

নিতু বলল, দরজা জানালা তো সব বন্ধ, আর হোস্টেল সুপারের ঘর তো একেবারে অন্য মাথায়, এত দুরে শব্দ যাবে না। দেখ চেষ্টা করে।

ঠিক আছে। মিতুল বিছানায় উঠে বসে মুখটা উপর দিকে তুলে ধীরে ধীরে গলায় গানের সুরের মতো মধুর একটা ধ্বনি বের করে আনে। ধীরে ধীরে শব্দের ধ্বনি তীক্ষ্ণতর হতে শুরু করে এবং শব্দের তীব্রতাও বাড়তে থাকে। নিতু অবাক হয়ে একবার মিতুলের দিকে আরেকবার লাইট বাল্বের দিকে তাকায়। সত্যি সত্যি লাইট বাল্বটি থর থর করে কাঁপতে শুরু করেছে। মিতুল ঠিক কম্পনটি ধরে নেয়ার পর শব্দের তীক্ষ্ণতাকে সমান রেখে হঠাৎ তার তীব্রতা বাড়িয়ে দিল মনে হল, কেউ বুঝি মিতুলকে আঘাত করেছে আর সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠেছে—সাথে সাথে ফটাশ শব্দ করে লাইট বাল্বটা চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে সারা ঘরে ভাঙ্গা কাচের গুড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেল সাথে সাথে।

নিতু বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠেছিল কিন্তু ঠিক তখন শুনতে পেল হোস্টেলের অন্য মাথায় হোস্টেল সুপার তার দরজা খুলে লম্বা পা ফেলে হেঁটে আসছে। মিতুলের গলার আওয়াজটা শুনতে পেয়েছে মনে হল।

মেঝেতে খাস খ্যাস শব্দ করে পা ঘষে ঘষে হোস্টেল সুপার তাদের ঘরের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে বলল, কে চিৎকার করেছে?

ব্যাপারটা চেপে যাওয়া সম্ভব কি না মিতুল কিন্তু ভেবে দেখল, কিন্তু মনে হল। তাতে বিপদের ঝুঁঝি আরো বেশি। সে নিচু গলায় বলল, আমি ম্যাডাম।

কেন চিৎকার করেছিস?

মিতুল দ্রুত চিন্তা করতে থাকে, বিশ্বাসযোগ্য কোনো কিছু বলা যায় কি না। সেরকম কিছু ভেবে পেল না তখন নিতু তাকে উদ্ধার করল, বলল, ইঁদুর ম্যাডাম।

ইঁদুর! হোস্টেল সুপার বিকট আর্তনাদ করে বললে সর্বনাশ! কোথায়?

এই ঘরের ভিতরে ছিল, ফুটো দিয়ে বের হয়ে গেছে।

সর্বনাশ! হোস্টেল সুপার প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে নিজের ঘরের দিকে ছুটে যেতে থাকে। সব মানুষেরই মনে হয় যেরকম ভালবাসার একটা জিনিস থাকে সেরকম ভয়ের একটা জিনিস থাকে। হোস্টেল সুপারের ভালবাসার জিনিস কী কেউ জানে না। কিন্তু ভয়ের জিনিস হচ্ছে ইঁদুর সেটা তারা কিছুদিন হল আবিষ্কার করেছে।

হোস্টেল সুপারের পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর নিতু গলা নামিয়ে মিতুলকে বলল, তুই কেমন করে পারিস রে মিতুল?

তানিয়া বলল, আমি ম্যাগাজিনে পড়েছি যারা অপরায় গান গায় তারা পারে। আমাদের মিতুল অপেরা গায়িকাদের থেকেও ভালো।

হ্যাঁ। নিতু উৎসাহে বিছানা থেকে নেমে বলল, তোর গলাটা সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতে হবে।

মিতুল লজ্জা পেয়ে বলল, থাক, এখন খালি পায়ে বিছানা থেকে নামিস। পা কেটে যাবে।

তা ঠিক। নিতু আবার বিছানায় উঠে বসে বলল, তোর এত সুন্দর গলা তোকে তো গান গাইতে শিখতে হবে।

মিতুল কোনো কথা বলল না, হঠাৎ করে তার চোখে পানি এসে গেল। তার যে কী গান গাইতে ইচ্ছে করে, কিন্তু এখানে সে কি কখনো গান শিখতে পারবে?

 

পরদিন বিকেল বেলা স্কুল থেকে ফিরে এসে নিতু খুব একটা সাহসের কাজ করে ফেলল। যখন তার বিছানায় লম্বা হয়ে ঘুমানোর ভান করার কথা তখন সে হোস্টেল সুপারের সাথে দেখা করতে গেল। হোস্টেল সুপার একটা বঁটা নিয়ে তার ঘরে কী যেন করছিল নিতুকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল, বলল, তুই? তুই কী করছিস এখানে? নিতু—৪

ম্যাডাম— নিতু যতটুকু সম্ভব মুখ কাচু মাচু করে বলল, আপনাকে একটা জিনিস বলতে এসেছিলাম।

হোস্টেল সুপার ঝাঁটা দিয়ে ঘরের ভিতর কী একটা জিনিসকে পিটাতে পিটাতে খ্যাকিয়ে উঠে বলল কী জিনিস?

নিতু মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমাদের মাঝে একজন আছে যে খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।

হোস্টেল সুপার যে জিনিসটাকে ঝাঁটা পেটা করছিল সেটাকে লাথি দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে বলল, কী বললি?

নিতু দেখল জিনিসটা একটা ছোট নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা একেবারে আধ আঙুল লম্বা ঝাঁটা পেটা খেয়ে মরে থেঁতলে গেছে। হোস্টেল সুপার ঝাঁটা হাতে আরো কি যেন খুঁজতে খুঁজতে আবার বলল, কী বললি তুই?

বললাম, যে আমাদের মাঝে একজন আছে সে খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।

হোস্টেল সুপার ঝাঁটা হাতে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটু অবাক হয়ে বলল, গান? গান গাইতে পারে?

জি ম্যাডাম। খুব সুন্দর গান গাইতে পারে।

তাহলে?

আমি বলছিলাম কী—

কী বলছিলি?

সে যদি গান গাওয়া শিখতে পারে তাহলে খুব বড় গায়িকা হবে।

হোস্টেল সুপার মুখ বাঁকা করে বলল, তাই নাকি?

জি ম্যাডাম। গলাটা খুব সুন্দর আর তেজী।

তেজী? বলেই হঠাৎ হোস্টেল সুপার কেমন যেন ক্ষেপে গেল, ঝাঁটা দিয়ে দমাদম করে কী একটা মারার চেষ্টা করতে লাগল, তার মুখ বিকৃত হয়ে যায় চোখগুলি ঠেলে বের হয়ে আসতে চায়, ঘরের মাঝে সে ছোটছুটি করে লাফাতে থাকে, দেখে মনে হয় হঠাৎ করে যেন পাগল হয়ে গেছে। নিতু মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করল, মনে হল একটা নেংটি ইঁদুরকে মারছে। ইঁদুরটা নিশ্চয়ই মরে ভূত হয়ে গেছে কিন্তু তবু হোস্টেল সুপারের রাগ যায় না। ঝাঁটা দিয়ে মারতে মারতে ঘরের বাইরে এনে দমাদম পিটাতে থাকে, ছোট নেংটি ইঁদুরের নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে থেঁতলে একটা বিচ্ছিরি অবস্থা হয়ে গেল।

নিতু হোস্টেল সুপারের খেপে যাওয়া ভাবটুকু কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, তাই ম্যাডাম, আমি বলছিলাম কী–

হোস্টেল সুপার ঝাঁটা হাতে নিয়ে চোখ লাল করে বলল, কী বলছিলি?

বলছিলাম, তাকে কী গানের মাস্টার দিয়ে গান শেখানো যাবে?

হোস্টেল সুপার এমনভাবে নিতুর দিকে তাকাল যেন নিতুর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, গানের মাস্টার দিয়ে?

নিতু খুব আশা নিয়ে বলল, জি ম্যাডাম।

মেয়েটা কে?

আমাদের রুমে থাকে। নাম মিতুল।

মিতুল?

জি ম্যাডাম।

নিতু আশা নিয়ে হোস্টেল সুপারের দিকে তাকিয়ে রইল। হোস্টেল সুপার ঠাণ্ডা চোখে বলল, খা ঘরে যা।

গানের মাস্টার–

হোস্টেল সুপার চিলের মতো চিৎকার করে বলল, ঘরে যা বলছি।

নিতু নিশ্বাস ফেলে নিজের ঘরের দিকে ফিরে আসতে শুরু করতেই হঠাৎ মেঝেতে চোখ পড়ল, দেওয়াল ঘেষে একটা ছোট্ট ইঁদুরের বাচ্চা পড়ে আছে। বাচ্চাটা মরে নি, আঁকুপাঁকু করছে। নিতু নিচু হয়ে ইঁদুরের বাচ্চাটা তুলে নিল, এত ছোট বাচ্চা যে এখনো চোখ ফোটে নি। হাতের তালুতে রেখে সে বাচ্চাটার পিঠে সাবধানে হাত বুলিয়ে দিতেই শুনতে পেল হোস্টেল সুপার ঘরের ভিতরে আবার খেপে উঁদুরকে আঁটা পেটা করতে করতে চিৎকার করছে, স্মার! মার! মেরে শেষ করে দে ইঁদুরে চৌদ্দগুষ্ঠি। খবিস গিদ্ধর ময়লার ঝাড়। মার! মার হারামির বাচ্চা হারামিকে!

ঝাঁটা দিয়ে মারতে মারতে হোস্টেল সুপার চিৎকার করতে করতে লাফাতে থাকে। ইঁদুরের উপরে এত খ্যাপা কোনো মানুষ নিতু এর আগে কখনো দেখে নি। নিতুর হাতের তালুতে এই ছোট ইঁদুরের বাচ্চাটা দেখতে পেলে হোস্টেল সুপার কী করবে কে জানে! নিতু হাত মুঠি করে ইঁদুরের বাচ্চাটাকে লুকিয়ে নিজের ঘরে নিয়ে এল। অন্য সবাই খুব দুশ্চিন্তা নিয়ে নিতুর জন্যে অপেক্ষা করছিল, তাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রেবেকা বলল, কোথায় ছিলি তুই?

হোস্টেল সুপারের কাছে গিয়েছিলাম একটা কাজে।

কী কাজে।

আছে একটা কাজ।

নিতু তার হাত তুলে নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটা টেবিলের উপর রাখতেই সেটি আঁকুপাঁকু করে হাটতে থাকে, মনে হয় তার মাকে খুঁজছে। বেচারা জানে পর্যন্ত না যে হোস্টেল সুপার মেরে তার মাকে থ্যাতলা করে ফেলেছে। নিতু বাচ্চাটার পিঠে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে দিল, বাচ্চাটী তখন গুটিশুটি মেরের কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে গেল।

রেবেকা অবাক হয়ে বলল,ওমা! ওটা কী?

ইঁদুরের বাচ্চা!

ইশ! কী সুইট! দেখেছিস?

তানিয়া তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে চাপা গলায় বলল, তোরা কী করছিস? তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। ম্যাডামরা আসছে শুনতে পাচ্ছিস না?

নিতু তাড়াতাড়ি তার ইঁদুরের বাচ্চাটা হাতে নিয়ে কোথায় লুকাবে বুঝতে না পেরে তার জুতোর ভেতরে রেখে দিল। তারপর তার বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল।

কিছুক্ষণের মাঝেই এক জোড়া পায়ের শব্দ শুনতে পায়, একটা গুম গুম করে, যেটা নিশ্চিতভাবে খোরাসানী ম্যাডামের অন্যটা খ্যাস খ্যাস করে যেটা হচ্ছে হোস্টেল সুপারের। দুজনের পায়ের শব্দ তাদের ঘরের সামনে এসে থেমে যায়, নিতু শুনতে পেল হোস্টেল সুপার বলছে, এই রুম।

দড়াম করে তাদের ঘরের দরজা খুলে গেল এবং নিতু চোখ বন্ধ করেই টের পেল দুইজন হেঁটে হেঁটে তাদের ঘরের মাঝামাঝি এসে হাজির হয়েছে। নিতু শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম মেঘের মতো গর্জন করে বলল, কোন বদমাইসটা?

হোস্টেল সুপার ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, এইটা।

নিতু চোখের ফাঁক দিয়ে দেখার আগেই হঠাৎ করে মনে হল একটা দানব তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং চুলের মুঠি ধরে হ্যাচকা টানে তাকে একেবারে বিছানা থেকে তুলে এনে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে মেঝেতে দাঁড়া করিয়ে দিয়েছে। খোরাসানী ম্যাডাম নিতুর চুল ধরে এত জোরে হ্যাচকা টান দিয়ে মাথাটা সোজা করল যে সে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। নিতু দেখতে পেল খোরাসানী ম্যাডামের বাঘের মতো মাথাটা নিচে নেমে এসেছে, লাল ভাটার মতো চোখ দুটি তার দিকে তাকিয়ে আছে, কোনটা গায়িকা?

গা-গা-গায়িকা?

হ্যাঁ খোরাসানী ম্যাডাম চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, যার গলার সুর শুনে তোর দিল ফানা ফানা হয়ে গেছে?

নিতু কী বলবে বুঝতে পারল না। হোস্টেল সুপার তার চিমশে মুখে বিদঘুটে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, ঐটার নাম হচ্ছে মিতুল।

মিতুল? খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিল, কোন বদমাইসটা মিতুল?

মিতুল ফ্যাকাসে মুখে তার বিছানায় উঠে বসল, বলল, আমি।

তার কথা শেষ হবার আগেই খোরাসানী ম্যাডাম মিতুলের চুল ধরে একটা হ্যাচকা টান দিয়ে বিছানা থেকে মেঝেতে নামিয়ে আনে। তারপর মাথা নামিয়ে এনে মিতুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুই তাহলে সেই গায়িকা যার গলার স্বর সাইরেনের মতো?

মিতুল কোনো কথা বলল না, নিতু দেখল তার চোখে পানি এসে গেছে, যন্ত্রণায় না অপমানে ঠিক বলতে পারল না।

খোরাসানী ম্যাডাম নিতুর গলা চেপে এক টান দিয়ে শূন্যে তুলে নিয়ে বলল, মামদোবাজীর আর জায়গা পাস না? স্কুলের মাঝে গান বাজনা? গলার মাঝে সুর? ছারপোকার ডিম, ইঁদুরের বাচ্চা, টিকটিকির লেজ কোথাকার? তোর গলা দিয়ে গান গাওয়া আমি বের করছি। টেনে আমি জিরাফের গলার মতো লম্বা করে ফেলব। গিটটু দিয়ে ছেড়ে দেব দেখি গলা দিয়ে আওয়াজ কীভাবে বের হয়। আমার সাথে মামদোবাজী? তোর গলা আমি ছিঁড়ে ফেলব আজকে।

মিতুলের গলা চেপে শন্যে ঝুলিয়ে রাখার জন্যে সে নিশ্বাস নিতে পারছিল, প্রাণপণে হাত পা ছুড়ে কোনোভাবে নিজেকে ছাড়াতে না পেরে যখন হাল ছেড়েদিল তখন খোরাসানী ম্যাডাম তাকে নিচে ছুড়ে ফেলে দেয়। মিতুল দেওয়াল ধরে বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে অতিংকিত চোখে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে থাকে।

খোরাসানী ম্যাডাম এবারে নিতুর দিকে তাকাল, নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, আর আমাদের সংগীত বিশেষজ্ঞ কী বলে? গায়িকার জন্যে ভালবাসায় যার বুক ফেটে যাচ্ছে, দিল ফানা ফানা হয়ে যাচ্ছে? খোরাসানী ম্যাডাম এসে খপ করে দুই হাত দিয়ে নিতুর দুইটা কান ধরে ফেলে। বলল, এত সুন্দর গান তুই কী দিয়ে শুনেছিস? এই কান দিয়ে? কান দুইটা কী যথেষ্ট বড়? ঠিকমতো শুনতে পেয়েছিস চামচিকার বাচ্চা? মনে হয় শুনতে পাস নি। কান দুইটা টেনে আরেকটু বড় করে দিতে হবে তাহলে শুনতে পাবি। আরো ভালো করে শুনতে পাবি। এই বলে খোরাসানী ম্যাডুমি হ্যাচকা টান দিয়ে নিতুর দুই কান ধরে তাকে শূন্যে ঝুলিয়ে ফেলল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় নিতু চিৎকার করে উঠে কিন্তু খোরাসানী ম্যাডাম তাতে ক্ষেপ করে না, নিতুকে দুই কানে ধরে ঝুলিয়ে রাখে। যখন নিতুর মনে হল তার দুই কান ছিঁড়ে আলাদা হয়ে যাবে তখন খোরাসানী ম্যাডাম তাকে ময়লা জঞ্জালের মতো নিচে ফেলে দিল। মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়তে পড়তে নিতু দেখল তাদের হোস্টেল সুপার পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে, এত মজার দৃশ্য মনে হয় সে আগে কখনো দেখে নি।।

নিতু আর মিতুল ভাবল তাদের শাস্তি বুঝি শেষ হয়েছে কিন্তু দেখা গেল সেটা শেষ হয় নি। খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, সবাই ঘুম থেকে ওঠ।

ঘরে অন্য চারজন দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল, এবার তারা ফ্যাকাশে মুখে বিছানায় উঠে বসল।

খোরাসানী ম্যাডাম বলল, সবাই জুতা মোজা পর। পরে বাইরে আয়।

জুতো পরতে গিয়ে নিতুর মনে পড়ল সে তার জুতোর মাঝে চোখ না ফোটা ছোট নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটাকে রেখেছে। সে এখন জুতো পরবে কেমন করে? সে সাবধানে লুকিয়ে ভেতর থেকে ইঁদুরের বাচ্চাটাকে বের করার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, কোনো একটা বিচিত্র কারণে খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপরি দুজনেই তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে। নিতু কোনো উপায় না দেখে পা দিয়ে উঁদুরের বাচ্চাটাকে জুতোর সামনে ঠেলে দিয়ে জুতো পরে নিল। নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটা এত ছোট যে জুতোর সামনে ফাঁকা জায়গাটাতে বেশ আরামেই থাকতে পারবে, তবু নিতু পায়ের আঙুলগুলো ভাজ করে রাখল যেন তার কোনো অসুবিধে না হয়।

ছয়জন জুতো মোজা ঘরে রেডি হওয়ার পর খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিল, কুইক মার্চ।

সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আসে, নিতু আর মিতুল বের হল সবার শেষে কারণ খোরাসানী ম্যাডাম তাদের দুইজনের ঘাড় ধরে আলাদাভাবে টেনে টেনে বের করে আনল। তাদের কপালে আরো কিছু দুঃখ কষ্ট এবং অপমান রয়েছে এবং সেটা হবে মাঠে, সব মেয়েদের সামনে।

হোস্টেল থেকে মেয়েরা বের হয়ে মাঠে ইতস্ততঃ হাঁটাহাটি করছিল, খোরাসানী ম্যাডামকে এক হাতে নিতু অন্য হাতে মিতুলকে ধরে আনতে দেখে সবাই কেমন জানি ঠাণ্ডা মেরে গেল। খোরাসানী ম্যাডাম নিতু এবং মিতুলকে নিয়ে হোস্টেলের বারান্দায় দাঁড়াল এবং মাঠে দাঁড়ানো সব মেয়ে ভয়ার্ত মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল। তাদের পিছনে হোস্টেল সুপার তার চিমশে মুখে আধা আধা একটা হাসি মাখিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে মনে হতে থাকে সে যেন খুব মজার একটি দৃশ্য দেখছে।

খোরাসানী ম্যাডাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা হুংকার দিল। এটেনশান।

মাঠের সবগুলি মেয়ে পা ঠুকে এটেনশান হয়ে দাঁড়াল। খোরাসানী ম্যাডাম গলা পরিষ্কার করে বলল, ইঁদুরের বাচ্চারা, এই যে দ্যাখছিস দুটি বদমাইস এদের একজন নাকি গায়িকা— এই পর্যন্ত বলে খোরাসানী ম্যাডাম মিতুলের ঘাড় ধরে হ্যাচকা টান দিয়ে শূন্যে ঝুলিয়ে ফেলল। মিতুল সেভাবে হাত পা ছুঁড়তে থাকে তখন তাকে নামিয়ে এনে নিতুকে হ্যাচকা টান দিয়ে উপরে তুলে আনে।

অরি এটা হচ্ছে সেই গায়িকার সমঝদার। গান শুনে তার দিল ফানা ফানা হয়ে গেছে। শূন্যে ঝুলে থেকে নিতু তার হাত পা ছুঁড়তে থাকে তখন খোরাসানী ম্যাডাম তাকে নিচে নামিয়ে আনে। পুরো ব্যাপারটা দেখে হোস্টেল সুপার খিক খিক করে হাসতে থাকে, যেন সে টেলিভিশনে হাসির নাটক দেখছে।

খোরাসানী ম্যাডাম নিতু আর মিতুলের চুল ধরে দুজনের মাথা কাছাকাছি নিয়ে এসে নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, এখন এই দুইজন তোদের গান গেয়ে শোনাবে। যে গায়িকা সে গান গাবে, অন্যজন তাল ঠুকবে। খোরাসানী ম্যাডাম এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, রেডি-ওয়ান-টু-থ্রী কথা শেষ করেই সে দুজনের মাথা প্রচণ্ড জোরে ঠুকে দিল। নিতু অর মিতুল দুজনেই আর্ত চিৎকার করে উঠে, তাদের মনে হয় বুঝি মাথা ফেটে মগজ বের হয়ে এসেছে। দুজনেরই চোখ অন্ধকার হয়ে আসে এবং চোখের সামনে বিচিত্র রং, খেলা করতে থাকে—এটাকেই নিশ্চয়ই চোখে সর্ষে ফুল দেখা বলে!

খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিল, শুরু কর ছাগলের বাচ্চারা।

মিতুল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে নেয়। তারপর সামনে মাঠের দিকে তাকাল, সেখানে প্রায় শখানেক মেয়ে চুপ করে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল নিতুর দিকে তাকাল, নিতুল চোখ নামিয়ে নিল সাথে সাথে। মিতুল তখন উপরের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে সে চমকে উঠল। খোরাসানী ম্যাডাম যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার উপরে দোতলার জানালা, জানালা দুটি খোলা জানালার কাচ যদি কোনোভাবে ভেঙ্গে যায় সেই কাচ এসে পড়বে খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপারের মাথায়। গলায় সুর এনে মিল কাচের গ্লাস ভেঙ্গেছে, লাইট বা ভেঙ্গেছে, কখনো জানালার কাচ ভাঙ্গে নি। কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই। আজ সে চেষ্টা করে দেখবে।

খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, শুরু কর মাকড়সার ডিম, গর্ধবের লেজ।

মিতুল শুরু করল। প্রথমে হালকাভাবে সে গলায় একটা সুরের ঝংকার তুলল, তার সমস্ত মনপ্রাণ ঢেলে দিল সেখানে। তার মিষ্টি গলার সুরে চারিদিক হঠাৎ যেন মায়াময় হয়ে উঠে, মনে হয় স্বর্গ থেকে বুঝি কোনো কিন্নরী এসে গান গাইছে। মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা শখানেক মেয়ে হতবাক হয়ে মিতুলের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারা বিশ্বাস করতে পারে না, এটা কী মানুষের গলার সুর না কী স্বপ্ন!

মিতুল তার গলার স্বর উঁচু করতে থাকে সাথে সাথে সে কাপন নিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করে দেয়। সে দেখতে চায় ঠিক কোন্ কম্পনে জানালার কাচ কাঁপিয়ে তুলতে পারবে। যে রকম অনুমান করেছিল ঠিক সে রকম নিচু একটা কাপনে জানালার কাচ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। মিতুল একটি হাত তার কানের উপর নিয়ে এসে চোখ বন্ধ করে গলার স্বর উঁচু করতে থাকে, মনে হয় আকাশে বাতাসে বুঝি তার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে আরো উঁচু করে তার গলার স্বর, সমস্ত স্কুল প্রাঙ্গন গম গম করে উঠে তার ভরাই গলার সুরে। আরো উঁচু করে তার কণ্ঠস্বর। তারপর আরো উঁচু, মিতুলের সমস্ত মুখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে, মনে হয় নিশ্বাস আটকে সে বুঝি এই মুহূর্তে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে যাবে, তবু সে নিরস্ত হয় না।

নিতু আরো উঁচু করে আনে তার গলার স্বর, মনে হয় তার গলা থেকে বুঝি ঝলক দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসবে এক্ষুনি। সমস্ত প্রাঙ্গণ তার গমগমে তেজী গলার স্বরে কাঁপতে থাকে এবং হঠাৎ ঝনঝন শব্দ করে জানালার কাচ ভেঙ্গে পড়ল। মাঠে দাঁড়ানো শখানেক মেয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখল দোতালার জানালা থেকে কাচ ভেঙ্গে পড়ছে নিচে, খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপারের মাথায়।

বিকট আর্তনাদ করে দুজনে মাথায় হাত দিয়ে লাফ দিয়ে সরে যাবার চেষ্টা করল। হোস্টেল সুপারের পায়ের সাথে পা বেধে প্রায় আছাড় খেয়ে পৃড়তে কোনোভাবে নিজেকে সামনে নিল দুজনে কিন্তু মেয়েরা সেটি ভালো করেও লক্ষও করল না তারা অবাক বিস্ময়ে মিতুলের দিকে তাকিয়ে রইল। নিতু মিতুলের দিকে তাকিয়ে নিজের চোখের থেকে দুই ফোঁটা পানি মুছে হাত তালি দিতে শুরু করে, তার দেখাদেখি মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা প্রায় শখানেক মেয়েও যোগ দেয়। এরকম অভূতপূর্ব দৃশ্য তারা তাদের জীবনে কখনো দেখে নি। খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপার রক্ত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে রইল, কিন্তু তারা ক্ৰক্ষেপ করল না, হাত তালি দিয়ে যেতেই লাগলো সবাই মিলে।।

খোরাসানী ম্যাডাম আর হোস্টেল সুপার যখন নিজেদের ঘরে ফিরে গেল তখন তারা ছিল হেরে যাওয়া মানুষ। বাচ্চা দুটি মেয়ের কাছে আজ তারা হেরে গেছে।

০৭. নেংটি ইঁদুর

নিতুর হাতের তালুতে ছোট্ট একটা নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা বসে দুই হাত দিয়ে এক টুকরা বিস্কুট ধরে কুট কুট করে খাচ্ছে। নিতু হাত দিয়ে হালকাভাবে ইঁদুর ছানাটার পিঠে আদর করে বলল, দেখে যা, ইঁদুরের বাচ্চাটা কী সুইট!

এই ঘরের ছয়জন উঁদুরের বাচ্চার ব্যাপারে দুই দলে ভাগ হয়ে আছে। নিতু রেবেকা আর তানিয়া মনে করে এই ছোট ইঁদুরের বাচ্চার মতো সুন্দর কিছু পৃথিবীতে সৃষ্টি হয় নি। রুনু ঝুনু আর মিতুল মনে করে একজন মানুষের পুরোপুরি মাথা খারাপ হলেই সে ইঁদুরের বাচ্চার সাথে মাখামাখি করতে পারে। কাজেই নিতু যখন তার হাতের তালুতে বসে থাকা ইঁদুরের বাচ্চাটা দেখে যাওয়ার জন্যে ডাকল তখন শুধুমাত্র রেবেকা আর তানিয়া উঠে এল। রেবেকা বলল, আমার হাতে একটু দিবি?

তানিয়া বলল তোর হাতে মনে হয় যাবে না।

কেন যাবে না?

ইঁদুরের বাচ্চাটার তো আগে চোখ ফোটে নি—যখন চোখ ফুটেছে তাকিয়ে দেখেছে নিতুকে, তাই এটা মনে করে নিতু হচ্ছে তার মা। এই জন্যে নিতুর সাথে এত খাতির।

আমি না হয় খালাই হলাম। খালার কাছে একটু আসতে পারে না?

দেখা গেল ইঁদুরের বাচ্চাটা খুব সহজেই মায়ের হাত থেকে খালার হাতে চলে গেল। শুধু চলেই গেল না, বিস্কুটটা খাওয়া শেষ করে নাক উঁচু করে গন্ধ শুকতে শুকতে সেটা হাত বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে রেবেকার কাপড়ের ভেতর ঢুকে গেল, বগলের পাশে দিয়ে নেমে পেটের উপর দিয়ে তিরতির করে হেঁটে নামতে থাকে আর রেবেকা কাতুকুতু লাগছে কাতুকুতু লাগছে— বলে হি হি করে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

রেবেকার হাসি শুনে মজা দেখার জন্যে রুনু ঝুনু আর মিতুলও এসে হাজির হল। ইঁদুরের বাচ্চাটা অবলীলায় রেবেকার শরীরের ভেতর দিয়ে তিরতির করে হেঁটে হেঁটে বের হয়ে এসে আবার নিতুর হাতে হাজির হল। সামনের দুই পা উপরে তুলে এটা পিছনের পায়ের উপর ভর দিয়ে বসে ইতিউতি তাকাচ্ছে। ইঁদুরের বাচ্চাটাকে দেখে এত বড় ইঁদুর, বিদ্বেষী রুনু ঝুনুও ফিক করে হেসে ফেলল। নিতু বলল, হাতে নিবি?

হ্যাক! খুঃ। বলেও ঝুনু অবশ্যি ইঁদুরের বাচ্চাটাকে আদর করে দেয়।

চোখ ফোটার কয়েক ঘণ্টার মাঝে অবশ্যি সবাই টের পেয়ে গেল একটা ইঁদুরের বাচ্চা মা হিসেবে একটা মানুষকে পেলে কী কী সমস্যা হতে পারে। যেহেতু বাচ্চাটা চোখ ফুটে নিতুকে মা হিসেবে আবিষ্কার করেছে কাজেই সেটি ধরে নিয়েছে মানুষ সম্প্রদায় মাত্রই তার শুভাকাক্তক্ষী। এটি যখন তখন শুধু যে নিতু রেবেকা বা তানিয়ার পা বেয়ে তাদের শরীরে উঠে পড়তে লাগল তাই নয়। সুযোগ পেলেই রুনুঝুনু কিংবা মিতুলের পা বেয়েও তাদের শরীরে উঠে পড়ার চেষ্টা করতে লাগল। নিতু, রেবেকা বা তানিয়া ব্যাপারটাকে একটা মজার ব্যাপার হিসেবে নিয়ে হেসে কুটি কুটি হয়। রুনু ঝুনু আর মিতুলের বেলায় অন্য ব্যাপার, তারা ভয়ে চিৎকার করতে শুরু করে, শরীর থেকে ঝেড়ে বাচ্চাটাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে। হোস্টেলে এরকম চিৎকার এবং চেঁচামেচি খুব ভয়ের ব্যাপার। খবরটা কোনোভাবে হোস্টেল সুপার কিংবা খোরাসানী ম্যাডাম পর্যন্ত পৌছে গেলে বড় বিপদ হতে পারে।

রাত্রে ঘুমানোর সময় ইঁদুরটি যেন ঘুমন্ত কারো শরীরে উঠে পড়তে না পারে সে জন্য নিতু সেটাকে একটা কার্ড বোর্ডের বাক্সে আটকে রাখল, রাতে খিদে পেলে খাবার জন্যে ভেতরে দুই টুকরা বিস্কুট, তৃষ্ণা পেলে খাওয়ার জন্যে ছোট একটা কৌটায় একটু পানি এবং ঘুমানোর জন্যে কম্বল হিসেবে ব্যবহার করার জন্যে একটা রুমাল। নিতু মোটামুটি নিশ্চিত ছিল রাতটা কাটিয়ে দেওয়ার জন্যে যা যা প্রয়োজন সবই দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু গভীর রাতে প্রথমে রেবেকা এবং তারপর রুনু চিৎকার করে জেগে উঠে, ইঁদুরের বাচ্চাটি নাকি তাদের পেটের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েছে, বগলের কাছাকাছি একটা আরামদায়ক জায়গা বের করে সেখানে ঘুমানোর চেষ্টা করেছে। নিতু জেগে উঠে ইঁদুরের বাচ্চাটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। সাধারণত একটা ইঁদুরের বাচ্চাকে খুঁজে বের করা খুব কঠিন, ঘরের নানা জিনিস পত্রের আড়ালে সেটি লুকিয়ে থাকতে পারে কিন্তু এই বাচ্চাটির কথা ভিন্ন, মানুষ থেকে যে লুকিয়ে থাকতে হয় সেটি এটা জানে না। তার ধারণা মানুষ হচ্ছে তার সবচেয়ে বড় বন্ধু এবং বিপদের সময় মানুষের কাছে ছুটে যেতে হয়। তাই ঘরের বাতি জ্বালানোর সাথে সাথে সেটি ঝুনুর মশারিতে কেটে করে রাখা ফুটোর ভিতর দিয়ে বের হয়ে লাফাতে লাফাতে নিতুর কাছে চলে এল এবং পা বেয়ে তার শরীরের উপর দিয়ে একেবারে ঘাড়ের কাছে হাজির হল। নিতু চাপা গলায় বলল, পাজী ছেলে। মানুষকে ঘুমের মাঝে এই ভাবে ডিস্টার্ব করে?

নিতু ইঁদুরের বাচ্চাকে কার্ডবোর্ডের বাক্সে আটকে রেখে এবারে বাক্সটার ঢাকানাটি কয়েকটা ভারী বই দিয়ে চাপা দিয়ে রাখল যেন ভেতর থেকে বের হতে না পারে। বাকি রাতটুকু যেন সবাই শান্তিতে ঘুমুতে পারে।

শেষরাতের দিকে বিকট চিল্কার করে মিতুল তার বিছানা থেকে প্রায় হুড়মুড় করে নিচে এসে পড়ল, হোস্টেল সুপার কিংবা আশে পাশের রুমের মেয়েরা জেগে উঠেছে কী না সেটা চিন্তা করতে করতে নিতু প্রায় লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে মিতুলের কাছে গিয়ে বলল, কী হয়েছে?

কী আবার হবে? মিতুল চাপা গলায় ফোঁস করে বলল, তোর পাজী ইঁদুরের বাচ্চা! কী সাহস আমার কানের ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করছে।

নিতু একটা নিশ্বাস ফেলল, এই ইঁদুরের বাচ্চা নিয়ে সত্যিই বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাবধানে উঠে লাইট জ্বালাতেই ইঁদুরের বাচ্চাটি মিতুলে বিছানা থেকে নেমে তির তির করে হেঁটে হেঁটে নিতুর কাছে হাজির হল। মিতুল এক ধরনের আতংক নিয়ে সেটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি যদি আস্ত একটা থান ইট দিয়ে ইটার মাথা ঘেঁচে না দিই—

নিতু ইঁদুরের বাচ্চাটাকে হাতে তুলে নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ছিঃ! মিতুল হোস্টেল সুপারের মতো কথা বলিস না! ঘুমা গিয়ে। আমি দেখছি আর যেন এটা বের হতে না পারে।

কার্ডবোর্ডের বাক্সের কাছে গিয়ে দেখল ইঁদুরের বাচ্চাটা দাঁত দিয়ে কেটে প্রমাণ সাইজ একটা ফুটো করে বের হয়ে এসেছে। এইটুকু ছোট ইঁদুরের বাচ্চা এরকম ধারালো দাঁত হতে পারে কে জানত! নিতু আবার সেটাকে বাক্সে বুন্দি করে বই চাপা দেয়। দাঁত দিয়ে কেটে যেন বের হয়ে আসতে না পারে সেজন্যে পুরো বাক্সটা ঠেলে ঘরের এক কোনায় নিয়ে চারিদিকে বই খাতা দিয়ে ঢেকে দিল। তার পাঠ্যবই কেটে বের হয়ে এলে কী হবে সেটা নিয়ে এখন দুশ্চিন্তা করার সময় নেই।

ইঁদুরের বাচ্চাটি অবিশ্যি ভোর হওয়ার আগেই সেই দুর্ভেদ্য বাক্স থেকে বের হয়ে এল। ততক্ষণে সকাল হয়ে গেছে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করে সবাই ক্লাশে যাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে তাই তাদের মাঝে উঁদুরের বাচ্চাটিও যে ছোটাছুটি করছে সেটি কারো চোখে পড়ল না।

রাতে ঘুমানোর সময় মিতুল এসে বলল, নিতু। আজ রাতে যদি তোর বাচ্চা আমার বিছানায় আসে আমি কিন্তু তার মাথা ছেচে ফেলব।

রুনু ঝুনু ও মাথা নাড়ল, বলল, কোনোদিন শুনেছিস ইঁদুরের বাচ্চা বিছানায় উঠে এসেছেঃ ছিঃ!

রেবেকা বলল, বাচ্চাটা দেখতে সুইট, তাই বলে বগলের তলায় ঘুমাবে? তানিয়া গম্ভীর হয়ে বলল, রোগ জীবাণুরও একটা ব্যাপার আছে।

নিতু দুর্বল ভাবে হেসে বলল, তোরা চিন্তা করিস না, আজ একটা পাকা ব্যবস্থা করছি।

কী করবি?

আমার একটা চকলেটের টিন আছে সেটার মাঝে আটকে রাখব, ওখান থেকে বের হতে পারবে না।

নিতু সত্যি সত্যি তার চকলেটের টিনের নিশ্বাস নেবার জন্যে কয়েকটা ফুটো করে ভিতরে ইঁদুরের বাচ্চার ঘুমানোর ব্যবস্থা করল। কয়েক টুকরো বিস্কুট, খাবার পানি ঘুমানোর জন্যে কম্বল, ধারালো দাঁত দিয়ে কাঁটাকুটি করার জন্যে কয়েকটা ভাঙা পেন্সিল, খেলার জন্যে একটা ছোট প্লাস্টিকের বল। রেবেকা মুচকি হেসে বলল, পড়ার জন্যে একটা গল্পের বই দিলি না? হাত মুখ ধোওয়ার জন্যে সাবান আর তোয়ালে?।

মিতুল হি হি করে হেসে বলল, দাঁত ব্রাস করার জন্যে টুথ ব্রাস?

নিতু বলল, ফাজলেমি করিস না। এইটুকুন একটা বাচ্চা একা একা থাকবে সারা রাত।।

গভীর রাতে নিতুর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানার নিচে রাখা চকলেটের টিনটাতে একটা শব্দ হচ্ছে। কুট কুট শব্দ, মনে হয় ইঁদুরের বাচ্চাটা বের হবার জন্যে চেষ্টা করছে। নিতুর ভাবল, আহা বেচারা, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।

মাঝরাতে আবার নিতুর ঘুম ভেঙ্গে গেল, তখনো বিছানার নিচে চকলেটের টিনটাতে ইঁদুদেরর বাচ্চাটা কুটকুট করে শব্দ করছে। নিতুর এত মায়া লাগল যে বলার নয়। স্বাধীন একটা বাচ্চা, সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়ানোর কথা অথচ একটা চকলেটের টিনে আটকা পড়ে আছে। যদি কোথাও কয়েক ঘণ্টার জন্যে ছেড়ে দিয়ে আসা যেত কী চমৎকারই না হতো। নিতু খানিকক্ষণ চিন্তা করে হঠাৎ চমকে উঠল, হোস্টেল সুপারের রুমে নিয়ে ছেড়ে দিলে কেমন হয়? হোস্টেল সুপার ইঁদুরকে যা ভয় পায় সেটি বলার মতো নয়, যখন নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা তার মিশে যাওয়া নাকের ভিতরে কিংবা কামের ফুটো দিয়ে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবে তখন যা একটা মজা হবে সেটি না দেখা পর্যন্ত বিশ্বাস করা যাবে । নিতু বিছানায় বসে একা একাই খিক খিক করে হাসতে থাকে।

পুরো ব্যাপারটা সে আরেকবার চিন্তা করে দেখল, এমন কিছু কঠিন নয় কাজটা। ঘুমানোর সময় হোস্টেল সুপারের বাশির মতো নাক ডাকে, কাজেই সে কি ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে বোঝা কঠিন নয়। যদি ঘুমিয়ে থাকে তাহলে জানালার ফাঁকে দিয়ে নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাকে ছেড়ে দেবে, বাকিটুকু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। ইঁদুরের বাচ্চাটা মানুষকে খুব ভালবাসে, সে ঠিক খুঁজে খুঁজে হোস্টেল সুপারের মশারি কেটে ভিতরে ঢুকে যাবে। তারপর যা একটা মজা হবে চিন্তা করে আবার নিতুর সবগুলি দাঁত বের হয়ে এল।

নিতু সাবধানে বিছানা থেকে নেমে আসে। চকলেটের টিনটা কোনো শব্দ না করে খুলতেই ইঁদুরের বাচ্চাটা দুটি ছোট ছোট লাফ দিয়ে নিতুর হাতে চলে এসে মুখ ঘষে আদর জানাতে থাকে। আবছা অন্ধকারে বাচ্চাটার পিঠে আঙুল বুলিয়ে সে একটু আদর করে উঠে দাঁড়ায়, সাবধানে দরজার কাছে গিয়ে ছিটকিনি খুলতেই খুট করে একটা শব্দ হল। মিতুলের ঘুম খুব হালকা সে সাথে সাথে জেগে উঠে বলল, কে?

আমি নিতু।

কোথায় যাস?

নিতু চাপা গলায় বলল, হোস্টেল সুপারের ঘরে।

সে কী! কেন? মিতুল তার বিছানায় উঠে বসল।

ইঁদুরের বাচ্চাটা ছেড়ে দিয়ে আসি, কী একটা মজা হবে না?

মিতুল এবার পুরোপুরি জেগে উঠল, চাপা গলায় বলল, তোর কী মাথা খারাপ হয়েছে?

মাথা খারাপ হবে কেন? হোস্টেল সুপার ইঁদুরকে কী ভয় পায় জানিস না? যখন গা বেয়ে উঠে যাবে— বাকিটা চিন্তা করে নিতু অন্ধকারে হি হি করে হাসতে থাকে।

মিতুল কিছুক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আবছা অন্ধকারে নিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সে নিজেও হি হি করে হাসতে শুরু করে। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল, সাবধানে যাবি, ধরা পড়লে কিন্তু বিপদ আছে।

চিন্তা করিস না তুই। নিতু সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে এল। বারান্দায় আলো জ্বলছে, হঠাৎ করে কেউ দেখে ফেললে বলবে বাথরুমে যাচ্ছে। হাতে ইঁদুরের বাচ্চাটা নিয়ে নিতু নিশব্দে হাঁটতে থাকে। কয়েকটা রুম পার হবার পরই দূর থেকে হোস্টেল সুপারের বাঁশির মতো নাক ডাকা শুনতে পেল। আরো খানিকদূর যাবার পর বুঝতে পারে নাক ডাকার শব্দটি ঠিক বাঁশির মতো নয় অনেকটা প্লেনের ইঞ্জিনের মতো অনেক দূর থেকে সেটাকে বাঁশির মতো শোনায়। এতো শুকনো চিমশে যাওয়া মানুষ কেমন করে এরকম বিকটভাবে নাক ডাকতে পারে কে জানে!

নিতু সাবধানে হোস্টেল সুপারের ঘরের সামনে দাঁড়াল। একটা জানালা আধ খোলা, সেদিক দিয়ে ভেতরে বিছানাটা দেখা যাচ্ছে, মশারি টানানো, ভিতরে হোস্টেল সুপার ঘুমাচ্ছে। নিতু সাবধানে হাতের মুঠো থেকে ইঁদুরের বাচ্চাটা জানালায় ছেড়ে দিয়ে ফিস ফিস করের বলল, যা ব্যাটা, মজা দেখিয়ে দে।

নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটা জানালায় বসে একবার ইতিউতি তাকিয়ে হঠাৎ করে লাফ দিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। নিতু সাথে সাথে নিশব্দে হেঁটে নিজের ঘরের ফিরে এল। মিতুল তখনো জেগে বসে আছে। নিতুকে দেখে ফিস ফিস করে বলল, কতক্ষণ লাগবে বলে তোর মনে হয়?

বেশিক্ষণ লাগার কথা না। নিতু চাপা গলায় বলল, হোস্টেল সুপারের ঘরটা একবার ঘুরে দেখে নিয়েই আমাদের ইঁদুর বাবাজী মশারির ভিতরে ঢুকে পড়বে!

কী হবে বলে তোর মনে হয়?

ঠিক কী হবে জানি না তবে বড় মজা হবে।।

নিতু আর মিতুল দুজনেই মুখে হাত চাপা দিয়ে এখন খিক খিক করে হাসতে থাকে।

দুজনে চুপ চাপ বসে মজার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু মজা আর শুরু হয় না। অপেক্ষা করে করে যখন তাদের মনে হতে থাকে নেংটি ইঁদুরের কোনো কারণে হোস্টেল সুপারকে অপছন্দ করে তার বিছানায় ঢুকতে চাইছে না ঠিক তখন হঠাৎ তারা একটি বিকট চিৎকার শুনতে পেল। মনে হল যেন ডাকাত পড়ছে—হোস্টেল সুপরি গলা ফাটিয়ে এমন ভয়ংকর আর্তনাদ করতে লাগল যে নিতু আর মিতুল পর্যন্ত ভয় পেয়ে গেল। হোস্টেল সুপারের ঘরে দড়াম দড়াম করে শব্দ হতে লাগল, মনে হতে লাগল পুরো হোস্টেল বুঝি ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে।

নিতু আর মিতুল মুখে হাত দিয়ে খিক খিক করে হাসতে থাকে। ঘরের অন্যেরাও জেগে ওঠেছে আশে পাশের রুমে যারা আছে তাদের কেউ কেউ দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। তখন নিতু আর মিতুলও দরজা খুলে বের হয়ে এল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা দেখতে পেল হঠাৎ করে হোস্টেল সুপারের দরজা খুলে গেল এবং ভিতর থেকে হোস্টেল সুপার গুলির মতো ছুটে বের হয়ে এল, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিকট অঙ্গভঙ্গি করে লাফাতে থাকে, দেখে মনে হয় কোনো একটা বিচিত্র কারণে হোস্টেল সুপার তার শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলি খুলে ফেলতে চাইছে। শুধু তাই নয়, সেই বিকট নর্তন কুর্তনের সাথে সাথে হোস্টেল সুপার মুখ দিয়ে প্রচণ্ড জোরে চেঁচাতে শুরু করেছে।

মেয়েরা অবাক হয়ে হোস্টেল সুপারের কাছে হাজির হল, সবাই মিলে মোটামুটি গোল হয়ে তাকে ঘিরে দাঁড়াল এবং মাঝখানে হোস্টেল সুপার তার বিকট ক্যারিকেচার করতে থাকল। ষাড়ের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে সে লাফাতে থাকে, দেখে মনে হয় তাকে কেউ গরম তাওয়ার ওপর ছেড়ে দিয়েছে। খানিকক্ষণ লাফাতে লাফাতে হঠাৎ হাত দিয়ে শরীরের বিচিত্র সব জায়গায় খামচাতে শুরু করে। মুখ বিকৃত করে বিকট শব্দ করতে করতে শরীরের কাপড় খুলতে শুরু করে এবং হঠাৎ করে থেমে গিয়ে শরীর ঝাকাতে ঝাকাতে ছোটাছুটি করতে থাকে দেখে মনে হয় অদৃশ্য কোনো ভূত বুঝি তাকে ধাওয়া করে বেড়াচ্ছে।।

সবগুলি মেয়ে হতবাক হয়ে হোস্টেল সুপারের এই বিচিত্র নৃত্য দেখতে থাকে। হৈ চৈ গোলমাল শুনে জমিলার মাও চলে এসেছে, এমনিতে তার মুখে কোনো রকম অনুভূতির ছাপ পড়ে না কিন্তু এখন সেখানেও একটা অবাক হওয়ার ভাব। সে খানিকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের গলায় ঝােলানো তাবিজটা হাত দিয়ে চেপে ধরে ফিস ফিস করে বলল, জীনের আছর।

কাসেম মেয়েদের মাঝে সবচেয়ে সাহসী, সে একটু এগিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, কী হয়েছে ম্যাডাম?

হোস্টেল সুপার তখন একটু শান্ত হয়েছে, কিন্তু ঠিক পুরোপুরি শান্ত হতে পারছে না, মাঝে মাঝেই কেমন যেন গা ঝাড়া দিয়ে শিউরে শিউরে উঠছে। শাড়ি প্রায় খুলে এসেছে, ব্লাউজের বোতাম খোলা, পাটের মতো চুল উশখুখুশকো, চোখে মুখে একটা অমানুষিক আতংক। কাসেম আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ম্যাডাম?

হোস্টেল সুপার মুখ হাঁ করে বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে বলল, ইঁদুর।

ইঁদুর? অনেক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায়?

হোস্টেল সুপার চোখ বড় বড় করে বলল, আমার পেটের ওপর দিয়ে এসে নাকের মাঝে ঢোকার চেষ্টা করেছে।

যে ছয়টি মেয়ে এই নেংটি ইঁদুরের বাচ্চার ইতিহাস জানে তারা ছাড়া অন্য সবাই হঠাৎ করে আতংক একটা আর্ত চিৎকার করে উঠল। হোস্টেল সুপার ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, আমি যখন হাত দিয়ে সরানোর চেষ্টা করেছি তখন শরীরের কাপড়ের ভিতর ঢুকে গেল।

মেয়েগুলি আবার একটা শব্দ করল, আনন্দে না ভয়ে এবার সেটা ঠিক ভালো করে বোঝা গেল না। জমিলার মা অবিশ্যি হোস্টেল সুপারের কথা বিশ্বাস করল না, মাথা নেড়ে বলল, জীনের আছর।

মিতুল অবাক হবার ভান করে বলল, জীনের আছর?

হ্যাঁ।

কেন? জীন কেন হবে?

ইন্দুর কখনো মানুষের কাছে আসে না। ইন্দুর মানুষকে ভয় পায়। মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকে।

সত্যি?

হ্যাঁ। ইন্দুর মানুষের ঘ্রাণ সহ্য করতে পারে না। তাদের নিশ্বাসের থেকে দূরে থাকে। এইটা ইন্দুর না। অন্য কিছু।

হোস্টেল সুপার ফ্যাকাসে মুখে বলল, তাহলে এইটা কী?

জীন ভুতের আছর হলে এরকম হয়। আমার ফুপাতো বোনের হয়েছিল।

কিন্তু—কিন্তু–হোস্টেল সুপার তোতলাতে তোতলাতে বলল, আমার স্পষ্ট মনে হল ইঁদুর।

নিতু হঠাৎ বলে ফেলল, হয়তো ইঁদুরের ভূত।

হোস্টেল সুপার ঢোক গিলে বলল, কী বললি?

বলেছি, ইয়ে মানে ইঁদুরের ভূত। মানে ইঁদুর মরে যে ভূত হয়।

ই-ই-ইঁদুরের ভূত?

হ। মনে নাই সোদন যে ইঁদুর গুলি মেরেছিলেন? মানে ইয়ে, হয়তো তাদের ভূত এসেছে। আপনি মেরেছিলেন তাই আপনার ওপরে রাগ বেশি। হতে পারে না?

এখানে ভূত বিষয়ক অভিজ্ঞ মাত্র একজনই, জমিলার মা, সবাই তার দিকে তাকাল, হতে পারে?

জমিলার মা মাথা চুলকে বলল, বলা মুশকিল। তবে—

নিতু বলল, মানুষ মরে যদি মানুষের ভূত হয় তাহলে ইঁদুর মরে ইঁদুরের ভূত কেন হতে পারে না?

হোস্টেল সুপার এতক্ষণ পর হঠাৎ খেয়াল করল যে তার দুর্দশা নিয়ে মেয়েরা কথাবার্তা বলছে। ব্যাপারটি ভালো নয়। সে তার শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে মুখ গম্ভীর করে ধমকে দিয়ে বলল, যা সবাই ঘুমাতে যা। তোরা কেন বিছানা থেকে উঠে এসেছিল।

ধমক খেয়ে সবাই নিজের নিজের ঘরে ফিরে গেল। নিতু এবং তার পাঁচ রুমমেট দরজা বন্ধ করে হেসে কুটি কুটি হয়ে গেল। যখন শুনতে পেল নিতু নিজে গিয়ে ইঁদুরের বাচ্চাকে ছেড়ে দিয়ে এসেছে তখন অন্যেরা বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খেতে শুরু করল।

নিতু হাসি থামিয়ে চাপা গলায় বলল, ইঁদুরের বাচ্চাটা এখনো ফিরে আসে। নি। তার মানে কী জানিস?

কী?

আজ রাতে আবার এটাক হতে পারে!

ব্যাপারটা চিন্তা করে আবার সবাই হি হি করে হাসতে শুরু করে।

বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ পর আবার যখন তাদের চোখে প্রায় ঘুম লেগে এসেছে তখন দ্বিতীয়বার হোস্টেল সুপার বিকট স্বরে চিৎকার করে লাফঝাপ দিতে শুরু করল। অন্য অনেকে দ্বিতীয়বার মজা দেখতে গেলেও এই ছয়জন ঝুঁকি নিল না, হোস্টেল সুপারের নর্তন কুর্দন দেখতে দেখতে হঠাৎ করে হেসে ফেললে বিপদ হয়ে যাবে। তা ছাড়া হাসি জলবসন্ত এবং হাম থেকেও বেশি সংক্রামক, একজন হেসে ফেললে অন্য সবাই হাসতে শুরু করব। এরকম একটা ব্যাপারে হাসি আটকে রাখা অসম্ভব ব্যাপার।

মিনিট দশেক তারা হোস্টেল সুপারের চিৎকার লাফঝাপ এবং হৈ চৈ শুনতে পেল। তারপর শব্দ কমে এল, যারা মজা দেখতে গিয়েছিল তাদের কাছে শুনতে পেল, হোস্টেল সুপার নাকি আর ঘুমুতে যাচ্ছে না। লাল রংয়ের একটা দোয়াদরূদের বই বুকে চেপে ধরে বিছানায় পা তুলে বসে আছে। নিতু একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল, ঘরের বাতি জ্বালানো থাকলে হঠাৎ করে যদি তার ইঁদুরের বাচ্চাকে দেখে ফেলে তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। তা ছাড়া ইঁদুরের বাচ্চাটা জানে না মানুষ থেকে দূরে দূরে থাকতে হয়।

নিতুর ভয় অবশ্য কিছুক্ষণেই কেটে গেল, হঠাৎ করে মনে হল কিছু একটা তার হাত বেয়ে তির তির করে উঠে আসছে। সে লাফ দিয়ে ওঠে ইঁদুরের বাচ্চাটাকে ধরে ফিস ফিস করে বলল, পাজী ছেলে! এখন আমাকে ভয় দেখাতে এসেছিস? এক রাতের জন্যে অনেক এডভেঞ্চার হয়েছে এখন ঘুমুতে দে আমাদের।

নিতু চকলেটের টিনে ইর্দুরের বাচ্চাটাকে আটকে রাখল, ভোর হওয়ার আগে আর তাকে ছাড়া হবে না।

পরদিন হোস্টেল সুপারকে দেখে সবাই শিউরে উঠল, একরাতে তার বয়স মনে হয় পঞ্চাশ বছর বেড়ে গেছে। চুল ময়লা পাটের মতো উশখু খুশকো চোখ গভীর গর্তে ঢুকে গেছে। মুখ তোবড়ানো, শুকনো চামড়া ঝুলে পড়েছে। মনে হয় সোজা হয়ে হাঁটতেও পারছে না, কেমন যেন কুঁজো হয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে ঘটছে। গলার স্বর ভেঙ্গে গিয়ে সেখান থেকে ফ্যাসফ্যাসে একটা শব্দ বের হচ্ছে একটা ছোট ইঁদুরের বাচ্চা একজন বড় মানুষকে এভাবে কাবু করতে পারে নিজের চোখে না দেখলে নিতু কখনো বিশ্বাস করত না।

 

গভীর রাতে আবার নিতুর ঘুম ভেঙ্গে গেল, সারাদিন এডভেঞ্চার করে ইঁদুরের বাচ্চা ফিরে এলে আবার তাকে চকলেটের টিনে আটকে রাখা হয়েছে। নিতু শুনতে পেল সে কুট কুট করে শব্দ করছে, এখান থেকে বের হতে চায়।

একবার হোস্টেল সুপারের রুমে ছেড়ে দেবার পর কী অবস্থা হয়েছে সে দেখেছে, আবার ছেড়ে দিলে কী হবে কে জানে! নিতু ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু ঘুম এলো না, ইঁদুরের বাচ্চার এই শোনা যায় না এরকম কুট কুট শব্দকে যে এত বেশি শব্দ মনে হবে সেটা কে জানত। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে নিতু নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাকে টিন থেকে বের করে আনল, ইঁদুরটা এর মাঝেই একটু লায়েক হয়ে গেছে। বের করা মাত্রই তিড়িং বিড়িং করে কয়েকটা লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল, কোথায় গিয়েছে কে জানে। আজ রাতে না জানি কার সর্বনাশ করবে!

গভীর রাতে হঠাৎ বাইরে বিকট আর্তনাদ শুনে সবাই ধড়মড় করে জেগে উঠল। হোস্টেল সুপার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে, নেংটি ইঁদুরের বাচ্চা আবার গিয়ে ঠিক একই জায়গায় হামলা করেছে।

আগের দিন ব্যাপারটি নিয়ে সবাই হেসে কুটি কুটি হয়েছে কিন্তু আজ আর হাসি পাচ্ছে না সবারই কেন যেন ভয় ভয় লাগছে। যদি হোস্টেল সুপারের কিছু একটা হয়ে যায় তাহলে কী হবে? তানিয়া ভুরু কুচকে নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, আবার হোস্টেল সুপারের রুমে ছেড়ে দিয়ে এসেছিস?

নিতু মাথা নাড়ল, বলল, উহুঁ। নিজেই লাফিয়ে গেছে।

মিতুল শুকনো গলায় বলল, এখন কী হবে?

রেবেকা উদাস গলায় বলল, কী আর হবে। যা হবার তাই হবে।

 

পরদিন সকালে ওঠে সবাই খবর পেল, যা হবার তাই হয়েছে। হোস্টেল সুপার বুতুরুন্নেসা আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। যে জায়গায় ভূতের ওৎপাত, বিশেষ করে ইঁদুরের ভূত সেখানে চাকরি করে জীবন খোয়াতে সে রাজি নয়।

মেয়েরা যদি আনন্দে গলা খুলে চিৎকার করার অনুমতি পেতো তাহলে তাদের সেই চিৎকার নিউ ইয়র্ক থেকে শোনা যেতো।

০৮. শান্তা আপা

সব আনন্দের পিছনে একটা করে দুঃখ থাকে। বুরুন্নেসা আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েদের জন্যে সেটা বেশি রকম সত্যি। তাদের কখনো কোনো আনন্দ থাকে না, যদি ভুল করে একটা আনন্দ হয়ে যায় তাহলে তার জন্যে মনে হয় দশটা দুঃখ এসে জমা হয়। কাজেই হোস্টেল সুপার চলে যাওয়ার জন্যে যে কিছু দুঃখ হাজির হবে তাতে অবাক হবার কী আছে। প্রথম দুঃখটি হল নেংটি ইঁদুরের বাচ্চাটিকে নিয়ে। একদিন ভোর বেলা সেটি বারান্দা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে তখন কোথা থেকে বিচ্ছিরী একটা কাক এসে ছোঁ মেরে তাকে ধরে নিয়ে উড়ে গেল। নিতুর এতো মন খারাপ হল যে সেটি বলার নয়। সে অবিশ্যি কল্পনা করে তার ইঁদুরের বাচ্চাটা কাকের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে গিয়ে দূরে কোনো এক গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে। একদিন তার সাথে দেখা করার জন্যে হেটে হেঁটে হোস্টেলে ফিরে আসবে ঠিক রূপকথার গল্পের মতো।

নিতু এবং তার বন্ধুদের দুই নম্বর দুঃখটি তাদের নূতন হোস্টেল সুপার নিয়ে। আগের হোস্টেল সুপার চলে যাওয়ায় নূতন একজনকে খোঁজা হচ্ছে এবং গত কয়েকদিন হল একজন মহিলাকে স্কুলে আসতে এবং যেতে দেখা যাচ্ছে। এই মহিলাটি নাকি কমবয়সী, ফর্সা এবং সুন্দরী। সেটাই হচ্ছে ভয়ের কারণ, কারণ দেখা গেছে একজন মানুষের চেহারা যত ভালো হয় সে তত অহংকারী হয়, আর মানুষ যত অহংকারী হয় তত বেশি নিষ্ঠুর হয়। একজন মানুষ যদি ভালো হয় নিতু-৫

তাকে এই স্কুলে নেয়া হয় না, এই স্কুলে যোগ দেওয়ার আগে একশ বার পরীক্ষা করে দেখা হয় মানুষটা কী রকম নিষ্ঠুর। হোস্টেলের মেয়েরা শুনেছে ইন্টারভিউ নেওয়ার সময় কেউ যদি হেসে ফেলে সাথে সাথে তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়, বুতুরুন্নেসা আবাসিক বালিকা বিদ্যালয়ে কখনো প্রকাশ্যে কেউ হাসতে পারে না।

কাজেই যেদিন এসেম্বলিতে নূতন হোস্টেল সুপার এসে দাঁড়াল সবাই মনে মনে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল। মহিলাটি হালকা পাতলা, কম বয়সী, ফর্সা এবং সুন্দরী, ঠিক যেরকম শুনেছিল, চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় মহিলাটি কত নিষ্ঠুর, বিশেষ করে ঠোটের কোনায় চাপা হাসিটি দেখেই কেমন জানি বুকের মাঝে ধ্বক করে উঠে।

এসেম্বলি শেষ হওয়ার পর খানিকক্ষণ ব্যায়াম হল—যখন হাত পা ছুড়ে লাফালাফি করতে হয়, তারপর খোরাসানী ম্যাডাম বক্তৃতা দেওয়ার জন্যে একটু এগিয়ে এল। সবার দিকে একবার তাকিয়ে খোরাসানী ম্যাডাম ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ফেঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে হুংকার দিয়ে বলল, পাজী, বদমাইশ হতচ্ছাড়া বেজন্মা শয়তানের ঝাড়–

লাইন করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েরা ঠিক এরকমই একটা কিছু আশা করছিল কিন্তু তাদের নূতন হোস্টেল সুপার কেমন যেন চমকে ওঠে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে তাকাল। খোরাসানী ম্যাডাম অবশ্যি ভ্রুক্ষেপ না করে কথা বলতে থাকে, তোদের পিটিয়ে ছাল চামড়া তুলে দেবার সময় হয়েছে। ভেবেছিলি হোস্টেলে কোনো সুপার নাই, মামদোবাজী আর ঘিড়িংগাবাজী করে সময় কাঁটাবি? তোদের সেই দিন শেষ। হোস্টেলে নূতন সুপার এসেছে, সে যেন তোদের রগড়া দিয়ে সিধে করে রাখে সেটা আমি নিজে ব্যবস্থা করব। মনে থাকে যেন বুতুরুন্নেসা স্কুল কোনো রং তামাশার জায়গা না। এখানে বানর হয়ে ঢুকৰি মানুষ হয়ে বের হবি। খোরাসানী ম্যাডাম সেনাপতির মতো সবার দিকে তাকিয়ে একটা হুংকার দিয়ে বলল, মনে থাকবে তো?

সবগুলি মেয়ে চিৎকার করে বলল, থাকবে ম্যাডাম।

খোরাসানী ম্যাডাম রক্তচক্ষু করে হুংকার দিল, জোরে।

সবাই দম ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, থাকবে ম্যাডাম।

লাইনে দাঁড়ানো শ খানেক মেয়ে অবাক হয়ে দেখল তাদের নূতন হোস্টেল সুপার হঠাৎ শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে খুক খুক করে হাসতে শুরু করেছে। এই স্কুলে কেউ হাসছে তাও একজন শিক্ষিকা, এসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে—এটি একটি অসম্ভব ব্যাপার, কেউ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। সবাই ভালো করে তাকাল, চোখের ভুল নয় সত্যিই নূতন হোস্টেল সুপার হাসছে। অন্য শিক্ষিকারা কেমন যেন ভয় পেয়ে তাকিয়ে আছে আর তাই দেখে খোরাসানী ম্যাডামের চোখ মুখ একেবারে থমথমে হয়ে গেল। সে এগিয়ে গিয়ে নূতন হোস্টেল সুপারকে নিচু গলায় কিছু একটা বলল, তখন হোস্টেল সুপার হাসি থামিয়ে এক পা সামনে এগিয়ে আসে। মনে হয় কিছু একটা বলবে, গালাগাল দিয়ে শুরু করবে নিশ্চয়ই, কী গালাগাল দেবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

মহিলাটি হাসি হাসি মুখে সবার দিকে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, আমি তোমাদের নূতন হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্ট। তোমাদের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি আমাকে তোমাদের বেশি পছন্দ হয় নাই, তাই সবাই এরকম মুখ শক্ত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছ! তাই না?

নিতু নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, তাদের নূতন হোস্টেল সুপার গালাগাল না দিয়ে কথা বলছে! শুধু যে গালাগাল দিচ্ছে না তাই না এমন ভাবে কথা বলছে যেন তাদেরকে পছন্দ করে। মেয়েগুলির চোখে প্রথমে অবিশ্বাস তারপর বিস্ময় এবং হঠাৎ করে একসাথে হাসি ফুটে উঠল। নূতন হোস্টেল সুপারের মুখও সাথে সাথে উজ্জ্বল হয়ে উঠে, এই তো সবাই হাসছে! কী সুন্দর লাগছে দেখতে, হাসি মুখ থেকে পৃথিবীতে সুন্দর কিছু আছে? নেই। হোস্টেল সুপারের কাজ খুব কঠিন। এত গুলি মেয়ের নিশ্চয়ই এতগুলি সমস্যা। কারো জ্বর উঠেছে, কারো মন খারাপ। কেউ বন্ধুর সাথে ঝগড়া করে আড়ি দিয়েছে, কারো বাসা থেকে চিঠি আসে নি, কারো পুতুলের মাথা আলগা হয়ে গেছে। কারো খেতে ইচ্ছে করছে না। কারো পড়তে ইচ্ছে করছে না। এত সমস্যা কী আর এক দিনে সমাধান করা যাবে? যাবে না। এই সব সমস্যা আস্তে আস্তে সমাধান করতে হবে। তোমরা আর অমিরা মিলে সমাধান করে ফেলব। সব অবিশ্যি সমাধান করা যাবে না, কিছু তো থেকেই যাবে। আর লাইফে যদি একটু আধটু সমস্যা না থাকে লাইফের কোনো মজাই থাকে না। তাই না?

সবগুলি মেয়ে গলা ফাটিয়ে চিঙ্কার করে বলল, জি, ম্যাডাম।

তাদের নূতন হোস্টেল সুপার মুখে আঁচল দিয়ে আবার খুক খুক করে হাসতে শুরু করলেন। তারপর হাসি থামিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, প্লীজ তোমরা আমাকে ম্যাডাম ডেকো না! ম্যাডাম শুনলেই আমার মনে হয় আমি বুঝি সুবেদার মেজর আর তোমরা সব আর্মী জওয়ান! হোস্টেল সুপার আবার মুখে আঁচল দিয়ে খুক খুক করে হাসতে লাগলেন।

তখন একটা ব্যাপার ঘটল যেটা বুতুরুনেসা বালিকা বিদ্যালয়ে আগে কখনো ঘটে নি, নিতু নিজে থেকে হাত তুলে জিজ্ঞেস করে বসল, তাহলে আপনাকে কী ডাকব!

আমাকে আপা ডাকতে পার। আমার নাম শান্তা, তাই শান্তা আপা। ঠিক আছে?

সবগুলি মেয়ে এক সাথে আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল, ঠিক আছে শান্তা আপা!

শান্তা আপা আবার মুখে আঁচল দিয়ে খুক খুক করে হাসতে লাগলেন, কী জনে। কে জানে! হাসি অত্যন্ত সংক্রামক, এটি জলবসন্ত হাম আর হুপিং কফ থেকেও বেশি সংক্রামক তাই প্রথমে এক দুইজন তারপর দশ বারোজন এবং শেষে সবাই শান্তা আপার মতো খুক খুক করে হাসতে শুরু করল।

নিতু দেখল খোরাসানী ম্যাডাম বিস্ফোরিত চোখে একবার শান্তা আপা আরেকবার মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছে কিছু একটা বলতে চাইছে, কয়েকবার মনে হয় চেষ্টাও করল কিন্তু বলতে পারল না।

 

এসেম্বলি শেষে সবাই সেদিন ক্লাশে গেল একটা অবিশ্বাস্য আনন্দ নিয়ে তাদের হোস্টেলে শেষ পর্যন্ত একজন সুপার এসেছে যে বাচ্চাদের পছন্দ করে। কী আশ্চর্য!

বিকাল বেলা ছুটির পর ক্লাশ থেকে সবাই দুদ্দাড় করে হোস্টেলে ফিরে এল, তাদের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তাদের হোস্টেল সুপার হচ্ছে শান্তা আপা! তারা তাড়াতাড়ি ফিরে এসে দেখতে চায় একটি সত্যি এটি আসলে স্বপ্ন নয়।

হোস্টেলে ফিরে এসে তারা আবিষ্কার করল এটি সত্যি। শান্তা আপা অদৃশ্য হয়ে যান নি, এখনো আছেন। শুধু আছেন না, ভালোমতোই আছেন, কোমরে শাড়ি প্যাঁচিয়ে তার ঘরটা পরিষ্কার করছেন। ঘরের বারান্দায় শান্তা আপার জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। মেয়েদেরকে ক্লাশ থেকে ফিরে আসতে দেখে উজ্জ্বল চোখে বললেন, কেমন হল তোমাদের ক্লাশ?

নিতুর চোখে পানি এসে গেল হঠাৎ, কতদিন হয়ে গেল কেউ তাদের সাথে এরকম নরম গলায় কথা বলে নি, তারা ভুলেই গিয়েছি যে তারা আসলে ফুটফুটে ছোট ছোট মেয়ে তাদের সাথে মিষ্টি করে কথা বলা যায় তখন তারাও মিষ্টি করে কথা বলে। তাদেরকে ভালবাসা যায় তখন তারাও ভালবাসে।

নিতু ঘাড় নেড়ে বলল, ভালো হয়েছে আপ।

ভেরি গুড়। যাও হাত মুখ ধুয়ে একটু বিশ্রাম নাও। তোমাদের তো বাড়ন্ত বয়স, ভালো করে খেতে হবে সবার। বেশি করে ক্যালসিয়াম, হাড় গুলি যেন শক্ত হয়।

আহা! কী ভালো লাগছে শুনতে, কেউ একজন সত্যি সত্যি তাদের ভালো চাইছে। নিতুর মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো, তার মা যেরকম তার ভালো চাইতেন ঠিক সেরকম। নিতু স্কুলের ব্যাগটা নিচে রেখে বলল, আপা, আমি আপনার সাথে ঘর পরিষ্কার করি?

শান্তা আপা কিছু বলার আগে অন্য সব কয়জন মেয়ে বলে উঠল, আপা, আমরাও করি?

শান্তা আপা চোখ কপালে তুলে বললেন, সে কী! তোমরা ক্লাশ করে টায়ার্ড হয়ে এসেছো, এখন ঘর পরিস্কার করবে কি? আগে একটু রেস্ট নিয়ে খেয়ে দেয়ে এসো!

না আপা এখনই করি বলে সবাই মিলে শান্তা আপার ঘর পরিষ্কার করতে শুরু করে দিল। শান্তা আপা হাসি মুখে ভালবাসার এই উৎপাতটুকু মেনে নিলেন, একা হলে হয়তো কাজটা গুছিয়ে করা যেতো, ঘরটা আরো ভালো করে সাজিয়ে নেয়া যেতো কিন্তু এরকম উৎসাহে বাধ সাধতে তার ইচ্ছে করল না।

ঘর যখন পুরোদমে সাজানো হচ্ছে তখন হঠাৎ করে দরজা অন্ধকার করে কী একটা দাঁড়াল, নিতু এবং অন্য মেয়েরা তাকিয়ে দেখল খোরাসানী ম্যাডাম। অন্য সময় হলে ভয়ে তাদের হার্ট ফেল করে যেতো কিন্তু আজ সবাই জানে তাদের শান্তা আপা ভয়ংকর খোরাসানী ম্যাডামের হাত থেকে রক্ষা করবেন, তাই কেউ ভয় পেল না। সোজাসুজি যেন খোরাসানী ম্যাডামের চোখে পড়তে না হয় সে জন্যে তারা শান্তা আপার পিছনে লুকিয়ে গেল। খোরাসানী ম্যাডাম চোখ লাল করে ওদের দিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলল, তোরা এখানে কী করছিস?

ওরা কিছু বলার আগেই শান্তা আপা কাছে যারা আছে তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি আজ নতুন এসেছি বলে ওরা আমাকে হেল্প করছে! কী সুইট দেখেছেন?

খোরাসানী ম্যাডাম কিছু বলার চেষ্টা করে তোতলাতে শুরু করল তারপর থমথমে মুখে বলল, এই স্কুলে একটা নিয়ম কানুন আছে, ডিসিপ্লিন আছে—

শান্তা আপা মুখের হাসিটুকু একটুও না সরিয়ে ইংরেজিতে বললেন, আমি এই বিষয়গুলো আপনার সাথে পরে আলাপ করব। এদের সামনে নয়।

খোরাসানী ম্যাডামের কালো মুখ লাল হওয়ার চেষ্টা করে কেমন জানি বেগুনি হয়ে গেল, সেই অবস্থায় নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, এদের এখন ঘুমানোর কথা। ঘুম থেকে উঠে খেলাধুলা করার কথা।

সেটাই যদি নিয়ম হয় তাহলে সেটাই করবে। তবে আমি আজ নতুন এসেছি তো তাই এদের সাথে পরিচয় করার জন্যে আজ একটু রুটিন পাল্টানো হতে পারে–

খোরাসানী ম্যাডামকে দেখে মনে হল সে বুঝি এক্ষুনি শান্তা আপার উপর লাফিয়ে পড়বে, দাঁতে দাঁত ঘষে হিংস্র গলায় বলল, এই বদমাইস হতচ্ছাড়া পাজী মেয়েগুলোকে–

শান্তা আপা আশ্চর্য রকম শান্ত কিন্তু কঠিন গলায় বললেন, এরা মোটেই বদমাইস হতচ্ছাড়া এবং পাজী মেয়ে নয়।

খোরাসানী ম্যাডামকে দেখে মনে হল কেউ বুঝি তার নাকের মাঝে দুই ইঞ্চি

তক্কা দিয়ে মেরে বসেছে। খানিকক্ষণ মুখ হা করে নিশ্বাস নিয়ে বলল, পনের বছর থেকে এই স্কুলের নিয়ম কানুন চলে আসছে, তুমি সেদিনের মেয়ে—

শান্তা আপা চোখের পাতি না ফেলে বললেন, আমার নামা শান্তা চৌধুরী। কথাবার্তা বলার সময় আমাকে মিসেস চৌধুরী বলে সম্বোধন করবেন। আর আমাকে দেখে বোঝা না গেলেও আমার বয়স খুব কম নয়। আমাকে সহজেই আপনি করে সম্বোধন করা যায়।

খোরাসানী ম্যাডামকে দেখে মনে হল সে বুঝি এখন ফটাশ শব্দ করে ফেটে যাবে। দরজাটা খামচে ধরে হিংস্র চোখে শান্তা আপার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি যেভাবে চালাই এই স্কুলে সেভাবে চলে।

শান্তা আপা ফিক করে হেসে ফেললেন, বললেন, বেশ! তাহলে সেটাই হোক, আপনি যেভাবে চালাবেন সেভাবে এই স্কুল চলবে আর আমি যেভাবে চালাব সেভাবে এই হোস্টেল চলবে।

খোরাসানী ম্যাডাম হঠাৎ করে ঘুরে গেল তারপর দুম দুম শব্দ করে হেঁটে বের হয়ে গেল। শান্তা আপা তখন সাথে সাথে মেয়েদের দিকে ঘুরে যেন কিছুই হয় নি সেভাবে বললেন, এখন শেলফে বইগুলো তুলে ফেললেই আমাদের কাজ শেষ তাই না।

সবাই মিলে বইগুলো শেলফে তুলতে থাকে। তাদের মনে হতে থাকে যেন সত্যিই কিছু হয় নি। তাদেরকে কেউ বলে দেয় নি কিন্তু তারা বুঝে গেছে হালকা পাতলা ছোট-খাট কমবয়সী শান্তা আপা একই সাথে লোহার মতো শক্ত আবার মাখনের মতো নরম। শক্তটা হচ্ছে খোরাসানী ম্যাডামের জন্যে আর নরমটা তাদের জন্যে। কী মজা!

নিতুর ইচ্ছে করল শান্তা আপাকে জড়িয়ে তার গালে একটা চুমু দিয়ে দেয় তার মাকে সে যেভাবে দিত।

শান্তা আপার ঘর গুছিয়ে তারা যখন বের হয়ে আসছে তখন বেশি উৎসাহ নিয়ে না দেখে হাঁটার জন্যে ঝুনু দেয়াল থেকে বের হয়ে আসা একটা ধাপের মতো জায়গায় পা বেঁধে আছাড় খেয়ে পড়ল। সাথে সাথে তার হাঁটুর কাছে খানিকটা ছাল উঠে গেল, দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে ঝুনু ওঠার চেষ্টা করল এবং তখন অন্যেরা তাকে ধরে টেনে তুলল। রেবেকা ধমক দিয়ে বলল, তোর হয়েছেটা কী? দেখে হাঁটতে পারিস না?

ঝুনু ছিলে যাওয়া হাঁটুটা দেখে বলল, দেখেই তো হাঁটছিলাম।

শান্তা আপা এগিয়ে এসে নরম গলায় বললেন, আহা! ওকে বকছ কেন? ও তো ঠিকই হাঁটছিল, হঠাৎ করে ঘরের ভেতরে এরকম ভাবে একটা ধাপ করে রাখবে কে জানত?

নিতু তাকিয়ে দেকে সত্যিই তাই। ঘরের মাঝখানে হঠাৎ করে একটা ধাপের মতো জায়গা বের হয়ে এসেছে। এখানে এটা কেন করেছে কে জানে? সবাই যখন ঝুনুর ছিলে যাওয়া হাঁটু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে তখন নিতু ধাপটাকে পরীক্ষা করল। ঠোকা দিয়ে মনে হল এটা ফাপা, নিচু হয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখল, পাশে খানিকটা জায়গা থেকে সিমেন্টের আস্তরণ খসে পড়ে ভেতরে কাঠের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। শান্তা আপা যখন ঝুনুর ছিলে যাওয়া হাঁটু ধুয়ে সেখানে এন্টিসেপটিক লাগিয়ে একটা তুলো বসিয়ে টেপ লাগিয়ে দিচ্ছিলেন তখন নিতু তার বল পয়েন্ট কলম দিয়ে ধাপের ভেতরের অংশটা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখছিল। সত্যিই এই ধাপটি ফাঁপা আর ভেতরে একটা বাক্সমতন কিছু একটা আাছে। ঝুনুকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সবাই নিতুর দিকে তাকাল, মিতুল বলল, তুই কী করছিস?

নিতু গম্ভীর হয়ে বলল, এই ধাপটা ফাঁপা। এর ভিতরে একটা গোপন বাক্স আছে।

গোপন বাক্স?

হ্যাঁ, এই দেখ, এদিক দিয়ে দেখা যাচ্ছে।

নিতুর কথা শুনে সবাই আবার ধাপটার চারিদিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। শান্তা আপা চোখ বড় বড় করে বললেন, কী বললে, গোপন বাক্স?

জি আপা, এই দেখেন, নিতু ঠোকা দিয়ে বলল, এটা ফাঁপা।

শান্তা আপাও ধাপটার দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিকই বলছ, মনে হচ্ছে এই ধাপটার মাঝে বাক্স জাতীয় কিছু আছে।

সবাই এবারে চোখ বড় বড় করে শান্তা আপার দিকে তাকাল। মিতুল চোখ বড় বড় করে বলল, কী হতে পারে আপা? কোনো গুপ্তধন?

শান্তা আপা ফিক করে হেসে ফেললেন, বললেন, একেবারে ঘরের ভেতরে গুপ্তধন?

নিতু মাথা নেড়ে বলল, কিংবা কাউকে মার্ডার করে ডেডবড়ি লুকিয়ে রেখেছে।

শান্তা আপা একটু শিউরে উঠলেন, কী বলছ তুমি?

তানিয়া মাথা নাড়ল, বলল, হতে পারে আপা। বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে দুই চারটা মার্ডার নিশ্চয়ই হয়েছে।

শান্তা আপা খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তানিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ঠিক আছে। যখন আমাদের খুব এডভেঞ্চারের মুড হবে তখন আমরা এই গোপন বাক্সটা বের করে দেখব কী আছে ভেতরে।

ঝুনু ভয় পাওয়া গলায় বলল, আপা —

কী হল?

আপনার ভয় করবে না, ঘরের ভেতরে একটা গোপন বাক্সের ভিতরে হয়তো একটা ডেডবড়ি?

শান্তা আপা খিল খিল করে হেসে বললেন, চারপাশে তোমরা এতগুলি মেয়ে, ভয় করবে কেন? আর যদি খুব বেশি ভয় করে তখন আমি না হয় তোমাদের ঘরে চলে আসব। থাকতে দেবে না?

সবগুলি মেয়ে সমস্বরে চিৎকার করে বলল, দেব আপা দেব।

নিতুদের পাশের ঘরে থাকে—ছোটখাট একটা মেয়ে বলল, আপা, আমাদের আগের হোস্টেল সুপার কিন্তু সত্যি সত্যি ভূতের ভয় পেয়ে চলে গেছেন।

তাই নাকি?

জি আপা। ইঁদুরের ভূত।

নিতু আর তার রুম মেটরা অনেক কষ্ট করে হাসি চেপে রাখল, শান্তা আপা খুব ভয় পেলেন বলে মনে হল না, হাসি মুখে বললেন, ইঁদুরের ভূত হলে সমস্যা নেই। খুঁজে পেতে একটা বিড়ালের ভূত নিয়ে আসব–তাহলেই ধারে কাছে আসবে না।

সবার মনে আনন্দের একটা ফুরফুরে ভার ছিল বলে এই ছোট কথাটিতেই সবাই হেসে গড়াগড়ি খেতে নাগল। ওরা যখন বের হয়ে যাচ্ছে তখন শান্তা আপা ঝুনুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি খুব দুঃখিত, যে তুমি আমার ঘরে এসে এরকম ব্যথা পেলে।

মিতুল হি হি করে হেসে বলল, আপা, ঝুনুর কাজই হচ্ছে ব্যথা পাওয়া। আপনার এখানে না হলে নিজের ঘরে ব্যথা পেতো। নিজের ঘর না হলে বাইরে গিয়ে ব্যথা পেতো।

রেবেকা বলল, আর এখন আমাদের সুবিধে হল কে রুনু কে ঝুনু বের করা। এই সপ্তাহে ঝুনু হচ্ছে যার পায়ে ছাল উঠে গেছে সে।

সবার মন ভালো বলে আবার সবাই হি হি করে হাসতে থাকে।

 ০৯. বিপদের শুরু

ক্লাশ শেষ হবার পর আগে যে রকম দৌড়াতে দৌড়াতে সবার নিজের রুমে এসে আধা ঘণ্টা ঘুমের ভান করে পড়ে থাকতে হলে এখন সেই যন্ত্রণাটা বন্ধ হয়েছে। কেউ চাইলে ঘুমাতে পারে কিন্তু সেটা আর কঠিন নিয়ম নয়—তাই কেউ ঘুমায় না, সবাই মিলে গল্পগুজব করে। বিকেলে নস্তা করে সবাইকে অবিশ্যি মাঠে গিয়ে খেলা ধুলা করতে হয়, সেখানেও নিয়ম পাল্টানো হয়েছে, যার যেটা ইচ্ছা খেলতে পারে। মেয়ে বলেই যে ছেলেদের খেলা খেলতে পারবে না সেরকম নিয়ম নেই তাই মেয়েরা খুব উৎসাহ নিয়ে ক্রিকেট আর ফুটবল খেলে। তবে এখনো সবচেয়ে প্রিয় খেলা সাত চাড়া —-তাকারণটা কী এখনো কেউ জানে না।

যেহেতু ঘুমানো নিয়ে তাড়া নেই তাই ক্লাশ শেষ হার পর যখন রেবেকা নিতকে বলল লাইব্রেরিতে একটা বই জমা দিহে যাওয়ার সময় তার সাথে যেতে নিতু রাজি হয়ে গেল। লাইব্রেরিটা কাছেই, সোজাসুজি মাঠের ভেতর দিয়ে গেলেই তাড়াতাড়ি হয় কিন্তু আজ রেবেকার কী হয়েছে কে জানে সে খেয়া বাধানো পথ ধরে রওনা দিল। শুধু যে খোয়া বাধানো পথ ধরে রওনা দিল তাই নয় রেবেকা হাঁটতে লাগল গদাই লস্করী চালে। নিতু বিরক্ত হয়ে বলল, কী হল? তুই এরকম ঢিলে হয়ে গেলি কেন?

রেবেকা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, কী বললি?

নিতু বিরক্ত হয়ে বলল, এখন সেটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর শুনতে হবে? হেঁটে হেঁটে শোনা যায় না?

যাবে না কেন? শোনা তো যায়ই। কিন্তু তবু রেবেকা নড়ে না, আরো ঢিলে হয়ে জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে।

তুই যেভাবে হাঁটছিস তাতে লাইব্রেরি যেতে লাগবে একমাস। রেবেকা খুব ধীরে ধীরে আবার হাঁটা শুরু করে বলল, লাগুক না। আমাদের কি কোনো তাড়াহুড়া আছে?

তাড়াহুড়া না থাকলেই তুই এরকম কচ্ছপের মতো হাঁটবি?

আচ্ছা বাবা অস্থা খরগোসের মতো হাঁটছি। বলে রেবেকা খরগোসের মতো দুইটা লাফ দিয়ে আবার দাঁড়িয়ে হি হি করে হাসতে শুরু করে। তারপর হঠাৎ হাসি থামিয়ে খোয়া বাঁধানো পথের পাশে কী একটা দেখিয়ে বলে, দেখ, দেখ।

কী দেখব?

এই ফুল গাছটা। কী সুন্দর ফুল দেখেছিস?

তারা প্রতিদিন সকাল বেলা এই দিক দিয়ে স্কুলে যায় বিকাল বেলা এই দিক দিয়ে স্কুল থেকে ফেরৎ আসে এই ফুলের গাছগুলি সবসময়েই দেখছে–কিন্তু এখন হঠাৎ করে রেবেকার কাছে ফুলগুলি কেন সুন্দর মনে হচ্ছে নিতু বুঝতে পারল না। রেবেকা শুধু সুন্দর ফুল দেখেই মুগ্ধ হল না হঠাৎ করে বলল, আয় গুনে দেখি গাছে কয়টা ফুল আছে!

কী বললি?

গুনে দেখি একটা গাছে কয়টা ফুল। তুই এদিকে থেকে গোনা শুরু কর, আমি ওদিকে থেকে গুনি— বলে সত্যি সত্যি রেবেকা গোনা শুরু করল।

নিতু এবারে সত্যি সত্যি খেপে গেল, বলল, তোর ইচ্ছে হলে ফুল কেন, গাছের পাতা আর মাঠের ঘাস গুনতে থাক, আমি গেলাম।

নিতু সত্যি সত্যি হোস্টেলে রওনা দিতেই রেবেকা দৌড়ে এসে নিতুর হাত ধরে ফেলল, আয় আয় প্লীজ, আমার একা যেতে ইচ্ছে করছে না।

লাইব্রেরির দিকে রওনা দিয়েও রেবেকা শুধু ধানাই পানাই করে, লাইব্রেরিতে পৌছেও সে লাইব্রেরির দরজায় বসে থাকা বুয়ার সাথে গল্প জুড়ে দেয় শুধু তাই না তার ঘরে আসা আরেকজনকে তার আগে পাঠিয়ে দিয়ে ইচ্ছে করে খানিকটা সময় নষ্ট করে ফেলল। শেষ পর্যন্ত সে বই জমা দিয়ে দেওয়ালে বড় ঘড়িটার দিকে তাকাল এবং হঠাৎ করে হোস্টেলে ফেরার জন্যে সে খুব ব্যস্ত হয়ে গেল। নিতুকে নিয়ে প্রায় ছুটতে ছুটতে হোস্টেলে এসে হাজির হল, ধুপ ধাপ করে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে এবং নিতুকে প্রায় টেনে নিজেদের রুমের দিকে নিতে থাকে। প্রত্যেক দিন যখন নিতুরা ক্লাশ থেকে ফিরে আসে আজকাল সব রুমে মেয়েরা হৈ চৈ করে গল্প গুজব করতে থাকে কিন্তু আজকে কেমন যেন নীরব।

নিজেদের রুমের সামনে এসে রেবেকা দাঁড়িয়ে গেল। দরজাটা ভেজানো রেবেকা নিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, যা ভেতরে ঢোক?

নিতু একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল, বিকাল বেলা থেকেই রেবেকা কেমন যেন বিচিত্র ব্যবহার করছে, কারণটা কী কে জানে। সে কয়েক মুহূর্ত রেবেকার দিকে তাকিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল, সাথে সাথে মনে হল একশ মেয়ে এক সাথে চিৎকার করে উঠল, হ্যা-পী-বার্থ-ডে-নি-তু-উ-উ-উ!

নিতু কিছু বোঝার আগেই ঘরের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা মেয়েরা চিৎকার করে বের হয়ে আসে, কাগজের বাঁশি বাজাতে থাকে, হাত তালি দিতে থাকে, শীষ দিতে থাকে এবং অর্থহীন ভাষায় চিৎকার করতে থাকে। নিতু অবাক হয়ে দেখল তাদের ঘরটাকে একটা পার্টির জন্যে সাজানো হয়েছে বিছানাগুলো ঠেলে সরিয়ে মাঝখানে জায়গা করা হয়েছে সেখানে একটা টেবিল। টেবিলে একটা কেক, কেকের মাঝে মোমবাতি জ্বলছে। পিছনে দেওয়ালে কাগজ কেটে লেখা শুভ জন্মদিন—নি। ঘরে রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হয়েছে, ঘরের কোনায় কোনায় বেলুন ঝুলছে।

নিতু হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল এবং হঠাৎ করে তার মনে পড়ল সত্যিই আজ তার জন্মদিন। যখন তার আম্মা বেঁচেছিলেন তখন হৈ চৈ করে তার জন্মদিন করা হয়েছে। এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে জন্মদিনের তারিখটা মনে রাখাটাও নিশ্চয়ই কোনো এক ধরনের অপরাধ বলে বিবেচনা করা হতো। তাই কোনো মেয়ে আর এটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। এখন শান্তা আপা আসার পর সব কিছু পাল্টো গেছে, শান্তা আপা ফাইল ঘেটে কবে কার জন্মদিন খুঁজে বের করে সবার জন্মদিন করা শুরু করছেন।

নিতু চোখ বড় বড় করে দাঁড়িয়ে রইল, কী বলবে বা কী করবে সে বুঝতে পারছিল না, সবগুলো মেয়ে তাকে ঘিরে হৈ চৈ আর চেঁচামেচি করতে থাকে। রেবেকা কেন বিকেল বেলা তাকে নিয়ে অনর্থক সময় নষ্ট করছিল এখন হঠাৎ করে সেটা নিতুর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

শুভ জন্মদিন নিতু  শান্তা আপার গলার স্বর শুনে নিতু ঘুরে তাকাল, শান্তা আপা আজকে কী সুন্দর একটা শাড়ি পরে আছেন! নিতু শান্তা আপার দিকে তাকিয়ে কী করবে বুঝতে না পেরে হঠাৎ ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল। শান্তা আপা অবাক হয়ে বললেন, আরে বোকা মেয়ে! একী হচ্ছে! কাঁদছ কেন?

নিতু চোখ মুছে বলল, আপা, আপনি চলে গেলে আমাদের কী হবে? শান্তা আপা অবাক হয়ে বললেন, আমি কেন চলে যাব?

জানি না। নিতু ফোঁপাতে ফেঁপাতে বলল, আমার খালি মনে হয় আপনি চলে যাবেন তখন আমরা আবার একা হয়ে যাব, কেউ আর আমাদের আদর করবে না।

ধুর বোকা! শান্তা আপা নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কেন আমি তোমাদের ছেড়ে চলে যাব?

আপনি তাহলে কথা দেন কখনো আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন না?

শান্তা আপার মুখটা হঠাৎ একটু বিষণ্ণ হয়ে যায়, নিতুর চোখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন, সেই কথা কী কেউ কখনো দিতে পারে? তবে আমার নিজের হাতে থাকলে তোমাদের কোনো একটা ব্যবস্থা না করে আমি কোথাও যাব না।

নিতু চোখ মুছল। শান্তা আপা নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, এসো এখন কেক কাটতে হবে। কেক কাঁটার পর উপহার খুলবে।

নিতু অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি কেকের পাশে বেশ কয়টা উপহার রঙিন কাগজে মুড়ে রাখা আছে।

ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভানোর আগে মিতুল বলল, তুই মনে মনে একটা কিছু ইচ্ছা করে ফুঁ দে। যদি এক ফুয়ে সব মোমবাতি নিভিয়ে দিতে পারিস তাহলে তোর ইচ্ছা পূরণ হবে।

সত্যি?

সত্যি।

নিতু বুক ভরে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে এক ফুয়ে সবগুলো মোমবাতি নিভিয়ে দিতেই সবাই হাত তালি দিয়ে উঠে। রুনু জিজ্ঞেস করল, কী ইচ্ছা করেছিস রে নিতু?

নিতু ইচ্ছা করেছে যেন শান্তা আপা কখনো তাদের ছেড়ে চলে না যান, কিন্তু সেটা সবার সামনে বলতে তার একটু লজ্জা করল, সে বলল, উহুঁ বলব না। এটা সিক্রেট।

ঝুনু বলল, বুঝেছি। নিশ্চয়ই মনে মনে একটা সুন্দর জামাই চেয়েছে।

ঝুনুর কথা শুনে সবাই হি হি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। শান্তা আপাও হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতেই বললেন, নিতু এত ভালো একটা মেয়ে সুন্দর একটা বর তো চাইতেই পারে। আর সুন্দর হোক কী না হোক ভালো যেন হয়। ভালো একটা মেয়ের ভালো একটা বর! তাই না নিতু?

নিতু লজ্জায় টমেটোর মতো লাল হয়ে উঠল। মিতুল নিতুকে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে শান্তা আপাকে বলল, আপা, আপনি কাকে ভালো একটা মেয়ে বলছেন? নিতু কী রকম পাজী আপনি জানেন? ও এখন পর্যন্ত কী কী করছে শুনলে আপনার হার্ট এটাক হয়ে যাবে।

রেবেকা বলল, পাজী একটা মেয়ের পাজী একটা বর দরকার।

শান্তা আপা বললেন, উহুঁ। তাহলে তো আরো বেশি দরকার ভালো একটা বরের, যেন দেখে শুনে রাখতে পারে। তাই না নিতু?

বর এবং তার ভালো মন্দের আলোচনা এবং সে কী পরিমাণ পাজী সেই আলোচনায় নিতু একেবারেই মজা পাচ্ছিল না তাই আলোচনা ঘোরানোর জন্যে বলল, আমি কী কেকটা এখন কাটব?

হ্যাঁ হ্যাঁ। মেয়েরা কেকটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, কাট কাট।

শান্তা আপা বললেন, তার আগে হ্যাপি বার্থ ডে গান গাইতে হবে। বলে নিজেই শুরু করলেন, তার সাথে সবাই যোগ দিল,

হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ
হ্যাপি বার্থ ডে টু নিতু
হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ…

সবাই উচ্চ স্বরে চিৎকার করে হাত তালি দিতে থাকে এবং তার মাঝে নিতু কেকটা কাটল। কেক কেটে টুকরো টুকরো করে সবাইকে দেয়া হল, সাথে খাবার জন্যে চানাচুর আর মিষ্টি আনা হয়েছে। তানিয়া আর মিতুল মিলে সবাইকে প্লেট করে খাবার দিতে থাকে। খাওয়া শেষ হবার পর উপহার খোলা হল। শান্তা আপা দিয়েছেন, সত্যজিৎ রায়ের বই। মেয়েরা কেউ দিয়েছে চুলের ক্লীপ, ফিতা আর চকলেটের প্যাকেট। সবচেয়ে সুন্দর যে উপহারটা সেটা হচ্ছে একটা জন্মদিনের কার্ড যেখানে সব মেয়ে কিছু একটা লিখে নিচে নিজের নাম লিখে দিয়েছে। ফুল লতা পাতা পাখি এঁকে সেই কার্ডটা নিজেরাই তৈরি করেছে।

পার্টি শেষ হবার পর নিতুদের ঘরটার যা একটা আবস্থা হল সেটি আর বলার মতো নয়, সেটা পরিষ্কার করতে গিয়ে সবার প্রায় বারটা বেজে যাবার মতো অবস্থা। নিতুর জন্মদিন বলে কেউ তাকে হাত লাগাতে দিচ্ছি না কিন্তু তবুও সে জোর করে সবার সাথে হাত লাগালো। সব কয়জন মেয়ে তার জন্যে এমন চমৎকার একটা জন্মদিনের উৎসব করেছে, সে কেমন করে এখন এই কাজ থেকে পিছিয়ে থাকে?

 

বেশ কয়দিন পরের কথা, সন্ধে বেলা সবাই পড়তে বসেছে এরকম সময় শান্তা আপা এসে হাজির হলেন। সবাই পড়ার টেবিল ছেড়ে লাফিয়ে উঠে শান্তা আপাকে ঘিরে দাঁড়াল। শান্তা আপা জিজ্ঞেস করলেন, কেমন হচ্ছে তোমাদের পড়াশোনা?

সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বলল, পড়তে ইচ্ছে করছে না আপা।

তাহলে কেমন করে হবে। ইচ্ছে করুক আর নাই করুক, সবাইকে পড়তে হবে।

নিতু মুখ কাচু মাচু করে বলল, প্রত্যেক দিনই তো পড়ি।

শান্তা আপা এসে নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ঠিক আছে আজকে যদি সবাই মন দিয়ে পড়াশোনা কর তাহলে রাত্রি বেলা একটা মজা করতে পারি।

সবাই আনন্দে লাফিয়ে উঠল। রেবেকা জিজ্ঞেস করল, কী মজা আপা?

আজকে হচ্ছে পূর্ণিমা। আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার তাই রাত্রি বেলা দেখবে কী চমৎকার জ্যোৎস্না হবে। সেই জ্যোৎস্নার আলোতে আজ রাতে গানের আসর হবে। তোমরা গান গাইতে পার তো?

পারে আপা পারে। মিতুল পারে।

ভেরি গুড। এখন পড়তে বসে যাও। আমি রুমে রুমে গিয়ে সবাএক বলে আসি।

সেদিন রাত্রিবেলা যখন সবার ঘুমিয়ে যাবার কথা তখন সবাই এসে বারান্দায় গোল হয়ে বসেছে। হোস্টেলের সব কয়টি লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে তাই শুধু মাত্র জোৎস্নার নরম আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। নিতু অবাক হয়ে জ্যোৎস্নার আলোর দিকে তাকিয়ে রইল কতবার নিশ্চয়ই এখানে পূর্ণিমা এসেছে এবং চলে গিয়েছে, কখনো চোখ মেলে দেখে নি, আজ প্রথম দেখছে। জ্যোৎস্নার আলো কী সুন্দর। মনে হয় কেউ একজন অনেক হিসেব করে এই আলোটা তৈরি করেছে, যেন বেশি উজ্জ্বল না হয়ে যায় আবার বেশি অন্ধকারও না হয়ে যায়। দেখে মনে হয় সবকিছু দেখা যাচ্ছে কিন্তু আবার ভালো করে দেখতে চাইলে সবকিছু কেমন যেন আবছা হয়ে যায়। মনে হয় কোনটা কী রং বোঝা যাচ্ছে কিন্তু ভালো করে দেখতে চাইলেই সেটা অস্পষ্ট হয়ে যায়। মনে হয় সবকিছুকে কোমল একটা কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। নিতু অবাক হয়ে জ্যোৎস্নার আলো আর এই আলোতে অন্য সবার দিকে তাকিয়ে রইল। একটু আগেই যে মেয়েরা চেঁচামেচি হৈ চৈ করছিল চৈ করছিল জ্যোৎস্নার নরম আলোতে এসে তারাই আবার কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। কী আশ্চর্য!

শান্তা আপা মাঝখানে এসে বসে বললেন, একটা হরমোনিয়াম আর তবলা থাকলে কী চমৎকার হত।

কেউ কিছু বলল না, নিতু মিতুলকে গান শেখানোর কথা বলার পর কী ভয়ংকর অবস্থা হয়েছিল সেটা সবার মনে পড়ে গেল কিন্তু এই চমৎকার পরিবেশে সেটা বলতে কারো রুচি হল না। শান্তা আপা বললেন, নাও, কে শুরু করবে?

কেউ কিছু বলল না, তখন শান্তা আপা আবার বললেন, কী হল? এত লজ্জা পেলে কেমন করে হবে? গীও কেউ একজন।

নিতু বলল, আমরা তো গান গাইতে পারি না, শুধু মিতুল পারে।

শান্তা আপা বললেন, মিতুল গাও একটা গান।

মিতুল লজ্জা পেরে বলল, আপা, আমার খুব গান গাইতে ইচ্ছে করে কিন্তু আমি তো কখনো গান গাইতে শিখি নাই, তাই কোনো গান পুরোটা জানি না!

যেটুকু জান সেটুকুই গাও।

মিতুল তখন গান গাইতে শুরু করল, তার গলা থেকে মধুর একটা সুর জ্যোৎস্নার আলোতে ছড়িয়ে পড়ল এবং হঠাৎ করে সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো নিশ্চপ হয়ে গেল। মিতুল যে কয়টা লাইন জানে সেটাই নিজের মতো করে খানিকটা ভুল সুরে এবং অনেক জায়গায় ভুল কথায় গেয়ে শোনাল কিন্তু সেটা শুনেই শান্তা আপা একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন।

গান শেষ হবার পর শান্তা আপা মিতুলকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, কী সর্বনাশ! মিতুল, তুমি এখানে কী করছ? খোদা তোমাকে যে গলা দিয়ে পাঠিয়েছেন তোমার তো বিশ্বজয় করতে হবে।

নিতু বলল, আপা, মিতুল এর মাঝে হোস্টেল জয় করে ফেলেছে।

সেটা কী রকম?

মিতুল ইচ্ছে করলে গান গেয়ে গ্লাশ, লাইট বাল্ব জানালার কাঁচ এসব ভেঙ্গে ফেলতে পারে।

শান্তা আপা অবিশ্বাসের সুরে বললেন, সত্যি?

সত্যি। তখন একাধিক মেয়ে গান গেয়ে জানালার কাঁচ ভেঙ্গে খোরাসানী ম্যাডাম আর আগের হোস্টেল সুপারেকে জব্দ করার ঘটনাটা শান্তা আপাকে শোনাল। শান্তা আপা হতবাক হয়ে বসে থেকে বললেন, পৃথিবীর কত বড় বড় শিল্পী আছে, তারা সারা জীবন সাধনা করে গলার মাঝে এরকম কন্ট্রোল আনে

আর আমাদের মিতুল এখানে বসে থেকে সেটা করতে পারে? কী আশ্চর্য!

রেবেকা বলল, আসলেই আশ্চর্য আপী। মিতুলের জ্যোৎস্না রাতের গানটা শুনেন, সেটা সবচেয়ে ভালো।

শান্তা আপা মিতুকে বললেন, পাও মিতুল।

মিতুল আবার গাইতে শুরু করল, আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে বসন্তের এই মাতাল সমীরণে …

সেই গান শুনে সবার মনে হতে লাগল সত্যিই বুঝি সবাই এই জ্যোৎস্নারাতে বনে চলে এসেছে। এই হোস্টেল, এই স্কুল, মানুষজন সবকিছু মিথ্যা, মিতুল যেটা বলছে সেটাই সত্যি। মিতুল গান গাইতে গাইতে কথা ভুলে যাচ্ছিল তখন শান্তা আপা তাকে সেটা ধরিয়ে দিতে লাগলেন।

গান শেষ হবার পরও অনেকক্ষণ সবাই চুপ করে বসে রইল, ওদের মনে হতে লাগল মিতুল বুঝি সবাইকে যাদু করে ফেলেছে।

গানের আসর শেষ হতে হতে মাঝ রাত হয়ে গেল, চাদটা যখন মাথার উপর উঠে গেছে বারান্দায় আর জ্যোৎস্নার আলো নেই তখন শান্তা আপা সে দিনের মতো আসর শেষ করলেন। কথা থাকল এখন থেকে প্রতি রাতে এরকম গানের আসর বসবে।

মেয়েরা আরো একটা জিনিস আবিষ্কার করল, শান্তা আপাও খুব সুন্দর গান গাইতে পারেন। সবার শেষে শান্তা আপা দুটি গান গেয়ে শোনালেন আর সেটা শুনে মিতুল শান্তা আপাকে বলল, আপা।

কী মিতুল?

আপনি আমাকে গান শেখাবেন?

শান্তা আপা খিল খিল করে হেসে বললেন, আমি তোমাকে কেমন করে শেখাব? আমি কী কিছু জানি? তোমাকে গান শেখাবে সত্যিকারের গানের ওস্তাদ।

মিতুল ম্লান মুখে বলল, কিন্তু আপা, আমি ওস্তাদ কোথায় পাব?

তোমাকে পেতে হবে কে বলেছে? তোমার জন্যে ওস্তাদ আমি খুঁজে বের করব। এই শহরে সবচেয়ে ভালো যে গানের ওস্তাদ আছে সে তোমাকে গান শেখীবে, তারপর শেখাবে যে দেশের মাঝে সবচেয়ে ভালো ওস্তাদ সে! বুঝেছ?

মিতুল মাথা নাড়ল। শান্তা আপা বললেন, কেন তোমার জন্যে আমি সবচেয়ে ভালো ওস্তাদ খুঁজে বের করব জান?

কেন আপা?

কারণ তুমি যখন সারা পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত গায়িকা হবে তখন যখন বিবিসি থেকে তোমার ইন্টারভিউ নেয়া হবে সেখানে সাংবাদিকরা তোমাকে জিজ্ঞেস করবে তুমি কেমন করে গান গাইতে শিখেছ, তখন তুমি আমার কথা বলবে! আর আমিও তখন বিখ্যাত হয়ে যাব।

আশে পাশে যারা দাঁড়িয়েছিল তারা বলল, আমরা তাহলে কেমন করে বিখ্যাত হব আপা?

নিতু হি হি করে হেসে বলল, আমরা একদিন মিতুলকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিই আপা, তাহলে বলতে পারব আমরা বিশ্ববিখ্যাত গায়িকাকে পিটিয়েছি।

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। শান্তা আপাও।

 

শান্তা আপী নিজের ঘরে এসে দেখলেন তার ঘরের দরজায় একটা চিঠি রাখা আছে। সবাই মিলে যখন জ্যোৎস্নার আলোয় বসে গান গাইছিল তখন কেউ একজন এসে তার দরজায় এই চিঠিটা রেখে গেছে। শান্তা আপা চিন্তিত মুখে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন, আলো জ্বেলে খাম খুলে চিঠিটা বের করলেন, ভিতরে একটা সংক্ষিপ্ত চিঠি, খোরাসানী ম্যাডাম লিখেছে। চিঠি লিখে সে জানিয়েছে স্কুল বোর্ড থেকে তাকে দেয়া ক্ষমতার বলে এই স্কুলের শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে শান্তা চৌধুরীকে বরখাস্ত করা হল। আগামী চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে তাকে স্কুল ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যেতে হবে।

শান্তা আপা তার বিছানায় গিয়ে বসলেন, কয়দিন থেকেই তার মনের ভিতরে এরকম একটা সন্দেহে দানা বেঁধে উঠছিল।

১০. বেগম জোহরা কামাল

ভোরবেলা হোস্টেলের মেয়েরা ভয়াবহ আতংকে জেগে উঠল, অনেকদিন পর হঠাৎ করে শুনতে পেল বারান্দায় গুম গুম শব্দ করে খোরাসানী ম্যাডাম হাঁটছে এবং হাঁটতে একেকটা রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় একটা লাথি মেরে হুংকার দিয়ে বলছে, দশ মিনিটের মাঝে মাঠে। নাহলে জবাই করে ফেলব।

নিতুর বুকটা ধ্বক করে উঠে, শান্তা আপা আসার পর থেকে তাদেরকে বুক আগলে খোরাসানী ম্যাডাম থেকে রক্ষা করে এসেছেন এখন হঠাৎ করে খোরাসানী ম্যাডাম ফিরে এসেছে, তার মানে কী? তাহলে কী শান্তা আপার কিছু হয়েছে? শান্তা আপা কী হাসপাতালে? একসিডেন্ট হয়েছে? নাকি খোরাসানী ম্যাডাম খুন করে তার ডেডবডি কোথাও পুতে ফেলেছে? নিতু ভয়ার্ত মুখে অন্যদের দিকে তাকায়, সবাই ফ্যাকাসে মুখে বসে আছে, হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে তাদের বুঝি কোনো প্রিয়জন মারা গেছে এবং তারা কী করবে বুঝতে পারছে না। কিন্তু খোরাসানী ম্যাডাম বলেছেন দশ মিনিটের মাঝে মাঠে হাজির হতে হবে, তাই কেউ আর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামানোরও সময় পেল না। দৌড়াদৌড়ি করে বিছানা থেকে উঠে যে যেভাবে পারে কোনোরকমে ঘুমের পোশাক ছেড়ে অন্য কিছু একটা পরে মাঠের দিকে ছুটল। শান্তা আপার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় সবাই এক মুহূর্তের জন্যে থেমে বন্ধ দরজার দিকে তাকাল, সেখানে একটা তালা ঝুলছে। ঘর ছেড়ে যাবার সময় শান্তা আপা প্রায় সব সময় তার দরজা খোলা রেখে যেতেন। মাঝে মাঝে ঘর বন্ধ করে যেতে হলে শান্তা আপা এই তালাটি লাগিয়ে যেতেন। চাবি কখনো সাথে নিতেন না জানালার কাছে আড়াল করে রেখে যেতেন সব মেয়েরা সেটি জানত। ঘরে তার তালাটি লাগানো কাজেই শান্তা আপা নিশ্চয়ই তার ঘরের তালা মেরে কোথাও গিয়েছেন। কিন্তু কোথায়?

সব মেয়ে ভয়ার্ত এবং পাংশু মুখে মাঠে লাইন বেঁধে দাঁড়িয়েছে তখন গুম গুম করে হেঁটে খোরাসানী বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কোমরে হাত দিয়ে খোরাসানী ম্যাডাম একটা জেনারেলের মতো দাঁড়াল, তার ঠিক পিছনেই জমিলার মা এসে দাঁড়িয়েছে, আজকে তাকে দেখতেও আমরি সুবদোরের মতো দেখাচ্ছে। খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, হতচ্ছাড়া পাজী, বদমাইস শয়তানের ঝাড়।

সবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। খোরাসানী ম্যাডাম সবার দিকে তাকিয়ে আবার খেকিয়ে উঠল, আরশোলার বাচ্চা, নোংরা ইঁদুর, হুকওয়ার্মের ছাও।

নিতু একটা নিশ্বাস ফেলল। গালাগালির মাঝেও কী এই দানবটি একটু সমবেদনা দেখাতে পারে না?

খোরাসানী ম্যাডাম হতে দিয়ে নিজের গলা কেটে ফেলার ভঙ্গি করে বলল, তোদের দিন শেষ। এখন তাদের জবাই করব। একজন একত্র করে। জবাই করে চামড়া ছিলে ফেলব। বুঝেছিস?

সবাই চুপ করে রইল খোরাসানী ম্যাডাম তখন আকাশ ফাটিয়ে হুংকার দিল, বুঝেছিস?

সবাই তখন ভয় পেয়ে একসাথে বলল, বুঝেছি, ম্যাডাম।

বুতরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ে আর কিছু থাকুক কী না থাকুক, এখানে একটা জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে শৃঙ্খলা। সেই শৃঙ্খলার যদি কেউ উনিশ-বিশ করে তাকে এই স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। খোরাসানী ম্যাডাম দাতের ফাঁক দিয়ে হুশশ করে একটা নিশ্বাস টেনে বলল, তোদের সেই হতভাগা হোস্টেল সুপারিনটেন্টেকে তাই এখান থেকে বের করে দিয়েছি। গরিলারা যেভাবে বুকে থাবা দেয় খোরাপানী ম্যাডাম সেইভাবে থাবা দিয়ে বলল, আমি ম্যাডাম খোরাসানী। আমি এই স্কুল চালাই যারা আমার কথা শুনে না এই স্কুলে তাদের জায়গা নাই। যন্ত্রণা যেটা ছিল সেটা দূর হয়েছে। আৰাগীর বেটি শান্তা চৌধুরী ইজ আউট। সে আর এই খানে ফেরত আসবে না। এখন আমি একজন একজন করে তোদের সিধা করব। তাদের চামড়া ছিলে সেই চামড়া দিয়ে আমি ডুগডুগি বাজাব।

খোরাসানী ম্যাডাম সবগুলো মেয়ের দিকে তাকিয়ে দাঁত দাঁত ঘষে আবার হুংকার দিয়ে বলল, আমি সব খবর রাখি। সব খবর। এই হোস্টেলে নাকি বার্থডে পার্টি হয়। খোরাসানী ম্যাডাম মুখ ভেংচে বলল, বার্থ-ডে-পার্টি! আমি দেখব সেই বার্থ-ডে পার্টি কে করে। বার্থ ডে না—ডেথ ডে হবে এখন থেকে। খুন করে ফেলব আমি। খুন!

নিতু একটা নিশ্বাস ফেলল, ভয় নয় হঠাৎ কেমন জানি ভয়ংকর রাগে নিতুর শরীরে ঝাঁ ঝাঁ করে উঠতে থাকে।

এখানে নাকি গানের আসর হয়। খোরাসানী ম্যাডাম মুখ খিচিয়ে বলল, গী-নে-র আ-স-র। আমি গানের আসর করা বের করব।দেখব, গানের আসর কেমন করে হয়। সবাইকে দিয়ে আমি যদি মড়া কান্নার আসর না বসাই তাহলে আমি ম্যাডাম খোরাসানী না। তোদের বাবা মা তোদের চায় না। তোদের ভাইবোন তোদের চায় না। তোদের আত্মীয় স্বজনও তাদের চায় না, তাই তোদেরকে এই খানে দিয়ে গেছে। এই পৃথিবীতে তোদের কোনো জায়গা নাই। যদি সিধা হয়ে না থাকিস তাহলে এই বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়েও তোদের জায়গা হবে না। আমি খুন করে তোদের মাটিতে পুঁতে ফেলব। খোরাসানী ম্যাডাম মাথা ঘুরিয়ে হিংস্র চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কথা বিশ্বাস হয়?

সবাই চুপ করে রইল, তখন খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলল, বিশ্বাস-হ-য়?

সবাই সমস্বরে বলল, হয় ম্যাডাম।

হ্যাঁ। বিশ্বাস হয়। না হয়ে উপায় নাই — এইভাবে এক সুরে খোরাসানী ম্যাডাম পাকা পায়তাল্লিশ মিনিট গালাগালি করে গেল। নিতু এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে খোরাসানী ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে থাকে, একজন মানুষ কী রকম করে এতো হৃদয়হীন আর নিষ্ঠুর হতে পারে? নিজের চোখে না দেখলে নিতু কখনো বিশ্বাস করত না যে একজন মানুষ তাদের মতো বাচ্চা মেয়েদের এত ঘেন্না করতে পারে। তারা কী সত্যিই এত খারাপ?

গালাগাল শেষ করে খোরাসানী ম্যাডাম সবাইকে নিজের ঘরে পাঠাল। সবাইকে প্রথমে নিজের ঘর পরিষ্কার করে তারপর বাথরুম এবং টয়েলট পরিষ্কার করতে হবে। এটা হচ্ছে তাদের শাস্তির শুরু, দুপুরের খাবারের পর নাকি সত্যিকারের শাস্তি শুরু হবে।

কেউ একটি কথা না বলে মাথা নিচু করে নিজেদের ঘরে ফিরে যেতে শুরু করল। শান্তা আপার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় মিতুল নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, শান্তা আপার কী হয়েছে মনে হয়?

রেবেকা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মনে হয় খুন করে ফেলেছে।

সবাই চমকে উঠে রেবেকার দিকে তাকল, নিতু বলল, কী বলছিস তুই?

শান্তা আপা কী কখনো আমাদের কিছু না বলে চলে যাবেন?

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, না।

তাহলে?

নিতু বলল, শান্তা আপা হয়তো কোনো কাজে গেছেন, চলে আসবেন আবার।

তানিয়া গম্ভীর গলায় বলল, খোরাসানী ম্যাডাম কোনো একটা ফন্দি করে শান্তা আপাকে বহিরে পাঠিয়েছে। এখন গেট বন্ধ করে রাখবে শান্তা আপাকে আর ঢুকতে দেবে না।

নিতু শান্তা আপার ঘরের বন্ধ দরজায় ঝোলানো তালার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল, যদি শান্তা আপা আর ফিরে না আসে তাহলে আমাদের সবার জীবন শেষ।

মিতুল মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ জীবন শেষ।

একজন একজন করে খুন করে আমাদের পুঁতে ফেলবে। পৃথিবীর কেউ আর খোঁজ পাবে না।

কেউ খোঁজ পাবে না?

নিতু হঠাৎ চোখ বড় বড় করে বলল, খোরাসানী ম্যাডামকে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেওয়া যায় না?

পুলিশের কাছে?

হ্যাঁ।

কেন?

সে যে মেয়েদেরকে খুন করেছে।

সবাই মাথা নাড়ল, কারো মনে এ ব্যাপারে একটু সন্দেহ নেই। রুনু দুর্বল গলায় বলল। কিন্তু তার প্রমাণ কই?

নিশ্চয়ই প্রমাণ আছে। খুঁজলেই পাওয়া যাবে। কোথায় খুঁজৰি?

রেবেকা হঠাৎ চমকে উঠে বলল, মনে নাই শান্তা আপার ঘরে একটা ধাপের মতো আছে, ভিতরে একটা বাক্স।।

সবাই চোখ বড় বড় করে রেবেকার দিকে তাকাল। মিতুল বলল, কিন্তু শান্তা আপাকে না বলে সেটা খুলবি?

শান্তা আপা কিছু মনে করবেন না।

নিতু বলল, মনে নাই শান্তা আপা বলেছিলেন যখন এডভেঞ্চার করার ইচ্ছা করবে তখন সেটা খোলা হবে?

এখন কী এডভেঞ্চার করার ইচ্ছা করছে?

এর থেকে বড় এডভেঞ্চার আর কী হতে পারে? আমাদের একজন একজনকে মেরে পুতে ফেলবে ম্যাডাম নিজে বলেছে।

তা ঠিক।

তাহলে দেরি করে কাজ নেই, আয় কাজ শুরু করে দিই।

যখন সব মেয়েরা নিজেদের ঘর পরিষ্কার করে বাথরুম পরিষ্কার করছিল তখন নিতু আর তার বন্ধুরা শান্তা আপার ঘরে ঢুকে গেল। শান্তা আপা সাধারনত তার ঘরে তালা লাগাতেন না, এটা খোলাই থাকত। মেয়েরা জিজ্ঞেস করলে বলতেন, আমার ঘরে কী ই বা আছে নেয়ার মতো! আর হোস্টেলের মেয়েরা চারপাশে থাকলে চোর ডাকাতের সাহস হবে কাছে আসার?

শান্তা আপা যদি কখনো বাইরে যেতেন তাহলে তালা মেরে চাবিটা জানালার ওপর একটু আড়াল করে রেখে যেতেন, সব মেয়েরাই সেটা জানে। শান্তা আপা নিজেই মাঝে মাঝে কাজ করতে করতে কোনো একটা মেয়েকে বলতেন তার ঘর খুলে কিছু একটা নিয়ে আসতে। কাজেই শান্তা আপার ঘরে ঢোকা খুব কঠিন কিছু নয়। রুনুকে বাইরে রেখে অন্য সবাই ভিতরে ঢুকে গেল, রুনু বাইরে থেকে আবার তালা মেরে দিল, হঠাৎ করে খোরাসানী ম্যাডাম এসে গেলে যেন বুঝতে না পারে শান্তা আপার ঘরে কেউ আছে।

রুনু যখন একা তাদের ঘরটা পরিষ্কার করছে তখন অন্য সবাই শান্তা আপার ঘরের ভিতরে কাজে লেগে গেল। ঘরের মাঝামাঝি দেয়ালের সাথে লাগানো ধাপটার একটা ছোট সুন্দর কার্পেট বিছিয়ে শান্তা আপা খুব সুন্দর একটা বসার জায়গা তৈরি করেছেন। ওরা সেটা সরিয়ে ধাপটা বের করে নিল। রান্নাঘর আর স্টোর রুম খুজেঁ একটা বড় ক্রু ড্রাইভার, একটা হাতুরি আর একটা বটি পাওয়া গেল। এগুলো দিয়েই তারা কাজ শুরু করে দেয়। এক পাশে প্যালেস্তারা খসে খানিকটা জায়গা বের হয়ে আছে সেখানে কে তারা পুরোটা বের করে আনতে শুরু করে। খুব সাবধানে কাজ করতে হচ্ছিল, হঠাৎ করে বেশি শব্দ হয়ে গেলে অন্যেরা সন্দেহ করতে পারে। ভিতরে যে পাঁচজন আছে তাদের মাঝে একজন সবসময় জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, সন্দেহজনক কিছু দেখলেই সে একটা সংকেত দিত এবং অন্য সবাই কাজ থামিয়ে ফেলত।

ধাপের ভেতর লুকিয়ে থাকা বাক্সটা বের করা প্রথমে একটা দুঃসাধ্য কাজ বলে মনে হল। ঠিক কী ভাবে কাজ শুরু করলে কাজটা সহজ হবে সেটাও তারা বুঝতে পারছিল না। শেষ পর্যন্ত ঠুকে ঠুকে ওপরের প্যালেস্তারাটা সরিয়ে ফেলাই একমাত্র উপায় বলে মনে হওয়ার পর একজন হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে ফাটল তৈরি করতে শুরু করে লাগল, অন্যেরা খুচিয়ে খুচিয়ে সেটা তুলে ফেলতে লাগল। ঘণ্টা খানেক কাজ করার পর কাজটা বেশ সহজ হয়ে গেল, স্কু ড্রাইভারের ফলা দিয়ে বাক্সের ওপর চাড় দিতেই একসাথে অনেকটুকু খুলে আসতে থাকে। ভেতরের বাক্সটা এখন বেশ বোঝা যাচ্ছে। এই বাক্সের ভেতরে একটা মেয়ের মৃত্যুদেহু থাকতে পারে ভেবে তাদের বুকের ভিতরে কেমন জানি শির শির করতে থাকে। আরো ঘণ্টাখানেক কাজ করার পর পুরো বাক্সটা বের হয়ে আসে।

সেটাকে ধরাধরি করে বের করে আনা মাত্রই জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা তানিয়া হঠাৎ চাপা স্বরে বলল, সাবধান।

সবাই যে যার জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তানিয়া জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে হঠাৎ একেবারে ফ্যাকাসে হয়ে গেল, রক্তশূন্য মুখে অন্যদের দিকে বলল, খোরাসানী ম্যাডাম।

তানিয়া জানালা থেকে সরে আসে যেন বাইরে থেকে দেখা না যায়। একটু পরেই তারা গুম গুম পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল এবং পায়ের শব্দ ঠিক শান্তা আপার ঘরের সামনে এসে থেমে গেল। নিতু এবং তার বন্ধুদের হৃৎস্পন্দন থেমে আসতে চায়। তারা নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে খোরাসানী ম্যাডামের গলার আওয়াজ শোনা গেল, শেষ পর্যন্ত যন্ত্রণাটাকে দূর করা গেছে।

যন্ত্রণা বলতে নিশ্চয়ই শান্তা আপাকে বোঝাচ্ছে। সাথে নিশ্চয়ই জমিলার মা আছে কারণ তার গলা শোনা গেল, জি মাডাম। যন্ত্রণা গেছে। আপদ বালাই দূর হইছে। একটু থেমে যে কথাটা বলল শুনে ভিতরে সবাই একেবারে চমকে উঠে, ঘরটা খুলবেন না ম্যাডাম?

চাবি এনেছিস?

চাবি তো নাই ম্যাডাম।

খোরাসানী ম্যাডাম তালা ধরে বলল, এই তালা খুলতে আবার চাবি লাগে নাকি? একটা লাথি দিলেই খুলে যাবে।

দিবেন একটা লাথি?

ভিতরে সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে রইল, শুনতে পেল কয়েক মুহূর্তে পরে খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, নাহ! এই মহিলা সাংঘাতিক বড় যন্ত্রণা। দেশের সব আইন কানুন জানে। তালা ভেঙ্গে ঘরে ঢুকলে আবার না কেস ফেস করে দেয়। যন্ত্রণা হবে।

জমিলার মা জিজ্ঞেস করল, কোথায় আছে এখন?

ঠিক জানি না। রাত্রে চিঠি পাওয়ার পর অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। খুব সকাল বেলা বের হয়ে গেছে। খোঁজ নেওয়ার জন্যে লোক লাগিয়েছি।

দরজার বাইরে খোরাসানী ম্যাডাম আর জমিলার মা আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। শেষে শোনা গেল খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, আয় যাই। শয়তানের ঝাড় গুলিরে একটা দাবড়ানি দিয়ে আসি।

জমিলার মা বলল, ম্যাডাম, এত মানুষ দেখেছি জীবনে, কিন্তু আপনার মতো দাবড়ানি আর কেউ দিতে পারে না।

ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে খোরাসানী ম্যাডাম বলল, দাবড়ানীর তুই দেখেছিস কী? এখনও তো শুরু করলামই না?

ঘরের ভেতরে সবাই নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে শুনতে পায় গুম গুম করে পা ফেলে খোরাসানী ম্যাডাম চলে যাচ্ছে। পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে তারা আবার বাক্সের উপর ঝুঁকে পড়ল। এটা খুলে ভিতরে কী দেখা যাবে কে জানে। যে ভাবে এটাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এর মাঝে কোনো না কোনো রহস্য নিশ্চয়ই আছে। কাঠের বাক্সের ঢালাটাতে একটা ছোট তালা লাগানো ছিল, দীর্ঘদিনে জংধরে সেটা জীর্ণ হয়ে গেছে, হাত দিয়ে ঝাকুনী দিতেই খুলে গেল! বাক্সের তালা ধরে টেনে খোলার আগে নিতু সবার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলর যদি ভিতরে একটা কংকাল থাকে কেউ ভয় পাবি না তো?

সবাই মাথা নাড়ল, বলল, তারা ভয় পাবেন এবারে সাবধানে ঢালাটা ধরে টেনে উপরে তোলার চেষ্টা করে। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে ঢালাটা খুলে যায়, ভেতর থেকে এক ধরনের ভ্যাপসা চোটকা গন্ধ বের হয়ে আসে। সবাই ভয়ে ভয়ে ভিতরে তাকাল, সেখানে কোনো কংকাল নেই—আছে কিছু বই, খাতা, কাগজ পত্র, কিছু ব্যবহারের জিনিস। নিতু সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়, যদিও মুখে কংকালের কথা বলছিল কিন্তু সত্যি সত্যি একটা কংকাল বের হয়ে গেলে কী করত কেউই জানে না।

ওরা ধীরে ধীরে বই খাতা কাগজ পত্রগুলো বের করতে থাকে। প্রথম বইটি রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। বইয়ের ভেতরের পৃষ্ঠায় নাম লেখা বেগম জোহর। কামাল। ওরা আরো একটা বই বের করল এই বইটার নাম তিথিডোর, লেখকের নাম বুদ্ধদেব বসু। এই বইটার উপরেও নাম লেখা বেগম জোহরা কামাল। ওরা আরো কয়েকটা বই বের করল, একটা ইংরেজি বই, নাম দা জাংগল বুক, লেখকের নাম রুডইয়ার্ড কিপলিং। একম আরো বেশ কিছু বাংলা আর ইংরেজি বই। তার নিচে কয়েকটা ডাইরি। পাতা পুরানো হয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে, ভিতরে গোটা গোটা হাতে লেখা, কোনো পৃষ্ঠায় একটা ছোট কবিতা, কোনো পৃষ্ঠায় একটা ছোট লিস্ট, কোনো পৃষ্ঠায় একটা দিনের বর্ণনা, আবার কোনো পৃষ্ঠায় একটা চিঠির অংশ। ডাইরিগুলো সরিয়ে তারা আরো কিছু খাতা পেল। গোটা গোটা হাতে সেই খাতায় অনেক কিছু লেখা, মনে হয় গল্প বা উপন্যাস। এবারে নিতু আর তার বন্ধুদের আশাভঙ্গ হতে শুরু করেছে। পুরো বাক্সটাই হচ্ছে বেগম জোহরা কামাল নামের একজন ভদ্রমহিলার বই, কাগজপত্র, লেখালেখির নমুনা আর ডাইরি। ভদ্রমহিলা যেসব বই পড়তেন বা যেভাবে লেখা লেখি করেছেন সেটা দেখে মনে হয় তিনি মানুষটা বেশ জ্ঞানী এবং বুদ্ধিমতী ছিলেন কিন্তু এত বড় বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এই বাক্সটা খুলে তার ব্যক্তিগত কাগজপত্র বের করে কী লাভ হল তারা বুঝতে পারল না। সত্যি কথা বলতে কী নিতু আর তার বন্ধুদের বেশ মন খারাপ হয়ে গেল। তারা এবারে দ্রুত বাক্স হাতড়ে কাগজপত্রগুলো বের করতে থাকে। একটা চিঠির বাণ্ডিল বের হল। বেশ কিছু খবরের কাগজ বের হল, একটা এলবাম সেখানে অনেকগুলো পারিবারিক ছবি, সবগুলো, ছবি সাদা কালো তখন নিশ্চয়ই রঙিন ছবি ছিল না। ওদের এখন ছবি দেখার সময় নেই তাই সেগুলো সরিয়ে রেখে অন্যান্য জিনিসগুলো বের করতে থাকে। ছোট একটা। টিনের কৌটা, তার মাঝে কিছু টাকা পয়সা একটা আংটি, কয়েকটা তেতুলির বিচি আর কয়েকটা কড়ি। ওরা বাক্সের নিচের দিকে চলে গেছে আর সেরকম কিছু নেই, আরো কিছু খবরের কাগজ, কয়েকটা ম্যাগাজিন একেবারে নিচে একটা ফাইল। ফাইলটা খুলে দেখা গেল অফিসের জাগজপত্র যেরকম হয় ঠিক সেরকম কিছু কাগজ পত্র।

ঝুনু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই?

রেবেকা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে খোলা বাক্স আর তার ভিতর থেকে যেসব জিনিস বের হয়েছে সেগুলির দিকে তাকিয়ে রইল তারপর প্রায় ভাঙ্গা গলায় বলল, এত কষ্ট করে বাক্সটা বের করলাম, তার ভিতরে এই সব ব্যবহারী জিনিস?

নিতু বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একজন মানুষের ব্যবহারী কাগজপত্র কেন এত কষ্ট করে লুকিয়ে রাখা হবে? নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।

মিতুল জানতে চাইল, কী কারণ?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

যাই হোক—এডভেঞ্চার তো শেষ হয়েছে, এখন চল ঘরে ফেরত যাই।

চল। সবাই উঠে দাঁড়াল এবং তখন হঠাৎ করে তাদের মনে পড়ল শান্তা আপার এই ঘরটিতে বাইরে থেকে তালা দেয়া রয়েছে। রুম খানিকক্ষণ পর পর এসে খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে এবং আরেকবার খোঁজ নিতে না আসা পর্যন্ত তাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

সবাই খুব মন খারাপ করে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে অপেক্ষা করতে শুরু করে। ঝুনু এলবামটাতে ছবি দেখতে থাকে, তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে মিতুলও ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকদিন আগের ছবি, দেখে কেমন যেন অবাক লাগে। রেবেকা ডাইরিটা পড়তে থাকে, অন্য একজন মানুষের ব্যক্তিগত ডাইরি পড়তে কেমন জানি সংকোচ হয় শুধু মনে হয় একটা অন্যায় কাজ করা হচ্ছে। তানিয়া বইগুলি দেখছে, নিতুও বইগুলো উল্টে পাল্টে দেখে আবার ফাইলটা টেনে নিয়ে ভিতরের রাখা অফিসের কাগজপত্রের মতো দেখতে কাগজগুলো দেখতে দেখতে হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্ঠের মতো চমকে উঠল চাপা স্বরে চিৎকার করে বলল, দেখ।।

সবাই মাথা তুলে তাকাল, কী?

বেগম জোহরা কামালের দলিল।

দলিল?

হ্যাঁ।

এই দেখ, স্ট্যাম্পের মতো কাগজ, এই দেখ কতগুলো সই। এটা হচ্ছে স্কুলের দলিল।

স্কুলের দলিল?

হ্যাঁ, এই দেখ আরো কাগজপত্র। সব স্কুলের কাগজ পত্র। এই দেখ এখানে কী লেখা—

কী লেখা?

নিতু পড়ে শোনাতে থাকে, আমি নয়নপুর নিবাসী বেগম জোহরা কামাল আমার সকল সম্পত্তি মেয়েদের একটি আদর্শ স্কুল তৈরি করার জন্যে দান করে গেলাম। কোনো অবস্থাতেই এই স্কুলের নামটি আমার নামানুসারে করা যাবে না তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে, শিক্ষার জন্যে সাহিত্যের জন্যে বা দেশের মানুষের অধিকারের জন্যে ত্যাগ করেছেন, দেশের প্রয়োজনে জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন এরকম একজন মহিলার নামে এই স্কুলের নামকরণ করতে হবে।

নিতু এইটুকু পড়ে থামল, বলল, দেখলি?

বুতুরুনেসা কী সে রকম মহিলা?

না। মিতুল চাপা স্বরে বলল, জানিস না বুতুরন্নেসা কে?

কে?

খোরাসানী ম্যাডামের নানী।

বুতুরুন্নেসা কী জাতির জন্যে নেতৃত্ব দিয়েছে?

কক্ষনো না।

তাহলে?

মিতুল বলল, আগে পড় বাকিটা।

নিতু পুরো কাগজগুলো দেখে বলল, পুরোটা পড়তে অনেকক্ষণ লাগবে, এই স্কুলটা কেমন হবে সবকিছু লেখা আছে। এই দ্যাখ—এই স্কুলটির আবাসিক অংশটিতে মেয়েদেরকে গভীর ভালবাসায় লালন করতে হবে যেন তারা অনুভব করতে পারে যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে ভালবাসা। তাদেরকে শারীরিক শাস্তি দূরে থাকুক কখনো তিরস্কারও করা যাবে না। নিতু পড়া বন্ধ করে বলল, দেখলি? দেখলি কি লেখা?

নিতু আবার কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ল, এই স্কুলের সকল মেয়েদের পড়াশোনার সাথে সাথে শিল্প সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে উৎসাহী করতে হবে। যারা গান গাইতে পারে তাদেরকে আলাদাভাবে গান শেখাতে হবে এবং জ্যোৎস্না রাতে স্কুল প্রাঙ্গণে সবাইকে নিয়ে মধুর গানের আসরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে? নিতু মুখ তুলে বলল, দেখলি?

আর কী লেখা আছে? পড় দেখি—

নিতু আবার পড়তে শুরু করছিল ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল, রুনু খোঁজ নিতে এসেছে। নিতু ফাইলটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল, বলল, চল যাই।

রুনু তালা খুলে দিতেই সবাই বের হয়ে এল, দরজায় আবার তালা লাগিয়ে সবাই সাবধানে নিজের ঘরে ফিরে এল। ঘরের দরজা বন্ধ করে আবার সবাই ফাইলটা নিয়ে বসে। সবাই পুরো ফাইলটা খুটিয়ে খুটিয়ে পড়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। বেগম জোহরা কামাল নামে একজন মহিলা তার বিশাল সম্পত্তির পুরোটা মেয়েদের একটা চমৎকার স্কুল তৈরি করার জন্যে দান করে দিয়ে গিয়েছেন। স্কুলটি কীভাবে চালাতে হবে তার একেবারে খুটি নাষ্টি এখানে লেখা আছে সেটি মানা না হলে কী করা হবে তাও বলে দেয়া আছে। অথচ সেই চমৎকার স্কুলটি বুতুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয় নাম নিয়ে একটা ভয়ংকর কয়েদখানা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরোটা পড়ে নিতু ফাইলটা বন্ধ করে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝতে পারছিস?

কোনটার কথা বলছিস?

আমাদের এখন কি করতে হবে?

কী?

শান্তা আপাকে খুঁজে বের করে তার কাছে এই ফাইলটা দিতে হবে।

মিতুল হাতে কিল দিয়ে বলল, ইয়েস!

অন্য সবাই তাদের হাতে কিল দিয়ে বলল, ইয়েস! ইয়েস!! ইয়েস!!!

১১. পলায়ন

বসে বসে সবাই খুব ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করল। অন্ধকার হওয়া মাত্র তারা ছয়জন ঘর থেকে বের হবে। এক সাথে বের না হয়ে সবাই আলাদা আলাদাভাবে। হোস্টেলের গেট রাত আটটার দিকে বন্ধ করে দেয়া হয় কাজেই ঠিক সন্ধ্যার দিকে বের হলে কোনো অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ঘর থেকে বের হয়ে হোস্টেলের পিছন দিকে চলে যাবে, সেখানে দেয়াল বেয়ে উঠে দেয়াল টপকে স্কুল থেকে বের হয়ে যাবে। বিছানার একটা চাদর পাকিয়ে দড়ির মতো তৈরি করা হবে, প্রথমে যে পার হবে সে সেটা দেয়ালের অন্যপাশে ধরে রাখবে যেন অনারা সেটা ধরে তাড়াতাড়ি ওঠে পার হতে পারে। ওরা একজুন একজন করে পালাবে। তাই যদি কেউ ধরা পড়ে যায় কখনোই অন্যদের কথা বলবে না। যদি কোনো কারণে ওরা আলাদা হয়ে যায় তাহলে স্কুলের বাইরে যে রাস্তা আছে সেই রাস্তার শেষ মাথায় যে বাস স্টেশন রয়েছে সেখানে অন্যদের জন্যে অপেক্ষা করবে। যেহেতু পুরো ব্যাপারটা একটা সত্যিকারের এডভেঞ্চার তাই সবাই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে বের হবে। তাদের পায়ে থাকবে টেনিস সু এবং পরনে থাকবে প্যান্ট এবং টী সার্ট। সবার সাথে একটা করে কাঁধে ঝুলিয়ে নেওয়ার মতো ব্যাগ থাকবে, সেই ব্যাগের মাঝে থাকবে আরো এক সেট কাপড়, একটা চাদর, কাগজপত্র, কিছু শুকনো খাবার, ছুরি চাকু বা কোনো এক ধরনের অস্ত্র। যার কাছে যে পরিমাণ টাকা পয়সা আছে সেটা নিয়ে নেয়া হবে, কখন কী প্রয়োজন হতে পারে সেটা কেউ জানে না। অনেক আলোচনা করে ঠিক করা হল প্রথমে বের হবে মিতুল। মিতুলের পর রুনু। রুনুর পর ঝুনু। ঝুনুর পর নিতু, নিতুর পর রেবেকা এবং সবার শেষে তানিয়া। নিতুর ব্যাগের মাঝে থাকবে ফাইলটা—-কাজেই সে যেন ঠিক ভাবে পালিয়ে যেতে পারে সেই ব্যাপারটা সবাই আলাদা করে লক্ষ্য রাখবে।

বাকি দিনটুকু উত্তেজনার মাঝে কেটে গেল। শান্তা আপা আসার আগে ছুটির দিনগুলি ছিল আনন্দে ভরপুর, প্রতিদিন কিছু না কিছু হত। কোনোদিন স্কুলের মাঠে বনভোজন কোনোদিন মজার কোনো বই পড়া কোনোদিন নাটকের রিহার্সাল। অথচ আজকে সবাইকে দিয়ে বাথরুম আর টয়লেট পরিষ্কার করিয়ে ঘরের মাঝে আটকে রাখা হয়েছে। কিছুক্ষণ আগে নোটিশ এসেছে যে সবাইকে চার পৃষ্ঠা ইংরেজি ট্রান্সলেশান করে কুড়িটা অংক করতে হবে। সবাই ঘরে বসে বসে সেগুলি করছে, নিতু এবং তার বন্ধুরা ছাড়া। যখন এই কাজগুলি জমা দেয়ার কথা তার অনেক আগেই তাদের স্কুল থেকে পালিয়ে যাবার কথা। যদি পালাতে না পারে আর খোরাসানী ম্যাডামের হাতে ধরা পড়ে যায় তাহলে ম্যাডাম এমনিতেই খুন করে মাটিতে পুঁতে ফেলবে, কাজেই এই চার পৃষ্ঠা ট্রান্সলেশান আর কুড়িটা অংক না করার জন্যে আলাদা করে শাস্তি পেতে হবে না।

ঠিক সন্ধেবেলা মিতুল তার ব্যাগ কাধে নিয়ে রেডি হল! চাদর পাকিয়ে যে দড়িটা তৈরি করা হয়েছে সেটা হাতে নিয়ে সে কেমন যেন ভীত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলল, ভয় করছে।

সবারই ভিতরে ভিতরে ভয় করছিল কিন্তু মিতুল মুখে সেটা উচ্চারণ করে ফেলার পর হঠাৎ করে সবাই যেন সেটা প্রথমবার টের পেলো। নিতু সাহস দেয়ার জন্যে বল্ল, ভয়ের কী আছে? একবার চিন্তা করে দেখ, ফাইলটা আমার যদি কোনোভাবে বাইরে নিয়ে শান্তা আপার হাতে দিতে পারি তাহলে কী সাংঘাতিক ব্যাপার হবে?

হুঁ। রুনু বলল, আর ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। যেটা করতে ভালো লাগে সেটা করতে পারব।

মিতুল ফিস ফিস করে বলল, তবু ভয় লাগে।

রেবেকা বলল, ভয়ের কিছু নেই। আয় কাছে আয়, তিনবার কুলহু আল্লাহু পড়ে তার বুকে ফুঁ দিয়ে দিই, তাহলে কোনো বিপদ তোকে ছুঁতে পারবে না।

মিতুল রেবেকার কাছে এগিয়ে গেল, তখন রোবক চোখ বন্ধ করে খুব গম্ভীর মুখে তিনবার কুলহু আল্লাহু পড়ে মিতুলের বুকে ফুঁ দিয়ে বলল, যা আর কোনো ভয় নাই। আমার বড় চাচা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যখন পাকিস্তানীদের সাথে যুদ্ধ করতে যেতেন সব সময় তিনবার কুলহু আল্লাহু পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে যেতেন। তাই কোনোদিন কোনো গুলি লাগে নাই।

রেবেকার কথা শুনে মিতুল মনে হয় একটু সাহস পেলো। সে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি গেলাম। দোয়া করিস। একটু থেমে যোগ করল, বেঁচে থাকলে দেখা হবে।

কেউ কোনো কথা বলল না এবং মিতুল দরজা খুলে বের হয়ে গেল। সবাই নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা যায় সে হোস্টেলের পিছনে পৌঁছে গেছে। অন্ধকারে ঝােপঝাড় ভেঙ্গে মিতুল ছুটে যেতে থাকে এবং দেখতে দেখতে সে হোস্টেলের পিছনে দেওয়ালের কাছে পৌছে গেল। মিতুল দেয়ালের কয়েকটা জায়গা পরীক্ষা করে একটা জায়গা বেছে নিয়েছে, অন্ধকারে অনেকদূর থেকে ঠিক স্পষ্ট দেখা গেল না, কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত যে দেওয়াল বেয়ে ওঠে পড়তে পারল, সেটা বোঝা গেল। দেওয়ালের ওপর বসে গুড়ি মেরে এদিক সেদিক তাকিয়ে মিতুল একটা জায়গা পছন্দ করে টুপ করে নেমে পড়ল এবং সাথে সাথে ঘরের ভিতরে সবার মুখে হাসি ফুটে উঠল। নিতু বলল, দেখলি কত সহজ?

রেবেকা বলল, এবারে রুনু।

নিতু মাথা নাড়ল, বলল, তোর জন্যে কাজটা আরো সহজ। মিতুল চাদরটা ধরে রেখেছে তুই শুধু বেয়ে উঠে যাবি।

রেবেকা বলল, যা রওনা দে। দেরি করিস না।

ঝুনু বলল, আমি আর রুনু এক সাথে যাই?

রুনু সায় দিল, যা যাই? তাহলে এক সাথে দুইজন চলে যাব।

দুই বোন সবসময় এক সাথে থাকে তাই এবারেও কেউ আপত্তি করল না। নিতু বলল, যা, রওনা দে।

রুনু আর ঝুনু দু জনের ব্যাগ হাতে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। সাবধানে দরজা খুলে মাথা বের করে এদিকে সেদিক তাকিয়ে বের হতে গিয়ে আবার ফিরে এসে রেবেকাকে বলল, আমাদের ফুঁ দিবি না?

রেবেকা বলল, আয়, কাছে আয়।

দুজনে কাছে এগিয়ে এল তখন রেবেকা আবার চোখ বন্ধ করে কুলহু আল্লাহ পড়ে দুজনের বুকে ফুঁ দিয়ে দিল। রুনু ঝুনু আবার ব্যাগ কাঁধে তুলে নেয় তারপর সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে যায়। ঘরের ভেতরে বসে পিছনের জানালা দিয়ে বাকি তিনজন উৎসুক চোখে তাকিয়ে থাকে। মিতুল যে রকম প্রায় সাথে সাথেই হোস্টেলের পিছনে চলে এসেছিল রুনু ঝুনুর বেলায় সেটা সত্যি হল না অনেকক্ষণ সময় পার হয়ে গেল কিন্তু তবু তার পিছনে এল না। রেবেকা ফ্যাকাসে মুখে বলল, সর্বনাশ! কোনো বিপদ হল না তো?

কী বিপদ?

ধরা পড়ে গেল না তো?

ধরা পড়ে গেলে চেচামেচি হৈ চৈ হতো না। কোনো রকম হৈ চৈ তো হচ্ছে না।

নিতুর কথা শেষ হওয়ার আগেই হঠাৎ করে বাইরে বিশাল হল্লা শোনা গেল। নিতু রেবেকা আর তানিয়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে যে দৃশ্য দেখল তাতে তাদের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে তার মাঝেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে রুনু আর ঝুনু প্রাণ নিয়ে দেওয়ালের দিকে ছুটে যাচ্ছে আর তাদের পিছু পিছু চিৎকার করতে করতে ছুটছে খোরাসানী ম্যাডাম। রুনু আর ঝুনু হালকা পাতলা কাজেই তারা ছুটছে একেবারে তীরের মতো, পিছু পিছু খোরাসানী ম্যাডামকে মনে হচ্ছে একটা চলন্ত ট্রাক, গাছ পালা ঝােপ ঝাড় ভেঙ্গে একেবারে কামানের গোলার মতো ছুটে যাচ্ছে। চিৎকার শুনে হোস্টেলে সবাই পিছনের জানালায় চলে এসেছে সবাই হতবাক হয়ে দেখছে রুনু ঝুনু পাই পাই করে ছুটছে আর তাদেরকে ধরার জন্যে ছুটছে খোরাসানী ম্যাডাম।

হোস্টেলের পিছনে অনেকটা জায়গা, খোরাসানী ম্যাডাম তার বিশাল শরীর নিয়ে ছুটতে ছুটতে নিশ্চয়ই হাঁপিয়ে উঠেছে। তা ছাড়া দেখতে পাচ্ছে সামনে দেওয়াল, সেখানে পৌঁছালে তো আর যাবার জায়গা নেই তখন তো এমনিতেই ধরা পড়ে যাবে ভেবে খোরাসানী ম্যাডাম তার দৌড়ে একটু রাস টেনেছে, সেই সুর্যোগ দুইবোন দেওয়ালের কাছে পৌছে গেল। মিতুল চাদর ঝুলিয়ে রেখেছে দুই বোন সেই চাদর ধরে একেবারে বানরের বাচ্চার মতো উপরে উঠতে শুরু করল। খোরাসানী ম্যাড়ম যখন হঠাৎ করে বুঝতে পারল দুইজন দেওয়াল টপকে পালিয়ে যাচ্ছে তখন আঁ আঁ আঁ করে আবার চিৎকার করতে করতে একেবারে রেলগাড়ির মতো ছুটে আসতে লাগল, এত বড় একটা মানুষ যে এত জোরে ছুটতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করত না। আর একটু হলে খোরাসানী ম্যাডাম দুইজনের একজনকে ধরে ফেলত, কিন্তু তারা ঠিক সময় মতো তার বিশাল থাবা ফসকে কোনো মতে পার হয়ে ঝুপ ঝুপ করে দেওয়ালের অন্যপাশে লাফিয়ে পড়ল। খোরাসানী ম্যাডাম তার বিশাল ছুটন্ত দেহকে সামলাতে না পেরে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আরেকটু হলে পুরো দেওয়ালটাকেই ধ্বসিয়ে দিত, কিন্তু তা না করে বিশাল শব্দে সে নিজেই নিচে আছড়ে পড়ল। গা গা গাঁ শব্দ করে সেই অবস্থাতে লাফিয়ে উঠে সে চাদরটা ধরে ঝুলে পড়ল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, এই বিশাল দেহটিকে অন্য পাশ থেকে মিতুল একা নিশ্চয়ই ধরে রাখতে পারবে না–তাই তারা যেটা ভাবছিল ঠিক সেটাই ঘটল হঠাৎ করে খোরাসানী ম্যাডাম ঝুলন্ত অবস্থা থেকে ধপাস করে নিচে আচড়ে পড়ল এবং এই প্রথম বার সবাই তার একটা কাতর আর্ত চিৎকার শুনতে পেল। পড়ে গিয়ে নিশ্চয়ই বেকায়দা ভাবে ব্যথা পেয়েছে কারণ দেখা গেল খুব সহজে আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। জমিলার মা এবং আরো দুয়েকজন তার দিকে ছুটে যাচ্ছে টেনে তোলার জন্যে।

নিতু এবারে রেবেকা আর তানিয়ার দিকে তাকাল, তারপর উত্তেজিত গলায় বলল, আমরা ধরা পড়ে গেছি। এখনই পালাতে হবে।

রেবেকা ফিস ফিস করে বলল, কোথায় পালাব?

জানি না, এক্ষুনি ঘর থেকে বের হ। ম্যাডাম এক্ষুনি আমাদের খোঁজ করতে আসবে।

কিন্তু —।

কোনো কিন্তু নাই, ঘর থেকে বের হ। তাড়াতাড়ি।

তাদের ব্যাগ আগে থেকে প্রস্তুত করা ছিল, হাতে নিয়ে তিনজন চোখের পলকে ঘর থেকে বের হয়ে এল। হৈ হল্লা এবং চেঁচামেচি শুনে সবাই জানালার কাছে চলে গেছে বলে তিনজন সবার চোখ এড়িয়ে সহজেই হোস্টেল থেকে বের হয়ে এল। হোস্টেল থেকে দূরে সরে গিয়ে স্কুল ঘরের সিঁড়ির পিছনে তিনজনই লুকিয়ে গেল।

নিতু যে রকম সন্দেহ করেছিল ঠিক তাই ঘটল, কয়েক মিনিটের মাঝে খোরাসানী ম্যাডাম তার দল বল নিয়ে হোস্টেলে তাদের ঘরে হাজির হল। তারা এতদূর থেকে শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম হুংকার দিয়ে বলছে, খুঁজে বের কর সবগুলিকে। সব বদমাসি পাজী হতছাড়া শয়তানের বাচ্চাদের। এক্ষুনি খুঁজে বের কর। না হলে সবগুলিকে আমি কাল সকালের মাঝে তাড়িয়ে দেব। আস্ত রাখব না একটাকেও।

কিছুক্ষণের মাঝে দেখা গেল খোরাসানী ম্যাডামের চেলারা তাদের খোজাখুজি শুরু করে দিয়েছে। ওরা শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম চিল্কার করে বলছে, টর্চ লাইট নিয়ে বাইরে যেতে, সবাই নিশ্চয়ই পালাতে পারে নাই, একটা দুইটা নিশ্চয়ই সীমানার ভিতরেই আছে, যেভাবে সম্ভব খুঁজে বের করতেই হবে।

রেবেকা ফিস ফিস করে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেল।

হ্যাঁ নিতু ফিস ফিস করে বলল, টর্চ লাইট নিয়ে খুঁজতে শুরু করলে নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে।

আমাদেরকে পেয়ে গেলে কী হবে চিন্তা করেছিস?

তানিয়া বলল, আমি চিন্তা করতে চাই না।

আমিও চিন্তা করতে চাই না।

কিন্তু কিছু একটা তো করতে হবে।

তা ঠিক। নিতু চিন্তিত মুখে বাইরে ইতি উতি তাকাতে থাকে, ভালো করে লুকানোর একটা জায়গা খুঁজতে থাকে কিন্তু সে রকম কোনো জায়গাই খুঁজে পায় না। এক পাশে হোস্টেল, অন্য পাশে দূরে খোরাসানী ম্যাডামের বাসা এবং হঠাৎ করে সে চমকে উঠল, বলল, পেয়েছি।

কী পেয়েছিস?

লুকানোর জায়গা।

কোথায়।

খোরাসানী ম্যাডামের বাসা। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আয়।

রেবেকা আর তানিয়া মুখ হা করে নিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারা এখনো বুঝতে পারছে না নিতু ফাজলেমি করছে কী না। কিন্তু এখন আর যাই করা যাক না কেন ফাজলেমি করার সময় নয়। তানিয়া চাপা গলায় বলল, কী বলছিস তুই?

নিতু অধৈর্য হয়ে বলল, বুঝতে পারছিস না? আমাদেরকে এই স্কুলের সীমানার প্রতি ইঞ্চি জায়গায় খুঁজবে শুধু একটি জায়গা ছাড়া। সেটা হচ্ছে খোরাসানী মডামের বাসা। আয় সেই বাসার ভিতরে গিয়ে লুকিয়ে থাকি, যখন খোজা বন্ধ করবে তখন বের হয়ে যাবো। আয়, দেরি করিস না।

তানিয়া মাখা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছিস।

রেবেকা এখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিল না কিন্তু তিনজনের মাঝে দুজন রাজি হয়ে যাওয়ার তার আর কিছু করার ছিল না।

কিছুক্ষণের মাঝে তিনজন খোরাসানী ম্যাডামের বাসায় হাজির হল, বাইরে থেকে বোঝা যায় না কিন্তু ভিতরে অনেক জায়গা। খোরাসানী ম্যাডাম খুব ভাল করে জানে কেউ কখনো তার বাসায় নিজে থেকে ঢুকাবে না তাই দরজা হাট করে খোলা। নিতু রেবেকা আর তানিয়া চুপি চুপি ভিতরে ঢুকে যায়। লুকানোর জন্যে সবচেয়ে ভালো জায়গা পেলো একটা বড় খাটের তলা, সামনে নানারকম বস্তা, প্যাকেট হাড়ি কুড়ি রাখা, পিছনে তিন জনের লুকিয়ে থাকার প্রচুর জায়গা। খোঁজাখুঁজির উত্তেজনাটা পার হয়ে গেলে তারা বের হয়ে আসবে। আর যদি বের হতে নাও পারে রুনু ঝুনু আর মিতুল শান্তা আপাকে খুঁজে বের করে তাদেরকে উদ্ধার করার একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করবে।

তিনজন গুটি শুটি মেরে খাটের নিচে শুয়ে রইল এবং বাইরে হৈ চৈ চেঁচামেচি শুনে বুঝতে পারল খোরাসানী ম্যাডাম আর তার চেলা চামুণ্ডা মিলে তাদেরকে খুঁজছে। খানিকক্ষণ পর রেবেকাকেও স্বীকার করতে হল এখানে এসে না লুকালে আজকে তাদের আর জানে বেঁচে থাকার কোন উপায় ছিল না!

খোরাসানী ম্যাডামের বিশাল খাটের নিচে প্রচুর জায়গা এবং মনে হচ্ছে বেশ নিরাপদেই সেখানে শুয়ে থাকা যাচ্ছে কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই তারা খানিকটা অধৈর্য হয়ে পড়ল। বিশেষ করে রেবেকার অবস্থা হল খুব খারাপ, সে মাকড়শাকে খুব ভয় পায় আর তার মনে হতে থাকে বড় বড় গোবদা মাকড়শা খাটের নিচে ঘোরা ফেরা করছে আর যে কোনো মুহূর্তে তার উপর ঝাপিয়ে পড়বে। ভয় পেলে যদি গলা ফাটিয়ে চিল্কার করা যায় তাহলে একটু আরাম হয়, কিন্তু তারা এমন জায়গায় লুকিয়ে আছে যে তারা যত ভয়ই পাক না কেন এতটুকু শব্দ করতে পারবে না, সেটাই হয়েছে মুশকিল। তা ছাড়া কতক্ষণ এখানে থাকতে হবে সেটাও আন্দাজ করতে পারছে না। সন্ধে হয়ে গেছে, একটু পরে রাত হয়ে যাবে। রাত্রি বেলা তাদের মতো ছোট ছোট মেয়েরা বাইরে ঘুরোঘুরি করবে কেমন করে?

তাদের সমস্যার সমাধান অবিশ্যি নিজের থেকেই হয়ে গেল, কিছুক্ষণের মাঝেই তারা শুনতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম ফিরে আসছে। খোরাসানী ম্যাডাম হাঁটলে গুম গুম করে একটা শব্দ হয়, কিন্তু কোনো একটা বিচিত্র কারণে এখন শব্দটা হচ্ছে গুম ক্যাঁৎ গুম কঁাৎ….। কারণটা তারা একটু পইে টের পেল। রুনু বুনুকে তাড়া করে দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে এবং মিতুলের ঝুলিয়ে রাখা চাদর বেয়ে উঠতে গিয়ে আছাড় খেয়ে খোরাসানী ম্যাডাম একটা পায়ে ভালো রকম ব্যথা পেয়েছে, সেই পাটা ফেলতে হচ্ছে খুব সাবধানে। তার বিশাল শরীরের ওজন সেই পায়ের ওপর ভর করতে গিয়ে কোথা থেকে জানি কাত করে শব্দ হচ্ছে। নিতু রেবেকা আর তানিয়া খাটের তলায় বসে থেকে দেখতে পেল খোরাসানী ম্যাডাম খোঁড়াতে খোঁড়াতে এই ঘরে এসে হাজির হয়েছে এবং যন্ত্রণার একরকম শব্দ করে ধপাস করে বিছানায় বসে পড়ল। সাথে সাথে পুরো বিছানাটি নিয়ে নেমে এল, নিতু রেবেকা আর তানিয়ার মনে হল বুঝি খাটটা ভেঙ্গে তাদের খাটের নিচে পিষে ফেলবে তারা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল কিন্তু খাটটা ভেঙ্গে পড়ল না।

খোরাসানী ম্যাডাম বিছানায় একটু আরাম করে বসে একটা হুংকার দিয়ে বলল, তারার মা–আমার হুক্কা টা—

খাটের নিচে বসে তিন জন চমকে উঠে, হুক্কা? হুক্কা মানে নিশ্চয়ই হুকো, কোনো মহিলা কী কখনো ইকো খেতে পারে? তাদের সন্দেহ একটু পরেই দূর হয়ে গেল, সত্যি সত্যি তারার মা নামে একজন বুড়ি একটা হুকোর ওপর কলকেতে জ্বলন্ত অংগারে ফুঁ দিতে দিতে নিয়ে আসে। সেটা বিছানার পাশে রেখে বলল, খাবার দিব?

দে।

আমার একটু তাড়াতাড়ি যাওয়া দরকার ছিল— কথা শেষ হওয়ার আগেই খোরাসানী ম্যাডাম তারার মাকে সুশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজ শুরু করে, সেই গালি গালাজের ভাষা এত খারাপ যে খাটের নিচে শুয়ে শুয়ে নিতু রেবেকা আর তানিয়া লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। খোরাসানী ম্যাডাম এত খারাপ গালগাল দিতে পারে অথচ সে তুলনায় তাদেরকে যে গালি গালাজ করে সেটা রীতিমতো ভদ্র ভাষা, ব্যাপারটা চিন্তা করে এই প্রথমবার খোরাসানী ম্যাডামের জন্যে তাদের ভিতর একটু কৃতজ্ঞতার জন্ম নেয়। গালাগালি শেষ করে খোরাসানী ম্যাডাম মনে হল শুয়ে থেকেই তারার মাকে একটা লাথি মারার চেষ্টা করল। তারার মা নিশ্চয়ই এরকম আচার ব্যবহারে অভ্যস্ত, এতকিছু ঘটে যাবার পরও শান্ত গলায় বলল, টেবিলে খাবার ঢেকে রাখব আফা, আপনি খেয়ে নিবেন কথা শেষ হবার আগেই খোরাসানী ম্যাডাম, যা হারামজাদি, যা ভাগ, তোর চাকরি শেষ- বলে তাকে দূর করে দিল।

তারার মা ঘর ছেড়ে যাবার সাথে সাথে খোরাসানী ম্যাডাম গুড় গুড়ক করে হুকো টানতে থাকে। নিতু রেবেকা আর তানিয়া হতবাক হয়ে হাটে নিচে শুয়ে থাকে, খোরাসানী ম্যাডাম কী মানুষ না অন্য গ্রহের একটা ভয়ংকর প্রাণী সেটা নিয়ে তাদের সন্দেহ হতে থাকে। খানিকক্ষণ ঘরে হুকোর গুড়ক গুড়ুক শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একসময় হঠাৎ মনে হল খোয়াসানী ম্যাডাম কিছু একটা টেনে নিল, জিনিসটা কী একটু পরেই বোঝা গেল, একটি টেলিফোন। কোনো এক জায়গায় ডায়াল করে কথা বলতে শুরু করে খোরাসানী ম্যাডাম।

কালু, খবর কী, বল?

টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে কী খবর দেওয়া হল ওরা শুনতে পেল না কিন্তু খবরটা যে গুরুতর সেটা খোরাসানী ম্যাডামের কথা শুনে বোঝা গেল, ম্যাডাম প্রায় চিৎকার করে বলল, কী বললি? আবাগীর বেটি গেছে নয়নপুর? জোহরা কামাল নিয়ে খোঁজ নিতে?

খাটের নিচে নিতু রেবেকা আর তানিয়া একসাথে চমকে উঠল। তাদের কাছে বেগম জোহরা কামালের দলিল পত্র, তিনি থাকতেন নয়নপুরে! আবাগীর বেটি বলাতে নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে তাদের শান্তা আপাকে! তার মানে শান্তা আপা নিজে নিজেই বেগম জোহরা কামাল সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেছেন?

কী বললি? দলিলগুলি খোঁজ করছে? সর্বনাশ! যদি কোনোভাবে পেয়ে যায় আমাদের কী অবস্থা হবে টের পাচ্ছিস? খোরাসানী ম্যাডাম নাক দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলল, স্কুলের জমি যা দখল নিয়েছি সব যাবে! মনে হয় জেল টেলও হয়ে যাবে।

গুড়ুক গুড়ুক করে হুকো খাওয়ার শব্দ হতে লাগল এবং খোরাসানী ম্যাডাম টেলিফোনের অন্যপাশ থেকে যে কথা বলা হচ্ছে সেটা শুনতে লাগল, যার সাথে কথা বলছে সে নিশ্চয়ই খুব ঘনিষ্ঠ, মহিলা হয়ে সে যে হুকো টানছে সেটা নিয়ে তার কোনো লজ্জা নাই।

খোরাসানী ম্যাডাম হুকো টানা বন্ধ করে বলল, মনে হয় তোর কথাই ঠিক। জোহরা কামালের বাক্স খুঁজে পাওয়া গেলে এতদিনে পাওয়া যেতো! এই স্কুলের মাঝেই তো থাকবে, আমি ইঞ্চি ইঞ্চি করে খুজেছি। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) আর এই বাক্সে যদি খুঁজে না পায় তাহলে আমাদের কিছু করতে পারবে না। জাল দলিল যেটা তৈরি হয়েছে সেইটা আসল দলিলের বাপ। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) তবে আবাগীর বেটি শান্তা চৌধুরী মহা ঝামেলা তৈরি করেছে। সেইদিনের ছেমড়ী কিন্তু শালীর বুদ্ধি কী সাংঘাতিক! অফিসের দুইটা কাগজ দেখেই সন্দেহ করে ফেলল। (গুড়ুক গুড়ুক)। বুঝলি কালু, আবাগীর বেটির কোনো ভয় ডর নাই, পুরা স্কুলটাকে ওলট পালট করে ফেলল।

খোরাসানী ম্যাডাম হুকো টানতে টতে আবার অন্য পাশে কী বলছে শুনতে থাকে, খানিকক্ষণ শুনে বলল, তাহলে তুই খবর পেয়েছিস আবাগীর বেটি ফিরে আসছে? আমি জানি কোথায় আসছে। (গুড়ুক গুড়ুক) আবাগীর বেটি ফিরে আসছে স্কুলে। তার পিয়ারের মেয়েদের দেখতে—তাদেরকে না বলে চলে গেছে তো, সেইজন্য মন টিকছে না। এসে নিশ্চয়ই তাদের বোঝ দিবে, সাহস দিবে। (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) দাঁড়া আমি বোঝাচ্ছি ঠেলা। কয়টার দিকে পৌঁছাবে বল দেখি?

টেলিফোনের অন্য পাশে বলা হল কয়টার সময় শান্তা আপা স্কুলে পৌঁছাবেন কিন্তু নিতু রেবেকা আর তানিয়া সময়টা শুনতে পেল না, তারা শুনল খোরাসানী ম্যাডাম বলছে, ঠিক আছে তাহলে আমি বাকি ব্যবস্থা করি। ওই আবাগীর বেটিরে আমি সিধা করে ছেড়ে দিব। (গুড়ুক গুড়ক) কালু, তুই জানিস শান্তা ছেমড়ি কী অবস্থা করেছে? মেয়েদের এমন লাই দিয়েছে যে ছয় ছয়টা মেয়ে স্কুল থেকে পালিয়ে গেছে! স্কুলের ভিতর ইঞ্চি ইঞ্চি করে খোঁজা হয়েছে কোথাও নাই। সেই রিপোর্ট ও দিতে হবে (গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক গুড়ুক) কিছু আর ভালো লাগে না। বদমাইস গুলিরে ধরতে গিয়ে বেকায়দা পড়ে মাজাটায় যা ব্যথা পেয়েছি, ওহ! রেখে দেই কালু, অনেক কাজ বাকি।

খোরাসনী ম্যাডামের অনেক কাজ কী সেটা বোঝা গেল একটু পরে, ফোন করে কথা বলতে শুরু করল শহরের বড় কোন্ মাস্তানের সাথে। স্কুলের রাস্তার ঠিক কোন্ নির্জন জায়গায় রাত নয়টার দিকে রিক্সা করে শান্তা আপা আসবেন এবং সেখানে কী ভাবে তাকে আক্রমণ করে আচ্ছা মতন শিক্ষা দিতে হবে সেটা নিয়ে আলাপ আলোচনা হতে থাকল। আচ্ছা মতন শিক্ষা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে সেটাও ব্যাখ্যা করা হল, জানে মারতে হবে না, হাত পা কিছু একটা ভেঙ্গে দিতে হবে। কোনো জয়েন্ট ভাঙ্গলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেওয়া যায়, সারতে খুব বেশি সময় নেয় এটা নিয়েও দীর্ঘ সময় আলোচনা করা হল। যে কাজটা ঠিক করে করতে হবে সেটা হচ্ছে ভয় দেখানো—এমন ভয় দেখাতে হবে যেন শান্তা চৌধুরী আর জীবনে এই এলাকায় না আসেন। যে মাস্তানের সাথে কথা হচ্ছে সে কীভাবে ভয় দেখাবে টেলিফোনে খোরাসানী ম্যাডামকে শোনাল এবং পদ্ধতিটা খোরাসানী ম্যাডামের খুব পছন্দ হল বলে মনে হল কারণ খোরাসানী ম্যাডাম দুলে দুলে হাসতে শুরু করল! বুতুরুন্নেসা স্কুলের কোনো মেয়ে কোনো দিন খোরাসানী ম্যাডামকে হাসতে দেখে নি, এখন হঠাৎ করে তার হাসি শুনে নিতু, রেবেকা আর তানিয়া কেমন জানি শিউরে উঠে, তাদের সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠতে থাকে, একজন মানুষের হাসি এরকম ভয়ংকর হতে পারে তারা নিজের কানে না শুনলে বিশ্বাস করতো না—হাসার সময় তার মুখটাও না জানি কী ভয়ংকর দেখাচ্ছে!

শান্তা আপার উপর কী রকম আক্রমণ করা হবে ঠিক করার পর তার জন্যে মাস্তানদের কত টাকা দিতে হবে সেটা নিয়ে দরদাম করা শুরু হল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া হতবাক হয়ে আবিষ্কার করল একেবারে মাছের বাজারে মানুষ যেভাবে দরদাম করে ঠিক সেই ভাবে দরদাম করা হল খোরাসানী মাঙামকে মনে হল এই লাইনে খুব অভিজ্ঞ, খুন করা জন্যে কত রেট, হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্যে কত, রগ কেটে দেওয়ার জন্যে কত বা গাড়ি ভাংচুর করার জন্যে কত রেট সব তার একেবারে মুখস্ত। শুধু তাই না বছরের কোন সময় এবং কোন্ দলের কোন্ সরকার থাকলে সেই রেট কীভাবে বাড়ে কমে সেটাও খোরাসানী ম্যাডাম জানে। তাই মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে এক হাজার নগদ, দুই হাজার কাজ শেষ হবার পর) রাত নয়টার দিকে স্কুলের রাস্তার নির্জন অংশে শান্তা ম্যাডামকে আক্রমণ করে পায়ের হাটু ভেঙ্গে দেওয়ার একটা কন্ট্রাক্ট করে ফেলা হল। নিতু, রেবেকা আর তানিয়া নিজের কানে না শুনলে এটা বিশ্বাস কত কী না সন্দেহ।

খাটের নিচে শুয়ে শুয়ে ফিসফিস করেও কথা বলা যায় না তাই নিতু রেবেকা আর তনিয়ার অপেক্ষা করতে হল। খোরাসানী ম্যাডাম যখন টেলিফোনে হোস্টেলের চাউল সাপ্লয়ারের সাথে প্রতি কে জি চাউলের জন্যে তাকে কত টাকা ভাগ না দিলে সে অন্য সাপ্লায়ারের কাছে চলে যাবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে থাকল তখন তারা গলা নামিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলতে থাকে। নিতু বলল, শান্তা আপাকে বাঁচানোর জন্যে এক্ষুনি আমাদের যেতে হবে।

কীভাবে যাবি?

যখন টেলিফোনে কথা বলছে তখন বের হয়ে যাই।

কিন্তু–

কোনো কিন্তু নাই। তাড়াতাড়ি চল—

কিন্তু বের হতে হতে টেলিফোনে আলাপ বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা আবার খাটের নিচে আটকা পড়ে গেল। খোরাসানী ম্যাডাম এবারে খাটের উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে, তার সমস্ত শরীরের ওজনে পুরো খাটটা মটমট করতে থাকে। নাড়া চাড়া করার সময় খোরাসানী ম্যাডাম মাঝে মাঝেই যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠেছিল এবং সাথে সাথে তাদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছিল, একজন মানুষ—বিশেষ করে মেয়ে মানুষ যে এরকম ভাষায় গালাগাল করতে পারে নিজের কানে না শুনলে ওরা বিশ্বাস করতে পারত না। খোরাসানী ম্যাডাম যদি জানত যারা তার এই দুরবস্থা করেছে তারা এই মুহূর্তে তার খাটের নিচে শুয়ে আছে তাহলে সে কী করত কে জানে!

এভাবে বেশ সময় কেটে গেল। নিতু রেবেকা আর তানিয়া যখন খাটের নিচে আটকা পড়ে বের হতে না পেরে একেবারে অস্থির হয়ে গিয়েছে ঠিক তখন তারা পৃথিবীর মধুরতম শব্দটি শুনতে পেল, বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে খোরাসানী ম্যাডাম ঘুমিয়ে পড়েছে, বাঁশির মতো তার নাক ডাকতে শুরু করেছে। মানুষের নাক ডাকার শব্দ যে এত ভালো লাগতে পারে সেটি তারা এর আগে কখনো কল্পনা করে নি।

তিনজন এবারে খুব সাবধানে খাটের নিচে থেকে বের হয়ে এল—যত তাড়াতাড়ি বের হওয়া সম্ভব ছিল তাদের তার থেকে একটু বেশি সময় লাগল সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। খাটের নিচে থেকে বের হওয়ার সময় তারা আবিষ্কার করল সেখানে যেসব জিনিস গাদাগাদি করে রাখা আছে তার মাঝে একটি হচ্ছে একটা বড় তেলের টিন। তারা সেটা খুলে পুরো তেলটুকু মেঝেতে ছড়িয়ে দিল। খোরাসানী ম্যাডাম যদি হঠাৎ ঘুম থেকে ওঠে তাদের পিছু নিতে শুরু করে তাহলে তেলে পা পিছলে দড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে তাদেরকে পালিয়ে যাবার জন্যে খানিকটা বাড়তি সময় দেবে? যদি পিছু নাও নেয় ঘুম থেকে উঠেও সে যদি খামোখা ধড়াম করে আছাড় খেয়ে পড়ে হাত পা কিংবা মাথা ভেঙ্গে ফেলে তাদের কারো মনে এতটুকু দুঃখ হবে না।

 ১২. এডভেঞ্চার

নিতু, রেবেকা আর তানিয়া কোনো কিছু করার আগে খুব ভালো ভাবে পরিকল্পনা করার সুফলটা টের পেল খুব তাড়াতাড়ি। দেওয়াল টপকে স্কুল থেকে বের হয়ে স্কুলের বাইরে রাস্তা ধরে হেঁটে একেবারে শেষ মাথায় বাস স্টেশনে চলে গিয়ে দেখতে পায়। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে মিতুল, রুনু-ঝুনু অপেক্ষা করছে, তবে ভয়ে, দুশ্চিন্তায় আর কী করবে সেই অনিশ্চয়তায় একেবারে আধখানা হয়ে গেছে।

মিতুল আর রুনু-ঝুনু অন্য তিনজনকে দেখে যা খুশি হল সেটি আর বলার মতো নয়। একজন আরেকজনকে ধরে খানিকক্ষণ জাপটা জাপটি করে নেয় তারপর দ্রুত কাজের কথায় চলে আসে।

আমাদের হাতে একেবারে সময় নেই।

শান্তা আপা কোন রাস্তা দিয়ে আসবে আমরা জানি, সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকবি। যখন দেখব শান্তা আপা রিক্সা করে আসছেন, দৌড়ে গিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে সবকিছু বলব, তারপরে আমাদের আর কিছু চিন্তা করতে হবে না।

কিন্তু পুলিশ কিংবা কোনো বড় মানুষকে বললে হতো না? মিতুল পুরো ব্যাপার নিয়ে কেমন যেন অস্বস্তি অনুভব করতে থাকে, যদি মনে কর কোনোভাবে আমরা ঠিক করে খেয়াল করতে না পারি আর শান্তা আপা চলে যান? তাহলে মিতুল ব্যাপারটা চিন্তা করে একেবারে শিউরে উঠে।

তানিয়া মাথা নাড়ল, বলল, মিতুল ঠিকই বলেছে। যদি শান্তা আপাকে থামাতে না পারি তাহলেই সর্বনাশ হয়ে যাবে।

নিতু বলল, তার মানে যেভাবেই হোক আমাদেরকে শান্তা আপাকে থামাতেই হবে। পুলিশের কাছে যেতে পারলে ভালোই হতো—কিন্তু দেরি হয়ে যাবে না?

তানিয়া বলল, আমরা আবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যাই। এক ভাগ যাই পুলিশের কাছে আরেক ভাগ যাই স্কুলের রাস্তায়, শান্তা আপাকে থামাতে।

গুড আইডিয়া। নিতু মাথা নাড়ল, পুলিশের কাছে কে যেতে চায়?

দেখা গেল কেউই পুলিশের কাছে যেতে চায় না। খবরের কাগজে পুলিশের সম্পর্কে যেসব খবর ছাপা হয় সেটা পড়ে আজকাল পুলিশকে দেখলেই ভয় হয়, মনে হয় এই বুঝি ধরে কিছু একটা করে ফেলবে। নিতু বলল, ঠিক আছে, এখানে দেরি করে লাভ নেই, যেখানে আমাদের অপেক্ষা করার কথা সেখানেই যাই। তারপর ঠিক করা যাবে কে কে পুলিশের কাছে যাবে।

কাজেই ছয় জনের দলটা রওনা দিয়ে দেয়। রাস্তা ঘাটে মানুষজন খুব বেশি নেই, যারা আছে তারা সবাই একটু অবাক হয়ে তাদের দেখছিল, এরকম রাত্রি বেলা ছয়টি মেয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে হন্তদন্ত হয়ে যাচ্ছে দেখে অবাক না হয়ে উপায় কী?

যে রাস্তা দিয়ে শান্তা আপার যাবার কথা সেখানে এসে তারা থেমে গেল। এই মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকলে লোকজন সন্দেহ করতে পারে তাই তারা খানিকটা এগিয়ে গেল। সেখানে একটা ছোট বাসার মতন রয়েছে, একটা বাসার সামনে তারা কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকে? ছয়জন তাই আরেকটু সামনে এগিয়ে গেল, সেখানে একটা ছোট পানের দোকানে একজন বুড়ো চুপচাপ উদাস মুখে বসে আছে, তাই নিরিবিলিতে দাঁড়ানোর জন্যে তারা আরেকটু এগিয়ে যায়, রাস্তাটা এখানে একটু বাঁকা হয়ে চলে গেছে রাস্তার ঠিক পাশে বিশাল বিশাল কয়টা রেইন ট্রি সেজন্য পুরো জায়গাটাকে কেমন যেন নিঝুম মনে হয়। রাস্তার দুই পাশে এখান থেকে কেমন যেন জংগলের মতো শুরু হয়ে গেছে, একটা লাইট পোস্ট টিমটিমে একটা লাইট বাল্ব জ্বলছে, এ ছাড়া কোথাও আর কোনো আলো নাই। লাইটপোস্টর আলো থেকে সরে গিয়ে বড় একটা গাছের আড়ালে তারা লুকিয়ে বসে গেল। এখান থেকে তারা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবে, রাস্তায় কে যাচ্ছে আসছে তারা স্পষ্ট দেখতে পাবে কিন্তু তাদেরকে কেউ দেখতে পাবে না।

সবাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে— হঠাৎ করে শান্তা আপা না চলে যান, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। রাস্তাটা অবিশ্যি খুব নির্জন, এটা তাদের স্কুলের রাস্তা যারা স্কুলে যাবে শুধু তারাই এই রাস্তা দিয়ে যায় কাজেই অন্য কারো এদিক দিয়ে যাবার কথা নয়। ভুল করে তাদের চোখ এড়িয়ে শান্তা আপা চলে যাবেন তার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে বসার পর নিতু আবার পুলিশের কাছে যাবার ব্যাপারটি তুলল, জিজ্ঞেস করল, এখন বল, কে যাবে পুলিশের কাছে?

রুনু স্বীকার করে ফেলল, সে পুলিশকে ভয় পায়। কিছুতেই যেতে চায় না। রুনু আর ঝুনুর মাঝে কোনো পার্থক্য নেই, কাজেই ধরে নেয়া হল ঝুনুও পুলিশের কাছে যাবে না। বাকি চারজনের মাঝে কী লটারী করে ঠিক করা হবে না এমনিতেই কেউ রাজি হয়ে যাবে সেটা নিয়ে যখন কথা বার্তা হচ্ছে ঠিক তখন তারা একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পেল, সাথে সাথে সবাই মাথা নিচু করে বসে যায়। গাড়িটা তাদের স্কুলের দিক থেকে আসছে, তাদের কাছাকাছি এসে গাড়িটার গতি কমে আসে, এবং ঠিক তাদের সামনে এসে গাড়িটা থেমে যায়। লাইটপোস্টের টিমটিমে আলোতে তারা স্পষ্ট দেখতে পায় গাড়ির দরজা খুলে দুইজন মানুষ বের হয়ে এসেছে। মানুষগুলির বয়স খুব বেশি নয়, তারা সেরকম লম্বা চওড়াও নয়। জিন্সের প্যান্টের সাথে টি সার্ট পরে আছে, একজনের মাথায় একটা বেসবল ক্যাপ। মানুষগুলো বের হয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল। বেসবল ক্যাপ মাথায় মানুষটা পিচিক করে থুতু ফেলে বলল, শান্তা মাস্টারনীকে এই খানেই ধরি! না কি বলেন ওস্তাদ?

যাকে ওস্তাদ বলে ডাকা হল সে হঠাৎ প্যান্টের বোতাম খুলে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে শুরু করে দিয়ে সিগারেটটা দাঁতের গোড়ায় চেপে ধরে বলল, সেই জন্যেই তো দাঁড়ালাম এইখানে। রং করার জন্যে কী দাঁড়িয়েছে?

পেশাব শেষ করে মানুষটি সরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল নিতু আর অন্য পাঁচজন। তারপর নিশ্বাস বন্ধ করে ওরা একটু পিছিয়ে গিয়ে নিচু হয়ে নিজেদের আড়াল করে ফেলল। নিতু চাপা গলায় বলল, সর্বনাশ! মাস্তানগুলো শান্তা আপাকে ধরার জন্যে যে এখানেই দাঁড়াল।

তানিয়া বলল, এই জায়গাটাই তো নির্জন। এখানেই তো দাঁড়াবে।

এখন উপায়?

আমাদের তাড়াতাড়ি রাস্তার গোড়ার দিকে যেতে হবে।

যাব কেমন করে? মিতুল ফিস ফিস করে বলল,  মাস্তান দুইটা যে এদিকেই তাকিয়ে আছে!

কিছু করার নাই, এর মাঝেই যেতে হবে। না হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

ওরা উবু হয়ে তাকিয়ে দেখল, রাস্তাটা ঠিক এখানো বাঁকা হয়ে গেছে, রাস্তার গোড়ায় যেতে হলে এই লোক দুজন দেখে ফেলবে। মাস্তান দুজন গাড়ির বনেটে বসে আছে, সেটা হচ্ছে আরেক বিপদ।

মাথায় বেস বল ক্যাপ দেয়া মানুষটা বলল, ওস্তাদ। লোহার রড টা বের করি?

কর।

কাঁটা রাইফেল

বের করবি? কর, কেউ নাই এখানে।

বেস বল মাথায় মানুষটা গাড়ির লাগেজ কম্পার্টমেন্ট খুলে সেখান থেকে একটা মোটা লোহার রড আর একটা কাঁটা রাইফেল বের করে এনে গাড়ির ছাদে রাখল। যে মানুষটাকে ওস্তাদ বলে ডাকা হচ্ছে সে বলল, কাচু।

জে, ওস্তাদ।

রাইফেলটা লোড করে রাখ। পারবি তো নাকি আগের মতো ট্রিগার টেনে গুলি করে দিবি?

কী বলেন ওস্তাদ! একবার ভুল হয়েছে দেখে বার বার ভুল হবে নাকি!

গাছের আড়ালে লুকিয়ে দেখতে পেল কাচু নামের মানুষটা কাঁটা রাইফেলে গুলি ভারে সেটা রেডি করে গাড়ির ছাদে রেখে দিয়ে খুব খুশি হয়ে বলল, সব রেডি। এখন মাস্টারনী আসলেই কেস কমপ্লিট।

কাচু যাকে ওস্তাদ বলে ডাকছে, সেই মানুষটা উদাস উদাস গলায় বলল, বুঝলি কাচু, তুই বেশি তড়পাবি না। কাজ ঠাণ্ডা মাথায় করতে হয়। যে কাজের যে স্টাইল। পলিটিক্যাল কাজ এক রকম টাকার কাজ অন্যরকম। টাকার কাজে কোনো মাথা গরম নাই, কোনো বাড়াবাড়ি নাই।

জে ওস্তাদ।

যখন দেখবি রিক্সাটা আসতেছে আমি কাঁটা রাইফেলটা নিয়ে আগাব। তুই পিছনে থাকবি। কথাবার্তা যা বলার আমি বলব। রিক্সাওয়ালাটা থাকবে তো তারেও নিউট্রালাইজ করতে হবে।

লাইট পোস্টটা যেন পিছনে থাকে। আলো আসবে পিছন থেকে চেহারা যেন ঠিক দেখতে না পারে। পুলিশের সাথে বন্দোবস্ত থাকলেও সব সময় সাবধান থাকতে হয়। বুঝলি?

জে ওস্তাদ, বুঝেছি।

আমি যখন বলব তখন রড দিয়ে মারবি। তার আগে না। মনে থাকবে?

থাকবে ওস্তাদ।

কাজ যেন ক্লীন হয়। এইটা টাকার কাজ। টাকার কাজ ক্লীন করলে কাস্টমার হাতে থাকে। পরের বারও বিজনেস দেয়। একটা বাড়ি দিয়ে হাঁটুটা গুড়া করে দিতে হবে। কোন্ হাঁটুটা করবি? ডান না বাম?

আমি তো বায়া, ডান হাঁটুতেই সুবিধা।

ঠিক আছে তাহলে ডান হাঁটু।

যাকে ওস্তাদ বলে ডাকা হচ্ছে সেই মানুষটা এবারে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে চুপ হয়ে গেল। কাচু নামের মানুষটা পুরো গাড়িটা একবার ঘুরে এসে শুকনো গলায় বলল, ওস্তাদ।

কী?

এইটা কী সেই জায়গা না?

কোন্ জায়গা?

সেই যে একটা স্কুলের ছেমড়ী সুইসাইড করল?

তাই নাকি?

জে ওস্তাদ। ছেমড়ীর নাম ছিল বকুল। গলায় দড়ি দিয়েছিল এইখানে।

অ।

কাচু কিছুক্ষণ পর বলল, জায়গাটা ভালো না।

কাচুর ওস্তাদ তখন চমকে উঠল, বলল, কী বলিস তুই?

জে ওস্তাদ, ঠিকই বলি। আপনি টের পাচ্ছেন না?

দুজনেই তখন ইতি উতি তাকাল এবং কাচুর ওস্তাদ ভয়ে ভয়ে বলল, ঠিকই বলেছিস। জায়গাটা জানি কেমন!

গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ছয়জনও তখন চারিদিকে তাকাল, জায়গাটা অন্ধকার এবং নির্জন, গাছপালা জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে, কেমন যেন থমথমে ভাব। কেউ যদি মনে করে জায়গাটা ভৌতিক তাহলে খুব দোষ দেওয়া যায় না।

কাচু বলল, ওস্তাদ, আপনি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন?

কাচুর ওস্তাদ শুকনো গলায় বলল, কী জিনিস?

এই জায়গাটাতে কোনো শব্দ নাই।

ওস্তাদ ভয়ে ভয়ে বলল, তাতে কী হয়েছে?

যে সব জায়গা খারাপ সেখানে কোনো পশুপক্ষী থাকে না ঝি ঝি পোকাও থাকে না। দেখেছেন—

কাচু আরো কী বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার ওস্তাদ ধমক দিয়ে থামিয়ে দিল, চুপ কর হারামজাদা। কথা বলবি না।

গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নিতু আর তার বন্ধুরা বুঝতে পারল এই মানুষ দুটি ভয় পাচ্ছে। নিতু গলা নামিয়ে বলল, এদের ভয় দেখালে কী রকম হয়?

ভয় দেখাবি? কথা বলতে গিয়ে রেবেকা নিজেই ভয় পেয়ে গেল।

হ্যাঁ। এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে, তার সাথে আর একটু চেষ্টা করলেই দেখাব কী ভয় পাবে।

আর একটু চেষ্টা কীভাবে করবি?

নিতু একটু চিন্তা করে বলল, মনে কর যদি একটা ঢিল ছুঁড়ি। কিংবা আরো ভালো হয়—

আরো ভালো হয়?

আরো ভালো হয় যদি জংগলের ভিতর থেকে একটা ভৌতিক শব্দ বের করা যায়। নিতু মিতুলের দিকে তাকিয়ে বলল, মিতুল তুই পারবি না?

আমি?

হ্যাঁ। ভৌতিক একটা শব্দ করে লাইট বাল্বটা ঠাশ করে ভেঙ্গে ফেলবি। পারবি না?

মিতুল লাইট বাটার দিকে তাকিয়ে বলল, একটু দূর হয়ে যায়, তবু মনে হয় পার।

দেখ কী মজা হয়!

তানিয়া ফিস ফিস করে বলল, দাঁড়া, আগেই শুরু করিস না।

পুরো জিনিসটা ঠিক করে প্ল্যান করে নেই আগে। একেবারে আগা গোড়া। কী কী করা হবে, সব কিছু।

রেবেকা মাথা নাড়ল, বলল হ্যাঁ তানিয়া ঠিকই বলেছে। প্ল্যানটা ভালো করে করি।

নিতু একটু ইতস্তত করে বলল, দেরি না হয়ে যায় আবার হঠাৎ করে যদি এখন শান্তা আপা এসে যায়?

আয় তাহলে তাড়াতাড়ি প্ল্যান করে ফেলি।

গাছের আড়ালে বসে আবার নিখুঁত পরিকল্পনা করা হল। তাদের মূল উদ্দেশ্য গাড়ির উপর রাখা কাঁটা রাইফেল আর লোহার রডটা সরিয়ে নেওয়া। একবার কোনোভাবে সেই দুইটা সরিয়ে নিতে পারলে কোনো ভয় নেই সেগুলি দিয়েই তখন তাদের কাবু করা যাবে। নিতু আর তানিয়ার উপর ভার দেওয়া হল সেগুলি সরানোর। মাস্তান গুলিকে ব্যস্ত রাখার দায়িত্ব রুনু ঝুনু আর মিতুলের। কীভাবে ব্যস্ত রাখা হবে তার খুঁটিনাটি সবকিছু ঠিক করে নেয়া হল। হঠাৎ করে যদি সরাসরি মারামারি শুরু করে দিতে হয় তাহলে সেটা চালিয়ে নেওয়ার জন্যে কিছু প্রমাণ সাইজ ঢিল বিভিন্ন জায়গায় জমা করে রাখা হল। রেবেকা তার দায়িত্বে আছে, অন্ধকার থেকে মাস্তান দুটির দিকে ঢিল ছুঁড়ে দরকার হলে তাদেরকে কাবু করে দিতে হবে।

পরিকল্পনার খুঁটিনাটি কয়েকবার পরীক্ষা করে দেখে নেবার পর তারা উঠে দাঁড়ায়। নিজের নিজের কাজে রওনা দেবার আগে হঠাৎ রুনু ফিস ফিস করে বলল, রেবেকা, আমাদের বুকে ফুঁ দিয়ে দিবি না?

রেবেকা তখন আবার তিনবার কুলহু আল্লাহ পড়ে সবার বুকে ফুঁ দিয়ে দিল।

পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু হয়ে যায়। নিতু আর তানিয়া গুড়ি মেরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ঠিক একই সময়ে রুনু ঝুন আর মিতুল রাস্তার পাশে দিয়ে বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে গেল। রেবেকা তার জায়গায় বসে বড় বড় ঢিল সংগ্রহ করতে শুরু করে।

মিনিট খানেক পর পরিকল্পনার ঠিক প্রথম অংশ টুকু কাজে লাগানো হল। গাছ পালা টাকা থমথমে নির্জন জায়গাটায় হঠাৎ একটা অশরীরি কণ্ঠ শোনা যায়, কাতর গলায় সেটি আর্তনাদ করে কাকে যেন ডাকছে, কণ্ঠস্বরটি মানুষের নয়, মানুষের কণ্ঠস্বরে এরকম ব্যাকুল কান্নার মতো দুঃখ থাকতে পারে না। গাছের আড়ালে বসে মিতুল এভাবে ডাকছে জানার পরও নিতুর সারা শরীর কেমন যেন শিউরে উঠে।

গাড়ির বনেটে বসে থাকা মাস্তান দুটি লাফিয়ে উঠে একজন আরেকজনকে প্রায় জড়িয়ে ধরল। কাচু বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, ওইটা কীসের শব্দ?

পা-পা- পাখি নিশ্চয়ই।

পাখি কি মা-মা মানুষের মতো ডাকে?

ওস্তাদ ভয় পাওয়া গলায় বলল, তা হলে কী?

রা-রা-রাত্রে বেলা নাম নিতে চাই না ওস্তাদ।

ঠিক এ রকম সময় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে রেবেকা ছোট একটা ঢিল ছুঁড়ে মারল, গাড়ির দরজায় লেগে সেটা তীক্ষ্ম একটা ধাতব শব্দ করে উঠল আর সাথে সাথে মানুষ দুইজন আবার ভীষণভাবে চমকে উঠে। কাচু শুকনো গলায় বলল, এইটা কীসের শব্দ ওস্তাদ? মনে হল কেউ ঢিল মেরেছে?

ঢিল? ঢিল এখানে কে মারবে?

তাহলে? কাচু কাঁদো গলায় বলল, এখানে কী হচ্ছে ওস্তাদ?

যখন মাস্তান দুজনকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে ঠিক তখনই দুই পাশ থেকে নিতু আর তানিয়া গুড়ি মেরে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আর একটু হলেই তারা গাড়ির নিচে লুকিয়ে যেতে পারবে।

পরিকল্পনা অনুসারে তখন সবচেয়ে বিপজ্জনক অংশটা করা শুরু হল। মাস্তান দুজন তখন অবাক হয়ে দেখল গভীর জঙ্গলের ভেতর থেকে ফুটফুটে একটা মেয়ে বের হয়ে এসেছে। মেয়েটা যেন এ জগতের বাসিন্দা নয়, কোনো কিছুতে তার কোনো কৌতূহল নেই, খুব ধীরে পায়ে সে হেঁটে হেঁটে মাস্তান দুটির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।

মাস্তান দুজন প্রথম রুনুকে দেখে আতংকে প্রায় চিৎকার করে উঠছিল, অনেক কষ্ট করে নিজেদেরকে সামলে নেয়। রুনু ধীরে পায়ে হেঁটে হেঁটে তাদের কাছে এগয়ে আসে। নিতু আর তানিয়া গাড়ির কাছে চলে এসেছে, মাস্তান দুটিকে ব্যস্ত রাখতে পারলে তারা গাড়ির নিচে ঢুকে যেতে পারবে। রুনু হেঁটে হেঁটে গাড়ির কাছাকাছি আসার সময়টুকুতে দুজন গাড়ির নিচে ঢুকে গেল।

রুনু হেঁটে হেঁটে মাস্তানদের কাছে এসে তাদের দিকে তাকিয়ে অশরীরি এক ধরনের গলায় বলল, আমার মা কে দেখেছ? মা? দেখ নাই, না? শুনলাম আমাকে ডাকল ব-কু-ল ব-কু-ল করে। কোথায় গেল আমার মা?

মানুষ গুলিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুনু অবাস্তব অশরীরি এক ধরনের ভঙ্গি করে জঙ্গলের দিকে হেঁটে যেতে থাকে। ঠিক একই সময় রুনু জঙ্গলের যে অংশ থেকে বের হয়ে এসেছে ঠিক সেই অংশ থেকে ঝুনু বের হয়ে এল ঠিক আগের মতো।

কাচু নামের মাস্তানটা শুকনো গলায় বলল, ঐ টা কে, ওস্তাদ?

ওস্তাদ মুখ খিচিয়ে বলল? আমি কেমন করে বলব?

না মানে বলছিলাম কী-ইয়ে–বলে সে থেমে গেল, যে জিনিসটা বলতে চাইছে সেটা বলতে তার সাহস হল না।

ঝুনু ঠিক রুনুর মতো এগিয়ে আসছে এবং রুনুও তখনো পুরোপুরি চলে যায় নি। মাস্তান দুজন এক সাথে দুইজনকেই দেখতে পাচ্ছে। ঝুনু যখন হেঁটে হেঁটে মাস্তান দুইজনের কাছে এল তখন রুনু হেঁটে যাচ্ছে। মাস্তান দুজন বিস্ফোরিত চোখে একবার রুনুর দিকে তাকাল আরেকবার ঝুনুর দিকে তাকাল। ঝুনু অশরীরি গলায় বলল, তোমরা আমার মাকে দেখেছ? দেখ নাই? শোন নাই আমার মা ডাকছে ব-কু-ল? শোন নাই? কোথায় যে গেল মা, আর খুঁজে পাই না।

রুনু যতক্ষণ কথা বলছিল সেই সময়টাতে ঝুনু জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। ঝুনু খুব আস্তে আস্তে হাঁটবে আর সেই সময়টার মাঝে রুনু আবার বের হয়ে আসবে, মাস্তানগুলি দেখবে একই জায়গা থেকে আবার একই মানুষ বের হয়ে আসছে।

ঝুনু যখন খুব ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে তখন মাস্তান গুলি সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন শিউরে উঠল। কাচু মাস্তান বলল, দে-দে-দেখেছেন?

হ্যাঁ।

দেখতে এক রকম। এ-এ-এ-কে বারে এক রকম।

ওস্তাদ শুকনো গলায় বলল, আসলে অন্ধকার তো এই জন্যে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ম-ম-মনে এ-এ-হচ্ছে এক রকম।

না ওস্তাদ! হুবহু এক রকম। জামা কাপড় চেহারা গলায় স্বর সব কিছু একরকম।

কাচু মাস্তানের কথা শেষ হবার আগেই জঙ্গলের ভেতর থেকে রুনু বের হয়ে এল। মাস্তান দুজন একবার বুনুর দিকে তাকাল আবার রুনুর দিকে তাকাল। রুনু খুব অশরীরি ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে আর ঝুনু অশরীরি ভঙ্গিতে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। ঝুনু মাস্তান দুইজনের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,  আমার মাকে দেখেছ তোমরা? খুঁজে পাচ্ছি না আমি। মনে হল শোনলাম ডাকছে ব-কু-ল কিন্তু গিয়ে দেখি নেই। কোথায় যে গেল আমার মা।

ঠিক তখন জঙ্গলের ভেতর থেকে কে যেন অশরীরী গলায় কেঁদে উঠল, কাতর, গলায় ডাকল, ব-কু-উ-উ-উ-ল।

রুনু সেদিকে তাকিয়ে বলল, ঐ যে ডাকছে আমার মা। যাই মায়ের কাছে।

রুনু কিন্তু খুব ব্যস্ততা দেখায় না, অশরীরী প্রাণীর জীবনে কোনো ব্যস্ততা নেই কোনো তাড়াহুড়া নেই জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ঝুনুকে তার আগের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সময় দিতে হবে সেটা হচ্ছে বড় কথা। এবং ঠিক পরিকল্পনা মতো আবার ঝুনু বের হয়ে এসে মাস্তান দুটিকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা দেখেছো আমার মাকে কোথায় গেছে আমার মা আমাকে ডাকছে ব-কু-ল- বকুল কিন্তু আমি তো খুঁজে পাচ্ছি না।

মাস্তান দুটি বিস্ফোরিক চোখে দেখে জংগলের একই জায়গা থেকে একজনের পর একজন মেয়ে বের হয়ে আসছে সবাই দেখতে হুবহু একরকম!

কাচু মাস্তান এবারে পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ল, ভাঙ্গা গলায় বলল, দেখেছেন ওস্তাদ? চারবার এক মানুষ এসেছে? দেখেছেন?

ওস্তাদ চাপা গলায় বলল, আরো আসছে।

ওস্তাদ।

কী হল?

কী হবে এখন?

আয়তুল কুরসী পড় হারামজাদা।

জানি না।

তাহলে কলমা পড়।

একটা সমস্যা হয়ে গেছে।

কী সমস্যা?

না-পাক হয়ে গেছি ওস্তাদ। ভয়ের চোটে পেশাব হয়ে গেছে।

হারামজাদা, দূরে সরে বস। ওস্তাদ একটা ধমক দিয়ে বলল, কাঁটা রাইফেলটা ল, দেখি জিন পরীরে দূর করা যায় কী না।

কাঁটা রাইফেল নিতে গিয়ে কাচু মাস্তান বেকুব হয়ে গেল। তার স্পষ্ট মনে আছে গাড়ির ছাদে রেখেছিল, সেখানে কিছু নেই। সে মিছেই ছাদে হাত বুলায়, কোথায় কিছু নেই। ভূত নয় এবারে অন্য একটা ভয় তাকে চেপে বসে। ভাঙ্গা গলায় সে ডাকল, ওস্তাদ!

কী হল?

কাঁটা রাইফেল আর রড গায়েব।

কী বললি? ওস্তাদ বনেট থেকে লাফিয়ে নেমে আসে, কী বললি হারামজাদা?

বলছি যে অস্ত্রপাতি গায়েব।

গায়েব? ওস্তাদ কাচুর মাথায় প্রচণ্ড জোরে একটা চাটি মেরে বলল,  গায়েব মানে কী?

গায়েব মানে গায়েব। কাচু ইংরেজিতে চেষ্টা করল, ভ্যানিশ

রংবাজির জায়গা পাস না? অস্ত্র গায়েব। তুই জানিস এইটা কার অস্ত্র আমরা ভারা এনেছি?

আমি কী করব ওস্তাদ, জিন পরীর সাথে আমি কী করব?

জিন পরীর আর কাজ নাই তোর অস্ত্রপাতি নিয়ে যাবে?

নিয়ে তো গেল ওস্তাদ-আপনি নিজেই দেখলেন।

খোঁজ ভালো করে ছাগলের বাচ্চা। তোর মতো গরু গাধাকে নিয়ে অপারেশনে আসাই ভুল হয়েছে।

মাস্তান দুজন যখন গাড়ির ভিতরে তাদের কাঁটা রাইফেল আর লোহার রড় খোজা খুঁজি করছে ঠিক তখন ছয়টি মেয়ে একত্র হয়েছে। এখন আর তাদের ভয় নেই, তারা ছয়জন এক সাথে, তাদের হাতে একটা কাঁটা রাইফেল, একটা লোহার রড় আর সবচেয়ে বড় কথা এত বড় মাস্তানদের বোকা বানিয়ে এখন তাদের সাহস বেড়ে গেছে একশ গুন।

ঠিক এই সময় টুং টুং করে একটা রিকশার শব্দ হল। শান্তা আপা রিক্সা করে আসছেন।

মাস্তান দুইজন সাথে সাথে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল। একজন আরেকজনের দিকে তাকাল তারপর সামনের দিকে তাকাল। ওস্তাদ কাচু মাস্তানের মাথায় প্রকান্তি আরেকটা চাটি লাগিয়ে চাপা গলায় বলল, অস্ত্র পরে খুঁজিস গাধা। এখন আয় অস্ত্র ছাড়াই শুরু করি।

রিক্সাটা এগিয়ে আসতেই মাস্তান দুইজন পথ বন্ধ করে দাঁড়াল, ওস্তাদ মাস্তান গলা উঁচিয়ে বলল, এই রিক্সা থাম!

রিক্সাওয়ালা বিপদের গন্ধ পেয়ে কোনোভাবে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু পারল না, মাস্তান দুইজন রিক্সা থামিয়ে ফেলল। শান্তা আপা রিক্সার হুড ফেলে জিজ্ঞেস করলেন, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?

ওস্তাদ মান্তান হুংকার দেয়ার চেষ্টা করে বলল,  চোপ।

ততক্ষণে ছয়টি মেয়ে তাদের তিন দিকে থেকে ঘিরে ফেলেছে। নিতুর হাতে কাঁটা রাইফেল, মিতুলের হাতে লোহার রড়টা। অন্যদের হাতে প্রমাণ সাইজের চিল। তাদের পায়ের কাছে ব্যাগ, সেই ব্যাগে বোঝাই নানা সাইজের দিলে। নিতু হাতের কাঁটা রাইফেল তাক করে হুংকার দিয়ে বলল,  হ্যাণ্ডস আপ।

মাস্তান দুইজন একসাথে চমকে উঠে। মাথা ঘুরিয়ে দেখতে চাইছিল তখন মিতুল হুংকার দিয়ে বলল, একটু নড়েছ তো গুলি করে খুলি ফুটো করে দেব।

রেবেকা বলল, বিশ্বাস না করলে ঘোরানোর চেষ্টা করতে পার, একেবারে খুন হয়ে যাবে কিন্তু।।

তানিয়া বলল, আগের বার তো ভয়ে পেশাব হয়ে গেছে এইবার বড় কাজটাও হয়ে যাবে।

তানিয়ার কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল এবং হঠাৎ করে মাস্তান দুজন মনে হয় কী হচ্ছে একটু অনুমান করতে পারে। শান্তা আপা রিক্সায় হতচকিত হয়ে বসেছিলেন, এবারে প্রায় আর্ত চিৎকার করে বললেন, কী হচ্ছে এখানে, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

নিতু বলল, আপা, এরা আপনার পা ভেঙ্গে ফেলার জন্য এসেছিল।

কী বলছ তোমরা?

জি আপা। নিতু বলল, আপনার হাতে যদি জোর থাকে তাহলে কষে এই দুজন মানুষের গালে দুটি চড় লাগান। এরকম ফাজিল আর বেয়াদপ মানুষ খুব কম আছে।

শান্তা আপা রিক্সা থেকে নেমে বললেন, আমি এখনো কিছু বুঝতে পারছি না–

নিতু তখন রিক্সাওলালাকে বলল, রিক্সাওয়ালা ভাই তাহলে–

নিতু তার কথা শেষ করার আগেই রিক্সাওয়ালা ছুটে এসে ওস্তাদ মাস্তানের গালে এমন জোরে চুড় বসালো যে সে একেবারে মুখে হাত দিয়ে বাবাগো বলে মাটিতে বসে গেল। নিতু ব্যস্ত হয়ে বলল, না, না—আপনাকে আমি চড় মারতে বলি নাই।

আপনি বলেন নাই তো কী হইছে? আমার একটা দায়িত্ব আছে — বলে রিক্সাওয়ালা হাত ওপরে তুলে কাচু মাস্তানের দিকে এগিয়ে যেতেই সে একেবারে হাঁটু ভেঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রিক্সাওয়ালার পা ধরে ফেলল।

থাক, থাক মারপিটের দরকার নেই বলে শান্তা আপা এগিয়ে এলেন, বললেন, এরা যদি আসলেই মাস্তান হয় তাহলে পুলিশের হাতে দিলেই হবে।

আপা, নিতু বলল, এদেরকে আগে বেঁধে ফেলতে হবে। ভীষণ বদমাইস এরা। টাকা নিয়ে খুন খারাপ করে।

রিক্সাওয়ালা ততক্ষণে তার কোমরের গামছা খুলে ওস্তাদকে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে। ব্যাগের ভেতর থেকে একটা চাদর খুঁজে পাওয়া গেল, সেটা ছিঁড়ে পাকিয়ে দডির মতো করে কাচু মাস্তানকেও বাঁধা হল। তানিয়া মাথা নেড়ে বলল, এদের পা ও বেঁধে ফেলতে হবে।

হ্যাঁ। আগে রিক্সায় তুইলা নেই, তারপর।

গুড আইডিয়া। মিতুল মাথা নাড়ল, পা বাঁধা থাকলে রিক্সা থেকে লাফিয়ে আর পালিয়ে যেতে পারবে না।

একেবারে পুরোপুরি ভড়কে যাওয়া মাস্তান দুইটি বিস্ফোরিত চোখে সবার দিকে তাকিয়ে ছিল, এখনো তারা বিশ্বাস করতে পারছে না কী ঘটছে।

রিক্সাওয়ালা যখন শক্ত করে মাস্তান দুটিকে বাঁধছে তখন শান্তা আপা বললেন, এখন আমাকে বল, কী হচ্ছে?

বিশাল স্টোরি আপা! রুনু দাঁত বের করে হেসে বলল, বলতে এক মাস লাগবে।

লাগুক।

নিতু জিজ্ঞেস করল, সংক্ষেপে বলব?

বল।

বেগম জোহরা কামালের সব কাগজপত্র খুঁজে পেয়েছি আমরা।

কী বললে? শান্তা আপা চিৎকার করে বললেন, কী বললে?

হ্যাঁ আপা। আপনার ঘরেই ছিল। ঐ সিক্রেট ধাপটার মাঝে! সব কিছু আছে। স্কুলের দলিল। স্কুলের পরিকল্পনা, সব।

কী আশ্চর্য! শান্তা আপা অবাক হয়ে ওদের দিকে তাকালেন, বললেন,  তোমরা খুঁজে পেয়ে গেছ! তার মানে কী জান? তার মানে হচ্ছে আর কেউ কখনো তোমাদের জ্বালাতন করতে পারবে না!

না আপা, পারবে না।

কী আশ্চর্য, আমি সারা দুনিয়া চষে ফেলছি, আর তোমরা কী না—

আপা।

কী হল?

চলেন স্কুলে যাই। সব মেয়েরা কী ভয়ে ভয়ে আছে, তাদেরকে গিয়ে সব কিছু বলি। সাহস দিই।

চল। হেঁটে যেতে পারবে তো?

কী বলেন আপা, আমরা এর মাঝে কী কী করেছি শুনলে আপনার হার্টফেল হয়ে যাবে।

শান্তা আপা মাথা নাড়লেন, বললেন, মনে হচ্ছে তোমরা ঠিকই বলছ, সত্যি হার্টফেল হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণের মাঝেই ছোট দলটি রওনা দিল। প্রথমে রিক্সায় আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা দুই মাস্তান। তার পিছনে ছয়জনের ছোট দল এবং সবার শেষে শান্তা আপা। কাঁটা রাইফেল থেকে বুলেট বের করে নেয়া হয়েছে এবং সেই একেকবার একেকজন ঘাড়ে করে নিচ্ছে। স্কুলের কাছাকাছি এসে ওরা ছোট খাট শ্লোগান দেয়া শুরু করল, হায় হায় এ কী হল? শান্তা আপা ফিরে এল কিংবা গুণ্ডা মাস্তান কান্দে—দড়ি দিয়া বান্ধে) ইলেকট্রিক শক খাওয়া খাড়া খাড়া চুল দাড়ি ওয়ালা দারোয়ান প্রথমে স্কুলের গেট খুলতে দারোয়ান রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু মেয়েদের হাতে কাঁটা রাইফেল দেখে আর আপত্তি করল না।

স্কুলের সীমানার ভিতরে ঢুকে, হবে হবে জয়, নাই ভয় নাই ভয় গাইতে গাইতে দলটি খোরাসানী ম্যাডামের বাসার দিকে যেতে থাকে। তাদের গান শুনে হোস্টেলের সব মেয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। গেটে তালা লাগানো না থাকলে নিশ্চয়ই সবাই এতক্ষণ ছুটে আসত।

খোরাসানী ম্যাডামের বাসায় যাবার আগেই দেখা গেল সে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, কপালে কাছে একটা অংশ ফুলে গিয়ে বাম চোখটা প্রায় বুজে গিয়েছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব বেকায়দা ভাবে সে একটা আছাড় খেয়েছে, ঘরের মেঝেতে তেল ঢেলে রাখার কারণেই হয়ে সম্ভবত কিন্তু এখন সেটা জানার কোনো উপায় নাই। খোরাসানী ম্যাডাম এই ছোট দলটি দেখে একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেল।

শান্তা আপা এগিয়ে গিয়ে বললেন, আপনি তো আমাকে বরখাস্ত করে দিয়েছেন এই স্কুলে তো আমার আসা উচিত না। তবু চলে এলাম। তিনটা খুব জরুরি কাজ পড়ে গেল কি না।

খোরাসানী ম্যাডাম কোনো কথা না বলে রক্তচক্ষু করে শান্তা আপার দিকে তাকিয়ে রইল। শান্তা আপা হাসি হাসি মুখে বললেন,  প্রথম কাজটা হচ্ছে একটা টেলিফোন করতে হবে পুলিশের কাছে। রাস্তা থেকে দুইটা মাস্তান ধরে এনেছি, অস্ত্রপাতি সহ। আসলে আপনার স্কুলের মেয়েরাই ধরেছে আমি শুধু সাথে ছিলাম। গুণ্ডা বদমাইস বাইরে থাকা ঠিক না।

আর দুই নম্বর কাজটা হচ্ছে একটা রিসিট নিয়ে। এই মাস্তান দুইজন নাকি আপনার কাছ থেকে এক হাজার টাকা এডভান্স নিয়েছে কিন্তু কোনো রিসিট দেয় নাই। কী অন্যায়। কী অন্যায়! রিসিট না দিয়ে এক হাজার টাকা নিয়ে গেল? এক্ষুনি একটা রিসিট লিখিয়ে নেন।

তিন নম্বর কাজটা আসলে ঠিক কাজ না– শান্তা আপা ইতস্তত করে বললেন, তিন নম্বর কাজটা একটা প্রশ্ন। আপনি কী মোটা চালের ভাত খেতে পারেন?

খোরাসানী ম্যাডাম নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, কী?

আপনি কি মোটা চালের ভাত খেতে পারেন? শুনেছি জেলখানায় নাকি শুধু মোটা চালের ভাত দেয়। আমরা বেগম জোহরা কামালের ফাইলটা খুঁজে পেয়েছি কি না—

শান্তা আপা কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ খোরাসানী ম্যাডাম আঁ আঁ শব্দ করে, তবে রে শয়তানী বলে চিৎকার করে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে একটা চলন্ত ট্রাকের মতো শান্তা আপার দিকে ছুটে এল, দরজার কাছাকাছি এসে বাঘ যেভাবে লাফ দেয় সেভাবে শান্তা আপার ওপর লাফিয়ে পড়ল। শান্তা আপা মনে হয় প্রস্তুত ছিলেন, শুধু বাম দিকে একটু সরে গেলেন আর খোরাসানী ম্যাডাম প্রচণ্ড শব্দ করে ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল। সেই অবস্থায় মাথাটা একবার তুলে শেষে একটা হুংকার দিয়ে নেতিয়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।

রিক্সাওয়ালা এগিয়ে এসে বলল, ইয়া মাবুদ! এইটা তো দশমনী লাশ! কোরবানীর গরু হলে ষাট হাজার টাকার এক পয়সা কমে কেউ গাবতলীর বাজার থেকে কিনতে পারত না।

এরকম অমার্জিত রূট একটা কথায় কিছুতেই ছাত্রীদের সামনে হাসবেন না ঠিক করেও শান্তা আপা হঠাৎ হি হি করে হেসে ফেললেন -তখন হাসতে হাসতে অন্য সবার যা একটা অবস্থা হল সে আর বলার মতো নয়।

 ১৩. শেষ কথা

বুরুন্নেসা বালিকা বিদ্যালয়ের নূতন নাম শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বিদ্যায়তন। শান্তা আপা হোস্টেল সুপারিনটেন্ডেন্টের দায়িত্বের সাথে সাথে আপাতত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করছেন। নূতন একজন প্রিন্সিপাল খোঁজা হচ্ছে যদিও ছাত্রীদের একান্ত ইচ্ছা শান্তা আপাই শেষ পর্যন্ত এই দায়িত্বে থেকে যান।

বেগম জোহরা কামাল যেভাবে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবে স্কুলটাকে নূতন করে দাঁড় করানো হচ্ছে, স্নেহ মমতা আর ভালবাসা দিয়ে। কাসেম পর্যন্ত চাঁদাবাজী ছেড়ে দিয়ে ভালো হয়ে গেছে, আজকাল তাকে অবিশ্যি কেউ কাসেম ডাকে না, ডাকে কুসুম। শান্তা আপার দেয়া নাম। অন্যে মেয়েরাও যা মিষ্টি স্বভাবের হয়েছে সেটা লিখে বোঝানো যাবে না। (তবে সবাই যে সবসময় মিষ্টি সেই গ্যারান্টি অবিশ্যি দেয়া যাচ্ছে না। এই কয়েকদিন আগে মাঝ রাতে যখন–থাক, সেই বৃত্তান্ত এখন টেনে আনা ঠিক হবে না।)

স্কুলের মেয়েরা আজকাল ছবি আঁকে, আবৃত্তি করে, গান গায়, নাচে। কয়দিন আগে শহরের সিনেমা হলে বাচ্চাদের জন্যে একটা সিনেমা এসেছিল সবাই মিলে সিনেমা হলে গিয়ে সেই সিনেমা দেখে এসেছে।

গল্প বই পড়ার জন্যে বিশাল একটা লাইব্রেরি তৈরি করা হচ্ছে। এর মাঝে কয়েক হাজার বই কেনা হয়েছে (খবর পাওয়া গেছে তার মাঝে কোনো জ্ঞানের বই নেই—সব এভভেঞ্চার, ডিটেকটিভ আর সায়েন্স ফিকশান!) কবি সুফিয়া কামালকে এনে এই লাইব্রেরি উদ্বোধন করা হবে। পরীক্ষার পর নাটক করা হবে, মুক্তিযুদ্ধের নাটক। সবাই শুধু বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযোদ্ধার অভিনয় করতে চায় কেউ রাজাকার আর গোলাম আযমের অভিনয় করতে চায় না। কেউ পরে খেপাবে না এবং সামনের বার মুক্তিযোদ্ধার পার্ট দেওয়া হবে কথা দেয়ার পর কয়েকজনকে রাজি করা হয়েছে। জোর রিহার্সাল হচ্ছে, নাটক যেদিন মঞ্চস্থ হবে সেদিন ফাটাফাটি অবস্থা হবে বলে মনে হয়।

স্কুল থেকে খোরাসানী ম্যাডামকে অবিশ্যি পুরোপুরি দূর করা যায় নি। এখনো প্রতি শুক্রবার একবার হানা দিয়ে যাচ্ছে—সেদিন প্রথম আলোর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় খোরাসানী ম্যাডামের একটা ছবি ছাপা হয়, নিচে বড় বড় করে লেখা থাকে, একে ধরিয়ে দিন। তার নিচে ছোট ছোট করে লেখা থাকে কেন তাকে ধরিয়ে দিতে হবে কি বৃত্তান্ত!

এখনো তাকে ধরা যায় নি, জোর গুজব খোরাসানী ম্যাডাম নাকি নাম পাল্টে পাকিস্তান চলে গেছে। সেটা মনে হয় ভালই হয়েছে, খোরাসানী ম্যাডামের জন্যে ভাল, পাকিস্তানের জন্যেও ভাল! খোরাসানী ম্যাডামের দরদ মনে হয় বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানের জন্যেই বেশি ছিল।

 

নিতু আর তার বন্ধুরা কেমন আছে? সেটা বলতে গেলে এক বিশাল ইতিহাস–

আজ থাক।

—০—

Exit mobile version