Site icon BnBoi.Com

আমার আছে জল – হুমায়ূন আহমেদ

আমার আছে জল - হুমায়ূন আহমেদ

আমার আছে জল – ০১ম পরিচ্ছেদ

রেল স্টেশনের এত সুন্দর নাম আছে নাকি? “সোহাগী”। এটা আবার কেমন নাম? দিলু বললো—আপা, কি সুন্দর নাম দেখছ?

নিশাত কিছু বললো না। তার ঠাণ্ডা লেগেছে। সারারাত জানালার পাশে বসেছিলো। খোলা জানালায় খুব হাওয়া এসেছে। এখন মাথা ভার ভার। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়ত নাক দিয়ে জল ঝরতে শুরু করবে। দিলু বললো—আপা স্টেশনের নামটা পড়ে দেখ না। প্লীজ।

পড়েছি। ভাল নাম।

দিলুর মন খারাপ হয়ে গেলো। সে আশা করেছিলো নিশাত আপাও তার মত অবাক হয়ে যাবে। চোখ কপালে তুলে বলবে—ও মা, কেমন নাম! কিন্তু সে আজকাল কিছুতেই অবাক হয় না। কথাবার্তা বলে স্কুলের জিওগ্রাফী আপার মত। নিশাত বললো—দিলু, দেখত বাবু কোথায়? দুধ খাবে বোধহয়।

দিলু বাবুকে কোথাও দেখতে পেলো না। এমন দুষ্টু হয়েছে। ওয়েটিং রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে হয়ত। কাছে গেলেই টু দেবে। ধরতে গেলেই আবার ছুটে যাবে।

ওয়েটিং রুমের সামনে একগাদা জিনিসপত্রের সামনে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। বিরক্ত মুখ। তিনি দিলুতে দেখেই বললেন—একেকজন একেক দিকে চলে গেছে। ব্যাপারটা কি? তোর মা কোথায়?

জানি না তো।

তোর মাকে খুঁজে বের কর।

আমি পারব না বাবা, আমি বাবুকে খুঁজছি।

বাবুকে খুঁজলে তোর মাকে খোঁজা যাবে না এরকম কথা কোথাও লেখা আছে?

সবাই আজ এরকম করে কথা বলছে কেন? কোথায়ও বেড়াতে গেলে সবার খুব হাসিখুশি থাকা উচিত। কিন্তু এখানে সবাই কেমন রেগে কথা বলছে। রাগটা তার উপরই। ট্রেনে মা তিনবার বললেন—দিলু পা নাচাচ্ছ কেন? পা নাচানো একটা অসভ্যতা। চুপ করে বস। পা নাচানোর মধ্যে আবার সভ্যতা অসভ্যতা কি? যত আজগুবি কথা।

দিলু।

বল।

তোর মাকে খুঁজে বের কর। আমার পাইপের তামাক রেখেছে কোথায় সে?

আমি কি করে জানব? আমি রাখলে আমি জানতাম। আমি তো রাখিনি।

দিলুর বাবা ওসমান সাহেব রাগী চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। ওসমান সাহেবের বয়স আটান্ন। কিন্তু দেখায় আরো বেশী। শরীর হঠাৎ ভারী হয়ে গেছে। মাথার সমস্ত চুল পাকা। মেজাজের পরিবর্তনও হয়েছে হঠাৎ করেই। এখন আর কিছুতেই ধৈর্য রাখতে পারেন না। তিনি দিলুর উপর ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়েও থেমে গেলেন। দিলুর বয়স এই মার্চে চৌদ্দ হবে। নাকি পনেরো? মেয়েদের এই বয়সটা অন্য রকম। এই বয়সে চেনা মেয়েগুলিকেও অচেনা লাগে। মনে হয় অন্য বাড়ির মেয়ে। এদের উপর কিছুতেই রাগ করা যায় না।

দিলু পরেছে একটা ধবধবে সাদা স্কার্ট। পায়ে মোজা ও জুতা দুই-ই লাল। মাথায় দু’টি লম্বা বেণী। শীতের সকালের রোদে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে বড় অচেনা লাগছে। এর উপর রাগ করা যায় না। ওসমান সাহেব বাক্স-পেটরা হাতড়াতে লাগলেন। পাইল ধরানোর ইচ্ছা হচ্ছে। অনিয়ম করা যায়। ছুটি হচ্ছে অনিয়মের জন্যে।

দিলু ওয়েটিং রুমে কাউকে দেখল না। তবে ওয়েটিং রুমের বাথরুমের দরজা বন্ধ। ভেতরে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। কেউ আছে নিশ্চয়ই। মা বোধহয় বাবুকে বাথরুম করাচ্ছেন। দিলু ডাকলো—বাথরুমে কে? জল পড়ার শব্দ থেমে গেলো। দিলু আবার বললো—বাবু তুমি? কোন সাড়া নেই। তার মানে মা। মা একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাথরুম থেকে কথা বলবেন না।

দিলু যদি বলে—মা, গায়ে মাখার সাবান আছে? মা জবাব দেবেন না। বাথরুম থেকে কথা বলা নাকি অসভ্যতা। এর মধ্যে অসভ্যতার কি আছে?

খুট করে দরজা খুললো। দিলু দেখলো ভেজা মুখে জালিম ভাই বের হয়ে আসছেন।

কিরে দিলু ইমার্জেন্সি নাকি? যা ঢুকে পড়।

ছিঃ কি অসভ্যতা। জামিল ভাইয়ের একেবারেই কাণ্ডজ্ঞান নেই। মেয়েদের কেউ বাথরুমে যাবার কথা ওভাবে বলে নাকি? সে যে বড় হচ্ছে এটা কি জামিল ভাইয়ের চোখে পড়ে না। এখন শাড়ী পড়লে অনেকেই তাকে আপনি করে বলে। জামিল ভাই বোধ হয় তাকে কখনো শাড়ী পরা দেখেনি।

জামিল ভাই, বাবুকে দেখেছেন?

না।

মা’কে দেখেছেন?

না। কেন?

আপা খুঁজছে বাবুকে। আর বাবা খুঁজছে মা’কে।

ওরা মনে হয় স্টেশনের বাইরে হাঁটতে গেছে। চল যাই খুঁজে নিয়ে আসি। তোকে তো দারুন লাগছেরে দিলু। ট্রেনে কি এই ড্রেসেই ছিলি নাকি?

হুঁ।

মাই গড। তখন তো চোখেই পড়েনি।

জামিল দেখলো দিলু খুব লজ্জা পাচ্ছে। এর কারণ সে ঠিক বুঝতে পারলো না। মেয়েটি কি বোড় হয়ে যাচ্ছে নাকি?

‘দেখতে দারুন লাগছে’ এই কথায় কান টান লাল করার মানেটা কি? জামিল তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো।

দিলু তুই যেন কোন ক্লাসে এবার?

ক্লাস নাইনে। ইস আপনি যেন জানেন না!

কোন গ্রুপ, সায়েন্স নাকি আর্টস?

সায়েন্স।

বাপরে বাপ, সায়েন্স! ইলেকটিভ অংকে গোল্লা খাবি তো।

কেন, গোল্লা খাব কেন?

মেয়েরা অংক-মানসাংক এসব জানে নাকি?

জামিল পাঞ্জাবির পকেট থেকে চিরুনি বের করে বাথরুমের আয়নায় চুল আঁচড়াতে গেলো। দরজা পর্যন্ত বন্ধ করলো না। কি বাজে অভ্যাস। দিলু শুনলো চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জামিল ভাই গুন গুন করে গান গাচ্ছে—আজি এ বসন্তে, এত ফুল ফোটে, এত পাখি গায়।

এই শীতে বসন্তের গান? দিলু বহু কষ্টে হাসি চেপে রাখলো। সুরেরও কোন ঠিকঠিকানা নেই। বাথরুমে ঢুকলেই গান গাইতে হবে এমন কোন কথা আছে?

চল দিলু, দেখি কাউকে পাওয়া যায় কিনা।

 

ওসমান সাহেব একটা কালো ট্রাঙ্কের উপর বসে আছেন। তাঁর মুখে বিরক্তির ভাব এখন আর নেই। পাইপের তামাক পাওয়া গেছে। পাইপ তৈরী করা হয়েছে। বাতাসের জন্য আগুন ধরাতে পারছেন না। জামিলদের বেরুতে দেখে হাসিমুখে বললেন—জামিল, আমাকে এখানে বসিয়ে একেকজন একেকদিকে কেটে পড়েছে, ব্যাপারটা কি বল তো?

সম্ভবত ছুটির দিনে আপনাকে কেউ ভয়-টয় পায় না। আপনাকে নিরীহ মনে করে।

ওসমান সাহেব শব্দ করে হাসলেন। এত শব্দে তিনি কখনো হাসেন না। দিলুও হাসলো। কাউকে হাসতে দেখলেই দিলুর হাসি পায়। ওসমান সাহেব বললেন—কি রকম মিসম্যানেজমেন্ট হয়েছে দেখলে? স্টেশনে জীপ নিয়ে থাকার কথা। জীপতো—নেই-ই, একজন মানুষ পর্যন্ত নেই।

এসে পড়বে।

কিছু মুখে দেয়া দরকার। এতবেলা হয়েছে, সবার ক্ষিধে পেয়েছে।

বেলা কিন্তু চাচা বেশী হয়নি, মাত্র সাড়ে সাতটা বাজে। সকাল হয়েছে মাত্র।

তাই নাকি?

ওসমান সাহেব বেশ অবাক হলেন। জামিল বললো, আমি দেখি চায়ের ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

ঐখানে একটা চায়ের দোকান আছে।

ঐ চা কি মুখে দেয়া যাবে?

চেষ্টা করতে দোষ কি। লেট আস ট্রাই।

ওসমান সাহেব আবার শব্দ করে হাসলেন। তাঁর মেজাজ সম্ভবত ভাল হতে শুরু করেছে, দিলুও হাসলো। এখন বেশ পিকনিক পিকনিক লাগছে।

আমার আছে জল – ০২য় পরিচ্ছেদ

নিশাত একটা কাঠের বেঞ্চিতে লাল চাদর গায়ে দিয়ে বসেছিলো। রোদ পড়েছে তার মুখে। শীতের বাতাসে তার কপালে ছোট ছোট কিছু চুল নাচছে। সে বসে আছে বিষন্ন ভঙ্গিতে। তার ফর্সা গালে লাল চাদরের আভা পড়েছে। দিলু ফিস ফিস করে বললো—আপা কত সুন্দর, দেখেছেন?

হ্যাঁ, দেখলাম।

আপাকে ডেকে সঙ্গে নিয়া যাই?

ডাক। ডাকলেই হয়।
দিলু ডাকলো—আপা, এই আপা। নিশাত ওদের দু’জনকে দেখলো। কিছু বললো না। মুখ ঘুরিয়ে নিলো। মুখ ঘুরিয়ে নেবার ভঙ্গিটি—রাগী ভঙ্গি। সে এমন রেগে আছে কেন?

আপা, আমাদের সঙ্গে যাবে? আমরা স্টেশনের বাইরে হাঁটতে যাচ্ছি। না। বাবু কোথায়?

বাবু মা’র সঙ্গে। ওদের খুঁজতে যাচ্ছি। তুমিও চলো।

না, আমি যাব না।

চল না আপা।

এক কথা বার বার বলতে ভাল লাগে না। তোর যা।

দিলু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। আপা মাঝে মাঝে এমন কড়া করে কথা বলে। এত সুন্দর একটি মেয়ে এরকম কঠিন করে কথা বলবে কেন? দিলু হাঁটতে শুরু করলো।

জামিল ভাই, এগুলো কি গাছ?

জানি না কি গাছ।

কৃষ্ণচূড়া না কি?

না, কৃষ্ণচূড়া না। কৃষ্ণচূড়ার পাতা তেঁতুল গাছের পাতার মত। এগুলি খুব সম্ভব জারুল। কচুরিপানার মত ফুল হয় এদের। নীল রঙের খুব সুন্দর।

এই স্টেশনের নামটা কত সুন্দর দেখেছেন?

নামটার একটা গল্প আছে, জান?

কি গল্প?

এখানে এক রাজা ছিলেন। রাজার একটি মাত্র মেয়ে। মেয়ের নাম সোহাগী। রাজ্যে পানির খুব কষ্ট। রাজা ঠিক করলেন এমন এক পুকুর কাটবেন যে, রাজ্যে পানির কষ্ট থাকবে না। তিনি সত্যি প্রকাণ্ড এক পুকুর কাটলেন। কিন্তু আশ্চর্য, একফোঁটা পানি নেই। সে বৎসর খুব খরা। রাজ্যের লোক হাহাকার করছে। রাজা শুকনো মুখে পুকুর পাড়ে বসে আছেন, তখন শুনলেন কে যেন বলছে—তোমার কন্যাকে পানিতে নামিয়ে দাও, জল আসবে। রাজা সোগাগীরে নামিয়ে দিলেন এবং বললেন—কোন ভয় নেই মা, জল আসতে শুরু করলেই তোমাকে টেনে তুলে ফেলবো।

মেয়ে পুকুরে নামামাত্রই চারদিক থেকে হু হু করে জল আসতে লাগলো। রাজা তাকে আর টেনে তুলতে পারলেন না। পুকুরটির নাম হলো সোহাগী পুকুর। জায়গাটার নাম হলো সোহাগী।

যান, এটা সত্যি না। বানিয়ে বানিয়ে বলছেন।

বানাব কেন? সোহাগী পুকুর সত্যি সত্যি আছে। জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবে। আর তুমি যদি ভরা পূর্ণিমার রাতে পুকুর পাড়ে বসে থাক তাহলে সোগাগীর কান্নাও শুনবে। ঐ মেয়েটি ভরা পূর্ণিমায় কাঁদে।

কেন?

পূর্ণিমার রাতে সে পুকুরে নেমেছিলো তাই। প্রতি পূর্ণিমাতেই সে আসে।

দিলু অন্য দিকে মুখ ফেরালো। তার চোখ ভিজে আসছে। তার খুব অল্পতেই কান্না পায়।

 

নিশাত দেখলো—ওরা লোহার গেট পার হয়ে স্টেশনের ওপাশের কাঁচা রাস্তায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। জামিল ভাই গল্প করছেন হাত নেড়ে নেড়ে। কি গল্প কে জানে। মুগ্ধ হয়ে শুনছে দিলু। দিলুকে আজ অন্যদিনের চেয়েও একটু বড় লাগছে। এত বড় মেয়ের স্কার্ট পরা ঠিক না। চোখে লাগে। মাকে বলতে হবে।

লোকজন বিশেষ নেই চারদিকে। শুধু একজন বুড়ো খুব মন দিয়ে নিশাতকে দেখছে। এই প্রচণ্ড শীতেও তার গায়ে শুধু একটা গেঞ্জি। নিশাত প্রথমে ভেবেছিলো ভিক্ষা চায় বুঝি। কিন্তু না, এ ভিক্ষুক নয়। ভিক্ষুকদের এতটা কৌতূহল থাকে না। তারা সরাসরি ভিক্ষা চায়। না পেলে চলে যায় অন্য কোথাও।

নিশাতের নাক দিয়ে জল পড়তে শুরু করেছে। দু’টি প্যারাসিটামল খেয়ে নেয়া দরকার। নিশাত উঠে দাঁড়ালো। বুড়োটি বললো—কই যাইবেন গো মা? আশ্চর্য, কত সহজেই মা ডাকলো। প্রশ্ন করতেও কোন সংকোচ নেই। যেন কতদিনের চেনা।

আমরা যাব নীলগঞ্জ।

ডাকবাংলোয়?

জ্বি।

নিশাত চলতে শুরু করলো। তার পিছনে পিছনে গেঞ্জি গায়ে বুড়োটি আসছে। আরো কিছু জানতে চায় হয়তো। গ্রামের মানুষদের খুব কৌতূহল। ওরা প্রশ্ন করতে ভালবাসে।

 

জামিল একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালো। দিলু বললো—এখানে চা খাবেন? যা ময়লা। জামিল বললো—গ্রামে ঝকঝকে তকতকে রেস্টুরেণ্ট কোথায়? এটা মন্দ কি।

বার তের বছরের একটা ছেলে চা বানাচ্ছিলো। তার সামনে কাঠের একটা লম্বা বেঞ্চে রোদে পিঠ মেলে দু’জন লোক বসে চা খাচ্ছে। তাদের একজন বললো “আপনেরা যাইবেন কোনখানে?”

নীলগঞ্জ।

ওরে ব্যাস মেলা দূর। যাইবেন ক্যামনে?

জীপ আসার কথা।

রাস্তা তো ঠিক নাই। জীপগাড়ি আওনের পথ নাই।

তাই নাকি?

জ্বি। এইজন কি আপনের মাইয়া?

না আমার বোন।

দিলু দেখলো দু’টি লোকই গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছে। তার বড় অস্বস্তি লাগতে লাগলো। জামিল ভাই এই বেঞ্চে বসেই চা খাবেন নাকি? লোক দু’টির কৌতূহলের সীমা নেই। একজন বললো—সাব আপনের নাম?

আমার নাম জামিল

আপনে করেন কি?

মাস্টারি করি ভাই। দেখি, একটু বসার জায়গা দেন।

দিলু অবাক হয়ে দেখলো ওরা সবাই বেঞ্চি ছেড়ে দিয়ে মাটিতে বসলো। আগের মতই তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে। এতটুকু সংকোচ নেই। জামিল বললো—দেখি, দু’কাপ চা দাও তো। দিলু খাবি তো?

খাব।

লোক দু’জনের একজন বললো—বজলু, সাবরে আর মাইয়াডারে কুকি বিসকুট দে। খালি পেডে চা খাওন ঠিক না। ছেলেটি দু’টি লম্বা বিসকিট হাতে করে এগিয়ে দিলো। দিলু নিলো না কিন্তু জামিল নিলো এবং চায়ে ভিজিয়ে বাচ্চাদের মত খেতে লাগলো। কি যে সব কাণ্ড জামিল ভাইয়ের। দেখতে বড় মজা লাগে।

আমার আছে জল – ০৩য় পরিচ্ছেদ

রেহানা বাবুকে নিয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলো সাব্বির। সাব্বির তাঁর দূর-সম্পর্কের ভাগ্নে। সাব্বিরে এখানে আসার কথা ছিলো না। হঠাৎ করেই এসেছে। এই হঠাৎ করে আসার অন্য কোন অর্থ আছে কিনা রেহানা তা বুঝতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সাব্বির ছেলেটি হয় খুব চাপা কিংবা অতিরিক্ত চালাক। তার হাবভাব কিছুই বোঝার উপায় নেই।

রেহানার ধারণা ছিল ট্রেনে সাব্বির নিশাতের আশেপাশে বসতে চেষ্টা করবে। এবং গল্পটল্প করবে। সে তেমন কিছু করেনি। বসেছে কোণার দিকে। কিছুক্ষণ অত্যন্ত মন দিয়ে কমিক পড়েছে। ত্রিশ-বত্রিশ বৎসর বয়সের একজন মানুষ মুগ্ধ হয়ে কমিক পড়ছে, ব্যাপারটা তার ভালো লাগেনি। কমিক শেষ হওয়া মাত্র সে জানালায় হেলান দিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করেছে কিংবা ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশাতের দিকে তার কোন রকম আগ্রহ বোঝা যায়নি। তবে এও হতে পারে যে, সে চেষ্টা করে তার আগ্রহ গোপন রাখছে। নিশাতকে তার ভাল রকম জানতে চায়।

আজ ভোরে তিনি দেখলেন সাব্বির ক্যামেরা হাতে একা একা যাচ্ছে। বাবুকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজেও এগুলেন। অল্প কিছু কথাবার্তা হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেন—দেশে কতদিন থাকবে?

বেশী দিন না। খৃসমাসের ছুটির পর যাব। জানুয়ারির তিন-চার তারিখের মধ্যে পৌঁছতে হবে।

তাহলে তো খুব অল্প দিন।

জ্বি।

রেহানা ইতস্ততঃ করে বলেই ফেললেন—বিয়ে করে বিয় নিয়ে ফিরবে নাকি? অনেকে তো তাই করে।

এখনো কিছু ঠিক করিনি। আমার মা অবশ্যি মেয়ে-টেয়ে দেখছেন। বিয়ে করতেও পারি।

রেহানা কিছু বললেন না। দেখলেন সাব্বির ক্রমাগত ছবি তুলছে। গাছের ছবি। নদীর ছবি। নৌকার ছবি। কুয়াশায় সব ঝাপসা দেখাচ্ছে। ভাল ছবি আসার কথা নয়। তবু ছবি তুলছে। রেহানা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলেন—এই ছেলেটি অত যে ছবি তুলছে, একবারও বলেনি—আসুন মামী, আপনার একটা ছবি তুলে দেই। এই বয়সে ছবি তোলার তাঁর কোন শখ নেই। তবুও এটা সাধারণ ভদ্রতা। সাব্বির বললো—আপনার নাতি খুব শান্ত। খুব চুপচাপ।

খুব শান্ত না। বিরক্ত করে। নতুন জায়গা দেখে চুপ করে আছে। অপরিচিত মানুষের সামনে সে ভেজা বেড়াল।

ওর বয়স কত?

পাঁচ বছরে পড়লো।

রেহানা আশা করেছিলেন সাব্বির এবার বাবুর সম্পর্কে কিছু বলবে। কিন্তু সে কিছুই বললো না। অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে একটা বকের ছবি ফোকাসে আনতে চেষ্টা করলো। টেলিস্কোপিক লেন্স থাকা সত্ত্বেও বকের ছবিটি স্পষ্ট হচ্ছে না। বেশ কুয়াশা। মোটামুটি স্পষ্ট হলে ছবিটি ভালো হতো। বকের ধ্যানী ছবিটি হালকা সবুজের ব্যাকগ্রাউণ্ডে ভালো আসছে। রোদ আরেকটু চড়ে গেলে ছবি ভালো হবে না।

সাব্বির, চল যাই। তোমার মামা বোধ হয় রেগে যাচ্ছেন।

চলুন।

বাবুকে কোলে নিয়ে হাঁটতে তার কষ্ট হচ্ছে। একবার বললেন—বাবু, আমার হাত ধরে হেঁটে হেঁটে চলো। বাবু শক্ত করে তাঁর গলা চেপে ধরলো। তার মানে সে কিছুতেই নামবে না। রেহানা আশা করেছিলেন সাব্বির বললে—আমার কোলে দিন। আমি নিয়ে যাব। কিন্তু সাব্বির সে সব কিছুই বললো না। লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলো। মেয়েদের সঙ্গে এত দ্রুত হাঁটা যায় না। এই সাধারণ ভদ্রতাজ্ঞানও কি ওর নেই? রেহানা মনে মনে বেশ বিরক্ত হলেন।

স্টেশনের কাছে এসে তিনি দিলু এবং জামিলকে দেখলেন। নোংরা একটি বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছে। তাদেরকে ঘিরে চার-পাঁচ জন গ্রামের মানুষ বসে আছে মাটিতে। দিলু স্কার্ট পরে থাকায় তার ফর্সা পা অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। দৃশ্যটি তার ভালো লাগলো না। গ্রামের মানুষগুলি বোধ করি বসে আছে ফর্সা পা দেখার জন্য। তিনি একবার ভাবলেন দিলুকে ডাকবেন। কিন্তু সেটা বোধ হয় ঠিক হবে না। দিলুর জামা-কাপড় কি কি এনেছেন সেটা ভাবতে চেষ্টা করলেন। মনে পড়লো না। জামা-কাপড় সব গুছিয়েছে নিশাত, তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

দিলু তাদের দেখেই ডাকলো—মা, কোথায় ছিলে তোমরা? তারপর ছুটে এলো তাদের দিকে।

আমরা ভাবলাম তোমরা বোধ হয় হারিয়েই গেছো।

হারিয়ে যাবো কেন? নে বাবুকে কোলে নে।

দিলু বাবুকে কোলে নিয়েই বললো—সাব্বির ভাই, আমাদের একটা ছবি তুলে দিনতো। এই বাবু, উনার দিকে তাকিয়ে হাসতো লক্ষ্মী ছেলের মত। সাব্বির ক্যামেরা ঠিকঠাক করতে লাগলো। এবং ছবি তুললো বেশ কয়েকটি। রেহানার মনে হলো এই একটি ব্যাপারে ছেলেটির আগ্রহ আছে। ছবি তোলায় তার কোন ক্লান্তি নেই।

 

ওসমান সাহেব ভেবে রেখেছিলেন রেহানার উপর খুব রাগ করবেন। সেটা সম্ভব হলো না। সাব্বির রয়েছে। তার সামনে সিন ক্রিয়েট করার প্রশ্নই ওঠে না। তবুও বিরক্ত স্বরে বললেন—তোমরা ছিলে কোথায়?

কাছেই। তোমার জীপ তো এখনো আসেনি। এত তাড়া কিসের?

জীপ আসবে না। নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। গরুর গাড়ী নিয়ে এসেছে।

গরুর গাড়ী?

দু’টা গরুর গাড়ী একটা মহিষের গাড়ী। তাড়াতাড়ি রওনা হওয়া দরকার। পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হবে।

রেহানা অবাক হয়ে বললেন—তিনটা গাড়ী কেন?

পাগল-ছাগলের কাণ্ড। যতগুলি পেয়েছে, নিয়ে এসেছে।

তোমার পুলিশের লোকজন কেউ আসেনি?

না।

ওসমান সাহেবের মনে হলো রেহানা মুখ টিপে হাসছে। কেউ নিতে আসেনি ব্যাপারটা দুঃখজনক। এ নিয়ে হাসবে কেন? রেহানা বললেন—তোমার খবর বোধ হয় পায়নি। পেলে আসত।

ওয়ারলেস ম্যাসেজ দিয়েছি। পাবে না মানে?

তোমাদের নীলগঞ্জ থানায় হয়তো ওয়ারলেস নেই।

প্রতিটি থানায় ওয়ারলেস সেটা আছে। কি বলছ এসব?

দিলু বললো—বাবা, আমি কিন্তু মহিষের গাড়িতে করে যাব।

ওসমান সাহেব একটা ধমক দিতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করে বের হয়েছেন ছুটির সময়টায় কোন রাগারাগি করলেন না।

কিন্তু মেজাজ ঠিক রাখা যাচ্ছে না। কেন কেউ নিতে আসবে না? থানাওয়ালাদের এত বড় স্পর্ধা থাকা ঠিক নয়।

আমার আছে জল – ০৪র্থ পরিচ্ছেদ

গাড়িতে গুছিয়ে বসতে বসতে ন’টা বেজে গেলো। প্রথম কথা হয়েছিলো একটিতে যাবে শুধু মালপত্র। অন্য দু’টির একটিতে জামিল ও সাব্বির এবং আরেকটিতে দিলুরা। কিন্তু নিশাত বললো, আমি মা, বাবুকে নিয়ে একটি গাড়িতে একা যেতে চাই।

কেন?

কোন কেন-টেন নেই। এমনি যেতে চাই।

সব সময় তুই একটা ঝামেলা করতে চেষ্টা করিস।

ঝামেলা করতে চেষ্টা করি না। কমাতে চেষ্টা করি। আমি মা একা যেতে চাই।

নিশাত শেষ পর্যন্ত অবশ্যি একা একা গাড়িতে উঠেনি। রেহানা উঠেছেন তার সঙ্গে। প্রথম গাড়িটিতে বাবা, দিলু ও বাবু। মহিষের গাড়িটিতে জামিল ও সাব্বির।

গাড়ি চলা শুরু করা মাত্রই সাব্বির মাথার নিচে একটা হ্যাণ্ড ব্যাগ দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়লো। জামিল বললো—কি, ঘুমুচ্ছেন নাকি?

হ্যাঁ। রাতে ভাল ঘুম হয়নি।

এই ঝাঁকুনিতে ঘুম হবে?

হবে। আমার অভ্যেস আছে।

ঘুমুবার আগে একটা সিগারেট খাবেন?

জ্বি না, আমি সিগারেট খাই না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সাব্বির ঘুমিয়ে পড়লো। জামিল একটা সূক্ষ্ম ঈর্ষা বোধ করলো। এত সহজে কেউ অমন ঘুমিয়ে পড়তে পারে? একা বসে থাকা ক্লান্তিকর ব্যাপার। নেমে গিয়ে প্রথম গাড়িটিতে উঠা যেতে পারে। সেখানে সিগারেট খাওয়া যাবে না এই একটা ঝামেলা। তাছাড়া সঙ্গী হিসাবে ওসমান সাহেব বেশ বোরিং হবেন বলেই তার ধারণা। লোকটির রসবোধ নেই। অফিসের বাইরে যে আরো কিছু থাকতে পারে তা খুব সম্ভব তিনি জানেন না।

এক সময় জামিলের মনে হলো এখানে আসা কি সত্যি দরকার ছিলো? মানুষ বেড়াতে যায় ফূর্তি করবার জন্য। এখানেও কি সে রকম কিছু হবে? সম্ভাবনা খুব কম। জামিল গাড়োয়ানের পাশে এসে বসলো। রাস্তায় ধুলো উড়ছে। গরুর গাড়ি খুব ধীরে চলে বলে যে ধারণা আছে সেটা ঠিক নয়। বেশ দ্রুতই চলছে। গান শুনতে শুনতে যেতে পারলে হতো। কিন্তু ক্যাসেট প্লেয়ারটি নিশাতদের সঙ্গে। ওদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে আসবে নাকি?

 

নিশাতের নাক ভার হয়ে আছে। মাথায় একটা ভোঁতা যন্ত্রণা। সে বললো—মা, তোমার কাছে প্যারাসিটামল আছে?

আছে। তোর জ্বর নাকি?

না সর্দি। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে।

রেহানা তার গায়ে হাত দিলেন—গা তো বেশ গরম। শুয়ে থাক।

শুয়ে থাকতে হবে না। তুমি দু’টি ট্যাবলেট দাও।

পানি তো নাই। পানির বোতল পেছনের গাড়িতে।

পানি লাগবে না। তুমি দাও।

রেহানা দু’টি ট্যাবলেট দিলেন। নিশাত একটুও মুখ বিকৃত করলো না। ট্যাবলেট দু’টি গিলে ফেললো।

শুয়ে থাক।

আমার শুয়ে থাকার যখন প্রয়োজন হবে আমি শুয়ে থাকব। তোমার বলতে হবে না।

তুমি এত রেগে আছিস কেন?

নিশাত মায়ের চোখে চোখ রেখে শীতল গলায় বললো—সাব্বির সাহেব আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে কেন? ঠিক করে বল তো মা।

বেড়াতে যাচ্ছে, আবার কেন? ও বাংলাদেশের অনেক ছবি তুলে নিতে চায়। আমরা গ্রামের দিকে যাচ্ছি শুনে সেও আগ্রহ করে যেতে চাইলো।

না, সে কোন আগ্রহ দেখায়নি। তুমি ঝুলাঝুলি করছিলে।

যদি করেই থাকি তাতে অসুবিধা কি? আমাদের আত্মীয়, এতদিন পর দেশে এসেছে। ঘুরে-ফিরে দেখতে চায়।

আসল ব্যাপার কিন্তু তা নয় মা।

আসল ব্যাপারটা কি শুনি?

তুমি চাচ্ছ ঐ ছেলেটি যাতে আমাকে পছন্দ করে ফেলে। এবং পুরানো দুঃখ-কষ্ট ভুলে আমি তাকে বিয়ে করে ফেলি।

যদি চেয়েই থাকি সেটা কি খুব অন্যায়?

হ্যাঁ অন্যায়। তুমি যা ভাবছ সেটা ঠিক নয়।

আমি কি ভাবছি?

তুমি ভাবছ আমার স্বামী নেই। একটা বাচ্চা আছে, কাজেই আমার একটা অবলম্বন দরকার। এটা মা ঠিক না। আমি তোমাদের বিরক্ত করব না, আমি নিজের দায়িত্ব নিজে নেব। অনেকবার তো তোমাদের বলেছি।

নিশাত দেখলো জামিল এগিয়ে আসছে। সে চুপ করে গেলো।

ক্যাসেট প্লেয়ারটা তোমাদের কাছে?

 

জ্বি না, দিলুর কাছে।

জামিল এগিয়ে গেলো। সামনের গাড়িটি অনেক দূর চলে গেছে। নিশাত দেখলো জামিল দৌড়াতে শুরু করেছে। এই দৃশ্যটি তার কেন জানি ভালো লাগলো। রেহানা বললেন—জামিলকে বলে দে পানির বোতলটা নিয়ে যাক।

কেন?

অষুধ খেয়ে তোর মুখ তেতো হয়ে আছে না?

মা, আমার জন্যে তোমাকে এত ভাবতে হবে না।

 

দিলু ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছিলো। ওসমান সাহেব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন তিনি দিলুর কথা বেশ মন দিয়ে শুনছেন এবং তাঁর ভালোই লাগছে।

সোগাগী নাম কেমন করে হয়েছে শুনবে বাবা?

বল শুনি।

আমার দিকে তাকাও বলছি। অন্যদিকে তাকিয়ে আছ কেন?

ওসমান সাহেব মেয়ের দিকে তাকালেন। দিলু হাত নেড়ে নেড়ে গল্পটা বললো। ওসমান সাহেব বললেন—এই জাতীয় মীথ প্রায় সব পুকুর সম্পর্কেই থাকে। এটা ঠিক নয়। একটা নির্দিষ্ট গভীরতায় মাটি কাটলেই পানি আসবে। শীতের সময় যদি নাও আসে বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি ভরে যাবে। দিলুর মন খারাপ হলো। গল্পটা তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ওসমান সাহেব বললেন—রাজার মেয়ের নাম সোহাগী এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়।

বিশ্বাসযোগ্য নয় কেন?

রাজাদের মেয়ের এমন সাধারণ নাম থাকে না। ওদের গালভরা নাম থাকে। ফুলকুমার, রূপকুমারী, নূরজাহান, নূরমহল।

দিলুর মন বেশ খারাপ হলো। সে মুখ ফিরিয়ে বাইরে তাকালো এবং অবাক হয়ে দেখলো জামিল ভাই আসছেন।

ক্যাসেট প্লেয়ারটা তোর কাছে?

হ্যাঁ।

ওটা নিতে এসেছি।

জামিল গরুর গাড়ীর পেছনে পা ঝুলিয়ে বসলো।

দিলু, ভালো দেখে কয়টা ক্যাসেট দে।

রবীন্দ্র সঙ্গীত?

না হিন্দী-ফিন্দী।

দিলু ক্যাসেট বাছতে বাছতে বললো—বাবা কিন্তু সোহাগী পুকুরের গল্পটা বিশ্বাস করেন নি। বাবা বলছেন মাটি কিছু দূর খুঁড়লেই পানি আসবে।

এটা ঠিক নয়। ঢাকা আর্ট কলেজে একটা বিরাট পুকুর আছে। খুব গভীর। বর্ষাকালে পর্যন্ত সেখানে এক ফোঁটা পানি থাকে না।

সত্যি?

হ্যাঁ। এবং অমাবশ্যা-পূর্ণিয়ায় কেউ যদি সেই পুকুরে নামে তাহলে খিলখিল হাসির শব্দ শোনে।

ওসমান সাহেব পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বললেন—জামিল, সত্যি নাকি?

পুকুরে পানি নেই বর্ষাকালেও এটা সত্যি, আমি নিজে দেখেছি। তবে হাসির কথাটা জানি না, ওটা বানানোও হতে পারে।

দিলু বললো—আমাকে ঐ পুকুরটা দেখাবেন?

একদিন গিয়ে দেখে এলেই হয়। তোদের বাসার কাছেই তো।

জামিল ক্যাসেট প্লেয়ার নিয়ে নেমে গেলো। দিলু বললো—জামিল ভাই অনেক কিছু জানে। ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না।

জামিল ভাই, আমাকে একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করেছিলো, সেটা দারুণ মজার, তোমাকে জিজ্ঞেস করব?

কর।

আচ্ছা মনে কর তোমার কাছে দশ সের পানি দেয়া হলো। এখন তুমি কি পারবে এই দশ সের পানি একবার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে। বালতি টালতি কিছু ব্যবহার করতে পারবে না। শুধু হাত দিয়ে নেবে এবং একবারে নেবে।

ওসমান সাহেব ভ্রু কুঁচকে ভাবতে লাগলেন। দিলু মিটি মিটি হাসতে হাসতে বললো—খুব সহজ বাবা। চেষ্টা করলেই পারবে। একটু হিন্টস দেব?

না হিন্টস দিতে হবে না।

ওসমান সাহেব সত্যিই গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করলেন।

 

জামিল নিজের গাড়িতে ফিরে এসে দেখে সাব্বির উঠে বসেছে। ক্যামেরা নিয়ে কি সব যেন করছে।

কি ঘুম হয়ে গেলো?

হ্যাঁ।

কি করছেন?

একটা ব্লু ফিল্টার লাগাচ্ছি।

ব্লু ফিল্টার দিয়ে কি হয়?

দিনের বেলা ছবি তুললে মনে হয় জ্যোৎস্না রাত্রিরে ছবি তোলা হয়েছে।

আপনি নিজে তো একজন ইন্‌জিনিয়ার?

জ্বি।

আপনাকে দেখে মনে হয় ছবি তোলাই আপনার একমাত্র কাজ।

এটা আমার একটা হবি।

খুব বড় ধরনের হবি মনে হচ্ছে?

সাব্বির শান্ত স্বরে বললো—আমি কিন্তু খুব নামকরা ফটোগ্রাফার। আমার নিজের তোলা ছবি নিয়ে আমেরিকান এক পাবলিশার একটি বই বের করেছে, নাম হচ্ছে—অন দি টপ অব দি ওয়ার্লড।

আপনার কাছে কপি আছে?

আছে, দিচ্ছি।

সাব্বির আহমেদ তিনশ পৃষ্ঠার একটি বই বের করলো তার স্যুটকেস থেকে। জামিলের বিস্ময়ের সীমা রইলো না।

এই বইটির কথা কি দিলুরা জানে?

না। নিজের কথা বলতে ভাল লাগে না।

সাব্বির ছবি তুলতে শুরু করলো। ক্যামেরার শাটার পড়ছে। কোন কিছু যে সে দেখছে মন দিয়ে তা মনে হচ্ছে না।

একটা গ্রাম্য বধু লম্বা ঘোমটা মাথায় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাটার পড়তে লাগলো ঘটাঘট।

ছাগলের গলার দড়ি ধরে একটা আট-ন’ বছরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। ঘটাঘট শাটার পড়তে শুরু করলো। জামিল বললো—এই ছবিটা আপনার ভাল হবে না। জোছনা রাতে কেউ ছাগল চড়াতে বের হয় না। আপনি বরং ব্লু-ফিল্টার বদলে নিন।

সাব্বির হালকা গলায় বললো—উল্টোটাও হতে পারে। ছবি দেখে মনে হতে পারে রাতের রহস্যময়তায় মুগ্ধ হয়ে একটা শিশু তার পোষা প্রাণীটি নিয়ে বের হয়েছে। দু’জনের চোখেই বিস্ময় ও ভয়, তাদের ঘিরে আছে জোছনা।

আপনি কি ফটোগ্রাফার না কবি?

আমি একজন ইন্‌জিনিয়ার।

জামিল বইটির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বললো—আপনার এই বইটিতে তো মানুষের কোন ছবি নেই। শুধুই জড়বস্তুর ছবি। মানুষের ছবি বেশী তোলেন না?

আমার অন্য একটি বইয়ে মানুষের ছবি আছে। সবই অবশ্যি ‘নূড’ ছবি।

বইটি আছে?

আছে।

আমেরিকায় আপনি কতদিন ধরে আছেন?

প্রায় এগারো বছর।

দেশে ফিরবেন না?

না।

কেন?

থাকবার জন্য ঐ জায়গাটি ভালো। বিশাল দেশ ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার সুযোগ। এরকম পাওয়া চায় না। তাছাড়া…।

তা ছাড়া কি?

সাব্বির কথা শেষ করলো না। মাঠের দিকে চোখ ফিরিয়ে বললো—এগুলি সর্ষে ফুল না? হলুদ রঙের কি চমৎকার ভেরিয়েসন।

আমার আছে জল – ০৫ম পরিচ্ছেদ

তারা নীলগঞ্জে ডাকবাংলোয় এসে পৌঁছলো বিকেল চারটার দিকে, তখন আলো নরম হয়ে এসেছে। শীতের উত্তরী হাওয়া বইছে।

ডাকবাংলোটি চমৎকার। ফিসারিজের বাংলো। হাফ বিল্ডিং। উপরের ছাদ টালীর, মন্দিরের গম্বুজের মত উঁচু হয়ে গেছে। বাড়ি যত বড় তার চেয়েও বড় তার বারান্দা। সেখানে কালো একটি গোল টেবিলের চারপাশে গোটাপাঁচেক ইজিচেয়ার। দেখলেই শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। বাড়িটির চারপাশে রেণ্টি (রেইন ট্রি) গাছ। বিকেল বেলাতেই বাড়িটিকে অন্ধকার করে ফেলেছে। পেছনে বেশ বড়সড় একটা পুকুর। কাকের চোখের মত জল।

রেহানা অবাক হয়ে বললেন—এই জঙ্গলে এত চমৎকার বাড়ি গভর্ণমেণ্ট কেন বানিয়েছে? ওসমান সাহেব নিজেও হকচকিয়ে গেছেন। এদিকে তাঁর প্রথম আসা। খোঁজ-খবর এসেছে জামিলের কাছ থেকে। জামিল, এই ডাকবাংলো তৈরী হয় কবে?

এটা সুসং দুর্গাপুরের মহারাজার শিকার বাড়ি। পরের সরকার নিয়ে নেয়। এখন ফিসারিজ ডিপার্টমেণ্টের হাতে দেয়া হয়েছে। আগে আরো সুন্দর ছিলো।

এরচে সুন্দর আর কি হবে?

একটা কাঁচঘর ছিলো। গোটা ঘরটাই কাঁচের তৈরী। লোকজন কাঁচটাচ সব নিয়ে গেছে। অনেক ঝাড় লণ্ঠন ছিলো। বড় বড় অফিসার একেকজন এসেছেন, একেকটা করে নিয়ে গেছেন। পেছনের পুকুরের ঘাটে মার্বেল পাথরের একটা দেবশিশু ছিলো ঢাকা মিউজিয়াম নিয়ে গেছে।

তুমি এতো কিছু জান কিভাবে?

আমি তো এখানে প্রায়ই আসি।

দিলু বললো—বাবা আমি একটা একটা ঘরে থাকব। ওসমান সাহেব উত্তর দিলেন না। জামিল বললো—তা পারবি না দিলু—সব পুরনো ডাকবাংলোয় ভূত থাকে।

আপনাকে বলেছে।

সন্ধ্যা হলেই টের পাবি। সন্ধায় নামুক। তখন দেখা যাবে।

 

বাবুর্চি আছে দু’জন। তারা রান্নাবান্না সেরে ফেলেছে। খাবার ঘরে খাবার দিতে শুরু করেছে। খাবার ঘরটা তুলনামূলকভাবে অন্ধকার। একটা হ্যাজাক বাতি জ্বালানো হয়েছে। সবাই হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছে শুধু নিশাত নেই। রেহানা খোঁজ নিতে গেলেন। নিশাত শুয়েছিলো। সে ক্লান্তগলায় বললো—আমি কিছু খাব না।

কেন খাবি না?

খেতে ইচ্ছে করছে না, তাই খাব না।

সারা দিন তো কিছুই মুখে তুলিসনি। কিছু মুখে দে।

আমি গোসল না করে কিছু মুখে দেব না। আমার গা ঘিনঘিন করছে।

জ্বর গায়ে গোসল করবি কি!

প্লীজ মা, আমার ব্যাপারের নাক গলিও না। বাবুকে খাওয়াও। তোমরা খাওয়া-দাওয়া কর।

রেহানা মুখ কালো করে বের হয়ে এলেন। দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল করলো নিশাত। ঠাণ্ডা পানি। গায়ে জ্বর থাকার জন্যে পানি বরফ শীতল মনে হচ্ছে। তবু ভালো লাগছে। ঝকঝকে বাথরুম। পেতলের বালতিতে পরিষ্কার জল। মোড়ক খোলা নতুন সাবান।

নিশাত যখন বেরিয়ে এলো তখন সত্যি সত্যি অন্ধকার নেমে এসেছে। নিশাত একটি ফুলহাতা সোয়েটার গায়ে দিলো। উঁকি দিলো মায়ের ঘরে। বাবু অবেলায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। আজ সারাদিন বাবুর সঙ্গে তার কোন কথাবার্তা হয়নি। বাবু কি ক্রমেই তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? রাতে সে এখন তার সঙ্গে ঘুমায় না। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে—দাদীর কাছে যাব। রেহানাকে সে দাদী বলে। কেন বলে কে জানে!

নিশাত বললো—ও কি কিছু খেয়েছে?

ভাত মুখে দেয়নি। দুধ খেয়েছে।

নিশাত নিচু হয়ে ছেলের কপালে চুমু খেলো। রেহানা বললেন—কিছু খাবি মা?

না। চা খাব এক কাপ।

বস তুই এখানে। আমি চায়ের কথা বলে আসি। মশারি খাটানোর কথাও বলতে হবে। খুব মশা এদিকে।

দরজায় কার যেন ছায়া পড়েছে। নিশাত মুখ তুলে দেখলো জামিল ভাই।

নিশাত, তোমার নাকি জ্বর?

ব্যস্ত হবার মত কিছু না।

ব্যস্ত হইনি নিশাত, খোঁজ নিচ্ছি। খোঁজ নেয়াটা অপরাধ নয় নিশ্চয়ই।

আমি ভাল আছি।

জামিল ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস গোপন করলো। চলে যেতে চাইলো। নিশাত বললো—আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে জামিল ভাই।

বল।

আপনি বারান্দায় বসুন, আমি আসছি।

ঝগড়া করবে মনে হচ্ছে।

নিশাত জবাব দিলো না। বাবুর গালে একটা মশা বসেছিল। হাত দিয়ে সেটিকে উড়িয়ে দিলো। ছেলেটিকে বড় রোগা রোগা লাগছে। এই ক’দিন ওর দিকে একটুও নজর দেয়া হয়নি। নিশাতের মনে হলো সে ক্রমের দূরে সরে যাচ্ছে। বাবু এখন আর মা’র জন্যে খুব ব্যস্ত নয়। শিশুরা অবহেলা খুব সহজেই টের পায়। নিশাত বাবুর চুলে হাত রাখলো। পাতলা লালচে ধরনের চুল। বাবার মত। কবিরের চেহারার সঙ্গে বাবুর খুব বেশী মিল নেই। কবিরের নাক ছিল খাড়া, বাবুর তা নয়। সে হয়েছে মা’র মত। নিশাত নিচু হয়ে বাবুর ঠোঁটে চুমু খেলো। কেমন দুধ দুধ গন্ধ। নিশাত আবার নিচু হলো। বাবু ঘুমের মধ্যেই তাকে হাত দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো।

 

বারান্দা অন্ধকার। এখানে কোন বাতি দিয়ে যায়নি। জামিল বসে ছিলো একা। নিশাত এসে ঢুকতেই সে সোজা হয়ে বসলো—হালকা গলায় বললো—ভেতরে বসলেই হতো, এখানে বড় হাওয়া।

থাকুক হাওয়া। বারান্দাই ভালো।

আলো দিতে বলব?

জামিল একটা সিগারেট ধরালো। সহজভাবে বললো—বল কি বলবে?

আপনি আমাদের এই বাংলোয় কেন নিয়ে এসেছেন?

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, তুমি কি মিন করছ।

আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন। এখন ভান করছেন বুঝতে পারছেন না।

দেখো নিশাত। আমি ভান করি না। ঐ একটা জিনিস আমি কখনো করি না।

তাহলে বলুন এত ডাকবাংলো থাকতে আপনি এখানে আমাকে নিয়ে এসেছেন কেন?

নিশাত, কবির এবং আমি অনেক রাত এই ডাকবাংলোয় কাটিয়েছি। এই ডাকবাংলোর উপর ওর একটা দুর্বলতা ছিলো। আমি জানি বিয়ের পরও অনেকবার তোমাকে নিয়ে এসেখানে আসতে চেয়েছে। আসা হয়ে ওঠেনি। আমি তাই ভাবলাম এখানে এলে তোমার ভালই লাগবে।

আমি ওর সঙ্গেই এখানে আসতে চেয়েছিলাম, আর কারো সঙ্গে নয়।

ভেবে নাও ও তোমার সঙ্গেই আছে।

সব কিছু কি ভেবে নেওয়া যায়। জীবন এত সহজ মনে করেন?

জীবন সহজও নয় জটিলও নয়। জীবন জীবনের মতো। আমরাই একে জটিল করি—সহজ করি। তুমি একে ক্রমেই জটিল করছো।

নিশাত চুপ করে গেলো। জামিল হালকা সুরে বললো—দুঃখ শুধু কি তোমার একার? আমাদের সবারই দুঃখ আছে।

আপনার আবার কিসের দুঃখ? দুঃখের আপনি কি জানেন?

নিশাত উঠে দাঁড়ালো। বাবু জেগে উঠে কাঁদছে। কে একজন এসে বারান্দায় একটি হ্যারিকেন রেখে গেলো। হ্যারিকেনের আলোয় সব কেমন অদ্ভুত লাগছে।

জামিল সাহেব, আপনি যেভাবে বসে আছেন বসে থাকুন। একটা ছবি তুলব। নড়বেন না, শাটার স্পীড খুব কম।

অনেকখানি সময় নিয়ে সাব্বির ছবি তুললো।

আমার আছে জল – ০৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদ

পানি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেয়ার ধাঁধাটি ওসমান সাহেবের মাথায় ঘুরতে শুরু করেছে দুপুর থেকে। ওসমান সাহেব নিজের ওপরই বিরক্ত হচ্ছিলেন। ধাঁধার মত সামান্য একটা ব্যাপার নিয়ে এই বয়সে কেউ এমন চিন্তিত হয়ে পড়ে না। কিন্তু তিনি হচ্ছেন। এটা কি বয়সজনিত স্থবিরতা? তিনি কেমন যেন চ্যালেঞ্জ বোধ করছেন। এর মধ্যে চ্যালেঞ্জ বোধ করার কি আছে? ধাঁধার উত্তর জানতেই হবে এমন কোন কথা নেই।

তিনি পাইপ হাতে বারান্দায় এসে বসলেন। তাঁর গায়ে ভারী একটা ওভারকোট। গলায় মাফলার। তবু তাঁর শীত করতে লাগলো। বয়স! বয়স বাড়ছে। এখন একদিন একটা মাইল্ড স্ট্রোক হবে। তার লক্ষণও টের পাওয়া যাচ্ছে। ব্লাড প্রেসার বেড়েছে। ঘুম কমে গেছে। খিদে কমে গেছে। চিন্তাও পরিস্কার করতে পারছেন না। পারলে এই সহজ ধাঁধার জবাব বের করতে পারতেন। কিংবা কে জানে এটা হয়তো সহজ নয়। হয়তো জটিল।

বারান্দায় রেহানা বাবুকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। ওসমান সাহেব রেহানার ডান দিকের খালি চেয়ারটিতে বসলেন। রেহানা বললেন—নিশাতের বেশ জ্বর।

তাই নাই?

একশ’ দুই-টুই হবে।

থার্মোমিটার দিয়ে দেখেছো?

না।

তাহলে বুঝলে কিভাবে একশ’ দুই?

অনুমান করে বলছি।

অনুমান করে আমাকে কিছু বলবে না।

তুমি এরকম করছ কেন?

কি রকম করছি?

এত মেজাজ দেখাচ্ছ কেন?

মেজাজ কোথায় দেখালাম?

থানার ওসি ভদ্রলোকের সঙ্গে এমন খারাপ ব্যবহার করলে কেন?

খারাপ ব্যবহার তো করিনি। আমি বিরক্ত হয়েছি। এই বিরক্তির ব্যাপারটি তাকে জানিয়েছি। সে জানে আজ ভোরে আমি আসব কিন্তু সে স্টেশনে আসেনি। আমি ডাকবাংলোয় পৌঁছানোর পর সে এসেছে। আমাকে সে কি ভেবেছে?

তুমি কোন সরকারী ট্যুরে আসনি। তুমি ছুটি কাটাতে এসেছো। কেন সে আসবে?

সে আসবে। তার পুরো দলবল নিয়ে আসবে কারণ আমি পুলিশের আই জি।

রেহানা একবার ভাবলেন বলবেন না। শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন। এবং বললেন বেশ তীক্ষ্ণ কণ্ঠেই,–তুমি এখন আর আই জি নও। রিটায়ারমেণ্ট নিয়েছো। রিটায়ারমেণ্টের আগের পাওনা ছুটি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ। তুমি পুলিশের আই জি এটা এখন যত তাড়াতাড়ি ভুলতে পার ততই ভালো।
ওসমান সাহেবের পাইপ নিভে গেছে। নিভে যাওয়া পাইপ হাতে তিনি মূর্তির মত দীর্ঘ সময় বসে রইলেন। রেহানা শীতল স্বরে বললেন—এখন আর তোমাকে দেখামাত্র পুলিশের অফিসাররা ছুটোছুটি করবে না। এটা মানসিকভাবে একসেপ্ট করার চেষ্টা কর। তোমার জন্যেও ভাল। আমাদের সবার জন্যেও ভালো। ওসমান সাহেব জবাব দিলেন না। দূরের রেণ্ট্রি গাছগুলির দিকে তাকিয়ে রইলেন। রেহানার মনে হলো এই কথাগুলি হয়ত না বললেও চলতো। তিনি গলার স্বর স্বাভাবিক করতে করতে বললেন—চা খাবে?

না।

শীতের মধ্যে ভাল লাগবে।

আমাকে এক ঢোক হুইস্কি দিতে বল।

হুইস্কি এখানে কোথায় পাবে?

আছে, আলিম নিয়ে এসেছে। আলিমকে বল।

আলিম ওসমান সাহেবের বাসায় গত বিশ বৎসর ধরে আছে। তার বয়স ওসমান সাহেবের চেয়েও বেশী কিন্তু গৃহভৃত্যদের কোন পেনসনের ব্যবস্থা নেই, কাজেই তাকে একদিন আগেই রান্নার কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নীলগঞ্জে আসতে হয়েছে। আজ প্রচণ্ড দাঁতব্যথা থাকা সত্বেও সারাদিন রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। রেহানা বললেন—আলিম শুয়ে আছে। ওর শরীর ভাল না। তাছাড়া এখানে এসব করতে পারবে না।

কেন, এখানে অসুবিধা কি?

অসুবিধা আছে। ঘরে তুমি যা কর, তাই বলে বাইরে এসেও করবে?

রেহানা, এখানে ছুটি কাটাতে এসেছি। রিলাক্স করতে এসেছি।

তুমি একা আসনি। তোমার সঙ্গে বাইরের মানুষ আছে।

বাইরের মানুষ এখানে কেউ না। জামিল ঘরের ছেলে, সে আমার অভ্যাস জানে আর সাব্বির এগারো বছর ধরে বাইরে আছে।

আমি তোমাকে এখন মদ খেতে দেব না।

রেহানা বাবুকে কোলে নিয়ে উঠে গেলেন। যাবার সময় হ্যারিকেন হাতে করে তুলে নিয়ে গেলেন। ওসমান সাহেব অন্ধকার বারান্দায় একা একা বসে রইলেন। এখানে মশা আছে। বন্য মশা। মানুষ কামড়িয়ে অভ্যেস নেই বোধ হয়। কামড়াচ্ছে না, শুধু বিরক্ত করছে। ওসমান সাহেব আবার ধাঁধা নিয়ে ভাবতে বসলেন। পানি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিতে হবে। শুধু হাতে নিতে হবে এবং একবারে নিতে হবে। কোন মানে হয়?

বাবা, তুমি অন্ধকারে বসে কি করছ?

দিলু ঢুকলো। ওসমান সাহেব মিষ্টি একটা গন্ধ পেলেন। দিলু পাউডার মেখেছে কিংবা সেন্ট-টেন্ট দিয়েছে। গন্ধটা হালকা এবং চেনা। পরিচিত কোন ফুলের গন্ধ। কি ফুল ওসমান সাহেব সেটা মনে করতে পারলেন না। অনেকদিন সচেতনভাবে কোন ফুলের গন্ধ নেয়া হয় নি। দিলু তার পাশের চেয়ারে বসলো এবং আবার বললো—অন্ধকারে একা একা বসে কি করছ?

তোর সমস্যা নিয়ে ভাবছি।

আমার? আমার আবার কি সমস্যা?

দিলু বেশ অবাক হলো। ওসমান সাহেব নরম গলায় বললেন—ঐ যে পানি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেবার ব্যাপারটা।

ও আল্লা, তুমি এটা নিয়ে এখনো ভাবছ?

হ্যাঁ, ভাবছি।

বলে দেব?

না বলিস না। নিজেই বের করব।

আরেকটা সহজ ধাঁধা ধরব? জামিল ভাইয়ের কাছ থেকে শিখেছি। দারুণ মজার।

না, আর না। যেটা দিয়েছিস সেটাই আগে সল্‌ভ করি।

দিলু হাসলো খিলখিল করে।

হাসছিস কেন?

বলা যাবে না।

মা আলিমকে একটু আসতে বল।

আমি পারব না বাবা।

পারবি নে কেন?

কি অন্ধকার দেখছো না? ভয় ভয় লাগে। বাবা!

কি?

একটা ভূতের গল্প শুনবে। সত্যি গল্প। জামিল ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি। উনার নিজের লাইফের ঘটনা।

ওসমান সাহেব কিছু বললেন না। পাইল ধরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। খুব হাওয়া দেশলাইয়ের কাঠি নিভে নিভে যাচ্ছে।

বাবা বলব?

বল।

দিলু তার বাবার কাছে ঘেঁষে এলো। একটা হাত রাখলো বাবার হাতে। গলার স্বর নিচু করে গল্প শুরু করলো।

বুঝলে বাবা, তখন শ্রাবণ মাস। জামিল ভাই গিয়েছেন তার বন্ধুর বাড়ি। গ্রামের দোতলা বাড়ি। জামিল ভাইকে যে ঘরটায় থাকতে দেয়া হয়েছে তার জানালাগুলো খুব ছোট ছোট। বাবা শুনছ তো?

শুনছি।

তাহলে হুঁ বলবে একটু পর পর। না বললে মনে হবে গল্প শুনছ না।

ঠিক আছে বলব। তারপর কি হলো?

মাঝখানে হঠাৎ খুব ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো। ঘরে হ্যারিকেন ছিলো, হ্যারিকেনটা গেলো নিভে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যায় না।

তারপর?

তারপর হলো কি শুন। কে যেন দরজায় ধাক্কা দিতে লাগলো। জামিল ভাই বললেন—কে? একজন মেয়েমানুষের গলা শোনা গেলো—দয়া করে দরজা খুলুন।

তারপর কি হলো?

জামিল ভাই দরজা খুলতেই ঘরে একটা মেয়ে ঢুকলো সতেরো-আঠারো বছর বয়স। বাইরে এত ঝড়-বৃষ্টি কিন্তু মেয়েটি খটখটে শুকনো।

ওসমান সাহেব বললেন—ঘুটঘুটে অন্ধকারে জামিল কি করে দেখলো মেয়েটি শুকনো এবং বুঝলই বা কিরে ওর বয়স সতেরো-আঠারো? দিলু থমকে গেলো। এটা সে ভাবেনি। ওসমান সাহেব হাসিমুখে বললেন—গল্পটার মধ্যে একটা ফাঁকি আছে। তাই না দিলু? দিলু জবাব দিলো না। তার একটূ মন খারাপ হয়ে গেলো। ওসমান সাহেব বললেন—গল্পটা শেষ কর।

না থাক!

থাকবে কেন? বাকিটা শুনি।

তোমাকে শুনতে হবে না।

দিলুর গলার স্বর ভারী। যেন সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। সে উঠে দাঁড়ালো।

কোথায় যাচ্ছিস?

জামিল ভাইকে কথাটা জিজ্ঞেস করে আসি।

পরে জিজ্ঞেস করলেও হবে।

না আমি এখন জিজ্ঞেস করব। কেন সে আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলবে?

গল্প তো গল্প। গল্প কখনো সত্যি হয়?

জামিল ভাই বলেছিলো এটা সত্যি গল্প।

দিলু প্রথমে গেলো খাবার ঘরে। সেখানে একজন অপরিচিত রোগা লোক হ্যাজাক লাইট ঠিক করতে চেষ্টা করছে। এক একবার দপ করে আগুন জ্বলে উঠে, লোকটি—“খাইছেরে” বলে এক লাফে পেছনে সরে। ব্যাপারটা দিলুর কাছে খুব মজার লাগলো। দিলু হাসিমুখে বললো—আপনার কি নাম?

আমার নাম বাদলা।

বাদলা আবার নাম হয়?

বাপ-মায় দিছে কি করমু কন।

তারা বোধ হয় নাম রেখেছিল বাদল।

দিলুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে হ্যাজাকটা ঠিক হয়ে গেলো—বাদলা দাঁত বের করে বললো—আফা আপনের খুব ভয়। দিলু বললো—আপনি কি জামিল ভাইকে দেখেছেন? ঐযে লম্বা। গায়ে পাঞ্জাবি আর ক্রিম কালারের চাদর।

জ্বি দেখছি।

কোথায় দেখেছেন?

এই সাব আরেকজন কোট পরা সাব বইসা আছে পুকুর ঘাটে। গফ করতাছে।

আপনি যানতো জামিল ভাইকে ডেকে নিয়ে আসুন। বলবেন—দিলু আপনাকে ডাকছে। আমার নাম দিলু। দিলশাদ থেকে দিলু।

লোকটি চলে গেলো। দিলু মুখ গম্ভীর করে বসে রইলো। রাত বেশী হয়নি। মাত্র আটটা কিন্তু মনে হচ্ছে গভীর রাত। ঝিঁঝিঁ ডাকছে চারদিকে। বাবুর কান্না শোনা যাচ্ছে। সে সারাদিন ঘুমিয়েছে কাজেই সারা রাত সে জেগে থাকবে। একটু পরে পরে কাঁদবে। মা-কে কোলে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে হবে। দিলু শুনলো মা তাকে গল্প বলার চেষ্টা করছেন। তুলা রাশি কন্যার গল্প। এই গল্পটি ছোটবেলায় সেও শুনেছে। এক রাজকন্যার ওজন মাত্র এক ছটাক। কিন্তু এক রাত্রে হঠাৎ তার ওজন বেড়ে গেলো।

কি ব্যাপার দিলু। জরুরী তলব কেন?

জামিল ভাই, আপনি আমাকে মিথ্যে কথা বললেন কেন? কেউ আমাকে মিথ্যে বললে আমার খুব খারাপ লাগে।

কোনটা মিথ্যে বলেছি বলেন তো? মিথ্যে তো আমি তেমন বলি না।

ঐ যে একটা সত্যি ভূতের গল্প বললেন—ওটা আসলে মিথ্যে ভূতের গল্প।

কোন গল্পটি?

ঐ যে বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছেন। ঝড়-বৃষ্টির সময়। ষোল-সতেরো বছরের একটা মেয়ে ঘরে ঢুকলো।

হ্যাঁ মনে পড়েছে। মিথ্যে হবে কেন? ওটা সত্যি গল্প।

না, সত্যি না। এই অন্ধকারে আপনি কি করে বুঝলেন ওর বয়স ষোল-সতেরো। ওর কাপড় ভেজা না।

জামিল গম্ভীর গলায় বললো—ঐ রাতে খুব ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিলো। ঝড়ের সময় ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায়। বিদ্যুতের আলো শহরের ইলেকট্রিকের আলোয়ে চেয়েও কড়া।

দিলু তাকিয়ে রইলো চোখ বড় করে। জামিল বললো—তবে মেয়েটির বয়সের ব্যাপারটা আমার কল্পনা। আমি নিজে তখন অল্পবয়স্ক ছিলাম, কাজেই সব মেয়ের বয়স মনে হতো ষোল-সতেরো।

দিলু কিছু বললো না।

কি এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না?

হচ্ছে। জামিল ভাই—

বল।

আরেকটা সত্যি গল্প বলেন।

আরেক দিন বলব!

জামিল ভাই, আপনি কি আমার ওপর রাগ করেছেন?

না, রাগ করব কেন?

দিলু হঠাৎ উঠে ঘর ছেড়ে চলে গেলো। জামিল হাসলো। দিলু নিশাতের মত হয়নি। সে হয়ত এখন কিছুক্ষণ কাঁদবে।

আমার আছে জল – ০৭ম পরিচ্ছেদ

রাতের খাবার দেয়া হলো ন’টার দিকে। দেখা গেলো কারোরই খাওয়ার দিকে মন নেই। শুধু সাব্বির, খাবার দেয়া হয়েছে শোনামাত্র, এসে বসেছে এবং খেতে শুরু করেছে। রেহানা বাবুকে কিছু একটা মুখে দেয়াবার জন্য আবার ঘরে এসে সাব্বিরের একা একা খাওয়ার দৃশ্যটি দেখলেন। সাব্বির ঘন ঘন পানি খাচ্ছে। রেহানা বললেন—খুব ঝাল হয়ে গেছে নাকি?

একটু হয়েছে। অসুবিধা নেই।

এরা বেশ ঝাল দেয়। আলিম রান্না করলে এটা হতো না। আলিম অসুখ হয়ে পড়ে আছে।

কি অসুখ?

দাঁতে ব্যথা।

সাব্বির গম্ভীর মুখে খেয়ে যাচ্ছে। রেহানা লক্ষ্য করলেন সে একবারও বললো না—অন্যরা কেউ খেতে আসছে না কেন? এটা একটা সাধারণ ভদ্রতা। দশ এগারো বছর বিদেশে থাকলেই কেউ অভদ্র হয়ে যায় না। বরং আরো ভদ্র হয়। সেটাই স্বাভাবিক। রেহানা বললেন—এত কিছু রান্না হয়েছে কিন্তু কেউ খেতে চাচ্ছে না। সব নষ্ট হবে।

দিলু ঘরে ঢুকলো। সে এসেছে নিশাতের জন্যে এক গ্লাস পানি নিতে। রেহানা দেখলেন, পানি ঢালতে গিয়ে সে অনেকখানি পানি টেবিলে ফেললো। মেয়েটা কাজকর্মে এত আনাড়ি হয়েছে। পানি গড়িয়ে যাচ্ছে সাব্বিরের দিকে। তাকে অল্প সরে বসতে হলো। দিলু বললো—সাব্বির ভাই আপনি এত পেটুক কনে, সবাইকে ফেলে খেতে বসেছেন।

রেহানার কপালে ভাঁজ পড়লো। মেয়েটা এমন রুচিহীন কথাবার্তা বলে। লজ্জায় পড়তে হয়।

দিলু চলে যেতেই সাব্বির বললো—আপনার এই মেয়েটিকে আমার খুব পছন্দ। ওর মধ্যে এক ধরনের সরলতা আছে।

রেহানা কিছু বললেন না। মনে মনে সাব্বিরের কথাটার অন্য কোন অর্থ হয় কিনা বুঝতে চেষ্টা করলেন। এই মেয়েটিকে তার পছন্দ এর মানে কি এই নয় যে বড় মেয়েটিকে পছন্দ নয়। বড় মেয়েটির মধ্যে সরলতা নেই। প্রথম দিকে সাব্বিরকে যতটা ভালো লেগেছিল এখন আর ততটা ভাল লাগছে না। ছেলেটি অভদ্র, অমিশুক। অবশ্যি সে অত্যন্ত সুপুরুষ। চেহারায় অন্য ধরনের কাঠিন্য আছে যা সহজেই চোখে পড়ে।

কবির এ রকম ছিলো না। কবিরের মধ্যে একটা হালকা ফূর্তির ভাব ছিলো যা কোন বয়স্ক মানুষকে ঠিক মানায় না। এটা ভাবতে ভাবতে রেহানা লজ্জিত বোধ করলেন। তিনি ঠিক এই মুহূর্তে কবিরকে অপছন্দ করার চেষ্টা করছেন। এটা অন্যায়। কবিরকে অপছন্দ করার উপায় নেই। সে এ বাড়ির সবাইকে মনমুগ্ধ করে রেখেছিলো। ওসমান সাহেব , যিনি পৃথিবীর কোন কথাই প্রায় বিশ্বাস করেন না তিনি পর্যন্ত কবিরের প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেছেন। একবার কবির এসে বললো—খবর শুনেছেন নাকি? মালয়েশিয়ায় একটা মৎস্যকন্যা ধরা পড়েছে।

কি ধরা পড়েছে?

মৎস্যকন্যা। মারমেইড। মালয়েশিয়ার ন্যাশনাল পত্রিকা বিরাট ছবি ছাপা হয়েছে। হুলস্থুল কাণ্ড!

বল কি?

অন্য কেউ এ কথা বললে ওসমান সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরাশায়ী করে ফেলতেন। কবিরের বেলায় সে রকম কিছুই হলো না। তাঁর মুখে দেখে মনে হলো তিনি বিশ্বাসও করছেন না আবার ঠিক অবিশ্বাসও করছেন না। রাতে শোবার সময় গম্ভীর মুখে স্ত্রীকে বললেন—দুনিয়ায় কত অদ্ভুত জিনিসই না হয়। রেহানা বললেন—জামাইয়ের কথার কি কোন ঠিক আছে? তুমি এটা বিশ্বাস করে আছ? ওসমান সাহেব রেগে গিয়ে বললেন—কোন কথাটা এ পর্যন্ত সে মিথ্যে বলেছে শুনি? ওসমান সাহেব কবিরের কোন বদনাম সহ্য করতে পারতেন না। এখনো পারেন না। যে লোক জীবনে কোনদিন নামাজ-রোজা করেছে বলে রেহানার মনে পড়ে না সেই লোকও দেখা যায় একুশে আগস্টে একটা জায়নামাজ টেনে বের করেন। এবং গভীর রাত পর্যন্ত টুপী মাথায় বসে থাকেন। অপরিচিত এই পোশাকে তাঁকে অদ্ভুত দেখায়। একুশে আগস্ট কবিরের মৃত্যুদিন।

পানি আনতে এতক্ষণ লাগলো?

দিলু পানি আনতে দেরী করেনি। গিয়েছে নিয়ে এসেছে। নিশাত আজ অকারণে রাগ করছে। দিলু বললো—নাও, পানি খাও।

লাগবে না যা। তৃষ্ণা মরে গেছে।

এটা কেমন কথা? তৃষ্ণা কখনো মরে যায়? তৃষ্ণা থাকেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে। দিলু নরোম স্বরে বললো—আপা খেয়ে নাও, প্লিজ। তুমি শুধু শুধু রাগ করছ। নিশাত পানির গ্লাস হাতে নিলো।

তুমি রাতেও কিছু খাবে না?

না।

কেন?

দেখছিস না আমার শরীর ভালো না।

মাথা টিপে দেব?

না, লাগবে না। তুই এখন যা।

অন্ধকারে একা একা বসে থাকবে কেন? আমিও থাকি তোমার সঙ্গে।

দিলু খাটের উপর পা উঠিয়ে বসলো। অন্ধকারে পা নামিয়ে বসতে তার ভাল লাগে না। সব সময় মনে হয় কেউ একজন খাটের নিচ থেকে চুপি চুপি এসে পা চেপে ধরবে।

 

আপা, একটা ভূতের গল্প শুনবে?

নিশাত জবাব দিলো না।

সত্যি গল্প। জামিল ভাইয়ের নিজের জীবনে ঘটেছিলো।

নিশাত তবুও চুপ করে রইলো।

এ গল্প শুনলে তুমি আর একা একা অন্ধকারে বসে থাকতে পারবে না। এবং রাতে ঘুমও আসবে না।

এত ভয়ের গল্প শুনতে চাই নে। থাক। মাথা ধরার মধ্যে গল্প শুনতে ভাল লাগে না।

আপা, তোমার মাথার চুল টেনে দেই?

দে। আস্তে আস্তে টানবি।

দিলু নিশাতের কপালে হাত দিয়েই চমকালো। বেশ জ্বর গায়ে। এতটা জ্বর তা বোঝা যায়নি।

আপা, তোমার গা তো খুব গরম।

হুঁ।

জানালা বন্ধ করে দেই, ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে।

না থাক। জানালা বন্ধ থাকলে আমার কেমন যেন লাগে। মনে হয় নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।

মশারি ফেলা নেই। মাঝে মাঝে মশা কামড়াচ্ছে। দিলু হালকা স্বরে বললো, জানো আপা, আমি কখনো মশা মারি না।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। কারণ যেসব মশা মানুষকে কামড়ায় তারা সব স্ত্রী মশা। পুরুষ মশারা কামড়ায় না। আমি নিজে মেয়ে হয়ে একটা মেয়ে মশাকে কি করে মারি বলো?

পুরুষ মশা কামড়ায় না এ কথাটা তোকে বলেছে কে?

জামিল ভাই বলেছেন।

নিশাত বিছানায় উঠে বসলো। নিচু স্বরে বললো—জামিল ভাইয়র সঙ্গে তোর এত মাখামাখি কেন? দিলু অবাক হয়ে বললো—এই কথা কেন বলছো?

সব সময় তোর মুখে জামিল ভাই। জামিল ভাই। এটা ভাল নয়। ভাল নয় কেন?

তোর বয়স কম। এই বয়সে মেয়েরা খুব সহজে নানান রকম দুঃখ কষ্ট পায়।

নিশাত চুপ করে রইলো। দিলু বললো—পরিষ্কার করে বল আপা। নিশাত কঠিন স্বরে বললো—তোর মত বয়সী মেয়েরা খুব সহজে মুগ্ধ হয়। দুঃখ-কষ্ট আসে সে জন্যেই।

তোমার কথা আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।

আমার মনে হয় তুই ঠিকই বুঝতে পারছিস। আমার যখন তোর মত বয়স ছিলো তখন তো আমি সবই বুঝতাম। তুই জামিল ভাইয়ের সঙ্গে বেশী মিশবি না।

কেন, সে কি খারাপ লোক?

না, সে খারাপ লোক না। ভাল মানুষ। বেশ ভাল মানুষ। সে জন্যেই ভয়। এক সময় তুই তাকে ভালবাসতে শুরু করবি। তোর জন্যে সেটা খুব দুঃখের ব্যাপার হবে।

দিলু দীর্ঘ সময় কোন কথাবার্তা বললো না। নিশাতের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। অন্ধকারে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু নিশাতের মনে হলো দিলু কাঁদছে।

তুই কাঁদছিস নাকি?

দিলু কোন উত্তর দিলো না। সে নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো।

চলে যাচ্ছিস?

দিলু সে কথারও কোন জবাব দিলো না। নিশাতের মনে হলো দিলুকে এসব কথা বলার কোন প্রয়োজন ছিলো না। কিন্তু এখন আর মনে করে কি লাভ? যা বলা হয়ে গেছে তা আর ফেরানোর উপায় নেই।

হ্যারিকেন হাতে রেহানা ঢুকলেন। তার কোলে ঘুমন্ত বাবু। তিনি বাবুকে বিছানায় শুইয়ে দিতে গেলেন। নিশাত বললো—ওকে তোমার কাছে রাখ মা। আমি আজ এ ঘরে একা শোব।

কেন, একা শুবি কেন?

সব প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না।

তোর শরীর ভাল নেই, একজন কেউ তোর সাথে থাকা দরকার। আমি থাকি কিংবা দিলু থাকুক।

কাউকে থাকতে হবে না।

রেহানা একটি কঠিন কথা বলতে গিয়েও বললেন না। শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলেন। সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গ তুললেন—রাতে কি খাবি?

কিছু খাব না।

খাবি না কেন? তোর রাগটা আসলে কার উপর? ঠিক করে বলতো?

কারো উপর আমার কোন রাগ-টাগ নেই। শরীর ভাল নেই তাই খাব না।

ঠিক আছে।

রেহানা চলে যাচ্ছিলেন, নিশাত বললো—দিলুকে একটু পাঠিও তো মা।

দিলু আসবে না। তুই ওকে কি বলেছিস জানি না। দিলু কাঁদছে।

কাঁদার মত আমি কিছু বলিনি।

রেহানা শীতল স্বরে বললেন—তোর কথাবার্তা শুনে আমারই কাঁদতে ইচ্ছে হয় আর ও তো বাচ্চা মেয়ে।

ও বাচ্চা মেয়ে নয়। এই বয়সে মেয়েরা বাচ্চা থাকে না।

সবাই তোর মত নয়। কেউ কেউ বাচ্চা থাকে।

এ কথার মানে কি মা?

মানে-টানে কিছু নেই। তুই নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ নিশাত। যার দুঃখে আজ এরকম করছিস তার সঙ্গে তোর আচার-ব্যবহার কেমন ছিলো? ক’টা দিন তুই কবিরের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলেছিস?

মানুষ সব সময় হাসিমুখে থাকতে পারে না।

তা পারে না। কিন্তু তুই ভালমত ভেবে দেখ তো কবিরের সঙ্গে তোর ব্যবহারটা কেমন ছিলো।

তুমি যাও তো মা।

রেহানা চলে এলেন। নিশাত অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে দরজার ছিটকিনি লাগানো। দরজায় পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দীর্ঘ সময়। বাবু ঘুম ভেঙে কাঁদতে শুরু করেছে—মা’র কাছে যাব। মা’র কাছে যাব। রেহানা তাকে সামলাবার চেষ্টা করছেন। নিশাত শুনলো মা বলছেন—কেন যে মরতে এখানে এলাম।

নিশাতের চোখ জ্বালা করছে। আজকাল তার চোখে জল আসে না। চোখ জ্বালা করে। মা একটু আগে যা বলে গেলেন সেটা কি ঠিক? মা কি ইঙ্গিত করতে চেষ্টা করছেন না যে, সে এখন যা করছে তা করার তার কোন অধিকার নেই। মা একটা মোটা দাগের ইঙ্গিত করছেন। স্থূল ধরনের কথা বলছেন।

সবার স্বভাব এক রকম নয়। সব মেয়েরাই তাদের স্বামীকে নিয়ে আহ্লাদ করে না। কেউ কেউ গম্ভীর স্বভাবের থাকে। সহজে উচ্ছ্বসিত হয় না। তাছাড়া কবিরের মধ্যে কি সত্যি সত্যি উচ্ছ্বাসিত হবার মত কিছু ছিলো?

সে ভালো ছেলে এতে সন্দেহ নেই। আমুদে ছেলে। হৈচৈ করতো। প্রচুর মিথ্যে কথা বলতো। টিভি’র প্রতিটা বাংলা সিনেমা গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখতো এবং শেষ হওয়ামাত্র বলতো—শালা, সময়টাই মাটি। আগে জানলে কে বসে থাকতো? কবির এমন একটি ছেলে যে পৃথিবীর যে-কোন মেয়েকে বিয়ে করেই সুখী হতো। এই সব ছেলেদের সুখী হবার ক্ষমতা অসাধারণ। এরা হয় সুখী স্বামী, সুখী বাবা এবং বুড়ো বয়সে একজন সুখী দাদা। সূক্ষ্ম রুচির মানুষ এত সহজে সুখী হয় না। সংসারে সুখী হবার মত উপকরণ ছড়ানো নেই।

বাবু খুব কাঁদছে। নিশাত দরজা খুলে বের হলো। হ্যাজাক লাইটটি বারান্দায় এনে রাখা হয়েছে। জামিল বাবুকে কোলে নিয়ে বারান্দায় এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটছে।

জামিল ভাই, ওকে আমার কাছে দিন।

জামিল ইশারায় তাকে কথা বলতে নিষেধ করলো। বাবুর ঘুমিয়ে পড়ার একটা সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে। মায়ের কথা শুনে জেগে উঠতে পারে। নিশাত অপেক্ষা করতে লাগলো।

আচ্ছা কবির বেঁচে থাকলে কি এরকম করতো? ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতো? এটা কখনো জানা হবে না। কিন্তু সবাই বলবে—বেঁচে থাকলে কত আদর করেই না ছেলে মানুষ করতো। মৃত মানুষের সম্পর্কে সব সময় ভালো ভালো কথা ভাবতে হয়। মৃত মানুষদের বয়স কখনো বাড়ে না। নিশাত এক সময় বুড়ো হয়ে যাবে। কিন্তু কবিরের বয়স সাতাস বছরেই থেকে থাকবে। তার কোনদিন চুল পাক ধরবে না। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হবে না। কোন মানে হয় না।

 

নিশাত বাবু ঘুমিয়ে পড়ছে। কোথায় রাখবে?

মা’র কাছে দিয়ে আসুন।

জামিল হাঁটছে কেমন ক্লান্ত ভঙ্গিতে। হাঁটার ভঙ্গিটাও কেমন চেনা চেনা। কবির কি এমন করেই হাঁটতো? এখন আর অনেক কিছুই মনে পড়ে না। স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসছে। একদিন হয়তো কিছুই মনে থাকবে না।

নিশাত, ওকে শুইয়ে দিয়ে এসেছি।

থ্যাংকস।

তোমার জ্বর কেমন?

আমার জ্বরের খবর মনে হচ্ছে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে।

জামিল তাকালো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। মৃদুস্বরে বললো—বেড়াতে এসে অসুখে পড়াটা খুব খারাপ।

আমি বেড়াতে-টেড়াতে আসিনি। সবাই এসেছে, বাধ্য হয়ে আমিও এসেছি।

জামিল হালকা স্বরে বললো, অবস্থা এরকম হবে জানলে আমি তোমার সঙ্গে জুটতাম না।

জুটছেন কেন, আপনাকে তো কেউ সাধাসাধি করেনি। নাকি করেছে?

না করেন। আমি নিজ থেকেই এসেছি।

কেন এসেছেন?

নিশাত, তোমার শরীর ভালো না। যাও তুমি শুয়ে থাক।

না, আপনি আমাকে বলুন আপনি কেন এসেছেন? ইউ গট টু টেল মি দ্যাট!
জামিল একটা সিগারেট ধরালো। সে লক্ষ্য করলো—নিশাত অল্প অল্প কাঁপছে।

জামিল ভাই, আমি আপনাকে আগেও পছন্দ করিনি, এখনো করিনা। আমার মনে হয় আপনি সেটা জানেন না।

নিশাত, যাও ঘুমুতে যাও।

ওসমান সাহেব অবাক হয়ে উঠে এলেন—এই নিশাত কি হয়েছে?

কিছু হয়নি বাবা।

জামিলকে কি বলছিলি?

কিছু বলছিলাম না।

নিশাত ক্লান্ত ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেলো। ওসমান সাহেব বললেন—জামিল, ও চেঁচামেই করছিলো কেন?

জানি না চাচা। আপনি এখনো বারান্দায় বসে আছেন কেন? ঠাণ্ডা লাগবে তো।

ঠাণ্ডা অলরেডি লেগে গেছে। কিন্তু অন্ধকারে বসে থাকতে ভালোই লাগছে। জামিল, তুমি একটা কাজ করতো, দেখ, আলিমকে কোথাও পাও কিনা। আর শোন, এই হ্যাজাকটা এখান থেকে সরাবার ব্যবস্থা কর। আলো চোখে লাগছে। তোমাদের খাওয়া-দাওয়া হয়েছে তো?

হয়েছে।

সাব্বির কোথায়? ওকে এখানে আসার পর একবারও দেখিনি।

উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।

 

আলিম ওসমান সাহেবের সামনে তাঁর প্রিয় গ্লাসটি রাখলো। লম্বা গ্লাস। জার্মান ক্রিস্টালের অপূর্ব গ্লাস। এই গ্লাস ছাড়া অন্য কিছুতেই তিনি তৃপ্তি পান না। ওসমান সাহেব স্পষ্ট একটা সুখের নিঃশ্বাস ফেললেন। আলিম মনে করে এনেছে। আলিম দ্বিতীয়বার একটা বাটিতে একগাদা বরফ নিয়ে এলো।

আরে তুই বরফ পেলি কোথায়?

আসার সময় নেত্রকোণা থেকে বিশ সের বরফ কিনলাম।

বলিস কি। গলে নাই?

কাঠের গুঁড়া দিছি চাইর দিকে। তবু গলছে। এখন আছে অল্প।

আলিম খুব সাবধানে হোয়াইট হর্সের বোতল খুলে হুইস্কি ঢাললো। ওসমান সাহেবের পেগ সাধারণ পেগের চেয়ে একটু বড়। আলিম মাপটা জানে। তবু অন্ধকারে কিছু বেশী পড়লো। অন্য সময় হলে ধমকে দিতেন। আজ কিছুই বললেন না। বরফের ব্যাপারটা তাঁকে অভিভূত করেছে।

তোর দাঁতের ব্যথার কি অবস্থা?

ব্যথা আছে।

রেহানার কাছ থেকে নিয়ে তিনটা এ্যাসপিরিন খা ব্যথা কমে যাবে।

আলিম কথা বললো না। ওসমান সাহেব দরাজ গলায় বললেন—তোর এখানে থাকার দরকার নেই। যা শুয়ে পড়।

স্যার আপনে ঘরে বসেন বাইরে ঠাণ্ডা।

বাইরেই ভালো। শোন আলিম, দু’টা পানির বোতল আর কিছু বরফ দিয়ে যাস।

আচ্ছা।

আলিম চলে যেতেই বিদ্যুতের মত ওসমান সাহেব দিলুর ধাঁধার রহস্য ভেদ করলেন। অত্যন্ত সহজ উত্তর। বরফ। দশ সের পানিকে প্রথমে জমিয়ে বরফ করতে হবে। তারপর সেই বরফের টুকরোটি হাতে করে যেখানে যাবার সেখানে যেতে হবে।

ওসমান সাহেব গভীর আনন্দ বোধ করলেন। নীলগঞ্জ ডাকবাংলোটি তাঁর কাছে হঠাৎ করে বড় প্রিয় হয়ে গেলো। যেন তিনি জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়াটি এই ডাকবাংলোয় পেয়ে গেলেন। যেন তাঁর আর কিছু পাওয়ার নেই। জীবনের সমস্ত সাধ পূর্ণ হয়েছে।

বাবা!

দিলু একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে উঠে এসেছে, শীতে কাঁপছে অল্প অল্প। কি রে দিলু?

তুমি এখানে বসে কি করছ?

কিছু করছিনা। বসে আছি।

আমার ঘুম আসে না বাবা। তোমার সঙ্গে একটু বসি?

বোস।

হুইস্কি খাচ্ছ, না? মা জানলে খুব রাগ করবে।

ওসমান সাহেব একটি হাত মেয়ের পিঠের ওপর রাখলেন। দিলু হালকা স্বরে বললো—বাবা, চা চামুচ দিয়ে এক চামুচ দেখি? আমার খুব খেতে ইচ্ছে করে।

ওসমান সাহেব একবার ভাবলেন বলবেন—যা একটা চামুচ নিয়ে আয়। বলতে পারলেন না।

দিলু বললো—তোমার শীত করছে না?

করছে। তোর মা কি ঘুমিয়ে পড়েছে?

হ্যাঁ। সবাই ঘুমুচ্ছে। শুধু আমরা দু’জনে জেগে আছি।

জায়গাটা কেমন লাগছে?

ভাল।

পুকুরটা দেখেছিস?

হুঁ।

বিরাট পুকুর তাই না?

হুঁ। এ রকম একটা বাড়ি আমাদের থাকলে খুব ভাল হতো—তাই না বাবা? পেছনে বিরাট একটা পুকুর থাকবে। সামনে থাকবে প্রকাণ্ড সব রেণ্টি গাছ।

এগুলা রেণ্টি গাছ নাকি?

হুঁ।

কে বলেছে?

জামিল ভাই বলেছেন।

দিলু ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো তারপর খুব হালকা গলায় বললো—আপা আমার সঙ্গে আজ খুব খারাপ ব্যবহার করেছে।

আমরা সবাই কখনো না কখনো খারাপ ব্যবহার করি।

কেউ আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে আমার খুব কষ্ট হয়। আমি তো কারোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না। করি? তুমি বল?

ঘুমুতে যা দিলু।

দিলু উঠে গেলো। ওসমান সাহেবের হঠাৎ মনে পড়লো, আরে তাই তো, ধাঁধার উত্তরটা তিনি জানেন এটা দিলুকে বলা হলো না। উঠে গিয়ে ডাকবেন নাকি? কিন্তু তাঁর উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

 

দিলু ঘুমিয়েছে নিশাতের সঙ্গে। প্রকাণ্ড একটা খাট। খাটের নীচে আলো কমিয়ে হ্যারিকেনটা রাখা। ঘরময় অবছা অন্ধকার। পায়ের দিকের জানালার একটা কাঁচ ভাঙ্গা। সেই ভাঙ্গা গলে শীতের হাওয়া আসছে। দু’টি কম্বল আছে গায়ে তবু শীত মানছে না। দিলু নিশাতের দিকে আরো একটু সরে এলো। নিশাত শীতল স্বরে বললো—গায়ের উপর এসে পড়ছো কেন দিলু? সরে শোও। এত ঘেঁষাঘেঁষি আমার ভালো লাগে না। দিলু অনেকখানি সরে গেলো। পাশের ঘরে বাবু কাঁদছে। বিড়বিড় করে কি সব যেন বলছে। বোঝা যাচ্ছে না। দিলু বললো—আপু বাবু কাঁদছে।

কাঁদছে কাঁদুক।

ওকে এখানে নিয়ে এসো না। অনেক জায়গা তো।

ভ্যান ভ্যান করিসনা, চুপ করে থাক।

দিলুর চোখ ভিজে উঠলো। এমন বাজে করে কথা বলে কেন আপা? কি করেছে সে? কিছুই তো করেনি। শুধু বলেছে বাবু কাঁদছে। এটা বলা কি দোষের? দিলু কম্বলের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে ফেললো। সেখানে গাঢ় অন্ধকার। বাবুর কান্নার শব্দও সেখানে যাচ্ছে না। অন্ধকার দিলুর ভাল লাগে না। অন্ধকারে তার মৃত্যুর কথা মনে হয়। দাদীজান মারা যাবার সময় থেকেই তার এ রকম হয়েছে। দাদীজান মারা গিয়েছিলেন রাত ন’টায়। সবাই যখন কান্নাকাটি করছে তখন হঠাৎ কারেণ্ট চলে গেলো। কি ভয়াবহ অবস্থা। সবাই কান্না থামিয়ে মোমবাতি মোমবাতি বলে চেঁচামেটি শুরু করলো। দিলু বসে ছিলো সোফায়। হঠাৎ তার মনে হলো দাদীজান যেন উঠে আসছেন তার দিকে। কি অবস্থা। ভাগ্যিস বাবা তখন লাইটার জ্বালিয়ে দিলুর পাশে এসে বসলেন।

নিশাত মৃদুস্বরে ডাকলো—দিলু ঘুমিয়ে পড়েছিস? দিলু জবাব দিলো না। নিশাত কম্বলের ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলুকে কাছে টানলো।

কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। এত অভিমানি হয়েছে কেন? নিশাতের ইচ্ছা হলো দিলুকে ডেকে তুলে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে। সে আবার ডাকলো—দি দিলু এই পাগলি। দিলুর ঘুম ভাঙ্গলো না। নিশাত ছোট্ট একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। আর ঠিক তখন জামিলের হাসির শব্দ শোনা গেলো। কি আশ্চর্য অবিকল কবিরের মত ঘর কাঁপিয়ে হাসি। জামিল ভাইতো এরকম কখনো হাসেন না। তাঁর সব কিছুই মাপা। এবং কোন কিছুর সঙ্গেই কবিরের কোন মিল নেই। তবু আজ এরকম মিল পাওয়া গেলো কেন? নাকি সব মানুষের মধ্যে অদৃশ্য কোন মিল আছে?

রাত বাড়ছে। বাবু কাঁদছে না। চারদিকে সুনসান নীরবতা নিশাত হাত বাড়িয়ে দিলুকে কাছে টানলো। দিলু ঘুমের মধ্যেই কাঁদছে। কোন মিষ্টি স্বপ্ন দেখছে হয়তো। কতদিন হয়ে গেলো নিশাত কোন মিষ্টি স্বপ্ন দেখে না!

আমার আছে জল – ০৮ম পরিচ্ছেদ

নিশাত খুব ভোরে জেগে উঠলো।

তখনো অন্ধকার কাটেনি। পূবের আকাশ লাল হতে শুরু করেছে। ঘন কুয়াশা চারদিকে। নিশাত দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। মাথার যন্ত্রণা আর নেই। শরীর ঝরঝরে লাগছে। প্রচণ্ড ক্ষিধে। এত ভোরে নিশ্চয়ই আর কেউ জাগেনি।

নিশাত টুথব্রাশ হাতে বারান্দায় হাঁটতে লাগলো। এত সুন্দর বাড়ি। রাতে ঠিক বোঝা যায়নি। নিশাত হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছনের দিকে চলে এলো। প্রকাণ্ড পুকুরটি চোখে পড়লো তখন। কুয়াশার জন্যে পুকুরটি পুরোপুরি দেখা যায় না। মনে হয় বিশাল সমুদ্র। পানি দেখলেই ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। নিশাত এগিয়ে গেলো।

এই ভোরেও পাতলা একটা উইণ্ডব্রেকার পরে বাঁধানো ঘাটে সাব্বির বসে আছে। তার পাশেই স্ট্যাণ্ড-ক্যামেরা বসানো। নিশাত বললো—এত ভোরে ক্যামেরায় কার ছবি তুলছেন?

কুয়াশার ছবি। আপনার জ্বর সেরে গেছে?

হ্যাঁ।

নিশাত সিঁড়ি বেয়ে শেষ পর্যন্ত নেমে গেলো। হাত বাড়িয়ে পানিতে আঙ্গুল ডুবালো। তার ধারণা ছিল পানি বরফ-শীতল হবে। কিন্তু তেমন ঠাণ্ডা নয়।

আপনি যেমন বসে আছেন ঠিক তেমনিভাবে বসে থাকুন, আমি আপনার একটা ছবি তুলবো।

অনুমতি প্রার্থনা নয়। যেন আদেশ। নিশাত বললো—মুখ টুথব্রাশ ঝুলতে থাকবে?

হ্যাঁ। থাকুক। আপনি হাত দিয়ে পানি স্পর্শ করছেন। এটাই আমার ছবির থীম।

সাব্বির ক্যামেরা হাতে কয়েক ধাপ নেমে এলো। নিশাতের কি রাগ করা উচিত না, বলা উচিত, এভাবে আমি ছবি তুলি না। কিন্তু নিশাত রাগ করতে পারছে না। কেন পারছে না সেও এক রহস্য। সাব্বির বললো—আজ ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই মনে হচ্ছিলো ছবির জন্যে একটা ভাল কম্পোজিশন পাবো।

আপনি ছবি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না?

ভাবতে পারি হয়তো কিন্তু ছবির কথা ভাবতেই ভালো লাগে।

নিশাত হাসতে হাসতে বললো—আপনার মাথার মধ্যে শুধু কম্পোজিশন ঘুরে তাই না? সাব্বির তার জবাব দিলো না। ক্রমাগত ছবি তুলতে লাগলো। পানিতে হাত ডুবিয়ে বসে রইলো নিশাত। সে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলো—সাব্বির অন্য ফটোগ্রাফারদের মতো নয়। অন্য ফটোগ্রাফাররা বলতো—একটা বাঁ দিকে ফিরুন, একটু হাসুন। মাথাটা একটু উপরে তুলুন। শাড়ির আঁচল টেনে দিন। সাব্বির কিছুই বলছে না। শুধু ছবি তুলছে। নিশাত হাসতে হাসতে বললো—এত ছবি তুলছেন একটা তো ভালো হবেই।

সব সময় হয় না। ছত্রিশটি ছবির মধ্যে যার একটি ছবি ভালো হয় সে একজন বড় ফটোগ্রাফার।

আপনি একজন বড় ফটোগ্রাফার।

হ্যাঁ।

নিশাত লক্ষ্য করলো সে হ্যাঁ বলছে খুব জোরের সঙ্গে। যেন সে মনেপ্রাণে কথাটা বিশ্বাস করে। সাব্বির বললো—যে ছবিটি দিয়ে আমি প্রথম নাম করি তার কথা শুনতে চান?

বলুন।

ছবিটির নাম সরলতা। ইনোসেন্স।

সাব্বির সহজভাবেই নিশাতের পাশে বসলো। যেন দীর্ঘদিনের পরিচিত কেউ পাশাপাশি বসছে।

আমি তখন থাকি নর্থ ডেকোটায়। একবার রুজভেল্ট ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে গিয়েছি। একা একা গভীর বনে ঢুকে পড়লাম। সেখানে দেখলাম ছোট্ট একটা জলা জায়গা। চারদিকে বড় বড় সব উইলি গাছ। উইলি গাছের ছায়া পড়েছে পানিতে। অপূর্ব পরিবেশ। এবং সেই অপূর্ব পরিবেশে অল্প বয়সী একটি মেয়ে লাঞ্চবক্স হাতে নিয়ে বসে আছে। ওর বন্ধুটি বোধ হয় কাছেই কোথাও গেছে। আমি মেয়েটিকে বললাম—তোমার কয়েকটি ছবি তুলতে চাই। সে সঙ্গে সঙ্গে রাজি। আমি বললাম—তুমি কি ঘুমিয়ে পড়ার মত একটা ভঙ্গি করতে পার? সে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো। অসংখ্য ছবি তুললাম, কিন্তু মনে হলো কোথায় যেন একটা ফাঁক রয়ে গেছে। ছবিটিও অসম্পূর্ণ। ঠিক তখন একটা বুনো প্রজাপতি এসে বসলো লাঞ্চবক্সে, তৈরী হয়ে গেলো ছবি। বিখ্যাত ছবি।

বুনো প্রজাপতি আবার কী? সব প্রজাপতিই তো বুনো। পোষা প্রজাপতি আবার আছে নাকি?

ঐ প্রজাপতিটির পাখায় কোন রঙ ছিলো না। কালো কালো দাগ। কাজেই বুনো প্রজাপতি বলেছি। আপনি কি ঐ ছবিটি দেখতে চান?

আছে আপনার কাছে?

হ্যাঁ। বসুন আপনি, আমি নিয়ে আসছি।

সাব্বির সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো।

সাব্বিরকে নিশাত কি আগে ভালো করে লক্ষ্য করেনি নাকি? বেশ লাগছে একে। মনে হচ্ছে এর মধ্যে ভান নেই। শুধু কথাবার্তা নয় চোখের দৃষ্টিও বেশ স্বচ্ছ। মেয়েদের মত বড় বড় চোখ। না কথাটা ঠিক হলো না। সব মেয়েদের চোখ বড় বড় নয়। বরং বলা উচিত মেয়েলী চোখ। পুরুষ মানুষকে এত বড় বড় চোখে মানায় না। না এটাও ঠিক হলো না। সাব্বির সাহেবকে তো ভালই মানিয়েছে। নিশাত বেশ আগ্রহ নিয়ে ছবির বইটির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো। যেন এই আগ্রহ থাকাটা ঠিক নয়। এটা অন্যায়।

 

এত চমৎকার একটা ফটোগ্রাফির বই নিয়ে সাবির ফিরবে নিশাত আশা করেনি। সে দু’বার বললো—এ বইয়ের সব ছবি আপনার তোলা?
হ্যাঁ। ব্যাক কভারে ফটোগ্রাফারের ছবি আছে। দেখুন না।

আপনি তো বিখ্যাত ব্যক্তি।

হ্যাঁ। মোটামুটি বিখ্যাত। ঐ দেশে অনেকেই আমাকে চেনে।

নিশাত পাতা উল্টাতে লাগলো। অপূর্ব সব ছবি। মন খারাপ করিয়ে দেবার মত ছবি।

তিপান্ন পৃষ্ঠায় ঐ ছবিটি আছে। দেখুন। ঐ ছবিটি দিয়ে আমি ফটোগ্রাফির জগতে প্রথম এণ্ট্রি পাই।

নিশাত তিপ্পান্ন পৃষ্ঠা খুলে অনেকক্ষণ কোন কথা বলতে পারলো না।

ছবিটা ভাল লেগেছে?

হ্যাঁ। কিন্তু মেয়েটার গায়ে কোন কাপড় ছিলো না এই কথা আপনি আগে বলেননি। ও কি এইভাবে বনে বসেছিলো?

হ্যাঁ।

এবং আপনি ছবি তুলতে চাইতেই রাজি হয়ে গেলো? কোন আপত্তি করলো না?

না কোন আপত্তি করেনি।

ঐ মেয়েটির কি নাম?

নাম জানি না। ছবির জন্যে মেয়েটির নামের কোন প্রয়োজন নেই।

আমার মেয়েটির নাম জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।

সাব্বির হেসে উঠলো। রোদ উঠে গেছে। কুয়াশা মিলিয়ে যাচ্ছে। কেমন চমৎকার লাগছে চারদিক। নিশাত নরম গলায় বললো—এই বইটি আমার কাছে থাকুক?

থাকুক।

নিশাত উঠে দাঁড়ালো। নিচুস্বরে বললো—যাই। সাব্বির বললো—আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।

বলুন।

দয়া করে রাগ করবেন না বা মন খারাপ করবেন না।

এমন কি কথা যে আমি রাগ করব?

সাব্বির অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বললো—আপনার আমার ভাল লেগেছে। শুধু ভাল লেগেছে বললে কম বলা হয়। আমার আরো কিছু বলা উচিত। কিন্তু আমি গুছিয়ে কিছু বলতে পারি না। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমার ভাল লাগার ব্যাপারটা আপনার মা’কে বলতে পারি।

নিশাত ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললো, কিন্তু কিছু বললো না, ঘাটের ধাপ ভেঙে উপরে উঠে এলো।

আপা, তুমি এখানে আর আমি সারা বাড়ি খুঁজছি।

কেন?

দিলু হাত নেড়ে নেড়ে বললো—আমরা সবাই মিলে শিকারে যাচ্ছি।

কোথায় যাচ্ছিস?

শিকারে। বালিহাঁস মারবো আমরা। এসো তাড়াতাড়ি নাশতা খেয়ে নাও। রোদ বেশী কড়া হলে হাঁস পাব না।

বাবু কোথায় রে?

জানি না কোথায়। তোমার জ্বর নেই তো?

নাহ্‌।

তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেন আপা?

সুন্দর সেই জন্যে সুন্দর লাগছে।

নিশাত হাসলো। আজকের দিনটি চমৎকারভাবে শুরু হয়েছে।

কুয়াশা নেই। ঝকঝকে রোদ উঠেছে। আকাশ, চৈত্রের আকাশের মত ঘন নীল। আহ্‌ চমৎকার একটি দিন।

আমার আছে জল – ০৯ম পরিচ্ছেদ

শিকারে যাবার প্রোগ্রাম হঠাৎ করেই হয়েছে। নীলগঞ্জ থানার ও সি সাহেব সকালবেলা একটি দোনলা বন্দুক আর একগাদা ছররা গুলি নিয়ে উপস্থিত—স্যার, শিকারে যাবেন নাকি? বড়গাঙ্গের চরে বালিহাঁস পড়েছে। কায়দামত একটা গুলি করতে পারলে বিশ-পঁচিশটা পাখি পড়বে।

বলেন কি?

স্যার, একটা স্পীডবোটের ব্যবস্থা করেছি।

ওসমান সাহেব বহুদিন পর উৎসাহিত বোধ করেন। শিকার করা অনেকদিন হয় না। শেষ শিকারে গিয়েছিলেন প্রায় পাঁচ বছর আগে।

ওসি সাহেব, তাহলে তো তাড়াতাড়ি রওনা হতে হয়।

জ্বি স্যার।

চা-টা খেয়েই রওনা দেব কি বলেন ও সি সাহেব?

ঠিক আছে স্যার।

ওসমান সাহেব ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। দীর্ঘদিন পর রক্তে যৌবনের উত্তেজনা অনুভব করেন। থানার ওসির মত একজন অধস্তন অফিসারকেও হঠাৎ বন্ধু স্থানীয় মনে হয়।

ও সি সাহেব।

জ্বি স্যার।

দিনটাও আজ শিকারের জন্যে ভালো। কুয়াশা নেই, কিছু নেই।

না স্যার কুয়াশা থাকলেই ভালো। পরিষ্কার দিন শিকারের জন্য না। একটু তাড়াতাড়ি করা দরকার স্যার।

প্রথমে ঠিক হয়েছিল সবাই যাবে। পাখি শিকার হোক বা না হোক নৌকা ভ্রমণ হবে কিন্তু সাব্বির যেতে রাজি হলো না। তার নাকি শিকারে তেমন উৎসাহ নেই। রেহানাও থেকে গেলেন। কারণ বাবুর গা গরম হয়েছে। সকালে একবার বমি করেছে। রেহানা ধরেই নিয়েছিলেন নিশাত বাবুকে রেখে যাবে না। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলেন নিশাত দিলুর মতই উৎসাহ নিয়ে সাজ করছে। অনেকদিন পর তার চোখ ঝমমল করছে।

 

স্পীড বোটটি আহামারি কিছু নয়। দেশী নৌকায় বার হর্স পাওয়ারের একটা মেশিন বসানো। বসবার জায়গা নেই। চারদিকে ভেজা। এটা বোধহয় মাছ আনা নেয়া করে। মাছের বোটকা গন্ধ। তবু দিলুর ভীষণ ভালো লাগছে। সে বসেছে জামিলের পাশে। বেণী দুলিয়ে দুলিয়ে ক্রমাগত গল্প করছে। ওসমান সাহেব হাসি মুখে বললেন—মেয়েটাতো বড্ড বক বক করতে পারে। সবাই হেসে উঠলো। দিলু মোটেও অপ্রস্তুত হলো না, প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তার এক বান্ধবীর গল্প করতে শুরু করলো। তার নাম লীনা কিন্তু সবাই তাকে ডাকে বক লীনা কারণ সে বকের মত মাথা নীচু করে হাঁটে। দিলু মাথা নীচু করে ব্যাপারটা দেখালো। ওসমান সাহেব বললেন—আয় মা তুই আমার পাশে বসে গল্প কর। কিন্তু দিলু নড়লো না। সে জামিলের পাশেই বসে রইলো।

বড় গাঙের চর পর্যন্ত স্পীডবোট নিয়ে যাবার উপায় নেই। পানি কম। তাছাড়া ভট ভট শব্দ হচ্ছে। শব্দে পাখি উড়ে যাবে। ওসি সাহেব বললেন—এখান থেকে যেতে হবে পায়ে হেঁটে। অসুবিধা হবে নাতো স্যার?

না অসুবিধা কি?

খানিকটা পানি ভেঙে যেতে হবে।

বেশী পানি?

জ্বি না স্যার। খুব বেশী হলে হাঁটুপানি। জুতো খুলে ফেলেন। ওসমান সাহেব জুতা খুলে ফেললেন। দিলুও জুতা খুললো। ওসি সাহেব অবাক হয়ে বললেন—তুমিও যাবে নাকি খুকি?

জ্বি।

কষ্ট হবে। একটু পরেই রোদ উঠবে কড়া।

উঠুক।

ওসমান সাহেব বললেন—শখ করে এসেছে, চলুক। নিশাত, তুই যাবি নাকি?

আমি হাঁটু পানি ভেঙে যাব? পাগল হয়েছ বাবা?

দিলু বললো—চলো না আপা। আমি তো যাচ্ছি। তোমার ভালই লাগবে।

এখানে বসে থাকতেই আমার ভাল লাগছে।

ওসমান সাহেব বললেন—একা একা বসে থাকবি, খারাপ লাগবে না?

একা একা থাকব না। জামিল ভাই থাকবেন। কি জামিল ভাই, আমাকে একা ফেলে নিশ্চয়ই আপনি পাখি শিকারে যাবেন না? নাকি আপনিও যেতে চান?

না, আমি আছি।

 

রোদের তাপ বাড়ছে। মিষ্টি গন্ধ উঠে আসছে মাঠ থেকে। এ অঞ্চল বেশ নির্জন। মাঝে মাঝে দু-একটা মাছ ধরার নৌকা শুধু যাচ্ছে। নৌকায় বসে থাকা লোকজন তাদের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু খুব একটা অবাক হচ্ছে না। স্পীড বোট নিয়ে শহরের লোকজন হয়তো প্রায়ই এদিকে শিকারে আসে।

নিশাত হাত বাড়িয়ে হাসি মুখে বললো—জামিল ভাই, এই কি সেই বিখ্যাত কাশফুল?

হুঁ। তবে এখনো ফুল ফুটেনি। সময় হয়নি।

কই, তেমন কিছু তো লাগছে না।

বাতাসে যখন ঢেউয়ের মত উঠানামা করে তখন ভালো লাগে। তুমি কি বোটেই বসে থাকবে না নামবে?

চলুন নামি। হিল পরে হাঁটা যাবে তো?

হিল পরে এসেছো?

হ্যাঁ, দেখছেন না কত লম্বা লাগছে আমাকে।

জামিল ঠিক বুঝতে পারছে না। নিশাতকে খুব খুশী খুশী মনে হচ্ছে। সাজগোজের মধ্যেও যথেষ্ট যত্নের ছাপ। ঠোঁটে কড়া করে লিপস্টিক দিয়েছে।

নিশাত বললো—গ্রাম-নদী এইসব কিন্তু আমার কাছে তেমন এক্সাইটিং মনে হয় না।

একেকজনের দেখার ক্ষমতা একেক রকম। সাব্বির সাহেব যা দেখে মুগ্ধ হবেন তুমি হয়তো তা দেখে মুগ্ধ হবে না। তাছাড়া…।
সাব্বির ভাইকে আপনার কেমন লাগে?

চমৎকার। ভদ্রলোক অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে দারুণ ইমপ্রেস করেছেন। এই একটি লোক দেখলাম যার মধ্যে ভান নেই।

নিশাত ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো—এত তাড়াতাড়ি একটা ডিসিশনে আসা ঠিক না। আপনি মানুষ সম্পর্কে খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্তে চলে আসেন। নিশাত খুব সাবধানে পা ফেলে এগুতে লাগলো।

জামিল বললো—জুতো পরে তোমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। জুতো খুলে ফেলো।

খালি পায়ে হাঁটব?

হ্যাঁ। খারাপ লাগবে না। শুকনো পথঘাট।

নিশাত হিল খুলে ফেললো—খালি পায়ে হাঁটতে তার ভালই লাগলো। খুশী খুশী গলায় বললো—ফ্লাক্সটা নিয়ে এলে ভাল হতো। কোথাও বসে চা খাওয়া যেতো। শাড়ি পরা আট-ন বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে কোত্থেকে হঠাৎ এসে উদয় হয়েছে। চোখ বড় বড় করে দেখছে। নিশাত বললো—এ্যাই তোমার নাম কি? মেয়েটি জবাব দিলো না।

বাড়ি কোথায় তোমার?

মেয়েটি হাত বাড়িয়ে যেদিকে দেখালো সেদিকে কোন ঘরবাড়ি নেই।

জামিল ভাই, মেয়েটি কি হারিয়ে গেছে নাকি?

না, ওরা হারাবে না। গ্রামের মেয়ে, সমস্ত অঞ্চল এদের খুব ভাল করে চেনা। নিশাত, কোনদিকে যেতে চাও?

চলুন ঐ গাছটার নিচে বসি। কি গাছ ওটা, বিরাট বড় তো।

শিমুল গাছ।

শিমুল গাছে এত বড় বড় কাঁটা থাকে নাকি?

থাকে।

জামিল সিগারেট ধরালো। নিশাত হ্যাণ্ডব্যাগ থেকে সানগ্রাস বের করে চোখে দিলো। হালকা স্বরে বললো—একটা হাসির গল্প বলুন তো। দিলুকে রোজ কিসব গল্প বলেন। দেখি এবার আমি একটা শুনি।

দিলুকে হাসির গল্প বলি না। দিলুকে বলি ভূতের গল্প। ভূতের গল্প শুনতে চাইলে বলতে পারি।

নিশাত খিলখিল করে হেসে ফেললো। তার হাসি দেখে ছোট্ট মেয়েটাও হাসতে শুরু করলো। জামিল নিজেও হাসলো।

না জামিল ভাই, বলুন একটা হাসির গল্প। দেখি আপনি আমাকে হাসাতে পারেন কিনা।

হাসাতে পারলে কি দেবে?

আপনি আগে বলুন, তারপর দেখা যাবে।

টেলিফোনের খুঁটি বসানো হচ্ছে। সারাদিন ধরে কাজ চলছে। সন্ধ্যাবেলা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কাজ দেখতে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন—তোমরা ক’টা খুঁটি পুঁতলে? ওরা বললো—স্যার বারটা। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বললেন—মন্দ না, বারটা খারাপ না। তারপর গেলেন অন্য একটা দলের কাছে—তোমরা কটা পুঁতলে? ওরা বললো—স্যার একটা। ইঞ্জিনিয়ার রেগে আগুন—এত কম? ঐ দল তো বারটা পুঁতলো। দলের সর্দার বললো—আমাদের কাজ আর ওদের কাজ? ওদের খুঁটির সবটাই মাটির উপর আর আমাদেরটা দেখুন। মাটির উপর আছে চার আঙুল। সবটাই ঢুকিয়ে দিয়েছি,

নিশাত গল্প শুনে হাসলো না। গম্ভীর হয়ে বললো—এই গল্পটা জামিল ভাই আপনি আমাকে ইচ্ছে করে বললেন।

ইচ্ছে করে বলব কেন?

গল্পটা বাবুর আব্বার।

হ্যাঁ, আমি কবিরের কাছ থেকে শুনেছি। এটা একটা চমৎকার গল্প, তাই তোমাকে বললাম। অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিলো না। সব কিছুতেই তুমি এত উদ্দেশ্য খোঁজ কেন?

নিশাত উঠে দাঁড়ালো—চলুন বোটে ফিরে যাই। ফেরার পথে কেউ কোন কথা বললো না। ছোট মেয়েটি আবার পেছনে পেছনে আসছে। খুব কৌতূহল মেয়েটির। ছোট্ট শাড়িটা পরেছেও খুব গুছিয়ে। শাড়ির রঙ গাঢ় সবুজ। তার মধ্যে লাল পাড়। জামিল বললো—নিশাত, তুমি কি লক্ষ্য করেছো বেশীর ভাগ গ্রামের মেয়ের শাড়ির রঙ সবুজ।

না, আমি লক্ষ্য করিনি। গ্রামই দেখিনি। গ্রামের মেয়ে দেখবো কোথায়?

গ্রামের মেয়েরা যে সবুজ শাড়ি পরে এটাও কিন্তু প্রথম নোটিশ করে কবির। তার ধারণা এরা সবুজ দেখতে দেখতে সবুজ রঙের প্রতি একটা উইকনেস জন্মিয়ে ফেলে। আমার ধারণা কিন্তু তা নয়।

আপনার কি ধারণা?

আমার ধারণা সবুজ রঙের কাপড় ময়লা হয় কম, সে জন্যই এরা সবুক কাপড় পরে।

আপনার ধারণাটাই প্রাকটিক্যাল। কিন্তু হঠাৎ করে আপনি রঙের প্রসঙ্গ আনলেন কেন?

জামিল কিছু বললো না। স্পীড বোটে উঠে বসলো। স্পীড বোটের ড্রাইভার রোদের মধ্যে পা মেলে দিয়ে দিব্যি ঘুমুচ্ছে। নিশাত ফ্লাক্স খুললো—চা দেব জামিল ভাই?

দাও।

চায়ের সঙ্গে আর কিছু? কেক আছে। নষ্ট হয়ে গেছে কিনা কে জানে।

নিশাত এক পিস কেক বের করে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলো। সে নিলো না। পিছিয়ে গেলো অনেকখানি। জামিল বললো—এ ভিখিরী নয় কারো কাছ থকে কিছু নেয়ে এর অভ্যেস নেই।

আপনি চট করে সবকিছু বুঝে যান কিভাবে?

জামিল হাসলো। ঠিক তখনি পর পর দু’টি গুলির শব্দ হলো। ওরা পাখি পেয়েছে কিনা কে জানে। স্পীড বোটের ড্রাইভার চোখ কচলে উঠে বসলো। শিকারীরা হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। নিশাত অবাক হয়ে দেখলো তার মাথার উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছে। আশ্চর্য, এত পাখি! তারা ডাকছে কর্কশ গলায়। শুনতে ভালো লাগে না।

ওরা কোথায় যাবে?

নিরাপদ কোন জায়গায় যাবে। তারপর সেখানেও শিকারীরা যাবে। সেখান থেকেও এদের উড়ে যেতে হবে।

নিশাত তাকিয়ে রইলো। জামিল বললো—সমস্ত জীব-জন্তু ও পশুপাখির জীবনের বেশীর ভাগ সময় কেটে যায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করতে গিয়ে। মানুষের জন্যেও এটা সত্যি। আমরাও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজি।

মাস্টারী করতে করতে বক্তৃতা দেয়া আপনার অভ্যেস হয়ে গেছে তাই না?

হ্যাঁ।

এবং আপনি মনে করেন জগৎ-সংসারের সমস্ত রহস্য আমি বুঝে ফেলেছেন?

না, তা বুঝিনি তবে বুঝতে চেষ্টা করি। তোমার মত চোখ বন্ধ করে থাকি না।

জামিল একটা সিগারেট ধরালো। নিজেই হাত বাড়িয়ে ফ্লাক্স থেকে চা ঢাললো। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছিলো সে বড়সড় একটা বক্তৃতা দেবে কিন্তু জামিল তেমন কিছুই করলো না। সিগারেট টানতে টানতে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। স্পীড বোটের ড্রাইভার নেমে গিয়ে ছোট মেয়েটির সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিয়েছে। এতক্ষণ যে মেয়ে একটি কথাও বলেনি, তার মুখে এখন খই ফুটছে।

 

তোর নাম কি?

ফুলি।

তোর বাপের নাম কি?

কসির শেখ।

কোন গ্রাম?

আতরা, মিয়াবাড়ি।

ভাই-ভইন কয়জন?

ছয়জন।

নিশাত খুব মন দিয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছে। এই মেয়েটি এতক্ষণ চুপ করে ছিলো কেন?

জামিল ভাই।

বল।

এই মেয়েটি এতক্ষণ কোন কথাবার্তা বলেনি কিন্তু দেখুন ঐ লোকটির সঙ্গে কেমন জমিয়ে গল্প করছে।

জামিল কোন উত্তর দিলো না।

জামিল ভাই, আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?

না, রাগ করিনি। রাগ করতে হলে একটা অধিকার থাকতে হয়। তোমার ওপর আমার সে রকম কোন অধিকার নেই।

দিলুর উপর আছে?

হ্যাঁ আছে। ওর সঙ্গে আমি কিন্তু প্রায়ই রাগ করি।

আপনারা কি নিয়ে এত কথা বলেন?

যা মনে আসে তাই বলি। ওর সঙ্গে তো আর হিসেব করে কথা বলতে হয় না।

নিশাত গম্ভীর ভঙ্গিতে বললো—আমার কিন্তু মনে হয় ওর সঙ্গেই আপনার সবচে সতর্ক হয়ে কথাবার্তা বলা উচিত।

কেন?

এই বয়সে মন অন্য রকম থাকে। আপনি কি বুঝতে পারছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি?

পারছি।

আপনি কি এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে চান?

চাই। নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার করা ঠিক নয়।

তার মানে?

দিলুর মত যখন তোমার বয়স ছিলো তখন তুমি আমার প্রতি অন্যরকম ধারণা পোষণ করতে।

এসব আপনি কি বলছেন?

স্কুল ছুটির পর ক’দিন এসেছ আমাদের বাড়িতে মনে আছে?

কেন আপনি এখন এইসব পুরনো কথা তুলছেন?

জামিল চুপ করে গেলো।

দেখা গেলো শিকারীরা ফিরে আসছে। ওসি সাহেবের হাতে কয়েকটা হাঁস। ওদের জবাই করা গলা দিয়ে তখনো ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ছে। দিলু ওসমান সাহেবের শরীরে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে ফাঁটছে। জামিল বললো—কি হয়েছে দিলু?

পায়ে কাঁটা ফুটেছে।

শিকার কেমন লাগলো?

ভালো না।

ওসমান সাহেব উল্লাস বোধ করছিলেন। তার চোখে-মুখে ক্লান্তির কোন চিহ্নই নেই। ওসি সাহেব বললেন—স্যার, কাল আবার যাবো নাকি?

চলেন যাই। নতুন কোন স্পটে চলেন।

স্যার, যেতে হবে কিন্তু আরো সকালে। সবচেয়ে ভাল হয় যদি শেষ রাতে উঠতে পারেন।

উঠব। শেষ রাতেই উঠবো। নো প্রবলেম।

ওসমান সাহেব নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেবের ওপর অত্যন্ত প্রসন্ন বোধ করেন।

ওসি সাহেব রাতে খান আমাদের সঙ্গে।

জ্বি-না স্যার। জ্বি না।

দিলু বসে নিশাতের পাশে। গাছের গুঁড়িতে বসে থাকা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে—এই, নাম কি তোমার?

ফুলি।

বাহ্‌ কি সুন্দর নাম! ফুল থেকে ফুলি।

ছোট্ট মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেললো। দিলু বললো—সাব্বির ভাই থাকলে এই মেয়েটির ছবি তুলতে বলতাম। কি সুন্দর মেয়ে দেখছ আপা? নিশাত জবাব দিলো না। দিলু বললো—গ্রামের মেয়েরা কি সুন্দর হয়। বড় মায়া লাগে।

আমার আছে জল – ১০ম পরিচ্ছেদ

ওসমান সাহেব হুইস্কির বোতল নিয়ে বসেছেন। তাঁর ভাগ্য ভালো বরফের জোগাড় হয়েছে। ওসি সাহেব জীপ পাঠিয়ে বরফ আনিয়েছেন। শুধু বরফ নয় তিনি এক কেস বিয়ার এনেছেন। ওসমান সাহেব বিয়ার খান না। তবু খুশী হলেন। প্রথম দিনে এই ওসির উপর এতটা বিরক্ত হওয়া ঠিক হয়নি।

ওসমান সাহেব সত্যিকার অর্থেই ছুটির আনন্দ ভোগ করলেন। আলিম এসে পেঁয়াজ, মরিচ ও ভিনিগার মাখানো এক প্লেট চিনাবাদাম রেখে গেছে। হুইস্কির সঙ্গে এই প্রিপারেশনটি অপূর্ব।

গ্লাসে চুমুক দিয়ে তাঁর মনে হলো বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত আনন্দের ব্যাপার। গভীর আনন্দে তাঁর শরীর কাঁপছে। হুইস্কি নিয়ে তো প্রায়ই বসেন এ রকম কখনো হয় না। আজ হচ্ছে কেন? ইচ্ছে হচ্ছে হেসে হেসে সবার সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে। চাঁদ উঠেছে কিনা কে জানে। যদি চাঁদ উঠে তাহলে ওভারকোটটি গায়ে দিয়ে একটু হেঁটে আসলে হয়তো ভালোই লাগবে।

বারান্দার কাছে কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে। অপরিচিত কেউ। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবু তিনি পরিষ্কার বুঝলেন লোকটির গায়ে ইউনিফর্ম।

 

খট শব্দে স্যালুট হলো—স্যার আমি। ওসি সাহেব পাঠিয়েছেন।

কি ব্যাপার?

কিছু না স্যার। পাহারার জন্য। ফিক্সড সেণ্ট্রি।

পাহারা লাগবে না তুমি চলে যাও।

সে ইতস্ততঃ করতে লাগলো। ওসমান সাহেব দরাজ গলায় বললেন—যাও যাও পাহারার কোন দরকার নেই? আমি কি মিনিষ্টার?

এই বলেই তিনি প্রচুর হাসতে লাগলেন। খালি পেটে দু’পেগ পড়ার জন্যেই বোধ হয় তাঁর কিঞ্চিত নেশা হয়েছে।

আলিমের দাঁতের ব্যথা কমেনি। আজ সারাদিন আরো বেড়েছে। ডান দিকের গাল ফুলে গেছে অনেকখানি।

আলিম গোটা চারেক প্যারাসিটামিল খাও।

স্যার খাইছি।

লবন পানি দিয়ে কুলকুচি কর।

করেছি স্যার।

গরম সেঁক দাও। সেঁকটা খুব উপকারী।

স্যার আর কিছু লাগবো?

না লাগবে না। খানা তৈরী হতে দেরী হবে নাকি?

জ্বি স্যার।

আচ্ছা ঠিক আছে।

 

আজ রাতে রান্নার দায়িত্ব নিয়েছে সাব্বির। ওয়াইল্ড ডাক রোস্টের সে নাকি একটা চমৎকার প্রেপারেশন জানে। দুপুর বেলাতেই সে বালি হাঁসগুলিত চামড়া তুলে টক দৈ-এ ডুবিয়ে রেখেছে। টক দৈ-এ আট ঘণ্টা ডুবানো থাকতে হবে, এক মিনিটো এদিও ওদিক হতে পারবে না।

আট ঘণ্টা পার হয়েছে রাত আটটায়। এখন হাঁসগুলোকে স্টীম করা হচ্ছে। কেটলীর পানি ফুটানো হচ্ছে। কেটলির নল দিয়ে যে বাষ্প বেরিয়ে আসছে তাই ব্যবহার করা হচ্ছে স্টীম করবার জন্যে। কায়দাটা ভালোই। দিলু সমস্ত ব্যাপারটা দেখছে মুগ্ধ হয়ে। সে রান্নাঘরে একটা চেয়ার নিয়ে চেয়ারের উপর পা তুলে আরাম করে বসে আছে। এবং সারাক্ষণই কথা বলছে।

সাব্বির ভাই স্টিম দিচ্ছেন কেন?

স্টিম দেয়ার জন্যে মাংশ নরম হবে।

টক দৈ-এ ডুবিয়া রাখলেন কেন?

রেসিপিতে বলা আছে তাই। টক দৈ না পেলে ভিনিগারেও ডুবিয়ে রাখা যেতো। টক দৈ ভিনিগারের চেয়ে ভালো।

এরপর কি করবেন?

পেটের ভেতর রসুন ভরে আগুনে ঝলসাবো। ব্যাস।

এই রান্না কার কাছ থেকে শিখলেন?

আমার এক মেক্সিকান বান্ধবী ছিলো ও রাঁধতো। ও অনেক রকম রান্না জানতো।

দিলু একটু লজ্জা পেলো। কেউ এভাবে বান্ধবীর কথা বলে নাকি? কিন্তু সাব্বির ভাই এমন সহজভাবে বলছেন যেন বান্ধবী থাকার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই।

উনার নাম কি সাব্বির ভাই?

ওর নাম মারিয়া।

মারিয়া?

কি বিশ্রী নাম।

বিশ্রী কোথায়? মেরী থেকে মারিয়া।

উনি দেখতে কেমন?

আমার কাছে তো ভালোই লাগতো। খুব লম্বা। বড় বড় কালো চোখ। খুব শব্দ করে হাসতো।

উনার ছবি আছে?

আছে। দেখতে চাও?

হুঁ।

আচ্ছা দেখাব।

সাব্বির ভাই, আমার কয়েকটা সুন্দর ছবি তুলে দেবেন তো।

দেব।

কবে দেবেন?

যখন চাও। কাল ভোরেই দিতে পারি। এক কাজ করো। তোমার লাল শাড়ি আছে?

না, লাল স্কার্ট আছে।

ঠিক আছে ঐ লাল স্কার্ট পরে পুকুরে সাঁতার দেবে। আমি ছবি তুলব। সবুজ পানির ব্যাকগ্রাউণ্ডে লাল স্কার্ট চমৎকার আসবে। তবে আমার ফিল্ম হাই স্পীড এ. এস. এ. ফাইভ হানড্রেড। আরেকটু কম হলে ভালো হতো।

আমি তো সাঁতার জানি নে।

ইস, সাঁতার দেয়া ছবি ভালো আসতো। জলকন্যার এফেক্‌ট পাওয়া যেতো।

রাত-দিন আপনি শুধু ছবির কথা ভাবেন। তাই না?

হুঁ ভাবি।

দিলু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। দেখলো সাব্বির কিভাবে হাঁসের গায়ে স্টীম লাগাচ্ছে। দেখে মনে হয় লোকটা এ কাজ দীর্ঘদিন ধরে করছে। দিলু বললো—মারিয়া বুঝি খুব ভালো মহিলা ছিলেন?

হ্যাঁ। বাঙ্গালী মেয়েদের মতো।

বাঙ্গালী মেয়েরা বুঝি ভালো?

হ্যাঁ। বাঙ্গালী মেয়েরা খুব সেণ্টিমেণ্টাল। সেণ্টিমেণ্টাল না হলে মেয়েদের মানায় না।

আচ্ছা, সাব্বির ভাই, আমি কি সেণ্টিমেণ্টাল?

হ্যাঁ।

কিভাবে বুঝলেন?

জামিল সাহেবের সঙ্গে বসে তুমি গল্প করছিলে, আমি শুনছিলাম।

কথা শুনেই বুঝে গেলেন?

দিলু, কথা শুনে অনেক কিছুই বোঝা যায়। আমি বুঝতে পারি।

দিলু ভয়ে ভয়ে বললো—আর কি বুঝেছেন?

বুঝলাম যে, তুমি জামিল সাহেবের প্রেমে পড়েছেও। এডোলেসেন্স লাভ। চমৎকার জিনিস।

দিলুর কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগলো। মিনিট পাঁচেক কোন কথাবার্তা না বলে সে চুপচাপ বসে রইলো। সাবির হাসিমুখে বললো—কি দিলু, ঠিক বলিনি?

দিলু কোন জবাব দিলো না।

রেহানা রান্নাঘরে ঢুকে দেখলেন চোখমুখ লাল করে দিলু চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে আছে। তিনি বিরক্ত স্বরে বললেন—তুই এখানে কি করছিস?

দেখছি।

বাবুকে একটু সামলাবার চেষ্টা করলেও তো পারিস। আমি কতক্ষণ দেখব?

দিলু নিঃশ্বব্দে উঠে চলে গেলো। রেহানা বললেন—সাব্বির, তোমার রান্নার কতদূর?

হয়ে এসেছে। এখন শুধু আগুনে ঝলসাব।

খাওয়া যাবে তো?

আপনাদের ভাল লাগবে। ভাল না লাগলে এতটা কষ্ট শুধু শুধু করতাম না।

রেহানা বললেন—আমাকে কিছু করতে হবে?

না আপনি বিশ্রাম করুন।

রেহানা চলে গেলেন। পুরুষ মানুষ রান্নাঘরে হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে এটা তাঁর দেখতে ভালো লাগে না। অসহ্য লাগে। রেহানা বারান্দায় থমকে দাঁড়ালেন। নিচু গলায় বললেন—আজও বসেছ?

হ্যাঁ বসলাম।

বোতল ক’টা এনেছ?

বেশী না, দু’টো মাত্র। রেহানা, একটু বস আমার পাশে।

না।

কেন এরকম করছ? বেশীদিন তো আর বাঁচবো না। শেষ ক’টা দিন আরাম করতে দাও।

বেশীদিন বাঁচবে না এই তথ্যটা আবার কবে জোগাড় করলে?

এক পামিস্ট আমার হাত দেখে বলেছে আমি বাঁচব মাত্র ষাট বছর। ভাল পামিস্ট। যা বলে তাই ঠিক হয়। একটু বস রেহানা।

রেহানা বসলেন। ওসমান সাহেব হৃষ্ট গলায় বললেন—একটা ধাঁধা জিজ্ঞেস করি, দেখি বলতে পার কিনা।

ধাঁধা জিজ্ঞেস করতে হবে না। বসে থাক চুপচাপ।

দারুণ ধাঁধা, দিলুর কাছ থেকে শিখেছি এবং নিজে নিজেই উত্তর বের করেছি। আমি এক হাজার টাকা বাজি রাখছি তুমি পারবে না। কি, বলব?

ওসমান সাহেব দিলুর পানি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়ার ধাঁধাটি খুব উৎসাহের সঙ্গে বলতে শুরু করলেন।

 

কাঁচঘরের পাশের ফাঁকা জায়গাটায় হাঁস ঝলসানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাতাসের জন্য আগুন তেমন জ্বলছে না। বাঁশের চাটাই দিয়ে হাওয়া আটকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। জামিল তদারক করছে মোডায় বসে। দিলু বারান্দা থেকে তাদের দেখলো। একবার ভাবলো কাছে যাবে। কিন্তু গেলো না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলো। জামিল ডাকলো—এই দিলু এদিকে আয়। দিলু এগিয়ে গেলো।

আমাদের ফটোগ্রাফার সাহেব কি হাঁসকে বাতাস দিয়ে শেষ করেছেন? দিলু জবাব দিলো না।

কি ব্যাপার এত গম্ভীর কেন?

মাথা ধরছে।

আগুনের পাশে বস। মাথা ধরা সেরে যাবে। চেয়ারটা টেনে আন।

দিলু বসলো।

গল্প শুনবি নাকি বল? মারাত্মক একটা ভূতের গল্প জানি। বলব?

না।

না কেন? তোর কি হয়েছে?

দিলু মৃদুস্বরে বললো—জামিল ভাই, আপনি আমাকে দুই করে বলবেন না।

কেন? বলব না কেন?

আমার খারাপ লাগে।

আপনি করে বলব। তাই চাস?

দিলু জবাব দিলো না।

তোর কি হয়েছে?

দিলু গম্ভীর মুখে উঠে দাঁড়ালো। জামিল তাকে হাত ধরে টেনে বসালো।

দিলু, তোমার কি হয়েছে?

কিছু হয়নি।

না কিছু একটা হয়েছে। আমাকে বল।

আমার খুব মন খারাপ লাগছে। মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।

দূর বোকা মেয়ে।

জামিল শব্দ করে হাসলো। একটা হাত রাখলো দিলুর পিঠে। নিশাত দূর থেকে দৃশ্যটি দেখলো। একবার ভাবলো—দিলুকে সে ডাকবে। কিন্তু ডাকলো না। আগুনের পাশে বসে থাকা মানুষ দু’টিকে সুন্দর লাগছে। বাবু জেগে উঠে কাঁদছে। রেহানা এসে বললেন—বাবুকে একটু পাড়িয়ে দেনা নিশাত।

আমি পারব না।

দাঁড়িয়েই তো আছিস।

দাঁড়িয়ে আছি না মা। দেখছি।

কি দেখছিস?

দিলুকে দেখছি। দিলু কেমন বড় হয়ে যাচ্ছে দেখেছো মা?

রেহানা তাকালেন। তিনি দিলুর বড় হয়ে যাওয়ার কোন লক্ষণ দেখলেন না। দিলু চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছে। এটা একটা অভদ্রতা, দিলুকে বলতে হবে। তিনি বাবুর কাছে গেলেন। নিশাত চড়া গলায় বললো—দিলু তুই একটু আয়।

দিলু শান্ত স্বরে বললো—না। জামিল বললো—যাও না, শুনে আস কি জন্যে ডাকছে।

না আমি যাব না।

জামিল কৌতূহলী হয়ে তাকালো। তার মনে হলো দিলু কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করেছে।

আমার আছে জল – ১১শ পরিচ্ছেদ

রোস্ট জিনিসটি যে খেতে এত ভাল হবে রেহানা কল্পনাও করতে পারেননি। তাঁর আফসোস হতে লাগলো তিনি পাশে বসে রান্নার পুরো ব্যাপারটা কেন দেখলেন না। সাব্বির বললো—আমি খুব গুছিয়ে লিখে রেখে যাব আপনার যখন ইচ্ছা রান্না করতে পারবেন।

বালি হাঁস ছাড়া সাধারণ হাঁস দিয়ে রান্না হবে?

জানি না। হওয়া তো উচিত। আমি অবশ্যি কখনো ট্রাই করিনি।

জামিল বললো, আমার মনে হয় না সাধারণ হাঁস দিয়ে এটা হবে। সাধারণ হাঁসগুলোর গায়ে প্রচুর চর্বি থাকে। বালি হাঁসের গায়ে চর্বি থাকে না।

নিশাত হাসিমুখে বললো—আপনি বুঝি পৃথিবীর সব জিনিস জানেন?

না, আমি খুব কমই জানি, মাঝে মাঝে লজিক খাটিয়ে দু’একটা কথা বলতে গিয়ে সবাইকে বিরক্ত করি।

ওসমান সাহেব বললেন—দিলুকে দেখছি না যে। দিলু কোথায়?

ও খাবে না। ওর মাথা ধরেছে।

চেখে দেখুক। ডেকে নিয়ে আয়তো নিশাত।

অনেক বলেছি বাবা।

জামিল বললো—আমি নিয়ে আসছি।

দিলু কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছিলো। জামিলকে ঢুকতে দেখে উঠে বসলো। ঘর অন্ধকার। আলো চোখে লাগে বলে হ্যারিকেন ডিম করে রাখা হয়েছে। জামিল বললো—দিলু আমাদের সঙ্গে এসে বস। জিনিসটা বেশ ভাল হয়েছে। তোমার ভাল লাগবে। দিলু জবাব দিলো না।

তুমি হয়তো লক্ষ্য করনি। আমি তুমি করে বলছি। এসো দিলু। খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা অনেক রাত পর্যন্ত আগুনের পাশে বসে গল্প করব।

আমার মাথা ধরেছে জামিল ভাই।

এমন মজার গল্প বলব যে মাথা ধরা সেরে যাবে। এসো!

দিলু উঠে এলো। গল্প খুব জমে উঠলো খাবার টেবিলে। ওসমান সাহেব পর্যন্ত একটা হাসির গল্প বলে ফেললেন। নাসিরুদ্দিন হোজ্জার গল্প। সবারই জানা তবু সবাই হাসলো। কিছু কিছু সময় আসে যখন সব কিছুই ভালো লাগে।

সাব্বির বললো নিউইয়র্কে এক হোটেলে তার অভিজ্ঞতার গল্প—তার বিছানার সঙ্গে একটা যন্ত্র ফিট করা। সেখানে লেখা গা ম্যাসাজ করতে হলে এখানে দু’টি কোয়ার্টার ফেলুন। বেচারা সরল মনে দু’টি কোয়ার্টার ফেললো। তারপর বিছানায় শোয়ামাত্র বিছানা কাঁপতে শুরু করলো। সে কি কাঁপুনি। বসে থাকা যায় না, ছুঁড়ে ফেলে দিতে চায়। মিনিট দশেক পর কাঁপুনি থামলো। কিন্তু যন্ত্রটির বোধ হয় কিছু একটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, কিছুক্ষণ পর আবার শুরু হলো কাঁপুনি। থামে, আবার শুরু হয়। আমার থামে আবার শুরু হয়।

গল্প শুনে হাসতে হাসতে রেহানা বিষম খেলেন এবং মনে মনে স্বীকার করলেন ছেলেটি রসিক। প্রচুর রসজ্ঞান না থাকলে গল্পটি এত সুন্দরভাবে বলা সম্ভব নয়। ওসমান সাহেব বললেন—সবাই একটা না একটা গল্প করছে। নিশাত চুপ করে আছে কেন?

বাবা আমি শুনছি।

শুধু শুনলে হবে না। বলতেও হবে।

নিশাত মৃদুস্বরে বললো—একটা মজার জিনিস লক্ষ্য করলাম আমি। জামিল ভাই হঠাৎ করে দিলুকে তুমি তুমি করে বলছেন।

জামিল শান্ত স্বরে বললো—দিলু বড় হচ্ছে এখন আর ওকে তুই বলা ঠিক নয়।

বড় কোথায়, ওর বয়স চৌদ্দ বছর মাত্র।

দিলু শীতল কণ্ঠে বললো—নভেম্বরে আমার পনেরো হয়েছে আপা। তোমার কিছু মনে থাকে না।

পনেরো হলেই যদি তুমি বলতে হয় তাহলে তো আমাদেরকেও তুমি বলতে হয়।

দিলু কিছু বললো না। ওসমান সাহেব বললেন—দিলু মা’র মনটা মনে হয় খারাপ। নিশাত বললো ওর মন ভালোই আছে। লোকজন ওকে তুমি করে বলা শুরু করেছে। মন খারাপ হবে কেন?

আমার মন ভালোই আছে।

সাব্বির বললো—মন ভালো থাকলে আমাদের একটা হাসির গল্প শুনাতে হবে। দিলু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গল্প শুরু করলো—পরীক্ষায় গরু সম্পর্কে রচনা এসেছে। সবাই লিখছে। একটি ছেলে বললো—স্যার জহির নকল করছে। স্কুলের মাঠে একটা গরু বাঁধা আছে। জহির জানালা দিয়ে গরুটা দেখছে আর লিখছে। ওসমান সাহেব ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলেন। মদ্যপানজনিত কারণে তিনি ইষৎ তরল অবস্থায় আছেন। ছোট ছোট হাসির ব্যাপারগুলো তাঁর কাছে অসাধারণ মনে হলো।

আরেকটা বলতো মা দিলু।

ইতিহাসের স্যার প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা বলতো শেরশাহ কোথায় মারা গেছেন? ছাত্র বললো—ইতিহাস বইতে স্যার। পনেরো পাতায়।

রেহানার মনে হলো তার এই মেয়েটি একটু অন্যরকম হয়েছে। কারো সঙ্গেই ঠিক মেলে না। একটু যেন আলাদা। নিশাত বললো, দু’টি গল্পই জামিল ভাইয়ের কাছ থেকে শোনা তাই না?

হ্যাঁ। তাতে কোন অসুবিধা আছে?

দিলু একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার দিকে যেন সে সত্যি জবাবটি শুনতে চায়। সাব্বির বললো—এক কাপ চা খেতে পারলে মন্দ হতো না। কেউ কি কষ্ট করে চা বানাবে?

নিশাত উঠে দাঁড়ালো—আমি বানাবো। দিলু, তুই আয়তো আমার সঙ্গে, একা একা ভয় লাগে।

 

কেটলিতে চায়ের পানি ফুটছে। নিশাত এবং দিলু বসে আছে চুপ-চাপ। দিলুর মুখ থমথম করছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁদবে। নিশাত বললো—তুই চা খাবি নাকি দিলু?

না।

আয় আমরা বরং কফি খাই। ইনসটেণ্ট কফির পটটা কোথায় দেখেছিস?

আপা, আমি কফি খাব না। তুমি কি বলবে বল।

আমি আবার কি বলব?

কিছু একটা বলবার জন্যেই আমাকে রান্নাঘরে এনেছ। এখন বল কি বলবে।

দিলু, তুই কি রাগ করেছিস?

দিলু চুপ করে রইলো।

নিশাত বললো, চল দু’জনে দু’কাপ চা নিয়ে পুকুর ঘাটে বসি। যা, গরম চাদর একটা গায়ে জড়িয়ে আয়।

তুমি কি ওখানে নিয়ে আমাকে কিছু বলতে চাও?

আয় না গিয়ে বসি, তারপর বলা যাবে। যা চাদর-টাদর কিছু একটা গায়ে দিয়ে আয়।

দিলু উঠে গেলো। লাল রঙের একটা শাল বের করে গায়ে দিলো। কাঁচঘরের পাশে জামিল সিগারেট টানছে। সে উঁচু গলায় বললো—কোথায় যাচ্ছিস রে?

দিলু জবাব দিলো না। জামিল ভাই তুই বললে সে আর জবাব দেবে না। জামিল বললো—দিলু কোথায় যাচ্ছ?

পুকুর ঘাটে।

একা একা? একটু সাবধানে থাকবে।

কেন?

ভূত আছে।

আপনার মাথা আছে।

জামিল শব্দ করে হাসলো—তুমি চাইলে আমি সাহস দেবার জন্যে সঙ্গে থাকতে পারি।

সাহস দিতে হবে না।

 

পুকুর ঘাটটি বড় বেশী নির্জন। মাঝে মাঝে হাওয়া আসে, গাছের পাতায় সরসর শব্দ হয়। ক্রমাগত ঝিঁঝিঁ ডাকে আবার কোন এক বিচিত্র কারণে হঠাৎ ঝিঁঝিঁর ডাক বন্ধ হয়ে চারদিকে সুনশান নীরবতা নেমে আসে। নিশাত বললো—একটু যেন ভয় ভয় লাগেরে।

ফিরে যাবে?

নাহ্‌, বস।

তারা বসলো। নিশাত ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললো। দিলু বললো—আপা, তুমি কি বলতে চাও বল। নিশাত চাপা স্বরে বললো—আমার যখন তোর মত বয়স তখন জামিল ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। জামিল ভাইরা তখন আমাদের পাশের বাসায় থাকতেন। মগবাজারে।

আপ, আমি জানি।

না, সবটা তুই জানিস না। তারপর কি হলো শোন। চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সটাতো খুব খারাপ। সেই বয়সে কাউকে ভালো লাগলে সেটা যে কত তীব্র হয় তা তুই বুঝতে পারছিস কিছুটা। পারছিস না?

দিলু তাকিয়ে রইলো, কিছু বললো না। নিশাত বললো—অল্প বয়সের ভাল লাগার অনেক রকম ব্যাপার আছে। যখন কলেজে উঠলাম তখন লক্ষ্য করলাম জামিল ভাইকে আর ভালো লাগছে না। এরকম হয়। বি. এ. পড়বার সময় বিয়ে হয়ে গেলো। যার সঙ্গে বিয়ে হলো সে জামিল ভাইয়ের ছোটবেলার বন্ধু।

এসব তো আপা আমি জানি।

সবটা জানিস না। শোন মন দিয়ে। তোর দুলাভাই একজন চমৎকার মানুষ ছিলেন। পৃথিবীর যে কোন মেয়ে তাকে বিয়ে করে সুখী হতে পারতো। কিন্তু আমি হইনি। আমার সারাক্ষণই জামিল ভাইয়ের কথা মনে হতো।

নিশাত চোখ মুছলো। দিলু বললো—আমাকে এসব শুনাচ্ছ কেন আপা?

জানি না কেন।

আমার এসব শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না।

নিশাত চুপ করে রইলো। কাছেই কোথাও সরসর শব্দ হচ্ছে।

দিলু বললো—চলো আপা ঘরে যাই।

আরেকটু বস। তোকে একটা মজার গল্প বলি। ক্লাস টেনে উঠলাম যেবার সেবার আমি আর জামিল ভাই মিলে ঠিক করলাম পালিয়ে যাব।

কোথায় পালিয়ে যাবে?

সে সব কিছু ঠিক হয়নি। ঐ বয়সে ভেবে চিনতে তো কিছু কখনো করা হয় না। ভেবে চিনতে কাজ করতে পারলে এত ঝামেলা হয়?

নিশাত হাসতে চেষ্টা করলো।

গল্প উপন্যাসের মত সত্যি সত্যি একদিন স্কুলে যাবার নাম করে চলে গেলাম কমলাপুর রেল স্টেশন।

তোমরা যাও নি নিশ্চয়ই?

না জামিল ভাই আসেন নি।

ভালোই করেছ যাওনি।
না ভাল করিনি। এখন তার জন্যে মনে একটা কষ্ট আছে আমার।

দিলু ছোট্ট করে বললো—তুমি কি জামিল ভাইকে বিয়ে করতে চাও?

নিশাত জবাব দিলো না। দিলু দ্বিতীয়বার বললো—তুমি কি জামিল ভাইকে বিয়ে করতে চাও?

হ্যাঁ। মনে হচ্ছে চাই।

দিলুর মনে হলো নিশাত কাঁদছে। গলার স্বর যেন ভাঙা ভাঙা। নিশাত খুব শক্ত মেয়ে। সে কি সত্যি সত্যি কাঁদবে? বিশ্বাস হয় না। দিলু মৃদুস্বরে বললো—জামিল ভাইকে কিছু বলেছ?

না

বল তাকে। তিনি তোমার জন্যেই আসেন।

নিশাত দিলুকে বুঝতে চেষ্টা করলো। শান্ত ভাবলেশহীন মুখ। লজ্জুল চোখ। বড় মায়াবতী চেহারা দিলুর।

নিশাতের মনে হলো আজ ঠিক এই মুহূর্তে দিলুর বয়স অনেকখানি বেড়ে গেছে।

লেবু ফুল ফুটছে কোথাও, মিষ্টি গন্ধ আসছে। গাঢ় অন্ধকার চারদিকে। নিশাত ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো—বেঁচে থাকা বড় কষ্ট।

আপা, চল যাই। শীত লাগছে।

আরেকটু বস? প্লীজ।

তারা দু’জন বসে রইলো প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত। এক সময় হাতে টর্চ নিয়ে তাদের খুঁজতে এলো জামিল—পানিতে ডুবে গেছো কিনা তাই দেখতে এলাম। মনে হচ্ছে ঠিক মতই আছ। কাজেই ডিস্টার্ব না করে চলে যাচ্ছি। শুধু একটা জিনিস তোমরা মনে রাখবে এ বাড়িতে ভূত আছে। ঠাট্টা না সত্যি।

নিশাত কিছু বললো না। দিলু বললো—জামিল ভাই, আপনি বসুন এখানে। আপা কি যেন বলবেন আপনাকে। টর্চটা দিন। আমি চলে যাই।

যেতে পারবে একা?

পারব।

দিলু যেতে যেতে থমকে পিছনে ফিরে তাকালো। অন্ধকারে জামিল ভাইয়ের জ্বলন্ত সিগারেট উঠানামা করছে। এর বাইরে আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কত কাছাকাছি বসে তারা দু’জন। নিশাত আপা যদি আজ বলে—জামিল ভাই চলুন আজ সারারাত আমরা গল্প করি তাহলে জামিল ভাই কি বলবেন?

 

রাত অনেক হয়েছে। ওসমান সাহেবের ঝিমুনি ধরে গেছে। তিনি উঠবো করছিলেন কিন্তু আবার ঠিক উঠতেও চাচ্ছিলেন না।

দিলু একসময় এসে দাঁড়ালো তার পাশে।

ঘুমোসনি মা?

না বাবা।

কোথায় ছিলি?

পুকুর ঘাটে বসেছিলাম আপার সঙ্গে। বাবা, আমি তোমার পাশে একটু বসি?

ওসমান সাহেব হাত বাড়িয়ে পাশের চেয়ারটি টানতে গেলেন। দিলু বললো—বাবা, আমি তোমার সঙ্গে বসবো। আমাকে একটু জায়গা দাও। ওসমান সাহেব সরে জায়গা করে দিলেন। নরোম স্বরে বললেন, দিলু তোর কি হয়েছে?

বাবা, আমার বড় কষ্ট!

কিসের কষ্ট?

জানি না বাবা।

ওসমান সাহেব মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তাঁর মনে হলো দিলু কাঁদছে। কিন্তু দিলু কাঁদছিলো না।

ওসমান সাহেব ভরাট গলায় বললেন—যাও মা ঘুমুতে যাও। ঠাণ্ডা হওয়া দিচ্ছে শরীর খারাপ করবে।

 

রেহানা বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়েছিলেন। দিলুকে দেখে বললেন—তোর কি শরীর খারাপ? তোকে এমন লাগছে কেন?

শরীর ভালই আছে।

নিশাত কোথায়?

পুকুর ঘাটে।

রেহানা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন-এত রাতে একা একা সেখানে কি করছে?

একা একা না মা। জামিল ভাই আছেন।

রেহানা উঠে বসলেন। তাঁর ধারণা ছিলো জামিলকে নিশাত সহ্য করতে পারে না। তিনি কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করলেন না। দিলু বললো—মা আমি তোমার পাশে একটু শুয়ে থাকি?

দিলু মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। ফিস ফিস করে বললো—নিশাত আপার সঙ্গে জামিল ভাইয়ের বিয়ে হলে ভালই হবে মা।

কি বলছিস বিড়বিড় করে। পরিষ্কার করে বল।

কিছু বলছি না মা।

দিলু আরো শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরলো। চারিদিকে আবছা অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। শীতের হিমেল হাওয়া। বাবু ঘুমের মধ্যেই কেঁদে উঠলো। একটা টিকটিকি ডাকলো—টিক টিক টিক।

আমার আছে জল – ১২শ পরিচ্ছেদ

দিলু ভাসছিল মাঝপুকুরে।

তার পরনে লাল একটা স্কার্ট। মাথার কালো চুল চারদিকে ছড়ানো। দীঘির সবুজ জলের ব্যাকগ্রাউণ্ডে একটি অসাধারণ কম্পোজিশন। একজন ফটোগ্রাফার এরকম একটি দৃশ্যের জন্যে সারা জীবন অপেক্ষা করে।

সাব্বির দীর্ঘ সময় দিলুর ভেসে থাকা শরীরটির দিকে তাকিয়ে রইলো। ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। স্কার্টের রঙ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। সাব্বির ছবি তুলতে গিয়েও তুলতে পারলো না। পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলো—তোমরা কে কোথায় আছ এই মেয়েটিকে বাঁচাও।

দমকা একটা হাওয়া এল তখন। সে হাওয়ায় দিলু ভেসে আসতে লাগলো ঘাটের দিকে। যেন সে বলছে—“ছবি তুলুন সাব্বির ভাই।”

 

(সমাপ্ত)

Exit mobile version