Site icon BnBoi.Com

রাজনগর – অমিয়ভূষণ মজুমদার

রাজনগর - অমিয়ভূষণ মজুমদার

 ০১. ফরাসী ফিরিঙ্গি জাঁ পিয়েত্রো

রাজনগর – উপন্যাস – অমিয়ভূষণ মজুমদার

ফরাসী ফিরিঙ্গি জাঁ পিয়েত্রোর হাওয়াঘরটা ছিলো নদীর দিকে মুখ করে। দশ হাত উঁচু সেই হাওয়াঘর। কিছুদূরে কদমগাছের নিচে তার সেই বেঁটে হাতি। কখনো এক পা এগোয়, কখনো এক পা পিছিয়ে আসে। কখনো শুঁড় তোলে। দু পাশে কলাগাছের স্তূপ–পচা হাজা শুকনোর উপরে নতুন টাটকা গাছ। বোঝা যায় কেউ আছে যে প্রাণীটাকে আহার দিচ্ছে। কিন্তু হাওয়াঘর? কে বসবে সেখানে? কোথায় ওয়ারিশান?

একদিন দেখা গেলো পিয়েত্রোর হাওয়াঘরে উঠছে শিবমন্দির। মন্দির সে তো পূজার জন্যই–আর তা গ্রামনগরেই উঠে থাকে। এখানে গ্রামের বাইরেনদীর ধারে একটেরে নিঃসঙ্গ হলো না?

কিন্তু তা হচ্ছে রানীর নিজের ইচ্ছায়, সুতরাং কেন কী জিজ্ঞাসা না করে যা হচ্ছে তা চোখে, যা হবে তা কল্পনায় দেখে নেয়া ভালো। দেখার মতো ব্যাপারও। দশ হাত উঁচু সেই হাওয়াঘরের ভিত আছে, চওড়া চওড়া সিঁড়িগুলো আছে, মন্দির কিন্তু উঠছে নিচের মাটি থেকে, ইদারার মতো গেঁথে তোলা। হাওয়াঘরের মেঝে থাকবে মন্দিরের চারিদিকে বারান্দা চত্বর হয়ে। সে চত্বরে উঠতে হবে পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে, অন্য নতুন সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে মন্দিরের গর্ভে পুজো দিতে। অখাদ্য-খাওয়া অনাচারী সেই আধা-ফরাসীর হাওয়াঘরের মেঝেতে মন্দির হয়?

দেখতে দেখতে অনেকটা উঠেছেও মন্দিরটা। এখনই যেন আন্দাজ করা যায় আর কতদূর উঠবে, শেষ পর্যন্ত তা কী রকমের হবে। নদীর দিক থেকে সরে এসে চত্বরের শেষে কিছুটা ছেড়ে প্রায় গোলাকার হয়ে গড়ে উঠেছে মন্দির। প্রায় গোলাকার বলতে হয় কেননা মন্দিরের মেঝে যেন মধুর খোপ এমন ষট্‌কোণ। দেয়াল সোজা উঠছে। কিন্তু এখনই বোঝা যায় তা গম্বুজে শেষ হবে না, বরং যেন রথ। সেই রথের মাথায় থাকবে পদ্ম; পদ্মের একটা ভারি পিতলের গোলা-শিবলিঙ্গের মাথায় যেমন বজ্র। তা চত্বরযুক্ত মন্দিরটার গড়নই যেন গৌরীপাটসমেত আর এক শিবলিঙ্গ।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বহু লোক কাজ করছে মন্দিরে। মন্দিরের কিছু পিছনে বাঁয়ের দিকে পিয়েত্রোর বাংলো। বাংলোর কাছে আর একদল কর্মব্যস্ত মানুষ। তারা কুমোর। মনে হয় একটা টালির কারখানা বসিয়েছে। ছোটো, বড়ো, নকশাদার; রোদে শুখানো হচ্ছে, পোআনে পোড়াচ্ছে।

মিস্ত্রি, জোগানদার, কুমোর মিলে অনেক লোক। কিন্তু যত লোক লাগুক, এমন এক মঠ কি দু-চার-ছমাসে হয়? আর এক শীতই পার হয়ে যাবে হয়তো।

কিন্তু ইতিমধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেলো। এসে পড়লো তারা। যেন হুমহাম শব্দও উঠছে এমনভাবেই ওরা গ্রামে ঢুকলো। আর তা স্বাভাবিকই। কারণ তারা তো পঞ্চতীর্থের মাটিই আনেনি শুধু, প্রায় তিন হাত উঁচু তিন হাত বেড় নিকষের সেই থামটিও এনেছে যা নাকি শিব হবে।

খবর পেয়ে রাজবাড়ির স্বর্ণকার অষ্টধাতুর সেই পদ্ম তৈরি করতে লেগে গেলো। সে তো থাকবে লিঙ্গের গোড়ায় মাটির নিচে, বসিয়ে দিলে তা আর চোখে দেখা যাবে না। কিন্তু সাগরেদদের বললো– সে, দেখবে তো কারিগরি সেই একজনই যে সব দেখে।

আর তখন হঠাৎ শোনা গেলো যে সাতদিনের মধ্যে শিব বসে যাবেন তাঁর মন্দিরে। একটু কেন, বেশ খানিকটা অবাক হওয়ারই কথা। মন্দির শেষ হলো কোথায়? গ্রামের পণ্ডিতেরা পাঁজি খুললো। সার্বভৌমপাড়ায় এখনো তো টোল আছে। এমন কী মাহেন্দ্রক্ষণ বয়ে যায় যে এখনই এই অপ্রস্তুত অবস্থায় শিব বসাতে হবে? মিস্ত্রিরাজদের মধ্যেও বিস্ময় দেখা দিলো। মনে করো উপর থেকে এক থান ইট খুলেই বা পড়ে লিঙ্গের উপরে।

নরেশ ওভারশিয়ার এলো। হরদয়াল শুনলো। একটু ভেবে বললো–আর কত গাঁথা বাকি?

বারো হাত।

গাঁথাও তো পনেরো হলো শুনেছি। হরদয়াল আর একটু ভেবে নিয়ে বললো–কড়ি বরগার মতো মোটা কাঠ বসিয়ে তার উপরে অস্থায়ী ছাদ করে, তার উপর বাকি দেয়াল গাঁথা চলে?

মিস্ত্রিরা, আজ্ঞা হাঁ বলে উঠে পড়লো। সোজার মধ্যে এমন পাকা বুদ্ধি বলেই না দেওয়ান।

কিন্তু এমন করে শিব বসানো অশাস্ত্রীয় যে তাও তো উড়িয়ে দেয়া যায় না। ওদিকে আবার রানীই ঠিক করেছেন তিথিটাকে।

.

০২.

দিন সাতেক আগে রানী বসবার ঘরে রূপচাঁদকে ডেকে বলেছিলেন উকিলসাহেবকে খবর দিতে।

এখনো এটাকে দেওয়ানকুঠি বলে। বাড়িটা তৈরির সময় থেকেই যে নামে পরিচিত ছিলো তা সহজেই বদলায় না। যদিও রাজবাড়ির লোকেরা এবং কাছারির আমলারা জানে এখনো সেখানে হরদয়াল থাকে বটে, সে কিন্তু দেওয়ান নয় আর।

পদমর্যাদায় কিছু লাঘব হয়েছে বৈকি। সেই একই লোক তো, আগে দেওয়ান ছিলো, এখন আর তা নয়, যদিও তেমনই প্রায় সবই–চালচলন, কথাবার্তা। বেতনটা কমেছে, তাহলেও গ্রামের কেন, সদরের হিসাবেও এখনো তা অনেক। কোনো বিষয়েই রানীর মত জানা সহজ নয়। সদর নায়েবমশাই এই বিষয়ে একদিন শুনেছিলেন এরকম : মানী লোক তো, তাছাড়া ওই টাকাই তো ওঁর অভ্যাস ছিলো। কেউ কেউ বলে উকিল। এটা একটা ব্যথার মতো ব্যাপার নাকি? রানী তাকে বরখাস্ত করেছিলেন। দু-তিনটি বছর গড়িয়ে গেলো না? ওদিকে কিন্তু তারপর আর কেউ দেওয়ান হয়নি।

হরদয়াল ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায়। চেয়ারের হাতলে কাঁচের গ্লাসে কিছু পানীয়। অন্ধকার হয়ে আসছে। মশালচি ওদিকের দরজায় বসে হিংসের একটা বড় বাতিকে ঠিক করছে। অন্ধকারে একটা কোমল ভুলে যাওয়া, দূরে সরে যাওয়ার ভাব দেখা দিয়েছে। হরদয়ালের হাত দুখানা কোলের উপরে রাখা। কিছু ভাবছে সে।

রূপচাঁদ খুক করে কাশলো।

-কে? রূপচাঁদ? হরদয়াল মুখ তুলো-তুমি ছাড়া আর কে?

রূপচাঁদ বললো–রানীমা একবার ডেকেছেন, আজ্ঞে।

-এখনই?

–আজ্ঞে, খাসকামরায়।

–আসছি, বলো।

রূপচাঁদ গেলে পোশাক পাল্টালো হরদয়াল। মশালচিকে নির্দেশ দিলো শোবার ঘরে আর লাইব্রেরিতে আলো যেন বেশি না হয়। আলনা থেকে বালাপোশ নিয়ে হরদয়াল রাজবাড়ির দিকে গেলো।

রানীর খাসকামরায় তখন ঝাড়ে আলো জ্বলছে। বোধ হয় মৃদু মৃদু বাতাস একটা আছে ১৮৬০-এর শেষে হেমন্তের ঠাণ্ডাটাকে বাড়ানোর মতো। কিন্তু বালাপোশ অথবা শাল সত্ত্বেও বিধবে এমন নয়। রানীর পায়ের তলায় লাল গালিচা। তার উপরে আঙুলের ডগা চোখে পড়ে। গায়ে পান্না রঙের শাল। রানী বললেন–এসো হরদয়াল, তোমাকে ডেকেছি আমি। যেন বা হাসলেন, বললেন–বসো।

রানীর হাসি সম্বন্ধে আলোচনা হয় না। কিন্তু তিনি যখন মুখ টিপে হাসেন তখন যে বাঁ দিকে সামান্য টোল খায় তো এতদিনেও হরদয়াল জানতো না। এজন্য, রানী না হলে বলা যেতো, হাসিটাতে একটা অল্পবয়সী ভাব জড়িয়ে থাকে। তার চুল টেনে তুলে বাঁধা, কিন্তু পাক দেখে অনুমান একসময়ে ঝাপটা ঢেউ তুলে থাকতো তা কপালের উপরে।

হরদয়াল বসলে তিনি বললেন–ব্যাপারটা একটা উৎসব। কথার সূচনা করে চোখ তুললেন তিনি, তাঁর টানা চোখের পক্ষ্মগুলো সাধারণের চাইতে বড়ো। মনে হয় উপরদিকে ঈষৎ বাঁকানো।

বললেন–তোমার মনে পড়ে হরদয়াল, মরেলগঞ্জে কালীপূজা হয়েছিলো। ডানকান করেছিলো। তুমি গিয়েছিলে। রাজুর নিমন্ত্রণ ছিলো। সে যায়নি।

বছর দু এক আগে ডানকান কালীপূজা করেছিলো, মরেলগঞ্জের নীলকুঠির ইংরেজ কুঠিআল ডানকান হোয়াইট। পূজা অবশ্য হয়েছিলো তার দেওয়ান মনোহর সিংহের আট চালা চণ্ডীমণ্ডপে। আর ওদিকে যখন পূজা এদিকে ডানকানের বাংলোয় তখন আতসবাজি ফুটছে, মদ আর নাচ চলেছে।

হরদয়ালের কাছে ব্যাপারটা এখনো কিম্ভুত। ঠিক হাস্যকর নয়, কেননা, শোনা যায় সেবারে সেই সিপাহী বিদ্রোহের অবসানে কলকেতার ফোর্টের কোন কোন জাঁদরেল ইংরেজও নাকি কালীঘাটে পূজা দিয়েছিলো।

রানী বলে গেলেন–পিয়েত্রোর হাওয়াঘরে শিবমন্দির হচ্ছে শুনছো বোধ হয়? আগামী বুধবারে, আর সাতদিনও নেই, বিগ্রহ স্থাপিত হবে। একটা উৎসব তো। ডানকানকে নিমন্ত্রণ দিলে হয়?

হরদয়াল বললো–শিববিগ্রহ স্থাপনে

থামলো সে। (এরকম মতামত দিতে পারতো দেওয়ান, সে আর দেওয়ান নয়) বললো– আবার দিনের বেলায় তো?

রানী বললেন–হ্যাঁ, নিমন্ত্রণ মন্দিরে হবে না। তোমার ভয় নেই। উপরন্তু এখনই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না যে ছোঁয়া লাগবে। (রানী কি হাসলেন!) পিয়েত্রোর বাংলোয় হতে পারে। দুপুরে একটা দুটোয় নাকি ডানকানেরা একবার খায়। বাগচীবাড়ি থেকে জানা গেলে তাকে নাকি লাঞ্চো বলে। ডানকানকে সপরিবারে বলল। মনোহরকে বলবে কিনা ভেবে। তোমাদের পক্ষে সস্ত্রীক বাগচী থাকবে। রাজু থাকতে পারে। তুমি থেকো। নায়েব-ই রিয়াসৎ থাকবেন না।

রানী উঠলেন। আসনের পিছনের পর্দা ঠেলে অন্তরে যেতে যেতে দাঁড়ালেন, বললেন, মরেলগঞ্জে কীবল নামে এক ছোকরা সাহেব এসেছে, জানো? হরদয়াল নিজের অজ্ঞতায় বিব্রত হলো। রানী হেসে বললেন, তাকেও বলো। দরবার শেষ হলো।

কখন কী মনে আসবে, কোনটা আগে আসবার সুযোগ নেবে তা বলা যায় না। লাঞ্চো এই শব্দটা মনে এলো হয়দয়ালের। উচ্চারণটা বিকৃত; কিন্তু তা কি ইচ্ছাকৃত কিংবা না জেনে? কৌতুক বোধ করলো হরদয়াল। তারপর তার মনে এলো নায়েব-ই-রিয়াসৎ এই ভারি শব্দটা। আর কেউ দেওয়ান হয়নি। পদটা শূন্য আছে। কিছুদিন আগেও তাকে সদরনায়েব বলা হতো। এখন তার দায়িত্ব বেড়েছে, নামটাও বদলেছে। দেওয়ানের পরিবর্তে সদর-ই-রিয়াস। ও, হ্যাঁ, কীবল নামে কোনো ছোকরা যদি এসে থাকে তার খোঁজ জানা তার কর্তব্য নয় আর এখন। রানী ও নায়েবের চরেরা তা করবে।

.

০৩.

সে যাই হোক, এর ফলে বিগ্রহস্থাপনের দিনটিতে ভিড়টা বেশ দর্শনীয় হয়ে উঠলো। আমন্ত্রিতদের, কর্মচারী আমলা কারিগরদের সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক রবাহূত যেমন এদিকে, ওদিকে তেমনি পিয়েত্রোরকুঠিতে লাঞ্চোর জন্য বাবুর্চি খানসামা, লাঞ্চে নিমন্ত্রিত নীলকুঠির সাহেব ডানকান, তার দেওয়ান মনোহর সিং, এপক্ষের বাগচীমাস্টার, তার স্ত্রী (ইংরেজ স্ত্রী ক্যাথারীন, সংক্ষেপে কেট), উকিল হরদয়াল তো বটেই, ডানকানের অতিথি সদ্য বিলেত-আগত কীবল নামে এক ছোকরা সাহেবও ভিড়টাকে বিশিষ্ট করে তুললো।

ভিড় যখন জমে উঠেছে, বেলা দ্বিপ্রহরের কিছু আগে, রানী এলেন। আগেপিছে দুটো হাতি। হাতির আগে ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে দুপাশে ঝোলানো লালসালুর ঝালরদার দুই দামামা, দুপাশ থেকে দুজন তা পিটে চলেছে। তাদের পিছনে চোপদার দুই সারিতে। হাতি দুটির পিঠে হাওদা। রামপিয়ারী আগে। তার ঝুটো জরির কাজ করা লাল বনাতের জামা মাটি ছোঁবে যেন। তার চৌদোলা হাওদায় রানী। তাঁর পাশে একজন মহিলা। ঠিক চেনা যায় না এমন অবগুণ্ঠন। কিন্তু রানীর পাশে মানায় বটে। হাওদার বাইরে রেলিং ধরে রূপচাঁদই। গায়ে তার লাল পটুর পিরহান। বুকে আড়াআড়ি বাঁধা নীল পশমী ধোকড়। মাথায় গাঢ় নীল মলমলের পগগ। পরের হাতিটি জয়নাল। একটু বয়স হয়েছে। রামপিয়ারীর দেড়া উঁচু, দাঁতাল। খোলা হাওদায় রাজু, রাজকুমার রাজচন্দ্র। রাজুর পরনে গলাখোলা ইংরেজি ব্লাউজ কামিজ। হাতে বন্দুক।

ডগরের ঘোড়াই পথ করছিলো। চোপদারদের দুই সারি সেই ফাঁকে ঢুকে ডাইনে বাঁয়ে সরে সরে চাপতেই ভিড়ের মধ্যে গলিপথটা তৈরি হলো। সেই গলিপথের মাথায় হাতি থামলো। প্রথমে রামপিয়ারী বসলো। মাহুত নেমে রেলিংদার কাঠের সিঁড়িটা নামিয়ে হাতির গায়ে হেলান দিয়ে ধরলো। রানী এবং তার সঙ্গিনী আগে পিছে নামলেন।

তাঁরা এগিয়ে গেলে রাজচন্দ্র নামলো তার হাতি থেকে। রূপচাঁদ এগিয়ে এসেছিলো। তার হাতে বন্দুক দিয়ে রাজচন্দ্র মন্দিরের চত্বরের দিকে এগিয়ে গেলো।

এতক্ষণ চত্বরটি খালি ছিলো। সিঁড়ি বেয়ে রানীমা উঠতেই চত্বরের নিচে থেকে পুরনারীরা উলু দিয়ে অনুসরণ করলো। তাদের কারো কারো কাঁখে ঝকঝকে নতুন ঘড়া। তারা এগিয়ে যেতেই অন্য এক সিঁড়ি দিয়ে স্বগ্রামের আমন্ত্রিত পুরুষরা উঠতে লাগলো চত্বরে। তখন জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠলো–দেখা যাচ্ছে, দেখা যায়, আসছে ওই। কারা শঙ্খ বাজালো৷ নিকষের থামের মত শিবলিঙ্গ বেশ দূর থেকেই দেখতে পাওয়ার কথা। ওদিকের আর এক সিঁড়ি দিয়ে হরদয়াল আর ডানকানকে উঠতে দেখা গেলো। তাদের ঠিক পিছনে বাগচীমাস্টার আর তার পাশে নতুন এক সাহেব। ভিড়ের মধ্যে ফিসফিসানি শোনা গেল বাগচীর শ্বশুরকুলের নয়তো? নাকি ডানকান বেটার মেতোভাই। সাধারণ, রবাহূতরাও একে-দুয়ে চত্বরে উঠতে শুরু করলো এবার।

ততক্ষণে মিস্ত্রিরা মন্দিরের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছে। ভিড়ের থেকে ছোকরা বয়সের কয়েকজন বুদ্ধি করে কাছের এক গাছে গিয়ে চড়লো। তারপর গাছ ভরে উঠলো মানুষে।

মন্দিরের দরজার সামনে, অর্থাৎ যেখানে দরজা বসবে, লিঙ্গকে স্নান করানো হলো। মিস্ত্রিরা ততক্ষণে লিঙ্গ বসানোর গোল ফাঁদটাকে ঠিক করেছে। মন্দিরের ঘরে তখন নামলেন রানী তার সঙ্গিনীকে নিয়ে তার হাতেই পূজার উপকরণ। রানী ভিড়ের আর একজনকে ডেকে বললেন–এসো, বড়গিন্নি।

পঞ্চতীর্থের মাটি বার করে সে ফাঁদে সেই মাটি বসানো হলো। প্রধান মিস্ত্রি বললো–—এবার–

রানী বললেন–একটু রসো।

পিছন ফিরে বললেন–দাও এবার যা এনেছে।

রানীর সঙ্গিনী ফুলের সাজি থেকে একটা ছোট রুপোর বাটি দিলো মিস্ত্রির হাতে। সে বাটি যেন রক্তচন্দনে টৈটুম্বর। সঙ্গিনীই মিস্ত্রিকে বলে দিলো–ওটার উপরে স্বর্ণের শতদল বসবে, তার উপরে শিবলিঙ্গ।

শোনা যায় মিস্ত্রিরা নলের বংশধর এবং হাতে যখন করনি তখন জোগান যেই দিক বাঁ হাতেই তা ধরে। এ নিয়ে সুগ্রীব না কার সঙ্গে একবার হাঙ্গামা হুজ্জত বেধেছিলো। তাতে কিন্তু ধারা বদলায়নি। তীর্থের মাটি সমান করে, করনি দিয়ে গোল গর্ত করে বাটিটাকে বসিয়ে বাঁ হাতেই রানীর সঙ্গিনীর দু হাতে ধরা অত বড় স্বর্ণপদ্মটাকে নিলো সে। সেটাকে বসিয়ে বললো–এবার তাহলে–

দু-তিনজনে মিলে নিকষের লিঙ্গটাকে সোজা করে ধরলো। প্রধান মিস্ত্রি নিজেও হাত লাগালো। মেয়েরা উলু দিয়ে উঠলো। ভিড় শিবের নামে জয় জয়কার দিলো। ততক্ষণে কুচো ইট আর মশলার জমাট গুঁজে করনির মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে পোক্ত করতে লেগেছে মিস্ত্রিরা। ফুল ছড়িয়ে দিয়ে রানী পিছন ফিরলেন।

একেই তাহলে শিব প্রতিষ্ঠা বলে। এই কি প্রথা–এরকমই মনে হলো দর্শকদের।

প্রথার কথা কজনেই বা জানে। রোজ তো আর হয় না। দুএকজনের স্মৃতিতে অন্য কোনো কোনো শিবপ্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সে নিরিখে কি আজ যা হলো তার বিচার হয়! রাজপুরোহিত ছিলেন। আমন্ত্রিতদের মধ্যে বৃদ্ধ শিরোমণিমশায় ছিলেন। রাজপুরোহিত প্রথমে কৌশলে কাটলেন–তা বাপু, আমি শিবতন্ত্র জানি না। এ শিবের জন্য তো নতুন পুরোহিতই এসেছে। পরে আর একটু কৌশল করে বললেন–তোমরা যদি অন্যত্র অন্যরকম দেখেই থাকো সে কি রাজবাড়ির ব্যাপার? আমি তো বলি বাপু, তোমরা যদি প্রতিষ্ঠে করো, আর আমাকেই ডাকো, এখন জানা রইলো, এমন বিধানই দেবো। শিরোমণি অত সহজে মুখ খোলেন না। মনে মনে শাস্ত্র ঘেঁটে শিবলিঙ্গের মূলে রক্তচন্দনেরও আধার বসানোর যুক্তি খুঁজলেন। অশাস্ত্রীয়ই বোধ হলো তার কাছে। শিবপূজায় শ্বেতচন্দনই বিধেয়।

ভিড়ের টানে একটা মেলা বসে গেলো। জিবেগজা আর আর দই, মুড়কি মোয়া মিঠাই, জোলাকি মাটা আর গামছা, বাঁশের দাঁড়ে বসা শোলার পাখি। মেলার টানেই মেলা চললো যেমন চলে, যদিও মন্দিরের চত্বর খালি হয়ে আসছে।

.

০৪.

মেলা থেকে ফিরতে ফিরতে গ্রামের পোস্টমাস্টার চরণদাস বললো–ছিলো ফরাসী সাহেবের হাওয়াঘর, হলো শিবমন্দির। লাও।

তার এক সঙ্গী বললো–এতদিনে পিয়েত্রোর আত্মার শান্তি হলো গো।

চরণদাস বললো–সেবাপু খেস্টানি আত্মা। ভারি মজেসে ঘুমোতে লেগেছে এখন। কোন ক্ষেতিবৃদ্ধি নেই। সেই কবে রোজকিয়ামৎ হবে তখন দেখা যাবে।

সঙ্গীরা নতুন খবরের আকর্ষণে ঘিরে ধরলো চরণদাসকে।

একজন বললো–ইনসাল্লা, বলিস কী রে? তাচরণ তোর জানারই কথা। তুই তো আবার খেস্টান বাগচীমাস্টারের সাগরেদ।

অন্য একে বললো–কী যেন রোজ বললে? তাতে কী হয়?

চরণদাস হেসে বললো–সে ভারি মজার। সেই একদিন, তা সে যে কত লাখ বছর পরে আসবে এখনো কেউ জানে না, সেদিন নাকি ভগবান বিচার করবেন।

মানে লাখ লাখ বছর ধরে কোনো বিচারই হবে না?

চরণদাস ঠা-ঠা করে হেসে উঠলো। বললো–তাই তো। বলতে পারো ভগবানের এজলাশে তামাদি হয় না। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের পাপের হিসাব লাখ লাখ বছর ধরে কে রাখে কে জানে। আমার তো মনে হয় ডানকান বেটা বুঝে নিয়েছে ওর আত্মার বিচারের কাগজপত্তর ততদিনে সব নিপাত্তা হয়ে যাবে। আর থাকলেও কিছু তা পড়া যাবে না।

ধরেছিস ঠিক। অন্য একজন বললো–আমার এতদিন মনে হতো রহিমুদ্দিন যেমন বলে, সেই ইবলিশের বাচ্চা তাই। এখন এবার রহিমুদ্দিনকে বুঝিয়ে বলবো–সেখানেও কাগজপত্তরের খেলা। তাছাড়া ধরো ঘুন বেনের জাত তো, অন্য কারো আত্মার ভালো কাগজ নিজের বলে হাতিয়ে নিতে পারে।

এক সরল গ্রামবাসী গাঁক গাঁক করে হেসে উঠলো। সামনে থেকে আর এক সরল গ্রামবাসী পিছন ফিরে বললো–তাই বুঝি ডানকানা কুঁদে বেড়ায়, চরণদা? তা, পিয়েত্রো কিন্তু ডানকানার মতো ছিলো না। তাছাড়া তাকে তো পোড়ানো হয়েছিলো। তার আত্মা ধরো যে ঘুমাবে কোথায়? আমার তোমার আত্মার মতোই নাক দিয়ে বেরিয়েই যদি যমদূতের হাতে না পড়ে থাকে, তবে চিতার আগুন নিবে অন্ধকার হতেই কী হয়েছে কে জানে। সে শিউরে উঠলো।

এখানে তাদের পথে আর একটি পথ এসে মিশেছে। চরণদাস বললো–সে পরে ভাবিস। মেয়েরা এই পথে আসবে। তোরা এগো, আমি বউ-এর জন্য দাঁড়াই।

হাসতে হাসতে চরণদাসের প্রথম সঙ্গী বললো–তা, চরণ, গাঁয়ে তোবউ একা তোমারই, কেমন নাকি?

চরণ বউ-এর অপেক্ষায় পথের পাশে সরে দাঁড়ালো হাসতে হাসতে।

.

০৫.

ভিড়ের প্রথম আর শেষ এক নয়। তখন আর চোপদারের সারিতে বাঁধা পথ নেই। বিশৃঙ্খলা, ঘোরাফেরা, ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। ব্যাপার বুঝে চোপদাররা এগিয়ে এলো। পথ দাও বলে রূপচাঁদ চেঁচাতে লাগলো।

রানী সামনে, পিছনে সঙ্গিনী। তার অবগুণ্ঠন কিছু শ্লথ। তিলফুল নাসা, সুগঠিত চিবুক আর টানা চোখ দুটি, নাকি লোচন বলে, চোখে পড়ছে। থেমে দাঁড়িয়েছিলো তারা। পাশে চাইতে গিয়ে অদূরে রাজকুমারকে দেখতে পেলো সে। কেমন বিড়ম্বনা দেখো–নিঃশব্দ হাসিতে যেন এই কথাটা ছিলো। রাজকুমারের শিকারের পোশাক দেখে টাকুঁচকে উঠলো তার। কিন্তু রাজকুমারের চোখ নিজের উপরে দেখেবরং পাশ দিয়ে টানা অবগুণ্ঠনে চিবুকের আর কিছুটা ঢাকা পড়লো।

শিক্ষিত হাতি, ক্ষতি করে না; কিন্তু তার পায়ে তো চোখ নেই। সুতরাং তার গলার ঘণ্টা বেজে উঠতেই আপনি ভিড়টা এদিকে পাতলা হলো। তখন চত্বরের শেষ ধাপ থেকে নেমে রানী বললেন–এসো, নয়ন।

হাওদায় বসে আবার বললেন–রাজু বোধ হয় শিকারে চলেছে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন আবার–সাহেব দুটোর মধ্যে বুড়োটা বোধ হয় ডানকান।

রানীকে নিয়ে রামপিয়ারী তখন খানিকটা এগিয়েছে। রামপিয়ারীর জরির জামার চৌদোলা হাওদার কিংখাবের ফুলকারি আলোয় চমকাচ্ছে। জয়নাল কিছু পিছনে। পাশে একটা গলিপথ। জয়নাল দাঁড়িয়ে পড়ে একটা গাছের ডাল ভাঙলো। মাহুত ডাঙ্গস ঠুকলো তার মাথায়। যেন হাসলো এমন ভঙ্গিতে মুণ্ডু ঘুরিয়ে জয়নাল পাশে সেই গলিপথটাকে ধরলো একটু দ্রুতগতিতে। ফলে সিঁদুরে খড়িতে আঁকা তার গায়ের পদ্মগুলো অস্পষ্ট হচ্ছে।

রানী আর একবার কথা বললেন, বাগচীমাস্টারের স্ত্রীর কাছে শুনেই সব ব্যবস্থা হয়েছে। নিশ্চয় লাঞ্চোর?

পাড়ছাড়া দুধ-গরদের ঘেরে তাকে অন্যমনস্ক দেখালো। উপোস করে আছে, মনে হলো সঙ্গিনীর, হয়তো সেজন্যই একটু শুকনো দেখাচ্ছে। আর এতক্ষণে তা ঠাহর হলো। রানীর সঙ্গিনীর অবগুণ্ঠন শ্লথ, নিচে থেকে বর্ণটা ঠাহর হলো, তার জড়োয়ার কন্ঠি কলার ঝিকমিক করলো।

.

০৬.

লাঞ্চ শুরু হলো ভাজা মাছ দিয়ে। লাঞ্চ বটে নাম, আয়োজনটা ডিনারের। অন্যদিকে যেন হালের কটেইল পার্টির অভ্যাসও আছে। ছজনের টেবিল, কিন্তু মাঝখানে সাজানো বোতল বোধ করি এক ডজন এবং তা নানা আকারের। সেগুলোকে ঘিরে কয়েক ডজন ঝকমকে কাঁচের গ্লাস। জলের গ্লাসই বরং অনুপস্থিত। সাদা ব্রোকেডের টেবল ক্লথে ঝকঝকে হেমন্ত দুপুরের আলো।

০২. পিয়েত্রোর বাংলো

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

পিয়েত্রোর বাংলোর একটা সাধারণ লাঞ্চ অবশ্যই ছিলো না। আমন্ত্রণপত্রে স্বাক্ষর ছিলো হরদয়ালের। তা কিন্তু রাজবাড়ির পক্ষ থেকেই হয়ে থাকবে এই ভেবেছিলো ডানকান, কারণ উপলক্ষ তো ফরাসডাঙায় রানীমার শিবমন্দির স্থাপন। প্রটোকল নিয়ে খুব একটা চিন্তা। করেনি ডানকান। কেননা মরেলগঞ্জ নীলকুঠির ম্যানেজার হিসাবে সে নিজে রাজবাড়ির ঠিক কার সমকক্ষ এ নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। তাছাড়া এটা এমন অনেকদিন থেকে চলে আসছে রাজবাড়ির নিমন্ত্রণ আসে হরদয়ালের কাছ থেকে। এবং খানাপিনা হয়। দেওয়ানকুঠিতে। সেও তো হরদয়ালের কুঠিই। অবশ্য রোজ রোজ হয় না। রানীমার জন্মতিথি উৎসবে হয়।

প্রথমেই ডানকান বোতলের দিকে আঙুল তুলেইঙ্গিত করলো। বাবুর্চির সাগরেদ এগিয়ে এসে নির্দেশমতো বোতল খুলে গ্লাসে ঢেলে দিলো।

এ ব্যাপারে সম্ভবত আমাদের আশ্চর্য হওয়া সঙ্গত নয়। কারণ এ সময়ের কাছাকাছি কলকাতায় মদ্যপান নিবারণী সমিতি স্থাপনের কথা শোনা যায় বটে;প্রকৃতপক্ষে সেটা তখন তিনবোতলী মানুষদের ভিক্টোরীয় যুগ। তাদের উদরও নিতান্ত উদার ছিলো। টেবিলের পায়া জড়িয়ে ধরে অনেকে ডিনার শেষ করার খ্যাতি অর্জন করতেন তখন।

টেবিলটা গোল। ঢুকতেই চোখে পড়ে কেটকে। পরনে চকোলেট রঙের স্কার্ট ব্লাউজ। মাথায় সাদা বনেট, তাহলেও তার লাল চুল কিছু চোখে পড়ছে। কুনুই অবধি সাদা গ্লাবস ছিলো, এখন পাশে খুলে রাখা। তার বিপরীত দিকে তার স্বামী বাগচী-চন্দ্রকান্ত এজ বাগচী। হালকা কালো ওরস্টেডের ব্রিচেস, কালো ভেলভেটের কোট, গলার সাদা বো। তার চিবুকে এখন দু-চারটে সাদা দাড়ি চোখ পড়ে। তাকে কালোই দেখায়।

কিন্তু সুবিচার করতে হলে বলতে হবে হরদয়ালের গায়ের রং আরও কালো। সে রং আরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে এজন্য যে তার নাক নিখুঁত এবং ধারালো। চোখ দুটি টানা। চিবুক সুগঠিত। ঠোঁট দুটি বিশেষ পাতলা এবং পরস্পরসংবদ্ধ। তার মুখটা শুকনো দেখাচ্ছে। চোখের কোণে কিছু কালি। তা কি অস্বাস্থ্যের? বরং হয়তো কাল রাতের লাল মদের ফলে। তার গায়ে গরদ রং-এর গলাবন্ধ কোট।

কে বললো–আজকের আবহাওয়াটা খুব সুন্দর।

হরদয়াল বললো–তাপটা কোমল এবং আরামদায়ক।

কেটের বাঁয়ে হরদয়াল ডাইনে ডানকান। রং যদি দেখতে হয় তাকেই লক্ষ্য করতে হবে যদিও তার পদবী হোয়াইট। গাজরের মতো রং। মাথার বিরল চুল তামার ভাবযুক্ত হলুদ। কাছে থেকে দেখার ফলে বোঝা যাচ্ছে তার নাকের মাথাটা মোটা এবং লাল। মুখে যথেষ্ট গর্ত গাড়া এবং গুটি। টুইডের কোট এবং ফ্ল্যানেল ব্রিচস। ঘরে ঢুকে সে রুপোবাঁধানো মালাক্কা লাঠি জমা রেখেছে দরজার পাশে স্ট্যান্ডে। সে যে মরেলগঞ্জের ইন্ডিয়া লিমিটেডের ম্যানেজার তা তার ঘোরাফেরা ওঠাবসায় প্রমাণ, যদিও ইদানীং তার মধ্যে কিছু আড়ষ্টতা ফুটছে; সেই উনবিংশ শতকীয় বাত-যা ইংরেজ ভদ্রলোকের লক্ষণ।

ডানকান বললো–মৃদু এবং মধুর।

কেটের বিপরীতে বাগচী। বাগচী এবং হরদয়ালের মধ্যে মনোহর সিং, বাগচী এবং ডানকানের মধ্যে কীবল। মন্দির দেখতে যাওয়ার আগেই হরদয়াল কেটকে আওয়ার হোস্টেস বলে পরিচিত করে দিয়েছিলো।

মনোহর চোগা চাপকান পরেছে। মাথায় জড়ির কাজ করা শামলা। তার মুখের গড়ন রোগাটে, কিন্তু গালের মাঝামাঝি তক্ নেমে আসা চওড়া জুলফি, এবং ঠোঁটের কোণ বেয়ে ঝুলে পড়া ঝোরা ঝোরা গোঁফ সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

কীবল এখানে বয়ঃকনিষ্ঠ। যেন খড়ির তৈরি এমন সাদা। মুখের গড়নে চৌকো চোয়াল এবং প্রয়োজনের চাইতে বড়োনাক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একেবারে কটা চোখ, চুল তামাটের চাইতে লাল। বাদামি লালে ডোরাকাটা টুইডের কোটে, গলাখোলা কামিজে দেখাচ্ছে যেন তাদের দেশের একজন আন্ডার গ্র্যাজুয়েট।

হরদয়ালের মুখোমুখি সে।

হরদয়াল বললো–মাছটা কি কিছু শক্ত ভেজেছে মনে হয়?

ডেলিশাস। কী বললো– কীবল।

কারো কারো চরিত্র তার প্রথম কথাতেই প্রকাশ পায়। মনোহর সিং বললো–কিন্তু তা বলে কি সার, এ কি আর টেমসের হেরিং।

কীবল বললো–ইউ নো টেমস?

সে কিছুটা অবাক। মনোহর কৃতার্থ।

বাট, বললো– হেসে কীবল–টেমস্ ওঅজ নেবার ফেমাস্ ফর ফিশ। ইজ ইট হিলসা দো?

বলা বাহুল্য তাদের ইংরেজি আলাপে ভাঙাচোরা বাংলা ও রংছুট বাঙালি ইংরাজির। মিশেল থাকছিলো।

হো হো করে হেসে উঠে ডানকান বললো–অ্যাংলো ক্যালকাটানদের রোগ টোমাকে ঢরেছে আমি ডেকছি। কিন্তু হিলসা টোমার টামির পক্ষে ভালো যথেষ্ট নয়। ডিসেন্ট্রি ঘটায়। হোঅট ফিশ দিস হৃদলাল?

হরদয়াল–উচিত ছিলো রুই, দেখছি কাতল।

মিষ্টি হেসে কেট বললো–আমি যে তার ব্যাপারে বিশেষ নস্ট্যালজিক তা নয়। বাট টেমস্ হ্যাজ হার ফিশে দো হেরিং ইজন্ট এ গুড ফ্রাই।

মাছের গ্রাসটাকে চিবিয়ে নিয়ে কীবল বললো– হাসিমুখে–হয়তো, হয়তো। হোয়েন ইউ লাস্ট স্ব হার। দা ব্ল্যাক ব্রাকিশ ওঅটর দ্যাটস্ নাউ টেমস্ ইজ এ ডেড রিভার ফর অল পারপাসেস। (এখন যে কালো বিস্বাদ জলকে টেমস বলা হয় তা সব রকমেই এক মৃত নদী)।

ডানকান যে বোতলটাকে খুলিয়েছিলো কীবল সেটাকে পছন্দ না করে ক্লারাট লেখা বোতলটাকে ইঙ্গিত করতে সেটা খুলে দিলো এক খানাবরদার। কীবল নিজের হাতে গ্লাস ভরে নিলো।

বাগচী আলাপে যোগ দিতে বললো–এরকম হলো কেন?

কীবল-এর বক্তব্যর অনুবাদ এই রকম–সবই কালো হতে চলেছে এখন, নদীর জল একসেপসন নয়। তাতে দুঃখও নেই। কারণ এ যুগটা কয়লা এবং লোহার–বোথ ব্ল্যাক। নয় কি? অন্য রং যদি কোথাও থাকে তবে তা হোয়াইটের নীলে।

সে হাসলো। ডানকান এই মৃদু রসিকতায় বললো—হ।

আলাপটা দ্বিতীয় কোর্সে লোহাকয়লা কারখানার দিকে গড়িয়ে তা থেকে স্টিম এঞ্জিন অবশেষে স্টিমারের গল্পে পৌঁছালো। স্টিমার যা নাকি বাষ্পের সাহায্যে সমুদ্রে চলে। কিমাশ্চর্যম্ অতঃপরং।

ডানকান বললো–কাম কাম, ফলমাউথের খেলনাগুলো ভালো কিংবা কলকেতা বন্দরে কিন্তু আমাদের বয়সে

কীবল বললো, মিট মিট করে হেসে, সে নিজের চোখে প্লীমাথেও স্টিমার দেখেছে এবং তা ম্যান অব ওআরদের মধ্যে ঘুরতে। এই শীতে ব্রিন্ডিসি পর্যন্ত আসবে স্টিমার যদি না আলেকজান্দ্রিয়া পর্যন্ত পারে।

হোয়াট ডু ই’মিন ব্রিন্ডিসি, ডানকান বললো–তুমি ডেখো, এই সমুদায় টয়েস্ সাহায্যে বড়োজোর ব্রিন্ডিসি আসা যাইবে কারণ তা ভূমধ্যসাগর।

কীবল হেসে বললো–ভূমধ্য হলেও তা সাগর।

ডানকান বললো–আটলান্টিক, প্যাসিফিক অথবা ভারতসাগরে স্টিমার আসিবে? ও নো, তুমি তেমন বলল না। কিংবা তা স্টিমারই থাকে কিন্তু হার ম্যাজেস্টির শিপ অফ দা লাইন হয় না। তুমি কি বলো ব্রিটেন ওন্ট সেইল দা সিস্।

কীবল বললো–ইনডিড, শি উইল। কিন্তু সেইল-এর অর্থ হবে তখন স্টিম অ্যাক্রস।

হরদয়াল বললো–জুলাই-এর টাইমসে এরকম একটা কথা সে দেখেছে বটে। কিন্তু তা কি সত্যি হবে। তা কি একটা সায়েন্টিফিক ফিকশনমাত্র নয়?

ডানকান টাইমস পড়ে না। কলকেতার ইংলিশম্যান বরং কেনে। কিন্তু ইতিপূর্বে সে কীবলের কাছে স্টিমারের উন্নতি সম্বন্ধে অবশ্যই জেনে থাকবে। তার কথায় বিস্ময়ের পরপরই যে কৌতূহলী অবিশ্বাস আসে তা দেখা দিয়েছে এখন।

মনোহর সিং বললো–ভগবানের কী সুবিচার। ইংরেজদের পক্ষেই এমন আবিষ্কার সম্ভব।

সে যে ইতিমধ্যে নতুন এক জমিদারবংশ স্থাপনের স্বপ্ন দেখছে তা ভিত্তিহীন নয়।

বাগচী কেটের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইলো। বললো–এও যদি সত্যি, বিস্ময় বলতে আর কিছু রইলো না।

মৃদুস্বরে কেট বললো–আশ্চর্য, ইউ নেভার ক্যান টেল।

বাগচী বললো– মানুষ হয়তো শূন্যপথেও চলবে আর ইঞ্জিনই তা পারবে।

কেট হেসে বললো–তা কি সম্ভব যে মানুষ এঞ্জেল হবে? উই আর নট অব দি এয়ার। স্টিম, তার শক্তি, ইংরেজদের স্বজাতি-প্রীতি, মনোহরের ইংরেজ প্রশংসা নিয়ে আলাপ জমে উঠলো। তখন তৃতীয় কোর্স চলেছে।

কিন্তু কেউ কেউ থাকে যাদের শৈশবেনাক টিপে ধরে নিঃশ্বাসে সমতা রাখতে শেখানো হয়েছে। মৃদু হেসে হরদয়াল বললো, বাট দি ওয়াইন উইল চাইড! সে একটা নতুন গ্লাসে ক্লারাট ঢেলে কেকে এগিয়ে দিলো। নিজের গ্লাসটা পূর্ণ করে নিয়ে বললো–লেটস ড্রিঙ্ক টু হিউম্যান উইজডম অ্যান্ড বিউটি।

টেবলের দু-তিনটি গ্লাস শূন্যে চিনক করে উঠলো।

লাঞ্চের ভার তার নিজের বাবুর্চির উপরেই যদিও তাকে সাহায্য করতে পিয়েত্রোর বাবুর্চি বন্দাকে পাওয়া গিয়েছিলো। তার বাবুর্চি নিশ্চয়ই তার পদ শেষের ইঙ্গিত বোঝে। তখন তাদের রোস্টবিরিয়ানি নিয়ে আসতে দেখা গেলো।

ডানকান বললো–হৃদলাল, মাই ফ্রেন্ড হিয়ার ইজ এ সোলজার, এ সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড এ সেন্ট অল ইন উয়ান। ইউ উইল লাভ টু নো হিম।

কীবল হাসিমুখে বললো–এ সোলজার ইয়েস,এ সায়েন্টিস্ট মে বি, বাট হাউ এ সেন্ট?

এইস্ট ইউ উয়ান অব দোজ এভানজেলিস্ট?

এই রসিকতা করতে পেরে ডানকান আত্মপ্রীতিতে হু হু করে হেসে উঠলো।

কীবল দুএক মুহূর্ত যেন এই রসিকতাটাকে অনুভব করলো, তারপর আলাপের ধারাটা বদলে নিলো। বললো, নিমন্ত্রণের কথায় সে আশঙ্কা করেছিলো কী ভয়ঙ্কর টেবলম্যানার্সের মধ্যে না পড়তে হয় কিন্তু এখানে ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। ইটস এ রিলিফ। বোঝা গেলো সে লাঞ্চটাকে প্রকৃতপক্ষে উপভোগ্যই মনে করছে।

হরদয়াল চিন্তা করলো একই টেবলে বসে অন্যের টেবলম্যানার্স নিয়ে আলোচনা করা ইংরেজ আভিজাত্য কিনা তা ঠিক তার জানা নেই। যদিও ও ছোকরার ইংরেজিটা উচ্চারণে ও শব্দ বাছাইতে ভালো। কিন্তু তার কোনো কোনো চিন্তা জিহ্বায় ধারালো না হয়ে চোখের কোণে ঝকঝক করে।

বাগচীও তখন কিছু সমস্যায় পড়লো। মনস্তত্ত্বগত কারণ হয়তো কীলের কথা এবং কীবলের কথার মূলেও হয়তো মনস্তত্ত্বগত এই কারণ ছিলো যে সদ্য বিলেত-আগত তার চোখে এখানকার টেবলম্যানার্স ঠিক বিলেতীনয়। বাগচী ভাবলো টেবলের মাথায় সে, যদিও এটা তার বাড়ির ভোজ নয়। সে কি প্রথম ছুরি বসাবে রোস্টে?

সমস্যার সমাধান করলো ডানকান। সেই প্রথম ছুরি বসালো বাদামী করে ভাজা পিগলেট রোস্টে। মরেলগঞ্জ ইন্ডিগোর ম্যানেজার হিসাবে সেই কি এদিকের সব আসরের হেড নয়।

যেন এটাকে, ডানকানের এই ম্যানার্স বিচ্যুতিকে ঢাকতেই বাগচী বললো– তাড়াতাড়ি–এটা উৎসব বটে, কিন্তু আমাদের স্বীকার করতেই হবে মরেলগঞ্জের সেই উৎসবের তুলনায় এটা কিছু নয়।

খুশী ডানকান বললো–কোনটে মনে করছে বাগচী?

–লোকে যাকে এখনো হোআইট সাহেবের কালীপূজা বলে।

কীবল বিস্ময়ে ভ্রূ তুলে জিজ্ঞাসা করলো কী বললেন, কী পুজো?

বাগচীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মনোহর সিং বললো–সে যে কী নাচ গান, কী পুজো আর কত হাউই তুবড়ি।

–এঃ! কীবল বিস্ময়ে থই পাচ্ছে না।

মনোহর বললো–শট অনলি বেঙ্গল লাইটস সার, রকেটস, বুমবুম, থাউজান্ড রুপি ড্যান্সিং ফাউন্টেন্স অব ফায়ার। সে এই জায়গায় হাউই ও তুবড়ির উৎক্ষেপ বোঝাতে হাত ও আঙুলের যথোচিত ভঙ্গি করতে ছাড়লো না।

কীবলের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। -সব্লাড ওঅজ ইট এ পেগান গড হোয়াইট?

ডানকান হাসলো-দি হেল ইট ওঅজ। এ গডেশ দো। সাম টাইমস ইউ হ্যাভ টু ইল্ড টু দা নাইট।

কৌতুক বুঝে কীবল বললো–অ্যান্ড হিয়ার ইন ইন্ডিয়া নাইট হ্যাজ হার ওয়ে। কি, এসব কি মিউটিনির পরে ঘটিয়া থাকে?

ডানকান বললো– (তার স্বরবর্ণকখনো কখনো বিশেষ চওড়া)-ওয়াল, সব পেগান ভালো না আছে। মানোআর এখানে ভালো পেগান হয়। ওয়াল তুমি কি জানো তাহার তিন ইস্ত্রি থাকে। সব ছোটোটি তেরো হবে। সি মাস্ট হ্যাভ হার ওন সুইটস।

কীবল কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু থমকে গিয়ে বললো–উই আর এ মিক্সড কোম্পানি, হোয়াইট। সে কেটের দিকে তাকালো। তার ইচ্ছা অনিচ্ছাকে কেয়ার না করে সেই রূপ তার ভাল লাগলো। সে বললো–ডেলিশাস। ইজ ইট পোলট্রি দো? হরদয়াল কেটকে। সাহায্য করে বললো–নো, ফ্রম এ হান্টার্স ব্যাগ।

কিন্তু ডানকান বললো–হঃ।

কিন্তু যেন সে মত বদলালো। কেটের উপস্থিতিকে মর্যাদা দিলো। ইতিমধ্যে কি তার মন টেবিলের সময়ের চাইতে ধীরে চলছে? বললো, কিন্তু মনোআর রাজপুট আছে। রিঅ্যাল রাজপুট। দে হেল্পড আস দা রাজপুটস। ইউ নো।

সে যেন সোৎসাহে পাশে দাঁড়ানো খানাবরদারকে ক্লারাট দিতে ইঙ্গিত করলো। কীবল বললো–কিন্তু এসবে তোমার পেগান গডেস পূজা করার আগুমেন্ট নেই। হোয়াইট, এখানে কি পিওর স্টিকিংএর সুবিধা আছে ডেওয়ানজি?

ক্লারাটটা হাতে নিয়ে ডানকান বক্তৃতার ঢঙে বললো–আনঅ্যালোয়েড পেগানরা ভালো হয় যাহারা ক্যালিকে মাদার বলে। অবশ্যই বিঅতিক্রম আছে। হৃদলাল এথা, আমি টোমাকে আবার ধন্যবাদি হৃদলাল, তোমার স্কুল ভালো চলে তো? এবং প্রিন্স! ইহাদের মতো না থাকিলে, জানো, এ জেলাতেই লাখনাউ হইয়া যেতো। দ্যাট ব্ল্যগর্ড শন অব এ বিচ পিয়েত্রো। কিন্তু ভালো খুবই ভালো। অ্যাডোলেসেন্স পার হওয়া কলে ঘটে। মিউটিনি ওঅজ গডসেন্ট।

শামলাসহ মাথা নুইয়ে মনোহর বললো–না, না, সার। কেন, সার, কী ভাবে, সার? ঈশ্বরের ইচ্ছা হবে কেন মিউটনি?

ডানকান বললো–ডেখো, মানোয়ার তুমি সব জানে না, ডেখো। ক্রিমিয়ায় মার খাইয়ে ব্রিটিশ আর্মসের লজ্জা হইয়েছে। ভালো লজ্জা। মিউটিনিতে লজ্জা ধুইয়া গেলো। কেমন, কীবল?

ডানকান হাত ধোয়ার ভঙ্গি করলো। ক্লারাটের বোতল উপুড় করে গ্লাস ভরে নিলো।

একটু ভেবে, প্লেটটাকে বুড়ো আঙুল দিয়ে একটু ঠেলে দিয়ে কীবল বললো–তাহলেও আমি রিফর্ম সম্বন্ধে কিন্তু এখনো কেউ ভাবছে না, হোয়াইট। এটা দরকার, যদিও মিস্ নাইটিঙ্গেলই সেদিকে হয়তো একদিন দৃষ্টি দেবে। আর তাহলে তা হবে, অন্ড বাই ডাব কুইক মার্চেস। বিস্মিত কেট বললো–ক্রিমিয়ায় কি এর মধ্যে যুদ্ধ হয়ে গেলো নাকি? সংবাদটা যে তার কাছে নতুন সে বিষয়ে সন্দেহ রইলো না।

বিস্ময়টা বাগচীরও। তার ভ্রূ উঠলো। ক্রিমিয়া সম্বন্ধে ভাসা ভাসা কিছু সে শুনেছে, কিন্তু সেখানে কি বড়ো যুদ্ধ হয়েছে! কী হয়েছে সে যুদ্ধে? একবার কীবল আর একবার ডানকানের মুখের দিকে চাইলো সে। পরে হেসে বললো–দেখো, ডার্লিং, কেমন আছি আমরা। যুদ্ধের এসব খবর ও আমাদের কানে পৌঁছায় না। আমরা ঘড়ির বিপরীত গতিতে চলছি না তো?

ডানকান বললো–এইটা কি সত্য অজানিত ছিলো? স্ট্রেঞ্জ! ভালো আমার ধারণা ফরাসীরা জানিত। যেমন সেই ওয়ালি ফক্স পিয়েত্রো ফর উয়ান। এবং তাহাদের কাছে। মারাঠীরা এবং দিল্লীর সেই বুড়া শয়তান। নিশ্চয়ই তাহারা সেকালে জানে আমরা ক্রিমিয়ার বেকায়দা পড়ি, ভালো বেকায়দা। আর তখন তাহারা মিউটিনি করে।

কীবল হেসে বললো–এখন আর বেকায়দা নেই হোয়াইট। আর তোমার পেগান গডেস পূজার কথাও অনেক লোক জানে না। কিন্তু তুমি যে বলছিলে এখানে কি সত্যি স্কুল আছে। অর্থাৎ যাকে ইংরেজিতে স্কুল বলে?

ডানকান বললো–আ, সার উইলিয়াম, নিশ্চয়। এখানে এই হৃদলালের স্কুল। আমি তাকে সাহায্য করিব তুমি ডেখো। এটা হৃদলালেরই থিয়োরি যে এইসব স্কুল আমাদের বিপদে আমাদের পাশে দাঁড়াবে। এই থিয়োরিতে কিছু আছে। হুঁ হুঁ। দি জেন্টস ইন ক্যালকাটা গেভ আস মর‍্যাল সাপোর্ট।

কীবল বললো–দেয়ার্স নাথিং রং উইথ স্যার উইলিয়াম জোনস। ইজ দেয়ার? আমি বাস্তবিক স্কুলের ব্যাপারে ইনট্রেস্টেড। এবং সাংস্ক্রিট পড়িতে চাই।

হরদয়াল প্লেটের উপরে কাটা-চামচ শুইয়ে রেখেছিলো। এবার প্লেটটাকে মৃদুভাবে ঠেলেও দিলো। তার মুখ যেন বিরস, কিন্তু হেসে বললো– সে-আসুন একদিন স্কুলে। জাস্ট এ বিগিনিং দো।

বাবুর্চিরা সম্ভবত হরদয়ালের ভঙ্গির উপরেই চোখ রাখছিলো, তারা প্লেট বদলাতে শুরু করলো।

নতুন কোর্সের সঙ্গে আলাপটা ঝুঁকলো আজকের উৎসব শিবলিঙ্গ স্থাপনের কথায়। ততক্ষণে প্রত্যেকের প্লেটের সামনে একাধিক পানীয়ের গ্লাস জমেছে। কারো বেশি, কারো কম। বোঝা যাচ্ছে তারা প্রায় প্রত্যেকেই নানারকমের পানীয়ের স্বাদ নিয়েছে; কেউ হয়তো একই পানীয় গ্লাস বদলে একাধিকবার, অন্য কেউ বা একই গ্লাসে একাধিক পানীয় মিশিয়ে।

কীবল বললো–মিস্টার হৃদলাল, ধর্ম নিয়ে কথা বললে আশা করছি এ টেবলে কেউ দুঃখ পায় না। আজ যা দেখিলাম তা হয় অর্থোডক্স পেগানিজম, পাথরপূজা, না? আর। আমাদের হোয়াইট হয়তো রিফর্মড পেগানিজমের উপাসক হয়।

ডানকান পোর্ট ঢেলে নিয়েছে এক গ্লাসে, অন্যটিতে শ্যাম্পেন। যেন তা মাপ করে মিশালে নতুন কিছু হয়। সে হোয়া হোয়া করে হাসলো। বললো–সইত্য। এ, মানোয়ার, তোমার আইডল ছিলো। দ্যাট ব্ল্যাক নেকেড গ্যাল, ওয়েলফমড় দো। শি ওঅজ অ্যান আইফুল, আই বেট। মনোহর তাদেরই একজন যারা নিজের জ্ঞান সম্বন্ধে সচেতন। সে বললো–এটাও একরকমের আইডল, সার, তবে একে বরং ফ্যালাস অর্শিপ বলতে হবে।

কীবল যেন শিউরে উঠলো। বললো–আক্‌ গশ।

বাগচীর মুখে কী একটা হাড়ের কুচি পড়েছিলো? কিছু সময় যেন সেজন্যই বিব্রত রইলো। কিন্তু হঠাৎ সে বললো–বাট মাচ অব ইট ইজ সিম্বলিজম। অ্যান্ড ইন এভরি। রিলিজিআন দেয়ার আর সিম্বলস দ্যাট ক্যান বি মিসইন্টারপ্রিটেড। (ইহার অনেকাংশই প্রতীক ব্যবহার। সব ধর্মেই প্রতীক ব্যবহার হয় যার কদর্য ব্যাখ্যা করা সম্ভব)।

কীবল বললো–ইন পেগানিজম ডু ইউ সে।

বাগচী হাসতে হাসতেই বললো–হোয়াই, মাচ অব আওয়ার স্যাক্ৰামেন্ট ইজ সিম্বলিক। হাউ ডু ইউ ইন্টারপ্রেট ইউক্যারিস্ট ওয়েফার? (কেন, স্যাক্রামেন্টের অনেকটা সিম্বলিক। ইউক্যারিস্টের রুটির কী ব্যাখ্যা হবে)?

কীবলের মুখ লাল হয়ে উঠলো। স্যাক্রামেন্ট-ইউক্যারিস্টকে লিঙ্গোপাসনার মতো অপবিত্র বিষয়ের সঙ্গে তুলনা? সে বেশ শক্ত গলায় জিজ্ঞাসা করলো, মিস্টার বাগচী তালে ক্রিশ্চিয়ান নয়?

বাগচী কাঁটা-চামচ রাখলো।

ডানকান চোখ দিয়ে ইশারা করলো কীবলকে। এমনকী স্পষ্ট করেই বললো–নাও মিট হিম। অবশ্যই ইতিপূর্বে কীবলকে বাগচী সম্বন্ধে কিছু বলছে সে, আর এখন তা মিলেও যাচ্ছে যেন।

হেসে হরদয়াল বললো–বাগচী বলে থাকেন এখনো ক্রিশ্চিয়ান হতে পারলাম না।

বাগচী হাসলো। বললো–দেওয়ানজি,কথাটা মিথ্যাও নয়। লাখনাউ কিংবা দিল্লী কিলিং কোনটাকেই অন্তর থেকে ক্ষমা করতে পারিনি। এ রকম আর আছে?

ডানকান যেন চেয়ার ঘুরিয়ে বসলো। ঝাঁজের সঙ্গে বললো–হোয়াট ডু ইউ মিন–দিল্লী কিলিং!

বাগচী বললো–লাখনাউতে যদি নরহত্যা হয়ে থাকে দিল্লীতেও হয়েছে। লেটস্ ড্রপ ইট।

অস্তস্তি বোধ করে গলা সাফ করলো হরদয়াল। অনেকসময়ে সুযোগ পাওয়ামাত্র তা ধরতে হয়। এই সময়ে বাবুর্চিরা ঢুকলো। ট্রের দিকে চেয়েই হরদয়াল উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো–চিকেন প্যাটিস আর দে? ওয়েল, মিস্টার হোয়াইট, আই স্পেশ্যালি ইনভাইট ইউ টু দেম। দে আর সামহোয়াট অভ এ স্পেশ্যালিটি অব মাই সোলটান আহমেদ।

হঠাৎ কী হয়ে গেলো। এই সাজানো গোছানো ঝকঝকে টেবলের পাশের মানুষগুলোকে আর যেন উৎসবের অঙ্গ বলে মনে হবে না। তাদের কথাগুলো তাদের চিন্তা যেন চীনামাটির ও কাঁচের পাত্রগুলোতে পুরনো ফাটল সৃষ্টি করছে। কেট অদ্ভুত সাহসে হোস্টেসের কাজ করলো। মধুর হেসে বললো–মিস্টারকীবল, ক্রিমিয়ায় প্রভিশন কেমন ছিলো? আপনাদের নিশ্চয়ই কষ্ট হয়েছে?

কীবলও বোধ হয় সেই মুহূর্তেই সম্বিৎ পেয়েছে। সে একটু জোর দিয়ে বললো–রাম ফর ব্রেকফাস্ট, রাম ফর ডিনার, রাম ফর ব্রোকেন লিম্বস। মিস নাইটিঙ্গেল ইজ থিংকিং অ্যাবাউট লাইস অ্যান্ড ভার্মিন অন দা সোলজার্স, ওয়েল সামাদার লেডি উইল্যাব টু থিংক আউট হোয়াট গোস অনসাইড দেম। (প্রাতরাশেরাম, ডিনারে রাম, হাত-পা গুঁড়োলে রাম। মিস নাইটিঙ্গেল সৈনিকদের গায়ের উকুন আর পোকার কথা ভাবছে। আর কাউকে ভাবতে হবে তাদের ভিতরে কী যায়)। সে হাসলো।

ডানকান তার উত্তেজনার বিষয়টা থেকে সরতে পেরেছিলো, কিন্তু ভিতরে ছিলো বিরক্তি। সে বিরক্তমুখে বললো–শি উইল আনম্যান দি সোলজার্স, দ্যাটস হোয়াট শি ইজ আফটার। (সৈনিকদের সে স্ত্রীলোক না করে ছাড়বে না। সেটাই তার উদ্দেশ্য)।

কে? কীবল জিজ্ঞাসা করলো।

ইওর লেডি উইথ দা ল্যান্টার্ন।

কীবল হো হো করে হেসে উঠলো। গশ, হোয়াইট? মিস নাইটিঙ্গেলকে লেডি উইথ দা ল্যাম্পই তো বলছে। তুমি তার হাতে লণ্ঠন দিলে?

সুতরাং প্যাটিসে কাঁটা ছোঁয়ালো তারা।

প্যাটির পর ফল-ফল আর মিষ্টি। তখন একটা যোগাযোগ ঘটে গেলো হরদয়ালের বাবুর্চির অসাবধানতায়। যেহেতু সে দেওয়ানকুঠি থেকে আনা মদের বোতলগুলোকে ভোরের অন্ধকার থাকতেই পিয়েত্রোর প্রভিশনের আলমারিতে তুলেছিলো, এবং টেবল প্রায় মদশূন্য অবস্থায় দেখে মদের আর একটা বোতল আনতে গিয়ে তাড়াতাড়িতে খেয়াল করলো না যেটা সে নিয়ে যাচ্ছে তার গায়ে অনেক মাকড়সার জাল, যা থাকা উচিত নয়। এবং বোতলটাও কালচে কাঁচের বেঁটে, মোটা এবং বেশ বড়ো। পিয়েত্রোর বাবুর্চির বান্দা লক্ষ্য করেছিলো, কিন্তু তার হাতের ইশারা হরদয়ালের বাবুর্চি সোলটান বুঝতে পারলো না।

বোতলটাকে কোমরের ঝাড়নে মুছে টেবলে রাখতে যে প্রথম অবাক হলো সে হরদয়াল। সে হাতে নিয়ে দেখলো ভিনটেজের তারিখটা ১৮৩৫। শব্দগুলো অপরিচিত।

ডানকান অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলোকী এটা? হাতে নিয়ে পড়লো, উচ্চারণ করলো চ্যাম্বার্টিন। প্রকৃত ইংরেজ কখনো ফরাসী পড়ার সুযোগ ছাড়ে না।

মদটা লাল রঙের। ইঙ্গিতে বাবুর্চি খুলে দিলো। নতুন গ্লাস দিলো সকলের সামনে।

ডানকান হয়তো আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলো যে এই আসরে অন্তত একবার তা করতেই হবে কেননা সে ইংরেজ। গ্লাস হাতে নিয়ে সে বললো, আসুন আমরা স্বাস্থ্য পান করি।

সে গ্লাস হাতে উঠে দাঁড়ালো। দেখে কীবল এবং হরদয়ালও দাঁড়ালো। গ্লাসগুলো মৃদু ঝনৎকার তুলে টেবিলের উপরে শূন্যে একত্র হলো।

অট্টহাস্য করে ডানকান বললো–হিয়ার্স টু হার ম্যাজেস্টি কুইন বিক্টোরিয়া। কীবল ও হরদয়াল যুগপৎ বললো–টু হার ম্যাজিস্টি। বাগচী, কেট ও মনোহরকেও উঠতে হলো।

ফরাসী মদটা গলায় ঢেলে বসতে বসতে সশব্দে গ্লাসটা বসালো টেবলে ডানকান। সেটা তার হাতের নিচে ফাটলো কি?

সে কি ফরাসী নাম থেকে মদটা পিয়েত্রোর ভাঁড়ারের এমন আন্দাজ করেছিলো? অথবা ফরাসী শব্দগুলোই একজন পরিচিত ফরাসীর কথা মনে আনতে পারে?

হরদয়াল তার গ্লাসে আবার একটু মদ নিলো। একাই উঠে দাঁড়ালো। শূন্যে হাত তুলে বললো–দিস্ টু রানীমাতা। মে গড ব্লেস হার। পান শেষে গ্লাসটাকে সে কাঁধের উপর দিয়ে পিছনে ছুঁড়ে দিলো। দেয়ালে লেগে সেটা ঝনঝন করে ভেঙে পড়লো।

ফলে হাত দিলো সবাই। সেগুলি অবশ্যই দুষ্প্রাপ্য এ অঞ্চলে এবং ইউরোপেও। হরদয়ালের ইঙ্গিতে বাবুর্চি তার চুরুটের বাক্স বার করলোকীবলের দিকে তা এগিয়ে ধরলো হরদয়াল।

কীবল এক্সকিউজ মি বলে প্রত্যাখ্যান করলো।

মনোহরই আবার সকলের চাইতে বেশি বিস্মিত হলো–সে কী, সার, সোলজার হয়েও খান না! ভালো জিনিস কিন্তু। আমাদের দেওয়ানসাহেব বিশেষ সৌখীন জানবেন।

কীবল হাসিমুখে বললো–ক্রিমিয়া-ফেরত সোলজাররা দাড়ি এবং তামাক ইংল্যান্ডে আবার ফিরিয়ে আনছে বটে। আমি কিন্তু পাইওনিয়ার্সদের একজন নই।

স্বচ্ছ কৌতুকের আশ্বাসে বাগচী বললো, ফিরিয়ে আনছে কী রকম?

মৃদু হেসে কীবল বললো–এইভাবে ফ্যাশান যাওয়া আসা করে। ইংল্যান্ডে তামাক ও দাড়ির আদল সত্তর আশি বছর ছিলো না। আবার প্রাদুর্ভাব হয়েছে। নস্য নয়, ধোঁয়া। এবং তা ক্রিমিয়ার পর।

ডানকান বললো–ইহার জন্যও কি তোমার উওম্যান উইথ ল্যাম্পকে ধন্যবাদি?

কীবল হো হো করে হেসে উঠলো। –হোয়াইট, তুমি লেডি উইথ দা ল্যাম্পকে নিয়ে মহা ফ্যাসাদে পড়েছে। কিন্তু অসুস্থ আহত ক্রিমিয়ার সেই সৈন্যদলের শয্যার পাশে তাকে কিন্তু অ্যাঞ্জেল বলেই মনে হতো। আর আমাদের মতো ভুক্তভোগী কে?

হরদয়াল বললো–গত সপ্তাহে টাইমসে একটি সংবাদ পড়ছিলাম। লন্ডনে সেন্ট টমাসের হসপিটালে নার্স ট্রেনিং স্কুল খোলা হয়েছে। এবং আশা করা হচ্ছে তা গোটা পাশ্চাত্য জগতে নার্সিং-এর ব্যাপারে আমূল পরিবর্তন আনবে। স্যার সিডনি হার্বাটের সহানুভূতি আকৃষ্ট হয়েছে। এসবের মূলেও মে-ফেয়ারের এক মিস নাইটিঙ্গেল।

কীবল বিশেষ বিস্মিত হলো। সে বললো–বটে? স্যার সিডনি যখন, তখন সংবাদের এই মহিলাই মিস নাইটিঙ্গেল। কিন্তু এটা বিশেষ আশ্চর্যের ব্যাপার যে এই গ্রামে এক ব্যক্তি টাইমস কাগজ পড়ে। এবং সেন্ট টমাস হাসপাতালে নার্সিং স্কুলের খবর একেবারেই নতুন তার নিজের কাছে।

সে বললো–আশ্চর্য! এখানে টাইমস আসে? সেন্ট টমাসে নার্সিং স্কুল হচ্ছে?

হরদয়াল লজ্জায় পড়লো। সে বললো–তাকে সাবসক্রাইবার হওয়া বলে না। আর কাগজগুলো আসতেও সময় নেয়। গত সপ্তাহে পড়েছি, কিন্তু সংবাদটা বেশ পুরনো।

কিন্তু, কীবল বললো–তাহলেও সংবাদটা এদিকে নতুন। আমি জানতাম না। ছমাস পিছিয়ে হলেও আধুনিক ইংল্যান্ডের খবর আপনি রাখছেন যা আমরাও অনেকে জানি না। না, ক্যালকাটাতেও অনেকেই নয়।

হরদয়াল মৃদু হেসে বললো– না জানলে মোকাবিলা হয় না।

লাঞ্চ কিংবা সে নামেরই অন্য কিছু হোক ঘণ্টাদুয়েক শেষ হয়েছে। দিনের আলো তখনো উজ্জ্বল। জানলা ও পর্দার ফাঁকে একটা আলোর ফলক এসে পড়লো টেবিলের কাঁচের উপর।

সিগার ধরালো হরদয়াল এবং ডানকান। বাগচী তার পাইপ।

ডানকান বললো–হৃদলাল, তোমাকে আবার পুনরায় ধন্যবাদি। হঁহঁ মরেলগঞ্জের পক্ষ হইয়া ধন্যবাদ। ফাইন কুকিং, ফাইন ওয়াইন।

ডানকানের ঘাড়টা কি একটু নড়লো কথা বলতে গিয়ে। সেই চ্যাম্বার্টিনের বোতলটার দুপাশে টেবিলের উপরে তার হাত দুটো ছড়ানো। মনে হলো আঙুলগুলো যেন টেবিলের উপরে ড্রাম বাজানোর চেষ্টায় আছে। তার মুখ তো বটেই চোখ দুটোও লাল। সে বোতলটাকে তুলে আলোয় ধরলোর তলায় কিছু মদ আছে তখনো।

হরদয়াল বললো–আর একটা আনিয়ে নেবো?

ডানকান বললো–ও নো। উই মাস্ট লিভ। আমাদের যাইতে হইবে। বৈকাল হয়।

কীবল রসিকতা করে জিজ্ঞাসা করলো–আর উই স্যুয়োর।

ডানকান বললো–যদি না স্কুলমাস্টারের বউ-এর প্রেমে পড়ে থাকো। ইজিন্ট শি বিউটিফুল? হো হো করে সে হাসলো।

সে উঠে দাঁড়ালো। এবং সেজন্যই তার হিক্কা উঠলো। মনোহরের পাশে গিয়ে তার বগলের তলে হাত দিয়ে ঠেলে তোলার চেষ্টা করলো। বললো–ওয়াল মাই ডার্লিং গার্ল।

হরদয়াল অল্প, বাগচী ঠোঁট টিপে, কেট হাত দিয়ে মুখ ঢেকে, কীবল প্রকাশে হো হো করে হেসে উঠলো। হরদয়াল ভাবলো, এই খুশীর ভাবটা কি লাঞ্চকে সার্থক করলো!

ডানকান হোয়াইটের রসিকতার কারণটা কী–তা কি নারীবর্জিত কুঠিতে দীর্ঘদিন থাকার ফল? অথবা ব্যার্গান্ডি যার ভিনটেজ ১৮৩৫? সে দস্তানা আর চাবুক সংগ্রহ করলো। একটু কি অসমান পড়লো তার পা? যখন এইসব বিষয়ে ভাবা যাবে এক অপ্রত্যাশিত পরিসমাপ্তির সূচনা করলো বাগচী।

ডানকান ও কীবলের ঘোড়া। রাজবাড়ির ভৃত্যরাই ঘোড়াদুটিকে এগিয়ে আনলো। তাদের পিছনে হরদয়ালের পালকি নিয়ে বেহারারা, শেষে মনোহর সিং-এর এক্কা নিয়ে তার সহিস এগোলো।

বাংলোর সিঁড়ি দিয়ে নামছে মনোহর আর ডানকান তখন। বাগচী বারান্দায় কীবলের পাশে। বাগচী বললো–মিস্টার কীবল, আপনি কি আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছেন? আমি এই পেগান রাইটের সঙ্গে স্যাক্ৰামেন্ট ইউক্যারিস্টের কথা বলে আপনার অনুভবকে আঘাত দিয়ে থাকবো। আমি দুঃখিত।

কীবল বাগচীর দিকে মুখ তুলো। কিন্তু কী বলা উচিত চট করে তা যেন খুঁজে পেলো না। এক্ষেত্রে এদেশে কিছু বলাই কি প্রথা?

শেষ সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে ডানকান পিছন ফিরলো।

সে বললো–গুডবাই হৃদলাল, গুডবাই বাগচী। আইস, কীবল। বাগচী, তোমার বোধ হয় অনুতাপে স্মরণ হয় (হিক্কা) অসাম্প্রদায়িক ক্রিশ্চিয়ানিটি আই মিন (হিক্কা) চার্চ ছাড়া যাহা তোমার তাহা মানুষকে সভ্য করে না। মানুষ হিদেনই রহে। টোমার মতো হইবে বাগডির ন্যায়।

হাসতে গেলে আবার হিক্কা উঠলো তার।

হয়তো, হয়তো–বাগচী বাও করলো। তার ঠোঁটের কোণে একটা হাসি স্পষ্ট হলো। কীবল ও কেটের মধ্যে নামতে নামতে সে বললো, ধর্মের সিম্বলগুলোর লৌকিক ব্যাখ্যা দেওয়াই বোকামি। ইউক্যারিস্টের ওয়েফার ছিঁড়ে মুখে দেওয়াকে নিশ্চয়ই কেউ নরমাংস ভক্ষণ মনে করে না, সত্যি তো সেটা ক্রাইস্টের মাংস নয়।

সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়েই ঘোড়ার লাগাম ধরলো ডানকান, ঘোড়ায় উঠতে যে জোরটা লাগে তা যেন তার মুখে প্রকাশ পেলো। হঠাৎ রেগে উঠে বললো–চও! ফের বলিলে হাড্ডি গুড়াগুড়া করিব।

কী যেন একটা ভেঙে পড়বে, যেন লাঞ্চটাই। বাগচীর মুখ এত কালো যেন তাকে চেনাই যাবে না। মনে হলো পাদরীদের পক্ষে তার কাঁধটা বিশেষ চওড়া দেখাচ্ছে। কিন্তু হো হো করে হেসে উঠলো বাগচী, বললো–লেট হিম স্লিপ ইট অফ, মিস্টার কীবল। (ঘুমিয়ে নেশাটা কাটাক)।

সিঁড়ির পাশে তখন কীবলের ঘোড়াটাও। সে কি কিছু বলবে? কিছু ভাবছে কি সে? ডানকানের ঘোড়াটা উল্টোপাল্টা নির্দেশের জন্য ল্যাজ দুলিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে একটা পাক খেয়ে সিঁড়ির দিকে ফিরে এলো। হরদয়াল হেসে বললো–গুডবাই মিস্টার হোয়াইট।

ডানকান বললো–আইম অ রাইট।

কিছুদুরে যখন কীবল ডানকানের কাছে পৌঁছেছে, মনে হলো ডানকান কিছু বললো, আর তা শুনে কীবল হাসলো। পরে ডানকানও হো হো করে মদো গলায় হাসলো। ঘোড়ার উপরে একবার সে শোয়ার চেষ্টা করলো যেন, পরে সেটাকে কাটিয়ে উঠলো। হাজার হলেও ইংরেজ তো।

.

০৭.

সস্ত্রীক বাগচী পিয়েত্রোর বাংলোর বারান্দায় গাড়ির জন্য অপেক্ষা করলো। গাড়ি অর্থাৎ গোরুর গাড়ি। জেনে রাখা ভালো, মরেলগঞ্জে দু-তিনখানা ঘোড়ায় টানা গাড়ি আছে। রাজার গ্রামে যানবাহন বলতে পাল্কি, ডুলি, গোরুর গাড়ি, হাতি, ঘোড়া বুঝিয়ে থাকে। মরেলগঞ্জের ওরা কুঠি তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর থেকে দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে পশ্চিম যোগচিহ্নের মতো দুটো সুরকির সড়ক তৈরি করেছে। সে জন্যই কি ঘোড়ার গাড়ি? যদিও বর্ষা ছাড়া অন্যসময়ে প্রচুর ধুলো উড়িয়ে মরেলগঞ্জের বাইরে এ গ্রামে ও গ্রামে মরেলগঞ্জের এক্কা ফিটনগুলি চলে। এটা এক আধুনিকতা যা রাজার গ্রামে এসেও আসছে না।

কথা বলছ না যে? –কেট বললো।

বলছি তো। আমি বেশ একটু অবাক বোধ করছি। বাগচী বললো–রেলগাড়ি হলে স্টিমার জাহাজও হতে পারে, কিন্তু কত তাড়াতাড়ি হলো তা দ্যাখো। কিছুদিন আগেই হয়েছে, আমরা খবর রাখিনি। কলকাতা থেকে দূরে।

কেট হঁ বলে নিজের চিন্তায় আবার ফিরলো। চিন্তার অনেক বিষয়ই থাকতে পারে। পিয়েত্রোর বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে যে অনুভূতি তার হচ্ছে তা নিয়ে কি আলাপ করা যায়? কখনো সেপিয়েত্রোকে দেখেনি। কিন্তু এটা পিয়েত্রোর বাংলো, যার মতো আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এদিকে কম দেখা যায়। সামনে পিয়েত্রোর হাওয়াঘর যেখানে মন্দিরটা উঠছে, আর, গুজব অনুসারে, যেখানে সিপাহীবিদ্রোহের আগুনের আভা দেখা দিয়েছিলো। বাগচী কিছু জানে। কিন্তু বাগচী বললো, আমরা ক্রিমিয়ার কথা কতটুকু জানতাম?

–আমরা ইংরেজি সংবাদপত্র পড়ি না।

হুঁ। কেন পড়ি না? ইংলিশম্যান পছন্দ হয় না? রোসোআজ থেকেই ব্যবস্থা হবে। দেওয়ানসাহেবের টাইমস আসে। চেয়ে আনলেই হলো।

-আচ্ছা, লন্ডনের মে-ফেয়ারের মহিলা হসপিটালে সোলজারদের নার্স করছে–এটা কি সমাজে আলোড়ন আনে না?

-আনে। বোধ হয় স্টিমারের চাইতে কম নয়। যদিও আমি জানি না স্যার সিডনি এখন ঠিক কোন পদে আছেন। মনে হয় এটা লন্ডনের একেবারে নতুন খবরের একটা। আর সেজন্যই কীবলের বিস্ময়।

বাগচীও যেন কিছু ভাবছে। তা কি লন্ডনে যে পরিবর্তন হচ্ছে তার কথা?

কিছুক্ষণ পরে কেট আবার বললো–আচ্ছা, মোকাবেলা কথাটার মানে কী?

–দেওয়ানজি যা বলেছিলেন, সামনা-সামনি হওয়া বলতে পারো। তবে তোমার আমার মুখোমুখি হওয়া নয়। সাধারণত একটা বিপদ বা আশঙ্কার আভাস পিছনে থাকা চাই।

অল্পসময়েই তাদের গাড়িটা এলো। গোরুগাড়িটা অসাধারণ কিছু নয়। কিন্তু তখনকার দিনে অর্থবান লোকেরা ব্যবহার করতো বলে পরিচ্ছন্ন এবং চোখের পক্ষে তৃপ্তিকর রাখার চেষ্টা ছিলো।

বাগচী হাসলো–কিন্তু, ডার্লিং, এটাও কি একরকমের টাইমলেসনেস নয়–ওই কাগজ পড়া?

কেট বারান্দা থেকে নেমে গাড়ির দিকে রওনা হলো, বললো–এসো, আমি কিন্তু এই সময়হীনের শকট থেকে হেঁটে যাওয়া পছন্দ করতাম।

কেটকে হাত ধরে গাড়িতে তুলতে গিয়ে বাগচী বললো–এর চাইতে ভালো হতো ঘোড়া। এরপরে এরকম কোথাও যেতে হলে দেওয়ানজিকে জোড়া ঘোড়ার কথা বলবো।

কেট বলেছিলো, সে তো পরে। আজ এ ব্যাপারটাকে সামলে নিই।

তার মুখ সত্যি কিছু বিবর্ণ।

এখন, গোরুর গাড়ির এই অভ্যাস যে তা আরোহীকে নানারকমে পরীক্ষা করে থাকে। এপাশ থেকে ওপাশে গাড়িয়ে, সাধারণভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে, উপর থেকে নিচে ছোটোখাটো আছাড় দিয়ে সে পরীক্ষা। তখন কোনো চিন্তা করা যায় না, করলেও চিন্তাই বরং ভেঙে টুকরো হয়ে যায়।

দুএকবার বাগচী হেসে উঠলো গাড়ির রসিকতায়, কেট অনেকবার কুটি করলো। একবার কেট মনে করলো রানীমার এই লাঞ্চ সম্বন্ধে আলোচনা করবে–এটা তার রাজনীতি হতে পারে যার স্বরূপ কিছু না বুঝে তাকে সার্থক করতে তারা আজ সহায়তা করেছে। যদিও তারা রাজকর্মচারী নয়। কেন আদৌ তাদের এ লাঞ্চে যোগ দিতে হলো। বাগচী বলেছিলো দেওয়ানজি বলেছেন। আর তোমাকেই হোস্টেসের দায়িত্ব নিতে হবে। দেওয়ানজি শুধু নিয়োগকর্তা নন। বলা যেতে পারে বন্ধু, পেট্রন। কিন্তু তাদের নিজেদের মনের মধ্যে কি দ্বিধা ছিলো না? কিন্তু ঠিক তখনই গাড়ির আচ্ছাদন, যাকে ছই বলে, কেটের মাথা তাতে ঠুকে গেলো। কেট মুখ লাল করে সামলালো কিন্তু চিন্তাটা ভেঙে গেলো।

গাড়িটা যখন রাজার গ্রামে ঢুকছে কেট তখন বললো–তুমি কি এর মধ্যে মরেলগঞ্জে যাচ্ছো নাকি?

-কেন? সেখানে কী?

–যদি ক্ষমা চাইতে ইচ্ছা হয়।

–এই দ্যাখো! কী অন্যায় করেছি কখন? তা মদ একটু বেশিই হয়েছে আজ। তার জন্য কার কাছে ক্ষমা চাইবো?

–আমার ধারণা ছিলো পাদরিরা সত্য বলে থাকে।

বাগচী হেসে উঠলো। –আ ডার্লিং, যদি সত্যি পাদরি হতাম।

অনেকসময়ে কিন্তু সাধারণ একটা দিনেও চিন্তা গুরুতর হয়ে যায়। বাগচীর মনে খানিকটা অনুপ দেখা দিলো। মদ খাওয়ার কথা মনে এলো তার। মদ স্পর্শ করবো না বলাটার মধ্যে একরকমের গোঁড়ামি দেখা দিচ্ছিলো বলে মদ একটু খেয়েছিলো সে। তখন সে ভেবেছিলো খাওয়া না খাওয়া কোনোটাকেই সে মূল্যবান করতে চায় না। কিন্তু তার ফলে কি খাওয়ার দিকে ঝোঁক আসছে? বিষণ্ণ লাগছে না? এই দ্যাখো, আমি ভাবতাম আমার চরিত্র ইতিমধ্যে কিছু স্থির হয়েছে।

কেট বললো–যা তার্কিক তুমি। তোমার মনে হতে পারে, ইউক্যারিস্ট নিয়ে কীবলের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

এঃ? বলে হাসলো বাগচী। কিন্তু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে সে ভাবলো, খ্রিশ্চিয়ান স্যাক্রামেন্টের আচরণ বিধিতে যে প্রতীকরূপে ইউক্যারিস্টের মদ আর রুটির কথা আছে তা তার কাছে কিছু স্থূল ব্যাপার মনে হয়। কিন্তু তাহলেও তার সঙ্গে শিবপূজার প্রতীকময়তার তুলনা দেওয়াটা ঠিক হয়নি। বিষণ্ণ হলো সে!

সে নিজে ইউক্যারিস্ট মানে না। এটা কি আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা যে সে, নিজের অজ্ঞাতেই প্রায়, স্যাক্রামেন্টের প্রতীককে আর এক স্কুল প্রতাঁকের সঙ্গে তুলনায় এনেছে? অর্থাৎ যেন এই কারণেই সে স্যাক্ৰামেন্ট থেকে দূরে থাকে?

তার বিষণ্ণ মন কিছুক্ষণের জন্য যেন চিন্তাশূন্য হলো। অন্য কথায় তার মন চোখের দেখা বিষয়গুলিকে অবলম্বন করলো। গাড়িটা চলছে। যেমন শব্দ করার ও ঝাঁকি দেবার তা হচ্ছে। রাস্তা দিক বদলাচ্ছে। পথের ধারে কোথাও ফাঁকা, কোথাও ছায়ার গাছ। ছই-এর ভিতরে সবসময়েই দুপুরের আলো। তাহলেও তা কিছুটা তীক্ষ্ণ, অথবা ম্যাটমেটে হচ্ছে থেকে থেকে। একবার একটা বড়ো গোছের আঁকুনি কেট ছই-এর বাতা ধরে সামলে নিলো।

বাগচী ভাবলো, রোসো, রোসো। কোথায় ঠিক মনে পড়ছে না, সে শুনেছে শালগ্রাম শিলাতেও শিবপূজা হয়ে থাকে। তাহলে? পূজার জন্য এই স্কুল প্রতীকটাই অনিবার্য না ও হতে পারে। শালগ্রামশিলা শোনা যায় অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক, আর বৃত্তের চাইতে, স্ফিয়ারের চাইতে পরিপূর্ণ কী আর কল্পনা করেছে মানুষ?

আসল কথা–আরো কিছু লেখাপড়া দরকার। বেশ কিছুদিন থেকে সে যা পড়ছে তা ধর্মগ্রন্থ নয়–চিকিৎসাশাস্ত্র। এটা ভালো নয়। বাগচী হেসে ফেলো আপন মনে। রোসো, আর একবার ক্যাম্পানেলা থেকে শুরু করতে হবে। গ্রীকরাও গোলককে পরিপূর্ণ মনে করতো।

কেট বললো–কথা বলছো না যে?

না, ডার্লিং, গুঁতো খাওয়া না খাওয়ার মধ্যে যখন কাগজের মতো পাতলা সতর্কতা, তখন অন্যমনস্ক হতে চাই না।

সে হেসে নিলো। ভাবলো : হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠার উৎসবে বিলেতি খানা নিষিদ্ধ খানাই বলতে পারো। তারা রাজী হলো কেন? দেওয়ানজি, যিনি বন্ধু ও পেট্রন, বলেছিলেন বলে? ডানকান তাকে বিদ্বেষ করে, বিদ্রূপ করে, কেটের নামে চূড়ান্ত কুৎসা রটায়। অথচ এখানে কেট আজ হোস্টেস! প্রমাণ করা হলো তার। ক্রিশ্চিয়ান?

সে অবাক হলো।

.

০৮.

শিব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে এয়োস্ত্রীরা এসেছিলো তাদের পুরোধা ছিলো নায়েবমশায়ের স্ত্রী। রানী যাকে বড়োবউ বলেন। রানী চলে গেলেও তার কিছু কাজ ছিলো। এয়োস্ত্রীদের সবাইকে পান, গন্ধতেলের মশলা, বাতাসা প্রভৃতি সুষ্ঠুভাবে বিতরণ করা সেই কাজের একটি। বিশেষ করে রাজবাড়ির ব্যাপারে এয়োদের সংখ্যার শেষ নেই। কিন্তু সে কাজও একসময়ে শেষ হলো।

ভিড় এখন কমে গিয়েছে, যে মেলা জমে উঠেছিলো তাও এখন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে, যদিও দু-চারজন করে লোক এখনো আসছে। সিঁড়ি বেয়ে সেকালের হাওয়াঘর একালের মন্দিরের চত্বরে ওঠাও কম কৌতুক নয়। মিস্ত্রিরা কাজ করছে, নিচে কুমোর ছবি-টালি বানাচ্ছে–এসবই কৌতূহলের ব্যাপার। এমন সময়ে নায়েবমশায় এলেন গিন্নিকে বাড়ি নিয়ে যেতে। অনেক বেলা হয়েছে, নাহার হয়নি।

নায়েবমশায় দেখলেন, ভিড়ের থেকে কিছু দূরে, চত্বরের উপরে, নদীর দিকে এগিয়ে, রোদ মাথায় একা দাঁড়িয়ে আছে তার স্ত্রী। যেন নদীর দিকে কিছু দেখছে। কিন্তু এখন সেখানে কীই বা দেখা যাবে! রোদে জল ঝলমল করছে। আসলে তো বালু। চোখে ধাঁধা লাগবে। শেষ হেমন্তের দুপুর শেষ হচ্ছে।

নায়েবমশায়ের মনে হলো সেই কবে এসেছিলো তার সংসারে আট বছরের খুকিটি; তারপর এই চল্লিশ বছর গেলো চার দেয়ালের মধ্যে; এতটা উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে এতখানি নদীই বা কবে দেখেছে! অথচ–না, ভঙ্গিটা ভালো লাগলো না যেন।

কিন্তু সেও তো নায়েব। কথায় বলে পরগনাগুলো তার হাতের তেলো। সে তাড়াতাড়ি বললো–গাড়ি এসেছে, এসো।

মনে মনে বললো–হ্মুঃ।

হাওয়াঘরের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে বললো– আবার–তাছাড়া দ্যাখো, তোমাকে তোতা বলেছি তাঁতাঁকে বলে দিও। ধুতির ঝুল সে ক্রমেই বাড়াচ্ছে। কোচার নিচেয় দ্যাখো কাদা মাটিতে একসা। নয় মিলের খাটো ধুতিই দেখো। তাই তো পরে সকলে আজকাল।

নায়েবগিন্নি চোখ নামিয়ে আনলো। চত্বরের নিচে কিছুদুরে নায়েবমশায়ের সাদা ক্যানভাসের ছইসমেত গোরুগাড়িটা চোখে পড়লো। বললো–অনেক বেলা হলো। চলো, তোমার স্নান খাওয়া হয়নি।

সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাড়ির কাছাকাছি এসে মৃদু হেসে,নায়েবগিন্নি বললো, একটু বোসো, পুরুতঠাকুরের সঙ্গে একটা কথাকয়ে আসি। নায়েবগিন্নি পূজারীদের জন্য তৈরি ঘরগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করলো। পাশে নায়েবমশায়।

নায়েবগিন্নি হাসতে হাসতে বললো–লাঞ্চো করলেও পারতে। না খেয়ে কষ্ট হতো না। কিন্তু ভাগ্যে তুমি লাঞ্চো করতে যাওনি, একা একা ফাঁপরে পড়তেম।

নায়েব বললো–হ্মুঃ!

পুরুতঠাকুরের ঘরে কাছে এসে নায়েবগিন্নি বললো–শিবপূজায় রক্তচন্দন কেন লাগে তা একটু জিজ্ঞাসা করবো। আমরাও তো গ্রামে একটা পিতিষ্ঠে করেছি, আর সার্বভৌম ঠাকুরই তখন বিধান দিয়েছিলেন। রক্তচন্দনের বাটির উপরে অষ্টধাতুর শতদোল রাখার বিধান দেননি কিন্তু।

নায়েব বললো–প্রথা, তায় আবার কথা।

পুরুতঠাকুরের দরজায় এসে নায়েবগিন্নি বললো–তুমি কিন্তু, বাপু বাইরে থাকে। স্নান করোনি, পায়ে জুতো।

দরজার বাইরে নায়েব। তা দাঁড়ানোই বা কেন? তারই বা কাজের অভাব কী? এখানেও তো রাজবাড়ির টাকাতেই কাজ হচ্ছে, আর এসবের হিসাবও যাবে যথাকালে তার সেরেস্তাতেই। যদিও তার হিসেবী মনে গোড়া থেকেই এটা অপচয়। কার বাড়ি, কে করে মেরামত! এই বাংলোরই ওদিকে হচ্ছে লাঞ্চ। সবই তো সেই বেওয়ারিশ ফৌৎ ফিরিঙ্গি পিয়েত্রোর। ঘরগুলোর দেয়াল পাকা, ছাদ খড়ের। তিনপো হাত পুরু খড়ের ছাদ। নতুন খড়ে ছাওয়া চলছে। চৌচালার জোড়গুলি বাঁশের জাফরি করে চেপে বসানো চলছে। দেয়ালে রং পড়বে, ভাঙা শার্সিগুলোকে পাল্টানো হচ্ছে। কিন্তু মিস্ত্রি কারিগরদের এখন কেউ নেই। ছাদে দুচারজন আছে, হাতের কাজ শেষ না করে গেলে যাদের অসুবিধা। তা বেলা হয়েছে বৈকি। রোদটা আর মিষ্টি নয়। লাঞ্চের জন্যই মেরামত, সে তো কাবার, কিন্তু মেরামত আরো দুচার দিন চলবে। তো, রানীর হুকমৎ।

মিনিটদশেক পরে নায়েবগিন্নি ফিরলো। দুপুর রোদের ঘাসে ঢাকা মাঠ পার হয়ে নায়েব তার পিছনে গোরুর গাড়িতে গিয়ে বসলো।

গাড়ির বাইরেটা যেমন সুদৃশ্য, ভেতরটা তেমনি সযত্নে গোছানো। পুরু করে খড় বিছানো, খড়ের চাটাই, তার উপরে সতরঞ্চ তোশক, তার উপরে সাদা জাজিমের ধবধবে ফরাস। দু-তিনটে তাকিয়া গির্দা। দুজন তোবসে-শুয়ে সুখে যেতে পারবে। ধাক্কাধাক্কি, ঝাঁকি ঝাপ্টা নিশ্চয়ই কম।

প্রথমে গিন্নি পরে নায়েব গাড়িতে উঠলে গাড়োয়ান বলদ এনে জুতলো। দুই-ই সাদা, দুটোই বেশ বড়ো।

নায়েবগিন্নি বললো–আরাম করে বসোনা হয় এই তাকিয়া নিয়ে শোও। গাড়ির পাশেই নগদী। নায়েবগিন্নি মুখ বাড়িয়ে বললো–বাবুমশায়কে তামুক দিও।

নগদী প্রস্তুতই ছিলো। গাড়ি ছাড়বার আগে নায়েবমশাই-এর রুপোর ডাবায় তামার ঢাকনদার ছিলিম পরিয়ে হাতে ধরিয়ে দিলো। নায়েব জোড়াসনে বসে ডাবায় মুখ দিলো।

গাড়ি ছাড়লে নায়েবগিন্নি হাসলো, বললো–—রক্তচন্দন না ছাই!রাজবাড়ির শিবপূজাতেও শ্বেতচন্দনই লাগে যেমন আমরা দিই। লাল রঙের জন্য একছিটে লালই লাগে। কিন্তু তাই বা কেন বলো?

কী?

–সে নাকি? বলবো কথাটা? তোমাকে বলতে আর কী? আর পুরুত যেমন মুখপাতলা দেখলাম সবাই জানবে ক্রেমে।

কী? বললো– নায়েব।

সে ভাবলো : এই চিরদিনের স্বভাব, আধখানা করে কথা বলে আস্ত মানুষকে পাগল করে। তা ভালো বাপু, দুপুরে অমন করে একদৃষ্টে নদী দেখার চাইতে এও ভালো।

বললো– নায়েব আবার বলল শুনছি।

–সে নাকি, নায়েবগিন্নি বললো, গাড়োয়ান না শোনে এমন করে গলা নামিয়ে রানীর নিজের বুকের রক্ত!

নায়েবগিন্নি কতদূর অবাক হয়েছে তা বোঝানোর জন্য গালে হাত রেখে মুখটাকেও চট করে ঘোরালো একদিকে। বুকের রক্ত? রানীমার? পিয়েত্রোর হাওয়াঘরে বসানো শিবলিঙ্গের গোড়ায়!

নায়েবগিন্নি বললো––শুনছো?

নায়েব ভাবলো, কী যেন সে ভাবছিলো, তাই তো, কেমন হলো না! এরকম সময়ে। সে সাধারণত যা বলে তাই সে বললো, তা হবে।

গাড়ি চলছে; এখনো এক-দেড় ঘণ্টার পথ। নায়েবগিন্নি বাইরের দিকে চাইলো। বলদ দুটো দেখার মতোই। একটু ভালো করে দেখলে কিন্তু বোঝা যায়, দুটোই সমান সাদা নয়। একটার ঝুঁটির কাছে পিঠে বেশ খানিকটা কালচে দাগ আছে। ওদিকে দুটোর শিঙেই এক বকমের পিতলের তাগা পরানো। গলাতে ঘণ্টা বাজছে টিং-টিং করে।

চোখ সরিয়ে আনলো নায়েবগিন্নি। নগদীকে ডাবা ফিরিয়ে দিয়ে নায়েব তখন থেকেই তাকিয়ায় মাথা রেখে চিত হয়ে শুয়েছে। ঘুম নয়। অনুমান হয়, ছই-এর ভিতর দিকের বাঁশ ও বেতের কাজ একদৃষ্টিতে দেখছে। তা দেখার মতোই, বাঁশের বাতা দিয়ে যেন বালুচরীর নকসা তুলেছে।

নায়েবগিন্নি শায়িত নায়েব-ই-রিয়াসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। পদের সঙ্গে এখন পোশাকে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যেমন হাতের হীরার আংটি, হাতির দাঁতের ছড়ি, গরদের পিরহান। এসবে রানীমা খুশি হয়েছেন। নায়েবগিন্নিকে প্রকাশ্যে সুগৃহিণী বলেছেন। কিন্তু ধুতি? দ্যাখো ব্যাপারটা। চওড়া কালোপাড় ধুতিটার পাড় বরাবর সত্যি খানিকটা ধুলো কাদায় ময়লা। চিরদিনই তো এরকম ধুতিই পরেন। তাহলে কি চালটা বদলেছে? আগের তুলনায় অতটাই ঝুঁকে পড়েই হাঁটেন নাকি?

নায়েবগিন্নির চোখ দুটি পিটপিট করলো। মণির চারিদিকে সাদা জায়গাটা ব্যথা করে উঠলো। গোপনে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরলো সে। ঠোঁট চেপে ধরা যায় দাঁত দিয়ে, কিন্তু মণির চারিদিকে সাদা জায়গাগুলোতে যখন জল আসছে মনে হয়, বুকের মধ্যে অনেক জলের ঢেউয়ে গলা বন্ধ হয়ে আসে, তখন চোখের কোণ প্রায়ই শুকনো থাকে না। বুকের ওঠাপড়াও গোপন রাখা যায় কি? তখন আবার বুজরুক, পিয়েত্রো, গোবর্ধনদের সেই ব্যাপারটা মনে ফিরে এলো নায়েব এখন ঝুঁকে পড়ে হাঁটেন তা ভাবতে গিয়েই যেন! যেন সে ব্যাপারটাই দশাসই মানুষটাকে নুইয়ে দিয়েছে।

নায়েব নিশ্চিতই ছই-এর বাঁশের সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখছিলো, কিন্তু সে তোনায়েবও বটে। সে কি নায়েবগিন্নির বুকের ওঠাপড়া দেখেনি? সে মুখ ঘুরিয়ে পাশ ফিরে শুলো।

নায়েবগিন্নি বললো–আর পুরুষের কী বুদ্ধি দেখো! ঘোড়া আর বন্দুক কেনার টাকা আমিই তো দিয়েছিলাম ছেলেকে। ভাবতাম, যে কালের যা। একদিন, দ্যাখো, খামে পুরে সেসব টাকা ফিরত পাঠালো পেত্রো। বলো, তখন কি আর গোপন রইলো? টাকা নেয়াটা ছিলো, তাহলে, আমার ছেলেকে পরখ করা।

নায়েব এদিকে ফিরলো। বললো– সে-ঝকমারি করেছে, এ কি নগদীর কাজ রে বাপু! গাড়িই থামাক, তামুক খাবো যে।

নগদী সঙ্গে সঙ্গে ছিলো। দৌড়ে এলো। গাড়োয়ানের কাছে জানলো তামাক চেয়েছেন। তামাক সেজে আনতে আর কতক্ষণ, নইলে কীসের নগদী। নায়েব উঠে বসে তামাকে মন দিলো। গাড়ি ছাড়লো। তেমন লোকের কাছে ডাবায় ভোমরার শব্দ ওঠে। তা উঠলে নায়েব বললো, ঠোঁট থেকে ডাবা সরিয়ে–গোপন আর কী, গ্রামের সবাই অল্পবিস্তর জানেও এখন।

ডাবাটা গাড়োয়ানের হাতে দিলো নায়েব, গাড়োয়ান গোরুর পিঠের উপর দিয়ে তা নগদীকে পৌঁছে দিলো। নায়েব যেন আবার গির্দায় কাত হবে। কিন্তু সে বসেই রইলো। বরং গির্দা টেনে নিলো। একটু বা চিন্তাকুল দেখালো তাকে।

হঠাৎ সে বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো, দ্যাখো, গিন্নি, সেই আট বছরের এয়েছিলে। শাড়ি নিয়ে বলতে পরিয়ে দাও। তারপর চল্লিশ বছর কাটলো সুখেদুখে। এখন তো আর ছোট্টটি নও, কেমন কিনা? নির্যাস কথা বলি শোনো। নদীর কাছে এলে কারো মাছের কথা মনে হয়, কেউ ভাবে তপ্পন করি। যাদৃশী ভাবনা যস্য। কিন্তু ভাবনা তো আগেই ছিলো,নদী দেখেই না মনে আসে? তা তোমার তো এখানে এসে মনে পড়ছে গোবরার কথা সব নতুন করে। কারণ তুমি আর আমি এই প্রথম এলেম সেখানে, যেখানে গোবরা সেপাই-টেরনিং নিতো। আরে, বাবা, আমার কাছে গোপন! এখন সুড়সুড় করে সবই বেরিয়ে আসছে। বুজরুক ছিলো গোঁয়ার। তা সাহস ছিলো বৈকি। রাবণরাজার কি সাহস ছিলো না? আসল মন্ত্রের নারদমুনি কিন্তু বুড়ো পিয়েত্রো। আর এসবই তোমার মনে হয়েছে। কিন্তু ভস্মীভূতস্য পুনরাগমনংকৃতঃ। ফেরেনা। ফিরলে এই তিন বছরে? আর, দ্যাখো, শোকও ভোলার কথা। নিজের ছেলের শোক ভোলে না? এ তো পরের ছেলে, ভাগনা। তুমি তাকে মানুষ করেছিলে বলেই কি বেশিদিন শোক করবে? আঁ? আমার মতো শক্ত হতে পারো না? আর তাছাড়া গ্রামের সব লোক জানে সে তো রাজদ্রোহ। নায়েব থামলো। বক্তৃতা সামলাতেই যেন বুক ওঠানামা করছে তার। নায়েবগিন্নি বলদ দুটোর মাথার উপর দিয়ে তাকালো পথের দিকে। চওড়া কিন্তু মাটির পথ। এখানে ওখানে বাতাস লেগে ধুলো উড়ছে। নায়েব বুকের তলায় গির্দা টেনে নিলো। নায়েবগিন্নি ভাবলো ব্যাপারটা নায়েব ঠিকই ধরেছে। খুব সহজ করেই তো বলা যায়। তাদের ভাগনা গোবর্ধন বুজরুকের সঙ্গে সিপাহীদের যুদ্ধে গিয়েছিলো, আর ফিরবে না। আর আজ সে কথা আবার মনে হয়েছে নতুন করে পেত্রোর হাওয়াঘরে। কিন্তু শক্ত হওয়া? তোমার মতো দশাসই পুরুষটা যে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে হাঁটছো সে কীসের বোঝার চাপে? সে আঙুলের ডগায় চোখ মুছলো।

কাঁচা পথ। পথের ধারে কোথাও আকন্দর ঝোপ, একটা-দুটো বাবলা গাছ, কোথাও বা প্রকাণ্ড সেগুনা সংখ্যায় বটগুলোই কম, কিন্তু তার তলায় পালকি নামায়, গোরুগাড়ি থামিয়ে বলদকেও জিরিয়ে নেওয়া হয়।

পথটা ফরাসডাঙা থেকে মরেলগঞ্জের ধার ঘেঁষে রাজার গ্রামের দিকে গিয়েছে। চওড়া যার ফলে রাষ্ট্রবাদ দিয়ে চলা যায়। ঝাঁকুনি কম। সেজন্যই এ পথে আসা। নায়েবগিন্নি দেখতে পেলো, গাড়ির রাস্তার উপরে ডানদিক থেকে একটা ছোটোপথ এসে মিশেছে। পথটা কি অপেক্ষাকৃত নতুন? কারণ সেটার এক জায়গায় যেন মাটিকাটার কাজ হচ্ছে এখনো, হয়তো পথটাকে আরো উঁচু আরো চওড়া করার চেষ্টা। গাড়িটা আর একটু এগোলে আর একটু ঝুঁকে দেখলো নায়েবগিন্নি। যেখানে মাটি কাটা হচ্ছে সেটা ধানের খেত। আধপাকা ধান আছে। তার এত কাছে মাটি পড়ছে যে মনে হবে পাকা ধানও চাপা দেবে মাটি। কৌতুকের ব্যাপার তো! আরো ভিতর দিকে, যেখানে মাটি পড়ছে তারও ওদিকে রাস্তাটাকে সুরকির মনে হয়। বেশ লাল, চারিদিকের সবুজ কালচে-মেটের মধ্যে বেশ রঙিন। ভাবলো সে : তুষের আগুনের কাছে দু মিনিট হাত রেখেছো, সেই ছাইচাপার কী তেজ? আর তার এক হাঁড়ি যদি বুকের মধ্যে জ্বলে? বলার উপায় নেই, কাদার উপায় নেই। আমার তবু তো পোষ্য আর এই পুরুষটার তো রক্তের সম্বন্ধ, ভাগনা। সে তাড়াতাড়ি ভাবলো, না, এ নয়, অন্য কথা ভালো। লুকিয়ে চোখ মোছা তার অভ্যাসেই আছে। কর্তার গায়ে আঙুল দিয়ে সে বললো–ওটা কোন পাকা সড়ক গো, সদরের বুঝি? দ্যাখো, দ্যাখো।

নায়েব না দেখেই বললো–সদর? সদর কোথায় এখানে? সে তো আগে যাকে বৈরামপুর দিয়ারা বলতো কায়েতবাড়ি ছআনীদের সেখানে। সদর ছিলো বটে এটাই, তা সে কি আজকের কথা? তখন খাঁয়েরাই ছিলো নায়েব-নাজিম। আর গড়ের জঙ্গলে ছিলো তাদের কিল্লা।

-তা বলছি না। এ পথে কি সদরে যাওয়া যায়? লাল সুরকির।

সব পথই সদরে যায়। নরেশ ওভারসিয়ারের কাজ হবে, রাজবাড়ির হাত থেকে শুরু দ্যাখো কী?

নায়েবগিন্নি হেসে ধাক্কা দিলোনায়েবের গায়ে। স্বপ্ন দেখছো নাকি, স্বপ্নেকথা কইছো? দ্যাখো না, ওই যে পথটা। এখানে রাজবাড়ি কোথায়?

তাকিয়া থেকে মাথা তুলতে হলো নায়েবের এবার। -ওটা, তা ওটা তো সকালেই দেখেছো। মরেলগঞ্জের সাহেবরা করছে। আবার তাকিয়ার মাথা রাখলো নায়েব। বললো–: তা এখানেই সদর থাকলে খুব সুবিধার দিন ছিলো না বোধ হয়। শুনেছি, শুধু খায়েরা না, তাদের অনেক আমলাও কোমরে কিরিচ বেঁধে তবে রাস্তায় নামতো। রিসালা ছাড়া মেয়েরা স্নানে যেতো না।

–তখন কি বিচার ছিলো না?

ছিলো না আবার! নায়েব বললো–এখানকার পথেই কাজীর তুরুকদের সঙ্গে বেঁধে গেলেই হলো। তা এরাও বিচার চাইতো না। বরং ধরে নিয়েছিলো মারকাট করতে করতে বংশে গড়ে একজন পুরুষ থাকলেই হলো। ছোটোকালে মাসিদিদিমার কোলে রাখো লুকে। তারপর সে-ও আবার কোমরে কিরিচ বেঁধে হাঁটবে। তা বাপু সেসব দিনের চাইতে নাকি এ রাজ্য ভালো। এই তো দ্যাখো, অত বড়ো মন্দির উঠছে, কেউ ভাঙতে এগোচ্ছে না।

গাড়ি একটু এগিয়ে গেলো। হঠাৎ নায়েব খাড়া হয়ে বসলোতা দ্যাখো এরাও তো রাজা। আর তার বিদ্বেষী তোমার ছেলে। বলল, রাজদ্রোহ তো পাপ। দ্যাখো কত লোকের ছেলে কমিসরিঅটে চাকরি করে কলকেতাতেই কত বাড়বাড়ন্ত। আর তোমার ছেলে? ফিরলো বলো তোমার তিন সালের কান্নায়? পাপ নয়? লুক্কে রাখতে হয় না? কেমন কি না! তাহলেই দ্যাখো, চোরের মায়ের কাদন নেই।

হঠাৎ নায়েব হা হা করে হেসে উঠলো। আর তখনই যেন তার উত্তাপ লেগে তার নিজেরই সারা মুখ ঝলসে গেলো। বললো–ওরে তোরা তামুক দিতে ভুলছিস। না থাক। আরে ও গাড়োয়ান, থামা বাপা, থামা। নামবো একটুকন। চারিভিত উজল যে। লালে লাল দেখি। শিমূল নাকি অকালের?

গাড়ি থামলো। নামলে গাড়ি থেকে নায়েব। কয়েক পা এগিয়ে পাকা সুরকির সড়কটার। মুখে যেখানে মাটি পড়ছে সেই বরাবর গিয়ে দাঁড়ালো সে। ঝুড়ি করে মাটি ফেলছে পাঁচ সাতজন, কোদালে মাটি কাটছে জনাপাঁচেক। একজন তো পথের ধারেই।

নায়েব ইশারায় তাকেই ডাকলো। সে এলে বললো–লাল সড়কের ধারে উই ছাতনা। গাছ নাকি বাদামগাছ–ওটাই না মরেলগঞ্জের সীমানা? বটে তো? ওখানেই তো মনোহর। সিং-এর মকান। তা, এখানে এ রাস্তা পাতে কে?

-শুনি তো সিংজী, আসলে নীলেসাহেব আজ্ঞা। শুনি যে কুতঘাট তক যাবে।

বাঃ। একেবারে ফরাসডাঙা ফুঁড়ে? আহা বড়ো ভালো গো। তোমাদের আর কষ্ট থাকবে না। তা বলি, এই যে জমির মাটি কাটছে আর যে ধানের উপরে মাটি ঢালছো–এ সবই বুঝি নীলসাহেবের!

লোকটি ভয়ে ভয়ে বললো–জমিটা কর্তা ওই মাথায় করে মাটি ঢালছে-ওরই।

এই বলে সে থামলো। কেমন যেন ভাষা না বাবুটির? আর মুখের সঙ্গে তাও মানায় না। ফিনফিন ধবধবে জামা-পিরহান। কিন্তু পিতলের গরম পিদিমের মতো যেন চোখ দুটি।

তাহলে নিজের ধানে মাটি ঢালে কেন? নায়েব হো হোকরে হাসলো। একদম বেহেড। দেখছি। লোকটি এদিক ওদিক দেখে স্বর নিচু করে বললো–ধান তো গেয়েই আছে। কাল নয় পরশু আসবে মনোহরের নোক ধান কেটতে। তা সামচাচা কইলে মরার বাড়া গাল। নেই, দে গোরে ধান।

সাফ মাথা। তা মনোহর তোমরা চাচার জমির ধান কাটে। তার বর্গা বুঝি? নাকি তারও চাচেরা লাগে।

সাদা ধবধবে গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে রাজার গ্রামে যাওয়ার সড়কে। এই ভদ্রলোক তাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে তাদের একজনের সঙ্গে কথা বলছে। যারা কাজ করছিলো তারা এই আকর্ষণেই কাজ ফেলে ক্রমশ নায়েবমশায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেলো।

তাদের একজন বললো–কও না, সামচাচা, মনোহরমশাইয়ের ফয়সলা। কেন ধানে মাটি। ডানকানের সুবিধার জন্যেই এই সড়ক হবে মনোহরের বাড়ির তল দে কুতঘাট পর্যন্ত।

নায়েব খুক করে হাসলো–তা সামসুদ্দি নাকি শ্যামাচাঁদ, তা যাই হোক জমির খাজনা নেয় কে?

-জী? সামসুদ্দিন, হুজুর। খাজনা লেয় না।

লাখেরাজ বুঝি? নায়েব হেসে উঠলো। কিন্তু হঠাৎ থামলো সে। কিছু যেন তার মনে এলো, কপালটা কোঁচকালো। তারপর তার বোধ হয় মনে হলো অনেক বেলা হয়েছে, সে গাড়ির দিকে ফিরলো। লোকগুলি কী করা উচিত বুঝতে না পেরে পায়ে পায়ে তার পিছন পিছন হেঁটে এলো গাড়ির দিকেই।

নায়েব যখন গাড়িতে উঠছে, সামসুদ্দিনের কী মনে হলো। ঝপ করে সত্যটা প্রকাশ করে ফেলো। আজ্ঞে, পেত্রোসাহেবকে খাজনা দিতাম না। বাপ ছিলো কারিগর। চাকরান স্বত্ব এই পাঁচ বিঘার। ফরাসডাঙার ছিটমহলে আজ্ঞা।

নায়েব বললো–এদিক ওদিক বুঝি সবই পেত্রোর ব্রহ্মোত্তর?

–আজ্ঞে, ব্রহ্মোত্তর? মানে তিনি তো খেস্টান; তা উদিকে রাস্তার পুবে হৈ শিমূল গাছ থেকে ইদিকেও রাজবাড়ির রাস্তার পুবে আর পশ্চিমে তাই। এ দুশো বিঘার টোকটা পেত্রোর ছিট শুনি।

নায়েবকীভাবলো, বললো–শোনো সামসুদ্দিন,আর এক কোদালমাটিও উঠবেনা। কাল প্রেভাতে আমিন আসবে, চেন আসবে। পেত্রোর ফরাসডাঙা এখানে ফালা হয়ে সেঁধিয়েছে, না? টোঁক? সাতপুরুষে জোলা, জমি বোঝো? কার জমিতে কে সড়ক বাঁধে, হ্যাঁ?

শেষ কথায় নায়েব হঠাৎ সাপটে উঠলো। আরে বাপ–বলে সামচাচা দুধাপ পিছিয়ে গেলো। গাড়ি চলতে শুরু করলো। চলতি গাড়িটার পিছনে সেলাম আদাব বলে সামসুদ্দির দল খানিকটা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই সাপটেই যেন চেনা চেনা লাগলো। দেওয়ানজি নিজেই নাকি?

গাড়ির ভিতরে বসে নায়েব নিজের বাঁ হাতের তেলোটা চোখের সামনে মেলে ধরলো। গাড়ি চলতে ঝাঁকুনি লাগে তাতেই যেন তার মুখটা আরো একবার কঠিন হয়ে উঠলো।

সে বললো–গিন্নি, সেই থেকে বসে ঝাঁকুনি খাচ্ছো। বাড়ি গিয়ে মাজা খুঁজে পাবে না; শাও দেখি।

প্রায় জোর করে সে শুইয়ে দিলো স্ত্রীকে।

বললো–এখন আর তামুক না, কী বলল। বেলা গড়িয়ে গেলো।

-তুমিই তো না হক সময় নষ্ট করে এলে।

–তাও বটে। নায়েব হাসলো। কিন্তু যেন রোদ লাগার ফলেই তার মুখটা শুধু থমথমে নয়, পোড়া পোড়া দেখালোতা তুমিও বাপুকমনও। সেই থেকে পাকা সড়ক লাল সড়ক করছিলে। এটা তোমার ধাত হলো দেখছি, কাঁথার নকশা নিয়েও এমন রাতভর বকর বকর করো। তাছাড়া ইংরেজ দেশের রাজা। ডানকানই দাখো লাল সড়ক করছে। সেই গল্প, সব লাল হো যায়গা। হ্মুঃ!

গাড়ি তখন রাজারে গ্রামেই ঢুকছে। নায়েব বললো–বড়োবউ, তুমি কিন্তু কান্নাকাটা একটু কম করে করো।

-কেন নিজের ঘরে মধ্যে কাঁদবো না?

-এই দ্যাখো বাপু, তা আমাকে দুষো না। আমি কিন্তু আর একজনকে পরপরই এনে দিয়েছিলাম। আর এই ভদ্রলোক? লোকের মুখে মুখে শোনা আগের চাইতে নাকি দপ্তরে দশগুণ কড়া হয়েছেন। আমলা ফামলা রাগের ভয়ে তটস্থ। কিন্তু তারাও নাকি বোঝে না। ক্ষুঃ বলে উঠলে গলদঘর্ম হয়। কার ভিতরটা কতখানি পুড়েছে তা বোধ হয় বোঝা যায় না। নায়েবগিন্নি ভয় পেলো। সে বললো–ওখানে কী করে এলে? তোমার কথার পাত আমি বুঝি। রাগের মাথায় সড়ক বন্ধ করে এলে নাকি নীলসাহেবের?

নায়েব বললো–মেয়েমানুষ আর কাকে বলে। রাগের মাথায় কাজ হয়!

এখানে সময়ের দিক দিয়ে অসামঞ্জস্যের হলেও পরের দিন সকাল হতেই যা ঘটতে শুরু করেছিলো তা বলা মন্দ হবে না।

সামচাচা ভেবে ভেবে কিনারা পায়নি, লাভের মধ্যে ঘুম বরবাদ। হাসিখুশি লোকটি যে হঠাৎসাপটে উঠেছিলো তা ভোলা গেলো কোথায়? মোরগের ডাকেই সেউঠে বসেছিলো। বাইরে বেরিয়ে সে দেখলো তার সেই সড়কে গ্রাস করা জমিটার উপরে যেন হাজার লোক পিলপিল করছে। তার জমি ছাড়িয়েও নতুন সড়ক বরাবর আরো অনেকে।

কী আপদ বলে সে এগিয়ে যা দেখলো তা বরং দূর থেকে হাজার লোকের ভিড় কল্পনার। চাইতেও খারাপ। অস্থত পঞ্চাশটা কান্তে চলছে তারই ধানে। এর মধ্যে বারো আনা কাটা শেষ, আঁটিতেও বাধ্য হয়েছে! ওদিকে মরেলগঞ্জের সীমা ঘেঁষে নতুন সড়কের আড়াআড়ি খাম্বা বাঁশের খোঁটা বসেছে সারিসারি। আর তার এপারে ঝুপঝাঁপ ত্রিশখানা কোদাল পড়ছে, নতুন সড়ক কেটে মিশিয়ে দিচ্ছে দুপারের জমি বরাবর। ফর্দাফাই মাঠান জমি। দুমাসের সড়ক একবেলায় মাঠ।

ভয়ে হাত-পা সেঁদিয়ে যাওয়া বোধ হয় একেই বলে। বাড়িতে ফিরে তবু তারই মধ্যে ভাবলো সে একবার মনোহর সিংকে একটা খবর দেওয়া উচিত; অন্তত বলা দরকার আমি এসবে নেই। একটু বেলা হলেই তা করবে সে, এই ঠিক করলো। কিন্তু তাই বা কী, এতক্ষণ ননোহর সিং কি আর খবর পেয়ে যায়নি? আর এতক্ষণে সে বা কী মূর্তি ধরেছে। কাল যে গোরুগাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের সঙ্গে সে কথা বলেছিল তা কি আর ছাপানো আছে? সে কল্পনায় লাল সূর্যে কখনো মনোহর সিং-এর চোখ, নীলসাহেবের মুখ দেখতে লাগলো। আর তা হবেই, কারণ বাঁধা সড়ক কেটে নামিয়ে দেওয়া তা গিয়ে লাথ ঝাড়ারই সামিল আর তা জোরসে এবং নাক বরাবর। বাঁদরামির হাসির মুখে ডান হাতের এক থাপ্পড়।

কথায় বলে হস্তিমূর্খ পণ্ডিত আর বলদবোকাই তাঁতী। নীলবাবুদের রেশমদাদন মেটাতে–পেরে ওনকানের নীলের দাদন। বোঝ এখন? পণ্ডিত তার শাস্ত্রের বাইরে কানা, তাতীও তার তাতের নকশার বাইরে কীই বা দেখে? সামসুদ্দিনের ততও নেই, কিন্তু টানা দেখে বালুচরীর নকশা কেউ ধরতে পারে না এ সে বোঝে। তার গোটা বুকের মধ্যে সাতপুরুষের ভাবনা উথাল পাথাল করে উঠলো। নইলে তাতের ভুলো যাওয়া কথা এমন করে মনে আসে? লোকে বলে মাথায় বাড়ি পড়লে ভিরমি যাওয়ার আগে শৈশবকালের ঘটনাও নাকি মনে ফেরে। সূচনা আর পরিণতি, টানা আর নকশায় অনেক তফাত। কালকের সেই সাদা ছই-এর গাড়ি আর আজ সকালের এই দৃশ্য। কিছু কি বোঝা গিয়েছিলো কতটা বাগ? একবারই সাপটেছিলো বটে!

কিন্তু আরো আছে। জমি থেকে ধানের বোঝা সব মাথায় উঠছে এবার। রাস্তা চৌরস করে এবার ধানকাটা জমিতে কোদাল দিচ্ছে। কোদালেই চাষ। ক্রমে তারা জমি আর সড়ক ছেড়ে উঠে আসছে। সরষেও ছিটায় নাকি? আল্লা! এগিয়ে আসছে আর সামসুদ্দিনের ঘরের সামনেই ঝুপঝাঁপ ফেলছে কাঁচাপাকা ধানের বোঝাগুলি। উঁই করে ফেলছে। সামসুদ্দিন ফকির দরবেশের মতো নির্ভাজ হয়ে বসে রইলো। কে কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে?

ধানের বোঝা ফেলা শেষ হলে লোকগুলি দল বেঁধে ফরাসডাঙার দিকে হাঁটতে শুরু করলো। তখন হঠাৎ এক বুদ্ধি খেলে গেলো সামসুদ্দিনের। বাড়ির ভিতরে গিয়ে বউকে বললো–বেলরা তো। বেরো, আয় আমার সঙ্গে। ছোটোমেয়েটা দাওয়ায় খেলছিলো, তাকে টেনে কোলে তুলো। ছেলেটা মায়ের আঁচল ধরে কী বায়না করছিলো, আঁচলসমেতই তার হাতে চেপে ধরলো। –আয় আমার পিছনে। বললো– বউকে। -আয় বলছি।

যারা দল বেঁধে ফরাসডাঙার দিকে যাচ্ছিলো তাদের লাগ রবার জন্য সামসুদ্দিন লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটতে শুরু করলো বউ-এর আঁচলসমেত ছেলের হাত চেপে ধরে মেয়ে-কাঁকালে।

বউ বললো–আরে আরে, করো কী? ছাড়ো, আঃ!

–শশুরের বাড়ি যাই।

তা শ্বশুড়ের বাড়ি বটে, ফরাসডাঙার অন্য প্রান্তে নদীর ধারে।

বউ বললো–এক বস্ত্রে? করো কী? খেপলে? ছাড়ো। লোক?

চপ। সাপূটে উঠলো সামসুদ্দিন।

সামসুদ্দিন জানে টানা টানাই, নকশা নকশা। এই তো সবে সূচনা। অথচ ভাবো একবার কাল সেই বাবুমশায় রাস্তা সড়ক হচ্ছে দেখে কত প্রশংসা না করলো নীলেদের। কেমন হলো না? আকাশে ভাসা মেঘ দেখে বিদ্যুতের পোড়ানি বোঝো? ওদিকে আবার ডানকান আর মনোহর। তাদের লেঠেলরাও বোধ হয় এতক্ষণ বেড়ার গায়ে দুমড়ে পড়েছে।

এসবই পরের দিন ঘটেছিলো।

.

০৯.

শেষ হেমন্তের দুপুর দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়, ১৮৬০, মতান্তরে ১৮৬১-র সেই দুপুরও হয়েছে। এখন সবকিছুই কাছের হলে বাদামী, দূরের হলে কালচে।

জয়নালের বয়স হয়েছে। তার গায়ে চকখড়ি এবং সিঁদুরের আলপনা যেটুকু সকালে দেখা গিয়েছিলো এখন চোখে পড়ছে না, বনজঙ্গলের ডালপালায় ঘষে উঠে গিয়ে থাকবে। কিংবা বাতাসে এখন রং থাকায় সেই নকশা এখন অস্পষ্ট। জয়নালের গুঁড়ে জড়ানো বেশ মোটা কিন্তু খাটো একটা কলাগাছের ডুমো। তার হাঁটা দেখে মনে হয় যেন সে ভাবছে কতক্ষণে হাওদা খুলবে, আর সে সেইনরম ডুমোটাকে সদ্ব্যবহার করবে। সেজন্য তার চলার মধ্যে যেন একটা খুশির ভাব।

হাওদায় রাজু রাজকুমার, রাজচন্দ্র। সারাদিনের পরে শিকার থেকে ফিরছে সে।

রাজুর সকালের কথা মনে হলো। শিবমন্দিরটা অনেকটা উঁচুই হবে! মেঝে থেকে অন্তত বিশ বাইশ হাত উঁচুতে থাকবে চূড়া। আর সেই মেঝে, যা সেই হাওয়াঘরের, তা না কোন দশ হাত। রাজবাড়ির চূড়া শোনা যায় মাটি থেকে পঁচিশ হাত। কিন্তু রাজবাড়ির চূড়াটা গম্বুজের। মন্দিরের চূড়া যেন রথ। রাজবাড়ির গম্বুজের কাছে দাঁড়ালে সেই চূড়া চোখে পড়বে কি?

গোটা মন্দির কী রকম হবে তার ছবি রাজু দেখেছে। রানী নিজেই দেখিয়েছিলেন। জয়পুরী সেই মিস্ত্রির নকশা।

হঠাৎ মনে হলো রাজুর, হাওয়াঘরটা থাকবে না। বলতে পারো এখনই নেই। কিছুদিন আগেই টেনে নামানো হয়েছে খড়ের সেই পুরু ছাদ, লোহা আর কাঠের তির বরগা। যেন হঠাৎ একটা ধাক্কা লেগে শূন্য হয়ে গেলো তার মন।

ওখানেই, ওই হাওয়াঘরেই, প্রথম বন্দুক চালাতে শিখেছিলো সে। শিখিয়েছিলো বুজরুক। কত তাড়াতাড়ি বর্তমান অতীত হয়ে যায়!

আর অতীত এমন বিষয় যে বর্তমানে পৌঁছে সবকিছু যেমন করে ঘটেছিলো পরপর তেমন করে দেখবারও উপায় থাকে না।

শাখা-পথটার কাছে জয়নাল দাঁড়ালো না।

আর এই শাখা-পথের উপরেই কিছুদূরে এগিয়ে গিয়ে সেই ঘটনাটা ঘটেছিলো। পালকি বেহারার হুমহাম শব্দে তার ঘোড়া বারবার শিষপায়ে দাঁড়াচ্ছে। ঘোড়ার উপর থেকে সে যেমন, পালকির ভিতর থেকেও তেমন বিরক্ত বুজরুক কে যায় বলে কেঁঝে উঠেছিলো। সারাক্ষণ বুজরুকের কথাই ছিলো মনের কাছে, ইংরেজের জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরছে। বুজরুক। অথচ তখন সেই পালকিতেই বুজরুক তা সে ভাবতেও পারেনি।

দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়লো রাজুর। তখন দেখা হয়ে গেলে কী না কৌতুকের হতো! সন্ধ্যার ম্লানভাবটা রাজু অনুভব করলো তার মনে। আসলে বোঝা যায় না। একই পথের উপরে মুখোমুখি অবস্থান করলেও চেনা যায় না, জানাও যায় না কী কার পরিণতি হবে। কেউ কি জানে পিয়েত্রো ঠিক কী আশা করেছিলো? তা কী ইংরেজদের প্রতি ফরাসীর মিথ্যা অর্থহীন আক্রোশ? একদিন গল্পের ঝোঁকে বলেছিলেন বটে এক হাজার লোক নিয়ে শুরু করে এক রাজ্য স্থাপন করা যায়–ভাগ্য সহায়তা করলে এবং অশেষ কষ্ট সহ্য করার উৎসাহ থাকলে।

রাজু হাসলো। হাওয়াঘরের কথাটাই আবার ঘুরে এলো মনে। সে অনুভব করলো ছাদ টেনে নামানোর পরেও সেদিকে চাইলে যেন হাওয়াঘরটার ছায়া সেখানে এতদিন দেখা যেতো। এরপর সেদিকে চাইলে নিরেট বিপুল শিবমন্দিরটাই চোখে পড়বে। এরপর পিয়েত্রোর বলা কোনো প্রতিধ্বনিও মনে আসতে আসতে হয়তো মন্দিরে ঘণ্টাশব্দে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাবে।

হাতের উপরে চিবুক রেখে সামনের দিকে চাইলো রাজু। তাহলে শব্দটা উঠছে জয়নালের গলায় ঝুলনো ঘণ্টা থেকেই? গ্রামের মধ্যে ঢুকে পড়েছেহাতি। শিকারের হাতির ঘণ্টা বাজালে চলে না। গ্রামে ঢুকেই সোভান দড়ির বাঁধনটা ছাড়িয়ে দিতেই বড়ো পিতলের ঘণ্টাটা হাতির গলার ডোর থেকে দোল খেয়ে খেয়ে বাজছে।

আর জয়নাল এখন গতিও বাড়িয়েছে যেন। বাড়ি ফেরার পথ, মাহুতকে অঙ্কুশ ব্যবহার করতে হচ্ছে না। কানের পিছনে পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে খোঁচা দিচ্ছে মাঝে মাঝে। কিন্তু অঙ্কুশটাও হাতে আছে। গ্রামে ঢুকে পিলখানার দিকে ছুটতে পারে, রাজবাড়ির দিকে না গিয়ে।

হ্যাঁ, গ্রামেই তো। খুব তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামছে এখন। তাহলেও পথ চেনা যাচ্ছে। লোজন আছে পথে। তারা সরে সরে যাচ্ছে হাতি বাঁচিয়ে।

হাওদায় বসে দুলুনিটা ডাইনে-বাঁয়ে লাগে ঠিকই, কিন্তু কাঁধের কাছেবসা মাহুত অনবরত উঠছে আর নামছে সন্ধ্যার অন্ধকারে।

এমন অন্ধকারেই পিয়েত্রোর হাতিটা একা একা এক গাছতলায় সামনে পিছনে দোলে। শুড় তোলে। কী ধরতে চায়? কিছু যেন শুড়ে টেনে পায়ে ফেলছে মনে হবে। মিথ্যা কিংবা উদ্দেশ্যহীন আক্রোশে।

পিয়েত্রোর হাতিটা ছোটো। তার পিঠে হাওদা, হাওদায় পিয়েত্রো। অন্য হাতিতে ছিলো বুজরুক।

রাজু ভাবলো সে শিকারের তুলনায় অন্য কোনোদিনের কোনো শিকারকেই সে নাম দেওয়া যায় না। অথবা তাকে কী শিকার বলা হবে? আহত বাঘের দিকে বুজরুক যেভাবে খোলা কিরিচ হাতে ছুটে গিয়েছিলো? সেটা হয়তো তার পক্ষে শিকার-খেলার অংশমাত্র ছিলো। কিন্তু আহত বাঘের সঙ্গে-ঘটনাটা যেন রাজুকে বলতে পারে, দ্যাখো, পুরুষের কত সাহস হতে পারে, নিজের হাতের কিরিচে কত বিশ্বাস রাখতে হয়!

আজকের হরিণটা কিছুমাত্র খেলেনি। পাকা ধান খেতে বনের ধার-ঘেঁষা ধানক্ষেতে ঢুকেছিলো। বেশি খেয়ে যেন ছুটতেও পারছিলো না।

এ জাতের হরিণ, অবশ্য, কচিৎ মেলে জঙ্গলে। প্রচলিত গল্প মানতে হলে বলতে হবে, রাজুর বৃদ্ধ পিতামহের সময়ে পুরনো বাড়িতে বন্যার জল পৌঁছলে হাতার চিড়িয়াখানার হরিণগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলো। এ হরিণ তাদেরই জ্ঞাতিগুষ্টি হবে।

রাজু ভাবলো, বনে বুনোমোষও আছে। বাঘও আসে হরিণের লোভে। তারপর বনের ধারে গ্রামে গোরু বলদের উপরেও হামলা করে।

হরিণ যদি তেমনভাবে এসে থাকে বুনোমোষও কি তবে গৃহস্থের হারিয়ে যাওয়া মোষ থেকেই এ অঞ্চলের বনে তৈরি হয়েছে? কিন্তু তা কি সত্যি হয়–পুরনো ঝাড় থেকে একেবারে নতুন বেপরোয়া এক বংশ। তা কি হতে পারে? গৃহস্থ মানুষ থেকে স্বাধীন এক পুরুষ!

এখন গ্রামের প্রধান পথে উঠেছে হাতি। তাই এ সন্ধ্যাতেও লোকচলাচল একটু বেশি এখানে তাদের কারো কারো কাঁধে অথবা মাথায় ধামা। ওদিকে কাঠুরেপাড়ার হাট ছিলো তবে দু-একজন এ-গলি ও-গলি থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে হাতির পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে উল্টোদিকে। শেষ হাটে কিছু কিনতে আশা রাখে। তাদের কেউ কেউ আবার দাঁড়িয়ে পড়ে হাতি ও হাতির পিঠের শিকারকরা জানোয়ারটাকে দেখে নিচ্ছে। এমন অস্পষ্ট আলোয় তা কি ঠাহর হবে?

প্রধান পথই সুরকির রং ধরেছে চোখে, সুরেন ওভারশিয়ারের রাস্তা। এখান থেকেই সার্বভৌমপাড়া শুরু। কাঠুরেপাড়াটা বরং সাহেবপাড়ার পিছনে। নাম সার্বভৌমপাড়া। তার অর্থ এই নয়, এ পাড়ায় একাধিক সার্বভৌম থাকেন। একজনই ছিলেন। তাতেই এই নাম। ব্রাহ্মণপ্রধান পল্লী এখনো।

কিন্তু সবসময় তাও হয় না। যেমন কাঠুরেপাড়াটা খুব পুরনো হলেও সেখানে এখন যারা থাকে তাদের অধিকাংশ রাজকাছারির আমলা। আর সাহেবপাড়া তো এখনো কাগজপত্রে ওঠেনি, মুখেমুখে চলছে। আগে নাম ছিলো গঞ্জ। প্রধান হাট বসতো। সুতার হাট, কাপড়ের হাট। এদিক ওদিকে এখনো কয়েকজন মহাজনের স্থায়ী আড়ত, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওখানে স্কুল-হরদয়ালের। স্কুলের হেডমাস্টার বাগচীসাহেবের বাসা। তা থেকেই সাহেবপাড়া বলছে। এটাও নতুন হওয়ার ঘটনা বইকি।

ইতিমধ্যে রাজবাড়ির দোতলার কোনো কোনো জানলার আলো চোখে পড়ছে। রাজু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলো, কিন্তু সোজা হয়েও বসলো। প্রায় সারাটা দিন কেটেছে হাতির পিঠে, এবার নামতে হবে। আসল কথা, এই অত্যন্ত পুরনো কথাটাকে টানাসুরে ভাবলে সে বদলে যায়, পুরনোকে ধরে রাখা যায় না।

মাহুত বললো–হুঁজুর!

কিছু বলবে?

-হাতি নিয়ে কইবেন বলেছিলেন।

–ও, হ্যাঁ। ওর বাঁ কানটার কথা।

সোভান মাহুত যা বললো– : তিন-চার বছর আগে জয়নাল সেই যে একটু খ্যাপাটে হয়, তখন বাগে আনতে তার উপরে অত্যাচার হয়েছিলো। বাঁকানের নিচে চার-পাঁচ আঙুল চেরা, সে সময়ের বল্লমের চিহ্ন। আর দাঁত দুটোর ডগা গোল নয়, মাপেও ছোটোবড়ো। সেও খ্যাপামির ফল। সে সময়ে একটা দাঁতের আগা বেশ খানিকটা ফেটে গিয়েছিলো। আসাম থেকে লোক আনিয়ে সমান করে কাটিয়ে নিতে হয়েছে। একবার কথা উঠেছিলো দাঁত দুটোয় সোনার রিং পরানো হবে। এখনো কিন্তু খুব ছুটতে পারে জয়নাল।

কারণটা মনে পড়লো রাজুরও। রিং পরানোর কথা হয়েছিলো, পরে কিছু আর করা হয়নি। কে ব্যবহার করবে জয়নালকে? কিছুদিন তার একমাত্র কাজ ছিলো বিলমহলে যাওয়ার জন্য কর্মচারীদের বাহন হওয়া। রাজুই ইদানীং তাকে তুলে এনে নতুন করে কাজে লাগাচ্ছে। এমন শিকারী হাতি হয় না, যদিও কানের ক্ষত চিহ্ন আর মুছবে না, দাঁতের গোল ডগাটা আর ফিরে পাবে না। দ্যাখো, এতদিন পরেও বনের স্মৃতি খেপিয়ে তোলে নাকি?

রাজু বললো–সোভান, হাতিটার গায়ে রং দিতে হয়।

-জী, তাই দেবো।

-পুরনো রং বেশ রগড়ে ঘষে তুলে দিও। রামপিয়ারী বা চন্দনের গায়ে যেমন অবিকল তেমন করো না। নকশাটা ভিন্ন করো। এখন তো জয়নাল আমার কাজেই লাগছে। ও আর। খেপবে না, দেখো। সবকিছু মেনে নেবে।

জী, হুজুর।

একটু পরে আবার বললো– রাজু-পিয়েত্রোর হাতিটার কী অবস্থা, সোভান?

-ওর মাহুতই ওকে দেখে, হুজুর। মাহুত মানে বান্দা, পেত্রার বাবুর্চি।

–সে কী? তার বেতন-তনখা?

–শুনি শেষমেস অনেককে চাকরান দিয়ে গিয়েছে পিয়েত্রো।

–আচ্ছা, সোভান, তোমাদের পিলখানাতে পিয়েত্রোর হাতিটাকে এনে রাখলে হয়।

–তা হয়, হুজুর।

–আমার তো মনে হয়, একা একা প্রাণীরাও বোঝে।

–হাতি তা বুঝবে, হুজুর।

রাজু ভাবলো, হ্যাঁ, কী আর কাজে লাগবে। তার নিজের হাতি তো নয়। কোথায় যেন পথের ধারের ঘাস-ঝোপ থেকে ঝিঁঝি ডেকে উঠলো। ঝিঁঝির ডাকের এই এক কৌতুক, তাতে যেন একটা ইশারা থাকে। যদিও বোঝা যায় না, কিন্তু যেন টানে, যেন দূরে নিতে চায়। আর তখন মন উদাস হয়।

রাজবাড়ির দরজায় হাতি বসছে, ভিতরে যেতে পারছে না। সদরদরজার কাছেই গোলমাল। ভারা বেঁধে কাজ করছে মিস্ত্রিরা। যদিও আগেরটাই যথেষ্ট সুন্দর এবং উঁচু ছিলো। এখন নাকি বিশ হাত ওপরে, চওড়াতেও বারো হাত আর সেই অনুপাতে কিছু হচ্ছে। রাজু মনে মনে হাসলো। এইসবই সে এবার ফিরে আসার পর দেখছে। ছ মাসের উপর ছিলো না সে। হঠাৎ একদিন স্থির হয়েছিলো। হঠাৎ একদিন বোট ভেসেছিলো তাকে নিয়ে। পাটনা, মুঙ্গের কাশী; এদিকে লক্ষ্ণৌ, দিল্লী, আলমোড়া। লক্ষ্ণৌ রেসিডেন্সি দেখেছে সে। অনেক কবর, গোলাগুলির চিহ্ন অনেক। দিল্লীর ভাঙা প্রাসাদগুলো, ভাঙা দরওয়াজাগুলো। ওহহ, এটাই তো বুলন্দ দরওয়াজার নকল বলছিল সুরেন। মাকে জিজ্ঞাসা করতে হবে, হাতে কাজ নেই বুঝি? পুরনোকে ভেঙে নতুন করছে সব? পুরনোকে ভাঙলে নতুন হওয়া যায় বুঝি? সে আবার মনে মনে হাসলো ।

ভারা থেকে মিস্ত্রি মজুররানামছে। রাজু হাওদা থেকে লক্ষ্য করলো, কয়েকজন কর্মচারী বেরিয়ে আসছে কাজ শেষ করে। তাদের মধ্যে সোনাউল্লা কাজীকে চিনতে পারলো সে। হাতির উপর থেকে সে বললো–আমিনসাহেব, শোনন। আমলারা দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো, এখন তটস্থ হলো।

হাতি থেকে নেমে রাজু বললো–হাতির উপরে হরিণ আছে।

সোনাউল্লা বললো–জী মেহেরবান।

–ওটার সদ্গতি করো তোমরা। চামড়াটা শুধু

–জী, রাজবাড়িতে পাঠাবো?

না। একটু হেসে রাজু বললো–শিবমন্দিরের পুরোহিতকে বরং পাঠিয়ে দিও। যদি তার কাজে লাগে। কেউ নাকি অজিন পছন্দ করে।

-বহোৎ খুব, হুজুর।

.

১০.

রাজবাড়িতে মশালচিরা তখনো আলো জ্বালিয়ে ফিরছে। অন্দরে সামনে দরদালানের সিঁড়ির গোড়ায় বেশ ধোঁয়া। ওখানে দাসীরা ধুনুচি ঠিক করছে তাহলে। সব ঘরে ধূপ দেওয়া শেষ করতে পারেনি।

রাজু তার মহলের সিঁড়ির কাছে পৌঁছতেই রূপচাঁদের সঙ্গে দেখা হলো। হাত বাড়িয়ে বন্দুক নিলো সে, গুলির বেল্টও। পিছন পিছন যেতে যেতে সে বললো, মাসি বললেন—

রূপচাঁদ ভয়ে ভয়ে বলছিলো। রাজুও অন্যমনস্ক ছিলো। সে বললো, কে, হৈমী? সে ভাবলো, দ্যাখো পাটনায় যখন তার বোটে এলো তখন কী করুণ অবস্থা! ইতিমধ্যে কিন্তু সামলে নিয়েছে। তার সুখ-সুবিধার বিশেষ ভার নিয়েছে। রূপচাঁদ বললো–আজ্ঞে না, মাসি!

-তোমার মাসি? কে? নয়নতারা? সে কি ফিরেছে?

বললেন তিনি রাজবাড়িতেই আছেন।

কয়েক ধাপ উঠে বললো– রাজু–রূপচাঁদ, স্নানের ব্যবস্থা করো।

-গরম জল তো?

-আ, রূপচাঁদ, এখন আমি বেশ বড়োই হয়েছি। তাছাড়া সাতদিন আগে যে ঠাণ্ডা লেগেছিলোনা না, থাক, গরম জলই দাও স্নানের ঘরে। এখন আর মাকে বিরক্ত করে মত আনতে যেতে হবে না। মা কোথায় রে, রূপচাঁদ?

-জেনে আসি, হুজুর।

না। শেষ কী করতে দেখেছিলে? রাজু হাসলো রূপচাঁদের চালাকিতে।

–আজ্ঞে, রানীমা বোধহয় মহাভারত শুনছিলেন।

–আর তোমার মাসিই পড়ছিলেন নিশ্চয়?

হ্যাঁ, না–কোনটা ভালো হবে তা ঠাহর করতে পারলো না রূপচাঁদ। মহাভারত পড়ার সব ব্যাপারটাই তার অনুমান।

এক মশালচি দোতলার সিঁড়ির দেয়ালে দেয়ালগিরি জ্বালছে। বেশ খানিকটা কসরত সেটা। এপাশের রেলিং-এ উঠেদাঁড়িয়ে মশালবাঁধা লাঠি দিয়ে দেয়ালগিরির উপরেই যেন ভর রাখতে হয়। যেন একটা পতঙ্গ, মশাল-লাঠিটা যার একটা শুড়ো। আসলে নিশ্চিতই তা নয়। তাহলে দেয়ালগিরির করবী ফুলের মতো চেহারার লাল কাঁচের ডোমটা, যা নাকি পিতলের কয়েক প্যাঁচে মাত্র বসানো খানখান হয়ে ভেঙে পড়তো।

একটু দাঁড়াতে হলো রাজুকে।

মশালচি আলো জ্বেলে নেমে দাঁড়িয়ে সেলাম করলো।

রাজু নিজের ঘরের দিকে চললো।

এ ঘরের আসবাব খুব কম, কিংবা এমন হতে পারে ঘরখানি বিশেষ বড়ো বলেই তেমন দেখায়। দেয়ালে বসানো আলমারিটা বেশ বড়ো। অপরিচিত লোকের কাছে আর একটা দরজা মনে হবে। শুধু তার পাল্লাগুলোর মেহগ্নি রং দরজার পালিশের চাইতে উজ্জ্বল এবং গভীর। বরং তা রঙের দিক দিয়ে খাট, চেয়ার, দেরাজের ডেক্সটার সঙ্গে মেলে। কিন্তু গাঢ় রং দেখতে গেলে মস্ত পিয়ানোটাকে লক্ষ্যে আনতে হবে যা উল্টোদিকের দেয়াল ঘেঁষে।

ঘরের মাঝামাঝি থেকে কিছু পিছিয়ে রাজুর খাট। স্বভাবতই তাতে নেটের মশারি এবং দুধে-সাদা চাদর। দেয়াল-আলমারি থেকে কিছু দূরে একটা ছোট র‍্যাক। রূপচাঁদ তাতে বন্দুকটা রাখলো। আরো বন্দুক সেখানে। ডেস্কের সামনে খান দু-তিন চেয়ার। পিয়ানোর সামনে গদিদার টুল। ডেস্কের উপরে হিংকসের বড় টেবল ল্যাম্পটা জ্বালানো হয়নি। ঘরের ঠিক মাঝখানে ছাত থেকে ঝোলানো ঝাড়টাও জ্বলছে না, যদিও দেয়ালের দেয়ালগিরির আলোয় ঝাড়ের ত্রিশিরা কাঁচগুলো ঝিকমিক করছে। ঝাড়টার ঠিক নিচে গালিচা।

ঠিক এই সময়েই সে ব্যাপারটা ঘটলো। একটা হীরা বসানো বাঁটের সোনার কিন্তু তীব্ৰধার তরোয়াল। রাজুর মনের মধ্যে হিংস্র হয়ে উঠলো। যেন প্রতিদ্বন্দ্বীর বুকের রক্তে তার পিপাসা। কিন্তু অবাক, সে রক্ত যেন তার নিজের চোখের জল যার ফলে তার বলতে ইচ্ছা হচ্ছে, কথা রাখোনি।

কিন্তু এখন ঠোঁটকে ফুলতে দেওয়া যায় না। এই কয়েক মাস গঙ্গায় বোটে কাটিয়ে তার ঠোঁটের উপরে সরু কালো গোঁফের রেখা বেশ স্পষ্ট। গালেও ইম্পীরিয়াল দাড়ি।

হেঁটে গিয়ে ডেস্কের সামনে চেয়ারে বসতে বসতে ডেস্কের উপরে আখরোট কাঠের বারকোশটায় চোখ পড়লো। ধারগুলো কারুকার্য করা। কাঠের অথচ স্বর্ণকারের কাজ মনে হয়। কিন্তু বারকোশে ফলও। রাজু কয়েকটা তুলে মুখে দিলো।

খেতে খেতে জুতো খুলতে গেলো রাজু। রূপচাঁদ তখন হাঁ হাঁ করে ছুটে এলো। নিচু হয়ে বসে জুতো খুলতে খুলতে বললো–জুতোয় হাত দেবেন, হুজুর, খাচ্ছেন যে।

-তুমি বুঝি হাট থেকে এনেছো? বেশ তো।

না, হুজুর, পিয়েত্রা কুঠির লাঞ্চোর জন্য সফর থেকে এসেছিলো। হৈমীদিদি ছাড়িয়ে হুজুরের ঘরে রাখতে দিলেন।

জুতো খুলে, চটিজোড়া পায়ের কাছে এগিয়ে দিয়ে রূপচাঁদ উঠে দাঁড়ালো। বললো–স্নানের জল তৈরিই থাকবে, দিতে বলি। আর এখন কি খাবারঘরে যাবেন? সারাটা দুপুর না খেয়ে কাটলো হুজুর।

-তাই তো দেখছি। স্নানটাই এখন দরকার।

ফিতে কষা জুতোমোজা খুলে ঢিলে চটি পরার একটা সুখ আছে। শিরশির করে রক্ত বয়ে যায় যেন আরাম দিয়ে দিয়ে পায়ের আঙুলগুলোতে। রূপচাঁদ চলে গেলে একটু পায়চারি করলো রাজু, বিছানার পাশ দিয়ে গিয়ে ওদিকের গরাদটার একটা জানলা খুললো। এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া এলো ঘরে। জানলা দিয়ে বাইরে চেয়েও খানিকটা সময় কাটলো। সে কি কিছু প্রত্যাশা করছে? সে কি জিজ্ঞাসা করবে, এই এক বছর কোথায় থাকলে? কিছু না বলে চলে গেলে কেন?

দরজার কাছে মৃদু শব্দ হলো।

একজন কে ঢুকছে। অল্পবয়সী, মুখটা ভরাভরা, চোখ দুটো বড়ো, ছোটো নাক, তাতে ঝুটা মুক্তার মোলক। চুল টেনে বাঁধা, সম্ভবত বেশি তেল দেওয়ায় আলোয় চকচক করছে। দুহাতে সাদা শাখার বালা। গায়ের উপর দিয়ে টেনে কোমরে এনে জড়ানো রাজবাড়ির থোসা। কাজ করছে বলে হাত দুখানা প্রায় কাঁধ থেকেই আবরণের বাইরে। তার হাতে ধুনুচি, ধোঁয়াচ্ছে। রাজুকে দেখে সে শশব্যস্তে ফিরে যাচ্ছিলো। রাজু বললো–ধূপ দেবে? দাও, আমি স্নানে যাচ্ছি। সে বেরিয়ে গেলো। কেমন ঠকলো সে আবার।

বিধান এই, ঝিরা রাজপরিবারের পুরুষদের সামনে চলতে ভয় পায়। বিধানও এই, যে ঘরে তারা থাকবেন না-ডাকলে সেখানে যাবে না। বিধানটা নতুন। পুরুষ ভৃত্যদের বেলায় এ বিধানটা খানিকটা শিথিল, কারণ তাদের সংবাদ আদানপ্রদান করতে হয়।

ঝিটি এখানে ওখানে ধূপ দিলো ধুনুচি দুলিয়ে। কিন্তু কেমন একটা অস্বস্তি লাগছে তার। সে কি বেআইনী কিছু করে ফেলেছে?

তবু কর্তব্য তো করতে হবে। ডেস্কের কাছে এলো সে ধূপ দিতে দিতে। ডেস্কের চারপাশে তার উপরে দেয়ালের গায়ে ধূপ দিতে দিতে সে যেন সৌন্দর্যে অবাক হয়ে গেলো। বারকোশটা আর বারকোশে সাজানো ফল। ধুনুচি দোলাতে দোলাতে সে সরে গেলো। এখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে পিয়ানোর দিকে ধূপ দেওয়া শেষ হলে। কিন্তু পিয়ানোর দিকে না গিয়ে বরং সে ডেস্কের কাছে সরে এসেই আবার ধুনুচি দোলালো। আর সেই সুযোগে বারকোশ এবং বারকোশের উপরে রাখা ফলগুলোকে আবার দেখলো। ধূপ দেওয়া কি আর হয়নি? দরজা দিয়ে বেরোতে গিয়ে এদিক ওদিক দেখলো। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে ধুনুচিটা মেঝেতে রাখলো। বারকোশের উপর থেকে একমুঠো যা উঠলো একবারে তুলে নিয়ে আঁচলে বাঁধলো। আঁচল কোমরে জড়িয়ে ধোসা দিয়ে ঢাকলো। তার মনে হলো এগুলোকেই কাবুলী-মেওয়া বলে। না জানি কী অমর্ত সোয়াদ। কিন্তু ঘর থেকে বেরোতে না-বেরোতে কিছু যেন তার বুক চেপে ধরলো। রক্ত চলাচলের অভাবে তার হাত-পা বিবশ হয়ে আসছে, মুখ বিবর্ণ।

দুড়দাড় করে সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো। সেখানে প্রাচীন একজন অন্য ঝিদের দিয়ে এদিক ওদিক ধূপ দেওয়াচ্ছে। প্রাচীনা বললো–কী রে, হাঁপাচ্ছিস কেন?

রাজকুমার ঘরে ছিলেন। তার পেটের কাছে বাঁধা মেওয়াগুলো লোহার দলার মতো ভারী আর শক্ত বোধ হলো।

-তা রাজকুমার ঘরে থাকলে–প্রাচীনা বললো–কিন্তু, আমি কিন্তু দরজার বাইরে পর্যন্ত গিয়েছিলাম তোর সঙ্গে, তাই না?

–ছাই গিয়েছিলে।

এবার প্রাচীনার মুখও বিবর্ণ হলো। সে ভাবতে লাগলো রানীমাকে কি এখনই গিয়ে বলা উচিত, সে যায়নি? বলে কি ক্ষমা পাওয়া যাবে? রানীমার হুকুমই এই নতুন নতুন ঝিয়েরা যখন কাজ করবে পুরনো বিশ্বাসী ঝিয়েরা তখন সঙ্গে থাকবে।

তাদের সে অবস্থায় দেখে কিছু একটা ঘটেছে আন্দাজ করে অন্য ঝিয়েরা এগিয়ে আসছিলো কৌতূহলের টানে। প্রাচীনা বেঁজে উঠে বললো–যা-যা, কাজ শেষ কর। আমি কটাকে সামলাই বল। এটাকে বললাম দাঁড়া, তো ওটা একাই ছুটলো রাজকুমারের ঘরের দিকে।

অন্য ঝিয়েরা নিজের গালে হাত দিয়ে এদিক ওদিক মুখ ফেরালো যেন ঘটনাটায় কী না বিস্ময়কর অভাবনীয়তা আছে। কী না গা শিরশির করা ঘটেছে।

নতুন ঝিটি যেন প্রাচীনার এই বিড়ম্বনার পিছনেই নিজের বিবশতাকে আড়াল করতে পারলো। পরামর্শ করার ভঙ্গিতে বললো–তা দিদি, তুমি তো ছিলেই দরজার কাছে! ধোঁয়ার। আমরা ঠাহর করতে পারিনি রাজকুমার ছিলেন ঘরে।

–তাই বল। তুই যে কখন কী ভয় দেখাস না!

কিন্তু তার গা তখনো কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে একবার ভাবলো, কিন্তু বারকোশটা কী বেশি খালি হয়ে যায়নি! প্রাচীনা তার মুখের দিকে চাইলো আবার। জিজ্ঞাসা করলোতোর শরীরটা কী খারাপ নাকি লো?

-মাথাটা ধরেছে খুব।

-তাহলে বাড়ি যাবি? সেই ভালো। প্রাচীন এই বলে ভাবলো, একেবারে ঘাবড়ে গিয়েছে। দূরে দূরে থাকে এখন তাই ভালো। সামলে নেওয়ার সময় পাওয়া যাবে। নবীনা ধুনুচি নামিয়ে রেখে বাড়ির দিকে চললো।

রাজবাড়িতে যারা কাজ করে তাদের সকলের ছুটি একসঙ্গে হয় না। এবং বর্তমানে ঝি বলতে যা বোঝায় সকলেই সে স্তরের ছিলো না। ঝি এবং কন্যায় যে কোথাও কোথাও মিলের আভাস আছে তা তখন এখানে অযুক্তির ছিলো না।

প্রথম পরিচারিকা পথে বেরিয়ে একজন সঙ্গী পেলো। এই দ্বিতীয়ার নাম সুন্দরী বামনি, এবং প্রকৃতপক্ষে তাকে সুন্দরীই বলা যায়। প্রথমার চাইতেও সে কিছু বয়সে বড়। সেজন্যই হয়তো সে সাহসিকা এবং হয়তোবা সেজন্যই তার সৌন্দর্য লোকের চোখে লাগে। টানা চোখ, নাকে ঝুটা পান্নার ফুল, কানে মাকড়ি। সবসময়েই সে পরিচ্ছন্ন কিন্তু অনেকসময়ে যেন ক্লান্ত দেখায় তাকে।

একই রাস্তায় যাবে তারা, আগে সুন্দরীর বাড়ি পড়বে।

খানিকটা দূরে গিয়ে সুন্দরী খুব ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করলো–সৌভাগ্য নাকি লো?

প্রথমা ঝি অবাক হলো। –কিসের? কী সৌভাগ্য দিদি?

রাজকুমারের ঘর থেকে এসে অমন হাঁপাচ্ছিলি।

সুখ? ও? আছি ছি! তুমি একমুঠো ছাই ধরেছো সুন্দরীদি।

দুজনে আর কথা না বলে হাঁটতে লাগলো। সুন্দরীকে যেন বিবর্ণ দেখালো। সুন্দরী বামনির বাড়ি এসে পড়েছিলো। বাড়ির দরজায় তার ফুটফুটে ছেলেটি আলো নিয়ে দাঁড়িয়ে। বোঝা যায় স্বামীও আছে কাছাকাছি। সুন্দরী তাড়াতাড়ি এগিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো। একটু বেশি জোরে।

প্রথমা ঝি ভাবলোনা, তার ছেলে খেতে পারেনা। তার দাঁত ওঠেনি। অন্যান্যেরা প্রায়ই লোভের জিনিস এটা ওটা ছেলেমেয়ের নাম করে চেয়ে নেয়। আটকুড়ি ব্রজবালার কথা সকলেই জানে। স্বামীর অসুখ বলে তো সে রানীমার মঞ্জুরই নিয়ে রেখেছে-মাছটা, দুধটা, ভালো খাবারের একটু বেশি বাড়িতে নিয়ে যাবেই। কিন্তু, না, তার স্বামীকেও সে দিতে পারবে না এই কাবুলী-মেওয়া। স্বামী তাকে কী ভাববে? চোখে জল এসে গেলো তার। না, শেষ পর্যন্ত লুকিয়ে লুকিয়ে একাই খেতে হবে, এখানে অন্ধকার হলেও ফেলে দেওয়া যায় না। কারো চোখে পড়বে কাল। আর সোয়াদে অর্মত্য।

কিন্তু তা কি পাপ, যা তার মনে আসছে? সুন্দরীর জিভে পাপ আছে। পরিচারিকা বিবাহিতা। সে জানে পুরুষের কামনা কখনো কখনো একটা কোমল স্নিগ্ধ প্রার্থনার মতো। সুকুমার সুবেশ রাজকুমারের যদি তেমন নিঃশব্দ অনুরোধ-পরিচারিকা হাঁপাতে লাগলো। আছি, ছি-ছি, না।

রাজু যখন স্নান করে ফিরলো অন্ধকার গাঢ় হয়েছে বলেই যেন ঘরের দেয়ালগিরিগুলিকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

এখন আলগা জামার উপরে শাল! এখনই স্নান করে এসেছে ঠাণ্ডায়, মুখটা লালচে দেখাচ্ছে দাড়ি সত্ত্বেও। এখন তাকে কি একটু অন্যরকমই দেখায়–আট-দশ মাস আগে যারা দেখেছে তাদের চোখেও আট-দশ মাস আগে কুড়ি ছিল না, এবার কুড়ি পার হলো!

রূপচাঁদ এসে জিজ্ঞাসা করলো ডেস্কের আলোটা জ্বেলে দেবে কিনা?

না। বলে রাজু খাটের দিকে এগিয়ে গেলো। বললো–আর কিছু দরকার নেই এখন।

রূপচাঁদ চলে গেলে সে ভাবলোকিংবা আরও স্পষ্ট করে বলতে হলে তার এই কথাটা মনে হলো–নয়নতারা ফিরেছে। কথাটার আগে এবং পরে যেন আর কিছু নেই।

ডেস্কের সামনে চেয়ার টেনে সে বসলো। যেন তার জাকুটি চিন্তায় কুটিল হবে, কিন্তু সে হাসলো। দু-এক মিনিটেই উঠে গিয়ে পিয়ানোর ডালা খুলে টুলের উপর বসলো। ডানার ভিতর দিকে একটা খাপে স্বরলিপি। কয়েকখানা বার করে কোলের উপর রেখে উল্টেপাল্টে দেখলো। ভাব দেখে মনে হলো কোনোটাই যেন তার পছন্দ হচ্ছে না। অথচ এগুলো তার খুবই পছন্দের জিনিস।

ব্যাপারটা যেন এই রকম : সদ্য স্নানশেষে শরীর থেকে যে সারাদিনটাকে সে সরিয়ে দিতে পেরেছে সেটাই তার বন, রৌদ্র, জনতা, উত্তাপ, ক্লান্তি, মৃত হরিণ, তার ব্যথা সব নিয়ে যেন তার শরীরের বাইরে অথচ মনের সামনে এসে পড়েছে। বাজানো যায় পিয়ানোতে সেই অনুভূতি? এদিকে ওদিকে এ-ঘাট ও-ঘাটে ঘা দিয়ে দিয়ে সে অন্যমনস্কের মতো শব্দঝঙ্কার তুলো, যার সবটুকু তার নিজের কানেও ধরা দিলো কিনা বলা কঠিন।

তারপর সে কিছু ভেবে স্থির করে নিলো। বেশ কিছুদিন আগে নয়নতারা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলো, সে বোধ হয় তার কাশীনা কোথায় যাওয়ারও কিছুদিন আগে, সে তখন বাজাচ্ছিলো। হাতে লেখা স্বরলিপির পাতাগুলো আবার কোলের উপরে নামালো সে। উল্টে উল্টে দেখতে দেখতে সেই ঝঙ্কারগুলো যেন স্মৃতিতে ফিরলো, স্কোর শীটটাকে খুঁজে পেলো সে। ডালার খাঁজে সেটিকে বসালো, ডাইনে থেকে বাঁয়ে চেয়ে যেন সবগুলি ঘাট দেখে নিলো এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত।

বাজাতে শুরু করলে অবশ্য সমস্ত মনটাই বাজনাতে রাখতে হয়। প্রায় মুখস্থই পাতাখানা, পিয়েত্রো যা বলেছিলো তাও মনে আছে :এদের সম্বন্ধে কখনই অতি সাহস দেখাবে না; তা হেন্ডেল, অথবা বাখ যে-ই হোন। নোটেশন সামনে রাখা চাই।

চারিদিক স্তব্ধ। পিয়ানোর সুর সে স্তব্ধতায় অনেকটা দূর দূর ছড়ায়। কেউ যদি অনুমান করে রাজবাড়ির বাইরে দেওয়ানের কুঠিতে বসে হরদয়াল তা শুনতে পাবে কিংবা পাচ্ছে তাহলে সে অনুমান অন্তত অযুক্তির হবে না।

.

১১.

রূপচাঁদ রাজকুমারের ঘর থেকে বেরিয়ে রানীর মহলের দিকে চললো। ঠিক এখন আর তার কোনো কাজ নেই। তাছাড়া কেউ তাকে কিছু করতেও বলেনি। তবু পায়ে পায়ে সে রানীর ঘরের দিকে এগোলো। চলতে চলতে তার মনে হলো একটা কাজ সে করতে পারে–নয়নঠাকরুনের সঙ্গে দেখা হলে তাঁকে খবর দিতে পারে রাজকুমার শিকার থেকে  নিরাপদে ফিরে এসেছেন।

দুটো অলিন্দ যেখানে মিশেছে সেখানে তাকে থেমে দাঁড়াতে হলো। রানীমার ঘরের থেকে একটা আলোর বৃত্ত দরজার বাইরে এসে পড়েছে। এদিকে পাশে সিঁড়ির উপরে বড়ো হিংকসের লণ্ঠন। সে আলোও একটা বৃত্ত তৈরি করেছে। বৃত্ত দুটি যেখানে পরস্পরকে ছেদ করেছে সেখানে একটু আগে পিছে তিনজোড়া পা লক্ষ্য করলো সে। আলো বড়োজোর হাঁটু পর্যন্ত উজ্জ্বল। উপরের দিকে তিনজনেরই প্রায় একই রকম চাদরমোড়া ঘোমটা-দেওয়া আকৃতি। কিছু যেন রঙের তফাত চাঁদরে-তার কোনটি কাশ্মীরি শাল, কোনটি আলোয়ান তা ধরা যায় না।

রানী বললেন (অনেক দূর থেকেই এই গলা রাজবাড়ির লোকেরা ঠাহর করতে পারে, যদিও তা কখনই উঁচু নয়) নয়ন, ইচ্ছা তো একটা শক্তি, তোমার কী মনে হয় যে অন্যের যা আছে তার উপরে লোভ থেকেই ইচ্ছার জন্ম, আর অন্যের যা আছে তানা-দেখলে লোভ জন্মায় না?

রানীমা বোধ হয় হাসলেন নিঃশব্দে। রূপচাঁদ আন্দাজ করলো, নতুবা নয়নঠাকরুণের হাসি শোনা যেতো না। উঁচু গলার না-হলেও কথায় হাসি জড়িয়ে থাকলে তা বোঝা যায় বৈকি।

-আমি কিন্তু সব ইচ্ছাকেই পরশ্রীকাতরতা বলিনি। তাছাড়া সদরদরজার পুরনো চেহারা ভেঙে নতুন নকশায় যা হচ্ছে তাতে অন্য কারো দরজা দেখে আপনার লোভ এমন নাও। হতে পারে। কবি-কল্পনা বলে কিছু আছে। যদিও দুপুরের লাঞ্চে খাওয়ার যে বর্ণনা শুনলাম। হয়তো একদিন আমাদের সেসব নানাবিধ মদ্য ও খাদ্যে লোভ হতে পারে।

রানী হেসে বললেন–দুষ্টু মেয়ে, তোমার কথায় মনে হবে লোভ যখন অসমর্থ তখন তা পরশ্রীকাতর হয়ে পড়তে পারে। কিন্তু নয়ন,সত্যি ভেবে দেখো কথাটা কতটা আমাদের সত্যিকারের অভাব আর কতটুকু তা বণিকের তৈরি।

রানীমা, হিংকসের হারিকেন দেখা দেবার আগেও আলোর অভাব ছিলো। তা হয়তো প্রদীপ, মশালে মিটতো। কিন্তু হিংসের হারিকেনে যদি তার চাইতে ভালো মেটে তাহলে বণিককে দোষ দেবো কেন?

রানী বলতে শুরু করলেন–সত্যিকারের অভাবটা হবে সত্যিকারের মানুষটার। তার তেমন চোখ নেই যে প্রদীপ আর লণ্ঠনে তফাত বোঝে। কিন্তু হঠাৎ এক কৌতুকবোধে। তিনি হেসে উঠলেন। বললেন–জানো নয়ন, কায়েতবাড়িতে নাকি নকল পাথুরে তৈজস ব্যবহার হবে। নাকি চীনামাটি বলে। বিলেতে নাকি তৈরি। শুনে নায়েবমশাই খোঁজ করেছিলেন যদি রূপোর কিছু তৈজস দরকার হয়ে থাকে। দূর করো। রূপোর দামেই নাকি সেসব চীনামাটি।

রানীর অন্য সঙ্গিনী বললো–আপনি তো হাসতে হাসতেই মঞ্জুরি দিলেন। -ওটা আমরা আলোচনা করি না,বলে রানী আবার হাসলেন। বললেন আবার–যাকগে, খুব কথা তুলেছে, নয়ন, পারো তো দুএকদিনের মধ্যে আবার এসো। তোমার বিদেশবাসের গল্পই শোনা হয়নি। সাবি, তুমি কি একা পারবেনয়নকে পৌঁছে দিতে। আচ্ছা,না হয় রূপচাঁদকে দ্যাখো। আমরা এখানে দাঁড়াই।

রূপচাঁদ খুক করে কাশলো। সাড়া দিলো, সে এসে পড়েছে। হিংসের লণ্ঠনটা যে নয়নতারাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে তা বোঝা গেলো।

রূপচাঁদ আগে আগে চললো। এই সময়ে কথাটা তার অনুভূতিতে এসেছিলো। একটু পরিবর্তন হয়েছে। আগেও নয়নঠাকরুন ঠাকুরানীদের মতোই ছিলেন। কিন্তু যেন ঘরোয়া, লক্ষ্মীঠাকরুন যেন। আসলে হয়তো এখনো তেমনি মিষ্টি করে হাসেন। কিন্তু চেহারা হাল্কা হলে কী হয় যেন চালির মধ্যে দুর্গা। হয়তো এ কয়েকমাস ছিলেন না বলেই ধরা পড়ছে। কতকটা যেন রানীমার মতো হয়ে উঠতে লেগেছে।

লণ্ঠন হাতে রূপচাঁদ। পিছনে নয়নতারা। নিজের বাড়ির দিকে চলতে চলতে নয়নতারা ভাবলো : অন্যের যা আছে তা দেখে তাকে পেতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু এটার অন্য দিক আছে। কাব্য তো সকলেই দেখে, পাঠ করে, কিন্তু সকলেই কি কবি হতে চায়? ইতিহাসের গল্প অনেকেই শোনে, কিন্তু বালক বয়স পার হলে সকলেই কি রাজা হতে চায়?

 ০৩. রাজচন্দ্র বললো

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

০১.

রাজচন্দ্র বললো–কেট, ডার্লিং, রবিবার কথাটা শিখলাম তোমরা গ্রামে আসার পরেই। জানলাম সেটা সপ্তাহের প্রথমে না এসে শেষে আসে, বিশ্রামের দিন হয়ে। কিন্তু হায়, দ্যাখো, রবিবারেই তোমার কর্তা কর্মব্যস্ত। ইতিমধ্যে শিব স্থাপন দশদিনের পুরনো ব্যাপার।

-আপনার কি কাজ ছিলো, রাজকুমার? কেট বললো।

রাজকুমারের কাজ থাকে এ-সংবাদ তোমাকে কে দিয়েছে মনস্বিনী?

ডেস্কের উপরে একগোছা খবরের কাগজ। পায়চারি থামিয়ে রাজচন্দ্র কাগজের গোছাটাকে কোলের উপরে তুলে নিয়ে একবার ডেস্কের উপরে পা ঝুলিয়ে বসলো।

স্থানটা হেডমাস্টার চন্দ্রকান্ত এভুজ বাগচীর বসবার ঘর। তখন রবিবারের সকাল আটটা হবে।

কেট বললো– হেসে-ওটা কী সম্বোধন হলো?

-কোনটা? মনস্বিনী? ওর মানে তুমি এক মনের অধিকারিণী। রূপসী বলে সম্বোধন করলে কেউ আপত্তি করতে পারে, তাই মনকে সম্বোধন। কিন্তু এই কাগজগুলো কী? কীই-বা লেখে তা বলো বরং।

কেট সেলাই-এর ঝুড়িতে উলকাঁটা রেখে রাজুর দিকে চাইলো। সে উঠে রাজকুমারের। কাছে এসে দাঁড়ালো। ঠিক এই সময়ে সদরদরজায় বাঁধা রাজকুমারের ঘোড়া হুঁডই করে নাক ঝাড়লো। তার সাজ-লাগামের মৃদু শব্দ উঠলো।

তা শুনে হাসিমুখে বললো– কেটকী চঞ্চল!

রাজকুমারের দিকে চেয়ে তার কিন্তু একটু অবাক লাগলো। ন-দশ মাস পরে সে আবার রাজচন্দ্রকে দেখছে কাছে। ইতিমধ্যে বোধহয় সে আর একদিনই দেখেছিলো তাকে। জানলায়। পথের ধার ঘেঁষে কী যেন ভাবনা নিয়ে চলেছিলো রাজকুমার। অন্যদিকে, রাজচন্দ্র নিজে কেটদের বাড়িতে না এলেও বাগচী গত একমাসে অনেকদিনই রাজবাড়িতে গিয়েছে। সন্ধ্যায়। তার অনেকগুলিই রাজকুমারের বৈঠকখানায় কেটেছে তা কেউ জানে। কথাটা। এখানে এই : কিছু সময়ের ব্যবধানে দেখে অবাক লাগছে আজ। পাহাড়ী শহরে হাওয়া। বদলে এলে পরিচিত লোককে এমন দেখায় নাকি? গাঢ় হয়েছে রংটা। সরু জুলফি দাড়ি চিবুকের নিচে ছোটো এক ইম্পিরিয়ালে মিশেছে। অনুমান, মানুষটিও বেশ কিছুটা উচ্চতায় যেন বেড়েছে। এসবেরই এই কারণ হতে পারে, যেমন বাগচী বলেছে, যে দিনের বেশির ভাগ সময় রাজকুমারের মাঠে জঙ্গলে কাটে শিকারের খোঁজে অথবা নিছক ঘোড়া ছুটিয়ে। কিংবা সময় কাটে উত্তর-পশ্চিম সংযুক্ত প্রদেশে বেড়িয়ে।

-কিন্তু এগুলো তো পুরনো কাগজ। বললো– কেটরাজবাড়ি থেকেই এসেছে।

–তা হোক না। কিংবা বলো কী ভাবছো অমন গাল লাল করে?

কই, কোথায়? কিংবা যদি বলি অনেকদিন পরে দেখছি, এখন রাজকুমারকে আরো সুন্দর দেখায়। কিন্তু এখন কাগজ থাক। তার চাইতে বলুন কর্তার খোঁজ কেন?

–এই দেখ, পুরুষের কত দরকারীকথা থাকে। বললো– রাজকুমার। একটু পরেই আবার হেসে বললো, তাই বলে তুমি ব্যস্ত হয়ো না। এখন এখানে নিছক আড্ডা। আড্ডার খোঁজেই এসেছি।

-সে তো রোজ সন্ধ্যাতেই হয়।

–রোজ নয়, সুভগে, মাঝে মাঝে বলতে পারো। তাও ইদানীং।

-রোজ হলেও আপত্তি নেই। কিন্তু আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয় কী করেন আপনারা আড্ডায়?

রাজু হাসলো–বলতে পারো খুব ভালো ক্লারাট আর সত্যিকারের টার্কিশ। অথবা তোমার জানাই ভালো, কর্তাকে তোমার বিপথে নিচ্ছি না। আপাতত পিয়েত্রোর স্বজাতি অর্থাৎ ফরাসীদের সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা চলছে। ভারি কৌতুকের, জানো? পিয়েত্রো ফরাসীদের সম্বন্ধে অনেক কথা আমাকে বলতেন, কিন্তু যাকে ফরাসীদের বিদ্রোহ বলে সে সম্বন্ধে দেখছি বিশেষ কিছুই বলেননি।

–আপনার কি সেসব গল্প ভালো লাগতো? অত রক্ত আর শানানো ধারালো গিলোটিন?

-তা জানতে পারলে গল্পটা অত করে শোনার দরকার হতোনা। আমার তো মনে হয়েছে ওটা এক ধরনের ব্যর্থতা। কিছু পুরনো ধারণা বদলেছে। রাজাকে বরতরফ করে ওরা বুঝতে চেয়েছিলো রাজা আর ঈশ্বর এক নয়। কিন্তু তা বুঝতে অত নরহত্যা দরকার ছিলো না। পিয়েত্রো এজন্যই বোধহয় আলাপে আনতো না ওটাকে।

একটু ভেবে আবার বললো– রাজচন্দ্রকার কোন গল্প ভালো লাগবে তা কি আগে বলা যায়? বেশ লাগে তোমাদের রাজা চার্লসকে। তোমাদের রাজা চার্লস আর ফরাসীদের সেই সব মার্কুইস,কাউন্ট কেউ মৃত্যুভয়ে কাঁদেনি বলেই গল্পগুলো ভালো লেগে থাকবে আমার।

কথাটা শুনে কেট অবাক হয়ে গেলো।

রাজু বললো–তুমি নিশ্চয়ই জানো রানী মারিকে ওর যখন নিয়ে যাবে গিলোটিনে, তখনো কিন্তু তিনি তাঁর সাজপোশাকে ত্রুটি করেননি। তারা কেউ কিন্তু বলেননি, যা করেছি ভুল করেছি। সূর্য-ডোবার মতো ব্যাপার নয়? তেমনি ম্লান হয়ে যাওয়া কিন্তু অনেক রঙের মধ্যে। কোনো অনুতাপ নেই।

এসবই আড্ডার বিষয় নাকি আপনাদের। বিষণ্ন শোনালো কেটকে।

–বিষয়টা দুপক্ষের জানা না থাকলে কী আলোচনা হয়? বাগচী বলেন, আমি শুনি। এলোপাথাড়ি প্রশ্ন করেকখনোতার অসুবিধা ঘটাই। ভেবেছো তার সঙ্গে আমার মত মেলে? তার কাছে সব ব্যাপারটাই খারাপ। মানুষকে সমাজের চাপে বিকলাঙ্গ করে দেওয়া হয়েছিলো। তারা যখন চাপ থেকে বেরিয়ে এলো তখন তাদের স্বভাবতই বিকলাঙ্গ সুতরাং কুৎসিতই দেখা গিয়েছিলো। কিন্তু ভেবে দ্যাখো তোমাদের রাজা চার্লস ফরাসীদের রাজা লুই আর এদেশের রাজা বাহাদুর শা-এর মধ্যে কত তফাত! শুনেছি সে বুড়ো। জীবন ভোগ করার কোনো ক্ষমতাই আর নেই। কিন্তু মরতে জানলো না, ছি!–অবশ্য একা বাহাদুর শা নয়। অনেক নকল নবাব, অনেক নকল রাজা কেউ এ শহরে, কেউ অন্য শহরে বৃত্তি ভোগ করছে। জানো কলকাতায় এক ভালো গাইয়ে নবাব আছেন? ভালো ঠুংরি গান?

-যুদ্ধে জয়-পরাজয় আছেই। হেরে গেলে কী করা যায়?

-ও কেট! তুমি রীতিমতো মেয়েমানুষ। রাজু হেসে উঠলো। রাজা সন্ধি করতে পারে, কিন্তু নিজেকে বন্দী করতে দেবে কেন? তাও ব্যবসাদারদের বেনিয়ানের মতো বৃত্তি ভোগ করতে?

কেট বললো–বাহাদুর শা-এর উপরে আপনার ভয়ানক রাগ।

যথেষ্ট, যথেষ্ট। হাসি হাসি মুখে বললো– রাজু-মাঝে মাঝে বরং মনে হয়, অনেকদিন থেকেই মোমভরা নকল মোতির মতো নকল বাদশা ছিলেন দিল্লীর ভদ্রলোকেরা। কী যেন, দিল্লীসে পালাম তক। যেমন অন্য কোথাও কেউ নকল রাজকুমার থাকতে পারে।

কেট রাজুর মুখের দিকে চাইলো।

কিন্তু তখনই আবার বললো– রাজকুমার–অয়ি স্বর্ণলোচনে, গৃহকর্তা আসছেন না, তোমার হাতের সেবা চাই। রাজকুমার তো বটি। এসো এই কাগজটা পড়ো, নয় পিয়ানোর টুলে যাও, এসোনা হয় একসঙ্গে বাজাই, অথবা কী যেন সেই উষ্ণ পানীয়, কফি নয়?

কেট হেসে বললো–হবে রাজকুমার। এই বলে সে ত্বরায় কফি আনতে গেলো।

কেট যতক্ষণ কফি করে আনতে গেলো রাজু উঠে পায়চারি করছিলো। বাগচীর টেবলে এবং শেফে অনেক বই। রাজু হাত দিয়ে না ছুঁয়ে দেখলো। বাংলা হরফের বইও আছে। তার একবার ইচ্ছা হলো উল্টেপাল্টে দেখে কী আছে এসব বই-এ। এতসব লেখা, এ কি লেখকের নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনাই শুধু, না, অন্যের মতামতের সংকলন? অন্যের মত বললেই কীবাসি মনে হয়না? কলকাতায় যেনানা মতের প্রচার চলছে তা নিয়ে একদিন আলোচনা হয়েছিলো–তখন হঠাৎ মনে হয়েছিলো রাজুরকী আশ্চর্য, সকলেই যেন নিজের মত দিয়ে সত্যটাকে ঢাকতে চায়।

সেসব মত দিয়ে জীবনের কোনো গূঢ় সূত্র খুঁজে পাওয়া দূরের কথা, নিজের চারপাশটাকেও চেনা যায় না। ভাবতে ইচ্ছা করে, কিন্তু লক্ষ্য করেছে যে কোন বিষয়ে ভাবতে গেলেই অন্য কারো মত এসে যেন মাঝখানে দেয়ালের মতো দাঁড়িয়ে যায়। অনেকসময়ে মনে হতে পারে সে দেয়ালের গোড়ায় পৌঁছে যাওয়াই যেন চিন্তার ভবিতব্য।

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাজকুমারের জন্য কফিসেট সাজিয়ে আনলো কেট।

রাজু চেয়ারে বসলে কফি করতে করতে সে ভাবলো ভাগ্যে কফিটা সকালেই ভাজা হয়েছিলো। কফি ঢেলে দিয়ে বললো–আপনি বাহাদুর শা হলে কী করতেন, রাজকুমার? আচ্ছা, এখন এত সকাল, আপনার ছোটো হাজির হয়েছে তো? কিংবা রাজকুমার, বাহাদুর শা একা কেন? নেপোলিয়ন কী বন্দীদশা স্বীকার করেননি? কেট পাশের চেয়ারে বসলো নিজের জন্য ছোট্ট একটা কাপ ভরে নিয়ে।

–যা প্রমাণ করা যায় না, বলে লাভ নেই। আমি হয়তো বাহদুর শা-এর চাইতেও নিরেস কিছু করতাম।

-কিন্তু এরকম প্রবাদ আছে, বাঁচতে সবাই চায়। যুদ্ধক্ষেত্রে যার বুকে গুলি লেগেছে সে-ও। কেট হাসিমুখে আলাপটা চালিয়ে গেলো।

পেয়ালা হাতে নিয়ে রাজু বললো–প্রবন্ধটা শুনলাম, কিন্তু যুক্তিতে আমার সন্দেহ আছে। কেট। আঘাতটা যার সত্যি ভয়ঙ্কর, তাই সেই অবস্থায় সে বোধ হয় বাঁচা-মরার কথা ভাবে না। হয়তো জল চায়, সেটা শরীর; হয়তো বলে শীত লাগছে, সেটা শরীর। বর্তমানটাই তখন তার কাছে প্রবল, যদি তার চিন্তা করার ক্ষমতা থাকেই।

কেট বললো–রাজাও তো মানুষ। তারও শরীর আছে। তারও তো ব্যথা লাগে।

রাজকুমার হেসে উঠলো : এতদিন তুমি তাই জেনেছো? রাজা একটা ধারণামাত্র, তার শরীর কোথায়? সব রাজা জানে না, কিন্তু জানা তো উচিত যে রাজা অনেকগুলি মানুষের স্বাধীনতার ধারণা; শক্তির ধারণা। সেটা গেলে রাজাই-বা কোথায়? শরীরটা? তোমাকে একটা খুব গোপন কথা বলে দিই। তরকারি কাটতে কখনো আঙুল কেটেছো? কিংবা রান্না করতে আঙুল পুড়িয়েছো? গলা কেটে গেলে তার চাইতে বেশি যন্ত্রণা হয় না। কিন্তু তাই বা কেন? সকলে কী চায়, আর রাজা কী চায় তার মধ্যে পার্থক্য থাকবে না? সারা জীবন সকলের থেকে পৃথক, আর মৃত্যুর সম্মুখে একাকার তা হয় না, হলে অন্যায় হবে।

রাজুর হাতে কফির কাপ, সামনে কেট, রবিবারের আবহাওয়াই। তবু মুখটা এমন দেখালো রাজুর যে অনুমান হবে, সে অন্তত কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে।

কেট বললো–এটা একটু খেয়ে দেখবেন? এই বলে সে নিজে হাতে একটা পেস্ট্রি তুলে রাজকুমারের হাতে দিলো।

বললো– আবার–শুনেছি লুই-এর রাজত্বে প্রজার কষ্টের সীমা ছিলো না! জনসাধারণ অত্যাচারী রাজার বদলে নিজেদের শাসন চাইছিলো।

-তোমারও তাই মত? কেক দেখে মনে হচ্ছে? কিন্তু বলো তো আবার নেপোলিয়ন অত সহজে সম্রাট হলেন কী করে? তার অধীনে যুদ্ধ করতে গর্ববোধ করেছিলো তারাই যারা ব্যাস্টিল ভেঙেছিলো। সেই প্রজাদের অত্যাচারী এক দলকে সরানোর ইচ্ছা ছিলো। তাদের দোষ দেওয়ার কিছু নেই। তাদের নিশ্চয় নিজের ইচ্ছাকে কাজে লাগানোর অধিকার আছে। অত্যাচার তাদের অমানুষের স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলো, তাদের ঘৃণায় হিংসায় রাক্ষুসে চেহারা ধরা পড়েছিলো। কিন্তু সেটা আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। অন্যপক্ষ কী করেছিলো, যা করলে তাদের মানায় তা করেছিলো কি না আমরা এতক্ষণ তাই ভাবছিলাম। রাজা লুই মরতে জেনেছিলো তা মনে করো আবার।

–তাহলে কি বলবো নেপোলিয়ন লুই-এর চাইতে ছোটো ছিলেন?

দ্যাখো, খটকা আছে। তিনি একবার যেমন নির্বাসন থেকে প্যারিসে ফিরেছিলেন শেষ পর্যন্ত আবার তেমন ফেরার আশা করেছিলেন হয়তো। ওদিকে ইংরেজরা যে তাঁকে সেঁকো বিষ দিচ্ছে তা জানতে পারেননি। আমার মনে হয়, ইংল্যান্ডে তখন রানী না থেকে রাজা থাকলে এমন কাণ্ডটা ঘটতো না।

–কি সর্বনাশ!

-কোনটি? সেঁকো বিষ, না মেয়েলি চক্রান্ত? দ্যাখো সেঁকো বিষের কথা বাগচী বিশ্বাস করেন না। আমি করি, কারণ পিয়েত্রো বলেছে বলেও বটে। রাজু হাসলো। বললো, আবার–দূর করো ইতিহাস। তুমি কি মনে করো আড্ডাটা আমাদের পাঠশালা? সেখানে ক্লারাট নেই? আর এখানে তুমি ক্লারাট-গ্লাসের চাইতেও মনোহরা, তোমার কফি এবং পিঠেও। তুমি বোধহয় এদেশী পিঠে খাওনি। এই শীতকাল, নয়নতারার এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

শুনলাম তিনি গ্রামে ফিরেছেন।

এসেছেন? আর একটু কফি দিই? কেটের মুখ উজ্জ্বল হলো।

–অবশ্যই নয়। বরং ডেস্কে চলো। তোমরা কি ভেবে দ্যাখোনা, কারোই দৃষ্টি নেই যে, কিছুদিনের মধ্যেই এ গ্রামের বইপড়া লোকেরা তোমার স্বামীর স্কুলের কল্যাণে অনায়াসে আমাকে মূর্খ বলতে পারবে। বুঝতে পারছি তুমি আমার প্রেমিকা নও।

-তা আমি জানি। কেট বললো– নতুবা নয়নঠাকরুন যতদিন ছিলেন না তখন অন্তত একবারও দেখা পেতাম। বরং উল্টো।

কেট হাসলো। হাসতে গিয়ে কি তার গালে রং লাগলো? আর সেজন্যই যেন এক মুহূর্ত আগে সে যা ভাবছিলো কথার আড়ালে তা অবিশ্বাস্য হলো। স্বভাবতই চিন্তাটা মাতৃভাষাতেই হয়। কিংবা তাকে চিন্তা না বলে অনুভূতি বলা সঙ্গত, একটা অনুভূতি যা শব্দের আকৃতি নিচ্ছে। হঠাৎ কথাটা মনে এসেছিলো কেটের নিজের ভাষাতেই-সিড অব ডেথ। এখন আবার রাজকুমারের মুখের দিকে চেয়ে তার মনে হলো তা কি হয়? মৃত্যুর বীজ কি এমন একজনে লুকিয়ে থাকে?

রাজচন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কের দিকে গেলো। তাতে যেন ঘরের আলোটা নড়ে উঠে উজ্জ্বল হলো।

কেট তখন ভাবলো পরের ভাবনাটা। এই যে রাজকুমার বললেন লেখাপড়ার কথা–এর মধ্যে সত্যি কি গ্লানি আছে? গ্রামের কথাই নয়। কলকাতাসমেত গোটা দেশটাকে একটা সমাজ মনে করলে আধুনিক মানুষদের বই পড়াটাই একটা লক্ষণ। রাজকুমার পড়েন না। কিন্তু এ বিষয়ে তুমি নিশ্চিত কিছু বলতে পারোনা। কথাগুলো কী তার ক্ষোভ প্রকাশ করে? কিংবা সিনিসিজম? যেন কোনো বিষয়েই আস্থা নেই। সেজন্য সবকিছু এমনকী নিজের অস্তিত্বও ঠাট্টার বিষয় হতে পারে।

-আচ্ছা, রাজকুমার, এই বলে সে থামলো। কথাটা গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলো, সুতরাং একটু চেষ্টা করে হেসে বললো, আর কী বলবে আমার স্বামীর ছাত্রেরা?

ডেস্কের সামনে দুখানা চেয়ারে বসলো দুজনে।

কী বলবে? রাজকুমার! আমাদের জমিদার অন্য জমিদারের চাইতে ভালো। রাজচন্দ্র ভাবলো, কেটের জানার কথা নয় জমিদার জাগীরদারে কী তফাত থাকতে পারে, আর এখন তফাতও নেই। এ ভাবটাকে বরং তাড়াতাড়ি অন্য কথার আড়ালে ফেলে দেওয়া ভালো।

সে বললো–বেশ, বলুক। এখন তুমি বলো লাঞ্চো কাকে বলে?

–আর, রাজকুমার!

-ঠিক বলিনি তবে? আমার কী হবে? ওদিকে শুনেছিকলকাতায় যেতে হবে কিছুদিনের মধ্যে যেখানে নাকি ওসবই ব্যবস্থা। আমার অবস্থাও দেখছি তাহলে ডানকানের মতোই। সে শুনেছি মনোহরকে মানোআর কালীমাঈকে কুল্লিমাদার, বাঈকে পাই বলে।

-ঠিক শিখলেই বা দোষ কী? কথাটা লাঞ্চ আর এটা ডেস্কো নয় ডেস্ক।

–আর এই কাগজটা টাইমেস নয় টাইমস। অগ্রসর হও। কিংবা থাক। লাঞ্চোর বয়ান একদিন আমাকে শুনতেই হবে, দু-দুবার বড্ড বেশি হবে। কাগজটাই পড়ো।

-কিন্তু কাগজটা তো অনেক পুরনো।

–হায়, বরাননে!

কাগজটা টাইমসই বটে। কেটের বাড়িতে নতুন। হরদয়ালের কাছ থেকে কালই মাত্র সংগ্রহ করেছে বাগচী। এবং তার মূলে লাঞ্চে কীবলের আলাপ। অন্যদিকে কাগজের তারিখটা ছ মাসের পুরনো। ইংল্যান্ড থেকে আসতেই তো সময় নিয়েছে।

এখানে একটা চমৎকার যোগাযোগের ব্যাপার ঘটে গেলো। কাগজের প্রথম পাতার ডান দিকে বিশেষ টাইপে একটা সংবাদ। রাজচন্দ্ৰ আঙুল দিয়ে সেটাকে দেখিয়ে বললো–এখানে নিশ্চয় কিছু মজার খবর থাকবে। ফ্লোরেন্সের খবর নাকি? বাগচী বলছিলেন ফ্লোরেন্স নাকি ভাস্কর্যের পীঠস্থান। সেটা কী ইংল্যান্ডের কাছে? নাকি নাইটইনজেল। দ্যাখোদ্যাখো ঠিক পড়লাম নাকি।

কেট রাজুর কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে কাগজ দেখতে শুরু করলো। সে অবাক হলো। নামটা সে-ও এই সেদিনমাত্র শুনেছে কীবলের মুখে। কাগজ খুলে তারই সংবাদ পাওয়া। যাবে ভাবতে অবাক লাগেনা? খবর ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের। অন্যদিকে এতে বিস্ময়ের কী বা আছে! প্রায় ছয় মাসের কাগজ একত্রে। তখনকার ইংল্যান্ডে দু মাসে একবারও ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল সম্বন্ধে ছোটো বড়ো কোনো সংবাদ থাকবে না এমন সম্ভব ছিলো না।

-লও, পড়ো–বলে রাজু কাগজটা কেটের হাতে দিলো।

কেট কাগজ নিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। অবাক হলে যেমন হয়, মনে মনে পড়তে ভুলে গেলো। পোপোজ্যাল ফর ওপনিং এ ট্রেনিং স্কুল ফর নার্সের্স আট সেন্ট টমাসেস হসপিট্যাল। (সেন্ট টমাসের হসপিটালে নার্সদের জন্য ট্রেনিং স্কুল খোলার প্রস্তাব)।

বাংলায় বলো। বললো– রাজু।

কেট পড়ে বাংলায় অর্থকরে সংবাদটাকে এইরকম দাঁড় করালো। ক্রিমিয়ার অভিজ্ঞতার পর এই ধরনের প্রস্তাব যা মিস নাইটিঙ্গেলের দূরদৃষ্টি ও সাহসিকতার পরিচয় এবং একমাত্র তার কাছে থেকেই আশা করা যায়। এ বিষয়ে এ রকম মনে করা হচ্ছে স্যার সিডনি হার্বাটের সহানুভূতি পাওয়া যাবে। কবি আর্থার ক্লাপ এ বিষয়ে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। সেন্ট টমাসের এই ট্রেনিং স্কুল যে গোটা পাশ্চাত্য জগতের হসপিটালে নার্সিং-এর ব্যাপারে আমূল পরিবর্তন আনবে তাতে সন্দেহ নেই। মে-ফেয়ারের এই মহিলার অন্যান্য ব্যাপারে যেমন দেখা গিয়েছে নার্স ট্রেনিং-এর ব্যাপারেও নিশ্চয়ই অনেক সদ্বংশজা কুমারী এগিয়ে আসবেন।

রাজু বললো– কী রকম হলো ব্যাপারটা? নার্স কারে কয়? খুলে বলল।

সংবাদটা কেটকেও ভাবিয়ে তুলেছিলো, সে বললো–নার্স মানে জানি, কিন্তু ব্যাপারটা আমাকে হতভম্ব করছে। সদ্বংশের এক মহিলার পক্ষে কেন, কোনো সৎ মহিলার পক্ষেই কি নিজের বাবা ভাই স্বামী ছাড়া আর কাউকে সেবা করা সম্ভব? বলুন, তা যায়? আর তিনি কিনা মে-ফেয়ারের মহিলা!

কেট ভাবলো, কীবল তাহলে উল্লেখযোগ্য খবর হিসাবেই ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের নাম করে থাকবে। কিন্তু এ বিষয়ে আলাপ এগোয় না, কারণ রাজু হসপিট্যাল দেখেনি, নার্স দূরের কথা। কেট রাজচন্দ্রকে বোঝনোর জন্য তুলনা দিলো–মনে করুন মিস নাইটিঙ্গেল নয়নতারার মতোই একজন রুচিবতী সুন্দরী মহিলা, যার স্যার সিডনি হার্বাটের মতো একজন শক্তিশালী বন্ধু আছেন।

রাজু হো-হো করে হেসে উঠলো। বললো–তাহলে আমাকেও তো একটা হসপিটাল করে দিতে হয়। সেখানে একা ফ্লোরেন্স, এখানে তুমি আর নয়ন।

রাজু বললো–দ্যাখো আর কী খবর আছে। চীনের খবর নাকি? টাইপিং কী? বিদ্রোহ বলছেনাকি? তাহলে একপক্ষে চীন? অন্যপক্ষে ইংরেজ নাকি? থাক থাক। কী যেন বললে, স্যার সিডনি হার্বাট না কী? তা তিনি আবার কীসের কারবারী? তুলল, না কয়লা?

-সিডনি হার্বাট বোঝা যাচ্ছে মন্ত্রী। তাছাড়া তিনি নাইট; জানেন রাজকুমার, আমাদের দেশে নাইটদের কিন্তু খুব সম্মান।

বটে? আমি শুনছিলাম তোমাদের দেশে কলওয়ালারাও আজকাল নাইট, লর্ড এসব হচ্ছেন।

বারে কলওয়ালা কি মানুষ নয়?

রাজচন্দ্র দুষ্টুমি করে চোখ সংকীর্ণ করলো, বললো–নিশ্চয়ই, আমারই ভুল। নেপোলিয়নও তো একজন সৈনিক ছিলেন মাত্র। তাছাড়া আমাদের দেশেও এখন অনেক নুনের বেনিয়ান, মুদি ইত্যাদি আকছার রাজা হচ্ছেন। কলকাতা আর লন্ডনে একই রীতি দ্যাখো। সেখানেও কি দশশালা?

খবরের কাগজ পড়া আর হলো না। রাজুর কিছু মনে পড়লো যেন। চেনে ঝোলানো ঘড়িটাকে বার করে সময় দেখে আবার তা জেবে ঢোকালো। এটা নিশ্চয়ই আলাপে একটা ছেদ।

রাজচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। বললো–ওটা আমারই ভুল, কেট। তুমিই ঠিক বলেছো। বেঁচে থাকতেই হয়! নেপোলিয়নও অনেকদিন তার সেই মেঘে অন্ধকার দ্বীপে বেঁচে ছিলেন, বন্দী হয়েও, সেঁকো বিষ সত্ত্বেও।

আপাতত আমি বিদায় নিচ্ছি, স্বর্ণময়ী, হেডমাস্টারকে বোলো আজ যে দাবা খেলার কথা ছিলো সন্ধ্যায় তা হবে না। আজ হৈমী তাস খেলবে বলেছে। তাই সকালেই মিটিয়ে নিতে এসেছিলাম।

দরজার কাছে কেট বললল–এখন কোথায় যাবেন?

বিলপাড় থেকে ওদের আসবার কথা। গোটাকয়েক কুমীর নাকি ভারি উপদ্রব করছে। শিউরে উঠলে তো? যদি পাই চামড়াটা তোমাকে উপহার দেবো। এতদিন তো ক্রোকোডাইল নামটাই শুনেছো।

রাজকুমার, ক্রোকোডাইল মানুষের ক্ষতি করে না?

রাজু হেসে বললো–শক্ত চোয়ালে দুসারি ছুরির ফলা। সেই চোয়ালে মানুষকে ধরে জলের তলায় নিয়ে শুধু কি চুম্বন করে?

সদরদরজার আড়কাঠে বাঁধা লাগাম খুলে ঘোড়াটাকে সড়ক অবধি হাঁটিয়ে নিলো রাজু। ঘোড়াটা নতুন। গাঢ় খয়ের রং। আর বেশ উঁচু।

রাজু রাস্তা বরাবর চেয়ে হাসিমুখে ভাবলো, ও ব্যাপারে সে কেটের কাছে ঠকেছে–ওই জীবন-মৃত্যুর কথায়। নির্জন, সব সময়ে মেঘ আর স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ার একটা দ্বীপের কথাই মনে হলো। নিঃসঙ্গ নয়? খুবই নিঃসঙ্গ, নিকটজন কয়েকজন থাকা সত্ত্বেও কেন ঠিক বলা যায় না বটে, কিন্তু বেঁচে থাকতেই হয়। আমাদের চিন্তাভাবনা সত্ত্বেও, জীবনের যেন নিজস্ব একটা টান আছে। মনে হয় যার জীবন আর যে ভাবে তারা এক নয় যেন।

তার মুখের হাসিটা সরে গেলো।

কেট রাজকুমারের পাশে পথের উপরে এসে দাঁড়িয়েছিলো। এমনটা সেবাগচীর জন্যও পারতো না। (সে অবশ্য এটাকে চিন্তাতেও আনলোনা)। ঠিক এ সময়ে সে নিজেকে অত্যন্ত দুর্বল বোধ করলো। সে রাজকুমারকে কিছুতেই বিপজ্জনক কুমীরগুলো থেকে দূরে রাখতে পারে না। কোনো জোরই নেই।

সামনে দিকে চাইতেই সে দেখতে পেলো, একজন তাদের দিকে হনহন করে আসছে। দূর থেকে তাকে ইউরোপীয় পোশাক পরেছে মনে হয়। কারো কারো হাঁটায় এমন বৈশিষ্ট্য থাকে যে তা-ই তাকে চিনিয়ে দেয়।

কেট বললো– রাজকুমার, স্কুলের নতুন ইংরেজি মাস্টারমশায় কী আপনাকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলো?

রাজুও সামনের দিকে চেয়েছিলো। বললো–কে, মিস্টার নিওগি? তিনিই তো আসছেন মনে হচ্ছে। এবং যথারীতি খুবই ব্যস্ত।

কেট বললো–ভদ্রলোক যেন সব সময়েই সময়ের অভাবে বিব্রত।

রাজু হেসে বললো–দুষ্টুমেয়ে, তা তুমি ওঁকে বলতে পারো-আমার এত সময় আছে, তা থেকে ওঁকে আমি বেশ কিছুটা দান করতে পারি।

রাজচন্দ্র সওয়ার হতেই ঘোড়া চলতে শুরু করলো।

কেট ততক্ষণই দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ ঘোড়া এবং সওয়ার অদৃশ্য না হলো। তারপর সে আবার বসবার ঘরেই ফিরলো। এখন তার কাজ আছে বটে লাঞ্চের জোগাড় করতে হবে। তাহলেও একটু বসে নিতে পারে। উলকাঁটার ঝুড়িটাকে সে কাছে টেনে নিলো।

মিস নাইটিঙ্গেলের কথাই কি সে ভাবছিলো? সে আর কোনোদিনই হয়তো ইংল্যান্ডে যাবে না, কিন্তু মে-ফেয়ারের এই মহিলার ব্যাপারটা কিন্তু ভারি কৌতূহলের।

কিন্তু রাজকুমার? (যেন সে ঘোড়া এবং তার সওয়ারকে আবার দেখতে পেলো)। তাঁর কথাগুলো কি আজকের সকালের মেজাজই মাত্র? চার্লস ও নেপোলিয়র মৃত্যু নিয়ে বলা কথাগুলো?

এবার তার মনে এলো যা সে যেন মনে মনে খুঁজছিলো। বিষণ্ণ হলো তার চোখ দুটি। সত্যি কি তা মৃত্যুর বীজ হতে পারে?

সিড অব ডেথ যার ইংরেজি হবে? যা রাজকুমারের মনে আছে?

কেটের এখন মনে হলো রাজকুমার এখন ঘোড়াতেই চলেছেন বটে, তা কিন্তু পথের পাশ দিয়ে, আর অমন তেজী ঘোড়াটাও যেন ধীরে চলেছে।

.

০২.

সেদিন শিকার হয়নি, দিন সাতেক পরের এক সকালে দেউড়িতে বিলমহলের লোকেরা রাজচন্দ্রের জন্য অপেক্ষা করছিলো।

কিন্তু তার আগে আর একদিন সেই একজন বর্ষীয়সী স্ত্রীলোক এসেছিলো রাজবাড়িতে। তার কথা বলে নিতে হবে।

দুপুরের কিছু আগে পিলখানা তদারক করে রাজু তখন সবেমাত্র ঘরে এসেছে। পিয়েত্রোর হাতিকে পিলখানায় আনা হয়েছে এখন। এমন সময়ে রানী তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

নিজের বসবার ঘরে ছিলেন রানী। রাজচন্দ্র যেতেই তিনি একটু সরে বসে নিজের সোফাতেই পাশের জায়গাটাকে দেখিয়ে বলেছিলেন বসো, রাজু।

রানীমার আসনের কিছু দূরে গালিচার উপরে একজন বর্ষীয়সী। রানীমা বলেছিলেন–এই আমার ছেলে রাজচন্দ্র, আমাদের রাজকুমার। কেমন, দেখবার মতো হয়ে ওঠেনি?

অথবা এমন কিছুই বলেছিলেন যদি রাজুর স্মৃতিকে আমরা অনুসরণ করি। রাজু তখন লক্ষ্য করেছিলো রানীর এই আসনটা নতুন। বিঘৎ পরিমাণ সিংহ-থাবা পায়ার উপরে নিচু চওড়া সোফা। চাপা রঙের উপরে সবুজ তুলোর পাতা ও ফুল আঁকা ছিটে মোড়া। এসব নিয়েই ব্যস্ত হলো রাজচন্দ্রের মন, এবং তখনই যেন এই গুরুতর সিদ্ধান্ত করলো সে, এটাও সেই বুড়ো চীনাটার কাজ। কিন্তু ততটা নিচু আসনে রাজুর প্যান্ট পরে বসতে অসুবিধা হচ্ছিলো মনে আছে।

এও রাজুর মনে আছে যে সেই বর্ষীয়সীর কপালের উপরে ঘোমটার বাইরে কিছু চুল ধবধবে সাদা, এবং সেই সাদার মধ্যে মোটা করে দেওয়া সিন্দুর। আর সে সাধারণের তুলনায় স্থূলাঙ্গী হওয়ায় তার চিবুক বোধ হয় যাকে জোড়া চিবুক বলে তেমন ছিলো। কতকটা ধানরঙের ত্বক।

সে ঘরে আরো স্ত্রীলোক উপস্থিত ছিলো। তারা বসেছিলো একটু দূরে বরং দেয়াল ঘেঁষে, গালিচার উপরেই, কিন্তু রাজকুমারের দিকে পাশ দিয়ে। ঘোমটায় মুখগুলি আধাআধি ঢাকা, গায়ে চাদর। স্ত্রীলোক কয়েকটি সুরূপা, তাদের নানা বয়স সত্ত্বেও। বিশেষ করে লক্ষ্য না করলেও তাদের কারো কানের গহনায় উজ্জ্বল পাথর, কারো বা কপালের উপরে লতানো চুলের ঝাপটা, কারো চিবুকের তিল চোখে পড়া স্বাভাবিক।

রাজু লক্ষ্য করেছিলো যেন রামধনুরই একটা টুকরো, যা তার জুতোর উপরে, পাইপধরা হাতের উপর দিয়ে সোফায় গিয়েপড়েছে। সেই বর্ষীয়সী এবং রানী আলাপ শুরু করলেন। রাজু তখন রামধনুর উৎস খোঁজ করলো। এই সিদ্ধান্ত হলো তার, সিলিং-এর বেলদার ঝড়ে সূর্যের আলো পড়েই এমন হয়েছে। চুলের ঝাপটায় নিচে চোখ দুটি নয়নতারার নয়? চিবুকের তিল, যা আঁকা মনে হয়, হৈমীরই হবে।

বোধহয় রানী বলেছিলেন রাজু, তোমাদের স্কুলের নতুন মাস্টারমশাই নিয়োগীর বোন উনি।

রাজু নিজের হাতের পাইপের বউল থেকে ওঠা অলস ধোঁয়াটাকে লক্ষ্য রাখছিলো। আর কী কথা হয়েছিলো সেখানে?

রানী কী বলেছিলেন? -ইনি তোমার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছেন একটি। বোধ হয় এমন কিছু বলে থাকবেন। তারপর তিনি বললেন–তোমার স্নান হয়নি রাজু? হৈম, তুমি একটু দ্যাখো তো।

রাজু উঠে এসেছিলো সে ঘর থেকে।

নিজের মহলের যাওয়ার অলিন্দ দিয়ে চলতে চলতে রাজু একবার পিছন ফিরে চেয়েছিলো। সে দেখেছিলো হৈমী পিছন পিছন আসছে। তাহলে সেই কি কিছুদিন যাবৎ রূপচাঁদের পিছনে থেকে তার স্নানাহারাদির ব্যাপারে তদারক করছে?

রাজচন্দ্র স্নানে গেলে সেই দরবার আরো কিছুক্ষণ চলেছিলো। তারই একসময়ে মহিলাদের একজন বলেছিলো, কনের গড়ন কী রকম? বয়স তো যোলো বললেন। আমাদের হৈম, কিংবা নয়নতারা এদের পাশে কি দাঁড় করানো যাবে? যিনি গেলেন তিনি হৈম, আর ইনি নয়নতারা।

নিয়োগীর বোন বললো– একটু ভেবে–যে বয়সের যা। পনরো যোললা বছরের মেয়ের গড়ন হাল্কা হবে এঁদের চাইতে।

-খুব ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ দেখাবে না তো?

বিদ্যাপতির সেই অল্পবয়সী বালা শুনেছেন তো?

গম্ভীর রানী বললেন–আচ্ছা, এখন এই পর্যন্ত। তিনি উঠলেন। বললেননয়ন, তুমি একটু কষ্ট করো, বাছা। এঁর জন্য পালকি জোগাড় করে দাও। আর তারপর আজ তুমি আমার ঘরে খেয়ো। দুপুরে তোমার সঙ্গে কথা আছে।

রানী চলে গেলে ঘটকীকে নিয়ে নয়নতারা বার হলো ঘর থেকে। দোতলা থেকে একতলায় পৌঁছনোর আগেই একজন পরিচারিকাকে দেখতে পেয়ে পালকির ব্যবস্থা করে ফেলো। বলে দিলো, আমরা নিচের হলঘরে দাঁড়াই। পালকি এলে খবর দিও।

নিচের হলঘরে পালকি আসার আগে ঘটকী বললো–দেখুন তো কী কথা! যোলো বছরের মেয়ে যত সুন্দরীই হোক, আর এ মেয়ে সুন্দরী কিনা তা আপনারা যাচাই করুন, কিন্তু যোলো বছর কখনো পঁচিশের রূপ হয়? কথায় বলে কুঁড়ি আর ফুল।

নয়নতারা হেসে বললো–তাতে আর কী হয়েছে? বিয়েতে লাখ কথা খরচ হয় শুনেছি। রানীমার সঙ্গে আপনার পাঁচশো কথাও হয়েছে কিনা সন্দেহ। আপনি কনের চিত্র পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।

ঘটকী বললো–আসল ব্যাপার কী, টকটকে একটা লাল গোলাপ সব পুরুষের চোখেই পড়ে, তার পাশের ছোটো কলিটা তখন নজরে আসে না। কিন্তু আমাদের রাজকুমার তো বছর বিশ বাইশ হবেন। যোলোর বেশি কী করে মানাবে তার সঙ্গে? পুরুষের বিশ বাইশ আর স্ত্রীলোকের পঁচিশ-ছাব্বিশে তেমন তফাত থাকে না। কিন্তু পুরুষের ত্রিশ আর স্ত্রীলোকের তেত্রিশ-চৌত্রিশে? তখন তফাতটা আগের চাইতে বেশি মনে হয় না? তারপরেও পুরুষের যখন চল্লিশ তখন চুয়াল্লিশ বছরে স্ত্রীলোক তো বৃদ্ধা হয়ে গিয়েছে। সে কী চল্লিশ বছরের পুরুষের কাছে বোঝা হয়ে পড়ে না?

নয়নতারা বললো–এসব আমি ঠিক বুঝি না।

ঘটকী হেসে বললো–তাহলেও, রানীমা, আপনার কথাকেই মূল্য দেন আমার মনে হলো। কথাটা ভেবে দেখুন। এই হৈমীসুন্দরী, খুব সুন্দরী, আহা বেচারা বিধবা। এমন রূপ রাজকুমারদের পাশেই মানাতো। আমি শুধু মানানোর অর্থে বলছি। কিন্তু এখন থেকে বিশ বছর বাদে চল্লিশ-বেয়াল্লিশে আমাদের এই রাজকুমার তো যুবকই থাকবেন। কিন্তু হৈমীর মতো একজন কী তখন পাপড়ি ঝরে-যাওয়া ফুলের মতো হবেন না?

যেন নয়নতারার মুখই শুকিয়ে উঠেছিলো। এমন অনুভব করেই সে বললো–আমি তো বললুম আমি বুঝি না। আর রানীমার কাছে আপনার এসব যুক্তিও আমি তুলতে পারি না। এ বাড়িতে তেমন প্রথা নেই।

ঘটকীর কথাগুলি অত্যন্ত হিসাবী, যেনবা দোকানে শোনা যাবে এমন। কিছুদিন আগেও, সেসব গল্প যদি সত্যি হয়, ক্রীতদাসী বিক্রি হতো। সেই বাজারে যাদের আনাগোনা ছিলো তারা এমন সব হিসাব করতে কিনা ক্রীতদাসীদের বয়স নিয়ে তা বলা সহজ হচ্ছে না। সত্যর মতো এমন রূঢ় আর কী?

.

০৩.

সে যাই হোক, আমরা রাজকুমারের কুমীর শিকারের গল্প বলতে যাচ্ছিলাম। কেটকে এক রবিবারে যা সে বলে এসেছিলো। আজ আবার রবিবার।

সংবাদটায় ভুল নেই। বেশ বড় কুমীরই। বিলে মানুষ নামে জলের জন্য, স্নান করতেও; মাছনা ধরলে চলে না; তাছাড়া গোরু বাছুর বিলের মাঝে মাঝে জেগে থাকা ডাঙায় ঘাসের লোভে জল পেরিয়ে যাওয়া-আসা করে। যা রটেছে তা সত্য হলে পাঁচ-সাতটি গোরু-বাছুর খোয়া গিয়েছে ইতিমধ্যে এবং একজন মানুষ।

রাজচন্দ্র কর্মচারীটিকে বললো–এদের যেতে বলে দাও, জলযোগ করিয়ে দিও। পিলখানায়, পিয়েত্রোর হাতিটাকে দিতে বলো তার মাহুতকে। আজই কাজে লেগে যাক।

রাজচন্দ্র যখন নিজের মহলে ঢুকছে তখন দেউড়ির পেটাঘড়িতে এগারোটা বাজতে শুরু করলো। শব্দ তার উৎসর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে । কিন্তু ততক্ষণে রাজু যেখানে পৌঁছেছে সেখান থেকে দেউড়ি চোখে পড়ার কথা নয়, বরং শব্দটা খুঁজতে গিয়ে একটা টুকরো গোলাপী দেয়াল চোখে পড়লো তার। এটার প্রয়োজনীয়তা কী? এটা ছাড়া কি এতদিন ল্যান্ডিংটাকে ন্যাড়া মনে হতো–এই চৌকোন খাড়া দেয়ালটা ছাড়া? এটা নতুন দেখছে সে ফিরে।

শোবার ঘরে ঢুকলো সে। পেটাঘড়ির শব্দ তাকে অন্যমনস্ক করেছিলো। সম্ভবত সেজন্যই ব্যাপারটা ঘটলো। সে যখন দেয়াল-আলমারি খুলে গুলির বেল্ট একটা বেছে নিয়েছে তখন তার চোখে পড়লো পালঙ্কের ওপারে ফ্রেঞ্চ উইনভোটা খোলা, তার ওপারে ঝুলবারান্দায় কেউ যেন দুহাতে কান চেপে ধরে ঘরের দিকে পিছন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো ঝি কি? কিংবা হৈম? এই ভেবে সে চোখ সরিয়ে নিতে গেলো, কিন্তু মস্ত এলোখোঁপা, এবং খোঁপার নিচে সাদা ঘাড় তাকে আকৃষ্ট করলো। আর ডালিমফুলী শাড়িটাও। রাজুর বুকের ভিতরে—

রাজু তাড়াতাড়ি আলমারির পাল্লা বন্ধ করলো। বললো–ও, তা, শব্দটা কি এখনো লাগছে কানে?

যে মুখ ফিরালো সে নয়নতারাই বটে।

হাসি হাসি মুখে সে বললো–আপনাকে দেউড়িতে দেখেই এসেছিলাম, রাজকুমার। ঝুলবারান্দায় এসে পুকুরে মাছধরা চোখে পড়লো। ঘড়ির ওই রাক্ষুসে শব্দ না-হলে পায়ের শব্দ কানে যেতো।

রাজচন্দ্র ঝুলবারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নিচে খিড়কির পুকুরের জলে নৌকো, জাল টানছে জেলেরা। তীরের গাছগুলোর ফাঁকে রোদ। চিল ও বক উড়ছে, মাছ চমকাচ্ছে, মাছরাঙা ঝুপ করে জলে নেমেই উড়ে যাচ্ছে আবার। কিন্তু এই মসলিন ডালিমফুলী!

সেদিকে পিঠ দিয়ে নয়নতারা রাজুর দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালো।

সে বললো–অনেক বেলা হলো। এ পোশাকগুলো এখন পাল্টালে হয় না? তার জ্ব কিছু বাঁকা হলো।

-অহো, বিস্ময়! তুমি কী আমার খানসামাকে বরতরফ করেছো ললনা? কিংবা এই জানলাম হৈমী নাকি তদারক করে। ইতিমধ্যে সে কোথায় গেলো?

-এটা কী রকম হলো? ডানকানের কাছে গিয়েছিলেন নাকি সকালে?

-তার কাছে? রাজু বিস্মিতই হলো। পরক্ষণেই ইঙ্গিতটা ধরতে পেরে বরং হাসিমুখেই বললো–তোমার কি ধারণা একজন রাজকুমারকে সামান্য মদের জন্য নিজের ঘরের বাইরে যেতে হয়! রূপচাঁদ পর্যন্ত জানে ডানকানটা হুইস্কি আর রম ছাড়া কিছু চেনে না।

বলতে চান এমন ভাষাই আজকাল স্বাভাবিক?

–এই দ্যাখো। রাজকুমারের ভাষা একটু পৃথক হবে না?

নয়নতারা যেন নিজেকে সামলে নিলো।

রাজু ঝুলবারান্দা থেকে ঘরে ফিরলো। দেয়াল-আলমারিটা খুললো। র‍্যাকের গায়ে রাখা বন্দুকগুলোর বাড়তি আরো দু-একটা সেখানে। কাগজের কাঠের বাক্সে গুলি। রাজু চামড়ার বেল্টটাতে কিছু গুলি বসিয়ে নিলো।

পিছন পিছন এসে নয়নতারা রাজচন্দ্রকে লক্ষ্য করছিলো। বললো–সময়মতো স্নানাহার করাটাকে কি আজকাল অন্যায় মনে হয়?

রাজু বললো–রূপচাঁদ নালিশ করেছে বুঝি? হতভাগাটার বাড় হয়েছে বিশেষ। ভেবেছিলাম আজ ও সঙ্গে যাবে। ওকে না-নিয়ে শাস্তি দিতে হচ্ছে।

নয়নতারা বললো–আপনি কী শিকারে যাবেন এখন? তা হলে কথা ছিলো।

–শিকার থেকে ফিরে এসে হয় না?

নয়নতারা ভাবলো। তার হাসি হাসি ঠোঁটের একটা কোণ দাঁতের ডগায় চাপা।

সে বললো–অনেকদিনের কথা তো, হয়তো প্রতিশ্রুতিটা মনে নেই।

রাজু একটা বন্দুক বাছাই করে র‍্যাকের কাছে থেকে সরে এসে বললো– বলল কেকয়কন্যা।

সে রুমাল দিয়ে বন্দুকের চোং মুছলো। তেলকালিতে রুমালটা বিশ্রী হতেই অ্যাঃবলে রুমালটাকে মেঝেতে ফেলে দিলো।

নয়নতারা বললো–আজ আমি শিকারে যাবো।

-তুমি? রাজু হাসিমুখে বললো–হা, অনেক অনেকদিন আগে এমন কথা ছিলো বটে। –হো-হো করে হেসে উঠলো সে। সেই পুরনো পরিস্থিতিটাকে মনে এনেই যেন। বললো–কিন্তু, না আজ হয় না, অন্তত।

-এতে আর এমন চিন্তার কী আছে? টোপর-হাওদা দিতে বলুন। আমি রানীমাকে বলে আসি।

রাজচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো সেই ভঙ্গিতে নয়নতারার প্রস্তাব নাকচ করে।

-কিন্তু স্নানাহারও হলো না। একবেলায় কখনো বিলমহলের কুমীর মেরে ফেরা যায় না।

রাজচন্দ্র দরজা পার হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হালকা গলায় বললো–স্নান সকালেই হয়। আর মাঝে মাঝে একবেলা না-খেলে মানুষের ক্ষতির চাইতে লাভই বেশি হয়ে থাকে।

হঠাৎ একেবারে ঘরটা শূন্য হয়ে গেলো এই অনুভূতি নিয়ে নয়নতারা ধীরে ধীরে রানীর মহলের দিকে চলে গেলো।

পিয়েত্রোর বেঁটে হাতিটাকে ওরা হাওদার সাজিয়ে এনেছিলো। কিন্তু পাইপ ধরানোর অজুহাতে রাজু খানিকটা সময় যেন অপেক্ষা করলে প্রথমে গাড়িবারান্দায়, তারপর হাতি যেখানে দাঁড়িয়েছে সেই চবুতরায়। কিংবা রোদটাই কি ভালো লাগলো? অবশেষে সে নয়নতারার চমকে দেওয়া শিকারে যাওয়ার প্রস্তাবের রসিকতাটাকে মনে করে হাসিমুখে হাতিকে বসতে বলার ইঙ্গিত করলো। কিন্তু এবার হাতিকেই একটু দেরি করতে হলো, কারণ তখনই অন্দরমহলের থেকে একটা ছোটো পালকি বেরিয়ে হাতির সম্মুখ দিয়ে আড়াআড়ি পার হচ্ছে। এটা সাধারণ পালকি। সাধারণ কোনো পুরস্ত্রী রাজবাড়ির বাইরে যেতে ব্যবহার করে থাকে। পরে হাতি যখন নিজের পথ নিয়েছে সে ভাবলো একবার, এটা কেমন হয়ে গেলোনা? নয়নতারাকে কুশলপ্রশ্নই করা হলো না। আজই তো প্রথম দেখা হলো কতদিন পরে। কতদিন হবে? গোটা বর্ষাকালটাই নয় কি? এবং শরৎও। আট-দশ মাস কম করেও; প্রায় বছরই ঘুরে আসে।

গ্রামের বাইরে এখন ক্রোশটাক পথ চলে এসেছে হাতি। পথটা এখানে ঘুরে গিয়েছে। একটা ফলের বাগানকে বেষ্ট করে। বাঁশের অনেক কঞ্চি এদিকে এমন ঝুঁকে রয়েছে যে হাওদায় লাগছে। মাহুত ধারালো দা দিয়ে কখনো কখনো পথের উপরে ঝুঁকেপড়া সেই বেয়ারা কঞ্চি কেটেও দিচ্ছে। ফলের বাগানের বেড়া সব সময়ে রাখা যায় না। গাছ বড়ো হয়ে গেলে সেটাকে নতুন করে দেওয়ার চেষ্টাও থাকে না। বাগানের গাছগুলোর নিচে নিচে বরং পায়ে চলা পথ।

একটা হুঁই-হাঁই শব্দ শোনা গেলো একবার। হাতি এগিয়ে চললো। হঠাৎ দেখতে পেলো। রাজু বাগানটার পাশ ঘেঁষে রাস্তা যেখানে মোড় নিচ্ছে সেদিকে একটা পালকি বাগানের গাছগুলোর ফাঁক থেকে বেরোচ্ছে। সেই পালকিটাই বটে। ভাবলো রাজু, রাজবাড়ি থেকে কেউ ফরাসডাঙায় যাচ্ছে পালকিতে। হয়তো তা রানীর শিবমন্দিরের সঙ্গে যুক্ত কোন ব্যাপারে। কিন্তু কিছুদূর যেতে না-যেতেই হাতিকেই থামতে হলো। কী মুশকিল! পালকিটা পথের উপরে নামানো। এমন ছুটে চলেছিলো সেটা যে ইতিমধ্যে শীতের দিনেও গামছা ঘুরিয়ে হাওয়া খাচ্ছে বেহারারা। তাদেরই একজন পথের ঠিক মাঝখানে হাতিকে দেখামাত্র হাত তুলে দাঁড়ালো।

কী ব্যাপার? বললো– রাজু-যেন শীতের রোদে ভিরমি!

কাছাকাছি এসে মাহুত জিজ্ঞাসা করলো বেহারাটি কিছু বলবে কিনা।

বেহারা বললো–হুঁজুরের খাবার আর জল।

খাবার? বিরক্ত রাজু জিজ্ঞাসা করলো।

বেহারাটির মুখ শুকিয়ে গেলো। মাহুত দ্বিধা করতে লাগলো। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই এরকম ভঙ্গিতে রাজু বললো–তুলে লও। বেহারা ভয়ে ভয়ে পালকির দিকে এগোলো। আর ঠিক তখনই পালকির দরজাটাও খুললো।

মোটা একটা রেশমের চাঁদরেই বটে–মাথা, মুখ,কাঁধ ঘিরে ঘেরাটোপের মতোই। কিন্তু নামতে দেখে, দাঁড়াতে দেখে রাজুর সন্দেহ রইলো না। রাজু কিছু বলার আগেই নয়নতারা বললো–মই আনেননি তো? এখন? নাকি হাত ধরবেন?

–কিন্তু

নয়নতারা হাতির গা ঘেঁষে হাত উঁচু করে দাঁড়ালো।

একটু টানাটানি করেই তুলতে হলো। হাতি বসলো। হাতির পিছনের পায়ের উপরে উঠে দাঁড়াতে হলো নয়নতারাকে। পালকি ফিরে গেলো। হাওদার আসনে বসে অবগুণ্ঠন একটু সরালো নয়নতারা। হাঁপাতে হাঁপাতে হাসলো। বললো–বাব্বা, কী ভয় লেগেছিলো!

রাজচন্দ্র বললো–কিন্তু, নয়ন

নয়নতারা তাড়াতাড়ি নিঃশব্দে আঙুল দিয়ে মাহুতকে দেখালো। যেন সে বলতে চায় লোকটির কান আছে, কৌতূহল সেকানকে বরং সজাগ রাখবে। কিন্তু তখনকার দিনে এমন একটা প্রসিদ্ধি ছিলো যে যখন এরা তাড়াতাড়ি নিজেদের মধ্যে একটু বিশুদ্ধ বাংলায় কথা বলে তার সবটুকু বেহারা বা মাহুতরা বোঝে না। আন্দাজ কি করে না? করে, এবং তাতেই তো নানা রূপকথা ও কাহিনীর সৃষ্টি।

কিন্তু কীসের? আমি কি এর আগে কোনোদিন হাতির দশ হাতের মধ্যেও গিয়েছি? আর এ একেবারে তার গায়ের উপরে দাঁড়ানো!

রাজচন্দ্র কিছু ভাবলো।

নয়নতারা বললো–গল্পটা বলবো? টেনে তুলতে পারবেন ভাবিনি।

–তার আবার গল্প কী?

নয়নতারা একটু হাঁপাচ্ছে। সেজন্য ঠোঁটের ফাঁকেও নিঃশ্বাস নিচ্ছে, দাঁতের নিচে জিভের লাল ডগার আভাস যেন চোখে পড়বে। নয়নতারা বললো–ঠাকুমারদের মুখে শোনা। বাল্যবিবাহ খুব খারাপ জিনিস, জানেন? ছোটো ছেলেমেয়েরা ব্রতর কীই বা বোঝে তাই ঠাকুমার দুপাশে বরকনে শুয়ে থাকে। এদিকে তাদের ভারি ইচ্ছা গল্পগাছা করে। একবার সারাদিন দুজনায় পরামর্শ হলো। ধনুকের ছবি দেখেছেন? কাঠের দুকোটি উপরের দিকে বাঁকানো থাকে না? গভীর রাতে ছেলেটি ঠাকুমার গায়ের উপর দিয়ে ধনুকের কাঠটিই এগিয়ে দিলো। মেয়েটি ধনুকের এক কোটির ভঁজ নিজের কোমরের নিচে দিয়ে এমনভাবে রইলো যে ভারটা এদিক ওদিক না হয়। তারপর ধনুকের অন্য ডগা ধরে ছেলেটি ধনুক তুলতে শুরু করলো। কপাল আর কাকে বলে! অনেকটা উঠেছে মেয়েটি, আর একটু তুলে ঘুরিয়ে নিতে পারলেই হয়। মচ করে একটা শব্দ। ধনুকটার মাঝখানটায় ভেঙে গেলো। ঠাকুমারা এমনি ঠাকুমা হয় না। সবই বুঝলো সে। বললো–আউর কুছ দের বা। এই বলে বুড়ি পাশ ফিরে ঘুমো।

রাজু অনুভব করলো গল্পটা আশ্চর্য রকমে বলা হয়েছে। এক মুহূর্ত যেন মাধুর্য অনুভব করে পরে সে হাসলো। বললো–এবার সংগ্রহ করা নাকি?

নয়নতারা বললো–ঠাট্টা মনে করলেন?

না।

–কেমন টেনে তোলার গল্প নয়। উদ্বহন। উদ্বাহ।

সন্দেহ কী? ধনুকের ডগায় কনেকে তুলে আনার শক্তি না-হলে বিয়ে হয়নি মনে করতে হবে। কিন্তু নয়ন

কী?

এদিকে দ্যাখো কী করে ফেলেছো!

বটে?

কারো হাত যে টেনে তোলার মতো শক্ত তা প্রমাণ করে ফেলেছে।

নয়নতারার মুখের খানিকটা রক্তাক্ত হয়ে উঠলো। কিন্তু সে ঝটিতি বললো–সেজন্যই তো ব্রহ্মময়ীর আসা যাওয়া। জানেন, ব্রহ্মময়ী কিন্তু বেশ অঙ্কের ধাঁধা বানাতে পারেন!

–অঙ্কের ধাঁধা?

বেশ একটা কৌতুকের ব্যাপার ঘটলো। ঘটকী ব্ৰহ্মময়ী একটা অঙ্কের হিসাবই বলেছিলো বটে। সেটাই মনে এসেছিলো নয়নতারার। যখন সে প্রায় বলে ফেলেছেন হঠাৎ সম্বিৎ পেয়ে থামলো সে।

-কই, বললে না?

নয়নতারা তাড়াতাড়ি বললো–আচ্ছা, রাজকুমার, আপনি যে একবার পিয়েত্রো বুজরুকের সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন সে কী এই পথ? সামনে ঘাসের জঙ্গল। হাতিটাও পথ চেনে যেন। রাতে যেমন ভূতের গল্প, এ জঙ্গলেও শিকারের গল্প তেমন।

রাজু বলতে যাচ্ছিলো, বাব্বা, কোথায় ঘটকীর অঙ্কের ফাঁদ আর কোথায় শিকারের গল্প, কীসের জঙ্গলটা তারও নজরে পড়েছে। বুজরুক পিয়েত্রোর সঙ্গে সে শিকারে গিয়েছিলো এমনই ঘাসের জঙ্গল পার হয়ে। সে দৃশ্যটা–যা দুটি অত্যন্ত প্রিয় মানুষের স্মৃতিতে জড়ানো তা ভোলার নয়, আর এখন তা মনে করাই হচ্ছে। রাজচন্দ্রর উজ্জ্বল মুখের উপরে একটা হালকা ছায়া পড়লো যেন।

তা দেখে নয়নতারা সময় নিয়ে পরে বললো–বাহ্, আমার শিকারের গল্পটা কী হলো? রাজু বললো–তোমাকে বরং একটা মজার কথা বলি। জানো নয়ন, পিয়েত্রো আর বুজরুক দুজনেই আমার চাইতে বয়সে বড়ো ছিলেন। সুতরাং তাদের কাল আর আমার কাল এক হতে পারে না প্রকৃতপক্ষে। কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়

-কী?

–ঠিক বলতে পারছি না। একালে আমার নিজের ঘরবাড়ি নেই বললে তো ভাষা হয় না।

-বেশ কথাটা তো! চটুল সুরে নয়নতারা বললো। কিন্তু ভাবলো সে। হঠাৎ এসে পড়া এই একটা কথা রাজকুমারের যাতে কোথাও ঠাট্টা নেই। লুকিয়ে রাজুর মুখ দেখবে নাকি? কিন্তু বরং সে মন থেকে বাইরে চলে এলো। বললো–দ্যাখোদ্যাখো রাজকুমার, হাতি ডুবে যাচ্ছে এমন ঘাস। গ্রামের কাছে এমন দেখিনি। এমন ঘাস। ধানও হতে পারে তাহলে।

রাজুর দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়লো। কিন্তু বাস্তবের ধাক্কায় হেসে সে বললো–কেন ধান হয় জানি না। হাত দিও না। ধার আছে ঘাসের। দ্যাখো হাতির গায়ে দাগ পড়ছে। একটু পরে সে আবার বললো–নয়নতারা, আমি কিন্তু তোমাকে কুশল প্রশ্ন করিনি।

–এতক্ষণে বুঝি মনে পড়ছে? ধাক্কাটা সামলে নিয়েছো বলো।

কীসের ধাক্কা? ও! এত গর্ব নাকি রূপের?

নয়নতারা ঠোঁটে আঙুল রেখে চোখের ইশারায় মাহুতকে দেখিয়ে দিলো। বললো–সবার কাছে শুনছি, নাকি বেড়েছে। তাই বললাম।

ঘাসের জঙ্গল কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নও বটে। সামনে কিছুটা ফাঁকা। তাতে ছোটো ঝোপঝাড় কাঁটাগাছ। লতা উঠেই যেন তাকে আরো দর্শনীয় করেছে।

রাজু তাড়াতাড়ি বললো–ওটা কি খদির, কবরেজ মহোদয়া?

-খয়ের? তাই কী? নয়নতারা বুঝতে পারলো রাজকুমার আন্দাজ করছে কবরেজি শিখতেই সে এতদিন গ্রামের বাইরে ছিলো। সে কি নিজেই বলতে পারে স্পষ্ট করে কেন সে দূরে চলে গিয়েছিলো? সে তাড়াতাড়ি বললো–আচ্ছা রাজকুমার, না-হয় এক কাজ করুন, আপনার এদিকের তহশীলটাই না-হয় আমাকে পত্তনি দিন। শুনেছি এদিকের তহশীল কাছারি নাকি একটা ভালো বাংলো। সেটাই পত্তনিদারের বাড়ি হতে পারবে। দিন না।

রাজু বললো–শুনেছি, উচ্চ অভিলাষ মহত্ত্বের ভিত্তিভূমি। আমি ভুল করেছি। সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিলো এতদিন কোথায় ছিলে, কেনইবা তেমন না বলে চলে গেলে?

রাজু, মানুষ শুধু কি বেড়াতে যায় না?

নয়নতারার চোখের কাছে কি ছায়া পড়লো? কিন্তু হাতির চলার একটা দোলা লাগলো কিনা-লাগলো, নয়নতারা হাসলো। আর তখন মনে হলো তার মতো চোখকেই খঞ্জন আঁখিও বলা যায়।

সে বললো–ওটা কী? বিল? কী সুন্দর যে! যদিনা-হাসেন বিল সম্বন্ধে আপনাকে একটা কথা বলি।

রাজু সম্মুখে চাইলো। দিগন্তের নীল রেখাটা যা বনে জন্য বিচ্ছন্ন হওয়ায় আরে বেশি বাঁকা মনে হচ্ছে সেটা মেঘ নয়।

নয়নতারা বললো–বিল নাকি কচ্ছপের মতো চলে বেড়ায়।

রাজু হো-হো করে হেসে উঠলো।

এদিকে বর্ষা মেই, তবু কখনো কখনো বিলের জল বেড়ে ওঠে, তা থেকেই মনে হয় বিল গুটিগুটি এগোচ্ছে। তা থেকেই এই প্রবাদ। আসলে হয়তো তা মরা নদীর খাত বেয়ে উত্তরের বর্ষার জল এসে পড়ার ফলেই।

এই বললো– নয়নতারা কিন্তু ভাবলো, এখানে রাজকুমারের সামনে কখনই দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলা উচিত হবে না।

হাতি এগিয়ে চললো।

নয়ন বললো–রাজকুমার, গরম লাগছে।

–তা লাগতেই পারে। এই খোলা হাওদাটা মহিলাদের জন্য নয়।

নয়ন এদিক ওদিক চেয়ে একটা বড় গাছ দেখতে পেয়ে মাহুতকে সেদিকে হাতি নিতে বললো। ছায়ায় জিরিয়ে নেওয়া দরকার। সেখানে হাতি পৌঁছলে নয়ন বললো– হাতিকে বসাতে। হাতি বসলে জানালো তার পিপাসা পেয়েছে। রাজু কিছু বলতে গেলে সে গলা নামিয়ে বললো–ভুল যা করেছি করেছিই, তুমি জল না-খেলে আমি খাই কী করে?

এটা একটা সাধারণ কৌশল যা মহিলারা অবলম্বন করে। আহার্য ও পানীয় তোত রাজবাড়ি থেকেই এসেছে। মাহুতকে যথেষ্ট খাবার দিয়ে তাকে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিলো। সে কিছু দূরে আড়ালে গেলে নয়ন বললো–রাজকুমার বন্দুক ধরে থেকে তোমার হাতে তেলকালি। এসো আমি খাইয়ে দিই।

রাজু অবাক হলো। সত্যি নয়নতারা তার মুখের কাছে খাবার তুলে ধরলো। যেন অভিমান হবে রাজুর। যেন জিজ্ঞাসা করবে–তাহলে এতদিন? কিন্তু নয়নতারা বললো–একটু তাড়াতাড়ি, মাহুতটার খাওয়া তাড়াতাড়ি হয়ে যেতে পারে।

রাজুর খাওয়া শেষ হলে তবে হাতি উঠলো। মনে হতে পারে এটাই সব চাইতে মূল্যবান–অন্তত এটাই অন্যতম কারণ যার জন্য নয়নতারা আজ শিকারে এসেছে।

এক কৌতুকের ব্যাপার হলো। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা বিলের বাঁক। তার একাংশ যখন প্রায় দিগন্তরেখায়, অন্য অংশ তখন হঠাৎ একেবারে চোখের সামনে খুলে গেলো। হাওদা পিছন দিকে ঝুঁকে ছিলো বলে অনুমান হচ্ছিলো বটে হাতি উপরে চড়ছে, নতুবা ঘাস, কাশ, নল, মাঝে মাঝে শিমূল, বাবলা, কচিৎ অশ্বত্থ হিজল, কদাচিৎ কিছু দূর ধরে বেতজঙ্গল, সব জায়গাতেই হাতির উচ্চতার তুলনায় সমান উঁচু বন।

ডানদিকে গড়ানে জমি শ্যাওলা জমেনি এমন জলের দিকে নেমে গিয়েছে। পারে এক অল্পবয়সী বট, যদিবা মানুষের অনুপাতে তাকে বিশেষ বৃদ্ধই বলতে হয়। বটের একটা ডাল জলের উপরে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। ডালটাকে অতদূর এগিয়ে যেতে দেওয়ার সুবিধা, করে দিতেই যেন জলের একেবারে ধার ঘেঁষে একটা মাঝারি মোটা বট। এগিয়ে যাওয়া । ডালটা থেকেও অনেক ঝুরি জলের উপরে জালের মতো ছড়িয়ে তাছে অথচ জল বলেই যেন আরো নামছে না। তেমন একটা ঝুরিতে একটা মাছরাঙাকে দেখতে পাওয়া গেলো। দেখতে দেখতে সোনা লাল সবুজের ঝিলিক দিয়ে এক পাক উড়ে ঝুপ করে জলে পড়ে আবার ঝুরিতে এসে বসলো। তখন দেখা গেলো কালো কালো গলা দিয়ে জল সেলাই করছে। অনেক পানকৌড়ি। তাদের কার্যকলাপই ছিলো মাছরাঙার নিশানায়।

নয়নতারা বললো–এমন সুন্দর দেখিনি।

তার চোখ দুটি ডাগর, তার লাল ঠোঁট দুটি একটু উন্মুক্ত, স্নিগ্ধ হাসিতে তার উজ্জ্বল দাঁতের দু-একটি ডগা চোখে পড়ছে। দেখে রাজুর মনে হলো এমন পাশ থেকে সে নয়নতারাকে কখনোই দেখেনি। কী আশ্চর্য!

সে, সোৎসাহে বললো–দ্যাখোদ্যাখো নয়ন, ডাহুক বোধ হয়, যাদের টিটিভ বলে।

হাতি বিলের পাশ ঘেঁষে এগিয়ে চলেছে। যেন একটা পায়ে-চলা পথও আছে সেখানে। অনুমান হয় তা থেকে এদিকে একটা গ্রাম থাকবে।

হঠাৎ নয়নতারা বললো, বলার আগেই হাসি ফুটলো তার মুখে–আচ্ছা রাজকুমার, টিটিভ না ডাহুক, কে ভালো?

রাজু বললো–নয়ন, তোমাদের রাজকুমার যে মূর্খ এটা প্রমাণ না করেই তা বলা যায়।

-আ, রাজু, আমি কি? দ্যাখো–নয়নতারা মুহূর্তের জন্য ভাবলো, সে কি বুঝিয়ে বলবে ডাহুক কথাটা অনেক বাংলা গানে আছে, টিট্টিভের সাক্ষাৎ বিষ্ণুশর্মার উপদেশের বাইরে নেই। সেজন্যই সে জিজ্ঞাসা করেছিলো।

কিন্তু বিলের দিকে চোখ রেখে রাজু বললো–ও কী, মুখের কেন অমন চেহারা? তুমি কি সত্যি ভেবেছো তোমাদের রাজকুমার মুখ থেকে যাচ্ছে? যদি তুমি সেই আড্ডাগুলো দেখতে নয়ন যা অনেক সন্ধ্যায় আমার বৈঠকখানায় বসে। কী শ্যাম্পেন! আর কত শের আমি শ্যারম, আঁশটে কত ঘনঘন! আমাদের বাগচী মাস্টারমশায় কিন্তু যত গম্ভীর দেখায় তত গম্ভীর নন।

নয়নতারা বললো–নিজের ব্যাপারে এখন দেখছি আপনার সব কথাই বাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

রাজচন্দ্র হাসলো। বিলে সৌন্দর্যের প্রফুল্লতাই যেন তার মুখে। সে বললো–কে বলেছে? আমার এই বন্দুকের রেঞ্জ ভেলোসিটি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করো কিংবা পিয়ানো সম্বন্ধে, দেখবে আমার কোনো কথাই বাঁকা নয়।

রাজকুমারের মুখের থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে নয়নতারা চিন্তা করলো। কথার সুরে কোথাও কোথাও সুখ জড়ানো আছে, কিন্তু শেষ কথাটার চাইতে বাঁকা আর কী?

কিন্তু মাহুত, যে এতক্ষণ নিজেকে লুপ্ত করে রেখেছিলো, কথা বললো– সামনে লোকজন দেখছি।

-হ্যাঁ, ওরাই পথ দেখাবে।

নয়নতারাও লোকগুলিকে দেখতে পেয়েছিলো। হঠাৎ যেন তার মুখ রাঙা হয়ে উঠলো।

কী ভাবছো?

মৃদুস্বরে নয়নতারা বললো–কাজটা ভালো হয়নি। হাওদায় কবরেজকে দেখে না-জানি অন্যে কী ভাবে। তাছাড়া আমি বোধ হয় ভুলে আপনাকে কয়েকবার তুমি বলেছি।

রাজকুমারের চোখ দুটিতে দুষ্টুমি দেখা দিলো। সে বললো–তাই তো, এখন আর অন্তর্ধানেরও উপায় নেই। একেই অগত্যা বলে, দেবী? মনে হয় করণ বুঝি, কিংবা হেত্বর্থে। কিন্তু আসলে প্রকৃত্যাদিভিঃ।

হাতি এগিয়ে চললো।

নয়নতারা ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবলো, সামনের লোকগুলি ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তার মধ্যেই মনে হলো তার একবার, এটা কি রাজুর একটা ঝকঝকে বাক্য তৈরির নেশা কিংবা শ্লেষ করে কিছু বলছে? স্ত্রীলোককেই তো প্রকৃতি বলে। সত্যি কী হেতু ছিলো এই শিকারে আসার তার পক্ষে?

.

০৪.

কীবল কেন এসেছিলো এই অঞ্চলে? নানা দিকে বিচার-বিবেচনা করার পর অনুমান হয়: তার অনেকটা জীবিকা অনুসন্ধান, কিছুটা পলাতকবৃত্তি। ক্রিমিয়া ফেরত সে তাইপিং বিদ্রোহ দমনে চীনে যেতে অনিচ্ছুক ছিলো কি? পরবর্তী জীবনে এদেশে আইন ব্যবসায় সে খ্যাতি ইত্যাদি লাভ করেছিলো। তার স্বদেশে কি তা হতে পারতো না? অথবা ভারতে তখন কয়েকটি হাইকোর্ট স্থাপিত হচ্ছে, সেইসব নতুন হাইকোর্টে নতুন আইনজীবীদের প্রতিযোগিতা করার সুবিধা ছিলো। অন্যদিকে তাহলে এই প্রশ্ন থাকে, কিছু বেশি টাকার জন্যই কি সহজে স্বদেশ ত্যাগ করা যায়? আসলে একথাও মনে রাখতে হবে, কারো কারো কাছে সাজানো-গোছানো লন্ডন সভ্যতার কেন্দ্রর চাইতে অসভ্যতার প্রান্তে যেখানে সভ্যতা গড়ে উঠছে এমন সংযোগস্থলেই আকর্ষণীয় বোধ হয়।

আপাতত সে রাজারগ্রামে চিঠি দিতে এসেছিলো ডাকে। কিন্তু সেটা এমন ব্যাপার নয় যে তাকে আসতেই হতো। মরেলগঞ্জের নিজস্ব ডাকহরকরা আছে। ঝোঁকের মাথায় কীবল কাল অনেক রাত পর্যন্ত একখানা চিঠি লিখেছে, এবং দ্বিতীয়বার না-পড়েই তা পোস্টকরতে ঝোঁকের মাথাতেই ডাকঘরে এসেছিলো। অনুপ্রেরণার স্বভাব এই যে দ্বিতীয়বার পড়লে তার অনেক কথাই বর্জনীয় মনে হয়।

কীবল চিঠি লিখেছিলো তার আত্মিক ভগ্নীকে। তাদের রোমান ক্যাথলিক ভিকারের বিধবা মেয়ে। বয়সে কীবলের চাইতে কিছু বড়ো হতে না-ও পারে, কিন্তু সম্মানে কীবলের চোখে গগনচুম্বী। তাকে চুম্বন করতে সুতরাং গগনই পারে। বিধবা এই মহিলাকে, তার নাম ম্যাগি হওয়ার সুবাদে, কীবলের চোখে ম্যাগডালেনের ঘোর লাগে। কিন্তু কী করে কী হয় বলা যায় না। বাইবেল নিয়েই বসা। কিন্তু সেই বিকেলের উজ্জ্বল আলোয় তারা বেশি বয়সে অল্পবয়সী ভাইবোনের মতো হাত কাড়াকাড়ি করছিলো। জাপ্টাজাস্টি শেষে বইটা দখল করে কীবল চেয়ারে বসতেই মুখোমুখি বসলো ম্যাগি। তখনো সে হাঁপাচ্ছে। হঠাৎ দেখতে পেয়েছিলো তখন কীবল। ব্লাউজের হুক খুলে গিয়েছে, পারঙের অর্গান্ডির আন্ডারগার্মেন্টের শাসনবিচ্যুত সুপক্ক পুষ্ট স্তনের অর্ধাংশ, যা নাকি স্বর্গের মতো। আর তখন হাঁপাচ্ছিলোও ম্যাগি।

কিন্তু তারা অবশ্যই নতুন সুতরাংক্যাথলিক কীবল তার আত্মিক ভগ্নীকেই চিঠি লিখতে অভ্যস্ত। কেননা চিঠিতে যেমন এই আত্মিকভগ্নীত্বের গভীরতা ছুঁয়ে চলা সম্ভব পাশাপাশির নৈকট্যে ততটা সাহস হয় না যেন।

চিঠি দেওয়ার পরে হাতে এখন অনেক সময়। সুতরাং সে এদিক-ওদিক ঘুরে। বেড়াচ্ছিলো। ঘণ্টাতিনেক আগে ব্রেকফাস্টহয়েছে। ঋতুটা এখন এমন যে চারিদিক থেকেই সূর্যের আলো তার গায়ে পড়ছে। ধুলো নয়, প্রচুর ঘাস; কাদা নয়, ট্যালকমের মতো মাটি। উপরন্তু যেদিকে তাকাও সবুজ, ময়ূরের পেখমের মতোনীলে জড়ানো সবুজ এবং উজ্জ্বল।

ঘোড়া ক্যানটারে চলছে। সে শিস দিতেও শুরু করেছিলো। তা এখানকার জলটাও ভাল, ক্যালকাটার তুলনায় বটেই। আর ক্যালকাটার নেটিভপাড়ার, এবং ক্যালকাটার বেশির ভাগই তাই, সেই খোলা পচা জলের নর্দমাগুলোর চাইতে এই বুনো পথও ভালো। ডিসাইডেড়লি। এখন আবার চিঠির কথাটা অথবা চিঠির প্রশ্নর কথাই তার মনে এলো। দুটো প্রশ্ন আছে এই চিঠিতে। সে প্রশ্ন দুটির বিষয়ে ম্যাগির ধারণা জানতে চেয়েছে : (১) সেন্ট পলের হাতে স্বর্গের যে চাবি আছে তা কি সোনার তৈরি? (২) সে হাত কি অ্যাঞ্জেলদের হাতের মতো? বস্তুত এই প্রশ্ন দুটো তৈরি না-হলে গত সপ্তাহের পর আজই আবার চিঠি কেন?

এখন মনে হলো, কীবলের অ্যাঞ্জেলদের হাতই বা কি? তা কী স্বচ্ছ একটা জমাটবাঁধা আলো? কিংবা অ্যামব্রোসিয়ায় তৈরি? কী আশ্চর্য, এ সম্বন্ধেও তার ধারণা স্বচ্ছ নয়।

কিন্তু চিঠিতে প্রশ্ন ছাড়াও অন্য কিছু থাকে। কীবল তার অভিজ্ঞতার কথাও কিছু লিখেছে। এটাকে মানে ইন্ডিয়াকে ন্যাংটো সন্ন্যাসী ও সাপুড়ের দেশ মনে করে বটে লোকে। এখানে অন্য অভিজ্ঞতাও হতে পারে। তোমাকে বলতে পারবো না সবটুকু। কিন্তু এখানে জননেন্দ্রিয় পূজা হয়ে থাকে। হ্যাঁ, আমি তা নিজের চোখে দেখেছি। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থেকো। তোমার মুখোনি আমার স্মৃতির দিগন্তে। আমি বিপথে যাবো না। তবে এ দেশটা, যা আমাদের সাম্রাজ্যের কোহিনুর, সত্যি অদ্ভুত। এখানে আমার পরিচিত ইংরেজ ভদ্রলোক কালীপূজা করেছিলো। এই কালী নাকি এক কালো ন্যুড গার্ল। এখানে এক কালো ভদ্রলোক আছে যার স্ত্রী বৃটিশ। এই কালো ভদ্রলোককে কখনো কোয়েকার মনে হয়। কখনো বিধর্মী। কিন্তু সবচাইতে বড়ো কথা একটি বৃটিশ গালা কী করে তার সঙ্গে টেলে বসে এবং ঘুমায়।

এটা বোধ হয় বেতের ঝোপ। ডানকানের কথা বিশ্বাস করতে হলে মালাক্কা কে আর এই বেত একই জিনিস। একটা নালার বরাবর তার দুপারে মানুষের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু বেতবোপ। ধারেকাছের গাছের ডালপালা আঁকড়ে ধরেও বেত উঠে পড়েছে। দুএকটি বড়ো গাছের মাথা ছাড়িয়ে রোদে ঝলমল করছে বেতের চূড়া।

ঘোড়াটা চমকে উঠলো। কারণ খুঁজে এদিক-ওদিক চাইতেই কীবল হাতি, হাওদা ও হাওদায় মানুষ দেখতে পেলো। বেশ দ্রুত চলেছে হাতি, আর তার ঘোড়াও ক্যান্টার করছে। আরো ভালো করে দেখতে হলে লাগাম টানতে হয়।

সে অনুভব করলো : মাইপ্লেনডিড! এর আগে কি হাতি দেখেছি, না তার সওয়ার!

আচমকা এরকম অনুভব করার পর তার মন যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলো। তুমি স্বপ্নও দ্যাখোনি। এমন রূপ সম্বন্ধে। কী আশ্চর্য, এমন রূপ কি হিদেন-নেটিভদের হয়? আচ্ছা, পুরুষটি রাজকুমার কি? কারণ প্রিন্সই হাতি চড়তে ভালোবাসে। পরবর্তী পর্যায়ে সে যুক্তি দিলো, মহিলাটি প্রকৃতপক্ষে ক্যাথারীনই? নতুন পোশাকেই তাকে তেমন দেখিয়েছে? অবশ্যই জিনুইন ব্রিটিশ ব্লাড়। নতুবা এত রূপ হয়! কীবলের চাপা ঠোঁটে ভাঙচুর দেখা দিলো, কিন্তু এই রাজকুমার অবশ্য হার ম্যাজিস্টির একজন সাবজেক্টমাত্র। বৃথা জাঁকজমক। এই সময়ে তার সদ্য শোনা প্রবাদটা মনে পড়লো :ইন্ডিয়ান প্রিন্সরা হাতিতে চড়ানোর লোভ দেখিয়ে স্ত্রীলোকদের সিডিউস করেন না, তাহলে কেট হয় না। প্রকৃতপক্ষে সে রাজচন্দ্র আর নয়নতারাকে দেখেছিলো।

এখন তার মরেলগঞ্জে ফেরারও তারা নেই। এদিকে দ্যাখো, সামনের ওই রাস্তাটা চওড়া। সে লাগাম টানতে ঘোড়াটা চওড়া পথটা ধরলো। কিছু দূরে গিয়েই গোল, সাদা, প্রকাণ্ড একটা ছাতার মতো গম্বুজ চোখে পড়লো। আচ্ছা! ওটাই নাকি রাজবাড়ি?

অতঃপর সে আবার রাজবাড়ির গম্বুজের টানেই যেন রাজারগ্রামের দিকে ফিরতে শুরু করলো।

তখন তার মনেও একটা উল্টো পাক দেখা দিয়েছে। সে ভাবলো, (যেন সে নৃতত্ত্ব সম্বন্ধেই উৎসুক) আসল কথা এদেশে অর্থাৎ এই ইন্ডিয়ায় বিভিন্ন রকমের মানুষ থাকাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ মানুষের যত রকমের দেহবর্ণ হতে পারে বোধ হয় সবরকমই এখানে পাওয়া যাবে আর তা হয়তো এইজন্য যে একের পরে এক মানবগোষ্ঠী এখানে তাদের বিভিন্ন বর্ণের দেহ নিয়ে এসেছে এবং থেকে গিয়েছে। হয়তো একদিন তেমন ইংরেজদেরও কিছু চিহ্ন পড়ে থাকবে। কীবলের মন থেমে দাঁড়ালো। নানা, অবশ্য তা প্রকৃতপক্ষে হবে না। কেননা কোন এমন জাত আছে পৃথিবীতে যা ইংরেজদের পরেও আবার এদেশে রাজ্য পাবে। অর্থাৎ ইংরেজ অপেক্ষা উন্নত ও শ্বেতকায়? রাজকুমার হয়তো এবং হয়তোবা রাজকুমারের সঙ্গীও তেমন কোনো অভিযাত্রী দলের বংশধর। তারা কী এরিয়ান ছিলো?

.

০৫.

অনেক সময়ে যোগাযোগ ঘটে যায়। চন্দ্রকান্ত এডুজ বাগচী তখন চরণদাসের বাড়ি থেকে নিজের কুঠিতে ফিরছিলো লাঞ্চের জন্য। তার পনিটা বেশ মোটা, গতিটাও শ্লথ। যদি কেউ দুএক বছর আগে দেখে থাকে তবে তার অনুমান হবে বাগচীর যত্নেই তার এই দৈহিক উন্নতি। হাঁটুর কাছে থোপা-থোপা পশম, ঘাড়ে সিংহসম কেশর ও লেজের মাটিছোঁয়া বালামচি দূর থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাগচীর পোশাকও গ্রামে লক্ষণীয়। স্প্যাটস, ক্রাভ্যাট সমন্বিত পুরো ইংলন্ডীয় তার পোশাক। শুধু মাথার পেন্টহ্যাট যেন বেশ বড়ো। পনি মাথা ঝাঁকিয়ে টিকটিক করে চলেছে। বাগচীর লম্বমান পা দুখানা মাটির কয়েক আঙুল উপরে। দুষ্টু ছেলেরা গোপনে মন্তব্য করে ঘোড়া ও সওয়ার দুজনেই একসঙ্গে হাঁটে। কিন্তু তা গোপনে, খুবই গোপনে।

চরণদাসের বাড়িতে একটা দাঁতব্য হোমিওপ্যাথিক ডিসপেনসারি গড়ে উঠেছে। সেখানে সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকালে কিংবা বিকেলে অন্তত একবার সে যায়ই। ছুটি ও রবিবারে দুবেলাই।

রবিবারে–আজ রোগীর ভিড় ছিলো। ফিরতে কিছু দেরি হয়েছে বাগচীর। বিলমহল থেকে, ফরাসডাঙা থেকে দু-চার ক্রোশ পায়ে হেঁটে কয়েকজন রোগী এসেছিলো। কারো বাত,কারো স্থায়ী মাথাধরা, একজনের তো ক্ষয়রোগ বলেই সন্দেহ হয়েছে, অজীর্ণ, আমাশা তো বটেই।

প্রশ্নের উত্তরে রোগীরা যে রোগলক্ষণ বলে চরণদাস তা সংক্ষেপে টুকে নেয়। বাগচী কিছুদিন যাবৎ চরণদাসকে প্রশ্ন করে, তুমি হলে কী দিতে? চরণদাস যদি সাহস করে কিছু বলে বাগচী কোনো ক্ষেত্রে তার ভুল দেখিয়ে দেয়, কোনো ক্ষেত্রে বলে দাও, দেখা যাক; অন্য কখনো বলে ঠিক বলেছো, আমারই ভুল হয়ে যাচ্ছিলো। এ সেই চরণদাস যে গ্রামের পোস্টমাস্টার, বাগচীর স্কুলে শিক্ষকতাও করে; এবং দেখা যাচ্ছে ডানকানের আত্মা বিচারের আগে লাখ-লাখ বছর ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ পাবে এমন গল্পও বানায়।

ডিসপেনসারির কাজ ভালোই চলেছিলো। বাগচী কখনো হেসে কখনো তিরস্কার করে রোগী দেখা শেষ করছিলো এবং চরণদাস ওষুধ দিয়ে চলেছিলা।

দেখা যাচ্ছে গুজবের মতো রসিকতাও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে কৌতুকের এই হলো : চরণদাসের সেই আমলের বিচার নিয়ে রসিকতা অন্যের মুখে ঘুরে চরণদাসের কানেই ফিরে এলো।

বিলমহলের সেই চিরস্থায়ী মাথাধরা রোগী, যার কপালে সুতোর ডোরে একটা সরু শিকড় বাঁধা, সেই বললো–চরণ কবরেজ, শুনেছো নাকি ডানকানার নাকি নরকেরও ভয় নেই।

চরণদাস ওষুধের ফোঁটা ঢালছিলো জলের শিশিতে।

বাগচী জিজ্ঞাসা করলোকে? কার কথা বলছো? ডানকানা কে? কিন্তু বাগচী নিজেই বুঝতে পারলো। সে হো-হো করে হেসে উঠলো। এরা ডানকান সাহেবকে একটামাত্র আকার দিয়েই কানা করে ছেড়েছে। রোগীটি বাগচীর সামনে লঘু কথা বলে ফেলে অপ্রস্তুত বোধ করছিলো। বাগচী হাসলেও রসিকতাটা আবার করা উচিত হবে কিনা এ বিষয়ে তার যথেষ্ট সন্দেহ হলো।

বাগচীই বরং বললো– হাসতে হাসতে–সে আবার কী গো, নরকের ভয় কার নেই?

সাহস পেয়ে রোগীটি বললো–নরকে তো আত্মাই যায়। তা সে আত্মা যদি লাখ লাখ বছর ঘুমিয়েই থাকে তার তবে কিন্তু ভয় কমে গেলো।

এই কৌতুকের জনক চরণদাস কিন্তু বিব্রত বোধ করলো। সে ব্যাপারটাকে হালকা করার জন্য বললো–পাপ কি কেউ এড়াতে পারে? ওর আর তামাদি নেই।

রোগীটি যা শুনেছে তা ভোলেনি। বললো– সে, তামাদি নয় নেই। কিন্তু তুমিই বলো; হলোইবা ইংরেজ চিত্রগুপ্ত। তার সেরিস্তায় কাগজ কি লাখ-লাখ বছর পরের পর ঠিক থাকে? বিচার তো করে সেই শেষের একদিনে।

বাগচী অবাক। একবার মনে হলো সে আবার হেসে উঠবে। কিন্তু রসিকতা হলেও এটা কি ভালো রুচির? একটু গম্ভীর মুখেই সে বললো–সব ধর্মেই এমন কিছু থাকে যা অন্য ধর্মের লোকেরা সহজে বুঝতে পারে না। ওষুধটা ওকে দিয়ে দাও চরণ। দেরী হচ্ছে।

একটু হেসে সে রোগীটিকে বললো–ওষুধটা কীসের তৈরি জানো? স্রেফ ঘোল। তাই বলে ঘোল খেলে মাথা ধরা সারবে না। হু-হুঁ!

ওষুধ নিয়ে রোগীটি উঠে দাঁড়ালো। ট্র্যাক থেকে পাঁচসিকে পয়সা বার করে বাগচীর জুতোর সামনে রেখে বললো–কবে আবার আসবো, সার?

বাগচী বললো––ও কী, পয়সা কেন?

সার কত গরীব লোককে পথ্য দেন শুনি। পয়সা কটা সেই ধর্মভাণ্ডারে দেবেন। দেখা যাচ্ছে ছাত্রদের দেখাদেখি রোগীরাও কখনো কখনো তাকে সার বলে।

বাগচী রোগীটির মুখের দিকে চাইলো। এই পরার্থপরতা তার ভালো লাগলো। সে সস্নেহে বললো–ফের রবিবারে এসো। নিজে আসতে না-পারা কাউকে পাঠিও খবর দিয়ে। আবার হেসে বললো–তোমাকে ঘোল খাওয়াচ্ছি বলে আবার কেউ ঠাট্টা করবে না তত, হে?

–তা করবে, সার, মেন্তুজা শুনতে পেলে রক্ষা রাখবে না।

কিন্তু রসিকতা কখনো নাছোড়বান্দা হয়। দাওয়া থেকে পৈঠায় নামতে অন্য আর-এক রোগী বললো– আবার–তা চরণ, যাই বলল ভাই, ভাগ্যটাই ওদের ভালো। এদিকে ইহকালে রাজা হয়েই জেতে বসেছে, ওদিকে দ্যাখো পরকালেরও সাজার ভয় নেই। মজা আর কাকে বলে।

ওদিকের বেঞ্চের উপরে স্বগ্রামের কয়েকজন রোগী ছিলো। তাদের একজন রসিকতার সুরেই বললো–তা, ভূতোদা মিথ্যে বলোনি। কিন্তুক এক কাজ করা যায়। সবসমেত পুড়িয়ে দিলে হয় একদিন। তাহলে আত্মা ঘুমুতে জায়গা পায় না। সরাসরি নরকে পৌঁছায়।

সকলেই হেসে উঠলো।

রোগীর ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে। বাগচী কিছু ভাবলো। তার মুখে হাসি ফুটেছিলো,

.

মিলিয়ে গেলো। পাইপ বার করে ধরালো। বরং পায়ের উপরে পা তুলে আয়েশ করে নেয়ার ভঙ্গিতে বসে বললো–চরণ, ডাবা টেনে নাও। ওতে মাথা ঠাণ্ডা থাকে। কিন্তু একটা কথা, ১রণ।

চরণ বললো––বলুন সার।

–এই এখনই যা বলা হলো।

চরণদাস উত্তর দেয়ার আগে চিন্তা করলো। তামাক, শোলা, চকমকির বাক্সটাকে আঙুলে নির্দেশ করে একজন রোগীকে বললো–তামাক খাও, চেলোকাকা।

তারপর হঠাৎ বাগচীর দিকে ফিরে বললো–যদি লাগাই হয়, সার, সবসমেত পুরিয়ে দেয়াই মন্দ নয়! যাকে সকার বলে। আর তা করতে হবে পাপ করে উঠেছে ঠিক এমন সময়ে। অনুশোচনা কর পাপ কাটানো সুযোগ যাতে না-পায়।

বাগচীর মুখে কথা নেই। সে যেন ভেবেই পেলো না সে হাসবে, না চটে উঠবে। একবার তার মনে হলো সেদিন সে আর রোগী দেখতে পারবে না, পরে একবার ভাবলো যত তাড়াতাড়ি এদের বিদায় করা যায় ততই ভালো। কী সাংঘাতিক কথা!

তাই করলো সে। রোগীদের বিদায় করে পাইপটা জ্বালালো সে আবার। ভাবলো এটা কি পরধর্মবিদ্বেষ চরণের? তাই কি?

কথাটা তখন মনে পড়লো তার। মূল ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে সে মনে মনে হেসে বললো–তা, চরণ, তুমি কি হিন্দু পেট্রিয়টের নাম শুনেছো?

-তা শুনেছি, সার ডাকঘরে একখানা নিয়মিত আসে দেওয়ানসাহেবের নামে।

–পড়েছো?

–দেওয়ানসাহেবের কাগজ কি খোলা যায়, সার?

বাগচী অনুমান করেছিলো চরণদাস হয়তো হিন্দু পেট্রিয়ট থেকেই নীলকরের প্রতি একটা গভীর বিদ্বেষ সংগ্রহ করে থাকবে, কারণ বাগচীর ধারণা ছিলো হিন্দু পেট্রিয়টের হরিশ নীলকরদের কঠোর সমালোচক। বিশেষত গত একবছর থেকে।

সে বললো–আচ্ছা, চরণ, তুমি কি কলকাতার নরেশবাবু, সুরেনবাবু এঁদের সঙ্গে আলাপ করোনি? দেখতে কলকাতার শিক্ষিত লোকেরা ক্রিশ্চান ধর্ম নিয়ে বিদ্রূপ করে না। বেশি কথা কী আমাদের নিয়োগীমশায়, তোমার কি মনে হয় না তিনি খৃস্টকে ঈশ্বর মনে করেন?

পথে বেরিয়ে ভাবলো বাগচী : এদিকেও লক্ষ্য করো শেষ বিচার, অনুতাপ এমন সব বিষয় সম্বন্ধে কিছু জানা না থাকলে তেমন বলা যায় না চরণদাস বলেছে। ভেবে দেখতে গেলে এটাকেই বরং বেশি আশ্চর্য মনে হওয়ার কথা। এখানে নীলকর অত্যাচার করে থাকলে হিন্দু পেট্রিয়টের সাহায্য ছাড়াই বিদ্বেষ জন্মানো সম্ভব। হিন্দু পেট্রিয়ট বরং দূরে, এরাই কাছে। কিন্তু ধর্মের তত্ত্ব কোথায় শেখে চরণ? বাগচী অনুমান করার চেষ্টায় স্কুলের নতুন মাস্টারমশাই নিয়োগী খুঁজে পেলো। তার কাছে কি শিখেছেচরণ অনুতাপে পাপমুক্তির তত্ত্ব? আচ্ছা!

কিছু দূর গিয়ে বাগচী এ ব্যাপারটা থেকে অন্যদিকে সরে গেলো। সে অনুভব করলো আজ ছুটির দিন। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাঞ্চ আর বিশ্রাম।

মনের এই ঢিলে ভঙ্গীতে প্রিয় কিছু চিন্তা করা ভালো। এই ভাবতে-না-ভাবতে সে অন্য চিন্তায় ঢুকে গেলো। বিষয়টা তার স্কুলের পরীক্ষা সম্বন্ধে। প্রশ্নটা এই : জ্ঞানের বিষয়কে মূল্য দেয়া হবে, না যে-ভাষায় বিষয়টাকে বলা হয়েছে তাকে মূল্য দেয়া হবে? কোনো ছাত্র যদি হীমালয়, জমুনা, গংগা প্রভৃতি বানান লিখেও পর্বত নদীগুলোর যথাযথ পরিচয় দিতে পারে তাহলে কি তা মূল্যহীন? তার মনে হচ্ছে কলকেতার আধুনিক শিক্ষাও ভাষাজ্ঞানের উপরেই জোর দিচ্ছে। সে তার স্কুলের পরীক্ষায় ভাষা ও বানানের উপরে জোর না, দেয় যদি, যদি সে লিখিত পরীক্ষার বদলে মৌখিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করে উঁচু শ্রেণীতেও? ভূগোল, ইতিহাস, বিজ্ঞানের কথা শেখাই কি আসল কথা নয়? আর সাহিত্যই যদি বলল, তাতেই কি বানান আর ব্যাকরণের চাইতে রস বিষয়টা মূল্য পাবে না? শেকপীয়রের ব্যাকরণ আর বানান এখনকার কোনো ছাত্র ব্যবহার করলে সেসব প্রশ্নেই কি জেরোর বেশি পাবে? কিংবা এদেশের কৃষকের ধর্মজ্ঞানের কথা ভাবো। এক অক্ষর পড়তে লিখতে জানে। না। কিন্তু শুনো দেখি তার কথা? মূর্খ বলবে? অথচ কলকাতার ভাষাজ্ঞানের নিরিখে তারা মূখের অধম। অবশ্যই দেওয়ানজীকে জিজ্ঞাসা করে নিতে হবে।

চিন্তার বিষয়টা তার বিশেষ প্রিয়। মনে আসা স্বাভাবিক। কিন্তু মনের একটা কৌশলও যেন এখানে ধরা পড়ছে। সে ঠিক এখন এ-বিষয়টাকে কেন ভাবছে? অন্য কোনো চিন্তাকে দূরে রাখতে কি? সেই অন্য চিন্তাটা নতুন চিন্তার দুপাশে অন্ধকার ঝোপের মতো থেকে যায় কিন্তু।

খানিকটা যেতে-না-যেতে বাগচীএকা একাই হো-হো করে হেসে উঠলো, দ্যাখো কাণ্ড, শুধু নামে একটা আকার যোগ করেই কেমন তিরস্কার তৈরি করেছে। ডানদিকে কানা। ডানকানা। আর কেমন সে, বিচারের কল্পনাও করেছে কোর্টের মতো।

ওদিকে কিন্তু লজ্জা হলো তার। কেউ দেখে ফেলেনি তো তাকে হাসতে? সে তাড়াতাড়ি হ্যাটটাকে কপালের উপরে টেনে নামালো। মুখটাকেও গম্ভীর করলো।

টকাটক করে চলছে পনি। মাটির কাছাকাছি বাগচীর সুদৃশ্য ও সুদৃশ্যতর সকপরা পা দুখানা দুলছে তালে তালে।

বাগচী হঠাৎ অবাক হয়ে স্বগতোক্তি করলো, আমিই কি শেষ বিচার কিংবা ইটারন্যাল ড্যামনেশন সম্বন্ধে কিছু জানি? ওসব কিন্তু আমার কাছেও ঠিক পরিষ্কার নয়। সেটা সেই ইটারন্যাল ড্যামনেশন কি মিল্টনের জ্বলন্ত গন্ধক ও কালো আগুন, ব্রিমস্টোন অ্যান্ড ব্ল্যাক ফায়ার? নাকি সে এক ঈশ্বরের সম্পর্কহীন অন্ধকারে বায়ুভূত নিরালম্ব অবস্থা? নাকি ছবিতে যেমন?

তার দুখানা ছবিকে মনে পড়লো। সে দুটিই বিশ্ববিখ্যাত। মাইকেল এঞ্জেলো এবং রুবেন্স নামক চিত্রীদ্বয়ের আঁকা দুখানা শেষ বিচারের ছবি। বিশেষ করে মাইকেলএঞ্জেলো। পরমপিতার সিংহাসনের নিচে ক্রাইস্টের ভঙ্গিতেও সেদিন ক্রোধ। ক্রাইস্টের পাশে ভার্জিন মেরিও যেন ক্রাইস্টের অটল গাম্ভীর্যকে, তার রুদ্র রূপকে স্নিগ্ধ করতে পারছে না। দণ্ডিত পাপীদের আত্মা নিচে কেরনের নৌকোর দিকেই ঘুরে-ঘুরে পড়ছে দেখা যাচ্ছে, অথবা তাদের সবলে টেনে নেওয়া হচ্ছে সেই বিভীষিকার দিকে। বাগচী নিজের ডান হাত তুলে চোখের সামনে রাখলো। যেন তাতে স্মৃতি থেকে সেই ছবিগুলোকে মুছে দেওয়া যায়, সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর আর্য ন্যুড আকৃতিগুলিকে।

কী আশ্চর্য, এ কি সে বিশ্বাস করে? সে অনুভব করলো, নিজের বিশ্বাস নিয়ে চিন্তা করলে মন বরং খারাপ হয়ে যায়। তাই নয়?

এরকম কিছু বিশ্বাস করতে পারলে তো ভগবান ছ-দিনে বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করে একদিন বিশ্রাম করেছিলেন তা-ও বিশ্বাস করা যায়। অথচ সে মনপ্রাণ দিয়ে আজও এ তথ্যে বিশ্বাস আনতে পারলো না। রবিবারেই সে কি প্রার্থনা করে?

তার মুখের গাম্ভীর্য কমে গিয়ে একটা স্বপ্নময় দুঃখাতার ছাপ পড়লো। লুকনো চিন্তাটা আত্মপ্রকাশ করলো। ডানকান তার স্ত্রীর সম্বন্ধে চূড়ান্ত কুৎসা রটিয়েছে, তাকেও প্রতি সুযোগে অপমান করেছে, সেজন্যই কি ডানকানকে এরা বিদ্রূপ করায় সে হাসছিলো?

কিন্তু চোখ তুলতেই যোগাযোগটা ঘটে গেলো। ঘোড়ার পিঠে কীবলকে দেখতে পেলো বাগচী, গলির মুখে বড়োরাস্তাটা পার হয়ে যাচ্ছে তার ঘোড়া। কীবল কি প্রকৃত ইভান্‌জেলিস্ট, যেমন ডানকান বলেছিলো?

.

০৬.

চন্দ্রকান্ত এণ্ড্রুজ বাগচী তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানে ইংরেজ ঠোঁটটেপা জাত, গায়ে পড়ে আলাপ করে না, অন্য কেউ তেমন করে তাও চায় না। তা সত্ত্বেও কীবলের সঙ্গে আলাপ করার আগ্রহ দেখা দিলো তার মনে, নিছক ভদ্রতার চাইতে বরং বেশি গভীর সে আগ্রহ কি কারণ তার? মনের বিচিত্র গতি বলা হবে? কিংবা চরণের রসিকতায় উল্লেখ করা লাস্ট জাজমেন্ট ও ড্যামনেশন, ধর্ম সম্বন্ধে নিজের বিশ্বাস ও অবিশ্বাস, কিংবা কীবল এই নামটা কি তার আগ্রহের মূলে ছিলো? অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মকে কেন্দ্র করে আন্দোলন হয়েছিলো তার মধ্যে কীবল নামে প্রধান একজন ছিলেন বটে। এবং অক্সফোর্ডের সে আন্দোলন নিয়ে সে এবং তার শ্বশুর ফাদার এজ একসময়ে বহু আলোচনা করেছে। কখনো কখনো আবেগের সঙ্গে।

পনিকে দ্রুত চালানোর চেষ্টা করলো বাগচী। সে তার রাশি রাশি বালামচিসহ ঘাড় এবং মাথা এমনভাবে নাড়লো যেন তখনই ধাপে ছুটবে। অথচ সে অসহায়। হায় আদরপুষ্টতা!

কিন্তু কীবলও তাকে দেখতে পেয়েছিলো। ক্রিমিয়াখ্যাত লাইট বিগ্রেডের সওয়ারের কায়দাতেই যেন রাশ টেনে ঘোড়াটাকে ঘুরিয়ে আনলো সে।

হেলো ফাদার, গুডমর্নিং! এই বলে সে হাসলো। সুন্দর এবং স্বাস্থ্যবান তার দন্তপংক্তি এখনো। গুডমর্নিং বলতে গিয়ে কি সময়ের কথা মনে পড়লো বাগচীর? তারপরেই সেও হাসিমুখে বললো–গুডমর্নিং মিস্টার কীবল, কিন্তু আমাকে ফাদার বলা বৃথা। আমি একজন ভিলেজ স্কুলমাস্টারমাত্র। এদিকে যখন এসেছেনই আসুন আমার কুটিরে, অতি নিকটেই। যদি আপনার আপত্তি না থাকে লাঞ্চের সময়টাকে আমরা এগিয়ে নেবো।

ইংল্যান্ডে অনুশীলিত কীবলের মনের ইংরেজি অভ্যাস অস্ফুটস্বরে একবার চিন্তা করলো, ইটনট ডান্ (এপ্রকার প্রথা না হয়)। কিন্তু পরক্ষণেই তার কী মনে হলো, আফটার অল দি ওনলি ইংলিশ গ্যার্ল দিশ সাইড ক্যালক্যাটা? (কলকাতার বাইরে ইংরেজদুহিতা আর কে? )। প্রকৃতপক্ষে তিনিই তো সম্ভাব্য হোস্টেস এক্ষেত্রে।

সে বললো–কিন্তু মিসেসের উপরে নির্যাতন হবে না? আচ্ছা, বরং এক কাপ কফি।

–আদৌ নয়-আদৌ নয়, বরং আমরা সম্মানিত জ্ঞান করবো। আসুন তাহলে। বাগচী ডান হাত প্রসারিত করে যেন তার বাংলোকে ইঙ্গিত করলো।

বাগচীর বাংলোর সামনে পৌঁছতেই, আর তাতে মিনিটকয়েক লাগলো, ঘোড়া দুটির ব্যবস্থা করলো সহিসই। তারা যখন বসবার ঘরে ঢুকছে ম্যান্টেলপিসের উপরে বসানো চার্চের আদলে তৈরি ছোটো ক্লকটায় একটা বাজতে কিছু দেরি আছে মাত্র।

ঘড়িটাতেই আগেকীবলৈর চোখ পড়ার একটা কারণ ছিলো। ক্লকের ফিট দুয়েক উপরে হলুদ-সাদা দেয়ালের গায়ে একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য। একটা বাড়ির, তার উপরের আকাশের, এবং একজোড়া গাছের ছবি। বাড়িটা অক্সফোর্ডের একটা কলেজের। কীবল যেটায় ছিলো অবশ্যই সেটা নয়। তাহলেও চেনা লাগলো তার। চিত্রকর এবং একজন অ-চিত্রকর ছাত্রের দেখায় পার্থক্য থাকেই। চিত্রকর আকাশের যে রং দেখে অথবা আকাশের যে রং লেগে কলেজবাড়ির এক বিশেষ অংশ ছবিতে আঁকার মতো হয়ে ওঠে তা চিত্রীর চোখেই ধরা পড়ে।

ততক্ষণে বাগচী বসুন-বসুন বলে চেয়ার এগিয়ে দিয়েছে।

এখন শীতকাল হলেও ঘরে অনেক আলো। একটা জানলার কাঁচে রোদও। কীবলের ত্বকে উষ্ণতাটা যেন একটু বেশি তীক্ষ্ণ মনে হলো, আরামদায়কের চাইতে তীক্ষ্ণ এবং হয়তো সেজন্যই বা কিছু উত্তেজক।

সে বললো–আজ দিনটা বেশ উষ্ণ।

–আরামদায়করূপে সে রকম, তাই নয়?

জানলার উপরে বসানো রঙিন কাঁচের স্কাইলাইট দিয়ে আলো আসছে। রঙিীন জ্যামিতিক ছবির মতো মেঝেতে।

বাগচী বললো–আপনি তো ধূমপান করেন না। কফি কিংবা অন্য পানীয় আনাই।

কীবল হাসিমুখে বললো–কফিই ভালো। যুদ্ধে খুব দামী মদ দেয় না, আর তাছাড়া অক্সফোর্ডে কিংবা ইন-এও দামী মদের জোগাড় করা কদাচিৎ সম্ভব।

বাগচী কীবলের কথা বলার সময়ে তার মুখের দিকে চেয়েছিলো। সে অনুভব করলো তার পরিচিত কোনো নীলকরের মুখে এমন সরল কথা সে শোনেনি। বেশ ভালো লাগলো তার। সেদিন লাঞ্চটা ভালোই হয়েছিলো, বেশ আলোকোজ্জ্বল এবং আধুনিক আবহাওয়ায়। বাগচীর বাংলোটা আকারে কিছু ছোটো হলেও ডানকানের বাংলোর সঙ্গে নকশায় একতা বুঝেছিলোকীবল। কিন্তু ডানকানের বসবার ঘর নিশ্চয় এমন গোছানো, আলোক-প্রতিফলিত নয়। মানানসই ছিটের পর্দা, ম্যান্টেলপিসের কিছু উপরে রাখা কটম্যানের আদত ছবি, বেশ বড়ো সেই পিয়ানোটা, সেলফে সাজানো বাগচীর বই, ডেস্কের উপরে রাখা টাইমস কাগজের ফাঁইল, আর সবকিছুতেই জানলা ও স্কাইলাইটের আলো। আর লাঞ্চে কিছু দেরি আছে বলে ঝকঝকে পাত্রে কফি নিয়ে কেট প্রবেশ করলো। সাদা প্রিন্টের স্কার্ট, তার উপরে নীল স্ট্রাইপের জ্যাকেট। তার লালচে চুল, যা বনেট পরলে ঢাকা থাকে, এখন বরং এলো খোঁপায় জড়ানো। অত অজু লাল রেশমি চুল! এ কি ভারতের জলবায়ুর প্রভাব? কীবল স্বীকার করেছিলো, তেমন সুন্দর পরিবেশ সে কল্পনাই করেনি। তার মনের কোথাও ঠোঁটচাপা কেউ সতর্ক করেছিলো–ইটস্ নট ডান। কিন্তু তার মনের অন্য অংশ তাকে উৎসাহিত করে বলেছিলো–এটা গ্রেট ব্রিটেন নয়, এখানে সীমার বাইরে যাওয়ার টান আছে। সে লাঞ্চে রাজি হয়ে টাইমস কাগজকে ইঙ্গিত করে বলেছিলো–লন্ডনের বাইরে এই প্রথম টাইমস দেখলাম। ক্যালকাটাতেওবা কজন রাখে?

তখন বাগচী বলেছিলো, কীবলের মুখে ইংল্যান্ডের কথা শুনেই তারা দেওয়ানসাহেবের কাছ থেকে টাইমস চেয়ে এনেছে। কাগজগুলো পুরনোই। তখন আবার বাষ্পীয় জাহাজ চললে কাগজও তাড়াতাড়ি আসবে, এবং তা কী অলৌকিক ব্যাপার তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। কফির সঙ্গে পিয়ানোর কথা উঠেছিলো। কীবল বলেছিলো, এমন দামী জিনিস নিছক খেয়ালের কথা। তখন কীবল ধর্মাচরণ এবং পিয়ানো বাজনা সম্বন্ধে এই গল্পটা বলেছিলো :

গল্পটা কার্ডিন্যাল নিউম্যানের প্রিয় শিষ্য ডব্লু. জি. ওয়ার্ড সম্বন্ধে। তাঁকে কীবল শেষবার দেখেছিলো অক্সফোর্ডের পথেই। বছর পঁয়তাল্লিশের একজন ইংরেজ ভদ্রলোক, কিন্তু ঘটনার সময়ে ওয়ার্ড যুবক। তখন ধর্মের ব্যাপারে ঝাঁজালো-ধারালো যুক্তি তৈরি এবং সঙ্গীতচর্চা এই দুইয়েতেই সমান প্রবল অনুরাগ তার। কখনো তিনি ইউক্যারিস্টের গুহ্যতত্ত্ব সম্বন্ধে পাণ্ডিত্যপূর্ণ রহস্যময়তার আঁধি তুলছেন, কখনো মোজার্টের কোনো ফিগারোর স্বরলহর ছড়িয়ে দিচ্ছেন কূজনের মতো। এই দুইয়ের কোনটিতে তার অন্তর সায় দিচ্ছে সে বিষয়ে তাঁর ধর্মগুরু ডক্টর পুসেরও দ্বিধা ছিলো। একদিন ওয়ার্ড শুকনো মুখে ডক্টর পুসের কাছে উপস্থিত হলেন। স্বীকার করলেন লেনটেনের সময়ে সঙ্গীতের মতো হালকা ব্যাপারে জড়িয়ে না-পড়ার যে প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন তা রাখতে গিয়ে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে। এ বিষয়ে ডক্টর পুসে কি কিছু উপায় বাতলাতে পারেন?

ডক্টর স্থির করলেন, একটু-আধটু পবিত্র ধাঁচের বাজনা তেমন ক্ষতি করে না বোধ হয়। কৃতজ্ঞ ওয়ার্ড এক বন্ধুর ঘরে বাজনার আসর পাতলেন। শুরু হলো হেন্ডেলের গম্ভীর সঙ্গীত দিয়ে। চেরুবিনির ধর্মীয় স্বরলহরী তারপরে; ম্যাজিক ফুটের স্বর্গস্পর্শী স্বরগ্রাম এসে গেলো। কিন্তু হায় মোজার্টে অনেক বিপদ। কেউ হয়তো পাতাটা উল্টে দিয়েছিলো। আর সেইখানেই ছিলো পাপাজেনো-পাপাজেনার সেই দ্বৈতসঙ্গীত। রক্তমাংসের মানুষ আর কত সয়! সঙ্গীতের পর সঙ্গীত, স্বরগ্রাম হালকা ও দ্রুততর ক্রমে। যখন শেষ হলো মনে হলো। তখন দেয়ালের গায়ে কে মৃদু কিন্তু বারংবার টোকা দিয়ে চলেছে। হঠাৎ বন্ধুদের খেয়াল হলো, সর্বনাশ! পাশের ঘরটাতেই ডক্টর পুসে থাকেন বটে।

গল্পটা বলে কীবল, গল্পটা শুনে কেট ও বাগচী হেসে উঠলো। হাসতে-হাসতে সে বললো, না-না, আমি এমন পাদ্রী নই যে পিয়ানোতে আপত্তি থাকবে।

গল্পের মধ্যেই কফি শেষ হয়েছিলো। কেট উঠে দাঁড়ালো। কফির কাপ-প্লেট ট্রেতে কুড়িয়ে নিতে নিতে বললো– সে–আমাদের ঝি-চাকর নেই। লাঞ্চ কিছু বাকি আছে তৈরি করতে। আপনারা গল্প করুন। আমিও মাঝে-মাঝে আসবো।

কেট চলে গেলে বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–মিস্টার ওয়ার্ড কি রোমান ক্যাথলিক?

কীবল বললো–সম্ভবত। কিন্তু অ্যাংলো ক্যাথলিকদের সঙ্গে বিবাদ আছেবলেও শুনিনি। আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক ধরেছি। আপনি কোয়েকার। প্রকৃতপক্ষে আমি আজই চিঠি দিলাম বাড়িতে, তাতে লিখেছি, এখানে একজন প্রকৃত কোয়েকারের সাক্ষাৎ পেয়েছি।

বাগচী কোয়েকার শব্দ শুনে তার তাৎপর্য আবার উপলব্ধি করেই যেন শিউরে উঠলো। ঈশ্বরের সান্নিধ্যের অনুভূতিতে কম্পমান! সে বললো–সর্বনাশ! আপনি করেছেন কী?

-কেন আপনি কোয়েকার নন?

–হয়তো ডিসেন্টার। কেউ কেউ বলে ইউনিট্যারিয়ান।

-আদৌ না। আমি এবার লিখতে পারবো ইউনিট্যারিয়ানদের মধ্যে কোয়েকারের ভাব থাকে। আমি কিন্তু ইংলিশ চার্চেই অর্থাৎ অ্যাংলোক্যাথলিক আছি। যদিও আমার বন্ধুদের মধ্যে অনেকে এবং ক্রিমিয়ার কমরেডদের মধ্যে অনেকে বিশেষ করে যারা আইরিশ, রোম্যান ক্যাথলিক ছিলো।

বাগচী হাসিমুখে বললো–ডানকান আপনাকে ইভানজেলিস্ট এবং সেন্ট বলেছিলো।

কীবল হেসে বললো–আমাদের বন্ধু এসব ব্যাপারে পুরনো খবর রাখেন। তিনি অবশ্য ইভানজেলিস্টদের যে একসময়ে সেন্ট বলে ঠাট্টা করা হতো সে খবর রাখেন। কিন্তু এখন সেসব দিন বেশ বদলেছে।

এরপরে যে আলাপ হলো তা ইংল্যান্ডের ধর্ম-আন্দোলন সম্বন্ধে। বাগচী মাঝে-মাঝে প্রশ্ন করে এহংকীবল তার উত্তর দিয়ে যে আলোচনা তৈরি করলো তাকে সংক্ষেপে এরকম বলা যায় : রাষ্ট্রস্বীকৃত সুতরাং বৃত্তিপ্রাপ্ত পুরোহিত সম্প্রদায় যে ক্রমশই জনসাধারণের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিলো, তার প্রমাণ তৎকালীন র‍্যাডিক্যাল প্রেসের বিদ্রূপ, পরিহাস, ক্যারিকেচার। ১৮৩১-এ রিফর্ম বিলের বিরুদ্ধে হাউস অভ লর্ডসে ধর্মীয় পীয়ররা ভোট দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ধূমায়িত অসন্তোষকেই বরং জ্বালিয়ে তুললেন। সেই বছরের শীতকালে রিফর্মসমর্থক জনতা বিশপদের গাড়িতে ঢিল ছুঁড়ে এবং তাদের প্রাসাদে আগুন দিয়ে শুধু ছেলেমানুষি আনন্দই করেনি, প্রাপ্তবয়স্কের ক্রোধও দেখিয়েছিলো।

ভয়সন্ত্রস্ত চার্চম্যানেরা এবং তাদের উল্লসিত প্রতিপক্ষও স্থির করে নিয়েছিলো, ১৮৩৩ এর পার্লামেন্টের প্রথম কাজই হবে ডিসেন্টারদের স্বীকৃত অভিযোগগুলো দূর করা।

বাগচী বললো–তা বটে। এঁর বাবা এডুজ বলতেন, তখন বরং ধর্মীয় লর্ডদের, যাদের সামাজিক ও সংস্কৃতিক সম্বন্ধ উঁচুতলায় অন্য শ্রেণীর লর্ডদের সঙ্গে, তাদের কুটি উপেক্ষা করেও জনসাধারণের যে কোনো একজনেরই যে বাইবেল থেকে ধর্মপ্রচারের অধিকার আছে তা প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিলো।

কীবল বললো, বলা বাহুল্য ডিসেন্টার এবং এভানজেলিস্টদের জনপ্রিয়তার কারণ যতখানি ধর্ম সম্বন্ধে তাদের ঐকান্তিকতা ঠিক ততখানিই তাদের সমাজসেবার আগ্রহ। উইলবারফোর্স এবং বাক্সটন যাঁরা ক্রীতদাসপ্রথা লোপ করার ব্যাপারে নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা মনেপ্রাণে এভানজেলিস্ট ছিলেন সন্দেহ নেই। বাগচী বললো–বেন্থামের সেই কথাটাও মনে রাখতে হবে। তোমার নিশ্চয় মনে পড়বে কেট, তিনি বলেছিলেন সমাজের অন্যায় দূর করলে যদি সেন্ট বলে বিদ্রূপ করা হয় তবে তিনি সেন্ট অথবা এভানজেলিস্ট হতে আপত্তি করবেন না।

কীবল বললো–অন্যদিকে কেউ-কেউ এখনই মনে করে, ডিসেন্টারদের প্রাদুর্ভাব যে শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাতে সন্দেহ নেই। শিল্পবিপ্লবে কিছু কিছু শ্বেতকায় ক্রীতদাস তৈরি হয়েছিলো। ডিসেন্টারদের সকলকেই অল্পবিস্তর তাদের উন্নতির চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছে। এককথায় হাই চার্চ-এর তারা যেমন রাজা, লর্ড, বিশপ এবং ধনী জমিদার ও ব্যবসায়ীদের পক্ষে, লো চার্চ-এর ওরা তেমন মধ্যবিত্ত নিম্নমধ্যবিত্ত যারাই আকাশের তলে মাথা তুলতে চাইছিলো তাদের প্রতিভূ ছিলো–এরকম মোটামুটি বলা যায়।

কিন্তু কেট এলো। সে ইতিমধ্যে লাঞ্চের ফ্রায়েড রাইসের জল বসিয়ে এসেছে উনুনে।

বাগচীকে বললো–তুমি স্নান করবে তো? আমি বসি বরং অতিথির কাছে।

বাগচী উঠলো। অতিথিকে কিছুক্ষণের জন্য মাপ করুন বলে স্নান করতে গেলো সে।

কেট বললো–এখানে আপনার নিশ্চয় অসুবিধা হচ্ছে। আউটল্যান্ডিশ মনে হয় না?

-আউটল্যাভিশ? কীবল বললো–রোম্যান্টিক বরং, কিংবা রোম্যান্টিক বিষয়টাতেই আউটল্যান্ডিশ ভাব থাকে না? কিন্তু আপনি আমাকে মাপ করবেন যদি আমি আপনাদের ছবিগুলোকে ভালো করে দেখি।

-স্বচ্ছন্দে। বলে কেট উঠলো। বললো–আসুন।

ওয়াল-ক্লকের উপরে প্রিন্ট। বেশ খানিকটা সময় নিবিষ্ট হয়ে সেটিকে দেখলো কীবল। বললো–ক্রাইস্ট চার্চ নাকি?

কেট বললো–আগে ছবির তলায় পরিচয় লেখা ছিলো। নতুন করে ফ্রেমে পরানোর সময়ে ঢেকে গিয়েছে। ঠিক বলতে পারি না। এটা বোধহয় একারম্যানের প্রিন্ট, এরকম শুনেছিলাম মনে পড়ছে। হ্যাঁ, ক্রাইস্ট চার্চই হবে।

-কিন্তু এসব প্রিন্ট এখন ইংল্যান্ডেও দুর্লভ।

প্রিন্ট ছবিটা দেখে বিপরীত দিকে দেয়ালের প্রাকৃতিক দৃশ্যের সেই জলরং ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কীবল। একটু উপরে ছবিটা। ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয় স্বদেশের দৃশ্য। চিত্রীও সুনিপুণ। কীবল মুগ্ধ হয়ে গেলো।

দেখতে-দেখতেই সে জিজ্ঞাসা করলো–এটা কি মূল ছবি? তাই যেন মনে হয়। টার্নার নাকি?

কেট পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিলো। সে বললো–না, টার্নার নয়, এ জানতাম। এ ছবিটাও আমার বাবার সংগ্রহ। তার কাছে শুনেছিলাম এটা নরউইচ স্কুলের। দস্তখতটাকে দেখুন, কটম্যান মনে হয় না?

ছবিটাকে আর একটু ভালো করে দেখার জন্য পিছিয়ে আসতে গিয়ে ছেলেমানুষি কেলেঙ্কারি ঘটালো কীবল। গায়ে-গায়ে লাগলো কি না-লাগলো, কেটের সেন্টের সৌরভ কীবলকে অন্তরে বিদ্ধ করলো। এ অবস্থায় অনেকক্ষেত্রে পুরুষের চোখে পরিবর্তন দেখা দেয়। কীবল না বুঝে সে রকমভাবে চাইলো। ফলে কেটের মুখও লাল হয়ে উঠলো।

কীবল বললো–আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে দয়া করে ক্ষমা করুন।

মুহূর্তের মধ্যেই হেসে কেট বললো–আসুন, তার চাইতে বরং আপনার যুদ্ধের কথা শুনি।

কীবল বললো–দেখুন মিসেস বাগচী, এমন আশ্চর্য লাগছে আমার এখানে। আমি নিজেই ঠিক পাচ্ছি না ম্যানার্সের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছি কিনা।

হয়তো ক্রিমিয়ার অভিজ্ঞতা কিছুটা আপনাকে নন কনভেনশ্যানাল করেছে। কেট হাসলো মিষ্টি করে।

বাগচী স্নান করে ফিরে এলো। মঞ্চের আগে গৃহকর্ত্রীরও বসে থাকে চলে না বিশেষ যদি সংসারের কাজ নিজে করতে হয়।

বাগচী বললো–এটা কিন্তু খুব মজার ব্যাপার। আমরা যখন ভাবতাম মানুষ ধর্মের কাছে। থেকে সরে যাচ্ছে বিজ্ঞানের আবিষ্কার এবং ইনডাস্ট্রির প্রসারের ফলে, তখনই ধর্মটা আবার সর্বত্র প্রবল হয়ে উঠছে, তাই নয়! নতুন রোমান ক্যাথলিকদের সঙ্গে আমাদের মত না মিলতে পারে, কিন্তু তাদের সে ব্যাপারটায় একটা ঐকান্তিক অনুসন্ধান ধরা পড়ে, কেমন তাই মনে হয় না?

কীবল বললো–ঐকান্তিকতা তো বটেই। নিউম্যান, পুসে, কীবল, ম্যানিং প্রত্যেকেই ধর্মের ব্যাপারে ঐকান্তিকভাবে আগ্রহশীল তাতে সন্দেহ কী?

লাঞ্চে বসেও আবার এই ধর্মের কথাটা উঠে পড়লো।

বাগচী বললো–কি লন্ডনে কি ক্যালকাটার শিক্ষিত মানুষমাত্রেই এখন ধর্ম সম্বন্ধে চিন্তা করে দেখুন। প্রচলিত পদ্ধতি যাচাই করে দেখছে অনেকেই। নতুন পথে অগ্রসর হতে চেষ্টা করছে যেন ঈশ্বরের দিকে। এসব খুবই ভালো, তুমি কী বলল কেট?

কেট বললো–সত্যর কাছে পৌঁছনোর আগ্রহ বলছো?

–আমার তো তাই মনে হয়। মিস্টার কীবল, আমি শুনেছিলাম শিক্ষিত সংস্কৃতিবান যুবকদের নিউম্যান, কীবল প্রভৃতি গুণীব্যক্তিরা বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছেন। আপনার কি মনে হয় রোম্যান ক্যাথলিকদের সংখ্যা ইংল্যান্ডে এখন বিশেষভাবে বাড়বে?

একটু জল খেয়ে নিয়ে কীবল বললো–তা বলা শক্ত কিন্তু। ১৮৪৫-এর পরে অর্থাৎ নিউম্যান রোম্যান ক্যাথলিকে দীক্ষিত হওয়ার পরই অক্সফোর্ড আন্দোলন দুভাগ হয়ে গিয়েছে। পুসে ও কীবলের অ্যাংলো ক্যাথলিক; নিউম্যান-ম্যানিং-এর রোম্যান ক্যাথলিক সম্প্রদায়।

কেন, তার কী দরকার ছিলো? কেট জিজ্ঞাসা করলো।

–রোম্যান ক্যাথলিকদের পক্ষে শিক্ষা, কালচার এবং ধর্মে অনুরাগ থাকলেও সেই মতবাদ যে চট করে ইংল্যান্ডে বেড়ে উঠবে তা মনে হয় না। ভেবে দেখুন ১৮৫০-এ পোপ কয়েকজন রোম্যান ক্যাথলিক বিশপের এক্তিয়ার ঘোষণা করার সঙ্গে-সঙ্গে পোপের আক্রমণবলে যে আন্দোলন তৈরি হয়েছিলো তা এখনো থিতিয়ে যায়নি। ইংল্যান্ডে রোম্যান ক্যাথলিকদের সহ্য করা হচ্ছে, কিন্তু পোপের প্রভাব রাজনীতির দিকে এগিয়েছে মনে করা মাত্র ইংল্যান্ডে প্রতিবাদের ঝড় উঠবে। তাই স্বাভাবিক নয়? এবং এই কারণেই অ্যাংলো ক্যাথলিক হয়েছেন কেউ-কেউ। দেশপ্রেমের তত টান একটা আছে। (কীবল এই জায়গায় একটু হাসলো)।

বাগচী বললো–হ্যাঁ, তা বটে। এরকমও শুনেছি।

সে কৌতুক বোধ করলো। যেন মনে মনে বললো, স্বাজাত্যবোধ এবং বিদেশীধর্ম, যতই বলো ধর্ম জাতি দিয়ে বিভাজ্য নয়। আসলে কিন্তু ধর্ম জাতীয়তার সীমা লঙঘন করলেই মুশকিল।

তখন আলাপের থেকে লাঞ্চের সুস্বাদ তাদের আকর্ষণ করলো।

পরবর্তীকালে কীবল অনুভব করেছে সেদিনকার লাঞ্চটা ভালোই হয়েছিলো, যার অন্য বিশেষণটা হয়তো ইনফর্মালও হতে পারে। আলাপটা, কি লাঞ্চের আগে কি লাঞ্চের সময়ে, বেশ উত্তেজক হয়ে উঠেছিলো। কিংবা তার অন্য নাম ঐকান্তিক!

লাঞ্চের পরে ইউরোপের সভ্যতার উপরে পেগানদের প্রভাব কিছু আছে কিনা, রেনেশায় তাকতটা খুঁজে পাওয়া যায় এমন আলোচনা হবে বলে মনে হয়েছিলো একসময়ে। তারুণ্যের ফলে কীবলের যেন আলোচনার বাতিকও আছে। কিন্তু এদেশের খাদ্য সুস্বাদু হতে পারে, কেট বলেছিলো, অতি সহজপাচ্যও, কিন্তু তা ভারী আর যেন আয়েশ করতে প্ররোচনা দেয়। লাঞ্চের ওজনটা ভারীই ছিলো, মদের পরিমাণই বরং কম। এবং একটু ঝাল বেশি।

পথে বেরিয়ে, তার ঘোড়া তখন ছুট করছে, কীবলের মনে হলো, সে তার আত্মিক ভগ্নীকে এরপরেই যে চিঠি লিখবে তাতে একারম্যানের প্রিন্ট সম্বন্ধে না-হোক নরউইচ স্কুলের কটম্যানের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতে বলবে।

ঠিক এই সময়েই তার মনে হলো, নাচতে গিয়ে সঙ্গিনীর মাড়িয়ে দেওয়া যেন। না, সে কথা আত্মিক ভগ্নীকে লেখা যায় না বোধহয় সেই কবোষ্ণ অনুভূতির কথা। অথচ এটা অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া কিছু নয়। একটা অনুভূতিই মাত্র, যার প্রমাণ নেই। এবং ভদ্রলোকের তা মনে রাখা উচিত নয়। না, উচিত হয় না।

কীবল অন্য মন দিলো, অর্থাৎ লাগাম দিয়ে আঘাত করে ঘোড়াটার গতি বাড়ালো।

বাগচী বললো–এখন কি আমরা বিশ্রাম করবো ডার্লিং?

–যদি কাজের কথা মনে না হয়। কেট হাসলো। চরণদাসের ডিসপেনসারি?

-বেশ লাগছে। সুন্দর লাঞ্চ, সুন্দর আলাপ। কেমন লাগলো কীবলকে? বাগচী লক্ষ্য করলো না, কেটের জতে একটা হালকা ছায়া পড়লো।

সে বললো–অন্যদিকে দ্যাখো কেট, মানুষ আবার তার ঈশ্বরকে ফিরে পাচ্ছে। নিছক অভ্যাসের ব্যাপারের চাইতে বেশি। ইংল্যান্ডের যাঁরা রোম্যান ক্যাথলিক নিদেন অ্যাংলো ক্যাথলিক হচ্ছেন, কলকাতার যাঁরা খৃস্টান ও ব্রাহ্ম হচ্ছেন, তারা সমান পিপাসা নিয়ে চলেছেন–এমন মনে হয় না? মনে হয় না যে, কি লন্ডনে, অক্সফোর্ডে, কি কলকাতায় যেন একই ঈশ্বরের প্রভাবে মানুষ ধর্মের দিকে মুখ ফিরিয়েছে। একটা কথা কিন্তু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। বিলেতের ওঁরা ইন্টারশেসনকে মূল্য দেন কিনা।

ইন্টারশেসন বলছো? আমার মনে হয় রোম্যান ক্যাথলিকরা তা মানবে।

বাগচী ভাবলো–আমি এবং আমার ঈশ্বর–আমাদের মধ্যে আমার হয়ে ঈশ্বরকে নিবেদন করার জন্য সত্যি কি অন্য কাউকে দরকার হয়? যাকে ইন্টারশেসন বলা যাবে?

কিন্তু তখন বিশ্রামের সময়, ছুটির দিন। বাগচী পাইপ ধরালো। উল কাটা নিয়ে বসলো কেট।

কয়েকদিন পরে একদিন বাগচী এই প্রশ্ন তুলেছিলো :বিলেতের ইভাঞ্জেলিস্ট আন্দোলন তাদের দেশের সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। সে দেশের মধ্যবিত্তদের সাংস্কৃতিক প্রাধান্য লাভের ইচ্ছা তার পিছনে কাজ করছে। কলকাতায়? এখানে এই দেশে কেউ কি বলবে না, ধর্ম আছে, যথেষ্ট ধর্ম আছে। অন্য কিছু চাই। তখন তার মন কালো থাকায় সে কলকাতার ধর্ম-আন্দোলনটাকে বিলেতিয়ানা বলে অনুভব করেছিলো। বিলেতে যা হচ্ছে এখানে তা হোক এমন বিলেতিয়ানা নিছক নকল। কিন্তু এ ভাবনা পরে।

তখন কেট বললে, উঠছো তো?

বাগচী বললো, দেরি করে ফেলেছি, রোগীটা বসে আছে।

.

০৭.

নয়নতারা বললো–দূরে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারাই কি শিকারের সঙ্গী?

ইতিমধ্যে কখন ঘোমটা উঠেছে খোঁপা ঢেকে। নয়নতারা একটা হাতে ঘোমটার দুপাশ ধরলো, তাতে রগ, কান, চিবুক আর-একটু ঢাকা পড়লো।

হাতি ক্রমশই লোকগুলির দিকে এগোচ্ছে।

নয়নতারা বললো– রাজকুমার, শুনেছি কুমীর শিকার নাকি জলের বুকে করতে হয়। ওই সরু-সরু নৌকোগুলোকেই ব্যবহার করা হবে?

দূরে বিলের বুকে সরু-সরু কয়েকটি নৌকো বটে।

নয়নতারা আবার বললো–জানো, কুমীর ইচ্ছা করলেই কাঠের গুঁড়ি হতে পারে? রাজু বললো–শুনেছি, বাঘও ঝোপঝাড় হতে পারে।

–কিন্তু

কী কিন্তু?

রাজু দেখলো নয়নতারার ঝুঁকে পড়া মুখটায় চাঁদরের ঘের বাঁহাতে চিবুকের উপরে ধরা। ঠোঁট দুটো হাসছে। কিন্তু চোখ দুটি যেন বেশি টানা আর স্নিগ্ধ হয়ে উঠলো। নয়নতারা এই প্রথম রাজুর হাতের উপরে হাত রাখলো যেন স্পর্শেও তেমন স্নিগ্ধ কিছু বলবে। চাপা গলায় বললো–আমি ক্ষত্রিয়া নই, দোহাই রাজু।

কিন্তু ততক্ষণে হাতি দেখে গ্রামবাসীরা হৈচৈ করে এগিয়ে এলো।

নয়নতারা বললো–আর কখনো মই ছাড়া হাতি বার করার কথা ভেবো না। কী মুশকিল!

রাজু নামলো শুঁড় বেয়ে। মাটিতে দাঁড়িয়ে হেসে বললো–তাহলে ঠাকুরানী তোমার নতুন পত্তনিটাকে পছন্দ হয় কিনা তা দ্যাখো। মাহুতকে বললো– কাছারিতে তহশীলদারনা থাকে অন্য কেউ থাকবে, মোড়লদের বাড়িতে খবর দিও, সাহেবান কাছারির খাস কামরায় দুপুরে থাকবেন। আমরাও কাছারির ঘাটে উঠবো বিকেলে।

পরে একদিন নয়নতারা রাজুর এই উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করেছিলো।

.

কেউ-কেউ বলে,কুমীরের নানা জাত আছে এবং তারা নাকি হিংস্র। তাদের গায়ের চর্ম বর্ম, চোয়ালে বসানো সারি-সারি বল্লমের ফলা, এবং জলের তলায় ডুবো জাহাজের গতিবিধি–এসবই নাকি তার গোপন হিংস্রতার কিছু কিছু প্রমাণ যা গোপন রাখতে পারেনি। কিন্তু কুমীর যে বোকা সে বিষয়েও অনেক গল্প আছে, বাঁদর, শিয়াল কার কাছেই না সে ঠকেছে। সুতরাং মানুষের সঙ্গে যারা সশস্ত্র এবং বন্দুকও আছে যাদের-তারা যখন দলবদ্ধ, তখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা সাময়িকভাবে আতঙ্কজনক হলেও দীর্ঘস্থায়ী হয় না। তীব্র ব্যথা যা সমস্ত শিরা-উপশিরা স্নায়ুকে পাগল করে তোলে, লুকোনোর পালানোর চেষ্টা যা শরীরের সব যন্ত্রকে একসঙ্গে পুরোদমে চালাতে চেষ্টা করে, তারপরের সেই বিস্ময় যখন কোনো যন্ত্র চেষ্টা সত্ত্বেও কোনোদিনই যেমন অচল অকেজো দেখা যায়নি তার চাইতেও অকেজো হয়ে যায়, আর নিজের চারপাশেই সেই রংটা দেখা দেয় জলে যা খাদ্যসংগ্রহের সার্থক চেষ্টার লক্ষণ হিসেবেই তার পরিচিত, এবং তখন খাদ্যসংগ্রহ হয়েছে কী না-হয়েছে, শরীরের ভিতরের সেই জ্বালা খাদ্যসংগ্রহের সার্থকতাবোধই কিনা এমন অনুভব করতে করতে রোদ পোহানোর অনুভূতি আর আগ্রহ এসে মিশে যায় সেই অনুভূতিতে, স্থির হয়ে যায় কুমীরটা।

কিন্তু এর বেশি কুমীরের কথা আমরা কী বলতে পারি?

কিন্তু বিল? তা যেন একটা আলাদা জগৎ। কোথাও দু-চার-দশ বিঘা পরিমাণ দাম। দামে কাষা, হোগলা প্রভৃতি ঘাস তো আছেই, আশশেওড়া, আকন্দ, এমনকী বাবলাও জন্মেছে কোথাও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদিকের অধিবাসীরা দাম কেটে জলের গলিপথ বার করেছে। অন্য কোথাও টলটলে পরিষ্কার জল। সে জলে কোথাও কলমি, কোথাও শাপলা, অন্য কোথাও দশ-বিশ বিঘা পরিমাণ পদ্মবন। দামের উপরে বক, হাড়গিলে, মাছরাঙা; কলমি, শাপলার মাঝে মাঝে পানকৌড়ি আর মাছরাঙা।

রাজু যেখানে দাঁড়িয়েছিলো তার কাছাকাছি পারের সমান্তরাল একটা চর জেগেছে যেন। চরটার ওপারে অন্তত এক ঝাক বুনো হাঁস।

বিলমহলে রাজুদের কাছারি আছে বটে। গ্রামের লোকেরা বললো, তা প্রায় একক্রোশের পথ হবে। কিন্তু কুমীরের আজ্ঞ সামনের বাঁকটা থেকেই দেখা যাবে।

রাজু জানালো কাছারীতে তার কোনো কাজই নেই, এখনই বরংকুমারীর খোঁজে যাওয়া যেতে পারে। গ্রামের লোকেরাও বললো, সেটাই ঠিক হবে। রোদের তাপকমলে কুমীরকেও ডাঙায় পাওয়া যাবে না। তারাই স্থির করলো যত লোক জমেছে সবাই গেলে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙবে, কুমীর তো একচোখ খুলেই ঘুমোয়। সুতরাং শালতি আর তার সঙ্গে দুখানা। ডোঙামাত্র যাবে । রাজুর সামনের যে চরের কথা বলা হয়েছে সেই চর আর এ পারের মধ্যে বিলের জল একটা ছোটোখাটো নদীর মতো। শালতি বা ডোঙার পক্ষে যথেষ্ট গভীরও বটে।

শালতি একটু এগিয়ে যেতে রাজু দেখতে পেলো চর একটাই নয়, আর প্রথমটিই সব চাইতে উল্লেখযোগ্য নয়। কোনো চর পারের সমান্তরাল, কোনোটি বা কোনা কুনি পারের দিকে এগিয়ে এসেছে। যেখানে চরটা বড়ো এবং খালের পরিসর এবং কম সেখানে দু-তিনটি বাঁশ পাশাপাশি বেঁধে সাঁকো করা হয়েছে। এমন একটা সাঁকোর নিচে দিয়ে শালতিটা অনায়াসে গলে গেলো।

এদিকের চরগুলোর বৈশিষ্ট্য আছে। নদীর নয় যে কোথায় বালি আর কোথায় পলি খুঁজতে হবে। যেদিন চর জাগে সেদিনই চাষ দেওয়া যায়, কলাই আর ধান হবেই। যেখানে চরটা বড় সেখানে চাষ হয়েছে। কোনো কোনো চরে দু-চারটি ছোটো ছোটো ঘরও চোখে পড়ছে।

দিনটা পরিষ্কার। অনেক দূর পর্যন্ত খোলা আকাশ চোখে পড়ছে। নীল উঁচু আকাশে কোথাও সাদা তুলো ছড়ানো।

কোথাও জল একেবারে শান্ত কাঁচের ফলকের মতো। অন্য কোথাও, যেখানে জলটা অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে, সেখানে, বিঘৎ পরিমাণ উঁচু ঢেউ উঠছে বাতাস লেগে। কোথাও শালতি দেখে জলের ধারের হাড়গিলে আকাশে উঠলো। কোথাও চাষ থামিয়ে কৃষক জলের ধারে এগিয়ে এলো বালতি-ডোঙার ছোটো বহরটাকে ভালো করে দেখতে। একবার একটা চর ঘুরে যেতে, না বুঝে এক ঝাক বুনো হাঁসের মধ্যে গিয়ে পড়লো শালতি। ডাহুক, হাঁস, করন্ডে সে কি প্রতিবাদ!

রাজুর সঙ্গীরা স্থির করেছিলো কুমীরকে তারা গ্রামের বিপরীত দিক থেকে আক্রমণ করবে। কারণ দেখিয়েছে–তাড়া খেলে গভীর জলের দিকেই ঝুঁকবে সে। যদিবা গ্রামের দিকে যায় সেখানে এক কোমরের চাইতে বেশি জল নেই, ভাল্লা তেঁটায় সেখানে কুমীরকে ঠেকানো যাবে।

আরো আধঘণ্টা শালতি এদিক-ওদিকে চলে একটা বড়ো চরের দু-তিনশো গজের মধ্যে এসে পড়লো। বড়ো চড়টার কাছেভিতে আরো কতগুলি ছোটো ছোটো চর কুমীরের পিঠের মতোই জেগে আছে।

কিন্তু কুমীর তো মাটির তৈরি নয়। আরো একঘণ্টা ধরে এ-চর সে-চরকে বেষ্টন করে ঘোরা হলো। কাদাখোঁচা পাখি আর টিটিভকে নড়তে-চড়তে দেখা গেলো, মাছ ধরার আশায় ডুবিয়ে রাখা ভোঙাকে ভুল বুঝে একবার খুব সন্তর্পণে এগিয়েও গেলো শালতি, কিন্তু কুমীরকে গল্প বলেই মনে হলো।

তখন রাজু আবার ঘড়ি বার করে দেখলো। চারটে বাজতে চলেছে। অনুমান হয় দিগন্তর বিস্তার ছোটো হয়ে আসছে। জলে লগির যে-ছায়া পড়েছে তা থেকে বোঝা যায় সূর্য ইতিমধ্যে পশ্চিমে নেমে পড়েছে। ঠিক এমন সময়ে লগিওয়ালাদের একজন চাপা গলায় ইশারা করলো। অন্য লগিওয়ালারা ইশারা বুঝে উল্টোদিকে লগি বসালো। সামান্য একটা আঁকি দিয়ে শালতি থামলো। হাতের ইশারায় ইশারায় জানাজানি হয়ে গেলো। শালতির দিকে মুখ করে একটা আর তার পেটের দিকে মুখ করে আর-একটা।

শালতির গলুই-এর কাছে খানিকটা পাটাতন, তার উপরেই বসেছিলো রাজু। তার উপরেই হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলো সে। দুটো তো আর সম্ভবনয়। যেটিকে আড়াআড়ি পাওয়া গেলো সেটির সামনের পা আর ঘাড়ের মাঝামাঝি জায়গায় লক্ষ্য করে একবার, গুলি খেয়ে সেটা লাফিয়ে উঠেই চলতে শুরু করতে না করতে পা ও পেটের মাঝামাঝি নিশানা পেয়ে আর একবার গুলি করলো রাজু। অন্য কুমীরটি ভয় পেয়ে শালতির দিকেই ছুটতে শুরু করলো। তার সুচলো মাথা ওপাশের ডোঙার হাত আট-দশের মধ্যে এসে পড়লো। ভোঙার লোকেরা চিৎকার করে উঠলো। কুমীরের মুশকিল হলো, কিংবা তার দুর্ভাগ্য। যেখান থেকে সে জলে নামতে ছুটছে সেখানে জল এক কোমরের বেশি নয়। আর একটু ঘুরে হাত-দশেক দূর দিয়ে গেলে সে গভীর জলই পেতো। ডোঙার মানুষরা তখন মরিয়া, কুমীর উপরে এসে পড়লে জলে পড়বে মানুষ; আর জলে কেউ কুমীরের সঙ্গে বিবাদ করে না। টেটা আর বল্লমের (সবগুলোতেই দড়িবাঁধা) খোঁচায় কুমীরকে রুখতে চেষ্টা করলো তারা। কুমীর ছুটে আসছিলো, তার ভারি শরীরের ওজনের সঙ্গে সেই গতি গুণ হচ্ছে। একটা ধারালো টেটা বিধতে তার শরীরের চাপেই সেটা তার মর্মে পৌঁছলো। মুহূর্তে দিক বদলালো সে, টেটার রশিতে টান পড়লো, আর সেই টানে ডোঙা কুমীরের ডাঙ্গায় উঠে পড়লো। রাখো রাখো, গেলো-গেলো করতে করতে অন্য ডোঙাটা লগি ঠেলে শালতিকে ধাক্কা দিয়ে প্রথম ভোঙাটাকে সাহায্য করতে এগোলো। সে ডোঙা থেকেও টেটা ছোঁড়া হলো দু-তিনটি। দৈবাৎ তার একটি মানুষকে না-বিধে কুমীরকেই বিধলো। দু-দড়ির টান পড়লো কুমীরের উপরে।

চরের উপরে আড়াআড়ি দুটো নালা। অল্প জল বলেই মনে হয়। সেই নালার দিকে ততক্ষণে চলছে গুলি-খাওয়া প্রথম কুমীরটা। শালতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে গিয়েছে। সেটা লেজ আছড়াচ্ছে। রাগে, কিংবা একটা পা ভেঙেছে বলেই, চলতে গিয়ে লেজের অমন ব্যবহার হচ্ছে।

ডাঙার লোকরা গেলো-গেলো রাখো রাখো করছে, রাজু একবার সেদিকে চেয়ে দেখলো। শালতিকে চরের উপরের নালায় নিতে বললো। পরিস্থিতিটা বুঝতে চেষ্টা করলো। একমুহূর্তে কীই-বা বোঝা যায়! মাথার উপরে বন্দুক আর টোটার বেল্ট এক হাতে উঁচু করে ধরে সে জলে লাফিয়ে পড়লো। ওদিকেও কুমীরের টানে ডোঙা জলে ধাক্কা মারছে।

কী করবে তা শালতির লোকরা বুঝে উঠতে পারলো না। জল এখানে খুব বেশি না থাকার কথা, তাহলেও এক কোমর জল কেন হাঁটুজলেও কি মানুষ কুমীরের সমকক্ষ? কিন্তু রাজকুমার তো, কী বিপদ! শালতির একজন চিন্তা করে জলে নামলো। অন্য আর-একজন তাকে দেখে জলে লাফিয়ে পড়লো। ততক্ষণে রাজু জল ঠেলে, জল ছিটিয়ে চরের মাঝামাঝি গিয়ে পৌঁছেছে। তার ভিজে স্যুট থেকে জল গড়াচ্ছে।

রাজু একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে পরিস্থিতিটা দেখলো, বন্দুকে দুটো গুলি পুরে সে আবার ছুটলো হাঁটুজল ভেঙে। জল ছিটোছে পায়ে-গায়ে। জলে গতি আটকাচ্ছে। কুমীরের সঙ্গে কি ছুটে পারা যাবে! ওদিকে ডুবো ঝোপঝাড়। কুমীর সেদিকে গেলে খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে, কিংবা চরের ওদিকে জল পায় যদি। চর অসমান, উঁচুনিচু, গাড়াগর্তও আছে।

না, কুমীরটা তেমন ছুটতে পারছেনা। চাকাভাঙা গাড়ির মতো অবস্থা তার। একটা ঢালু দেখে সে বোধ হয় আশা করলো সেদিকে জল আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে একটা গাড়া। নিচে নেমে গিয়ে জল না পেয়ে কুমীরটা দিক বদলে কিংবা ভুল করে বরং রাজুর দিকে এগিয়ে এলো, কিংবা পাশ কাটাতে গিয়ে দূরত্বটা কমিয়ে আনলো। হাঁটু গেড়ে রাজু কাদামাটিতে বসে পড়লো। একমুহূর্ত তাক করে রাজু গুলি করলো। এবার কুমীরের গতিটা থেমে গেলো।

অন্য কুমীরটাকে নিয়ে ভোঙার লোকেরা বিপদেই পড়েছিলো। দুটো টেটার, তা অবশ্য কুমীর যত টানছে ততই তার নাড়িতে টান দিচ্ছে, দড়ি ধরা বটে কিন্তু তাতে তার লেজের আছড়ানো কমছেনা, চলাও বন্ধ করেনি সে। একজন সাহস করে বল্লম মারলো পাশ থেকে, কিন্তু যেন ঠিকরে এলো কুমীরের কাটার খোলা থেকে। তখন আর-একজন বরং তার মুখের দিকে এগিয়ে গিয়ে পেটের কাছাকাছি আর একটা টেটা বিধিয়ে দিতে পারলো। টেটাটার দড়িবাধা ডগাটা মাটি আর কুমীরের শরীরের চাপে পাটকাটির মতো ভেঙে গেলো, কিন্তু সেই চাপেই তার ধারালো ফলাটা কুমীরের শরীরের মধ্যে এক হাত পরিমাণ বসে গেলো।

তখন পশ্চিমের আকাশ লালচে হয়ে উঠেছে। শালতিটাকে চরের কোণে ভেড়ানো হয়েছে। রাজু শালতিটাতে বসে দেখলো, বাদামীবাদামী সেই আলোয় দুটো ভোঙার মতো দুটো কুমীর এখন স্থির হয়ে আছে।

শালতির একজন বললো–পা ঝুলিয়ে বসুন, হুজুর, জুতোর কাদা ধুয়ে দিই।

আর-একজন বললো–এখন হুজুর, আমাদের খুব তাড়াতাড়ি যেতে হবে। অন্ধকার হলে চরে-চরে গোলকধাঁধায় পড়বে।

রাজু বললো–একজন বরং বন্দুকটাকে একটু মুছে রাখো, জল লেগেছে।

রাজু ঘড়ি বার করলো। পাঁচটা পার হয়ে গিয়েছে। স্নান হেমন্তের সন্ধ্যা ছটাতেই গাঢ় হবে বটে। ঘড়িটার গায়ে জল। রুমাল দিয়ে রাজু মুছলো।

শালতির সেই লোকটি বললো–এখন হুজুর, শালতির দু মাথাতেই লগি মারা হবে, দুলবে শালতি, আপনার কি অসুবিধা হবে হুজুর?

রাজু বললো–একটার চামড়া কী আমাকে পৌঁছে দিতে পারো তোমরা?

রাজু হেসে বললো–অত তাড়াতাড়ি দরকার নেই।

শালতি চলতে শুরু করলো, শালতির আগেপিছে ডোঙা। একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে গড়িয়ে-গড়িয়ে ছুটছে সেগুলো। ডোঙায় দুজন, শালতিতে চারজন দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে লগি মারছে। একটা শব্দমাত্র করে চারটে লগি পড়ছে জলে। বাচ্ খেলার মতো চলছে শালতি। কী যেন একটা বিড়বিড় করছে লগিওয়ালারা, মন্ত্র যেন। হঠাৎ একসঙ্গে গানটা একটা চিৎকারে ফুটে উঠলো, প্রথমে শালতিতে, পরমুহূর্তে ভোঙা দুটিতেই।

জল কালো, শালতির দুপাশের দাম অথবা চরের আগাছার ঝোপঝাড় বরং কালচে খয়েরি। আকাশ ধোঁয়াটে আর নিচু। শীত শীত লাগছে ভিজে স্যুটে রাজুর।

কাছারির ঘাটে পৌঁছতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়, তা হলোও না। অন্ধকারে পথ হারানোর ভয় রইলো না, কারণ সন্ধ্যার আগেই কাছারির সামনে বড়ো বড়ো মশাল জ্বালানো হয়েছিলো, উপরন্তু কাছারির বজরাই আলো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলো রাজকুমারকে বিকেলের আলোয় ফিরতে না-দেখে।

পারে উঠলো রাজু। জনতার আগ্রহই সীমা ভেঙে এগিয়ে গেলো, আধো অন্ধকারে পায়ের উপরে পা ফেলার জায়গা রইলো না। তখন হঠাৎ একজন মানুষ কোথা থেকে দুই বাহু ছড়িয়ে দিলো। তার দুই ছড়ানো হাতের তেলোর মধ্যে ব্যবধানটা গজচারেক হবে। দুই তেলো দিয়ে সে ভিড়কে চাপ দিয়ে পিছু হঠতে লাগলো যেন দাম কেটে নৌকোর পথ করছে। যেন সে এক অপরিচিত ইঙ্গিতে রাজুকে এগিয়ে যেতেও বলছে। তার হাঁড়ির মতো মাথা, প্রচণ্ড চৌকো চোয়ালের উপরে থাবা-থাবা মেদমাংস বসানো মুখমণ্ডল, উপরের এবং নিচের ঠোঁট-ঢাকা সিন্ধুসিংহের মতো গোঁফ সত্ত্বেও মনে হলো লোকটি নাচছে যেন। অন্তত ভিড় ঠেলতে ঠেলতে তার কাঁধ দুটো এবং বাহুর উপরিভাগ ওঠানামা করছে, মাথাটা ডাইনে বাঁয়ে ফিরছে দুখানাও ঠিক সোজা পড়ছেনা। লোকটির গায়ে কাঁধকাটা পিরহান, কোমরে উড়নি জাতীয় কিছু জড়ানো, ধুতির ঝুল ছোটো তাই কেঁচা হাঁটুর কাছে দুলছে।

লোকটি পিছিয়ে পিছিয়ে যেখানে থামলো সেটা একটা গাছের তলা।

মশালে মশালে গলা সোনা রং। মাটিতে একটা সরু কাজ করা চাটাই বিছানো, তার উপরে একখানা চেয়ারের মতো উঁচু জলচৌকি।

কথা বলতে গেলে বোধহয় গোঁফ তুলে ধরতে হয়, তেমন করে গোঁফ পাকিয়ে লোকটি বললো– বসতে আজ্ঞা হোক, রাজকুমার।

ভিজে জামাকাপড়ে বসবে কিনা এই দ্বিধা করতে লাগলো রাজু। কিন্তু ততক্ষণে সেই বড়ো মাপের লোকটি আর-এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে। সে বললো–জোকার দাও।

যারা ভিড় করছে তারা সবাই পুরুষ। অপটু, অনভ্যস্ত, পুরুষালি গলায় হুলুধ্বনির নকল করে দুএকজন ডুকরে উঠতেই হাসির গররা পড়ে গেলো।

লোকটি বললো–চপ! সে এদিক-ওদিক চাইলো, ভিড়ে কাউকে খুঁজে পেয়ে বললো–ও বামুন, ইদিকে, ইদিকে।

শুটকো কালো চেহারার, কিংবা শুটকো না, বলে, হাড়েমাসে দড়া পাকানো একজন প্রৌঢ় এগিয়ে এসে বললো–তোমার আর সুখের পিরবার নেই মণ্ডল। নাও, ধরো।

সে নিজের মুখের কাছে হাতের তেলো রেখে আ বাবা ইয়া বলে ফুকরে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে সেই মেদের পাহাড়ও।

রাজুর বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠলো। সেই শুটকো বামুনের গোট শরীরটাই একটা শিঙা হলে তবেই তেমন ফুকরে ওঠা সম্ভব।

এই প্রাথমিক কর্তব্য সমাপ্ত হলে মেদমাংসের সেই বালিআড়ি (বালিআড়ি বলাই ভালো, পাহাড় স্থির কঠিন, এক্ষেত্রে পাহাড়ের গা যেন সবসময় সচল, খসে খসে পড়ছে উপরের স্তর হাসি হয়ে হয়ে), সে ট্যাক থেকে হলদে কিছু একটা বার করলো। ডান হাত স্পর্শ করে এগিয়ে ধরলো রাজুর সামনে; গোটা শরীর কোমরের কাছে ভঁজ করে ঝুঁকে দাঁড়ালো। বললো–নেকনজর দিতে আজ্ঞা হোক, রাজকুমার। দৃশ্যটা হেসে ওঠার মতো। কিন্তু ডান হাতের তর্জনী দিয়ে মোহরটাকে ছুঁতে হলো রাজুকে।

রাজুর শীতশীত লাগছিলোই, এখন উত্তেজনার বদলে অস্বস্তি। কারণ সেই কাদাজল হাঁটুর উপর পর্যন্ত পৌঁছেছে। হাতির খোঁজে সে এদিক-ওদিক চাইলো। নিজের অস্বস্তির কথা প্রকাশ করা যায় না। সে বললো–আমার সঙ্গে সদরে দেখা করো, মণ্ডল।

লোকটি এবার সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বললো–হুঁজুরের এই কোলের ছেলের নাম গজা। ওরে হাতি আন। হাতি আন। ভিজে পোশাকে হুজুরের খারাপ লাগছে।

চার মণ ওজনের সেই গজা কোলের ছেলেই বটে।

কিন্তু ততক্ষণে তহশীলদার নিজে পৌঁছতে পেরেছে। ঘণ্টার শব্দও হলো। তাহলে হাতি এবার নড়ছে। বোধহয় হাতিও এতক্ষণ কোণঠাসা হয়েছিলো।

হাতি বসলো। তহশীলদারের লোকরা আলো এগিয়ে আনলো। শালতির লোকেরা শিকারের সরঞ্জাম তুলে দিলো। রাজু হাতির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মাহুতের ইশারায় শুড় নামালো হাতি। রাজু শুড়ের উপরে দাঁড়াতেই শুড় উঁচু করলো। রাজু হাওদায় বসতেই হাতি চলতে শুরু করলো।

নয়নতারা বললো–একেবারে ভিজেছো তো অবেলায়?

রাজু হাসলো। বললো–পাইপ ধরাতে পারলে হতো।

সেই চামড়ার পাউচ বার করতে করতে নয়নতারাকে জিজ্ঞাসা করলো সে কোলের ছেলে গজা মণ্ডলকে দেখেছে কিনা?

মাহুতরা সাধারণত কথা বলে না। কিন্তু গজা সম্বন্ধে বোধহয় না বলে থাকা সহজ নয়। সে বললো–হুঁজুর গজাও নয়, মণ্ডলও নয়। ওর বাপঠাকুর্দা ছিলো মেজা। সেই মিলিয়ে নাম নিয়েছে গজা। তা কাঁধে মাপও গজ হবে।

রাজু দেখলো দেশলাই তামাক ভেজেনি।

অন্ধকার বেশ ঘন হচ্ছে ক্রমশ। ঘাসবনে হাতিও হাওদার তলায় অস্পষ্ট। পাইপেতামাক ভরে দেশলাই জ্বাললো রাজু। আর তখন তার নজরে পড়লো সেই আলোয় নয়নতারার কপালে মস্ত একটা গোল সিঁদুরের টিপ।

রাজু হেসে বললো–সে কী?

এতক্ষণে নয়নতারারও খেয়াল হলো।

রাজু বললো–গ্রামের মেয়েরা তাহলে দুয়ে-দুয়ে চার করে সাজিয়ে দিয়েছে?

নয়নতারা বললো–ছি ছি, উৎকণ্ঠায় কিছু কী মনে ছিলো! রুমালটা দিন।

নয়নতারা আবার বললো–কই দাও রুমালটা।

কপাল মুছতে মুছতে নয়নতারা বললো–আমি তখন জলের বুকে নৌকো খুঁজছি, ওরা এলো সাজাতে।

–তা বটে, রাজু হেসে বললো–কী করেই-বা বলো আমি কেউই নই।

ব্যাপারটা ঠিক তাই-ই নয় কি? কিন্তু এবার থামো৷ এমন ঘন অন্ধকারে এই বনে হাতি কি পথ খুঁজে পাবে? আমার ভয় করছে। এর চাইতে কাছারিতে রাত কাটালেও হত। সে ঠোঁট টিপে হাসলো।

.

০৮.

পেটাঘড়ির শব্দে রাত তখন আটটা, রূপচাঁদ হাই তুলো। রাজচন্দ্রর ঘরের সামনে আর একবার ঘুরপাক খেলো। রানীর ঘরের দরজায় উসখুশ করলো। তারপর সেই দরজার সামনেই খুকখুক করে কাশলো। শীতের রাত, রাত আটটা, মাঝরাত যেন।

ভিতরে তখন আরব্য রজনীর গল্প চলেছে। রানী হাসছিলেন মৃদুমৃদু আরব্য অভিজাত মহিলাদের আত্যন্তিক কাফ্রী ক্রীতদাস-প্রীতির কথায়। অবশ্য, তাঁর হাসি দেখে তার খোশমেজাজ কিংবা বিরক্তি বোঝা গেলে তো রাজবাড়িতে অনেক কিছুই সহজ হতো।

কাশির শব্দ শুনে রানী বললেন–রূপচাঁদ নাকি, এসো।

রূপচাঁদ এ ঘরে কদাচিৎ চোখ তোলে। মেঝের নকশায় চোখ রেখেই সে জানালো রাজকুমার বিলমহলে গিয়েছেন, তখনো ফেরেননি।

রানীর মুখে উদ্বেগ দেখা দেবে যেন। কিন্তু বললেন তিনি-তাই নাকি? হয়তো কোনো কারণে দেরি হচ্ছে।

রূপচাঁদ সরে যেতে ফিরলো। তখন রানী আবার বললেন–নয়নতারার খোঁজ নিয়ে তো একবার।

রূপচাঁদ চলে গেলো।

গল্প আবার শুরু হলো।

কিন্তু নতুন গল্পটার মাঝখানে রানী বললেন–সব দেশের গল্প এক নয়। তাই মনে হচ্ছে না? মন্দ নয়, মানদা, তুমি গল্প বলতে ভালোই শিখেছো। অন্য শ্রোতাদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন–তোমরা কি আরো শুনবে এখন? তাহলে বাটা থেকে পান নাও।

শ্রোতারা বাটা থেকে পান নিয়ে উঠে পড়লো।

যে গল্প বলছিলো তাকে রানী বললেন–আবার তোমাকে খবর দেবো, মানু।

সকলে চলে গেলে রানী উঠলেন। ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবলেন। দরজা থেকে একটু দূরে একজন ঝি দরজার দিকে চোখ রেখে বসে সুপারি কুচোচ্ছিলো। তার দিকে দু-পা এগিয়ে রানী বললেন–মোক্ষ, হরদয়ালকে এখনই একটু আসতে বলে এসো।

রানী ঘর থেকে বেরুলেন।

.

রূপচাঁদ নয়নতারার বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে বুঝতে পারলো সে বাড়িতে নেই। তাহলে জানলায় আলোর আভাস থাকতো। সে যখন ফিরে যাচ্ছে তখন নয়নতারার দাদা ন্যায়রত্নের চতুষ্পঠীর দাওয়ায় প্রথমে একটা প্রদীপ এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কাউকে যেন বসে থাকতে দেখতে পেলো।

কে?

–আমি, বলা।

লোকটি উঠে এলো। বলা এখন আর রূপচাঁদের অপরিচিত নয়।

সে বললো–দিদি কি রাজবাড়িতে?

-আমিও খুঁজছি। বিলমহলে রাজকুমার গিয়েছেন। হয়তো মাসিও সঙ্গে আছেন। এত রাত হয়। অবিশ্যি চোরচোট্টা আর কে এ গ্রামে? তবে কিনা ফরাসডাঙায় এসে উঠতে বড়ো জঙ্গল পার হতে হবে তো!

বলা বললো–এগিয়ে দেখতে হয়, না?

কী যে করি! দরকার হচ্ছে আলোর নিশানা।

রূপচাঁদ রাজবাড়ির দিকে হনহন করে ফিরতে শুরু করলো। পথের উপরে খানিকটা এসেবলার বাড়ি। রোসো, আসি, রূপদাদা বলে সে ভিতরে গিয়ে তার লাঠিটা নিয়ে এলো।

বলা বললো–কিন্তু সে তো ঘাসেরও জঙ্গল। হাতিডোবা ঘাস। মশাল নিতে চারপাশের ঘাসে আগুন ধরে যাবে না? আর সে জঙ্গলে কি মানুষ?

রূপচাঁদ বললো–তাও তো।

সে ভাবতে-ভাবতে চললো।

রাজবাড়ির প্রাচীরের ভিতর দিকে একপাশে বরকন্দাজদের ছোটো ছোটো ঘর।

যে তিনজন বরকন্দাজ মাঝরাতে জাগবার জন্য এখন ঘুমোতে যাচ্ছিলো রূপচাঁদ তাদের আটকালো। সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিলো। রাজকুমারকে এগিয়ে আনতে যেতে হবে। তৈরি হও, আসছি।

মশালচিদের ঘরে গিয়ে পাঁচ-সাতটি হারিকেন জ্বালিয়ে আনলো রূপচাঁদ। বলাকে দেখিয়ে পরামর্শ নিলো-কেমন, বলা, এই ভালো নয়?

–আগুনের ভয় থাকলো না।

বরকন্দাজ বন্দুক নিয়ে তৈরি হয়ে আসতেই ছুটতে শুরু করলো রূপচাঁদের দল।

.

রানী খানিকটা ইতস্তত চলে বেড়ালেন তার মহলে। বসবার ঘরে না ফিরে একটু বাঁয়ে চলে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলার ছাদে গিয়ে উঠলেন।

আকাশের অনেক তারা। রাজবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে আলোতে বাড়ির পরিসরটা ঠাহর হয়। প্রাচীর বলে যাকে মনে হচ্ছে তা ছাড়িয়েও গ্রামের মধ্যে এখানে-ওখানে দুচারটি আলোর বিন্দু। গাছপালা বাড়িঘরের আকৃতি ছায়া-ছায়া, কিংবা কালিতে আঁকা ছবিতে কালি পড়ে গেলে তার কোনো কোনো রেখা তা সত্ত্বেও যেমন ফুটে ওঠে। অবশ্যই হালকা গভীর কোনো সিহাই এমন রং নিতে পারে না-নীলের ধার ঘেঁষা কালো একখণ্ড স্ফটিক যেন। স্ফটিক–অর্থাৎ উজ্জ্বলতার একটা ভাব আছে। কিন্তু এখানে এরকম দেখালেও নিচে গাঢ় অন্ধকারই হবে গাছপালার কোলে বাড়িঘরের কোণে। শীতের রাত ইতিমধ্যে বেশ গভীর বাইরে। হঠাৎ তিনি দেখলেন কতগুলি আলোর বিন্দু যেন খুব তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছে, মুছে যাচ্ছে না, আর তাদের পরস্পরের দূরত্বও সমান থাকছে সারিতে। এ কি রাজকুমারের বিলম্বের সঙ্গে জড়িত কোনো ব্যাপার? বুকের মধ্যে কী যেন জোরে নড়ে উঠলো তার। একটু চঞ্চল হলেন রানী।

সিঁড়িতে এমন সময়ে পায়ের শব্দ হলো।

রানী জিজ্ঞাসা করলেন–কে, মোক্ষ, হরদয়ালকে খবর দিয়েছো?

ছাদের যে-প্রান্তে সিঁড়ি সেখান থেকে হরদয়াল জানালো, সে এসেছে, নিচে অপেক্ষা করছিলো, তাই দেরি।

রানী বললেন–হরদয়াল, রাজকুমার বিলমহলে গিয়েছিলেন, হয়তো শিকারে। এখনো ফেরেননি।

হরদয়াল বললো–সে কী কথা, একা নাকি?

রানী জানালেন-সঙ্গে নয়নঠাকরুন থাকতে পারে। তাও ভাবনার বিষয়।

হরদয়ালের নীরবতা তার চিন্তারই চিহ্ন। সে বললো– অবশেষে-হাতিতে গিয়েছেন?

–পিয়েত্রোর হাতিতেই বলে অনুমান। কিন্তু পথে একটা বড়ো বন আছে শুনেছি।

–তা আছে। তবে পিয়েত্রোর হাতি, বনের পথ চিনবে ভরসা করি।

–কিন্তু অন্ধকার রাত হলো।

–তা হচ্ছে।

রানী একটু থেমে বললেন আবার–আজ গ্রামে কীবল এসেছিলো?

-হ্যাঁ, চার-পাঁচ ঘণ্টা ছিলো, বাগচীমাস্টারের বাড়িতে লাঞ্চ করেছে।

–একে কি দরকারী খবর মনে করো হরদয়াল?

–এখন পর্যন্ত তেমন মনে করার কোনো যুক্তি দেখছি না।

কথাটা রানীর মনঃপূত হলো। খানিকটা চুপ করে থেকে আবার বললেন–আচ্ছা, হরদয়াল, ডানকান একটা সুরকির রাস্তা করেছিলো, সে রাস্তার খানিকটা কেটে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থানে এক রায়তের জমির ধান বিলমহলের লোকেরা কেটে তা আবার সেই রায়তের ঘরেই এমন করে রেখেছে যে রায়তের নিজেরই আর জায়গা হয়নি। রাস্তাটা কি তোমাদের রাজকুমারের জমি উপর দিয়ে হচ্ছিলো?

-সন্দেহ আছে, কিন্তু নয় তাও বলতে পারি না এখন আর। পিয়েত্রোর দরুন ফরাসডাঙাও হতে পারে।

রানীমা বললেন–হঠাৎ রাস্তাটাকে কেটে উড়িয়ে দেওয়ার কী দরকার হলো?

হরদয়াল একটু ভেবে বললো–সাধারণত বড়ো রকমের নালিশ না-হলে ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীকে রাজবাড়ি থেকে প্রশ্ন করা হয় না। এক্ষেত্রে কেউ বোধ হয় নালিশ করেনি। কিন্তু, রানী, রাজকুমারের বিলম্বের কথা বলতে বলতে এসব সংবাদ আলোচনা করার কোনো যুক্তি দেখি না।

নিজের অমূলক আশঙ্কায় রানী কি হাসলেন? অন্ধকারে তা বোঝা গেলো না।

-চলো, হরদয়াল, নিচে বসি।

রানী ছাদের ঝরোকা-ঝিলিমিলির কাছে থেকে সরে এলেন। তার শাড়ি দুধে-গরদের বলেই হয়তো একেবারে অদৃশ্য নয়, তার হাতের বালার পাথর কিছু কিছু নিজের পরিচয় সেই অস্পষ্টতায় দিলেও অযুক্তির হয় না, কিন্তু কোনো কোনো দেহবর্ণও কি অন্ধকারে ঈষৎ আভাসিত হয়?

একটা সুঘ্রাণ পেলো হরদয়াল, যা বিহ্বল কিন্তু মৃদু, এখন যেন বিষণ্ণ। তাড়াতাড়ি দু পা পিছিয়ে গেলো সে সিঁড়ির মুখ থেকে। রানী সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলেন। হরদয়াল ধীরে ধীরে অনুসরণ করলো।

নিচের বসবার ঘরে চাদর গায়ে জড়িয়ে বসে রানী বললেন–নায়েব অবশ্যই দৃষ্টি রাখছেন, মামলা হয়ই যদি কোম্পানীর আদালতে। আচ্ছা, হরদয়াল, কলকেতায় এবারই কি হাইকোর্ট হবে? বসো।

প্রসঙ্গান্তরে কি যাচ্ছে কথা? কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই যেন রাজকুমারের সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা থেকে, ডানকানের সঙ্গে বিরোধ, বিরোধের হেতু হিসাবে নতুন ম্যাকাডাম রাস্তাটা কেটে দেওয়া, তার ফলে সম্ভাব্য মামলা, তা থেকে কলকাতার হাইকোর্ট।

হরদয়াল সঙ্গে সঙ্গে বললো–চেষ্টা তাই।

-তোমার কি মনে হয় তা সবদিক দিয়েই ভালো? মুন্সেফি আদালতও নাকি হবে?

–আমাদের গ্রামেও হতে পারে।

-সেটা কী, আচ্ছা হরদয়াল, তুমি ভেবে দ্যাখো, তোমাদের রাজকুমারের এক্তিয়ারের মধ্যে যদি আদালত বসে সেটা কি ভালো? ওরা কী প্রস্তাব করেছে? তোমাদের তো সদর আমিন আছেই।

হরদয়াল বলতে যাচ্ছিলো, আমাদের গ্রামের আয়তন লোকসংখ্যা ও গুরত্বের দিক দিয়ে তেমন হওয়াটাই উচিত হবে। কিন্তু চোখ তুলতেই রানীর আয়ত চোখ দুটিকে সে দেখতে পেলো। কিছু ভাবছেন তিনি।

রানী বললেন–শুনেছি বেহার রাজের নিজের আদালত আছে।

দেউড়ির পেটাঘড়িতে ঘণ্টা পড়লো দশটার। এমন সময়ে মোক্ষদা-ঝি এসে বললো–রূপচাঁদকাকা গেছে বরকন্দাজ নিয়ে।

রানী শুনে বললেন–আচ্ছা, মোক্ষদা।

মোক্ষদা দাঁড়ালো না।

রানী একটু পরেই আবার বললেন–তুমি কি আজকাল তেমন বই পড়ো না? বই কি তেমন আসছে না?

–আসছে।

বইটই আনতে কি তুমি এর মধ্যে কলকাতায় যাবে?

–তেমন স্থির করলে জানাবো আপনাকে।

হরদয়াল কান পেতে শুনলো কোথাও একটা ঘড়ি টিকটিক করছে। একে প্রতীক্ষা ছাড়া আর কী বলা যাবে? কিন্তু এখনই তো একটা নির্দিষ্ট মতও প্রকাশ হলো রানীর।

বললেন রানী আবার–আচ্ছা, রাজকুমারের বিয়ের কথা আর কী ভেবেছো?

রানীর কি মুখ নিচু করলেন? হরদয়ালকে কি বিচলিত দেখা গেলো?

হরদয়াল ভাবলো ইতিপূর্বে রানী দুবার দু-রকম সুরে বলেছেন নয়নতারা সঙ্গে থাকাতেই ভাবনা। যেন ভাবনাটা দুবারে দুজনের জন। কিন্তু এসবই কি প্রতীক্ষাকে অচঞ্চল রাখতে বলা?

সে বললো–আপনি হুকুম করলেই চেষ্টা করব। সেই পাত্রীই, যদি সেইতিপূর্বে পাত্রস্থ না-হয়ে থাকে।

রানী বললেন না।

তার ঠোঁট দুটিতে হাসি হাসি ভাবটাই রইলো, কিন্তু এই এক বর্ণের শব্দটা গোটা একটা বাক্যের মত ভারি শোনালো। কিন্তু প্রসঙ্গান্তরে গেলেন তিনি, বললেন, তোমার তত্ত্ববোধিনী আর সোমপ্রকাশ পত্রিকাগুলো পড়া হয়েছে। নিয়ে যেও। তোমার বইয়ের ঘরে কি একজন দপ্তরি দরকার?

হরদয়াল বললো–দরকার হলে জানাবো।

.

ততক্ষণে রূপচাঁদের দল ফরাসডাঙা পেরিয়ে বনে ঢুকেছে। হাঁপাচ্ছে তারা দৌড়ে এসে। ছুটতে ছুটতেই ভাবছিলো রূপচাঁদ–যে মাহুতই হোক সে চওড়া পথের দিকে আসবে, অন্তত আন্দাজে দিক ঠিক করে। ভয় আর-এক–বিলে গিয়ে না পড়ে। সুতরাং পুরনো নদীর পার ধরে, তারপর নদীর পুরনো শুকনো খাতের ডান পারে যেতে হবে। কিন্তু আলো এনে কি হয়েছে যদি-না হাতির সওয়ার তা দেখতে পায়? বনে ঢুকলে ঘাসবন মানুষের মাথা ছাড়িয়েই উঠবে। আলো দ্যাখে কে?

সে হনহন করে চলতে চলতে বললো–আলো দেখানোর কি বলা?

একটা গাছের কাছে এসে তার খেয়াল হলো। একজন বরকন্দাজকে সে বললো–ওঠো এই গাছে। গাছে গাছে আলো রাখা যাক।

যে কথা সেই কাজ। তা দেখে বলা বললো–মন্দ না। আধকোশ জুড়ে গাছে গাছে বেড় দিলে কোনো-না-কোনো আলো দেখবে হাতি আর সেদিকে কেটে উঠবে। তাছাড়া, ধরো, সেই বেড়ের কেউ-না-কেউ হাতির ঘণ্টা শুনবে।

ঘাসবনের মধ্যে ডুবে ডুবে মানুষ কয়েকটি রাস্তার অসমান লেশমাত্র ধরে ছুটে চললো। ঘাসেই হাত-পা কাটছে, কাঁটায় কী হচ্ছে বলা বেশি।

অবশেষে বলাও এক গাছে চড়লো আলো নিয়ে। রূপচাঁদ একা ছুটলো তখন। আর কিছুক্ষণ ছুটেই তার মনে পড়লো সে একা। এই মানুষ-ডোবা ঘাসবনে সে এমন একা যে মনে হয় দু-দশ ক্রোশে দ্বিতীয় প্রাণী নেই। আর এই তো পুরনো নদীর খাত, আর পার, আর চরা, আর এখানে কি সেই আদিকাল থেকে লাখ মানুষ দাহ হয়নি! নিজের ঘামেই পিরহান ভিজে, ঘাসবনের ওম সত্ত্বেও তার শীত লেগে গেলো। পায়ের তলায় একটা শক্ত ঢেলা লাগতেই মড়ার মাথার খুলি এই বিশ্বাস হলো। সে আতঙ্কে চিৎকার করে দৌড়লো।

.

রাজু বললো–আচ্ছা বাঁদর তো, গছে কেন?

গলাটা রাজকুমারেরই বটে। রূপচাঁদ দেখলো হাতিটা গাছের নিচেই দাঁড়িয়েছে। মাহুত বললো–ওখান থেকেই নামো, রূপুদা হাতির পিঠে।

রূপচাঁদ বললো–তা যদি ঝুপ করে পড়ি, তোমার হাতি ভয় পাবে না তো?

মাহুতের হাতে লণ্ঠন ধরিয়ে দিয়ে রূপচাঁদ ডাল দুলিয়ে ঝুল খেয়ে নামতে গিয়ে পলক ডালটা ভেঙে থেবড়ে পড়লো। মাহুত অন্য হাত বাড়িয়ে না-ধরলে নিচেই পড়তো।

রাজু বললো–একেবারে বাঁদর।

রূপচাঁদ হেসে বললো–হনুমান, হুজুর। হাতি কিন্তুক ছুটে চলুক। আলোর বেড় বরাবর।

হরদয়াল ভাবলো : রানী বলেছিলেন, নয়ন সঙ্গে থাকাতেই ভাবনা। তারপর বললেন কলকাতা যাওয়ার আর রাজকুমারের বিয়ের কথা। এগুলি কি রানীর মনে পরস্পর সংবদ্ধ? বলা যায় এখন তেমন সময় যখন রানী আশংকায় সম্ভব-অসম্ভব সব অমঙ্গলকে যাচাই করে দেখছেন।

ঠিক এমন সময়েই দেউড়িতে এবং তারপরে বারমহলে হরদয়ালের চিন্তাকে ছিন্ন করে কলরব শোনা গেল, এবং তার মধ্যে হাতির ঘণ্টাও।

আগে হরদয়াল এবং পিছনে রানী বারমহলের দরজার দিকে এগোলেন।

হরদয়াল দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, রানী কিছু পিছনে দালানের একটা দেয়ালগিরির নিচে।

তখন হাতি থেকে নেমেছে রাজু। আলোতে বোঝা গেলো তার স্যুটের এখানে-ওখানে কাদা শুকিয়ে আছে।

নয়নতারার কথা জিজ্ঞাসা করা কি উচিত হবে? ভাবলো হরদয়াল।

ততক্ষণে রাজচন্দ্র এগিয়ে গিয়েছে। রূপচাঁদ তার শিকারের সরঞ্জাম নামাচ্ছে। রাজু রানীর কাছাকাছি যেতেই তিনি বললেন–এ কী রে? এত কাদা?

রাজু হেসে বললো–বাহ্, কুমীর তো কাদাতেই থাকে।

রানী যেন একটু চমকালেন। তার মুখ কিছু বিবর্ণ হলো। কিন্তু তখনই বললেন–আচ্ছা হরদয়াল।

বিচক্ষণ হরদয়াল তখন নিজের কুঠির দিকে চলতে শুরু করলো।

রাজুকে বললেন রানী–তুই জামাকাপড় ছাড়, রাজু, আমার ঘরে তোর খাবার দেব।

রানী আর দাঁড়ালেন না। রূপচাঁদকে নিয়ে রাজু নিজের মহলের দিকে এগিয়ে গেলো।

বাইরের জামাজোড়া ছেড়ে হরদয়াল বালাপোশ নিলো। ঘড়ি না-দেখলেও বলা যায় এখন অনেকটা রাত হয়েছে। কী করবে সে এখন? রানী ডেকে পাঠানোর আগে সে চিন্তা করছিলো। তার কলকাতার বন্ধু চিঠি লিখেছে। তা থেকেই চিন্তাটা। এখনো কি সে-চিন্তাই করবে। রাজকুমারের বিয়ের কথাই যেন। সে একবার চারদিকের বইয়ের আলমারিগুলোর দিকে চাইলো। রাত্রির একটা এই কৌতুক যে এই লাইব্রেরি-ঘরে সময় যেন মন্থরগতিতে চলে।

কখন কোন সূত্রে কোন চিন্তা আসবে বলা যায় না। হরদয়াল যেন একটা মৃদু সুবাস পেলো। তাকে নির্দিষ্ট করে বর্ণনা করা যায় না, উৎসটাও বোঝা যায় না। নিশ্চয়ই স্মৃতি।

হরদয়ালের হঠাৎ মনে হলো এই লাইব্রেরির অধিকাংশ বই রানীর উপহার। অর্থাৎ বই সে-ই কিনেছে বটে, টাকাটা দিয়েছে স্টেট, রানীর ইচ্ছা। আজ সকালেই সে একবার নিজেকে বলছিলো, আর কত? এমন হচ্ছে দুএকখানা পড়া না-হয়েই শেফে উঠছে।

বালাপোশটাকে বাহুর উপরে গুটিয়ে আলমারি থেকে সে একখানা বই টেনে নিলো।

কিন্তু সবসময়ে ইচ্ছা পূর্ণ হয় না। বইটা খুলবার আগেই চাকর এলো, পিছন পিছন বাবুর্চি। বাবুর্চি-চাকরের সংসার তার। চাকর জিজ্ঞাসা করলো গড়গড়া দেবে কিনা। বাবুর্চি জানালো নদীর ধার থেকে ভালো রুই পাওয়া গিয়েছে। ভাজা হয়েছে।

সামনের দেয়ালঘড়িতে রাত এগারোটার কাছে এসেছে। হরদয়াল হেসে মাথা নাড়লো। বাবুর্চি টেবিল গোছতে গেলো। অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এমন দেরির কথা ভাবাও যায় না।

হরদয়াল লক্ষ্য করলো, চাকর তার পাশেপাশে চলতে চলতে হাসছে। সে যেন কিছু বলতে চায়।

-কিছু বলবে?

বাবুর্চি বলছিলো, হুজুর।

কী?

নতুন মাস্টারমশাই নিউগিবাবু নাকি বাবুর্চিকে জিজ্ঞাসা করেছেন সে কী জাত?

–তাতে হাসির কী হলো?

–ওই মগটাকে নাকি ধর্ম সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছেন।

–আচ্ছা?

বাবুর্চি বলছিলো সে নাকি প্রকৃতপক্ষে মুসলমানই ছিলো, যদিও নমাজ পড়ে না। জিজ্ঞাসা করছিলো এতদিন পরে নমাজ পড়লে আপনি রাগ করেন কিনা।

হরদয়াল হো-হো করে হেসে উঠলো খাবার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে।

 ০৪. হরদয়াল

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কিন্তু পরের দিনই হরদয়াল চিন্তা করার অবসর পেয়েছিলো।

এখন সন্ধ্যা হচ্ছে। হরদয়ালের কুঠির বারান্দায় কাঠের মিস্ত্রি তার সরু র‍্যাদাটা তুলে মাথায় ঘষে নিলো একবার। তাতে নাকি র‍্যাদা আরো তেলালো হয়। দুবার ঘষে ফুঁ দিয়ে র‍্যাদায় ওঠা গুঁড়ো কাঠ ঝেড়ে ফেলো মিস্ত্রি। আর তখন সুগন্ধটা পাওয়া গেলো কাঠের। আসবাবটা এমন কিছু মূল্যবান নয়, একটা বুকশেলফ। কিন্তু যত্ন দেখে মনে হচ্ছে তা হাতির দাঁতের।

সকালেও হরদয়ালের কুঠির বারান্দায় ছুতোর মিস্ত্রি কাজ করছিলো। রোদটা তখন সরে গিয়েছে, ওমটা আছে। চেয়ারে হরদয়াল। তার বাঁদিকে আলবোলা। আলবোলার সম্মুখে তেপায়ার উপরে কাগজপত্র যা লমোহরার গৌরী রেখে গিয়েছে।

সকালে গৌরী এসেছিলো মামলার কাগজপত্র দিতেই। মুখে বলেছিলো মামলাটা মরেলগঞ্জের মনোহর সিং-এর বিরুদ্ধে। ট্রেসপাস। মনোহর তার এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে রাস্তা তৈরি করছিলো। এটাকে বলা যায় সাধারণ দপ্তর থেকে আইন দপ্তরে ফাঁইল আসা। হরদয়াল বলেছিলো, মামলাটার কী দরকার হলো? আচ্ছা, রেখে যাও।

কিন্তু গৌরীর আসল বক্তব্য ছিলো যেন এবারে রানীমার জন্মতিথি উৎসবে কাছারির কর্মচারীরা এবং তাদের বন্ধুবান্ধব মিলে একটা নাটক করতে চায়। নায়েবমশায়কে অনুরোধ করেছে। এটা তো যাত্রা নয়,নাটক–আধুনিক ব্যাপার। কাজেই হরদয়াল নিজে একটু সমর্থন না করলে নায়েবমশায় রাজী হবেন না। হরদয়াল হাসিমুখে তাকে আশ্বাস দিয়েছিলো।

এখন হরদয়ালের গায়ে মটকার গলাবন্ধ কোট। চুনুট করা ধুতির কালো পাড়, তালতলার চটির উপরে। সে বৈকালিক ভ্রমণ শেষ করে ফিরেছে। তার চাকর জুতো নিয়ে চটি দিয়ে গিয়েছে। আলবোলা নিয়ে ফিরবে।

রানীমার জন্মতিথি? গৌরী চলে গেলে হরদয়াল চিন্তা করেছিলো। এবার কি একটু আগে? তা অসম্ভব নয়, তিথি অনুসারে চলে; কখনো এগোয় কখনো পিছিয়ে যায়।

কিন্তু গৌরীর পরেই সকালেই হরদয়াল সদর-নায়েবকে দেখেছিলো। কাছারির থেকে যে রাস্তাটা তার কুঠি দিকে তার উপরে সদরনায়েবকে দেখে সে ভৃত্যকে ডেকে চেয়ার দিতে বলেছিলো। এমন নয় যে নায়েব মাঝে-মাঝেই হরদয়ালের কুঠিতে আসেন, সুতরাং নায়েবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে হরদয়ালের কৌতূহল হয়েছিলো।

হরদয়ালকে অবাক করে নায়েবমশায়ও নাটকের কথাই তুলেছিলেন। খুব মুশকিল তার। নাটক কারে কয়? ছোকরারা খেপে উঠেছে। হরদয়াল হেসে ফেলেছিলো। আমাদের দেশে যাত্রা, অন্য দেশে নাটক হয়। এতে আর মুশকিল কী এই বলেছিলো সে হেসে। কলকাতায় হচ্ছে।

–ও বাবা, না করে থামছে না দেখছি। কিন্তু সে তো শুনি অনেক খরচ। মঞ্চ না কী একটা করবে। নরেশও এর মধ্যে আছে। নায়েব বলেছিলো।

হরদয়াল বলেছিলো–তা, দিন না মঞ্জুরি।

নায়েব উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ বললেন–ভালো কথা, নরেশের কথায় মনে হলো, ও তো দেখছি ক্রমে এ কাজে ও কাজে জড়িয়ে পড়ছে। কাজ শেষ হবে কবে? ওদিকে সুরেনও। আমার তো মনে হয় ওদের বাবদে একটা পৃথক হিসাব বই খোলা দরকার। আজ গেট করে তো কাল সড়ক, সড়ক ছাড়ে তো রাজবাড়ি। তা করতে আবার এক খাবোল অন্য সড়ক।

–তা মন্দ কী? নতুন কাজ পুরনো কাজ মিলে তো পরিমাণ কম নয়।

নায়েব হাসলো-মাঝে-মাঝে মনে করি একটা আলাদা বিভাগ তৈরি করে দিই। নরেশ কাজ করবে। হিসাবের জন্যও না-হয় একজনকে দেওয়া গেল। কিন্তু তারা যে ঠিকঠাক কাজ করছে তা অন্তত মাসে একবার দেখা দরকার। মাপজোখের উপরে মাপজোখ আর কি। কিন্তু দেখে কে? আমি কি সিএফটি বুঝি? যতদিন অন্য ব্যবস্থা না-হচ্ছে আপনার পক্ষে কি একটু দেখা সম্ভব হয়?

–আমাকে ভার নিতে বলছেন?

–যদি সম্ভব হয়।

হরদয়ালও উঠে দাঁড়িয়েছিলো।

নায়েব বললেন–আপনি রাজী হলে রানীমার অনুমতি চাইবো।

হরদয়াল কী একটু চিন্তা করলো, বললো–আপনি বললেই হবে। রানীমা পর্যন্ত যেতে হবে কেন?

তারপরে নায়েব মামলার কথায় গিয়েছিলো। কাগজপত্র দেখেছেন নিশ্চয়। ওপক্ষ একেবারে চুপচাপ। যেন রাস্তা কাটার ব্যাপারটা সম্বন্ধে ওদের ভাবনা চিন্তা এখনো শেষ হয়নি।

হরদয়াল তখন বলেছিলো, গৌরী বলছিলো ট্রেসপাসের প্রমাণ গোছাচ্ছে সে।

নায়েব বলেছিলো, প্রমাণ হোক তা নয়, কিংবা সেটা মরেলগঞ্জের লীজভুক্ত জমি এবং লীজে এখানে-ওখানে রাস্তাঘাট তুলবার শর্ত ছিলো নাকি ফৌজদারিতে যেতে চাইছেন না? তাহলে ওরাই এগোবে? হরদয়াল বলেছিলো, দেখি ফাঁইলটা।

তখন আর কথা হয়নি। নায়েবমশাই তিন বিষয়ে বলেছিলেন। কোন উদ্দেশ্যে দেওয়ান কুঠি পর্যন্ত আসা তা কি বোঝা গেলো? তা কি মাঝখানে যা বলেছিলেন? এখন সন্ধ্যা হচ্ছে। মিস্ত্রি কাঠগুলোকে গুছিয়ে তুলো। উঠে দাঁড়ালো, তাতেই যেন সন্ধ্যার সূচনা হলো। কাজটাকে গুটিয়ে তুলতে-তুলতেও মিস্ত্রি তা যেন চোখের সম্মুখে মেলে দেখলো। তা থেকে হরদয়ালের মনে হলো, সৌন্দর্যসৃষ্টি নাকি? পরখ করে দেখছে? লোকটি রোজই কাজ করে, কিন্তু তার মধ্যে টাকা উপার্জনের বাড়তি কি কিছু থাকে?

রাজকুমারের ঘরের আসবাবপত্র করার জন্য লোকটিকে গত বছর আনানো হয়েছে। নরেশ চিনতো। তারপর থেকে কাজের পর কাজ চলেছে। জাতে চীনা। ইতিমধ্যে একটি স্থায়ী ঘরও জুটেছে, রাজবাড়ির মালীদের ঘরের একটি। লোকটি অভ্যাসবশে হয়তো ডিজাইন তুলে যায়, কিন্তু অন্য অনেকে তার মধ্যে সৌন্দর্য আবিষ্কার করে। মৌমাছির মতো নাকি? কয়েকদিন আগে সে এক বই-এ পড়েছিলো–মৌমাছি গান করে না। কর্মব্যস্ততায় সে উড়ে বেড়ায়, তার পাখা কাপে, মানুষ তাতে গুঞ্জরণ আবিষ্কার করে।

কিন্তু দ্যাখো, এই লোকটিকে এনেছে নরেশ, অনুরূপভাবে নরেশকে এনেছিলো সে নিজে। গত সনের সেই মেরামতির জন্য। নরেশের কাজের সুখ্যাতি হয়েছে।

সকালে গৌরী ও নায়েবমশায় চলে গেলে হরদয়াল ব্রেকফাস্টে বসেছিলো। আর তখন সে নরেশ সম্বন্ধে চিন্তা করেছিলো।

হরদয়াল তাদের মতো নয় যারা ব্রেকফাস্ট না করে পৃথিবীর মুখ দেখে না। এ কি তার আহার-বিলাসের ফল? অথবা কোনো ব্যাপারেই তাড়াতাড়ি করে কী হয়–এরকম এক মনোভাব থেকে ব্রেকফাস্টের ব্যাপারে ঢিলেমি? ওদিকে কিন্তু টেবল দেখলে মনে হবে ভৃত্য বাবুর্চির সংসারের পরে তার ব্রেকফাস্টের ব্যাপারটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।

একটা জানলার পাল্লা খোলা। খানিকটা রোদ টেবিলে এবং সেখান থেকে রূপোলি প্লেট চামচের গায়ে মাখামাখি করছে। পাশের জানলার কাঁচ থেকে রঙীন আলো মেঝের উপরে একটা রঙীন আয়তক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছে। রোদে পিঠ রেখে হরদয়াল ব্রেকফাস্টে বসেছিলো।

সে বাদামযুক্ত হালুয়া দিয়ে ব্রেকফাস্ট শুরু করে ভাবতে শুরু করলো। কী যেন? ও, সে নরেশের কথা ভাবছিলো। ভদ্রলোকের নাম নরেশ পান। তিন মাসের কড়ারে আনা হয়েছিল। মিলিটারি কনট্রাক্টরের এক ফার্মে এবংকখনো কখনো ফোর্ট উইলিয়ামে সরকারি এঞ্জিনীয়ারের অধীনে কাজ করতো। এ কাজটা তোনরেশের কুলকার্য নয়। চাষবাস করতো। তারপর একসময়ে সে কী করে বা এইসব কাজে যুক্ত হয় এখন বিষয়ে কিছু লেখাপড়া না করেও সে প্রায় ওস্তাদ শ্রেণীর একজন হয়ে উঠেছে। লেখাপড়া নয়ই-বা বলছো কী করে, কাগজকলমে নকশা, এস্টিমেট প্রভৃতি করতে শিখেছে। রাস্তাঘাটের কাজে যদি সুরেন, বাড়িঘরের কাজে তবে নরেশ। কোথাকার বীজ কোথায় উড়ে এসে পড়ে গাছ হয় দ্যাখো। এটাও কিন্তু কৌতুকের–তুমি বলতে পারো নরেশ আছে বলেই মেরামতের কাজের বাইরে নতুন কাজ হচ্ছে, কিংবা নতুন কাজ করানো হবে বলেই তাকে রাখা হচ্ছে।

আগে প্রতি বছরেই রাজবাড়ির রং মেরামত ইত্যাদির কাজ হতো। গ্রামের গহরজান মিস্ত্রির পরিবারের পুরুষরা কাজ করতো। কখনো মুর্শিদাবাদ থেকে তাদের আত্মীয়স্বজন কাজের খোঁজে এলে যেন তাদের সুবিধার জন্যই কাজ করা হতো। আজ থেকে তো মনে হচ্ছে নরেশ ও সুরেন পাকাপাকি থেকে যাচ্ছে। হয়তো কথাটা পূর্তবিভাগনা হয়ে বাস্তুবিভাগ হলে মানাতো। একটা বিভাগ যখন হয় তখন ধরে নিতে হবে অন্তত বেশ কিছুদিনের জন্য তা হলো।

এবং তার ভারটা আজ থেকে এসে গেলো যেন তার নিজের দপ্তরে। আজ থেকেই। ওটাকে হুকুমই বলতে হয়। যদি তার চারিদিকে খুবনরম কিছু থেকে থাকে তবে তানায়েবের কথা বলার কায়দা। হরদয়ালের ঠোঁটে মৃদু হাসি খেলা করে গেলো। অথচ তুমি কায়দাটাকে ধরতে পারো না। কিন্তু এতদিন?

তখন ব্রেকফাস্টের টেবলের পাশে দাঁড়িয়ে তার ভৃত্য, দরজার কাছে বাবুর্চি।

হরদয়ালের হাতে চামচটা দুললো। যেন সে মিষ্টিটা পছন্দ করছে। কিন্তু চামচটা রেখে সে বরং কফির পাত্রটা টেনে নিলো।

এটা কি অস্বীকার করা যায়, ভাবতে গিয়েও গলা সাফ করতে হলো, নায়েবই কিছুদিন আগে তার অধস্তন কর্মচারী ছিলো।

তাই তো, আজ যেন, আজই প্রথম যেন, প্রমাণ হয়ে গেলো নরেশের এই ব্যাপারটায়–যে নায়েব একসময়ে শুধুমাত্র নায়েবই ছিলেন, এবং তখন হরদয়াল ছিলো দেওয়ান।

ব্রেকফাস্টের কফিটা শেষ করে যে-জানলায় রৌদ্র আসছিলো তার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। যেন দিনটার কী রং তা দেখলে বিস্ময়টা কাটবে। নিশ্চিতই আকাশে মেঘ নেই কিংবা ঝড়ো হাওয়াও বইছেনা যে দিনটাকে গতকাল যা ছিলো তা থেকে ভিন্ন দেখাবে।

সে এ সময়ে, ব্রেকফাস্টের পরেই কাজ করে। জানলাটা থেকে সরে এসেছিলো সে। লাইব্রেরিতেই তো। সে লাইব্রেরিতে ঢুকেছিলো। ফাঁইলটা দিয়ে গিয়েছে গৌরী যাতে নায়েবের মন্তব্য আছে মামলা সম্বন্ধে। পাশের দরজা দিয়ে ভৃত্য গড়গড়া নিয়ে ঢুকে চেয়ারের পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখেও গেলো। তখন বেলা দশটা হবে।

সম্মুখে ডেস্কের দিকে চেয়েছিলো সে। সমতল অংশটার উপরে অনেককিছুই তো। একটা সুদৃশ্য ট্রের উপরে সকালের আসা ডাক তখন। চরণদাস নিজেই দিয়ে গিয়েছে। আর তখনই সে ম্যানিলা রং-এর খামটাকে এবং তার উপরের ঠিকানার হরফগুলোকে লক্ষ্য করেছিলো।

এখন এই সন্ধ্যায় সে তো আবার লাইব্রেরির সেই ডেস্কের সামনে। উজ্জ্বল টেবল ল্যাম্পের আলোয় একটু দ্বিধা করে সেই চিঠিখানাই হাতে নিলো। চিঠিখানা তার বন্ধুর। খুলবার আগেই সে ভাবলো কোনো কোনো কাজে কেমন করে যেন বাধা পড়ে যায়। বন্ধুর আগের চিঠিটার জবাব এখনো দেওয়া হয়নি। কাল রাত্রিতে একবার সে ভাবতে বসেছিলো এ বিষয়ে। কিন্তু রানী ডেকে পাঠিয়েছিলেন।

চিঠিখানা খুললো সে। পুরো নোটশীট, কিন্তু বন্ধুর চিঠি সাধারণত যত বড় হয় তেমন নয়। হরদয়াল পড়লো। বন্ধু লিখেছে : তার আগের চিঠির (যার জবাব সে পায়নি) অনুসৃতিতে সে সানন্দে জানাচ্ছে পৃথক প্যাকেটে শেকসপীয়র পাঠানো যায়। এক সিভিলিআন প্রমোশন-প্রাপ্ত ও অন্যত্র স্থাপিত হওয়ায় ফার্নিচার ইত্যাদিসহ হস্তান্তর করে। সুতরাং মরোক্কো বাঁধাই হলেও রিবে মালিকের নাম ঘষে তোলা। পৌঁছনো মাত্র প্রাপ্তিসংবাদ দেবে। পুনশ্চ বলে সে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়-মহলে খোঁজখবরে জানতে পারা গেলো ডান্নামে (লক্ষ্য করবে ওটা ডা) এক কবি ছিলো বটে। কিন্তু ইংরেজি ভার্সে লিখিত হলেই কবিতা হয় এমন নয়। মিলটনের পরে তো বার্নস, ব্লেক, মধ্যে আর কবি কে? লন্ডনের পাবলিশার্স ও স্টেশনার্সদের ঠিকানা পাঠালাম। ১৮৫৮ ও ১৮৫৯ প্রকাশিত দশখানি বই তোমার টাইমসের সাপ্লায়ার রোজার গুনের কাছে আছে।

চিঠিটা যত্ন করে খামে পুরলো সে আবার। একটা প্রশান্ত তৃপ্তি যেন অনুভব করলো হরদয়াল। তাই বলে সে তো ডাকঘরে খোঁজ নিতে যেতে পারে না। বই-এর প্যাকেট পৌঁছনোর একঘণ্টার মধ্যেই তার হাতে নিশ্চয় আসবে। বাঁ হাতটা উঁচু করে তার উপরে গাল রেখে সানন্দ দৃষ্টিতে বই-এর শেলফগুলোর দিকে চাইলো সে।

কিন্তু আজ সকালেও চিঠি লেখা হয়নি। অর্ধসমাপ্ত চিঠিটাকে সরিয়ে রাখতে হয়েছিলো, কারণ বাগচী নিজে এসেছিলো স্কুলের বিষয়ে আলাপ করতে। একটা সমস্যাই যেন। তাও এক চিঠি নিয়ে। চিঠিটা পেয়ে বাগচী বারদুয়েক পড়েছে, যাকে বলে তার উপরে ঘুমিয়েছে। কিন্তু এখনো কর্তব্যটাকে সে স্পষ্ট দেখতে পায়নি। এদিককার বিদ্যালয়-পরিদর্শক এতদিনে যেন এই বিদ্যালয়ের সংবাদ পেয়েছেন। এবং তিনি বিদ্যালয়টিকে পরিদর্শন করতে বাসনা করেছেন। এটা তাঁর সরকারী কর্তব্যও বটে। তিনি বস্তুত লিখেছেন :ইহা আমার কর্তব্য বলিয়া বোধ করি যে যত শীঘ্র সম্ভব আপনার বিদ্যালয় পরিদর্শন করা হয়।

বাগচী বলেছিলো উনি এসে পড়তে পারেন, তার আগেই জবাব যাওয়া দরকার। নতুবা লাঞ্চের পরে আসতাম।

হরদয়াল চিঠিখানা আদ্যোপান্ত পড়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো, বাগচীর মত কী? এতে কি স্কুলের লাভক্ষতি কিছু আছে?

বাগচী বলেছিলো, কারো কারো মতে, যেমন নিয়োগীমশায়,এ সুযোগ ছাড়া উচিত হবে । স্কুল সরকারের নজরে পড়লে তার মর্যাদা বাড়ে।

-তা কি শিক্ষক অথবা পাঠক্রম নির্বাচন, অথবা সরকারী গেজেটে আসা এবং আর্থিক আনুকুল্য?

–নিয়োগী বলেন সবই হতে পারে। সব স্কুলই তাই চায়।

-এখনই শেষ কথা বলা কঠিন। যে সুবিধা দেয় তার পক্ষে নিজের মত চাপাতে চাওয়াও অসম্ভব নয়।

নিয়োগী বলেন, শিক্ষার ব্যাপারে যাঁরা কর্ণধার শিক্ষা সম্বন্ধে তাদের মতামতের নিশ্চয়ই মূল্য আছে। এবং এই শিক্ষাধারাই ইংরেজ জাতকে মহৎকরেছে, আমাদের দেশের কুসংস্কার দূর হচ্ছে।

-ঠিক তাই। হেসে বলেছিলো হরদয়াল। –এর একটাও আপনার নিজের মত নয়। আপনি হয়তো বৃহত্তর মঙ্গল চিন্তা করে নিজের মতকে কুণ্ঠিত করে রাখছেন। কিন্তু আমি জানি ঠিক এখন আপনি যা ভাবছেন তা ভাষাশিক্ষাকে অন্তত তার ব্যাকরণ ও বানানকে কম মূল্য দিতে যা কলকাতায় গ্রাহ্য হবে না। নিষেধ করে দিন।

বাগচী চলে গেলেও চিঠিটায় আর হাত দেওয়া হয়নি। এখন আবার সন্ধ্যা পার হচ্ছে। ছুতোর মিস্ত্রি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই সে লাইব্রেরির এই আরামকেদারায় এসে বসেছে। এখন কি সে ডায়েরি লিখবে? দু-তিন দিন তা হয় না। কিংবা বন্ধুর চিঠি দুটির উত্তর?

হরদয়াল উঠে পাশের ঘরে গেলো। প্রভিশনের আলমারি খুলে মদের বোতল এবং গ্লাস নিয়ে লাইব্রেরিতে ফিরলো। গ্লাসটা লম্বা, সরু, গায়ে কাঁচের মধ্যে সাদা রঙে একটা লতার মটিফ। হরদয়াল নিজের অজ্ঞাতেই যেন হাসলো ডেস্কের উপরে বোতল আর গ্লাস পাশাপাশি রেখে।

ডায়েরির মরোক্কো বাঁধাই মলাটের উপরে লিখবার প্যাড। প্যাড আর ডায়েরির মাঝখানে সেই অর্ধসমাপ্ত চিঠিটাকে পাওয়া গেলো যা সে বন্ধুকে লিখতে শুরু করেছিলো কাল।

হরদয়াল বোতল থেকে তার লম্বা গ্লাসটাকে ভরে নিলো। এবার বন্ধুর আগের চিঠিটাকেও বার করলো। হ্যাঁ, সেই চিঠিতেই বন্ধু জানিয়েছিলো সে গত একমাস মদ্য স্পর্শ করেনি। আশা প্রকাশ করেছিলো হরদয়ালও ইচ্ছামাত্র সেরকম পারবে। একেবারে নতুন নয় সংবাদ। হরদয়াল তার কলকাতার অভিজ্ঞতা থেকে জানে সেখানে মদ্যপান নিবারণ নিয়ে কথা উঠেছে বটে।

হরদয়াল চিঠিটা হাতে ধরেই গ্লাসটাকে ঠোঁটে তুলো। দ্যাখো কাণ্ড, এই বলবে যেন সে, ইচ্ছামাত্রই কি সব কাজ হয়? কিন্তু বন্ধুর চিঠির এটা জবাবনয়, বরং ডায়েরিতে লিখবার মতো কিছু।

ডায়েরি কেন লেখা হয়? এর সহজ উত্তর আছে। ডায়েরিতে দিনে কতবার মিথ্যাভাষণ হলো, কতবার লোভ থেকে ত্রাণ পাওয়া গেলো, কতবার বা ঈশ্বরের গুণগান করা হয়েছে তা লেখা থাকে। হয়তোবা একসময়ে চারিত্রিক উন্মেষের সহায়ক হিসাবেই হরদয়াল ডায়েরি রাখতে শুরু করে থাকবে। এখন? ইচ্ছামাত্রই মদ ছাড়বে এমন চারিত্রিক দৃঢ়তা কি তার আছে আর। তেমন ইচ্ছাই কি হবে?

একসময়ে কলকাতার সত্যনির্ভর ইংরেজিনবিশ ছাত্রদের মতো সে হয়তো সব অবস্থাতেই সত্য বলতো। সেই যে গল্প আছে যে তেমন একজন ছাত্রকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো :তুমি মদ খাও–সে বলেছিলো খাই; জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো :অসৎ স্ত্রীলোকের বাড়িতে যাওয়া-আসা করো–সে বলেছিলো, করি।

রানীমার জন্মতিথির উৎসবটাই ধরো। হঠাৎ একটা চালু হয়েছিলো কিছু একটাকে। ঢাকতে। এখন সময়ের হিসাবে দূরে এসে স্পষ্ট করেই বলা যায় সত্যকে গোপন রাখতে। বিপদমুক্তির জন্য রানী কালীপূজা করবেন। বাৎসরিক কালীপূজার কয়েকদিন পরেই। কালীপূজা। সেটা অনভিপ্রেতভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। তাই বলা হলো রানীমার জন্মতিথি। কেউ কি জানে সেটা সত্যিই কারো জন্মতিথি কিনা? সে কি বলতে পারে এটা তা নয়? এ বছরের উৎসবটা এসে পড়েছে। আমলারা সেই সুযোগে নাটক করতে চাইছে।

অন্যমনস্কের মতো গ্লাসটাকে নামিয়ে সে বন্ধুর আগের চিঠিটাকে চোখের সামনে ধরলো। আলোটাকে একটু উসকে দিলো সে।

বন্ধু আগের চিঠিতে তাকে বলেছিলো কলকাতায় যেতে। জানতে চেয়েছিলো হরদয়ালের স্কুল কেমন চলছে। নবনিযুক্ত নিয়োগী মাস্টারমশাই যে লোহার মতো খাঁটি মানুষ এ বিষয়ে আবার আশ্বাস দিয়ে জানতে চেয়েছিলো কেমন সে পড়াচ্ছে। সংবাদ দিয়েছিলো প্রায় দুমাস হয় সে মেট্রোপলিটনে অধ্যাপকের পদপ্রাপ্ত হয়েছে। ঘোষণা করেছিলো সে গত একমাস মদ্য স্পর্শ করেনি এবং আশা প্রকাশ করেছিলো হরদয়াল ইচ্ছামাত্র সেরকম পারবে। চিঠির পরের অনুচ্ছেদে সে বলেছেগ্রামের রাজসরকারের চাকরি যতই ভালো হোক হরদয়ালের মতো মানুষের পক্ষে কলকাতার বাইরে থাকা আর উচিত হয় না। কেননা দ্রুতউন্নতিশীল জীবনের পরাকাষ্ঠা রাজধানীতে, তাই রাজধানীর বাইরে জীবন কি অপচয়মাত্র নয়? বর্তমানে হাইকোর্টের বিষয়ে যেরূপ শোনা যায় তাতে ব্যবহারজীবীদের আশাতিরিক্ত উন্নতির সুযোগ আসছে। হরদয়াল কলকাতায় গেলে সে যে অনায়াসে দুচার হাজার তঙ্কা উপার্জন করবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। মনে হয় শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রাজা রামমোহনের পুত্র রামপ্রসাদ এবং আরো অনেকে কোনোনা-কোনোভাবে হাইকোর্ট স্থাপিত হওয়ামাত্র তাতে যুক্ত হবেন। নতুন জীবনে রওয়ানা হওয়ার মতো সঞ্চয় কি এখনো হরদয়ালের হয় নাই?

হরদয়াল নিজের অর্ধসমাপ্ত চিঠিটাকেও উপরে তুলো আবার। মেট্রোপলিটানে অধ্যাপকের পদপ্রাপ্তির জন্য অভিনন্দন জানিয়েছিলো সে বন্ধুকে। স্কুল ভালো চলেছে। নিয়োগী কিছু পাগলাটে বটে, বোধহয় কার্পণ্য দোষ আছে যার জন্য তিনি গর্ববোধ করেন, কিন্তু পড়ান ভালোই। নিয়োগের পরে আর আলাপ হয়নি। সে জানতে চেয়েছিলো এই চার বছরে নবপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় জনসমাজে কী কী পরিবর্তন সূচনা করেছে।

নিজের কথা সে কিছু লেখেনি। কেন সে গ্রামে থাকে অর্থাৎ দ্রুত ধাবমান কলকাতা শহরের আধুনিক সমাজের বাইরে, কী তাকে গ্রামে আকৃষ্ট করে–এসব কিছু জানায়নি সে। সে কি লিখবে গ্রামের সৌন্দর্য অথবা শান্তির কথা?

বন্ধুর চিঠিটা সযত্নে রেখে দিলো হরদয়াল। চিঠি লেখা এখন অন্তত হবে না।

কয়েকটি সত্যভাষণহলো,কয়টি মিথ্যাভাষণ হলো, ডায়েরি তার হিসাবনা-হয়েও অন্য রকমের কিছু হতে পারে। হরদয়াল চিন্তা করলো আমরা কি নিজের স্বরূপ নিজের কাছে। প্রকাশ করি ডায়েরিতে? আত্মজীবনী হতে পারে? যাতে কোনো পোজ থাকে না। হরদয়াল ভাবলো পোজ শব্দটার বাংলা কী হবে?

দেয়ালঘড়িতে মৃদু গম্ভীর শব্দ হলো। রাত হয়েছে তাহলে। আত্মজীবনীতে নিশ্চয়ই পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধেও সংবাদ থাকে। কারণ মন তো নিরালম্ব নয়।

হরদয়াল উঠলো। আবার আলমারি থেকে নতুন একটা কাঁচের গ্লাস নিয়ে এলো। একবার ব্যবহার করা গ্লাসে আবার মদ নিলে কি স্বাদে তারতম্য হয়?

ডায়েরিতে অন্যের সম্বন্ধেও মন্তব্য থাকে। আত্মজীবনীতেও অন্যের জীবনী এসে পড়ে। এই গ্রামে যদি কারো জীবনের কথা লেখা যায় তিনি নিশ্চয়ই রানী? তাই নয়? অন্যদিকে বন্ধু ভাবছে এখনো সে দেওয়ান। না সে আর দেওয়ান নয় এ কথাও বন্ধুকে জানায়নি কেন? এত বড়ো একটা সংবাদ সে দিতে পারলো না কেন? এটা কি একটা পোজ নয়? এই পোজ থেকে মুক্তি ডায়েরি লেখার যুক্তি হতে পারে?

হরদয়ালের চোখের কাছে কি বেদনার চিহ্নের মতো কিছু দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে গেলো। হ্যাঁ, সে আর দেওয়ান নয়। আজই কি তা আবার প্রমাণ হলো না? তার একসময়ের অধস্তন নায়েবমশায় এখন অনায়াসে সে কী কাজ করবে তার নির্দেশ দিতে পারেন। এটা কি নিদারুণ লজ্জার বিষয় বলেই ডায়েরিতে স্থান পায়নি?

ঘটনার কথা মনে আছে তার। সেদিন তখন অনেক রাত হয়েছে। হরদয়াল তার নিজের শয্যায় একখানা বই পড়ছিলো। পদশব্দে এবং বোধ করি সুগন্ধেও সে বই থেকে চোখ সরিয়েছিলো। রানী স্বয়ং, একা! রাজকুমারের বিবাহের সম্বন্ধ নিয়ে কলকাতার এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনি ফিরে যাওয়ার পরে রানীর নিজের আত্মীয়স্থানীয় এক মহিলা কিছু লিখেছিলো চিঠিতে যাতে রানী অপমানিত বোধ করেছিলেন। হয়তো কেটের মতো বিদেশিনী সুন্দরীর সাহচর্যে রাজকুমার ভ্রষ্টচরিত্র এরকম ইঙ্গিত ছিলো। কারণ রানী বাগচীমাস্টার এবং তার স্ত্রী কেটের গ্রামে থাকা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। হরদয়াল বলেছিলো তারা নিরপরাধ। সে বলেছিলো এর জন্য রাজকুমারের বিবাহ বন্ধ হতে পারে না। সে এই পাত্রীর সঙ্গেই বিবাহ ঘটিয়ে দেবে। রানী তাকে সেই রাতেই বরখাস্ত করেছিলেন। হরদয়াল শুধু বলতে পেরেছিলো আমার স্কুল? রানীতাকে সাধারণ প্রজাদের একজন হয়ে সে-বিষয়ে আবেদন করতে বলেছিলেন। অথচ সে গ্রাম ছেড়ে যায়নি।

ডায়েরিতে (তা যদি আত্মজীবনীও হয়) অন্যের চরিত্রও ফুটে ওঠে। হরদয়ালের মনশ্চক্ষে রানী যেন ফুটে উঠলেন। কেন এই পদচ্যুতি তা কি সে বুঝতে পেরেছে? রানীকে শেষ যেদিন দেখেছে সে তখন যেমন তাকে দেখিয়েছিলো তেমনটাই যেন হরদয়াল দেখতে পেলো। রানীর মতো এমন চরিত্রই-বা কার এই গ্রামে?

হরদয়ালের মনের কি এটা পলায়ন-প্রবৃত্তি? পদচ্যুতির মতো কঠিন শাস্তি, যা অপমানজনকও বটে তা থেকে সরে আসার চেষ্টা? কিংবা এটা কি এমন যে, যে-রানী সেই। শাস্তির উৎস হরদয়ালের মন তার সম্মুখে গিয়ে এখনো বিষয়টাকে বুঝতে চেষ্টা করছে?

বাগচীমাস্টার এ গ্রামে থাকায় রানীর আপত্তি শুধু সেটুকুই ছিলো নিশ্চয় যেটুকুমাত্র তাদের জীবনযাত্রার প্রভাব রাজবাড়িতে প্রবেশ করে। নতুবা তার প্রজারা কে কী ধর্ম আচরণ করে তার জন্য তাঁর চিন্তার কিছু নেই। অর্থাৎ রাজকুমারের উপরে কেটের প্রভাব পড়ছে। কেট বিদেশিনী এবং সুন্দরী। হ্যাঁ, তরুণ মনে প্রভাব রাখতে পারে এমন সৌন্দর্যই বটে তার। রাজকুমারের তরুণ মনকে রূপসীর প্রভাব মুক্ত রাখাই কি রানীর চেষ্টা? রাজকুমার কেটকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলো এই জেনেই কি রানীর ক্রোধ? যার ফলে সে আর দেওয়ান নয়?

এদিকে দ্যাখো, কাল রাতে আবার অন্য ভাবনাও উপস্থিত ছিলো। দুবার অন্তত, যদিও হয়তো তা দুই রকমের সুরে, তিনি বলেছিলেন নয়নতারা রাজকুমারের সঙ্গে থাকাতেই ভাবনা। অথচ রানীর প্রশ্রয় ছাড়াই কি নয়নতারা রাজকুমারের সঙ্গী হতে পারতো?

রানীর মুখ কী রকম দেখিয়েছিলো সেই প্রতীক্ষার সময়ে যখন দুবার বলেছিলেন নয়নকে নিয়ে তাঁর ভাবনার কথা? সেই আয়ত চোখ দুটির কোলে কি হাসি ছিলো? অথবা কি রানীর গালে কিছু টোল খেয়েছিলো? একটা আলোর মতোই রানীর মুখটা যেন স্মৃতিতে ধরা দিচ্ছে।

কেন এই প্রশ্রয় নয়নতারাকে তা ভাবতে গেলে কোনো হেতু কি খুঁজে পাওয়া যায়? রানী যা কিছু করেন তার অনেকটা রাজনৈতিক কৌশল–এরকম একটা প্রত্যয় আছে। কেটের চাইতেও নয়নতারা কি বেশি সুন্দরীনয়? হয়তো রূপ দুটি দুরকম, কিন্তু তুমি বলতে পারো না নয়নতারার চাইতে বেশি আকর্ষণীয়া কেউ হতে পারে।

তাহলে এটা কি বুদ্ধিমতী রানীর বিষের ওষুধ হিসাবে বিষ প্রয়োগ করা? এক সুন্দরীর প্রভাব কাটাতে অন্য এক রূপসীকে পাশে এনে দেয়া। বিষস্য বিষৌষধি?

হরদয়ালের মুখে একটা হাসি যেন দেখা দিলো। যেন সে ডায়েরিতে মন্তব্য করবে-কিন্তু রানী, খুব হুঁশিয়ার হয়েই এই বিষ প্রয়োগ করা উচিত হবে।

এসবে তার পদচ্যুতির কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। বিদেশী প্রভাবেই কি রানীর আপত্তি? বিদেশী প্রভাব কি আলোর ডোমগুলিতে, পর্দাগুলিতে, আসবাবপত্রের অজুহাতে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে না রাজবাড়িতে?

রানীর চরিত্রই যেন হরদয়ালের সম্মুখে। আজ সেটাই সবচাইতে মূল্যবান এমন অনুভব করলো সে হাসিহাসি মুখে, যেন সে একজন লেখক যে নিজেই একটা চরিত্র সৃষ্টি করে। তখন তো লেখক অন্য সবকিছু ভুলেও যায়, নিজের জীবনে ক্ষতি কিছু থাকে তাও।

অন্যদিকে ওটাও কি বিদেশী প্রভাব দূরে রাখা? কাল রাতের সেই মুন্সেফি কোর্ট দূরে রাখার অসহায় ইচ্ছাটা ভাবো। কলকাতায় হাইকোর্ট বসবে। এবং দেশের সব আদালত তার অধীনস্থ হবে। হয়তো শেষ পর্যন্ত কোম্পানীর আদালতগুলি উঠে যাবে। ছোটো-ছোটো আদালত স্থাপিত হবে হাইকোর্টের এক্তিয়ারে। রানী চান না তেমন কোনো আদালত গ্রামে স্থাপিত হয়।

মুন্সেফি কোর্ট আসাটা হরদয়াল নিজেও সমর্থন করে। সে এ-ধরনের শাসন বিস্তারে শুভ দেখতে পায় বৈকি।

কিন্তু রানী কী চাইছেন? তিনি কি কল্পনাতেও নিজের আদালত স্থাপনের কথা চিন্তা করেন? করদ রাজ্য বেহার রাজ্যের আদালতের কথা বলছিলেন না? অন্য কেউ বললে এ সম্বন্ধে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে না হরদয়াল। কিন্তু রানীর লাবণ্য যত কোমল মস্তিষ্ক তেমনই তীক্ষ্ণধার নয় কি? কিন্তু তুমি চিঠি লেখো আর না-ই লেখো, ডায়েরিতে চিন্তাগুলোকে বসাও কিংবা না-ই বসাও রাত হয়ে যায়।

রাত হলো বৈকি। ইতিমধ্যে ভৃত্য একবার পর্দার ওপারে এসেছিলো। দশটা বাজে ঘড়িতে। লাইব্রেরীর এটা একটা কৌতুক যে রাতের বয়স কত হলো তা এখানে বোঝা যায় না যেন।

বন্ধু তাকে বলেছে কলকাতায় গিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে। কলকাতায় কী হয় জানি না, এখানে আমাদের কিন্তু অনেকের বয়স হয়েছে। বয়স হলে তার অতীত থাকে না। অতীতকে কি বিসর্জন দেওয়া যায় সবসময়ে, কিংবা সবটুকু অতীতকে?

ভৃত্য এসে এবার বললো– টেবল পাতা হয়েছে।

হরদয়াল উঠলো।

লাইব্রেরি থেকে খাবার ঘরে যেতে একটা সরু প্যাসেজ পার হতে হয়। তার একটা জানলা রাজবাড়ির দিকে। চলতে চলতে কানে এলো, মনে হবে যেন জানলার ওপারেই বাজছে। তা সম্ভব নয়। কারণ এটা পিয়ানো এবং রাজকুমার বাজাচ্ছেন। তাহলে বরং এটাই প্রমাণ হয় রাজকুমারের ঘর–যেখানে তিনি পিয়ানো বাজান-তা দেওয়ানকুঠির এই দিকেই।

একটু দাঁড়ালো হরদয়াল। ইতিপূর্বেও দু-একবার বাজনা কানে এসেছে তার। রাজকুমার যে বাজান তা সে ভালোভাবেই জানে। প্রতিবারেই কলকাতায় তাকে স্বরলিপি খোঁজ করতে হয়। বাঃ, ভারি সুন্দর তো! বাজনাটার বৈশিষ্ট্যই যেন জানলার কাছে নিয়ে গেলো তাকে। গম্ভীর মধুর কিছু, যেন কিছু বিষণ্ণ। যেন মানুষ যখন চাঞ্চল্যের বাইরে যায় সেই বয়সের সুর। কিন্তু তা হয় নাকি? হরদয়ালের মনে পড়লো এই গ্রামে যারা চল্লিশ হচ্ছে তাদের কথা; সে নিজে, বাগচী, রানীমা। কিন্তু এই গম্ভীর মধুর ক্লান্ত সুর কি প্রাণ থেকেই উঠে আসে না? পছন্দ-অপছন্দে মানুষের স্বরূপ ধরা পড়ে। এই সুর অন্তরে অনুভব করার মতো গম্ভীর হয়েছে নাকি রাজকুমার ইতিমধ্যে?

 ০৫. দলিল-দস্তাবেজ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

০১.

ঘটনা কী সে সম্বন্ধে ভিন্ন মত আছে। উপরন্তু যদি কেউ সে সময়ের দলিল-দস্তাবেজ উল্টে পাল্টে দেখে তবে তার হঠাৎ অনুমান হতে পারে তখনই তো এক নতুন জাতের সব ঘটনার সুচনা হচ্ছিলো গ্রামে। একটা উদাহরণ নাও। কাছারিতে তখন রানীমার জন্মোৎসবের কথাই প্রাধান্য পাচ্ছিলোতা ঠিকই, কিন্তু সেই একরকমের যুদ্ধ, যার অন্য নাম আধুনিকতাও বলা যায়, তার কথাও এসে পড়ছিলো।

মূলে সেই রাস্তা কাটার ব্যাপারটাই। সোজা সে কথা? নাক কেটে দেওয়ার চাইতে কম কিছু? তাও কার? ডানকানের? হতে পারে সে স্কচ, একেবারে যোলআনা ইংরেজ নয়, তা হলেও সে কি রাজার দেশের লোক নয়? জ্ঞাতকুটুম্বদের মধ্যে পড়ে না? অথচ মাথা ফাটলো না দু-পাঁচজনের, দু-চারজনের বুকে বল্লম বিধলো না, এক কথায় রক্তে মাটি ভিজলো না। এদিকে নায়েবমশায়ও যেন ব্যাপারটাকে নিজের মনের মধ্যে চেপে রেখেছেন। রাগ (নাকি ক্রোধই বলবে) ছাড়া কী? দারুণ ক্রোধ। নতুবা আলাপ-আলোচনা নেই, কথাবার্তা নেই, শাসানো নেই। লাঞ্চো খেলে তো একই সঙ্গে বসে (না-হয় নায়েব নিজে খাননি) আর সেই লাঞ্চো থেকে উঠে এঁটোমুখেই হুকুম গেলো সড়ক কাটার। এদিকে সব শুমশাম। যেন কিছুই নয়। কিছু না-ঘটাই তো একটা ঘটনা।

কারো কারো মতে এটাই ঘটনা যে ১৮৫৭ শেষবারের মতো ঘটেছে আর ঘটবে না, ঘটনা এটাই যে এখন থেকে নতুনভাবে ঘটবে। এসব লক্ষ্য করেই তারা বলতে পারে :হতে পারে তখনও স্যার বানেশ পীকক কলকাতার হাইকোর্টে জমকালো হয়ে বসেনি। কিন্তু এখানে যেন পরে যা হবে তার সূচনা সেবারই দেখা দিয়েছিলো। একটা বড়ো রকমের পরিবর্তনের সূচনা। তুমি তোমার ধর্মমত, আর্থিক সঙ্গতি এমনকী চামড়ার রং নিরপেক্ষ অন্য সকলের সমান। এ কি আগে কখনো ছিলো? তুমি বিধর্মী হলেই কোণঠাসা, তোমার চামড়ার রং কালো বলেই তোমার কথা মিথ্যা এইনা-এতদিন, পাঁচশ বছর ধরে, হয়ে এসেছে। এখন দ্যাখো সমান হচ্ছে। ন্যায়নীতির প্রতিষ্ঠা হবে। এই সমান কথাটা নিয়ে রসিকতা আছে। ফুটপাথে শুয়ে থাকা ধনী-নিধনের পক্ষে সমান অপরাধ। সত্যমিথ্যা নিয়েও কম গোলযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে সত্য কি তাই নয় যা প্রমাণিত হলো! আর প্রমাণ মানেই হলপ করে বলা কথা।

কথাটা ন্যায়নীতি নিয়ে। ন্যায়নীতির কথায় অবশ্যই কিছু কিন্তু আছে! এ বিষয়ে নায়েব মশাই ও হরদয়ালের আলাপই উদাহরণ হতে পারে। হরদয়াল বলেছিলো, দেখছি জমিটা মূলে ফরাসডাঙার, দখলদার কৃষক শামসুদ্দিন। নায়েব বলেছিলো, তাহলেও প্রমাণ হয় না জমিটাতে মনোহরের স্বত্ব অর্শাচ্ছে। হরদয়াল বলেছিলো, জমিটা হয়তো মনোহরের কাছে দায়বদ্ধ। নায়েব বলেছিলো, জমি দায়বদ্ধ হতে পারে, তাতে কিন্তু তার উপরে স্থায়ী রাস্তা করার অধিকার মনোহরের জন্মায় না। হরদয়াল হেসে বলেছিলো, তা বটে, কিন্তু আমরাই বা কোন পক্ষ? জমিটা ফরাসডাঙার যে বলবে তা কি প্রমাণসাপেক্ষ নয়? যদি অন্যরকম প্রমাণ হয় তা কি সত্য হয় না? সত্য কী? যা এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী তোমার বক্তব্যকে প্রমাণ করে। এটা কি হরদয়াল আর নায়েবমশায়ের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হরদয়ালের মন কি এখনো রাজনীতিতে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার করে? শেষ পর্যন্ত রাজনীতির দাবি তাকেও মানতে হয়, কিন্তু কিছুটা তা কি নিজের মনের সঙ্গে বিবাদ করে? অন্যদিকে নায়েবমশায় যেন ন্যায়-অন্যায় বিচারের অসারত্ব সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ।

নায়েবমশায়ের এই মনোভাবকে অথবা মাঝপথে মনোভাব বদলানো তাদের একটা বিশেষ আধুনিকতা বলেই মনে হয়েছিলো। মানুষ এখন থেকে ক্রোধ, হিংসা ঈর্ষা, থেকে সরে যাওয়ার এক নতুন পথ পাবে। এতদিন তো হাতাহাতি, দাঁতের বদলে দাঁত, নাকের বদলে নাক নেওয়া ছিলো। এখন যেন সেসব থেকে দূরে থাকা হবে কৌশল। যে মামলায় জিতলো সে তো শান্ত হলোই, যে হারলো সে-ও ভাবলো, কী আর করা যাবে বলো, এবার থামো। যদি বলা হয় এ ধরনের শান্তিতে প্রকৃত কিছু লাভ নেই, তাহলে অপরপক্ষ বলবে যা নিয়ে বিবাদ তারইবা প্রকৃত মূল্য কী? কিছুদিন পরে বিবাদের উভয়ংক্ষিই বুঝতে পারে যা নিয়ে এত উত্তেজনা, কলহ, তা সবই নিতান্ত মূল্যহীন। এ যেন এক খেলার আইন মেনে চলা। জুয়ার খেলাতেও আইন আছে, যদিও সে আইনে টেবলের মালিকের লাভ হয় শেষ পর্যন্ত।

যাকে অন্যায় বলে মনে হয় তার প্রতিকারের জন্য মানুষের যুদ্ধ করার দিকে ঝোঁক। আছে। এবং এই আধুনিক প্রথায় সে-ঝোঁকটারও তৃপ্তি হয়ে থাকে। সূচনায় চিনতে কিছু অসুবিধা হচ্ছে বটে। দলিল দস্তাবেজ, কমিশন আর মিশন, গাউন-পরা শিক্ষিত উকিল ব্যারিস্টারের ছুটোছুটি আদালতে, গাউন ছাড়াই তাদের ছুটোছুটি সেনেটে আর মাঠে-পরবর্তী একশো বছরের সেসব বাকযুদ্ধের সূচনা পাবে এতেই! আর এও যে এক রকমের যুদ্ধ তা নাকি রানীমাই উল্লেখ করেছিলেন। অন্তত তার কথাতেই যুদ্ধ শব্দটার উল্লেখ ছিলো।

.

০২.

অন্যান্য দিনের মতো কাছারিতে কাজ হচ্ছে। নিঃশব্দেই বলা যায়। অর্থাৎ নায়েবমশায়ের খাসকামরার দিকে যত এগোবে ততই নিঃশব্দ। নতুবা এ-ঘরে ও-ঘরে চাপা গলার আলাপ, এমনকী তামাক টানার মৃদু শব্দ নিশ্চয় আছে।

কিছুক্ষণ আগে জমানবিশ মহেন্দ্র বেরিয়েছে নায়েবের কামরা থেকে, এখন আবার। সুমারনবিশ সুরেন্দ্রর ডাক পড়লো। জমানবিশকে চিন্তাকুল মুখে বেরোতে দেখা গিয়েছে।

তাকে সে অবস্থায় যে দেখেছে সে সদর-আমিন সোনাউল্লা। সোনাউল্লা চট করে সামনে যে-দরজাটা পেলো তা দিয়েই ঢুকে পড়লো। সে ঘরটা ল-মোেহরার গৌরীর।

সোনাউল্লা বললো–গতিক ভালো দেখি না।

–শুনছি তাই। বললো– গৌরী। –আসলটা জানেন কিছু?

-আরে আমি ভাই লেঠেলদের সদ্দার। কাগজপত্রের খোঁজ কী রাখি?

যেখানেই জমি নিয়ে বিবাদ সেখানেই আমিনের ডাক পড়ে। জমি মাপজোখের জন্য সঙ্গে লোকলস্কর থাকে এবং যেহেতু বিবাদ সঙ্গে দুচারজন পাইকবরকন্দাজও। এ থেকেই সোনাউল্লা কাজী, যে প্রায় মুনসেফ-ম্যাজিস্ট্রেটের কাজ করে, নিজেই লেঠেলদের সদ্দার–কথাটা নিজের সম্বন্ধে তৈরি করেছে।

সে হেসে বললো–আমিও ভাবছি আলি বলে বেরিয়ে পড়ি। বিলমহলের মাপজোখ শেষ করে ফেলি। ওদিকে এ ওর জমিতে কামড় দিচ্ছে।

–আপনার কি মনে হয় গতিকটা মন্দ কাজ ফেলে রাখার জন্যই?

-শুনছি গত বছরের তুলনায় এই আট মাসের গড় আদায় বেশকিছু কম। পরগনায় পরগনায় নায়েব আহিলকারদের কাছে কড়া চিঠি যাচ্ছে নাকি।

–আপনার ভদ্রপুরের ঝামেলাটা মিটলো? গৌরী জিজ্ঞাসা করলো।

-ওটা আর আমার ঝামেলা নয়। বাঙালি নীলকরের নাম শুনেছো? দত্তবাবুরা নীলকর হতে চাইছে, জোড়াসাঁকোর ঠাকুররা যেমন হয়েছিলো।

লাভ?

সাতপুরুষে ব্যবসাদার ওরা। তেজারতী বন্ধকী তো ছিলোই, এখন দাদন ব্যবসা। শুনছি আগে তাঁতীদের মহাজন ছিলো। এখন তাঁতী কই? নীলছাড়া আর ব্যবসা কোথায়? একটা তুলোর ক্ষেত দ্যাখো?

কারখানাও করবে?

–আপাতত মরেলগঞ্জের সঙ্গে বন্দোবস্ত। কিন্তু তোমার ঘরে মুসলমানী হুঁকো যদি না রাখো, আমার আসাই বন্ধ করতে হবে।

-রাখবো। গৌরী বললো–শামসুদ্দিনের দরুন সেই রাস্তা কাটার জমিটা আপনি মেপেছিলেন নাকি?

কবে! না এবার উঠি। চক্‌ ইসমাইলের দিকে যাবো। ভদ্রপুরের কানুনগোকেও চিঠি দিতে হবে। আরে গৌরী, এবার রানীমার জন্মোৎসবের খাওয়াদাওয়ার ইনচার্জো কে? গতবার মুসলমান জোতদাররা কলাপাতায় খেতে বিরক্ত হয়েছিলো।

উঠেছিলো বটে কথাটা। দেখতে সুন্দর হয়নি। মনে হয় সুরেনবাবুই ভার নেবেন। টেবল-চেয়ার কাঁচের বাসন হলেই হয়।

.

নায়েবের খাসকামরায় সুমারনবিশ সুরেন্দ্র দেখলো নায়েব তখনো জমার বই দেখছেন। পাশে গত সনের জমার চুম্বক-নথিনাকি রেভেনিউ অ্যাবস্ট্রাক্ট বলে। আঙুলের ডগায় ডগায় হিসাব হচ্ছে।

নায়েব বললো–বসো, সুরেন্দ্র।

দুপাঁচ মিনিট আরো হিসাব চললো। চুম্বক-নথিতে লাল পেনসিলের দাগ পড়লো। খাসবরদারকে ডেকে নায়েব বললো, রানীমার সঙ্গে দেখা করবো। হুকুম আনো। আর্জি নিয়ে খাসবরদার চলে গেলো, জমা বই ঠেলে দিয়ে নায়েব মুখ তুলো।

সাহসী সুরেন্দ্রও চমকে উঠলো।

নায়েব বলেলা–দ্যাখো, সুরেন্দ্র, দেওয়ান উৎসবটা শুরু করেছিলেন, তখন নিশ্চয় হেতু ছিলো। এখন কিন্তু ওটা আমাদেরই ব্যাপার। আমরাই উৎসাহ নিয়ে এগোবো। যাঁর জন্মতিথি তিনি কী আর বলেন? ছেলেরা নাটক করার কথা বলছে, কিন্তু তোমার দফাওয়ারি আগাম হিসাব, নাকি তাকে বডজেট বলে?

-এবার তিথিটাই আজ্ঞে এগিয়ে এসেছে। আমি দুএক দিনেই পেশ করবো বড়জেট।

হলেই বা। সেদিন সুমার দেখতে দেখতে হঠাৎ নজরে না পড়লে আরো কয়েকদিন পিছিয়ে যেতো জোগাড়যন্তর।

তা কি আর হতে দিতাম, হুজুর। রেলের শেয়ারের দরুন অ্যাটর্নির খত দেওয়ানজির মন্তব্যসমেত এসেছে। আড়াই লাখ মতো।

–হুঁ। বডজেটে ধরো।

সুমারনবিশের উৎকণ্ঠাটা গেলো।

সে বললো–সব পরগনার সব জোতদারদের কি বলা হবে?

গতবারও বলেছিলো বটে। কিন্তু একজায়গায় তো থামবে। বার্ষিক দাখিল পাঁচ হাজার পর্যন্ত পত্র দাও। জমানবিশের সেরেস্তায় লিস্টি করতে বলল।

সুমারনবিশ উঠলো। কিন্তু যেন দাঁড়িয়ে পা ঘষে, যেন কিছু বলবে।

নায়েব তা লক্ষ্য করলো।

নাচগান আর আতসবাজীর কথা নাকি?

সুমারনবিশ খুশি গোপন করে বললো–আচ্ছা, হুজুর, তা পরে বলবো।

সকালের কাছারি ভাঙে দুপুরের আগে। এগারোটা বাজে আজকাল তখন। সময়টা সেদিকে চলেছে। নায়েবের খাসবরদার আর্জি পৌঁছে দিয়ে ফিরে গড়গড়ার জল বদলে ছিলিম দিলো। নায়েব দুএক টান দিলেন। হাঁ, ঠাণ্ডা বটে এ তামাকটা। যে বয়সের যা এই রকম একটা চিন্তা নায়েবের মনে একপাক ঘুরে গেলো। রাজবাড়ি থেকে রূপচাঁদ এলো। নায়েব তখনো তামাক টানছেন। কাছারি ভাঙলে যেতে বলেছেন রানীমা।

তামাক শেষ করে নায়েবউঠলো। ধীর পায়ে কাছারির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। কখনো কখনো কোনো সেরেস্তায় ঢুকে পড়ে নায়েব আমলাদের খাতাপত্তর পরীক্ষা করে থাকে। কাজেই যতটুকু দেখা যায় দরজা-জানলার ফাঁকে নায়েবকে তেমন দেখে নিয়ে আমলারা কাগজে চোখ নামিয়ে নিলো।

নায়েব এই সময়ে লক্ষ্য করলো সদর-দরজা দিয়ে হরদয়াল এগিয়ে আসছে।

দেওয়ানকুঠি থেকে কোথাও যেতে খানিকটা কাছারির দিকেই আসতে হয়।

হরদয়াল কাছে এলে নায়েব বললো, নমস্কার-কাছারিতে নাকি?

হরদয়াল বললো–রানী ডেকেছেন।

নায়েব বললো–আমিও তো যাচ্ছি, তাহলে

হরদয়াল একটু ভেবে, হেসে বললো, দুজনকেই দরকার হয়তো একত্রে।

রাজবাড়ির দরজাতে রূপচাঁদ জানালো, রানীমা দরবার-ঘরে। দেউড়ির ঘড়িতে তখন সশব্দে এগারোটা বাজলো। দরবার-ঘরের নিচু কৌচে রানী বসেছিলেন। কাছারির প্রধানতম দুজন দরবারে। রূপচাঁদ সুতরাং যথোপযুক্ত আসনের ব্যবস্থা করে রেখেছিলো।

রানী বললেন–বসো হরদয়াল, বসুন নায়েবমশাই।

নায়েব দরবার চেয়েছিলো, সুতরাং সে-ই আগে বলবে। জানালো জন্মোৎসব সম্বন্ধে বলতে চায়।

.

০৩.

রানী শুনে বললেন, তুমি যখন সে বিষয়ে এখনো আলাপ করার কথা ভাবছো, সব পাকা হয়নি। ওটাকে কি চালিয়েই যেতে হবে? না-হলেই কি নয়?

–আজ্ঞে, এটা এক বিশেষ উৎসব যা আমাদের অঞ্চলেই হয়। দশজনের আনন্দ, গ্রামের সুখ্যাত।

বলো।

গতবার জোতদারদের মধ্যে বড়োদের, সদরের হাকিমদের, মরেলগঞ্জের ওদের নিমন্ত্রণ হয়েছিলো। এবার

–মরেলগঞ্জে দিতে চাচ্ছো না? ইংরেজদের সঙ্গে ফৌজদারি-ফরিয়াদিতে কিন্তু লাভ হয় না। একটু দেরি হলো নায়েবের উত্তর দিতে। বললো–এখনো সবটা ভেবে উঠতে পারিনি।

কৌতুক বোধ করে রানীমা ভাবলেন, এ কি কখনো সম্ভব নায়েবের, মরেলগঞ্জেই দু একজন লোক নেই যে ডানকান কী করবে তা ধরতে পারছে না? বললেন–মামলা চলুক, নিমন্ত্রণ পাঠাও। তাছাড়া লীজের হলেও মরেলগঞ্জও তোমাদের একরকম পত্তনীদার। দেওয়ানি স্বত্বের মামলা ভালো নাকি বিলেত পর্যন্ত নেওয়া যাবে। বেনে নীলকরেরা ততদুর যেতে চাইবে না বোধ হয়।

কিন্তু তখনই স্নিগ্ধ ডাগর চোখদুটো যেন চঞ্চল হলো, গালে কোথাও একটু যেন রং লাগলো। বললেন রানী–তুমি কি শুনেছো? তোমাদের পেত্রো নাকি ইংরেজদের একটা কথাই ইংরেজিতে বলতেন : দেয়ার্স নাথিং আনফেয়ার ইন লভ অর ওঅর!

দরবার শেষ হলো, নায়েব উঠলো। কিন্তু ডানকান আর তার মামলা সম্বন্ধে নির্দেশ নিয়ে দরবার ভাঙা যায় কি? বরং দরকারি কথার মাঝে এসে পড়েছিলো এমন ভাবটা থাকা উচিত।

বিচক্ষণ নায়েব সেজন্যই যেন বললো–ঘরবাড়ি সংস্কার ইত্যাদির কাজে খরচটা বৃদ্ধির দিকে। রানী কথা না বলে নায়েবকে বলতে দিলেন।

নায়েব বললো– হাসিমুখে নরেশ, সুরেন, এরা যত কাজ করছে, তত যেন কাজ বাড়ছে। ওদের একটা আলাহিদা দপ্তর করলে হয় না? পৃথক হিসাবনিকাশ, তদারকি। দেওয়ানজিকে অনুরোধ করেছি ভার নিতে।

ভাবতে যেন মুহূর্তই যথেষ্ট। রানী বললেন–ভালো করেছে। নিয়োগপত্রের দরকার হবে? আচ্ছা, আমি বলি, হরদয়াল, নরেশদের কাজ দেখে দিলে তোমার উপরে খুব চাপ পড়বে?

কোনো কোনো বিষয় খুব দ্রুত অগ্রসর হয় দেখা যাচ্ছে। নতুন এই পূর্তবিভাগটি পৃথক করে খোলার ব্যাপারে তা দেখা গেলো।

নায়েব চলে গেলে হরদয়াল বললো, আমাকে ডেকেছেন?

-হ্যাঁ, হরদয়াল, বসো। রানী বললেন, ভালোই হলো তোমার হাতে কাজের ভারটা এসে। একটা শহর গড়ে তোলার মধ্যেও পৌরুষ থাকে, নয়? রানী হাসলেন। পরে অন্য পুরুষ এসে তাকে অন্য রকমে গড়তে চাইবে, তাহলেও কিছু একটা করেছি এরকম অনুভব থেকে যায় না? তুমি ভেবে দেখো আমাদের এই বাড়িতে গাড়িবারান্ডা জুড়লে কেমন হবে, তার জন্য নাকি আলগা কয়েকটা মিনারও বসাতে হবে মাথায়। কিন্তু তার চাইতেও বেশি ভাবা দরকার ছ-আনির কায়েতবাড়ি পর্যন্ত রাজবাড়ির সদর থেকে বর্ষায় বেচাল হয় না এমন পাকা সুরকি রাস্তা কী করে হয়।

কায়েতবাড়ি? হরদয়াল বিস্মিত হলো–কোথা দিয়ে যাবে? মরেলগঞ্জের আড়াআড়ি?

রানী যেন কৌতুকে হাসলেন। বললেন–না না। ফরাসডাঙা দিয়ে।

-সে তো তিন-চার ক্রোশ হয়ে যাবে, অনেক–

রানী বললেন, অনেক টাকা বলেই তো নায়েবমশাই তোমাকে ভার নিতে বলছেন।

দরবার কি দীর্ঘস্থায়ী হবে? কৌচের উপরে কুশন ছিলো। হেলে বসলেন রানী। মোটা বাঁশগিরে রুলিতে আলো চিকমিক করলো যেন। বললেন–চীনে নানকিং কী? টাইপিং কী বিষয়?

হরদয়াল লক্ষ্য করছিলো, ভঙ্গিটা পরামর্শের বটে। সে অতি দ্রুত চিন্তা করলো, চিন্তায় থই পেয়ে বরং বিস্মিত হলো। টাইমস কাগজে সোরগোল। টাইপিং বিদ্রোহে ইংরাজ অন্য পক্ষ, সুবিধা করতে পারছে না। এমনকী সেনাপতি বদলের কথা হচ্ছে। কিন্তু রানী জানলেন কী করে? চীনাদের এক অংশ স্বজাতির স্বার্থে, ইংরেজ তাদের অবাধ বাণিজ্যের নামে মুখোমুখি।

রানী হালকা কথার সুরে বললেন, কায়েতবাড়ির ছেলে ইংরেজ পক্ষে সাবলটার্ন না কী হয়ে যেতে চায় সেখানে।

আমরা? হরদয়াল বললো–অনেকদিন পরে আবার সে রাজবাড়ির পক্ষকে আমরা বললো–আমাদের কিছু ভাবতে হবে? সাবলটার্ন বলছেন?

রানী ভাবলেন, বললেন অবশেষে-ছেলেরা যদি মত চায়, তার অবশ্য একুশ পার হয়েছে। মতনা-চাইলেও কী হতো? একটু থেমে বললেন আবার কেউ কেউ বাপের মতো হবেই। সবদিক ভেবে দেখে বলল।

রানী উঠলেন।

.

০৪.

নায়েব রাজবাড়ি থেকে বেরিয়ে খাসকামরায় বসতেই খাসবরদার একটু দ্বিধা করলো, কিন্তু বসছেন যখন এই ভেবে ছিলিম পাল্টে আলবোলার নলটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো–এবার রানীমার জন্মদিনে তসরের গড়া চাই, হুজুর।

-সে কী? ও আচ্ছা। তা তো বটেই। গৌরীকে ডেকে দাও একবার।

ল-মোহরার গৌরী এলে নায়েব চেপে চেপে হাসলো, বললো–কীবল ছোকরা কি ব্যারিস্টার? দ্যাখো তো মনোহরকে সে-ই পরামর্শ দিচ্ছে কিনা।

অবাক গৌরী বললো–আচ্ছা-আচ্ছা, খোঁজ রাখতে হচ্ছে, হুজুর।

কিন্তু গৌরী একা নয়। সুমারনবিশকে সামনে রেখে বেশ কয়েকজন ভিড় করে এলো। নায়েব চোখ তুলো। তার কী বুঝতে আর বাকি? বললো–ঢের হয়েছে, হাতের কাছে রামযাত্রা আছে কিনা দ্যাখো।

সুমারনবিশ আজ্ঞে বলে ইতি করতে চাইলো, কিন্তু তার পিছনে অন্যেরা এমন দরজা জুড়ে যে পিছানোর উপায় নেই।

দরজার পাশ থেকে একজন জানালো-আজ্ঞে, নাটক কলকাতায় যা হয়, ঠিয়াটার। আমাদের ব্রজকান্ত দেওয়ানজির সঙ্গে গিয়ে দেখেছে। দেওয়ানজিকে বলেছিলো ব্রজ। তিনি বলেছেন, দ্যাখোনা চেষ্টা করে। আপনি বললে রিহারস্যাল শুরু করি।

–এই মরেছে! এখন যাও, এখন যাও। ঠিয়াটারে রক্ষে নেই রিস্যাল দোসর। সেরেছো তোমরা। এখন বোঝোগে, সে কিন্তু রানীমার চোখে পড়তে পারে।

আমলারা খুশি মুখে চলে যেতেই নায়েব জমাবন্দির খাতাটা খুলছিলো, কিন্তু খাসবরদার নিবেদন করলো এগারোটা বেজে এ বেলার কাছারি ভাঙলে তবেই তিনি রাজবাড়ি গিয়েছিলেন। তিনি না-উঠলে আমলারা কেউ যেতে পারছে না।

কাছারি বারান্দায় নায়েবের পালকি। হঠাৎ একদিন যেমন সে শুনতে পেয়েছিলো সেদিন সকাল থেকেই সে নায়েব আর নয়, নায়েব-ই-রিয়াসৎ, তেমনি হঠাৎ একদিন কাছারির গোড়ায় ছ বেহারার পাকিটাকে দেখতে পেয়েছিলো।

কে এলো রে? আজ্ঞে, কেউ নয়। আপনার বাসায় যেতে।

পালকিটা চলেছে মাঝারিগতিতে। একহাত নিচে পথটা সরে সরে যাচ্ছে। রানীমার ছোটো আট বেহারার পালকিটাও মাটি থেকে কোমরসমান উঁচুতে থাকে। তাকিয়ায় কনুই রেখে আধশোয়া অবস্থায় নায়েব। এখন সে কিছু ভাবতে চায় না। এখন স্নানাহার বিশ্রামের সময় নয়? কিন্তু, তার মনের মধ্যে কেউ ফাঁকিটা ধরে হাসলোম্মুঃ। তাহলে তো উল্টোদিকে যোগই হলো।

হুঁই-হাই করে চলছে পালকি। হ্যাঁ, নিচুই তো। কাহারদের সে বেঁটে দেখে দেখে বাছাই করেছে। পাকির ছাদের দিকে চাইলো নায়েব। বেশ উঁচু। ও, হ্যাঁ, কোনো-কোনো ঘোড়ার পিঠ ওরকম উঁচু হয় বৃটে। তা ছিলো। আর লাফিয়ে উঠতো তার পিঠে। কায়েতের ছেলে, কিন্তু লাফিয়েই উঠতো বুজরুকের মতোই।

কাহাররা গুমগুম গুনগুন করে উঠলো। নায়েব বললো–আস্তে চলো, বাপারা, এ কি রাজবাড়ির পাকা হাতা?

নায়েব ভাবলো পাকা রাস্তাই তো কথায় উঠেছিলো। তা ভালো সদরে গেলে বোঝ যায় সুবিধা কোথায়, ফীটিন বলল, ল্যান্ডো বলল, সকলেরই সুবিধা। …আর রাজবাড়ির দেউড়ির কাছে যখন পাকা রাস্তায় উঠেছে বুরুকের ঘোড়া লাল আগুনের শিখার মতো ধুলো উড়তো, নাকি বালামচি?

কিন্তু, কিন্তু তুমি বাপু কায়েতের ছেলে গোবরা, তোমার কেন তেমন ঘোড়া? কী লাভ?

কী লাভ?

নায়েব নিজেকে জানালো, আসলে গৌরী বেজোদের দেখে মনে পড়েছে তোমার। তাদেরই সমবয়সী ছিলো তো। থাকলে ওদের ঠিয়াটারে জমতো।

সে স্থির করলো গিন্নিকে আজ বুঝিয়ে দেবে, (প্রথম) যে গিয়েছে সে শত কান্নাতেও ফেরে না, (দ্বিতীয়) পেটের ছেলের শোকও মানুষ ভোলে, ভাগনা বলে শোক বেশি হয় না, (তৃতীয়) আমি তো আর-এক ভাগনাকে এনে দিয়েছিলাম, ভরলো তোমার বুক?

কাহাররা কাঁধ বদলালো, তাই একটা মৃদু ঝুঁকি লাগলো। নায়েব দু হাত একত্র করে বুকে রাখলো।

না, আনন্দ হয় এমন কোনো বিষয়ে আজ আলাপকরতে হবে। তেমন বিষয়ের খোঁজেই যেন তার মনে পড়লো রানীমার কথা। সেই স্নিগ্ধ ডাগর চোখ দুটির চঞ্চল হয়ে ওঠা, ঠোঁটের কোণের সলজ্জতা আর হাসির মধ্যে সেই ইংরেজি কথা। রানীমা ইংরেজি বলেছেন শুনে তুমি কাঠ হবে, গোবরার মামী। তা এক বিদ্যুতের ঝিলিক।

হঠাৎ যেন কাহারদের হুই-হাই বেড়ে উঠলো। সে বাড়ির গিন্নিকে খুশি করতে। তো, রাজবাড়ির তত্থা। গিন্নি কাপড়চোপড় দেন, এ সুযোগে-সে সুযোগে মাহিনায় দশদিন খাওয়ান।

মর্যাদার প্রশ্ন এসব।

রানীমা অবশ্য যুদ্ধের কথা বলেছিলেন। কিন্তু সড়ক কাটা কি যুদ্ধ? যুদ্ধ? আঃ অন্ধকারে অদৃশ্য ঘোড়ার কাজলকালো পেশীর মতো কিছু কী তার মনের মধ্যে টগবগিয়ে উঠছে। নাকি এক হিংস্র দাঁতের সারি। আর, জানো বাপু, বুড়োবয়সে রাশ টেনে রাখতে পিঠ ভেঙে আসে, দম ফেটে যায়; হাত…

বাড়ি পৌঁছে ধীরে-সুস্থে স্নানাহার করে নায়েব গিন্নিকে ডেকে বললো, গোবরার মামী, শোনো। একটু শোও দেখি, বাছা, আমার পাশে। এখনই সলতে পাকাতে হবে কেন? সলতে, সলতে…প্রদীপে ঘর সাজিয়ে লাভ?

তিরস্কারের মতো সুর শুনে নায়েবগিন্নি বিছানায় এলো।

নায়েবের চোখ দুটি দুপুরের ঘুমে জড়িয়ে আসছে, সেই কত দিনের অভ্যাস তো। হঠাৎ যেন উৎকর্ণ হলো সে। যেন কিছু শুনছে? পাখি? ক্রোক-ক্রোক করে ডাকছে। খুব নিস্তব্ধ দুপুরে, কিংবা পোড়োবাড়ির কাছে শোনা যায়। কাঠঠোকরাই। কিন্তু এ কী? আমার বাড়ির কাছে? নায়েব ধড়মড় করে উঠে বসলো।

পাশের লোক উঠে পড়লে শুয়ে থাকা যায় না। নায়েবগিন্নিও উঠে বসলো।

–খাস সিন্ধুকের চাবির গোছাটাই বোধ হয় ভুলে এসেছি। সেরেছে!

–আদৌ না, এসেই আমার হাতে দিয়েছে।

–এই মরেছে! ধরা পড়েছে তা গোপন করতে নায়েব হাসলো। তা, উঠেই যখন পড়লাম, চাকরকে বলো তামাকু দিতে।

গিন্নি শয্যা থেকে নামতে গেলো। নায়েব বললো, আহা, এখনি নেবে যাচ্ছো কেন?

গিন্নি হেসে বললো, চাকর তোমার শোবার ঘরে কবে ঢুকলো যে তোমার শোবার ঘরের তামাকে হাত দেবে?

নায়েবগিন্নি নিজেই তামাক সেজে ডাবাসমেত নিয়ে এলো।

নায়েব বললো, চলো, এবার তোমাকে কলকেতা দেখিয়ে আনি। ওদিকে কালীঘাট দক্ষিণেশ্বর দেখা হয়ে যাবে, এদিকে কলকেতা শহর, এস্তেক নবদ্বীপ। যেখানে যাও, প্রাণ ভরে ঢিপঢিপ।

গিন্নি বললো, সে শহরে নাকি গাছপালা অনেক কম, সব বাড়ি নাকি পাকা, রাস্তাঘাট সব সুরকির? রাস্তার মোড়ে মোড়ে নাকি আলো? আর

কী আর? কলকেতা বলছো?

–পথে পথে নাকি ইংরেজ-ঠাসা? এখেনে এক ডাংকাং-এ রক্ষে নেই

শহরটাই তো ইংরেজের। ওরাই পত্তন করেছে। সেখানে সবই ইংরেজি। ছোটো ছোটো বাঙালি ছেলে ফুট ফুট করে ইংরেজি বলে। বড়োদের তো কথাই নেই। স্বপ্নও নাকি ইংরেজিতে দ্যাখে। সেখানে টেবল ইংরেজি, চেয়ার ইংরেজি, মদ ইংরেজি। শিবঠাকুরও নাকি রবিবারে ইংরেজি মতে পুজো নেন।

রবিবার নিষ্ফলা না?

দ্যাখো কাণ্ড। সে কি ধূপধুনোর পূজো? আর্গিন বাজিয়ে গান। সবাই নাকি চোখ মুদে বসে থাকে আর একজন খুব বক্তৃতা দেয়? ; হু-হুঁ করে চোখের জল পড়ে।

-ছেলেছোকরারা যায়?

যায় না আবার। পেশকার বেজো বলে, আমি শুনি। মাগীরাও। হাতটাকা জামা কামিজ, পায়ে জুতোমুজো।

নায়েবগিন্নির গালটা লাল হলো। বললো, দ্যাখো, আমি শুনেছি, যেসব ইংরেজ এখেনে আসে তাদের নাকি বাপ নেই। মানে মা আছে কিন্তু, বুঝলে তো? কলকেতারও কি তাই?

–ছি-ছি! কী যে বলো? আজকাল ছেলেছোকরারা কি বাপ-মার কথা শোনে? কোনো দিনই কি শোনে? আমাদের গোবরাই ভাবলো আমাদের কথা?

দ্যাখো, তুমি আমার গোবরাকে, তুমি ওসব ছেলের সঙ্গে তুলনা দিও না। ঝটকায় উঠে দাঁড়ালো নায়েবগিন্নি।

-পরের ছেলেরা ভুল করছে, আর তোমরা ছেলে বুঝি ঠিক করেছিলো? ডাবা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো : সেও ভুল করেছে, ভুলই। কলকেতার সব ভদ্রলোক সব শিক্ষিত লোক যার নিন্দে করছে, এস্তেক আমাদের দেওয়ানজি, তাই কিনা করতে গেলে তোমার ছেলে! দ্যাখো দেখি কত তফাত, যখন যে-বছর লখনউ, কানপুর, ঝাসিতে মারপিট, ঠিক সে-সময়ে সে বছর বিশ্ববিদ্যালয় বসলো কলকেতায়। কেন? ইংরেজি শিখতে নয়?

ভারি ঢং-এর কথা বোলো না গোবরার মামা। আমার ছেলে ভুল করে না। তুমি কী জানো? তুমি কী শুনেছো? খবরদার কাউকে বোলো না যেন; কিন্তু জানো আর-একজনও ছিলো সেই দলে, বলবো? রাজকুমার।

শেষ কথাটায় গলার স্বরটা অনেক নামিয়ে আনলো নায়েবগিন্নি। আঁচল তুলে চোখের কোণটা মুছলো।

-আহা-হা! বললো– নায়েব। কী লাভ? এসব খোঁজ নেওয়াই বা কেন আর এখন? ওরে তামুক দে, গেলো কোথা সব, হারামজাদাদের বাড় বেড়েছে দেখছি।

-রাগ কোরো না। শোবার ঘরে ওরা ঢোকে না। তামুক তো হাতেই।

নায়েব ভাবলো, সড়ক কাটার ব্যাপারটার সঙ্গে কী করে যেন গোবরা জড়িয়ে যায়। কিন্তু কথায় বলে নায়েব। হঠাৎ যেন খোলামেলা দেখতে পেলো। বলবে ভুল করে, কিংবা

পেত্রোর পাল্লায় পড়ে, যে করে হোক, ইংরেজ গোবরার শত্রু। তা থেকেই সেদিন ইংরেজদের উপরে রাগ হয়েছিলো। তা থেকে সড়ক কাটা। আশ্চর্য কথা দেখছি। কিন্তু এ কি উচিত তোমার রাগে মনিবকে মামলা-হামলায় জড়ানো?

গিন্নি বললো, তামুক খেয়ে কি এখনই কাছারিতে যাবে? তাহলে জলপান

-আমি বলি কী–এখন কিছুদিন দইয়ের শরবৎ দিও।

–এই শীতে দইপানা?

–পিত্তটা বিশেষ কুপিত মনে হচ্ছে না? খামকো রাগ হয়ে যায়।

–তাহলে ওষুধ করতে হয়। বলো কী!

কী লাভ বলো? নায়েব হেসে উঠলো। তামাকের ধোঁয়াটাও গলায় লাগলো। হাসি ও কাশির মধ্যে বললো– তো, একবেলায় খোঁয়াড়সমেত সায়েবটাকে ছাই করা যায়। সবকটাকে, বন্দুকে ঠেকে না, গ্রামসমেতই যদি বলো। তাতে কিন্তু পিত্তই কুপিত হয়। রাস্তা কেটে কী বা হয় বুড়োবয়সে পিত্ত কুপিত হওয়া ছাড়া?

কাছারিতে ফিরে নায়েব ল-মোহরারকে ডাকলো। সে এলে বললো, একটা কথা ঠিক রেখো। মামলায় লম্বা লম্বা তারিখ নেবে। ঢিলে দিতে থাকো, উকিলকে টাকা ঢেলে দিক ডানকান। এদিকে শামসুদ্দিনকে ফিরিয়ে আনেনা, জমিতে চাষ দিক। না আসে, অন্য কাউকে বসাবে জমিতে। গ্রামে কি শামসুদ্দিনের অভাব পড়েছে? তাকিয়ে তাকিয়ে দ্যাখো, খেলো খেলো এগোও। জেবন কেটে যাক ওই সড়কে। স্বত্বটা দেখে নিক।

গৌরী গেলে নায়েব হেসে তামাকেই মন দিলো আবার। তার নায়েবি মাথায় তখন খেয়াল–স্বত্বের কিন্তু দুই পক্ষ, এক স্বামীত্ব করে, অন্যে বলে তারই হক। ফিরিঙ্গি পেত্রোর ফরাসডাঙায় স্বামীত্বই বা কে করে? …ওদিকে দ্যাখো, গিন্নি যেমন বললো, রাজকুমার নাকি কী কাণ্ড!নায়েব তার ফরাস আর দেয়াল বরাবর সাজানো কুর্সির মাঝখানে ধোঁয়ায় ভরা ফাঁকটাকে দেখছিলো। ধোঁয়া, খালি পাক খাওয়া ধোঁয়া। আরে কাণ্ড! সে একেবারে স্তম্ভিত! দোলডগর, লোকলস্কর, খানাপিনায় চেপে গিয়েছে ব্যাপারটা। দখল বলে দখল? শোবার ঘরে বাঁশগাড়ি। হাওয়াঘরে শিব-গাড়া! রানীর বিচক্ষণতায় সে দিশেহারা হয়ে গেলো।

 ০৬. রানীমার জন্মোৎসব

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

০১.

রানীমার জন্মোৎসব নিশ্চয়ই বড়ো ঘটনা। তখন সেই রঙিন মেঘে সকলের আকাশই ঢাকা। কিন্তু উল্লেখযোগ্য আর কিছুই কী নেই? সেটাও তো রানীমারই উৎসব–শিবমন্দিরের বিগ্রহের প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়নি, সেটা হবে তো। জন্মোৎসবের দিনবিশেক আগে রানীমা নয়নতারাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। নয়নতারা রাজবাড়ি আসতে গিয়ে নতুন জোগাড় করা একখানা পুঁথি এনেছিলো।

এটা কৌতূহলের ব্যাপার। নয়নতারার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে রানীমার কি এত বই পড়ায় ঝোঁক ছিলো? অথবা নয়নতারাই কি মহাভারত ও অন্যান্য পুঁথিতে এত মনোনিবেশ করতে অভ্যস্ত ছিলো? পাঠকের মনে পড়বে, রানী যখন নয়নতারাকে রাজবাড়িতে ডেকেছিলেন, তখন অন্য উদ্দেশ্য ছিলো। এখন সে রাজবাড়িতে এলে বারানসী অক্ষরে লেখা মহাভারতের কোনো-না-কোনো পর্ব তার হাতে থাকে। ব্যাকরণ ভাষ্য টীকা সহকারে তা পাঠ হয়। এ থেকে কি কোনো সাধারণ সূত্রে পৌঁছনো যায়? –মানুষ কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে যে-কাজ আরম্ভ করে, একসময়ে উদ্দেশ্যকে ছাপিয়ে সেই কাজটাই নতুন উদ্দেশ্য সৃষ্টি করতে পারে।

নয়নতারা আসতেই রানীমা বলেছিলেন, তোমাকে একদিন শিবমন্দিরটা দেখতে যেতে হয়। শিবচতুর্দশীর আগে শেষ হওয়া দরকার। তাছাড়া সেই রাতে মেয়েরা কোথায় থাকবে, কোথায় স্নান করবে? পড়ো দেখি কী এনেছে আজ।

কিন্তু পড়া শুরু করার আগেই রানী হাসলেন। বললেন–হা,নয়ন, সেদিন বেনেরা ইচ্ছা তৈরি করে বলে খুব বলে খুব ঠকালে। কিন্তু আর-একরকম ইচ্ছাও কি নেই? এমনকী হতে পারে যাকে আমরা বুদ্ধির সাহায্যে ক্ষুধা নাম দিয়েছি, সেটাও আসলে একটা প্রবল ইচ্ছা? সেটা আছে বলেই বুদ্ধি তার নাম দিয়েছে।

-আপনি কি বলবেন তা বুদ্ধির চাইতে পুরনো?

বাহ্, যে-শিশুর কথা ফোটেনি তারও ক্ষুধা আছে, যে-প্রাণীর চেতনা নেই বলি, তারও ক্ষুধা আছে। দ্যাখো, ক্ষুধা নামে ওই ইচ্ছাগুলো আমাদের চালাতে থাকে, বুদ্ধিনা না করলেও থামা নেই।

–এ তো বড়ো ভয়ঙ্কর কথা যে আমরা বুদ্ধিতে চলি না! নয়নতারা হাসলো।

রানী বললেন–সেদিন হৈমী বাইবেলের গল্প করছিলো। ওদের ভগবান নিষেধ। করেছিলো তা সত্ত্বেও আদম না কে একজন ফল খেলোই। বুদ্ধি চালালে ভগবানের অত কাছের মানুষ কি বোকার মতো সেই ফল খায়, হলোই বা মেয়েমানুষের পরামর্শ? চৌদ্দপুরুষ ধরে অভিশপ্ত হয়?

রানী হাসলেন। নয়নতারা জিজ্ঞাসা করলো–হৈমী বাইবেল পড়ে নাকি?

রানী নয়নতারাকে ভালো করে দেখলেন, ভাবলেন, হয়তো পরে একদিন জানবেনই; তাহলেও এখনই কেন? যেন হালকা কিছু এমনভাবে হেসে বললেন, কিন্তু কপালের প্রান্তে যেন বিষণ্ণতাও। বললেন–তো, তোমার এই ইচ্ছা যার নাম ক্ষুধা সে কি বেনেদের চাইতে পুরনো নয়? অন্যদিকে গাছেরও আত্মপুষ্টির ফুল ফুটানোর ক্ষুধা থাকে। সে কি জানে ফলে তার কী লাভ?

আলাপটা এগোতে পারলো না। নায়েব উৎসবের ব্যাপারে দেখা করতে চাইছে জেনে রানী উঠে গেলেন। নায়েব নিবেদন করলো : শিশাওয়াল ফেলিসিটার কাল বিকেলের দিকে এসে পৌঁছবে আশা করা যাচ্ছে। আজ চিঠি পেলাম। নায়েব হাসলো। বললো– আবার, লিখেছে আলো দিয়ে সম্পূর্ণ রাজবাড়ি সাজানোর ভার এবার সে নিতে চায়। সেই ব্যবস্থা করে আসছে। আমরা কি অপেক্ষা করবো?

রানীমা বয়স্ক কর্মচারীর এই কমবয়সী আনন্দ দেখে হাসলেন, বললেন–বেশ তো, তোমরা যা ভালো বোঝে। নায়েব উঠে দাঁড়ালো। বললো–ফেলিসিটার লিখেছে তার নৌকোয় কায়েতবাড়ির কুমার আসছেন। রানী একটু ভাবলেন। বললেন এক মুহূর্তেই, তাহলে দুপুরের পর থেকেই হাওদা রাখতে হয় বোধ হয় কুতঘাটে।

নায়েব চলে গেলে রানী নিজের ঘরের দিকে ফিরতে ফিরতে ভাবলেন। তার কল্পনায় বিশেষ আলোকোজ্জ্বল রাজবাড়িটা ধরা দিলো। অন্যান্যবার কিছু কম আলো থাকে না, এবার তা বিশেষ হবে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলার নিজের ঘরের দিকে চলতে চিন্তা করলেন, এসবই কেমনভাবে ঘটতে থাকে না? ডানকানই আর তার সেই তশীলদারের কথা ভাবে? চন্দ্রকান্ত বোধ হয় নাম ছিলো। কিন্তু রোহিণী নামে সেই স্ত্রীলোকটি? রাজকুমার হয়তো বয়সের ধর্মে ভুলে যেতে পারে। তার মনে হলো, আচ্ছা, রাজুকে কি উদাস দেখায়? নাকি ছেলেরা বড়ো হলে তেমন মনে হয়?

অলিন্দ দিয়ে চলতে চলতে সেই দুপুরের বসার ঘরের দরজার মুখোমুখি অলিন্দ যেখানে ঝুলবারান্দায় বেড়েছে তার কাছে দাঁড়ালেন। নয়নতারা তখনও বই-এর সামনে দরজার পাশেই। মুখটা নিচু কিন্তু তার কোণে যেন কৌতুক।

পায়ের শব্দে নয়নতারা মুখ তুললে রানী বললেন, কী করছোনয়ন? বইটা কি ভালো নয়, নাকি টীকায় সন্দেহ আছে?

নয়নতারা বললো–কত বড়ো পণ্ডিতের লেখা; সন্দেহ কোথায়?

–মুখের চেহারায় রানী হাসলেন।

নয়নতারা অবাক হলো। অসময়ের এই কালীপূজা যা রানীমার জন্মোৎসবের অঙ্গ সে বিষয়ে তার তো কিছু সন্দেহ আছেই। তাই কি ধরা পড়েছে তার মুখে? সে হেসে বললো, আমার ভ্রূর গঠনে কিছু দোষ আছে, রানীমা।

–হুঁ। তুমি তো কম নও।

নয়নতারার মুখটা একটু বিবর্ণ হলো। কথাটা সুপ্রয়োগ হয়নি।

কিন্তু রানী হাসতে হাসতে বললেন, এবার কিন্তু তুমি দুষ্টু হয়ে ফিরেছে। রানীকে তেমন মানছে না। কিন্তু যেন চেঞ্জো থেকে ফিরে আরো ভালো দেখায় তোমাকে।

কথার আড়ালে সরে রানীমা ভাবলেন, ছেলেরা বড়ো হলে….কিন্তু কালীপূজার ব্যাপারটাকে নানাভাবেই প্রশ্ন করা যায়। রাজবাড়ির জন্মদিনের উৎসবগুলোতে সাধারণত গৃহদেবতা রাধাগোবিন্দর পূজা হয়। ছেলেরা বড়ো হলে তাদের মনের এক শরিক হতে পারে যে মা নয়। হঠাৎ একটা ধাক্কা লাগলো মনে। নয়নতারা কি জানে? রাজু কি তাকে বলেছে? এসব কত দিনে তামাদি হয়?

রানীর অন্তর চঞ্চল হলো। একটু যেন ঝুঁকে নিচের উঠানটাকে দেখলেন। একটু যেন আবার শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন। ভাবছিলেন তো। ঘরের দিকে ফিরে বললেন–দ্যাখো নয়ন, ভুলে গিয়েছি। তুমি কাউকে দিয়ে এখনই একবার হরদয়ালকে আসতে বলে দাও।

রানীর স্বরটা দ্রুত। নয়নতারা তাড়াতাড়ি উঠে ভৃত্যদের খোঁজে গেলো।

রানী চারিদিকে চাইলেন, কিন্তু সেখানেই বা বিষণ্ণতা কোথায়? দিনশেষের বেলা তো নয়, দুপুরের দিকে চলেছে দিন যার উজ্জ্বলতা চকমিলানো দেয়ালগুলোর মধ্যে রোদে কবোষ্ণ জলাশয়ের মতো অগাধ স্থির। তখন কিছু কি উদাস? রানী মনে করতে পারলেন না রাজুর চোখ দুটিকে শেষ কবে ভালো করে দেখেছেন। বরং অনেক পিছিয়ে মনে হলো রাজুর ধাই-দাসী বলছে, এ মা, একেবারে হরিণচোখ, মেয়ে নাকি, রানীমা! এখন রাজু অনেক বেড়েছে। নায়েবমশাই, হরদয়াল দুজনেই দীঘল চেহারার মানুষ, রাজুকে তাদের চাইতে দীঘল দেখায়। হাসি হাসি দেখালো রানীমার মুখ, কিন্তু সে হাসি দেখলে দৃঢ়তার কথাও মনে হতে পারে কারো। আসলে ছেলেরা বড়ো হলে পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হবে। পরিচয়ে সত্য থাকবে। পারো কি আড়াল করতে?

ইতিমধ্যে নয়নতারা ফিরেছিলো। রানী বললেন, শিশুর চোখ দুটি মায়ের চোখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে; তার বাইরে কিছু দেখতে চায় না। বড়ো হলে, তুমি দেখবে, তা স্বাভাবিক নয়। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবী মায়ের মুখের চাইতে বিচিত্র, তাই নয় কি নয়ন?

নয়নতারা প্রস্তুত ছিলো না। সে কথাটা ভালো করে বুঝে উত্তর দেবার আগেই অলিন্দর। শেষ প্রান্তে পায়ের শব্দ হলো।

হরদয়ালই এসেছে। নয়নতারা অন্যত্র গেলো।

কিন্তু তখন কি আলোচনার সময়? বরং স্নানাহারের উদ্যোগ করতে হয়। রানীকী নির্দেশ দেবেন যা জরুরি? তিনি অলিন্দেই দাঁড়িয়ে রইলেন, সুতরাং হরদয়ালকেও সেখানে দাঁড়াতে হলো। রানী যেন গায়ে রোদ লাগাচ্ছেন, যেন বা কথা বলার জন্যই কথা বলা, থেমে থেমে কথা বলছেন। রানী বললেন, হরদয়াল, কলকাতার বাড়ি সম্বন্ধে আর কিছু ভেবেছো?

আহিরিটোলার বাড়িটা কেনা যায়, আর কালীঘাটের দক্ষিণে গিয়ে হেস্টিংয়ের বাড়ি ছাড়িয়ে সেই জমিটা দেখতে বলেন

-উৎসবের পরেই তাহলে কলকাতায় যাও। এদিকে নরেনের তৈরি বাড়ির সামনে বসানোর গাড়িবারান্দার নক্সা কি দেখলে? সব ইংরেজি বাড়িতেই নাকি তা থাকে। ভালো হবে? খৃস্টমাসে এবার রাজুর কলকাতায় যাওয়ার কথা কী ভাবলে?

নক্সাটা আর-একটু দেখে আপনাকে জানাবো। খৃস্টমাসের জন্য আপাতত আহিরিটোলার বাড়িটা ভাড়া নেওয়া যায়।

রানী দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। হরদয়াল চিন্তা করলো, এসব কথা কি এমন জরুরি? এ কি রানীর মনের কোনো চঞ্চলতাকে ঢাকার চেষ্টা? কিছু কি ঘটেছে? কথা শুনতে সে মুখ তুলেছিলো, নিজে থেকেই মুখ নামালো।

রানী বললেন–আচ্ছা, হরদয়াল, তুমি কি ভেবেছো আমাদের নায়েবমশাই বুড়ো হয়েছেন, হয়তো চার-পাঁচ বছরে বিশ্রাম নিতে চাইবেন। তার জায়গায় তখন কাজের মানুষই লাগবে। আমাদের ধরন বোঝে, তাকে ভালো লাগে এমন একজন দরকার হবে না? (রানী এই জায়গায় হাসলেন)। তাছাড়া এমন দুএকটা গোপন ব্যাপার থাকে যা গোপন রেখে চলতে হয়। আজকালকার ব্যাপার তো, নতুন লোককে ইংরেজিতে দক্ষ হতে হবে।

-এখনই খোঁজ করা দরকার?

-ভাবছিলাম এখন থেকেই রাজবাড়িতে অভ্যস্ত হোক, রাজুকে চিনুক, সম্ভবপক্ষে ভালোবাসতে শিখুক। আচ্ছা, আজকাল নাকি প্রাইভেট সেক্রেটারি রাখা হয়। সব লাটেদের ছোটো হোক, বো হোক–থাকে একজন।

হরদয়াল হাসিমুখে বললো–সে রকম লোক যদি পাওয়া যায় পরিকল্পনাটা বিশেষ ভালো।

রানী ঈষৎ হেসে বললেন জন্মোৎসবের পর নতুন কিছু করার রেওয়াজ হলো দেখছি। ভেবেছি, আমলাদের বেতন বাড়ানোর সঙ্গে এই পদটার জন্যও বড়জেটে ধরা হোক। কলকাতা থেকে কাউকে আনিয়ে নেবে? আচ্ছা, তোমার বাগচীমাস্টার ভালো ইংরেজি জানেন শুনি, রাজুর সঙ্গে ভাবও।

এবার রাজু ফিরবার পর থেকে প্রায় সন্ধ্যাতেই বোঠোকখানায় বসেন। দুজনে খুব কথা হয়। ইংরেজ রাজাদের গল্প। শিক্ষক তো, গল্প বলতে জানেন। ইতিমধ্যে হৈমীকে দিয়ে বিলেতি পিঠে, কেক না কী, তৈরি করিয়ে নিয়েছিলো। আচ্ছা, পাঞ্চো কী? এ কী বিষয়?

একটু ভেবে ইংরেজি শব্দ দুটোকে ধরলো হরদয়াল, কিন্তু পাঞ্চো যে ইংরেজি পাঞ্চ, ব্রান্ডিতে লেবু-গরমজল-চিনি ইত্যাদির এক বিশেষ মিশ্রণ, একরকমের মদকে যে এ বলে, ইংরেজিতে কেকস্ অ্যান্ড এ বলে যে এক প্রবাদ চালু আছে–এসব কি রানীকে বলা যায়!

কিন্তু রানী হাসলেন, বললেন–আচ্ছা, এই সন্ধ্যাগুলোর জন্য বাগচীকে কি কিছু বেতন দেওয়া উচিত? হরদয়াল ভাবলো, এতক্ষণে কথাটাকে সে ধরতে পেরেছে। বললো, আপনি কি মিস্টার বাগচীকে আপাতত প্রাইভেট সেক্রেটারি নিয়োগের কথা ভাবছেন?

–ভেবে দ্যাখো, ওদিকে তোমারে স্কুলও আছে।

হরদয়াল রানীর মনের গতি বুঝতে তার মুখের দিকে চোখ তুলো আবার, কিন্তু রানী ততক্ষণে আবার সুরেন-নরেশের বিষয়ে ফিরে গেলেন, বললেন–সিংদরজা থেকে পাকা পথটা আপাতত শিবমন্দির পর্যন্ত থাক। বসন্তে তো প্রাণপ্রতিষ্ঠা। তারপর সড়কটা ফরাসডাঙার আড়াআড়ি না-নিয়ে কায়েতবাড়ি থেকেও ওদিকে ফরাসডাঙার সীমা পর্যন্ত আনলে হয়। তুমি কি শুনেছো কায়েতবাড়ির ছেলেটি কালই আসছে এখানে?

হরদয়াল পথের কথায় বললো–আপনার হুকুম হলে তা হবে।

কিন্তু কায়েতবাড়ির কারো আসা যাওয়া সম্বন্ধে সে কী বলবে?

রানী ঝিকমিক করে হাসলেন, বললেন, ঝিলটায় এখন জল নেই বললেই চলে, ফরাসডাঙার সীমা পার হতে যা পেরোতে হবে। আগে হাঁস আসতো। ওটাকে বুজিয়োনা। ওর ওপারেই ছিলো ফরাসীদের ডিয়ার পার্ক। এখন একটা হরিণও বোধ হয় নেই। ওটা পিয়েত্রো এক তাসের বাজিতে তোমাদের রাজার কাছে জিতেছিলো। তারও আগে অবশ্য আমার শ্বশুর পিয়েত্রোর বাবাকে বাধ্য করেছিলেন জমিটুকুকে তাঁর কাছে ইস্তফা দিতে।

হরদয়াল কী বলবে খুঁজে পেলোনা। অনেকগুলো কথা হয়েছে, কোনোটাই অকার্যকরী নয়, কিন্তু কোনটা প্রধান? সবগুলো কাজ হলে ভিতরে বাইরে এক পরিবর্তনের ছাপ পড়বে অবশ্যই।

রানী নিজেই বললেন–আচ্ছা, হরদয়াল, তুমি সবদিকে চিন্তা করে জানিও।

রানী নিজের ঘরে গেলেন। সেখানে নয়নতারা তখন অপেক্ষায়। রানী বসলেন। গায়ের চাদরটাকে রাখলেন। কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বললেন, চলো, নয়ন, স্নানে! তুমি কি বাড়ি যাবে ভাবছিলে? আজ দীঘিতে স্নান। ওদিকের ওই আলমারিটা খোলো; ওতেই বোধ হয় নতুন কাপড়। তোমার-আমার জন্য শাড়ি বেছে নাও।

এগুলো প্রাত্যাহিক আলাপের মতোই। যদিও এ কি এক পরীক্ষা–এই শাড়ি বাছার ব্যাপার? সেখানে তো নানা রং নানা ঢং নানা জাতের শাড়ি।

.

০২.

হরদয়াল সিঁড়ি দিয়ে নামলো। এখন তারও কাজের চাপ নেই। রানী কেন ডেকেছিলেন? অন্তত আধঘণ্টা দাঁড়িয়ে কথা বললেন। বাগচীমশায়কে নিয়োগের কথা বলতে? রানী যেমন চাইছেন বাগচী তেমন একজনই বটে।

ইংরেজি ভাষার দখলে যে কোনো ইংরেজের সমকক্ষ। পরবর্তীকালে স্টেটের দেওয়ান, নায়েব ম্যানেজার যা হয় একটা হবেন। কিন্তু এখন কী কাজ হবে তার? প্রাইভেট সেক্রেটারিদের কী কাজ থাকে? মনিবদের চিঠিপত্র আদানপ্রদান কিংবা দেখাসাক্ষাতের ব্যাপারে মনিব এবং বাইরের জগতের মাঝখানে বাফার? কিন্তু আসল কাজ কি মনিবের চিন্তার প্রতিফলক হওয়া? চিন্তার প্রতিফলক! বেশ কথাটা, আয়না যেমন ব্যক্তির–যেমন–যেমন সে নিজেই বুঝি বা রানীর চিন্তার প্রতিফলক হয়ে পড়ছে। হরদয়াল কিছুটা কৌতুক বোধ করলো। কিন্তু এ তো বোঝাই যাচ্ছে, রানীর সবগুলো প্রস্তাবের মধ্যে যেন সবলতর হয়ে ওঠার ভাব ছিলো। তাহলে কোনো কারণে কি দুর্বল বোধ করছিলেন?

নিজের কুঠির কাছাকাছি এসে কেকস্ অ্যান্ড এল এই বাক্যাংশে যেন আবার শুনতে পেলো। ও দুটোর সমন্বয় তার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। কিন্তু কে আনলো কেক রাজবাড়িতে?

কোন ময়রা মিষ্টান্ন পাঠায়, অন্দরে কোথায় কী মিষ্টান্ন তৈরী তা কাছারিতে জানার কথা নয়। সে জন্য রাজবাড়ির গোমস্তা-সরকার আছে। কিন্তু বিজাতীয় এই কেক যা বাগচী বাড়িরও নয়? কে হৈমী যে বিজাতীয় কেক তৈরী করতে পারে রাজবাড়ির ভিতরে? কে কোন পালকিতে ঢুকে রাজবাড়ির অন্দরে থেকে গিয়েছে তাও তোমার জানার কথা নয়, তাহলেও এটা বিস্ময়ের যে তেমন একজন কী করে কোথা থেকে এই গ্রামেই বা এসেছে? ওটাও দ্যাখো বিস্ময়ের যে, বাগচীমশায় ইদানীং অনেক সন্ধ্যায় রাজকুমারের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন। বলবে, বাগচী স্কুলের শিক্ষক, তাকে তুমিই এই গ্রামে এনেছো? হরদয়াল হাসলো। অবশ্য বাগচী তার এমন অধীন থাকতে পারে না যে তিন বছর বাদেও গ্রামের অন্যান্য মানুষের সঙ্গে সে নিজের সম্বন্ধ স্থাপন করবে না। তাহলেও আশ্চর্য লাগে যে সে এ বিষয়েও জানতো না!

আসল কথা, হরদয়াল ভাবলো, তাহলে কি এই যে জীবনের স্রোত তাকে পাশ কাটিয়ে তার লাইব্রেরি-ঘরের বাইরে দিয়ে বয়ে চলে গেলো? সে ভাবলো, দেওয়ানকুঠি রাজবাড়ির এত কাছে যে রাজকুমারের পিয়ানো ঘরে বসে শুনতে পারো, তাই বলে রাজবাড়ির অন্দরে কী ঘটছে তা কি জানতে পারো যদি রানী না-জানান? এটাই বোধ হয় সেই ব্যাপার যে রানী এবং তার সংসার এবং যারা সেই সংসারের হিসাব রেখে চলে তার মধ্যে একটা অদৃশ্য। পর্দা আছে বলে অনুভূত হয়। সেজন্য ওপারের সবই বিস্ময়ের আর কৌতূহলের। কী বলবে? রানীর মতোই? নাকি একটা হীরার মতো? আলো দেখে মনে হয় ভিতরটা ছুঁতে পারা যায়, কিন্তু কে কবে হীরার ভিতরে ঢুকেছে?

প্রমাণ তো আছেই। মনে হয় রাজবাড়ির সঙ্গে বাইরের যে যোগাযোগ তাকাছারির মধ্যে দিয়ে চলে। কিন্তু ইদানীং রানীর মুখে মরেলগঞ্জের সংবাদ শুনে মনে হয় না যে তার নিজের লোক আছে সেসব খবর রাখতে? ইদানীং বা কেন? দেওয়ান হিসাবে তুমি জানতে সাহবাদ পরগনায় ছ-আনি তরফ আছে যাকে কায়েতবাড়ি বলে; জানতে, সেখানে এক কুমার আছে; জানতে, নামে তা ছ-আনি তরফ হলেও রাজার সম্পত্তি ভাগ হয়নি; জানতে, এক ট্রাস্ট ডিডের বলে রানীই সব সম্পত্তির ট্রাস্টি। জানতে, বছরের শেষে সম্পত্তির লাভ থেকে যে কোম্পানির কাগজ নিয়মিত কেনা হয় তা যেমন রাজকুমারের নামে তেমন সেই কায়েতবাড়ির ছেলেটির নামেও। জানতে, চার-পাঁচ বছর আগে থেকে সেই কুমার কলকাতায়। কিন্তু জানে না সেই কায়েতবাড়ির সঙ্গে এই রাজবাড়ির ঠিক সম্পর্কটা কী। রানী বলেননি। কর্মচারীরা, গ্রামের লোকেরা কি জানে, আন্দাজ করে? কিন্তু দেওয়ান না জানতে চাইলে কে নিজে তা বলতে চাইবে? সেই ট্রাস্টি-ডিড সে কখনো দেখেনি। এটা এখানকার নিয়ম রানী কাকে কী করতে বলেছে তা নিয়ে আলোচনা হবে না।

তাহলেও, হরদয়ালের অনুভব হল, আগে হলে বাগচীর এইসব আসরের কথা সে জানতো এই ঘটনাটা সেই কথাই মনে করিয়ে দেয় সে দেওয়ান নয় আর, আর রাজকুমারের সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই।

আসল কৌতুকটা অন্যত্র। রানী কী চাইছেন? সেক্রেটারি না টিউটর? নাকি বয়স্য চাইছেন যে বাগচীর মতো স্থিতধী এবং সৎচরিত্র, মদ খায় কিন্তু মদ্যপ নয়। সে নিজে এসেছিল রাজকুমারের সেই পাঁচ বছর বয়সে টিউটর হয়ে। টিউটর এবং রাজকুমারের দিনমানের সঙ্গী। তারপর ক্রমশ বদলে গেল। রাজকুমার তখন তেরো-চোদ্দো হবে। ক্রমশ পিয়েত্রো বুজরুক তার দিনের বেশির ভাগ নিতে লাগলো। সে নিজে অবশ্য তখন কাছারিতে বহাল। বুজরুক মাঝে-মাঝেই আসতো রাজকুমারকে নিয়ে যেতে। সেসব কি রানীর ইচ্ছাতে? এখন পিয়েত্রো বুজরুক নেই। সে জন্যই কিনতুনতর সঙ্গী হিসাবে বাগচী? তাহলে কিন্তু অবাক হতে হয়। ভাবলো হরদয়াল, সবটার পিছনেই কি পরিকল্পনা ছিল রানীর? কলকাতার শিক্ষা দিতে তাকে নিযুক্ত করে পরে পিয়েত্রো বুজরুক উপযুক্ততর মনে হয়েছিলো? আর এখন পিয়েত্রো বুজরুকের কাল চলে গিয়েছে বলে বাগচী?

হরদয়াল নিজের উত্তেজনায় হাসলো। নিজের উপমাকে মনে ফিরিয়ে আনলো। মনে মনে বললো, নিজেই বলছো, হীরার ভিতরে ঢোকা যায় না। কিন্তু রানীমাতা, এটা আপনার হাতড়ে হাতড়ে চলা হতে পারে, যেমন আমরা চলি। নতুবা বলতে হয় পুরুষদের মধ্যে দয়াল, পিয়েত্রো, বাগচী যেমন ক্রমে ক্রমে, স্ত্রীদের মধ্যে তেমন নয়নতারা, কেট, বর্তমানে হৈমী।

.

০৩.

স্নানে চলেছেন রানী, সঙ্গে নয়ন। পিছনে কিছু দাসী কাপড় ইত্যাদি নিয়ে।

অন্দরমহলে চতুষ্কোণ পার হয়ে প্রাচীরের মধ্যেই এই আর-এক মহল। মন্দির, নাটমন্দির, তাদের পিছনে শালবন, শালবনের পাশে দীঘি। বন অর্থে ঝোপঝাড় নয়, আগাছাও নয়। বরং গাছগুলোর তলা যেন নিকানো এমন পরিষ্কার। গাছের ফাঁকে ফাঁকে পথ। সেই বনের সামনে সোনালী গম্বুজওয়ালা লাল নাটমন্দিরসমেত সাদা মন্দির।

এখানে কারো কৌতূহল জাগতে পারে মন্দিরটা ঠিক এখানে এমনভাবে কেন?

মন্দিরের চেহারা নাটমন্দিরের চেহারা দেখে মনে হয় যথেষ্ট যত্ন আছে। কিন্তু এই রাজবাড়িরই যেখানে জাঁকজমকেরানীর জন্মতিথির কালীপূজা হয়, সে তত কাছারির দিকে, সদরে, প্রাসাদের এক অংশে। এই মন্দিরটিকে যেন কেমন লুকানো মনে হয়। শালবনের জন্য এই ধারণাটায় জোর পড়ে। আলো যখন ম্লান তখন হঠাৎ কারো মনে হতে পারে এই মন্দির পরিত্যক্ত।

বিষয়টি আসলে কিন্তু পার্থক্য। কাছারির কাছে সদরের আচার-আয়োজনের সঙ্গে এই মন্দিরের সেগুলির কিছু প্রভেদ দেখা যায়। সেখানে উৎসবের অঙ্গ হিসাবে দশটা ঢাকে কাঠি পড়ে, তেড়ে তেড়ে কাড়ানাকাড়া বাজে, বিদ্যাসুন্দরের পালাগান হয়, এবার তো শোনা যাচ্ছে নাকি ঠিয়াটারই হবে। এখানেও বাজনা বাজে, তা কিন্তু মৃদু বাঁশি আর ঢোল, কদাচিৎ জগঝম্পর একটানা ঝরঝমর। এখানে নাটমন্দিরে কখনো কীর্তন হয়, মুষ্টিমেয় শ্রোতার সামনে কীর্তনীয়া পদাবলীর সঙ্গে আখর জোগায়, কচিৎ কখনো কথকতা।

এই পার্থক্যগুলির কারণ সম্বন্ধে নানা গল্প আছে। এক গল্প বলে : এই বংশের বৃন্দাবনী গুরু, গুরু-পরম্পরায় যিনি নাকি শ্রীজীবের বংশধর, তিনি এখানে প্রায় পাঁচ বছর ছিলেন। এবং সাধনা করতেন। এবং তাঁর প্রত্যাদেশেই এই রাধামাধব বিগ্রহ। এই শালগাছগুলি তখনকার। যদি দেখতে পাওয়া যায় তার মধ্যে মেহগ্নিও আছে তবে বুঝতে হবে সেগুলিই পরে লাগানো। সাধনার জন্য নিভৃত স্থানই প্রশস্ত।

এখনো (সাধনাটা বোধ হয় নেই। কিন্তু নিভৃতিটা আছে। পূর্ণিমা কিংবা তার আগের কয়েকটি রাত্রিতে শালবনে যখন জালিকাটা আলো তখন এই মন্দিরের কাছে, কারো তেমন। চেষ্টা থাকলে, সে নিভৃতিকে খুঁজে পেতে পারে।

অন্য গল্প এই যে, কাছারিতে নানা ধর্মমতের লোক আসে। আরো আগে তো ভিন্ন। ধর্মমতের এমন কেউ কেউ আসতো যাদের মুখ থেকে কথা খসলে দু-চারটে মন্দির চূর্ণ হয়ে প্রমাণ করতে পারতো প্রকৃতপক্ষে সেসব মন্দিরের বিগ্রহরা সবইঠুটো জগন্নাথ, ভক্তকে। রক্ষা করা দূরে থাক আত্মরক্ষাও করতে পারে না। অথচ তখন এমন অবস্থা যে রাজবাড়ির। কর্তাব্যক্তিদের ওঠাবসা কাজকর্ম সবই সেই ক্ষমতাবান ভিন্ন ধর্মমতের মানুষের সঙ্গে। তারা। এলে, কাছারিতে, এমনকী প্রাসাদের কোনো কোনো ঘরেই, ওঠাবসা এমনকী আহার না হোক একত্রে মদ্যপান তো চলতোই। কর্তাব্যক্তিরা তখন শিলোয়ারচুস্ত, চোগা চাপকান পরতেন। সে পোশাক নিয়ে কি রাধামাধবের সামনে দাঁড়ানোও যায়!

গল্প যাই হোক, এই নিভৃতির অর্থ পরিত্যক্তনয় তা এখনই বোঝা যাচ্ছে। দূর থেকেই মন্দিরের বারান্দায় কাজের লোকদের দেখা গেলো। শীতের ছোটো দিন। হয়তো অন্নভোগের আয়োজন শেষ করে দিয়ে এখনই শীতলের আয়োজন করছে।

শিরোমণি একবার যেমন বলেছিলো, রজোগুণটার প্রকাশ তবু চোখে দেখা যায়। সত্ত্ব যেন ফুলের গন্ধর চাইতেও হাল্কা আর অদৃশ্য, যেন লুকিয়ে থাকে। বলা হয়ে থাকে, রাধামাধব বলল মদনমোহন বলল সত্ত্বগুণের উপাসনা। এ নিয়েও এক গল্প আছে। একজন মদনকে পুড়িয়ে ছাই করেছিলেন। অন্যজন মদনকে মোহিত করেছিলেন। মদন পায়ের কাছে লুটিয়ে স্বীকার করেছিলো হার। নারূপে না-গভীরতায় সেই একজনের প্রেমের কাছে প্রেমের রাজা মদন কিছু নয় তা স্বীকার করেছিলো। তারপরে মদন কী করেছিলো? সে সম্বন্ধে এখনো কবিতা লেখা হয়নি।

কিন্তু মানুষ কি পারে–কামের চাইতেও মনোমোহন কোনো অন্তহীন অতল ভালোবাসায় পৌঁছতে, তেমন কোনোরসকে আস্বাদন কতে, আহা, যা পরকীয়া প্রেমের চাইতেও মধুর? চরম সাত্ত্বিকতার সেই চরম মাধুর্য কৌপীনবন্ত কারো ভাগ্যে জুটেছে কিনা জানি না, কিন্তু মানুষের পক্ষে? বিনা দহনে আলোয় ঝলমল করা!

আর তার প্রমাণও আছে। রানী নিজেই জানেন। (তার মুখে হাসির মতো কিছু! তার কি এই কথাগুলোই মনে আসছে)?

কাদম্বিনী খুবই ভালো গাইতে পারতো। বৃন্দাবনের সেই মন্দির ছাপিয়ে, শুধু বৃন্দাবনের পথেই নয়, তার যশ তখনকার খাস দিল্লীর দিকে চলেছিলো। পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগেকার দিল্লী। দিল্লীতে তখনো বাদশা। সুতরাং আমীর উজীর মনসবদার। উপরন্তু কাদম্বিনী তার শ্যামবর্ণ সত্ত্বেও টিকলো নাকে, টানা চোখে, শরীরের গঠনে, সুন্দরী ছিলো অসামান্যই, তার সেই পঁচিশ বছর বয়সে। ফলে কাদম্বিনী বৃন্দাবন থেকে কাশী এসেছিলো, বাঈজী না হয়ে মাথা কামিয়ে গৈরিক পরে সেই কায়স্থের বিধবা নিজের চারিদিকে এক কঠিন ছদ্মবেশ তৈরী করেছিলো। কিন্তু একসময়ে সে রানীর সহচরী হয়েছিলো। এবং ক্রমশ সেই ছদ্মবেশ থেকে বেরিয়ে এসেছিলো একনতুন সৌন্দর্যের ভিমিত পূর্ণতা নিয়ে। তখন অবশ্য রানীরানীহননি, কাদম্বিনীর পঁচিশ, রানীর বারো হবে। পরে কাদম্বিনী এই রাজবাড়িতেও এসেছিলো, রানীর সহচরীরূপেই। দাসী বা পরিচারিকা নিশ্চয়ই নয়, বরং সঙ্গিনী, যেন বা নতুন পরিস্থিতিতে মন্ত্ৰিণী। আর তার প্রমাণ তার বেশভূষাতেও ধরা পড়তো। সে আপত্তি করলেও রানী সোনার কাজ করা বেনারসী পরলে তাকে রূপোর কাজকরা বেনারসী পরতে হত, নিদেন ঢাকাই জামদানি।

সেই কাদম্বিনী এখানে গান করতো। সেই বৃন্দাবনের গানই। বৈষ্ণব মহাজনদের পদাবলি। রানীর ধারণা তা প্রাণহীন ছিল না। কারণ কাদম্বিনী বৈষ্ণব ধর্মতত্ত্বের জ্ঞানে যে কোনো পণ্ডিতের সমকক্ষ ছিলো। এই গান এবং এই জ্ঞানই রাজাকে আকর্ষণ করেছিল। নতুবা এটা বলার বিষয়ই হয় না। রানীরা ছাড়াও অন্তঃপুরে সবসময়েই সুন্দরী স্ত্রীলোক থাকে। তাদের কেউ কেউ রাজশয্যায় কখনো স্থান পেলে দর্পিতাই হয়; ধর্ম গেলো এবং ভক্ষিতও হলাম এরকম মনে করে না।

কাদম্বিনী একদিন চোখের জলে ডুবে রানীকে বলেছিলো, আমি এখন কী করি বলো? সব শুনে রানী বলেছিলেন, তুমি আমার চাইতে বয়সে বড়ো, ধর্ম-অধর্ম বেশি বোঝা। তুমি যা হতে চলেছে সে সম্বন্ধেও আমি বা কী জানি?

রানী ভাবলেন। একটা কৌতুক বোধ সেই ভাবনার খুব কাছে থাকায় তার ঠোঁটদুটিতেহাসি জড়ানো। আসলে সূর্যও কি পারে বিনা দহনে শুধু আলো দিতে! আর আমরা মানুষেরা তো সূর্যেরই সৃষ্টি।

কাদম্বিনী বলেছিলো–আমি কায়স্থ, আমি বিধবা, আমি রাজার বিবাহিতা স্ত্রী নই। সেদিন রানীর মুখ লজ্জায়, ব্যথায় লাল হয়ে উঠেছিলো হয়তো। (এখন তা রানীর মনে পড়ে না। সেই তো প্রথম জানা গেলো নিঃসন্তান রাজার সন্তান হতে চলেছে। সপ্তদশী রানী তখন নিজের শরীরের অবস্থাকে কিছু সন্দেহ করছে মাত্র, আর এদিকে কাদম্বিনী নিজের অভ্যন্তরে সত্তাটাকেই উপলব্ধি করছে)। রানী বলেছিলেন, এ নিয়ে তুমি খুব লজ্জিত বা অপমানিত বোধ করছো এরকম অন্তত রাজার কানে ওঠা ভালো হবেনা। বিবাহিত না হলেও রাজবাড়িতে থাকাই তোমার পক্ষে ভালো হবে। সামান্য কিছু মাসোয়ারা নিয়ে অন্য কোথাও থাকলে কোথায় নেমে যাও তা বুঝে দ্যাখো। গান্ধর্ব মতটাকে যখন মেনেছে তার উপরে বিশ্বাস রাখো।

এখনো কাদম্বিনী তার টিকলো নাকে তেমন সরু করে তিলক কাটে। কঠোর ব্রহ্মচর্য পালন করে। কায়েতবাড়িতেও তার মহলটাই আলাদা। আসল ব্যাপারটা এই যে মানুষের পক্ষে সেই প্রেমোত্তর প্রেমের সাধনা খুবই কঠিন। কিন্তু তাহলেও প্রত্যয়টাও মিথ্যা নয়। সুগন্ধির ঝাঁপি যদি ঠাসা ভরতি না হয় তবে সুগন্ধি বস্তুগুলোর উপরে যে অন্তরীক্ষ, সেই আঁপিতে তা অদৃশ্য সুগন্ধে ম-ম করে। যেমন রাজবাড়ির পিছনে এই শালবাগান। হয়তো বাদশাহী ফারমানের যে রাজা পাটনা অযোধ্যা হয়ে দিল্লী তক্‌ যাতায়াত করতো তার মনে মধ্যেও কোথাও এমন একটা অসাধারণের প্রতি আকাঙ্ক্ষা ছিলো যা সার্থক হলে রূপ সনাতনের বৈরাগ্য হয়।

রানীর মুখ অন্তর্লীন হাসিতে উজ্জ্বল দেখালো। পায়ের তলায় শুকনোশালপাতা বিছানো পথ।

নয়নতারা বললো–বনমর্মর বলে নাকি একে?

নয়নতারার দুষ্টুমিতে আবার হাসলেন রানী।

এটাও কিন্তু কম কৌতুকের নয় যে রানী আজ খিড়কির দীঘিতে স্নানে চলেছেন। স্নানের জন্যই তো দীঘি এবং সেখানকার বাঁধানো ঘাট এমনকী পুরনারীদের জন্য স্নানের ঘর আছে, জলের উপরে-তা সত্ত্বেও। এবং এখানে চলতে গিয়ে এ পুরনো কথাগুলো যেন তার মন ছুঁয়ে যাচ্ছে। ঠিক ভাবছেন এমন নয়, যেন মনে ঢুকতে দিচ্ছেন। কৌতুকটা এই যে এভাবে এ পথে স্নানে এসেই কি এমন হলো, অথবা মনে আসছিলো বলেই তিনি এ পথে এসেছে আজ?

রানী সংবাদ পেয়েছেন কাদম্বিনীপুত্র, অন্য কথায় কায়েতবাড়ির ছেলে, রাজবাড়িতে আসছে। রাজুর জন্মের পর এই প্রথম। রাজুর মনে কি ধাক্কা লাগবে? যখন তাদের সাক্ষাৎ হবে?

পরে না হয় ভবিষ্যতের কথা ভাববেন, কিন্তু অতীত? অতীত আর ভবিষ্যতে এই তফাত যে অতীত নিজের মনেরই এক অংশ যেন।

কাদম্বিনীকে এরপরে অন্যত্র থাকতে হয়। গম্ভীর খাদের গলা ছিলো রাজার।

-তা তো বটেই। (কী বা বুদ্ধি তখন সেই সপ্তদশী রানীর!)–আপনি কি বাগানবাড়ির মতো কিছু ভাবছেন?

–সে রকম কিছু। যদি বলো কলকেতার দিকে যেমন হচ্ছে তেমন একটা দূরে শাহাবাদ পরগনায়।

তাই হোক। কিন্তু তা রাজবাড়িই হোক। নতুবা কাদম্বিনী ছোটো হয়ে যায় না? আর সে ছোটো হলে আমারও সম্মান থাকে না।

তাই হয়েছিলো। শাবাদ পরগনার আয়েও একটা রাজবাড়ি চলে বৈকি। আর সেখানে কায়েতের মেয়ে কাদম্বিনী একা নয়, যেন এটা নীচ কিছু নয় এরকম বোঝতে, এ বাড়ির অনেক আশ্রিত সে বাড়ির আশ্রয়ে গিয়েছিলো, অথবা তাদের তেমন রাখা হয়েছিলো। আর আশ্রিত মানুষরা যদিও তারা রাজার আত্মীয় এবং কায়েতও নয়, কাদম্বিনীর সম্বন্ধে উন্নাসিক হবে এমন হয় না।

শাবাদ পরগনার কাছারি অবশ্য অন্যান্য পরগনার কাছারির মতোই নায়েব-ই রিয়াসতের অধীন। আর আয় ব্যয়ের শেষ হিসাব সুমারনবিশ দেখে থাকে।

রাণি বললেন, আচ্ছা, নয়নতারা, তুমি কি কখনো কায়েতবাড়ি গ্রামে গিয়েছে? নাম শুনেছো নিশ্চয়?

-হ্যাঁ, সদরে যেতে পড়ে। সেখানে এক জমিদারবাড়ি আছে, যারা নাকি কায়স্থ।

–সেখানে একজন কুমার আছে যার বয়স রাজুর কাছাকাছি, জানো?

–শুনিনি তো।

–সে আমাদের রাজবাড়িতে আসবে লিখেছে।

–আমাদের রাজকুমারের সঙ্গে পরিচয় বুঝি?

না। রাজু কবে কায়েতবাড়ি গেলো? তাছাড়া সেই কায়েত-কুমার তো পাঁচ-ছ বছর বয়স থেকেই বেশির ভাগ কলকাতায়।

রানী আলাপটাকে অন্য দিকে নিলেন। বললেন–তোমার সঙ্গে হৈমীর আলাপ হলো নয়ন? মেয়েটি ভালো নয়! বেশ সুন্দরী, কি বলল?

নয়নতারা বললে–বেশ কম বলা হয়।

রানী হাসলেন। বললেন–ভাগ্যে মেমসাহেব বলোনি। রাজুর একরকম মামাতো বোন, ওদের শাখাটার রং ওরকমই। কিন্তু দুঃখের ছায়া পড়লো রানীর মুখে। বললেন, তুমি ওর কথা জিজ্ঞাসা করছিলে না? কিন্তু কী কপাল! তোমাদের বয়স হবে, এর মধ্যে দুবার কপাল পুড়িয়েছে। জানো, ওর বাবা পাটনায় কমিসেরিয়টে ছিলেন। বালবিধবা মেয়েকে সব আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছিলেন। পাটনার কুঠির পার্টিতে যেতো। সেখানে শেষ পর্যন্ত এক ইংরেজ না কী আইরিশ ক্যাপটেনের সঙ্গে প্রণয় পরিণয় হয়। কিন্তু দুমাস পরেই দানাপুরের কাছে কানোয়ার সিংকে রুখতে গিয়ে আর ফিরলো না।

নয়নতারা কী বলবে খুঁজে পেলো না। অবশেষে এই সাদা প্রশ্নটা করলো, উনি কি খৃস্টান?

রানী বললেন–বিবাহটা চার্চে হয়ে থাকবে। কিন্তু তাই বলে কি ধর্ম বদলেছে? মনে হয় না। জিজ্ঞাসা করিনি। ওর বাবা অনেক সাহস করেছিলো, কিন্তু এখন ফিরিয়ে নিতে সাহস পাচ্ছে না। দোষ দেওয়া যায় না, তার ছোটো বাড়িতে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায়।

দূর থেকে যাদের দেখা গিয়েছিলো মন্দিরের বারান্দায় এখন তারা স্পষ্ট। তারা সকলেই ব্যস্ত। তারা কেউ ক্ষীরছানায় মিষ্টি গড়ছে, কেউ লুচির ময়দা নিয়ে ব্যস্ত। তারাও রানীকে দেখেছে। আজ কেউ কাজে ফাঁকি দিচ্ছে না, সুতরাং কর্মরত অবস্থায় রানীর দৃষ্টিতে পড়তে পেরে তারা বরং খুশি হলো।

রানী ওদের থেকে কিছু দূরে বারান্দায় বসলেন। রানীর পা নিচের সিঁড়িতে। রানীজুতো পরেন না, পায়ে আলতাও দেন না। তিনি তেমন করে সিঁড়িতে পা রেখে বসেছেন বলে জানা গেলো, পায়ে গুফের নিচে সরু পাটিহারের মতো পায়জোর। ঘুণ্টি নেই, তাই নিঃশব্দ; অযত্নে রূপোটা কি কিছু ম্লান?

এখন কি রানী এখানে গল্প করবেন? যেহেতু প্রাচীনাগণ পরিচারিকা শ্রেণীর নয়, বরং দূরের হলেও আত্মীয়াই, এখানে গল্প চলতে পারে।

আজ ভোগের আয়োজন কী হয়েছে, শীতলের আয়োজন কীকী হবে এসবই আলাপে এলো কারণ এসবই তো সেই একজনের যিনি রাজার রাজা। আজ শীতল-প্ৰসাদ কার বাড়িতে যাবে তা আলোচনার পর যখন জানা গেলো, আজ তা লিস্টি অনুযায়ী শিরোমণিমশায়ের বাড়িতে যাচ্ছে, তখন সেই সূত্রে যেন আলাপটা কেঁপে উঠতে পারলো। এটা একটা প্রথা, শীতলের প্রসাদ গ্রামের ভদ্র গৃহস্থদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। একশো জনের নাম আছে তালিকায়, ঘুরে ঘুরে সেই তালিকা অনুযায়ী বাড়িতে যায় প্রসাদ। গ্রামের একশত ভদ্র পরিবার বলা বাহুল্য তারা কিছু পরিমাণে অর্থবান, এবং এমন যে অনাহূত ভাবে রাজবাড়ির মন্দিরে প্রসাদ পেতে আসবে না।

শিরোমণির নামের সূত্রেই একজন বললো–অনেকদিনকথকতা হয় না। সামনে পূর্ণিমা। বললে হয় শিরোমণিকে।

রানী বললেন–কেউ কেউ বলে শিরোমণির কথকতা কাঠকাঠ।

সংস্কৃত বেশি থাকে। কিন্তু অমন ব্যাখ্যাও সহজে কেউ দিতে পারে না। গতবারে মানভঞ্জনের ব্যাখ্যা যা করেছিলো তা এখনো যেন কানে লেগে আছে। আমরা কি জানতাম যিনি তাঁর হাদিনী শক্তি, যিনি প্রায় অভেদ তার থেকে, তারও এমন অভিমান উচিত নয় যে তিনিই ঈশ্বরকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসেন, ঈশ্বর তারই একমাত্র। ঈশ্বর চন্দ্রাকেও কৃপা করবেন। সেজন্য মান করা শোভা পায় না। আমি সবচেয়ে বড় ঈশ্বরভক্ত এটাও তো সাধনার বিঘ্ন।

হেসে রানী বললেন–তোমার ব্যাখ্যাও কম যায় না, সুরধুনি। বেশ তত, শিরোমণির বাড়িতে যে যাবে শীতল নিয়ে তাকেই বলে দিও শিরোমণিকে কথকতার নিমন্ত্রণ দিতে।

আমার তো মনে হয় বিরুদ্ধপক্ষীয় নেতা হওয়া মানুষের স্বভাবেই থাকে। সেই আসরেও একজন ছিলো। ক্ষণকালের আসর, রানী এখনই উঠবেন স্নানে, কিন্তু মনের মধ্যে বিরোধপ্রবণতা নিজেকে নিয়েই একশো।

তেমন একজন বললেনয়ননাকি এবার ফিরেই শিরোমণিদের ব্রাহ্মণভোজনের নিমন্ত্রণ দিয়েছিলে?

–শিরোমণিদের নয়, শুধু তাকেই। নয়নতারার মুখটা যেন একটু লাল হলো।

–তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন, আর তারপর বলতে পারোনি কাউকে আর?

যেন নয়নতারাকে প্রত্যাখ্যান করায় শিরোমণির রাজবাড়িতেও অনাদৃত হওয়া উচিত। আর একজন বললো–আমাদের রাজবাড়িতে তো ব্রাহ্মণ কর্মচারীর অভাব নেই।

অপরা বললো–তারা অন্তত বাধ্য হয়েই আসতো।

নয়নতারা মুখ নামিয়ে নিজের পায়ের দিকে চেয়ে রইলো।

কিন্তু রটালো কে এই প্রত্যাখ্যান? এই শেষ প্রশ্নটাই বা কে করলো? তা কি রানীর দৃষ্টি?

রানী যখন কথা বললেন, তার গলাটা গম্ভীর শোনালো। তাকেও কথা বলতে সময় নিতে হয়েছে। বললেন তিনি–তোমার কি ব্রাহ্মণভোজনের দিন পার হয়ে গিয়েছে? ওরা যেমন। বলছিলো তাও করতে পারো, নয়ন।

নয়নতারা রানীর দিকে চাইলো। তার চোখের পাতা দুটো কি কপলো? সে ধীরে ধীরে বললো–তাতে কি শিরোমণিকে অপমান করা হবে না?

রানী হাসলেন। এ হাসির নানা অর্থ করা যায়। একটা অর্থ এই হতে পারে, তোমার বুদ্ধিকে বিশেষ পছন্দ করলাম। কিন্তু যে শুরু করেছিলো আলাপটা তার মুখ ততক্ষণে কালো হয়ে গিয়েছে। বিশ্রী এই শব্দটাই যেন অন্যান্যদের মুখ থেকে বেরুবে। শিরোমণির প্রত্যাখ্যানটা যে রাজু এবং নয়নতারার সম্বন্ধ নিয়ে নানা কল্পনা থেকে ঘটছে তাতে সন্দেহ। নেই। রানীর মনে আলোচনাটাকুৎসিত, এই কথাটাই এলো। যেন কেউ ক্রুদ্ধও করে তুলেছে তাকে। কে সেই ক্রোধের পাত্র? যারা শিরোমণির কথা তুলেছিলো? তারা তো বিবর্ণমুখ, যন্ত্রের মতো হাত চলছে শুধু। অথবা ক্রোধের পাত্র কি শিরোমণি? কিংবা নয়নতারা? ক্রোধের পাত্র খুঁজে না-পেয়ে কি তিনি নিদারুণ রকমে হেরে যাবেন? তার একবার মনে হলো এরকম আকস্মিকভাবে কথাটা উঠে পড়লো কেন? সে জন্যই বিষয়টাকে আয়ত্তে রাখতে পারছে না! অথবা প্রকাশ আকস্মিক হলেও একদিন এ তত আলোচনার বিষয় হতোই। অতীতের সেইসব তো ছেলেমানুষি মোহ ছিলো রাজুর। এখন?

হঠাৎ যেন তার মনে কাদম্বিনী ফিরে এলো। কাদম্বিনী আর নয়নতারার পার্থক্য কি সেকাল আর আধুনিকতায়? কিংবা কাদম্বিনী নিজেকে রাজবাড়ির বাইরের সমাজে কখনো নিয়ে যায়নি যেমন নয়নতারা শিরোমণিকে আহ্বান করতে গিয়ে করেছে? কিংবা কথাটা আধুনিকতাই হয়তো। বাদশাহী ফারমানে যে রাজা তাকে যা মানায় রাজুকে তা মানায় না।

কিন্তু রানী গলা তুলে বললেন–এই দ্যাখো, মনে পড়ে গেলো, নয়ন, তুমি আর রাজু যে সেদিন অত গভীর রাত করে ফিরলে শিকার থেকে সে গল্পই আমার শোনা হয়নি। স্নান করতে করতে শুনবো।

নয়নতারা বললো–তাহলে চলুন, রানীমা, বেলা হচ্ছে।

রানী চলতে শুরু করলেন। তার মুখে ক্লান্তির পাশে স্নিগ্ধতা ফুটবে এবার মনে হলো। কিন্তু তাও কি সহজে! পাশে এখনো নয়নতারা রয়েছে তো! তিনি যেন নিজেকে তিরস্তার করবেন এরকম এক মনোভঙ্গির কাছে গেলেন একবার। যেন বা নিজেকে বলবেন এমন করে সমস্যাটা থেকে দূরে থেকেছে বলেই এমন বিস্ফোরণ হলো তোমার নিজেরই অন্দরমহলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজের ব্যক্তিত্বকে, যেমন অন্য সকলে, শ্রদ্ধা করেন। তাকে হীন করলে কি তিনি কিছু করতে পারবেন আর? নয়নতারা এবং রাজুর ব্যাপারটা ওদেরই নিজস্ব। সেটা কি আদৌ কিছু ব্যাপার? নয়নতারাকে হীন করলে ব্যাপারটা মলিন হয়ে যায়।

তিনি বললেন–নয়ন, তোমার সঙ্গে বিদ্যেসাগরের মত মিলছে না মহাভারতে, শিরোমণির সঙ্গে মিলছে না ব্রাহ্মণভোজনে। আমার মনে পড়ছে আগে এরকম কথা ছিলো গ্রামে তোমার দাদা ন্যায়রত্নের মত মেলে না কারো সঙ্গেই।

নয়নতারা বললো–ন্যায়রত্ন বলতেন মহাভারত বৃক্ষ।

–সেই যার মূল ধৃতরাষ্ট্র মহারাজা? সে তো সাধারণ মতই।

–ঠিক নয়। বলতেন বৃক্ষ জমি অনুসারে বৃদ্ধি পায়। মন অনুসারে মহাভারতের বৃদ্ধি।

কথাটা ভেবে দেখার মতো।

রানী স্থির করলেন তাকে এবার থেকে ভাবতে হবে। কিন্তু এখন নয়, অন্তত নয়নতারার পাশে থেকে নয়, যেমন নয় বিবর্ণমুখ তার সেই বর্ষীয়সী আত্মীয়াদের কাছে বসে। বিষয়টাকে নিজের আয়ত্তে এনে চিন্তা করতে হবে।

রানী বললেন–আ, নয়ন, ফরাসডাঙার ব্যাপারটা ভাবতে হয়। ওরা কি করছে? এবার শিবচতুর্দশীতেই কি সেখানে পুজো হবে? কেউ সেদিকটাকে দেখছে না যেন। ওদিকটার ভার নেবে? প্রকৃতপক্ষে রাজবাড়ির পুজোটুজোর ব্যাপারে বিশেষভাবে যাকে দায়িত্ব দেওয়া যায় এমন একজন কেউ নেই। নেবে সে ভার?

আপনার প্রয়োজন হলে তা করবো।

একবার রানী ভাবলেন নয়নতারার পাশে কি সত্যি তিনি ক্ষুদ্রকায়া ও মলিন হয়ে গেলেন? তা অবশ্যই নয়। নয়নতারা এখনো প্রাপ্তবয়স্ক রাজুকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে। এটা ভাবতে গিয়ে তেমন বোকামির কথা মনে এসে থাকবে? আসলে তিনি যা অনুভব করছেন তাকে কথায় আনলে এরকম হয়? আর দ্যাখো এই গরবিনীর রূপ, এই রূপসীর তেজ। চোখ দুটোকে দেখেছো?

স্নানের ঘাটে বসলেন রানী।

 ০৭. নয়নতারা রাজবাড়ির পালকিতে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

০১.

সুতরাং একদিন পরেই নয়নতারা রাজবাড়ির পালকিতে ফরাসডাঙা চলেছিলো। তখন শীতের আরামদায়ক উষ্ণতার মধ্যাহ্ন। যোগাযোগের ফলে নয়নতারার পালকিতে হেডমাস্টারের স্ত্রী ক্যাথরিন, কেট। পালকির পাশে, কখনো কিছু আগে, রাজকুমার রাজচন্দ্র তার খয়েরি কালো প্রকাণ্ড ঘোটকীতে। পালকির কিছু আগে হাওদাদার হাতি, পায়ে পায়ে কয়েকজন বরকন্দাজ, পালকির পিছনে আর কয়েকজন বরকন্দাজের আগে আগে রূপচাঁদ। একটা চোখ ধাঁধানো শোভাযাত্রা।

যোগাযোগটা এই রকম। নয়নতারা আহারদি শেষে বন্দোবস্ত মতো নিজের বাড়ি থেকে রাজবাড়ির পালকিতে রওনা হয়েছিলো, পালকির সঙ্গে একজন বরকন্দাজ থাকেই। রাজুর তা জানার কথা নয়। আহারাদি শেষে দুপুরের রোদ ঝুলবারান্দায় যেখানে আরামদায়ক সেখানে দাঁড়িয়ে সে অন্যমনস্ক হয়ে নিচে কাছারি চত্বরে হাওদাদার হাতি, রূপচাঁদ,বরকন্দাজ প্রভৃতি দেখছিলো। কে যেন বললো, এরা কুতঘাটে যাবে। কুতঘাট বর্তমানে ফরাসডাঙা ঘেঁষে পড়েছে। তাতে রাজুর মনে হলো সেও ফরাসডাঙা যাওয়ার কথা ভাবছে। এই দুপুরটা তা যাওয়ার মতোই। সুতরাং সে আস্তাবল থেকে নতুন ঘোটকটাকে আনিয়ে রওনা হয়েছিলো।

রাজচন্দ্রর ঘোড়া যখন হেডমাস্টারের বাড়ির কাছে, সে দেখতে পেয়েছিলো গেটের বাইরে টপহ্যাট মাথায় ছাতা হাতে বাগচী, গেটের ভিতরে কিন্তু গেটের উপরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে কেট। সে সুতরাং লাগাম টেনে সেখানকার রোদে দাঁড়িয়ে গল্পে জমেছিলো।

রূপচাঁদ গঞ্জের পথে উঠেই রাজবাড়ির সেই ঝালরদার আট বেহারার পালকি দেখে মাহুতকে হাতি ধীরে নিতে বলে পালকির দিকে নিজে এগিয়েছিলো। পালকির কাছে যেইমাত্র বুঝেছে পালকিতে নয়নতারা, তখনই অদূরে হেডমাস্টারের গেটের সামনের দৃশ্যটাও দেখতে পেলো। বললো, রাজকুমারকে দেখছি।

রূপচাঁদের কথায় পালকির দরজা আর একটু মেলে নয়নতারাও রাজকুমারকে দেখতে পেয়ে পালকি থামিয়েছিলো।

নিজেদের অজ্ঞাতসারে পালকি, হাতি, রূপচাঁদ এবং বরকন্দাজেরা যে শোভাযাত্রা তৈরী করেছিলো তা নিঃশব্দও নয়। বেহারাদের হুমহাম,হাতির গলার ঘণ্টা তো ছিলোই। পালকির ঝালরে, হাতির জামায়, বরকন্দাজদের পাগড়িতে তা রংদারও বটে।

নয়নতারা স্পষ্ট কিন্তু নিচু গলায় বললো–বেশ একটা ছবিই যেন। তার বক্তব্য ছিলো কেট, বাগচী ও রাজকুমারের সংযোগকে উদ্দিষ্ট করে।

রাজচন্দ্র মুখ ফিরিয়ে নয়নতারাকে দেখে হেসে বললো–কোথায় চলেছছ? দ্যাখো, দ্যাখো কেট, কবরেজমশায়ের রোগী দেখতে যাওয়া কাকে বলে।

নয়নতারা বললো, প্রজাদের নানা উপজীবিকা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু সামনে পিছনে চেয়ে সেই জৌলুস চোখে পড়ায় সেও বিস্মিত এবং লজ্জিত হলো। উপরন্তু বাগচীও তাকে বিস্মিত হয়ে দেখছে, আর বাগচীর সঙ্গে ছদ্ম ব্যবহারও চলে না। নয়নতারা একেবারে সহজ হয়ে বলনোক্যাথরিন, ফরাসডাঙার মন্দির দেখতে যাচ্ছি। তুমিও এসো না। এতক্ষণে তোমাদের লাঞ্চে নিশ্চয় শেষ হয়েছে।

কেট না-যাওয়ার অজুহাত হিসাবে বললে হাসিমুখে–জৌলুস থামিয়ে তো পোশাক করা যায় না, আর পোশাক না করে জৌলুসেও যাওয়া যায় না।

নয়নতারা সুবিধা পেয়ে বললো–যে পোশাকে রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করা চলে সে পোশাকে তার রাজ্যে সর্বত্রই মুখ উঁচু করে চলা যায়। এসো এসো।

বাগচী হেসে বললো–যুক্তিতে হারলে কেট। অন্য কহ আর। কিংবা যাও না রোদটা গায়ে লাগাতে!

রাজকুমার বললো–গেট ইন, গেট ইন।

নয়নতারা বললো–ওমা, ইংরেজি বলছেন যে! শিগগির পালিয়ে এসো।

বাকিটা অবশ্যই তরুণী মনের রঙ্গমুখিনতা।

পালকির কাছাকাছিদলপতি রূপদ থেমে দাঁড়ানোর ফলে মাহুত তার হাতিকে খানিকটা এগিয়ে পথের ধারে দাঁড় করিয়েছিলো, রূপচাঁদের সঙ্গের বরকন্দাজেরা পালকির কিছু পিছনে। তাদের গন্তব্য যাই হোক রাজকুমারকে ডিঙিয়ে চলে যেতে কোনোরকমের একটা ইশারা চাই।

কেট পালকিতে উঠলে, পালকি কাহারদের কাঁধেউঠলে,নয়নতারা মুখ বাড়িয়ে বললো, আগে আগে চলুন রাজকুমার। রাজচন্দ্র বরং দ্বিধা করলো। ফরাসডাঙায় সে যেজন্য যাচ্ছে তা কি নয়নতারাদের সঙ্গে গেলে সার্থক হয়? তখন নয়নতারা হেসে কেট আর রাজচন্দ্র যাতে শোনে শুধু এমন গলায় বললো–দ্যাখো কেট, তোমাকে বলেছিলাম, হিন্দুদের অমন যে সদাশিব তারও বর দিতে কত বায়নাক্কা। কেট সম্ভবত নয়নতারা কবে এরকম বলেছিলো কী অর্থে তা ভেবে দেখতে গেলে, ফলে সে নয়নতারার জ্বর জ্যামুক্ত তীরটাকে দেখতে পেলো না।

সুতরাং তাদের গন্তব্য যাই হোক, হাতি, হাতির পরে তার খয়েরি কালো ঘোটকীতে রাজকুমার, পরে সেই জরির ঝালরদার পালকি, তারপর ছুটন্তবরকন্দাজদের নিয়ে রূপচাঁদ, এইভাবে সেই জৌলুসটাকে এগিয়ে যেতে দেখলে বাগচী। সে ভাবলো, কী এমন ব্যাপার আবার রাণীমার শিবমন্দিরে যে আজ এমন উজ্জ্বল শোভাযাত্রা!

কিন্তু কেট এভাবে চলে যাওয়ায় তার কর্তব্য দেখা দিলো। কেট কখন ফিরবে কে জানে, সেও সন্ধ্যার আগে ফিরবে না। তার কুঠিতে ঝি-চাকর বলতে সবেধন এক সহিস। সুতরাং তাকে ডেকে ফাঁকা বাসার দিকে চোখ রাখতে এবং মেমসাহেবের ফিরতে দেরি হলে সন্ধ্যার আগে আগে সহিস যেন কয়েকটা বাতি জ্বালায় এমন নির্দেশ দিলো সে। এইসময়ে তার মনে হলো তাদের কুঠিতে ঝি, চাকর, আয়া, খিদমদগার বলতে কেউ নেই।

এখন আর দ্বিধা হয় না। কিন্তু কেট তার স্ত্রী হওয়ার পরে মনে হতো বৈকি বাগচীর, কেটের মতো ইওরোপীয় কোনো মহিলার কুঠিতে এদেশে অন্তত, কাজ থাক আর নাথাক, সহিস ছাড়াও একজন ফুটম্যান, একজন বাবুর্চি, অন্তত চার-পাঁচজন ঝি-চাকর থাকে। কেটের বাবা ফাদার অ্যানড্রজের সেন্ট্রাল প্রভিন্সের মিশন-বাংলোতেও তা থাকতো। প্রথম যখন এখানে তারা এসেছিলো দেওয়ানজি নিজে থেকেই ঝি-চাকর ঠিক করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। বাগচীর মনে আছে, সে নিজে বলেছিলো দুজনের ছোট্ট একটা সংসার, সেলফ হেল্পই ভালো হবে। কেট হেসে বলেছিলো, আমাদের দেশে মধ্যবিত্তদের পরিবারে ঝি চাকর তেমন থাকে না। এদেশে থেকে যারা টাকাপয়সা করে তাদের কথা আলাদা। পরে কেট তাকে বলেছিলো, এদেশে সমাজ কোথায় যে মান রাখতে ঝি-চাকর রাখতে হবে?

এটা কিন্তু বাগচী হালকা মনে তার স্কুলের দিকে যেতে যেতে ভাবলো, সেলফ-হেল্প ভালো, আর সমাজে মান রাখার প্রয়োজনের অভাব কি দুরকম কথা নয়? এইসময়ে বাগচী তার চোখের উপরেই যেন কেট ও নয়নতারার সেই উজ্জ্বল শোভাযাত্রাটাকে দেখতে পেলো। কী যেন? নিজের মনে এই প্রশ্ন করলো বাগচী হাসি হাসি মুখে। মনে পড়ায় সে হাসলো। এখানে আসার পরে মনে মনে সে বললো, তোমার মনে পড়বে কেট, পালকি চড়া নিয়ে সে বেশ একটা ব্যাপার হয়েছিলো। দেওয়ানজি কুতঘাটে পালকি রেখেছিলো। এখানে সমাজের উচ্চতর অংশের তাই তো স্বাভাবিক যানবাহন। সেদিন কিন্তু সে কিংবা কেট প্রথম দিনেই পালকিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলো, এমনকী সে নিজে মানুষের ঘাড়ে চেপে স্বর্গে যাওয়ার চেষ্টা করে নহুশের দুর্গতির গল্পটা বলেছিলো। এসব ব্যাপারে কি মন আগে থেকেই তৈরী হতে থাকে? কেটের পৈত্রিক মিশন হাউস, যা অবশ্য তারও একমাত্র আশ্রয় ছিলো আবাল্য, তা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনাড়ম্বর জীবনের দিকে ঝোঁক দেখা দিয়েছিলো তাদের? তা অবশ্য বাস্তবিক, কারণ তখন তো স্কুলমাস্টারের বেতনই তাদের উপজীবিকা।

বাগচী লঘু মনে হাসলো।

বাস্তব পরিস্থিতি আর নীতিতে বেশ মিল তোর কিন্তু না, এটা নিয়ে হাসাহাসি নয়। আজ লাঞ্চে হাসাহাসিটা হয়েছিলো অন্য ব্যাপারে। রোসো, কেটের পালকি চড়া নিয়ে আজ সন্ধ্যায় ক্ষেপিয়ে তোলা যাবে। কী গো, এ কি ডু অ্যাজ দ্যা রোম্যান ডাজ! বেশ তো পালকিতে চড়লে!

কয়েক পা গিয়ে তার মনে হলো এটা ঠিক তার হাসির ব্যাপার নয়। আজ লাঞ্চে বসে বেশ হাসাহাসিই হয়েছিলো, এমনকী রাজকুমার এসে পড়ার আগেও সেব্যাপারটা নিয়ে তারা রঙ্গ করছিলো। বলতে পারো অন্যত্র যাই হোক একজন পাদরির বাড়িতে তা বেশ গম্ভীর বিষয় হওয়া উচিত। কথাটা বোধ হয় স্কুলে বিজ্ঞানের দিকে ঝোঁক দেওয়ার কথা থেকে কেট তুলেছিলো। আত্মা আর মন নিয়ে কথা উঠেছিলো। এক সময়ে হাসতে হাসতে কেট বলেছিলো, মনের চোখ, কান, নাক এসব, বুদ্ধি, চেতনা এসব আছে, বেচারা আত্মার? নাকি সে দশশালার জমিদার যে মনের উপরে ম্যানেজারি ছেড়ে দিয়ে নিজে মজা নিয়ে আছে। বাগচী বলেছিলো তাহলে কান্টকে আনতে হয়। কেট কপট আশঙ্কায় বলেছিলো, না না, এখন লাঞ্চ। কিন্তু কম দুষ্টু ভেবেছো? –ভাবলো বাগচী, কিছুক্ষণ পরেই আবার বলেছিলো, আচ্ছা, চেহারা, স্বভাব, গলার স্বর, পশুপাখি থেকে মানুষ, সকলেই অনেক পরিমাণে পিতামাতার কাছে পায়, কিন্তু আত্মা? তা কি দুই আত্মার থেকে কিছু কিছু নিয়ে তৃতীয় একটি বাগচী মনে মনে হাসলো। তো, সেও বেশ একটা লাগসই কথা বলেছিলো; হিন্দুদের বেশ একটা ধারণা আছে, আত্মার জাতি নেই, পুরুষ আত্মা, স্ত্রী আত্মা, ইহুদি আত্মা, মুসলমান আত্মা এরকম নাকি হয়না। যদি থাকে তাহলে তার সমাজই বা কি? ভালোমর বিচারও বারো আনা চলে যায়।

এখন বাগচী ভাবলো, একটা কথা কিন্তু ভাববার মতো। আত্মার চোখ কান না থাক তার একটা প্রজ্ঞা আছে যাকে স্বজ্ঞাও বলা যায়। মনই বরং অনেক বুদ্ধি বিবেচনা করে চলে। কিন্তু তাতে চালাকিও থাকেনাকি? যেমন মন ভদ্রতার খাতিরে সমাজের সঙ্গে মানিয়ে চলতে যা সে চাইছে না তা করে, বলে। ফাঁক থেকে যায় না?

কিন্তু এটা তার চিন্তার বিষয় নয়। তার মনে তলায় তলায় যে চিন্তা চলেছিলো তা প্রকাশ পেতেই সে অবাক হলো। এই গ্রামের সমাজ, কি আশ্চর্য, আজকার এই শোভাযাত্রা, যেমন জোনাথন গাই বলতো, দশশালা বন্দোবস্তের ফল? অর্থাৎ নিজেদের ধন উৎপাদনের শ্রম করতে হয় না এমন এক শ্রেণীর ব্যসন? কিন্তু ওদিকে আবার গাইলস, যেনাকি মতবাদে মিলকে অনুসরণ করে, নিজেকে প্রকাশ্যে ইউটিলিটেরিয়ান বলে, বলে বৃটিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ভারতকে উন্নত করার জন্যই, সে নিজেই স্বীকার করেছিলো কর্নওয়ালিশ কতগুলো দালাল সৃষ্টি করেনি, ইংল্যান্ডের ভূমি-আভিজাত্যই অনেকটা এখানে প্রবর্তন করতে এসেছিলো। স্বীকার করেছিলো ইংল্যান্ডের তারাও শ্রম করে খায় না এবং ব্যসনও যথেষ্ট। দশশালার আগেকার জায়গীরদার প্রথাতে রায়তের অবস্থা ভালো না হয়ে বরং আরো খারাপ ছিলো নাকি।

গাইলস এখন, ভাবলো বাগচী, চাকরিটা ভালো পেয়েছে। সেন্ট্রাল স্টেটস এজেন্সির অধ্যক্ষ। এজেন্সিটা কি আগেই ছিলো, নাকি সিপাহী বিদ্রোহের পরে হয়েছে? তখন, তারা যখন মধ্যপ্রদেশে, সে নাগপুরে রেসিডেন্ট ছিলো বটে।

ভাবলো বাগচী, লাঞ্চে আজ আলাপের প্রথম বিষয় ছিলো ডাকে আসা গাইলসের চিঠিটাকে নিয়ে। প্রথমে অবাক লেগেছিলো, গাই তাদের ঠিকানা পেলো কী করে! কেট বলেছিলো, গত ক্রিস্টমাসে তাদের সেই অরফানেজে একসময়ে মানুষ হয়েছিলো এমন কয়েকজনকে কার্ড পাঠিয়েছিলো তাতে এখানকার ঠিকানা ছিলো।

এবার বাগচী চলতে চলতে গাইলসের চিঠিটার কথা ভাবতে লাগলো। আকস্মিক ব্যাপারই বটে। ভাবা যায়নি গাইলস চিঠি লিখে বসবে। ও, গাইলস তার চিঠিতে তাদের ছেড়ে আসা মধ্যপ্রদেশের সেই মিশন হাউস সম্বন্ধে লিখেছে। আঃ কতদূর! নস্ট্যালজিয়া আছে বৈকি! জীবনের ত্রিশ বছর কেটেছিলো যেখানে। কিন্তু শোক করেও লাভ নেই। সে জানতোই বস্তারী আদিবাসীদের গ্রামের সেই ছোটো সুন্দর মিশন হাউস, তার সংলগ্ন অরফানেজ সবই তার শ্বশুরের টাকায় তৈরী, কিন্তু নীতির প্রশ্ন উঠলে জবাব দেওয়া কঠিন।

লন্ডন মিশনের সেই পাদরিকেই যেন সে দেখতে পেলো আবার। গাইলসকে সঙ্গে করেই সে এসেছিলো। গাইলস নাকি মধ্যস্থতা করবে। তো, সেবারই ইউটিলিটেরিয়ান কথাবার্তা বলেছিলো গাইলস। তখন কিন্তু গাইলস তাদের সমর্থন করে একটা কথাও বলেনি, যদিও এ চিঠিটার সুর অন্য রকম। এ চিঠিটা একটা বড়ো ঘটনা বৈকি? সেটাও বেশ বড়ো ঘটনা ছিলো। লন্ডন মিশনের সেই পাদরি যুক্তি দিয়েছিলো কেটের পিতা ফাদার অ্যান্ড্রুজ যে টাকাই জমিয়ে থাকুন তা তো লন্ডন মিশন তাকে যে স্টাইপেন্ড দিতো তা থেকেই, অন্য কোনো উপার্জনই ছিলো না। তিনি যখন অ্যাংলিকান ধর্ম ছেড়ে দিয়েছিলেন তখন নীতিগতভাবে সেই স্টাইপেন্ডের কোনো অংশেই, তা তিনি যত কষ্ট করেই জমিয়ে থাকুন, তার উপরে তার অধিকার জন্মায় কি? সেই পাদরির আসল উদ্দেশ্য ছিলো মিশন হাউসটা যত কমে সম্ভব কেটের কাছ থেকে কিনে নিয়ে ফাদার অ্যান্ড্রুজ, ইউনিটেরিয়ান মত প্রচার করে যে ক্ষতি করেছিলেন তা শোধরাতে। ক্ষতিটা খৃস্টধর্মের। দুদিন ধরে এসব শোনার পরে কেট বিবর্ণ কিন্তু কঠিন মুখে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর কাছে এসে হাত চেপে ধরে বলেছিলো, ফাদার বাগচী, তুমি একটা সংসার চালাতে পারো? পারো? তবে নিজেদের পোশাক ছাড়া আর কিছু নয়। তারা পরের দিনই প্রায় সে রকমই চিরদিনের জন্য মিশন হাউস ত্যাগ করেছিলো। মৃত পিতার পক্ষ হয়ে তার ধর্মমত ভারতে কিংবা ইংল্যান্ডে মামলা চালানোর ইচ্ছা ছিলো না কেটের। এখন বোঝা যায়, গাই তখনই ইউনিটেরিয়ান মত ছেড়ে দিয়েছিলো।

গাইলস একরকম মামলার কথাই যেন কিছু লিখেছে চিঠিতে। সে অবশ্য বিরক্ত হয়ে চিঠির সেই লম্বা প্যারাগ্রাফটাকে বাদ দিয়েছিলো। বটে? এই বলে বাগচী অন্য দিকে ভাবলো। আত্মা সম্বন্ধে সেই আলাপগুলো করতে গিয়ে আত্মাকে দশশালার জমিদার বলার। কারণ কী গাইলসের সেই বিতর্ক মনে হওয়া কেটের, কিংবা সে যে আত্মার জাতি না থাকার কথা তুলেছিলো তার কারণও কি গাইলসের চিঠির কোনো কথা? তার মন আবার কৌতুকের দিকে ফিরলো।

অনেকসময়ে যেমন হয়, বিরক্তিতে যা দেখিনি বা শুনিনি মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে তা এমন যে ভাবতে গেলে দেখা যায়, তার অনেকটাই মনে ঢুকে গিয়েছে; গাইলসের চিঠির সেই লম্বা প্যারাগ্রাফটার অনেক কথাই বাগচীর মনে আসতে লাগলো। গাইলস লিখেছে : অরফানেজে যারা মানুষ হয়েছিলো তারা তো বটেই মধ্যপ্রদেশে এখানে ওখানে যারাই কোনো না কোনো দিক দিয়ে ইংরেজ রক্তে সংশ্লিষ্ট তাদের এখন ভাবার সময় এসেছে। পিতা ইংরেজ, আইরিশ কিংবা স্কচ, মাতা মুসলমানী গোয়ানীজ, অথবা ভারতীয় আদিবাসী খৃস্টান হোক, পিতার ধর্ম প্রটেস্ট্যান্ট, ক্যাথলিক, প্রেসবাইটেরিয়ান যাই হোক, তাদের এখন এক হতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে, কি ভারতের সরকার, কি ইংল্যান্ডের সরকার কেউই তাদের ইংরেজ বলে স্বীকৃতি দিতে চায় না আর। এক কথায়, ভারতীয় ও ইউরোপীয় মিশ্র রক্তের লোকদের কোনো ভবিষ্যই দেখা যাচ্ছে নানা এদেশে,না ইংল্যান্ডে। কিছুদিন হয় এরকম দশ হাজার অফিসার ও আদার র‍্যাঙ্কস আর্মি থেকে ছাঁটাই হতে চলেছিলো। সিপাহী যুদ্ধে তাদের শৌর্য, ত্যাগ ইত্যাদি মনে রাখা হয়নি। তাদের অপরাধ তারা ইংল্যান্ড থেকে আগত অফিসার ও আদার র‍্যাঙ্কসের সমান সুযোগ সুবিধা চেয়েছিলো। এমনকী তিন পুরুষ বৃটিশ রক্তের যোগও হয়েছে যাদের তাদেরও সমস্যার মুখেই পড়তে হবে। এদেশের প্রবাদ অনুসারে না ঘরকা, না ঘাটকা। তোমাদেরও সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবতে হয়। এদেশের সমাজ যা থেকে আমরা শিক্ষা, দীক্ষা, রুচি,নীতি,কালচার, ধর্মে এত পৃথক সেখানে আমরা মিশতে পারি না, অন্যদিকে ইংল্যান্ডই আমাদের দেশ তাই বা বলার সুযোগ কোথায়?

বাগচীর ভ্রু কুঁচকে গেলো। একবার সে ভাবলো, চিঠিটা কেটকে লেখা, সে-ই বুঝবে তা নিয়ে কী করা উচিত। যদি বলল, আমি নিজেকে ইংরেজ বলতে গেলাম কেন? তাতে কিন্তু সমস্যাটা যায় না। জাতিতে ভারতীয় কিন্তু ধর্মে ক্রিশ্চিয়ান বললেও কিন্তু কোণঠাসা হয়ে পড়তে হয়, যদি ইংরেজ বিশেষ স্বীকৃতি তুলে নেয়।

বাগচী নিজেকে বললো–এসব ভাবতে চাই না। মধ্যপ্রদেশে যেমন সমাজ এখানে গ্রামে তেমন একটা সমাজ আছে। এ সমাজ অবশ্যই আমাদের অন্তরঙ্গ করে নেয়নি। নিতে কে পারে? কিন্তু একেবারে কি দূরে রেখেছে? তাছাড়া আমাদের সন্তান কোথায়? বাগচী যে আত্মায় বিশ্বাস করতো তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু মনকে অবিশ্বাস করতো তাও বলা যায় না। মন ততবুদ্ধিরই দুর্গ। সে ভাবলো, কেট বেশ বুদ্ধিমতী। সে অনায়াসে চিঠিটাকে পুড়িয়ে দিতে পারবে। সে অবশ্য খুব জেদীমানুষ। দ্যাখো, কিছু দেবো না, বলতে সে মিশন হাউস থেকে তার সখের জিনিসগুলোও আনেনি। আসবাবপত্র এমনকী নিত্য সন্ধ্যার সঙ্গী অর্গানটার দিকেও ফিরে চায়নি।

.

০২.

কাহাররা আস্তে চলতে জানে না। যেন যত তাড়াতাড়ি পারে গন্তব্যে পৌঁছে বোঝাটাকে নামানো চাই। চাপা হু-হুঁ করে আটজন ছুটছে। এক হাত পালকির দাঁড়ায়, অন্য হাত ভাঁজ করে বুকের কাছে নেওয়া, সেটা সে অবস্থায় হুঁ-কারের তাল রাখছে। পিছনে,কখনো সামনে, সরু সরু লম্বা পায়ের সেই কালো ঘোটকী, যার নিতম্ব ছাড়া সর্বত্র হালকা হরিণের ভাব, সামনের দুপায়ে দু থোপা সাদা চুল থাকায় রূপার মল পরেছে বলে ভুল হতে পারে, মাথা উঁচু করে ঘাড় বাড়িয়ে চলেছে,যাকে অ্যালিং বলে। রূপচাঁদ আর বরকন্দাজের দল হাসি হাসি মুখে ছুটতে ছুটতে পিছিয়ে পড়ছে।

পথে একবার পালকি আর ঘোড়ায় ছাড়াছাড়ি হলো। ঘোটকী ক্যান্টারে নাচতে নাচতে এগিয়ে গেলো। আর সেই সময়ে এই অধ্যায়ে যা প্রক্ষিপ্ত এমন একটা ব্যাপার ঘটলো। পথের পাশে সঙ্কুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে একজন গ্রামবাসী আনত হয়ে রাজকুমারকে নমস্কার করলো। তার ভঙ্গিটা এমন যেন সে কিছু বলতে চায়। রায়ত হলেও বিশিষ্ট হবে, গায়ে মেরজাই, পাকানো চাদর, পায়ে চীনা জুতা। রাজচন্দ্রর অনুমান হলো মানুষটিকে সে কোথাও দেখেছে। রাজচন্দ্র লাগাম টানলো, পালকি এসে পার হয়ে গেলো। হাতিটাও ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে কাছে এসে পড়লো। লোকটি তাড়াতাড়ি পথের ধারে একটা পাত ঝরান্যাড়া-জিওল গাছের নিচে সরে দাঁড়ালো। সেই গাছ আর সে যেন সমান বিষণ্ণ।

রাজু বললো–কিছু বলবে?

আজ্ঞে? লোকটি যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলো, যেন রাজকুমারকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে চেষ্টা করলো। তাই কি এই যে রাজকুমার নিজের বুদ্ধিতে চলার মতো বড় হয়েছেন কিনা?

রাজু জিজ্ঞাসা করলো–তোমার নাম কী?

-আমি চরণ দাস। গ্রামের পোস্টামাস্টার। আমি–আমরা খুব বিপন্ন।

–বিপন্ন? কেন? তুমি কি এ বিষয়ে নায়েবমশায়কে বলেছো?

তিনি জানেন, নতুন করে তাঁকে বলা হয়নি।

চরণ দাস দ্বিধা করতে লাগলো। ভাবলো, কেনই বা হঠাৎ শুরু করলো এই আলাপ? ডানকানের ব্যাপারে কী-বা করবেন রাজকুমার? ডানকান অঘ্রাণের ধান কাটার আগে যে ঢিলে মরসুম সেই সুযোগে টাকা বিলোচ্ছে মরেলগঞ্জের বাইরে এসে, তাতে রাজকুমারের কী করার থাকবে?

রাজচন্দ্রর মনে হলো এমন হতে পারে খাজনার গোলমাল করে লোকটি বিপন্ন। সে বলতে গেলে, তুমি তোমার অসুবিধা জানিয়ে রানীমার কাছেও দরখাস্ত করতে পারো।

চরণ দাস ভাবলো, কাজটা ভুলই হয়েছে। সেদিনের লাঞ্চে রাজকুমার ছিলেন না, আর সেদিন রাজবাড়ি থেকে ডানকানের সড়ক কেটে দেওয়া হয়েছে মনে মনে এ দুটোকে যোগ করে রাজকুমারকে কিছু বলতে যাওয়ার কোনো যুক্তি নেই। সে তো জানেই রাজবাড়ির খাজনা দেওয়ার জন্যও কেউ টাকা ধার করে, আর মনোহর সিং সেই সুযোগও নিয়ে থাকে দাদন দিতে।

রাজকুমার লাগাম ঢিল দিয়ে ঘোড়ার পিঠে তা দিয়ে মৃদু আঘাত করলো। ঘোড়াটা চলতে শুরু করলো। কিন্তু দুপা যেতে না যেতে সে লাগাম টানলো, জিনের উপরেই ফিরে পিছনে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলোরোসো, তুমি সেই চরণ নয় যে পোস্টমাস্টার গোবরা অর্থাৎ গোবর্ধনের বন্ধু ছিলে?

চরণ এক পা এগিয়ে সমর্থন করলো।

রাজচন্দ্রর মুখটা গম্ভীর হলো, বললো–আচ্ছা চরণ, জন্মোৎসবের পরপরই তুমি রাজবাড়িতে যেয়ো। যে কোনো সন্ধ্যাতেই আমাকে সেখানে পাবে।

জুলুসটা থাকার কথা নয়, ফরাসডাঙায় ঢুকবার মুখেই কুতঘাটের পথ, তা পেতেই রূপচাঁদ তার হাতি ও বরকন্দাজদের নিয়ে চলে গেলো। পিয়েত্রোর হাওয়াঘরের ভিতেই তো মন্দির, তা তখনো এক রশি। নয়নতারা পালকি থামিয়ে নামলো, রাজচন্দ্রকে বললো– রাজকুমার, ঘোড়াটাকে বরকন্দাজকে ধরতে দিলে হয় না? রাজচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলো নয়নতারা এত দূরে নামলো কেন? নয়নতারা বললো–প্রাণ আছে না? তার কথাও আছে?

কাহার বরকন্দাজদের কবল থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে হাসতে হাসতে মন্দিরের কাছে পৌঁছলো তারা। এ কখনো ঠিক নয়, রাজকুমার তেমন সন্দেহ প্রকাশ করলেও, যে। নয়নতারা তত্ত্বাবধানে আসেনি বলে মিস্ত্রিরা কাজে ঢিল দিয়েছে। মন্দিরটা শেষ হয়নি, ইতিমধ্যে তার মাথা যেন মেঘে। যাকে মন্দিরের শিখর বলা হবে, নিচ থেকে আন্দাজ হয়, তার কাছে কাজ হচ্ছে। চত্বরের নিচে অর্থাৎ পিয়েত্রোর সেই হাওয়াঘরের ভিতের গোড়া থেকে মিস্ত্রিদের পুতুলের মতো ছোটো দেখাচ্ছে। তাদের ডান দিকে নদী, পাড়টা বাঁধানো, মনে হচ্ছে আকাশটা বাঁধের ওদিকটায় নেমে পড়েছে।

কেট এই বিরাটত্বের বিস্ময়টা প্রকাশ করে ফেললো।

উজ্জ্বল মুখে নয়নতারা বললো–এসো এস, আজ আমরা মন্দিরটাকে ভালো করো দেখবো চলল।

কেট বললো–আমিও আসবো?

চত্বরের সিঁড়ির দুএক ধাপইতিমধ্যে উঠেছেনয়নতারা। বললো–ডানকানরা উঠেছিলো ভেবে দেখো।

উঠে পড়ো। তাছাড়া তোমাকেই বরং সাবধানে চলতে হয়। তোমার চাপার কলি আঙুলগুলো দেখে না ফেলেন। চার-চারটি থাকতেও উনি এমনকী কুচনী পেলে ছাড়েন না।

ক্যাথরিন কিছু সঙ্কুচিত হলো। এইসব মিথোলজি!মনে মনে এই বলে সময়ের উপযুক্ত কথা খুঁজে বললো–উনি কি তা হলে কুলীন হলেন?

নয়নতারা বললো–কাপও হতে পারেন। একজন মাথায় চড়ে, বকবকানিতে কান ঝালাপালা, একজন বুকে গলায় জড়িয়ে থেকেও ফোঁসফোঁস করছে, কাউকে ঠাণ্ডা রাখতে তার পায়ে লুটোচ্ছেন, একজন তো শরীরের আধখানাই জুড়ে আছেন। এসো এসো,স্ত্রীলোক হলেই হলো, ওঁর আবার জাতি কী!

দ্রষ্টব্য বিষয় যদি আকারে প্রকারে বিপুল হয়, তবে তার পাশে একাদড়ানো আর অনেক মানুষের ভিড়ে দাঁড়ানো এক নয়। মন্দিরের কাঁধে উঠে শিখরের গোড়ায় ইট গাঁথা চলেছে এখনো, নিচেও, বলা যায় মন্দিরের কোমরের কাছে হচ্ছে আন্তরের। ইট গাঁথবার সময় খাঁজ রেখে গিয়েছে, এখন মশালের সাহায্যে টালি বসানো হচ্ছে। নিচে তো সেজন্য একটা টালির কারখানা বসেছে। কাঁচামাটির তাল কাঠের ছাঁচে চেপে টালি করে তা রোদে শুকোচ্ছে। ওদিকে পোয়াল ধোঁয়াচ্ছে। সেখানে টালিগুলো পুড়ে লাল হয়। টালিগুলো এক মাপের নয়। বড়ো বড়ো গুলোতে একটা একটা পুরো দৃশ্য–বেলতলায় তপস্বী, অন্নপাত্র হাতে সীমন্তিনী, পাশাপাশি বসালে এক পৌরাণিক গল্প হবে। ছোটোগুলোর কোনটিতে একটি হাতি আর মাহুত, কোথাও একটা ধুমসোককুদ ষাঁড়। সে রকম একসারি টালি চার দেয়াল ঘুরে বসানো শেষ হওয়ায় মনে হচ্ছে তা এক শোভাযাত্রার দৃশ্য। হাতি ঘোড়া মানুষ, শিং-এর কারুকার্য ষাঁড়, রামশিঙা নিয়ে পাগড়িবাঁধা মানুষ, ঢোল নিয়ে তেমন মানুষ।

কেট বললো–এদের আকৃতিতে কিন্তু নতুনত্ব আছে।

নয়নতারা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো, বললো–যেমন চোখে দেখি তেমন নয়, তাই। বলছো না?

কেট বললো–মনে হচ্ছে না যে হাতিটা যেমন অসাধারণ ঘোড়াটাও ঠিক তাই? বেশিও নয়, কমও নয়।

রাজচন্দ্র বললো–অর্থাৎ সবই সমান অবস্তু।

নয়নতারা কিন্তু ওদের রাজ্যের হিসাব মানি, যদি সকলেই মানানসই। রামশিঙাটা মানুষের সমান কারণ তা বাজছে; ঘোড়াটা খুব কায়দা করে গলা বেঁকিয়েছে, সেজন্যই গলায় অত অলঙ্কার; হাতিটা পিঠের সওয়ারের জন্য খুব দাম্ভিক, সেজন্য চোখ অত বড়ো আর কানের দুপাশে বাঁধা ঝুমকি ঝুলে মাটি ছুঁয়েছে। এমন সুন্দর হয় না।

হঠাৎ কেট হেসে বললো–এদিকে দেখুন তবে।

-আ রে, এ যে দেখছি আমাদের বন্ধু, একেবারে টুপিসমেত। খিলখিল করে হাসলো নয়নতারা।

রাজু বললো–তা আমার একটা তুলনা মনে আসছে। এসবই যেন আমাদের কেটের মুখের বাংলা। ঠিক স্পষ্ট নয় উচ্চারণ, ঠিক আমাদের মতো ব্যাকরণ নয়, কিন্তু মিষ্টি শব্দ শুনে তার উৎস লাল ঠোঁটদুটিকে দেখতে হয়, যেন তা লোভনীয় ফুলের মতো ফুটে ফুটে উঠছে।

কেটের মুখ লাল হয়ে উঠলো, নয়নতারা ঝিকিমিকি হেসে বললো–ধন্যবাদ, এজন্যই তো রাজকুমার।

টালির গায়ে হাতির পিঠে শিকারীর ছবি, হাওদায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে সে বাঘ শিকার করছে। বাঘটি চেহারায় দুর্গার সিংহ, আকারে হাতির অর্ধেক অন্তত। রাজু নিজের সেই সম্ভাব্য ব্যঞ্জনায় হা হা করে হেসে উঠলো। কিন্তু পরে বললো, ছবি হিসাবে বেমানান হলো, ওই রামশিঙা আর ককুদ্বান বৃষের পাশে বন্দুক-টুপিধারী শিকারী মানায় না।

-কেন? বললো– নয়নতারা। এই বলে সে একটু ভেবে নিয়ে বললো, আকবর বাদশার সময়ে কি রামশিঙা বাজতোনা? কিংবা তখন কি বলদের শিঙে সোনারূপার গহনা দেওয়া হতো না, অথবা ঘোড়ার পিঠে সোনারূপার কাজ করা মাটি ছোঁয়া কিংখাবের জামা?

হয়তো,হয়তো।

–আকবর বাদশার সময়ে, শুনেছি কিংবা রানীমার ঘরে তসবীরে দেখে থাকবো, বন্দুকে গাধা কিংবা সিংহ শিকারের ব্যবস্থা ছিলো। এখানেও বন্দুকের গায়ে কত কারুকাজ। তেমন বন্দুকই।

–তাহলে, কেট বললো, বন্দুক সত্ত্বেও এই শোভাযাত্রা দু-তিনশো বছরের পুরনো?

–অর্থাৎ আমাকে, রাজু বললো, তুমি আকবর বাদশাহের সময় থেকে উঠে আসা একজন মনে করো? হা ঈশ্বর!

নয়নতারা বললো–হলোই বা, কী লোকসান তাতে? কিন্তু দেখুন এদিকে, টালিগুলোর উপর-পাড় বরাবর নক্সাটা যেন আধখানা বাঁশের। আস্ত বাঁশকে লম্বায় চিরলে যেমন হয়। রোসো হয়েছে। তাহলে উপরের টালির থাকের নিচ-পাড়ে বাঁশের বাকি আধখানা পাওয়া যাবে।

রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো–তাতে কি হবে? বাঁশ কি এমন দুপ্রাপ্য বিষয়?

-তখন, আমার মনে হচ্ছে, নয়নতারা ভাবতে ভাবতে বললো, এই শোভাযাত্রার দৃশ্যগুলোর উপর দিয়ে গোটা মন্দিরটা ঘিরে একটা বাঁশগিরে রুলির নক্সা ফুটবে।

না কেট,না রাজু বাঙালিনীর অতি প্রিয় এই রুলি-অলঙ্কার সম্বন্ধে কল্পনা উদ্দীপ্ত হওয়ার কিছু পেলো না। কিন্তু নয়নতারার সুন্দরের দৃষ্টিতে যেন স্বপ্নের ঘোর লাগলো। ভাবলো সে, কোনো এক রমণীর বলয়ের ঘেরের মধ্যে মন্দির? নিজের দুখানা বাহুতে ঘেরা কিংবা হৃদয় দিয়ে ঢাকা, ছবিতে এমন ফুটানো যায় না বলেই যেন নিজের বলয় দিয়ে ঘেরা। কিন্তু কার বলয়?

ততক্ষণে কেট ও রাজকুমার এগিয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি চলে তাদের পাশে গিয়ে। নয়নতারা বললো, রাজকুমার কি এখনো আকবর বাদশার যুগের কথা ভাবছেন?

-কই না।

কথাটা বোধ হয় নয়নতারার নিজের চিন্তাকে টাঙিয়ে দেবার খিল। সে হেসে বললো, অন্যভাবেও এটাকে দেখা যায়, রাজকুমার। মন্দিরটা মহাকালের তত। তার চোখে শিঙে সোনার-টোপর-পরা বলদ, কিংখাবের জামা-পরা ঘোড়ার সেকাল আর কারো বন্দুক দাগা সোলার টুপি-পরা আধুনিকতায় সময়ের এমন তফাত নেই যে এক শোভাযাত্রায় মানায় না।

–অর্থাৎ এই সব আধুনিকতা প্রাচীন থেকে এমন কিছু পৃথক নয়? এ তো দারুণ কথা!

রাজু এক সমস্যার অভিনয় করলো।

ন্যাতারা গলা নিচু করে বললো–লোকগুলি কাছে থেকে আমাদের আলাপ শুনতে চাইছে, ভয়ে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। কাহাতক আর কষ্ট দেবেন? ডেকে কথা বলুন। দরকারের কথাও আছে।

রাজু শোনো মিস্ত্রি বলে ডাকতেই যে এগিয়ে এলো সে প্রবীণ, বোধ হয় নিজের হাতে এখন কাজ করে না আর। নয়নতারার ইঙ্গিতে রাজু তাকে জিজ্ঞাসা করলোতোর্মাদের সব কাজ শেষ হতে আর কতদিন লাগতে পারে?

সে-ই প্রধান মিস্ত্রি, বললো–এখন তো কাজ ভালোই চলেছে–হুঁজুর, শীতের বাদলে যদি দকে না যাই, বর্ষার মুখে কাজ শেষ করে, বড়োপূজার আগে রঙের কাজ ধরবো। ততদিনে নাটমন্দিরে খিলান গাঁথা শেষ হবে।

রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো, আরো ন-দশ মাস তো বটেই। বর্ষায় কাজ অনেকদিন বন্ধ থাকলে এক বছরও হতে পারে। দ্যাখো, মুশকিল!

শেষ কথাটা লঘু স্বরে নয়নতারাকে বলা।

নয়নতারা বললো–তাহলে এবার শিবচতুর্দশীতে কি পূজা হবে না?

–হুজুরাইন, চেষ্টাই হচ্ছে যাতে হয়। সেজন্য উপরের ছাতিতে দেখুন, সব লোক লেগেছে। এখন একমাস ওই কাজ। পদ্মটা বসিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্দি, তখন ভিতরে পূজা, বাইরে কাঁধত টালি বসানো চলবে। শিবের মাথায় দাঁড়াতে সাহস নেই যে আজ্ঞা।

নয়নতারা উপরে চাইলো। দড়ির জালে আটকানো অনেকগুলো শাখামৃগ যেন। প্রকৃতপক্ষে বাঁশের ভারা বেঁধে মিস্ত্রিরা কাজ করছে।

এই কথাই বলে মিস্ত্রিকে বিদায় দিলো নয়নতারা। তারা তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলো। কিছুদূরে যেখানে কুমোরেরা টালি গড়ছে সেখানে যেতে চাইলো কেট।

হো হো করে রাজু হাসলোদেখলে, হুজুরাইনকে ঠিক চিনেছে।

ঠিক এরকম সময়ে মনে হলোনয়নতারার, রানীমা জানতে চেয়েছিলেন মন্দিরটা কেমন দেখায় তার চোখে। এখন তো আকারটা স্পষ্টই হয়ে উঠছে। বাইরের দেয়ালটা যতদূর মানায় টালির কারুকার্যে অপূর্ব রকমে সুন্দর দেখাবে; চত্বরসমেত রথটার বিরাট আকারও দ্যাখো; যেন সৌন্দর্যে গাম্ভীর্যে সংযুক্ত। নয়নতারার মনে হলো, রানীমার এরকম নির্দেশের অর্থ কি এই হতে পারে যে তিনি নিতান্ত উৎসুক মন্দির সম্বন্ধে? আর তা স্বাভাবিকও। সেই রক্তচন্দনের পাত্রে যা ছিলো তা বুকের রক্ত, বুকটা অনেকখানি চিরে না দিলে ফেঁটায় ফোঁটায় অতটা রক্ত জমে না। অন্যদিকে চলো দেখে আসি, বলে সে ভাবলো, তবে কি মন্দির শেষ হওয়ার আগে দেখতে আসাটা লঘুতা হবে বোধ করছেন? কৌতুকের এই দোটানা? একটুপরেই নয়নতারা অনুভব করলো, এমনটাই রানীদের মানায়।

টালিকারখানার কৌতূহল মিটলে তারা চকচকে মুখে ঘুরে দাঁড়ালো আর তখন আবার তারা অন্যকিছুতে আকৃষ্ট হলো। বাঁধের নিচে নদীর খাত। আকাশরেখা বাঁধের কাঁধে। সেই আকাশে ইতিমধ্যে রং জমতে শুরু করেছে। যথেষ্ট আলো, কিন্তু তা যেন রঙিন। তারা পায়ে পায়ে বাঁধের দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু ততদূরে যাওয়ার আগে চত্বরে উঠবার সিঁড়ির একটা অংশ কমলা-আলোয় রঙানো মনে হলো।

আমরা কি এখানে বসবো? –এই বলে রাজচন্দ্র সেই সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। নিজেই বসলো। বললো–তোমরা? কিংবা সে আমার ভাবনা নয়। অনুমতি করো, পাইপ ধরাই।

কেট বললো–ধুলো নয়?

রাজু বললো–যথেষ্ট, এবং শুকনো পাতাও কয়েকটি। সে নিচের সিঁড়িতে বসে উপরেরটিতে, যেন আরাম কেদারায় হেলান দিয়ে বসে, পাউচ পাইপ বার করলো।

রাজু-আবার কী দৃশ্য পেলে?

কেট বলতে গিয়ে কম বললেন।

রাজু-কী? সে প্রথমে একটু অবাক, পরক্ষণেই সে নিজেই তাদের আলোচনার বিষয় বুঝে হো হো করে হেসে উঠলো। কী যেন কেট, বাগচী তোমার কথায় হেসে বলেছিলো? কাপিটাল! কিংবা—রোসো, আলো থেকে সরে বসি, রোদটা লাগছে বটে।

কিন্তু নয়নতারাই নিজের কথায় লজ্জা পেয়ে সরে গেলো, বললো–রাজকুমার, এখনো রাজকার্য বাকি। শিবপূজায় যথেষ্ট জল লাগে। তার তো ব্যবস্থা দেখছি না।

নদীর ধারেই আকণ্ঠ তৃষ্ণা! বসো, উজিরাইন, খোঁজখবর নিই।

রাজু পাইপে তামাক ভরে উঠে দাঁড়ালো। দূরে দাঁড়ানো বেহারাদের দিকে হাত তুলে ইশারা করলো। বরকন্দাজ দৌড়ে এলে, সে তাকে পুরোহিত-ঠাকুরকে ডেকে দিতে বললো।

লোকটি চলে যেতেই নয়নতারার দিকে ফিরে বললো–কেমন ব্যবস্থা হলো,উজিরাইন! তুমি অন্তত, কেট, পাশে বসে রাজকুমারের বুদ্ধির মূল্য দাও।

হেসে নয়নতারা রাজচন্দ্রের পাশে বসলো, কেটকে বসালো মাঝখানে। সিঁড়িটা যথেষ্ট চওড়া, ঘেঁষাঘেঁষি হলো না।

নদীর এত কাছে কিছুক্ষণ পরেই আকাশে যে রং বদলের খেলা শুরু হবে এখন যেন তার মহড়া হচ্ছে। আলো কমছে, বাড়ছে। এখানে সব শান্তনয়, নতুবা সিঁড়িতে এত শুকনো পাতা কী করে আসবে? তেমন একটা হাওয়া হালকা-ধুলোর ঝাপটা দিয়ে গেলো। রাজচন্দ্র হেসে, মুখের পাইপ সরিয়ে, রুমালে নাক-মুখ মুছলো।

নয়নতারা হাসলো ধুলোর দুষ্টুমিতে। কিন্তু ভাবলো, এই পাইপেতামাকটা নতুন, যেমন নতুন এই দাড়ি। এটা ভারি মজার যেন যে রাজু পাইপ টানছে! কী আছে ওতে? অর্থাৎ রাজকুমার এখন পুরুষ। তার যেন এক বিস্ময় লাগলো, পাইপ-পাউচ আর তার পাশে রাখা বিলেতি দেশলাই-পাতা দেখে।

একটা সুন্দর কবোষ্ণ অনুভূতির অবসর। নয়নতারার কর্তব্য, অন্তত যা তাকে এনেছে, সে তো প্রায় সমাধাই হয়েছে। ঝরঝরে আলোর দিন। আর রঙিন আলোটা তো থেকে থেকে এখন তিনজনের গায়েই যেন পড়ছে। নয়নতারা কেটের ডান হাতখানা নিজের হাতে তুলে নিয়ে অন্যমনস্কের মতো তার আঙুল নিয়ে খেলতে খেলতে সামনের দিকে চেয়ে ছিলো। সামনে তো কয়েকটা ছোটো ঝোপ ছাড়া অবারিত ঘাসে ঢাকা একটা মাঠই, যার প্রান্তে একটামাত্র গাছ। গাছটা বিলিতি।

ফুট তিনেক উপর থেকে কাণ্ডটা যেন দুভাগে দুটো গাছ হয়ে আবার কয়েক ফুট উপরে এক হওয়ার চেষ্টা করছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতেইনয়নতারা দেখলো, একটা ছোট্ট ঘূর্ণি বাতাস একটা খরগোস বা কোনো বড়ো পাখির মতো মাটির উপরে ছুটোছুটি করছে। সেটা একবার পাতাটাতা ঘুরিয়ে পাঁচ-ছ আঙুল ব্যাসের শুড়ের চেহারা নিয়ে উপরে উঠলো। তাদের দিকে এগিয়ে আসতে মুখ থুবড়ে পড়লো।

আর তখন মনে হলোনয়নতারার, আশ্চর্য, এটাই কি সেই গাছ যাতে পিয়েত্রোর ছোটো হাতিটা বাঁধা ছিলো। হাতিটাও কেন যেন চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো। তাই বলে এটা কখনো কি সত্য হতে পারে, সেই মূক প্রাণী বুঝেছিলো সেই বাদলের সন্ধ্যায় পিয়েত্রোর মরদেহ ঘিরে তখন তার চাকর বাবুর্চিরা হাহাকার করছে। সে নিজে বাংলোর বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলো রাজুর অপেক্ষায়। রানীমা আগেই নিঃশব্দে চলে গিয়েছিলেন।

ঘূর্ণিটা এবার যেন ফণা তুলে নাচতে নাচতে এগিয়ে এসে তাদের পায়ের কাছাকাছি ভাঙলো। কয়েকটা পাতা সরসর শব্দ করলো। নয়নতারা মাঠটার দিকে চেয়ে চেয়ে হাসিমুখে বললো–আচ্ছা, কেট, তুমি কখনো দাবা খেলেছো, ঘোড়ায় চড়েছো?

রাজচন্দ্র বললো–কেন, কেট, দাবা তো তোমাদের দেশেও আছে। বাগচী তার প্রমাণ। আমাকে মাঝে মাঝে মাৎ করেন।

কেট হেসে বললো, কিন্তু আমি তো পাদরির মেয়ে, পাদরির স্ত্রী।

রাজচন্দ্র বললো–আর আমি তোমার কাছে শুনেছি তোমার ঘোড়া ছিলো। এমনকী তোমাদের সেই সেন্ট্রাল প্রভিন্সের মিশন হাউসেসহিসের ছেলেই তোমারবাল্যপ্রেমিক ছিলো।

কিন্তু নয়নতারার মনে যে-গল্পটা আসছিলো তা যতই ঝকঝকে, রঙিন, আলোকোজ্জ্বল হোক, তা কাছে এলেই শঙ্কার চেহারা নিলো। তার অনুমান হচ্ছিলো, এই মাঠেই হয়তো বরকন্দাজদের নিয়ে রাজকুমার আর বুজরুক শতরঞ্জ খেলেছিলো, সে শতরঞ্জের চাল দিতে নাকি মাঠের চারদিকে ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে হয়েছিলো তাদের। আর, রাজবাড়ির আর পিয়েত্রোর বরকন্দাজেরা ছিলো খুঁটি। কারণ সে খেলা তো ছিলো প্রকৃতপক্ষে তরোয়াল নিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা ও আত্মরক্ষার কৌশল অভ্যাস করা। সেই গল্প বলেছিলো রাজু নয়নকে, আর তা শুনে নয়নতারা তারও ঘোড়া চড়া দরকার হতে পারে এরকম বলে হাসাহাসি করেছিলো। কিন্তু শঙ্কারই তো বিষয়। সেই বরকন্দাজরা বুজরুকের সঙ্গে সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলো, খুব কমই ফিরেছে। এই গল্প উঠলে রাজু যদি এখন সেসব কথা কেটের সামনে বলে? নয়নতারার মুখ আশঙ্কায় বিবর্ণ হলো। কীকরে গল্পটা ঢেকে অন্যদিকে আলাপ নেয় এখন?

কেট রাজুর কথার উত্তর না-দেওয়ায় নয়নতারার ঘোড়া আর দাবার গল্প থিতিয়ে গেলো।

রাজচন্দ্র ভাবলো, সময় নিয়েই কিন্তু আজ অনেকবার কথা হয়েছে। সেই আকবর বাদশাহের যুগের কথা। খুব বলেছে কথাটা নয়নতারা, ওখানে ওই মন্দিরে একাল থেকে ওকালের তফাত এক আঙুলও নয়। কিন্তু, সে মনে মনে হাসলো, এখানে এই চত্বরের সিঁড়িতে? যেন সে বর্তমানে ফিরতে যত্ন নিলো। হেসে বললো–বাবা, কী সুন্দর! তোমাদের দুজনের এমন করে বসা!

দুজনেই একসঙ্গে চোখ তুলেছিলো। এরকম প্রশংসা শুনে একসঙ্গেই চোখ নামালো তারা।

রাজচন্দ্র জিজ্ঞাসা করলোহা, কেট, তোমাদের দেশে কালো চুল, কালো চোখ কি হতে নেই? তাতে কি তোমাদের পুরুষরা বশ থাকে না? তারা কি শুধু মণিমাণিক আর সোনাই খোঁজে? যেজন্য তোমার চোখ দুটিকে গোমেদ আর চুলকে সোনা করতে হয়েছে?

প্রশংসা বিরত কেট কিছু বলার আগেই বরকন্দাজ ফিরে এলো। জানালো-পুরোহিত নদীতে স্নান করতে গিয়েছে।

আচ্ছা যাও, বলে তাকে বিদায় দিয়ে রাজচন্দ্র বললো–এখন তাহলে অপেক্ষা করতে হবে?

নয়নতারা বললো–তা কেন? পূজার্থিনীরাও যদি নদীতেই স্নান করতে চায়? চলুন আমরা নদীটাকেও দেখে আসি। বাঁধ থেকে কী করে নদীতে নামা যায় বুঝতে হবে না?

কিন্তু, সে ভাবলো, এখন তোমার কেট আর হৈমীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তাই বলে। তাদের কাছেপিয়েত্রো বুজরুকের সঙ্গে কাটানো সময়ের কথা বলা ভালো হয় না। কথাগুলো ছড়ালে অনেকেই বিপন্ন হয়ে উঠতে পারে।

তার সিঁথির নিচে কপালটাকে ম্লান দেখালো।

তারা একেবারে বাঁধের কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালো। এই বাঁধ ফরাসীরা করে থাকবে। নদীর খাত থেকে দশ-পনেরো হাত ইট দিয়ে গেঁথে তোলা নদীর খাতে দাঁড়ালে মনে হবে কেল্লার প্রাচীর। কোনো কোনো জায়গায় এমন খাড়া, উপর থেকে দেখতে গেলে গা শিরশির করে। কিন্তু নদী?

নয়নতারা ভাবলো, তখন কিন্তু নদী বাঁধ বরাবর চলতো। নয়তো হাওয়াঘরে দাঁড়িয়ে সুলুপের পালে রাজকুমার বন্দুকের নিশানা করতে পারতো না। এখন বাঁধের নিচে বালুচর। আর বালুচর কেমন যেন দুঃখের মতো ব্যাপার। বালিই কিংবা পলি গুড়ো হলে যেমন হয় সাদা মিহি-মাটি। জলে ভেসে আসা বালিতে অর্ধেক পোঁতা একটা গাছের কঙ্কাল।

সে নিজের মন থেকে সরতে গেলে তার চোখ দুটি চঞ্চল হলো। সে বললো, রাজকুমার, আপনাদের দেশের পুরুষরা বুঝি শুধু অসীমকে খোঁজে, তাই কালো চোখের মণি, কালো চুল।

রাজচন্দ্র বললো–ও, সেই কথা। এ বিষয়ে আমি একটা গল্প বলতে পারি। কেটের দেশেও কালো চুলের কালো মণির মানুষ আছে। প্রমাণ বাগচীমশাই। তবে এরকম কুংসস্কারও আছে, আবার বাগচীই প্রমাণ, পুরুষরা তাদের সংস্পর্শে এলে ফল ভালো হয় না। আর সভ্য দেশে থেকেও তারা নাকি অসভ্য। চাকা লাগানো বাড়িতে কিংবা ছোটো ছোটো গাড়িকে বাড়ি করে বাস করে। তাতে ঘোড়া লাগিয়েই এক জায়গা থেকে অন্যত্র চলে যায়। কী যেন নাম কেট?

কেট জিজ্ঞাসা করলো–আপনি জিপসি মেয়েদের কথা মনে করছেন? ভালোনয় কিন্তু।

খুব গরম বুঝি? রাজু হাসলো। বললো–কিন্তু জাতিটার কথাই মনে করো। বললো– সে, জানো নয়ন, তাদের নিজস্ব নানা বিদ্যা আছে নাকি, পূর্বপুরুষ থেকে মুখে মুখে শোনা অলিখিত নীতিগুচ্ছ আছে। সারা ইউরোপে তারা হাজার বছর থেকে বাস করছে, কিন্তু কিছুতেই ইউরোপীয়দের সঙ্গে মিশে যায়নি। এমনকী ভাষা–যে ভাষায় তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে, তা না ইংরেজি, না ফরাসি, ইউরোপীয়ই নাকি নয়।

নয়নতারা বললো–তারা কি আমাদের দেশের বেদের মতো?

রাজু বললো, কিন্তু তাদের সম্বন্ধে এই এক গল্প আছে, হাজার বছর ধরে তারা পথ হাঁটছে। তাদের ভাষাই প্রমাণ তারা একসময়ে ভারতবর্ষে ছিলো। কিন্তু হাজার বছর হেঁটেও ভারতবর্ষে ফিরতে পারছে না আর। বরং আরো দূরেই চলে যাচ্ছে। বোধ হয় ফেরার। সময়টাকে হারিয়ে ফেলে আর তা খুঁজে পাচ্ছে না।

নয়নতারা গোপনে রাজুর মুখের দিকে তাকালো। যে কথা বলছে তার স্বর কোনো কোনো সময়ে যা সে বলছে তার থেকে পৃথক কিছু বলতে থাকে।

.

০৩.

কিন্তু নয়নতারা বললো, কতদূরে সরে গিয়েছে নদী! কোথায় বা নৌকা ভিড়বে, কী করেই বা স্নানে যাবে মানুষ, পুরোহিতই বা কোথায় গেলো? এই খাড়া বাঁধ, ফরাসীরাই বা জলের কী করতো?

রাজচন্দ্র বলল–এখন কুতঘাট অনেকটা উজানে। সেখানেনদীর পাড় চালু হয়ে নিশ্চয় জল ছোঁয়। গোরুর গাড়িগুলোকে যেতে হয় জলের ধারে। কিন্তু তাই বা কেন? ফরাসডাঙারই ঘাট আছে, যে পথে তোমার পুরোহিত স্নানে গিয়েছে নিশ্চয়।

ডানদিকে খানিকটা চলে তারা বাঁধের গায়ে গড়ে তোলা ঘাট পেলো। এত চওড়া এত সিঁড়ির সেই ঘাট অনেক খরচে তৈরী হয়ে থাকবে। এখন তো ভাঙাই, মাঝে দু-এক ধাপ সিঁড়িও উধাও। ফাটলে ঘাস জন্মেছে।

-তোমরা নামবে কি? কী করে তা পারবে? রসসা, হাত ধরো। শুধু রোদ আর আলো নয় ধুলোও কিন্তু। প্রথম কেটকে, পরে নয়নতারাকে হাত ধরে নামতে সাহায্য করলো রাজচন্দ্র। সে বললো, আমরা কি নদীর জল পর্যন্তই যাবো? তাহলে কিন্তু চরের সীমা বলে যা মনে হচ্ছে ওই ঘাসবন পর্যন্ত যেতে হবে। অনেকটা দূরই। নয়নতারা বললো–আধঘণ্টায় ফেরা যাবে না? তাহলে চলুন, ভালো লাগছে না কেট?

কেট বললো, এখন আর অসুবিধা কি বালিটা সমতলই তো।

খানিকটা দূরে গিয়ে সম্ভবত বাঁধটাকে দেখতে ইচ্ছা হলো, নয়নতারা ফিরে দাঁড়ালো। প্রকাণ্ড নিরেট ইটগাঁথা বাঁধ। নয়নতারা বললো–দেখুন, রাজকুমার, দেখুন। ওদিকে কেমন ফাটল লেগেছে বাঁধে।

তা বটে। শুধু ফাটলই নয়, সেখানে বাঁধটার গোড়ায় একটা সুড়ঙ্গ, যেন কোনো বন্যজন্তু গুহা তৈরী করেছে।

রাজচন্দ্র বললো–তুমি কি বলবে শেয়াল গর্ত করেছে? নাও হতে পারে।

যেখানে তারা দাঁড়িয়েছিলো তার বাঁদিকে খানিকটা দূর পর্যন্ত চরটা বালিআড়ির মতো উঁচু হয়ে উঠেছে। তার ওদিকের ঢালুটার গায়ে যেন সবুজের ভাব। বালিআড়ির গায়েও এখানে চরঝাউ। সবুজের ভাবটা প্রমাণ করে, জল কাছেই হবে সেদিকে। অন্যদিকে তাদের পিছনেই বাঁধানো পাড়ের বড়ো ফাটলটা যেন তখন দূর থেকে গুহার মতো দেখাচ্ছে।

কিন্তু পতপত করে শব্দ হলো। বালিআড়ির ওপাশ থেকেই যেন আকাশে উঠে পড়েছে শব্দটা। কেট উত্তেজিত হয়ে বললো–হাঁস, হাঁস।

হাঁস হলে তা বেশ বড় আর রঙিন। দুটো ডানাই চঞ্চল, কিন্তু ঠোঁট গলা যেন তখন মাটির দিকে ঝুঁকে।

বুনো হাঁস? নয়নতারাও জিজ্ঞাসা করলো।

রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো, কী বলল তো, সার্বভৌমপাড়ার মেয়ে? এই কিন্তু সেই চক্রবাক বধূ আমন্ত্রয়স্ব ইত্যাদি। কেট, ফর ইনফরমেশন, একে চকা বলে। দ্যাখো, ঠিক একজোড়া।

কিন্তু তাদের বালিআড়ির সবটা উঠতে হলো না। তারা ওপার থেকে একজন মানুষকে আসতে দেখলো। খালি গায়ে, কাঁধে ভিজেকাপড়, হাতে ঘড়ার মতো বড়ো পিতলের কমণ্ডলু। পূজারী ছাড়া এখানে আর তেমন কে হবে?

নয়নতারা বললো– রাজকুমার, এ যদি পূজারী হয় তবে পূজার খবর, স্নানের খবর এর চাইতে আর কে ভালো বলবে? আমাদের আর এগিয়ে কী হবে? কী বলল, কেট?

পূজারীই লম্বা লম্বা পায়ে তাদের কাছে এসে পড়লো। নয়নতারা তাকে জানালো, রাজবাড়ি থেকে তারা শিবমন্দিরের খোঁজ খবর নিতে এসেছিলো। পূজারী বোধহয় স্বল্পভাষী এবং নমস্কার করে না। একবারমাত্র তিনজনকে দেখে নিয়ে মৃদু হেসে পথ চলতে লাগলো। রাজু বললো–চলো, আমরাও ফিরি। বাঁধের সেই ফাটলটা কিন্তু আমাদের পথের দিশারী। নাকি পূজারীর পিছন পিছন চলবে। অন্তত কোথায় স্নান হবে তা তোমার জানা হয়েছে।

তারা ফিরতে শুরু করলো।

কেট বললো– চলতে চলতে–আচ্ছা, রাজকুমার, সেই গর্তটা কি কাঁকড়ার হতে পারে? হাসছেন যে?

হাসছি? রাজচন্দ্র হাসিমুখেই বললো, এ কি হাসির কথা? দ্যাখো মন্দিরের অনেকটা দেখা যাচ্ছে আকাশ ছুঁড়ে যেন, আর এদিকে বাঁধে এত বড়ো ফাটল।

সামনে থেকে পূজারী বললো–অউর ভি হৈ।

পূজারীর এই অনুপ্রবেশ সামলে নিয়ে নয়নতারা নিচু গলায় বললো–শুনলেন?

আপনি কি বলছেন রাজকুমার, মন্দিরের বিপদ হতে পারে?

রাজনগর রাজচন্দ্র বললো–নদীর যদি ফেরার মতি হয়। এ বিষয়ে আপনার কী মত, ঠাকুরমশাই?

নয়নতারা চাপা গলায় আ বলে রাজচন্দ্রকে নিরস্ত করতে গেলোলা। কিন্তু তার আগেই পুরোহিত ভাঙা বাংলায় বললো–নাম যাই হোক, আসলে গঙ্গামাঈ। তো লোটাসে গঙ্গা চড়াই বুঢ়াকে। কখুন মাঈ-এর সওখ হোবে বুঢ়াকে আপন কোরে নিতে।

রাজচন্দ্রর মুখে চাপা হাসি, নয়নতারার গালে রক্তাভা।

কিন্তু বালিআড়ির আলগা ঢালুটায় বোধ হয় পূজারী সতর্ক ছিলো নিজের ভারি শরীরের জন্য। বালিআড়ির থেকে নামতে পেরে লম্বা লম্বা পায়ে পূজারী অনেকটা এগিয়ে গেলো।

রাজচন্দ্র বললো–নয়ন, লোকটি পূজারীবটে তো? গোঁফটা দেখেছো? কমণ্ডলুটা খালি থাকলেও তুমি তুলতে পারবে কি?

কেট বললো–লোকটি, আমি বাজি রাখতে পারি, পাহাড়ী, অন্তত পাহাড়ে ঘোরা অভ্যাস আছে।

তারা সেই ঘাটের কাছে এসেছিলো। পূজারী কয়েকটা লম্বা পা ফেলে উঠে গেলো। রাজচন্দ্র বললো–এবার?

নামার চাইতে ওঠাই আরো কঠিন। শুধু হাত ধরাতেই হলো না।

পারে উঠে রাজচন্দ্র বললো, এখন কিন্তু বেলা আর বেশি নেই। দ্যাখো, নদীর উপরে আকাশের ওদিকটা সোনালি রাংতার মতো।

নয়নতারা নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলো। যে-চাদরটা সারাক্ষণই ছিলো এখন আবার তা অবগুণ্ঠন হয়ে মুখের দুপাশকেই খানিকটা করে ঢেকে ফেলেছে।

রাজচন্দ্র হাসি হাসি মুখে বললো–তোমার পুরোহিত হয়তো আবাল্য সন্ন্যাসী, কিন্তু প্রেমের কথা বোঝে দ্যাখো! কিংবা রানীমার উজিরাইন কি এখনো বাঁধের ফাটল নিয়েই দুশ্চিন্তায়?

নয়নতারা বললো–নদীর গতি তো বদলায়ই। কুতঘাট সরে গিয়েছে সেটাও একটা প্রমাণ।

রাজচন্দ্র জোরে জোরে হাসলো। বললো, তাতেই বা তোমার ভাবনার কী? ফরাসীরা শক্ত করে বাঁধ দিয়েছিলো। রানীমা কি প্রয়োজনে আরো শক্ত করে বাঁধ দেবেন না?

.

০৪.

তারা মন্দিরের কাছে যেতে রাজুর ইশারায় পালকি এগিয়ে এলো। তখনো অন্ধকার হয়নি, কিন্তু আলো বাদামী হয়েছে। কেট ও নয়নতারা পালকিতে উঠলো, রাজচন্দ্র তার ঘোড়ায়। ততক্ষণে বরকন্দাজ মশাল জ্বালিয়ে নিয়েছে। বেহারারা পালকি নিয়ে চলেছে, কিন্তু ঘোড়ার শব্দ কানে না আসায় পালকির দরজায় মুখ বার করলো নয়নতারা। সে অবাক হলো। দেখলো, যেখানে তারা পালকিতে উঠেছিলো সেখানে বাদামী আলোতে কালো স্তব্ধ এক ঘোড়সওয়ার হয়ে রাজচন্দ্র : নড়ছে না। কিছু ভাবছে?

পালকি ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে। ছাদের কাছে ছোটো গোল কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরের মশালের আলো লাল ছোটো বৃত্তের মতো পড়ছে, লাফাচ্ছে। কখনো তা নয়নতারার সিঁথির উপর দিয়ে, কখনো কেটের মুখে, কখনও কোলের উপরে জড়ো করে রাখা তাদের হাতে। এরকমক্ষেত্রে মনও দুলে দুলে ওঠে, সরে সরে যায়। চিন্তার উৎস অনির্দেশ্য হয়ে পড়ে। কেট বললো– শীত এসে গেলো, এখন কিন্তু সোয়েটারকে বুনে তুলতে হয়। সে কি কল্পনায় সুন্দর সুঠাম এক পুরুষকে তার বৈঠকখানার দেখলো! অথবা মেলাই বৈঠকখানার আলাপের অভ্যাস!নয়নতারা যেন শুনতে পায়নি এমনভাবে চাইলো। শুনতে সে অবশ্যই পেয়েছিলো, মন সজাগ হতে একটু দেরি হলো। কেটকে দেখেই তার পরামর্শে গত শীতের গোড়ায় রাজকুমারের জন্য একটা সোয়েটার বুনতে শুরু করেছিলো। সেই বিলেতি উলের রং রাজকুমারকে নিশ্চয়ই মানাতো। তাছাড়া কি বিলেতি উল, কি উলবোনা তখন কলকাতাতেও চূড়ান্ত আধুনিকতা। একবছর থেকে তা আরম্ভ হয়েই পড়ে আছে।

নয়নতারা কল্পনায় কি এক খয়েরি অন্ধকারে গাঢ় খয়েরি এক ঘোড়সওয়ারকে দেখতে পেলো? কী চায়? কী খোঁজে? এখন কি আর মানায়? নয়নতারা বললো–বলতে গিয়ে যেন বিব্রত হয়ে হাসলো–দ্যাখো কাণ্ড! একেবারে মনে ছিলো না। তুমি কি বুনে দিতে পারো না, কেট?

পালকিটা হুমহাম করে চলতে লাগলো। নয়নতারা কেটের হাতে-মুখে যেন সেই আলোর বৃত্তগুলোর নাচন দেখছে। তখন অনুভব করলো, পার্থক্যটাই অভিপ্রেত। তাই নয় কি? কষ্ট বটে।

উলের কথায় নীরবতা কাটলো না দেখে অন্য গল্প ভেবে নিয়ে কেট বললো–পুরোহিত যে গঙ্গার ফিরে আসার কথা বলছিলেন, তা কি কোনো উপাখ্যান?

নয়নতারা হাসিমুখে বললো–ধারণাটা আছে, গল্প বানালেই হলো। এই বলে গঙ্গাকে শিবের স্ত্রীরূপে কল্পনা করা হয়, শিবের জটায় গঙ্গা নেমেছিলো, সেখানে ফাঁদে পড়েছিলো কিংবা প্রেমে–এমন সব গল্প করলো।

কেট বললো–এটা কি কোনো প্রাকৃতিক ঘটনার বিন্যাস? তাহলে শিক্ষিত মানুষেরা কেন পূজা করবে?

নয়নতারা হেসে বললো–এই দ্যাখো আমি নাকি শিরোমণিঠাকুর! আমরা বড়োজোর অনুভব করতে পারি। গঙ্গা চঞ্চলা, স্নিগ্ধা, প্রমত্তা,কী যেন এক অদ্ভুত প্রবাহ! প্রাণের বলবে? কিংবা প্রবহমান কালের ছায়া? অন্যদিকে জানো কেট, শিবের নাম মহাকাল–যার শেষ নেই, প্রথম নেই, খণ্ড হয় না। এরকম ব্যক্তিত্বে স্নেহ থাকতে পারে? কিন্তু মনে হয় না যে সে গঙ্গাকে যদি বা ভালোবাসে যেন কোনো এক বিষে তার মন জর্জর, যেন উদাসীন, যেন কীসের সাধনা করে, যেন বুঝতে পারে না কী চায়?

নয়নতারার গলাটা ধরে এলো।

বাগচীর কুঠির সামনে পালকি থামলে কেট দরজা খুলে নামতে গিয়ে দেখলো, ইতিমধ্যে ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে। বাগচী তোফিরেছেই, রাজকুমারও অন্যপথে তাদের একটু আগেই এসেছে। সে তখনো ঘোড়ার পিঠে, ঘোড়াটা স্থির, কিন্তু বালামচি দোলাচ্ছে।

রাজচন্দ্র বললো–আমরা আর দাঁড়াবো না। দ্যাখো, আলো তোমাকে অভ্যর্থনা করতে পথে এসে পড়েছে।

কেট কিছু বলতে দাঁড়িয়েছিলো। পথের ধারের একটা গাছের ডালপালায় আটকানো একখণ্ড চাঁদ তার চোখে পড়লো যা এই সন্ধ্যাকে কখনোই ঘন কালো হতে দেয়নি। তার আলো যেন নয়নতারার মুখেও। কেট বললো–আমি আর মাঝখানে থাকতে চাইছিনা। গুড নাইট ডিয়ার্স।

এক ভারি কৌতুকের প্রশ্ন : আমাদের চিন্তা কি সিঁড়ি বেয়ে চলে? অথবা কি নিত্য প্রবহমান?

কেট দেখলো রাজকুমার ঘোড়া থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে গেলো। নয়নতারা তো পালকি থেকে নেমেছিলোই। সেও কয়েক পা হেঁটে রাজকুমারের কাছাকাছি গেলো, দাঁড়ালো। কেট অনুভব করলো, এই সুন্দর যুবক…ও সেই সিড অব ডেথ…আশ্চর্য! কিন্তু যদি তা হয়, এমন স্বাস্থ্য, এত রূপ!মৃত্যুবীজ থেকে কেউ কি বাঁচাতে পারেনা? কেন পারছে না তবে?

রাজচন্দ্র বললো–তোমাকে কি তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেবো।

নয়নতারা বলতে গেলো, কী সুন্দর চাঁদ, রাজু। রাজকুমারের লাগাম-ধরা হাতটার দিকে বাড়ানো আঙুলগুলোকে মুঠি করে গুটিয়ে আনলো। বললো–রাজবাড়িতে যেতে হবে না? রানীমাকে খবর দিতে হবে। একটু হাসলো সে। বললো– আবার-যাই রাজকুমার, আমি কিন্তু গুড নাইট বলতে জানি না।

নয়নতারা উঠলে পালকিটা ছুটে চলতে শুরু করলো। এখানে রাস্তা বিশেষ ভালো।

০৮. সে রাতের রাজবাড়ি

অষ্টম পরিচ্ছেদ

সে রাতের রাজবাড়ি অন্যান্য রাতের চাইতে কিছু পৃথক হয়ে উঠলো। অনেক বেশি আলো এবং নোক-চলাচল। পালকি যখন সদর-দরজায়, তখনই আলোগুলো চোখে পড়েছিলো। নয়নতারার। কাছারির বড়ো চত্বরটা পার হয়ে যেতে যেতেই নয়নতারা দেখলো, প্রাসাদের কাছাকাছি হাতিটা বসেছে। তার চোখে পড়লো হাতিটাকে কিছু দূরে রেখে রাজকুমার তার। ঘোড়ায় আর-একটা দরজার দিকে গেলো। হাতির হাওদা থেকে সিঁড়ি বেয়ে বিলেতি পোশাকের একজন নামছে। তাকে সাহায্য করতে, এগিয়ে নিতে বরকন্দাজ ও পরিচারকেরা এগিয়েছে। কিন্তু রূপচাঁদই এদিকে এদিকে বলে তার পালকির আগে আগে ছুটে পালকিটাকে খিলানের তলা দিয়ে অন্দরে নিয়ে গেলো।

নয়নতারা ভাবলো, সত্যি কি তাই হয়, সময় কি নদীর স্রোতের মতো সরে যায়? তা কি ওড়াগের মতো কোনো ব্যক্তিত্বের আধারে স্থির থাকে না?

আমাদের চিন্তার প্রবাহ অবিরত অখণ্ড কিনা তা নিয়ে তর্ক আছে, কিন্তু আলাপ যে তার খানিকটাকে কিছু সময়ের জন্য আয়ত্তে আনতে পারে সন্দেহ নেই।

রানীমাকে তার দোতলার বসবার ঘরেই পাওয়া গেলো। নয়নতারাকে বাড়ি যাওয়ার আগে তো দিনের খবরগুলো দিয়ে যেতে হবে। রানীকে মন্দির সম্বন্ধে বলা শেষ হলে নয়নতারা নদীর বাঁধানো পাড়ে ফাটলের কথাও বললো। রানী বললেন–তাই? অবশ্য বাঁধানো পাড় ধীরে ধীরে ঢালু স্বাভাবিক পাড় হয়ে গেলেই বা ক্ষতি কি? নয়নতারার মনে পুরোহিতের রসিকতাটা এলো। তা কিন্তু রানীর সামনে বলা যায় না। রানী নিজেই বললেন, নদী ফিরলে ভয়ের কথা। কিন্তু তা ফিরবেই তা বলা যায় না। তখন আবার বাঁধ দেওয়া শক্ত কি? হাসলেন রানী, বললেন আবার-ওদিকে কিন্তু সময়ের বন্যা আছে।

রানী সেই রাতে নতুন কিছু করলেন, অভাবিতভাবে, যেমন শুধু রাজকুমারের বেলাতে তার আবদারেই হয়ে থাকে, নয়নতারাকে পাশে নিয়ে রাত্রির আহার করলেন। ব্যাপারটা কাল সকাল থেকেই গল্প হয়ে ছড়াবে। আর তাই যেন রানী, যাঁর এসব ব্যাপারের কড়াকড়ি সার্বভৌম পাড়াকে হার মানায়, তিনিই চাইলেন।

সে কিন্তু কিছুটা রাত হলে। তার আগে, রানী তখন বসবার ঘরেই, নয়নতারা তো ছিলোই, হৈমীকে ডাকিয়ে আনলেন। বললেনবসো হৈমী, সারাদিনে তা করোনি। হেসে বললেন–এ দিকের ঘরগুলোকে দেখেছো, নয়ন? চিনতে পারবে না। ইকিরিন, শোপা, টেবিল গাচেতে ছয়লাপ। হৈমী এসব বোঝে ভালো।

সেখানেই রূপচাঁদ এদিকে এদিকে বলে ছ-আনির কুমারকে নিয়ে এলো।

রানী বললেন–বসো। জলযোগ হয়েছে তো? পথে নিশ্চয় খুব ক্লান্ত হয়েছে। তোমার থাকবার জায়গা পছন্দ হলো তো? এঁর নাম হৈমী। ইনি তোমার দেখাশুনা করবেন। কাল তোমার চীনের গল্প শুনবো। কালই হরদয়াল আর নায়েবমশায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো। রাজুর সঙ্গেও তখন আলাপ হতে পারবে।

ছ-আনির কুমার প্রণাম করে বসেছিলো, প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালো। তখন রানী-হৈমীকে বললেন–ইনি মুকুন্দকুমার। কাছে কাছে থেকে ওঁর যত্ন কোরো।

নয়নতারার একটু অবাক লাগলো। প্রথম, অবশ্য, কৌতূহলের নিবৃত্তি। এই তাহলে কায়েতবাড়ির কুমার। এসবক্ষেত্রে অবগুণ্ঠন থাকে, নয়নতারা ও হৈমীর তা ছিলো। কিন্তু সে অবগুণ্ঠন রেশমের, যা স্বচ্ছ। আলাপে না আনলেও বোঝা যায় তা রানীর অভিপ্রেত ছিলো,নতুবা সঙ্গে নিয়ে বসতেন না। কিংবা নাকি মনের চঞ্চলতাকে আড়ালে রাখতে পার্ষদ নিয়ে বসা। নয়নতারা অনুভব করলো কায়েতবাড়ির কুমার সম্বন্ধে রানী কি কিছু বলতে চাইছেন? যেন, যা একদিন গোপন ছিলো এখন প্রকাশ হতে চলেছে, কিন্তু প্রকাশটাকে আয়ত্তে রাখতে হবে।

কথা বলার আগে রানীউঠলেন। নয়নতারাকে নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর ঘুরলেন। তার নিজের শোবার ঘরের পাশের ঘরটিতে এসে বললেন–দ্যাখো। এ ঘরে ঘুমোতে কি অসুবিধা হবে তোমার? রাত করে আর বাড়িতে ফিরো না।

বসবার ঘরে ফিরে কথা বলার আগে কী এক আমোদ পেয়ে হাসলেন নিঃশব্দে, বলতে বলতে একটু জোরে হেসে উঠলেন। শুনেছো নাকি? পিয়েত্রোর এক বাবুর্চি নাকি তার বাংলোতেই থেকে গিয়েছিলো। বন্দা না কী নাম। রাজু তাকে পিলখানায় রেখেছে কিছুদিন হয়। নাকি ভালো রসুই। তো পিয়েত্রো তো ফরাসী। বড়ো বড়ো সোনা ব্যাং দেখেছো?

ম্যাগো! সেসব রাঁধতো কিনা বন্দা কে জানে! রূপচাঁদ বলতেই হৈমী বললো–সে থাকলে সুবিধা হয়। বন্দা ব্যাং না রাঁধুক শোর যে রাঁধতে সন্দেহ কি? শোর মেরে মেরে একটাও কি আর রেখেছিলো এ তল্লাটে!

নয়নতারা বললো– বুনো শোর বিপজ্জনক হয়ে থাকে। কমিয়ে দেওয়াই ভালো হয়েছে।

–ও হরি, তাই, পরোপকার ভেবেছো? প্রতি রবিবারে ঘোড়ায় চড়ে বল্লমে বিধে মারা! কী হৈ রৈ! এখানকার রাজাও সঙ্গী। খেতে অমর্ত! ঘেন্নায় মরি। তা বন্দার এখানে এই প্রথম রাঁধা। রাজু আবার একদিন তার হাতে ভগবতী খেতে চাইবে কিনা কে জানে! একবার…হরদয়াল বলেছিলো, কলকাতার ভদ্রলোকের ছেলেরা নাকি আজকাল…।

একটু থেমে রানী বললেন আবার রাজু অবশ্য…আজকাল সে রোজ পিলখানায় যায় হাতির তদ্বির করতে। ওখানে নাকি বন্দার সঙ্গে তরোয়াল খেলে। রূপচাঁদের কথা, বলে বিপজ্জনক। রাজু অবশ্য হাসে। ওতে নাকি বুক কাঁধ চওড়া হয়, হাতের গুলকবজি ফোলে, চোখের ধার বাড়ে।

রানী একটু ভাবলেন-বললেন, যাক গে, একটা গল্প বলো শুনি।

নয়নতারা বললো–যদি আপনি বলেন দয়া করে

রানী একটু ভেবে নিয়ে বললেন–তোমরা ফার্সি পড়বে না, আরব্য উপন্যাসের গল্পও জানলে না। তুমি কি সিন্ধুবাদের গল্প শুনেছো?

নয়নতারা বললো–সেই সিন্ধুবাদ নাকি, যার কথা সেদিন মানদাদিদি বলতে শুরু করেছিলো?

-হ্যাঁ, সেই বটে। মস্ত বণিক, দুধর্ষ সাহস। ধনরত্নের জন্য প্রাণকে পণ রাখতে আপত্তি নেই। জাহাজ ডুবছে, শেষ রক্ পাখির পায়ে নিজেকে বেঁধে পাহাড়ের উপরে সাপের রাজ্য, নাকি অগ্নিয়গিরির গর্তে হীরার জন্য। হীরা যে প্রাণের চাইতে বড়। কিন্তু সেই হীরা পেয়েও কি ঘরে থাকতে পারছে?

নয়নতারা বললো–আপনি কি বলবেন এ সেই ন জাতু কামঃ।

রানী বললেন কী শক্তি দ্যাখো সেই কামের, যে বুদ্ধিমান সিন্ধুবাদকে চালিয়ে নিয়ে বেড়ায়। যেন তাতেই ভালো হবে। সেই সিন্ধুবাদ একদিন দ্বীপের বুড়োর খপ্পরে পড়েছিল। বুড়ো তার কাঁধে বসে দুই হাঁটুতে এমন গলা চেপে ধরেছিলো যে প্রাণ যায়। বুড়ো ধুর্ত বটে, কিন্তু খোঁড়া।

নয়নতারা বললে–আপনি জ্ঞান বুদ্ধি এসবকে খোঁড়া বলছেন?

রানী হেসে বললেন–তুমি তো আবার ন্যায়রত্নের বোন;নব্যন্যায়ের ঘর। একটু হাসলেন তিনি।

তাঁর দৃষ্টি কোমল হলো। বললেন–তা হয় না, না? একটা জিনিস লক্ষ্য করো। সেই মহাভারতের সময়ে লোভ, হিংসা, ক্রোধ ছিলো, এখনো তারা সব তেমনি আছে, তখন বুদ্ধি করে করে যেসব নীতি করা হয়েছিলো এখন সেগুলোকে বোকামি বলা হয়। ভাবো দ্রৌপদীর সংসার, কিংবা অর্জুনের পত্নীমালা। মনে হয় না কি যে বুদ্ধিটার এক যুগ পার হয়ে অন্য যুগে যাওয়ার ক্ষমতা নেই?

নয়নতারা হেসে বললো–সমাজের নীতিটিতি মানুষ বুদ্ধি দিয়ে করে বটে।

কিন্তু রানীকে উঠতে হলো। হৈমী কায়েতকুমার মুকুন্দর ব্যবস্থা ভালোভাবেই করবে সন্দেহ নেই, রাজুর খোঁজও নেওয়া দরকার।

তখন রাতের আহার পর্ব মিটেছে। হৈমী নিজেই এলো। জানালো খাওয়া শোয়ার ব্যবস্থা মুকুন্দকুমারের পছন্দ হয়েছে। বন্দাকে আশ্বাস দিলেন।

রানী বললেন–নিশ্চিন্ত করলে।

এইসময়ে হৈমী বললো–উনি নাকি চীনে যাবেন। সেখানে নাকি ইংরেজ-চীনে যুদ্ধ, গর্ডন না কী গার্ডন নামে এক সেনাপতির জাহাজ কলকাতায় ভিড়েছে। অনেকে যাচ্ছে। কেউ কেউ কমিসরিয়াটের কাজে। তবে উনি যেতে চাইছেন যুদ্ধ করতে। আপনি অনুমতি দিলে আর কেউ আপত্তি করবে না।

এ সম্বন্ধে রানী তাকে আগেই বলেছেন, ভাবলো নয়নতারা। তাহলেও তার বিস্ময়বোধ হচ্ছে, কায়েতবাড়ির ছেলে এ বাড়ির অনুমতি চাইছে! কিন্তু তার চাইতে বিস্ময়ের, মানুষ কি স্বভাবতই যুদ্ধ থেকে দূরে থাকে না? তা তো অন্যের যুদ্ধ, অন্য দেশে।

কথার কথা বলার মতো ভঙ্গিতে নয়নতারা বললো–এরকম যেতে কি আপনি অনুমতি দেবেন?

রানী বললেন–এবার ওর একুশ পার হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক হলে কিছু করতে চাইবে তো! এদিকে ইংরেজরা তো এদেশে আর কাউকে মনসবদার করছেনা। রানী যেন আমোদ পেয়ে হাসলেন।

হৈমী বললো–নিজেরই কিন্তু ঘোড়া, বন্দুক, তরোয়াল এসব কিনে দিতে হবে।

রানী বললেন–তোমার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে তো!

নয়নতারা অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলো, সে ভাবলো, নিজের চিন্তার ভুল ধরলো যেন, সেজন্য অবাক লাগছে না। এটাও অবাক হওয়ার মতো। একই বয়সের। একজন চলেছে ইংরেজের পক্ষে অন্যদেশে যুদ্ধ করতে, আর অন্য একজন…?

কিন্তু রানীর হাই উঠলো।

রানীর পাশের ঘরেই তো নয়নতারার শোবার ব্যবস্থা। রানীমা শুয়ে পড়লে নয়নতারা নিজের জন্য নির্দিষ্ট শোবার ঘরে সামনে অলিন্দে দাঁড়ালো। রাত্রির রাজবাড়ির অন্দরমহল তার চোখে পড়লো। এখন চতুষ্কোণ উঠোনটার চারিদিকের সবগুলো ঘরেই আলো। লোকজনের সাড়াও যেন। দোতলার অলিন্দের দেয়ালগিরিগুলো জ্বলছে, কিন্তু অনেক ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অলিন্দে বরং কোমল অন্ধকার এখানে ওখানে। বাঁ দিকটায় বেশ কয়েকটা ঘরের পরে একটা ঘরের পর্দার আলো আসছে অলিন্দে। এবার সেটা বন্ধ হলো। ও ঘরটা কি হৈমীর, অথবা ও ঘরেই কি মুকুন্দকুমার? নয়নতারা এবার ডানদিকে চাইলো। বড়ো একটা থামের পাশ দিয়ে অলিন্দটা ঘুরে গিয়েছে কোণ তৈরী করে। থামটাই প্রমাণ যে ওখানেই দোতলায় উঠবার সিঁড়ি। সেজন্যই ওখানে একটা ঝাড় যা থামের পাশ দিয়ে খানিকটা চোখে পড়ছে। সিঁড়ির থাকটাই রাজকুমারের মহলকে রানীর মহল থেকে পৃথক করে। রানী শুয়ে পড়েছেন, দোতলা নিঃশব্দ হয়ে আসছে। কার্নিশের নিচে বসান ঝরোকায় আলো আসছে, আন্দাজ করা যায় ওটাই রাজকুমারের ঘর।

আশ্চর্য! নয়? –এই ভাবতে ভাবতে নয়নতারা তার শোবার জন্য নির্দিষ্ট রানীমার ঘরের পাশের ঘরে ফিরে এলো। অসাধারণ শয্যা। রানীমার নির্দেশে যে রকম হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু কেন যে এমন করেন?

শয্যায় বসে সারাদিনের ক্লান্তি সত্ত্বেও নয়নতারার ঘুম আসতে দেরি হলো। বরং রানীর কথাগুলো মনে এলো তার। আলাপে আলাপে বাঁধের ফাটলের সমস্যা, তার সমাধান, কায়েতবাড়ির মুকুন্দকুমার, চীনের যুদ্ধ, বান্দা বাবুর্চির তরোয়াল খেলার কথা হয়েছিলো। দ্যাখো কাণ্ড, বলে ভাবলো নয়নতারা, জাঁ পিয়েত্রোর বাবুর্চির নাম বন্দা, যে নাকি তরোয়ালবাজ, যেমন বুজরুক ছিলো তার মসলিনরেশম কারবারের ম্যানেজার। এসব কি পিয়েত্রোর পরিকল্পনা না খেয়াল? হয়তো খোঁজ করলে জানা যাবে, বন্দা ছিলো প্রকৃতপক্ষে তাঁর অবিচল দেহরক্ষী।

তরোয়াল খেলার গল্পটা যেন হঠাৎ তার বুকের ভিতরে কিছুকে ধাক্কা দিলো। বন্দুকও প্রাণঘাতী। কিন্তু তরোয়াল খেলা, কি নকল তরোয়াল দিয়ে হয়? সে মনে মনে বললো, কী আশ্চর্য, এ তো আমাকে বলোনি! এ বিষয়ে আলাপ করা দরকার নয়? তরোয়ালকে কৃপাণ, করবাল ইত্যাদিও তো বলে। পিয়েত্রোর সেই মখমলে ঢাকা কিন্তু অদ্ভুত ধারালো। মস্ত তরোয়ালটা ব্যবহার করে নাকি? লোহার জামা গায়ে দিয়ে নেয় তো? দেখা দরকার। না, না। তা ভালো নয়। সে কাছে থাকলে যদি রাজকুমার অন্যমনস্ক হয়?

কিন্তু কী করে একা একা অনুভব করে সমস্যার সমাধান হয়। কারো সঙ্গে আলাপ করতে পারলে হতো। শিকল বুনে বুনে জামা তৈরীর কথা যদি বলো (নয়নতারার অজ্ঞাতে এটা কি ইস্পাতের জামার ছায়া?) সোয়েটারটা কিন্তু বোনা হয়নি। কী আগ্রহে উল আনালো কলকাতা থেকে, কি আগ্রহে বুনতে শেখা। কিন্তু আশ্চর্য, আগ্রহটা কেন নেই? কারো সঙ্গে আলাপ করা দরকার নয় কি?

রাজকুমারকে একবার নিজের হাতে সুতো কেটে ধুতি চাদর উপহার দিয়েছিলো বটে। তেমন সেই এক উৎসবের রাতে অনভ্যস্ত মদে বিহ্বল কিশোর রাজকুমার তার বাড়িতে গিয়ে তার বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলো।

আলাপের কথাতে মনে পড়লো নয়নতারার, এ বিষয়ে একজনই মাত্র বেশ স্পষ্ট করে আলাপ করেছে। ঘটকী, সেই ব্ৰহ্মঠাকরুন। সেই যে অঙ্কের ধাঁধার মতো স্ত্রী-পুরুষের বয়সের পাশাপাশি হিসাব।

ছি ছি! এসব কি আলাপে আনা যায়? রাজকুমারের এখন একুশ হবে। যেন উপরের পাতার চাপে জল এসে নয়নতারার নিচের পাতার পক্ষগুলো জলবিন্দুতে ভারি হলো। সে। স্থির করলো সে ঘুমোবে। দরজা বন্ধ করে টিপয়ায় বসানো বড়ো ডোমদার সেজটাকে নিবিয়ে বিছানায় এলো সে। দেয়ালে লাল কাকড়ার মৃদু দেওয়ালগিরিটা জেগে থাকবে। এখন সে গায়ের কাপড় আলগা করে দিচ্ছে।

শুয়ে নয়নতারা ভাবলো, রানী কিন্তু বিচলিত নন। বাঁধটাকে নতুন করে শক্ত করে তুলবেন। ফাটলগুলো থাকবে না। পুরোহিত যেমন বলেছিলো, গঙ্গার সেই বুঢ়াকে…কিন্তু ক্ষতি কি যদি অগাধ শান্ত হয়ে নদীটা মন্দিরের কিছু দূরে প্রবাহিত হতে থাকে।

চোখে যখন ঘুম জড়িয়ে আসছে সার্বভৌমপাড়ার মেয়ের মনে হলো : তোমার কাছে। আকবর বাদশার কাল আর রাজুর কালে ব্যবধান নেই। রানীমার মন্দির কখন আকাশ স্পর্শ করে, কখন আবার মাটিতে মিশে যায়, দু-তিনশো বছরের সেব্যবধানও তোমার কাছে মূল্যহীন। কিন্তু তুমি তো মহাকাল, সৃষ্টির উৎস। স্নেহ নেই কেন? সময়ের ব্যবধানে আমাদের যা অতীত হয়ে যায় তা কি তুমি করুণায় পূর্ণ করো না?

এক দারুণ উৎকণ্ঠায় আর লজ্জায় ঘুম ভেঙে গেলোনয়নতারার। বিছানায় উঠে বসলো সে। কিন্তু বিছানা, ঘর, আলো যেন বিশ্বাসে আসছে না। স্বপ্নটা এরকম যেন : এক অগাধ জলরাশির পার বাঁধানো চলেছে কিংবা গতিশীল জলরাশিকে বাঁধেহ্রদে পরিণত করা হচ্ছে। রানীমা, হরদয়াল, নায়েবমশাই, লোকজন। কিন্তু যেন চিড় ধরলো। মেঘের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ফুলেফেঁপে সেই জল মন্দিরকে বিগ্রহকে গিলে ফেলছে। বিষণ্ণ উৎকণ্ঠায় যেন দম বন্ধ হবে। যেন হাহাকার করা হচ্ছে। কিন্তু যেন গোপনে নয়নতারা সুখী হয়ে উঠলো।

আশ্চর্য! সে বিছানার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবলো, এ কি অন্যায় যে রানীমার পরাজয়ে সে এত সুখী হয়েছিলো! রানীমাকে সে কি বিদ্বেষ করে?

নয়নতারা উঠলো। দাঁড়াতে গিয়ে পা দুটো একটু শিরশির করলো। একটা জানলা খুলে দিলো সে। তখন পেটাঘড়িতে একটা একটা করে এগারোটা বাজলো। রাত হয়েছে বটে, তবে তেমন বেশি নয়। জানলা ধরে দাঁড়ালো সে। বাতাসটা বেশ ঠাণ্ডাই। সে কি একটা বাজনা শুনতে পেলো? মৃদু, যেন ক্রমশ ফুরিত হচ্ছে। আগে কি ছিলো? কিন্তু পিয়ানো বাজাতে বসার পক্ষে এখন কি বেশি রাত নয়?

.

নয়নতারা ভুল শোনেনি। বিছানা দেখে মনে হচ্ছে, সে এতক্ষণ বসেই ছিলো। স্থির হয়ে বড়ো চেয়ারটায় চিবুকের নিচে ডান হাতে চেপে ধরার ভঙ্গিতে ছুঁয়ে বসে থাকাকে আর কিছু বলে না। এখন সে উঠে পিয়ানোর সামনে বসলো। মিউজিক শীটটার গায়ে ইংরেজি অক্ষরে লেখা চপিন। শিশাওয়ালও তাই বলেছিলো। কিন্তু এতক্ষণ ভেবে সি ঠিক করেছে ফরাসী হলে সিএইচ শ হয়ে যাবে, শেষের এনটা চন্দ্রবিন্দু। এই উচ্চারণ বিভ্রাটই যেন তাকে ভাবাবে। সে স্কোর শীটটার উপরে চোখ বোলালো। অভ্যাসের ফলে টানা লাইনে নানাভাবে নিবদ্ধ স্বরগুলির শব্দ তার মনে মনে ঝংকার তুলতে লাগলো।

রাজচন্দ্র অবশ্যই এই চপিন-শপ্যাঁ সম্বন্ধে এই প্রথম জানছে। আজ সন্ধ্যাতেই পৌঁছানোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই শিশাওয়াল তার সঙ্গে দেখা করে মিউজিক শীটের রোলটা তাকে দিয়ে বলেছিলো, এটা সার, আপনার জন্য এই অধমের আনা উপহার। জঙ্গিলাটের প্রাইভেট সেক্রেটারির স্ত্রীর কাছে সংবাদ পেয়ে সেই রাতেই সংগ্রহ করি। তো স্পিংক সাহেব আমাকে বললো, এটা যখন রচনা হচ্ছে চপিন প্যারিসে, স্বদেশ পোল্যান্ড থেকে নির্বাসিত। যেন স্বদেশ স্বকাল থেকে বিচ্যুত। আর সেখানে খবর এসেছিলো পোল্যান্ডকে চিরকালের আগ্রাসপন্থী রাশিয়া গ্রাস করে ফেলছে। সেই রাগে এটার রচনা। শুনে হাসি পাওয়া স্বাভাবিক। শিশাওয়াল ভালো সেলসম্যানের মতো অনর্গল কথা বলতে পারে, কেউ তার কথা বিশ্বাস করছে কিনা তা পরোয়া করে না। তার গল্পের কোন অংশটা মিথ্যা কে বলবে?

কিন্তু পিয়ানোই রাজুকে আকর্ষণ করলো। নোটেশনগুলোতে চোখ পড়তে তার মনে হচ্ছে, বাজালে তা বুকের মধ্যে তরঙ্গ তুলবে। শীটের মাথায় ইংরেজ-প্রকাশক রিভলিউশনারী স্টাডি কথাটা জুড়ে দিয়েছে। রাজু বাজাতে শুরু করলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সুর এমন হলো যে কিছু যেন ভেঙে পড়ছে, কোথাও বিদ্রোহ যেন, আক্রোশ আর বেদনা, হার না মানার প্রবল প্রতিজ্ঞা।

সে রাত্রিতে রাজু শপ্যাঁর সেই রিভলিউশনারী স্টাডি বারবার বাজিয়ে যেন মুখস্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। যেন রিহার্শাল, কাল তাকে শ্রোতাদের সামনে উপস্থিত হতে হবে। অস্বীকার করা যায় না যে কোনো বিচক্ষণ শ্রোতার কানে ধরা পড়তে বাজানোর ব্যাপারটা প্রতিবারে শপার নির্দেশ মতো হচ্ছে না। ইম্প্রোভাইজ করা হচ্ছে যেন, অন্তত তীব্র কঠোর ধ্বনিগুলি দীর্ঘায়ত আর উচ্চরব হচ্ছে। যেন বাঁধনছেঁড়া, বাঁধভাঙা, তাকে তীব্রভাবে অস্বীকার করা যা তোমাকে স্বাধীন হতে দেয় না, আর ব্যর্থতা যখন ভাগ্যের মতো তখন বিষণ্ণতার ঘাটগুলো বেজে উঠছে।

 ০৯. সময়ের হিসাব

নবম পরিচ্ছেদ

০১.

রানীর জন্মোৎসবেই সময়ের হিসাব। তখন অঘ্রানের প্রথম, নভেম্বরের মাঝামাঝি, জন্মোৎসব দু সপ্তাহও দূরে নয় আর। শীত পড়েছে। হালকা রাগ নেমেছে শয্যায়।

সেদিন রবিবার। বাগচীর ঘুম ভেঙেছে যেন, কিন্তু এখনো সে শয্যায়। রবিবার বলে? ছুটির দিনেই কিন্তু অন্যদিনের আগে তার কাজের দিন শুরু হয়। সে কি অসুস্থ? উল্টো বরং নরম, ল্যাভেন্ডারগন্ধী রাগের নিচে তার শরীরটা সুস্থ, সানন্দ, বিশেষ রকমে হালকা। তার কি স্কুলের কথা মনে নেই? বরং এখনই সে ঘুমে জড়িয়ে ভাবছিলো, গতবারের চাইতে এবার তার স্কুলে ছুটি বেশি। রাসের ছুটি, জন্মোৎসবের ছুটি, বড়দিনের ছুটি। গতবার রাসের ছুটি ছিলো না।

অন্যান্য সকালে বাগচী উঠে যাওয়ার পরে কেট তার নিজের শয্যা ত্যাগ করে। নির্দিষ্ট অভ্যস্ত সময় পার হতে দেখে কেট উঠে, গোসলখানা ঘুরে হাত-মুখ মুছতে দুই খাটের মাঝখানে রাখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিলো। তখন রাত্রিবাস থেকে দিনের হাউসকোটে যাওয়ার সময়। কারো রাত্রিবাস ল্যাভেন্ডারগন্ধী মসলিনের হতে পারে। কেট ভেবেছিলো বাগচী ঘুমিয়ে আছে, উপরন্তু শয্যার দিকে পিছন ফিরেই তো সে। কিন্তু প্রতিবিম্বর মুখ তো শয্যার দিকেই।

বিস্মিত বাগচী পাশ ফিরেছিলো। সে ভাবলো : ক্রিস্টমাসে কেটকে নিয়ে কলকাতা গেলে হয়। গতবার সে সময়ে রাজকুমারের কলকাতা যাওয়ার কথা ছিলো, তাদের সঙ্গী হওয়ার আমন্ত্রণ ছিলো। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন ঘটেনি, রাজকুমার নৌকাবহরে পশ্চিমভ্রমণে গিয়েছিলেন। …এবার তাদের বিবাহের পঞ্চম বার্ষিকী এগিয়ে আসছে। সে সময়ে অবশ্যই স্কুলের পরীক্ষা চলতে থাকবে। তা কেটের এতদিনে ত্রিশ হবে। পরীক্ষা নেওয়ারই পরীক্ষা, লেখার বদলে মুখে। নতুন পদ্ধতি বটে। তত শোবার ঘরের আয়না…। তাছাড়া, সলজ্জ বাগচী ভাবলো,কাল বিকেলে চরণ দাস যে চিঠি দিয়েছে, বেশবড়ো চিঠি। বানান দেখে বলতে পারো না, কিন্তু উচ্চারণ রলে, রেভরেন্ড ফাদার সিবাস্টিয়ান বলে। দ্যাখো, কীবল কাল আবার এসেছিলো বিকেলে। তখনই চরণ দাসও চিঠিটা এনেছিলো। কেমন সব যোগাযোগ নিত্য ঘটছে। কীবল এসেছিলো রলের কথা বলতেই। ফলে রলের। চিঠিটানা খুলেই জানা গিয়েছিলো রলে এ অঞ্চলে একটা মিশন হাউস করতে চায়। কীবল চলে গেলে চিঠি খুলে অবাক। রলের চিঠি। মিশন হাউস তো বটেই, সম্ভব হলে সে একটা স্কুল, একটা হাসপাতালও করতে চায়। …গাছটা বেশ বড়ো, রুক্ষ মোটা ত্বক; হঠাৎ ফুল ফুটলে কেমন ছেলেমানুষ দেখায়। এরকম একটা অনুভূতির পাশ দিয়ে বাগচী স্থির করলো, বেশ আরামই লাগছে, ব্রেকফাস্টের ডাক পেলে উঠলেই হবে।

কিন্তু কেট এলো। কোমরের অ্যানে বোঝা যায় ব্রেকফাস্ট তৈরিতে ব্যস্ত ছিলো সে। বিছানার পাশে এসে বললো, অতিথি।

বাগচী তো জেগেই ছিলো। উঠে বসে বললো, কে, রলে নাকি?

কেট বললো, ওই যে যার প্রার্থনা, ও গড, মেক মি এ সেন্ট বাট নট ইয়েট।

-আমারে করো সন্ত, কিন্তু এখনই নয়! সে কি? বাগচীবিছানা থেকে নামলো। আন্দা করতে পেরে হেসে উঠলো, গুড, গ্রেশাস, ব্রেকফাস্টে বসতে বলেছো নিশ্চয়।

বললেন, তাঁর প্রাতরাশ শেষ হয়েছে। তাহলেও পাছে আমরা ভাবি পানাহারে তা ছোঁয়া যাওয়ার কুসংস্কার আছে, তাই টেবিলে বসতে রাজী হয়েছেন।

বাগচী আর একবার হেসে বললো, ঠিকই ধরেছি তবে। ভদ্রলোক কিন্তু সবসময়েই ভেবে কথা বলেন, ভেবে কাজ করেন। তোয়ালে হাতে গোসলে যেতে যেতে বাগচী। দাঁড়ালো; কেটের চিবুকের নিচে আঙুল রেখে বললো–মেক মি এ সেন্ট বাট নট ইয়েট প্রার্থনাটা প্রকৃতপক্ষে কার বললো– তো?

-কেন, সেন্ট টমাসের নয়?

কেটের চিবুক ঈষৎ উঁচু করে বাগচী বললো–আমার, আমার, রেভরেন্ড এন্ড্রুজ বাগচীর।

বাগচীর বসবার ঘরে তখন যে অপেক্ষা করছিলো সে সর্বরঞ্জন প্রসাদকুসুম নিয়োগী। ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় স্কুলে যে তিনজন শিক্ষক এসেছেন তাদের প্রধানতম, সহকারী প্রধানশিক্ষক বলা হয়। প্রায় এক বৎসর এই গ্রামে আছেন কিন্তু এখনো অনেক পরিস্থিতিতে তাকে নবাগত মনে হয়। ইতিপূর্বে একদিন কেট তাকে সেন্ট ফ্রান্সিস বলেছিলো। চেহারা দেখেই মন্তব্য। সর্বরঞ্জন অবশ্যই বৃদ্ধ নয়। হয়তো পঁয়ত্রিশ হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যে তার কথায় অর্ধেক থাকে ধর্ম সম্বন্ধে। তার দিকে চাইলেই যা দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা তার শ্মশ্রুজাল। প্রচুর আবক্ষ সেই দাড়ি সাধুসন্তের কথা মনে আনে, কিন্তু তা ঘনকৃষ্ণ হওয়ায় যেন বিপরীতমুখিনতাও। তার পরনে গলাবন্ধ কোট, ঢিলে সাদা ট্রাউজার্স। কলকাতার আধুনিকতা, কিন্তু সম্ভবত ক্ষারে কাঁচা এবং ইস্ত্রিও হয়নি। পোশাকটা ঘোষণা করছে সর্বরঞ্জন সাদাসিধে, মিতব্যয়ী, কিন্তু অন্যদিকে কতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ক্লিনলিনেস ইজ নেকস্ট টু গডলিনেস, সন্দেহ কী?

বসবার ঘরে ঢুকে নিয়োগীকে দেখে বাগচীর সন্ত টমাসের রসিকতাটা আবার মনে এলো। সে প্রফুল্ল বোধ করলো। স্কুল সম্বন্ধে কেটের রসিকতায় সস্নেহ ভাবটা স্পষ্ট থাকে।

সর্বরঞ্জন হেসে বললো–এখানে বলা দরকার তার এই থ্রি পিস নাম ইংরেজ ক্রিশ্চানদের অনুরূপ হলেও এখানে সুবিধার জন্য সংক্ষেপ করা হচ্ছে। আমি একটু ভুল করেছি, সার, আমার ধারণা ছিলো আপনি ব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করে থাকেন।

ব্রাহ্মমুহূর্তে! বাগচী চশমার কাঁচ দুটোকে রুমালে মুছে নিলো।

-উপাসনার সেটাই প্রকৃষ্ট সময় নহে কি? এবং যেহেতু আপনি ধার্মিক, সুতরাং অবশ্যই উপাসনা করে থাকেন,এবংসুতরাংব্রাহ্মমুহূর্তে শয্যাত্যাগ করতে অভ্যস্ত ধরে নেওয়া যায়। নিয়োগী হাসলো। বিহ্বল বাগচী বললো, আপনি অবশ্যই ব্রাহ্মমুহূর্তে উপাসনা সমাধা করেছেন?

সর্বরঞ্জন মাথাটাকে একবার ডান কাঁধে আর একবার বাঁ কাঁধের উপরে ছোঁয়ালো। তার মুখে একটা শুভ্র উজ্জ্বল হাসি দেখা দিলো, (সেই প্রচুর কালো দাড়িকে ছাপিয়ে হাসির পক্ষে যতটুকু তা সম্ভব) সে বললো–ওটাই কি ডায়েরির দৈনিক হিসাবে জমার দিকে প্রথম অঙ্কপাত হয় না?

ব্রেকফাস্টের আগে কেউ যদি বাড়ি বয়ে এসে প্রার্থনার কথা আলোচনায় আনে তবে তাতে একটা কৌতুকের দিক থাকে। কিন্তু ব্যাপারটা বাগচীকে চিন্তার বিষয়ও এনে দিলো। সে অপ্রতিভভাবে হেসে বললো–ওটা নিশ্চয়ই সবসময়েই জমার দিকে পড়ে, কিন্তু স্বীকার করছি, আমার জমা অনেক কম।

সর্বরঞ্জন দাড়িঢাকা চিবুক উঁচুনিচু করলো। সে কি বিব্রত অথবা আনন্দিত? কিন্তু সুশিক্ষা এমন উল্লাসকে মনে গোপন রাখতেই বলে। সুতরাং তা গোপন করতে সে যথেষ্ট বিব্রত হয়ে পড়লো।

বাগচী বললো–মিস্টার নিয়োগী, আপনার নিশ্চয় গুরুতর কিছু প্রয়োজন আছে, কেউ কি অসুস্থ? কিংবা আপনি কি স্কুল সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করবেন? কিংবা ব্যক্তিগত কিছু?

সর্বরঞ্জন বললো–আমি আপনাকে অন্যবিষয়ে কিছু বলতে এসেছিলাম। কিন্তু স্কুলের কথাটা যখন উঠে পড়লো তখন বলি। আজই তো স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য পরীক্ষক নির্বাচন করা হবে, এই সুযোগে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তাবটা আর একবার ভেবে দেখলে হয় না? এমনকী শিরোমণিমশায়ও বলছিলেন ব্যাকরণজ্ঞান না হলে, শুদ্ধ বানান লিখতে না জানলে বিদ্যাশিক্ষাই হয় না। মৌখিক পরীক্ষায় ছাত্ররা ব্যাকরণ বানান ইত্যাদিকে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ পাবে না কি?

শিরোমণি? বাগচীর মনে পড়লো কিছুদিন আগে শিরোমণিকে উঁচু ক্লাসে সংস্কৃত ও বাংলা পড়ানোর জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে। স্কুল সম্বন্ধে তার চিন্তায় যে কয়েকটি মানুষের। কথা মনে আসে শিরোমণি এখনো তাদের মধ্যে একজন নয়। সে বললো–এটা তো পরীক্ষা নেওয়ার পরীক্ষামাত্র। যদি দেখা যায় ব্যর্থ হচ্ছে, আগামীবছরে পুরনো বিধিতে ফেরা যাবে। আগেও বলেছি হিমালয়কে ঈকার দিয়ে লিখলে বা ভাবলে তার উচ্চতা কমে না, তুষারও হ্রাস পায় না।

-কিন্তু এর একটা অন্য দিক আছে, সার। কিছুদিন পরে পুস্তকগুলি ভাষার ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠবে না?

-সে যখন আমাদের এই ছাত্ররা বই লিখবে। বাগচী হাসলো, তাছাড়া আপনি অবশ্যই জানেন, বানান কোনো ভাষাতে স্থির নয়, ব্যাকরণ ইতিমধ্যে বদলাচ্ছে; আমরা ইতিমধ্যে করিবেক আমাদিগের ইত্যাদি পদ এমনকী স্কুলেও ব্যবহার করছি না।

–তাও যদি মেনে নেওয়া হয় বিদ্যালয়-পরিদর্শকের মতকে অবহেলা করে কলকাতার পদ্ধতিকে গ্রাহ্য না করে, এই এক নতুন পথে চললে আমরা কি দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বো না?

বাগচী হেসে উঠলো, কিন্তু তখনই সস্তৃত হলো, বললো– কলকাতার লোকসংখ্যা কি সারা দেশের লোকসংখ্যার চাইতে বেশি। তাদের সংস্কৃতিকে কি সারা দেশের সংস্কৃতি করতে হবে? সেখানে কি ইংরেজির কয়েকটা শব্দ জানাকে সংস্কৃতির লক্ষণ মনে করা হচ্ছে না?

নিয়োগী বললো–সার, আপনার প্রশ্রয় আমাকে তর্ক করতে সাহসী করছে। কলকাতার ইংরেজি শিক্ষার উপরে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু তা কি অন্যায়? সেকালের রাজা রামমোহন, একালের বিদ্যাসাগর কি ইংরেজি শিক্ষার গুণগ্রাহী নয়?

বাগচী বললো–উভয়েই বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র কিন্তু তারা কি ইংরেজি পড়ে পণ্ডিত? কিন্তু আসল কথাটা তা নয়। আপনি কি এ দেশের চাষীদের সঙ্গে, স্ত্রীলোকদের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে, রামায়ণ মহাভারত পুরাণ ইত্যাদি নিয়ে, পাপ পুণ্য সমাজ নীতি ইত্যাদি নিয়ে আলাপ করেছেন? তাদের অক্ষরজ্ঞান নেই, কিন্তু

-সেটা হয়তো কথকতা ইত্যাদির ফলে। কিন্তু তাদের সেই জ্ঞানই তো কুসংস্কারের উৎস।

কুসংস্কার? হয়তো, হয়তো। আমি চাইছি আমাদের ছাত্ররা আপাতত ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান চিকিৎসা সম্বন্ধে অনেক কিছু, আর তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানুক। সময়ের ব্যবধান কমাতে চাইছি। শুধু ইংরেজি ভাষার উপরে জোর দিলে একটা ইংরেজিনবিশ সংখ্যালঘিষ্ঠ শ্রেণী তৈরী হবে যারা আর সকলকে মূর্খ আর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে করবে।

এই বলে বাগচী হেসে উঠলে। কিন্তু আলোচনাটাকে গুটিয়ে নিতে সাহায্য করলো কেট। সে ঘোষণা করলো ব্রেকফাস্ট দেওয়া হয়েছে। বাগচী দাঁড়িয়ে উঠে বললো–আসুন, আসুন টেবলে যাওয়া যাক।

আলাপটা এখানে মুলতবী হতো। কিন্তু নিয়োগীর ব্রেকফাস্টেনা বসেও টেবলে বসার বিষয়টা তো আগেই স্থির করা হয়েছে। সে তো ক্রিশ্চানদের সঙ্গে এক খাওয়ার টেবলে বসতে না পারার মতো কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিতে পারে না, সুতরাং সে সেই ব্রেকফাস্টা টেবলের পাশেই বসলো।

বাগচীর এইসময়ে একবার রলের চিঠির কথা মনে হলো, একবার চরণ দাসের ডিসপেনসারির কথা মনে হলো, কিন্তু সেসব দিকে মন দিলে নিয়োগীর দিকে অনাদর দেখানো হয়ে যেতে পারে এই আশঙ্কায় সে তার দিকে ফিরে বললো, বলুন মিস্টার নিয়োগী, আমি কোন বিষয়ে আপনার কাজে লাগতে পারি? আপনার দরকারী কথা না বলে এতক্ষণ আমি অন্য কথা বলেছি; দুঃখিত।

সর্বরঞ্জন প্রসাদ বললো–সমস্যা দু রকমের সার। আমি গতকাল স্কুল থেকে বাড়ি যাওয়ার সময়ে এ বছরের ছুটির তালিকা এবং আগামী বছরের তালিকার খসড়াটাকে দেখছিলাম। দেখলাম, রানীমার জন্মতিথির উৎসবের কাছেই লাল কালিতে নতুন একটা ছুটি বসানো হয়েছে রাস উপলক্ষ্যে। আগামী বছরের খসড়ায় দেখলাম কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদি তো বটেই শিবচতুর্দশী উপলক্ষ্যেও ছুটি হবে।

বাগচী বললো–এ বছরের রাসপূজার কথা আমার জানা ছিলো না। শিরোমণিমশায়। কয়েকদিন আগে এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছিলেন। আগামী বছরের শিবচতুর্দশীর ছুটির কারণ রানীমা ফরাসডাঙায় যে শিব স্থাপন করেছেন, শুনতে পাচ্ছি সে সময়ে সে উপলক্ষ্যে ভারি বড়ো মেলা হবে। কাছারিও বন্ধ থাকবে হয়তো।

এ ব্যাপারে, সার, দেওয়ানজিরও কি এই মত?

তিনি স্কুলের এসব ব্যাপারে আমাকেই মত স্থির করতে বলেন।

-তাহলেই দেখুন, সার, এসব অন্যায়ের সব দায়দায়িত্ব আমাদেরই থেকে যাচ্ছে। এই বলে সর্বরঞ্জন প্রসাদ বেশ খানিকটা মাথা ঝাঁকালো। বললো, আপনি আমার উপরওয়ালা। ডিসিপ্লিনের জন্য আপনার কথা আমাকে মানতেই হবে। কিন্তু এও আমি বলে দিচ্ছি, এতে আমার অন্তরলোকের সায় নেই। প্রত্যেকের একটা মিশন আছে। আমাদের ছাত্ররা যদি তাদের পিতামাতার অন্ধকারাচ্ছন্ন পুতুলপূজার মানসিকতায় ফিরে যায় তবে বৃথাই আমাদের শিক্ষাদীক্ষা, বৃথাই শিক্ষকতা করা।

বাগচী হাসিমুখেই বললো–ছাত্রদের পিতামাতারও নিজস্ব মত থাকতে পারে।

–অন্যায় মতও মানতে হবে?

অন্যায় বলছেন?

অন্যায় নয়? রাসের কথাই ধরুন। ওটার মতো কুৎসিত জঘন্য নীতিহীন কিছু হতে পারে? লাম্পট্যের জঘন্য প্রকাশ ছাড়া কিছু বলবেন?

-ওটা তো ধর্মের ব্যাপার। শিরোমণি বলছিলেন। আমি ঠিক জানি না।

সর্বরঞ্জনের মুখ গম্ভীর হলো, জমকালো দেখালো তাকে। ধর্ম এবং নীতিহীনতা, এটাই তো সে বলতে চাইছিলো। বিষয়টার নীতিহীনতাকে আক্রমণ করতে পারলে পুতুলপূজাটাকে সার্থক আক্রমণ করা যায়। এটাই তো প্রমাণ পুতুলপূজা কত আবিলতা সংগ্রহ করতে পারে। সে বললো–তাহলেই দেখুন, ওটা কি ধর্ম! মহিলা উপস্থিত না থাকলে বলতে পারতুম ধারণাটাই কী জঘন্যভাবে কুৎসিত।

এমনকী সর্বরঞ্জনের মুখে দাড়িহীন অংশটুকু যেন লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। নিয়োগীর কথা বলার ভঙ্গি, মুখচোখের চেহারা দেখে রাস উৎসব সম্বন্ধে বাগচী প্রকৃতই ভীত হলো। তাকে দুশ্চিন্তা করতে দেখা গেলো। সে বললো–আপনি শিরোমণির সঙ্গেও আলাপ করুন। আপনার মত তাকে জানান। স্কুলে নীতিহীন ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া যায় না।

কেট বাংলা বোঝে, বলে। সুতরাং ইতিমধ্যে সেও কুণ্ঠিত হয়ে উঠেছিলো। সেদিকে লক্ষ্য রেখে বাগচী তাড়াতাড়ি আলাপটাকে ঘুরিয়ে নিতে বললো–আপনার বাড়ির খবর বলুন, ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ভালো থাকছে তো? এই সমাজে আপনার স্ত্রীর অসুবিধা হচ্ছে না তো? আপনার বাসগৃহ সম্বন্ধে কিছু করা দরকার আছে কি? আপনার বেতন জানুআরি থেকে পুরো একশো করা যায় কিনা এ সম্বন্ধে দেওয়ানজি ভেবে দেখবেন বলেছেন।

আলোচনাটা এদিকে ফিরলে কেট বিস্কুট ও কফি এগিয়ে দিলো। সর্বরঞ্জন তা গ্রহণ করে উৎফুল্ল হলো। সুনীতির সার্থক সুপ্ৰয়োগে কার না সুখ হয়?

বলা বাহুল্য বাগচীদের প্রাতরাশ সেদিন অন্য অন্য দিনের মতো হলো না। বাগচী আলোচনাটাকে গ্রাম সম্বন্ধে, গ্রামজীবনের সুবিধা অসুবিধা সম্বন্ধে, নিয়োগীর সুবিধা অসুবিধা সম্বন্ধে ধরে রাখলো। অন্যান্য দিনের মতো তাদের পরস্পরের অন্তরঙ্গ বিষয় নিয়ে আলাপহলোনা। কেট নিয়োগীকে একবার আরো কিছু খেতে অনুরোধ করে ভাবলো, এসব হয়তো আমার ভাবা উচিত নয়, কিন্তু ভদ্রলোকের দাড়িটাকে অন্যের বলে মনে হয় যেন। আর এই মাথা নেড়ে কথা বলার ভঙ্গি? বাগচী একবার ভাবলো, ভদ্রলোক ছুটির ব্যাপারটাকে কত কঠিনভাবে নিয়েছেন দ্যাখো! ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে চলে এসেছেন, কারো গৃহস্থালিতে ব্যাঘাত হয় কিনা তা ভাবার অবকাশ পাননি।

প্রাতরাশ শেষ হতেই বাগচী পাইপ হাতে টপ হ্যাট মাথায় বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। অন্যান্য দিনের মতো পাইপ মুখে কেটের সঙ্গে আধঘণ্টা নিছক গল্পগাছা করার সুযোগও আজ ছিলো না।

তা দেখে বাগচীর সহিসও তার টাট্টু নিয়ে এলো।

বাড়ির বাইরে পথে এখন সকালের রোদ। উজ্জ্বলতায় ও কবোষ্ণতায় তা তৃপ্তিদায়ক। রবিবারের অভ্যাসমতো বাগচী চরণের ডিসপেনসারির কথা ভাবলো। ইতিমধ্যে সে বোধ হয় দেরি করে ফেলেছে।

সর্বরঞ্জন বললো–আপনি কি এখনই বেরোচ্ছেন, সার? আমার আলাপের দ্বিতীয় বিষয়টার দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছিলাম।

-ও, হ্যাঁ, বলুন বলুন। চলুন তাহলে আমরা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলি।

তারা হাঁটতে শুরু করলো। সহিস অগত্যা টাট্টু নিয়ে পিছনে হেঁটে চললো।

সর্বরঞ্জন বললো–এবার এ গ্রামে নাটকও হচ্ছে।

নাটক? মানে থিয়েটার? কলকাতায় হুজুগ উঠেছে বটে। হঠাৎ হচ্ছে যে?

–রানীমার জন্মোৎসবে।

বাহ! অন্যান্যবার শুনেছি যাত্রা হয়। তো আপনি এবং আমাদের সব শিক্ষকই অবশ্যই আমন্ত্রিত হবেন। শুনেছি খুব আনন্দ হয়।

–তা হয়তো হবে। কিন্তু থিয়েটার বলে কথা? বেশি বাস্তব নয়?

–যাত্রার চাইতে সাসপেনসন অব ডিসবিলিফ বেশি হয় বলছেন?

–আমাদের ছাত্ররাও তো তা দেখবে।

–খুব সম্ভব। শুনেছি রাজবাড়ির দরজা সে রাতে বন্ধই হয় না।

-তাহলেই দেখুন, সার! উপরন্তু যদি তারা দেখে তাদের একজন শিক্ষকই সেই অভিনয়ে অংশ নিচ্ছে–

–সে কী? কে? বাগচী অবাক হলো।

আমাদের চরণ দাস।

বাগচী হো-হোকরে হেসে উঠলো চরণ দাসকে অভিনয় করতে দেখার কল্পনায়। পথের ধারে সে দাঁড়িয়ে পড়লো। হাসি থামলে বললো–বলেন কী, আমাদের চরণ দাস? তার চোখের সামনে ধুতি, বেনিয়ান,দড়ির মতো পাকানো চাদর গলায় গম্ভীরমুখ এক যুবক ভেসে উঠলো যে কাজের ব্যস্ততায় প্রায়ই দাড়ি কামায় না।

গম্ভীর স্বরে সর্বরঞ্জন প্রসাদ বললো–টকমাত্রেই নারীচরিত্র থাকে নাকি? সেই নারীচরিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত কোনো পুরুষচরিত্রে অভিনয় করা কি ভালো?

বাগচীর গায়ে সকালের রোদ পড়ছে। আবার গাছপালা থাকায় কুয়াশাও আছে। পথের ধারের গাছের ডালপালার ছায়া যেমন পথে তেমনি তার গায়ে জালি কাটছে। সে হেসে বললো–এই এক মহা অনিষ্ট, আজন্ম আমরা নারীচরিত্রের সঙ্গে জড়িত। ওতপ্রোতভাবেই। এমনকী আমরা শুরু হচ্ছি নারীর উদর থেকে।

একী অদ্ভুত কথা!একটা কঠিন আঘাত পেলো সর্বরঞ্জন। একী সাংঘাতিক কথা বলছেন এত হালকা সুরে হেডমাস্টারমশাই! হায়, সুনীতি বলে কিছু আর রইলো কি? কিন্তু সেও অনেক যুদ্ধের পোড় খাওয়া সৈনিক; হয়তো হেরেছে বেশি, কিন্তু জয়লাভও করেছে। সে তার বক্তব্য বাছাই করে নিলো। তার দাড়িটা কেঁপে উঠলো একবার। সে বললো–না না, না, একে আমরা বোধ হয় এত সহজে চিন্তা থেকে সরিয়ে দিতে পারি না। তাদের এই নাটকে পরনারী ধর্ষণের কথা আছে, আয়োজন আছে। জগদীশ্বর আমাদের পাপ কথন ক্ষমা করুন। নিয়োগী দু হাত তুলে দুটি তর্জনী অনেকটা করে নিজের দুকানে ঢুকিয়ে দিলো যাতে তার নিজের কথাটাও সবটুকু কানে না যায়।

কারো কারো কৌতুকবোধ বেয়াড়া রকমের থাকে। মনে হলো, বাগচী আবার হেসে উঠবে। কিন্তু সে বরং থমকে গিয়ে চিন্তা করলো। নিয়োগীর প্রকাশটা কৌতুকের হতে পারে, কিন্তু এর মধ্যে চিন্তার বিষয় থেকে যাচ্ছে। নারীধর্ষণ অসম্ভব ঘটনা নয়, কোনো নাটকে তার চিত্রণও থাকতে পারে, কিন্তু তার সঙ্গে একজন শিক্ষকের অভিনয়ে সংযোগ থাকা উচিত হয় কি? বাগচীর হাতের ছাতাটা একবার দুললল, সে বললো, আচ্ছা, এ বিষয়ে আমি চিন্তা করবো, চরণের সঙ্গে কথা বলে নিই।

প্রকৃতির স্নিগ্ধ কবোষ্ণতা এই ছুটির দিনে বাগচীর আরামদায়ক বোধ হচ্ছিলো। এমনও হতে পারে, ব্রেকফাস্ট অন্যান্য দিনের মতো স্বচ্ছন্দ হয়নি, এখন কিন্তু জীর্ণ হতে হতে স্নিগ্ধ পুষ্টিতে তার কোষগুলিকে হৃষ্ট করছে। বাগচী বললো–আচ্ছা নিয়োগীমশায়, আপনার কি মনে হয়, এ গ্রামটার কিছু কিছু বিশেষত্ব আছে? কথাটা বোধ হয় এই, আনন্দদায়ক শান্তি এখানে খুঁজলে পাওয়া যেতে পারে।

–ঈশ্বরের কৃপায় তা হতে পারে, সার।

নিশ্চয় নিশ্চয়, তিনি কৃপা না করলে কৃপা চাইবার বুদ্ধিও হয় না, এরকম শুনেছি। আপনাকে একটা ভালো সংবাদ দিতে পারি, আপনার মতও জেনে নিতে পারি। এ অঞ্চলে রেভরেন্ড রলে নামে একজন ক্যাথলিক মিশনারী একটি মিশন হাউস করতে চাইছেন। ইংল্যান্ডের নতুন ক্যাথলিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এঁরা।

–এ তো আশ্চর্যের কথা, সার, ভারি আশ্চর্যের কথা!

–হয়তো পরে একটা স্কুল কিংবা চিকিৎসালয়ও হবে সেই মিশনে।

নিয়োগী বললো–না, না, সার, এর চাইতে পরমাশ্চর্যের বিষয় আর কিছু হতে পারে ।

তারা পাশাপাশি হেঁটে চললো। বাগচীর একবার মনে হলো তার পক্ষে এখনই কি ঘোড়ায় ওঠা ভালো হবে? তার আর মিস্টার নিয়োগীর উদ্দেশ্যে এখন কিছু পার্থক্য আছে বটে। কিন্তু একজন ভদ্রলোক তার বাড়িতে এসেছিলেন, তাকে কী করে বিদায় নিতে বলা যায়? আলাপ চালিয়ে নিতে সে বললো, ক্যাথলিকরা কিন্তু এ রকম সাকার পূজাই করে থাকে। পুতুল না হোক, মূর্তি থাকে।

নিয়োগী বললো–অবশ্যই সার, তা কিন্তু পবিত্র ক্রিশ্চান ধর্ম।

কিন্তু সে অন্যদিকে ভাবছিলো, অন্তত তার ঠোঁট এবং চোয়াল কিছু চিবানোর ভঙ্গিতে নড়ছিলো। সে বললো–সার, আমাদের চরণ দাসের পদস্খলনের ব্যাপারটা-না, না, সার, এ কথা আমাকে বলতেই হবে-ওঠা তুচ্ছ ব্যাপার নয়। যদিও হয়তো স্ত্রীলোক অভিনয় করবে না, কিন্তু কী মারাত্মক, বিশেষ এই গ্রামে, রুগ্নদেহে কুপথ্য সম্বন্ধে যেমন, এ বিষয়ে সতর্ক থাকতেই হবে।

বাগচী ভাবছিলো, তার নিজের ধর্ম যা ক্যাথলিক বা প্রটেস্ট্যান্ট কিছুনয়, তাতে ঈশ্বরের কোনো আকার করার কথা ওঠে না, ওদিকে কিন্তু ভাবতে গেলেই আকার একটা আসে। ফলে অন্যমনস্ক থাকায় সে নিয়োগীর কথা সবটুকু শুনতে পায়নি। রোগের কথায় উৎকর্ণ হয়ে বললো–কী বলছিলেন? এই গ্রামে কি বিশেষ রোগের কথা বলছিলেন? বিশেষ কোন প্রাদুর্ভাব নাকি? শুনিনি তো!

নিয়োগী বললো–সত্যভাষণের সুযোগ সত্যই কম। সুযোগ হলে তার সদ্ব্যবহার করা উচিত। আপনি যখন এই গ্রামে ক্যাথলিক রলের মিশন হাউস কল্পনা করে প্রফুল্ল, তখনই দেখুন, কত না জাঁকজমক সহকারে শিবমন্দির হচ্ছে এই গ্রামে।

–রানীর মন্দিরের কথা বলছিলেন কি? ওঁরা ধনবান, জাঁক হবেই। গ্রামটাও ওঁদের।

কিন্তু, নিয়োগীর মুখ আরো গম্ভীর হলো, সে বললো–এও কি ভালো সেই বিগ্রহ প্রতিষ্ঠায় রক্তচন্দন ব্যবহৃত হবে? বাগচী হো হো করে হেসে উঠলো, কিন্তু তৎক্ষণাৎ বললো–আমার লঘুভাব ক্ষমা করবেন, বিশ্বাস করুন শিব প্রতিষ্ঠায় রক্তচন্দন প্রয়োজনের কিংবা অধর্ম তা আমার জানা নেই। আপনার কি মনে হয় শ্বেতচন্দনই প্রশস্ত?

নিয়োগী বললো–না,না, এসব ব্যাপার লঘুভাবে দেখা উচিত হয়না। রক্তচন্দন কি রক্তের প্রতীক নয়? তাতে কি লিঙ্গ উপাসনা আরো বাস্তব হয় না। তিনি আমাদের অন্নদাত্রী, কিন্তু একবারও না বললে সত্য কুণ্ঠিত হয়। যে প্রকার শুনি তা হয়তো চন্দন নয়, রানীমার রক্তই।

নিয়োগী দুই কানে আবার তো আঙুল ঢোকালো বটেই, শিউরে উঠে চোখ দুটিও বন্ধ করে ফেলো। বাগচীর মুখ নিরতিশয় গম্ভীর। সে বললো, নমস্কার মশাই, আপনার বাসা অদূরে। তাছাড়া ডিসপেনসরিতে রোগী আসার সময় হয়ে যাচ্ছে।

বাগচী পিছনে তাকিয়ে তার সহিসকে দেখতে পেলো। সে টাট্টু নিয়ে এতক্ষণ নিঃশব্দে অনুসরণ করেছে। টাটুটা নিচু, চড়তে সহজ। বাগচী লাগাম হাতে নিয়ে টাটুতে বসলো।

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখন রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার সুযোগ চলে গিয়েছে; নবকৃষ্ণ, মতি শীল, এমনকী দ্বারকানাথ হওয়ারও সুযোগ কম। তখনকার কলকাতায় নিম্নমধ্যবিত্তদের একরকম প্রাবল্য চোখে পড়ে। কেরানি, মুৎসুদ্দি, দালালের। দালাল, শিক্ষক, কিছু উকিল, কিছু ডাক্তার, বড়ো জোর ডেপুটি, এবং দোকানদার, অর্ধ বেকার, বেকার। এদের এক অংশ খুব লিখতো, বক্তৃতা দিতে, পত্রিকা ছাপাতে। গবেষণা করতে হলে এইসব কাগজপত্রই হাতের কাছে। ফলে এ রকম ধারণা হয়, কলকাতায় তখন সমাজ ও ধর্মের সংস্কার ও সংস্কৃতি বিষয়ের আলোচনা ছাড়া কিছু নেই, সেই যুগটাই ছিলো সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের। তা অবশ্যই হয় না। তখনো যুগটা খাওয়া পরার দরুন অর্থ সংগ্রহের যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলো।

এখনো যেমন তখনো তেমন কলকাতার হালফিলের চালচলনকে সংস্কৃতি মনে করা হতো, যদিও হয়তো সংস্কৃতি কথাটা তখনো জন্ম নেয়নি। তখনকার দিনে মধ্য, নিম্নমধ্যবিত্ত স্কুলে কলেজে পড়া মানুষদের মধ্যে ধর্মমত, সুনীতি, দুর্নীতি নিয়ে, স্ত্রীলোকের শিক্ষা ও নানা রকমের সমাজ-সংস্কার নিয়ে আলাপ আলোচনা যথেষ্ট গুরুত্ব পাচ্ছিলো। গো-মাংস খেয়ে, মদ্যপান করে সমাজ-সংস্কার করার চাইতে বিধবাবিবাহ প্রবর্তন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ রোধ, স্ত্রীলোকের শিক্ষা ও তাদের পর্দার বাইরে আনা এগুলোই সমাজ-সংস্কারের উপাদান হিসাবে মূল্য পাচ্ছে ক্রমশ যদিও কি উকীল, কি ডাক্তার, কি ইংরেজ ব্যসায়ীর মুৎসুদ্দি, কিছু সঙ্গতি হলেই উপপত্নী বা রক্ষিতা রাখাকে জীবনের সাফল্যের নিদর্শন মনে করছে। তখন মিশনারীরা ১৮৫৭র আশঙ্কাকে কাটিয়ে উঠতে না পেরে ক্রাইস্টের মত প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় ধর্মের কুৎসা প্রচারের ব্যাপারটায় ঢিলে দিয়েছে। ভারতীয়রা বুঝতে পারছে, নামে মাইকেল, এমনকী রেভরেন্ড যুক্ত হলেও জীবনের প্রেয় সহজলভ্য হয় না। কিন্তু পৌত্তলিকতা যে মন্দ তা নিয়ে তর্কের অবকাশই ছিলোনা। শিক্ষিত হলে কথা নেই, এমনকী স্কুলের ছাত্র কী এক গ্লানিতে উপনিষদে মুখ লুকাবে যেন। ইংরেজ রাজা হওয়ায় এই এক সুবিধাও ছিলো, পথেঘাটে প্রকাশ্যে ধর্ম নিয়ে কথা বললে কাজীর লোকেরা ধরতে আসে । তখন তো নতুন যে ব্রাহ্মধর্ম তাতেও কোন শাখা আভঁ-গার্দ এমন তর্ক যেন দেখা দেবে। বেদ অপৌরুষের কিনা, উপাসনা-বেদীতে অব্রাহ্মণ বসবে কিনা এসব সমস্যা পার হয়ে তখন উপবীত ত্যাগের আন্দোলন হচ্ছে। আদি ব্রাহ্মসমাজ থেকে নববিধান বিচ্ছিন্ন হয়নি বটে, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ক্রাইস্ট সম্বন্ধে কোনো কোনো মন্তব্যের ফলে কোনো কোনো ব্রাহ্ম পত্রিকার গ্রাহক থাকতে অনিচ্ছুক হচ্ছেন। তখনো কেশবচন্দ্র রামকৃষ্ণের সংস্পর্শে ব্ৰহ্মকে মা বলে ডাকতে শুরু করেননি, বিজয়কৃষ্ণ নিরাকার ত্যাগ করে সাকারে ঝোঁকেননি। তাহলেও ধর্ম তখন এক নিরতিশয় উত্তেজক বিষয়। অন্যদিকে তখন এদেশের ভাষায় নাটক লেখা হচ্ছে। এটা কৌতুকের যে নাটকের পৃষ্ঠপোষকেরা ব্যক্তিগত জীবনে মদ ও ভ্রষ্টাদের সঙ্গে যেভাবেই সংশ্লিষ্ট হোক, নাটকে সেসবের সমালোচনা দেখা দিচ্ছে, রায়তদের কষ্টের ইঙ্গিত থাকছে। কিন্তু সেই সব প্রাগ্রসর মানুষের প্রাগ্রসর অংশে নাটক সম্বন্ধেই বিরূপতা দেখা দিচ্ছে, কারণ নাটক অলীক, নারী-সংযুক্ত বিষয়। তখন এক দল মদ খেতে না শেখায় পুত্রস্থানীয়দের কী করে ভদ্রসমাজে পরিচিত করবেন ভেবে চিন্তিত, অন্য এক অংশে তখন মদ্যপান নিবারণ সম্বন্ধে ভাবা হচ্ছে।

ঠিক এইসময়েই সর্বরঞ্জন কুসুমপ্রসাদ রাজনগরের জ্ঞানদা বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক-শুনতে পেলো, মানুষের গলায় কেউ তাকে কিছু বলছে। তার সামনে, পিছনে, পায়ের নিচে কয়েক গজ রৌদ্রে উজ্জ্বল পথ, তার বাইরে কিন্তু বৃত্তাকারে কুয়াশা। সে শুনলো:করুণাময় আর বিধানচন্দ্র দুজন আলাদা বাবু, হুজুর কাকে খবর দিতে বলেছেন?

নিয়োগী পিছন ফিরে দেখলো বাগচীর সহিস কয়েক হাত দূরে করজোড়ে দাঁড়িয়ে। দ্যাখে, তার মুখে কিনা এই সকালেই একটা ঘাসের উঁট। নিয়োগী একবারমাত্র তাকে দেখে নিয়ে দম দম করে হাঁটতে শুরু করলো। সে অবশ্যই অন্য অনেক আদর্শবান ব্যক্তির মতো নিরর্থক, অসত্য অকিঞ্চিৎকরকে পিছনে ফেলে চলতে শিখেছিলো।

.

০২.

টাট্টুর উপরেই ট্যাকঘড়ি বার করে বাগচী দেখলো, নটা বাজতে চলেছে। চরণ দাসের বাড়ি কম করেও এক ক্রোশ। টাটুটাকে দ্রুততর করতে তার পশমদার ঘাড়ে চাড় দিয়ে যা, যা বলতে সেটা গলা লম্বা করে তা দুলিয়ে কঁকিয়ে গতির পরাকাষ্ঠা অভিনয় করলো। বাগচী তাকে আরো গতিশীল করতে পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে তার নিতম্বদেশে যু, যুঃ বলে চাপড় দিলে টাট্টু একেবারে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়ালো। বাগচী অবাক। টাটুর আপাদমস্তক দেখে নিয়ে গোড়ালি দিয়ে তার পেটে আঘাত করে হেট, হেটবলাতে টাট্টু আবার তার নিজের চালে চলতে আরম্ভ করলো।

বাগচী চশমা খুললো, রুমালে মুছলো, হাসলো। ব্যাপারটা ধরতে পেরে মনে মনে বললো, তাহলে এই গাধাটা চু চু আর যুঃ যুঃর তফাত বোঝে না।

তখন তার চারিদিকে ঈষৎ রঙিন কুয়াশার মধ্যে আরামদায়ক টাটকা রোদ, ভিতরেও জীর্ণমান ব্রেকফাস্টের কবোষ্ণতা। সে এক চম্পক করাঙ্গুল দেখতে পেয়ে মনে মনে হাসলো, তৃপ্তি বোধ করলো, স্থির করলো কেটকে বলতে হবে, অতটা করে চিনি যেন টাট্টুকে আর না খাওয়ায়। কিন্তু আগে যে চিন্তাটা মনে ছিলো সেটাকে খুঁজে পেলো না। অস্পষ্টভাবে মনে পড়লো, বিষয়টা বোধ হয় আত্মা আর মন। আত্মাও কাজ করে, মনও করে। যত বুদ্ধিসুদ্ধি তা তো মনেরই, তাহলে আত্মা কীভাবে কাজ করে? মনের কাজগুলোকে কি এরকম বলবে যে তার সঙ্গে খানিকটা বুদ্ধি করে চলার, লাভক্ষতির, মানিয়ে নেওয়ার চিন্তা থাকে, যতই আন্তরিকতা থাকুক?

এখন ভাবার সময় নয় এই ভাবতে গিয়ে সে ভাবলো কাল সন্ধ্যার কফির সময়ে, রাতের ডিনারের সময়ে কেটকে বিশেষ উত্তেজিত দেখাচ্ছিলো। বিশেষ তার গাল লাল হয়ে উঠেছিলো, চোখ উজ্জ্বল হচ্ছিলো। গাইসের চিঠির কথা উঠেছিলো আবার।

এটাও তার ভাববার বিষয় কিনা সন্দেহ। সকালে আয়নার সামনে তখন কেট কিন্তু ভেবেছিলো সে ঘুমিয়ে আছে। আজ দেরিই হয়ে গেলো ডিসপেনসারিতে যেতে। তা, কেট অবশ্যই সুন্দরী, গড়নটাও, তাতে প্রাচুর্যও আছে। এবার তার ত্রিশ হবে। আর তাদের বিবাহের তো এবার পঞ্চবার্ষিকী।

সে এদিক ওদিক চাইলো। সব চাইতে কাছের মানুষ একটা খেজুর গাছের মাথায় রস সংগ্রহ করছে। অবশ্যই বলতে পারো তার মতো চল্লিশের এক রেভরেন্ড পাদরির এসব ব্যাপারে বাক্যব্যয় করা উচিত হচ্ছে না। কেট নিশ্চয়ই বুদ্ধিমতী, সংসারের ব্যাপারে পদক্ষেপগুলো হিসাব করা। আর তুমি কি কল্পনাও করতে পেরেছিলে, কত সহজে পরিবর্তন আনা যায়, কথাটা বলা যায় কাল রাতে কেট যা বললো–! আমাদের সংসার এবার পূর্ণ হোক। অবশ্য এখন বলতে পারো, কালকের রাতের পোশাকে আর চুলের খোঁপায় কিছু বিশেষ ছিলো। খুব সোজা কথা–একটু মুখ লাল করে বলা, সংসার পূর্ণ হোক।

এরকমও সে শুনেছে যে কোনো এক বসন্তের প্রভাবে উভয়ে যখন কী এক লাবণ্যে পূর্ণপ্রাণ…কেট খুব বুদ্ধিমতী, হিসাব করে চলে। তা বুদ্ধির তো সেটাই ধর্ম। কিন্তু তুমি কি বলবে সন্ধ্যার সেই উত্তেজনা গাইলসের চিঠি নয়? একটা পরিবর্তন কিন্তু।

বাগচী ভাবলো, ও সেই নারীসংযোগের কথা। আচ্ছা আচ্ছা, নিয়োগীমশায়কে ওভাবে পথের উপরে ত্যাগ করা ভালো হয়নি। দেখা হলে ক্ষমা চেয়ে নিলে হবে। সে মনে মনে হাসলো, কিন্তু লক্ষ্য করো কি ক্যাথলিক রলে, কি বৌদ্ধ শ্ৰমণ, কি হিন্দু সন্ন্যাসী পরিহার করতে বলে। তাকে কিছু লজ্জিত দেখালো। না, নিয়োগীকে দোষ দেওয়া যায় না।

বাগচী কিছু অন্যমনস্ক থাকায় চরণের সেই ডিসপেনসারির বারান্দার ভিড়টাকে লক্ষ্য করেনি। ফলে সে কাছাকাছি যাওয়ামাত্র চারিদিকে একদল ছাত্রকে দেখতে পেলো। তাদের মধ্যে দুএক পা এগিয়ে তার মনে হলো, এ সময়ে এখানে তাদের থাকার কথা নয়। সে বললো–তোমরা এখানে? কয়েকজন একসঙ্গে বললো–আমাদের ইসমাইলের চোখটা তো সারবে সার? বাগচী নিজেই তাদের সমস্যা ও উত্তেজনার কারণটাকে দেখতে পেলো। বারান্দায় বেঞ্চিতে বসা এক বালকের চোখ কপাল জড়িয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। বাগচীর এক হাতে লাগাম, অন্য হাতে ছাতা, সে দুটিকে দুজনের হাতে দিয়ে বারান্দায় উঠে কোটটাকে তৃতীয় জনকে ধরতে বলে ব্যান্ডেজ খুলতে শুরু করলো। অসুখটা কঠিন। চোখটা বিশ্রীরকমে ফুলে বন্ধ হয়ে আছে। যে তুলো দেওয়া হয়েছে তাতে রক্তের চিহ্ন। অন্যটিও আক্রান্ত, কিছু কম। বাগচী সস্নেহে ব্যান্ডেজটা আবার বেঁধে দিলো।

একজন ছাত্র বললো–ওকে ওষুধ দেন সার।

স্বভাবত ধীরভাষী চরণ ধমকে উঠলো–ওষুধ দেওয়া হয়েছে। যাও এখন, বিরক্ত কোরো না।

ছাত্ররা হকচকিয়ে বারান্দা থেকে নেমে গেলো।

বাগচী বললো, তোমাদের ইসমাইল আমাদের বুঝি কেউ নয়? তুমি কিন্তু টক খেও ইসমাইল। ভয় পেয়ো না, চরণবাবু তো ওষুধ দিয়েছেনই। ইসমাইল কি ওষুধ নিতে আবার বিকেলে আসবে, চরণ?

চরণ অন্য দিনের চাইতে অনেক গম্ভীর। সে বললো–আমি ওকে সেরকমই বলেছি সার।

ছাত্ররা চলে গেলে চরণের বারান্দা ফাঁকা হয়ে গেলো। বাগচী রসিকতা করে বললো– দ্যাখো তোমার ওষুধের গুণ, ডিসপেনসারিতে একজন রোগী নেই।

চরণ বললো–এখন মসুর কলাই-এর ক্ষেত করার সময়, যার যেটুকু অঘ্রাণের ধান আছে কাটার সময়। দুএকজন এসেছিলো, ওষুধ নিয়ে গিয়েছে।

আলাপটা এগোলো না। ব্যাগ কাঁধে ডাকহরকরা দেখা দিলো। সেখানে বসেই ডাকের ব্যাগ নিলো চরণ, তেমন একটা মুখ বন্ধ ব্যাগ এনে দিলো ডাকহরকরাকে। চরণ যখন ডাকের এই কাজ করছে, বাগচী ভাবলো কী অদ্ভুত কাজ করে এই লোকটি। সকালে ডাকের কাজ করে, সেখান থেকে স্কুলে, আবার কিছু ডাকের কাজ, বিকেলে এই ডিসপেনসারিতে ওষুধ বিলোয়, নিজের ক্ষেতখামারের কাজ তো আছেই। নিয়োগী আসার পর থেকে সন্ধ্যায় ইংরেজি শিখছে। রবিবারেও এই ডাক এলো।

হরকরা চলে গেলে বাগচী বললো–রোগী আসে আমি দেখবো, তুমি ডাকের কাজ করতে পারো। চরণ ডাকের কাজ করতে শুরু করলো। বাগচী বসে রইলো খানিকটা সময়। এক এক করে দু-তিনজন রোগী এলো। তাদের বিদায় করে পাইপ ধরালো বাগচী। সে অনুভব করলো তামাকটা বেশ ভালো, আর এখনকার আবহাওয়াটাও। তাছাড়া কেট দেখা যাচ্ছে চিরদিনই বেশ সাহসী। ভাবো, সেবার রাজকুমারের সঙ্গে গড়ের জঙ্গলে চলে যাওয়া। অবশেষে ঘড়ি দেখে বললো–আর মিনিট দশেক। তোমার কাজ হলো? আজ দিনটা বেশ ভালো। ভাবছি তোমাকে সঙ্গে করে কিছুটা ঘুরি। আমার কিছু সিল্ক কেনার ইচ্ছা হচ্ছে যদি পাই। দেখা যাক না, কী বলে?

চরণ বললো–দু-তিন দিন আগে সেই আর্মেনি শিশাওয়ালকে দেখেছিলাম। তার কাছে সিল্ক নেই?

শিশাওয়াল কলকাতা থেকে নৌকা সাজিয়ে অন্যান্য বছরের মতো এবারও এসেছে। তার ব্যবসাই এটা। পণ্যের দিক দিয়ে সে একচেটিয়া। এসব অঞ্চলের ধনীদের, মধ্যবিত্তদের, এমনকী নিম্নমধ্যবিত্তদের উপযুক্ত পণ্য থাকে তার। মুখ্যত অবশ্য মরেলগঞ্জের কুঠিয়ালদের এবং রাজবাড়ির অর্ডার-সাপ্লায়ার। শিশাওয়াল নামও পণ্য থেকেই। কাঁচের শীট, গ্লাস টাম্বলার, চিমনি, ডোম, ঝাড় এসব তো বটেই, নানা আকারের মদের বোতলও অবশ্যই থাকে। কলকাতার আধুনিকতার কথা মনে রেখেই কুঠি ও রাজবাড়ি থেকে অর্ডার দেওয়া হয়। কিন্তু আধুনিকতার সৃষ্টি তো মুখ্যত বণিকের পণ্যে, সুতরাং আমদানি অর্ডারকে ছাপিয়েই যায়। অবশ্যই তার সেলসম্যানশিপও যথেষ্ট। সে ধনীদের শাল, দোশালা, বনাত আনে। নানা দামের রাগ-কম্বল আনে, সূতার বস্ত্র ইত্যাদিও আনছে নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য।

সম্ভাব্য রোগীদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বাগচী শিশাওয়াল থেকে রানীমার জন্মোৎসব, তা থেকে নাটকের চিন্তায় পৌঁছে মনে মনে হাসলো। জিজ্ঞাসা করলো–আচ্ছা, চরণ, খবরটা আজই শুনলাম, তোমরা নাকি এবার থিয়েটার করছে রাজবাড়িতে?

চরণ লজ্জায় মুখ নামালো।

বাগচী বললো–কী নাটক? সে কি আমি পড়েছি?

চরণ বললো–প্রথমে ঠিক হয়েছিলো নীলদর্পণ।

বাগচী মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো–কিসের দর্পণ? রসো রসো, মনে পড়ছে। গত মাসে দেওয়ানজি যে কয়েকখানা বই স্কুলে দিয়েছেন তার মধ্যে এটা ছিলো। কিন্তু ভাষা সহজ হলেও তা কিন্তু ছাত্রদের পড়ানো যায় না। ভাষা সহজ ভালো, কিন্তু অত গেঁয়ো ভালো নয়। বলবে ঘরের চারপাশের ভাষা। কিন্তু ঘরের চারপাশে তোজঞ্জালও থাকে। কিছুউপরে উঠতেই না স্কুল।

চরণ বললো–দেওয়ানজির সেরেস্তদার বেজো কলকাতা থেকে বইটা এনেছে। তা কিন্তু আমরা করছি না। গৌরীরা বুড়ো শালিখ পছন্দ করেছে, আর একেই কি বলে।

এসবও কি বেজোবাবু এনেছে? কার লেখা,কী বৃত্তান্ত সেসবনাটকের? চরণ বললো– হ্যাঁ সার, বেজোই এনেছে। মাইকেলসাহেবের লেখা।

কিন্তু বাগচী তখন নীলদর্পণের কথাই ভাবছিলো। সেই নীলকরদের অত্যাচারের কথা যা সেই নাটকে দগদগে করে আঁকা। সেই দাদন আর দাদনের নীল আদায়ের জন্য গাদন। সে বললো–আচ্ছা, চরণ, তোমার সেই ডানকানার খৃস্টানি আত্মার কাগজপত্তর জাল করার, লাখ বছর ঘুমিয়ে থাকার গল্প মনে আছে?

-ওটা, সার, গ্রাম্যরসিকতা হয়েছিলো। চরণ অপ্রতিভ হলো।

না চরণ, না। তোমাদের সেই রসিকতা বেশ তীক্ষ্ণ ছিলো। বলতে কি তোমাদের সেই আলাপ নীলদর্পণে ঢুকিয়ে দিলে মানাতো। সে তুলনায় নীলদর্পণের রসিকতাই মোটা।

চরণ অবাক হয়ে বাগচীরমুখটাকে দেখে নিলো। সে জানে হেডমাস্টারমশাই-এর চিন্তার খেই ধরা তার পক্ষে সম্ভব নয়। দেওয়ানজির বন্ধু, আচারে ব্যবহারে সংস্কৃতিতে যিনি পুরোপুরি ইংরেজ, তিনি এ বিষয়ে কী ভাবছেন কে জানে! নীলদর্পণই এখনো মনে রেখেছেন,হয়তো শোনেননি যে তারা নীলদর্পণ নাটক করছেনা। মুখটা যেন থমথম করছে।

বাগচী বললো–দ্যাখোচরণ, লোকে বলে আত্মা কৃতকর্মের বিচারের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, কেউ বলে পাপের শাস্তি সঙ্গে সঙ্গে হয়, এরকম মতও আছে–পাপপুণ্য, তার শাস্তি পুরস্কার সমাজ শাসনে রাখার জন্য তৈরী গল্প। কিন্তু, চরণ, অন্যকে পীড়ন করা যে পাপ এ কিন্তু খৃস্টানরাও স্বীকার করে।

চরণকে আজ অন্যরকমই দেখাচ্ছে। সে যেন কোথা থেকে মনকে ফিরিয়ে আনলো, বললো–কিছু বলবেন, সার? বাগচী প্রশ্নটায় অবাক হলো। বললো–তুমি কিছু ভাবছিলে, চরণ, আমার বক্তৃতাটা মাঠে মার খেলো। কোন রোগীর কথা ভাবছো? আচ্ছা, চরণ, তুমি কি মিশন হাউস দেখেছো? মনে করো, এই অঞ্চলে একটা মিশন হাউস হচ্ছে। সেখানে ইংল্যান্ডের মিশনারিরা থাকবেন।

চরণ বললো–মরেলগঞ্জের কুঠিতে একাধিক ইংরেজ সপরিবার আছেন।

চরণের তুলনাটা তার কাছে এত ভ্রমাত্মক যে বাগচী হেসে বললো–মনে হচ্ছে তুমি মিশনারীদের দ্যাখোনি। আমি তোমাকে তাদের ধর্মমত মানতে বলছি না। আমিও সব মানি না। মিশন হাউসের সঙ্গে শিক্ষাদীক্ষা, বদান্যতা, পরোপকার, আধুনিকতা অনেক কিছু জড়িত থাকে। মরেলগঞ্জের কুঠিয়ালদেরই কেউ কেউ এ ব্যাপারে উৎসাহী। তুমি তো কীবল সাহেবকে নিজেই দেখেছো আমার কুঠিতে।

-তবেই তো, সার। দা ডেভিল ওয়জ সিক দা ডেভিল এ সেন্ট উড বি।

কী বললে? ডেভিল?

চরণ তাড়াতাড়ি বললো–হয়তো আমারই ভুল, সার।

না, চরণ, তোমার ইংরেজি উচ্চারণটা ভালোই। আমি মনে করতে পারছি না ছড়াটা কোথায় শুনেছি। কিন্তু দ্যাখো, এ অঞ্চলে মিশন হাউস হলে আমাদের গ্রামেরও পরিবর্তন হবে। তাছাড়া নতুন আদর্শ চোখের সামনে থাকা ভালো। আমাদের পুরনো আদর্শ প্রয়োজনমতো বদলে নিতে পারি। তাতে ভালো হয়।

-ভালো হয়?

তর্কে অভ্যস্ত পাদরির সতীদাহ নিবারণ ও বিধবাবিবাহ আইনের কথা মনে এলো। যুক্তি হিসাবে এটাকেই সে খুব জোরালো মনে করলো, কারণ চরণ নিজেই বিধবাবিবাহ করেছে। সে বলতে গেলে এদেশে কিছুদিন আগেও বিধবাদের পুড়িয়ে মারা হতো, এখন প্রয়োজনে তারা বিবাহিত হচ্ছেন। কিন্তু নিতান্ত ব্যক্তিগত এই যুক্তি থেকে সে নিজেকে সামলে নিলো।

পাইপটা ঝেড়ে পকেটে রেখে সে ঘড়ি দেখে হেসে বললো–দশটা বাজলোচরণ। আমি তোমাকে মিশনারিদের সম্বন্ধে অনেক বলতে পারতাম। কিন্তু এখন চলল, একটু ঘুরি। সিল্ক খুঁজতে হলে তুমি তাঁতিদের কাছেই যাও, তাই নয়?

চরণ বললো, চলুন সার, আমি দুমিনিটে তৈরী হয়ে আসছি।

চরণ দাস অন্দরে গেলে বাগচী ভাবলো : এটাও ভেবে দেখার মতো বৈকি যে মিশনারিদের প্রধান উদ্দেশ্য ধর্মান্তরীকরণ। কিছু মানুষকে তা ক্রিশ্চান করতে চেষ্টা করবেই। চরণ কি এই ভেবেই বিরক্ত? এটা কি চিন্তায় উঠে আসেনি, কিন্তু মনের তলায় আছে এমন স্বজাতিক্ষয়ের আশঙ্কা?

চরণ প্রস্তুত হয়ে এলে তারা বেরিয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ তারা পাশাপাশি নিঃশব্দে হেঁটে চললো। পরে বাগচী বললো–সব যদি ছেড়েও দাও চরণ, মিশনারিরা ইংরেজ শাসনকে তাড়াতাড়ি টেনে আনতে পারে। পথঘাট হবে, হয়তো রেল এসে যাবে, হয়তো তারে খবর পাঠানোর বন্দোবস্ত হবে।

এটা একটা কৌতুকের ব্যাপারই হলো। বাগচী টের পেলো না এই পথঘাটের কথাটা এইমাত্র বাইরে থেকে তার মনে ঢুকলো। তারা ফরাসডাঙার দিকে চলেছেতখন। তারা তখন যেখানে তার কিছু দূরে পথের উপরে বেশ কয়েকজন মানুষ কিছু মাপজোখ করছে। ওভারসিয়ার সুরেন তাদের নেতা। বাগচী যেন তাদের লক্ষ্যে আনলোনা, কিন্তু যেন আগের তর্কের টানে বললো, রাণিমার শিবমন্দির হচ্ছে, তাতে কত লোক একবছর থেকে কাজ পাচ্ছে, দেখেছো? মিশন হাউসও খুব ছোটো হয় না। তাদের বাড়িঘর পথঘাট তৈরীতেও কত লোক কাজ পাবে দেখো।

আলাপটা ক্রিশ্চান মিশন হাউসের অনেক বড় বড় সম্ভাব্য উপকরণ থেকে অকস্মাৎ কিছু লোকের কিছুদিন ধরে মজুরি পাওয়ার সম্ভাবনায় নামলে চরণ হেসে ফেলো। আশ্চর্য রকমে অন্যমনস্ক না হলে এমন হওয়ার নয়। হেডমাস্টারমশায়ের কথা। কিন্তু তার কথাও অনেকক্ষণ থেকে কি একগুঁয়ের মতো শোনাচ্ছে না? সে যেন একমত হওয়ার সুযোগে স্বস্তি পেয়ে বললো–তা ঠিকই, সার। শিবমন্দির শুধু নয়। ডাকঘরের পর থেকেই এবার পাকা সড়কের কাজ শুরু হয়েছে। শুনছি নাকি রাজবাড়ির সদর থেকে শিবমন্দির তকএকই পাকা রাস্তা হবে, আমাদের স্কুলের পাশ ছুঁয়ে, পুরনো ঝিলের উপরে অ্যাকোয়াডাক্ট তৈরী করে। চাষআবাদ নেই, কাজকর্ম নেই এমন লোকজনের উপকার হচ্ছেই তো বটে।

বলো কী? এসব বলোনি তো আগে? বাগচী হো হো করে হেসে উঠলো। বললো– তুমি তো আচ্ছা অন্যমনস্ক লোক হে! সামনে কত লোক সড়কের কাজ করছে দ্যাখোনি? ওখানে সুরেনবাবুদের দেখছি। মুখ ঘুরিয়ে চলো। বন্ধুদের দলে জুটে থিয়েটারে মাতো যদি আমার রেশম খোঁজাই হবে না।

খানিকটা দূরে গিয়ে বাগচী বললো–এত সব সড়ক কি শুধু শিবমন্দিরে যেতেই মনে করো?

চরণ বললো–শুনছি সেখানে পেত্রোর বাংলোও নতুন করে করা হচ্ছে। একটা নতুন বাড়িও নাকি উঠবে কলকেতার সাহেববাড়ির কায়দায়।

-তাহলেই দ্যাখো। আচ্ছা, সেখানে সে বাড়িটা কেন হবে আন্দাজ করছো?

চরণ বললো, ওটা তেমন তেমন সাহেবসুবোদের জন্য গেস্টহাউস হতে পারে। হতে পারে রাজবাড়ির কেউ থাকবেন, রানীমাও হতে পারেন।

বাগচী ভাবনো, রানীমা, রানীমা কেন? তা, শুনেছি রাজাদের বিবাহ হলে তেমন ব্যবস্থা হয়। চরণ চিন্তা করলো, তার কথাটা কি শ্লেষের মতো শুনিয়েছে? এ বিষয়ে সে হেডমাস্টারমশায়ের সঙ্গে একমত যে রাজবাড়ির মন্দির, সড়ক ইত্যাদির ব্যাপারে মানুষ কাজ পাচ্ছে। তা দরকার ছিলো। কুমোর, কামার, তাঁতি, চাষীদের কাজের বয়স হলেই বর্ণগত জীবিকা ধরবে সে সুযোগ আর কোথায়? তাদের কেউ কেউ জীবিকা পাচ্ছে। কিন্তু আর সব জমিদারের মতো রানীমা যদি কলকাতা ঘেঁষা হতেন? সে মনে মনে হাসলো: আসলে বিধবা রানীমা ক্রিস্টান ব্রাহ্মদের ব্যাপারগুলোকে ম্লেচ্ছকাণ্ড ভেবে কলকেতার দিকে যেতে চান না। তাই উপকার।

.

০৩.

তখন তারা ফরাসডাঙা দিয়ে চলেছে। বাগচীর মন ততক্ষণে পথঘাট থেকে রেশমের দিকে সরে গিয়েছে। সে বললো–এবার তাহলে আমাদের এই গ্রাম ক্রমশ হুগলী চুঁচুড়া, শ্রীরামপুরের মতোই একটা শহর হয়ে উঠবে দেখো। কিন্তু পরক্ষণেই বললো–এদিকেই কোথায় ধনঞ্জয় বসাকের বাড়ি, সেদিকেই চলল।

সেকালটা, অবশ্যই, রাজনগরে আর এমন ছিলো না যে বাগচী যে কোনো সকালে বেরিয়ে তার আশামতো ব্রোকেড-সিল্ক দূরের কথা গরদ-মটকাই পেয়ে যাবে। সে প্রথমে বসাক-পাড়ার ধনঞ্জয় পরে মালিকপাড়ার মেহেরালির দেখা পেলো। চিকিৎসার সূত্রে তারা পূর্ব-পরিচিত বটে। তাঁতিদের মধ্যে দবীর বক্সের সাগরেদ আল্লারাখা বসাকের কথা বাদ দিলে তারাই এ অঞ্চলে প্রধান।

ধনঞ্জয়ের লম্বাৰ্তাতঘরে তখন তাত চলছিলো; অন্তত চারখানায় কাজ হচ্ছিলো; তারই একখানায় সে নিজে। সে জানালো রাজবাড়ির উৎসবের দরুণ সে কিছু তসরের গড়ার বরাত পেয়েছে। শীতে ওম দেবে, কিন্তু খসখসে আর মোটা। হুজুরের হুকুম পেলে সে পরে এক থান তসর বুনে দিতে পারে। গরদ চাইছেন, সে সুতো নেই। বামুনমশায়রা মাঝে মাঝে তসর কেঠো নেন, গরদ কে নিচ্ছে আর? শুনেছি মালিকবাড়ির ওরা রাজবাড়ির দরুন গরদের শাড়ির বরাত পেয়েছে। দেখুন ওখানে, তাছাড়াও গরদ বুনছে কিনা। সুতোনাকি রাজবাড়ির সরকারই এনে দিয়েছে।

বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–এখানে বুঝি গরদের সুতো হয় না?

-হতো তো। সে কিন্তু পেত্রোসাহেবের আমলে। ফরাসডাঙার আধখানায় উঁতচাষ ছিলো, আজ্ঞা।

-এখন বুঝি তসরের সুতো হয়। বামুনদের লাগে বলছিলে।

–আজ্ঞে না। সেও তো আনাতেই হয়। দামে কম,ঝুঁকি কম। বামুনে তসর বছরে দশখানা বিকোয়, দাম পেতে আজ্ঞে একবছর। কিনছে কে যে কাটুনি সুতো কাটে, তাঁতি তাঁত বয়? জোলাপাড়ায় দেখুন গামছা আর মোটা সুতোর মাঠা। আট আনায় যে মিলেন শাড়ি, তাঁতি দিনরাত খেটে ডেড় টাকায় দিতে পারবেনি। আর বামুনমশায়রা যে কিনবে আমরা আগে তো দেবো-থোবো। আমরা গিইচি তো তেনারা রইলেন? শাপমুন্যিরও আর আগুন নেই।

বাগচী হেসে ফেলো, কিন্তু বললো–না, না, বোধ হয় ঠিক বলছো না। পিয়েত্রো গত বলে খরিদদাররাও গত হবে কেন?

ধনঞ্জয় বললো–এখন বুঝি, আগেই টান ধরেছিলো। এখন ভাবলে বুঝি, ত্রিশ বছর থেকে তাঁতের বৃদ্ধি বন্ধ ছিল। সাহেব থাকা তক বাজারের কথা ভাবতাম না। বোনা মাল গুদামে পৌঁছে দিলে হলো, সুতো চাই, আনো গুদাম থেকে। দেখতে হতো মালটা কী হচ্ছে, তাতে হাঁকফাঁক না পড়ে।

-তাহলে বলছে, পিয়েত্রোর মতো মহাজন আর একজন না-আসা পর্যন্ত তসর গরদ আর উঠতি হচ্ছে না।

আজ্ঞে না। নামার দিকে। বরাত ছাড়া, আগাম দাদন ছাড়া কে বুনবে? কী এক মিলেন কাপড় হয়েছে, তাই নাকি বাবুয়াদের ফ্যাশোয়ান। সাপানে কাচো, গরমে ইস্তিরি চালাও। কে আর তিনগুণ দিয়ে রেশম কিনছে?

বাগচী বললো–হ্যাঁ, ধনঞ্জয়, কী হবে তাহলে এখন?

ধনঞ্জয় বললো–জন্ম থেকেই শুনছি, কী হবে? বোকার জাত সার, ধানপানের কাজ জানি না, রোদজল সয় না, কাদাপাকে গা ঘিনঘিন। কী হবে দেখেন গে ওস্তাগর পাড়ায়। দরজায় দরজায় রঙের ভ্যাট, ধুমসো চাড়ি-গামলা, কাঠের ছাপা, ইস্তিরির কুঁদো। সাদামাটা রেশম চলে না, কে আর কিনছে? রঙিন আর ফুলদার

বাগচী অপ্রতিভের মতো হেসে বললো–তাহলে ব্রোকেড দূরের কথা?

ধনঞ্জয় বললো–চরণভায়া, মাস্টারসাহেবকে নিয়ে মালিকবাড়ি যাও। মেহেরচাচার পাগলামি আছে। বোরকেট করলেও করে দিতে পারে।

মেহের মালিকের বয়স অনেক হবে। মুখে সাদা কিন্তু সৌখীন ফরাসী কায়দার দাড়ি। কথা বলার আগে ঠোঁটে হাসি জড়ায়।

বাগচী তার কাছে মেমসাহেবের গাউনের উপযুক্ত সিল্কের কথা বলতেই সে  বললো–সে আর হয় না।

-ব্রোকেড চেনো, মালিক?

মেহের আলির আত্মসম্মানে আঘাত লাগলো। কী একটা বলতেও যাচ্ছিলো–কিন্তু কথাটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, পেত্রো বুজরুকের বাপেরা আমার আব্বাজান আর চাচাজীকে চুরি করে এনেছিলো মুকসুদাবাদ থেকে। ভরার খুবসুরৎ হিন্দু মেয়ে দেখে নিকাহ দিয়েছিলো।

বলো কী? বাগচী হেসে ফেলো।

–জি, চাবুক খাও, নয় বোরকেড়। রেশমে ফুল ফোঁটাও, ঠাসসা যেন জল না গলে। বোনো জমিজিরৎ মৌরসীতে। লেকিন বিশ থান বোরকে।

–এসব গল্প।

কারিগরে আর ফকিরে ওই এক মিল, হুজুর। কারিগরের বিশ থান হয়ে ওঠে না, ফকিরও খোদাকে পায় না। কিন্তু এই জমিজিরত পেত্রোদের দেওয়া। তো, ওদিকে দবীর বক্সের দবীরখানি মসলিন, ইদিকে আব্বাজানের মালকানি বোরকেডের নাম ছিল, হুজুর। লোকে বলতো, আঙুলে হয় না শুধু, তুকতাক আছে।

বাগচী বললো–ব্রোকেড হয় না, ঠাসা জমির গরদও কি হয় না?

তখন মেহের তার তাতঘরে ঢুকলো। লম্বা উঁচু আটচালাটায় তখনো আট-দশখানাঠাত। তিন-চারটিতে কাপড়, একজন একটিতে কাজ করছে। মেহের জানালো সে তার ছোটো ছেলে। মেহের নিজেই তাঁতের উপরে ঝুঁকে বললো–এসব কাপড়ে কি আপনার হয়? কিন্তু কাপড় দেখে বললো, না, হুজুর, এ আপনাকে দেওয়া যায় না। ছেলেকে হেঁকে বললো, এ রকম কেন রে?

ছেলে বললো–ওখানা রাজবাড়ির নয়। হীরু মহাজনের দরুন। সে বলেছে, মুখপাত, ঠেসে দিও, সব ঠাসলে দামে পোষায় না।

মেহের আলি বললো–না হুজুর, এদিকে ঘুরে লাভ নেই। আপনি বরং আল্লারাখার খোঁজ নেন। সে এখনো রাজবাড়ির দরুন গরদ বোনে।

বাগচী বললো–কাপড় নাই পেলাম। এই আলাপও ভালো লাগছে। কিন্তু, ওস্তাদ, এরকম হলো কেন?

মেহের বললো–হয়েছে কি আজ? তিন কৃড়ির উপরে দশ হলো, তিন কুড়ির খবর রাখি। পেত্রোদের স্থায়ী গুদাম হওয়ার আগে পূজা ঈদের ছমাস আগে দাদন বরাত নিয়ে সাধাসাধি, এক, দেড় মাস আগে কুতঘাটে নৌকার ভিড় লাগতো মহাজনের। রেশম তো বটে, সুতোর শাড়ি নিয়ে কাড়াকাড়ি। সেসব নৌকা বন্ধ হলো; এক কুড়ি বছর আগে পেত্রোদের জাহাজ চলাও বন্ধ হলো।

মেহের থামলো একটু, পরে হেসে বললো–তো পেত্রো বলতেন, মেহের, হাজার বছর ধরে কাপড় দিয়ে সোনা লুঠেছে ওদের, এবার ওরা আইন করে কাপড় দিয়ে সোনা লুঠবে। শুধু কি কাপড়? ইস্তক খোস্তা, কুড়ুল, দা, হেঁসো সেই জাহাজে আসছে। বাগচী বললো–মেহেরমিঞা, তোমার বোরকেড জাহাজে নাই উঠলো,এদেশেও তো বহু লোক

হুজুর ফেশোয়ান বদলায়। পাঁচ সাল আগেও বুজরুক খাঁর কিস্তি যেতো লখনউ। এখন, হুজুর, সেখানে সে ফেশোয়ান নেই। কে আছে কলকেতায় মুকসুদাবাদে দবীরখানি মসলিনের শাড়ি পিন্ধে, কামিজ বানায়, দোপাট্টা পিন্ধে? কে আছে হুজুর, মালকানি বোরকেটের শেরোয়ানি, আছকান, চোগা পিন্ধে?

বাগচী তা সত্ত্বেও বললো–শুনে মনে হয় বরাত ছাড়া, আগাম টাকার দাদন ছাড়া তাতে বসতে চাও না।

মেহের আলি একটু ভেবে বললো–হুঁজুর, সুতোর টাকা বরবাদ, এক মাসের পরিশ্রম বরবাদ যদি এক থান বুনে একবছর বসতে হয় তা বেচতে। আসলে, হুজুর, রোগটা অনেক দিনের। সেই ছিয়াত্তরের রক্তবমি। রাজবাড়ি আর পেত্রার চেষ্টায় ওস্তাদেরা বেঁচেছিলো, কিন্তু পাঁচআনি লোক, কাটুনি জোলা, রজক ওস্তাগর, কামার কুমোর, গুড়ে, চাষী শেষ হয়েছিলো। পেত্রো বলতেন, তারপরে শরীর সারেনি, জাতটাই আধহাত কমে গিয়েছে।

বাগচীর কৌতূহল বাড়ছিলো। রাজনগর-ফরাসডাঙার এ অঞ্চলের খ্যাতিটা তাহলে ছিলো তাঁতের। সেজন্যই বর্ধিষ্ণু। নতুবা শুধু ধানে, তিলে আর গুড়ে বোধ হয় অত বাড়ি রাজবাড়ি এতদিন ধরে গড়ে ওঠে না। সে বললো–আসলে তোমাদের বাজার চাই, বাজারে নিয়ে যাবে দাদনদার বরাতদার মহাজন চাই।

মেহের আলি বললো–আমার ছোটো দামাদের ভাই মহাজন হতেছিলো, এ গেৰ্দের মাল নিয়ে দুসাল কলকেতায় গেলো।

-তারপর?

–মিয়াদ খাটছে।

–সে কী?

মেহের বললো–দাদনদার হতে রাজার জাত হতে হয়। দামের কাজ আদায় হয় না সহজে, আগাম টাকা গরীবের পেটে ঢুকে যায়। আদায় করতে-তো ইংরেজ তা করেঝকে অন্যের মিয়াদ হয়।

.

০৪.

মাসদেড়েক পরে এইসব কথা বিচিত্রভাবে বাগচীর মনে ফিরেছিলো চরণের বাড়িতে বসেই। সে তো পিয়েত্রোর কাছেই শুনেছিলো সেই পাঠান-মুঘল আমলে, ইউরোপেও যেমন, ধর্ম নিয়ে বর্বরতা ছিলো, কিন্তু প্রতিবাদও ছিলো; ক্ষুধা ছিলো, সোনা-জহরৎ ছিলো,নবাব রাজা ওমরাদের বিলাস ছিলো, সোনাও ফিরতে কারিগরদের হাতে। এখন প্রতিবাদ নেই, সোনাজহরৎ নেই, কারিগর নিশ্চিহ্ন। সে চিকিৎসক এবং সেটা তো ডিসপেনসারি। হঠাৎ এরকম ঘোর লেগেছিলো তার মনে! তার স্কুল, ছাত্র, হাটবাজার, লোকজনের চলাফেরা এসব কি সেই ছিয়াত্তরের উচ্ছিষ্ট।

কিন্তু সেদিন তখন বেলা হয়েছে। প্রথম শীতের হলেও, বেলা বারোটায় প্রকৃতি তপ্ত, প্রখর। তারা চরণের বাড়ির দিকে ফিরছিলো। বাগচী লক্ষ্য করলো, চরণ এতক্ষণ সঙ্গে থেকেও একটা কথাও বলেনি। সে হেডমাস্টারের এই রেশম খোঁজায় কৌতুক বোধ করছে না তো? তার এই রেশম খোঁজা কি অস্বাভাবিক ব্যাপার হলো? সে বললো–হা চরণ, তুমি কি সেই অসুস্থ ডেভিলের কথা ভাবছো এখনো?

চরণ বললো–ওরা দাদন-বরাতের কথা বললো।

বাগচী বললো–তাই তাই। সিল্ক নেই বলে এমন করে নেই তা কি তুমি জানতে?

চরণের বাড়ির কাছাকাছি এসে বাগচী বললো–তোমাদের সেই নাটকের কথা যা বলছিলাম।

নাটক হবে। তবে আমি ঠিক ওতে নেই।

বাগচী ভাবলো, দ্যাখো, কেমন সমস্যার সমাধান হয়ে গেলো।

চরণের বাড়িতে টাট্টুর লাগাম হাতে নিয়ে সে বললো––ও হা, ইসমাইলের চোখটা! মার্ক সল দিয়েছো তো? তাই দিও আবার।

টাট্টুরও ক্ষুধার সময়। সেটা একটু তাড়াতাড়ি চলছে চেষ্টা করে, এমনকী তার ক্ষুরে ঘোড়ার মতো না হোক পটপট করে একটা শব্দ হচ্ছে। বাগচী তখন ভাবলো, কী লজ্জা থেকেই বাঁচা গেলো! ভাগ্যে সিল্ক পাওয়া যায়নি। তার চল্লিশ হয়েছে। কেটের ত্রিশ হবে। আজ সন্ধ্যায় পিয়ানো বাজাতে বলা যায়। আমি চরিতার্থ, হে ঈশ্বর! কিন্তু সিল্ক কিনে দিলেই তা বেমানান হতো। এই সিল্ক খোঁজার গল্পও কি বলা যাবে? কেটের তো এমন মনে হতে পারে, সে কাল রাত্রিতে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এসব তারই পুরস্কার দেওয়ার ইচ্ছা। না, না। এ রকম ধারণা অন্যায় হবে যে একজন শুধু কেটকে নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলো না।

সে যখন সার্বভৌমপাড়ার পাশ কাটিয়ে গঞ্জের রাস্তা ধরছে, ভাবলো, তাহলে এতদিন এসব ব্যাপারে সিদ্ধান্তে নেওয়ার ভার আলোচনা না করেও কেটের উপরেই রাখা ছিলো? কেটই দেখতে গেলে তাদের সংসারে ভিন্নজাতীয়া হিসাবে অতিথি। ব্যাপারটা কি এই ভিন্নজাতীয়তার দরুন সমস্যা হয়ে ছিলো? স্বীকার করতেই হবে, কেট যেমন বুদ্ধিমতী, তেমন জেদী। এ দুটোর প্রকাশের সময়েই তাকে কিন্তু ভালো দেখায়।

বাগচী তখন স্কুলডাঙার দিকে যাওয়ার প্রধান পথগুলোর একটির কাছে। সেটার ধার দিয়ে একসারি গাছ থাকায় তার সবটুকু চোখে পড়ছে না। সে ভাবলো, যা স্বাভাবিক তা নিয়ে সে ভাবছেই বা কেন? …সকলেই ভাবে? তাও কিন্তু তার এই চল্লিশে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারে না। কেটকে জিজ্ঞাসা করা যায় না। না, না। এটা তার নিজস্ব সিক্রেট থাক।

রবিবার থাকায় যোগাযোগ হলো একটা। একটা হাঁক শুনে সে চমকে উঠলো। সে দেখতে পেলো, যেখানে সে প্রধান পথটায় উঠবে সেই মোড় দিয়ে একজন যাচ্ছে বটে। তার পরনে ট্রাউজার্স, কিছুটা বিবর্ণ চেক্ ফ্ল্যানেলের শার্ট, মাথার চুল বেশ লালচে, মুখের রং গাজর জাতীয়। হলুদ হলে, মাথার চুল কালো হলে চীনা বলা যেতো। অন্তত তার পিঠে কলকাতার চীনা ফিরিওয়ালাদের মতো কাপড়ের গাঁটরি। দৃশ্যটা বাগচী মনের মধ্যে নিতে না নিতে আবার হাঁকটা শুনতে পেলোবনাত, বনা-ত, বনা-ত।

সেদিকে চোখ থাকায় বাগচীকে আবার মৃদুভাবে চমকাতে হলো, তার টাট্টু এখন যেভাবে চলেছে তাতে যে কোনো লম্বা লোক অনায়াসে তার পাশে পাশে চলতে পারে, লম্বা পায়ে চললে তাকে ছাড়িয়েও যেতে পারে। বাগচী শুনতে পেলো তার কনুইয়ের কাছে কে বললো, গুড মর্নিং, সার; যদি অনুমতি করেন, আপনার কুঠিতে যেতে চাই। আজ রবিবার বলেই এই পথে এসেছি। কয়েকপিস্ ভালো শাল আছে, সার। গত রবিবারে আপনাকে পাইনি।

বাগচী হাসিমুখে ওসবে আমার দরকার নেই বলে নিরস্ত করতে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার আগেই শিসাওয়াল উঁচু গলায় গজ দশেক আগে চলা সেই ফিরিওয়ালাকে ডাকলো। বাগচী লাগাম টেনেছিলো। সেই ফিরিওয়ালাও পিছিয়ে এলো। সে কাছে এলে শিশাওয়াল বললো– আলফ্রেড মিনহাজ ডিসিলভা আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট, রেভরেন্ড ফাদার বাগচী, হেডমাস্টার।

ভদ্র বাগচী বললো, হাউ ডু ইউ ডু মিস্টার ডিসিলভা।

মিনহাজ তার হলুদ দাঁতে হেসে ইংরেজিতে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার। কিন্তু আমার প্রিন্সিপ্যাল আমার নামটা প্রায়ই গুলিয়ে ফেলেন, আমি ডিসিলভা নই, রিয়ালি আইম ও সুলিভান।

তখন সেখানে আলাপ করার সময় নয়। বাগচী কিছু বলার আগেই শিশাওয়াল, যার প্রকৃত নাম য্যাকব ফেলিসিটার, বললো–ডিসুলিভান, তুমি ছোটো গাঁটরি আর পিতলের গজকাঠিটা আমাকে দাও। আর বিকেলের আগে পুবদিকটা শেষ করে এসো।

ও ‘সুলিভান তার বড় গাঁটরির নিচে থেকে একটা ছোটো গাঁটরি বার করে দিলো। তার হাতে এতক্ষণ বোঝা যায়নি, দুটো গজকাঠি ছিলো। তার একটা ফেলিসিটারকে দিয়ে আবেগহীন মুখে হাঁটতে শুরু করেই হাঁক দিলোবনাত। য্যাকব বললো–শুধু বনাত কেন? চাদর, চেকচাদর বলল, সুতি দোরুখী আলোয়ান বলেও হাঁক দাও। দিনে খানদশেক চাদর কাটা চাই।

ও ‘সুলিভান জোরে চাদ্দর বলে হাঁক দিলো।

বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–চেকচাদর কী?

এবারের ফ্যাশান, সার। উল আর সূতোয় মিশানো, নানা রঙের চেক। অল-উল বলে চলে যাচ্ছে। তিন থেকে চারে দিচ্ছি রং অনুসারে। তাঁতের একটা মোটা সুতোর চাদর যেখানে দুটাকা, রঙিন সুতোর চাদর বারো আনা থেকে দেড় টাকায় দিচ্ছি। দোরুখীগুলো দুটাকায়। চলুন, সার।

বাগচীর টাট্টু চলতে শুরু করলো, শিশাওয়াল তার পাশে হেঁটে চললো।

বাগচী বললো–তুমি আমার কুঠিতে যেতে চাইছে বটে, আমি কিন্তু শাল কিনবার কথা দিচ্ছি না।

য্যাকব বললো–না সার, মাল না দেখে কেন তা বলবেন?

বাগচী মনে মনে হেসে ফেলো, গতবারও এরকম ধরনের কথা হয়েছিলো বোধ হয়। ফেলিসিটার একখানা এমারেল্ড রঙের শাল না গছিয়ে ছাড়েনি, যা থেকে কেট একটা সুন্দর গাউন করেছিলো।

তার কুঠি তখনো খানিকটা দূরে। বাগচীর মন কেনাকাটা থেকে খানিকটা অন্যদিকে সরলো। সামনে খানিকটা দূরে ওসুলিভানকে দেখা গেলো। বাগচী ভাবলো, সুন্দর অসুন্দরের প্রশ্ন নয়, শুধু চুলের রংও নয়, আলফ্রেড মিনহাজ, তা সে ডিসিলভা বা ওসুলিভান যা হোক, তাকে দেখামাত্র ইউরোপীয়দের কথা মনে আসে। কিন্তু এটাও ঠিক, ভালো করে দেখতে গেলে, ড্রেগ আর স্কাম শব্দ দুটোও মনে আসে। বয়স কিছুতেই পঁচিশের বেশি নয়, কিন্তু ইতিমধ্যে অনেক গুটিযুক্ত মুখের নাকটির অগ্রভাগ লাল, অনাবৃত বাহুর উপরে অনেক ছিট, ক্ষয়গ্রস্ত হলুদ দাঁত। ইউরোপীয় নয়, এদেশে এখনো এমন কোনো ইউরোপীয়ান আসে না যাকে অন্য ইউরোপীয়ানরা ফেলিসিটারের ভারবাহী হতে দেবে। স্বজাতির মানরক্ষায় হয়তো তাকে চাকরি দিতে। বাগচীর মন আবিল করে এই চিন্তা দেখা দিলো :হয়তো টাকায় বশীভূত কোনো ন্যানীর প্রতি কোনো ও সুলিভানের লালসার ফল।

কিন্তু তখন ফেলিসিটার বলছে–সার, ম্যাডাম অনুমতি করলে তাকে তো শাল দেখাবোই, আপনাকে এখন একটা প্রস্তাব দিতে চাই। দয়া করে ভেবে দেখুন। এখন তো এটা শহর হয়ে উঠছে ক্রমশ। বেশ কয়েকটি সুরকির পথ হচ্ছে, আপনাকে একটা ফেটনের বিষয়ে চিন্তা করতে বলবো কি? মেহগ্নি কাঠ, নিকেলের কাজ, ক্যানভাসের হুড। মরেলগঞ্জের ক্রিস্টমাসের আগেই একটা দিচ্ছি।

বাগচী হেসে বললো, না না, আমি একজন স্কুল-টিচার মাত্র।

শিশাওয়াল হেসে বললো, এটা কি সমস্যা? মিদনাপুরের হেডমাস্টারসাহেবকে গত মাসে একটা ফেটন এবং একটা খাঁটি ওয়েলার দিয়েছি। এই গ্রামে প্রকৃতপক্ষে এখন মিদনাপুরের চাইতে ভালো পথ তৈরী হচ্ছে। এমনকী সার, একটা ফ্লাই আপাতত নিন। আপনার টাটুর মাপে, খুব হালকা, সিমলার রিকশার মতো, দুজনে বসা যায়, দু চাকার, হালকা সেগুন আর নিকেলের একটা ফ্লাই…

বাগচী ফেলিসিটারের কথা সবটুকু শুনতে পায়নি। সে ভাবলো, কিংবা সত্য পরিচয় খুঁজে না পাওয়াতেই ডিসিলভা হবে কিংবা ওসুলিভান–এই সমস্যা। এটা তাহলে বড়ো বড়ো শহরের উপান্তে যে মিশ্রজাতের মানুষগুলো কখনো নিজেদের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, কখনো ইউরেশিয়ান বলে পরিচয় দেওয়ার চেষ্টা করছে, যারা ইংল্যান্ডেরও নয়, ভারতেরও নয়, তাদের শিকড় খুঁজে বেড়ানোর সমস্যা। ও হো, এ তো গাইলসের চিঠি থেকে নামলো যেন। সে বললো, তোমার এই ওসুলিভান লোকটি…।

শিশাওয়াল হেসে বললো, সে গল্প সার। প্রথমে কলকাতার স্কুলে শিক্ষক ছিলো, শেষ চাকরি ছিলো রেলে। আমার এই চাকরি দিয়ে ভালো করিনি? খেতে পরতে পাচ্ছে, সন্ধ্যায় রম্ টানছে।

শিক্ষক ছিলো? লেখাপড়া জানে বলো?

-বিলক্ষণ! ইংরেজি বলে, লেখে। আমার কাছে চাকরি চাইতে এসে কলকাতার . কয়েকখানা পত্রিকা দেখিয়েছিলো, যাতে ওর লেখা কবিতা ছাপা হয়েছে।

–তাহলে স্কুলে চাকরি যাওয়ার হেতু? বাগচী বেশ বিস্মিত হলো। ক্রিশ্চান ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতো? ছাত্রদের হিন্দু অভিভাবকেরা আপত্তি করেছিলো?

না সার। হিন্দুদের কুসংস্কারের কথা বললে তত গোল হতো না, মদ আর গোরু না খেলে মানুষ সভ্য হয় না এ বললেও ক্ষতি ছিলো না। রটেছিলো যে, ও নাকি বলতে ভাইবোনের বিবাহে দোষ নেই। আসলে যিশুকে, মানে মাতা মেরীর কুমারীত্বেই, সন্দেহ। স্কুল কমিটির হিন্দু ক্রিশ্চান সব সভ্যই ওর বিরুদ্ধে চলে গেছলো।

তারা হেডমাস্টারকুঠির কাছে এসে পড়েছিলো। বাগচী ভাবলো, তারাও তো ক্রাইস্টকে ঈশ্বরপুত্র মনে করে না। ন্যায় অনুসারে মেরীর কুমারীত্ব মানে না। এই বেদনার চিন্তা থেকে মুখ তুলে সে কুঠির বাইরের দিকের বারান্দায় দূর প্রান্তে যেখানে ছাদ থেকে অর্কিডগুলো ঝুলছে সেখানে কেটকে দেখতে পেলো। ফুলের পরিচর্যায় নাকি অন্যমনস্ক।

ফেলিসিটার বললো, সার, আমি গেটের বাইরে দাঁড়াই, ম্যাডাম অনুমতি করলে আমি ভিতরে যেতে পারি।

গেট পার হয়ে কুঠির বারান্দায় উঠে বাগচী বললো, হ্যালো ডারলিং, আমরা এসেছি। ওখানে কী?

কেট ফিরে দাঁড়ালো। তাঁর মুখটা কি বিবর্ণ? মুহূর্তে রক্ত ফেরার চাপেই যেন স্বাভাবিকের চাইতে বেশি লাল হলো। সে হেসে বললো–একমিনিট আগে বনাতওয়ালা গেলো একজন।

বাগচীও ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে হেসে বললো–বনাত কিনবে নাকি? সহিসের জন্যে? এদিকে গেটের কাছে দ্যাখো শালওয়ালা।

কেট বললো–নাঃ, কেন কিনবো? ভাবছিলাম, রাজা রামমোহন পার্লামেন্টের কাছে সেই যে দরখাস্ত করেছিলেন যাতে ইংল্যান্ডের লোকেরা বেশি সংখ্যায় এদেশে এসে বসবাস করে।

বাগচী বললো–হ্যাঁ। কিন্তু সে কথা কেন? বনাতওয়ালাকে এড়াতে পারো, শালওয়ালাকে পারবে না। গেট দিয়ে ঢুকছে দ্যাখো।

সেদিন রবিবারের লাঞ্চের তখন ঘণ্টাদুয়েক দেরি। ফেলিসিটারও ভালো সেলসম্যান। প্রয়োজনের অতিরিক্ত, গ্রামের পক্ষে তো বটেই কলকাতাতেও তেমন সুলভ নয়, এমন পণ্য বিক্রি করতে যে মসৃণ প্রগলভতা দরকার তা ছিলোই তার। সে, উপরন্তু, হাসতে জানতো, ঠাট্টায় চটতো না, ধারে পণ্য দিতে কুণ্ঠিত ছিলো না, এবং তখনো–সে অনুগৃহীত এমন ভঙ্গি তার অভ্যস্ত ছিলো। সন্দেহ হয়, ব্যবসায় লাভের অতিরিক্ত কিছু সে পেতো, হয়তো ভালো লাগার ব্যাপার। কতকটা যেন সমাজ-সংস্কার, সমাজকে আধুনিক করাইবা, যেন ওপারের সংস্কৃতিকে এদেশে বহন করে আনা। এখনকার মতো তখনো আধুনিক হতে, সংস্কৃতিবান হতে মানুষের একটা সহজ আগ্রহ তার কারণ হতে পারে।

বসতে বসতে সে ঘোষণা করলো, সে কয়েক পিস কাশ্মীরি শাল দেখাতে এসেছে। তারপর প্রায় একঘণ্টা তার সেলসম্যানশিপে বাগচীর পার্লার সরগরম করে রাখলো। একের পর এক শাল বার করে একবার তা বাগচীর হাতে, একবার কেটের হাতে দিয়ে, তাদের গুণাগুণ, দাম, কীভাবে সেগুলোর কারুকার্য নষ্ট না করেও ম্যাডামের গাউন করা যেতে পারে তার বর্ণনা দিয়ে, একশো থেকে হাজার টাকা দামের শাল দেখিয়ে, বাগচীকে কতটা কমিশন দেওয়া যায়, সে বাগচীর জন্য কতটা লাভ ছাড়তে রাজী, তা বুঝিয়েও যখন অকৃতকার্য হলো, তখন সে রুমাল বার করে কপাল ঠোকার ভঙ্গিতে ঘাম মুছে, কিন্তু হাসিমুখে, বললো–এবার অনুমতি করুন কিছু সার্জ দেখাই। বিশেষ একটা লাল সার্জ।

কেট বললো, সার্জ? নানা, দরকার নেই। তাছাড়া টমিদের রং আদৌভালোনয়। বাগচী হেসে বললো–ডারলিং, আমাদের সাহেবকে একটু কফি খাওয়াতে পারো?

কেট কফি করতে গেলো। মিনিটদশেকে কফি নিয়ে ফিরে এলো। এই সময়ে বাগচী আর একবার ওসুলিভানের কথা ভাবলো। নিজের ভারতীয় মায়ের উপরে ঘৃণা ও অবিশ্বাস থেকেই সে কি মাতা মেরীকে কলঙ্কযুক্তা মনে করে? কিংবা তা কি একরকম বাস্তববোধ? চিন্তাটা মনকে স্বস্তি দেয় না। কিন্তু ফেলিসিটার তাকে সাহায্য করলো। পানীয়র কথা থেকেই যেন তার মনে পড়েছে এমনভাবে সে বললো, বাগচীকে সে কিছু পোর্ট ও শ্যাম্পেনও দিতে পারে। মরেলগঞ্জের জন্য ও দেওয়ানজির জন্য যা এনেছিলো তার বাড়তি কিছু আছে। তাই বা কেন? সে তো মাসখানেক বাদে ফিরে আসবেই, ক্রিস্টমাসের আগেই, তখন বাগচীর পছন্দমতো ওয়াইন এনে দিতে পারে।

বাগচী বললো–একমাস পরেই আবার? এত তাড়াতাড়ি?

ফেলিসিটার এক জায়গার গল্প অন্য জায়গায় নেয়। সে বললো–মরেলগঞ্জের ওরা ক্রিস্টমাসের আগে আগে এক গ্রোস মদ চেয়েছে। অর্ধেকটাই হুইস্কি, বাকিটা ব্রান্ডি, শ্যাম্পেন আর পোর্ট।

-ক্রিস্টমাসে? এক গ্রোস? বাগচী হাসলো।

ফেলিসিটার গলা নিচু করে এক চোখ বন্ধ করে বললো–ক্রিস্টমাসের উৎসবেই। ক্রিস্টমাসের গাছের জন্য ছোট্ট ছোট্ট রঙীন ডোমেরও অর্ডার পেয়েছি। অনেকে আসবেন। আসলে কিন্তু, যেরকম শুনি, এক কমিশন, নাকি ইন্ডিগোর।

কিন্তু তখন কেট কফি নিয়ে আসায় ফেলিসিটার ধন্যবাদ দেবার তাগাদায় মরেলগঞ্জের সেই বিশেষ উৎসবের গল্প ভুলে গেলো।

কফির পরে পাত্রগুলো সরানো হলে সার্জ বার করলো ফেলিসিটার। মুখবন্ধে সে বললো, দুটোইমাত্র দেখাবে। বটল গ্রীন একটা আছে। থানের অনেকটা রাজকুমারের ওস্তাগর নিয়েছে রাজকুমারের আচকান করতে। বাকিটায় একটা ভালো জ্যাকেট অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু যেটা সে মেমসাহেবের জন্য বিশেষ করে মনে আনছে তা লাল সার্জটা। কখনই টমি-ইউনিফর্মের লাল নয়। বলতে কী এ থানটার আধখানা দিনদশেক আগে জঙ্গিলাটের সিস্টার-ইন-লকে বিক্রি করেছে। বলতে বলতে সে সার্জটাকে বার করে হাতের খেলা দেখানোর কায়দায় আঁকি দিয়ে কয়েক ভাজ খুলে মেলে ধরলো।

যদিও প্রমাণ ছিলো না, ফেলিসিটারের কথায় ছাড়া, যে কাপড়টার আধখানা জঙ্গিলাটের বাংলোয় বিক্রি করেছে, কিন্তু কেট ও বাগচী দুজনেই কাপড়টাকে হাতে নিয়ে দেখলো। বুনোটটা মিহি, স্পর্শটা কোমল। রংটা নিয়ে একটু কথা হলো। টমিদের লাল থেকে কতটা পৃথক তা স্মৃতি থেকে ঠিক করা শক্ত হচ্ছিলো কেটের পক্ষে। তখন ফেলিসিটার হেসে বললো–ম্যাডাম এই সার্জ টমিদের গায়ে দিতে হলে মহারানীর ভারতরাজ্য বিক্রি করতে হবে।

কেট বললো– তা সত্ত্বেও–এটা অত্যন্ত দামী কাপড়।

দামের কথায় বাগচীর মুখের হাসিটা কমে গেল। তা দেখে কেট বললো–আমার তো ভালো গাউন রয়েছে অনেক।

তখন বাগচী বললো– হেসে-ফেলিসিটারের পরিশ্রমটাও ভাবো ডারলিং, একঘণ্টা গল্প শুনিয়েছে।

কেট রাজী হয়েছিলো। কাপড়টা নিশ্চয়ই ভালো। তাছাড়া বাগচীর চোখে তার আগ্রহ প্রমাণ হচ্ছিলো। সুতরাং ফেলিসিটার তার সেলসম্যানশিপ সার্থক করে বিদায় নিলো।

কেট বললো–খাবারগুলোকে বাষ্পে বসিয়ে এলাম। পনেরো মিনিটে সব গরম হবে। তখনো ঘরটায় ফেলিসিটারের অদৃশ্য উপস্থিতি বিরাজ করছে। তা অনুভব করেই যেন বাগচী। বললো–আ, ডারলিং, তোমাকে বলতে ভুলে গিয়েছি, মিদনাপুরের হেডমাস্টার একটি ফিটন কিনেছেন।

আচমকা সংবাদটা শুনে তার গুরুত্ব কোথায় তা খুঁজতে কেট কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। সংবাদটা এমনভাবে বলা যেন অন্ধকারে এই চাঁদ উঠলো। কেট হেসে ফেলো। কিন্তু বললো–সেই হেডমাস্টারকে আমরা চিনি না তবে কেন ঠাট্টা করছো?

-ঠাট্টা! একে তাই বলে বুঝি? ফেলিসিটার অন্তত একটা ফ্লাই কিনতে বলেছে আমাদের, টাটুটাই টানতে পারবে, সিমলার রিকশার মতোই-হাল্কা, সুন্দর-সেও কি ঠাট্টা?

কেট বললো–তাহলে আর কথা কী!

-এবার তুমি ঠাট্টা করলে। দ্যাখো, রাজবাড়ির হাত থেকে ফরাসডাঙা পর্যন্ত একটা মেটাল্ড রোড হচ্ছে। আর তাহলে তা থেকেও আরো ছোটো ছোটো তেমন রাস্তা বার হবে।

কেট হাসতে হাসতে বললো, পথের জন্য ফিটন না হয়ে ফিটনের জন্যই না হয় পথ । হবে, এবার বলো কোথায় যাবে। পিয়েত্রার কুঠিতে লাঞ্চ নাকি?

বাগচী বললো–আরে তা কেন? ফাদার রলের মিশন হাউসটার কথা ভুলে গেলে? সেখানে যেতে তোমার নিদেন একটা ফ্লাই লাগবে না?

কেটের মুখে হাসির পাশে ছায়া পড়লো যেন। সে বললো, কিন্তু তুমি সে বিষয়ে কিছু ভেবেছো ফাদার বাগচী?

বাগচী বললো–আমি কেন ভাবতে গেলাম? টাকাটা তো আমার নয়, মিশন হাউস বানানোর খরচ দেবে তাদের লন্ডন সোসাইটি। মরেলগঞ্জের ওদেরও উৎসাহ আছে। কীবল চাইছে রাজবাড়ির আনুকূল্য থাকে তা যেন আমি দেখি।

কেট উঠে দাঁড়ালো। বললো–চলো দেখি, খাবার এতক্ষণে গরম হয়েছে। কিন্তু ফাদার রলে তো ক্যাথলিক।

বাগচী কেটকে অনুসরণ করতে উঠলো। বললো–ওহ তুমি তাই ভাবছো? সে তো প্রটেস্ট্যান্টরাও। তারাও আমাদের ক্রিশ্চান মনে করে না। ক্যাথলিকরাই বা তা কেন করবে?

বাগচী কেটের মুখ দেখতে পেলো না, কিন্তু তার এই ভুল ধরিয়ে দিয়ে বেশ খানিকটা হেসে নিলো।

লাঞ্চে একসময়ে কেট বললো–বারেবারে চাইছো, কেন, কিছু বলবে?

–ভাবছিলাম।

কী? গাউনটার কথা বুঝি? সত্যি, কী হবে তেমন দামী পোশাকে?

বাগচী বললো–কেন? আমরা কি কলকাতা যেতে পারি না, সামনে ক্রিস্টমাস? এবার রাজকুমারের সঙ্গে সে সময়ে কলকাতা যাওয়ার প্রস্তাব আসতে পারে। আমরা যেতেও পারি।

কেট বললো–কিন্তু সেখানকার উৎসবে

-তুমি বলবে আমরা যিশাসকে ঈশ্বরপুত্র বলি না, মানবপুত্র বলি। কিন্তু তাকে সর্বোত্তম মানুষের একজন মনে করি, সেটাই আমাদের আনন্দের কারণ হতে পারে।

কেট ভাবলো, মানুষটি এই রকমই। কিছুতেই যেন বুঝবে না উৎসব একা হয় না। সমমতের দশজনকে লাগে। সেখানেও তো আমরা একাই। উৎসব বলতে যা তা পাশ দিয়ে বয়ে যাবে। কিন্তু তার ইচ্ছা হলে বাগচীর মন অন্যদিকে নিয়ে যায়। সে বললো–আচ্ছা ডারলিং, রাজকুমার কেন এ উৎসবে কলকাতা যাবেন?

বাগচী একটু ভেবে হাসিমুখেই বললো–ধর্ম নয় বলছো? না, ধর্ম নয়। রাজনীতি বলবে? তা হতে পারে, দেওয়ানজি যখন উদ্যোগী।

কেট বললো, একটু বুঝিয়ে বলো সেটা কী রকম রাজনীতি হতে পারে?

লাঞ্চের গল্প খানিকটা হালকাভাবেই হয়। কিন্তু রাজকুমারের ব্যাপার বলেই যেন কিছু গম্ভীরও হতে হয়। বাগচী বললো–আমি ঠিক বুঝি না, কিন্তু দেওয়ানজির পদক্ষেপগুলোকে সাধারণ মনে হয় না। আচ্ছা, তোমার সেই নিয়মিত টাইমস পড়া আর সেই সুবাদে বলা দেওয়ানজির মোকাবিলা কথাটা মনে আছে? তাছাড়া, কেট, ভেবে দ্যাখো, লন্ডনের ক্রিস্টমাসে গ্রামীণ লর্ডরাও এসে থাকেন।

কেটও একটু ভেবে বললো–তারা কিন্তু লর্ড-সভার সদস্য, সে দেশের রাজ্যশাসনের সঙ্গে যুক্ত।

বাগচী ভেবে ভেবে বললো–অন্নদাতা সম্বন্ধে এ রকম আলোচনা করা উচিত হয় না। আমার কিন্তু মনে হয়, এসব ব্যাপারে রানীমার, রাজকুমারের এবং দেওয়ানজির ধারণা শেষ পর্যন্ত এক নয়। যেজন্য গতবার রাজকুমার কলকাতায় না গিয়ে পশ্চিমে চলে গেলেন। দেওয়ানজি একাই ছিলেন কলকাতায়। ওদিকে বুজরুকের একটা ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত দেওয়ানজির মতই প্রাধান্য পেয়েছিলো। কিন্তু তারপরই কোনো বিষয়ে রানীমা আর দেওয়ানজির মতের পার্থক্য এমন প্রবল যে, রানীমা দেওয়ানজির ক্ষমতা কিছু খর্ব করেছেন। অবশ্যই এসব আমরা দ্বিতীয়বার আলোচনা করবো না। আপাতত রাজপুরুষদের সঙ্গে সখ্যস্থাপন, আর একটু এগিয়ে, রাজকুমারের রাজোপাধি পাওয়াতে যাতে প্রতিবন্ধক না আসে–এরকম কোনো উদ্দেশ্য হতে পারে।

কেট বললো–আচ্ছা, বাগচী, রাজকুমারের এখন বোধ হয় সাবালকত্ব হয়েছে। তাকে কখনোকখনো বিশেষ বিষণ্ণ দেখায়। এমন কি মনে হয় তোমার, তারাজোপাধি পেতে দেরি হওয়ার জন্য হতে পারে?

তখন তো লাঞ্চ। ভালো রান্না অনেকসময়েই মনকে সেদিকে নিয়ে যায়।

বাগচী তখন লাঞ্চের পরে বসবার ঘরে। পোশাক খোলা হয়নি, পায়ে জুতোর বদলে স্লিপার। হাতে আরামদায়ক পাইপ। একবার যেন অসংলগ্নভাবে তার মনে ওসুলিভান দেখা দিলো। তেমনি অসংলগ্নভাবে সে অনুভব করলো, কেট কিন্তু খুবই সাহসী। কিন্তু রান্নাঘরের। কাজ শেষ করে কেট এলো। হেসে হেসে বললো–পোশাক খুললে না, এখনই রোগী দেখতে যাচ্ছো নাকি?

বাগচী বললো–কে বলেছে? আজ আমার ছুটি নয়?

কেট গোপনে হেসে বললো–তাহলে কী ভাবছো এমন?

–আমাদের গ্রামে শুধু রাস্তা তৈরী হচ্ছে না। রাজবাড়ির সদর-দরজাটা নতুন করে করা হয়েছে। রাজবাড়িতেও নতুন কিছু করা হবে মনে হয়। মাপজোখ হতে দেখেছি। ওদিকে ফরাসডাঙায় নাকি একটা আধুনিক প্রাসাদ হবে।

কেট ভাবলো, এটাই বৈশিষ্ট্য, পরের সুখে সুখী হয়ে ওঠা। তার বাবা এটাকেই বাগচীর সবচাইতে আকর্ষণীয় গুণ বলতেন। প্রশ্রয়ের সুরে সে বললো–ও মা! কেন?

বাগচী বললো–সম্ভবত রানীমা থাকবেন।

-কেন?

-তোমার নিশ্চয়ই জানা আছে কেট, রাজরাজড়ার ঘরে নতুন রানী এলে পুরাতন রানী ভিন্ন প্রাসাদে চলে যান।

তার মানে? কেট দুএক মুহূর্ত সংবাদটা মনে মনে ওজন করলো। বললো, ও, আচ্ছা, তাহলে ঠিকই ধরেছি।

কী ধরেছো? কেট বললো–ঠকে গেলাম। একটু বুদ্ধি করলে সংবাদটা তো আমিই দিতে পারতাম তোমাকে।

এবার বাগচীই বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো–রাজকুমারের বিবাহের কথা আগেই শুনেছো নাকি কেট?

-শুনতে হবে কেন? চোখেই তো পড়ছে।

-চোখে? সেকী! তাহলে বিবাহের অন্যপক্ষকে তুমি-ও আচ্ছা, আচ্ছা। বাগচী আনন্দে হেসে উঠলো।

–কিন্তু…, কেটের ভ্রূ একটু কুঞ্চিত হলো, বয়স একটু বেশি হলো না?

বয়স? তুমি কার কথা বলছো? নয়নঠাকরুন কি?

–তাছাড়া আবার কে? কেট উজ্জ্বল মুখে বললো, তা অবশ্যই পুরুষের চোখে ধরা পড়ে । বরং সেই বাড়তিটা অনেকসময়ে বেশি টানে। পরে, দিন গেলে

বাগচী বললো–দ্যাখো, দ্যাখো, এ ব্যাপারে আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। বেশি তো একটু বয়েস? বলবো? বলো তো আমাদের পরিচিত জানা পুরুষদের মধ্যে ভালোবাসাকে সবচাইতে বেশি কে জেনেছে? পারলে না তো! বলবো? শেক্সপীয়র। ঠিক বলিনি?

-এখানে শেক্সপীয়র কে হচ্ছে?

দ্যাখো ডারলিংশেক্সপীয়রের অ্যান্ কিন্তু তার চাইতে বছরদশেকের বড়ো ছিলেন। জানতে না তো! দ্যাখো।

আনন্দোজ্জল কেট বললো–কী সুন্দর হবে! কী সুন্দর মানায়! আর দুজনেই যে অমৃতসরসীতে ডুবে আছেন।

.

০৫.

কিন্তু আলোর কথা বলতে হলে বলতে হবে, সে তত শুধু লাল আর কমলা নয়। নীলাভ হয়, বিষণ্ণ বাদমী হয়।

সেদিন আবার শনিবার। প্রায় সপ্তাহ ফিরে এলো। অকালে বাদল হয়েছে। স্কুল ফেরত বাগচী ঘরে বসেছে। বোঝা যাচ্ছে, আজ রাজবাড়িতে যাবেনা। ইতিমধ্যে ঢিলে নাইট-গাউন পরে সে তার পড়বার ঘরে। আলো জ্বলছে সেজে। বিশেষ কোমল আলো। কফি নিয়ে কেট সেই ঘরেই বসেছিলো। দুজনের সংসারে বারবার দেখা হয়, বারবার গল্পও হয়। টিপয়টার উপরে সেজ, তার উপরে কফির ছোট্ট ট্রে-টা রাখা। সেজের গোড়ায় বাগচীর পাইপ পাউচ। পাইপের খানিকটা অ্যাম্বার, পাউচটা বাদামী। পাশের বইটার মলাট লাল। তাতে রূপালি রংও। রূপালী অক্ষরে লেখা ইন ইমিটেশন অব ক্রাইস্ট। কেট বইটাকে ভালোভাবেই চেনে। কেম্পিসের লেখা। বাগচী কতবার পড়েছে ঠিক নেই। সে নিজেও অন্তত বারদুয়েক। রঙের কথাই যদি, বাগচীর সেই ছোটো স্টাডি নামক ঘরে তার মুখোমুখি দেয়ালে এদেশের হাতে তৈরী কাগজে এদেশের এক চিত্রকরের আঁকা, এদেশের গেরুয়া মাটির রঙে আঁকা ছবিটার কথা বলতে হয়। কীবল দেখে বলেছিলো, খুব সরল করে আঁকা, এদেশের নমাজের ছবিনাকি? কেট বলতে বাধ্য হয়েছিলো প্রার্থনারত ক্রাইস্ট। কীবল কিন্তু এসব ব্যাপারে কৌতূহলী। বলেছিলো, তাকে কি প্রার্থনা করতে হতো? কিন্তু খুব লম্বা করে আঁকা নয়? কেট আবার বলতে বাধ্য হয়েছিলো, এটায় না জেনেও চিত্রকর এল গ্রেকো নামে একজনের স্টাইলে গেছেন।

তা, কফি খেতে খেতে বাগচী তার এবং কেটের মাঝের দু-হাত শূন্যটাকে বারবার দেখছিলো। আর কফির সেই অবসরেই ডিসিলভা ওসুলিভান সম্বন্ধে বলেছিলো। কেট একেবারেই অবাক হয়েছিলো শুনে।

এখন কেট রাতের খাওয়া তৈরীতে ব্যস্ত। সংসারের কাজে এঘর ওঘরও যাওয়া আসা করছে। একটু প্রসাধনও করছে সে আজকাল। সে শোবার ঘরের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। যেন প্রসাধন কী করবে খুঁজতে লালের ছোঁয়া লাগা নিজের চাপা রঙের মুখটাকে, আর হাত ও বাহুকে দেখলো। জ্যাকেটের হুক খুলে গলার নিচে ক্যামিসোলের উপরে দুধসাদা ভি টাকে দেখলো। একটু সরে এসে দরজা দিয়ে যেমন সম্ভব শ্যামল রঙের বাগচীকে দেখলো দু-একবার।

একটু চঞ্চল হয়ে সে বাইরে এলো, যেন বাগচীর রংটাকে ভালো করে দেখতে। সে দেখলো বাগচী পড়ছে, লাল রঙে প্রমাণ তা সেই ক্রাইস্টের অনুসরণ;বসার ভঙ্গিটানমাজের কিন্তু। দু হাঁটু একত্র, গোড়ালির উপরে বসা। আচ্ছা! ঘন কালো চুলগুলো তো বেশ বড়ো হয়েছে। বাবরির মতো দুপাশে নেমেছে কান ঢেকে। না, পড়া নয় তো। মুখটা দ্যাখো ক্রাইস্টের ছবির দিকেই। একেবারে অবাক হয়ে গেলো কেট; বাগচীর দু-চোখের কোণ বেয়ে জল নেমেছে।

.

কিন্তু সেই শনিবারের সন্ধ্যার আগে তার দুপুর আর বিকেলের কথা বলা চাই। আর তাতে একরকমের সুবিধাও আছে।

এখানে ইতিহাসের উপাদানগুলো অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য। না আছে রাজকাহিনী, না আছে পাথরে বা তামার পাতে লেখা সন-তারিখের সাক্ষ্য। অন্যদিকে নিয়োগীর মতো যারা তারা যা কিছু করে, ভাবে, বলে, লিখে রাখে, পত্রিকায় ছাপায়; যেখানে তা সম্ভব নয় সেখানে তাদের ডায়েরিগুলো সরব। ফলে ইতিহাসের কথা বলামাত্র সেই সব বিবর্ণ পত্রপত্রিকাই সত্যের সাক্ষী হয়। মনে হতে থাকে পত্রপত্রিকা অনুসারে গোটা দেশটা ওঠাবসা করতো।

সে যাই হোক, সর্বরঞ্জনকুসুমপ্রসাদ একদিন নিজেকে মার্টাররূপে দেখতে পেলো। সে অবশ্য তার ডায়েরিতে এই বিদেশাগত শব্দটাকে উল্লেখ করেনি।

সে বুঝতে পেরেছে, সুরেন ও নরেশ কলকাতার মানুষ হওয়ায় নতুন ধর্মমত সম্বন্ধে আগ্রহী বটে, কিন্তু থিয়েটারেও আগ্রহী কম নয়। চরণ দাস জনান্তিকে বলেছে থিয়েটার শেষ হওয়ার পরে সে আবার নিয়মিত বাইবেল পড়বে, কিন্তু অভিনয় না করলেও বন্ধুদের এই ব্যাপারে প্রপ্ট তাকে করতেই হবে। দ্বিতীয়ত, সে বুঝতে পেরেছে এখানকার যে শিক্ষাব্যবস্থা হেডমাস্টারমশাই প্রবর্তন করছেন তা হবে অনিবার্যভাবে কলকাতার থেকে পৃথক। এক সপ্তাহের মধ্যে মৌখিক পরীক্ষার আদর্শ প্রশ্নপত্র হেডমাস্টারমশায়ের হাতে পৌঁছে দিতে হবে।

তৃতীয়ত রাজবাড়ির ব্যবস্থাপনায় শুধু যে ফরাসভাঙার শিবমন্দির ক্রমশ উলঙ্গ হয়ে আকাশকে স্পর্শ করতে চলেছে তাই নয়, রানীমার জন্মোৎসবও এসে গেলো, যার কেন্দ্রে কালীপূজা, যার আয়োজন, আবহাওয়ার মতো নিজের গৃহকোণে বসেও অনুভব করো।

এমনকী তার সাধ্বী স্ত্রী বলছিলেন, আমাদেরও তো নিমন্ত্রণ থাকে, ছেলেমেয়েরা তো এখনো নাবালক, আলো বাজি এসব দেখলে অথবা মিষ্টান্ন খেলে দোষ কী? সে তো প্রসাদ নয় শুনেছি।

অন্যদিকে কাল বিকেলে তাকে অবাক করে সুদৃশ্য এক প্রস্থ আসবাব তার বাসায় পাঠানো হয়েছে। হেডমাস্টারমশায়ের সঙ্গে আলাপে আসবাবের কথা উঠেছিলো বটে। একজন শিক্ষকের সুবিধার কথা মনে রাখা হয়েছে। চারিদিকের ঘোর কালোর মধ্যে এগুলি ঈশ্বরের কৃপালোক বলে অনুভূত হয়।

এরই ফলে সর্বরঞ্জনপ্রসাদের মনে একইকালে বেশ কিছু হতাশা এবং অল্প পরিমাণে উৎসাহ। সেই সকালেই সে অনুভব করলো তার এই পঁয়ত্রিশ বেড়ে বেড়ে পঁয়ষট্টিতে পৌঁছালেও তাকে হয়তো এই গ্রামে অল্প পরিমাণ উৎসাহ এবং সমধিক হতাশা নিয়ে চলতে হবে। না, না, এটা অনিবার্যই। কেননা যারা বি. এ. পাশ করেই হাকিম হতে পেরেছে তাদের মতো সৌভাগ্যবান সে নয়। ডেপুটি হওয়ার দিন গতপ্রায়। এমনকী বি.এ. পাশ করার পর সিম্পসন-স্যামসন অ্যাটর্নি কোম্পানিতে যে আর্টিকেল্ড ক্লার্ক হওয়ার কল্পনা ছিলো তাও অবাস্তব। কেননা ততদিনে তার সংসার কে চালায়? এই অবস্থায় ভাদুড়ীমশায় যখন এই চাকরি করে দিলেন তখন এটাকেই ঈশ্বরনির্দিষ্ট বলে মানতে হবে এরকম সম্ভাবনার কথা হেডমাস্টারমশায় বলেছেন। যাত্রার সময়ে সমাজবৃদ্ধরা সকলেই উচ্চকণ্ঠে তাকে আশীর্বাদ করেছে। সকলেই এক বাক্যে বলেছিলো : ইহাকে ঈশ্বরপ্রেরিত জ্ঞান করবে। মনে করো তোমার বদলে যদি পৌত্তলিক কারো এই চাকরি হতো? সে কি দেশের ওই অংশকে আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন করতে সহায়তা করতো না? এখন তোমার আলোকে কত ছাত্ৰই না আলো জ্বালে!

কিন্তু প্রদীপের এই এক অনিবার্যতা-আলোর কেন্দ্রেই দাহ থাকে।

সুতরাং তার মনে দাহ ছিলো। আপাতত তা সুরেন নরেশ প্রভৃতির নাটকপ্রিয়তা, যার অন্য নাম তার চিন্তার পরাজয়, তাকে অবলম্বন করে তীব্র। এই অবস্থায় শনিবার সকালে স্কুলের জন্য পথে বেরিয়ে তার যেন অসংলগ্নভাবে মনে হলো, সেন্ট বার্থলোমিউ-এর ওরা জীবন্তে গায়ের চামড়া তুলে নিয়েছিলো, সেন্ট ফ্রান্সিসকে ওরা পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো। হে প্রভু, সুতরাং আমাকে দগ্ধ করো, কে না জানে খাদ পান না পুড়লে সোনা উজ্জ্বল হয় না, না পুড়লে আলো হয় না।

এসব চিন্তার ফলে তার মুখমণ্ডলে প্রশান্ত শান্তি, চোখে নিজের পরিবেশকে লক্ষ্য করার স্থির দৃষ্টি, কিন্তু অন্তরে আলোক বিকিরণ করার আগ্রহ, যাকে জ্বালার থেকে এককালে পৃথক করা যায় না। এইসময়ে পথের উপরে শ্বেতশুভ্র আলোর মতো কিছু একটা সে দেখতে পেলো। সে ভাবলো :এই আলোক, আশ্চর্য এই আলোক! এমনকী সে যখন আরো এগিয়ে গিয়ে এই আলোকের কথা ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করার কথা ভাবছে সে দেখতে পেলো সেটার উৎস একটা সাদা রঙের ছাতা। ছাতা যখন তার নিচে শিরোমণিমশায় অবশ্যই আছে। রাজবাড়ি থেকে প্রতি বৎসরের শেষে জলপূর্ণ তাম্ৰকলস ও এই ছত্র পেয়ে থাকেন। সর্বরঞ্জন মুখ লুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো, তাড়াতাড়ি স্কুলের দিকে চলতে শুরু করলো। এই শিরোমণি পদাধিকার বলে তার অধস্তন, কিন্তু যেমন ঠিক তিনদিন আগে, ঠিক তিন দিন, বলেছিলো, আলো জ্বালতে ব্রহ্মের যে এত বেকুবি, কেবল পোড়াচ্ছে আর দাহ করছে আপনাদের। ঠিক জানেন তো, সে ব্ৰহ্ম কিংবা খেস্ট? তখনই ঠিক করেছিলো সর্বরঞ্জন, সম্ভবপক্ষে শিরোমণির সঙ্গে ধর্ম সম্বন্ধে কথা বলবে না আর, যদিও শিরোমণির উপস্থিতিই যেন অবিরত তাকে তর্কে আহ্বান করে।

কিন্তু সর্বরঞ্জনপ্রসাদকে পথের পাশে ঝটিতে সরে দাঁড়াতে হলো। তিনটি ঘোড়া তীরের ফলার মতো বেগে আসছে; পুরোবর্তীটির একটু পিছনে রাস্তার দুপাশে দুটি। পুরোবর্তী সওয়ার নিতান্ত তরুণ, তার পোশাক ইউরোপীয়রাইডিং কোট ও ব্রিচেস, মাথায় বারান্দা টুপি, হাতে সুদৃশ্য ডাঁটযুক্ত চাবুক। রাজকুমার কি? শ্যামল দেখালো না অনেকটা? পিছনে সওয়ার দুটিকে চেনা মনে হলো। লাটসাহেবের সওয়ারদের পোশাকই যেন, পাগড়ির রঙে তফাত। তাদের দুজনের হাতে রূপার বল্লম। পাগড়ি দ্যাখো, গাঢ় নীলে রূপালি জরি। এমন একটা ব্যাপার যা ধ্যান ভাঙিয়ে দেয়। এত তাড়াতাড়ি গেলো, বোঝা গেলো না রাজকুমার কিনা।

সে অবশ্যই মুকুন্দ যে রানীমার কাছে দরবার শেষ করে কায়েতবাড়িতে তার মায়ের কাছে চলেছে। এই ছোট্ট রিশালাটা চলেছে অবশ্যই তার সম্মান রাখতে। রাজবাড়ির ছাদ আর ঝুলবারান্দা থেকে সদরের গেট পর্যন্ত যারা সেটিকে যেতে দেখলো তারা ভাবলো এই কুমার অবশ্যই অসাধারণ সম্মানের পাত্র, যদিও সে কায়েত।

তার এইদিন পড়ানোর কাজের চাইতে অফিসের কাজ বেশি। প্রয়োজন হলে সে সুতরাং কাজকে খানিকটা পিছিয়ে রেখে চিন্তার অবসর করে নিতে পারে। সে কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে কাজ করলো; আর তা করতে করতে একবার চরণ, আর একবার শিরোমণিকে দেখতে পেলো। এই সময়ে তার মন এরকম বললো– :ঈশ্বরের সৈনিক, অগ্রসর হও। সে অনুপ্রেরণার জন্য মনকে আঘাত করতে লাগলো।

উৎসবই উৎসবের সমকক্ষ। না, না। সে স্থির করলে তাকে একটা উৎসব করতেই হবে। যা হবে প্রকৃত উৎসব; যেখানে বেদী থেকে পরম করুণাময় একমাত্র সেই নিরাকার ঈশ্বরের প্রার্থনা হবে। তার মনে পড়ে গেলো তার শেষ সন্তানের নামকরণ-উৎসব হয়নি। আর একটি শিশুকে সত্যধর্মে অভিষিক্ত করার চাইতে উৎসবের কী এমন ভালো সুযোগ হতে পারে? এবং এটাও দেখতে হবে যে সেই উৎসব শক্তির উৎসে যুক্ত হয়। ভাবো সেই রিশালার কথা! দেওয়ানজির সহায়তায় কি রাজকুমারও একদা সত্যধর্মে উৎসাহিত হন না?

সুতরাং সর্বরঞ্জন স্থির করলো : আজই, এখনই, স্কুল থেকেই সে দেওয়ানজির সঙ্গে দেখা করতে যাবে। না না, তাকে যেতেই হবে। প্রথমত আসবাবগুলির জন্য তাকে ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে; দ্বিতীয়ত সে ভাদুড়ীমশায়ের চিঠি পেয়েছে গত সপ্তাহে তা জানানো যেতে পারে। ভাদুড়ীমশায় তার মুরুব্বি, তেমনি দেওয়ানজিরও বন্ধু; তাছাড়া থিয়েটার বলো, রাজবাড়ির উৎসব বলো, তিনি তো সর্বেসর্বা। আর ধর্ম ছাড়া তার উপায়ই বা কী? সে তো হাকিমও নয়, এমনকী আটিকেল্ড ক্লার্কও নয়।

দেওয়ান কুঠিতে যখন সে পৌঁছালো, হরদয়াল তার লাইব্রেরিতে। নিয়োগীর বেশ একটু অস্বস্তি বোধ হলো। একটি গৃহ যে এমন নিঃশব্দ হতে পারে তা তার অভিজ্ঞতায় ছিলো না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কুঠির ভিতরের কোনো দেয়ালঘড়ির মৃদু টিক টিক সে শুনতে পেলো। কী করে সে খবর দেবে যে সে দেখা করতে এসেছে। অবশেষে একজন ভৃত্য। বেরিয়ে এসে তাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে লাইব্রেরিতে বসালো। তার জুতোজাড়া যে এক রকমের কিম্ভুত ফাপা, শব্দ করে শান্তির বিঘ্ন ঘটায় তা সে জানতো না।

ভৃত্য তাকে যে চেয়ারটায় বসিয়েছিলো সেখানে বসে লাইব্রেরি ঘরের এই ঠাসা সেলফগুলি, এখানে ওখানে ছড়ানো গাঢ় কালো রঙের সুদৃশ্য চেয়ারগুলো, ঘরের প্রায় কেন্দ্রে সুদৃশ্যতর সোফাসেট প্রভৃতি লক্ষ্য করতে করতে তার আর একবার মনে হলো, এভাবে আসা তার পক্ষে ভালো হয়নি। দুএক মুহূর্তে আলোটা চোখে ঠিক হলে সে যেন একটা সেলফের আড়ালে হরদয়ালকে খানিকটা দেখতে পেলো। আরো ভালো করে দেখতে গিয়ে সে লক্ষ্য করলো, সোফার সামনে টিপয়ের উপরে একটা চাপা রঙের তরলপূর্ণ বোতল, তার পাশে বড় করবী ফুলের মতো কিন্তু লম্বা বৃন্তের উপরে একটা গ্লাস। সেই বোতল ও গ্লাসের পাশে একখানা বই যার ভিতরে একটা সুদৃশ্য রূপার পেজকাটার। সে একটা মৃদু গোলাপী গন্ধ পাচ্ছে। তা কি ধূপের, অথবা মদের?

— দুএক মুহূর্তে হরদয়াল সেফের পাশ থেকে বেরিয়ে সোফার কাছে এগিয়ে বললো–এখানে আসুন। বসতে বসতে হরদয়াল হাসলো। আর সে হাসি যেন কোনো রমণীর হতে পারে এমন নরম এবং কুণ্ঠিত। বললো– সে–একার সংসার, বইগুলো সারা ঘরে ছড়ানো ছিলো, তাই তুলছিলাম।

সর্বরঞ্জন এক কঠিন সমস্যায় পড়লো। সোফায় বসতে বসতে সে অনুভব করলো, তার জিভটা শুকিয়ে উঠছে। এই তো মদ, যা ইতিপূর্বে ছবিতে মাত্র দেখেছে এবং যাকে সে দুশ্চরিত্রা রমণীর মতো কুহকী ও ঘৃণ্য মনে করে। সে কী করে এগুলোর উপর দিয়ে দেওয়ানজির মুখের দিকে চাইবে? সে মনে মনে ভাবলো : উনি হয়তো ক্রিশ্চান সন্তদের মতো, মদের পাশে বইটা অবশ্যই ধর্মগ্রন্থ হবে। সে আড়চোখে বইটার নামটা পড়লোওরিজিন অব স্পেসিস্। চার্লস ডারউইন নামে একজন লেখক। প্রকাশস্থল লন্ডন, ১৮৫৯।

কিন্তু হরদয়াল বললো–আপনার সব কুশল তো? আপনার কথা আমি প্রায়ই ভাবি। সাহিত্যের লোক আপনি। এখানে ছাত্রদের প্রাইমার পড়াতে আপনার অবশ্যই অসুবিধা হচ্ছে।

সর্বরঞ্জন নিয়োগী বললো–পরম করুণাময় ঈশ্বরের যদি তার এই কর্মশালাতেই আমাকে আহ্বান করার ইচ্ছা হয়ে থাকে, তবে সার, এখানে আনন্দিত হওয়াই আমার কর্তব্য।

উত্তর দিতে হরদয়ালের একটু দেরি হলো। সর্বরঞ্জনের সঙ্গে তার এটা দ্বিতীয়বার আলাপ হচ্ছে। প্রথমটা হয়েছিলো এক বৎসর আগে চাকরিতে বহাল করার ইন্টারভিউ-এ। তখন নিয়োগীর ইংরেজিটা ক্রিস্পই বোধ হয়েছিলো। সর্বরঞ্জনের এই বিশেষ ধরনের বাংলা তাকে পুরোপুরি স্তম্ভিত করতে পারলো না, কেননা কলকাতায় তার। বন্ধু ভাদুড়ীমশায়ের চারপাশে এরকম বাংলাই শোনা যায়। সে বললো–তবে তো কথাই নেই। আপনার পরিবারের সকলের স্বাস্থ্য ভালো থাকছে তো? যে কারণেই হোক এ অঞ্চলটায় ম্যালেরিয়ার উৎপাতটা কম।

নিয়োগীআবার বললো–এবিষয়েও তারই মঙ্গলময় বিধান দেখতে পাই। সে সুন্দর করে হাসলো, অবশ্যই তার প্রচুর শ্মশ্রুজালের আবরণের বাইরে তা যতটা প্রকাশ হতে পারে।

হরদয়াল বললো–আগে করা যায়নি, এবার আপনাদের কোয়ার্টারগুলোকে বড়ো করে দেবো।

হরদয়াল তার মুখের দিকে চেয়ে কথা বলছে, কিন্তু তার দৃষ্টিটা বোতলের পাশে রাখা বইটার উপরেও পড়লো, আর তা যেন সস্নেহ। মদ ঢালতে কখন এক ফোঁটা কী করে মলাটে পড়ে থাকবে। হরদয়াল তা হঠাৎ দেখতে পেয়ে কোঁচার খোঁট তুলে বিন্দুটাকে মুছে নিলো।

কিন্তু আলাপটা গতি নিতে পারছে না। হরদয়াল তো শুনতেই প্রস্তুত কিন্তু নিয়োগী অনুভব করলো এখানে বাগচীর সঙ্গে সে উপরওয়ালা হলেও, কলকাতার সমাজনেতাদের সঙ্গে, এমনকী সেখানকার ধনী মানুষদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলা যায় এই স্থির মানুষটির সঙ্গে তার এই নিঃশব্দ লাইব্রেরিতে বসে সেভাবে কথা বলা যায় না। তার একবার মনে। হলো সে শিক্ষক, বই সম্বন্ধে কথা বলতে পারলে সুবিধা হতো। কিন্তু এই যে একখানা বই যা ১৮৫৯-এ প্রকাশিত এবং ইতিমধ্যে এখানে, তার সম্বন্ধে কি কিছুমাত্র বলার সুবিধা হচ্ছে? ওরিজিন অব স্পেসিস বাক্যাংশটার অর্থই বা কী? লেখক এই চার্লস ডারউইনবা কে? এ রকম কোনো কবির বা ঔপন্যাসিকের নাম সে কলকাতায় শোনেনি। অথচ এই নিস্তব্ধ লাইব্রেরিতে ঘড়ি টিক টিক শব্দে সময়টা দ্রুত চলে যাচ্ছে, অপব্যয়ই হচ্ছে, এবং সময়টা হরদয়ালের।

সুতরাং নিয়োগী তার মাথাটাকে কয়েকবার উঁচুনিচু করলো। অবশেষে বললো–সার, আজ যে আপনার মহামূল্যবান সময়ের খানিকটা এই যে অপব্যয় করতে উদ্যত হয়েছি, এই যে আপনার বিশ্রামের ব্যাঘাত ঘটিয়ে চলেছি, এসবেরই একটা উদ্দেশ্য আছে।

বলুন।

-এখানে একটি পরম করুণাময় সেই এক এবং অদ্বিতীয় ঈশ্বরের উপাসনা মন্দির হলে কি ভালো হয় না?

হরদয়াল বললো–উপাসনার ব্যাপার মিস্টার বাগচী সব চাইতে ভালো বোঝেন।

বাগচী বললো–আমি নবতর কোনো সংগঠনের কথা ভাবছিলাম, সার।

-সেটা কী ব্যাপার হচ্ছে?

সর্বরঞ্জন ক্রমশ তার চিন্তাগুলোকে গুছিয়ে নিলো। বললো–বিষয়টা আনন্দজনক নয়, সার, তা আমাকে বলতেই হবে। না, না, তা না বলে উপায় নেই। কিন্তু ঈশ্বর নিরানন্দের মধ্যেও নিজেকে প্রকাশ করেন, এই তার অভিরুচি। আর এ তো আত্মসমালোচনাও বটে। ব্রাহ্মদের অর্থাৎ যারা পরম ব্রহ্মের উপাসনা করি তাদের কাছে কি কে শুদ্র কে ব্রাহ্মণ এ বিচার থাকা উচিত? অথচ আমাদের পুরোধা কারো কারো প্রার্থনাবেদীতে ব্রাহ্মণেতর কাউকে বসতে দিতে আপত্তি, এখনো কেউ কেউ উপবীতকে আঁকড়ে ধরে আছেন। এ বিষয়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়।

খানিকটা বাধা দেয়ার মতো করে হরদয়াল বললো, দেবেন্দ্র ঠাকুর মশায় কলকাতার লোক, যদিও নানা অঞ্চলে তাদের জমিদারি আছে; কিন্তু তাঁর বিষয়ে আমাদের এখানে করণীয় কিছু আছে কি? এ অঞ্চলটা তার জমিদারিতে পড়ে না।

আবেগের প্রাবল্যে নিয়োগীর মাথাটা দুলে উঠলো। বললো– সে,না,না, সার, এ আমাকে বলতেই হবে। এই গ্রামে গোড়া থেকেই সবদিকে বাঁধ দিয়ে অগ্রসর হওয়া কি ভালো নয়? এমন মন্দির হওয়া উচিত যার সংবিধান বলে আচার্য হিসাবে যে কোনো সম্প্রদায়ের লোকই উপাসনায় নেতৃত্ব দেবে।

হরদয়ালের মুখে সূক্ষ্ম একটা হাসি দেখা দিলো। গতবার কলকাতায় এসব ব্যাপারে সে কিছু কিছু শুনেছিলো বটে। এমনকী তার বন্ধু ভাদুড়ীমশায়ের চারিদিকেও এ বিষয়ে উত্তেজনা ছিলো। কৌতূহলের অভাবে তা সে ভুলে গিয়েছিলো। এখন মনে পড়লো এই স্ববিরোধে কেশব সেন মশায়ের নামও শোনা যাচ্ছিলো। হরদয়াল বললো, কিন্তু এখানে তো আপনি মাত্র একা। এখানে কে আর আপনার বিরুদ্ধতা করছে? আপনাদের শুনেছি। উপনিষদ নিয়ে ব্যাপার। আপনার ব্যাখ্যার সঙ্গে এ অঞ্চলে বিরুদ্ধ মত মাত্র একজনেরই হতে পারে। তিনি শিরোমণি। তাঁকে ধর্তব্যের মধ্যে আনছি না, কারণ তিনি নিজে যেচে অনধিকারীকে উপনিষদ সম্বন্ধে কিছু বলেন না।

না, না, সার, একথা আমাকে আবার করে বলতে হবে, সার। মন্দির হওয়ার আগে থেকেই আমরা প্রার্থনাসভা করতে পারি। আর সে প্রার্থনাসভায় আপনাকেই প্রধান ও পরম পূজনীয় আচার্যরূপে পেতে ইচ্ছা করি। আর একাই বা কেন? আমার পরিবারে সাতজন তো রয়েছি।

হরদয়ালের হাসি পেলো। সর্বরঞ্জনের পরিবারের সাতজনে দু-তিন বছরের শিশু গুটি দুয়েক। কিন্তু বাড়িতে যে দেখা করতে এসেছে তাকে পরিহাস করা যায় না। সে বরং আবার শান্ত দৃষ্টিতে সর্বরঞ্জনের দিকে চাইলো। এত বিস্তৃত সে দৃষ্টি যে নিয়োগী লক্ষ্য করতে পারলো সেই চোখের প্রান্তগুলি বেশ লাল।

হরদয়াল বললো–এটা এমন সময় যে কী দিয়ে আপনার পরিচর্যা হয় বুঝি না। তাছাড়া আমার তো চাকরবাবুর্চির সংসার। আপনাকে কি কিছু পানীয় অফার করতে পারি? কী পছন্দ করেন? এটা বার্গান্ডিই, যদিও রংটা গাঢ়।

এই বলে সে বোতলের দিকে হাত বাড়ালো।

সর্বরঞ্জন জীবনে এমন বিপন্ন হয়েছে কিনা সন্দেহ। যা উপস্থাপিত হলে ডানকান সাগ্রহে অগ্রসর হয়। পিয়েত্রো যার অনুপস্থিতি অসম্মানজনক মনে করতো, এমনকী বাগচী যার কথায় হয়তো হেসে বলতো লুব্ধ হচ্ছি, সন্ধ্যায় আসবো; সর্বরঞ্জনকে তা একেবারে নির্বাক করে দিলো। সে কি উঠে দাঁড়িয়ে স্থান ত্যাগ করতে পারে? সে কি মদ্য সম্বন্ধে তার ঘৃণা প্রকাশ করতে পারে এই মানুষটির সম্মুখে?

কিন্তু মুহূর্তটি নির্বিঘ্নে পার হলো। এমন হয় যে কোনো বিষয় কোনো বিশেষ অঞ্চলের অনেক মানুষের চিন্তাকে প্রভাবিত করে। হরদয়ালের চিন্তাকে আজ সকাল থেকেই গৌরীদের নাট্যাভিনয় ব্যস্ত রেখেছিলো। সে বললো–মিস্টার নিয়োগী, বাগচীমশায় আপনার সাহিত্যজ্ঞানের বিশেষ প্রশংসা করে থাকেন। আপনি কিন্তু গ্রামের যুবকদের বিশেষ এক উপকার করতে পারেন।

অন্য আলাপে যেতে পেরে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারলো নিয়োগী। সে সাগ্রহে বললো– কীভাবে, সার? সাধ্য হলে নিশ্চয়ই করবো।

হরদয়াল বললো–গ্রামের যুবকদের একাংশ হঠাৎ অভিনয় করতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু ভালোনাটক কই? বুড়ো শালিখআর একেই কি বলে এবার করতে চাইছে। আমার কাছে ভালো লাগেনি।

সর্বরঞ্জন ক্রমশ অনুভব করলো সে নাচাইতে সমস্যাটার কথা উঠে পড়লো। এটায় কি সে আশ্চর্য হবে? কিংবা দ্যাখো সপ্ৰয়াস কীভাবে ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করে। দ্যাখো এবার দেওয়ানজির মতের সঙ্গে তার মত মিলছে। সে ইতিমধ্যে চরণ দাসদের আড্ডায় একবার অন্তত রিহার্শালে গিয়ে পড়েছিলো, ফলে নাটক যে কত কুৎসিত সে বিষয়ে তার সংশয় ছিলো না। সুতরাং সে একটু সাহস করে বললো–ভালোলাগার কথাও নয়, সার। যদি অনুমতি দেন, বলবো তা জঘন্য। আমার তো মনে হয় রাজবাড়ির কোথাও এরকম নাটকের অভিনয় হওয়া উচিত হয় না।

হরদয়াল ভাবলো সেটা খুব বড় সমস্যা নয়, রানীমা আদৌ নাটক দেখতে আসবেন । রাজকুমার যদি আসেও নাটকে যেসব পুরুষের কথা বলা হয়েছে তারা এত নিম্নবিত্ত শ্রেণীর যে তাদের সস্তা দুশ্চরিত্রতাকে তার কাছে ভাঁড়ের ভাড়ামি মনে হবে। সে বললো–আপনি কি শেকপীয়রের দু-একটা কমেডি অনুবাদ করে দিতে পারেন? কী হবে বলছেন? মানুষ নাটক করতে চায়, কিন্তু ভালো নাটকই নেই।

-হয়তো তা করা যায়, কিন্তু

আমি তাও ভেবেছি। সেকষ্পীয়রের কাব্যগুণ অনুবাদে ধরা যায় না। আমার মনে হয় শেরিডান অথবা কংগ্রিবের নাটক অনুবাদ করা তার তুলনায় সহজ হবে।

সর্বরঞ্জন এক সমস্যা থেকে উঠতে গিয়ে যেন অন্য সমস্যায় ডুবে যাচ্ছে এরকম বোধ করলো। বুড়ো শালিক কুৎসিত-দেওয়ানজির সঙ্গে এই পর্যন্ত তার মত মেলায় সে উৎসাহিত হয়েছিলো, এখন সে তো এক চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। কংগ্রিব! সে তো ব্ল্যাকগার্ডদের সম্বন্ধে ব্ল্যাকগার্ডদের জন্য এক ব্ল্যাকগার্ডের লেখা। সে কি চূড়ান্ত নির্লজ্জ আদিরসের কথা নয়?

সে কিছুই বলতে পারলো না। সে অনুভব করলো এই অবস্থায় এই ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেই মাত্র তার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। কলকাতার কারো বৈঠকখানা হলে তা সে অবশ্যই করতো। কিন্তু এখানে দেওয়ানজি হরদয়ালের ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া যায় না, কেননা প্রকৃতপক্ষে এই লাইব্রেরি ঘরের বাইরে যে রাজপথ, যে স্কুল, শিক্ষকদের আবাসিক বাড়ি, এবং তারও পরে গ্রামের পরে গ্রাম, কতদূর কে জানে, সবই দেওয়ানজির বৈঠকখানা।

সাক্ষাৎ শেষ হয়েছে অথচ বিদায় নেয়ার ঠিক কথাটা ভেবে ওঠা যাচ্ছে না বলে বসে আছে এমন অবস্থাই যেন তার। এই সময়ে ঘড়িতে কোন এক আধঘণ্টা সূচনা করলো। পদার কাছে হরদয়ালের ভৃত্যের সাড়া পাওয়া গেলো। সে যেন গোসলখানায় জল দেয়া হয়েছে একরম বললো।

নিয়োগী বললো–আপনার স্নানাহার? আপনার স্নানাহারের সময় হলো?

হরদয়াল বললো–সে হবে। আপনি কংগ্রিব অথবা শেরিডান অনুবাদ করা ভেবে দেখুন।

হরদয়াল উঠে দাঁড়ালো। নিয়োগী যেন কিছু লজ্জিতভাবে নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

ভৃত্য পর্দার এপারে এসে বললো– রান্না শেষ হলো।

তখন চিন্তার সময় নয়। তাহলেও চলো তবে বলে ভৃত্যের পিছন পিছন যেতে যেতে হরদয়াল চিন্তা করলো, আমাদের এই নতুন মাস্টারমশায়ের মনে ধর্মাভাব যত প্রবল সাহিত্যপ্রীতি কি ততটা প্রবল নয়? ধর্মের ভাব কিন্তু এখন প্রবল হচ্ছে কলকাতাতেও। একে কি ইংরেজি শিক্ষার ফল বলবে? তাহলে ও-জাতটাকেই ধার্মিক বলতে হয়।

পথে বেরিয়ে সর্বরঞ্জনও ভাবছিলো, তাহলে এতদিন যা ভেবে এসেছে তা কি সবই ভুল? তাহলে মেট্রোপলিটানের ভাদুড়ীমশাই তাঁর বন্ধুকে চেনেন কি? ভাবো দুপুরের স্নানাহারের আগে ওই মদ্যপান। না, না, এ কখনোই গোপন করা যায় না তিনি মদ্যাসক্ত। এবং ঈশ্বরেও বিশ্বাস আছে কি? ভাবো শিরোমণিকে, উপনিষদ-অভিজ্ঞ ভাবেন! অথচ ইংরেজিনবিশ সে বিষয়ে সন্দেহ কী? গায়ের সেটা অবশ্যই ড্রেসিংগাউন, কত দাম কে বলবে? সে হঠাৎ আবিষ্কার করলো। তাহলে দেওয়ানজি ডিরোজিও ধারার মানুষ, নিরীশ্বর, দুর্বিনীত, মদ্যপায়ী আধুনিকদের একজন যারা নষ্ট স্ত্রীলোক সংসর্গে সঙ্কুচিত নয়? না, না, একথা আমাকে বলতেই হবে দেওয়ানজি সেই প্রজন্মের মানুষ একসময়ে ভয়ঙ্কর রকমে আধুনিক ছিলো, কিন্তু এখন কলকাতার চোখে আর আধুনিক নয়। না, আধুনিক নয়।

হরদয়ালও ভাবছিলো। সে ভাবলো, এদিকে লক্ষ্য করো। এই চার্লস ডারউইনকে যদি বিশ্বাস করো তবে এই লাল কাপড়ের মলাটের বইটা এখন একখানা ইট যার আঘাতে অনেক গির্জার অনেক কাঁচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে। যদি এঁকে বিশ্বাস করো ওটা আর বিশ্বাস করতে পারো না যে ঈশ্বর মানুষকে হাজার পাঁচেক বছর আগে নিজের আকারে সৃষ্টি করেছিলেন। একটা চাপা হাসি হরদয়ালের চাঁপা ঠোঁটে জড়িয়ে গেলো। অবশ্য ওদের কথা, হয়তো প্রমাণ করবে ডারউইন ঠিকই বলেছেন তবে তা লাল আর কালো মানুষ সম্বন্ধে। ঈশ্বর বেশ ব্লোন্ড এবং নর্ডিক, আর সেরকম মানুষ সৃষ্টির কথাই বাইবেলে আছে।

.

০৬.

স্কুলে পৌঁছে সর্বরঞ্জন নিজের আবিষ্কার নিয়ে নিতান্ত গম্ভীর হয়ে রইলো। সে কি আর কখনো দেওয়ানজির কাছে সাহায্য আশা করতে পারে? স্কুল ভাঙার আগে তার দুটো ক্লাস ছিলো, একটাতেও সে মন দিয়ে পড়াতে পারলো না।

সে শিক্ষকদের বসবার ঘরে গিয়ে একবার মনে করলো পরীক্ষার যে-প্রশ্নপত্র আগামী সপ্তাহে দিতে হবে সেগুলোকে আর একবার দেখে দিলে হয়। কিন্তু উৎসাহটা তৈলহীন প্রদীপের মতো নিস্তেজ। সে তখন দেরাজ থেকে একখানা খেরো বাঁধানো খাতা বার করলো। এটা তার একরকমের ডায়েরি। ক্লাসে কী পড়ানো হলো কী পড়ানো উচিত এসব যেমন থাকে, তেমনি লেখা থাকে তার নানা সময়ের চিন্তা। এটা অবশ্যই তার সেই ডায়েরি নয় যা সে বাড়িতে প্রত্যহ সন্ধ্যার উপাসনার পরে লেখে। বরং এই দুই নম্বর ডায়েরিতে যা সব থাকে তার কিছু কিছু পরিমার্জিত হয়ে বাড়ির এক নম্বর ডায়েরিতে স্থান পায়।

দুনম্বর ডায়েরি লিখতে সর্বরঞ্জন দেখলো গোলটেবিলটার একপ্রান্তে শিরোমণি এসে বসলো। কিছুপরে তার থেকে দুএকখানা চেয়ার বাদ দিয়ে চরণদাস বসলো এসে। সে একটা বাঁধানো খাতায় লাল কালো কালিতে রুল টানতে শুরু করলো। নতুন বছরের অ্যাটেন্ড্যান্স রেজিস্টার হবে।

চরণ দাসের পরনে বেঁটে আচকান জাতীয় পিরহান, পাকানো চাদর কোমর ঘিরে বুকে ক্রশ করে দুই কাঁধে। শিরোমণির গায়ে খাটো ঝুলের খাটো হাতার পাশে ডোরে বাঁধা মেরজাই, চাদরটা গলার দুপাশ দিয়ে ঝুলছে। গলার কাছে মোটা পৈতের গোছা। কিন্তু সব চাইতে দর্শনীয় তার অর্ধেকের বেশি কামানো মাথায় সাদা ধবধবে টিকির গোছাটা।

হয়তো নিঃসঙ্গতাবোধ নিয়োগীকে এত পীড়িত করছিলো যে নিজের অজ্ঞাতসারে তার মন তালাশের সুযোগ খুঁজছিলো। সে বললো–চরণদাসবাবু এখনই আগামী বছরের কাজ সেরে রাখছো? নাকি এটাও থিয়েটার সম্বন্ধে কিছু।

চরণ দাস মুখ না তুলে বললো, আগেকারটাই ঠিক। সে হাসলো। ইতিপূর্বেই থিয়েটার সম্বন্ধে নিয়োগীর সঙ্গে কিছু তর্ক হয়েছে।

সর্বরঞ্জন বললো, ভয় নেই তোমাদের। এখানে এই গ্রামে তোমাদের থিয়েটারকে কেউ নিন্দা করবে না। থিয়েটার নিয়ে আলোচনার ফলে দেখা যাচ্ছে শিরোমণিও শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। সে বললো–তা কি বলা যায়? থিয়াটার বা অভিনয় যাই বলুন, ভালো না হলে নিন্দা হবেই।

চরণ বললো–উনি বোধ হয় অন্য অর্থে বলছেন।

-কথাটা ঠিক ধরেছো। বললো– সর্বরঞ্জন। কিন্তু তারপরে সে নির্বাক হয়ে গেলো। সে কি কখনোই প্রকাশ্যে বলতে পারে দেওয়ানজি হরদয়াল থিয়েটার নাটক সম্বন্ধে কী জাতীয় নিন্দনীয় মত পোষণ করেন? সে কি এইমাত্র ডায়েরিতে যা লিখেছিলো সেই আশঙ্কার কথা বলবে? যে অতি শীঘ্রই এই নাটকের প্রশ্রয়ে ড্রপওয়ালী, খেমটাওয়ালী, সাধারণভাবে নষ্টা স্ত্রীলোক অভিনয়ের সুযোগে কীভাবে প্রকাশ্যে বহুলোকের চোখের সামনে ক্রমশ আদরণীয় হয়তো দেবীরূপে কথিতা হবে।

সে মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, মুশকিল কী জানো, চরণ দাসবাবু, মানুষকে দেখে দেখে যে ধারণা করো আর তার প্রকৃত ব্যবহারে অনেক তফাত। এবারেও নিয়োগীর মনে দ্বিধা দেখা দিলো। সে কি বলতে পারে হরদয়ালের ব্যবহার তাকে আজ কীরকম আঘাত দিয়েছে। সে বললো, জানো খিদিরপুরে এক মিত্তিরজা আছে যিনি নতুন সত্যধর্মকে আলিঙ্গন করেছেন। কিন্তু তা করার আগে নিজেদের গৃহবিগ্রহ গোপীনাথ প্রভৃতিকে এক মন্দিরে দিয়ে এসেছেন। যাতে সেই অবস্থাতেও পূজা হয় সেজন্য সে মন্দিরকে আট-দশ বিঘা জমিও কিনে দিয়েছেন।

শিরোমণি বললো–কৌতুকের ব্যাপার তো। বিবেকের সঙ্গে রফা?

-আমার কিন্তু মশায় তা নেই। মিথ্যা মিথ্যাই। আমাদের নারায়ণশিলা বিগ্রহ ছিলো চরণ বললো–তা বুঝি গঙ্গায় দিয়েছেন?

রস, রসো, চরণদাস, শিরোমণি বললো, গঙ্গায় দেয়া তো হিঁদুআনিই হলো।

নিয়োগী বললো–আপনি যদি দয়া করে আমার বাসায় যান, দেখতে পাবেন সে শিলা আমার টেবিলে কাগজ চাপার কাজ করছে। আমি চাই আমার পুত্রেরা তাকে নুড়ি বলে জানুক। সে বললো– আবার, না না, আমাকে বলতেই হবে, আজ পর্যন্ত সেই পাথর থেকে নূপুরের শব্দও শুনিনি, বাঁশিও বাজে না। এই বলে সে হাসলো মৃদু মৃদু।

শিরোমণি তাতে প্রচণ্ড শব্দে হা হা করে হেসে উঠলো, বললো–এখানেই চিন্তার ত্রুটি। যাকে নুড়ি জ্ঞান করলেন তার আবার নূপুর অথবা বাঁশি কী? এ যে পরম ব্রহ্মের দয়াময় হওয়ার মতোই।

চরণদাস বললো, আপনি বলছেন নুড়ি ভাবলে তা নুড়ি হয়?

-তাই তো হয়ে থাকে, শিরোমণি বললো, তোমার আমার কাছে যা রক্তে বসায় মাখানো আড়াকাঠ, কারো কারো কাছে তা আবার পূজনীয় অবতারের প্রতীক। হয়তো নিয়োগীমশায়ও এমন একখানা কাঠ দেখলে যুক্তকর অন্তত বুক পর্যন্ত ওঠান।

সর্বরঞ্জনের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। তার মুখে যে শক্ত শক্ত শব্দগুলো আসছে সেগুলো আয়ত্তে রাখা কঠিন হচ্ছে। সে বললো–সত্যি গোপন করা আমার অভ্যাস নয়। স্বীকার করি আপনি যাকে আড়াকাঠ বলছেন সেই ক্রুশ দেখলে যুক্ত করে শ্রদ্ধা জানালে লজ্জার কিছু দেখি না। আপনি ইংরেজি জানলে আপনাকে কেশব সেন মশায়ের বক্তৃতা পড়তে দিতাম। দেখতেন বড়ো বড়ো ইংরেজরাও কেন তাকে প্রশংসা করছে। না, না, একথা আমাকে বলতেই হবে, আমাদের এই দেশে এমন প্রতীকও পূজা করা হয়, যা স্বীকার করতেই হবে, যে কোনো ভদ্ৰব্যক্তিকে লজ্জিত করে। তার তুলনায় ক্ৰশ?

চরণ জিজ্ঞাসা করলো নিয়োগীমশায় ওলাবিবি, শীতলা ঠাকুরানীর কথা বলছে কিনা।

নিয়োগী বললো–আমি তোমাদের দেবতার দেবতা। মহাদেবের কথা বলছি।

কোনো কোনো কথা একটা আলগা আলগা ধরনের আলাপকে যেন বিদ্যুতের আঘাতে সজীব করে তোলে। এই ক্লাসটা শেষ হলে শনিবারের ছুটির ঘণ্টা পড়বে। শিরোমণির তখন গৃহে ফেরার কথাই মনে হচ্ছে। টেবিলের উপরে তার হাতের কাছে স্কাইলাইট থেকে রোদ এসে পড়ছে। শিরাবহুল বৃদ্ধ হাত দুটিরও যেন রোদ পোহানোর ভঙ্গি।

চরণ বললো–সে তো এক থাবা কাদা কিংবা একটুকরো পাথর । লজ্জার কী?

–কিন্তু আকৃতি? বিশেষ করে এই গ্রামে–সর্বরঞ্জনপ্রসাদ জুগুল্পিত বোধ করে থেমে– গেলো।

শিরোমণি বললো–অ। তা বিশেষ করে এই গ্রামে কেন?

নতুবা শিবলিঙ্গের গোড়ায় কারো বুকের রক্ত দেয়া হয়?

–তাকেও যৌনতাগন্ধী বলছেন? শিরোমণি হাসলো যেন।

–আপনি ব্রাহ্মণ, স্বীকার করবেন শিবপূজায় রক্তচন্দন অবিধেয়। রানীমা সম্বন্ধে আপনি যে কথা বললেন এই গ্রামে বসে আমি সেকথা মুখে আনতে চাই না।

–অর্থাৎ চিন্তা গোপন করছেন? শিরোমণি হাসলো আবার!

–তাহলে শুনতে চান? ওকে আমি পশুত্ব পূজা বলি।

শিরোমণির কৃশ শরীরে অনেক শিরাই প্রকাশমান। কপালের ঠিক মাঝখানে একটা শিরা যেন রক্তের চাপে দপদপ করছে। হঠাৎ সে ঠা-ঠা করে হেসে উঠলো। সে বললো–খুব বলেছেন। আমি শুনেছি সাহেবদের শিশুরা রুমালে বাঁধা অবস্থায় সারস দ্বারা নীত হয়। আপনি বাঙালি, আপনাদেরও তা হয় কিনা জানি না। ভেবে দেখুন নিজের জন্ম, নিজের সন্তানের জন্ম পাপপঙ্কে পশুত্বের ফলে কিনা। আমরা স্বর্গদ্বার থেকে ভূমিষ্ঠ হই কিন্তু। যদি বলেন একবারই জন্মানোর সুযোগ পেয়েছি, এ জন্ম সার্থক, তবে সেই সার্থকতার উৎস, জীবনের সবটুকু আনন্দের উৎস, মাতৃযোনির মতো কি এমন পবিত্র, মশাই?

-ছি-ছি-ছি, এসব আপনি কী বলছেন। নিয়োগী দুহাতের তর্জনীদুকানে খানিকটা করে। ঢুকিয়ে দিলো।

শিরোমণি বললো–মস্তিষ্কের সাহায্যে ব্যাপারটাকে বিবেচনা করুন। পবিত্রতার বোধ বদলাবে। রক্ত মাখানো কাঠ, যা মৃত্যু, বেদনা, প্রতিহিংসার কথা মনে আনতে পারে, তা যদি আপনারা সামনে রাখতে পারেন, তাহলে আমরা যদি আনন্দ ও জন্মের প্রতীককে সামনে রাখি তাতেই কি দোষ?

ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজলো। ছুটির ঘণ্টা শুনে সেই হলের বাইরে ছেলের দল হৈ হৈ করে বেরোচ্ছে! শিরোমণি উঠে দাঁড়ালো। বললো–নমস্কার মশায়। বুড়োর কথায় দোষ নেবেন না। আজ মাছি, কাল নেই।

কিন্তু সেদিন ভবিতব্য অন্যপ্রকার ছিলো। ভিতরের দিকের এই হলে বসে বাইরে গুঁড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে তা বোঝা যায়নি। বাতাসও ছিলো। শিরোমণি হলের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ভিজে বাতাসের ঝাপটা খেয়ে পিছিয়ে এলো। টেবলের কাছে এসে বললো–খুব ধমক খেলাম হে চরণ, জল হচ্ছে।

চরণ বললো–তাড়া কী? বসুন।

নিয়োগীর বোধ হয় এমন স্পষ্ট, তার কাছে যা নির্লজ্জ, কথা শোনার অভ্যাস ছিলো না। সে কথা খুঁজে পাচ্ছিলো না। শিরোমণিকে ফিরে চেয়ারে বসতে দেখে সে বেশ তিক্তস্বরে বললো–আপনার এই অনুভূতিগুলিকে আমি নিতান্ত নিম্নস্তরের মনে করি। এ কথাটা আপনাকে জানানো খার।

শিরোমণি বললে–আপনি ঠিকই বলেছেন। এগুলো সেই স্তরের কথাই যখন মানুষ শিবলিঙ্গে জগৎ পিতাবৌকে দেখতে পাচ্ছে না, দেখতে পাচ্ছে না তাদের স্নেহ ঢল ঢল মুখ। হ্যাঁ হে চরণ, তুমি বাইবেল পড়ো শুনি, কালিদাস পড়েছে?

নিয়োগী বললো–আমি পড়েছি, আমাকে বলুন। কৈশোরে সে দুর্ভাগ্য হয়েছিলো আমার। কালিদাস শৈব ছিলেন, এই বলবেন তো? তাতে কিছু প্রমাণ হয় না।

শিরোমণি বললো–প্রমাণ নয়, তুলনা। আপনি হয়তো শকুন্তলমও পড়েছেন। প্রথমে শিবকে প্রণাম শেষে ভরতবাক্যেও তাই, মাঝখানে কামজ মিলন থেকে আর এক কুমারসম্ভবের পবিত্রতায় পৌঁছানো। এই এক ব্যাখ্যা হয় যে মানুষ কামজ অস্তিত্ব থেকে শিবত্বে পৌঁছাতে পারে। আদিরসকে বাদ দিয়ে নয়, তাকে দেবত্বের সার্থকতায় চালিত করেই কাব্য হয়। যদিও আপনারা ভাবেন ভগবান আদিম মানুষকে কোন এক উদ্যান থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, এ পতন হয়নি, বরং পশুত্ব থেকে ঊর্ধ্বে চলেছে মানুষ। কিছু উন্নতি হয়েছে।

সর্বরঞ্জন বললো–থাক থাক। এতেও আপনার শিশ্নপূজার সমর্থন হয় না। সে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো।

শিরোমণি স্মিত হাস্যে বললো–হয়। যতক্ষণ না তাকে জগৎপিতা যোগীশ্বর বলে বোধ হয়, জন্ম জীবন মৃত্যুর হেতু বলে মনে হয়, ততক্ষণ না হয় নিজের প্রাণশক্তির প্রতীকরূপে পূজা করুক।

শিরোমণি অভ্যাসবশে শিখায় হাত রাখলো, যেন সেটাকে বাঁধবে ফুল দিয়ে, কিন্তু আচমকা অন্যদিকে গেলো ঘটনার গতি। কে যেন জিজ্ঞাসা করলো–আপনি কি শৈব, শিরোমণিমশায়?

শিরোমণি পিছন ফিরে দেখলো, তার চেয়ারের পিছনেই বাগচী, এবং তার কাছাকাছি অন্যান্য শিক্ষকরাও। শিরোমণি বিশেষ বিব্রত বোধ করলো, কিছুটা যেন ভীতও। সে জিভ কাটলো। সে ইতস্তত করে বললো–না মশায়, বিষ্ণুকে পূজা করার চেষ্টা হয়।

বাগচী বললো–ও আচ্ছা। কিন্তু আপনি যোগীশ্বর রূপের কথা কী বলছিলেন, জগৎপিতাও বলছেন। বৃষ্টি থামেনি, আপনি বলতে পারেন।

শিরোমণি লজ্জায় অপোবদন হলো। কিন্তু সে লক্ষ্য করলো যে অন্য অনেকেই তার মুখের দিকে চেয়ে আছে। যেন সে ধিকৃত পরাজিত এক জনগোষ্ঠীর প্রতিভূ এরকম একটা অনুভব হলো তার।

সে বললো, তারপরও, কল্পনা করি, তার অনুভূতিতে যোগীশ্ব সেই রূপ ক্রমশ এক আনন্দময় জ্যোতিস্বান্ কালস্রোতে মিলিয়ে যায়। সে হয়তো অনুভব করে সেই মহাকালস্রোতে সূর্য-চন্দ্রাদি জন্মাচ্ছে, লোপ পাচ্ছে, সে নিজেকে সূর্য-চন্দ্রাদির মতো মহাকালপ্রসূত এবং তাতেই বিলীন মনে করে। সেই জগৎ-জনয়িতা মহাকালকে অনুভব করে তার জন্মের আনন্দ নেই, মৃত্যুর ভয় নেই, তার সুখ দুঃখ নেই, সে কাউকে ভয় করে না, বিদ্বেষ করে না। সে যদি কখনো বলে আমিই শিব তাহলে তা মিথ্যা হয় না।

এই বলে সে থামলো। তাকে বিশীর্ণতর দেখালো। সে মনে মনে ভাবলো : এই বিধর্মী মানুষটির কাছে কেমন বা কটু বোধ হলো তার কথা!

কিছুক্ষণ কেউই কিছু বললো– না। কিন্তু কেউ কেউ করিৎকর্মা খাকে। কৈলাসপণ্ডিত ইতিমধ্যে উঠে দরজা পর্যন্ত গিয়েছিলো। সে বললো– ধরেছে সার। এবার যাওয়া যাবে।

বাগচী হেসে বললো–পণ্ডিতমশায় দেখছি আলোচনাটা চালাতে চান না। চলুন তবে।

পথে বেরিয়ে শিক্ষকেরা শীতের এই ক্ষণস্থায়ী বৃষ্টি শীত বাড়াবে কিনা, ফসলের পক্ষে ক্ষতিকর হবে কিনা, ধান-চালের দাম এবার গতবারের চাইতে বেশি কেন ইত্যাদি আলোচনায় ব্যস্ত হলো।

শিরোমণি সকলের পিছনে হাঁটছিলো। বাগচী শিক্ষকদের পরে স্কুল থেকে বেরিয়েছিলো। কখন সে শিরোমণির কাছে এসে পড়েছে। সে বললো–এগুলো কি আপনার নিজেরই ব্যাখ্যা? কিংবা কোনো দর্শন থেকে বলছেন? হ্যাঁ, মশায়, ওই উদাসীন মহাকালের কথা? সবাই উদাস হলে কি চলবে?

শিরোমণি নিজের মনের মধ্যে খোঁজ করলো যেন, বললো–নিশ্চয়ই পূর্বসূরীদের কাছ থেকে পাওয়া। কিন্তু হঠাৎ বিশেষ কারো নাম মনে করতে পারছি না। কাল ছাড়া কি কুম্ভকারই একটা ঘট বানাতে পারে? কিন্তু উদাস না হলেও চলে। যোগীশ্বর রূপে তাঁকে আদর্শ করে লোক সংগ্রহ করা যায়। তিনি অপরের জন্য বিষ পান করেন। শিরোমণি নিতান্ত কুণ্ঠিত হয়ে হাসলো।

বাগচী এই কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কিছুক্ষণ শিরোমণির পাশে চললো। সে বিস্ময় বোধ করলো। জন্মান্তরবাদ নয়, কর্মফল নয়, সবই যেন এক উদাসীন মহাকালস্রোতে ভাসমান। কী সাংঘাতিক কথা, তাহলে ক্রাইস্ট দূরের কথা, ঈশ্বরই থাকেন কি?

শীতের এই এক পশলা বৃষ্টি ধুলোকে জব্দ করতে পারেনি। বরং বাতাস এনে ধুলোর উৎপাত বাড়িয়েছে। একবার তা উঠে শিরোমণিকে ব্যতিব্যস্ত করলো! সে চাঁদরে নাক-মুখ ঢাকলো বটে, তার পাকা চুলে, শীর্ণ দেহে ধুলোর স্তর পড়লো যেন। ধুলোয় ঢাকা ক্লান্ত শীর্ণ এক হতাশ মানুষ যেন সে।

নিজের বলা কথা চিন্তার সূচনা করতে পারে। শিরোমণি মনের তলায় চলে নিজের অজ্ঞাতে রামায়ণের ভাষায় চলে এলো। কিছু বদল করে সে ভাবলো : উনষোড়শ বর্ষ পৌত্র যে রাজীবলোচন। আজ সন্ধ্যা থেকে তাকে মেঘদূত পড়াতে হবে। বালবিধবা ভ্রাতুস্পুত্রী গৃহে থাকায় টোলেও ভট্টি ছাড়া কাব্য পড়ানো হতো না। এখন তা যায়। বাড়ির কাছাকাছি এসে সে ভাবলো : কিন্তু তা কি ভালো হচ্ছে? পৌত্র ও পুত্রতে কি বিবাদ দেখা দেবে? এ কি সত্য যা সে কখনো আশঙ্কা করে? নিজের গৃহের পরিস্থিতি সে বিশ্লেষণ করলো। এবার নিয়ে সাত বছর হলো পুত্র বিজয়কুমার কলকাতায় অর্থোপার্জনের জন্য। মাঝে কী এক পরীক্ষা দিয়ে জজ-পণ্ডিত হওয়ার চেষ্টায় ছিলো, কিন্তু জজ-পণ্ডিত কি এখনো হয়? তা কি গুজবনয়? এই সাত বছর বিজয় কালের সঙ্গে অনেক আপোস করেছে। সে ধর্মান্তরিত হয়নি বটে, কিন্তু স্মৃতিতে বিশ্বাস অনেকটাই কমেছে। সে গতবার হাসতে হাসতে তার মাকে বলেছিলো, সময়ও মুনিদের কাছে বেদের মতো প্রমাণ। কিন্তু সে আজকের নিয়োগীর মতোই উত্তেজিত ছিলো। সেদিন টোলের দু-তিনজন ছাত্র তার মায়ের পক্ষ নেওয়ায় কণ্ঠস্বরগুলো ক্রমশ উচ্চতর হচ্ছিলো। তার সে মা আর নেই। কথাগুলো কি তার সঙ্গে গিয়েছে? সে বলেছিলো, দোষটা ভাগ্যের যে ব্রাহ্মণকুলে জন্মেছি, কুল ত্যাগ করতে পারছি না। কিন্তু শীল, সোনার বেনে, কৈবর্ত, কায়েতের মুখে বামুন বামুন ঠাট্টাও শুনবো আর তাদের দেওয়া নামমাত্র বৃত্তি ভোগ করবো–তাই বা কেন? আমরাই যদি নিজেদের স্বার্থে ধর্ম তৈরী করে থাকে আমরাই তা চুরমার করে দিই না কেন? তুমি কি বলবে এই গ্রামের বাইরে শিরোমণি শব্দটাকে কেউ শ্রদ্ধা করে? তার চাইতে বামুন বিদ্যাসাগর ভালো। কলকেতায় বাস করলে খানিকটা কলকেতার মতোই হবে, বিজয়েরও হয়েছে। কিন্তু পৌত্র বৈজয়ন্তের উপরে বাড়ির প্রভাব বেশি। পৌত্রের প্রতি স্নেহাবিষ্ট হয়ে, অথবা সপরিবারে পুত্রের কলকেতায় থাকা অসুবিধার হবে এই যুক্তিতে পৌত্রকে নিজের কাছে রাখা কি ভালো হচ্ছে?

কিন্তু কাব্য পাঠের কথা হচ্ছিলো। সময় হয়েছে বটে। কাব্যের রস ও ব্যক্তির ইন্দ্রিয় কর্তৃক উপভোগ-জাত সুখ এক নয় তা বুঝতে হবে। কিন্তু রাজীবনোচন পৌত্রের বাহুও তো পরিঘসদৃশ হওয়া উচিত। কাব্যের রস সেই রকম ব্যঢ়োরস্ক পুরুষের জন্যই কি? কাব্যের স্মৃতি শিরোমণির কল্পনাকে উদ্দীপ্ত করায় সে যেন তার সম্মুখে রসপিপাসু কয়েকটি যুবাকে দেখতে পেলো।

কিন্তু কল্পনা অনেকসময়েই বাস্তবকে বৈপরীত্যর সাহায্যে স্পষ্ট করে। এসব কাব্য যাদের, মহাকাল যাদের উপাস্য, তারা চার হাতে ধনুতে জ্যা রোপণ করতে পারতো। যবন ধ্বংসী সেই সেনা নিশ্চয় ক্ষুধাখিন্ন ছিলো না।

তার চতুষ্পঠীতে কি তেমন যুবক আছে? কিংবা গ্রামে? মাংসল স্কন্ধ, সুবলিত বাহু। আর ধনুর অনুকল্প তো বন্দুক।

বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে নিজের চিন্তাগুলোকে লক্ষ্য করে সে লজ্জিত হলো। এসব কেন ভাবছে? যখন এসব কাব্য লেখা হয়েছে তখনো অপরাধগুলো সবই ছিলো, অবশ্যই ক্ষুধা, তৈল, ইন্ধন, লবণ চিন্তা ছিলো, কিন্তু একরকমের বলিষ্ঠতাও ছিলো। এইসব যে সে ভাবছে কে জানবে? শালগ্রামশিলা? ক্ষুধার অভাব, দৃপ্ত যৌবন, ধীরোদাত্ত পুরুষ শত সহস্র কুটির থেকে ছুটে আসছে, যাদের অপরাধকে ভুল বলে ক্ষমা করা যায়, তাদের জন্য কার কাছে প্রার্থনা করা যায়?

বাগচীও বাতাসের ঝাপটায় পড়েছিলো। পথের ধারের গাছগুলোর ব্যস্তসমস্ততা দেখতে পেলো। আকাশে যে হালকা মেঘ তাতে আর কি বৃষ্টি হবে? কী যেন ভাবছিলো সে? শিরোমণির কথা? সে কি তবে নিজেই জানে না তার কথাগুলোর উৎস কোথায়? এ কি নতুন দার্শনিক চিন্তার দিকে চলেছে তার মন, অসীম অকম্পিত কালকেসময়কে–সে যাকে হিন্দুরা ব্রহ্ম বলে তার প্রতিভাস মনে করছে? এ কি নতুন দার্শনিক চিন্তা যা এই গ্রামে বলা হচ্ছে? কী জানি! কিন্তু তা কি ভালো? তাহলে কি বিপন্ন হতে হয় না? ঈশ্বর থাকে না।

ঠিক এই সময়ে নিয়োগীও চিন্তা করছিলো। সে মাথা নিচু করে হাঁটছিলো, যেন সে পরাজিত। কিন্তু মনের জোরে সে এই অলীক কল্পনা থেকে মুক্ত করে নিলো নিজেকে। বাগচীকে দেখেই সে ভদ্রতায় থেমে গিয়েছিলো কেননা শিরোমণি তখন নিতান্ত অরুচিকর যৌন বিষয়ক কথা বলছিলো। কী আশ্চর্য, দেওয়ানজি এঁকেই উপনিষদের ব্যাখ্যা করার উপযুক্ত বিবেচনা করেন! কালিদাস! শকুন্তলম্! ঈশ্বর আমাদিগকে পাপ শ্রবণ ও পাপ কথন থেকে রক্ষা করুন। একবার তার মনে হলো সে নিজেকে এবং নিজের সন্তানদের পাপ থেকে উৎপন্ন মনে করে কিনা। পরমুহূর্তেই সে ভাবলো এই যে তার ঈশ্বরচিন্তায় বারবার যৌনতা যুক্ত হয়েছে এর জন্য কি সে দায়ী? অথবা এই কি অসুলিনির্দেশ যে তাকে গ্রাম ত্যাগ করতে হবে?

আদর্শবাদীদের চিন্তা অনেকসময়ে বাধার সম্মুখে অনুপ্রেরিত হয়ে ওঠে। গ্রাম ত্যাগের কাল্পনিক শূন্যতার সামনে তার চিন্তা শক্ত হয়ে দাঁড়ালো যেন। না, না, সত্যধর্মের পরাজয় হয় না। সে অতি দ্রুত চিন্তা করতে লাগলো। এই গ্রামে দেওয়ানজি নিশ্চয়ই প্রচণ্ড শক্তিশালী, না না, তা আমাকে স্বীকার করতেই হবে। কিন্তু তার শক্তির উৎস? তা কি আরো শক্তিশালী নয়? সে যেন পেয়েছি পেয়েছি বলে উঠবে। সে ভাবলো, আর দিদি ব্রহ্মবালার কথা সত্য। হলে, অবশ্যই তা সত্য, রানীমা গুণাঢ্যমশায়ের কন্যা সম্বন্ধে ভাবতে রাজী হয়েছেন। আগ্রা, মথুরা, পাটনার এবং বর্তমানে কলকাতারও এই পরিবারের ন্যায় কাদের এমন সত্যধর্মে নিষ্ঠা? গুণাঢ্যমশায় কমিশরিয়াটের কনট্রাকটাররূপে ধনাঢ্যও বটেন। তাঁর কন্যা যদি রাজকুমারের স্ত্রীরূপে এদেশে আসেন? না না, দিদিকে আজই পত্র দিতে হবে। এ সম্বন্ধ ঘটাতেই হবে। রানী হতেই কি রোমসম্রাট ক্রিশ্চান হননি?

.

০৭.

বাড়ি যাওয়ার কথা সকলের আগে মনে হলেও কৈলাসপণ্ডিত সকলের পিছনে ছিলো। সঙ্গে চরণদাস। চরণদাস তো দাঁড়িয়ে থেকে স্কুলের দরজা জানালা বন্ধ করায়। কৈলাসপণ্ডিতের গন্তব্যই হারিয়ে গিয়েছে, কোথাও কোনোরকমে পৌঁছে গেলে সেখানেই নিজেকে ছড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে। বয়স শিরোমণির চাইতে কম হবে, এমন জরাজীর্ণ যে কেউ প্রতিকারের কল্পনা করে না।

তার এই এক সুবিধা, সে দারিদ্র্যকে অনুভব করতে পারে না আর। দ্বিতীয় সুবিধা ইদানীং দেখা দিয়েছে, সে ক্রমশই অতীতকে ভুলে যাচ্ছে। তার মনে আছে বটে, এই স্কুলটা হওয়ার আগে বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজির দু-এক কথা শিখতে তার পাঠশালাই একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিলো, আর দেওয়ানজির বদান্যতায় স্কুল হলেও তাকে সেখানে কাজ সুতরাং জীবিকার পথ দেওয়া হয়েছে। এখন কৈশোর-যৌবনের ঘটনাগুলোকে তার অলীক মনে হয়। সে যে কায়স্থ তা নিশ্চয় মনে আছে; পিতার নাম গোত্র মনে আছে, কিন্তু তার মুখখানা স্মৃতিতে আর আসে না। মায়ের? তা যেন ভাসে, দোলে, ডুবে যেতে চায়। কায়স্থের বিধবা। কিন্তু কী কঠোর বামনাই! সেই কঠোর একাগ্রতা ধরা পড়তো চরকা নিয়ে বসলে। তেমন সূক্ষ্ম রেশম মাকড়সাও পারে না। ফরাসডাঙার সাহেব কিনতে। আর তাতেই মা-ছেলের ভাত? মা যখন সব-সেরা কাটুনি তখনই মাসে দুটো করে উপবাস, প্রতি রাত্রিতেই অরন্ধন, মায়ের প্রতি রাত্রিতেই অভক্ষণ। শুভঙ্করে দড় পণ্ডিত জানে এসবে ভাতের প্রয়োজন এক-তৃতীয়াংশ কমে আসে। কৈলাসের আর এক সুবিধা হয়েছে এখন, বালকের মতো কথায় কথায় চোখে জল আসে, চিন্তা ভেসে ভেসে হারিয়ে যায়।

সে আজ ধর্মের কথা ভাবতে বাধ্য হয়েছে। ধর্ম? ভাবতে গেলে মায়ের সেই শীর্ণ, ক্ষুধাখিন্ন মুখটাকে মনে আসে। এখন বাতাসা-টাতাসা মানত করার দায়িত্ব তার স্ত্রীর। তার মেয়ে চারু এখন বড়ো হয়েছে, সে বরং এ ব্যাপারে মাকে সাহায্য করে। কিন্তু এই ধর্ম নিয়ে একটা বিপদ যেন ঘনিয়ে আসছে। আজ আবার নিয়োগীমশায় শিরোমণিকে চটিয়ে দিলেন।

মুশকিল! সে কিছুদিন থেকে নিয়োগীমশায়ের কাছে ঋণী বোধ করছে। অসময়ে বিনা সুদে দুচার টাকা ধার দেওয়া তো বটেই। আসল কথা তার মেয়ে চারু। বছর দুয়েক আগেও সে গ্রামের সব চাইতে গেছোমেয়ে ছিলো! এখন বিষণ্ণ হয়েছে, যোলো-সতেরো হলো তার। তার মেয়ের বিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। বছর দুয়েক আগে শেষ চেষ্টা করেছিলো সে। সে কুলীন নয় আর কুলের কথা ভাবেনা। তা সত্ত্বেও তখনই পাত্রপক্ষ সোনায় নগদে চারশো চেয়েছিলো যা তার এক বছরের উপার্জন। চারুকে দরজা বন্ধ করে থাকতে হতো যদি না নিয়োগীমশায়ের স্ত্রী তাকে ডেকে নিতেন। দিনমানের দু-পাঁচ ঘণ্টা চারু তার কাছে কাটায়, তার ছোটোছেলেটিকে বুকে করে রাখে, কুটনো কেটে দেয়, সব কাজেই সাহায্য করে। একটু রুগ্নই তিনি, সন্তানও বেশ কয়েকটি। কিন্তু তিনিও চারুকে ভালো মন্দ খেতে দেন, সেলাই শেখান, খাতা বেঁধে হাতের লেখা শেখান।

হাতের লেখা সে নিজেই পাঠশালায় শিখিয়েছিলো। কিন্তু এটা তার চিন্তার বিষয় নয়। সে নিয়োগীমশায়ের দিকে ঝুঁকেছে, তার কাছে কৃতজ্ঞ বোধ করছে। তিনি যেমন দয়াবান তেমন যদি নরম হতেন! কিন্তু তিনি দলাদলির দিকে চলেছেন। কৈলাসের আতঙ্ক হলো–এ রকম চলতে থাকলে সে নিয়োগীমশায়ের দলে গ্রামের অন্য অনেকের বিরুদ্ধে গিয়ে পড়তে পারে। উদাসীন, নিস্পৃহ শিরোমণি, আর ক্রুদ্ধ অপমানিত শিরোমণি এক নয়। কী হবে তখন গুরুর?

ভয়ে ভয়ে কৈলাস বললো–চরণ, তুমি ধর্ম-টর্ম বোঝো?

–তেমন বুঝি কোথায়?

কথাটা এগোলো না। কৈলাসের মনে তার মেয়ে চারুই ফিরে এলোদ্রুত চলেছে এমন চারু, দ্রুত কাজের হাত চলেছে এমন চারু, হাস্যময়ী এক চারু, যার হাসি দেখে তার দুঃখ। বোঝা যায় না। কিন্তু সে আজ মনকে ভেসে যেতে দেবে না। গোপনে চরণকে পাওয়া গিয়েছে। চরণের একরকম বেপরোয়া সাহস আছে যা এ-গ্রামে দুর্লভ। ভাবো নিজের বিধবা ভ্রাতৃবধূকে প্রকাশ্যে বিবাহ করা! কিন্তু কৈলাসের চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো।

তার অনুভূতিতে এই কান্না উঠলো–ও মা, উমা, পাষাণ বলেই কি সইবে? তা সত্ত্বেও মনকে শক্ত করে সে বললো–আচ্ছা, চরণ, তুমি কি জানো, সুরেন সাঁপুই কী জাতি? বামুন কায়েত নয় বোধ হয়? তোমরা তো একসঙ্গে ওঠো বসো, খাওয়া-দাওয়া করো?

চরণ বললো–জাতি তো জানি না পোনমশাই, আর আড্ডায় অত বিচারও নেই।

–চরণ, শুনলাম, নিয়োগীমশায় ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু সুরেন হেঁসেলে ঢোকে, খায়।

-ওদের সমাজে ওসব চলে।

এতক্ষণে কৈলাসের চিন্তা যেন একাগ্র হলো, আর তার তীক্ষ্ণতায় সে ভীত হয়ে এদিক ওদিক চাইতে লাগলো। নিয়োগীর স্ত্রী কাল বিকেলে বেড়াতে এসেছিলেন। তখন চারুর মাকে অনেক কথার মধ্যে বলেছেন, সুরেন সাঁপুই, যে নাকি রাজবাড়িতে কাজ করে, আশি টাকা বেতন পায়, যার স্ত্রী একটিমাত্র শিশু রেখে দু বছর হয় গত হয়েছেন, সেই সুরেন্দ্রর বয়স কখনই পঁয়ত্রিশের বেশি নয়। সে নাকি নিয়োগীর বাড়িতে চারুকে দেখেছে; দেখে বলেছে বেশ মেয়ে চারু।

চরণ বললো–আমি এখান থেকে কাট করবো পোনমশাই।

কৈলাস তার এই পুরনো ছাত্রটিকে যেন ইংরেজি ছড়াই পড়াচ্ছে এমনভাবে বললো– হেসে-কাট, কাট, কাট, কাটান।

চরণ চলে যাওয়ায় সে যেন বেঁচে গেলো। বললো–এসব কি লোকজনের মধ্যে ভাবা যায়? কিন্তু নির্জনে ভাবতে গিয়েও সে থরথর করে কেঁপে উঠলো। হে ঈশ্বর, করুণাসিন্ধু, রক্ষা করো, রক্ষা করো।

সে কী করে চারুকে সুরেনের স্ত্রীরূপে কল্পনা করলো! কৈলাসপণ্ডিতের শুকনো গাল বেয়ে জলের ধারা নামলো। পথের উপরে দাঁড়িয়ে যেন চারুকেই বলছে এমনভাবে যুক্তকরে কেঁদে উঠলো : ও মা, ভবদারা, পাষাণ ফেটে যায় দ্যাখো।

.

তখন চরণের খুব তাড়াতাড়ির সময়। কৈলাসপণ্ডিতকে ছাড়িয়ে এসে সে খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগলো। তার নিজের কৃষাণরা আসবে কাজকর্মের হিসাব দিতে, রোগীরা আসবে ডিসপেনসারিতে, ওদিকে রিহার্সালেও যাওয়া দরকার। এসব কাজ না থাকলেও তাকে তাড়াতাড়ি করতে হতো। সে জানে এ সময়ে বনদুর্গা মাঝে মাঝেই তার শোবার ঘরের জানলায় এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞাসা করলে স্বীকার করে না।

কয়েক পা গিয়ে সে ভাবলো, সে পোনমশাইকে ঠকায়নি। ধর্ম সম্বন্ধে সে কিছুই কি জানে? আত্মা, পরমাত্মা, দেব দেবী, ব্রহ্ম–এসব কথা সে শুনেছে। কলকাতা-ফেরত গৌরী, বেজো এরাও, সুরেনবাবু, নরেশবাবু তো কলকেতারই মানুষ, নিয়োগীমশায় তো তাকে বাইবেলই পড়ান যা ধর্মেরই বই, কাজেই ধর্মের কথা উঠে পড়েই। সেও কালই এক কঁকিবাজ ক্ষেতমজুরকে বলেছিলো–অতটা নয়, ধর্মে সইবে না।

কিন্তু ধর্ম বলে কি কিছু সত্যিই আছে যা থেকে অন্যায়ের পাপের শাস্তি হয়? কে শাস্তি পায়? সেই আত্মা বলেই কি কিছু আছে? পায় নাকি ডানকানরা শাস্তি? নাকি ওদের ধর্মে তেমন করে মানুষকে পীড়ন করা অন্যয় নয়? পাপ হয় না, বাঘ মানুষ খেলে যেমন তার পাপ নেই, যেমন আমরা মোষ-গোরুকে পিটলে পাপ নেই?

আর আত্মা? …চরণ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। শিরোমণি আজ নতুন ধরনের কথা বলেছেন। মানুষ নাকি দিবিহ্ত দেবতা নয়। পশু থেকে উঠছে। নিয়োগীমশায় আবার যেন বাইবেলের গল্পের মতো খানিকটা বিশ্বাস করেন। মানুষ নাকি আবার অমৃতস্য পুত্রা। ডানকানও? ওদিকে মানুষ যে দেবত্বে যাবে–শিরোমণির শরীরটা দ্যাখো। তার আর কী হবে? তবে কী আত্মা?

আত্মা সম্বন্ধে বলা ভালো নয়। নিজে সে একদিন বলেছিলো। বনদুর্গা বলেছিলো একদিন ঘাট থেকে ফিরে। আমাদের সেই পোস্টমাস্টার গোবর্ধনের কথা মনে পড়ে, চরণ?

মনে না-পড়ার কথা নয়। সে তো একইসঙ্গে তার আর বনদুর্গার বন্ধু ছিলো। তাদের বিবাহ তো তারই উদ্যোগে।

এখন তো জানাই যাচ্ছে বুজরুকের সঙ্গে সেই চলে যাওয়ার পরে আর কখনো সে ফিরবে না। কিন্তু বনদুর্গা জিজ্ঞাসা করলো–আচ্ছা চরণ, আবার কখনো কি গোবর্ধনবাবুর সঙ্গে আমাদের দেখা হতে পারে?

চরণের বলা উচিত ছিলো, তা হয় না বলেই আমরা শোকে কাদি। কিন্তু সে বোকার মতো বলেছিলো–হবে বৈকি, আমাদের আত্মা আছে না?

রাত্রিতে ছেলে ঘুমালে বনদুর্গা চরণের বিছানায় এসেছিলো। সে চরণের বক্ষসংলগ্না, কিন্তু তার চোখ দুটি প্রদীপের আলোয় অন্য সময়ের চাইতে আয়ত মনে হচ্ছিলো। সে বলেছিলো–আচ্ছা চরণ, তোমার সেই দাদার সঙ্গেও কি আবার দেখা হতে পারে-আমার কিংবা তোমার?

একটা অব্যক্ত নিষ্ঠুরতা আছে যেন কোথাও আত্মার ব্যাপারে, যার হিসাব আমাদের পৃথিবীর হিসাবকে তছনছ করে দেয়। আত্মা কি নিঃসঙ্গ যেমন সে মরেলগঞ্জের অত্যাচারে বিষণ্ণ বনদুর্গার পূর্ব-স্বামী, তার সেই জ্ঞাতি-ভ্রাতাকে কখনো কখনো কল্পনা করে?

চরণ তার বাড়ির কাছে এসে গিয়েছিলো। জানলায় বনদুর্গার চোখ দুটিকে দেখার আশায় সে চোখ তুলো, সে বরং তার বাড়ির বাইরের বারান্দার পাশে ঘোড়ার পিঠে একজনকে দেখতে পেলো।

চরণ সাগ্রহে এগিয়ে বললো–গোপালদা যে, কখন এলে? বসোনি কেন? ঘোড়ার পিঠে রয়েছো?

গোপাল বললো–তোমার সঙ্গে কইতে এলাম, চরণ, বেশ কিছুক দিন মরেলগঞ্জ যাচ্ছো নি। সেখেনে তোমার সুঁই ফাঁকা, চাষ পড়ছে না।

চরণ সলজ্জভাবে বললো–ঠিয়াটারের রির্সেল নিয়ে পড়েছি, আর কয়েকদিন। তার পরেই ভাবছি। এসো, বসিগে, পান-তামুক খাও।

না গো, চর চারিদিগে।

–এখানে চর কোথাকে? নদী ডেরকোশ।

–ভালো, ভালো। গোপাল গলা নিচু করলো, বললো, ডানকান এবার দাদন দিচ্ছে নি। চরণ বারান্দায় উঠতে থমকে দাঁড়ালো। একমুহূর্তে তার মনের আবহাওয়াই যেন বদলে গেলো। থিয়েটার, ধর্ম, বনদুর্গা এসব থেকে অনেক দূরে এই এক জায়গা। তার মুখটাই যেন সারাদিনের রোদে কালো এবং ক্লান্ত হয়ে উঠলো।

তা সত্ত্বেও সে হাসলো। বললো–বেশ যা হোক, না দেয় তোমার কী?

গোপাল বললো–মনোহর শা কইছে বিঘে প্রতি দু-দশ টাকা ঋণ দিতে পারে সাহেবকে ধরাধরি করলে।

-কেন, নীলের যন্তর কী তুলে দিচ্ছে?

–অনেক কইছে। কইছে নীলের দাম পড়ছে, ফাটকায় মার খেয়েছে সগলেই, কার ঠাকুর কোম্পানিই বরবাদ, দাদন আর হবে নি। বিঘেতে হদ্দ দশ টাকা ধার পেতে পারো।

চরণের ধোঁকা লাগলো, বললো, রসো-রসো, এর মধ্যে প্যাঁচ আসছে। অমন অখিদে হয় না। জমি বাঁধা দিয়ে ধার? ভাবতে হবে, গোপালদা।

–কিন্তুক ধার নেওয়া তো শুরু হয়েছে।

চরণের মুখ শুকিয়ে উঠলো, বললো–ভেবে দ্যাখো গোপালদা, ধার নয় নিলে, শুধবে তো সেই নীল বেচে? কিনবে তো সেই ডানকান? যদি বলে কেনার গরজ নি। যদি এমন বলে এক বিঘার নীলের দাম ঋণের টাকার কম হয়? সে মণ প্রতি দাদনের চাইতে খারাপ। না, গোপালদা, ভালো ঠেকছে নি। ঋণ নিও না। এখন তো সকলের হাতে কিছু ধান হবে। অন্তত পিছিয়ে দাও না ধার নেওয়া।

গোপাল কম অভিজ্ঞ নয়, বললো–ধান বেচে এগোতে কইছো, কজনা পারবে? খাওয়ার ধান বেচে, শেষে? সে ধান সগলে হাটে আনলে তার দামও পড়ে, বোঝো?

চরণ ভাবতে লাগলো। বললো–এতে কিন্তুক শয়তানী আছে–গোপালদা, কলকেতার শয়তানী। গত বছরের গোলমালের কথা ভাবো। যশোর-নদের কৃষকেরা এককাট্টা হয়েছিলো। আমার মনে হচ্ছে তো নীলে শালারাও এককাট্টা হচ্ছে। দু সন নীল আমদানী কম ছিলো, দাম কমে কেন?

গোপাল বললো–তোমার তো পুরো পঞ্চাশ বিঘে সেখেনে। ত্রিশে নীল করো! সব তো শুনলে, এখন?

–আরো শুনবো, গোপালদা।

–সগলে গিয়ে একবার ডানকানকে ধরলে হয় না!

না। ভাবতে দাও। অমর্ত্যদা কী বলে?

-দাবা খেলে চলতে বলছে। শোনো, চরণ, গতবার অন্য জেলার গোলমালে ডানকান নরম ছিলো। এবার?

-দাদন না-নিয়ে ইচ্ছামতো চাষ।

–কিন্তু চরণ, শেষে যদি সে তোমার নীল না-ছোঁয়, দাদনের টাকা আদায়ের তাগিদ থাকবে না। তোমার নীল কি তখন খড়ি হবে আখার?

শীতের বিকেল, তা সত্ত্বেও আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম চেঁছে ফেলো চরণদাস। সে রেগে উঠে বললো– বললাম তো ভাবতে সময় দাও।

গোপাল বললো–আচ্ছা, চরণ, এখন তুমি খাটনি করে এসেছে। দিন তিনেকে আবার আসবো। তো দাবার মতোই ভেবো। এ সময়ে প্রতি সালেই দাদনের নগদ পায় চাষী। হঠাৎ দাদন বন্ধ হলে ধারই নিতে চাইবে। মনোহর শালা বলছিলো কলকেতায় নাকি কমিছন বসেছে। তাতেই দাদন বন্ধ। দাদনেই নাকি সাহেব কুলের বদনাম। সেজন্যেই নাকি কমিছন। রঙ্গ করে কয়েছে, তো দাদনের পাপই আর না। ভেবো নগদের অভাবে চাষীতে চাষীতে হাহাকার পড়বে।

গোপাল চলে গেলে চরণ তার দাওয়ায় গুম হয়ে বসে রইলো। ডানকানের পাঁচটা ধরেও ধরতে পারছে না। জমি খাস করতে চায় রেহানে জমি রেখে-রেখে। নাকি দাদনে ঘাটতি লাগিয়ে মণ করা আরো কম দাদন দেবে?

বনদুর্গা দরজার আড়াল থেকে শুনছিলো। গোপালের ঘোড়ার শব্দ মিলিয়ে যেতে বেরিয়ে এসে বললো–বসি তাহলে এখেনেই।

চরণ তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে হেসে বললো–চলো যাই।

বনদুর্গা বললো–হাত মুখ ধোও। রির্সেল থেকে ফেরার সময়ে একটু চুয়া আনবে।

চরণ বললো–দোক্তা ধরবে নাকি? তাকে কিন্তু দাঁত -সাধ্যি কী দাঁত কালো করি? আমার লোভই বুঝি কম? চুয়া ধূপে দিলে সুগন্ধ বেশি হয় তুলসীতলায়। আর শোনো, তোমার ঠিয়াটার দেখতে কিন্তু আমি যাবোই, আর ছেলে। নিয়ে। আমাকে একটু ভালো দেখে বসার জায়গা দিতে হবে। রানীমার জন্মতিথি কিন্তুক এসেই গেলো।

 ১০. বড় সংবাদ

দশম পরিচ্ছেদ

০১.

তখন রাজনগরের সবচাইতে বড় সংবাদ রানীমার জন্মতিথির উৎসব। তা যে সমাসন্ন তা ক্রমশই গ্রামবাসীদের চালচলন কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিলো। আর তার নিকটবর্তী গ্রামগুলোর পণ্য-উৎপাদকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো।

মুনিষ লেগেছে মাটি ঢেলে পিটে গ্রামের প্রধান পথগুলোকে সমান করতে, পথের ধারের আগাছা কেটে তুলতে। অত বড়ো রাজবাড়ি সাফ সুতরো করা, রং করা এসব তো আছে। যারা কিছু করছে না তারাও আলো, আতসবাজি, ভোজ, থিয়েটারের চিন্তায় উত্তেজিত আলাপ করছে। গ্রাম ভেঙে আসবে সেই সন্ধ্যায় রাজবাড়িতে।

প্রকৃতপক্ষে বলা যায় না এ রকম কেন হতো। বোধ হয় সেবার উৎসবে আমন্ত্রিতদের মধ্যে রাজনগরের একজনই মাত্র যোগ দেয়নি। অন্যান্যবার বাগচী অনুপস্থিত থাকতো। সেবার, তার ডায়েরিই প্রমাণ, সর্বরঞ্জনপ্রসাদই ছিলো একমাত্র আমন্ত্রিত যে যায়নি।

উৎসবের দিন সকালে, ছুটির দিন, একটু বেলায় ব্রেকফাস্ট শেষ করে উঠেছে তখন বাগচী, সর্বরঞ্জনপ্রসাদ তার কুঠিতে এসেছিলো, তার কথা অনুসারে, সম্মান জানাতে। রবিবারে ছুটি থাকে বটে, কিন্তু সকালগুলো তার প্রার্থনাতে কাটে, এবং সে অনুমান করে হেডমাস্টার সাহেবেরও তাই হয়। আজ অন্য একটা ছোট্ট প্রশ্ন তার মনে নেই এমন নয়।

এসব আলোচনার পর সে একটু চিন্তা করে নিয়ে সেই প্রশ্নটায় এলো। সূত্রপাতে বললো–মিস্টার ও সুলিভানের সঙ্গে দেখা হলো। অনেকটা আলাপ করলেন।

মিস্টার শব্দটা বাগচীকে বিপথে নেওয়ার সে জিজ্ঞাসা করলো কে?

নিয়োগী বললো–দু-তিন দিন হয় এসেছেন আবার। এক নৌকা মদ এনেছেন নাকি।

বাগচী বললো–ওহো, ওসুলিভান! এত আগেই এসে গিয়েছে? তা তো আসবেই, সে তো ফেলিসিটার নামে মদ-ব্যবসায়ীর কর্মচারী। এই প্রথম দেখলেন বুঝি? ওসবই বোধ হয় মরেলগঞ্জের জন্য।

নিয়োগী বললো–শুধু কি তাই, রাজবাড়িতেও আলো আতসবাজি ইত্যাদিতে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হবে। সেসবেও আর এক নৌকো।

বাগচী হাসিমুখে বললো, তাহলে এজন্যই তাড়াতাড়ি এসেছে। আলো আতসবাজিতে এমন অনেক খরচ হয় বলেই গ্রামের লোকেরা তার প্রতীক্ষা করছে। আমাদের কাছে পাঁচ হাজার টাকা অবশ্যই অনেক, এক বৎসরে উপার্জন হয় না।

-তাহলেই দেখুন। আর তা শুধু এক বীভৎস পুতুলপূজার আড়ম্বর বাড়াতে। কী অপব্যয়, অর্থের কী অপচয়! আশ্চর্য, গ্রামের লোকেরা একটা প্রতিবাদ করে না, বরং নির্লজ্জের মতো উত্তেজিত! ভাবতে গিয়ে আজ সকালেই মনে হলো, এসব টাকাও তো রায়তকে শোষণ করে। উৎসব তো রাজবাড়ির, তোমাদের কী? এমন নির্বুদ্ধিতা দেখলে রাগ হয় না?

বাগচী আলাপটাকে হালকা রাখার চেষ্টায় একটু ভেবে নিয়ে বললো– রায়তের কাছে খাজনা পৃথিবীর সব দেশেই এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়, তাই না? তাছাড়া যদি ভেবে দেখেন, ভগবানই যেন মানুষকে কেমন নির্বোধ করেছেন! বিখ্যাত একটা মন্দির বা চার্চের ছবি দেখলে আমরা খুশি হই, অন্যের বাগানে ফুলের সমারোহেও তা হই, আকাশে রামধনুর মতো অলীক নিয়ে তো কবিতাই আছে। হিমালয়ের কাছে গেলে সে আমাকে ক্ষেপও করে না, অথচ তার জন্য আমার বলে গর্ব বোধ হয়।

সর্বরঞ্জন আলোচনায় সুবিধা করতে পারলো না। সে বললেও–তাহলেও কিন্তু এই উৎসবে, আমন্ত্রিত হলেও আমাদের যাওয়া উচিত হচ্ছে না। আপনি কি এই উৎসবে যোগ দিয়ে থাকেন?

বাগচী বললো–এবার যাবো স্থির করেছি।

নিয়োগীকে চিন্তিত দেখালো। একটু পরে সে বললো–আমার এই প্রথম শিক্ষক হিসাবে আমন্ত্রিত হয়েও না-যাই যদি তবে তাকীরাজবাড়ির, বিশেষ দেওয়ানজির, অসন্তুষ্টির কারণ হয়?

বাগচী বলল–তা আমার মন হয়না। আমন্ত্রিতদের কে এলো গেলো তা খেয়াল রাখার জন্য নিশ্চয়ই কেউ কেউ আছেন, কিন্তু আপনি না-গেলে তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে মনে করি না।

কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে থেকে সর্বরঞ্জন ভারী মনে বিদায় নিয়েছিলো।

সর্বরঞ্জনপ্রসাদ চলে গেলে বাগচী অনুভব করলো, কী যেন একটা ব্যথার কথা হচ্ছিলো? ও, সার্ক–রায়ত। হ্যাঁ, নিদারুণ পরিশ্রম আর দারিদ্র্য। কিন্তু ওরাই পাবে। সে আপন মনে হাসলো। না, এটা কারণ নয় যে দরিদ্র বলে পাবে। হয়তো দারিদ্র্য আর শ্রমে পাপ-বিলাসের অবকাশ কম। রোমের সেনেটার লাঙল দিয়ে জমি চাষ করতো এমন গল্প আছে বটে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে, সেই গমের ক্ষেতে এবং অলিভ-বাগিচায় যারা কাজ করতো তারা ক্রীতদাস, যেমন এখনো আমেরিকার তুলার ক্ষেতে। হয় ক্রীতদাস, নয় রায়ত। ইংল্যান্ডে তো বটেই, ফরাসী বিপ্লবের পরেও ইউরোপে রায়ত থেকে গেলো। আর তারা খাজনা দেয়। আচ্ছা, আচ্ছা, মনে মনে এই বলে সে হাসলো, খাজনা মানে ফসলের উদ্বৃত্ত অংশ পরিবারের যা লাগে তার উদ্বৃত্ত। ওহো, এই উদ্বৃত্ত যদি রায়ত না-দেয় হেডমাস্টার খায় কী? উদ্বৃত্ত নিজের ইচ্ছায় দেবে এমন হয় কি? অন্যদিকে দ্যাখো, কি ইংল্যান্ডে কি ভারতে রায়ত সুখে নেই।

এটা সে সময়ের একজনের চিন্তার প্রতিচ্ছবি হতে পারে, ব্যক্তিবিশেষের চরিত্রের এক পাশ। এমনও বলা যায়, বাগচী উৎসবে যোগ দেওয়া স্থির করেছিলো বলেই তার চিন্তা এই পথে চলেছিলো; নিয়োগী উৎসবে যোগ দেবে না বলেই রায়তদের কথা তুলেছিলো।

বাগচী পায়ের শব্দে মুখ তুলে দেখলো, বসবার ঘরে যেখানে বেশ খানিকটা রোদ এসে পড়েছে সেখানে কেট চেয়ার টেনে কিছু করছে। সে আবার মনে মনে হাসলো, ওয়েল, ওয়েল, এটা সেই এমারেল্ড গাউনটা। ক্যাপ আর গ্লাভস, দ্যাখো, গ্লাভসটাও এমারেল্ড! আর সব ঢেকে গাঢ় নীলের এই ক্যাপটা থাকবে কেটের। এটা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, দারুণ সাহসী পদক্ষেপ এটা কেটের এই নিজে থেকে উৎসবে যাওয়া। কিন্তু পদক্ষেপটা কোন দিকে? কেট তার হালকা নীল সোয়েডের উঁচু গোড়ালির জুতোজোড়া রোদে দিতে। এসে থমকে দাঁড়ালো। বিবর্ণ হলো তার মুখ। বাগচীও উৎকর্ণ হয়েছিলো। হেসে বললো, ঢাক বলে। বোধ হয় একসঙ্গে একশোটা।

.

০২.

একশো না-হোক পঞ্চাশ হতেই পারে। পূজার বা উৎসবের অঙ্গ হিসাবে না-হতে পারে, হয়তো তারা এতক্ষণ পুরো দলটা একত্র হয়েছে বলেই তারা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে উঠে ঢাকগুলোর মাথায় খাড়া করা চামর দুলিয়ে, দুলে দুলে, বাতাসে হেলান দিয়ে জোড়কাঠিতে তেহাই দিয়ে হাসি হাসি মুখে পরস্পরের ওস্তাদির তারিফ করলো।

তা হতেই পারে। পূজা তো সেই মাঝরাতে, উৎসব শুরু হয়েছে ভোরের সানাইয়ে। সন্ধ্যায় তা হাউই, তুবড়ি, রংমশালের ঝাড়ে উৎসারিত হবে! হাউই-তুবড়ির উচ্ছ্বাস মিটতে মিটতে কাছারির চত্বরে শুরু হবেনাকি ঠিয়াটার যা কলকেতায় হচ্ছে। ভিনগ্রামের আমন্ত্রিতরা। আগেই জলযোগে বসে যাবে কাছারির ঘরে ঘরে, এমনকী অন্দরেরও কোনো কোনো হলে। রাত গম্ভীর হবে ক্রমশ, ফেলিসিটারের চেষ্টা সত্ত্বেও অভিনয়ের আসর ছাড়া অন্যত্র আলোগুলো লালচে হয়ে আসতে থাকবে। আর তখন অন্দরে যাওয়ার পশ্চিমের খিলানের ওপারে একটা স্তিমিত ঔজ্জ্বল্য দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। আর সেখানে তখন সারাদিন এখানে ওখানে কারণে-অকারণে চমকে দিয়ে যে ঢাকগুলো বেজেছে সে সবগুলো একসঙ্গে বেজে উঠবে, পুরোহিতের উচ্চকণ্ঠের মন্ত্রোচ্চারণ শোনা যাবে, আর তা ছাপিয়ে কারো কারো মা মা ডাক।

সকাল থেকে শুরু, মাঝরাত অবধি ভিড়। সে ভিড় বাড়ে, কমে, সরে, নড়ে, আর তাতে বোঝা যায় উৎসবের কোন অংশ কোথায় গুরুত্ব পাচ্ছে। আর ভিড়ও উৎসবকে মনে করিয়ে । দিচ্ছে, তা সারাদিন ধরেই। কর্মচারী, দাসদাসী, বরকন্দাজ, বরদার, এরা তো ভিড়ের সর্বত্রই, সকলেই সজ্জিত। তাদের পরনে নতুন কোরা ধুতি শাড়ি, পুরুষদের মাথায় নতুন গামছা, কারো মাথায় তা পঙ্গু করে বাঁধা। দাসীদের মুখ পানে রাঙা, পায়ে আলতা, তাদের অনেকেই রেশমী ধাকড় পেয়েছে, কেউ কেউ পশমী বনাতও।

উৎসবের আসল ব্যাপারটা অর্থাৎ যেখানে পূজা সেখানে সকাল থেকে ভিড়ের চেহারা স্বতন্ত্র। উঁই করা ফুল বেলপাতা প্রকাণ্ড রূপার পুষ্পপাত্রে বেছে দেখে সাজানো হচ্ছে। ডাঁই করা আনাজ তেমনি প্রকাণ্ড পিতলের কাঁসার পরাতে। চাল, ডাল, মশলার স্তূপগুলোকে ঝেড়ে বেছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেওয়া চলছে। হাত চলেছে, মাথা দুলছে, কোথাও চুড়ি বালার শব্দ, কিন্তু কথা কম, খুবই কম, হু-হার বেশি নয়। সাবধান থুতু না-ছেটায়। এ তো সেই ভয়ঙ্করী, এই ভয়ানক দুঃসময়ে যার কঠোর কর্কশতায় লুকানো স্নেহই একমাত্র ভরসা।

এসব তো প্রতি উৎসবেই। এবার কি কিছু পার্থক্য চোখে পড়ছে? মণ্ডপে রানীমাকে দেখা যাচ্ছে না বরং নয়ন-ঠাকরুণ মাঝে মাঝে ঘুরছে। রানী কাল তাকে গোপনে ডেকে বলেছিলেন বটে, মণ্ডপে থাকতে হবে, আমি পারছি না। মণ্ডপে যেমন নয়নতারা, অন্দরের জলযোগের হলগুলোতে তেমন হৈমী, দরবার হলের মাঝামাঝি তেমন নায়েবগিন্নি।

শীতের সন্ধ্যা ঝুপ করে নামে। বাইরে আকাশে কিছু আলো, কিন্তু মণ্ডপের দরদালানে আলো জ্বালাতে হয়। প্রতিমার চোখ আর তিলক নিয়ে কিছু অসুবিধা ঘটেছে। এখানেই এক দিনেই তো কাঁচা মাটির প্রতিমাকে আকারে রঙে জীবন্ত করে তুলতে হবে। কী অসম্ভব ব্যাপার! নিচের মাটি সরস, উপরে রংয়ে চোখ ধাঁধাবে। আচার্যিকারিগরমশায় সাগরেদ নিয়ে তুলি হাতে রং ছোঁয়াচ্ছে, পিছিয়ে পিছিয়ে দেখছে। সন্দেহ হয়, তার চোখে কিসের চাপে জল আসছে যেন। চোখগুলি একইসঙ্গে ডাকাতের মতো তীব্র আর মায়ের মতো স্নিগ্ধ করতে হবে না? আচার্যিমশায় ফিরে ফিরে নয়নতারাকে বলছে–দেখুন, মা, এবার। ভয়ের কথা বৈকি! মাঝরাতে রানীমা নিজে এসে প্রতিমার দিকে মুখ করে বসবেন না? এখনো প্রতিমার তিনফুল নাকে সোনার নথ ওঠেনি, কানে দোলেনি কাঁধছোঁয়া কুণ্ডল।

.

০৩.

উৎসবটা ধর্মের সঙ্গে জড়িত, তারা বিশেষ নিমন্ত্রিত হলেও ক্রিশ্চান। কোন দিকে গেলে অশোভন হয় না এরকম চিন্তা ছিলো বাগচীর। রাজবাড়ির সদর-দরজায় পৌঁছলে যারা অভ্যর্থনায় তারা তো এগিয়ে এলোই, নায়েবমশাইও তাদের দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে নির্দেশ দিলোবাগচীসাহেবকে নিয়ে আমার কামরায় বসাও। মেমসাহেবকে বড়োগিন্নির কাছে পৌঁছে দিও। নাকি, আপনারা দেওয়ানকুঠিতে যাবেন?

বাগচী মনে মনে বললো, সমস্যাটা অন্যরকম হলো দেখছি। সে বললো–এ দিকেই তো আলো, আলোরই তো উৎসব।

সন্ধ্যা থেকে আলো কিন্তু রাত যত বাড়ছে তত যেন উজ্জ্বলতর। যারা আগেও দেখেছে তাদের মনে হচ্ছে সেবার কাছারির বারান্দাগুলোতে, কামরায় কামরায়, রাজবাড়ির ঘরে ঘরে এত আলো ছিলো না। অন্যদিকে সেবারের দেওয়ানকুঠি যত উজ্জ্বল ছিলো এবার তা নয়। অনুমান সত্যই হবে। শিশাওয়াল তো এখনো ঘুরছে এখানে ওখানে তার সেই সাহেব সহকারী নিয়ে এখনো এখানে একটা বিচিত্র চেহারার ডোম, ওখানে একটা দেয়ালগিরি বসিয়ে চলেছে। কাছারি আর রাজবাড়ির মাঝের চত্বরে সেবার সামিয়ানার নিচে বেলদার ঝাড়ের আলো, সামিয়ানার থামে থামে হারিকেন ঝুলিয়ে বিদ্যাসুন্দরের পালা হয়েছিলো। এবার সেখানে থিয়েটারের মঞ্চ আলোয় ঝকঝক করছে।

একজন কর্মচারী কেটকে পথ দেখিয়ে রাজবাড়ির দিকে নিয়ে গেলো। বাগচী যেখানে বসলো কাছারির সেই ঘরে গ্রামের বিশিষ্টদের আসন। বাগচী যেন চোখ বুলিয়ে দেখলো, নিয়োগী সেখানে কোথাও আছে কিনা। নায়েবমশাই সেখানেই উঠে এলো, বললো–একটু বসে নিই, বুড়ো হয়েছি তো; কী বলে?

নায়েবমশাই বসতেই তার হুঁকাবরদার তামাক নিয়ে এলো। সে-ই বাগচীকে জিজ্ঞাসা করলো তাকেও তামাক দেওয়া হবে কিনা। বাগচী পাইপ বার করলো, হেসে বললো–আমার হুঁকো সঙ্গেই থাকে।

একজন অভ্যাগত জোতদার বললো– আমাদের এই গ্রামে আর একজনকে মাত্র এমন দেখা যেতো, শিরোমণিমশায়ের জ্যেঠা সার্বভৌমকে।

–তিনিও পাইপ নাকি? বাগচী জিজ্ঞাসা করলো।

–না, থেলো হুঁকো থাকতো সঙ্গে, কিন্তু তেমন নিটোল ছোটো খোলটি পাওয়া কঠিন। একজন রসিকতা করে বললো–কেউ জাত মেরে দেবে ভয় ছিলো নাকি?

সাধ্য কী? প্রথমজন বললো, ব্রাহ্মণের হুঁকোতেও খেতেন না। বলতেন উচ্ছিষ্ট উচ্ছিষ্টই, তা ব্রাহ্মণের হলেও।

নায়েব বললো–কড়া লোক ছিলেন। শুনেছি, নিজের গৃহবিগ্রহ নারায়ণের প্রসাদ ছাড়া অন্য পূজার প্রসাদও পেতেন না।

মনে হলো পূজার প্রসাদ দেবতার উচ্ছিষ্ট কিনা এ নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু কাছে পিঠে সদর-আমিন সোনাউল্লা কাজী ছিলো। পিছন থেকে সে বললো, তিনি কি–অর্থাৎতার কি ব্রাহ্মণী ছিলো না?

-তা ছিলো বৈকি?

–তাহলে আর উচ্ছিষ্ট মুখে না-দেওয়ার প্রতিজ্ঞা থাকে না, জী।

–মানে? নায়েব বললো–আ, সোনাউল্লা!

মুখের হাসি আড়াল করে নায়েব উঠে পড়লো। বললো, তুমি এদিকে আছো, সোনাউল্লা, আমি ওদিকে দেখি। যিনি যখনই যান, কিন্তু জলযোগ না করে নয়, দেখো।

কুল্লাযুক্ত শিরপেঁচ দুলিয়ে হেসে সোনাউল্লা জমিয়ে নেবে মনে হলো, কিন্তু একজন সোনাউল্লার কানে ফিসফিস করে বললো–মুসলমান জোতদাররা যেখানে জলযোগে বসেছেন সেখানে একবার যাওয়া দরকার। কিছু ত্রুটি থাকায় তারা মুখ টিপে হাসছেন। সুমারনবিশ ঠিক পারছেন না। পীরজাদা আপনাকে বলতে বললেন।

ঠিক এই সময়েই, সদর-দরজার পাশে পটপট দুমদুম শব্দ হলো। মঞ্চের সামনে যারা হৈ-হুঁল্লোড় করছিলো সেই ছেলের দল হো হো করে ছুটলো সদর দরজার দিকে। কাছারির বারান্দায় ভিড় করে দাঁড়ালো অনেকে। রাজবাড়ির আলোর মালার নিচে নিচে নড়াচড়া দেখে বোঝা গেলো সেখানেও আতসবাজি দেখার জন্য ভিড় হয়েছে।

একতলার হলঘরে, যাকে দরবার-হলও বলা হয়, সেখানেই মহিলা অভ্যাগতদের অভ্যর্থনার ব্যবস্থা। সেখানে তেমন ভিড় ছিলোনা। কারণ সেখানে কিছুক্ষণ থেকেই মহিলারা প্রতিমা দেখতে অথবা জলযোগের ঘরে সরে যাচ্ছে। তাহলেও দরবার-ঘরের সৌন্দর্য, বিশালতা ইত্যাদির আকর্ষণ আছে। কিছু কিছু স্ত্রীলোকের যাওয়া-আসা ছিলোই। বিশেষ তারা তো ছিলোই যাদের সকলের পরনে একই রকম লালপাড় শাড়ি এবং গায়ে রেশমের চৌখুপি বোড়। কেট বুঝলো, এরা কর্মচারী। সে ঘরে একজন বর্ষীয়সীরই প্রাধান্য। কেটকে সেই কর্মচারী তার কাছে এনে উপস্থিত করে চলে গিয়েছিলো। কেট অনুমান করেছিলো, রানী অবশ্যই নয়, কারণ সেই বর্ষীয়সীর কপাল-ছোঁয়া সাদা চুলে ওড়া করে দেয়া সিঁদুর; পরনে হালকা রঙের হলেও উজ্জ্বল ব্রোকেড এবং কণ্ঠা থেকে বুক-ঢাকা। অলঙ্কার স্তরে স্তরে যেন ব্লাউজের কাজ করছে।

লোকের কথায় ঠাহর করলো কেট উনি বড়োগিন্নি। ইংরেজিতে তর্জমা করে অনুমান করলে চিফ মেট্রন হবে। তার অবশ্যই জানার উপায় ছিলো না তিনিই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নায়িব-ই-রিয়াসতের স্ত্রী।

কেটকে তার পাশের শোফায় বসতে বললেন।

কেটের সঙ্গে গ্রামের কজনেরই বা পরিচয়! কিন্তু সে তো কৌতূহলের বিষয়। কাজেই তার চারিদিকে কিছু ভিড় হলে আবার।

যখন কেট বললো–আপনিই বড়োগিন্নি? তখন এই ভাষা শুনে এমনকী বড়োগিন্নির দূরে সরে যাওয়া দৃষ্টি যেন হেঁটে এসে কেটের সিঁদুরহীন কপালে দস্তানায় ঢাকা পুরো বাহুতে পড়লো। কিন্তু বড়োগিন্নির বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেলো যখন তার সেই অনুত্তেজিত মুখে, বয়স এবং সাদা চুল সত্ত্বেও, ব্রীড়ার গভীর রং দেখা দিলো।

বড়োগিন্নি বললো–রানীমা বড়োগিন্নি বলেন। আসলে আমি গোবর্ধনের মামী। আমি কি আপনার নাম জানি?

কেট বললো–ক্যাথারিন।

বড়োগিন্নি বললো– সুন্দর নাম। ভারি সুন্দর নাম। তা, শাড়ি পরে গণেশ কোলে বসলে কাত্যায়নীর মতোই দেখাবে।

হলঘরের ভিতরে এবং বাইরে সবকিছুই উৎসবের কথাই মনে করিয়ে দিতে থাকে। গতবার, তার আগেরবার কেমন হয়েছিলো এসব আলোচনা শুরু হলো।

একজন বললো–কিন্তু যা আসছে তার তুলনায় এ কিছুই নয়।

আর একজন বললো–আমাদের রাজকুমারের বিয়ের কথা নাকি?

বড়োগিন্নি বললো–হা, সে উৎসবও নিশ্চয়ই অনেকদিন মনে রাখার মতো হবে।

অন্য একজন বললো, বিয়ের ঘটকালি নাকি ব্রহ্মঠাকরুণ করছেন? তিনি নাকি নতুন আসা নিয়োগীমাস্টারের বোন?

একজন বললো, জোগাড়ে লোক বলতে হবে। কদিন আর এসেছে, এরই মধ্যে খোদ রানীমার দরবারে।

বড়োগিন্নি কেটে দিয়ে বললো–ওটা কী আর দরকারি কথা!

কেট কৌতূহল নিয়েই শুনছিলো। আলাপটা একটু ঘোরাপথে হচ্ছে বটে, হয়তো মাধুর্যকে এমনভাবে গভীর করাই উদ্দেশ্য। সে বললো–এ বিষয়ে আসল কথা নয়ন ঠাকরুণের কাছে জানা যাবে বোধ হয়।

অনেকেই এদিক ওদিক চাইলো যেন।

কিন্তু আলাপটা এগোলো না। পটপট চড়বড় করে বাজি ফুটে উঠতেই আতস দেখবার জন্য নিমন্ত্রিতদের অধিকাংশ দরবার-ঘরের বাইরে চলে গেলো। শুধু পটকা নয়, ফানুস, উই, ফুলেন তুবড়ি, রংমশাল। কেট বসে বসে দেখছিলো। কিন্তু রংমশাল যখন কখনো নীল, কখনো লাল, কখনো সবুজ আলোয় কাছের লোকগুলিকে রঙে স্নান করাচ্ছে, ভারি সুন্দর তো বলে সে উঠে দাঁড়ালো।

বড়োগিন্নি বললো–সামনের বড়ো জানলাটার কাছে গেলে আরো ভালো দেখা যাবে। এই বলে সে নিজেও তেমন একটা জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।

যারা বাইরে গেছে তারা বাইরে, ঘরে যারা ছিলো তারা কোনো না কোনো দরজা বা জানলার কাছে। কেট একটা জানলায় একাই ছিলো। আতসবাজি যখন জ্বলে ওঠে তখন যারা তৈরী করে তারাও অবাক হয়ে যায়।

হঠাৎ যেন কেউ পাশে এসে দাঁড়িয়ে, আরো ভালো করে দেখার জন্য, অথবা আনন্দের উত্তেজনায় কেটের হাতের উপরে হাত রাখলো।

একটু ফিরে দাঁড়ালো কেট। বাইরের রংমশালের আলো এসে পড়েছে মহিলাটির মুখে, সবুজ পান্নার আলো, কিংবা তা কি তার গলার পান্নার কণ্ঠীর থেকে? মাথায় ঈষৎ ঘোমটা, ঘোমটা ঘিরে রক্তলাল শাল। কী বলবে, কী বলা উচিত ভাবলো কেট এক মুহূর্ত। রংমশালটা নিবতে সাদা আলোয় চিনতে পেরে সে হেসে বললো–নয়ন-ঠাকরুণ?

নয়নতারা নিজের হাতের নিচে ধরা কেটের হাতটায় চাপ দিলো। বললো–এসেছেন শুনেছিলাম। অসুবিধা হচ্ছে না তো?

না। কিন্তু এদিকে ওদিকে চেয়ে আপনার প্রত্যাশা করছিলাম। কেট দু হাতে তার হাতের উপরে রাখা নয়নতারার হাতটাকে ধরলো। হেসে বললো–এখন তো অভিনন্দন নেওয়ার সময়, আমার অভিনন্দন নিন।

নয়নতারা একটু বিব্রত হলো। কেটের চোখের দিকে সে কিছুক্ষণ চাইলো। ঠিক এই সময়েই একটা বড়ো আকারের ফানুস উঠতে শুরু করায় তার সুবিধা হলো, সে বললো– ওই দেখন, ওই দেখুন, ভারি সুন্দর, নয়?

ফানুসটা অবাক করে দিয়ে, প্রথমে ধীরে ধীরে, পরে বেশ জোরে আর সোজা উঠে গেলো। কিন্তু আচমকা কেঁপেও গেলো।

কেট বললো–সংবাদ পেয়ে আমি যে কী সুখী হয়েছি, আমাদের দেশে হলে আপনার ঘোমটা সরিয়ে ওই সুন্দর গালে চুমু দিতাম।

কিসের সংবাদ? নয়নতারা জিজ্ঞাসা করলো, কিন্তু হঠাৎ যেন নিজেই কিছুটা আন্দাজ করলো, তার গাল দুটোর যতখানি চোখে পড়ে তা যেন রংমশালের আলো পেয়ে লাল হলো।

-কিংবা, কেট বললো, রাজকুমার নিজে বলেননি বলে আমাদের চুপ করে থাকা উচিত? কিন্তু আপনিও তো বলেননি।

সাঁ করে একটা হাউই উঠলো চমকে দিয়ে, দুম করে সেটা ফাটলো, লাল, নীল, সবুজ আলোর কয়েকটি বল শূন্যে নেচে নেচে ফেটে ফেটে আকাশকুসুম রচনা করলো, তারপর নক্ষত্ৰচুতির মতো নিবে নিবে খসে খসে পড়লো।

আর তাতেই যেন অন্ধকার হলো। তখন নয়নতারা যেন কারো ডাক শুনতে পেয়ে একটু গলা তুলে বললো, যাচ্ছি।

কেটের হাতের উপরে এবার একটু জোরে চাপ দিয়ে যেমন নিঃশব্দে এসেছিলো তেমনি চলে গেলো। তার শাড়ির মৃদু খসখস শব্দ হলো একটা।

.

০৪.

আতসবাজির কাছে আসতে হরদয়ালের আধ ঘণ্টা দেরি হলো। সে বাগচীকে দেখতে পেয়ে বললো– ডানকানের জন্য অপেক্ষা করতেই দেরি। এবার ওরা আসছে! দেখছি। সেই কীবল ছোকরা বোধ হয় কালীপূজা নিয়ে আরো ঠাট্টা করেছে।

বাগচীর সেই লাঞ্চের কথা মনে পড়লো যেখানে ডানকানের কালীপূজা নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো। সে কুণ্ঠিত হয়ে ভাবলো বিষয়টাকে। ডানকান ক্রিশ্চান, তা মনেপ্রাণে না-হোক, এতদিন এ উৎসবে যোগ দিতো, এবার দিলো না। এটা কি কোনো নতুন পরিস্থিতির সূচনা? কিন্তু কী আশ্চর্য, তার চোখের সামনে একটা ফুলবাগান যা বিভিন্ন রঙের আলোর তৈরী। বাগানটা মিলিয়ে গেলো। হরদয়াল হাসিমুখে বললো–আপনি কী ঘুরে ঘুরে দেখেছেন? আসুন, আমরা রাজবাড়ির কাছে যাই।

তারা উঠে যেদিকে থিয়েটারের মঞ্চ সেদিকে হাঁটতে শুরু করলো। হরদয়াল বললো– মিসেস বাগচীও বোধ হয় ঘুরে ঘুরে দেখেননি?

তারা যখন কাছারির চত্বরের মাঝামাঝি হরদয়াল একজন দাসীকে দেখতে পেয়ে বললো–বাগচীসাহেবের মেম অন্দরে আছেন। তাকে বলো আমরা এখানে অপেক্ষা করছি।

গ্রামে মেমসাহেব তো একজনই, কাজেই খুঁজে বার করে সংবাদ দিতে দাসীর অসুবিধা হলো না। ফলে থিয়েটারের সামিয়ানার কাছাকাছি হরদয়াল এবং বাগচী পৌঁছতেই কেট এসে তাদের সঙ্গে যোগ দিলো।

তখন হরদয়াল বললো–এবার একটা কথা বলি। যাঁরাই উৎসবে এসেছেন তাদের সকলেরই জলযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি ভাবছিলাম মিসেস বাগচী এবং আপনার জন্য সে ব্যবস্থাটা আমার কুঠিতে কেমন হয়?

কেট বললো–না না, এসবের জন্য আপনি ভাববেন না। এটা কিছু নয়। আলোটাই আসল।

হরদয়াল বললো–আপনাদের বিশেষ ব্যবস্থা নায়েবমশায় নিশ্চয়ই করে রেখেছেন, তার বদলে যদি আমার কুঠিতে একটা ছোট্ট ডিনার-জাস্টটু কিপ এ লোশলি ব্যাচেলর কম্পানি?

বাগচী হেসে ফেলো। এরপরে আর আপত্তি করা চলে না। নটায় সে ডিনার হবে স্থির করে তারা আলোকজ্জ্বল প্রাসাদের দিকে এগিয়ে গেলো।

তারা একটা উঁচু আলোকিত খিলানের পথে এসে পড়লো। এরকম খিলান আরো আছে, সেগুলোর নিচে দরজা এবং সম্মুখে সিঁড়ি, এটার তলায় একটা প্রকাণ্ড ঝাড় যা নিচের পথটাকে আলোকিত করে রেখেছে। হরদয়াল বললো–এদিকেই পূজা।

বাগচী বললো–দেখবার মতো কাছে যাওয়া যায় না-ছুঁয়ে? যাবে কেট। মনে করো ডানকান বেকায়দায় একবার কালীপূজা করেছিলো।

এরপরে যা ঘটলো তা ইতিহাসের পক্ষে অপ্রয়োজনের। তারা কাছাকাছি যেতে যেন জোড়ায় জোড়ায় অনেকগুলো ঢাক বেজে উঠলো। নাচছে ঢাকীরা। ঢাকের উপরে চামরগুলো তালে তালে নাচছে, লাফাচ্ছে, ঢাকীদের মাথায় বাঁধা রঙিন নতুন গামছার পাগ। দুলছে। প্রতিমার দালানে আলোয় আলোময়। প্রতিমার দালানের মুখোমুখি রকে অনেক স্ত্রীলোকের ভিড়। তাদের রেশমে আর সোনারূপায় আলো পড়ছে। তারা থেকে থেকে বহু কণ্ঠে উলু দিয়ে উঠছে। সেই রক আর প্রতিমার দালানের মাঝখানে নিচু গলিপথ। সেই পথে অনেক পুরুষ। তারা যুক্তকরে প্রতিমার মুখের দিকে চেয়ে। প্রতিমার দালানে লোহার রেলিংয়ে দুটি ভাগ, তা যেন প্রতিমাকে কিংবা পূজার স্থলকে পৃথক করেছে। সেই ঘেরের বাইরে একজনমাত্র মহিলা যার পরনে দুধ-শাদা গরদের থান, যিনি প্রতিমার মুখের দিকে মুখ করে স্তব্ধ। ঘেরের এপারে নামাবলি গলায় দুজন পুরুষ, যারা নিশ্চয় পুরোহিত এবং তন্ত্রধার, এবং চার-পাঁচজন মহিলামাত্র। তারা একটা চালনে প্রদীপ ইত্যাদি রেখে চার পাঁচজনে একসঙ্গে ধরে প্রতিমার মুখের কাছে তুলছে, পায়ের কাছে নামাচ্ছে। কেট একটু ঠাহর করে তাদের মধ্যে বড়োগিন্নিকে দেখতে পেলো।

তারা অবশেষে সেই চালন পূজার ঘেরের মধ্যে একপাশে রেখে বেরিয়ে এলো। কেট অবাক হলো দেখে বড়োগিন্নি মুখে আঁচল দিয়ে নিঃশব্দে ফুলে-ফুলে কাঁদছে। কেট বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা না করে পারলো না।

হরদয়াল বললো–এসব আমরা বুঝি না। হয়তো মেয়ে বাড়িতে আসছে এরকম অনুভব করছেন। হয়তো সঙ্গে-সঙ্গে নিজের দুঃখের কথাও সেই মেয়েকে বলতে চাইছেন। বোধ হয় উনি নায়েবমশায়ের স্ত্রী।

কিন্তু আলোর প্রদীপমালার মধ্যে যে মধ্যমণির মত, যার সামনে দুজন পুরুষ অতি সন্ত্রস্তভাবে পূজার উপকরণ নামাচ্ছে, যা একইসঙ্গে সুন্দর, ভয়ঙ্কর, হাস্যময়ী, লোলজিহ্বা, লজ্জিতা অথচ দিগম্বরী।

কেটের মুখ নীল হয়ে উঠলো। সে বিড়বিড় করে কিছু বললো।

হরদয়াল কী লক্ষ্য করছে তা সবসময়ে বোঝা যায় না। বাগচী কথা বলার জন্য কেটের মুখের দিকে চেয়েছিলো। সে বললো–তোমার কি গরম লাগছে ডারলিং, এই শীতেও অনেক প্রদীপে জায়গাটা গরম।

হরদয়ালও বললো–হ্যাঁ চলুন, আমরা ফাঁকা জায়গায় যাই।

রাজবাড়ির বাইরে কাছারির দিকে আতসবাজি তখনো। কিন্তু লোক-চলাচলে অনুমান উৎসবের টান এখন অন্যদিকে। তাদের পথনাটকের সামিয়ানার পাশ দিয়ে। শুধু ভিড় নয়, বাজনাও তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। বেহালা, সারেঙ্গী কে কে করছে, সানাই বাঁশি বাজছে, ডোল তাল ঠুকছে, সব মিলে একটা পরিচিত সুরের দিকে, কিন্তু তুলনায় শব্দ বেশি।

আড়াআড়ি ঘাসে-ঢাকা চত্বর পার হয়ে সামিয়ানার কাছে যেতেই সেদিকের এক কর্মকর্তা আসুন হুজুর; আসুন স্যার; আসুন ম্যাডাম বলে অভ্যর্থনা করলো।

সামিয়ানার নিচে মঞ্চের সামনে ডাইনে-বাঁয়ে কিছু নিচু সুদৃশ্য কৌচ। তারপর থেকে চেয়ার ও বেঞ্চ। সামনের সারিটা উচ্চস্তরের জন্য বোঝা যায়। রাজকুমার আসেননি। অভ্যর্থনাকারী হরদয়াল প্রভৃতিকে সেদিকে নিয়ে গেলো। দেখা গেলো, বাঁদিকের একটা কোচে নায়েবমশাই একা বসে, তার মুখে বিড়ম্বনা।

হরদয়াল এবং বাগচী দম্পতী বসলে নায়েবমশাই বললো–তবু যা হোক, একা ভয়ই করছিলো।

হরদয়াল হেসে বললো– রাজবাড়ির প্রাচীরের মধ্যে কী ভয়?

কিন্তু দারুণভাবে কনসার্ট বেজে ওঠায় কথা বলার সুবিধা থাকলো না। কিন্তু বাজনাটা দপ করে থামলো। তখন সেই অভ্যর্থনার কর্মচারী বললো–আর একবার ছোট্ট একটু বেজেই পর্দা উঠবে।

সেই অবসরে হরদয়াল বললো–কী নাটক হচ্ছে শেষ পর্যন্ত?

নায়েব বললো– কী যেন, একেই বলে বুড়ো শালিখ।

অভ্যর্থনাকারী বললো–আসলে নায়েবমশাই কিছুতেই বুঝতে চাইছেন না দুটো নাটক।

নায়েব বললো–বেশ করেছে, বাপসকল, টাকাটা যে খরচা করলে তার যেন মান থাকে।

হরদয়াল হেসে বললো–অনেক চাইছে বুঝি?

-আর বলেন কেন? পোশাক রে, পরচুলা রে, রং রে, আবার কী ছিন-ছিনারি! তা পটো এঁকেছে ভালো। আর এবারে শিশাওয়ালও মজা পেয়েছে। সেও সব ঘোমটা পরা আলো দিয়েছে শুনি। ঠাহর পাচ্ছি না, কত বা হাঁকে।

সেই ছোটো বাজনা বেজে উঠলো। নায়েবমশায় আর হরদয়ালের গড়গড়া এসে গেলো তাদের হুঁকা বরদারদের হাতে। এটুকু করতে না-পারলে তাদের আর চাকরি কীসের? এখন বেশি আলাপের সময় নয়, সিন উঠে গেলো। নাটকটা মনে হচ্ছে প্রহসন। নাট্যকার যেভাবে হাসাতে চেয়েছিলো হাসিটা তা থেকে স্বতন্ত্র ধরনের হতে লাগলো মাঝে মাঝে। স্ত্রীচরিত্রে অভিনেতা এক ছোকরা পরচুলা নিয়ে ফ্যাসাদ ঘটাতে না-ঘটাতে, তার বক্তব্য অন্যে বলে ফেলে জিভ কাটালো। কথা শেষ করার আগেই কেউ নেপথ্যে গিয়ে ওদিকের তাড়া খেয়ে গলা বাড়িয়ে বক্তব্যের বাকিটুকু বলে দিলো। তা সত্ত্বেও ব্যাপারটার অভিনবত্ব দর্শকদের টানছে।

কখনো মানুষকে অটল গাম্ভীর্য নিয়ে থাকতে হয়। গড়গড়ার ধোঁয়ার আড়ালে নায়েব মশায় যেন কোন গোপন ব্যথায় পীড়িত। হরদয়াল মাঝে মাঝে মুখের উপরে হাত রাখছে, তাতে তার ঠোঁট দুটি আর চিবুক ঢাকা পড়ছে। বাগচী কিছু অনভিজ্ঞ। সে পাইপ কামড়াচ্ছে বটে, কিন্তু কি তার পাইপ, কি তার দাড়ি তার চোরাহাসি গোপন করতে পারছে না।

একবার সাধারণ দর্শকরা হো হো করে হেসে উঠলো। এতক্ষণ যে মোটামুটি ভালো পার্ট করছিলো, সম্ভবত লমোহরার গৌরী, সে ভুল পথে তার যেখানে আদৌ থাকা উচিত নয়, সেখানে এসে এক দারুণ বিপত্তি সৃষ্টি করে দুম দুম করে পালালো। তৎক্ষণাৎ সিন। পড়লো এবং দারুণভাবে বাজনা বেজে উঠলো।

কেট পিছন ফিরে দর্শকদের হাসিটাকে লক্ষ্য করলো যেন। কিন্তু বললো–জমিদার দেখছি অত্যন্ত প্রজাপীড়ক এবং নীতিহীন, রায়তরা ক্ষেপে না যায়। বাগচী হাসতে হাসতে বললো–নিয়োগীমশায় দেখলে ভালো করতেন। তাঁর সাসপেনশন অব ডিসবিলিফ নিয়ে ভয় রইতো না।

কিন্তু নায়েবমশায় যেন এই সুযোগের অপেক্ষা করছিলো। বললো–বুড়োমানুষ তো। একভাবে এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা কষ্টের। আপনারা বসুন। ওদিকে দেখি ঠিক চলছে কিনা।

হরদয়াল বললো–আপনাকে বলা হয়নি। মিস্টার ও মিসেস বাগচীকে জলযোগের বদলে আমার সঙ্গে রাতের খাওয়া সারতে বলেছি।

বাঃ বেশ, অতি উত্তম করেছেন। বলে নায়েব উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু যেতে গিয়ে বোধ হয় কিছু দরকারি কথা মনে পড়লো। বললো–রানীমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো নাকি? বিকেলের দিকে খুঁজছিলেন আপনাকে, পরে বললেন, থাক আজ।

-বাইরে গিয়েছিলাম একটু। বললো– হরদয়াল।

-এবারের উৎসবের উপহার শুনেছেন? এবার কিন্তু বেতন বেড়ে যাচ্ছে না। বলেছেন, সব কর্মচারীকে বারো দিনের বেতন অতিরিক্ত এককালীন দেওয়া হবে। আদায় ভালো হয়নি, তাই সারা বছরের এবং ভবিষ্যতের জন্য বেতনবৃদ্ধি নাকচ করেছেন।

–কিন্তু বর্তমানে তো নগদ বেশি যাবে। হরদয়াল বললো।

-তা হবে। এবার দুটো নতুন পদ সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের মধ্যে একটি রাজকুমারের ব্যক্তিগত পরামর্শদাতার। বললেন, সে বিষয়ে আপনার সঙ্গে আগেই আলাপ হয়েছে। এই পদে উনি এমন একজনকে চান যিনি রাজবাড়ির ধরন-ধারণ বোঝেন, রাজকুমারকে ভালোবাসতে পারবেন, নিজে বিশেষ সচ্চরিত্র হবেন, অথচ ইংরেজিতে ভালো।

হরদয়াল বললো–এমনটি রানী কিছুদিন থেকে ভাবছেন। সেরকম একটি মানুষ পেতে হবে তো।

–দেখা যাক। বলে নায়েব চলতে শুরু করলো।

হরদয়াল ঘড়ি বার করে বললো–সে কী, পৌনে নয় হচ্ছে। আসুন মিস্টার বাগচী, এই সুযোগে আমরাও উঠি। ডিনার জুড়োতে দিলে হবে না।

.

০৫.

দেওয়ানকুঠি রাজবাড়ির প্রাচীরের মধ্যেই, সুতরাং তারও কিছু আলোকসজ্জা আছে। যদিও তা অন্যান্য অংশ থেকে স্তিমিত। আলো দেওয়ার কৌশলে কুঠির স্থাপত্য-সৌন্দর্যকেই শুধু প্রকাশ করা হয়েছে। বাগচী দম্পতিকে নিয়ে সেদিকে যেতে যেতে হরদয়ালের মন প্রথম উৎসবের দিকে ফিরে গেলো। তখন সে-ই দেওয়ান। আর গোটা উৎসবটা ছিলো তার ফরমায়েশ মতো। সেবার এতক্ষণে কুঠির হলঘরে সারেঙ্গী, পাখোয়াজ বাজছে, বাঈজী। নাচছে। ডানকান মদের ঘোরে বোকার মতো হাসছে, বাইজীদের সম্বন্ধে উত্তেজনা গোপন করতে পারছে না। শেষে পিয়েত্রো বলেছিলো তুমি বাঘে বলদে একঘাটে জল খাওয়ালে, হে দেওয়ান।

তারা দেওয়ানকুঠির সিঁড়িতে পা রাখতে হরদয়ালের ভৃত্য পর্দা টেনে ধরে দাঁড়ালো। এটা হয়তো হরদয়ালের পছন্দ যে ভিতরের ও বাইরের আলো এরকম নয়। এটা তার বসবার ঘর যেখানে টিপয়ে রাখা একটা হারিকেনমাত্র স্তিমিত আলো দিচ্ছে। কিন্তু বসবার ঘরে না বসে সে তার লাইব্রেরিতে গেলো। সেখানে জলচৌকির উপরে ঢোলক আকৃতি চকচকে কাঁচের ডোমে উজ্জ্বল মোমের শামাদান। জলচৌকির কাছাকাছি কয়েকটা সোফা, হরদয়ালের নিজের আরামকেদারা।

হরদয়াল বললো–মিস্টার বাগচী, ওরা টেবিল পাততে পাততে ক্ষুধা বাড়াতে একটু চলবে কি? বাগচী কিছু বলার আগে হরদয়াল নিজেই ওয়াইনের বোতল আর গ্লাস নিয়ে এলো। সে তিনটি গ্লাসে ঢাললো। কিন্তু কেট বললো–আমি এ রকম কখনোই খাই না। আপনারা খান। আমি বরং আপনার লাইব্রেরি দেখি। আগে যেমন দেখেছিলাম তার চাইতে বই আর শেলফ দুই-ই বেড়েছে মনে হচ্ছে। সে দেয়াল বরাবর সাজানো শেলফগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করলো। সুতরাং গ্লাস হাতে বাগচী এবং হরদয়াল তাকে অনুসরণ করলো। কেট একবার বললো–দেওয়ানজিকে কিন্তু এই লাইব্রেরিতে না-ঢুকলে বোঝা যায় না।

বিব্রত হরদয়াল বললো–না না, এ সবই রানীর আনুকূল্যে।

বাগচী বললো–কিন্তু বই বাছাই করার রুচি?

হরদয়াল তা সত্ত্বেও বললো–বই আর এত কোথায় আসছে এদেশে যে বাছাই করা হবে। যা পাওয়া যায় তাই কিনে ফেলা হয়।

কেট বললো–বই-এর জন্য টাকা খরচ কিন্তু সংস্কৃতির একটা প্রমাণ।

তারা ঘরের মাঝামাঝি একত্র হলে বাগচী ভাবলো, কালচার, ও হ্যাঁ, কালচার। সে বললো–দেওয়ানজি, রামমোহন রাজার সব বই কি আপনার আছে?

–আপনার কি বিশেষ কোনোটির কথা মনে পড়েছে?

বাগচী বললো–সেই পার্লামেন্টের উদ্দেশে লেখা প্রবন্ধ।

–কোনটি? সেই রিমারস অন দা কলোনাইজেশন অব ইন্ডিয়া বাই ইউরোপীয়ানস?

-তাই হবে নাম। যেটায় রাজা ইংল্যান্ডের কিছু লোককে জমিদার হিসাবে ভারতে স্থায়ী বসবাস করানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন।

হরদয়াল বললো–ওটা কিন্তু পাণ্ডুলিপিতে আছে। কলকাতায় পেয়ে নকল করে রেখেছিলাম।

-আচ্ছা, আপনার কি মনে হয়, সেই প্রবন্ধের কি এই উদ্দেশ্য যে সেই ইংরেজ জমিদাররা স্থায়ীভাবে এদেশে বসবাস করলে এ দেশের টাকা এ দেশেই থাকবে, নাকি জ্ঞান বজ্ঞানের প্রসার, ইনডাস্ট্রির প্রসার, এসবের আশাও করেছিলেন।

হরদয়াল বললো–আবার তাহলে পড়তে হবে। যতদূর মনে পড়ে সেসব ছাড়াও ধর্ম এবং সংস্কৃতির কথাও ছিলো। বোধ হয় সংস্কৃতির বিনিময়ও। কিন্তু বিশ বছর আগেকার মত, রাজা কি বর্তমানে মত পরিবর্তন করতেন না? হরদয়াল হাসলো। কিন্তু তার ক্রুর কাছে গাম্ভীর্যও দেখা দিলো। সে ভাবলো, যেমন আজ ডানকানরা এলো না। সে বললো– কলকাতায় কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে ৫৭-৫৮র সেই সব ব্যাপারের পরে ইংল্যান্ডের। লোকেরা দূরে দূরে সরবে।

আলাপটা এগোলো না। টেবিল পাতা হয়েছে এই খবর জানালো হরদয়ালের ভৃত্য। অপেক্ষাকৃত ছোটো টেবিলে প্রকাণ্ড উজ্জ্বল হারিকেন ঘিরে তিনজনের ডিনার। বসা হলে হরদয়াল বললো–এক কাজ করলে হয়; আমাদের খাবারগুলো দিয়ে ওরা যদি চলে যায়, মসেস বাগচীতবে ফ্যামিলি ডিনারের মতো আমাদের সার্ভ করতে পারেন। বেশ ইনফর্মাল হয়।

কেট বললো–নিশ্চয়, সে তো খুব ভালোই হবে।

ভৃত্য ও বাবুর্চি দুজনে সার্ভ করবে স্থির ছিলো। হরদয়াল তাদের ডেকে বললো–তোমরা। কোর্স কটিকে একইসঙ্গে টেবিলে রাখো। মেমসাহেব ব্যবস্থা করবেন। তাছাড়া তোমরা তো এতক্ষণ বেরোতে পারোনি, এবার একটু ঘুরেফিরে আনন্দ করো।

তারা ব্যাপারটাকে আদেশ মনে করেই টেবিল সাজিয়ে দিয়ে চলে গেলে কেটের অসুবিধা হলো। সুপটাকে বোঝা যায়। মাছ ভাজা, মাংসের কারিকে বোঝা যাচ্ছে। লুচি নম্বন্ধেও কিছু জ্ঞান আছে তার। কিন্তু দুটো সুদৃশ্য পাত্রে দুরকমের পোলাও দেখে সে বিব্রত হলো। কোনটা কোন কোর্সে চলবে, কোনটির পরে কোনটি–এটা তাকে চিন্তিত করলো।

তখন হরদয়াল বললো–হোস্টেসের রুচিই আমাদের রুচি।

বাগচী বললো– হাসতে হাসতে-দেখ কেট, বই বাছাই-এর ব্যাপারে দেওয়ানজির রুচির কথা তুলেছিলাম, এবার কিন্তু

সুপের সঙ্গে সঙ্গে রুচির কথাকেই ফিরিয়ে আনলো হরদয়াল। বললো, বলার আগে ভাবলো, যেন নিজের মনের দিকে চেয়ে কিছু অনুভব করার চেষ্টা করলো, তাকে সলজ্জ দেখলো। -আচ্ছা, মিস্টার বাগচী, আপনার কি কখনো এমন হয়েছে যে আপনার ফেভারিট কোনো কবির চাইতে সেদিন অন্য কবিকে ভালো লাগছে।

একটু বুঝিয়ে বলুন।

মনে করুন শেলীর তুলনায় কীটস।

কীটস নিশ্চয়ই বড়ো কবি। বিশেষ কোনো মনের অবস্থায় কাউকে আরো ভালো লাগে যদি অন্যায় কী?

হরদয়াল ভাবলো, তার চিন্তাটা স্বচ্ছ হলো না। সে টেবিলে মন ফেরালো।

কিন্তু কেট মুশকিলে পড়লো। সে নিজে ভেবে ঠিক করতে না-পেরে হরদয়ালকে জিজ্ঞাসা করলো নিরামিষ পোলাও যদি আগে দিই তার সঙ্গে কী দেবো, মাছভাজা কী?

হরদয়াল বললো–সে আর কঠিন কী? কিন্তু সে থমকে যেন মনে করার চেষ্টা করলো। পরে বললো–আমার মনে হয়, সেবার রাজবাড়িতে নিরামিষ দোলমা দিয়ে খেয়েছিলাম। মাছ খেলে সুগন্ধ নষ্ট।

বাগচী হেসে উঠে বললো–দেওয়ানজি, খাওয়ার ব্যাপারে স্মৃতিতে নির্ভর করা সবসময়ে ভালো নয়। তোমার মনে পড়ে, কেট?

কেট বললো–গুড গড, এ কি সে রকম হতে যাচ্ছে নাকি? সে যেন কী? ও, বড়ি! বড়ি

হরদয়াল বললো– কী রকম?

কেট বললো–হরিবল্। সেদিন হেডমাস্টারের খেয়াল হলো নতুন লাঞ্চ খাবে। বোধ হয় ডালের সেই কোণগুলো যাকে বললো– বড়ি। বললো, কিছু করতে হবে না, চাল আর এগুলো একসঙ্গে সিদ্ধ করলে সুগন্ধে ঘরসুদ্ধ ভরে যাবে। বড়োজোর খাওয়ার আগে তেল দিয়ে নিও।

কৌতুক বোধ করে হরদয়াল বললো–আচ্ছা!

কেট বললো–সে কি খেতে পারা যায়? হরিব, স্ট্রেঞ্জ!

বাগচী বললো– কী জানি সে রকম কেন হলো! অথচ আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার সেই সাত-আট বছরে এটা ছিল একটা ট্রিট। আমার মনে হয় কিছু একটা মা দিতেন যা আমরা না-জানায় দিতে পারিনি। অবশ্য তখন আমরা খুবই গরীব ছিলাম।

কেট বললো– হেসে-সে জিনিসটার নাম নস্ট্যালজিয়া।

হরদয়াল বললো–ওইসব ভালো লাগা হয়তো বড়ো হলে চলে যায়, তখন স্মৃতিটা থাকে। এ বিষয়ে একটা প্রমাণ দিতে পারি। আমাদের রাজকুমার সবরকমই খান। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি সেদিনও, তিনি উত্তেজিত, বিরক্ত, খুব মন খারাপ করে থাকলে রানী একটা সহজ কৌশল করেন। বলেন, স্নান করে আয়, আমার সঙ্গে খাবি। সে কিন্তু নিরামিষ আর খুবই অল্প আয়োজনের। হরদয়াল হাসলো।

তখনো আতসবাজি শেষ হয়নি, কিংবা সেটা হয়তো শেষ হাউই-গোছার একটি। তার আলো কোনো জানলা দিয়ে টেবিলে এসে পড়লো। সে আলোটা সরে গেলে হরদয়াল নতুন আলাপ খুঁজে নিলো। বললো–মিস্টার বাগচী, নায়েবমশায় থিয়েটারে বলছিলেন তা কি শুনেছিলেন?

–আপনাদের বেতন বৃদ্ধির একটা ব্যাপার ছিলো।

-হ্যাঁ, সেই সময়ের কথাই। সেই নতুন দুটি পদ তৈরীর কথা। দুটির মধ্যে একটি বোধ হয় ধর্ম সম্বন্ধে-দেবত্র আর ওয়াকফ। অন্যটি রাজকুমারের প্রাইভেট সেক্রেটারি।

বাগচী বললো–হ্যাঁ, শুনেছিলাম। রাজবাড়িকে ভালোবাসবে, তার ধরন-ধারণ জানবে, ইংরেজিতে দক্ষ এবং বিশেষ সচ্চরিত্র হতে হবে। ইংরেজিতে দক্ষ মানুষ আজকাল কলকাতায় পাওয়া যায়, সচ্চরিত্র কথাটার ব্যাখ্যা নিয়ে গোলমাল আছে বটে, তবে বোঝা যায় কী বলা হচ্ছে। সে রকম পাওয়া একটু কঠিন। কিন্তু রাজবাড়িকে আপন মনে করবে, তার ধরন-ধারণ জানবে সে-লোক এ গ্রামের বাইরে কোথায়?

হরদয়াল একটু ইতস্তত করে বললো–কথাটা পরে বলবো ভেবেছিলাম, কিন্তু উঠে পড়লো। কিছু মনে যদি না করেন, বলি। প্রকৃতপক্ষে যা বলতে যাচ্ছি তাতে আমার লোকসান, গ্রামেরও ক্ষতি। কিন্তু রানী যেদিন প্রথম এ কথাটা তুলেছিলেন তখন, আমার ধারণা, তার চোখের সামনে আপনি ছিলেন।

বাগচী বলোনা না, এ আপনি কী বলছেন? ইংরেজিতে না-হয় দক্ষতা হয়েছে, আর তা ইংরেজ পরিবারে ত্রিশ বছর কাটিয়ে। কিন্তু অন্য গুণগুলো?

হরদয়াল বললো–আমি আপনাকে এত রাতে মত দিতে বলছিনা, কিন্তু ব্যাপারটা শুনুন। নায়েবমশায় এই এস্টেটে পঞ্চাশ বছর কাজ করছেন। বয়স সত্তর হয়। নিজেকে ক্লান্ত বলছেন। এ অবস্থায় রানীমা একজন কর্মচারীকে সেই পদের উপযুক্ত করে ট্রেনিং দিয়ে নিতে চান। এই প্রাইভেট সেক্রেটারির পদটা একটা স্টেপিং স্টোন। রানীর কথা শুনে আমিও ভেবেছি। স্কুলটার সর্বময় কর্তৃত্ব আপনারই থাকবে। হয়তো হেডমাস্টার অন্য কেউ হবে। আপনি কিউরেটর রূপে থাকতে পারেন। আমার মনে হয়, প্রাইভেট সেক্রেটারির কাজ এক্ষেত্রে রাজকুমারকে কিছুটা পরামর্শ দেওয়াও বটে।

–কিন্তু রাজবাড়ির ব্যাপার। বাগচী বললো, আমি তো বুঝতেই পারছি না।

হরদয়াল বললো–এটা এমন নয় যে আমরা খাওয়া থামাবো। মিসেস বাগচী, এরপরে আমাদের কী দেবেন?

আমার মনে হয়, আপনি যে রাজকুমারের সঙ্গে আজকাল সন্ধ্যায় গল্পগাছা করেন তা রানী জানেন, আর তা থেকেই আপনাকে নিয়োগ করার কথা রানীর মনে হয়েছে।

হরদয়াল নতুন একটা খালি প্লেট সেকেন্ড কোর্স নেওয়ার জন্য কেটের সামনে বাড়িয়ে ধরলো। বললো–এবার যদি বিরিয়ানি দেন আমি মাছভাজা চাইব। বাগচী সাহেব যদি মাংস নেন আমার আপত্তি নেই। এই বলে সে হাসলো। প্লেটটা নিজের সামনে নামিয়ে নিয়ে মাছের ফর্ক খুঁজে নিয়ে সে খেতে আরম্ভ করে বললো– আবার, এমন হতে পারে, মশাই, রানী লক্ষ্য করেছেন সেই সব আসবে আপনি মদ খান বটে, কিন্তু তা সন্ধ্যার ঠোঁট ভিজানোমাত্র। পাইপ টানেন, তা কদাচিৎ।

বাগচীর মুখে আশঙ্কার চিহ্ন দেখা দিলো। তার উপরে নজর রাখা হচ্ছে এরকম ভেবে সে বিপন্ন বোধ করলো। হরদয়াল হেসে বললো–না, সে রকম নয়। আমাদের সকলকেই এমনভাবে দেখে নেওয়া হয়েছে। শুনেছি। নায়েবমশায় তখন আমিন যখন রানীমার হাতে এস্টেট আসে। বিচার করে তাকে নায়েব-ই-রিয়াসৎ করেছেন।

হেসে বাগচী বললো–দেওয়ানজি, আর কিছু না-হোক, রাজবাড়ির এই একটা ধরন আমার জানা হলো।

হরদয়ালও হেসে উঠলো।

.

০৬.

ডিনার ও ওয়াইন শেষ করে তারা বাইরে এলে হরদয়াল জানতে চাইলে বাগচী আর একবার থিয়েটারের দিকে যেতে চায় কিনা। ঘড়ি দেখে বাগচী বললো– রাত এগারোটা হতে চলে।

তারা সদরদরজার কাছে এসেছিলো। তখনো সেখানে বেশ লোকজন, পালকি, গোরুগাড়ি। বোধ হয় নিমন্ত্রিতরা ফিরে যেতে শুরু করেছে।

হরদয়াল হেসে বললো–রাজবাড়ির আমরা আজ কেউই ঘুমবো না। আপনাদের সঙ্গে খানিকটা চলি।

তারা পথে চলতে শুরু করলে কেট বললো–এঁরা এত রাতে ফিরছেন, পথে বিপদ হতে পারে না?

সম্ভাবনা কম, বললো– হরদয়াল। যতদূর জানি নতুন ঠগী-ঠ্যাঙাড়ের দল তৈরী হয়নি আর।

বাগচী বললো– শ্লীম্যানের কথা বলছেন? এখানে তা হলে ঠগী-ঠ্যাঙাড়ে ছিলো?

হরদয়াল কথাটা বলার আগে হাসলো, একটু দ্বিধা করে বললো–না। বছর চল্লিশ আগেকার কথা। আমদের নায়েবমশায় তখন তশীলদার। তখনকার রাজার হুকুমে বরকন্দাজ নিয়ে পথে নেমেছিলো। লোকে বলে দুই সপ্তাহে দশ দিনে পঞ্চাশজনকে মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলো যাদের কিছু তখনো জীবন্ত।

কেট বললো– কী সাংঘাতিক! এই নায়েবমশায়?

বাগচীও চমকে উঠেছিলো। বললো–বটে? না, সে ভদ্রলোক তো হিসাবমতো বছর ত্রিশের একজন তখন। কিন্তু সে-ও ভাবলো, এখন সেই দুর্দম বৈর কি বয়সে নিশ্চিন্ত? হোক ঠ্যাঙাড়ে-ঠগী, তাহলেও সেভাবে বিনা বিচারে শেষ শাস্তি দেয় অতগুলো মানুষকে? সেই নৃশংসভাবে? কিন্তু এটা তো আজকের আবহাওয়া নয়। সে বরং প্রাচীরের উপর দিয়ে আলোয় উজ্জ্বল রাজবাড়ির দিকে লক্ষ্য করে বললো–অনেক খরচ হবে, কী বলেন?

শীতের রাত এগারোটা। অন্ধকার তো বটেই, বাতাসেরও কামড় আছে। সে রাতে উপরন্তু ধোঁয়ানো মশাল ছিলো পথের উপরে এখানে ওখানে। একটা-দুটো ছুটে চলা পালকি, কোথাও কাঁচকোচ শব্দ তুলে গোরুগাড়ি। পায়ে হেঁটে চাঁদরে মাথা মুড়ে পথচারী। অনভিজ্ঞ বাগচী-দম্পতির কাছে কখনো বা স্বপ্নে দেখা এমনই বোধ হতে লাগলো।

হরদয়াল হেসে বললো–আমাদের রানীর এই এক বদনাম আছে, তিনি কৃপণ। কাজেই এ ব্যাপারে হাজার পঞ্চাশের বেশি খরচ হতে দেবে না নায়েবমশায়। হরদয়াল রানীকে কৃপণ বলে বোধহয় মজা পেলো। সে বললো–আপনাকে একটা ব্যাপার বলতে পারি। রানী কয়েকটি ব্যাপারে প্রোটেস্টান্ট কিংবা পিউরিটানদের মতো যেমন নিজের খাওয়াদাওয়া, পূজাটুজা, যেমন টাকা জমানো। আপনি শুনলে অবাক হবেন, জমিদারীর লভ্যাংশের শতকরা প্রায় চল্লিশ দিয়ে প্রতি বছর, বছরে দুবার করে স্টক ইত্যাদি কেনা হয়। রেলের স্টক, কয়লাখাদের ডিবেঞ্চার, বিশেষ কম্পানির কাগজ।

তারা স্কুলবাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছিলো। বাগচী এবার বললো–দেওয়ানজি, আপনার অনুগ্রহের জন্য ধন্যবাদ। বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে। আপনি কুঠিতে ফিরুন।

হরদয়াল থেমে দাঁড়ালো। হাসিমুখে বললো–গুডনাইট! একটা ভালো ডিনারের জন্য এক নিঃসঙ্গ মানুষের ধন্যবাদ নিন।

একবার বাগচী ফিরে দেখলো, হরদয়াল যেন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু হরদয়ালের অজ্ঞাতসারে তার গতিবিধি লক্ষ্য করা ভালো হবে না মনে করে তারা হাঁটতে লাগলো।

কেট বললো–আশ্চর্য নয়, এই মানুষ, যাকে লোকে বাঘের মতো ভয় পায়, কত কাছে আসতে পারেন অবলীলায়!

বাগচী বললো–কিন্তু, কেট, ওটা কী দেওয়ানজির আদেশ–ওই চাকরিটা নেওয়া?

কেট ব্যাপারটার এরকম ব্যাখ্যা আশা করেনি। সে বিস্মিত হয়ে বললো–তাই মনে করো?

-দেওয়ানজি বলছিলেন রানীমা আমাকে দেখেই পদটির কথা চিন্তা করেছেন।

কেট হাই তুলো। বললো–কিন্তু ওটা কী কথা হলো পিউরিটান সম্বন্ধে?

বাগচী বললো–এরকম কথা আছে বটে। পিউরিটানরা টাকা ধার দিতে আপত্তি করেন! আধ পয়সা সুদ মাপ করাকে দলিলকে সুতরাং সত্যকে অবজ্ঞা করা মনে করেন। বলা হয়, ইংল্যান্ডের ক্যাপিটালের অনেকটা এইসব পিউরিটানের সঞ্চয়।

হরদয়াল চলতে শুরু করে পথচারীদের এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করতে লাগলো। পথচারীরা তাকে চিনতে পারলে কথা বলতে চাইবে, যা তার এখন ভালো লাগবে না।

সে রাজবাড়ির হাতায় পৌঁছালো। সদরদরজা দিয়ে খানিকটা গিয়ে পরে তার কুঠিতে যাওয়ার পথ। সে এক মুহূর্ত যেন দ্বিধা করলো কোনদিকে যাবে। আতসবাজি শেষ হয়েছে, রাজবাড়ির দেয়ালের আলোগুলোও এখন স্তিমিত। তার মন যেন একটা সুখ ও একটা নিরানন্দের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়লো। সে নিজেকে শোনালো; কীটসই তো। এতক্ষণ তো কীটই মনে ছিলো। সে হিম ও পরিপক্ক ফলে আনত ঋতু। সেই হেমন্তের কবিতা! মনে মনে কবিতাটা আবৃত্তি করাতে গিয়ে শেষের দিকে পৌঁছে তার মন উদাস হয়ে গেলো।

সে নিজের বাংলোর দিকে চলতে চলতে ভাবলো, সে এখন তার লাইব্রেরিতে যেতে পারে। তার আর কিছুই করার নেই। বলতে পারা যায় সেই প্রথমবারের পর থেকে তার কাজ কমে যাচ্ছিলো। তাহলেও গতবারেও নায়েবমশায় কী হবে কী হবে না তা নিয়ে আলাপ করেছিলো! এবার…প্রথমবার সেই উৎসবে দেওয়ান কুঠিরই যথেষ্ট গুরুত্ব ছিলো। সেই বাঈজীনাচ যা থেকে উঠে গিয়ে পিয়েত্রো বাঘে-বলদে একঘাটে জল খাওয়ানোর কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছিলো, দেখো স্ত্রীলোক নিয়ে নাচের আসরে গোল না-হয়। ডানকান ও সদরওয়ালা ডেপুটি দুইয়েরই তখন মদে বেসামাল অবস্থা। সেই রাতেও তার নিঃসঙ্গ মনে হয়েছিলো নিজেকে, কিন্তু পরমুহূর্তেই কর্তব্যের অনেক কোলাহল তার চারিদিকে কৌশল, মন্ত্রণা, ভবিষ্যৎদৃষ্টি নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলো।

হরদয়াল তার বসবার ঘরে বসলো। চিন্তার খেই তুলে নিলো একটা। তো, বাগচীকে কিন্তু রাজবাড়ির কাছাকাছি আনলেও বলা যাবে না এই উৎসবটা প্রকৃতপক্ষে সেই একটা ঘটনার উপরে পর্দা টেনে দেওয়া। যেন কিছুই হয়নি বোঝাতে ডানকানকে নিমন্ত্রণ করা। তদন্তে এসেছে এমন সদরওয়ালাকে বিভ্রান্ত করা। বাগচীকে বলা যাবে না রানীর জন্ম বৈশাখে বলেই তার এক নাম বিশখা।

হরদয়াল জামা জুতা খুললো। তৃষ্ণা পেয়েছে তার। ডিনারে মদটা ভালো ছিলো। আর্মেনিটা এই এক ব্যাপারে ঠকায় না। সে উঠে টেবিল থেকে পোর্টের অর্ধসমাপ্ত বোতলটা এবং একটা নতুন গ্লাস নিয়ে ফিরলো। এখন পোর্টই। কলকাতায় এ রকম প্রবাদ, পোর্ট হজমের সাহায্য করে। আবার কলকাতা থেকেই বন্ধু লিখেছে মদ্যপান নিবারণের কথা, যা হয়তো এ মাসের শেষ আধুনিক কথা। ঠোঁটে সেই গাঢ় রঙের মদ তুলে হরদয়াল মনে মনে হাসলো। একেই কী বলে সভ্যতার ফল নাকি? সেনাটকে মদ্যপানকে ধিক্কার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন এই, মাইকেল ডাটু মদ ছেড়েছেন কি?

গ্লাসটা শেষ করেও তৃষ্ণা না-মেটায় সে ভাবলো : বোধ হয় বাতাসে যাওয়া আরামের হবে। সে নিজেকে মৃদু ঠাট্টা করে মৃদু হেসে ভাবলো–এত রাতে কীটস আর অট হয় না!

শোবার ঘরে গিয়ে জামাজোড়া খুলে চটি পরে চাদর গায়ে দিতে গিয়ে হাতের সামনে যে শাল পেলো তাই পরে পায়চারির ভঙ্গিতে কুঠি থেকে বার হলো। বাইরের আলো শালে পড়ায় সে ভাবলো, এটা কেন? ভৃত্যদের কাজ। বালাপোষ সরিয়ে তার জায়গায় নতুন কোনো শাল রেখেছে।

আলো অনেক স্তিমিত, তাহলেও এখনো যথেষ্ট, এখনো মানুষজন চলেছে। সদরের পেটা ঘড়িতে বারোটা বাজলো।

শালটা এমারেল্ড রঙের, মহামূল্য তাতে সন্দেহ কী! য্যাকব নিজেই বলেছিলো। আজ সকালের কথাই তো। য্যাকব তার পুটুলি নিয়ে এসে খুলে শালটা বার করে বলেছিলো, এটা, সার, আপনার জন্য। হরদয়াল বলেছিলো, রাখো, রাখো। যা আছে তা পরি কখন? তখন য্যাকব বলেছিলো, রানীমা নিজে পছন্দ করে এটা আপনার জন্য পাঠিয়েছেন। আমার শুধু পৌঁছে দেওয়া।

রাজবাড়ির সেই একটা খিলান বিশেষ আলোকিত। সেখানে কয়েকজন ব্যস্ত সমস্ত দাসদাসীকেও দেখা যাচ্ছে। থিয়েটারের চত্বর পার হয়ে সে পূজামণ্ডপের খিলানটার দিকে গেলো।

আসলে তো মন্দির নয়। রাজবাড়ির অন্দরে ঘোড়া ও পালকি ঢোকার পথ। তারই পাশের দালানে রদবদল করে, দেয়াল তুলে, রেলিং-এ ঘিরে পূজার জায়গা করা হয়েছিলো। প্রথম বার এত আলো ছিলো না। কিন্তু আন্তরিকতা কি বেশি ছিলো? রাজকুমারের বিপদমুক্তির দরুন কৃতজ্ঞতা জানানোর ব্যাকুলতাও ছিলো।

হঠাৎ হরদয়াল স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। চিন্তাটা কোথা থেকে উঠলো ভেবে পেলো না। কিন্তু তা তার মনকে বিবশ করে দিলো। কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হলে সে বরখাস্তই হয়। রানী তাকে দেওয়ান পদ থেকে বরখাস্ত করেছিলেন, কিন্তু বিতাড়িত করেননি। কুঠিতে থাকতে দিয়েছেন, তার স্কুলে টাকা দিচ্ছেন, লাইব্রেরির বই কেনার খরচ দিয়ে চলেছেন, সে কি এজন্যই যে রাজকুমারের সেই অপরাধের সংবাদ সে জানে? যে বিবেক সেবার সে বিসর্জন দিয়েছিলো রাজকুমারকে রক্ষা করতে, যার মৃত দেহটাকে যেন সে টেনে চলেছে, তা যেন তাকে অস্থির করে তুলো।

সেই প্রথমবার দেওয়ানকুঠির নাচের আসরের আলো নিবে গেলে সে এরকম মাঝরাতে এই পূজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলো। রানী উঠে এসেছিলেন। পিয়েত্রো ডানকান প্রভৃতি নাচমহলে খুশি হয়েছে জেনে নিয়ে রানী জানিয়েছিলেন পূজা শেষ হতে দেরি আছে। এখন দেওয়ান বিশ্রাম নিতে পারে।

চেহারার বৈশিষ্ট্য বলল, কিংবা বসার ভঙ্গি, অনেক ভিড়ের মধ্যেও তাকে চিনতে পারা যায়। হরদয়াল দেখতে পেলো কিছু দূর থেকেই, দালানের মেঝেতে রানী বসে আছেন। এখানকার আলো চোখ ধাঁধানো নয়। অনেক প্রদীপ, কিন্তু আলোটা কোমল। রানীর পরনে দুধ-গরদের থান, তার চোখ দুটো আয়ত।

দালানের নিচে হরদয়ালের সামনে আট-দশজন মানুষ, তারা পূজায় উৎসাহী। ওপারের রকে পুরনারীদের ভিড় এখনো রেশমে অলঙ্কারে উজ্জ্বল। পুরুষদের মধ্যে একজন কথা বললো। গলার স্বরে নায়েবমশায়কে চিনতে পারা গেলো।

নায়েবমশায় বললো–সব ব্যবস্থা ঠিক করা আছে। দশজন বরকন্দাজ ঘুরে পাহারা দিচ্ছে। এবার আমি যাই।

এ রকম অনুমতি রানীর কাছেই চাওয়া হয়। রানী বললেন–এসো, বাবা।

হরদয়াল তো দেখতেই পাচ্ছে সব ব্যবস্থা ঠিক করা আছে। নায়েবমশায়ের চালটা ধীর, কিন্তু নিশ্চয় ব্যবস্থায় ত্রুটি থাকে না। বরকন্দাজদের কাঁধে আজ বন্দুক থাকবে।

কী হবে কিছু খোঁজ করে?

কিন্তু রানী উঠলেন। যেখানে নায়েবমশায় দাঁড়িয়ে ছিলো সেদিকে না গিয়ে রেলিং বরাবর সরে এলেন। বললেন–হরদয়াল? এখনো পুজো শেষ হতে ঘণ্টাতিনেক। তুমিও বিশ্রাম নিতে পারো।

আশ্চর্য নয়? হরদয়াল চোখ তুলে তাকালো, যেন ঘোমটা ঘেরা মুখটাতে সে একটু স্পষ্ট করে দেখলো।

রানী ঈষৎ হাসলেন। বললেন–শালটা ঠকায়নি। মানিয়েছে তোমাকে।

.

০৭.

দ্বিতীয় নাটক শেষ হওয়ার কিছু আগেই চিকের আসন থেকে উঠে পড়েছিলো নয়নতারা। সে পূজার কাছে আমন্ত্রিত মহিলাদের রকে গিয়ে বসলো। কে একজন জিজ্ঞাসা করলোনাটক থেকে এলেন? কেমন হচ্ছে নাটক? হচ্ছেই তো, বলে নয়নতারা পাশ কাটালো।

পুরোহিতের ঈষৎ প্রকাশিত মন্ত্রোচ্চারণ দ্রুততর হয়েছে এখন, যেন তা শব্দ ঝংকারের নেশা। মাঝে মাঝে দ্রুত লয়ে ঢাক বেজে উঠছে কিছুক্ষণের জন্য। রাত বেশি হলে তা অনুভূতিতে ধরা পড়ে।

আসল কথা, সারা রাজবাড়ি জুড়ে যে আলো ছিলো তা এখন মৃদু হয়ে আসছে। আলো এখানেও কোমল। সেজন্য বোধহয় স্ত্রীলোকদের ভিড় কচিৎ ঝিকমিক করছে। নয়নতারার মনে নিজের জড়োয়র কণ্ঠীর কথা উঠলো। সেই কবে সেটা রানীমা দিয়েছিলেন নিজে হাতে তুলে।

আলোর দিকে আবার চোখ পড়লো তার। হ্যাঁ, উৎসবই তো। নয়নতারা কিছুক্ষণ যেন এই বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসায় ব্যস্ত রইলো যে মশালচিরা আন্দাজ করতে পারে কতটুকু তেলে আলোগুলো কতক্ষণ জ্বলবে, ফলে একবার জ্বেলে দেওয়ার পরে আলোগুলোকে আর উস্কে দেওয়ার দরকার হয় না।

উস্কে দিতে গিয়ে প্রদীপটা নিবে গিয়েছিলো। …কিন্তু তখন অনেক রাত হবে। দরজা খুলে অন্ধকারে রাজকুমারকে দেখে সে অবাক হয়ে গিয়েছিলো। রাজকুমারের চোখ দুটো আয়ত। কোথা থেকে একটা মদির সুঘ্রাণ উঠছে। সে নিজে বলতে পেরেছিল শুধু বসো, রাজকুমার, আমি আসছি। ফিরতে একটু দেরিই হয়েছিলো তার। ফিরে সে দেখেছিলো, রাজু তার বিছানাতে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্চিন্ত ঘুমের নিশ্বাসে বুক ওঠা-পড়া করছে। একটু কি হেসেছিলো তখন সে? আর-একটু গাঢ় হোক ঘুম বোধ হয় এই ভেবে সে প্রদীপের সামনে বসে ছিলো। তখন প্রদীপটা উস্কে দিতে গিয়ে নিবিয়ে ফেলেছিলো। বিছানায় গিয়ে রাজকুমারের অধিকার করা বালিশের কোণে মাথা রেখে সেও দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। কী অবুঝ, কী কিশোর, রাজকুমার!

ঢং করে একটা শব্দ হলো। তবে একটা মৃদু প্রতিধ্বনিও উঠলো। রাত একটা হলো পেটাঘড়িতে। কে একজন পানের অভাব অনুভব করলো। পান তখনো নিশ্চয় অনেক থাকতে পারে কিন্তু ততটা রাতে কে আনবে তা জোগাড় করে?

কিন্তু নবকুমার সব জায়গাতেই থাকে। নয়নতারা উঠে দাঁড়িয়ে বললো–দেখছি।

দরবার-হলের পিছন দিকের একটা ঘরেই পান সাজা হচ্ছিলো। আর সেদিকটা, যেন হঠাৎ লক্ষ্য করলো নয়নতারা, যেন জনশূন্য হয়ে এসেছে। ছিঃ নয়নতারা!

নাটক আর পূজার আকর্ষণ তখন দাসদাসীদেরও টেনে নিয়েছে। তা বলে একেবারেই কেউ নেই এমন নয়। দূরে বাঁধানো উঠোনের একপাশে একজন এখনই বঁটা নিয়ে ব্যস্ত। ওদিকের দালানের খিলানের থামের পাশে আর একজন প্রদীপের আলোয় সলতে পাকাচ্ছে, যদি দরকার হয়। পান সাজার ঘরের ঝাড়লণ্ঠনের বেশ কয়েকটা শাখা নিবে গিয়েছে। পানের সরঞ্জামের সামনে একজন দাসী বটে। আলো যেখানে লালমেঝেতে পড়ার ফলে রঙিন, সেখানে দাসীটি পা ছড়িয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ঘুমোচ্ছে। দরজার কাছে নয়নতারা বললো–শুনছো, ওরা পান চাইছে।

কথটা বলে নয়নতারা সরে এলো। তার ঠোঁট দুটিতে একটা হাসির ভাব ফুটলো। অনেকের ঘুমের ভঙ্গি হাস্যকর।

পূজার দিকটায় গুমোট, এদিকে বরং বাতাস চলছে। খিলান ধরে রাখা থামের আড়ালে টানা দালান, কিন্তু ওখানে পথটা মোড় নিয়েছে দুই দেয়ালের জোড়ে। আর জোড়ের কাছেই দেয়াল। সিঁড়িটা সন্ধ্যার মতো না-হলেও এখনো উজ্জ্বল–যেন খানিকটা জায়গায় দুধ ঢালা। এপারে ওপারে আলো কম। মাঝখানে ওটা যেন স্রোতের ব্যবধান। সাবধানে পার হতে হবে। ঝটিতি আলোটুকু পার হলো নয়নতারা। কিন্তু কোথায়?

একটা সিঁড়ি এখানে নিচের বাঁধানো চত্বরে নেমে গিয়েছে। থামের গায়ে হেলান দিয়ে কে একজন বসে সে-সিঁড়িতে। নয়নতারা চাঁদরের ঘোমটাকে কপাল মুখের দুপাশ ঢেকে ঠোঁটের কোণ পর্যন্ত এগিয়ে আনলো। সিঁড়ির লোকটি মাথা ফেরালো।

শাড়ি ঘিরে এই পশমিনা চাদর যা আর শাল নয়, মোটা বুনোটের যা আধো-অন্ধকারে গড়া থেকে পৃথক নয়। কিন্তু এ কি সত্য প্রত্যেকের হাঁটার ভঙ্গি পৃথক যাতে শুধু হাঁটা দেখে বোঝা যায় কে চলেছে? লোকটি সম্ভবত রূপচাঁদ। হয়তো এখনই জানতে চাইবে নয়নতারাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে কিনা। নয়নতারা দেয়াল ঘেঁষে সেই দেয়ালগিরি পার হয়ে এলো। ছি ছি, নয়নতারা!

চাদরটাকে একটু টেনে নিজের হাত দুখানাকেও ঢাকলো সে। সামনে একটা ছোটো দেয়াল। এখানে পথ বাছাই করতে হবে তাকে। সামনের দেয়ালটার গায়ে তার ছায়া পড়লো। মাথাটা একটু নিচু করে যেন নিজের ছায়াতে ডুবে দেয়ালটার বাঁ পাশ ঘুরে দেয়ালটাকে পার হলো সে, এবং তারই ফলে যেন উপরের মহলে যাওয়ার সিঁড়ির সামনে এসে পড়লো। উপরের মহল, যেখানে রানী এবং রাজকুমারের ঘরগুলি। রানীমা তো এখন পূজার সামনে।

কাচকড়ার দেয়ালগিরি সিঁড়িতে। কাঠের সিঁড়ি। কী অসম্ভব নির্জনতায় চওড়া, পিছল ধাপগুলো চকচক করছে। যাকে ল্যানডিং বলা হয় তার উপরে বেশ খানিকটা আলো। রাজকুমারের ঘরের দরজা ল্যানডিং থেকে একপাক ঘুরলেই। কিন্তু আলোটা কি তার ঘরের? জেগে আছে কেউ?

এ কি নিমন্ত্রিতদের জন্য পান আনতে যাওয়া?

নিশ্বাসে একটা অসমতা দেখা দিচ্ছে। কিন্তু তাই বা কেন, সে তো এখনো সিঁড়ির গোড়ায়। মানসিক শ্রম? নিশ্বাসের অসমতা তার অনুভূতির ভুল ভাবতে গিয়ে তার অস্ত্রে কোথাও কাঁপন লাগলো। বুকের মধ্যে রক্ত কেমন করছে, সেজন্যই যেন ঠোঁট দুটিও ঈষৎ ফুলে গেলো।

রাজু কি জেগে আছে? এখন তো অনেক রাত, নাকি তার ত্বকেই এটা কাপন। সে নিজেই লক্ষ্য করেছে, রাজু নাটক দেখতে যায়নি।

আসলে–আসলে এইসব বিচিত্র রকমের আলোই দায়ী। ঠিক যেন আলোও নয়। রক্তস্রোতে সেই আলো মিশে গিয়ে কী সব ঘটাতে পারে।

সিঁড়ির গোড়া থেকে ডাইনে কিছু দূরে একটা বড়ো জানালা, নাকি ফ্রেঞ্চ উইনডো বলে। নয়নতারা একটু তাড়াতাড়ি সেদিকে সরে গেলো। সে তো পান নিতে এসেছে। সে বড়ো জানলাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, আর তখন এক ঝাপটা ঠাণ্ডা বাতাস লাগলো তার কপালে।

কী আশ্চর্য! নিচে কাছারির আঙিনার এদিকে ওদিকে আলো এখন অনেক কম। সদরদরজার নিচে ঝাড়টা বেশ স্পষ্ট। কাছারির বারান্দার দেয়ালগিরি যেগুলো চোখে পড়ছে, প্রদীপের মতো মৃদু। এত সহজে এত তাড়াতাড়ি কেমন একটা পরিবর্তন হয়। রাজবাড়ির দেয়ালের আলো, কাছারির দেয়ালের আলো, সদরদরজার আলো সব মিলে আলোর একটা জাজিম বিছানো ছিলো। যেন বিভিন্ন উৎসের আলো খানিকটা গিয়ে থেমে যাচ্ছে, মধ্যে মধ্যে অন্ধকারের গলিপথ।

জানলাটার নিচে দুধাপ সিঁড়ি।

নয়নতারা নিজের গলার মধ্যে কী অনুভব করলো। যেন তা বাষ্পের মতো, যা থেকে জল হয়। হঠাৎ তার মনে হলো, কেটের অভিনন্দনই তাকে এমন কষ্ট দিচ্ছে। তার বলা উচিত ছিলো, মিথ্যা। আর বুকের মধ্যে যে-চাপ সে তো উপোসের জন্য। মিথ্যা নয়, রাজকুমারের বিয়েতে যে-উৎসব হবে এই উৎসব দিয়ে তার ধারণাই করা যায় না।

উপোস রানীমাও করছেন রাজকুমারের কল্যাণ কামনায়। অনেক বেলায় সে একবার রানীমার চোখে পড়ে গিয়েছিলো। বলেছিলেন, মুখ শুকনো দেখছি, খাওনি তুমি? সে বলেছিলো, রাত হয়ে গেলো, এখন আর খাবো না ভাবছি।

দুটো বাজলো দেউড়িতে। এরই মধ্যে! কৌতুকের তো! শব্দ লক্ষ্য করে অস্পষ্ট হলেও নয়নতারা দেউড়ির সেই বরকন্দাজকে দেখতে পেলো যে ঘড়ি পিটলো।

কিন্তু তিরস্কারে কার না চোখে জল আসে?

ওরা বোধ হয় থিয়েটারের দল যারা মঞ্চের সামনে নেমে সব জিনিসপত্র গুছিয়ে তুলছে। তাদের শরীরের উপরের দিকটায় কিছু আলো।

তিরস্কার কোথায়? সেই যে ব্রহ্মঠাকুরানী একটা হাসির অঙ্কের ধাঁধা পেতেছিলো।

লোকগুলোর, দ্যাখো, পিঠে আলো পড়ছে। সুতরাং ওই ছোটো ছোটো দলগুলো যা চোখে পড়ছে, যারা দেউড়ির দিকে চলেছে, তারা উৎসব শেষে ঘরে ফেরার দল। দেউড়ির বাইরেও এই রাতেও তাহলে লোক চলেছে। তাদের কেউ কেউ নিশ্চয় সার্বভৌমপাড়ার পথ দিয়ে যাবে।

ফ্রেঞ্চ উইনডোর নিচে সিঁড়িতে পা দিলো নয়নতারা। একটু অসুবিধা হয়ই, ধাপগুলো স্বাভাবিকের চাইতে উঁচু। কিন্তু মাটিতে পা দিয়েই সে তরতর করে হেঁটে চলতে পারছে। কোনো একটা দলের পিছনে পৌঁছে, দলটার পাশ কাটিয়ে একটু তাড়াতাড়ি হেঁটে তার আগের দলটিকে ধরে, এমন করে একটু তাড়াতাড়ি চলে। শাড়ি-চাঁদরে সে তো নিজেকে ভালো করেই ঢেকে নিয়েছে, সে নিজের বাড়িতে পৌঁছে যেতে পারবে। হলোই বা শেষ রাত।

প্রতিমার সামনে রাখা ঘিয়ের প্রদীপের সারিতে তন্ত্রধার পলতেগুলোকে উস্কে দিলো। পূজা এখন শেষ হতে চলেছে, বোধ হয় যজ্ঞ শুরু হবে। পুরোহিতের কিছু পিছনে যাঁকে প্রতিমার মুখের দিকে চেয়ে স্তব্ধভাবে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে, তিনি রানীমা-ই। এখানে আসবার আগে স্নান করেছিলেন। চুলগুলো ভিজে ছিলো, নির্জনতায় এখন ঘোমটার পাশ দিয়ে সেগুলোকে সামনে এনেছেন। সে চুল অজস্র, আসনের উপরে লুটোচ্ছে।

রানী ভাবলেন : ইনি মহান অর্থাৎ অনন্তকালের প্রতীক। কোটিকে কোটি দিয়ে গুণ করেও অনন্ত হয় না। যাহা হয় তাহা কালেই হয়। কালের বাইরে কিছু হয় না। হওয়া অর্থে জন্ম, বেড়ে ওঠা, মৃত্যু, মিলন, বিচ্ছেদ। আমাদের জ্ঞান, বুদ্ধি, অনুভূতিতে ইনি সীমাযুক্তা কিন্তু অনন্ত ব্যাপ্তিতে প্রবাহিতা, সুতরাং জ্ঞান ও অনুভূতি উভয়ের প্রতি উদাস। সুখ কী? দুঃখ কী?

পুরোহিত ঘণ্টা বাজালো মৃদু শব্দ করে। ঝুঁকে পড়ে একমুঠো ফুল নিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো। দ্রুত অস্ফুট স্বরে কিছু বলছে, তার বুকের পাশ দুটো যেন ফেঁপাচ্ছে। দ্যাখো তন্ত্রধারকের গাল বেয়ে ধারা। রানীমা বলেছিলেন বটে, আমার হয়ে অঞ্জলি দিও। সে কি ভয় পাচ্ছে? ফুলের সঙ্গে সঙ্গে ফুলকে প্রতীক করে নিজের চেতনার সীমা দ্বারা আবদ্ধ সব কিছুকে সীমাহীনতায় নিমগ্ন করার ভয়?

.

০৮.

নয়নতারা তার বাড়ির কাছাকাছি এসে একটু আস্তে চলতে শুরু করলো। মৃদু ক্লান্তিও বোধ করছে সে। রাত জাগার ক্লান্তির সঙ্গে উপবাসের লঘুতা। সার্বভৌমপাড়ার এই পথেও দূরে দূরে দু-একজন লোক, গাছের ছায়ায়, আলো-অন্ধকারে চলেছে। শেষ রাতের হিমেল বাতাসে শেষ রাতের মলিন চাঁদের আলোতে পথের ধারের দুএকটা পশ্লব মৃদু মৃদু নড়ছে।

একটু চমকে গেলো সে। একটা মাঝারি চেহারার পালকি নিঃশব্দে, বিনা হাঁকে কিন্তু অস্বাভাবিক দৌড়ে, যেন তার গায়ে এসে পড়তে পারে, সে সরে দাঁড়ানোতে তার পাশ কাটিয়ে উড়ে গেল যেন। একজন ছিপছিপে চেহারার বরকন্দাজই যেন পালকির ওপাশে দৌড়চ্ছে।

নয়নতারা কৌতুক বোধ করলো। কৌতূহলও। এ পথে এখন কে এমন যায় পালকিতে? হতে পারে কোনো জোতদার যে আমন্ত্রণ সেরে ফিরছে। কিন্তু মজা দ্যাখো, হুমহাম নেই বেহারাদের। অবশ্য সে শুনেছে, জোতদাররা রাজবাড়িতে সম্মান দেখাতে রাজার নিজগ্রামে যানবাহনের ব্যবহারে বাহুল্য করে না।

কৌতূহল ও কৌতুক নয়। বিদেশী বাকরীতিতে, বিস্ময় ও ভয়ই তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। সে নিজের বাড়ির দরজায় পা দিয়ে দেখলো, পালকিটা আরো এগিয়ে তার বাড়ির উঠোনে দাওয়া ঘেঁষে নামানো হলো। মলিন নিষ্প্রভ আলো সত্ত্বেও পালকির চতুষ্কোণ গাঢ় ছায়া, বেহারাদের ছায়া কালো ঘন-সন্নিবিষ্ট দীর্ঘতা-চোখের ভুল হতে পারে না। আগের চিন্তার ছায়া পড়লো মনে, কোনো অর্থশালী জোতদার? সঙ্গে সঙ্গে কী এই একটা অনুচ্চারিত শব্দ প্রতিস্পর্ধায় তার সমস্ত চেতনায় ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো।

কিন্তু অন্যপক্ষেরও চোখ ছিলো। সেই ছদ্মবেশী বরকন্দাজ অত্যন্ত দ্রুত নিশব্দে এগিয়ে এলো। সে খুক করে কাশলো। তারপর যেন অব্যক্ত কান্নার শব্দ করলো।

রূপচাঁদ? নয়নতারা বিস্মিত প্রশ্ন করলো।

মা, আপনাকে মা-জি বলেছি সেই কতদিন আগে।

–বেশ তো! তাতে কী হলো?

–ভালোই লাগছিলো। বললেন, চল তো সব ঘুরে দেখি। এ-ঘর ও-ঘর, এখানে আলোর নিচে, ওখানে ছায়ায়, এ মহল, সে মহল, সঙ্গে বেড়াচ্ছিলাম, মনে হলো হাসছেন, মনে হলো কিছু খুঁজছেন, ক্রমশ রেগে যাচ্ছেন, এক জায়গায় হোঁচট খেলেন, তারপরে বললেন, তুই জানিস না, হতভাগা, আমি একা থাকতে পারি না? তারপর বললেন, কোথায় সে? আরো রেগে বললেন, আধ ঘণ্টার মধ্যে যদি তাকে আমার ঘরে না-আনতে পারিস, কাল সকালে তোর মুখ যেন দেখি না।

রাজকুমারের কথা বলছ, রূপচাঁদ?

–অমন রাগের কথা আমি কখনো শুনিনি। মনে হলো, ভয়ঙ্কর রকমে জোর খাটাতে চাইছেন।

-তুমি পালকি এনেছো কেন? গ্রাম ছাড়া হওয়ার ভয়ে?

তর্জন-গর্জন নয়, কিন্তু সে রাগ এতটুকু মিথ্যা নয়।

নয়নতারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো, তারপর কী ভেবে পালকিটার দিকে এগিয়ে গেলোলা। কিন্তু রূপচাঁদই এগিয়ে এসে পালকির দরজা আড়াল করে দাঁড়ালো বরং।

বললো, মা-জি, মনে হলো বে-এক্তিয়ার।

-তুমি যেতে নিষেধ করছো?

–সাধ্য কী আমার? কী সর্বনাশ না-জানি হয়! আমি বরং গ্রাম ছাড়া হই এই রাতেই।

নয়নতারা চাপা গলায় প্রশ্ন করলো–খুব মদ খেয়েছেন নাকি? সে এগিয়ে গিয়ে মৃদু আলোতে পালকির দরজার চকচকে কাঁচের হাতলে হাত রাখলো। রূপচাঁদ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো৷নয়নতারা নিজেই পালকির দরজা সরিয়ে হেঁট হয়ে পালকির গদিতে গিয়ে বসলো। দরজা টেনে দেওয়ার আগে বললো–পালকি তুলতে বলল রূপচাঁদ।

কাউকে কাউকে অভ্যাসবশেই মাথা খাটিয়ে চলতে হয়। রাতের শেষ প্রহরে রাজবাড়িতে পালকি করে পৌঁছলে বহু দূর দূর ছড়ানো গল্পের একটা উপকরণ হবে। গল্পটা কী হবে সেটাই আসল কথা। সে পালকির দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে রূপচাঁদকে খুঁজলো। রূপচাঁদ কি লজ্জায় পিছিয়ে পড়েছে? নয়নতারা লজ্জার মতোই কিছু অনুভব করলো, যাকে বরং গ্লানি বলা উচিত। রাজবাড়ির হাতার যে কোনো আলো-নিবে-যাওয়া নির্জন জায়গায় নেমে পালকি আর রূপচাঁদকে বিদায় দেওয়া কি ভালো হবে? রাজবাড়ির সেই জায়গাটা রাজকুমারের মহল থেকে যত দূরে হয় ততই ভালো। রূপচাঁদের কথাতেই প্রমাণ। ব্যাপারটাকে কী অর্থে নেওয়া সম্ভব।

রূপচাঁদের মনও চিন্তামুক্ত ছিলো না। যেমন সে চিন্তার ভারে পিছিয়ে পড়ছিলো তেমন চিন্তার চাপেই এগিয়ে এলো। তখন রাজবাড়ির সদর দরজায় ঝুলানো ঝাড়ের আলো পড়ছে বেহারাদের মুখে।

বেহারারা অদ্ভুতভাবে নিঃশব্দ, তাই রূপচাঁদের চাপা গলা শুনতে পেলো নয়নতারা। আপনি কি পূজার আঙিনায় নামবেন, মা-জি?

এটাই কি ভালো হয়? বেচারারা যদি তাদের অভিজ্ঞতার গল্প করে, বলবে, পূজায় কী দরকার পড়ায় সার্বভৌমপাড়া থেকে নয়ন-ঠাকরুনকে আনতে হয়েছিলো। নয়নতারা ভাবলো, এটা কি একটা ধোঁকা তৈরী করছে রূপচাঁদ? কিংবা সে কি ভাবছে, তার এখন রানীমার কাছে আশ্রয় নেওয়া উচিত? পালকি নিশব্দ হলেও দ্রুতগতি। কী গ্লানি!

নয়নতারা একটু হাসলো যেন, বললো, বলো কী রূপচাঁদ? সেখানে পূজার ভিড়ে কোথায় কোন কাজে আটকে পড়বো। গলার কাছে একটা বাধা। সেটাকে গিলে ফেলে সে বললো–গাড়ি বারান্দা থেকেই রাজকুমারের মহল কাছে হবে।

গাড়িবারান্দার আলোটা যেন বাসি। গাড়ি বারান্দা থেকে হল, হল পার হয়ে ঢাকা অলিন্দ দিয়ে সিঁড়ির ঘর, এখন সব জায়গাতেই আলো কম। আলো থেকে দূরে দূরে যে অন্ধকার তাই বরং গুণবান, তার স্নিগ্ধতা আছে।

সিঁড়ির মাথায় চৌকোণ জায়গাটা যাকে ল্যানডিং বলা হচ্ছে সেখানে একটা আলোর পাত। নয়নতারা সেখানে পৌঁছতে রাজচন্দ্র বলে উঠলো–কে নয়ন? কথা ছিলো।

এখন নয়নতারার অবাক লাগলো যে তার এত নিশব্দ চলার শব্দও রাজকুমার শুনেছে। এই রাতে, রাত যখন শেষ হতে চলেছে, সে জেগে আছে! কিন্তু এসবের আড়াল থেকে তার মনে হলো, কী ঘটেছে যে ঘুমোত পারেনি? কী আশায় জেগে আছে?

একটু সাহসের সঙ্গে আধখোলা দরজাটার কাছে গিয়ে সে বললো–এই দেখুন, সকলের মধ্যে থেকে যদি এমন করে অনুরোধ করবেন?

রাজচন্দ্র বললো, রাজকুমারের মনে থাকে না। কী করি? তুমি যে আমার নয়ন, বড়ো লাজুক। অথচ নিচে ওই যে জনারণ্যে যার কথা হচ্ছে সে কিন্তু বেশ সাহসিকা।

নয়নতারা বললো–ঘুমোননি কেন?

তোমাদের এই উৎসবের এত সোরগোল! এই বলে রাজচন্দ্র সরে এসে নয়নতারার মুখোমুখি দাঁড়ালো, বললো–বাহ কী সুন্দর এই চুল কয়েকটি!

নয়নতারা ভাবলো, কার কথা বলছে রাজু? কে যথেষ্ট সাহসিকা?

রাজচন্দ্র বললো–আর দ্যাখো তো এই রূপসীর কপাল!

নয়নতারা বললো–আপনি কি কোনো পালাগানের কথা ভাবছেন, রাজকুমার?

রাজচন্দ্ৰ হেসে বললল, তুমি কী আজও আবার মনে করিয়ে দেবে বিদ্যা নামে সেকন্যে সাধারণ মানুষী নন?

-আপনি ওরকম করে কথা বলবেন না। আমি বলছিলাম, আজ নিচের চত্বরে নাটক হয়েছে। পালাগান হয়নি।

নয়নতারা ভাবলো, আশ্চর্য নয় কি যে জানলার নিচেই এত সোরগোল তুলে, ভালো হোক মন্দ হোক, একটা নতুন কিছুহলো যার নামনাটক, অথচ রাজকুমার যেন অন্য কোথাও থেকে এইমাত্র এলো! যেন রাজবাড়ির কোথাও ছিলো না!

রাজকুমার বললো–হয়নি? না হোক। কিন্তু তা বলে তোমার চুলগুলি যদি এই রাতের আলোয় কপালে লতিয়ে সুন্দর দেখায়, কেউ কি বলবে না?

–কেউ না বলে, তুমি বলো। না হয়, কাল কোথাও চলো, বেড়াতে যাবো। কিংবা কাল এই প্রাসাদের নানা নির্জন ঘরের যে কোনো একটিতে বসে আমরা সারাদিন গল্প করবো।

কিছু বোঝ না, তুমি নয়ন। আজ তোমাকে দরকার। বরং ভোরবেলায় কাক ডেকে উঠতে যখন তোমাদের পূজার সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের রাত্রি শেষ হবে, রানীমা ঘুমোত যাবেন, তখন তাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে তুমিও বাড়ি যেয়ো। বাহ, কাছে এসো।

নয়নতারা নিজের হাতের দিকে চোখ নামালো। কখনো কখনো আঙুলগুলো অশান্ত হয়।

রাজু ল্যানডিং-এর ব্যানিস্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। বললো–তোমার প্রথমবারের উৎসবের কথা মনে আছে নয়ন? সে হাসলো যেন। সকালে উঠে অবাক! কিংবা তখন উঠিনি, ভাবছি এ কোথায়? দেখি, পাশে ঘুমিয়ে আছো তুমি। কী করে যে হয়? একটা রাত ঘুমিয়ে থাকলাম, একটা কথাও হয়নি! কোথা থেকে সুঘ্রাণ আসে?

কথার কি নিজেরই জন্মানোর ক্ষমতা আছে? নয়নতারা বললো, শুনেছি, এক রকম মৃগের ওই দশা হয়।

কিন্তু কথাটা বলে ফেলেই পিছিয়ে এলোয়নতারা, যেন অদৃশ্য কোন গণ্ডি তার পায়ের আঙুলে মুছে গিয়েছে। যেন অদৃশ্য এক পর্দা কিছু সরে গেলো হাত লেগে। এরকম অবস্থায় ভয় ভয় করে ওঠে।

কিংবা খানিকটা ভয় তার ছিলোই, যেজন্য রাজচন্দ্রকে সে ভালো করে দেখেনি। তার মনে হলো, এমন মৃদু সুরার গন্ধ ছিলো সেই প্রথম উৎসবের রাত্রিতে রাজুর মুখে! চোখের প্রান্তগুলো লাল হয়ে উঠেছে। আর যেন টালমাটাল করছে দৃষ্টি। পায়ের ডিম-ছোঁয়া ঢিলে জোব্বা, ঢিলে পালুন, চটি, ধোঁয়াচ্ছে এমন পাইপ বাঁ হাতে, একগোছা চুল কপালের উপরে। বাঁ পায়ের পাৎলুনে রক্ত!

এসো নয়ন, বললো– রাজু।

-কোথায় যাবো? নয়নতারা ভাবলো, রাজকুমরের কাছে গিয়ে কি তাকে অনুরোধ করা যায় ঘুমোতে যেতে?

রাজচন্দ্র ল্যানডিং বরাবর একটু সরলো। এমন কোনো কোনো জায়গা আছে যেখানে দাঁড়ালে কুয়োর গোড়ায় সিঁড়ির শেষ ধাপটা চোখে পড়ে। সেখানে কি কাউকে চোখে পড়লো? কেউ কি সেখানে ক্লান্তিতে বিবশ হয়ে মুখ ঢেকে বসে আছে?

রাজু বললো–এখন আর আমার কিছু দরকার নেই, রূপচাঁদ। ওদিকেও পুজো শেষ হতে চললো। একবারে স্নান শেষ করে পুজোর কাছ থেকে ঘুরে এসে ঘুমোবো। তুমি ওদের ভোররাতেই গরম জল দিতে বলল।

রাজু ব্যানিস্টার থেকে সরে এলো। তার কি তখন পা টললো?

নয়নতারা বললো–কোথাও যাবে বললে?

রাজু এগিয়ে গিয়ে তার শোবার ঘরের দরজা খুললো। ঘরে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে তামাকের থলে বার করতেই নয়নতারা বললো–খুব হয়েছে! ভালো হয়েছে বাগচী মাস্টারের শিক্ষা। কিন্তু এখন অনেক রাত। রাজু পাইপ থেকে ভস্মাবশেষ গালিচার উপরেই ঢালছিলো, হাত বাড়িয়ে পাইপটা নয়নতারার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো–নাও।

রাজকুমার হেঁটে গিয়ে চেয়ারে বসলো। পিছন দিকে যেন আর একটু ঘেঁষে বসলো। কিন্তু এই চোখে কি ঘুম আসে? ইস্পাত হলে তা সাদা হতে হবে এমন নয়, নীলাভ হতে পারে। প্রান্তগুলো লাল, কোলে কালিমা।

নয়নতারা বললো–এই তামাকই ঘুম তাড়িয়েছে।

রাজু চোখ মেলে চাইলো। নয়নতারাই বরং চোখ নামালো। রাজু হাসলো। অনুচ্চ, কিন্তু তা যেন সেই গ্রামের তুলনায় তরল। যেন কয়েকটি কাঁচের গুলি একসঙ্গে গড়িয়ে গেলো। সে বললো–বলো এখন কী করি? কিংবা দ্যাখো আমাদের দুজনকে ঘিরে কেমন নিস্তব্ধ অগাধ রাত্রি এই মহলে। তুমি কি ওই দেয়ালগিরি দুটোকে নিবিয়ে দেবে?

নয়নতারা জিজ্ঞাসা করলো–তুমি এতক্ষণ কী করছিলে, রাজকুমার?

রাজকুমার বললো–সে এক ভারি মজার ব্যাপার! রূপচাঁদকে সঙ্গে নিয়ে রাজবাড়ির নিরাপত্তা পরীক্ষা করতে বেরিয়েছিলাম। (মুখটা কঠিন হলো যেন)। রূপচাঁদ হয়তো গুলি খেয়েছিলো, আমি মদ ছাড়া কিছু খাইনি। জানো, একবার রূপচাঁদকে জিজ্ঞাসা করলাম, বল তো কোন ঘরটা মানায় নয়নকে?

-কিন্তু তার জন্য রাত জাগতে হবে কেন?

বাহ, অন্যান্য দিন দেখার সুবিধা কোথায়? লোকজনে আসবাবপত্রে গিস্ গি করে? জানো, অনেক কিছু জানতাম না এই রাজবাড়ির। জানো, রূপচাঁদ ক্রীতদাস? জানতে না তো? রাজু হাসলো।

-এতে হাসির কিছু নেই।

নেই? জানো রূপচাঁদের উপরে খুশি হয়ে বললাম, বাগচীমাস্টার বলেছে আইনে আর ক্রীতদাস রাখা যায় না। তুই তোর লখনউ-এ ফিরে যা। তাতে ও যেন কাদলো। নাকি আমি ভয় পেলাম। ওর চোখ দুটো ভিতরে ঢুকে গেলো যেন মড়ার খুলিতে। বললো, রাজবাড়ির বাইরে যেতে তার খুব লজ্জা করবে। আচ্ছা, আমি ঠিক উচ্চারণ করছি তো কথাগুলো?

এ রকম ঠাট্টা আমার ভালো লাগে না, রাজকুমার। আমাকে কি তোমার কাছে যেতে দেবে? পা-টা একটু দেখবো।

-আসলে রূপচাঁদ ঠিকই বলেছে। আমাকে যদি কেউ রাজবাড়ির বাইরে যেতে বলে আমারও লজ্জা করবে।

-তুমি কি আজকাল রূপচাঁদের সঙ্গে তুলনা করছে নিজেকে?

কী যে বলো! রূপচাঁদ গুলি খায়! উ-উ, লাগে!

–একটু স্নানের ঘরে এসো। পা-টা ধোয়া দরকার।

-আচ্ছা, নয়ন, তেলাপোকাকে শুড় নাড়তে দেখেছো? আমার নিজেরই মনে হলো আজ তা দেখে-পণ্ডিতরা বলেন, তা করে নাকি ওরা বুঝতে চেষ্টা করে কোথায় আছে।

কথাটা অসংলগ্ন হলো। এই শীতের ভোররাতে তোমার তেলাপোকা আবিষ্কারে। উৎসাহ বোধ করছি না।

রাগ কোরো না। আমি রাজবাড়িটাকে মেপে দেখছিলাম মনে মনে। রাজকুমারের দৃষ্টিটা হঠাৎ যেন গম্ভীর হলো। সে বললো, গোড়াতে ছিলো না। পরে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ মনে হলো, আমার মা, আমার নয়নতারা, আমার গ্রাম, আমার বাড়ি তার মধ্যে ঠিক যেন আমি কোথায় বুঝতে পারছিলাম না। জানো, আর বিদ্রোহ হবে না।

নয়নতারা বললো–তাও ভালো, আমি ভাবি নতুন রানী এলে তার জন্য প্রাসাদের কোথায় কী বদলাবে তাই দেখতে ঘুরছিলে।

মধুর রসিকতাটার উত্তর দিতেই যেন অভ্যাসবশে মুখটা তুলো রাজকুমার, কিন্তু উত্তরের মুহূর্তটা পার হয়ে গেলো।

নয়নতারা ভাবলো, কিছু কি দুশ্চিন্তা করতে হবে রাজকুমারের জন্য? এগুলো কি নেশার ঘোরের গোপনে জেগে ওঠা কোনো ব্যথা?

নয়নতারা বললো– রাজু, আমি তোমার বিছানায় বসলে কি তোমার ঘুম হবে?

রাজচন্দ্র বললো–না বোধ হয়। তার চাইতে চলো তোমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিই। অন্ধকারে খানিকটা হাঁটা হবে।

দরজায় এখন ইংরেজি কায়দায় গা-তালা। নয়নতারা চাবি ঘুরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। বললো–পকেটে হাত দিচ্ছো? তামুক খেতে ভালো লাগবে?

না, রাজকুমার বললো, গলার ভেতরটা যেন শুকিয়ে উঠেছে।

–একটু মদ খেলে কি হয়? কিংবা রাত শেষ হতে এখনো দুঘণ্টা বাকি।

-আমরা বরং…রাজু উঠলো। একটা জানালার কাছে গিয়ে সেটাকে খুললো। ফিরে দাঁড়িয়ে হাসলো। বললো, এমনকী রানীমার এই জন্মতিথি-উৎসবের মূলেও

নয়নতারা বললো–ঘটনাটা আমি জানি। তুমি আমাকে জানতে দিয়েছে। কী ভাবছে বুঝতে পারছি না। তোমার এই জবরজং জোব্বাটা খুলে দিই?

-তুমি তো জানবেই। তোমাকে বলতে পেরে ভারমুক্ত হয়েছিলাম। আর কী লজ্জা, বলল, তুমি সেই ভার নিয়ে একজনকে রাজকুমার করে ফেললে।

নয়নতারা বললো–এই উৎসবটার উৎসব হিসাবেও মূল্য আছে। সে হালকা সুরে বললো। প্রিয়জনের কল্যাণে অনেক কিছু করতে হয়। জানো, সেসব শুনে আমিও স্থির করে রেখেছি, মানুষের পানীয় জলের জন্য একটা পুকুর কাটিয়ে দেবো।

রাজচন্দ্ৰ নয়নতারার দিকে সরে এলো। যেন নয়নতারা কী বললো– তা ভালো করে বুঝতে! বললো– হেসে-এই, দ্যাখো, নৈনা, তুমিও একজনের পাপ স্খলনের চেষ্টায় আছে। একটি প্রাণ হরণ করে অন্য অনেক প্রাণ পোষণ করলে শোধ হয়?

নয়নতারা ভাবলো, এখনই রাজকুমার বললো, আর কোনো বিদ্রোহ হবে না। এমন জায়গায় কথাটা বলা হয়েছে যে মনে হবে আর একটা বিদ্রোহ হলে সে নিজেকে খুঁজে পায়, রাজবাড়ির ঘরে ঘরে নিজেকে খুঁজতে হয় না। আর তখন, নয়নতারার মনে পড়লো, সেই কিশোর রাজুকে সে বলেছিলো, যেহেতু রাজা অনেক আত্মসম্মানের প্রতীক, সেহেতু রাজাকে নিজের আত্মসম্মান রক্ষায় নির্দয় হতে হয়। সে ভাবলো, মরেলগঞ্জের কটুভাষী সেই তহশীলদারকে হত্যা করার ব্যাপারটাই তো রাজকুমারের মনে। তা হতেই পারে। এই জন্মতিথির উৎসব তো সেই নরহত্যাকে আলোর আড়ালে লুকিয়ে ফেলতেই শুরু করা হয়েছিলো। কিন্তু তাকে কি নিরর্থক আর ভয়ঙ্কর বোঝা বলে মনে হয়, যদি একজন নিজেকে আর রাজা মনে করতে না পারে! সে মনে মনে বললো, ঈশ্বর সাক্ষী, আমি তোমাকে ঠকাই নি। তখন সেই বিদ্রোহের আয়োজনে তোমাকে রাজকুমারই মনে হতো।

ব্যাকুল হয়ে বললো–রাজু, এসব তুমি ভাবছো কেন? রাজু।

নয়ন।

নয়নতারা মুখ নামালো। রাজু হাসলো। বললো–নয়ন, একবার এক বোকাছেলে তোমাকে নিজের আংটি দিয়ে তোমার আংটি নিয়েছিলো। মুখ ভোলো। এই জানলাটার পাশে আসবে, নয়ন?

নয়নতারা বললো–রাজু তোমার জোব্বাটা খোলো। বিছানায় এসো। আমি চুল খুলে দিচ্ছি।

খাটের বাজু ধরে দাঁড়ালো নয়নতারা। তারপর সে বিছানার এক প্রান্তে বসলো। রাজচন্দ্র তার সামনে এসে দাঁড়ালো। কোথা থেকে মুখে একটা হালকা হাসি আনলো, বললো–এ কী নয়ন? তোমার চোখের কোণগুলিতে মুক্তো? এসব কথা তুলে আমি অন্যায় করেছি। আমাকে মাপ করো। জানো, একা একা আমার মনে হতে লাগলো, সেই একটা মানুষ একটা গুলিতে মাটিতে পড়ে কেমন হাহাকার করেছিলো! তুমি দেখো, তুমি দেখো, এই রাত্রির প্রভাব রাত্রি শেষ হতেই শেষ হবে। তুমি মুখ তোলো, ওই জল আমার সহ্য হয় না।

নয়নতারা বললো–তোমার মদ তো এ ঘরেই থাকে, কোথায় আছে বলো।

-এঃ? রাজচন্দ্র বললো।

নয়নতারা ভাবলো, সারাদিন নির্জলা উপবাস করেই বোধ হয় তার এরকম বোধ হচ্ছে। কেমন যেন ছায়া-ছায়া নয়? অথচ দ্যাখো, রাজকুমার বিদেশী এই জবরজং পোশাকের দু পকেটে হাত দিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে। এমন তো নয় যে সে ভুলে যাবে কী করে শেষ রাতে সে নিজে এ ঘরে এসে পৌঁছলো। এটা কি এক অভিনয়ের পোশাক? কিংবা কিংবা এটাই কি একমাত্র কিছু যা রাজকুমারকে এই বর্তমানের, এই বাস্তবের অস্তিত্বে ধরে রাখছে? এমন উপবাস ভালো হয়নি। ভয় ভয় করে উঠলো তার। রানীমা কিংবা পিয়েত্রোর সম্ভাব্য বিদ্রোহের নায়ক, তার নিজের এক কাল্পনিক সিংহাসনের রাজার অস্তিত্ব থেকে সরে এসে রাজকুমার কি সত্যই অতীত এবং বায়বীয় হতে পারে? এগুলোর চাইতে বিষণ্ণ আর কী আছে?

উৎসবের রাত্রিতে তখন নিদ্রা ও বিশ্রামের শ্লথতা লেগেছে। জানলার নিচে তখন আলোর তুলনায় কোমল শীতল অন্ধকার। কালো আকাশে অজস্র হীরার টুকরার মতো তারা। হঠাৎ আবার সাড়াজাগানো ঢাকের শব্দ কানে এলো। রাজচন্দ্র বললো–দ্যাখো, দ্যাখো নয়ন, এ আবার কী জুলুস!

মশাল, পুরোহিত, ঢাক–কোথাও যাচ্ছে, সদরদরজার কাছে দেখা গেলো।

নয়নতারা উঠে এলো। রাজচন্দ্র বললো– বুঝেছি, শেয়ালকে দিতে যাচ্ছে। তাহলে যজ্ঞ শুরু হতে দেরি নেই। জানো, নয়ন, এবার উৎসবে আমার কী লাভ? রানীমা এবার আমাকে কী উপহার দিচ্ছেন? বিশেষভাবে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ একজন সবসময়ের সহচর থাকবে। নাকি প্রাইভেট সেক্রেটারি। ছোটোলাট, বডোলাট, জঙ্গি লাট সকলেরই নাকি একজন করে থাকে। রানীমার প্রস্তাব। নায়েব-ই-রিয়াসত মন্তব্যের জন্য আমাকে পাঠিয়েছিলেন। লিখে দিলাম, আপত্তি নেই।

নয়নতারা ভাবলো, কী বিষঃ রাজু! আর এ বিষণ্ণতার মধ্যে দ্যাখো ঠাট্টা যেন অপমানের মতো।

রাজু বললো–নয়ন, আমাকে মার্জনা করো। চলো না-হয় পুজোর কাছে।

নয়নতারা ভাবলো, আর আমি নিজে সময় নিয়ে অঙ্ক কষছি যেন কোন ব্রহ্মা-ঠাকরুনের অঙ্কের হিসাবে পৃথিবী চলে। এদিকে এখনই ভাবছিলাম (অনুভূতিকে ভাবনা মনে হলো), রাজু সময়ের তলায় তলিয়ে গেলো, আমরা আর-সকলে যখন অনায়াসে ভাবছি।

কিন্তু সে হাসলো, যেমন করে সেই পারে। উঠে দাঁড়াতেই তার চুলগুলো পিঠের উপরে ছড়িয়ে পড়লো। রাত জাগার কাজল চোখে, চোখ দুটো ঝিকমিক করলো। বললো, তুমি এখন ঘুমোবেনা বুঝতে পারছি। আমি এখন পুজোর কাছে যাবো। তুমি আসবে? কিংবা কিছুক্ষণ পরে তোমাকে ডাকতে পাঠাবো কাউকে।

সে চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুললো।

 ১১. ইতিহাসের এই এক নিয়ম

একাদশ পরিচ্ছেদ

০১.

ইতিহাসের এই এক নিয়ম, তার উপকরণ না-পেলে সংক্ষেপে বলা ভালো। আমাদের অনুমান ইতিহাস-কথাতেও সে রকম প্রথাই থাকা উচিত। মরেলগঞ্জে এবং রাজনগরে এক বিদ্বেষ-প্রীতির টানাপোড়েনের সম্বন্ধ তৈরী হচ্ছিলো। কিন্তু সেই শীতে রানীমার জন্মতিথিতে ডানকানের পক্ষ থেকে কেউ না আসলেও বিদ্বেষটা না বেড়ে প্রীতির ভাবটাই দেখা দিয়েছিলো যেন। দিন চার-পাঁচ পরে ডানকানের এই উপেক্ষার কথা না তুলেও নায়েবমশাই বলেছিলেন, ওকে চাপে রাখো। কেন তা হলো না তা নিয়ে অনেক গবেষণা চলতে পারে, কিন্তু সঠিক যেটা জানা যায় তা বিশেষ সংক্ষিপ্ত। যেমন জন্মতিথির এক সপ্তাহ গেলো না। নায়েবমশাই অন্য অনেক দপ্তরের কাজের মধ্যে ল-মোহরারের দপ্তর দেখতে দেখতে বলেছিলেন, মনোহর সিং-এর সেই টেরেসপাসের হামলার কী হাল? গৌরী বলেছিলো, আজ্ঞে, আপনি ঢিলে দিতে বলেছিলেন। নায়েব বললেন, আর কেন? তদ্বির করো, সমন বার করাও। কিন্তু সে সকালেই বাড়ি যাওয়ার মুখে যখন, তার নিজের ভাষায় বুড়ো হাড়ে রোদ লাগাতে তিনি বারান্দায়, দেখলেন, মরেলগঞ্জের ফিটন ঢুকলো রাজবাড়ির দরজায়। অবাক কাণ্ড! ফিটন থেকে নামলো মনোহর সিং। এদিক ওদিক না চেয়ে সোজা, চলে গেলে দেওয়ানকুঠিতে। এখন তো সকালের কাছারি ভাঙতে আরো আধঘণ্টা। রোদে রাখা চেয়ারটায় বসেই গৌরীকে ইঙ্গিত করলেন। মনোহর সিং আধঘণ্টা বাদেই ফিরে গেলো। গৌরী দেওয়ানকুঠিতে গেলো। হরদয়ালকে জানালো নায়েবমশায় জানতে চাইলেন, যে এসেছিলো সে সত্যি মনোহর সিং কিনা। দেওয়ানের কাছে গৌরী জানালো, মনোহর সিং কাঁদছিলো! তার বিবাহ একাধিক, কিন্তু ছেলে একটিই। সে নাকি কলকাতায় লেখাপড়া করতো। কী করে কার পাল্লায় পড়ে ক্রিশ্চান হয়েছে কিংবা হবে। আমাদের দেওয়ানজি তাকে উদ্ধার করার ব্যাপারে সাহায্য করতে পারেন কীনা। নায়েব তামাক খাচ্ছিলেন। তিনি ঠাট্টা করে হেসে উঠতে গিয়ে বেদম হলেন। দশ-বিশ মিনিট কথা বলতে পারলেন না। তার বাড়িতে যাওয়ার পালকি এলো। বাড়িতে যেতে উঠলেন হাসি-হাসি মুখে। পালকির পাশে দাঁড়ালেন। গৌরীকে ডাকলেন। সে এলে কুটি করে ভাবলেন। বললেন, মনোহরের ওই একই ছেলে? আচ্ছা, গৌরী, মামলায় কী বা হয়? তা, তুমি টেরেসপাসের মামলাটা তুলেই নাও। তিনি পালকিতে উঠলেন। নায়েবমশায়ের হঠাৎ এই মত-পরিবর্তন কাছারিকে ধোঁকায় ফেলেছিলো। কিন্তু সেই ধোঁকা দূর করার মতো কোনো বিশদ বিবরণ কি পাওয়া যায়?

.

এরকমই একটা ছোটো ঘটনায় হেডমাস্টার বাগচীর ক্রোধের বিবরণ পাওয়া যায়। অথচ সে তো আদৌ ক্রোধী ছিলো বলে মনে হয় না। তখন বাগচীর স্কুলে সেই পরীক্ষা নেওয়ার পরীক্ষা চলেছে। স্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণীতে সর্বরঞ্জন ইংরাজির পরীক্ষা নিচ্ছে, অন্যান্য। শিক্ষকেরা নানা শ্রেণী নিয়ে ব্যস্ত। মৌখিক পরীক্ষা সুতরাং শিক্ষকদের পরিশ্রম করতে হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, তা জন্মোৎসবের পরে এবং সেবারের ক্রিস্টমাসের আগে, কিন্তু ঠিক কখন ধরা যায় না। পরীক্ষার একটা উদাহরণ নেওয়া যেতে পারে। রোল নাম্বার অনুসারে। ষষ্ঠ বালক ইসমাইল আসতে বাগচী বললো–বসো, ইসমাইল, বলল এবার, তোমার ধর্ম কী?

-মুসলমান।

–তোমার ভগবান কজন?

–একজনা, স্যার।

বাহ! তুমি প্রার্থনা করো? কোন দিকে মুখ করে করো?

–পশ্চিম, স্যার।

–কেন, তা কেন? অন্য দিক নয় কেন?

–পশ্চিমে মক্কা স্যার।

–ও, আচ্ছা, আচ্ছা। ওই ম্যাপটার কাছে যাও। বলো পশ্চিম কোন দিক হয় ম্যাপে?

বাঁ দিক।

বাহ! ম্যাপটা?

–আশিয়ার, স্যার।

সুন্দর! মক্কা কোন দেশে?

–আরব দেশে।

–বেশ, আরব দেশ প্রথমে, পরে মক্কা দেখাও।

ইসমাইল মক্কা খুঁজে বার করতে পারলো না। বাগচী তখন তাকে মক্কার গল্প, মহম্মদের গল্প বলে জিজ্ঞাসা করলো, ক্লাসে কখনো মক্কার ম্যাপ দেখেছিলো কিনা? মক্কা কোথায় জানতে ইচ্ছা হয়েছিলো কিনা?

সে কি কিছু মুখস্ত বলতে পারে? ইসমাইল নমাজের একটুখানি আবৃত্তি করলো। বাগচী বললো–তাহলে মক্কা বার করা উচিত ছিলো। এই সময়ে ইসমাইল ভয়ে ভয়ে বললো– চোখে কম দেখছি, স্যার।

কম দেখছো? বাগচী সোজা হয়ে সললো। ভূগোল, ইতিহাস, স্মৃতিশক্তি, সপ্রতিভতা–এসব নিয়ে পরীক্ষা। সব থমকে গেলো। কেন কম দেখছো?

ইসমাইল দ্বিধা করতে লাগলো। তখন হঠাৎ বাগচীর মনে পড়লো, কিছুদিন আগে তার এক ছাত্রের চোখের অসুখ নিয়ে কথা হয়েছিলো। অন্য ছাত্ররাও ছিলো। তার নাম তো ইসমাইলই বটে। সে কি এই ইসমাইল?

বাগচী চেয়ার থেকে উঠে ইসমাইলকে জানলার ধারে আলোয় নিয়ে তার চিবুক তুলে ধরে চোখ পরীক্ষা করলো। তার তো এখন ঠিকই মনে পড়ছে বটে। বিশ্রী রকমের কনজাংটিভাইটিস ছিলো সেটা। সে ইসমাইলকে জিজ্ঞাসা করলো চরণবাবু ওষুধ দিচ্ছিলো কিনা, সে ওষুধ খেয়েছে কিনা? অবশেষে বললো–চরণবাবুকে ডেকে আনো তো, পরামর্শ আছে।

চরণ এলে বাগচী বললো– কী ব্যাপার চরণ, ইসমাইলের চোখটা-কী ওষুধ দিয়েছো?

চরণ বললো–হামোমেলিস, স্যার, আর্নিকা দেবো কিনা ভাবছি।

বাগচী বললো–ডাক্তার হয়েছে, না? বুদ্ধিতে কুলোয়নি, আমাকে খবর দিলে না কেন?

চরণ একটু দ্বিধা করে বললো–আপনি কনজাংটিভাইটিস বলেছিলেন, আসলে ওটা ঘুষির ফলে। কীবল ঘুষি মেরেছিলো।

বাগচী হুড়মুড় করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। সে কী করবে খুঁজে পাচ্ছে না! তার চিৎকার করে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে! তার দুহাত দু পাশে ঝোলানো, তাদের আঙুলগুলো তেলোকে কুরছে। তার চোখে রাগ আর জল যেন প্রতিযোগিতা করছে! সে তোতলাতে তোতলাতে বললল, কীবল? কেন, কেন বলোনি?

চরণ ভুল করে সত্য বলে ফেলোকীবলসাহেব আপনাদের বন্ধুলোক, স্যার।

বাগচী কী বলবে ভেবে পেলো না। তার সম্মুখে বাড়ানো ডান হাতের তর্জনী ডাইনে বাঁয়ে দুলতে লাগলো। বললো–কেন, কেন বলোনি আমাকে? ছেলেটার চোখ নষ্ট করে দিলে? এত অবিশ্বাস আমাকে? এত ঘৃণা করো আমার ধর্মকে? গেট আউট, গেট আউট!

বাগচী নিজেই তার ঘর থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেলো।

বলা হয়, সাহেব হলে কী হবে, রাগটা বামুনে। অর্থাৎ বাগচীর রাগ পড়েছিলো। লাঞ্চ শেষে যথাসময়ে স্কুলে ফিরে পরীক্ষা নিয়েছিলো। তাকে নাকি রোগা দেখাচ্ছিলো, অসুখে ভুগলে যেমন হয়। কিন্তু একটা যেন পরিবর্তন হলো। কেট দেখলো, বাগচী যেন শীত কাতর হয়েছে। শীতের নাম করে স্কুল ফেরত বাড়ির বার হচ্ছে না। কফি নিয়ে স্টাডিতে ঢোকে, লেখাপড়া করে। পরীক্ষা চলছেই।

লাঞ্চে ফেরবার সময়ও হাতে বই পত্রিকা দেখা যায়। একদিন বললো, স্কুল থেকে দেওয়ানজির কাছে গিয়েছিলাম, আগস্টের টাইমসগুলো নিয়ে এলাম। আর-একদিন তার হাতে বড়ো এক বান্ডিল পত্রিকা দেখে কেট জিজ্ঞাসা করলে বললো– কলকাতার পত্রিকা। হিন্দু পেট্রিয়ট। দেওয়ানজির কাছে নিয়মমতো আসে। গত ছ মাসের কাগজ নিয়ে এলাম। সময় কাটবে।

এটাই আশ্চর্য, যার সময়ের অভাব ছিলো, তার সময় কাটানোর কথা উঠলো। এক সন্ধ্যায় কেট তাকে পত্রিকায় মুখ দিয়ে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো কী এমন বিষয়, এতে মনোযোগে? বাগচী হেসে মুখ তুলে বললো, আ, ডারলিং, বসো বসো, তেমন কিছু নয়। ইংরেজিটা গ্রামারে ঠিক, কিন্তু ভাষার যা আসল কথা ইমেজারি নেই, একটু বাসি মনে হয়। আর শুধু রায়তদের কথা, তাদের সুবিধা-অসুবিধা,নীলচাষ, তার দাদন এইসব। তবে প্রশংসা করতে হবে। এই হরিশ মুখুয্যে সরকারী চাকরি করেন, তার উপরে এই পত্রিকার সম্পাদক, লেখক, প্রিন্টার একাধারে একাই সব প্রায়। ভদ্রলোক সময় পান কী করে?

কেট বললো–তবে যে বলেছিলে ভাষাটা বড়ো নয়, ভাষা শিক্ষার চাইতে ভুল বানান। হলেও অন্য সব শিখে নেওয়া ভালো। তোমার কি মনে হয় না ভাষা আর কালচার খুব কাছাকাছি ব্যাপার?

বাগচী হেসে বললো–এই দ্যাখো, ডারলিং, আমি কি ইংরেজি ভাষা আর কালচারকে বাদ দিতে বলেছি? একজনের মুখের ইংরেজি শব্দগুলো কীভাবে ঠোঁট দুটিকে ফুলে পরিণত করে তা না দেখলে জগৎ অন্ধকার।

এক রবিবারে ব্রেকফাস্টের পরে কেট বললো– রাজকুমার অনেকদিন এদিক দিয়ে যান না। তুমি তো বিকেলে বার হচ্ছোই না।

বাগচী বললো, তাতে আর কী হলো?

সে নিজের চারিদিকে চাইলো। জীবন সংযুক্ত হলে স্মৃতিও সংযুক্ত হতে পারে। হঠাৎ কেটের তখন মনে হলো বাগচীর এই ভঙ্গিটা তার পরিচিত। এখানে আসার আগে, এমনকী এখানে আসার পরও প্রথম দিকে যেমন নিজেদের বসবার ঘরের বাইরের পৃথিবী সম্বন্ধে নিস্পৃহ ছিলো–এটা যেন তেমনই। তখনো এরকম বই পড়া ছিলো। বাগচী বললো– বটে, তাতে কী হলো, কিন্তু তখনই বললো, তুমি ভাবছো আমি ঘরকুনো হচ্ছি? আদৌ না, আমি এখনই বেরোতে পারি। বলতে কী যোগাযোগ দেখা দিয়েছে। কাল স্কুলে শুনলাম, আমাদের শিরোমণিমশায় পড়ে হাত ভেঙেছেন। না, ওষুধ দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। ভদ্রতা রক্ষা। তাছাড়া দেওয়ানজির সঙ্গে দেখা করা দরকার। ওই যে সেই চাকরিটার কথা, তার কিন্তু উত্তর দেওয়া হয়নি। শিরোমণির বাড়ি থেকে দেওয়ানজির কাছে যাবো। ডিকেনসের বই যে কখানা আছে তোমার জন্য নিয়ে আসবো ভাবছি।

সেদিন বাগচীরবিবার উপভোগ করতেই বেরিয়ে পড়েছিলো। সেরকম মেজাজ অনেক বিচিত্র সংবাদ সংগ্রহ করতে পারে। শিরোমণির টোলের খবর, সেখানকার সংস্কার কুসংস্কার এই সংবাদের মধ্যে ছিলো। কেটকে যা সে বলেছিলো তাতে বোঝা যায় সেখানে শিরোমণির চিকিৎসার জন্য এক দরবেশ উপস্থিত ছিলো। সেই দরবেশ দাবী করেছিলো সে বা তার গুরুপরম্পরায় কোনো বৃদ্ধ-গুরু কাছাকাছি থাকলে আলিবর্দি খাঁ সেভাবে মরতো না। হোক তরোয়ালের চোপ, সে সারতেই। তবে কিন্তু আছে, গুরুরা খবর পায়নি এজন্য যে আলিবর্দির পাপের শরীল, মনিবের সঙ্গে বেইমানি, বন্ধুত্বের নাম করে কোন পণ্ডিতকে নাকি খুন করেছিলো। সেই দরবেশের জীবনটা যেমন রহস্যের, সে জীবনটাকেও তেমন রহস্যময় মনে করে। ঠাকুরদা ছিলো ওস্তাদ ঢুলি, শেষ বয়সে এক মুসলমানী বাঈজীর জন্য সমাজের বাইরে গিয়েছিলো; বাপ ছিলো লেঠেল ডাকাত, এক বোষ্ট্রমীকে নিয়ে তিলক সেবা-টেবা করতো। দরবেশ তার গুরুদত্ত গুণ নিয়ে ভালোই আছে, পদস্খলিতা এক ভৈরবী জটা ও ত্রিশূল সত্ত্বেও ওর গৃহ রক্ষা করে। দরবেশের এই এক গুণ, ভাঙা গায়ে হাত দিয়ে ব্যথা অর্ধেক কমায়।

শিরোমণির টোলে ছাত্রসংখ্যা তখন কমতে কমতে পাঁচ। কুড়িজন ছাত্রের জন্য সেই কবে থেকে দেওয়া ত্রিশ বিঘা দু-ফসলী নিষ্কর ব্রহ্মোত্তর। ছাত্ররাও বিচিত্র। তিনজন উপস্থিত ছিলো, তাদের একজন ন্যায়, একজন স্মৃতি, তৃতীয়জন বেদান্ত পড়ছে। শিরোমণিই পরিচয় করে দিয়েছিলো। সে বলেছিলো, এটির নাম গোপাল। পিতার অর্থশালী যজমান আছে। আশৈশব পিতামহ পিতাকে দেখে পূজা বিবাহাদি ব্যাপারে মন্ত্রে দক্ষ। নিজগ্রামে কবিভূষণ উপাধি পেয়েছিলো। এখানে স্মৃতি পড়েছে। তন্ত্রে কিছু অধিকার আছে। কিন্তু জননীর ইচ্ছায় এবং দৃঢ়তায় এখানে ফিরে নতুন করে ন্যায় পড়ছে। ওই ফুটফুটে ছাত্রটিকে দেখুন, ব্রজ গোঁসাই, অদ্বৈত বংশের। পিতা অনেক ধনী জোতদার মহাজনের কুলগুরু। কথকতায় ইতিমধ্যে জুড়ি পাওয়া ভার। ইতিমধ্যে ন্যায় ও স্মৃতির উপাধি আছে। এই টোলে ফিরেছে। বেদান্তের জন্যে। কোন এক তোতাপুরী সন্ন্যাসী নাকি ওদের গ্রামে বারমাস্যায় ছিলো। তিনি নাকি বলে গিয়েছেন, কৃষ্ণ কালী ইত্যাদি অলীক কাব্যমাত্র। একমাত্র নিগুণ অব্যক্ত ব্ৰহ্মই সত্য, যিনি পূজা ইত্যাদিতে ভ্রুক্ষেপ করেন, ই নেই তার ক্ষেপ। ব্রজ বোধ হয় ব্রহ্মের এরকম ব্যাখ্যায় বিড়ম্বনা বোধ করলো। সে কিছুটা মুখ লাল করে বললো, গুরুমশায়, তোতাপুরী কিন্তু আমার মাকে শুধু নয়, সন্দেহ হয় এখানকার রানীমাকেও মন্ত্রণা দিয়ে থাকবেন। তাছাড়া আপনার কৃত বেদান্তসার-পাণ্ডুলিপিতে–সে থতমত হয়ে মাঝপথে থেমে গেলো। কপিল নামে তৃতীয় ছাত্রটি বয়ঃকনিষ্ঠ। শিরোমণি বলেছিলো, বারান্দার নিচে খড়ি ফাড়ছে, ওর নাম কপিল। একরকমের স্মৃতিধর। গত বৎসর পড়া বন্ধ করে আমার পুত্রের সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলো। ছ মাস ছিলো চাকরির খোঁজে। তারপর সেখান থেকে পদব্রজে পালিয়েছে। আহা, ও আমার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ভালোবাসে, একটু খেতে ভালোবাসে। কলকাতায় নাকি নেটিভপাড়া আছে। সেখানে নাকি হাতি গেলা কালো গঙ্গা বয়। একটু রয়ে সয়ে থাকলে দু-তিন বছরে এন্টান্সে পাস করে উকিল মোক্তার হতে পারতো। বাগচী এই জায়গায় জিজ্ঞাসা করেছিলো, আপনার এখানে ইংরেজি পড়া হয় না? সেটা তো অর্থকরীও বটে। কপিল খড়ি গুছিয়ে রাখছিলো। কথাটা তার কানে গেলো। গুরুর পক্ষে সে কথা বলেছিলো। বাগচীকে প্রায় চমকে দিয়ে সে বলেছিলো, দি অ্যাজাপশন ইজ রং, স্যার। অলরেডি দেয়ার আর দেয়ার স্কোরস অব আন্ডার এমপ্লয়েড গ্র্যাজুয়েটস্ হু ইক আউট আ মিজারেবল ইগজিস্টেন্স ইন আনক্লিন স্লাম। শিরোমণি বললো–কী বললো– কে জানে! বাগচী কিছুটা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলো তুমি তো কলকাতায় ছিলে, সেখানে রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচরণ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে দ্যাখোনি? কপিল দ্বিধা করলো। দু হাতে জড়ো করা খড়িগুলোকে স্থানান্তরে নিতে বুকে জড়িয়ে তুলে, ইতিমধ্যেই সে লজ্জিতও বটে, বললো–একসেপশস্ টেন্ড টু প্রুভ দা রুল–ডোন্ট দে?

কিন্তু আসল কৌতুকটা অন্য দিকে। এক ঘোর কুসংস্কার যেন তাদের। তারা বহুবিবাহ প্রথা লোপ অথবা বিধবা-বিবাহ প্রথার প্রচলনকে নিতান্ত মূল্যহীন মনে করে, স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে নিজ নিজ জননীর কথা মনে রেখে কৌতুক বোধ করে। বহুবিবাহ সম্বন্ধে তাদের যুক্তি রামলক্ষ্মণাদির একদারনিষ্ঠা, ভীমার্জুনের বহুবিবাহ সমাজে কী এমন ক্ষতিবৃদ্ধি করে? বহুবিবাহ কি ভদ্রসমাজে ছিলো? শ্রীচৈতন্যের কাল থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর পর্যন্ত যাঁদের নাম আমরা জানি সকলেরই পিতা, দেখা যাচ্ছে, একদারনিষ্ঠ। অন্য দিকে বহুবিবাহ গণিতশাস্ত্র অনুসারে অসম্ভব। যেহেতু স্ত্রী পুরুষের সংখ্যা সবসময়ে সমান থাকে, বহুবিবাহ ব্যাপক চলতে থাকলে বহু অবিবাহিত পুরুষ থেকে যায়, যাদের হিংস্রতায় বহুবিবাহকারীরা নিহত হতো। সতীদাহ প্রথা লোপহওয়াকে তারা ভালোই বলে, কিন্তু জিজ্ঞাসা করে বৎসরে হাজার রমণীর সেই মৃত্যুর চাইতে তেমনি হাজার রমণীর বারাঙ্গনায় পরিণত হওয়াকে হেডমাস্টারমশায় সুখদায়ক মনে করেন কিনা? যারা সতীদাহ প্রথা লোপে অগ্রণী তাদের সমাজে বারাঙ্গনা-প্রীতি যথেষ্ট। তাদের বক্তব্য বিধবাবিবাহ প্রথা হিসাবে অচল হবে, কেননা যে দেশে কুমারীর বিবাহই সমস্যা সে দেশে বিধবার সুযোগ কোথায়? গোপাল একটু বয়স্ক, সে বলেছিলো এই কথাতেই আমরা পুরুষের সমস্যায় আসি। সে বাঁকা করে বলেছিলো, কলকাতার তারা পুরুষের সমস্যার কথা তোলেন না, কারণ তাহলে তাদের পৃষ্ঠপোষক ইংরেজ শাসকের সঙ্গে বিবাদে অবতীর্ণ হতে হবে। পুরুষের সমস্যা অবশ্যই অর্থ উপার্জনের, সমস্যা বলহীনতার যা নারীকে আদর করে, রক্ষা করে।

তখন টপ-হ্যাট মাথায় ঠিক করে বসিয়ে বাগচী একজন বলশালী পুরুষের মতো দীর্ঘ পদক্ষেপে চলেছে। তার হাতের ছড়ি অনেক সময় শূন্যে চক্র খাচ্ছে, ফরাসী গোটিযুক্ত মুখে হাসি-হাসি ভাব। চতুষ্পঠীতে যা সে শুনে এলো তা সব পিছিয়ে যাওয়ার ব্যাপার, যে পথে সে এবং তার স্কুল শিরোমণির পথটা যেন তার বিপরীত দিকে। কিংবা বলবে সেই টোলটি এক পুরনো মতবাদের গভীর কিন্তু স্রোতহীন দহ? ওটা কিন্তু দারুণ প্রশ্ন-বৈধব্য জীবনযাপন, সতী হিসাবে দগ্ধ হওয়া কিংবা কলকাতার বারাঙ্গনার সংখ্যা বৃদ্ধি করা কোনটি বেশি যন্ত্রণার? ও দিকে দ্যাখো ভীমার্জুন এমনকী দ্রৌপদীর বহুপত্নীত্ব বা বহুপতিত্ব কোন নীতির? তাদের সেই সমাজে কি তাদের কেউ ধিক্কার দিয়েছে? যদিও সেই সমাজে একপতিত্ব নীতির পরাকাষ্ঠা গান্ধারী বর্তমান। এর কারণ কি এই যে ভীমার্জুন বলশালী, দ্রৌপদী ওজস্বিনী। যেন বিবাহের ব্যাপারটাই গৌণ, আলোচনার গুরুত্ব পায় না।

বাগচী ভাবলো, তা নির্বলই এ সমাজ। পুরুষের সমস্যাই তো প্রবল। কলকাতায় যারা ভাগ্যান্বেষণে, তাদের কজনই বা সার্থক? এটা কি সত্য পুরুষের সমস্যা নিয়ে কথা উঠলেই শাসকের সঙ্গে বিবাদ অবশ্যম্ভাবী? এদিকেও দ্যাখো, রাজবাড়ির বাইরে এদেশে দাদনের সমস্যাটাকেই কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। কৃষক তাঁতি সবাই সমান সমস্যাজর্জর। তার মনে একবার ধনঞ্জয়ের একবার চরণের ক্লিষ্ট মুখ ফুটে উঠলো। ধর্ম কি মানুষের অতীত হীনমন্যতা, নীতিহীনতা থেকে মুক্ত করে বলশালী করতে পারে? তার মনে পড়ে গেলো কে এক ব্ৰহ্মবাদী সন্ন্যাসী রানীমার কাছে মূল্য পেয়েছে। কিছুক্ষণ সংবাদটাকে সে মনে মনে। ওজন করলো। সংবাদটানতুন। ওদিকে দ্যাখো, বোধহয় ব্রজগোঁসাই-ইব্ৰহ্ম সম্বন্ধে জানতে শিরোমণির কাছে পড়ছে। তাহলে কিন্তু নতুন ধর্ম-আন্দোলন যা কলকাতায় ইংল্যান্ডের ইভানজেলিস্টদের মতো সরব, তার নতুনত্ব থাকছে না। সেদিন এই শিরোমণি এক নতুন মত বলেছিলো, জন্মটা পাপ থেকে নয়, মৃত্যুও দুঃখের নয়–সবই বড়োজোর সময়ের ব্যাপার।

বাগচী একটু ধীরে চলতে শুরু করে নিজেকে ঠাট্টা করলো, ওদের চিন্তাকে সমর্থন করছো নাকি? না, না, সত্যই তো, বলেরই তো প্রয়োজন-যে বল কৃষক ও কারিগরকে এক নীরোগ সমাজে স্থাপন করে! সে অবাক হয়ে ভাবলো, আশ্চর্য, এমন কী হতে পারে, এইসব-কোন দহে এক আশ্চর্য ফোয়ারা আছে যা অকস্মাৎ দহকে এক বেগবতী নদীতে পরিণত করতে পারে? এমন কী হতে পারে, এমন কোন এক তোতাপুরী দেখা দেবে, যে বলশালী হয়ে ব্রহ্মবিদ্যা আয়ত্ত করবে এবং সমাজকে বলশালী করতে তাঁতিদের, চাষীদের নানা সমস্যা নিয়ে চিন্তা করবে, ধার্মিক হয়েও বলেরই প্রশংসা করবে?

সে অন্যমনস্কের মতো চলে রাজবাড়ির কাছে এসে পড়েছিলো। তখন তো বেশ বেলাই হয়েছে। কিন্তু সে চোখ তুলতেই দেখতে পেলো, সদরদরজার খিলানের নিচে দেওয়ানজি, তার সঙ্গে ফেলিসিটার। দেওয়ান ফেলিসিটারকে কিছু বুঝিয়ে দিলো। হরদয়ালও বাগচীকে দেখতে পেয়ে ফেলিসিটারকে পিছনে রেখে এগিয়ে এলো। অভ্যর্থনা জানালো। বললো–আপনার কথাই ভাবছিলাম। ডিকেনসের খানতিনেক নভেল সোফার উপরে একত্র দেখে মনে হলো পরে, হয়তো আপনি পড়ার জন্যে নামিয়েছিলেন। আজই আপনার কুঠিতে পাঠাচ্ছিলাম। চলুন, বসি গে।

বাগচী হেসে বললো–সেদিন ডারউইন পড়তে পড়তে উত্তেজিত হয়ে ওই কাজ। গৃহিণীর জন্য নামিয়েছিলাম ডিকেন্স। এখন সেগুলো নিয়ে যাই। সন্ধ্যায় যদি আসি,বসবো।

হরদয়াল বললো–ডারউইনে এত উত্তেজনা কেন? অ্যাডাম থাকছে না বলে? সেও হাসলো।

দুজনে পাশাপাশি দেওয়ানকুঠির দিকে চলতে লাগলো। এই সময়ে পিছন থেকে ফেলিসিটার বললো–আমার কথাটা একবার ভাববেন, সার!

হরদয়াল চলতে চলতে খানিকটা মুখ ফিরিয়ে বললো–তোমার সেই রোডরোলার তো? তা কিন্তু নৌকোয় আনতে মরেলগঞ্জের সেই এক গ্লোসে ঠোকাঠুকি হয়ে যেতে পারে। সেবাগচীকে বললো, এবার ডানকানের দারুণ ক্রিস্টমাস। অনেক গেস্ট। ইয়াকোভের মতে তা নাকি কমিশন। কিন্তু কমিশনারদের কারো কারো মেমসাহেবও আসছেন, অবশ্য যাদের তা আছে।

তারা তখন দেওয়ানকুঠির সিঁড়ি দিয়ে উঠছে। পায়ের শব্দে হরদয়াল মুখ ফিরিয়ে বললো–ও, তুমি যাওনি? আরো কিছু আছে নাকি সওদা?

-তাহলে রোডরোলারটা মঞ্জুর তো সার? ও ছাড়া কি পাকা রাস্তা হয়, সার?

-আমি তো বলেছি, নরেশ কলকাতা যাচ্ছে, সে দেখবে। পছন্দ করে নেওয়া হবে। আচ্ছা, রসো। তুমি যখন থেকেই গেলে, তোমাকে সেই আহিরীটোলার বাড়িটা সম্বন্ধে বলে দিই।

তখন বাগচীকে একদিকে ফেলিসিটারকে অন্যদিকে নিয়ে হরদয়াল তার ড্রয়িংরুমে বসলো। বাগচীর কাছে অনুমতি চেয়ে নিয়ে ফেলিসিটারকে একটা বাড়ির নক্সা দেখালো। বললো–নরেশকে সব বলে দেওয়া আছে। সেই সব কাজ দেখে করাবে। তোমাকে প্রয়োজন মত মিস্ত্রি, কুলি সরঞ্জাম জোগান দিতে হবে। নক্সাটা দ্যাখো। নিচের এই হলটাতে ক্রিস্টমাস গাছ হবে। সেটাই সেদিন বসবার ঘর। তার পশ্চিমের এই বড়োঘরটাতে হবে ডাইনিংরুম। এই হল আর ডাইনিং রুমের উত্তরদক্ষিণের ঘরগুলোর সব কটিতেই শোবার ঘর করে সাজাবে। গালচে, খাট, বসার কিছু আসন, আয়না, টেবিল, সাইডবোর্ড। ফার্নিচার যেন খেলো রং-চটা না হয়, ভাড়া নেওয়ার সময় দেখবে। ওসব ঘরে ধরো আমি, বাগচীসাহেব, এমন আরো কেউ কেউ থাকবো। দোতলার ঘরগুলোর জন্য তোমার ভাবনা নেই। সাফসুতরো করাবে ভালো করে। মেঝের পুরনো শ্বেতপাথরে কিছু করাতে পারবে না। কিন্তু দেয়ালে ছাদে দাগ না থাকে। ফার্নিচার সবই এখান থেকে যাবে। ওখানে রানীমা, রাজকুমার, আর তাদের পরিবারের যাঁরা যাবেন থাকবেন। তুমি দেখবে, নরেশ পৌঁছে কোনো অসুবিধায় না পড়ে।

ফেলিসিটার অবশ্যই উকর্ণ হয়ে শুনছিলো। বললো–আপনারা কবে তক গিয়ে পৌঁছবেন?

হরদয়াল বললো–সেটা ভেবো না। নরেশ পরশু সকালে নৌকোয় রওনা হচ্ছে। তুমি তার সঙ্গে যেতে পারবে? নাকি মরেলগঞ্জের কাজ শেষ হয়নি? তাহলে তুমিও পরশু নৌকো ছাড়ো। পনেরোই ডিসেম্বরে বাসা সবদিক দিয়ে তৈরী হওয়া চাই।

য্যাকব ফেলিসিটার এতদিনে অবশ্য বুঝতে পারে দেওয়ানজির কথার সুর কখন কার দরবার শেষ করছে। সে ইয়েস, সার, মোস্ট ডেফিনিটলি সার্টেন, সার বলে উঠে গেলো।

তখন হরদয়াল হেসে বললো–এবার ক্রিস্টমাসে রানীমা কলকাতা যাচ্ছেন। রাজকুমার তোবটেই। তাহলে আপনিও চলুন। বাসাটার কথা তো শুনলেন। আর সবদিক দিয়ে ভালো, সামনের লনটা ছোটো। ও, আচ্ছা, সেই কথাটা। এখনো কিন্তু আপনার মত জানতে পারিনি।

বাগচী বললো–আমি ডিসেম্বরটা ভেবে দেখি। শেষদিকে জানাবো।

-তা মন্দ হবেনা, যদি পয়লা জানুয়ারী থেকেই টেক আপ করেন। হরদয়াল হাসিমুখে বললো, অতঃপর? লাঞ্চের সময় এসে যাচ্ছে, একটু অ্যাপিটাইজার

বাগচী হেসে বললো–না, না। সন্ধ্যায় যদি আসি, তখন অবশ্যই।

বাগচী ডিকেনসের নভেল তিনখানা নিয়ে চলে এসেছিলো। পথে একবার তার মনে হয়েছিলো, ভাগ্যে এখানে দেওয়ানজি আর তার লাইব্রেরি আছে।

সেদিন সন্ধ্যায় কফির কাপ নিয়ে বাগচী তার স্টাডিতে ঢুকলে কেটও তাকে অনুসরণ করলো। কফি শেষ হয়েছিলো। দু-চারটি সংসারের কথার পর কেট ডিকেন্স পেয়ে তা নিয়ে বসেছিলো। বাগচী তো কিছুদিন থেকেই যেন ভারতীয় জার্নালিজমের ভক্ত হয়ে পড়েছে। আজও সে হিন্দু পেট্রিয়টের ফাঁইল নিয়ে বসেছে। ঘণ্টাদেড়েক পার হয়েছে এর মধ্যে একটাই কথা হয়েছে। বাগচী পাইপ সাজিয়ে বলেছিলো–ম্যাচটা?

কেট বাগচীর হাতে ম্যাচবক্স তুলে দিয়েছিলো। কিন্তু একটানা ডিকেন্স পড়তে চোখ অন্তত ক্লান্ত হয়।

কেট বললো–ও, আচ্ছা, আজ তো রাজবাড়িতেও গেলে না?

বাগচী যেন চমকে উঠলো। পকেট থেকে ঘড়ি বার করে বললো–তাই তো! তারপর হেসে বললো–তাতে কী, আজ তো একবার রাজবাড়িতে গিয়েছিলাম। বই আনলাম না? তাছাড়া গ্রামের লোকের সঙ্গেও মিশেছি। তোমাকে শিরোমণির টোলের গল্প বলবো?

বাগচী শিরোমণির টোলের গল্প করলো রাতের খাওয়ার সময় পর্যন্ত। খেতে খেতে বাগচী বললো–একটু পিয়ানো বাজাও না আজ। ভেবে দেখো, ওটা রাজকুমার রেখেছিলেন এখানে বেশির ভাগ তুমি একা, কখনো কখনো তিনি, বাজাবেন বলে। সে রাতে খানিকটা পিয়ানো বাজানো হয়েছিলো।

কিন্তু কখনো কখনো একটা অনুভূতি হয় যার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। কেটের অনুভূতি হলো তারা যেন আবার তাদের সেই মধ্যপ্রদেশের বাংলোর আবহাওয়া তৈরী করে নিচ্ছে। যেন মাঝখানে নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছিলো, আবার গুটিয়ে নিজেদের নিঃসঙ্গ করে নিচ্ছে কী আশ্চর্য, বাগচী এই দু সপ্তাহ তো, কি সকালে কি বিকালে, একবারও তাদের সেই ডিসপেনসারিতে যায়নি।

.

০২.

এরকম একটা সংবাদই আছে মরেলগঞ্জের জীবন সম্বন্ধে। নীলকুঠির বাংলোর পুবমুখী বারান্দায় সেদিন ব্রেকফাস্টে বসেছিলো কীবল ও ডানকান। শীতের রোদ টেবিলে, বারান্দা বটে কাঠের ফ্রেমে তারের জালে ঘেরা। বাংলোর দেয়াল পাকা, খড়ের ছাদ। আটচালা। নিচে সুরকির সড়কে ইতিমধ্যে পাশাপাশি দুটি ঘোড়া। টেবলে ইংলিশ ক্ৰকারি, ড্রেসডেনের বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। ভাসে গোলাপ। খাদ্যগুলি ইংরেজি হতে পারে না। ডিম, মুরগি, চাপাটিসকালে, লাঞ্চে, ডিনারে। বেকন,হ্যাম, পর্ক আশা করা যায় না, ভালো ব্রেডও নয়। পরশুদিন বীফ হয়েছিলো, কারণ কালেক্টর ম্যাকফার্লান এসেছিলো। তার সঙ্গে কীবল সদর পর্যন্ত গিয়েছিলো, ফিরতে বিকেল।

ডানকান কি বিচলিত? তার কাবার্ডে কি অনেক কঙ্কাল? ইন্ডিগো কমিশন নিয়েই চিন্তা। আলোচনায় আর্চি হিলের নাম উঠেছিলো। ম্যাক আর্চির নাম জানেনা। ডানকান বলেছিলো, আর্চি একজন প্ল্যান্টার যার কথার মূল্য আছে। আলোচনায় লর্ড পামারস্টোন এবং গ্ল্যাডস্টোনের কথা উঠেছিলো। গ্ল্যাডস্টোন, যেনাকি চ্যান্সেলার অব দি এক্সচেকার। ডানকান বলেছিল, হুইরা ব্যবসা বাণিজ্যকে শেষনা করে ছাড়বেনা। ম্যাক কীবলের সমবয়সীহবে। সে কিন্তু খুব সহজভাবে একটা পরিবর্তনের কথা বলেছিলো। সে আর কম্পানির কর্মচারী নয়, সেক্রেটারি অব স্টেটের কর্মচারী।

আজ কথা কম হচ্ছে, ডানকান ভাবছে। হয়তো কমিশন নয়, স্ত্রী-পুত্রের কথাই ভাবছে। তারা সেই ৫৭-তে হোমে গিয়েছে, এদেশে আসতে চাইছে না। যদিও ১৮৫৭-৫৮র ব্যাপারগুলো তারা প্রত্যক্ষভাবে জানে না। ফলে এখন এই ১৮৬০-এর শেষেও এই মরেলগঞ্জ স্ত্রীলোকহীন। এই পর্যন্ত ভেবেই কীবল তাড়াতাড়ি মুখ তুললল, বললো–হোয়াইট, তুমি কি মনে করো কম্পানি রুল আর সেক্রেটারি অব স্টেটের শাসনে সত্যই তফাত হয়? কাল্পনিক নয়?

ডানকান বললো, তুমি কি হোয়াইট মিউটিনির খবর রাখো?

কীবল হেসে বললো–তা আবার কবে করলে, কিংবা করতে চলেছো?

ডানকান রসিকতার দিকে না গিয়ে বললো, দুই শাসন এক হলে কম্পানির দশ হাজার ইংরেজ সৈনিক ও অফিসার পদত্যাগ করতে চায় কেন? তারা কম বোঝে? আর সবচাইতে বড়ো প্রমাণ এই কমিশন! জাস্ট থিংক অব ইট! আমি আমার রায়তদের সঙ্গে কী করেছি, তার বিচার? ম্যাঞ্চেস্টারে কাপড় হবে, কিন্তু তার রং? এদিকে দ্যাখো, ম্যাক ছোকরা বলছিলো, সে চায় না কমিশন তার জেলায় কিছু কেলেঙ্কারি খুঁজে পায়। যেন আমরা তার। অধীন আর আমাদের কাজের জন্য তার দায়িত্ব আছে। এর চাইতে বড়ো, ঔদ্ধত্য স্বপ্নে দ্যাখো? উত্তেজিত ডানকান ঢেকুর তুলো।

ব্রেকফাস্টে হাল্কা বিষয়ই ভালো, তাছাড়া সে কি ক্লান্তনয়? না, সকালে কেন ক্লান্ত হবে? এই ভেবে কীবল বললো, তুমি কি সত্যই যাচ্ছে হোমে?

–নিশ্চয়, ইস্টারে অবশ্যই। তার আগে তোমার পিক আপ করা চাই। তবে কিডিসদের আনবো কিনা ভাবতে হবে।

-কেন, এখানে কি তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত বোধ করেছো? ১৮৫৭ বারবার হয় না।

ডানকানের মুখ একটু লাল হলো, সে বললো–ইন এ সেন্স তা বলতে পারো। ১৮৫৯ এর চাষীদের ঔদ্ধত্য ভাবো। আমার মনে হয়, এর চাইতে গায়েনা ভালো, নীলের চাইতে সুগার ভালো; সেখানে অন্তত কোয়েকাররা নেই।

-এখানে কোয়েকার? কোথায়, কলকাতায়?

নয় তো কমিশন বসায়? জাস্ট থিংক অব ইট!

কীবলের গায়ে রোদ। উষ্ণতায় অনুভব করলো, ঘুমিয়ে নিলে হয় ব্রেকফাস্টের পরে। কিন্তু সে নিজেকে সজাগ করলো। বললো–তুমি কিন্তু কোয়েকারদের প্রশংসাই করতে, যদি আমার ঠিক মনে থেকে থাকে।

ডানকান বললো–সে তাদের ধর্মের ভণ্ডামির জন্য নয়। লন্ডন স্টক মার্কেটের বিশিষ্ট ফোর্স হিসাবে। বলা হতো, যত ধার্মিক তত রেলওয়ের স্টক।

প্লেট বদলে দিলো আয়া। কীবল বললো–ধর্মের কথায় বলি, রলের চার্চ মিশনের জন্য একশো একরের টিলাটা আমি আবার দেখেছি। ওটাই ভালো হবে। সদরে কিছু খবরও জেনে এসেছি। ওটা ফরাসডাঙার পিয়েত্রোর ছিলো।

ডানকান গুমরে ওঠার ভঙ্গিতে বললো, তার জন্য সদরে যাওয়া দরকার ছিলো না। ওটা ইদিলপুর পরগনা। মনোহর সব খবর রাখে। পরগনাটা সেই খেকশিয়াল পিয়েত্রোর ছিলো। কিছু খাস ছিলো যার গোটাটাই সে তার তাতিদের, রায়তদের, বরকন্দাজদের মোকরারি দিয়ে গিয়েছে। বাকিটা জোতদারদের। পাঁচ-ছজন তারা। তাদের নাম মনোহর দিতে পারে।

কীবল ডানকানের চাইতে একদিকে অন্তত এগিয়ে তা বোঝানোর সুযোগ নিলো, বললো, কিন্তু পিয়েত্রো জীবিত নয়। রেভেনু কে দিচ্ছে পরগনার? ম্যাকফার্লান নিজেও শুনে অবাক। বললো–জানতাম না তো, খোঁজ নিচ্ছি।

চা নিয়ে এলো ডানকানের আয়া। মাঝখানে চেরা একমাথা খয়েরি চুলের নিচে বড়ো বড়ো চোখ, তার নিচে বাদামী ফুলোফুলো গাল যাতে অনেক ব্রণ, চোখের মণিকে নীলচে গ্রে রং বলতে হবে, ছাপা ছিটের গাউনে ঢাকা পিছন দিকটা ঘোটকীকে পরাস্ত করে। কীবল মুখনা তুলে চোরাচোখে চাইলো। ফুলীততক্ষণে কিচেনের দরজার কাছে। বাইশ হতে পারে বয়স। হয়তো ডানকানের আগে যে ছিলো তার, কিংবা কলকাতা থেকে আনা। কিন্তু কয়েকদিন আগে ভোররাতে স্নাইপ শুটিং-এর জন্য বন্দুক আনতে গিয়ে তাকে ডানকানের শোবার ঘরের দরজা খুলে বেরোতে দেখা গিয়েছিলো। আর সে কিন্তু এতটুকু বিব্রত ছিলো না। বরং কিচেনে ডেকে ছোটোসাহেবকে গরম এক কাপ চা করে দিয়েছিলো।

কিচেনের দরজার পাশে কীবল জুড়ান পাইকের সেই তৃতীয় স্ত্রীকে দেখতে পেলোলা। জুড়ান, তার মনে পড়লো, সে এখানে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে বল্লমের খোঁচায় এক রায়তকে খোঁড়া করে দিয়েছিলো। একটা ঝোপের মাত্র ব্যবধান ছিলো তার আর সেই ঘটনার মধ্যে। সেই রায়তের পা থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। সে ডানকানকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, বাধ্য হয়েই যেন, এটা কী? এরকম কেন হবে? জুড়ান পাইকের তৃতীয় স্ত্রীর পরনে সবজে চেকশাড়ি, দাসীরা যেমন পরে।

কীবল বললো–যাটের রেভেনু তো কেউ না কেউ দিয়েছে। অথচ পিয়েত্রো তখন মৃত। ম্যাক অবাক হয়ে বললো–তাই তো, নীলামে ওঠেনি পরগনা! তুমি বোধ হয় এসর আগে ভাবোনি, হোয়াইট?

ডানকান বললো, ১৮৫৮-৫৯ ভালো ছিলো না। ৬০টা দেখে নেওয়া গেলো। হাতের তাস কি সবসময়ে টেবলে ফেলা যায়? আমার বন্ধু আর্চিবলড হিল কলকাতায় খোঁজ নিচ্ছে।

চা শেষ করে ডানকান উঠলো। তার তো পোশাক পরাই ছিলো। রাস্তায় ঘোড়া ধরে সহিস। এখন প্ল্যান্টেশন দেখতে বেরোবে। দেখা দরকারই তা নয়। আরামদায়ক রোদে ঘোরা, ব্যায়ামও বলতে পারো। তবে নিশ্চয়ই জানিয়ে দেওয়া আমি এখানেই।

কিন্তু আশ্চর্য, সবুজ শাড়ি-পরা স্ত্রীলোকটি কি তাকে লক্ষ্য করছে? কীবল চা শেষ করে উঠলো। ডানকান ঘোড়ায় উঠছে। কীবলের নিজেরও পরনে ব্রিচেস, রাইডিং কোট, হাতে ক্র-হুঁইপ, তার জন্যও ঘোড়া অপেক্ষা করছে।

সে ঘোড়ায় উঠলো। বারান্দা-দেওয়া টুপিটা টেনে দিলো কপালে। সামনে পথের উপরে রায়তদের ছছটো এক জটলা দেখে সেদিকে চললো সে, যেন ভিড়টাকে ভেঙে দিতে। –এখানে কী করছো তোমরা?

তাদের একজন বললো–আমি কৃষ্ণানন্দ। দেওয়ান মনোহর সিং-এর কাছ থেকে ফিরছি। দাদনের সময় যায়, এবার কী বন্দোবস্ত? আমরা কি ধানের দিকে যাবো? বড়োসাহেব মনোহর সিং-এর কাছে শুনতে বলেছিলেন। মনোহর বললো–ছোটোসাহেব ব্যবস্থা করছে।

কীবল ঘোড়ার লাগামে ঢিল দিয়ে ঘোড়র পেটে গোড়ালি দিয়ে আঘাত করে বললো, বড়োসাহেব কিছু না বললে কিছু হবে না।

ঘোড়াটা ক্যান্টারে চলেছে। আচ্ছা, সে ভাবলো, এদিকে প্ল্যান্টেশনের এদিকের সীমায় এসে পড়া গেলো। ঘোড়াটার মুখ ফিরিয়ে বাঁয়ে চক্কর দেবে নাকি? কিন্তু তার মনে পড়লো, বেডশীট দুটোকেই বদলে নিতে হবে। রাগটাকেও। এই ভেবে তার মন থমকে দাঁড়ালো, যদিও ঘোড়া তার হাত ও পায়ের ইঙ্গিতে গ্যালপে চলেছে। তার থমকে-থাকা মন ঘোড়ার খুরের ধপধপ শব্দটাকে যেন গবেষণা করছে।

কিন্তু, আশ্চর্য, ঘটলো কী করে? তখন বিকেল শেষ হচ্ছে। সদর থেকে ফিরে সে কি ক্লান্ত, হাতে পায়ে ব্যথা যেন। বারান্দাতেই ফুলী চায়ের সরঞ্জাম গোছাচ্ছে। দাঁতে বোঁটা চেপে ধরা একটা গোলাপ ঝুলছে চিবুকে। সে নিজে বোধ হয় জিজ্ঞাসা করেছিলো, হোয়াইট কোথায়। ফুলী হেসে তার ইয়ার-ডুপ দুলিয়ে ইঙ্গিত করেছিলো। আটচালা বড়ো হলেও অনেক পার্টিশন কাঠের। গোসলখানা থেকে জলের শব্দ ও ডানকানের মোটা গলার গান আসছিলো। কীবল ফুলীর ডান কনুইয়ের উপরে চেপে ধরেছিলো। ফুলী কিন্তু তার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে হেসেছিলো।

কিন্তু আধঘণ্টা বাদে নিজের শোবার ঘরে গিয়ে সে নতুন আয়াকে দেখতে পেয়েছিলো, ম্যাকফার্লান আসবে বলে তিন-চার দিন আগে যে নিযুক্ত হয়েছিলো। নীলে সাদা ডুরে খাটো শাড়ি, দাঁতগুলো ছোটো ছোটো, ঝকঝকে সাদা, চোখ দুটো কিন্তু আশ্চর্য রকমের বড়ো। যেন বিছানা ঝাড়ছে। আধঘণ্টা বাদে আবার সেই লণ্ঠন দিয়ে গিয়েছিলো। পোশাক ছেড়ে ডানকানের সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার সময়ে তার অনুমান হয়েছিলো, জানলার বাইরে ওপাশের বারান্দায় সে দাঁড়িয়ে আছে।

কীবল বুঝতে পারছে, সে আবাদের অনেক বাইরে এখন। অনেক রোদ যা তাকে স্নান করাচ্ছে যেন। …যখন সে ডিনারে যাচ্ছে সেই আয়া বলেছিলো, সে বাড়ি যাবে কিনা? আর কাজ আছে কিনা? কীবল কোনো উত্তরই দেয়নি।

কীবল বুঝতে পারলো না কখন সে লাগাম টেনেছে। ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে পড়েছে, তার দুই উরুর মধ্যে হাঁপাচ্ছে, কাঁপছে।

ডিনার শেষে ডানকান শিস দিতে দিতে উঠে গেলে সে-ও শিস দিতে দিতে তার শোবার ঘরে ফিরেছিলো। আর তখন দেখেছিলো, শোবার ঘরের অ্যান্টি-চেম্বারের মেঝেতে একটা মমামের আলোর পাশে আয়া বসে আছে। তখন রাত নটা তো বটেই। বাংলো নিঃশব্দ।

এই, খেয়েছো তুমি? দরজা বন্ধ করে দাও। আশ্চর্য যে কত সহজে ঘটে! ঘোড়াটাও, দ্যাখো, আবার গ্যালপ করছে। আর শেষ রাতে সে বলেছিলো, তার নাম মেহের, সে জুড়ান পাইকের তৃতীয় স্ত্রী। ওটাও একটা নিশ্চিন্ত।

সে অবশ্যই জুড়ানকে ভয় করে না। জুড়ান বল্লম সড়কিতে ওস্তাদ। কিন্তু পিস্তলের কাছে? জুড়ান যদি খুলিফাটা হয়ে আবাদে কোথাও পড়ে থাকে, তার এত শত্রু যে তাদের কে দায়ী খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর ওটা কি একরকমের নিশ্চিন্তই যে জুড়ানের স্ত্রী শেষরাতে তাকে জানিয়েছে, তার উদরে তিনমাসের বাচ্চা আছে।

কীবল নিজের চারিদিকে চেয়ে বুঝতে পারলো, সে মরেলগঞ্জের সীমার বাইরে তো বটেই, রাজাগ্রামের গঞ্জের কাছে এসে পড়েছে। কী আশ্চর্য, এত কালো, সাধারণ,দাঁতগুলো সুন্দর, শরীর নিটোল, আর এত বোকা যে কিছু গোপন করতে জানে না। তাই বলে একজন কি পরের দিন সকালে উঠেই পালাতে পারে? আর যাই হোক, সে বৃটিশ আর্মির একজন অফিসার ছিলো। কীবল ঢোক গিললো। খুব জোরে জোরে সে ছুটেছে নাকি? ফেঁপাচ্ছে যেন কিছু তার ভিতরে। কিন্তু বেডশীট হয়তো ফুলীই এতক্ষণে বদলে ফেলেছে। রাগটাকে সে নিজেই বদলে নেবে। কী আশ্চর্য, সে, লেফটেন্যান্ট আর্থার হোগাৰ্থ কীবল, কী করে পবিত্রতা হারিয়ে ফেলো?

কীবল তাড়াতাড়ি তার ঘোড়াটাকে একটা ঝোপের আড়ালে নিয়ে গেলো। সে দেখতে পেলো একটা ঘোড়া আসছে। তার উপরে এক সওয়ার। অবশ্যই সে ডাকঘরে যাচ্ছে না, সে কি এরপরে ম্যাগিকে, অন্তত আজই, চিঠি লিখতে পারে? সামনে বাঁদিকে বরং সেই ক্যাথরীন বাগচীর বাড়ি।

এখন, ক্যাথরীন বাগচীর কুঠির দিকে কেন এসে পড়েছিলো কীবল তা কখনো জানা যাবে না। যদি এ রকম বলা হয়, সে প্রমাণ করতে চাইছিলো মেহের নামে অদ্ভুত সুন্দর, জন্তুপ্রায়, স্ত্রীজন্তুই একজন তাকে চেনার অতীত বদলে দিতে পারে না; আর ক্যাথরীন নামা ইংরেজ মহিলা যদি তাকে আগের মতোই সহাস্যে রিসিভ করে তাহলে বোঝা যাবে সে ময়লা নয়, তাহলে কিন্তু মনের এমন কথা বলা হয় যার প্রমাণ নেই। এর এই এক সমর্থন, সে লাঞ্চের আগে আগে ফিরেছিলো মরেলগঞ্জে, তখন তার কপালে কুঞ্চন ছিলোনা। উল্টো যুক্তি দেওয়া যেতে পারে। সে লাঞ্চের আগে আগে মরেলগঞ্জে ফিরে গিয়েছিলো, তার ঘোড়াতেই, আর ঘোড়াও ক্যান্টার করছিলো। তখন সে ভাবছিলো–এটা কি খুব ভাবার কিছু? দশ টাকার একট নোট দিলে মিটে যাবে না? দশ টাকা, ত্রিশ টাকা, পঞ্চাশ টাকা? বেশ, আজ রাতে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া যাবে। প্রকৃতপক্ষে এটা এমন ঘটে যাচ্ছে এখানে, জুড়ান পাইক বা ফুলী নতুবা তেমন চোখ পায় কোথায় কালো চামড়ায়? জুড়ান সম্বন্ধে অনেকেই বলে সে মরেলসাহেবের। কিন্তু কাল মেহের বলেছিলো ফুলী জুড়ানের মায়ের বটে, কিন্তু মরেলের নয়। তাহলে? কীবল অবাক হলো আবার–ডানকানেরই! কিন্তু তার মন আবার থমকে দাঁড়ালো–আজ রাতে জিজ্ঞাসা করবে মানে?

কিন্তু সে তখন ঘোটকীটাকে দেখছে। ওয়েলার নয়। মুখটা সরু হওয়ায় ঘাড়টা অপেক্ষাকৃত লম্বা, পাগুলো সরু, যদিও গাঢ় খয়েরি। ঘাম-ধোঁয়ানো নিতম্ব দেখে শক্তির আন্দাজ হয়। ঘোড়াটার পিঠে সুবেশ রূপবান সওয়ার। এটাকেই কি সকাল থেকে খুঁজছিলো? শীতের সকালের রোদে তপ্ত সাদার দাগটানা নীল আকাশের নিচে এমন ঘোটকীটা!

সে নিজেকে বললো–দ্যাখো, দ্যাখো। সে ঝোপটার বাইরে এলো। ছুটন্ত ঘোটকীর পিঠে সেই সওয়ার স্ক্যাবার্ড থেকে লং সোর্ডটাকে টেনে বার করতে চাইছে, কিন্তু সোর্ডটা এত লম্বা যে, দুবার তো তার চোখের সামনেই ঘটলো, তা পেরে উঠছে না। তা করতে গেলে ঘোটকীর বাঁ কানটাই উড়ে যাবে।

অভ্যস্ত ভঙ্গিতে, সে তো ক্যাভালরিরই লোক, কীবল নিজের ঘোড়াটাকে সেই ঘোটকীর প্রায় পাশে এনে ফেলে গ্যালপ করাতে শুরু করে, ক্যাভালরিরই তো কায়দা, বললো–ইউ ডোন্ট ডু ইট লাইক দ্যাট।

অন্য সওয়ার মুহূর্তে ঘোড়ার রাশ টেনে ঘোড়াকে প্রায় পুরো ঘুরিয়ে পাশ থেকে সামনে গিয়ে কীবলের মুখোমুখি হলো, কীবলকেও তখন বিপরীতে চক্কর দিয়ে মুখোমুখি ধাক্কা থেকে নিজেকে আর ঘোড়াকে বাঁচাতে হলো। এক মুহূর্তেই দুজনে দম নিয়ে নিলো। কীবল বললো–আপনি কে হন? প্রিন্স কী? একইসঙ্গে রাজচন্দ্র বললো, তুমি কে? কী তেমন করা যায় না বলছো?

আমি লেফটেন্যান্ট আর্থার হোগাৰ্থ কীবল। ক্যাভালরিতে গ্যালপিং ঘোড়ার উপরে লং সোর্ড টানা হয় না। ঘোড়া এবং পাশের মানুষ ইনজিওর্ড হয়। সেজন্য চার্জের আগেই সোর্ড আনসীফ করা হয়।

কথাগুলো ইংরেজিতে বলে সে প্রিন্সের মুখে বিস্ময় দেখে ইংরেজিতেই জিজ্ঞাসা করলো–প্রিন্স ইংরাজি বলেন কিনা?

রাজচন্দ্র খানিকটা বুঝছিলো। সে ফরাসীতে বললো–তুমি কি ফরাসি বলো? একজন দোভাষী পেলে হতো। আমি রায় রাজচন্দ্র খাঁখানা।

রাজকুমার যেন দোভাষীর জন্য এদিক ওদিক লক্ষ্য করলো। তার মুখ ব্যায়ামের ফলে রক্তাভ, এখন যেন খানিকটা বিব্রত হওয়ার কুমারীর ব্রীড়ার মতো রক্ত চলাচল করছে গালে। সে কিছু না বলে অদূরে বাগচীর কুঠিটাকে দেখিয়ে দিয়ে বললো–কাম।

তার কুঠির এত কাছে দুজনে বলেই বলা যায় ভিন্ন ভিন্ন কারণে তারা বাগচীর বাড়িতেই যাচ্ছিলো।

.

সে সময়ে বাগচী তার স্কুলে ছিলো, মৌখিক পরীক্ষার ফলাফলের ট্যাবুলেশন এবং মডারেশনে সে ব্যস্তই ছিলো। লাঞ্চের পরেই সে বাড়িতে থাকবে স্থির করেছিলো। কেট তাকে বরং সকালের ঘটনাটাকে এ রকম করে বলেছিলো। লাঞ্চের পক্ষে একটু দেরি করেই এসেছিলো বাগচী। কেট বরং অপ্রস্তুত, তার কাজ তখনো শেষ হয়নি। সুতরাং এসো, এসো, কিচেনেই বসো। যেটুকু বাকি তা করতে করতে গল্প করবো। বলে বাগচীকে কিচেনে বসিয়ে কেট বললল : সে তখন সেই লাল সার্জটাকে কাটার জোগাড় করে নিয়েছে, এমন সময় দুজন পুরুষকে একসঙ্গে ঢুকতে দেখে বিস্ময়ে বাকবন্ধ তার। দুজনেরই মুখ লাল। কপালে ঘাম, দুজনের মাথাই যেন তাদের পার্লারের সিলিং ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। একজনের পরনে শালের আচকান,শালের চুস্ত, কুঞ্জাদার মুরেঠা, কোমরে লম্বা সোর্ড। আর একজনের পরনে ফ্ল্যানেলের রাইডিং কোট, ব্রিচেস, হাতে রুপো বাঁধানো ক্রপ। বাগচী মিটমিট করে হেসে বললো–একজন তো রাজকুমার। তখন কেট হেসে বলেছিলো, রাজকুমার হেসে বললেন, কেট, মিট মাই ফ্রেন্ড লেফটেন্যান্ট কীবল, মাই ফ্রেন্ড মিসেস ক্যাথরীন বাগচী। আমার ইংরেজি ফুরিয়ে গেলো। কীবল আমাকে কিছু শেখাতে চায়। তুমি প্রথমে ক্লান্তদের কফি খাওয়াও, পরে দোভাষীর কাজ করো।

কেটের শুধু বিস্ময় নয়, ভয়-ভয়ও করছিলো। কিন্তু গল্পটা বলতে গিয়ে সে অনুভব করলো, তা বোধ হয় বলা যায় না। ভয়ই কি সেটা? কীবলের চাহনিতে কী যেন ছিলো যাকে আগ্রহ জাতের কিছু বলা যায়। এবং তাতে তার মনটা যেন কেমন শিউরে উঠছিলো। যাই হোক, কী করা উচিত বুঝতে না পেরে কেট কফি করতে চলে গিয়েছিলো। ভাবছিলো, সে সময়ে কী না ঘটে। কিন্তু দু মিনিটেই পিয়ানো বাজতে শুনেছিলো। তা যে রাজকুমার তা বুঝতে পেরেছিলো।

কেট কফি নিয়ে এসেছিলো। ততক্ষণে কীবল রুমাল দিয়ে ঘাম মুছে ফেলেছে, রাজকুমার পিয়ানোর টুল থেকে উঠে এলেন। কিন্তু কফি নামাতে গিয়ে কেট দেখলো সেই সেন্টারপিসটার উপরে লাল মখমলে ঢাকা একটা প্রকাণ্ড তরোয়াল। রাজকুমার সেটাকে কোলে নিয়ে বসলে কফি খাওয়া শুরু হলো। আর আলাপও। দোভাষী হিসাবে তাকে মাঝখানে বসতে হয়েছিলো।

রাজকুমার একবার জিজ্ঞাসা করলেন, কীবল আধুনিক যুদ্ধে যোগ দিয়েছে কিনা? যখন গোলাগুলি চলতে থাকে তখন ঘোড়সওয়াররা কীরকম ভাবে অগ্রসর হয়? কীবল বলেছিলো বটে ঘোড়া ছোটানোর আগেই তরোয়াল হাতে নেওয়া হয়, ঘোড়াই বা কী। গতিতে চলে?

এটাকে কেট ইংরাজিতে অনুবাদ করে দিলে কীবল যা বলেছিলো তা ক্রিমিয়ার গল্প। শদলের ব্যাটারি দখল করতে তাদের ক্যাভালরি চার্জ করেছিলো। শত্রুরা প্রস্তুত ছিলো এটা। জানা ছিলো না। ফলে সাতশো জনের মধ্যে তিনশো জন ফিরেছিলো মাত্র। তখন মনের অবস্থা কী রকম হয় বলা যায় না। নেশা, ভয়, পিছুটান, সম্মুখবেগ সবই থাকে। জীবনের প্রথম। নারী কিংবা প্রথম বেত্রক্রিয়ার কথা মনে এসে যেতে পারে, কিংবা নিজের ঘরের কথা। কিন্তু ঘোড়ার উন্মত্ত গতি; কামানের শব্দ, আঘাত; সঙ্গীদের আর্তনাদ ও রাগের চিৎকার; অফিসারদের চিৎকার করে বলা নির্দেশ; তরোয়াল, বল্লম, লাগাম ঠিক করে রাখা; গোলার গর্ত, পড়ে যাওয়া সঙ্গীকে ও তার ঘোড়াকে টপকে যাওয়া; দুপাশের ঘোড়ার ধাক্কা থেকে নিজেকে ও ঘোড়াকে বাঁচানো–অন্য সবকিছুকে মন থেকে তাড়িয়ে দেয়।

কেটের বেশ স্পষ্ট মনে আছে এই কথাগুলো বলতে বলতে কীবল যেন অতীতকে মনে এনে উত্তেজিত হয়েছিলো। কেট প্রত্যেকটা বাক্যের বাংলা অনুবাদ করে যাচ্ছিলো। এই জায়গায় থেমে কীবল বলেছিলো, অফিসাররা ঘোড়ায় ওঠবার আগেই তরোয়াল খুলে হাতে নেয় বটে, কিন্তু এই রকম নয়, এটা ক্যাভালরির তরোয়াল নয়।

কেট এটাকে অনুবাদ করে দিলে রাজকুমার বলেছিলো, এটা ক্যাভালরির কেন হবে? পিয়েত্রোর দ্যাখো, লেফটেন্যান্ট, এটায় সোনার অক্ষরে পিয়েত্রোর নাম লেখা আছে। এই বলে রাজকুমার খাপসমেত তরোয়ালটাকে কীবলের হাতে দিয়েছিলো। কীবল খাপ থেকে তরোয়াল বার করে সোনা দিয়ে এমবস করে লেখা জাঁ পিয়েত্রো দেখে বলেছিলো, আশ্চর্য, এটা সেই ওয়াইলি ফকস পিয়েত্রোর? কেটের নিজের দ্বিধা হচ্ছিলো, পিয়েত্রোকে যে ফকস বলা হলো তা অনুবাদ করা চলে কিনা। কিন্তু রাজকুমার বলেছিলো, কেট, ডারলিং, ফকস মানে আমি জানি। তুমি হয়তো পিয়েত্রোকে রোঁয়া-ওঠা একটা উলফ মনে করো। তা হোক, তুমি বলো, এটা পিয়েত্রো পায়ে দাঁড়িয়ে ভাজতেন।

কেট অনুবাদ করলে কীবল বলেছিলো, তা কীকরে হবে? এ তো ফেনসিং-এর উপযুক্ত নয়।

কেটের তর্জমা শুনে রাজকুমার উঠে দাঁড়িয়ে সস্নেহে তরোয়ালটা খাপসমেত নিজের হাতে নিয়ে মুঠি ধরে তাকে টেনে বার করলো। তখন কেট লক্ষ্য করেছিলো, রাজকুমার কীবলের চাইতেও কয়েক ইঞ্চি লম্বা। রাজকুমার হেসে বললো, কিছুক্ষণ আগেই তো এটাকে নিয়ে খেলছিলাম। তাকেই তো ফেনসিং বলে, না কী?

কেটের অনুবাদ শুনে কীবল বলেছিলো, না, রায় খানখানান, তা আপনার পক্ষে উচিত হবেনা। এটা ফেনসিং-এর ফয়েলনয়। এত ভারি এবং ধারালো তরোয়াল যে এতটুকু ভুলেই খেলার সঙ্গীর প্রাণ যাবে। ফেনসিং-এর তরোয়াল হাল্কা, তুলনায় ছোটো হয়, ধার প্রায় থাকেই না। সে রকম ফয়েলের জন্য কলকাতায় খোঁজ করতে হয়।

রাজকুমার শুনে ভাবলো। পরে বলেছিলো, কেট, জিজ্ঞাসা করো, আমি কলকাতা থেকে ফয়েল আনিয়ে নিলে লেফটেন্যান্ট আমাকে ইংরেজি তরোয়াল চালানো শেখাতে পারে কী না, আর তা শেখালে কত করে কী নেবে?

কেটের তর্জমা শুনে কীবল বলেছিলো, আপনি আনিয়ে নিন, আমি যথাসাধ্য করবো যদি আপনি ইংলিশ স্টাইলটা শিখতে আগ্রহী থাকেন।

কেট এই জায়গায় আর একবার প্রস্তাব করলে রাজকুমার উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলো, কীবলকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ দাও।

কীবল বলেছিল, প্রিন্সকেও ধন্যবাদ। এখন বিশ্বাস করছি, ডানকান যেমন বলেছিলো, আপনার মতো লোক না থাকলে পিয়েত্রো এখানে রক্তপাত ঘটাতে।

কেট এটাকে অনুবাদ করলে রাজকুমার বেশ জোরে জোরে হেসে উঠলো। বললো, তা বটে, তা বটে। একবার পার্লারে পায়চারি করলো, তারপর কীবলের সামনে এসে বাও করে বললো, মের্সি, শের আমি, বঁজুর মঁশিয়ে লেফতেন্যান্ত।

.

০৩.

কীবল লাঞ্চের জন্য ফিরতে ফিরতে কী ভাবছিলো তা বলা হয়েছে। সে যখন মরেলগঞ্জের কুঠির সামনে তখন ভাবলো, ডানকানের ব্যাপারটা ভাবো। উত্তেজনার মুখে কী করে বোঝালো মেহের, ফুলী জুড়ানের বোন হতে পারে, কিন্তু ডানকানের মেয়ে, যদিও সঙ্গে ঘুমোয়। এ কি অ্যাবসলিউট পাওয়ারের লক্ষণ? যা হোক, এটা তো আর মাস দুয়েকের ব্যাপার, তারপর জুড়ানের কাছে ফিরবে, তখন তো ভুলেও যাবে। গোটা দু-তিন গিনি দিলেই যথেষ্ট। কিন্তু কনডিশন, জুড়ান জানলে চলবে না। একই গাধায় সে আর জুড়ান চড়েছে এটা গোপন রাখা চাই।

যখন সে কুঠির সামনে নামবে, ঘোড়র উপরে থাকায়, দৃশ্যটা কীবলের চোখে পড়লো। একটা ছোটো শোভাযাত্রা যেন এগিয়ে আসছে। কিন্তু ঘোড়া থেকে নেমে সে একটু বিষণ্ণ বোধ করলো আবার। মনে মনে বললো– : ম্যাগি, তুমি নিজেই বলেছিলে তুমি সোলজার, তারা একটু এদিক ওদিক করে, কিন্তু সাবধান, খোরপোষ করতে না হয়। যা শুনি সেখানে তো সবই নেগ্রেস। …তাছাড়া, দ্যাখো, কেট কিছু মনে করেনি।

কীবল অবাক হলো, শোভাযাত্রাটা সুরকির পথ ধরে তাদের বাংলোর কাছাকাছি এসে পড়েছে। সামনের লোকটি কি পাগল? গায়ে কামিজ, কিন্তু কোমর থেকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ। তার হাত দুখানা পিঠমোড়া করে বাঁধা, বোধ হয় তারই ধুতিতে। তার বাহু আর পিঠের মধ্যে একটা লাঠি ঢোকানো আর সেই লাঠিটাকে দু প্রান্তে ধরে দুজনে লোকটিকে সামনে ঠেলছে। তারা হাসছে। সেই উলঙ্গ লোকটি ভাঙা গলায় অব্যক্ত চাপা আর্তনাদ করছে।

সিঁড়ির উপরে দাঁড়িয়ে পড়েছিলোকীবল। তারা আর একটু কাছে আসতে কীবল চিনতে পারলো, পিছনের লোকদের মধ্যে একজন জুড়ান পাইক। সামনের লোকটিকেও চেনা-চেনা মনে হলো। একটু ঠাহর করে দেখে নামটা মনে পড়লো। এই সেই অমর্ত্য দাস। লোকটি একদিন ফ্যাক্টরির কাছে খুব প্রতিবাদ করেছিলো বটে। লোকটি ধার্মিক, অবশ্য পেগানরা যেমন হয়, আর কিছু কিছু লেখাপড়াও জানে। আর এখনো তো বোঝাই যাচ্ছে, পাগলরা ধরা দেওয়ার আগে যেমন করে, তেমন ধস্তাধস্তি করে থাকবে, সেজন্য তার গায়ে ধুলো এবং রক্ত।

কীবল বললো–আহা জুড়ান, পাগলকে কষ্ট দেয় না। তাছাড়া এই কুদৃশ্য এদিকে কেন?

কথাটা বলে পিছন ফিরে সে দেখলো, তার আশঙ্কা সত্য হতে চলেছে। ঘেরা বারান্দার জালের ওপারে ফুলী দাঁড়িয়ে, যেন উপভোগ করছে।

জুড়ান জানালো, এখনো পূর্বদিকের গ্রামটাতে ঘোরানো হয়নি। এর আত্মীয়স্বজনরা সেদিকেও আছে, তারা দেখবে না? মুহূর্তে কীবল বুঝতে পারলো, সেটা পাগলকে আটকানোর ব্যাপার নয়। উদ্দেশ্যটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু সেটা এক অভূতপূর্বশয়তানী জুড়ানের।

লাঞ্চে সে ডানকানকে বললো, ডানকান প্রথমে না জানার ভান করলো। পরে বললো, মারধোর করলে কমিশন দোষ দেখবে। এটা কি এমন অপরাধ পিনালকোডে কোনো ধারায় পড়বে? সে হাসলো। পরে আবার বললো, যাই হোক লোকটা অসন্তোষ ছড়ায়। তুমি চিনে রাখলে ভালো করবে। রায়তদের বলছে, দাদন নিও না, ঋণ নিও না। পিছিয়ে পিছিয়ে যাও, এড়িয়ে এড়িয়ে চলো।

বুদ্ধিটা তবে তোমার? কীবল জিজ্ঞাসা করলো।

ডানকান হো হো করে হেসে বললো, বিশ্বাস করো, তা নয়।

কীবলের একবার মনে হলো, পুরুষের কি এত চাইতে বড়ো অপমান আছে?

কিছুক্ষণ পরে আবার তার মনে হলো, এ অবস্থায় ভারতীয় স্ত্রীলোকেরাও বোধ হয় রটায় না। তাছাড়া এই তো ডানকানও, সেখানে কেট এমনকী প্রিন্স যেমন, কেউই কিন্তু তাকে দেখে কোনো পার্থক্য বুঝতে পারছে না।

.

লাঞ্চের শেষে কেট ও বাগচী পার্লারে বসবে ঠিক করলো। বাগচী জানালো, তখন আর সে স্কুলে যাচ্ছে না। কেট জানালো, বাগচীর আপত্তি না থাকলে সে সার্জের জামাটাকে কাটা শেষ করবে। বাগচী জানালো, তা করতে করতে কেট যদি গল্প করে তবে বাগচীর আপত্তি থাকবে না।

কিন্তু পার্লারে ঢুকে কিছুক্ষণের জন্য আবার তারা পুরনো কথায় ফিরে গেলো।

বাগচী বসতে গিয়ে অবাক, বললো–আরে এ কি? এই দ্যাখো, এটাই কি সেই তরোয়ালটা রাজকুমারের, যার গল্প করছিলেন? কী কাণ্ড!

কেটও অবাক। বললো–আচ্ছা অন্যমনস্ক তো রাজকুমার। এখন কী হবে?

বাগচী বললো–তুমিও কম অন্যমনস্ক নও! নইলে এর আগেই দেখতে পেতে। কিন্তু। এখন? এ তো মারাত্মক ব্যাপার। দিয়ে আসবো? নাকি কাউকে দিয়ে খবর পাঠিয়ে রাজকুমারের কাছে জানতে চাইবো? রসো, না হয় শোবার ঘরের কার্ডে রেখে আসি।

বাগচী খাপসমেত তরোয়ালটা শোবার ঘরে রাখতে গেলো। তখন কেট আবার একটু ভাবলো। তার মুখ তো চিন্তার ফলেই উজ্জ্বল। তার সেই সকালের দৃশ্যটা মনে এলো, পাশাপাশি যেমন কীবল ও রাজকুমারকে দেখেছিলো। সুন্দর! দুজনকেই দু রকম সুন্দর দেখাচ্ছিলো। তফাতও আছে। তার আবার মনে পড়ল,কীবলের চোখ দুটিতে যেন নেশার মতো কোনো আগ্রহ ছিলো। অন্য দিকে রাজকুমারের চোখ দুটি যেন দূরকে দেখছিলো। নাকি অস্থির বলবে? অস্থিরতাই বোধ হয়। দুজনকে মুখোমুখি বসিয়ে কফি করতে গিয়ে সে তো নিশ্চয়ই আশঙ্কা করছিলো, সেই আতপ্ত উত্তেজিত পুরুষ দুটি কী বা ঘটায়! কিন্তু তার মধ্যেই হঠাৎ পিয়ানো শুনেছিলো। কেটের মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হলো।

বাগচী ফিরে বললো–দ্যাখো, একজনের যা খেলার, অন্যের তাতে কত ভয়?

কেট বললো, কিন্তু জানো একটা কথা? কীবল সৈনিক, সে বোঝে। এ নিয়ে কি রাজকুমারের ফেনসিং খেলা উচিত হচ্ছে?

বাগচী ভাবলো, এটা কি ছেলেমানুষের অজ্ঞতা? তাহলে কি আজ সন্ধ্যায় দেখা করে এটাকে খেলায় ব্যবহার করতে নিষেধ করবে? বললো–তুমি একটা অসুবিধায় ফেললে, ডার্লিং ।

কেটও ভাবছিলো। সে বুদ্ধি করে বললো, এক কাজ করলে হয়। আমি কী নয়ন ঠাকরুনকে বলে দেবো?

এই সময়ে কেট ভাবলো, এসব কি রাজকুমারের অস্থিরতা? নাকি চপলতা বলবে? নাকী কিছু না ভেবে যেদিকে খুশি বয়ে যাওয়া?

সময় তখন সন্ধ্যার দিকে। আলোর রাত নয়, অন্তত চাঁদের আলো থাকলেও নিতান্ত ক্ষীণ ছিলো। বাগচীইতিমধ্যে তার স্টাডিতে, কেট সন্ধ্যায় কফি তৈরীকরতে কিচেনে। কেট শুনতে পেয়েছিলো, পার্লারে কারা কথা বলতে বলতে ঢুকছে। সে বেরিয়ে এসে আপাদমস্তক চাঁদরে ঢাকা নয়নতারা এবং পুরো ইংরেজি পোশাকে রাজচন্দ্রকে দেখতে পেলো। তার উচ্চকণ্ঠের অভ্যর্থনার সাড়া পেয়ে বাগচীও বেরিয়ে এসেছিলো।

তাদের বসিয়ে বাগচীকে সেখানে রেখে কফি করে আনলো কেট।

রাজচন্দ্র তখন বললো, দ্যাখো, কেট, কেমন ধরে এনেছি। বাড়ি ফিরছিলেন দিনের কাজ শেষ করে। আমি তো বাপু আজ আমার বেতো চওড়া পিঠের ঘোড়াকে ব্যায়াম করাবো বলে রাস্তার পাশ দিয়ে চলেছিলাম। এদিকে পালকিটা দেখি রাজকুমারকে অগ্রাহ্য করে সার্বভৌমপাড়ায় ঢোকে। থামাতে হলো। তো দেখি পাতার আড়ালে ঘুমন্ত ফুল। বললুম, চলল, না হয় একটু ঘুরি। রাজী কি হয়? শেষে বললুম, যা কখনো দ্যাখোনি তাই দেখাবো। পিয়ানো বাজাবো তোমার সামনে। অবশ্য পথে অন্য সমস্যাও উঠেছে।

নয়নতারা নিভৃতে কেটকে চোখের ইশারা করলো, যেন বললো, সবটুকু বিশ্বাস করবে কি?

উৎসাহিত কেট বললো–তাহলে কফির পরে পিয়ানো হোক। সকালে যেটা একটু হচ্ছিলো।

রাজচন্দ্র বললো–আপত্তি নেই। কিন্তু তার আগে মাস্টারমশাই আমাদের মামলাটা শুনুন।

নয়নতারা বিপন্ন বোধ করলো। কিন্তু এই বুদ্ধি করলো, বাধা দিলে উল্টোপাল্টা ফল হবে, অনেক অর্ধসত্য রসিকতাচ্ছলে বলে যাবেন রাজকুমার। মুখে কিছু আটকাবে?

রাজচন্দ্র বললো, মামলার বিবরণ দেওয়ার আগে একটা ফয়সালা হোক। একজন জমিদার তার প্রজাকে নিঃশর্ত কিছু দান করতে পারে কিনা?

এটা তো একটা হাল্কা মেজাজের কিছু, যা খেলার মতো। বাগচী বললো–দানের অধিকার সকলেরই আছে, আর তা নিঃশর্ত হওয়াই উচিত।

নয়নতারা নিচু গলায় বললো, মাস্টারমশাই ডিক্রি দিলেও, রাজকুমার, মামলাটা উঠে যায় না। দানটা যদি জমি হয় তবে বুঝতে হবে রাজকুমার তা অন্য কোনো প্রজার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে দান করবেন।

হাসিমুখে বাগচী বললো–তাহলে আমি বোধ হয় ভুল করেছি। এ কথাটাও ঠিক বটে, রাজকুমারের সব জমিই কোনো না কোনো প্রজার দখলে থাকার কথা। মামলার বিবরণটা শোনা দরকার।

রাজচন্দ্র বললো–জনৈক মহিলার প্রিয়জনের পাপস্খলনের জন্য এই বৈশাখে জলদানের ইচ্ছা দেখা দিয়েছে। জলদান নাকি প্রাণদান। জলদানের সব চাইতে ভালো উপায় দীঘি খুঁড়ে দেওয়া। দীঘি তো শূন্যে হয় না। জমিতে হবে। আর জমি দীঘি হয়ে গেলে সেখানে চাষের জমি কিংবা বসত বাড়ি আর থাকে না। এখন সেই মহিলার ধারণা চাষের জমি কিংবা বসত বাড়ি নাকি শুধু তাই নয়, অনেক স্মৃতিতে জড়ানো নিজের জীবনের অংশ।

বাগচী বললো–তো বটেই। একথা একশোবার সত্য।

-সেই মহিলার মতে প্রত্যেক পুরুষের একমুঠো মাটি থাকা দরকার, যা তার জীবনের দুর্গ, যা গেলে নাকি তার পৌরুষেরও কিছু থাকে না।

বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–জমিদার যদি জমিটা কিনে নেন দান করার আগে?

–সে নাকি আরো খারাপ। তা নাকি টাকার প্রলোভনে নীতিভ্রান্ত করা। ঘুষ দিয়ে দুর্গ দখল। বাগচী এক মুহূর্ত ভেবে নিলো। আন্দাজ হচ্ছে এটা রাজকুমার এবং নয়ন-ঠাকরুনের মধ্যে কোনো ব্যাপার। হয়তো লঘু প্রমোদও আছে। সে বললো, রাজকুমার যদি গ্রামের মাঝখানে একটা দীঘি কাটিয়ে দেন তাহলে কিন্তু জনসাধারণের উপকারই হয়।

নয়নতারা বললো–রাজকুমার, আপনি না হয় আপনার আর্জিটা মাস্টারমশাইকে দিয়ে যান। উনি দেখবেন। কফি খাবেন না কী বলছিলেন? কিংবা নাকি বাজনা হবে?

বাগচী বললো–ও, হ্যাঁ। রাজকুমার আপনার সেই তরোয়ালটা। সেটা তো এখানেই রয়েছে।

কেট বললো–রাজকুমার, ও কফিটা আপনি খাবেন না, জুড়িয়ে গিয়েছে। আমি আবার করে আনছি।

কেট কফি করতে উঠলো। বাগচী তরোয়ালটা আনতে গেলো। রাজকুমার উঠে পিয়ানোর দিকে গেলো। বাগচী তরোয়াল এনে সোফার উপরে রাখলো। রাজকুমার পিয়ানোর ডালা খুলে কিছু ভাবছে তখন। নয়নতারা একেবারে স্থির হয়ে বসে।

কিন্তু পার্লারের দরজার কাছে এসে কেট নয়নতারাকে ডাকলো। নয়নতারা সেদিকে উঠে গেলো। কিছুক্ষণ তারা কিচেনেই আলাপ করলো সম্ভবত। কেট কফি নিয়ে ফেরার আগে নয়নতারা ফিরলো না।

কেট টিপয়ে কফি রাখলে রাজচন্দ্র সেদিকে এসে বসলো।

রাজচন্দ্ৰ কফি নিলে নয়নতারা বললো–একটা কথা বলবো। ভরসা দেবেন? এ ব্যাপারে মাস্টারমশাই আর কেটও আগ্রহী। কীবল নামে একজন গোরা সিপাহী নাকি আছে। সে নিশ্চয় আমাদের চাইতে ভালো চেনে অস্ত্রশস্ত্র।

রাজচন্দ্ৰ কফিতে চুমুক দিয়ে বললো–সন্দেহ কী? নইলে কি বাহাদুর শা, কি নানা এমন মার খায়? অন্তত ব্রিচলোডার রাইফেল আরো সংগ্রহ করা উচিত ছিলো নামার আগে।

নয়নতারা বললো–আমি শুনেছি কদার সঙ্গে সকালে রোজ তরোয়াল খেলেন আজকাল?

–তাতে কী?

-কীবল বলেছে, কেটও এখন বলছে, এই ধারালো তরোয়াল নিয়ে তা উচিত হয় নানয়নতারা বললো।

বাগচীও বললো–হ্যাঁ, রাজকুমার, নয়নতারা-ঠাকরুন এ বিষয়ে ঠিকই বলছেন।

নয়নতারা হাসতে গেলো, কিন্তু তার স্বরটা গাঢ় হলো। বললো–এটা আমাকে দান করতে হবে, রাজকুমার।

রাজকুমার একটু বিস্মিত হয়ে বললো–ও! কিন্তু সে নয়নতারার মুখের দিকে চাইলো। একমুহূর্ত পরেই হেসে বললো, মাস্টারমশাই, আপনি সাক্ষী, নয়নতারা আমার দান নিতে রাজী হয়েছে। তা হলে বলো, দীঘিটা কোথায় হচ্ছে, কতটা লম্বা চওড়া হবে?

বাগচী ও কেট এতক্ষণের আলাপের এদিকে গতি দেখে কৌতুক ও আনন্দে হাসিমুখে বসে রইলো। কিছু বলতে ভুলে গেলো। নয়নতারা নিচু গলায় চোখ নিচু করে বললো–তাই যদি শর্ত হয় হোক, তাহলে কিন্তু এটা আর খেলা হবে না।

সেদিন কিন্তু পিয়ানো বাজানো হলো না। রাজচন্দ্র পিয়ানোর কাছে গেলো, পিয়ানোর ডালা খুলে বললো–সেই সকালেরটাই বলছো? তাহলে তোমরা কাছে এসো। কিন্তু পিয়ানোর ডালায় আটকানো রূপার ফলকটা আর তাতে লেখা নামটা এই সময়ে তার চোখে পড়লো। রাজচন্দ্র বললো–দেখে যাও নয়ন।

নয়নতারা কাছে গেলে বললো–দেখছো? এটা একটা বিলিতি নাম। উচ্চারণ বাইচে। বলল তো কেন? পিয়েত্রোরা শুধু তরোয়ালবাজ ভাবলে ভুল করবে। এটা তার প্রেমিকার নাম। এই নামে তিনি ডাকতেন তাকে। কেটও বিস্মিত হলো। নয়নতারা তোহবেই। কেটের বাড়িতেই তো পিয়েত্রোর এই পিয়ানো রাখা হয়েছিলো।

পুরনো প্রেমকে লোকে ঠাট্টা করতে পারে। নয়নতারা বললো–সেই ফরাসী মহিলা কি এদেশে আসতে রাজী হয়নি?

রাজচন্দ্র বললো–তাহলে আর একটু গোড়া থেকে বলতে হয়। পিয়েত্রোর জননী ভারতীয় মহিলা ছিলেন তা কি তার আনুকূল্যে বসানো এই স্কুল থেকে আন্দাজ করতে পারোনি? মায়ের নাম পিয়েত্রো আমাকে বলেননি বটে, কিন্তু আমার ধারণা তার নাম জ্ঞানদা ছিলো। পিয়েত্রোর মামা ছিলেন এক স্মার্ত ব্রাহ্মণ। তিনি তাঁর বিধবা বোনকে পিয়েত্রোর পিতার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে স্বদেশ ও স্বসমাজ ত্যাগ করেছিলেন। পশ্চিমের কোনো তীর্থশহরে বাস করতেন বলে ধারণা হয়। তখন পিয়েত্রোর বয়স হয়েছে, চল্লিশের দিকে চলেছে। জাহাজের ব্যবসা করেন। এদেশের রেশম ও মসলিন ইউরোপে পাঠান; উত্তর-ভারতেও বন্দুক, ব্রোকেড ও রেশমের ব্যবসা করেন। পিয়েত্রো কখনো কখনো সেই স্মর্তবাড়িতে যেতেন। সেই স্মাৰ্তমশায়ের পরিবারের কন্যাদের ফরাসিনী না হয়ে স্মার্তকন্যা হওয়াই স্বাভাবিক। চোখে চোখ না পড়লে ভালোবাসাও হয় না। নিজের মনের মতো করে নাম রাখাও যায় না। ওদিকে স্মার্তকন্যারা যে কী নির্দয় হতে পারে!

স্মার্তকন্যা নয়নতারার ভ্রুকুটি কেট ও বাগচী লক্ষ্য করলো না, কারণ কটাক্ষটা হলো শালের অবগুণ্ঠনের ভিতর থেকে।

বাগচী বললো, পিয়েত্রোর কাছে আমি যা শুনেছি তাতে মনে হয়, এটা চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ের কথা।

রাজচন্দ্র বললো–তা হতে পারে। সেখানেই পিয়েত্রো সেই ফুটফুটে ননীর পুতুল হেন চতুর্দশীকে দেখে থাকবে, আর সঙ্গে সঙ্গে,তার নিজের ভাষায়, নিজের হৃদয় দুহাতে উপড়ে সেই বালিকার পায়ে রেখেছিলেন। আসলে তার তো আর ইটালীয়ান নাম হয় না। তাকে না পেয়ে অতৃপ্ত মধুর যন্ত্রণায় এক ইটালীয়ান মহিলার স্মরণে তার নাম রেখেছিলেন। বিয়াত্রিচে, যেটা সংক্ষেপে এই বাইচে।

কেট বললো–এমন একটা ছোট্ট মেয়েকে পিয়েত্রোর হৃদয় দেওয়া উচিত হয়নি।

বাগচী বললো–কেট, আমি কিন্তু আসল বিয়াত্রিচেরও এরকম বয়সই ছিলো বলে পড়েছি। তাছাড়া ভালোবাসা বোধ হয় বয়সকে গ্রাহ্যে আনে না। তাকে যখন চিকিৎসা করতাম, পিয়েত্রো বলেছিলেন, সেই বালিকার প্রেম চাপার সুঘ্রাণের চাইতেও সুন্দর ছিলো, এমনকী সর্বশ্রেষ্ঠ ফরাসী মদের বোকেও তার তুলনায় কিছু নয়।

কেট বললো–এটা কিন্তু ফরাসী অতিশয়োক্তি, যদিও সুন্দর।

— নয়নতারা বললো–শেষ পর্যন্ত কিন্তু বয়সের, ধর্মের ব্যবধান বাধা হয়।

বাগচী বললো–আমার তা মনে হয়নি। সেই মহিলা ছিলেন পিয়েত্রোর সেই স্মাৰ্তমামার মেয়ে। হিন্দুদের মধ্যে এ রকম সম্বন্ধ থাকলে বিবাহ হয় না।

বাগচী তার পাইপ ধরালো। রাজচন্দ্র পিয়ানোর উপরে আঙুল রাখায় তার ঝংকার উঠলো। কিন্তু সে বরং কেটের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো–গুড নাইট কেট, এরপরে বাজালে চাপার সুঘ্রাণটা থাকে না। অন্য একদিন এসে সকালের সেই বাজনার স্কোর তোমাকে দিয়ে যাবো। ভালোই। আমি নাম জানতাম না। শ্যা নামে একজনের।

রাজচন্দ্র উঠে তরোয়ালটাকে কোমরে বেঁধে নিলো। নয়নতারা হেসে বললো–এ পোশাকেও তো ওটা বেশ মানায়। তারা দরজার দিকে গেলে বাগচী ও কেট তাদের এগিয়ে দিতে গেলো গেট পর্যন্ত। এই সময়ে কেট দেখতে পেলো পায়রার ডিমের রং-এর শালের ঘোমটা মুখের দুপাশ বেয়ে নেমে এমনকী হাত দুখানাকে ঢেকে নয়নতারার হাঁটু অবধি নেমেছে। শালের ঘেরের নিচে লাল স্বচ্ছ শাড়ি। সারা গায়ে অলঙ্কার নেই, কিন্তু জুতা ছাড়া সুন্দর পা দুটোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেই যেন একজোড়া সুন্দর অ্যাংকলেট, তা সোনারই হবে। রাজকুমারের গায়ের জ্যাকেটটার গাঢ় আকাশী রং, ট্রাউজার্সটার নীলে সাদা টান। একটা ঘোড়া বাঁধা আছেবটে। বাইরের সন্ধ্যা তো এখন প্রায় গাঢ় খয়েরি। চাঁদ আলো করতে পারছে না। কেট শুনলো, নয়নতারা বলছে, পালকিটাকে তাড়িয়েছেন দেখছি।

নয়নতারা ও রাজকুমার হাঁটতে শুরু করলো। ঘোড়াটা নিজে থেকেই পিছনে চললো।

কেট ঘরে ফিরতে ফিরতে সুখী মুখে ভাবলো, রাজকুমার যেমন বলেছিলেন ঘোড়াটাকে। চওড়া পিঠের মনে হচ্ছিলো। তাহলে তারা সরে গেলে রাজকুমার কি নয়নতারাকেও ঘোড়ায় তুলে নেবেন?

.

০৪.

এ রকম সংবাদ আছে, সেই বৎসরের শীতেই সেই প্রথম অ্যালবেট্রস নামে স্টিমশিপ রাজনগরের নদীতে চলাচল করেছিলো, কুতঘাটে একবেলা থেমেছিলো। যে রাজনগরের কাছাকাছি রেলরোড ছিলোনা তখন, যে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের কাছে স্টিম-এঞ্জিন মাত্রই তখনো গল্পের বিষয়, সেই এক কুয়াশা-আচ্ছন্ন নদীর বুকে ভোরের অস্পষ্টতার সেই কলের জাহাজ তার আলো এবং হর্ন, এবং কালো আকৃতি নিয়ে নিশ্চয়ই বিস্ময়, কৌতূহল এবং অজানা আশঙ্কার সৃষ্টি করে থাকবে। তা যেন এমন এক একচক্ষু জলদানব যার অশুভ উচ্চ ছাগনিনাদের কথা এমনকী কোনো কাব্যে-পুরাণেও বলা যায়নি। হরদয়ালের চিঠিপত্র থেকে একটা মন্তব্য পাওয়া যায় :

স্টিমশিপ অবশ্যই উন্নয়নের সহায়ক হইবে। ব্যক্তিগতভাবে এই প্রচেষ্টাকে আমরা সমর্থন করি, কেননা যেখানে নদীপথ আছে সেখানে রেলপাতার তুলনায় স্টিমশিপ লাইন প্রবর্তন অনেক কম শ্রমে ও অনেক কম ব্যয়ে হইতে পারে। কিন্তু বলিব কী, হয়তো বহু দিনের সংস্কারে মনে হইল সব দিক দিয়া আচ্ছন্ন হইলেও হয়তো বা রক্তে কোথাও আরোগ্যের বীজ ছিলো, কিন্তু এই স্টিমশিপ যেন নদীরূপ শিরা বাহিয়া দেশের অন্তঃকরণকেও আক্রমণ করিল। কিছু আর অজিত রহিল না।

এই স্টিমশিপ কেন এসেছিলো তা নিয়ে মতদ্বৈধ কিছু আছে। অ্যালবেট্রস জাহাজ যে একবেলা কুতঘাটে ছিলো সে ঠিক নয়। কারণ সেটা পরে নিয়মিত কয়েকবার এসেছিলো। এরকম মত আছে এই অ্যালবেট্রস স্টিমশিপে সেই শীতেই পরে জঙ্গীলাট এসেছিলো রাজনগরে। জঙ্গীলাট যে এসেছিলো এবং প্রায় এক সপ্তাহ ছিলো রাজনগরে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আছে : রাজবাড়ির সেই বুলন্দ-দরওয়াজার অনুকরণে তৈরী সদরদরজার সামনে রাখা ক্যারেজসমেত দুটি গান মেটালের কামান। কামানের চোং-এ মেরামত করা ফাটল থেকে তার ব্যবহারযোগ্যতা সম্বন্ধে নিশ্চয় সন্দেহ করা যায়। কিন্তু তার গায়ে খোদাই করা সংবাদ থেকে জানা যায় কামান দুটি কানপুরকে বিদ্রোহমুক্ত করতে ব্যবহার হয়েছিলো। এবং তা জঙ্গীলাটের উপহার। অ্যালবেট্রস জঙ্গীলাটকে নিয়ে যাওয়া-আসা করেছিলো তা প্রায় নিশ্চিত।

প্রথমবার তা হয়তো জলপথের গভীরতা নাব্যতা ইত্যাদি পরীক্ষা করতেই এসেছিলো, পরে কিছুদিন কিন্তু মাঝেমাঝেই আসতো, অন্তত যতদিন শীতের ভাবটা ছিলো। বসন্তের মাঝামাঝি হঠাৎ একবার চলে গিয়ে আর আসেনি। ডুবেছিলো কি? পরে, তা অনেকদিন পরেই, অন্য জাহাজ চলতো এই লাইনে। কিন্তু এটা সম্ভব নয় যে ইন্ডিগো কমিশনের সাহেবরা এসেছিলো অ্যালবেট্রসে। কারণ অ্যালবেট্রস প্রথম এসেছিলো সরস্বতী পূজার সকালে, তখন জানুয়ারির শীত, আর ইন্ডিগো কমিশনের সভ্যরা এসেছিলো ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। ক্রিস্টমাসের বরং আগে।

সুতরাং ডিসেম্বরের কথা আগে বলে নিতে হয়। তখন স্কুলের পরীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। প্রমোশন শুধু বাকি। বাগচী এবং শিক্ষকেরা নতুন বছরের শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক নিয়ে আলোচনার জন্যই দুপুরে একবার করে স্কুলে যাচ্ছে। বাগচীর হাতে ঢালা অবসর। ব্রেকফাস্টের পরও সে এখন মাঝে মাঝে স্টাডিতে ঢুকে লাঞ্চের সময় পর্যন্ত কাটিয়ে দেয়। কেটকেই বলতে হয় স্কুলে যাবে কিনা সে? সন্ধ্যায় মাঝে মাঝে রাজবাড়িতে যাওয়া আছে। সেখানে রাজকুমারের সঙ্গে অথবা হরদয়ালের সঙ্গে সময় কেটে যায়। একজন হেডমাস্টারের পক্ষে পড়ার ঝোঁক থাকাই স্বাভাবিক। শুধু স্কুলের পাঠ্যপুস্তক পড়ে নির্বাচন করাই নয়।

নিজের পড়াশোনা আছে। কেট লক্ষ্য করেছে হিন্দু পেট্রিয়টের পুরনো ফাঁইলগুলোর বদলে তারই নতুন সংখ্যাগুলো এখন বাগচীর টেবিলে। ইমিটেশন অব ক্রাইস্ট বইটা তাকে তোলা, তার বদলে নিও-প্লেটোনিক দর্শন পাঠ হচ্ছে কখনো কখনো।

আগের দিন সন্ধ্যায় রাজবাড়ি থেকে ফিরে বাগচী বলেছিলো, রাজকুমার, রানীমা, দেওয়ানজি ঠিক পনেরোই ডিসেম্বর রওনা হবেন। দুখানা বোট আছে। সঙ্গে আরো কয়েকখানি দেশী নৌকো থাকবে। আমাদের যাওয়া তো একরকম ঠিকই। দেওয়ানজি বলেছেন একটা-দুটো পোর্টম্যান্টোতে পোশাক নিলেই হবে শুধু।

কেট বললো–এখনো দিন সাতেক দেরি। একটা কথা কিন্তু বলি।

বাগচী চোখের সামনে থেকে বই সরিয়ে কেটের দিকে ফিরলোবলো, কিছু ভাবছো মনে হচ্ছে।

একটা কথা কি–না, তোমার স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে তা কখনোই নয়, কিন্তু কথাটা কি, তুমি কিন্তু বেশ অনেকদিন থেকে বাড়িতেই বসে থাকছে।

–কেন, মাঝে মাঝেই রাজবাড়িতে যাচ্ছি না, স্কুলে ছাড়াও?

বলবো কি? প্রায় সপ্তাহ তিনেক হয়, তুমি কিন্তু কি সকালে, কি বিকেলে তোমাদের সেই ডিসপেনসারিতে একবারও যাওনি বোধ হয়।

বাগচী যেন বিস্মিত হয়ে গেলো এই আবিষ্কারে। কিছুপরে হেসে বললো–কেন যেতে হবে? সেটা কি আমার প্রফেশন? সে বেশ খানিকটা হো হো করে হাসলো কেটের অযুক্তি ধরে ফেলে।

সেদিন সকালে উঠেই বাগচী বললো– কথা তুমি মন্দ বলোনি, ডারলিং। চলো, আজ। সন্ধ্যায় আমরা দুজনেই দেওয়ানকুঠিতে যাবো। তারা সেদিন সন্ধ্যায় দেওয়ানকুঠিতে অনেকটা সময় কাটালো। তারা লাইব্রেরিতেই ইচ্ছা করে বসেছিলো, সুতরাং আলাপে বই এর কথাই বেশি হলো। আসবার সময়ে বাগচী নিজে থেকেই বললো–দেওয়ানজি, আমি ভেবে দেখলাম রাজকুমারের সেই চাকরিটা আমার গ্রহণ করাই উচিত হচ্ছে। তা শুনে হরদয়াল বললো–এটা খুব ভালো সংবাদ। আমি রানীমাকে জানিয়ে দেবো।

তারা যখন পথে বেরিয়েছে, তখন মাঝারি ধরনের জ্যোৎস্না পথে। এতক্ষণ আলাপের পরে তারা দুজনেই নিঃশব্দে চলেছিলো। তারা যখন গঞ্জের কাছে, কেট বললো–চাকরিটা কিন্তু অন্য জাতের। হঠাৎ কথা দিয়ে ফেললে না তো?

বাগচী বললো–কেন? ওটা কি একরকমের শক্তি দেয় না, ওই রকম চাকরি? হঠাৎ কেন?

কিন্তু হঠাৎ দৃশ্যটা তাদের চোখে পড়লো। গঞ্জের দোকানগুলোতে আলো থাকে, কিন্তু তারপরেই রাস্তাটা বরং আজ আলো-আঁধারি থাকার কথা, কিন্তু কিছুউঁচুতে একটা ফানুসের মতো আলো যেন। কেট তাই বলে বাগচীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। কিন্তু ভালো করে দেখে ফানুস বলা গেল না। বিস্মিত কেট জিজ্ঞাসা করলো–স্ট্রিট লাইটিং! আশ্চর্য! এই গ্রামে?

বাগচী বললো–হতেই পারে, হতেই পারে। কে যেন বলছিলো আমাদের গ্রামটা মিদনাপুর না হুগলির মতো শহর হতে চলেছে।

তাদের বেড়াতে ভালোই লাগছে, মনটাও লঘু। কেট বললো, তাহলেও আশ্চর্য হতে হবে। দ্যাখো, মিদনাপুর আর হুগলি কলকাতার কথা নাই তুলোম, সেসব জায়গায় আলো দেয় তো গভর্নমেন্ট, দেশের রাজা। এখানে এঁদের কি এত টাকা? আর এঁরা দেশের রাজাও নন।

বাগচীও লঘুভাবে বললো–অপচয় বলছো? এঁদের উপরে দেশের মঙ্গল দেখার ভার নেই বলছো? দ্যাখো, ডারলিং, আমরা নেহাত মধ্যবিত্ত। মধ্যবিত্ত নয় এমন এক দলের কাছাকাছি ঘেঁষে কি আমাদের এসব চিন্তা? সে হেসে নিলো। বললো, টাকা থাকলে অপচয় হয় বটে, কিন্তু দ্যাখো তার কিছু ঘটানোর ক্ষমতাও আছে।

কেট বললো–ডারলিং, ইতিমধ্যে তুমি যেন রাজবাড়ির ধরন-ধারণকে ভালোবেসে। ফেলেছো।

বাগচী হো হো করে হেসে বললো–বলছে, চাকরি পাওয়ার আগেই হলো? কিন্তু একটু গম্ভীর হলো সে। বললো, টাকা, টংকা, রূপিয়া, পৌন্ড যে নামেই বলো, ক্রাইস্ট অনেক দিন আগেই বলেছেন, ওটা থাকলে স্বর্গে যেতে দেরি হয়। হয়তো এ রাজবাড়ির পিতামহ পিতার সময়ে লুটপাট ইত্যাদি অর্থ সংগ্রহের ভিত্তি ছিলো। আমার তো মনে হয়, ও জিনিসটার সঞ্চয়ের গোড়ায় লুট, ধ্বংস, নৃশংসতা থাকেই। যদিও এখানকার প্রচুর ধনের কারণ কার্পণ্য। তুমি, উৎসবের রাতে দেওয়ানজি যা বলেছিলেন মনে করো। তিনি হয়তো বলতে চাইছিলেন কলকাতার কোনো কোনো রাজা যেমন সাহেব-মেমেদের মদ আর খানা দিয়ে লাখপতি থেকে কোটিপতি হতে চলেন, এখানে এই এক আধুনিকতা যে ইংল্যান্ডের ধার্মিক মানুষদের মতো রানী স্টকে এবং কম্পানির কাগজে টাকা রেখে যাচ্ছেন।

-তুমি কি সত্যি বিশ্বাস করো–ধর্ম অর্থাৎ পিউরিটানদের যেটা, তার সঙ্গে টাকার যোগ আছে?

–আদৌনা। এখান থেকে লুটপাট করে যারা ন্যেবর হয়ে ফেরেন তারাও স্টকে ঢালেন। কিন্তু আমার সন্দেহ তারা অন্য স্রোতেও ঢালেন। ফলে যারা সেখানে তিল তিল করে সঞ্চয় করে আর আচার ব্যবহারে পিউরিটান, অন্তত নির্দয়ভাবে মর্যালিস্ট তারাই প্রায় সব রেলরোডের মালিক।

-তুমি কিন্তু টাকার শক্তির দিকটাই তুলে ধরছো শুধু।

-তা তো বটেই, তা তো বটেই। এমনকী এখানে ডানকানের যে শক্তি তাও তো তাই। নয় কি?

সেদিন ডিনারে বসেও বোধ হয় তাদের মনে হালকা ভাব ছিলো। তারা যেমন গল্প করছিলো তেমনই করতে লগলো। কিন্তু হঠাৎ কেট বলে বসলো, তোমাকে একটা গল্প বলতে পারি।

বাগচী বললো–নিশ্চয়। বলো।

কেট বললো–কতগুলি শক্তি নয় কি যা আমরা দেখি? যেমন ধরো রাজকুমার এই গ্রামের একরকম শক্তির প্রতীক।

বাগচী বললো–ভেরি গুড। তাই বলে ডানকানের শক্তি থাকলেও তাকে কিন্তু অন্য নাম দিতে হয়।

কেট বললো, বলতে দিচ্ছো না কেন? যেমন ধরো দেওয়ানজি আর একরকমের শক্তির প্রতীক।

–এটা অস্বীকার করা যায় না। তুমি তৃতীয় শক্তির প্রতীক হিসেবে তাহলে রানীমাকে দেখছো? কেমন ধরিনি?

বাগচী খুশিতে হাসলো।

কেট বললো–তা হবে কেন? আমাকে বলতে দিচ্ছে না। তৃতীয়টি এক দারুণ মর্যাল শক্তি। আমার আনন্দ, তার প্রতীক আমার ঘরে।

বাগচী যেন চমকে গেলো। হাসতে গিয়ে গম্ভীর হলো। ঠাট্টার সুরে বললো, এ একেবারে নিজের কোলে ঝোল টানা। রাজকুমার আর দেওয়ানজির পাশে আমার মতো…। কিন্তু তার এরকম মনে হলো, এ ধরনের চিন্তা কি সেও করেছে সন্ধ্যা থেকে? যেন শক্তি পাওয়ার ইচ্ছা।

সে দেখলো, কেটের গাল দুটো লাল দেখাচ্ছে, চোখ দুটি উজ্জ্বল। সে ভাবতে চেষ্টা করলো, এই অদ্ভুত গল্পটা যা এখন কেট বললো, তার কিছু কি ভিত্তি আছে?

সম্ভবত পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের আগেই বাগচীতার কুঠির পিছন দিকের বাগানটার । গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। সেখানে একটা কিচেন গার্ডেন। সহিস তদারক করে। সেখানেই তার প্যাডকও, যেখানে তার টাট্টা থাকে। সে রোদে রোদে ঘুরছিলো। শীতে তা আরামই লাগে। সে সহিসকে বাড়তি ঘাস কেটে ফেলতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো–দুএকটা করে ফুলগাছ লাগালে কেমন হয়? অলসভাবে রোদ পোয়ানোর ভঙ্গিতে সে প্রকৃতপক্ষে গোলাপ নিয়ে আলাপ করলো। কিন্তু টাট্টা তাকে দেখে ফেলেছিলো। সে নাক না ঝেড়ে পারলো না। বাগচী হাসলো। কিন্তু তার মনে পড়লো তিন সপ্তাহ, কম করেও, সে টাট্টাকে ব্যবহার করেনি। সে জিজ্ঞাসা করলো–সহিস তাকে হাওয়া খাওয়াচ্ছে কিনা। বলে দিলো, অন্তত মাইল দুয়েক যেন রোজ হাঁটায়। সেখানে কেট এলো তাকে কিচেনের জানলায় দেখে। সে বললো–এখানে কী হচ্ছে? বাগচী হেসে বললো, ভাবছো রোদ পোয়াচ্ছি? মোটেই না। বাগানটার উন্নতির কথা ভাবছিলাম। তুমি হয়তো জানো না, আমাদের কুঠি একেবারে মরেলগঞ্জের কুঠির স্টাইলে। শুধু আকারে ছোটো। কাজেই একটা বাগিচা থাকলে ভালো হয় না? তাছাড়া ভেবে দ্যাখো, আমাদের আয় তো জানুয়ারি থেকে একজন সিনিয়র ডেপুটির সমান বটে।

কেট হেসে বললো–বিউটিফুল।

কিন্তু বাগচী লজ্জিত হলো, অবাক হলো, আবিষ্কার করলো, দ্যাখো কাণ্ড! সত্যিই তো, সহিসের সঙ্গে গোলাপ লাগানোর কথা বলছিলো। এখন যা বললো– তাহলে কি তা ঠাট্টা নয়? এরকমই নিজে না জেনেই ভাবছে?

কিন্তু সেদিন রবিবারও বটে। ব্রেকফাস্ট শেষে তখন তারা পার্লারে, সর্বরঞ্জনপ্রসাদ আজ আবার শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হলো। আজও তার ছোট্ট একটা প্রস্তাব ছিলো, শ্রদ্ধা জানানোর শেষে সে বললো–আমার একটা নিবেদন আছে, সার। ক্রিস্টমাস আগতপ্রায় এখন কি একটা সভার আয়োজন করতে পারি না? স্কুল বন্ধ হতে পারে, কিন্তু আপনি অনুমতি করলে অনায়াসে আমাদের অধিকাংশ ছাত্র এবং তাদের অভিভাবকদেরও সংবাদ দেওয়া যায়। এটা কি ভালো হয় না যে আমরা শিক্ষকেরা এবং তারা ছাত্রেরা মিলে এই বিশেষ দিনটিতে লোকাতা ঈশ্বরপুত্রকে স্মরণ করি?

বাগচী নিয়োগীর কথার মৃদু টানা স্রোতে যেন ভেসে যাচ্ছিলো। তার মনে হচ্ছিলল, ভদ্রলোক যে উন্নত মনের সন্দেহ কী? প্রস্তাবটা তো ভালোই। কিন্তু হঠাৎ কিছুতে যেন তার ধৈর্যচ্যুতি ঘটালো। সে বললো–আচ্ছা মশাই, একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি? আপনি কি ক্রাইস্টকে–আচ্ছা, কেন শ্রদ্ধা করেন ক্রাইস্টকে? প্রেমের জন্য কি?

নিয়োগী বললো–সেটাই কি সত্য নয়? প্রেমই কি নয়? তিনি এমন প্রেম করিলেন যে

বাগচী বললো–আচ্ছা মশাই, আপনি হিন্দু না হতে পারেন, ক্রিশ্চিয়ানও তো নন। এমন দুর্বল কেন বলুন তো? আপনি কি কখনো শ্রীচৈতন্যের জন্মদিবসে সভা করার কথা ভেবেছেন? তিনিও শুনি প্রেমের পথেইনা, না, ওসব সভা হবে না। তাছাড়া আপনি কি পারবেন? আচ্ছা, আপনাকে ইন ইমিটেশন অব ক্রাইস্টবইটা পড়তে দেবো। সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলো। ক্রিশ্চিয়ানরা পারছে?

নিয়োগী অবশ্যই শ্রীচৈতন্যর ধর্মের সঙ্গে যুক্ত পরকীয়া ইত্যাদির কথা মনে যুক্তি হিসাবে গুছিয়ে নিচ্ছিলো, কিন্তু সেদিন সে ভারাক্রান্ত মনে বিষণ্ণ মুখেই বিদায় নিতে বাধ্য হলো। বাগচীকে নিত্যন্ত চিন্তাকুল দেখাচ্ছিলো।

কেট তার সেলাই-এর ঝুড়ি নিয়ে এলো। আজ সকালেই সে স্থির করেছিলো সারাদিন বুনলে রাজকুমারের সোয়েটারটা শেষ হবে। তারপরে তিনদিনে তার নতুন সার্জের গাউনটাকে সেলাই করে নেওয়া যাবে। তারপর সোয়েটারটাকে নয়নঠাকরুনকে পৌঁছে দিতে হবে কোনোভাবে। নয়ন সেটাকে রাজকুমারের গায়ে তুলে দিলে যে দৃশ্যটা হবে তার আলোটাকে সে অনুভব করছিলো।

কিন্তু কথা অন্যভাবে শুরু হয়। সে বললো–নিয়োগীমশায়…দুর্বলের কথা কী বলছিলেন?

বাগচী বললো–তুমি শুনেছেনাকি আমাদের কথা? ভালো নয়, ভালো বলতে পারিনি। বোধহয় খুব তাড়াতাড়ি ভাবতে গিয়ে মনে হলো তখন। দ্যাখো, এটা তো ঠিকই ক্রাইস্ট ইহুদিদেরই একজন যারা তখন প্রায় বর্বর ধনী রোমকদের পদানত; দ্যাখো, এটা তো ঠিকই প্রথম যারা তার ধর্মকে নিয়েছিলো তারা তো ছিলো উৎপীড়িত ক্রীতদাস। তখন হঠাৎ মনে হলো, চৈতন্য যখন এদেশে প্রেমের ঈশ্বরের কথা বলেছিলেন তখনো পাঠানের উৎপীড়নে, ছিলো একটা জাতি। মনে হলো দুর্বলতাতেই, পরাজিত হলেই মানুষ প্রেমের প্রচার করে নাকি? বাগচীর মুখটা নিয়োগীর চাইতেও বিষণ্ণ হলো। কেট মুখ তুলে কিছু বলতে গেলো, কিন্তু তার যেন এই ভয় হলো, অত তাড়াতাড়ি এসব বিষয়ে কথা বলতে নেই। তার। অস্পষ্টভাবে মনে হলো, ক্রিশ্চান সব চাৰ্চই তাদের ইউনিটারিয়ান মতকে বিদ্রূপ করে তা সত্ত্বেও ক্যাথলিক রলের চার্চ মিশনের ব্যাপারে বাগচীর উৎসাহ দেখে সে এরকম কিছুই বলতে গিয়েছিলো। সেও বিষণ্ণ হলো।

কেটকে সংসারের কাজে কিছুক্ষণের জন্য উঠে যেতে হলো–তা মিনিট দশেক হবে। সে ফিরে এসে অবাক। ইতিমধ্যে বাগচী ইদানীং-অভ্যস্ত ড্রেসিং-গাউন বদলে বাইরের পোশাক পরা শেষ করে সযত্নে ক্র্যাভাট বাঁধছে। কেট বসলো; যেন কৌতুক ঘটবে কিছু। বাগচী তার টুপিটাকে ব্রাশ করে মাথায় চাপালো। এক টুকরো কাপড় তুলে তার ছড়িটাকেও ঘষে নিলো।

কেট একটু কৌতুকের সুরেই বললো–সে কী, কোথায়?

বাগচী বললো–আজ রবিবার নয়? ডিসপেনসারিতে যেতে হয় না? সহিসকে জানলা দিয়ে বলল ঘোড়া আনতে।

বাগচী ভাবলো-কী আশ্চর্য, কী ভয়ঙ্কর, সে কি ধর্ম থেকে এতদূর সরে গিয়েছে? আজ সম্ভবত বিশ দিন হয়, চরণের সঙ্গে প্রতিদিনই দেখা হয়েছে, কিন্তু ইসমাইলের সেই পরীক্ষার পর থেকে একটা কথাও তার সঙ্গে বলেনি। এও রাগ নাকি? আশ্চর্য!ইসমাইলের চোখেরই বা কী হলো? হয় চরণ তোমার ধর্মকে আঘাত করেছে, তোমার সংস্কৃতিকে বিদ্বেষ করে, কিন্তু ইসমাইলের কীঅপরাধ যে বিনা চিকিৎসায় তার চোখ নষ্ট হবে? সে মনে মনে বললো, ভগবান, আমার জন্য কি ক্ষমা আছে? কুড়ি দিনে অন্তত কুড়িবার মনে হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও চরণকে ক্ষমা করতে পারিনি।

পথে বাগচী স্থির করলো, চরণকে গোটা ব্যাপারটা সে বুঝিয়ে বলবে। সে তো যেমন পাদরি, তেমন হেডমাস্টারও। ধর্মের কথা নাই হলো, হেডমাস্টার, শুধু ছাত্রদের নয়, শিক্ষকদের সঙ্গেও তো আলোচনা করে তাদের গাইড করে। হয়তো চরণ বলবে, আমরা তো সার, ক্রীতদাস। তখন কিন্তু বলতে হবে, হ্যাঁ, চরণ, স্বীকার করি যে আমরা পরাধীন, কিন্তু তাই বলে ক্রীতদাস? তুমি কি জাহাজের খোলে বেতের বাঁধনে বাঁধা সেই কালো কালো মানুষের যন্ত্রণা আর গোঙানির কথা জানো? রোসো, তোমাকে পড়তে দেবো। দেওয়ানজির লাইব্রেরিতে পাবে সেই টমচাচার গল্প। সোজা ইংরেজি। তাই বা কেন, আজ চরণকে উইলবারফোর্স আর ক্ল্যাপহ্যাম সেকটের কথা বলতে হবে। সেই যারা ইংল্যান্ডে বসে ক্রীতদাস প্রথাকে লোপ করেছে। বলতে পারো, চরণ, ইংরেজরাই বেশি জাহাজ নামিয়েছিলো ক্রীতদাসের ব্যবসায়। তারাই কিন্তু ক্রীতদাসপ্রথা লোপও করেছে। তুমি কি কলকাতাতে রাজাদের বাড়িতেও আর ক্রীতদাস দ্যাখো? একটাও পাবে না। হাবসীবাগান আছে বটে, কিন্তু সেখানে ক্রীতদাস নেই। অথচ এই দেশে এমনকী নুরজাহও ক্রীতদাস ছিলো। তোমাকে আরো বলি, সে আপন মনে হাসলো, এরা কিন্তু সকলেই ডানকানের কীবলের জাতি। ক্রিশ্চিয়ানই ধর্মে। তাদের স্বীকার করার সাহস আছে তাদের দেশে কল কারখানায় শ্বেত-ক্রীতদাস আছে। তারা কিন্তু তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন করে। বেশ কথা, ইংল্যান্ডের কথা যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, আমেরিকাকে দ্যাখো। সেখানে সবচাইতে বেশি ক্রীতদাস। সেখানেই কিন্তু গত এক দশক সব চাইতে বেশি আন্দোলনও। এমন হতে পারে সেখানে এ নিয়ে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। টাইমস পড়েছো?

তিন সপ্তাহের নিরুদ্ধ আবেগে এসব ভেবে যখন চরণদের পাড়ায় ঢুকছে, নিজের আবেগের দরুন লজ্জিত হয়েই চিন্তাটাকে যেন মাটিতে নামিয়ে আনলো। ব্যাপারটা তো ডানকানের নীল চাষ আর দাদন নিয়ে। নীল চাষ যে করা হয় তা লাভের বলেই। দাদনটাও যে কী তা আমরা তাঁতিপাড়ায় দেখেছি। দাদন পেলেই তবে তাতে রেশম চাপায়। বিক্রির নিশ্চয়তার জন্যই দাদন নেওয়া। নীলেও দ্যাখো, বিক্রির নিশ্চয়তার জন্যই দাদন চলেছে। কেউ তো আর জমিতে নীল চাষ করে নীল বার করে, তারপরে জাহাজ কিনে, জাহাজে মাল চালান দিতে পারে না। দাদন অন্তত এই নিশ্চয়তা দেয়, ফসল মাঠে পড়ে থাকবে না। মুশকিল হচ্ছে এই, মহাজনের সংখ্যা কমলে, প্রতিযোগিতার অভাবে তারা দাদনের পরিমাণ কমায়। নীলের ব্যাপারেও মহাজনের এই সুবিধা–একটাই তো নীলকুঠি ও অঞ্চলে। রাগ করে ভাবতে হবে, যারানীলচাষ নিয়ে ধর্মঘট করেছিলো তারাও নীল চাষই করছে আবার।

কিন্তু ততক্ষণে সে চরণের বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছে।

তাদের সেই ডিসপেনসারিতে কয়েকজন রোগী ছিলো। বাগচী যেন কিছুই নয় এমন ভাবে গুডমর্নিং বলে বারান্দায় উঠে তার জন্য নির্দিষ্ট চেয়ারে চেপে বসে হেসে বললো, ক্যারি অন, চরণ, ক্যারি অন। সে আধঘণ্টা ধরে চরণের চিকিৎসা দেখতে লাগলো। শেষ রোগীটা চলে গেলে বারান্দাটা ফাঁকা যখন,বাগচী বললো–হা, চরণ, আমাদের ইসমাইলের খবর কী? তার চোখটা?

চরণ বললো–সারেনি, কিন্তু অনেকদিন আসছেও না। এরাই বলছিলো, সে নাকি এখন এক সোলোমান সাহেবের সঙ্গে নৌকায় করে মাছ ধরে বেড়ায়। সোলোমান না কী সোলোভান নাম তার।

বাগচী বললো–কীবলের সঙ্গে যখন মারামারি, ইসমাইলদের তাহলে মরেলগঞ্জে জমি ছিলো? ওইটুকু ছেলে, ও কি মাছ ধরে কিছু করতে পারছে?

-নিজের পেট চলছে বোধহয়।

–নিজের পেট? ও কি তার আত্মীয়স্বজন থেকে পৃথক?

চরণ একটু অসুবিধায় পড়লো। সে ভাবলো, একবার কীবলের কথা গোপন করে মুশকিল হয়েছিল, যা আজই মাত্র মিটতে চলেছে। সে স্থির করলো সাধারণত যা বলা হয় না তেমন কথাও গোপন করা উচিত হবে না। সে বললো, মাস ছয়েক আগে ইসমাইলের বাপ মরেছে। সংসারে থাকার মধ্যে মা আর ছেলে। ছেলে চাষ না করে স্কুলে যেতে বলেই জুড়ান তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলো ছোটোসাহেবের কাছে। সেজন্যই চোখের ওই অবস্থা। তা এখন নিশ্চিন্ত, জুড়ানই ওর মাকে নিয়ে থাকছে।

বাগচীর মনে করুণা আর ঘৃণায় মিশ্রিত একটা অব্যক্ত ভাব দেখা দিলো। কিন্তু আবার কি ধর্মনীতির কথা ওঠে? এই ভেবে সে একরকম হাসলো। বললো–সলোমান, সোলেভান বললে, সে কি ডিসিলভা কিংবা ওসুলিভান হতে পারে? ফেলিসিটারের সেই লোকটি কি এখনো এই গ্রামে?

–সেই হবে। এক হতভাগা তাতে সন্দেহ নেই। কয়েকদিন আগে ইসমাইলকে গঞ্জে ধরেছিলাম। বললাম, জলে জলে ভাসছিস! তা, বললো, সাহেবও ভেসে যাওয়ার কথা বলে। ভাসতে ভাসতে একদিন নাকি চোখ ভালো হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু এটা তো এমন নয় যার জন্য সে এসেছে আজ। বাগচী বললো–তোমার সঙ্গে আজ নীল চাষের কথা বলবো। গত তিন সপ্তাহ এ বিষয়ে পড়েছি, ভেবেছি। মনে করো আমরা নীল চাষ করবো না। কী করবো-ধান, কলাই, সরষে, আখ?

চরণ একটু ভেবে বললো–গোপালদা এসব বিষয়ে ভাবছে। বলছিলো, সবাই ধান কলাই করলে তার দাম এমন পড়ে যায় যে তাতে যারা কিনে খায় সেই বাবুদের সুবিধা, চাষীরা কিন্তু না খেয়ে থাকে?

-তাহলে কি আখ?

চরণ আবার ভাবলো। বললো, আগে এদিকে আখ হতো, গুড় হতো। মরেলগঞ্জের পশ্চিমে সোহাগপুরে এখনো গুড় আছে। কিন্তু তারাও অন্য চাষের কথা ভাবছে। বলে, জাহাজী চিনির সঙ্গে, জাহাজী গুড়ের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাচ্ছেনা। পূজা ছাড়া,বামুন কায়েতের বিধবারা ছাড়া কে আর দেশী গুড় আর দেশী চিনি খাচ্ছে?

বাগচীর নিজের ঘরের সুগার বউলের কথা মনে পড়লো। চকচকে বড়ো দানার সেই চিনি যা গঞ্জের বাজার থেকে সহিস নিয়ে গিয়েছে তা কিন্তু দেশী বলে মনে হয়নি।

বাগচী খানিকটা সময় স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। পাইপ ধরালো। তা পুড়িয়ে শেষ করলো। বললো–চরণ, এখন তো টানা ছুটি স্কুলের। ক্রিস্টমাসে একবার কলকাতা যাবে। কিন্তু তার আগে রোজই আসবো। দু-বেলাই। রোগীদের খবর দিও। কলকাতা যাওয়ার আগে ক্রনিক রোগীদের ওষুধ দিয়ে যাবো।

সে ভাবতে লাগলো। এই সময়েই কথাটা তার মনে হলো–আচ্ছা, চরণ, ইন্ডিগো কমিশনের কথা শুনছো কিছু? এ কি সত্য যে মরেলগঞ্জে কমিশন আসছে? তারা কি মরেলগঞ্জের অন্যায় নিয়ে খোঁজখবর করবে?

চরণ বললো–হ্যাঁ, সার। দিন তিনেক আগে সকলকে নুটিশ দিয়েছে। যার যার ইচ্ছা কমিশনকে বলতে পারে অভাব-অভিযোগের কথা। বড়োদিন পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ নেবে। তারপর জানুয়ারির শেষ দিকে তারা আবার এলে সেই দরখাস্তের উপরে জেরা হবে।

একবার বাগচীর মনে হলো সে বলবে, দ্যাখো, তাহলে এখানেও ইংরেজরা কমিশন বসাচ্ছে!এটা কি একটা ভালোর লক্ষণ নয়? কিন্তু সেচরণের মুখে অপ্রীতিকর কিছু শোনাকে এড়িয়ে যেতে অন্য কথায় গিয়ে বললো, তাহলে, চরণ, কঠিন রোগীদের, বিশেষ ক্রনিক রোগীদের যেন সংবাদটা জানানো হয়। কলকাতায় যাওয়ার আগে ওষুধ দিয়ে যাবো।

দিন তিন-চার পরে বিকেলের দিকে সে রোগী দেখা শেষ করে তখন কুঠিতে ফেরার উপক্রম করছে, চরণের বাড়ির দিকে দু-তিনজনকে একত্র আসতে দেখে সে বারান্দার নিচে দাঁড়ালো। পাশে দাঁড়ানো চরণকে জিজ্ঞাসা করলো–রোগী নাকি চরণ? ততক্ষণে তাদের দেখতে পেয়ে চরণ গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। আগন্তুকদের একজন প্রৌঢ় আর দুজন যুবক। চরণ একটু বিরক্তির স্বরেই বললো, অমর্ত্যমামাকে এখন এখানে আনতে গেলে কেন, কৃষ্ণকাকা?

সেই প্রৌঢ় বললো–তুমিই তো লোককে জানিয়েছে, ডাক্তারসাহেব কলকাতা যাওয়ার আগে রোগী দেখবেন–তাই শুনেই অমর্ত্য ধরেছে তাকে একবার দেখতে।

বাগচী কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করলো–অমর্ত্য কোনটি, তার কী হয়েছে, এরাই বা কে?

চরণ আবার সমস্যায় পড়লো। আবার কী গোপন করবে, আর তার ফলে আবার এক ভুল বোঝাবুঝি? সে তখন পরিচয় দিয়ে জানালো প্রৌঢ়টির নাম কৃষ্ণানন্দ, তার স্ত্রীর পূর্ব পক্ষের শ্বশুর এবং তারও খুড়ো সম্বন্ধে। অমর্ত্য কৃষ্ণানন্দের সম্বন্ধে শ্যালক। বললে, অমতাঁর কিছুদিন থেকে একটা পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। তার স্ত্রী এবং কন্যা, সংসারে নিজের বলতে তারাই। তাদের সঙ্গে ব্যবহারের পরিবর্তন হয়েছে। সংসারের বাইরে যারা তাদের সঙ্গে তো বটেই। সবসময়েই প্রায় চুপচাপ থাকে, কথা বলতে গেলে চিনতে পারে না, অন্য সময়ে রেগে গিয়ে ঘরের জিনিসপত্র নষ্ট করে।

বাগচী গলা নিচু করে বললো–তুমি কি এটাকে মেন্টাল কেস বলছো?

তখন চরণ কিছুটা ইতস্তত করে কীভাবে অমর্ত্যকে ডানকানের হুকুমে জুড়ান পাইক সারাটা মরেলগঞ্জে উলঙ্গ করে ঘুরিয়েছে তা বললো।

বাগচী স্তম্ভিত হয়ে গেলো। সে হাসবে যেন এমন ভাব হলো তার মনে। পরমুহূর্তে রক্ত যেন মাথায় চড়ে গেলো, কথা বলতে কষ্ট হতে লাগলো। সে অবস্থায় সে ভাবলো, না, বর্বর নয়, শয়তান।

বাসায় ফিরে বাগচী অনেকক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলো। এমনকী ডিনারের আগে পর্যন্ত কেটের সঙ্গেও খুব কমই কথা হলো। ডিনারে বসে সে বললো–আচ্ছা কেট, এবারেও ক্রিস্টমাসে যদি কলকাতায় না-যাই আমরা?

পরের দিন সকালে, তখন তো কলকাতায় রওনা হতে আর দিন তিনেক বাকি, সে দেওয়ানকুঠিতে গেলো। হরদয়ালকে পেয়ে জানালো তার পক্ষে কলকাতা যাওয়া একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না। মরেলগঞ্জে ইন্ডিগো কমিশন আসছে। ২৫ তারিখ পর্যন্ত তারা নালিশ নেবে। পরে তার উপরে জেরা হবে। মরেলগঞ্জে অনেক নালিশ। কিন্তু কেই বা তাদের সেসব নালিশ লিখে দেয়?

হরদয়াল জিজ্ঞাসা করলো–বাগচী সেখানকার রায়তদের পক্ষে উকিল হিসাবে দাঁড়াতে চাইছে কিনা।

বাগচী হেসে বললো–আপাতত নালিশগুলো লিখে দিতে হবে। আর পরিচিত অপরিচিত মিলিয়ে অন্তত পঞ্চাশ-ষাটটা নালিশ তো হবেই মনে হচ্ছে। সময়ও লাগবে। তাদের জেরা করে নিখুঁত সত্য উদঘাটন করে তা লেখা ২৫ তারিখের মধ্যে পেরে উঠলে হয়।

চরণের বাড়িতে গিয়ে সে বললো–শোনো, আমার গায়ের রং কালো, তা বেশ কালোই; কিন্তু আমি নিজেই জানি ইংরেজিটা আমি ভালো লিখি। একশোটা তো কম করেই নালিশ হবে। আর কদিনই বা বাকি ২৫-এর। এর মধ্যে সকলের সঙ্গে আলাপ করে নিয়ে সত্যকে স্থির করে নিয়ে নালিশগুলোকে লিখতে হবে। চরণ এ তো বুঝতে পারা যাচ্ছে এ নালিশগুলো কখনো যদি প্রকাশ পায় পার্লামেন্টের সভ্যরা লজ্জায় লাল হবে। আমি জানি কী করে চোখের জল আর আগুনের আংরা ইংরেজিতে ভরে দেওয়া যায়। ইসমাইলের মা, ইসমাইল, অমর্ত্য কারো কথা বাদ যাবে না।

এরকম সিদ্ধান্ত করলে, সময় তো তখন বেশি ছিলো না। একশোটা না হোক অন্তত পঞ্চাশটা নালিশ বাগচী খাড়া করেছিলো। যাদের নালিশ তাদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে অতীত ও বর্তমানের অত্যাচার অনাচারের কাহিনীকে সত্যের ভিত্তিতে নির্ণয় করা, তাকে উপযুক্ত ভাষায় লেখা বাগচীর দিনরাত কেটে যেতে লাগলো। কিছুদিন যেমন তাকে বাড়ির বাইরে দেখা যেতো না, তখন আবার খাওয়ার সময়ে ছাড়া কুঠিতেই পাওয়া যায় না। এমনি হলো।

এক রাতে বাগচী বললো–আর দুদিন, ডারলিং। বোধ হয় পেরে উঠবো শেষ করতে। তা তো হবেই, ছাপালে আড়াই তিনশো পাতার বই হবে।

কেট বললো–তোমার শীত করছে না তো? পায়ের উপরে রাগ দেবো?

হয়তো সে নানারকম গরম কাপড়ের কথাই ভাবলো। হঠাৎ যেন গল্পটা মনে পড়লো, মুখ তুলে বললো–সেই বনাতওয়ালা, জানো, ফেলিসিটার তো চলে গিয়েছে কিন্তু বনাতওয়ালা সেই ও সুলিভানকে দেখলাম কাল পথ দিয়ে যেতে।

বাগচী তার কাগজ থেকে মুখ তুলো। অন্যমনস্কভাবে বললো–শুনেছি বটে সে নাকি ভেসে বেড়ানোর কথা বলছে।

–ভেসে বেড়ানো? তুমি কি শ্যাওলার কথা ভাবছো, নাকি জলের উপরে ভাসা স্কাম?

বাগচী আবার কাগজে মুখ নামালো। কেট বললো, আচ্ছা, ডারলিং, এরা কি সবাই রুটলেস? সবাই কি ধর্মহীন? ওসুলিভানের বাবা-মা হয়তো দুই জাতির, তাই নয়?

কেট সম্ভবত পথে ও সুলিভানকে দেখার পরেই কিছু ভেবেছে। সে আবার বললো, আচ্ছা, ডারলিং, মানে এদের মতো মানুষদের বাবা-মায়ের একত্র হওয়া কি অন্য কিছু? ওয়ান ইন গড় হওয়া নয়?

অন্যমনস্ক বাগচী বললো–তা তো বটেই। খানিকটা তো বটেই।

শোবার সময় হলে বাগচীর গায়ের উপরে রাগ বিছিয়ে দিতে দিতে কেট তার বিছানাতেই কিছু সময়ের জন্য বসলো। বললো–আচ্ছা, ডারলিং, আমার ভয় করে, আমরা ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছি না তো?

বাগচী বললো–কেন? সামনে ক্রিস্টমাস। এবার কিন্তু আমরা পরপর দুদিনই বেশ অনেকটা সময় প্রার্থনা করবো।

সে রাতটাকে ক্রিস্টমাস ইভ বলা হয়। ডিনারের অসাধারণ আয়োজন করেছিলো কেট। বাগচীর জানার কথা নয় কেট কখন কী বোনে। নতুন একটা সোয়েটার তাকে পরতেই হয়েছে। খেতে খেতে বাগচীর হাসি দেখে কেট বললো–হাসছো যে একা একা? আমি ভাগ পেতে অধিকারী।

–নিশ্চয়, নিশ্চয়। আমার মনে হচ্ছিলো, খড়ের বাড়িতে খড়ের কুচিতে গা ঢাকলে কি। শীত যায়? তা থেকে আরো মজার কথা মনে হলো। পাগলা ফ্রান্সিসের কথা।

-পাগলা?

নয়? ভাবো ইটালিতে তো এসময়ে বরফও পড়ে। ভাবো খালি গায়ে তুষার, চুলে তুষার, দাড়িতে তুষার। বোধ হয় এরকম কোনো ঋতুতেই বরফ দেখে বলেছিলেন–আগুন আমার ভাই!

-বোন বলেছিলেন বোধ হয়। কেট বললো।

–কেমন, অসাধারণ অনুভব করার শক্তি নয়? যেন এক মহাকবি?

কেট দেখলো-বাগচীর চোখের কোণ দুটো চিকচিক করছে।

রাত তখন এগারোটা হবে। কেটের হাই উঠলো। বাগচী বললো–তুমি একটু শুয়ে নাও ডারলিং, আমি ঠিক রাত বারোটায় তোমাকে ডেকে তুলবো। সারাদিন খেটেছে উৎসবের আয়োজনে।

–ঘুমিয়ে পড়বে না তো?

না না, আমি ঠায় বসে থাকবো। এই সোয়েটার এমন আরামদায়ক, খুলতে ইচ্ছা করছে না।

রাত বারোটার কিছু পরে কেটের ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো। সে তাড়াতাড়ি সময় ঠিক করতে এসে দেখলো, বাগচী তার টেবিলে আলোর সামনে, কাগজের উপরে ঝুঁকে পড়ে লিখে যাচ্ছে।

১২. রাজকুমার কলকাতায়

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

০১.

সেবার রাজকুমার কলকাতায় পুরো একমাস ছিলো। জানুয়ারির মাঝামাঝির আগে ফেরেনি, যদিও হরদয়াল ও রানীমা কিছু আগে চলে এসেছিলেন। তাতে অসুবিধারও কিছু হয়নি। উপরতলায় হৈমী ছিলো, একতলায় রূপচাঁদ ছিলো, নরেশ ওভারসিয়ার, হরদয়ালের সেরেস্তাদার ব্রজ ছিলো, দাসদাসী বরকন্দাজেরা ছিলো। উপরন্তু বড়োদিনের পরেও যে নববর্ষের উৎসব, তখন তো হরদয়ালই ছিলো তত্ত্বাবধানে।

এরকম আন্দাজ হয়েছিলো, জঙ্গীলাট আর রাজকুমার একইসঙ্গে আসবেন। কিন্তু হরদয়াল অবশ্যই সঠিক জানতো। দুদিন দিয়ে সংবাদ আসছিলো তার, সদরে সওয়াল বহাল ছিলো যাতে টেলিগ্রাম এলেই তা নিয়ে আসে, দীর্ঘতর পত্রাদি আসছিলো ছিপ মারফত। পথে দাঁড়ি বদলে তারা আড়াই দিনে কলকাতার সঙ্গে যোগ রাখছে।

হরদয়ালের দুর্ভাবনা বরং কমে আসছিলো, এবং সংবাদটা ক্রমশ ধীরে ধীরে কাছারির এ-মুখে ও-মুখে শোনা যাচ্ছিলো। এমন তো ঘটতে দেওয়া যায় না যে রটে গেলো জঙ্গীলাট রাজনগরে তিন-চারদিনের জন্য ক্যাম্প করবেন, অথচ তিনি এলেন না। অন্যের কানে সংবাদ তখনই গেলো যখন কমিসারিয়েটের কন্ট্রাকটর জানালো জঙ্গীলাট আর তার পার্টির জন্য অ্যালবেট্রস জাহাজ চার্টার করা হয়েছে। কলকাতা থেকে নদীপথটাকে অবশ্যই দেখে নেওয়া হবে। এখনকার মতো তখনো এইসব ট্যুরের খবর তখনই প্রকাশ করা হতো যখন উদ্যোক্তারা সব আয়োজন প্রায় শেষ করে এনেছে।

কিন্তু অ্যালবেট্রস? হরদয়ালের দিন দশেক আগেকার কথা মনে পড়লো। তার মুখে হালকা একটা চিন্তা যাওয়া-আসা করলো। সেটা একটা বিশেষ দিন ছিলো। যেদিন অ্যালবেট্রসঅশ্রুতপূর্ব জলদানের মতো রাজনগরের ভোররাতেরনদীতে দেখা দিয়েছিলো। এমন নয় যে কুতঘাটে সংবাদ আনার লোক ছিলো। হরদয়াল হাসলো এবার মনে মনে। জেলেরা খবর এনেছিলো। সেদিন তাদের আবার ইলিশ ধরার সূচনা। সরস্বতীপূজা তো। সেদিন থেকেই আবার ইলিশ খাওয়া হবে। তার কুঠিতে হয় না। কিন্তু রাজবাড়ির অন্দরেও জোড়া ইলিশ, জোড়া বড়ি, ধানদুর্বা, সিঁদুর এসব দিয়ে ইলিশকে অভ্যর্থনা করা হয়। যেমন গ্রামের পথে পথে, তেমন রাজবাড়ির দিকেও জেলেরা ঝাঁকা মাথায় ছুটতে থাকে। ইলিশ তো জীবিত থাকে না অন্য মাছের মতো, কিন্তু এমন চাই যে তখনো রক্ত গড়িয়ে আসছে কানকো থেকে। দেওয়ানকুঠিতেও মাছ দিতে আসবে তারা। সেখানে দাম নয়। দুটো মাছে দশটাকা বকশিশ তো!

তারাই প্রথম অ্যালবেট্রসের কথা বলেছিলো। ভোর ভোর রাতে তখন বেড়াল গুটিয়ে আনার চেষ্টা চলছে, প্রথমে আলোর ঝলকানি–যেন সূর্য উঠলো অকালে; কিন্তু দিকটা তো পুব নয়, দক্ষিণ। আর সূর্যের আলো কি জলের বুকে ঝাটায়? আর তখন বিরাট একটা ছাগলের ভ্যা ভ্যা। কিন্তু জল কাঁপছে, ঢেউ উঠছে, তাদের ডিঙিগুলো নাচছে, জাল টানতে অন্যরকম লাগছে হাতে। অবাক হতে হতে, ভয় কাটাতে কাটাতে তারা গেলো গেলো করে উঠলো। সেই দানব তো জালের উপরেই উঠে পড়তে চায়। জাল বাঁচাতে চার-পাঁচখানা ডিঙ্গি, তারাই তো সেদিকে, ঢেউ অগ্রাহ্য করে ছুটলো। জাল বাঁচলো, কিন্তু শ্ৰীমন্তর নৌকাখানা ডুবেছে। বাপবেটা মিলে তারা চারজন সাঁতরে উঠেছে বটে। তবে (জেলে দুজন হাসলো এই জায়গায়) মাছও এবার উঠেছে! বোধহয় সেই কলের নৌকাই ঝেটিয়ে এনেছে। মাছ।

এ বিষয়ে হরদয়ালের প্রথম চিন্তা আমরা শুনেছি ইতিপূর্বে–এটা একটা এগিয়ে যাওয়া, কিন্তু কিছুই আর অর্জিত রইলোনা। এ বিষয়ে সর্বরঞ্জনপ্রসাদের মনোভাবেরও কিছু পরিচয় পাওয়া যায়। সে বাড়ির সামনে, গঞ্জে নয়, জেলে দেখে অবাক হয়েছিলো। জেলেরা যখন প্রায় জোর করেই তাকে জোড়া ইলিশ দিতে চাইলো, সে প্রথম বললো, এখানে এরকম পাওয়া যায়? কিন্তু তার মনে পড়ে গেলো, সেদিন পূজার ব্যাপার একটা আছে। তার মনে বিমুখতা দেখা দিলল। গৃহিণীর উৎসাহকে সে দৃঢ়ভাবে নিরস্ত করলো,নানা,এ কি কখনো, না না, এ হতে পারে না যে এমন কুসংস্কারকে আমরা প্রশ্রয় দেবো।

আদর্শবাদী মানুষদের চিন্তা যেন আদর্শের তাড়নাতেই দ্রুততর হয়। সর্বরঞ্জনপ্রসাদ জেলেদের প্রায় পিছন পিছন বেরিয়ে পড়েছিলো। সে তাদের প্রায় সবগুলো পথ দিয়েই ছুটতে দেখলো। কোথাও কি তাদের গতিরোধ হবে? হঠাৎ অনুপ্রেরণার মতোই তার মনে পড়ে গেলো : এদিকে চরণই একমাত্র, অন্তত একদিক দিয়ে, আধুনিক মনের পরিচয় দিয়েছে, অন্তত বিবাহে আর পুরোহিতের অসুবিধা বলে চরণের বাড়িতে পূজা নেই। সে একটু তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে চরণের বাড়ির দিকে চলেছিলো। আদর্শবাদীদের মতোই আবার পরাজয় তার প্রতীক্ষা করছিলো। সে তখন চরণের বাইরের দিকের ঘরের বারান্দার কাছে। সে স্তম্ভিত হয়ে গেলো। দেখলো : চরণের মাথায় নতুন গামছা বাঁধা, সে খুরপি হতে বাড়ির সামনে একটা কঞ্চি-ঘেরা জায়গায় মাটি ঠিক করছে; চরণের বউ থালা হাতে বেরিয়ে এলো উলু দিতে দিতে। চরণ যে জায়গাটা খুঁড়ছিলো সেখানে থালা কাত করে যা ঢেলে দিলো তা যে রক্ত তা দূর থেকেই বোঝা যায়; আর আঁশগুলোও রোদে চকচক করে উঠলো; চরণ তার ট্র্যাক থেকে কীসের বীজ বার করে সে মাটিতে পুঁতে দিলো।

সর্বরঞ্জনপ্রসাদ গলা-খাঁকারি দিয়ে নিজের উপস্থিতি না জানিয়ে পারলো না। বনদুর্গা, চরণের স্ত্রী, দৌড়ে পালালো। চরণ মাথার গামছা খুলে তাড়াতাড়ি হাত মুছে সলজ্জভাবে বললো–এত সকালে যে?

সর্বরঞ্জন নিশ্চয়ই শিক্ষিত ও সংস্কৃতিসম্পন্ন মানুষ। সে তো বুঝতেই পারছে এইমাত্র যা সে দেখলো, তা পৌত্তলিকতার চাইতেও অনেক পিছিয়ে থাকা–মাটি, রক্ত, বীজ নিয়ে এক ঘোরতর আদিমতা! সে কোনো কথা না বলেই পিছন ফিরে নিজের বাড়ির দিকে চলতে শুরু করলো।

চরণ একটু অবাক, এমনকী একটু লজ্জিতও হয়েছিল বটে, কিন্তু তখন তাকে একটু ভাবতেই হলো। তাতেও অ্যালবেট্রস দেখা দিয়েছিলো। তা বিশেষভাবেই, সকালের ব্যাপারটাকে পূর্বাপর সাজিয়ে নিয়ে ভাবতে আগ্রহ হচ্ছে তার। বনদুর্গার দাবি মেটানোর পরে।

মরেলগঞ্জ থেকে নদীর ধারে যেতে কিংবা ফরাসডাঙর উপর দিয়ে যেতে হয়। মাছ কিনতে গোপাল দাস নদীর ধারে যাওয়ার পথে চরণদাসের বাড়িতে এসেছিলো ভোর সকালে। চরণ শুনে বলেছিলো, তোমার সুখের কমতি নেই, গোপালদা। কিন্তু চলো যাই বলে সে-ও সঙ্গী হয়েছিলো। বাছাই মাছ পেতে নদীর ধারই ভালো।

তারা একা একা যখন তখন তো ভাবেই, একত্র হলে ভাবনাটা বাড়া স্বাভাবিক।

চরণ বললো–এ মাসের শেষ থেকে তো আমাদের সাক্ষী দিতে শুরু হবে।

গোপাল নিস্পৃহভাবে বললো–বামুনাদিয়াড়া, শালুকডুবি, হিমায়েতপুর সেরে কাল নাকি সদরের দিকে গেলো। কালেক্টরও নাকি সঙ্গে আসবে তখন এখানে।

চরণ জিজ্ঞাসা করেছিলো কিছু বুঝলে সেখানে কী হলো?

কী করে জানব? কাল বিশে চাষ দিচ্ছিলো। বিশেকে তুমি চেনো না এমন নয়। তার দরখাস্ত ঠিক করতে হেডমাস্টারের একবেলা লেগেছিলো। জিজ্ঞাসা করলাম ওসব জায়গার রায়তরা কমিশনে কী বলেছে, না বলেছে। বিশে লাঙল ঘুরিয়ে নিয়ে দূরে গেলো যেন কানে শোনে না।

চরণ একবার গত সনেই ইলিশের কথা তুলেছিলো। সেখান থেকে সরে এসে আবার বললো–বামুনদিয়াড়া, শালুকডুবি সব তো রাজার জমিদারিতেই, সেখানে তো গুড় হতো।

-হতো তো। শাবাবু আর পালবাবু পত্তনিদার। ডানকানের সঙ্গে কমিশনে নীলের চাষ করায়।

খবরটা দুজনেরই জানা, আলাপে বিষয়টাকে এনে খতিয়ে দেখলো যেন।

খানিকটা গিয়ে গোপাল বলেছিলো–এসব কী শুনি, চরণ, তোমাদের গ্রামে ইংরেজি মাসেই নাকি কারা সব আসবে? তারাও সব ইংরেজ নাকি?

-তুমি হাসালে গোপালদা, জঙ্গীলাট বাঙালি হবে, না মুসলমান?

নদীর ঘাটে ইলিশ তো অবশ্যই উত্তেজনার কারণ, ক্রেতা জেলে ফড়ের ভিড়। নামানো চুবড়ি-ডালাগুলো ঘিরে ক্রেতাদের ভিড়, জেলের মাথায় চুবড়ি ঘাটে আসতে তাকে টেনে নামানোর চেষ্টা চলেছে, কোনো কোনো জেলে না না করে অন্য গ্রামে যেতে ছুটছে। কিন্তু ভিড় যেন দো-মনা। অন্য কোথাও যেন আর এক উত্তেজনার কারণ থাকতে পারে।

চরণ বললো–এবার বেশ মাছ।

গোপাল বললো–হুঁ।

দুজনে ভিড়ে গলে মাছ পছন্দ করছিলো। চরণ একজোড়া পছন্দ করে কিনে ফেলো। গোপাল বললো–আর একটি দেখি, দাঁড়াও। তারা দুজনে আর এক ভিড়ে ঢুকলো। তখন সেখানে মাছের চাইতে কলের নৌকোর কথা বেশি। গোপাল সেই গল্পবাজ জেলেকে বললো, রাখো, রাখো, মাছ দেখাও। জলে নাকি রেলগাড়ি চলে!

মাছ কেনা যখন শেষ তখন তাড়াতাড়ি ফেরা ভালো। চরণ বলেছিলো–ফরাসডাঙা দিয়ে চলো, তাড়াতাড়ি হবে।

খানিকটা গিয়ে চরণ বললো–গোপালদা, চুপচাপ যে?

গোপাল বললো–অমর্ত্য আর কৃষ্ণানন্দ আউসের খোঁজ করছে, তুমি কী ভাবছো, চরণ?

এখনো ভাবিনি, কমিশনটা মিটুক।

মিটবে? যারা কমিশনে কাগজ পাঠায়নি তারা এখন যে যা পাচ্ছে দাদন নিচ্ছে। –

-নেবে তো। খাওয়ার ধান কিনতে টাকা লাগে।

–যারা দাদন পেলোনা, তারা কিন্তু রেগে কই। আমার জমিতে কিন্তু এর আগেও আউস তেমন ফলতো না।

চরণ বললো–উল্টোপাল্টা কী বলছো, গোপালদা?

দুজনেই মাথা নিচু করে পায়ের দিকে চেয়ে হাঁটছিলো। চিন্তার ভারই তো ঘাড়ে।

নদী বরাবর চলে ফরাসডাঙায় উঠতে কুতঘাট পেরোতে হয়। তারা সামনে আট-দশজন গ্রাম্যমানুষ এবং কয়েকটি উলঙ্গ বালককে জটলা করতে দেখতে পেয়েছিলো। গলা বাড়িয়ে দেখতে গিয়ে জটলার মধ্যে অভূতপূর্ব পোশাকের দুজন লালমুখোকে দেখতে না দেখতে তাদের পিছনে কুতঘাটে বাঁধা সেই চোংদার কলের নৌকোকে দেখতে পেয়েছিলো। এমনকী কপালের উপরে দুহাতে বারান্দা করে সেই জাহাজের গায়ে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড অক্ষরে লেখা অ্যালবেট্রস শব্দটাকেও পড়তে পেরেছিলো চরণ।

কিন্তু সেই লালমুখোরাও তাদের দেখতে পেয়েছিলো। তাদের পোশাক জটলার লোকদের চাইতে কিছু উন্নত হওয়াতেই বোধ হয় লালমুখোদের একটা বললো–হে, ব্ল্যাকি! ডু ই নো দা ওয়ে টু প্ল্যানটেশন।

ইংরেজি-পড়া চরণ থমকে দাঁড়ালো। কিছু একটা তাকে আঘাত করেছে এই রকম অনুভূতির সঙ্গে তার রাগ চড়চড় করে উঠছিলো : ইউ ব্লাডি সোয়াইন, ইউ ফিলদি শ্বেতী, এ রকম সব কথা তার মনে আসছিলো।

কিন্তু সে দাঁড়ালো না, গোপালের হাত টেনে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে শুরু করলো। জাহাজী গোরা দুটো হেই, ইউ দেয়ার, ইউ–এমন সব চিৎকার করতে লাগলো।

বেশ খানিকটা চলে এসে গোপাল জিজ্ঞাসা করলো–পালিয়ে এলে যেন,কী কইছিলো? ধমকালো যেন তোমাকে?

চরণ বললো–ডানকানের কাছে যেতে চায়। তা পথ খুঁজে নিক না।

গোপাল বললো–ওরা তো ওই কলের জাহাজ থেকেই, নয় কি? ঘাটে তো নৌকোও ছিলো, বিলিতি মনে হলো যেন।

আরো খানিকটা চলে গোপাল বলেছিলো–এই এরা, আবার জঙ্গীলাট, আবার কমিশনের তারা সবাই কিন্তু এক জাত।

চরণ ভাবছিলো। তখন গোপাল বললো–মুশকিল এই, চরণ, তোমার জমির অনেকটা মরেলগঞ্জে কিন্তু বাড়িটা রাজনগরে, ডানকানের এলাকায় নয়।

–এ কথা যে?

–ভাবছি।

তারা তখন সেখানে এসেছে যেখানে পথটার এক-শাখা মরেলগঞ্জে, অন্যটি রাজনগরের দিকে গিয়েছে। চরণ একটু দাঁড়ালো, বললো–গোপালদা, সকলকেই কিন্তু সাক্ষী দিতে একইসঙ্গে যেতে হবে। পরের পর সাক্ষী দিয়ে যাবো। প্রথমে আমরা দিলে আর সকলে জোর পাবে। হেডমাস্টারমশায়ের কাছে আবার বসতে হয় কিন্তু।

চরণ অনেকক্ষণ ধরে কথাগুলোকে মনের মধ্যে তোলাপাড়া করলো। তার একটা খটকা লাগছে মনে। গোপালদা কী বলতে চাইছে? শেষে সে ভাবলো এখনো আট-দশ দিন, দেখা যাক।

.

সর্বরঞ্জনপ্রসাদ অবশ্যই সেদিন অ্যালবেট্রসের কথা শোনেনি। সেও নিতান্ত ভারাক্রান্ত মনে নিজের বাসার দিকে ফিরে চলেছিলো। গঞ্জের উপর দিয়ে তাড়াতাড়ি হবে। তা করতে গিয়ে সে ভুলে গেলো, দুদিন আগেই প্রতিজ্ঞা করেছিলো এ পথটাকে সে ভবিষ্যতে বর্জন করবে। পরপর কয়েকটি কুমোরদের চালা। সেখানে কুমোরেরা পট ও প্রতিমা তৈরী করছিলো। বয়স্ক পুরুষ, নারী, বালক, বালিকা সকলেই কাজ করছে। বালকদের মধ্যে তার পরিচিত ছাত্ররাও কয়েকটি। অবাকই লাগে দেখতে, সাদা সরার উপরে কী অবলীলায় তুলি টানছে সেই বালকেরা এবং স্ত্রীলোকেরা। কিন্তু সেখানে কোনো ভদ্রব্যক্তিরই থাকা চলে? অধোবদনে পালাতে হয় না? কী এত অভূতপূর্ব নির্লজ্জতায় সেই কুমোরেরা নারীদেহের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তৈরী করছে। নিতম্বের বর্তুলতা এবং মসৃণতা, স্তনের বর্তুলতা এবং তারও মসৃণতা, এমনকী পা দুটির সন্নিহিত ভাজ। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে পালিয়েছিলো সর্বরঞ্জন। তাড়াতাড়ির মাথায় এখন সেখানেই এসে পড়ে বিপদ থেকে বাঁচার জন্য চোখ তুলতেই সে দেখতে পেলো, তেমনি বড়ো বড়ো দুটো প্রতিমাকে শাড়ি পরানোর তোড়জোড় চলেছে।

হতাশ, বিপন্ন, দুঃখার্ত সর্বরঞ্জন কী ভাববে তাই ভেবে পেলো না। একবার তার মনে হলো, এই গ্রামে এমনই সব ঘটবে। কী ভয়ঙ্কর এই এক আদিম অন্ধকার।

কিন্তু সত্যকে স্বীকার না করে উপায় নেই। প্রকৃতপক্ষে সেদিনটা তো ভলোই ছিলো। সকাল দশটাতেই তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। গম্ভীর সর্বরঞ্জন হেসে ফেলো। এমনকী কথা বলার ছন্দে গোলমাল হয়ে গেলো। সে বললো–দেখে যাও, দেখে যাও, দিদির চিঠি।

ব্রহ্ম-ঠাকরুনের চিঠি। সে লিখেছিলো গুণাঢ্যমশায়ের কন্যাকে রানীমা পছন্দ করেছেন।

.

০২.

অ্যালবেট্রসে জঙ্গীলাটের আসার সংবাদ হরদয়ালকে অবশ্য নিশ্চিন্ত করেছিলো। জঙ্গীলাট, তার পরিবারের মহিলারা। তার দেহরক্ষী দল, তার অফিসাররা। তাদের জন্য তাঁবু ইত্যাদি, তাদের প্রভিশন, এসব নৌকো, পাসি, বোট আনা সহজ ছিলো না। এখন তো এই একটা জাহাজে সবই ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে। এমনকী কয়েকটা ঘোড়াও আসবে সঙ্গে। এ বুদ্ধিটা সিম্পসন সানিয়াল কম্পানি ভালোই করেছে।

কিন্তু তখন আসল সংবাদ তো রাজকুমারের ফিরে আসা।

সেই সকালে কুয়াশার গায়ে রোদ খেলা করছে তখন। কেট তাদের কুঠির সেই কিচেন গার্ডেন থেকে ভাসের জন্য ফুল সংগ্রহ করতে গিয়েছিলো। সে জানতো না, সহিস মূলা লাগিয়েছিলো। সহিস কেটের কাঁচি চেয়ে নিয়ে মূলার কচিপাতা সংগ্রহ করে দিচ্ছিলো। কিছু দূর থেকে তাদের চেনা যায় না কুয়াশায়। কিন্তু কেট সম্ভবত শাকের ব্যাপারে খুব বেশি মনোযোগ দিয়েছিলো, নতুবা কুয়াশার ওপারের খুরের শব্দ, চামড়ার শ্যাড়লের মৃদু কাঁচকোচ শব্দ কানে আসতো। সেজন্যই সে চমকে উঠলো যখন সে অনুভব করলো একটা ঘোড়া ঠিক তাদের কাঁধের উপরে নাক ঝাড়লো। অনুভূতিটা ঠিক নয়। সে দেখতে পেলো ফেনসিং-এর ধারে লাগানো স্থলপদ্ম ঝোপটার লম্বা লম্বা ডালের মধ্যে দিয়ে ঘোড়া আর তার সওয়ারকে অস্পষ্টভাবে হলেও দেখা যাচ্ছে। এক মুহূর্ত ভয়ে ভয়ে কাটিয়েই সে চিনতে পারলো। আর তখন দৌড়ে স্থলপদ্মটার গোড়ায় গিয়ে সম্ভাষণ করলো রাজকুমার!

রাজকুমার বললো–আমি ভাবছিলাম, কেট, শীত পড়েছে, একটু কফি খেলে হয়, কিন্তু তুমি তো গৃহকাজে বাঁধা।

কেট হেসে বললো–আ, ডারলিং, খুব হয়েছে। আসুন।

বাড়িটাকে ঘুরে আসতে রাজকুমারের যে সময় লাগে তার মধ্যে কুঠিতে ফিরে, হাত পা, জামা, চুল থেকে শিশির ও ভেজা কুটো সরিয়ে, বাগচীর ঘুম ভাঙিয়ে, রান্নাঘরে কফির জল চাপিয়ে, বাইরের দরজা খুলে দেওয়ার সময় করে নিতে কেটকে তো পরিশ্রম করতেই হলো। ফলে সে যখন পার্লারে রাজকুমারকে ডেকে আনছে, তার বুক মৃদু ওঠাপড়া করছে, গাল দুটো লাল হয়ে উঠেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও পার্লারের জানলাগুলো ভোলা যায়নি, ফলে সেখানে অন্ধকার; কুশনগুলো অগোছালো, পর্দাগুলো বিপর্যস্ত। কেট রাজকুমারের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে সেসব দিকে ঝুঁকতেই রাজচন্দ্র বললো–অন্ধকার থাক, তুমি কফি আনো।

বাগচী ঘুম ভেঙে রাজকুমারের কথা শুনে ততটা বিস্মিত হলো না, যতটা হলো সে এই সকালেই তার কুঠিতে এসেছে শুনে। কাল দুপুরে সে রাজবাড়িতে গিয়েছিলো। জানুয়ারি থেকেই সে যাচ্ছে, কারণ নতুন চাকরিটা তো সে গ্রহণ করেছেই। আর রাজবাড়ি সম্বন্ধে যদি জানতে চাও তবে নায়েবমশায়ের চেম্বারেই তো সংবাদ। সেখানেই সে কাল শুনেছিলো : ছিপ ফিরেছে, রাজকুমারের বোট সুতরাং বিকেলের পরপরই কুতঘাটে ভিড়বে। নায়েবমশায় আলোচনা থামিয়ে তখনই ঘাটে যানবাহন রাখার বন্দোবস্ত করতে উঠে পড়েছিলো।

আলোচনাটা আর বিশেষ কী? বাগচীর মনে হয়েছিলো কমিশনের ব্যাপারে সে যেটুকু করেছে, তাতে মরেলগঞ্জের সঙ্গে অসদ্ভাব ঘটার সম্ভাবনা। এখন তো সে রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িতই। তাই অসদ্ভাবটায় রাজবাড়িও জড়িয়ে না পড়ে। আগে থেকে নায়েবমশাইকে জানিয়ে রাখা ভালো। সুতরাং সে কমিশনের কাছে দরখাস্ত নালিশ লিখে দেওয়ার কথা বলেছিলো নায়েবকে। নায়েবমশায় শুনে বললো, আমার মনে হয় এসব ব্যাপারে রায়মশায় ভালো বুঝবেন। আমার খবর এই, যারা দরখাস্ত পেশ করেছিলো চরণ তাদের খুব বোঝাচ্ছে, কিন্তু অনেকেই সাক্ষী দিতে চাচ্ছে না। দোষও দেওয়া যায় না। ডানকান জনাত্রিশেক রায়তকে তৈরী করেছে যারা ডানকানের প্রশংসা করে সাক্ষী দেবে।

প্রকৃতপক্ষে বাগচীর ঘুম তো আগেই ভেঙেছিলো, সে শুয়ে থেকে এসবই ভাবছিলো। সে অবাক হয়ে যাচ্ছিলো, আশ্চর্য, এদিকটা সে ভেবে দেখেনি। নায়েবমশায় না বললে সে আশঙ্কাই করতো না।

রাজকুমার এসেছেন শুনে সে উঠে বসলো। কোনোরকমে প্রস্তুত হয়ে সে বসবার ঘরে পৌঁছে দেখলো, সেই প্রায়ান্ধকার ঘরে দাঁড়িয়ে কেট রাজকুমারের সঙ্গে গল্প করছে।

রাজকুমারের মুখে খুশি চকচক করছে।

বাগচী বললো–ঘর অন্ধকার তো। জানলা খুললে রোদ আসতে পারে।

রাজচন্দ্র বললো–থাক মশায়। গেঁয়োমানুষ গাঁয়ে ফিরেছি। এবার যাও, কেট, শিগগির তিন কাপ কফি। ওসব জানলা দরজা খোলা-টোলা কাল থেকেই হৈ চৈ ধুন্ধুমার করে রাজবাড়িতে হচ্ছে না মনে করো? জানো, কেট, এখানে তোমার বাড়িটা যেমন এক পালানোর জায়গা তেমন কলকাতায় ছিলো না।

কেট কফি করতে গেলে বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–ভালো ছিলেন কলকাতায়? ভালোই দেখাচ্ছে আপনাকে।

-তা ছিলাম। রাজচন্দ্র নিজেই একটা জানলা খুলে দিলো। খানিকটা কোমল রোদ এসে পড়লো। তার মধ্যে বসে সে আবার বললো–বোধ হয় কানে কিছু কম শুনছি, আর হজমটা কেমন হচ্ছে ঠিক ঠাহর করতে পারছি না।

বাগচী কি অভ্যাসের ফলে চিকিৎসার কথা ভাবতে গেলো?

রাজচন্দ্র বললো, মানুষ অত শব্দ করে কেন, বলুন তো? খেতে বসেও অত কথা? তা মশায়, ওটা আপনার অন্যায়-ওই লোকগুলোর কথা আমাকে আগে থাকতে না বলে। দেওয়া।

কাদের কথা বলছেন, রাজকুমার?

–কেন, দিনকর রাও, সালর জং, জং বাহাদুর রাণা।

–এরা?

–আমি কি জানতাম, এঁরা কত আধুনিক, কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন?

কেট এলো কফি নিয়ে। রাজচন্দ্র বাঁচালে বলে কফি টেনে নিলো।

এই সময়ে কেট লক্ষ্য করলো রাজচন্দ্রের গায়ের পুলোভারের ডিজাইনটা উল্টো উল্টো লাগছে। আরো একটু ভালো করে দেখতে গিয়ে সে বুঝলো সেটা উল্টো করে পরা হয়েছে। রাজচন্দ্রও বুঝলো সে কিছু ভুল করেছে, অনুমান করলো তা পোশাকেই। বললো–ও, কেট, কফিটুকু খেতে দাও, তুমিও দেখছি হৈমবতী।

কেট নিজের সঙ্কোচ কাটাতে তাড়াতাড়ি বললো–হৈমবতী কী?

কী না, কে। তোমার মতোই, আর তারও আছে একজনের পোশাকের দিকে এমন ট্যারচা করে চাইবার অভ্যাস।

-কে হৈমবতী, রাজকুমার? কেট এই বলে অনুমান করতে চেষ্টা করলো, রাজবাড়িতে এই নামের কোনো মহিলা কি এসেছেন?

রাজকুমারের পোশাকের উপরে এমন দৃষ্টি নয়নতারা ছাড়া আর কার হতে পারে?

রাজচন্দ্র বললো, তুমি হৈমীকে দ্যাখোনি বুঝি? তোমার মতোই বরফে তৈরী, চোখ দুটোতে তোমার যেমন সোনার ভাব, তার তেমন নীলের। তা, তোমার মতোই সুন্দরী বলা যায়।

কেট একটু রঙ্গভরে বললো–কিন্তু নয়নঠাকরুনের চাইতে

রাজচন্দ্র বললো–তিনি কি আছেন গ্রামে?

কফি শেষ করে রাজচন্দ্র উঠলো। হেসে বললো–আর একদিন আসবো কেট। নতুন কয়েকটা স্কোরশীট এনেছি। ভালো কথা, তুমি কি জানতে, কেট, প্রকৃতপক্ষে লাট তিনজনা? জঙ্গীলাটের এক শ্যালী আছেন, তাঁরও পিয়ানোর বাতিক। আমি তাঁকে তোমার কথা বললাম। যদি আসেন এখানে তখন দেখবো বাগচী মাস্টারমশায়ের পোশাক নিয়ে কী হেনস্তা করো তুমি!

বাগচী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলোতাঁরা কি এই গ্রামে আসবেন?

রাজচন্দ্র এই বিস্ময়ের সুযোগে দরজার কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো, সেখানে দাঁড়িয়ে হেসে বললো–আমাদের হরদয়াল পারেও বটে। ভাগ্যে আমাদের খানিকটা জঙ্গল আছে আর তাতে বাঘ, চিতা, হরিণ, মোষ এসব থাকতে পারে।

তারা অবশ্যই দরজা পর্যন্ত এমনকী কুঠির গেট পর্যন্ত এগিয়ে গেলো। ঘোড়াটা ল্যাজ নেড়ে দুলকি চালে চলতে আরম্ভ করলে বাগচী বললো–একটা হাওয়ার মতো, নয়?

.

০৩.

তখন জঙ্গীলাটের সপারিষদ সপরিবার রাজনগরে ক্যাম্প করা, শিকার করা ইত্যাদির সংবাদে আর সংশয় নেই। ব্রজ, নরেশ আরো কিছু সংবাদ এনেছে। হৈমীও তো তাদের সঙ্গেই পরে এসেছে, তার কাছেও কিছু সংবাদ থাকবে। রাজকুমার, হৈমী, ব্রজ ইত্যাদির গ্রামে ফেরার দিন চারেক পরে রানী হরদয়ালকে ডেকে পাঠালেন। হরদয়াল অনুমান করলো রানী অবশ্যই জঙ্গীলাটের ক্যাম্প সম্বন্ধেই বলতে চান।

হরদয়ালের কিছু দেরি হলো দরবারে যেতে। কারণ তখনই বাগচী এসে বসেছিলো। সে ইন্ডিগো কমিশন সম্বন্ধে কিছু বলতে চায়। সে তত ইতিমধ্যে চরণের সঙ্গে আলাপ করেছে। নায়েবমশায়ের কাছে যা সে শুনেছিলোতা চরণকে বলে জিজ্ঞাসা করেছিলো, রোজ দেখা হচ্ছে, এসব তো বলোনি? দারুণ লজ্জায় চরণের মুখের চেহারা বদলে গিয়েছিলো, একবার তো মনে হলো সে ফেঁপাচ্ছে। অবশেষে বলেছিলো, এরকমই আমরা। গোপালদারই তো সবচাইতে শক্তি, সে এখনো বলছে, ভাবছি। তার পাড়ার যারা দরখাস্ত করেছে তাদের অন্তত পনেরোজনকে অনুরোধ করেছি। মুখ ঘুরিয়ে থাকে, যেন চেনে না। বাগচী হরদয়ালকে সমস্যার কথাই বললো। হরদয়াল মিনিট পাঁচ-সাত চুপ করে থেকে বললো, আপনাকে এখনই হতাশ হতে বলি না; কিন্তু কুমীরের সঙ্গে জলে থেকে বিবাদ না করার প্রবাদটা কত দিনের ভেবে দেখুন।

বাগচী বললো–আমি ভাবছি কমিশন চলে যাওয়ার পরে কী হয়।

এই সূত্রেই বড়ো ইংরেজ এবং ছোটো ইংরেজের আলাপ উঠবে এমন হলো। তারা দুজনেই ক্লাইভ ইম্পের কথা জানতো, বার্ক শেরিডানের কথাও। বার্ক শেরিডানের বক্তৃতা তো গ্রন্থাকারেই হরদয়ালের লাইব্রেরিতে। তারা জানতে অস্ট্রেলিয়া আফ্রিকায় যারা আদিবাসীদের গুলি করা আর পশু শিকার করা একই মনে করে, এবং সে রকম গুলি করে এসে লাঞ্চ বা ডিনারে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে, স্ত্রীদের সঙ্গে, হাসি তামাসা প্রণয় করে, বাইবেল পড়ে, যারা ধর্মের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমেরিকা গিয়ে সেখানকার রেড ইন্ডিয়ানদের নির্মূল করে নিজেদের মহাবীর মনে করেছিলো, যারা পশ্চিম আফ্রিকা থেকে জাহাজের খোলে ভরে ক্রীতদাস চালান দেয়, আর যারা সেখানে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করে, তারা একই ইংরেজ জাতি। সে জাতে হিগিন-বোথামের মতো দাস ব্যবসায়ী এবং উইলবারফোর্সের মতো ক্রীতদাস-মুক্তির আন্দোলনে সমর্পিত-প্রাণ মানুষ আছে, নীলকর ডানকান আছে, আর্চি হিল আছে, উইলিয়াম জোন্স, হেয়ার,বীটন আছে। তারা সুতরাং এদিকে আলোচনায় গেলো না।

হরদয়াল হেসে বললো–আপনি কি মনে করেন, মিস্টার বাগচী, আর্মি কমিশনে ইংল্যান্ডের রাজকীয় অফিসারদের কেউ কেউ মিথ্যা সাক্ষী দেবে না? চাইল্ড লেবার কমিশনের ফলে দেশের শিশুদের মিলের কয়েদখানায় কিংবা খনির মৃত্যু ফাঁদে যাওয়া বন্ধ হবে? ডানকানেরা যে ভালো না-ও হতে পারে এরকম প্রশ্ন তো স্বীকৃত হচ্ছে। হয়তো চরণদাসের মতো কেউ কেউ সাক্ষী দেবে।

.

হরদয়াল রাজবাড়িতে গিয়ে শুনলো, রানী খানিকক্ষণ আগে নিচের বসবার ঘর থেকে উঠে গিয়েছেন। কিন্তু সেই দাসীই বললো, আপনাকে বলতে বলেছেন, এখন সম্ভবত উপরের বসবার ঘরে থাকবেন। দোতলায় পৌঁছেও হরদয়ালকে কিছুক্ষণ বসবার ঘরের অ্যান্টিচেম্বারে অপেক্ষা করতে হলো। সে শুনতে পেলো রানী কাদের সঙ্গে কথা বলছেন। আলাপের বিষয়গুলো অনেকটাই তার কানে আসতে লাগলো। তা অবশ্যই এমন নয় যে কোনো দিক দিয়েই তাকে সঙ্কুচিত হতে হবে।

রানীর ঘরে তখন নয়নতারা আর হৈমী। নয়নতারা বোধ হয় তাকে কিছু পড়ে শোনাচ্ছিল।

হরদয়াল এসেছেন–দাসী এই খবর দিলে নয়নতারা পুঁথিটাকে পাটায় জড়িয়ে বাঁধলো। কিন্তু হাসতে হাসতে বললো, রানীমা পৌত্রকে রাজা করতে হলে ভীমার্জুনের বয়স তখন কম করেও ষাট-সত্তরে দাঁড়ায়;কৃষ্ণ তাদের সখা, তারও সেরকমই বয়স হবে। ষাট-সত্তরে কি আর গাণ্ডীব টানা যায়, না সুদর্শন তোলা যায়? বেচারীরা!

হৈমী বললো–কৃষ্ণেরও মহাপ্রস্থানে যাওয়া ভালো ছিলো, তাহলে ব্যাধের হাতে প্রাণ দিতে হতো না।

তখন কী অবস্থা দেশের! একদিকে ডাকাত অন্যদিকে ব্যাধ, তাদের হাতে ক্ষত্রিয়রা যদুবীরেরা মার খাচ্ছে। তাদের স্ত্রীদের কেড়ে নিচ্ছে। এখনকার ভীলদের পূর্বপুরুষ হতে পারে। বোধ হয় পরীক্ষিত বাদশার বাদশাহীও ছিলো দিল্লী সে পালাম তক।

রানী খিলখিল করে হেসে উঠলেন-বললেন, খুব হয়েছে। হৈমী, তাহলে কলকাতায় এরকম আলোচনাও তুমি শুনেছো? কৃষ্ণ ঐতিহাসিক মানুষ একজন, বিষ্ণু নন? তোমরা আমাকে ব্রাহ্ম না করে ছাড়বে না দেখছি।

নয়নতারা বললো–আমাদের শিরোমণিমশায়

–তার আবার কী?

এক গল্প ছড়াচ্ছে আবার। আমাদের রাজবাড়ির পুরোহিতমশায় সেদিন বলছিলেন। শিরোমণিমশায় নাকি তাকে কী কথায় ধমকে দিয়েছেন, তুই তো বাপু ব্রাহ্মই। রোজই তো যা ভেবেছিস, বলেছিস, করেছিস, স্বপ্ন দেখিস সবাই তো ব্রহ্মকে সমর্পণ করিস।

রানী হেসে বললেন–সেকেলে ব্রাহ্মণদের রসিকতার তল নেই। হৈমী, এবার বাপু তুমি ওঠো। রাজুকে দেখছিলাম ময়লা পায়জামা আচকান পরতে। তুমি বাপু, কলকাতায় ওর পোশাক ভালো রাখতে, এখানেও তেমনি রাখো। ওর ঘরের আলমারিটা আজ খুলল। কে যেন বলছিলো ঘোড়ায় চড়ার, শিকারে যাওয়ার, এমনকীনাকি ঘোড়ায় চড়ে শোর মারারও আলাদা আলাদা পোশাক দরকার হয়। তা কি আছে ওর? না হয় কাউকে দিয়ে খালেক ওস্তাগরকে খবর দিও।

হৈমী উঠে দাঁড়িয়ে বললো–সিমসন তো রাজকুমারের দলের সঙ্গে অনেক কাপড় চোপড় দিয়ে গ্রাহামকে পাঠিয়েছে। সেই আর্মির টেলার। রাজকুমারের পোশাক বানাতে শুরুও করেছে।

দ্যাখো, রানী হেসে বললেন, হরদয়ালের কী রকম সবদিকে দৃষ্টি। জানো,নয়ন, এবার কলকাতায় অনেক নতুন ব্যাপার হয়েছে, তাই না, হৈমী? আমাদের রাজু এবার পীরালি হতে পেরেছে।

হরদয়ালের বাবুর্চি সোলটান আর পিয়েত্রোর বাবুর্চি বান্দার রান্নাই খুব খেয়েছে। শোর টোর কীসব খেয়ে থাকবে।

নয়নতারা বললো–অ্যা, মাগো!

হৈমী বললো–না, রানীমা, শোর একদিনও ছিলো না।

রানী বললেন–তবে যে সেই মেয়েটি, আমাদের হরদয়ালের বন্ধুপত্নী বললো, মহাভারতেই আছে–অর্জুন তো বটেই, এমনকী যাকে নিরামিষাশী বলে চালাচ্ছো সেই শিবঠাকুরও দারুণ শশারভক্ত ছিলেন। তাই মরা শোর নিয়ে নাকি যুদ্ধ, নাকি এক কাব্যও আছে।

নয়নতারা হেসে বললো–দেখলেন, ওরা কলকাতায় এখন ইংরেজদের মতো বুদ্ধিমান হয়েছে, কাব্যের মানে করতে আটকায় না আর।

রানী আবার বললেন–জানে আবার না? আমাকে সেই ভাদুড়ীবউই বলেছিলো সঙোসকিতো নামে নাকি এক ভাষা আছে, আর তাতে নাকি গোগ্নো বলে এক শব্দও আছে, যাতে প্রমাণ মুনি-ঋষিরা আকছার ভগবতী খেতেন আর তাতেই পোষ্টাই।

নয়নতারা খিলখিল করে হেসে বললো–এবার আমাদের রানীমা বেশ জ্ঞান নিয়ে ফিরেছেন। ভাগ্যে তিনি বলেননি ভগবতী খাওয়া ছেড়েই হিন্দুরা যুদ্ধে হেরেছে বারবার।

হৈমী বললো–কিন্তু রানীমা, দুবার তো ভোজ হয়েছে, দুবারই কিন্তু হরিণ, তিতির আর হাঁস শিকার করেছিলেন রাজকুমার। কলকাতার কাছেই তো জঙ্গল। হরিণ খেতে খেতেই তো এখানকার জঙ্গলে হরিণ আর নদীতে চখা শিকারের কথা উঠলো জঙ্গীলাটের।

রানী বললেন–দ্যাখো আমাদের হরদয়ালকে; দরকারে সে কেমন হরিণসমেত জঙ্গল জোগাড় করতে পারে। কিন্তু হৈমী, তোমাকে যেজন্য ডেকেছি তাই জিজ্ঞাসা করা হয়নি। তুমি কি জঙ্গীলাটের স্ত্রী আর শ্যালীকে হার দুটো দিয়ে আসতে পেরেছিলে, তাদের হাতেই? রাজু কি সঙ্গে গিয়েছিলো? হার পছন্দ হয়েছে তো?

হৈমী বললো–ভেবেছিলাম একই প্রায় দেখতে, স্ত্রী আর শ্যালীতে গোল না বাধে। কিন্তু রানীমা, ওদের অত দামী না দিলেও হতো।

রানী হেসে বললেন–পাগল কোথাকার! লক্ষ্য করোনি ওটা একটা পুরনো সাত নহর ভেঙে তার পাঁচ নহরে দুটো বানিয়ে ওদের দেওয়া হয়েছে। আর গোল হওয়ার কথাও নয়, একটা তিন নহর, অন্যটা দু নহর ছিলো।

-কিন্তু মুক্তো তো? হৈমী বললো।

–এই দ্যাখো, তাছাড়া আমি কি দিতে পারতাম? ভালো কথা মনে করেছে। স্যাকরাকে আজই ডাকিও তো। কলকাতায় সেই হার দুটিকে গড়াতে দেবো ভেবেছিলাম। বাকি দু নহরে দুটো বানাতে দিও। তোমার কাছেই তো আছে। বাগচী মাস্টারমশায়ের স্ত্রী তো এখন প্রাইভেট সেক্রেটারির স্ত্রী হয়ে জঙ্গীলাটের পরিবার এলে মিশবে-টিশবে। তার কী আছে আমি জানি না। আমার পক্ষ হয়ে তাকে দিও একটা। আর দ্যাখো বাপু, তুমি তো সব সাদাই পরো। অন্যটাকে তুমি সবসময়ে পরবার জন্য না হয় বানিয়ে নিলে। একেবারে গলা খালি রাখো!

নয়নতারা উঠে বললো–আপনি কি এখন স্নানে যাবেন?

রানী বললেন–তোমরা এসো। হরদয়াল ও-ঘরে অপেক্ষা করছে, তার সঙ্গে কথা বলে নিই। কাউকে বলে দিও হরদয়ালকে আসতে বলে দিতে।

রানী এখন দেখা করবেন দাসীর মুখে জেনে হরদয়াল রানীর বসবার ঘরে গেলো। এ অঞ্চলটা তো সবসময়েই স্নিগ্ধভাবে নিঃশব্দ, ফলে এ ঘরের আলাপ অ্যান্টিচেম্বারে স্পষ্টই শোনা যায়। কথাগুলো হরদয়ালের মুখে একটা স্মিত হাসি হয়ে রইলো। সে এই ভাবতে ভাবতে ঢুকলো, মুক্তোর নহরের সংখ্যায় কি যারা পরবে তাদের স্তরভেদ হয়?

ততক্ষণে রানী কথা বলতে শুরু করেছেন। সুরেনকে ডেকেছিলাম। লাটের কথা বলতেই হকচকিয়ে গেলো। বললো–যত লোকই লাগানো হোক এই শীত ঋতুতেই কি তেমন একটা করা যাবে?

-তা তো নয়ই, হরদয়াল বললো। সেজন্যই কি এখন সে নরেশকে সঙ্গে নিয়ে পিয়েত্রোর বাংলোর দিকে গেলো?

-সেটাকে কিছু করা যায় কিনা তাই বোধ হয় ভাবছে। বোধ হয় ফিরে এসে তোমাকে জানানোর মতলব।

হরদয়াল বললো–এখন কিছু নতুন করে করার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। এরকম একটা আন্দাজ করছি, লাট আর তার পরিবারের যে দু-তিনজন তারা আপনার দেওয়ানকুঠিতে থাকতে পারবেন। আমার অভিজ্ঞতায় তা যে কোনো শহরের সার্কিট-হাউস বা কালেক্টর বাংলোর নিচু নয়। তাঁর সঙ্গী অন্য জনাদশেক অফিসার অনায়াসে পিয়েত্রোর বাংলোয় থাকতে পারবে। দেহরক্ষী টমিরা অবশ্য লাটের কাছাকাছি থাকতে চাইবে। তাদের জন্য দেওয়ানকুঠির লনে ছোলদারি টেন্ট খাটানো যেতে পারবে। সিমসন সেই রকম উদ্যোগ করছে। তবে তোষাখানা থেকে কিছু গালিচা বার করতে হতে পারে। আপনার এ ব্যবস্থা পছন্দ হলে টমিদের ছোলদারি আর দেওয়ানকুঠি ঘিরে ফুট ছয়েক উঁচু ফেনসিং-এ রাজবাড়ি থেকে তাকে আলাদা করে দেওয়ার কথাও ভাবছি। আমি কি এ ব্যাপারে আপনাকে নিশ্চিন্ত থাকতে অনুরোধ করবো?

রানী বললেন–তা যদি বলো তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। কিন্তু রানী হাসলেন। হরদয়াল বললো–সিমসন সানিয়াল দ্বিতীয় ব্রহ্মযুদ্ধ থেকে কমিসারিয়টের কাজ করছে। সে সময়ে তো শুধু খাদ্য নয়, ঘোড়া, তবু সবই জাহাজে গুছিয়ে নেওয়ার অভ্যাস করেছিলো। এদিকে পাটনা থেকে মীরাট পর্যন্ত যে ইংরেজ সৈন্যদল ছিলো তাদের খাদ্য, তাঁবু, ঘোড়া এসবের জোগান দিয়েছে। এবার সেই সিমসনই ঘোড়া, তাঁবু, প্রভিশন ইত্যাদি পাঠাবে।

রানী খানিকটা ভাবলেন। ঈষৎ হেসে বললেন–এই সানিয়ালদের একজনই তো গুণাঢ্য লিখছে পদবী। তার কন্যা সম্বন্ধে তুমি আর কী ভাবলে?

হরদয়াল একটু ইতস্তত করে বললো–এরকম প্রচার ছিলো কনে বছর পনেরোর হয়েছে…

রানী বললেন–ঠিক নয়। তোমার বন্ধুর স্ত্রী আমাকে বলেছেন বছর তেরো হলো। ওদের সমাজে আজকাল কম বয়সের মেয়ের বিবাহ নিন্দার, সেজন্য ঘটকী বয়স বাড়িয়ে থাকবে।

হরদয়াল নিজের করতলের দিকে মুখ রেখে বললো–সেজন্যই বলছিলাম…

রানী বললেন–খোঁজ নিয়েছিলে, সংযুক্ত প্রদেশে গুণাঢ্য সত্যিই জমিদারি কিনেছে কিনা?

-হ্যাঁ, দু লাখের মতো হবে। কিন্তু একটা কথা এই, গুণাঢ্য ব্রাহ্মণ ছিলেন, কিন্তু ইদানীং ব্রাহ্ম, এবং উপবীত ত্যাগ করার কথাও ভাবছেন।

রানী বললেন–খোঁজ নিয়ে দেখেছো ওটা সত্য কিনা যে গুণাঢ্যকন্যা বিলিতি মেমের কাছে লেখাপড়া শিখেছে, দরকারে ইংরেজিতে কথা বলে কিনা?

–এটাও সত্য।

উপবীতের কথা ভাবছো? রানী হাসলেন, একটু দ্বিধা করলেন, বললেন পরে, তুমি কি জানোনা, তোতাপুরী এরকম পরিচয় দিয়েছিলো নিজের? লোটা, চিমটে, হরিণ-চামড়া সম্বল। নাগাই বলতে পারো একরকম। গত বর্ষায় শিরোমণি তাকে মন্দিরের পিছনে শালবাগান দেখিয়ে দিয়েছিলো। রাজবাড়ি থেকে ধুনির কাঠ আর সিধে দেওয়া হতো। তার কিন্তু শিখা উপবীত ছিলো না। সাকার পূজাকে ব্যর্থ পুতুলপূজা বলত।

হরদয়াল অবাক হলো। সে ভাবলো, কে এই তোতাপুরী যে একসময়ে এসে রাজবাড়ির সীমার মধ্যে মন্দিরের পিছনে শালবাগানে আশ্রয় পেয়েছিলো? সেটা কৌতূহলের নয়, সে যে তেমন আশ্রয় পেয়েছিলো সেটাই কি আবার তাকে অবাক করে দেবে? সে কিন্তু এত কাছে থেকেও এই বহিরাগতের তেমন রাজবাড়ির সীমার মধ্যে আশ্রয় পাওয়ার বিষয়ে কিছু জানতে পারেনি! এটা কি তেমন আর একটা বিষয় যা প্রমাণ করে রানী কাছারির এতগুলো সতর্ক দৃষ্টির ভিতরেও, যে কোনো সময়েই অভাবনীয় কিছু ঘটাতে পারেন!

হরদয়ালের এই অনুভূতি যখন তার অভিমানকে মৃদু আলোড়িত করছে, সে শুনতে পেলো রানী বলছেন–তাকেও তুমি উপবীত-ত্যাগী ব্রাহ্ম বলতে পারো, যদিও সে আকাশ মন্দির।

হরদয়াল বললো–আপনি আদেশ করলে এ বিবাহ হবে।

রানী বললেন–তাছাড়া আমি শুনেছিকনেকে তাদের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো, রাজকুমার কেমন? তাতে সে মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে নাকি বলেছে, খুব ভালো। ওদিকে কিন্তু যতগুলি দেখলাম এইটিই সুন্দরী হয়ে উঠবে মনে হয়।

রানীমার সামনে এসব বিষয়ে আলোচনা হয় না। হরদয়াল মুখ নিচু করে শুনলো।

রানী আবার বললেন–এখনই ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। সুরেন তোমার কাছে যাবে। সে তো বলছে রাজকুমারের বিয়ের উপযুক্ত করে আমাদের গ্রামকে সাজাতে কয়েক লাখ ইট লাগবে। আর অঘ্রান মাসের আগে তা হয়ে উঠবেনা। (রানী হাসলেন)। এক বছরেরই ধাক্কা। ও পক্ষকেও তো প্রস্তুত হতে সময় দিতে হবে!

রানী স্নানের জন্য উঠলেন।

হরদয়াল তার কুঠিতে ফিরলো। কমিরিয়টের কনট্রাকটররা অবশ্যই জানে লাটের এরকম ক্যাম্পে কী কী লাগে। তাছাড়া তারা অবশ্যই লাটের দপ্তরে যোগাযোগ রেখে চলেছে। লাটের অসুবিধা হলে তারাও কি অসন্তোষ থেকে রেহাই পায়? ব্রজনাথ ইতিমধ্যে ঝাড়, দেয়ালগিরি, লণ্ঠন, টেবল ল্যাম্প ইত্যাদির লিস্ট করে রাজবাড়ির গুদাম তোলপাড় করছে। ছোটো আকারের কার্পেটগুলোতে পিয়েত্রোর বাংলোয় চলে যাবে, কিন্তু রাজবাড়ির নতুন কার্পেটগুলো সবই কি বড়ো মাপের নয়? সেগুলো কি দেওয়ানকুঠিতে হবে? না হলে মাপ দিয়ে কলকাতায় লোক পাঠাতে হয়। ওদিকেও দ্যাখো রাজকুমারের বন্দুক, ঘোড়া, হাতি আছে, কিন্তু সেই শোর শিকারের বল্লম? আর কুকুরও লাগে বোধহয়। তাহলে কি ব্রজকেই পাঠাতে হয় কলকাতায়? পারবে ছিপে যাওয়া-আসা করে। তার চাইতে তার করা ভালো।

কিন্তু নরেশ এলো। সে আসতে হরদয়াল বললো–সুরেন বাংলো দেখছে। তুমি পথ ঘাট দ্যাখো। কুতঘাটে জেটি তৈরীর কতদূর? এদিকে বলতে ভুলেছি, দেওয়ানকুঠি আর রাজবাড়ির মধ্যে অন্তত ফুট ছয়েক উঁচু ফেনসিং খাড়া করে দাও। দেখতে খারাপ না হয়। কাঠেরই। মাপ নাও গে। আর নায়েবমশায়কে বলে যেও, আমি বুনোদের জন্য অপেক্ষা করছি।

বুনোরা এলে জেনে নিতে হবে হরিণ, বাঘ, চিতা, কোনো কোনো অঞ্চলে পাওয়া সম্ভব। সেদিকের পথঘাটের কিছু কিছু উন্নতি করা দরকার।

.

০৪.

সন্ধ্যার আগে আগে বাগচী রাজবাড়ি পৌঁছলো। পথে হরদয়ালের লাইব্রেরি থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহের টাইমসগুলোকে সে সংগ্রহ করেছে। তার সাড়া পেয়ে রূপচাঁদ, যে এতক্ষণ ফরাশ আর মশালচিদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সে-ই এদিকে সারবলে পথ দেখিয়ে রাজকুমারের দোতলার বসবার ঘরে নিয়ে গেলো বাগচীকে। ইতিমধ্যে সে-ঘরের পরিবর্তন হয়েছে, কি আসবাবে, কি আলোতে। চীনা লেকারের কাজকরা ছোটো টেবিলের চারিদিকে খয়েরিতে সোনার ছাপ মখমলের গদিদার ইংরেজি সোফা। টেবিলের উপরে রূপার বড়ো শ্যমাদানে জ্বলন্ত মোমকে ঘিরে ঝকঝকে কাঁচের গোলক। সেই আলোতে একটা দাবার ছকে গুটি সাজিয়ে রাজকুমার একাই দুজনের হয়ে খেলছে।

বাগচী ভাবতে ভাবতেই উঠছিলো, তার স্বীকার করতে আপত্তি নেই সে বুঝতে পারছে না কী তার কাজ, কেন তাকে বেতন দেওয়া হবে? প্রকৃতপক্ষে আজই তো সে তার নতুন কাজে যোগ দিতে এসেছে। রাজবাড়ির ধরন-ধারণ জেনে নেওয়া তো কারো কর্তব্য হতে পারে না। রাজকুমারের সঙ্গে গল্প করা? তা তো সে করতোই, এই ঘরেই; কিন্তু আজ, দ্যাখো, ঘরটারও পরিবর্তন হয়েছে। গল্প করা? কাল সন্ধ্যাতে রাজকুমারের দেখা না পেয়ে সে যখন ফিরে যাচ্ছে তখন সদরদরজার কাছে রাজকুমারের সঙ্গে দেখা হয়েছিলো। তখন কী করে হঠাৎ লন্ডনের ইভানজেলিস্টদের কথা উঠে পড়েছিলো। বাগচীবলেছিলো, ব্যবসা বাণিজ্যে হাতে টাকা হওয়ার পরেও কিছু লোক দেখলো সমাজে সম্মানটা যতটা পাওয়া উচিত ততটা তারা পাচ্ছেনা। সে রকম সম্মান তখনো বিশপ ইত্যাদির; তখন সেই লোকেরা ধর্মের দিকে ঝুঁকেছিলো এরকম একটা মত আছে। রাজকুমার হেসে উঠেছিলো। কিছুক্ষণ পরে বলেছিলো, কলকাতাতে বেশ কিছুদিন থেকে ধর্ম নিয়েই আন্দোলন। যতদূর জানা যায় তাদের বেশির ভাগ নিতান্ত মধ্যবিত্ত, ব্যবসা বাণিজ্যে টাকা হয়েছে মনে হয় না। বাগচীতখন বলেছিলো, তারাও একরকম সম্মান পান বৈকি। নিছক একজন কেরানি কিংবা শিক্ষকের চাইতে ধর্ম-আন্দোলনে যুক্ত তেমন শিক্ষক কেরানির সমাজে কিছু বেশি মান। রাজকুমার বলেছিলো, আপনার এই মত ভালো নয়! বাগচী হেসে বলেছিলো, ঠিক আমার মত নয়, একটা প্রচলিত মত, যা হয়তো কোণঠাসা কোনো বিশপ ইভাজেলিস্টদের হীন দেখাতে তৈরী করেছে। আপনি কি বলবেন, যে ধর্ম দীর্ঘ দিন নিন্দায়, ধিক্কারে কুণ্ঠিত ছিলো তা এখন নতুন রূপে নিজের স্থান খুঁজছে?

কিন্তু এসব তো সময় কাটানোর আলাপ। তার ইংরেজিতে দক্ষতাই বা কী কাজে লাগে?

বাগচী লক্ষ্য করলো, রাজকুমারের দুটো হাত যেন দু পক্ষের হয়ে চাল দিচ্ছে। বাগচী দরজার কাছে গুড ইভনিং বলে ঢুকতে ঢুকতে বললো, আমি একটা হাত নেবো কি? রাজকুমার ছক থেকে হাসিমুখ তুলো। হয়তো আধঘণ্টার চিন্তায় দু রঙের যে দুটো ব্যহ সাজিয়েছিলো ছক ধরে উল্টে দিয়ে তা ভেঙে দিয়ে, ছকটাকে একপাশে সরিয়ে রাখলো। গলা একটু তুলে বললো–কে আছো, হৈমীকে ডেকে দিও।

হৈমী দু-চার মিনিটে এলে রাজচন্দ্র বললো–ইনি হৈমী, রানীমার লোক। ইনি মিস্টার বাগচী, আমার সেক্রেটারি। তো, হৈমী কলকাতায় ব্র্যান্ডি লাঞ্চ খাইয়েছিলে। এখন একটু চাই যে। চিনিটা কমিয়ে নেবুর বদলে নারাঙ্গি দিলে কী হয় দ্যাখো।

হৈমী চলে গেলে রাজকুমার বললো, আচ্ছা, মাস্টারমশাই, আমি কী জাতি? আপনি বলেছিলেন, বিপ্লবের আগে পরে ফরাসী দেশে একটা জাতি। নেপোলিয়নের সৈন্যদল সেই জাতির হয়ে যুদ্ধ করতো। আপনি, আমি, কেট, রাজনগরওয়ালি, ডানকান হোয়াইট কি এক জাতি? দিল্লীওয়ালে মুসলমানরা মারাঠাদের বিরুদ্ধে আবদালিকে সাহায্য করেছিলো, তারা আর মারাঠীরা এক জাতি নয়। নানাসাহেব গোয়ালিয়রের বিশ হাজার সৈন্যকে টেনেছিলো সেই বর্গিরা আর রোহিলারা কি এক জাতি? ওদিকে রানীমা বড়ো রানীর এক ঘোষণাপত্রের অনুবাদ পড়তে দিয়েছেন। আমরা আর কম্পানির প্রজা নই, তাতে আমি আর ডানকান কি এক জাতি হলাম?

বাগচী বিব্রত বোধ করলো বললে কমই বলা হয়। রাজকুমারের মুখ কি আলোর জন্য রক্তাভ? রাজকুমারের দাবা খেলার সঙ্গে কি এই চিন্তার যোগ থাকতে পারে? এ কি কোনো জাতিবৈর যা রাজকুমারকে বিচলিত করছে?

বাগচী কিছু বলার আগে রাজকুমার জেব থেকে রুমাল বার করে আঙুলগুলোকে মুছে নিলো। আর তখনই ভৃত্যের হাতে রূপার ট্রেতে ব্র্যান্ডি, গরম জল, চিনি, সন্তরা, রাম দিয়ে হৈমী তার পিছন পিছন এলো। রূপার ও কাঁচের ঔজ্জ্বল্যে মনে হলো গরম জলের জাগটাতে অন্য কোনো মদ আছে।

রাজকুমার হেসে বললো–মার্সি ম্যাডামোয়াজেল। তুমি পাঞ্চটা বানাতে থাকো, আমরা দুই ছাত্র শিখে নিই। কিংবা মনে হচ্ছে মিশোনোর ব্যাপারটা পরিশ্রমসাপেক্ষ; তুমি মেপে দিতে থাকো, আমি শেকিংটা করি। পিয়েত্রোকে বুজরুকের জন্য নিজের হাতে বানিয়ে দিতে দেখেছি, তাতে অবশ্য গরম জল থাকতো না। বসো হৈমী, এটা আমার প্রাইভেট চেম্বার।

হৈমীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে রাজকুমার বাগচীর দিকে চাইলো। বললো, আপনার হাতে কি আখবরের রোল? টাইমস না কী যাতে মেফেয়ার, নাইটিংগেল, সার সিডনির কথা লেখে?

বাগচী বললো–এখন চীন আর মিশরের কথাই বেশি। চীনের যুদ্ধ। ওয়াং বিদ্রোহ।

রাজকুমার হেসে বললো–দ্যাখো, হৈমী তাহলে তো তুমি ঠিকই বলেছো। মুকুন্দ তো তাহলে ঠিকই যুদ্ধে গিয়েছে। কিন্তু ওয়াংটা ঠিক কী মাস্টারমশাই?

বাগচী বললো, ওয়াং একজন লোকের নিজের নেওয়া উপাধি। সে নিজেকে তিয়েন ওয়াং বলে। নিজেকে ক্রাইস্টের ছোটোভাই বলে, সে পৃথিবীতে তাইপিং অর্থাৎ স্বর্গরাজ্য স্থাপন করতে চায়।

রাজকুমার হেসে উঠলো, এই চমকপ্রদ গল্পটা তার ভালো লেগে গেলো। বললো–হৈমী বলেছিলো, সে যুদ্ধে ইংরেজও একপক্ষ। কেন, সেটা কি বড়ো যিশু ছোটো যিশুর যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াচ্ছে?

বাগচী বললো–আমার কিন্তু মনে হয়, এটা মূলত মাঞ্চু আর সিং-এর লড়াই। যুদ্ধটা গড়াতে গড়াতে ইংরেজের বাণিজ্যকুঠির দিকে গেলেই তারা জড়িয়ে পড়ছে।

রাজকুমার বললো, তা জড়িয়ে পড়া ওদের কেমন একটা স্বভাব। সেখানেও কি কোনো সম্রাট তাদের দেওয়ানি দিয়েছে? তোমার কী মনে হয়, হৈমী? তুমি তো আবার যুদ্ধ সম্বন্ধে জানো।

হৈমীর পাঞ্চ-প্রস্তুতরত হাত দুখানা থামলো, তার মাৰ্বল-সাদা গাল রক্তাভ হলো।

রাজকুমার বললো–এবারে কলকাতায় শেষের কয়েকদিন হৈমী আমাকে অনেক গল্প শুনিয়েছে। একটা বিষয় আপনাকে জানাই, মাস্টারমশাই। হৈমীর স্বামী কিন্তু খুব বড়ো যোদ্ধা ছিলেন। ক্যাপটেন বিলি। দানাপুরের অ্যামিউনিশন ডিপো তার অধীনে ছিলো।

দুটো ঝকঝকে গ্লাস মিশানো মদে পূর্ণ করে তার উপরে চাকা করে কাটা সন্তরা ভাসিয়ে দিলো হৈমী। রাজচন্দ্র বললো–ক্যাপটেনের কথায় মনে পড়লো,…কিন্তু হৈমী, তোমার গ্লাস কই? কিছু নাও। কী যেন তুমি বলেছিলে কলকাতায়–রিল্যাক। মনে পড়লো লাট আসছেন শিকারে। হরদয়াল এতদিনে জেনে নিয়েছে বনমহলের কোথায় চিতা, কোথায় হরিণ, কোথায় বা বাঘ। বুনোমোষের দিকে জেনারেল না যায় তাই ভালো। ওদের লোভ দেখিয়ে বাইরে আনা কঠিন।

হৈমী একটা গ্লাসে নিজের জন্য পাঞ্চ নিলো। এই সময়ে এই এক অদ্ভুত ভাবনা হলো বাগচীর–আজই তো সে প্রথম এ ঘরে বসছে না; কিন্তু নতুন চাকরির পরে এই প্রথম। আজই দ্যাখো আবহাওয়াটা যেন কেমন বদলে গিয়েছে, যেন কতদিনের অভ্যস্ত এই ব্যাপারগুলো।

কিন্তু রাজকুমার বললো–আমি বিলির জন্য দুঃখিত। সাতদিনের বিবাহিত জীবনের পরেই তাকে প্রাণ দিতে হলো। কিন্তু হৈমীর কাছে শুনেই আমার মনে হয়েছিলো : কানোয়ারের লোকেরা তো দেশপ্রেমের আদর্শের জন্য প্রাণ দিয়েছিলো। বিলি? এটা তো তার স্বদেশ নয়। কীসের জন্য প্রাণটা দিলো?

বাগচী হৈমীর দিকে চাইলো। সে মুখ নিচু করে গ্লাসটার দিকে চেয়ে আছে। বাগচী তাড়াতাড়ি করে বললো–লয়্যালটিও তো একটা আদর্শ। বাগচীর মনে হলো এই সময়ে, রাজকুমার কী নিদয়, যে এখানে এই কথাগুলো তুলছে? কিংবা একি একরকমের নিস্পৃহতা?

হৈমী বললো– রাজকুমার, আর একটু দেবো কি আপনাকে, এখনো গরম আছে।

রাজকুমারের আর দরকার হলো না। একটু থেমে সে আবার জিজ্ঞাসা করলো–মিস্টার বাগচী, আপনি তো একাধিকবার লন্ডনে গিয়ে থাকবেন, সেখানে কি দশসালার বন্দোবস্ত আছে?

বাগচী বললো–কিছু কিছু লর্ড আছেন যাঁরা পারমানেন্ট। কিন্তু সেখানে এই নতুনত্ব একটি ছেলেই বিষয় পায়।

কৌতুক বোধ করে রাজকুমার জিজ্ঞাসা করলো–অন্যরা তবে?

–অনেকক্ষেত্রেই আর্মিতে নেভিতে যায়, নতুবা…আজকাল কেউ কেউ ব্যবসা করতে শুরু করেছে।

রাজচন্দ্র হো হো করে হেসে উঠে বললো, তাহলে, হৈমী, মুকুন্দ ঠিকই করেছে।

সেদিন কুঠিতে ফিরতে ফিরতে বাগচীর মনে হলো, একি অন্য রাজকুমার? কিংবা এটা কি এই সন্ধ্যারই ধরন? কিছুদিন পরে, সেদিন সে কায়েতবাড়ির বিষয়ে জেনেছে (এখন তো রানী ব্যাপারটাকে প্রকাশ্যে এনেছেন, অনেকেই জেনেছে)। বাগচীর রাজকুমারের এই আবেগশূন্য হাসিটাকে মনে পড়েছিলো।

সেই সন্ধ্যায় হরদয়াল বেশ ক্লান্ত হয়ে তার কুঠিতে ফিরেছে। এখন সে বিশ্রাম নিতে পারে। মনে মনে রাজবাড়ি, দেওয়ানকুঠি, পিয়েত্রোর বাংলো, গ্রামের কয়েকটি পথ, বনমহলের এ-অংশ সে-অংশ সে তো একজায়গাতে বসেই দেখতে পাচ্ছে।

তুলনা দিতে হলে একটা সুদৃশ্য জাল বুনে তার একপ্রান্তে সে যেন এখন অলক্ষিত ভাবে নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে পারে। তাহলেও শেষ কাজটার কথা না ভেবে সে পারছে না। কিছুক্ষণ আগে শুরু হয়েছে, আলো জ্বেলে অনেক রাত পর্যন্ত করবে। জাহাজ ভিড়বার জেটি কুতঘাট থেকে সরিয়ে কিছুটা নতুন পথ করতে হয়েছে বটে, কিন্তু নদীর বাঁকটায় সেখানে জল গভীর থাকায় জেটিটা লম্বায় কম হয়েছে। বিলমহলে যাওয়ার হাতিঘাসের বনের মধ্যে দুধারে ঘাস রেখে মাঝখানের দশ ফুট পথটা দেখতে বেশ লাগছিলো কিন্তু। ওটাও খুবই ভালো, গাছের উপরে সেই দু কামরার বাড়িটা; সিঁড়িটা কতকটা মই-এর মতোই হলো, কিন্তু মহিলারা পছন্দ করলে তার উপরে থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত শিকারের দলকে দেখতে পাবে। সিমসন জানিয়েছে কুকুর পার্টির সঙ্গেই যাবে, শুয়োরবল্লমের কথা কখনোই ভুল হবে না। টেলিগ্রাম সে পেয়েছে। কিন্তু সবচাইতে ভালো বুদ্ধি হয়েছে দেওয়ানকুঠি আর রাজবাড়ির মধ্যে ফেনসিংটার ব্যাপারে। ফেনসিং খাড়া হলে তাতে রং আর নকশা থাকলেও কেমন যেন কৃত্রিম আর ন্যাড়া মনে হচ্ছিলো। তারপর বুদ্ধিটা এলো। দু-তিন গাড়ি সোনালিলতা আনা হলো তো। ফেনসিং-এ লতাগুলো তুলে দিলে একটা সোনালি বাগান স্ক্রিনের মতো দেখাবে। মনে হবে লতাগুলো সেখানেই জন্মেছে। এই লতাগুলোয় সবুজ থাকে না বলে ছ-সাত দিন অবিকৃত থাকবে।

হরদয়াল ক্লান্তিটাকে খুশির মতো অনুভব করলো। তার লাইব্রেরিতে উজ্জ্বল আলো। সেদিকে যেতে যেতে তার মনে হলো–সেটা আগামীকাল। ব্রজই দেখবে ব্যাপারটা। লাট থাকার কয়েকদিন সদর গেট থেকে দেওয়ানকুঠি পর্যন্ত, ফেনসিং-এর ধারে ধারে, রাজবাড়ির বাইরের দেয়ালে, সদর দরজার বাইরে পিয়েত্রোর বাংলোর দরজা পর্যন্ত যে আলো জ্বলবে তখন সেই আলো জ্বালিয়ে দেখা হবে। দেওয়ানকুঠির বা পিয়োত্রার বাংলোর ভিতরের আলোটা মশালচিরাই পারবে। আর এই লাইব্রেরি, লাটের শ্যালী এবং স্ত্রী কি উপন্যাসই খুঁজবে শুধু? এই সময়ে তার মনে হলো রানীমাকে কি বলা যায় আপনি বেরিয়ে আলোর মহড়াটা একবার দেখুন?

কিন্তু আর একটা কাজ আছে তার। সেদিন রানী বলেছিলেন গুণাঢ্যর কন্যা সম্বন্ধে লিখতে। হরদয়াল দাঁড়িয়ে পড়লো। রানী গুণাঢ্য কন্যাকে পছন্দ করেছেন তার একটা কারণ এই: সে মেমসাহেবের কাছে পড়ে, ইংরেজি শেখে, পিয়ানো শিখছে। রানী ইংরেজি আদব কায়দার কথা উহ্য রেখেছেন। তাহলে?

হরদয়ালের মুখে আবার হাসি দেখা দিলো। যেন সে মনে মনে বলবে–এটা কেমন হচ্ছে না? সেই কেট তো এখন প্রাইভেট সেক্রেটারির স্ত্রী হিসেবে ইংরেজ এবং খ্রিস্টান হওয়া সত্ত্বেও আদরের হলো। মুক্তোর হার হচ্ছে না? তার মনের মধ্যে যে কথাটা উঠেছিলো সেটা ফুটবার আগেই তার মনের মধ্যেই কারো রুচিতে আটকালো। শেষোক্তজন যেন বললো– বারবার কেন সেই কথা? কিন্তু সে বিস্মিত হয়ে গেলো যেন। এটা তো সে ভাবেনি। এখানকার এই নায়েব-ই-রিয়াসৎ তো তখনো ছিলেন যখন তাকে ডিঙিয়ে হরদয়ালকে দেওয়ান করা হয়। সে কি তার ইংরেজি দক্ষতা এবং বরং আধুনিক চালচলনের জন্য নয়? সেই কবে তখনই তো রানী খানিকটা আধুনিকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন। এতদিনের হিসাবটা তবে ভুল?

অসাধারণ বুদ্ধিমতী রানী। নতুবা রাজার মৃত্যুর পরে এই বিশ বছর হতে চলে, আয় কমে দ্বিগুণে দাঁড়াতো না। কিছুই ক্ষতি হয়নি, সর্বত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। বলবে রানী ইচ্ছা প্রকাশ করে নিশ্চিন্ত, কী করে তা হবে সে চিন্তা নায়েব ও দেওয়ানের? কিন্তু ইচ্ছাটা?

কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমতীর পক্ষেও ওটা একটা ঝুঁকি, বিষে বিষ দূর করার চেষ্টা হয়। যদি। হৈমীকি অসাধারণ রূপসীনয়? বলবে দুঃখিনী, আশ্রয়প্রার্থিনী, রাজবাড়িকে প্রভাবিত করতে পারে না?

সে কিন্তু এখানেই থেকে গিয়েছে। সে লাইব্রেরির বইগুলোকে দেখলো ঘুরে ঘুরে। ওটাকে স্মৃতিই বলতে হয়। প্রায় শিশু সেই রাজকুমারকে বালক ও কৈশোরে পৌঁছে দেয়া একপাশে উপস্থিত থেকে। অন্যপাশে রানী।

চিঠিটা লেখাই দরকার। সে লাইব্রেরী থেকে বসবার ঘরের ডেস্কে গেলো। সেখানেই কয়েকদিন থেকেই কাজ হচ্ছে। সেখানেই প্যাড, কলম, সিহাই।

ভাদুড়িকেই তো চিঠি, সুতরাং তার এবং তার স্ত্রীর কথা মনে পড়লো। কোনো কোনো মানুষকে দেখে মনে হয় বটে জীবন যেন নিজ বেগে উচ্ছল স্রোতমাত্র নয়, বরং যেন এক নৌকা যাকে বিচক্ষণতার সঙ্গে চালনার চেষ্টা করতে হয়। এই যোগাযোগের ব্যাপারে ভাদুড়িও একজন, কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর বিবাহের সে ঘোর বিরোধী। ধর্ম-বিশ্বাসে সে স্বীকার করে : সে হয়তো অজ্ঞেয়বাদী, কিন্তু বিশ্বাস করতে একমাত্র তেমন ঈশ্বরকে করা যায় যার সম্বন্ধে পুরাণে কিছু বলা হয়নি। পুরাণের দেবদেবীকে সে দুশ্চরিত্র নরনারী মাত্র মনে করে। একবার বৈষ্ণব কাব্যের কথায় রজকিনীর কথা ওঠামাত্রই সে কানে আঙুল দিয়ে নিজের বৈঠকখানা থেকে পালিয়েছিলো। থানা থেকে পালিয়েছিলো।

কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে তার বন্ধুকে লিখলো :

ব্যাপারটা সম্ভবত ক্যাচ দেম ইয়ং। রানীমাতা গুণাঢ্য মহাশয়ের কন্যাটিকে পছন্দ করিয়াছেন। তুমি তাহার বয়স বিবেচনায় নীতিগত আপত্তি তুলিতে পারো, কিন্তু গুণাঢ্যকে সংবাদটি দিবে। সংবাদ দিবার সময় তাহাকে তোমার নীতিগত আপত্তির কথা বলিতে পারো। গুণাঢ্য প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি। তাহার পর সে অগ্রসর হইলে তোমাতে দোষ অর্শে না। অবশ্যই তুমি এরূপ ধারণা দিবে না যে রানীমাতা নিতান্ত আগ্রহী, শেষেরটি গুণাঢ্যের তরফে প্রকাশ হওয়া চাই।
অপর, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের কোনো সংবাদ পাইতেছি না এরূপ কিছুদিন গেলো। অবগত আছে যে রাজপরিবারের পক্ষে উক্ত সভার আমি সভ্য। এবার কলিকাতায় রাজকার্যে ব্যস্ত থাকায় যোগাযোগ করিতে পারি নাই। আমি তাহাদের ঠিকানায় পত্র দিয়াছি। কিন্তু এরূপ সন্দেহ তাহাদের ঠিকানা বদল হওয়ায় পত্র না পঁহুছিতে পারে। …

হরদয়াল একটু ভাবলো, একটু যেন দ্বিধাও করলো। পরে আবার লিখলো :

…এই সুযোগে তোমাকে অন্য এক বিষয়েও বলিতে পারি। কলিকাতায় থাকাকালীন আমি হিন্দু হরিশ মুখোপাধ্যায় সম্বন্ধে কিছু সংবাদ পাইয়াছি। প্রকৃতপক্ষে তাহার চেষ্টাতেই যে ইন্ডিগো কমিশন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। সেই কমিশন বর্তমানে এই অঞ্চলে। কিন্তু যাহা শুনিয়াছি তাহা এই যে মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের স্বাস্থ্য ভালো চলে, হয়তো এরূপও সত্য অর্থকৃচ্ছতা দেখা দিয়াছে। অবগত আছি, তোমাদের সমাজের একাংশে তাহার কার্যকলাপে নিরুৎসাহ আছে; অধিকন্তু সেখানে তাহার পানদোষ এবং আনুষঙ্গিক ধনাঢ্যদের পীড়া সম্বন্ধে বক্র-ইঙ্গিত শুনিয়াছি। সে বিষয়ে আমার বলিবার নাই। শুনিয়াছি সে গৃহের দ্রব্যসামগ্রী বিক্রয় করিতেছে। ইহা নিন্দার প্রচারমাত্র হইতে পারে। যাহা হউক, যদি পুস্তকাদি বিক্রয় দ্যাখো, বিশেষ পুরাতন এডিনবরা রিভুর মতো পত্রিকা, তুমি গোপনে আমার পক্ষ হইতে একটা দাম বলিবে। এক এক বৎসরের এডিনবরা রিভুর জন্য আমি এক এক হাজার দিতে প্রস্তুত জানিবে। টাকার জন্য প্রয়োজনে আমাদের নতুন স্থাপিত কলিকাতার দপ্তরে যোগাযোগ করিতে পারো। কিন্তু অবশ্যই লক্ষ্য রাখিও মুখোপাধ্যায় মহাশয় দাম শুনিয়া ক্রেতার বদান্যতা এরূপ সন্দেহ না করে, যেন মানের হানি না হয়। ..

চিঠি শেষ করে তামাকে মন দিলো হরদয়াল।

 ১৩. সে বৎসর বসন্ত রাজনগরে

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

০১.

অনুমান করি সে বৎসর বসন্ত রাজনগরে আগে এসে পড়েছিলো। বসন্ত যে তাতে ভুল নেই; করবী তা নানা রঙের, টগর তা নানা মাপের, গোলাপ যা রাজবাড়ির হাতায় পৌঁছে বসরাই, চম্পকচাপা, কৃষ্ণচূড়া, গুলমোর–এসব তো বটেই, শালে আমে সে বসন্তরই এসে পড়া। এমনকী পাখিরাও তা বুঝতে পেরে গিয়েছিলো। গম্ভীর কোনো পথচারীকে চমকে দিয়ে পথের ধারে ছোটোঝোপটা থেকে পরিষ্কার উঁচু গলায় কেউ আচমকা গান করে উঠছিলো, তারপর মানুষের গাম্ভীর্য দেখে মাথা ঠোঁট এদিক ওদিক করে যেন যা করেছে, না-দেখে করেছে এমনভাবে নিজের পোকা খোঁজায় গম্ভীর হয়ে যাচ্ছিলো। বনে কী ফুটছে, কত ফুটছে, তার ইয়ত্তা করা যায় না।

একটা প্রাকৃতির কারণ দেখানো যায় : অঘ্রান, পৌষ, মাঘ তিনটি মাস গেলো একফোঁটা বর্ষা হয়নি;বসন্তের শুকনো ভাবটাকে, বাতাসের হালকা ভাবটাকে তা এগিয়ে আনতে পারে। অন্য কারণ বোধ হয় এই যে জঙ্গীলাটের ক্যাম্পের উজ্জ্বলতা আর বসন্তের ঘটনাগুলোর মাঝখানে যে ঘটনাগুলো ঘটেছিলো তা যেন নিষ্প্রভ কুয়াশা-ঢাকা, যেন দুইপাশের উজ্জ্বলতার মাকে চোখে পড়তে চায় না।

জঙ্গীলাটের সেই ক্যাম্প নিশ্চয়ই সুদীর্ঘকাল মনে রাখার মতো ছিলো। অত যার আয়োজন, অত যার বাহুল্য, যেন চোখকে ধাঁধায়, তা মিটে যাওয়ার পরও যেন চোখের সামনে ঘটতে দেখা যায়। গ্রামটাই যেন সাহেবদের হয়ে গিয়েছিলো। সেই ভোর-সকালে বিউগল বেজে উঠতে ফরাসডাঙায় কুচ। সেই তালে তালে রাজবাড়ির দিকে গিয়ে অবশেষে লাটের সামনে নাকি পতাকায় অভিবাদন করে, বিউগল বাজে। আবার সন্ধ্যায় বিউগল। আর তারপরই দপ করে যেন একসঙ্গে সব আলো জ্বলে ওঠে, ওদিকে ফরাসডাঙা এদিকে রাজবাড়ি একটানা আলোয় ঝলমল করে ওঠে। রানীমার জন্মতিথির উৎসবে আলো হয়; কিন্তু সে তো রাজবাড়িতে, সে আলো এমন করে পথে পথে ছড়ায় না। তুমি বলতে পারো না, আলো জ্বলে উঠলে রাজবাড়ির হাতার মধ্যে দেওয়ানকুঠিতে কী হতো; কারণ রাজবাড়ির দরজা দিয়েই তো দেওয়ানকুঠির পথ; সেই দরজার সামনে সারাদিনই তো লালকুর্তা সিপাহী বন্দুক ঘাড়ে এ-মাথা থেকে ও-মাথা করছে অষ্টপ্রহর। কিছুপরে আবার এক রকম বাজতো। তাই নাকি ব্যাগপাইপ, নাকি গোরার বাদ্যি। আর তখন নাকি লাট খেতে বসেছেন।

আর এর মাঝে তো গোটা দিনটাই ব্যস্তসমস্ত সওয়াররা রাজবাড়ি থেকে ফরাসডাঙা, ফরাসডাঙা থেকে রাজবাড়ি করছে। কত ঘোড়া, কত রকমের রং। আর বেলা দশটা বাজে কি না বাজে, সারিসারি হাওদাদার হাতি বেরোল রাজবাড়ি থেকে। সব হাওদায় দু-তিনজন করে সাহেব, একটিতে কখনো কখনো মেমসাহেব, এই মেমসাহেবদের হাওদায় কখনো কখনো রাজকুমারকে দেখা যেতো। রাজকুমারের কথা যদি বলল, এক ঘোড়ার পিঠেই না তাকে কত রকম দেখা যেতো, কত রঙের পোশাকে। কত রঙের শুধু নয়; কত জাতের তা। আর ঘোড়াগুলোও। সেটা সব চাইতে ভালো দেখা যেতো সেই সময়ে যখন রাজবাড়ি থেকে একদল সাহেব, তাদের সঙ্গে রাজকুমারও, হাতে বল্লম, হৈ হৈ করে ঘোড়া ছুটিয়ে যেন কোনো দুর্গা আক্রমণ করতে যেতো। ঘোড়াগুলোর পায়ে পায়ে একদল কুকুর ছুটতো। পিলপিল করে, চাপা পড়তো না আশ্চর্য।

কিন্তু তা তো চিরস্থায়ী নয়। তখন তো প্রগাঢ় শীত আর কুয়াশাও বটে। শীত কমার আগেই সেই অ্যালবেট্রসে চেপেই তারা চলে গিয়েছিলো। ভোজবাজি নয়, তার প্রমাণ পথের সেই স্ট্রিট লাইটিং কিছু কিছু থেকেই গিয়েছে। রাজবাড়ির গেটে দুটো পিতল রঙের চকচকে কামান, বিলমহলে যাওয়ার জন্য হাতিঘাস বনের পথটাকে এখনো ঘাসে ঢেকে দিতে পারেনি, একটা গাছের উপরে নাকি এক কাঠের তৈরী বাড়ি এখনো আছে।

এই ক্যাম্প কেন তা নিয়ে অবশ্যই এখনকার মতো তখনো কেউ কেউ ভেবেছিলো। একই উত্তরে সকলে পৌঁছতে অবশ্যই পারেনি। সে সময়ের কোনো খবরের কাগজে লাটের এই টুর সম্বন্ধে কিছু না লেখায় এরকম সন্দেহ থাকে, তা হয়তো প্রাইভেট কিংবা সিক্রেট ছিলো। এদিকে সব লাটই যে আত্মজীবনী কিংবা মেমোয়ার্স রেখে যাবে তাও হয় না।

রাজবাড়ির পক্ষে কি এই আয়োজন সার্থক হয়েছিলো? একটা মত এই : সন্ধ্যায় কেট, লাটের শ্যালী, লাটের মহিষী একত্র পিয়ানোর কাছে বসতেন। লাট নিজেও কি অদূরে থাকতেন না? সেই রকম এক সন্ধ্যায় রাজকুমারকে নিয়ে আলাপ হয়েছিলো। লাট-ললনা বলেছিলো, রাজার পুত্র রাজাই হয়; স্ট্রেঞ্জ, এখনো তা হয়নি! আচ্ছা, আজ ডিনারে হিজ একসেলেন্সিকে বলবো তো!

চিন্তা করার লোক রাজনগরে অবশ্যই ছিলো। হরদয়ালের চিন্তার কথা জানা যায় না। সে তো অ্যালবেট্রসের লাট-পার্টির সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিলো। বাগচী, যাকে দুএকবার লাটের পার্টির সামনাসামনি হতে হয়েছে, যার সঙ্গে তার পার্টির সেই ডাক্তার মেজর চীবসের গ্রামের চিকিৎসা বন্দোবস্ত নিয়েও কিছু আলোচনা হয়েছে; সে যেন অন্য কোনোদিকে ব্যস্ত। নায়েবের চিন্তার কথা বলা যায়।

তারা চলে গেলে নায়েব একদিন যখন তার খাসকামরায়, হঠাৎ তার মনে হলো :সদরের খবর, এই ডানকানের উস্কানিতে কালেক্টর ম্যাকফার্লান অনেকবার কলকাতায় লিখেছে পিয়েত্রোর সিপাহী বিদ্রোহের সঙ্গে যোগ থাকার কথা। সেইজন্যই কি জঙ্গীলাট তদন্ত করে গেলো? নায়েবের মুখে হাসি দেখা দিয়েছিলো। এত ভয়! এখনো? দেখছে, ঘাসের ছাই এর নিচে স্ফুলিঙ্গ আছে কিনা? কিন্তু সে গম্ভীরও হলো। সদরের এটাও খবর, ম্যাকফার্লান কালেকটরিতে খোঁজ নিচ্ছে, পিয়েত্রো দুসন আগে গত হয়েছে, তাহলে ফরাসডাঙার লাট জমা পড়লো কী করে? জমা তো পিয়েত্রোর উকিলই দিয়েছে। কিন্তু…

তাই বলে কিছুই ঘটেনি শীতের সেই শেষ কয়েকটি দিনে, এমন হয় না। যেমন বাগচী তো লাটের ক্যাম্পের কয়েকটি দিন তাদের ডিসপেনসারিতে যেতেই পারেনি। সে কিছু করছে না রোগীদের সম্বন্ধে এ রকম চাপ ছিলো মনে। উপরন্তু মেজর চীবসের সঙ্গে আলোচনায় জানতে পেরেছে যে বাংলাদেশের যশোর খুলনা জেলা জুড়ে ম্যালেরিয়া এপিডেমিকের চেহারা নিচ্ছে ক্রমশ। জ্বর হলেই এখন থেকে তাই লিভার ও সৃপ্লিনের কথা ভাবতে হবে। সুতরাং সে জঙ্গীলাট চলে যাওয়ার দুএক দিনের মধ্যেই চরণের ডিসপেনসারিতে গিয়েছিলো। রোগী ছিলো না, চরণকে বাগচী জিজ্ঞাসা করলো–তুমি তো আমাকে কমিশনের সামনে যেতে নিষেধ করছো? তোমার কথা শুনে কি ঠিক করলাম? না হয়, যারা সাহস করে সাক্ষী দিতে পারছে না, এখানেই ডাকো তাদের, কথা বলি। লোকগুলোকে খারাপ মনে হয় না। আজ কালই তো সাক্ষ্যের দিন বোধ হয়।

চরণ বললো–সাক্ষ্য গতকাল হয়েছে। আরো দুদিন হওয়ার কথা। গোপালদার পাড়ার কেউ সাক্ষ্য দেবেইনা। কাল আমরা চারজন সাক্ষী দিয়েছি। আমি, অমর্ত্যমামা, শ্বশুরমশায়, কৃষ্ণানন্দ, আর ইসমাইল। একটু থেমে আবার সে বললো, ইসমাইলকে নিয়ে এসেছিলো ওসুলিভান। ওসুলিভান সকলের বেলাতেই দোভাষীর কাজ করেছে।

বাগচী সংবাদটার নতুনত্বের বাইরে যখন তার মূল্যটাকে ওজন করেছে, চরণ বলেছিলো, সাক্ষ্য না দেওয়া তো ছিলো ভালো। যাদের দরখাস্ত লিখে দিয়েছেন তাদের জনাকুড়ি আমাদের সামনেই এক লাইন করে হলফ নিয়ে গেলো :তারা দরখাস্তর বিষয়ে কিছু জানে না, সবই চরণদাস আর রাজনগরের বাগচীমাস্টারের কাজ।

বলো কী? বলে চমকে ওঠা যায়, তাতে কিন্তু চিন্তা শেষ হয় না। বাগচী দিন দুয়েকের মধ্যে সব ব্যাপারটা আনুপূর্বিক রাজকুমারকে বলেছিলো।

রাজকুমার কী ভাবলো বোঝা গেলো না। পরে বললো–আপনি কিন্তু এখন আর রাজনগরের হেডমাস্টার নন। আপনাকে এদিকটা দেখতে হয়। আপনার টাট্টু ভালোই। কিন্তু আজ আমার সঙ্গে আস্তাবলে যাবেন। সেখান থেকে যে ঘোড়াটা পছন্দ হয় নেবেন। আপনার সহিস ঘোড়া চিনবে না। সহিস আমি ঠিক করে দেবো। আর কথা এই, সেই সহিস কিন্তু মাথায় পাগড়ি-টাগড়ি বাঁধবে। গ্রামে ঘুরতে হলে সে তার ঘোড়ায় আপনার সঙ্গে থাকবে। একটু থেমে থেকে রাজকুমার জিজ্ঞাসা করেছিলো, দিনকর রাও আর সালর জং দুজনেই নাকি সার উপাধি পেয়েছে?

এ ঘটনাটা নিশ্চয় সামান্য, কিন্তু সেই শিবচতুর্দশীর পূজা এবং তার মেলা? সে রাতে কিন্তু খুব শীতই ছিলো। আর সেই শিব তো রানীমার প্রতিষ্ঠিত। দুদিন ধরে মেলা হয়েছিলো। সেই মেলায় তো অনেকেই গিয়েছিলো। পরিচিতদের মধ্যে কেট ও বাগচীর নাম করতে হয়। বনদুর্গা আর চরণও গিয়েছিলো। চরণের তবু দ্বিধা ছিলো। বনদুর্গা তো শেষ প্রহরের পূজানা-দিয়েই ছাড়েনি। চরণ বলেছিলো, সেখানে কি আমাদের পূজা হয়, সেখানে কি যেতে আছে? বনদুর্গা হেসে বলেছিলো, মশায় কিছু জানেন না। গ্রামের সব লোক জানে, রানীমা নিজে মুখে বলেছেন, সেনাকি খেস্টানি শিব, সকলেই পূজা দিতে পারে, ছুঁতে পারে। কথাটা তো সত্যি, দ্যাখো। সে তত খেস্টানের হাওয়াঘরের ভিতেই।

মেলা খুব বড়ো নয় বটে, কিন্তু দুদিন তো চলেছিলো। দ্বিতীয় দিনে কেট ও বাগচী গিয়েছিলো। কেটই উৎসাহী। তার উৎসাহ কি এজন্য যে বাগচীর নিরুৎসাহের সময় চলেছিলো? সে বাগচীর পাশে পাশে, তার সুদৃশ্য গুলফ দেখিয়ে যেন কিছুটা নেচে নেচে, চলেছিলো। পুরুষ হলে বলা যেতো, সে যেন বলছে, লেটস টেক ইট ইন আওয়ার স্ট্রাইড। একবার পিছন ফিরে সে কিছু বিপন্ন বোধ করছিলো। তাদের দুতিন হাত পিছনে, যেন তাদের গায়েই এসে পড়বে, একজন প্রকাণ্ড চেহারার মানুষ যার ঝালরদার পাগড়িতে জরি, যার লম্বা আচকানের বোতামগুলো যেন সোনার,হাতে ঝকঝকে তীক্ষ্ণ ফলার লম্বা বল্লম। কেট এর দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকে দেখে বাগচী বলেছিলো, তোমার বডিগার্ড আমরা আর হেডমাস্টার নই, কেমন কিনা? মেলাতেও একটা কৌতুক হয়েছিলো। কেটই দূর থেকে বলেছিলো, দ্যাখো, গাছতলাটায় কি ক্রাইস্টের মিশনারি? একদল চাষী একজন লোককে ঘিরে দাঁড়িয়েছে আর সে ভাঙা বাংলায় ইংরেজি শব্দ মিলিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে। একেবারে মুখোমুখি না হয়ে, কৌতূহল মেটানো যায় তেমনভাবে ভিড়ের কাছে বাগচী এগিয়েছিলো। তার মনে দুঃখই হয়েছিলো। সুরটা মিশনারীদের, তাদের মতোই কখনো আকাশের দিকে আঙুল তুলছে, কখনো দিগন্তের দিকে হাত বিস্তার করে দিচ্ছে। কিন্তু সে ও সুলিভান এবং নিশ্চয় নেশার ঘোরে। প্যারাডাইস, স্বর্গ বোঝাতে শান্তির দ্বীপ, সুস্বাদু জল, উজ্জ্বল সূর্যালোক, ছোটো ছোটো কুটির এবং যার যত চাষ করার ক্ষমতা এমন জমির কথা কোনো বাইবেল বলে না। বাগচী শুনলো, সে বলছে : আমরা ভাসিয়া যাইবো, এই পুরাতন হইতে নতুনে, এবং আমরা শান্তির দ্বীপে পহুঁছিবো। কেটেরও ধারণা হয়েছিলো, মাতাল। বাগচী তার মনোভাব দূর করতে বললো, ও নাকি পূর্বজন্মে কবি ছিলো।

আর শিবমন্দির তো রানীমারই। ভোরের শেষ প্রহরের পূজার আগে তাঁর হাতি গলার ঘণ্টা বাজিয়ে মন্দির-চত্বরের নিচে থেমেছিলো। যারা পিয়েত্রোর বাংলোয় পূজার জন্য রাত্রিবাস করছিলো তাদের সে সংবাদে উৎসাহিত হওয়ারই কথা। তারা সকলেই বললো, দুধজল দিলে তবেই আমরা সারি বেঁধে তার পিছন পিছন এগোবো। তখন ভোরের আলো ফুটছে, পূজা শেষ হয়েছে। রানী নয়নতারাকে ডেকে হাওদায় নিয়ে রওনা হয়েছিলেন। মাহুতকে বলেছিলেন নদীর খাতের দিকে যেতে। অনেকটা ঘুরে, কুতঘাটের কাছে যেখানে নতুন জেটি, সেখানে বাঁধ এড়িয়ে নদীর পার ধরা যায়। পার ধরে ক্রমশ ফরাসডাঙার কাছে। বাঁধের নিচে হাতি পৌঁছলে রানী বলেছিলেন, এই নাকি তোমার বাঁধ,নয়ন? এ নিয়ে তোমার দুর্ভাবনা? কিন্তু একসময় ফাটলগুলো চোখে পড়েছিলো। তখন রানীমার মুখে হাসির পাশে পাশে চিন্তা দেখা দিয়েছিলো।

.

০২.

কিন্তু এসবকে উপেক্ষা করে, ছাপিয়ে যেন সেই দ্রুতগামী বসন্ত এসেছিলো। বনে ছায়ায় ছায়ায় কী ফুল, কত ফুল তার খবর অবশ্যই কম রাখা হয়। গ্রামের এখানে ওখানে টগর, করবী, জবা, চীনাজবা, গন্ধরাজ, গোলাপ, চাপা তো অজস্রই তখন। আমের মুকুল দেশ বিদেশের মৌমাছি ডেকে আনায় তার গুঞ্জরণও আছে। গাছের আশ্রয়ে পাখনাখালির ডাকাডাকি ঝুটোপাটি তো নিশ্চয়ই। সকালের দিকে শিশির পড়ে এখনো, তাতেই ফুলের জোর তো। কিন্তু যেখানে ফুল নয়, গাছ নয়, চাষের জমি, সেখানে সকাল ফুরোতে না ফুরোতে গরম হয়ে ওঠে বাতাস। দুপুরে খালি মাঠগুলোর দিকে, হলুদ বাদামী মাঠগুলোর দিকে চাওয়া যায় না। সকালে শিশির বরং ক্ষতিই করছে, তাকে কিছুটা ভেজে বলেই দুপুরের রোদে ফাল্গুনেই মাঠ ফেটে যাচ্ছে।

দিনের হিসাবে সেটা শিবচতুর্দশীর দু-তিন দিন পরে হতে পারে। রাজকুমার রাজচন্দ্র তার ঘরের কাছারির দিকের ঝুলবারান্দায়। নিচে যে ফেনসিং দেওয়া হয়েছিলো রাজবাড়িকে দেওয়ানকুঠি আর টমিদের তাঁবু থেকে পর্দানশীন রাখতে সেগুলো খোলা। হচ্ছে। তার মনে এই পর্দানশীন কথাটাই উঠলো, সেটাই খেলা করলে সেখানে।

কিছুক্ষণ পরে যেন অসংলগ্ন এমনভাবে তার মনে পড়লো, কয়েকদিন আগে বেলা আটটা-নটার আলোতে কাছারির সামনে দিয়ে হাতিটা এগিয়ে গিয়ে রাজবাড়ির কাছাকাছি বসেছিলো। হাতিতে হাওদা ছিলো, হাওদার মাথায় নকল মুক্তোর ঝালরদার রঙিন ছাতা। হাতিটা রামপিয়ারী নয়, বরং পিয়েত্রোর বেঁটে হাতিটা। এরকমটা সচরাচর দেখা যায় না। রাজচন্দ্র তখন ফিরছিলো তার ঘোড়ায় বেড়াননা শেষ করে। হাতিটা তার আগে আগে ঢুকেছে গেট দিয়ে। সে দূর থেকে দেখেছিলো একই রকম চাঁদরে জড়ানো, একই রকম অবগুণ্ঠন, দুজন হাতি থেকে নেমে রাজবাড়ির গাড়িবারান্দার দিকে চলে গেলো। এরকমটাও সচরাচর দেখা যায় না। রানীমার হাতি বাগান দিয়ে ঘুরে গিয়ে অন্দরে বসে। পিয়েত্রোর হাতি, মাহুতটিও তার। এ বাড়িতে সে নতুনই তো। রাজকুমারের পাশ দিয়ে হাতিটা যখন পিলখানার দিকে ফিরে যাচ্ছে, রাজচন্দ্র জিজ্ঞাসা করে ফেলো–কে রে? মাহুত বলেছিলো, দুজন রানী এলেন।

রোদটা এখন আর আরামের নয়। ঝুল বারান্দা থেকে সরতে গিয়ে মনে হলো তার, নতুন মাহুত বুঝতে ভুল করেছে। জিজ্ঞাসা না করলেও চলতো। দূরে হলেও হাঁটার ভঙ্গিতে বোঝা গিয়েছিলো তারা নয়নতারা এবং রানী। রাজু নিজের মনে মনে হেসে ঝুল বারান্দা থেকে বরং ছায়ার দিকে সরলো। আজ সে সকালেই উঠেছে। কিন্তু কাল ঘুমোতে বেশ দেরি হয়েছিলো।

সে অনুভব করলো সেজন্য সে ক্লান্ত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা নয়। বলা যায়, রাত দুটো পর্যন্ত হৈমী তার ঘরে ছিলো। পিয়ানোনা শেখার কথা হয়েছিলো একবার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হৈমীর ব্যক্তিগত জীবনের কথা হয়েছিলো। এটা খুব খারাপ লাগছে। হৈমী তার আশ্রিত বলেই কি তেমন উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলো তার প্রশ্নের! না, ভালো নয়। একজন মানুষের বুকের ভিতরে তেমন নির্দয়ভাবে প্রবেশ করা। এখন তো ভাবতে গিয়ে খারাপ লাগছে যে হৈমী তেমন করে বলেছিলো, সে তারই আশ্রিত।

রাজচন্দ্র তার ঘরে এলো। ঘর পার হয়ে উল্টোদিকের দরজা খুলে আবার সেদিকের ঝুলবারান্দায় দাঁড়ালো। তখন তার হঠাৎ মনে হলো, এটা কি আশ্চর্য বলবে না কেউ-ই, যে রানীমার জন্মতিথির সেই রাতে তুমি তাহলে পূজার কাছে এসো বলে চলে যাওয়ার পর নয়নতারাকে আজ পর্যন্ত সে আর দেখেনি! অথচ সেদিন সেভাবে হাওদা থেকে নামায় প্রমাণ হয়, সে তো রাজবাড়িতে এসেছিলো! সে কি রানীর উজিরাইন বলে ঠাট্টা করবে?

অনেকসময় ঠাট্টা করলেও রাগ যায় না। সে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। দোতলার অলিন্দ দিয়ে রানীমহলের দিকে চলতে লাগলো। তখন মনে মনে বললো, বলে গেলেই হতো আর তোমার সঙ্গে দেখা হবে না রাজু। রানীর মহলে রানী ছিলেন। কিন্তু তাকে তো বলা যায় না, তার সামনেও বলা যায় না, উজিরাইন কোথায়? দোতলা থেকে নেমে সে মন্দিরের দিকে চললো। সে ভাবলো, মনে তো হয় সে এ বাড়িতে এলেই পূজা, মন্দির ইত্যাদির কাছে থাকে আজকাল।

মন্দিরের কাছাকাছি গিয়ে রাজচন্দ্র দেখতে পেলো, কয়েকজন পুরস্ত্রী সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তার কি চিনতে দেরি হয়? আর এখন তো অবগুণ্ঠনও নেই। মাঝখানের সেই গজ বিশেক মাটি সে খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে গেলো। যারা দাঁড়িয়েছিলো তারাও তো তাকে দেখেছিলো। কিন্তু তারা সরে যাওয়ার আগেই সে নয়নতারার মুখোমুখি দাঁড়ালো, এমন যে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারে। সে বললো–তুমি আসবে? না, হাত ধরে নিয়ে যেতে হবে?

হতচকিত নয়নতারা পিছন পিছন, কখনো পাশে, অন্দর পার হয়ে একতলার অলিন্দ দিয়ে হাঁটছে তখন, রাজু গলা তুলে বললো–রূপচাঁদকে বলো, হাওদা-হাতি আনবে।

নয়নতারা বলতে গেলো এভাবে কোথায়?

ততক্ষণে রাজচন্দ্র দরবারের হল পার হয়ে গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়েছে। সে বললো–তোমার কি চাদর ছাড়া খুব অসুবিধা হবে নয়ন? কাজটা আমি হয়তো ভালো করলাম না। রূপচাঁদ তোমাকে দেখে গেলো, সে টোপর-হাওদা আনবে।

তারপর সে হাসলো, বললো–চলো না নয়ন, আজ একটু বেরিয়ে আসি।

হাতি তখন গ্রামের পথ ছাড়িয়ে বনের দিকে চলে এসেছে। রাজচন্দ্র বললো–তোমার সঙ্গে কথা না বললে আমার চলছিলোনা। নয়নতারা হাত বাড়িয়ে টোপর হাওদার ছাদ থেকে ঝোলানো পর্দাটা ফেলে মাহুত থেকে নিজেদের আলাদা করে নিলো।

রাজচন্দ্র পাশের খিলান দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ছিলোনয়নতারার থেকে মুখ আড়াল করে। হেসে বললো–একবার দ্যাখো নয়ন, হরদয়ালের কীর্তি, গাছের উপরে বাড়ি। কিন্তু নয়নতারা সেটাকে দেখলে কি না দেখলো, রাজচন্দ্র বললো, নয়ন, তোমার সঙ্গে দু-আড়াই মাস দেখা হয় না। আচ্ছা নয়ন, তুমি কি আমাকে ঘৃণা করো? আমি আর রাজকুমার নেই বলে? তুমি কি দরজায় বসানো কামান দুটোর মতোই আমাকে জাল মনে করো?

নয়নতারাকে একটু ভাবতে হলো। চেষ্টা করে সে হাসি আনতে পারলো না। বললো, তোমার খোঁজ নিইনি বললে ঠিক বলা হয় না। তোমার বাজনা মাঝেমাঝেই শুনি। হৈমীদিদি তোমার সব ব্যাপার দেখছে তো। সে তাড়াতাড়ি নিজের কথা থেকে সরে আসতে বললো, এই হৈমীদিদি, সেই ছ-আনির কুমার, এদের কথা বেশ আশ্চর্য না?

খানিকটা দূরে গিয়ে রাজচন্দ্র বললো, হাতিটা ছেড়ে দিই। কাছে থাকো। চলো আমরা হাঁটি। এই বনে ছোটো একটা নদী আছে। তার উপরে লাটের জন্য ছোটো কিন্তু মজবুত সাঁকো হয়েছিলো। চলো দেখি গে।

হাতি থেকে নেমে তারা পায়ে হেঁটে চললো।

যখন অনেক কথা বলতে ইচ্ছা করে তখনই যেন কথা বলা যায় না। সাঁকো পেরিয়ে প্রায় একশো গজ হেঁটে একটা ঘাসে ঢাকা জমি দেখে রাজচন্দ্র বললো, এসো বসি। দ্যাখো পাখি ডাকছে। তুমি একবার আমার সঙ্গে শিকারে আসবে বলেছিলে,দ্যাখো আজ তা হলো।

রাজচন্দ্র বললো, ইতিমধ্যে দুএক বিকেলে তোমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। দু বারই শুনলাম, তুমি রাজবাড়িতে। অনুমান, রানীমহলে লুকিয়ে থাকছে।

–হুকুম করলেই আসতাম।

হুকুম, নয়ন?

নয়নতারা মুখ নামিয়েছিলো, মুখ তুলে বললো–আমাকে কিছুদিনের ছুটি দিতে হবে, রাজকুমার। মামাবাড়ি যাবো।

-তোমার মামাবাড়িও কাশী?

–মহাভারত পড়তে গিয়ে দেখি এখনো অনেক জায়গা স্পষ্ট বুঝি না।

–গত তিন-চার বছরেও হলো না? সেবার আমি পশ্চিমে গেলে তুমিও তো কোথায় চলে গিয়েছিলে! এই তো আমি এবার কলকাতা যাওয়ার আগে থেকেই আড়াই মাস হবে দূরে দূরে ছিলে।

নয়নতারা যেন সময়টাকে আঙুলে গুনবে।

রাজচন্দ্র বললো–আমার অনুমতি দিতে ইচ্ছা নেই।

এটাই তো নয়নতারার ভয়। তবু সে সাহস করে বললো–অবুঝ হতে নেই।

রাজচন্দ্র বললো, রানীমা তোমাকে নিজের কাছে রেখে নিজের বস্ত্রালঙ্কারে সাজিয়ে-তোমরা ভালো জানো, হয়তো মেয়েদের ছেলে থাকার মতো একটি মেয়ে থাকাও দরকার মনে হয়, কিন্তু তোমাকে সকলের অপ্ৰাপণীয় করে তুলেছেন।

নয়নতারা জোড়াসনে বসে ছিলো। তার নিজের পায়ের সোনার কামদার মোটা মলজোড়ায় চোখ পড়লো।

সেই কবে পুরনো সিন্দুক সাফ করতে গিয়ে এটা বেরিয়েছিলো। নয়নতারা কৌতূহল দেখিয়েছিলো। রানী তার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলেন, পরো তুমি। ক্ষতি কী? কিন্তু সোনা যে! নয়নতারার এই দ্বিধায় রানী হেসে বলেছিলেন, আমি পরতাম, তাতে দোষ কেটে গিয়েছে।

নয়নতারা লজ্জায় পুড়ে গেলো যেন। রানী পরতে বলেছিলেন, পরে ছিলো। রানী ছাড়া কাউকে কি মানায়? কেউ যেন বললো, খুলে ফেলোনি কেন?

সে বললো, রাজকুমার, আমার স্পর্ধা, হয়েছে, আমাকে মাপ করো।

রাজচন্দ্র বললো–দ্যাখো নয়ন, তুমি কী নির্দয়! আমার কথার ভুলকে ক্ষমা করো না। আমি কি তাই বলেছি? সে হেসে বললো, আচ্ছা নয়ন, তোমার সেই বাইচে নামে একটা মেয়ের কথা মনে পড়ে?

-তুমি গল্প করেছিলে বটে। সেই পিয়ানোর গায়ে নাম তো? যার তেরো চৌদ্দ বয়সের সুঘ্রাণ ছিলো? সে বলেই ভাবলো, রাজকুমার কি কলকাতার কনে সম্বন্ধে কিছু বলতে চায়? তার সম্বন্ধে কোনো অনুভূতি বা সুঘ্রাণের কিংবা তার অভাবের? তা কি বলতে দেওয়া উচিত?

কিন্তু রাজচন্দ্র বললো–জানো, চরণদাস, গ্রামের পোস্টমাস্টার, ওদের খুব দুঃসময়। খুব বিপদে পড়েছে। কাল বিকেলে তার বাড়ির চারিদিকে ঘোড়া নিয়ে ঘুরতে ইচ্ছা হলো! চরণ আমাকে দেখেনি। আমি কিন্তু দেখলাম, বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে তার ভারি মুখটা উজ্জ্বল হলো।

নয়নতারা গলাটাকে চেপে ধরার চেষ্টায় বললো–দুঃসময়ের কথা বলছিলে।

রাজচন্দ্র বললো–একই গল্প। কাল সন্ধ্যায় দাবা খেলতে খেলতে বাগচী হা হা করে হাসছিলেন। তিনি যাদের জন্য দরখাস্ত লিখে দিয়েছিলেন তারা অনেকেই তাকে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করেছে। হাসি দেখে আমার বলতে কষ্ট হলো, ডানকান আরো এগিয়ে গিয়েছে, তাদের নামে মিথ্যা দলিল তৈরী করার মামলা আনছে। আচ্ছা নয়ন, তা সত্ত্বেও এদের মুখে হাসি দেখে কি মনে হয় না?

-কি রাজকুমার?

–যে এদের স্ত্রী আছে?

নয়নতারা অবাক হলো। সে একবার হাসিমুখে বলতে গেলে, সেই চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তার আগেই রাজচন্দ্র বললো–আচ্ছা নয়নতারা, তুমি কি কখনোই আমার হবে না?

নয়নতারার চোখে জল এসে যাচ্ছে। সে অনুভব করলো, কথা বলতে গেলে ঠোঁট দুটোকে শাসনে রাখা যাবে না। ফুঁপিয়ে উঠবে নাকি শেষে? সে সেসবের পাশ কাটিয়ে হাসিমুখে পৌঁছালো। বললো–সেই কবে থেকেই এই দ্যাখো, সেই আংটিটা আজ আবার পরেছি।

সে যেন নিজের হাতটাকে রাজচন্দ্রর চোখের সামনে ধরবে। কিন্তু রাজকুমার হাতজোড় করেছে কি? তেমনভাবে কি কিছু বলছে? সে দেখতে পেলো না, শুনতে পেলো-স্ত্রীরা যেমনভাবে পুরুষের নিজের হয়?

নয়নতারা দুএক মিনিট দম বন্ধ করে বসে রইল। নিচের দাঁত ঠোঁটে চেপে ধরে চোখের জল ঝরে না যায় এমন করে মাথাটাকে ডাইনে বাঁয়ে দোলালো।

একসময়ে রাজচন্দ্র হেসে উঠলো। চলো নয়ন, আজ আর শিকার হবে না।

.

০৩.

তারা যখন রাজবাড়ির হাতায় ঢুকছে বেলা দুটোর ঘণ্টা পড়লো। নয়নতারা বলতে গেলো, আজ সারাদিন স্নানাহার হলোনা। তখন কাছারি আবার বসেছে। কাছারির চত্বরে তো মানুষ জনের ভিড়ই। হাতিটা চলছে, তা সত্ত্বেও সেই ভিড়ের দুএকজন যেন হাতিটার দিকে এগোলো। হাতি বসলে রাজকুমার তাদের একজনকে চরণদাস বলে চিনতে পারলো। কাছারির একজন কর্মচারী এগিয়ে এসে বললো, এরা সকাল থেকে হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে এসে বসে আছে। এখন কি তাই বলে দেখা হয়?

রাজচন্দ্র বললো–এদের দরবারে বসাও।

তারা চলে গেলে নয়নতারাকে নামতে সাহায্য করলো রাজচন্দ্র। বললো–দেখেছো, এদেরও খাওয়া-দাওয়া হয়নি আজ। তুমি কি এখন বাড়িতে ফিরবে? যদি পারো থাকো না হয়, বিকেলে কথা বলবো।

নয়নতারাকে বাড়িতে যেতে হলেও তো রানীকে বলে যেতে হয়। অন্দরে যেতেই হবে। সকালের সেই দৃশ্যটার কথা কি এতক্ষণে সর্বত্র ছড়ায়নি? একরকম লজ্জায় নয়নতারার পা দুখানা যেন পড়তে চাইছে না। কিন্তু রাজচন্দ্র বললো, শোনো নয়ন, এক কাজ করো না হয়। কাউকে বলে দাও এদের কিছু খেতে দেবে।

চরণ তো রাজকুমারের পরিচিতই। তাদের বিপন্নতার কথা সে বরং তাদের চাইতেও বেশি জানে। তারা হয়তো এখনো সেই মামলার কথা শোনেনি যা রাজ বাড়ির চরেরা সংগ্রহ করেছে ইতিমধ্যে। দরবারের আসনে বসেই রাজচন্দ্র সেজন্য বললো, তোমরা কী ভেরে এসেছো? আমি তোমাদের জন্য কী করতে পারি? তোমরা কি মরেলগঞ্জের জমি ছেড়ে চলে আসতে চাইছো?

তারা কী বা বলতে পারে? তাদের সমস্যার কি কোনো সমাধান আছে কোথাও? চরণ দুএকবার কথা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। রাজচন্দ্র ভাবলো, এই সময়ে মরেলগঞ্জের বাড়ি জমি ছেড়ে আসতেই বা এদের কীরকম লাগবে? তার মনে পড়লো, নয়নতারা একদিন জমি সম্বন্ধে কীসব বলেছিলো। সে তাদের চুপ করে থাকতে দেখে বললো, আচ্ছা, এ কি সত্যি সেই জমি যার জন্য তোমাদের কষ্ট, অপমান, তা ছেড়ে আসতে কী তোমাদের খুব কষ্ট হয়? এ কি সত্যি যে সেই জমি তোমাদের আত্মীয়স্বজনের মতো আপন হয়ে যায়?

চরণ বললো–সে জমি যদি আমরা ছেড়ে দিয়ে আসি, তাতে কিন্তু ডানকানেরই সুবিধা। যে কিনবে সে তো তার কথাতেই সেই নীল চাষই করবে।

রাজচন্দ্র ভাবলো, ওটা হয়তোনয়নতারার ভাবুকতা যে জমিকে অনেক স্মৃতিতে জড়ানো জননীর মতো মনে হয়। চরণ বললো–রাজকুমার, বাপ-পিতামোর কথা মনে এসে যায়। তাদের কষ্টের, আদরের, যত্নে বাড়িয়ে তোলা জমিকে ডানকানের লোভ থেকে বাঁচাতে ইচ্ছা করে। সে জমি যদি বিক্রি করতে হয়, ইচ্ছা হয় যে তা এমন কেউ নিক যে ডানকানকে ছুঁতে দেবে না।

রাজচন্দ্র বললো–চরণ, তোমাকে একটু কষ্ট দিই, নায়েবমশায় এসে থাকবেন, তাকে এখানে একটু আসতে বলল।

চরণ নায়েবকে ডাকতে গেলে রাজচন্দ্র পরিচয় নিয়ে জানলো বাকি দুজন অমর্ত্য আর কৃষ্ণানন্দ। তাদের দুজনের এবং চরণের জমি পাশাপাশি। যোগ করলে একশো বিঘায় দাঁড়াবে। জমিগুলো সবই মরেলগঞ্জ রাজনগরের সীমা ঘেঁষে।

সে বললো, নায়েবমশায় খোঁজখবর করে বিলমহলে তোমাদের জমি দিতে পারবেন। হয়তো পাশাপাশি হবেনা, কাছাকাছি হবে, এমন করা যাবে। কিন্তু ওটা কি হয়, যে তোমাদের মরেলগঞ্জের জমি নেবে সে ডানকানকে জমি ছুঁতে দেবে না? এমন তো করা যায় না। তোমাদের মরেলগঞ্জের জমি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। এ তো সত্যি মা নয় যে বুড়িকে মাথায় নিয়ে পালাবে? রাজকুমার হাসলো।

নায়েব এলে রাজচন্দ্র তাদের সমস্যার কথা বলে বললো–এদের একটা ব্যবস্থা করুন, তাই বলে ডানকানকে ধরে এনে পিটিয়ে দেওয়ার কথা ভাববেন না।

নায়েব হেসে বললো, খুব কড়কে দেওয়া যায়, বছরখানেক মুখ নিচু করে চলবে। তাতে কিন্তু রানীমার মত নিতে হবে। এদের না হয় জমি দেওয়া গেলো, কিন্তু মরেলগঞ্জের মায়া তো ছাড়তেই হবে। ছেলেমানুষি কি চলে? সে জমি যে কিনবে তাকে তো ডানকানকে মানতেই হবে। নীলের ফসল ভোলা চাই।

রাজচন্দ্র বলতে গেলে, দেখলে চরণ, দেখলে অমর্ত! কিন্তু সে কিছু ভাবলো। তার মুখের হাসিটার অর্থ ধরা যায় না, কিন্তু বোঝা যায়, চিন্তাটা বিচিত্র খাতে চলেছে। সে বললো, নায়েবমশায়, এরা চাইছে জমিটা এমনভাবে বিক্রি হোক যাতে বরং পতিত থাকবে কিন্তু ডানকানের জোর খাটবে না। তোক না ওটা রাজবাড়ির নামে কিংবা আমার নামে কেনা!

নায়েব বললো– রাজকুমার, তা কি ভালো দেখায়? ডানকানরা খাজনা দেয় না, লীজে একবারে আগাম দিয়েছে। কিন্তু মরেলগঞ্জের দরুন লাট তো আমরাই দিই। প্রজার জমি খাস করা যায়, আপনার নামে কেনা যায় কি?

একজন ভৃত্য ও একজন দাসী চরণদাসদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিলো। রাজকুমার বললো–তোমরা কি নয়নতারা-ঠাকরুনকে চেনো? তিনি যদি রাজবাড়িতে থাকেন, এখনই একবার তাকে দরবারে আসতে অনুরোধ করো। রাজচন্দ্রের মুখে একটা বিচিত্র হাসিই যেন। সে বললো–খাও তোমরা, চরণ। সে যেন মনে মনে এমন লোক খুঁজতে লাগলো যে এদের জমি কিনতে পারে অথচ ডানকানকে পরোয়া করবে না।

নায়েবমশায় অনুমতি নিয়ে চলে গেলো। নয়নতারা এলো। এই সময়ে রাজচন্দ্ৰ হেসে উঠেছিলো। সে বললো–বসো নয়ন, এরা সকলেই আমায় কিছু করতে বলছে। সে গলা তুলে বললো, নায়েবমশায়কে আবার ডাকো তো। নয়নতারাকে বললো, তুমি একদিন জমি নিয়ে বলেছিলে, এদেরও সেই সমস্যা। জমি আর স্ত্রী কিংবা মা কিন্তু এক নয়। জমিকে মাথায় করে পালানো যায় না।

বিব্রত নয়নতারা কী বলবে খুঁজে পেলো না।

রাজচন্দ্র মৃদু মৃদু হেসে বললো–রসো, নায়েবমশায় আসুন।

নায়েব তখনো কাছারি পৌঁছায়নি যখন তাকে ভৃত্য আবার ডেকে আনলো।

রাজচন্দ্র বললো–আসুন, আসুন। তোক খুঁজছিলেন তো মনে মনে একশো বিঘার। জমিটা আমি যদি নয়নতারার নামে কিনি?

নায়েবও কী বলবে খুঁজে পেলো না। এটা কেমন এক লজ্জার ব্যাপার হয়ে যাচ্ছে না? -লজ্জা এবং অবিবেচনার?

রাজচন্দ্র বললো, হ্যাঁ, এই ঠিক হয়েছে। তোমরা রাজী হয়ে যাও। প্রকৃতপক্ষে বুদ্ধিটা নয়নঠাকরুনই আমাকে দিয়েছিলেন। এদের কথাও থাকছে। নয়নঠাকরুনকে ডানকান নীল বুনতে বলবে না নিশ্চয়। তাছাড়া, নয়ন, এরা যেমন চাইছে তাও নয়। জমিকেই নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায়। ওটা এক একশো বিঘার দীঘি হতে পারে।

নয়নতারা খুব মৃদু করে বললো, রাজকুমার! কিন্তু চাঁদরের ঘোমটা থাকায় সেই মৃদুস্বরকে যে-ভঙ্গি অর্থবহ করবে তা প্রকাশ পেলো না।

রাজকুমার বললো–এই ভালো হলো, নয়নতারা। ও জমিতে আর চাষ হতে হয় না। ও জমি আমার চাই। বুঝেছো তোমরা? বৈশাখের আগেই,নয়ন, ওই মার্টিটুকু কেটে উড়িয়ে দেওয়া যাবে। একটা দীঘি, কিন্তু এমনভাবে কাটবে যেন বৈশাখে জল আসে। তারপরে লম্বার দিকটা চওড়া করে আবার কাটাব, ফের লম্বার দিকটাকে চওড়ার দিক করে দিলে তোমার একশো বিঘা ঢেকে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা দীঘিই হবে। তোমরা খাও। আমি এবার উঠবো। নায়েবমশায়, আপনি এদের আগাম দিয়ে বায়নাপত্রে দস্তখত নিয়ে রাখবেন। কিংবা নগদে দাম চায়, দিয়ে দেবেন, আর তা আজই। নয়নঠাকরুনের যদি সই করতে হয়, ইনি আপাতত রাজবাড়িতে থাকবেন।

নয়ন স্তম্ভিত,নায়েবমশায় বাকরুদ্ধ। তখন বোধ হয়, চরণদাসদের মাথা ঝিমঝিম করছে।

নয়নতারা কিছু বলতেই হবে এরকম ভেবে মিনমিন করে বললো–আমাকে কি সই করতে হবে?

নায়েব কথা খুঁজে পেয়ে বললো–তা তো করতেই হবে, মাঠাকরুন।

রাজু বললো–চলো নয়নতারা, সারাদিন আজ স্নানাহার করতে দিলে না। কী পুকুর তোমার মাথায় ঢুকেছে। অবশ্য একশো বিঘার দীঘি না করে একটা ভালো বাড়ির জন্যও জমি ছেড়ে রাখা যায়। তোমার বাড়ি হলে আমিও কি যাবো না মাঝেমাঝে? চরণ, অমর্ত, কৃষ্ণানন্দ, খাও তোমরা। না খেয়ে যেয়ো না। ভয় নেই তোমাদের। নায়েবমশায় তোমাদের জমির ন্যায্য দাম দেবেন।

.

তখনকার দিনেও এমন মত ছিলো, ধনাঢ্যদের পীড়া একসময়ে প্রকাশ পাবেই। কাছারির লোকেদের যাদের ঘটনাটা সেই সন্ধ্যার আগেই টাকার অঙ্কসমেত জানা হয়েছিলো তাদের মনোভাব এ রকম হলো :সম্বন্ধটা যে কোনোভাবেই প্রকাশ পেতে পারতো। তাদের কেউ কেউ এ রকম চিন্তা করলো বরং–গোলমাল বাধার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। সে গ্রামে তখন ন্যায়নীতি নিয়ে চিন্তা করার লোকও ছিলো, যাদের পক্ষে ধনাঢ্যদের পীড়া বলেই উপেক্ষা করা সম্ভব ছিলো না। এরকম সংবাদ কাছারির বাইরে যেতে কিছু সময় লাগে, কিন্তু যেহেতু নরেশ, সুরেন প্রভৃতি জমি বিক্রির ব্যাপারটা চরণের সঙ্গে আলাপ করেছিলো, সংবাদটা নিয়োগীর কানে একটু তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলো।

তাতে তো এখন অধ্যক্ষের কাজও কিছু কিছু করতে হচ্ছে, সুতরাং সেও দুএকদিন সংবাদটাকে নিজের মধ্যে ধরে রাখতে বাধ্য হলো। কিন্তু রবিবার এসে যাওয়াতে সে সকালের দিকেই বাগচীর কুঠিতে উপস্থিত হলো। বিষম বিপদ যে, এই ঘৃণার ব্যাপারটা সেখানে কীভাবেই বা আলোচনায় আনা যায়। অন্যত্র এই এক সুবিধা থাকে যে গৃহের মহিলারা আলোচনায় যোগ দেন না, অথবা ইংরেজি বোঝেন না। এক্ষেত্রে তো ইংরেজিতে আলোচনারও সুবিধা নাই। কিন্তু কর্তব্য তোকর্তব্যই বটে। তাছাড়া ঋষিপ্রতিম ওয়ার্ডসওয়ার্থ কি কর্তব্যকে স্বয়ং ঈশ্বরের গম্ভীরা কন্যা বলেন নাই? অন্যদিকে সে-ই-বা কলকাতার সমাজে কীভাবে মুখ দেখায়? দিদি ব্ৰহ্ম-ঠাকুরানীই বা অতঃপর কী করেন? না, না, এ আমাকে বলতে হবে, অবিবাহিত একটি স্ত্রীলোককে পুকুরসমেত বাগানবাড়ি করে দেওয়াকে তাই বলে, ধনাঢ্যদের পীড়াই।

সর্বরঞ্জন সেদিন যত কম কথায় সম্ভব বাগচীর সঙ্গে আলোচনা করবে স্থির করে নিলো। সে প্রায় বসতে বসতেই বললো, এটা আমাদের স্কুলের বিষয় নয়, এ থেকে আমরা কানে আঙুল দিয়ে দূরে থাকতে পারতাম, কিন্তু একটি কুমারী কন্যার সর্বনাশকে তো আর নিশব্দে উপেক্ষা করা যায় না।

বাগচী ও কেট কারোপক্ষেই সরঞ্জনের বক্তব্য বুঝতে সহজ হলো না। বাগচী এমনকী কল্পনা করলো, নিয়োগী হয়তো কৈলাশ পণ্ডিতের সেই অবিবাহিতা কন্যার কথা কিছু বলছে। বাগচী বললো–এ সম্বন্ধে কি কাছারিতে প্রতিকার চাওয়া হয়েছে?

সর্বরঞ্জন বললো–সেটাই তো বিপদের উৎস। আপনি কি শোনেননি? নয়নতারা নামে এক অবিবাহিতা স্ত্রীলোককে রাজকুমার বাগানবাড়ি কিনে দিচ্ছেন, তাও প্রকাশ্যে?

বাগচী প্রায় হেসে ফেলো–কেটের মুখে তো হাসি খেলা করলোই! সে খুব মৃদুস্বরে বললো, সেন্ট বটল?

সেন্ট বটলের ব্যাপারটা মাথায় না ঢুকলেও সেই সকালে নিয়োগী বাগচী এবং কেটকে প্রায় বিপর্যস্ত করে দিতে পেরেছিলো। সে অনেকবার শুরু করে, মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে, আবার শুরু করে, ডাইনে বাঁয়ে মাথা দুলিয়ে, দু-একবার লাল হয়ে বাগচীকে বুঝিয়ে দিতে পারলোয়নতারা একজন অবিবাহিতা স্ত্রীলোক। তাকেই রাজকুমার বাগানবাড়ি তৈরী করে দিচ্ছেন, ঠিক তখনই, যখন কলকাতার এক কুসুম কোমল কুমারী কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ প্রায় স্থির। সে কী করে বা এই পাপে অংশ নিতে পারে? কেননা এখানে সত্য গোপন করা কি পাপে অংশীদার হওয়া নয়? বিশেষ সেই কন্যা যখন হিন্দুনয়,বরংনবধর্মের বিশিষ্ট সদস্য, এমনকী ইংরাজি-দক্ষা আধুনিকাও বটে।

বাগচীকে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে থাকতে হলো। তার এবং কেটের একটা আনন্দোজ্জ্বল ধারণা। যা রাজকুমারের বিবাহ সম্বন্ধে তাদের আনন্দের কারণ হয়েছিলো সেটা কি কলঙ্কিত হবে? কেটের মুখটা শুকনো দেখালো। কিন্তু বাগচী বললো, একে অন্যের কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশ দিতে পারেনা। আমি আপনাকে এই বলতে পারি, রাজ-পরিবারে এরকম ঘটে থাকে। আপনি প্রচার করবেন কিনা আপনার বিবেচনার বিষয়।

সর্বরঞ্জন নিয়োগী নিতান্ত চিন্তাকুল মুখেই চলে গেলো।

সে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে কেট জিজ্ঞাসা করলো–তুমি কি এখন রাজবাড়িতে যাচ্ছো?

-হ্যাঁ, দশটা বাজে। আমি তো কাছারির নিয়মে বসি না। বাগচী রাজবাড়িতে যাওয়ার জন্য টুপি হাতে করলো। তার মুখটা অস্বাভাবিক কঠোর দেখালো।

 ১৪. বসন্ত যেন আগে এসেছিলো

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

০১.

ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, বসন্ত যেন আগে এসেছিলো রাজনগরে। এখন তো চৈত্র এসে গেলো। অনাবৃষ্টিতে নদীর জলও শুকিয়ে উঠছে। কিন্তু দোলও এসে পড়েছে। ঘাটের কাছে সকালের থেকেই যেন প্রচ্ছন্ন একটা জ্বালা অনুভব করা যায়। খরার কথা উঠে পড়ছে। স্মরণকালে এমন হয়নি।

সেদিনটা অন্যদিনের মতোই। বাগচীকে রাজবাড়িতে যেতে হয় বলে সে বরং বেশ সকালেই চরণের ডিসপেনসারিতে যায়। কিন্তু রোগী আজকাল যেন কমেছে। বাগচী বেশ গম্ভীরভাবেই বললো–দ্যাখো, চরণ, বাদলা ভাব না থাকায়, জ্বর, সর্দি, পেটের পীড়া কম। চরণও তেমন গম্ভীরভাবেই মন্তব্য করলো–এতো শুকনোবসন্ত, বসন্তনা লেগে যায়। বাগচী বললো–রোগটার সঙ্গে কিন্তু ঋতুর যোগ নেই।

এটা তো দুজনেই লক্ষ্য করছে রোগীর সংখ্যা খুবই কম। বিশেষ মরেলগঞ্জের রোগী গত কয়েকদিনে একটিও আসেনি। সেখানে পুরাতন রোগের রোগী কোনো অঞ্চল থেকেই কমনয়। বাগচীর একবার মনে হলো সে জিজ্ঞাসা করে, মামলার খবর চরণ আর কিছু শুনেছে কিনা। কিন্তু তার বরং এই অদ্ভুত অনুভূতি হলো, ডানকান মামলা করছে, উকিল ব্যারিস্টারে অনেক খরচ করবে, তার চাইতেও বড়ো কথা সে অনেকগুলি লোককে হলফ করে ঈশ্বরের নামে মিথ্যা বলতে বাধ্য করবে। এই সময়ে একটি অপরিচিত ভীত চেহারার বালককে চরণের বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে বাগচী তার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলো। চরণ বললো, অমর্ত্যর ছেলে। অমর্ত্যর স্ত্রী কন্যা এখনো মরেলগঞ্জে আছে। দোলের পূজা করে তারা রাজনগরে চলে আসবে। কৃষ্ণানন্দও সেদিন থেকেই উঠে আসবে। আপাতত তারা চরণের বাড়ির কাছেই তারই জমিতে ঘর তুলে নেবে।

বাগচী বললো–ওদের তো মরেলগঞ্জের সঙ্গে কোনো যোগই থাকলো না।

রাজবাড়ির দিকে যেতে যেতে বাগচীর মনে হলো, পড়া টাইমসগুলোকে ফেরত দিয়ে নতুন টাইমস আনতে হয়। সুতরাং সে কুঠিতে ফিরে তার স্টাডিতে ঢুকলো। কেট এখন খানিকটা সময় বিশ্রাম করে। অনেকসময়ে বাগানে গিয়ে বসে।

সুতরাং তার খোঁজ না করেই সে স্টাডি থেকে বেরিয়ে আসছিলো। এই সময়ে তার মনে হলো, পার্লারে কেউ কথা বলছে। হয়তো রাজকুমার–এই ভেবে উঁকি দিয়ে সে অবাক হলো।

পার্লারে রাজকুমারের বদলে ও সুলিভান। বোঝা যায় সে কিছুক্ষণ এসেছে। তার সামনে ধোঁয়াচ্ছে এমন কফির কাপ। বাগচী হাসিমুখে বললো–বনাত কিনছো নাকি, কেট? নাকি সিল্ক, এখন গরম পড়বে তো?

কেটও হেসে বললো–না, মিস্টার ও সুলিভানের সঙ্গে গল্প করছিলাম।

–বেশ, করো। আমি রাজবাড়িতে যাচ্ছি। বলে বাগচী বেরিয়ে গিয়েছিলো।

লাঞ্চে কেট বললো, ভারি মজার কথা, বাগচী, ওসুলিভান বলেই ফেলো, আমিই নাকি প্রথম ইউরোপীয়ান মহিলা যে তাকে বসতে বলেছে, নিজে থেকে কথা বলেছে, বাড়িতে ঢুকতে আমন্ত্রণ করেছে।

বাগচীর মন তখন প্লেটে, মনের অন্য অংশে বোধ হয় কেটের সান্নিধ্য ও রাজকুমারের ফেনসিং অভ্যাসের কথা সমানভাবে। সে মনের উপরিভাগ থেকে বললো– হেসে, তাহলে দ্যাখো হেট দা সিন, নট দা সিনার–এই উপদেশটা কত কম লোকে মানে। তাছাড়া দেখা যাবে হয়তো ও সুলিভান দরিদ্র বটে, পিতামাতার সিনের ফলভাগী, নিজে সিনার নয়।

.

দোল-উৎসবের আগের দিন ছিলো সেটা। রাজবাড়িতে উৎসবের আয়োজন শুরু হয়েছে। রানী নয়নতারাকে বললেন, তোমার কাজ শেষ হতে চায় না। বিকেলে বেড়াতে যাবে এমন সময় হয় না। তুমি কি নতুন জেটি ছাড়া আর কিছু দেখেছো? কাল সন্ধ্যার পরে শব্দ শুনে জানা গেলো সেই অ্যালবেট্রস জাহাজ নাকি আবার ভিড়েছে ঘাটে। ভোররাতেও তার ভো শুনলাম। নয়নতারা তো বুঝতেই পারছে, রানীর বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছা। সে বললো, পালকী দিতে বলবো রানীমা?

রানীর সেদিন হাতি পছন্দ হলো। তারা দুপুর শেষ হওয়ার আগেই বেরিয়ে পড়লেন। তাতে অসুবিধা হলোনা। টোপর-হাওদার চারদিকের জানলার মাথায় বাইরে ছড়ানো ঢাকনা থাকে, জানলায় রেশমের পর্দাও। রানী সেদিন জয়নালকে পছন্দ করেছিলেন। অনেকটা উঁচুতেই সুতরাং সেই হাওদা। খানিকটা দূরে গিয়েই রানী বললেন–হাওয়া দিচ্ছে কিন্তু এখানে।

সেই বিকেলে অনেকটা সময় তারা বেড়ালেন। নতুন জেটিতে খানিকটা দূরে থেকেই একটা গাছতলায় হাতি থামিয়ে তাঁরা অ্যালবেট্রসকে দেখলেন। রানী বললেন, কত। জোরে বা চলে! যাই বলো বাপু, ইংরেজদের যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। একেবারে দাগাবাজ নয়।

নয়নতারার হঠাৎ মনে হলো, এটা কিন্তু সুলুপ নয়। দু-চারটে বন্দুকের গুলিতে এটা বানচাল হয় না।

রানীও বললেন–আচ্ছা, নয়ন, এটা পতাকা নয়? ওর নামই কি ইউনিয়ন জ্যাক?

সেদিন রানীর শখ হলো ফরাসডাঙার পথে ঘুরে বেড়াতে। মন্দিরের পাশ দিয়ে তারা ফরাসডাঙার প্রথম পথগুলোকে দেখে দেখে বেড়ালেন। অবশেষে যখন বিকেল হয়ে গিয়েছে রানী মাহুতকে বললেন–এদিকে একটা ডিয়ার পার্ক ছিলো। চেনো? নয়নতারাকে বললেন, জানো নয়ন, জমিটা চারপাশের জমি থেকে বেশ উঁচু। একসময় হরিণ থাকতো, এখন আর নেই। নয়নতারা কৌতূহল প্রকাশ করলে, রানী হেসে বললেন, কী জানি, খেস্টান ততা। নিজেই খেয়েছিলো হয়তো।

নয়নতারা বললো–দেখুন, রানীমা, কত পাখি! হাঁস নয় তো? নাকি বক?

রানী দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক চাইলেন। হাতিটা তখন কয়েক পা মাত্র চলেছে। নয়নতারা তার দিকের জানলা দিয়ে ঝুঁকেছিলো,হঠাৎমুখ সরিয়ে আনলো, বললো–রানীমা, সাহেব যে!

ততক্ষণে রানীমার চোখেও পড়েছে। হাতিটা এখন যেখানে তা থেকে স্পষ্টই তিন চারজন শ্বেতাঙ্গকে ডিয়ার পার্কের টিলার কাছে দেখতে পাওয়া গেলো। রানীমা হাতিকে গাছের আড়ালে নিতে বললেন।

নয়নতারা জিজ্ঞাসা করলো–অ্যালবেট্রসের নাকি? চড়ুইভাতি করছে?

রানী বললেন, সোভান, সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, এবার ফিরে চলল।

.

সেদিন সন্ধ্যার পর রাজকুমারের কাছে বিদায় নিয়ে বাগচী রাজনগরে অগ্রগতির কথা ভাবছিলো। রাজকুমার বলেছিলো, গ্রামের পাশ দিয়ে রেললাইন গেলে গ্রামের উন্নতি হয় কিনা, হলে তা কেন হবে? বাগচীর মনে হচ্ছিলো সে ভালো যুক্তি দিতে পারেনি। কিন্তু কথাটা উঠেছিলো সন্ধ্যায় বাতাসে ভেসে আসা স্টিমশিপের হর্ন থেকে। রাজকুমার জিজ্ঞাসা করেছিলো, ওরা কি এখন যাত্রী নিয়ে যাতায়াত করবে নিয়মিতভাবে? তাহলে তো একটা স্টেশনও করতে হয় ওদের। সেই স্টেশন থেকেই রেলের কথা উঠেছিলো।

চিন্তা বিচিত্র গতি নিয়ে থাকে। রাজনগরের অগ্রগতির থেকে বাগচীর মন চরণদের সমস্যায় চলে গেলো। বিষণ্ণ মনে সে ভাবলো, ভালো হবে বলে যা কিছু করেছে তার ফলেই তারা আরো বিপন্ন হয়ে পড়লো। অন্তত দুটো পরিবারকে উদ্বাস্তু হতে হলো।

তার এরকম মনে হলো, যা তার সাধ্যাতীত ছিলো তা করতে গিয়েই এই বিপত্তি। তার এরকমও মনে হলো, চরণের চরিত্রে অনেকখানি ছিলো আদর্শবাদ। সেই আদর্শবাদ এরপরে আর কখনো মাথা তুলতে পারবে কি? এ অবস্থায় তার এরকমও মনে হলো, পাদরির পক্ষে বাইবেলের বাইরে যাওয়াই ভুল হয়েছে।

সে রাত্রিতে ডিনারের আগে পরে সে চিন্তা করার জন্য অনেকক্ষণ স্টাডিতে বসে রইলো।

তার মনে পড়লো রাতের পর রাত জেগে মেমোর্যান্ডামগুলোকে তৈরী করেছিলো। সে কিছু পড়ার জন্য বুকশেলফটাতে খুঁজলো কিছুক্ষণ, কিন্তু কিছুই যেন পছন্দ হলো না। বরং লেখার অভ্যাসটাই তাকে প্ররোচনা দিতে থাকলো।

হঠাৎ বুদ্ধিটা মাথায় এলো তার। সে অস্ফুটস্বরে বললো–না, চরণ, আদর্শবাদের মৃত্যুটা অত সহজে মেনে নেওয়া যায় না, যায় কি? না, চরণ। তুমি তো তাহলেও রোগ সারাবে, কেমন কিনা?

সে আর একটু ভাবলো। মজা পেয়ে মিটমিট করে হাসলো। নিজেকে বললো, এতক্ষণ বুদ্ধিটা আসেনি।

এতেই প্রমাণ হয় আজকাল তেমন তীক্ষ্ণ করে সে ভাবে না আর। সে উঠে ডায়েরি ক্যালেন্ডার খুলে তারিখ খুঁজলো। গুড ফ্রাইডের তারিখটাকে পেয়ে মনের আনন্দে হেসে ফেলো। সেই পুনরুত্থানের সূচনা নয়? যখন আদর্শবাদ মৃত্যুর অতীত হয়? আঙুলে গুণে দেখলো গুড ফ্রাইডের আর পাঁচদিন বাকি।

সে কাগজ কলম টেনে নিয়ে তার চেয়ারে বসে পড়লো। পারতেই হবে, নিজেকে বললো–না পারলে চলবে কেন? সে মনে মনে চরণকে বোঝালো, চিকিৎসা তুমি ভালো শিখেছে বটে, কিন্তু ইংরেজি মেটেরিয়া মেডিকা বুঝতে তো অসুবিধা হয়ই। বাংলায় হলে? আপাতত বারোটা পলিস্টে।

বাগচী পাঁচদিনে বারোটা প্রধান ওষুধের রোগলক্ষণ–নিজের অভিজ্ঞতা, এবং মেটেরিয়া মেডিকার অনুবাদের সাহায্যে লিখতে শুরু করলো।

সেদিন রাত এগারোটার সময় কেট এসেছিলো একবার খোঁজ নিতে। বাগচী হেসে বললো, যাচ্ছি ডারলিং, কিছুই না। প্রকৃতপক্ষে গুড ফ্রাইডের কথা মনে হলো। তুমি যাও, আসছি এখনই।

.

০২.

সকালটা অন্যদিনের মতোই শুরু হয়েছিলো চরণের। বনদুর্গা জল পান তামাক দিয়ে বললো, আজই অমর্ত্যমামাদের শেষ দোল মরেলগঞ্জে, তুমি তোমার ছেলে, আর অমর্ত্য মামার ছেলেকে নিয়ে একবার যাও। চরণ এসব ব্যাপারে বনদুর্গার কথা সহজেই মেনে থাকে। কিন্তু আজ সে বললো–তার মন ভালো লাগছে না। দোলের আর আনন্দ কোথায়?

চরণ যখন কৃষ্ণানন্দের বাড়ির কাছাকাছি তখন বেলা দশটা বাজে। অন্যান্যবার সে কি এরকম সময়ে আসে, কিংবা আরো আগে? অন্যান্যবার এ সময়ে মৃদঙ্গের শব্দ শোনা যায়। সে ভাবলো, লজ্জা হতেই পারে। মানুষ যখন কেবলই হেরে যেতে থাকে তখন তার তো মনে হয়ই আমার আবার উৎসব কেন? আর আজ কিনা মদন-বিমোহন যাঁর রূপ, তাকে। রং দিয়ে, ফুলের সৌরভ দিয়ে সাজাবে। বোধ হয় চুপচাপ ফিরে যাওয়াই ভালো।

অমর্ত্যর বাড়ি আগে পড়ে। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নিঃসাড় দেখে সে ভাবলো, সকলেই তাহলে কৃষ্ণানন্দের বাড়িতে পূজার কাজে। সে নিজেকে বোঝালো, তা ভালো, বিপদে একত্র হতে হয়। কৃষ্ণানন্দর বাড়িতে মানুষের সাড়া পাওয়া গেলো। তার বাইরের দিকের ঘরেই বেশ কয়েকজন মানুষ। চরণ ঢুকতে ঢুকতে দেখলো কৃষ্ণানন্দ ছাড়াও পাড়ার দু-চারজন পুরুষ আছে, একপাশ ঘেঁষে কৃষ্ণানন্দর পরিবার ছাড়াও স্ত্রীলোকও কয়েকুজন। চরণকে ঢুকতে দেখেই তাদের একজন হু হু করে কেঁদে উঠলো। এসবক্ষেত্রে মেয়েদের দিকে চাওয়া হয় না। কিন্তু আনন্দের দিন তো বটে, তখন এ রকম হলো কেন? যেন এই ভেবে চোখ তুলে চরণ দেখলো, যে কেঁদে উঠলো সে অমর্ত্যর স্ত্রী বটে।

কৃষ্ণানন্দ বোধ হয় নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে যদিও সেই প্লাবনে পাড় ভেঙে পড়া থেকে বাঁচানোর মতো মহীরুহ সে নয়। সে তো নিজেই থরথর করে কাঁপছে। সে বললো–দ্যাখো, চরণ, এই চিঠিটা অমর্ত্যর বিছানায় ছিলো।

ফাঁকা কাগজে একছত্র লেখা : চললেম, সখি। অমতাঁর বাইরেটা শক্ত ছিলো, বলবান ছিলো সে, কিন্তু রসিকতা ছিলো নিজেদের মধ্যে। এটা তার স্ত্রীকেই লিখে থাকবে। কিন্তু এই দুঃসময়ে এটা কী রকম রসিকতা? স্ত্রী বলেছে, অমর্ত্য তার মাথা খারাপ হওয়ার আগে কখনো কখনো তাকে সখি বলতো বটে। তাই বলে ভোররাত থেকে মানুষটার দেখা নেই! তাছাড়া কৃষ্ণানন্দ কোমরের কাপড় থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বার করে বললো, আমি তোমার কাছেই যাচ্ছিলাম চরণ, এই চিঠিটা তোমাকে লেখা ইংরেজিতে, তাই আমি পড়িনি। চোপ, ফের কাদছো তোমরা! এই বলে ঘরের স্ত্রী পুরুষকে ধমকাতে গিয়ে কৃষ্ণানন্দ নিজেই ভ্যাক করে কেঁদে ফেলো।

কৃষ্ণানন্দ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো–গোপালদার এক কিষাণ কুতঘাট থেকে এদিকে। আসছিলো, তার হাতে এই চিঠিটা দিয়েছে সেই ও সুলিভান।

চিঠিটা ইংরেজীতে লেখা নয়, চরণকে লেখাও নয়। এতক্ষণ এই মিথ্যা ছলনায় কি কৃষ্ণানন্দ এই বিপন্ন বিহ্বল লোকগুলিকে শান্ত রাখছিলো? সে কি ভেবেছিলো এত বড়ো দুর্ভাগ্যের কথা প্রকাশ করে শত্রুকে হাসতে দেওয়া যায় না? তার হয়তো মনে হয়েছিলো কিছু করতে হলে চরণের সঙ্গে পরামর্শ করে নেওয়া দরকার।

অমর্ত্য লিখেছে :

কৃষ্ণদাদা, তুমি আমাকে মানুষ করেছো। তোমাকে ছেড়ে যেতেও কষ্ট। সাহেব বলেছে সে দেশ নতুন, সেখানে নীলচাষ নাই। জমি বিক্রির টাকা রাজকুমারের কাছে গচ্ছিত আছে। তা দিয়ে বউ-ছেলেকে…(লেখাটায় এখানে জলের দাগ)…চরণকে বলো সে যেন আমাকে না খোঁজে। মাঝরাতেই আমরা দূরে চলে যাবো। এইটুকু শুনেছি, সে দেশের নাম মরিস। অ্যালবেট্রস…(এখানে লেখায় জল পড়েছে, তা মোছর চেষ্টায় লেখাও মুছে গিয়েছে)।

চরণ লাফিয়ে উঠে ছুটতে শুরু করলো। সে তো জানেই কুতঘাটের নতুন জেটিতে অ্যালবেট্রস বাঁধা আছে।

সে কুতঘাটে পৌঁছে অ্যালবেট্রসকে দেখতে পেলোনা। একটা জেলেনৌকো ভিড়লো। চরণ তাকে জিজ্ঞাসা করতেই জানলো মাঝরাতে মাইলচারেক আঁটিতে তারা কলের জাহাজকে পেরিয়েছে বটে।

চরণ ফোঁপাতে লাগলো। সে বুঝতে পারলোনা যাকাঁপছে, ভেঙে পড়তে চাচ্ছে, তাকে চোখে দেখতে দিচ্ছে না, তা আলো ঢালা নদীর জল কিনা।

১৫. রানীর পক্ষে সংবাদ পাওয়া

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

০১.

রানীর পক্ষে সংবাদ পাওয়া কঠিন নয়। কাছারির লোক ছাড়াও তাঁর নিজেরও তো সংবাদ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিলো। বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া যেত বলেই তো তার কাছে পৌঁছানো সংবাদকে নির্ভুল মনে করা হতো। সিদ্ধান্ত নিতেই যেন দেরী হচ্ছে। তিনি জানেন অ্যালবেট্রসের লোকেরা চড়ুইভাতি করতে নামেনি। তিনি জানেন সেই সাহেবের দলে মরেলগঞ্জের নীলকররা ছিলো; কালেক্টর, যার নাম ম্যাকফার্লান ছিলো; কলকাতা থেকে আসা এক সাহেব ছিলো, যার নাম সিবাস্টিয়ান, বলে, সে নাকি পাদরি। তারা ডিয়ার পার্কের টিলার উপরের দিকের কয়েকটা মেহগ্নি গাছ ইতিমধ্যে কেটেছে। তারা সেদিন জরিপ করছিলো। ওখানে একটা চার্চ বসাবে। তারা জায়গাটাকে খুব পছন্দের মনে করেছে। এমন ঢেউ খেলানো জমি আর এদিকে কোথায়? অন্যদিকে প্রজাও নেই, পিয়েত্রোর খাসে ছিলো। কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও নেই। চার্চ আর মিশনারি সাহেবদের বাংলোর পক্ষে এমন জায়গা আর হয় না। সামনের গুড ফ্রাইডে, পবিত্র দিন, সেদিনই চার্চের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে। চার্চের নামও নাকি হবে চার্চ অব দা হোলি অ্যাসেনশন।

শেষ পর্যন্ত সেদিন সকালে রানী তার মহলের অলিন্দ দিয়ে চলতে চলতে বললেন, রূপসী, রূপচাঁদকে ডাক। রূপচাঁদ উঠতে উঠতে তাকে সিঁড়ি দিয়ে দরবার হলের দিকে নামতে দেখলো। রানী রূপচাঁদকে বললেন–নায়েবমশায়কে দরবার হলে আসতে বলল।

রানী দরবারের ঘরে বসতেই রূপসী জানাতে এলো রূপচাঁদকে সে খবর দিয়েছে। রানী মিষ্টি করে হেসে বললেন–রূপী, একবার রাজকুমারের মহলে যাও। রাজকুমারের সময় থাকলে জানিও, আমি কথা বলবো।

যদি বলা হয় নায়েবমশায় কিংবা হরদয়াল তখন জানতো না চার্চের কথা, তবে বলতে হয় দুজনেই বয়সের ভারে শ্লথ হয়ে পড়েছিলো। নায়েব শুনে নিজেকে বলেছিলো, তাতে তোমার কীরে বাপু? যে খবর এনেছিলো তাকে বলেছিলো, দূরে দূরে থাকো গা। হরদয়ালকে খবরটা দিয়েছিলো বাগচী নিজে। আবার রলের চিঠি পেয়েছিলো বাগচী। সে এই ভাবতে চেষ্টা করেছিলো, রলে হয়তো মরেলগঞ্জের এবং ইন্ডিগো কমিশনের কথা জানে না। সে ভাবছে, হয়তো এখনো সব আগের মতোই আছে। কিন্তু সংবাদটা হরদয়ালকে জানানো দরকার যদিও রলের চিঠির প্রস্তাব মতো হরদয়ালকে অনুকূলে আনার চেষ্টা সে আর করতে পারে না।

হরদয়াল ও নায়েব, প্রায় একইসঙ্গে এসেছে তারা, বসলে রানী বললেন–ফরাসডাঙায় চার্চ হচ্ছে?

–আজ্ঞা, হাঁ।

–শুনেছো কালেক্টর নিজে নাকি উদ্যোগের পিছনে।

নায়েব বললো–অতটা শুনিনি।

রানী একটু ভেবে বললেন, এবার লাটের দিন এখন আসেনি। গত সনের ফরাসডাঙার লাট নাকি পিয়েত্রোর উকিল দয়ালকৃষ্ণ দিয়েছে।

হরদয়াল বললো–এরকম কিছু অসম্ভব নয়। নতুবা গত সনে ডাকে উঠত।

নায়েবমশায় বললো–গৌরী খবরাখবর নেয়। সে বলেছিলো, পিয়েত্রো মৃত্যুর আগে দয়ালকৃষ্ণকে এই মর্মে আমমোক্তারনামা দিয়েছে যে ৬১ সন তক সে আদায় করবে এবং লাট দিতে থাকবে।

হরদয়াল ভেবে বললে–এটা একটা আইনের ব্যাপার দাঁড়াচ্ছে, উকিল তো ওয়ারিশ নয়।

রানী বললেন–ওয়ারিশ নেই বলে, লাট দেওয়া সত্ত্বেও কালেক্টর কি ওটাকে খাস করে নিচ্ছে মনে করো?

হরদয়াল বললো–খাস এখনো করেনি, চার্চের সাহেবদের অনুমতি দিয়েছে, পরে খাস হবে স্থির করেছে হয়তো। চৈত্র শেষ হতে আর কদিন?

রানী যেন খুব লজ্জিত হয়ে পড়লেন। বললেন–অথচ, দ্যাখো, ভেবেছিলাম ওই টিলাটায় একটা সুন্দর বাড়ি হয়। আবার হয়তো ডিয়ার পার্ক হয়ে ওঠে।

হরদয়াল বিমর্ষ বোধ করলো, কারণ উত্তরটা সুখের হয় না। নায়েব ভাবলো, রানী কি ভেবেছিলেন যেমন শিবমন্দিরের বেলায় তেমন এই প্রাসাদের ব্যাপারে জবরদখল করে বেওয়ারিশ পিয়েত্রোর খাসজমি রাজবাড়ির সম্পত্তি করে নেবেন?

নায়েব বললো, রায়মশায় ঠিকই বলেছেন। ওটা আইনের প্রশ্নই দাঁড়াচ্ছে। মৃতের আমমোক্তারনামাও অচল। যদিবা লাট জমা পড়ে থাকে তা কিন্তু পিয়েত্রো জীবিতই এরকম বিশ্বাসে।

রানী ভাবতে লাগলেন। একবার তার মুখ রাঙা হয়ে উঠলো, একবার তার সুন্দর ছোটো কপালটা যেন ছায়া পড়ে বিবর্ণ হলো। তিনি হঠাৎ বেশ জোর দিয়ে বললেন না, তা হয় না। ফরাসডাঙার কিছুই খাস করতে দিতে পারি না।

এই সময় রাজকুমার বাগচীকে নিয়ে দরবারে এসে বসলো।

রানী তা দেখে বললেন রাজু, পিয়েত্রোর ফরাসডাঙা সরকার খাস করার মতলব নিয়েছে বোধ হয়।

রাজকুমার একটু ভেবে বললো–আপনার মন্দিরটাকেও দখলে নেবে নাকি?

রানী বললেন–তুমি এখন বড়ো হয়েছে, রাজু। একটু থেমে বললেন, শুনুন নায়েবমশায়, শোনো হরদয়াল। ওটা আমার চাই।

নায়েব বেশ বিচলিত হলো। হরদয়াল বললো, কী করে তা পারা যাবে যদি ওটা লাটের নিলামে ডাকার সুবিধা না হয়? আমরা জানি না কালেক্টর কলকাতায় পিয়েত্রো সম্বন্ধে কিছু লিখেছে কিনা, সেখান থেকে খাস করার মতো আনিয়েছে কিনা রেভেনু বোর্ডের।

রানীর ঠোঁটের কোণ দুটি শক্ত হলো। বললেন, তাহলে রেভেনু বোর্ডের সঙ্গে লড়তে তৈরী হও।

নায়েব বললো, তার আগে কিন্তু কালেক্টর চার্চ তোলার অনুমতি দিয়ে বসেছে। চার্চ উঠে যাবে।

রানী বললেন, এমন কি কেউ নেই যে টিলাটাকে আমার দখলে এনে দিতে পারে? আমি নতুন বন্দোবস্তে তাকেই ফরাসডাঙার পত্তনিস্বত্ব দেবো।

হরদয়াল বললো, দখল করে নেওয়ার ঝুঁকি আছে এক্ষেত্রে। তাছাড়া, রেভেনু বোর্ডের সঙ্গে মামলা লড়ে যাওয়ার জন্যই এমন কিছু দখল নেওয়া যায় না।

রানী বললেন, আমরা বিলেতে প্রিভি কাউন্সিলেও যেতে পারি তো?

হরদয়াল মৃদু হেসে বললো, রানীমা, মামলায় তো অন্তত কিছুটা যুক্তি থাকবে। বেওয়ারিশ একজন ফরাসীর সম্পত্তির ব্যাপারে কালেক্টরের আদেশকে অগ্রাহ্য করার পক্ষে অন্তত কিছু স্বত্বের জোর থাকা দরকার।

রানীমুখ নিচু করে নিজের হাত দেখছিলেন। মুখ তুলে বললেন, মুখ তার থমথম করছে, ও ফরাসডাঙার সবই রাজুর, রাজুর মাতুল-সম্পত্তি। রাজু ব্যতীত পিয়েত্রোর আর কোনো । ওয়ারিশ নেই। যেন লজ্জায় শিউরে-রানী উঠে দাঁড়ালেন।

বাগচী হঠাৎ বলে উঠলো, আমি দৃঢ় বিশ্বাস রাখি, রানীমা সঠিক যুক্তি দিয়েছেন। আমি মঁসিয়ে পিয়েত্রোর কাছে শুনেছিলাম, তাঁর মাতুলকন্যা, তিনি ব্রাহ্মণ কন্যাও বটেন, কোথাও রানী। এখন বুঝতে পারছি, তিনিই আমাদের রানীমাতা।

হরদয়াল ও নায়েবরানীর উঠেদাঁড়ানো দেখে বুঝতে পেরেছিলো দরবার শেষ হয়েছে। নায়েব আজকাল আগের মতো তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করে না। সে চিন্তাকুলও বটেইতিমধ্যে। সে ধীরে ধীরে উঠে রানীমাকে নমস্কার করতে গিয়ে দেখলো রানী চলে গিয়েছেন। নায়েব চলে গেলেও হরদয়াল দু-এক মিনিট তেমনি বসে রইলো। তার বিস্ময় যেন কাটতে চাইছে না।

রাজকুমার আর বাগচীও উঠে দাঁড়ালো। রাজকুমার যেন কৌতুক দেখেছে এমনভাবে বাগচীর দিকে চেয়ে হাসলো।

তখন কাছারি পুরোদমে চলেছে। নায়েব তার খাসকামরায় ঢুকে দু-চার মিনিট চুপ করে বসে রইলো। তামাক দিতে বললো। ল-মোহরার আসবার অনুমতি চাইলে বললো, বিকেলে। জমানবিশ নিজে এলে বললো, তোমাকে ডাকিনি, আমিনকে। জমানবিশ চলে গেলে তার খাসবরদারকে বললো, রাজবাড়ির নতুন রসুইওয়ালা বান্দাকে চেনো? তাকে বলবে ডেকেছি। আমিন এলে বললো, বিল মহলের গজাকে চেনো? কাল ভোরে তাকে চাই। বেরিয়ে পড়ো, মুখের এত্তেলা নয়। নায়েব গড়াগড়ার নল রেখে বারান্দায় এলো। বরকন্দাজদের একজনকে দেখে আঙুলের ইশারায় ডাকলো। সে এলে বললো, বুনোদের রেমো আর পেল্লাদকে চেনো? সন্ধে নাগাদ কাছারিতে আসে যেন। সে আবার তার খাস কামরায় ঢুকলো, ল-মোহরারকেই ডাকলো এবার। খাওয়া-দাওয়া করে সদরে যাও তো। ইদিক-উদিকে খবর করো, গুড ফ্রাইডে নাকী আছে তোমাদের, সেই ছুটি কাটাতে কালেক্টর কোন দিকে যাচ্ছে?

হরদয়ালও চিন্তা করতে করতেই তার কুঠির দিকে চলেছিলো। এটা কিন্তু খুব বিস্ময়ের হবে যদি প্রমাণ হয় যে জাঁ পিয়েত্রো রানীর আপন পিসিমার ছেলে। আর এখন তো তা প্রমাণ হলোই। সে ভাবলো, তাহলে কি রানীর খৃস্টান ধর্ম ও ইউরোপীয় সংস্কৃতি সম্বন্ধে অনেক মনোভঙ্গির বিশ্লেষণ হয়? তার মনে পড়ে গেলো, রাজকুমার বালকত্ব পার হয়ে কৈশোরের দিকে যেতে তার শিক্ষাদীক্ষার ভারই যেন পিয়েত্রো বুজরুকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। অন্তত দিনের অনেকসময়েই ফরাসডাঙায় কাটাতো রাজকুমার। একটা পক্ষপাতই ছিলো যেন রানীর রাজকুমারের বেড়ে ওঠার ব্যাপারে।

সে যখন তার কুঠিতে ঢুকেছে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো। সিঁড়ির উপরে যেন রাজবাড়ির দিকে ফিরে কিছু দেখবে। সে নিজেকেই যেন প্রশ্ন করলো, এখন তাহলে কি ব্যাপারটা বোঝ যাচ্ছে? এমন কী হতে পারে, সেই বিশেষ এক রাতে যখন রাজকুমারকে বুজরুকের সহায়তা করতে সে বাধা দিয়েছিলো তখনই রানী ক্রুদ্ধা হয়েছিলেন? সেজন্যই কি তাকে পদচ্যুত করা হয়েছে? বুজরুকের পরিকল্পনা যে পিয়েত্রোরও পরিকল্পনা তা তো সহজেই জানা যায়। কিন্তু এ কি সম্ভব, রানী ভেবেছিলেন এই রাজবাড়ি, বিশেষ রাজকুমার, সেই ৫৭-এর ব্যাপারে জড়ায়? কী হতো? কী লাভ হয়েছে কার? কিংবা রানী নিজেও কি বুঝেছিলেন পরিকল্পনা ব্যর্থ হবেই? তা সত্ত্বেও পিয়েত্রোর কাছ থেকে রাজকুমারকে সরিয়ে আনাও সহ্য করতে পারছিলেন না? তার পদচ্যুতি কি এক দুঃসহ নিরুপায় ক্রোধের প্রকাশমাত্র? তাতে কিন্তু প্রমাণ হয়, পিয়েত্রো রানীর কত কাছের মানুষ ছিলেন। কিন্তু কোনোদিনই কি কেউ পিয়েত্রোর সঙ্গে কথা বলতে দেখেছে তাঁকে?

.

সেদিন গুড ফ্রাইডে।

বাগচী দু-তিন দিন আগেই বলেছিলো, রাজকুমার, ছুটি চাই। একটা বই লিখে শেষ করতে হবে। আর তিনদিন সময়মাত্র হাতে। রাজকুমার বলেছিলো, ছুটি নয়, বই লেখার জন্য অবসর। বাগচী সেই সন্ধ্যার পর থেকে আসছে না।

কারো কথা ভাবতে গেলে মন অনেকসময়ে তাকে যেখানে শেষ দেখেছিলো সেখানে ফিরে যেতে পারে। বাগচী না আসায় তার সন্ধ্যাগুলো ফাঁকা যাচ্ছে এই অনুভূতি থেকে তার মন যেন বাগচীকে অনুসরণ করে তার কুঠিতে গেলো। তার মনে পড়লো, সেদিন বেশ হাসাহাসি হয়েছিলো কিন্তু নয়নতারার দীঘির জমি দেখার কথা নিয়ে। আর বোধ হয় পিয়েত্রোর তরোয়াল নিয়েও। আর সেই সময়ে, তার মনে পড়লো, পিয়ানোর ডালায় সেই রূপার ফলকে, পিয়েত্রোর পিয়ানোই তো সেটা, লেখা সেই বাইচেনাম। ও, সেই চতুর্দশীর সুঘ্রাণ! সেই বাইচে যে নাকি পিয়েত্রোর আদরের মামাতো বোন।

রূপচাঁদ এসে জিজ্ঞাসা করলো, রাজকুমার তখনই বাইরে যাবেন কিনা?

রাজচন্দ্র বললো, তা দিয়ে তোমার কী হবে? তুমি দুলকিকে আনতে বলল।

কিন্তু রূপচাঁদ যাওয়ার আগে রাজচন্দ্র তাকে থামিয়ে বললো, হারে রূপচাঁদ, তোর সঙ্গে কাঠের মিস্ত্রির জানাশোনা আছে? তুই কি গাছের উপরে সেই দুখানা ঘরের বাড়ির দেখেছিস? আমি জানতে চাইছি, সেই গাছের আর একটু নিচের দিকে আর খানদুয়েক ঘর হয় কিনা? মিস্ত্রিরা পারে কিনা? কাঠের সিঁড়িও করে দিতে হবে এঘরে ওঘরে যোগ করে। সব মিলিয়ে একটা বাড়ির মতো। খোঁজ নিয়ে জানাস তো আজ সন্ধ্যায়। আর একটা কাজ করিস। পিয়ানোটাকে ভালো করে মেপে নিবি। গাছের উপরে যে ঘর দুটো তার কোনটিতে সেটাকে বসানো যায় কিনা দেখে আসিস একসময়ে।

রূপচাঁদ বললো, আজ্ঞে আচ্ছা। কিন্তু সেখানে কি রাজকুমার একা থাকবেন?

-তুই বুঝি যেতে চাস?

–আজ্ঞে না, সে আমার বেশ ভয় করবে। আপনারও খুব একা লাগবে?

–আচ্ছা বাঁদর হয়েছিস। যা, সহিসকে ঘোড়া আনতে বল।

রূপচাঁদ চলে গেলে রাজচন্দ্র ভাবলো, কী যেন সে ভাবছিলো? হৈমীর কথা? না, হৈমী কাল রাতে বলছিলো মুকুন্দর চিঠি এসেছে চীন থেকে। আর তা নিয়ে কাদম্বিনীই এসেছে কায়েতবাড়ি থেকে। হৈমীর কথাতেও বোঝা যাচ্ছিলো মুকুন্দ প্রকৃতপক্ষে এই রাজবাড়িরই কুমার বটে। এসব ভাবতে কিন্তু অবাক লাগে। আগেকার মানুষগুলোকে একটু স্পষ্ট করে চেনা যায় যেন।

সহিস রাজচন্দ্রের কথা মতো অর্থাৎ তার খয়েরি রঙের প্রিয় ঘোটকীটাকেই এনেছে।

রাজচন্দ্র ঘণ্টাখানেক চলে গাছ-ঘরের কাছে পৌঁছে গেলো। ঘোড়াটাকে ঘরে উঠবার মই-সিঁড়ির রেলিং-এ বেঁধে দিয়ে সে বরং আতপ্ত ঘাসের উপরে বসলো।

রাজচন্দ্র ভাবলো : একসময়ে সে কিন্তু ভাবতো, পিয়েত্রোর গল্প শোনার পর, যদি পিয়েত্রোর আত্মীয়া সেই রানী তাদের বাড়িরই হতো তবে ভালোই হতো। এরকম হয় না, হলে ভালো হতো, এরকম অনুভব করেই সে মায়ের কাছে প্রস্তাব করেছিলো অসুস্থ পিয়েত্রোকে রাজবাড়িতে এনে রাখতে। রানী বলেছিলেন, মানুষ বয়স্ক হলেই একা হয়ে যায়, তিনি নিজের কথা, পিয়েত্রোর কথা তুলে যেন একা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝিয়েছিলেন। তখন পিয়েত্রো তার আত্মীয় জানলে সে কি আর রানীর কথা শুনত? শেষে কিন্তু পিয়েত্রোর মৃত্যুর মুহূর্তে দয়াশীলা রানী পিয়েত্রোর নিভে আসা চোখের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন একবার।

এই সময়েই হঠাৎ যেন রাজচন্দ্র এতদিনে নিজেকে প্রাপ্তবয়স্ক মনে করলো। ওটা তো ভালোবাসার গল্পই। বিচিত্র সুঘ্রাণের ভালোবাসা। সে মনে মনে হাসলো, যেন মনে মনেই বললো, তাহলে কিন্তু রানীমা মা থাকে না। আমাদের মতো মানুষ হয়ে যাও, যার নিজের সুখ-দুঃখ আছে।

সে অনুভব করলো, এতদিন কি সে মায়ের সঙ্গে যুক্ত ছিলো, আর এখন প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে মায়ের থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে?

প্রথমে পায়ের শব্দ, তারপর দেখতে পেলো রূপচাঁদকে। সে ভাবলো, তাহলে কিছু না করে, কিছু না ভেবে পুরো দিনটা কাটিয়ে দিয়েছে নাকি? হয়তো বনের বাইরে সূর্য ঢলে পড়ছে। কিন্তু রূপচাঁদ হাঁপাচ্ছে, ছুটে এসেছে সন্দেহ কী?

রূপচাঁদ বললো, হুজুর আপনি এখানে?

–এখানে কী দোষ করেছে?

রূপচাঁদ বললো, ওদিকে যে সর্বনাশ! শিগগির চলুন। আপনাকে নিয়ে যেতে না পারলে হৈমীদিদি আমাকে সদরদরজার সামনেই গুলি করে মারবে বলেছেন। নিজেও সেখানে দু তিনজন বরকন্দাজ নিয়ে পথ আগলাচ্ছেন।

রাজচন্দ্ৰ কপট আশঙ্কায় বললো, সে কী রে, হাতে কি বন্দুকও নাকি?

রূপচাঁদ বললো, আজ্ঞে হ্যাঁ, হুজুর, আপনার রাইফেলই একটা আর তাতে গুলিও ভরা।

এবার রাজচন্দ্রকে উঠে বসতে হলো। সে কারো তার রাইফেল ছোঁয়া পছন্দ করে না। সে বিরক্ত হয়ে বললো, এসব কেন?

রূপচাঁদ বললো, হুজুর, বান্দাকে মেরে ফেলেছে।

বান্দাকে? কে? কেন?

বান্দা মরেলগঞ্জের নতুন জমিতে পুকুর কাটাতে গিয়েছিলো একশো কোদাল নিয়ে। জুড়ান পাইক সড়কি চালালে বান্দা তাকে দুফালা করে ফেলেছিলো। তখন কীবল এসে দূর থেকে বান্দাকে গুলি করে মেরেছে। হুজুর, শিগগির চলুন। ওদিকে আরো। ফরাসডাঙায় গিয়েছে গজা মণ্ডলের দল। সাহেবদের ভিতের পাথর গাড়ার কাজ ভেঙে উড়িয়ে দিতে।

সেখানে শুনি কালেক্টর, তার ফৌজ, ডানকান আর কে কে সব সাহেব!কটার বা প্রাণ গেল। সেখানে! আপনাকে কোথাও না পেয়ে আপনি ফরাসডাঙায় ভেবেমাসি পাল্কি করে সেদিকে। গেলেন। কী যে বিপদ! আমাকে বললেন, রূপচাঁদ, রাজকুমারের হাতে যে বন্দুকটা। সবচাইতে ভাল চলে সেটা দাও পাল্কিতে। গুলি আর বন্দুক তুলে নিয়ে বেহারাদের বললেন, উড়ে চলো, বকশিশ দেবো। রূপচাঁদ কেঁদে ফেলো, হুজুর, আমারই ভুল। আমি বলেছিলাম, রাজকুমার খালি হাতে বেরিয়েছেন।

রাজচন্দ্রের ঘোড়া ততক্ষণে ধাপে ছুটতে শুরু করেছে।

.

০২.

বাগচী ভাবছিলো আজ সারাদিন সারারাত লিখেই কী শেষ করতে পারবে–এই শেষ দুটি ওষুধের কথা? ইতিমধ্যে বেলা দুটো হয়ে গেল। চরণের হাতে এ দুটি ওষুধ কত যন্ত্রণা কত হতাশাকেই না দূর করতে পারবে! কত রকমেরই তো দুঃখ, যন্ত্রণা, অপমান, হীনতা! তাদের পক্ষে অনেকগুলিই দূর করা সম্ভব নয়। আত্মার যন্ত্রণা, মনের যন্ত্রণার কিছুই কি করতে পারে তারা। কিন্তু দেহের যন্ত্রণার কিছু লাঘব করতে চেষ্টা করা সম্ভব। রোগগ্রস্ততাও তো একরকমের হীনতা, অপমানও বটে। সে স্থির করলো এই রকম পাইপ টানার জন্য যে সময় ব্যয় হবে তাছাড়া অন্য সময়টুকু সে লিখে যাবে। সে অবশ্যই এ পর্যন্ত ক্রাইস্টের কাছে ঈশ্বরজ্ঞানে কিছু চায়নি। কিন্তু তার হাতের স্পর্শে যে নিরাময়গুলি সম্ভব হয়েছিলো তেমন নিরাময়কেই সে প্রার্থনা করছে এখন।

অস্বাভাবিক শব্দে বাগচী তার স্টাডি থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। কেট অবশ্যই এখন কিচেনে, তার কুঠিতে এরকম সব শব্দ কেন হয়? সে দেখতে পেলো, এক উন্মাদিনী বিলাপ করতে করতে তার কুঠিতে ঢুকে পড়েছে। খোলা চুল পিঠের উপরে। হয়তো ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে থাকবে, ফলে বিস্বস্ত শাড়ি ঘেঁড়াও বটে। তার প্রথমেই মনে হলো সে কি কেটকে কিছু পোষাক আনতে বলবে? তার এরকমও মনে হলো, হায়, এ কি মরেলগঞ্জের কোনো উৎপীড়িতা? সেই উন্মাদিনী হাঁপাতে হাঁপাতে বললো, সে চরণের বউ। চরণকে কাল সন্ধ্যার সময় কালেক্টরের পেয়াদা ধরে নিয়ে গিয়েছে। এখনো ফেরেনি। আর কী ফিরবে? এই কাগজ দেখুন।

চরণের স্ত্রীর বনদুর্গা বোধ হয় তার শক্তির শেষ সীমায় এসেছিলো, সে হাহাকার করে কেঁদে বসে পড়লো। কাগজটাকে পড়ে বাগচী পকেটে পুরলো। সে বলতে গেলে, চরণের বউ, তুমি কেঁদো না। আমি এখনই এই মুহূর্তে যাচ্ছি, দেখবো কেমন কালেক্টর, আর কেমন তার বিচার! কিন্তু হঠাৎ তার প্রচণ্ড রাগ হয়ে গেলো। পার্লারের কোণে তার নানারকম ওয়াকিং স্টিক। সে সবচাইতে মোটা আর বড়ো মালাক্কা বেতের লাঠিটাকে বেছে নিয়ে সেটাকে মেঝেতে ঠুকতে ঠুকতে বললো, তুমি কিছু ভেবোনা, কিছু ভেবোনা, চরণের বউ। সীমা আছে অত্যাচারের। ভারি ইংরেজ হয়েছে! ভেবেছে আমার গায়ের রং কালো বলে ওরা আমার চাইতে বড় ইংরেজ! আমি টাইমসে লিখবো, আমি পার্লামেন্টে কোশ্চেন তুলবো। আমি, আমি-আমি চরণকে না নিয়ে ফিরবো না।

এইসব সোরগোলে কেট ছুটে এসেছিলো। বাগচী কেটের সঙ্গে একটাও কথা না বলে লাঠি হাতে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে গেলো।

.

ঘোটকী তখন তীরবেগেই ছুটছে। রাজচন্দ্র বিরক্ত মুখে ভাবলো, এসব কি নায়েবমশায়ের হুকুম? কে বলেছিলো এখনই তাকে দীঘি কাটাতে? কী লাভ? শুধু কয়েকটা মানুষের প্রাণ যায়! কী হয় ফরাসডাঙার পরগনাটাকে রাজনগরের সঙ্গে যোগ করলে! অকারণে কিছু নরহত্যা। মনে করো ডানকানের কুঠিকে নিশ্চিহ্ন করা হলো, তা কি হাস্যকর প্রস্তাব নয়? বান্দার কথা মনে পড়লো তার। ও, সেই ফেনসিং-বিশারদ কীবল! রাজচন্দ্রর মনে হলো, কাপুরুষ। বান্দার তরোয়াল যে খেলার নয় তা বুঝে দূর থেকে গুলি করে মেরেছে! একটা দুঃসহ ক্রোধ উঠে পড়ছে, ছুটন্ত ঘোটকীর উপরে সেটাকে সে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। ওদিকে আবার হৈমী কী বোকামি করে বসেছে! রাজকুমারের হাতে তার সবচাইতে শক্তিশালী রাইফেলটা তুলে দিতে পারলেই কি কিছু হয়? এতক্ষণে কি সে ফরাসডাঙায় পৌঁছে গেলো?

সেই খয়েরি ঘোটকী মুখে ফেনা নিয়ে রূপার বিট কামড়ে ধরে যেন চারখানা পায়ে একটামাত্র শব্দ তুলে রাজবাড়ির সদর দরজা পার হয়ে গেলো।

বাঁ হাতের দিকে তখন গাছের মাথাগুলোর উপর দিয়ে পাক খাওয়া সাদা কালো ধোঁয়া, দুপুরের রোদের আকাশকেও লাল করে আগুনের আভা। উভয় পক্ষেই গোপন করার চেষ্টা ছিলো, ফলে সেই গুড ফ্রাইডেতে ঠিক কী ঘটেছিলো তার বিবরণ উদ্ধার করা সহজসাধ্য নয়। দীঘি কাটার সেই জমিটাতে অকরুণ নিচে রৌদ্রদগ্ধ মাটির উপরে দুটি শব পড়ে ছিলো সন্ধ্যা পর্যন্ত। একশো জন কোদালি না হলেও, তখনো কিছু কোদাল যন্ত্রের মতো মাটি কেটে চলেছে।

মরেলগঞ্জের দেওয়ান মনোহর সিং-এর সেই প্রকাণ্ড আটচালাসমেত গোটা বাড়িটা দাউদাউ করে জ্বলছে। গজা মণ্ডল, যার আসল নাম মেন্ডোজা ছিলো একসময়ে, যার কাঁধের মাপ এক গজ বলে নতুন নাম মানিয়ে যায়, সে জানতে পেরেছিলো চরণকে শেষ দেখা গিয়েছিলো মনোহর সিং-এর আটচালাতেই। কিন্তু তন্ন তন্ন করে প্রত্যেকটি ঘর খুঁজেও তাকে না পেয়ে, দড়িতে বাঁধা মনোহরকে লাঠিতে খুঁচিয়েও যখন চরণের সম্বন্ধে জানা যাচ্ছে না, তখন তার সঙ্গের লোকেরা আগুনের ভয় দেখাতে গিয়েই নাকি আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলো। চৈত্র-বৈশাখের দিনে সে আগুন কি থামানো যায়? নতুবা গজার ইচ্ছে ছিলো না মানুষকে পুড়িয়ে মারার।

এসবই অনেকপরে গজার বিচারের সময়ে জানা গিয়েছিলো। গজারই শাস্তি হয়েছিলো। নায়েবমশায় দণ্ড কমাতে চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু বোকা রোকনুদ্দিন, কাজটা খুবই ভুল করেছিলো। মনোহর সিং-এর চতুর্থ স্ত্রী, যাকে গজার বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলো রোকনুদ্দিন, সে গজাকে সনাক্ত করেছিলো।

গজাকে যখন সেই ঘোষজা ডেপুটি ধরে নিয়ে যায় তার আগে সেই ডেপুটির লোকেরা বিলমহলে কবর খুঁড়ে রহিম আর রমজানের শবও বার করেছিলো। তাদের গায়ে তখনো ঘায়ের চিহ্ন ছিলো, কিন্তু সে বিশ্বাস করেনি তা বসন্তের। বরং আগুনের পোড়া হওয়াই সম্ভব এই মত ছিলো তার।

কিন্তু তখন দেওয়ান মনোহর সিং-এর কুঠি দাউদাউ করে জ্বলছে, যদিও দিন শেষ হয়ে আসছে। বিলমহলের থেকে যারা এসেছিলো তারা তখন ফরাসডাঙায় পিছিয়ে এসেছে আর সেই পিছিয়ে যাওয়ার টানে ডিয়ার পার্কের টিলার উপরে চার্চ অব হোলি অ্যাসেনশানের যে ভিত্তি গাঁথা হয়েছিলো তা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

.

০৩.

বিলমহলের সেই ভিড় দুপুর থেকেই ফরাসডাঙার পথে ছড়িয়ে পিয়েত্রোর বাংলোর এপাশে-ওপাশে অনেকটা সময় ছিলো, তারপরে সন্ধ্যার অন্ধকারে ক্রমশ মিলিয়ে গিয়েছিলো। এরকম প্রমাণ আছে তারা ততক্ষণই ছিলো ফরাসডাঙায় যতক্ষণ রাজকুমার পিয়েত্রোর বাংলোয় ছিলো সেদিন।

পিয়েত্রোর বাংলোয় একই সময়ে কালেক্টর, ডানকান, বাগচী এবং রাজকুমার ছিলো। কী হয়েছিলো সেখানে সেটাই তো আসল গোপন করার বিষয়।

তখন বেশ রাত হয়েছে। দেওয়ানকুঠির বসবার ঘরে হরদয়াল আর ম্যাকফার্লান। মুখোমুখি। হরদয়াল বললো, বসো ম্যাকফার্লান, তোমার সঙ্গে এই প্রথম আলাপ আমার। একটু ওয়াইন আনি?

ম্যাকফার্লানের এই কালো রঙের দেওয়ানটির কথা বলার ভঙ্গিটা ভালো লাগছিলো না। সার তা বলছেই না, নামের আগে মিস্টারও বলছে না। তার এরকমও মনে হলো, আজ সারাদিন যা ঘটেছে তারপরে তিনজনমাত্ৰ সিপাহীর ভরসায় রাজবাড়ির ভিতরে ঢোকা ভালো হয়েছে কি?

হরদয়াল ওয়াইন নিয়ে ফিরলো। গ্লাসে ভরে দিলো। বললো, আমি বার্গান্ডিতে সোড়া খাই না, জলও না। তুমি? তারপরই হেসে বললো, আমি কিন্তু ভেবে পাচ্ছি না তুমি আর হোয়াইট কী করে তখন পিয়েত্রোর বাংলোয় ঢুকলে।

ম্যাকফার্লান বললো, ইংল্যান্ড আশা করে তার ছেলেরা তাদের কর্তব্য করবে।

-আহা, তুমি উত্তেজিত হচ্ছো কেন? ওটা তো নেলসন না কে বলেছিলো, আর তা যুদ্ধের সময়ে। এটা তো সামান্য জমি নিয়ে হাঙ্গামা। তুমি কালেক্টর, নিশ্চয় জানো, রাজকুমারের খরিদকরা জমিতে রাজকুমারের দীঘি কাটানোর এক্তিয়ার আছে। জুড়ান পাইক এবং কীবল ছোকরা ট্রেসপাস করেছিলো। তুমি কি কীবলকে ইতিমধ্যে অ্যারেস্ট করেছো? ট্রেসপাস এবং খুন।

কথা ইংরেজিতে হচ্ছিলো। ম্যাকফার্লান বললো, তুমি আমার ডিউটি আমাকে শিখিয়ে * না। তুমি বলছো মরেলগঞ্জের মধ্যে সেটা রাজকুমারের জমি?

-প্রমাণ চাও? যাকগে, সেটা কলকাতার কোর্ট বুঝবে। তুমি নিজে ট্রেসপাস করেছিলে কেন ফরাসডাঙার কুঠিতে? না কি সেটাও কর্তব্য ছিলো? বলবে, রাজকুমার কিংবা মিস্টার । বাগচীকে অ্যারেস্ট করতে? হরদয়াল হাসলো। বললো– আবার, তুমিই বলছিলে, বাগচী প্রথমে, পরে রাজকুমার তোমাদের পরে সেখানে গিয়েছিলো। আর তখন তো কেউ কোনো অপরাধই করেনি।

ম্যাকফার্লান বললো, ট্রেসপাস! সেটাও কি তোমাদের রাজকুমারের বাড়ি নাকি?

হরদয়াল নিশব্দে হাসলো। বললো, এতদিন তো তাই জানতাম, যদিও ওটা রাজকুমারের বাসের উপযুক্ত নয়। তুমি বোধ হয় জানতে না? সেজন্যই আজ সকালে ফরাসডাঙার টিলার কী একটা ভিত গাড়ার সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছো, প্রতিবাদ করোনি? ভেবে দ্যাখোনি, রাজকুমারের কলকাতার গেস্টরা ওই বাংলোতেই ছিলো?

–সিলি!

–কোনটা? ডানকানের মত লোকের গুড ফ্রাইডেতে চার্চ করার ব্যাপারে উৎসাহ?

অন্যমনস্কের মতো ওয়াইনকাপের স্টেমে আঙুল রেখেছিলো ম্যাকফার্লান। সে নিজেকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে সোজা হয়ে বসলো, বললো, তুমি রাজকুমারকে এখানে আসতে বলবে? অথবা আমি কি তাকে অ্যারেস্ট করতে রাজবাড়িতে ঢুকবো?

হরদয়াল বললো, ওয়াইনের বোকেটা কিন্তু আকর্ষণ করে, তাই না? কিন্তু রাজকুমারের অপরাধ কী তাই ভালো করে জানি না। তুমি বলছে, রাজকুমার ডানকান হোয়াইটকে ঘোড়ার ক্রপ-চাবুক দিয়ে চাবকেছে। সে তো শুনেছি ডানকান রাজকুমারকে গাল দেওয়ায়। রাজকুমার যদি তাকে লাথি মেরে থাকে সে তো ডানকান রেভরেন্ড বাগচীর সহধর্মিণীকে বীচ এবং প্রটিচুট বলার রাগে। আর রেভরেন্ড বাগচী যা করেছিলো সে তো সেলফ-ডিফেন্স। ডানকানের রিভলবারটা কার দিকে লক্ষ্য করা ছিলো তা কি বোঝা যায়? তা যে রাজকুমারকে মারতেই তা সে কী করে বুঝবে? ভেবেছিলো হয়তো সে নিজেই তার শিকার। সেলফ-ডিফেন্সে সে ডানকানের কোমরে লাঠি মেরেছে। এমন তো হতে পারে তার জন্য ডানকানের বাতই দায়ী। তাড়াতাড়ি সরে যেতে পারেনি বলেই, বাগচী তাকে চেয়ার তুলেও, মেরেছিলো। কিন্তু ও কাজটা কি তোমার ভালো হয়েছে? তুমি বাগচীকে অত ক্লোজ রেঞ্জে গুলি করলে! হয়তো তার পাটাকে বাদ দিতে হবে, যদি হেমারেজে মৃত্যু না হয়!

ম্যাকফার্লান বললো, তাকেও অ্যারেস্ট করবো। আর তা আজ রাতেই।

-তা কী করে পারবে? আমি তো তাকে আর তার স্ত্রীকে সন্ধ্যাতেই কলকাতায় পাঠিয়েছি। আগে তো বলেনি। এতক্ষণে তারা বিশ-পঁচিশ ক্রোশ চলে গিয়েছে। আশা করছি কাল দুপুরে নাগাদ মেজর চীবসের সাহায্য পাবে। হরদয়াল যেন একটু ভাবলো। বললো– আবার, তা, জয়নাল বুড়ো হয়েছে বটে। কিন্তু প্রায় সাড়ে ন ফুট উঁচু, আর পাগলার মতো ছোটে এখনো; আশা করছি কোল্যান্স না করা পর্যন্ত সে ঘণ্টায় পনেরো-বিশ মাইল ছুটবে, শিকারী হাতি তো।

ম্যাকফার্লানের সন্দেহ হলো, লোকটি কি কথা বলে বলে সময় নিচ্ছে? রাজকুমারকে পালাতে সাহায্য করছে। ইতিমধ্যে নায়েবকে পাওয়া যাচ্ছে না, গা-ঢাকা দিয়েছে সে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, তুমি রাজকুমারকে আনবে? না, আমি রাজবাড়িতে ঢুকবো? স্ত্রীলোকদের সরে যেতে বলবে?

হরদয়াল বললো, বসো, কালেক্টরসাহেব। রাজকুমারকে আনি।

হরদয়াল ভ্রূকুটি করে প্রাসাদে ঢুকলো। রানীর কাছেই দরকার। সে দেখলো রানী তার বসবার ঘরে। রানীর সামনে একটি শেজ। শেজের গোড়ায় রূপার ট্রেতে যা মৃদু আলোয় ঝকঝক করছে তাকে পৃথক পৃথক করে চেনা শক্ত, কিন্তু তা যে নানা দামী পাথর আর সোনার একটা ছোটো স্তূপ তা বোঝা যাচ্ছে। রানী কী ভাবছেন বোঝা শক্ত। অনুশোচনা নাকি তার? কিন্তু একেবারে স্থির। হরদয়াল কথা বলতে গেলো। কী করে যেন, কোথা থেকে যেন হরদয়ালের চোখের কোণ দুটি ভিজে উঠলো।

সে বললো, অতটা নয়। আমি ভাবছি হাজার দশেক পাউন্ড মোহরে। তোষাখানা কি খোলা আছে? চাবিটা? রাজকুমারকে পোশাক পরতে বলুন।

হরদয়াল তোষাখানার চাবি নিয়ে সেখান থেকে একটা থলি সংগ্রহ করে তার বসবার ঘরে ফিরতে মিনিট বিশেক সময় নিলো। টেবিলের ওয়াইনের পাশে একটা জিংলিং শব্দ করে সেই সিল্কের থলিটাকে নামালো। তাকে তখন কিছুটা ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বললো, রাজকুমার পোশাক পরছেন।

ম্যাকফার্লান বললো, নো ফানি বিজনেস। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।

হরদয়াল তার স্কার্লেটে সাদায় আঙুরলতার নকসা নাইট-গাউনের জেব থেকে একটা কাগজ বার করলো। আলোর সামনে ধরে পড়লো। সেটাকে পকেটে রেখে সিগার ধরালো। তুমি খাবে, কালেক্টর? রিয়্যাল টার্কিশ। অবশ্য তোমার পার্মিশন নিচ্ছি। সে গলা সাফ করলো। আলতো করে গলা নামিয়ে বললো, চরণদাস বলে একজনের কথা জানো?

ম্যাকফার্লান বললো, আমি কী জানি!

হরদয়াল তার জেব থেকে কাগজটাকে বার করলো, বললো, এই কাগজটায় কিন্তু তোমার দস্তখত এবং মোহরও। তুমি কি জানো, ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে যাকে সামন্ করা হয় তাকে অত্যাচার থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব থাকে ম্যাজিস্ট্রেটের? হরদয়ালের এই প্রথম যেন রাগ প্রকাশ পেলো। তার শান্ত মুখে দাঁতগুলো ঝকঝক করে উঠলো একবার। আমি যদি বলি তুমি এখানে আসার কিছু আগেই চরণদাসের কাঁচা কবর খুঁড়েছে আমার লোকেরা। তার বিকৃত শরীরটাও পাওয়া গিয়েছে। তোমার সামনে মনোহর তাকে চাবকাচ্ছিলো। হুকুমটা কি তোমার?

ম্যাকফার্লানের মুখটা কিছু বিবর্ণ হলো।

হরদয়াল বললো– হেসে, আমি বলি কি এখানে এই থলিতে দশ হাজার পাউন্ড সভরেন আছে।

দু-তিন মিনিট ছটফট করলো ম্যাকফার্লান। গলা নামিয়ে বললো, তুমি বলছো–কিন্তু।

এসব ব্যাপারে মনস্থির করতে সময় নেয়। অন্যপক্ষের ধীর শান্ত কোমল প্ররোচনা দরকার। আধঘণ্টা সময় লাগলো। অবশেষে বার্গান্ডি স্পর্শ করলো ম্যাকফার্লান। হরদয়াল ফিসফিস করে বললো, একটা রসিদ সই করে দাও, দুই দিক থেকেই সুবিধা। একটা আই ও ইউ তো। অসুবিধা হলে তুমি বলবে ধার নিয়েছে। আমারও একটা দলিল থাকে।

ম্যাকফার্লান অবশেষে বললো, কিন্তু রাজকুমারকে অ্যারেস্ট তো করতে হবে। কলকাতা আছে।

–অবশ্যই, অবশ্যই।

অবশেষে এই স্থির হয়েছিল, রাজকুমার দু-তিন মাস পিয়েত্রোর বাংলোর নজরবন্দী রূপে থাকবেন। একজন ঝি, একজন চাকর থাকতে পারবে। দুজন সিপাহী বাংলোর বাইরে থাকবে বটে। কিন্তু ওয়ার্ড অব অনার রাজকুমার পালাতে চেষ্টা করবেন না। তারপরে তদন্ত শেষ হবে।

হরদয়াল অতিশয় গম্ভীর মুখে বলেছিলো, ওয়ার্ড অব অনার।

তখন মাঝরাতের কাছে সময়। একটা ধোঁয়ানো মশাল। তার পিছনে একটা ঘোড়া। ঘোড়াটার গলা যেন বৃত্তাকারে মাটিতে ঝুঁকেছে। ঘোড়ার পিঠে স্থির রাজকুমার পিয়েত্রোর বাংলোর দিকে এগিয়ে চলেছিলো।

১৬. মাস দেড়েক চলে গিয়েছে

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

তারপরে মাস দেড়েক চলে গিয়েছে। এতদিনে দুএক পশলা বৃষ্টি নেমেছে, কিন্তু এতবড়ো নদীর ধারে বর্ষাকাল এভাবে সাধারণত আসে না। ফরাসডাঙার টিলায় নতুন করে চার্চের ভিত বসেনি। দয়ালকৃষ্ণ ফরাসডাঙার লাট জমা দিয়েছে যেমন সে অনেকদিন থেকে দিয়ে আসছে। ওয়ারিশের প্রশ্ন এবারও ওঠেনি। ম্যাকফার্লান রেভেনু বোর্ডে কী লিখেছে জানা যাচ্ছে না।

রাজনগরের লোকেরা কালক্রমে যে-গল্পটাকে মেনে নেবে তা এখনই কারো কারো মুখে শোনা যাচ্ছে : কী একটা গোলমাল আছে ফরাসডাঙার স্বত্বে, সেক্ষেত্রে দখলদারী প্রমাণ করতে রাজকুমারের স্বয়ং সেখানে থাকা ভালো। রানীর শিবমন্দিরই দখল প্রমাণ করে বটে, রাজকুমার নিজে থাকলে যা হয় তেমন কী করে হবে? রাজকুমারের স্বত্বটা হয় কীসে, সে প্রশ্ন তুললে বলতে হয়, পাল্টা স্বত্ব নিয়েই বা কে এগিয়েছে?

দীঘিটা সব কাটা হয়নি। বিঘা পঁচিশেক কাটা হয়েছে উপর উপর, বৈশাখে জল আসেনি।

নায়েবমশায় ইতিমধ্যে ফরাসডাঙায় পাল্কি থামিয়ে নেমেছিলেন। পত্তনিদারদের দুজনকেই প্রথম ধাপে ডাকিয়েছিলেন। বলেছেন, দয়ালকৃষ্ণ আসবে, তোমাদের নিয়ে আমার সেরেস্তায় যাবে। ভালো দিন দেখে নজর দিয়ে এসো।

নায়েবমশায়ের গা-ঢাকা দেওয়ার গল্পটাকে কাছারির আমলারা হেসে উড়িয়ে দেয়। উনি তো বিলমহলের তসীল কাছারিতে তখন। বছরে একবার করে তো যেতেই হয়।

তবে নাকি ডেপুটির পাল্কির বেহারা বদলে গিয়েছিলো মাঝপথে? তার উত্তরে সদর আমিন বলে, তোমরাও যেমন! বেহারা বদলালে কি হয়? ডেপুটির চার বেহারার পাল্কি ধিকিধিকি করছে তখন। ওদিকে তখন অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। বিলমহলের পথও তো সুবিধার নয়। সেজন্যই নায়েবমশায়ের আট বেহারার পাল্কিটা এগিয়ে এসেছিলো। কী? এত মশাল কেন? এই পাল্কি কেন পথে? হুজুর, রাত হয়, আপনার কষ্ট, নায়েবমশায় আপনার জন্য পাঠালেন। ডেপুটি সঙ্গের সিপাহীদের সতর্ক হয়ে আসতে বলে সেই বড় পাল্কিটায় উঠেছিলো। বেহারাদের ভুল। নায়েবমশায় কালেক্টরকে আশা করেছিলেন। ডেপুটি জানলে কি আর নিজের পাল্কি পাঠান? তো, তোমার তেলেঙ্গি সিপাহী কি বিলমহলের জঙ্গলে পথ চিনবে হাতে মশাল থাকলেই? সেদিন গোলমাল ছিলো,নায়েবমশায়ের বরকন্দাজরা ভালো মশাল জ্বালাতে পারেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের মশাল নিবে গিয়েছিলো। কাজেই ডেপুটির পাল্কি আর তেলেঙ্গিরা গেল একদিকে, অন্যপথেনায়েবমশায়ের পাল্কিতে ডেপুটি। অন্ধকারে এরকম আকছার হয়ই। নায়েবমশায় যে কালেক্টরকে আশা করেছিলেন তার প্রমাণ কাহাররা বেদম ধমক খেয়েছিলো। আরে ছোঃ, এ কী? কাকে এনেছো?

সদর আমিন চিরকালই কথায় লোক হাসাতে পারে। ডেপুটি ছো শুনে একটু তেড়ে উঠেছিলো। তা বাপু তখনও সে ক্ষুঃ শোনেনি। তখন নায়েবমশায় গড়গড়ায় মুখ দিয়ে খানিকটা টানলেন। ক্ষুঃ করলেন। পরে বললেন, বুড়ো হয়েছি, বাপু, কথার দোষ নিও না। তুমি তো সেই ঘোষ ছোকরা? তা বলি কুলীন কায়েত? নাকি শ্রীকৃষ্ণের জাত?

ডেপুটি তবু মাথা নাড়া দেয়। তখন নায়েব বলেছিলেন, ছোটো হলেও জাত বটে। তাহলে তোমাকেই জামাই আদরটা দিতে হয়। এটাই গল্পের উৎপত্তি। সত্যি কি আর নায়েবমশায় তাকে কুলীন কায়েতের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে কায়েত করতে চেয়েছিলেন, না, বিল মহলের খাসের তহসীল তাকে বিনা-নজরে পত্তনি দিতে চেয়েছিলেন?

(বিল মহলের খাস তহশীলের আধখানা নিয়ে এক ঘোষ পত্তনিদার বংশে কিছুদিন। আগেও ছিলো বটে। তাছাড়া ও গল্পের, যা নায়েবমশায়ের কাশীলাভের পরে কিছুটা চালু হয়েছিল, যে ঘোষ ডেপুটিকে আটন ফুট লম্বা, দু হাত চওড়া, হাত দুয়েক গভীর কালো একটা অন্ধকার খাদ নায়েবমশায়ের সামনের মেঝে থেকে গালিচা সরিয়ে দেখানো হয়েছিলো, নতুবা সেই বা কায়েত-কন্যাকে কেন শেষ পর্যন্ত বিবাহে রাজী হবে? তার কোনো প্রমাণ নেই)।

একটা ধাঁধা আছে যা কখনো কখনো, বেশ কিছুদিন ধরে, মনে হতো হরদয়ালের। দশ হাজার রানী ভিক্টোরিয়ার মোহরের থলিগুলো ধীরে ধীরে জোগাড় করতে হয় বটে। কিন্তু সে রকম কিছু কিছু থলি তোষাখানায় আছে তা সে-ই যখন জানতো, রানী কি জানতেন না? ফরাসডাঙার দখল নিতে ম্যাকফার্লানকে ডেকে আগেই থলিটা দিলে হতো। এতসব ঘটার কি দরকার ছিলো? ভরসা–এই ডেপুটি মনোহর সিং-এর বাড়ির ব্যাপারটাকেই তদন্তের বিষয় করেছে। ছেলেটি বুদ্ধিমান, তদন্তটা বিলমহলের দিকে গড়িয়ে দিয়েছে। মরেলগঞ্জ ও ফরাসডাঙার তদন্তের ভার তোকালেক্টরের নিজের হাতেই। গত মাসে ছোকরা একবার এসেছিলো, নায়েবমশায়ের সঙ্গে আলোচনা করেছে, জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তখনই জানা গিয়েছিলো গজার বাড়িতে মনোহরের নাবালিকা স্ত্রীকে পাওয়া গিয়েছে। নায়েবমশায় হরদয়ালকে এসব বলেছিলো। পরে নিজেই আবার বললো, গজার বিপদের কথা তাই রানীমার কানে আনা যাবে না। হরদয়াল বলেছিলো, একদিক দিয়ে ফুটে বেরোবেই, ভালো উকিল দিয়ে কিছু করা যায়?

কিন্তু আসল কথা, কেন এসব? বুদ্ধিমতী রানীর এটা আর-এক হিসাবের ভুল? সেই দশ হাজার তো দিতেই হলো।

.

রাজচন্দ্র এ বিষয়টাকে আর ভাবে না। সেই রাতেই কালেক্টর জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলেই সে বলেছিলো, আপনাদের দেশে কী হয় জানি না। আমাদের দেশে নায়েব, দেওয়ান যখন যা করে রাজার হুকুমেই করে। আমার কোনো কর্মচারী কিংবা প্রজাবর্গ কোনো কিছুর জন্য দায়ী হয় না। হরদয়াল, কালেক্টরকে ইংরেজি করে বুঝিয়ে দাও। ন্যায়, অন্যায়, ভালোমন্দর। দায়িত্ব রাজবাড়ির একমাত্র সক্ষম প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হিসাবে আমারই।

তার মনে বাগচী সম্বন্ধে একটা আশঙ্কা ছিলো। বাগচীকে তো নিজের চোখেই সে কালেক্টরের গুলি খেয়ে ঘুরে পড়তে দেখেছিলো। কয়েকদিন পরে যে দাসী ঘরের কাজ করে সে খুব নিচু গলায় বলছিলো, হৈমীদিদি বলেছিলেন শিবঠাকুরের পুরোহিতকে, পুরোহিত আমাকে জানালেন, বাগচীমাস্টার ক্রমশ ভালো হচ্ছেন।

তবে কিছুই আর ভাবার নেই। বাগচী কোথায় তা জেনেই-বা কী হবে? নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধেও সে কি ভাবছে? দিনরাত্রি মিলে বর্তমান একটা যেন স্তব্ধ তড়াগ। অতীতকে ভেবেই-বা কী লাভ? একদিন সে ভাবতে গিয়ে হেসে ফেলেছিলো, অতীতকে আমরা মনে আনি ভবিষ্যতের জন্য। বর্তমানের জন্য আদৌ নয়।

একদিন তার ভৃত্য বলেছিলো, হুজুর, রূপকাকা পুরোহিতকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, আপনার সকালে বিকালে বেড়ানো হয় কিনা। তা আমি তেলেঙ্গি দুটোকে জিজ্ঞাসা করলাম। তারাও বললো, হুজুরকে তারাও বেড়াতে দেখেনি। মন্দির দিয়ে, মাঠ দিয়ে, নদীর ধার দিয়ে কতই তো বেড়ানোর জায়গা!

রাজচন্দ্র একসময়ে তার সেই নতুন ঘোটকীর কথা মনে করেছিলো। ছুটতে পারে বটে। একবার ছুটিয়ে আনলে শরীর ঝরঝরে হয়ে যায় সারাদিনের মতো। একদিন হঠাৎ তার পিয়ানোর কথা মনে হয়েছিলো। খুবই সত্য যে পিয়ানোর ঘাটে হাত রাখলে মন ফাঁকা থাকে না।

পিয়েত্রোর বাংলোর জানলা দিয়ে নদীর বাঁধানো পার চোখে পড়ে। সে জানে পারের পরেই শুকনো খাত, তার অনেক পরে জল। একদিন বাংলোর বারান্দার রেলিং-এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয়েছিলো আলোতে নদীর জল কাঁপছে, মৃদু ঢেউ তুলছে। এমন যে চোখে ধাঁধা লাগে, চোখে আর দেখতে পায় না। সে কিন্তু চোখের ভুল, সেখান থেকে নদীর জল চোখে পড়ে না।

কিন্তু রাজবাড়ি থেকেই তো তার আহার ও পরিচ্ছদের উপকরণ আসে। একদিন সেখানে খবর গেলো, রাজকুমার ইদানীং অর্ধেকও খাচ্ছেন না। শরীর কি শুকিয়েছে? রাজবাড়িতে কথা হলো ঝিয়ের বদলে একজন রাঁধুনি পাঠালে হয়। নায়েবের পরামর্শ চাইলে

জানা গেলো, এক আসবে এক যাবে, তাতে তেলেঙ্গিদের আপত্তি কী?

দু-চারদিনে রাজচন্দ্র একবার খেয়াল করলো রান্নার স্বাদে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যে স্বাদের কথা তুলো আর যে পাত্রটাকে ঠেলে দিয়ে উঠে গেলো তারা এক লোক নয়। সে যখন খেতে বসে সামনে ভৃত্য থাকে, ঝি তার পিছনে। গগাড়া থেকেই তাই ব্যবস্থা। সেও কথা বলে না, তাদের সাহস কী কথা বলে? প্রথম কয়েকদিন তবু ভৃত্য এসে বলতো খেতে দেব, হুজুর? খেতে দেওয়া হয়েছে। এখন সে-ই নিয়মমতো গিয়ে বসে খাওয়ার জায়গায়।

একদিন এক মুহূর্তের জন্য অসাবধানতার ফলে রাঁধুনি ভৃত্যের আগে দাঁড়িয়েছিলো। রাজচন্দ্রর মনে হলো জাল জাল কম দামের শাড়ির পায়ের কাছে কিছু একটা চক চক করছে। সোনার মল? যে সোনার মল দেখলো, যে আহারের স্বাদ নিচ্ছে তারা যেন দুজন মানুষ।

একদিন আবার রাজচন্দ্রর মনে হলো সময় যদি স্রোত হয় তবে তার দহও থাকতে পারে। স্রোতটা বয়ে যেতে থাকলে উপর থেকে কোথায় দহ বোঝা যায় না। কিন্তু স্রোতের গতি কমলে জলটা দহে জমতে থাকে। দহের পার ছাপিয়ে আর বহতা থাকে না।

কয়েকদিন থেকেই নদীর দিকে চেয়ে থাকলে, বিশেষ দুপুর যখন শেষ হতে থাকে, ধুলো ওড়ে। বাঁধের উপরে ঝুঁকে থাকা আকাশে ধূসর রং দেখা যায় হালকা নীলের নিচে নিচে। ইতিমধ্যে একদিন বিকেলে আকাশে একরকমের অদ্ভুত সজে মেঘ দেখা দিয়েছিলো। হলুদ, সবুজ, ধোঁয়ার রং মিলে একটা থমথমে ভাব। হতেই পারে। জ্যৈষ্ঠ শেষ হতে চলে, কালবৈশাখী হয়নি একঘণ্টার জন্যও।

সেদিন দুপুরের পরপরই হঠাৎ নদীর দিক থেকে কয়েকটা ধুলোর ঝাপটা এলো। কিছুক্ষণ বাদে সেদিকের আকাশে খানিকটা কালো মেঘ দেখা দিলো। সেই কালো মেঘের মধ্যে দিয়ে কয়েকটা পাখি উড়ে গেলো। খানিকটা বাদে যেন বাতাস একদম বন্ধ। একদল কাক তাড়াতাড়ি ডেকে উড়ে পালালো। মিনিট দশেক গেলো না বিকেলের আকাশে সন্ধ্যা নেমে গেলো যেন। এমন যে নদীর উপরের আকাশটা বিদ্যুতে চিরছে মনে হলো।

রাঁধুনি আর ভৃত্য জানলা দিয়ে দেখছিলো। ভৃত্য বললো, আলো জ্বালাতে হবে।

ভৃত্য ঘরে ঘরে আলো জ্বালতে চলে গেলো।

রাঁধুনি দেখলো রাজকুমার বাংলোর বারান্দায় এলো। খানিকটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে রাজকুমার বারান্দা থেকে মাঠে নামলো। মাঠে থেকে থেকে একটা বাদামী রং পড়ছে, যেন উপর থেকে। রাজকুমার মাঠে ঘুরে ঘুরে অবশেষে মন্দিরের সেই উঁচু চত্বর, যা প্রকৃতপক্ষে ফরাসী পিয়েত্রোর হাওয়া ঘরের ভিত, তার উপর গিয়ে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে একেবারে চত্বরের কিনারে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। দূর থেকে বোঝা যায় না, কিন্তু দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকে বোঝা যায় যেন কৌতুকে আর কৌতূহলে কিছু দেখছে।

আর এক ঝাঁক পাখি খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে উড়ে গেল। মাঠের উপরের বাদামী রংটা ছাই-এর রং নিলো এবার।

এই দ্যাখো, নিজের মনে মন্তব্য করলো রাঁধুনি, রাজকুমার চত্বর থেকে নেমে ডানদিকে চলেছে! ওটা কি হাতিশুড়ো যা নিচে থেকে বাঁধ ছাড়িয়ে উঠলো এবার? রাজকুমার কিন্তু সেটাকে আমল দিলো না। দাঁড়িয়ে পড়ে শূন্যে দুহাত তুলছে। এত দূর থেকে বোঝা যায় না কিন্তু আকাশে কি কিছু আছে, যার দিকে হাত তুলছে?

রাঁধুনি বারান্দায় এলো। সে দেখলো ডানদিকে বাঁধের উপরে একটা অদ্ভুত চেহারার কালো মেঘের টুকরো। সেটাই যেন রাজকুমারের লক্ষ্যে। কালো আর সাদায় মিশিয়ে তৈরী সেই মেঘ। তার জন্যই যেন হাত দুটো আকাশের দিকে তোলা।

এ তো ঝড়, এ তো ঝড়, এই বললো– রাঁধুনি। মাটির উপরে সর সর খর খর করে, দরজা-জানালার ঝাপটা শব্দ দিয়ে, বাতাসটা বারান্দাতে ধাক্কা মারলো। নদীর ধারে-কাছে বাতাসে বালি থাকবেই। নাকি সেই হাতিশুড়োটা ভেঙে পড়লো? গাছপালা নেই, এত শোঁ শোঁ শব্দ কিসের?

কিন্তু এ কী কাণ্ড! রাজকুমারকে দেখা যায়, যায়ও না। দ্যাখো, ঝড় উঠে এসেছে, ঝড়। পাক খাচ্ছে। অন্ধকার হয়ে গেলো। রাজকুমার সেই মেঘের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে মুখটা এখনো উঁচুদিকে। হঠাৎ ভয় হলো রাঁধুনির, যেভাবে চলেছেন বাঁধের ধার থেকে নিচে পড়ে যান যদি!

রাঁধুনি বারান্দা থেকে নেমে নিজেকে বললো, দাঁড়ানো যায় না দেখি। কিছু যেন তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠলো। সে কি ডাকবে রাজকুমারকে? এই শব্দে তা কি শোনা যাবে?

দাঁড়ানোই যায় না। চাদর খুলে গিয়ে পতাকার মতো উড়ছে। তার প্রান্তটাকে গুটিয়ে আনাও কঠিন, তা করতে গেলে পায়ের পাতার ওপরের শাড়ি হাঁটুর কাছে উঠে পাক খাচ্ছে। কিন্তু রাজকুমার? পড়ে গেলেন নাকি?

রাঁধুনি ডাকলো, রাজকুমার! ডাকটা এক হাত দূরে গেলো কিনা সন্দেহ। রাঁধুনি ছুটতে ছুটতে ডাকলো, রাজু! তার পায়ের মলের শব্দ দূরের কথা, তার ফোঁপানোর শব্দও শোনা গেল না।

নয়নতারা ছুটতে-ছুটতে ঘাটের মাথায় এসে দেখলো, দেখাই কি যায় চোখ মেলে, নিচে যেন তোলপাড় চলেছে, যেন বাঁধের কোলে নদীর খাত একটা প্রকাণ্ড মন্থন-ভড়। ধুলোর বাতাস ঘূর্ণি তুলে পাক খাচ্ছে। সে কি নামতে পারে? রাজকুমার হাত ধরে ধরে নামিয়েছিলো তাকে এই ভাঙাঘাটে। চুল এলো হয়েছিলো, হাত তুলে চুল জড়ো করতে গিয়ে চাদরটা গা থেকে উড়ে সিঁড়িগুলোর পাশ দিয়ে নিচে পড়ে অদৃশ্য হলো। কিন্তু রাজকুমার? তাকে তো দেখাই যাচ্ছে না!নয়নতারা চিৎকার করে ডাকলো, রাজুজু! ডাকটা বাতাসের শব্দে ডুবে গেলো না শুধু, যেন তার চাপে ফিরে এসে তার মুখে জড়িয়ে গেলো কান্নার মতো হয়ে। ঘাটের ধাপ বেয়ে নামতে নামতে, সে তো হাতে পায়েই চলা, শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে গেলো নিজের পায়ে জড়িয়ে।

শেষ ধাপটা সে লাফিয়ে নামলো। কিন্তু রাজকুমার কোথায়? লাফিয়ে নামতে গিয়ে সে হামা দিয়ে পড়েছিলো। এ কী, জলও যে এখানে! এ কি বাতাসের তাড়ায় নদীর জলের উপরে উঠে আসা? উঠতে গিয়ে কাঁধের শাড়ি কোমরে নেমে পৎ-পৎ শোঁ-শোঁ করে উড়ছে। তা সত্ত্বেও সেই শব্দকে–সব শব্দকে ডুবিয়ে নয়নতারা হাহাকার করে উঠলো, রাজু, আমার রাজু।

ঝড়ের গতির বিরুদ্ধে, প্রবাদ আছে, এই গঙ্গার বুকে যখন সেই ঝড়, হাজার পাঁচ হাজার মুণি হলেও, পাল নামিয়ে না দিলে পাল ছিঁড়ে রসাতলে যায় নৌকো। মাস্তুলসমেত পাল উড়ে যায়। বাতাসের ঝাপটায় নৌকোকে চরে তুলে দেয়। ধুলোর ঝাপটায় আলোর চোখ অন্ধ করে। নয়নতারার পক্ষে শাড়ি ধরে রাখাই কি সম্ভব! শেষবার বালিয়াড়িটার মাথায় উঠতে গেলে তা কোমর থেকে নেমে একপাকে হাঁটুর কাছ জড়িয়ে ছিলো। কে আর দেখছে সেসব দিকে? সে তো বালির উপরে কপাল চাপড়ে, আমার রাজু বলে কঁদছে তখন।

আর তখন আকাশ থেকে তেরচা ধারে জলও নামছে। পায়ের তলে তখন মাঝে মাঝে অগভীর জল। বালিয়াড়িটার, তার মাথাও তো তখন ঝড়ে অনেকটাই উড়ে গিয়েছে, ওপারের গোন গায়ে প্রায়ান্ধকার সেই আলোতে নয়নতারা একটা স্তূপের মতো কিছু পড়ে থাকতে দেখলো বটে। সে কি বিশ্বাস করবে? সে ভয়ে ভয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে শেষে আতঙ্কে কেঁদে উঠে দৌড়লো আবার।

ঝড়ে কি শোনা যায়? এই একটু সুবিধা, নয়নতারা তখন দু হাতে জড়িয়ে রাজুর মুখকে নিজের বুকের উপরে তুলে নিতে পেরেছে। রাজুর কান তার ঠোঁটের কাছে। সে বললো–রাজু! রাজু!

রাজুর মন তার শরীরে ফিরলো। সে একবার জিজ্ঞাসা করলো–কে? নয়ন? নয়নতারা? কিন্তু সে-মনটা যেন অন্য কারোও। যেন ঘুমের ঘোরে সে-মন।

নয়নতারা বললো–বা, ওঠো। চলো, আমরা চলে যাই।

রাজচন্দ্র হঠাৎ সম্বিত পেয়ে উঠে বসে বললো–আরে ছি ছি, নয়নতারা, এই ঝড়ে এভাবে বার হতে হয়?

নয়নতারা চোখ মুদলো না, দু হাতের বাঁধন একটু আলগা করে দিলো, নিজের অজ্ঞাতসারে নিজেরই ঠোঁট দুটিকে রাজুর কপালে ছোঁয়ালো।

দুএক পা চলে রাজচন্দ্র বললো–ওমা, এ কী?

নয়নতারা বললো–ওভাবে তাকিয়ো না, দেখো না কোথায় খসে পড়েছে। ঠাট্টা কোরো না।

রাজচন্দ্র হাসলো-চাইবো কেন? অনুভবে ধরা পড়ে।

তখন বাতাস কমেছে। বাঁকা বৃষ্টির ফলায় শীত লাগিয়ে দিচ্ছে। নয়নতারার পা ঠিকমতো পড়তে চাইছেনা। রাজচন্দ্র বললো–একেবারে অন্ধকার না-হলে বাংলোয় ফিরবে কী করে?

গাঢ় অন্ধকার হলে তারা বাংলায় ফিরে থাকবে।

তখন রাত হয়েছে। বললো–আলোটা? থাকবে?

শেজের আলোতে সে ঘরের চারিদিকে চাইলো, যেন ঘরটা তার পরিচিত হওয়াতেই ভালো লাগছেনা। বলে–চলে যাবো, চলো। এখানে আসা তো সেই ফরাসডাঙাতে ফেরাই।

কিন্তু নয়নতারা শয্যায় এলো। বললো–বা, আমাকে বুঝি দেখবে না?

শেজের আলোয় নয়নতারা ঝিকমিক করে হাসলো।

 ১৭. ১৮৮৩ খৃস্টাব্দের শীতকাল

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

০১.

সেটা ১৮৮৩ খৃস্টাব্দের শীতকাল। আবার প্রশ্ন উঠবে, শীত তো খ্রিস্টবর্ষের প্রথমেও থাকে, শেষেও; অর্থাৎ তখন নভেম্বর-ডিসেম্বর অথবা জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি? আমার ধারণা নভেম্বর-ডিসেম্বর সময়টাই যুক্তিযুক্ত হবে। শীতকালে প্রকৃতিতে সবুজ কমে,বাদামী, হলুদ, সোনালি বাড়ে। এতক্ষণ তো রেলপথের দু পারেই মাঠগুলোতে, কৃষকদের বাড়িগুলোতে অনেক গাছের পাতায় সেই বাদামী, হলুদ, লাল এবং সোনালি। তখন গাড়িটা বেশ দ্রুত গতিতে চলেছিলো, কিন্তু দিনের আলো ছিলো; এখন ধীরে চললেও দিনের আলোও তো কমে আসছে। ফলে তখন জানলার বাইরে রোদ-মাখানো দৃশ্যগুলোই আকর্ষণ করছিলো। তখন রেল রোড এত নতুন যে কামরার জানলায় এরকম দৃশ্য-পরিবর্তন বিশেষ আনন্দজনক। কারো কাছেই একঘেয়ে লাগার মতো হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এখন সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে কামরার ভিতরে আনতে হয়। বাতাসটাও ঠাণ্ডা। সার রাজচন্দ্র পরপর দুটো জানলার শার্সি ফেলে দিয়ে কামরার ভিতরের দিকে দৃষ্টি দিলো। প্রথম শ্রেণীর কামরা। এখন যেমন তখনো তেমন কিছুটা বৈশিষ্ট্য তো ছিলোই অন্য শ্রেণী থেকে। এই কামরাটার আর একটু বৈশিষ্ট্য বলে নেওয়া যায়। লোহালক্কড়, রিবেট, ক্রু সব সোনালি রঙের পিতলের হবে, সিলিং-এর আলোটা তো পিতলেরই, আর বসবার গদিগুলো প্রকৃতপক্ষে উজ্জ্বল পালিশদার চামড়ার। এটা বলা সম্ভব নয়, এই গাড়িটাতে এরকম কামরা বরাবর থাকতো কিনা। সেদিন ছিলো, কয়েকখানাই ছিলো। বরং সাধারণের জন্য কামরাই কম। এই কামরায় আপাতত তিনজন যাত্রী। সার রাজচন্দ্র নামে এই দশাসই পুরুষ। তার পায়ের ভারি পুরু সোলের বিলিতি জুতো ওস্টেড ট্রাউজার্স ও জুতার মধ্যে দৃশ্যমান খয়েরিতে সাদার ফুল তোলা উলের মোজা, গায়ের চেক টুইড কোট থেকে বোঝা যায়, তার চল্লিশোর্ধ্ব শরীরটা এখন বেশ ভারি, যদিও মজবুত। মাথার পিছন দিকের চুলগুলো ঈষৎ লাল। কলপ? মুখটায় একটা লালচে ভাব আছে যাকে সানট্যান বলা যায়। তার উপরে বেশ বড়ো মাপের খয়েরি বাদামি গোঁফ। দুটো বাঙ্ক। এপারের বাঙ্কে সার রাজচন্দ্র। ওপারেরটিতে দুজন। একজন মহিলা, অন্যজন পুরুষ। মহিলাটির পরনে দুধ-গরদ, কিন্তু পাড় নেই। সাদা কারো কারো পছন্দের হয়। সেজন্য গলায় এক লহরের একটা মুক্তার হার, হাতে দুগাছা মুক্তার বালা।

স্নানের সুবিধা কোথায়? তাহলেও কিছুক্ষণ আগে, বিকেলের অভ্যাস অনুসারেই, পাশের ক্লোজেটে গিয়ে শাড়ি পালটে ফিরেছে। এক দুধ-গরদ থেকে অন্য দুধ-গরদ, তখনই চুলগুলো ব্রাশে উজ্জ্বল করে পিঠে ছড়ানো হয়েছে। ফলে মাথা ঝাঁকালে মৃদু সৌরভ উঠছে। সেই বাঙ্কের পুরুষযাত্রীটি বয়সে তরুণ। তাকে এরকম বললে বা তার বয়স একুশ-বাইশ বললেই তারুণ্যটাকে বোঝা যায় না। কারো কারো চোখে মুখেও বিষয়টা সুখের আকারে জড়ানো থাকে। মনে হয় যেন পৃথিবীর চূড়ায় বসে। খুবই গৌরবর্ণ রং। চুলগুলো কালো এবং কপাল-ঢাকা অবাধ্য। চোখ দুটো ডাগর, চঞ্চলা কোনো মেয়ের যেন। ঠোঁট লাল, তার উপরে সরু গোঁফের রেখা। কারো কারো এসব পুরুষালি চিহ্ন পরে প্রকাশ পায়। এই তরুণটিকে এখন কিছুটা সলজ্জ দেখাচ্ছে, আর তা বেড়েছে সার রাজচন্দ্র শার্সি নামিয়ে কামরার ভিতরে চোখ রাখাতে। কারণ তরুণটির ট্রাউজার্সের হাঁটুর উপরে একটা সুদৃশ্য তোয়ালে, তার উপরে অনেক রকমের অনেক মিষ্টিযুক্ত রূপার একটি থালা। তরুণটি বুঝতে পারছে না মহিলাটিতে ঝাজ কিংবা মিষ্টি বেশি। মিষ্টি সাজিয়ে দিয়ে হাতের উপরে থালা রেখে বলেছিলো, হাত দিয়েই খাও, লজ্জা কী? প্রায় একশো মাইল দক্ষিণে একটা স্টেশনে সে তার সুটকেসটা হাতে গাড়ির কামরায় কামরায় ঢু মেরে বেড়াচ্ছিলো। এই কামরার হাতলে হাত দিয়ে এটাকেও রিজার্ভড় দেখে সে ফিরে যাচ্ছিলো। এই সময়ে মহিলাটির সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়েছিলো। মহিলা বলেছিলো, কোথায় যাওয়া হবে? তরুণের গন্তব্য শুনে বলেছিলো, আসুন। আমরাও তাই। তরুণ উঠে এসে ইংরেজিতে ধন্যবাদ দিলে মহিলাটিও যথোপযুক্ত উত্তর দিয়েছিলো সেই ভাষাতেই। কিন্তু সেই অত্যন্ত রাজকীয় মহিলার আর একটি দিক টিজ করা, খোঁচানো, খেপানো। প্রথম পাঁচ মিনিটেই এইরকম কথা হয়েছিলো।

তরুণ–সবগুলো ফার্স্টক্লাস রিজার্ভড়। সবগুলোতে লালমুখো বাঁদর।

সার রাজচন্দ্র-হতেই পারে। এটাকে স্পেশাল ট্রেন বলা যায়।

মহিলা-কারো ল্যাজ টানোনি তো?

তারপর এক ঘণ্টার মধ্যে তরুণের নাম কুমারনারায়ণ জেনে তাকে কুমার বলে যাচ্ছে। এই মহিলা। একবার তরুণ বলেছিলো দুটো শব্দ মিলে একটা নাম। মহিলাটি বলেছিলো, আমরা কুমার বলতে অভ্যস্ত। অসুবিধা হচ্ছে না। সার রাজচন্দ্র গাড়ির ভিতরের দিকে মুখ ফেরালে তরুণটি ভাবলো, এই সার লোকটি? চটপটে তো বটেই, যদিও চোখে দেখে অন্য রকম মনে হতে পারে। নৃশংস? নাকি কিছু ভেবে কাজ করে না? এর আগের স্টেশন ছাড়ার কয়েক মিনিট পরেই ট্রেনটাকে চেন টেনে থামিয়ে রাইফেল নিয়ে নেমেছিলো। যে হরিণটাকে ছুটন্ত ট্রেনের সব যাত্রী দু-তিন মিনিট ধরে দেখে অবাক হচ্ছিলো, সেটাকে গুলি করে মারলো। যাই হোক, গাড়িটার সেখানে, সেই মাঠের মধ্যে, আধঘণ্টা দেরি হয়ে গিয়েছে। আর এখন তো ধিকিধিকি চলেছে। নতুন লাইন, মাত্র দুমাস আগে শেষ হয়েছে। এখন ট্রেন এই লাইনের বর্তমান শেষ স্টেশন তারাবাড়ির উদ্দেশ্যে চলেছে।

আর কয়েক মাইল পরেই সেই তারাবাড়ি স্টেশন। এখানে এখনো প্রধান যোগাযোগ তো স্টিমারেই ছিলো। তার স্টেশনের নাম তারাবাড়ি-ঘাট। এখন এই রেল-স্টেশন হওয়ার পরে হয়তো স্টিমার-স্টেশনটার মর্যাদা কমে যাবে। আজ সেই তারাবাড়ি রেল-স্টেশনে, তার নতুন বাড়িতে, নতুন-করা প্ল্যাটফর্মে, যাতে এখানে ওখানে রাখা টবের গাছ, নিশ্চয় এতক্ষণে অনেক আলো জ্বালানো হয়েছে। নতুন স্টেশনমাস্টার তার স্টাফ নিয়ে এই প্রথম ট্রেনের অপেক্ষায় ঘর বার করছে। আমাদের ভাবাই অভ্যাস। এই তারাবাড়ি নাম নিয়ে ভাবাটা অবশ্য কিছু পুরনো, কারণ তারাবাড়ি ঘাট তো বছর পনেরোই হয়েছে। ধর্মের দেশে ধর্মের কথাই আগে মনে আসে। কিন্তু তারাবাড়িতে সার রাজচন্দ্রের প্রকাণ্ড বাড়িটার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে যে একমাত্র মন্দিরটা দেখতে পাও, সেটা বিশেষ সুন্দরই, যদিও রক্ষণাবেক্ষণে কিছু ত্রুটি চোখে পড়ে, সেটা কিন্তু শিবের, আর মন্দির বলতে এখানে ওই একটিই। পুরোহিতকে এরকম বলায় সে নাকি বলেছিলো, তা তারা গৌরী একই তো; গৌরীপাটেই তো তারারও অধিষ্ঠান ধরা যায়। তাছাড়া শিবের অন্তরে কি তারা নেই?

মহিলা বললো–তোমাকে স্যান্ডউইচ দু-একটা?

সার রাজচন্দ্র প্রথমে বললো, না; পরে বললো, একটু পোর্ট দাও।

মহিলা উঠে বেত কাঠ পিতলের সমন্বয়ে তৈরী সুদৃশ্য কাঁপ খুলে প্লেট ইত্যাদি বার করে, একটা প্লেটে একটা স্যান্ডউইচ সার রাজচন্দ্রর বাঙ্কে তার পাশে রাখলো। দুটো ওয়াইন কাপ বার করে আর একটা তেমন প্লেটে রাখলো। একটা গাঢ় ব্রাউন রঙের বোতল বার করে রাখলো তার উপরে। তরুণ নিষেধ করলেও খান-দুয়েক স্যান্ডউইচ তার প্লেটে তুলে দিলো মহিলা। বললো, মাটন ওনলি। সার রাজচন্দ্র বোতল খুললো, নিজের ওয়াইন কাপটাকে পুরো ভরে নিয়ে দ্বিতীয় কাপটাকে আধাআধি ভরে মহিলাকে নাও বলে তুলে দিলো।

একবার মহিলা বললো–এতগুলো গেস্ট নিয়ে চলেছো, অথচ গাড়ি তো যেন শামুক। ডিনার শেষ হতে মাঝরাত না হয়। ঘরগুলোর বা কী ব্যবস্থা হয়েছে, কে জানে!

সার রাজচন্দ্র বললো–তুমি তো তাদের টেলিগ্রাম করেই জানিয়েছে গেস্টের কথা; কেন মিছে উদ্বেগ?

তরুণ কুমারনারায়ণ ভাবলো, সম্বন্ধটা স্বামী-স্ত্রীর মতো মনে হয়; বোধ হয় হিন্দু নয়। সিঁদুর তো নেই-ই, শাড়ি সাদা। আর এখন দ্যাখো। ওয়াইন কাপটা অবলীলায়! সার রাজচন্দ্র তবু তো স্যান্ডউইচ চিবোচ্ছেন, এঁর দ্যাখো, নিছক ওয়াইন।

ট্রেনটা জোরে কটা হুইসিল দিলো, তাহলে তারাবাড়ি নামে সেই নতুন স্টেশনের আলো চোখে পড়েছে। তরুণ জানলার কাঁচ দিয়ে একবার চাইলো। দূরে যে আলোকবিন্দু তা কোথায় কত দূরে কত অন্ধকারের গভীরে বোঝা যায় না। তাহলেও গন্তব্যের আর বেশি দেরি নেই। সে তার লাগেজ বলতে একমাত্র বড়ো সুটকেসটার উপরে চোখ বুলিয়ে নিলো। বোঝাটা বড় নয়, আসল ব্যাপারটা অন্ধকার। ট্রেনটার শিডিউল স্টপ বিকেল পাঁচটায়, এখন সাতটা বাজতে চলেছে। ওই আলোকবিন্দুই প্রমাণ করে তার চারিদিকে কী রকম অন্ধকার হবে গ্রামের পথে। লোককে জিজ্ঞাসা করেই যেতে হবে, হয়তো পথে লোকও থাকবে না। উপরন্তু যে রকম হদিশ পাত্তা নিয়ে সে রওনা হয়েছিলো, এখন ব্যাপারটা তার কিছু অন্য রকম দেখছে। সে শুনেছিলো, মরেলগঞ্জে রেলওয়ে স্টেশন নেই। কিন্তু সেটা রাজনগরের মাইল দুয়েক উত্তরে। নামে যে স্টেশনটা তারা পার হয়ে এসেছে তা নাকি মরেলগঞ্জ থেকে ক্রোশ পাঁচ-ছয় দূরে। আসছে শুনে সে নামার জন্য প্রস্তুত হতে। গেলে মহিলা জিজ্ঞাসা করেছিলো–তুমি রাজনগরে নামবে বলেছিলে না?

-এটাই তো?

মহিলা বলেছিলো–স্টেশনে, না রাজনগরে? এটা নয়, আসলে এটাকে কায়েতবাড়ি বলে। রাজা থাকতেন এখানেই বলে স্টেশনের নাম রাজনগর। আসল তারাবাড়ি নামে নতুন স্টেশনের দিকে, বরং তাকেও ছাড়িয়ে দু ক্রোশ। তোমার তারাবাড়িতে নামা ভালো। তারাবাড়িও আসল নাম নয়। আসল নাম ফরাসডাঙাই এখনো চলে।

তরুণের সম্ভবত রাজা সম্বন্ধে কৌতূহল ছিলো অন্য অনেকের মতো। সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে রাজার কথা তুলেছিলো। তখন মহিলা বলেছিলো, রাজার নাম ছিলো মহারাজা কর্নেল সার মুকুন্দবিলাস স্মৃতি খাঁ, কে. সি. বি.। কিন্তু বছর দুয়েক হলো তিনি গত হয়েছেন। মহারানী পুত্রকন্যাদের নিয়ে বিলেতেই থাকেন প্রায়।

পোর্টের বোকেটা বিশেষ ভালো। কামরাটা ভরে উঠেছে গন্ধে। সার রাজচন্দ্র সিগার ধরালো। টান দিয়ে কাশতে শুরু করলে মহিলা বললো–পাহাড় থেকে নামা সাত দিন হয়ে গেলো। কাশিটা রয়ে গেলো। কিছুতে শুনলে না ডাক্তার দেখানোর কথা, কলকাতায় থেকেও

সার রাজচন্দ্র কথাটাকে কিংবা মুখের সামনের ধোঁয়াটাকে মৃদু হাত নেড়ে সরিয়ে দিলো। তার আঙুলগুলো লম্বা, শরীরের গড়নের তুলনায় বরং সরু আর হালকা। সে হেসে বললো, তার চাইতে মজার কথাটা ভাবো হৈমী, রানীমারই লোকসান হয়েছিলো। তার বান্দা আর গজা গিয়েছিলো; ওদের তো একটা পাইক।

হৈমী বললো, মনোহর সিং-এর ব্যাপারটা?

–সেটা একটা ভড় ছিলো না?

সার রাজচন্দ্র, ধোঁয়া লাগলে যেমন, চোখ দুটোকে স্তিমিত করে একটু ভাবলো।

হৈমী বললো, মশাল নাকি?

রাজচন্দ্র কাঁচের উপরে পিছলে যাওয়া ধোঁয়াটে লাল আলোটাকে দেখে নিয়ে বললো, লাইন ক্লিয়ারেন্স। তাহলে তোমার তারাবাড়ি আর এক ফারলং। সে সিগারেটকে কামরার অ্যাশট্রেতে রেখে নিজের ওয়াইন-কাপটা আবার ভরে নিলো, হৈমীর ওয়াইন কাপটাতেও ঢেলে দিলো প্রায় পুরো কাপ।

কুমারনারায়ণ নামে সেই তরুণের একটা বিচিত্র অনুভূতি হলো। এক ফারলং যেতে কতটুকুই বা সময়, কিন্তু দ্যাখো, নামার আগে যে গোছগাছ করা হয় তার কোনো চেষ্টা নেই। বাম্পারটার ডালা খোলা হয়েছিলো, তেমন ভোলা। এদিকে-ওদিকে অনেক মালপত্র ছড়ানো। দু-দুটো রাইফেল, পাহাড়ে বেড়ানোর দু-একটা লাঠি, শহরে বেড়ানোর লাঠি, শাল, কোট, রাগ, এখানে-ওখানে রাখা; তাছাড়া স্তুপাকার ট্রাঙ্ক, সুটকেস। সে মনে মনে হেসে ভাবলো, ওয়াইন-কাপ হাতেই নামবে? হয়তো বোতলটা, ক্লাসগুলোও ছড়ানো থাকবে কামরায়। হয়তো ভৃত্যরা এসে গুছিয়ে নামাবে সবকিছু।

.

ওয়াইন-কাপটা তুলে ঠোঁটের কাছে এনে হৈমী সলজ্জভাবে হাসলো। এই প্রথম তার মাৰ্বল সাদা গালে কিছু অন্য রং দেখা দিলো। লজ্জা বোধ হলো তার। তার মনে পড়লো, লজ্জায় পড়েছিলো সে। বিশ বছর আগেকার সে লজ্জা অবশ্যই পালাতে বলে না। গল্পের মতো মনে পড়ে।

হ্যাঁ, বেশ লজ্জাই। যা কেউ ভাবতে পারে না তেমন করে নিজের মহল থেকে রাজকুমারের মহল পর্যন্ত সমস্তটা পথ দাসদাসী, আত্মীয়স্বজন, কর্মচারীদের ভীত সন্ত্রস্ত করে রানী নিজে রাজকুমারের শোবার ঘরে এসে দাঁড়ালেন। বলতে বলতে ঢুকলেন, কী আক্কেল তোমার, রাজু? স্নানের সময় হয়। ওরা গন্ধ নিয়ে, কত রকমের জল নিয়ে বসে-কিন্তু কথা শেষ করার আগে রাজকুমারের বিছানার দিকে চোখ পড়েছিলো। বিছানার উপরে রাজকুমার, তার হাতে ওয়াইন-গ্লাসে ভরা হুইস্কি তখন। এক হাত দূরে হৈমী, তার হাতেও তেমন। মনে হয়েছিলো, রানীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেউ রং ঢেলে দিলো। যেন ফিরে যাবেন, দৌড়ে পালাবেন। কিন্তু লোহার মতো শক্ত হয়ে দাঁড়ালেন, বললেন–হৈমী!

হৈমী উঠে দাঁড়ালো। হুইস্কি চলকে পড়লো, কিন্তু যা সে বুঝতে পারেনি, ততটা হুইস্কি, অনেকবার অল্প অল্প করে হলেও, তার ভিতরে তখন। পা টলে উঠলে সে খাটের থাম ধরে দাঁড়িয়েছিলো।

রানী ছিঃ ছিঃ বলতে গেলেন, কিন্তু দৃঢ়স্বরে বললেন

এটা স্বীকার করতেই হবে, হৈমী ভাবলো, তখন কম বয়সের তুলনাতেও, বোকা ছিলাম। নতুবা কেউ একজন অনুরোধ করতে থাকলেই প্রায় এক দেড় ঘণ্টা ধরে, কারো সঙ্গী হওয়ার জন্যই, একটু একটু করে অতটা হুইস্কি কেন খেয়ে ফেলবো যাতে পা টলে যায়, সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে? রাজকুমার বেএক্তিয়ারই ছিলেন। তা না হলে কেউ কি বলে, যেমন বলছিলেন, এত লোক, বাড়ি-ভরা এত মানুষ, এর মধ্যে কি নয়নতারা নেই? নয়ন আসেনি বলছো? এত উৎসব, এত আয়োজন, তবু নয়নতারা ফেরেনি–এ কি বিশ্বাস করতে বলো? অথচ দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়ার পর থেকে রাজকুমার একেবারে স্তব্ধ ছিলেন। সেই পাঁচ ছয় মাসে কারো সঙ্গেই কি কথা বলেছেন? রাজবাড়ির সংসার তেমনই চলছিলো যেমন চলে, বরং সেই উৎসবের আয়োজনগুলো ধীরে ধীরে। এটা কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপারই যে রাজবাড়ির বোটটা থেকে কেউ তেমন পড়ে যেতে পারে, শুধু দুই নদী কেমন মিলছে দেখতে গিয়ে! হোক তা ভাদ্রের গঙ্গা। সংবাদ পেয়ে স্বয়ং হরদয়াল গিয়েছিলো তদন্তে, কিন্তু এলাহাবাদের কাছে গঙ্গায় জাল ফেলে কি কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়? রূপচাঁদ তো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জলে লাফিয়ে পড়েছিলো; সেও তলিয়ে গিয়েছিলো মাত্র। কারো কারো জীবন দুর্ঘটনাবহুল হয়।

রানী দৃঢ়স্বরে বললেন–হৈমী, রাজকুমারকে বাথে নিয়ে যাও স্নান করাতে, রূপচাঁদকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। খবরটা যেন বাইরে না যায়। রাজু, আজ তোমার বিবাহের দিন তা জানতে, অথচ

রাজচন্দ্র উঠে দাঁড়ালো। তার মুখ কথা বলার আবেগে লাল হয়ে উঠলো। সে যে দু পায়ের উপরে টলছে তা বোঝা গেলো। কথা তৈরি করার চেষ্টায় ডান হাতে বাড়িয়ে যেন শূন্যে অক্ষর আঁকতে লাগলো। কিন্তু কথা এসেও গেলো-বিয়ে? কার বিয়ে? কী যে বলে তুমি, মা!

হঠাৎ রাজকুমার যেন রানীমাকে এতক্ষণে দেখতে পেলো, নিজের মুখের উপরে হাত রাখলো, বেশ স্পষ্ট করে ভেবে নিলো, বললো–ও, তুমি আমার বিবাহের কথা বলছো? তা সব লোককে বিবাহ করতে হবে কেন? নাঃ, আমি বিবাহ করবো না।

রানীমা কী বুঝলেন কে জানে? ধমক দিতে গেলেন, কিন্তু গলা নামিয়ে বললেন–রাজু, এখন আর তা বলা যায় না। কন্যাপক্ষ উপস্থিত। কন্যার অধিবাস হয়ে গিয়েছে। তার মুখ চেয়েও। কথাটা শেষ হলো না।

শেষ করা যায় না। সকলেই জেনেছিলো, হৈমীর তত বেশি জানার কথাই। গুণাঢ্য মহাশয় সপরিবারে সবান্ধবে তখন রাজনগরে। একটা গোলমাল চলেছিলো বটে। তা কিন্তু বিবাহ হবে না এমন কথা নয়। রানী নাকি বিবাহের আগের বিকেলে আবদার তুলেছিলেন শালগ্রামশিলা সাক্ষী রাখা হোক, মন্ত্রগুলো সংস্কৃতে পাঠ করা হোক, আমার একইমাত্র ছেলে। এটা কি তাৎক্ষণিক আবেগ? অথবা অনেকদিনের পরিকল্পনা? ব্রাহ্ম মেয়েকে পুত্রবধূ করছি অথচ বিবাহটা হবে হিন্দুমতে? গুণাঢ্য মহাশয়ের সঙ্গে তার পরিবার ছাড়াও সমাজের অনেক প্রধান স্থানীয় ব্যক্তি। তারা বলে পাঠালেন, এমন অপমানজনক প্রস্তাবে রাজী হওয়ার চাইতে তাঁরা বরং কন্যাকে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। তখন রানীর সেটা আর অনুরোধে রইলো না। সন্ধ্যার কিছু পরে গুণাঢ্য আর তার কন্যাকে তাদের আপত্তি সত্ত্বেও রাজবাড়িতে এনে রাখা হয়েছে। অবশিষ্ট কন্যাত্রী তখন? আমোদ-আহ্লাদ, খাওয়া-দাওয়া, বিভুগুণগান সব চলতে পারে, বিবাহ-কর্ম সমাধা না-হওয়া পর্যন্ত কেউ সেই বাড়ির বাইরে যাবে না। রানীমার হুকুম। অন্তত ত্রিশজন বরকন্দাজ যেন তাদের সম্মানের জন্য বাড়িটাকে চারদিক ঘিরে পাহারা দিচ্ছিলো।

কিন্তু রানীর সেটা পরাজয়ের দিন ছিলো। পরাজয়কে জয়ে পরিণত করার কৌশলগুলো কি একটাও খাটলো? কবিরাজ রাজচন্দ্রকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলো। সন্ধ্যার কিছু আগে রাজচন্দ্র ঘুম থেকে উঠেছিলো। ইতিমধ্যে দাসীরাও হৈমীকে ঘুম থেকে তুলে বলেছিলো, রানী বলেছেন রাজকুমারকে স্নান করিয়ে সাজিয়ে দিতে। হৈমী এসে দেখেছিলো, রাজকুমার তার রাইডিং কোট পরছে। আর তখন রানী দ্বিতীয়বার এসেছিলেন রাজচন্দ্রর শোবার ঘরে। কথা কি আর বেশি হলো? দুজন তো দুজনকে চেনেনই।

রানীকে তখন বরং শান্ত দেখাচ্ছিলো। তার ঠোঁট কাপছিলো মনে হলেও, কথাগুলি নিচু স্বরের হলেও, তা সব খুব স্পষ্ট ছিলো। তিনি বললেন, তুমি কি বাইরে যাচ্ছো, পিয়েত্রোর বাংলোয় ফিরে যাচ্ছো?

-হ্যাঁ, মা। সেটাই ভালো লাগবে মনে হচ্ছে।

রানী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বললেন–তোমার বিবাহের ব্যাপারে ইতিমধ্যে আমি কেলেঙ্কারি করেছি।

–বিবাহ আমি করছি না।

–এইসব মানুষেরা অপমানিত হয়ে ফিরে যাবে? সেই নির্দোষ কন্যাটির কথাও ভাবো।

–আমি নিরুপায়। কিছু টাকা দিয়ে দাও।

রানী গলাটাকে আরো নামালেন–শোনো, রাজু, তোমাদের সম্পত্তির চার আনা অংশ আমার, তা জানো? আমি আজ সেই চার আনা অংশ আমার ভাবী পুত্রবধূর নামে লিখে দিয়েছি। গুণাঢ্যমশায় নিজে তার একজন সাক্ষী। আমি সে দস্তখত ফেরত নিতে পারবো না। তার অর্থ কী হয় জানো?

রাজু বললো–ওটাই তো যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ হয়েছে।

–এটা হাসির কথা নয়, রাজু। মুকুন্দ এখন সাবালক, তাকেও তার ছ আনা দিয়ে দিতে হবে। তোমার তাহলে কী রইলো?

রাজু বললো–আমাকে কি তোমার পা ছুঁয়ে বলতে হবে বাকি ছ আনাতেও আমার লোভ নেই?

রানী অদ্ভুতভাবে হাসলেন। বললেন–যেন রসিকতাই, অবশ্য তোমার ফরাসডাঙা থাকে।

বিবাহ হয়েছিলো, আর তা গুণাঢ্যর সমাজকে খুশি করেই, ব্রাহ্মমতে। গুণাঢ্যকে ধাক্কাটা সামলে নিতে সময় দিয়ে সকন্যা তাকে কন্যা-নিবাসে ফেরত পাঠিয়েছিলেন রানী। কায়েত কুমার মুকুন্দ তো এই উৎসবের জন্যই ফারলো নিয়ে চীন থেকে এসেছিলো, আর মায়ের সঙ্গে রাজবাড়িতেই উপস্থিত ছিলো। সেই রাত্রিতেই গুণাঢ্যর কন্যার সঙ্গে বিবাহ হয়েছিলো তার। ঘুমের ঘোরে কন্যা কি টের পেয়েছিলো যে বর বদলে গেলো?

সে দিনই জানা গিয়েছিলো, কায়েত বাড়ির কুমারও এ বাড়িরই রাজকুমার, বরং সেই জ্যেষ্ঠ এবং তার নামটা অত বড়-মুকুন্দবিলাসস্মৃতি।

অবশ্য বলা যায়, হৈমী সার রাজচন্দ্রকে একবার দেখে নিলো, সম্পত্তির ছ-আনা অংশের সঙ্গে ফরাসডাঙা আর নানা শেয়ার ও স্টক যোগ হলে কম হয় না, যদিও রাজনগরের রাজবাড়িটাও রানীমার চারআনি অংশের মধ্যে পড়ে বলে তা হাতছাড়া হয়; আর তখনকার দিনে গুণাঢ্যর সহায়তা না পেলে ফরাসডাঙাকে নিয়ে অত কেলেঙ্কারির পরে কারো আর রাজা উপাধি পাওয়া সম্ভব ছিলো না।

.

০২.

সেই রাত্রির সেই ব্যাপারে মৃত রাজার সম্পত্তির ট্রাস্টি হিসাবে রানী একটা দীর্ঘদিনের ভুলকে শুধরে নিলেন কিনা বলা যায় না। কিন্তু গাড়িটা থামলো। যেমন ছিলো তেমন অবস্থাতেই সার রাজচন্দ্র প্রথমে, পরে হৈমী নামলো গাড়ি থেকে। ভৃত্যরা, কর্মচারীরা তো প্রস্তুত ছিলোই। তারা মালপত্র গুছিয়ে নিতে গাড়িতে উঠলো। কুমারনারায়ণেরই বরং তাদের ভিড় এড়িয়ে নামতে অসুবিধা হলো। ততক্ষণে পাশাপাশি আর সব কামরা থেকে কুমারনারায়ণের সেই লালমুখোরা নামছে। সার রাজচন্দ্র একজন কর্মচারীকে তাদের দেখিয়ে দিলো। তারা অবশ্যই শুধু লালমুখোনয়। রেলের বড়ো অফিসার, জেলার কালেক্টর, ছোটোলাটের প্রাইভেট সেক্রেটারি ইত্যাদি।

তারা সকলেই কর্মচারীদের যার যার মালপত্র দেখিয়ে দিতে ব্যস্ত, তাছাড়া তার পরেও তো তাদের স্টেশন পরিদর্শন নামে কর্তব্য আছে। নতুন স্টেশনে সেই সন্ধ্যাতেই তো প্রথম। গাড়ি এসেছে। স্টেশনটাকেও সেজন্যই সুসজ্জিত করা।

তারা সকলেই আবার সে রাত্রির জন্য রাজচন্দ্রর গেস্ট। রাজচন্দ্র এবং হৈমী স্টেশনের টিকেট-গেটের পাশে আলোর নিচে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। কুমারনারায়ণ তার সুটকেসটাকে টানতে টানতে, স্টেশনের আলো আর সেই আলোর বাইরে অন্ধকার, যাকে সূচীভেদ্য বলা যায়, দেখতে দেখতে গেটের কাছেই এসে পৌঁছলো। হৈমী তাকে আগে দেখতে পেলো। সে নিজে তো অন্ধকার দেখেই চিন্তাকুল।

হৈমী বললো–এই যে কুমার, জার্নিস এন্ড?

কুমারনারায়ণ হেসে বললো–আপনাদের কর্মচারীর ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম, অসংখ্য ধন্যবাদ।

নট অ্যাট অল। এখন কোথায় যাবে মনস্থ করেছো? তোমার গাড়ি এসেছে?

কুমার জানালো-সে মরেলগঞ্জে যাবে, তার গাড়ি আসার কোনো কথা নেই।

-মরেলগঞ্জ। সেখানে? সেখানে অন্ধকারে কী করে যাবে? আগে কখনো গিয়েছে?

কুমার বললো–অন্ধকার দেখে এখন আশঙ্কা বটে। পথপ্রদর্শক–অন্তত একটা হারিকেন পেলেও হতো।

-তা তোমাকে দেওয়া যায়, হৈমী হাসলো, কিন্তু এমন সোফিস্টিকেটেড মানুষ, সেই অজপাড়াগাঁয়ে এত রাতে কোথায় যাবে?

-মরেলগঞ্জে আমার মামার বাড়ি।

-তাহলে তোক ঠিক করে দেবো? আমি অবশ্য মরেলগঞ্জের কাউকে চিনি না। শুনছো, এই যুবক মরেলগঞ্জে যেতে চাইছে।

সার রাজচন্দ্র ছিলো। সে হৈমীর কথা শুনে আপাদমস্তক ইউরোপীয় পোশাক-পরা কুমারকে দেখে নিলো, সে তত গাড়িতে অনেকক্ষণ ধরেই তার ইউরোপীয় ম্যানার্স লক্ষ্যও করেছে, সে অন্যমনস্কর মতোই বললো, কিন্তু নীলকুঠি তো বছর বিশেক আগে থেকেই উঠে গিয়েছে। সেখানে একমাত্র তাদেরই বাসযোগ্য বাংলো ছিলো। হ্যাঁ, বিশ বছর তো হলোই। খোঁড়া ডানকান ফিরেছিলো বটে, কিন্তু তারপর তারা সকলেই তো আমাদের চা বাগানে। তারা তখনই বুঝেছিলো নীলের চাইতে চায়ে লাভ বেশি। বাংলো-টাংলোও সম্পত্তিসমেত মহারাজার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলো। বোধ হয় বছর দশেক আগে একটি ট্যাস মেয়ে থাকতো বটে সেই ভাঙাচোরা বাংলোয়।

সার রাজচন্দ্র কর্তব্য শেষ করে শিস দেওয়ার জন্য ঠোঁট গোল করলো। বোঝা যাচ্ছে, নিজের বাড়িতে ফিরে বেশ সুখী।

হৈমীকুমারকে এবার বেশ বিব্রত দেখতে পেলো। বললো–তাহলে? কাল দিনের বেলা বরং মামাকে খুঁজো। আজ বরং আমাদের কাছে থাকবে? এখানে সম্ভবত ওয়েটিংরুম হয়নি এখনো ।

-কিন্তু এমনিই তো আপনাদের অনেক গেস্ট শুনলাম।

হৈমী বললো–শুনছো, এই ছেলেটি বলছে তোমার অনেক গেস্ট সেজন্য তাকে রাত করে মরেলগঞ্জ যেতে হচ্ছে।

রাজচন্দ্র সবার উপর দিয়ে সেই লালমুখোদের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখছিলো, বললো–সিলি! গলা তুলে একটু উঁচু করে বললো, ও, বিলি, আইম্ ওয়েটিং।

বিলি সম্ভবত ছোটোলাটের সেক্রেটারি, কাঁধে হাতে ভঙ্গি করে বললো–দিজ রেলওয়ে মে!

সুতরাং অন্যান্য গেস্টরা দু-তিনটে হ্যাঁমে ভাগ করে উঠলে, জোড়া ঘোড়ার ল্যাভোটাতে হৈমী ও সার রাজচন্দ্রের সঙ্গে কুমারকে উঠতে হলো।

.

সাতজন গেস্ট তো ছিলোই; টেলিগ্রাম পেয়ে অল্প সময়ে ভৃত্যরা একতলার সাতটা শোবার ঘর প্রস্তুত রেখেছিলো। দোতলায় ওঠার স্টেয়ারকেসের বাঁ দিকে আরো দু-তিনখানা ঘর। পুরো শীতটা সেগুলো তালাবন্ধ ছিলোলন পার হয়ে গাড়িবারান্দার দুপাশের ঘরগুলোতে দিস ইয়োর্স বলে এক-একজন গেস্টকে দেখিয়ে দিয়ে এবং ড্রিংকস্ পাঠাচ্ছি, কিন্তু বোধ হয় আধঘণ্টায় ডিনার গং বলে সিঁড়ির গোড়ায় তখন সার রাজচন্দ্র এবং হৈমী। তখন কুমারনারায়ণ তাদের পিছনে। তাকে দেখে ভৃত্যরা একটু মুশকিলে পড়লো। বন্ধ ঘরের তালা খুলবে কিনা এই দ্বিধা করতে লাগলো। তখন রাজচন্দ্র বললো––ও ঘর তো ঠাণ্ডা হবে, তুমি বরং ওপরে এসো, মিস্টার কুমারনারায়ণ।

দোতলায় রাজচন্দ্র বললো–তুমি এই ড্রয়িংরুমে আপাতত বসো। এটার সঙ্গে বাথ আছে। এখানে তুমি তৈরী হয়ে নাও। ইনফরম্যাল ডিনার, পোশাক না-পাল্টালেও চলবে। আমি তোমার শোবার ঘর ঠিক করে দেবো। তোমার ড্রিংকস্?

কুমার শুধু চা বললে, রাজচন্দ্র বললো–বেশ, বেশ, হৈমী এসে ততক্ষণ গল্প করবে। আমি একটু গেস্টদের ড্রিংকসের ব্যবস্থা দেখে আসছি।

সুতরাং কিছু রিফ্রেশড় হয়ে কুমার বসতে না বসতেই ভৃত্য তার চা নিয়ে এলো এবং কিছুপরেই হৈমীরও হাসিমুখ দেখা দিলো। ইতিমধ্যে সে আবার পোশাক পালটেছে। শাড়ি তেমন সাদাই বটে, মুক্তোর বদলে কানে হাতে গলায় লোখরাজ। গল্পটা কোনদিকে গড়ায়, সূচনায় যাই থাক, তা সম্ভবত যে গল্প করছে তার মনের নিকটতর বিষয়গুলোর দিকে গড়িয়ে যায়। সুতরাং কুমার যখন সেই ড্রয়িংরুমের কোণে রাখা পাহাড়ে চলা লাঠির দিকে লক্ষ্য করে বললো, আপনারা দুজনেই পাহাড়ে গিয়েছিলেন? অনেক দূর উঠেছিলেন নাকি? হৈমী এক কথায় হাঁ-নানা বলে বললো, এই তত দিন সাতেক আগে পাহাড় থেকে নামা হলো। আমি অবশ্য আলমোড়ার চাইতে বেশি ওপরে উঠিনি। সার রাজচন্দ্র অনেক দূরই গিয়েছিলেন। তুমি কি ওদিকের পাহাড়ে কখনো গিয়েছো? সার রাজচন্দ্ররও এবার এই প্রথম। কিন্তু আসকোট, বালুয়াকোট, সাংখোলা, গারবিয়ং, লিপুধুরা পর্যন্ত এবার গিয়েছিলেন।

কুমার বললো–এসব তো বিখ্যাত জায়গা নয়। তাহলে জানতাম বোধ হয়। আমি আলমোড়ার এক প্রাইভেট স্কুলে কিছুদিন পড়েছি। আলমোড়াই সবচাইতে বড় জায়গা ওদিকে, কিন্তু সেটাও তো বন, আর পাহাড়, চীর বন, আর বড়জোর ঝর্না।

হৈমী বললো–না, বড়ো জায়গা নয়। আসলে সার রাজচন্দ্র একজনকে সি-অফ করতে গিয়েছিলেন। হৈমী একটু ভাবলো, সার রাজচন্দ্র ফিরে এসে যে পথের কষ্টের কথা বলেছে, অনেক জায়গাতেই যে বরফ ছিলো, আবহাওয়ার তাপমান যে হিমাঙ্কের নিচে, সব পথটাই প্রাণ হাতে করে চলা, তা তার অনুভূতিতে ফিরলো। বললো, হ্যাঁ, এটা সার রাজচন্দ্রর খুবই দৃঢ়তা আর সহনশীলতার পরিচয়। তুমি নিশ্চয় মানস-সরোবরের নাম শুনেছো।

হ্যাঁ, তা তো তিব্বতে।

–নিশ্চিয়। লিপুধুরাতে পৌঁছেতেই হাত পা অবশ হয়ে যায়। প্রচুর শীতবস্ত্র না থাকলে মৃত্যু হওয়া অসম্ভব নয় এই শীতে। আর পথ তো পাথরে পাথরে পা রেখে চলা, ভালো গাইড না থাকলে আর তারা সাহায্য না করলে আমাদের মতো মানুষেরা এক পাও বাড়াতে পারবে না। আর মানস-সরোবর সে তো শুনেছি বরফে চলা আর প্রতি মুহূর্তে পড়ে প্রাণ হারানোর ঝুঁকি নয় শুধু, ডাকাতের হাতে পড়ার আশঙ্কা।

আগ্রহ বোধ করে কুমার বললো–আপনি সি-অফ করার কথা বলছিলেন, ও পথে সি অফ মানে? ওটা কোথাকার পথ?

হৈমী ভাবলো কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা, কিন্তু পরে সেই গল্পটার আবেগই যেন নিজে থেকে তার মনে আত্মপ্রকাশের চাপ দিলো। সে বললো–তিনি একজন বৃদ্ধা, না না, প্রকৃতপক্ষে তিনি একজন বৃদ্ধা রানী। তিনি মানস-সরোবরের উদ্দেশে গেলেন কিনা। বয়স প্রায় ষাট হয়েছে। সঙ্গে দু-একজন মাত্র লোক। তা সেই ভৃত্যটিও বৃদ্ধ। গাইডটা অবশ্য মাঝবয়সী। পাহাড়ী ঘোড়ায় হয়তো এখনো চলেছেন। এই দারুণ শীতে আর সেই নিঃসঙ্গ বরফ-ঢাকা পাহাড়ে দিনে তিন-চার মাইলের বেশি কি আর চলা সম্ভব? আর রোজ কি চলতেও পারবেন? হৈমী তার সাদা শালটাকে টেনে হাত দুটোকে ঢেকে নিলো।

কুমার বললো, বাপরে! তিনি খুব ধর্মপ্রাণা? এ যে মহাপ্রস্থানের মতো! এ রকম গেলে তো আর ফেরার সম্ভাবনাই থাকে না। আশ্চর্য কিন্তু, নয়?

.

কিন্তু ডিনারের ড্রেসিং গং বেজে উঠলো। সার রাজচন্দ্র, গেস্টদের ঘরে যখন ভৃত্যরা ড্রিংকসের ট্রে নিয়ে ঢুকছে, প্রত্যেক দরজার সামনে একবার করে হাসিমুখ দেখিয়ে হ্যালো জো, হেল্প ইয়োরসেলফ বিলি ইত্যাদি বলে দোতলায় ফিরে বাথে ঢুকেছিলো। গরম বাথটাকে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে ল্যাভেন্ডার ঘ্রাণটাকে উপভোগ করছিলো। ড্রেসিং গং-এর শব্দে বাথটাব থেকে উঠে পড়লো। এতগুলো গেস্ট! কিন্তু সেই গরম থেকে উঠেই স্বগতোক্তি করলো, কী ঠাণ্ডা, কী শীত! সে তাড়া তাড়ি শরীর ঘষতে লাগলো টাওয়েলে। মনে মনে বললো, বাব্বা, এ যে লিপুধুরা! গায়ে জামা চাপিয়ে তার মনে হলো, তা অবশ্য নয়। লিপধুরায় সেদিন তুষার পড়ছিলো। সাদা ছাড়া কোনো রংই ছিলো না চারিদিকে। সে তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরতে লাগলো। তার মুখটা উদাসীন নিস্পৃহ, কিন্তু চোখ দুটো যেন স্বপ্নাচ্ছন্ন কিংবা সজল। ঠাণ্ডা লাগলে যেমন হয়। তার চোখ দুটোয় কালো গ্লাসে ঢাকবার আগের কয়েক মিনিটেই, সেই সাদা দেখে, ঠাণ্ডা লেগে কষ্ট দিচ্ছিলো।

কিন্তু লিপুধুরায় পৌঁছে সে কাউকেই দেখতে পায়নি। তার গাইড অনেক চেষ্টায় বরফে বারো আনা ঢাকা ছোট গোয্যায় একজন লামাকে পেয়েছিলো। সেই লামাই বলেছিলো, এখন তো সব লোকই আসকোটের দিকে নেমে গিয়েছে। তবে সকালে একটিমাত্র দল তিনটি ঘোড়া নিয়ে লিপুধুরা ছেড়ে তাকলাখারের দিকে রওনা হয়েছে, নিষেধ শোনেনি। যদি বরফ পড়ার আগে পুরাং-এর জং-এ আশ্রয় পায়। সার রাজচন্দ্রর কঠিন মুখে গগল্স-ঢাকা চোখ থেকে জলের ধারা নেমেছিলো।

সারা পথটাই এমন হয়েছে। কখনো একবেলা আগে, কখনো একদিন আগে, রানীমার এগিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গিয়েছিলো। স্থানীয় দুঃসাহসী লোকেরা অতি প্রয়োজনে যাওয়া-আসা করছিলো, নতুবা সাধারণ গ্রামবাসীদের অধিকাংশ তখন নিচে নেমে গিয়েছে। উপায়হীন শীতে বন্দী যারা ছিলো তারাও একটা তিনজনের দলকে ক্রমশ উপরের দিকে চলতে দেখেছে। বালুয়াকোটের প্রধানের অতিথিশালায় পৌঁছে সে আর বাগচী সেই শেঠানীর কাছে শুনেছিলো, আগের দিন রানী রওনা হয়ে গিয়েছেন। লিপুধুরায় তবু তো সময়টা কমে একবেলার তফাতে দাঁড়িয়েছিলো। শেঠানী বাগচীর মারফত জানিয়েছিলো রাজচন্দ্রর ফিরে যাওয়া উচিত হবে। কারণ তার ধারণা কারো সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা থাকলে সেই দলটা থেকে যেতো সেদিনও। সেই রকম কথাই হয়েছিলো রাতে। সকালে উঠে সেই রানী যখন রওনা হওয়ার জেদ করলেন, তখন শেঠানী ঘোড়া তিনটে বদলে দিয়েছে আর এখানকার সবচাইতে ভালো গাইডটাকেই দিয়েছে।

রাজচন্দ্রর ইচ্ছা ছিলো, শেঠানীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে, কিন্তু বাদামী সিল্কের অবগুণ্ঠনে ঢাকা সেই ধনী শেঠানী পর্দার আড়ালেই ছিলো। বাগচীর রোগী বলে তার সঙ্গে কথা বলে, অন্যের সঙ্গে কথা বলবে কেন? রাজচন্দ্র পর্দার নিচে তার পা দুখানা দেখেছিলো আর পর্দা একবার একটু সরে গেলে একটামাত্র চোখ।

লিপুধুরার সেই লামা বলেছিলো, বরফ আরো বেশি পড়লে কালাপানি দিয়ে নামা যাবে । আপনারা নেমে যান এখনই। শেঠানীও তেমন বলেছিলো, আপনারা আর উঠবার চেষ্টা করে নেমে যান।

বালুয়াকোটে রাত্রিতে খেতে বসেছিলো, সে আর বাগচী। বাগচী বলেছিলো, আলমোড়ায় সংবাদ পেয়েই টেলিগ্রাম করেছিলাম। আমার ধারণা হয়েছিলো রানীমা মানস যাওয়ার আগে আপনাকে একবার দেখতে চান। আপনিও তো ঠিক এসেই পড়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারটা অন্যরকম হলো। এ যেন মহাপ্রস্থান। কয়েক বছর থেকেই হিমালয়ের এদিক ওদিক ঘুরছিলেন। বছরে দু-একবার করে আলমোড়ায় নামতেন। কিন্তু এখন অন্যরকম মনে হচ্ছে।

রাজচন্দ্র বলেছিলো, আপনি আলমোড়ায় ফিরে যান, আপনার প্রাইভেট স্কুলের ছাত্ররা আছে, রোগীরা আছে। শেঠানীকে অনুরোধ করুন যাতে আমি দুটো ভালো ঘোড়া ও একজন গাইড পাই। যা টাকা লাগে দেবো।

পরের দিন সকালেও রাজচন্দ্রকে বাগচী নিরস্ত করার চেষ্টা করেছিলো। রাজচন্দ্র একটু শক্ত হয়ে বলেছিলো, কাল রাতে আপনি শেঠানীর সঙ্গে আলাপ করছিলেন আমি শুনেছি। এই মহাপ্রস্থানকে আমার সুইসাইডাল মনে হয়।

তখন শেঠানীর সেই মৃদু গলা আবার শোনা গিয়েছিলো-রাজাসাহেবের ইংরেজিটা আমি বুঝলাম না। কিন্তু মহাপ্রস্থান আগেও হয়েছে।

-সে তো কাব্যে, রাজচন্দ্র বলেছিলো।

পর্দার ওপার থেকে শেঠানী সেই একবার তাকে সরাসরি কিছু বলে ফেলেছিলো। রাজাসাহেব, কাব্য কি মিথ্যা? কাব্যে যা সম্ভব কোনো কোনো মানুষ নিজের জীবনে তেমন কিছু করতে চাইবে। সেই সময়েই পর্দার নিচে বাদামী সিল্কে ঘেরা পা দুখানা আর তার মলদুটো আবার চোখে পড়েছিলো রাজচন্দ্রর।

আর সে কথাটা বোধহয় বাগচী বলেছিলো আলমোড়ায় ফিরে যেতে। রাজচন্দ্র নেমে এসে বাগচীকে বালুয়াকোটেই পেয়েছিলো। বলেছিলো, শেঠানী নামতে দেয়নি। বাগচী বলেছিলো, মনে আছে রাজকুমার, সেই চতুর্দশীয় সৌরভ? আমরা ভুলে যাই সেই চতুর্দশীর মনেও ব্যূঢ়োরস্ক, বয়োবৃদ্ধ, জ্ঞানবৃদ্ধ এক স্বপ্ন থাকতে পারে। এই পাহাড়ে বিশ বছর কাটিয়ে আমার মনে হয়, এই হিমালয়কে, হাজার হাজার বছর ধরে, তেমন একজন পুরুষ বলে কল্পনা করা হয়েছে। তারপর একটু হেসে বলেছিলো, জাঁ পিয়েত্রোর ছবি আপনার যা মনে আছে। তাও কি এক বৃদ্ধের নয়?

টাইটা বাঁধলো রাজচন্দ্র নিখুঁত করে। গলাটা উঁচু করে আয়নায় বাঁধনটাকে লক্ষ্য করতে করতে রাজচন্দ্র ভাবলো, আলমোড়া থেকে সে অবশ্য বাগচীর টেলিগ্রাম পেয়ে অবাক হয়নি।

-ও না, তা সে ভাবছিলো না। রানীমা যে অবিরত পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরতেন ইদানীং, তার ব্যাখ্যা কি বাগচীর ও কথায় হয়?

.

০৩.

ডিনারের পরে গেস্টরা শুতে গেলো। সার রাজচন্দ্রর মনে হলো এখনো তার অষ্টম গেস্ট সেই কুমারনারায়ণের শোবার ঘর ঠিক করে দেওয়া হয়নি। হৈমী সে ব্যবস্থা করবে ভেবে সময় কাটানোর জন্য সার রাজচন্দ্র তাকে নিয়ে নিজের শোবার ঘরে গেলো। বললো–বোসো, গল্প করি। তুমি খেতে বসে যে বলছিলে ইংরেজ তোমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে, তা কি অন্তর থেকে বলেছিলে?

কুমারনারায়ণ হেসে বললো–ডিমোক্র্যাসি, লিবার্যালিজম,ন্যাশনালিজম,এগুলো তো শিখেছি। তাছাড়া বোধ হয় আন্দোলন করতেও।

রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো–এটা কী রকম কথা হলো?

কুমার হেসে বললো–দু রকমে। প্রথমত, ওদের দেশের আন্দোলনের ঐতিহ্যটার পরিচয় দিয়ে; দ্বিতীয়ত, ভালো আদর্শ তুলে ধরে সেই আদর্শ নিজেরাই ভেঙে দিয়ে বরং দমনমূলক এবং পক্ষপাতমূলক আইন তৈরী করে। ভিকটোরিয়ার ডিক্লারেশনের আদর্শ নিজেরা মানেনি। একটা উদাহরণ দেখুন, তার ফলেই ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে আন্দোলন, লালমোহন ঘোষের লন্ডনে যাওয়া। আর্মস অ্যাক্ট এবং ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট নিয়ে আন্দোলন তত দমনমূলক ও পক্ষপাতমূলক আইনের বিরুদ্ধেতা কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক চেতনাকে বাড়িয়েছে। এখন তো ইলবার্ট বিলের ব্যাপারটা দেখতেই পাচ্ছেন।

সার রাজচন্দ্র আবার হেসে বললো–তুমি খেতে বসে ওদের বলছিলে বটে ইংরেজদের ইলবার্ট বিল বিরোধী আন্দোলনের জন্য তুমি সুখী। তোমার এ মন্তব্য আমার গেস্টদের আনন্দিত করেছে।

কুমার হেসে বললো–আপনি বলছেন, ছলনা করা উচিত নয়। কিন্তু আমি সত্যি সুখী। ওদের আন্দোলনের জয় না হলে সুরেন্দ্র ব্যানার্জির অল ইন্ডিয়া ন্যাশন্যাল ফান্ড তৈরী হতো না। সারা ভারতবর্ষ থেকে প্রতিনিধি নিয়ে যে ইন্ডিয়ান ন্যাশন্যাল কনফারেন্স হতে চলেছে, তাও হতো না। এই অল ইন্ডিয়া, সারা ভারতবর্ষ সর্বভারতীয় শব্দগুলোই সবচাইতে মূল্যবান।

রাজচন্দ্র বললো–তুমি, মনে হচ্ছে, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির পক্ষপাত। এইসব ব্যাপারেই কি কলকাতা এসেছিলে?

কুমার একটু দ্বিধা করে বললো, কিছুটা তা বলতে পারেন। আবার হেসে বললো, আপনাদের জেনারেশনে কিন্তু এই সর্বভারতের বোধটা ছিলো না। সে হাসলো। বললো–সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে, তখন আপনাদের বয়স সম্ভবত আমার এখনকার বয়সের মতো ছিলো, আপনারা কিছু করতে পারেননি, কারণ তখন মারাঠা, শিখ, বাঙালি, হায়দ্রাবাদী, দিল্লীওয়ালা এইসব স্বার্থ পৃথক ছিলো। কলকাতা আসার অন্য কারণ, কিছুদিনের মধ্যে বিলেতে যাবো। বাঙালি হয়েও এর আগে বাঙলা দেশে আসিনি, তাই ঘুরে যাওয়া।

রাজচন্দ্র বললো–তোমার হাই উঠছে, মিস্টার কুমার। আচ্ছা, না হয় তুমি এই ঘরেই শোও। এ ঘর কি তোমার পছন্দ হচ্ছে?

কুমার চারিদিকে চেয়ে বললো–আমার মনে হচ্ছে, প্রিন্সলি। বোধহয় এটাই রাজকীয় বাড়িতে সব চাইতে রাজকীয়। বরং সঙ্কোচ হচ্ছে, হয়তো এটা আপনার নিজের ব্যবহারের।

-সে কিছু নয়। কাল তোমার মামাবাড়ির গল্প শুনবো। মরেলগঞ্জে একাধিক পুকুর থাকার কথা। নীলের জন্য জল লাগে। রাজচন্দ্র হাসলো। বললো–মামাবাড়ি খুঁজে পেতে পুকুর মেপে বেড়াতে না হয়! তার চাইতে এক কাজ করো। আমি লোক পাঠিয়ে বাড়িটা খুঁজে বার করতে পারি তোমার জন্য। তোমার কম্পানি বেশ লাগছে। …আরে দ্যাখো, সেই থেকে তোমাকে মিস্টার কুমার বলছি। কুমার তত তোমাদের উপাধি নয়, নিশ্চয়? নাকি রাজনৈতিক কারণে ইকগনিটো?

কুমারের মুখটা মুহূর্তের জন্য লাল হলো। কিন্তু তখনই সে বিড়ম্বনাটা পার হলো। হেসে বললো, আধুনিক কালে পূর্বপুরুষের নাম সবক্ষেত্রে না করাই ভালো। মনে করুন কেউ যদি রাজার ছেলেই হয়ে থাকে, তবে সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে সেই রাজা কী করেছিলো তাই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। হয় সেই রাজা বিদ্রোহে প্রাণ দিয়েছে, ফলে রানীকে আত্মগোপন করতে হচ্ছে। অথবা সেই সময়ে সেই রাজা এমন কিছু করেছে যে তার পুত্রদের লজ্জায় থাকতে হয়, সেই রাজা বেঁচে থাকলেও এখন হয়তো এমন একজন প্রৌঢ় যার মধ্যে রাজাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমাদের উপাধি রায়। আসলে এমন কি হয় না যে আজ আমাকে যেমন দেখে আমার কম্প্যানি ভালো লাগছে, এখন থেকে বিশ বছর পরে আবার যদি দেখা হয় আমাকে আপনার তেমন না লাগতেও পারে। তাহলেও যেহেতু মরেলঞ্জের সঙ্গে আমার মায়ের যোগ, সুতরাং আমারও যোগ, আমি কিন্তু আপনার এস্টেটের ব্যারিস্টার হওয়ার ইচ্ছা এখনই প্রকাশ করছি। সার রাজচন্দ্ৰ হেসে বললো–বিউটিফুল! আচ্ছা, এবার বিছানায় যাও। কাল দিনের আলোয় মামাবাড়ির খোঁজ কোরো।

সার রাজচন্দ্র বারান্দায় এলো। সারাদিন ট্রেনে চলার পরে এখন বিছানার কথা মনে হচ্ছে বটে। বারান্দা দিয়ে চলতে চলতে কুমারনারায়ণের কথা বলার ভঙ্গিটাকেই আবার ভাবলো। কেউ কি এমন করে ঘুরিয়ে বলে কথা আর হাসির আড়ালে চিরকাল লুকিয়ে থাকতো? হতে পারে, এই ছেলেটির জননী প্রবাসী বাঙালি পরিবারের মেয়ে। সে তো আমাদের রানীমাও ছিলেন। হয়তো সিপাহী বিদ্রোহের সমসাময়িক কালে ওসব দেশের কোনো রাজপুত্র অথবা সামন্তপুত্রকে ভালোবেসেছিলো। তারপর ছাড়াছাড়ি। এরকম হয়। পাশাপা। দুটো আলোকোজ্জ্বল ঘর থেকে পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। দুইটি আলোর চিত্রের মাঝখানে কোমল অন্ধকারটায় সার রাজচন্দ্র থেমে দাঁড়ালো। তারপর আলোকোজ্জ্বল ড্রয়িংরুম পার হয়ে তার পাশের ঘরটায় ঢুকলো।

সেটা শোবার ঘর। কিন্তু শয্যা থেকে অদূরে বসবার বন্দোবস্ত। টিপয়ের উপরে আলোয় হীরার মতো ঝকঝকে দুটি হুইস্কির গ্লাস। পাশে একটি হুইস্কির বোতল। প্ল্যাটিনাম ব্লোন্ড হৈমী টিপয়টার সম্মুখে বসে। সার রাজচন্দ্রকে ঢুকতে দেখে সে বললো–ঘুমোতে হবে, না কী?

রাজচন্দ্র টিপয়টা অন্যদিকে বসলো। গ্লাস দুটোকে হুইস্কিতে পূর্ণ করলো। একবার ভাবলো, কুমারনারায়ণ রায়ের কথা বলবে। কিন্তু বললো, আচ্ছ হৈমী, হিন্দুরা কি সচরাচর সোনার মল পরে? কী একটা সংস্কার আছে না?

সোনা পায়ে পরা লক্ষ্মীকে অপমান? হৈমী জিজ্ঞাসা করলো, তাই বলছো? এত রাতে?

এমন হতে পারে, হৈমী, তা সত্ত্বেও কোনো শেঠানী যদি তা পারে, তাহলে কি এই প্রমাণ হয় সে খুব দাম্ভিকা? খুবই দাম্ভিকা? শুধু ধনের দম্ভ নয়–

ঘুমোবে না আজ? আমার ঘুম পায়, বাপু।

হুইস্কির গ্লাসটাকে এক চুমুকে প্রায় শেষ করলো রাজচন্দ্র। বললো–নিশ্চয় নিশ্চয়। চলো, এবার আমরা ইউরোপ ঘুরে আসি। যাবে? তুমিও তো ঘুরতেই ভালোবাসো। বেশ এটাই কথা রইলো।

Exit mobile version